০১. গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ দুই ভাই
গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ দুই ভাই। তাহারা সহোদর নহে, —সম্বন্ধ অতি দুর। সেকালে এমন দূর-সম্পৰ্কীয় ব্যক্তিও আপন হইয়া যাইত। গোরাচাঁদের পিতার এক মাস্তুতো ভাই বড়ই দরিদ্র ছিলেন। তাঁহার সংসারে একমাত্র স্ত্রী ছিলেন, আর কেহই ছিল না। একটা পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াই এই মাসতুতো ভাইয়ের স্ত্রী যখন মারা যান, তখন গোরাচাঁদের পিতা এই মাতৃহীন শিশুটীর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। ছেলেটীর রং বড়ই কালো বলিয়া গোরাচাঁদের পিতা নিজপুত্র গোরাচাঁদের নামের সঙ্গে মিল করিয়া এই ছেলেটীর নাম রাখেন কালাচাঁদ।
গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ সহোদরের মতই প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। যাঁহারা প্রকৃত সংবাদ জানিতেন না, তাঁহারা মনে করিতেন, ইঁহারা সহোদর ভ্রাতা। কিন্তু দুই ভাইয়ের প্রকৃতি এমন বিভিন্ন ছিল যে, চক্ষুস্মান ব্যক্তিমাত্রেই বলিতে পারিতেন, এক পিতার ঔরসে, এক মায়ের গর্ভে এমন বিরুদ্ধ স্বভাবের দুই ভাই জন্মগ্রহণই করিতে পারে না। গোরাচাঁদ সৰ্ব্ববিষয়েই গোরাচাঁদ, আর কালাচাঁদ ভিতর-বাহিরেই কালাচাঁদ।
ইঁহাদের উপাধি মুখোপাধ্যায়,-মহা কুলীন, ফুলের মুখুটী, বিষ্ণুঠাকুরের সন্তান। বাড়ী সুবর্ণপুর। অবস্থা তেমন মন্দই বা কি? জমাজমি যাহা আছে, তাহাতে বেশ চলিয়া যায় এবং দুপয়সা সঞ্চয়ও হয়। তাহার পর কালাচাঁদ মুখুয্যে যেমন-তেমন লোক নহে; যেখানে সূচ প্রবেশের পথও লোকে দেখিতে পায় না, কালু মুখুয্যে সেখানে হাতী চালাইতে পারে। বড় ভাই গোরাচাঁদ অতি কোমল-প্রকৃতি, সদাশয় ব্যক্তি। তিনি গ্রামের বিদ্যালয় হইতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করিয়াই পড়াশুনা ত্যাগ করিয়াছিলেন। পিতা যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন, ততদিন তিনিই বিষয়-কৰ্ম্মের তত্ত্বাবধান করিতেন, গোরাচাঁদকে কিছুই দেখিতে হইত না। পিতা যখন পরলোকগত হইলেন, তখন কালাচাঁদের বয়স কুড়ি বৎসর; কিন্তু সেই বয়সেই তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা এমন পরিপক্ক হইয়াছিল যে, গোরাচাঁদ আর বিষয়-কৰ্ম্মের ভার গ্রহণ করিলেন না, কালাচাঁদের উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া সেই বয়সেই অর্থাৎ ২৬ বৎসর বয়সেই ধৰ্ম্মকৰ্ম্মে মনোনিবেশ করিলেন। তিনি খান-দান, পূজার্চ্চনা করেন, গ্রামের দশজনের সুখ-দুঃখের সময় উপস্থিত হন এবং যথাসাধ্য সকলের সাহায্য করেন। গ্রামের সকলেই তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিত।
কালাচাঁদ কিন্তু গোরাচাঁদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল; দয়াধৰ্ম্ম তাহার ছিল না। যাহাতে দুপয়সা প্রাপ্তি হয়, এই চিন্তাতেই সে নিবিষ্ট থাকিত। এতদ্ব্যতীত তাহার স্বভাব-চরিত্রও তেমন, ভাল ছিল না।
গোরাচাঁদ ভুলিয়াই গিয়াছিলেন যে, কালাচাঁদ তাঁহার দুরসম্পর্কের ভাই—বলিতে গেলে কেহই নহে; কিন্তু তাঁহার পিতা মৃত্যুকালে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, কালাচাঁদকে যখন তিনি পুত্রনিৰ্ব্বিশেষে পালন করিয়াছেন এবং তাহার যখন আর কেহই নাই, তখন গোরাচাঁদ যেন তাহাকে কিছুতেই পরিত্যাগ না করে; নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া মনে করে। গোরাচাঁদ তাহাই করিয়াছেন, কালাচাঁদের উপরেই সমস্ত ভার দিয়া তিনি নিশ্চিন্ত। কালাচাঁদ কাজকৰ্ম্মে খুব উপযুক্ত; এ অবস্থায় তাহার চরিত্র-দোষ এবং অন্তবিধ অত্যাচারের কথা শুনিয়াও গোরাচাঁদ মুখ ফুটিয়া তাহাকে কিছু বলিতে পারিতেন না-শাসন করা ত দুরের কথা।
বাড়ীতে স্ত্রীলোকের মধ্যে দুই ভাইয়ের স্ত্রী; গোরাচাঁদের মাতাঠাকুরাণী অনেক দিন হইল, পিতা পরলোক গমনের পূৰ্ব্বেই দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। গোরাচাঁদের স্ত্রী পরমা সুন্দরী ছিলেন; তাঁহার পিতৃকুলে কেহই ছিলনা। একটী কন্যা ব্যতীত তাঁহার আর সন্তানও হয় নাই।
গোরাচাঁদ যেমন মানুষ ছিলেন, তাঁহার স্ত্রীও তেমনই লক্ষীস্বরূপিনী; কিন্তু কালাচাঁদের স্ত্রীর অবস্থা বড়ই শোচনীয় ছিল। কালাচাঁদ নিজেও কালাচাঁদ, তাহার অদৃষ্টে প্রজাপতি মিলাইয়া দিয়াছিলেনও তেমনই অর্দ্ধাঙ্গিনী। শুনিতে পাওয়া যায়, সম্পন্ন গৃহস্থের একমাত্র কন্যা দেখিয়া গোরাচাঁদের পিতা কালাচাঁদের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়াই কুৎসিত মেয়েটীকে কালাচাঁদের অঙ্কলক্ষ্মী করিয়া দিয়াছিলেন। দেখিতে কুৎসিত হইলেও কালাচাঁদের স্ত্রী বড় ভাল মেয়ে। স্বামী যে তাহাকে দুইচক্ষে দেখিতে পারিত না, কোন দিন ভাল মুখে একটা কথাও বলিত না, সৰ্ব্বদা দূর দূর করিত, তাহাতেও কিন্তু ব্রাহ্মণ-কন্যাকে কেহ বিচলিত দেখে নাই। ছোটবধু মন্দাকিনী বড় যায়ের মুখের দিকে চাহিয়া, তাঁহার স্নেহ আদরের অধিকারিণী হইয়া স্বামীর অনাদর নির্য্যাতন নীরবে সহ করিতেন। বড়-যা মানদা তাঁহার স্নেহের অঞ্চল দিয়া এই অভাগিনী ছোট যাকে ঢাকিয়া রাখিতেন। দেবর স্বামীর ছয় বৎসরের ছোট হইলেও মানদা কোন দিন তাহার সহিত কথা বলিতেন না। সাধারণতঃ, দেবরের সহিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধু যে প্রকার ব্যবহার করিয়া থাকে, পরস্পরের মধ্যে যে প্রকার সম্বন্ধ প্রায় সকল গৃহস্থের বাড়ীতেই দেখিতে পাওয়া যায়, মানদা সে রকম ভাবে দেবরের সঙ্গে ব্যবহার করিতেন না। তিনি দেবরকে যে ঘৃণা করিতেন তাহা নহে; কিন্তু কালাচাঁদের ব্যবহার তাহার নিকট ভাল বোধ হইত না। এই কারণে তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিতেন না। কালচাঁদ, অনেক সময়ে এ জন্য বিরক্তি প্রকাশ করিত, রাগ করিত, অনেক ঠাট্টা-তামাসাও করিত; কিন্তু মানদা তাহাতে কৰ্ণপাতও করিতেন না। দুই যায়ে সংসারের কাজকৰ্ম্ম করিতেন, একমাত্র কন্যা সুহারের লালন-পালন করিতেন।
কালাচাঁদের একটা গুণ ছিল; সে নানা উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিত, ন্যায় অন্যায় অবিচার অত্যাচার করিয়া টাকা, সংগ্ৰহ করিত; টাকার জন্য কাহারও প্রাণনাশ করিতেও হয়ত দ্বিধা বোধ করিত না; ব্যয়ের বেলায় কিন্তু সে ভারি হিসাবী ছিল। যাহাদের স্বভাব-চরিত্র খারাপ হয়, তাহারা অপব্যয়ী হইয়া থাকে; তাহাদের হাতে বিষয় বা টাকাকড়ি পড়িলে তাহারা দুইদিনেই উড়াইয়া সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়ে। কালাচাঁদ কিন্তু সে রকমের মানুষ ছিল না। তাহার স্বভাব অতি মন্দ ছিল; কিন্তু সে ব্যাপারেও সে মুক্তহস্ত ছিল না; সে বিশেষ হিসাব করিয়াই অপব্যয় করিত। তাহার রোজগারের অনুপাতে সে ব্যয় অতি সামান্য বলিলেই হয়। সংসার-খরচের দিকেও তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল; কোন প্রকারে ছপয়সা বেশী খরচ হইবার যো ছিল না। অথচ কাহার জন্য যে সে জোতজমা বৃদ্ধি করিতেছিল, অর্থ সঞ্চয় করিতেছিল, লগ্নী কারবারে একেবারে পিশাচের ন্যায় ব্যবহার করিত, কাহাকেও একটা পয়সা রেন্থাই দিত না, তাহা বুঝিয়া উঠা যাইত না। স্ত্রীর সহিত তাহার মুখ দেখাদেখিও ছিল না; সে রাত্রিতে বাড়ীতেই থাকিত না। সংসারে অবলম্বন একমাত্র তাহার দাদার মেয়েটী। তাহাকেও সে তেমন আদর-যত্ন করিত না; তাহার জন্যও কখন কোন দ্রব্য কিনিয়া দিত না। তবুও যে কেন যে এমন করিয়া অর্থ উপার্জন করিত, সেই জানে। গোরাচাঁদ যদি কখন কোন বিষয়ে কিছু বলিতেন, তাহা হইলে কালাচাঁদ অতি গম্ভীর ভাবে বলিত, “সময় অসময় আছে দাদা! চারিদিকে দেখে-শুনে খরচ করতে হয়। দু-দশ টাকা হাতে না থাক্লে কি মান-সম্ভ্রম রক্ষা করে চলা যায় না, না দশজনে মানে চেনে।” গোরাচাঁদ আর দ্বিরুক্তি করিতেন না।
এই ভাবেই কয়েক বৎসর গেল। তাহার পরই এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে এক অভাবনীয় পৈশাচিক দৃশ্যের অভিনয় হইল। সেই কথা বলিবার জন্যই তাঁহাদের পরিবারের এই পরিচয়টুকু দিতে হইল।
০২. আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি
আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তাহার ছয়মাস পূর্ব্বে গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রায় মাসাধিক কাল জ্বরে ভুগিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার কন্যা সুহারের বয়স তখন বার বৎসর। মানদার এতদিন যখন সামান্য যাহা প্রয়োজন হইত, গোরাচাঁদকে বলিলেই তাহা পূর্ণ হইত; এখন দুইটী পয়সার প্রয়োজন হইলেই কালাচাঁদের কাছে দরবার করিতে হয়। তিনি কালাচাঁদের সহিত কথা বলিতেন না; সুহারের দ্বারাই কালাচাঁদের কাছে অভাবের কথা জানাইতে হইত। কালাচাঁদ ইহাতে, বড়ই বিরক্ত হইত; বলিত, “কেন? তোর মায়ের মুখ নেই, সে কি বোবা; যখন যা দরকার হয়, আমার কাছে নিজে চাইলেই পারে। তোর মা নিজে মুখে না চাইলে আমি কোন কথা শুনব না।” এই কারণে সুহারও তাহার কাকার কাছে কিছু বলিতে চাহিত না; তাহার মাকে বলিত “মা, তুমি কাকার সঙ্গে কথা বল্লেই পার? তা হ’লে ত কাকা এমন রাগ করতে পারবেন না।”
মানদা বলিতেন, “না মা, তিনি বেঁচে থাক্তে এতকাল যখন ঠাকুরপোর সঙ্গে কথা বলি নাই, তাঁকে দেখে লজ্জা করে এসেছি, এখন কি আর কথা বলা যায়। যাক্, আমার আর কয় দিনই বা ভিক্ষা করতে হবে। কোন রকমে তোকে পার করতে পারলেই হয়; তারপর আর আমার কিছুরই দরকার হবে না।”
এদিকে কালাচাঁদও যেন একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিল। সে যখন-তখনই বাড়ীর মধ্যে আসিয়া “বড় বৌ, এটা দেও, ওটা দেও” বলিয়া মানদাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে; ঠাট্টা-তামাসার মাত্রাও যেন ক্রমেই বাড়িয়া যাইতে লাগিল। মানদার বয়স তখনও বেশী হয় নাই; পনর বৎসর বয়সে সুহার জন্মগ্রহণ করে; সুহারের বয়স এখন বার বৎসর; সুতরাং মানদা সাতাশ বৎসরের যুবতী। তাঁহার শরীরেও কোন রোগ ছিল না।
কালাচাঁদ এতদিন বাহিরেই বেশী থাকিত; বিশেষ প্রয়োজন না হইলে বাড়ীর মধ্যে আসিত না; এবং যখন যাহা চাহিত, মানদা মন্দাকিনীর দ্বারাই তাহা যোগাইয়া দিতেন, নিজে বড়-একটা সম্মুখে যাইতেন না। ইহাতে মন্দাকিনীকে সৰ্ব্বদাই লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত, স্বামীর কটূক্তি শুনিতে হইত; কিন্তু বড়-দিদির কথা তিনি কিছুতেই অমান্য করিতে পারিতেন না, কাজেই সমস্ত তিরস্কার, অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করিতে হইত।
দিন কয়েক পূৰ্ব্বে কালাচাঁদের নিকট পত্র আসিল যে, তাহার শাশুড়ী অত্যন্ত পীড়িতা, বাঁচিবার আশা নাই; মন্দাকিনীকে তাঁহারা একবার লইয়া যাইতে চান। কালাচাঁদের তাহাতে কোন দিনই আপত্তি ছিল না——ও-পাপ বিদায় হইলেই সে বাঁচে। পূৰ্ব্বেও অনেকবার মন্দাকিনী পিত্রালয়ে গিয়াছেন; কিন্তু দুইমাস যাইতে না যাইতেই গোরাচাঁদ নিজে যাইয়া ভাদ্রবধূকে বাড়ী লইয়া আসিতেন; মন্দাকিনীর পিতা মাতা আপত্তি করিতে পারিতেন না। এবার শাশুড়ীর পীড়ার সংবাদ পাইয়া কালাচাঁদ শ্বশুর-বাড়ীতে পত্র লিখিয়া দিয়াছিল যে, তাঁহাদের যখন ইচ্ছা, তখনই মন্দাকিনীকে লইয়া যাইতে পারেন; তাহার কোনই আপত্তি নাই। এই পত্র পাইয়াই মন্দাকিনীর পিতা কন্যাকে লইয়া যাইবার জন্য লোক প্রেরণ করিলেন। মানদা মন্দাকিনীকে বারবার বলিয়া দিলেন যে, মাকে একটু সুস্থ দেখিলেই সে; ষেন চলিয়া আসে– “দেখ্ছ ত ভাই, আমি একেলা মানুষ, কথা বল্বার লোকটী নেই। তুই না থাক্লে আমার বড়ই কষ্ট হবে। এতদিন তবুও তিনি বেঁচে ছিলেন। এখন যে আমার সব দিক্ অন্ধকার। তুই থাক্লে কথায়-বাৰ্ত্তায় কাজে-কৰ্ম্মে দিনগুলো কেটে যায়। দেখিস্ ভাই, বেশী বিলম্ব করিস না।” মন্দাকিনী মানদার পদধূলি লইয়া বলিল “না দিদি, তোমাকে এমন একেলা ফেলে কি আমি সেখানে থাক্তে পারি; মাকে একটু ভাল দেখ্লেই আমি চলে আস্ব ।”
০৩. সেদিন একাদশী
সেদিন একাদশী। কালু মুখুয্যের বাড়ীর পাশেই তাহাদের জ্ঞাতি চণ্ডী মুখুয্যের বাড়ী। চণ্ডী বাবুর অবস্থা পূৰ্ব্বে তেমন ভাল ছিল না। তাঁহার পিতা জ্যেষ্ঠা কন্যা রমাসুন্দরীর দেবগ্রামের জমিদার হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের সহিত বিবাহ দেন এবং তদুপলক্ষে কিছু জমিজমা ও নগদ টাকা পান। চণ্ডী মুখুয্যের সেই জোত-জমার আয়েই চলে এবং যখন যা দরকার হয়, দেবগ্রামে দিদির নিকট চাইলেই তাহা পূর্ণ হয়। চণ্ডী বাবুর পরপর ছয়টী মেয়ের পর এবার একটী পুত্র-সন্তান হইয়াছে। ছয় মেয়ের পর ছেলে, তাহার অন্নপ্রাশনে ঘটা না করিলে কি ভাল দেখায়। তাই তিনি অনেক আত্মীয়-কুটুম্ব নিমন্ত্ৰণ করিয়াছেন। তাঁহার দিদিও এই শুভকৰ্ম্ম উপলক্ষে সুবর্ণপুরে আসিয়াছেন। জমিদার হরিপ্রসন্ন বাবুর মৃত্যু হইয়াছে; উপযুক্ত পুত্র সিদ্ধেশ্বর বাবুই এখন মালিক। মায়ের সঙ্গে সিদ্ধেশ্বর বাবুও মাতুল-পুত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আসিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, এই অন্নপ্রাশনের সমস্ত ব্যয়ভারই চণ্ডী বাবুর দিদি বহন করিয়াছেন। সঙ্গে লোকজন, দাস-দাসীও অনেক আসিয়াছে। এই একাদশীর দিনই অন্নপ্রাশন। গ্রামের ভদ্র ইতর সকল লোকই নিমন্ত্রিত হইয়াছে। কালাচাঁদের বাড়ীতে আজ আর উনানে হাঁড়ি চড়াইবারই প্রয়োজন হয় নাই। মানদার একাদশী; কালাচাঁদ ও-বাড়ীর ব্যাপারেই নিযুক্ত; সুহার এবং চাকর-চাকরাণীরা সকলেই সেখানে নিমন্ত্রণ খাইয়াছে। লোকজনের আহারাদি শেষ হইতে প্রায় অপরাহ্ণ হইয়া গিয়াছিল। কালাচাঁদ সন্ধ্যার সময় বাড়ীতে আসিয়া পুনরায় স্নান করিয়া চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে আহার করিতে গেল,—দিনমানে আর তাহার আহার হয় নাই।
রাত্রিতে কালাচাঁদ বাড়ীতে থাকিত না; তাহার রাত্রি-বাসের অন্য স্থান ছিল। বাড়ীতে বৃদ্ধ দাসী গোপালের মা রাত্ৰিতে মানদার ঘরের বারান্দায় শয়ন করিত; বাহিরে বৈঠকখানায় দুইজন চাকর থাকিত। মন্দাকিনীর ঘর এ কয়দিন বন্ধই আছে। মন্দাকিনী এখানে থাকিবার সময়েও রাত্রিতে মানদার ঘরেই তিনি শয়ন করিতেন।
একে বৈশাখ মাস, তাহাতে একাদশী। মানদা ক্লান্ত হইয়া তাঁহার ঘরের বারান্দায় একখানি মাদুর পাতিয়া শয়ন করিয়া ছিলেন। গোপালের মা অন্য দিন সেই বারান্দার অপর পাশেই শয়ন করিত। সে দিন মানদাকে বারান্দায় শয়ন করিতে দেখিয়া সে মন্দাকিনীর ঘরের বারান্দায় সুহারকে লইয়া শয়ন করিয়া তাহাকে নানা গল্প শুনাইতেছিল; তখনও তাহাদের নিদ্রাকর্ষণ হয় নাই।
রাত্রি তখন সাতটা বাজিয়া গিয়াছে।কালাচাঁদ চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে আহার শেষ করিয়া বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোপালের মা ও সুহার তখনও জাগিয়া ছিল। কালাচাঁদকে আসিতে দেখিয়া তাহারা গল্প বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া শুইয়া রহিল। কালাচাঁদ প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া মানদার ঘরের বারানায় উঠিয়া ডাকিল “বড়বৌ, একবার ওঠ ত ।”
কালাচাঁদের আহবান শুনিয়াই মানদা বস্ত্রাদি সংযত করিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়লেন।
কালাচাঁদ বলিল “বড়বৌ, কাল যে তোমার কাছে একটা কাগজের বাণ্ডিল রেখেছিলাম, সেইটা বের করে দাও ত। এখনই দরকার।”
মানদার ঘরের মধ্যে আলো ছিল না। তিনি আলো জ্বালিবারও প্রয়োজন বোধ করিলেন না, কারণ সেই কাগজের বাণ্ডিলটা তিনি বাহিরে তাকের উপরই রাখিয়াছিলেন। অন্ধকারেই তাহা আনিয়া দিতে পারিবেন ভাবিয়া তিনি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তিনি প্রবেশ করিতে না করতেই কালাচাঁদ সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। বোধ হয় এক মিনিটও অতীত হয় নাই—মানদা ঘরের মধ্যে চীৎকার করিয়া উঠিল। সে ভীষণ চীৎকার!
সেই চীৎকার শুনিয়াই গোপালের মা ও সুহার তাড়াতাড়ি উঠানে নামিয়া জ্যোৎস্নার আলোকে দেখিল মানদার ঘরের দ্বার বন্ধ এবং ভিতরে কেমন যেন “গোঁ গোঁ” শব্দ হইতেছে। সুহার কাঁদিয়া উঠিল; গোপালের মা চীৎকার করিতে করিতে পাশের বাড়ীর দিকে দৌড়িল “ওগো, তোমরা এসে গো! সৰ্ব্বনাশ হোলে! ছোট বাবু বড়-মাকে মেরে ফেলছে গো!”
চণ্ডী বাবুর বাড়ী তখন আত্মীয় কুটুম্বে পূর্ণ! গোপালের মায়ের চীৎকার এবং সুহারের ক্ৰন্দনের শব্দ শুনিয়া স্ত্রীপুরুষ যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, উৰ্দ্ধশ্বাসে এ-বাড়ীতে আসিয়া পড়িলেন। সকলের মুখেই “কি হয়েছে? ব্যাপার কি ?” শব্দ।
গোপালের মা চীৎকার করিয়া বলিল “ওগো, শীগগির বড় মায়ের ঘরের দোর ভেঙ্গে ফেল! হায় হায়, ছোটবাবু বুঝি তাকে মেরে ফেল্লে গো।”
তখন চণ্ডী বাবু ও আরও দুই তিনজন একসঙ্গে মানদার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া দেখেন দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। ঘরের মধ্যে কি যেন একটা ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ হইতেছে। আর বিলম্ব না করিয়া তাঁহারা দুয়ারে পদাঘাত করিতে লাগিলেন। চার পাঁচ আঘাতেই দ্বারের অর্গল ভাঙ্গিয়া গেল। ঘর অন্ধকার! মেজের এক কোণ হইতে কেবল একটা কাতরোক্তি শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। একজনের হাতে একটা দিয়াশলাই ছিল; সে একটা কাঠি জ্বালিতেই ঘরের মধ্যের অন্ধকার দূর হইল। সকলে সভয়ে দেখিল, মানদা ঘরের মেজের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহারই কণ্ঠ হইতে অব্যক্ত কাতরোক্তি বাহির হইতেছে। ঘরের চারিদিকে দেখিবার পূৰ্ব্বেই দিয়াশলাই নিবিয়া গেল। চণ্ডী বাবু বলিলেন “খবরদার, তোমরা দোর আগ্লে, দাঁড়াও, পাজিটা যেন পালাতে না পারে। আর একটা দিয়াশলাই জ্বাল।”
আর দিয়াসলাই জ্বালিতে হইল না; চণ্ডী বাবুর বাড়ী হইতে তিন-চারিটা লণ্ঠন আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রাঙ্গণ তখন লোকে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
চণ্ডী বাবু তখন চীৎকার করিয়া বলিলেন “ওগো, তোমরা মেয়েরা কে এসেছ, শীগ্গির ঘরের মধ্যে এস। বড়-বৌ যে কেমন করছেন?”
এই কথা শুনিয়াই চণ্ডী বাবুর দিদি অগ্রসর হইলেন। তাঁহাকে ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিয়াই দ্বারের নিকট যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা একটু সরিয়া দাঁড়াইলেন।
কালাচাঁদ তখন দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মনে করিল, এই তাহার পলায়নের সুযোগ; সে ঘরের অন্য যে দ্বার ছিল, তাহা খুলিবার উপায় ছিল না। সে তখন রমামুন্দরীকে এক ধাক্কা দিয়া বারান্দায় আসিয়া পড়িল। সকলেই সতর্ক ছিল—তাহার আর পলায়নের পথ হইল না। একজন তাহাকে এমন এক ধাক্কা দিল যে, সে বারান্দা হইতে একেবারে নীচের উঠানে পড়িয়া গেল। তিনচারি জন আসিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল; দু-চারটী উত্তম-মধ্যমও হইয়া গেল।
সিদ্ধেশ্বর বাবু বাহিরে উঠানে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি বলিলেন “আহা মেরো না গো! যাতে পালাতে না পারে, তাই কর। কোন অত্যাচার কোরে না।”
চণ্ডী বাবু তখন বারান্দা হইতে নামিতে নামিতে বলিলেন “ঘরের মধ্যে আর গোল করে কাজ নাই। মেয়েরাই যা হয় করবেন। তোমরা নেমে এস।”
প্রাঙ্গণে আসিয়া দেখেন, পাড়ার অনেক লোক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। চণ্ডী বাবু বলিলেন “আর এখানে গোল করে কাজ নেই; আমার ওখানে যাওয়া যাক্। সেখানে গিয়ে যা কৰ্ত্তব্য তা স্থির করা যাবে।” চাকরদের উদ্দেশ করিয়া বলিলেন “ওরে, তোরা তিন চারজন এখানে থাক, দিদি যা বলেন তাই করিস।”
রমাসুন্দরী ঘরের মধ্যে হইতেই বলিলেন “কোন ভয় নেই, জ্ঞান হয়েছে। ডাক্তার ডাকতে হবে না। তোমরা বাড়ীতে যাও।”
একজন বলিল “ওরে, হারামজাদা যেন পালিয়ে যেতে না পারে।” এই বলিয়া কালাচাঁদকে পদাঘাত করিল। কালাচাঁদের মুখে আর কথা নাই; সে চোরের মত, মার খাইতে লাগিল। যে মারিতে নিষেধ করে, সেও কিন্তু দুই-ঘা দিয়া পথ দেখায়।