- বইয়ের নামঃ বিপদ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
আফসারউদ্দিন জাহাজ কোম্পানির বড় অফিসার
আফসারউদ্দিন খুব গম্ভীর ধরনের একটা দেশি জাহাজ কোম্পানির বড় অফিসার। বড় অফিসাররা এমনিতেই গাড়ীর হয়ে থাকেন। ইচ্ছে না-করলেও তাঁদের গাষ্ঠীর থাকতে হয়। আফসার সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে-রকম নয়। তিনি এই গান্তীর্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন। কঠিন হয়ে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে। হাসি-তোমাশা, ঠাট্টা-ফাজলামি তাঁর একেবারে সহ্য হয় না। তাঁর কথা হল-হাসিতামাশাই যদি লোকজন করবে। তাহলে কাজ করবে। কখন? পৃথিবীটা কোনো নাট্যশালা না যে হাসি-তামাশা করে লোক-হাসাতে হবে।
আফসার সাহেবের দুর্ভাগ্য, তাঁর আশেপাশের মানুষজনের স্বভাব তাঁর স্বভাবের একেবারে উন্টো। তাঁর স্ত্রী মীরা সৰ্ব্বক্ষণই হাসছেন। কারণ্যে-অকারণে হাসছেন। এই তো সেদিন তাঁদের কাজের ছেলে কুদ্দুস হাত থেকে ফেলে টী-পট ভেঙে ফেলল। এই দেখে মীরা ফিক করে হেসে ফেললেনঃ আফসার সাহেব বললেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। হাত থেকে ফেলে একটা দামি জিনিস ভেঙেছে। এতে হাসির কী হল?
মীরা বললেন, দী-পট ভেঙেছে দেখে হাসি নি। টী-পট ভাঙার পর কুদ্দুস কেমন হতভম্ব হয়ে ভাঙা পটটার দিকে তাকিয়ে ছিল তাই দেখে হোসে ফেললাম।
তার মুখের ভঙ্গি দেখে তুমি হেসে ফেললে?
হ্যাঁ।
দয়া করে আমার সামনে এই কাজটা করবে না। হাসতে ইচ্ছা করলে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাসবে।
মীরা আবার হেসে ফেললেন। আফসার সাহেব বললেন, হাসলে যে?
তুমি কেমন গম্ভীর মুখে কথা বলছি তাই দেখে—
দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও।
মীরা উঠে চলে যান, তবে হাসতে-হাসতে যান। তা দেখেও আফসার সাহেবের গা জ্বালা করে।
তাঁর দুই মেয়ে সুমী আর রুমীও অবিকল মার মতো। দিন-রাত হাসছে। তারা মাঝেমাঝে স্কুলের মজার-মজার সব ঘটনা বাবাকে বলতে আসে। ঘটনা বলবে কি, বলার আগেই হাসি।
আফসার সাহেব শীতল গলায় বলেন, কী বলতে চোচ্ছ ঠিকমতো বল। এত হাসলে বলবে কী করে?
না-হাসলে এই ঘটনা বলা যাবে না। বাবা! হি-হি-হি-হয়েছে কি, আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে অরুণা-হি-হি-হি-সে করল কি, হি-হি-হি—
চুপ কর।
ঘটনাটা শোন বাবা। ভারি মজার— তারপর অরুণা-হি-হি-হি।
স্টপ। স্টপ।
অরুণার গল্প বলা হয় না। মেয়ে দুটি দুঃখিত হয়। তবে সেই দুঃখও খুব সাময়িক। আবার কোনো- একটা মজার ঘটনা ঘটে। এক বোন অন্য বোনের গায়ে হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
আজ সোমবার।
আফসার সাহেব নাশতা খেতে বসেছেন। তাঁর দুই মেয়ে সুমী রুমী বসেছে দু পাশে। রুমী কী একটা হাসির কথা বলতে যাচ্ছিল। বাবা কড়া করে তার দিকে তোকানোর কারণে সে চুপ করে গেল। সুমী তখন কী একটা বলতে গেল! মীরা চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। নাশতার টেবিলে হাসাহসি না-হওয়াই ভালো। মীরা টী-পট থেকে কাপে চা ঢালছেন। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটল। মেঝে থেকে লাফ দিয়ে একটা বিড়াল আফসার সাহেবের কোলে এসে বসল। আফসার সাহেব লাফ দিয়ে তিন হাত ওপরে উঠে গেলেন। যে-পিরচে ডিম, রুটি, মাখন এবং পনিরের টুকরো সাজানো ছিল তা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পুরো ঘটনোটা ঘটল দু সেকেণ্ডের ভেতর।
সুমী রুমী খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারা জানে এখন হাসা মানেই বিপদ।। ভয়ংকর বিপদ। বাবা প্রচণ্ড রাগ করবেন! কিন্তু কিছুতেই তারা হাসি থামাতে পারল না। মীরা খুব চেষ্টা করছেন না-হাসতে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। লাভ হচ্ছে না। হাসি এসে যাচ্ছে। আর বুঝি আটকানো গেল না।
আফসার সাহেব মেঘগর্জন করলেন, রুমী সুমী, তোমরা আমার সামনে থেকে উঠে গেলে আমি খুশি হব।
মেয়ে দু জন তৎক্ষণাৎ ছুটে ঘরে চলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে তাদের হাসি শোনা যাচ্ছে—হা-হা-হা– হি-হি-হি।ভ
এবার মীরাও হেসে ফেললেন। তবে শব্দ করে নয়, নিঃশব্দে। হাসির কারণে তাঁর হাত কাঁপছে। চায়ের কাপে ঠিকমতো চা চালতে পারছেন না।
মীরা।
কি?
হাসছ কেন জানতে পারি?
হাসি এসে গেল। তাই হাসছি। বিশেষ কোনো কারণে নয়।
কেন হাসি এসে গেল তা জানতে পারি?
সরি।
সরির কোনো ব্যাপার না। তুমি বল কেন হাসলে?
মীরা গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কেমন চমৎকার শূন্যে উঠে গেলো! হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু নেই। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগল। তাই হাসলাম।
তুমি যদি আমার সামনে থেকে চলে যাও আমি খুশি হব।
সত্যি চলে যেতে বলছ?
যদি হাসি বন্ধ করতে না পার তাহলে অবশ্যই চলে যাবে।
তোমার নাশতা তো বিড়াল ফেলে দিয়েছে। নাশতা নিয়ে আসি?
না।
চা দিই, নাকি চা-ও খাবে না? ভালো করে তাকিয়ে দেখ, আমি কিন্তু হাসছি না। গম্ভীর হয়ে আছি।…
বলতে-বলতে মীরা ফিক করে হেসে ফেললেন। খানিকট চা ছিলকে টেবিলে পড়ে গেল। তিনি টী-পট নামিয়ে রেখে প্রায় ছুটে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দুই মেয়ের হাসির সঙ্গে যুক্ত হল তাঁর হাসি।
চায়ের কোপ হাতে আফসার সাহেব এক-একা বসে আছেন। তাঁর মন বিষগ্ন। শোবার ঘর থেকে মা এবং দুই মেয়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। হাসির জোয়ার নেমেছে। রাগে আফসার সাহেবের গা জ্বলে গেল। যে-বিড়ালের জন্যে এত কাণ্ড, সে নিশ্চিন্ত এবং আনন্দিত ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে থাকা ডিম, পনির এবং মাখন-রুটি খাচ্ছে। সে একা খাচ্ছে না, তার সঙ্গে দুটো বাচ্চাও আছে। তারাও খাচ্ছে এবং মাঝেমাঝে চোখ তুলে আফসার সাহেবকে দেখছে। আফসার সাহেবের ইচ্ছে করছে প্রচণ্ড লাথি দিয়ে বিড়ালটাকে ফুটবলের মতো দূরে ছুঁড়ে দেন।