Site icon BnBoi.Com

ক্যাসিনো রয়্যাল – জেমস বন্ড

ক্যাসিনো রয়্যাল - জেমস বন্ড

ক্যাসিনো রয়্যাল

০১. সারারাত ধরে জুয়া খেলা চলেছে

সারারাত ধরে জুয়া খেলা চলেছে এই ক্যাসিনোতে। এখন ভোর তিনটে।

জেমস বন্ড এখন নিদারুণ ক্লান্ত। ক্লান্তি তার দেহে ও মনে, তাই পৃথিবীর সেরা ডিটেকটিভ হয়েও যার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, তার পক্ষেও এখন ভুলভ্রান্তি হবার উপক্রম। এই খেলাটার মধ্যেই এমনকিছু আছে, যা নেশা ধরিয়ে দেয়।

বন্ড, জেমস বন্ড, আধুনিক পৃথিবীতে এই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সবচেয়ে নামজাদা সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট। দেশে দেশে তার কারবার। এর সাথে সাধারণ ডিটেকটিভদের তুলনা হয় না।

রুলেত–এর টেবিল ছেড়ে সে চুপিচুপি উঠে গেল। ঘরের বাইরে গিয়ে পিতলের রেলিং-এর কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। ল্য শিফ একটানা জিতেছে তার টেবিলের সামনে একগাদা পিতলের চাকতি–এক একটা এক লাখের। বাঁ দিকে হলুদ চাকতিগুলোর প্রত্যেকটার মানে পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।

ক্যাশ কাউন্টার উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা। টুলে বসা কাশিয়ার যেন এক সতর্ক ব্যাংক কেরানি। তার সামনে এবং দুপাশে সাজিয়ে রাখা থাকে গোল চাকতি আর করকরে নোটের বান্ডিল। কারুর সাধ্যি নেই ক্যাশ কাউন্টারের রেলিং টপকে ঢোকে অথবা বেরিয়ে আসে। দুজন ক্যাশিয়ার। ক্যাসিনো থেকে টাকা হাতাবার ব্যাপারটা অসম্ভব।

বন্ড কিছু নোটের বান্ডিল নিচ্ছিল— দশ হাজার এবং এক লাখ ফ্রাঁ-র নোটের বান্ডিল। তার মনে তখন আর একটা চিন্তা কাল সকালে ক্যাসিনো কমিটির মিটিং। অবশ্য এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার।

আজকের ফলাফল ঘোষণা হচ্ছে। মঁসিয়ে ল্য শিফ পেয়েছেন দু লাখ, একইভাবে নিজস্ব স্টাইলে খেলেন তিনি। মিস ফেয়ারচাইল্ড একঘন্টার মধ্যে দশ লাখ জিতে চলে গেছেন। ভাইকাউন্ট দ্য ভিলোরা জিতেছেন দশ লাখ। বহু ঝুঁকি নিয়ে খেলেছেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য সহায়। তাই শেষ পর্যন্ত ভালোই লাভ করেছেন। এরপর ওই ইংলিশ জেন্টলম্যানকে লক্ষ করতে হয়–মিস্টার বন্ড। আশ্চর্য এই, তিনি জিতেছেন তিরিশ লাখ। দুদিনের মধ্যে এতখানি জয় সোজা কথা নয়। শেফ দ্য পার্টি বিশদ বিবরণ নোট করেছে। লোকটার স্বভাব এবং চালচলন লক্ষণীয়–বরাবর চড়া দরে বাজি ধরে। সুদৃঢ় নার্ভ এবং ভাগ্যও আশ্চর্য রকমের ভালো।

ঘোষণা শেষ। সভাও শেষ। সৌজন্য বিনিময় চলছে।

বন্ড সুইং ডোর ঠেলে বাইরে এল। সামনেই একজন স্যুটেড-বুটেড লোক, সে মাথা নোয়াল বটে, যেন বিরক্তি চেপে। এর কাজটা খুব দায়িত্বপূর্ণ–গোলমাল দেখলেই পা দিয়ে ইলেকট্রিক সুইচ টিপে দেয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ভিতরের কেউ বেরোতে পারে না, উটকো লোক ঢুকতে পারে না।

এরপর ক্যাসিনো কমিটি খেতে যাবে–কেউ বাড়িতে, কেউ কাফেতে।

বন্ডের ভাবভঙ্গি অবশ্য রহস্যজনক কিন্তু ক্যাশ লুঠ করবার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। বরং ব্যাপারটা কল্পনা করে তার মজা লাগছিল। হ্যাঁ, যদি ক্যাশ লুঠ করতেই হয়, তাহলে এক ডজন শক্তিমানের দরকার, যা সহজেই দু চারটেকে খতম করে দিতে পারবে। অবশ্য এতেও ঝুঁকি আছে–এরাই আবার পরস্পরকে ধরিয়ে দেয়।

ফ্রান্সের অপরাধ জগতের চরিত্র মোটামুটি ভালোই বুঝেছে বন্ড।

ক্লোক রুম। এখানে এক হাজার ফ্রাঁ দিতে হল। নীচে নেমে গেল বন্ড। একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, ক্যাশ লুঠের চিন্তাটা ত্যাগ করাই উচিত।

অতঃপর কী বড় ভাবতে গিয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তার চোখ জ্বলছে, দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। অবশ্য এখন বাইরে এসে রাতের হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়াটা সহজ হল। সাধারণ অনুভূতিগুলো সাথে সাথে মস্তিষ্ক আবার কাজ শুরু করল।

হোটেল স্‌প্লেনডিড! ঘরে ঢুকে আগে দেখতে হবে, অনুপস্থিতিতে কেউ ঢুকেছিল কিনা।

কেয়ারটেকার চাবি ও টেলিগ্রাম দিল।

বন্ডের রুম নং ৪৫। টেলিগ্রাম এসেছে জ্যামাইকা থেকে।

…কিংস্টোন, জ্যামাইকা… বন্ড স্প্লেন্‌ডিড রয়্যাল লেজো। খারাপ মাল তৈরি হয়েছে, সব হাভানা সিগারের ফ্যাক্টরিতে, ১৯১৫…এক কোটি রিপিট এক কোটি স্টপ…. আশা করি এই টাকায় কাজ হবে… শুভেচ্ছা… দাসিলভা…

বন্ড বুঝল, এক কোটি ফ্রাঁ তাকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু লন্ডনে হেড কোয়ার্টারের কাছে তার দাবি ছিল আরও বেশি। কাল বিকেলে প্যারিস থেকে লন্ডনে ক্লিমেন্টসের কাছে যে বার্তা পাঠানো হয়, তার উত্তরেই এই টেলিগ্রাম এসেছে। ক্রিমেন্টস বন্ডের ডিপার্টমেন্টে চিফ। তিনি যার সাহায্য চাইছেন তার সাংকেতিক নাম এম। এম এব সাহায্যে ট্রেজাবিকে প্রভাবিত করা গেছে।

জ্যামাইকা বন্ডের কাছে নতুন নয়। কিন্তু এখন তাকে নতুন ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। তার ছদ্মভূমিকা অনুযায়ী সে এখন মেসার্স ক্যাফারি নামে জ্যামাইকার সবচেয়ে বড়ো কোম্পানিব এক জাঁদরেল ক্লায়েন্ট। মেসার্স ক্যাফারির আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা। সমস্ত নির্দেশ আসছে জ্যামাইকা থেকে। নির্দেশদাতা খবরের কাগজের লোক, সংবাদপত্রটির নাম ডেইলি প্লিনার, আর নির্দেশদাতার নাম ফসেট।

কে এই ফসেট? একসময় কোন আইল্যান্ডে একটি কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করত। কোম্পানির কাজ ছিল কচ্ছপ ধরা। পরে যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে নাম লেখায় সে। এবং শেষ পর্যন্ত মাল্টায় নেভির গোয়েন্দা দপ্তরে কেরানির কাজ পায়। যুদ্ধশেযে সিক্রেট সার্ভিসের নজর পড়ে তার দিকে। ক্যারিবিয়ান শাখায় ফসেট ফটোগ্রাফির কাজ শেখে। এরপর এক বড়ো ব্যক্তির সাহায্যে ডেইলি প্লিনারে চাকরি পায়। প্রধানত ফটোগ্রাফ বাছাইয়ের কাজ।

মাঝে মাঝে অজানা লোকের কাছ থেকে টেলিফোনে আদেশ পেত সে। এবং সেই আদেশ ঠিকমতো সময়মাফিক পালন করতে হত। পুরো ব্যাপারটাই ছিল টপ সিক্রেট। এর জন্য সে মাসে অতিবিক্ত কুড়ি পাউন্ড পেত। ব্যাংকে জমা পডত টাকা; সবাই জানত তার এক আত্মীয ইংল্যান্ড থেকে টাকা পাঠাচ্ছে।

ফসেটের বর্তমানে কাজ এই অজানা ব্যক্তির নির্দেশগুলো ঠিকমতো বন্ডকে জানিয়ে দেওয়া। কেন, ফসেটের মাধ্যমে কেন? কারণ, ফসেটকে জ্যামাইকার পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট কোনো সন্দেহ করবে না। তাছাড়া সে এখন ম্যারিটাইম বেস এন্ড ফোটো এজেন্সির সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করে। ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে কিছু বিশে সুযোগ পায়। ফলে উপরি টাকা মাসিক আরও দশ পাউন্ড।

উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে করতে একটা গাড়ি বুক করে বসল সে। অফিসেও একটা সবুজ রঙের আই-শেড চোখে লাগিয়ে ডেস্কে বসে কাজ করত। এমন একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি করল যে, সবাই তাকে মান্য করতে বাধ্য।

বন্ড ভাবছে–এটাই ভালো, মানে এই ঘুরপথে নির্দেশ আসা। হয়তো এই শহরে সিক্রেট সার্ভিসের আরও লোক আছে। রিজেন্ট পার্কের হেড কোয়ার্টার থেকে ফন্দিফিকির আঁটছে–অর্থাৎ মাত্র ১৫০ মাইল দূর থেকে। তাছাড়া কিংস্টোনে বসে একবারে গাড়ি কেনা সহজ হবে না লন্ডন থেকে প্রশ্ন উঠবে।

বন্ড টেলিগ্রামের উত্তর দিল–ধন্যবাদ .. এই দিয়েই কাজ হবে… বন্ড।

টেলিগ্রামটা আর কে করে ফেলেছে কে জানে! কেউ হয়তো কপি করে নিয়েছে। কেয়ারটেকারকে ঘুস দেওয়া সোজা ব্যাপার।

গুড নাইট!

বন্ড লিফটে উঠতে গিয়ে থেমে গেল। না, লিফটে সে উঠবে না। লিফটে সবসময় সিগন্যাল ফিট করা থাকে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠাই ভালো। ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বন্ড এম–কে পাঠানো খবরটার কথাই চিন্তা করছিল। এটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। জুয়া খেলতে গিয়ে সে শিখেছে, অল্প মূলধন নিয়ে কাজে নামা ঠিক নয়। যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। তাছাড়া এম-এর বেশি টাকা দিতও না।

হঠাৎ কী ভেবে এক নিমেষে আলো জ্বেলে দরজা খুলল। বলাবাহুল্য তার হাতে এখন উদ্যত রিভলবার। ঘর অবশ্য খালি… কিন্তু একী! বাথরুমেব দরজাটা অর্ধেক খোলা! কিন্তু সেটাও বড়ো ব্যাপার নয়। রুমের দরজা ভিতর থেকে লক করে দিল বন্ড। টেবিলের কাছে এসে মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখল! আসলে দু এক গাছি চুল টেবিলের ড্রয়ারে আটকে রেখেছিল সে। দেখল, সেগুলো ঠিকই আছে। আলমারির কাচের হাতলের ওপর পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছিল। না, কারো হাতের ছাপ নেই সেখানে। বাথরুমের রিজার্ভারে জলের লেভেলে একটা আঁচড় দিয়ে মার্কা করে রাখা হয়েছিল। জল ঠিক লেভেলেই আছে।

সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা জানে–এরকম ছোটোখাটো কাজগুলো করতে হয়। আত্মরক্ষার জন্য, সাবধানতার জন্য। প্রতি পদে বিপদ। হাঁ করে ওৎ পেতে বয়েছে। সবসময় মৃত্যুর পাশে পাশে তাদের জীবন কাটে। এদেব সঙ্গে তুলনা করা যায় গভীব জলের ড়ুবুবি বা টেস্ট পাইলটের জীবনের। সবসময় মৃত্যু নিয়ে খেলা–এটাই কাজ। এটাই জীবিকা।

যাই হোক, এখন বোঝা যাচ্ছে, এই ঘরে কেউ ঢোকে নি। আপাতত নিশ্চিন্ত মনে স্নান সারল বন্ড। তারপর টাকার হিসেব শেষ হল। নোটবুকে কয়েকটা সংখ্যা টুকতে হল! হ্যাঁ ঠিকই দু দিনেব জিত তিবিশ লাখ। লন্ডনে সে পায় এক কোটি, চাওয়া হয়েছিল আরও এক কোটি। টেলিগ্রাম বলছে সেটা আসছে। সুতরাং, আপাতত সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে–দুকোটি তিরিশ লাখ ফ্রাঁ–মানে তেইশ হাজার পাউন্ড।

সিগারেট ধরাল বন্ড। এই নিয়ে আজ সাবাদিনে সত্তরটা সিগারেট খরচ হল। আলো নিভিয়ে জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর বালিশের তলায় নোটের বান্ডিল এবং ৩৮ কোল্ট পুলিশ পজিটিভ রিভলভারটা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

০২. দুসপ্তাহ কেটে গেল

দুসপ্তাহ কেটে গেল।

হঠাৎ, এম এর কাছে পৌঁছে গেল ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের চিঠি। বিভাগীয় প্রধান লিখেছেন (বার্তার স্টাইলে)–

…. টু এম

ফ্রম দ্য চিফ অব দ্য ডিফেন্স মিনিস্ট্রি,

ইংল্যান্ড,

বিষয় : মঁসিয়ে ল্য শিফকে ধ্বংসের পরিকল্পনা। (ল্য শিফ দা নামবার, হের নামবার, হির জিফার….)।ল্য শি শত্ৰুদলের চিফ এজেন্ট, ফ্রান্সে। আলসেস-এর শিল্পাঞ্চলে কম্যুনিস্ট প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে গোপনে অর্থ দেয়। এই ট্রেড ইউনিয়ন যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের হয়ে স্পাইং করতে পারে–এটা আমরা জানি। বার্তায় আরও জানানো হয়েছে, আমাদের অনুমান ল্য শিফ আগুন নিয়ে খেলছে। স্মার্শ এবং গুপ্তচর সংস্থা তবে সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এদের সোভিয়েট রাশিয়ার উপযুক্ত এজেন্ট বলা যায়। কিন্তু তাদের কতগুলো নীতিগত দুর্বলতা রয়ে গেছে, সেটা আমরা জেনেছি। ল্য শিফের একজন বান্ধবী আছে (নং ১৮৬০), সে আমাদেরই লোক। স্টেশন এফ থেকে নির্দেশ পেয়ে সে ল্য শিফ সম্পর্কে অনেক ব্যক্তিগত ঘটনা আমাদের জানিয়েছে।

…এখন ল্য শিফের চরম আর্থিক সংকট চলছে। নং ১৮৬০ জানিয়েছে, ল্য শিফ গয়না বিক্রি করেছে, অ্যান্টিবেসের বাড়িটাও বিক্রি করেছে। আগে সে যথেচ্ছ খরচ করত, কিন্তু এখন ব্যয়বাহুল্য সংযত করেছে। এই কেস-এ আমাদের সাহায্য করছেন দোয়াজিয়েম ব্যুরো।

তাছাড়া ১৯৪৬-এর জানুয়ারিতে ল্য শিফ কতগুলি খারাপ ব্যবসার মালিক হয়ে ওঠে। কর্ডন জুন নামে পরিচিত এই সংস্থার অনেকগুলো ব্রাঞ্চ আছে নৰ্মান ডি এবং ব্রিটানিতে। এই আপত্তিকর সংস্থাটি কেনার জন্য সে পাঁচকোটি ফ্রাঁ ব্যয় করে। লেনিনগ্রাড থেকে ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়নকে যে টাকা দেওয়া হত ল্য শিফের মাধ্যমে, সেই টাকা এই খারাপ ব্যবসায়ে লাগিয়ে সে বিরাট বোকামি করেছে। যদি টাকা খাটিয়ে ইউনিয়নের সম্পত্তি বাড়ানো তার উদ্দেশ্য হত, সেদিক থেকে অবশ্য এই খারাপ ব্যবসাটাই ভালো ছিল। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি, এবং সেইসঙ্গে নিন্দনীয় আত্মতৃপ্তি। ফলে যা হবার তাই হল।

তিন মাসের মধ্যে, ১৩ই এপ্রিল ফ্রান্সে একটি নতুন আইন পাস হল….

এম-কে এই বার্তাটা ফরাসিতে লেখা হয়েছে।

–হুম….

ইনটারকমের সুইচ টিপে বললেন–হেড অফ এস্?

-ইয়েস!

–একটা শব্দের মানে জিজ্ঞেস করছি।

শব্দটা বলার পর উত্তর এল— এর মানে হচ্ছে দালালি।

–তাহলে, ইংরেজিতে লেখাই ঠিক হতো। অহেতুক ভাষাজ্ঞান….

–সরি স্যার।

এম আবার লেখাটা পড়তে শুরু করলেন।

লেখাটা এই : সুতরাং সমস্ত আপত্তিকর সংস্থাগুলো, খারাপ ভাষায় লেখা বই, নারীর মর্যাদা নিয়ে ব্যবসাগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল ল্য শিফ-এর অবস্থা সঙ্গীন। তবু সে তার অসৎ, অসাধু পথে চলতে থাকল। কিছু খারাপ ছবির ব্যবসাও চালাবার চেষ্টা করল। চলল না। এবার সব কিছু বেচে দিয়ে সে একটা মোটা টাকা জোগাড়ের ধান্দা করল। কিন্তু পুলিশ সতর্ক ছিল, তার সমস্ত আপত্তিকর ব্যবসা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেল।

….. পুলিশ তাকে চিনত অসাধু, অশ্লীল বিষয়ের ব্যবসায়ী বলে। দোয়াজিয়েম ব্যুরোতে রচিত তার ফাইলটি বের করে আরো বিশদ খবর পাওয়া গেল। সুতরাং আমরা এবং ফরাসি বন্ধুরা জোর কদমে এগোতে থাকি। এতে কাজ দেয়। জানা যায়, ল্য শিফেব অবস্থা এখন কাহিল। সবই বন্ধ হয়ে গেছে। এমন কি তার কাছে জমা থাকা ইউনিয়নের ফান্ডেও পাঁচ কোটি ফ্রাঁ কম দেনা যাচ্ছে।

… কিন্তু এখনও লেনিনগ্রাড যথেষ্ট সতর্ক হয়নি। হয়তো স্মার্শ কিছুটা সন্দেহ করছে। পি স্টেশন থেকে জানা গেছে, এক সোভিয়েট সংস্থা থেকে একজনকে পাঠানো হয়েছে। সে ওয়ারশ, পূর্ব বার্লিন হয়ে স্ট্রাসবার্গ যাবে। একজন ডাবল এজেন্টও আছে।

… সুতরাং ল্য শিফ-এর পালানো বা আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই। সে টাকা উদ্ধারে মরিয়া, কিন্তু তার প্রাণহানির সম্ভাবনা সে বোধহয় টের পায়নি। আমরা উলটো চাল চালছি।

… ল্য শিফ জুয়ার আড্ডা বসাচ্ছে। অন্য বে-আইনি ব্যবসায়ে এত টাকা তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবেনা। রেস খেলেও হবেনা।

…. ইউনিয়নের ফান্ড থেকে সে লুকিয়ে বাকি দুকোটি পঞ্চাশ লক্ষ ফ্রাঁ নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তহবিল নিঃশেষিত। দুপ্তাহ পরে সে উত্তবে রয্যাল লিজোর বাংলোতে যাবে।

… তাই রয়্যাল ক্যাসিনোতে টাকার খেলা জমবে। গ্রীষ্মের সিজনে এখানে বহু ধনীরা আসবে। ল্য শিফেব আশা তখন প্রায় পাঁচ কোটি ফ্ৰাঁ লাভ হতে পারে। ১৫ জুনের মধ্যে।

…এবং সংক্ষেপে আমাদের পরিকল্পনা এই–শুধু সোভিয়েট নয়, উত্তর আটল্যান্টিক চুক্তিভুক্ত সব দেশকেই পর্যুদস্ত করতে হবে। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের সম্মান তো যাবেই। এদের গুপ্তচর ও অন্যান্য সদস্য মিলে সংখ্যাটা কম নয়— প্রায় ৫০,০০০। ল্য শিফকে খুন করে লাভ নেই, ববং জুয়াব টেবিলে তাকে পথের ভিখারি বানানোই কাজ দেবে। সিক্রেট সার্ভিসের দক্ষ জুয়াড়িদের নিযোগ কবছি। যদি কাউকে না পাঠানো হয়, তবে সব কাগজপত্র সি আই.এ-র বা দোয়াজিয়েম ব্যুরো-ব হাতে তুলে দেওয়া হবে। স্বা এস। অ্যাপেন্ডিক্স এ। নাম ল্য শিফ। ছদ্মনাম…..ইত্যাদি, যেমন হের জিফাব। কেস হিস্ট্রি–অতীতের জানা নেই। তবু গুজব আছে যে, ১৯৪৫-এ সে ছিল মার্কিনীদের দখলে উদ্বাস্তু শিবিবে। স্মৃতিভ্রংশ ও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত রোগীর ভান করত। জাল পাসপোর্টের নম্বর ছিল ৩০৪ ৫৯৬। সে থেকে সে নিজের নাম ল্য শিফ বলে চালু করে।

বার্তা শেষে তার চেহারার বিবরণ আছে। দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, ওজন ১৮ স্টোন…ইত্যাদি। অভ্যাস সম্পর্কে বলা হয়েছে বেশ কিছু বদ-অভ্যাস, নারীঘটিত দুর্বলতা, হাইস্পিডে গাড়ি চালানো, দ্রুত অস্ত্র চালানো ইত্যাদি। জরুরি বিষয় : হ্যাট ব্যান্ড, বাঁ দিকে জুতোর সেলে এবং সিগারেট কেসে তিনটে ধারালো ব্লেড থাকে। ভালো জুয়াড়ি, বডিগার্ড দুজন একজন ফরাসি, একজন জার্মান। এককথায় বিপজ্জনক রাশিয়ান এজেন্ট। প্যাবিসে পোস্টেড। স্বা. আর্কাইভিস্ট।

অ্যাপেন্ডিক্স বি: বিষয় স্মার্শ। সংবাদ সূত্র . সি. আই. এ. ইত্যাদি।

স্মার্শ শব্দটি দুটি রুশ শব্দের মিশ্রণে তৈরি, যার মানে–স্পাইদের হত্যা করো।

সর্বময়কর্তা, বেরিয়া। হেড কোয়ার্টার : লেনিনগ্রাদ। মস্কোতেও শাখা আছে।

এদের পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ : ১৯৪০-এ ট্রটস্কি হত্যাকান্ড এদেরই ছক। এই SMARS হিটলারের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা নেয় রাশিয়ার গুপ্তশত্রুদের খতম করার। নানা শাখা নানা কাজ করে— দেশ বিদেশে গুপ্তশত্রুদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। সক্রিয়কাজ বলতে হত্যাও বোঝায়। আর্থিক পরিচালনা, আইন, বিচার ও দণ্ডদান এদের শাখার নির্দিষ্ট কাজ।

রিপোর্ট বলছে : এ পর্যন্ত আমাদের হাতে মাত্র একজন স্মার্শ ধরা পড়েছে। গয়েৎশভ ওরফে গ্যারাড জোন্স ১৯৪৮ সালে ৭ আগস্ট হাইডপার্কে যুগোশ্লাভ দূতাবাসেব মেডিক্যাল অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। তদন্ত চলার সময় সে পটাসিয়াম সাইনাইড দিয়ে তৈরি কোর্টের বোতাম খেয়ে আত্মহত্যা করে। বহু ব্রিটিশ ডাবল এজেন্ট স্মার্শের হাতে মরেছে।…. সুতরাং আমাদের দিক থেকে এদের মোকাবিলার মধ্যে যে কোনো গলতি না থাকে।…

রিপোর্ট শেষ।

০৩. রুশ বিরোধী বিষয়

এস-বিভাগ মূলত কাজ করে রুশ বিরোধী বিষয়গুলো নিয়ে।

এর প্রধান-এর অফিস বাড়ি রিজেন্ট পার্কে। এখন প্রধান কাজ ল্য শিফ খতম!

ফাইল হাতে সে এগিয়ে গেল হেড অফ এস এর কাছে। ১৯৪৪ সাল থেকে সে এই কাজ করছে। এখনও বেশি বয়েস হয়নি।

এম-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস মানিপেনি সুন্দরী মহিলা। কিন্তু তার চোখ দুটি বরফ দেওয়া মাছের মত। ভাষাহীন। এস-এর চিফ মিস মানিপেনিকে একটা ফাইল দিয়ে বললেনতোমার কর্তাকে দিয়ে আমায় এই কাজটা পাশ করে দাও।

–ও. কে. স্যার!

আদেশ এল। এস-এর চিফ এম-এর হেড অব অফিসের চেম্বারে গেলেন। নীল আলো জ্বলে উঠল। অর্থাৎ জরুরি কথা হচ্ছে। এখন যেন কেউ এই ঘরে না ঢোকে।

একটু পরে কথাবার্তায় বোঝা গেল হেড অব এস বেশ খুশি। ল্য শিফকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদের হাতে একজন যথেষ্ট যোগ্য লোক আছে।

–কে?

–০০-দের কেউ হবে মনে হয়। খুব সম্ভব ০০৭। মন্টিকার্লোতে জুয়ার আড্ডায় ভালো কাজের রেকর্ড আছে। ০০৭ আর দেরাজিয়েন বুরো মিলে ওদের ফিনিশ করে দিয়েছিল। লাভ হয়েছিল দশলক্ষ ফ্রাঁ! মন্দ নয়!

বন্ডকে হেড অফ এস্-এর রিপোর্টটা পড়তে দেওয়া হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানলা দিয়ে গাছের মাথাগুলো দেখল বন্ড। তারপর এম-এর ঘরে ঢুকে গেল।

–কাম ইন!

–থ্যাংক ইউ স্যার ফর দ্য জ! তবে জেতা নিশ্চিত কিনা বলা মুশকিল। চড়া বাজি, প্রথমেই পাঁচলাখ ফ্রাঁ লাগবে।

–টাকার অভাব হবে না। তাছাড়া, ওরাও হারতে পারে। আড়াই কোটি পাবে তুমি, প্রথমে এককোটি নাও। আশাকরি, পঞ্চাশ লাখ নিজেই খেলে রোজগার করতে পারবে। … আমার ইচ্ছে, কয়েকদিন আগে থাকতেই যাও। দোয়াজিয়েম বুরোকে বলব–ম্যাথুসকে পাঠাতে। তোমার সঙ্গে ওর বোঝাঁপড়া ভালো; NATO-র স্বার্থজড়িত। ফনটেন ব্লোতে সি. আই.এ-কে পাবে। আর কী চাই?

–ও. কে. স্যার। থ্যাংক ইউ।

–গুড লাক। …আচ্ছা, আরও দুজন লোক দেন। ক্যাসিনো রয়্যালে ওরা তোমাকে কনট্যাক্ট করবে। দক্ষ লোক।

বন্ড একাই কাজ করতে ভালোবাসে। তবু যখন দিচ্ছে, দিক।

০৪. হোটেল বিছানায় শুয়ে

ঘুমের মধ্যে হোটেল স্‌প্লেনডিডের বিছানায় শুয়ে এসব কথা ভাবছিল বন্ড।

রয়্যাল লেজোতে সে দুদিন আগে এসেছে।

এখন লাঞ্চ টাইম। রেজিস্টারে সই করেছিল–জেমস বন্ড, পোর্ট মারিয়া, জ্যামাইকা। অর্থাৎ পরিচয় গোপন করে নি। এম-ও পরিচয় গোপন রাখতে বলে নি। শুধু বলেছিল— যখন তুমি খেলার টেবিলে ল্য শিফকে চ্যালেঞ্জ করবে তখন অনেকেই বুঝে যাবে।

কথাটা সত্যি।

তবু জ্যামাইকা সম্পর্কে একটু স্টাডি দরকার, দু-একজনের সঙ্গে আলাপ থাকলে ভালো। নিজের পরিচয় হিসাবে সে পরদের কাছে জ্যামাইকাবাসী এক ধনী বাগান মালিকের পুত্র, তামাক ও চিনির ব্যবসায়ে প্রভূত আয় হয়েছে তার।

ইতিমধ্যে দুটি রাত ক্যাসিনোতে কেটেছে। তিরিশ লাখ ফ্ৰা লাভ হয়েছে। ল্য শিফকে ভালো করে দেখেছে। লোকটা দক্ষ এবং খুবই সৌভাগ্যবান।

আজকের দিনটা উজ্জ্বল। স্নান সেরে অরেঞ্জ জুস খেতে খেতে লেখার টেবিলে বসল বন্ড। ডিম, বেকন এবং একটু পরে কড়া কফি খেয়ে সিগারেট ধরাল। বলকান ও টার্কিশ তামাকের মিশ্রণ এই সিগারেটে।

নীচ থেকে টেলিফোন। ওর অর্ডার দেওয়া রেডিও সেটটা এসেছে।

–পাঠিয়ে দিন।

বন্ড ভাবল–এখুনি ম্যাথুস এলে ভালো হয়। ঠিক কথা, ম্যাথুসই।

ম্যাথুস বলল–মঁসিয়ে, এই আপনার সুপারহিট রেডিও। ইউরোপের সবকটা রাজধানী ধরতে পারবেন।

–ফাইন!

–সাড়ে এগারোটা বাজে। রেডিও সেটটা একটু টেস্ট করা ভালো।

পুরো ভল্যুমে রেডিও ছাড়া হল, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। অথচ লং ওয়েভের লাল ব্যান্ডে আলো জ্বলছে। একটু পরেই অবশ্য সাউন্ড এল।ম্যাথুস বন্ডের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল–টিউন ঠিক ছিলনা, সরি।

চাপড় মেরে আঙুল ঝাঁকাতে লাগল ম্যাথুস। বন্ডের মনে হল যেন ওর আঙুল ভেঙে গেছে। বিছানায় বসে সিগারেট ধরাল ম্যাথুস। বন্ড বলল–এবার খবর বলো।

ম্যাথুস বলতে থাকল— সত্যি এটা আশ্চর্যের ব্যাপার। ওরা কী করে টের পেল! মোটকথা, শত্রু সদলবলে হাজির। তোমার ঘরের উপরে আছেন মুনজ্‌ দম্পতি। লোকটা জার্মান। ওদের ইলেকট্রিক ওভেন আছে। চিমনির মধ্যে দিয়ে তার গেছে ওই ওভেন পর্যন্ত। স্ত্রী অসুস্থ, শয্যাশায়ী। মুনজ্‌ স্ত্রীর সেবায় রত। এখানে ঢুকে আমাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হল।

এবার রেডিও বন্ধ করল ম্যাথুস।

বন্ড বলল— এইরকম একটা সেট আমি জ্যামাইকা নিয়ে যেতে চাইছি।

–আরে দূর! জ্যামাইকার কথা বাদ দাও।

রেডিওতে রোমের মিউজিক বাজছে। বন্ড জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা, জ্যামাইকার ব্যাপারটা কি রাশিয়ানরা ধরে ফেলেছে?

–আরেকটু হলেই ধরে ফেলত। লন্ডন এখন সংকেত বদলেছে। আচ্ছা, এবার কাজের কথাই বলি। প্রথম পয়েন্ট, মেয়েটা খুব সুন্দরী, রেডিও-র কাজে পাকা। সেলস্-এ আমাকে সাহায্য করে। তবে মেয়েটা মাঝে মাঝে বিগড়ে যায়। বেশ মেজাজি!

–তাহলে এমন মেয়েকে পাঠানো হল কেন? পাগল মেয়েকে–

–আরে, সেই অর্থে তুমিও পাগল! মেয়েটা ভালো কাজ জানে, তোমার কোনো অসুবিধা হবেনা।

–আর কী খবর?

-ল্য শিফ ভিলাতে সবাই উঠেছে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে। তিনটে মনুষ্য-জন্তু এসেছে ওখানে। দুটো গার্ড আগে থেকেই ছিল। রাশিয়ান ওদের নানা কাজে লাগায়। বিশেষ করে খুনখারাপির কাজে। ধরা পড়লে ওদেরই বলির পাঁঠা করে।

–হুঁ, আমার কেসটাও তাই। যাইহোক, তারপর?

-আর বিশেষ কোনো খবর নেই।…তুমি লাঞ্চ সেরে বারে এসো, মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করে নাও। ওকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিও। পারলে ক্যাসিনোতে নিয়ে যেও। আমি আর আমার এক সঙ্গী ফেলিস লিটার একটু আড়ালে থাকব।

ম্যাথুস চলে গেল।

ওর কথা থেকেই বন্ড বুঝে গেল, ম্যাথুস ধরা পড়ে গেছে। ল্য শিফের বিরুদ্ধে নামার আগেই ওকে সরিয়ে দেবে ওরা। রাশিয়ানদের খুন করতে হাত কাঁপেনা। মেয়েটা একটা ঝামেলা। কাজের ক্ষতি হবে বেশি।

০৫. বন্ড হোটেল থেকে বেরোল

বেলা বারোটা।

বন্ড হোটেল থেকে বেরোল। মিষ্টি বাতাসে যেন ব্যালের মিউজিক। দিনের বেলা সূর্যের উজ্জ্বল আলো।

রয়্যাল-লেজের প্রথমে ছিল রয়্যাল–জেলেদের গ্রাম। আর লেজো মানে জল। সেকথাটা পরে যুক্ত হয়েছে। এই গ্রামের পিছনে পাহাড়ের জলে হঠাৎ সালফার পাওয়া গিয়েছিল। ফলে লিভারের রোগীদের পক্ষে ভালো–এবং ফ্রান্সে বহুলোক লিভারের রোগে ভোগে। সুতরাং জায়গাটা স্বাস্থ্যকর স্থান বলে পরিচিত হয়ে গেল। কিন্তু জল-বিক্রির ব্যবসা অন্যান্য কোম্পানিব তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বন্ধ হয়ে গেল। তবে মাছ-ধরা ব্যবসাটা অটুট রইল। তাই মোটামুটিভাবে ট্যুরিস্টের ভিড় রইল।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নতুন সাজে সাজল রয়্যাল ক্যাসিনো বিল্ডিংটা। সাদা-সোনালি রং, ভেতরে বৃহৎ ঝাড়লণ্ঠন সাজানো বাগান। ফোয়ারাগুলোতে আলোর বাহার। ব্যবসা জমানোর জন্য প্রথমে আনা হল মহম্মদ আলি সিন্ডিকেটকে। জুয়া থেকে সান-বাথ সবই আধুনিক! ভালোই কাস্টমার জুটল।

বন্ড এই ইতিহাস-চিন্তা মন থেকে দূর করল।

ল্য শিফের ভিলাটা একবার দেখা ভালো!

বন্ডের গাড়িটা নতুন মডেল। হাইস্পিডে ড্রাইভ করল বন্ড।

কয়েক ঘন্টা পরেই হার্মিটেজ বার। একটা বড়ো জানলার পাশের টেবিলটায় বসল সে। ঐশ্বর্যমণ্ডিত গৃহসজ্জা। মেহগনি, চামড়া আর পেতলের নানা আসবাব, নানা কাজ। পানীয়ের অর্ডার দিয়ে লক্ষ করল, ছেলেরা খাচ্ছে শ্যাম্পেন, মেয়েরা মার্টিনি।

ওই তো ম্যাথুস। তার পাশে একটি মেয়ে। বন্ড ইচ্ছে করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

আবে, মঁসিয়ে বন্ড! আপনি এখানে, একা! কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি?…আসুন, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন মাদমোয়াজেল লিন্ড। আমার সহকর্মী। আর ইনি মি বন্ড, জ্যামাইকার বড়ো ব্যবসায়ী।

বন্ড বলল–আসুন, আমি একাই রয়েছি।

পানীয়ের অর্ডার দেওয়া হল ওদের জন্য। মেয়েটি বেশ স্মার্ট, কিন্তু বেশি কথা বলছে না। নীল চোখ, চুলে বব-ছাঁট। চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা ভাব, যেন সব কিছুকে ঠাট্টা করছে। মেয়েটির গলায় সোনার চেন, আঙুলে পোখরাজের আংটি। ঠোঁটে লিপস্টিক। নেলপালিশে রাঙানো নখ। সুন্দর শরীর গঠন। ধূসর রঙেব স্কার্ট ব্লাউজ। কোমরে বেল্ট, স্ট্র হ্যাট পাশের চেয়ারে রেখেছে।

মেয়েটার চেহারা আকর্ষণীয়, কিন্তু ওপর-ওপর একটা শান্ত ভাব। তাই বন্ডের কৌতূহল বাড়ছিল। এর সঙ্গেই কাজ করতে হবে। সেটা ভেবে মনে একটা অস্বস্তি মেশানো আনন্দ হচ্ছে।

হঠাৎ ম্যাথুস উঠে পড়ল।

–দাঁড়াও আমি ডিনারের ব্যবস্থাটা পাকা করে ফেলি। কিন্তু লিন্ড, সন্ধেটা আমি তোমার সঙ্গে থাকছি না।

মেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

বন্ড বলল— আপনি আজ যদি একা আমার সঙ্গে ডিনারে যোগ দেন তো–

–আপত্তি নেই। তারপর কি আমবা ক্যাসিনোতে যাব? মঁসিয়ে ম্যাথুস বলছিলেন, আপনি প্রায়ই

–যদি আপনার অসুবিধে না হয়–

–না, না, অসুবিধে কীসের। হয় তো আমি যাওয়াতে আপনার সৌভাগ্য বেড়ে যেতে পারে।

মেয়েটাকে কিছুটা বুঝল বন্ড। কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস। কাজের পর গল্প-গুজব করা যায়, বন্ধুত্ব হতে পারে।

ম্যাথুস ফিরে এল। বন্ড একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ছুতো করে উঠে পড়ল। হ্যান্ডশেক করল মেয়েটির সাথে। সেই হাতের স্পর্শে বুঝিয়ে দিল, জরুরি কথা আছে। বন্ডের চলে যাবার ভঙ্গিটা লক্ষ করল মেয়েটি।

ম্যাথুস বলল–ও আমার বন্ধু।

মেয়েটি বলল–হা। চেহারাটা খুব ভালো। কিন্তু কোথায় যেন একটা নিষ্ঠুরতার ভাব আছে।

হঠাৎ, ঝনঝন, … ঝনঝন…

জানলার কাচ গুঁড়ো করে কী যেন এসে পড়ল ঘরে। অতি আকস্মিক আঘাত। টেবিল, র‍্যাক, বোতল— সব চুরমার! চারদিকে আর্তনাদ, চিৎকার, আতঙ্ক, হল্লা।

জানলা দিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার আগে ম্যাথুস লিন্ডকে বলল তুমি এখানেই বসে থাকো, কোথাও যেও না।…

০৬. ফুটপাত ধবে হাঁটছিল বন্ড

তার কিছু আগে বাইরে ফুটপাত ধবে হাঁটছিল বন্ড। দুপাশে গাছের সারি। সূর্যের তাপ, তাই গাছের ছায়া ভালো লাগছিল।

গাছতলায় দাঁড়ানো লোক দুটোর ভাব দেখলেই সন্দেহ জাগে! ওরা হোটেল স্‌প্লেনডিড এর মেইন গেট থেকে একশো গজ দূরে, ফিসফিস করে কথা বলছে। পরনে স্যুট, স্ট্র-হ্যাটে কালো ফিতে। দুজনের করে ক্যামেরা বক্স ঝুলছে–লাল, নীল।

বন্ড যখন ওদের থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে, তখন লাল ক্যামেরার কেস যার কাঁধে, সে নীলকে কী যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। চারদিকে কম্পন। বন্ড নিজেও ছিটকে পড়ল একটা গাছের তলায়। চিৎ হয়ে পড়ে শুনতে পেল মাটিতে গুমগুম ধ্বনি। আধাঅজ্ঞান অবস্থায় সে টের পেল শূন্যে উড়ছে, গাছের ডাল, চুন-সুরকি, পাথরের টুকরো এবং মানুষের খণ্ড-বিচ্ছিন্ন দেহ। বারুদের গন্ধ, পোড়া কাঠ, পোড়া মাংসের গন্ধ। রাস্তায় গর্ত, দুটো গাছ উপড়ে পড়েছে।

লোকদুটোর পাত্তা নেই। তবে লালরঙের কী একটা রাস্তায় পড়ে আছে।

বন্ড বমি করতে শুরু করল।

সামলে নিয়ে কোনো মতে গাছটা ধরে উঠে দাঁড়াল। এই গাছটাই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

সামনে ম্যাথুস।

হোটেলের রুমে ঢুকে শুনল ঢং ঢং দমকলের গাড়ির শব্দ। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের গাড়িও এসে গেছে।

বঙ রক্তমাখা পোশাক ছাড়ছে। ম্যাথুসের প্রশ্নের উত্তরে সে লোক দুটির চেহারার বর্ণনা দিহিতা।

হঠাৎ টেলিফোনে ম্যাথুস বলল–শোনো, পুলিশকে বলো, যে ইংরেজ ভদ্রলোক, জ্যামাইকা থেকে এসেছে, তাকে নিয়ে বেশি না ভাবলেও চলবে। ওরা বলবে— দুই বুলগেরিয়ানের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব! প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপার। আমি পরে বুঝিয়ে বলব। একজন অন্যজনকে বোমা মেরেছে। তৃতীয় জন এখন ঘুরঘুর করছে। যাই হোক, অপরাধী পালাতে চাইছে। ওকে ধরতে হবে।…. হ্যাঁ, অপরাধী প্যারিসে যাবার চেষ্টা করবে, খেয়াল রেখো।

টেলিফোন রাখল ম্যাথুস। বন্ডকে বলল–ওঃ, ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছ। তোমাকে লক্ষ করে বোমা ছুঁড়ে গাছের আড়ালে লুকাতে চাইছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অন্যরকম হয়ে গেছে ব্যাপারটা। বুঝতে পারছি–ওরা তোমাকে এখনই খুব গুরুত্ব দিচ্ছে।

এ আবার কেমন কথা!

অপমানিত মুখে ম্যাথুস বলছে–শয়তান বুলগেরিয়ান দুটো পালাল কোথায়? লাল বাক্সের টুকরোটায় কী আছে দেখা দরকার।

বলল–আমি যাই, পুলিশকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে।

একা ঘরে বন্ড। চুপচাপ শুয়ে রইল।

খাবার এল। হ্যাঁ, দারুণ খিদে পেয়েছে।

খাবারের প্লেটে হাত দিতে রিং রিং টেলিফোন রিসিভার তুলতেই ওপারে নারীকণ্ঠ— আমি লিন্ড বলছি। আপনার কিছু হয়নি তো?

–না, না, আমি ঠিক আছি।

–যাক। কিন্তু সাবধানে থাকবেন।

বন্ড কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিল সে।

০৭. জুয়া শেষ হতে ভোর

মনে হয়, জুয়া শেষ হতে ভোর হয়ে যাবে।

বন্ড একজনকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তার আসার কথা তিনটের সময়। খাবার পর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজের চিন্তায় ড়ুবেছিল বন্ড।

দরজায় টোকা। লোকটি এসেছে, সুইডিশ।

কিছুক্ষণ ম্যাসেজ করল সে, পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত। ম্যাসেজের আরামে ঘুমিয়ে পড়ল বড়।

এবার ক্যাসিনো। জুয়াড়ির পেশাগত গুণগুলো চিন্তা করে নিল সে ধৈর্য, আশা এবং অঙ্কজ্ঞান। বন্ডকে অবশ্য বলা যায়–জন্ম জুয়াড়ি।

তাসের খসখস আওয়াজের মধ্যে একটা মনোমুগ্ধকর ব্যাপার আছে। খেলা চলবে, দামি পানীয় পাওয়া যাবে। শ্যাম্পেন তো থাকবেই। নিজের চেয়ারে বসে সে একাধারে অভিনেতা এবং দর্শক। বেশ ইনটারেস্টিং লাগে ব্যাপারটা। ভাগ্যকে মানুষ চালায়। ভাগ্য মানুষকে নয়। ভালোমন্দ যাই হোক না কেন, সংযমী-নিস্পৃহ থাকতে হবে। বন্ডের সৌভাগ্য, এখনও পর্যন্ত জুয়া তার কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে—

আজকেও বন্ডের মনে আত্মবিশ্বাস অটুট। প্রথমে খেলার ধারাটা লক্ষ করল সে। একটা বল, সেটাকে মার্কামারা জায়গায় ফেলতে হবে।

রিপোর্টে এতক্ষণের খেলার বিবরণ যা লেখা আছে, তাতে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নজরে এল না। সুতরাং ভেবেচিন্তে খেলা শুরু করল সে। দফায় দফায় এক লাখ ফ্ৰা জিততে থাকল।

দেখতে দেখতে সংখ্যাটা পৌঁছে গেল দশ লাখ ফ্রাঁতে। অবশ্য যোগ বিয়োগ মিলিয়ে, কারণ ইতিমধ্যে বন্ড একবার চার লাখ ফ্রাঁ হেরেছে। সুতরাং বন্ড এবার আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করল। এবং পরপর জিততে থাকল।

উলটো দিকে বসেছিল এক আমেরিকান। মনে হল, সে বন্ডের হয়ে খুব উৎফুল্ল। বন্ড যে খেলা ছেড়ে উঠল, সে-ও উঠে দাঁড়াল। নিজেই যেচে বন্ডের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল— দারুণ খেলেছেন। চলুন, দু-এক পেগ খাওয়া যাক।

বন্ড অবশ্য নিশ্চিত, এ সি. আই.এ-র লোক, লোকটির নাম ফেলিক্স লিটার।

নানারকম কায়দা করে একটা পানীয়ের অর্ডার দিল লোকটি।

বারম্যানকে ঠিকমতো বোঝাতে তার সময় লাগল।

বন্ড বলল— আমি এখন বেশ ব্যস্ত। সবসময় কাজের চিন্তা রয়েছে। তাই ডিনারের আগে এসব পান করিনা।

এবার পানীয় নিয়ে বন্ড তার নিজের বিদ্যার কিছু নমুনা পেশ করল। বারম্যানকে বললপানীয়টা আলুর বদলে অন্য শস্য থেকে নিলে আরও ভালো হত। যাইহোক, খুব ভালো হয়েছে।

লিটার মন্তব্য করল–এটা ককটেল! এবং আজ দুপুরে যা ঘটে গেল, তাকে বলা যায় মলোটভ ককটেল।

বন্ড জিজ্ঞেস করল–ব্যাপাবটা কী হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?

–কেউ বলছে, কম্যুনিস্টদের অন্তর্কলহ। কেউ বলছে। গ্যাসের শেল ফেটেছে। সৌভাগ্যের কথা, আপনি বেঁচে গেছেন।

–তা বলতে পারেন।

–দেখুন। আমরা এই কেসটাতে ইনটারেস্টেড। ওয়াশিংটন চাইছে, আমরা টেক-আপ করি, কিন্তু আপনি তো লন্ডনের নির্দেশে কাজে নেমে পড়েছেন। তাইনা?

–তাতো বটেই।

–তবু বলছি, আমরা আপনার পাশে আছি। যখন যা প্রয়োজন হবে বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন।

–হুঁ! ল্য শিফ এখন বেপরোয়া। স্বাভাবিক। তবে এই মুহূর্তে আমরা তেমন কিছু বলতে পারছি না। তবে আজ রাতে ক্যাসিনোতে আমার কাছাকাছি থাকবেন। আমার সহকারী মিস লিস্তকে একটু দেখবেন।…. তাছাড়া, ল্য শিফের বডিগার্ড দুটোর ওপর নজর রাখলে ভালো হয়।

–মেরিন কোর কাকে বলে জানেন?

–জানি।

–আমি আগে ওখানে কাজ করেছি। সুতরাং আমাকে আপনার কাজে লাগবে মনে হয়। জানা গেল, লিটার টেক্সাসে থাকে। ন্যাটোর জয়েন্ট ইনটেলিজেন্স-এ কাজ করত একসময়ে। বয়েস পঁয়ত্রিশ, লম্বা-পাতলা চেহারা। আস্তে কথা বলে, কিন্তু যথেষ্ট দৈহিক শক্তি আছে বোঝা যায়। ওর সঙ্গে মুনজদের সম্পর্কে কিছু কথা হল। তাছাড়া ল্য শিফের ভিলার কথাও উঠল।

সাড়ে সাতটা। ওরা হেঁটে হোটেল পর্যন্ত যাবে।

বেরোবার আগে বন্ড সব টাকা—দুকোটি চার লক্ষ ফ্রা-ক্যাশিয়ারের কাছে রেখে দিল। কয়েকটা দশ হাজারের নোট সঙ্গে রইল।

রাস্তায় বোমাবিধ্বস্ত জায়গাটায় মেরামতের কাজ চলেছে। উপড়ে-যাওয়া গাছ দুটো সবানো হয়েছে। হার্মিটেজের সামনের দিকটাও সারানো হয়ে গেছে।

রয়্যাল লিজো আবার স্বাভাবিক চেহারা ফিরে পেয়েছে।

লিটার জিজ্ঞেস করল কেয়ারটেকারটাকে আপনার কেমন মনে হয়?

বন্ডকে ম্যাথুস বলেছিল, সব কেয়ারটেকার টাকা খায়। সমাদরটা ওদের কৃত্রিম ব্যবহার। তবু এই নিয়ে বিশেষ কথা হল না। আবার আসল রূপ প্রকাশ পাবে খেলার সময়।

ক্যাসিনোতে পরের রাউন্ড খেলা এগারোটায়।

০৮. আবার সাবধানী পর্যবেক্ষণ

নিজের ঘরে এসে আবার সাবধানী পর্যবেক্ষণ সারল বন্ড। তারপরে যথারীতি শাওয়ারবাথ, এবং শয্যায় টান হয়ে শোওয়া। চিন্তার পর্দায় ছবি উঠছে—ম্যাথুস, লিটার আর মিস লিন্ড। কার কী ভূমিকা, সেটা বোঝা যাবে ঠিক সময়েই।

এখন নটা কুড়ি। ল্য শিফের সঙ্গে লড়াই তো আরম্ভ হয়ে গেছে।

পোশাক পরতে পরতে আয়নায় নিজের চেহারাটাও ভালো করে দেখল বন্ড। ডানগালের কাটা দাগটার জন্য মুখটা একটু ভিলেন টাইপের হয়ে গেছে বটে, কিন্তু সব মিলিয়ে চেহারাটা বেশ আকর্ষণীয় আছে।

হিপ পকেটে সিগারেট কেস নিয়ে সে আবার পরীক্ষা করল লাইটারে গ্যাস আছে কিনা। পকেটে এক বান্ডিল দশ হাজারর নোট, তারপর সেফটি ক্যাচ লাগিয়ে লোডেড ২৫ অটোমেটিক রিভলবারটাও নিল। গায়ে চড়াল একটা প্রিন্টেড জ্যাকেট।

হঠাৎ লিফট খোলার শব্দ।

–গুড ইভিনিং।

মিস লিন্ড! বন্ড সামান্য উত্তেজিত। মিস লিন্ড লিফটের কাছেই দাঁড়িয়ে। কালো ভেলভেটের ড্রেস, গলায় সরু হিরের নেকলেস। বুকের কাছটা V শেপে কাটা, সেখানেই লকেটটা।

–বাঃ, ইউ আর লুকিং ফাইন।

সোজাসুজি বন্ডের হাত ধরে মিস লিন্ড বলল–চলুন আগে খেয়ে নিই। আপত্তি নেই তো?

সামান্য হাসি-ঠাট্টা! ততক্ষণের খাদ্যের সঙ্গে সামান্য পানীয়ও এসে গেছে। এই রেস্টুরেন্টের একটা অংশ জাহাজের মতো বাগানের দিকে ঢুকে গেছে। এই জায়গাটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ।

মিস লিন্ড অবশ্য তার পছন্দমতো পানীয়ের অর্ডার দিল।

বন্ড বলল— আজকে আপনার পোশাক মুগ্ধ করার মতো। এবার আপনার নামটা বলুন।

–ভেসপার। ভেসপার লিন্ড! আমার জন্ম এক ঝড়ের সন্ধ্যায়। তাই নিজের নামের তাৎপর্য। ব্যাখ্যা করতে হয় অনেক সময়। নামটা কারুর ভালো লাগে, কারুর লাগে না।

–আমার ভালো লেগেছে।

কিছু হালকা সুন্দর কথাবার্তা।

বন্ড বলল— এবার খাবারের অর্ডার দিই?

-হ্যাঁ, লাখোপতির উপযুক্ত আইটেম চাই।

–বুঝিয়ে দিন।

–যেমন, ক্যাভিয়ার দিয়ে শুরু হোক। তারপর গ্রিলড় রোভোন দ্য ভো। সঙ্গে পোম্ সুফল। তারপর ফেজ দ্য বোয়া ক্রিম! …ইস, খুব নির্লজ্জের মতো কথা বলছি। তাইনা?

–নট অ্যাট অল! তবে প্রচুর টোস্ট চাই। নইলে খাবারটা জুতসই হবে না।

এরপর আরও কিছুক্ষণ পানীয় বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করল বন্ড। টর্নেডো, সঙ্গে বার্নিস স। স্ট্রবেরি, আভাকাভো পেয়ার সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ড্রেসিং।

এরপরেই শেষ নেই। শেষরাতে দুজনেই শ্যাম্পেন খাওয়ার পরিকল্পনা করল।

বাটলারও কমতি নয়। সে সুপারিশ করল–-ব্লা দ্য ব্লা ব্রাট ১৯৪৩! বলল–এটাকেই বলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন।

বন্ড বলল— অবিবাহিতদের দোষ সব কিছু খুঁচিয়ে দেখা।

–আমারও সেই অভ্যাস। তবে আমাকে বোধহয় মানায় না।

গেলাস তুলে বলল–আজ রাতে কথাবার্তা ঠিক হবে মনে হয়।

বন্ড চুপ করে শুনছে।

ভেসপার বলল–হ্যাঁ, ভালো কথা। ম্যাথুস খবর পাঠিয়েছে ওই বোমাবিস্ফোরণ সম্বন্ধে। খবরটা অদ্ভুত, গল্পের মতো।

০৯. কথাবার্তা জমে উঠেছে

খাওয়া শেষ হয়নি। কথাবার্তা জমে উঠেছে।

বন্ড বলল–আপনিই বলুন না গল্পটা।

–বেশ। শুনুন, তৃতীয় বুলগেরিয়ানটা অ্যারেস্টেড হয়েছে। প্যারিসে পালাতে চাইছিল। পথে দুজন ইংরেজকে গাড়িতে তুলেছিল। সে একজন পুলিশকে মাথায় গুলি করে মেরেছে। অপরজন ওকে পাকড়াও করেছে। সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। পরে রুয়েনে নিয়ে গিয়ে ওর সব কথা পেট থেকে বের করা হল।

–কী কথা?

–ওদের দল ফ্রান্সে নানারকম স্যাবোটেজের কাজ করে। আরও দল আছে ওদের। আপনাকে খুন করার জন্য ওদের কুড়ি লাখ ফ্লা দেওয়া হবে ঠিক হয়েছিল।

–তারপর?

–হ্যাঁ, তারপরেই আসল কথা। এজেন্ট ওদের দুটো ক্যামেরা কেস দেয়— লাল-নীল রং–আপনি দেখেছেন সেগুলো। নীল কেসে স্মোক্ বোম, লাল কেসে আসল বোমা। ওদের প্ল্যান ছিল, বিস্ফোরণের পর ধোঁয়া সৃষ্টি করে পালাবে। কিন্তু আসলে ওরা জানত না–দুটি কেসেই বিস্ফোরক বোমা আছে। লাল-নীলে তফাত নেই।

বন্ড চমৎকৃত– তারপর?

–আসলে বুলগেরিয়ানরা কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। আগে ধোঁয়া বোমা এবং পরে আসল বোমাটা ছুড়বে ভেবেছিল। কিন্তু ধোঁয়া বোমা বলে কিছু ছিল না। দুটোই ছিল বিস্ফোরক বোমা। সুতরাং দুজনেই খতম।

–তিন নম্বর লোকটা কী করল?

–সে যখন দেখল ধরা পড়ে গেছে, পুলিশ ওকে না-ফাটা লালরঙা বোমাটা দেখাল, তখন ও সবই বলে দেয়। তবে এখনও জেরা চলছে, তবে সে ল্য শিফের নাম শোনেনি।

বন্ড বলল–তাহলে আমাকে খুন করতে এসে খুনিরাই মারা গেল। মজা এই যে, নিজেরাই নিজেদের মারল। ম্যাথুস খুশি হবে, পাঁচজন শত্ৰু চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে খতম!…. যা হোক, এবার বলো, এই লাইনে তুমি কী করে এলে? কোনো বিভাগে করছ?

–আমি হেড অব এস-এর পি. এ.। যোগাযোগ রাখার কাজ!…. আচ্ছা, আপনি নাকি এসব কাজে কোনো মেয়েকে দেখালে রেগে যান?

বন্ড চুপ করে রইল।

লিন্ড জানাল, সে ম্যাথুসের সঙ্গে প্যারিসে কাজ করেছে। বলল— আপনাকে কিন্তু সবাই হিংসে করে।

–কারণ?

–কারণ, আপনি আমাদের হিরো।

বন্ড ভাবল, এই হচ্ছে ডবল জিরোর ইমেজ! খুন করার বাহাদুরি। আমি দুটো খুন করে এই পজিশন পেয়েছি–নিউইয়র্কে এক জাপানি জ্যোতিষী, আর স্টকহোমে এক নরোয়েজিয়ান ডবল এজেন্টকে।

বন্ড বলল—আমি এখানে এসেছি সম্পূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে। কাজের নানাদিক আছে, নানারকম সম্ভাব্য ফলাফল আছে।

সেসব বোঝাবার সময় দ্বিতীয় দফায় খাবার এল। বন্ডকে একটু কঠোর লোক বলেই মনে হচ্ছে তার। বস বলেছিল–বন্ড কাজ-পাগলা লোক। কাজেই প্রধান ওর কাছে, অন্য দিকে বেশি মন নেই। তবে সুন্দর চেহারা, ওকে দেখে অনেকেই ভালোবেসে ফেলবে। মনে রেখো, ওর হৃদয় বলে কিছু নেই।

লিন্ড তাই এই বন্ড-এর সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জের মত নিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে বন্ডের গলার সুরে সে কিছুটা আহত।

বন্ড বলল–আসল কথা লাক! পক্ষে বা বিপক্ষে দুদিকেই ভাগ্য থাকা চাই। সংক্ষেপে প্ল্যানটা এই :

… আজ রাতে ল্য শিফ ইজিপ্সিয়ান সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ব্যাংক কিনে নিয়েছে। দাম দিয়েছে দশ লক্ষ ফ্রাঁ। ওর ক্যাপিটাল এখন কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুকোটি চল্লিশ লক্ষ। আমারও মূলধন প্রায় তাই। খুব সম্ভব দশজন খেলবে আজ।

.. টেবিলটাকে দুভাগে ভাগ করা হবে। বয্যালে বাকীরা প্লেয়ারদের সংখ্যা কম। ওদের জেতার সম্ভাবনা কম, কিন্তু একটা সুবিধে আছে। মাঝখানে ব্যাংকার বসে। একজন পার্টনার ডাক দেয়

বন্ড তাসখেলার বিশদ তাৎপর্য ও কায়দাগুলো বোঝাল। সঙ্গে ব্যাংকারের ভূমিকাও বুঝিয়ে দিল। কীভাবে ব্যাংকার দান ও টাকার পৰিমাণ ঘোষণা করবে, এক নম্বর টাকা ফেলবে, দু-নম্বর পাশ দেবে, সারা টেবিল ঘুরবে। দর্শকরাও অংশ নিতে পারে। অল্প পরিমাণ দিয়ে শুরু হয়, ক্রমশ টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। দশ বা কুড়ি লাখের মাথায় বন্ড যোগ দেবে। সমান সমান টাকা দিয়ে খেলা শুরু হতে পারে।

এবার কফি এল।

কথাবার্তায় বন্ড এখন পুরো পেশাদার। পয়েন্ট পাওয়া, ব্যাংকারের তাস পাওয়া,নয় সংখ্যাটার গুরুত্ব, টেক্কা এক, কিন্তু ছবিওয়ালা তাসগুলোর দাম নেই–ইত্যাদি ইত্যাদি।

মিস লিন্ড সুবাধ্য ছাত্রীর মতো বোঝার চেষ্টা করছিল।

–যে নয়ের কাছে আসবে সেই জিতবে। ড্র হলে আবার খেলতে হবে।

বন্ড বলল–মনে রেখো, একদিক থেকে ব্যাংকাব সুবিধেজনক অবস্থায় থাকবে। তবে, প্রথমবারের আট আর নয় থেকে জিত। তাই দেখতে হবে আট আর নয় গুলো আমি যেন ওর থেকে বেশি পাই।

এত মারপ্যাচ মাথায় নিতে কিছুটা নার্ভাস লিন্ড। কিন্তু বুদ্ধিমতী সে, তাই অনেকটাই বুঝে ফেলেছে।

বন্ড অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজে দিল।

১০. খেলা শুরু

খেলা শুরু। বন্ড উত্তেজিত। এই তো ল্য শিফের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হতে চলেছে। এখন সে শুধু জুয়াড়ি–আর কিছু নয়।

এর আগে হোটেল থেকে বেরিয়ে ওরা যখন কাসিনোতে এল, তখন ভালো সম্বর্ধনা পেল বন্ড।

ভেসপার লিন্ডের সঙ্গে ফেলিক্স-লিটার এর আলাপ হল। লিটার চাইল ভেসপার লিন্ডকে রুলেতের আসরে নিয়ে যেতে। ভেসপাব রাজি। লাকি নাম্বারের কথা উঠল।

–আমার কোনোও লাকি নুম্বব নেই।–বন্ড বলল।

রেলিং এর ওপার যাবার পথটা ভেলভেট মোড়া চেন দিয়ে ঘেরা। শেফ দ্য পার্টি চেন সরিয়ে ঢুকল।

–মঁসিয়ে বন্ড। ছ-নম্বরটা আপনার জন্য, যেমন আপনি চেয়েছিলেন।

–থ্যাংক ইউ।

টেবিলে তখন তিনটে জায়গা খালি যখন বন্ড ঢুকল। জুয়াড়িদের একনজরে দেখে নিল বন্ড বেলজিয়ান, গ্রিক–নানা জাতেব লোক। এখনও অনেকে এসে পৌঁছায় নি। বন্ড হিসাব কষল–

এক নম্বর– …

দুনম্বর–কারমেল ভিলানি, আমেরিকান ফিলমের নায়িকা।

তিন নম্বর লেডি ভ্যানডার্স।

চার ও পাঁচ নম্বর–মি. অ্যান্ড মিসেস ড়ু পন্ট।

ছয় নম্বর–জেমস বন্ড।

সাত নম্বর–মঁসিয়ে সিক্সটে।

আট নম্বর–এক ভারতীয় মহারাজা।

নয় নম্বর–লর্ড ভ্যানডার্স।

দশ নম্বর–সিনর ডোমেলি, ইতালীয়ান ব্যবসায়ী।

খেলার শুরুতে জমা পড়েছে পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁ। খেলা শুরুতেই ল্য শিফ ঝুঁকে পড়েছে। চৌকা, পাঞ্জা, ছক্কা, সাত্তা–এলোমেলো ভাবে ঘুরছে।

ক্রুপিয়ার ঘোষণা করল জমা দশ লক্ষ।

গ্রিক বলল–লেট গেম গো অন।

বন্ড টান হয়ে বসল–এইবার আসল খেলা আসছে।

একটু পরে পিয়ারের ঘোষণা–কুড়ি লক্ষ।

সবাই চুপ। বন্ড বলল–আছি।

১১. ল্য শিফের চোখের দৃষ্টি সাদা

ল্য শিফের চোখের দৃষ্টি সাদা।

বন্ড তাকে সর্বক্ষণ লক্ষ করছিল। খোঁচা খোঁচা লালচে চুল। চওড়া ডিনার জ্যাকেট। এবার খেলায় বেশ রেষারেষি। সংখ্যাটা একটি, উত্তেজক ফিগার। কেউ আপশোশ করছে কেউ উল্লসিত, নানা কথাবার্তা চলছে। ড়ুপন্ট দম্পতি উৎসাহী। ল্য শিফের ডানপাশে লম্বা চেহারার লোকটার কাঠের মতো চেহারা, জ্বলজ্বলে চোখ। রেলিং-এর ওর হাতের মুভমেন্ট দেখে বন্ড বুঝল লোকটা গলাটিপে খুন করতে অভ্যস্ত। মাদক খায়। অন্য লোকটির চেহারা লোমশ জন্তুর মতো, হাতে লাঠি–আসলে গুপ্তি-জাতীয় কিছু আছে।

খেলা চলছে। ব্যাংকার হারছে।

ল্য শিফও সারাদিন হেরেছে। বাত একটার সময় বন্ড জিতেছে চল্লিশ লক্ষ। ফলে তার মোট মূলধন দুকোটি আশি লক্ষ। অতি সতর্ক হয়ে খেলছে সে। টেবিল ঘিরে সবাই চুপচাপ। ক্রুপিয়ের থেকে তার সংখ্যা ঘোষণা করে যাচ্ছে।

–এখন জমা হয়েছে চল্লিশ লক্ষ।

–আছি–বন্ড বলল।

এরপর আশি লক্ষ। বন্ড বলল— লেট আস গো অন্।

এবার ল্য শিফ জিতছে। বন্ডের হাতের তালু ঘর্মাক্ত।ল্য শিফের চোখে কৌতুক— আরও দম আছে? বন্ড বলছে–চলুক।

শেষবাজি! ক্লাইমেক্স!

সাবধানে দান দিল ল্য শিফ। শেষ তাস চার তুলে সে পৌঁছলো নয়ে।

বন্ড পরাস্ত! সর্বস্বান্ত। ফতুর!!

১২. এখন কী করণীয়

এখন কী করণীয়?

রুটিন কাজ— হোটেলে ফেরা, শয্যাগ্রহণ, লন্ডনে ফোন, পরের দিন প্লেন ধরা। ট্যাক্সিতে রিজেন্ট পার্ক। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এম-এর সামনে। কর্তাদের কৃত্রিম সান্ত্বনা বাক্য।

অলরাইট! নেক্সট টাইম—

নেক্সট টাইম আর আসবে না— সেটা ভালোই জানে বন্ড।

উঠে দাঁড়িয়ে সে আশ্চর্য হয়ে দেখল ভেসপার লিন্ডের হাসিমুখ। হাসি! আশ্চর্য! একটা মোটা খাম সে নীচু হয়ে এগিয়ে দিল। বেশ মোটা খাম— ডিকশনারির মতো। মুখটা আঠা দিয়ে আঁটা।

টাকা!

কে পাঠাল? টুকরো কাগজে লেখা–মার্শাল এন্ড। তিন কোটি কুড়ি লক্ষ ফ্রাঁ! শুভেচ্ছা, আমেরিকার পক্ষ থেকে।

বন্ড নিজের চোখ-কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

ভেসপারের পাশে ফেলিক্স দাঁড়িয়ে। তার মুখেও হাসি।

আবার দান শুরু হচ্ছে। পরের রাউন্ড। ক্যাসিনোর প্রাপ্য টাকা কেটে নিচ্ছে ক্রুপিয়ার।

দ্য শিফ টেবিলে রয়েছে।

এখন এসপার-ওসপার। হয় জয়, নয় মৃত্যু।

পুরো তিনকোটি কুড়ি লক্ষ ফ্ৰাঁ টেবিলে। সব টাকার উপর বাজি ধরা। ক্রুপিয়ার সংখ্যাটা ঘোষণা করতেই সকলে চমকে উঠল।

বাকারার ইতিহাসে এতটাকার বাজি রেকর্ড করল। শোনা যায়, একবার ১৯৫০ সালে দোভিলে এমন কাণ্ড নাকি হয়েছিল।

সংখ্যাটা সত্যি কেন, সেটা শেফ দ্য পার্টি একবার বাজিয়ে নিল। তাবপর টাকাটা গুনে দেখা হল। গোনা শেষ হতে বন্ড টের পেল তার মেরুদণ্ডের নীচে শক্ত কী যেন স্পর্শ করল। তার ডান দিক থেকে চাপা গলায় কেউ বলল–মঁসিয়ে, এটা রিভলবার। সাইলেন্সার দেওয়া আছে, তাই কোনো শব্দ হবে না। আপনার শিরদাঁড়া উড়ে যাবে। লোক মনে করবে, আপনি উত্তেজনায় জ্ঞান হাবিয়েছেন। তোক ডাকলেই গুলি চালাব। আমার কথা, আমি দশ গোনা শেষ করার আগেই বাজি ফিরিয়ে নিন।

আসলে সেই মোটা ছড়িব ভেতর এই অস্ত্র ছিল। বন্ড এও জানে–এরা যা বলে তাই করে।

লোকটা গোনা শুরু করেছে— এক, দুই, তিন…

ল্য শিফ বন্ডের দিকে তাকিয়ে।

–চার, পাঁচ, ছয়—

আঃ, ভেসপার এবং ফেলিক্স দূরে নিশ্চিত মনে কথা বলছে। কিছু বুঝতে পারেনি ওরা।

–সাত, আট, নয়—

সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার পেছনে ধাক্কা মারল বন্ড। বেতের ছড়িধারী রিভলবারওয়ালা ছিটকে পড়ল। একটা ভল্ট খেয়ে পেছনে দাঁড়ালো ভল্ট। চেয়ারটা মট করে ভেঙে গেল। মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল সে। সকলের সাহায্যে উঠে দাঁড়াল। এমন কি শেফ দ পার্টিও সাহায্য করল। অভিনয়

অবশ্য!

কপালের ঘাম মুছে বন্ড বলল–হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল, উঃ কী গরম।

–ডাক্তার ডাকা হোক।

–না, না, দরকার নেই। প্লিজ, আই অ্যাম সো সরি!

পরিচারক ছড়িটা তুলে পরীক্ষা করছে।

বন্ড বলল–ওটা মি. ফেলিক্সের এক বন্ধুর। ওর হাতে দিন।

ছড়ির মালিক উধাও। একজন বডিগার্ডকেও এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না।

কী ঘটল আসলে কেউ-ই সেটা বুঝল না। অবশ্য যে বা যারা বোঝবার তার বুঝেছে।

আঙুল দিয়ে টেবিলে জোরে টোকা মারল বন্ড।

অর্থাৎ, খেলা আবার শুরু হোক। সে প্রস্তুত।

১৩. ঘোষণা হল

ঘোষণা হল আবার জমা পড়েছে তিন কোটি কুড়ি লক্ষ।

ল্য শিফ টেবিলে চাপড় মারল।

বন্ড এখন আবার সতেজ। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। অবশ্য শরীর এখনও ঘামে ভিজে আছে।

দশ মিনিট বিরতি দেওয়া হয়েছিল।

এখন রাত দুটো।

একজন বলল–লালের ন’নম্বর জিতেছে।

রোমহর্ষক স্তব্ধতা। তাস টানাটানি, উলটে দেখা চলছে।

এখন টেবিলে বন্ডের তাস : দুটির গোলাপি পিঠ–আরেকটা হরতনের নয়। দুই বিবি সবুজ কাপড়ে ঢাকা। ব্যাংকারের নাক বেয়ে ঘাম ঝরছে। ল্য শিফের মুখে ধূর্ত হাসি। সবাই ধরে নিয়েছে বন্ডের অবশ্য পরাজয়।

কুপিনের কাঠের হাতা এগিয়ে দিল।

তাস উলটে দিল বন্ড–আঃ, দুই লালবিবি হাসছে।

ল্য শিফ চেয়ারে এলিয়ে পড়েছে। মনে হবে কেউ যেন ওর বুকে ছুরি মেরেছে।

ক্রুপিয়ের হাঁক দিল–এক কোটি জমা পড়েছে।

বন্ড সিগারেট ধরিয়ে দেখল পাশে একটা গোলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোঁ চোঁ করে এক গেলাস উড়িয়ে দিল সে।

ডাকাতির পাহাড় জমে উঠেছে।

পরের দান নয় উঠতেই ল্য শিফ উঠে পড়ল। বন্ডও উঠে দাঁড়াল। অজস্র ধন্যবাদ বর্ষিত হচ্ছে। ক্যাসিনোর ডাইরেক্টরদের পক্ষ থেকে তার নিমন্ত্রণ এল। টেবিলে এবার নোটের পাহাড়।

মোট সাতকোটি ফ্রাঁ!!

ফেলিক্সের টাকা বন্ড ক্যাশে নিল, বাকি প্রায় চার কোটি চেকে। ডাইরেক্টররা বললেন–কাল সন্ধেবেলা আসছেন তো!

বন্ড হ্যাঁ বা না, কিছুই পরিষ্কার বলল না।

নিভৃতে আসার পর লিটার বলল–তোমার কান্ড দেখে আমরা তাজ্জব। পরে অবশ্য বুঝেছি। রিভলবারধারী ছড়ি ফেলে পালিয়েছে। এই দেখ ওর বুলেট! যাক সব ভালো যার শেষ ভালো। ল্য শিফকে মারাত্মক শিক্ষা দিয়েছ তুমি!

বন্ড হেসে বলল–আসলে তোমার দেওয়া খামের জয়। দুঃসময়ে প্রকৃত বন্ধুর কাজ করেছ। এর প্রতিদান দেব নিশ্চয়ই!

ভেসপার লিন্ডকে বন্ড বলল–চলো, নাইট ক্লাবে। একটু শ্যাম্পেন খেলে ভালো লাগবে।

–চলুন, টাকাটা রেখে আসুন। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।

ওরা দুজন এরপর বেরিয়ে পড়ল। বাইরে জ্যোৎস্না।

বন্ডের ঘর ঠিকঠাক আছে।

বাথরুমে গিয়ে মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে কুলকুচো কবল বন্ড। হ্যাঁ, ভল্ট খেতে গিয়ে মাথার পেছনে একটু চোট লেগেছে। ডান কাঁধেও।

একদিনে দুবার মরণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সোজা কথা নয়।

রাতেও এক আক্রমণ অপেক্ষা করছে।

নাকি ল্য শিফ পালিয়েছে, জাহাজে পাড়ি দিয়েছে অন্যকোথা। স্মার্শ তো ওকে ছাড়বে না।

দরজায় তালা লাগিয়ে এবার বাইরে এল সে।

১৪. ছোটো নাইট ক্লাব

রোগা গোলান্তের ছোটো নাইট ক্লাব।

ভেসপারকে ঢুকল বন্ড। শ্যাম্পেন খেতে খেতে গল্প চলল। নানা বিষয়–ম্যাথুস, লিটার, ল্য শিফের ভবিষ্যৎ–ইত্যাদি। জানা গেল, ওরা বডিগার্ড দুটোর ওপর নজর রাখছিল বটে। কিন্তু বন্ডের পেছনে চলে-আসা ছড়ি রিভলবারধারীকে লক্ষ করেনি আগেই। সে অবশ্য প্যারিসে ফোন করেছে। এম-এর লোককে খেলার ফলাফল জানিয়ে দিয়েছে।

ভেসপার লিন্ড যেন একটু নিস্পৃহভাবে কথা বলছিল। বন্ড একটু বিরক্ত হল। রেগে মেগে একটু বেশি শ্যাম্পেন খেয়ে আবার ডিমের অর্ডার দিল।

স্টুয়ার্ট ভেসপারকে একটা চিঠি দিয়ে গেল। সে চিঠিতে ম্যাথুস লিখেছে–তুমি সামনের হলে এস। বন্ডের জন্য খবর আছে। আমার ইভিনিং ড্রেস পরা হয়নি, তাই এখন আসতে পারছি না, বাড়ি যাচ্ছি।

বন্ড সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়াল। মেজাজটা আরও বিগড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে শরীরও ক্লান্ত। শ্যাম্পেনের শেষ চুমুকটা তেতো লাগল। ভাবল-হঠাৎ এমন চিঠি কেন? এটা ম্যাথুসের কাজ বলে তো মনে হচ্ছে না। ইভিনিং-ড্রেসের ব্যাপারটা ছুতো বলে মনে হচ্ছে। সত্যি কি চিঠিটা ম্যাথুসের থেকে এসেছে? ঘর থেকে বেরিয়ে এল বন্ড।

তার আগে সামনের হলেতে গিয়ে দেখেছে–ভেসপার বা ম্যাথুসেব কোনো পাত্তা নেই।

রাস্তায় বেরিয়ে এল বন্ড। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল একটা অস্ফুট চিৎকার। গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। দুসেকেন্ড পবেই ওর সামনে দিয়ে হাই স্পিডে বেরিয়ে গেল একটা সিত্রো। গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। তাই বিশেষ কিছু দেখা না গেলেও বোঝা গেল, ভেতরে একটা লড়াই চলছে। কারণ পিছনের দিকের স্পিংটা ওঠানামা করছে। তীব্রবেগে টপ গিয়ারে গাডিটা রাস্তায় পৌঁছেই উধাও হয়ে গেল।

একটা কালো ব্যাগ কুড়িয়ে পেল বন্ড। এটা যে ভেসপারেব তাতে কোন সন্দেহ নেই। সিঁড়িব আলোর কাছে দৌড়ে এসে ব্যাগটা খুলল বন্ড। এক টুকবো কাগজে লেখা আছে যা ভেসপার লিন্ড বন্ডকে আগেই জানিয়েছিল–সামনের হলে একবার এস। খবর আছে, তোমার সঙ্গীর জন্য। রেনে ম্যাথুস।

১৫. চিঠিটা জাল

বন্ডের কোনো সন্দেহ নেই যে, চিঠিটা জাল।

আর দেরি না করে একলাফে নিজের গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল বন্ড। গেটের বাইরে এসে বা দিকে যেতেই লাফিয়ে উঠল গাড়ি। হ্যাঁ, আন্দাজেই শত্রুর পিছু নিতে হবে। সি বিচের দিকে রাস্তাটা ধরা যাক। হেডলাইট জ্বেলে যেন এক বিরাট গুহার মধ্যে আধমাইল লম্বা আলো ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে।

বন্ডের ধারণা, সিত্রোটা ওই পথ দিয়েই গেছে। কারণ, ধোঁয়া আর ধুলো উড়ছে। সমুদ্রের কুয়াশার মধ্য থেকেই যেন ফগ হর্নের আওয়াজ আসছে। গাড়ির স্পিড বাড়াতে বাড়াতে বন্ড ভাবছিল, ভেসপার মেয়েটা একেবারে বোকা। পাঠাবার আর লোক পেল না এম! তাছাড়া মেয়ে সহকারী নিয়ে কাজ করতে গেলে এরকম উটকো ঝামেলায় পড়তেই হয়।

শত্রুপক্ষ ভেসপারকে কেন কিডন্যাপ করেছে, সেটাও বোঝা সহজ–চার কোটি টাকার চেকটা দাও, নয়তো মেয়েটার জান যাবে। অবশ্য বন্ড এসব ভাওতায় ভুলছে না। আগে ওদের গাড়িটাকে ধরতেই হবে, গুলির উত্তরে গুলি ছুড়তে হবে। তাতে মেয়েটার ভাগ্যে যা আছে হবে। বন্ডের গাড়ির স্পিড এখন ঘন্টায় একশো দশ-কুড়ির মধ্যে।

ড্যাশ বোর্ডের নীচ থেকে ৪৫ লং ব্যারেল কোল্ট আর্মি স্পেশালটা বের কবল বন্ড। অন্তত একশো গজ দূর থেকে শত্রুপক্ষের গাড়ির টায়ার বা পেট্রোল ট্যাঙ্ক ফুটো করতে পারবে।

এবার সামনে সিত্রো গাড়িটা চোখে পড়ল হেডলাইটের আলোয় গাড়ির ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। তিনজন পুরুষ এবং একটি মেয়ে দেখা যাচ্ছে। ল্য শিফ নিজে ড্রাইভ করছে। এইবার সেই ছড়ি হাতে লোকটাকেও দেখা গেল। পিছনের সিটে রিভলবার হাতে একটি রোগা লোক, তার পাশেই ভেসপার। ওর স্কার্টটা ওপরে টেনে দুই উরু বস্তার মতো বেঁধে রাখা হয়েছে। মাথাও কাপড় দিয়ে মোড়া, খালি পা।

সামনে কাঁচা রাস্তা। গাড়ির স্পিড কমাল বন্ড।

সামনের গাড়ির ভিতর সাসপেন্স! ল্য শিফ অর্ডার দিল–জাস্ট নাউ।

তৎক্ষণাৎ ঝনঝন শব্দ! ল্য শিফ বলল–হিট হিম।

গাড়ি থেমে গেল। রিভলবার হাতে তিনজন একটা ঝোপের কাছে এগিয়ে গেল। একজনের হাতে একটা বিশাল কালো গোলা। সেটা ছুটে আসছে।

১৬. বন্ড গাড়ি থামায়নি

বন্ড গাড়ি থামায়নি। হঠাৎ সামনের গাড়িটা কাছে এসে যাওয়ায় সে সজোরে ব্রেক কষল। কোনো লাভ হল না। ধাক্কাটা লাগলই। বন্ড ড্রাইভিং সিট থেকে ছিটকে পড়ে গেল। ওর গাড়ি এখন শূন্যে, হেডলাইট যেন আকাশের দিকে, এইবার আস্তে আস্তে উলটে গেল গাড়িটা।

ঝোপের আড়াল থেকে দুই সঙ্গী সমেত ল্য শিফ বেরিয়ে এল। হুকুম দিল আগেইংরেজটাকে বের করে আন। সাবধান যেন মরে না যায়। লোকটার বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে খুব জরুরি। কুইক, ভোর হয়ে আসছে!

ক্যানভাসের ছাদটা ছুরি দিয়ে কেটে বন্ডের সংজ্ঞাহীন দেহটা বের করল ওরা। বন্ড এখন রাস্তায় শোয়া। রোগা লোকটা ওর বুকে হাত রেখে দেখল, হৃদ্যন্ত্র কতটা সচল। তারপর বন্ডের দুই গালে টেনে চড় লাগাল। বন্ডের গলায় সামান্য আওয়াজ। একটা হাত একটু নড়ল। লোকটা আবার সজোরে চাপড় দিল।

ল্য শিফ বলল–ঠিক আছে ঠিক আছে। বাড়াবাড়ির দরকার নেই। ওর পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে আমায় দাও। আর এই তারগুলো দিয়ে ওর হাত ভালো করে বাঁধ, এবার আমার গাড়িতে তোল ওকে।

লোকটা বন্ডের অটোমেটিক রিভলবারটা ল্য শিফকে দিল। এবার টেনে হিচড়ে গাড়িতে ভোলা হল বন্ডের দেহটা।

ইতিমধ্যে কিছুটা জ্ঞান ফিরেছে বন্ডের। পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে সে। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। কিন্তু হাড়গোড় ভাঙেনি বলেই মনে হচ্ছে। অপরিসীম ক্লান্তি! তাই আপাতত আত্মসমর্পণ ছাড়া গতি নেই।

গাড়িতে উঠেই প্রথম মনে এল, ভেসপারের কথা। কোথায় সে? তারপরেই চোখে পড়ল মেয়েটার অসহায় দুটি পা। লক্ষ করল, ওর স্কার্ট দিয়েই ওর মাথাটা পুটলির মতো করে বাঁধা হয়েছে। চুপি চুপি ডাকল–ভেসপার।

–শাট আপ! সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড চাপড় বুকের ওপর।

বন্ড বুঝল, লোকটা পেশাদার খুনি। দুটি লোকই খুব ওস্তাদ। আপশোশ হল যে, সে বুঝতে পারেনি–যখন খুশি মনে সে শ্যাম্পেন খাচ্ছিল, তখন শত্রুপক্ষ ওদের যথেষ্ট বেগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ভেসপার বোকা কিন্তু বন্ড নিজেও কম বোকামি করেনি।

যাকগে, এখন আর ভেবে কী হবে। ল্য শিফের গাড়ি এখন সত্তর মাইল স্পিডে চলছে। বন্ড ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। জানলা দিয়ে দেখছে, ভোর হয়ে এল। এখন গাড়ি বোধহয় যাচ্ছে ল্য শিফের ভিলার দিকে, অর্থাৎ ভিলার মোড়টা আর এক দুমাইল দূরে। বোঝা গেল, ভেসপারকে এখন টোপ বানিয়ে এগোবে ওরা।

ল্য শিফের ভিলায় পৌঁছে গেছে ওর গাড়ি। ভিলার দশা এখন জীর্ণ কোনো স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য নেই। অবশ্য ল্য শিফের কায়দা-কানুনের পক্ষে এমন বাড়িই উপযুক্ত। গুতো মারতে মারতে বন্ডকে নামানো হল গাড়ি থেকে। বন্ড বুঝল, এইবার তা ভেসপারের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হবে। ভাবতেই সাহসী বন্ডের বুকে কম্পন শুরু হল।

কর্সিকান লোকটি অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে ভেসপারকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। বন্ড শান্ত মনে রোগা লোকটার পাশে পাশে চলল। ডানদিকের দরজার সামনে ল্য শিফ দাঁড়িয়ে আছে। ভেসপারকে ভিতরের ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। এই মুহূর্তে নিজেকে প্রস্তুত করল বন্ড।

মুহূর্তের মধ্যে বন্ডের প্রচণ্ড লাথি লোকটার হাঁটুর নীচে আঘাত করল। লোকটা চিৎকার করে ছিটকে পড়ল। হাত বাঁধা অবস্থাতেই বন্ড ছুটল ভেসপারের দিকে। তার এখন এই পা দুটোই শুধু সম্বল। কিন্তু কর্সিকানের উদ্দেশে মারা লাথিট লক্ষ্যভ্রষ্ট। বরং লোকটাই বন্ডের পা-টা ঘুরিয়ে দিতেই মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল বন্ড। এইবার রোগা লোকটা এগিয়ে এল। কলার ধরে টেনে তুলল বন্ডকে। পিস্তলটা দিয়ে বন্ডের পায়ে সজোরে আঘাত করল। আর্তনাদ করে কুঁকড়ে গেল বন্ড। লোকটা বলল–ফের এমন করলে সবকটা দাঁত ভেঙে দেব।

মুহ্যমান বন্ড দেখতে পেল, ল্য শিফ কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। ভেসপার নেই। ল্য শিফের মুখে ব্যঙ্গ হাসি। বলল–ওয়েলকাম ফ্রেন্ড। সময় নষ্ট করে লাভ কী?

সত্যিই লাভ নেই। বন্ড এবার ওদের কবজায়।

১৭. এই ঘরটা বিরাট

এই ঘরটা বিরাট। ড্রয়িংরুম না ডাইনিং রুম কে জানে। সারা দেয়াল জুড়ে আয়না। রং ওঠা সোফা ঘরের মাঝখানে কোনো টেবিল নেই। শুধু একটা চৌকো কার্পেট। জানলার কাছে অদ্ভুত শেফের একটি চেয়ার। ভেলভেটের গদি। নীচু টেবিলে জলের বোতল আর দুটো গ্লাস। আর একটা গদিহীন বেতের চেয়ার আছে।

ল্য শিফ বলল–ওকে রেডি করে নিয়ে এস। গণ্ডগোল করলে উচিতমতো কিছুটা জখম করে দেবে।

এবার বন্ডের দিকে তাকিয়ে সে নিস্পৃহভাবে বলল–জামাকাপড় ছেড়ে ফেল। নইলে বেসিল একটা একটা করে তোমার আঙুল ভেঙে দেবে। তোমার শরীর নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। তবে তোমার মরণ বাঁচন নির্ভর করছে তোমার কথাবার্তার ওপর।

ল্য শিফের ইঙ্গিতে বন্ডের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। ছুরি দিয়ে বন্ডের কোটের পিছনদিকটা চিরে দিতেই হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। ডিনার জ্যাকেটও দুটুকরো। এটা একধরনের পুলিশি কায়দা। লোকটা বলল—কুইক।

গায়ের শার্টটা খুলে ফেলল বন্ড। ল্য শিফ বড়ো চেয়ারটায় সিংহাসনের মতো বসে ইশারা করল। কফি এল। আয়েস করে গেলাসে কফি ঢেলে নগ্ন এন্ডের দণ্ডায়মান শরীরটাকে ভালো করে লক্ষ করল মে। হ্যাঁ, আঘাতগুলো গায়ে চাপ চাপ দাগের সৃষ্টি করেছে। বন্ডের মুখে ক্লান্তি এবং আতঙ্ক।

–সিট ডাউন। বলে বেতের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল ল্য শিফ। বন্ডের দুহাত চেয়ারের দুই হাতলের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। বুকের ওপর দিয়েও একটা দড়ি চেয়ারের পিঠের সঙ্গে গিট দিয়ে বাঁধা হল। চেয়ারের পায়া দুটোর সঙ্গে দুই হাঁটু শক্ত করে বাঁধতে ভুল হল না।

এরপর স্নেহভরে বন্ডকে দেখতে দেখতে হাত উঠিয়ে এমন একটা টেকনিক্যাল অত্যাচারের চমক দিল ল্য শিফ, যে মুহূর্তের মধ্যে বন্ডের ঘাড় পিছনে হেলে পড়ল। সারা দেহ যেন রক্তশূন্য, যেন প্রচণ্ড ঘাম ঝরছে।

আর্তনাদ করল বন্ড।

ল্য শিফ বলল–আরো অনেক কায়দা আছে, বুঝেছ বন্ধু। সেগুলো ধীরে ধীবে প্রকাশ পাবে… যাই হোক, কাজের কথা শুরু করি। নিশ্চয়ই এও বুঝেছ, তোমার খেল খতম। আমাদের কাছে তুমি নেহাতই শিশু। তোমার কর্তারা তোমাকে পাঠিয়ে ভুল করেছে…. এবার বল, টাকাটা কোথায়?

এবার গর্জন করল ল্য শিফ। সঙ্গে সঙ্গে বেতের ঘা মেরে সেই টেকনিক্যাল যন্ত্রণা দান। বন্ড কাঁপতে থাকল।

ল্য শিফ বলল–শোন খোকা, আমার কথাবার্তাগুলোকে রূপকথার গল্প ভেব না। আমার অভিধানে দয়া-মায়া বলে কোনো শব্দ নেই। তাছাড়া গল্পে যা থাকে, বাস্তবে তা হয় না–ভিলেনের নিপাত, নায়কের পুরস্কার, নায়ক-নায়িকার মিলন–এসব হয় না। কথা যদি না শোন, তাহলে তোমার সামনে মেয়েটিকে এনে এমন অত্যাচার করা হবে, তা দেখলে তুমিও পাগল হয়ে যাবে। তবুও যদি গোঁয়ার্তুমি করো, তাহলে দুজনকেই বীভৎসভাবে আমরা খুন করতে বাধ্য। তোমার মৃতদেহ এখানেই পড়ে থাকবে। কবর দেবার লোকজনও পাওয়া যাবে না। আর আমি? হাঃ হাঃ–আমি চলে যাব বিদেশে। সেখানে চমৎকার একটি বাড়িতে বিয়ে করে সংসার পাতব। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে আনন্দে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি টাকা দিলে ভালো কথা,

দিলেও আমার কিছু আসে যায় না।

আবার সেই অত্যাচার। এখন পর্যন্ত বন্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যতটা পারা যায় অত্যাচার সহ্য করতে হবে।

ল্য শিফ বলল–তুমি এবার ঠিক করো কী করবে। নাহলে বেশকিছু যন্ত্রণা–অবশেষে মৃত্যু। এই তোমার ভাগ্যে আছে।

বন্ডের কিছুসহকর্মী জার্মান ও জাপানিদের হাতে অত্যাচার সয়েছিল তাদের মুখে বন্ড শুনেছিল যে, অত্যাচার সইতে প্রথমদিকে কষ্ট হয় কিন্তু যদি কোনোমতে প্রথমদিকে সহ্য করা যায়। তবে আপনা থেকেই সহ্যশক্তি চলে আসে।

ল্য শিফ বলল–চার কোটি ফ্রাঁর চেকটা নিশ্চয়ই তোমার ঘরেই আছে। কিন্তু তোমার ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে আমরা সেটা পাইনি। পেলে তোমার আর এই অবস্থা হত না। তাহলে তুমি এখন গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আরামেই থাকতে … আর একটা কথা শোন, অত্যাচারীর পক্ষে নিগ্রহ চালানো খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক কাজ। বিশেষ করে বন্দি যদি পুরুষ হয়। এই যন্ত্রণাই যথেষ্ট। তবে যুদ্ধের ব্যাপারে তো শুনেছ।… যদি তোমার পুরুষত্ব কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে বেঁচে থাকলেও তুমি কিন্তু আর পুরুষ থাকবে না। এমন মানসিক কষ্ট হবে যে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। সারা পৃথিবী তোমার কাছে তখন অন্ধকার।.. টাকাটা কোথায়?

বন্ড কোনোমতে বলল–জল।

–রাইট। জিভ শুকোলে তো আর কথা বলা যায় না।

উঠে এসে বন্ডের চুলের মুঠি ধরে মাথাটা ঠেলে কয়েক ফোটা কফি ওর মুখে ঢেলে দিল ল্য শি, তারপর মুঠো ছেড়ে দিতেই বন্ডের মাথা আবার ঝুঁকে পড়ল।

ল্য শিফ বলল–অবশ্য আমার কোনো তাড়া নেই। এখন যে খেলাটা চলছে সেটাই চলুক। অপরের সহ্যশক্তি পরীক্ষা করতে আমার বেশ ভালোই লাগে।

আবার সেই অত্যাচার। তার মধ্যেই বন্ডের চিন্তাশক্তি কাজ করে চলেছে। এখন হয়তো বেলা সাতটা। হয়তো লিটাব বা ম্যাথুস এখুনি এখানে এসে পড়বে। হয়তো বন্ডের গাড়িটা চোখে পড়েছে। এই যেকোনো একটা হয়তো সত্যি হলে ল্য শিয–ধরা পড়বেই।

দাঁতে দাঁত কামড়ে অত্যাচার সইতে লাগল বন্ড। এবার অত্যাচাবের মাত্রা বাড়ছে। হঠাৎ একসময় সাবা জগৎ অন্ধকার হয়ে গেল তার চোখে।

ল্য শিফ পরীক্ষা করল, বন্ড মরে গেছে কিনা। নিশ্চিত হল, না মরেনি। সে বলল–আপাতত তোমার ব্যাপারে থামছি। প্রাণে মারছি না অবশ্য। তবে যা বলেছি, ওই প্রাণে মারার চেয়েও ভয়ংকর কাণ্ডটা ঘটবে। তারপর মেয়েটাকে আনব এখানে। দেখি, ওকে নিয়ে কী করা যায়।

গম্ভীর গলা এবার ল্য শিফের–জেমস বন্ড, নিজেকে চিরকালের মতো হারানোর জন্য প্রস্তুত হও।

১৮. চেতনাহীন হয়ে পড়েছিল প্রায় বন্ড

ক্রমাগত মারের ফলে চেতনাহীন হয়ে পড়েছিল প্রায় বন্ড। ল্য শিফের সব কথা তার কানে ঢুকছিল না। আচমকা এক বজ্রকঠিন স্বরে বন্ডের হুঁশ ফিরে এল।

নুয়ে পড়া মাথা সোজা হল বন্ডের। সামনের দিকে তাকাল সে। কয়েক সেকেন্ড লাগল অস্পষ্ট দৃষ্টি কাটতে। বন্ড এবার পরিষ্কার দেখতে পেল ল্য শিফের মুখের হিংস্র চেহারার বদলে এক ভয়ার্তভাব।

বন্ড শুনতে পেল আবার সেই শব্দ–হাত থেকে ওটা ফেলে দাও ল্য শিফ।

ল্য শিফের হাত কাঁপছে, মুখ ভয়ার্ত। বন্ড দেখল, ল্য শিফ যেই পকেটে হাত ঢোকাতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে পিছনের কণ্ঠস্বরটি বলে উঠল।–নো নো, কোনোরকম বাজে চেষ্টা কোর না। ট্রিগারে আঙুলটা শুধু ছোঁয়ানো আছে। আঙুলে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করিও না।

কয়েকমুহূর্ত চুপচাপ। পিছনের লোকটি কি আছে? তবে চুপচাপ কেন? কে ও?

সেই লোকটির গলা আবার শোনা যায়—কী হল? আমি সময় নষ্ট করা একদম পছন্দ করি না। ফেলে দাও ওটা।

ল্য শিফের মুখের কথা আটকে যাচ্ছে–আসলে আমি মি. বন্ডকে একটু ভয়… মানে–

–চোপ। শয়তান, বিশ্বাসঘাতক, ঠগবাজ। শোন হে, আমাকে যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন। থেকে পাঠিয়েছে, তার বলেছে, তোমার মৃত্যুটা যেন পরিপূর্ণ যন্ত্রণাময় হয়। যেরকম যন্ত্রণা তুমি একে দিচ্ছিলে। হাতে আমার সময় কম। তাই একটা মাত্র গুলিই আমাকে খরচ করতে হবে।

ল্য শিফ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে — আমি মুক্তি চাইছি। আমি চলে যাব এখান থেকে। আমি যা করেছি–

আর কোনো কথা বলতে দিল না বন্ডের পিছনে দাঁড়ানো আগন্তুকের রিভলবার। ল্য শিফের নাকের ওপরে শুধু একটা ছিদ্র তৈরি হল। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এল। হুমড়ি খেয়ে ঘুরে গিয়ে একটা চেয়ারের হাতলের ওপর পড়ল ল্য শিফ।

ল্য শিফের দেহটার ওপর একটা পা রেখে, মাথায় টুপি, মুখে মুখোশ পরা সেই লোকটা এবার বন্ডের থুতনিটা নেড়ে দিয়ে বলে–তোমার কপাল ভালো মিস্টার। বেঁচে গেলে। এই নিয়ে দুবার। প্রথমবার বরাতজোরে, দ্বিতীয়বার আমরাই ভুল করেছি। অবশ্য যদি তোমার প্রাণ নেওয়ার হুকুম থাকত। শোন হে, তোমার দলকে বোল যে, এইসব গদ্দার ললাকেদের সাথে যদি তোমার মতো বিদেশি গুপ্তচরগুলোকে মারা যেত। হ্যাঁ, আর একটা কথা–স্মার্শ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না, খাতির করতে জানে না।

লোকটা বলে চলে–তোমার মতো জুয়াড়ির সাথে আবার দেখা হবে কোথাও। কিন্তু তোমাকে এমনি ছেড়ে দেব না। গুপ্তচর বলে তোমার শরীরে বেশ ভালোরকম চিহ্ন বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।

বলে বুটের চেন খুলে একটা ছুরি বার করে অতি দ্রুত এবং যন্ত্রণাদায়কভাবে সে বন্ডের ডান হাতে খুব দ্রুত এম কথাটা লিখে দিল। বন্ডের সারা দেহ যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল। চোখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল বণ্ড।

লোকটার বুটের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। বন্ডের হাত দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে।

বন্ড জ্ঞান হারাল।

বেলা বাড়ছে। বন্ডের হাত থেকে পড়া রক্ত এখন জমাট বেঁধেছে, তার ওপর রৌদ্রের আলো এসে পড়েছে।

টাটকা রক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধতে এক গোলাকার বৃত্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর ওই বৃত্তের ওপব রোদ্র এসে এক আতঙ্কের দৃশ্য তৈরি করেছে।

১৯. ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের প্রকৃতি

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের প্রকৃতি মানুষকে কখনো ঘুম পাড়িয়ে রাখে, আবার কখনো বা নিদ্রাভঙ্গ ঘটায়। আধোজাগরিত তন্দ্রার মধ্যেও ছন্দহীন স্বপ্ন একে একে চলে যায়।

বন্ড এখন একটা শয্যায় শায়িত। কখনো গভীর ঘুমে, কখনো আচ্ছন্নের মতো। বুঝতে পারছে বন্ড, তার পাশে মাঝে মধ্যে কেউ এসে তাকে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু সে নিজের মুখ খুলতে চায়নি। এর মধ্যেই তার স্বপ্নে ঘটে গেল এমনই ঘটনা, যা বন্ডকে বিছানা থেকে উঠতে বাধ্য করল।

বন্ড বুঝতে পারল দুটো কোমল হাত তাকে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দিল। এই ঘরটাও প্রায় অন্ধকার। কে এই মেয়েটি? শত্রুডেরার কোনো মেয়ে কি? মেয়েই এবার সুগন্ধীমাখা একটা টাওয়েল দিয়ে তার মুখ, হাত, চাদর সরিয়ে বক্ষদেশ, একটু পাশ ফিরিয়ে দিয়ে পিঠ সব স্নেহভরে মুছিয়ে দিল।

ধীরে ধীরে বন্ড আবার ঘুমের দেশে চলে গেল।

যখন ঘুম ভাঙল তখন তার নিজেকে যেন বেশ তরতাজা বলে মনে হচ্ছিল। কানে এল। পক্ষীকুলের কলতান, আর সমুদ্রের গর্জন। তার মানে এখন সে অন্যত্র! বন্ড আস্তে আস্তে উঠে বসল এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন নার্স ঘরে ঢুকে বন্ডের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল আশা করি, এখন বেশ সুস্থ বোধ কবছেন।

–অনেকটা। আপনি কে? আর আমি এখন কোথায়?

–আমি নার্স। গিবসন। আর আপনি এখন রয্যালের নার্সিংহোমে। আপনার পরিচর্যার ভার আমার হাতে। আচ্ছা, আমি ডক্টরকে খবর দিয়ে আসি।

নার্স বেরিয়ে গেল।

হঠাৎ হাঁটুতে আর কবজিতে টান ধরল। ডান হাতের কবজিতে ঐ রাশিয়ানটা ছুরি দিয়ে এম লিখে দিয়েছিল।

–গুড মর্নিং মি. বন্ড।–ঘরে ঢুকে ডাক্তার বলে। সঙ্গে নার্স আর ম্যাথুস। ম্যাথুসের মুখে হাসি। বন্ড অনেকটা স্বস্তি পেল।

দোয়াজিয়েম বুরোর এই ফরাসি ডাক্তার বন্ডকে পরীক্ষা করতে করতে বলে মি, বন্ড, আপনি এখন অনেকটাই সুস্থ। মঁসিয়ে ম্যাথুসের সাথে ঠিক পাঁচ মিনিট কথা বলবেন।

–আচ্ছা, আমি এখানে কী করে এলাম?

–বয়্যালে যাবার সময় রাস্তায় এক চাষি আপনার গাড়ি দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে আপনাকে, ল্য শিফ আর মিস লিন্ডকে উদ্ধার করে। মিস লিড অক্ষত আছেন। অবশ্য খুব শকড়। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া অবধি উনি এখানেই থাকবেন। সেরকমই নির্দেশ আছে। আচ্ছা মি. বন্ড, ল্য শিফেব হত্যাকারীদের আপনি কি দেখেছেন?–ডাক্তাব বলে।

–ইয়েস।

ডাক্তার বলে–আচ্ছা, আপনি কতক্ষণ ধরে ওদের অত্যাচারের শিকার?

–ধরে নিন, এক ঘন্টারও বেশি সময়।

–হুঁ। যাই হোক, আপনার চিন্তার কিছু নেই। ওষুধের সঙ্গে চাই এখন ঠিকমতো খাওয়া আর ঘুম। হ্যাঁ, আপনি ঘুমিয়ে পড়লে আপনার হাত-পা বেঁধে দেওয়া হবে। যাতে ঘুমের মধ্যে কোনোরকম খকতি না হয়। সত্যি বলতে কী, আপনার মতো বেদম মার খাওয়াওনেকে লোকেরই চিকিৎসা করতে হয়েছে আমাকে। সেটা মঁসিয়ে ম্যাথুস ভালোই জানেন। সেই তুলনায় আপনি যথেষ্ট শক্তিশালী। দেন ও, কে. টেক রেস্ট। এবার মঁসিয়ে ম্যাথুস কথা বলুন। ঠিক পাঁচ মিনিট।–ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ম্যাথুস একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল সে। দরজার পাশ থেকে এসে এবার সে ডাক্তারের চেয়ারে বসে।

বন্ড নার্সিংহোমের বেড়ে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায়। ডান দিকের হাতটা মাথার ওপরে তুলতে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। নার্স ছুটে আসে। ব্যথার জায়গাটায় কী যেন একটা স্প্রে করে দেয়।

নার্স বলে–বেশি নড়াচড়া করার চেষ্টা না করাই ভালো।

নার্স বেরিয়ে যায়।

হাসতে থাকে মঁসিয়ে।

–কী হল, হঠাৎ পাগলের মতো হাসতে শুরু করলে যে?

ম্যাথুস বলে–না এমনিই। আসলে মহাশক্তিমান জেমস বন্ডের এরকম দুরবস্থা, এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও শান্তভাবেই বন্ড বলে–কোনো খবর যদি না থাকে, তাহলে আমি এখন একা থাকতে চাই।

–সরি সরি ফ্রেন্ড।, প্যারিস, লন্ডন সব জায়গা থেকে খবরের জন্য ওরা অপেক্ষা করে আছে। লিটারকে ওরা যোগাযোগ করছে। এম আমাকে ফোনে তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন যে, ট্রেজারি বিভাগ দুশ্চিন্তামুক্ত আছে।…

–যেদিন তোমাকে উদ্ধার করা হল সেদিন একটা হাতকাটা লোক–রোগাটে, লম্বা এসে তোমার সব ব্যবস্থা করে গেল। মনে হল সে ভেসপারের ওপরওয়ালা হবে। ভেসপারকে সব দায়িত্ব দিয়ে গেছে।

–সে কিগো! আমি যে একেবারে ভি ভি আই পি–যাকগে, এবার বলি, ল্য শিফের মার্ডারার হল স্মার্শ।

এরপর বন্ড ল্য শিফের খুনের ঘটনা সব বলল। এবং–

ম্যাথুস বুঝল, বন্ড আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ম্যাথুস বলে–যাকগে যাকগে, তুমি এসব নিয়ে আর কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবে না।

বন্ডের মুখ ঘামে ভরে ওঠে।

ম্যাথুস ভয় পেয়ে যায়। নার্সকে ডাকতে গিযেও ডাকে না। নার্স এলে তাকে প্রচণ্ড ঝাড়বে। খাটের পাশে স্ট্যান্ডে রাখা টাওয়েলটা নিয়ে বন্ডের মুখ মুছিয়ে দেয়।

বন্ড আরাম অনুভব করে।

ম্যাথুস বলে–আমরা রটিয়ে দিয়েছি, শিফ তার দুই সহকর্মীকে খুন করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। কেননা, ইউনিয়নের টাকা নয়ছয় করার কোনো উত্তর ছিল না ওর কাছে।

ম্যাথুস এবার লক্ষ করল, বন্ড এসব খবরে বেশ উৎসাহিত বোধ করছে। ওকে আগের থেকে ফ্রেশ লাগছে। ম্যাথুস বলতে লাগল আবার।

–উত্তর অঞ্চল আর স্ট্রাসবর্গে এখন খুব অশান্তি। নিস্ট পার্টির এক বিরাট নেতা হিসেবে ও আর ওর দলের ক্যাসিনো ও অন্যান্য অ-সামাজিক কাজকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়াতে অসম্মানিত হতে হয়েছে চতুর্দিকে, এমনকি ওদের পাটির কাছেও।.. বন্ড, নার্স হয়ত এখুনি এসে পড়বে। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। এখন বল, ওই টাকাটা কোথায়? কোথাও পাইনি আমি।

বন্ড এবার হো হো করে হেসে উঠল। যেন কিছুই হয়নি তার।

বন্ড বলে–সেদিন লিটার চলে যাওয়াব পর দরজার বাইরে কালো প্লাস্টিকের নাম্বারপ্লেটটা খুলে চেকটা ভাঁজ করে আমি নাম্বারপ্লেটটা আগের মতোই করে রেখেছি। এতে কী প্রমাণিত হয় জান?

–কী?

–বোকা ইংরেজরাও চালাক ফরাসিদের একটু আধটু শেখাতে পারে।

ম্যাথুস হেসে উঠল। বলল–তোমার জবাব নেই। শোন, মুনজদের খবরটা আমিই দিয়েছিলাম। ওরা ধরা পড়ে গেছে। সব ভাড়াটে ওরা। তাহলে এখন আসি। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।

ডাক্তার ইতিমধ্যে এসে গেল।

বন্ডের ঘুম পাচ্ছে। সে ভাবতে থাকে–এখনও অনেক সমাধান বাকি রয়ে গেল।

এই ভাবনার মধ্যে ভেসপারের চেহারাটাও ভেসে উঠল। তাকেও ভোলেনি বন্ড।

২০. ক্রমশ সুস্থ হচ্ছে বন্ড

ক্রমশ সুস্থ হচ্ছে বন্ড। এখন উঠে বসতে পারছে। কোমরের নীচটা ঢাকা। দেহের নীচের অংশে বেশ ব্যথা আছে।

ম্যাথুস এসে বলল–এই তোমার চেক! বেশ কিছুদিন চারকোটি ফ্রাঁ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, কতখানি ঝুঁকি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ! চেকটা সই করে দাও, অ্যাকাউন্টে জমা করে দিই।

–স্মার্শের বন্ধুটির খবর কী?

–তার পাত্তা নেই, একেবারে হাওযা হয়ে গেছে।

–সেকী!

–হ্যাঁ। ওয়াশিংটন নাকি কিছু কিছু খবর জানে। তবে সেগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। রিফুইজিদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে যতটুকু জানা গেছে আর কী!

বন্ড চিন্তিত। সে যতদূর জানে, লোকটা ওয়ারশ হয়ে লেনিনগ্রাড় এসেছিল। কিন্তু বন্ডকে খুন করার অর্ডার ছিল না বলে হয়তো ফিরে গেছে। বার্লিন থেকে ইউরোপের নানা অংশে যাওয়া যায়।

–শোন ম্যাথুস, আমার সম্বন্ধে ওদের কাছে একটা ফাইল আছে। তারা মধ্যে একটা ওরা কেটে দিয়েছে।

–তার মানে?

–মানে ওটা রাশিয়ান অক্ষর। স্মার্শ (SMARSH) কথাটার প্রথম অক্ষর। কাটা হলে মানেটা দাঁড়ায–ডাউন উইথ ট্রেটরস। মোট কথা, আমি দাগী হলাম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে।

একটু ভেবে বন্ড বলল–যাক গে, সেটা বড়ো কথা নয়। আমি ঠিক করেছি রেজিগনেশন দেব।

–সেকি, কেন?

–আমার অন্যরকম একটা ফিলিং হচ্ছে। মার খাওয়ার সময় ভাবছিলাম, বেঁচে থাকার মধ্যে অনেক সুখ আছে। এইরকম চাকরি করে, নিত্য মৃত্যুর মোকাবিলা করে হঠাৎ একদিন টেসে গিয়ে লাভ কী? কম বয়েসে কত অ্যাডভেঞ্চারাস চিন্তা থাকে, কিন্তু পরিণত বয়েসে-

ম্যাথুস বলল–কিন্তু দুম্ করে পদত্যাগ করা উচিত নয়।

বন্ড বলল–দুটো খারাপ লোককে শেষ করেছি আমি। মানে গত দু-বছরের মধ্যে। নিউ ইয়র্কে সেই জাপানিটাকে যে আর. সি. এ. বিল্ডিং-এ বসে আমাদের সংকেতগুলো ধরত। ওটা কে কী ভাবে মেরেছি, তা কখনও ভুলব না।

ম্যাথুস কোনো প্রশ্ন না করলেও বন্ড সেই ঘটনাটার বর্ণনা দেয়।

–ওই বাড়ির পাশে একটা উঁচু বাড়ির চল্লিশতলায় ঘর নিলাম। নিউইয়র্ক অফিস থেকে দুটো রেমিংটন থার্টি-থার্টি রিভলভার আনালাম, টেলিস্কোপিক সাইট আর সাইলেন্সার ফিট করা। অপেক্ষা করছি। আমার ধারণা, ও আগে একদিন গুলি চালাবে। তাতে জানলায় একটা ফুটো হবে। পরে আমি সেই গর্তটা দিয়ে গুলি চালাব। তাই হল। হাঃ হাঃ। আমার গুলিটা সোজা ওর হাঁ করা মুখের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।

ম্যাথুস চুপচাপ শুনছে। বন্ড এখন বেশ খোশমেজাজে। নিজের কীর্তিকাহিনি শুনিয়ে যাচ্ছে।

–দ্বিতীয়টা স্টকহোমে। সে ব্যাটা একটা নরোয়েজিয়ন। সে জার্মানদের হয়ে স্পাইং করত। ওকে ছুরি মেরে, স্ট্যাবিং করে খুন করতে হল। ওর বেডরুমেই।… হ্যাঁ, এই দুটো সাহসিকতার জন্য ডবল জিরো–০০ টাইটেল পেলাম।

…কিন্তু এখন অন্য চিন্তা হচ্ছে। প্রথমে নিজেকে খুব হিরো মনে হচ্ছিল। কিন্তু নিজে যখন ল্য শিফের হাতে মার খেলাম। তখন বুঝলাম, বন্ড যদি দুটি শয়তানকে খুন করে থাকে, তাহলে বন্ডের মতো শয়তানকেও খুন করার লোক থাকবে না কেন? কিন্তু আমি তো শয়তান নই! হয়তো ল্য শিফের চোখে আমি–সে যাইহোক, বিচারটা কে করবে? কে হিরো, কে ভিলেন?

ম্যাথুস কিছু বলার আগেই বন্ড বলল–আরে জানি, জানি, তুমি কী বলবে। দেশপ্রেম, দেশের কাজ, দেশের নিরাপত্তা–এই সব কথা তো? এসব পুরোনো কথা। এখন কমুনিজমের বিরুদ্ধে লড়ছি, বেশ! কিন্তু এটাই বা এমন কী! এটাও পুরোনো হয়ে যাবে একদিন। দিন বড়ো জোরে ছুটছে, ম্যাথুস, বুঝেছ?

ম্যাথুস বলল–ল্য শিফ তোমাকে চিরকালের মতো পঙ্গু করে দিচ্ছিল, সেটা চরম শয়তানি নয়? তোমার মনে এসব চিন্তা কে ঢোকাল? ল্য শিফকে খতম করাই তোমার ডিউটি। দেখবে কর্তারা তাই বলবে। স্মার্শদের কথা এত সহজে ভুলতে পারছ? তোমার কোনো কর্তব্য নেই?

–হুঁ। কিন্তু ল্য শিফকে যদি আমি খুন করতাম, সেটা নিজের স্বার্থেই করতাম! দেশের সাথে নয়–টু বি ফ্রাঙ্ক।

ম্যাথুস বলল–মনে হচ্ছে, তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে। নতুন জেমস বন্ড কথা বলছে। তবে, তোমার যুক্তিগুলো আমি শিখে নিচ্ছি।

বন্ড বলল–দুটো মূর্তি আছে আমার মনে। একটা সাদা, আরেকটা ঘন কালো। ভগবান পরিষ্কার, শয়তান অন্ধকার। কিন্তু শয়তানকে দেখতে কেমন?

–শয়তানকে অনেকটা মেয়েদের মতো দেখতে।

ম্যাথুসের কথায় বোঝা যায়, নারীজাতির উপর তার রাগ এবং সন্দেহ হচ্ছে। অবশ্য, এই লাইনে মেয়েদের দিয়ে অনেক হিংস্র হৃদয়হীন কাজ করানো হয়, ডিউটির নাম করে।

বন্ড বলল–আমার কিন্তু শয়তানের জন্য মায়া হয়। কী করে ভালো হবে, পুণ্যবান হবে, বইয়ে লেখা থাকে। কিন্তু কী করে শয়তান পাপী হবে, তেমন লিখিত নির্দেশ কোথায় আছে? হাঃ হাঃ, শয়তানের টেন কম্যান্ডমেন্টস কেউ লিখে যায় নি! ছোটোবেলা থেকে গল্প পড়েছি, হিতোপদেশ পড়েছি–দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। কিন্তু দুষ্টের পক্ষ নিয়ে কেউ একবার ভাবেনি!

বন্ড তার ভাষণ শেষ করল।

–আসলে কি জানো? ল্য শিফ আমাদের উপকারই করেছে। শয়তান না থাকলে আমরা ভালোকে বুঝব কেমন করে?

–ফাইন!–ম্যাথুস হাততালি দিল–তোমার কথায়, এবার আমি পাপের রাস্তায় যাবার প্রেরণা পাচ্ছি। খুন, রাহাজানি, নারী-নির্যাতন কোন দিক দিয়ে শুরু করি বলো তো!.. কিন্তু, বন্ড, বিবেক বলে একটা জিনিস আছে। বাঁদর জাতির মধ্যেও বিবেক জন্ম নিয়েছিল, মানুষের আগে। তবে তুমি যদি পদত্যাগ করো আমার মতে সেটা হবে একই সঙ্গে হত্যা এবং আত্মহত্যা।

হঠাৎ ঘড়ি দেখে চমকে উঠল ম্যাথুস।

–আর আধঘন্টা দেরি হয়ে গেল। চিফ অব পুলিশের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। দরজার কাছে গিয়ে ম্যাথুস বলল–জেমস্, তোমার আবার ইউনিভার্সিটির ছাত্র হওয়া উচিত। নীতিশাস্ত্র পড়ো–কে ভালো, কে মন্দ ইত্যাদি। তবে একটা কথা শুনে নাও। আমার ধারণা, লন্ডন থেকে ফিরে শুনব, আরও বেশ কয়েকটা ল্য শিফ তৈরি রয়েছে তোমায় খুন করতে। এম-এর কাছেই জানতে পারবে। তাছাড়া বন্ড, তুমি এখন একটা মেশিন হঠাৎ মানুষ হতে চাইলে গোলমাল হবে।… চলি।

২১. ভেসপার রোজই নার্সিংহোমে আসত

ভেসপার রোজই নার্সিংহোমে আসত ফুল নিয়ে, বন্ডকে দেখতে।

আশ্চর্য, বন্ড খুব একটা ফুল ভালোবাসে না। তার কাছে ফুল কেমন এক মেয়েলি জিনিস! তাছাড়া, ফুল মনকে নরম করে দেয়। বন্ড নরম মন চায় না।

তাছাড়া, কাজের দিক থেকে ভেসপার লিন্ড বেশ কয়েকটা ভুল করেছে। এম-এর কাছে রিপোর্টে এখুনি সে সব লেখার খুব প্রয়োজন নেই।

ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছেন–শরীরে বড়ো কোনো ক্ষতি হবে না। ধীবে পুরো ফিট হয়ে যাবে। তবে দুর্দান্ত ধকল গেছে, সময় লাগবে।

তবে মনটা বেশি ধাক্কা দিয়েছে। ইস্, তার পৌরুষ কেড়ে নেওয়া–ভাবা যায় না!

ভেসপারকে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তাকে কাছে পাওয়ার অনেক সুযোগ এসেছিল–গাড়িতে, ভিলাতে। অবশ্য এখনও সে জানেনা, কেমন মেয়ে ভেসপার, কেমন তার মন।

রিপোর্টটা পাঠাতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আটদিন কেটে গেছে। এখন সকাল। রাতে ভালো ঘুম হওয়াতে শরীর-মন দুই-ই সতেজ। ভেসপার লিন্ড এল। ক্রিম রঙের ফ্রক, কালো বেল্ট।

–বাঃ, ভেসপার, বিপদে পড়ে তুমি দেখছি আরও সুন্দর হয়ে উঠেছ। কী করছ তুমি এখন? ভেসপার একটু মনমরা।

–কী আর করব! এখন আমি একা। সমুদ্রের ধারে যাই, বই পড়ি। বেশ কিছু দিন রোদে পুড়েছি, চান করেছি। এখন শুধু বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে বেড়াতে ভালো লাগে।

বন্ড চুপ করে শুনছে।

ভেসপার বলল–ডাক্তাব বলেছেন, তুমি শিগগিরই হাঁটা-চলা করতে পারবে। তখন তোমাকে সমুদ্র পারে নিয়ে যাব। সমুদ্রে স্নান করা তোমার পক্ষে ভালো।

–আমার গা এখন ক্ষতবিক্ষত। সমুদ্রস্নানের সময় যে কেউ আমার চেহারার দশা দেখলে আঁতকে উঠবে।

বন্ড ইঙ্গিতে দেখাল। তার নিম্নাঙ্গের অবস্থা, যা চাদরে ঢাকা আছে, আরও ভয়াবহ।

ভেসপার অনুতপ্ত। সে নিজেকে দোষী মনে করছে। দু-হাতে মুখ ঢাকল সে।

বন্ড পরিস্থিতিটা হালকা করার চেষ্টা করল।

–ঠিক আছে। সেরে উঠে আমরা সমুদ্রপারে বেড়াব, স্নান করব। বেশি দেরি নেই।

এরপর অন্য কথা। ল্য শিফ খতমে লন্ডনের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

বন্ড জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা ভেসপার, তোমাকে নাইট ক্লাব থেকে ওরা কীভাবে ছিনতাই করল?

–মাথাটা ঠিক ছিল না। অন্যমনস্ক অবস্থায় বাইরে আসতেই পাশের গাড়ি থেকে দুটো লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি ভাবছি, পত্রবাহক ওই গাড়ির মধ্যে আছে, তাই গাড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম। আমার স্কার্টেই আমাকে মুড়ি দিয়ে বেঁধে তুলে নিয়ে গেল। ছিঃ, গাড়িতে সিটের ওপর ফেলে আমাকে আবার বাঁধতে চাইল। আমি ব্যাগটা জানলা দিয়ে ফেলে দিলাম .. যদি কারুর চোখে পড়ে! মাথা কাজ করছিল না, যা মনে এল, তাই করলাম।

–হ্যাঁ, ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে তুমি বুদ্ধিমতীর কাজই করেছিলে! ল্য শিফের ভিলাটায় পৌঁছে দেখেছিলাম তুমি আমার কাছে আসার চেষ্টা করছ।

–তোমায় ওরা কী করল?

–আর্ম চেয়ারে ফেলে ওরা নিজেরা মদ আর তাস নিয়ে বসে গেল। স্মার্শের লোকটা একবার ঢুকেছিল। বাইরে থেকে নানা শব্দ কানে আসছিল। কেমন একটা ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম, কিন্তু তোমার চিৎকার শুনেছিলাম একবার। স্বপ্ন কিনা জানি না।

— স্বপ্ন নয়, সত্যি।

–ইস্‌, সবই আমার জন্য!

ভেসপারকে সান্ত্বনা দিল বন্ড–থাক, ওসব কথা থাক।

–কাল আসছ তো?

–আসব।

চোখ মুছে চলে যায় ভেসপার।

২২. বন্ড এখন প্রায় পুরো সুস্থ

বন্ড এখন প্রায় পুরো সুস্থ।

লন্ডনে রিপোর্ট পাঠানো হয়ে গেছে। ভেসপারের কিডন্যাপিংটা বিশদভাবে লিখল।

ভেসপার রোজই আসে বন্ডকে দেখতে। দুজনে অনেক গল্প করে। সে জানাল, চিফ অব পুলিশ এবং ক্যাসিনোর এক কর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার।

বন্ড মেয়েদের খুব একটা পছন্দ করত না। কিন্তু ভেসপারের আন্তরিকতা ওকে অনেকটা মুগ্ধ করেছিল। ভেসপার এক ঝলক পরিষ্কার হাওয়া, যা প্রাণবন্ত, শান্তি দেয়, জীবন জুড়ায়।

বন্ড সুস্থ হয়ে প্রথম দিন বাগানে বসার অনুমতি পেল। তারপর অল্প হাঁটাচলা শুরু করল। প্যারিস থেকে যে ডাক্তার এসেছিলেন তার চিকিৎসার জন্য, তিনি ঘোষণা করলেন–এবার বন্ড একেবারে সুস্থ!

তিন সপ্তাহ আগেই মৃত্যু এসেছিল, সেটা অবশ্য ভোলার নয়।

ভেসপার বলেছিল–আজ আমার সঙ্গে চলো।

–চলো।

কিন্তু কোন দিকে যাচ্ছে, বন্ড জানত না। বন্ড চেয়েছিল শহর থেকে কিছু দূরে যেতে।

–তাই হবে।–ভেসপার বলেছিল, কিন্তু জায়গাটা বলে নি।

ওরা যাচ্ছে সমুদ্রতীর দিয়ে। ল্য শিফের ভিলার দিকে। সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ছিল বন্ডের।

–কী ভাবছ?

–না, কিছু না।… মনে হচ্ছিল কেউ ফলো করছে। বোধহয় তা নয়।

হঠাৎ পেছন দিকে তাকিয়ে বন্ড বলল–ওই দেখ!

চারশো গজ দূরে একটা কালো গাড়ি! ভেসপার বেশ ভয় পেয়েছে। বন্ড বলল–রাস্তাটা তো আমাদের একার নয়, যে কেউ গাড়ি চালাতে পারে। তাছাড়া, এখন আমাদের ফলো করে কার লাভ?

হঠাৎ বন্ড ড্রাইভারকে বলল–গাড়িটা রাস্তা পেরিয়ে দাঁড় করাও।

আয়না দিয়ে পেছন দিকটা দেখল বন্ড।

সাঁ করে গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। শুধু সিটে বসা লোকটার মুখের একটা পাশ দেখা গেল। লোকটি অবশ্য একটি সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল। রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড।

ভেসপার বলল–লোকটা কিন্তু আমাদেরই ফলো করছিল। আমাদের দেখে নিশ্চিত হল।

–না, না, সে সব কিছু নয়।

–তাই! সত্যি আমার মনে যা ভয় ঢুকে গেছে!

ওরা এবার নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গেল। মানে, যেখানে ভেসপার বন্ডকে আনতে চেয়েছে।

পাইনগাছের মধ্যে একটা সাদামাটা ছোটো হোটেল। দূরে সমুদ্র।

–তেমন কিছু নয়। তবে বেশ নির্জন। খাবারটা চমৎকার।

বেশ আয়েস করে খেতে খেতে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল বন্ড। অর্থাৎ, বন্ড জায়গাটাকে বেশ ভালোভাবে অন্তদৃষ্টি দিয়ে পরীক্ষা করে নিতে চায়।

বন্ডের এই মাথা ঘোরানো, আইবল মুভিং ভেসপারের দৃষ্টি এড়াল না। সে চিন্তিত হল–বন্ড কি জায়গাটাকে নিরাপদ মনে করছে না।

খাবারে একটা কামড় দিয়ে বন্ড একটা শ্বাস ছাড়ল। দেখা দিল মুখে এক হালকা প্রসন্নতা। অর্থাৎ, জায়গাটা নিরিবিলি বলেই মালুম হচ্ছে। চিন্তার সেরকম কোনো কারণ নেই।

হোটেল থেকে সমুদ্রের দূরত্ব বোধহয় হাতে গোনা। ছন্দে ছন্দে সমুদ্রলহরী সোনালি বালুকাভূমিকে সিক্ত করে রাস্তায় ওঠবার সিঁড়িকে এসেও কখনো কখনো ছুঁয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে যাচ্ছে আপন ছন্দে। আঃ, কী মনোরম, শান্ত স্থান। এরকম নিভৃত এক স্থানে যদি জীবনটা কেটে যেত। তাহলে পৃথিবীর নানা উপদ্রবকে কাঁধে নিয়ে তার সমাধানের বোঝা বইতে হত না।

ভাবতে ভাবতে বন্ডের মনটা যখন অন্য জগতে বিচরণশীল, তখন একটা গাড়ির শব্দে তার চমক ভাঙে।

বাড়ির মালিক মঁসিয়ে ভারসোয়া ও তার স্ত্রী।

মাদাগাস্কার যুদ্ধে একটা হাত বাদ গেছে মধ্যবয়সি এই সিয় ভারসোয়ার। সমুদ্রের ধারে এই স্বর্গীয় নিবাসটি তারই। রয়্যালের পুলিশের চিফের বন্ধু তিনি। এবং চিফের অনুরোধেই মঁসিয়ে ভারসোয়া বন্ডের সব ব্যবস্থা করে দেন। অবশ্য তার আগে ভেসপারকেও চিফ সব বলে রেখেছেন। দিন সাতেক এখানে থাকবে বন্ড। সাত দিন কেন, বন্ড ভাবে–যদি সাত সাত করে বহুদিন সে এখানে থাকতে পারত–

বন্ড হোটেলের আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে অ্যাপ্রন-পরিহিতা মাদাম ভারসোয়াকে দেখলেন। বোঝাই যাচ্ছিল–যুবতি, সুন্দরী এই মহিলা এখন রান্নায় ব্যস্ত। ভারসোয়া দম্পতি নিঃসন্তান। তাই বোধ হয় হোটেলের অতিথিদের সেবাতেই এঁরা বিশেষত মাদাম ভারসোয়া নিজেইএই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

মাদাম ভারসোয়া বলেন–কেমন লাগছে জায়গাটা মিস্টার?

–দারুণ! এইরকম একটা জায়গায় যদি সারাটা জীবন কেটে যেত—

–তাই! তাহলে থেকে যান এখানেই।

দুজনেই হেসে ওঠে।

একটা গাছের আড়াল থেকে ভেসপার ওদের দেখে।

মাদাম ভারসোয়া এবার বন্ডদের থাকবার ঘর দেখাতে নিয়ে যায়।

বন্ড ও ভেসপারের দুটো ঘর, পাশাপাশি। মাঝখানে টয়লেট। সবকিছুই একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার।

মাদাম ভারসোয়া বলল–আজকে শুধু আপনারা দুজনেই হোটেলের গেস্ট। মঙ্গলবার আজকে। সাধারণত শুক্রবার বিকেল থেকে ভিড় জমে ওঠে। ইংরেজরা তাদের অবকাশ কাটাতে এই সময়টাতে ভিড় করে এখানে। কিন্তু কেন জানি না, এ বছর সেরকম ভিড় হচ্ছে না। তবে রয়্যালে যারা ঢোকে, বেশিরভাগই হেরে ফিরে যায়। সেটাও একটা কারণ। নইলে কিছুদিন আগে পর্যন্তও বেশ ভালোই ভিড় হত।

বন্ড বলে–ঠিক আছে, দেখি আমি আপনার হোটেলে ভিড় বাড়াতে পারি কিনা।

আবার দুজনে হেসে ওঠে। ওরা বাইরে বেরিয়ে আসে। ভেসপার বাইরে চেয়ারে বসে আছে।

বন্ড বলে–এই যে ভেসপার, তুমি এখনও এখানে বসে। আমাদের থাকবার ঘর দুটো দেখেছ?

 ২৩. বন্ড ও ভেসপারের ঘরের মাঝখানে বাথরুম

বন্ড ও ভেসপারের ঘরের মাঝখানে বাথরুম। ভেসপারের ঘর ডবল বেড রুম। ভেসপারের ঘরের বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বন্ড, ভেসপার এবং প্রোপ্রাইটর। প্রোপ্রাইটর পরে আসবে জানিয়ে চলে যায়।

প্রোপ্রাইটর চোখের বাইরে চলে গেলে দরজায় গায়ে হেলান দেওয়া বন্ড এবার ভেসপারের দিকে তাকায়।

ভেসপারও তার দৃষ্টি বন্ডের দৃষ্টির সাথে আটকে নেয়।

বন্ড ভেসপারের সারা শরীরটার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। ভেসপারের উদ্ধত বুকের দিকে বন্ডের দৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডের জন্য আটকে যায়। তাবপর সে সোজা হয়ে দাড়িয়ে ভেসপারকে কাছে টেনে নিয়ে প্রথমে দুই গালে চুমু দেয়। এরপর–

বন্ড একহাতে দরজাটা বন্ধ করে অন্য হাতে ভেসপারকে টেনে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।

চুম্বন-প্রদান নতুন করে শুরু হল। বন্ড ভেসপারের নিম্ন ওষ্ঠটি এবার নিজের দুই ওষ্ঠের মধ্যে রাখে। ভেসপারও বন্ডকে প্রবল কামনায় জড়িয়ে ধবে।

ওরা দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ। বন্ড বলে–আজকে আমাদের সুখ, আনন্দে ডুবে যাবার এক স্বর্গীয় স্থান পেয়েছি। ডারলিং, মাই সুইট ডারলিং–

কামনাতাড়িত ভেসপারের চোখ জ্বলছে।

বন্ড এবার আরও জোরে ভেসপারের দেহটা দুই বাহু দিয়ে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে। আবার চুম্বন দিতে দিতে বন্ড এবার তার মুখ ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামাতে থাকে। বুকের স্তনযুগলের মাঝে এখন বন্ডের মুখ। বন্ড বাঁ হাত দিয়ে ভেসপারের জামার চেনটা টেনে দেয়।

ভেসপার এখন স্মার্ট, সপ্রতিভ। বন্ডের ভালোবাসার উত্তর দিতে তার এখন কোনো জড়তা নেই। সে-ও এবার বন্ডকে দাঁড় করিয়ে তার টাই, জামার বোম খুলে দিচ্ছে। এবং

ভেসপার নিজের জামাটা খুলে ফেলে। বন্ডকে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। বন্ডের মাথাটা ধরে তার দম্ভভরা দুই স্তনের মধ্যে চেপে ধরে। ভেসপারের পরনে শুধু রঙিন ব্রেসিয়ার।

আস্তে আস্তে সে বন্ডকে নিয়ে বিছানায় চলে আসে। কিন্তু–

বুকে মুখ ঘর্ষণরত বন্ড আচমকাই ভেসপারকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ভেসপারের দিকে তাকিয়ে বলে–সরি ডারলিং। এখনই না–

ভেসপারের মুখটা শুকিয়ে যায়। কেন? বুঝতে পারে না সে।

ওরা উভয়ই উভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু প্রত্যেকের শরীরের মধ্যে বয়ে চলেছে দেহজ কামনার নীরব ঝড়।

বন্ড ঝুঁকে পড়ে ভেসপারের ঠোটে, বুকে ঘনঘন চুম্বন এঁকে দিল। ৩বিপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে কী যেন খুঁজতে লাগল।

–কী খুজছ?

–আমার ব্যাগটা। এর মধ্যে আমার সিগারেট আছে।

ভেসপার উঠে বন্ডকে নিজের ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট দিল। তারপর নিজেও নিল। লাইটাব জ্বেলে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করল।

ঘরের জানলাটা খুলে ভেসপার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা হাত তুলে জানলার বিটের ওপর বাখে, অন্য হাতে সিগারেট টেনে চলেছে সে।

ভেসপারের পরনে এখন শুধু ব্রা আর প্যান্টি। কোমরের খাজ পিছন থেকে আরও চিত্তাকর্ষক মনকে মাতাল করে তোলে।

সিগারেট টানতে টানতে বন্ড বিছানায় গিয়ে বসে। এক দৃষ্টিতে ভেসপারকে সে লক্ষ করতে থাকে। ভেসপারও সেটা বুঝতে পারে। না বোঝার কিছু নেই।

বন্ডের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট, প্রায় শেষ হয়ে আসছে। উত্তেজনায় ঘন ঘন টান দিচ্ছে সে। বন্ড টাই, জামা সব খুলে ফেলে। উঠে দাঁড়ায়। দুপা এগিয়ে আসে। সিগারেটটা ঘরে রাখা অ্যাশ ট্রেতে গোঁজে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ভেসপারের দিকে।

পিঠের ওপর ব্রেসিয়াবের স্ক্রিপে হাত রাখে। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভেসপারকে। সবল হাতেব আলিঙ্গনে ভেসপারের যৌবনপুষ্ট দেহটা সামান্য কেঁপে ওঠে। ঠোঁট থেকে সিগারেটটা পড়ে যায়। বন্ড তার ঠোঁট রাখে ভেসপারের নগ্ন কোমল কাঁধে। ব্রেসিয়ারের হুক খুলে দেয়। তারপর–

না। এবার নিজেকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিল ভেসপার। বন্ডকে অবাক করে দিয়ে সে এক ঝটকায় ব্রেসিয়ারটা খুলে ফেলে দিল। পাগলের মতো বলে উঠল–কাম অন, কাম অন ডারলিং!

মুগ্ধ বিস্ময়ে বন্ড তাকিয়ে রইল ভেসপারের দিকে। ভেসপারের চোখ নয়, যেন তার গর্বোদ্ধত স্তনদ্বয় তাকে সুখক্রীড়ায় নীরব আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ভেসপার বন্ডের একটা হাত তুলে তার নিজের বুকের ওপর রাখে।

একী! বন্ড কাঁপছে। দুর্দম, কঠিন জেমস বন্ডের হাত কাঁপছে কেন? কপালে ঘাম ফুটে উঠছে। চরম আবেগে ভেসপার জড়িয়ে ধরে বন্ডকে। বন্ডের নগ্ন বক্ষে এখন ভেসপারের শরীরের এক পরম সুখসম্পদ গভীরভাবে ঘসে চলেছে। বন্ডও এখন পাগল হয়ে গেছে।

ভেসপার বলে–বিছানায় চল। এখানে নয়।

বন্ড ওর দুই স্তনের মাঝে মুখ বেখে বলে–এখন নয় ডার্লিং। আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি।

বন্ডের দুই হাত ভেসপারের কাঁধে। ভেসপার ওর এক হাত বন্ডের এক হাতের ওপর রেখে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে বন্ডের বুকে আলপনা আঁকতে আঁকতে বলে–বেশ, তুমি যা বলবে। এক কাজ করো। তুমি তোমার ঘরে যাও। আমি ততক্ষণ স্নান সেরে আসি। তারপর তুমি।

ভেসপারের ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও দরজার কাছে এসে বন্ড আবার ঘুরে দাঁড়াল। ভেসপার ততক্ষণে গায়ে তার জামাটা দিয়ে জড়িয়ে নিয়েছে। বন্ড ডাকল–ভেসপার, ডারলিং–

ভেসপার ঘাড়টা সামান্য ঘোরাল। বন্ড দেখল, ভেসপারের চোখ দুটো ভিজে উঠেছে। বন্ড এগিয়ে গিয়ে ওকে আবার গভীরভাবে চুমু খেল। কোনো কথা বলল না কেউ। তারপর দরজা খুলে চলে এল নিজের ঘরে।

বন্ড এখন নিজের ঘরের বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে। সে ভাবছে, এখন কি সে সমুদ্রস্নানে যাবে, নাকি ভেসপারের কাছে? ভেসপার যে তাকে এখনই সব দিতে চেয়েছিল। ভেসপারের সারা দেহ কামনার আগুনে ভীষণভাবে জ্বলছিল। কিন্তু বন্ড কেন জানিনা ভীষণ টায়ার্ড ফিল করছে। তার কাছে তো ভেসপার সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। তবে?

–চল। ঘরে যাওয়া যাক।–বন্ড ভেসপারকে বলে।

ভেসপার বন্ডের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে মুখটা ফিরিয়ে নেয়।

বন্ড তা বুঝতে পারে। বলে–ভেসপার, এখন অভিমান করে থেকো না। চল, ঘরে গিয়ে আমরা বসে কফি খাব।–বন্ড ওর একটা হাত ধরে।

কফি খেতে খেতে ঘরে বসে জানলা দিয়ে ওরা রহস্যময়ী সমুদ্রের ক্রীড়াশৈলী দেখছিল।

কফিতে চুমুক দিয়ে বন্ড বলে–একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ ভেসপার?

–কী?

–ওই যে সমুদ্র; এত গর্জন, এত আস্ফালন–দেখো, শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় এসে তাকে মাটির সাথে মিশে যেতে হচ্ছে। সত্যি, ভাবতেও বেশ লাগে।

ভেসপার হেসে ওঠে। তারপর চেয়ারের পিছনে এসে বন্ডের দুই কাঁধে হাত রেখে সে বলে–রিয়েলি! তুমি যেন কবি হয়ে উঠছ।

বন্ড সিগারেট ধরায়। তারপর চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়ায়।

সমুদ্রের দৃশ্য। সমুদ্রের ওপর মুক্ত নীল আকাশের নীচে সামুদ্রিক পাখির দল তাদের ডানা মেলে আনন্দে মাতোয়ারা যেন। সমুদ্রের ধ্বনির সাথে পাখিদের কলতান মিশে অন্য এক সংগীতের সৃষ্টি করেছে।

ভেসপার বলে–আমি চললাম নিজের ঘরে। যাই, স্নানটা সেরে নিই।

বন্ডের দৃষ্টি ধরে রেখেছে সমুদ্র ও নীলাকাশ। হাতে সিগারেটটা পুড়ে চলেছে।

—কী হল? কী ভাবছ?

চমকে ওঠে যেন বন্ড। ঘাড় ঘুরিয়ে ভেসপারের দিকে তাকাতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়–ভাবছি, সমুদ্রের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলা করে আসি।

–হোয়াট? খেলা করবে মানে?

–মানে… ঘুরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বন্ড হেসে বলে বুঝতে পারলে না। চল, আমরা দুজনে স্নান করে আসি।

ভেসপার বলে না তুমি যাও। আমার এখন সমুদ্রস্নানের মুড নেই। আমি বাথরুমেই স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে রেস্ট নেব কিছুক্ষণ।

–ও. কে.। অ্যাজ ইউ লাইক।

ভেসপার নিজের ঘরে চলে যায়।

বন্ড অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা খুঁজে স্যুটকেসটা খুলে সুইমিং কমটা পরে তার ওপর একটা গাউনমতো চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে।

সি-বিচের ওপর দিয়ে বন্ড হেঁটে চলেছে। চারদিক তাকিয়ে দেখল ভালোভাবে–না, ওর দৃষ্টিতে কোনো সমুদ্র দর্শনার্থী বা স্নানার্থীকে চোখে পড়ছে না। কোমরে হাত দেয় বন্ড বেখেয়ালে। না, মনে হয়, ছোটো যন্ত্রটির কোনো প্রয়োজন নেই এখানে।

আবার হাঁটতে শুরু করে বন্ড। সমুদ্রের ঢেউ এসে তার হাঁটু পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়। জল পিছন দিকে সরে যাবার সময় মনে হচ্ছে যেন, পা বোধহয় বালির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। মন্দ লাগছে না।

বন্ড এখন সি-বিচের ওপর শুয়ে। পাশে গাউনটা রাখা আছে।

ভেসপারের কথা হঠাৎ মনে আসে তার আরও নানা চিন্তার মধ্যে। বন্ড ভাবে–ভেসপার আসলে কী চায়? ওব ইচ্ছেটা কী? যদিও এসব প্রোফেশনে ভেসপাররা কোনোদিনই পার্মানেন্ট নয়। যদিও সে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে, অন্যের সুখ-দুঃখের প্রতিও তার দৃষ্টি আছে। সে যাই হোক না, বন্ড তার কাছে প্রয়োজন ছাড়া খোলামেলা হবে না। তাতে বন্ডেরই অনেক সময় সুবিধে হবে।

প্রায় মিনিট দশেক পর বন্ড চোখ মেলল। সূর্যের তেজ কমতে শুরু করেছে। কিন্তু সমুদ্রের গর্জন অব্যাহত। দাঁড়িয়ে এক সুব, আর সমুদ্রের কোলে শুয়ে অন্য এক রিদ কানে বাজে।

উঠে বসে বন্ড। নাঃ, আর স্নান করবে না সে এখানে। বরং, হোটেলে ফিরে গিয়েই স্নানটা করা যাবে। ভেসপার নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।

হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করে বন্ড। গাউনটা হাতে নিয়ে নেয়।

২৪. সমুদ্রে স্নান

–হ্যালো, জেন্টলম্যান, সমুদ্রে স্নান করলেন?–মাদাম ভারসোয়া গেটের মুখে দাঁড়িয়ে।

–না, তবে জাস্ট সান-বাথ।

আর কোনো কথা না বলে বন্ড তার ঘরের দিকে চলে যায়।

মাদাম ভারসোয়া উন্মুখ হয়ে বন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঘরে ঢুকে বন্ড বিস্মিত। একী! তার জিনিসপত্র টিপটপ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানে যেটা থাকা উচিত। এমনকি বেসিনে টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, শেভিং আইটেমস, সোপ, আফটার-বাথফ্র্যাগারান্স–যেখানে যা থাকা দরকার। বাথটবে পর্যন্ত জল ভর্তি। শাওয়ার খুলে দেখল বন্ড। না, ঠিকই আছে।

ভেসপারের ঘরের দরজা খুলে উঁকি মারতেই টেবিলের ওপর চোখে পড়ল একটা স্লিপিং পিলের ছোটো শিশি। তার মানে ভেসপার এখন মানসিক অস্থিরতায় আক্রান্ত।

–ভেসপার।–বন্ড ডাকে।

ভেসপার ঘুমিয়ে পড়েছিল। দারুণ দেখাচ্ছে যেন ওকে।

বন্ড আবার ডাকে–ভেসপার। ভেসপার।

ভেসপার উঠে বসে।

বন্ড বলে–আচ্ছা, তোমাকে এত কষ্ট করে আমার জিনিসপত্র কে গুছিয়ে দিতে বলেছে?

একটা হাই তুলে, স্কার্টটা ঠিক করে ভেসপার বলে আমি তোমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। তোমার দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। আর কিছু?

বন্ড মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ে।

ভেসপার বলে–যাও, তাড়াতাড়ি স্নান করে এসো। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। ঐ মেয়েটা মনে হয় আজ দারুণ সব রান্না করেছে। কিছুক্ষণ আগে আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম।

এখন ওরা ডাইনিং টেবিলে। যদিও লাঞ্চের সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এবং ওদের ডাইনিং টেবিল বাইরের লনে। ডাইনিং টেবিলের ওপর শ্যাম্পেনের দুটো বোতল। মেটে দিয়ে বানানো হয়েছে একটা কারি, মাখনে ভাজা রুটি, মাখনের কিউব, বরফের কিউব। আর রয়েসে সস, কিছু কাটা ফ্রুটস। মিনারেল ওয়াটার।

প্রথম মিনিট দুই ওরা যেভাবে খাবার গলাধঃকরণ করল; দেখে বোধ হবে, ওরা বোধহয় কয়েকদিন খায়নি।

বন্ড একবার দুটো গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালল। চুমুক দিয়ে বলল–কেমন লাগছে?

–ভালোই। তবে মনে হয় ভেসপার মি. জেমস বন্ডের ঠিক যোগ্য নয়।

–হঠাৎ এরকম মনে হওয়ার মানে?

শ্যাম্পেনের গ্লাসটা খালি করে ভেসপার বলে–না মানে, এই যে কাজের জন্য আমি সর্বক্ষণের সঙ্গী তোমার, সে কাজ ফুরিয়ে গেলে আমাদের রাস্তা আবার দুদিকে চলে যাবে। এই দেখনা। দীর্ঘকাল কেউ একসঙ্গে থেকেও একসময় তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে।

-তুমি কি আমার সঙ্গে…।

বন্ড থেমে যায়। না, মনের সব কথা কোনো সুন্দরী মহিলাকে সবসময় উচিত নয় বলা।

বন্ড শুধু বলে–ও. কে., ও. কে.। রিল্যাক্স। আগে তো পেটভরে খেয়ে নাও। পরে আমরা আমাদের কাজের বিষয় ও অন্যান্য সবকিছু নিয়ে ফ্রিলি আলোচনা করব।

বলে বন্ড ভেসপারের গ্লাসে আবার শ্যাম্পেন ঢেলে দেয়।

ওদের খাওয়া শেষ হয়। বয় এসে খাবারের প্লেট, বোতল সব তুলে নিয়ে যায়।

বন্ড বলে–চল, সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে আসি।

সমুদ্রের ধারে বসে, কিছুক্ষণ শুয়ে ওরা অনেকক্ষণ গল্প করল।

বন্ড শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছিল। ভেসপার বলে–কী ভাবছ?

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বন্ড বলে–ভাবছি বিগত কয়েকটা দিনের কথা। কীভাবে যে আমি বেঁচে ফিরলাম। সত্যি আশ্চর্য! এখনও কাজ বাকি আছে।

বন্ডের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ভেসপার বলে–কী কাজ? কোনটা?

–যথাসময়ে জানতে পারবে।–বলে বন্ড হাতঘড়ির দিকে তাকায়।

রাত আটটা।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙল বন্ডের। সিগারেট ধরিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল। ভোরের সূর্যের রঙে সমুদ্রের এ এক অন্য রূপ। প্রকৃতির এ রূপকে বন্ড অগ্রাহ্য করতে পারল না।

ভেসপার এখনও ঘুমোচ্ছে। ওর সম্বন্ধে আজকেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। থাক, ঘুমোক ভেসপার। ওর ওপর দিয়েও তো কম অত্যাচার হয়নি।

না, আর দেরি নয়। এরপর দেরি করলে প্রকৃতির এই রূপদর্শন থেকে সে বঞ্চিত হবে।

সুইমিং কমটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বন্ড সমুদ্রের উদ্দেশে।

বন্ডের পা এখন সমুদ্রের জলে।

২৫. এখন হোটেল অন্ধকার

এখন হোটেল অন্ধকার, কেন?

একটা টেলিফোন বুথ থেকে ভেসপার বেরিয়ে আসছে। বন্ডের চিৎকার শুনে সে ফিরে দাঁড়াল। মুখে হাত চেপে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

বন্ড বলল–কী ব্যাপার? কী হয়েছে তোমার?

–তেমন কিছু না। পরার মতো ড্রেস নেই। জামাকাপড়ের দোকানে এক বান্ধবীর খোঁজ করছিলাম। ম্যাথুসকেও জানাচ্ছিলাম, যদি কিছু পোশাক জোগাড় করে দিতে পারে।

–কিন্তু তুমি তো সি বিচে এলে না?

–যেতাম। তুমি অপেক্ষা করলে না কেন?

–যাকগে! চলো, আমরা বাইরে ব্রেকফাস্ট সারি।

ভেসপারকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। বন্ডের মনটাও নরম হয়ে যাচ্ছে। বন্ড বলল–তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

সুন্দর কাটল কয়েকটা দিন। বেশ অন্তরঙ্গভাবেই।

কিন্তু ক্রমশ একঘেয়ে লাগছে। নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব দেখা দিল। সেদিন ওই টেলিফোনটা আসলে কাকে করেছিল ভেসপার। জামাকাপড়ের এতই অভাব দেখা দিল? ড্রেস নেই— ব্যাপারটা স্রেফ ছুতো! আজও বন্ড জানতে পারেনি। টেলিফোন বুথ থেকে কাকে ফোন করেছিল ভেসপার লিন্ড!

সম্পর্কটায় আর জোড়াতালি দেওয়া গেল না।

ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারে দেখা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কথাবার্তার সুর পালটে গেছে। ভেসপারই উদাসীন। হাঁ করে দায়সারা উত্তর সারছে।

হঠাৎ অন্যমনস্ক ভেসপার যেন চমকে উঠল। হাতে খাবারের কাটাটা ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে গেল।

উলটোদিকের টেবিলে একটা লোক এসে বসেছে। ভেসপার তাকে দেখেই চমকে উঠেছে, ফ্যাকাসে মুখ!

–কী ব্যাপার, ডার্লিং?

–সেই লোকটা।

–কোন লোক?

–সেই গাড়ির লোক, যে গাড়িটা আমাদের ফলো করেছিল।

লোকটি এখন মেনুকার্ড দেখছে। খাবার পছন্দ করছে। খাবারের সঙ্গে ওয়াইনের অর্ডার দিল সে। বোধহয় বুঝতে পারল সে এখন কারুরলক্ষ্যবস্তু। তাই খবরের কাগজের পাতায় মন দেওয়ার ভান করল।

লোকটার একটা চোখ ঢাকা। কালো কাপড়ের ব্যান্ডেজ করা একচক্ষু দানবের মতো দেখায় মুখটা। চোখের কভারটা ক্রু দিয়ে আটকানো!

বন্ড বোঝাল–বাদ দাও! হোক না কেউ, কী করা যাবে? কিন্তু ভেসপার উত্তেজিত। চাপা উত্তেজনা। সামলাতে গিয়ে থরথর করে কাপছে সে। গেলাস তুলতে গিয়েও তার হাতে কম্পন! ভেসপার বিড়বিড় করল–সেই লোক! আমি নিশ্চিত, এ সেই লোক!

মাথা ধরার অজুহাত দেখিয়ে উঠে পড়ল ভেসপার।

–একী।

–ভীষণ মাথা ধরেছে। দুপুরে ঘরেই থাকব।

দ্রুত বেরিয়ে গেল ভেসপার।

বন্ড কফির অর্ডার দিল। একটু দেরি আছে। সে বাইরে এসে একটা গাড়ি লক্ষ করল। খুব সম্ভব এই লোকটার গাড়ি! এটাই কি ওদের ফলো করেছিল? নম্বর প্লেটটা দেখল। লাগেজ ক্যারিয়ারে তালা-আঁটা।

রেস্টুরেন্টে ফিরে এল বন্ড।

লোকটি আহাররত।

বন্ডের কফি এল। প্রোপ্রাইটারকে ডাকল বন্ড। সে লোকটির সঙ্গে খাবার বাছাই-এর সময় হেসে হেসে কথা বলছিল।

–আচ্ছা, ওই লোকটা কে বলুন তো? আপনার পরিচিত?

–মোটেই না। কেন বলুন তো?

–না, আমার এক বন্ধুও ওইরকম চোখে কালো কভার বাঁধে। অনেকদিন দেখা হয় না। ভাবলাম, ও নাকি! হয়তো আপনার জানাশোনা, তাই–

প্রোপ্রাইটর-এর কাছ থেকে অন্য একটা বিষয় জানতে পারল বন্ড। এক্সচেঞ্জ জানিয়েছে, এখানকার একজন গেস্ট প্যারিসে ফোন করেছিল, কিন্তু নো রিপ্লাই হয়েছে। তারা নাকি মাদাম, অর্থাৎ ভেসপারের খোঁজ করছিল! একটা নম্বর দিয়েছে, মাদামের কি সেটা দরকার?

২৬. আরও তিনটে দিন

আরও তিনটে দিন পার হয়ে গেল।

ভেসপার একবার রয়্যালে গিয়েছিল। ফিরে এসে জানাল, ওর কতগুলো ওষুধের খুব প্রয়োজন ছিল। হঠাৎ সে খুব উল্লসিত। আসল, না নকল, কে জানে। কিন্তু বহুদিন বাদে বন্ডের সঙ্গে হাসিঠাট্টা-আদর-আহ্লাদের মধ্যে রাতটা কাটিয়ে দিল সে।

আশ্চর্য, ভোরবেলা কান্না। গমকে গমকে কান্নায় ভেঙে পড়ছে। বন্ড ব্যাপারটা ধরতে পারল না।

ভোরবেলায় চুপি চুপি নীচে গেল ভেসপার।

ফোন করতে কি? রবিবার আবার সেই চোখে পট্টি-আঁটা লোকটির আগমন।

ইতিমধ্যে কালো গাড়ি এবং লোকটার খবর জেনেছে ম্যাথুস। লোকটার নাম অ্যাডলফ গেটলার। ভাগ্য ভালো হিটলার নয়। তবে সে জার্মান নয়, সুইস। ঠিকানা, জুরিখের একটা ব্যাংক।

এখানে কী মতলবে এসেছে লোকটা। একটা ঘরও ভাড়া নিয়েছে।

ভেসপার আরও অদ্ভুত ব্যবহার করছে। যেন পাথর হয়ে গেছে। যেন বন্ডকেও চিনতে পারছে না।

বন্ড এবার বলল–ভেসপার, এভাবে চলতে পারে না। তোমার কী হয়েছে পরিষ্কার বলো।

ভেসপার চুপ।

বন্ড বলে–আমি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু—

ভেসপারের চোখ দিয়ে জল পড়ছে।

–কীসের কষ্ট তোমার?

–আমায় একটু সময় দাও।

রাতের ডিনারে শ্যাম্পেন চাইল ভেসপার। আবার রুমাল দিয়ে চোখ মুছল।

রাতটাও সুন্দর কাটল বটে, কিন্তু ভেসপার আসল কথা বিন্দুমাত্র বলল না।

২৭. পরদিন সকালে যা ঘটল

পরদিন সকালে যা ঘটল, তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না বন্ড। অবশ্য ঘটনা ঘটছে সকালে নয়, আগের বাতেই।

প্রোপ্রাইটার ছুটে এসে জানাল–দারুণ অ্যাক্সিডেন্ট, মাদাম—

তার হাতে একটা খাম। পরিচারিকার চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

বন্ড লাফিয়ে উঠে ভেসপারের ঘরে ছুটল।

ভেসপারের ঘরের দরজা খোলা। ভেসপার ইহজগতে নেই।

টেবিলে খালি গেলাস। চারপাশে সাদা সাদা ওডে। স্লিপিং পিলের বোতলটা সম্পূর্ণ খালি। সেটা মাটিতে গড়াচ্ছে।

প্রোপ্রাইটারের হাতেব খাম সমেত চিঠিটা নিয়ে নিজের ঘরে এল বন্ড। চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল।

–ডার্লিং জেমস।

আমি তোমায় ভীষণ ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসা নিয়েই বিদায় নিলাম। কাবণ আমার জন্য তোমার ভালোবাসাও নিঃশেষে মুছে যাবে, যখন তুমি আসল সত্য জানতে পাববে। আমি এম ডব্লিউ ডি এ এজেন্ট। হ্যাঁ, ডাবল এজেন্ট আমি। আর এ এফ এল এক পোল্যান্ডবাসীর সঙ্গে আমার ভালোবাসা ছিল। সেই থেকে ওদের হয়েই কাজ কবছি। আমার সেই লোকই আমাকে চিঠি লিখত, বা ফোন করত। কাবণ, আমার সঙ্গে তার মেলা মেশা কর্তাবা বাবণ করে দিয়েছিল। হ্যাঁ, এম তাকে ট্রেনিং দিয়ে পোল্যান্ডে পাঠিযেছিল। আমি বাশিনদেব হয়ে কাজ কবছিলাম এখন। আমার ডিউটি ছিল ব্যালে তোমার কাজকর্ম দেখে ওদের খবর দেওয়া। সুতরাং, আসলে আমি তোমার শত্রু।

কিন্তু তোমায় কেন আমি ভালোবেসে ফেললাম। আমার সব পরিকল্পনা গোলমাল হয়ে গেল। তোমার সঙ্গে আমার এই ভালোবাসার সম্পর্ক ওরা বুঝতে পেরে গেল। এবার ওরা পোল্যান্ডে আমার প্রেমিককে মারবে, আমাকেও মারবে।

কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমি তোমার কেনো ক্ষতি করতে পারব না। আমার সব কিছু তোমায় উজাড় করে দিয়ে বসে আছি। আমার আর ঐ দলে ফিরে যাবার পথ নেই।

ভেবেছিলাম, তোমায় নিয়ে পালিয়ে যাব। কোথায়?

আমেরিকায় যেতে পারতাম। বিয়ে করতাম। নতুন একটা সংসার পাততাম।

কিন্তু ওরা আমার পিছু ছাড়েনি। ঠিক এখানে এসে গেল।

এবার আমার কাছে তিনটে পথ। অপেক্ষা করা, তবে স্মার্শ আমায় খুন করবে। কবে, তোমাকে আমার জন্য মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে আবার। অথবা–

অথবা–আত্মহত্যা!

বিদায় নিচ্ছি তাই।

প্যারিসের ওই ফোন নম্বর, আঁভালিদ ৫৫২০০।

তোমাকে বলিনি। তাহলে তুমি তোমার জীবন বিপন্ন করে আমার প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করবে।

যাই, বিদায়, প্রিয়।

 

নিজেকে সামলে নিল বন্ড।

কে এই ভেসপার?

সে শুধু বস্তের শত্রুপক্ষের গুপ্তচর মাত্র। ভালোবাসা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই।

ভেসপার এক বিশ্বাসঘাতক!

এখন যেটা চিন্তার ব্যাপার, সেটা হল স্মার্শ আবার কখন আঘাত হানবে।

ভেসপারের আত্মহত্যায় বন্ডের বিপদ কিছুমাত্র কমেনি। এমন আত্মহত্যা কতই ঘটে! কাজের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা ঢুকলে মরতেই হবে।

বন্ড-ও মরত।

এখন লড়াই চলবে : স্মার্শ বনাম জেমস্ বন্ড।

লন্ডন অফিস থেকে ফোন এল।

বন্ড বলল : আমি ০০৭ বলছি। একটাই খবর। ওই ৩০৩০ মেয়েটা ডাবল এজেন্ট ছিল। কাল রাতে সুইসাইড করেছে। ও. কে.!….

Exit mobile version