ন্যাকামি বাদ দাও, টাওয়ার, ঝাঁঝের সাথে বলল ইনগ্রিড। সবাই আমরা জানি, এই মুহূর্তে ব্রিটিশ আর মার্কিন অ্যামব্যাসাডর তোমাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন। ওঁদের বল, দুঘণ্টার মধ্যে একজন লোক চাই–তা না হলে প্রথম জিম্মির লাশ দেখবে তোমরা।
২. একজোড়া বাথিং ট্রাঙ্ক
সব কাপড়চোপড় খুলে শুধু একজোড়া বাথিং ট্রাঙ্ক পরেছে পিটার, পায়ে ক্যানভাস চপ্পল। সামনাসামনি দেখা করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে ইনগ্রিড, মেয়েটাকে কাছ থেকে মাপজোক করার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়েছে ও।
প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে আমরা কাভার দেব, পিটারকে বলল কলিন নোবলস্, ঘণ্টা বাজার আগে বক্সারকে ঘিরে কোচ যেমন ব্যস্ত থাকে তেমন আচরণ করছে সে। গানারদের সরাসরি নির্দেশ দেব আমি—পার্সোনালি।
বিশেষভাবে হাতে তৈরি পয়েন্ট টু-টু-টু ম্যাগনাম দেয়া হয়েছে স্নাইপারদের, প্রচণ্ড ভেলোসিটি আর স্ট্রাইকিং পাওয়ার নিয়ে ব্যারেল থেকে বেরিয়ে আসবে ছোট হালকা বুলেট। ম্যাচ-গ্রেড অ্যামুনিশন, প্রতিটি রাউন্ড হাতের সযত্ন পরশ দিয়ে পালিশ করা হয়েছে। ইনফ্রারেড টেলিস্কোপিক সাইট তো আছেই, একপলকের ব্যবধানে লেজার সাইটও ব্যবহার করা যাবে, ফলে কি দিনে কি রাতে অস্ত্রটা হয়ে উঠেছে লক্ষ্যভেদে ভীতিকর রকম অব্যর্থ। প্রায় একই সমতল সরলরেখা ধরে সাতশ গজ পর্যন্ত ছুটবে বুলেট। সন্দেহ নেই, মানুষ খুন করার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলো। যাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হবে তাকেই লাগবে শুধু, পাশে দাঁড়ানো কাউকে বা আরোহীদের গায়ে আঁচড়টিও কাটবে না। বুলেট হালকা হলেও, তেড়ে আসা যাড়ের মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে টার্গেট করা লোকটাকে। শরীরের ভেতর ঢুকে বিস্ফোরিত হবে বুলেট, ফলে টার্গেটের পিছনে কেউ থাকলেও তার কোনো ক্ষতি হবে না।
তুমিও যেমন! হাসল পিটার। কথা বলতে চায় ওরা, গুলি করবে না–অন্তত এখুনি করবে না।
তবু মেয়ে মানুষ তো, সাবধান করে দিল কলিন। কি করতে কি করে বসে। আর একটা তো স্রেফ প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।
বন্দুকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরা আর সাউন্ড ইকুইপমেন্ট।
কয়েকজনের কান মুচড়ে দিয়ে এসেছি, ছবি যা তুলবে অস্কার না পেয়ে যায়! হাতঘড়ি দেখল কলিন। যাবার সময় হলো। মহারানীকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক হবে না। হালকাভাবে পিটারের কাঁধ চাপড়ে দিল সে। দেরি কোরো না, স্যার, একসাথে কফি খাব। শান্তভাবে রোদে বেরিয়ে এল পিটার, হাত দুটো কাঁধের ওপর তুলল-তালু খোলা, আঙুলগুলো ছড়ানো।
নিজের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই–শান্ত, নিঃসংকোচ, দৃঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে পিটার। তবু মনে হলো ওর জীবনের দীর্ঘতম পদযাত্রা এটা। বোয়িংয়ের যত কাছে চলে এল ততই সেটা টাওয়ারের মতো উঁচু হতে থাকল, চোখের দৃষ্টি ক্রমশ উঠে গেল আরো ওপরে। ইনগ্রিড ওকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় আসতে বলেছে, কারণটা শুধু এই নয় যে সাথে অস্ত্র রাখতে পারবে না, মুখপাত্রকে আড়ষ্ট এবং অসহায় অবস্থায় পেতে চায় সে। গেস্টাপো কৌশল, জেরা করার সময় তারাও উলঙ্গ করে নিত বন্দীদের। কিন্তু পিটারের বেলায় ইনগ্রিডকে নিরাশ হতে হবে। ওর মধ্যে কোনো আড়ষ্ট ভাব নেই, বুকের ভেতরটা ধুকধুক করলেও চেহারায় তার কোনো ছাপ নেই-বুক টান করে হাঁটছে ও, নিজের মেদহীন পেটা শরীর নিয়ে গর্বিত। চর্বিবহুল, ভুড়ি বিশিষ্ট একটা স্কুল শরীর এই চারশো গজ বয়ে নিয়ে আসতে হলে লজ্জায় মরে যেত পিটার।
অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে, এই সময় সামনের দরজা, ককপিটের ঠিক পিছনে, খুলে গেল। চৌকো ফাঁকাটায় একজন নয়, একটা দলকে দেখা গেল। চারপাশ কুঁচকে চোখ ছোট করল পিটার, ইউনিফর্ম পরা তিনটে মূর্তি-না, চারটে-ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ইউনিফর্ম। দুজন পাইলট, ওদের মাঝখানে একটা নারীমূর্তি। স্টুয়ার্ডেস।
কাঁধে কাঁধে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, ওদের পিছনে আরো একটা মাথা, মনে হলো সোনালি চুল। বাইরে প্রখর রোদ, প্লেনের ভেতর আলো কম, ভালো করে দেখা গেল না।
আরো কাছে এসে দেখল ডানদিকে দাঁড়ানো পাইলটের বেশি, ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা চুল মাথায়, মুখটা গোল। তার মানে কমান্ডার ওয়াটকিংস হবে। যোগ্য লোক, তার সার্ভিস রেকর্ড পড়েছে পিটার। কো-পাইলট আর স্টুয়ার্ডেসের দিকে না তাকিয়ে তাদের পিছন দিকে মনোযোগ দিল ও। কিন্তু খোলা হ্যাচের ঠিক নিচে না দাঁড়াবার আগে মেয়েটা ওকে তার চেহারা দেখার সুযোগ দিল না।
চুল নয় যেন সোনালি, কোমল আগুন। মুখ নয় যেন সূর্যমুখী ফুল। মুগ্ধ বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল পিটার। কমলা রঙের মুখে রোদের পালিশ, সবুজ চোখে কি গভীর সরলতা, পিটারের মনে হলো সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। বিশ্বাসই হতে চায় না মেয়েটা টেরোরিস্টদের একজন।
কথা বলল মেয়েটা, আমি ইনগ্রিড। পিটার ভাবল, কিছু বিষাক্ত ফুল খুব সুন্দর হয়।
আমি ব্রিটিশ আর মার্কিন সরকারের নির্বাচিত নেগোশিয়েটর, বলল পিটার, পাইলটের মাংসল মুখের দিকে তাকাল। তোমার কমান্ডোদের কজন রয়েছে প্লেনে?
কোনো প্রশ্ন নয়! কঠিন সুরে চিৎকার করল ইনগ্রিড, আর ঊরুর সাথে সেঁটে থাকা ডান হাতের চারটে আঙুল সিধে করল সিরিল ওয়াটকিংস, চেহারায় কোনো ভাব ফুটল না।