ব্যক্তি সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে বহুত্বে বিলীন হবার জন্য এটা অবশ্যই জরুরী বলে আমি মনে করি।
এ প্রসংগে আমি পবিত্র কোরান শরীফের একটি সুরার উল্লেখ করতে চাই:
হে রাসূল (সঃ), যারা ঈমান আনেনি তাদের কাছে আপনি দ্বীনের দাওয়াত প্রচার অব্যাহত রাখুন।
আপনি যার এবাদত করেন, আমি তার এবাদত করি না আর আমি যা করি আপনি তা করেন না।
আপনার কর্মফল আপনার কাছে।
আর আমার কর্মফল আমার কাছে।
আমরা নিজেরা নিজেদের ব্যাপারে যে মত পোষণ করি, আমরা নিজেরা যা বিশ্বাস করি আমাদের কাছে সেটাই সত্য। একদা আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আস্থা এনছিলাম তাই আজ এতদূর আসতে পেরেছি। এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করতে পারলে এই অবস্থাই আমাদের ব্যক্তি থেকে মহাকালে ছড়িয়ে দেবে।
ভারতীয়রা নিজেদের মর্যাদাশালী জাতি হিসেবে হাজার বছর ধরে ভেবে এসেছে। আমাদের পূর্বপুরুষরাও সেই বিশ্বাস নিয়ে তাদের জীবন কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের দিনে ভারতের মানুষ তার সেই চেতনাকে ফেলে এমন গভীরভাবে বস্তুজগতের মোহে ছোটা শুরু করেছে যা প্রকৃত জীবনের জন্য অত্যন্ত পশ্চাৎপদ বলে আমি মনে করি।
একবার এক বিশেষ উপলক্ষ্যে আমাকে ব্যাঙ্গালোরে যেতে হচ্ছিল। আমার এক বন্ধুকে আমার সম্ভাব্য যাত্রা সম্পর্কে বললাম। তাকে জানালাম সেখানে গিয়ে আমি তরুণ-কিশোরদের সংগে দেখা করব, তাদের সংগে কথা বলবো। এ ব্যাপারে আমি তার পরামর্শ চাইলাম। তিনি সরাসরি আমাকে কোন পরামর্শ দিলেন না কিন্তু একগুচ্ছ প্রজ্ঞাময় হাদীসের বাণী শোনালেন—
যখন কথা বলবে, সত্য বলবে,
প্রতিশ্রুতি দিলে পূরণ করবে
কাউকে আঘাত করা এবং মন্দ ও বেআইনি জিনিস
গ্রহণ থেকে তোমার হাতকে বিরত রাখবে।
কোন কাজ সর্বাপেক্ষা উত্তম? মানুষের মনে শান্তি দেওয়া, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেওয়া, দুস্থকে সহায়তা করা, দুঃখীর দুঃখ হ্রাস করা আর আহতকে মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা সারিয়ে তোলাই সর্বাপেক্ষা ভাল কাজ।
আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি নিয়েই তার পরিবার এবং সেই ব্যক্তিই তার সবচে প্রিয় যে তার সৃষ্টির জন্য ভাল কিছু করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়।
এগুলোই রাসুলের হাদীস। এ হাদীসগুলো যিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন তিনি হলেন তামিলনাড়ু র বিখ্যাত এক দীক্ষিদারের নাতির ছেলে এবং একজন গণপতিগল (বেদ বিশেষজ্ঞ)র নাতি। আমার এ ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি ওয়াই, এস, রাজন ছাড়া আর কেউ নন। এমন উদার মানসিকতা খুঁজে পাওয়া কেবল আমাদের দেশেই সম্ভব। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে,
আনো ভদ্রো ও কর্তব্য য়েনথু বিম্ব থা?-অর্থাৎ সর্বদিক হতে (তোমাদের দিকে) মহান জ্ঞান আসতে দাও।
আমার পরিবারের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমার দাদা ও তার বাবা রামেশ্বরের আম্বালাকারার বা সম্ভ্রান্ত নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কথিত আছে আমার জন্মভূমি এই রামেশ্বর দ্বীপেই ভগবান রাম রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করতে রামেশ্বরমবাসী প্রতি বছর রাম-সীতার বিবাহ উৎসব পালন করে থাকে।
এখানে রাম তীর্থম নামে একটি পবিত্র পুষ্করণী আছে। পুষ্করণীটি সাংঘাতিক গভীর। পুষ্করণীর মাঝখানে ছোট একটি ভাসমান মন্ডপ বানানো হয়েছে। উৎসবের দিন স্বর্ণালংকার শোভিত রাম-সীতার বিগ্রহ একটি সুসজ্জিত ভেলায় ওই মন্ডপে নিয়ে যাওয়া হতো এবং পুজো করা হতো। আমার দাদার বাবা প্রতিবছর ওই ভেলা সরবরাহ করতেন। বহু প্রাচীনকাল থেকে রামেশ্বরে ওই রাম-সীতার বিবাহ উৎসব আজ অবধি পালিত হয়ে আসছে।
এক বছর, আমার দাদার বাবা পুষ্করণীর পাড়ে দাঁড়িয়ে উৎসব দেখছিলেন। তখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটে। হঠাৎ তিনি দেখলেন বিগ্রহটি ভেলা থেকে পড়ে ডুবে গেল। কোন ভাবনা চিন্তা না করেই তিনি পুষ্করণীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং ডুবন্ত সেই বিগ্রহ উদ্ধার করে আনলেন। ঘটনাটি ঘটলো পুরো রামেশ্বরমবাসীর সামনে।
এ ঘটনার পর–
মন্দিরের পুরুৎ আমার দাদার বাবার সম্মানে আমাদের পরিবারকে বিগ্রহে প্রথম শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের সুযোগ দিলেন। বিগ্রহ উদ্ধারের পর করুণাময়ের প্রশংসায় ও আমাদের পরিবারের শান্তি কামনা করে ওই দিন রামেশ্বরম মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছিল।
আজকের বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্প্রীতি ও মানবতার ক্ষেত্রে আমার কাছে। এ ঘটনা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়।
আমরা কি সবাই এমন সৌভ্রাতৃত্ত্বের মন্ত্রে জেগে উঠতে পারবো না?
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ শুনতে আমার হাইস্কুলের শিক্ষক ইয়াদুরাই সলোমন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা এখন স্বাধীন এমন ঘোষণা শুনতে আমরা সবাই সেদিন জড়ো হয়েছিলাম।
পরের দিন সকাল বেলায় নেহেরুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ পত্রিকার প্রধান শিরোনামে ছাপা হল। তামিল ভাষায় প্রকাশিত ওই সংবাদপত্রে নেহেরুর ভাষণের সংবাদের পাশেই আরেকটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল যা আজও আমার স্মৃতিতে প্রোথিত হয়ে আছে। সংবাদটি ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কবলিত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে মহাত্মা গান্ধী ১৫ আগস্ট নোয়াখালিতে পায়ে হেঁটে উপস্থিত হয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই জাতির জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী সেদিন স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা উত্তোলন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে মানবাত্মার সেবায় তিনি তখন খালি পায়ে নোয়াখালিতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এমনই ছিল মহাত্মার মহত্ব। যে মহত্ব একজন স্কুলছাত্রের মনে কী ভীষণ এক অমোচনীয় রেখাপাত করেছিল।