যুদ্ধের মতো, আর্থিক ব্যবস্থাও বিপাকে পড়ে। কারণ এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের পক্ষপাত গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিকূলে যায়। যখন নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, নৌ এবং পদাতিক বাহিনীর বিশেষজ্ঞরা মূল উদ্দেশ্যের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা এমন নয় যে ঐ লোকগুলো অসাধু। তাদের পেশাগত অভ্যাসই অস্ত্রশস্ত্রের প্রশ্নটা প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিতের আলোকে দেখা বাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই একই ঘটনা ঘটে আর্থিক ব্যাপারে। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান কম লোকেরই আছে। ব্যতিক্রম শুধু তারা যাত্রা প্রচলিত ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ লাভে লিপ্ত। এদের পক্ষে স্বাভাবিক কারণে পুরোপুরি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনও সম্ভব হয় না। এই অবস্থার প্রতিকার করতে হলে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে পৃথিবীর আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে আর্থিক নীতিমালা সহজতর করা জরুরি যাতে সবাই তা বুঝতে পারে। স্বীকার করতে হবে কাজটা সহজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি না যে এটি একটি অসম্ভব কাজ। চলতিকালে গণতন্ত্র সফল করে তোলার জন্য অন্যতম বাধা এই যে, আধুনিক জগত্তাই জটিল, এ জন্য সাধারণ নর-নারীর পক্ষে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত মতামত গঠন ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। কাদের বিশেষজ্ঞ মতামত সর্বাধিক শ্রদ্ধা করা উচিত যে সম্পর্কে মনস্থির করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার প্রতিকার সম্ভব শিক্ষাদর্শের উন্নতিসাধন করে। তাছাড়া সমাজের কাঠামো ব্যাখ্যা করার জন্য বর্তমানে যে উপায় প্রচলিত রয়েছে তার চেয়ে সহজ উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। যারা প্রকৃতই কার্যকর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা এ ধরনের সংস্কার সমর্থন করবেন। কিন্তু হয়তো শ্যামদেশ এবং মঙ্গোলিয়ার দূরাঞ্চল ছাড়া আজ আর কোথাও কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তি অবশিষ্ট নেই।
০৫. ফ্যাসিবাদের পূর্বসূত্র
আমরা যখন আমাদের যুগের সঙ্গে (ধরুন) ১ম জর্জের যুগের তুলনা করি, আমরা লক্ষ্য করি বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার মেজাজে একটা গভীর পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই পরিবর্তনের অনুসরণে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক সুরও বদলে গেছে। এক হিসেবে গত দুশো বছর আগের ধ্যান-ধারণাকে যুক্তিশীল বলা যেতে পারে এবং আমাদের যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে বলা যেতে পারে যুক্তিবিরোধী। কিন্তু আমি এই শব্দগুলোকে ব্যবহার করছি কোনো একটি মেজাজ সম্পূর্ণ গ্রহণ কিংবা সম্পূর্ণ বর্জন অর্থে নয়। উপরন্তু এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাজনৈতিক ঘটনা বারে বারে নতুন রঙে রঞ্জিত হয় পূর্বতন কালের ভাবনা দ্বারা একটি তত্ত্ব ঘোষণা এবং তার ব্যবহারিক কার্যকারিতার ভেতর বিরাট বিরতি থাকে। ১৮৬০ সালে ইংরেজ জাতির রাজনীতি প্রভাবিত হয়েছিল ১৭৭৬ সালের অ্যাডাম স্মিথের ভাবনা-ধারণা দ্বারা। আজকের জার্মান রাজনীতিকে ১৮০৭ সালের ফিশতের তত্ত্বের বাস্তবায়ন গণ্য করা চলে। রুশ রাজনীতি ১৯১৭ সালের পর কম্যুনিস্ট ইশতেহারের মতবাদ বাস্তবায়িত করেছে, ঐ ইশতেহার প্রথম ঘোষিত হয় ১৮৪৮ সালে। সুতরাং বর্তমান যুগকে বুঝতে হলে অনেক আগের সময়ের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ব্যাপক প্রচারণা পেলে ধরে নিতে হবে এর পেছনে দুটো কারণ ক্রিয়াশীল ছিল। একদিকে থাকে পূর্বতন কালের জ্ঞানচর্চা। অর্থাৎ থাকেন কিছু লোক যারা কিছু তত্ত্ব এগিয়ে নিয়ে যান, যে তত্ত্বগুলো গজিয়ে উঠেছে পূর্বতন তত্ত্বের বিকাশ কিংবা প্রতিক্রিয়া হিসেবে। অপরপক্ষে, কিছু-কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনগণকে এমন দৃষ্টিকোণ গ্রহণে আগেই অনুপ্রাণিত করে রাখে যা সুনির্দিষ্ট মেজাজ অবলম্বনে মন্ত্রণা যোগায়। তবু শুধু এগুলো থেকেই সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা মেলে না, যেহেতু প্রায়ই দেখা যায়, পূর্বতন জ্ঞানচর্চা অবজ্ঞা করা হয়। যে ব্যাপার নিয়ে আমরা এখানে ভাবতে বসেছি তাতে দেখা যায় যে, যুদ্ধোত্তর কালের দুনিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীর অসন্তোষের সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল, ফলে তা আগের কালে উদ্ভাবিত নির্দিষ্ট একটি দর্শনের প্রতি তাদের সহানুভূতিশীল করেছে। এই দর্শন বিষয়ে প্রথমে কিছু কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করি। অতঃপর এই দর্শনের বর্তমান জনপ্রিয়তার বিষয়ে ভাবা যাবে।
যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় যুক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নিউটন যখন মানুষের মন শাসন করছিলেন, তখন একটা বিশ্বাস ব্যাপক প্রসার লাভ করে যে প্রাঞ্জল সাধারণ সূত্র আবিষ্কারের মধ্যেই জ্ঞানের পথ মেলে। এবং এই সাধারণ সূত্র থেকে অবরোহী যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। অনেকেই ভুলে গেছিলেন যে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ সূত্রের ভিত্তি এক শতাব্দীর সতর্ক পর্যবেক্ষণ, এবং তিনি কল্পনা করতেন যে সাধারণ সূত্র প্রকৃতির আলোকে আবিষ্কার সম্ভব। সে সময় ছিল প্রাকৃতিক ধর্ম, প্রাকৃতিক আইন, প্রাকৃতিক নৈতিকতা, এবং প্রাকৃতিক আরো অনেক কিছু। ধরা হতো এই বিষয়গুলো গঠিত স্বতঃপ্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধান্ত থেকে গৃহীত প্রতিপাদক অনুমান, অনেকটা ইউক্লিডের নিয়মে। এই দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক ফল ছিল মানুষের অধিকার, যা আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রচার পায়।