টারজান বলল, তাহলে কাল আমরা থেনার উপত্যকার এথনি শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।
নতুন দিনের শুরু হল মেঘমেদুর ভয়ঙ্কর পরিবেশে। বর্ষাকাল পার হয়ে গেছে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে যে, পাহাড় শ্রেণীর ভিতর দিয়ে টারজান ও ভালুতোর হারানো থেনার উপত্যকার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে তারই সুউচ্চ শিখরের মাথায় বিলম্বিত ঝড় যেন পুঞ্জীভূত হচ্ছে। রোদের উত্তাপে ও রাতের ঠাণ্ডা কাটেনি। ডালপালার বিছানা ছেড়ে উঠে মানুষ দু’টি শীতে কাঁপছে।
পড়ন্ত বিকেলে একটা গভীর খাদ বেয়ে উঠে উঁচু উপত্যকার উপর এসে তারা দাঁড়াল। হঠাৎ ভাতের সানন্দে চীৎকার করে উঠল, পেয়েছি পেয়েছি! ঐ তো জারাটর!
টারজান সেদিকে তাকিয়ে দেখল দূরে একটা চওড়া-মাথা পর্বত-শিখর মেঘ-ভাঙা রাঙা আলোয় ঝলমল করছে। বলল, তাহলে ওটাই জারাটর! আর থেনার ওর ঠিক পূর্ব দিকে?
ভালতোর জবাব দিল, হ্যাঁ; তার অর্থ এই উপত্যকার নিচে ঠিক আমাদের সামনেই ওন্থার। ওথারের প্রায় দক্ষিণ সীমান্তে আমরা পৌঁছ গেছি। ঐ তো স্বর্ণ-শহর ক্লাথুনি। খুবই সমৃদ্ধ শহর, কিন্তু আদিবাসীরা আমার জাতির শত্রু।
টারজান আর একবার কাথুনি শহরের উপর চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করল, ওটাকে তোমরা স্বর্ণশহর বল কেন?
ভালতোর বলল, সোনালী গম্বুজ আর সোনার সেতুটা দেখতে পাচ্ছ না? ওগুলো নিরেট সোনা দিয়ে মোড়া। কোন কোন গম্বুজের সোনা এক ইঞ্চি পুরু, আর সেতুটা নিরেট সোনার ইট দিয়ে তৈরি।
টারজান প্রশ্ন করল, এত সোনা ওরা পায় কোথায়?
শহর থেকে সোজা দক্ষিণের পাহাড়ে সোনার খনি আছে, ভালতোর জবাব দিল।
আর তোমার দেশ থেনার কোথায়?
ওনথারের পূর্ব দিকের পাহাড়ের ঠিক ওপারে। শহরের প্রায় পাঁচ মাইল উপরে যেখানে নদী ও রাস্তাটা বনের মধ্যে ঢুকে গেছে দেখতে পাচ্ছ?
এথনি থেকে আমরা কতদূরে আছি? টারজান শুধাল
প্রায় পঁচিশ মাইল, ভালতোর জবাব দিল।
টারজান বলল, তাহলে তো আমরা এখনই রওনা দিতে পারি।
ভালতোর বলে উঠল, অবশ্যই পার; কিন্তু দিনের আলোয় ওনথার পার হবার চেষ্টা করাটা নিরাপদ হবে না। কাথুনির ফটকে শান্ত্রীরা নিশ্চয় আমাদের দেখতে পেলে আমাদের খুন করবে, নয় তো বন্দী করবে। রাতেও ও পথে সিংহের ভয় আছে। কিন্তু দিনের বেলায় অবস্থা আরও শোচনীয়।
কোন্ সিংহ? টারজান জানতে চাইল।
ভালতোর বলল, কাথুনির মানুষরা সিংহ পালে; গোটা উপত্যকায় অনেক সিংহ ঘুরে বেড়ায়। নিচে নদীর এপারে যে বিস্তীর্ণ উপত্যকা দেখতে পাচ্ছো ওটার নাম ‘সিংহ-ক্ষেত্র। ও জায়গাটা সন্ধ্যার পরে পার হওয়াই নিরাপদ।
তোমার তেমন ইচ্ছা, কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান বলল। এখনই যাত্রা করা অথবা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার কাছে দুই-ই সমান।
এক সময় অদৃশ্য সূর্য পশ্চিম দিগন্তে আরো ঢলে পড়ল; ঘন কালো মেঘ উত্তরের পর্বত শিখরকে ঢেকে ফেলল। ভালতোর বলল, এবার আমরা যাত্রা করতে পারি।
একটা গিরিপথ ধরে দু’জনে নিচে নামতে লাগল। দু’পাশের খাড়া পাহাড় কাথুনি শহরের দৃষ্টি থেকে তাদের আড়াল করে রাখল। ঝড়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সঙ্গে বজ্রের গর্জন। আকস্মাৎ বিদ্যুতের একটা প্রচণ্ড ঝিলিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য গোটা উপত্যকাটিকে ঝলসে দিল; প্রচণ্ড এক জলধারার ধাক্কায় দু’জনেই মাটিতে পড়ে গেল।
কোনরকমে আবার যখন উঠে দাঁড়াল তখন তারা দাঁড়িয়ে আছে প্রচণ্ড জলস্রোতের মধ্যে। কিন্তু ঝড়ের দেবতার সব জারিজুরির বুঝি সেখানেই ইতি ঘটল। বৃষ্টি থেমে গেল। ভালতোর আবার পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল।
থেনারের রাস্তাটা যেখানে নদীকে অতিক্রম করেছে সেই জায়গাটা স্বর্ণ সেতু অর্থাৎ কাথুনি শহরের ফটক থেকে সাত মাইল দূরে। তিন ঘণ্টায় সেই পথটা পার হয়ে দু’জনে এসে দাঁড়াল নদীতীরে।
ভালতোর ইতস্তত করে বলল, সাধারণত জল থাকে ফুটখানেক গভীর। এখন তিন ফুট গভীর।
টারজান বলল, অচিরেই জল গভীরতর হবে। পাহাড় ও উপত্যকার উপর থেকে ঝড়ের সব জল এখনও এসে পৌঁছয়নি। আজ রাতেই যদি নদী পার হতে হয় তো এখনই পার হতে হবে।
ভালতোর বলল, ঠিক আছে। আমাকে অনুসরণ কর; আমি খালটাকে চিনি।
জলে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের মুখে আবার মেঘে ঢেকে গেল। খালটা ভাতোরের পরিচিত, তাই সে বেশ দ্রুতগতিতেই সেটা পার হতে লাগল। ফলে টারজান ক্রমেই তার থেকে পিছিয়ে পড়তে। লাগল। তবু প্রাণপণ শক্তিতে সে খালটা পার হতে লাগল।
জলের স্রোত প্রবল; টারজনের মাংসপেশীও প্রবল শক্তিধর। তিন ফুট গভীর জল ক্রমে ফুলে ফেঁপে টারজনের কোমর পর্যন্ত উঠল। হঠাৎ পথ ভুল করে সে একটা গর্তে পা দিল। সঙ্গে সেঙ্গ প্রচণ্ড স্রোত। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
ওদিকে ভালতোর নিরাপদে অপর তীরে পৌঁছে টারজনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেও সে যখন এল না তখন ভালতোর তার নাম ধরে অনেক ডাকল, কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।
সারাটা রাত সে অপেক্ষা করে রইল। ভোরের আলো ফুটল। তবু বন্ধুর দেখা নেই। অবশেষে তার দৃঢ় ধারণা হল, উন্মত্ত বন্যার টান টারজানকে মৃত্যুর মুখে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ হৃদয়ে নদীর তীর ছেড়ে সে আবার যাত্রা শুরু করল থেনার উপত্যকার দিকে।
উচ্ছ্বসিত নদীর ক্রুদ্ধ জলধারার সঙ্গে প্রাণ রক্ষার যুদ্ধে সতত ব্যস্ত টারজান সময়জ্ঞান একেবারেই হারিয়ে ফেলল। মৃত্যুর বিরুদ্ধে এ সংগ্রামের যেন শুরু নেই, শেষ নেই।