Site icon BnBoi.Com

হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন (১) – জে. কে. রাওলিং

হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন (১) - জে. কে. রাওলিং

হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন (১)

০২. কাঁচের খাঁচার অন্তর্ধান

হ্যারি পটারকে যেদিন ডার্সলিরা কোলে তুলে নিয়েছিলেন, সেদিন থেকে দেখতে দেখতে দশটা বছর কেটে গেছে। তবে প্রিভেট ড্রাইভে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।

সূর্য আগের মতোই পূর্বদিকে উঠছে আর পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে যেদিন মিসেস ডার্সলি তার দরোজার সামনে থেকে হ্যারি পটারকে কুড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছিলেন, যে রাতে মি. ডার্সলি পেঁচা সম্পর্কে দুঃখজনক খবর শুনেছিলেন। সবই আগের মত চলছে, শুধু দেয়ালে ঝুলানো তাদের ছবিগুলো দেখে বোঝা যায় কত বছর পার হয়ে গেছে।

ডাডলিও আর এখন শিশু নয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। মেলা দেখতে যাচ্ছে। বাবার সাথে কম্পিউটারে গেমস খেলছে। ঘরে ঢুকে কিছুতেই বোঝা যাবে না এখানে ডাডলির কোন এক সঙ্গী আছে বা আর কেউ এখানে থাকে! হ্যারি পটার তখনও ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে ঘুমোতে পারল না। আন্ট পেতুনিয়ার কর্কশ কণ্ঠ তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। তার উচ্চ কণ্ঠ দিনের নীরবতা ভঙ্গ করল

এখনি উঠে পড়। এখুনি।

হ্যারি উঠে পড়ল।

তার আন্ট দরোজা ধাক্কাচ্ছেন।

হ্যারি, ওঠো বলে আন্ট পেতুনিয়া চিৎকার করছেন।

হ্যারি বুঝতে পারল তার আন্ট রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। চুলার ওপর কড়াই বসানো হচ্ছে।

পাশ ফিরে হ্যারি স্বপ্নের কথা ভাবছিল। একটু আগেই সে একটা মজার স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নে দেখছিল যে একটা উড়ন্ত মোটর বাইকে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আন্ট পেতুনিয়া দরোজার কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করলেন–হ্যারি তুমি কি উঠেছ?

উঠেছি। হ্যারি জবাব দিল।

তাড়াতাড়ি এদিকে এসো। আন্ট হ্যারিকে নির্দেশ দিলেন–তুমি শূকরের মাংসের দিকে খেয়াল রেখো। দেখো সবকিছু যেন পুড়ে না যায়। আমি চাই আজ ডাডলির জন্মদিনে সব কিছু নিখুঁত হোক।

হ্যারি বিড় বিড় করে কী যেন বলল।

আন্ট তাকে প্রশ্ন করলেন–হ্যারি, তুমি কি কিছু বলছিলে?

হ্যারি জবাব দিল–না, কিছু নাতো।

ডাডলির জন্মদিনের কথা তো সে ভুলে যেতে পারে না। হ্যারি বিছানা থেকে উঠে মোজা খুঁজতে লাগল। বিছানার নিচেই সে এক জোড়া মোজা পেল। মোজার ওপর থেকে একটি মাকড়সাকে তাড়িয়ে দিয়ে হ্যারি মোজা দুটি পরল। হ্যারি মাকড়সাকে ভয় পায় না কারণ কাবার্ডে অনেক মাকড়সা। আর সিঁড়ির নিচের ঘুপচির এই কাবার্ডেই হ্যারিকে ঘুমোতে হয়।

জামা পরে হ্যারি নিচে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। ডাডলির জন্মদিনের উপহারগুলোর জন্য টেবিলটাই দেখা যাচ্ছে না। জন্মদিনে ডাডলি তার পছন্দের সব জিনিসই পেয়েছে বলে মনে হলো। সে নতুন কম্পিউটার পেয়েছে, আরেকটা টেলিভিশন পেয়েছে, রেসের বাইক পেয়েছে।

ডাডলি কেন রেসের বাইক চেয়েছে এটা হ্যারির কাছে রহস্যই রয়ে গেল। কাউকে সাইকেল দিয়ে ধাক্কা মারার জন্য হলে ঠিক আছে। ডাডলি খুব মোটা এবং ব্যায়াম সে একেবারেই পছন্দ করে না। অবশ্য কাউকে ঘুষি মারা সেটা অন্য কথা–বিশেষ করে হ্যারিকে। এই ব্যায়ামটাই সে সব সময় করে থাকে। তবে হ্যারিকে বাগে পাওয়া সহজ ছিল না।

হ্যারি কিন্তু গায়ে–গতরে তেমন বড় হয়ে ওঠেনি। তার শরীর রোগা পাতলা। ডাডলির বড় জামা–কাপড়ে তাকে আরো বেশি রোগা দেখায়। আকারে–আয়তনে ডাডলি ছিল তার চার গুণ। হ্যারির মুখ পাতলা, হাঁটু গোল, চুল কালো আর চোখ উজ্জ্বল সবুজ। চোখে গোল কাঁচের চশমা। চশমায় অনেক সেলোটেপের টুকরো, কারণ ডাডলি প্রায়ই তার নাকে ঘুসি মেরে চশমা ভাঙতো। নিজের চেহারার যে জিনিসটা হ্যারির ভালো লাগে তা হলো তার কপালের চিকন দাগ। ঝিলিক মারা বিদ্যুতের মতো আঁকাবাঁকা।

তার কপালে এই দাগ কেন-এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আন্ট পেতুনিয়া জবাব দেন–যখন মোটর দুর্ঘটনায় তোমার বাবা–মা দুজনই মারা যান তখন থেকেই তোমার কপালে এই দাগ। এর বাইরে তুমি আমাকে আর কোন প্রশ্ন করো না।

হ্যারি জানে, ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকতে হলে-এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করা যাবে না।

হ্যারি যখন কড়াই-এ শূকরের মাংস উল্টাচ্ছিলো ঠিক তখনই আঙ্কল ভার্নন রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন।

চুল আঁচড়াওনি কেন? তিনি হ্যারির কাছে যেন কৈফিয়ত চাইলেন।

আঙ্কল ভার্নন সপ্তাহে একদিন পত্রিকার শিরোনামের ওপর চোখ বোলান এবং উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করেন–হ্যারির এখনই চুল কাটা দরকার। কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না। হ্যারির চুল যথারীতি বাড়তেই থাকে।

হ্যারি যখন ডিম ভাজছিল ঠিক তখনই ডাডলি এবং তার মা রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। ডাডলির চেহারার সাথে আঙ্কল ভার্ননের অনেক মিল আছে। ডাডলির মা বলেন, ডাডলির চেহারা শিশু এ্যাঞ্জেলদের মতো। আর হ্যারির কাছে মনে হয় ডাডলি পরচুলা পরা একটা শূকর।

টেবিলের ওপর ডিম ও শূকরের মাংস রাখতে হ্যারিকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। কারণ টেবিলে তেমন জায়গা নেই। আর ডাডলি তখন তার উপহারগুলো গুনছে।

উপহার গুনতে গুনতে ডাডলির মন একটু দমে গেল।

ডাডলি মন্তব্য করল–ছত্রিশটা, তার মানে গতবারের জন্মদিনের তুলনায় দুটি কম।

আন্ট বললেন-এর সাথে মার্জ আন্ট আর আমার উপহার যোগ কর। এবার গুণে দেখো কত হয়?

ঠিক আছে। তাহলে সাইত্রিশটা হলো –ডাডলির জবাবের মধ্যে ভীষণ ক্রোধের গন্ধ পেয়ে আন্ট পেতুনিয়া বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি বললেন–ঠিক আছে, আমরা আজ যখন বাইরে যাবো তখন তোমাকে আরো দুটা উপহার কিনে দেব।

ডাডলি মুহূর্তের জন্য কী যেন ভাবল। তারপর বলল–ঠিক আছে। তাহলে আমার উপহারের সংখ্যা হবে ত্রিশ।

আন্ট পেতুনিয়া কথা শেষ করলেন–লক্ষ্মীসোনা, সংখ্যা হবে ত্রিশ নয়, বেশি। ঊনচল্লিশ। আহ ডাডলি চেয়ারে বসে সবচে কাছের প্যাকেটটা হাতে তুলে বললো, তাহলে ঠিক আছে।

আঙ্কল ভার্নন মৃদু হাসলেন।

বাবার মতোই ডাডলি তার প্রাপ্যটা চাচ্ছে। এই বলে আঙ্কল ভার্নন ডাডলির চুলে আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন। ঠিক এই সময় ফোন বেজে উঠল। আন্ট পেতুনিয়া ফোন ধরতে চলে গেলেন। হ্যারি আর আঙ্কল ভার্নন দেখলেন ডাডলি তার উপহার সামগ্রীর মোড়ক খুলছে। ডাডলি একটা রেসিং বাইক পেয়েছে। পেয়েছে একটা সিনে–ক্যামেরা। কম্পিউটারের ১৬টা নতুন খেলা, একটা ভিডিও রেকর্ডার। ডাডলি মোড়ক খুলে সোনালি হাতঘড়িটা বের করল। এই সময় আন্ট পেতুনিয়া হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। তাকে ক্রুদ্ধ ও চিন্তিত মনে হল।

তিনি বললেন–দুঃসংবাদ, ভার্নন। মিসেস ফিগের পা ভেঙে গেছে। তিনি ওকে নিতে পারবেন না। এই বলে তিনি হ্যারির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।

ডাডলির চেহারায় অপ্রত্যাশিত আতঙ্ক দেখা গেল। হ্যারি অবশ্য হাফ ছেড়ে বাঁচল। প্রতি বছর ডাডলির জন্মদিনে তার বাবা–মা তাকে এবং এক বন্ধুকে নিয়ে সারাদিনের জন্য বাইরে যান। এ্যাডভেঞ্চার পার্ক, হামবার্গার বার বা সিনেমায়। প্রতি বছরই হ্যারিকে ফিগের কাছে রেখে যেতেন তাঁরা। ফিগ হচ্ছেন একজন উন্মাদ বৃদ্ধা, তিনি দুটো রাস্তার পরেই থাকেন। হ্যারি মিসেস ফিগকে একদমই পছন্দ করে না।

তাহলে এখন কি হবে? আন্ট পেতুনিয়া কথাগুলো বলে হ্যারির দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হল মিসেস ফিগের পা ভাঙার জন্য হ্যারিই দায়ী। ভার্নন বললেন–মার্জকে ফোন করা যেতে পারে।

বোকার মতো কথা বলো না ভার্নন। সে হ্যারিকে একেবারেই পছন্দ করে না–মিসেস ডার্সলির জবাব।

হ্যারির সামনেই ডার্সলি পরিবারে তাকে নিয়ে প্রায়ই এ ধরনের কথাবার্তা হতো। যেন হ্যারি ধারে–কাছেও নেই বা তারা যখন হ্যারি সম্পর্কে এমন অবজ্ঞার সুরে কথা বলতেন যে মনে হতো, তার এখানে কোন উপস্থিতিই নেই।

হ্যারি মনে মনে আশা করছিল একা থাকলে সে টেলিভিশনে তার খুশিমতো অনুষ্ঠান দেখতে এবং ডাডলির কম্পিউটার রুমেও যেতে পারবে।

তাদের কথাবার্তার মাঝখানে হ্যারি বলল–আমাকে তোমরা বাড়িতে রেখে যেতে পারো। আমি টিভি দেখে সময় কাটাব।

আন্ট পেতুনিয়া হ্যারির দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো যেন এইমাত্র তিনি তেতো কিছু মুখে দিয়েছেন।

তিনি মন্তব্য করলেন–ঘরে ফিরে দেখা যাবে সব তছনছ হয়ে গেছে।

আমি বাড়ির কোন কিছুর ক্ষতি করব না। হ্যারি বলল। কিন্তু কেউই তার কথা কানে তুললেন না।

আন্ট পেতুনিয়া বললেন–চলো চিড়িয়াখানায় যাই। এক গাড়িতে বসিয়ে রাখা যাবে।

গাড়িটা নতুন। নতুন গাড়িতে ও একা থাকতে পারবে না।

ডাডলি কাঁদতে শুরু করল। আসলে কাঁদা নয়। কাঁদার অভিনয়। ডাডলি জানে কাঁদলেই সে যা চায় তাই পায়।

দুষ্ট ছেলে এভাবে কাঁদে না। তার মা বললেন, তোমার মা কখনোই চাইবে না যে সে তোমার জীবনের এই দিনটা নষ্ট করে দিক।

আমি চাই না, একদম চাই না সে আমাদের সঙ্গে যাক। ডাডলি বলল–সে সবকিছু নষ্ট করে দেয়। এই বলে সে হ্যারির দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল।

ঠিক তখনই দরোজায় বেল বেজে উল। আন্ট পেতুনিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওহ ঈশ্বর, তারা এসেছে। কিছুক্ষণ পর মাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ডাডলির ঘনিষ্টতম বন্ধু পায়ার্স পলকিস। ডাডলির কান্না থেমে গেল। পায়ার্সের চেহারাটা যেন অনেকটা ইঁদুরের মতো। পায়ার্স পলকিস ডাডলির মজার বন্ধু। ডাডলি যখন লোকজনকে আঘাত করে তখন সে তাদের হাত পেছনে আধমোড়া করে বেঁধে ফেলে।

আধঘণ্টা পরেই হ্যারি গিয়ে বসল ডার্সলিদের গাড়িতে। হ্যারি ভাবতেও পারেনি তার এমন সৌভাগ্য হবে। গাড়িতে ডাডলি এবং পায়ার্সও আছে। তারা সকলেই যাবে চিড়িয়াখানায়।

আঙ্কল ভার্নন তারিকে সতর্ক করে দিলেন–সাবধান। কোনপ্রকার গগুগোল করবে না। গণ্ডগোল করলেই বড়দিন পর্যন্ত তোমাকে কাবার্ডে কাটাতে হবে।

সত্যি বলছি। আমি কোন রকম গণ্ডগোল করব না। হ্যারি আশ্বাস দিল।

আঙ্কল ভার্ননের মতো কেউই হ্যারির কথা বিশ্বাস করল না।

হ্যারিকে নিয়ে প্রায়ই অঘটন ঘটে। এর আগেও হ্যারি তাদের বিরক্ত করেছে।

সমস্যা হলো হ্যারিকে নিয়ে প্রায়ই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। তাকে নিয়ে ডার্সলি পরিবার মোটেই খুশি নন।

একবার সেলুন থেকে চুল কেটে হ্যারি বাড়িতে ফিরে আসতে আসতেই তার চুল আগের মত হয়ে যায়। আন্ট পেতুনিয়া দেখতে পান তার মাথার চুল আগের মতোই। যেন চুল কাটাই হয়নি। এতে তিনি বিরক্ত হলেন এবং রান্নাঘর থেকে কাঁচি এনে হ্যারির মাখা মুড়িয়ে দিলেন। কেবল কপালের দাগ ঢেকে রাখার জন্য সামনের দিকে কিছু রেখে দেয়া হলো। ডাডলি তাকে দেখে হাসছিল। সারারাত তার ঘুম হলো না। সে স্কুলের কথা ভাবছিল। সকালে উঠে দেখে হ্যারির মাথাভর্তি চুল, আন্ট কেটে দেয়ার আগে যে অবস্থা ছিল। এ কারণে আন্ট তাকে সাত দিন কার্ডের মধ্যে আটকে রাখলেন। যদিও হ্যারি বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যে সে এর কারণ জানে না।

আরেকদিন আন্ট পেতুনিয়া ডাডলির একটা পুরনো ঢোলা জাম্পারের ভেতর হ্যারিকে ঢুকানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যতই তিনি হ্যারির মাথা ঢুকাতে চান ততই জাম্পারের মুখটা ছোট হয়ে আসে। আন্ট পেতুনিয়া ভাবলেন, হয়তো ধোয়ার পর ছোট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত জাম্পারে হ্যারির মাথা ঢুকে এবং হ্যারি শাস্তি থেকে রেহাই পায়।

আরেকবার হ্যারি ভীষণ বিপদে পড়েছিল। তাকে একদিন স্কুল ভবনের ছাদে পাওয়া গেল। আসলে ছাদে সে স্বেচ্ছায় ওঠেনি। ডাডলির দুষ্টু বন্ধুরাই হ্যারিকে তাড়া করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী ডার্সলি দম্পতিকে একটা চিঠি লিখে জানান যে, হ্যারি স্কুলের ছাদে উঠেছে। হ্যারি রান্নাঘরের বাইরে বড় শিম গাছের পেছনে লাফ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। হ্যারির ধারণা বাতাস তাকে উড়িয়ে এত ওপরে তুলেছে।

কিন্তু আজ কোন গোলমাল হলো না। তার স্কুল, কাপ বোর্ড অথবা মিসেস ফিগ-এর বাঁধাকপির গন্ধভরা রুম থেকে ডাডলি ও পায়ার্স-এর সঙ্গে দিন কাটানো ভাল।

গাড়ি চালাতে চালাতে আঙ্কল ভার্নন আন্ট পেতুনিয়ার কাছে অভিযোগ করছিলেন। তিনি অভিযোগ করতে পছন্দ করেন। সচরাচর তার অভিযোগ হলো : কর্মরত লোকজন, হ্যারি, ব্যাংক, এরপর কাউন্সিল আবার হ্যারি বিষয়ক। আজ সকালে অভিযোগ হলো মোটরবাইক বিষয়ক।

…মোটরবাইক ক্ষেপাটে ও তরুণ মস্তানের মতো গর্জন করে চলে। একথা তিনি বললেন, যখন পাশ দিয়ে একটা মোটরবাইক অতিক্রম কর চলে গেল।

আমি মোটরবাইক নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। হ্যারির হঠাৎ মনে পড়ল। সে বলল, মোটরবাইকটি উড়ছিল।

আরেকটু হলেই ভার্ননের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ত। তিনি ডানদিকে ঘুরে হ্যারির দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকালেন। তার মুখ তখন বৃহদাকার মূলার মত। বললেন মোটরবাইক উড়তে পারে না!

ডাডলি ও পায়ার্স হাসছিল।

আমি জানি এটি উড়তে পারে না। হ্যারি বলল, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম।

এরপরই হ্যারি ভাবল, কিছু না বললেই ভাল হতো। সে কথা বলুক এটা ডার্সলি পরিবারের কেউ চায় না। তারা তাকে ঘৃণা করে। স্বপ্ন হোক বা কার্টুন হোক তাতে কিছু আসে যায় না। তারা মনে করবে এটা নিশ্চয়ই হ্যারির ভয়ঙ্কর কোন ব্যাপার।

দিনটি ছিল রোদ ঝলমলে শনিবার, ছুটির দিন। চিড়িয়াখানায় প্রচণ্ড ভিড়। ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক পরিবার এসেছে। ডার্সলি দম্পতি ডাডলি ও পায়ার্সের জন্য বড় সাইজের চকোলেট আইসক্রিম কিনে দিলেন। হ্যারিকে আড়াল করার আগেই যখন ভ্যানে বসা লাস্যময়ী মহিলা হ্যারির জন্য কি কেনা হবে জানতে চান, তখন একটি সস্তা লেমন আইস কিনে দেন। হ্যারি মনে মনে ভাবল, তাও মন্দ নয়।

দীর্ঘদিন পর হ্যারির একটা সুন্দর সকাল কাটল। ডাডলি এবং পিয়ার্স থেকে একটু ব্যবধান রেখেই হ্যারি হাঁটাহাঁটি করল। চিড়িয়াখানার রেস্তোরাঁয় তারা খাওয়া–দাওয়া সারল। দুপুরে খাবারের পর তারা সাপজাতীয় প্রাণীদের ঘর দেখতে গেল। ঘরটা ছিল খুব ঠান্ডা ও অন্ধকার। তবে দেয়ালের পাশের জানালাগুলোতে আলো জ্বালানো ছিল। ঘরে ছিল টিকটিকি, সাপ ও অনান্য সরীসৃপ। বিশাল আকারের বিষধর কোবরা, এমনকি মানুষকে পিষে মেরে ফেলতে পারে এমন মোটা একটি অজগর।

একটা বিশাল সাপ ঘুমিয়ে ছিল। ডাডলি ওর বাবাকে ফিস ফিস করে বলল–ওটাকে জাগাও।

আঙ্কল ভার্নন কাঁচে টোকা দিলেন, কিন্তু কোন কাজ হলো না। সাপটা একটুও নড়ল না। কিছুক্ষণ পর সাপটা মাথা তুলল। মনে হলো সাপটা হ্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারি সাপটাকে লক্ষ্য করল এবং আর কেউ সাপটাকে লক্ষ্য করছে কিনা এটাও দেখে নিল। না আর কেউ লক্ষ্য করছে

সাপটা তার মাখা আঙ্কল ভার্নন ও ডাডলির দিকে বাড়াল। চোখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। তারপর হ্যারির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলতে চাইল আমি তো সব সময় এরকমই ব্যবহার পেয়ে থাকি।

আমি তা জানি। হ্যারি বিড় বিড় করে বলল।

সাপটি জোরে জোরে মাথা নাড়াচ্ছে।

তুমি কোথা থেকে এসেছো?–হ্যারি জানতে চাইল।

সাপ লেজ দিয়ে কাঁচের গায়ের লেখা দেখাল–বোয়া কনসট্রিকটর, ব্রাজিল।

জায়গাটা কি বেশ ভালো? হ্যারি প্রশ্ন করল। সাপটা লেজ দিয়ে আবার গ্লাসের ওপর লেখা দেখাল। হ্যারি পড়তে পারল। এই সাপটাকে এই চিড়িয়াখানায় বড় করা হয়েছে।

হ্যারি বলল–তাহলে তুমি কখনও ব্রাজিল দেখনি? সাপ মাথা নেড়ে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি সজোরে চিৎকার করে উঠল ডাডলি। মিস্টার ডার্সলি। শিগগির এদিকে এসো। অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা দেখে যাও।

সবাই দৌড়ে এলো। ডাডলি সুযোগ পেয়ে হ্যারির পাঁজরে একটি ঘুষি বসিয়ে দিল।

হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে গেল। এরপর যা ঘটল তা আরো আশ্চর্যজনক। ডাডলি এবং পায়ার্স যখন কাঁচের দিকে তাকাল তখন তারা উডয়ে ওরে বাপরে বলে মাটিতে ছিটকে পড়ল।

হ্যারি বসে হাপাতে লাগল। একটু পর হ্যারি তাকিয়ে দেখে কাঁচের খাঁচাটা নেই। সাপটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সরীসৃপ ভবনে হৈচৈ ও শোরগোল পড়ে গেল। যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল। সাপটা যখন হ্যারির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন হ্যারি সাপের কণ্ঠে শুনল–আমি ব্রাজিল থেকে এসেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

সরীসৃপ ভবনের কীপার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

চিড়িয়াখানার পরিচালক আন্ট পেতুনিয়াকে এক কাপ মিষ্টি চা তৈরি করে খাওয়ালেন। তিনি বারবার তার কাছে মাফ চাইলেন।

সরীসৃপ ভবন থেকে পায়ার্সের বের হয়ে না আসা পর্যন্ত আঙ্কল ভের্নন অপেক্ষা করলেন।

সাপটা কারো কোন ক্ষতি করেনি। হ্যারির পায়ের পাশ দিয়ে সামনের দিকে চলে গেছে। কোন অঘটন ঘটেনি। তারা সবাই ভার্নন আঙ্কলের গাড়িতে উঠে পড়ল।

ডাডলি বলল–আরেকটু হলে সাপটা আমার পায়ে কামড় বসিয়ে দিত।

পায়ার্স বলল–আমাকে তো পাকে পাকে সাপটা জড়িয়ে ধরেছিল। আর সাপটা হ্যারির সাথে কথা বলেছিল। তাইনা হ্যারি?

আঙ্কল ভার্নন বারবার হ্যারির দিকে তাকালেন। তিনি হ্যারির ওপর খুবই অসন্তুষ্ট। রাগে আঙ্কল ভার্ননের মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছিল না। তারপরও আদেশ দিলেন, যাও কাবার্ডে যাও… তোমার জন্য কোন খাবার নেই।

বাড়িতে ফিরে আঙ্কল ভার্নন একটি চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন। আন্ট পেতুনিয়া ব্রান্ডি আনতে ছুটলেন।

হ্যারির ঠাঁই হলো অন্ধকার কাবার্ডে। সে ভাবছিল, তার যদি একটা ঘড়ি থাকত। ঘড়ি না থাকায় সে সময় জানতে পারল না। ডার্সলি পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা এটা তো সে বুঝতে পারছিল না। তারা না ঘুমোলে সে রান্নাঘরে যাবার কথা ভাবতেও পারে না।

প্রায় দশ বছর হ্যারি ডার্সলি পরিবারের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে। দশটা বছর খুব বিরক্তিকর ও কষ্টকর সময়। ছোটবেলার কথা, তার যতদূর মনে পড়ে, তার বাবা–মা যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তখনকার কথা। যে গাড়িতে ওর বাবা–মা দুর্ঘটনায় মারা যান, সেখানে সেও ছিল কিন্তু সে সময়ের কোন কথাই তার স্মরণ নেই।

কাবার্ডে যখন সে দীর্ঘক্ষণ তার অতীত স্মরণ করার চেষ্টা করছে, তখন এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখল। এক তীব্র সবুজ আলোক রশ্মি দেখে সে কপালের কাটা দাগে ব্যথা অনুভব করে। কপালের ব্যথা থেকে সে দুর্ঘটনার কথা মনে করতে পারে। কিন্তু সবুজ আলো? ওটা কোথা থেকে আসে? বাবা–মার কথা একেবারেই তার স্মরণে নেই। তার বাবা–মা সম্পর্কে কোন কথা হ্যারির আঙ্কল বা আন্ট তার সাথে বলতেন না। এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করাও হ্যারির জন্য বারণ ছিল। এই বাসায় তার বাবা–মার কোন ছবিও নেই।

হ্যারির বয়স যখন আরো কম ছিল তখন সে প্রায়ই স্বপ্ন দেখত, একজন অচেনা আত্নীয় এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। তার একমাত্র পরিচিত বলতে এই ডার্সলি পরিবার।

একবার আন্টের সাথে দোকানে কেনাকাটার সময় একজন লোক এসে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে তাকে চেনে কিনা। এ প্রশ্ন শুনে কোন কিছু না কিনেই আন্ট পেতুনিয়া দোকান থেকে বাইরে চলে এলেন।

একবার এক অচেনা মহিলা চলন্ত বাস থেকে হ্যারিকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলো। মহিলার গায়ে সবুজ পোশাক। চেহারাটা একটু বুনো ধরনের। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো–হ্যারি যখনই তাদের সাথে কথা বলতে চাইতো তারা অদৃশ্য হয়ে যেত। স্কুলে হ্যারির কোন বন্ধু ছিল না। সবাই জানতো এই ঢোলা জামা ও ভাঙা চমশা–পরা হ্যারি পটারকে ডাডলি এবং তার দুষ্টু বন্ধুরা কেউই পছন্দ করে না।

কেউ হ্যারির সাথে মিশতো না, কারণ ডাডলিকে চটাবার মতো সাহস কারোরই ছিল না।

০৩. যে চিঠি কেউই লেখেনি

ব্রাজিলিয়ান বোয়া সাপটা বের হয়ে যাওয়ার কারণে হ্যারিকে দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।

শাস্তিভোগের পর যখন সে কাবার্ড থেকে মুক্তি পেল তখন গরমের ছুটি চলছে। এরই মধ্যে ডাডলি তার নতুন সিনেমা ক্যামেরাটা ভেঙে ফেলেছে। নষ্ট করেছে রিমোট কন্ট্রোল এরোপ্লেন। তাছাড়া মিসেস ফিগ যখন ক্রাচে ভর করে প্রিভেট ড্রাইভের রাস্তা পার হচ্ছিলেন তখন ডাডলি তার রেইসিং সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়।

স্কুল ছুটি থাকায় হ্যারির বেশ ভালো লাগছে। তবে ডাডলির সাঙ্গপাঙ্গদের অত্যাচার থেকে কোন মুক্তি নেই। তারা প্রতিদিন এই বাসায় বেড়াতে আসে। পায়ার্স, ডেনিস, ম্যালকম এবং গর্ডন এরা সবাই নির্বোধ। ডাডলি ছিল এই নির্বোধদের দলপতি। তাদের প্রধান খেলা ছিল হ্যারির ওপর নির্যাতন চালানো।

এই কারণে হ্যারি ইচ্ছে করেই বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে কাটাতো। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। শিগগিরই ছুটি শেষ হয়ে যাবে। সেপ্টেম্বর মাসে হ্যারি সেকেন্ডারি স্কুলে যাবে। তখনই সে প্রথমবারের মতো ডাডলির হাত থেকে ছাড়া পাবে। ডাডলি ভর্তি হবে আঙ্কল ভার্ননের পুরনো স্কুলে। পায়ার্সও সেখানে ভর্তি হবে। হ্যারি ভর্তি হবে স্টোনওয়াল হাই-এ।

ডাডলি হ্যারিকে বললো–স্টোনওয়ালে কি হয় জানিস? প্রথমদিনই তোদের মাথা টয়লেটে ঢুকিয়ে রাখবে। একবার ওপর তলায় গিয়ে প্র্যাকটিস করে দেখ কেমন লাগে?

না, ধন্যবাদ। হ্যারি জবাব দিল। এই খারাপ টয়লেটে মাথা ঢোকাবার মতো নোংরা আর কিছু হতে পারে না। এই বলে হ্যারি দৌড়ে পালিয়ে গেল যাতে ডাডলি তাকে দিয়ে এ ধরনের প্র্যাকটিস না করাতে পারে।

জুলাই মাস। স্কুলের ইউনিফর্ম কেনার জন্য আন্ট পেতুনিয়া ডাডলিকে নিয়ে লন্ডন গেলেন। হ্যারিকে রেখে গেলেন মিসেস ফিগের কাছে। তার অবস্থা তখন এত খারাপ ছিল না। জানা গেল তিনি তার পোষা বিড়ালের একটাকে ডিঙোতে গিয়ে পড়ে গিয়ে এক পা ভেঙে ফেলেছেন। এর পর থেকে বিড়ালের প্রতি তার ভালোবাসার ঘাটতি পড়েছে। তিনি হ্যারিকে টিভি দেখতে দিলেন এবং বছরের পর বছর রেখে দেয়া কিছু বাসি চকোলেট কেকও খেতে দিলেন।

ওইদিন সন্ধ্যায় বসার ঘরে ডাডলি তার নতুন ইউনিফর্ম পরে হেঁটে দেখালো সবাইকে। স্মেলটিং স্কুলের মেরুন রঙের নিকার বোকার ইউনিফর্ম। হাতে একটা লাঠি। অপরকে পেটাবার জন্য। অবশ্যই শিক্ষকের দৃষ্টি এড়িয়ে। এটা পরবর্তী জীবনের জন্য ভাল ট্রেনিং বলে মনে করা হয়।

আঙ্কল ভার্নন ডাডলিকে নতুন ইউনিফর্মে দেখে খুব খুশি। তিনি খুশি হয়ে বললেন–আজ আমার জীবনে একটি পরম গর্বের দিন।

ডাডলিকে দেখে আন্টের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি বললেন–আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, ডাডলি এত বড় হয়ে গেছে। এসব কথায় হ্যারির হাসি পাচ্ছিল। সে বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলো।

পরদিন সকালে হ্যারি নাশতার জন্য রান্নাঘরে গেলে একটা বিশ্রী গন্ধ পেল। রান্নাঘরটা ছিল বড়সড়। সেখানেই খাবার টেবিল। মনে হচ্ছে ওখানে রাখা একটা বড় গামলা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। হ্যারি উঁকি দিয়ে দেখল যে বড় গামলায় ময়লা কাপড় পানিতে ভেজানো।

সে আন্ট পেতুনিয়াকে জিজ্ঞেস করল-এগুলো কি?

আন্ট ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিরেট কণ্ঠে বললেন-এগুলো তোমার স্কুলের ইউনিফর্ম।

হ্যারি মন্তব্য করল–আমি বুঝতে পারিনি যে এগুলো এত ভেজা হবে।

আন্ট বললেন–বোকার মতো কথা বলো না। আমি তোমার জন্য ডাডলির কিছু পুরনো কাপড় রঙ করে দিয়েছি। শেষ হলে দেখবে তোমাকে ঠিকই মানাচ্ছে।

হ্যারির মনে সন্দেহ দেখা দিলেও সে কোন প্রশ্ন করল না। ওই পোশাকে স্টোনওয়াল স্কুলে তাকে প্রথম দিন কেমন দেখাবে। তাকে দেখে মনে হবে সে হাতির চামড়ার পোশাক পরেছে।

ডাডলি এবং আঙ্কল ভার্নন ঘরে ঢুকে নাক কুঁচকালেন–কারণ হ্যারির ইউনিফর্ম থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন পত্রিকার পাতা খুললেন আর ডাডলি লাঠি দিয়ে টেবিল পেটাতে লাগল।

বাইরে ডাকবাক্সে পড়ার শব্দ শোনা গেল।

আঙ্কল ভার্নন বললেন–ডাডলি যাও তো, চিঠিগুলো নিয়ে এসো।

হ্যারি যাক না। ডাডলি বলল।

হ্যারি, যাও তো চিঠিগুলো নিয়ে এসো আঙ্কল ভার্নন বললেন।

ডাডলি, ওকে লাঠি দিয়ে খোঁচা মারো তো। আঙ্কল ভার্নন বললেন।

লাঠি তোলার আগেই হ্যারি উঠে ডাক বাক্সের দিকে রওনা দিলো।

হ্যারি গিয়ে দেখল পাপোসের ওপর তিনটা চিঠি পড়ে আছে। একটা পোস্টকার্ড এসেছে আঙ্কল ভার্ননের বোন মার্জের কাছ থেকে। তিনি আইলসঅউইটে ছুটি কাটাচ্ছেন। দ্বিতীয় চিঠি একটি বাদামী খামের ভেতর। কোন বিল থাকতে পারে এতে। তৃতীয় চিঠিতে লেখা–হ্যারির জন্য চিঠি, নিজের চিঠিটি হ্যারি হাতে তুলে নিল। তার বুক ধড়পড় করতে লাগল। তাকে তো এ পর্যন্ত কেউ চিঠি লেখেনি। তার কোন বন্ধু–বান্ধব বা আত্নীয়স্বজনও নেই। তাহলে কে লিখতে পারে? চিঠির খামে হ্যারির নাম লেখা। চিঠি যে হ্যারিকে লেখা এ ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই।

মি. এইচ. পটার
সিঁড়ির নিচের কাবার্ড
৪, প্রিভেট ড্রাইভ
লিটল হুইংগিং
সারে

চামড়ার মতো শক্ত হলুদ খামে সবুজ অক্ষরে লেখা ঠিকানাটা। ওপরে কোন ডাকটিকেট নেই। হ্যারি খামটা উল্টেপাল্টে দেখল। তার বুক কাঁপছিল। হ্যারি দেখল, খামের ওপর কতগুলো রঙিন ছাপ–সিংহ, ঈগল আর সাপের। চারদিকে বড় অক্ষরে ইংরেজি এইচ লেখা আছে।

রান্নাঘর থেকে আঙ্কল ভার্নন চিৎকার করলেন হ্যারি, জলদি এসো। ওখানে তুমি কী করছ। তুমি কি পত্ৰবোমা পরীক্ষা করছ?

নিজের রসিকতায় আঙ্কল ভার্নন নিজেই হাসলেন।

হ্যারি রান্নাঘরে আঙ্কল ভার্ননের হাতে দুটো চিঠি দিল। তারপর তার নিজের চিঠি খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আঙ্কল ভার্নন চিঠিটা খুলে দেখলেন এবং বিরক্তির সাথে পোস্টকার্ডটি দেখলেন। আন্ট পেতুনিয়াকে বললেন, শুনছ, মার্জ নাকি অসুস্থ। কী এক ঝামেলা।

ঠিক এই সময় ডাডলি দৌড়ে এসে বলল–বাবা, হ্যারি যেন কিছু পেয়েছে।

হ্যারি চিঠিটার ভাঁজ খুলতে যাচ্ছিল। এই চিঠিটার কাগজটিও খামের মত শক্ত। চিঠি খোলার আগেই আঙ্কল ভার্নন এসে হ্যারির হাত থেকে চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন।

এ চিঠি তো আমার। এই বলে হ্যারি চিঠি ফেরত নেয়ার চেষ্টা করল।

তোমাকে আবার কে চিঠি লিখবে। আঙ্কল ভার্নন ঠাট্টা করে বললেন। হাতে ধরা চিঠিটা তিনি বার বার পরখ করে দেখলেন। তারপর পড়তে শুরু করলেন। তার মুখের রঙ ট্রাফিক লাইটের মতো বদলাতে লাগল। লাল থেকে সবুজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখের রঙ হয়ে গেল ধূসর শাদা। অনেকটা পুরনো পরিজের মতো।

তিনি চিৎকার করে উঠলেন–পে–পে–পে–তুনিয়া।

ডাডলি চিঠিটা পড়ার জন্য হাতে নেয়ার চেষ্টা করল। নাগালের বাইরে থাকায় সে ধরতে পারল না। আন্ট পেতুনিয়া চিঠিটা পড়লেন। প্রথম লাইন পড়েই তার ভিরমি খাবার জোগাড়। তিনি চিৎকার করে উঠলেন–ভার্নন, ওহ মাই গুডনেস, ভার্নন?

আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়া পরস্পরের দিকে তাকালেন। ঘরে যে ডাডলি আছে তা তারা ভুলেই গেলেন। তবে ডাডলি এ পরিবারে কখনোই অবহেলিত নয়। সে তার লাঠি দিয়ে তাঁর বাবার মাথায় মৃদু টোকা দিল। তারপর চিৎকার করে বলল–আমি চিঠিটা পড়তে চাই।

হ্যারি বলল–আমি চিঠিটা পড়তে চাই। কারণ আমাকে লেখা।

তোমরা দুজনই ঘর থেকে বেরোও। আঙ্কল ভার্নন ডাডলি ও হ্যারিকে ধমক দিলেন। অবশেষে হ্যারি আর ডাডলিকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়ার পর তিনি নিজেই দড়াম করে রান্নাঘরের দরোজাটা বন্ধ করে দিলেন।

আন্ট পেতুনিয়া বললেন–ভার্নন দেখো তো, চিঠিতে কি ঠিকানা লেখা আছে। হ্যারি কোথায় ঘুমায় এটা তারা জানল কী করে? তোমার কি মনে হয় না, তারা আমাদের বাসার ওপর নজরদারি করছে?

নজরদারি?…তার মানে গোয়েন্দাগিরি। তুমি বলতে চাইছ কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।

তাহলে আমরা কী করব ভার্নন? আমরা কী লিখে দেব–আমরা এ ধরনের কিছু আশা করিনা।

আঙ্কল ভার্নন বললেন–আমরা বিষয়টা আমলে আনব না। ওরা যাতে কোন উত্তর না পায়, সেটাই ভালো হবে।

কিন্তু….

আমি ঘরে এসব ঘটতে দেব না, পেতুনিয়া। আঙ্কল ভার্নন বললেন আমরা যখন ওকে ঘরে এনেছিলাম তখনই কি আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি–তার মগজে যা কিছু খারাপ আছে সব ঝেটিয়ে বিদেয় করব!

ওইদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আঙ্কল ভার্নন এমন এক কাজ করলেন যা তিনি জীবনেও করেননি। তিনি কাবার্ডে হ্যারিকে দেখতে গেলেন।

হ্যারি তাকে প্রশ্ন করল, আমার চিঠি কোথায়? কে আমাকে চিঠি লিখেছে?

আঙ্কল ভার্নন বললেন–ভুল করে খামে তোমার ঠিকানা লেখা হয়েছিল। আমি সেই চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলেছি।

খামে ভুল ঠিকানা লেখা হয়নি। হ্যারি দৃঢ়তার সাথে বলল-এমনকি ওখানে আমার কাবার্ডের ঠিকানাও ছিল।

চুপ। আর কোন কথা নয়। আঙ্কল ভার্নন ভীষণ জোরে ধমক দিলেন। তার ধমকের শব্দে সিলিং থেকে কয়েকটি মাকড়সা নিচে পড়ে গেল।

ধমকের পর পরিবেশ সহজ করার জন্য তিনি হাসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার চেহারার কাঠিন্য কিছুতেই দূর হলো না।

হ্যাঁ, হ্যারি। আঙ্কল ভার্নন বললেন–আমি আর তোমার আন্ট ভাবছিলাম–যেহেতু তুমি বড় হয়েছে সেহেতু তোমাকে আর কাবার্ডে রাখা হবে না। তুমি ডাডলির দ্বিতীয় শোবার ঘরে চলে যাও।

কেন? হ্যারি প্রশ্ন করে বসল।

কোন প্রশ্ন করা যাবে না। আঙ্কল কড়া ভাষায় বললেন–তোমার মালামাল ওপরে নিয়ে যাও।

ডার্সলি পরিবার যে বাড়িতে থাকে সেখানে চারটা কক্ষ। একটায় থাকেন আঙ্কল আর আন্ট, দ্বিতীয় কক্ষটি অতিথিদের জন্য পৃথক করে রাখা হয়েছে, আরেকটাতে থাকে ডাডলি। সর্বশেষ ঘরটা সব থেকে ছোট, এখানে ডাডলির সব খেলনার জিনিসে ভরা। ডাডলির শয়নকক্ষে এগুলোর স্থান সংকুলান হয় না।

অন্যদিকে হ্যারির জিনিসপত্র এত কম যে কাবার্ড থেকে মালামাল নিয়ে সে একবারেই উপরে উঠে গেল।

হ্যারি বিছানায় বসে চারদিকে তাকাল। ঘরের প্রায় সব জিনিসই ভাঙা।

মাত্র এক মাসের পুরনো সিনেমা ক্যামেরাটি ভাঙা, ভাঙা টেলিভিশনও, এছাড়া আছে পাখির একটি বড় খাঁচা, যেটায় কাকাতুয়া থাকত। এছাড়াও আছে ভাঙা এয়ারগান। র‍্যাকগুলোতে অসংখ্য বই। বই গুলো দেখেই বোঝা যায় যে এখনও কেউ স্পর্শ করেনি। নিচ থেকে ডাডলির বিরক্তির কথা শোনা যাচ্ছিল মা, আমি চাই না সে ওই ঘরে থাকুক। সে এখানে থাকতে পারবে না। ঘরটা আমার, ঘরটা আমার লাগবে।

হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর ভাবতে লাগল, গতকাল হলেও ওপরতলার ঘরে আসার জন্য হ্যারি সম্ভব সব ধরনের চেষ্টাই চালাত। আর আজ তার কাছে কাবার্ডই বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ কাবার্ডের ঠিকানাতেই তার চিঠিটা এসেছে।

***

পরদিন সকালে সবাইকে শান্ত দেখা গেল। কিন্তু ডাডলির রাগ আর ছটফটানি দেখে কে? সে বাবাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল। মাকে লাথি মারল। তার ছোট খরগোশটা ছুঁড়ে ফেলল। হ্যারি ঘর ছাড়েনি। আঙ্কল আর আন্ট গম্ভীর মুখে পরস্পরের দিকে তাকালেন।

পরদিন যখন ডাকপিয়ন এলো তখন আঙ্কল ভার্নন হ্যারিকে নয়, নরম স্বরে ডাডলিকে বললেন–বাবা যাও তো! চিঠিগুলো নিয়ে এসো। ডাডলি তার লৌহদণ্ডে দুম দাম শব্দ করতে করতে হল ঘর পার হয়ে চিঠি আনতে দরোজার দিকে গেল।

সেখান থেকেই ডাডলি চিৎকার করে উঠল, আবার একটা চিঠি এসেছে। ঠিকানা লেখা আছে–

মি, এইচ পটার
স্মলেস্ট বেডরুম
৪ প্রিভেট ড্রাইভ

আর্তনাদ করে উঠলেন আঙ্কল ভার্নন এবং চেয়ার থেকে উঠে হল রুমের দিকে ছুটলেন। হ্যারি তার পেছনে পেছনে ছুটলো। চিঠিটা হাতে নেয়ার জন্য ডাডলিকে মাটিতে ফেলে দিলেন ভার্নন। এদিকে হ্যারি পেছন থেকে তার গলা ধরে ঝুলে পড়ার কারণে চিঠিগুলো ডাডলির কাছ থেকে কেড়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। প্রত্যেকের গায়েই লোহার রডটা আঘাত করেছে। একটা বিভ্রান্তিকর এলোমেলো পরিস্থিতির পর পর–আঙ্কল ভার্নন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, দীর্ঘশ্বাস নিলেন এবং হ্যারিকে লেখা চিঠিখানা খামচে ধরলেন।

আঙ্কল ভার্নন নির্দেশ দিলেন–হ্যারি তোমার কাবার্ডে… মানে তোমার শোবার ঘরে যাও…. আর ডাডলি তুমিও এখান থেকে ভাগো।

হ্যারি তার নতুন শোবার ঘরের বাইরে পায়চারি করতে লাগল। হ্যারি নিশ্চিত হল–তাকে যিনি চিঠি দিয়েছেন তিনি জেনেছেন হ্যারির ঘর বদল হয়েছে এবং হ্যারি আগের চিঠিটা পায়নি। তিনি নিশ্চয়ই আবার চিঠি লিখবেন। এবার তাকে চিঠিটা পেতেই হবে। হ্যারি একটা পরিকল্পনার কথা ভাবতে লাগল। সে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখল।

পরদিন সকাল ৬টায় ভাঙা ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে উঠল। ভোরের আলো তখনও ঘরে প্রবেশ করেনি। হ্যারি অ্যালার্ম বন্ধ করে চুপি চুপি জামা পরে নিল। ডার্সলি পরিবারের কাউকেই সে জাগাবে না। কোন বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। হল ঘর পার হয়ে সে দরোজার কাছে গেল। তার ইচ্ছে ছিল প্রিভেট ড্রাইভের কোনায় দাঁড়ানো যাতে ডাক পিয়ন আসা মাত্রই সে চিঠি তার হাতে নিতে পারে! দরোজার কাছাকাছি পা দিতেই…

হঠাৎ আ–র–র–র—

হ্যারি লাফ দিয়ে উঠল। আরে পাপোসের ওপরে কি যেন! আরে এ যে জীবন্ত প্রাণী।

হ্যারির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। এ কী, এ যে আঙ্কল ভার্নন। তিনি দরোজার গোড়ায় একটি স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়ে আছেন। হ্যারি এমন কিছু একটা করবে তার মনে আগেই সন্দেহ হয়েছিল। আঙ্কল ভার্নন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা হ্যারিকে বকাঝকা করলেন। তারপর হুকুম দিলেন চা বানাবার জন্য। হ্যারিকে রান্নাঘরে ঢুকতে হল। চা নিয়ে এসেই হ্যারি দেখে যে ডাকপিয়ন এসে গেছে এবং চিঠিগুলো আঙ্কল ভার্ননের কোলে। হ্যারি লক্ষ্য করল তিনটা চিঠিই সবুজ কালি দিয়ে লেখা।

হ্যারি বলল–আমার চিঠি কোথায়?

এর মধ্যে আঙ্কল ভার্নন সব চিঠির খাম খুলে ফেলেছেন।

তোমাকে আবার কে চিঠি লিখবে? আঙ্কল ভার্নন প্রশ্ন করলেন। তোমাকে কেউই চিঠি লিখবে না। আঙ্কল ভার্নন আবার বললেন–ওই চিঠিতে ভুল করে তোমার নাম লেখা হয়েছিল।

আমার চিঠি কোথায়? হ্যারি প্রশ্ন করল। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আঙ্কল ভার্নন হ্যারির সামনেই সবগুলো চিঠি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন।

তিনি সেদিন আর অফিসে গেলেন না। সারাদিন বাসায় কাটালেন। ডাকবাক্সটাতে এমনভাবে পেরেক ঠুকে দিলেন যাতে এখানে কেউ চিঠি ফেলতে না পারে।

ভালোই হলো। আন্ট পেতুনিয়া মন্তব্য করলেন-এখন তারা আর চিঠি দিতে পারবে না। চিঠি দিতে হলে তাদেরকে ওপরে উঠতে হবে।

আঙ্কল ভার্নন ততটা আশ্বস্ত হতে পারলেন না। তিনি বললেন-এসব লোক আমাদের মত নয়। সব সময়ই এরা নতুন নতুন ফন্দি–ফিকির বের করতে জানে।

***

শুক্রবারে হ্যারির নামে কম করে হলেও বারোটা চিঠি এলো।

ডাকবাক্সে ফেলা সম্ভব হয়নি বলে চিঠিগুলি এবার দরোজার নিচের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু চিঠি বাথরুমের জানালা দিয়েও ভেতরে ফেলা হয়েছে। আঙ্কল ভার্নন এদিনও অফিসে গেলেন না। বাসাতেই কাটালেন। তিনি হাতুড়ি, পেরেক আর ছোট ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে দরোজা ও জানালার সবগুলো ফাঁক বন্ধ করলেন।

শনিবারে আরো বড়ো অঘটন ঘটল। হ্যারির নামে চব্বিশটা চিঠি এলো। চিঠিগুলো দুডজন ডিমের বাক্সের ভেতর পাঠানো হয়েছিল। ডেইরির লোকেরা কিছু বুঝতে না পেরেই শয়নকক্ষের জানালা দিয়ে ডিমগুলোর সাথে চিঠিগুলো আন্ট পেতুনিয়ার কাছে দিয়েছিল। ক্ষিপ্ত হয়ে আঙ্কল ভার্নন ডাকঘর আর ডেইরিতে বার বার ফোন করলেন। আর আন্ট পেতুনিয়া চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ফুড মিক্সচারে দিয়ে নষ্ট করে ফেললেন।

ডাডলি বিস্ময়ের সাথে হ্যারিকে প্রশ্ন করল–তোমার সাথে কথা বলার জন্য কে এমন উতলা হল?

***

রোববার সকালে আঙ্কল ভার্নন নাশতার টেবিলে বসলেন। তিনি পরিশ্রান্ত। তবে তাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল।

তিনি বললেন–আজ রোববার, ছুটির দিন। আজ আর কোন চিঠি আসবে না।

কিন্তু হঠাৎ রান্নাঘরের চিমনিতে শব্দ শোনা গেল। কিছু যেন গড় গড় করে চিমনি বেয়ে নিচে পড়ছে। তিনি যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। উনুনের চিমনি দিয়ে তিরিশ চল্লিশটা চিঠি বুলেটের মত বেরিয়ে এল। ডার্সলি পরিবারের সবাই অবাক। আর চিঠিগুলো ধরার জন্য হ্যারি লাফ দিল।

বের হও! এখান থেকে বের হও!

আঙ্কল ভার্নন হ্যারির কোমর জড়িয়ে ধরে উঁচু করে তাকে রান্নাঘর থেকে হল ঘরে ছুঁড়ে ফেললেন। আন্ট পেতুনিয়া আর ডাডলি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বাইরে চলে গেল। আঙ্কল ভার্নন দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। চিঠিগুলো দেয়াল এবং মেঝেতে এসে পড়েছে-এ শব্দ তাদের কানে আসছিল। রাগে ক্ষোভে টান দিয়ে গোঁফ ছিঁড়তে ছিঁড়তে আঙ্কল ভার্নন বললেন–তোমাদেরকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে তোমরা তোমাদের গুটি কয়েক জামা–কাপড় নিয়ে নিচে নেমে আসবে। আমরা এখান থেকে চলে যাব। এই বিষয়ে আর কোন কথা নয়।

আঙ্কল ভার্ননের অর্ধেক গোঁফ উড়ে যাওয়ায় তাকে খুবই ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। তাই কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করতে সাহস করল না। সবাই গিয়ে গাড়িতে বসল। ডাডলি পেছনে বসে ফুঁসছিলো। কারণ সে তার টেলিভিশন, ভিডিও আর কম্পিউটার সাথে নেয়ার জন্য প্যাক করছিলো। আঙ্কল ভার্নন তার মাথার চারদিক চেপে তাকে জোর করে উঠিয়ে দেন।

গাড়ি চলছে তো চলছেই। আন্ট পেতুনিয়ারও সাহস হলো না প্রশ্ন করে, গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন একটু পর পরই ডানদিকে বামদিকে কঠিন মোড় নিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলেন।

খাওয়া–দাওয়ার জন্যও গাড়ি কোথাও থামল না। সন্ধ্যা হতেই ডাডলির বিলাপ শোনা যেতে লাগল। তার জীবনে কোন দিন এত খারাপ যায়নি। সে খুবই ক্ষুধার্ত। সে টেলিভিশনের পাঁচটা প্রোগ্রাম মিস করেছে যা সে দেখতে চেয়েছিল। তাকে এত খেসারত দিতে হবে জানলে সে গাড়িতেই উঠত না। অবশেষে আঙ্কল ভার্নন এক শহরতলীতে এসে একটা হোটেলের সামনে তার গাড়ি থামালেন। একটা ঘরে দুটো নোংরা বিছানায় হ্যারি আর ডাডলিকে খাকতে হল। ডাডলি বিছানায় পড়েই নাক ডাকা শুরু করল। হ্যারির চোখে কোন ঘুম নেই। হ্যারি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চলন্ত গাড়িগুলোর আলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

পরদিন সকালের নাশতায় তারা খেলো বাসি কর্নফ্লেক ও টোস্টের সাথে টিনের টমেটো। নাশতা খাবার পর পরই হোটেলের মালিক তাদের টেবিলে এলেন।

তিনি বললেন-এক্সকিউস মি, আপনাদের মধ্যে হ্যারি পটার কে? তাঁর নামে ফ্রন্ট ডেসকে একশ চিঠি এসেছে।

হোটেলের মালিক ভদ্রমহিলা একটা চিঠি তাদের সামনে তুলে ধরলেন। সবুজ কালিতে লেখা–

মি. এইচ. পটার
কক্ষ নং–১৭
রেইলভিউ হোটেল
ককওয়ার্থ

চিঠিটা নেবার জন্য হ্যারি হাত বাড়াল। হ্যারির হাতটি আঙ্কল ভার্নন সরিয়ে দিলেন। হোটেলের মালিক ভদ্রমহিলা বিস্মিত হলেন। আঙ্কল ভার্নন উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে বললেন–চলুন। আমি চিঠিগুলো নেব।

***

কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আন্ট পেতুনিয়া ভয়ে ভয়ে বললেন–ঘরে ফিরে গেলে কি ভালো হত না?

কিন্তু আঙ্কল ভার্নন তার কথায় কান দিলেন না। তিনি যে ঠিক কী চাইছেন তা অন্য কেউ জানে না। তিনি গাড়ি চালিয়ে একটি গভীর বনে প্রবেশ করলেন। গাড়ি থেকে নামলেন। চারদিকে তাকালেন। মাথা নাড়লেন। আবার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। এ রকম ঘটনা আরো একাধিকবার ঘটল।

ডাডলি বলে উঠল–বাবার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

সমুদ্র উপকূলের কাছে এসে আঙ্কল ভার্নন গাড়ি পার্ক করলেন। সবাইকে গাড়ির ভেতর বসিয়ে রেখে কোথায় যেন গেলেন। বাইরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গাড়ির ছাদেও বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল।

ডাডলি তার মাকে বলল–আজ সোমবার। আজ রাতে টিভিতে দ্য গ্রেট হামবেটেসি আছে। আমি যদি টিভি আছে এমন স্থানে থাকতে পারতাম।

সোমবার হ্যারিকে কষ্ট করে মনে করতে হয় না, আজকে কি বার। কোনদিন সোমবার তা জানার জন্য ডাডলির ওপর নির্ভর করা যায়, কারণ সোমবারের টিভির প্রিয় এই প্রোগ্রামের জন্য দিন গুনতে থাকে সে। আগামীকাল মঙ্গলবার। আগামীকাল হ্যারির একাদশ জন্মদিন। অবশ্য এ বাড়িতে হ্যারির জন্মদিনের কোন গুরুত্ত্ব নেই। গত জন্মদিনে সে ডার্সলি পরিবার থেকে পেয়েছিল একটি কোট হ্যাঙার এবং আঙ্কল ভার্ননের এক জোড়া পুরনো মোজা। প্রতিদিনই তো বয়স এগারো থাকে না।

আঙ্কল ভার্নন ফিরে এলেন। মুখে ঈষৎ হাসি। হাতে লম্বা ও সরু একটা প্যাকেট।

কী কিনেছো? আন্ট পেতুনিয়া জানতে চাইলেন। তিনি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন–চমৎকার একটা জায়গা পেয়েছি। সবাই গাড়ি থেকে নামো।

গাড়ির বাইরে খুব ঠাণ্ডা। আঙ্কল ভার্নন যে জায়গাটা দেখালেন সেটা একটা শিলাময় ছোট দ্বীপ। এর মাঝখানে পুরনো একটা ছোট বাড়ি। এ বাড়িতে যে কোন টেলিভিশন নেই–তা হলফ করেই বলা যায়।

আঙ্কল ভার্নন বললেন–আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে আজ রাতে ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বীপটাতে যাবার জন্য এই ভদ্রলোক আমাদেরকে তার নৌকাটা ধার দিয়েছেন।

ফোকলা মুখের এক বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে একটা নৌকা দেখিয়ে তাদের সেদিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তার মুখে কপট হাসি।

আমার কাছে এখনো কিছু খাবার আছে। সবাই নৌকায় ওঠো। আঙ্কল ভার্ননের নির্দেশ।

নৌকাতে হিমেল হাওয়া। সাথে বৃষ্টি। সবাই ঠাণ্ডায় অস্থির। মনে হলো কয়েক ঘণ্টা যাত্রার পর তারা দ্বীপে পৌঁছল। আঙ্কল ভার্নন তাদেরকে একটি ভাঙা বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

বাড়ির ভেতরটা ছিল আরো ভয়ঙ্কর। ঘরের ভেতরে সামুদ্রিক আগাছার গন্ধ। ফায়ার প্রেস স্যাঁতসেঁতে, কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রের বাতাসের শো শো শব্দ। বাড়িতে মাত্র দুটো কক্ষ।

আঙ্কল ভার্ননের খাবার ভাণ্ডারে যা ছিল তা হল মাত্র এক প্যাকেট মচমচে বিস্কুট ও এক হালি কলা।

তিনি ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানে কোন কাঠ নেই, একেবারেই খালি।

আঙ্কল ভার্নন আনন্দের সাথে মন্তব্য করলেন–যাক, এখানে কোন চিঠি আসবে না। তিনি নিশ্চিত যে এই ঝড়ের রাতে কেউ তাদের কাছে আসতে পারবে না। রাত নামলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মোতাবেক ঝড় শুরু হলো। সমুদ্রের তরঙ্গ দেয়ালে ছিটকে পড়ছে। বাইরের ঝড়ো বাতাস জরাজীর্ণ ও নোংরা জানালায় আঘাত করছে।

আন্ট পেতুনিয়া একটা পোকায়–কাটা সোফার ওপর কম্বল বিছিয়ে ডাডলির শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়া পাশের কক্ষে চলে গেলেন। হ্যারি মেঝের ওপর একটা ছেঁড়া পাতলা কম্বল বিছিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঝড়ের বেগও বাড়তে লাগল। হ্যারি ঘুমোতে পারল না। একটু আরাম পাবার জন্য এপিঠ–ওপিঠ করছে। পেট খিদেয় চো চো করছে। অপরদিকে ডাডলি নিশ্চিন্তে নাক ডাকছে। তার হাতঘড়ির আলো একটু পর পর ঠিকরে পড়ছে। অন্ধকারে ঘড়ির আলো থেকে হ্যারি বুঝতে পারল আর দশ মিনিটের ভেতর তার বয়স এগারো পূর্ণ হবে। ডাডলি ভাবছিল পত্রলেখক এখন কোথায়।

পাঁচ মিনিট পর হ্যারি বাইরে যেন কিসের আওয়াজ শুনল। তার ভয় হচ্ছিল–ছাদ মাথার ওপর ভেঙে পড়বে না তো? ছাদ ভেঙে পড়লে সে অবশ্য আরো বেশি উষ্ণতা উপভোগ করতে পারত।

আর চার মিনিট বাকি–হয়তো বা প্রিভেট ড্রাইভে এত চিঠি আসবে যে সারা বাড়ি চিঠিতে ভরে যাবে। সেখান থেকে যেভাবেই হোক অন্ততঃ একটা চিঠি চুরি করতে হবে। তিন মিনিট বাকি।

সমুদ্রের ঢেউ কি এ বাড়ির ওপর আছড়ে পড়ছে।

এখনও দু মিনিট বাকি।

অদ্ভুত শব্দ। সাগরে শিলাখণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে?

আর একটা মিনিট।… তিরিশ সেকেন্ড… কুড়ি সেকেন্ড…. দশ,.. নয়… বিরক্ত করার জন্য হলেও ডাডলিকে জাগাবে কি?

তিন… দুই… এক… বুম। বুম।

হঠাৎ বিকট আওয়াজ।

গোটা দ্বীপটা কেঁপে উঠল, হ্যারির দরোজায় কে যেন খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ছে। কে যেন ভেতরে আসতে চায়।

০৪. চাবির রক্ষক

বুম। বুম। দরোজায় আবার ধাক্কার শব্দ। ডাডলি লাফ দিয়ে জেগে উঠল।

কামানের শব্দ? সে বোকার মত প্রশ্ন করল।

তাদের পেছনে একটি বিকট শব্দ শোনা গেল। আঙ্কল ভার্নন ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটি রাইফেল। এখন তারা বুঝতে পারল তিনি সরু লম্বা প্যাকেটে কি এনেছিলেন।

কে ওখানে? আঙ্কল ভার্নন চিৎকার করে উঠলেন–সাবধান, আমার হাতে অস্ত্র আছে

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর আবার…

ধ পা স

দরোজায় এমন জোরে ধাক্কা লাগল যে কান–ফাটানো আওয়াজে দরোজার সব পাল্লা মাটিতে পড়ে গেল। দরোজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে এক অতিকায় মানুষ–দৈত্য বললেও ভুল হবে না। চুল–দাঁড়িতে মুখ প্রায় ঢাকা। জ্বলজ্বলে চোখ। তার মাথা গিয়ে ঠেকেছে ঘরের ছাদ পর্যন্ত। মাথা নত করে পিঠ বাঁকিয়ে কুঁজো হয়ে দৈত্যটা ঘরে ঢুকে গেলেন। সে মাথা নিচু করে দরোজাটি হাতে তুলে নিলেন এবং জায়গামতো বসিয়ে দিল। বাইরে ঝড়ের গর্জন কিছুটা কমল। দৈত্যটা সবার দিকে তাকাল।

আমাকে কি এক কাপ চা বানিয়ে দেয়া যায়? পথে যা ধকল সহ্য করেছি।

তারপর সে সোফার দিকে এগিয়ে গেল যেখানে ডাডলি ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে।

দৈত্য বলল-এই মটু উঠে দাঁড়া।

ডাডলি ভয়ে জড়সড় হয়ে মাকে আড়াল করে লুকোবার জন্য ছুটল। আঙ্কল ভার্ননের পেছনে তিনিও ভয়ে কাঁপছিলেন।

আরে এইতো হ্যারি। দৈত্য হ্যারিকে দেখে বলল। হ্যারি দৈত্যাকার লোকটার দিকে তাকাল। লোকটার মুখে স্মিত হাসি।

দৈত্যাকার লোকটা হ্যারিকে বলল–আমি তোমাকে প্রথম যখন দেখি তখন তুমি মাত্র একটি ছোট্ট শিশু। তোমাকে ঠিক তোমার বাবার মত দেখাচ্ছে। অবশ্য তোমার চোখ দুটো তোমার মায়ের মতো।

আঙ্কল ভার্ননের গলায় ঘাড় ঘ্যাঙ শব্দ।

তিনি বললেন–তুমি এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও। এটা আমার হুকুম। তুমি দরোজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছো।

চুপ করো, নির্বোধ–দৈত্য দাপটের সাথে ধমক দিল। সে সোফার পেছনে গিয়ে আঙ্কল ভার্ননের হাত থেকে রাইফেলটি নিয়ে নিল। রাইফেলটাকে বাঁকিয়ে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলল। এত সহজে যেন রাবারের তৈরি কোন জিনিস দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিল। আঙ্কল ভার্নন মৃদুকণ্ঠে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু অদ্ভুত কিছু শব্দ করা ছাড়া তার গলা দিয়ে কথা বেরুল না।

দৈত্য হ্যারিকে উদ্দেশ্য করে বলল–হ্যারি, যাহোক, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।

এর পর দৈত্যটা তার জামার পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে হ্যারিকে দিল। হ্যারি কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুলল। একটা বড়ো চকোলেট কেক। কেকের ওপর সবুজ রঙের আইসক্রিম দিয়ে লেখা হ্যাপি বার্থ–ডে হ্যারি।

হ্যারি দৈত্যের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছিল–তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো–কে তুমি?

দৈত্যটা প্রথম একটু আমতা আমতা করল। তারপর বলল–আমারই ভুল হয়ে গেছে। প্রথমেই আমার পরিচয় দেয়া উচিত ছিল। আমার নাম রুবিয়াস হ্যাগ্রিড। আমি হোগার্টসে থাকি। সেখানকার দরোজার চাবি আমার হেফাজতে আর মাঠের দেখাশোনা করি।

হ্যারির সাথে করমর্দন করার জন্য দৈত্যটি বিশাল হাত বাড়িয়ে দিল। করমর্দনের সময় হ্যারির মনে হলো তার হাতটা বুঝি খসে পড়ছে।

চা পাওয়া যাবে? হ্যাগ্রিড মনে করিয়ে দিলেন। চা যদি একটু কড়াও হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই।

এবার হ্যাগ্রিডের দৃষ্টি গেল ঘর গরম করার ফায়ার প্লেস-এর দিকে। তিনি ঘরের ফায়ার প্লেস-এর কাছে একটু কুঁজো হলেন। মুহূর্তের মধ্যে সেখানে গনগনে আগুন জ্বলে উঠল। ঘর এত গরম হলো যে হ্যারির মনে হল, সে যেন একটা হট বাথ নিচ্ছে। আগুনে গোসল করে নিচ্ছে।

হ্যাগ্রিড এবার সোফায় বসে পড়লেন। মনে হল গদিটি বুঝি ডুবে যাবে। এবার হ্যাগ্রিডের জামার পকেট থেকে হরেক রকমের জিনিস বেরুল–তামার কেতলি, এক প্যাকেট শূকরের মাংসের সসেজ, লম্বা মগ, বোতল, চা ইত্যাদি। হ্যাগ্রি তার কাজ শুরু করে দিলেন। সসেজের আগুনে ঝলসানোর শব্দ ও পোড়া মাংসের গন্ধে ঘর ভরে গেল। তিনি যখন ছয়টি মোটা, রসে ভরা এবং কিছুটা পুড়ে যাওয়া সসেজ লোহার শিকের কড়াই থেকে বের করল ডাডলি লোভাতুর দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকাল। আঙ্কল ভার্নন কড়াভাবে বললেন–ডাডলি, ওর দেয়া কোন জিনিস স্পর্শ করবে না।

হ্যাগ্রিড মুচকি হেসে রসিকতা করে বললেন–তোমার ছেলে ডাডলি তো একটি আস্ত থলথলে পুডিং, ওর জন্য চর্বির প্রয়োজন হবে না। তোমার কোন চিন্তার কারণ নেই।

হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে সসেজ বাড়িয়ে দিলেন। হ্যারি এত ক্ষুধার্ত ছিল যে খেয়ে মনে হলো এর আগে কখনো সে এত সুস্বাদু খাবার খায়নি। যদিও সে ভয়ের চোখে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে ছিল।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। তারপর নিজ থেকেই বলল–আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আপনি কে?

হ্যাগ্রিড এক ঢোক চা গিললেন। হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছলেন।

বললেন–সবাই যেমন ডাকে–তুমিও আমাকে হ্যাগ্রিড বলে ডাকবে। তোমাকে একটু আগেই বলেছি, আমি হোগার্টসের চাবির রক্ষক। ধীরে ধীরে তুমি হোগার্টস সম্পর্কে সব জানতে পারবে।

না। হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিড একটু ধাক্কা খেলেন মনে হলো; তিনি হ্যারির এই উত্তর আশা করেনি।

আমি দুঃখিত। হ্যারি দুঃখ প্রকাশ করল।

এবার হ্যাগ্রিড ডার্সলি পরিবারের অন্য সবার দিকে তাকাল। হ্যারি, তোমার দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। দুঃখিত হবার কারণ তো ওদেরই। আমি জানি–তোমাকে লেখা একটি চিঠিও ওরা তোমাকে দেয়নি। হোগার্টসের ব্যাপারেও তারা তোমাকে কিছু জানায়নি। তোমার বাবা–মার ব্যাপারেও ওরা তোমাকে কিছু বলেনি।

আমার বাবা–মার সম্পর্কে কী? হ্যারি আগ্রহ ভরে জানতে চাইল।

তুমি কিছুই জানো না! হ্যাগ্রিড বিস্ময় প্রকাশ করল। বলল–ঠিক আছে, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করো।

হ্যাগ্রিড এত ক্ষেপে গেলেন যে মনে হল মুহূর্তেই বাড়িটা লন্ডভণ্ড করে ফেলবেন। ডার্সলি ভয়ে পেছনে হটে দেয়ালে পিঠ ঠেকালেন।

হ্যাগ্রিড হুংকার দিয়ে বললেন–তোমরা আমাকে বল, ছেলে-এই ছেলেটা–মানে হ্যারি কি কিছুই জানে না?

হ্যারির মনে হলো–হ্যাগ্রিড একটু বাড়াবাড়ি করছেন। সে তো স্কুলে পড়ছে। লেখাপড়ায় সে খুব একটা খারাপ নয়।

হ্যারি বলল–আমি পড়াশোনা করি। আমি অঙ্কে ভালো।

হ্যাগ্রিড হ্যারির কথায় কান না দিয়েই ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রশ্ন করলেন আপনারা কি ওকে ওর পরিবার, ওর বাবা–মার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানাননি?

হ্যাগ্রিড যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিলেন।

আঙ্কল ভার্নন ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে পড়লেন। হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার বাবা–মা সম্পর্কে তোমার জানা উচিত। তারা খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন। তুমিও সেই হিসেবে খ্যাতিমান।

কী বললেন? আমার বাবা–মা খ্যাতিমান ছিলেন? হ্যারি বিস্ময়ে হ্যাগ্রিডকে জিজ্ঞেস করল।

তুমি একেবারে কিছুই জানো না? হ্যাগ্রিড বিস্ময়ে হ্যারির দিকে তাকালেন।

অনেকক্ষণ পর আঙ্কল ভার্নন কিছু বলার সাহস পেলেন। তিনি বললেন–হ্যারির বাবা–মা সম্পর্কে কিছু না বলার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছি।

এতে হ্যাগ্রিডের রাগ কমল না। হ্যাগ্রিড রাগের সাথেই বললেন আপনি তো কখনো তাকে বলেননি চিঠিগুলোতে কী লেখা ছিল? ডাম্বলডোর হ্যারিকে এই চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলেন আমার সামনেই। আপনি এতগুলো বছর হ্যারির কাছ থেকে সবকিছু গোপন রেখেছেন। তাই না?

কী লুকিয়ে রেখেছেন? হ্যারি কৌতূহলী হয়ে উঠলো।

চুপ কর, এসব কথা বলতে আমি কি তোমাকে নিষেধ করিনি? আঙ্কল ভার্নন বিরক্তি প্রকাশ করলেন।

আন্ট পেতুনিয়ার চেহারায়ও আতঙ্কের ছাপ দেখা গেল।

আপনারা দুজন মাথা গরম করলেও কিছু হবে না। হ্যারি তুমি একজন জাদুকর। হ্যাগ্রিড বলল।

ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। শুধু কেবল সাগরের গর্জন আর বাতাসের শির শির আওয়াজ ভেসে আসছে।

আমি একজন কী? হ্যারি আরো কৌতূহলী হলো।

তুমি একজন জাদুকর। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমার কাছে পাঠানো চিঠিগুলো তোমার পড়া উচিত ছিল। এই বলে হ্যাগ্রিড একটি হলুদাভ খাম হ্যারির হাতে দিলেন।

হ্যারি খামটি হাতে নিল। খামের ওপর হালকা সবুজ কালিতে লেখা ছিল

মি, এইচ পটার
দি ফ্লোর, হার্ট অন দি রক
সমুদ্র

হ্যারি চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো–

হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়
প্রধান শিক্ষক : আলবুস ডাম্বলডোর

প্রিয় মি. পটার,
আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আমাদের জাদু বিদ্যালয়ে তোমার জন্য একটি আসন রাখা আছে। চিঠির সাথে প্রয়োজনীয় বইপত্র ও সরঞ্জামাদির তালিকা দেয়া হলো।
আগামী ১লা সেপ্টেম্বর থেকে কোর্স শুরু হবে। ৩১শে জুলাইয়ের ভেতর তোমার কাছে পেঁচা প্রত্যাশা করছি।

ইতি
মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল
উপ–প্রধান শিক্ষক

হ্যারির মাথায় একগাদা প্রশ্ন কিলবিল করছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, কোন প্রশ্নটা আগে করবে। কয়েক মিনিট পর অস্ফুটস্বরে বলল, তারা আমার পেঁচার জন্য অপেক্ষা করবে, এর অর্থ কী? একহাতে নিজের কপাল চেপে হ্যাগ্রিড বলল, এতক্ষণে মনে পড়েছে তার অপর হাতটি ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে একটি জীবন্ত পেঁচা, একটি লম্বা পালকের কলম ও মোটা কাগজের রোল বের করলেন। হ্যাগ্রিড তার দাঁতে পাখির পালক চেপে কাগজে কিছু লিখলেন যা বুঝতে হ্যারির একটুও অসুবিধে হলো না।

হ্যাগ্রিড লিখলেন :

প্রিয় মি, ডাম্বলডোর,
হ্যারিকে তার চিঠি দেয়া হয়েছে। তার জিনিসপত্র কেনার জনা আমি আগামীকাল বেরুব। আবহাওয়া দুর্যোগময়। আশা করি আপনি ভালো আছেন।
ইতি
হ্যাগ্রিড

লেখাটা ভাঁজ করে হ্যাগ্রিড পেঁচাকে দিলেন। পেঁচা এটা ঠোঁটে চেপে ধরল। এবার পেঁচাটিকে জানালা দিয়ে হ্যাগ্রিড আকাশে উড়িয়ে দিলেন। এমন স্বাভাবিকভাবে হ্যাগ্রিড ফিরে এসে বসলেন, যেন এইমাত্র ফোনে কথা বলে এলেন। এরপর আঙ্কল ভার্নন হুংকার দিয়ে উঠলেন–হ্যারি তুমি কোথাও যাবে না। হ্যাগ্রিড রেগেমেগে আগুনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং বললেন–আমি দেখতে চাই তোমার মতো একটা মাগল তাকে কীভাবে আটকায়।

মাগল। মাগল কী? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–মাগল হলো যে সব লোক জাদুর মর্ম বোঝে না। তোমার দুর্ভাগ্য এরকম একটি মাগল পরিবারে তুমি বড় হয়েছে।

এবার আঙ্কল ভার্নন এগিয়ে এসে বললেন–আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা তাকে এ ধরনের ভোজবাজি থেকে দূরে রাখব। তার ওই ধরনের জাদু–টাদু শেখার ইচ্ছা চিরকালের জন্য আমরা শেষ করে দেব।

হ্যারি বলল–তোমরাও কি জানো যে আমি একজন–জাদুকর।

অবশ্যই জানি। পেতুনিয়া জবাব দিলেন-এটা কী করে হয় যে আমি আমার বোন সম্পর্কে কিছু জানবো না। সেও সেই স্কুল থেকে এরকম চিঠি পেয়েছিল এবং একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল। ছুটির সময় সে বাড়িতে আসতো–তার পকেটে থাকতে ব্যাঙের পা, চায়ের কাপকে সে ইঁদুর বানাতো। একমাত্র আমিই জানতাম, সে একটি ভণ্ড! কিন্তু আমার মা–বাবার কাছে সে ছিল প্রিয়–সবকিছুতেই তারা লিলিকে নিয়ে গর্ব করতো। সবসময় বলতে লিলি এটা… লিলি ওটা…। তারপর তোমার বাবার সাথে স্কুলে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্টতা এবং বিয়ে। ওরা দুজনেই পাগল, অদ্ভুত, অস্বাভাবিক। তারপর তোমার জন্ম হয়। আমি জানতাম তুমি তাদের মত হবে। তারা একদিন বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গেল। তারপর থেকে তুমি আমাদের কাছে।

কথাগুলো শুনে হ্যারির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটু পর হ্যারি মুখ খুলল–বিস্ফোরণ! তোমরা না বলেছিলে, আমার বাবা–মা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে?

গাড়ি দুর্ঘটনায়! হ্যাগ্রিড গর্জন করে উঠলেন। ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড প্রশ্ন করলেন-এটা কি বিশ্বাস করা যায় যে লিলি আর জেম্স্ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এটা অসম্ভব। এটা নিছক গুজব। বানোয়াট গল্প। এটা বদনাম। আমাদের জগতের প্রতিটা শিশুই হ্যারি পটারের নাম জানে। এটা কি করে হয় যে সে নিজেই তার সম্পর্কে জানে না। কিন্তু কেন এই দুর্ঘটনা ঘটলো। হ্যাগ্রিড কঠিন ভাষায় প্রশ্ন করলেন।

হ্যাগ্রিডের ক্রোধ খুব দ্রুতই উদ্বেগে পরিণত হলো। উদ্বিগ্ন স্বরে হ্যাগ্রিড বললেন–আমি এটা কখনোই আশা করিনি। আমি তখন বুঝতে পারিনি ডাম্বলভোর কেন আমাকে বলেছিলেন তোমাকে নিতে অনেক বাধা–বিপত্তি পেরুতে হবে। তুমি যে অনেক কিছু জানো না-এটাও আমার জন্য কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। তোমাকে আমার অনেক কিছুই বলার আছে। তবে সবটুকু এখন বলা যাবে না। আমি ততটুকুই বলব যতটুকু আমার পক্ষে বলা সম্ভব।

ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বলতে লাগলেন–বিষয়টি এই, আমার মনে হয় একটা লোক, নাম–কিন্তু আশ্চর্য তুমি তার নাম জানো না! পৃথিবীর সকলে তার নাম জানে।

লোকটা কে? হ্যারি প্রশ্ন করে বসে।

তার নাম …বলতে গিয়ে হ্যাগ্রিড থেমে গেলেন। হ্যাগ্রিডের মুখ থেকে নামটি বেরুল না।

আমি তার নাম বলতে পারব না। কেউই তার নাম উচ্চারণ করে না হ্যাগ্রিড বললেন।

কিন্তু কেন? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাগ্রিড বললেন–ঘটনার সাথে আরেকজন জড়িত। তার নাম গালপিন গারগোয়েলেস। সে একজন ভেলকিবাজ ও বদমায়েশ। খুবই জঘন্য, জঘন্যের চেয়েও জঘন্য। তার নাম বলা… আচ্ছা ঠিক আছে, তার নাম ভোলডেমর্ট। দ্বিতীয়বার তার নাম নিতে বলবে না। তার জগতটাই ছিল জাদুলীলা, ডাইনি আর ভেলকিবাজদের নিয়ে। প্রায় বিশ বছর আগে সে তার অনুসারী বানাবার জন্যে লোকজন খুঁজতো। সে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে। সে কয়েকজনকে খুন করেছে। বিশেষ করে তার বিরোধী মতের লোকদেরকে। একমাত্র ডাম্বলডোরকেই সে ভয় পেতো। তার স্কুলটাকে সে নিতে সাহস পায়নি।

হ্যাগ্রিড বলে চললেন–তোমার বাবা মা খুব ভাল জাদুকর ছিলেন। তাদের তুলনা হয় না। ছাত্রাবস্থায় হোগার্টস স্কুলে তারা হেড বয় ও হেড গার্ল ছিলেন। তবে এটা অজানাই থেকে গেল যে কেন ভোলডেমর্ট তাদেরকে পক্ষে নেয়ার চেষ্টা কখনো করেনি। এর কারণ হতে পারে যে তোমার বাবা–মা ডাম্বলডোরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তখন তোমার বয়স মাত্র এক বছর। ভোলডেমর্ট তোমাদের বাড়ি যায়। তোমার বাবা–মাকে হত্যা করে। এ সময় ইউ–নো–হু তোমাকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। তাই তোমার কপালের এই দাগ দেখে আমি বিস্মিত হইনি। এটাও তো কম কষ্ট নয়। এটা একটি শক্তিশালী অভিশাপের পরিণাম। শাপটা তোমার ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এজন্যই তুমি খ্যাতিমান হ্যারি। কারণ সে যাকে মারতে চাইতো তার বাঁচার কোন উপায় থাকত না। একমাত্র তুমিই তার ব্যতিক্রম।

গ্রিডের কথা শুনে হ্যারির মন বিষাদে ভরে গেল।

করুণ দৃষ্টিতে হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকালেন।

হ্যাগ্রিড বলনেল–ডাম্বলডোরের নির্দেশেই আমি তোমাকে সেই ভাঙা বাড়ি থেকে উদ্ধার করি। তবে শেষ পর্যন্ত তুমি যেখানে আছ–অর্থাৎ ডার্সলিদের পরিবারে–সেটাও তো তোমার জন্য ভালো হয়নি। এটা তো তোমার জন্য একটি নরক।

ইতোমধ্যে আঙ্কল ভার্নন তার সাহস কিছুটা ফিরে পেয়েছেন। তিনি বললেন–আমি স্বীকার করি হ্যারির ভেতর অদ্ভুত কিছু জিনিস আছে। সে ডাইনি জগতের লোক। হয়ত শাসন করে তাকে বশে আনা যাবে অথবা যাবে না। তবে আমি চাই না সে ওই জগতের সাথে কোন সম্পর্ক রাখুক।

আঙ্কল ভার্ননের কথা শুনে হ্যাগ্রিড সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। তার প্যান্ট থেকে একটা ভাঙা ছাতা বের করে সেটাকে তরবারির মতো করে আঙ্কল ভের্ননের সামনে উঁচিয়ে ধরলেন। তারপর বললেন–ডার্সলি, আমি তোমাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, তুমি আর একটি কথাও বলবে না।

ছাতার খোঁচা খাবার ভয়ে আঙ্কল ভার্নন একেবারে চুপসে গেলেন।

হ্যাগ্রিড পুনরায় সোফায় বসলেন।

ভোলডেমর্টের কী হলো? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাগ্রিড বললেন–সে সেদিন পালিয়ে গেল। পরের রাতে সে তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তবে ওর ব্যাপারটাও রহস্য রয়ে গেছে। কেউ বলে ও মারা গেছে। কেউ বলে ও এখনও জীবিত।

আন্তরিকতা ও উষ্ণতার সাথে হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকালেন। ওঁর কথায় হ্যারি খুশি ও গর্বিত হওয়ার পরিবর্তে বরং মনে করলো কোথাও বড় ধরনের ভুল হচ্ছে। সে জাদুকর! সে কীভাবে জাদুকর হয়? সে তো ডার্সলি পরিবারে আঙ্কল ভার্নন এবং আন্ট পেতুনিয়ার কাছেই প্রতিপালিত হয়েছে। সে যদি জাদুকরই হবে তাহলে তাকে কেন যাযাবরের জীবন কাটাতে হচ্ছে? কেন কাবার্ডের ওপর ঘুমোতে হয়। সে যদি খ্যাতিমানই হবে তাহলে ডাডলি কেন সব সময় তাকে ফুটবলের মতো লাথি মারে।

হ্যারি হ্যাগ্রিডকে বলল–আপনি বোধহয় ভুল করছেন। আমার মনে হয় না, আমি একজন জাদুকর।

হ্যারির কথায় হ্যাগ্রিড মৃদু হাসলেন।

তুমি জাদুকর হবে না কেন? জাদুবিদ্যাকে কি তুমি ভয় পাও?

হ্যারি আগুনের দিকে তাকাল। এখন সে ভাবতে লাগল ভার আঙ্কল আন্ট তার সাথে কেন দীর্ঘদিন এমন ওলট–পালট ও অস্বাভাবিক ব্যবহার করেছেন।

হ্যারি হাসিমুখে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে দেখল, হ্যাগ্রিডের মুখে তখনও স্মিত হাসি। আঙ্কল ভার্ননের উদ্দেশ্যে হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি কি দেখতে চাও হ্যারি জাদু জানে কিনা।

আঙ্কল ভার্নন বলল–আমি তোমাকে বলেছি হ্যারি কোথাও যাবে না। ও স্টোনওয়াল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। তোমাদের ফালতু চিঠি আমি পড়েছি।

হ্যারি হোগার্টসে যদি যেতে চায়। তোমার মত একজন বড় মাগলও কিছুতেই তাকে রুখতে পারবে না–হ্যাগ্রিড বললেন। তুমি কি পাগল, ভাবছো, লিলি ও জেমস-এর ছেলের হোগার্টস যাওয়া বন্ধ করতে পারবে। জন্মের পরেই ওর নাম এ স্কুলে লেখা হয়ে গেছে। সে সেখানে হোগার্টসের ইতিহাসে যার মত বড় শিক্ষক হননি সেই আলবাস ডাম্বলডোরের অধীনে পড়াশোনা করবে।

তাকে ম্যাজিকের কারসাজি শেখানোর জন্য কোন মাথা খারাপ বৃদ্ধকে আমি এক কানা কড়িও দিচ্ছি না। আঙ্কল ভার্ননের কণ্ঠে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

শেষ পর্যন্ত তিনি খানিকটা বেশিই বলে ফেললেন। হ্যাগ্রিড আবার ছাতাটি তরবারির মতো করে আঙ্কল ভার্ননের সামনে তার মাথার ওপর শূন্যে ঘুরালেন। আর বলল–হুঁশিয়ার আলবাস ডাম্বলডোরের বিরুদ্ধে তুমি একটা কথা বলবে না।

হিশ… শব্দ করে ছাতাটি যখন ডাডলির সামনে চলে এল, বেগুনি রঙের আলোর ঝলকানি, আতশবাজির মত একটা শব্দ, এক তীব্র চিৎকার এবং পরমুহূর্তেই ডাডলি তার নিতম্বে দু হাত চেপে তীব্র ব্যথায় বিকট শব্দ করে উঠল। হ্যারি দেখলো একটি শূকরের লেজ ডাডলির ট্রাউজার খুঁড়ে বের হচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন আর্তনাদ করে উঠলেন। তিনি এত ভয় পেলেন যে তৎক্ষণাৎ আন্ট পেতুনিয়া আর ডাডলিকে দ্রুত টেনে অন্য ঘরে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় যখন দরোজা বন্ধ করছিলেন তখন তার চেহারায় ভীষণ আতঙ্কের ছাপ। হ্যাগ্রিড তার দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে ছাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাথা গরম করা ঠিক নয়, কিন্তু অনেক সময় এটা কাজ করে। মানে… ওকে শূকর বানানো, তবে সে এমনিতেই দেখতে শূকরের মতো।

হ্যারি হ্যাগ্রিডকে জিজ্ঞেস করল–আপনি জাদু দেখান না কেন?

একথার কোন জবাব না দিয়ে হ্যাগ্রিড তাঁর কোটটা হ্যারির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, তুমি আমার কোটটি পরে নাও। খেয়াল রেখো। এর ভেতরে আরো কিছু জিনিস আছে।

০৫. ডায়াগন এলি

পরদিন খুব সকালেই হ্যারির ঘুম ভাঙল। যদিও সে জানে চারদিক ফরসা হয়ে গেছে। তবুও চোখ বন্ধ করে রইল।

তার মনে হলো রাতে সে স্বপ্ন দেখেছে যে হ্যাগ্রিড নামে এক দৈত্য এসে তাকে জাদুবিদ্যার স্কুলে ভর্তি হতে বলেছে। হ্যারি মনে মনে বলল, এখন আমি চোখ খুললেই দেখবো বাড়িতে আমি আমার কাবার্ডের ওপর শুয়ে আছি।

ঠিক এই সময় দরোজায় ঠক–ঠক আওয়াজ। মনে হচ্ছে আন্ট পেতুনিয়া দরোজায় শব্দ করছেন। তবুও সে চোখ বন্ধ করে থাকল। কারণ গত রাতে সে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখেছে।

আবার দরোজায় ঠক–ঠক আওয়াজ।

হ্যারি বলল–আমি আসছি।

হ্যারি উঠতেই তার গা থেকে হ্যাগ্রিডের দেয়া কোটটা নিচে পড়ল।

চারদিকে সুর্যের আলো। ঝড় থেমে গেছে। হ্যাগ্রিড তখনও সোফায় ঘুমোচ্ছেন। একটা পেঁচা জানালায় ডানা ঝাপটাচ্ছে। ঠোঁটে একটা খবরের কাগজ। হ্যারি উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। পেঁচাটা ঘরে ঢুকে হ্যাগ্রিডের গায়ের ওপর খবরের কাগজটা ফেলে দিয়ে হ্যাগ্রিডের কোটে আক্রমণ করল। হ্যারি পেঁচাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। হ্যাগ্রিড চোখ না খুলেই হ্যারিকে বললেন–ওকে কিছু পয়সা দিয়ে দাও।

–কত দেব? হ্যারি জানতে চাইল।

–দেখ, আমার পকেটে কী আছে।

হ্যাগ্রিডের কোটের পকেটে চাবির গোছা, ব্রোঞ্জ মুদ্রা, টি–ব্যাগসহ নানা কিসিমের জিনিস পাওয়া গেল।

অবশেষে হ্যারি অদ্ভুত ধরনের কিছু মুদ্রা বের করল।

তাকে পাঁচটি নাট দিয়ে দাও। হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বললেন।

নাট! অবাক হয়ে হ্যারি প্রশ্ন করল।

হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যাঁ, ব্রোঞ্জের ছোট ছোট মুদ্রাগুলো। হ্যারি গুণে গুণে ব্রোঞ্জের পাঁচটি মুদ্রা বের করল। পেঁচা পা বাড়িয়ে দিতেই হ্যারি একটি পুটুলিতে মুদ্রাগুলো রেখে পুটুলিটি পেঁচার পায়ের সাথে বেঁধে দিল। পেঁচা জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশে উড়াল দিল।

হ্যাগ্রিড ঘুম থেকে উঠে বসলেন। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আজকে অনেক কিছু করতে হবে। বললেন–লন্ডন যেতে হবে। লন্ডন যাবার আগে জাদুবিদ্যার স্কুলের দরকারি সব জিনিসপত্র কিনতে হবে।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের উদ্দেশ্য বলল–আমার কোন টাকা পয়সা নেই। আর আপনিও শুনলেন জাদুবিদ্যার স্কুলে ভর্তি হবার জন্য আমার আঙ্কল আমাকে কোন টাকা দেবেন না।

এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি কি মনে করেছো যে, তোমার বাবা তোমার জন্য কিছুই রেখে যাননি? তোমার বাবা তোমার জন্য প্রচুর ধন–সম্পদ রেখে গেছেন।

কিন্তু তাদের বাড়ি তো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল–হ্যারি বলল।

তারা তাদের সোনা–দানা বাসায় রাখেননি। আমাদের কাজ হবে প্রথমে গ্রিংগটস উইজার্ড ব্যাংকে যাওয়া। নাও সসেজ খাও। খুব বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। তোমার জন্মদিনের কেকও খেতে পার… তোমার যা ইচ্ছে। হ্যাগ্রিড বললেন।

জাদুকরদের কি ব্যাংক থাকে? হ্যারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, তাদের একটাই ব্যাংক আছে। গ্রিংগটস উইজার্ড ব্যাংক।

বিকেলে হ্যাগ্রিড পাহাড়ে গেলেন। সাথে হ্যারিও গেল। আকাশ নির্মেঘ, পরিষ্কার, সমুদ্রে সূর্যাস্তের প্রতিফলন। ভাড়ার একটি নৌকা ঘাটে বাঁধা আছে। নৌকার তলায় বৃষ্টির পানি জমেছে।

অন্য একটি নৌকার সন্ধান করে হ্যারি হ্যাগ্রিডকে প্রশ্ন করল–আপনি এখানে এলেন কী করে?

উড়ে এসেছি। হ্যাগ্রিড বলল।

উড়ে এসেছেন–মানে? হ্যারি অবাক হলো।

হ্যাঁ–আমরা এটাতেই ফিরে যাব। হ্যাগ্রিড় বলল–আমি যখন এটা পেয়েছি এখন আর জাদুবিদ্যার সাহায্য দরকার নেই।

তারা দুজন নৌকায় উঠলেন। হ্যারি তখনও হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়েছিল এবং কল্পনা করছিল কিভাবে হ্যাগ্রিড উড়ছেন।

হ্যাগ্রিড বলেছেন নৌকা বাওয়াটা লজ্জার ব্যাপার। তাহলে কি নৌকাটা উড়বে–হ্যারি ভাবছিল।

হ্যাগ্রিড বললেন–আমি যেখানেই থাকি সেখানে সবকিছুর গতি বেড়ে যায়। তুমি কি হোগার্টসে গিয়ে এসব বিষয়ে গল্প করবে? হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকালেন।

অবশ্যই না। হ্যারি জবাব দিল।

হ্যাগ্রিড তার গোলাপী ছাতাটা বের করে দুভাগ করলেন। নৌকার পাশে ধরতেই নৌকাটা দ্রুতবেগে পাড়ের দিকে রওনা হলো।

আপনি গ্রিংগটস থেকে টাকা আনার জন্য এত ব্যস্ত হলেন কেন? হ্যারি জানতে চাইল।

জাদুবিদ্যা কাজে লাগিয়েছি। পত্রিকার ভাঁজ খুলতে খুলতে হ্যাগ্রিড বললেন–বলা হয় ড্রাগন নাকি ব্যাংকের ভল্টগুলো পাহারা দিচ্ছে। গ্রিংগটস লন্ডন থেকে শত শত মাইল দূরে। সমুদ্রের নিচ দিয়ে যেতে হবে। ওখানে যেতে হলে তুমি খিদেয় মারা যাবে। হ্যারি বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল। ডেইলি প্রফেটের পাতা ওল্টাতে ওল্টাভে হ্যাগ্রিড মন্তব্য করলেন জাদু মন্ত্রণালয় সব সময় গোল পাকায়।

জাদুর জন্য কি আবার একটি মন্ত্রণালয় আছে নাকি? হ্যারি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

অবশ্যই আছে। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–সরকার চাচ্ছিলেন ডাম্বলডোর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিক। কিন্তু ডাম্বলডোর হোগার্টসের জাদুবিদ্যার স্কুল ছেড়ে মন্ত্রী হতে আগ্রহী নন।

জাদুবিদ্যা মন্ত্রণালয়ের কাজ কী? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–মাগলদের হাত থেকে জাদুবিদ্যা শাস্ত্রকে রক্ষা করা।

নৌকা ঘাটে ভিড়ল। তারা নৌকা থেকে নেমে সড়কপথে হাঁটতে লাগল। পথচারীরা অবাক দৃষ্টিতে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দোষ দেওয়া যায় না। হ্যাগ্রিড এত লম্বা যে, তিনি সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।

লন্ডন যাওয়ার জন্য তারা স্টেশনে পৌঁছল। পাঁচ মিনিটের ভেতরই লন্ডনের জন্য ট্রেন পাওয়া যাবে। মাগলদের টাকার ব্যাপারে হ্যাগ্রিডের কোন ধারণা ছিল না। সে টাকাকে মাগল টাকা বলে থাকে। তাই টিকিট করার জন্য হ্যারিকে টাকা দিলেন। ট্রেনের দিকে না তাকিয়ে সবাই শুধু হ্যাগ্রিডের দিকে তাকায়। হ্যাগ্রিড দুটো আসন নিয়ে বসলেন।

তোমার চিঠি কি তোমার সাথে আছে? হ্যাগ্রিড হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যারি হলুদ খামের চিঠিটা পকেট থেকে বের করলো।

ঠিক আছে। হ্যাগ্রিড বললেন, তোমার কী কী লাগবে তার একটা বিস্তারিত তালিকা চিঠিতে লেখা আছে।

হ্যারি কাগজের দ্বিতীয় অংশটার ভাঁজ খুলল। রাতে সে কাগজটা লক্ষ্যও করেনি এবং পড়েওনি। হ্যারি পড়তে শুরু করল–

হোগার্লস স্কুল অফ উইচক্রাফট এবং উইজারডি

ইউনিফর্ম
প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবশ্যক
১। তিন সেট স্বাভাবিক কাজের পোশাক (কালো)
২। দিনে পরার জন্য একটা সাধারণ চোখা হ্যাট (কালো)
৩। একজোড়া দস্তানা (ড্রাগন ও অনুরূপ প্রাণীর চামড়ার তৈরি)
৪। শীতের একটা পোশাক (কালো–রূপালী এবং টিলা)
লক্ষ্য করুন–প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পোশাকে নেইম–ট্যাগ থাকতে হবে।

নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক
প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেকটা বইয়ের একটা করে কপি রাখতে হবে
(ক) The Standard Book of Spells (Grade–1) by Miranda Goshawk
(খ) History of Magic by Bathilda Bagshot
(গ) Magical Theory by Adalbert Wafting
(ঘ) A Beginners Guide to Transfiguration by Emeric Switch
(ঙ) One Thousand Magical Herbs and Fungi by Phyllida Spore
(চ) Magical Drafts and Potions by Arsenius Jigger
(ছ) Fantastic Beasts and Where to Find Them by Newt Scamander
(জ) The Dark Forces–A Guide to Self–Protection by Quentin Trimble

অন্যান্য যন্ত্রপাতি
একটা জাদুর কাঠি
একটা কলড্রন (পিউটার স্ট্যান্ডার্ড সাইজ–২)
এক সেট গ্লাস অথবা স্কটিক ফিঅল
একটি দূরবীন
এক সেট তামার স্কেল
ছাত্রছাত্রীরা একটা পেঁচা বা একটা বিড়াল অথবা একটা ব্যাঙ আনতে পারবে।
অভিভাবকদের জানানো যাচ্ছে যে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদেরকে তাদের নিজস্ব ঝাড়ুলাঠি ব্যবহার করতে দেয়া হয় না

এগুলো সবই লন্ডনে কিনতে পাওয়া যাবে? হ্যারি প্রশ্ন করল।

কোথায় পাওয়া যাবে সেটা তোমার জানা থাকলে অবশ্যই পাওয়া যাবে–হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন।

হ্যারি এর আগে কখনও লন্ডন যায়নি। সে যে কোথায় যাচ্ছে-এটাও তার জানা ছিল না। তবে যাওয়ার পথ ও পদ্ধতি খুব বিচিত্র। ট্রেনের আসনগুলো ছোট, গতি খুবই কম। জাদুবিদ্যার সাহায্যে এরা এসকেলেটর দিয়ে উঠল। এই তো রাস্তা। এই তো সারি সারি দোকান।

হ্যাগ্রিড এত বিশালদেহী যে ভিড় ঠেলে যেতে কোন অসুবিধেই হলো না। আর হ্যারির কাজ হলো পেছনে থেকে তাকে কেবল অনুসরণ করা। তারা বইয়ের দোকান, মিউজিকের দোকান, ফাস্টফুডের দোকান এবং সিনেমা হল পার হয়ে গেল, কিন্তু কোথাও তারা জাদুর কাঠি বিক্রি হতে দেখল না। রাস্তায় লোকজনের ভিড়। এখানে মাটির তলায় কোন জাদুকরের গুপ্তধন কি লুকিয়ে থাকতে পারে? জাদুবিদ্যার বইপত্র, জাদু ঝাড়ু কোথায় বিক্রি হয়? এটা নিশ্চয়ই ডার্সলিদের তৈরি বড় রকমের কৌতুক নয়? হ্যারি যদি জানত যে ডার্সলিদের কোন রসবোধ নেই, তাহলে হয়তো সে রকম কিছু একটা ভাবত। যদিও হ্যাগ্রিড তাকে যা যা বলেছেন তার অনেক কিছুই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। হ্যারি তাকেও খুব একটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

এক জায়গায় এসে হ্যাগ্রিড বললেন–আমরা এসে গেছি, এ জায়গার নাম লিকি কলড্রন এটা খুব বিখ্যাত স্থান।

এটা দেখতে অনাকর্ষণীয় ছোট পাব। হ্যাগ্রিড যদি তাকে না দেখাতেন তাহলে হ্যারি বুঝতেই পারত না যে এটা পাব।

এটা বিখ্যাত কোনও স্থানের মত নয়, অন্ধকার ও অপরিষ্কার। কয়েকজন বয়স্কা মহিলা এক কোণায় বসে ছোট গ্লাসে শেরি পান করছিলো। তাদের মধ্যে একজন লম্বা পাইপে ধূমপান করছিলো। একজন ছোট খাটো লোক টাকমাথা বৃদ্ধ বার–ম্যানের সাথে কথা বলছিলো। তারা ভেতরে ঢুকতেই কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই হ্যাগ্রিডকে দেখে হাসলো ও হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালো। মনে হলো হ্যাগ্রিডকে সবাই এখানে চেনে। বার-ম্যান গ্লাস বের করে বলল, তোমার সেটাই দেবো?

একজন লোক বেরিয়ে এল, হ্যাগ্রিডের পূর্ব পরিচিত। হ্যারির সাথেও তার আলাপ হলো! আরও বেশ কয়েকজনের সাথে হ্যারির পরিচয় হলো। তারা বেশ একটু ঘুরে দেখল। এখানে হ্যাগ্রিডকে সবাই চেনে।

হ্যারির কাঁধে হাত রেখে হ্যাগ্রিড বললেন–না টম, আমি হোগার্টসের কাজে এখানে এসেছি।

গুড লর্ড ভদ্রলোক বললেন-এ কি সে?–তা কি করে হয়? লিকি কলড্রনের দোকানপাট মুহূর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেল।

আমার আত্নাকে আশীর্বাদ করুন। বারের বৃদ্ধ লোকটা বললেন আমার কী সৌভাগ্য যে হ্যারি পটার আপনার সাথে দেখা হলো। কি সম্মানের বিষয়.. !

বৃদ্ধ বার-ম্যান বারের পেছন থেকে বের হয়ে হ্যারির দিকে ছুটে আসলেন। তিনি হ্যারির হাত ধরলেন–তার চোখে জল।

মি. পটার, তোমাকে পুনরায় স্বাগতম, মি. পটার তোমাকে পুনরায় স্বাগতম। কী বলবে হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। হ্যারি অবাক হয়ে দেখল–সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। হ্যাগ্রিডের মুখে স্মিত হাসি। বৃদ্ধা মহিলাটির তামাক শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তিনি পাইপ টেনেই চলছেন সেদিকে খেয়াল না করে।

তারপর চেয়ার টানাটানির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই হ্যারি দেখল যে লিকি কলড্রনের প্রত্যেকেই তার সাথে করমর্দন করছেন।

আমি ডরিস ক্রকফোর্ড, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমার সাথে দেখা হবে, মি. হ্যারি পটার।

তোমার সাথে দেখা হওয়ায় আমি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করছি, মি. পটার।

তোমার সাথে করমর্দন করার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আজ আমার আনন্দের দিন।

তোমার সাথে দেখা হওয়াতে আমি যে কত আনন্দিত হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না–মি. পটার’ ডিডালুস ডিগল বললেন।

জবাবে হ্যারি বলল–আমি আপনাকে আগে দেখেছি। একটা দোকানে আপনি আমাকে বো করেছিলেন।

ডিডালুস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন–তোমরা কি দেখেছ–সে আমাকে এখনও মনে রেখেছে এখনও।

হ্যারি সবার সাথে করমর্দন করল। ডরিস ক্রকফোর্ড প্রায় সময়ই হ্যারির কাছাকাছি থাকলেন।

একজন তরুণ উদ্বিগ্নভাবে হ্যারির দিকে এগিয়ে এলেন। হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি, ইনি অধ্যাপক কুইরেল। হোগার্টসের জাদুবিদ্যা স্কুলে তিনি তোমার একজন শিক্ষক।

প-প-পটার তোতলাতে তোতলাতে অধ্যাপক কুইরেল বললেন হ্যা…রি। তোমার সাথে দেখা… হওয়াতে আমি যে ক–কত খুশি হয়েছি ভা-ভা-ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

আপনি কী ধরনের জাদু শেখান, অধ্যাপক কুইরেল।

কালো জাদুর বিরুদ্ধে আত্নরক্ষার জাদু–অধ্যাপক কুইরেল জবাব দিলেন।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হ্যারির–প্রায় দশ মিনিট লেগে গেল।

হাতে আর সময় নেই। হ্যারি, তাড়াতাড়ি কর। হ্যাগ্রিড তাগিদ দিলেন।

ডরিস ক্রকফোর্ড হ্যারিকে বিদায়ী করমর্দন করলেন। এরপর ওরা দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন।

আমি কি তোমাকে বলিনি তুমি খ্যাতিমান? হ্যারির উদেশ্যে হ্যাগ্রিড বললেন। তোমার সাথে দেখা করে অধ্যাপক কুইরেল প্রায় কাঁপছিলেন।

তিনি কি সব সময় এরূপ নার্ভাস থাকেন? হ্যারি জানতে চাইল।

অবশ্যই। হ্যাগ্রিড বললেন–তিনি অত্যন্ত মেধাবী, যখন তিনি পড়াশোনা করতেন তখন সবই ঠিক ছিল। যখন তিনি অভিজ্ঞতার জন্য এক বছর হাতে–কলমে কাজ করতে গেলেন তখনই গোল বাঁধল। কেউ কেউ বলেন, যখন থেকে তিনি রক্তচোষাদের সাক্ষাৎ শুরু করলেন তখন থেকেই তার এই অবস্থা। ছাত্রদের দেখলেও তিনি ভয় পেয়ে যান। যাক সে কথা। আমার ছাতা কোথায়? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।

হ্যারি রক্তচোষাদের কথা ভাবছিল।

হ্যারি, সোজা হয়ে দাঁড়াও। হ্যাগ্রিড হ্যারিকে নির্দেশ দিলেন।

হ্যাগ্রিড ছাতার মাথা দিয়ে দেয়ালে তিনবার আঘাত করলেন। দেয়াল নড়ে উঠল। দেয়ালের মাঝখানে একটি গর্ত দেখা গেল। গর্তটি ধীরে ধীরে বড় হলো ও সিংহদ্বারে পরিণত হলো। গর্তের ভেতর দিয়ে হ্যাগ্রিডের মত বিশাল দেহের ব্যক্তিও প্রবেশ করতে পারে। ডায়াগন এলিতে স্বাগতম হ্যাগ্রিড বললেন।

হ্যারির বিস্মিত সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি হাসলেন। হ্যারিও গর্তের ভেতর প্রবেশ করল। হ্যারি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো সিংহদ্বারটা ছোট হতে হতে দেয়ালে মিলিয়ে গেল। বাইরে দোকানগুলোর কলড্রনের সারির ওপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। জল গরম করার কলড্রনগুলোর ওপর একটা সাইনবোর্ডও ঝুলছিল। কলড্রনস–অল সাইজেস–রূপা, পিতল, পিউটের, তামা সেলফ–স্টিয়ারিং–কলাপসিবল।

হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বললেন–তোমারও পানি গরম করার একটা কলড্রন লাগবে। তার আগে চলো তোমার টাকা উঠিয়ে নিই।

হ্যারি ভাবছিল তার যদি আরো আটটা চোখ থাকত। হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ চারদিকে ঘুরতে লাগলো। দোকানপাট, লোকজন সবকিছু সে দেখার চেষ্টা করল। হ্যারি দেখল তার বয়সের কিছু ছেলে ঝাড়ুর দোকানের জানালার গ্লাসের ওপর তাদের নাক ঘষে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারি তাদের একজনকে বলতে শুনল–দেখো, নিউ নিম্বাস টু থাউজেন্ড। এটাই সবচে দ্রুতগামী। বিভিন্ন দোকানে পোশাক, দূরবীন ও রূপার অদ্ভুত যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছিল। যা হ্যারি এর আগে কখনোই দেখেনি। তারা হাঁটছেন। এক সময় হ্যাগ্রিড বললেন–আমরা গ্রিংগটসে এসে পড়েছি।

তারা একটা তুষার শুভ্র ভবনের সামনে এলো যা অন্যান্য ছোট দোকানগুলোর অনেক উঁচুতে। এক ব্যক্তি তাদের স্বাগতম জানাল। এই তো গবলিন, হ্যাগ্রিড বললেন। লোকটা উচ্চতায় হ্যারির চেয়েও খাটো। তার চেহারায় একটা ধূর্ত ভাব আছে। খাড়া খাড়া কুঁচলো দাঁড়ি। হ্যারি লক্ষ্য করল যে লোকটির আঙুল ও পা অনেক লম্বা। এবার তার দরোজার দ্বিতীয় অংশে এল দরোজার ওপর একটি কবিতা ঝোলানো ছিল।

আগন্তুক, তুমি মন দিয়ে শোনো
লোভের পাপের কি শাস্তি হয় জানো?
যারা শুধু নেয়, অর্জন করে না কিছুই
তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে, মানো।
আমাদের মেঝের নিচে যে গুপ্তধন
সেগুলো তোমার নয়, তবুও বলি
যদি তুমি হুঁশিয়ার না হও, করো চুরি
তাহলে দেখবে সেখানে
গুপ্তধন ছাড়াও আছে ‘অন্য কিছু’।

আমি বলেছি না, তোমারও এ ধরনের একটি পোশাক নিতে হবে। হ্যাগ্রিড বললেন।

দুজন গবলিন তাদের বো করল। তারা তখন মর্মরের তৈরি বিশাল হল রুমে। আরো প্রায় একশ গবলিন উঁচু চেয়ারে বসেছিল। তারা বড় বড় লেজারে লিখছিল, তামার দাঁড়িপাল্লায় মুদ্রার ওজন নিচ্ছিল এবং চোখে লাগানো ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মূল্যবান পাথর পরীক্ষা করছিল।

সুপ্রভাত হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি পটারের সিন্দুক থেকে কিছু টাকা ওঠাবার জন্য আমরা এখানে এসেছি।

আপনাদের কাছে কি চাবি আছে?

হ্যাঁ, আছে হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন। তারপর তিনি তার পকেট খালি করে সমস্ত জিনিসপত্র কাউন্টারের ওপর রাখতে শুরু করলেন। হ্যারি ডানদিকে লক্ষ্য করে দেখল যে গবলিনটা একটা মুক্তার স্তূপ ওজন করছে।

পেয়েছি সোনালী চাবিটা হাতে পেয়ে হ্যাগ্রিড বললেন।

গবলিন চাবি পরখ করে বলল–ঠিক আছে।

হ্যাগ্রিড বেশ গুরুত্বের সাথে বললেন–আমি ডাম্বলডোরের কাছ থেকে একটি চিঠিও নিয়ে এসেছি। চিঠিটা ইউ–নো–হোয়াট, সাতশত তের ভল্টের বিষয়ে। গবলিন মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ল। ঠিক আছে। গবলিন হ্যাগ্রিডকে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল–ভলটে যাবার জন্য আমি এই বলে গবলিন গ্রিপহুককে ডাকলো।

গ্রিপহুকও একজন গবলিন। হ্যাগ্রিড সব ডগ–বিস্কুট পকেটে ভরার পর তারা দুজন গ্রিপন্থককে অনুসরণ করল।

৭১৩ নং ভলটে ইউ–নো–কী করে? হ্যারি জানতে চাইল। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–আমি তোমাকে তা বলতে পারব না। এগুলো হোগার্টসের গোপনীয় জিনিস। ডাম্বলডোর বিশ্বাস করে আমাকে যতটুকু কাজ দিয়েছেন-এর বাইরে আমার কিছু করার নেই।

গ্রিপহুক তাদের জন্য দরোজা খুলে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকেই হ্যারি বিস্মিত। ঘরে মশাল জ্বলছে। যাওয়ার রাস্তাটা সরু এবং নিচের দিকে ঢালু হয়ে চলে গেছে। মেঝেতে বেশকিছু রেল লাইন। গ্রিপহুক বাঁশি বাজাতেই একটা ছোট বাহন তাদের সামনে এল। তারা চড়ে বসলো। অবশ্য হ্যাগ্রিডের বিরাট শরীর নিয়ে একটু কষ্ট হল উঠতে। বাহনটা ছুটতে শুরু করল। খুব দ্রুত ছুটছে। আঁকা–বাঁকা পথ দিয়ে। হ্যারি ডাইনে বায়ে উডয়দিকে তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না শুধু বাহনটার চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বাহনটা সবুজ আলোকিত এক স্থানে থামলো। হ্যাগ্রিডের পা ঝিম ঝিম করছিল, সে দাঁড়াতে পারছিলো না, পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সরু পথের দেয়ালে একটা দরজা। গ্রিপহুক দরজার তালা খুললো।

ঘরের ভেতর রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা। রূপোর স্তম্ভ। পাহাড়প্রমাণ ছোট ছোট ব্রোঞ্জের টুকরো। এবার স্মিত হেসে হ্যাগ্রিড হ্যারির উদ্দেশ্যে বললেন-এসবই তোমার। স্বর্ণগুলো হলো গ্যালিওন আর রূপোগুলো হলো সিকেল।

সব আমার, বলেন কী? অবিশ্বাস্য। হ্যারির কণ্ঠে বিরাট বিস্ময়।

মুদ্রাগুলো ব্যাগে ভরার ব্যাপারে হ্যাগ্রিড হ্যারিকে সাহায্য করলেন, হ্যাগ্রিড বললেন–সিন্দুক আর ভল্টে আরো আছে।

গ্রিপহুক বলল–ধীরে ধীরে সেগুলোও পাবে।

তারা আগে বাড়তে লাগল। তারা যতই আগে বাড়ল ততই তারা শীত অনুভব করতে লাগল।

মাটির নিচে একটা ছোট নদী। ওরা নদী অতিক্রম করল। তাদের সামনে সাতশ তের নাম্বার ভল্ট, কিন্তু চাবি ঢোকাবার ছিদ্র নেই। গ্রিপহুক বলল–সরে দাঁড়াও। বলেই তার লম্বা আঙুল ভল্টের গায়ে লাগিয়ে দিল। ভল্টের দেয়াল সরে গেল। গ্রিপহুক বলল–গ্রীংগট গবলিন ছাড়া অন্য কেউ হলে দরোজা ওদের শুষে নিত এবং ওরা এর ভেতর আটকে যেত।

হ্যারি জিজ্ঞেস করল–কেউ ঢুকেছে কিনা তা দেখার জন্য তুমি কতদিন পর পর পরীক্ষা কর।

গ্রিপহুক জবাব দিল–দশ বছরে অন্তত একবার। গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা নির্ভর ভল্টে কিছু অসাধারণ ঘটনা ঘটে থাকে। হ্যারি নিশ্চিত ছিল, এখানে অসাধারণ কিছু সে দেখবে। ঘর ভর্তি অলংকার। হঠাৎ একটা ছোট প্যাকেটের ওপর তার দৃষ্টি পড়ল। হ্যাগ্রিড মাটি থেকে প্যাকেটটা তুলে তার কোটের ভেতর রাখল। হ্যারি জানতে চাইল, ভেতরে কী!

চলে এসো। এই মাটির তলার বাহনে। হ্যাগ্রিড কললেন–আমার সাথে এখন কোন কথা বলবে না।

আমার এখন কোন কথা না বলাই ভাল। হ্যারি ভাবছে এত ভারী বস্তা ভর্তি টাকা পয়সা নিয়ে তারা কোথায় এবং কিভাবে যাবে।

একটা বাহনে করে ঝড়ের গতিতে তারা গ্রীংগটসের বাইরে চলে এলো। বাইরে তারা সূর্যের আলোর রেখা দেখতে পেল।

তার এখন জানার দরকার নেই কত গ্যালিওনে এক পাউন্ড হয়। এত অর্থ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে যা সারা জীবনেও সে দেখেনি–সারা জীবনে ডাডলিও দেখেনি।

এখনও হ্যারির ইউনিফর্ম কেনা বাকি। মাদাম মালকিনের দোকানে কি ইউনিফর্ম পাওয়া যাবে?

মাদাম মালকিনের সঙ্গেও আলাপ হলো।

অবশ্যই পাওয়া যাবে। তিনি বললেন–হোগার্টস থেকেও একটি ছেলে এসেছে, তাকেও ইউনিফর্ম দিয়েছি।

সেই ছেলেটার সাথেও হ্যারি আলাপ করল। তাদের মধ্যে বেশ কিছু কথাবার্তা হলো। স্কুল সম্পর্কেও তাদের মধ্যে কথা হলো। তার কাছ থেকে একটা নাম শোনা গেল–কিডিচ। কিডিচ কী? কিডিচ এক ধরনের খেলা। খেলাটা অনেকটা ফুটবল খেলার মতো। এ খেলায় কিছু ঝাড়ু লাগে।

ফ্লারিশ ব্লট নামে এক বইয়ের দোকান থেকে হ্যারির জন্য স্কুলের বই কেনা হলো। এই দোকানে বইয়ের স্ট্যাকগুলো সিলিং পর্যন্ত পৌঁছেছে।

চামড়া বাঁধাই বিরাট বিরাট বই, সিল্ক কাপড়ের বাঁধাই ডাকটিকেটের মতো ক্ষুদ্র বই, বিচিত্র রকমের প্রতীক চিহ্নের বই আবার কিছু বই আছে যেখানে কিছুই ছাপা নেই। এমনকি ডাডলির মতো ছেলে–যে মোটেও বই পড়ে না, এসব বই পাওয়ার জন্য সেও নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যেত।

বই দেখতে দেখতে এক জায়গায় হ্যারি থেমে গেল, বইটা ছিল শাপ ও প্রতিশাপ… কারসেস এন্ড কাউন্টার কারসেস। বন্ধুদের কিভাবে বোকা বানানো যায় বা শত্রুদের কিভাবে ক্ষতি করা যায়। লেখক অধ্যাপক ভিনডিকটাস ভিরিডিয়ান।

হ্যাগ্রিড এখান থেকে হ্যারিকে প্রায় ঠেলেই সরালেন। আমি দেখছিলাম, ডাডলিকে অভিশাপ দেয়ার কিছু পাওয়া যায় কিনা।

মন্দ নয়, আমি বলবো না যে আইডিয়াটা খারাপ হ্যাগ্রিড বললেন, কিন্তু তুমি তো বিশেষ কোন কারণ ছাড়া মাগলদের ওপর শাপ দিতে পারবে না। এটা নিষিদ্ধ। তাছাড়া তুমি এ কাজ পারবেও না। এর জন্য তোমাকে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হবে।

হ্যাগ্রিড হ্যারিকে স্বর্ণের তৈরি কলড্রন কিনতে দেননি। তবে জাদুপানীয় তৈরির উপাদান মাপার নিক্তি ও ভাঁজ করা যায় এমন একটি স্কেল কিনে দিলেন। এরপর ওরা গেল ওষুধের দোকানে–ফার্মেসিতে। পচা ডিম ও পচা পাতাকপির বিশ্রী গন্ধ এক ধরনের ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে সেখানে। মেঝেতে পিপা ভর্তি কিছু সরু জিনিস, জারভর্তি ভেষজ, শুকনো শিকড় ও চকচকে উজ্জ্বল গুড়ো পদার্থ দেয়ালে লাইন করে সাজানো।

পাখার বান্ডেল, ছাদ থেকে নিচে পর্যন্ত ঝোলানো সুতোয় বিষধর সাপের দাঁত, পাখির হাড়ের তৈরি অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। হ্যারি নিজে একুশ গ্যালিওন দিয়ে ইউনিকর্নের দুটো রূপার শিং কিনলো।

দোকান থেকে বের হয়ে হ্যাগ্রিড হ্যারির জন্য ক্রয় তালিকা বের করলেন। ও, তোমার জন্মদিনের উপহার তো কেনা হয়নি। হ্যারি লজ্জা পেয়ে বলল, না এর কোন প্রয়োজন নেই।

না, এ কথাটা তোমাকে আমার বলার দরকার ছিল না। তোমার জন্য ব্যাঙ কিনবো না। এটা কেউ এখন পছন্দ করে না। বিড়ালও না। বিড়াল থাকলে আমার হাঁচি হয়। তোমার জন্য কিনবো পেঁচা। এটা এখনকার ছোটরা খুব পছন্দ করে। খুবই প্রয়োজনীয়। চিঠিপত্রও নিয়ে যায়। তোমার অন্য জিনিসপত্রও নিয়ে যেতে পারবে।

আউল এমপোরিয়ামটা ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার। পেঁচার ঝটপটানির শব্দ। একটা সাদা পেঁচাকে একটা সুন্দর বড় খাঁচায় ভরে হ্যারি অগ্রসর হতে লাগল।

কুড়ি মিনিট পরে ওরা আউল এমপোরিয়াম অতিক্রম করে শেষ দোকানে পৌঁছল। সরু এবং নোংরা রাস্তা। দরোজায় লেখা আছে অলিভ্যান্ডার্স–সুন্দর জাদুদণ্ড প্রস্তুতকারক, স্থাপিত খ্রি. পূ. ৩৮২।

তারা দোকানের ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথেই দোকানের বেশ ভেতর থেকে টুং করে ঘণ্টা বাজল। কেউ আসলেই এটা বাজে। ভেতরটা খুবই ছোট, বসার জন্য একটা মাত্র চেয়ার। সেখানে হ্যাগ্রিড বসলেন। সেখানকার নিস্তব্ধতা হ্যারির কাছে মনে হলো যেন কোন পাঠাগারে তারা প্রবেশ করছে। ছোট ছোট বাক্সে সিলিং পর্যন্ত বই। ধুলো জমেছে। পিন পতন নিস্তব্ধতা। গুড আফটারনুন শব্দ কানে ভেসে আসায় হ্যারি চমকে উঠল। হ্যাগ্রিডও চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এক বৃদ্ধ লোক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ দুটো চাঁদের আলোর মত জ্বল জ্বল করছে।

***

আহ্ হা, দোকানে বৃদ্ধ লোকটি হ্যারিকে বললেন–হ্যাঁ, হ্যারি আমি ভাবছিলাম–তোমার সাথে শিগগিরই আমার দেখা হবে। তোমার চোখ ঠিক তোমার মায়ের মতো। মনে হচ্ছে যেন গতকালই তিনি এখানে এসেছিলেন। তার জাদুদণ্ড কিনছেন। জাদুকাঠির দৈর্ঘ্য ছিল সোয়া দশ ইঞ্চি।

তোমার বাবা মেহগনি কাঠের জাদুকাঠি পছন্দ করতেন। তার কাঠির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ইঞ্চি।

মি. অলিভাল্ডার হ্যারির কপালের বিদ্যুৎ চমকানোর সাদৃশ্য কাটা দাগে তার লম্বা ও সাদা আঙ্গুল স্পর্শ করলেন। তারপর বললেন, আমি দুঃখিত, যে জাদুর কাঠি এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা আমিই বিক্রি করেছি। সাড়ে তের ইঞ্চি লম্বা খুবই শক্তিশালী এই কাঠি ভুল মানুষের হাতে পড়েছিল। আমি যদি জানতাম এই জাদুকাঠিটা পৃথিবীতে কি করতে যাচ্ছে…।

তিনি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হ্যারির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার চোখ পড়লো হ্যাগ্রিডের দিকে, রুবিয়াস। রুবিয়াস হ্যাগ্রিড! কি ভাল লাগছে তোমাকে দেখে… ওফ, ষোল ইঞ্চি, একটু বাঁকা, তাই না?

জী স্যার, ওটা তা-ই ছিল, হ্যাগ্রিড বললেন।

ওটা খুবই ভাল জাদুকাঠি ছিল। তুমি যখন বহিষ্কৃত হলে তখন ওরা ওটাকে দুটুকরো করে দিয়েছিল, ঠিক তাই না। মি. অলিভান্ডার পেছন ফিরে বললেন।

হ্যাঁ, তারা দু টুকরো করেছিল। পদচারণা করতে করতে হ্যাগ্রিড বললেন খণ্ডগুলো অবশ্য আমার কাছেই আছে। কথাটা বলে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

কিন্তু তুমি তো ওগুলো এখন ব্যবহার করো না?

মি. অলিভান্ডার বেশ জোর দিয়ে বললেন।

না স্যার—হ্যাগ্রিড দ্রুত উত্তর দিলেন।

হ্যারি লক্ষ্য করলো হ্যাগ্রিড যখন কথা বলছেন, তখন তিনি খুব শক্ত করে তার গোলাপী ছাতা আঁকড়ে ধরেছিলেন।

তারপর মি. অলিভান্ডার হ্যারির দিকে ফিরে বললেন। এখন কি ধরনের জাদুর কাঠি চাই তোমার? তিনি মাপ নেওয়ার জন্য তার পকেট থেকে রূপোর দাগ দেওয়া লম্বা মাপের ফিতা বের করলেন। তিনি হ্যারিকে মাপলেন, কাঁধ থেকে আঙ্গুল, তারপর কব্জি থেকে কনুই, কাঁধ থেকে ভূমি, কনুই থেকে বগল ও মাথা চক্রাকারে। তিনি যখন মাপ নিচ্ছিলেন তখন বলে চলছিলেন, প্রত্যেকটি অলিভান্ডার জাদুর কাঠিতে শক্তিশালী জাদুর পদার্থ থাকে মি. পটার। আমরা ইউনিকর্নের চুল, ফিনিক্সের লেজ ও ড্রাগনের হার্টস্ট্রিং ব্যবহার করি। তবে সব জাদুকাঠি এক হয় না। যেমন সব ইউনিকর্ন, ড্রাগন বা ফিনিক্স সমান হয় না। এটা নিশ্চিত যে তুমি এর চেয়ে ভাল জাদুকাঠি আর কোথাও পাবে না। এক সময় হঠাৎ করে হ্যারি দেখলো মাপার ফিতাটি নিজে নিজেই তার মাপ নিচ্ছে। মি. অলিভান্ডার তখন বিভিন্ন তাক খুঁজে বাক্স নামাচ্ছিলেন। এটাই তোমার জন্য ভাল হবে। মি. অলিভান্ডার বললেন, পরীক্ষা করে দেখ। বীচ কাঠ এবং ড্রাগন হার্টস্ট্রিং-এর তৈরি। নয় ইঞ্চি লম্বা। সুন্দর এবং বাঁকানো যায়। এটা নিয়ে ঢেউয়ের মত নাড়াও।

হ্যারি কাঠিটি নিয়ে যেই একটু ঢেউ খেলালো এবং কোন কিছু অনুভব করার আগেই মি, অলিভান্ডার দ্রুত তার হাত থেকে কাঠিটি কেড়ে নিলেন। না-এটা দেখ! এবনি গাছের কালো কাঠের এবং ইউনিকর্ন চুলের, সাড়ে আট ইঞ্চি। দেখ, চেষ্টা কর।

হ্যারি চেষ্টা করে। একের পর এক কাঠি দিয়েই যাচ্ছেন মি. অলিভান্ডার। হ্যারি বুঝতেই পারে না, ঠিক কোনটার জন্য মি. অলিভাণ্ডার অপেক্ষা করছেন। উঁচু টুলটিতে একের পর এক জাদুকাঠি জমে এক বড় স্তূপে পরিণত হলো। মি. অলিভান্ডারের যেন কোন কষ্টই হচ্ছে না, আনন্দেই একের পর এক জাদুরকাঠি তাক থেকে নামাচ্ছেন আর হ্যারিকে দিয়ে চেষ্টা করছেন।

আমরা ঠিক কাঠিটাই পেয়ে যাব।

তিনি স্বগতোক্তি করলেন। হ্যাঁ বোধহয় এটাই–বেরি গাছের কাঠ মাঝখানে ফাঁপা এবং ফনিক্স পাখির পাখা, এগার ইঞ্চি, সুন্দর ও বাঁকানো। যায়।

হ্যারি জাদুর কাঠিটা হাতে নিল। সে তার আঙ্গুলে হঠাৎ করে তাপ অনুভব করলো। কাঠিটা সে তার মাথারও উঁচুতে উঠালো এবং শো শো করে নিচে নামালো, কাঠিটির প্রান্ত থেকে তারা বাতির মতো লাল ও সোনালী আলো বিভূতির মতো বিচ্ছুরিত হলো, ঘরের দেয়াল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। হ্যাগ্রিড তালি দিয়ে উঠলেন। মি. অলিভান্ডার চিৎকার করে উঠলেন, ওহ, ব্রাভো, খুব ভালো, ঠিক… ঠিক… কি আশ্চর্য… তিনি হ্যারির জাদুর কাঠিটি বাক্সে ভরলেন, এবং বাদামী কাগজে মোড়াতে মোড়াতে বিড় বিড় করে বললেন, কি অদ্ভুত… কি অদ্ভুত…

আপনি আশ্চর্য হলেন কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো। মি. অলিভান্ডার হ্যারির দিকে বিষণ্ণভাবে তাকালেন আমার স্মরণ আছে, প্রত্যেকটি জাদুকাঠি যা এ পর্যন্ত আমি বিক্রি করেছি, মি. পটার। প্রত্যেকটি জাদুকাঠিই। তোমার জাদুকাঠিতে যে ফিনিক্স পাখিটার লেজের পালক দেওয়া হয়েছে সেই পাখিরই আর একটা পালক–শুধু আর একটাই মাত্র। আশ্চর্যজনক, তোমার ভাগ্য নির্ধারিত ছিল এই জাদুদন্ডটাতেই এই জোড়ার অপরটা তোমার কপালের এই দাগের কারণ।

হ্যাঁ–সেটাই, সাড়ে তের ইঞ্চি। সত্যিই কি আশ্চর্যভাবে এটা হলো। আমার স্পষ্ট স্মরণ আছে এর অপরটি কোন জাদুকর কিনেছিলেন। আমি তোমার কাছে অনেক বড় কিছু আশা করি মি. পটার… বড় কিছু… যিনি অপরটি কিনেছিলেন নিশ্চয়ই তিনি বড় মহান কিছু করেননি। তিনি বড় ধরনের সাংঘাতিক খারাপ কাজ করেছিলেন।

হ্যারি কেঁপে উঠলো। মি. অলিভান্ডারকে তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। জাদুর কাঠিটার জন্য সে স্বর্ণের সাত গ্যালিওন দিল এবং মি. অলিভান্ডার মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে তাদের বিদায় দিলেন।

বিকেলে আকাশে সূর্য যেন নিচু হয়ে ঝুলছিল। ওরা ডায়াগন এলি থেকে বেরিয়ে এল সেই লিকি কলড্রন অতিক্রম করে। পথে হ্যারি কোন কথা বলল না। আশপাশের লোকজনের দিকেও তাকায়নি।

ব্যাগ কাঁধে তুলে হ্যাগ্রিড বললেন–ট্রেন ধরার আগে খাবার জন্য কিছু সময় আছে।

হ্যাগ্রিড হ্যারির জন্য একটি হ্যামবার্গার কিনলেন। তারা প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। হ্যারি চারদিকে তাকাচ্ছে। সবকিছু তার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।

হ্যারি সব কিছু ঠিক আছে তো? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন। হ্যারি নিজকে ঠিক প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছিল না। এই প্রথম সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্মদিন পালন করেছে। সে হ্যাম্বারগারে কামড় দিল।

একটু থেমে হ্যারি বলল–আমার কাছে সবকিছু অপূর্ব লাগছে। লোকজন, লিকি কলড্রন, অধ্যাপক কুইরেল, অলিভান্ডার সবই অপূর্ব। কিন্তু আমি তো জাদুবিদ্যার কিছুই জানি না। কীভাবে তারা আমার কাছে থেকে বড় কিছু আশা করেন। আমি বিখ্যাত, কিন্তু আমি জানি না–কেন আমি বিখ্যাত–আমার বাবা মা যে রাতে মারা যান সে রাতে কি ঘটেছিল। টেবিলের অপর প্রান্তে হ্যাগ্রিডের ভ্রূ ও দাঁড়ি ভেদ করে একটি সদয় স্মিত হাসির রেখা দেখা দিল।

হ্যাগ্রিড তাকে অভয় দিয়ে বললেন–হ্যারি, তুমি চিন্তা করো না। তুমি দ্রুতই সব জানতে পারবে। সবাইকে হোগার্টসে প্রথম থেকেই শুরু করতে হয়, তুমি সেখানে ভালোই করবে। আমি জানি এটা কঠিন। তবে, তোমাকে সেখানে ভিন্নভাবে দেখা হবে, তোমার কাছে বেশি… আশা করা হবে, এটা সব সময় কঠিন। তবে হোগার্টসে তোমার সময় ভালোই কাটবে।

হ্যাগ্রিড হ্যারিকে ট্রেনে উঠতে সাহায্য করলেন। এই ট্রেনে করেই হ্যারি ডার্সলিদের পরিবারে ফিরে যাবে। বিদায় নেয়ার আগে হ্যাগ্রিড হ্যারিকে একটা খাম দিয়ে বললেন, হোগার্টসে যাবার জন্য তোমার টিকিট, পহেলা সেপ্টেম্বর–কিংস ক্রস, এটা ওয়ানওয়ে টিকেট। ডার্সলি পরিবারে যদি তোমার কোন সমস্যা হয় পেঁচার মাধ্যমে তুমি আমাকে চিঠি দিও।

তোমার সাথে শিগগিরই দেখা হবে।

ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করল। যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে রইল।

 ০৬. পৌনে দশ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে যাত্রা

ডার্সিলি পরিবারে হ্যারির শেষ মাসটা খুব আনন্দে কাটেনি। ডাডলি তাকে এমন ভয় পেত যে সে তার সঙ্গে কোন সময়ই এক ঘরে থাকতে চাইত না। অন্যদিকে তাকে কাবার্ডে ভরতে, ধমক দিতে বা জোর করে কিছু করতে ডার্সলিরা সাহসও পেতেন না। প্রকৃতপক্ষে, কেউই হ্যারির সাথে পারতপক্ষে কথা বলতেন না। কিছুটা ভয়, কিছুটা রাগের কারণে হ্যারি সামনে বসে থাকলেও তারা মনে করতেন চেয়ারটা খালি। ওখানে কেউ নেই। এটা অনেক দিক থেকে ভালো হলেও হ্যারির কাছে এই উপেক্ষা বিষাদে পরিণত হয়েছিলো।

সঙ্গী হিসেবে পেঁচাকে হ্যারি তার ঘরে রেখেছে। পেঁচার নাম দিয়েছে সে হেডউইগ। এ নামটি সে পেয়েছে এ হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক গ্রন্থে। তার বইগুলো ছিল খুব মজার। সে গভীর রাত পর্যন্ত বইগুলো পড়ত। হেডউইগ জানালা দিয়ে ইচ্ছেমত ঘরের বাইরে যেত আবার আসত। ভাগ্য ভালো যে, আন্ট পেতুনিয়া কখনো হ্যারির ঘরে ঢুকতেন না, কারণ, প্রতিদিনই হেডউইগ ঘরে মরা ইঁদুর নিয়ে আসত। শোবার আগে সে প্রতি রাতেই দেয়ালে পিন দিয়ে আটকানো একটা কাগজে লেখা একটি করে তারিখ কেটে দিত। এভাবেই সে হিসাব রাখতো ১লা সেপ্টেম্বর আসতে আর কদিন বাকি আছে।

আগস্টের শেষ দিন হ্যারি কিভাবে সে কিংসক্রসে যাবে সে বিষয়ে আঙ্কল–আন্টের সঙ্গে একটু কথা বলে নেয়া ভালো। হ্যারি যখন তাদের বসার ঘরে গেল তখন তারা টিভিতে একটি কুইজ দেখছিলেন। হ্যারি গলা দিয়ে কাশির মতো শব্দ করল। তাকে দেখেই ডাডলি চিৎকার করে পালিয়ে গেল।

হ্যারি কাশি দিয়ে নিজের আসার কথা জানান দিল।

ভার্নন আঙ্কল, হ্যারি বলতে শুরু করল।

আঙ্কল কোন কিছু বললেন না, তবে বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি হ্যারির কথা শুনছেন।

হ্যারি বলল–আঙ্কল কাল আমি কিংস ক্রস স্টেশনে যাব। আমাকে হোগার্টস যেতে হবে। আপনার গাড়িতে আমাকে লিফট দিতে পারবেন?

আঙ্কল ভের্নন কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

ধন্যবাদ। হ্যারি বলল।

হ্যারি যখন ওপরতলায় ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল তখন তার আঙ্কল কথা বললেন, জাদুকরদের স্কুলে যেতে আবার ট্রেনের প্রয়োজন হয় কেন? ওদের ম্যাজিক কার্পেটগুলো কি ফেঁটে গেছে? তারপর হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন–তোমার স্কুল কোথায়?

আমি ঠিক জানি না। হ্যারি জবাব দিল। হ্যারি তখনই উপলব্ধি করলো যে সে বিষয়টি আগে খেয়াল করেনি। সে পকেট থেকে হ্যাগ্রিডের দেয়া টিকিট বের করলো।

কী জানো তাহলে?

হ্যারি জবাব দিল-এতটুকু জানি পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠিক এগারোটায় ট্রেনে চড়তে হবে।

কী প্ল্যাটফর্ম বললে? আন্ট ও আঙ্কল তার দিকে বিস্ময়ে তাকালেন।

পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। হ্যারি বলল।

যত্তসব রাবিশ–

এ নামে তো কোন প্ল্যাটফর্ম নেই। আঙ্কল ভার্নন মন্তব্য করলেন। টিকিটে তো তাই লেখা আছে। হ্যারি মরিয়া হয়ে জবাব দিল।

যত্তসব পাগলের কাণ্ড। আঙ্কল ভার্নন মন্তব্য করলেন–ঠিক আছে। অপেক্ষা করো, তুমি নিজেই দেখতে পাবে। তোমাকে কিংস ক্রস স্টেশনে নামিয়ে দিতে আমার কোন অসুবিধে নেই। কারণ কাল আমরাও লন্ডন যাচ্ছি।

পরিবেশ লঘু করার জন্য হ্যারি প্রশ্ন করল–আপনারা লন্ডন যাচ্ছেন, কেন?

ডাডলিকে হাসপাতালে নিতে হবে। বড় হওয়ার আগেই তার পেছনের ছোট লেজটায় অস্ত্রোপচার করতে হবে। সে-ই লেজটাই, যেটা গজিয়েছিল ঝড়ের রাতে, হ্যাগ্রিডের জাদুমন্ত্রে। সে রাত থেকে হ্যারিকে ডাডলির জ্বালাতন করাতো দূরের কথা, ওর ধারে কাছে যেতে সাহস পায় না।

পরদিন ভোর পাঁচটায় হ্যারি ঘুম থেকে উঠল। ভেতরে টান টান উত্তেজনা। তাই দ্বিতীয়বার আর ঘুমোতে গেল না। সে তার জিনসের কাপড় বের করল, কারণ জাদুকরের পোশাক পরে সে স্টেশনে যেতে চাচ্ছিল না। ট্রেনে উঠে সে পোশাক পালটে নেবে। হোগার্টসের জন্য যা যা জিনিস, তার তালিকা হ্যারি একবার যাচাই করে নিল। কারণ হোগার্টসে গিয়ে দেখা যাবে যে এমন কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা দরকার ছিল কিন্তু সেগুলো আনা হয়নি।

তারপর হ্যারি অপেক্ষা করতে লাগল–ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের কখন ঘুম ভাঙে। দু ঘণ্টা পর হ্যারির ভারী ট্রাংক ডার্সলির গাড়িতে ওঠানো হলো। আন্ট পেতুনিয়া ডাডলিকে বলে দিলেন–গাড়িতে ও যেন হ্যারির পাশে বসে। ভয়ে ভয়ে হলেও ডাডলি হ্যারির পাশে গাড়িতে বসলো, গাড়ি চলতে শুরু করলো।

সাড়ে দশটায় তারা কিংস ক্রস স্টেশনে পৌঁছলেন। আঙ্কল ভার্নন হ্যারির ট্রাংকটা ট্রলিতে উঠিয়ে দিলেন এবং নিজেই ট্রলিটি স্টেশনে ঠেলে নিয়ে গেলেন। হ্যারি আঙ্কলের ওই কাজকে একটা আশ্চর্য সদয় ব্যবহার বলে মনে করল। একটু পরে যখন আঙ্কল ভার্নন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলেন তখন তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি।

আঙ্কল ভার্নন বললেন-এই তোমার প্ল্যাটফর্ম প্ল্যাটফর্ম নয়… প্ল্যাটফর্ম দশ। তোমার প্ল্যাটফর্ম এ দুটি সংখ্যার মাঝামাঝি হওয়া উচিত। মনে হচ্ছে–প্ল্যাটফর্ম এখনও তৈরি করেনি। আঙ্কল ভার্নন ঠিকই বলেছেন। প্ল্যাটফর্মের কোন এক জায়গায় প্লাস্টিকে বড় অক্ষরে নয় এবং অন্য এক স্থানে দশ লেখা আছে। এ দুয়ের মাঝামাঝি জায়গায় কোথাও কোন কিছু লেখা ছিল না।

ভালো থেকো। এই বলে তার সে-ই অদ্ভুত ও সংশয়মিশ্রিত হাসি হেসে আঙ্কল ভার্নন আর কোন কথা না বলেই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেলেন। হ্যারি তাকিয়ে দেখল ডার্সলিরা গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের তিনজনই হাসছে। হ্যারির মুখ শুকিয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল সে এখন কি করবে? পেঁচা হেডউইকের কারণে লোকজন তার দিকে তাকাচ্ছে। ট্রেনের ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত। হ্যারি গার্ডের কাছে গিয়ে হোগার্টসের ট্রেনের কথা জানতে চাইল। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পৌনে দশ বলতে হ্যারির সাহস হচ্ছিল না। হোগার্টস কোথায়? জানতে চাইল গার্ড। হ্যারিও তাকে বলতে পারল না হোগার্টস দেশের কোন জায়গায় অবস্থিত। হ্যারি কি বলবে, তার মাথায় কিছু আসছিলো না। এবার প্রশ্ন করল–আচ্ছা এগারোটার সময় কোন ট্রেন আছে কি?

তাতো বলতে পারলাম না। গার্ড জবাব দিল। তখন এগারোটা বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ট্রেনের মাত্র দশ মিনিট বাকি। সে স্টেশনের মাঝখানে ভারি ট্রাঙ্ক, পেঁচা ও পকেটভর্তি জাদুকরদের টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ঠিক এই সময়ে পেছনে একদল লোক দেখতে পেল যারা আলাপে মাগল শব্দটি বারবার বলছিল। এক মোটা মহিলা চারজন লাল চুল যুবকের সাথে কথা বলছিলেন। হ্যারি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। শুনতে পেল মহিলা বলছেন–

–তোমাদের প্ল্যাটফর্ম নাম্বার কত?

পৌনে দশ। একটি ছোট মেয়ে জবাব দিল। তারও লালচুল। মাম, আমিও কি ওদের সাথে যেতে পারি না।

না, না, গিনি তুমি ছোট এখনো বড় হওনি। এখন চুপ কর। আর পার্সি তুমি আগে আগে যাও।

ছেলেদের মধ্যে যাকে সবচে বেশি বয়সের মনে হলো তাকে প্ল্যাটফর্ম নয় ও দশের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল। হ্যারি তাকে অপলক দৃষ্টিতে লক্ষ্য রেখে তার পেছনে পেছনে অগ্রসর হলো। ছেলেটা যখন এই দুটো প্লাটফরমের মাঝামাঝি পৌঁছলো, তার সামনে দলে দলে পর্যটক। যখন সর্বশেষ ব্যাগটিও ট্রেন থেকে খালাস করা হলো তখন দেখা গেল যে ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ফ্রেড, তারপর তোমার পালা। ভদ্রমহিলা বললেন।

আমি ফ্রেড নই। আমি জর্জ। ছেলেটি জবাব দিল। তুমি কি আমাকে জর্জ বলে ডাকতে পারো না?

দুঃখিত, জর্জ। ভদ্রমহিলা বললেন।

ঠাট্টা করছিলাম। আমিই ফ্রেড। এই বলে সে চলে গেল।

তারপর তৃতীয় ভাইটি বদ্ধ দেয়ালের দিকে অগ্রসর হলো। তাকে আর দেখা গেল না। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল তারও কোন হদিস নেই। হ্যারির পাশে কেউ আর রইল না।

মাফ করবেন। ভদ্রমহিলার কাছে এসে হ্যারি বলল।

হ্যালো! হ্যারিকে সম্বোধন করে ভদ্র মহিলা বললেন–তুমি কি প্রথমবারের জন্য হোগার্টসে যাচ্ছে? রনও প্রথমবারের মতো যাচ্ছে।

তিনি তার ছোট ছেলের প্রতি ইশারা করলেন।

রন লম্বা, পাতলা। হাত পা বড় বড়। চোখা নাক।

হ্যাঁ হ্যারি জবাব দিল। কীভাবে যাব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি

কেন, তুমি কি প্লাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছি না।

না। হ্যারির জবাব।

চিন্তা নেই। তোমাকে শুধু দু প্লাটফর্মের মাঝখানে যেতে হবে। নয় ও দশের মাঝখানে। ওই দেয়ালের দিকে যাও। ঘাবড়াবার কারণ নেই। চেষ্টা কর যাতে রনের আগে পৌঁছতে পারো।

ঠিক আছে। হ্যারি বলল।

হ্যারি তার ট্রলি ধাক্কা দিল এবং সামনের বদ্ধ দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়ালটা একেবারে নিরেট।

হ্যারি হাঁটতে শুরু করল। যাওয়ার পথে লোকজনের সাথে হ্যারির ধাক্কাধাক্কি হলো। হ্যারি আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল। টিকিট বাক্সের সাথে হ্যারির ধাক্কা লেগে গিয়েছিল প্রায়। ধাক্কা লাগলে তার জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে যেত। ভাগ্য ভালো। হ্যারিকে দুর্ঘটনায় পড়তে হয়নি।

জনাকীর্ণ প্লাটফর্মের পাশে একটি লাল রঙের বাস্পীয় ইঞ্জিন অপেক্ষা করছিল। ইঞ্জিনের ওপর লেখা ছিল হোগার্টস এক্সপ্রেস।

১১টা। হ্যারি পেছনে তাকাল। তাকিয়ে দেখল। নয় ও দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে লেখা ভেসে উঠল–প্লাট ফরম পৌনে দশ।

কথাবার্তায় ব্যস্ত লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে ইঞ্জিনের ধোঁয়া ভেসে চলেছে। নানা রঙের বিড়াল পায়ের ফাঁক গলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক পেঁচা এদিক–সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রাংক টানাটানির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

প্রথমদিকের কামরাগুলোতে ছাত্ররা গা ঘেষাঘেষি করে বসে আছে। কেউ কেউ জানালা দিয়ে মুখ গলিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলছে। একটা ছেলে তার ব্যাঙ হারিয়ে ফেলেছে। হ্যারির ভাগ্য ভালো। সে মোটামুটি একটি খালি কামরা পেয়ে গেল।

ফ্রেড নামের ছেলেটা হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল–তুমি কি হ্যারি পটার?

হ্যাঁ। হ্যারি জবাব দিল।

হ্যারির দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে লালচুল যমজভাই দুজন ট্রেন থেকে নেমে এল। হ্যারি জানালার পাশে বসেছিল। সেখান থেকে নিজেকে অনেকটা আড়ালে রেখে হ্যারি প্ল্যাটফর্মে লালচুল পরিবারের সবাইকে লক্ষ্য করছিল এবং তারা কি বলছিল তা শুনছিল। মা এইমাত্র তার রুমাল বের করলেন।

রন, তোমার নাকে ওটা কি?

ছোট ছেলেটি তার মার কাছ থেকে সরে যাচ্ছিল। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে তার নাক মুছে দিলেন।

যমজ ভাইদের একজন বলে উঠল–রনের নাকে কি কিছু আছে?

চুপ কর। রন ধমক দিল।

পার্সি কোথায়? তার মা জানতে চাইলেন।

সে আসছে

বড় ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এল। এরই মধ্যে সে তার পোশাক বদলে হোগার্টসের জাদুর স্কুলের পোশাক পরে নিয়েছে। হ্যারি দেখল ইংরেজি পি বর্ণ দিয়ে তার বুকের ওপর একটি উজ্জ্বল ব্যাজ।

মা, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। ছেলেটি বলল।

আমি প্রিফেক্টদের কামরা থেকে এলাম। তারা তাদের জন্য দুটি কামরা পৃথক করে রেখেছেন।

পার্সি, তুমি কি একজন প্রিফেক্ট? যমজদের একজন প্রশ্ন করল।

যমজদের একজন আবার প্রশ্ন করল–পার্সি প্রতিদিন নতুন পোশাক পায় কিভাবে?

কারণ সে একজন প্রিফেক্ট। মা জবাব দিলেন। ভালোভাবে থেকো। যখন সুযোগ পাবে তখন আমাকে একটা পেঁচা পাঠাবে।

তিনি পার্সির কপালে চুমু দিলেন। পার্সি চলে গেল! এরপর তিনি যমজ ভাইদের দিকে নজর দিলেন।

হ্যারি লক্ষ্য করল ট্রেন বাঁক নেবার সাথে সাথেই মা ও মেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ট্রেনে চড়তে পারায় হ্যারির অনেক আনন্দ হচ্ছিল। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ করে সামনের দরোজা খুলে গেল। একজন লালচুলের বালক কামরায় প্রবেশ করে হ্যারির উল্টোদিক দেখিয়ে জানতে চাইল-এখানে কি কেউ আছে? হ্যারি না বলাতে বালকটি ওই আসনে বসে পড়ল।

প্রথমে সে হ্যারিকে লক্ষ্য করল। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে এমনভাবে তাকাল যেন সে হ্যারিকে দেখতেই পায়নি। হ্যারি লক্ষ্য করল এর ভেতরে দু যমজ ভাই ফিরে এসেছে।

যমজ ভাইদের একজন বলল আমাদের কি পরিচয় হয়েছে? আমরা ফ্রেড ও জর্জ। এ হলো আমাদের ভাই রন। আবার দেখা হবে।

বিদায়, হ্যারি ও রন বললো। যমজ দু ভাই অন্য কামরায় গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিল। তুমি কি আসলেই হ্যারি পটার? রন আবার প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ। মাথা নেড়ে হ্যারি বলল। রন আবার বলল–আমি ভেবেছিলাম ফ্রেড বা জর্জের মধ্যে কেউ একজন হবে।

রন হ্যারির কপালের দিকে ইঙ্গিত করে বলল।

হ্যারি, এখানেই কি ইউ-নো-হুর…।

হা হ্যারি জবাব দিল–কিন্তু আমার কিছু মনে নেই।

তোমার কি কিছুই মনে নেই? রন আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল।

তীব্র সবুজ আলোর কথা আমার মনে পড়ে। এর বাইরে কিছুই মনে করতে পারি না। হ্যারি জবাব দিল।

ওহ। এই বলে রন বসে পড়ল ও হ্যারিকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণের জন্য। তারপর সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

তোমাদের পরিবারের সবাই কি জাদুকর? হ্যারি রনকে প্রশ্ন করল। রনকে হ্যারির খুব ভাল লেগেছে।

রন জবাব দিল–আমার তাই মনে হয়। মায়ের এক দূরসম্পৰ্কীয় ভাই আছেন যিনি হিসাবরক্ষক। আমরা তাকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা করি না।

তাহলে তুমি অনেক জাদু জানো। হ্যারি মন্তব্য করল।

ওয়েসলি পরিবার পুরনো জাদুকর পরিবারের অন্যতম। ডায়াগন এলির সেই ছেলেটি এ ধরনের মন্তব্য করেছিল।

আমি শুনলাম তুমি মাগলদের সাথে থাকতে গিয়েছিলে। তারা কেমন? রন হ্যারিকে প্রশ্ন করল।

খুবই খারাপ। তবে তাদের সবাই নয়। হ্যারি জবাব দিল। মাগল চেনার জন্য আমার চাচা, চাচী ও চাচাতো ভাইই যথেষ্ট। আমার যদি তিনজন জাদুকর ভাই থাকত।

পাঁচ–রন বলল। যেকোন কারণেই হোক রনকে একটু মনমরা দেখাচ্ছিল। রন বলে চলল–আমাদের পরিবারে আমি ষষ্ঠ ব্যক্তি যে হোগার্টসে যাচ্ছি। তুমি হয়তো বলতে পার বিল আর চার্লি যা রেখে গেছে তার অনেক কিছুই আমি পেয়েছি। বিল ছিল হেডবয়, আর চার্লি কিডিচ দলের অধিনায়ক। এখন পার্সি একজন প্রিফেক্ট। ফ্রেড আর জর্জ অনেক হইচই করে বেড়ায়। তবুও তারা ভালো নম্বর পায়। সবাই মনে করে তারা খুব মজার। প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা আমিও তাদের মত ভালো করব। আমি যদি ভালো করি তাতেও আমার কোন কৃতিত্ব থাকবে না। কারণ এ রকম ফলাফল ওরা সবাই আগে করে গেছে। যার পাঁচ ভাই আছে সে কখনো নতুন কিছু পায় না। আমি বিলের কাছ থেকে তার পুরনো পোশাক, চার্লির কাছ থেকে জাদুদণ্ড এবং পার্সির কাছ থেকে পুরনো ইঁদুর পেয়েছি।

রন তার জ্যাকেটের ভেতর হাত দিয়ে একটা মোটা ধূসর রঙের ইঁদুর বের করল। ইঁদুরটা তখন ঘুমোচ্ছিল। এর নাম স্ক্যাবাস। এটা কোন কাজের নয়। কখনও ঘুম থেকে ওঠে না। পার্সি প্রিফেক্ট হওয়ার পর আমার বাবার কাছ থেকে এক পেঁচা পেয়েছিল। আর আমি পেলাম এই স্কাবার্সকে। রনের কান গোলাপী বর্ণ ধারণ করল। তার মনে হল সে অনেক বেশি কথা বলছে। তাই সে আবার জানালার বাইরে তাকাল। কারো কাছে যদি একটি পেঁচা না থাকে তাহলে তাকে দুঃখিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই–হ্যারির কাছে তাই মনে হলো। একমাস আগেও হ্যারির কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। হ্যারি রনকে জানাল যে তাকে সব সময় ডাডলির পুরনো কাপড় পরতে হয়েছে এবং জন্মদিনে সে কখনো কোন উপহার পায়নি।

হ্যারির কথা শুনে রন খুশি হয়ে উঠল।

হ্যারি রনকে আরও বলল–হ্যাগ্রিডের সাথে সাক্ষাতের আগে বুঝতে পারিনি যে আমাকে জাদুকর হতে হবে। তার সাথে সাক্ষাতের আগে আমি আমার বাবা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।

রন একটি দীর্ঘশ্বাস নিল।

কি ব্যাপার? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তুমি ইউ-নো-হু-এর নাম বললে। আমিও ভেবেছিলাম তোমরা সবাই… রন বলল। তাকে একই সাথে অভিভূত আবার দুঃখিতও মনে হচ্ছিল।

আমি তার নাম উল্লেখ করে বাহাদুরি দেখাতে চাইনি।

হ্যারি বলল আমি মনে করি আমি যে শব্দগুলো উচ্চারণ করেছি সেগুলো তোমার না জানাই ভালো। আমাকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে। আমার মনে হয় আমি ক্লাশের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র হবো?

না, তুমি তা হবে না। রন বলল-এখানে অনেকেই মাগল পরিবার থেকে আসে। তারা অল্প সময়েই সব শিখে ফেলে।

তারা যখন কথা বলছিল ঠিক তখনই ট্রেনটি লন্ডন শহরের বাইরে চলে গেল। তারা জানালা দিয়ে মাঠে গরু–ছাগল–ভেড়া দেখতে লাগল।

ঠিক সাড়ে বারোটার সময় তারা ট্রেনের করিডোর থেকে কথাবার্তা ও হাসির শব্দ শুনতে পেল। তাদের কামরার দরোজা খুলে এক ভদ্রমহিলা এসে হাসি মুখে তার টেনে আনা খাবারের ট্রলির দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–তোমাদের কারো কোন খাবার লাগবে?

হ্যারি সকালে নাশতা করতে পারেনি। তাই সে উঠে দাঁড়ালো। রন বলল তাকে বাইরে যেতে হবে না। তার কাছেই স্যান্ডউইচ আছে।

হ্যারি যখন ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকত তখন তার কাছে কোন টাকা–পয়সা থাকত না। অবশ্য এখন তার পকেট গরম। তার পকেট ভর্তি সোনা ও রূপার মুদ্রা। মহিলাটির ট্রলিতে সব আজব ধরনের খাবার, যা সে জীবনে দেখেনি। সে কোনটাই হারাতে চাইলো না, সবকিছুই অল্প অল্প করে কিনলো এবং মহিলাকে এগারটি সিলভার সিকেল ও সাতটি ব্রোঞ্জ নাটস দিল।

হ্যারি অনেক খাবার দাবার এনে খালি আসনে রাখল।

রন জিজ্ঞেস করল–তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে? কুমড়োর একটি প্যাস্ট্রি মুখে দিতে দিতে হ্যারি বলল–হ্যাঁ আমার খিদে পেয়েছে।

রন প্যাকেট খুলে চারটি স্যান্ডউইচ বের করল। হ্যারিকে বলল, তুমি এখান থেকে কিছু নেবে? অবশ্য স্যান্ডউইচগুলো শুকনো। বুঝতেই পারছো। আমরা পাঁচ ভাই, মা খুব একটা সময় পায় না।

হ্যারি তার প্যাস্ট্রি রনের সামনে রেখে বলল নাও, এখান থেকে নাও। এ পর্যন্ত ভাগাভাগি করে খাবার সুযোগ হ্যারির হয়নি। রনের সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়াতে হ্যারির মনে এক আনন্দময় অনুভূতির সৃষ্টি হলো। রনের সাথে হ্যারি প্যাস্ট্রি ও কেক খেল। স্যান্ডউইচের কথা তারা একেবারেই ভুলে গেল।

চকোলেট ফ্রগের একটি প্যাকেট বের করে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল-এটা কী?

হ্যারি বলে চলল-এগুলি নিশ্চয়ই ব্যাঙ নয়।

হ্যারি যেকোন বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল।

না ব্যাঙ নয়। রন জবাব দিল। দেখো সাথে একটি কার্ড আছে।

কি? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তুমি জানো না। রন বল–চকোলেট ফ্রগের ভেতর কার্ড থাকে। এসব কার্ডে বিখ্যাত জাদুকর ও জাদুকরণীদের ছবি থাকে। আমি এ পর্যন্ত পাঁচশ কার্ড সংগ্রহ করেছি, কিন্তু কোনো কার্ডেই এগ্রিপা বা টলেমির ছবি পাইনি।

হ্যারি তার চকোলেট ফ্রগের প্যাকেটটি খুলল। কার্ডে একজন মানুষের ছবি। তার চোখে অর্ধচন্দ্রাকার চশমা। লম্বা বাঁকা নাক। রূপালী চুল, দাঁড়ি ও গোঁফ। ছবির নিচে লেখা

আলবাস ডাম্বলডোর

রন বলল, আমি একটা ফ্রগ চকোলেট নেই, দেখি এগ্রিপা বা টলেমির ছবি পাই কিনা।

হ্যারি পড়তে লাগলো…

আলবাস ডাম্বলডোর হোগার্টস-এর বৰ্তমান অধ্যক্ষ, যাকে বিবেচনা করা হয় এ যুগের শ্রেষ্ঠতম জাদুকর হিসেবে। ১৯৪৫ সালে কালো যাদুকর গ্রিনডে ওয়াল্ডকে পরাজিত করেই ডাম্বলডোর বিখ্যাত হন; ড্রাগন রক্তের ১২টি ব্যবহার উদ্ভব ও সহকর্মী নিকোলাস ফ্লামেলের সাথে আলকেমির উপর কাজ করাও তার অন্যতম কীর্তি। প্রফেসর ডাম্বলডোর উপভোগ করেন চেম্বার মিউজিক ও টেনপিন বোলিং।

হ্যারি এবার কার্ডটি উল্টাল। এবার তাকিয়ে দেখে কার্ডে ডাম্বলডোরের কোন ছবিই নেই।

কই, তিনি তো নেই। হ্যারি অবাক বিস্ময়ে মন্তব্য করল।

তুমি তো আশা করতে পার না তিনি সারাক্ষণ কার্ডের সাথে লেগে থাকবেন। রন বলল–তিনি আবার আসবেন। আমি আবার মর্গানাকে পেয়েছি।… তার ছটা ছবি পেয়েছি।

তুমি কি কার্ড জমাতে চাও?

রনের দৃষ্টি চকোলেট ফ্রগের প্যাকেটগুলোর দিকে।

না–ও না–ও হ্যারি বলল, তুমি তো জান, মাগল জগতে ছবির ভেতর মানুষ স্থায়ীভাবে থাকে।

সত্যিই কি তারা তাই করে? তারা কি একটুও নড়াচড়া করে না। রন আশ্চর্য হয়ে মন্তব্য করল–সত্যিই কী অদ্ভুত!

হ্যারি দেখল যে ডাম্বলডোরের ছবি পুনরায় কার্ডে চলে এসেছে এবং তিনি হ্যারির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বিখ্যাত জাদুকরদের ছবির চেয়ে রন-এর মনোযোগ ছিল খাবারের দিকে। একটু পর হ্যারি কার্ডে শুধু ডাম্বলডোরই নয়–আরো বিখ্যাত জাদুকরদের ছবি দেখল। এরপর হ্যারি বেরটি বোটস-এর বিচিত্র গন্ধের মটরশুটির প্যাকেট খুললো। এ সব বিষয়ে তোমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রন হ্যারিকে সাবধান করে বলল। যখন তারা বলে সকল প্রকার গন্ধ, তার মানে সকল প্রকার গন্ধ–তুমি জান, চকোলেট, পিপারমেন্ট এবং মার্মালেড-এর মত সাধারণ জিনিসে যা পাও, আবার তুমি পালং শাক, কলিজা বা ষাড়ের ভুঁড়ির গন্ধ।

রন একটি সবুজ মটরদানা হাতে নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল এবং মটরদানায় কামড় বসাল।

তারা বেশ মজা করে খাচ্ছিল। হ্যারি টোস্ট, নারকেল, সেকা মটরশুটি, স্ট্রবেরি, তরকারি, ঘাস, কফি ও সার্দিন খেল। এবং সাহস করে একটি ধূসর রঙের খাবারে এক কামড় দিল যা রন কখনো করবে না, ওটা আসলে ছিল মরিচ।

এবার তারা জানালা দিয়ে দেখল, খেত–খামার নয়, ট্রেনটি বন, আঁকাবাঁকা নদী ও ঘন সবুজ পাহাড় অতিক্রম করছে। তাদের কম্পার্টমেন্টের দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ পেল এবং দরজা টেনে গোলমুখ ছেলেটি ভেতরে ঢুকলো, ওকে হ্যারি পৌনে দশ প্লাটফর্মে দেখেছিল। কাঁদো কাঁদো মুখ তার। বলল, তোমরা কি একটি ব্যাঙ দেখেছো? তারা যখন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না। সে কেঁদে ফেলো, আমি ওটা হারিয়ে ফেলেছি। হ্যারি তাকে সান্ত্বনা দিল–পেয়ে যাবে। ঘাবড়িওনা।

যাহোক, যদি দেখতে পাও, আমাকে জানিও বলে ছেলেটি চলে গেল। একটু পর আবার সে ফিরে এল। এবার সাথে একটি মেয়ে। তার গায়ে হোগার্টসের ইউনিফর্ম। তোমরা কি কেউ একটা ব্যাঙ দেখেছো, নেভিল হারিয়েছে। মেয়েটি বলল।

আমরা আগেই ওকে জানিয়েছি–আমরা দেখিনি। রন বলল। রনের হাতে জাদুদণ্ড।

একি, তুমি কি ম্যাজিক দেখাবে? রনের হাতে জাদুকাঠি দেখে মেয়েটি বলল।

দেখি কি ম্যাজিক করছো, বলে মেয়েটি বসে পড়লো।

রন একটু ভয়ই পেয়ে গেল, তারপর বলল, ঠিক আছে। কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে শুরু করলো সানসাইন, ডেইসিস, বাটার মেলো টান দিস স্টুপিড, ফ্যাট র‍্যাট ইয়েলো। বলে সে জাদুকাঠিটি ঘুরালো। কিন্তু কিছুই হলো না। ইঁদুরটা ধুসরই থেকে গেল এবং ওটা তখনও ঘুমাচ্ছিল।

আমি রন ওয়েসলি। রন মৃদুস্বরে বলল।

আমি হ্যারি পটার। হ্যারি বলল।

তুমি কি সত্যিই হ্যারি পটার? অবাক হয়ে হারমিওন প্রশ্ন করল। তারপর হারমিওন বলে চলল–আমি তোমার সবকিছুই জানি। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আমি কিছু বই পাই। মডার্ন ম্যাজিকাল হিস্ট্রি, দি রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দি ডার্ক আর্টস এবং গ্রেট উইজার্ডিং ইভেন্টস অফ দি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বইগুলোতে তোমার নাম উল্লেখ আছে।

সত্যিই? বিস্ময়ের সাথে হ্যারি প্রশ্ন করে।

আশ্চর্য, তুমি কিছুই জান না। হারমিওন বলল–আমি যদি তোমার জায়গায় হতাম তাহলে আমি সবকিছু খুঁজে বের করে ফেলতাম। আচ্ছা, তোমরা কি কেউ জানো তোমরা কোন হাউজে থাকবে? আমি গ্রিফিল্ডর হাউজে থাকতে চাই। আমার মনে হচ্ছে ওটা ভাল হবে। আজ আমি যাচ্ছি। নেভিলের ব্যাঙ খুঁজতে হবে। আর তোমরা জামা–কাপড় পালটে নাও আমরা শিগগিরই পৌঁছে যাব।

যে ছেলেটি ব্যাঙের খোঁজে এসেছিল তাকে নিয়ে হারমিওন বিদায় নিল।

আমি যে হাউজে থাকি না কেন আমি চাই যেন এই মেয়েটি সেখানে না থাকে। একথা বলে রন তার জাদুদণ্ড ট্রাংকে ভরল।

তোমার অন্য ভাইরা কোন হাউজে আছে? হ্যারি জানতে চাইল। গ্রিফিল্ডর হাউজ। রন জবাব দিল। রনের চেহারা একটু বিবর্ণ হলো। তবুও সে বলে চলল–বাবা ও মা এই হাউজে ছিলেন। আমি যদি এই হাউজে থাকতে না পারি তাহলে বাবা–মা কী ভাববেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। হাউজ হিসেবে ব্যাভেনক্লও খারাপ নয়। কিন্তু ভেবে দেখ, তারা যদি আমাকে স্লিদারিন হাউজে রেখে দেয়।

এই হাউজেই… ইউ নো হু ছিল।

হ্যারি ভাবছিল স্কুল ত্যাগ করার পর জাদুকররা কী করে।

রন জানাল–ড্রাগনশাস্ত্রে অধ্যয়নের জন্য চার্লি রোমানিয়া গিয়েছে এবং গ্রিংগটসের প্রস্তুতি নেবার জন্য বিল আফ্রিকায় গেছে। তুমি কি গ্রিংগটসের নাম শুনেছ? ডেইলি প্রফেটে এর ওপর অনেক লেখালেখি হয়েছে। মাগলদের কাছে সে পত্রিকাটা পাবে না। কেউ একবার ভল্ট ভেঙ্গে ডাকাতির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি।

হ্যারি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সত্যিই? এরপর কি ঘটেছিল?

কিছুই নয়, এই জন্যই তো বড় খবর হয়েছিল সেই ঘটনা। রন বলল–আমার বাবার ধারণা ওটা ছিল কোন কালো জাদুকরের কাজ। কিন্তু ওরা মনে করে না যে, কেউ সেখান থেকে কিছু নিয়ে যেতে পেরেছে। এগুলো খুবই খারাপ জিনিস। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সকলেই শঙ্কিত হয় এবং এর সাথে যদি ইউ নো হু-এর হাত পেছনে থাকে, তা হলে তো কথাই নেই। যদিও সে জেনেছে এসব জাদু জীবনের বিষয়। কিন্তু ভোলডেমর্ট নামটি তেমন তাকে অস্বস্তিতে ফেলে না বা তাকে ভয় পাইয়ে দেয় না।

কিডিচ খেলা সম্পর্কে তোমার কি কোন ধারণা আছে? রন হ্যারিকে প্রশ্ন করে।

এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই। হ্যারি জবাব দিল।

তুমি কি বললে নাম শোননি? বিস্ময়ের সাথে রন প্রশ্ন করে-এটা তো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলা।

তারপর রন কিডিচ খেলার বিভিন্ন নিয়মকানুন সম্পর্কে হ্যারিকে বলল। তারা যখন গল্প করছিল তখন তাদের কামরার দরোজা খুলে গেল। এবার কামরায় ব্যাঙ হারানো ছেলে নেভিল নয়, হারমিওন গ্রেঞ্জার। তিনটি বালক তাদের কামরায় প্রবেশ করল। হ্যারি মাঝখানে বিষণ্ন মুখের বালকটিকে মুহূর্তেই চিনতে পারল। তাকে মাদাম মালকিনের পোশাকের দোকানে দেখেছিল। ডায়াগন এলির চেয়ে এখন বেশি আগ্রহ নিয়ে সে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল।

এটা কি সত্য? ছেলেটি বলল–সবাই বলাবলি করছিল এই কামরায় হ্যারি পটার আছে। তাহলে তুমিই সেই হ্যারি পটার?

হ্যাঁ হ্যারি জবাব দিল। হ্যারি অন্য দুই ছেলের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই খুব মোটা ও তাদের দুজনকেই সংকীর্ণ মনা মনে হলো। তারা দুজনেই বিষণ্ন মুখের বালকটির দুপাশে এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন তারা ওর বডিগার্ড।

এরা দুজন হলো ক্ৰেব ও গয়েল। বিষণ্ণ মুখের ছেলেটি বলল আমার নাম ম্যালফয়–ড্রেকো ম্যালফয়।

রন কাশি দিল। ড্রেকো ম্যালফয় তার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার নামটি কি কৌতুককর মনে হয়। তুমি কে সেটা জিজ্ঞাসা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমার বাবা আমাকে বলেছেন ওয়েসলি পরিবারের সদস্যদের মাথার চুল লাল এবং তাদের পরিবারে অনেক বেশি ছেলেমেয়ে।

সে হ্যারির দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

পটার, তুমি অল্পদিনেই বুঝতে পারবে যে কিছু জাদুকর পরিবার অন্য পরিবার থেকে ভালো। তুমি খারাপ লোকের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। আমি তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।

হ্যারির সাথে করমর্দনের জন্য সে তার হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু হ্যারি সাড়া দিল না।

ধন্যবাদ, কে ভালো কে মন্দ সেটা আমিই বলতে পারব। শীতলভাবে সে কথাগুলি বলল।

ড্রেকো ম্যালফয়ের চেহারা লাল না হলেও তার চেহারায় একটা গোলাপী আভা দেখা গেল।

আমি যদি তুমি হতাম তাহলে আমি আরো সতর্ক থাকতাম। সে আস্তে আস্তে বলল–তুমি যদি আর একটু নম্র না হও তাহলে তোমাকেও তোমার বাবা–মার পথে যেতে হবে। তারা বুঝতে পারেনি কোন জিনিসটি তাদের জন্য কল্যাণকর ছিল। তুমি যদি ওয়েসলির মত মাস্তান আর হ্যাগ্রিডের সাথে মেলামেশা কর, তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো যাবে না।

হ্যারি এবং রন দুজনেই দাঁড়াল। ওয়েসলির চেহারা তার চুলের মত লাল হয়ে উঠল।

রন বলল–কথাটা আবার বলতো।

তোমরা কি আমাদের সাথে মারামারি করতে চাও? ম্যালফয় ধমকের সুরে বলল।

যদি তোমরা এক্ষুণি এখান থেকে বিদেয় না হও। হ্যারি খুব কড়াভাবে বলল। একটু বেশি কড়াভাবেই। কারণ ওর সাথে অপর দুজন ক্রেবে আর গয়েল ওদের উডয়ের চেয়ে গায়ে–গতরে বড়সড় ছিল।

আমাদের এখান থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমাদের খাবার সব শেষ হয়ে গেছে এবং মনে হচ্ছে তোমাদের কাছে এখনও কিছু খাবার আছে।

রনের কাছে রাখা চকোলেট ফ্রগের দিকে গয়েল এগুল। রন লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। গয়েলকে স্পর্শ করার আগেই বিকট শব্দ করে গয়েল আর্তনাদ করে উঠল।

স্ক্যাবার্স, রনের ইঁদুরটি তার আঙুলের ডগায় ঝুলছিল। ইঁদুরটি তার ছোট ধারাল দাঁত গয়েলের আঙুলে বসিয়ে দিয়েছে। ক্রেবে আর ম্যালফয় পেছনে সরে দাঁড়াল। স্কাবার্সের কামড়ে গয়েল হাউ–মাউ করছিল। গয়েল ইঁদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত মুরাতে লাগলো। এক সময় ইঁদুরটা ছুটে গিয়ে জানালায় আঘাত করলো। এরপর তারা তিনজনই ছুটে পালালো। হতে পারে তারা ভেবেছিল ঘরে বোধহয় আরো অনেক ইঁদুর আছে। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ঘটনার এক সেকেন্ড পরই হারমিওন গ্রেঞ্জার কামরায় প্রবেশ করল।

এখানে এতক্ষণ কী ঘটলো? মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিষ্টি দেখে হারমিওন প্রশ্ন করল। রন লেজ ধরে টেনে স্ক্যাবার্সকে হাতে তুলে নিল।

আমার মনে হচ্ছে সে আঘাত পেয়েছে। রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল। সে স্ক্যাবার্সের দিকে তাকাল। তারপর বলল–না, না–আমার বিশ্বাস হয় না… সে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

আসলে সে ঘুমিয়েই পড়েছিল।

তোমার সাথে ম্যালফয়ের এর আগে কখনও দেখা হয়েছে?

হ্যারি তাকে বলল, ডায়গন এ্যালিতে তাদের দেখা হওয়ার বিষয়।

আমি এই পরিবারের কথা শুনেছি। রন খুব গুরুগম্ভীর ভাবে বলল। ইউ-নো-হু অদৃশ্য হয়ে যাবার পর যারা আমাদের সাথে প্রথমে এসেছিলেন ওর মধ্যে ওরাও ছিল। ওরা বলেছিল ওদের ওপর জাদু করা হয়েছিল। আমার বাবা অবশ্য এ গল্প বিশ্বাস করেন না। কালো জাদুর দিকে যেতে ম্যালফয়ের বাবার অজুহাত বের করতে কোন রকম অসুবিধে হয় না।

রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বলল–আমরা কি কোনভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

তোমাদের উচিত তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নেয়া। আমি ট্রেনের চালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন–আমরা গন্তব্যে এসে গেছি প্রায়। তোমরা তো মারামারি করছিলে এখানে, করছিলে কিনা? আমাদের সবার নামার আগে তোমরা যদি সেখানে নাম, তোমাদের বিপদ হতে পারে।

রন জবাব দিল–স্ক্যাবার্স মারামারি করেছে। আমরা করিনি। আমরা এখন পোশাক পরিবর্তন করব। তুমি কি একটু বাইরে যাবে?

হারমিওন বলল–ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। আমি এখানে এসেছি, কারণ ছোট ছেলেমেয়েদের মত এখানকার লোকজন করিডোরে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর তুমি কি জানো তোমার নাকে ময়লা লেগেছে।

রন হারমিওনের যাবার দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। মেঘলা আকাশের নিচে পাহাড় ও বন দেখা যাচ্ছে। মনে হলো ট্রেনের গতি কমে আসছে।

হ্যারি ও রন তাদের জ্যাকেট খুলে হোগার্টসের জন্য কালো পোশাক পরে নিল।

ট্রেন থেকে একটি ঘোষণা এলো–আমরা পাঁচ মিনিটের ভেতর হোগার্টস পৌঁছব। তোমাদের মালামাল ট্রেনেই রেখে দিও! মালামালগুলি পৃথকভাবে হোগার্টস স্কুলে পাঠানো হবে।

ট্রেনের গতি কমল। এক সময় ট্রেন থামল। নামার জন্য সবাই দরোজায় ভিড় করছে। প্ল্যাটফর্মে বেশ ঠাণ্ডা। হ্যারি হঠাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল প্রথম বর্ষের ছাত্র যারা তারা ডানদিকে এসো। হ্যারিও এদিকে এসো। এটা ছিল হ্যাগ্রিডের কণ্ঠস্বর।

হ্যাগ্রিড বললেন–যারা প্রথম বর্ষের ছাত্র তারা আমাকে অনুসরণ কর প্রথম বর্ষের আরও কেউ আছে? সাবধানে পা ফেলো। আমাকে অনুসরণ করো।

পা পিছলিয়ে ও হোঁচট খেতে খেতে তারা হ্যাগ্রিডকে অনুসরণ করে খাড়া ও সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে আগে বাড়ল। দুপাশেই এত অন্ধকার ছিল যে হ্যারি ভাবল এখানে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। যাবার পথে কেউ তেমন কোন কথা বলল না। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমরা সবাই প্রথম বারের মতো হোগার্টস জাদুবিদ্যায় স্কুলে এসেছে।

হঠাৎ জোরে উ–উ–উ–ধ্বনি শোনা গেল।

সংকীর্ণ পথটি যেখানে গিয়ে থামল সেখানে সামনে একটি বড় লেক।

লেকের দুপাশে পাহাড়। আকাশে তারা। কাছাকাছি কয়েকটি দুর্গ আছে বলে মনে হলো।

হ্যাগ্রিড এক সারি নৌকা দেখিয়ে বললেন একটা নৌকায় চারজনের বেশি উঠবে না।

সবাই ঠিকমতো উঠল কিনা হ্যাগ্রিড তা ভাল করে দেখে নিলেন।

অনেকগুলো ছোট ছোট নৌকা এগিয়ে যেতে থাকল। লেকের পানি স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ। সবাই চুপ করে আছে। নৌকাগুলো দুর্গের কাছাকাছি এল।

হ্যাগ্রিড চিৎকার করে বলল–তোমরা সবাই মাথা নিচু কর।

তারপর একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গ। মনে হলো দুর্গের নিচ দিয়ে নৌকা চলছে।

শেষ পর্যন্ত মাটির নিচে বন্দরের মত একটা স্থানে পৌঁছালো। সম্পূর্ণ জায়গাটাতে নুড়ি–পাথর ছড়ানো।

সবাই নৌকা থেকে নামছে কিনা হ্যাগ্রিড দাঁড়িয়ে দেখছিলো। নেভিলকে দেখে হ্যাগ্রিড জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তোমার ব্যাঙ? নেভিল ব্যাঙটা দেখে আনন্দে বলে উঠলো, ট্রেভর! ট্রেভর তার ব্যাঙটির নাম।

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে তারা ওপরে উঠতে থাকলো। পাথুরে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে ওক গাছের দরোজা। হ্যাগ্রিড বললেন, সবাই ঠিকমত এসেছে, আর তুমি তোমার ব্যাঙ পেয়েছ। তিনি তার বিশাল মুষ্টি দিয়ে দরজায় তিনবার আঘাত করলেন।

 ০৭. সেই হ্যাট

মুহূর্তেই দরোজা খুলে গেল। লম্বা, কালো চুলের এক মহিলা পান্নার মত সবুজ রঙের পোশাক পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চাহনি খুব কড়া। হ্যারি ভাবল, এ মহিলাকে পেরিয়ে সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।

হ্যাগ্রিড বললেন, অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, এরা প্রথম বর্ষের ছাত্র।

ধন্যবাদ হ্যাগ্রিড। আমি ওদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি।

ম্যাকগোনাগল সবাইকে হল ঘরে নিয়ে গেলেন। হল ঘরটি বিশাল। পাথরের দেয়ালে মশালের আলো। ছাঁদ অনেক উঁচুতে।

তারা সবাই অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলকে অনুসরণ করলো। পাথরের মেঝেতে নানা রকম চিত্র আঁকা। হ্যারি ডানদিকের দরোজার ওপাশ থেকে শত শত লোকের কণ্ঠ শুনতে পেল–স্কুলের বাকি অংশটুকু নিশ্চয়ই এখানে কিন্তু অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদেরকে হল ঘরের মধ্যে একটা খালি ছোট কামরায় নিয়ে গেলেন। তারা সবাই পরস্পরের গা ঘেঁষে কোনমতে সেখানে দাঁড়ালো, সাধারণত এতক্ষণ তাদের দাঁড়ানোর কথা নয়। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে।

ম্যাকগোনাগল বললেন–তোমাদের সবাইকে হোগার্টসে স্বাগত জানাচ্ছি। টার্ম শুরুর ভোজসভা শিগগিরই শুরু হবে। গ্রেট হলে আসন গ্রহণ করার আগেই তোমাদের কে কোন হাউজে যাবে তা বণ্টন করা হবে। এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হাউজটাই হবে তোমাদের পরিবার। তোমরা হাউজের ডর্মিটরিতে থাকবে। অবসর সময় কমনরুমে কাটাবে।

এখানে চারটা হাউজ আছে–গ্রিফিল্ডর, হাফলপাফ, র‍্যাভেন ক্ল ও স্লিদারিন। প্রত্যেকটা হাউজের ম্যাজিকের ইতিহাস আছে। হাউজে থাকার ব্যাপারে কিছু নিয়ম–কানুন আছে। অনিয়ম করলে পয়েন্ট কাটা যাবে। বছরের শেষে হাউজ-কাপ দেয়া হয়। যে হাউজ সবচে বেশি পয়েন্ট পাবে সে হাউজই কাপ পাবে। হাউজ কাপ পাওয়া একটা সম্মানের ব্যাপার।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্কুলের সামনে বাছাই অনুষ্ঠান হবে, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল নেভিলের জামা ও রনের নাকের দিকে লক্ষ্য করলেন। হ্যারিকে খুব নার্ভাস দেখাছিল। সে যথাসম্ভব তার চুল ঠিক করে নিলো।

তোমরা শান্তভাবে অপেক্ষা কর। আমি সময়মতো ফিরে আসবো। এই বলে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বিদায় নিলেন।

তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদের হাউজ ভাগ করে দেবেন? রন জানতে চাইল।

আমার মনে হয় তারা কোন একটা পরীক্ষা নেবেন। ফ্রেড বলছিল এই পরীক্ষা বেশ কষ্টকর। ফ্রেড বোধহয় ঠাট্টা করেছে। হ্যারির বুক কাঁপছে। আবার পরীক্ষা দিতে হবে। কিসের পরীক্ষা!

হ্যারির বুক ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো। পরীক্ষা? স্কুলের সবার সামনে। সে তো এখন পর্যন্ত কোন জাদু জানে না। তাকে কি করতে হবে? এই সময় যে এই ধরনের কিছু হবে, আসার আগে সে ভাবেনি।

কেউ বিশেষ কোন কথা বলছে না। শুধু হারমিওন ফিস ফিস করে নিজের জাদুর ক্ষমতার কথা বলল।

হ্যারি চারিদিকে দেখল যে প্রত্যেকের চেহারায় একটা আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠেছে।

তারপর হঠাৎ কিছু একটা ঘটলো, হ্যারি লাফ দিয়ে এক ফুট ওপরে উঠলো–তার পেছনের কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো। প্রায় বিশটা ভূত পেছনের দেয়াল থেকে স্রোতের মত আসছে। দেখতে মুক্তোর মত সাদা ও কিছুটা স্বচ্ছ। তারা একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে ভেসে বেড়ালো। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দিকে তারা খুব একটা তাকালো না। একজন মোটা সন্ন্যাসীর মতো ভূত বলছে–ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ। আমার মনে হয় ওকে আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিত। আরেকজন বলছে—না না। তাকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর দেয়া যায় না।

একটা ভূত হঠাৎ করে ছাত্রদের দেখে বলল, এখানে তোমরা কী করছ?

কেউ জবাব দিল না।

মোটা সন্ন্যাসী বলল-এরা নতুন ছাত্র। একটু পরে এদের বাছাই পর্ব শুরু হবে।

কয়েকজন নীরবে সম্মতি জানাল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ফিরে এসে বললেন-এখন অন্যসব কাজ বন্ধ। এখন বাছাই পর্ব শুরু হবে।

এরপর ভূতগুলো পেছনের দেয়াল দিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

যাবার আগে একটা ভূত বলল–আশা করি, তোমাদের সাথে হাফলপাফে দেখা হবে। আমি ওই হাউজের সদস্য ছিলাম।

সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াও এবং আমাকে অনুসরণ কর। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নির্দেশ দিলেন।

পায়ে ব্যথার কারণে হ্যারি খুব দ্রুত হাঁটতে পারছিল না। তার সামনে ছিল বালু রঙের চুলের একটি ছেলে, আর তার পেছনে ছিল রন। তারা কামরা থেকে বের হয়ে হল ঘর পার হয়ে গ্রেট হলে প্রবেশ করল।

জায়গাটা খুবই মনোরম। হ্যারি এ ধরনের অপূর্ব সুন্দর জায়গা কল্পনা করতেও পারে না। চারটা লম্বা টেবিলের ওপর হাজার হাজার মোমবাতি মৃদু বাতাসে জ্বলছে। মঞ্চে একটা লম্বা টেবিল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলসহ শিক্ষকগণ এই টেবিলটাতে বসলেন। তাদের দিকে যে শত শত মুখ তাকিয়ে ছিল, তাদের দেখে মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল মোমবাতির সামনে ক্ষণপ্রভা লণ্ঠন। ছাত্রদের মাঝে দুএক ভূতকেও দেখা যাচ্ছিল। সামনের চেহারাগুলো দেখার জন্য হ্যারি ওপরে তাকাল। ওপরে সে কালো ভেলভেটের সিলিং ও তারা দেখতে পেল। হারমিওন হ্যারির কানে কানে বলল, হোগার্টস, এ হিস্টরি–বইতে আমি পড়েছি, বাইরের আকাশের মতই এটা আকর্ষণীয়। এখানে কোন ছাদ আছে এবং এই গ্রেট হলটা স্বর্গের কোন স্থান নয়। এটা একেবারেই মনে হয় না।

হ্যারি নিচে তাকিয়ে দেখলো অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটা চার–পায়া টুল তাদের সামনে রাখলেন। টুলের ওপর ছিল জাদুকরের একটা চোখা হ্যাট। হ্যাটটা খুবই পুরনো ও জরাজীর্ণ। আন্ট পেতুনিয়া হলে এটাকে কোনদিন বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না। একটু পরে এই হ্যাটটা গান গাইতে শুরু করল। ছাত্রদের মাঝখানে এখানে সেখানে ভূত ঘোরাফেরা করছিল।

হে তুমি হয়তো ভাবনি আমিও সুন্দর
শুধু চোখের দেখা দিয়ে করো না বিচার
যদি আমার চেয়ে চৌকস কোনো হ্যাট
দেখাতে পারো তুমি; আমি নিজেই,
নিজেকে গিলে খাবো।
তুমি তোমার টুপিকে কালো রাখতে পারো
তোমার উঁচু হ্যাট মসৃণ ও লম্বা
কিন্তু আমার জন্যে আছে হোগার্টসের সর্টিং হ্যাট
এবং আমি সবাইকে তা পরাতে পারি
তোমার মাথায় কিছুই নেই গোপন
সর্টিং হ্যাট দেখতে পায় না কিছু
অতএব আমাকে পরীক্ষা করো, বলে দেবো
কোথায় তুমি যেতে চাও?
হতে পারো তুমি গ্রিফিল্ডরের বাসিন্দা
যেখানে হৃদয়ে বাস করে সাহস
তাদের সাহস, স্নায়ু ও মর্যাদা
গ্রিফিল্ডরদের করে তোলে মহীয়ান
হতে পারো তুমি হাফলপাফের বাসিন্দা
যেখানে তারা ন্যায়বান ও অনুগত
আর ধৈর্যশীল হাফলপাফেরা হচ্ছে সৎ
এবং পরিশ্রমে অকাতর।
অথবা বিজ্ঞ পুরনো র‍্যাভেন ক্লর বাসিন্দা
যদি থেকে থাকে তোমার তৈরি মন
যেখানে ধীমান ও শিক্ষিতেরা সহযাত্রী খুঁজে পাবে
কিংবা হতে পারো বাসিন্দা স্লিদারিনের
যেখানে খুঁজে পাবে তুমি প্রকৃত বন্ধুকে
ধূর্ত লোকেরা উদ্দেশ্য হাসিল করতে
বেছে নেয় যেকোন উপায়।
অতএব আমাকে ভয় পেও না, করো না হৈচৈ
(আমার কেউ না থাকলেও) তুমি রয়েছ
ঠিক নিরাপদ হাতে, যে কারণে আমি থিংকিং ক্যাপ।

হ্যাটের গান শুনে হলভর্তি সবাই আনন্দে করতালি ও শীস দিয়ে উঠল। হ্যাট সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে চুপ হয়ে গেল।

এই হ্যাট নিয়ে কি আমাদেরকেও পরীক্ষা দিতে হবে। রন হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল।

হ্যারি খুব নিস্পৃহভাবে মুচকি হেসে বলল–জাদু শেখার চেয়ে হ্যাট নিয়ে নাড়াচাড়া করাও অনেক ভালো।

হ্যাটটাকে দেখে হ্যারি বুঝতে পারল যে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই হ্যারি হ্যাটটার কাছে যেতে সাহস পেল না।

এবার অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল পার্চমেন্টের একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।

ম্যাকগোনাগল বললেন–আমি যখন তোমাদের রোল কল করব তখন তোমরা এই হ্যাটটা পরে টুলের ওপর বসবে।

গোলাপী বর্ণের ও বাদামী চুলের একটা মেয়ে হ্যাট পরল। পরার সাথে সাথেই হ্যাটটা চিৎকার করে উঠল–হাফল পাফ।

ডানদিকের টেবিলের সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। হান্না হালপাফের টেবিলে গিয়ে বসল। হ্যারি দেখল আগে দেখা সেই ভূতটাও আনন্দ প্রকাশ করছে।

এরপর ডাকা হল–বোনস, সুজান।

হালপাফ আবার হ্যাটটা চিৎকার করল। সুজান হাননার পাশে বসল।

বুট, টেরি।

এবার হ্যাটটা চিৎকার করল–র‍্যাভেন ক্ল।

বাঁ দিকের দ্বিতীয় টেবিলের সবাই করতালি দিল। টেরি র‍্যাভেন ক্লর জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে বসল।

ম্যান্ডি ও ব্রকলহার্স্ট র‍্যাভেন ক্ল হাউজে গেল। তবে ল্যাভেন্ডার ব্রাউন গেল গ্রিফিল্ডর হাউজে। বাঁ দিকে দূরের টেবিলটা যেন আনন্দে বিস্ফোরিত হল। হ্যারি দেখতে পাচ্ছিল রনের যমজ দু ভাই বিদ্রূপ করে শব্দ করছে।

মিলিসেন্ট বালসট্রোড স্লিদারিন হাউজের সদস্য হয়ে গেল। হ্যারি ভাবছিল তার ভাগ্যে স্লিদারিন হাউজ পড়বে। হ্যারির মনে হলো ওদের বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তার কল্পনাও হতে পারে।

হ্যারির এখন নিজেকে অসুস্থ মনে হতে লাগলো। মনে পড়ল তার স্কুলে খেলার জন্য যখন কোন দলে তাকে বেছে নেয়া হত, সব সময় তাকে সবার শেষে বেছে নেয়া হত। সে যে খারাপ খেলতো সে কারণে নয়, তারা বরং ডাডলিকে বোঝাতে চাইতো না যে, তারা হ্যারিকে পছন্দ করে।

ফিনচ, ফ্লেচলি, জাস্টিন

তার ভাগ্যে হাফলপাফ হাউজ পড়ল।

হ্যারি লক্ষ্য করল কারো কারো নাম ডাকতে হ্যাটটার তেমন কোন সময়ই লাগছে না। অথচ কারো কারো জন্য অনেক সময় নিচ্ছে।

হ্যারির পাশে দাঁড়ানো বেলেচুলের ছেলেটি সিমাস ফিনিংগাম টুলের ওপর বসল। এবার হ্যাটটি ঘোষণা দিল–গ্রিফিল্ডর।

গ্রেঞ্জার, হারমিও।

হারমিওন দৌড়ে গিয়ে টুলে বসল। মাথায় হ্যাট লাগাল। এবার আওয়াজ এল–গ্রিফিল্ডর।

হ্যারির মনে একটি দুর্ভাবনার উদয় হলো। আসলে যখন কেউ খুব নার্ভাস থাকে তখন তার মনে নানা দুর্ভাবনা হয়। যদি তার নাম একেবারেই না ডাকা হয়!

যদি এমন হয় যে সে হ্যাট মাথায় দিয়ে টুলের ওপর বসে আছে দীর্ঘক্ষণ কিন্তু হ্যাট কোন কিছু বলছে না। যদি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যাটটা খুলে নিয়ে হ্যারিকে বলেন–নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে, তোমার আর ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। তুমি ট্রেনে ফেরত চলে যাও।

ব্যাঙ হারানো ছেলেটা নেভিল লংবটমকে যখন ডাকা হলো, টুলে যাবার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। দীর্ঘ বিরতির পর হ্যাট ঘোষণা করল গ্রিফিল্ডর। অনেক হাসি–ঠাট্টার ভেতর দিয়ে নেভিলকে ফিরে যেতে হলো।

নাম ডাকা হলে ম্যালফয় আগে বাড়ল। মাথায় হ্যাট লাগাবার সাথে সাথেই ঘোষণা এল–স্লিদারিন।

খুশি মনে ম্যালফয় তার বন্ধু ক্রেব ও গয়েলের কাছে গেল।

আর বেশি নাম ডাকতে বাকি নেই।

তারপর ডাকা হলো মুন…নট….. পার্কিনসন যমজ বোন, পাতিল ও পাতিল-এরপর পার্ক, স্যালি, অ্যানাকে। প্রায় শেষের দিকে দু একজনের আগে ডাকা হলো হ্যারি পটারকে। পটার, হ্যারি? যেই হ্যারি এগিয়ে গেল অমনি গুঞ্জন শুরু হল

পটার, তিনি কি ঠিক তা-ই বলেছেন?

হ্যারি পটার?

হ্যাট পরার আগে হ্যারি দেখলো সবাই তাকে ভাল করে দেখার জন্য উঁচু হয়ে তাকাচ্ছে। পরের মুহূর্তে সে হ্যাটের ভেতরের কালো রং দেখছে। হাম, তার কানে এল। কঠিন। খুব কঠিন। অনেক সাহস। মনটাও খারাপ নয়। প্রতিভাও আছে–কিছু করার আগ্রহও আছে।

হ্যারি টুলের কোণা শক্ত করে ধরে উচ্চারণ করল–না, স্লিদারিন নয়….. স্লিদারিন নয়।

স্বরটি তাকে বলল–তুমি তাহলে স্লিদারিন হাউজে যেতে চাও না। তুমি ভালো করে ভেবে দেখ। স্লিদারিন হাউজ তোমাকে সাহায্য করবে। স্লিদারিন হাউজ তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি স্লিদারিন হাউজে তুমি একেবারেই যেতে না চাও তাহলে তোমাকে গ্রিফিল্ডর হাউজে দেয়া হবে।

হ্যাটের কাছ থেকে ঘোষণা শুনে হ্যারি মাথা থেকে হ্যাটটা নামাল। তারপর ধীরে ধীরে গ্রিফিল্ডরের টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। স্লিদারিন হাউজের বদলে গ্রিফিল্ডর হাউজ পাওয়ায় হ্যারি বেশ স্বস্তি বোধ করছে।

প্রিফেক্ট পার্সি উঠে দাঁড়াল ও শক্ত হাতে হ্যারির সাথে করমর্দন করল। ওয়েসলি পরিবারের যমজ দুভাই অন্যদের সাথে চিৎকার করে উঠল। হ্যারি পটারকে আমরা পেয়েছি। হ্যারি পটারকে আমরা পেয়েছি। আগে দেখা ভূতটার উল্টো দিকে হ্যারি বসল। ভূতটি মৃদুভাবে হ্যারির কাঁধে চাপড় দিল।

হ্যারি এখন উঁচু টেবিলটা ভালভাবে দেখতে পারছে। হ্যারি হ্যাগ্রিডের কাছাকাছি বসল। হ্যাগ্রিড বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। একটি সোনার চেয়ারে বসে আছেন আলবাস ডাম্বলডোর। হ্যারি তাকে চিনতে পারল। আরো কয়েকটা মুখ হ্যারির পরিচিত যেমন অধ্যাপক কুইরেল।

হাউজ বাছাইয়ের জন্য আর মাত্র তিনজন বাকি। তারপিন, লিসা গেল র‍্যাভেন ক্ল হাউজে! তারপর রনের পালা। রনের মুখ শুকিয়ে সবুজ হয়ে গেল। ওর জন্য হ্যারি টেবিলের তলায় ফিঙ্গার ক্রস করল। হ্যাট ঘোষণা দিল–গ্রিফিল্ডর।

আনন্দে হ্যারি অন্যদের সাথে মিলে হাততালি দিল। রন হ্যারির পাশের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লো।

শাবাশ রন। চমৎকার। হ্যারির পাশে পার্সি উইসলি হর্ষধ্বনি করল। জেবনী ব্লেইজ গেল স্লিদারিন হাউজে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল রোল কলের কাগজ গুটিয়ে হ্যাট তুলে নিয়ে ঘোষণা দিলেন–বাছাই পর্ব শেষ।

হ্যারি তার স্বর্ণের থালার প্রতি দৃষ্টি দিল। সে এই প্রথম অনুভব করল যে সে খুব ক্ষুধার্ত। সে কদুর প্যাস্ট্রি তুলে নিল। আঃ কী মজা।

আলবাস ডাম্বলডোর উঠে দাঁড়ালেন। দুই হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন নবীন ছাত্রগণ। তোমাদেরকে স্বাগত জানাই। এই হোগার্টসে তোমরা স্বাগত। আমাদের খাওয়ার পর্ব শুরু হওয়ার আগে আমি চারটি শব্দ উচ্চারণ করব। সেগুলি হলো–নিটউইট! ব্লুবার! অডমেন্ট! টুইক। ধন্যবাদ।

তিনি বসে পড়লেন। সবাই করতালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করলো। হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না-এখন কী করবে।

উনি কি পাগল। হ্যারি পার্সিকে জিজ্ঞেস করল।

পার্সি বলল–কী বলছ তুমি। তিনি তো এক অসামান্য প্রতিভা। তিনি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর। একজন অসাধারণ ব্যক্তি। অবশ্য অসাধারণ ব্যক্তিরাই এক আধটু পাগল হয়। তোমাকে আলু দেব, হ্যারি।

হ্যারির খিদে পেয়েছে। সামনে খাবারের পাহাড়। খাবারে কী নেই রোস্ট, চিকেন, ল্যাম্ব চপ, সসেজ, শূকরের মাংস, আলু সেদ্ধ, পুডিং, আরো নানা রকমের সস।

ডার্সলি পরিবারে হ্যারিকে অনাহারে থাকতে হয়নি। তবে সে কখনোই পেট পুরে বা ইচ্ছেমত খেতে পায়নি। তার পছন্দের খাবার তার কাছ থেকে সব সময় ডাডলি কেড়ে নিত। এই মুহূর্তে হ্যারির খুব খিদে পেয়েছে। সে একটা প্লেটে সব খাবারই অল্প অল্প করে নিয়ে খেতে শুরু করলো। পাশ থেকে ভূত তাকে লক্ষ্য করছিল।

ভূতটা বলল-এগুলো খুব সুস্বাদু খাবার।

তুমি খাবে না। হ্যারি ভূতকে বলল।

আমি প্রায় চারশ বছর কিছুই খাইনি। ভূতটি জবাব দিল। আমার এখন খাবার প্রয়োজন নেই। তবে সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? আমি তো এখনও আমার পরিচয় দিইনি। আমার নাম স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি পর্পিংটন। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের আবাসিক ভূত।

আমি তোমাকে চিনি। হঠাৎ করে রন বলে উঠল–আমার ভাই তোমার কথা বলেছে, তুমি তো মুণ্ডহীন গলা।

আমাকে স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি বলে ডাকলে আমি খুশি হব। ভূত বলল।

মুণ্ডহীন? কীভাবে তুমি মুণ্ডহীন হলে? বেলেচুলের সিম্মাস ফিননিগান জিজ্ঞেস করলো।

ভূতটাকে খুব বিব্রত মনে হলো। কারণ প্রশ্নটা তার পছন্দ হয়নি।

এভাবেই–সে রেগে বলল। সে তার বাম কান টান দিয়ে পুরো মাখাঁটি নিচে নামিয়ে ঘাড়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখল। মনে হলো কেউ যেন তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিকোলাস কিছুক্ষণ পর তার মাথাকে ঘাড়ের সাথে সংযুক্ত করল। একটু কেশে বলল–গ্রিফিন্ডারের নবীন ছাত্ররা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে তোমরা আমাদের সাহায্য করবে

হ্যারি এবার স্লিদারিন টেবিলের দিকে তাকাল সেখানেও একটা ভূত বসে আছে। ভয়ঙ্কর চেহারা। সারা পোশাকে রূপালী রক্ত।

ওর জামায় রক্ত কেন?–সিমাস জিজ্ঞেস করলো।

প্রায় মুণ্ডহীন ভূতটা বলল–আমি তো তাকে জিজ্ঞেস করিনি।

সবাই পেট পুরে খেল তারপর অবশিষ্ট খাদ্য প্লেট থেকে উধাও হয়ে গেল। প্লেটগুলো আবার ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরেই টেবিলে পুডিং দেখা গেল। সব ধরনের ও সব স্বাদের আইসক্রিম ও উপস্থিত। তারপর এল আপেল, পাই, চকোলেট, জেলি, বাদাম, স্ট্রবেরি, চালের পুডিং…. যখন একটা খাবার নেবার জন্য হ্যারি হাত বাড়াল তখন তাদের পরিবারের বিষয়ে কথা উঠল।

এরপর চললো নানা বিষয়ে কথাবার্তা। মাগল পরিবারের সব দুষ্কর্মের কথা। নেভিল এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দিল। হ্যারির ঘুম পাচ্ছে। সে উঁচু টেবিলের দিকে তাকাল। অধ্যাপক মাকগোনাগল ডাম্বলডোরের সাথে কথা বলছেন। অধ্যাপক কুইরেলের মাথায় একটা অদ্ভুত পাগড়ি। অধ্যাপক কুইরেল কথা বলছেন চকচকে কালো চুলের এক শিক্ষকের সাথে। শিক্ষকটার লম্বা বাঁকানো নাক ও গায়ের রঙটা হলুদাভ। হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটলো। বাঁকানো নাক শিক্ষকটা কুইরেলের পাগড়ির পেছন থেকে হ্যারির চোখাচুখি হলেন–তিনি হ্যারির কপালের দিকে তাকালেন। সাথে সাথেই হ্যারি তার কপালের দাগে তীব্র ব্যথা ও গরম অনুভব করতে লাগল।

আ…. উ….

পার্সি প্রশ্ন করল–কি ব্যাপার, তোমার কী হয়েছে?

না–কিছুনা হ্যারি জবাব দিল।

ব্যথাটা যত তাড়াতাড়ি এসেছিল, ঠিক তত তাড়াতাড়ি চলে গেল।

অধ্যাপক কুইরেল যে শিক্ষকের সাথে কথা বলছেন তিনি কে? হ্যারি পার্সিকে প্রশ্ন করে।

ওহ, তুমি তাহলে অধ্যাপক কুইরেলকে আগে থেকেই চেনো? পার্সি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

পার্সি বলে চলল–তিনি প্রফেসর স্নেইপ, তিনি তরল পানীয় ও ওষুধ বিষয়ে পড়ান।

অবশেষে পুডিংও অদৃশ্য হয়ে গেল। অধ্যাপক ডাম্বলডোর আবার দাঁড়ালেন। হলরুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা। তিনি বললেন–তোমাদের কাছে আমার কিছু বলার আছে। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জানানো যাচ্ছে যে মাঠের জঙ্গলে যাওয়া তোমাদের নিষেধ। সিনিয়র ছাত্ররাও একথাটি মনে রাখলে ভালো করবে।

ডাম্বলডোরের দৃষ্টি হঠাৎ করে উইসলি যমজ ভাইদের ওপর পড়ল।

তিনি বললেন–আমাদের কেয়ারটেকার মি. ফিলচ একটা সংবাদ তোমাকে জানাবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। দু ক্লাসের মাঝখানের বিরতিতে করিডোরে জাদুবিদ্যার কোন অনুশীলন চলবে না। টার্মের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিভিচ খেলার অনুশীলন হবে। যারা এ খেলায় অংশগ্রহণ করতে চায় তারা তাদের হাউজের মাধ্যমে মাদাম হুচের সাথে যোগাযোগ করবে।

তোমাদেরকে আরেকটি কথাও আমাকে জানাতে হচ্ছে, চতুর্থতলার ডানদিকের করিডোরটি তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তাদের পরিণাম হবে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।

হ্যারি হাসল, কিন্তু তার সাথে আর কেউ হাসল না।

তিনি আসলে সত্যি কথা বলছেন না, ভয় দেখাচ্ছেন। হ্যারি পার্সিকে বলল।

তিনি সত্যি কথাই বলে থাকেন। পার্সি জবাব দিল–তিনি যখনই কোন কিছু আমাদের নিষেধ করেন তার কারণও জানিয়ে দেন। সবাই জানে বনে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। আমি মনে করি তিনি এ তথ্যটি প্রিফেক্টদের জানাতে পারতেন।

ডাম্বলডোর এবার তার জাদুদণ্ডে মোচড় দিলেন। একটি সোনালী রিন উড়ে গেল। টেবিলের ওপর সাপের মত উড়তে উড়তে সে কতগুলো শব্দ লিখে ফেলল–

হোগার্টস হোগার্টস হোগি ওয়ার্টি হোগার্টস
দয়া করে আমাদের কিছু শেখাও
আমরা বুড়ো বা টেকো মাথা হই
কিংবা ইস্পাত দৃঢ় হাঁটুর তরুণ
আমাদের মাথায় আছে কিছু কৌতূহলী জিনিস
এখন সেগুলো খালি, বাতাসভরা
কিছু মরা মাছি, কিছু পেজা তুলা
মূল্যবান কিছু আমাদের শেখাও
মনে করিয়ে দাও, যা আমরা ভুলে গেছি
যা উত্তম তাই তুমি করো
বাকিটা আমাদের জন্যে রেখে দাও
এবং মাথার ঘিলু পচে না যাওয়া তক
আমরা শিখতে থাকবো।

সবাই বার বার এ গান গাইতে লাগল। শেষ দিকটা যেন শব যাত্রার সঙ্গীতের মত। ডাম্বলডোর জাদুদণ্ড ঘোরালেন। আবার হর্ষধ্বনি।

তিনি বললেন-এখন শোবার সময়। তোমরা ঘুমোতে যাও।

সবাই গ্রেট হলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। হ্যারি খুব ক্লান্ত। সে খুব বেশি খেয়েছে। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। তাই চারপাশের কথা তার কানে আসছে না। সিঁড়ির দুপাশে বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ছে না। এর পর কিছু বেলুন উড়ল। কিছু হাঁটার ছড়ি আকাশে উড়ল। ব্যারনের কথা শোনা গেল। করিডোরের শেষে একটা মোটা মহিলার ছবি দেখা গেল। গোলাপী রঙের পোশাক। ছবিটা বলল–তোমার পাসওয়ার্ড জানাও।

পার্সি বলল–ক্যাপুট ড্রাকোনিস।

সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা এগিয়ে গেলে দেখা গেল দেয়ালে একটা গোল ছিদ্র।

ওরা ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ল। আর এটাই নাকি কমনরুম। বাঃ বেশ আরামের। বেশ কয়েকটা আরাম চেয়ার রয়েছে।

পার্সি মেয়েদের ডর্মিটরি যাবার দরোজাটা দেখিয়ে দিল। ছেলেদের দরোজা পৃথক। একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে তারা ওপরে উঠল। সুন্দর শোবার ঘর। লাল ভেলভেটের পর্দা। কয়েকটা পোস্টার ঝুলছে। শোবার পাজামা পরে তারা বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

হ্যারি একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। তাই সে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগল। স্বপ্নে দেখল, সে অধ্যাপক কুইরেলের পাগড়ি পরেছে এবং পাগড়ি তার সাথে কথা বলছে, তাকে বলছে সে যেন এক্ষুণি স্লিারিনে বদলি হয়, কারণ এটাই তার নিয়তি। হ্যারি পাগড়িকে বলল, সে শ্লিদারিনে বদলি হতে চায় না। পাগড়িটা ক্রমশই ভারি হয়ে উঠছে, সে ওটা খুলে ফেলতে চাইলো, কিন্তু সেটা খুব শক্ত হয়ে আঁকড়ে আছে। ব্যথাও দিচ্ছে তাকে। তার সাথে কথা বলছে। ম্যালফয় হাসছে। হঠাৎ এক লম্বা নাকওয়ালা শিক্ষক–ক্ষেইপ হয়ে গেল। স্নেইপ হাসছে কখনও উঁচু কখনও নিচু স্বরে তীব্র সবুজ আলোর ঝলক! হ্যারি জেগে উঠলো, সে ঘামছে ও কাঁপছে।

একটু পর হ্যারি অন্যদিকে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে ওঠার পর হ্যারি আগের স্বপ্নের সবকিছুই ভুলে গেল।

০৮. ওষুধের ওস্তাদ

ওইদিকে তাকাও।

কোনদিকে?

লম্বা লাল চুল ছেলেটার পরের ছেলেটা।

চশমা পরা?

ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছ কি?

ওর কপালের দাগটা দেখেছ কি?

হ্যারি পরের দিন ডরমিটরি থেকে বের হলেই চারদিকে এ রকম ফিসফিস, গুঞ্জন। ক্লাসরুমের বাইরেও লোকজন পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে ওকে দেখে বা হ্যারি যখন করিডোরে হেঁটে যায় তখন লোকেরা ওকে ভাল করে দেখার জন্য দ্বিতীয়বার ফিরে আসে। এসব হ্যারির ভালো লাগে না। হ্যারি লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে চায়।

হোগার্টসে একশ চল্লিশটা সিঁড়ি আছে–কোনটা চওড়া, কোনটা খাড়া, কোনটা সরু, কোনটা অস্থায়ী কাঠের। কিছু সিঁড়ি শুক্রবার দিন অন্য স্থানে নিয়ে যায়। কিছু সিঁড়ি আর মাঝপথে মাঝামাঝি গিয়ে শেষ হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন এগুলো পার হতে হবে লাফ দিয়ে। কিছু দরোজা আছে নম্রভাবে কথা না বললে বা যথাস্থানে হালকাভাবে টোকা না দিলে খুলবে না। কিছু স্থান দরোজার মত মনে হয়, কিন্তু আসলে দরোজা নয়–শক্ত দেয়াল। এখানে কোন কিছু মনে রাখা কঠিন, কোন কিছু স্থির নয়, সব সময় স্থানের পরিবর্তন ঘটছে। মানুষের প্রতিকৃতিগুলোরও পরিবর্তন ঘটছে, এক ফ্রেমের ছবি থেকে অন্য ছবির ফ্রেমে চলে যাচ্ছে। হ্যারির ধারণা তা হলে নিশ্চয়ই অস্ত্রাগারে রাখা কোটগুলোও নিশ্চয়ই হেঁটে বেড়ায়।

ভূতেরাও কোন রকম সাহায্য করে না। কেউ কোন দরোজা খুলে কোথাও যাবে, হঠাৎ করে অপরদিক থেকে ভূতেরা সেই দরোজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চমকে দেয়। এদের মধ্যে মুণ্ডুহীন নিক ব্যতিক্রম, খুশি মনে পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু পিভস তার চিরাচরিত অভ্যাস মত আড়ালে থেকে কিছু ফেলে তার উপস্থিতি জাহির করে, কেউ যদি ক্লাসে যেতে দেরি করে ফেলে তাকে দুটো তালাবদ্ধ দরজা ও গোলমেলে সিঁড়ি পার হতে যেটুকু সময় লাগে তার চেয়ে বেশি দেরি করিয়ে দেবে ক্লাসে যেতে। সে কারো মাথায় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট ফেলবে, পায়ের তলা থেকে কম্বল টেনে নেবে, চক ছুঁড়ে মারবে, চমকে দেয়ার জন্য দেখা না দিয়ে কারো পেছনে এসে দাঁড়াবে, পেছন থেকে নাক চেপে ধরে বলবে, কেমন লাগছে এখন।

পিভসের চেয়ে আরো বেশি খারাপ হলো কেয়ারটেকার আরগুস ফিলচ। প্রথম দিন সকালে হ্যারি ও রন ওর ধারে–কাছে না গিয়ে ভিন্ন পথে গেল। তারা দুর্ভাগ্যক্রমে ভুল করে তৃতীয় তলার নিষিদ্ধ করিডোরের প্রবেশ পথ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফিলচের বিশ্বাসই হয়নি যে ওরা পদ্ধ হারিয়ে ওই পথে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে ভাবল ওরা ইচ্ছে করেই এটা করছে এবং এখানে তাদের আটকে রাখার ভয় দেখাল।

প্রফেসর কুইরেল সে সময় যদি ওই পথ দিয়ে না যেতেন তা হলে নিশ্চয়ই তাদের ফিলচের হাতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো।

ফিলচের একটা বিড়াল ছিল। বিড়ালটার নাম মিসেস নরিস। ধূলো রঙের গোঁফধারী বিড়ালটা ছিল অনেকটা মনিব ফিচের মত। বিড়ালটা যেন এখানকার নিয়মরক্ষক। একটু এদিক–ওদিক হলেই বিড়ালটা ফিলচকে ডেকে আনে। যারা ভুল করে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হয়। সকলে তাকে এত ঘৃণা করে যে সুযোগ পেলেই নরিসকে লাথি লাগায়।

বুধবার মাঝ রাতে দুরবী এর সাহায্যে নানা গ্রহ–নক্ষত্রের আসা–যাওয়া দেখানো হলো। অধ্যাপক স্পাউট সপ্তাহে তিনবার অদ্ভুত সব উদ্ভিদের কিভাবে যত্ন নিতে হয় তা পড়াতেন।

সবচে বিরক্তিকর ক্লাস ছিল জাদুর ইতিহাস। এটাই একমাত্র ক্লাস যা নিতেন এক ভূত–শিক্ষক। বৃদ্ধ প্রফেসর বিনস শিক্ষকদের স্টাফ রুমের ফায়ার স্পেস-এর সামনে অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়তেন আবার পরদিন সকালে তার শরীরটা সেখানে রেখেই ক্লাস নিতে চলে যেতেন।

অধ্যাপক ফ্লিটউহক ছিলেন বশীকরণ বিদ্যার শিক্ষক। তিনি ক্লাসে অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে মনোমুগ্ধকর গল্প শোনাতেন। আকারে ছোটখাটো, একগাদা বই এর ওপর দাঁড়িয়ে তাকে টেবিল থেকে উঁচু হতে হতো। হাজিরা খাতায় হ্যারির নাম ডাকতে গিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে নিজেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন তিনি।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটু অন্য ধরনের। মেজাজ কড়া হলেও তিনি মানুষ হিসেবে ভালো। ছাত্ররা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। তিনি বলেন যে শরীর বদল অথবা অন্যরূপ ধারণ করা সবচে জটিল জাদুবিদ্যা।

তিনি আরও বলতেন, আমার ক্লাসে কোন উল্টা–পাল্টা করবে না। করলে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আর ফিরে আসতে পারবে না।

একটু পরে তিনি তার টেবিলটাকে বাচ্চা শূকরে রূপান্তরিত করলেন। কিছুক্ষণ পর আবার তা টেবিল হয়ে গেল। সকল আসবাবপত্রই মাঝে মাঝে একদল পণ্ড হয়ে যায়। একদিন ছাত্রদের দেশলাই দিয়ে বলা হল–কাঠিকে সূচ বানাও। একমাত্র হারমিওন গ্রেঞ্জারই সফল হয়। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ওদের দেখালেন কিভাবে কাঠিটি ধাতব পদার্থে পরিণত হলো এবং সূচালো হলো।

যে ক্লাসটা তাদের সবচে ভালো লাগতো সেটা ছিল কালো জাদু টোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। মাঝে মাঝে হাসি–ঠাট্টা হয়। সারা ক্লাসে রসুনের গন্ধ। রোমানিয়া থেকে রক্তচোষা এসেছে এবং তার পাগড়ির ভেতর থেকে এই গন্ধ আসে। পাগড়ির ভেতরের রসুন নাকি অধ্যাপক কুইরেলকে নানা রকম বিপদ–আপদ থেকে রক্ষা করে। তাকে এই পাগড়িটা দিয়েছে আফ্রিকার কোন এক রাজপুত্র।

হ্যারি এই ভেবে আশ্বস্ত যে সে পড়াশোনায় খুব একটা পেছনে পড়ে নেই। মাগল পরিবার থেকেও অনেক ছেলে এখানে এসেছে। তারই মত। ডাইনি জাদুকর সম্পর্কে তাদের অনেকেরই সামান্যতম ধারণা নেই। এমন কি রনের মাথাতেও অনেক কিছু আসে না।

শুক্রবার দিনটা কারি ও রনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওইদিন তারা সঠিক পথে গ্রেট হলে এসে নাশতা করত।

পিরিজে চিনি ঢালতে ঢালতে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল–আজ আমাদের কি কাজ?

স্লিদারিনদের সাথে দ্বিগুণ ওষুধের উপাদান মেশানো রন বলল। গেইপ ছিলেন স্লিদারিন হাউজের প্রধান। সবাই বলে তিনি নাকি তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেন। আমরা দেখবো এটা সত্যি কিনা।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল যদি আমাদের পক্ষে থাকতেন। হ্যারি বলল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ছিলেন গ্রিফিল্ডর হাউজের প্রধান। তা সত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের গাদাগাদা হোমটাস্ক দিতে কার্পণ্য করতেন না।

ডাক আসার সময় একশ পেঁচাকে গ্রেট হলে প্রবেশ করতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের মালিকদের খুঁজে নিয়ে চিঠি বিলি করলো। কিছু কিছু পারসেল ছিল।

হেডউইগ এ পর্যন্ত হ্যারির জন্য কোন চিঠি আনেনি। হেডউইগ খুবই অলস। তবে চিঠি আসলে সে নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। তার কাজ একটিই, সেটা হলো ঘুমোবার আগে তার কানের লতি ছুঁয়ে আদর করা ও শুভরাত্রি বলে পেঁচাঁদের থাকার জায়গায় যাওয়া।

অবাক কাণ্ড। আজ সকালে হেডউইগ হ্যারির জন্য একটা চিঠি টেবিলে রাখল। হ্যারি বিস্মিত হয়ে ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে। চিঠিতে লেখা আছে–

প্রিয় হ্যারি,
আমি জানি, তুমি প্রতি শুক্রবার বিকেলে বাইরে যাও। তুমি কি বিকেল তিনটায় আমার সাথে এক কাপ চা পান করতে আসতে পারো? আমি জানতে চাই ডর্মিটরিতে তোমার প্রথম সপ্তাহ কেমন কাটল? অপর পৃষ্ঠায় জবাব লিখে হেডউইগ মারফত পাঠিয়ে দিও।
ইতি
হ্যাগ্রিড

হ্যারি রনের কাছ থেকে পালকের কলম নিয়ে লিখল–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেখা হবে। সে চিঠিটি হেডউইগের কাছে দিল। হেডউইগ চিঠি নিয়ে শো করে উড়ে চলে গেল।

হ্যারিও হ্যাগ্রিডের সাথে দেখা করার জন্য উৎসুক ছিল। কারণ ওষুধ তৈরির উপকরণের ক্লাস হ্যারির সবচে বিরক্তিকর মনে হত। কোর্সের প্রথম দিকেই হ্যারি বুঝতে পেরেছিল যে, স্নেইপ তাকে অপছন্দ করেন না শুধু, মৃণাও করেন।

ওষুধ ডোজের ক্লাসগুলো হতো নিচে বন্দিশালার মত একটা কক্ষে। এই কক্ষটা অনেক বেশি ঠাণ্ডা ছিল। শেইপ হাজিরা খাতা নিয়ে নাম ডেকে ক্লাস শুরু করতেন। তিনি জারি পটারের নাম এভাবে ডাকলেন–হ্যারি পটার… আমাদের নতুন বিখ্যাত ব্যক্তি।

হ্যারির অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে ম্যালফয় ক্রেব ও গয়েল খুব আনন্দ পেত। নামডাকা শেষ হলে স্নেইপ ক্লাসের দিকে তাকালেন।

তার চোখও হ্যাগ্রিডের চোখের মত কালো। কিন্তু সে চোখে হ্যাগ্রিডের চোখের উষ্ণতা নেই। তার চোখ দুটি শীতল ও শূন্য। তার চোখ দেখলে গভীর সুড়ঙ্গের কথা মনে পড়ে। স্নেইপের ক্লাস ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনত। এজন্য ক্লাসে কোন গোলমালও হত না। তিনি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তার ক্লাসকে প্রাণবন্ত রাখতে পারতেন।

হ্যারি পটারকে স্নেইপ হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসলেন–আচ্ছা হ্যারি বল তো–আমরা যদি অ্যাসফোডেল পাউডারের রুটের সাথে তিক্ত গুল্মরস মিশিয়ে দিই তাহলে আমরা কী পাব?

হ্যারি বলল–আমি ঠিক বলতে পারব না। স্নেইপ হ্যারিকে কটাক্ষ করে বললেন–তু, তু–খ্যাতিই সবকিছু নয়।

হারমিওন হাত তুললেও তিনি সেদিকে নজর দিলেন না।

স্নেইপ এবার বললেন–আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যাক। আমি যদি বলি আমাকে একটা বিজোয়ার দেখাও তাহলে তুমি কি করবে? হারমিওন হাত তুলল। বিজোয়ার সম্পর্কে হ্যারির বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

হ্যারি জবাব দিল–আমি জানি না স্যার।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল হাসল। হ্যারি নিশ্চিত ম্যালফয়, ক্রেব বা গয়েল–ওদের কারোরই ওই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।

স্নেইপ মন্তব্য করলেন–পটার আমার মনে হয়, তুমি ক্লাসে আসার আগে বই খুলে দেখনি।

হ্যারি স্নেইপের চোখের দিকে তাকাল। তারপর মনে মনে বলল ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকার সময়ও আমি বইপত্র দেখেছি। অধ্যাপক স্নেইপ কি মনে করেন যে One Thousand Magical Herbs and Fungi–র সবকিছুই আমার মুখস্থ থাকবে।

হারমিওন আবার হাত তুললেও স্নেইপ সেদিকে মনোযোগ দিলেন না।

এভাবে আরো প্রশ্ন করে স্নেইপ হ্যারিকে বিব্রত করলেন। অবশেষে অধ্যাপক স্নেইপের ক্লাস শেষ হল। হ্যারি পটারের মন এমনিতেই ভালো ছিল না, কারণ সেসনের প্রথম সপ্তাহেই গ্রিফিল্ডর হাউজের দু নম্বর কাটা গেল। আর হ্যারি গ্রিফিল্ডর হাউজের সদস্য। পাঁচটা বাজার তিন মিনিট আগে তারা গ্রিডের ঘরের দিকে রওনা হলো। নিষিদ্ধ বনের পাশে একটা কাঠের বাড়ি ছিল। দেখতে কুঁড়েঘরের মত। সেটাই হ্যাগ্রিডের আবাসস্থল।

তারা যখন দরোজায় করাঘাত করল তখন ভেতর থেকে ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা গেল। একটু পর শোনা গেল হ্যাগ্রিডের কণ্ঠস্বর ব্যাক ক্যাগে, ব্যাক।

দরোজার ফাঁক দিয়ে হ্যাগ্রিডের বিরাটকায় চুলভর্তি মুখ দেখা গেল। দরজা খুলতে খুলতে হ্যারি ও রনকে দেখে হ্যাগ্রিড বলল–দাঁড়াও।

হ্যাগ্রিড একটা বিরাট কালো বোর হাউন্ড কুকুরের শিকল ধরে রেখে ওদের ভেতরে ঢুকতে বললেন।

ভেতরে একটামাত্র ঘর। এক কোণায় বিছানা। আমার কেতলিতে পানি ফুটে ধোয়া বেরুচ্ছে। কুকুরটার নাম ফ্যাংগ।

কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে হ্যাগ্রিড হ্যারি ও রনকে বললেন–আরাম করে বসো। ফ্যাংগকে যত হিংস্র মনে হয় আসলে সে তত হিংস্র নয়।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-এই হচ্ছে রন।

হ্যাগ্রিড তখন সেদ্ধ পানি একটা বড় টি-পটে-ঢালছিলেন এবং প্লেটে রক কেক সাজাচ্ছিলেন।

রক কেকে কামড় দিতে গিয়ে তাদের অবস্থা কাহিল। তবে হ্যারি আর রন এমন ভাব দেখাল যে তারা বেশ মজা করে রক কেক খাচ্ছে। তারা তাদের লেখাপড়া সম্পর্কে হ্যাগ্রিডকে জালাল। ফ্যাংগ হ্যারির হাটুর ওপর যাথা রেখে হ্যারির কাপড় শুকতে লাগল।

কথা প্রসঙ্গে ফিলচের কথা আসলো। হ্যারিরাই আসলে তার বিষয়ে কথাটা বলল। হ্যাগ্রিড ফিলচকে বোকা বৃদ্ধ বলায় হ্যারি আর রন উডয়েই খুশি হলো।

ফিলচের বিড়াল নরিস সম্পর্কে হাহ্যাগ্রিড বললেন–আমার কুকুর ফ্যাংগের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেব। শুধু তোমাদের কেন ওর বিড়ালটা আমাকেও অনুসরণ করে। ফিলচ–ই তাকে এই কাজে লাগিয়েছে।

হ্যারি হ্যাগ্রিডকে জানাল যে অধ্যাপক স্নেইপ তাকে ঘৃণা করেন। রন বলল–দুঃখ করে লাভ নেই। অধ্যাপক স্নেইপ কাউকেই পছন্দ করেন না।

বাজে কথা। হ্যাগ্রিড মন্তব্য করেন সে তোমাকে ঘৃণা করবে কেন?

হ্যারির কাছে মনে হলো হ্যাগ্রিড তার কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

রনের দিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিন্ড বললেন–তোমার ভাই চার্লি কেমন আছে। তাকে আমার খুব ভালো লাগে।

এরপর হ্যাগ্রিড রনের সাথে তাদের পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ করলেন। হ্যারির টেবিল থাকা ডেইলি প্রফেট পত্রিকার একটা কাটিং চোখে পড়ল :

গ্রিংগটস–সর্বশেষ বার্তা

গ্রিংগটসে ডাকাতির বিষয়টি নিয়ে ৩১শে জুলাই থেকে তদন্ত চলছে। মনে করা হচ্ছে এটি কালো জাদুকর ও ডাইনিদের কাজ।
গ্রিংগটসের গবলিনরা দাবি করছে সেখান থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। ভল্টগুলো এইদিনই খালি করা হয়েছিল।
কিন্তু সেখানে কি ছিল এ ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারব না। তোমাদের মঙ্গলের জন্য এ ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো–গবলিনদের একজন মুখপাত্র জানান।

হ্যারির মনে পড়ল–ট্রেনে তাকে রন বলেছিল যে গ্রিংগটসে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কোন তারিখে হয়েছিল-এটা সে উল্লেখ করতে পারেনি। হ্যাগ্রিডকে হ্যারি বলল যেদিন গ্রিংগটসে ডাকাতি হয় সেদিনটা ছিল আমার জন্মদিন। আমরা যখন সেখানে ছিলাম হয়ত তখনই ঘটনাটা ঘটে। হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি তুমি ঠিকই বলেছ। এই বলে হ্যাগ্রিড আরেকটা রক কেক হ্যারির দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

হ্যারি পত্রিকার কাটিংটা আরেকবার পড়ল। ভল্টটা ওইদিনই খালি করা হয়েছিল যেদিন গ্রিগেটস থেকে হ্যারির জন্য টাকা তোলা হয়। হ্যারি আর রন যখন রাতের খাবার জন্য দুর্গে আসছিল তখন তাদের পকেট ছিল হ্যাগ্রিডের দেওয়া বক কেকে ভর্তি। তারা হ্যাগ্রিডকে না বলতে পারেনি।

হ্যারির মনে হলো এতদিনে লেখাপড়ায় যতটুকু এগুনো দরকার ছিল ততটুকু সে পারেনি। তার এটাও মনে হলো সেই সম্পর্কে হ্যাগ্রিড অনেক কিছু জানেন কিন্তু তাকে কিছু বলেননি।

০৯. মধ্যরাতের মল্লযুদ্ধ

হ্যারি কখনো ভাবতে পারেনি যে, ডাডলির চেয়েও কোন খারাপ ছেলের সাথে তার দেখা হবে। কিন্তু তাই হলো। ছেলেটির নাম ম্যালফয়। গ্রিফিল্ডর ও স্লিদারিন হাউজের প্রথম বর্ষের ছাত্ররা শুধুমাত্র ওষুধ তৈরির ক্লাস করতেই এক সাথে মিলিত হতো।

ওই ক্লাস ছাড়া অন্য কোন ক্লাসে ম্যালফয়ের সাথে দেখা হতো না। বৃহস্পতিবার থেকে ফ্লাইং শেখানো হবে। গ্রিফিল্ডর ও স্লিদারিন হাউজের ছাত্রদেরকে একসাথে ওড়া শেখানো হবে জেনে হ্যারি আক্ষেপ করে বলল ম্যালফয়ের সামনে আমাকে ঝাড়ু লাঠির ওপর বোকা বানাবার জন্যই এটা করা হয়েছে।

উড়তে শেখার অনুশীলন নিয়ে হ্যারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রন বলল–তুমি এখনই সব কিছু বলতে পার না, ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা দেখে নিজেই হয়তো অবাক হবে। ম্যালফয় দেখাতে চায় যে, কিডিচ খেলায় সে কতখানি দক্ষ। আসলে সে যতটা বলে ততটা সে নয়।

ম্যালফয় ওড়ার বিষয়ে তার দক্ষতা নিয়ে অনেক কথা বলত। সে এটাও জোর দিয়ে বলত যে, প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে হাউজ টিমে কিডিট খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় না। সে নিজের সম্পর্কে গল্প করতো, কীভাবে খাগলরা তার কাছ থেকে অল্পের জন্য হেলিকপ্টারে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। তার গল্পের শেষটা সব সময় এই রকমই হয়–অল্পের জন্য…।

শুধু ম্যালফয়ই নয়। সিমাস ফিনিগানও এ ধরনের বাড়িয়ে কথা বলত। সে দাবি করত যে ছোটবেলায় ঝাড়ুর সওয়ার হয়ে সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। এমন কী রনও দাবি করত যে, সে উড়তে গিয়ে তার ভাই চার্লির ঝাড়ুর সাথে প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল। জাদুকর পরিবার থেকে যারা এসেছে তারা প্রায় সবাই কিভিচ খেলার ব্যাপারে আলোচনা করত।

এ নিয়ে ডীন টমাসের সাথে রনের তর্ক হয়ে গেছে। বিতর্কের বিষয় ছিল ফুটবল। রন বুঝে উঠতে পারে না কেবল একটি বল নিয়ে খেলায় কীভাবে এত আনন্দের হতে পারে, যেখানে ওড়ার কোন সুযোগ নেই।

নেভিল কখনও ঝাড়ুর ওপর সওয়ার হয়নি কারণ ওর নানী কখনো ওকে ওটার ধারে কাছে যেতে দেয়নি। কারণ, সে ইতোমধ্যে মাটিতেই খেলতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। নেভিলের মত ওড়ার ব্যাপারে হারমিওন-এরও সাহস কম, এটা এমন একটা জিনিস যা বই পড়ে শেখা যায় না।

বৃহস্পতিবার সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় হারমিওন লাইব্রেরি থেকে সগ্রহ করা কিডিচ থ্রু এইজেস বই থেকে জানা ওড়ার বিষয়ে নানা জ্ঞান দেওয়া শুরু করে। নেভিল তার পেছন থেকে হারমিওনের দিকে ঝুঁকে গভীর আগ্রহে তার কথা শোনে। অন্যদের শোনার কোন আগ্রহ ছিল না। বরং ডার্ক চলে আসার পর তার বক্তৃতা থেকে সবাই যেন রেহাই পায়।

হ্যাগ্রিডের সাথে সাক্ষাতের পর হ্যারির নামে কোন চিঠি আসেনি-এটা ম্যালফয় লক্ষ্য করেছে। এসব বিষয় সে খেয়াল করে বেশি। ম্যালফয়ের ঈগলপেঁচা তার জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে। ম্যালফয় ঝাঁপিয়ে পড়ে তা স্লিদারিন হাউজের টেবিলের ওপর খোলে। একটি পেঁচা নেভিলের নানীর বাড়ি থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো।

সে উত্তেজনায় দ্রুত প্যাকেটটি খুলল। এটা ছিল মার্বেল আকারের একটা কাঁচ। মনে হলো কাঁচের ভেতর ধুয়া।

এটা একটা স্মারক। সে ব্যাখ্যা করল। আমার নানী জানেন যে আমি অনেক কিছুই ভুলে যাই। তুমি যদি কিছু ভুলে যাও এই কাঁচটা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে। শক্ত করে ধরে এটার দিকে তাকিয়ে থাক। এটা যদি লাল হয়ে যায় তাহলে তুমি বুঝবে তুমি হয়ত কিছু ভুলে গেছ। স্মারকটা হঠাৎ লাল হয়ে উঠল, এর অর্থ আমি নিশ্চয়ই কিছু ভুলে গেছি।

নেভিল ভাবতে লাগলো এমন কিছু কি আছে যা সে ভুলে গেছে। সে সময় ম্যালফয় তার গ্রিফিল্ডর হাউজের টেবিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে নেভিলের হাত থেকে স্মারকটা ছিনিয়ে নিল। হ্যারি আর রন লাফ দিয়ে ম্যালফয়ের ওপর চড়াও হলো। তারা ভাবছিল ম্যালফয়কে একহাত দেখিয়ে দেবে। ঠিক এই সময় অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন–কী ব্যাপার, এখানে গণ্ডগোল কিসের?

প্রফেসর, ম্যালফয় আমার স্মারক নিয়ে নিয়েছে। ম্যালফয় তাড়াতাড়ি স্মারকটা টেবিলের ওপর রেখে দিল।

ঠাট্টা করছিলাম। এই বলে সে ক্রেব আর গয়েলকে নিয়ে সরে গেল।

***

তখন বিকেল সাড়ে তিনটা। প্রথম উড়ান শিক্ষা শুরু হবে। হ্যারি, রন ও অন্যরা মাঠে গেছে। সবুজ দুর্বাঘাস বাতাসে হেলে পড়েছে।

স্লিদারিন হাউজের ছাত্ররা ইতোমধ্যে এসে গেছে। কুড়িটা ঝাড়ু মাঠে সারি করে সাজানো। হ্যারি শুনেছে ফ্রেন্ড আর জর্জ এই ঝাড়ি নিয়ে অনেক অভিযোগ করেছে। এগুলো নাকি বেশি উপরে উঠলে কাঁপতে থাকে। আর বাঁদিকে ঘুরে যায়।

তাদের শিক্ষক মাদাম হুচ ক্লাসে প্রবেশ করলেন। তার চুল ছোট ও ধূসর রঙের। চোখ বাজপাখির চোখের মত হলুদ।

তিনি এসেই চিৎকার করে বললেন তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবাই ঝাড়ুর পাশে দাঁড়াও তাড়াতাড়ি চলে এসো।

হ্যারি তার ঝাড়ুর দিকে তাকাল। ঝাড়ুটি পুরনো এবং কিছু কাঠি বাঁকা হয়ে নড়ে গেছে।

মাদাম হুচ এবার নির্দেশ দিলেন–ডান হাত সামনের দিকে ঝাড়ুর ওপর রাখ। এবার বল–আপ।

হ্যারির ঝাড়ুটা তার হাতে লাফিয়ে উঠল। হারমিওনেরটা মাঠের ওপর গড়িয়ে পড়ল। নেভিল এক চুল পরিমাণ নড়তে পারল না। ওর হাত কাঁপছে। ওর মাথায় ভয়ের ছাপ। ও মাটি থেকে উপরে উঠতে ভয় পাচ্ছে। মাদাম হুচ দেখালেন কিভাবে ঝাড়ুর ওপর চড়তে হয়। তিনি ম্যালফয়কে ধমক দিলেন–তুমি কি সারাজীবন ভুল করবে?

এই কথাটা শুনে হ্যারি ও রন দারুণ খুশি হলো যে, ম্যালফয় সব সময়ই ভুল করছে।

মাদাম হুচ বললেন–আমি বাঁশি বাজাবার সাথে সাথে তোমরা লাফ দেবে। ঝাড়ু সোজা রাখবে। কয়েক ফুট ওঠার পর সামনের দিকে ঝুঁকবে। তারপর নিচে নেমে আসবে। তোমরা প্রস্তুত হও। আমি এখন বাঁশি বাজাচ্ছি। তিন……..দুই……..

এক বলা বাকি। নেভিল আগেই লাফ দিল। মাটি থেকে উপরে উঠার পর সে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ল। সে একটু বেশিই উপরে উঠেছে কারণ সে মাটিতে জোরে ধাক্কা দিয়েছিল।

মাদাম হুচ চিৎকার করলেন–কামব্যাক মাই বয়। কিন্তু নেভিল সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হ্যারি লক্ষ্য করল যে, নেভিলের চেহারা একেবারে ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। ঝড়ির পাশে থেকে সে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। নেভিল যখন মাটিতে পড়লো তখন ধুম করে শব্দ হলো।

নেভিলের কবজি ভেঙে গেছে। সে উপুড় হয়ে একটা ঘাসের পে শুয়ে পড়ল। তার ঝাড়ু এখনও ঊর্ধ্বমুখী। ঝাড়ুটা নিষিদ্ধ বনের দিকে যেতে যেতে এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। মাদাম হুচ নেভিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। দুজনেরই মুখ ফ্যাকাসে, সাদা।

হ্যারি শুনতে পেল, মাদাম হুচ বলছেন–কজি ভেঙে গেছে। কাম অন বয়। দাঁড়াও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাদাম হুচ এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এর ভেতর তোমরা এক পাও নড়বে না। যার যার ঝাড়ু যেখানে ছিল সেখানে ঠিকমত রাখবে আর তা না করলে তোমাদের কিডিচ খেলার আগেই হোগার্টস ছেড়ে যেতে হবে।

নেভিলকে বললেন–আমার সাথে এসো।

নেভিলের দুচোখেই অশ্রু। কবজি চেপে ধরে টলতে টলতে সে আগে বাড়ল। ওরা চলে যাবার সাথে সাথেই ম্যালফয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তোমরা কি এই থল থলে মাংস পিণ্ডটির চেহারা দেখেছো?

স্লিদারিন হাউজের অন্যান্যরা নেভিলকে তামাশা করা শুরু করল। চুপ করো ম্যালফয়। পার্বতি পাতিল ধমক দিল।

লংবটমের জন্য তোমার এত দরদ? স্লিদারিন হাউজের এক কর্কশ চেহারার ছাত্রী প্যানসি পার্কিনসন বলল। পার্বতি, আমি কখনো ভাবতে পারিনি তুমি হিঁচকানে শিশুদের এত পছন্দ কর।

দেখো। মাটি থেকে একটা জিনিস উঠিয়ে ম্যালফয় বলল—

এক ফালতু জিনিস, লংবটমের নানী তাকে এটাই পাঠিয়েছে।

স্মারকটা সূর্যের আলোতে চকচক করে উঠল।

ম্যালফয়, ওটা এদিকে দাও। হ্যারি গম্ভীর কণ্ঠে ম্যালফয়কে বলল।

কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য সবাই একেবারে চুপ।

ম্যালফয় দুষ্ট হাসি হেসে বলল-এটা আমি কোথাও রাখবো, সেখান থেকে লংকটমকে নিতে হবে–গাছের ওপর হলে কেমন হয়?

ওটা এদিকে দাও। হ্যারি চিৎকার করে উঠল। ম্যালফয় তার ঝড় নিয়ে উড়তে শুরু করল। মিথ্যে বলেনি, সে ভালো উড়তে পারে। ম্যালফয় একটা ওক গাছের চূড়ায় উঠে হ্যারির উদ্দেশ্যে বলল-এসো। এখান থেকে নিয়ে যাও।

হ্যারি তার ঝাড়ুটা হাতে তুলে নিলো।

না, না। হারমিওন গ্রেঞ্জার চিৎকার করে উঠল–মাদাম হুচ বলে গিয়েছেন আমরা যেন একটুও না নড়ি। তুমি আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলবে।

কিন্তু হ্যারি তার কথা শুনল না। মাথায় তার রক্ত চড়েছে। সে তার ঝাড়ুতে চড়ে মাটিতে ধাক্কা দিল। আর সাথে সাথে সে উড়তে লাগল। বাতাসে তার চুল উড়ছে! পোশাক উলটে যাচ্ছে। তার কাছে খুব অবাকই লাগলো। না শিখেই সে কোনো বিদ্যা রপ্ত করতে পারে। তার কাছে ওড়াটা অত্যন্ত সহজ মনে হলো। নিচে মেয়েদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। রনের উল্লাস হ্যারির দৃষ্টি এড়াল না।

হ্যারি তার ঝাড়ু ঘুরিয়ে মধ্য আকাশে ম্যালফয়ের দিকে অগ্রসর হলো। ম্যালফয় স্তম্ভিত হয়ে গেল।

এবার দাও, নইলে আমি তোমাকে ওই ঝাড়ু থেকে ফেলে দেবো। হ্যারি বলল।

এতো সহজ। ম্যালফয় বলল, কিন্তু তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। হ্যারি জানে এখন কী করতে হবে। দুহাতে নিজের ঝড় শক্ত করে ধরে হ্যারি বর্শার মত তীব্র বেগে ম্যালফয়ের দিকে ছুটল। বিপদ বুঝে ম্যালফয় সরে গেল। নিচে করতালির শব্দ শোনা গেল।

হ্যারি বলল-এখানে তো তোমার বন্ধু ক্রেব আর গয়েল নেই।

ম্যালফয়ের মনেও একই চিন্তা।

চেষ্টা করে দেখো, নিতে পারো কিনা। এই বলে ম্যালফয় কাঁচের গোলকটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল।

হ্যারি প্রথমে ওপরে উঠল। পরে নিচে নামতে লাগল। সে ঝুঁকে ঝাড়ুর মুখ ঘুরিয়ে দিল। তার ঝাড়ু দ্রুতবেগে নিচে নামতে লাগল। হ্যারি মাটি থেকে ঠিক এক ফুট উঁচু থেকে গোলকটা ধরে ফেলল। তার মুঠোর ভেতর কাঁচের গোলকটা নিয়ে হ্যারি মাটিতে নামল।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ছুটে এসে চিৎকার করে বললেন—

হ্যারি পটার।

ম্যাকগোনাগল বললেন–তুমি কোন সাহসে এত ওপরে উঠলে। আর একটু হলেই তো ঘাড় ভেঙে যেত। তিনি রাগে কাঁপছিলেন।

এটা তার দোষ নয়…

চুপ কর, মিস পাতিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন।

কিন্তু ম্যালফয়।

আর বলতে হবে না। মি. উইসলি ও পটার এখন আমাকে অনুসরণ কর। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল আদেশ দিলেন।

হ্যারি দেখল–ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল বিজয়ের হাসি হাসছে।

হ্যারি বুঝতে পারল এখন সে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি। তার মনে ভয় যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য হ্যারি কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ম্যাকগোনাগল তার কথায় কান দিলেন না। তিনি হন হন করে সামনে এগিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে তাল রাখার জন্য হ্যারিকে রীতিমত দৌড়াতে হলো। হ্যারি ভাবতে লাগল, তাকে বের করে দেয়া হলে সে কোন মুখে আবার ডার্সলি পরিবারে ফিরে যাবে।

ম্যাকগোনাগল দরোজা খুলে করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলেন। হ্যারিও উদ্বিগ্ন মনে তাকে অনুসরণ করছে। কোথায় যাচ্ছে তারা! হ্যারি ভাবল, তিনি হয়ত অধ্যাপক ডাম্বলডোরের কাছে যাবেন। হ্যারি হগ্রিডের কথা ভাবল। হ্যাগ্রিন্ডকেও তো হোগার্টস থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তবে তার গেমকিপারের চাকরিটা ছিল। হ্যাগ্রিডের সহকারী হিসেবে তাকে রেখে দেয়া যেতে পারে।

ম্যাকগোনাগল একটা ক্লাস রুমের বাইরে দাঁড়ালেন। তিনি দরোজা খুলে মুখটা ক্লাস রুমের ভেতরে গলিয়ে বললেন–অধ্যাপক ফ্লিটউইক আমাকে মাফ করবেন। আপনি কি এক মুহূর্তের জন্য উডকে দিতে পারেন।

উড কেন? হ্যারি অবাক হয়ে ভাবল–উড কি কোন বেত নাকি যা তার ওপর প্রয়োগ করা হবে।

দেখা গেল উড একজন মানুষ। সে ফিফথ ইয়ারের ছাত্র। সে কিছু না জেনেই ক্লাস থেকে বাইরে এলো। ম্যাকগোনাগল দুজনকেই বললেন তোমরা দুজনেই আমার পেছন পেছন এসো।

তারা করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। উড কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে হ্যারির দিকে তাকাল।

এখানেই বলে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদেরকে একটা ক্লাসরুমে নিয়ে গেলেন। ক্লাসে কেউ ছিল না। কেবল পিভিস ব্ল্যাকবোর্ডে বাজে কিছু লিখছিল। পিভিস, এখান থেকে যাও। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল কড়া নির্দেশ দিলেন। পিভিস তার চকটি ফেলে দিল। বেশ জোরে শব্দ হলো। তারপর অভিশাপ দিতে দিতে পিভিস ক্লাসরুম ত্যাগ করল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ঠাস করে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে দুই বালকের দিকে তাকালেন।

ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন-এই হচ্ছে অলিভার উড। উড–তোমার জন্য আমি একজন পেয়েছি।

উডের মুখে ধাঁধা থেকে খুশির রেখা।

উড এবার জিজ্ঞেস করল–প্রফেসর আপনি কি সত্যিই বলছেন?

অবশই। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জোর দিয়ে বললেন, ছেলেটা খুবই ভাল। আমি এর মত আর কাউকে দেখিনি।

এবার তিনি হ্যারির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন–তুমি কি এই প্রথম ঝাড়ুর ওপর উড়লে? হ্যারি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালো।

হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না তাকে নিয়ে কী করা হবে। তবে এতটুকু সে বুঝতে পারল যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না। সে তার পায়ে শক্তি পেতে শুরু করল।

হ্যারি পঞ্চান্ন ফুট ওপর থেকে নিচে ড্রাইভ দিয়ে একটা জিনিস ধরেছে। ম্যাকগোনাগল উডকে বললেন। তার গায়ে একটুও আচড় লাগেনি। এটা চার্লি উইসলিও করতে পারত না। উডের কাছে মনে হল তার স্বপ্ন যেন এখনই সফল হতে যাচ্ছে।

তার চোখমুখে আনন্দের ঝিলিক। একই সঙ্গে উত্তেজনা। জিজ্ঞেস করল, হ্যারি তুমি কি কখনও কিডিচ খেলা দেখেছো?

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ব্যাখ্যা করে বললেন–উড, গ্রিফিল্ডর হাউজের অধিনায়ক।

তার শারীরিক গঠনও একজন সিকারের মতই। হ্যারির চারদিকে হেঁটে ও হ্যারির দিকে তাকিয়ে উড এই মন্তব্য করল। হালকা… গতিসম্পন্ন। প্রফেসর, তাকে একটি সুন্দর ঝাড়ু দিতে হবে–নিম্বাস ২০০০ অথবা ক্লীনসুইপ সাত।

আমি অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে কথা বলব। আমরা দেখি প্রথম বর্ষের জন্য নিয়মকানুন কিছু শিথিল করা যায় কিনা। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন। গতবারের চেয়ে আমরা ভাল দল চাই।

স্লিদারিনদের কাছে গত ম্যাচে হেরে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ লজ্জায় সিভিরাস স্নেইপের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি!

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যারি, আমি শুনতে চাই তুমি এখানে ভালো প্রশিক্ষণ নিচ্ছ। আমি শুনতে চাই তুমি প্রশিক্ষণকালে পরিশ্রম করছো, আর ভিন্ন কিছু শুনলে তোমার শাস্তির বিষয়ে আমার মত পরিবর্তন করতে পারি বলে মুচকি হাসলেন।

তারপর তিনি বললেন–তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই গর্ব করতেন। তিনি একজন উঁচুমানের কিডিচ খেলোয়াড় ছিলেন।

***

রন তার স্টিক অ্যান্ড কিডনি পাই অর্ধেক মুখে পুরেছে, কিন্তু সে খেতে ভুলে গেল। সিকার? সে বলল, কিন্তু প্রথম বর্ষের কেউ তো হতে পারে না, কখনোই না, তুমি সবচেয়ে ছোট, এর আগে…তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছো।

মধ্যাহ্নভোজের সময় ম্যাকগোনাগলের সাথে মাঠ থেকে যাওয়ার পর কি কি ঘটেছে এই মাত্র হ্যারি বলে শেষ করেছে।

হ্যারি বলল–শতাব্দীর মধ্যে এটাই প্রথম। উড আমাকে তাই বলল।

এ খবর শুনে রন এত অবাক ও অভিভূত হল যে, সে হ্যারির দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

হ্যারি রনকে বলল–আগামী সপ্তাহ থেকে আমার প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তুমি কাউকে বলো না কিন্তু, কারণ উড চায় না কেউ এটা জানুক।

ঠিক এই সময় ফ্রেড আর জর্জ উইসলি হলঘরে প্রবেশ করল। হ্যারিকে দেখে জর্জ নিচু কণ্ঠে বলল–শাবাশ! উড আমাদেরকে সব বলেছে। আমরাও এই টিমে আছি।

ফ্রেড বলল-এবার আমরা নিশ্চিতভাবে কিডিচ কাপ জিতব। চার্লি চলে যাবার পর আমরা কখনো এ খেলায় জিততে পারিনি। তবে এ বছর আমাদের দল অনেক শক্তিশালী। হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই ভালো খেলবে। তোমার কথা বলতে গিয়ে উড যেন লাফাচ্ছিল।

যাহোক, আমাদের যেতে হবে। স্কুল থেকে বেরুবার জন্য লী জর্ডান একটি নতুন গোপন পথ বের করেছে।

ফ্রেড ও জর্জ যাবার পরপরই ম্যালফয়, ক্রেব আর গয়েল এসে উপস্থিত হলো।

তারা হ্যারিকে বলল-এখানকার খাবার কি শেষ, মি. পটার? তুমি কোন ট্রেনে আবার মাগলদের কাছে ফিরে যাচ্ছ?

হ্যারি খুব শীতল কণ্ঠে বলল–বেশ সাহস দেখছি তো এখন, মাটিতে ফিরে এসেছ বলে। সাথে ক্ষুদে বন্ধুদেরও দেখছি।

উঁচু টেবিলে শিক্ষকরা বসে থাকায় আঙ্গুল বাঁকানো বা ভয় দেখানো, ক্রেব এবং গয়েলের একটু–আধটু বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু ঘটেনি।

ম্যালফয় হ্যারিকে বলল–সুযোগ পাওয়া মাত্রই আমি বদলা নেব। তুমি যদি চাও আজ রাতেই জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ হতে পারে, শুধু জাদুদণ্ড। শারীরিক নয়। কী, এ ব্যাপারে কথা বলছ না যে, তুমি কি জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানো না?

অবশ্যই সে জানে। রন জবাব দিল–আমি ওর দ্বিতীয় হবো। তোমার সাথে কে থাকবে?

ম্যালফয় ক্রেব ও গয়েলের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ক্রেব সে বলল, মাঝরাতে ঠিক আছে? ট্রফি রুমেই দেখা হবে। ওটা তালা লাগানো থাকে না।

ওরা চলে গেলে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল–জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ জিনিসটা কী? আর দ্বিতীয় বলতেই বা কী বোঝায়? রন বলল–তুমি যদি মল্লযুদ্ধে মারা যাও তাহলে আমি তোমার দায়িত্ব নেব। যিনি এই দায়িত্বটা নেন তাকেই দ্বিতীয় বলা হয়।

রন আরো বলল–আসল জাদুকর যখন মল্লযুদ্ধে অংশ নেয় তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যায়। তোমার আর ম্যালফয়ের মধ্যে কেউই এতটা দক্ষ হওনি যে কেউ কারো ক্ষতি করতে পারবে। আমি নিশ্চিত যে ম্যালফয় ভেবেছিল তুমি তার মল্লযুদ্ধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।

আমি যদি জাদুদণ্ড ব্যবহার করি আর দেখা গেল কিছুই ঘটেনি তাহলে কী হবে? হ্যারি জানতে চাইল।

তাহলে তুমি তার নাকে জোরে একটা ঘুষি মারবে। রন বলল।

এক্সকিউজ মি। হ্যারি আর রন তাকিয়ে দেখল যে হারমিওন গ্রেঞ্জার এসেছে। রন মন্তব্য করল-এখানে কেউ শান্তিতে খেতেও পারবে না নাকি?

রনের কথার পাত্তা না দিয়ে হারমিওন হ্যারিকে বলল–আমি তোমার আর ম্যালফয়ের কথা আড়ি পেতে না শুনে পারলাম না।

না শুনলেও পারতে? রন বলল।

হামিওন রনের কথার উত্তর না দিয়ে হ্যারিকে বলল–মধ্যরাতে তোমার স্কুলে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হবে না। ভেবে দেখো, তুমি যদি ধরা পড়ো, ধরা পড়বেই, তাহলে গ্রিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কাটা যাবে। হ্যারি, মাঝে মাঝে তোমাকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হয়।

এটা তোমার দেখার বিষয় নয়। হ্যারি মন্তব্য করল।

বিদায়। বলে রন বিদায় নিল।

***

নেভিল এখনও হাসপাতালে।

সব দিনই এক রকম। হ্যারি ভাবলো, দিনটি ভালভাবে শেষ হয়েছে বলা যাবে না। ডীন ও সিমাস ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। নেভিল হাসপাতাল থেকে ফিরে আসেনি। হ্যারি বিছানায় জেগে সময় কাটালো।

রন আস্তে আস্তে হ্যারির কাছে এসে কানে কানে বলল–রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। চলো যাওয়া যাক।

ড্রেসিং গাউন পরে জাদুদণ্ড হাতে নিয়ে তারা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে কমনরুমে এসে পৌঁছল। হঠাৎ সামনের চেয়ার থেকে কে যেন বলে উঠল হ্যারি, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না–তুমি এসব কাজে যাচ্ছ।

হালকা আলোতে হারমিওন গ্রেঞ্জারকে দেখা গেল। গায়ে গোলাপী রঙের গাউন।

রন চিৎকার করে বলল–তুমি এখানে? যাও শুতে যাও।

হারমিওন বলল–আমি তোমার ভাই পার্সিকে আভাস দিয়েছি। সে তো এখানকার প্রিফেক্ট। সে তোমাদের এসব কাজ বন্ধ করবে।

কেউ যে কারো কাজে এতটা হস্তক্ষেপ করতে পারে-এটা হ্যারি ভাবতেই পারে না।

চলে এসো। হ্যারি রনকে বলল। সেই মোটা মহিলার ছবিটি সরিয়ে গর্ত দিয়ে ওপরে উঠে গেল।

হারমিওনও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। মোটা মহিলার ছবিটি সরিয়ে সে–ও রনকে অনুসরণ করল।

হারমিওন ওদের পেছনে পেছনে এসে রুক্ষ কণ্ঠে বলল–গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য কি তোমাদের একটুও দরদ নেই? তোমরা কি কেবল নিজের স্বার্থই দেখবে? আমি চাই না স্লিদারিন হাউজ হাউজকাপ জয় করুক। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কানে গেলে তোমরা সব পয়েন্ট খোয়াবে।

এখান থেকে ভাগো। রন হারমিওনকে ধমক দিল।

ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। হারমিওন বলল–আমি যে তোমাদেরকে সতর্ক করেছি-এ কথাটি মনে রেখে বিশেষ করে যখন তুমি কাল বিকেলে বাড়িতে ফেরত যাবার জন্য ট্রেনে উঠবে।

ওদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার জন্য হারমিওন মোটা মহিলার প্রতিকৃতির দিকে তাকাল। না, সেখানে কোন প্রতিকৃতি নেই। মোটা মহিলা রাতে ভ্রমণের জন্য বাইরে গেছে। হারমিওন বের হওয়ার কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।

আমি এখন কী করব? হারমিওন উৎকণ্ঠার সাথে বলল।

রন বলল–সেটা তোমার ব্যাপার। আমাদের এক্ষুণি যেতে হবে। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তোমাদের সাথে আমিও যাব। হারমিওন বলল।

না, তুমি আসবে না। রনের দৃঢ় নিষেধাজ্ঞা।

হারমিওন বলল–তোমরা কি চাও আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আর ফিল আমাকে পাকড়াও করুক। যদি তিনি আমাদের তিনজনকে এক সঙ্গে পান আমি সত্যি কথাটাই বলব। আমি বলব, আমি তোমাদের থামাবার চেষ্টা করছিলাম আর তুমিও আমাকে সমর্থন করতে পার।

চুপ! তোমরা দুজনেই চুপ কর। হ্যারি বলল–আমি যেন কিসের আওয়াজ পাচ্ছি।

শ্বাস–প্রশ্বাস নেয়ার শব্দ।

মিসেস নরিস? বিস্ময়ের সাথে রন উচ্চারণ করল।

আসলে এটা মিসেস নরিস নন। নেভিল। সে মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিল। তার কাছে গেলেই সে ঘুম থেকে উঠে পড়ল।

হায় ঈশ্বর। তোমরা এখানে। আমি কয়েক ঘণ্টা ধরে এখানে আটকে আছি। বিছানায় যাবার নতুন পাসওয়ার্ডটি এখন মনে করতে পারছি না।

তোমার স্বর নিচুতে রাখো, নেভিল। নতুন পাসওয়ার্ড হল–পিগ আউট। তবে এতে এখন কোন কাজ হবে না, কারণ মোটা মহিলাটা কোথায় যেন গেছে।

তোমার হাতের অবস্থা এখন কেমন। হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

ভাল। হাত দেখিয়ে নেভিল বলল–মাদাম পমফ্রে এক মিনিটের ভেতরই সব সারিয়ে দিয়েছেন।

ভালো কথা। হ্যারি বলল–নেভিল, আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে। তোমার সাথে পরে দেখা হবে। নেভিল বলল–আমাকে তোমরা একা ফেলে যেও না। আমার এখানে একা থাকতে ভাল লাগছে না।

রন ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর ক্রুদ্ধভাবে নেভিল ও হারমিওন দুজনের দিকেই তাকাল।

রন বলল–তোমাদের দুজনের যে কেউ একজন যদি আমাদের ধরিয়ে দাও তাহলে তোমাদের খবর আছে। বোগিস কুইরেল আমাদের যে অভিশাপ শিখিয়েছেন আমি তোমাদের ওপর সেই অভিশাপ দেব।

হারমিওন তার মুখ খুলল। কীভাবে অভিশাপ দিতে হয়-এটাই বোধ হয় সে রনকে বলতে চাচ্ছিল। হ্যারি তাকে ফিস ফিস করে চুপ করতে বলল। তারপর সবাইকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।

তারা করিডোর ধরে এগোতে লাগলো। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। প্রতি মুহূর্তেই হ্যারি আশঙ্কা করছে ফিলচ অথবা মিসেস নরিসের সাথে দেখা হয়ে যাবে। তার ভাগ্য ভালো–তার আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। তারা চার তলায় যাবার সিঁড়িতে এল। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে কোন শব্দ না করে তারা আগে বাড়তে লাগল। তাদের লক্ষ্য ট্রফি হাউজ।

ম্যালফয় আর ক্রেব তখনও এসে পৌঁছায়নি। ট্রফি হাউজের শোকেসের স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচের ওপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। ট্রফি হাউজের রূপা বা সোনার কাপ, শিলড, প্লেট ও মূর্তি অন্ধকারেও চক চক করছে। ওরা দেয়াল ঘেঁষে এগুতে লাগল। তাদের চোখ দুটি দরোজারই ওপরে। পাছে ম্যালফয় এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে সেই আশঙ্কায় হ্যারি তার জাদুদণ্ড বের করলো। সময় বয়ে চলল। কিন্তু ম্যালফয়ের দেখা নেই। হয়ত এমনও হতে পারে সে ভয় পেয়ে গেছে।

একটু পরে পাশের কক্ষে একটা শব্দ শোনা গেল। তারা সতর্ক হলো। হ্যারি যখন তার জাদুদণ্ড ঘোরাল তখন কয়েকটা শব্দ তার কানে ভেসে এল। না এটা মালফয়ের কণ্ঠস্বর নয়।

আরে এ যে ফিলচ। তিনি নরিসের সাথে কথা বলছেন। ওরা একটু এগিয়ে দেখল পোশাকের গ্যালারি। দৌড় দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নেভিল রনের কোমর জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ালো। নেভিল দেখল–ফিলচ ট্রফি রুমে প্রবেশ করেছেন।

হ্যারি আর রন শুনতে পেল ফিলচ বলছে–তারা কাছাকাছি কোথাও আছে। হয়ত তারা লুকিয়ে।

এই দিকে। হ্যারি উল্টোদিকে ছুটলো এবং ভীত–সন্ত্রস্ত হয়ে তারা একটি লম্বা গ্যালারি নিঃশব্দে পার হতে লাগল। গ্যালারিতে ছিল অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র। তারা বুঝতে পারল, ফিলচ নেভিলের কাছাকাছি চলে গেছেন।

বিভিন্ন ধরনের আওয়াজে দুর্গের সবাই জেগে গেছে।

পালাও বলে হ্যারি দৌড় দিল। তারা চারজন নিচের দিকে দৌড়াতে লাগল। মি. ফিলচ ওদের পেছনে আসছেন কিনা–পেছন ফিরে সেটা দেখার অবকাশ তাদের নেই। একটা দরোজা দিয়ে বেরিয়ে তারা একের পর এক করিডোর পার হল। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে হ্যারি। তারা কোথায় যাচ্ছে–কেউই জানে না। এরপর ওরা পেল দেয়াল ঢাকা একটি বড় পর্দা এবং ওটা সরিয়ে ওরা পেল একটি গুপ্তপথ। এই পথ দিয়ে তারা বশীকরণ ক্লাসরুমের কাছে এলো। তাদের পরিচিত বশীকরণ ক্লাসরুম থেকে ট্রফি রুমের ব্যবধান কয়েক মাইল।

মনে হচ্ছে তার নাগালের বাইরে চলে এসেছি–ক্লান্ত–শ্রান্ত হ্যারি ঠাপ্তা দেয়ালে হেলান দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। নেভিল কুঁজো হয়ে দুহাঁটুতে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল ও তার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছিলো।

হারমিওন বলল–আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলাম।

আমাদেরকে খুব দ্রুতই গ্রিফিল্ডর টাওয়ারে পৌঁছতে হবে। রন শান্ত কণ্ঠে বলল।

হারমিওন–তুমি কি এখন বুঝতে পেরেছে যে, এটা ম্যালফয়ের চালাকি। সে কখনোই মল্লযুদ্ধ করার জন্য তোমার কাছে আসবে না। যেভাবেই হোক ফিল খবর পেয়েছেন ট্রফি রুমে কেউ আসবে। হয়ত ম্যালফয়ই তাকে সব বলে দিয়েছে।

হ্যারি ভাবল, হারমিওনই বোধহয় ঠিক। তবে তার কাছে হ্যারি নিজের ভুলের কথা স্বীকার করবে না।

চলো, যাওয়া যাক। হ্যারি বলল।

তখন তারা দশ–বারো পাও অতিক্রম করেনি, একটা দরোজা খোলার আওয়াজ পেল। দৃশ্য দেখে তারা অবাক। পিভিস বেরিয়ে আসছেন ক্লাস রুম থেকে।

তোমাদের তো ডরমিটরিতে থাকার কথা। এই মধ্যরাতে তোমরা বাইরে কেন। পিভস প্রশ্ন করল।

পিভস দয়া করে চুপ কর। তুমি দেখছি আমাদের বিপদে ফেলবে।

পিভস হো হো করে হেসে উঠলো। মধ্যরাতে ঘুরে বেড়ানো? তু, তু, তু। নটি, নটি, ইউ উইল গেট কটি

না ধরা পড়বো না দয়া করে পথ ছাড় পিভস।

আমি ফিলচকে বলব। আমার বলা উচিত। পিস বলল। তার চোখে দুষ্টুমির হাসি। তোমাদের মঙ্গলের জন্যই এটা বলা উচিত।

পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও। রন ধমকের সুরে বলল। মানছি এটা আমাদের ভুল হয়েছে।

যেসব ছাত্র বিছানায় নেই। পিভস চিৎকার করে বলল–যেসব ছাত্র বিছানায় নেই তারা নিচে বশীকরণ ক্লাসের সামনে করিডোরে।

পিভসের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে জীবন বাঁচাতে তারা বশীকরণ ক্লাসের করিডোরের শেষ প্রান্তে উধ্বশ্বাসে দৌড়ালো। সেখানে তারা একটি দরোজা খোলার চেষ্টা করলো। না, বন্ধু, খোলা যাচ্ছে না। এই হলো আমাদের পরিণতি। রন কাদো কাঁদো কন্ঠে বলল।

দরোজা ধাক্কা দিয়েও খুলতে না পেরে রন বলল, আমাদের আর কোন উপায় নেই। আমরা শেষ হয়ে গেছি।

তারা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পিভসের চিৎকার শুনে ফিলচ ছুটে আসছেন।

এখান থেকে যেতে হবে। হারমিওন বলল। সে হ্যারির হাত থেকে জাদুদণ্ডটি নিয়ে তালাটিতে ছোঁয়ালো, তারপর ফিসফিস করে বলল আলোহেমোরা।

তালায় ক্লিক করে আওয়াজ হলো এবং দরোজাটা খুলে গেল। তারা ভেতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে কান পেতে রইল। তাদের কানে ভেসে এলো–ওরা কোনদিকে গেছে, পিভস। আমাকে তাড়াতাড়ি বল। ফিলচ পিভসকে জিজ্ঞেস করছে।

আগে বল প্লিজ। ঝামেলা করো না পিভস, বল ওরা কোন দিকে গেছে?

আমি কিছুই বলব না! হা হা হা! আমি বলেছি যতক্ষণ তুমি ভালভাবে প্লিজ না বলবে আমি কিছুই বলব না। হা হা হা!

বল, প্লিজ।

ঠিক আছে–প্লিজ

তারা শুনতে পেল পিভস হুস করে উধাও হয়ে যাচ্ছে আর ফিলচ তাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

হ্যারি ফিসফিস করে বলল–তিনি হয়তো মনে করছেন দরোজাটা বন্ধ। তাই এখানে কেউ আসেনি। মনে হচ্ছে আমরা এখন নিরাপদ। নেভিল বেরিয়ে এসো।

নেভিল হ্যারির গাউনের আস্তিন ধরে টানছে।

কী?

হ্যারি চারদিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হল সে এখন একটা দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি! খুবই বাজে কাজ করেছে সে আজ। তার আজকের কাজ আগের সব কিছু অতিক্রম করেছে।

হ্যারি যা ভেবেছিল আসলে ঘটনা তা ছিল না। তারা কোন ঘরের ভেতরে নয়। ছিল একটা করিডোরে। এটা তৃতীয় তলার নিষিদ্ধ করিডোর। এখন ওরা বুঝতে পারে, এটা কেন নিষিদ্ধ। তাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল একটা দানবীয় কুকুরের চোখের ওপর। কুকুরটা এতো বড় যে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত পুরো জায়গা সে দখল করে রেখেছে। কুকুরটার তিনটি মাথা, তিনটা নাক, তিনটা মুখ। তার মুখের লালা গড়িয়ে পড়ছে পিচ্ছিল রশির ওপর। কুকুরটা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তার দুটো চোখই তাদের ওপর নিবদ্ধ। হ্যারি উপলব্ধি করল কেন তারা এখনো মারা যায়নি, হঠাৎ এসে পড়ায় কুকুরটা তাদের দেখে অবাক হয়েছে। অবাকের পালা শেষ করে কুকুরটি আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে উঠল। কুকুরের বজ্র নিনাদের অর্থ কী তা বুঝতে হ্যারি বা তার সঙ্গীদের স্বাকি রইল না। হ্যারি দরোজা খোলার জন্য হাতল মোচড়াতে লাগলো।

এখন হ্যারিকে দুটো বিকল্পের একটাকে বেছে নিতে হবে, হয় মৃত্যু নয় ফিলচ। সে বেছে নিল ফিলচকে!

তারা পেছন দিকে হটে এসে করিডোরে ফিরে এল। হ্যারি দরোজাটা সজোরে বন্ধ করে দ্রুতবেগে নিচে করিডোরে নামল। ফিলচ নিশ্চয়ই তাদের কোথাও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কারণ, তারা ফিরে আসার পথে কোথাও ফিলচকে দেখেনি। এটা এখন তাদের জন্য বড় বিষয় নয়, তাদের এখন একমাত্র চেষ্টা দানব থেকে বাঁচা–তাই দানব থেকে দূরত্ব বাড়াতে তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো। আট তলায় সেই মোটা মহিলার প্রতিকৃতির সামনে না আসা পর্যন্ত তারা তাদের দৌড় থামায়নি।

তাদের কাধ থেকে পড়ে যাওয়া ঝুলন্ত ড্রেসিং গাউন এবং ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে মহিলাটা প্রশ্ন করলেন-এত রাতে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?

তেমন কিছু না–পিগ স্নাউট, পিগ আউট। হ্যারি উচ্চারণ করল। হ্যারির জবাবের সাথে সাথেই ছবিটি তাদের দিকে এগিয়ে এল এবং যাওয়ার পথ ছেড়ে দিল। তারা কমনরুমে প্রবেশ করে ধপাস করে আরাম কেদারায় বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ নিরব ছিল, কোন কথা বলেনি, দেখে মনে হলো নেভিলের এমন অবস্থা হয়েছে যে, সে বোধ হয় আর কথা বলতে পারবে না

এ রকম একটা জিনিসকে তারা স্কুলে আটকিয়ে রেখেছে কেন? রন বলল কুকুরের ব্যায়ামের প্রয়োজন হয়, এরও প্রয়োজন হতে পারে। এতক্ষণে হারমিওনের শ্বাস–প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল এবং মেজাজও। হারমিওন ওদের থামিয়ে বলল–তোমরা কি কেউ ভাল করে দেখেছো? তোমরা কি লক্ষ্য করেছিলে কুকুরটা কিসের ওপর দাঁড়িয়েছিল?

মেঝের ওপর? হ্যারি বলল–আমি তার পায়ের দিকে তাকাইনি। আমার চোখ ছিল তার মাথার ওপর।

না, মেঝের ওপর নয়। কুকুরটা দাঁড়িয়েছিল একটা গোপন দরোজার ওপর। এটা স্পষ্ট যে কুকুরটা কোন কিছু পাহারা দিচ্ছিল। হারমিওন দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে এ কথা বলল।

বলল–আজ আমরা সবাই মারা পড়তে পারতাম। অথবা ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হতে পারতাম। আশা করি তোমরা নিশ্চয়ই এখন নিজেদের ভাগ্যের জন্য খুশি, এখন তোমরা যদি কিছু না মনে কর আমি ঘুমুতে যাই।

হা করে রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে রইল।

না, আমরা কিছু মনে করবো না। বন বলল–তুমি কি মনে কর আমরা তোমাকে জোর করে আমাদের সাথে নিয়ে গেছি।

কিন্তু হারমিওন হ্যারিকে চিন্তার জন্য একটা কিছু দিয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে হ্যারি ভাবতে লাগল–কুকুরটা নিশ্চয়ই কিছু পাহারা দিচ্ছে… হগ্রিড় একবার বলেছিলো পৃথিবীতে গ্রিংগটস হলো কোন কিছু নিরাপদে রাখার জন্য সব থেকে নিরাপদ জায়গা এবং তার চেয়েও নিরাপদ হোগার্টস।

এইখানে কি ৭১৩ নম্বর ভল্টের ছোট্ট প্যাকেটটা পাওয়া যাবে?

১০. হ্যালোইন

পরদিন সকালে যখন হ্যারি এবং রনকে হোগার্টসেই দেখতে পেল, ম্যালফয় নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার ধারণা ছিল হ্যারি আর রন মরে ভূত হয়ে গেছে। ক্লান্ত দেখালেও তারা বেশ উফুল্ল ছিল।

হ্যারি আর রন সেই তিনমুখো কুকুরের সাথে দেখা হওয়াটাকে একটা দারুণ অভিযান হিসেবে ভাবতে শুরু করলো এবং আবার সেখানে যাওয়ার কথা মাথায় রাখলো।

এর মধ্যে হ্যারি রনকে সেই প্যাকেটের মনে করিয়ে দিল যেটা সম্ভবত গ্রিংগটস থেকে হোগার্টসে পাঠানো হয়েছে। তারা দুজন ভাবছিল এত কড়া প্রহরার প্রয়োজন কী।

এটা হয়ত খুব মূল্যবান অথবা খুব বিপজ্জনক কিছু। রন মন্তব্য করল।

বা দুটাই, হ্যারি বলল।

শুধু তারা নিশ্চিত যেটা জানতে পারল, সেটা হলো যে, রহস্যজনক বস্তুগুলোর দৈর্ঘ্য দুই ইঞ্চি। অন্য কোন সূত্র ছাড়া প্যাকেটের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করাও সম্ভব হলো না। নেভিল বা হারমিওন কুকুর অথবা গোপন দরজার ভেতরে কী আছে–সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করেনি।

হারমিওন কয়েকদিন ধরে ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছে। এতে রন বা হ্যারির বরং লাভ, কারণ হারমিওন সব সময় তার কর্তৃত্ব ফলাতে চায় যা তাদের পছন্দ নয়। ওদের এখন একমাত্র লক্ষ্য ম্যালফয়কে এক হাত দেখিয়ে দেয়া, এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই ডাকযোগে সে সুযোগ এসে গেল।

যখন পেঁচারা এসে গ্রেট হলে প্রবেশ করল তখন সবাই তাকিয়েছিল একটা প্যাকেটের দিকে যেটি ছুটি পেঁচা বয়ে নিয়ে এসেছে। যখন পেঁচারা প্যাকেটটা হ্যারির ঠিক সামনে ফেলল তখন সত্যি সে অবাক হলো। পেঁচাগুলো বাইরে চলে গেলে হ্যারি দেখল প্যাকেটের ওপর একটা চিঠি। হ্যারি চিঠিটা খুলল। চিঠিটা এসেছে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কাছ থেকে আনন্দের সংবাদ নিয়ে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল লিখেছেন

পার্সেলটা টেবিলের ওপর খুল না।
এর ভেতর আছে নতুন নিম্বাস–২০০০।
আমি চাই না অন্য কেউ জানুক তুমি একটা নতুন ঝাড়ু পেয়েছ।
আজ রাতে অলিভার উড তোমার সাথে দেখা করবে–কিভিচ খেলার মাঠে।
ঠিক সাতটায়–তোমার প্রশিক্ষণের জন্য।
–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল

নিজের আনন্দ গোপন করতে হ্যারির কষ্ট হচ্ছিল। তাই সে চিঠিটা রনকে পড়তে দিল।

রন বলল–নিম্বাস ২০০০! আমি তো এ ধরনের ঝাড়ু এখন পর্যন্ত স্পর্শই করিনি।

তারা হলের বাইরে এসে দেখে ওপরে সিঁড়ি আটকে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেব আর গয়েল। ম্যালফয় হ্যারির হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। আরে এটা তো একটা ঝাড়ু। এই বলে দ্বেষ ও হিংসাভরা দৃষ্টিতে ম্যালফয় ঝাড়ুটা হ্যারির দিকে ছুঁড়ে মারল আর বলল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য তো ঝাড়ু নিষিদ্ধ।

রন আর চুপ থাকতে পারল না। বলল-এটা তো পুরনো ঝাড়ু নয়, নিম্বাস–২০০০। ম্যালফয় তুমি বলেছিলে যে, তোমার কাছে একটি কমেন্ট ২৬০ আছে?

রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল–কমেট দেখতে বড়। কিন্তু নিশ্বাসের সাথে কমেন্টের কোন তুলনাই হয় না।

এটা পেয়ে তোমাদের কোন লাভ নেই। এর হাতলের অর্ধেক তোমরা ব্যবহারই করতে পারবে না। ম্যালফয় মন্তব্য করল।

রন জবাব দেয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক ফ্লিটউইক। তিনি বললেন–কী ব্যাপার। তোমরা কী নিয়ে ঝগড়া করছ।

হ্যারিকে একটি ঝাড়ু পাঠানো হয়েছে। ম্যালফয় বলল।

আমি তা জানি। ফ্লিটউইক বললেন–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারির ব্যাপারে আমাকে সবকিছু জানিয়েছেন। এটা কোন মডেল?

নিম্বাস ২০০০, স্যার। ম্যালফয়ের আতঙ্ক দেখে অনেক কষ্টে হাসি চেপে হ্যারি জবাব দিল। আর এটা পাবার জন্য আমি ম্যালফয়কে ধন্যবাদ দিতে চাই।

ম্যালফয়ের হতাশা দেখে হ্যারি আর রন খুব খুশি। হাসতে হাসতে ওরা ওপরে উঠতে লাগল।

মর্মর পাথরের সিঁড়ির ওপরে উঠে হ্যারি বলল–সে যদি নেভিলের স্মারকটি চুরি না করতো, আমি আজকে এখানে থাকতে পারতাম না।

তুমি কি মনে কর-এটা তোমার আইন ভাঙার পুরস্কার? পেছন থেকে হারমিওনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

আমি ভেবেছি তুমি আমাদের সাথে কথা বলবে না? হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বলল।

আমাদের সাথে কথা না বলার অভ্যাসটা তুমি চালিয়ে যাও। রন মন্তব্য করল।

বিরক্ত হয়ে হারমিওন উঠে চলে গেল।

ওইদিন নানাবিধ ঝামেলা হ্যারির পড়াশোনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটালো। তার বড় চিন্তা ডর্মিটরির কোন জায়গাটিতে সে তার নতুন ঝাড়ুটা রাখবে। সে রাতে হ্যারি কিছুই খেল না। ঝাড়ুর প্যাকেট খোলার জন্য সে আর রন ওপরে গেল। খোলার পর দেখা গেল–চিকন চকচকে ঝাড়ু। মেহগনি কাঠের হাতল। ঝাড়ুর গায়ে সোনালী হরফে লেখা–নিম্বাস ২০০০।

চমৎকার। রন মন্তব্য করল। সন্ধ্যা সাতটা বাজার কিছু আগেই হ্যারি দুর্গ ছেড়ে কিডিচ মাঠের দিকে রওনা হলো। এর আগে সে কখনও স্টেডিয়ামে আসেনি। একশর মত আসন। খেলা বা অনুশীলনের জন্য যথেষ্ট।

উড তখনও আসেনি। হ্যারির ওড়ার ইচ্ছে হলো। সে মাটিতে লাথি দিয়ে ঝাড়ু নিয়ে উড়ে চলল। বারবার গোলপোস্টের ভেতর দিয়ে ঢোকা আবার বেরিয়ে আসা। হ্যারির দারুন মজা লাগছে। তার সামান্য স্পর্শে নিম্বাস ২০০০ অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করছে।

হায় পটার, এদিকে এসো। অলিভার উড এসে গেছে।

তার হাতে কাঠের একটা বড় বাক্স। হ্যারি উডের পাশে দাঁড়াল।

চমৎকার। ঊড মন্তব্য করল। হ্যারি, আমি দেখতে পাচ্ছি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল যা বলেছিলেন… একেবারে খাঁটি। আজ আমি তোমাকে কিডিচ খেলার নিয়মকানুন সম্পর্কে কিছু বলব। তারপর তুমি সপ্তাহে তিনদিন খেলা অনুশীলন করবে। উড বাক্সটা খুলল। বাক্সের ভেতর বিভিন্ন আকারের চারটা বল। অলিভার ঊড় এবার তাকে খেলাটা বোঝালেন। বললেন–খেলাটা একটু কঠিন। প্রত্যেক দলে সাতজন খেলোয়াড় থাকবে। তাদের মধ্যে তিনজন হবে চেজার বা ধাওয়াকারী।

তিনজন চেজার? হ্যারি প্রশ্ন করল।

উড এবার ফুটবল আকৃতির একটা উজ্জ্বল লাল বল বের করল।

উড এবার ব্যাখ্যা করল-এই বলটার নাম কুয়াফল।

চেজারগণ কুয়াফল পরস্পরের মাঝে হস্তান্তর করে এবং গর্তে ফেলে গোল করার চেষ্টা করে।

উড আরো ব্যাখ্যা করল–প্রতিটা দলে একজন খেলোয়াড় থাকে যার নাম কীপার। কীপারের দায়িত্ব হলো গোল ঠেকালো। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের কিপার।

এ খেলায় তাহলে তিনজন চেজার ও একজন কীপার থাকে। তারা কুয়াল নিয়ে খেলা করে। হ্যারি খেলার বিস্তারিত নিয়মকানুন আগ্রহের সাথে জানার চেষ্টা করলো।

এবার আমি তোমাকে দেখাবো কীভাবে খেলতে হয়। উড বলল এটা হাতে নাও।

উড হ্যারিকে তিনটা ছোট ব্যাট ও একই রকম দুটো বল দিলেন। বল দুটো কালো রঙের এবং কুয়াফলে থেকে একটু ছোট। বল দুটোর নাম ব্লুজার। এবার দাঁড়িয়ে থাকো। উড হ্যারিকে নির্দেশ দিল।

হঠাৎ করে কালো ব্লুজারটা ওপরে উঠে হ্যারির মুখের কাছে চলে এলো। হ্যারি ব্যাট দিয়ে সরিয়ে দিল যাতে বলটি তার মাকে আঘাত না করে। এটা ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে উডের কাছে চলে গেল। উড ব্লুজারটা ঠেকিয়ে গর্তে পাঠিয়ে দিল।

খেলা নিয়ে হ্যারিকে উড কয়েকটা প্রশ্ন করল। হ্যারি প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল।

চমৎকার। উড মন্তব্য করল।

হ্যারি উডকে প্রশ্ন করল–আচ্ছা ব্লুজারদের হাতে কখনও কি কেউ মারা গেছে?

হোগার্টসে কখনও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সর্বোচ্চ যেটা হয়েছে সেটা হলো কারো কারো দাঁত ভেঙেছে। এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটেনি। এবার শোন, এই দলের সর্বশেষ ব্যক্তি হলো সিকার–সেটা হচ্ছো তুমি। অবশ্য কুয়াফল বা ব্লুজার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

যতক্ষণ না তারা আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়।

তোমার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। উড বলল–ব্লুজারদের ঠেকাতে দুই উইসলি যমজ ভাই–ই যথেষ্ট। তারা নিজেরাই একটা ব্লুজার জুটি। এরপর উড বাক্স থেকে চতুর্থ এবং শেষ বলটা বের করল। কুয়াফল এবং ব্লুজারের তুলনায় এটা ছিল আরো ছোট এবং বড় একটা কাঠবাদামের সমান। এটা ছিল উজ্জ্বল সোনালী রঙের, ছোট একটু গোলাপী পাখা।

বলগুলো হাতে নিয়ে উড বলল-এটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এ বলটার গতি এত বেশি যে এটা ধরাই মুশকিল। আর সিকারের দায়িত্ব হল বলগুলো ধা। সিকার যদি এ বলটা ধরতে পারে তাহলে তার দল অতিরিক্ত ১৫০ পয়েন্ট পাবে।

আর কোন প্রশ্ন আছে? উড হ্যারির কাছে জানতে চায়।

হ্যারি মাথা নাড়ল। তার কী করণীয় এটা সে বুঝতে পেরেছে।

আমরা এখনও স্নিচ বল নিয়ে খেলিনি। বলগুলো বাক্সে রাখতে রাখতে উড বলল-এত অন্ধকারে বল হারিয়ে যেতে পারে।

উড তার পকেট থেকে গলফ বলের একটা সাধারণ ব্যাগ বের করল। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল উড চারদিকে জোরে জোরে বলগুলো ছুঁড়ে মারছে আর হ্যারি তা লুফে নিচ্ছে।

হ্যারি প্রতিটা বল লুফে নিল। উড খুব খুশি। আধঘণ্টা পর যখন সত্যি সত্যিই অন্ধকার নেমে এল, তখন তারা অনুশীলন বন্ধ করল।

এবার কিডিচ কাপ আমরা পাব। খুশি মনে উড মন্তব্য করল। দুর্গে ফেরার পথে উড বলল–তুমি যদি চার্লস উইসলির চেয়ে ভালো খেল, আমি অবাক হব না। সে হয়ত ইংল্যান্ডের পক্ষ হয়েই খেলতে পারত যদি সে ড্রাগনের পেছনে না ছুটত।

হ্যারি এখন খুবই ব্যস্ত। একদিকে কিন্ডিচ খেলার জন্য সপ্তাহে তিনবার অনুশীলন। অন্যদিকে হোমওয়ার্ক তো আছেই। হ্যারি ভাবতে লাগল সে হোগার্টসে এসেছে মাত্র দুমাস হলো। এর ভেতরই সে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রিভেটড্রাইভের তুলনায় দুর্গটি তার কাছে অনেক আপন মনে হচ্ছে। লেখাপড়া গোড়াতে কঠিন মনে হলেও এখন খুব উৎসাই বোধ করছে।

ঘুম ভাঙলো সুস্বাদু খাবারের গন্ধে। হ্যারির মনে হলো, হ্যালোইন ব্যাপারটা বোঝা দরকার। অধ্যাপক ফ্লিটউইক ঘোষণা দিলেন, এখন ছাত্ররা জিনিসপত্র আকাশে ওড়াতে পারবে। এজন্য তিনি ছাত্রদের জোড়ায় জোড়ায় বসিয়ে দিলেন। হ্যারির জুটি হলো সিমাস ফিনিগান। নেভিলের ব্যাঙ একটি ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছিল। রানের জুটি হলো হারমিওল গ্রেপ্পার। রন অথবা হারমিওন কেউ এতে অখুশি কিনা তা বোঝা যাচ্ছিল না। যেদিন থেকে হ্যারি ডাকে ঝাড়ু পেল সেদিন থেকেই হারমিওন হ্যারি ও ব্রনের সাথে কথা বলে না।

অধ্যাপক ফিটউইক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন-একটা কথা মনে রেখো। কথাটি হলো–সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক, মনে রেখো সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক। এ মন্ত্র উচ্চারণ করো। কখনো ভুল করে উচ্চারণ করবে না। মনে রেখো–ভুল করে জাদুকর বারুফিয়ে একবার স এর বদলে ফ উচ্চারণ করেছিল, তারপর সে নিজেকে আবিষ্কার করলো মেঝেতে। তার বুকের ওপর একটা মহিষ।

এটা ছিল বেশ কঠিন! হ্যারি ও সিমাস বার কয়েক সুইশ এন্ড ফ্লিক করলো একটা পালক আকাশের দিকে পাঠানোর জন্য। কিন্তু এটা টেবিলের ওপর থেকে আর আকাশের দিকে উঠলো না। সিমাস ধৈর্য হারিয়ে জাদু কাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে পালকটাতে আগুন ধরিয়ে দিল আর হ্যারিকে তার টুপি দিয়ে সেই আগুন নিভাতে হলো।

পাশের টেবিলে রন তেমন সুবিধে করতে পারছিল না। রন তার লম্বা হাত ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–উইংগার্ডিয়াম লেভিওসা।

হারমিওন বলল–ভুল হলো। তুমি ভুল উচ্চারণ করেছ।

এতই যদি জানো তাহলে তুমি নিজেই উচ্চারণ কর। হারমিওনের উদ্দেশ্যে রন বলল।

হারমিওন তার গাউনের আস্তিন গুটালো, এবং জাদুর দণ্ডটা ঘোরাল। তারপর উচ্চারণ করল–উইং–গার–ডিয়াম লেভি–ও–সা। এরপর পালকটা টেবিল থেকে ওপরদিকে উঠতে লাগলো এবং তাদের মাথারও চার ফুট ওপরে উঠলো। অধ্যাপক ফ্লিটউইক করতালি দিয়ে উঠলেন এবং হারমিওনের প্রশংসা করলেন।

ক্লাসশেষে রনের মেজাজ খুব খারাপ।

জনাকীর্ণ করিডোর অতিক্রম করতে করতে রন হ্যারিকে বলল-এটা কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে কেউই হারমিওনকে সহ্য করতে পারে না। সত্যি বলতে কী সে সবার জন্য একটা দুঃস্বপ্ন।

মনে হলো কেউ যেন হ্যারির পিঠ ছুঁয়েছে। হ্যারি তাকিয়ে দেখে হারমিওন। হারমিওনের চোখে অশ্রু দেখে হ্যারি সত্যিই অবাক হলো।

মনে হয় সে তোমার কথা শুনতে পেয়েছে। হ্যারি রনকে বলল।

তাতে কী হয়েছে? রন একথা বললেও খুব অস্বস্তিবোধ করছিল। একটু থেমে বলল–সে এখন বুঝতে পেরেছে তার কোন বন্ধু নেই।

পরবর্তী ক্লাসে হারমিওন এল না। বিকেলেও কোথাও তাকে দেখা গেল না। হ্যালোইন ভোজে যোগদানের জন্যে গ্রেট হলে যাবার পথে হ্যারি আর রন শুনতে পেল যে পার্বতী পাতিল তার বন্ধু ল্যাভেঞ্জারকে বলছে, হারমিওন মেয়েদের টয়লেটে গিয়ে কাঁদছে এবং সে চাইছে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। একথা শুনে রনের খুব খারাপ লাগতে লাগল। পরে যখন তারা গ্রেট হলে প্রবেশ করলো, সেখানকার চোখ ধাঁধানে সাজসজ্জায় ও হইচইয়ে তারা হারমিওনের কথা একেবারেই ভুলে গেল।

হাজার খানেক জীবন্ত বাদুর সিলিং ও দেয়াল ধরে এদিক–ওদিক ঊড়ছিল। আরো হাজার খানেক বার টেবিলের সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে মোমবাতিগুলো কুমড়োর খোলে বসিয়ে দিল। ছাত্রদের টার্মের প্রথম দিকের ভোজসভা বলে সোনালী থালায় খাদ্য পরিবেশিত হলো।

হ্যারি যখন তার প্লেটে আলু তুলে নিচ্ছিল ঠিক তখন প্রায় দৌড়ে অধ্যাপক কুইরেল গ্রেট হলে প্রবেশ করলেন। তার পাগড়ি বিপর্যস্ত। সবাই অবাক হয়ে দেখল তিনি ডাম্বলডোরের চেয়ারের দিকে যাচ্ছেন। টেবিলের কাছে গিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন–ট্রল, সেই বিরাট জল্পটা… বন্দিশালা… আমার ধারণা ছিল আপনি সব জানেন। তারপর তিনি মুৰ্ছা খেয়ে মরার মত মেঝের ওপর পড়ে গেলেন।

চারদিকে শোরগোল পরে গেল, কোণ থেকে অধ্যাপক ডাম্বলডোর তার জাদুদণ্ড ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেন।

প্রিফেক্টগণ। ডাম্বলডোর নির্দেশ দিলেন, এখনই তোমরা হাউজের সকলকে নিয়ে ডর্মিটরিতে ফিরে যাও।

পার্সি কাছেই ছিল।

পার্সি বলল–তোমরা সবাই আমাকে অনুসরণ কর। প্রথম বর্ষের সব ছাত্র আমার পেছনে এসো। আমার পেছন পেছন এলে তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। ট্রল তোমাদের কিছু করতে পারবে না। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা একাট্টা হয়ে আমার পেছনে পেছনে এসো। সরে দাঁড়ান, প্রথম বর্ষের ছাত্ররা আসছে। আমি একজন প্রিফেক্ট।

হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলো, ট্রল এলো কি করে?

আমাকে এ প্রশ্ন করো না। মনে হয় তারা সবাই বুন্ধু। রন বলল। হয়ত হ্যালোইন ভোজসভায় মজা করার জন্য পিভস এটা করেছে।

তারা বিভিন্ন গ্রুপের ছাত্রদের পার হয়ে গেল যারা ঊর্ধ্বশ্বাসে বিভিন্ন দিকে ছুটছে। তারা যখন হাফলপাফ হাউজের উদভ্রান্ত ছাত্রদের ভিড় অতিম করছিল তখন হ্যারি হঠাৎ করেই রনের হাত চেপে ধরলো।

আমি কিন্তু ভাবছি হারমিওনের কথা। হ্যারি বলল।

তার সম্পর্কে কী ভাবছো? রন জানতে চাইল।

ট্রলের বিষয়ে সে জানে না।

রন ঠোঁটে কামড় দিল।

ঠিক আছে। রন বলল–পার্সি আমাদেরকে না দেখে ফেললেই হলো।

তারা হাফল পাফ হাউজের ছাত্রদের দলের ভেতরে মিশে গেল। সেখান থেকে সটকে পড়ে একটি নির্জন করিডোরের দিকে অগ্রসর হলো। আরেকটু এগিয়েই তারা মহিলা টয়লেটের কাছাকাছি এলো। পেছন দিকে তারা দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পেল।

পার্সি। নিচু কণ্ঠে রন উচ্চারণ করল।

তারা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল–পার্সি নয়, স্নেইপ।

স্নেইপ করিডোরে তৃতীয় তলার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

হ্যারির নাকে এক ধরনের বাজে গন্ধ এলো। অনেকটা ভেজা, স্যাঁতসেতে অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের গন্ধ। একটু পরেই মনে হলো কে যেন আসছে। পদশব্দ, দৈত্যের পদশব্দের মত। অতিকায় জীবটি ঘরে ঢুকল। বারো ফুট লম্বা। গায়ের চামড়া অন্যরকম। গ্রানাইট পাথরের মতো গায়ের রঙ। মাথায় টাক। অনেকটা নারকেলের মত। হাতে একটা বিশাল কাঠের ডাণ্ডা। দরোজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলো ট্রল।

হ্যারি বলল চাবিটা তালার মধ্যেই আছে। আমরা তো ট্রলকে আটকে রাখতে পারি।

চমৎকার। রন মন্তব্য করল–চলো তাই করি। তারা দুজন আগে বাড়ল। তারা মনে মনে প্রার্থনা করছিল যেন ট্রল তাদের দিকে অগ্রসর না হয়। তাদের প্রার্থনায় কাজ হলো। হ্যারি লাফ দিয়ে কোনমতে তালা ও চাবি হাতের নাগালে পেল। তারপর তালা লাগিয়ে ট্রলকে বন্দি করে ফেলল।

সাফল্যের আনন্দে তারা যখন ফিরে আসছিল ঠিক তখনই তারা শুনলো একটা বিকট আর্তনাদ। যে ঘরে তারা ট্রলকে বন্দি করেছে, সেখান থেকেই শব্দটা আসছে।

ওটা তো মেয়েদের টয়লেট। হ্যারি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।

আরে এ তো হারমিওন। বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে তারা একসাথে চিৎকার করে উঠল।

তারা যে কাজটি করতে চাইল সেটা করা ছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় ছিল না। তারা আবার দরোজার কাছে গেল। ভয় ও আশঙ্কা নিয়ে দরোজার তালাটি খুলেই দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

হারমিওন গ্রেঞ্জার বিপরীত দিকের দেয়ালে ভয়ে কুঁচকে গেছে। মুৰ্ছা যাবার উপক্রম। দৈত্যটি তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তাকে বিভ্রান্ত কর। রনের উদ্দেশ্যে হ্যারি কলল। তারপর হ্যারি একটি ট্যাপ থেকে ট্রলের চোখে অনবন্ত পানি ছুঁড়তে লাগল।

হারমিওনের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ট্রল। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল আওয়াজটি কোত্থেকে আসছে। তার ছোট চোখ দুটি হ্যারির ওপর পড়ল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মুগুরটা হাতে নিয়ে ট্রল হ্যারির দিকে অগ্রসর হলো।

ঘরের অপর প্রান্ত থেকে রন একটা ধাতব পাইপ ছুঁড়ে মারল। ট্রলের ঘাড়ে পাইপটা লাগলেও তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলো না।

তবে তার বিকট চিৎকার শোনা গেল। সে হ্যারিকে পালাবার সুযোগ দিয়ে তার বিশ্রী মুখটা রনের দিকে বাড়িয়ে দিল।

চলে এসো। দৌড়, দৌড় দাও। হারমিওনের উদ্দেশ্যে হ্যারি চিৎকার করল। কিন্তু হারমিওন নড়তে পারছে না। সে দেয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভয়ে তার মুখ হা হয়ে আছে।

এরপর হ্যারি যে কাজটা করল তা একদিকে যেমন সাহসের অপরদিকে বোকামির। সে এক লাফ দিয়ে ট্রলের পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরল। এবার ট্রল আর নড়তে পারছে না। হ্যারি তার জাদুদণ্ড তার একটা নাকের ফুটোয় সোজা ঢুকিয়ে দিল।

যন্ত্রণায় ট্রল আর্তনাদ করে উঠল। সে তার মুগুরটা ঘোরানো শুরু করলো, এবং হ্যারি আশঙ্কা করছে যেকোন সময় এটা তার মাথা দু ভাগ করে দেবে।

হারমিওন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। রন তার নিজের জাদুদণ্ডটা নিয়ে কি করবে প্রথমে ভেবে পাচ্ছিল না, পরে উচ্চারণ করলো, উইনগারডিয়াম লেভিওসা?

মুগুরটা হঠাৎ ট্রলের হাত থেকে ছুটে ওপরে ওঠা শুরু করলো এবং ফিরে এসে ট্রলের মাথায় পড়লো। তীব্র আঘাতে ট্রল মাটিতে পড়ে গেল।

হ্যারি উঠে দাঁড়ালো। সে কাঁপছে, কোন শ্বাসও নিতে পারছে না।

হঠাৎ দরোজা বন্ধ হবার আওয়াজ শোনা গেল। পদশব্দও শোনা গেল। তারা তিনজন মাথা উঁচু করে তাকাল। তারা বুঝতে পারল না তারা কোন্ চক্রের ভেতর জড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য নিচতলায় কেউ না কেউ তাদের হৈচৈ এবং জন্তুটার গর্জন শুনেছে।

একটু পরই ঘরে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। তার পেছন পেছন এসেছেন স্নেইপ ও অধ্যাপক কুইরেল। কুইরেল এক নজর ট্রলের দিকে তাকালেন। মৃদু আর্তনাদ করে দুহাতে কান চেপে টয়লেটে বসে পড়লেন। স্নেইপ মাথা ঝুঁকিয়ে ট্রলকে দেখতে লাগলেন। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারি আর রনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। হ্যারি কখনও তাঁকে এত ক্ষুদ্ধ দেখেনি। তার ঠোঁট বিবর্ণ, সাদী। হ্যারি ভাবল গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য যে পঞ্চাশ পয়েন্ট পাওয়ার কথা ছিল তা আর পাওয়া যাবে না।

তোমরা নিজেদের কি ভাব? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল খুব রেগেমেগে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন। হ্যারি রনের দিকে তাকাল। রনের হাতে তখন ওর জাদুদণ্ড। ম্যাকগোনাগল বললেন–তোমাদের ভাগ্য ভালো, তোমরা মারা যাওনি। তোমরা ডর্মিটরির বাইরে কেন এসেছিলে?

স্নেইপ তীব্র দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারির মনে হচ্ছিল রনের জাদুদণ্ডটা নামিয়ে রাখা উচিত। শিক্ষকদের সামনে ওভাবে হাতে রাখা ঠিক নয়।

একটু পরে পেছনের অন্ধকারের মধ্য থেকে মৃদু শব্দ শোনা গেল। ম্যাকগোনাগল দয়া করে একটু শুনুন। ওরা আমাকে খুঁজছিল।

মিস গ্রেঞ্জার?

হারমিওন অবশেষে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে।

আমি ট্রলের সন্ধান করছিলাম। কারণ, আমার ধারণা ছিল আমি একাই তার সাথে লড়তে পারব। আমি তাদের ওপর অনেক পড়াশোনা করেছি।

রন তার জাদুদণ্ড নামিয়ে রাখল। হারমিওন কীভাবে শিক্ষকের সামনে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে?

আমি ভেবেছিলাম আমি ট্রলকে আটকাতে পারবো। কারণ, এই জন্তুটা সম্পর্কে অনেক বই পড়েছি। তারা যদি আমাকে খুঁজে না পেত, তাহলে এতক্ষণে আমি মারাই যেতাম। হ্যারি তার জাদুদণ্ডটা ট্রলের নাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর রন ট্রলের মুগুর দিয়েই ওর মাথায় আঘাত করেছে। তারা কোন সময় পায়নি অন্য কাউকে ডাকার।

ও–তা হলে তুমি–ই… প্রফেসর ম্যাকগোনাগল তাঁদের তিনজনের মুখ পরখ করে বললেন। মিস গ্রেঞ্জার তুমি তো এক ভীষণ বোকার মত কাজ করেছো। তুমি কী করে ভাবলে যে তুমি এই পাহাড়ি জন্তুটিকে আটকাতে পারবে।

হারমিওন তার শিক্ষকের কাছে একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা বলল।

১১. কিডিচ

নভেম্বর আসার সাথে সাথেই শীতের প্রকোপও বেড়ে গেল। স্কুলের চারপাশের পাহাড়গুলো বরফ জমে ধূসর রং ধারণ করেছে এবং খালের জল জমে ঠাণ্ডা ইস্পাতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকালে খেলার মাঠে বরফ জমে। ওপরের জানালা দিয়ে দেখা যায় হ্যাগ্রিড চামড়ার ওভারকোট, খরগোশের চামড়ার হাতের দস্তানা এবং চামড়ার ভারি জুতা পরে বরফ গলাবার ঝাড়ু দিয়ে কিডিচ খেলার মাঠের বরফ পরিষ্কার করছেন।

কিডিচ খেলার মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রথমবারের মত হ্যারি মাছ খেলবে। তার এক সপ্তাহ অনুশীলন শেষ। শনিবার হ্যারি প্রথমবারের মত ম্যাচ খেলবে। গ্রিফিল্ডর বনাম স্লিদারিন। হ্যারির কিডিচ খেলাটা গোপনই রাখা হয়েছে, এটা উডই চেয়েছিল। কেউ তেমন তাকে খেলতে দেখেনি। উড চেয়েছে হ্যারি হবে তাদের গোপন অস্ত্র, তার বিষয়ে অন্য কাউকে জানানো হবে না। কিন্তু যে করেই হোক সে যে সিকার হিসেবে খেলবে অন্যরা এটা জেনে গেছে এবং এই বিষয় নিয়ে কথাবার্তাও হচ্ছে। কেউ বলছে ও খুব ভাল করবে আবার কেউ কেউ বলছে ওর জন্য ম্যাট্রেস নিয়ে আসতে হবে। কারণ সে ধপাস করে পড়ে যাবে।

আসলে খুবই ভাল হয়েছে যে হ্যারি ও হারমিওন, ওরা এখন বন্ধু। হ্যারি চিন্তাই করতে পারে না হারমিওনের সাহায্য ছাড়া কিভাবে সে তার এত হোমওয়ার্ক করবে। হারমিওন হ্যারিকে কিডিচ থ্রু এইজেস নামে একটা চমৎকার বই পড়ার জন্য ধার দিয়েছে। হ্যারি বইটা থেকে জেনেছে কিডিচ খেলায় সাতশ ধরনের ফাউল হয় এবং ১৪৭৩ সালের বিশ্বকাপে এর সব ধরনের ফাউলই হয়েছিল।

জন্তুটির ঘটনার পর থেকে হারমিওন এবং রন আইন–কানুন মেনে চলার ব্যাপারে একটু শিথিল। হ্যারির প্রথম কিডিচ খেলার আগের দিন, ক্লাসের অবসরে তারা তিনজন স্কুলের প্রাঙ্গণে যায়। শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হারমিওন জাদু করে উজ্জ্বল নীল আগুনের সৃষ্টি করলো, যা একটা জ্যামের বোতলে করেও বহন করা যায়। তারা আগুনের দিকে পেছন ফিরে শরীরটাকে গরম করছিল। স্নেইপ তাদের কাছ দিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাচ্ছিলেন। আগুন জ্বালাটা নিয়মসিদ্ধ নয়। তিনি যেন আগুন না দেখতে পান সে জন্য তারা তাদের পেছন দিয়ে আগুন আড়াল করে রাখলো। ওদের মুখ ও ভাবসাব দেখে স্নেইপের সন্দেহ হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু গলদ আছে। তিনি আবার ফিরে এসে ওদের দিকে ভালভাবে তাকালেন। কিন্তু তিনি কোন আগুন দেখতে পাননি। কিছু না পেয়ে একটা অজুহাত তিনি খুঁজতে লাগলেন।

তোমার হাতে কি, মি. পটার?

এটা কিডিচ থ্রু এইজেস, হ্যারি বইটি দেখাল।

লাইব্রেরির বই স্কুলের বাইরে নেয়া নিষেধ। বইটা আমাকে দাও। গ্রিফিল্ডরের পাঁচ পয়েন্ট কাটা গেল।

স্নেইপ খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেলে হ্যারি রেগে গিয়ে বলল, এই নিয়ম খেয়ালখুশি মতো তার তৈরি। তাঁর পায়ে কী হয়েছে?

জানি না, তবে তাঁর পায়ের তীব্র ব্যথায় তিনি কষ্ট পেলে খুশি হবো, রন তিক্তস্বরে বলল।

সেদিন সন্ধ্যায় গ্রিফিল্ডরের কমনরুমে বেশ শোরগোল হচ্ছিল। হ্যারি, রন ও হারমিওন একটি জানালার কাছের টেবিলে বসলো। হারমিওন হ্যারি ও রনের বশীকরণ বিদ্যার হোমওয়ার্ক দেখে দিচ্ছিল। হারমিওন কখনো তার খাতা থেকে ওদের ঢুকতে দেয় না, বলতো এতে তোমরা কিছু শিখবে না। হারমিওন ওদের হোমওয়ার্ক পড়ে সংশোধন করে দিত এবং এর ফলে তাদের উত্তর সঠিক হতো।

হ্যারি কিডিচ থ্রু এইজেস বইটা ফিরে পাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়লো। স্নেইপকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে। সে যাবে তার কাছে এবং সোজাসুজি বলবে বইটা তার দরকার। হারমিওন ও রনকে বলল ওই কথাটা। তারা দুজনেই বলল, তুমিই যাও। আমরা না। সে শিক্ষকদের কামরায় গিয়ে দরজায় টোকা দিল। কোন শব্দ নেই। আবার দিল। কেউ নেই। স্নেইপতো বইটা ওখানে রেখেও যেতে পারেন। দেখা যাক ভাগ্য পরীক্ষা করে। সে দরোজাটা ধাক্কা দিয়ে ফাঁক করলো এবং এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখল।

স্নেইপ ও ফিলচ ভেতরে, মাত্র ওরা দুজন। স্নেইপের আলখেল্লা তার হাটুর ওপর তোলা, এক পা রক্তাক্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত। আর ফিলচ তার পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে।

স্নেইপ বলছিলেন, কিভাবে একজন লোক তিন মাথার চোখের প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারে?

হ্যারি সন্তর্পণে ভেতরে প্রবেশ করে দরোজা সাবধানে বন্ধ করতে যাচ্ছিল।

পটার।

স্নেইপ বিরক্তিতে তার মুখ বাঁকালেন এবং দ্রুত তার আলখেল্লা টেনে পা ঢেকে দিলেন।

আমি কি আমার বইটা ফেরত পেতে পারি।

বেরিয়ে যাও। বের হয়ে যাও।

হ্যারি দ্রুত বের হয়ে গেল যেন স্নেইপ আবার কোন পয়েন্ট কাটার সময় না পান। সে দৌড়ে ওপরে চলে গেল। খুবই সাবধানে ফিস ফিস করে রন ও হারমিওনকে সব কথা খুলে বলল।

এর অর্থ বুঝতে পারছো? কোন শ্বাস না নিয়েই সে বলল। স্নেইপ হ্যালোইনের রাতে তিন মাথা কুকুরকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতে চেয়েছিলেন। সেদিনই, যে সময় আমরা ওঁকে দেখেছিলাম ওইদিকে যাচ্ছিলেন। তিন মাথা কুকুর যা পাহারা দিচ্ছে সেটার প্রতি নজর তার। সেদিন ট্রল নামক পাহাড়ি জন্তুটিকে তিনি ছেড়ে দিয়ে সবার দৃষ্টি ওইদিকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।

হারমিওনের চোখ বড় হলো।

না–তিনি এটা করবেন না। যদিও তিনি খুব একটা ভাল লোক নন, কিন্তু ডাম্বলডোরের জিনিস চুরি করবেন বা চুরির চেষ্টা করবেন, তা হতে পারে না।

তুমি মনে করতে পারো সব শিক্ষক একেবারে দেবতা। আমার হ্যারির কথাই সঠিক মনে হচ্ছে। রন বলল।

পরেরদিন সকালটা ছিল উজ্জ্বল এবং শীতল। গ্রেট হল সসেজ ভাজার গন্ধে ম ম করছে এবং সবাই খেলাটা কেমন হবে–সেই আলোচনায় ব্যস্ত।

তোমার কিছু নাস্তা খেয়ে নেয়া দরকার।

না আমি কিছু খাব না।

কমপক্ষে টোস্ট নাও। হারমিওন বলল।

আমার কোন ক্ষিদে নাই।

হ্যারির সেদিনের খেলার চিন্তায় ক্ষুধা উধাও। সিমাস অনুরোধ করল, হ্যারি তোমাকে খেতে হবে। খেলার জন্য তোমার শক্তির দরকার।

হ্যারি সিমাসের দিকে তাকাল, দেখল, সে সসেজের ওপর কেচাপ ঢালছে, বলল ধন্যবাদ সিমাস।

সকাল এগারটার মধ্যে সবাই স্কুল মাঠে চলে এসেছে। কিডিচ পিচের চারদিকে বসার স্থানে জায়গা করে নিচ্ছে। অনেক ছাত্রের হাতে বায়নোকুলার। বসার স্থান যদিও ধাপে ধাপে ওপরের দিকে উঠেছে তবুও অনেক সময় দেখা যায় না ঠিক কি ঘটছে।

নেভিল, সিমাস ও ওয়েস্ট হামের ডীন বসেছিল একেবারে ওপরের সারিতে। রন ও হারমিওনও তাদের সাথে যোগ দিল যেন সেখান থেকে তাদের দলকে সাপোর্ট করা যায়। হ্যারি অবাকই হলো, ওদের বড় বড় ব্যানারের মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে গেছে। ওতে লেখা আছে পটার ফর প্রেসিডেন্ট এবং লেখাটার নিচে গ্রিফিল্ডারের প্রতীক সিংহ এঁকেছে ভীন। ডীন একজন ভাল আঁকিয়ে। এরপর হারমিওন ব্যানারগুলো যাদু করে নানা রঙে ভরে দিল।

হ্যারি প্রসাধন কক্ষে অন্য খেলোয়াড়দের সাথে জার্সি পরে নিল। তাদের জার্সির রঙ লাল, আর স্লিদারিন হাউজের জার্সির রঙ সবুজ।

উড গলা পরিষ্কার করে সবাইকে নীরব থাকতে বলল।

তারপর সে খেলোয়াড়দের উদ্দেশে প্রশ্ন করল–তোমরা সবাই প্রস্তুত তো?

মেয়েরা তোমরা তো প্রস্তুত। চেজার মিস অ্যাঞ্জেলিনা জনসন জানতে চাইল।

আমার মনে হয় মেয়েরাও প্রস্তুত। উড় মন্তব্য করল।

সেই বড় একজন। ফ্রেড উইসলি বলল।

সেই একজনের জন্য আমরা সবাই প্রতীক্ষা করছি। জর্জ বলল।

অলিভারের ভাষণ আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। হ্যারির উদ্দেশ্যে ফ্রেড বলল। গত বছর আমরা দলে ছিলাম।

তোমরা দুজন চুপ করো। উড ধমক দিল।

গুডলাক। উড খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বলল।

খেলার প্রস্তুতি নিয়ে হ্যারি, ফ্রেড ও জর্জের অনুসরণ করল। হ্যারির মনে আশংকা ছিল–খেলার সময় তার হাঁটু তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মাদাম তুচ হলেন এ খেলার রেফারি। তিনি ঝাড়ু হাতে নিয়ে মাঠে উপস্থিত হলেন। তার দুদিকে দুদল দাঁড়াল।

তিনি খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বললেন–আমি তোমাদের কাছ থেকে একটি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন খেলা দেখতে চাই।

মাদাম হুচ খেলার সূচনা করলেন–তোমরা তোমাদের ঝাড়ুর ওপর উঠে পড়ো।

হ্যারি নিম্বাস ২০০০ ঝাড়ুর ওপর উঠল।

মাদাম হুচ তার রূপালী বাঁশি বাজালেন।

পনেরটা ঝাড়ুকে ওপরে উঠতে দেখা গেল।

গ্রিফিল্ডর হাউজের অ্যাঞ্জেলিনা জনসনের হাতে কুয়াফল।

দেখতে সুন্দর এই মেয়েটি ভাল ধাওয়া করতে পারে…

উইসলি যমজ ভাইদের একজন লী জর্ডান খেলার ধারা বিবরণী দিচ্ছিল।

জর্ডান?

তার ওপর সবসময় নজর রাখছিলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল।

দুঃখিত প্রফেসর।

এবার পরিষ্কার পাস দেয়া হলো এলিসিয়াস্পিনেটকে। সে উডের প্রিয় ছাত্রী। গত বছর সে রিজার্ভে ছিল। বল আবার জনসনের কাছে। না না। এবার বল স্লিদারিন হাউজের দখলে। বলটা চলে গেছে ওদের অধিনায়ক মার্কাস ফ্রিন্টের কাছে। ঈগলের মত উড়ে চলেছে সে। এই বুঝি সে স্কোর করবে। না হলো না। গ্রিফিল্ডর হাউজের কিপার উড় ঝাঁপ দিয়ে বলটি ধরে ফেলেছে। চেজার কেটি বেল এগিয়ে যাচ্ছে। বল অবার অ্যাঞ্জেলিনার হাতে। স্লিদারিন হাউজের কিপার ব্লেচলি ঝাঁপ দিল। না বলটি সে ধরতে পারেনি। গ্রিফিল্ডর হাউজ স্কোরটি করল।

চারদিকে বিপুল হর্ষধ্বনি।

আনন্দে হ্যাগ্রিড রন ও হারমিওনকে জড়িয়ে ধরলেন।

অ্যাঞ্জেলিনা স্কোর করার পর থেকেই হ্যারি মিচের ওপর নজর রাখছিল। হ্যারি বল নিয়ে তীরবেগে এগোচ্ছে। একজন ব্লুজার বাধা হয়ে পঁড়ালেও মাথা নত করে হ্যারি তা এড়িয়ে গেল। কেউ তাকে রুখতে পারছে না। কি করবে চেজারও বুঝে উঠতে পারছে না।

ওরা মাঝ শূন্যে উড়ছে।

হ্যারি অবশ্য হিগসের চেয়েও দ্রুতগামী।

বল এবার গোলার মত ছুটে আসছে।

ধাম।

গ্রিফিল্ডর হাউজ চিৎকার করে উঠল—ফাউল।

মাদাম হুচ শটের নির্দেশ দিলেন।

স্নিচ আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। গ্যালারির মধ্য থেকে টমাস চিৎকার করে উঠল–তাকে লাল কার্ড দেখানো হোক।

রন বলল-এটা তো ফুটবল খেলা নয়। এখানে লালকার্ডের কোন নিয়ম নেই।

হ্যাগ্রিড বললেন–খেলার তো কিছু নিয়ম–কানুন আছে। ফ্লিন্ট হ্যারিকে আকাশে ধাক্কা দিয়েছে। লি জর্ডান বলল-এটা খুব খারাপ। এক ধরনের ধোকাবাজি।

ম্যাকগোনাগল জর্ডানকে ধমক দিলেন।

জর্ডান বলল–ওটা তো ফাউল ছিল। তিনি নিরপেক্ষ হতে পারছিলেন না।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–জর্ডান, আমি তোমাকে আবার হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।

খেলা জমে উঠল। হ্যারি একজন ব্লুজারকে কাটিয়ে গেল। ঝাড়ুর আঘাত থেকে রুজারের মাথাটা কোনভাবে বেঁচে গেল। হ্যারিও কিছুটা আঘাত পেয়েছে। এই রকম ঘটনা আবারও ঘটল। হ্যারির ঝাড়ু নিম্বাস ২০০০ খুব স্বাভাবিকভাবেই আকাশে উড়ছে। এবার বল গ্রিফিল্ডারদের গোলপোস্টে। হ্যারি কিপার উডকে সতর্ক করে দিল। ওরা একটু আঁকা বাকাভাবে উড়ছে। দারুন শব্দ হচ্ছে।

জর্ডান খেলার ধারাভাষ্য বর্ণনা করে চলেছে।

খেলার ভেতর কেউ লক্ষ্য করল না যে, হ্যারির ঝাড়ু অদ্ভুত আচরণ করছে। ঝাড়ুটা তাকে ধীরে ধীরে খেলার বাইরে ওপর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ঠিক বুঝতে পারছি না, হ্যারি কী করছে। বাইনোকুলার দিয়ে খেলা দেখতে দেখতে হ্যাগ্রিড এই মন্তব্য করলেন।

হ্যাগ্রিড বলে চললেন–আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে হ্যারি ঝড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা তো কখনোই হতে পারে না। একমাত্র শক্তিশালী জাদু ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।

এবার সবার নজর হ্যারির ওপর পড়ল। দেখা গেল তার ঝাড়ু কোন কাজ করছে না। মাঝে মাঝে ঝাঁকুনিতে হ্যারির ঝাড়ুর শলা পড়ে যাচ্ছে। সে কোনমতে একহাতে ঝাড়ুটা ধরে রেখেছে।

কোন কিছু কি ঘটেছে? সিমাস প্রশ্ন করল।

হারমিওন হ্যাগ্রিডের কাছ থেকে বাইনোকুলারটি নিয়ে খেলা দেখতে লাগল। তার দৃষ্টি হ্যারির ওপর না পড়ে পড়ল জনতার ওপর। হতাশ কণ্ঠে রন জিজ্ঞেস করল–তুমি এখন কী করতে চাচেছা?

আমি জানি এটা স্নেইপের কারসাজি।

রন বাইনোকুলার হাতে নিয়ে দেখল, তারা যেখানে বসেছিল ঠিক তার বিপরীত দিকে অধ্যাপক স্নেইপ দাঁড়িয়ে আছেন। আর তার দৃষ্টি হ্যারির ওপর নিবদ্ধ। তিনি অনর্গল কথা বলে চলেছেন।

সে ঝাড়ুর ওপর জাদুবিদ্যা খাটাচ্ছে। আমরা এখন কী করব? হারমিওন বলে উঠল।

আমরা তাহলে কী করতে পারি।

সেটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।

রন কিছু বলার আগেই হারমিওন অদৃশ্য হয়ে গেল। রন বাইনোকুলার নিয়ে আবার হ্যারির দিকে তাকাল। তার ঝুড়িটা এত কাপছিল যে এটার ওপর বসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। উইসলি যমজভাই ওপরে উড়ে গিয়ে হ্যারিকে নিরাপদে ঝড়ির ওপর আনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। যতবারই তারা হ্যারির কাছাকাছি গেছে ততবারই ঝাড়ু ওপরে উঠে তাদের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। তারা নিচে নেমে চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। তাদের প্রত্যাশা ছিল হ্যারি নিচে নামলে তারা তাকে ধরে ফেলবে। এই সুযোগে মার্কাস ফ্লিন্ট কুয়াফলটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে পাঁচ বার স্কোর করে ফেলল।

হারমিওন, এখানে চলে এসো। রন বেপরোয়া হয়ে তাকে ডাকল। স্নেইপ যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন হারমিওন দৌড়ে গিয়ে তার পেছনের সারিতে দাঁড়াল। স্নেইপের কাছে গিয়ে সে তার জাদুদ বের করল, কয়েকটা নির্বাচিত শব্দ উচ্চারণ করল, উজ্জ্বল নীল শিখা তার জাদুদণ্ড থেকে বেরিয়ে স্নেইপের পোশাক স্পর্শ করল।

সমস্ত ঘটনা ঘটতে তিরিশ সেকেন্ডের বেশি সময় নিল না। সেই বুঝতে পারলেন তার জামায় আগুন লেগেছে। তিনি চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন। হারমিওন আবার জাদুদণ্ডে ফুঁ দিল। পকেট থেকে একটা ছোট পাত্র বের করে সব আগুন পাত্রের ভেতর ঢোকাল। পাত্রটি নিয়ে সে এমনভাবে উধাও হল যে, তাকে খুঁজে বের করা স্নেইপের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হলো না। এতক্ষণে শূন্যে হ্যারি নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। ঝাড়ুর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ফিরে এল।

নেভিল এবার তাকিয়ে দেখ। রন বলল। নেতি প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে হাগ্রিডের জ্যাকেটে মুখ রেখে কাঁদছিল।

হ্যারি এবার দ্রুতগতিতে ভূমির দিকে এগোচ্ছে।

দর্শকরা দেখল–হ্যারি তার দুহাত মুখের ওপর রাখল। মনে হলো সে অসুস্থ। সে চারদিকে আঘাত করল। এরপর কাশল। সোনা জাতীয় একটা বস্তু তার হাতে এসে পড়ল।

আমি এবার স্নিচকে হাতে পেয়েছি। বস্তুটা মাথার ওপর তুলে হ্যারি চিৎকার করে উঠল। খেলাটা বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে শেষ হলো।

সে তো এটা লুফে নেয়নি। সে তা বলতে গেলে এটা গিলে ফেলেছে। বিশ মিনিট ধরে ফ্লিন্ট এ নিয়ে খুব হইচই করল। এতে কোন ফল হলো না। কারণ হ্যারি কোন নিয়ম ভঙ্গ করেনি। আর লী জর্ডানও তার ধারাভাষ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। খেলাশেষে গ্রিফিল্ডর হাউজ পেল ১৭০ পয়েন্ট আর স্লিদারিন হাউজ পেল মাত্র আট পয়েন্ট। হ্যারি এসবের কোন খবর পায়নি।

বিকেল বেলা হ্যাগ্রিড, হ্যারি, রন আর হারমিওনকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।

রন বলল-এসব কিছুর জন্য স্নেইপই দায়ী। হারমিওন আর আমি দেখলাম তিনি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন আর তাঁর দৃষ্টি তোমার ওপর নিবদ্ধ।

যতসব বাজে কথা। হ্যাগ্রিড বললেন।

হ্যারি, রন ও হারমিওন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল তারা স্নেইপ সম্পর্কে কী বলবে। হ্যারি সত্য কথা বলাটাই ঠিক মনে করল আমি তাঁর সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছি। হ্যারি হাগ্রিডের উদ্দেশে বলল–তিনি হ্যালোইনে তিন মাথাওয়ালা কুকুরটাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কুকুরটা তাকে কামড় দেয়। আমার ধারণা তিনি সবকিছুই চুরি করতে চেয়েছিলেন যা কুকুরটা পাহারা দিচ্ছিল।

হ্যাগ্রিড হ্যারিকে প্রশ্ন করলেন–তুমি কি ফ্লাফি সম্পর্কে কিছু জানো?

ফ্লাফি? হ্যারি অবাক হয়ে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে।

ফ্লাফি হল সেই কুকুরটার নাম। আমি এ কুকুরটা একজন গ্রীক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে ডাম্বলডোরকে দিয়েছি।

তারপর? হ্যারি জানতে চাইল।

আর জিজ্ঞেস করো না। এটা অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়।

এবার হারমিওন চিৎকার করে জানতে চাইল–তাহলে তিনি কেন হ্যারিকে খুন করতে চাইবেন?

হ্যাগ্রিড রেগে গিয়ে বললেন–তোমরা ভুল করছ। আমি জানি না, হ্যারির ঝাড়ু কেন এমন করল। কিন্তু স্নেইপ কখনোই তার একজন ছাত্রকে খুন করবেন না। তোমরা তিনজনের এমন ভাবাই উচিত নয়। তোমরা কুকুরটার কথা ভুলে যাও। কুকুরটা কী পাহারা দিচ্ছে সেটা নিয়ে তোমাদের মাথাব্যথার কোন কারণ নেই। এটা ডাম্বলডোর আর নিকোলাস ফ্লামেলের ব্যাপার। ওহ তাই হ্যারি বলল। তাহলে নিকোলাস ফ্লামেল নামক কেউ এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।

এখানে ফ্লামেল নামে কেউ আছেন কি? হ্যাগ্রিডের মুখ রাগে লাল হয়ে ও

১২. এরিসেডের আয়না

বড়দিন আসছে। ডিসেম্বর ৩০,সর মাঝামাঝি কোন এক সকালে দেখা গেল যে সমগ্র হোগার্টস কয়েক ফুট বরফে ঢেকে গেছে। হ্রদের পানিও জমে বরফ হয়ে গেছে। বরফের টুকরো নিয়ে জাদু করার জন্য উইলি পরিবারের যমজ দুভাইয়ের শাস্তি হয়েছে। তারা বরফের বল তৈরি করে কুইরেলের পেছনে লাগায় এবং বলটা কুইরেলের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তার পাগড়িতে লেগে ফিরে আসে। এই শীত উপেক্ষা করে চিঠি বিলি করার জন্য যেসব পেঁচা আসত সেগুলোকে সেবা করে সুস্থ করার দায়িত্ব হ্যাগ্রিডের ওপর।

সবাই ছুটির জন্য অধীর হয়ে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের কমন রুম ও গ্রেট হল গরম রাখার ব্যবস্থা থাকলেও করিডোর ছিল কনকনে ঠাণ্ডা। শীতল হাওয়ায় জানালায় প্রচণ্ড ঝটপটানি শোনা যায়।

সবচে খারাপ হলো অধ্যাপক স্নেইপের মাটির তলায় বন্দিশালায় ক্লাস–সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আর ছাত্ররা চেষ্টা করত গরম কলড্রনের কাছাকাছি বসতে।

ওষুধ তৈরির এক ক্লাসে হঠাৎ করে ম্যালফয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল আমার তাদের জন্য দুঃখ হচ্ছে যাদেরকে বড়দিনের সময় হোগার্টসে কাটাতে হবে, কারণ তাদের নিজ বাড়িতে ঠাঁই নেই।

ম্যালফয় হ্যারির দিকে তাকিয়ে এই কথা বলল। ঐেব ও গয়েল টিটকারি দিল। হ্যারি তখন ওষুধ প্রস্তুত করছিল। সে ম্যালফয়ের কথায় গা করল না।

কিডিচ খেলায় গ্রিফিল্ডর হাউজের কাছে শিদারিন হাউজের পরাজয়ের পর হ্যারির ওপর তার ক্রোধ বহুগুণ বেড়ে গেছে।

ম্যালফয়ের এইসব শ্রেষপূর্ণ কথাবার্তায় আর কেউ যোগ দেয়নি। কিডিচ খেলায় গ্রিফিল্ডর হাউজের বিজয়ে হ্যারির বিশেষ ভূমিকা থাকায় হ্যারি এখন হোগার্টসে খুব জনপ্রিয়। হ্যারিকে কাবু করতে না পেরে ম্যালফয় এবার বলল–হ্যারির নিজস্ব কোন পরিবার নেই।

বড়দিনের ছুটিতে হ্যারি প্রিভেট ড্রাইভে যাবে না। বড়দিনের এক সপ্তাহ আগে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এসে তালিকা তৈরি করলেন–কারা বাড়িতে যাবে, আর কারা হোগার্টসে থাকবে। বড়দিনে হোগার্টসে থাকতে হবে বলে হ্যারির কোন দুঃখ ছিল না। কারণ এবারের বড়দিনটা হ্যারির খুব আনন্দে কাটবে। রন ও ফ্রেডও হোগার্টসে থাকবে কারণ চার্লিকে দেখার জন্য তার বাবা–মা বড়দিনের ছুটিতে রুমানিয়া যাবেন।

ক্লাস শেষ করে তারা যখন বাইরে বেরুল তখন দেখল, একটি ফারগাছ তাদের গতিরোধ করছে। গাছের পেছন থেকে একটি শব্দ শোনা গেল। ওরা অবাক, কি হতে পারে, না, গাছের পেছনে হ্যাগ্রিড দাঁড়িয়ে আছেন।

গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে রন চিৎকার করে উঠল–হ্যাগ্রিড! কোন সাহায্য করতে হবে?

কোন সাহায্যের দরকার নেই। আমি ঠিকই আছি। হ্যাগ্রিড বললেন।

আপনি কি পথ ছাড়বেন? পেছন থেকে ম্যালফয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। উইসলি, তুমি কি কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে চাইছ। ভবিষ্যতে তুমিও কি গেমকীপার হতে চাও না–কি? তোমাদের বাড়ির তুলনায় হ্যাগ্রিডের কুঁড়ে ঘর নিশ্চয়ই একটি প্রাসাদ।

রন ম্যালফয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক সেই সময় স্নেইপ এসে হাজির। তিনি রনকে জিজ্ঞেস করলেন–কী ব্যাপার, কী হয়েছে? রন ম্যালফয়কে ছেড়ে দিল।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হ্যাগ্রিড বললেন–প্রফেসর, ম্যালফয় রনকে খামোখা খেপিয়েছে। সে রনের পরিবার সম্পর্কে যা–তা বলেছে।

তা-হোক। মারামারি করা হোগার্টসের নিয়মের বাইরে, হ্যাগ্রিড। অধ্যাপক স্নেইপ বললেন–উইসলি, গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে পাঁচ পয়েন্ট কাটা গেল। তোমার ভাগ্য ভালো, তোমাকে বেশি কঠিন শাস্তি দেয়া হয়নি। তোমরা সবাই যেখানে যাচ্ছিলে যাও।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল গাছটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে যত্রতত্র গাছের কাটা ফেলে দুষ্টামির হাসি হেসে চলে গেল।

ম্যালফয়ের পেছন থেকে রন দাঁত কিড়মিড় করে বলল আমি তাকে একহাত দেখে নেব। একবার না একবার তো সুযোগ পাব।

ম্যালফয় আর স্নেইপ, আমি দুজনকেই ঘৃণা করি। হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিড বললেন-এসব বাদ দাও। বড়দিন আসছে। চল আমরা গ্রেট হলে আনন্দ করি।

হ্যারি, রন, হারমিওন, হ্যাগ্রিড ও তার গাছ অনুসরণ করল। তারা গ্রেট হলে প্রবেশ করে দেখল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ও ফ্লিটউইক বড়দিনের সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত।

হ্যাগ্রিড, সবশেষে গাছটা এনেছ তুমি, এই গাছটা কোনায় শেষের দিকে রাখবে একটু।

গ্রেট হল খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। কমপক্ষে বারোটা ক্রিসমাস গাছ ঘরের ভেতর রাখা হয়েছে।

ছুটির আর কদিন বাকি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।

মাত্র একদিন। হারমিওন জবাব দিল। আর এই কথার সাথে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে–মধ্যাহ্নভোজের আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি আছে। হ্যারি ও রন, চলো এই সময়টুকু লাইব্রেরিতে কাটাই।

অধ্যাপক ফ্লিটউইক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রন বলল–হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। ফ্লিটউইক সে সময় তার জাদুদণ্ড দিয়ে সোনালী বুদবুদ তৈরি করে সেগুলো নতুন গাছের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।

আবার লাইব্রেরি কেন? হ্যাগ্রিড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ছুটির আগে লাইব্রেরি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে লেখাপড়ায় তোমরা খুবই মনোযোগী।

লেখাপড়া করার জন্য আমরা লাইব্রেরিতে যাচ্ছি না। হ্যারি জবাব দিল।

আপনার মুখে নিকোলাস ফ্লামেলের নাম শুনেছি। আমরা তার সম্পর্কে আরো জানতে চাই।

কী জানতে চাও? বিরক্ত কণ্ঠে হ্যাগ্রিড বললেন–আমার কথা শোন। আমি তো আগেই বলেছি এ চিন্তাটা মাথা থেকে নামাও। কুকুর কী পাহারা দিচ্ছে। এ নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই।

নিকোলাস ফ্লামেল লোকটা কে–শুধু এটাই জানতে চাই। এর বাইরে অন্য কিছু জানার আগ্রহ আমাদের নেই। হারমিওন বলল। আপনি একটু সাহায্য করলে আমরা খাটনি থেকে মুক্তি পেতে পারি। হ্যারি বলল আমরা এ পর্যন্ত শতাধিক বই পড়েছি। কিন্তু নিকোলাস ফ্লামেল সম্পর্কে কিছুই পাইনি। তবে, আমার মনে হয় কোথায় যেন তার নাম শুনেছি।

আমি এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু বলব না। হ্যাগ্রিডের স্পষ্ট জবাব।

ঠিক আছে, আমরা নিজেরাই খুঁজে বের করব। রন বলল। বিরক্ত হয়ে তারা সবাই দ্রুত হাগ্রিডের কাছ থেকে বিদায় নিল।

লাইব্রেরিতে তারা নানা ধরনের বই খুঁজল। জাদুর ওপর সেখানে যে কটা বই ছিল সব তারা তন্ন তন্ন করে দেখল। কোথাও নিকোলাস ফ্লামেলের নাম পাওয়া গেল না। কিন্তু ফ্লামেল সম্পর্কে জানতে না পারা গেলে অধ্যাপক স্নোইপ কী চুরি করতে চেয়েছিলেন জানা যাবে না।

হারমিওন লাইব্রেরির ক্যাটালগ দেখতে লাগল। রন লাইব্রেরির বই দেখছিল আর হ্যারি চলে গেল নিয়ন্ত্রিত বইয়ের কোনায়। এখানকার বই ইস্যু করতে হলে কোন একজন শিক্ষকের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। কালো জাদুর ওপর নিয়ন্ত্রিত কিছু বই ছিল যা হোগাৰ্টসে কখনও পড়ানো হতো না। কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বিষয় নিয়ে যে সমস্ত সিনিয়র ছাত্র লেখাপড়া করত কেবল তাদেরকেই এ সমস্তু বই পড়তে দেয়া হত।

তোমরা কী খুঁজছ?

কিছুই না। হ্যারি জবাব দিল।

লাইব্রেরিয়ান মাদাম পিনস–তার ধূলা ঝাড়ার পালক তাদের দিকে ভাক করে বললেন–তাহলে তোমরা এখন বাইরে যাও।

হ্যারি লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে এলো। সে, বন ও হারমিওন একমত হয়েছিল যে তারা মাদাম পিসকে ফ্লামেল সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। তিনি নিশ্চয়ই ফ্লামেল সম্পর্কে বলতে পারবেন। তবে তারা কী খুঁজছে এটা স্নেইপ জানুন সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

হ্যারি কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে দেখে রন ও হারমিওন কোন ক্লু পেয়েছে কিনা। তবে হ্যারি তেমন আশাবাদীও ছিল না। গত পনেরো দিন ধরে তারা ফ্লামেল সম্পর্কে জানার এত চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তারা চাচ্ছিল মাদাম পিনসের অনুপস্থিতিতে লাইব্রেরিতে এটা ভালভাবে খুঁজবে।

পাঁচ মিনিট পর রন আর হারমিওন হ্যারির কাছে এলো। তারা নানা রকম চিন্তাভাবনা করে মধ্যাহ্নভোজে গেল। আমি না থাকলেও তোমরা খুঁজে দেখ। হারমিওন বলল–যদি কিছু পাও আমার কাছে একটি পাচা পাঠিয়ে দিও।

তুমি তোমার বাবা–মাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো নিকোলাস ফ্লামেল কে? রন হারমিওনের উদ্দেশ্যে বলল। তাদেরকে জিজ্ঞেস করাটাই নিরাপদ হবে।

তুমি ঠিকই বলেছ, কারণ তারা দুজনেই দন্তচিকিৎসক। হারমিওন বলল।

বড়দিনের ছুটি শুরু হলে হ্যারি আর রনের সময় খুব ভালো কাটতে লাগল। ফ্লামেল সম্পর্কে ভাবার জন্য তারা অফুরন্ত সময় হাতে পেল। ঊর্মিটরি এখন তাদের দখলে। কমনরুম আগের তুলনায় অনেক ফাঁকা। ছুটিতে সবাই বাড়ি গেছে। তারা ইচ্ছেমত ভালো ভালো আরাম কেদারা নিয়ে আগুনের পাশে বসে। তারা ইচ্ছেমত খেতেও পারে।

বন এখন হ্যারিকে জাদুর দাবা শেখাচ্ছে। খেলাটা অনেকটা মাগলদের দাবা খেলার মত। তফাৎ হলো-এখানে রাজা, মন্ত্রী, হাতী, ঘোড়া, নৌকা সবই জীবন্ত।

বড়দিনের আগের রাতে শোবার সময় হ্যারি ভাবছিল, এবার বড় দিনে অনেক মজা হবে, তবে তার জন্য কোন উপহার আসবে না। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে অবাক। বিছানায় পায়ের সামনে একগাদা প্যাকেট।

শুভ বড়দিন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে রন হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। হ্যারি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে তার ড্রেসিং গাউন পরে নিল।

তোমাকেও শুভ বড়দিন। হ্যারি বললো–দেখ, আমি একটা উপহার পেয়েছি।

নিজের উপহারগুলোর দিকে তাকিয়ে রন বলল–হ্যারি তুমি কি শালগম আশা করেছিলে?

রনের অনেক উপহার।

হ্যারি তার উপহার খুলল। বাদামী কাগজে প্যাকেটটা মোড়ানো। মোড়ক খোলার পর দেখা গেল ওপরে সুন্দর করে লেখা আছে–হ্যারির জন্য, ইতি হ্যাগ্রিড। প্যাকেটটার ভেতর ছিল একটা কাঠের বাঁশি। হ্যারি বাঁশিটা বাজাল। পেঁচার ধ্বনির মত শব্দ শোনা গেল। দ্বিতীয় প্যাকেটটা ছিল খুবই ছোট। প্যাকেটের ভেতর ছিল টাকা আর একটা চিঠি।

চিঠিতে লেখা আছে–আমরা তোমার বার্তা পেয়েছি। এখানে তোমার বড়দিনের উপহার। আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়ার উপহারের সাথে সেলো টেপ দিয়ে লাগানো ছিল ৫০ পেনসের একটা নোট।

উপহারের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। হ্যারি বলল। হ্যারি ৫০ পেনসের নোট পাওয়াতে রন খুব অভিভূত হলো।

আশ্চর্য। রন মন্তব্য করল-একেবারে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।

তুমি এটা রাখতে পারো। রনের উল্লাস দেখে হ্যারি রনকে বলল।

হ্যাগ্রিড এবং আমার আঙ্কল ও আন্ট এই দুটো পাঠিয়েছেন।

আর এই প্যাকেটটা?

প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রন বলল–আমার মনে হয় আমি বলতে পারব-এটা কোত্থেকে এসেছে। আমার মা পাঠিয়েছেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে হ্যারিকে বড়দিনে কেউ উপহার পাঠাবে না। তাই তিনি তোমার জন্য একটা পশমীর সোয়েটার পাঠিয়েছেন।

হ্যারি প্যাকেটটা খুলে দেখল–ভেতরে হাতে বোনা একটি সোয়েটার। নিজের প্যাকেট খুলতে খুলতে রন বলল–আমার মা প্রতিবছর আমাদের সোয়েটার বানান। আমারটির রঙ হবে অবশ্যই মেরুন।

তিনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ। হ্যারি বলল।

পরবর্তী প্যাকেটে ছিল হারমিওনের পাঠানো মিষ্টি ও চকোলেট ফ্রগ।

উপহারের আরেকটা প্যাকেট খোলা বাকি। ওজনে খুবই হালকা। হ্যারি খুলে দেখে ভেতরে একটা অদৃশ্য হওয়ার পোশাক। হ্যারি পোশাকটা পরল। রন বলল–দেখ পোশাক থেকে একটা চিরকুট নিচে পড়ে গেছে। হ্যারি চিরকুটটা কুড়িয়ে নিল। চিরকুটে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা আছে

মৃত্যুর আগে তোমার বাবা আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছিলেন।
এখন সময় হয়েছে এটা তোমাকে ফেরত দেয়ার।
এটার সঠিক ব্যবহার কর।
শুভ বড়দিন।

চিঠিতে কারো স্বাক্ষর ছিল না। রন পোশাকের প্রশংসা করে হ্যারিকে চিন্তিত দেখে প্রশ্ন করল–হ্যারি, কি ব্যাপার, কি হয়েছে?

না কিছু না। হ্যারি বলল। তারপর চিন্তা করতে লাগল কে তাকে এ পোশাকটা পাঠিয়েছে। তার বাবাই কি এ পোশাকটার মালিক ছিলেন?

হ্যারি যখন চিঠির রহস্য উদঘাটনের কথা চিন্তা করছিল ঠিক তখনি দরোজা খুলে গেল।

ফ্রেড ও জর্জ ওয়েসলি ভেতরে প্রবেশ করেছে। হ্যারি পোশাকটা সাথে সাথে লুকিয়ে ফেলল। সে তার অনুভূতি কারো সাথে ভাগ করে নিতে চায় না।

শুভ বড়দিন।

তাকিয়ে দেখ হ্যারি একটা উইসলি জাম্পার পেয়েছে।

ফ্রেড আর জর্জ জাম্পার পরা ছিল। একটাতে হলদে রঙে বড় করে এফ লেখা ছিল অপরটাতে হলদে রঙে বড় করে জি লেখা ছিল।

হ্যারির জাম্পার হাতে নিয়ে ফ্রেন্ড বলল–আমাদের উপহারের তুলনায় তোমার উপহার সবচেয়ে ভাল। যেহেতু তুমি আমাদের পরিবারের সদস্য নও, সেহেতু মা তোমার জন্য আরও বেশি পরিশ্রম করে সুন্দর করে বানিয়েছে।

তুমি কেন তোমারটা পরছ না রন? জর্জ জানতে চাইল ও বলল এটা পর, কি সুন্দর এবং উষ্ণ।

মেরুন রঙ আমার পছন্দ নয়, মা প্রতিবছর এই রঙের সোয়েটার আমার জন্য বুনেন। জাম্পার খুলতে খুলতে রন বলল।

তোমারটাতে কোন অক্ষর নেই। জর্জ বলল–তার ধারণা তুমি তোমার নাম ভুলে যেতে পার না। আমরা বুদ্ধ নই। আমরা জানি আমাদেরকে ফ্লেভ এবং জর্জ বলা হয়।

কী ব্যাপার, এত হইচই কিসের? পার্সি উইসলি বিরক্ত স্বরে দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললো। তারও উপহারের প্যাকেট খোলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তার হাতেও একটা জাম্পার। ফ্রেন্ড তার জাম্পারটা কেড়ে নিল।

প্রিফেক্ট লিখতে পি। পার্সি এদিকে এসো। আমরা সবাই আমাদের জাম্পার পরেছি। হ্যারিও একটা পরেছে।

না, আমি পরব না। পার্সি বলল।

উইসলি যমজ দুভাই পার্সিকে চশমা পরা অবস্থায় জাম্পার পরাতে গেল। তার চশমাটা বাঁকা হয়ে গেল।

আজ তো তুমি প্রিফেক্টদের সাথে বসছ না। জর্জ বলল–বড়দিনের অনুষ্ঠান তো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান।

***

হ্যারি তার জীবনে বড়দিনের কোন ভোজে যোগ দেয়নি। একশটি তরতাজা টার্কির রোস্ট, অফুরন্ত সেদ্ধ আলু, মাখন দেয়া মটরশুটি এবং সুস্বাদু সস। একটু পর পরই বিকট আওয়াজে বোমা ফুটছে।

এই অদ্ভুত আতশবাজির সাথে মাগলদের আতশবাজির কোন তুলনা হয় না। ডার্সলি প্লাস্টিকের খেলনা এবং পাতলা কাগজের হ্যাটের সাথে সেসব আতশবাজি ক্রয় করে থাকেন। ফ্রেডের সাথে হ্যারি জাদুকরের আতশবাজি ফোটালো। এটা শুধু শব্দ করেনি, কামানের মতো বিকট আওয়াজ করেছে। কালো ধোঁয়া তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। আর ভেতর থেকে বিস্ফোরিত হলো একটা রিয়ার এ্যাডমিরালের হ্যাট ও কয়েকটা প্রাণী, সাদা ইঁদুর। উঁচু টেবিল ডাবলডোর তার হ্যাটটা ফুলের তোড়ার ওপর রেখে ফ্লিটউইকের সাথে আনন্দ কৌতুক করছেন।

ভোজনের পর এলো পুডিং। পার্সি তার দাঁত খোয়াতে বসেছিল প্রায়। হ্যারি লক্ষ্য করে দেখল–মদ চাইতে চাইতে হ্যাগ্রিডের চেহারা ক্রমশ লাল হচ্ছে। হ্যারি অবাক হয়ে দেখল হ্যাগ্রিড অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের চিবুকে চুমো খাচ্ছেন। ম্যাকগোনাগল লজ্জায় লাল হয়ে হাসলেন। তার হ্যাটটা তেরচা হয়ে গেছে।

হ্যারি যখন সবশেষে টেবিল ত্যাগ করল তখন তার ওপর এক বোঝার ভার। অদাহ্য তারাবাতি, বেলুন ও টুকটাক জিনিস। তার জাদুর নিজস্ব দাবার সেট। সাদা ইঁদুর অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং হ্যারির মনে এক বাজে চিন্তা এল যেন তাদের দশা হবে মিসেস নরিসের বড়দিনের ভোজের মত।

হ্যারি আর উইসলি যমজ দুই ভাই মাঠে বরফ নিয়ে খেলা করে একটি সুন্দর বিকেল কাটাল। ঠাণ্ডা, ভিজে অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে তারা তিনজন শরীরকে গরম করার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজের কমন রুমে ফিরে এলো। হ্যারি দাবা খেলায় রনের কাছে গো–হারা হারল। হ্যারির ধারণা–পার্সি যদি রনকে এত সাহায্য না করত তাহলে খেলার ফলাফল এরূপ হতো না।

তারপর চায়ের সাথে এলো টার্কি স্যান্ডউইচ, বড়দিনের কেক ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এটাই ছিল হ্যারির জীবনে সর্বোত্তম বড়দিন পালন। বিছানায় শুয়ে সে পাশ থেকে অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা বের করার চেষ্টা করল। এটা তার বাবা ব্যবহার করেছেন। রেশমের চেয়ে কোমল। এত হালকা যে বাতাসে ওড়ে। চিরকুটে লেখা ছিল-এটার সঠিক ব্যবহার কর।

এই পোশাকটার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তাকে এখন পোশাকটা পরতে হবে। পোশাকটা পরে সে বিছানা থেকে নামল। তার পায়ের সামনে জ্যোৎস্না খেলা করছে।

পোশাকটা পরার পর হ্যারির সমস্ত সত্তা নতুন করে জেগে উঠল। সম্পূর্ণ হোগার্টস তার সামনে উপস্থিত হলো। অন্ধকার আর নীরবতায় দাঁড়িয়ে নিজেকে মহানায়ক ভাবতে হ্যারির খুব ভালো লাগছিল। এ পোশাক পরে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারে। কেয়ারটেকার ফিলচও কিছুই জানতে পারবেন না।

রন ঘুমিয়েছিল। হ্যারি ভাবছিল তাকে জাগাবে কিনা। পরে সে ভাবল রনকে জাগানো ঠিক হবে না। তার বাবার পোশাকের সাথে কাউকে সঙ্গী করা ঠিক হবে না। সে ঠিক করল একাই পোশাকটা ব্যবহার করবে।

সে ডর্মিটরি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। কমনরুম দিয়ে বেরিয়ে দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

ওখানে কে? মোটা মহিলাটি প্রশ্ন করল–হ্যারি কোন জবাব দিল না। সে তাড়াতাড়ি করিডোর পেরিয়ে নিচে নামল।

সে কোথায় যাবে? সে দাঁড়াল। তার বুক কাঁপছে। এখন সে সেই স্থানটিতেই আসল–লাইব্রেরির নিয়ন্ত্রিত অংশ। হ্যারি এবার জানতে পারবে, পড়তে পারবে ফ্লামেল কে ছিলেন। অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে সে হাঁটতে লাগল।

লাইব্রেরির ভেতরে ছিল ভুতুড়ে অন্ধকার। হ্যারি একটা প্রদীপ জ্বাললো।

নিয়ন্ত্রিত শাখাটা ছিল লাইব্রেরির ঠিক পেছনের ডানদিকে। দড়ির ওপর দিয়ে হ্যারি সতর্কভাবে হাঁটতে লাগল। দড়িটা বইগুলোকে মূল লাইব্রেরি থেকে পৃথক করে রেখেছিল। হ্যারির খুব একটা লাভ হলো না। বইয়ের মুছে যাওয়া, মলিন হয়ে যাওয়া স্বর্ণাক্ষরের লেখা হ্যারি বুঝতে পারেনি কারণ সেগুলো ছিল ভিন্ন ভাষায়। কোনও কোনও বইয়ে নামও ছিল না। একটা বই দেখে হ্যারি শিউরে উঠল। মনে হয় রক্তমাখা। হয়ত তার মনের ভুল। কে যেন ফিসফিস করছে। হয়ত বা শোনার ভুল। হঠাৎ নিচের রকে একটা মোটা বই নজরে পড়ল। কালো চামড়ায় রূপালী লেখা। বেশ ভারী। কোলের ওপর নিয়ে হ্যারি বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগল।

আরে একি। বইটা যেন আর্তনাদ করছে। অস্ফুট চাপা আর্তনাদ। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার প্রদীপটা পড়ে গেল। চারদিক আবার অন্ধকার। আরও ভয় পেয়ে গেল হ্যারি। কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

দৌড়ে পালাতে গিয়ে হ্যারি দেখল অধ্যাপক স্নেইপ ও কেয়ারটেকার ফিল। তারা অবশ্য হ্যারিকে দেখতে পাননি। পথটা ছিল খুবই সরু। সে পথে গেলে এঁদের দুজনের সাথে ধাক্কা লাগবেই। পোশাক তাকে অদৃশ্য করতে পারলেও তার শারীরিক অবয়বকে অদৃশ্য করতে পারবে না।

হ্যারি দৌড় শুরু করল।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে মালখানায় এসে পৌঁছল।

এতক্ষণ পালাবার সময় তার খেয়ালই ছিল না, সে কোন দিকে যাচ্ছে। চারদিক অন্ধকার থাকায় সে এটাও ঠাহর করতে পারেনি যে, সে এখন কোথায় আছে।

শুনতে পেল, প্রফেসর, আপনার কাছে সরাসরি চলে আসার জন্য আমাকে বলেছিলেন। যাতে রাতে কেউ লাইব্রেরিতে আসে কিনা সেটা দেখা যায়। মনে হয় লাইব্রেরির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কেউ না কেউ আছে।

হ্যারির মনে হলো তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে যেখানেই যাবে ফিলচ তা জানতে পারবে। তার কণ্ঠস্বর খুব কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে। ভীত হ্যারি শুনতে পেল যে অধ্যাপক স্নেইপ কথার জবাব দিচ্ছেন।

নিয়ন্ত্রিত এলাকা? এটা তো খুব দূরে নয়। যেই আসুক তাকে আমরা ধরতে পারব।

হ্যারি দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। অধ্যাপক স্নেইপ ও কেয়ারটেকার ফিলচ তার সামনে দিয়ে গেলেও তাকে দেখতে পেল না। আহ্, খুব বাঁচা গেছে। হ্যারি মনে মনে ভাবল।

হ্যারি একটু এগোতেই তার সামনে একটা দরোজা খুলে গেল। দরোজা দিয়ে সে ভেতরে চলে ঢুকলো। অধ্যাপক স্নেইপ ও ফিলচের দৃষ্টি এড়িয়ে হ্যারি একটি কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। আরো একটু আগে বেড়ে যে কক্ষে প্রবেশ করল। দেখে মনে হলো সেটা একটা পরিত্যক্ত ক্লাসরুম!

ডেস্ক আর চেয়ারগুলো দেয়ালের পাশে স্তূপ করে রাখা। ওয়েস্ট পেপারের বাস্কেটগুলো উলটিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর হ্যারি যে জিনিসটার ওপর দৃষ্টি দিল সেটা ক্লাসরুমের অংশ মনে হলো না। মনে হলো বাইরে থেকে কেউ এনে এখানে বসিয়ে দিয়েছে।

সিলিংয়ের সমান উঁচু একটি আয়না। সোনার ফ্রেমে বাঁধা। আয়নার চারদিকে খোদাই করে লেখা-এরিসেড স্ত্রা এহরু অয়েত উবে কাফ্রু অয়েত অন ওহসি।

এতক্ষণে হ্যারির ভয় কেটে গেছে। ফিলচ আর স্নেইপেরও কোন সাড়াশব্দ নেই। নিজেকে দেখার জন্য হ্যারি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কোন প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না। সে আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

ভয়ে চিৎকার বন্ধ করার জন্য হ্যারি নিজের মুখে হাত হাত চেপে ধরলো। সে যখন আয়নার দিকে তাকাল তখন সে শুধু নিজেকেই দেখল না দেখল বিশাল জনতা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ হ্যারি যে কক্ষে দাঁড়িয়েছিল সে কক্ষটি ছিল সম্পূর্ণ খালি। দ্রুত নিশ্বাস নিতে নিতে হ্যারি আবার আয়নায় তাকাল।

হ্যারি আয়নায় অন্তত আরো দশটি মানুষের প্রতিবিম্ব দেখল। সে ঘাড় নাড়িয়ে এদিক–সেদিক তাকাল। না কেউই তো নেই। তাহলে আয়নায় যাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে তারা কি সবাই অদৃশ্য।

হ্যারি আবার আয়নায় তাকাল। আয়নায় দেখা গেল একজন মহিলা ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। হ্যারি ভাবল-এই মহিলা যদি সত্যিই সত্যিই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে তার হাতের ছোঁয়া হ্যারি তার ঘাড়ে অনুভব করবে না, তেমন কিছু ঘটল না। তাহলে তাদের অস্তিত্ব কি কেবলই আয়নার মধ্যেই।

মহিলাটি খুবই সুন্দরী। তার ঘন লাল চুল। তার চোখ দুটি হ্যারির চোখের মত। চেহারাও অনেকটা হ্যারির মতো। হ্যারি আয়নাতে দেখল

মহিলা চিৎকার করছেন আবার হাসছেন আবার কাঁদছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন পুরুষ, ভদ্রলোকের চোখে চশমা। তিনি তার বাহু দিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলেন। লোকের চুল ছিল একটু এলোমেলো। হ্যারি আয়নার এত কাছে এলো যে, তার নাক আয়না স্পর্শ করল।

মা হ্যারি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল।

একটু পর আবার উচ্চারণ করল–বাবা।

তাঁরা দুজনেই স্মিতহাস্যে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি আয়নায় অন্য এক মানুষের প্রতিবিম্বও দেখল। তাকে ভাল করে লক্ষ্য করে হ্যারি, তার মত গাঢ় সবুজ দুই চোখ, তার মত নাক, খাটো বৃদ্ধ মানুষটার হাঁটু হ্যারির মতো। হ্যারি এই প্রথমবারের মতো তার পরিবারকে দেখতে পেল।

হ্যারির বাবা–মা স্মিতহাসিতে তার দিকে তাকালেন এবং হাত নেড়ে হ্যারিকে অভিনন্দন জানালেন। হ্যারি ক্ষুধার্ত মানুষের মতো আয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু বাবা–মার সাথে করমর্দন করা গেল না। চরম আনন্দ আর প্রচণ্ড ক্ষোভ হ্যারিকে একাকার করে ফেলল।

হ্যারি এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তা সে বলতে পারবে না। একটা আচ্ছন্নতা তাকে ঘিরে ছিল। দীর্ঘসময় তার ঘোরের ভেতর কাটল। দূর থেকে শোরগোল শুনে হ্যারির চেতনা ফিরে এলো।

এখানে তো আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। তাকে ডর্মিটরিতে ফিরে যেতে হবে। ইচ্ছে না হলেও এখান থেকে তাকে বেরুতে হবে। মায়ের চেহারা থেকে হ্যারি তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অস্ফুট কণ্ঠে হ্যারি বলল–আমি আবার আসব। এই বলে হ্যারি সেখান থেকে বিদায় নিল।

*****

তুমি তো আমাকে জাগাতে পারতে। অনুযোগের স্বরে রন হ্যারিকে বলল।

তুমি আজ রাতে যেতে পারো। আমি আজও যাব। আমি তোমাকে সেই আয়নাটা দেখাতে চাই।

আমি তোমার বাবা–মাকে দেখতে চাই। রন আগ্রহের স্বরে বলল।

আর আমি তোমার পরিবারের সবাইকে দেখতে চাই। উইলি পরিবারের সবাইকে। তুমি আমাকে তোমার অন্যান্য ভাই ও তোমার পরিবারের সবাইকে দেখাবে। হ্যারি বলল।

তুমি যখনই খুশি তাদের দেখতে পারো। রন বলল–তুমি এই গ্রীষ্মকালে আমার সাথে আমার বাড়িতে এসো। সত্যি লজ্জাজনক যে আমরা ফ্লামেলের বিষয়টা ভুলেই গেছি। জানতে পারিনি। আরো কিছু খাবার মাও। একি, তুমি খাচ্ছ না কেন?

আসলে হ্যারি খেতে পারছিল না। তার বাবা–মার চেহারা বার বার তার চোখে ভাসছে। সে ফ্লামেলের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিল। কারণ এখন ফ্লামেল তার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিন মাথা কুকুরও এখন তার ভাবনার বিষয় নয়। আর অধ্যাপক স্নেইপ যদি কোন কিছু চুরি করেই থাকেন তাতে হ্যারির কী আসে যায়।

তুমি ঠিক আছ তো? রন তাকে জিজ্ঞেস করে। তোমাকে খুব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।

***

হ্যারি মনে মনে ভয় পাচ্ছিল–আরেকবার গিয়ে যদি আয়নাটি না পাওয়া যায়।

রন আর হ্যারি অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে তাদের অভিযানে বেরুল। লাইব্রেরি থেকে বেশ ধীরে ধীরে তারা এগুতে থাকল। তারা আগের পথ ধরেই অন্ধকারে প্রায় আধঘণ্টা কাটাল।

আমি বরফে জমে যাচ্ছি। রন বলল।

কোন কথা বলবে না। হ্যারি বলল–আমি জানি এটা এখানে কোথাও হবে।

উল্টোদিক থেকে আসা একটা ডাইনি পেত্নীকে তারা অতিক্রম করল। এছাড়া তারা কোন লোকজন দেখতে পেল না। হ্যারি অস্ত্রভাণ্ডার ঘরটা শনাক্ত করে বলল-এটা এখানে।

দরোজা ধাক্কা দিয়ে তারা দুজনে ভেতরে ঢুকলো। ঘাড় থেকে অদৃশ্য হবার পোশাকটা নামিয়ে হ্যারি আয়নার দিকে তাকাল।

তারা দুজনেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। হ্যারির বাবা–মা উৎফুল্ল হলেন।

তাকিয়ে দেখ। নিচু হয়ে হ্যারি রনকে বলল।

রন জবাব দিল–আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

ভালো করে দেখ। এখানে সবাই আছে। হ্যারি বলল।

আমি তো কেবল তোমাকে দেখছি। রন বলল।

ভালো করে দেখ। আমি যেখানে আছি সেখানে এসে দাঁড়াও।

হ্যারি সরে দাঁড়াল।

রন আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালে সে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

রন হতবুদ্ধি হয়ে তার নিজের ছায়ামূর্তি দেখছিল। হ্যারি বলল আমার দিকে তাকাও।

তুমি দেখতে পাচ্ছ তোমাদের পরিবারের সবাই তোমার চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে।

না, আমি কিছুই দেখছি না। এখানে আমি একা। আমাকে একটু বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে। আমি এখন হেডবয়।

তুমি কি বললে?

বিল যে ধরনের ব্যাজ পরে আমি এখন সে ধরনের ব্যাজ পরে আছি। আমার হাতে হাউজক্যাপ আর কিডিচ ক্যাপ। আমি কিডিচ খেলায় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছি।

এই চমৎকার দৃশ্য থেকে রন তার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল। তারপর উত্তেজিতভাবে সে হ্যারিকে বলল–তুমি কি মনে কর এই আয়না ভবিষ্যৎ বলতে পারে?

আয়না কী করে বলবে। হ্যারি জবাব দিল–

হ্যারি নিজে আয়না দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সে রনকে বলল,

আমার পরিবারের কেউ তো আর বেঁচে নেই। আমাকে আরেকবার আয়নাটি দেখতে দাও।

গত রাতে তো তুমি একাই দেখেছ। আজ তুমি আমাকে একটু বেশি সময় দাও।

তুমি তো কিডিচ কাপ হাতে ধরে নিজেকে দেখেছে। এর মধ্যে মজাটা কি? আর আমি আমার বাবা–মাকে দেখতে চাই। হ্যারি বলল।

আমাকে সরিয়ে দিও না।

বাইরের করিডোরে একটি শব্দ শুনে কথা বলা বন্ধ করলো ওরা। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি যে তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল।

তাড়াতাড়ি পালাও।

ওরা অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেলো। মিসেস মরিসের জ্বলজ্বলে চোখ তখন দরোজার ওপর। হ্যারি আর রন দুজনেই দাঁড়িয়ে ভাবছিল-এই অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা কি বিড়ালের ওপরও কাজ করে। তাদের মনে হলো তারা এখানে এক যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস নরিস ঘুরে দাঁড়ালেন এবং ঘর ত্যাগ করলেন।

এটা মোটেও নিরাপদ নয়। তিনি ফিলচকে বলতে পারেন, আমি বাজি ধরে বলতে পারি তিনি আমাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছেন। এসো। রন হাত ধরে হ্যারিকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল।

***

পরদিন সকালে তখনও বরফ ভালোভাবে গলেনি।

হ্যারি, দাবা খেলবে নাকি? রন জিজ্ঞেস করে।

না। হ্যারি বলে।

তাহলে চল হ্যাগ্রিডকে দেখে আসি। রন আবার বলল।

না, যাব না। তুমি যাও।

আমি জানি তুমি কি চিন্তা করছ। হ্যারি, আজ রাতে আর ওখানে যেও না। রন বলল।

কেন যাব না? হ্যারি প্রশ্ন করে।

রন বলল–আমি ঠিক বলতে পারবো না, কিন্তু আমি সামনে বিপদ আশঙ্কা করছি। তুমি কয়েকবারই অল্পের জন্য বেঁচে গেছ। কেয়ারটেকার ফিলচ, অধ্যাপক স্নেইপ আর মিসেস নরিস সবাই তোমার ওপর নজর রাখছেন। তারা তোমাকে দেখতে না পেলেও তোমার আশেপাশেই ছিলেন। যদি হঠাৎ তারা তোমাকে দেখে ফেলেন।

তুমি দেখি হারমিওনের মত কথা বলছ। হ্যারি হেসে বলে।

হ্যারি, আমি তোমার ভালোর জন্যই কথাটা বলছি। আজ তুমি ওখানে যেওনা।

আয়নার কাছে যাবার জন্য হ্যারি অস্থির হয়ে পড়ল। রন তাকে ফেরাতে পারল না। তৃতীয় রাতে হ্যারি আরো তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছল। সে দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছিল বলে শব্দ হচ্ছিল। এত জোরে শব্দ করা ঠিক নয় জেনেও হ্যারি নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারেনি। তবে সে আশেপাশে কাউকেই দেখে নি।

এবারও হ্যারি আয়নায় তার বাবা–মার স্মিত হাসি দেখল। শুধু তাই নয়, তার একজন দাদাও তাকে সম্বোধন করল। হ্যারি আয়নার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল। তার মনে হল, সে সারারাত এখানে কাটিয়ে দিতে পারে। এমন সময় পেছন থেকে শব্দ শোনা গেল–হ্যারি তুমি আবার এখানে এসেছ?

হ্যারির অন্তরাত্না বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হ্যারি পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে, তার ঠিক পেছনেই ডেস্কে বসে আছেন অধ্যাপক ডাম্বলডোর। হাঁটার সময় তাকে অতিক্রম করলেও তাড়াহুড়ার কারণে সে তাকে লক্ষ্য করেনি।

আত্নপক্ষ সমর্থন করে হ্যারি আমতা আমতা করে বলল–স্যার, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি।

আশ্চর্য। অদৃশ্য হতে গিয়ে তুমি যে চোখে কম দেখছো–তা বুঝতে পারনি। ডাম্বলডোর বললেন। ডাম্বলডোরকে মুচকি হাসতে দেখে হ্যারি অনেকটা আশ্বস্ত হলো। না, ভয়ের কারণ নেই।

তাহলে ডেস্ক থেকে নেমে অধ্যাপক ডাম্বলডোর হ্যারির পাশে মেঝেতে বসে বললেন–তোমার আগে বহুলোক এরিসেডের আয়নার আনন্দ উপভোগ করেছে।

স্যার আমি এটার নাম জানতাম না। হ্যারি বলল।

এটা কি কাজ করে–তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন।

এটা–হা স্যার আমার পরিবারকে দেখিয়েছে।

এবং তোমার বন্ধু রনকে হেডবয় হিসেবে দেখিয়েছে।

কি করে জানলেন?

অদৃশ্য হবার জন্য আমার কোন পোশাক লাগে না। তুমি কি এখন বলতে পার এরিসেডের আয়না আমাদেরকে কি দেখায়।

হ্যারি মাথা নেড়ে না বলল।

অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–ঠিক আছে। আমি বলছি। পৃথিবীতে যিনি সবচে সুখী ব্যক্তি তিনিই এ আয়নাটি স্বাভাবিক আয়না হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি ঠিক যেমন–আয়নাতে ঠিক তেমনি দেখতে পাবেন। এতে কি কোন লাভ হয়?

হ্যারি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আস্তে আস্তে বলল–আমরা যা চাই বা যা কিছুই চাই–তা এ আয়নায় দেখা যায়।

তুমি যা বলেছ তা সত্যি আবার সত্যিও নয়, ডাম্বলডোর বললেন আমাদের হৃদয়ের পরম ইচ্ছে এই আয়নায় দেখা যায়। এই যে তুমি, এতদিন তোমার পরিবারের কাউকে দেখতে পাওনি। এখন আয়নায় তাদের দেখতে পেয়েছ। তুমি তোমার বাবাকে দেখতে পেয়েছ। তবে কি জান, এই আয়না কোন জ্ঞান দিতে পারে না বা সত্য জানাতে পারে না। এর আগে বহুলোক এই আয়নার দিকে তাকিয়ে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। আয়নায় যা দেখা যাচ্ছে তা বাস্তব বা সম্ভব কিনা–বিষয়টা তার ভেবে দেখেনি।

ডাম্বলডোর আরো বললেন–আগামীকালই আয়নাটি অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে। আবারও আয়নাটি দেখতে আমি তোমাকে বারণ করব। এরপরও যদি তুমি যাও তোমার ক্ষতি হতে পারে। এ কথাটা মনে রেখো। এই আয়না কোন স্বপ্নের কথা বলে না। এই আয়না কাউকে কিছু ভোলাতে পারে না। বুঝেছ? এখন তোমার অদৃশ্য হওয়ার পোশাক খুলে ঘুমুতে যাও।

হ্যারি উঠে দাঁড়াল।

স্যার, প্রফেসর ডাম্বলডোর, আমি কি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?

ডাম্বলড়োর বললেন, তুমি তো এই মাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছ। ঠিক আছে, কর।

আপনি যখন আয়নার দিকে তাকান তখন আপনি কি দেখতে পান। হ্যারি প্রশ্ন করল।

আমি দেখি আমি এক জোড়া পশশী মোজা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অধ্যাপক ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। হ্যারি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন-একজন লোকের অনেক মোজা থাকে। আরেক বড়দিন এসে চলেও গেল। এই বড়দিনেও আমি একজোড়া মোজা উপহার পাইনি। সবাই আমাকে বই উপহার দিয়েছে।

যখন হ্যারি বিছানায় ঘুমোতে গেল তার মনে হল অধ্যাপক ডাম্বলডোর তাকে পুরোপুরি সতা কথা বলেননি। হ্যারি যে প্রশ্নগুলো করেছিল তা অবশ্য ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত।

 ১৩. নিকোলাস ফ্লামেল

অধ্যাপক ডাম্বলডোরের পরামর্শের পর হ্যারি আর সেই আয়নার কাছে যায়নি। তাই তার অদৃশ্য হওয়ার পোশাক বড়দিনের ছুটিতে তার ট্রাংকের মধ্যে রয়ে গেল। তবু হ্যারি চেষ্টা করেও সেই আয়নার কথা ভুলতে পারে না। প্রতি রাতে সে দুঃস্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্নে দেখে তার বাবা মা, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তা অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর অট্টহাসির শব্দ।

রন বলল–অধ্যাপক ডাম্বলডোর ঠিকই বলেছেন। এই আয়না মানুষকে পাগল করে দিতে পারে।

ক্লাস শুরু হবার আগে গতকালই হারমিওন ফিরে এসেছে। সে বিষয়টা অন্য দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করল। হ্যারি পর পর তিন রাত বিছানায় না থেকে আয়না দেখতে গিয়েছে-একথা শুনেই সে শিউরে উঠল। সে শঙ্কিত, যদি কেয়ারটেকার ফিলচ দেখে ফেলত তা হলে কি হত। নিকোলাস ফ্লামেলের ব্যাপারে কোন তথ্য সংগৃহীত না হওয়ায় সেও হতাশ।

ফ্লামেল সম্পর্কে জানার ব্যাপারে হ্যারি এখনও হাল ছাড়েনি। লাইব্রেরিতে অনেক বই খোঁজাখুঁজি করেও তারা ফ্লামেলের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। তবে ব্যারির মনে পড়ছে সে কোথায় যেন ফ্লামেলের নাম পড়েছে।

ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় এখন তাদের হাতে আগের মত সময় নেই। প্রতিদিন বিরতির সময় তারা লাইব্রেরিতে বই খোঁজে। দুজনকেই খুঁজতে হচ্ছে। কারণ কিডিচ প্রতিযোগিতার জন্য হ্যারিকে অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে। দলের জন্য উড় এখন দ্বিগুণ পরিশ্রম করছে। লাগাতার বৃষ্টি সত্ত্বেও উডের উৎসাহে কোন ভাটা পড়ল না। উইসলি ভাইয়েরা উডের অতি উৎসাহের বিরুদ্ধে আপত্তি করলেও হ্যারি ছিল উডের পক্ষে। তাদের পরবর্তী খেলা হাফলপাফ হাউজের বিরুদ্ধে। এ খেলায় যদি জেতা যায় তাহলে গ্রিফিল্ডর হাউজ স্লিদারিন হাউজের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। খেলার অনুশীলন শুরু হওয়ার পর থেকে হ্যারির দুঃস্বপ্নও কমে গেল। খেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সময় নাই তার।

কর্দমাক্ত মাঠে অনুশীলন চলছে। একদিন উড় রন আর তার ভাইয়ের ওপর খুব ক্ষেপে গেল। কারণ তারা ডাইভিং বোমা ও ঝাড়ু থেকে পড়ে যাবার ভান করেছিল।

উড চেঁচিয়ে বলল–তোমরা কি ফাজলামি বন্ধ করবে। এসব করলে তো খেলায় জেতা যাবে না। মনে রাখবে, এবার রেফারি হবেন অধ্যাপক স্নেইপ। তিনি অজুহাত পেলেই গ্লিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কেটে নেবেন। একথা শুনে জর্জ ওয়েসলি সত্যি সত্যিই ঝাড়ু থেকে পড়ে গেল।

জর্জ বলল, অধ্যাপক স্নেইপ রেফারি? এর আগে কি কোন খেলায় তিনি রেফারি ছিলেন? আর তিনি রেফারি হলে খেলা তো তিনি নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করবেন না।

উড বলল-এখানে আমার কিছুই করার নাই। আমাদের ভালো খেলতে হবে। তাহলেই স্নেইপ কোন অজুহাত খুঁজে পাবেন না।

হ্যারি চায় না যে সে যখন খেলবে তখন স্নেইপ সেখানে থাকুন। এর পেছনে আরেকটি কারণ আছে…।

অনুশীলন শেষে খেলোয়াড়রা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন রন আর হারমিওনের সাথে দাবা খেলার জন্য হ্যারি সরাসরি গ্রিফিল্ডর হাউজের কমনরুমে চলে এল। সেখানে হারমিওন ও রন দাবা খেলছিল।

দাবা খেলায় হারমিওনকে হারানো কঠিন। হ্যারির ও রন মনে করে হারমিওনের জন্য এই খেলাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত। হ্যারি রনের পাশে গিয়ে বসতেই রন বলল, এখন আমার সাথে কথা বলবে না, আমার মনযোগ নষ্ট হবে বলেই হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারিকে খুব চিন্তিত দেখে রন নিজেই কথা বলল–কি ব্যাপার, তুমি এত কী ভাবছ?

হ্যারি খুব শীতলকণ্ঠে বলল–চক্রান্ত করে স্নেইপ কিচি প্রতিযোগিতার রেফারি হয়েছেন।

তাহলে তুমি খেলো না। হারমিওন বলল।

তুমি বল তুমি অসুস্থ। রন পরামর্শ দিল।

তুমি ভান কর তোমার পা ভেঙে গেছে। হারমিওন বলল।

সত্যি সত্যিই পা ভেঙে ফেল। রন পরামর্শ দিল।

হ্যারি বলল-এটা তো সম্ভব নয়। আমাদের দলে কোন রিজার্ভ খেলোয়াড় নেই। আমি না থাকলে গ্রিফিল্ডর হাউজ খেলতেই পারবে না।

ঠিক এ সময়ে নেভিল ঘরে প্রবেশ করল। সে কীভাবে প্রতিকৃতির গর্ত দিয়ে এত ওপরে উঠল কেউ সেটা বলতে পারবে না, কারণ তার পা ছিল অভিশপ্ত। দুপা জোড়া লাগা। নিশ্চয়ই সে ব্যাঙ-এর মত লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছে।

নেভিলকে দেখে সবাই হাসলেও হারমিওন হাসল না। হারমিওন তাকে প্রতি–অভিশাপ দিলে তার পা দুভাগ হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে সে পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াল।

কি হয়েছিল? হারমিওন তাকে হ্যারি আর রনের পাশে বসবার সময় জিজ্ঞেস করল।

নেভিল বলল–লাইব্রেরির বাইরে ম্যালফয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। সে অনুশীলনের জন্য একজনকে খুঁজছিল।

তুমি এখনই বিষয়টা অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলকে জানাও।

নেভিল মাথা নেড়ে বলল–আমি সেটা পারব না। তাহলে আরো ঝামেলা হবে।

তাকে তোমার মোকাবিলা করতে হবে। রন নেভিলকে বলল–সে সবার মাথার ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে। সে যা করবে তার সব মেনে নেব, তা হতে পারে না।

আমি তা পারব না। আমাকে বলার দরকার নেই যে গ্রিফিরে থাকার মত সাহস আমার নেই। নেভিল বললো।

হ্যারি তার জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চকোলেট ফ্রগ বের করল। হারমিওন তাকে বড়দিনের উপহার হিসেবে যে বাক্সটা পাঠিয়েছিল এটাই ছিল সে বাক্সের শেষ চকোলেট ফ্রগ। হ্যারি এটা নেভিলকে দিলে সে খুশিতে আত্মহারা হলো।

হ্যারি বলল–ম্যালফয়কে এত ভয় পাও কেন, তুমি বারোজন ম্যালফয়ের সমান। তোমার কি মনে নেই সেই হ্যাটটা তোমার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজ নির্বাচিত করেছিল আর ম্যালফয়ের জন্য করেছিল স্লিদারিন হাউজ?

চকোলেট ফ্লগের প্যাকেট খুলতে খুলতে নেভিলের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল।

ধন্যবাদ হ্যারি… আমি এবার ঘুমোতে যাচ্ছি… ও তুমি তো কার্ড জমাও, এই কার্ডটা নাও। সে চকোলেট ফ্লগের প্যাকেটের কার্ডটা হ্যারিকে দিল। নেভিল চলে গেলে হ্যারি কার্ডটা দেখল।

আর ডাম্বলডোর। হ্যারি মন্তব্য করল।

হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আবার সে কার্ডের পেছনে দেখতে লাগল। সেখানে কার্ডের জাদুকর সম্পর্কে তথ্য থাকে।

তারপর হ্যারি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–পেয়েছি। আমি পেয়েছি। নিকোলাস ফ্লামেলকে পেয়েছি। ১৯৪৫ সালে একটা জাদু প্রতিযোগিতায় অধ্যাপক ডাম্বলডোর তার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

হারমিওন লাফ দিয়ে উঠল। হোমটাস্কের প্রথম অংশের মার্ক পাওয়ার পর হারমিওনকে আর কখনো এত উত্তেজিত দেখা যায়নি। তোমরা এখানেই থাকো। এই বলে হেমিওন সিঁড়ি দিয়ে উঠে মেয়েদের ডর্মিটরিতে চলে গেল। হ্যারি আর রন দৃষ্টি বিনিময় করার পূর্বেই সে বিশাল মোটা একটা বই হাতে ফিরে এল।

হারমিওন বলল-এ বইটা আমি কয়েক সপ্তাহ আগে লাইব্রেরি থেকে এনেছিলাম, কিন্তু পড়ার সময় পাইনি। তারপর হারমিওন রহস্যময় সুরে বলল–নিকোলাস ফ্লামেল কে জানো? ফ্লামেল হচ্ছে আমাদের জানা লোকদের মধ্যে পরশমণির একমাত্র আবিষ্কারক।

পরশমণি?

হ্যাঁ, পরশমণি। ফিলজোফার্স স্টোন।

সেটা কি?

আগে বইয়ের এ জায়গাটা পড়।

হ্যারি আর রন পড়তে লাগল। লেখা আছে–

রসায়নশাস্ত্রের প্রাচীন গবেষণায় যা পাওয়া গেছে
তা হলো ফিলোসফারস স্টোন-এ রয়েছে
কিংবদন্তী মর্মবস্তু, বিস্ময়কর ক্ষমতা
যেকোন ধাতু সোনা হয়ে যাবে ছোঁয়ালে
সে পরশ পাথর; এ পাথর জীবনের অমরত্ব সুধা
যে পান করবে সে হবে চিরঞ্জীব।

ফিলোসফারস স্টোন নিয়ে বহু গল্প শুনেছি
শতকের পর শতক; কিন্তু এখন একটি পাথরই
আছে নিকোলাস ফ্লামেলের কাছে
যিনি নিজেও একজন রসায়নবিদ ও অপেরা প্রেমিক
যিনি গত বছর তার ৬৬৫তম জন্মদিন পালন
করেছেন; যিনি ডিভোন-এ সস্ত্রীক যাপন করেন
ধীরস্থির জীবন বর্ষব্যাপী (ছয়শত আটান্ন)।

রন ও হ্যারির পড়া শেষ হলে হারমিওন বলল–আমার ধারণা ওই কুকুরটাই ফ্লামেলের পরশমণি পাহারা দিচ্ছে। এটা ডাম্বলডোরেরও দায়িত্ব বটে। তারা দুজনে বন্ধু। তাই তিনি চান এটা গ্রিংগট থেকে বাইরে থাকুক।

হ্যারি বলল–যে পাথর সব ধাতুকে সোনা করে, মানুষকে অমর করে, এমন একটি পাথরের পেছনে স্নেইপ তো ছুটবেনই। এতে আশ্চর্যের কী আছে। যেকোন লোকই এই পাথরের পেছনে ছুটবে।

রন বলল–বইটাতে উল্লেখ আছে নিকোলাস ফ্লামেল সম্প্রতি তার ৬৬৬তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছেন।

পরদিন কালো জাদুর ক্লাসে ক্লাস লেকচার নোট করার সময়ও হ্যারি আর রন ভাবছিল যদি একটা পরশমণি পেয়ে যায় তাহলে তারা কী করবে। রম বলল–আমি নিজে একটা কিডিচ দল কিনে ফেলব। ব্যারির মনে পড়ল শিগগিরই কিডিচ প্রতিযোগিতা হবে যেখানে স্নেইপ রেফারি থাকবেন।

আমি খেলব। রন আর হারমিওনকে হ্যারি বলল। আমি যদি না খেলি তাহলে দিারিন হাউজের খেলোয়াড়গণ মনে করবে আমি খেলতে ভয় পাচ্ছি। আমরা যদি জিতি তাহলে তাদের মুখের হাসি শুকিয়ে যাবে।

যতক্ষণ না আমরা তোমাকে মাঠ থেকে তুলে আনছি। হারমিওন ফোড়ন কাটলো।

প্রতিযোগিতার সময় যতই ঘনিয়ে এল হ্যারি ততই অস্থির হয়ে উঠল। দলের মধ্যেও অস্থিরতা বাড়ছে। স্লিদারিনদের বিরুদ্ধে হাউজ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা গৌরবের বিষয়। গত সাত বছরে কেউ ওদের থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ নিতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো–পক্ষপাতদুষ্ট রেফারির কাছে কি নিরপেক্ষ খেলা পরিচালনা আশা করা যায়?

এসব হ্যারির কল্পনা না সত্যি, তা সে জানে না। শুধু জানে সে যেখানেই যায় সেখানেই সে স্নেইপের কথা ভাবতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় স্নেইপ তার পিছু লেগেছেন। স্নেইপের ওষুধ তৈরির ক্লাসটা ছিল যেন নরক যন্ত্রণা। শেইপ কি জানেন যে, তারা পরশমুণির সন্ধান পেয়েছে?

***

পরের দিন বিকালে ওরা হ্যারিকে গুডলাক জানিয়ে বিদায় নিল, কিন্তু হ্যারি জানে হারমিওন ও রন ফিরে এসে হ্যারিকে জীবিত দেখতে পাবে কিনা সে ব্যাপারে ওদের সন্দেহ আছে। তবে হ্যারিকে খেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তাই সে কিডিচ খেলার পোশাক পরে নিল এবং নিম্বাস ২০০০ ঝাড়ু হাতে তুলে নিল।

রন ও হারমিওন নেভিলের কাছাকাছি একটা জায়গা করে নিল। নেভিল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ওরা এত গম্ভীর কেন। ওরা দুজন জাদুদণ্ড নিয়ে কেনই বা মাঠে এল তার বোধগম্য হচ্ছিল না। হ্যারিও জানত না যে হারমিওন ও রন স্নেইপের ওপর পা–অচল হওয়ার অভিশাপ প্রয়োগ করবে যদি তিনি রেফারি হিসেবে পক্ষপাতিত্ব দেখান।

ভুলে যেও না-এটা লোকোমোটর মর্টিস। হারমিওন নিচুস্বরে হ্যাবিকে বলল।

রন তার আস্তিনে জাদুদণ্ডটি রেখে বলল–আমি তা জানি। প্রসাধন কক্ষে উড হ্যারিকে পৃথকভাবে নিয়ে বলল–হ্যারি, তোমার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। তবে আমাদের যদি জিততে হয় তাহলে এটাই সুযোগ। অধ্যাপক স্নেইপ পক্ষপাতিত্ব করার আগেই খেলা শেষ করতে হবে। ফ্রেন্ড উইসুলি এসে বলল–স্কুলের সবাই খেলা দেখতে এসেছে। এমন কী অধ্যাপক ডাম্বলডোরও এসেছেন।

ডাম্বলডোর! হ্যারি বিস্মিত কণ্ঠে বলল। একটু পরে নিজে গিয়েই দেখে এল যে ফ্রেড মিথ্যে বলেনি।

হ্যারি অনেকটা স্বস্তি বোধ করল। কারণ ডাম্বলডোর খেলা দেখলে স্নেইপ কোন পক্ষপাতিত্ত্ব দেখাতে পারবেন না এবং হ্যারিকে কোন ক্ষতি করতে পারবেন না।

খেলোয়াড়রা যখন মাঠে নামছে তখন স্নেইপকে খুব ক্ষুব্ধ দেখাল। রন বুঝতে পারল ডাম্বলডোরের উপস্থিতিই তার ক্ষোভের কারণ।

স্নেইপ যে এত নিচে নামতে পারেন তা আমি কখনোই ভাবিনি। রন হারমিওনকে বলল।

কে যেন রনকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল। সে পেছন ফিরে দেখে ম্যালফয়।

দুঃখিত, উইসলি। আমি খেয়াল করিনি। ম্যালফয় বলল।

এবার দেখা যাবে হ্যারি কতক্ষণ ঝাড়ুর ওপর থাকতে পারে। কেউ কি আমার সাথে বাজি ধরবে? উইসলি তুমি ধরবে? ম্যালফয় প্রস্তাব দিল।

রন কোন জবাব দিল না। খেলা শুরু হল।

স্নেইপ জর্জের একটা ফাউলকে কেন্দ্র করে হাফলপাফের অনুকূলে পেনাল্টি দিলেন। হ্যারি সারা মাঠ চষে স্নিচ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট পর মালয় উচ্চকণ্ঠে বলল–দেখেছ গ্রিফিল্ডর হাউজ কেমন খেলোয়াড় বেছে নিয়েছে।

প্রথম পেনাল্টি ব্যর্থ হলে কিছুক্ষণ পর স্নেইপ বিনা কারণে হাফলপাফের অনুকূলে আরেকটি পেনাল্টি দিলেন।

দর্শকরা হইচই করে উঠলো। সমস্ত দর্শকের সহানুভূতি এবার হ্যারির প্রতি।

ম্যালফয় বলে চলল, এদের জন্য সকলের দুঃখ হয়। এই যে পটার, ওর মা–বাবা নাই, আর উইসলি গরিব, কোন টাকা–পয়সা নেই ওর। আর এই যে তুমি লংবটম, তোমার একটা ভাল টিমে থাকা উচিত ছিল, কারণ তোমার মত যাদের মাথায় কিছু নেই তদেরই তো টিমে থাকার কথা।

নেভিলের চেহারা রাগে লাল হয়ে উঠল। সে পেছন ফিরে ম্যালফয়ের মুখোমুখি হলো।

আমি তোমার মত বারোটার সমান, ম্যালফয় নেভিল বলল।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল উচ্চস্বরে হেসে উঠল। রন খেলা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েই নেভিলকে বলল–ঠিক বলেছ নেভিল, বলে যাও।

লংবটম, যদি মস্তিষ্ক সোনা হতো তাহলে তুমি উইসলির তুলনায় গরীব হতে। আজ এইটুকুই বললাম, যাও।

হ্যারির চিন্তায় রন এমনিতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সে ম্যালফয়ের দিকে মুখ না ফিরিয়ে বলল–ম্যালফয়, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। এরপর যদি তুমি আর একটি বাজে কথা বল তাহলে তোমাকে দেখে নেব।

রন হারমিওন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–হ্যারি, হ্যারি,..

কী হয়েছে?… কোথায়?

হ্যারি একটা চমৎকার ডাইভ দিয়ে বুলেটের মত ছুটে গেল। দর্শকরা হর্ষধ্বনি ও হাততালি দিয়ে বাহবা দিল হ্যারিকে। হারমিওন হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে তার মুখে ফিঙ্গার ক্রস করল। আর হ্যারি বুলেটের মত মাটির দিকে ছুটছে।

উইসলি তোমাদের ভাগ্য ভাল। হ্যারি নিশ্চয়ই মাঠের ভেতর কিছু পয়সার সন্ধান পেয়েছে। ম্যালফয় হ্যারির মাটির দিকে ছুটে যাওয়া দেখে তামাশা করে বলল।

ম্যালফয়কে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই রন তাকে মাটিতে ফেলে দিল। নেভিল কাছেই ছিল। কিছুক্ষণ দ্বিধা করে সে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেল।

শাবাশ হ্যারি খেলে যাও। তার আসন থেকে উঠে হারমিওন চিৎকার করল। হারমিওন লক্ষ্য করল যে, হ্যারি স্নেইপের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হারমিওন ভীষণভাবে উত্তেজিত। হারমিওন এতক্ষণ লক্ষ্যই করেনি যে, তার পায়ের কাছে রন আর ম্যালফয় মারামারি করছে।

স্নেইপ তার ঝাড়ু সোজা করতে করতে অবাক হয়ে দেখলেন যে আকাশ থেকে একটি ঝাড়ু তার নাকের এক ইঞ্চি দূর দিয়ে তীরবেগে ছুটে গেল। আরেকটু হলেই…

ডাইভ থামিয়ে হঠাৎ হ্যারির চিৎকার। সে স্নিচটাকে ধরে ফেলেছে। এটা একটা রেকর্ড। সারা গ্যালারিতে হইচই। এর আগে কেউ কোন দিন এত তাড়াতাড়ি মিচ ধরে ফেলতে পারেনি।

হারমিওন চিৎকার করে বলল–রন, রন। কোথায় তুমি। খেলা শেষ। হ্যারি জিতেছে।

সবাই শুনল হেরমিওনের উল্লাস। আমরা জিতেছি, আমরা জিতেছি। গ্রিফিল্ডর এখন এগিয়ে।

হারমিওন আনন্দে নাচছে। সামনের সারির পার্বতী পাতিলকে জড়িয়ে ধরল।

মাটি থেকে মাত্র এক ফুট ওপরে থাকতেই হ্যারি ঝাড়ু থেকে লাফ দিল। এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, সে জিতেছে। একটু আগেই খেলা শেষ হয়েছে।

শাবাশ। ভালো খেলেছ। তুমি নিশ্চয়ই এখন আর আয়না নিয়ে চিন্তা করছ না। ডাম্বলডোর তাকে বললেন খুব ধীরে যাতে অন্য কেউ না শোনে।

স্নেইপ খুব তিক্ত বদনে মাটিতে থুথু ফেলল।

হ্যারি প্রসাধন কক্ষ থেকে একটু পরেই বের হয়ে এলো। এরপর নিম্বাস ২০০০ নিয়ে সে ঝাড়ুশালার দিকে রওনা হল। আজ তার মত আনন্দিত পৃথিবীতে আর কেউই নেই। সত্যিই সে গর্বিত হওয়ার মত কাজ করেছে। তার সুনাম এখন চতুর্দিকে। ক্লান্তি কাটাবার জন্যে হ্যারি কিছুক্ষণ ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ালো।

সে ঝাড়ু রাখার শেডে পৌঁছে শেডের কাঠের দরোজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সে হোগার্টসের দিকে তাকাল। অস্তাচলগামী সূর্যের কিরণে জানালার কাঁচ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। গ্রিফিল্ডরে এখন অগ্রগামী। আর এই কৃতিত্বের দাবিদার হ্যারি নিজে। স্নেইপকে বুঝিয়ে দেয়া গেছে।

হ্যারি স্নেইপের কথা ভাবতেই, দেখল.

একটি সারা শরীর আবৃত মূর্তি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। যেন চুপি চুপি কোথাও যাচ্ছে যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। যাচ্ছে নিষিদ্ধ বনের দিকে। হ্যারির মাথায় এবার আর জয়ের আনন্দ নেই। জয়ের পরিবর্তে এখন উৎকণ্ঠা। এ যে স্নেইপ। সবাই যখন ডিনারে যাচ্ছে তখন তিনি বনে যাচ্ছেন কেন?

হ্যারি আবার নিম্বাস ২০০০ এর ওপর চড়ে বসল। কাছে গিয়ে দেখল স্নেইপ বনে ঢুকে গেছেন।

বিরাট বিরাট গাছ হ্যারিকে বাধা দিচ্ছে। সে স্নেইপকে দেখতে পেয়ে নীরবে একটি বা গাছে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে স্নেইপ কি করছেন দেখতে থাকলে।

গাছের ঠিক নিচেই স্নেইপ দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে অধ্যাপক কুইরেল। তবু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হ্যারি শুনতে পাচ্ছে কুইরেল তোতলাতে তোতলাতে বলছেন–আ… আ… আমি জানি… না তুমি কেন আমাকে এখানে কেন। …. সেভেরাস…. স্নেইপ শীতল কণ্ঠে বললেন–আমি বিষয়টি গোপন রাখতে চাই। আমার ধারণা ছাত্ররা এখনও পরশমণি সম্পর্কে কিছুই জানে না।

হ্যারি আরেকটু সামনে ঝুঁকল। কুইরেল কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। স্নেইপ তাকে থামিয়ে দিলেন। স্নেইপ বললেন–হ্যাগ্রিডের কুকুরটাকে কীভাবে এড়ানো যায়, ভেবে দেখেছ কি?

কুইরেল বললেন–আ… আ… আমি কিছুই জানি না। তুমি কী বলতে…. চাইছ।

তুমি ভালোভাবেই জানো আমি কী বলতে চাইছি।

হঠাৎ একটা পেঁচা উড়ে গেল। হ্যারি একটু অসতর্ক হলেই গাছ থেকে নিচে পড়ে যেত। হ্যারি নিজেকে সামলে নিল।

ঠিক আছে। স্নেইপ বললেন–আমরা পরে আবার কথা বলব। তখন তুমি আরো ভেবে দেখতে পারবে। তোমার আনুগত্য কোনদিকে–সেটাও ঠিক করতে পারবে।

হ্যারি দেখল অধ্যাপক কুইরেল ভীত–সন্ত্রস্ত হয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন।

১৪. নরওয়ের নর্বার্ট

কুইরেলকে যতটা মনে হয়েছিল আসলে তিনি তারও বেশি সাহসী। পরের সপ্তাহগুলোতে তিনি আরো বিষণ্ণ, আরো শীর্ণ হয়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি। যতবারই তারা চারতলার দরোজায় কান পেতেছে ততবারই তারা ফ্লাফির গর্জন শুনতে পেয়েছে। স্নেইপের মাথা এখন গরম। তার মানে পরশমণি এখনও নিরাপদ।

কুইরেলের সাথে হ্যারির দেখা হলেই তিনি উৎসাহব্যঞ্জক হাসি হাসেন। এতে হ্যারি অনুপ্রাণিত হয়।

পরশমণি ছাড়াও হারমিওনের মনযোগ দেয়ার অনেক বিষয় ছিল। সে তার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করল এবং হ্যারি ও রনকে এ ব্যাপারে তাগিদ দিতে থাকলো।

পরীক্ষার তো অনেক সময় বাকি। হ্যারি আর রন বলল।

মাত্র দশ সপ্তাই। হারমিওন জবাব দিল। এটা অনেক কম সময়। আর নিকোলাস ফ্লামেলের কাছে এটা তো একটি মুহূর্ত মাত্র।

কিন্তু আমাদের বয়স তো ছশ বছর হয়নি। রন হারমিওনকে মনে করিয়ে দিল। তা যাই হোক–তুমি কী রিভাইজ দিচ্ছ? তোমার তো সবই জানা।

আমি কী রিভাইজ দিচ্ছি? তোমাদের কি মাথা খারাপ? আমার পড়া এখনো বাকি। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার জন্যে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। আমার একমাস আগেই পড়া শুরু করা উচিত ছিল। একাধারে হারমিওনের উপদেশ ও ক্ষেদোক্তি।

শিক্ষকরাও যেন মনে হলো হারমিওনের সাথে একমত হয়ে অতিরিক্ত পড়া চাপাতে লাগলেন। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হ্যারি ও রন তাদের অবসর সময়টাও লাইব্রেরিতে কাটাতে লাগলো।

আমার কিছুই মনে থাকছে না। এই বলে বিরক্ত হয়ে একদিন বিকেলে রন বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে লাইব্রেরির জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার মনে হলো অনেকদিন পর সে একটা সুন্দর দিন প্রত্যক্ষ করলো। মুক্ত অপরাজিতা নীল আকাশ এবং বাতাসে গ্রীষ্মের হাতছানি।

হ্যারি এক হাজার জাদুকরী গাছপালা ও ছত্রাক নামক বইটি নেড়ে চেড়ে দেখছে, তখনি তার কানে গেল রন বলছে হ্যাগ্রিড, আপনি লাইব্রেরিতে কী করছেন?

হ্যাগ্রিডকে দেখে মনে হলো তিনি তার পেছনে কিছু লুকোচ্ছেন। গন্ধমুষিকের চামড়ার ওভার কোটটাতে তাকে বেখাপ্লাই দেখাচ্ছে।

এমনি দেখছি, হ্যাগ্রিডকে বিব্রত মনে হল। তা তোমরা এখানে কী করছ, তোমরা কি এখনও নিকোলাস ফ্লামেলকে খুঁজছো?

না, আমরা বহু আগেই তাকে পেয়েছি। রন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল। এবং আমরা এটাও জানি কুকুরগুলো কি পাহারা দেয়। সেটা হচ্ছে পরশ…।

শ্‌শ্‌! হ্যাগ্রিড চারদিক সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন, কেউ শুনছে কিনা। এটা নিয়ে এত চিৎকার করো না।

আমরা আসলে আপনাকে দুএকটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে চাই। হ্যারি বললো, ফ্লাফি ছাড়াও ওই পাথরটা পাহারার আর কি ব্যবস্থা আছে, সে সম্পর্কে যদি বলেন।

শ্‌শ্‌…? হ্যাগ্রিড ভীত দৃষ্টিতে ফিস ফিস করে বললেন, ছাত্রদের এ বিষয়ে জানানো নিষেধ, এখানে এটা নিয়ে আলোচনা করনা, সাবধান! পরে আমার সাথে দেখা করো। হ্যাগ্রিড বিদায় নিলেন।

তিনি পেছনে কি লুকোচ্ছিলেন? এটা পরশমনির সাথে সম্পর্কিত কিছু নয়তো? চিন্তিত মনে হারমিওন বললো।

হ্যাগ্রিড যেখানে ছিলেন, এই জায়গাটা আমি একটু দেখে আসি। বলে রন এগিয়ে গেল। মিনিট খানেক পরেই ফিরে এল, হাতে একগাদা বই। সবাই বিস্মিত হলো এটা দেখে যে, বইগুলোর সবই ড্রাগন ও এদের লালন–পালন সম্পর্কিত।

হ্যাগ্রিড সব সময়ই একটা ড্রাগন চেয়েছেন, প্রথম সাক্ষাতের দিনই তিনি আমাকে তার ইচ্ছার কথা বলেছেন–হ্যারি বললো।

কিন্তু ১৭০৯ সালের ওয়ারলকস কনভেনশন অনুযায়ী ড্রাগন লালনপালন করাতো বেআইনি–রন বললো।

***

তাহলে হ্যান্ডি জেনেশুনে ড্রাগন চর্চা করছেন কেন? হারমিওনের প্রশ্ন।

ঘণ্টাখানেক পরে ওরা তিনজন যখন হ্যাগ্রিডের বাসায় পৌঁছুলো, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ঘরের সব জানালায় পর্দা টানা। এই গরম কালেও আলাদাভাবে আগুন জ্বেলে ঘর গরম করা হচ্ছে। হ্যাগ্রিড ওদেরকে চা এবং বেজীর স্যান্ডউইচ খেতে দিতে চাইলেন, কিন্তু তারা তা খেল না।

হ্যাঁ, কি যেন তোমরা জিজ্ঞেস করবে বলছিলে?

কোন রকম ভুমিকা না করে হ্যারি সরাসরি প্রশ্ন করলো–ফ্লাফি ছাড়া আর কে বা কারা পরশমনি পাহারা দেয়–সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন তো আমরা খুশি হব।

হ্যাগ্রিড ভ্রূ কুঁচকে হ্যারির দিকে তাকালেন। আমি এটা বলতে পারব না। প্রথমতঃ আমি নিজেই জানি না। দ্বিতীয়তঃ জানলেও আমি বলতাম না। কারণ, পরশমনিটা এখানে একটা ভাল কাজে রাখা আছে। তাছাড়া তোমরা ফ্লাফি সম্পর্কেই বা কিভাবে জানলে?

হ্যাগ্রিড, আপনি শান্ত হোন। হারমিওন মিষ্টস্বরে হ্যাগ্রিডকে অনেকটা খুশি করার জন্য বললো, আপনি জানেন, এখানে যা কিছু ঘটছে, সবই আপনি জানেন, আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আপনি না বলতে চাইলে সেটা আলাদা কথা। হ্যাগ্রিডের দাঁড়ি নড়ে উঠছে, মনে হলো তিনি মুচকি হাসছেন। হারমিওন বলে চললো–আমরা জানি পাহারার আসল কাজটি কে করেন। আমরা এও জানি ডাম্বলঙের সব কাজে কার ওপর বেশি নির্ভরশীল, আপনি ছাড়া আর কে?

শেষ কথাগুলোতে হ্যাগ্রিডের বক্ষ স্ফীত হলো, হ্যারি ও রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।

হ্যাঁ, তোমাদেরকে বললে আর কি ক্ষতি হবে!

অধ্যাপক ডাম্বলডোর ফ্লাফিকে আমার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। এরপর সকল শিক্ষক মিলে ফ্লাফিকে জাদু দিয়ে বশ করে এই পরশপাথর পাহারায় বসান। তাদের মধ্যে অধ্যাপক স্নেইপও ছিলেন। হ্যাগ্রিড ব্যাখ্যা করলেন।

স্নেইপ? হ্যারি অবাক হয়।

হ্যাঁ–হ্যাঁ, তোমরা এই ব্যাপারটা জান না, তাই না? স্নেইপ পরশপাথর রক্ষা করতে চান, তার পক্ষে এটা চুরি করা সম্ভব নয়। হ্যান্ডি বললেন।

ওরা তিনজনই ভাবছে–যদি স্নেইপ পরশমনি রক্ষার পক্ষে থাকেন তাহলে অন্যান্য শিক্ষকগণ কিভাবে এটা রক্ষা করেন তা জানা সহজ হবে। হ্যাগ্রিড সবই জানেন।

অন্ততঃ অধ্যাপক কুইরেলের জাদুশক্তি ও কিভাবে ফ্লাফিকে ফাঁকি দেয়া যাবে–সবই জানা যাবে।

গরমে সিদ্ধ হওয়ার দশা সকলের। একটা জানালা খুলে দিলে হয়, মি. হ্যাগ্রিড! হ্যারি জানালা খুলতে উদ্যত হয়।

খোলা যাবে না, হ্যারি আমি দুঃখিত। বলেই হ্যাগ্রিড আগুনের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হ্যারিও আগুনের দিকে দৃষ্টি দিল। নজরে এল আগুনের মধ্যে কেতলির নিচে বিশাল কালো একটা ডিম। হ্যাগ্রিডকে বিচলিত মনে হলো।

কোথায় পেলেন এটা মি. হ্যাগ্রিড? রন আগুনের আরো কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে।

জিতেছি–হ্যাগ্রিড বললেন। গত রাতে পাশের গ্রামে গিয়ে একজনের সাথে তাস খেলায় বাজি ধরে এটা জিতেছি। লোকটা যেন এটা দিতে পেরে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। হ্যাগ্রিডের চোখে মুখে গর্বের হাসি দেখা গেল।

কিন্তু বাচ্চা ফুটে বেরুলে আপনি কি করবেন। হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।

এ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনা করছি। হ্যাগ্রিড বালিশের নিচ থেকে একটা বড় বই বের করলেন। বইটার নাম আনন্দ ও লাভের জন্য ড্রাগন প্রজনন। এর মধ্যেই লেখা আছে, কীভাবে আগুনে দিয়ে ডিম ফুটাতে হবে, কীভাবে ড্রাগনের বাচ্চাকে আধঘণ্টা পর পর মুরগির রক্ত মিশিয়ে পাতিল ভর্তি ব্রান্ডি খাওয়াতে হবে। এবং দেখো, আরও লেখা আছে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ডিম চিনতে হবে। আমার এটা নরওয়েজিয়ান রিজব্যাক। খুবই দুর্লভ এগুলো।

হ্যাগ্রিড খুশি হলেও ওদের দুশ্চিন্তা গেল না। তারা ভেবে পেল না হ্যাগ্রিডের এই কাঠের ঘরে কেউ যদি এই অবৈধ ড্রাগনের বাচ্চা দেখে ফেলে তাহলে হাগ্রিডের কী হবে।

রাতের পর রাত ওরা পড়ায় ব্যস্ত রইলো। হারমিওন হ্যারি ও রনকে রিভাইজ দেয়ার সময়সূচি বানিয়ে দিল। পড়ার চাপে তারা পাগলপ্রায়।

এমনি একদিন নাস্তার সময় হেডউইগ এল হ্যাগ্রিডের ছোট চিরকুট নিয়ে। হ্যাগ্রিড মাত্র দুটো শব্দ লিখেছেন : বাচ্চা ফুটছে।

পড়া রেখে রন হাগ্রিডের বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। হারমিওনের যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই।

হারমিওন, সারাজীবনে আমরা কটা দিন ড্রাগনের বাচ্চা ফোঁটা দেখার সুযোগ পাব বলতো? রনের জিজ্ঞাসা।

আমাদের পড়াশোনা আছে। আমরা বিপদে পড়ব, তাছাড়া কেউ যদি হাগ্রিডের ব্যাপারটা জেনে ফেলে, তখন কিছুই করার থাকবে না। হেমিওন জবাব দিল।

চুপ? হ্যারি ফিসফিসিয়ে বললো।

কয়েক গজ দূরে ম্যালফয়কে দেখা গেল সন্তর্পণে ওদের কথা শুনছে। কতটা শুনে ফেলো কে জানে। ম্যালফয়ের চাহনিটা মোটেই ভাল ঠেকল না।

আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত হারমিওন ওদের সঙ্গী হতে রাজি হলো এবং কোনাকুনি মাঠের ওপর দিয়ে হ্যাগ্রিডের বাসায় হাজির হলো ওরা। আনন্দে–উত্তেজিত হ্যাগ্রিড ওদের অপেক্ষায় ছিলেন।

প্রায় ফুটে বেরুল বলে। তিনি ওদেরকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন।

ডিমটা টেবিলের ওপর রাখা। ডিমের চারপাশে ফাটল দেখা যাচ্ছে। ভিতরে কি যেন নড়ছে। একটা মজার শব্দ নির্গত হচ্ছে।

সবাই আগ্রহভরে টেবিলের চারপাশে জড় হলো। বন্ধ নিঃশ্বাসে সবার দৃষ্টি একমাত্র ডিমের দিকে।

অকস্মাৎ সশব্দে ডিম ফেঁটে গেল। বাচ্চা ড্রাগন টেবিলের ওপর পড়ল। দেখতে যে খুব সুন্দর তা নয়। হ্যারির মনে হলো যেন একটা কালো ছাতা। ভানা দুটা জেট প্লেনের ডানার সাথে তুলনা করা যায়। উন্নত নাশা, তীক্ষ্ণ শিং যুগল, উজ্জ্বল কমলা রঙের চোখ। মুখ দিয়ে দু দুবার আগুনের রশ্মি বেরিয়ে গেল।

কি সুন্দর তাই না?–হ্যাগ্রিড বিড়বিড় করে বললেন–ওকে আশীর্বাদ কর, দেখ, ও কিন্তু ওর মাকে চেনে।

মি. হ্যাগ্রিড, একটা নরওয়েজিয়ান রিজব্যাক কতদিনে বড় ইয়?–হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাগ্রিড জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার চেহারা মলিন হয়ে গেল। দ্রুত জানালায় গিয়ে উঁকি দিলেন।

একটা বাচ্চামত কেউ পর্দা সরিয়ে আমাদের দেখে গেল। স্কুলের দিকে দৌড় দিয়েছে। হ্যাগ্রিড বললেন। হ্যারি দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে নিঃসন্দেহ হলো। আর কেউ নয়–ম্যালফয় ড্রাগন দেখে ফেলেছে।

পরের সপ্তাহে ম্যালফয়ের হাসি হাসি মুখ দেখে ওরা তিনজন বেশ উদ্বিগ্নতার সাথে কাটালো।

হারমিওন, রন ও হ্যারি তাদের অবসর সময় হ্যাগ্রিডের অন্ধকার কুটিরেই কাটালো।

এটাকে আটকে রাখবেন না, হ্যারি বলল, এটাকে মুক্ত করে দিন।

একে ছাড়ব না, এ অত্যন্ত ছোট। হ্যাগ্রিড বললেন। আমি এটাকে নর্বার্ট বলে ডাকবো।

কিন্তু প্রধান চিন্তা হলো, হ্যাগ্রিড তো সারাজীবন এটাকে রাখতে পারবেন না। ম্যালফয়ের মাধ্যমে এ কথা প্রচার হবেই।

হ্যারি হঠাৎই রনের দিকে ফিরে বললো পেয়েছি। রন, তোমার ভাই চার্লি রোমানিয়ায় থাকে না? চার্লিই পারবে নৰ্বার্টকে যত্নে রাখতে।

চমৎকার! রন বললো। হ্যাগ্রিড কি বলেন?

অবশেষে হ্যাগ্রিভ রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হলো চার্লিকে পেঁচা পাঠানো হবে তার মত জানার জন্যে।

পরের সপ্তাহ বুধবার পর্যন্ত গড়াল। সবাই যখন শুতে গিয়েছে তখন হারমিওন আর হ্যারি একান্তে কমনরুমে গিয়ে বসল। মধ্যরাত। হঠাৎ করে প্রতিকৃতির গর্তটা খুলে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল রন। সে গা থেকে হ্যারির ছদ্ম আবরণটা খুলে ফেলল। সে এতক্ষণ হ্যাগ্রিডের কুঁড়ে ঘরে নর্বার্টকে মরা ইঁদুর খাওয়াচ্ছিল।

ড্রাগনটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে। রন তার হাত দেখিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার হাত একটা রক্তাক্ত রুমাল দিয়ে বাঁধা।

রন বলল–আমার জীবনে আমি এ পর্যন্ত যত প্রাণী দেখেছি তার মধ্যে এই ড্রাগনটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। হ্যাগ্রিড যখন এটার কাছে যান, মনে হয় তিনি যেন তার পোষ খরগোশের কাছে যাচ্ছেন। আমাকে যখন কামড় দিল তখন হ্যাগ্রিড বললেন–ভয়ের কিছু নেই, তোমাকে ভয় দেখাল। আমি যখন চলে আসি তখন শুনতে পেলাম হ্যাগ্রিড দিব্যি গান গাচ্ছেন।

অন্ধকার জানালায় টোকা পড়লো।

এটা হেডউইগ। হ্যারি বলল–ওকে ঢুকতে দাও। ও হয়তো চার্লির জবাব নিয়ে এসেছে।

তিনজন একত্র হয়ে চিঠি পড়তে শুরু করল–

প্রিয় রন,
তুমি কেমন আছ? তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। নরওয়ের প্রাণীটি নিজে আনতে পারলে আমি খুশিই হতাম। তবে তাকে এখানে নিয়ে আসার কিছু ঝামেলা আছে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে তাকে পাঠিয়ে দাও। তারা আগামী সপ্তাহে আমার এখানে আসছে। তবে তাকে এমনভাবে আনতে হবে যাতে এটা বাইরে থেকে দেখা না যায়।
তুমি কি শনিবার মধ্যরাতে তাকে নিয়ে সবচেয়ে উঁচু চুড়ায় আসতে পারবে? আমার বন্ধুরা তোমার সাথে সেখানে দেখা করবে। অন্ধকার থাকতেই তাকে সরিয়ে দিও।
যত দ্রুত সম্ভব জবাব দিও। ভালবাসা রইল।
চার্লি

তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।

এটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। হ্যারি বলল–আমাদেরও অদৃশ্য হওয়ার পোশাক আছে। নর্বার্টকে নিয়ে আমরা দুজন অনায়াসে ওই পোশাকের ভেতর ঢুকে পড়তে পারব।

তারা একমত হল যে, গত সপ্তাই তাদের বেশ খারাপ গেছে। তাই তারা যেকোন মূলোই নর্বার্ট ও ম্যালফয়ের কাছ থেকে মুক্তি চায়।

পরদিন সকালে বেশ সমস্যা দেখা দিল। রনের হাত দ্বিগুণ ফুলে গেছে। সে ভাবছিল মাদাম পমফ্রের কাছে যাবে কিনা। তিনি কি বুঝতে পারবেন যে, এটা ড্রাগনের কামড়। নিরুপায় হয়ে বিকেলে তাকে পমফ্রের কাছে যেতেই হল। তার হাতে কামড়ের জায়গাটা অনেকটা সবুজ হয়ে গেছে। তার মনে হল নবার্টের দাঁত খুব বিষাক্ত। দিনশেষে হ্যারি আর হারমিওন হাসপাতালে গিয়ে দেখে রনের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সে বিছানায় শুয়ে আছে।

আমার হাতের সমস্যা বড় সমস্যা নয়। রন ফিস ফিস করে বলল এ ব্যথা বেশিক্ষণ থাকবে না। ম্যালফয় মাদাম পমফ্রেকে জানিয়েছে সে আমার কাছে বই ধার চাইতে আসবে। সুতরাং সে আসতে পারে। আমাকে নিয়ে সে কৌতুক করবে। সে বার বার আমাকে চাপ দিচ্ছিল–আমাকে কোন প্রাণী কামড় দিয়েছে তা মাদাম পমফ্রেকে জানাই। আমি মাদাম পমফ্রেকে বলেছি এটা কুকুরের কামড়। আমার মনে হয় তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কিডিচ খেলায় ম্যালফয়কে মারা আমার ঠিক হয়নি। এখন সে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে।

হ্যারি আর হারমিওন রনকে সান্ত্বনা দিল।

শনিবার মাঝরাতের ভেতরই সব ঠিক হয়ে যাবে। হারমিওন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। এতে রনের উদ্বেগ কাটলো না। রন হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল–সর্বনাশ হয়ে গেছে। চার্লির চিঠিটা তো সেই বইয়ের ভেতরই রয়ে গেছে। ম্যালফয় যদি চিঠি পড়ে ফেলে তাহলে তো সে বুঝে ফেলবে যে আমরা নর্বার্টকে সরাবার চেষ্টা করছি। ঠিক সেই মুহূর্তে মাদাম পমফ্রে হাজির হলেন। তিনি বললেন–তোমরা এখন যাও। রনের নিদ্রা প্রয়োজন।

***

হেরমিওনকে হ্যারি বলল-এখন তো পরিকল্পনা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভাগ্য ভালো ম্যালফয় আমাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমাদেরকে সাবধানে এগোতে হবে। হ্যাগ্রিডকে তারা চার্লির চিঠির কথা বললে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তার অশ্রুর কারণ হতে পারে নৰ্বার্ট তার পায়ে কামড় দিয়েছে।

ও কিছু না! সে আমার জুতো নিয়ে খেলছিল। নর্বার্ট তো এখনও শিশু। হ্যাগ্রিড বললেন।

ড্রাগনটা তার লেজ দিয়ে দেয়ালে আঘাত করলে দেয়াল এত জোরে কেঁপে ওঠে যে জানালার কাঁচ চুরমার হয়ে। হ্যারি আর হারমিওন দূর্গে ফিরে এল। কিন্তু তাদের বারবার মনে হচ্ছিল–শনিবার হনুজ দূর অস্ত। শনিবার এখনও অনেক দূর।

নর্বার্টকে বিদায় দেবার সময় হ্যাগ্রিডের জন্য তাদের দুঃখ হলো। তারা এতটা উদ্বিগ্ন না হলে হয়ত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারতো। রাতটা ছিল মেঘলা ও গাঢ় অন্ধকার। হাগ্রডের কুঁড়ে ঘরে সবকিছু প্রস্তুত করতে একটু বেশি সময় লাগলো। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তারাও একটু দেরিতে এসেছে। কারণ পিভস প্রবেশ কক্ষে দেয়াল জুড়ে টেনিস খেলছিল। পিভস সেখান থেকে খেলা শেষ করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। একটা বড় বাক্সে নৰ্বার্টকে রাখা হলো।

শোকাভিভূত হ্যাগ্রিড বললেন–বেশ কিছু ইঁদুর ও কিছুটা ব্রান্ডি বাক্সে রেখে দিয়েছি। খিদে পেলে খেয়ে নেবে। তাছাড়া ওর টেডি বিয়ারটা দিয়ে দিয়েছি, যাতে সে একজন সঙ্গী পায়, নিঃসঙ্গ অনুভব না করে।

বাক্সের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে ড্রাগন বোধহয় টেডি বিয়ারের মুও উড়িয়ে দিচ্ছে।

বাক্স বন্ধ করা হলে হ্যাগ্রিড ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। হ্যারি আর হারমিওন অদৃশ্য হওয়ার পোশাক দিয়ে বাক্সটা ঢেকে দিল এবং তারা দুজনও ওই পোশাকের নিচে ঢুকে গেল! কীভাবে দুর্গের চূড়ায় বাক্সটা ওঠানো হলো তা তারা জানতেও পারলো না।

এখন কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তারা অদৃশ্য পোশাকে। তবে তারা একটু পরেই প্রায় দশফুট দূরে প্রদীপের আবছা আলোয় দুটা ছায়ামূর্তি দেখল। তারা হলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এবং ম্যালফয়। ম্যাকগোনাগল ড্রেসিং গাউন পরেছেন। তিনি ম্যালফয়ের কান টেনে চিৎকার করছেন–ডিটেনশান। মাঝরাতে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এত বড় স্পর্ধা। স্লিদারিন হাউজের বিশ পয়েন্ট কাটা গেল।

ম্যালফয় বলল–অধ্যাপক, আপনি বুঝতে পারছেন না। হ্যারি পটার আসছে। তার কাছে একটা ড্রাগন আছে।

বাজে কথা বল না। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–চল অধ্যাপক স্নেইপের কাছে।

তারা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন।

যখন রাতের শীতল হাওয়া গায়ে কাঁটার মত বিধছে ঠিক তখনি টাওয়ারের চূড়ায় পৌঁছে তারা তাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক খুলে ফেলল। হারমিওন বলল–ম্যালফয় শাস্তি পেয়েছে। আমার একটা গান গাইতে খুব ইচ্ছে করছে।

হ্যারি তাকে চুপ থাকতে বলল।

ম্যালফয়ের শাস্তির কথা চিন্তা করে তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। নর্বার্ট বাক্সের ভেতর ছটফট করছে। ঠিক দশ মিনিট পর হঠাৎ চারটা ঝাড়ু তাদের সামনে উপস্থিত হলো। চার্লির বন্ধুরা খুব হাসি খুশি মেজাজের। নর্বার্টকে ওরা ঝুলিয়ে নিয়ে যাবে। হারমিওন ও হ্যারিকে ওরা দেখালো কি ভাবে ওকে ঝোলাবে এবং ওরা সবাই ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

নর্বার্ট চলে গেল। অবশেষে তারা নৰ্বার্ট থেকে অব্যাহতি পেল।

তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন তারা ফিলচকে দেখল।

সামনে বোধহয় আমাদের বিপদ আছে। তারা টাওয়ারের ওপর ভুল করে তাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক ফেলে এসেছে।

১৫. নিষিদ্ধ বাগান

পরিস্থিতি এর চেয়ে আর খারাপ হতে পারে না।

ফিলচ তাদেরকে নিয়ে দোতলায় অধ্যাপক মাকগোনাগলের কক্ষে গেলেন। ওরা চুপচাপ বসে আছে। হারমিওন ভয়ে কাঁপছে। হ্যারি নানা রকম অজুহাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

এই বিপদ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। তারা এত নির্বোধের মত কাজ করল কীভাবে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কাছে কোন অজুহাতই টিকবে না। তারা রাতে চুপিচুপি বেডরুম ছেড়ে বাইরে চলে গেছে। আর টাওয়ারে ওঠার অপরাধ, এটা তো মাফ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। টাওয়ার নিষিদ্ধ এলাকা। শুধু ক্লাসের জন্য টাওয়ারে যাওয়া যায়। এর সাথে যোগ হয়েছে নর্বার্টকে পার্সেল করা। সবচে বড় বোকামি তারা করেছে অদৃশ্য হওয়ার পোশাক ছেড়ে এসে।

একটু পরই ম্যাকগোনাগল এলেন। পেছনে নেভিল। নেভিল চিৎকার করে বলল–হ্যারি, আমি তোমাকে সাবধান করার জন্য খুঁজতে গিয়েছিলাম। ম্যালফয় বলেছিল ও তোমাকে ধরতে যাচ্ছে। তোমার কাছে নাকি একটা ড্রাগ…

হ্যারি জোরে মাথা নেড়ে ইশারা দিয়ে নেভিলকে থামাতে চাইল। ম্যাকগোনাগল সেটা দেখে ফেলেছেন। তার প্রশ্বাসে যেন নবার্টের চেয়েও বেশি আগুনের হলকা বেরুচ্ছে। তিনি বললেন–আমি বিশ্বাসই করতে পারি না যে তোমরা এ রকম একটা কাজ করবে। মি. ফিল বলেছেন, তোমরা নাকি এস্ট্রোনমি টাওয়ারে উঠেছিলে রাত একটার সময়। জবাব দাও।

এই প্রথমবারের মতো হারমিওন তার শিক্ষকের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে মাথা নিচু করে নীরব মূর্তির মতো তার চটি জুতোর দিকে তাকিয়ে রইল।

ম্যাকগোনাগল বলে চললেন-এই ব্যাপারটি বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার দরকার হয় না। আমি বুঝতে পেরেছি। তোমরা একটা গাঁজাখুরি গল্প তৈরি করেছো। তোমরা ম্যালফয়কে এই মিথ্যা গল্প শুনিয়েছ যাতে সে বিছানা ছেড়ে ওখানে যায় ও বিপদে পড়ে।

হ্যারি নেভিলের চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলতে চাইল যা বলা হয়েছে তা সত্য নয়। এসব শুনে নেভিলকে হতভম্ব ও ব্যথিত মনে হচ্ছিল। অন্ধকারে তাদেরকে সাবধান করতে গিয়ে নেভিলকে কী খেসারত দিতে হবে তা হ্যারি বুঝতে পারছিল।

ম্যাকগোনাগল বললেন–জঘন্য ব্যাপার। চার চার জন মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে বাইরে চলে গেছে। এ রকম কখনো আগে ঘটেনি। মিস গ্রেঞ্জার, আমি ভেবেছিলাম তোমার বেশ বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। ঠি, পটার, আমি ভেবেছিলাম এসবের তুলনায় তোমার কাছে গ্রিফিল্ডর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তিনজনেই এখন ডিটেনশনে যাবে–মি. লংবটম, তোমাকেও যেতে হবে। তোমারও মুক্তি নেই। মাঝরাতে স্কুলের আশপাশে ঘুরে বেড়াবার অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি। বিশেষ করে এই সময়ে যখন পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে পঞ্চাশ পয়েন্ট কাটা হল।

পঞ্চাশ। হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তাহলে তো গ্রিফিল্ডর আর এগিয়ে থাকতে পারবে না। গত কিডিচ প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে তারা এক ঈর্ষান্বিত অবস্থানে এসেছিল।

তোমাদের প্রত্যেকের পঞ্চাশ পয়েন্ট কাটা গেল। দীর্ঘ খাড়া নাকের মাধ্যমে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ম্যাকগোনাগল বললেন।

প্রফেসর প্লিজ….

আমার কিছু করার নেই। ম্যাকগোনাগল জবাব দিলেন।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বলে চল্লেন–আমি কি করবো, কি করবো না, এটা তোমার বলার দরকার নেই মি. পটার। এবার তোমরা সবাই ঘুমোতে যাও। গ্রিফিল্ডর হাউজের ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য আমাকে আর কখনও এত লজ্জা পেতে হয়নি।

এক রাতেই ১৫০ পয়েন্ট কাটা যাওয়াতে গ্রিফিল্ডর হাউজ অনেক পেছনে পড়ে গেল। মনে হলো তুলাটা পড়ে গেছে, পাত্রে আর কিছু নেই। কীভাবে তারা এই ক্ষতি পূরণ করবে?

হ্যারি সারারাত ঘুমোতে পারেনি। সে সারারাত নেভিলের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। সে বুঝতে পারে নেভিলও তার মত শোকাভিভূত। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা বা বলার কিছু হ্যারির নেই। গ্রিফিল্ডর হাউজ এত পেছনে পড়ে গেছে এ ক্ষতিটা কীভাবে তারা পূরণ করবে-এ নিয়ে নেভিল হ্যারির মতই খুব উদ্বিগ্ন। কি হবে, যখন গ্রিফিল্ডরের সবাই জানবে তারা কি করেছে?

হ্যারি পটার থাকতেও দলের এই দশা। সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় হ্যারি পটারকে সবাই হঠাৎ ঘৃণা করতে শুরু করল। এমনকি বাভেনক্ল এবং হাফলপাফস-এর সবাই তার ওপর ক্ষুদ্ধ। কারণ তারাও চায় স্লিদারিরা যেন হাউজ কাপ না পায়। স্লিদারিন হাউজ খুবই উৎফুল্ল। তারা এখন হ্যারিকে দেখলেই মস্করা করে–থ্যাংক ইউ হ্যারি পটার। তোমার কাছে আমরা ঋণী।

একমাত্র রনই হ্যারির পাশে এসে দাঁড়াল।

কয়েক সপ্তাহের ভেতর তারা এটা ভুলে যাবে। এখানে আসার পর ফ্রেড ও জর্জ আনেক পয়েন্ট হারিয়েছে। তবুও তাদের সবাই পছন্দ করে।

তারা একবারে দেড়শ পয়েন্ট হারায়নি, হারিয়েছে কি? রন বলল, না, কখনোই না।

যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে। হ্যারি ভাবল এখন থেকে তার দায়িত্ব বা এখতিয়ারের বাইরে কোন জিনিস নিয়ে সে মাথা ঘামাবে না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, অন্যের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করা-এ ধরনের কাজে সে আর লিপ্ত হবে না। সে ভীষণ লজ্জিত হয়ে উডের কাছে গিয়ে বলল–আমি পদত্যাগ করতে চাই। পদত্যাগ। উড় হতভম্ব হয়ে বলে। কেন? পদত্যাগ করে কী লাভ হবে? উড পাল্টা প্রশ্ন করে-এতে কি তোমাদের দল জিতবে? যে পয়েন্ট খোয়া গেছে কিডিচ খেলায় না জয়লাভ করে তা কি করে ফেরত পাওয়া যাবে?

কিন্ডিচ খেলায় আগের মত মজা নেই। অনুশীলনের সময় দলের কোন খেলোয়াড় হ্যারির সাথে কথা বলে না। হ্যারির সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে তারা তাকে তার নাম না বলে সিকার বলে ডাকে।

হারমিওন আর নেভিলও কষ্ট পাচ্ছিল। তবে তাদের কষ্ট হ্যারির মত এত বেশি নয়। কারণ, তারা হ্যারির মত এত পরিচিত নয়। তাদের সাথেও কেউ কথা বলছে না। ক্লাসে হারমিওনও আগের মতো শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। সে মাথা নিচু করে নীরকে তার কাজ করে।

সামনে পরীক্ষা চলে আসায় হ্যারির খুব ভালো লাগল। কারণ পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সহজেই তার কষ্টের কথা ভুলতে পারবে।

হ্যারি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে অন্যের বিষয় নিয়ে সে আর মাথা ঘামাবে না। তার এই প্রতিজ্ঞা হঠাৎ এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো।

স্কুলের পরীক্ষা শুরু হবার সপ্তাহখানেক আগে লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে সে অধ্যাপক কুইরেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

কুইরেল বলছেন–না, না, আর নয় প্লীজ মনে হল কেউ তাকে ভয় দেখাচ্ছে। হ্যারি এগিয়ে গেল।

আবার কুইরেলের গলা–ঠিক আছে,.. ঠিক আছে।

একটু পরেই অধ্যাপক কুইরেল ফিরে এলেন। তিনি তার পাগড়ি ঠিক করলেন। তাকে বেশ মনমরা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই বুঝি তিনি চিৎকার করে উঠবেন।

হ্যারির মনে হল অধ্যাপক কুইরেল তাকে দেখতে পাননি। তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত হ্যারি অপেক্ষা করল। তারপর ক্লাসরুমে ঢুকল। সেখানে কেউই ছিল না। অবশ্য অপর প্রান্তের দরোজা খোলা ছিল। হ্যারি এগোচ্ছিল। হঠাৎ তার নিজের প্রতিজ্ঞার কথা মনে হলো। এসব নিয়ে ভাবা তো তার কাজ নয়।

লাইব্রেরিতে ঢুকে হ্যারি হারমিওন ও রনকে সব খুলে বললো। অভিযানের আগ্রহ রমের ভেতর আবার জাগতে শুরু করেছে, তার আগেই হারমিওন বললো–ডাম্বলডোরের কাছে যাও। অনেক আগেই তার কাছে আমাদের খাওয়া উচিত ছিল। এবার যদি আমরা কোন কিছু নিজেরাই করি তাহলে স্কুল থেকে নির্ঘাৎ আমাদের বের করে দেয়া হবে।

কিন্তু আমাদের হাতে তো কোন প্রমাণ নেই। হ্যারি বলল

আমাদেরকে সমর্থন করতে অধ্যাপক কুইরেলও ভয় পাবেন। অধ্যাপক স্নেইল্প বলবেন–হ্যালোইন দৈত্যটি কীভাবে এল তা তার জানা নেই। চতুর্থ তলায় যখন ঘটনা ঘটে তখন তিনি ধারে কাছে কোথাও ছিলেন। না। তাহলে কাকে বিশ্বাস করবেন–তাকে মা আমাদেরকে। ডাম্বলডোর ভাববেন তাকে পদচ্যুত করার জন্য আমরা গল্পটা বানিয়েছি। ঝুঁকি থাকলে ফিলও আমাদের সাহায্য করবেন না। আর এটাও মনে রেখো পরশমণি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানার কথা নয়। এটা জানাজানি হলে অনেক ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে হবে।

হারমিওন তার কথায় সন্তুষ্ট হলেও রন হলো না।

আমরা যদি এই নিয়ে একটু মাথা ঘামাই।

কোন প্রয়োজন নেই। হ্যারির সরাসরি উত্তর। আমরা বহু মাথা ঘামিয়েছি। এবার হ্যারি একটা মানচিত্র বের করল। জুপিটারের মানচিত্র। হ্যারি এর মধ্যেই জুপিটার গ্রহের চাঁদগুলোর নাম জেনে গেছে। পরদিন সকালে তারা যখন নাশতা করছিল তখন তাদের তিনজনের কাছেই একই বার্তা এল–

আজ রাত ১১টা থেকে তোমাদের ডিটেনশন শুরু হবে।
প্রবেশ কক্ষে গিয়ে ফিলচের সাথে দেখা করো।
–অধ্যাপক এস. ম্যাকগোনাগল।

হ্যারি ভুলেই গিয়েছিল যে পয়েন্ট খোয়ানোর জন্য তাদেরকে ডিটেনশনের মুখোমুখি হতে হবে। ওই রাতে তারা রনের কাছ থেকে বিদায় নিল। রাত ১১টায় তারা প্রবেশ কক্ষে গেল। ফিলচ সেখানেই ছিলেন। সেখানে ম্যালফয়কেও দেখা গেল। হ্যারি ভুলে গিয়েছিল যে ম্যালফয়েরও ডিটেনশন হয়েছে।

ফিলচ বললেন–আমার পেছন পেছন এসো। তারা তার পেছনে পেছনে গেল। ফিলচ বললেন–স্কুলের আইন–কানুন ভাঙার আগে তোমাদেরকে দুবার করে ভাবতে হবে। আমি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে আরও কঠিন শাস্তি দিতে পারতাম। কয়েকদিন তোমাদেরকে এ ঘরে বন্দি করে রাখতে পারতাম। শিকল দিয়ে বেঁধেও রাখতে পারতাম। আমার অফিসেই শিকল আছে। কিন্তু এবারের মতো ওদিকে যাচ্ছি না। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কোন কাজ করবে না। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না। করলে তোমাদেরই বেশি ক্ষতি হবে।

তারা অন্ধকার মাঠ দিয়ে এগিয়ে গেল। হ্যারি ভাবছিল তাদের কী শাস্তি হবে। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু।

চাঁদ ছিল উজ্জ্বল। তবে মেঘ চাঁদকে খানিকটা ঢেকে রেখেছিল। একটু এগিয়ে যেতেই হ্যারি গ্রিডের কুটিরের জানালায় আলো দেখতে পেল। তারা দূর থেকে কিছু কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেল। এটা কে? তুমি ফিলচ? তাড়াতাড়ি এসো। আমি কাজ শুরু করতে চাই।

হ্যারি ভাবছিল তারা যদি হ্যাগ্রিডের সাথে কাজ করে, তাহলে খুব খারাপ হবে না। হ্যারি বেশ আশস্ত বোধ করল। কারণ ফিল তাকে বলল নিশ্চয়ই ভাবছ বন্ধুটার সাথে তুমি তোমার সময় আনন্দেই কাটাতে পারবে। ভালো করে ভাব, তোমরা ঠিকমতো ফিরে আসতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

এই কথা শুনে নেভিল কাদো কাঁদো হল আর ম্যালফয় পথে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গেল।

এই বনে। সে বার বার বলল–রাতের বেলায় যাওয়া নিষেধ। এছাড়া ওখানে অনেক কিছু আছে। আমি শুনেছি সেখানে নেকড়ে বাঘ আছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

নেভিল হাৱির জামার আস্তিন ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।

সেটা তোমাদের দেখার ব্যাপার। ফিলচ বললেন–

যদি নেকড়ে থেকে থাকে তাহলে তোমাদের আগেই ভেবে দেখা উচিত ছিল। তাই নয় কি?

অন্ধকার ভেদ করে হ্যাগ্রিড তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সাথে তার কুকুর ফাং। আর কাঁধে ছিল বড় ধনুক ও তীর।

হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি আর হারমিওন, আমি তো আধঘণ্টা ধরেই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।

ফিলচ শীতল কণ্ঠে বললেন–তাদের সাথে তোমার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা ঠিক হবে না, হ্যাগ্রিড। তাদেরকে এখানে আনাই হয়েছে শাস্তি দেবার জন্য।

এ জন্যই বুঝি তোমার দেরি হয়েছে? হ্যাগ্রিড প্রশ্ন করলেন। ফিলচের প্রতি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণ বক্তৃতা দিচ্ছিলে। তুমি তোমার কাজ করেছ। এবার আমি আমার কাজ শুরু করব।

ফিলচ বললেন–কাল সকালে আমি খবর নেব। এদের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে আমি দেখব।

হাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে ম্যালফয় বলল–আমি এই বনে যাব না। ম্যালফয়ের স্বরে ভয় পাওয়ার ভাব দেখে হ্যারি বেশ খুশি হলো।

হ্যাগ্রিড বললেন–হোগার্টসে থাকতে হলে তোমাকে ওখানে যেতেই হবে। তুমি অন্যায় করেছ। এখন তার শাস্তি ভোগ করতে হবে।

এগুলো তো চাকরবাকরের কাজ। ছাত্রদের নয়। আমরা ভেবেছিলাম আমাদেরকে কিছু লেখালেখি বা এ ধরনের কিছু করতে হবে।

হ্যাগ্রিড তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন–হোগার্টসে তাই করতে হয়। যদি না করতে ইচ্ছে হয় তাহলে দুর্গে ফিরে যাও এবং বহিস্কৃত হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও।

ম্যালফয় একটুও নড়ল না। কঠোর ভঙ্গিতে হ্যাগ্রিডের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল।

এবার হ্যাগ্রিড তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন–মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা, আমি আজ রাতে ফে কাজটা করতে যাচ্ছি–তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমি চাই না তোমরা কেউ বিপদে পড়। এসো, আমার পেছনে পেছনে এসো।

হ্যাগ্রিড তাদেরকে বনের এক প্রান্তে নিয়ে এলেন। হাতে একটা লণ্ঠন ধরে একটা আঁকাবাকা পথ তাদের দেখালেন। পথটা বনে মিলিয়ে গেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে তাদের চুল উড়ছিল।

এদিকে তাকাও। হ্যাগ্রিড বললেন–মাটির ওপর ঝলমলে জিনিসটা দেখ। রূপালী রঙ। এটা ইউনিকর্নের রক্ত। এখানে একটা ইউনিকর্ন আছে যে আঘাত পেয়েছে। এ সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের ঘটনা ঘটল। গত বুধবারে আমি একটা ইউনিকর্নকে মৃত অবস্থায় দেখেছি। আমাদের চেষ্টা হবে আহত প্রাণীটাকে খুঁজে বের করে তাকে কষ্ট থেকে বাঁচানো।

নিজের ভয় গোপন না করে ম্যালফয় প্রশ্ন করল–ইউনিকর্ন যদি প্রথমেই আমাদেরকে আক্রমণ করে বসে।

যতক্ষণ তোমরা আমার সাথে অথবা আমার কুকুর ফ্যাঙের সাথে থাকবে ততক্ষণ তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।

ফ্যাঙের দীর্ঘ দাঁত দেখে ম্যালফয় বলে উঠল–আমি ফ্যাঙকে চাই।

হ্যাগ্রিড বলল–ফ্যাঙকে নিতে চাও নাও। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি ফ্যাঙ নিজেই খুব ভীরু। আমার দিকে তাকাও। হ্যারি আর হারমিওন বাম দিকে যাবে। ম্যালফয়, নেভিল আর ফ্যাঙ ডানদিকে যাবে। যদি আমাদের কেউ ইউনিকর্ন দেখতে পায় সে বা তার দল সবুজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবে। ঠিক আছে তোমরা তোমাদের জাদুদণ্ড বের কর। এখনই এটা নিয়ে অনুশীলন কর। যদি আমাদের কেউ বিপদে পড়ে সে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবে। আমরা সবাই তার খোঁজে চলে আসব। সাবধানে থেকো। চলে, যাওয়া যাক।

বনটা অন্ধকার ও নীরব। কিছুদূর যাবার পর পথ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। স্যরি, হারমিওন আর হ্যাগ্রিড বাঁদিকের রাস্তা ধরল। ম্যালফয়, নেভিল আর ফ্যাঙ ডানদিকের রাস্তায় আগে বাড়ল।

মাটির ওপর দৃষ্টি রেখে তারা নীরবে কিছুদূর অগ্রসর হল। একটু পরই তারা চাঁদের আলোতে ঝড়ে পড়া পাতার ওপর রূপালী নীল রক্ত দেখতে পেল। হ্যারি দেখল, হ্যাগ্রিড খুবই উদ্বিগ্ন।

নেকড়েবাঘ কি কোন ইউনিকর্নকে হত্যা করেছে? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাগ্রিড বললেন–ইউনিকর্ন ধরা খুব সহজ নয়। তারা শক্তিশালী ঐন্দ্রজালিক প্রাণী। ইউনিকর্ন আহত হয়েছে-এর আগে আমি কখনো শুনিনি।

তারা একটি পিচ্ছিল শেওলাপড়া গাছ পার হলো। হ্যারি জল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। বুঝতে পারল কাছাকাছি কোথাও জলাশয় আছে। আঁকাবাঁকা পথের এখানে সেখানে তারা ইউনিকর্নের রক্ত দেখতে পেল?

হারমিওন তুমি ঠিক আছো তো, কোন অসুবিধা হচ্ছে? হাড়ি বললেন।

যদি এটা আহত ইউনিকর্ন হয় তাহলে এটা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি।

তারপর হ্যাগ্রিড হঠাৎ বলে উঠলেন, তোমরা এই গাছটার পেছনে চলে যাও।

হ্যাগ্রিড, হ্যারি ও হারমিওনকে হাতে ধরে তাদেরকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে একটা বিশাল ওক গাছের পেছনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তিনি একটা তীর বের করে ধনুতে লাগালেন। তীর ছোঁড়ার জন্য তিনি প্রস্তুত। কাছাকাছি শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একটা পোশাক যেন শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর শব্দটি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

আমি জানি। তিনি বিড়বিড় করে বললেন-এখানে এমন কেউ আছে যার এখানে থাকার কথা নয়।

নেকড়ে? হ্যারি প্রশ্ন করে।

এখানে কোন নেকড়ে বাঘ নেই, নেই কোন ইউনিকর্ন। হ্যাগ্রিড বললেন–ঠিক আছে। এবার তোমরা আমার পেছনে পেছনে এসো। তবে সাবধান থেকো।

কিছুক্ষণ পর তারা একটা অদ্ভুত জীব দেখল। কোমর পর্যন্ত মানুষ। লালচুল–দাঁড়ি। কিন্তু কোমরের নিচ থেকে ঘোড়া। এমন কী একটা লাল লেজও রয়েছে!

হ্যাগ্রিড জানালেন যে এর নাম রোনান।

আর রোনান হচ্ছে একজন সেন্টর। গ্রীক পুরানে–তোমরা নিশ্চয়ই এর কথা শুনেছ। অর্ধমানব আর অর্ধ অশ্বদেহধারী।

ও তুমি রোনান। হ্যাগ্রিড নিরুদ্বেগে জানতে চাইলেন–তুমি কেমন আছ?

রোনান সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত নাড়ল।

গুড আফটারনুন হ্যাগ্রিড। রোনান বলল। তার কণ্ঠে একটা করুণ আর্তি ছিল।

রোনান হ্যাগ্রিডকে প্রশ্ন করল–তুমি কি আমাকে মারতে চেয়েছিলে?

তীরের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে হ্যাগ্রিড বললেন–নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। বনে এমন কেউ ছিল যার থাকার কথা ছিল না। থাক সে কথা। এরা ইল হ্যারি পটার আর হারমিওন গ্রেঞ্জার। তারা দুজনেই ছাত্র। আর ও হল রোনান। একজন সেন্টর।

আমরা দেখেছি। হারমিওন স্তিমিত কণ্ঠে বলল।

গুড আফটারনুন। রোনান বলল–তোমরা কি ছাত্র? তোমরা কি স্কুলে অনেক কিছু শিখেছো?

অল্প-সল্প। বিনীত কণ্ঠে হারমিওন জবাব দিল।

অল্প-সল্প। তবুও কিছু শিখছ রোনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। মাথা পেছনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ও মন্তব্য করল–আজ মঙ্গলগ্রহ বেশ উজ্জ্বল।

তুমি ঠিকই বলেছ। আকাশের দিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড সায় দিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড বললেন–আমি আনন্দিত যে আমরা একত্রিত হয়েছি। একটা ইউনিকর্ন আহত হয়েছে। তুমি কি তাকে কোথাও দেখেছ?

রোনান কোন জবাব দিল না। সে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–সর্বত্রই দেখা যায় যে নিরীহ ব্যক্তিরাই সবার আগে শাস্তি পায়। এখানেও তাই দেখছি।

হ্যাগ্রিড বললেন–রোনান, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু তুমি কি কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখেছ?

মঙ্গলগ্রহ আজ উজ্জ্বল। রোনান বলল। হ্যাগ্রিড অধীরভাবে রোনানকে লক্ষ্য করছিলেন।

রোনান আবার বলল–আজ রাতে মঙ্গলগ্রহটা অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল।

হ্যাগ্রিড বললেন–তাহলে তুমি অদ্ভুত কিছু দেখনি?

এবারও জবাব দিতে রোনান অনেক সময় নিল।

তারপর বললেন–বনে অনেক জিনিস লুকিয়ে থাকতে পারে।

রোনানের পেছনে গাছে মৃদু আন্দোলন দেখা গেল। হ্যাগ্রিড তার তীর ধনুক প্রস্তুত করতে উদ্যত হলেন। এবার দ্বিতীয় সেন্টর সামনে এল। তার চুল কালো। সে রোনান থেকেও বেশি হৃষ্ট–পুষ্ট।

হ্যালো বেইন। হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি কি ভালো আছো?

গুড আফটারনুন হ্যাগ্রিড, আশা করি ভালো আছো।

ভালো। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন। দেখো, আমি রোনানকে জিজ্ঞেস করছিলাম তুমি কি সম্প্রতি এখানে অদ্ভুত কিছু দেখেছ? এখানে একটি ইউনিকর্ন আহত হয়েছে। তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানো?

বেইন উঠে রোনানের পাশে বসল। আকাশের দিকে তাকাল। তারপর শুধু বলল–আজ রাতে মঙ্গলগ্রহ উজ্জ্বল।

একথা তো আমরা আগেও শুনেছি। হ্যাগ্রিড একটু বিরক্তির সাথে বললেন–ঠিক আছে, তোমাদের দুজনের কেউ যদি কোন অদ্ভুত জিনিস দেখ তাহলে আমাকে জানিও। এবার আমি উঠি।

হ্যারি আর হারমিওনও উঠল। কয়েকটা বৃক্ষ তাদের পথরোধ না করা পর্যন্ত তারা হাঁটতে লাগল।

সেনটরের কাছ থেকে কখনো সরাসরি উত্তর আশা করো না। হ্যাগ্রিড হ্যারি আর হারমিওনের উদ্দেশ্যে বললেন।

এখানে কি অনেক সেন্টর আছে? হারমিওন জানতে চায়।

না, খুবই কম। তারা নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখতে চায়। তবে তারা মাঝে মাঝে বেশ উপকারী হয়ে ওঠে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যায়। তারা অনেক কিছুই জানে কিন্তু বলতে চায় না।

গভীর বনের ভেতর দিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। হ্যারি ভাবছিল সেনটরদের কথা। রাস্তার বাঁকে আসার পর হারমিওন হ্যাগ্রিডের হাত আঁকড়ে ধরে বলল–দেখুন, দেখুন ওখানে লাল শিখা দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তারা বিপদে পড়েছে।

তোমরা দুজন এখানে দাঁড়াও। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমরা এখান থেকে কোথাও যাবে না। আমি এখানেই ফিরে আসব।

বনের ভেতর দিয়ে হ্যাগ্রিডের যাবার শব্দ তারা শুনতে পেল। তারা দুজনেই খুব ভয় পেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পাতার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ তাদের কানে এলো না।

হারমিওন ফিসফিস করে বলল–তোমার কি মনে হয় না তারা আঘাত পেয়েছে।

আমি ম্যালফয়ের জন্য ভাবি না। তবে নেভিলের জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে, কারণ সে প্রথমবারের মতো এখানে এসেছে।

সময় বয়ে যাচ্ছিল। তারা সবাই সজাগ হয়ে রইল। প্রতিটি শব্দ হ্যারিকে সচকিত করে তুলছে। হ্যারি ভাবছিল–কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা এখন কোথায়। অবশেষে একটা জোরালো শব্দ গ্রিডের ফিরে আসার কথা জানাল। হ্যাগ্রিড রাগে ফুঁসছিলেন।

হ্যাগ্রিডের সাথে ছিল ম্যালফয়, নেভিল আর ফ্যাঙ। নেভিলকে কৌতুক করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় সে ভয় পেয়ে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়।

হ্যাগ্রিড বললেন-এবার আমি দল পরিবর্তন করে দিচ্ছি। নেভিল তুমিও হারমিওনের সাথে থাকো। হ্যারি, তুমি এই বুদ্ধ ও ফ্যাঙের সঙ্গে যাও। আমি দুঃখিত। হ্যাগ্রিড ফিসফিস করে হ্যারিকে বললেন–তোমাকে ভয় দেখানো তার জন্য কঠিন। আমাদের কাজটা এভাবেই সারতে হবে।

ম্যালফয় আর ফ্যাঙকে নিয়ে হ্যারি বনের আরো গভীরে যাত্রা শুরু করল। আধঘণ্টা হাটার পর তারা গভীর বনের আরো ভেতরে প্রবেশ করল। আরো কিছুদূর যাবার পর তারা খুবই ঘন গাছের মধ্যে এল যেখানে হাঁটা আর সম্ভবপর ছিল না। সামনে গাছপালা খুব চওড়া এবং ঘন ঘন।

হ্যারির কাছে মনে হল রক্ত ক্রমশঃ পুরু হচ্ছে। একটা গাছের শেকড়ে বেশ রক্ত দেখে হ্যারির কাছে মনে হলো আহত প্রাণীটি আশপাশে কোথাও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একটা পুরনো ওক গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে হ্যারি একটা প্রাণী দেখতে পেল।

ওই দিকে দেখ। ম্যালফয়কে থামাবার জন্য তার বাহুতে হাত রেখে সে নিচু কণ্ঠে বলল।

মাটিতে সাদা উজ্জ্বল কী যেন চিকচিক করছিল। তারা তার কাছাকাছি গেল।

এটা একটা ইউনিকর্ন। মৃত। হ্যারি জীবনে এত সুন্দর প্রাণী দেখেনি। পাগুলো ছিল চিকন। পাগুলোর ওপর অস্বাভাবিক চাপ পড়েছে। মাটিতে পড়ে আছে। ইউনিকর্নের কেশর কালো পাতার ওপর ছড়িয়ে আছে।

হঠাৎ ঝোঁপ থেকে একটা কাপড়–ঢাকা ছায়ামূর্তি ইউনিকর্নের কাছে। এসে রক্তপান করতে শুরু করল।

আর্তনাদ করে ম্যালফয় আরও পিছিয়ে এল। ফ্যাঙও পিছু হটল। কাপড়ে ঢাকা ছায়ামূর্তিটি মাথা তুলে সরাসরি হ্যারির দিকে তাকাল। ইউনিকর্নের রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তারপর দ্রুতগতিতে হ্যারির দিকে ছুটে এল। ভয়ে হ্যারি নড়তে পারছিল না।

হ্যারির তীব্র মাথাব্যথা শুরু হল। এত ব্যথা এর আগে তার কখনও হয়নি। প্রচণ্ড ব্যথায় সে তার হাটুর ওপর হাত রাখল। হ্যারি মাথা উঠিয়ে দেখল ছায়ামূর্তি অপসৃত হয়েছে, একটা সেন্টর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

হ্যারিকে কাছে নিয়ে সেন্টর প্রশ্ন করল–তুমি ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, হ্যারি জবাব দিয়ে প্রশ্ন করল–প্রাণীটা কী ছিল?

সেন্টর হ্যারির প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছিল বিবর্ণ নীলকান্ত মণির মত আশ্চর্যজনকভাবে নীল। সে খুব সতর্কভাবে হ্যারির দিকে তাকাল এবং অনেকক্ষণ ধরে হ্যারির কপালের দাগের দিকে তাকিয়ে রইল।

এরপর বলল–তাহলে তুমিই হ্যারি পটার। তোমার এখন হ্যাগ্রিডের কাছে চলে যাওয়া উচিত। এই বন নিরাপদ নয়। বিশেষ করে তোমার জন্য। তুমি কি আমার পিঠে চড়তে পারো? তাহলে এই পথে তাড়াতাড়ি যেতে পারবে।

সেন্টর বলল–আমার নাম ফিরেঞ্জ। সে সামনের হাঁটু ভাঁজ করে পিঠ কাত করে হ্যারিকে তার পিঠে উঠতে বলল। ওইদিকে ঘন বনের গাছের ডাল–পালা কেটে কারো আসার শব্দ শোনা গেল।

দ্রুতগতিতে রোনান ও বেইন এসে উপস্থিত হলো।

ফিরেঞ্জ, বেইন ধমকের স্বরে প্রশ্ন করল-এটা কী করছ তুমি? তোমার পিঠে একজন মানুষ। তোমার কি লজ্জা করে না? তুমি কী একটি মামুলী খচ্চর?

ফিরেঞ্জ বলল–তুমি কি জানো ছেলেটি কে? এ হল হ্যারি পটার। সে যত তাড়াতাড়ি বনের বাইরে যেতে পারবে ততই তার জন্য ভালো।

তুমি তাকে কী কথা বলছিলে বেইন বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করল ফিরেঞ্জ তোমার কি মনে নেই যে, আমরা শপথ নিয়েছি আমরা স্বর্গের বিরুদ্ধে কিছু করব না। আমরা কি গ্রহ–নক্ষত্রের গতিবিধি পড়িনি?

রোনান নার্ভাস হয়ে মাটি খুঁটতে লাগল।

আমি নিশ্চিত, ফিরেঞ্জ মনে করছে সে ভালো কাজ করছে। খুব বিমর্ষভাবে রোনান এই মন্তব্য করল।

রেগে গিয়ে বেইন তার পেছনের পা দিয়ে মাটিতে লাথি মারল।

অন্যের মঙ্গল–তাতে আমাদের কী এসে যায়? যা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে কেবল তার ওপরই নির্ভর করা সেনটরদের দায়িত্ব। আমাদের বনে বিপন্ন মানুষের সেবা করা আমাদের কাজ নয়।

ফিরেঞ্জ রেগে হঠাৎ তার পেছনের পায়ে ঝাঁকি দিল। তার পিঠে সওয়ার থাকার জন্য হ্যারিকে ফিরেঞ্জের কাঁধ জড়িয়ে ধরতে হয়।

তুমি কি ইউনিকর্নটা দেখতে পাচ্ছ না? ফিরেঞ্জ চিৎকার করে বলল তুমি কি বুঝতে পারছ না–কেন এটা মারা গেছে? গ্রহগুলি কি তোমাকে এই গোপন খবরটি জানায়নি? বনের অপশক্তিগুলো দূর করার জন্য আমি নিজেকে নিয়োজিত করেছি। হ্যাঁ বেইন, প্রয়োজন হলে আমি মানুষের সাথে কাজ করে যাব।

রোনান ও বেইনকে পেছনে রেখে হ্যারিকে নিয়ে ফিরে দ্রুত অরণ্য ছেড়ে গেল।

হ্যারি ঠিক বুঝতে পারছিল না সে কোথায় যাচ্ছে।

তোমার ওপর বেইনের এত রাগ কেন? হ্যারি জানতে চাইল–কী কারণে তুমি আমাকে উদ্ধার করতে চাইছ?

ফিরেঞ্জ তার গতি কমিয়ে হ্যারিকে বলল মাথা নিচু রাখতে যেন ছোট গাছের ডাল–পালার সাথে তার ধাক্কা না লাগে, কিন্তু সে তারির প্রশ্নের কোন জবাব দিল না, দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা নীরবে বনের গাছপালা পার হলো। হ্যারির মনে হল–ফিরেঞ্জ বোধহয় তার সাথে কথা বলতে চায় না। তারা যখন বনের গভীরে ঢুকছিল তখন ফিরে হঠাৎ করে থেমে হ্যারিকে প্রশ্ন করল–হ্যারি পটার, তুমি কী জানো ইউনিকর্নের রক্ত কি কাজে লাগে?

এই অদ্ভুত প্রশ্নে হ্যারি হতভম্ব হয়ে গেল। একটু থেমে হ্যারি জবাব দিল–আমি ঠিক জানি না। আমি শুধু এইটুকু জানি যে শিং, লেজ আর পশম ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়।

ফিরেঞ্জ ব্যাখ্যা করল–ইউনিকর্ন হত্যা করা ভয়াবহ অপরাধ। যার হারাবার কিছু নেই এবং সবকিছু পাবার সম্ভাবনা আছে কেবল সেই লোকই এ ধরনের অপরাধ করতে পারে। তুমি যদি মৃত্যু থেকে এক ইঞ্চি দূরেও থাক, ইউনিকর্নের রক্ত লোমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে। তবে এর জন্য তোমাকে ভয়ঙ্কর মাশুল দিতে হবে। তুমি নিজে বাঁচার জন্য এক পবিত্র অক্ষম প্রাণীকে হত্যা করেছ। তোমার জীবন হবে অর্ধেক জীবন, অভিশপ্ত জীবন। ইউনিকর্নের রক্ত তোমার ঠোঁটে স্পর্শ করার সাথে সাথেই এই জীবন শুরু হবে।

হ্যারি পেছন ফিরে ফিরেঞ্জের মাথার দিকে তাকাল। ওর মাথা চাঁদের আলোতে রূপালী দেখাচ্ছে।

এমন বেপরোয়া কেউ কি আছে? হ্যারি জোরে বলে উঠল–সারা জীবনের জন্য অভিশপ্ত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু কি ভাল নয়?

তুমি ঠিক বলেছ। ফিরেঞ্জ বলল–জীবিত থাকার জন্য অন্য কিছু খাওয়া যেতে পারে–যা তোমার শক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে। এমন কিছু যা তোমাকে অমর করে রাখবে। হ্যারি পটার তুমি কি জানো, এই মুহূর্তে স্কুলে কি লুকোনো আছে?

নিশ্চয়ই পরশমণি। জীবনের সুধা। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কে–

তুমি কি এমন কারোরই কথা ভাবতে পারো না যে বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আসার অপেক্ষা করছে, জীবনের সাথে কোনভাবে ঝুলে থাকতে চাচ্ছে, সুযোগের অপেক্ষায় আছে?–ফিরেঞ্জের স্বগতোক্তি।

মনে হল লোহার মুষ্টি হ্যারির হৃদয়কে দুদিক থেকে চেপে ধরেছে। গাছের পাতার মর্মরশব্দের ভেতর দিয়ে হ্যারির মনে হল সে সেই কথা শুনতে পেয়েছে যা হ্যাগ্রিড তাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন।

কেউ বলেন উনি মারা গেছেন, আমি ঠিক জানি না উনি জীবিত না মৃত

তুমি কি বলতে চাচ্ছো তিনি ভল… হ্যারি উৎকণ্ঠিত।

হ্যারি, হ্যারি তুমি ঠিক আছে তো? হারমিওন দৌড়ে তাদের দিকে আসছিল। হ্যাগ্রিড তার পেছন পেছন।

ঠিক কী বলছে তা না বুঝেই হ্যারি বলল—

আমি ভালো। হ্যাগ্রিভ, ইউনিকর্নটা মারা গেছে।

আমি তোমাকে এখানে ছেড়ে যাচ্ছি। ফিরেঞ্জ বিড়বিড় করে বলল।

ইউনিকটা পরীক্ষা করার জন্য হ্যাগ্রিড ছুটে গেল।

তুমি এখন নিরাপদ। তোমার সৌভাগ্য কামনা করি, হ্যারি, ফিরেঞ্জ বলল-এর আগেও সেনটরগণ গ্রহ–নক্ষত্রের ভুল পাঠ করেছেন। আমার মনে হয় এবারও তাই হয়েছে।

হ্যারিকে পেছনে রেখে ফিরেঞ্জ আবার গভীর বনে ফিরে গেল।

***

তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থেকে রন অন্ধকার কমনরুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে কিডিচ খেলার ফাউলকে কেন্দ্র করে সে যখন চিৎকার করে উঠল, তখনই হ্যারি জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগাল। হ্যারি কি কি ঘটেছে বলা শুরু করতেই রনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

হ্যারি বসতে পারছিল না। সে আগুনের সামনে পায়চারি করছিল। তখনও সে কাঁপছিল।

স্নেইপ ভলডেমর্টের জন্য পাথরটা চাচ্ছেন,.. আর ভলডেমর্ট বনে অপেক্ষা করছে। অথচ আমরা ধারণা করে আসছি স্নেইপ পাথরটা চাচ্ছেন নিজে ধনী হওয়ার জন্য।

এসব কথা এখন রাখো তো। রন ফিসফিস করে বলল। রন এমনভাবে কথা বলল যে মনে হচ্ছে ভলভেমৰ্ট কাছাকাছি কোন স্থান থেকে। তার কথা শুনছে। হ্যারি রনের কথা শুনছে না।

ফিরেঞ্জ আমাকে রক্ষা করেছে যদিও এটা তার করার কথা নয়। বেইন খুব ক্ষিপ্ত ছিল। সে বলছিল ফিরে যা করছে তা গ্রহ নক্ষত্রের নির্দেশের হস্তক্ষেপ। তাদেরকে দেখাতে হবে যে ভলডেমর্ট ফিরে আসছে। বেইন মনে করে ফিরেঞ্জের উচিত আমাকে হত্যা করার জন্য ভলডেমর্টকে সুযোগ দেয়া। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে গ্রহ–নক্ষত্রের ভবিষ্যদ্বাণী আছে।

ওই নামটা কি তোমরা বলা বন্ধ করবে? রন ফিসফিস করে বলল।

এখন আমার অপেক্ষা করে দেখতে হবে স্নেইপ কখন পাথরটা চুরি করেন। হ্যারি আস্তে আস্তে বলে চলল–ভলডেমর্ট এসে আমাকে শেষ করে দেবে। আমার মনে হয় বেইন এতে খুশি হবে।

হারমিওন খুব ভয় পেয়েছে মনে হলো। তবে সে হ্যারিকে সান্ত্বনা দিল হ্যারি, সবাই জানে ডাম্বলডোরই একমাত্র ব্যক্তি যাকে ইউ-নো-হু ভয় পায়। যতক্ষণ ডাম্বলডোর আছেন–ততক্ষণ ইউ-নো-হু তোমার গা স্পর্শ করতে পারবে না। কে বলল সেনটররা সব সময় সঠিক কথা বলে? আমার কাছে এটা ভাগ্য–গণনার মত মনে হয়। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বলেন এটা জাদুর একটি অপরিপূর্ণ শাখা।

তাদের কথাবার্তা শেষ হবার আগেই আকাশ ফর্সা হয়ে গেল। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে তারা শুয়ে পড়ল। তবে রাতের বিস্ময় কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। হ্যারি বিছানার চাদর নিচে টেনে ঠিক করার সময় সুন্দরভাবে ভাঁজ করা অবস্থায় তার অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা পেল। পোশাকে একটা চিরকুট পিন দিয়ে আটকানো।

চিরকুটে লেখা—

যদি দরকার হয়।

১৬. দরোজার ফাঁদের ভেতর দিয়ে

সুদূর ভবিষ্যতে হ্যারি কখনও মনে করতে পারবে না এত সহজে কীভাবে সে সব পরীক্ষায় উতরে গেল। আর বিশেষ করে যখন ভলভেমর্টের আগমনের আশঙ্কা তার মাথার ওপর খাঁড়া হয়ে ঝুলছে।

এর মধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কুকুর ফ্লাফি এখনও নিশ্চয়ই সেই তালাবদ্ধ দরোজাটা পাহারা দিচ্ছে।

বড় ক্লাসরুমটা অত্যন্ত গরম। পরীক্ষার জন্য তাদের পালকের কলম দেয়া হয়েছে। এই কলমগুলো জাদু করা যেন কেউ পরীক্ষায় নকল না করতে পারে।

ব্যবহারিক পরীক্ষায় অধ্যাপক ফ্লিটউইক ছাত্রদের এক এক করে ডাকলেন। তারপর বললেন ডেস্কের ওপর নৃত্যরত আনারস তৈরি করতে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদের নির্দেশ দিলেন, ইঁদুরকে নস্যির কৌটা বানাতে। ভালো ফলাফলের জন্য পয়েন্ট দেবার ব্যবস্থা ছিল। বিস্মৃতির ওষুধ তৈরি করার নির্দেশ দিয়ে অধ্যাপক স্নেইপ তাদের অলক্ষ্যে পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে শ্বাস ফেলে সবাইকে নার্ভাস করেন।

কপালের তীব্র ব্যথা সত্ত্বেও হ্যারি যথাসাধ্য ভালো করল। বনে যাওয়ার পর থেকে সে কপালের যন্ত্রণায় ভুগছে। নেভিল ভেবেছিল, হ্যারি পরীক্ষায় ভালো করবে না। কারণ, তার মত হ্যারিরও রাতে ঘুম হয়নি। নেভিলের ধারণা পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় ওর ঘুম হয়নি, কিন্তু আসলে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ভেতর রক্তাক্ত ছায়ামূর্তি দেখতে পেতো।

হ্যারি বনে যা দেখেছে–তারা তা দেখেনি। অথবা এমনও হতে পারে যে তাদের কপালে হ্যারির মতো কাটা দাগ নেই। পাথর নিয়ে হ্যারি যতটা উদ্বিগ্ন রন বা হারমিওনকে তেমন উদ্বিগ্ন মনে হয় না। ভুলডেমর্টের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা তাদেরকেও ভাবনায় ফেলেছিল। অবশ্য ভলডের্ট তাদের কাছে স্বপ্নে এসে দেখা দিত না। তারা পরীক্ষার পড়া নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে–স্নেইপ বা অন্য কেউ কী করছেন বা কী করবেন-এ নিয়ে ভাবার মতো সময় তাদের হাতে ছিল না।

শেষ পরীক্ষাটা ছিল জাদুর ইতিহাসের ওপর। এক ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর। অধ্যাপক রিনসের ভূত যখন তাদের বলল–কলম বন্ধ কর আর তোমাদের পার্চমেন্ট ভাঁজ কর তখন অন্যদের সাথে হ্যারিও ভীষণ খুশি না হয়ে পারলো না। পরীক্ষার ফলাফল বের হবার আগ পর্যন্ত তাদের ছুটি।

রৌদ্র করোজ্জ্বল মাঠে সবাইকে ডেকে হারমিওন বলল–আমি ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক সহজ।

হারমিওন সব সময় পরীক্ষার পর পরীক্ষার খাতাগুলো আবার দেখে। রন বলে যে এতে করে সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই তারা মাঠে, হ্রদে, বৃক্ষের নিচে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগল।

ঘাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে রন বলল–আবার এত রিভিসনের দরকার কি। পরীক্ষার চিন্তা বাদ দাও হাসিখুশি থাক হ্যারি। এখনও এক সপ্তাহ হাতে আছে। এক সপ্তাহ পর জানা যাবে আমাদের পরীক্ষা কেমন হলো। অতএব এখন চিন্তা করার কোন কারণ নেই। হ্যারি তার কপালে হাত বুলাচ্ছিল।

হ্যারি ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–আমার এই কপালের কাটা দাগ সব সময় আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি যদি জানতে পারতাম-এর অর্থ কী। এর আগেও কষ্ট দিয়েছে তবে এত কষ্ট দেয়নি কখনও।

মাদাম পমফ্রের কাছে যাও। হারমিওন পরামর্শ দিল।

আমি অসুস্থ নই। হ্যারি জবাব দিল–আমার মনে হয় এটা একটা সতর্ক সংকেত, মনে হয় সামনে বিপদ আসছে।

রনও কাজ করতে পারছিল না, কারণ তখন খুব গরম আবহাওয়া ছিল।

রন আর হারমিওন হ্যারিকে সান্তুনা দিয়ে বলল–হ্যারি এত অস্থির হয়ো না। ঘাবড়াবার এত কি আছে, যেখানে ডাম্বলডোর রয়েছেন সেখানে পরশমণি নিরাপদ। আর অধ্যাপক স্নেইপ কখনোই ফ্লাফিকে কোন অবস্থাতেই কাবু করতে পারবেন না।

হ্যারি মাথা নাড়াল, কিন্তু একটা চিন্তা মাথা থেকে কিছুতেই দূর করতে পারছিল না। তার বার বার মনে হচ্ছিল, একটা কাজ তার করা উচিত ছিল কিন্তু করা হয়নি। যখন সে বিষয়টা হারমিওনের কাছে ব্যাখ্যা করল, হারমিওন বলল–সামনে পরীক্ষা। আমি রাত জেগে পড়ছিলাম। পড়ার মাঝখানে আমার মনে হল যে কাজটা আমরা শেষ করেছি।

হ্যারি জানে, তার অস্থির মনের সাথে কাজের কোন সম্পর্ক নেই। হঠাৎ সে দেখলো একটা পেঁচা স্কুলের দিকে উড়ে আসছে। ঠোঁটে একটা চিঠি। আকাশটা উজ্জ্বল, নীল। হ্যাগ্রিড ছাড়া আর কেউ হ্যারিকে চিঠি লেখে না। অবশ্য হ্যাগ্রিড কখনোই ডাম্বলডোরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। হ্যাগ্রিড কখনোই বলবেন না, কীভাবে ফ্লাফিকে কাবু করা যায়–হ্যারি দ্রুত লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। রন জানতে চাইল–কোথায় যাও।

আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আমাদেরকে এখুনি হ্যাগ্রিডের কাছে যেতে হবে।

কেন? হারমিওন প্রশ্ন করল।

তুমি তো জানো, হ্যাগ্রিড কি চান? হ্যারি বলল–তিনি সবার আগে একটা ড্রাগন চান। অনেকেই পকেটে ড্রাগনের ডিম রাখে। এটা কিন্তু জাদু আইনের পরিপন্থী।

তুমি কী করতে চাও? রন জানতে চাইল। এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে হ্যারি বনের দিকে রওনা হল, রন ও হারমিওন তার পেছনে পেছনে গেল।

হ্যাগ্রিড বাইরে আরাম কেদারায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার ট্রাউজার আর জামার আস্তিন গুটানো। মটরশুটি ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে পাশে রাখছিলো।

হ্যালো মুচকি হেসে হ্যাগ্রিড তাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন পরীক্ষা তো শেষ। কি, একটু পানীয় পানের সময় হবে কী?

হ্যাঁ, তা হতে পারে। : বন বলল, কিন্তু হ্যারি ওর কথা থামিয়ে বললো–না, আমাদের একটু তাড়া আছে, হ্যাগ্রিড। আমরা একটা বিশেষ কারণে এখানে এসেছি। আপনার মনে আছে, আপনি যে রাতে নর্বার্টকে ডিমটা পেয়েছিলেন, তখন আপনি যে লোকটার সাথে তাস খেলছিলেন, সে লোকটি দেখতে কেমন।

আমার মনে নেই। হ্যাগ্রিড নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল।

হ্যাগ্রিডের কথা শুনে তারা তিনজনই হতভম্ব হয়ে গেল। হ্যাগ্রিড বললেন, এখানে কত রকম লোক আসে। গ্রামের শেষ প্রান্তের পাবে মদ খেতে কত কিসিমের আজব লোক আসে। কেউ কেউ ড্রাগন ডিলার। ওই লোকটার মুখটাও তো আমি দেখতে পাইনি, মাথার টুপিটা এমন নিচু করে মুখ ঢেকে রেখেছিল। হ্যারি মটরশুটি বৌলের কাছে বসে পড়ল।

হ্যাগ্রিড, আপনি তার সাথে কি কথা বলেছেন। আপনি কি কখনও হোগার্টসের কথা উচ্চারণ করেছেন?

হয়ত বলে থাকতে পারি। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন তাকে আমি এটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে হোগার্টসে আমি একজন গেইম কীপার। তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন আমি কী ধররে প্রাণী দেখাশোনা করি। আমি তাকে বলেছিলাম যে ড্রাগন আমার প্রিয় প্রাণী।

সে কি ফ্লাফির ব্যাপারে কোন আগ্রহ প্রকাশ করেছে?

হ্যারি জানতে চাইল।

হতে পারে, বলে হ্যাগ্রিড মনে করার চেষ্টা করলেন। বলল, হ্যা মনে পাড়েছে, আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ

আচ্ছা, হোগার্টসে তোমরা কটা তিন মাথাওয়ালা কুকুর দেখেছ? তাই আমি তাকে বলেছিলাম–তুমি যদি ওকে শান্ত করতে জান, তা হলে ফ্লাফি একটি কেকের মতো। গান বাজালেই সে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়বে।

হ্যাগ্রিড হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন-এসব তোমাদের বলা আমার উচিত হয়নি। যা বলেছি সব ভুলে যাও। তাকে চিন্তিত মনে হল উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে গিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলেন। হ্যারি, রন আর হারমিওন কেউ কোন কথা বললো না।

বিষয়টা ডাম্বলডোরকে জানাতে হবে। হ্যারি বলল–ফ্লাফিকে কীভাবে বশ করা যায়, হ্যাগ্রিড ওই লোককে বলে দিয়েছেন। আমার ধারণা লোকটা–ছদ্মবেশে হয় স্নেইপ নতুবা ভোলাডেমর্ট। আমার ধারণা, ভালভোর আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন, আমার এটাও বিশ্বাস, ফিরে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন যদি বেন তাকে বাধা না দেয়।

ডাম্বলডোরের অফিস কোথায়?

তারা চারিদিকে দেখতে লাগলো, ডাম্বলডোরের অফিসে যাওয়ার কোন নির্দেশনা দেখা যায় কিনা। ডাম্বলডোর কোথায় থাকেন তারা জানে না কেউ তাদের বলেওনি। ডাম্বলডোরের বাসভবনে কেউ গিয়েছে কখনো, এমন কথাও তারা শোনেনি।

আমাদের করতে হবে… হ্যারি যখন কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই একটা কণ্ঠস্বর হল ঘর থেকে তাদের কানে ভেসে এল।

তোমরা তিনজন এখানে কী করছ? কণ্ঠস্বরটা ছিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের। তার হাতে একগাদা বই।

আমরা অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে দেখা করতে চাই। হারমিওন সাহসের সাথে বলল। হ্যারি, আর রন চুপ রইল।

ম্যাকগোনাগল বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন–ডাম্বলডোরের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাও, কিন্তু কেন? একটু ঢোক গিলে হ্যারি বলল–বিষয়টা গোপনীয়।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের চেহারায় বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট।

তিনি বললেন–দশ মিনিট আগে ডাম্বলডোর বের হয়েছেন। তিনি জাদু মন্ত্রণালয় থেকে জরুরী পেঁচা পেয়ে লন্ডন গেছেন।

তিনি চলে গেছেন? হ্যারি হতাশার সাথে মন্তব্য করল–তাহলে এখন কী হবে?

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যারি, অধ্যাপক ডাম্বলডোর খুব উঁচু মাপের জাদুকর। তার সময়ের মূল্য আছে।

কিন্তু এটাও তো খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়।

মি. পটার। জাদু মন্ত্রণালয়ের কাজের চাইতে কি তোমার কথা বলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

কলড্রনটা বাতাসের দিকে ঠেলতে ঠেলতে হ্যারি বলল–প্রফেসর, বিষয়টা পরশমণি সংক্রান্ত।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল প্রত্যাশা কেন, কল্পনাও করতে পারেননি যে, তিনি এ রকম একটা কথা শুনবেন। অবাক বিস্ময়ে পাথরের মত তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং হাতের বইগুলো হাত থেকে পড়ে গেল। কিন্তু তিনি একটা বইও মাটি থেকে তুললেন না।

তোমরা এসব জানো কীভাবে? ম্যাকগোনাগল প্রশ্ন করলেন।

প্রফেসর–আমার মনে হয়–আমি জানি–অধ্যাপক স্নেইপ এটা চুরি করতে চাচ্ছেন। এই পাথরটা। তাই এ ব্যাপারে ডাম্বলডোরের সাথে আমাকে কথা বলতেই হবে।

সন্দেহ আর বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকালেন। তারপর একটু থেমে বললেন–অধ্যাপক ডাম্বলডোর আগামীকাল ফিরে আসবেন। আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কীভাবে পাথরটার খোঁজ পেলে। তবে নিশ্চিত থেকো–কেউই এটা চুরি করতে পারবে না। এটা এখন নিরাপদেই আছে।

কিন্তু প্রফেসর…

আমি কী বিষয়ে কথা বলছি সেটা আমি জানি। ম্যাকগোনাগল এই কথা বলে মাটি থেকে বইগুলো কুড়িয়ে নিলেন। তারপর একটু থেমে বললেন–তোমরা সবাই একটু বাইরে গিয়ে রোদ উপভোগ কর।

ম্যাকগোনাগল তাদের চোখের আড়ালে চলে যেতেই হ্যারি বলল আজ রাতেই স্নেইপ দরজার ফাঁদ পার হবেন। তার যা যা দরকার সবই তিনি হাতে পেয়ে গেছেন। ডাম্বলডোরকে কৌশলে বাইরে পাঠানো হয়েছে। আমি নিশ্চিত, ডাম্বলডোরের লন্ডন পৌঁছানোর পর জাদু মন্ত্রণালয়ও বিরাট ধাক্কা খাবে।

তাহলে আমরা কী করতে পারি?

হারমিওন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হ্যারি ও রন একটু ঘুরে তাকাতেই দেখে স্নেইপ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে।

তার দিকে তাকাতেই, গুড আফটারনুন, অদ্ভুত ধরনের হাসি হেসে স্নেইপ বললেন-এমন একটি দিনে তো তোমাদের এখানে থাকার কথা নয়।

আমরা হ্যারি কী বলতে কী বলবে, গুছিয়ে নিতে না পারায় তার কিছু বলা হলো না।

সাবধানে থেকো। এইভাবে ঘোরাফেরা করলে লোকে সন্দেহ করবে। আর তোমরা নিশ্চয়ই এটা চাইবে না যে, গ্রিফিল্ডর হাউজ আরো পয়েন্ট হারাক।

তারা বাইরে যেতে উদ্যত হলো। ঠিক তখনি স্নেইপ আবার তাদের ডাকলেন।

হ্যারি, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আবার যদি তোমাকে এভাবে রাতে ঘোরাঘুরি করতে দেখি, তাহলে তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

স্নেইপ স্টাফরুমের দিকে অগ্রসর হলেন।

হ্যারি রন ও হারমিওনের দিকে তাকাল।

আমাদের এখন যা করতে হবে। হ্যারি ফিস ফিস করে বলল আমাদের একজনকে অন্তত স্নেইপকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে। স্টাফ রুমের বাইরে তাকে ফলো করতে হবে। হারমিওন, তোমাকেই এ দায়িত্বটা নিতে হবে।

আমি কেন? হারমিওন প্রশ্ন করে।

কারণ, তুমি এ কাজটা ভালো করতে পারবে। ভান করবে, যেন তুমি ফ্লিটউইকের জন্য অপেক্ষা করছ। কেননা ফ্লিটউইকের সাথে তোমার পরিচয় আছে।

প্রথমে আপত্তি করলেও হারমিওন এই প্রস্তাবে রাজি হলো। হ্যারি বলল–আমাদের এখন চার তুলার করিডোরের বাইরে যাওয়া উচিত। রন, চলে এসো।

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। যে দরোজাটা ফ্লাফি থেকে স্কুলটাকে পৃথক করেছে, সেই দরোজায় তারা হাজির হওয়া মাত্র সেখানে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। তিনি তাদের দেখে রেগে আগুন, তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন–মনে হচ্ছে, তোমরা কাউকেই তোয়াক্কা করার প্রয়োজন মনে করছ না। তোমরা তো একেবারেই সীমা ছাড়িয়ে গেছ। আমি যদি তোমাদের কাউকে এখানে আবার দেখি, আমি গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে আরো পঞ্চাশ পয়েন্ট কেটে নেব। হ্যাঁ, গ্রিফিল্ডর আমার নিজের হাউজ হওয়া সত্ত্বেও

হ্যারি আর রন কমনরুমে ফিরে এলো। হ্যারি শুধু এইটুকু বলেছে–যা হোক হারমিওন স্নেইপের ওপর নজর রাখছে। ঠিক তখনি মোটা মহিলার প্রতিকৃতিটি উন্মুক্ত হলো এবং হারমিওনও এসে উপস্থিত হলো।

হ্যারি, আমি দুঃখিত। হারমিওন বলল–স্নেইপ এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি করছি। আমি বললাম–আমি ফ্লিটউইকের জন্য অপেক্ষা করছি। ফ্লিটউইককে আনার জন্য স্নেইপ চলে গেলেন। আমিও চলে এসেছি। আমি জানি না স্নেইপ আসলে কোথায় গেছেন।

ঠিক আছে। হ্যারি জবাব দিল।

অন্য দুজন তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ ও চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।

হ্যারি বলল–আমি আজ রাতে বেরিয়ে পরশমণির খোঁজ করব।

তুমি কি পাগল হয়েছ? রন বলে উঠল।

না তুমি যেতে পারবে না। হারমিও বলল–বিশেষ করে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল আর স্নেইপের সাবধানের পর। তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দেবে।

হ্যারি জবাব দিল–বহিষ্কারই তো হবে আর কী? তোমরা কি বুঝতে পারছ না–স্নেইপ যদি পাথরটা পেয়ে যান তাহলে ভোলডেমর্ট ফিরে আসবে। সে তার ক্ষমতা ফিরে পেতে চায়। সে এলে হোগার্টসকে কালো জাদুর বিদ্যালয়ে পরিণত করবে। তোমরা কী মনে কর, গ্রিফিল্ডর হাউজ কাপ পেলেও তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে সে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবে। আমার পরশমণি পাবার আগে ওরা যদি আমাকে ধরে ফেলে, আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি বাড়ি ফিরে যাব। আজ রাতে আমি গোপন দরোজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করব। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না। মনে রেখো ভোলডেমট আমার বাবা–মাকে হত্যা করেছে।

তুমি ঠিকই বলেছ, হ্যারি। হারমিওন নিচু কণ্ঠে বলল।

হ্যারি বলল–আমি আমার অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা ব্যবহার করবো। ভাগ্য ভালো, পোশাকটা পাওয়া গেছে।

রন বলল-এ পোশাকটা কি আমাদের তিনজনকে ঢাকবে?

তিনজন কেন? হ্যারি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

তুমি কি ভেবেছ–আমরা তোমাকে একা যেতে দেব?

অবশ্যই নয়। হারমিওন সাথে সাথে করল–তুমি কি করে ভাবলে, আমাদেরকে বাদ দিয়ে তুমি পরশপাথরের খোঁজে যাবে? আমি এক নজর বইগুলো দেখে আসি। হয়ত সেখানে জরুরী কিছু পেয়েও যেতে পারি। যদি আমরা ধরা পড়ি তাহলে তোমাদেরকেও তো স্কুল থেকে বের করে দেয়া হবে। হ্যারি বলল।

না, আমার বেলায় তা হবে না। হারমিওন বলল–ফ্লিটউইক আমাকে গোপনে বলেছেন যে, আমি তার পরীক্ষায় ১১২% নম্বর পেয়েছি। এরপর তারা আমাকে আর স্কুল থেকে বের করে দেবে না।

***

ডিনারশেষে তারা তিনজন কমনরুমে গিয়ে বসলো, তারা চিন্তিত। কেউ তাদের ধারে কাছেও ভিড়লো না। গ্রিফিন্ডারের কারো যেন হ্যারির সঙ্গে কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই। এই প্রথমবারের মতো হ্যারি এ ধরনের উপেক্ষা নিয়ে মাথা ঘামালো না।

হারমিওন আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, বইয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা। হ্যারি আর রন তেমন কোন কথাবার্তা বলেনি। তাদের দুজনেরই মাথায় চিন্তা–আজ রাতে তারা যে কাজে বেরুবে সেটা নিয়ে।

এক সময় কমনরুম খালি হয়ে গেল। প্রায় সবাই শুতে গেছে।

অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা নিয়ে এসো। রন আস্তে আস্তে বলল।

হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ডর্মিটরিতে গেল। পোশাকটা নেবার সময় বাঁশির ওপর হ্যারির দৃষ্টি গেল। বাঁশিটি হ্যাগ্রিড তাকে তার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। এই বাঁশিটা ফ্লাফির ওপর প্রয়োগ করলে কেমন হয়!

হ্যারি আবার কমনরুমে ফিরে এলো।

আমরা এখানেই পোশাকটা পরে দেখি তিনজনের হয় কিনা। আবার ফিলচ আমাদের কাউকে দেখে ফেলে–সে ভয়ও রয়েছে।

তোমরা কী করছ? ঘরের কোন থেকে একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

নেভিলের কণ্ঠস্বর।

পোশাকটা পেছনে ভাল করে হ্যারি তাড়াতাড়ি বলল–না, কিছু না।

তাদের অপরাধী অপরাধী মুখের দিকে তাকিয়ে নেভিল বলল–তোমরা নিশ্চয়ই আবার বাইরে যাচ্ছো? তোমরা আবারও ধরা পড়বে। আবার গ্রিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কাটা যাবে।

হ্যারি জবাব দিল–তুমি বুঝতে পারবে না। আমাদের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নেভিলও ওদের থামাবার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সে বলল আমি তোমাদের যেতে দেব না। প্রতিকৃতির গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে নেভিল বলল–আমি তোমাদের বাধা দেব।

নেভিল রন বলল–সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। বুদ্ধুর মত কাজ করো না।

আমাকে বুন্ধু বলল না। নেভিল বলল–আমি তোমাদেরকে আর নিয়ম ভাঙতে দেব না। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা তোমরাই আমাকে শিখিয়েছ।

আমাদের বিষয়ে তোমাকে একথা বলা হয়নি। রন হতাশার সুরে বলল–নেভিল তুমি বুঝতে পারছ না তুমি কি করছ?

রন এক পা আগে বাড়ল। নেভিল তার ব্যাঙ ট্রেভরকে মাটিতে ফেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমাকে আঘাত করে যেতে পারলে যাও। নেভিল হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল–আমি তোমাদের বাধা দেয়ার জন্য প্রস্তুত।

হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকাল।

কিছু একটা করো। অস্থির হয়ে হ্যারি বলল।

হারমিওন আগে বাড়ল।

নেভিল, হারমিওন বলল–সত্যিই আমি তোমার ব্যবহারে খুবই দুঃখ পেয়েছি।

হারমিওন এবার তার জাদুদণ্ড ওঠাল।

পেট্ৰিফিকাশ টোটালাস। নেভিলের প্রতি ইঙ্গিত করে সে এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করল।

নেভিলের মুষ্টিবদ্ধ হাত শিথিল হয়ে ঝুলে পড়ল। সারা পা–শরীর পাথর হয়ে গেল। তারপর একটু নড়ে উঠে দুম করে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

হারমিওন দৌড়ে নেভিলের কাছে গেল। তার দাঁতে খিল লেগে গেছে। তাই সে কথা বলতে পারছে না। কেবল তীর চোখ কাজ করছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নেভিল শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

তাকে তুমি কী করেছ? হ্যারি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

আমি তার শরীর নিশ্চল করার জাদু করেছি। হারমিওন জবাব দিল নেভিলের ওপর এ জাদু প্রয়োগ করতে হয়েছে বলে আমার খুব খারাপ লাগছে।

নেভিল, আমরা এটা করতে বাধ্য হয়েছি। ব্যাখ্যা করার মতো সময়ও। আমার হাতে নেই। হ্যারি বলল।

নেভিল তুমি পরে এটা বুঝতে পারবে। নেভিলের দেহের ওপর দিয়ে যেতে যেতে রন বলল। তারা অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা পরে ফেলো।

নেভিলকে এভাবে বেহুশ অবস্থায় ফেলে যাওয়াও ঠিক হচ্ছে না। এই নিয়ে তারা তিনজনই খুব উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় প্রতিটি ছায়ামূর্তিকেই তারা ফিলচ বলে মনে করতে লাগল। আর প্রতি মুহূর্তে ভয় করছিল-এই বুঝি পিভিস তাদের ওপর লাফিয়ে পড়বে। সিঁড়ির গোড়ায় তারা মিসেস নরিসকে দেখতে পেল।

তাকে লাথি দিয়ে ফেলে দেই। রন হ্যারির কানে কানে বলল। হ্যারি মাথা নাড়িয়ে না বলল। নরিস তার উজ্জ্বল চোখ দিয়ে তাদের দিকে তাকালেও সে কিছু করেনি।

চার তলার সিঁড়িতে ওঠার আগে তারা কাউকেই দেখেনি। চার তলায় এসে পেল পিভসকে। পিভস কার্পেটটা ঝাড়ুছিল। পিভস চিৎকার করে উঠল–কে ওখানে?

সে তার কালো চোখ ছোট করে বলল–আমি দেখতে না পেলেও আমি জানি তোমরা এখানে আছে। সে ছন্দ করে প্রশ্ন করলো, তোমরা কারা? তোমরা কী ভূত না পেত্নি, না ছাত্র না জন্তু…।

সে বাতাসে ভর করে তাদের কাছে চলে এলো।

আমি কি ফিলচকে ডাকব? পিভস বলল। কোন কিছু যদি অদৃশ্য হয়ে আমার চারদিকে ঘোরে তাহলে আমাকে তাই করতে হবে।

হঠাৎ হ্যারির মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। ধমকের স্বরে বলল, ব্লাডি ব্যারনের প্রয়োজন হলে সে অদৃশ্য হবেই। পিভস হ্যারিকে ব্যারন মনে করে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো।

নরম তল তলে স্বরে পিভিস বলল, জ্বী স্যার, জ্বী স্যার।

নিজেকে ব্লাডি ব্যারন বলে পরিচয় দিয়ে হ্যারি অনায়াসে ছাড়া পেয়ে গেল।

পিভস। হ্যারি একটু কর্কশকণ্ঠে বলল–আমাদের এখানে কিছু কাজ আছে। আজ রাতটার জন্য এখান থেকে একটু দূরে সরে থাকো।

আমি অবশ্যই দূরে থাকব স্যার। পিভস খুব বিনয়ের সাথে বলল আশা করি আপনার কাজ ঠিকভাবে হবে। পিভস তৎক্ষণাৎ বিদায় নিল।

চমৎকার হ্যারি। রন ফিসফিস করে বলল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা চার তলার করিডোরে পৌঁছলো। দরোজা আগে থেকেই খোলা ছিল।

আমরা এসে গেছি। হ্যারি নিচু কণ্ঠে বলল–স্নেইপ ইতোমধ্যেই ফ্লাফিকে অতিক্রম করেছেন।

দরোজা খোলা দেখে তাদের তিনজনেরই ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারিত হয়ে গেল।

পোশাকের ভেতরে থেকেই হ্যারি অন্য দুজনের উদ্দেশ্যে বলল তোমরা যদি ফিরে যেতে চাও যেতে পার, আমি তোমাদের দোষ দেব না। ফিরে যাওয়ার সময় অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা নিয়ে যেতে পারো। এটার প্রয়োজন আমার আর নেই।

বোকার মত কাজ করো না। রন বলল।

আমরা তোমার সাথেই আছি। হারমিওন বলল।

হ্যারি ধাক্কা দিয়ে দরোজাটা খুলল।

দরোজা খোলার সাথে সাথে কুকুরের গর্জন তাদের কানে ভেসে এলো।

কুকুরটা এর তিনটি নাক দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করছে। যদিও কুকুরের দৃষ্টি ছিল তাদের দিকে কিন্তু তাদেরকে দেখেনি।

তার পায়ে এটা কী? হারমিওন ফিসফিস করে প্রশ্ন করল।

বীণার মত মনে হচ্ছে। রন বলল নিশ্চয়ই অধ্যাপক স্নেইপ এটা ফেলে গেছেন। বাঁশি বাজানো শেষ হওয়া মাত্রই কুকুরগুলো জেগে উঠবে। হ্যারি বলল।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের দেয়া বাঁশিটা ঠোঁটে লাগিয়ে বাজাতে শুরু করল। বাঁশিতে হ্যারি তেমন কোন সুর তুলল না। কিছুক্ষণের মধ্যে কুকুরের ঘেউ ঘেউ বন্ধ হলো। হ্যারির বাঁশী শুনে কুকুর আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ল। গর্জন স্তিমিত হয়ে এলো। হাটু মুড়ে কুকুরটা বসে পড়ল। তারপরই মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

অদৃশ্য হওয়ার পোশাক থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁদের দরোজার দিকে যেতে যেতে রন বলল–বাঁশী বাজিয়ে যাও। এগিয়ে যেতে যেতে তারা যখন কুকুরের দানবীয় মাথার কাছাকাছি পৌঁছল তখন তারা কুকুরের নিঃশ্বাসের তাপ অনুভব করল।

রন বলল–আমার মনে হয়–চেষ্টা করলে আমরা দরোজাটা খুলতে পারব। হারমিওন, তুমি কি আমার সাথে যাবে?

না, আমি যাব না। হারমিওন বলল।

ঠিক আছে। দাঁতে দাঁত চেপে রন বলল। কুকুরের লেজ অতিক্রম করে রন ফাঁদের দরোজার হাতল চাপতেই দরোজাটা খুলে গেল।

তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ? হারমিওন উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করল।

রন বলল না, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। কিছু ধরে নিচে নামারও কোন উপায় নেই। আমাদেরকে লাফ দিতে হবে।

হ্যারির বাঁশি বাজানো তখনও শেষ হয়নি। তার দিকে তাকানোর জন্য হ্যারি রনকে ইশারা করল।

হ্যারিকে রন বলল–তুমি কি সবার আগে যেতে চাও? আমি জানি না স্থানটি কতটা গভীর। হ্যারি বাঁশি হারমিওনকে দিল, যাতে সে বাঁশি বাজিয়ে কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারে।

কয়েক মুহূর্ত বাঁশি বাজানো বন্ধ থাকায় কুকুরটা মৃদু স্বরে ঘেউ ঘেউ করল। হারমিওন যখন আবার বাঁশি বাজানো শুরু করল তখন কুকুরটা আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

হ্যারি ওপরে উঠল। সেখান থেকে নিচে তাকিয়ে সে কোন খেই খুঁজে পেল না। হ্যারি মাথা নিচু করে তার হাতের আঙুলের ওপর ভর দিল। এবং দরোজার ফঁদের ভেতর দিয়ে ওপরে রনের দিকে তাকিয়ে বলল–আমার যদি কোন কিছু ঘটে তাহলে তোমরা আর আমার পেছনে আসবে না। সরাসরি পেঁচাঁদের কাছে চলে যাবে এবং হেডউইগকে অধ্যাপক ডাম্বলডোরের কাছে পাঠিয়ে দেবে।

ঠিক আছে। রন জবাব দিল। আশা করি এক মিনিটের ভেতর আবার দেখা হবে।

হ্যারি নিচে ঝাঁপ দিল।

গভীর, গভীর তলদেশ। সে নিচে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কোথায় এর শেষ কে জানে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস।

ধপ করে হ্যারি নরম কোন বস্তুর ওপর পড়ল। মনে হল নরম কোন উদ্ভিদ।

হ্যারি ওপরের দিকে চেঁচিয়ে বলল–রন, ঝাঁপ দাও। ভয় নেই। এখানে রম কিছু আছে।

রন লাফ দিয়ে হ্যারির কাছে চলে এলো।

জিনিসটা কী? রন প্রথমেই প্রশ্ন করল।

মনে হচ্ছে এক ধরনের উদ্ভিদ। তারপর হারমিওনের উদ্দেশ্যে বলল হারমিওন তুমিও চলে এসো।

দুরের বাঁশি বন্ধ হয়ে গেছে। বিকট আওয়াজে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। হারমিওনও ঝাঁপ দিয়ে তাদের কাছে চলে এল।

আমরা এখন স্কুল থেকে অনেক অনেক দূরে। হারমিওন মন্তব্য বলল।

আমাদের ভাগ্য ভালো, এখানে উদ্ভিদ ছিল। রন বলল।

ভাগ্যবান! শব্দটি উচ্চারণ করেই হারমিওন চিৎকার করে উঠল।

তোমরা দুজনেই নিজেদের দিকে লক্ষ্য কর।

কোন কিছু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হারর্মিওন লাফ দিয়ে একটি স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। সে কোন কিছু থেকে আত্নরক্ষার জন্য হাত পা ছুড়ছে। সে যখন উদ্ভিদের ওপর লাফ দেয় তখন উদ্ভিদটার লতা সাপের মত পেচিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরেছে।

হ্যারি আর রনের অজান্তেই সাপ জাতীয় উদ্ভিদ তাদের পা জড়িয়ে ধরেছে।

হারমিওন কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে লতার বন্ধন থেকে মুক্ত করলেও হ্যারি আর রনকে লতা শক্ত করে জাপটে ধরেছে। তারা বাধন শিথিল করার জন্য যতই চেষ্টা করছে বন্ধন ততই শক্ত হচ্ছে।

হারমিওন বলল–তোমরা নড়াচড়া করো না। আমি জানি এটা কী। এটাকে বলা হয় ডেভিলস স্নেয়ার বা শয়তানের কাজ।

আমি খুশি হয়েছি যে, তুমি লতাটার নাম জানো। এটাও একটা বিরাট সাহায্য। এই বলে রন তার গলা থেকে লতার বাঁধন খোলার চেষ্টা করল।

চুপ করে থাক। এটাকে কীভাবে হত্যা করা যায় সেটা আমি মনে করার চেষ্টা করছি। হারমিওন বলল।

রন চিৎকার করল–আমাকে বাঁচাও। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

শয়তানের কাজ। অধ্যাপক স্প্রাউট এ বিষয়ে ক্লাসে কি বলেছিলেন হারমিওন মনে করতে পারছে না।

হ্যারি বলল আগুন জ্বালাও।

আগুন তো জ্বালাব। কিন্তু কাঠ কোথায়? হারমিওন প্রশ্ন করল।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রন চিৎকার করল। তুমি না জাদুকর?

ওহ! ঠিক বলেছ। বলে হারমিওন তার জাদুদণ্ড বের করল।

কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করল। বহ্নিশিখা ছুঁড়ে দিল। এ শিখ সে অধ্যাপক স্নেইপের দিকেও ছুঁড়ে দিয়েছিল। নীল ধোঁয়া এসে তার বাধন ঢিলে করে দিল। হ্যারি ও রন বাঁধন খুলে নিজেদের মুক্ত করল।

এরপর থেকে তুমি হার্বোলোজিতে আরো বেশি মনোযোগ দিও। হ্যারি তার মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল।

আমিও তাই বলি। রন বলল, আর এটা আমাদের সৌভাগ্য যে, কোন সঙ্কটের সময় হ্যারি মাথা গরম করে না।

এই পথে যেতে হবে। হ্যারি একটা পথের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

হঠাৎ পানির ছলাৎছল আওয়াজ।

কিছু শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

কোন ভূত প্রেত নয় তো।

বলা মুশকিল। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা নড়ছে।

হঠাৎ সামনে পড়ল উজ্জ্বল আলোকিত একটা ঘর। উঁচু সিলিং? আর্চের মতন। এক ঝাঁক পাখি উড়ছে। নানা রঙের পাখি। একদিকে একটা মোটা কাঠের দরোজা।

রন বলল–ঘরটা পেরোতে গেলে কি তারা আমাদেরকে আক্রমণ করবে?

হতেও পারে! হ্যারি বলল। তবে ওদের খুব খারাপ মনে হচ্ছে না। ওরা যদি সত্যিই আমাদেরকে আক্রমণ করে আমি দৌড় দেব।

হ্যারি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকল। তারপর ঘরের ভেতর দিয়ে দৌড় দিল।

হ্যারির আশঙ্কা ছিল পাখিরা তাদের তীক্ষ্ণ ঠোই বা নখ দিয়ে যেকোন সময় তাকে আক্রমণ করতে পারে।

কিন্তু ভাগ্য ভাল তেমন কিছু ঘটেনি। হ্যারি নির্বিঘ্নে দরোজার কাছে গিয়ে হাতল ধরে টান দিল, দরোজা খুলল না। দরোজাটা তালাবদ্ধ।

রন ও হারমিওন হ্যারিকে অনুসরণ করল। দরোজার সামনে এসে তারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা দরোজাটাকে একটুও নড়াতে পারল না। হারমিওনের মন্ত্রোচ্চারণও কোন কাজে আসল না।

এখন কি হবে? হ্যারি প্রশ্ন করল।

এ পাখিগুলো নিশ্চয়ই সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নয়। হারমিওন মন্তব্য করল।

তারা পাখিগুলোকে লক্ষ্য করলো।

এগুলো পাখি নয়। এগুলো উড়ন্ত চাবি। হ্যারি মন্তব্য করল।

দেখ, ঝাড়ু পাওয়া যায় কিনা।

ঝাড়ু নিয়ে উড়ে গিয়ে তারা চাবিগুলো ধরতে গেল, কিন্তু জাদু করা চাবি তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেল।

হ্যারি ছিল শতাব্দীর কনিষ্ঠতম সিকার। অন্যান্য লোকের তুলনায় কোন কিছু চেনার তার ক্ষমতা ছিল বেশি। মিনিটখানেক পরই রঙধনুর মতো পালকের ভেতর একটা চাবি হ্যারির নজরে পড়ল। রূপালী রঙের চাবি। হ্যারি দ্রুত চাবি ছিনিয়ে নিয়ে নিচে নেমে এল।

হ্যারি চাবি নিয়ে তালায় ঢুকাল, কিন্তু কোন কাজ হলো না।

হ্যারি বলল–রন, ওই চাবিটা আন তো। ওই পাশের বড় বাঁকা চাবিটা।

আমাদের সবাইকে কাছাকাছি থাকতে হবে। হ্যারি বলল–রন তুমি ওপরে থাকে। আর হারমিওন, তুমি নিচে।

রন দ্রুতগতিতে হ্যারির দেখানো স্থানে উঠতে গিয়ে তার মাথা ছাদে ধাক্কা খেল এবং অল্পের জন্য ঝাড়ু থেকে পড়ে যেতে যেতে রক্ষা পেল।

আর নিচে যেও না। আমি চেষ্টা করছি। তুমি এটা ধর। ঠিক আছে। এখনই আমদের এটা ধরতে হবে।

ওপর থেকে রন নিচে ঝাঁপ দিল। হারমিওন গেল ওপরের দিকে। কিন্তু চাবিটা তাদের দুজনকেই ফাঁকি দিয়ে দেয়ালের দিকে চলে গেল। এরপর হ্যারি ওষ্টার পেছনে ছুটলো। চাবিটা কেবল দেয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হ্যারি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চাবিটাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। এবার আর চাবি তাকে ফাঁকি দিতে পারল না। ধরা দিতেই হল। নিচে রন আর হারমিওনের উল্লাস শোনা গেল।

ওরা নিচে নেমে দরোজার দিকে দৌড় দিল। তালায় চাবি ঢুকিয়ে ঘোরাতেই দরোজা খুলে গেল। তালা খোলার সাথে সাথেই চাবিটা আবার উড়ে চলে গেল।

তোমরা প্রস্তুত? হ্যারি রন আর হারমিওনকে জিজ্ঞেস করল। হ্যারি দরোজার হাতলে হাত রাখল। তারা দুজন মাথা নাড়িয়ে জানাল তারা প্রস্তুত।

হ্যারি দরোজা খুলে ফেলল।

ভেতরের ঘরটি অন্ধকার। এত অন্ধকার যে এ ঘর থেকে তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু যখন ঘরে প্রবেশ করল ঠিক তখনই আলোর বন্যা পুরো ঘরটিকে উদ্ভাসিত করে দিল। আলোতে তারা যা দেখল তা সত্যিই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

বিশাল এক দাবাবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরের এক দাবা খেলোয়াড়। কিন্তু দড়ির কোন মুখ নেই।

এখন কী করা? হ্যারি ফিসফিস করে বলল।

এটাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। রন জবাব দিল-এখন আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকে আমাদের কাজ সারতে হবে।

তারা পেছনে আরেকটা দরোজা দেখতে পেল।

এখন কী হবে? নার্ভাস হয়ে হারমিওন প্রশ্ন করল।

আমার মনে হচ্ছে রন বলল–আমাদেরকে দাবাড়ু সাজতে হবে। তারা ব্ল্যাক নাইটের ঘোড়া স্পর্শ করার সাথে সাথেই পাথরে প্রাণ এল। ব্ল্যাক নাইট তাদের অভিবাদন জানাল! দাবার ছকের ঘুটি সব জীবন্ত হয়ে উঠল।

এই স্থান অতিক্রম করার জন্য আমাদেরকেও কি দাবা খেলায় যোগ দিতে হবে?

ব্ল্যাক নাইট মাথা নাড়াল। হ্যারি রন ও হারমিওনের দিকে তাকাল।

হ্যারি আর হারমিওন চুপ করে অপেক্ষা করছিল, রন যেন কি ভাবছে। অবশেষে সে বলল–আমার কথায় তোমরা কেউ কষ্ট পেয়ো না। আসলে তোমাদের দুজনেরই কেউই দাবা খুব ভালো খেলতে পারো না।

আমরা কিছু মনে করিনি। হ্যারি বলল–আমাদের কি করতে হবে কেবল সেটা বলে দাও।

ঠিক আছে, হ্যারি তুমি বিশপ হও। আর হারমিওন তুমি কিস্তির পরিবর্তে হ্যারির পাশে দাঁড়াও।

আর তুমি কী হবে?

রন বলল–আমি নাইট হব।

দাবা খেলা জমে উঠল।

রন আটকা পড়ে গেছে। সে বলল–আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও।

–না, তা হতে পারে না। হ্যারি আর হারমিওন দুজনেই চিৎকার করে উঠল।

আরে এটাই তো দাবা খেলা। এখানে কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। সাদা রানী আমাকে গ্রাস করবে। হোয়াইট কুইন। ফাঁকা জায়গা। তোমরা পালাও। হ্যারি, তোমার রাজাকে বাঁচাও।

কিন্তু।

তুমি কী স্নেইপকে আটকাতে চাও, না চাও না?

রন–

দেখ, যদি দেরি করো, তাহলে স্নেইপ পাথর পেয়ে যাবে। আর পরশমণি চিরকালের জন্য আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

তোমরা প্রস্তুত? রন প্রশ্ন করল-এই আমি যাচ্ছি। তোমরা জেতার পর আর অপেক্ষা করবে না।

রন এগিয়ে গেল। সাদা রানী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোহার হাত দিয়ে সে রনের মাথায় আঘাত করল। রন মেঝের ওপর ছিটকে পড়ল। সাদা রানী তাকে একদিকে ছুঁড়ে ফেললো। হারমিওন চিৎকার করে উঠল।

এবার হ্যারির যুদ্ধ সাদা রাজার সাথে। রাজা তার মুকুট খুলে হ্যারির দিকে ছুঁড়ে মারল।

তারা জয়লাভ করল। পাথরের দাবাড়ুরা মাথা নত করে ধীরে ধীরে ভেগে পড়লো। দরোজা খোলা রেখেই হ্যারি ও হারমিওন শেষবারের মতো রনের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে এগুলো।

রনের কি হবে? হারমিওন জানতে চাইল।

রন ঠিক হয়ে যাবে। হ্যারির জবাব অনেকটা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো।

এখন আমরা কি করবো।

আমরা স্প্রাউটকে পার হয়ে এলাম, শয়তান জাদুটা করেছে ফ্লিটউইক চাবিগুলোকে মন্ত্র পড়িয়ে রেখেছেন। ম্যাকগোনাগল দাবাড়দের ভেতর শারীরিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, যাতে তারা প্রয়োজনে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এরপর বাকি থাকে অধ্যাপক কুইরেল আর স্নেইপ…।

তারা আরেকটা দরোজার সামনে উপস্থিত হলো।

সব ঠিক আছে তো? হ্যারি নিম্নকণ্ঠে বলল।

আগে বাড়ো।

হ্যারি দরোজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলল।

বিশ্রী গন্ধ তাদের নাকে এল। বাধ্য হয়ে তারা নাকে কাপড় দিল। তাদের চোখ ভিজে গেল। তারা দেখল তাদের সামনে একটা বিরাট দানব। তারা যে দানবটাকে কুপোকাত করেছিল এটা তার চেয়ে অনেক বড়। মাথায় একটা কুঁজ।

আমাদের ভাগ্য ভালো, ওটার সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়নি। হ্যারি অস্ফুট কন্ঠে বলল। তারপর তারা দানবের বিশাল পা ডিঙ্গিয়ে অগ্রসর হলো। হ্যারি বলল–চলে এসো। আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না।

হ্যারি ধাক্কা দিয়ে পরের দরোজাটা খুলল। এরপর তাদের সামনে কি আসতে পারে দেখার মতো সাহস তাদের ছিল না। না, এখানে ভয় পাবার মত কোন কিছু ছিল না। একটা টেবিল, টেবিলের ওপর বিভিন্ন ধরনের সাতটা বোতল সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে।

স্নেইপের কাজ। হ্যারি বলে উঠল–আমাদের কী করা উচিত?

হঠাৎ দরোজার কাছে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। অর্থাৎ ওরা হ্যারি, রন আর হারমিওন-এখন আটকা পড়ে গেছে। হারমিওন বোতলের পাশ থেকে এক টুকরো কাগজ তুলে নিল। কাগজটাতে লেখা–

বিপদ তোমার সামনে যখন নিরাপদ তোমার পেছনে
আমাদের দুজন তোমাকে সাহায্য করবে যেভাবে তুমি পেতে চাও
আমাদের সাতজনের একজন তোমাকে সামনে নিয়ে যাবে
আরেকজন মদ্যপায়ী পেছনে নিয়ে আসার বাহন হবে
আমাদের দুজন শুধু নিখাঁদ মদ নিয়ে টিকে আছে
আমাদের তিন জন খুনি, অপেক্ষা করে আছে আড়ালে
পছন্দ করো, অন্যথায় আজীবন তোমাকে এখানে থাকতে হবে
আর তোমার পছন্দের জন্য আমরা চারটি সমাধান সূত্র দেব
এক, যদি তুমি বিষ গোপন করার চেষ্টা কর, সেটি হবে হাস্যকর
তুমি সর্বদা কিছু নিখাঁদ মদ পাবে বাম পাশে
দুই. যারা শেষে দাঁড়িয়ে আছে তাদের দেখবে ভিন্নতর
যদি তুমি সামনে এগোও কাউকেই বন্ধু হিসেবে পাবে না
তিন, যেমন পরীক্ষার তুমি দেখো, বিভিন্ন আকারের তারা
অথবা অভিন্ন; ডোয়ার্ক বা অতিকায় কেউই ভেতরে মরে না
চার, বামদিকের দ্বিতীয় ও ডানদিকের দ্বিতীয়টি যদি চেখে দেখ
অভিন্ন স্বাদের; যদিও প্রথম দেখায় ভিন্ন মনে হবে।

হারমিওন এই লেখার মধ্যে একটা ইঙ্গিত খুঁজে পেল। হ্যারি বিস্মিত হয়ে দেখল যে হারমিওন মুচকি মুচকি হাসছে।

চমৎকার। হারমিওন বললো। এটা কিন্তু জাদু নয়। এটা একটা ধাঁধা। অনেক বড় বড় জাদুকরের মাথায় একবিন্দু যুক্তি কাজ করে না। তারা জীবনের জন্য এখানে আটকা পড়ে।

তাহলে আমরা এই কাগজের লেখাই মেনে চলব, কি বল?–হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

অবশ্যই। হারমিওন জবাব দিল–আমাদের যা যা দরকার সবই এই কাগজে লেখা আছে। এখানে সাতটা বোতল। তিনটা বিষাক্ত, দুটো মদের বোতল। একটা আমাদেরকে নিরাপত্তা দেবে। অন্যটা আমাদেরকে জাদুর জাল ভেদ করে নিয়ে যাবে।

কিন্তু কী করে বুঝব কোনটা পান করার মদ?

এক মিনিট। হ্যাঁ, পেয়েছি। ছোট বোতলটা। কাগজে লেখা আছে ওটাই আমাদেরকে কালো আগুনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবে–পরশমণির কাছে।

হ্যারি ছোট বোতলটার দিকে তাকাল।

এখানে তো মাত্র একজনের পানীয় আছে। হ্যারি বলল-এক চুমুকও তো হবে না।

তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।

কোনটা তোমাকে আগুন থেকে বাইরে নিয়ে যাবে?

সারির শেষে একটি গোলাকার বোতলের দিকে হারমিওন ইশারা করল।

তুমি ওটা পান কর। হ্যারি বলল–না, না শোনে, ফিরে গিয়ে রনকে নিয়ে চাবির ঘর থেকে আগে ঝাড়ুটি নিয়ে এসো। এরপর রনকে নিয়ে এসো এবং ফাঁদের দরোজা দিয়ে কুকুরটা পার হও। তারপর যাবে পেঁচাঁদের কাছে। হেডউইগকে ডাম্বলডোরের কাছে পাঠিয়ে দাও। তাকে দরকার। আমি স্নেইপকে কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারব, কিন্তু তিনি আমার চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী।

কিন্তু হ্যারি, স্নেইপের সাথে যদি ইউ-নো-হু থাকে তাহলে কী হবে?

আমি এক সময় সৌভাগ্যবান ছিলাম। নয় কি? সে তার কপালের দাগের প্রতি ইশারা করল–আশা করি, সেই ভাগ্য আরেকবার আমাকে দেখা দেবে।

হারমিওনের ঠোঁট কাঁপছিল। সে হঠাৎ হ্যারির গায়ে পড়ে গিয়ে বাহু দিয়ে হ্যারিকে ধরে ফেলল।

হারমিওন। হ্যারি বিস্মিত হলো।

হারমিওন বলল–হ্যারি, তুমি কি জানো তুমি একজন বড় মাপের জাদুকর।

তোমার মত দক্ষ নই। হ্যারি বলল।

আমি! হারমিওন আশ্চর্যের সাথে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল। আমি তো বই পড়েছি আর বুদ্ধি খাঁটিয়েছি। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। তা হলো বন্ধুত্ব আর সাহস। হ্যারি, তুমি সতর্ক থেকো।

হ্যারি হারমিওকে বলল–তুমি আগে চুমুক দাও। তুমি সঠিকভাবে জানো কোন বোতলটি কোন কাজের জন্য।

তা ঠিক। এই বলে হারমিওন গোলাকার বোতল থেকে মদ পান করলো।

বিষ নয়তো এটা? হ্যারি উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করল।

না–তবে বরফের মত ঠাণ্ডা। হারমিওন জবাব দিল।

তাড়াতাড়ি যাও।

গুডলাক। সাবধানে থেকো।

তুমি যাও।

বেগুনি আগুনের ভেতর দিয়ে হারমিওন পার হয়ে গেল।

হ্যারি এবার ছোট বোতলটাতে চুমুক দিল। এরপর সে কালো অগ্নিশিখার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। আমি আসছি। হ্যারি চিৎকার করে বলল।

মনে হলো তার দেহ যেন বরফে ভাসছে। সে বোতল রেখে এগিয়ে গেল। কালো শিখা তাকে ঘিরে ধরল। সে কিন্তু কিছুই টের পেল না। কিছুক্ষণ শুধু কালো আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।

তারপর একদম ওপরে। শেষ চেম্বার। সেখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি স্নেইপও নন, এমনকি ভোলডেমর্টও নন।

১৭. দু’মুখো মানুষ

সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন অধ্যাপক কুইরেল।

আপনি! অবাক হয়ে হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

কুইরেল মুচকি হাসলেন। তার মুখ অন্য সময়ের মত এখন কাঁপছিলো না।

হ্যাঁ, আমিই। কুইরেল জবাব দিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমার সাথে এখানে দেখা হয়ে যাবে, মি. পটার।

আমি ভেবেছিলাম, আমি এখানে স্নেইপকে দেখতে পাব। হ্যারি বলল।

সেভেরাস? অধ্যাপক কুইরেল হাসলেন। তবে তার হাসিটাও অন্য সময়ের মত নয়। ছিল তীক্ষ্ণ ও শীতল। তারপর বললেন–হ্যাঁ, সেভেরাসকে ওই রকমই মনে হয়। তাই নয় কি? বড় বাদুরের মত তিনি ছোঁ মারতে পারেন। তাকে নিয়ে এলে ভালোই হতো। কেউ কি বিশ্বাস করতে পারবে এখানে আসবেন অধ্যাপক কুইরেল।

হ্যারি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।

কিন্তু স্নেইপই তো আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। হ্যারি বলল।

না, না, এটা ঠিক নয়। কুইরেল জবাব দিলেন–আমিই তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। তোমার বন্ধু মিস গ্রেঞ্জার কিডিচ প্রতিযোগিতায় যখন আগুন লাগাতে যায় তখন সে হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের ওপর পড়ে। সে তোমার সাথে আমার আই কন্টাক্ট ভেঙে দিয়েছিল। আর কয়েকটি মুহূর্ত হাতে পেলে আমি তোমার কাছ থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিতাম। তোমাকে বাঁচাবার জন্য স্নেইপ যদি মন্ত্র উচ্চারণ না করতেন, তাহলে সেদিনই তোমার একটা কিছু হয়ে যেত।

আপনি বলেন কি? স্নেইপ আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন! হ্যারি বিস্ময়মাখা স্বরে প্রশ্ন করল।

অবশ্যই। কুইরেল জবাব দিলেন–তুমি কি জানোনা তোমার পরবর্তী প্রতিযোগিতায় তিনি কেন রেফারি হতে চেয়েছিলেন। বোকা একটা… তার ভাবা উচিত ছিল, যতক্ষণ ডাম্বলডোর খেলা দেখছিলেন ততক্ষণ তোমার কোন অনিষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্য সকল টিচার ভেবেছিলেন স্নেইপ গ্রিফিল্ডরকে বাধা দিতে চান। স্নোইপ নিজেকে সকলের কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সময় নষ্ট আর করা কেন, এত কিছুর পর আমি তোমাকে হত্যা করতে যাচ্ছি। অধ্যাপক কুইরেল তার হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁক করে কাঁপালেন, অমনি একটা রশি বাতাসে শাপের মত লাফিয়ে হ্যারিকে শক্ত করে বেঁধে ফেলো।

তুমি সব কিছুতেই নাক গলাও পটার। তোমার বেঁচে থাকাটা বিপজ্জনক। স্কুলের চারদিক ঘুরে বেড়াও। আমি জানি পাথরটা কে পাহারা দিচ্ছে দেখতে এসে তুমি সেখানে আমাকে দেখেছিলে।

তাহলে আপনিই সেই দানবটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাঁ, আমিই সে দানবটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। অধ্যাপক কুইরেল জবাব দিলেন–তবে আমার একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। স্নেইপ আমাকে সন্দেহ করে দৌড়ে তিন তলায় আমাকে মোকাবিলা করার জন্য চলে এলেন। তিনি আমাকেই শুধু ব্যর্থ করে দেননি, দানবটা তোমাকেও হত্যা করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ওই তিন মাথা কুকুরটাও স্নেইপের পা–টা ভালো করে জখম করতে পারেনি।

কিছুক্ষণ থেমে কুইরেল বললেন–হ্যারি, একটু অপেক্ষা কর। আমি এই মজার আয়নাটা নিয়ে একটু পরীক্ষা করতে চাই।

আর ঠিক তখনই হ্যারি বুঝতে পারল কুইরেলের পেছনে যে আয়না সেটা এরিসেডের আয়না।

ফিরে এসে কুইরেল বললেন-এই আয়নাটি হল পরশমণি পাবার চাবিকাঠি।

কুইরেলের উদ্দেশ্যে হ্যারি বলল–আমি আপনাকে ও স্নেইপকে অরণ্যে দেখেছি।–হ্যারি কুইরেলকে কথায় ব্যস্ত রাখতে চায়।

তুমি ঠিকই দেখেছ। আয়নাটা দেখতে দেখতে কুইরেল বললেন তিনি সব সময় আমাকে সন্দেহ করেন। তাই তিনি দেখতে এসেছিলেন আমি কত দূর এগিয়েছি। ভোলডেমর্ট আমার পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাকে ভয় দেখিয়েছেন।

কুইরেল আয়নার পেছন থেকে ফিরে এসে ক্ষুধার্তের মত আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কুইরেল বললেন–আমি পাথরটা দেখতে পাচ্ছি। আমি এটা আমার প্রভুকে উপহার দিতে যাচ্ছি। কিন্তু পাথরটা গেল কোথায়?

হ্যারি দড়ির বাঁধন শিথিল করার চেষ্টা করছিল। হ্যারি বুঝল তার এখনকার কর্তব্য হলো আয়না থেকে কুইরেলের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখা।

কিন্তু স্নেইপ সব সময় আমাকে দারুণ ঘৃণা করেন। হ্যারি বলল।

হ্যাঁ, স্নেইপ তোমাকে ঘৃণা করেন। হোগার্টসে তিনি তোমার বাবার সাথেই ছিলেন। তারা একে অপরকে খুব ঘৃণা করতেন। তবে তিনি কখনই তোমার মৃত্যু চাননি।

আমি শুনলাম হ্যারি বলল–কয়েকদিন আগে আপনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। কারণ স্নেইপ আপনাকে হুমকি দিয়েছিলেন?

প্রথমবারের মতো কুইরেলের চেহারায় একটা ভয়ের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল।

কুইরেল জবাব দিলেন–কখনও কখনও প্রভুর নির্দেশ মেনে চলা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি একজন উঁচু মাপের জাদুকর, আর আমি একজন মামুলী জাদুকর।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, তিনি ক্লাস রুমে আপনার সাথেই থাকেন? হ্যারি জানতে চাইল।

আমি যেখানেই যাই তিনি আমার সাথে থাকেন। কুইরেল শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন। আমি যখন বিশ্বভ্রমণে বের হই তখন তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন ছিলাম বোকা। ভালো ও মন্দ সম্পর্কে আমার মনে উদ্ভট ধারণা ছিল। লর্ড ভোলডেমর্টই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে আমার ধারণা কত অপরিপকু ছিল। তিনি আমাকে বোঝালেন যে ভালো বা মন্দ বলে কোন জিনিস নেই। যা আছে তা হলো শক্তি। তবে অনেকেই তা দেখতে পায় না। তারপর থেকেই আমি বিশ্বস্ততার সাথে তার সেবা করে যাচ্ছি। যদিও আমি তাকে বহুবার হতাশ করেছি। কোন ভুল তিনি সহজে ক্ষমা করেন না। আমার ভুলের জন্যই তিনি আমার সাথে কখনও কখনও কঠোর ব্যবহার করেন। আমি যখন গ্রিংগট থেকে পাথর চুরি করতে ব্যর্থ হই তখন তিনি আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট হন এবং আমাকে শাস্তি দেন। তারপর থেকেই তিনি আমাকে চোখে চোখে রাখা শুরু করেন। কুইরেলের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল। হ্যারির মনে পড়ল ডায়াগন এলির কথা। সে এত বোকা হল কী করে! সেই দিনই সে প্রথম অধ্যাপক কুইরেলকে দেখেছে এবং লিকি কলড্রেনে তার সাথে করমর্দন করেছে।

কুইরেলের নিঃশ্বাসে অভিশাপ।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না পাথরটা কি আয়নার ভেতর? আমি কি আয়নাটা ভেঙে ফেলব?

হ্যারি দ্রুত ভাবছিল।

হ্যারি মনে মনে বললো–আমার এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে কাম্য কাজ হলো–কুইরেলের আগে পরশমণিটি হস্তগত করা। আমি যদি আয়নাটা দেখি তাহলে আমি নিজেই জানতে পারব পরশমণিটা কোথায়? কুইরেলকে বুঝতে না দিয়ে আমি এ কাজটা কীভাবে করব?

কুইরেলের দৃষ্টি এড়িয়ে আয়নার কাছে যাবার জন্য হ্যারি বাঁ দিকে বাঁক নিল। হ্যারির পায়ের গোড়ালিতে দড়ি এত শক্তভাবে বাঁধা ছিল যে তার পক্ষে বাঁধনমুক্ত হওয়া কঠিন। সে বাঁধন মুক্ত করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কুইরেল এদিকে লক্ষ্য না করেই নিজে নিজে কথা বলছিলেন

এ আয়নাতে কী কাজ হয়। প্রভু, আমাকে সাহায্য কর।

সন্ত্রস্ত হয়ে হ্যারি এ প্রশ্নের উত্তর শুনতে পেল, আর উত্তরটাও ছিল কুইরেলের কণ্ঠস্বরে, ছেলেটাকে কাজে লাগাও! ছেলেটাকে কাজে লাগাও।

কুইরেল হ্যারির দিকে তাকালেন।

তারপর বললেন–পটার, এদিকে এসো।

কুইরেল হাতে তালি দিলেন। সাথে সাথে হ্যারির বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। হ্যারি নিজের পায়ে দাঁড়াল।

এদিকে এসো। কুইরেল আবার তাকে ডাকলেন, বললেন–আয়নায় তাকিয়ে আমাকে বল কী দেখছ।

হ্যারি হেঁটে হেঁটে কুইরেলের কাছে এল।

আমাকে মিথ্যে বলতে হবে। হ্যারি মনে মনে বলল–আমি অবশ্যই দেখব, কিন্তু দেখার ব্যাপারে মিথ্যে বলব।

কুইরেল হ্যারির পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কুইরেলের পাগড়ির বিশেষ গন্ধ হ্যারির নাকে এল। হ্যারি চোখ বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়াল এবং আবার চোখ খুলল।

আয়নাতে হ্যারি প্রথমে তার প্রতিবিম্ব দেখল। প্রথমে তার চেহারা বিবর্ণ দেখা গেলেও পর মুহূর্তেই দেখা গেল প্রতিবিম্বটা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। প্রতিবিম্ব পকেট থেকে একটা রক্ত–রাঙা পাথর বের করল। এ দৃশ্য দেখার পর তার পকেটে সে একটা ভারী বস্তুর অস্তিত্ব অনুভব করল। অবিশ্বাস্যভাবে পাথরটা হ্যারির নাগালের ভেতর চলে এল।

কুইরেল জানতে চাইলেন–তুমি কী দেখতে পেলে?

সাহস সঞ্চয় করে হ্যারি বলল–আমি দেখলাম আমি ডাম্বলডোরের সাথে করমর্দন করছি। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য হাউজ কাপ জয়লাভ করেছি।

কুইরেল আবার অভিশাপ দিলেন।

কুইরেল বললেন–আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। হ্যারি একটু সরে গেল এবং পকেটে পরশমণির স্পর্শ অনুভব করল। সে কি পরশমণিটি বের করে ফেলবে?

হ্যারি পাঁচ কদমও এগোতে পারল না। কুইরেলের ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে শোনা গেল–সে মিথ্যা বলেছে। সে মিথ্যা বলেছে।

কুইরেল আবার বললেন–পটার তুমি ফিরে এসো। তুমি আসলে কী দেখেছ তা সত্যি করে বল।

কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি হলো।

আমি তার সাথে মুখোমুখি কথা বলতে চাই।–কুইরেলের সেই কণ্ঠস্বর।

প্রভু, তোমাকে আজ রাতে তত শক্তিশালী মনে হচ্ছে না।

এর জন্য আমার যথেষ্ট শক্তি আছে।

হ্যারির মনে হল সে শয়তালের জাদুর চক্রান্তে আটকে গেছে। সে তার পেশী নাড়াতে পারছে না। ভয়ে আর আতঙ্কে সে কুইরেলের দিকে তাকাল। কুইরেল তার পাগড়ি খুললেন। পাগড়িবিহীন তার মাথা অস্বাভাবিক রকম ছোট মনে হলো। পাগড়ি মাটিতে পড়ে গেল। এবার তিনি ধীরে ধীরে তার ঘাড় নাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন

হ্যারির চিৎকার করে ওঠার কথা, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বেরুচ্ছে না। যেখানে কুইরেলের পিঠ তার সামনে থাকার কথা, সেখানে সামনে থেকে দেখা গেল তার বিকট চেহারা। এত ভয়ঙ্কর চেহারা হ্যারি এর আগে কখনোই দেখেনি। এ চেহারাটা চর্কের মত শাদা, তীক্ষ্ণ লাল চোখ আর সাপের মত নাক দিয়ে পানি বেরুচ্ছে। চেহারার দুপাশে দু রকম! দুজনের। কুইরেল আর ভোলমেট।

হ্যারি পটার। ফিসফিস শব্দ শোনা গেল।

হ্যারি পেছনে যেতে চাইল। কিন্তু তার পা চলছে না।

মুখটা বলছে–হ্যারি পটার, দেখতে পাচ্ছ আমার এখনকার রূপ। শুধু ছায়া আর ধোয়া দিয়ে অন্যের শরীর ধারণ করা যায়। ইউনিকর্নের রক্ত খেয়ে আমার শক্তি বহুগুণ বেড়ে গেছে। তুমি আগেই দেখেছ কুইরেলের রূপ ধরে, আমি অরণ্যে গিয়ে ইউনিকর্নর রক্তপান করেছি। এখন তুমি দয়া করে তোমার পকেট থেকে পরশমণিটা বের করে আমাকে দিয়ে দাও।

কুইরেল তা হলে সব জানে-এই কথা ভেবে হ্যারি পেছনে যেতে চাইল, কিন্তু তার পা চলছে না।

মুখটা হ্যারিকে বলল–বোকার মত কাজ করো না।

তোমার জীবন বাঁচাতে চাইলে আমার সাথে যোগ দাও। নতুবা তোমার বাবা–মার মতই তোমার পরিণতি হবে। তারা দুজনই মারা যাওয়ার সময় আমার অনুকম্পা চেয়েছিলেন।

মিথ্যুক। হ্যারি চিৎকার করে উঠল।

কুইরেল পেছন ফিরে হ্যারির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন যাতে ভোলডেমর্ট তাকে দেখতে পায়। শয়তানি মুখে মুচকি হাসি।

বড়ই মর্মস্পর্শী। শয়তানিমুখে উচ্চারিত হলো।

আমি সর্বদাই বীরত্বকে দাম দেই। তোমার বাবা–মাও সাহসী ছিলেন। প্রথমে আমি তোমার বাবাকে হত্যা করি। তিনি আমার সাথে সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তোমার মায়ের মারা যাবার কথা ছিল না। তিনি তোমাকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তার মৃত্যুকে ব্যর্থ করতে না চাইলে তুমি আমাকে পাথরটা দিয়ে দাও।

কখ্‌খনো না। হ্যারি জোর দিয়ে বলল।

হ্যারি লাফ দিয়ে আগুনের শিখার দিকে ধাবিত হল। ভোলডেমর্ট চিৎকার করে উঠল–তাকে পাকড়াও কর। পর মুহূর্তেই হ্যারি অনুভব করল যে কুইরেলের হাত তার মুষ্টির ওপরের অংশ স্পর্শ করেছে। সঙ্গে সঙ্গেই হ্যারি তার কপালের কাটা দাগে তীব্র ব্যথা অনুভব করল। তার মনে হলো তার কপাল দুটুকরো হয়ে যাবে। সে তার সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে জোরে চিক্কার দিল। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল, কুইরেল তাকে ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার ব্যথা অনেকটা কমে গেছে। কুইরেল কোথায় আছেন তা দেখার জন্য সে চারিদিকে তাকাল। কুইরেল ব্যথায় কুঁজো হয়ে তার আঙুল দেখছিলেন।

পাকড়াও কর। তাকে পাকড়াও কর। আবার ভোলডেমর্টের চিৎকার।

কুইরেল আবার উঠে হ্যারিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছে। হ্যারির কপালের কাটা দাগের ব্যথা অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও সে দেখতে পেল যে কুইরেল নিজে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

কুইরেল চিৎকার করছেন–প্রভু, আমি তাকে আর ধরে রাখতে পারছি না–আমার হাত আমার হাত…।

কুইরেল হাটু দিয়ে হ্যারিকে মাটির ওপর চেপে রাখলেও সে তার গলা ছেড়ে দিলেন এবং বিস্ময়ে বিচলিত হয়ে নিজের হাতের ব্যথার প্রতি দৃষ্টি দিলেন।

তাহলে ওকে হত্যা কর, বোকা কোথাকার। ভোলডেমর্ট চিৎকার করে বলল।

একটা কঠিন অভিশাপ দেবার জন্য কুইরেল তার হাত ওপরে ওঠালেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই হ্যারি তার মুখ চেপে ধরল।

আহ…

কুইরেল মাটিতে পড়ে গেলেন। হ্যারি জানতো যে মারাত্নক যন্ত্রণায় কাতর হলে কুইরেল তার কেশ স্পর্শ করতে পারবেন না। সুতরাং অভিশাপ বন্ধ রাখতে কুইরেলকে কাবু করে রাখা ছাড়া উপায় নেই।

হ্যারি লাফ দিয়ে কুইরেলকে এমন শক্তভাবে জাপটে ধরল যে কুইরেল নড়তেই পারছিলেন না, শুধু চিৎকার করছিলেন। কুইরেল হ্যারিকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। হ্যারির কপালের ব্যথা আবার বাড়তে লাগল। হ্যারি কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। কেবল কুইরেলের চিৎকার আর ভেলডেমর্টের তাকে হত্যা কর, তাকে হত্যা কর কথাগুলো শুনছে। সে অনুভব করল, কুইরেল তার বাহুবেষ্টনি থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। সামনে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার।

মাথার ওপর সোনার মত কি যেন চকচক করছে। হ্যারি সেটা ধরতে গেল। তার হাত বেশ ভারি হয়ে যাওয়ায় সে এটা ধরতে পারল না।

হ্যারি ভালো করে তাকাল। দেখল, আসলে সেটা এক জোড়া চশমা। কী আশ্চর্য ব্যাপার।

শুভ অপরাহ্ন, হ্যারি ডাম্বলডোর তাকে বললেন।

হ্যারি তার দিকে তাকাল। তারপর সবকিছু মনে পড়ল। সে বলল স্যার, পরশমণিটা অধ্যাপক কুইরেল হস্তগত করে ফেলেছেন। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করুন।

শান্ত হও বাছা। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–তুমি সময়ের একটু পেছনে আছ। কুইরেল পরশমণি পাননি।

তাহলে? হ্যারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

হ্যারি শান্ত হও। ডাম্বলডোর বললেন–নতুবা মাদাম পমফ্রে আমাকে এখান থেকে বের করে দেবেন।

হ্যারি ঢোক গিলে চারদিকে তাকাল। এতক্ষণে সে বুঝল, সে এখন হাসপাতালে সাদা বিছানার ওপর শুয়ে আছে। পাশেই একটা উঁচু টেবিল। টেবিলের ওপর এত মিষ্টি রাখা আছে, দেখে মনে হবে এটা বুঝি মিষ্টির দোকান।

এই দেখ তোমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তোমার জন্য উপহার পাঠিয়েছে। ডাম্বলডোর বললেন–পাতাল পুরীতে বন্দিদশায় তোমার আর কুইবেলের ভেতর কী ঘটেছে-এটা কেউ জানে না। সবাই জানে তুমি অসুস্থ। হাসপাতালে তোমার চিকিৎসা হচ্ছে।

কতদিন ধরে আমি এখানে আছি? হ্যারি জানতে চাইল।

তিনদিন হবে। তুমি যে সুস্থ হয়েছ এটা শুনতে পারলে রোনাল্ড উইসলি ও মিস গ্রেঞ্জার খুব স্বস্তিবোধ করবে। তোমার ব্যাপারে তারা খুব উদ্বিগ্ন।

স্যার, পরশমণি কোথায়? হ্যারি জানতে চাইল।

ডাম্বলডোর বললেন–আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি এখনও পাথরের কথা ভুলতে পারনি। অধ্যাপক কুইরেল তোমার কাছ থেকে পরশমণিটা নিতে পারেননি, কারণ আমি যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে পড়েছিলাম। যদিও তুমি খুব ভালভাবে ওঁকে মোকাবিলা করছিলে।

তাহলে পরশমণি আপনার কাছে। হ্যারি জানতে চাইল।

আমার ভয় ছিল, আমার যেতে হয়ত দেরী হয়ে যেতে পারে। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন।

না, আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন।

আমি তাকে বেশিক্ষণ পরশমণি থেকে দূরে রাখতে পারতাম না। হ্যারি বলল।

ডাম্বলডোর আরো বললেন–আমি পাথরের কথা বলছি না। বলছিলাম তোমার চেষ্টার কথা। এতে তোমার মৃত্যুও হতে পারত। এজন্য আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আর পরশমণির কথা বলছ, সেটা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

ধ্বংস করা হয়েছে! হ্যারি বিস্ময়ের সাথে মন্তব্য করল–আপনার বন্ধু নিকোলাস ফ্লামেল?

তুমি তাহলে নিকোলাস সম্পর্কে জানো। ডাম্বলডোর বললেন–তুমি ঠিক কাজটাই করেছ, তাই না? আমি আর নিকোলাস আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম। যা করা হয়েছে তা ঠিকই ছিল।

তার মানে নিকোলাস এবং তার স্ত্রী মারা যাবেন। তাই নয় কি?

তবে তাদের কাছে প্রচুর মৃতসঞ্জীবনী সুধা আছে। হ্যাঁ, পরবর্তীতে তাঁরা মারা যাবেন।

হ্যারির চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ দেখে ডাম্বলভোর মুচকি হাসলেন।

ডাম্বলডোর বললেন–তোমাদের মত তরুণদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। নিকোলাস এবং পেরেনেলের কাছে এটা হবে দীর্ঘদিন পর শোবার জন্য বিছানায় যাওয়া। বড় কথা হলো সুসংগঠিত মৃত্যু হলো পরবর্তী পর্যায়ে যাবার অভিযান।

ডাম্বলডোর আরো বললেন, পরশমণি বড় কথা নয়। মানুষ এমন কিছু আকাঙ্ক্ষা করে যা বাস্তবে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।

হ্যারি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। ডাম্বলডোর মৃদু হেসে ওপরে ঘরের ছাদের দিকে তাকালেন।

স্যার, হ্যারি বলল–আমি ভাবছিলাম পরশমণি তো ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু ভোলডেমর্ট এবং ইউ-নো-হুর ভূমিকা কী হবে।

হ্যারি, তাকে সবসময় ভোলডেমর্ট ডাকবে। তার সঠিক নামে ডাকবে। কোন বিশেষণেরও দরকার নেই। নামের ভীতি মানুষের প্রতি বাড়িয়ে দেয়।

জী স্যার। হ্যারি বলল–ভোলডেমট ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। তাই না? তিনি তো এখনও বিদায় হননি, হয়েছেন কী?

হ্যারি তুমি ঠিকই বলেছ। ডাম্বলডোর বললেন–ভোলডেমর্ট ফিরে আসার চেষ্টা করছে। সে যায়নি। সে কাছাকাছি কোথাও আছে। সে কারো সঙ্গে তার শরীর ভাগাভাগি করে নিতে চাচ্ছে। সে যদি সত্যি সত্যিই জীবিত না থাকে তাহলে কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না। সে কুইরেলকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। শত্রু মিত্র কারো প্রতি সে করুণা করে না।

হ্যারি মাথা নাড়ল। তার কপালের ব্যথাটা আবার বেড়ে গেছে। তারপর ডালভোরের উদ্দেশ্যে বলল–স্যার, আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনি কি আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন?

সত্য শব্দটি একটা সুন্দর ও নিষ্ঠুর শব্দ। ডাম্বলডোর মন্তব্য করলেন তাই খুবই সতর্কভাবে তোমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবার চেষ্টা করব। সমস্যা না হলে আমি তোমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেব। যদি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে মিথ্যা বলব না।

হ্যারি শুরু করল, ভলডেমর্ট বলেছে তিনি আমার মাকে হত্যা করেছে, কারণ আমার মা আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। এখন সে আমাকে কেন হত্যা করতে চাচ্ছে?

ডাম্বলডোর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন–হ্যারি, আমি দুঃখিত। আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। অর্থাৎ আজ ৰা এখন আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। তবে একদিন তুমি এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। তুমি বড় হলে সব জানতে পারবে। আর আমি এটাও জানি, এই প্রশ্নের উত্তর তোমার ঘৃণা উদ্রেক করবে। বড় হলে তুমি নিজেই সব জানতে পারবে।

হ্যারি বুঝতে পারল এ বিষয়ে আর কথা বলা অবান্তর।

কিন্তু কুইরেল কেন আমাকে স্পর্শ করতে পারেননি। হ্যারির পরবর্তী প্রশ্ন।

ডাম্বলডোর জবাব দিলেন–তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার মায়ের মৃত্যু ঘটেছে। ভালোবাসা কী জিনিস-এ বিষয়ে ভোলডেমর্টের কোন ধারণা ছিল না। ভালোবাসা যে কত শক্তিশালী হতে পারে তা সে কখনোই বুঝতে পারেনি। তোমার জন্য তোমার মায়ের ভালোবাসা একটা অনন্য ঘটনার স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি তার ভালোবাসার কোন চিহ্ন রেখে যেতে পারেননি। তোমার জন্য তোমার মায়ের ভালোবাসা তোমাকে চিরদিনের জন্য নিরাপদ করে দিয়েছে। আর কুইরেলের ভেতর আছে–ঘৃণা, লোভ আর উচ্চাভিলাষ। তার এই দোষগুলো ভোলড়েঘর্টের কাছ থেকে পাওয়া। এ জন্যই কুইরেল তোমাকে স্পর্শ করতে পারেননি।

ডাম্বলডোর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এই ফাঁকে হ্যারি তার চোখের জল মুছলো।

হ্যারির বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে এলে তার পরবর্তী প্রশ্ন–আপনি কি জানেন অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা আসলে কে পাঠিয়েছিল?

ডাম্বলডোর জবাব দিলেন–তোমার বাবা আমাকে এ পোশাকটা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মনে হলো, পোশাকটা তোমার পছন্দ হবে। তোমার বাবা এই অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করতেন।

আমার আরো কিছু প্রশ্ন আছে।

বল।

কুইরেল বলছিলেন স্নেইপ–… হ্যারি বলল।

অধ্যাপক স্নেইপ ডাম্বলডোর জিজ্ঞেস করল!

জী স্যার… কুইরেল আমাকে জানালেন যে স্নেইপ–আমাকে ঘৃণা করেন কারণ তিনি আমার বাবাকে ঘৃণা করতেন।

হ্যাঁ, তারা দুজন দুজনকেই ঘৃণা করতেন। ডাম্বলডোর ব্যাখ্যা করলেন–তবে তাদের অপছন্দ তোমার আর ম্যালফয়ের অপছন্দের মত নয়। তোমার বাবা এমন একটা কাজ করেছিলেন, যা অধ্যাপক স্নেইপ কখনোই ক্ষমা করতে পারেননি।

সেটা কী? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তিনি তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ডাম্বলডোর বললেন।

আপনি কী বলছেন? হ্যারি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, ডাম্বলডোর স্বপ্নিল দৃষ্টিতে বললেন–মানুষের মন বড় বিচিত্র। তারা কত রকম অদ্ভুত কাজ করে। স্নেইপ কখনোই তোমার বাবার কাছে ঋণি থাকতে চাননি। আমার ধারণা, এ বছর তোমাকে রক্ষা করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি তোমার পিতৃঋণ শোধ করতে চান। এটা করতে পারলে তিনি তোমার বাবার স্মৃতিকে ঘৃণা করতে পারবেন।

এসব কথা শুনে হ্যারির মাথা গুলিয়ে গেল। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।

স্যার, আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে। হ্যারি বলল।

একটাই মাত্র প্রশ্ন? ডাম্বলডোর বললেন।

আয়না থেকে আমি কীভাবে পরশমণিটা পেলাম? হ্যারি জানতে চাইল।

আমি খুব আনন্দিত যে, তুমি এই প্রশ্ন করেছ। ডাম্বলডোর বললেন এটা আমার চিন্তাপ্রসূত। এছাড়া তোমার সাথে আমার অন্য রকম একটা সম্পর্ক আছে। ভেবে দেখ, মাত্র একজন লোক পাথরটা পেতে চেয়েছিল পেলও কিন্তু ব্যবহার জানে না। নতুবা এটা থেকে সোনা বানাবে অথবা অমৃত মনে করে পান করবে। হয়েছে, অনেক প্রশ্ন করেছ; আর নয়।

এরপর ডাম্বলডোর হ্যারিকে মিষ্টি খাবার আমন্ত্রণ জানালেন এবং হ্যারির মুখে একটা মিষ্টি তুলে দিলেন। ডাম্বলডোরের উত্তরটা হ্যারির কাছে হেঁয়ালিই রয়ে গেল।

***

ম্যাট্রন মাদাম পমফ্রে অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু বড্ড কড়া মহিলা।

হ্যারি বলল–আর মাত্র পাঁচমিনিট।

অসম্ভব। মাদাম পমফ্রে বললেন।

অধ্যাপক ডাম্বলডোরকে ভেতরে আসতে দিয়েছিলেন…। হ্যারি বলল।

মাদাম পমফ্রে বললেন–হ্যাঁ, তাকে দিয়েছি, তবে অধ্যাপক ডাম্বলডোর তো হোগার্টসের প্রধান শিক্ষক। তবে হ্যারি, তোমার বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।

আমি তো বিশ্রাম নিচ্ছি। দেখছেন তো আমি বিছানায় শুয়ে আছি। হ্যারি বলল।

ঠিক আছে। মাদাম পমফ্রে বললেন–মনে রেখো। তোমাকে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হলো।

তিনি রন ও হারমিওনকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

হ্যারি। রন ও হারমিওন আনন্দে চিৎকার করে উঠল। তারা বলল আমরা আর অধ্যাপক ডাম্বলডোর তোমার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম।

পুরো স্কুলে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রন বলল–কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল?

এটা এমন একটা সত্য ঘটনা যা গল্পের চেয়েও অদ্ভুত এবং উত্তেজনাপূর্ণ।

হ্যারি তাদেরকে সব খুলে বলল–কুইরেলের কথা, ভলডেমর্টের কথা, আয়না ও পরশমণির কথা।

রন আর হারমিওন মনোযোগ দিয়ে হ্যারির কথা শুনল। হ্যারি তাদের কুইরেলের পাগড়ির তলায় কি আছে সেটাও বলল।

হ্যারির কথা শেষ হওয়া মাত্রই রন বলে উঠল–পরশমণি তাহলে কোথায়?

আর যদি পরশমণি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তো নিকোলাস ফ্লামেলের মৃত্যু অবধারিত। হারমিওন আত্নচিৎকার করল।

হ্যারি বলল–আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু ডাম্বলডোর আমাকে বোঝালেন যে সুসংগঠিত মনের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য অভিযান মাত্র।

তোমাদের দুজনের কী হয়েছিল? হ্যারি জানতে চাইল।

আমরা ঠিকভাবেই ফিরে এসেছি। হারমিওন বলল–রনকে নিয়ে আসতে অবশ্য কিছুটা সময় লেগেছে। অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমরা পেঁচার ঘরে যাওয়ার পথে প্রবেশ হলে ডাম্বলডোরকে পাই, তিনি আগেই সব জেনেছেন। তিনি বললেন–হ্যারি তার পেছনে গিয়েছে, তাই না? তারপর তিনি দ্রুত তোমার দিকে ছুটলেন।

তোমার মাধ্যমেই তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন কি? রন জানতে চাইল তোমাকে তোমার বাবার পোশাক আর অন্যান্য জিনিস পাঠিয়ে।

হারমিওন ক্রোধের সাথে বলল–তিনি যদি কিছু করে থাকেন–আমি বলতে চাচ্ছি–তোমার তো মৃত্যুও হতে পারত।

ঘটনা তা নয়। হ্যারি প্রতিবাদ করে উঠলো–আসলে তিনি আমাকে একটি সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। এখানে যা কিছু ঘটেছে সবই তার জানা ছিল। আমার ধারণা–আমরা কী করতে চাচ্ছি–তাও তিনি জানতেন। তিনি আমাদেরকে বাধা না দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। আমার মনে হয়, আয়নার বিষয়টা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। আসলে আগে থেকে তিনিই সবকিছুর পরিকল্পনা করেছিলেন।

হ্যাঁ, তুমি তো ডাম্বলডোরের প্রশংসা করবেই? রন বলল-এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আগামীকাল ভোজ হবে। খেলাতে স্লিদারিন হাউজ জিতেছে। কিডি প্রতিযোগিতায় তুমি ছিলে না। তোমাকে ছাড়া আমরা পেছনে পড়ে গেছি, তবে আগামীকালের ভোজটা ভালো হবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে মাদাম পমফ্রে ঘরে ঢুকেই বললেন–তোমরা পনেরো মিনিট কথা বলেছ। এবার বাইরে যাও।

রাতে ভাল ঘুমের ফলে হ্যারির সুস্থতা ফিরে এলো। হ্যারি মাদাম পমফ্রেকে বলল–আমি ভোজে যোগ দিতে চাই। আমি কি যেতে পারব?

মাদাম পমফ্রে বললেন–ভোজে যাবার জন্য অধ্যাপক ডাম্বলডোর তোমাকে ইতোমধ্যেই অনুমতি দিয়েছেন। তবে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, সেখানে যাওয়াটা তোমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে কিনা।

তোমাকে দেখতে আর একজন এসেছেন।

খুব ভাল, কে সে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। দরোজা খুলে হ্যাগ্রিড ভেতরে প্রবেশ করল। তার ইয়া বড় শরীর নিয়ে যখন সে ভেতরে ঢুকলো, তার শরীরের কাছে ঘরটাই ছোট মনে হচ্ছিল। হ্যাগ্রিড হ্যারির পাশে বসলেন। হ্যারির দিকে এক নজর তাকিয়ে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন।

এসবই আমার দোষে। হ্যাগ্রিড বললেন। আমিই তাদের ফ্লাফির কথা বলেছি। তারা ফ্লাফির কথা জানত না। তোমরা তো মারাও যেতে পারতে। আমি এসব করেছি ড্রাগনের ডিম পাবার জন্য। আমি আর পান করব না! এখন থেকে আমি সব কিছু বাদ দিয়ে মাগলদের মত জীবনযাপন করব।

হ্যাগ্রিড। হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিডকে অনুতপ্ত ও তার কান্না দেখে হ্যারির খুব খারাপ লাগল। হ্যাগ্রিডের দাঁড়ি বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল।

সে যেভাবেই হোক বের করে ফেলত। এ-ই হলো ভোলডেমর্ট। তাকে না বললেও সে সব ঠিক বের করে ফেলত।–হ্যারি যুক্তি দেখালো।

তুমি তো মারাও যেতে পারতে। হ্যাগ্রিড ফুঁপিয়ে কাঁদলেন–দয়া করে ওই নামটি আর উচ্চারণ করো না। ভলডেমর্ট হ্যারি নিচু স্বরে উচ্চারণ করলো। নামটা শুনে হ্যাগ্রিড এতটা চমকালো যে তার কান্না থেমে গেল।

হ্যারি বলল–আমি তাকে দেখেছি। এজন্যই আমি তাকে তার নাম ধরে ডাকছি। হ্যাগ্রিড, দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। বরং খুশি হোন। আমরা পরশমণিকে রক্ষা করেছি। যদিও এটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ভোলডেমর্ট তো এটা আর ব্যবহার করতে পারবে না। একটা চকোলেট ফ্রগ নিন। আমার কাছে অনেক আছে…।

হ্যাগ্রিড হাত দিয়ে নাক মুছে বললেন-এখন আমার মনে পড়েছে। হ্যারি, আমার কাছে তোমার জন্য উপহার আছে।

এটা কি আপনার সেই স্যান্ডউইচ? হ্যারি আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস

না, ডাম্বলডোর গতকাল আমাকে ছুটি দিয়েছেন। হ্যাগ্রিড বলল যেখানে আমাকে অপসারণ করার কথা–যাক তিনি তোমার জন্য এই উপহারটা দিয়েছেন।

দেখে মনে হলো চামড়ায় বাধানো একটা সুন্দর বই। হ্যারি আগ্রহের সাথে বইটা খুলল। বইয়ে ছিল জাদুকরদের অসংখ্য ছবি। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছিল তার বাবা ও মার ছবি। স্মিতহাসিতে তারা তাদের দিকে হাত নাড়ছেন।

***

ওই রাতে হ্যারি একাকীই তাদের বছর শেষের ভোজে গেল। মাদাম পমফ্রে তাকে আরেকবার চেক–আপের জন্য পীড়াপীড়ি করায় হ্যারির একটু দেরি হয়ে গেল। হ্যারি যখন পৌঁছল তার আগেই গ্রেট হলটা ভরে গেছে। হল ঘরটা ক্লিারিন হাউজের রঙ সবুজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কারণ স্লিথারিন হাউজ পর পর সাতবার হাউজ কাপ জয় করেছে। একটা ব্যানারে স্লিদারিন হাউজের প্রতীক–সাপ দেখানো হয়েছে। ওই ব্যানারটা বড় টেবিলের পেছনের দেয়ালে টাঙানো হয়েছে?

হ্যারি যখন হল ঘরে প্রবেশ করল তখন চারদিকে জোরে জোরে নানা কথাবার্তা শুনতে পেল। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হ্যারি নিজেই। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।

হ্যারি চুপচাপ গ্রিফিল্ডর টেবিলে রন আর হারমিওনের মাঝখানে একটা আসনে বসল। তাকে নিয়ে যে এত কথা হচ্ছে, সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে-এই নিয়ে হ্যারি মাথা ঘামাল না।

সৌভাগ্যবশতঃ একটু পরই ডাম্বলডোর এলেন, আর সাথে সাথে সব গুঞ্জন মিলিয়ে গেল।

আরেকটা বছর পার হয়ে গেল। ডাম্বলডোর বললেন–ভোজ শুরু হবার আগে আমি তোমাদেরকে কিছু কথা বলতে চাই। বছরটি কেমন ছিল। আশা করি–তোমরা যখন এখানে এসেছিল সেই সময় থেকে এখন তোমাদের জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। তোমাদের সামনে পুরো গ্রীষ্মকাল পড়ে আছে। সেটা তোমরা কাজে লাগাতে পার।

ডাম্বলডোর বলে চললেন–আমার মনে হয় এখন হাউজকাপ বিতরণ করা যেতে পারে। পয়েন্ট অনুযায়ী বিভিন্ন হাউজের অবস্থান তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি।

৩১২ পয়েন্ট নিয়ে গ্রিফিল্ডর হাউজ চতুর্থ

৩৫২ পয়েন্ট নিয়ে হাফলপাফ হাউজ তৃতীয়

৪২৬ পয়েন্ট নিয়ে ব্যাভেনক্ল হাউজ দ্বিতীয়

৪৭২ পয়েন্ট নিয়ে স্লিদারিন হাউজ প্রথম

স্লিদারিন হাউজ আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ল। হ্যারি দেখল ড্রাকো ম্যালফয় তার টেবিলে তার বাটি দিয়ে আওয়াজ করছে। দৃশ্যটা ছিল হ্যারির জন্য মনোকষ্টের।

শাবাশ। স্লিদারিন হাউজ। হাউজকে উৎসাহ দিয়ে ডাম্বলডোর বললেন–তবে সাম্প্রতিক ঘটনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।

ঘর আবার শান্ত হয়ে গেল। স্লিদারিনদের হাসিও কিছুটা মিলিয়ে গেল।

ডাম্বলডোর বললেন, সবশেষে আমি তোমাদেরকে কিছু বলতে চাই।

হ্যাঁ, প্রথমে রন উইসলি।… ভয়ে রনের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল।

গত কয়েক বছরের মধ্যে হোগার্টসে সবচে ভালো দাবা খেলার জন্য আমি গ্রিফিল্ডর হাউজকে পঞ্চাশ পয়েন্ট দিচ্ছি।

গ্রিফিল্ডর হাউজ ছাঁদ ফাটা হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ঘর শান্ত হলো।

দ্বিতীয় অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–আমি মিস গ্রেঞ্জারকে…। কঠিন অবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় অভূতপূর্ব সাহসের পরিচয় দেবার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজকে আমি পঞ্চাশ পয়েন্ট দিচ্ছি।

হারমিওন তার ভাঁজ করা হাতের ওপর তার মুখ গুজলো। হ্যারি নিশ্চিত যে হারমিওন আনন্দে কাঁদছে। গ্রিফিল্ডর হাউজ খুব খুশি। মোট একশ পয়েন্ট পেয়েছে।

তৃতীয়ত, হ্যারি পটার। ডাম্বলডোর বললেন। হ্যারির নাম ঘোষণার সাথে সাথে সমস্ত ঘর পিনপতন স্তব্ধ। কোথাও কোন কথা নেই। ধৈর্য ধারণ করে অভূতপূর্ব সাহস প্রদর্শন করার জন্য আমি গ্রিফিল্ডর হাউজকে ষাট পয়েন্ট দিলাম।

কান ফাটা হর্ষধ্বনি। চারদিকে হৈ-হুল্লা। আনন্দ উৎসব। গ্রিফিল্ডর হাউজের এখন পয়েন্ট হয়েছে ৪৭২। স্লিদারিন হাউজের সমান পয়েন্ট। ডাম্বলডোর যদি হ্যারিকে আরেকটা পয়েন্ট বেশি দিতেন তাহলেই গ্রিফিল্ডর হাউজ–হাউজ কাপ পেয়ে যায়।

ডাম্বলডোর তার হাত ওঠালেন। পুরো ঘর শান্ত হয়ে গেল।

ডাম্বলডোর বললেন–সাহসের রকমফের আছে, শত্রুকে মোকাবিলা করতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। আবার বন্ধুকে সাহায্য করতে হলেও সাহসের প্রয়োজন হয়। এবার আমি মি, নেভিল লংবটমকে দশ পয়েন্ট দিচ্ছি। গ্রেট হলের বাইরে যদি কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি ভাবতেন ঘরের ভেতর নিশ্চয়ই একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের আনন্দ উল্লাসের আওয়াজ ছিল এত তীব্র। নেভিলকে উৎসাহ দেয়ার জন্য হ্যারি, রন আর হারমিওন দাঁড়িয়ে হাত তালি দিতে শুরু করল। আর তখন নেভিলকে সবাই বুকে জড়িয়ে ধরছে। ওকে আর দেখাই যাচ্ছে না সবার ভিড়ে।

কেউ কেউ হ্যারিকে চাপড়ে দিচ্ছে। হ্যারি, রন ও হারমিওন দাঁড়িয়ে আনন্দ করছিলো, নেভিল অভূতপূর্ব ঘটনায় হতবিহ্বল ও তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য–নেভিল এর আগে কখনোই এত পয়েন্ট পায়নি। হ্যারি তখনও আনন্দে উদ্বেলিত। রনকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে হ্যারি ম্যালফয়ের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ম্যালফয়কে এত হতভম্ব ও বিচলিত আর কখনোই দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে অন্ধ হবার

অভিশাপটা তার ওপর প্রভাব ফেলেছে।

আবার ডাম্বলডোর হাত উঠিয়ে বললেন–সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। চারদিকে তখনও করতালি ও হর্ষধ্বনি।

স্লিদারিন হাউজের পয়েন্ট কমে যাওয়ায় র‍্যাভেনক্ল ও হাফলপাফ হাউজও হর্ষধ্বনি করছে। তারা বললেন–পয়েন্ট পুনর্বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাজ সজ্জাতেও কিছু পরিবর্তন করতে হবে।

ডাম্বলডোর হাতে তালি দিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই সবুজ চাদর লাল চাদরে রূপান্তরিত হলো। রূপো সোনা হয়ে গেল এবং পেছনের ব্যানারে স্লিদারিন হাউজের প্রতীক সাপের পরিবর্তে গ্রিফিল্ডর হাউজের প্রতীক সিংহ প্রতিস্থাপিত হলো। কৃত্রিম হাসি নিয়ে অধ্যাপক স্নেইপ অধ্যাপক স্ম্যাকগোনাগলের সাথে করমর্দন করলেন। একটু পর তার নজর পড়ল হ্যারির ওপর। হ্যারি অনুভব করল যে, তার প্রতি স্নেইপের মনোভাবে সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। এতে অবশ্য হ্যারি উদ্বিগ্ন হলো না। জীবন তার স্বাভাবিক গতিতেই চলবে।

হ্যারির জীবনে এ সন্ধ্যাটা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। কিডিচ খেলায় জয়লাভ করা বা বড় দিনের উপহার পাওয়া বা দানবটাকে হত্যা করার তুলনায় এই সন্ধ্যাটা ছিল অনেক অনেক বেশি ভাল। এটা ছিল হ্যারির জন্য একটা অবিস্মরণীয় সন্ধ্যা।

সামনে যে পরীক্ষার ফল বেরুবে-এটা হ্যারি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফল শেষ পর্যন্ত বেরুল। বিস্ময়ের সাথে হ্যারি আর রন লক্ষ্য করল যে ভালো মার্ক পেয়েই তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। হারমিওন অবশ্য প্রথম হয়েছে। নেভিল হার্বোলজিতে ভালো করে ওষুধ তৈরির বিষয়ে প্রাপ্ত কম নম্বরকে পুষিয়ে নিয়েছে। তাদের ধারণা ছিল যে গর্দভ ও নীচুমনা গয়েল পরীক্ষায় পাস করবে না। তাদের বিস্মিত করে সেও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। এটা ছিল লজ্জার বিষয়। তবে রন হ্যারিকে বোঝাল–জীবনে যা চাওয়া যায় তার সবই কিন্তু পাওয়া যায় না।

হঠাৎ করেই ওয়ার্ডরোবগুলো খালি হয়ে গেল। সবাই তাদের ট্রাংক ভরে ফেলেছে। এবার ফেরার পালা। তাদেরকে নৌকা দিয়ে নিয়ে যাবার জন্য হ্যাগ্রিড এসে উপস্থিত। এরপর তারা হোগার্টস এক্সপ্রেসে উঠবে। প্ল্যাটফর্মে আসতে তাদের একটু বিলম্বই হলো। তারা দুজন দুজন করে, তিনজন তিনজন করে দরোজা অতিক্রম করল। তাদের প্রতি মাগলরা কেউ তেমন লক্ষ্য করল না।

তোমাকে গ্রীষ্মকালে আমাদের বাড়িতে কিছুদিন এসে থাকতে হবে। রন বলল–আমি তোমার কাছে পেঁচা পাঠিয়ে দেব।

ধন্যবাদ। হ্যারি জবাব দিল–আমি এর জন্য অপেক্ষা করবো।

বাই হ্যারি।

সি ইউ পটার।

তুমি তো এখানেও বিখ্যাত।

আমি কোথাও যাচ্ছি না। তবে তোমার শুভ কামনা করি। হ্যারি জবাব দিল।

সে, রন আর হারমিওন একত্রে গেইট অতিক্রম করল।

মা, এই তো হ্যারি। তাকিয়ে দেখ।

চুপ করো, জিনি। কাউকে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো অভদ্রতা। এটা ছিল গিনি উইসলি–রনের বোন।

তাদের দিকে তাকিয়ে মিসেস উইসলি মুচকি হাসলেন।

নিশ্চয়ই বছরটা ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। তিনি বললেন।

আসলেই। হ্যারি জবাব দিল–মিষ্টি আর জাম্পারের জন্য ধন্যবাদ।

এটা উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। মিসেস উইসলি বললেন।

তুমি কি যাওয়ার জন্য তৈরি?

আশ্চর্যের ব্যাপার। এ তো আঙ্কল ভার্নন। হ্যারির হাতে খাঁচা–বন্দি পেঁচা দেখে গোঁফধারী আঙ্কল তার বিরক্তি প্রকাশ করতে দ্বিধা করলেন না, তার পেছনে আছেন চাচী পেতুনিয়া। এমনকি ডাডলি পর্যন্ত। হ্যারির চেহারা দেখে সে কিছুটা সন্ত্রস্ত।

আপনারা নিশ্চয়ই হ্যারির পরিবারের সদস্য? মিসেস উইসলি তাদের জিজ্ঞেস করলেন। বলতে পারেন আঙ্কল ভার্নন উত্তর দিয়ে হ্যারির উদ্দেশ্যে বললেন–

বাছা, তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমাদের হাতে সময় নেই। আঙ্কল ভার্নন হাঁটতে শুরু করলেন।

রন আর হারমিওনের সাথে শেষ কথা বলার জন্য হ্যারি একটু দেরী করছিল।

গ্রীষ্মকালে আবার দেখা হবে।

তুমি সুন্দর ছুটি কাটাতে পারবে ভেবে আমার খুব ভালো লাগছে। হারমিওন এই বলে আঙ্কল ভার্ননের দিকে তাকালো। হারমিওনের বোধগম্য হল না–মানুষ কীভাবে দেখতে এত অপ্রীতিকর হতে পারে।

আশা করি পারব। হ্যারি জবাব দিল।

হ্যারি মনে মনে বলল–ওরা তো জানে না যে বাড়িতে জাদুবিদ্যার অনুশীলন করা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। হ্যারি ভাবতে লাগল–গ্রীষ্মের ছুটিতে ডাডলির সাথে অনেক মজা করা যাবে।

***

Exit mobile version