আমার এখনও মনে আছে, প্রথম রোহিনী রকেটটিতে সংযোজিত ছিল ৩২ কেজি ওজনের একটা একক প্রপালসন মোটর। এটা ৭ কেজি পেলোড উত্তোলন করেছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উঁচুতে। এরপর পর আরও একটা রকেট ছোঁড়া হয়, তাতে ১০০ কেজি পেলোড় উৎক্ষেপণ করা হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার উঁচুতে।
.
বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় রকেটের উন্নয়ন কার্যক্রমকে দেখা যেতে পারে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দেখা টিপু সুলতানের স্বপ্নের পুনরুজ্জীবন। টিপু সুলতান যখন নিহত হন, তখন বৃটিশরা ১৭৯৯ সালে তুরুখানাহালীর যুদ্ধে ৭০০ রকেট ও ৯০০ রকেটের সাবসিস্টেম দখল করেছিল। টিপুর সৈন্যবাহিনীতে ছিল ২৭টি ব্রিগেড, এদের বলা হতো কুশুন, আর প্রতিটা ব্রিগেড়ে ছিল রকেট নিক্ষেপকারীদের নিয়ে একটি করে কোম্পানি, এদের বলা হতো জুর্ক। উইলিয়াম কনগ্রিভ এই রকেটগুলো ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়। বৃটিশরা সেখানে এইসব রকেট নিয়ে যে গবেষণা চালায় আজকের দিনে তাকে আমরা রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং বলি। সেই সময় অবশ্যই কোনো গ্যাট, আইপিআর অ্যাক্ট, অথবা পেটেন্ট ব্যবস্থা ছিল না। টিপু সুলতানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রকেট বিজ্ঞানেরও মৃত্যু ঘটে– অন্তত ১৫০ বছরের জন্য।
ইতোমধ্যে বিদেশে রকেট প্রযুক্তি ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। রাশিয়ায় কন্সতান্তিন সিওলকোভস্কি (১৯০৩), যুক্তরাষ্ট্রে রবার্ট গড়ার্ড (১৯১৪) এবং জার্মানিতে হেরমান ওবার্থ (১৯২৩) রকেটবিজ্ঞানকে পৌঁছে দেন নতুন মাত্রায়। নাৎসি জার্মানিতে ভের্নার ফন ব্রাউন-এর গ্রুপ V-2 নামে নিকটপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন করে এবং মিত্রবাহিনীর ওপর অগ্নিবর্ষণ শুরু করে দেয়। যুদ্ধের পর ইউএসএ ও ইউএসএসআর উভয়েই জার্মান রকেট প্রযুক্তি হস্তগত করে আর আটক করে রকেট ইঞ্জিনিয়ারদের। এদের দিয়ে তারা মিসাইল ও ওয়ারহেড উৎপাদনের মাধ্যমে শুরু করে তাদের ভয়াবহ অস্ত্র-প্রতিযোগিতা।
ভারতে রকেট বিজ্ঞান, পুনর্জন্ম লাভ করেছে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রযুক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির কল্যাণে। অধ্যাপক সারাভাই এই স্বপ্নকে মূর্ত করে তোলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। অসংখ্য ব্যক্তি একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে মহাকাশ গবেষণার এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যে রাষ্ট্রে অসংখ্য মানুষ খাদ্য-সংকটে ভোগে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরু বা অধ্যাপক সারাভাই তাদের লক্ষ্য থেকে পিছপা হননি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার ও ভারতীয়রা যদি বিশ্ব-সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাদের বাস্তবজীবনের সমস্যায় প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। আমাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল না।
.
৫.
অধ্যাপক সারাভাই প্রায়ই থুম্বায় আসতেন। প্রতিবারই তিনি পুরো দলের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতেন খোলামেলাভাবে। তিনি কখনও নির্দেশ দিতেন না। বরং মুক্ত মত বিনিময়ের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন সামনের দিকে, এতে অনেক সমস্যার সমাধান আমরাই বের করতে পারতাম, এবং তা খুব সহজেই। ফলপ্রসূ নেতৃত্বের প্রধান গুণের সমস্যার সম্মিলিত বোঝাপড়ার বিষয়টি তিনি বিবেচনা করতেন। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, দেখ, আমার কাজ হলো সিদ্ধান্ত নেওয়া; কিন্তু আমার দলের সদস্যরা আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে কিনা সেটাও বিবেচনা করা সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে অধ্যাপক সারাভাই ধারাবাহিকভাবে কতকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা ছিল অনেকের জন্য লাইফ-মিশন। আমরা আমাদের নিজেদের রকেট তৈরি করব। নিজেদের স্যাটেলাইট তৈরি করব। আর এসব করা হবে একটার পর একটা নয়, একই সঙ্গে। একটা বহুমাত্রিক ধারায়। সাউন্ডিং রকেটের জন্য পোলোড উৎপাদনে, একটা নির্দিষ্ট পেলোড নিয়ে রকেটে তা সংযুক্ত করার পরিবর্তে, আমরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম বিভিন্ন অবস্থানে এবং বিভিন্ন সংগঠনে কর্মরত পেলোড বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। আমি এমনকি এও বলতে পারি যে, সাউন্ডিং রকেট কর্মসূচির সবচেয়ে অসাধারণ সাফল্য ছিল দেশব্যাপী, মিউঁচুয়াল ট্রাস্ট গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
আমার বৈধ কর্তৃত্ব খাটানোর চেয়ে লোকজনকে আমি বুঝিয়ে কাজ করাতাম বুঝতে পেরে অধ্যাপক সারাভাই আমাকে পেলোড বিজ্ঞানীদের আনুষঙ্গিক সহায়তা দানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভারতের প্রায় সব ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি জড়িত ছিল সাউন্ডিং রকেট কর্মসূচিতে, প্রত্যেকের ছিল নিজ নিজ দায়িত্ব, নিজের বিষয় এবং নিজের পেলোড। এসব পেলোড এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে করে ফ্লাইট কন্ডিশনে এগুলো যথাযথভাবে কাজ করে। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য রকেটে যুক্ত করা হতো এক্স-রে পেলোড; অ্যাটমসফিয়ারে ওপরের স্তরে গ্যাস কম্পজিশন বিশ্লেষণের জন্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাস স্পেক্ট্রমিটারে যুক্ত পেলোড; হাওয়ার অবস্থা, প্রবাহ ও গতি বুঝতে সোডিয়াম পেলোড। অ্যাটমসফিয়ারের বিভিন্ন স্তর আবিষ্কার করার জন্য আয়োনসফেরিক পেলোডও আমাদের ছিল। টিআইএফআর, ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি (এনপিএল) ও ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (পিআরএল)-এর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তো মিলিতভাবে আমাকে কাজ করতে হয়েছিলই, তাছাড়াও আমি একত্রে কাজ করেছিলাম ইউএসএ, ইউএসএসআর, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপানের পেলোড বিজ্ঞানীদের সঙ্গে।