Site icon BnBoi.Com

গোল্ডেন ফক্স – উইলবার স্মিথ

গোল্ডেন ফক্স - উইলবার স্মিথ

গোল্ডেন ফক্স

১. সূর্যের আলোয় চকচক

গোল্ডেন ফক্স – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : জেসি মেরী কুইয়া

সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠল প্রজাপতির মেঘ; হালকা বাতাস পেয়ে ছড়িয়ে পড়ল গ্রীষ্মের আকাশে। হাজার হাজার বিস্মিত চোখ উপরের দিকে চেয়ে দেখল এগুলোর চলে যাওয়া।

বিশাল জমায়েতের একেবারে সামনের দিকে বসে আছে মেয়েটা, দশ দিন হতে চলল যাকে সে অনুসরণ করছে। শিকারকে পরখ করছে শিকারি, অদ্ভুত এক অন্তরঙ্গতার মাধ্যমে জেনে নিচ্ছে মেয়েটার প্রতিটি পদক্ষেপ আর আচরণ। কোনো কিছু তার মনোযোগ কেড়ে নিলে কেমন করে সে মুখ ঘুরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়, কান পেতে কিছু শুনতে চায়, বিরক্তি কিংবা অধৈর্য হলে মাথা ঝাঁকিয়ে কিভাবে তা দূর করে দেয়। এবারে তো একেবারে নতুন এক ভঙ্গিমায় মুখ তুলে তাকালো পাখনাওয়ালা মেঘখানার দিকে। এতদূর থেকেও সে ঠিকই দেখতে পেল মেয়েটার উজ্জ্বল দাঁতের মারি আর বিস্ময়ে ‘ও’ হয়ে উঠা নরম ঠোঁটদুটো।

সামনের উঁচু মঞ্চে সাদা সাটিনের শার্ট পরা লোকটা হাতে আরেকটা বাক্স নিয়ে হেসে ফেলল। নাড়া দিতেই বের হয়ে উঠল আরো এক ঝাঁক রঙীন পাখা। হলুদ, সাদা আর অসংখ্য রঙ দেখে সকলের দমবন্ধ হয়ে উঠার যোগাড়। সমস্বরে শোনা গেল “উহুহু”।

গোত্তা খেয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে নিচে নেমে এলো একটা প্রজাপতি। শত শত হাত এগিয়ে এলো ছোঁয়ার জন্যে। কিন্তু কেন যেন এটি বেছে নিল মেয়েটার-ই মুখ। সকলের গুঞ্জন ছাপিয়েও কানে এলো মেয়েটার হাসি। আপন মনে সে। ও হেসে ফেলল।

কপালে হাত দিয়ে খুব সাবধানে দু’হাতের মাঝে প্রতাপতিটাকে নিয়ে নিল মেয়েটা। খানিক তাকিয়ে রইল মুগ্ধ হয়ে। নীলরঙা ওই জোড়া চোখ ভালোভাবেই চেনে সে। হঠাৎ করেই সতৃষ্ণভাবে নড়ে উঠল ঠোঁট দুটো। ফিসফিস করে কিছু বলে উঠল মেয়েটা, কিন্তু শব্দগুলো তার শোনা হল না।

মন খারাপ ভাব কেটে গিয়ে হাসি ফুটল ওই চমৎকার ঠোঁটে। বৃদ্ধাঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার উপর দুই হাত তুলে ধরল মেয়েটা।

দ্বিধায় পড়ে গেল প্রজাপতি। খানিক মেয়েটার আঙুলের ডগায় অপেক্ষা করে অবশেষে উড়ে গেল। শুনতে পেল মেয়েটার কণ্ঠ। “উড়ে যাও! আমার জন্য উড়ে যাও।” একইভাবে সকলেই চিৎকার করে উঠল, “উড়ে যাও! শান্তির জন্য উড়ে যাও!”

খানিকক্ষণের জন্য সকলের মনোযোগ কেড়ে নিল মেয়েটা। মঞ্চের মাঝখানে থাকা সুসজ্জিত লোকটাকে ছাপিয়ে সবার দৃষ্টি এখন ওর উপর।

লম্বা আর নমনীয় গড়নের নগ্ন পাগুলো রোদে পুড়ে, স্বাস্থ্যের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আধুনিককালের ফ্যাশন অনুযায়ী পরে আছে সাদা লেসঅলা খাটো স্কার্ট।

এটা এমন এক মুহূর্ত মনে হল যেন পুরো প্রজন্মের সামনে মহিমান্বিত হয়ে উঠল মেয়েটা। ও’র চারপাশে থাকা সকলের মাঝে এই বন্য আর মুক্ত উদ্দীপনার বোধটুকু অনুভব করল ছেলেটা। এমনকি মঞ্চের উপর থাকা লোকটা’ও সামনের দিকে ঝুঁকে এলো মেয়েটাকে আরো ভালোভাবে দেখার জন্য। মনে হল মৌমাছি কামড়ে দিয়েছে এমন মোটা কালশিরা পড়া ঠোঁটে হেসে, লোকটাও চিৎকার করে উঠল : “শান্তি!” মঞ্চের দু’পাশে উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা এম্পিফায়ারে ধাক্কা খেয়ে অসম্ভব জোরে শোনা গেল সেই শব্দ।

হাত থেকে উড়ে গেল প্রজাপতিটা আর সবকয়টি আঙুল ঠোঁটের উপর এনে কিস ছুঁড়ে দিল মেয়েটা। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল রঙিন প্রজাপতি। মিশে গেল ভিড়ের মাঝে। মেয়েটা ঘাসের উপর বসে পড়ল আবারো। কাছাকাছি বসে থাকা অন্যেরা এগিয়ে এলো ওকে ছুঁয়ে দেখতে, জড়িয়ে ধরতে।

মঞ্চের উপর দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে সবাইকে নীরব হতে বলল মাইক জ্যাগার। এরপর কথা বলে উঠল মাইক্রোফোনে। কিন্তু ভালোভাবে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। উচ্চারণও এতটা মোটা আর দুর্বোধ্য যে দর্শকেরা বোধ হয় কিছুই বুঝলো না, উন্মত্ত এক সাপ্তাহিক পার্টির সময়ে মাত্র কয়েক দিন আগেই সুইমিং পুলে ডুবে মারা যাওয়া তার ব্যান্ডের সদস্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পড়া শোক গাথা।

সকলের ফিসফিসানি শুনে জানা গেল পানিতে নামার সময় নেশায় পুরো কুঁদ হয়েছিল মৃত লোকটা। তবে এটা ছিল বীরের ন্যায় মৃত্যু, কেননা এখন সময়ই হল মুক্তি, শান্তি, যৌবনের স্বাদ নেয়া আর নেশায় মত্ত হয়ে উঠা।

বক্তৃতা শেষ করল জ্যাগার। বেশ সংক্ষিপ্তই হল বলা চলে, তাই জমায়েতের উজ্জ্বল ভাবটুকু রয়েই গেল। ইলেকট্রিক গিটার বাজিয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে “হঙ্কি টঙ্ক উইমেন” গেয়ে উঠল জ্যাগার। সেকেন্ডের মাঝে তার সাথে দৌড়াতে লাগল হাজার হাজার হৃদপিণ্ডের গতি, শত শত তরুণ দেহ নড়ে উঠল, আর এর দ্বিগুণ হাত উঠে গেল মাথার উপরে। ঠিক যেন বাতাসে দুলছে কোনো গমের ক্ষেত।

সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণের মতো তিক্ত হয়ে কানে বাজতে লাগল সেই সুর। মনে হল যেন খুলি ভেদ করে ঢুকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে সবকিছু। খুব দ্রুত সকলেই হয়ে পড়ল এক বিশাল পোকার মত। এক সাথে দুলছে আর মাঝে থেকে উড়ছে ধুলা আর ঘামের গন্ধ। ক্যানাবিসের অসুস্থ করে দেয়া বোটকা ধোয়া।

এত সব কিছুর ভিড়েও বিচ্ছিন্ন হয়ে একাই দাঁড়িয়ে আছে সে। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেয়েটাকে, অপেক্ষা করছে কিভাবে তার মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছে।

আদিম এক মূৰ্ছনায় আপ্লুত হয়ে নাচছে মেয়েটা। অন্যরকম এক সৌন্দর্য তাকে আলাদা করে রেখেছে চারপাশের অন্যদের কাছ থেকে। মাথার উপর চুড়া করে বেঁধে রাখা চুলগুলো রুবির মতো লাল আভা ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো পেয়ে। কয়েক গোছা আবার পেচিয়ে নেমে এসেছে ঘাড়ের উপর, আর এর উপর বসানো মুখখানা ঠিক যেন বৃন্তে ফোঁটা টিউলিপ।

মঞ্চের ঠিক নিচেই খানিকাটা জায়গা ঘেরা দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ অতিথিদের জন্য। এখানেই অন্যান্য স্ত্রী আর ক্যাম্পের লোকদের সাথে ভোলা কাফতান গায়ে নগ্ন পায়ে বসে আছে মেরিয়ান ফেইথফুল। বহুদূরের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে এই নারীকে। অন্ধ কারো মতই স্বপ্নীল আর দৃষ্টিহীন চোখ, স্থির-ধীর পদক্ষেপ। পায়ের কাছে বসে আছে। ছেলে-মেয়ের দল। আর সবাইকে পাহারা দিচ্ছে হেল’স এনজেলেস এর পদাতিক সৈন্যদল।

মাথায় কালো স্টিলের হেলমেট, ঝুলছে চেইন আর নাৎসি আয়রন ক্রস, রুপার পাতে মোড়া কালো চামড়ার দেহবর্মের নিচ দিয়েও দেখা যাচ্ছে বুকের কোকড়ানো পশম। পায়ে স্টিলের বুট, হাত জুড়ে আঁকি-ঝুঁকি আকা। অসংখ্য ট্যাটু। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ফলে ভঙ্গিতে ফুটে রয়েছে যুদ্ধের ভাব। মুষ্টিবদ্ধ হাতের মুষ্টিতে ধারালো আর চোখা স্টিলের আংটি। উদ্ধত আক্রোশে সবার উপর নজর বুলিয়ে ঝামেলা খুঁজলো সৈন্যের দল। আসলে তা আশাও করল।

ঘণ্টা পার হয়ে গেল; তবুও থামল না গান। কেটে গেল আরো এক ঘণ্টা। গরম হয়ে উঠল চারপাশ। পশুর খাঁচার মতো গন্ধ বের হতে লাগল। দর্শকদের মাঝে কয়েকজন তো এই উন্মাদনার কোনো কিছুই মিস্ করতে চায় না। নারী আর পুরুষ সবাই আছে এ দলে। কেউ কেউ তাই নিজেদের জায়গাতেই মূত্র থলি খালি করে দিল।

অবশেষে বিরক্ত হয়ে উঠল সে। বন্য উন্মত্ততা আর এই সবকিছুতে আঘাত পেল তার বিশ্বাসের গোড়ায়। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল, মাথা ব্যথ্য শুরু হল। গিটারের তালে তালে দপদপ করে উঠতে চাইল মন। নাহ্ যাবার সময় হয়েছে। আরো একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। কখনোই আসেনি এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতে কেটে গেল আরেকটা দিন। যাই হোক, শিকারীর মতই ধৈর্যশীল সে। আরো দিন আসবে, কোনো তাড়াহুড়া নেই। তবে মুহূর্তটুকু হতে হবে তার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

চলতে শুরু করল। এতক্ষণ সকলের ভিড়ে, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিচু টিবি পার হয়ে এলো। কিন্তু সকলে এতটাই সম্মোহিত হয়ে আছে যে কেউই তাকে খেয়াল করল না।

একবার পেছন ফিরে তাকাতেই সরু হয়ে উঠল চোখ জোড়া। দেখতে পেল পাশে বসে থাকা ছেলেটার সাথে হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে কথা বলছে মেয়েটা। একটু পরে আবার উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটাও হাঁটতে শুরু করল। ভিড়ের মাঝে দিয়ে সারি সারি আসন পার হয়ে কারো কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় পদক্ষেপে এগোতে লাগল। কখনো কখনো হাসিমাখা মুখে ক্ষমাও চাইল।

পথ বদলে ফেলল সে। ঢালু পার হয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। শিকারীর সহজাত বোধ মনে জানান দিয়ে গেল যে অপ্রত্যাশিতভাবেই এসে গেছে তার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত।

মঞ্চের পেছনে দোতলা বাসের মতো সারির পর সারি কেবল টেলিভিশন ট্রাক। এত কাছাকাছি পার্ক করে রাখা হয়েছে যে ইঞ্চিখানেকের মতো ফাঁক একেকটার মাঝখানে।

পিছিয়ে এলো মেয়েটা। নিচু বেড়া ডিঙিয়ে মঞ্চের পাশ দিয়ে চেষ্টা করল ভিড় থেকে সরে যেতে। কিন্তু আবারো থেমে যেতে হল। চারপাশে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে উঠে পথ খুঁজতে লাগল।

হঠাৎ করেই সোজা বেড়ার দিকে এগিয়ে এসে অ্যাথলেটদের মতো করে লাফ দিল। পড়ল গিয়ে দুটো উঁচু টেলিভিশন ট্রাকের মাঝখানে। হেলস্ এনজেলস’দের একজন দেখল নিষিদ্ধ এলাকায় মেয়েটার চলে যাওয়া। চিৎকার করে দৌড়ে চাইল পিছু নিতে। কাঁধ বাঁকিয়ে চেষ্টা করল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মেয়েটার দিকে যেতে। লোকটা একবার ঘুরতেই মুখে হাসির ঝলক দেখতে পেল সে।

মেয়েটা যেদিক দিয়ে চলে গেছে বেড়ার সে অংশ দিয়ে যাবার জন্য প্রায় দুই মিনিট যুদ্ধ করতে হল। কে যেন দৌড়ে এলে তাকে থামাতে। কিন্তু লোকটার হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে পার্ক করা উঁচু স্টিলের ট্রাকগুলোর মাঝখানে নেমে পড়ল।

একপাশে কাত হয়ে চলতে হচ্ছে। জায়গাটা এতটাই সংকীর্ণ যে কাঁধ ঠেকে যাচ্ছে। আর সামনেই চিৎকার আওয়াজ শুনতে পেল যখন, ততক্ষণে ডাইভারের ক্যাবের দরজা বরাবর চলে এসেছে। মরিয়া হয়ে দৌড় লাগালো সে। বনেটের পাশে এসে মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে রইল সামনের দৃশ্য দেখে।

হেলস্ এনজেলস এর লোকটা ট্রাকের সামনের অংশে মেয়েটাকে চেপে ধরে রেখেছে। মেয়েটার এক হাত পিছমোড়া করে কাঁধের সাথে লেপ্টে আছে। দু’জনে মুখোমুখি, কিন্তু নিজের কোমর আর বিশাল পেট দিয়ে মেয়েটাকে স্টিলের গায়ে ঠেসে ধরেছে লোকটা। সে বুঝতে পারল কী ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটার পিঠ বেঁকে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে একপাশ থেকে অন্যপাশে মাথা নাড়াচ্ছে কেবল। হাসতে হাসতে খোলা মুখ নিয়ে লোকটা এগোতে চাইছে মেয়েটার মুখের কাছে।

ডান হাত দিয়ে মেয়েটার ছোট্ট স্কার্ট তুলে ফেলেছে কোমর অব্দি। মোটর সাইকেলের কালি লাগানো লোমশ হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটার কোমরের প্যান্টিতে। সন্ত্রস্ত মেয়েটা মুক্ত হাত দিয়ে লোকটাকে আঁচড় কাটতে চাইলেও কাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে বর্বরের মতো হাসছে লোকটা।

সামনে এগিয়ে এনজেলস সৈন্যটার কাঁধে হাত রাখল সে। সাথে সাথে যেন জমে গেল লোকটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জ্বলে উঠল চোখ জোড়া। মেয়েটাকে এত জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল যে ট্রাকের মাঝখানে ঘাসের উপর টলতে টলতে পড়ে গেল বেচারি। বেল্টের সাথে ঝুলতে থাকা লাঠির দিকে হাত বাড়াল এনজেলস্।

এগিয়ে এসে লোকটার স্টিলের হেলমেটের ঠিক নিচে কানের উপর হাত রাখল সে। দুই আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই শক্ত হয়ে গেল এনজেল। সমস্ত পেশি অসাড় হয়ে গলা দিয়ে ঘরঘর শব্দ বের হতে লাগল। পুরো শরীর দুলতে দুলতে মাটির উপর পড়ে মৃগী রোগীর মতো খিচুনি শুরু হয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে নিজের বেশ-বাশ ঠিক করে নিল মেয়েটা। আর নগ্ন ভয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল সবকিছু। লোকটাকে ডিঙিয়ে মেয়েটার কাছে এসে ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে।

“এসো” নরম সুরে জানালো,

নয়তো ওর বন্ধুরা এসে পড়বে।”

হাত ধরে দ্রুত মেয়েটাকে নিয়ে চলল সে আর শিশুর মতই ভরসায় এগোতে লাগল মেয়েটাও।

পার্ক করে রাখা ট্রাকগুলোর পেছনে রডোডেনড্রন ঝোঁপের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা গলি। এবারে পথে নেমে দমবন্ধের মতো করে মেয়েটা জানতে চাইল, “তুমি তাকে মেরে ফেলেছ?”

“না।” সে একবারের জন্য তাকালো না পর্যন্ত, “পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার সিধে হয়ে যাবে।

“তুমি তাকে একেবারে চ্যাপ্টা করে দিয়েছ। কিভাবে করলে? আঘাতও তো করোনি?”

উত্তর না দিয়ে মোড় ঘুরে থেমে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে বলল,

“তুমি ঠিক আছে?” কোনো কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।

এখনো হাত ধরে আছে দু’জনে। মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখে নিল সে। জানে চব্বিশ বছর বয়সী মেয়েটা এইমাত্র ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে এসেছে অথচ গাঢ় নীল চোখের দৃষ্টিতে তার কোনো ছায়াই নেই। নেই কোনো কান্না কিংবা যন্ত্রণা, এমনকি গোলাপি ঠোঁট জোড়া একটুও কাঁপছে না, হাত দু’টোও নরম আর উষ্ণ।

মেয়েটার উপর লেখা মনোবিজ্ঞানীর রিপোর্ট যেটা সে পড়ে এসেছে এ পর্যন্ত খাপে খাপে মিলে গেছে। এরই মাঝে নিজেকে সামলে নিয়েছে আত্মবিশ্বাসী মেয়েটা। এরপরই আস্তে আস্তে রং জমল মেয়েটার গালে। লম্বা গলার নিচে শ্বাস হয়ে উঠল সন্দিহান।

“তোমার নাম কি?” জানতে চাইল মেয়েটা; গভীরতা নিয়ে তাকাল তার দিকে যা অন্য নারীদের চোখেও দেখেছে।

“রামোন।” উত্তরে জানাল সে।

“রামোন” নরম সুরে মেয়েটা ওর নাম বলতেই মনে হল হা ঈশ্বর, ও কত সুন্দর!

“রামোন কে?”

“যদি বলি তুমি বিশ্বাস করবে না।” ছেলেটার ইংরেজি ওর মতই নিখুঁত। বিদেশি হলেও কণ্ঠস্বর সুন্দর, গভীর আর সাহসী মুখশ্রীর সাথে পুরোপুরি মানিয়ে গেছে।

“বলে দেখো একবার।” নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল মেয়েটা।

“রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” গানের মতো করে বলে উঠল ছেলেটা। অসম্ভব রোমান্টিক লাগল পুরো ব্যাপারটা। এত সুন্দর নাম আর কণ্ঠ মনে হল আর কখনো শুনেনি সে।

“আমাদের যাওয়া উচিত।” এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা।

“আমি দৌড়াতে পারি না।”

“তা না করলে একটু পরে দেখবে মোটর সাইকেলে ঝুলে যাবে মাসকটের মত।”

হাসতে হাসতেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে থামাল মেয়েটা। “এরকম করো না। আমাকে আর হাসিও না। আমার ব্লাডার খালি করতে হবে। সহ্য করতে পারছি না।”

“আহ তাহলে তুমি সেখানেই যাচ্ছিলে যখন প্রিন্স চার্মিং তোমার সাথে ভালোবাসার খেলা খেলতে এসেছিল।”

“দেখ, সাবধান করে দিচ্ছি।” বহুকষ্টে নিজের হাসি থামাল মেয়েটা।

“পার্কের গেইটের কাছে পাবলিক টয়লেট আছে। এতদূর যেতে পারবে?”

“জানি না।”

“তাহলে বাকি আছে রডোডেনড্রন।”

“না, ধন্যবাদ। আর কোনো শো হবে না আজ।”

“তাহলে চল।” মেয়েটার হাত ধরল রামোন।

আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে চলতে চলতে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “তোমার বয়ফ্রেন্ডের রাগ বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোনো দেখা নেই।”

“হুম, সেটাই। আমি তো ভেবেছিলাম তোমার সেই কৌশলটা আবার দেখব। আর কতদূর বাকি?”

“এইতো এসে গেছে।” গেইটের কাছে পৌঁছাতেই রামোনের হাত ছেড়ে দিয়ে লাল ইটের ছোট্ট দালানটার দিকে দৌড় দিল মেয়েটা। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল।

“আমার নাম ইসাবেলা। ইসাবেলা কোর্টনি। কিন্তু বন্ধুরা ডাকে বেলা। কাঁধের উপর দিয়ে কথা কটা ছুঁড়ে দিয়ে ঢুকে গেল বেলা।

হ্যাঁ, আমি জানি। মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে উঠল রামোন।

এতদূর থেকেও কানে আসছে গানের শব্দ; নিচু দিয়ে উড়ে গেল একটা হেলিকপ্টার। কিন্তু এসব কিছুই কোনো গুরুত্ব পেল না। রামোনের কথাই ভাবছে বেলা।

হাত ধুতে গিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখল নিজেকে। সব চুল এলোমেলো; তাড়াতাড়ি ঠিক করে নিল। রামোনের চুলগুলো ঘন, কালো আর ঢেউ খেলানো। লম্বা, কিন্তু ততবেশি না। লেপ্টে যাওয়া গোলাপি লিপস্টিক মুছে নিয়ে মুখে আবারো হাত বুলালো। রামোনের মুখখানা বেশ পুরুষালি, নরম কিন্তু শক্তিশালী।

লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নার কাছে ঝুঁকে দেখল নিজের চোখ জোড়া। সাদা অংশটুকু এতটাই পরিষ্কার যে নীলচে দেখায়। জানে তার সৌন্দর্যের সেরা অংশ এটাই। কর্নফ্লাওয়ার আর স্যাপায়ারের মাঝামাঝি এই কোর্টনি র। রামোনের চোখ জোড়া সবুজ। প্রথম দেখাতে সেদিকেই চোখ যায়। এই অদ্ভুত সবুজ-সুন্দর কিন্তু; সঠিক উপমা খুঁজে পাচ্ছে না, সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর। হেলস্ এনজেলস্ লোকটার কী হয়েছে সে বর্ণনা না জানতে চাইলেও ওই চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় যে রামোন অসম্ভব ভয়ংকর! ঘাড়ের পিছনে একই সাথে ভয় আর প্রত্যাশার এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে গেল। হয়ত, এই-ই সেই-ই। ওর পাশে সবাইকেই নিষ্প্রাণ লাগছে। হয়তো এতদিন ধরে রামোনকেই খুঁজছিল সে।

‘রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” নিজের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা। সোজা হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চেষ্টা করল তাড়াহুড়া না করতে। ধীরে ধীরে, লম্বা স্টিলেটো হিল পরা পায়ে কোমর দুলছে চলার ছন্দে।

ঘন পাপড়ি দিয়ে চোখ ঢেকে আস্তে করে বাইরে বের হয়েই জমে গেল

চলে গেছে রামোন। মনে হল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। পাকস্থলীতে যেন পাথর গিলে ফেলেছে ভুল করে। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল। দৌড় দিয়ে সামনে গিয়ে নাম ধরে ডাকল, “রামোন।” ওর দিকে আরো শত শত দেহ এগিয়ে আসছে গানের আসর ছেড়ে; কিন্তু কাক্ষিত সেই অবয়ব কোথায়ও নেই।

“রামোন” ডাকতে ডাকতে এস্তপায়ে গেইটের দিকে এগোল বেলা। বেইজওয়াটার রোড লোকে লোকারণ্য। হন্যে হয়ে ডানে বামে তাকাল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, চলে গেছে। এমনটা আর কখনো হয়নি। রামোনের প্রতি নিজের আগ্রহ দেখিয়েছে বেলা তারপরেও সে চলে গেছে।

ক্ষোভে ফেটে পড়ল মেয়েটা। ইসাবেলা কোর্টনির সাথে এমনটা আর কেউ কখনো করেনি। নিজেকে মনে হল অসম্ভব তুচ্ছ, অপমানে রাগ উঠে গেল।

“ধুত্তোরি, চুলোয় যাক রামোন।”

কিন্তু সেকেন্ড খানেকের মাঝেই রাগ পানি হয়ে গেল। মনে হলো চারপাশ খালি হয়ে গেছে। কেমন এক অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে নিল সবকিছু।

চিৎকার করে বলে উঠল, “ও এমন করতে পারে না। তারপর আবারো। কিন্তু লাভ হল না।

পেছনে হৈ-হল্পা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল তাড়াতাড়ি। একদল হেলস্ এনজেলস এর সৈন্য এগিয়ে আসছে। শ’খানেক গজ দূর থাকলেও সোজা এদিকেই আসছে। এখানে আর থাকা উচিত হবে না।

কনসার্ট শেষ, সবাই যে যার পথে চলে যাচ্ছে। যে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনেছিল সেটা নিশ্চয়ই জাগার আর তার রোলিং স্টোন’কে নিতে এসেছে। বন্ধুদের সাথে দেখা করার এখন আর সুযোগ নেই; এত মানুষের ভিড়ে সবাই হারিয়ে গেছে। নিজের চারপাশে দ্রুত আরেকবার চোখ বুলিয়ে খুঁজে দেখল ঘন ঢেউ খেলানো চুলের রাশি। মাথা ঝাঁকিয়ে চিবুক তুলে আপন মনে বলে উঠল, “কেইবা ওর পথ চেয়ে আছে?” নেমে গেল রাস্তায়।

পেছনে শোনা গেল হুইসেলের শব্দ। এনজেলস্ এর কেউ ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, লেফট, রাইট, লেফট-”

বেলা জানে যে হাইহিলের জন্য কোমর অসম্ভব জোরে দুলছে। জুতা খুলে তাই খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। স্ট্যান্ডে অ্যামব্যাসি কার পার্কের কাছে গাড়ি রেখে এসেছে। তাই ল্যাঙ্কাস্টার গেইট স্টেশন থেকে টিউব ধরতে হবে।

ব্রান্ড নিউ মিনি কুপার চালায় বেলা, একেবারে লেটেস্ট ১৯৬৯ মডেল। জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছে। অ্যান্থনী আর্মস্ট্রং এর মিনি যেখানে থেকে সাজগোজ করে আনা হয়েছে সেই একই জায়গা থেকে তারটাও আনা হয়েছে।

ছোট্ট ব্যাকসিটে জুতা ছুঁড়ে ফেলে ইঞ্জিন চালু করল বেলা। টায়ারের ঘর্ষণ শোনা গেল-কারপার্কে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলির দিকে তাকিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে পৈশাচিক উল্লাস ফুটে উঠল ওর চোখ মুখে। ইচ্ছে মতো গাড়ি চালাতে লাগল মেয়েটা। মেট্রোপলিটান পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গেল-ডিপ্লোমেটিক প্লেট নাম্বার থাকায়। ড্যাডিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

হাইভেল্ড পর্যন্ত আসতে নিজের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ফেলল বেলা। পৌঁছালো চেলসি’তে অ্যাম্বাস্যাডরস রেসিডেন্সে প্রবেশ পথে পার্ক করে রাখা আছে ড্যাডির অফিসিয়াল বেন্টলি। শফার ক্লোনকি ওকে দেখে হেসে স্যালুট করল। কেপ টাউন থেকে নিজের বেশির ভাগ স্টাফ নিয়ে এসেছে ড্যাডি।

নিজেরে মুড সামলে নিয়ে ক্লোনকির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে চাবি ছুঁড়ে মারল বেলা। “আমার গাড়িকে সরিয়ে নিয়ে যাও ডিয়ার ক্লোনকি।” পরিচারকদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ড্যাডি বেশ কড়া। অন্য যে কারো উপর মুড দেখাতে পারলেও ওদের উপর নয়। ড্যাডির মতে, “ওরা পরিবারেরই অংশ বেলা।” আর তাদের বেশির ভাগই আসলে উত্তমাশা অন্তরীপে পারিবারিক আবাস ওয়েন্টেড্রেডেনে ওর জন্মের আগে থেকেই আছে।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে বাগানের দিকে বানানো স্টাডির ডেস্কে বসে আছে ড্যাডি। কোট-টাই খুলে রেখেছে আর ডেস্কের উপর ছড়িয়ে আছে অফিসিয়াল ডকুমেন্টস্। তারপরেও মেয়েকে ঢুকতে দেখে কলম নামিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে তাকাল বেলার দিকে। খুশি হয়ে উঠলেন সন্তানের আগমনে।

বাবার কোলে ধপ করে বসে পড়ে কি করল বেলা। “ঈশ্বর, এ পৃথিবীতে তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই।” হেসে ফেললেন শাসা কোর্টনি। “কেন বল তো?”

“পুরুষেরা হয় বিরক্তিকর নয়তো শুয়োের। তবে তুমি ছাড়া। “আহ্! আর রজারই বা কী করল যে ক্ষেপে গেছ? আমার তো তাকে একেবারে খারাপ লাগে না।”

কনর্সাটে যাবার সময় ওকে পাহারা দিয়েছিল ব্লজার। তবে মঞ্চের সামনের ভিড়ের মাঝেই তাকে রেখে এসেছে বেলা। এতক্ষণে মাত্র মনে পড়ল ওর কথা। “জীবনেও আমি আর কোনো ব্যাটা ছেলের পাশে যাচ্ছি না।” ঘোষণা করল ইসাবেলা। “হয়ত কোনো সন্ন্যাসিনীদের আশ্রয়ে চলে যাব।”

“স্বর্গীয় এই আদেশ কি কাল পর্যন্ত বলবৎ করা যায়? আজ সন্ধ্যায় ডিনারে আমার এক অতিথি আসছেন অথচ এখন পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি।”

“হয়ে গেছে, বহু আগেই। আমি কনর্সাটে যাবার আগেই সব ঠিক করে গেছি।”

“মেনু?”

“আমি আর শেফ মিলে গত শুক্রবারেই তা ঠিক করে রেখেছি। ভয় পেও না পাপা। সব তোমার পছন্দের খাবার : কোকুইলিস সেইন্ট জ্যাকস আর ক্যামডি থেকে ল্যাম্ব।” কারু’তে নিজের ফামের ল্যাম্বই কেবল পরিবেশন করেন শাসা। মরুভূমির ঝোঁপ ঝাড়ে পালিত হওয়ায় অন্যরকম এক স্বাদ আসে ভেড়ার মাংসে। অ্যামব্যাসিতে গরুর মাংস আসে রোডেশিয়াতে তার র‍্যাঞ্চ থেকে। আর ওয়াইন আসে ওয়েন্টেড্রেডেনের আঙ্গুর ক্ষেত থেকে। সেখানে গত বিশ বছর ধরে তার জার্মান ওয়াইনমেকার অসম্ভব অধ্যবসায় আর নিখুঁত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে এর গুণ। তার উচ্চাকাঙ্খা হলো এমন এক ওয়াইন তৈরি যা কোতে ডি.আর.এর সাথে টেক্কা দিতে পারবে।

আর এসব কিছুর বহন কার্যে উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে লন্ডন পর্যন্ত কোর্টনি শিপিং লাইন চালু রেখেছে সাপ্তাহিক রেফ্রিজারেটেড নৌ-যান চলাচল করে আটলান্টিক রুটে।

.. আর আজ সকালেই ক্লিনারস এর কাছ থেকে তোমার ডিনার জ্যাকেট নিয়ে এসেছি। এছাড়াও পিকাডেলি আর্কেডে আরো তিনটা ড্রেস শার্টের অর্ডার দিয়েছি সাথে ডজনখানেক নতুন পট্টি।”

বাবার কোলে বসেই চোখের উপর পট্টিটা ঠিক করে দিল বেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইটালি’র বিপক্ষে আবিসিনিয়াতে হারিকেন চালানোর সময় বাম চোখ হারিয়েছেন শাসা। আর এখন তো চোখের উপর কালো সিল্কের পট্টিটা এক ধরনের জলদস্যুর ভাব এনে দিয়েছে চেহারাতে।

নিশ্চিন্ত হলেন শাসা। প্রথম বার বেলা’কে যেবার নিজের সাথে লন্ডনে আসার কথা জানিয়েছিলেন মেয়েটার বয়স তখন মাত্র একুশ। এত কম বয়সী কারো উপর অ্যামব্যাসি’র ঘরকন্নার ভার দেবার আগে বিস্তর ভেবেছেনও। তবে এখন আর চিন্তার কিছু নেই। মোটের উপর দাদীমা’র হাতে শিক্ষা পেয়েছে বেলা। এর সাথে আবার শেফু, বাটলারসহ স্টাফদের অর্ধেকই এসেছে কেপ থেকে। তাই সুপ্রশিক্ষিত দল নিয়েই জীবন শুরু হয়েছে এখানে।

“ডিনারের পর আধা ঘণ্টা ধরে যখন তোমার ইসরায়েলি বন্ধুকে নিয়ে অ্যাটম বোমা বানাবার প্ল্যান করবে, তখন থাকব তোমার সাথে?”

“বেলা!” তাড়াতাড়ি প্রাকটি করে উঠলেন শাসা, “তুমি জানো আমি এরকম মন্তব্য পছন্দ করি না।”

“মজা করেছি, ড্যাডি। কেউ তো আমাদের কথা শুনছে না।”

“যতই একা থাকো কিংবা মজা করো, বেলা।” জোরে জোরে মাথা নাড়লেন শাসা। সত্যির খুব কাছে চলে গেছে মেয়েটা। মনটা তাই খচখচ করছে। ইসরায়েলি মিলিটারি অ্যাটাশে আর শাসা প্রায় বছরখানেক ধরে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। আর এখন তো একেবারে মজার ঊর্ধ্বে চলে গেছে এ সম্পর্ক।

গালে কিস্ করতেই নরম হয়ে গেলেন শাসা। “যাই, স্নান করে নেই।” কোল থেকে নেমে দাঁড়াল বেলা। “সাড়ে আটটায় তোমার নিমন্ত্রণ। আমি এসে তোমার টাই বেঁধে দিব।” ইসাবেলা’র ধারণা বাবা এই কাজটা পারে না, অথচ তার আগে চল্লিশ বছর ধরে নিজেই টাই বেঁধেছেন শাসা। এবারে মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “মাদমোয়াডেলে তোমার স্কার্ট যদি আরেকটু খাটো হয় তাহলে তো খবর হয়ে যাবে।”

“আহা। আঠারো শতকের বাবাদের মতো কথা বলো না তো পাপা।” দরজার দিকে এগিয়ে গেল বেলা। দরজা বন্ধ হতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন শাসা।

“ফিউজ বিহীন ডিনামাইট নিয়ে বাস করছি যেন।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন, “যাই হোক হয়তো ভালই হচ্ছে যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”

সেপ্টেম্বর মাসে, শাসা’র তিন বছরে কূটনৈতিক দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। আবারো দাদি সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এর নিয়ম নীতির ঘেরাটোপে ফিরে যাবে বেলা। এ ব্যাপারে নিজের সফলতা যে বিফলে গিয়েছে তা ভালই বুঝতে পেরেছেন শাসা; তাই খুশি মনেই দায়িত্ব হস্তান্তরে কোন আপত্তি নেই।

কেপ টাউনে ফেরার কথা ভাবতে ভাবতেই ডেস্কের কাহজে চোখ ফেরালেন শাসা। লন্ডন অ্যামব্যাসিতে কাটানো বছরগুলো তার জন্য রাজনৈতিক প্রায়শ্চিত্তের মত। ১৯৬৬ সালে গুপ্তঘাতকের হাতে প্রধানমন্ত্রী হেনড্রিক ভারউড এর মৃত্যুর পর বেশ বড় একটা ভুল করে বসেন শাসা আর ভুল লোকটাকে সাহায্য করেছেন এই সর্বোচ্চ পদ পাবার জন্য। এই ভুলের মাশুলস্বরূপ জন ভর্সটার প্রধানমন্ত্রী হবার সাথে সাথে শাসা’কে ছুঁড়ে ফেলা হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থায়। কিন্তু অতীতের অনেক সময়ের মতো এবারেও বিপর্যয়কে বিজয়ে পরিণত করেছেন তিনি।

নিজের সমস্ত মেধা আর ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা, নিজের উপস্থিতি আর সৌন্দর্য, প্ররোচিত করার ক্ষমতা প্রভৃতির মাধ্যমে মাতৃভূমিকে পৃথিবীর রোষানল থেকে বাঁচাতে পেরেছেন। বিশেষ করে ব্রিটেনের লেবার গর্ভনমেন্ট আর তার কমনওয়েলথ এর হাত থেকে; যেটির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগেরই প্রধান কোনো কৃষাঙ্গ কিংবা এশীয়। এসব অর্জনকেই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন জন ভরসটার। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়ার আগে, আর্মসকোর এর সাথে বেশ জড়িয়ে পড়েছিলেন শাসা আর ভরসটার তাই গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর আর্মসকোরের চেয়ারম্যানের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন তাকে।

সহজভাবে বলতে গেলে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগ হলো আর্মসকোর। আর্মস বয়কটের বিরুদ্ধে দেশটির উত্তর হলো এ প্রতিষ্ঠান। যা শুরু করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডুওয়াইট আইজেনহাওয়ার আর এখন তা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্য দেশগুলোর মাধ্যমেও যারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিরক্ষাহীন, নাজুক করে ফেলতে চায়। আমর্সকোর অস্ত্র উৎপাদন ও উন্নয়ন কোম্পানি একক ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা পুরো দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প হিসেবে কাজ করছে।

যখন বিভিন্ন কোম্পানি মিলে সুদৃঢ় হয়ে গেছে কোর্টনি ফিনানসিয়াল আর বিজনেস এম্পায়ার, তখন এহেন সিদ্ধান্ত বেশ উত্তেজনাকর আর বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের এই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে ম্যানেজমেন্টের অনেকটুকুই ধীরে ধীরে ছেলে গ্যারি কোর্টনির হাতে তুলে দিয়েছেন শাসা। একই সাথে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান হবার সময়ে শাসার বয়সও বেশি ছিল না।

এছাড়া গ্যারি, তার দাদিমার প্রত্যক্ষ সমর্থনও পেয়েছে। কাজ করেছে শাসা আর সেনটেইন কোর্টনি এবং গত চল্লিশ বছরে জড়ো করা দক্ষ সব কর্মীর অধীনে।

তবে, এতে করে গ্যারি’র অর্জনকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিশেষ করে যেভাবে সে সম্প্রতি জোহানেসবার্গ স্টক একচেঞ্জের হ্যাপা সামলেছে। ষাট শতাংশ পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল শেয়ারের দাম। এই কৃতিত্ব শাসা কিংবা সেনটেইনের নয়, পুরোটাই গ্যারি’র। তাই ধ্বংস হওয়া তো দূরে থাক কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ এই ধাক্কা সামলে উঠে হয়ে উঠেছে আরো শক্তিশালী আর নগদ অর্থের ভাণ্ডার। একই সাথে মার্কেটে দর কষাকষির জন্য সুবিধাজনক অবস্থাতেও আছে।

নাহ হেসে ফেলে মাথা নাড়লেন শাসা-গ্যারি আসলেই কাজ করছে। তারপরেও এখনো শাসা বেশ তরুণই বলা চলে। বয়স পঞ্চাশের উপর যায়নি। তাই আমসকোর এর চাকরি পুরোপুরি যুৎসই হয়েছে তার জন্য।

কোর্টনি বোর্ডে থাকলেও নিজের বেশির ভাগ সময় আর শক্তি আমসকোর-কেই দেবেন। বেশির ভাগ সাব-কন্ট্রাক্ট কোর্টনি কোম্পানিকে দেয়ার ফলে উভয় এন্টারপ্রাইজেরই লাভ হবে। অন্যদিকে পুঁজিবাদের ফসল কাজে লাগিয়ে দেশপ্রেমকে চাঙ্গা করে তুলতে পারাটা হবে শাসার জন্য বাড়তি পাওনা।

একটু আগেই ইসাবেলা’র মন্তব্যের বিরোধিতা ছিল এই নতুন কাজের সাথে সম্পৃক্ত। নিজের কুটনৈতিক কানেকশন কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলি অ্যামব্যাসিকে প্ররোচিত করেছেন উভয় দেশের মাঝে যৌথ নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট প্রকল্পে। আজ রাতে তেল আভিভে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেক সেট ডকুমেন্টস্ তুলে দেবেন ইসরায়েলি অ্যাটাশের হাতে।

হাত ঘড়িতে চোখ, বোলালেন। ডিনারের জন্য তৈরি হবার আগে এখনো বিশ মিনিট সময় আছে হাতে। সমস্ত মনোযোগ তাই ঢেলে দিলেন সামনে পড়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে।

***

ইসাবেলা’কে গোসল করাতে ছুটে এলো ন্যানি।

“তুমি দেরি করে ফেলেছ, মিস বেলা। এখনো তোমার চুল ঠিক করাও বাকি।” কেপ রঙা ন্যানির রক্তে বইছে হটেনটট বীজ।

“বেশি বকো না তো, ন্যানি।” পাল্টা জবাব দিল ইসাবেলা। কিন্তু ন্যানি ঠিক যেভাবে তার পাঁচ বছর বয়সে করত তেমনিভাবে তাড়িয়ে নিয়ে গেল স্নান করাতে।

চিবুক পর্যন্ত বিলাস বহুল স্টিমিং ফোমে ডুবে গেল ইসাবেলা, ওর কাপড় জড়ো করে নিল ন্যানি। “তোমার পুরো পোশাকে ঘামের দাগ আর নতুন প্যান্টিও ছেঁড়া। কী করেছ?” নিজের হাতে ইসাবেলার সমস্ত অন্তর্বাস পরিষ্কার করে দিল ন্যানি, এক্ষেত্রে লন্দ্রিকে সে এতটুকুও বিশ্বাস করে না।

“আমি একটা হেলস এনজেলের সাথে রাগবি খেলেছি ন্যানি। আমাদের দল জিতে গেছে।”

“তুমি নির্ঘাত কোনো ঝামেলায় পড়বে। সবকটা কোর্টনিরই রক্ত গরম। “ ছেঁড়া প্যান্টি তুলে নিয়ে অসন্তোষে মাথা ঝাঁকাল ন্যানি। “নিরাপদে বিয়ে হবার এখনো বহু দেরি তার আগেই।”

“তোমার মাথা ভর্তি যত্তসব হাবিজাবি চিন্তা। এবার বলো আজ কী কী হলো। ক্লোনকি’র নতুন গার্লফ্রেন্ডের খবর কী?” ইসাবেলা ভালোভাবেই জানে তাকে কিভাবে ভোলাতে হয়।

কূটকচালিতে ওস্তাদ ন্যানি এ সময়টায় ইসাবেলার কাছে পুরো ঘরে কী হয়েছে না হয়েছে সবকিছু সবিস্তারে তুলে ধরে। ওর কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে আবার উৎসাহও দেয় বেলা, কিন্তু বলতে গেলে আজ কিছুই শুনছে না। সাবান লাগানোর জন্য উঠে দাঁড়াতেই নজর গেল রুমের ওপাশে রাখা ফুল নেংথ আয়নার দিকে।

“আমি কী মুটিয়ে যাচ্ছি ন্যানি।”

“তুমি এতটাই শুকনা যে কোনো ছেলে এখনো বিয়ে করছে না।” ঠোঁট বাঁকিয়ে বেড রুমের দিকে চলে গেল ন্যানি।

তারপরেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখল বেলা। শরীরের কোনো অংশে কী কিছু কমতি আছে, কিংবা কিছু কী করতে হবে? নাহ্, মাথা নেড়ে আপন মনেই ভাবলো, সবকিছুই নিখুঁত দেখাচ্ছে। “রোমোন ডি সান্তিয়াগো-ই মাচাদো” ফিসফিস করে উঠল বেলা, “তুমি জানতেও পারলে না যে কী হারালে।” কিন্তু মন খারাপ ভাবটা তবুও কেন কাটছে না।

“তুমি আবারো নিজের সাথে কথা বলছ, লক্ষ্মীটি।” বিছানার চাদরের সমান বাথ টাওয়েল নিয়ে ফিরে এলো ন্যানি। “এবার শেষ করো। সময় নষ্ট হচ্ছে।”

ইসাবেলাকে পুরো ভোয়ালে দিয়ে মুড়ে পেছনটা শক্ত করে ঘসে মুছে ফেলল ন্যানি। বেলা জানে ওকে বলে কোনো লাভ নেই যে এটুকু সে নিজেই পারবে।

“আহ, আস্তে। এত জোরে না।” গত বিশ বছর ধরে একই কথা বলে আসছে বেলা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। “তোমার কতবার বিয়ে হয়েছিল, ন্যানি?”

“তুমি তো জানোই আমি চারবার বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু গির্জাতে একবারই গিয়েছি।” বেলা’কে চেক্ করে মনোযোগ দিয়ে দেখল ন্যানি। “কিন্তু কেন বিয়ে নিয়ে কথা বলছ? মজার কিছু পেয়েছ নাকি? প্যান্টি যে ছিঁড়ে গেল?”

“ছিঃ তুমি এত বাজে কথা বলো না বুড়ি!” অন্যদিকে চোখ সরিয়ে থাই সিল্ক গাউন নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেল বেলা।

হেয়ারব্রাশ নিয়ে মাথায় দিতেই ন্যানি এসে হাজির।

“এটা তো আমার কাজ, লক্ষ্মীটি। দৃঢ়স্বরে ন্যানি জানাতেই ইসাবেলা চুপ করে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল আরামে।

“মাঝে মাঝে মনে হয় আমার একটা বাচচা হলে মন্দ হয় না, তুমি তাহলে আমাকে আর জ্বালাতে পারবে না, ওকে নিয়ে পড়ে থাকবে।”

হাত থেমে গেল ন্যানির। কী শুনছে খানিক ভেবে নিয়ে বলল, “বাচ্চার কথা বলার আগে তো বিয়ে করো।”

জান্দ্রা রোডস এর নকশা করা পোশাকটার রঙ এক অদ্ভুতি স্বর্গীয় মেঘ যেন; এর উপর সিকুইন আর মুক্তোদানার কাজ। এমনকি ন্যানিও মাথা নেড়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল ওর সামনে ঘুরতে থাকা ইসাবেলার দিকে।

শেফ এর সাথে শেষ মিনিটের জরুরি কথা সারতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও আরেকটা কথা মনে পড়ায় হঠাৎ করে থেমে গেল বেলা।

আজকের ডিনার গেস্টদের একজন তো আবার স্প্যানিশ চার্জ-ডি অ্যাফেয়ার্স। তাই সেকেন্ডের মাঝেই টেবিল সাজানোর পরিকল্পনা নতুন করে করে ফেলল।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।” নামটা শোনার সাথে সাথেই মাথা নাড়ল স্প্যানিশ চার্জ। “পুরনো আন্দা রুসিয়ান পরিবার। আমার যতটা মনে পড়ছে গৃহযুদ্ধের পরপরই মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো স্পেন ছেড়ে কিউবা চলে গেছেন। একটা সময়ে দ্বীপের চিনি আর তামাকের উপর বেশ বড় ব্যবসা থাকলেও আমার ধারণা ক্যাস্ট্রো সব পরিবর্তন করে দিয়েছেন।”

একজন মারকুইস-মুতখানেক চুপ করে কী যেন ভাবল। স্প্যানিশ অভিজাত সম্পদ্রায় সম্পর্কে ওর জ্ঞান যৎসামান্য হলেও মনে হল মারকুইস র‍্যাঙ্ক ডিউকের ঠিক নিচেই হবে।

“দ্য মারকুইসা ইসাবেলা ডি-সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো” ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে পড়ে গেল ওই ভয়ংকর সবুজ চোখ জোড়া আর একটুক্ষণের জন্য মনে হলো দমবন্ধ হয়ে যাবে। কণ্ঠের উত্তেজনা চাপাতে না পেরেই জানতে চাইল, “মারকুইস এর বয়স কত?”

“ওহ, এতদিনে কিছুটা তো হয়েছেই। মানে যদি এখনো বেঁচে থাকেন। ষাটের শেষ কিংবা সত্তরে।”

“কোনো পুত্র সন্তান আছে নিশ্চয়ই?”

“আমি আসলে জানি না।” মাথা নাড়লেন চার্জ। “কিন্তু খুঁজে বের করা শক্ত কিছু না। আপনি চাইলে আমি অনুসন্ধান করে দেখব।”

“ওহ্, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” লোকটার বাহুতে হাত রেখে নিজের সবচেয়ে সুন্দর হাসি হাসল বেলা।

মারকুইস হও কিংবা না হও, এত সহজে ইসাবেলা কোর্টনির কাছ থেকে নিস্তার নেই তোমার। ধূর্তের মতো ভাবল মেয়েটা।

***

“প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেল তার কাছে যেতে আর যখন অবশেষে পারলে সাথে সাথে আবার চলে যেতে দিলে।” টেবিলের মাথায় বসে থাকা লোকটা হাতের সিগারেট ঘসে নিভিয়ে ফেলল সামনে রাখা উপচে পড়া অ্যাশট্রেতে। সাথে সাথে আকেরটা জ্বালালো। লোকটার ডান হাতের প্রথম দুটো আঙুলের ডগায় গাঢ় হলুদ দাগ। আর তার্কিশ সিগারেটের ধোয়ায় এরই মাঝে ছোট্ট রুমটাতে নীল রঙা মেঘ জমে গেছে।

“তোমাকে কী এই অর্ডার দেয়া হয়েছিল?” জানতে চাইল লোকটা।

হালকাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল রামোন মাচাদো। মেয়েটার মনোযোগ পাবার জন্য এই একটাই উপায় ছিল। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ছেলেদের সঙ্গ পাওয়া এই মেয়ের কাছে পানি-ভাত। আঙুল তুললেই পুরুষেরা এসে হামলে পড়বে। মনে হয় এবার আমার ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস করবেন।”

“তুমি তাকে চলে যেতে দিয়েছ।” বৃদ্ধ জানে তিনি বারবার একই কথা বলছেন তারপরেও এই ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছে না।

এই তরুণকে সে পছন্দ করে না আর এতটা জানেও না যে বিশ্বাস করবে। এমন নয় যে কখনো তার অধীনস্থদের কাউকে বিশ্বাস করেনি। যাই হোক এই ছেলেটা একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী। অফিসারের চেয়ে নিজের মতই তার কাছে শ্রেয়।

চোখ বন্ধ করে ফেললেন জো সিসেরো। পুরনো ইঞ্জিনে অয়েলের মতই অস্বাচ্ছ আর কালো জোড়া চোখ, কান আর কপালের উপর পড়ে আছে রূপালি সাদা চুল।

“তোমার উপর আদেশ ছিল কনট্যাকট তৈরি করা।”

“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু, আমার উপর, আদেশ ছিল মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করা, পাগলা কুত্তার মতো ওর দিকে ছুটে যাওয়া নয়।

না, জো সিসেরো কিছুতেই তাকে পছন্দ করতে পারছে না। আচরণে ঔদ্ধত আছে; কিন্তু শুধু সেটাই কারণ না। ছেলেটা একটা বিদেশি। রাশান নয় এমন সবাইকেই বিদেশি ভাবেন সিসেরো। আন্তজার্তিক সমাজতন্ত্র যাই বলুক কেন পূর্ব জার্মান, যুগোশ্লাভ, হাঙ্গেরীয়রা, কিউবা আর পোলিশ সকলেই তাঁর কাছে বিদেশি।

মাচাদো শুধু যে বিদেশি তা নয়, ওর পুরো শেকড়ই হচ্ছে দুর্নীগ্রিস্ত। ছেলেটা না কোনো প্রোলাতারিয়েট বংশ থেকে এসেছে, না কোন হতাশাগ্রস্ত বুর্জোয়া পরিবার থেকে। বরঞ্চ ঘৃণ্য সেই সুবিধাভোগী অভিজাত পরিবারেরই সন্তান।

যদিও মাচাদো তার পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কিছু পেতে চায় না, তারপরেও সিসেরো তাকে বিশ্বাস করে না।

মোটের উপর আবার ছেলেটা স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই ফ্যাসিস্ট দেশটা শাসন করেছিল ক্যাথলিক রাজাগণ, যারা ছিল জনগণের শত্রু। এখন তো আরো বেশি। একনায়ক ফ্রাঙ্কো গলা টিপে হত্যা করেছে কম্যুনিস্ট বিপ্লব। নিজেকে তাই ছেলেটা কিউবার সোশালিস্ট হিসেবে দাবি করলেও জো সিসেয়োর কাছে অভিজাততন্ত্রের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

“তুমি তাকে যেতে দিয়েছ।” আবারো জোর দিয়ে একই কথা বললেন। “এই সময় আর অর্থ সবই নষ্ট হয়েছে।” সিসেরো উপলব্ধি করলেন যে, কী পরিমাণ গুরুভার চেপে বসেছে তার উপর। শক্তিও কমে আসছে। অসুস্থতা এরই মাঝে চিন্তা ভাবনাকে ধীর করে দিচ্ছে।

রামোন হেসে ফেলল। আর এই গা জ্বালানো হাসিটা সবচেয়ে অপছন্দ করেন সিসেরো। “মাছের মতই, বরশিতে গেঁথে গেছে মেয়েটা। যতক্ষণ না আমি তীরে তুলে আনছি শুধু সাঁতারই কাটতে থাকবে।”

আবারো নিজের সুপিরিয়রকে খাটো করল ছেলেটা। জো সিসেরো এবারে। সর্বশেষ কারণটা খুঁজে পেলেন তাকে অপছন্দ করার। ছেলেটার তারুণ্য, স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য। ব্যথার মতো মনে পড়ে গেল নিজের নশ্বরতার কথা। মারা যাচ্ছেন জো সিসেরো।

ছোট্ট বেলা থেকেই চেইন স্মোকার সিসেরো এই তার্কিশ সিগারেটগুলো। খেয়ে আসছেন আর অবশেষে শেষবার মস্কো ভ্রমণের সময় ফুসফুসে ক্যান্সার পেয়েছেন ডাক্তারেরা। নিরাময়ের জন্য স্বাস্থ্যসনে ভর্তি হবার কথা জানালেও জো সিসেরো কাজের মাঝে ডুবে থাকার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন। চেয়েছেন নিজের ডিপার্টমেন্ট যোগ্য কোনো উত্তরসূরির হাতে দিয়ে যাবেন। তখন তো জানতেন না যে এই স্প্যানিয়াডটার হাতে দিয়ে যেতে হবে; তাহলে হয়ত স্বাস্থ্য নিবাসকেই বেছে নিতেন।

এখন তো রীতিমতো ক্লান্ত আর নিরুৎসাহ লাগে সবকিছুতে। নিজের শক্তি আর উচ্চাকাক্ষার সব শেষ করে ফেলেছেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে চুলগুলো ছিল ঘন আর কালো। আর এখন অ্যাজমা রোগীর মতো কাশি আর হাঁপানি ছাড়া বারো কদমও চলতে পারেন না।

আজকাল তো প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, ঘামতে ঘামতে অন্ধকারে নিঃশ্বাসের কষ্টের সাথে মনে পড়ে ভয়ংকর সব চিন্তা। সারা জীবন ব্যয় করে দিয়ে কী করলেন তিনি? কী পেলেন? কতটা সফল হলেন?

কেজিবি’র চতুর্থ পরিচালকের দপ্তরে আফ্রিকান ডিপার্টমেন্টে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল। গত দশ বছর ধরে দক্ষিণের হেড হিসেবে কাজ করছেন। আর স্বাভাবিক যে তাঁর এবং ডিপার্টমেন্টের পুরো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই অঞ্চলের দেশ, রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা।

টেবিলে বসে থাকা অন্য লোকটা দক্ষিণ আফ্রিকার। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে থাকলেও এবারে নরম স্বরে বলে উঠল, “আমি বুঝতে পারছি না যে মেয়েটাকে নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার কী। আমাকে বুঝিয়ে বলো।”

টেবিলে বসা শ্বেতাঙ্গ দু’জনেই তার দিকে তাকাল। রালেই তাবাকা যখন কথা বলেন অন্যরা সচরাচর শুধু শোনে। এমন এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য আছে লোকটার মাঝে যে আপনাতেই কৰ্তত্ব এসে যায়।

সারা জীবন ধরেই জো সিসেরো কালো আফ্রিকানদের সাথেই কাজ করে এসেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের নেতারা শুধু জীবন ভর সংগ্রাম করে গেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের সমস্ত ন্যাশনালিস্ট নেতাদেরকেই চেনেন। তারা হলো জোমো কেনিয়া, কেনেথ কুয়ান্তা, কৌমি নাকুমাহ এবং জুলিয়াস নাইরিরি প্রমুখ। কাউকে কাউকে তো বেশ ব্যাক্তিগতভাবে জানেন : শহীদের মৃত্যুবরণ করা মোজেস গামা আর হোয়াইট রেসিজম এর স্বীকার, কারাবাসরত নেলসন ম্যান্ডেলা।

এই কীতির্মান কোম্পানির একেবারে প্রথম স্থান রালেই তাবাকাকে দিয়েছেন সিসেরো। বস্তৃত মোজেস গামার ভাগনে এই রালেই আর দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ যে রাতে গামাকে খুন করেছিল, তখন সেও উপস্থিত ছিল। মোজেস গামা’র বিশাল ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক শক্তির পুরোটাই পেয়েছে। তাবাকা। তাই গামার শূন্য স্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে। ত্রিশ বছর বয়সে স্পিয়ার আব দ্য নেশন এর ডেপুটি ডিরেকটর, দক্ষিণ আফ্রিকা ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখাসহ সিসেরো জানেন যে এ এন সি’র কাউন্সিলেও নিজেকে বহুবার প্রমাণ করেছে তাবাকা।

শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিশ ওই ছোঁকড়াটার চেয়েও তাবাকা’কে সিসেরো বেশি পছন্দ করলেও বুঝতে পারলেন যে বংশ আর রঙের পার্থক্য ছাড়া এরা দু’জনে হল একই ছাচে গড়া মানুষ। শক্ত আর বিপদজনক, মৃত্যু আর সহিংসতা ভালোই জানে, বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো কুশলী। এদের হাতেই নিজের লাগাম দিয়ে যেতে হবে সিসেরোকে আর এই কারণেই তাদেরকে তার এত অপছন্দ। “এই মেয়েটা” ভারী কণ্ঠে জানালেন তিনি, “হতে পারে তুরুপের তাস। যদি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু মারকুইস পুরোটা জানাবে। এটা তার কেস আর সাবজেক্ট নিয়ে সে ভালোই স্টাডি করেছে।

সাথে সাথে রামোন মাচাদো’র হাসি মুছে গিয়ে চোখ জোড়া হয়ে উঠল তীব্র। “আমি আশা করব কমরেড ডিরেকটর এই পদবী আর ব্যবহার করবেন না। এমনকি মজা করেও না।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালো রামোন।

জো সিসেরো বুঝতে পারলেন যে একমাত্র এই পথেই সম্ভব স্প্যানিয়ার্ডটাকে কাবু করা। “মাফ চাইছি, কমরেড।” কপট প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন সিসেরো।” যাই হোক শুরু করে দাও।”

সামনে পড়ে থাকা হালকাভাবে বাঁধা কাগজের তোড়া খুলে ফেলল রামোন মাচাদো। কিন্তু একবারের জন্যও তাকালো না। ভালোভাবেই জানে কী লেখা আছে।

“মেয়েটার কেস নাম দিয়েছি “লাল গোলাপ।” আমাদের মনোবিজ্ঞানী ওর পুরো প্রোফাইল তৈরি করেছে। মূল্যায়নে জানা গেছে এই নারী যে কোন নিখুঁত কাজ পাবার জন্য অসম্ভবভাবে যোগ্য। কাজে লাগাতে পারলে মূল্যবান ফিল্ড অপারেটর হয়ে উঠতে পারবে।”

আরো মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলো রালেই তাবাকা। রামোন খেয়াল করে দেখল যে এ পর্যায়ে ও কোনো প্রশ্ন কিংবা মন্ত ব্য করল না লোকটা। ভালই হল। দুজনে এখন পর্যন্ত একসাথে তেমন কাজ করা হয়নি। এ নিয়ে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ। পরস্পরকে এখনো ওজন করে দেখছে দু’জনেই। “লাল গোলাপকে অনেকভাবেই ব্যবহার করা যাবে। বাবার দিক থেকে মেয়েটা দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ শাসক গোষ্ঠীর সদস্য। ব্রিটেনে দেশের অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে মাত্রই নিজের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন ভদ্রলোক। ফিরে গিয়ে ন্যাশনাল আর্মামেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবার কথা চলছে। ফিন্যান্স, ল্যান্ড আর মাইনের উপরও লোকটার বিশাল প্রভাব আছে। অপেনহেইমার’স আর তাদের অ্যাংলো আমেরিকান কোম্পানির পর দক্ষিণ আফ্রিকাতে সম্ভবত এই পরিবারটিই সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী। এর পাশাপাশি আবার শাসক গোষ্ঠীর একেবারে উচ্চ পর্যায়েও বেশ ভাল জানা শোনা আছে তার। যাই হোক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লাল গোলাপ বলতে অজ্ঞান মেয়েটার বাবা। তাই একটু চেষ্টা করলেই যে কোনো কিছু পেতে পারে এই নারী। এর মাঝে আছে সরকারের যে কোনো পর্যায়ে প্রবেশ থেকে শুরু করে অতি গোপনীয় সব তথ্য বের করে আনা, এমনকি যদি তা আর্মামেন্টস, করপোরেশনে তার নিয়োগ সম্পর্কিতও হয় না কেন।”

মাথা নাড়লেন রালেই তাবাকা। কোর্টনি পরিবারকে চেনেন, তাই এই মূল্যায়নের কোনো খুঁত চোখে পড়ল না। “লাল গোলাপের মায়ের সাথে একবার আমার দেখা হয়েছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা রাজনৈতিকভাবে আমাদের পক্ষেই ছিলেন।” বিড়বিড় করে জানাতেই মাথা নাড়ল রামোন।

“ঠিক তাই, সাত বছর আগে স্ত্রী তারা-র সাথে ডির্ভোস হয়ে গেছে শাসা কোর্টনি’র। ভদ্রমহিলা তো আপনার আংকেল মোজেস গামা’র সহযোগী ছিলেন; হোয়াইট রেসিস্ট পার্লামেন্টে বোমা হামলার সময়ে। যার কারণে শেষ পর্যন্ত কারাবাস আর হত্যার স্বীকার হলেন গামা। এছাড়াও তারা ছিলেন গামা’র মিসট্রেস আর তার বাস্টার্ড ছেলেটার মা। বোমা পরিকল্পনায় ব্যর্থতার পর গামার ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে গেছেন তারা। লন্ডনে থেকে এখন তো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এ এন সি’র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জুনিয়র কোন ব্যাভক আর রুটিন অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দক্ষ কিংবা মানসিকভাবে যোগ্য নন। লন্ডনে এ এন সি পার্সোনেলদের জন্য সেফ হাউজ, মাঝে মাঝে কুরিয়ার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে র‍্যালি আর প্রতিবাদ সভায় সাহায্য করা এই তাঁর কাজ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ হল লাল গোলাপের উপর তার প্রভাব।”

“হ্যাঁ।” অধৈর্যভাবে একমত হলেন রালেই। “আমি এসব কিছুই জানি। বিশেষ করে আমার আংকেলের সাথে তার সম্পর্ক। কিন্তু মেয়ের উপর ভদ্রমহিলার আদতেই কি প্রভাব আছে? মনে তো হয় বাবা কেই মেয়েটা বেশি ভালবাসে।”

আবারো মাথা নাড়ল রামোন। “অবস্থা এখন সেরকমই। কিন্তু মেয়েটার মা ছাড়াও পরিবারে আরো একজন আছেন যিনি প্রগতিবাদী নীতিতে বিশ্বাসী : ভাই মাইকেল, ওর উপর যার বেশ ভালো প্রভাব আছে। এছাড়া আরেকটা পথ আছে ওর মত ঘুরিয়ে নেবার।”

“কী সেটা?” জানতে চাইলেন তাবাকা।

“এগুলোর একটা হল হানি ট্র্যাপ মোহমোয়তার ফাঁদে ফেলা।” এবারে উত্তর দিলেন সিসেরো। “দ্য মারকুইস ক্ষমা চাইছি-এক্ষেত্রে কাজ শুরু করে দিয়েছে কমরেড মাচাদো। তার বহু গুণের একটি হল এই হানি ট্র্যাপ।”

“প্রগ্রেস সম্পর্কে নিয়মিত আমাকে জানাবেন।” নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন রালেই। বাকি দুজনের কেউ কোনো উত্তর দিল না। রালেই তাবাকা এ এন সি’র এক্সিকিউটিভ কিংবা কম্যুনিস্ট পাটির সদস্য হলেও বাকি দুজনের মতো রাশান কেজিবি’র অফিসার নয়।

অন্যদিকে জো সিসেরো কেজিবি’র একজন জ্যেষ্ঠ অফিসার। যদিও কর্নেল থেকে কর্নেল জেনারেল পদোন্নতি নিশ্চিত হয়েছে মাত্র মাসখানেক আগে। সিসেরো’র ধারণা সারা জীবন ব্যাপী ডিপটিমেন্টে বিশ্বস্তভাবে কাজ করার জন্য একেবারে শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এ পদোন্নতি। যেন অবসর জীবনে মোটা অংকের পেনশন ভোগ করতে পারেন।

রামোন মাচাদো’র বিশ্বস্ততার পথ আরো সোজা-সাপ্টা। তার জন্যে আর পারিবারিক পদবী স্প্যানিশ হলেও মা ছিলেন একজন কিউবান নারী। কিউবার হাভানার কাছে মাচাদো এস্টেটে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় রামোনের বাবার সাথে।

স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ে মারকুইস জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্টের বিরোধিতা করেছেন। পারিবারিক পটভূমি আর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ সত্ত্বেও রামোনের পিতা ছিলেন রিপাবলিকান সেনাবাহিনীতে। যোগ দিয়ে মাদ্রিদ অবরোধের সময়ে এক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেয়ার সময় ভদ্রলোক গুরুতরভাবে আহতও হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর ফ্রাঙ্কো শাসনামলের নিগ্রহ আর বঞ্চনা সইতে না পেরে ক্যারিবীয় দ্বীপে পুত্রসহ চলে যাবার মনস্থির করেন- রামোনের মা। কিন্তু ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো’র শাসনামলে অতিবাহিত জীবনের চেয়ে কোনো অংশে শান্তি ছিল না বাতিস্তার এক নায়কতন্ত্রে।

রামোনের মা ছিলেন তরুণ বামপন্থী ছাত্র নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আন্টি ও তার সমর্থক। তাই তিনিও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বাতিস্তা বিরোধী আন্দোলনে। ছোট্ট রামোনও নিজের রাজনৈতিক দীক্ষার পাঠ প্রথম পেয়েছে তার মা ও তার জননন্দিত বোন-পো থেকে।

১৯৫৩ সালের ছাব্বিশে জুলাই সান্তিয়াগো ব্যারাকে সেই দুঃসাহসিক কিন্তু ব্যর্থ আক্রমণের কারণে কারাবন্দি হন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। অন্যান্য বিদ্রোহীর সাথে রামোনের পিতা-মাতাকেও গ্রেফতার করা হয়।

হাভানা’তে পুলিশ সেলে ইন্টেরোগেশনের সময় মৃত্যুবরণ করেন রামোনের মা। একই কারাগারে কয়েক সপ্তাহ পরেই অযত্ন আর ভগ্ন হৃদয়ে মারা যান রামোনের বাবা। পারিবারিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে রামোন কেবল মারকুইস পদবীটাই পেল, ভাগ্য কিংবা সম্পত্তি নয়। এসব কিছুই ঘটে যখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। এরপর ক্যাস্ট্রো পরিবারেই বেড়ে উঠে রামোন।

সাধারণ ক্ষমা পেয়ে জেল থেকে মুক্ত হয়ে রামোনকে নিয়ে মেক্সিকো চলে যান ফিদেল ক্যাস্ট্রো। ষোল বছর বয়সে বিদেশে কিউবার লিবারেশন আর্মির প্রথম দিককার কর্মী হিসেবে নিয়োগ পায় রামোন।

মেক্সিকোতে থাকতেই ছেলেটা প্রথম শেখে যে কিভাবে নিজের অসাধারণ সৌন্দর্যকে কাজে লাগাতে হয়। নারীদেরকে আকর্ষণ করার এক সহজাত ক্ষমতা আছে তার। সতের বছর বয়সে সঙ্গী-সাথীরা তার নাম রাখে এল জোরো ডোরাডো, “দ্য গোল্ডেন ফক্স।” বিশ্ব প্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তার খ্যাতি।

বাতিস্তা’র কারাগারে পিতার গ্রেফতার হওয়া আর মৃত্যুবরণের পূর্ব পর্যন্ত ধনী অভিজাত পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তানটির জন্য সর্বোচচ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই হারো’র ছাত্র হিসেবে মাতৃভাষা স্প্যানিসের মতই ইংরেজিও বলতে পারে। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের পাশাপাশি তার মাঝে গড়ে উঠেছে ভদ্রলোকের সমস্ত আদব-কায়দা। গুলি ছোঁড়া, নাচ-গান, ঘোড়ায় চড়া, মাছ ধরা, সব কিছুতেই পারদর্শী রূপবান এই তরুণ ১৯৫৬ সালের দোসরা জিসেম্বর কিউবাতে ফিরে আসে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও অন্যান্য বিরাশি জন বীরের সাথে। আর তখনই প্রমাণ পেল যে মারামারিতেও সে সমানভাবে দক্ষ।

কাস্ট্রোর সাথে পর্বতের দিকে পালিয়ে যাওয়া অন্যান্যের সাথে রামোনও ছিল। পরবর্তীতে শুরু হওয়া গেরিলা যুদ্ধের সময়ে এল জোরো’কে শহরে আর গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয় নারীদের উপর তার ক্ষমতা অনুশীলনের জন্য। তরুণী কিংবা তরুণী নয়, সুন্দরী অথবা সাধারণ সব ধরনের নারীকুল রামোনের বাহুতে এসে হয়ে উঠে বিপ্লবী কন্যা। প্রতিটি বিজয়ের সাথে সাথে রামোন হয়ে উঠে আরো দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী। পরবর্তীতে দেখা যায় বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় আর বাতিস্তাকে উচ্ছেদ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার নারীবাহিনী।

এরই মাঝে নিজের এই তরুণ আত্মীয়ও সেনার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছেন ফিদেল কাস্ট্রো। তাই ক্ষমতায় এসে পুরস্কার হিসেবে। রামোন’কে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকাতে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি নিজের অমোঘ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশান্তরী কিউবানদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয় রামোন। যারা কিনা আমেরিকান সি আই এর সহাযযাগিতায় দ্বীপটিতে কাউন্টার রেভোলিউশন ও আক্রমণের গোপন পরিকল্পনা করছিল।

বিশেষভাবে রামোনের বুদ্ধিতেই বে অব পিগ’স ল্যান্ডিং এর সময় ও স্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ঠিক করা হয়েছে। ফলাফলে নির্মূল হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের দল। এরই মাঝে মিত্রদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে তার মেধার সুখ্যাতি।

ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর কেজিবি’র কিউবা ডিরেক্টর ফিদেল কাস্ত্রো ও ডিজিএ’র ডিরেক্টরকে প্রভাবিত করেছেন রামোনকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোতে পাঠানোর ব্যাপারে। আর রাশিয়াতে গিয়ে তার দক্ষতা সম্ভাবনা সম্পর্কে কেজিবি’র ধারণাকে ভালোভাবেই উৎরে গিয়েছে ছেলেটা। রামোন হচ্ছে সেসব দুর্লভ সৃষ্টিদের একজন যারা কিনা অনায়াসে সমাজের যে কোনো স্তরে প্রবেশ করতে পারে। জঙ্গলের নিষ্ঠুর গেরিলা ক্যাম্প থেকে শুরু করে ড্রয়িংরুম কিংবা ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রাইভেট ক্লাবগুলোসহ সব জায়গায়।

ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আশির্বাদ ধন্য হয়ে কেজিবি’তে নিয়োগ পেয়েছে রামোন। তাই স্বাভাবিক যে আফ্রিকাতে রাশান ও কিউবা’র স্বার্থ রক্ষায় তৈরি যৌথ কমিটির ডিরেকটর হিসেবেই কাজ করছে রামোন। একই সাথে এ এন সি’র সদস্য হিসেবে আফ্রিকান রেজিস্ট্যান্স দলকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।

স্বল্প সময়ের মাঝে নিজের কর্মক্ষেত্রে থাকা সমস্ত আফ্রিকান দেশ চষে ফেলেছে রামোন। নিজের স্প্যানিশ পাসপোর্ট আর পদবী, চতুর্থ মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে সরবরাহ করা কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে পুজিবাদী ব্যবসায়ী হিসেবে ভ্রমণ করেছে সর্বত্র। সবাই সাদরে তাকে গ্রহণও করেছে। তাই আফ্রিকান ডিভিশনের অসুস্থ জেনারেল সিসেরো’র জায়গায় নতুন স্টেশন হেড হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য রামোন হয়ে উঠে এক নম্বর পছন্দ।

বেইজ ওয়াটার রোডের রাশান কনস্যুলেটের ব্যাক রুমে কৃষাঙ্গ আফ্রিকান গেরিলা নেতার সাথে বসে থাকা রামোনের বিশ্বস্ততা তাই তার উপর অলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

রালেই তাবাকা’র ঘোষণা শুনে বিমূঢ় হয়ে গেছে রামোন। কেননা “যতটুকু প্রয়োজন” নীতিতেই কাজ করে সে। এছাড়া তার আর তার সরকার, উভয়েরই ধারণা, আফ্রিকা মহাদেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ জুড়ে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে এই লোকটা কিংবা তার প্রতিষ্ঠান খুব নগণ্য ভূমিকাই পালন করবে।

“অবশ্যই, এ বিষয়টুকু ছাড়াও যৌথ স্বার্থ রক্ষায় জড়িত সমস্ত ব্যাপারে সবসময়ে আপনাকে জানানো হবে। এতটা আন্তরিকভাবে রামোন উত্তর দিল যে কৃষাঙ্গ লোকটা নিশ্চিত হয়ে চেয়ারে হেলান দিল; ফিরিয়ে দিল রামোনের হাসি। নারী কিংবা পুরুষ খুব কম লোকই তার মায়াজাল কাটাতে পারে। এহেন কঠিন কারো উপরেও নিজের যাদু দেখতে পেয়ে তৃপ্তি ফুটে উঠল রামোনের চোখে।

অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ লোকটার আত্ম-তুষ্টি ভালোভাবেই টের পেলেন রালেই তাবাকা। যদিও চেহারায় তেমন কোনো ভাব বোঝা গেল না। বহু বছর ধরেই রাশিয়া আর কিউবা থেকে আগত শ্বেতাঙ্গদের সাথে কাজ করে আসছেন। তাই ভালোভাবেই জানেন যে এদের ব্যাপারে একমাত্র নীতি হলো কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই না। যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন সে ব্যাপার।

এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যান না যে তারা শ্বেতাঙ্গ। অন্যান্য বেশিরভাগ আফ্রিকানের মতে, রালেই নিজেও গোত্র আর জাতির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। শার্পভিলে গুলি ছোঁড়া সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশগুলোকে যতটা ঘৃণা করে ততটাই করে কনফারেন্স টেবিলে বসে থাকা এসব শ্বেতাঙ্গকেও।

মুহূর্তখানেকের জন্যও ভুলতে পারে না ভয়ংকর সেই দিন, যেদিন নীল আফ্রিকান আকাশের নিচে তার হাতের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেছে অনিন্দ সুন্দরী সে কৃষাঙ্গ দাসী। যার কথা ছিল তার স্ত্রী হবার। তাকিয়ে দেখেছে ভালোবাসার জনের মৃত্যু। এরপর দেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই বুকের বুলেটের ক্ষতের মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেছে। রালেই তাবাকা’র প্রাণশক্তিই আসে এ ঘৃণা থেকে।

টেবিলের ওপাশে থাকা সাদা মুখগুলোকে দেখে নিয়ে নিজের ঘৃণা থেকে শক্তি সঞ্চয় করলেন তাবাকা। “তো” আবারো শুরু করল, “ঠিক হল যে মেয়েটা আপনার দায়িত্ব। এখন চলুন বাকি…”

“এক মিনিট” রালেইকে থামিয়ে দিয়ে সিসেরোর দিকে তাকাল রামোন, “যদি আমি লাল গোলাপ’কে যদি এগোতে চাই তাহলে অপারেশনের বাজেটের প্রশ্নও এসে যায়।”

“এরই মাঝে দুই হাজার ব্রিটিশ স্টালিং দেয়া হয়েছে প্রতিবাদ জানালেন সিসেরো। “প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট ছিল। তবে আরো বাড়াতে হবে। ধনী পুঁজিবাদের কন্যা এই মেয়ে, তাকে মুগ্ধ করার জন্য আমাকেও স্প্যানিশ যুবরাজের ভূমিকা পালন করতে হবে।

আরো কয়েক মিনিট ধরে দু’জনে কথা কাটাকাটিই করে চলল। টেবিলের উপর অধৈৰ্য্যভাবে পেন্সিলের টোকা দিয়ে চললেন তাবাকা। আফ্রিকান ডিভিশন হচ্ছে সিনডারেলার মতো, তাই প্রতিটি রুবল হিসাব করে খরচ করতে হবে।

রালেই’র মনে হলো এদের হাউকাউ শুনে যে কারো বোধ হবে যে ধূলিমাখা আফ্রিকান কোনো রাস্তার পাশে কুমড়া বিক্রি করছে এক জোড়া বৃদ্ধা। কিছুতেই মাথায় আসবে না যে শক্রর রাজত্ব ধ্বংস করে পনের মিলিয়ন নিগৃহীত আফ্রিকান আত্মাকে মুক্তি দিতে চাইছে দুই পুরুষ।

অবশেষে দুজনে একমত হলো। তাই আবারো যখন কথা বলে উঠলেন, কণ্ঠের উষ্মা লুকাতে পারলেন না তাবাকা, “আচ্ছা এবার কি আমরা আমার আফ্রিকা টুারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে কথা বলতে পারি?” তার ধারণা ছিল যে আজকের মিটিং এর মুখ্য উদ্দেশ্য এটাই। “মস্কো থেকে গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেছে?”

আলোচনা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। কাজ করতে করতে কনস্যুলেট ক্যান্টিন থেকে পাঠানো খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিল তিন জনে। আর অনেক উপরের একটা মাত্র জানালা দিয়ে হারিয়ে গেল জো সিসেয়োর সিগারেটের ধোঁয়ার মেঘ। একেবারে উপরের তলায় হাই সিকিউরিটিতে মোড়া রুমটাকে নিয়মিত পরিস্কার রাখা হয় ইলেকট্রনিক লিসনিং ডিভাইসের হাত থেকে বাঁচাতে। বাইরের কড়া নজরদারির বিপক্ষে সেফ হাউজের মতো কাজ করে এ কক্ষ।

অবশেষে সামনে রাখা ফাইলটাকে বন্ধ করে উপরের দিকে তাকাল জো সিসেরো। ধোয়ার জ্বালায় লাল টকটকে হয়ে গেছে কালো চোখ জোড়া। “আমার মনে হয় আর নতুন কিছু না থাকলে প্রতিটা পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। তাই না?”

মাথা নাড়ল বাকি দুজনে।

“সবসময়কার মতো কমরেড মাচাদো আগে যাবে। প্রাথমিকভাবে এ নিয়ম কঠোরভাবে পালন করা হয় যেন জনসমক্ষে তাদেরকে একসাথে না দেখা যায়।

বিল্ডিং এর সবচেয়ে ব্যস্ত অংশ ভিসা সেকশনের প্রবেশ পথ দিয়ে কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে এলো রামোন; সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নে বর্তমানে পড়তে যেতে আগ্রহী এমন হাজারো ছাত্র আর পর্যটকের ভিড়ের মাঝে তাকে কেউ খেয়ালই করবে না।

দেয়াল ঘেরা কনস্যুলেটের ঠিক বাইরেই আছে বাস স্টপ। ৮৮ নম্বর বাসে চড়েও পরের স্টপেজে নেমে গিয়ে দ্রুত পায়ে ল্যাঙ্কাস্টার গেইট দিয়ে কেনসিংটন গার্ডেনে চলে গেল। রোজ গার্ডেনে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হল যে তাকে কেউ অনুসরণ করছে না। তারপর পার্ক পার হয়ে চলে গেল।

কেনসিংটন হাই-স্ট্রিট থেকে বাইরে চিকন একটা গলির মাঝে রামোনের ফ্ল্যাট। লাল গোলাপ অভিযানের জন্যই বিশেষভাবে ভাড়া নেয়া হয়েছে। সিঙ্গল বেডরুম হলেও লিভিং রুমটা বেশ প্রশস্ত আর পাড়াটাও কেতাদুরস্ত।

মাত্র দুই সপ্তাহ হলেও ফ্ল্যাটটাকে এরই মাঝে বেশ সাজিয়ে নিয়েছে রামোন যেন বহুকাল ধরেই আছে এখানে। ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে কিউবা থেকে চলে এসেছে ওর ব্যক্তিগত সিন্দুক। এর মাঝে আছে বাবার রেখে যাওয়া কয়েকটা চমৎকার ছবি আর ছোট-খাট আসবাব : যেমন রুপার ফ্রেমে আটকানো পিতা-মাতাসহ ফ্যামিলি পিকচার, আন্দালুসিয়াতে কাটানো সুখের দিনগুলোতে পারিবারিক এস্টেট আর দুর্গের ছবি। কাঁচ আর পোর্সেলিনের সেটগুলো পুরোপুরি না থাকলেও মাচাদো পদবী আঁকা আছে এখনো। লাল গোলাপ সম্পর্কে যতটা জেনেছে, মেয়েটা এসব জিনিস বেশ খেয়াল করে।

যাই হোক তাড়াতাড়ি করতে হবে। ভারী আর ঘন দাড়ি বেশ দ্রুত গজায়। তাড়াতাড়ি কিন্তু সাবধানে শেভু করে চুল থেকে জো সিসেরো’র তার্কিশ সিগারেটের গন্ধ মুছে স্নান করে নিল রামোন।

বেডরুমে গিয়ে আপনাতেই চোখ চলে গেল আয়নাতে। তিন সপ্তাহ আগে রাশিয়া থেকে ফেরার পর স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত চমৎকার। কৃষ্ণ সাগরের তীরে কেজিবি ট্রেনিং কলেজের সিনিয়র অফিসারদের জন্য রিফ্রেশার কোর্সটা সুঠাম করে তৈরি করে দিয়েছে তার দেহ। তারপর থেকে তেমন একটা শারীরিক কসরৎ না করা হলেও অভাব এখনো চোখে পড়ছে না। শক্ত আর পাতলা গড়নে সমান পেট, কোকড়ানো কালো পশম। কোন রকম অহমিকা ছাড়াই নিজ প্রতিবিম্ব খুঁটিয়ে দেখে নিল রামোন। অনিন্দ সুন্দর দেহ আর মুখশ্রী একে অপরের সাথে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে গেছে; কার্য উদ্ধারের জন্য এই অস্ত্রের জুড়ি নেই। যোদ্ধা যেমন তার অস্ত্র ভালোবাসে তেমনি ভাবেই নিজের এ অংশকে কাজে লাগায় সে।

“আগামীকাল জিমে। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করল রামোন। ব্লমসবেরি’তে এক হাঙ্গেরীয় শরণার্থী চালিত মার্শাল আর্ট স্টুডিওতে যায় রামোন। সপ্তাহে কয়েকবার দুই ঘন্টার কঠোর অভিযানের জন্যে ফিট হয়ে যাবে শরীর।

ঘোড়ওয়ারের উপযুক্ত পোশাক পরে নিল রামোন। জানে লাল গোলাপ নিজেও ঘোড়া চালায় মেয়েটার পৃথিবীতে ঘোড়াদের অস্তিত্ব বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে। তাই রামোনের জুতা জোড়া দেখে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হবে তার আভিজাতত নিয়ে।

আবারো ঘড়ি দেখে নিল; নাহ, পুরোপুরি সময়মতোই তৈরি হয়েছে।

ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো রামোন। বিকেলের দিকে বৃষ্টির হুমকি দেয়া মেঘগুলো এখন উধাও হয়ে গেছে। চমৎকার এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা চারপাশে। তো প্রকৃতিও তাহলে তাকে সাহায্য করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে।

সৈন্যদের ব্যারাকের পেছনে ঘোড়ার আস্তাবল। তাকে দেখে চিনতে পারল ম্যানেজার। রেজিস্টারে সাইন করতে করতেই চোখ বোলালো নামের সারিতে। যাক ভাগ্যদেবী আজ তার সাথেই আছে। বিশ মিনিট আগে প্রবেশ করেছে লাল গোলাপ। সাইন তো তাই বলছে।

স্টলে গিয়ে দেখা গেল তার ঘোড়ায় জিন পরিয়ে রেখেছে সহিস। নিজের বাজেট থেকে মূল্যবান পাঁচশ পাউন্ড এই বাচ্চা ঘোটার জন্য ব্যয় করেছে রামোন। তারপর সবকিছু চেক্ করে গায়ে হাত বুলিয়ে নরম স্বরে ঘোড়ার সাথে কথা বলে নিয়ে সহিসকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিনের উপর চড়ে বসল।

রোটেন রো’তে প্রায় পঞ্চাশ বা তার চেয়েও বেশি ঘোড়সওয়ার চলে এসেছে এরই মাঝে। ওক গাছের নিচে ঘোটকীটাকে নিয়ে এলো রামোন। সামনে পিছনে চলে গেল অন্যরা। কিন্তু মেয়েটার দেখা নেই।

খানিকটা ওয়ার্ম-আপের পর বুড়ো আঙুল দিয়ে গায়ে তো দিতেই দুলকি চালে চলতে শুরু করল ঘোটকী। দুয়ে মিলে ভালই জুটি বানিয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন নারীই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রামোনের দিকে।

সারির শেষ মাথায় পার্ক লেনে, রামোন ঘুরে গেল আর খানিকটা জোরে ছোটাল ঘোড়া, টগবগ করে ঘোড়া ছোটানো এখানে নিষিদ্ধ। শখানেক গজ সামনে থেকে তার দিকেই এগিয়ে আসছে চারজনের এক দল। দুটো জোড়া। বেশ ভালোভাবেই এসেছে প্রত্যেকে কিন্তু তারপরেও সবার মাঝে মেয়েটাকে দেখাচ্ছে চড়ুই এর ঝাঁকের মাঝে রঙিন পাখির মত।

রাইডিং হ্যাটের নিচ দিয়ে বের হয়ে থাকা চুলগুলো দুলছে পাখির পাখার মতো; মাখনের মতো সূর্যালোকে চকচক করছে। হাসতেই দেখা গেল অসম্ভব সাদা দাঁত। বাতাস আর পরিশ্রমে গায়ের রং দেখাচ্ছে সজীব, প্রাণবন্ত।

মেয়েটার পাশে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা ছেলেটাকেও চিনতে পারল রামোন। গত দুই সপ্তাহ ধরে লাল গোলাপের পিছু নেয়ার সময় বেশির ভাগ জায়গায় দুজনকে একসাথে দেখেছে। রেকর্ড থেকে ছেলেটা সম্পর্কে জেনেও নিয়েছে। অত্যন্ত ধনী পরিবার থেকে আসা ছেলেটাকে লন্ডনে নাম দেয়া হয়েছে “ডেব’স ডিলাইট” কিংবা “হুররে হেনরী নামে; প্লেবয় সুলভ স্বভাবের জন্য। চারদিন আগে রোলিং স্টোনের কনর্সাটেও মেয়েটার সাথে ছিল। রামোন খেয়াল করে দেখেছে ছেলেটার সাথে মেয়েটার সম্পর্ক সেন্ট বানার্ড বাচ্চা কুকুরের মতো। আর নিজের এম জি তে করে মেয়েটাকে এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে পৌঁছে দেয়া ছাড়া দু’জনকে আলাদা একাকী কোথাও দেখেওনি রামোন। খানিকটা অবাক লাগলেও ১৯৬৯-এর এই উদ্দাম সময়েও একে অন্যের সাথে কখনোই বিছানায় যায়নি তারা, এ ব্যাপারেও সে প্রায় নিশ্চিতই বলা চলে।

যদিও জানে মেয়েটা কোনো বোকা-সোকা কুমারী নয়। হাইভেন্ডে থাকাকালীন গত তিন বছরে অন্তত তিনটা সম্পর্কে জড়িয়েছে এই মেয়ে, রিপোর্ট তো তাই বলে।

দুজনের দূরত্ব কমে আসতেই ঘোড়ার দিকে মনোযোগ দিল রামোন। ঝুঁকে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে লাগল জম্ভটার গলাতে। “এসে গেছি, ডালিং।” চোখের কোণা দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে স্প্যানিশ ভাষায় ঘোড়ার সাথে কথা বলতে লাগল।

একে অন্যকে প্রায় পার হয়ে যাচ্ছে এমন সময় নড়ে উঠল মেয়েটার চিবুক। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। কিন্তু না দেখার ভান করল রামোন।

“রামোন!” উঁচু গলায় চিৎকার করে যেন প্রার্থনা জানাল বেলা। “দাঁড়াও।”

ঘোটকীকে দেখে নিয়ে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকাল মাচাদো। ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে মিস কোর্টনি। মুখের ভাব একই রকম রেখে শীতল ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইল রামোন।

ও’র পাশে এসে ঘোড়াটাকে ধীর করে বলে উঠল, “আমাকে চিনতে পারোনি? ইসাবেলা কোর্টনি। তুমি তো আমার ত্রাণকর্তা!” অদ্ভুত অনিশ্চয়তা নিয়ে হাসছে মেয়েটা। পুরুষেরা সবসময় তাকে মনে রাখে, যতই অতীতে হোক না কেন সেই সাক্ষাৎ এমন ব্যবহার পেয়েই অভ্যস্ত সে। অবশেষে মৃদু স্বরে যোগ করল, “পার্কের কনর্সাটে।”

“আহ!” সহৃদয় হল রামোন। মোটর সাইকেল মাসকট। মাফ করো। তোমার পোশাক সে সময় বেশ আলাদা ছিল।”

“ধন্যবাদ জানাব সেটুকু সময়ও দাওনি আমাকে।” অনুযোগ করল বেলা। ইচ্ছে হলো জোরে হেসে উঠে যে, যাক অবশেষে তাকে চিনতে পেরেছে ছেলেটা।

“কোনো ধন্যবাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এছাড়া আমার যতদূর মনে পড়ে অন্য একটা জরুরি কাজও ছিল তোমার।”

“তুমি কি একা?” তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে পরিবর্তন করে বেলা, জানালো “আমাদের সাথে জয়েন করো। আমার বন্ধুদের সাথে পরিচিত হবে এসো।”

“ওহু, না, না; আমি অযথা তোমাদেরকে বিরক্ত করতে চাই না।”

“প্লিজ।” অনুনয় করছে বেলা। তোমার ভালই লাগবে। ওরা বেশ মজার।” জিনের উপর বসে হালকাভাবে মাথা নাড়ল রামোন।

“এত সুন্দর একটা মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া নিমন্ত্রণ কিভাবে প্রত্যাখ্যান করি?” রামোন জানাতেই ধুপধুপ করে উঠল ইসাবেলার হৃদয়। স্বর্গদূতের মতো চেহারায় ওই সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো রীতিমতো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে।

বাকি তিনজন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কাছে না এসেও বেলা ঠিকই বুঝতে পারল যে রজার মুখে গোমড়া করে আছে। পুলকিত হয়ে তাই জানাল : রজার, ও হচ্ছে মারকুইস ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো। রামোন, ও হচ্ছে রজার কোটস্ গ্রেইনার।”

পরিহাসের দৃষ্টিতে রামোন ওর দিকে তাকাতেই বেলা বুঝতে পারল ভুল করে ফেলেছে। কেননা প্রথমবার সাক্ষাতের সময় নিজের পদবী জানায়নি রামোন।

যাই হোক ক্ষণিকের অস্বস্তি কেটে গেল হারিয়েট কু-চ্যাম্পের সাথে রামোনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময়। মজা লাগল হ্যারিয়েটের প্রতিক্রিয়া দেখে। লন্ডনে ইসাবেলার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী হল এই হ্যারিয়েট। যদিও এর অন্য আরেকটা কারণই প্রধান। লন্ডন সোসাইটি’র ইনার সার্কেলে ইসাবেলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লেডি হ্যারিয়েট। হ্যারিয়েটও তাকে পছন্দ করে কেননা বেলা থাকলেই আশে পাশে ছেলেদের ভিড় জমে যাবে। তাই রামোনকে দেখে প্রায় সাথে সাথে ঠোঁট চাটতে থাকা হ্যারিয়েটকে ইসাবেলা নিঃশব্দে সতর্ক করে দিল দু’জনের মাঝখানে নিজের ঘোড় রেখে।

“মারকুইস?” ঘোড়া চালাতে চালাতে বিড়বিড় করে উঠল রামোন। “তুমি তো আমার সম্পর্কে ভালই জানো, কিন্তু তোমার সম্পর্কে আমি তো তেমন কিছু জানি না।”

“ওহ্ কোন পত্রিকার কলামে বোধ হয় তোমার ছবি দেখেছিলাম।” হাওয়া থেকে অযুহাত বানিয়ে ইসাবেলা ভাবতে লাগল : ঈশ্বর, ও যাতে বুঝতে না পারে যে আমি এতটা আগ্রহী।

‘আহ্, নিশ্চয়ই টাটলার…’

মাথা নাড়ল রামোন। কখনো কোথাও ওর ছবি ছাপা হয়নি, শুধু সি আই এ অথবা দুনিয়ার অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকলে থাকতেও পারে।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাটলারেই।” পালানোর পথ পেয়ে লুফে নিল নামটা বেলা। প্ল্যান কষতে লাগল কিভাবে নিজের আগ্রহ না দেখিয়ে বাগে আনা যায় এই রাজকুমারকে। তবে যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল কাজটা, মনে হচ্ছে তা না। রামোন নিজেও খোলামেলাভাবে মিশে গেছে ওদের দলে। একটু পরেই সকলে বেশ মিশে গেল, একসাথে হাসছে। গল্প করছে, শুধু রজার বাদে। ওর গোসা মুখ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সবাই ফিরে চলল আস্তাবলের দিকে। হ্যারিয়েটের কাছাকাছি এসে হিসহিস করে ইসাবেলা বলে উঠল, “ওকে আজ রাতের পার্টিতে দাওয়াত করো।”

“কে?” যেন আকাশ থেকে পড়ল এমনভাবে তাকালো হ্যারিয়েট। “টং করবে না দস্যি মেয়ে। গত এক ঘণ্টা ধরে চোখ গোল গোল করে কাকে দেখছ আমি জানি না বুঝি?”

***

হ্যারিয়েটের দেয়া অন্যান্য স্মরণীয় পার্টিগুলোর চেয়ে ভালোই হলো আজকের আয়োজন। এতটাই ভিড় হলো যে মাথায় জরুরি কাজের তাড়া থাকা জুড়িগুলোর’ও বিশ মিনিট লেগে গেল বল রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে যেতে। সেখানে আবার অপেক্ষা করতে হল তাদের পালা আসার জন্য।

হ্যারিয়েটের পাপার জন্য করুণাই হলো ইসাবেলা’র। দশম আর্ল যদি জানাতেন যে তার বিছানার উপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে।

চারপাশের উদ্দাম হই-হল্লার মাঝেও একটাই চিন্তা ঘুরছে ওর মাথায়। মার্বেলের সিঁড়ির মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা পাওয়া গেছে যেখানে দাঁড়িয়ে নজর রাখা যাবে সদর দরজা দিয়ে আগত প্রত্যেকের উপর। একই সাথে দেখা যাবে বল রুম আর নাচিয়েদের ভিড়ে ভারাক্রান্ত ড্রয়িং রুম।

একসাথে নাচার সব নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে যাচ্ছে বেলা। অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত জনের জন্য। আর রডার কোটস্ গ্রেইনজারের সাথে এতটাই ঠাণ্ডা আচরণ করেছে যে বেচারা ছাদের শ্যাম্পেন বারে চলে গেছে মন খারাপ করে। যাই হোক, ভালই হয়েছে।

টলতে টলতে, চিৎকার করতে করতে ভেতরে এলো আরো এক দল। তাদের মাঝে ঢেউ খেলানো কালো চুল দেখে ধড়াস ধড়াস করতে লাগল বেলা’র হৃদপিণ্ড। কিন্তু না, লোকটা বেশ খাটো। এদিকে ঘুরতেই চেহারা দেখে তো রীতিমতো রাগ হতে লাগল।

এক ধরনের বিকৃত যৌনানন্দের মর্মপীড়ায় আপ্লুত হয়ে পুরো সন্ধ্যায় মাত্র এক গ্লাস শ্যাম্পেন শেষ করল বেলা। এখন তো ওয়াইনও সাদা-মাটা আর গরম লাগছে। চারপাশে তাকিয়ে রজারকে খুঁজল, ভাবল আরেক গ্লাস আনিয়ে নেবে। দেখতে পেল, আলগা পাপড়ি লাগানো লম্বা আর কৃশকায় এক মেয়ের সাথে নাচে মত্ত সে।

ঈশ্বর, মেয়েটা কী ভয়ংকর ভাবতে ভাবতে তাকাল ড্রইং রুমের দরজার উপরে রাখা পোর্সেলিনের ফ্রেঞ্চ ঘড়ির দিকে। একটা বাজতে বিশ মিনিট বাকি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে করল বাবার কথা।

আজ দুপুর বেলায় পার্লামেন্টের প্রভাবশালী কনজারভেৰ্টিড মেম্বার আর তাদের স্ত্রীদের সাথে নিয়ে লাঞ্চ করবে ড্যাডি। বরাবরের মতো বেলাকেই সব ঠিকঠাক করতে হবে। তাই একটু ঘুমিয়ে নেয়া খুবই দরকার। তারপরেও ও এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কোথায় গেল ছেলেটা? তখনতো বলেছিল আসবে। “আসলে ও বলেছিল আসতে চেষ্টা করবো। কিন্তু সব কিছু এত হাসি-খুশি ছিল যে সেটাকে প্রমিজ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়।

চেহারার দিকে না তাকিয়েই খারিজ করে দিল আরেকটা নাচের প্রস্তাব। ঢকঢক করে গলায় ঢালল শ্যাম্পেন। উফ! কী বাজে।

“একটা বাজার পর আর এক মিনিটও অপেক্ষা করব না।” নিজেকে শোনাল বেলা। আর এটাই শেষ কথা।”

আর তারপরেই বেড়ে গেল হার্টবিট। গানের শব্দ মনে হল কানে মধু বর্ষণ করছে। বিরক্তিকর ভিড় আর হট্টগোল সব ভুলে গেল। মন খারাপ ভাব কেটে গিয়ে বন্য এক উত্তেজনায় চাঙ্গা হয়ে উঠল।

ওই, সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এতটা লম্বা যে আশে পাশের সবার চেয়ে অন্তত আধা মাথা উঁচু। কপালের উপর প্রশ্ন চিহ্নের মতো পড়ে আছে একটা চুল। অভিব্যক্তিতে স্থির, অচঞ্চল সুদূরের অবয়ব।

ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে উঠে, “রামোন, আমি এখানে।” কিন্তু না নিজেকে থামাল। গ্লাস রেখে দিল একপাশে। গড়িয়ে যেতেই ঈষদুষ্ণ শ্যাম্পেন পড়ল নিচের সিঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটার খোলা পিঠে। ইসাবেলা এমনকি মেয়েটার অভিযোগও শুনতে পেল না। হালকাভাবে উঠে দাঁড়াতেই রামোনের সবুজ দৃষ্টি এসে খুঁজে নিল ওকে।

চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকা অন্যদের মাথার উপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল দু’জনে। মনে হল যেন কেউ কোথাও নেই। কেউই হাসল না। ইসাবেলার কাছে মনে হলো এই সেই পবিত্ৰক্ষণ। ও এলো; আর অদ্ভুত কোন উপায়ে ইসাবেলা টের পেল কী হতে যাচ্ছে। নিশ্চিত যে এই মুহূর্ত থেকে বদলে গেল তার জীবন। কিছুই আর আগের মতো রইবে না।

সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়াজড়ি করে বসে থাকা কারো উপর ধাক্কা না খেয়েই নেমে আসতে লাগল বেলা। মনে হলো যেন ওরাই তাকে পথ করে দিল আর পা দুটোও খুঁজে নিল নিজেদের গন্তব্য।

রামোনকেই দেখছে শুধু। এগিয়ে এলো না। এত ভিড়ের মাঝে একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভঙ্গি দেখে মনে পড়ে গেল বিশাল শিকারি আফ্রিকান বিড়ালপুলোর কথা। ছেলেটার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠল ভয় মেশানো উত্তেজনা।

একে অন্যের সামনে দাঁড়িয়েও কেউই কথা বলল না। মুহূর্তখানেক পরে রোদে পোড়া শূন্য বাহু তুলে ধরতেই বুকের কাছে টেনে নিল রামোন। হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল বেলা। একসাথে নাচল দুজনে আর প্রতিটা পদক্ষেপে ঠিক যেন ওর শরীর থেকে বিদ্যুতের ঢেউ এসে আঘাত করতে লাগল বেলাকে।

চারপাশে ভিড়ে অতিরিক্ত গানের শব্দের মাঝেও নিজেদের রচিত সুরে মগ্ন হয়ে নেচে চলল রামোন আর ইসাবেলা। প্রচণ্ড শারীরিক আকর্ষণে যেন বেলাকে কোন বাদ্যযন্ত্রের মতই বাজিয়ে চলেছে ছেলেটা।

ইসাবেলার নিজেকে মনে হল আঙ্গুর লতা, যে কিনা জড়িয়ে রয়েছে রামোন বৃক্ষের গায়ে অথবা ঢেউ হয়ে আঁছড়ে পড়ছে রামোন পাথরের উপর। মনে হলো রামোন কোনো সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ আর নরম মেঘ হয়ে তাকে ঢেকে রেখেছে বেলা।

হালকা আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো রামোনের বাহুডোরে নাচছে মেয়েটা। সময় আর স্থান-কালও যেন স্থির হয়ে গেছে। এমনকি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও খেই হারিয়ে ফেলেছে। জমিনে যেন পা-ই পড়ছে না আপ্লুত বেলার।

ওকে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে রামন। দূর থেকে দেখল রজার কী যেন বলছে। লম্বা মেয়েটা চলে গেছে আর খেপে আগুন হয়ে আছে রজার; কিন্তু জালের মাঝে একসাথে তড়পাতে থাকা মাছেদের মতো মানুষের ভিড়ে ও’কে রেখে রামোনের সাথে চলে এলো বেলা।

সদর দরজায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে সিকুইনের কাজ করা ব্যাগ থেকে মিনি কুপারের চাবি বের করে রামোনের হাতে তুলে দিল।

শূন্য রাস্তা দিয়ে সাই সাই করে গাড়ি ছোটাল মোন। যতটা কাছে আসা সম্ভব ততটাই হেলান দিয়ে একমনে কেবল ছেলেটাকেই দেখছে বেলা, খেয়াল নেই তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রামোন। শুধু ভাবছে তৃষিত শরীরে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে।

হঠাৎ করেই থেমে গেল মিনি। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেলার পাশে চলে এলো রামোন। বেলা বুঝতে পারল ছেলেটার আকুলতা। রামোনের হাত ধরে মনে হল শূন্যে চেপে রাস্তা ছেড়ে একই রকমের দেখতে লাল-রঙা দালানগুলোর একটার দ্বিতীয় ফ্লোরে উঠে এলো।

দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে উভয়ের বাঁধ ভেঙে গেল। সদ্য গজানো দাড়িঅলা হাঙ্গরের মতো শক্ত চামড়ামাখা মুখটা এসে স্বাদ নিল নরম উষ্ণ আর টসটসে মিষ্টি ঠোঁটের।

নিজের ভেতরে বিস্ফোরণের আওয়াজ পেল বেলা। ভেসে গেল সমস্ত বোধ-বুদ্ধি-বিবেক। কানের কাছে গজন করতে লাগল সামুদ্রিক ঝড়ো হাওয়া।

ছোট্ট হলওয়ের পলিশ করা কাঠের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল পোশাক। বেলা’র দেখাদেখি একই রকম এস্ত ভঙ্গিতে নিজের পোশাকও দ্রুত খুলে ফেলল রামোন। ক্ষুধার্তের মতো তাকে দেখছে মেয়েটা।

কোন পুরুষের শরীর যে এতটা সুন্দর হতে পারে জানত না বেলা। মনে হলো অনন্তকাল ধরে কেবল তাকিয়েই থাকতে পারবে যদিও তর সইছে না আর।

মেয়েটাকে দুহাতের মাঝে তুলে নিল ছেলেটা। তারপর নিয়ে গেল ঝড়ের মুখে ভেসে যেতে।

***

জেগে উঠতেই, এক ধরনের ভালো লাগা এসে ছড়িয়ে গেল ইসাবেলা’র পুরো দেহে। মনে হল এই অনির্বচনীয় আনন্দ বুঝি কখনোই কাটবে না। শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন নব জীবন লাভ করেছে।

বহুক্ষণ ধরে বুঝতেই পারল না যে কী হচ্ছে। তবু মুহূর্তটুকু উপভোগ করতে পড়ে রইল চোখ বন্ধ করে। জানে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে এই যাদুকরী অনুভূতি, তবু চায় না এটা ফুরিয়ে যাক। এখনো সারা দেহে ছড়িয়ে আছে মানুষটার গন্ধ, স্পর্শ আর সুখকর এক ব্যথার আবেশ।

আর তারপর হঠাৎ বিস্ময়ে ফিরে পেল চেতনা : আমি প্রেমে পড়ে গেছি। পুরোপুরি জেগে উঠতেই বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দে মনে হলো পাগল হয়ে যাবে।

তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই পায়ের কাছে পড়ে গেল চাদর। “রামোন” মাথার পাশের বালিশের উপর চোখ চলে যেতেই শিহরিত হয়ে উঠল শরীর। সাদা চাদরের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে গাঢ় রঙা চুল। হাত বাড়াতেই বুঝতে পারল ঠাণ্ডা হয়ে আছে বিছানার প্রান্ত। বহু আগেই উঠে গেছে ছেলেটা। আনন্দটুকু উবে গিয়ে হতাশায় ছেয়ে গেল মন।

“রামোন” বিছানা থেকে নেমে নিরাভরণ দেহেই বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল বেলা। খালি বাথরুমের দরজাটা কিঞ্চিৎ খোলা। আরো একবার উধাও হয়ে গেল ছেলেটা। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হতাশা নিয়ে চারপাশে তাকাল মেয়েটা।

এরপরই চোখ পড়ল বেডসাইড টেবিলে। পারিবারিক পদবী খোদাই করা দামি ক্রীম রঙা কাগজের পাতা পড়ে আছে। মিনি কুপারের চাবি আর বেলা’র আংটি দিয়ে চাপা দেয়া হয়েছে কাগজটা। আগ্রহ নিয়ে ছোঁ মেরে কাগজটা তুলল হাতে। কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা আছে,

অসাধারণ এক নারী হওয়া সত্ত্বেও ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে দেখায় শিশুর মত, সুন্দর সুবোধ একটা শিশু। তাই তোমাকে জাগালাম না। ছেড়ে যেতেও মন চায়নি, কিন্তু যেতে হবে।

সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে যদি আমার সাথে মালাগা যেতে পারো, তাহলে আগামীকাল সকাল নয়টায় এখানে চলে এসো। পাসপোর্ট নিয়ে এসো, কিন্তু পায়জামা না হলেও চলবে।

রামোন আবারো মন ভরে উঠল চাপা আনন্দে। আরেকবার পড়ে দেখল, লেখাটা। মসৃণ আর মার্বেলের মতো ঠাণ্ডা কাগজটা ছুঁয়ে আঙ্গুলের ডগাও যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ল। স্বপ্নাতুর চোখে ভেসে উঠল গত রাতের প্রতিচ্ছবি।

রামোনের সাথে শারীরিক মিলনের পর মনে হচ্ছে ওর শরীরের সাথে পুরো চেতনাও গ্রাস করে নিয়েছে ছেলেটা।

স্বর্গীয় কোনো স্পৃহাতে একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে দু’জনে। এক হয়ে উঠেছে দেহ আর মন।

গত রাতে বহুবার মনে হয়েছে এই বুঝি চূড়ায় পৌঁছে গেছে দু’জনে। কিন্তু না, তারপরেই আবিষ্কার করেছে তখনো সামনে থাকা বৃহৎ পর্বতের পাদদেশেই কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর আরেকটা, আরো একটা। প্রতিটাই আগেরটার চেয়ে আরো আরো উঁচু আর বিশাল। এর যেন কোনো শেষ নেই। অবশেষে গভীর ঘুমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ায় যেন সমাপ্ত হয়েছে সবকিছু। আর পুনরুষ্ণানের পর জেগে উঠেছে নব আনন্দ আর অস্তিত্ব নিয়ে।

“আমি প্রেমে পড়ে গেছি।” প্রায় প্রার্থনার মতো করে বিড়বিড় করে উঠল বেলা। চোখ নামিয়ে তাকাল নিজ শরীরের দিকে। সবিস্ময়ে ভাবল কেমন করে পলকা দেহ ভরে আছে এতটা আনন্দ আর অনুভূতিতে।

এরপরই চোখ পড়ল বেড সাইড টেবিলে গাড়ির চাবির সাথে পড়ে থাকা হাতঘড়ির উপর।

“ওহ ঈশ্বর! সাড়ে দশটা বাজে।” ড্যাডি’র লাঞ্চ! দৌড় দিয়ে বাথরুমে গেল। ওয়াশ-বেসিনের উপর মোড়ক লাগানো নতুন ব্রাশ রেখে গেছে রামোন। দেখে যারপরণাই কৃতজ্ঞ হলো বেলা।

মুখ ভর্তি টুথপেস্টের ফেনা দিয়ে গুণগুণ করে উঠল “ফার অ্যাওয়ে প্লেসেস।”

তাড়াতাড়ি গোসল করে নেবে কিনা ভাবতে ভাবতেই উষ্ণ পানিতে গা ডুবিয়ে মনে করল রামোনের কথা। শূন্যতায় ছেয়ে আছে শরীর, রামোন ছাড়া যা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না।

তোয়ালে হাতে নিতেই দেখা গেল এখনো ভেজা। নিশ্চয়ই রামোন স্নান করে গেছে। নাক-মুখের উপর চেপে ধরে ঘ্রাণ নিল উদভ্রান্তের মত। উত্তেজিত হয়ে পড়তেই নিজেকে শুধালো, “থামো এবার!” ধোয়া ঢাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সাবধান করল। এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে ট্রাফালগার স্কোয়ারে পৌঁছাতে হবে।”

ফ্ল্যাট থেকে বের হতে যাবে এমন সময় আবারো কী মনে হতেই দৌড়ে গেল বাথরুমে। সিকুইনের হ্যান্ডব্যাগ হাতড়ে বের করে আনল ওভানন পিল।

জিভের উপর ছোট্ট সাদা ক্যাপসুলটা রেখে কল থেকে আধা মগ পানি নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে স্যালুট করল নিজেকে।

‘জীবন, ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য। আর মেনি হ্যাপি রিটার্নস।” গিলে ফেলল ওষুধটা।

***

রক্ত নিয়ে খেলা করতে কখনোই আপত্তি জানায় না ইসাবেলা কোর্টনি। ওর বাবা সবসময় শিকারিই ছিল। উত্তমাশা অন্তরীপের ওয়েল্টেভ্রেদেনে তাদের বাড়ি ভর্তি হয়ে আছে সেসব ট্রফিতে। পারিবারিক সম্পত্তি মাঝে, জাম্বেজি উপত্যকার শিকার অভিযানের আয়োজন করে এমন একটি সাফারী কোম্পানিও আছে। লাইসেন্সধারি শিকারি আর কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের নকশাকার বড় ভাই শন কোর্টনির সাথে মাত্র গত বছরেই শান্ত সমাহিত জঙ্গলের মাঝে রাত কাটিয়েছে বেলা। হ্যারিয়েট বু-চ্যাম্পের নিমন্ত্রণে বেশ কয়েকবার হাউন্ড নিয়েও শিকার করেছে। এক্ষেত্রে ইসাবেলার সঙ্গী সতের বছরের জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া স্বর্ণের খোদাই করা ছোট্ট সুন্দর হল্যান্ড এন্ড হল্যান্ড ২০ গজ শটগান।

আজ দ্বিতীয় দিন। প্রায় তিনশ প্রতিযোগীর সকলে ঝরে পড়ে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র দু’জনে। তাই অবস্থা হচ্ছে, “একটা মিস করলেই আউট।” কিংবা “যে জিতবে সে সব পেয়ে যাবে” টাইপ প্রতিযোগিতা। প্রবেশ মূল্য ছিল প্রতিজন এক হাজার ইউ এস ডলার; ফলে প্রায় মিলিয়নের চার ভাগের এক ভাগ অর্থ। চারপাশ টেনশনের উত্তাপে এতটা জমে উঠেছে যে ঠিক যেন আমেরিকানদের প্লেটে বিভিন্ন সবজি আর মাংস দিয়ে তৈরি স্যুপ।

এক আমেরিকান আর রামোন মাচাদো হচ্ছে টিকে যাওয়া দুই প্রতিযোগী। গত তেইশ রাউন্ড ধরে দু’জনে সমান সংখ্যক গুলি ছুঁড়েছে। তাই বিজয়ী নির্বাচনের জন্য স্প্যানিশ বিচারক আদেশ দিয়েছেন এখন থেকে জোড়া পাখি মারতে হবে।

আমেরিকানটি ফুল-টাইম প্রফেশন্যাল। স্পেন, পর্তুগাল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা আর গত বছর পর্যন্ত মোনাকো সহ ভ্রমণ করত এ ছেলে। কিন্তু ছোট্ট দেশটাতে এই খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে যখন গুরুতর আহত একটা কবুতর স্টেডিয়াম পার হয়ে রাজপ্রাসাদের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেয়ে অবশেষে আছড়ে পড়েছে রাজকুমারী গ্রেস’র চায়ের টেবিলে। লেসের টেবিল ক্লথ আর লেডিসদের টি গাউনে ছিটিয়ে পড়েছে রক্ত। ক্ষুদ্র রাজ্যের পুরো অধের্ক জুড়ে শোনা গেছে চিৎকার। আর তারপর থেকেই মোনাকোতে জীবন্ত কবুতর খেলা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।

আমেরিকানটার বয়স ইসাবেলারই মত। এখনো পঁচিশও হয়নি। কিন্তু এরই মাঝে বছরের কোটি ডলার আয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। গুলি ছুড়ছে “সাইড বাই সাইড” বারো গজ দিয়ে; যেটি প্রায় শতবর্ষ আগে তৈরি করে গেছেন কিংবদন্তী অস্ত্রনির্মাতা জেমস মার্টিন, তবে আধুনিক আমলের লম্বা কার্টিজ আর ধোঁয়াবিহীন পাউডার ব্যবহার করার মতো সংশোধন আনা হয়েছে এর নকশায়।

নিজের শ্যুটিঙের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল তরুণ আমেরিকান। বন্দুকের হ্যাঁমার টেনে, ডান হাতের তালুতে হাতল ধরে জোড়া মাজল তাক করল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে থেকে ত্রিশ গজ সামনে অর্ধ বৃত্তাকারে ঝোলানো পাঁচটা ঝুঁড়ির ঠিক মাঝখানে।

প্রতিটি ঝুড়িতে আছে একটা করে কবুতর। বেশির ভাগ বড় শহরের মাঝে ঝাঁক বেঁধে বাস করে এ জাতীয় বন্য পাখির দল।

পাখিদের মজুদ নিশ্চিত করার জন্য শু্যটিং ক্লাব ফিডিং শেড তৈরি করেছে। ট্রে অলা কাঠামোতে প্রতিদিন রাখা হয় গমের গুঁড়ো। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ফিডিং বার্ড এলেই আটকে দেয়া হয় ফাঁদের দরজা। প্রায়ই দেখা যায় যে কিলিং গ্রাউন্ড থেকে বেঁচে যাওয়া কবুতরগুলো উড়ে আবার ফিরে আসে এই ফিডিং শেডে। আগেও বহুবার মারা গেছে অসংখ্য পাখি। এই ছোট্ট প্রাণীগুলোও তাই বের করে ফেলেছে কিভাবে এড়িয়ে যেতে হয় গুলি, সেই কৌশল। এর উপর আবার পাখিগুলোকে যারা কুঁড়িতে রাখার দায়িত্ব পায়, তারা জানে কিভাবে পাখনা কিংবা লেজ থেকে একটা কি দুটো পালক খুলে নিলেই এলোমেলোভাবে অনিশ্চিৎ দিকে উড়ে যাবে প্রাণীগুলো।

শ্যুটার “পুল” বলার সাথে সাথে এক থেকে পাঁচ সেকেন্ডের মাঝে খুলে যায় কুঁড়ি। আর এই পাঁচ সেকেন্ড, দুরু দুরু বুকে ঘামতে থাকা, হাজার হাজার ডলারের টেনশন করা কারো জন্য ঠিক যেন অনন্তকালেরই সমান।

ঝুড়িগুলোর দূরত্ব ত্রিশ গজ আর ১২ গজ শটগানের রেঞ্জ সাধারণত চল্লিশ গজ ধরা হয়। আর ঘুরে আসার সার্কেলটাকে রাখা হয়েছে খুঁড়ির লাইনের দশ গজ পিছনে।

এটা মাত্র আট ইঞ্চি উঁচু একটা কাঠের দেয়াল। সাদা রং নির্দেশ করছে কিলিং গ্রাউন্ডের সীমানা। জিতলে হলে পাখির মরা দেহ কিংবা খণ্ডিত দেহের সবচেয়ে বড়অংশ কাঠের দেয়ালের ভেতর পড়তে হবে। তাই সীমানা পার হবার আগেই ছাড়া পাবার দশ গজের ভেতর পাখিটাকে মেরে ফেলতে হবে।

সামনে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি অর্ধবৃত্তাকারে দুলছে ঝুঁড়িগুলো। জানার কোনো উপায় নেই যে “পুল” বলার সাথে সাথে কোন ঝুঁড়িটা খুলে যাবে কিংবা পাখিটা কোন দিকে উড়ে যাবে। ডানে-বামে; দূরে যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারে আর সবচেয়ে বাজে হলো কখনো কখনো সোজা শু্যটার এর দিকেই উড়ে আসে।

দ্রুত আর শব্দ করে উড়ে বেড়ানো কবুতরের ক্ষেত্রে এখন আবার নিয়ম করা হলো একসাথে দুটো করে পাখি ছাড়া হবে।

খানিকটা হামাগুড়ির ভঙ্গিতে নিজের জায়গা আঁকড়ে ধরল আমেরিকান ছেলেটা। বক্সারদের মতো করে বাম পাটা খানিক এগিয়ে রয়েছে। হালকাভাবে রামোনের হাতে চাপ দিল ইসাবেলা। দু’জনে বসে আছে প্রতিযোগী আর ক্লাব অফিসারদের জন্য সংরক্ষিত। সামনের দিকে নিচের সারির চামড়ায় সোজা চেয়ারে।

“পুল!” আমেরিকানটা চিৎকার করে উঠতেই মনে হল ওর টেক্সান গলার স্বর এমনভাবে নীরবতা ভেঙে ফেলেছে যেন কামারের নেহাই এর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে।

“যাতে না লাগে!” ফিসফিস করে উঠল ইসাবেলা। “ফ্রিজ মিস্ হোক গুলি!”

প্রথম দুই সেকেন্ডে কিছুই ঘটল না। এরপরই শব্দ করে খুলে গেল দুটো ঝুডির ঢাকনা। আমেরিকানটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে খানিকটা বামে আর পুরোপুরি ডানে’র দুই আর পাঁচ নম্বর ঝুড়ি। ঝুড়ির তলা’র আটকে থাকা বাতাসে আঘাত পেয়ে আস্তে আস্তে উড়ে গেল পাখিগুলো।

দুই নম্বর পাখিটা নিচু দিয়ে দ্রুত উড়ে গেল। খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই কাঁধে শটগান তুলে গুলি ছুড়ল আমেরিকান ছেলেটা। ঝুড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচ গজ যেতে না যেতেই ভবলীলা সাঙ্গ হল পাখিটার।

দ্বিতীয়টির দিকে নজর দিল ছেলেটা। বার্নিশ করা তামার মতো চকচকে শরীর নিয়ে ডানদিকে উড়তে থাকা পাখিটা গুলির শব্দে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘুরছে। ফলে নিশানা ঠিক করতে পারল না ছেলেটা। হার্ট, আর ব্রেইন ফুটো না করে পাখিটার ডান পাখা ভেঙে দিল গুলি। বাতাসে পালক ছড়িয়ে টলমল করে নামতে লাগল আহত পাখি।

নিচু সাদা কাঠের দেয়ালের মাত্র ফুটখানেক ভেতরে আছড়ে পড়ল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল দর্শকেরা। এরপরই অবিশ্বাস্যভাবে একটা পাখা বিহীন পাখিটা উন্মাদের মতো নাড়তে লাগল বাকি পাখনা। উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক সাথে দাঁড়িয়ে গেল সব দর্শক। অন্যদিকে একেবারে মাঝখানে কাঁধে শটগান নিয়ে বরফের মতো জমে গেল আমেরিকান ছেলেটা। মাত্র দুই কার্টিজ দেয়া হয়েছে ওকে। তাই তৃতীয় কার্টিজ লোড় করে পাখিটাকে মেরে ফেললে তৎক্ষণাৎ তাকে বাতিল ঘোষণা করে কেড়ে নেয়া হবে পুরস্কারের অর্থ।

ব্যারিকেডের কাছে গিয়ে দুর্বলভাবে লাফ দিল কবুতরটা। উপর থেকে ইঞ্চি খানেকের জন্য বুক বেঁচে গেল কাঠের দেয়ালে বাড়ি খাবার হাত থেকে। আর তারপরই পড়ে গেল। সাদা রঙের উপর উজ্জ্বল লাল রঙের ছিটে লাগল।

দর্শকদের অর্ধেক চিৎকার করে উঠল, “মরে গেছে!” অন্যদিকে আমেরিকান ছেলেটা’র বিরুদ্ধ সমর্থকেরা চিৎকার করে উঠল, “চলে যারে পাখি, যা!”

নিজের সর্বশক্তি এক করে আরো একবার লাফ দিল কবুতরটা। এবারে উপরে পৌঁছে অনিশ্চিতভাবে আগু-পিছ টলতে রইল আহত প্রাণীটা।

অন্যদের সাথে ইসাবেলা নিজেও বন্য উন্মাদে চিৎকার করছে, “লাফ দে।” অনুনয়ের সুরে বলে উঠল, “নাহ্-ওহ, মরিস না রে সোনা! উড়ে যা, প্লিজ।”

হঠাৎ করেই ঝাঁকি দিয়ে উঠে শক্ত হয়ে গেল পাখিটার দেহ। ঘাড় পেছনের দিকে বেঁকে পড়ে গেল দেয়াল থেকে, সবুজ লনের উপর পড়ে রইল নিথর হয়ে।

“থ্যাঙ্ক ইউ!” হাপ ছেড়ে নিজের আসনে এসে বসল ইসাবেলা।

সামনের দিকে পড়ে যাওয়ায় সার্কেলের বাইরে মারা গেছে কবুতরটা। মাথার উপরে থাকা লাউড স্পিকার গম গম করে শুনিয়ে দিল ফলাফল। স্প্যানিশ ভাষায় হলেও গত দুই দিনে তা ভালোভাবেই শিখে গেছে ইসাবেলা।

“ওয়ান কি। ওয়ান মিস্।”

“আমি আসলে এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।” নাটকীয় ভঙ্গিতে পেট চেপে ধরতেই শীতল সবুজ চোখ জোড়া তুলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রামোন।

“নিজের দিকে তাকাও। একেবারে একটা বরফের মত। তুমি কি কোনো কিছুই অনুভব করো না?”

“তোমার বিছানার বাইরে কিছুই না আসলে।” বিড় বিড় করে জানাতেই লাউড স্পিকারে শোনা গেল, “নেক্সট গান আপ নাম্বার ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড টেন!”

যুৎসই কোন জবাব দেয়ার ফুরসৎ পেল না ইসাবেলা।

উঠে দাঁড়াল রামোন। একই রকম শীতলভাবে কানের উপর ঠিকঠাক করে বসিয়ে নিল প্রটেক্টর। ইসাবেলা’কে শিখিয়েছে যেন তাকে কখনো সৌভাগ্যের জন্য উইশ না করে। তাই মেয়েটাও কিছু বলল না। গেইটের কাছে লম্বা র‍্যাকে রাখা একমাত্র অস্ত্রটা নামিয়ে হাতে নিয়ে উজ্জ্বল আইবেরীয় সূর্যালোকে বেরিয়ে এলো রামোন।

মুগ্ধ হয়ে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। নিজ জায়গামতো এসে পেরাডিজ ১২ গজ লোড় করে ব্রিচ বন্ধ করে দিল রামোন। আর তারপরই কেবল কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল ইসাবেলার দিকে। গত দুদিন ধরেই গুলি ছোঁড়ার সময়ে এ কাজটা করে আসছে। বেলাও জানতো তাই দুই হাত বাড়িয়ে রামোন’কে দেখাল মুষ্টিবদ্ধ হাত।

ঘুরে দাঁড়িয়েই মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল রামোন। আরো একবার আফ্রিকান বিড়ালের কথা মনে পড়ে গেল বেলার। আমেরিকান ছেলেটার মতো হামাগুড়ি নয়, সটান দাঁড়িয়ে থেকে মোলায়েম স্বরে উচ্চারণ করল, “পুল!” মুক্তি পেয়েই বন্যভাবে পাখা ঝাঁপটাতে শুরু করে দিল দুটো পাখি। মনে হল কোনো তাড়াহুড়া নেই এমন অভিজাত ভঙ্গিতে অস্ত্র তুলে নিল রামোন।

মেক্সিকোতে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে থাকাকালীন লিবারেশন আমির ফান্ডের অনেকটুকুই খরচ হত গুয়াভালাজারা’তে শটগান দিয়ে জীবন্ত কবুতর মারা’য় রামোনের প্র্যাকটিসের পেছনে। তাই পেশাদারদের মতো তারও আছে এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ময়কর দৃষ্টি শক্তি আর প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা।

প্রথম পাখিটা দ্রুত উজ্জ্বল সবুজ পাখা ছড়িয়ে উড়ে চলল দেয়ালের দিকে। নিচের ব্যারেল থেকে ছয় নম্বর শটে চমৎকারভাবে গুলি করল পাখিটাকে। ফেটে যাওয়া বালিশের মতো পালক ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হল অবোধ প্রাণীটা।

এবারে, নর্তকীর মতো ঘুরতে থাকা দ্বিতীয় পাখির দিকে নজর দিল রামোনএই কবুতরটা বেশ অভিজ্ঞ। এর আগেও কয়েকবার গুলি ছোড়া হয়েছে ওর দিকে। তাই ঝুঁড়ির কাছাকাছিই নিচেই রইল। দেয়ালের দিকে না গিয়ে সোজা নেমে আসতে লাগল রামোনের মাথা লক্ষ্য করে। রেঞ্জ দশ ফুট কমে যাওয়ায় গুলি লাগানো বেশির ভাগ সময়েই কষ্ট হয়ে পড়ে। চোখের সামনে ঝলকানি দেখে সেকেন্ডের শত ভাগের এক ভাগ মাত্র সময় পেল প্রতিক্রিয়া করার। রামোনের মনে হলো একটাই মাত্র গুলি ছোঁড়ার সুযোগে যদি ভুল হয়ে যায়, অথবা অ্যাংগেলে গণ্ডগোল হয় তাহলেই সর্বনাশ ঘটে যাবে।

পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে চৌকোণাভাবে কবুতরটার মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করল রামোন। রক্তমাখা পাখা নিয়ে নিথর দেহ ছিটকে পড়ল দূরে। অক্ষত রইল কেবল দুটো পালক। গোত্তা খেয়ে এসে পড়ল রামোনের পায়ের কাছে।

পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলো ইসাবেলা। এক ঝটকা মেরে ভেঙে ফেলল ব্যারিয়ার। দুর্বোধ্য স্প্যানিশে রেঞ্জ মাস্টার কিছু বললেও কে শোনে কার কথা। লম্বা, ডেনিমে মোড়া পা দুটো দৌড়ে এলো রামোনের কাছে।

এতক্ষণ উত্তেজনা আর টেনশনে দর্শকেরাও কাহিল হয়ে পড়েছিল। রামোন আর ইসাবেলা এবারে স্টেডিয়ামের মাঝখানে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সবাই হাততালি দিল হাসতে হাসতে। সুদর্শন এই জুটির দু’জনেই অত্যন্ত লম্বা, অ্যাথলেটিক, স্বাস্থ্য আর তারুণ্যে ভরপুর। অন্যদিকে ভালোবাসার এই স্বচ্ছন্দ্য বহিঃপ্রকাশ ছুঁয়ে গেল দর্শকদের হৃদয়।

***

এয়ারপোর্টে ইসাবেলার ভাড়া করা মার্সিডিজে চড়ে শহরে এলো দু’জনে। মেইন স্কোয়ারের বাঙ্কো ডি এসপানাতে একটা একাউন্ট ওপেন করে বিজয়ীর চেক জমা দিল রামোন।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো অর্থের ব্যাপারে দুজনেরই মনোভাব এক। কোনো কিছুর দাম নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না ইসাবেলা। রামোন খেয়াল করে দেখেছে, কোনো পোশাক কিংবা গয়না পছন্দ হলে দাম জিঙ্গেস না করেই নিজের ব্যাড় খুলে প্ল্যাস্টিক ক্রেডিট কার্ডের বিশাল কালেকশন থেকে একটা তুলে রেখে দেয় কাউন্টারে। স্লিপে সাইন করে একইভাবে না দেখেই কপি রেখে দেয় ব্যাগের ভেতর। হোটেল রুমে ব্যাগ উপুড় করে সব স্লিপ দিয়ে বল বানিয়ে অতঃপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় ট্র্যাশবিনে।

এছাড়াও মেয়েটার সাথে থাকে এক তোড়া ব্যাংক নোট। যদিও স্টালিং আর স্প্যানিশ পেসেতাসের বিনিময় মূল্য নিয়ে ভাবিত নয় ইসাবেলা। প্রায়ই দেখা যায় এক কাপ কফি কিংবা এক গ্লাস ওয়াইনের বিল মেটাতে গিয়ে সাইজ আর রং দেখে যে কোনো একটা ব্যাংক নোট সিলেক্ট করে রেখে দেয় টেবিলে আর পেছনে নির্বাক বিস্ময় নিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওয়েটার।

একই কথা খাটে রামোনের বেলাতেও। প্রথমতো পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার ভিত্তি আর নিদর্শন হিসেবে একে অবজ্ঞা করে ছেলেটা। অন্যদিকে দায়িত্ব পালন করার জন্য ক্যাশ চাইতে গিয়ে মস্কোর সাথে যে পরিমাণ দেনদরবার করতে হয় তাতেও অরুচি ধরে গেছে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই বুঝে গেছে উপর অলারা তাকে কতটা অর্থ অনুমোদন দেবে, তাই অনেক অপারেশনের খরচ সে নিজেই বহন করে।

মেক্সিকোতে এভাবেই জীবন্ত কবুতর গুলি করে মারত। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মাদক এনে ক্যাম্পাসে বিক্রি করত। ফ্রান্সে থাকার সময় আলজেরীয়দের হয়ে অস্ত্র চালাত। ইটালীতে চোরাকারবারী ছাড়াও যুক্ত ছিল চারটা অপহরণ কার্য পরিচালনার সাথে।

আর এসব অপারেশনের অর্থই পৌঁছে গেছে হাভানা আর মস্কোতে। এর ফলেই দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে এ বয়সেই নির্বাচিত হয়েছে জেনারেল সিসেরোর স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য।

এবারেও প্রথম থেকেই লাল গোলাপের মতো অভিযানে সিসেরো যতটা অর্থ বরাদ্দ করেছেন তা অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে যতটা সম্ভব পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা ছাড়াও অপারেশনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য স্পেনকে বেছে নিতে হয়েছে।

রোমোনের বিজয়কে উদযাপনের জন্য ছোট্ট একটা সী-ফুড রেস্টোরেন্টে এসে বসল দুজনে, ডিনার গেস্টদের মাঝে ইসাবেলাই একমাত্র বিদেশি।

ক্ল্যাসিক্যাল ট্রাডিশন অনুযায়ী তৈরি অসম্ভব সুস্বাদু খাবারের সাথে পরিবেশন করা হলো কোনো এক সময় রামোন’দের পরিবারিক সম্পত্তি ছিল এমন এক এস্টেট থেকে আসা ওয়াইন; স্পেনের বাইরের আর কোথাও বিক্রি হয় না এ উপাধেয় পানীয়।

ওয়াইনের স্বাদ নিয়ে মুগ্ধ ইসাবেলা জানতে চাইল, “তোমাদের পারিবারিক এস্টেটগুলো কী হয়েছে?”

“ফ্রাঙ্কো ক্ষমতায় আসার পর সব হারিয়ে ফেলেছে বাবা।” গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু রেখে রামোন জানাল, “প্রথম থেকেই তিনি অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ছিলেন।”

বুঝতে পেরে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল ইসাবেলা। তার বাবাও আজীবন ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছেন।

“তোমার বাবা আর পরিবার নিয়ে আমাকে কিছু জানাবে না?” রামোনকে নিমন্ত্রণ করল বেলা। উপলব্ধি করল প্রায় সপ্তাহখানেক একসাথে থাকলেও ডিনার টেবিলে স্প্যানিশ চার্জের দেয়া তথ্য ছাড়া ছেলেটা সম্পর্কে আর কিছুই জানে না সে।

হা হয়ে তাই শুনল রামোনের স্মৃতিচারণ। ১৪৯২ সালে কলম্বাসের সাথে আমেরিকা আর ক্যারিবীয়তে আসার পর পদবী লাভ করেছিল ওর পূর্বপুরুষ। এহেন পূর্ব ইতিহাস জানতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা।

নিজের কথা জানাতে গিয়ে বলল, “প্রপিতামহ শন কোর্টনির বংশধর আমরা। উনিশ শতকের কোন এক সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর এসময় খেয়াল হল, যদি রামোন সন্তানের জনক হয় তাহলে কোন একদিন তার নিজের ছেলেও গর্ব ভরে উচ্চারণ করবে এই ইতিহাস। এর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শুধু রামোনের সাথে থাকতে পারাটাই আনন্দের ছিল; কিন্তু এখন মোমবাতির আলোয় সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে দিগন্তে ডানা মেলল স্বপ্নেরা।

“আর এতসব সত্ত্বেও, বেলা, বুঝতেই পারছ আমার কোনো টাকা-পয়সা নেই।”

“হ্যাঁ, সেটাই। আজ বিকেলেই তো দেখলাম ব্যাংকে দুই কোটি ডলার জমা দিয়েছ।” হালকাভাবে বলে উঠল, “অন্তত আরেক বোতল ওয়াইন তো কিনে দিতে পারবে।”

“যদি তোমাকে কাল সকালেই লন্ডন ফিরতে না হত, তাহলে এই অর্থের কিছুটা খরচ করে তোমাকে গ্রানাডা নিয়ে যেতাম। ষাড়ের লড়াইয়ে সঙ্গ দেয়াসহ দেখাতাম সিয়েরা নেভাডাতে আমাদের পারিবারিক

“কিন্তু তোমাকেও তো লন্ডন ফিরতে হবে, তাই না?”

“হুম কয়েকটা দিন ম্যানেজ করে নিতে পারব।”

“রামোন, তুমি যে কী করো, আমি তাও জানি না। উপার্জন করো কিভাবে?”

“মার্চেন্ট ব্যাংকিং।” অস্পষ্টভাবে মাথা ঝাঁকাল রামোন। “প্রাইভেট একটা ব্যাংকের হয়ে কাজ করি। দায়িত্ব হচ্ছে আফ্রিকান বিষয় সামলানো। মধ্য আর দক্ষিণ আফ্রিকার উন্ননশীল কোম্পানিগুলোর জন্য ঋণ সরবরাহ করি।”

চিন্তার ঝড় বইছে ইসাবেলার মাথায়। কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের টপ লেভেলে মার্চেন্ট ব্যাংকারের জন্য নিশ্চয়ই একটা জায়গা তৈরি হয়ে যাবে। সবকিছুই বেশ চমৎকারভাবে এগোচ্ছে।

“তোমার দুর্গটা দেখার চেয়ে দুনিয়াতে আর কোনো জরুরি কাজ নেই আমার, রামোন ডালিং।” ফিসফিস করে জানিয়েই মনে হলো : একটা দুর্গের কতটা দাম হতে পারে, গ্যারি’কে অনায়াসে এর কথা বলা যাবে। কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আর ফিনান্সিয়াল হেড হল গ্যারি। পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের চেয়ে ইসাবেলা’র সবচেয়ে কাছের এই ভাই।

“আর তোমার বাবা? আমি তো জানি যে তুমি সোমবারে ফেরার কথা প্রতিজ্ঞা করে এসেছ।” জানতে চাইল রামোন।

“বাবা’কে মানানোর ভার আমার উপর ছেড়ে দাও।” দৃঢ় স্বরে জানাল ইসাবেলা।

***

“বেলা, এটা কোনো সময় হলো কাউকে ঘুম থেকে জাগানোর?” টেলিফোনে বলে উঠলেন শাসা। “কয়টা বাজে বল তো?”

“ছয়টার বেশি বাজে, আমি এরই মাঝে সাঁতার কেটে এসেছি আর তুমি মোটেও বুড়ো হয়ে যাওনি, ড্যাডি। আমার দেখা সবচেয়ে তরুণ আর সুদর্শন পুরুষ হচ্ছ তুমি।” ইন্টারন্যাশনাল লাইনে বাবার সাথে আহলাদী করল বেলা।

“আমার তো ভয় হচ্ছে রে।” বিড়বিড় করে উঠলেন শাসা। “প্রশংসা যত বেশি আবদারও তত ভয়ংকর। কী চাস রে বেটি? এবারে কোন মতলব?”

“তুমি আসলেই খালি দোষ খুঁজে বেড়াও, বাবা।” রামোনের বুকের পশম নিয়ে খেলতে খেলতে উত্তর দিল বেলা। ডাবল বেডে ঘর্মাক্ত দেহে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। “আমি তো শুধু এটুকু জানাতে চাইলাম যে আই লাভ ইউ পাপা।”

মুখ টিপে হাসছেন শাসা। “কতটা দায়িত্বশীল এই ছোট্ট ইন্দুরটা। ভালই শিক্ষা দিয়েছি।” বালিশে হেলান দিয়ে পাশে শুয়ে থাকা নারীর কাঁধে তুলে দিলেন মুক্ত হাতখানা। ঘুমের মাঝেই কাছে সরে এলো নারীদেহ। মুখ ঘসল শাসার বুকে।

“হ্যারিয়েট কেমন আছে?” স্পেনে ইসাবেলার অভিসারকে কাভার দিতে রাজি হয়েছে হ্যারিয়েট বু-চ্যাম্প।

“ও ভালো আছে।” আশ্বস্ত করল বেলা। “এই তো এখানেই আছে। চমৎকার সময় কাটছে আমাদের।”

“ওকে আমার ভালোবাসা দিও।” জানালেন শাসা।

“ওহ, ঠিক আছে।” মাউথপিসে হাত দিয়ে ঝুঁকে রামোনকে কিস করে বেলা জানাল, ‘আজ সকালের লন্ডনের প্লেন ধরতে চাইছে না ও।”

“আহ! তো এবারে এলো আসল কথা।”

“আমি না ড্যাডি, হ্যারিয়েট ও গ্রানাডাতে যেতে চায়। বুলফাইটে আমাকেও নিতে চাইছে।” আস্তে করে চুপ হয়ে গেল বেলা।

“বুধবারে তুমি আর আমি প্যারিস যাব, ভুলে গেছ? ক্লাব ডিমানছে’তে আমার বৃক্ততা আছে।”

“ড্যাডি, তুমি এত চমৎকারভাবে কথা বলো! ফ্রেঞ্চ লেডিসরা’ও যথেষ্ট সমাদর করে, আমি নিশ্চিত আমাকে তোমার দরকারই হবে না।”

খানিক কোনো কথা বললেন না শাসা। মাউথপিসে হাত রেখে বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকা নারীর কাছে জানতে চাইলেন,

“কিটি, বুধবারে প্যারিস যেতে পারবে।”

চোখ খুলে উত্তরে জানাল, “তুমি তো জানো আমি শনিবারেও এইউ কনফারেন্সের জন্য ইথিওপিয়া যাচ্ছি।”

“ততদিনে আমরা চলে আসব।”

কনুই এর উপর র দিয়ে উঠে চিন্তার ভঙ্গিতে শাসার দিকে তাকিয়ে সঙ্গিনী জানাল, “ঠিক আছে শয়তান, তাই হবে।”

“ড্যাডি, তুমি শুনছ?” দুজনের মাঝে ছেদ টানল বেলা।

“তো আমার নিজের দেহ আর মাংস আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে, তাই না?” আহত হয়েছেন এমন স্বরে জানালেন শাসা। “দুনিয়ার সবচেয়ে রোমান্টিক শহরে একাই যেতে হবে।”

“আমি তো হ্যারিয়েটকেও মানা করতে পারি না।” ব্যাখ্যা দিল বেলা। “তুমিই তাহলে বলল কী করব?”

“মনে রেখো। ইয়াং লেডি। ভবিষ্যতে এই অকৃতজ্ঞতা মনে রেখো।”

“মনে হচ্ছে গ্রানাডাটা ভয়ংকর বোরিং হবে। তোমাকে মিস্ করব পাপা।” রামোনের পেটে, বুকে, পেটের নিচে আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে বলে উঠল বেলা। যেন নিজের কাজ নিয়ে সে বেশ অনুতপ্ত।

“আর তোমাকে ছাড়া আমারও ভাল লাগবে না, বেলা।” একমত হলেন শাসা। ক্রেডলে টেলিফোন সেট রেখেই কিটিকে আলতো করে ঠেলে দিলেন বালিশের উপর। “এবারে উপরে উঠে এসো শয়তান।” ঘুম জড়ানো স্বরে জানাল শাসার সঙ্গিনী।

***

রামোনের পরিচিত যে কোনো পুরুষেরই ন্যায় দ্রুত আর দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে ইসাবেলা। ভাড়া করা মার্সিডিজের চামড়ায় মোড়া বাঁকানো আসনে বসে খোলাখুলিভাবেই তাই পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে মেয়েটাকে।

বছরের পর বছর ধরে পূর্ণ করা অ্যাসাইনমেন্টগুলোর মতো করে এবারেও নিজের অংশ পালন করতে রামোন’কে খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না। এর পাশাপাশি আবার মেয়েটার ভেতরের শক্তি, অসম্ভব সাহস আর অখণ্ড প্রত্যয় দেখে উৎসাহ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।

বুঝতে পেরেছে অসন্তুষ্ট আর অপূর্ণতা বোধে ভুগতে থাকা চঞ্চল মেয়েটা খুঁজে ফিরছে এমন কোনো চ্যালেঞ্জ, এমন কিছু একটা যার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা যায়।

শারীরিকভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়াতে মেয়েটার প্রতি মিথ্যে আগ্রহ দেখাতে রামোন’কে কোনো বেগ পেতে হয়নি। তাই ইসাবেলার দিকে যখনই তাকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ হয়ে যায়। তার দৃষ্টির আকুলতা বোঝে মেয়েটা। সাপের শীতল সবুজ দৃষ্টি দেখে যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে বন্য পাখি। এছাড়া ফাইলেও পড়েছে, অন্য পুরুষদের সাথে আগেও থেকেছে ইসাবেলা। কিন্তু গত কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে অন্তঃস্থলে মেয়েটার গভীর সত্তা এখনো অনাঘ্রাতা কুমারীরই ন্যায় আর অদ্ভুত এই সীমানায় পৌঁছাতে তাই ব্যাকুল রামোন।

কিংবদন্তীতুল্য অন্যান্য পুরুষ প্রেমিকদের মতো রামোন নিজেও স্বাদ পেয়েছে অসংযত যৌন-কামনার। শব্দটা এসেছে রোমান পৌরাণিক কাহিনীর সেসব অর্ধ-পুরুষ আর অর্ধ-পশু দেবতাদের কাছ থেকে যাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা কখনো তৃপ্ত হত না। যে কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করা রামোন মাচাঁদের অবস্থাও ঠিক তাই। পাটনারকে নিঃশেষ করে দিতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না সঙ্গিনী নিজেই চিৎকার করে দয়াভিক্ষা চায়। কিন্তু অর্গাজম প্রাপ্তি বেশির ভাগ সময়েই দুরূহ হয়ে পড়ে।

যাই হোক, পাশের ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা এই নারী সেসব দুর্লভ প্রাণীদের একজন যারা তাকে এক্ষেত্রে হারিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার সাথে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই সত্যিকারের রাগমোচনের স্বাদ নেয়া রামোন জানে ভবিষ্যতে আরও পাবে। তবে এটাও তার পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

গ্রীষ্মের গুমোট আবহাওয়াতেও উপকূল থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে যারপরনাই খুশি আর উত্তেজিত ইসাবেলা অনুভব করল যে সে প্রেমে পড়েছে। মনে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই যে আগে আর কখনো এমনভাবে কাউকে চায়নি। পাশে বসে থাকা ছেলেটা আর তার সবুজ দৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সূর্যের তেজ হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল, সিয়েরার উষ্ণ বাতাস মনে হচ্ছে অত্যন্ত কোমল।

চারপাশের সমতল ভূমি আর পর্বতগুলো মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা। মনে পড়ে গেল বিশাল কারু’র খোলা দিগন্তের কথা। সেখানকার জমিনও একই রকম সিংহ রঙা আর পাথরগুলো গাঢ় বাদামি। উচ্ছল আনন্দে ভেসে যেতে যেতে মন চাইল চিৎকার করে বলে উঠে, “ওহ, রামোন, মাই ডালিং আই লাভ ইউ। আমার দেহ-মন শুধু তোমাকেই ভালবাসে।”

যদিও আপন মনে পণ করে রেখেছে যে রামোন’কেই প্রথম স্বীকার করতে হবে ভালোবাসার কথা। তাহলেই প্রমাণিত হবে তার সত্যিকার ভালোবাসার নিশ্চয়তা।

রামোন এ পার্বত্য অঞ্চল ভালোভাবেই চেনে। তাই গড়পরতা ট্যুারিস্ট রুটে না গিয়ে বিশালতা আর আপন সৌন্দর্য নিয়ে লুকিয়ে থাকা পেছনের রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসেছে বেলা’কে। ছোট্ট গ্রামগুলোর একটায় থেমে নিয়ে এসেছে গোলাপি সেরানো হ্যাম কার্ডের টুকরা, চাষীদের বানানো শক্ত রুটি আর ছাগলের চামড়ায় করে মিষ্টি গাঢ় রঙের মালাগা ওয়াইন।

গ্রামের বাইরে প্রাচীন এক পাথরের সেতুর পাশে মার্সিডিজ পার্ক করে মিয়েরা নেভাডা’র পাদদেশ থেকে নদীটাকে অনুসরণ করে জলপাই বনের ভেতর দিয়ে পথ চলল দু’জনে। নদীর গোপন একটা অংশে এসে উলঙ্গ দেহে স্নান করার সময় উপরের চূড়া থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দাঁড়িঅলা পাহাড়ি ছাগল। একই অবস্থায় পিকনিক লাঞ্চ খেয়ে নিল মসৃণ কালো পাথরের উপর বসে।

রামোন দেখিয়ে দিল কেমন করে হাতের উপর রেখে চামড়ার থলে থেকে ওয়াইন খেতে হবে। অথচ চেষ্টা করতে গিয়ে ইসাবেলার গাল আর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ফোঁটা ফোঁটা ওয়াইন। ওর আবদার শুনে জিভ দিয়ে চেটে নিল রামোন। আর এতটাই মজা হলো যে লাঞ্চ ভুলে উদ্দাম ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে উঠল দু’জনে।

হাঁটু পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে ইসাবেলাকে দেখছে রামোন। এখনো পাথরের উপর পড়ে আছে মেয়েটা। ফিসফিস করে বলে উঠল, “আমার পা দুটো মনে হচ্ছে জেলী অসাড় হয়ে গেছে। গাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে চলো।”

বিকেলের বেশির ভাগটাই পানির কাছে কেটে গেল।

সূর্য উঠে এলো পাহাড়গুলোর মাথায়। চোখে পড়ল দুর্গ।

ইসাবেলা যতটা ভেবেছিল ততটা বিশাল কিংবা জমকালো নয় দুৰ্গটা। গ্রামের মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা গাঢ় রঙা সাদামাটা একটা দালান। কাছে যেতেই দেখা গেল সামনের দিকে অযত্ন অবহেলায় জন্মে গেছে ঝোঁপ-ঝাড়। সীমানা প্রাচীনের বেশ কিছু অংশই ভেঙে পড়েছে।

“এখন এ জায়গার মালিক কে?” জানতে চাইল ইসাবেলা?

“রাষ্ট্র।” কাধ বাঁকাল রামোন। কয়েক বছর আগে শোনা গিয়েছিল পর্যটকদের জন্য হোটেল বানানো হবে; কিন্তু আদতে কিছুই হয়নি।”

বৃদ্ধ কেয়ারটেকার মনে করতে পারল রামোনের পরিবারের কথা। গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমগুলোতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল দু’জনকে। শূন্য রুমগুলোর ঝাড়বাতিতে জমে আছে ফুল আর ধুলা পারিবারিক ঋণ মেটানোর জন্য আসবাবপত্র বহু আগেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির দাগ লেগে আছে হলের দেয়ালে।

“অযত্ন-অবহেলায় একদা খুব প্রিয় ছিল এমন কিছুর এহেন দুদর্শা দেখাটা খুব কষ্টের।” ফিসফিস করে জানাল ইসাবেলা। “তোমার খারাপ লাগছে না?”

“চলে যেতে চাও?” পাল্টা প্রশ্ন করল রামোন।

“হ্যাঁ, আজকের দিনে মন খারাপ করতে চাই না।”

চুলের কাটার মতো সরু পথ ধরে গ্রামের দিকে যেতে যেতে দেখা গেল পাহাড়ের উপর সূর্য ডোবার অসাধারণ দৃশ্য।

গ্রামের সরাইখানার মালিক চিনতে পারল রামোনের পদবী। সামনের রুমের বিছানার লিনেন চাদর বদলে দিতে বলল দুই মেয়েকে আর স্ত্রীকে রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিল আন্দালুসিয়ার বিশেষ খাবার কসিদো মাদ্রিলেনো বানাবার জন্য। নুডলস এর উপর বসানো মসলাদার ছোট্ট চোরিজো সসেজ আর চিকেন স্ট্র দিয়ে তৈরি খাবারটা যুৎসই নাম পেয়েছে।

বেলা’র গ্লাস পূর্ণ করে দিতে দিতে রামোন জানালো, “স্পেনের লোকদের পানীয় হলো শেরী।” পাহাড়ি এলাকায় ঠাণ্ডা এত জেঁকে বসেছে যে পাথরের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে হলো। শিখার আভায় ছেলেটাকে মনে হল অসম্ভব রূপবান।

“মনে হচ্ছে আমরা কেবল এই তিনটা জিনিসই করব।”-গ্লাসের সোনালি ওয়াইনের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ বেলা বলে উঠল-”খাওয়া অথবা পান করা অথবা…ওয়াইনে চুমুক দিয়ে অসমাপ্ত রেখে দিল বাক্য।

“তোমার ভাল লাগছে না?” জানতে চাইল রামোন।

“অসম্ভব।” ক্ষুরধার দৃষ্টি হেনে বলে উঠল বেলা, “কসিদো আর শেরী শেষ করো, সিনর, অনেক শক্তি চাই তোমার।”

খোলা জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো পড়ে ঘুম ভেঙে গেল বেলার এবং যথারীতি রামোন নেই। কিন্তু না বড় সড় নরম বিছানাটায় পাশেই শুয়ে ঠাণ্ডা এক অভিব্যক্তি নিয়ে ওকে দেখছে ছেলেটা।

“ওহ, গড!” বুঝতে পারল ওকে পেতে অধীর হয়ে আছে রামোন। আনন্দের চোটে ফিসফিস করে বলে উঠল, “অসভ্য কোথাকার।” ওর মতো করে আর কেউ আগে চায়নি ইসাবেলাকে।

দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনায় বেগুনি ফি আর গোর্ট চিজ দিয়ে ওদের জন্য নাশতা রেখে গেছে ইন কীপার। নেইল পলিশ লাগানো লম্বা নখ দিয়ে চামড়া খুলে অত্যন্ত সুস্বাদু ফিগ রামোনের ঠোঁটে গুঁজে দিল ইসাবেলা। এই কাজটা একমাত্র বাবার জন্যই করত এতদিন।

সরাইখানার মালিকের দুই মেয়ের একজন ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে আসতেই এক্সকিউজ মি বলে উঠে বেডরুমে চলে এলো রামোন। বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে নিচের আঙ্গিনায় ইসাবেলা দেখা গেল হাসতে হাসতে নিজের সদ্য শেখা স্প্যানিশ জাহির করছে।

এর আগে ওয়াশবেসিনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে ওকে বার্থ কন্ট্রোল পিল খেতে দেখেছে রামোন। এক ধরনের হাস্যকর আনুষ্ঠানিকতাও করে এর সাথে, পানির গ্লাস নিয়ে টোস্ট করে বলে, “মেনি হ্যাপি রিটার্নস।” যাই হোক আপাতত টয়লেট ব্যাগে পাওয়া গেল না পিলগুলো।

বেডরুমে ফিরে এলো রামোন। মেঝের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই বিছানা রাখা।

দরজার পাশের পর্দা ঘেরা কুলুঙ্গির উপর জড়ো করে রাখা হয়েছে ওদের লাগেজ। স্যটকেসের উপর অনাদরে পড়ে আছে ইসাবেলা’র বড় সড় চামড়ার কাঁধের ব্যাগ।

একটু থেমে কান পাততেই ভোলা জানালা দিয়ে আবছাভাবে শোনা গেল মেয়েটার গলা। বিছানার উপর ব্যাগটা ফেলে তাড়াতাড়ি কিন্তু সাবধানে সব বের করে ফেলল। কেনসিংটন ফ্ল্যাটে সিকুইনের হ্যান্ড ব্যাগ খুলে বার্থ কন্ট্রোল পিলের ব্র্যান্ড চেক করে নিয়েছিল রামোন। পরে অ্যামব্যাসি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছে, যদি পিরিয়ডের দশম দিনের পূর্বে কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে অভ্যুলেশনের সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেড়ে যায় সে নারীর।

অবশেষে ব্যাগের তলায় পড়ে থাকা কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি কালো পাসের ভেতর পাওয়া গেল ওষুধের চিকন প্যাকেট। আরো একবার ঘাড় সোজা করে কান পাতল রামোন। আঙ্গিনা থেকে কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে তাড়াহুড়া করে দৌড়ে এলো জানালার কাছে। দেখা গেল ইন কীপারের কালো বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে বেলা।

আবারো তাই বেডরুমে ফিরে এলো নিজের কাজ শেষ করতে। প্যাকেট থেকে সাতটা ওষুধ মিসিং আছে। নিজের পকেট থেকে ওভাননের মতো হুবহু দেখতে আরেকটা প্যাকেট বের করল রামোন। এটা তাকে দিয়েছে অ্যামব্যাসির ডাক্তার। নিজের প্যাকেট থেকে সাতটা ওষুধ নিয়ে টয়লেট বোলে ফেলে দিয়ে ইসাবেলার পার্সে রেখে দিল বাকি ওষুধসহ প্যাকেটটা। আর অরিজিন্যাল ওষুধের প্যাকেট নিয়ে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিল। মেয়েটা জানতেও পারবে না যে বার্থ কন্ট্রোল পিলের পরিবর্তে সাধারণ অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট যাচ্ছে পেটে। সবশেষে হাত ধুয়ে সুবোধ বালকের মতো সিঁড়ি বেয়ে আঙ্গিনাতে অপেক্ষারত ইসাবেলার কাছে নেমে এলো রামোন।

***

গ্রানাডাতে ইসাবেলাকে করিডা ডি টোরোসে নিয়ে গেল রামোন আর তাদের ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন যে এল কোরডোবেস্ এর কাজও দেখতে পেল।

সামান্য নভিলেরো, থাকা অবস্থাতেও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এই ম্যাটাডোরের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন রামোনের বাবা। তাই তারা পৌঁছবার পরেই সকালবেলা হোটেলে রেখে যাওয়া হয়েছে দুটো টিকেট; নতুবা এতটা শর্ট নোটিশে টিকেট পাবার কথা নয়। রিং সাইডে প্রেসিডেন্টের বক্সের ঠিক ডানদিকে বসতে দেয়া ছাড়াও দর্শকদের সামনেই আমন্ত্রণ করা হয়েছে করিডা’র জন্য এল কোরডোবস এর ড্রেস দেখার জন্য।

হেমিংওয়ের ডেথ ইন দ্য আফটারনুন ইসাবেলাও পড়েছে। তাই সে বুঝতে পারল এহেন নিমন্ত্রণের মাহাত্ম। তারপরেও ম্যানুয়েল বেনিটেজ’র প্রতি রামোনের শ্রদ্ধা অথবা পোশাক পরিধানের এই প্রায়ই উপাসনার রীতির জন্য প্রস্তুত ছিল না মেয়েটা।

এনট্রি প্যারেডের ঢোলের আওয়াজ শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেছে উত্তেজনার ঢেউ। অত্যন্ত দর্শনীয় হল পুরো ব্যাপারটা : সোনা, রুপা আর মুক্তো দানা বসানো কস্টিউম পরানো ঘোড়াগুলো, অ্যামব্রয়ডারী করা খাটো জ্যাকেট আর স্কিন টাইট ট্রাউজার পরিহিত ম্যাটাডোর।

রিং এর মাঝে বের হয়ে এলো বঁড়। শিংঅলা মাথা উঁচু করতেই রাগে ফুলে উঠল কাঁধের বিশাল কুঁজ। পায়ের খুরের কাছ থেকে উড়তে লাগল সাদা ধুলা। ভিড়ের সাথে দাঁড়িয়ে ইসাবেলা নিজেও চিৎকার শুরু করে দিল।

এল কোরাডোবস এর প্রারম্ভিক আগমনের সাথে সাথে ইসাবেলার হাত ধরে ওর কাছে ঝুঁকে এলো রামোন। বর্ণনা করে বুঝিয়ে বলল বিভিন্ন অংশ। রামোনের চোখ দিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিষ্ঠুরতা আর বিয়োগান্তক গল্পের স্বাদ পেল বেলা।

ষাঁড়ের সাথে লড়াইয়ে বল্লমধারী অশ্বারোহী যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে স্যালুট জানানোর জন্য তারা প্রবেশের সাথে সাথেই বেজে উঠল বাজনা। আর দাঁতে দাঁত ঠেকে গেল ইসাবেলা’র। পেট ফেটে পায়ের সাথে নাড়িভুড়ি বেঁধে যাওয়ার পরিণতির ভয়ংকর সব ঘোড়াদের কথা শুনেছে মেয়েটা। ওর ভয় কাটাতে তুলা। ক্যানভাস আর চামড়ার মোটা দেহবর্ম দেখাল রামোন, যাতে রক্ষা পাবে অবলা জীবগুলো। সবশেষে দেখা গেল একটাও ঘোড়া একটুও ব্যথা পায়নি।

ঘোড়ার জিনের উপর বসে ষাঁড়ের পিঠে স্টিলের গুঁতো দিল বল্লমধারী যোদ্ধা। ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত।

ভয়ংকর এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ইসাবেলা ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল। রামোন বিড়বিড় করে জানাল : একেবারে সত্যিকারের রক্ত। এখানে যা দেখছ তার সবই সত্যি। জীবনেরই মতো সত্যি। এটাই জীবন, ডালিং জীবনের সমস্ত নিষ্ঠুরতা, সৌন্দর্য আর আবেগ এখানে পাবে।”

বুঝতে পেরে অবশেষে শান্ত হয়ে ঘটনার প্রবাহমানতায় নিজেকে সঁপে দিল বেলা।

নিজের ব্যান্ডেরিলাস তুলে নিল এল কোরডোবসস। রঙিন কাগজের ফিতে লাগানো লম্বা অস্ত্রটাকে মাথার উপর উঁচু করে সূর্যের আলোয় পোজ দিল লোকটা। এরপর ষাঁড়কে ডাকল। জম্ভটা কাছে আসতেই হালকা নাচের ছন্দে দৌড়ে গেল। একসাথে হতেই দমবন্ধ করে বসে রইল ইসাবেলা। কিন্তু ব্যান্ডে রিলাম মাটিতে গেঁথে ঘুরতে ঘুরতে দূরে চলে গেল মাস্টার। মাথা নামিয়ে রশিতে পুঁতো দিতে চাইল ষাঁড়টা।

ঢোলের আওয়াজে বোঝা গেল সর্বশেষ অঙ্ক, সত্যের ঘন্টার, সময় হয়ে গেছে। স্টেডিয়াম জুড়ে তৈরি হল নতুন এক পরিবেশ। ষাঁড় আর এলকোরডোবস নেচে একে অন্যকে সাথে নিয়ে মৃত্যু নৃত্যে মেতে উঠল। একে অন্যকে এত কাছ থেকে পাস করে যাচ্ছে যে প্রাণীটার কাঁধের রক্তের ছিটে এসে পড়ল ম্যাটাডোরের উরুতে।

অবশেষে প্রেসিডেন্ট বক্সের নিচে দাঁড়িয়ে কালো সিল্ক লাগানো নিজের মনতেরা টুপি খুলে বঁড়টাকে উৎসর্গ করার অনুমতি চাইল। ইসাবেলার আনন্দ বাঁধ ভেঙে গেল যখন লোকটা তার আসনের নিচে এসে ষড়টাকে উৎসর্গ করতে চাইল ওর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। মনতেরা ইসাবেলার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ষড়টার কাছে ফিরে গেল লোকটা।

রিং-এর একেবারে মাঝখানে সর্বশেষ পাস্ খেলল এল কোরডোবস। একটার চেয়ে অন্যটা হল আরো বেশি দর্শনীয়। প্রতিবার সমস্বরে চিৎকার করে উঠল বিমুগ্ধ দর্শক। অবশেষে একেবারে ইসাবেলার সিটের নিচে এসে উদ্যত হল ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার জন্য। লম্বা রূপার তরবারি বের করতেই ইসাবেলার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রামোন জানাল, “দেখো! সবচেয়ে। কঠিন কাজ, রেসিবিয়েন্দা। সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে যেতে চাইল ষড়টা। দৌড়ানোর পরিবর্তে চারকোণা করে দাঁড়িয়ে শিং এর গিয়ে পড়ল এল কোরডোবস। ছিঁড়ে গেল হৃদপিণ্ডের সবচেয়ে বড় ধমনী, ঝরনার মতো করে ছুটে এলো তাজা রক্ত।

যাঁড়ের লড়াই দেখে হোটেলে ফেরার পথে কেউই কোন কথা বলল না। রহস্যময় এক বোধে আপ্লুত হয়ে আছে দু’জনে। রক্ত আর পুরো ব্যাপারটার ট্র্যাজিক সৌন্দর্য এক ধরনের আত্মিক বেদনার সৃষ্টি করেছে যা কেবলই মুক্ত হবার পথ খুঁজছে। ইসাবেলা বুঝতে পারল তার চেয়েও বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে রামোন।

জোড়া দরজা আর রট আয়রনের ব্যালকনি লাগানো তাদের বেডরুম মুখ করে আছে পুরাতন মুরিশ রাজপ্রাসাদের দিকে। মেঝের একেবারে মাঝখানে ও’কে দাঁড় করাল রামোন। মাথার উপরে কর্কশ শব্দে ঘুরছে প্রাচীন আমলের ফ্যানের ব্লেড। বেলা’র পোশাক খুলে নিল রামোন। মনে হচ্ছে যেন সে নিজেও করিড়া প্রথা পালন করছে। হাঁটু গেড়ে বেলা’র কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিল পেটের নিচে। বেলা এতটা কোমলভাবে ওর মাথায় হাত রাখল যেন এই স্বর্গীয় ভালোবাসার যোগ্য নয় সে, নশ্বর মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এ বিশাল মহিমা বহন করা।

ছোট্ট শিশুর মতই কোলে তুলে ইসাবেলাকে বিছানায় নিয়ে গেল রামোন। মনে হচ্ছে যেন এর আগে কিছুই হয়নি অথবা অতল গহীনে লুকিয়ে রাখা শরীর আর আত্মার সেই গোপনীয়তায় প্রবেশ করেছে রামোন যার অস্তিত্ব বেলা নিজেও জানত না।

ছেলেটার বাহুতে এলেই স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত হয়ে যায় বেলা। যেন ধূমকেতুর ন্যায় উঠে যায় ঊর্ধ্বাকাশে স্বর্গের দিকে। সবুজ চোখ জোড়া দেখে বুঝতে পেয়ে দেহের ন্যায় রামোনের আত্মাও বিলীন হয়ে গেছে ওর মাঝে। যখন মনে হয় যে আর পারবে না, তখনই টের পায় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উষ্ণ তরল এসে ভরে যাচ্ছে শরীর।

দিনের শেষ আলো মরে যেতেই রুমের মাঝে দেখা গেল ছায়ার নৃত্য। নিঃশেষিত হয়ে কথা বলা কিংবা নড়া-চড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে বেলা; একটুকানি কাদার শক্তি আছে কেবল। অবশেষে নিদ্রা এসে সাঙ্গ করে দিল তাও।

***

২. মেয়েটার পৃথিবী উজ্জ্বল আর আনন্দময়

রামোন’কে পেয়ে আরো উজ্জ্বল আর আনন্দময় হয়ে উঠেছে মেয়েটার পৃথিবী।

দুনিয়ার বুকে স্বর্গ হয়ে উঠেছে প্রাণশক্তিতে ভরপুর শহর লন্ডন। সোনালি কুয়াশা মাখা উত্তেজনা ছেয়ে আছে চারপাশ। সোনার উপর বসানো মূল্যবান পাথরের মতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রামোনের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত।

তিন বছর আগে লন্ডনে এসে পড়াশোনা শুরু করার পর ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেছে ইসাবেলা। এরপর বাবার উৎসাহে ডক্টরেট করার জন্য ভর্তি হয়েছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল আর আফ্রিকান স্টাডিজ স্কুলে। থিসিসের বিষয় হিসেবে পছন্দ করেছে “আ ডিসপেনশেসন ফার পোস্ট কালোনিয়াল আফ্রিকা।” ভালই এগোচ্ছে থিসিস; আশা করছে কেপ টাউনে ফেরার আগেই শেষ করতে পারবে।

যাই হোক এ সমস্ত কিছুই রামোনের সাথে দেখা হবার আগের ঘটনা। স্পেন থেকে ফেরার পর একবারও নিজের শিক্ষকের সাথে দেখাও করেনি কিংবা বই খুলে দেখারও সময় পায়নি।

এখন বরঞ্চ রামোনের কাছে শিখছে জুড়ো আর আত্মরক্ষার রহস্য। মাঝে মাঝে আবার হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ায় গ্যালারি আর মিউজিয়ামে। আর সবকিছুই শেষ হয় কেনসিংটনে রামোনের ফ্ল্যাটের বিছানাতে গিয়ে। ভেবেও দেখে না ব্যাংকে সময় না দিয়ে ওর সাথে কিভাবে এত সময় কাটায় ছেলেটা। রামোনের সান্নিধ্য পেয়েই সে ধন্য, কৃতজ্ঞ।

উপরন্তু ব্যাংকের রহস্যময় কোনো এক প্রয়োজনে রামোন আটদিনের জন্য লন্ডন ছেড়ে যাবার পর কেমন নির্জীব আর মনমরা হয়ে গেল বেলা। প্রতীক্ষার বিরহে আকুল হয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর বমি করা শুরু করে দিল।

ফ্ল্যাটের সবকিছু গুছিয়ে রাখা। ফুল সাজানো আর চমৎকার সব রান্না নিয়ে ব্যস্ত রইল সারাক্ষণ।

অবহেলা করতে লাগল অ্যামবাসির দায়িত। অফিসিয়াল নিমন্ত্রণ বাতিল করে শেফ আর স্টাফদেরকে নিজেদের মতো করে কাজ করার উপর ছেড়ে দিল। উদ্বিগ্ন হয়ে শাসা একদিন মেয়েকে বললেন, “তুমি তো ঘরেই থাকো না

বেলা। একটা জিনিসের জন্যও তোমার উপর ভরসা করতে পারি না। এর উপর আবার ন্যানি জানাল, গত সপ্তাহে নাকি মাত্র দুদিন নিজের বিছানায় ঘুমিয়েছ।”

“ন্যানি তো গল্প বানাতে ওস্তাদ।”

“কী হয়েছে ইয়াং লেডি?”

“আমার বয়স একুশেরও বেশি ডালিং পাপা, আর তোমার সাথে তো আমার অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে যে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলতে বাধ্য নই।”

“তোমার সাথে এও অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে যে মাঝে মাঝেই আমার রিসেপশনে নিজের চেহারা দেখাবে।”

“চিয়ার আপ, পাপা।” বাবাকে কিস্ করে ঘুস দিতে চাইল মেয়েটা। “কয়েক মাসের মধ্যেই তো আমরা কেপ টাউনে ফিরে যাচ্ছি। তখন আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।”

সে সন্ধ্যাতেই রামোনের কাছে বেলা জানতে চাইল দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় লেখক অ্যালান প্যাটনের লন্ডন আগমন উপলক্ষে স্ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যামব্যাসিতে শাসার দেয়া ককটেইল পার্টিতে আসবে কিনা সে।

পুরো এক মিনিট ধরে সাবধানে চিন্তা করার পর মাথা নাড়ল রামোন। “তোমার বাবার সাথে দেখা করার জন্য সঠিক সময় এখনো আসেনি।”

“কেন না ডার্লিং?” মুহূর্তখানেক আগেও ব্যাপারটা ওর কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; কিন্তু এবারে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খানিকটা নাখোশ হল বেলা।

“অনেক কারণ আছে।” মাঝে মাঝে এত অদ্ভুত আচরণ করে ছেলেটা। বুঝতে পারল কোনো লাভ নেই। অসম্ভব সুদর্শন ওই চেহারার নিচেই আছে। ইস্পাতের মতো কঠিন এক বর্ম।

“আর এতে করেই বেড়ে গেছে ওর আকর্ষণ।” আপন মনেই হাসল বেলা। আর কারো সাথেই রামোনকে শেয়ার করতে চায় না। পরস্পরে মগ্ন এই জুটির অন্য কাউকে তাই প্রয়োজন নেই।

মাঝে মধ্যে হ্যারিয়েট কিংবা অন্য কোনো পরিচিতের সাথে লেস এ অথবা হোয়াইট এলিফ্যান্ট এ খেতে যাওয়া; এক আধবার অ্যানাবেল’ এর পার্টিতে নাচতে যাওয়া ছাড়া পারতপক্ষে কারো মাথে মেশে না বেলা আর রামোন। ছেলেটার নিজের কোনো বন্ধু নেই কিংবা থাকলেও বেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। যদিও এসব নিয়ে মোটোওভাবে না বেলা।

যেসব উইকেন্ডে আ্যামবাসির কাজ থেকে কৌশলে পালাতে পারে, সেসব দিনে মিনি কুপারের পেছনে ওভার নাইট ব্যাগ আর টেনিস র‍্যা গ্রামের দিকে চলে যায় বেলা আর রামোন। রবিবারে শহরে ফিরতে ফিরতে হয়ে যায় গভীর রাত।

আগস্টের শুরুতে, নির্জনে বাসের অভ্যাস ছেড়ে দু’জনে অতিথি হিসেবে গেল হ্যারিয়েট কু-চ্যাম্পের পারিবারিক এস্টেটে।

রামোনের হয়ে বন্দুক লোড় করে দিল ইসাবেলা। বারোটা গুলিতে বারোটা পাখি মারল ও শ্যেনচক্ষু দিয়ে দেখে মাথা নেড়ে বলে উঠল, “তেত্রিশটা সিজনে আমি এমনটা আর কেউ দেখিনি।” ইংরেজ ইতিহাসের দক্ষ বন্দুকবাজদের কথা স্মরণ করিয়ে দিল হ্যারিয়েটের আর্ল বাবাকে।

দেখা গেল সন্ধ্যায় লম্বা ডিনার টেবিলে বসে বিশপ আর ব্যারোনেটদেরকে ছাপিয়ে, রামোনের সাথেই কথা বলছেন ভদ্রলোক। মনে হচ্ছে ভালোই কাটবে উইকেন্ড। বিশাল দুর্গের মতো পুরাতন কাউন্ট্রি হাউজের একেবারে কোণার দিকের লাগোয়া রুম দিয়েছে হ্যারিয়েট দু’জনকে। ব্যাখ্যা হিসেবে বলল, “পাপা’র ইনসমনিয়া আছে। আর তুমি আর রামোন তো যা শব্দ করো!”

“তুমি এত পচা কথা বলো না। প্রতিবাদ করে উঠল ইসাবেলা।

“আমার কথা ছাড়ো। রামোন’কে বলেছ তোমার সাইপ্রাইজের কথা?” মিষ্টি স্বরে জানতে চাইল হ্যারিয়েট।

“নাহ্, সঠিক মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছি।” আত্মরক্ষায় তাড়াতাড়ি বলে উঠল বেলা। “অভিজ্ঞতা থেকে জানি এ ধরনের সংবাদের জন্য সঠিক মুহূর্ত বলে কিছু নেই।”

অন্তত একবারের জন্য হলেও ঠিক কথাটাই বলেছে মেয়েটা। উইকেন্ড কেটে গেল। কোন সুযোগ পাওয়া গেল না। লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছে তাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব ঝেড়ে ফেলে দিল বেলা, ভাগ্য ভালো ফাস্ট-ক্লাস কম্পার্টমেন্টে কেবল তারাই আছে।

“ডার্লিং, গত বুধবারে আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম অ্যামব্যাসি ডাক্তার নয়, হ্যারিয়েটের পরিচিত একজন। টেস্টের রেজাল্ট পেয়েছি। শুক্রবারে।” একটু থেমে রামোনের অভিব্যক্তি দেখল। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একই রকম সুদূরের সবুজ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে বেলার দিকে। জানে একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসায় কেউ চিড় ধরাতে পারবে না। তারপরেও কেমন একটা দূরত্ব থেকেই যায়। তাড়াতাড়ি তাই শেষ করার জন্য বলল,

“আমি প্রায় দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিশ্চয় স্পেনেই হয়েছে। সম্ভবত গ্রানাডা’তে, ষাঁড়ের লড়াইয়ের পর…” দম হারিয়ে কাঁপতে শুরু করল যেন, তারপরেও বলতে লাগল, “আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। মানে, আমি নিয়মিতো পিল খেয়েছি। তুমি দেখেছ…” বুঝতে পারল ঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছে না, তারপরেও শেষ করল, “জানি আমি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম; কিন্তু তুমি কিছু ভেবো না। এখনো সময় আছে। গত বছর হ্যারিয়েটের সাথেও একই হয়েছিল। আমস্টারডামে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে রবিবারেই লন্ডনে ফিরে এসেছে একদম নতুন হয়ে। ও আমাকে ঠিকানা দিয়েছে, বলেছে প্রয়োজন হলে সাথেও যাবে।”

“ইসাবেলা!” তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠল রামোন। “চুপ করো একদম চুপ। আমার কথা শোন! ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।

তুমি জানই না যে কী বলছ। তুমি কী কসাই!”

“আই এম সরি, রামোন।” অবাক হয়ে গেল বেলা। “আমার আসলে তোমাকে বলাটা উচিত হয়নি। হ্যারিয়েট আর আমি মিলেই….”

“হ্যারিয়েট একটা শয়তানের বাচ্চা। আর ওর হাতে আমার সন্তানের জীবন তুলে দিলে তোমাকেও ছাড়ব না।”

হা হয়ে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। এমনটা তো আশাই করেনি।

“এটা একটা মিরাক্যল ইসাবেলা। বিশ্ববক্ষান্তের সবচেয়ে বড় রহস্য। আর তুমি একে ধ্বংস করে ফেলার কথা বলছ। ও আমাদের সন্তান, ইসাবেলা। নতুন একটা জীবন, ভালোবেসে আমরা যার সৃষ্টি করেছি। বুঝতে পারছ না?”

পাশে এসে মেয়েটার হাত ধরতেই রামোনের দৃষ্টির শীতলতা কেটে গেছে দেখতে পেল বেলা।

“তুমি রাগ করোনি?” দোনোমোনো করে জানতে চাইল-বেলা, “আমি তো ভেবেছি তুমি খেপে যাবে।”

“আমি গর্বিত। ডিয়ার।” ফিসফিসিয়ে উঠল রামোন। “আই লাভ ইউ। আমার কাছে তুমিই হচ্ছ সবচেয়ে দামি।” বেলার হাত ভাজ করে কব্জিতে ধরে পেটের উপর রাখল রামোন।” ওখানে যে আছে আমি তাকেও ভালোবাসি। ও ‘ও আমার কাছে তোমার মতই মূল্যবান।” অবশেষে জানালো, “আই লাভ ইউ।”

“ওহ, রামোন!” কেঁপে উঠল বেলার স্বর, “তুমি এত সুন্দর, এত ভালো! আর সবেচয়ে বড় মিরাক্যল হলো তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া।”

“তুমি আমাদের সন্তানের জন্ম দিবে, মাই ডার্লিং বেলা।”

“হ্যাঁ, হাজার বার আমি হ্যাঁ-ই বলব ডার্লিং। ইউ হ্যাভ মেইড মি সো প্রাউড, সো হ্যাপি!”

অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে উত্তেজনা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটার বাকি সবকিছু।

***

এতদিনে উদ্দেশ্য আর গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে তার আর রামোনের ভালোবাসা। সারাক্ষণ মগ্ন হয়ে কেবল সে কথাই ভাবে বেলা। কয়েক বার ভেবেছে ন্যানিকে জানাবে, কিন্তু তারপরেই বুঝতে পেরেছে এই বুড়ী উত্তেজনার চোটে পেট ফেটে মরে যাবে আর চব্বিশ ঘন্টার মাঝে জেনে যাবে বাবাসহ পুরো অ্যামবাসি আর দুনিয়া। তাই অপেক্ষা করছে কিছু কাজ না সারা পর্যন্ত। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে ন্যানি কিছু টের পাচ্ছে না কেন। বুড়ীর দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে ওয়েল্টেভ্রেডেনের বাড়িতে কোনো মেইডের এমনটা হলেই বুঝে ফেলে অব্যর্থভাবে। আর বাসায় থাকলে তো সে-ই বেলাকে স্নান করিয়ে দেয়।

সন্ধ্যাবেলা দ্রুরি লেইনে ফ্ল্যামেঙ্কো ফেস্টিভ্যালের টিকেট কেটে এনেছে রামোন; কিন্তু ব্যাংকের প্রাইভেট নাম্বারে ওর কাছে ফোন করল বেলা।

“রামোন ডার্লিং, আজ রাতে বের হতে মন চাইছে না। তার চেয়ে বরং তোমারি সাথে একাকী সময় কাটাতে চাই। আমি ডিনার তৈরি করব। তুমি ফ্ল্যাটে আসতে আসতে আমি রেডি করে ফেলব, তারপরে একসাথে ভন কারান’র নতুন ডিস্ক শুনব।”

সারা সপ্তাহ ধরে এ উৎসবের জন্য অপেক্ষা করেছিল রামোন। মাঝে মাঝে স্প্যানিশ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করে। বেলা’কে তো চাপ দিচ্ছে ভাষাটা শেখার জন্য। এক সেট রেকর্ডও কিনে দিয়েছে। যাই হোক অবশেষে রাজি করাল বেলা।

অ্যামব্যাসি থেকে ফ্ল্যাট পর্যন্ত আসতে আসতে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে সেন্ট জেমস্ স্ট্রিট থেকে পোল রজার আর মাচেট’র বোতলসহ হ্যারোডস্ থেকে কিনে নিল দুই ডজন হুইট স্ট্যারেল অয়েস্টার আর এক জোড়া নিখুঁত বাছুরের মাংসের কাটলেট।

সামনের জানালা দিয়ে রামোনকে দেখা গেল। ব্রি-পিস স্যটে পাক্কা সাহেব দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। এটা এমন এক অদ্ভুত গুণ যে সব পরিবেশেই চমৎকারভাবে মানিয়ে যায় রামোন, যেন জন্ম থেকেই এভাবে আছে।

শ্যাম্পেন খুলে সদর দরজায় রামোনের চাবির আওয়াজ শুনতেই দুজনের গ্লাস ভরে নিয়ে রেখে দিল বরফ কুচি দিয়ে ভরা রূপার ট্রে’র পাশে, যার উপর সাজিয়ে রেখেছে খোলা অয়েস্টার। ইচ্ছে হল দৌড়ে যায়, তা না করে লিভিং রুমে রামোন এলে পর কিস দিয়ে ভরিয়ে তুলল ছেলেটাকে।

“বিশেষ কিছু নাকী?” বেলা’র কোমরে হাত রেখেই জানতে চাইল রামোন। লম্বা টিউলিপ গ্লাসের একটা তুলে ওর হাতে দিল বেলা আর নিজের গ্লাসের কিনারা দিয়ে চোখ তুলে তাকাল রামোনোর দিকে।

“ওয়েলকাম হোম, রামোন। আমাকে বিয়ে করলে তুমি কী কী পাবে। তার ছোট্ট একটা নমুনা দেখালাম শুধু।”

রামোনের চোখ জোড়া কেঁপে উঠল; এতটা তীক্ষ্ণ আর মর্মভেদী দৃষ্টি আর কখনো দেখেনি বেলা। সবসময় স্থিরভাবেই তাকায় ছেলেটা।

ওয়াইনে একটুও চুমুক না দিয়ে গ্লাসটাকে একপাশে রেখে দিল রামোন। মনে মনে প্রমাদ গুনল বেলা।

“কি হয়েছে, রামোন?” জানতে চাইল তড়িঘড়ি করে।

বেলার হাত থেকেও শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে ওয়ালনাট টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রামোন বলে উঠল, “বেলা।” নরম স্বরে মেয়েটার নাম ধরে ডেকে কি করল খোলা হাতের তালুতে।

“কী হয়েছে রামোন? বলো?” বুক শুকিয়ে গেল মেয়েটার।

“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না ডার্লিং অন্তত এখন না।” বেলার পায়ের নিচের জমি কেঁপে উঠল যেন। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে হেঁটে আর্মচেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে জানতে চাইল, “কেন?” ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল রামোন। না তাকিয়েই বেলা আবার জানতে চাইল, “আমি তোমার সন্তান বহন করতে পারলে আমাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না কেন?”

“বেলা, তোমার মতো স্ত্রী আর তোমার সন্তানের পিতা হবার জন্য আমি সব করতে পারি, কিন্তু…?”

“কিন্তু কী?”

“প্লিজ আমার কথা শোন। পুরোটা না শুনে কিছু বলল না।”

এবারে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল বেলা।

“আমি নয় বছর আগে মিয়ানিতে একটা কিউবান মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম।”

চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা।

“কিন্তু শুরু থেকেই সব কিছু নষ্ট হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হবার আগে কয়েক মাস মাত্র একসাথে ছিলাম। কিন্তু আমরা দুজনেই ক্যাথলিক…” কথা বন্ধ করে বেলার ফ্যাকাসে গালে স্পর্শ করল রামোন। পিছিয়ে গেল বেলা। ছেলেটা জানাল, “তাই, আমরা এখনো বিবাহিত।”

“ওর নাম কী?” চোখ না খুলেই জানতে চাইল ইসাবেলা।

“কেন জানতে চাও?”

“বলো।”

“নাটালি।” কাঁধ ঝাঁকাল রামোন।

“ছেলেমেয়ে?” আবারো জানতে চাইল বেলা, “তোমাদের কয়টা ছেলে মেয়ে আছে?”

“একটাও না।” উত্তরে জানাল রামোন। “তুমিই আমার প্রথম সন্তানের মা হবে।” দেখতে পেল ফিরে এলো মেয়েটার গালের রঙ। খানিক পরে চোখ খুললেও দেখা গেল হতাশার ভার গিয়ে সবটুকু নীল কালো হয়ে গেছে।

“ওহ, রামোন, এখন কী করব আমরা?”

“আমি এরই মাঝে আমার কাজ শুরু করে দিয়েছি। স্পেন থেকে ফেরার পর; তুমি আমাকে বাচ্চার কথা বলার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে স্ত্রী হিসেবে তোমাকেই চাই।

“ওহ, রামোন।” শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল বেলা।

“নাটালি এখনো মিয়ামিতে ওর পরিবারের সাথে বাস করে। কয়েকবার টেলিফোনে কথাও বলেছি। জানিয়েছে এমন কিছু নেই যার কারণে আমাকে ডির্ভোস দিতে রাজি হবে।”

হা করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ভয়ংকর দুঃখের সাথে মাথা নাড়তে লাগল ইসাবেলা।

“তিনটা সন্ধ্যায় ওকে ফোন করেছি আর অবশেষে এমন এক বস্তুর সন্ধান মিলেছে যা ওর কাছে ঈশ্বর আর পাপ স্বীকারের চেয়েও জরুরি।”

“কী?’

“টাকা।” গলায় ব্যাকুলতা এনে বলল রামোন। “কবুতর মারা প্রতি যোগ্যতা থেকে পাওয়া অর্থের বেশির ভাগটাই এখনো রয়ে গেছে। পঞ্চাশ, হাজার ডলারের বিনিময়ে ডির্ভোস ফাইল করতে অবশেষে রাজিও হয়েছে।

“ডার্লিং! “ খুশিতে চকচক করে উঠল ইসাবেলার চোখ। “ওহ্ থ্যাঙ্ক গড়! কখন? কখন মুক্তি দিবে তোমাকে?”

“এইখানেই সমস্যাটা। সময় লাগবে। আমি ওকে জোর করতে পারব না। নাটালি’কে ভালোভাবেই চিনি আমি। যদি সে তোমাকে খুঁজে পায় আর বুঝতে পারে কেন ডিভোর্স চাইছি তাহলে আরো ব্ল্যাকমেইল করবে। আগামী মাসের শুরুতে রেনো যেতে রাজি হয়েছে। মায়ের অবস্থাও তেমন ভালো না।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিন্তু কতদিন সময় লাগবে?” অধৈর্য হয়ে জানতে চাইল বেলা।

“রেনো’তে থাকার ব্যাপারে নেভাডা স্টেট ল’র নিয়ম হল ডিভোর্স গ্রান্ট করতে তিন মাস লেগে যায়।”

“ততদিনে ছয় মাস হয়ে যাবে। ড্যাডি আর আমি ইতিমধ্যে কেপ টাউনে ফিরে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। ওহ্ রামোন এখন কী হবে?”

“তুমি কেপ টাউনে ফিরবে না।” সোজা-সাপ্টা জানিয়ে দিল রামোন। “আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না আর তোমার বন্ধু আর পরিবারের সকলেও জেনে যাবে ততদিনে।”

“তাহাল আমি কী করব? কী চাও?”

“আমার ডির্ভোস ফাইনাল না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে থাকো। আমার ছেলের জীবনের একটা দিনও মিস করতে চাই না।”

অবশেষে বেলার মুখে হাসি ফুটল। “ছেলেই হচ্ছে তাহলে তাই না?”

“অবশ্যই।” ভান করে বলে উঠল রামোন। “পারিবারিক পদবী দেবার জন্য উত্তরাধিকার তো লাগবে তাই না? আমার সাথে থাকবে তত বেলা?”

“তাহলে বাবা আর দাদীমাকে কী বলল? পাপা’কে না হয় মানিয়ে নিতে পারব কিন্তু দাদী…!” চোখ পাকালো ইসাবেলা। “সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস হলেন পারিবারিক ড্রাগন। তার নিঃশ্বাসে আসলেই আগুন ঝড়ে আর ভিকটিমের তো হাড় পর্যন্ত চিবিয়ে খায়।”

“আমি তোমার ড্রাগনকে পোষ মানাবো।” প্রমিজ করল রামোন।

“আমার সত্যিই মনে হয় তুমি পারবে।” দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে সন্তুষ্টি ফুটল মেয়েটার চোখে। নানা’কে কেউ খুশি করতে পারলে তুমিই পারবে, ডার্লিং।”

***

সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্ ছয় হাজার মাইল দূরে থাকায় সহজ হয়ে গেল কাজটা। খুব যত্ন করে সবকিছুর ছক করল ইসাবেলা। প্রথমেই নজর দিল বাবা’র দিকে। রাতারাতি বনে গেল অত্যন্ত দায়িত্বশীল কন্যা আর নিখুঁত হোস্টেজ। কূটনৈতিক কাজে শাসা কোর্টনির শেষ কয়েক সপ্তাহে বেশ কিছু সোশ্যাল প্রোগ্রামের আয়োজন করল বেলা।

“যেখানেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলে সেখান থেকে ফিরে আসায় ওয়েলকাম ব্যাক। জানো তোমাকে কতটা মিস্ করেছি।” বেলা’র আয়োজনকৃত সুন্দর একটা ডিনার পার্টির পরম মন্তব্য করলেন উফুল্ল শাসা। হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পিতা-কন্যা। হাইভেন্দ্রের সামনের দরজার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখছে লিমুজিনে চড়ে সর্বশেষ অতিথির প্রস্থান।

“সকাল একটা বাজে।” হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন শাসা। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ইসাবেলা।

“এত তাড়াতাড়ি বিছানায় যাবার কী দরকার?” বাবার হাতে চাপ দিল বেলা। “চল তোমার জন্য সিগার নিয়ে আসি। সারা সন্ধ্যাতে তোমার সাথে একটুও কথা বলতে পারি নি।”

রুমের একপাশে রাখা চামড়ায় মোড়া আর্মচেয়ারে আরাম করে বসলেন শাসা। স্পষ্ট আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ঠিক যেন তার আস্তাবল থেকে আসা টগবগে কোনো বাচ্চা ঘোড়া কিংবা আর্ট কালেকশনে থাকা রতুগুলোর একটা। অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে তার এই মেয়ে হলো কোর্টনিদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী।

তরুণ বয়সে তার মা’ও ছিলেন একই রকম সুন্দরী। বহু বছর হয়ে যাওয়ায় শাসা’র স্মৃতিতে তেমন উজ্জ্বল না থাকলেও ওয়েল্টেভ্রেডেনের ড্রইং রুমে পোর্ট্রেট করা আছে বেলা’র দাদীমা’র ছবির কালো চোখ জোড়া দিয়েও ঠিকরে বের হচ্ছে তার চারিত্রিক মাধুর্যতা।

বাবা’র ডেস্ক থেকে স্বর্ণের কাটার বের করে সিগারের মাথা কেটে শাসা কে তৈরি করে দিল বেলা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অ্যামব্যাসডর নিশ্চিত হলেন যে, যৌবনের তারুণ্যে দাদীমা’র রূপকেও হার বানিয়ে দিয়েছে ইসাবেলা।

“আজ সকালে প্রোফেসর সিমন্স আমার থিসিসের লেটেস্ট অংশটা পড়েছেন।”

“তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধূলি দিয়ে এখনো তুমি তাদেরকে ধন্য করো।” আগুনের নরম আলোতে মেয়ের খালি কাঁধের দিকে তাকালেন শাসা। মায়ের আইভরি রঙা দেহতুক পেয়েছে মেয়েটা।

“ওনার ধারণা ভালই হয়েছে।” খোঁচাটুকু এড়িয়ে গেল বেলা।

“তুমি আমাকে যে প্রথম একশ পৃষ্ঠা পড়তে দিয়েছিলে, যদি সেরকমই হয় তাহলে প্রফেসরের ধারণাই সঠিক।”

“উনি চান আমি যেন এখানে থেকেই বাকিটুকু শেস করি।” বাবা’র দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল বেলা। বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠল শাসা কোর্টনির।

“একা একা লন্ডনে?” তাড়াতাড়ি জানতে চাইলেন।

“একা একা? পাঁচশ বন্ধু, কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের কর্মচারীরা, আমার মা…!” বাবার কাছে ব্যান্ডি বেলুন এনে জুড়ে দিল বেলা, ‘অদ্ভুত এই শহরে একেবারে একা থাকব না, পাপা।”

কগন্যাবো চুমুক দিতে দিতে মরিয়া হয়ে কোনো কারণ খুঁজতে লাগলেন যাতে করে সাথে যেতে বাধ্য হবে বেলা।

“কোথায় থাকবে?” জানতে চাইলেন শাসা।

“পারলেন না বাবা, হেরে গেল।” পিতার মুখের উপর হেসে হাত থেকে সিগার নিয়ে নিল বেলা। লাল রাঙানো ঠোঁটে এক গাল ধোয়া বানিয়ে ছুঁড়ে মারল বাবার মুখের উপর। “সাদোগান স্কোয়ারে প্রায় মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটা পারিবারিক ফ্লাট খালি পড়ে আছে।”

সবচেয়ে অমোঘ অস্ত্রটা হানার জন্য প্রস্তুত হলো বেলা। “পাপা, তুমিই তো চাইতে যেন আমি ডক্টরেটটা শেষ করি। এখনো মানা করবে না, তাই না?”

শাসাও খেলতে চাইলেন; উত্তরে মেয়েকে বলে উঠলেন, “তুমি এত সাবধানে সব কিছু ভেবে রেখেছ; তাহলে এরই মাঝে দাদীমা’কেও নিশ্চয় জানিয়েছ?”

চুপ করে আমচেয়ারে বসে থাকা বাবার কোলের উপর বসে পড়ে কপালে কি করে বেলা বলে উঠল, “ডার্লিং ড্যাডি আমি তো আরো ভাবলাম যে আমার হয়ে তুমিই নানা’কে সব খুলে বলবে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মিঃ অ্যামবাসাডর।

যাক, নিশ্চিন্ত হলো বেলা। নানা’কে বাবাই সামলাবে। কিন্তু ন্যানিও তো আছে। যাই হোক আগে ভাগেই ওর সতের জন নাতী-নাতনীর নাম মুখস্থ করে বেলা জানাল, “ভেবে দেখো ন্যানি তুমি তিন বছর ধরে বাড়ি যাওনি। কেপে নৌকা থামার সাথে সাথে জোহানসকে দেখবে দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে।” সবচেয়ে প্রিয় পুত্রের কথা শুনে চক্ করে উঠল ন্যানির চোখ। তাই দু’দিন জোরাজুরির পর বেলা’র কাছেই হেরে গেল বুড়ী।

সাউদাম্পটনে সবাইকে বিদায় জানাতে এসেছে বেলা। জিরাফের গলার মতো লম্বা ক্রেন দিয়ে ইউনিয়ন ক্যাসেল লাইনারে ভোলা হচ্ছে শাসা’র নতুন অ্যাশটন মার্টিন। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল পরিচারকদের দল। শফার ক্লোনকি থেকে শুরু করে মালয় শেষ পর্যন্ত সবাইকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাল বেলা। ইসাবেলা কিস্ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ন্যানি।

“তুমি হয়ত এই বুড়ীর চেহারা আর দেখতে পাবে না। চলে গেলে মনে করো আমার কথা স্মরণ করো ছোটবেলায় তোমাকে কিভাবে পেলেছি…।”

“যাও তো ন্যানি। তুমি না থাকলে আমার বাচ্চাদের কে দেখবে?”

“তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো সোনা। বুড়ী ন্যানি তাহলে তোমাকে চোখে চোখে রাখতে পারবে। তোমাকে সুন্দর একটা দক্ষিণ আফ্রিকান ছেলে খুঁজে দেব।”

শাসা’কে গুডবাই বলতে এসে হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করে দিল বেলা। ভাবল-ব্রেস্টেড ব্লেজারের পকেট থেকে কড়কড়া সাদা রুমাল মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন শাসা। বেলা কাজ সেরে বাবাকে দিতেই তিনি নিজেও শব্দ করে নাক মুছলেন।

“এত বাতাস না এখানে?” ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “হাঁচি শুরু হয়ে যাচ্ছে।”

জেটি ছেড়ে আস্তে আস্তে নদীর দিকে চলে গেল লাইনার। অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের থেকে আলাদা হয়ে জাহাজের রেইল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন লম্বা, ঋজুদেহী শাসা। ডির্ভোসের পর আর কখনো বিয়ে করেননি। বেলা জানে ডজন ডজন মেধাবী-সুন্দরী’র দেখা পেলেও একাই পথ চলেছে বাবা।

“কখনো তাঁর একা লাগত না?” জাহাজের ডেক্‌ অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ভাবল বিস্মিত বেলা। “ গাড়ি চালিয়ে লন্ডনে ফেরার সময় কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে গেল সামনের রাস্তা।

“এই বাচ্চাটাই আসলে আমাকে এত সেন্টিমেন্টাল করে তুলেছে!” পেটে হাত দিয়ে চাইল কারো অস্তিত্ব টের পাবার। পরিবর্তে সোজা। সমান মধ্যদেশে হাত দিয়ে ভাবল, “ঈশ্বর, যদি সবকিছুই মিথ্যে আশংকা হয়!”

মন খারাপ ভাব আরো বেড়ে যেতেই মিনি’র বদ্ধ প্রকোস্টে হাতড়ে বের করে আনল ক্লিনেক্সর প্যাকেট।

যাই হোক ফ্ল্যাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই খুলে গেল দরজা। রামোন এসে হাত ধরতেই শুকিয়ে গেল সব কান্না।

***

অত্যন্ত রুচিশীল আর সুসজ্জিত কাডোগান স্কোয়ারের পারিবারিক ফ্ল্যাটের প্রথম দুই ফ্লোর ভিকটোরিয়ান আমলের লাল ইট দিয়ে তৈরি।

শুধুমাত্র ঠিকানা হিসেবে ঐ বাড়িকে ব্যবহার করা ইসাবেলা শুক্রবারে এসে চিঠি-পত্র নিয়ে যায় আর নিচের ভাড়ার ঘরে বসে ফুলটাইম হাউজকীপারের সাথে চা খেয়ে যায়। ওয়েল্টেজ্ৰেদেন আর অন্যান্য জায়গা থেকে আসা লং ডিসটেন্স ফোনগুলো ভালোভাবেই সামাল দেয় বেলার এই সুহৃদ হাউজকীপার।

রামোনের ছোট্ট ফ্ল্যাটটাকেই সত্যিকারের ঘর বানিয়েছে ইসাবেলা। এখানকার ওয়াডড্রোবে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় কাডোগান স্ট্রিটের বাড়িসহ দু’জায়গায়তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে পোশাক। বিছানার এক কোণাতে ছোট্ট করে বানিয়েছে তার স্টাডি।

বিবাহিত দম্পত্তিদের মতো রুটিন মেনে চলে রামোন আর ইসাবেলা। গাইনোকোলজিস্ট জগিং করতে বারণ করায় জিমে কিংবা রাইডিং করে। এরপর রামোন ব্যাংকে যাবার পর লাঞ্চ পর্যন্ত মন দিয়ে থিসিসের কাজ করে বেলা। অ্যালকোহল ছেড়ে দিয়ে বাচ্চার সুস্থতার দিকে নজর দেয়ায় জাস্টিন ডি ব্ল্যাঙ্ক কিংবা হ্যাঁরোড’য়ে গিয়ে বসে দুজনে।

“আমি ব্যাঙের মতো ফুলে যেতে চাই না।”

“আমার কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রমণীই হচ্ছ তুমি, আর গর্ভবতী হওয়াতে তো যৌবন পূর্ণতা পেয়েছে।”

বেলা’র বিশাল উদরে হাত দিয়ে স্পর্শ করল রামোন।

লাঞ্চের পরে টিউটরের সাথে দেখা করে কিংবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে বসে বাকি বিকেলটা কাটিয়ে দেয় বেলা। এরপর মিনিতে চেপে বাসায় ফিরে যায় রামোনের ডিনার রেডি করার জন্য। ভাগ্য ভালো ডিপ্লোম্যাটিক প্লেট নাম্বার এখনো ব্যবহার করতে পারে বেলা; বাবা’ই সব ঠিকঠাক করে গেছে। তাই ট্রাফিক সত্ত্বেও সময় মতো পৌঁছে যায় ফ্ল্যাটে।

পারতপক্ষে এখন আর রাতের বেলা কোথাও বের হয় না। মাঝে মাঝে শুধু থিয়েটার কিংবা গিয়ে বসে হ্যারিয়েট আর তার লেটেস্ট বয়ফ্রেন্ডের সাথে।

আস্তে আস্তে স্ফীত হতে লাগল সমান মধ্যদেশ। সিল্কের ড্রেসিং গাউনের সামনের অংশ খুলে গর্বিতভাবে দেখাল রামোন’কে। উচ্ছল আনন্দে বলে উঠল, “দেখো”।

“হ্যাঁ, ছেলে না হয়ে যায় না।” সায় দিল রামোন।

“তুমি কিভাবে জানো?”

“এখানে।” বেলার হাত ধরে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে রামোন বলল, “বুঝতে পারছ না?”

“আহ, একেবারে বাপের মতই হয়েছে নিশ্চয়। ঘুম পেয়ে গেছে আমার।”

মেয়েকে হ্যারোজস এর চার্জ কার্ড দিয়ে গেছেন শাসা। সেখান থেকেই কিনেছে বেলা। যদিও তরুণী হবু মায়েদের জন্য পোশাক বানাতে বিশেষ নিত্য নতুন বুটিক খুঁজে বের করে হ্যারিয়েট।

প্রতি মাসে অন্তত একবার সপ্তাহখানেক বা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকের কাজে শহরের বাইরে যায় রামোন। যাই হোক, সুযোগ পেলেই ফোন দেয় বেলাকে। তাই ছেলেটা ফিরে আসার পর পর আনন্দ বেড়ে যায় শতগুণ।

এরকম এক ট্রিপের পর হিথ্রো থেকে রামোনকে সরাসরি ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো বেলা। হলে ট্রাভেল ব্যাগ ফেলে টেয়ারের উপর জ্যাকেটটাকে ছুঁড়ে রেখে বাথরুমে চলে গেল রামোন।

হঠাৎ করেই জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে পাসপোর্টটা স্লিপ করে পড়ে গেল কার্পেটের উপর। উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে রামোনের ছবি দেখতে পেল বেলা। একই সাথে জন্ম তারিখও পেয়ে গেল। মনে পড়ে গেল আর মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই রামোনের জন্মদিন। ভাবতে লাগল কিভাবে এবার স্মরণীয় করে রাখা যায় দিনটাকে। প্ল্যান করে ফেলল মে-ফেয়ার বুটিক শপে দেখা কাঁচের নগ্ন মূর্তি কিনে গিফট করবে ছেলেটাকে। রেনে লালিক’র তৈরি মূর্তিগুলো ঠিক যেন তার দেহ সৌষ্ঠরের মতো করেই বানানো হয়েছে।

পাসপোর্টের আরো কয়েকটা পাতা ওল্টাতেই ভিসা দেখে চোখ আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখল আজ সকালেই মস্কোর স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে।

“ডার্লিং” বাথরুমের দরজার এপাশ থেকে জানতে চাইল বেলা, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রোমে গেছ। মস্কো’র সিল কেন তাহলে?” সারা জীবনের শিক্ষা থেকে জানে রাশিয়া হলো সবচেয়ে বড় খ্রিস্ট-বিদ্বেষী দেশ। তাই পাসপোর্টে মিলটা দেখেই কপালের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।

বন্ধ দরজার ওপাশে মিনিট খানেকের জন্য নেমে এলো নীরবতা। এরপর হঠাৎ করেই বের হয়ে বেলা’র হাত থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নিল রামোন। শীতল অভিব্যক্তি আর চোখ দুখানা দেখে ভয় পেয়ে গেল বেলা।

“আর কখনো আমার কোনো বিষয়ে নাক লাগবে না।” নরম স্বরে ঘোষণা করল রামোন।

পরে আর কখনোই এ বিষয়ে কিছু না বললেও প্রায় সপ্তাহখানেক পর বেলা’র মনে হল যে তাকে মাফ করে দিয়েছে রামোন। এতটা খারাপ লাগল যে বেলা নিজেও চেষ্টা করল পুরো ব্যারটাকে ভুলে যেতে।

নভেম্বরের শুরুতে, কাদোগান স্কোয়ারে রুটিন ভিজিটের সময় হাউজকীপার হাতে তুলে দিল এক গাদা চিঠি। সবসময়ের মতই বাবার চিঠি এসেছে। কিন্তু এবারে তার সাথে ভাই মাইকেলের হাতের লেখা খামের উপর দেখে খুশি হয়ে উঠল বেলা।

তিন ভাইয়ের প্রত্যেকেই চেহারা, ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক দিক থেকে এতটাই ভিন্ন যে বিশেষভাবে কাউকে পছন্দ করা অসম্ভব।

অ্যাডভেঞ্চার স্বভাবের বড় জন শন তার দেখা সবচেয়ে সুপুরুষ। এখন অবশ্য রামোন সে জায়গা নিয়েছে। সৈন্য আর শিকারী শন্ এরই মাঝে রোডেশিয়া’তে বীরত্ব দেখাবার জন্য সিলভার ক্রস’ও পেয়েছে। তাই সন্ত্রাসীদের পেছনে দৌড়ানো ছাড়া তার আরেকটা কাজ হল জাম্বেজি উপত্যকায় কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের হয়ে শিকারের আয়োজন করা।

মায়োপিয়া আর অ্যাজমা রোগে ভুগতে থাকা দ্বিতীয় ভাই গ্যারিক নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে পূরণ করেছে চরিত্রের মাঝে কোর্টনি’দের দৃঢ় প্রত্যয় আর অদম্য উৎসাহ ধারণ করার মাধ্যমে। ছোটবেলায় “বেচারা গ্যারি” উপাধি পাওয়া ছেলেটাই” কসরৎ করে গড়ে তুলেছে পুরুষালী গড়ন; হয়ে উঠেছে গলফ প্লেয়ার, রাইফেল আর শট গানে সিদ্ধহস্ত বন্দুকবাজ।

এর পাশাপাশি কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হয়ে বাবা’র স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এখনো বয়স ত্রিশও হয়নি, এরই মাঝে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি চালানো পরিশ্রমী গ্যারি কখনোই বেলা’র জন্মদিন ভুলে যায় না। বোনের যে কোনো আবদার মেটাবার জন্য কখনো পিছপা’ও হয় না; হোক না সেটা যতটা তুচ্ছ কিংবা মূল্যবান। বড়-সড় আদুরে স্বভাবের ভাইটাকে “টেডি বিয়ার” ডাকে বেলা।

এরপর হচ্ছে নম্র-ভদ্র, ভাবুক। সহানুভূতিশীল, কবিমনা আর পারিবারিক শান্তি রক্ষাকারী মাইকেল, যে কিনা কোর্টনি হওয়া সত্ত্বেও, বাবা আর অন্য দুই ভাইয়ের উদাহরণ কিংবা উৎসাহে আমল না দিয়ে সারা জীবনে কখনো একটাও পাখি কিংবা জীব হত্যা করেনি। এর বদলে প্রকাশ করেছে তিনটা বই। একটা কবিতা আর অন্যাটা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস আর রাজনীতি নিয়ে লেখা। শেষের দু’টো তত দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসায়ী সমাজ নিষিদ্ধ করেছে সে দেশে। এছাড়াও অত্যন্ত বিখ্যাত সাংবাদিক মাইকেল গোল্ডেন সিটি মেইল নামক ইংরেজি পত্রিকার ডেপুটি এডিটর। যারা শক্ত কণ্ঠে লিখে চলেছে, জন ভরসটার আর তার বর্ণবাদী নীতির বিপক্ষে। অবশ্য পত্রিকাটার আশি শতাংশ শেয়ার কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের। নতুবা এত কম বয়সে এতটা দায়িত্বশীল পদ পাওয়া সম্ভব হত না।

ইসাবেলার শৈশবে মাইকেলই ছিল তার রক্ষক আর উপদেষ্টা। নানা’র পরে সেই-ই হচ্ছে মেয়েটার প্রিয় গল্পকথক। নিজের জীবনে অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে মাইকেলকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে বেলা।

এবারে তাই ভাইয়ের হাতের লেখা দেখে আনন্দের সাথে সাথে অনুতপ্ত বোধও এলো মনে। রামোনের সাথে দেখা হবার পর থেকে ছয় মাস ধরে কোনো চিঠি লেখেনি ভাইকে।

প্রথম পাতার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে চোখ যেতেই সাথে সাথে চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে দিল বেলা…।

বাবা বলেছে তুমি নাকি কাদোগান স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে বেশ মনোযোগ দিয়েই থিসিসের কাজ করছ। গুড ফর ইউ, বেলা। যাই হোক, তুমি নিশ্চয় পাঁচটা বেডরুমের সবক’টি কাজে লাগাচ্ছে না। তাই আশা করি আমার জন্য কোথাও না কোথাও একটু জায়গা হয়ে যাবে। এ মাসের পনের তারিখ থেকে তিন সপ্তাহের জন্য লন্ডনে থাকতে হবে আমাকে। প্রতিদিন সারাক্ষণই বাইরে থাকব। প্রচুর ইন্টারভিউ আর মিটিং আছে। তাই প্রমিজ করছি তোমার পড়া শোনায় বিরক্ত করব না…।

তাই বাধ্য হয়ে এ সময়টা কাদোগান স্কোয়ারেই কাটাতে হবে। একদিকে খুশিই হল বেলা, কেননা এ সময় রামোনের’ও বিদেশে ট্রিপ পড়েছে। তাই অন্তত মাইকেলের সঙ্গ পাওয়া যাবে।

জোহানেসবার্গে মেইলের’ অফিসে চিঠির উত্তর পাঠিয়ে কাদোগান স্কোয়ারকে সাজাতে বসল বেলা। এখনো এক সপ্তাহ সময় আছে হাতে। সবকিছু এমনভাবে ঠিকঠাক করতে হবে যেন সত্যিই সে এখানে থাকে।

“ওকে অনেক কিছু নিয়েই কৈফিয়ত দিতে হবে।” ঈষৎ ফোলা পেটের উপর হাত রেখে রামোনকে বলল বেলা।” তাও ভালো যে মাইকেল বেশ সমঝদার। আমি নিশ্চিত তোমাদের দু’জনের ভালই মিলবে। শুধু যদি দেখা

“তোমার ভাই থাকতে থাকতে কাজ সেরে লন্ডনে চলে আসতে চেষ্টা করব।”

“ওহ, রামোন ডার্লিং, খুব মজা হবে তাহলে প্লিজ চেষ্টা করো।”

হিথ্রো এয়ারপোর্টের আন্তজার্তিক ব্যারিয়ার দিয়ে লাগেজ ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে এলো মাইকেল। হাস্যমুখে দাঁড়িয়ে থাকা বোনকে দেখেই কোলে নেয়ার মতো ভঙ্গি করে উপরে তুলে ফেলল। কিন্তু বেলা’র পেট নিজের শরীরে লাগতেই তাড়াতাড়ি অতি সাবধানে নামিয়ে দিল মেঝেতে।

মিনিতে করে শহরে নিয়ে আসার সময় মাঝে মাঝেই ভাইয়ের দিকে তাকাল বেলা। রোদে পোড়া দেহত্বক সত্ত্বেও চুলগুলি বেশ লম্বা হয়ে গেছে। যাই হোক হাসিটা এখনো বেশ অকপট আর নীল কোর্টনি চোখ জোড়াতে অন্যদের মতো শব্দ চাহনি নয় বরঞ্চ বেশ চিন্তাশীলতার ছাপ।

ভাইয়ের কাছ থেকে বাসার টুকটাক খবর নিতে নিতে কায়দা করে নিজের বিষয় এড়িয়ে যেতে চাইল বেলা। মাইকেলের কাছ থেকে জানা গেল বাবা নাকি আমর্সকারের চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন পদে রীতিমতো জাকিয়ে বসেছেন। আর ওয়েস্ট্রেভেদেনের উপর নানা’র শাসন দিনে দিনে আরো বেশি কঠোর হয়ে উঠছে। শন্ এখনো গেরিলাদের প্ল্যাটুনের পাশাপাশি সঁড়ের দলকেও খতম করে চলেছে। অন্যদিকে শেয়ার হোল্ডারদেরকে রেকর্ড পরিমাণ লাভের ভাগ দিয়েছে গ্যারি। তার স্ত্রী হোলি অন্তসত্ত্বা হওয়ায় এবারে সবাই কন্যা শিশুর জন্যই দিন গুনছে।

সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে বোনের দিকেও ঠিকই তাকাচ্ছে মাইকেল। তাই ব্যাখ্যা দেয়ার ভয়ে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেলা। অবশেষে মিনি এসে পৌঁছল গন্তব্যে।

জেট ল্যাগের ধকল কাটিয়ে উঠার জন্য মাইকেল স্নান সেরে নিতে নিতে হুইস্কি আর সোডা এনে দিল বেলা। টয়লেটের সিটের বন্ধ ঢাকনির উপর বসে কথা বলতে লাগল ভাইয়ের সাথে। এভাবে ফেনায় গা ডুবিয়ে গোসল করার সময় শন্ কিংবা গ্যারির সাথে কথা বলার ব্যাপারে চিন্তাও করবে না বেলা; কিন্তু মাইকেলের ব্যাপার ভিন্ন। নগ্নতা এই দু’ভাই বোনের কাছে অস্বাভাবিক কিছু না।

“আচ্ছা তোমার সেই অনর্থক ছড়াটা মনে আছে?” অবশেষে জানতে চাইল মাইকেল।

“ডাম ডি ডাম-ডাম,

বাবা শুধোলেন ‘নেলী,

কী আছে তোমার পেটে।

যা যায়নি তোমার মুখে! “

একটুও লজ্জা না পেয়ে হাসল বেলা। এর মানেই হল সাংবাদিকে শ্যেন দৃষ্টি? কিছুই তোমার চোখ এড়ায় না, তাই না মিকি?”।

“চোখ এড়াবে?” হেসে ফেলল মাইকেল। “তোমার পেট তো আমার সাংবাদিকের প্রশিক্ষিত চোখ’কেও হারিয়ে দিয়েছিল আরেকটু হলে!”

“সুন্দর না?” যতটুকু সম্ভব পেট ঠেলে বের করে দিয়ে হাত বুলালো ইসাবেলা।

‘অসম্ভব!” ঐকমত হল মাইকেল বাবা আর নানা দেখলেও একই কথা বলবে।”

“তুমি তো বলবে না, তাই না মিকি?”

“তুমি আর আমি তো কখনো একে অন্যের সিক্রেট বাইরের কাউকে বলিনি। কখনো বলবোও না। কিন্তু শেষতক হুম ফলাফল নিয়ে তুমি কী করবে?”

“আমার ছেলে, তোমার ভাগনে-ফলাফল হলো? তোমার লজ্জা হলো না মিকি? রামোন তো বলে এ হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় রহস্য আর মিরাক্যাল।”

“রামোন! তো কালপ্রিটটার নাম হলো রামোন। আশা করছি নানা’র পুরনো আর তৃঞ্চাৰ্ত শর্টগানের হরিণ মারার গুলি এড়াবার জন্য বুলেট প্রুফ পোশাক পরে যাবে বদমাশটা।”

“ও একজন মারকুইস, মিকি। দ্য মারকুইস ডি সান্টিয়াগো-ই-মাচাদো।”

“আহ, খানিকটা কাজ হবে মনে হচ্ছে। নানা’ও হয়ত পশু মারার গুলি না নিয়ে পাখি মারার গুলি নিয়ে নেবে।”

“নানা যতক্ষণে সব জানবে, ততদিনে আমি মারকুইসা হয়ে যাবো।”

“এখন?”

“একটু সমস্যা আছে। কিন্তু বেশি দেরি নেই।” স্বীকার করতে বাধ্য হল বেলা।

“তারমানে ও এরই মাঝে বিয়ে করেছে আগেও?”

“তুমি কিভাবে জানো মিকি?” অবাক হয়ে জানতে চাইল বেলা।

“আর তার স্ত্রী তাকে এখন ডির্ভোস দিতে চাইছে না?”

“মিকি!”

“মাই লাভ, এই পাড় শয়তানগুলো সব এক গোয়ালের গরু।”

উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ালে নিল মাইকেল।

“তুমি তো ওকে চেনোও না মিকি। ও এমন নয়।”

“বুঝতে পারছি তুমি কতটা অন্ধ হয়ে গেছ।” গায়ে তোয়োলে জড়িয়ে নিল মাইকেল।

“ও আমাকে ভালবাসে।”

“তাতো দেখতেই পাচ্ছি।”

“এমন করো না মিকি।”

“আমাকে কথা দাও, বেলা, যদি কখনো কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সবার আগে আমার কাছে আসবে। ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে বেলা জানালো; “হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুমি এখনো আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। কিন্তু দেখে নিও কোনো সমস্যাই হবে না।

এরপর মাইকেলকে ওয়ালটন স্ট্রিটে’র মা কুইজিনে ডিনার করাতে নিয়ে গেল বেলা। ভাই লন্ডনে আসছে, জানার সাথে সাথে রিজাভেশন না দিলে হয়ত জায়গাই পেত না এই জনপ্রিয় রেস্টোরেন্টে।

“সবাই আমাকে এমন ঘুর ঘুর করে দেখছে যেন আমিই সবকিছুর জন্য দায়ী।”

“ননসেন্স। ধ্যাৎ, তুমি এত হ্যান্ডসম যে সবাই তাই দেখছে।” এরপর নিজ নিজ কাজ নিয়ে কথা বলল দুজনে। ইসাবেলা প্রমিজ করল ভাইকে নিজের থিসিস পড়তে দেবে। মাইকেল জানাল যে বর্ণবাদী আন্দোলনের উপর সিরিজ আটিকেল আর ব্রিটেনে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতির খবর লেখার জন্য লন্ডনে এসেছে।

“প্রধান সারির কয়েকজন নেতা’র ইন্টারভিউ নিতে হবে : অলিভার টাম্বো। ডেনিস ব্রুটাস…”

কিন্তু আমাদের সেন্সর তোমাকে সেসব ছাপাতে দেবে? বিশেষ করে লাভের আশায় জল ঢাললে গ্যারি তো খেপে আগুন হয়ে যাবে।”

মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। “বেচারা গ্যারি। জীবন ওর কাছে এতটা সহজ সাদা-কালো নীতি বোধ নয় বরঞ্চ লাল আর কালো ব্যাংক স্টেটমেন্ট।

ডেজার্ট শেষ করেই মাইকেল হঠাৎ করে জানতে চাইল, “মা’র কোন খবর জানো? এর ভেতর দেখা হয়েছিল?”

“মা-মাম্মি। কিছুই নয়।” তিক্ত স্বরে ভাইকে শুধরে দিল বেলা, “তুমি তো জানই এসব শব্দকে বুর্জোয়া হিসেবে ভাবে সে। কিন্তু তোমার প্রশ্নের উত্তর হলো না, তারা’র সাথে অনেকদিন ধরেই আমার কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয় না।

“উনি আমাদের মা, বেলা।”

“বাবা আর আমাদের সবাইকে ছেড়ে ওই কালো বিপ্লবীটার সাথে চলে আসার সময় সে তো সেটা ভাবেনি। আবার ওই বাদামি বাস্টাড় টাকেও বহন করেছে।”

“বাস্টার্ড বহন করার কথা এলে তোমার ব্যাপারটাও নিশ্চয় আসবে।” নরম স্বরে বললেও বোনের চোখে আঁধার ঘনাতে দেখল মাইকেল।” আমি দুঃখিত বেলা। কিন্তু তোমার মতই সবকিছুরই নির্দিষ্ট কারণ আছে বেলা। ওনাকে তাই এভাবে বিচার করতে পারব না আমরা। তুমি তো জানেনা বাবাকে বিয়ে করা কোন সহজ কাজ নয়। আর নানা’র নিয়মানুযায়ী চলাও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। আমার ধারণা প্রথম থেকেই পরিবারে খাপ খাওয়াতে পারেননি তারা। সবসময় অবহেলিতদের প্রতিই ছিল তাঁর সহানুভূতি আর এরপর তো মোজেস গামা এলেন…”

“মিকি ডার্লিং”-টেবিলের ওপাশ থেকে ঝুঁকে এসে ভাইয়ের হাত ধরল বেলা-”তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে বুঝদার অনুকম্পী ব্যক্তি। সারা জীবন ধরে আমাদের জন্য অযুহাত খুঁজে ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছ। আই লাভ ইউ সো মাছ। তাই এ ব্যাপারে কোনো তর্ক করতে চাই না।”

“সেটাই ভালো।” বোনের হাতে চাপ দিল মাইকেল। “তাহলে চলো দু’জনে মিলে তারা’র সাথে দেখা করে আসি। উনি তোমাকে অসম্ভব ভালবাসেন ইসাবেলা, মিস করেন। তাই তুমি তাকে অবহেলা করলে মনে কষ্ট পান।”

“ওহ, মিকি তুমি তো মহা শয়তান। আমাকে ফাঁদে ফেলছ।” সেকেন্ডের মতো ভেবে নিয়ে বেলা জানাল, “কিন্তু আমার এই অবস্থায়?”

তারা তোমার মা। তোমাকে অসম্ভব রকম ভালোও বাসেন। তাই তার চেয়ে উদার আর কেউ হতে পারে না। তুমি আঘাত পাবে এরকম কিছুই যে করবে না, তা তুমিও জানো।”

“তোমাকে খুশি করার জন্য; শুধু তোমার জন্যই যাব, মিকি।”

তাই পরের শনিবারে সকাল বেলা ব্রম্পটন রাস্তাতে দুই ভাই-বোনকে দেখা গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে। বেলা’র সাথে তাল মেলানোর জন্য মাইলকে বেশ কষ্টই করতে হল।

“তুমি কি পরের অলিম্পিকের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছ নাকি?” হাসি মাখা মুখে বোনের দিকে তাকাল মাইকেল।

“তুমি দেখছি ইদানীং বেশি বেশি সিগারেট খাচ্ছো?” ভাইকে মৃদু ভর্ৎসনা করল বেলা।

“আমার এই একমাত্র দোষ।”

তারা কোর্টনি কিংবা বর্তমানে নিজেকে তারা গামা নামে পরিচয় দেয়া ভদ্রমহিলা ক্রমওয়েল রোডে আবাসিক হোটেল পরিচালনা করেন। ক্লায়েন্টদের বেশির ভাগই হচ্ছে বিশেষ করে আফ্রিকা, ভারত আর ক্যারিবীয় থেকে আসা প্রবাসিগণ।

কাদোগান স্কোয়ার থেকে এই জায়গার দূরত্ব সাকুল্যে বিশ মিনিট। ইসাবেলা অবাক হয়ে ভাবে যে কোন এক সময় এই একই ব্যক্তি সামলেছেন ওয়েল্টেভ্রেদেনের সেই ফরাসি দুর্গ। মায়ের স্মৃতি বলতে মনে পড়ে ফুল লেংথ বল গাউন আর শুভ্র গলা-কানে হানি’র কোর্টনি খনি থেকে আসা হলুদ হীরে পরিহিত মা নেমে আসছেন মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে। ইসাবেলা কখনোই বুঝতে পারেনি যে সেই রাজকীয় দেহাবয়েবের মাঝে লুকিয়ে ছিল এতটা অতৃপ্তি আর বেদনা।

তারা’র মাথা ভর্তি ঝলমলে সেই চুলগুলোর জায়গা নিয়েছে সস্তা রঙ করা আদা আর ধূসরের আভা। জন্মসূত্রে যা ইসাবেলা পেয়েছে সেই কমনীয় দেহত্বক অনাদর অবহেলায় বয়সের ছাপে জড়িয়ে আছে। নাকে, গালে ব্ল্যাকহেডস, মুখের তুলনায় বড় ফল দাঁতের ভারে নষ্ট হয়েছে ঠোঁটের সৌন্দর্য।

কোলনের গন্ধ ছড়িয়ে হোটেলের সদর দরজার সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন তারা। আগ্রহ নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। খানিকটা অপরাধবোধ নিয়ে বেলা নিজেও আলিঙ্গন করল মা’কে।

“দেখি তো আমার ডার্লিং মেয়েটাকে।” দু’হাতের মাঝে ইসাবেলাকে ধরে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ চলে গেল নিচের দিকে। “তুমি তো আরো সুন্দর হয়ে গেছ বেলা; অবশ্য কারণটাও বোঝা যাচ্ছে। খুশি আর আনন্দ ভরা ছোট্ট একটা পুটুলি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ তাহলে, তাইনা।”

খানিকটা বিরক্তি মেশানো হাসি হাসলেও কথা বাড়াল না বেলা।

“তোমাকেও ভাল দেখাচ্ছে মাম্মি-মানে তারা।”

“কত মাস কেটে গেছে; অভিযোগ করলেন তারা, “প্রায় বছরই বলা যায়। তুমি তো ঐ রাস্তার শেষ মাথাতেই থাকো। অথচ বুড়ী মাকে দেখতেও আসো না।”

এবারে যোগ দিল মাইকেল। সত্যিকারের উষ্ণ মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরল জননী’কে।

“মিকি, আমার ছেলে-মেয়েদের মাঝে তুমিই সবসময় ছিলে সবচেয়ে মিষ্টি আর আদুরে।”

অন্যদিকে মুখে হাসি ধরে রাখলেও ইসাবেলা’র মাথায় ঘুরছে কতক্ষণে এখান থেকে পালাতে পারবে। মনে হচ্ছে না সহজ হবে ব্যাপারটা। দুদিকে দুজনের হাত ধরলেন তারা। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন হোটেলের ভেতরে।

“তোমাদের জন্য চা-বিস্কুট রেডি করে রেখেছি। যখন থেকে মাইকেল বলেছে যে তোমরা আসছ, আমার আর তর সইছিল না।

শনিবারের এই সকালবেলায় তারা’র অতিথি’তে ভরে আছে লর্ড কিচেনার হোটেলের পাবলিক লাউঞ্জ। সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাতাস। সবার সাথে সন্তানদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারা। যদিও আগেও এদের অনেককেই দেখছে বেলা।

“দক্ষিণ-আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে আমার ছেলে আর মেয়ে এসেছে।” আর দেশের নাম শুনতেই কয়েক জনের চোখ পিট পিট করে জ্বলে উঠল। দেশে থাকলে নিজেকে লিবারেল হিসেবেই মনে করে বেলা কিন্তু বিদেশে এলে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখলে কেমন যেন দেশপ্রেমিকের ভাব আসে মনে।

অবশেষে লাউঞ্জের এক কোণাতে তাদের নিয়ে বসাল তারা। কাপে চা ঢালতে ঢালতে এমন চনমনে স্বরে কথা বলতে লাগল যে এত বড় রুমের সকলেই শুনতে পেল : “তো বেলা, এখন তোমার বেবি’র সম্পর্কে বলো। ডেলিভারী ডেট কবে আর বাবা’ই বা কে?”

“এই জায়গাটা কিংবা সময় কথা বলার মতো নয়, তারা।” বিবর্ণ মুখে জানাল বেলা; কিন্তু হেসে ফেলল তারা।

“ওহ্, এখানে সবাই আমরা একটা বড় সড় পরিবারেরই মতন। তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারো।”

এবারে মাইকেল খুব দ্রভাবে বলে উঠল : নিজের ব্যক্তিগত বিষয় দুনিয়াকে জানাতে চায় না বেলা। আমরা এ বিষয়ে পরে কথা বলব তারা।”

“ধ্যাৎ তোমাদের যত সেকেলে চিন্তা।” টেবিলের ওপাশ থেকে বেলাকে ধরতে চাইল- তারা; কিন্তু চা ছলকে পোশাকে পড়াতে ক্ষান্ত দিল চেষ্টা।

“যথেষ্ট হয়েছে তারা। তারপর তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বলে উঠল, “বেনজামিন কোথায়? কী করছে এখন?”

‘ওহ্ বেনই হচ্ছে আমার আনন্দ আর গর্ব।” বিষয়টা যেন লুফে নিল তারা। এই তো কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে গেছে। ও অসম্ভব বুদ্ধিমান হয়েছে। এ বছরই এ লেভেল করছে। হেডমাস্টার তো বলেন যে রায়হাম গ্রামারে এত দক্ষ ছেলে গত দশ বছরেও আর দেখেননি। আর মেয়েরা তো, ওর মহা ভক্ত’ও এতটাই সুদর্শন হয়েছে।” তারা’র গল্প শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল বেলা। যাক কথা বলতে হচ্ছে না।

মা-র এই ভিন্ন দুনিয়াতে খাপ খাওয়াতে না পারার আরেকটা কারণ হলো বেনজামিন গামা। এই স্ক্যান্ডালের মাধ্যমে কোর্টনি পরিবারকে তারা এতটাই কলঙ্কিত করেছে যে নানা ওর নাম উচ্চারণও ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

শুধু মাইকেল-ই এ বিষয়ে কথা বলে বেলা’র সাথে বেলা’কে এও জানিয়েছে যে মোজেস গামা গ্রেফতার হবার পরেও তারা’র বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি আর কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি যে তারা কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল।

“কিন্তু পরিবারের সুনাম বাঁচাতে বাবা কি কিছু করেননি?”

“তুমি নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করো।” একবার বেলা চেষ্টাও করেছিল; কিন্তু ওই একবারই তার সাথে গোমড়া মুখে শীতল আচরণ করেছেন শাসা। ইসাবেলা’ও বেঁচে গেছে। কেননা সত্যি কথা বলতে মায়ের অপরাধের মাত্রা সম্পর্কে জানতে ওর’ও ইচ্ছে ছিল না। বুকের গভীরে ভাবতেও ভয় লাগত যে মা এমন এক কুখ্যাত “গাই ফকস” দলের সদস্য যারা কিনা মোজেস গামা’কে দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্ট ভবন আর যদি এ পরিকল্পনা সফল হত তাহলে মারা যেত ওর নানা, তারা’র নিজের বাবা। তাই মাকে বিশ্বাসঘাতক ধরে নেয়াটাই শ্রেয়। আর স্কুল এ ব্যাভিচার দক্ষিণ আফ্রিকার আইনে জঘন্য অপরাধ হওয়ায় বেলা অবাক হয়ে ভাবল যে সে এখানে কী করছে।

হঠাৎ করেই তারা’র মুখে ভেসে উঠল হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের ঝলক। খুশিতে নেচে উঠল চোখ মুখ।

“বেন!” চিৎকার করে উঠল ছেলেকে দেখে। “দেখ, আমাদেরকে দেখতে কে এসেছে। তোমার ভাই-বোন। বেশ মজা না?”

নিজের চেয়ারেই ঘুরে বসল ইসাবেলা। পেছনে, হোটেল লাউঞ্জের দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর সৎ ভাই। গত এক বছরে বেশ বড় হয়ে গেছে। কিশোর থেকে পুরুষালী ভাব এসেছে চেহারাতে।

“হ্যালো বেনজামিন।” কণ্ঠে উৎসাহ নিয়ে ডেকে উঠল বেলা। কিন্তু মুখে হাসি সত্ত্বেও বেনে’র মাঝে কঠোর ভাবটা চোখ এড়াল না।

মা-হলেও একটুও বাড়িয়ে বলেননি তারা। বেনজামিন আসলেই বেশ সুন্দর হয়েছে দেখতে। আফ্রিকান উজ্জ্বতার সাথে মিশে গেছে মায়ের রূপ। তামাটে গায়ের রঙে ঘন কোকড়াচুল।

“হ্যালো ইসাবেলা।” মুগ্ধ হয়ে আফ্রিকার সন্তানের কণ্ঠে লন্ডনের টান শুনল বেলা। তবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করল না। প্রথমবার সাক্ষাতের সময় থেকেই আপনাতেই গড়ে উঠেছে এ নিয়ম। দুজনেই হাত মিলিয়ে পিছিয়ে গেল। আর কি বলা যায় ভাবার আগেই মাইকেলের দিকে ফিরল বেনজামিন।

এবারে ঝকঝকে দাঁত আর ভালো চোখ জোড়াসহ সবখানে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ হাসি।

“মিকি!” দ্রুত দুই কদম এগিয়ে এসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাইয়েরই মতন।

চারপাশের সবার মনে বিশ্বাস জন্মানোর মাইকেলের এই গুণকে ঈর্ষা করে ইসাবেলা। ইসাবেলার সাথে খানিকটা দূরত্ব রেখে চললেও মাইকেলের সাথে কতটা সহজ এই বেনজামিন! একটু পরে দেখা গেল তারা, বেন আর মিকি মিলে বেশ খোশ গল্পে মেতে গেছে। নিজেকে কেমন অচ্ছুত লাগল বেলার।

যাক, খানিক পরেই লাউঞ্জ পার হয়ে তারা’র কাছে এসে জানাল কুষাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান এক ছাত্র। ঘড়ির দিকে তাকাল তারা।

“ওহ্ ঈশ্বর, আমাকে মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ নেলসন। আমরা এতই গল্পে মজে গেছি যে সময় খেয়াল করিনি।” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। “চলুন সবাই! ট্রাফালগার স্কোয়ারে যেতে হলে এখনি বের হতে হবে।”

লাউঞ্জের সবার মাঝে চঞ্চলতা দেখা যেতেই মাইকেলের দিকে তাকাল বেলা।

“এসবের মানে কী মিকি? মনে হচ্ছে তুমিও জানো সবকিছু।”

“ট্রাফালগার স্কোয়ারে র‍্যালি আছে।”

“ওহ গড না! সেসব বর্ণবাদ বিরোধী জাম্বুরী নয় নিশ্চয়ই। আমাকে বলল নি কেন?”

“তাহলে তুমি সটকে পড়ার বাহানা পেয়ে যেতে।” বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল মাইকেল। “চলো, তুমিও চলো।”

“না, থ্যাঙ্কস্। বাবা অ্যামব্যাসিতে আসার পর থেকে গত তিন বছর ধরে এ ঝামেলাই সহ্য করছি। তুমিই বা কেন যাচ্ছ অযথা এই হ্যাপা’র মাঝে?”

“বেলা, মাই সুইটি, এটাই আমার কাজ। তোমার কথা মতো এই হ্যাপা নিয়ে লেখার জন্যই আমি লন্ডনে এসেছি। এখন চলল আমাদের সাথে।”

“কেন?”

“খানিকটা চেঞ্জের জন্য বেড়ার ওপাশ থেকে দেখলে দুনিয়াকে হয়ত ভালই লাগবে-তাছাড়া আমিও আছি। একসাথে বেশ ভাল সময় কাটবে।” অনিশ্চিতভাবে হাত নাড়ল বেলা। বিষয়টা বাদে মাইকেলের সঙ্গ আসলেই পছন্দ করে। এছাড়া রামোন না থাকাতেও একা হয়ে পড়েছে।

“যাব যদি বাসের উপরে চড়ে বেড়ানো যায় তাহলে। টিউবে না।”

নেলসন লিটালুঙ্গি, সেই কৃষাঙ্গ ছাত্রসহ জনা বিশেকের দল গেল লর্ড থেকে। লাল বাসের উপর তলায় বেলার জন্য একটা সিট খুঁজে নিয়ে গাদাগাদি করে বসল তিনজন। সামনের বেঞ্চে তারা আর বেন। কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে সারাক্ষণ একসাথে হাসি তামাশা করল সকলে মিলে। ইসাবেলার নিজেরও একেবারে খারাপ লাগল না। সবকিছুর মধ্যমণি মাইকেল। নেলসন আর সে মিলে গানও গাইতে লাগল। দুজনের কণ্ঠই বেশ মধুর। দিস ইজ মাই আইল্যান্ড ইন দ্য সান-গানের সাথে গলা মেলানো বাকিরা। হ্যাঁরী বেলাফন্টে’কে নকল করতে পারে নেলসন। দেখতেও অনেকটা তার মত। প্রথম থেকেই জমে গেছে মাইকেল আর তার জুটি।

ন্যাশনাল গ্যালারীর সামনে বাস থেকে নামতেই দেখা লম্বা থামের নিচে খোলা চত্বরে এরই মাঝে জমায়েত হয়ে গেছে সকলে। নেলসন আর হোরাশিওকে নিয়ে কী একটা ঠাট্টা করল মাইকেল। হাসতে হাসতে চতুরের দিকে পা বাড়ালো পুরো দল। পায়ের কাছ থেকে পাখা ঝাপটে মেঝের মতো করে উড়ে গেল কবুতরগুলো।

চতুরের শেষ দিকে সাউথ আফ্রিকা হাউজের ঠিক সামনে টেমপোরারি তার টাঙ্গানো হয়েছে। দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে পুরো এরিয়া। পেছনের সারিতে বসে পড়ল মাইকেলরা। প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ থেকে হাতে আঁকা ব্যানার বের করল তারা। মেলে ধরতেই দেখা গেল লেখা আছে, “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হল বর্ণবাদ।”

মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে ইসাবেলা এমন ভাব করতে চাইল যেন কেউ কাউকে চেনে না। “এত মানুষ তাঁকে দেখছে। এটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই উনার, তাই না?” ভাই’কে ফিসফিস করে বলতেই হেসে ফেলল মাইকেল।

“বহুদিনের চেষ্টায় আসলে এমন হয়ে গেছেন।”

মোটের উপর এই বৈচিত্র্যময় সমাবেশের অংশ হতে পেরে মজাই পেল ইসাবেলা। এর আগে বহুবার এ ধরনের মানুষগুলোর দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়েছিল অ্যামব্যাসির উঁচু জানালা দিয়ে আর আজ দেখছে পুরোপুরি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা চারজন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ কৌতুক শোনার মতো করে হেসে ফেলল এক বক্তার মুখে প্রিটোরিয়ার মতই লন্ডনও পুলিশ স্টেট আর খারাপ হবার কথা শুনে। নিজের সাপোর্ট প্রকাশের জন্য খুব সুন্দর করে হাসি দিয়ে বক্তার দিকে কিস্ ছুঁড়ে দিল ইসাবেলা।

প্লাটফর্মের উপর থেকে বক্তারা তুলোধুনো করে ছাড়ল ট্রাফিক আর বেগুনি বাসগুলোকে। এর সবকিছুই আগেও শুনেছে ইসাবেলা। তবে দিনের সবচেয়ে হাস্যকর অবস্থার উদ্রেক হল যখন মাথার উপর ঘুরতে থাকা একটা কবুতর পায়খানা করে দিল এক বক্তার চকচকে টাকের উপর। চিৎকার করে উঠল বেলা : “ফ্যাসিস্ট পাখি, বর্ণবাদী প্রিটোরিয়া শাসকের প্রতিনিধি!”

মিটিঙের শেষে ভোট হলো যে জন ভরসটার আর তার অবৈধ শাসন তন্ত্র নিপাত যাক, ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হোক ডেমোক্র্যাটিক পিপলস গভর্নমেন্ট অব সাউথ আফ্রিকার হাতে। সকলেই একবাক্যে মেনে নিল এ ঘোষণা। ফুটবল ম্যাচ দেখে ফেরা ভিড়ের চেয়েও শান্তভাবে সাঙ্গ হলো মিটিং।

“চলো একটা পাবে যাই।” বলে উঠল মাইকেল। “ফ্যাসিস্ট সরকারের কথা শুনতে শুনতে তেষ্টা পেয়ে গেছে।

“স্ট্যান্ডে বেশ ভাল একটা পাব আছে।” পথ বাৎলে দিল নেলসন।

“চলো তবে।” উৎসাহ দিল মাইকেল।

জিনজার বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে ইসাবেলা জানাল, “এভাবে আসলে আগের মতই সময় নস্ট হবে শুধু। দুইশ মানুষ বাতাস গরম করে তুললেই কিছু আর বদলে যাবে না।”

“এতটা নিশ্চিত হয়ো না।” হাত দিয়ে ঠোঁটের উপর লেগে থাকা ফেনা মুছে ফেলল মাইকেল। “হয়ত এটা বাঁধের দেয়ালের গায়ে একটুখানি আঁচড়-শীঘ্রিই হয়ে যাবে দফায় দফায় ঢেউ আর তারপরেই ভয়ংকর সামুদ্রিক গর্জন।”

“ওহ্ পাগল হলে নাকি মিকি।” একবাক্যে ভাবনাটা খারিজ করে দিল ইসাবেলা। “সাউথ আফ্রিকা এতটাই ধনী আর শক্তিশালী। এছাড়া আমেরিকা আর ব্রিটেনও অনেক বিনিয়োগ করেছে সে দেশে তাই তারা নিশ্চয়ই আমাদের জন্মগত অধিকারকে একদল মার্কসিস্টের হাতে ছেড়ে দেবে না।” গত তিন বছরে অ্যামব্যাসাডর বাবার মুখে শোনা কথাগুলোই হুবহু বলে দিল বেলা। মা সৎভাই–নেলসন কিংবা লড় কিচেনার হোটেলের আরো বিশজন আবাসিকের সাথে কাটানো সান্নিধ্য ও তার যুক্তিকে একটুও টলাতে পারে নি। কাদোগান স্কোয়ারে ফিরে তাই মাইকেলকে বলে দিল নিজের অপছন্দের কথা।

“ওরা বড্ড বেশি রাগী ছিল, মিকি।”

“এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিস্থিতি বেলা। যদি সারভাইভ করতে হয় এর সাথে মীমাংসা করতেই হবে।”

“এমন তো না যে ওদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। ওয়েল্টেভ্রেদেনে ন্যানি, ক্লোনকি, গ্যামিয়েট আর অন্যদের কথাই ধরো না। আমি বলতে চাইছি যে অন্য বহু শ্বেতাঙ্গের চেয়েও ওরা অনেক ভাল আছে।”

“আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি, বেলা। সঠিক আর ভুল ভেবে ভেবে তুমি পাগল হয়ে যাবে; কিন্তু শেষতক একটাই কথা তাদের অনেকেই অনেক ভালো আর সুন্দর। তাহলে কোন অধিকার বলে আমরা তাদেরকে জন্মভূমির সব কিছু সহভাগীতা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারি?”

“থিরি অনুযায়ী ঠিকই আছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তো ওরা সশস্ত্র যুদ্ধের কথাই বলছিল। তার মানে নারী আর “শিশুদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলা। রক্ত আর মৃত্যু মিকি। ঠিক আইরিশদের মত। তাই না?”

“জানি না বেলা। মাঝে মাঝে মনে হয়না! হত্যা, জ্বালিয়ে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু আবার একেক সময় মনে হয়-কেন না? শত শত বছর ধরে নিজেকে আর তার জন্মগত অধিকারকে রক্ষার জন্য মানুষই খুন করে আসছে মানুষকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সশস্ত্র বিপ্লবের কথা শুনে আমাদের বাবা বক্তৃতা দেয়, চিৎকার করে, কিন্তু একই মানুষটাই ১৯৪০ সালে হারিকেনে চড়ে ইথিও পিয়া, ইটালী আর জার্মানীর উপর গুলি ছুঁড়েছেন নিজের স্বাধীনতার আশায়। নানা, আইনের ধ্বজাধারী হয়েও মুক্ত বাজারের রক্ষক হিসেবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর আর রক্তাক্ত ঘটনা, হিরোশিমা নাগাসাকির উপর বোমা বর্ষণের ঘটনায় খুশি খুশি মাথা নেড়ে বলেন, “ভাল হয়েছে, তাহলে আমাদের কিংবা আমাদের পরিবারের তুলনায় তারা, বেনজামিন আর নেলসন কতটাই বা রক্ত পিপাসী? কে ঠিক আর কে ভুল, বেলা?”

“তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।” উঠে দাঁড়াল বেলা। “আমি শুতে যাচ্ছি।”

***

সকাল ছয়টায় ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ওপাশে রামোনের গলা শুনতেই। বেলা’র উপর থেকে বিষণ্ণতার চাদর সরে গেল।

“ডার্লিং, তুমি কোথায়?”

“এথেন্স।”

“ওহ, খানিকটা চুপসে গেল বেলা। “আমি আরো ভেবেছিলাম বোধহয় হিথ্রোতে।”

“আমার দেরি হবে। আরো অন্তত তিনদিন থাকতে হবে এখানে। তুমিও চলে এসো না?”

“এথেন্সে?” এখনো আধো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বেলা।

“হ্যাঁ। কেন নয়? তুমি চাইলে দশটার বি ই এ ফ্লাইট ধরতে পারো। তিন দিন কাটানো যাবে একসাথে। চাঁদের আলোয় অ্যাক্রোপলিস কেমন লাগবে বলো তো? দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিব।”

“ঠিক আছে। তোমার ফোন নাম্বার দাও। প্লেনে উঠেই তোমাকে ফোন দেব।” ব্রিটিশ ইউরোপীয়ান এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশনের প্রতিটা লাইন ব্যস্ত থাকায় মিনি’তে করে ওকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এলো মাইকেল। হাতে সময়ও বেশি নেই।

“তোমার রিজার্ভেশন কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করছি।” জানাল মাইকেল।

“না, মিকি, আমি জানি তুমি অনেক লক্ষ্মী। হলিডে সিজন তো শেষ। তাই কোনো সমস্যা নেই। তুমি যাও। রামোন আর আমি বাসায় ফেরার সময় ফ্ল্যাটে তোমাকে ফোন করব।”

টার্মিনাল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো নিরাশ হয়েই না ফিরতে হয় শেষমেষ। উদ্বিগ্ন মুখে লাগেজ নিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে পর্যটকেরা। বহুকষ্টে অবশেষে ইনফর্মেশন ডেস্কে পৌঁছাতে শোনা গেল ফরাসি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের স্ট্রাইকের কারণে সব ফ্লাইট পাঁচ ঘণ্টা করে ডিল হয়ে গেছে। এছাড়া এথেন্সের ফ্লাইট’ও পুরো বুকড়। তাই ফাস্ট ক্লাসে সিট পেতে হলেও ওয়েটিং লিস্টে অপেক্ষা করতে হবে।

পাবলিক টেলিফোন ব্যবহার করার জন্য দাঁড়াতে হলো আরেকটা লাইনে। রামোনকে জানাতেই বেলার মতো সেও মন খারাপ করে ফেলল।

“আমি এত সহজে হাল ছাড়ছি না। দরকার হয় সারাদিন এখানে বসে থাকব।” ঘোষণা করল বেলা।

হতাশা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে পার হল পুরো দিন। অবশেষে বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট ছাড়ার কথা শুনে প্রার্থনা করতে করতে চেক ইন কাউন্টারে দাঁড়াল বেলা। সামনে না হলেও আরো আধডজন লোক একই প্রার্থনাই করছে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। অনুতপ্ত হবার মতো করে মাথা নাড়ল। বুকিং ক্লার্ক।

“আয়্যাম সো সরি, মিস্ কোর্টনি।”

আগামীকাল সকাল দশটার আগে এথেন্সের আর কোনো ফ্লাইট নেই। আশা হত ইসাবেলা আবারো রামোনকে ফোন করল। কিন্তু ওকে না পেয়ে মেসেজ রেখে দিল বেলা। আশা করল রামোন বুঝতে পারবে যে বেলা নিরুপায় হয়ে যাবার আশা বাতিল করেছে।

বেলার মতো অন্য শত শত প্যাসেঞ্জার’ও নিরাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরাতে কোনো ট্যাক্সিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতে ব্যাগ রেখে শহরে ফেরার জন্য। বাসস্ট্যান্ডে লাইনে দাঁড়াল বেলা।

আটটার’ও পরে বাসে উঠে ফ্ল্যাটে পৌঁছে মনে হল কেঁদে দেবে। সুস্বাদু রান্নার গন্ধ নাকে আসতেই বুঝতে পারল কতটা ক্ষিধে লেগেছে। লবি’তে ব্যাগ রেখে জুতা ছুঁড়ে ফেলে কিচেনে দৌড় দিল বেলা। বোঝাই যাচ্ছে যে মাইকেল নিজেই ডিনার তৈরি করেছে। ব্রেকফাস্টের বাসন-কোসন এখনো পড়ে আছে। নিজের জন্য বেঁচে যাওয়া চিকেন কিয়েভ আর চিজ কেক নিয়ে নিল বেলা। সিঙ্গের দিকে চোখ যেতেই দেখা গেল দুটো এন্টো ওয়াইন গ্লাস আর বাবার নুটস্ সেন্ট জর্জেস ১৯৬১। তার পরেও মাথায় অন্য কোনো সন্দেহ এলো না।

উপরের তলায় মাইকেলের বেডরুম থেকে হার্ড মিউজিকের শব্দ আসছে। সোজা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাইকেলের রুমের দরজা খুলেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেলা।

এমন কিছু দেখবে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি; তাই কী দেখছে বুঝতেই কেটে গেল ক্ষাণিক সময়।

এরপরই মনে হল মাইকেলকে বোধ হয় কেউ আক্রমণ করেছে। মন চাইল চিৎকার করে উঠে। তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিতেই বুঝতে পারল কী ঘটছে।

ডাবল বেডের উপর হাঁটু গেড়ে আছে নিরাভরণ মাইকেল। মেঝেতে গড়াচ্ছে সাটিনের বিছানার চাদর।

একইভাবে উলঙ্গ অবস্থায় পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে আছে নেলসন। মাইকেলের চির পরিচিত অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানায় এমন একটা অভিব্যক্তি দেখতে পেল যে কেপে উঠল বেলা।

চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই বোন’কে দেখতে পেল মাইকেল, শরীরে ভয়ংকর রকম ঝাঁকি দিয়েই নেলসনের কাছ থেকে সরে গিয়ে চাইল বালিশ দিয়ে নিজেকে ঢাকতে।

তাড়াহুড়া করে রুম থেকে চলে এলো ইসাবেলা।

সারদিনের ক্লান্তির কল্যাণে ঘুমিয়ে পড়লেও আধ-ছেঁড়া সব স্বপ্ন দেখল। একবার তো মনে হল উলঙ্গ অবস্থায় ভয়ংকর কোনো দানবের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে যুঝছে মাইকেল। ঘুমের মাঝেই এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে ঘুমই ভেঙে গেল।

ভোর হবার আগেই রেস্ট নেবার চেষ্টা ছেড়ে উঠে গেল বেলা। রান্নাঘরে যেতেই দেখা গেল গত রাতের নোংরা প্লেট গ্লাস সব পরিষ্কার করে জায়গামতো রেখে দেয়া হয়েছে। খালি ওয়াইন গ্লাস আর বোতল উধাও হয়ে ঝকঝক করছে পুরো রান্নাঘর।

কফি পার্কোলেটরের সুইচ্ অন্ করে লেটার বক্স চেক করতে গেল বেলা। এত ভোরে নিউজ পেপার আসার সম্ভাবনাও নেই। তাই ফিরে এসে এক কাপ কফি ঢেলে নিল। জানে বেবি’র জন্য ক্যাফেইন মোটেও ভাল না; কিন্তু এ সকালবেলায় না হলে আর চলছে না।

কফি’তে প্রথম চুমুক দিতেই সিগারেটের গন্ধ পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ তুলে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল।

“কফি’র গন্ধটা বেশ লাগছে।” নীল চোখ জোড়ায় একরাশ অপরাধ বোধের ছায়া নিয়ে সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল। ঠোঠের কোণে অনিশ্চয়তা আর আত্মপ্রত্যয়হীনতা নিয়ে বলে উঠল; “আমি ভেবেছিলাম তুমি এথেন্সে চলে গেছ-স্যরি।”

রান্নাঘরের দু’প্রান্ত থেকে কয়েক সেকেন্ড মাত্র পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দু’ ভাই-বোন। অথচ মনে হল অনন্তকাল পার হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াল। ইসাবেলা। বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের গালে কিস্ করল। বলল,

“আই লাভ ইউ মিকি। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তি হলে তুমি।”

গভীরভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাইকেল। “থ্যাঙ্ক ইউ বেলা। আমার বোঝ উচিত ছিল যে তুমি কতটা আন্ডারস্টান্ডিং। তারপররে’ও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়ত আমাকে প্রত্যাখ্যান করে বসবে ভাবতে গিয়ে আমি যে কতটা ভয় পেয়েছি তুমি জানো না।”

“না, মিকি। তোমার ভয় পাবার কিছু নেই।”

“আমিই তোমাকে বলতাম। শুধু সঠিক সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“আমাকে কিংবা অন্য কাউকেই দোহাই দেয়ার কিছু নেই। এটা একান্তই তোমার ব্যাপার।”

“না, আমি চাই তুমি পুরোটা জানো। আমাদের মাঝে কোনো সিক্রেট তো কখনো ছিল না। জানতাম যে আগে কিংবা পরে তুমি ঠিকই জানবে। শুধু চেয়েছিলাম ওই ঈশ্বর, যেভাবে জেনেছে সেরকমই কখনো চাইনি। পুরো ব্যাপারটা নিশ্চয় তোমাকে প্রচণ্ড ঠাক্কা দিয়েছে।”

চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা। মন চাইল, যা দেখেছে তা দূর হয়ে যাক মাথা থেকে। কোনো হরর সিনেমার দৃশ্যের মতো এখনো চোখে ভাসছে মাইকেলের সেই নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণাক্লিস্ট চেহারা।

“কোনো সমস্যা নেই মিকি। কিছুই যায় আসে না এতে।”

“অবশ্যই যায়, বেলা।” আলতো করে বোন’কে চোখের সামনে ধরে চাইল মেয়েটার মনের ভাব বুঝতে। যা দেখল তাতে মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। ইসাবেলা’র কাঁধে হাত রেখে ব্রেকফাস্ট টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিল মাইকেল।

“অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো, একদিকে স্বস্তি পেয়েছি যে তুমি জেনে গেছ। যেভাবে দেখেছ তা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, পৃথিবীতে একটাই মানুষ আছে, যার কাছে আমি আমার মতো করেই থাকতে পারি। যার কাছে আমাকে মিথ্যে বলতে হবে না।”

“কেন লুকিয়ে রেখেছিলে মিকি। ১৯৬৯ সালে এসে এখনো কেন নিজেকে মেলে ধরতে পারো না? কেভাবে কার কথা?”

ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা জালিয়ে নিল মাইকেল। জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থেকে বলে উঠল : “অন্যদের জন্য এটা সত্যি হতে পারে; কিন্তু আমার জন্য না। পছন্দ করি বা না করি, আমি একজন কোর্টনি, এখানে নানা আছে, বাবা, গ্যারি, শ পারিবারিক সুনাম সব জড়িত।”

ইসাবেলার মন চাইল প্রতিবাদ করে। কিন্তু বুঝতে পারল এটাই চরম সত্যি।

“নানা আর বাবা” আবারো বলে উঠল মাইকেল, “জানতে পারলে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।”

ভাইয়ের হাতের উপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে চাইল ইসাবেলা। জানে সত্যি কথাই বলছে মাইকেল। কখনোই নানা কিংবা বাবাকে জানানো যাবে না। তাদের জন্য এটা বহন অসম্ভব দুঃসহ হবে এমনকি তারার চেয়েও বেশি। তারা তো বাইরের মানুষ; কিন্তু মাইকেলের দেহে বইছে কোর্টনি বংশের রক্ত। দাদীমা আর বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। কবে তুমি নিজের এই দিকটা সম্পর্কে জানতে পারলে?” আস্তে করে জিজ্ঞেস করল বেলা।

প্রিপারেটরী স্কুলের সময় থেকে।” খোলামেলাভাবেই উত্তর দিল মাইকেল। “আমি বহুবার চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলাতে। চাইনি এমন কিছু হোক। কখনো মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত কিন্তু পারি নি বেলা। মনে হয়েছে এমন একটা পশু আছে ভেতরে যে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এর উপর।”

প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল বেলা। “ন্যানি কী বলবে জানো-হট কোর্টনি ব্লাড়। আমাদের সবার মাঝেই এটা আছে। কেউই খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি; বাবা, গ্যারি, শন, তুমি কিংবা আমি কেউই না।”

“এ ব্যাপারে কথা বলতে তোমার খারাপ লাগছে না তো? আমি তো সবসময় ঢেকে রাখতেই চেয়েছি।”

“যেভাবে ইচ্ছে বলল। আমি শুনছি।”

“পনের বছর ধরে এভাবেই আছি আর মনে হচ্ছে আরো পঞ্চাশ বছরও এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো-পারিবারিক কারণে যা জানলে সবাই বেশি আহত হবে-কৃষণাঙ্গরাই কেবল আমাকে আকর্ষণ করে। নানা, বাবা আর আমাদের গৃহ আদালতে এ কারণেই বেশি দোষী হব!” থর থর করে কেঁপে উঠেই সিগারেট ফেলে দিল মাইকেল। আর প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা জ্বালালো।

“কালো পুরুষরা যে কেন আমায় এত আকর্ষণ করে বুঝি না। অনেক বার ভেবেছি। মনে হয়, তারা’র মতো হয়েছি। হয়ত অবচেতন মনে একটা অপরাধবোধ কিংবা আকাঙ্খা রয়ে গেছে ওদের উন্মা প্রশমন করার। মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। অনেক দিন ধরেই তো ওদেরকে দমিয়ে রাখছি, তাই কিছু যদি ফেরত দেয়া যায়?”

“নাহ!” নরম স্বরে জানাল ইসাবেলা। এমনভাবে কথা বলে নিজেকে ছোট করো না মিকি। তুমি অসম্ভব সুন্দর আর ভদ্র একজন মানুষ। আর প্রবৃত্তির জন্য আমরা কেউ দায়ী নই।”

ইসাবেলা’র মনে পড়ল যে মাইকেল কতটা লাজুক, স্নেহশীল আর পরোপকারী; তারপরেও কেমন যেন বিষণ্ণ। এবারে এই বিষাদের কারণও বুঝতে পারল। আপন হৃদয়ে অনুভব করল যে, যা দেখেছে তা নিয়ে আর কোনো ঘৃণ্য ভাব নেই মনে। শুধু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে তার প্রিয়। মানুষটা কতটাই না মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে।

‘মন খারাপ করো না, মিকি ডার্লিং।”

“না।” স্বীকার করল মাইকেল। “যতক্ষণ তুমি আমার পাশে আছে।”

***

দুদিন পর। ইন্টারভিউ নিতে বাইরে গেছে মাইকেল। ডেস্কের উপর রাজ্যের বই আর কাগজ পত্র ছড়িয়ে নিয়ে বসে আছে ইসাবেলা। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। অন্যমনস্ক থাকায় প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কী শুনছে কিংবা কে কথা বলছে।

“রামোন? তুমি? কোনো সমস্যা হয়েছে? কোথায় তুমি? এথেন্সে?”।

“আমি আমাদের ফ্ল্যাটে…”

“এখানে? লন্ডনে?”

“হ্যাঁ। জলদি আসতে পারবে? আই নিড ইউ।”

লাঞ্চ আওয়ারের ট্রাফিকের মাঝ দিয়ে দ্রুত গতিতে মিনি চালিয়ে ফ্ল্যাটে পৌঁছে একেকবারে দুটো করে সিঁড়ি টপকে যখন দরজার সামনে পৌঁছাল মনে হল দম বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি।

“রামোন!” কোনো সাড়া না পেয়ে বেডরুমের দিকে দৌড় লাগাল বেলা। রামোনের কিট ব্যাগ বিছানার উপর খোলা পড়ে আছে। মেঝের উপর দুমড়ানো শার্টের গায়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া পুরনো রক্ত ছাড়াও নতুন তাজা রক্ত।

“রামোন! ওহ্ ঈশ্বর! রামোন!

শুনছ?

বাথরুমের দরজার দিকে দৌড় দিল বেলা। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। একটু পিছিয়ে হিলসহ লাথি দিল তালা’য়। জুড়ো’র এই কৌশল ওকে রামোন শিখিয়েছিল। ঠুনকো তালাটা ভেঙে পড়তেই খুলে গেল দরজা।

টয়লেটের পাশে টাইলসের মেঝেতে পড়ে আছে রামোন। পড়ে যাবার সময় বোধহয় ওয়াশবেসিনের উপরকার শেফ ধরে ফেলেছিল, বেসিন আর পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বেলা’র কসমেটিকস্। কোমর থেকে উপর পর্যন্ত পুরোপুরি নিরাভরণ রামোনের বুকে ভারী ব্যান্ডেজ। এক নজর দেখেই বুঝতে পারল যে দক্ষ হাতে কেউ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। শার্টের মতো ব্যান্ডেজের গায়েও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কিছু পুরনো, কিছু একেবারে তাজা।

হাঁটু গেড়ে বসে রামোনের দিকে তাকাল বেলা। পার মুখে নাকে সিকনির ঘাম। কোলের উপর রামোনের মাথা নিয়ে ঝুলতে থাকা তোয়ালে দিয়ে কাছের ঠাণ্ডা পানির নল থেকে পানিতে ভিজিয়ে মুছে দিল মুখ আর গলা।

পিট পিট করে উঠল রামোনের চোখের পাতা। তাকাল বেলার দিকে।

“রামোন।”

দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, “আমার সারা পৃথিবী দুলছে।”

“মাই ডার্লিং, তোমার কী হয়েছে? কিভাবে এত আঘাত পেয়েছ?”

“আমাকে বিছানায় নিয়ে চলো।” রাইডিং আর টেনিস খেলা বেলা নিজেও যে কোনো পুরুষের মতই শক্তিশালী। কিন্তু রামোন’কে উঠে বসাতে গিয়ে মনে হলো কারো সাহায্য ছাড়া এ কাজ সম্ভব না।

“যদি আমি ধরে রাখি, দাঁড়াতে পারবে?”

মাথা নেড়ে চেষ্টা করতে গিয়েই দুলে উঠল রামোন। ব্যথার চোটে খামচে ধরল বুকের ব্যান্ডেজ।

“আস্তে আস্তে।” ফিসফিস করে উঠল বেলা। মিনিট খানেকের মতো উপুড় হয়ে থেকে আস্তে আস্তে সোজা হল রামোন।

“অল রাইট।” দাঁতে দাঁত ঘসল রামোন। নিজের কাঁধে ওর বেশির ভাগ ভার নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল বেলা।

“তুমি কি এথেন্স থেকে এভাবেই এসেছ?” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে জানতে চাইল ইসাবেলা।

মাথা নেড়ে মিথ্যেটাতে সম্মতি দিল রামোন। আসল কথা হল কুরিয়ারের কাজ করার জন্যই বেলা’কে এথেন্সে ডেকে পাঠিয়েছিল। হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছিল প্রয়োজনটা। অন্য কোনো এজেন্ট খালি না থাকায় আর বেলার জন্যও সময় হয়ে যাওয়ায় ঠিক করেছিল এটাই উপযুক্ত সময়। এখন মেয়েটার যা অবস্থা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে রামোনের নিদেশ। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তেমন কষ্টও হবে না। সুন্দরী সরল আর গর্ভবতী হওয়ায় চট করে সহানুভূতি আদায় করাটা ওর জন্য সহজ হত। এছাড়া পৃথিবীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে একেবারেই নতুন মুখ হিসেবে অচেনা মেয়েটাকে মোসাদ’রাও চিনবে না। এর উপরে আবার বেলা’র কাছে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার পাসপোর্ট। আর এই দেশটার সাথে ইস্রায়েলের সম্পর্ক বেশ অন্তরঙ্গই বলা চলে।

প্ল্যান ছিল এথেন্স থেকে ফ্লাইটে চডে তেল আবিব গিয়ে পিক আপ সেরে আবার একই পথ ধরে ফিরে আসবে বেলা। খুব বেশি হলে একদিনের কাজ। কিন্তু এথেন্সে পৌঁছাতে না পারায় পাল্টে গেল পুরো ব্যাপারটা। পিক্‌ আপটা বেশ জরুরি ট্র্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওইপন্স সিস্টেম উন্নয়নের কাজে জড়িত ইসরায়েল আর দক্ষিণ আফ্রিকান বিজ্ঞানের সবকিছু ছিল এই প্যাকেটের মাঝে। মোসাদ ওর আদ্যপান্ত জানে জেনেও রিস্কটা নিয়েছে রামোন।

যতটা সম্ভব ছদ্মবেশ ধারণ করে রওনা দিয়েছে সাথে কোনো অস্ত্র ছাড়াই। সাথে অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলি সিকিউরিটি চেক পার হবার চেষ্টা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছু না। মেক্সিকান পাসপোর্ট বহন করলেও নিশ্চয়ই বেন গারিয়ান। এয়ারপোর্টে ওকে চিনে ফেলে টিকটিকি লাগিয়ে দিয়েছে পেছনে।

ফেউ’টাকে রামোনও চিনে ফেলেছিল। কিন্তু খসাতে পারেনি। তাই মোসাদ এজেন্টের ঘাড় ভেঙে দেয়ার সময় নিজেও গুলি খেয়েছে। পরে ভয়ংকর রকম আহত হলেও তেল আবিবের পি এল ও সেফ হাউজে চলে, গেছে। বারো ঘন্টার ভেতরে সিরিয়াতে ওদের পাইপ লাইনের মাধ্যমে রামোনকে বের করে দিয়েছে ওরা।

যাই হোক, লন্ডন হচ্ছে সবচেয়ে বড় সেফ হাউজ। ইনজুরী আর রিস্কের কথা চিন্তা করে দামাস্কাসও ছেড়ে আসতে হয়েছে। স্থানীয় কেজিবি’র স্টেশন হেড পাহারা দিয়ে অ্যারোফ্লোট ফ্লাইট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। সেখান থেকে। লন্ডন। বহুকষ্টে ফ্ল্যাটে পৌঁছেই ফোন করেছে বেলা’কে। আর তারপর কোনো মতে বাথরুমে গিয়েই আবার পড়ে গেছে।

“আমি ডাক্তারকে ফোন করছি।” বলে উঠল বেলা।

“না, কোনো ডাক্তার ডেকো না!” দুর্বলতা সত্ত্বেও সেই চির পরিচিত শীতল কণ্ঠে আদেশ দিল রামোন। যা অবাধ্য করার সাহস নেই বেলা’র।

“তাহলে কী করব?”

“টেলিফোন আমার কাছে নিয়ে এসো।” তাড়াহুড়া করে সিটিং রুমে দৌড় দিল বেলা।

“রামোন, তোমার অবস্থা বেশ খারাপ। কিছু অন্তত করতে দাও এক বাটি স্যুপ নিয়ে আসি?”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল রামোন। এক মনে ডায়াল করছে ফোন। রান্না ঘরে গিয়ে ক্যান থেকে ঘন ভেজিটেবল স্যুপ নিয়ে গরম করল বেলা। কাজ করতে করতেই কানে এলো স্প্যানিশে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে রামোন। কিন্তু এ বিষয়ে জ্ঞান দুর্বল থাকায় আলাপচারিতার কিছুই বুঝল না বেলা। স্যুপ আর প্রো-ভিটা বিস্কেটের ট্রে নিয়ে এসে দেখল ফোন রেখে দিয়েছে রামোন।

“ডার্লিং, কী হয়েছে তোমার? কেন ডাক্তারকে ফোন করতে দিলে না?”

মুখ বাঁকা করে ঠোঁট উল্টালো রামোন। কোনো ব্রিটিশ ডাক্তার যদি দেখে ফেলে এ ক্ষত; তাহলে রিপোর্ট করতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে কিউবান অ্যামবাসির ডাক্তার দেখলেও রক্ষে নেই। ফাঁস হয়ে যাবে রামোনের কাভার। তাই বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যাই হোক বেলার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই জানাল, “এখনি একটু বাইরে যেতে হবে তোমাকে। শ্লোয়ান স্কোয়ার আগ্রাউন্ড স্টেশনের পশ্চিম দিকে প্লাটফর্মে গিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকবে। কেউ একজন তোমাকে একটা খাম দিয়ে যাবে…”

“কে? তাকে চিনবই বা কিভাবে?”

“তুমি চিনবে না।” বেলা’র চিন্তা খারিজ করে দিল রামোন। “সে-ই তোমাকে চিনে নেবে। কিন্তু কোনোভাবেই তার সাথে কথা বলবে না কিংবা চেনার চেষ্টা করবে না। খামের ভেতরে আমার প্রেসক্রিপশন আর চিকিৎসার : যাবতীয় কিছু লেখা থাকবে। পিকাডেলী সার্কাসে গিয়ে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে দরকারি ওষুধগুলো নিয়ে আসবে। যাও।”

“ঠিক আছে রামোন; কিন্তু এটা তো বলবে যে আঘাত পেলে কিভাবে?”

“যা বলেছি সেভাবেই কাজ করা শিখতে হবে-এত্ত প্রশ্ন করো না তো। এখন যাও!”

“হা যাচ্ছি।” নিজের জ্যাকেট আর স্কার্ফ নিয়ে ঝুঁকে রামোনকে কিস্ করল বেলা।

“আই লাভ ইউ।”

সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও গেছে। হঠাৎ করেই একটা কথা মনে পড়াতে থেমে গেল ইসাবেলা। শৈশবের পর থেকে নানা ছাড়া আর কেউ ওর সাথে এতটা হুকুমের স্বরে কথা বলেনি। এমনকি বাবাও অনুরোধ করেন, আদেশ নয়। অথচ এখন স্কুল গার্লের মতই রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে নির্দেশ পালনের জন্য। রাস্তায় নেমে এলো বেলা।

আন্ডারগ্রাউন্ড প্লাটফর্মের শেষ মাথায় তখনো পৌঁছেনি; এমন সময় কে যেন আলতো করে কব্জি ছুঁয়ে পেছন থেকে খাম্ ঢুকিয়ে দিল হাতের মাঝে। কাঁধের উপর দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল লোকটা এরই মাঝে উল্টো দিকে হাঁটা ধরেছে।

ডিসপেনসারীর বিক্রেতা প্রেসক্রিপশনটা পড়ে জানতে চাইল : “আপনার কেউ কি খুব মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে?” মাথা নাড়ল বেলা।

“আমি ডাক্তার এলভিসের রিসেপশনিস্ট। এত কিছু জানি না।”

আর কিছু না বলেই ওষুধ প্যাক করে দিল লোকটা।

মনে হচ্ছিল রামোন ঘুমাচ্ছে। কিন্তু বেলা ঢোকার সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাল। সে চেহারা দেখেই মনের মাঝে ভয় ফিরে এলো বেলা’র। দুদিনের বাসী মরা’র মতো গায়ের চামড়া; গাঢ় দাগের মাঝে গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে চোখ জোড়া। যাই হোক এসব আজে বাজে চিন্তা একপাশে সরিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইল বেলা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় রেডক্রসের উপর একটা কোর্স করেছিল। এছাড়া ওয়েন্টেলেদেনে ভিজিটিং ডাক্তারের সাথে কুষাঙ্গ কর্মচারীদের। চিকিৎসায় সাহায্যও করেছে। তাই আঙুল কাটা, থেতলানো পা কিংবা ফার্মের মেশিন থেকে পাওয়া অন্যান্য আঘাতও যথেষ্ট দেখেছে।

কেমিস্টের কাছ থেকে আনা ওষুধ বের করে তাড়াতাড়ি পড়ে নিল খামে রাখা টাইপ করা নির্দেশিকা। বেসিনে হাত ধুয়ে পানিতে হাফ কাপ ডেটল মিশিয়ে রামোনকে তুলে বসাল; তারপর খুলতে শুরু করল ব্যান্ডেজ।

রক্ত শুকিয়ে যাওয়ায় ক্ষতের সাথে লেগে গেছে ব্যান্ডেজ। চোখ বন্ধ করে ফেলল রামোন। কপাল আর চিবুকে গড়িয়ে পড়ল হালকা ঘামের ফোঁটা।

“আয়্যাম স্যরি।” ফিসফিস করে ওকে ভোলাতে চাইল বেলা। “চেষ্টা করছি যত কম ব্যথা দেয়া যায়।”

অবশেষে খুলে এলো ড্রেসিং আর ক্ষত দেখে মনে হল গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠবে বেলা। বহুকষ্টে নিজেকে থামাল। বুকের একপাশে বেশ গভীর একটা গর্ত আর দ্বিতীয় ক্ষতটা মসৃণ পিঠের উপর একই জায়গায় জমাট বাঁধা কালো রক্তও দেখা যাচ্ছে। তেতে আছে ক্ষতের চারপাশের চামড়া। ইনফেকশনের হালকা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।

দেখা মাত্রই এর কারণ বুঝে গেল বেলা। শেষবার শর্তনের সাথে জাম্বেজী উপত্যকায় শিকারে যাবার পর সন্ত্রাসদের হামলার পর বাটোঙ্কা গ্রামে সাহায্যের জন্য যেতে হয়েছিল। সেখানেই প্রথম দেখেছে একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তৈরি ক্ষত। রামোন ওর দিকে তাকিয়ে থাকায় কিছুই বলল না বেলা; চেষ্টা করল মনের ভাব মুখে না আনতে। চুপচাপ ডিসইনফেক্টাষ্ট দিয়ে ক্ষতের চারপাশ মুছে দিল। এরপর ফ্রেশ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

নিজেও বুঝতে পারল যে ভালই হয়েছে ওর সেবা; তারপরেও নিশ্চিত হল বালিশে শুইয়ে দেবার সময় রামোনের বিড়বিড়ানি শুনে। “গুড়। তুমি ভালোভাবেই জানো কী করছ।”

“এখনো শেষ হয়নি। তোমাকে ইনজেকশন দিতে হবে। ডাক্তারের আদেশ।” হালকা করতে চাইল বেলা, “এবারে তোমার মোটকু পাছু দেখাও সোনা।”

বিছানার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রামোনের জুতা-মোজা আর ট্রাউজার খুলে নিল বেলা।

“এবারে আনডারপ্যান্টস।” অন্তর্বাস নিচে নামিয়ে কপট স্বস্তি ফুটিয়ে বলে উঠল, “যাক বাবা, স্পেশাল সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। নয়ত আমি পাগল হয়ে যেতাম।” এবারে হেসে ফেলে পাশ ফিরল রামোন।

অ্যাপুল থেকে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জে ভরে রামোনের পশ্চাদ্দেশে ঢুকিয়ে দিল বেলা। এরপর আস্তে করে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল শরীরের নিচের অংশ।

“এখন, ওষুধ নিয়ে এলো বেলা, “এই দুটো পিল্ খেয়ে ঘুম।”

কিছু বলল না রামোন। চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিতেই বেডসাইড লাইট জ্বালিয়ে ওকে কিস করে চলে এলো বেলা, “আমি সিটিং রুমেই আছি, যদি কোনো দরকার লাগে।”

***

সকাল হতেই দেখা গেল গায়ের রঙের বেশ উন্নতি হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক তার কাজ শুরু করেছে। শরীরের উত্তাপ কমে গিয়ে চোখ দুটোও পরিষ্কার হয়ে গেছে।

“ঘুম কেমন হল?” জানতে চাইল বেলা।

“পিলগুলো একেবারে ডিনামাইটের মতো ছিল। মনে হচ্ছিল চূড়া থেকে পড়ে যাচ্ছি, এখন তো গোসলও করতে পারব।”।

স্নানের সময় সাহায্য করল বেলা। ব্যান্ডেজের চারপাশ পরিষ্কার করতে করতে সাবান মাখা স্পঞ্জ নিয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠল বেলা।

“আহ, শরীরের উপরের দিকে ব্যথা পেলেও নিচের দিকের সব দেখছি ভালই কাজ করছে।”

ডিয়ার নার্স, তুমি কি কাজ করছ না মজা করছ?”

“একটুখানি একটা আর বেশির ভাগই অন্যটা।” স্বীকার করল বাধ্য মেয়ে বেলা।

বিছানায় এসে বেলা’কে আবারো সিরিঞ্জে অ্যান্টিবায়েটিক ভরতে গিয়ে বাধা দিতে চাইল রামোন। সোজা কথা শুনিয়ে দিল মেয়েটা : “ছেলেরা এত ভীরু হয় না! নাও পাছা তোল!” বাধ্য হয়ে গড়িয়ে গেল রামোন। “গুড বয়। এবারে তোমার ব্রেকফাস্টের সময় হয়েছে।”

রামোনের সেবা করতে মজাই পাচ্ছে বেলা। অন্তত এই একটা জায়গায় ওকে আদেশ দেয়া যাচ্ছে আর রামোনও মেনে নিচ্ছে। রান্নাঘরে কাজ করার সময় শুনতে পেল আবারো কার সাথে যেন স্প্যানিশে দ্রুত বকবক করছে রামোন। মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝল না বেলা। শোনার চেষ্টা করতেই ফিরে এলো গত রাতের আশঙ্কাগুলো। জোর করে মাথা থেকে সন্দেহ দূর করার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল টিউর স্টেশনের বিপরীত কর্ণারে থাকা ফল ফুলের দোকানে।

ফিরে এসেও দেখল রামোন তখনো ফোনে কথা বলছে।

ব্রেকফাস্ট ট্রে’তে সুন্দর করে গোলাপ আর পীচু সাজিয়ে নিল বেলা। বেডরুমে যেতেই চোখ তুলে তাকাল রামোন। হাসল তার সবচেয়ে সুন্দর আর রেয়ার হাসি।

বিছানার কিনারে বসে কাটা চামচ দিয়ে সাবধানে ফল খাওয়াতে লাগল রামোনকে। মুখে নিয়েই আবার ফোনে কথা বলছে ছেলেটা। খাবার শেষ হতেই ট্রে-রান্নাঘরে রেখে আসতে গেল বেলা। ধুতে ধুতে শুনতে পেল রিসিভার জায়গামতো রেখে দিচ্ছে রামোন।

তাড়াতাড়ি বেডরুমে ফিরে এসে রামোনের পাশে পা দুটাকে একপাশে মুড়ে নিয়ে বসল বেলা।

“রামোন” নরম স্বরে হলেও সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, “এটা বুলেটের ক্ষত তাই না?”

সাথে সাথেই ভয়ংকর শীতল আর সবুজ হয়ে গেল রামোনের চোখ। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে তাকালো বেলার দিকে।

“কিভাবে হয়েছে?” এবারেও চুপচাপ তাকিয়ে আছে ছেলেটা। বেলা বুঝতে পারল তার সাহস ফিকে হয়ে আসছে; তারপরেও শক্ত হতে চাইল।

“তুমি কোনো ব্যাঙ্কার নও, তাই না?”

“বেশির ভাগ সময়েই আমি ব্যাঙ্কার।” মোলায়েমভাবে উত্তর দিল রামোন।

“আর অন্য সময়ে? কী কর তখন?”

‘একজন দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য কাজ করি।”

স্বস্তির তপ্ত হাওয়া বয়ে গেল বেলা’র বুক জুড়ে। সারারাত জুড়ে কত যে হাবিজাবি ভেবেছে : ড্রাগ স্মাগলার, ব্যাংক ডাকাত কিংবা অপরাধী চক্রের সদস্য হওয়াতে গ্যাং ওয়ারে আহত হয়েছে।

“স্পেন।” জানতে চাইল বেলা, স্প্যানিশ সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য তাই না?”

এবারেও কিছুই না বলে সাবধানে বেলা’কে পরখ করছে রামোন। অল্প অল্প করে ফাঁদের কাছে টেনে নিয়ে আসতে হবে।

“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ বেলা, যদি ঘটনা এরকম হয়ও আমি তোমাকে বলতে পারব না।”

“অবশ্যই।” খুশি খুশি হয়ে মাথা নাড়ল মেয়েটা। এই বিপদজনক আর উত্তেজনাময় এসপিওনাজ দুনিয়ার আরেকটা লোক’কে চিনত সে। রামোনের আগে একমাত্র ওই লোকটাকেই ভালবেসেছিল বলে মনে করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকান সিকিউরিটি পুলিশের সেই বিগ্রেডিয়ারই একমাত্র তার বন্য আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। জোহানেসবার্গের ফ্ল্যাটে ছয় মাস উদ্দাম আনন্দে কাটিয়েছে বেলা আর লুথার ডিলা রে। স্বামী-স্ত্রী’র মতই কাটানো সেই দিনগুলোকে কোনোরকম ওয়ার্নিং ছাড়াই শেষ করে দিয়েছে লুথার। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল বেলা। এখন বুঝতে পারে যে কতটা বোকা ছিল সেসময়। খানিক সেই মোহের সাথে কোনো তুলনা নেই তার আর রামোন মাচাদোর এই বন্ধন।

“আমি বুঝতে পেরেছি ডার্লিং। তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো। আর একটাও অহেতুক প্রশ্ন করব না।”

“আমি তা জানি। এ কারণেই তো প্রথম তোমাকেই ডেকেছি সাহায্যের আশায়।”

“আই এম প্রাউড অব দ্যাট। তুমি স্প্যানিশ আর আমার সন্তানের পিতা হওয়াতে নিজেকেও স্প্যানিশই মনে হয়। তাই যতটা সম্ভব তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”

“হ্যাঁ।” মাথা নাড়ল রামোন। “বুঝতে পেরেছি। বেবি’র কথা প্রায়ই মনে পড়েছে।” হাত বাড়িয়ে বেলা’র পেট স্পর্শ করল রামোন। কিন্তু হাতটা বেশ শক্ত আর ঠাণ্ডা। “আমি চাই আমার পুত্র স্পেনে জন্ম নিক। তাহলে স্প্যানিয়াত হবার পাশাপাশি ওর টাইটেলও ঠিক থাকবে।

মুগ্ধ হয়ে গেল বেলা। ধরেই নিয়েছিল যে তার সন্তান লন্ডনে হবে। ম্যাটারনিটি হোমে এরই মাঝে সম্ভাব্য রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছেন গাইনোকোলজিস্ট।

“আমার জন্য এটা করবে, বেলা? আমার সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে একজন স্প্যানিয়ার্ড হিসেবে তৈরি করে তুলবে?” রামোন জানতে চাইলে এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না বেলা।

“অফ কোর্স। মাই ডার্লিং। তুমি যা চাও তাই হবে।” ঝুঁকে রামোনকে কি করল বেলা। এরপর পাশে রাখা বালিশের উপর শুয়ে পড়ে বলল, “তুমি যদি এরকমটা চাও, তাহলে তো জোগাড় যন্তর শুরু করতে হবে।”

“আমি এরই মাঝে অনেক কিছু গুছিয়ে রেখেছি।” স্বীকার করল রামোন। “মালাগার ঠিক বাইরেই চমৎকার একটা প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। ওখানকার ব্যাংকের হেড অফিসে আমার বন্ধু আছে। ও আমাদেরকে ফ্ল্যাট আর মেইড খুঁজে দেবে। হেড অফিসে ট্রান্সফারের বন্দোবস্তও করে ফেলেছি। তাই বেবি হওয়ার সাথে সাথে তোমার কাছে চলে যেতে পারব।”

“শুনে তো বেশ ভাল লাগছে।” একমত হল বেলা। “তাহলে তুমি যদি ঠিক করো যে বেবি কোথায় হবে, আমিও ঠিক করব যে আমরা বিয়ে কোথায় করব। দু’জনে সমান সমান, তাই না?”

হেসে ফেলল রামোন, “হ্যাঁ সেটাই ভালো।”

“আমি চাই আমাদের বিয়ে হবে ওয়েল্টেভেদেনে। দেড়শ বছর আগে তৈরি পুরানো একটা গির্জা আছে এস্টেটে। গ্যারি’র বিয়ের সময় দাদীমা নানা এটাকে সম্পূর্ণ নতুন করে ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। পুরো গির্জা ভরে দিয়েছিলেন ফুলে ফুলে। আমিও তেমনটাই চাই। অরাম লিলি’স। কেউ কেউ ভাবে যে এ ফুলগুলো অশুভ, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার ফেরারিট ফুল আর আমি কুসংস্কারে’ও বিশ্বাসী নই…”।

ধৈর্য ধরে মেয়েটার কথা শুনছে রামোন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে উৎসাহ দিচ্ছে। অপেক্ষায় আছে কখন নিজের পরের চাল চালবে; এক্ষেত্রে ও’কে বেলাই পথ দেখাল।

“কিন্তু রামোন ডার্লিং, সবকিছু রেডি করার জন্য নানা অন্তত ছয় সপ্তাহ সময় নিবে। ততদিনে আমি ছোট খাট একটা পাহাড় হয়ে যাব। বেদী থেকে নেমে এলে ওরা আমাকে নিয়ে “বেবি এলিফ্যান্ট ওয়াক” গান গাইতে থাকবে।”

“না, বেলা।” ইসাবেলা’কে থামিয়ে দিল রামোন। বিয়ের সময় তুমি পুরোপুরি স্লিম আর সুন্দরীই থাকবে। কারণ ততদিনে তো আর প্রেগন্যান্ট থাকবে না।”

বিছানার উপর বসে থাকার মতো করে উঠে বেলা জানতে চাইল, “কী বলতে চাইছ রামোন কী হয়েছে?”

“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ, খবর তেমন ভালো না। নাটালি’র খবর পেয়েছি ও এখনো ফ্লোরিডাতেই আছে। একগুয়ে মেয়েটার কারণে আইনি জটিলতাও বাড়ছে।”

“ওহ রামোন!”

“আমার অবস্থাও তোমার মত। বিশ্বাস করো যদি কিছু করার থাকত, আমি নিশ্চিত করতাম।”

“আই হেইট হার।” ফিসফিস করে উঠল বেলা।

“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমারো তাই মনে হয়। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, অহেতুক ঝামেলা ছাড়া বড় কোনো ক্ষতিও হবে না। আমাদের বিয়ে হবে, তোমার অরাম লিলিও থাকবে। শুধু এ সবকিছুর আগেই আমাদের সন্তান জন্ম নেবে।”

“প্রমিজ করো, রামোন, আমার কসম-তুমি মুক্ত হবার সাথে সাথে আমরা বিয়ে করব।”

“প্রমিজ।”

রামোনের পাশে শুয়ে ভালো কাঁধের উপর মাথা তুলে দিল বেলা। মুখটা আড়াল করে রাখল; যেন বিতৃষ্ণার ভাবটা রামোন দেখতে না পায়।

“আই হেইট হার, বাট আই লাভ ইউ।” ইসাবেলার ঘোষণা শুনে তৃপ্তির হাসি হাসল রামোন। দেখতে পেল না বেলা।

***

ক্ষত ভালো না হওয়ায় আরো এক সপ্তাহ ফ্ল্যাটে বন্দি হয়ে রইল রামোন। তাই কথা বলার প্রচুর সময় পাওয়া গেল। রামোন’কে মাইকেলের কথা জানাতেই ওর আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে গেল বেলা।

একে একে সবকিছু বলে দিল রামোনকে। মাইকেলের গুণ, ওদের মাঝের বিশেষ সম্পর্ক। এমনকি পরিবারের বাকি সদস্যদের কথা, তাদের গোপনীয়তা, দুর্বলতা এমনকি স্ক্যান্ডালের কথা। শাসা আর তারা’র ডির্ভোস। কোনো এক সময় আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের মরুভূমিতে বাস্টার্ড চাইল্ডের জন্ম দেয়া সংক্রান্ত নানা’র বিরুদ্ধে সন্দেহের কথাও জেনে গেল রামোন।

“কেউ কখনো এটা প্রমাণ করতে পারেনি। আসলে পারবেও না। নানা যা চীজু একটা!” হেসে ফেলল বেলা। “যাই হোক, তারপরেও ১৯২০ সালে কিছু তো একটা ঘটেছিল।”

একেবারে শেষে, আবারও মাইকেলের প্রসঙ্গ টেনে আনল রামোন। “যদিও এখন লন্ডনেই থাকে, তাহলে আমাদের দেখা করিয়ে দিচ্ছ না কেন? আমার ব্যাপারে লজ্জা পাচ্ছে নাকি?”

“ওহ সত্যি? সত্যি ওকে এখানে নিয়ে আসব রামোন? তোমার সম্পর্কে ওকে খানিকটা বলেছি। জানি ও’ও তোমার সাথে দেখা করতে চায় আর তোমার’ও ভাল লাগবে। ও হচ্ছে সত্যিকারের লক্ষ্মী কোর্টনি। আর আমরা বাকিরা…!” চোখ পাকালো বেলা।

বগলের নিচে বাবার ব্যার্গান্ডি থেকে বোতল একটা নিয়ে এসে পৌঁছাল মাইকেল। “আমি ভেবেছিলাম ফুল আনব,” ব্যাখ্যা দিয়ে বলে উঠল, “পরে ভাবলাম, থাক দরকারি কিছু নিয়ে যাই।”

হাত মেলাতে গিয়ে খুব সাবধানে পরস্পরকে মেপে নিল মাইকেল আর রামোন। উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইল বেলা, প্রাণপণে চাইছে যেন দুজনে দুজনকে পছন্দ করে।

“এখন পাজরের কী অবস্থা?” জানতে চাইল মাইকেল। ইসাবেলা আগেই ভাইকে জানিয়েছে যে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে পাজরের তিনটা হাড় ভেঙে ফেলেছে রামোন।

“তোমার বোন তো আমাকে বন্দি করে রেখেছে। আমার কিছুই হয়নি-এমন কিছু না যে এই অসাধারণ বার্গান্ডি খেয়ে সারবে না। নিজের চরিত্রের বিশেষ সেই চার্ম প্রদর্শন করল রামোন; যার আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না। স্বস্তির হাপ ছাড়ল বেলা।

বার্গান্ডি নিয়ে রান্নাঘরে গেল ছিপি খোলার জন্য। ভোলা বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে আসতেই দেখল বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মাইকেল; ইতিমধ্যেই গল্পে মজে গেছে দু’জনে।

“ব্যাংকে তোমার গোল্ডেন সিটি মেইল’র কপি পড়তে পারি। তোমার ফিনানসিয়াল আর ইকোনমিক কাভারেজ আমার বেশ পছন্দ।”

“আহ, তো তমি ব্যাংকিং পেশায় আছ, বেলা তো আমাকে বলেনি।”

“মার্চেন্ট ব্যাংকিং। বিশেষ করে সাব-সাহারা আফ্রিকা।” জুতা খুলে নীল জিন্সের নিচের অংশ গুটিয়ে রামোনের পাশে বিছানায় উঠে বসল বেলা। আলোচনায় অংশ না নিলেও মনোযোগ দিয়েই শুনল সবকিছু।

তার জানাই ছিল না আফ্রিকা নিয়ে রামোন এতটা ভাবে। বেলার মাতৃভূমির বিভিন্ন স্থান, ব্যক্তি আর ঘটনা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান এই ছেলের। এই আলোচনার সাথে বেলার সাথে হওয়া পূর্বের সব গল্পই কেমন ফিকে মনে হল। দু’জনের কথা শুনতে শুনতে একেবারে নতুনভাবে অনেক কিছুই উপলব্ধি করল বেলা।

মাইকেলের অবস্থাও একই। এমন কাউকে পেল, বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও যে কিনা তার মতো করেইভাবে।

মধ্যরাত পার হয়ে গেছে; ওয়াইনের প্রথম, বোতল আর বেলার ছোষ্ট্র রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসা বোতল-টা’ও শূন্য হয়ে গেছে। পুরো বেডরুম আচ্ছন্ন হয়ে আছে মাইকেলের সিগারেটের ধোঁয়ায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বেলা : “তোমাকে তো মাত্র একটা ড্রিংকের জন্য দাওয়াত করেছিলাম মিকি আর রামোনের’ও শরীর খারাপ। এখন বিদায় হও।” ভাইয়ের ওভারকোর্ট তুলে নিল বেলা।

“তুমি যদি রাজনৈতিক প্রবাসীদের নিয়ে কোনো সিরিজ করতে চাও তাহলে তো সেটা রালেই তাবাকাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” বিছানা থেকে নরম স্বরে জানাল রামোন।

অনুতপ্ত হবার মতো করে হাসল মিকি। “তাবাকা’কে পেলে তো বর্তে যেতাম। রহস্যময় সেই মানুষটা। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।”

“ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের সুবাদে উনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সবার খবরই রাখতে হয়। তুমি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।” কোটের হাতায় একটা হাত ঢুকিয়ে বরফের মতো জমে গেল মাইকেল।

“গত পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি তুমি পারো…”

“আগামীকাল লাঞ্চ টাইমের দিকে ফোন দিও। দেখি কী করতে পারি।” জানাল রামোন।

দরজায় দাঁড়িয়ে বোনকে বিদায় জানানোর সময় মাইকেল বলে উঠল, “তার মানে আজ রাতে তুমি ঘরে ফিরছ না।”

“এটাই তো ঘর।” ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা। “তোমাকে দেখানোর জন্যই তো সাময়িকভাবে ছিলাম কাভোগান স্কয়ারের ফ্ল্যাটে। এখন আর তার দরকার নেই।”

“তোমার রামোন তো বেশ আকর্ষণীয়।” মাইকেলের কথা শুনে বেলার মনে হঠাৎ করেই কেমন যেন হিংসা জন্ম নিল। মনে হল অন্য কোনো নারী এমনটা বলছে। নিজেকে সামলাতে চাইল বেলা। এই প্রথম মিকি’র কোনো কিছু এতটা খারাপ লাগল। বেডরুমে এসে রামোনের কথা শুনে আরো বেড়ে গেল এই ব্যথ্য বোধ : “তোমার ভাইকে আমার পছন্দ হয়েছে। ওর মতো মানুষ দেখা পাওয়া সত্যিই ভার।”

নিজের কথা ভেবে লজ্জা পেয়ে গেল বেলা। শুধু শুধু মিকি’কে সন্দেহ করল। জানে মাইকেলের প্রাণশক্তি আর বুদ্ধিমত্তার জন্যই ওকে পছন্দ করেছে রামোন-কিন্তু তারপরেও কিসের যেন কাঁটা খোঁচাচ্ছে মনের ভেতর।

বিছানার উপর ঝুঁকে এতটা আবেগ নিয়ে রামোনকে কিস করল যে বেলা নিজেই নিজের উপর অবাক হয়ে গেল। প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে রামোনও সাড়া দিল।

অবশেষে শান্ত বেলা বলল, “আমাকে ছেড়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ইউরোপে ঘুরে বেড়িয়েছ; যাও বা এলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু খাও আর ঘুমাও। “

নিজের প্রয়োজন জানাতে ব্যাকুল হয়ে উঠল বেলা, “নার্সের কথা একটু খেয়াল নেই। এখন আমার সবকিছু শোধ করো মাস্টার রামোন।”

“আমি তো সাহায্য ছাড়া পারব না।” সাবধান করে দিল রামোন।

“ঠিক আছে তুমি শুধু শুয়ে থাকো। বাকি সব আমি দেখছি।”

বুকের ব্যান্ডেজের যেন একটুও ক্ষতি না হয়; এরকম সাবধানে রামোনের উপর উঠে বসল বেলা। সবুজ চোখ জোড়াতে ভেসে উঠতে দেখল ওর মতই ব্যাকুলতা। কেটে গেল সব সংশয়। রামোন তার শুধু তার।

রামোনের সুস্থ বুকের ওমে নিরাপত্তা খুঁজে নিল তৃপ্ত বেলা। আধো ঘুম আধো জাগরণে কথা বলতে শুরু করল দু’জনে। কিন্তু রামোন আবারো মাইকেলের কথা তোলায় ঝিলিক দিয়ে উঠল খানিক আগের দ্বিধা। এতটাই রিলাক্সড মুডে আছে যে ভাবল রামোন’কে সব বলে দেয়া যাক।

“বেচারা মিকি, কখনো বুঝতেই পারি নি যে এত বছর ধরে ও কতটা যন্ত্রণা সহ্য করছে। অন্য যে কারো চেয়ে আমি ওর সবচেয়ে কাছের হয়েও কিছুই টের পাইনি। মাত্র কদিন আগে দুর্ঘটনাবশত জেনে গেছি যে ও হোমো…”

কী বলছে বুঝতে পেরেই চুপ করে গেল বেলা। কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগল যে এটা সে কী কল। মাইকেল ওকে বিশ্বাস করে। যাই হোক এরপর যা শুনল তা মোটেও আশা করেনি।

“হ্যাঁ।” শান্তস্বরে একমত হল রামোন। আমি জানি। কিছু ব্যাপার খেয়াল করলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। প্রথম আধা ঘণ্টাতেই আমি টের পেয়েছি।”

স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল বেলা। রামোন জানে, তার মানে বেলার দিক থেকে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা হয়নি।

“তোমার কি খারাপ লেগেছে?”

“না, একদম না।” উত্তরে জানাল রামোন। এদের বেশির ভাগই বেশ সৃজনশীল আর উদ্যমী হয়।”

“হ্যাঁ, মিকি’ও তাই।” আগ্রহ নিয়ে বলল বেলা। “প্রথমে চমকে গেলেও এখন আমার কিছুই মনে হয় না। শুধু চাই ওকে যেন অপরাধী সাব্যস্ত না করা হয়।”

“আমার তো মনে হয় না তার কোনো সুযোগ আছে। সমাজ এরই মাঝে মেনে নিয়েছে।”

“তুমি বুঝতে পারছ না রামোন। মাইকেল শুধু কৃষাঙ্গ ছেলেদেরকেই পছন্দ করে আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকে।”

“হ্যাঁ, এবারে চিন্তান্বিত স্বরে জানাল রামোন, “এতে কিছু সমস্যা হতে পারে।”

***

দুপুরের খানিক আগে ফ্লিট স্ট্রিটের পে-বুথ থেকে ফোন দিল মাইকেল। দ্বিতীয় রিং’য়ে সাড়া দিল রামোন!

“খবর বেশ ভালো। রালেই তাবাকা এখন লন্ডনে আর তোমাকেও চেনেন। রেজ’ নামে ১৯৬০-এ তুমি কোনো অটিকেল লিখেছিলে?”

“হ্যাঁ, মেইল এর জন্য ছয়টার একটা সিরিজ। কিন্তু এ কারণে সিকিউরিটি পুলিশ নিষিদ্ধ করেছিল কাগজটা।”

“তাবাকা লেখাগুলো পড়েছেন আর পছন্দও করেছেন। তাই রাজি হয়েছেন তোমার সাথে দেখা করতে।”

“মাই গড রামোন। বলে বোঝাতে পারব না যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ। এর মতো ব্রেক-”।

বাধা দিল রামোন। “আজ সন্ধ্যায় তোমার সাথে দেখা করবেন। কিন্তু কিছু শর্ত দিয়েছেন।”

“যে কোনো কিছু।” তাড়াতাড়ি মেনে নিল মাইকেল।

“তুমি একা আসবে। সাথে অস্ত্র তো দূরে থাক, টেপ রেকর্ডার কিংবা ক্যামেরাও থাকবে না। ছবি কিংবা ভয়েসের কোনো রেকর্ড রাখতে চান না। শেপার্ডস বুশ-এ একটা পাব আছে।” ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিল রামোন। “সন্ধ্যা সাতটায় থেকো। এক হোড়া ফুল নিয়ে যেও-কার্নেশনস। কেউ একজন এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”

“রাইট, বুঝতে পেরেছি।”

“আরেকটা কথা। ইন্টারভিউ নিয়ে লেখা তোমার কপিগুলো প্রিন্টের আগেই তাবাকাকে দেখাতে হবে।”

খানিকক্ষণের জন্য চুপ মেরে গেল মাইকেল। সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ী মেনে নিতে পারছে না এই শর্ত। মনে হচ্ছে ওর পেশার উপর সেন্সরশীপ ফেলা হচ্ছে। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে পাবে আফ্রিকার মোস্ট ওয়ানটেড মানুষগুলোর একজনের ইন্টারভিউ।

“অলরাইট।” ভারি সরে উত্তর দিল মাইকেল।” উনাকেই সবার আগে পড়তে দিব।” এরপরই চন মনে হয়ে উঠল কণ্ঠ, “তুমি আমার অনেক উপকার করলে রামোন। কাল সন্ধ্যায় এসে তোমাকে সব জানাব।”

“ওয়াইনের কথা ভুলো না।”

তাড়াহুড়া করে কাভোগান স্কোয়ারে ফিরে এলো মাইকেল। টেলিফোন হাতে নিয়েই দিনের বাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট সব বাতিল করে দিল। এরপর বসল ইন্টারভিউ’র স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। প্রশ্নগুলো এমন হবে যেন তাবাকা’র মড় ঠিক রেখেই পেটের কথা বের করে নেয়া যায়। ইচ্ছে করেই সংঘর্ষ আর রক্তপাতের পথ বেছে নেয়া মানুষটার সামনে মাইকেলকে হতে হবে সিনসিয়ার, সিমপ্যাথেটিক আর তীক্ষ্ণ। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রশ্নগুলোকে নিরপেক্ষ হতে হবে। আবার একই সাথে এমন হবে যেন নিজেকে মেলে ধরেন। তাবাকা মোদ্দা কথা হল, সাদামাটা কোনো বৈপ্লবিক শ্লোগান চায় না মাইকেল। “সন্ত্রাসী” শব্দটা দিয়ে সাধারণভাবে বোঝায় এমন কোনো ব্যক্তি যে কিনা রাজনৈতিক দমননীতির কারণে এমন কোনো সংঘর্ষ ঘটায় যার নিশানা হয় বে-সামরিক জনগণ কিংবা স্থাপনা; এতে করে বেড়ে যায় নির-অপরাধ মানুষের ভোগান্তি আর মৃত্যু। আপনি কি এই সংজ্ঞাটা মেনে নিচ্ছেন? যদি তাই হয় তাহলে উমকুম্ভ সিজো’র উপরে এই লেবেল দেয়া যায়?”

প্রথম প্রশ্নটা ঠিক করে আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে পুনরায় পড়তে বসল মাইকেল।

“যাক। ভালই হয়েছে। এর মানেই হচ্ছে দুই পা সোজা করে লাফ দেয়া। কিন্তু কী যেন বাদ রয়ে গেছে। আরেকটু ঘষামাজা করতে হবে। এক মনে কাজ করতে করতে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মন মতো বিশটা প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেল। স্মোকড স্যামন স্যান্ডউইচ আর এক বোতল গিনেস খেয়ে আবারো স্ক্রিপট নিয়ে রিহার্সাল করল মাইকেল।

এরপর ওভারকোট কাঁধে নিয়ে কোণার দোকান থেকে কেনা এক তোড়া কার্নেশনস হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ট্যাক্সি নিয়ে চলল স্লোয়ান স্ট্রিট।

মানুষের দেহের উত্তাপে ঝাপসা হয়ে আছে পাব। হাতের কানেশনস তুলে ধরে মৃদু নীল রঙা সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে তাকাল মাইকেল। প্রায় সাথে সাথেই বার কাউন্টার থেকে উঠে ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এলো পরিষ্কার নীল উলের থ্রি-পিস স্যুট পরা এক ইন্ডিয়ান।

“মি. কোর্টনি, আমি জোভান।”

“নাটাল থেকে।” উচ্চারণ চিনতে পারল মাইকেল।

“স্টানজার থেকে।” হেসে ফেলল জোভান। “কিন্তু তাও ছয় বছর আগে।” মাইকেলের কোর্টের কাঁধ খেয়াল করে বলল, “বৃষ্টি থেমে গেছে? ভাল, চলুন হাঁটি। খুব বেশি দূরে নয়।”

মেইন রাস্তায় নেমে শখানেক গজ হেঁটে যাবার পর হঠাৎ করেই পাশের একটা গলিতে নেমে গেল জোভান। দেখাদেখি মাইকেল। এরপরই দ্রুত পা চালাল লোকটা। তাল মেলাতে গিয়ে প্রায় লাফাতে হচ্ছে মাইকেলকে।

গলি’র মাঝেই মোড় নিয়ে কোণার কাছে থেমে গেল জোভান। মাইকেল কিছু বলতে যেতেই হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিল। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল দু’জন। কেউ তাদেরকে অনুসরণ করছে না নিশ্চিত হবার পরেই কেবল মুঠি আলগা করল জোভান।

“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেননি।” হেসে ফেলল মাইকেল। পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিল কার্নেশনস।

“আমরা কাউকেই বিশ্বাস করি না। আবারো পথ দেখাল জোভান। “বিশেষ করে বোয়াদেরকে। প্রতিদিনই তারা নতুন কোনো না কোনো নষ্টামী শিখছে।”

দশ মিনিট পরে বেশ প্রশস্ত আর আলোকিত এক রাস্তায় আধুনিক ফ্ল্যাট ব্লকের বাইরে থামল দু’জনে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সব মার্সিডিজ আর জাগুয়ার। যত্ন সহকারে ছেটে রাখা হয়েছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনের লন আর বাগান। বোঝাই যাচ্ছে বেশ বড়লোকি হালত এই এলাকার বাসিন্দাদের।

“আমি এখন যাচ্ছি।” বলে উঠল জোভান। “ভেতরে যান। লবি’তে জানাবেন আপনি মিস্টার কেন্দ্রিকের গেস্ট। ফ্ল্যাট-৫০৫।”

ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে, কাঠের প্যানেল লাগানো দেয়াল, সোনালি কারুকাজ করা লিফটের দরজা। উর্দিধারী পোর্টর মাইকেলকে স্যালুট করে জানতে চাইল “ইয়েস, মিঃ কেন্ড্রিক আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, মিঃ কোর্টনি। প্লিজ ফিফথ ফ্লোরে উঠে যান।”

লিফটের দরজা খুলতেই দেখা গেল শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুই কৃষাঙ্গ তরুণ।

“এদিকে আসুন মিঃ কোর্টনি।” কার্পেটে মোড়া প্যাসেজ ধরে ৫০৫ নম্বর ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল মাইকেল।

দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দ্রুত কিন্তু পুখানুপুঙ্খ বাপে মাইকেলের। দেহ তল্লাশী করল দুই তরুণ। হাত উঁচু করে মাইকেল’ও সাহায্য করল। এরই ফাঁকে সাংবাদিকের দৃষ্টি মেলে দেখে নিল চারপাশ। অর্থ আর রুচির চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে এই ফ্ল্যাটের সাজসজ্জাতে।

সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল দুই কৃষ্ণাঙ্গ। একজন আবার মাইকেলের জন্য খুলে দিল সামনের জোড়া দরজা।

বেশ বড়সড় আর সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা একটা রুমে ঢুকল মাইকেল। কনোলী চামড়া দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে ক্রিম রঙা সোফা আর ইজি চেয়ার। মোটা ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেটের রঙ হালকা কফি। ক্রিস্টাল আর ক্রোম দিয়ে তৈরি হয়েছে টেবিল আর ককটেল বার। দেয়ালে ঝুলছে হনির সুইমিং পুল সিরিজের চারটা বিশাল পেইন্টিং।

একেকটার দাম না হলেও পনের হাজার করে, মনে মনে হিসাব কষে নিল মাইকেল আর তখনি চোখে পড়ল রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার অবয়ব।

ইদানীংকালের ভেতর তার কোনো ছবি ভোলা না হলেও, মেইলের আর্কাইভে থাকা বহু পুরাতন ঝাপসা একটা ছবি দেখাতে, এক নজরেই মানুষটাকে চিনে ফেলল মাইকেল।

“মিঃ তাবাকা” অস্ফুটে বলে উঠল। মাইকেলের মতই লম্বা হলেও কাঁধ বেশ চওড়া আর কোমর সরু।

“মিঃ কোর্টনি” এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন রালেই তাবাকা। পদক্ষেপে বক্সার সুলভ আচরণ।

দৃঢ় আর গম্ভীর গলার স্বরে আফ্রিকার স্পষ্ট অনুরণন পাওয়া গেল। পরনে খাঁটি উলের নতুন স্যুট, সিল্পের টাই’য়ে গুচির নকসা। দেখতেও বেশ সুদর্শন রালেই তাবাকা।

“আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ।” বলে উঠল মাইকেল।

“আপনার” রেজ “সিরিজটা আমি পড়েছি।” কালো পাথরের মতো চোখ জোড়া দিয়ে মাইকেলকে দেখছেন তাবাকা, “আমার জনগণকে ভালোই বুঝতে পারেন। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকেও ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন।”

“সবাই অবশ্য আপনার সাথে একমত হবে না। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়িত্বে আছেন যারা।”

হেসে ফেললেন রালেই। পরিষ্কার চকচকে সাদা নিখুঁত দাঁতের সারি। “আমি আপনাকে যা বলব সেটা শুনেও উনারা তেমন খুশি হবেন না। যাই হোক তার আগে একটা ড্রিংক নিন?”

“জিন আর টনিক।”

“হুম, এই জ্বালানি পেয়েই সচল থাকে সাংবাদিকদের মগজ। তাই না?” তাবাকার গলার স্বরে টের পাওয়া গেল অবজ্ঞার ভাব। তারপর বারে গিয়ে নিয়ে এলেন স্বচ্ছ ড্রিংকটুকু।

“আপনি ড্রিংক করেন না?” মাইকেলের প্রশ্ন শুনে আবারো ভ্রুকুটি করলন রালেই।

“এত এত কাজ বাকি আছে, শুধু শুধু মাথা জ্যাম করে লাভ কী?” হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন; “এক ঘন্টা সময় দিচ্ছি আপনাকে, এরপর আমাকে যেতে হবে।”

“আমি এর এক মিনিটও নষ্ট করব না।” মাথা নাড়ল মাইকেল। ক্রিম রঙা কনোলী চামড়ায় মোড়া চেয়ারে মুখোমুখি বসে পড়ল দুজনে : “আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে মোটামুটি সবই জানিঃ জন্ম তারিখ, স্থান, সোয়াজিলল্যান্ডের ওয়াটারফোর্ড স্কুরে আপনার শিক্ষা জীবন। মোজেস গামার সাথে সম্পর্ক, এ এন সি’তে আপনার বর্তমান অবস্থান। তাহলে এখন আগে বাড়ি?”

সম্মতি দিলেন রালেই।

“সন্ত্রাসী” শব্দটা বলতে…” মাইকেলের সংজ্ঞা শুনতে শুনতে রেগে গেলেন রালেই। শরীর শক্ত করে বসে রইলেন। তারপর জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকাতে নিরাপরাধ বলে কেউ নেই এটা একটা যুদ্ধ। তাই কেউই নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করতে পারবে না। আমরা সবাই যোদ্ধা।”

“তরুণ কিংবা বৃদ্ধ কোনো ব্যাপারই না? আপনার জনগণের আকাঙ্খার প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল সেটাও ধর্তব্যের বিষয় নয়?”

“না।” আবারো একই কথা বললেন রালেই। “দোলনা থেকে সমাধি, আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। দুটো ক্যাম্পের যেকোনো একটাতেই যেতে হবে সবাইকে-নিপীড়িত কিংবা নিপীড়নকারী।”

“পুরুষ। নারী কিংবা শিশু কারোরই কিছু বলার নেই?” জানতে চাইল মাইকেল।

“হ্যাঁ, বলতে পারবে-যে কোনো একটা দিক বেছে নিতে পারবে। কিন্তু নিরপেক্ষ থাকার কোনো অপশন নেই।”

“ভিড়ে-ভিড়াক্কার কোনো সুপার মার্কেটে বোমা বিস্ফোরণ হয়ে মারা গেল আপনার নিজের লোক, অনেকে আহতও হল। আপনি অনুতপ্ত হবেন না?”

“অনুশোচনা কোন বৈপ্লবিক অনুভূতি নয়। যেমন বণর্বাদের অপরাধীদের কাছেও এটা কোনো অনুভূতিই নয়। তাই যারা মৃত্যুবরণ করে হয় তারা সাহস আর সম্মানের সাথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে, নতুবা শত্রুর ক্ষয় ক্ষতিতে সামিল হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এদেরকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই, বরঞ্চ কাঙিক্ষতই বলা চলে।”

নোটপ্যাডের উপর খসখস করে লিখে চলেছে মাইকেল। ভয়ংকর এসব ঘোষণা শুনে রীতিমতো কাঁপছে, একই সাথে বেশ উত্তেজনাও বোধ করছে।

মনে হচ্ছে। মথ পোকার মতই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আগুনের কাছে। মানুষটার ক্রোধের উত্তাপে না জানি পুড়েই যায় সে। জানে শব্দগুলোর হুবহু রেকর্ড রাখলেও এতটা আবেগ কিছুতেই ফুটে উঠবে না ছাপা কাগজে।

সময় এতটা দ্রুত চলে যাচ্ছে যে একটা সেকেন্ডও যাতে নষ্ট না হয়, হিমমিস খাচ্ছে মাইকেল। তাই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাতেই তাবাকা উঠে দাঁড়ালেও চাইল বাধা দিতে।

“আপনার যে শিশু যোদ্ধাদের কথা বলেছেন, তাদের বয়স কত?”

“অস্ত্র হাতে সাত বছর বয়সী বাচ্চাদেরকেও দেখাতে পারি আপনাকে আর সেকশনের কমান্ডার হিসেবে পাবেন দশ বছর বয়সীদেরকে।”

“আমাকে দেখাবেন?” হতবাক হয়ে গেল মাইকেল, “সত্যিই কি আমাকে দেখাবেন?”

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত মাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন রালেই। মনে হচ্ছে রামোন মাচাদো’র কথাই ঠিক। লোকটা অসম্ভব বুদ্ধিমান। একে ভালই কাজে লাগানো যাবে। তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পুরোপুরি ফিট এই মাইকেল। লেনিনের “উপকারী বোকার” মত। প্রথমে একে ব্যবহার করতে হবে কোদাল আর লাঙলের ফলা দিয়ে জমি চাষ করার মতো করে। আর তারপরই যখন সময় এসে যাবে, হয়ে উঠবে যুদ্ধের তলোয়ার।”

“মাইকেল কোর্টনি” নরম স্বরে জানালেন তাবাকা, “আমি আনপাকে বিশ্বাস করছি। মনে হচ্ছে আপনি আসলেই বেশ ম্ল আর জ্ঞানী। যদি আপনিও আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেন। তাহলে এমন সব জায়গায় নিয়ে যাবো যা নিয়ে কেবল স্বপ্নই দেখেছেন এতদিন। সোয়েতো’র রাস্তায় নিয়ে যাব। আমার লোকদের হৃদয়ে আর হ্যাঁ, শিশুদেরকেও দেখাব।”

“কবে?” জানে সময় আর বেশি নেই, তাই উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইল মাইকেল।

“শীঘ্রিই।” প্রমিজ করল রালেই আর সাথে সাথে সদর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। “আমি আপনাকে কিভাবে খুঁজে পাবো?”

“আপনি পাবেন না। আমিই আপনাকে খুঁজে নেব।”

সিটিং রুমের জোড়া দরজা খুলে যেতেই দোরগোড়ায় দেখা গেল এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। রালেই তাবাকা’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও লোকটাকে দেখে জমে গেল মাইকেল। স্ট্রিট ক্লথ পরনে থাকলেও দেখার সাথে সাথে তাকে চিনে ফেলল। কেন্ড্রিক নামটা শুনে আগেই ঠাওর করার দরকার ছিল আসলে।

“ইনি হচ্ছেন আমাদের হোস্ট, এই অ্যাপার্টমেন্টের মালিক।” পরিচয় করিয়ে দিলেন তাবাকা। “অলিভার কেন্ড্রিক, ইনি মাইকেল কোর্টনি।”

হাসলেন অলিভার কেন্ড্রিক। ব্যালে ডাঙ্গার সুলভ ঝরণার মতো এগিয়ে এসে মাইকেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা হাতটা’র হাড়গুলো ঠিক পাখির মতই হালকা। পরিস্কার বোঝা গেল কেন লোকে তাঁকে “দ্য ব্ল্যক সোয়ান” নামে ডাকে। পাখির মতই লম্বা, অভিজাতগলা আর চোখ জোড়া তো দ্রুতটাই আলো ছড়াচ্ছে যেন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কোন পুল। একই রকম গাঢ় দ্যুতি ছড়াচ্ছে দেহত্বক।

কেন্ড্রিক এগিয়ে আসতেই মনে হল দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে মাইকেল। স্টেজের রোমান্টিক আলোর চাইতেও বেশি সুদর্শন লাগছে বাস্তবের অলিভারকে। মাইকেলের হাত ধরা অবস্থাতেই রালেই’র দিকে তাকালেন অলিভার। “এত তাড়াহুড়া কিসের, রালেই?” মনে হল যেন পশ্চিম ভারতীয় গানের ছন্দে আকুতি জানালেন।

“আমাকে যেতেই হবে।” মাথা নাড়লেন তাবাকা। “প্লেন ধরতে হবে।”

আবারো মাইকেলের দিকে ফিরলেন অলিভার। এখনো ওর হাত ধরে আছেন। “এত জঘন্য একটা দিন গেছে না। মনে হচ্ছে মরেই যাবো। আমাকে একা রেখে যাবেন না মাইকেল। এখানে থাকুন। মনে হচ্ছে বেশ মজা হবে। তাই না?”

অলিভারকে ভেতরে রেখে ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন তাবাকা। কিন্তু বিল্ডিং এর বাইরে নয়। এর বদলে লোক এসে রালেই’কে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল খানিক দূরের দ্বিতীয় আরেকটা ফ্ল্যাটে। ছোট্ট রুমটাতে তাবাকা’কে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয় আরেকজন। লোকটাকে ইশারায় বসতে বলে জানালার দিকে এগোলেন রালেই। লম্বা আর চিকন কাঠামোটা দেখতে পুরোপুরি একটা ফুল লেংথ ড্রেসিং-মিররের মত। আয়না দেখে বোঝা গেল দু’পাশ থেকেই অন্য পাশের সব দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যায়।

আয়নার অপর দিকে দেখা যাচ্ছে অলিভার কেন্দ্রিকের অ্যাপার্টমেন্ট। হালকা অয়েস্টার আর মাশরুম রঙা রুমের বেড কাভারটা চমৎকারভাবে মিশে গেছে কার্পেটের সাথে। আয়নার টাইলস করা সিলিং-এ আলো ফেলছে লুকানো বাতি। বিছানার দিকে মুখ করে থাকা কুঠুরিতে রাখা আছে হিন্দু মন্দির থেকে আনা এক মূল্যবান অ্যান্টিক। রুমটা খালি থাকায় টু ওয়ে আয়নার এপাশের ক্যামেরা ইকুপমেন্টের দিকে চোখ দিলেন রালেই।

অ্যাপার্টমেন্ট আর ক্যামেরা সবকিছুই অলিভার কেন্দ্রিকের সম্পত্তি। এর আগেও রালেইকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে যে এহেন সাজানো নাটকে অংশ নিতে কখনো দ্বিধা করেন না কেভ্রিকের মতো মেধাবী আর বিখ্যাত লোক। যাই হোক তিনি নিজে যে সাগ্রহে একাজ করছেন তা নয়, এসব কিছুর প্রস্তাবও দিয়েছেন অলিভার স্বয়ং। এতটা আনন্দ নিয়ে পুরো কাজের উদ্ভাবন করেছেন যে বোঝাই যাচ্ছে এসব তার কতটা পছন্দের। একটাই মাত্র শর্ত দিয়েছেন যেন নিজের বিশাল কালেকশনে রাখার জন্য পুরো ভিডিও’র একটা কপি তাঁকে দেয়া হয়। আলো-আঁধারী পরিবেশেও অত্যন্ত নিখুঁত কাজ করা এই পেশাদার ক্যামেরার ফলাফল দেখে মুগ্ধ রালেই।

আরো একবার হাতঘড়ি দেখে নিলেন। দেহরক্ষী দু’জন ভালোভাবেই সামলে নিতে পারবে সবকিছু। তারা আগেও একই কাজ করেছে বহুবার। কিন্তু নিজের কৌতূহলও দমাতে পারলেন না। প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে যাবার পর খুলে গেল বেডরুমের দরজা। আয়নার ওপাশে দেখা গেল কেন্ড্রিক আর মাইকেল কোর্টনি। দ্রুত নিজ নিজ জায়গায় চলে গেল রালেই’র দেহরক্ষীদ্বয়। একজন ভিডিও রেকর্ডারের কাছে আরেকজন ট্রাইপতে বসানো ক্যামেরায়।

ওপাশের বেডরুমে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কিস্ করল দুই পুরুষ। হালকা একটা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে ভিডিও-রেকর্ডার।

সাটিনের চাদরের উপর শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শ্বেতাঙ্গ কোর্টনি। অন্যদিকে আয়নার সামনে এসে উলঙ্গ দেহে দাঁড়িয়ে রইল কৃষাঙ্গ কেন্ড্রিক। ভাব দেখাল যেন নিজের শরীর দেখছে। অথচ ভালোভাবেই জানে আয়নার ওপাশে কারা আছে। বহু ঘণ্টা কসরৎ করে গড়ে তুলেছেন নিজের পেশি বহুল দেহ সুপুরুষ চেহারা।

গর্বিত ভঙ্গিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘোরাতেই ঝিলিক দিয়ে উঠল কানের হীরের দুল। ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে তাকিয়ে রইলেন রালেই তাবাকা’র চোখে। পুরো ব্যাপারটাতে এমন একটা ঘৃণ্য ভাব আছে যে কেঁপে উঠলেন তাবাকা। বিছানার দিকে চলে গেলেন কেন্ড্রিক। কৃষাঙ্গ পশ্চাদ্দেশের চমক দেখে হাত বাড়িয়ে দিল বিছানায় শুয়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ।

ঘুরে দাঁড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হবার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন তাবাকা। লিফটে করে নিচে নেমে চলে এলেন সান্ধ্য রাস্তায়। বুকের কাছে ওভারকোট শক্ত করে ধরে নিঃশ্বাস নিলেন পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাসে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলেন সামনের দিকে।

***

৩. ইসাবেলার জীবন

গত কয়েক সপ্তাহে ইসাবেলার জীবন পূর্ণ করে তোলা আনন্দের খানিকটা নিয়ে লন্ডন ছাড়ল মাইকেল।

ভাইকে হিথ্রোতে নামিয়ে দিল ইসাবেলা। “মনে হচ্ছে আমাদেরকে সবসময় গুডবাই বলতে হবে, মিকি।” ফিসফিস করে জানাল মাইকেলকে, ‘তোমাকে অনেক মিস করব।”

“বিয়রে সময় দেখা হবে।”

“এর আগে তো বোধহয়। বাপ্তিস্মের প্রোগ্রামই হয়ে যাবে।” উত্তর দিতেই বোনকে হাত দিয়ে ধরল মাইকেল।

“এটা তো আগে বলনি।”

“ওর স্ত্রীর কারণে।” ব্যাখ্যা দিল বেলা। “জানুয়ারির শেষেই আমরা স্পেন চলে যাবো। রামোন চায় ওর সন্তান যেন ওখানেই জন্ম নেয়। স্প্যানিশ আইনানুযায়ী পেয়ে যাবে।”

“যেখানেই থাকো আমাকে সবসময় সবকিছু জানাবে ঠিক আছে?”

মাথা নাড়ল বেলা। “যদি প্রয়োজন হয় সবার আগে তোমাকেই জানাব।”

ডিপারচার হলের দরজা থেকে বোনকে কিস্ ছুঁড়ে দিল মাইকেল। ভাই চলে যেতেই কেমন একা একা বোধ করল বেলা।

মালাগা উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরের ছোট্ট জেলে গ্রামে অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করল রামোন। দোতলা বাড়িটার চওড়া ছাদে দাঁড়ালে পাইনের মাথার উপর দিয়ে দেখা যাবে দূরের নীল ভূমধ্যসাগর। দিনের বেলা রামোন যখন ব্যাংকে থাকে, ছাদের এক কোণায় নিরাপদে বিকিনি পড়ে শুয়ে নিজের থিসিসের শেষ অংশ নিয়ে কাজ করে বেলা। আফ্রিকাতে জন্ম নেয়াই সূর্য তার বেশ পছন্দের, যা লন্ডনে থাকতে মোটেই পেত না।

লন্ডনের মতো এখানেও যখন তখন ব্যাংকের কাজে বাইরে যেতে হয় রামোন’কে। ওকে যেতে দিতে একটুও মন চায় না। কিন্তু যখন দু’জনে একসাথে থাকে, স্বপ্নের মতো কেটে যায় মুহূর্ত! মালাগা’তে ব্যাংকের ডিউটি বেশ হালকা হওয়াতে মাঝে মাঝেই পুরো সন্ধ্যা ডুব মেরে সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়ায় বেলা’কে নিয়ে। স্বাদ নেয় স্থানীয় সামুদ্রিক খাবার আর দেশীয় ওয়াইনের।

পুরোপুরি সেরে গেছে রামোনের জখম। “এক্সপার্ট নার্স পেয়েছিলাম আসলে।” বেলাকে জানিয়েছে ঠাট্টার সুরে। শুধু রয়ে গেছে বুকের উপর আর পিঠের একটা জায়গাতে এক জোড়া দাগ। রোদে পুড়ে মেহগনির মতো হয়ে গেছে ছেলেটার গায়ের রঙ। আর এর বিপরীতে চোখগুলো দেখায় হালকা সবুজ।

রামোনের অনুপস্থিতি আদ্রা’র সঙ্গ পায় বেলা। ন্যানির চমৎকার বিকল্প হয়ে উঠেছে আদ্রা অলিভারেস।

চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের আদ্রা শুকনা হলেও শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। অল্প কয়েকটা রূপালি চুল থাকলেও মাথার পেছনে খোঁপা হয় ক্রিকেট বল সাইজের। কালো বর্ণের চেহারাতে একই সাথে দয়ালু আর রসিক ভাব। বাদামি রঙা চার কোণা হাতদুটো ঘরের কাজ করতে গেলে হয়ে উঠে বেজায় শক্তিশালী। অন্যদিকে রান্না করা কিংবা বেলা’র কাপড় ইস্ত্রি করার সময় হালকা আর উজ্জ্বল। আবার একই সাথে ইসাবেলা’র পিঠে হাত বুলিয়ে দেবার সময়, পেটে অলিভ অয়েল মেসেজ করার সময় এতটা নরম আর আরামদায়ক হয়ে উঠে যে অবাকই লাগে।

ইসাবেলা’কে স্প্যানিশ সেখানের দায়িত্বও নিয়েছে আদ্রা। আর বেলার উন্নতি দেখে তো রামোন নিজেই অবাক হয়ে গেছে। মাসখানেকের ভেতর স্থানীয় সংবাদপত্র পড়ার পাশাপাশি প্লাম্বার, টেলিভিশন রিপেয়ার ম্যান কিংবা বাজারের মুদি দোকানদারদের সাথে ঝগড়ার সময় আদ্রা’কে সাহায্য করার পুরোপুরি পাকা হয়ে গেছে বেলা।

ইসাবেলা’র পরিবার নিয়ে জানতে চাইলে নিজের কথা কিছুই বলে না আদ্রা। বেলা ভেবেছিল হয়ত স্থানীয়-ই হবে। কিন্তু একদিন সকালবেলা পোস্ট বক্সে নিজেদের মেইলের সাথে দেখেছে হাভানা, কিউবার স্ট্যাম্প লাগানো। আদ্রার চিঠি।

“তোমার স্বামী কিংবা পরিবারের কেউ কি লিখেছে আদ্রা? কিউবা থেকে তোমাকে কে লিখে?” জানতে চাইতেই রূঢ়ভাবে আদ্রা বলে উঠল, “আমার বান্ধবী লিখেছে সিনোরা। স্বামী তো কবেই মরে গেছে।” দিনের বাকি সময়টুকু জুড়ে কেমন যেন মৌন হয়ে রইল। সপ্তাহের শেষ নাগাদ গিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হল। তাই কিউবা বিষয়ে আর কোনো কথা তুলল না বেলা।

ইসাবেলা’র ডেলিভারীর সময় কাছে চলে এসেছে। তাই আদ্রা আর বেলা। মিলে শিশুদের পোশাক সংগ্রহের কাজে লেগে গেল। একেবারে সবার আগে এ উদ্যোগ নিয়েছে মাইকেল। জোহানেসবার্গ থেকে উৎকৃষ্টমানের তুলা দিয়ে তৈরি বালিশের কাভার, দোলনার চাদর আর উলের বেবি জ্যাকেট এসে পৌঁছেছে এয়ারমেইলে। এছাড়া প্রতিদিন মিনি’তে চড়ে ঘণ্টাখানেক লাগবে এরকম দূরত্বে যতগুলো বেবি শপ আছে সব কয়টা ঘুরে বিশাল কালেকশন বানিয়ে ফেলল বেলা। সাহায্য করল আদ্রা।

বিজনেস ট্রিপ থেকে ফেরার পথে প্রায় এটা সেটা নিয়ে আসে রামোন। মাঝে মাঝে কাপড়ের সাইজ টিন এজারদের মতো হয়ে গেলেও ভুল ধরিয়ে দেয় না মুগ্ধ বেলা। একবার তো এমন একটা প্রাম নিয়ে এলো যে এটার ধারণ ক্ষমতা, চকচকে রঙ দেখে মনে হল রোলস রয়েসের ওয়ার্কশপে তৈরি হয়েছে। নিজের দাদীমা’র বিয়ের পোশাক থেকে নেয়া অ্যান্টিক লেস্ দিয়ে বানানো সিল্কের বাপ্তিম্মের রোব উপহার দিল আদ্রা। ইসাবেলা এতটাই আপ্লুত হয়ে গেল যে রীতিমতো কেঁদে ফেলল। বারে বারে মনে পড়ল ওয়েল্টেভ্রেদেনের কথা, বাবা কিংবা নানা’র সাথে কথা বলার সময় বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করতে হয় যেন রামোন কিংবা সন্তানের কথা মুখ ফসকে বের হয়ে না যায়। সকলে ভাবছে থিসিসের কাজে কিংবা ছুটি কাটাতেই স্পেন গেছে বেলা।

এর মাঝে বার কয়েক রামোনের কথা মতো ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা জায়গায় গেছে বেলা। প্রতিবার কোনো একটা খাম কিংবা ছোট প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরে আসত। তেল আবিবে গেলে নিজের দক্ষিণ আফ্রিকান পাসপোর্ট ব্যবহার করে। কিন্তু বেনগাজী আর কায়রোতে ব্যবহার করে ব্রিটিশ পাসপোর্ট। একদিন কিংবা এক রাতের এসব ট্রিপে কিছুই ঘটে না বলা চলে। কিন্তু বেরির জন্য শপিং করার প্রচুর সুযোগ পাওয়া যায়। একবার তো বেনাগাজী থেকে ফেরার সপ্তাহখানেক পর কর্নেল মুয়ামার গাদ্দাফী সামরিক অভ্যুত্থান করে পতন ঘটান রাজা প্রথম ইদ্রিশের রাজতন্ত্র। নিজের আর শিশু’র নিরাপত্তার কথা ভেবে, স্বস্তি পায় বেলা। তাই বাচ্চার জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এরকম আর কোনো কাজ দেয়া হবে না বেলাকে বলে প্রমিজ করে রামোন। এ সমস্ত কাজ কি ব্যাংক নাকি তার জীবনের অন্ধকার দিকের সাথে জড়িত সন্দেহ করলেও কখনো কিছু জানতে চায় না বেলা।

সপ্তাহে একবার রামোনের ঠিক করে দেয়া ক্লিনিকে যায় চেক আপের জন্য। সবসময় সাথে যায় আদ্রা। গাইনোকোলজিস্ট বেশ ভদ্র আর অভিজাত।

“সবকিছুই চমৎকারভাবে এগোচ্ছে সিনোরা। প্রকৃতি তার কাজ করে যাচ্ছে আর সন্তান জন্মদানের জন্য আপনিও বেশ তরুণ আর স্বাস্থ্যবান।

“ছেলে হবে তো?”

“হ্যাঁ। খুব সুন্দর স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।”

প্রাক্তন মুরিশ রাজপ্রাসাদকে ঘষামাজা করে তৈরি হয়েছে এই ক্লিনিক। আধুনিক সব ব্যবস্থা আর যন্ত্রপাতিও আছে।

একবার চেক আপের পর পর্দা ঘেরা কিউবিকলে ইসাবেলা যখন ড্রেস পড়ছে, ওয়েটিং রুমে আদ্রা আর ডাক্তারের কথোপকথন শুনে ফেলে। স্প্যানিশ এতদিনে এতটাই রপ্ত করে ফেলেছে যে দুজনের আলাপ শুনে বেশ টেকনিক্যাল আর স্পেসিফিক মনে হল। ঠিক যেন একই পেশার দু’জন মানুষ কথা বলছে। অবাক হয়ে গেল বেলা।

বাসায় ফেরার সময় অন্যান্য রাবের মতই সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা রেস্টোরেন্টে বসে আইসক্রীম আর চকলেট সস্ অর্ডার করল বেলা। তারপর আদ্রার কাছে জানতে চাইল,

“তোমাকে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে শুনেছি। নিশ্চয় কখনো নার্স ছিলে, তাই না। তুমি তো অনেক কিছু জানো-টেকনিক্যাল শব্দগুলো যে বলছিলে।”

আরো একবার সেই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখাল আদ্রা।

“আমি তো একটা হাঁদা। এসব কিভাবে জানব।” ককভাবে উত্তর দিয়েই একেবারে ভোম মেরে গেল আদ্রা।

ডাক্তারের কথা মতো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ডেলিভারী হবে। তাই এর আগেই থিসিস শেষ করতে চায় বেলা। মার্চের শেষ দিনে ফাইনাল পেইজ টাইপ করে লন্ডনে পাঠিয়ে দিল। চিন্তা হল এই ভেবে কেমন হল পুরো গবেষণা। পাঠিয়ে দেয়ার পর মনে হতে লাগল আরো কী কী সংশোধন করা যেত।

যাই হোক এক সপ্তাহের ভেতর ফোন আসল ইউনিভার্সিটি থেকে। ফ্যাকাল্টি এক্সামিনারদের সামনে থিসিস নিয়ে ভাইভা দেবার জন্য ডাকা হল বেলাকে।

“উনারা পছন্দ করেছেন; অন্তত বিরক্ত তো হননি।” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল বেলা।

ডেলিভারী ডেট থাকা সত্ত্বেও তিনদিনের জন্য লন্ডন উড়ে গেল। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও ভাল হয়েছে ভাইভা কিন্তু মালাগা’তে আসতে আসতে জান বের হবার দশা।

“যতটা সম্ভব দ্রুত জানাবার প্রমিজ করেছেন উনারা? কিন্তু মনে হচ্ছে সব ভালোই হবে-” রামোনকে জানাল বেলা।

চাঁদের আলোয় শুয়ে আছে দু’জনে; এমন সময় শুরু হল প্রসব বেদনা।

চুপচাপ শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হতে চাইল বেলা। বুঝতে পারল সময় হয়ে গেছে। রামোন’কে জাগাতেই তড়িঘড়ি পাজামা পরে ছুটল নিচ তলায় আদ্রা’কে ডাকতে।

ইসাবেলা’র স্যুটকেস তৈরিই ছিল। তিনজনে মিলে উঠে বসল মিনি’তে। পেছনের সিটে ইসাবেলা’কে শুইয়ে দিয়ে ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছোটাল মোন।

বাচ্চা বড় হওয়া সত্ত্বেও কোনো সমস্যা হল না। দ্রুত আর প্রাকৃতিকভাবেই সাঙ্গ হল সবকিছু।

বহুকষ্টে একটা কনুই’র উপর ভর দিয়ে উঠে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল ঘামে ভেজা চুল। কী হয়েছে? ছেলে?”

জানতে চাইল উদ্বিগ্ন বেলা। চকচকে লাল ছোট্ট দেহটা তুলে ধরলেন ডাক্তার।

চোখ দুটোকে শক্ত করে বন্ধ রেখেছে ছোট্ট মানুষটা। মুখটা বেগুনি হয়ে আছে। ঘন, কালো চুলগুলো লেপ্টে আছে মাথার সাথে। নিজের হাতের বুড়ো আঙুলের সমান সন্তানের পুরুষাঙ্গ দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল বেলা, “ছেলে! ছেলে আর একজন কোর্টনি!”

সন্তানের মুখ দেখার সাথে সাথে, ওকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের ভেতরের মাতৃত্ব ভাব টের পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল বেলা। কোথায় লুকিয়ে ছিল এই অনুভূতি; এত শক্তি! বুকের মাঝে চিনচিন করে উঠল আদিম এক ব্যথা।

বাবা’র মতই সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। এ সুন্দর কিছু আর কখনো স্পর্শ করেনি বেলা। প্রথম কয়েকদিন তো চোখই ফেরাতে পারে না। রাতের বেলাতেও প্রায় ঘুম ভেঙে দোলনার কাছে গিয়ে দেখে আসে চাঁদের আলোয় ওই ছোট্টমুখখানা। অথবা দুধ খাওয়াবার সময় গোলাপি মুঠি খুলে দেখে ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো।

“ও আমার। শুধু আমার।” বারে বারে নিজেকেই যেন শোনায় বেলা; কিছুতেই কাটতে চায় না এই ঘোর।

ক্লিনিকের রৌদ্রস্নাত বড় সড় ঘরটাতে প্রথম তিনদিনের বেশিরভাগটাই ওদের সাথে কাটালো রামোন। বেলার মতো তারও প্রায় একই অবস্থা। দু’জনে মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাম নিয়ে। আর বিস্তর গবেষণা, কাটছাট শেষে বেলার দিক থেকে ঠিক হল শাসা আর শন আর রামোনের পক্ষ থেকে ঠিক হল হুয়েশা আর ম্যাহন। অবশেষে বাচ্চার নাম ঠিক করা হল নিকোলাস মিগেল রামোন ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো। মাইকেলকে সংক্ষিপ্ত করে ইসাবেলার ইচ্ছে মিগেল রাখা হল।

চতুর্থ দিনে রামোনের সাথে ক্লিনিকে এলো কালো স্যুট পরিহিত তিনজন অসম্ভব ভদ্রলোক। সবার হাতেই ব্রিফকেস। একজন অ্যাটনী, একজন স্টেট রেজিস্টার অফিসের কর্মকর্তা আর তৃতীয় জন হল স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট।

প্রত্যক্ষদশী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অ্যাডপশন পেপারে সাইন করল বেলা। নিকোলাসের গার্জিয়ান হিসেবে মেনে নিল মারকুইস ডি সান্তি য়াগো-ই-মাচাদা’কে। রামোন’কে পিতা হিসেবে দেখিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট দিল রেজিস্ট্রার।

অবশেষে মাতা-পুত্রের সুস্থ জীবন কামনা করে বিশাল বড় গ্লাসে শেরী পান করে বিদায় নিল তিন ভদ্রলোক। এতক্ষণে ইসাবেলা’কে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল রামোন।

“তোমার ছেলের পদবী নিশ্চিত হয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল রামোন।

“আমাদের ছেলে।” ওকে কিস্ করল বেলা।

ক্লিনিক থেকে তিনজনে মিলে বাসায় ফিরতেই ফুল ভর্তি রোল নিয়ে আদ্রা’কে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে; ওদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। ইসাবেলা চাইল নিজেই নিকি’কে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠবে।

কিন্তু নিয়ে নিল আদ্রা। “ও ভিজে গেছে। আমি চেঞ্জ করে দিচ্ছি।” নিজেকে ইসাবেলার মনে হল যেন এক সিংহী মা, যার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে ছোট্ট শাবক।

পরবর্তী দিনগুলোতে দেখা গেল অনুচ্চ এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল এই দুই নারীর মাঝে। ইসাবেলা জানে যে শিশু লালন-পালনে আদ্রা সিদ্ধহস্ত। তারপরেও নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। তাই নিকি সবকিছু একাই করতে চায়।

নিকি’র চেহারায় ধীরে ধীর ফুটে উঠল পিচু রঙা আভা। ঘন কালো চুলগুলোও কোকড়া হয়ে গেল। প্রথমবার চোখ মেলতেই দেখা গেল ঠিক বাবার মতো সবুজ চোখ পেয়েছে। ইসাবেলা’র মনে হলো এটাই বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মিরাকল।

দুধ খাওয়াতে গিয়ে ছেলেকে শোনায়, “তুমি ঠিক বাবার মতই সুন্দর হয়েছ, সোনা। একমাত্র এই কাজটাতেই ভাগ বসাতে পারে না আদ্রা।

য়েক মাসের মাঝেই সবার বেশ প্রিয় হয়ে উঠল ইসাবেলা। ওর সৌন্দর্য, সদয় আচরণ, গর্ভাবস্থা আর ভাষা শেখার দারুণ আগ্রহ দেখে বেজায় খুশি দোকানদাররা।

তাই, প্রায় দশদিনের দিন নিকি’কে প্র্যামে বসিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে আনল বেলা। এও মজা হল যে ফ্ল্যাটে ফিরল একগাদা প্রশংসা আর অসংখ্য উপহার নিয়ে।

ইস্টার ডে’তে বাড়িতে ফোন করার পর চিৎকার করে উঠলেন নানা : “স্পেনে এত কিসের জরুরি কাজ যে ওয়েল্টেভ্রেদেনে বাসায় ফিরতে পারছ না?”

“ওহ নানা, আই লাভ ইউ অল। কিন্তু এখন যে কিছুতেই সম্ভব না।”

“ইয়াং লেডি, তোমাকে আমি ভালই চিনি। জানি কোনো অ-কাজ নিয়ে তুমি ব্যস্ত; ট্রাউজার তাই না?”

“নানা, তুমি এত বাজে বকো না। কিভাবে ভাবলে আমি এমন করব?”

“বিশ বছরের অভিজ্ঞতা।” সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বললেন, “আর কোন ঝামেলা বাড়িয়ো না, বাছা।”

“প্রমিজ করছি, করব না।” পেটের কাছে ছেলেকে ধরে মিষ্টি স্বরে জানাল ইসাবেলা। মনে হল, আহারে যদি তোমাকে বলতে পারতাম। ছোট্ট মানুষটা তো এখনো ট্রাউজার পরতে পারে না।

“থিসিস কেমন হচ্ছে?” জানতে চাইল বাবা। এরই মাঝে যে শেষ করে ফেলেছে, বলতে পারল না বেলা। কারণ স্পেনে থাকার এটাই তো অজুহাত।

“প্রায় শেষ।” নিকি আসার পর থেকে এ ব্যাপারে কিছুই ভাবেনি বেলা।

“ঠিক আছে। গুড লাক্।” এরপর খানিক চুপ থেকে শাসা জানালেন, “মনে আছে তুমি আমার কাছে কী প্রমিজ করেছ?”

“কোনটা?” না বোঝার ভান করল বেলা। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অনুতপ্তও হলো। ভালোভাবেই জানে যে বাবা কিসের কথা বলছেন।

“প্রমিজ করেছিলে যে কখনো কোনো সমস্যায় পড়লে একা একা কিছু করবে না, আমার কাছে আসবে।

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“তুমি ঠিক আছে তত বেলা, মাই বেবি?”

“আমি ঠিক আছি, বাবা, জাস্ট ফাইন।”

মেয়ের কণ্ঠস্বরে আনন্দের ঝিলিক শুনে নিশ্চিত হলেন শাসা।

“হ্যাপি ইস্টার, আমার ছোট্ট বেবি।”

মাইকেলের সাথে টানা পয়তাল্লিশ মিনিট কথা হল। এমনকি নিকি পর্যন্ত ফোনে শুনিয়ে দিল নিজের খলবলে আওয়াজ।

“বাসায় কবে ফিরবে, বেলা?” অবশেষে জানতে চাইল মাইকেল।

“জুনের ভেতরেই রামোনের ডির্ভোস নিশ্চিত হয়ে যাবে। স্পেনে সিভিল ম্যারেজ সেরে ওয়েল্টেভ্রেদেনের গির্জায় বিয়ে করব। তুমি কিন্তু দু’জায়গাতেই থাকবে।”

“বাধা দেয়ার চেষ্টা করে দেখ।” বোনকে চ্যালেঞ্জ করল মাইকেল।

***

টেবিলের পাশে নিকি’র প্র্যাম রেখে পছন্দের সী-সাইড রেস্টোরেন্টে ডিনার করল সবাই মিলে।

ওদের সাথে আদ্রাও ছিল। এতদিনে বেলা’র ছোট্ট পরিবারের অংশ হয়ে গেছে এই নারী। রামোনর হাত ধরে হাঁটছে বেলা। এতটা খুশি আর কখনো বোধ করেনি জীবনে।

বাসায় পৌঁছাতেই চেঞ্জ করার জন্য নিকি’কে নিয়ে গেল আব্রা। এই বার আর ক্ষেপে গেল না বেলা।

সামনের বেডরুমের জানালা আটকে রামোনের কাছে এলো বেলা।

নিকি জন্ম নেবার পরেও তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। তুমি তো জানই যে আমি কাঁচের মতো ঠুনকো নই। ভেঙে পড়ব না।”

মিটি মিটি হেসে ভালই উপভোগ করছে রামোন। জানে অনেকদিন ওর আদর থেকে বঞ্চিত মেয়েটা।

“আমার মনে হয় তুমি সবকিছু ভুলেই গেছ।” রামোনের পিঠে ধাক্কা দিল বেলা, “চলো তোমাকে মনে করিয়ে দেই।”

“তুমি আবার ব্যথা পাবে না তো।” বেলার জন্য সত্যি উদ্বিগ্ন হল রামোন।

“যদি কেউ ব্যথা পায় তো সে হবে তুমি দোস্ত। নাও এবার সিটবেল্ট বাঁধা। টেক-অফের জন্য প্রস্তুতি নাও।”

একটু পর। বন্ধ রুমে ঘর্মাক্ত অবস্থায় পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনে। রামোন বলতে বাধ্য হল, “আগামী সপ্তাহে চার দিনের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হবে।”

তাড়াতাড়ি উঠে বসল বেলা। “ওহ্ রামোন এত জলদি!” প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনে হল একটু বেশি দখলদারি করছে বেলা। তাই নতমুখে জানতে চাইল, “প্রতিদিন ফোন করবে, ঠিক আছে?”

“চেষ্টা করব এর চেয়েও বেশি কিছু করতে। আমি প্যারিসে যাচ্ছি, দেখি তোমাকেও নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। লাজারে’তে একসাথে ডিনার করব দু’জনে।”

“বেশ মজা হবে, কিন্তু নিকি?”

“আদ্রা সামলাবে। নিকিও ভাল থাকবে তাই-আদ্রাও খুশি হবে।”

“আমি আসলে …” দ্বিধায় পড়ে গেল বেলা।

“মাত্র তো এক রাতের জন্য। তাছাড়া তোমারও পুরস্কার পাওনা রয়েছে।”

“ওহ্ মাই ডার্লিং।” মুগ্ধ হয়ে গেল বেলা। “তোমার সাথে থাকতে পারলে আমারও ভাল লাগবে। ঠিকই বলেছ, আদ্রা আর নিকি আমাকে ছাড়া এক রাত ঠিকই কাটিয়ে দিতে পারবে। তুমি ডাকলেই আমি চলে আসব।”

***

“প্রায় এক মাস হয়ে গেছে যে মেয়েটার ডেলিভারী হয়েছে।” তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন জেনারেল জোসেফ সিসেরো। তাহলে আর দেরি কিসের? এখন থামাও এ অপারেশন। খরচ সবকিছুকে ছাড়িয়েই যাচ্ছে। কেবল!”

“জেনারেলের নিশ্চয় মনে আছে যে নিজের ফান্ড থেকেই খরচ মেটাচ্ছি আমি। ডিপার্টমেন্টের বাজেট থেকে নয়।” আলতো করে মনে করিয়ে দিল রামোন।

কাশি দিয়ে মুখের সামনে পত্রিকা মেলে ধরলেন সিসেরো। দুজনে পাশাপাশি বসে আছেন প্যারিস মেট্রোর সেকেন্ড ক্লাস কোচে। কনকর্ড স্টেশন থেকে উঠে রামোনের পাশে বসেছেন সিসেরো। পরস্পরকে চিনতে পারার কোনো ভাবই ফুটল না চেহারায়। আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলে ট্রেন ছোটার আওয়াজে কিছু শুনতেও পারবে না আড়ি পাতার দল। দুজনে চোখের সামনে পত্রিকা মেলে কথা বলছে” শর্ট মিটিং এর জন্য প্রায়শই তারা এমন করে থাকে।

“আমি যে শুধু রুবলের হিসাব করছি তা নয়। প্রায় এক বছর ধরে এ প্রজেক্টের পেছনে লেগে থেকে ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য কাজের অপূরণীয় ক্ষতি করছ।”

লোকটাকে রোগ যে কতটা কাবু করে ফেলেছে দেখে অবাক হচ্ছে রামোন। প্রতিবার দেখলে মনে হয় স্বাস্থ্য আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আর মাত্র কয়েক মাস আছে হাতে।

“এই কয়েক মাসের কাজ সামনের বছরগুলোতে কিংবা দশকগুলোতেও বলা যায় ফিরে আসবে অসাধারণ ফলাফল নিয়ে।”

“কাজ।” নাক সিটকালে সিসেরো। “এটা যদি কাজ হয় তাহলে মজা লোটা কোনটা মারকুইস? আর তাহলে মাসের পর মাস ধরে ইস্তফা টানতেও বা দ্বিধা করছ কেন?”

“যদি এই মেয়েটা আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে থাকে তাহলে অপারেশনের পরবর্তী পর্যায়ে যাবার আগে অবশ্য ওকে সময় দিতে হবে বাচ্চাটার সাথে ভাব করার জন্য।”

“কবে হবে সেটা?” জানতে চাইলেন সিসেরো।

“হয়েও গেছে ইতিমধ্যে। ফসল তোলার জন্য প্রস্তুত। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। শুধু এই শেষ দৃশ্যেও আপনার সহযোগিতা দরকার। এ কারণেই এই মিটিং এর জন্য প্যারিসকে বেছে নিয়েছি।”

মাথা নাড়লেন সিসেরো। “চালিয়ে যাও।”

এরপর পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলে চলল রামোন। কোনো মন্তব্য ছাড়াই শুনলেন সিসেরো। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে অপূর্ব হয়েছে প্ল্যানটা।

“ঠিক আছে।” অবশেষে জানালেন জেনারেল। “তোমাকে আগে বাড়ার অনুমোদন দেয়া হলো। আর অনুরোধ করেছ তাই শেষটার দেখভাল করব।”

বাস্টিলে ট্রেন পৌঁছাতেই কাগজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন সিসেরো।

দরজা খুলে যেতেই একবারও পিছনে না তাকিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেলেন

***

রামোন যেদিন চলে গেল সেদিনই সন্ধ্যায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোটিশ এলো বেলা’র কাছে।

ইসাবেলা কোর্টনিকে ডক্টর অব ফিলোসফী ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়েছে।

সাথে সাথেই ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফোন করল বেলা। মালাগা আর কেপ টাউনের সময়ের পার্থক্য খুব বেশি না। মাত্রই পোলো মাঠ থেকে ফিরেছেন

নিচ তলার স্টাডিতে মেয়ের ফোন ধরেই চিৎকার করে উঠলেন, “সন অফ আ গান!” বাবার উচ্ছ্বাস টের পেল বেলা। “ওরা তোমাকে কবে টুপি পরাবে ডার্লিং?”

“জুন-জুলাইয়ের আগে না। ততদিন পর্যন্ত থাকতে হবে।” এই বাহানাই মনে মনে খুঁজছিল বেলা।

“অবশ্যই।” সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন শাসা। “আমি’ও আসব তখন।”

“ওহ ড্যাডি, কতটা দূর!”

“বাজে কথা বলো না ড, কোর্টনি। আমি এটা কোনো মতেই মিস্ করতে চাইনা। তোমার দাদীও হয়ত আসতে চাইবেন সঙ্গে।” অদ্ভুত হলেও বেলা ভাবল যাক এই সুযোগে রামোন আর নিকি’র সাথে ওদের দেখা করিয়ে দেওয়া যাবে।

এই মুহূর্তে অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে রামোনের সঙ্গেই বেশি অভিপ্রেত হলেও সে রাতে কিংবা পরের দিনও ফোন করল না ছেলেটা। বৃহস্পতিবার সকাল হতে হতে তো চিন্তায় পাগল হবার দশা।

অবশেষে যখন ফোন বেজে উঠল তখন রসুনের কোয়া নিয়ে রান্নাঘরে ঝগড়া করছে বেলা আর আদ্রা।

“রামোন ডার্লিং, আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি ফোন করোনি কেন?”

“অ্যায়াম সরি বেলা।” ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে গলে গেল বেলা।

“তুমি কি এখনো আমাকে ভালবাসো?”

“প্যারিসে এসো, প্রমাণ দিচ্ছি।”

“কখন?”

“এখনি। এয়ার ফ্রান্স’র এগারোটার ফ্লাইটে তোমার জন্য রিজার্ভেশন দিয়েছি। এয়ারপোর্টে টিকেট পেয়ে যাবে। দুটোর মধ্যে পৌঁছে যাবে এখানে।”

“তোমার সাথে কোথায় দেখা করব?”

“প্লাজা এথেনী’তে স্যুট বুক করেছি আমাদের জন্য।”

“তুমি আমাকে নষ্ট করে ফেলছ রামোন ডার্লিং?”

“এর কম কিছুও তোমার প্রাপ্য নয়।”

তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে বের হয়ে এলো বেলা। কিন্তু এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট চল্লিশ মিনিট ডিলে হলো। ব্যাগেজ পেতে দেরি হওয়ায় বিকেল পাঁচটারও পরে রাজসিক প্লাজা অ্যাথনী’র সামনে এসে পৌঁছাল বেলা’র ট্যাক্সি।

মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখবে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে রামোন। কিন্তু না, কেউ নেই। রিসেপশন ডেস্কের উল্টো দিকে সোনালি কারুকাজ করা আর্মচেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে খেয়াল না করেই কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল বেলা।

“আপনাদের গেস্ট মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো’র স্ত্রী আমি।”

“এক মিনিট, ম্যাডাম।” লিস্ট চেক করে কিছুই পেল না উর্দিধারী ক্লার্ক। তারপর কী ভেবে দ্বিতীয়বার চেক করল।

“আমি দুঃখিত, মারকুইসা। মারকুইস এখানে নেই।”

“হয়তো উনি মঁসিয়ে মাচাদো নামে রেজিস্টার করেছেন।

“না। এই নামেও কেউ নেই এখানে।”

দ্বিধায় পড়ে গেল ইসাবেলা। “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ সকালেও তো কথা বলেছিলাম।”

“ঠিক আছে, আমি আবার চেক করছি।” বুকিং ক্লার্কের সাথে কথা বলে সাথে সাথে ফিরে এলো লোকটা। “আপনার হাজব্যান্ড এখানে নেই আর কোনো রিজার্ভেশনও দেননি।

“হয়ত ওর দেরি হচ্ছে। নিজেকে সামলাতে চাইল বেলা, “কোনো রুম পাওয়া যাবে?”

“হোটেলের সব রুম বুকড় হয়ে গেছে।” ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জড়ো করল লোকটা, “এখন বসন্ত। বুঝতে পারছেন মারকুইসা। প্যারিস পর্যটকের ভিড়ে ভরে গেছে।”

“ও নিশ্চয় আসবে।” জোর করে হাসতে চাইল ইসাবেলা “আমি যদি গ্যালরিতে অপেক্ষা করি, কিছু হবে?”

“মোটেই না, মারকুইসা। ওয়েটার আপনাকে কফি এনে দিবে। স্টোরে ব্যাগেজের দিকে খেয়াল রাখবে পোর্টার।”

বেলা লম্বা গ্যালারির দিকে এগোতেই আর্মচেয়ার থেকে উঠে বসল সে ভদ্রলোক। কিন্তু নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকা ইসাবেলা খেয়ালই করল না অসুস্থের মতো হাঁটতে থাকা লোকটাকে। রাস্তায় নেমে ডোরম্যানের এনে দেয়া ট্যাক্সিতে চড়ে গ্রেনেল চলে এলেন সিসেরো। শেষ ব্লক হেঁটে পৌঁছে গেলেন সোভিয়েত অ্যামব্যাসিতে। নাইট ডেস্কের গার্ড দেখা মাত্র চিনতে পারল জেনারেলকে।

দ্বিতীয় তলার মিলিটারি অ্যাটাশে’র অফিস থেকে মালাগা’তে ফোন করলেন সিসেরো।

“মেয়েটা হোটেলে পৌঁছে গেছে।” খসখসে কণ্ঠে জানালেন অপর পার্শ্বের শ্রোতাকে। আগামীকাল দুপুরের আগে ফিরতে পারবে না। পরিকল্পনা মতো কাজ শুরু করে দাও।”

সাতটার খানিক আগে গ্যালারিতে ইসাবেলার কাছে এলো দ্বাররক্ষী।

“আপনার জন্য ভালো একটা সংবাদ এনেছি মারকুইসা। একটা রুম খালি হয়েছে। আপনার ব্যাগজেও পাঠিয়ে দিয়েছি উপরে।”

একশ ফ্রাংক টিপস্ দিয়ে রুমে ঢুকেই মালাগাতে ফোন করল বেলা। আশা করেছিল রামোন হয়ত আদ্রার কাছে কোনো মেসেজ রাখবে; কিন্তু না, ঘটনা তার চেয়েও ভয়াবহ। একশ বার রিং হলেও কোনো উত্তর এলো না। ভয় পেয়ে গেল বেলা। রাতে আরো দু’বার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না।

“ফোন বোধহয় কাজ করছে না। নিজেকে বোঝাতে চাইলেও সারারাত একটুও ঘুমোত পারল না।

সকালে এয়ারলাইন রিজার্ভেশন অফিস খোলার সাথে সাথেই মালাগার ফ্লাইটে সিট বুক করে নিয়ে দুপুরেরও পরে নিজ অ্যাপার্টমন্টে পৌঁছে গেল বেলা।

ট্যাক্সি থেকে নেমে ব্যাগটাকে কোনোমতে হেঁটে হেঁচড়ে সদর দরজার কাছে এসে থামল। দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তিতে অবসন্ন হাতে কাঁপতে কাঁপতে চাবি ঢোকাল তালা’তে।

ভূতের বাড়ির মতো নির্জন হয়ে আছে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট। খোলা দরজা দিয়ে শুনতে পেল নিজের গলার আওয়াজ।

“আদ্রা, আমি ফিরে এসেছি। কোথায় তুমি?”

আত্রা’র রুমের দিকে যেতে যেতে রান্নাঘরেও চোখ বুলালো বেলা। ধুপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের বেডরুমের সামনে গিয়ে দেখে হাট করে খুলে রয়েছে দরজা। নিকির দোলনাটা থাকলেও দেখল না আর টেডি বিয়ারগুলো উধাও।

ছাদের দরজাতে গিয়েও দেখে এলো। নেই নিকির প্র্যাম।

“আদ্রা!” অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল বেলা, “তুমি কোথায়?”

দৌড়ে অন্য রুমগুলোতেও কেবল ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে লাগল, “নিকি! মাই বেবি! ওহ্ গড় প্লিজ। তুমি নিকি’কে কোথায় নিয়ে গেছ?”

আবারো বেডরুমে নিকির শূন্য দোলনার কাছে ফিরে এলো বেলা।

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না? কী হয়েছে সবার?”

কী মনে হতেই নিকি’র ড্রয়ার খুলতেই কেঁপে উঠল সারা গা। ন্যাপি, ভেস্ট, জ্যাকেট কিছু নেই।

“হাসপাতাল!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজেকেই শোনাল, “নিশ্চয় কিছু হয়েছে ওর!”

দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে টেলিফোনে হাত দিয়েই জমে গেল বেলা। টেপ দিয়ে একটা খাম আটকে রাখা হয়েছে যন্ত্রটার ক্রেডলে। ধপ করে রিসিভার ফেলে দিয়ে খামটা খুলল বেলা। হাত এতটাই কাঁপছে যে নোটের লেখা প্রায় কিছুই পড়তে পারছে না।

যাই হোক রামোনের হাতের লেখা দেখার সাথে সাথে চিনতে পারলেও স্বস্তি উড়ে গেল পড়তে গিয়ে :

“নিকোলাস আমার কাছেই আছে। কিছু সময়ের জন্য নিরাপদে থাকবে। তুমি যদি আবার ওকে দেখতে চাও, তাহলে বিনা বাক্য ব্যয়ে নিচের নির্দেশগুলো অনুসরণ করো। মালাগা’তে কারো সাথে কিছু বলবে না। এখনি ফ্ল্যাট ছেড়ে লন্ডন চলে যাও।

কাদোগান স্কোয়ারেই তোমার সাথে যোগাযোগ করা হবে। কাউকেই বলবে না যে কী ঘটেছে, এমনকি তোমার ভাই মাইকেলকে’ও না। সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলে নিকি’র পরিণাম হবে ভয়াবহ। হয়ত কখনো আর ওকে দেখবেই না। এই নোটটাও নষ্ট করে ফেলল।

বেলা’র মনে হল কোমরের কাছ থেকে সবকিছু অবশ হয়ে গেছে। দেয়ালের সাথে ঘসে ঘসে টাইলসের মেঝেতে বসে পড়ল অথবের মত। বারে বারে পড়ল হাতের নোট; কিন্তু মাথা যেন কাজ করছে না।

কোলের উপর কাগজের টুকরাটাকে ফেলে দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল ওপাশেরে দেয়ালের দিকে।

জানে না কতক্ষণ বসে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহুকষ্টে টেনে তুলল নিজেকে। দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। আরো একবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা এগিয়ে গেল বেডরুমে রামোনের কার্বাডের দিকে। দরজা খুলতেই দেখতে পেল খালি কার্বাড। এমনকি কোট হ্যাঁঙ্গারগুলোও নেই, চেস্ট অব ড্রয়ারের কাছে গিয়েও দেখা গেল সব শূন্য। কিছুই রেখে যায়নি রামোন।

আবারো নিকির দোলনার কাছে ফিরে এলো বেলা। বোমা বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তির মতো দিকবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে মেয়েটা। ছেলের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, “ওহ্ নিকি, বাছা আমার, ওরা তোমার সাথে কী করছে?”

হঠাৎ করেই দোলনার কাঠের বার আর বেবি ম্যাট্রেসের ফাঁক গলে কিছু একটা পড়ে গেল মাটিতে। মনে হল বেদীর সামনে থেকে প্রসাদ নিচ্ছে; এমনভাবে হাঁটু গেড়ে বসে নিকি’র উলের নরম জুতায় মুখ ডুবিয়ে দিল বেলা, প্রাণ ভরে গন্ধ নিল ছোট্ট দেহটার। এতটা কাদল যে নিঃশেষ হয়ে গেল সব শক্তি। ততক্ষণে ছাদ গলে বেডরুমেও নেমে এলো অন্ধকার। কোনোমতে বিছানায় উঠেই ঘুমিয়ে পড়ল বেলা। গালের কাছে ধরে রইল উলের ছোট্ট জুতাটা।

ঘুম থেকে জেগে উঠেও দেখল অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। বহুক্ষণ পর্যন্ত বুঝতেই পারল না কোথায় আছে, কী হয়েছে। এরপর চেতনা ফিরে পেতেই ধড়মড় করে উঠে বসল।

বিছানার পাশের টেবিলে পড়ে আছে রামোনের নোট। হাতে নিয়ে আবারো পড়ল। তারপরেও মনে হল কিছুই বুঝতে পারছে না।

“রামোন, মাই ডার্লিং, কেন আমাদের সাথে এমন করছ?” ফিসফিস করে বলে উঠলেও বাধ্য মেয়ের মতো বাথরুমে গিয়ে টয়লেট বোলের উপর ছোট্ট ছোট্ট কুচি করে ফেলল পুরো কাগজ। তারপর ফ্লাশ করে দিল। জানে যা পড়েছে মাথা থেকে তা কখনোই যাবে না, তাই এই ভয়ংকর কাগজটা সাথে রাখার কোনো প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছে কিছুই নেই।

গোসল করে কাপড় পরে টোস্ট আর কফি বানাল। সবকিছুই বড় বেশি বিস্বাদ লাগল মুখের ভেতরে।

এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল পুরো ফ্ল্যাট। আদ্রার রুম থেকে শুরু করল। কাপড়, কসমেটিকস, অয়েন্টমেন্ট এমনকি বিছানার চাদরের উপর আদ্রা অলিঙারেসের একটা চুলও পাওয়া গেল না। সব নিশানা উধাও।

লিভিং রুম আর রান্নাঘরেরও একই অবস্থা।

আবারো উঠে বেডরুমে গেল বেলা। রামোনের কার্ডের পিছনে স্টিলের একটা ওয়াল সে আছে। খুলতেই দেখা গেল একটাও ডকুমেন্টস নেই। নিকির বার্থ সাটিফিকেট আর অ্যাডপশন পেপারসও গায়েব।

বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়ে পরিষ্কার মাথায় চিন্তা করতে চাইল বেলা। এই পাগলামির পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে! সম্ভাব্য সব অ্যাংগেল থেকেই ভাবতে চাইল ঠাণ্ডা মাথায়।

কিন্তু ঘুরে ফিরে মন শুধু একটাই উপসংহারে আসছে; রামোন কোনো গভীর সমস্যায় পড়েছে। তাই বাধ্য হয়েছে নিকি’কে নিয়ে সরে পড়তে। তাই ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ দু’জনের নিরাপত্তার জন্য রামোনের কথা মানতেই হবে বেলাকে।

অ্যাপার্টমেন্টে ছেড়ে নিচের রাস্তায় নেমে এলো বেলা। ওপারে একটা বেকারি শপ আছে আর বেকারস্ এর স্ত্রীর সাথে গত কয়েক মাসে ভালই খাতির হয়ে গেছে। দোকানের শাটার টানছিলেন মহিলা। এমন সময় এগিয়ে গেল বেলা।

“হ্যাঁ, আপনি বৃহস্পতিবারে চলে যাবার পর আদ্রা নিকোলাসকে এ্যামে করে বীচের দিকে নিয়ে গিয়েছিল আর দোকান বন্ধ করার আগেই দেখেছি। ফিরে এসেছে। অ্যাপার্টমেন্টেও যেতে দেখেছি কিন্তু তারপর আর দেখিনি।”

অ্যাপার্টমেন্টে ব্লকের আশেপাশে আরো কয়েকজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেও সকলে একই কথা জানালো। কয়েকজনে ওদেরকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেখলেও এরপর আর দেখেনি। একমাত্র বাকি রইল পার্কের কর্ণারের জুতা পালিশওয়ালা। এই লোকটার কাছেই রামোন সব সময় জুতা পালিশ করাতো, মুক্ত হস্তে টিপসও দিত। বেলাও বেশ পছন্দ করে।

“হাই, সিনোরা” বেলা’কে দেখে হাসল লোকটা। জানালো, “বৃহস্পতিবারে আমি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করি। সিনেমা আর আর্কেড থাকে। দশটার সময় মারকুইসকে দেখেছি। দু’জন লোককে নিয়ে এসেছেন, সাথে বড় একটা কালো গাড়ি। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে সবাই উপরে উঠে গেছে।

“অন্য লোকগুলো দেখতে কেমন ছিল চিকো? তুমি চেনো? আগে কখনন দেখেছ?”

“না। তবে বেশ কঠিন চেহারা পুলিশের মত। এরা এত ঝামেলা করে, তাই আমি পুলিশধ পছন্দ করি না। সবাই মিলে উপরে গিয়েও একটু পরেই নেমে এসেছে। সঙ্গে আদ্রা। আদ্রা’র কোলে নিকো বেবি। গাড়িতে উঠে সবাই একসাথে চলে গেছে। এরপর আর দেখিনি ওদেরকে।”

পুলিশ ছিল, তার মানে ইসাবেলা’র সন্দেহই সত্যি। রামোন বাধ্য হয়ে এসব করেছে। বুঝতে পারল রামোনের কথামতো কাজ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি প্যাক আপ শুরু করে দিল। ম্যাটারনিটি ক্লথসগুলো মেঝেতে ফেলে রেখে ভালো কাপড়গুলো দুটো সুটকেসে ভরে নিল।

কসমেটিকস্ এর ড্রয়ার খুলতেই দেখল নিকির জন্মের পর থেকে তোলা ছবিসহ মোটাসোটা অ্যালবামটা নেই। এমনকি লেগেটিভগুলো’ও নিয়ে গেছে ওরা। ভাবতেই দুলে উঠল সারা পৃথিবী যে ওর কাছে সন্তানের কোন চিহ্নই রইল না। কোনো ছবি, রেকর্ড, ব্যবহারী জিনিস, কিছু না; শুধু উলের জুতাটা কেমন করে যেন পেয়ে গেছে।

পেটমোটা স্যুটকেস দুটো নিয়ে নিচে নেমে তুলে ফেলল মিনি’র পেছনে। তারপর রাস্তা পার হয়ে গেল বেকার’পত্নীর দিকে।

“যদি আমার হাজব্যান্ড ফিরে এসে আমার কথা জানতে চায়, বলবেন যে লন্ডনে চলে গেছি।”

“আর নিকো? আপনি ঠিক আছেন তো সিনোরা?” মহিলার সহৃদয়তা দেখে হাসল বেলা,

“নিকো আমার হাসব্যান্ডের কাছেই আছে। শীঘ্রিই লন্ডনে ওদের সাথে দেখা হবে। ভাল থাকবেন সিনোরা।”

***

উত্তর দিকে যাত্রা মনে হলো আর কখনো শেষই হবে না। গত কয়েকদিন মাথার ভেতর শুরু নিকোলাসের খেলার দৃশ্যই ঘুরছে; মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলের সাথে কাটানো শেষ মুহূর্তগুলো। পাগল হতে বুঝি আর দেরি নেই।

ক্রস-চ্যানেল ফেরিতে স্যালুনের হৈ-হট্টগোল এড়াতে ডে’কে উঠে গেল বেলা। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। শীতল বাতাস আর নিজের বিষণ্ণতায় কাঁপতে কাঁপতে অবশেষে নেমে এলো নিচে উইমেনস টয়লেটে। দুধের ভারে ব্যথা হয়ে আছে স্তন। তাই বাড়তি অংশ একস্ট্রা পাম্প করে ফেলে দিতে হল, যা নিকি’র পাওনা ছিল।

“ওহ নিকি, নিকি?” নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের মুখ মনে করার চেষ্টা করল বেলা। এখনো স্পষ্ট অনুভব করে শিশু শরীরের সেই ঘ্রাণ আর ওম।

বহুকষ্টে অবশেষে নিজেকে সামলে মনে করিয়ে দিল, “এখন কিছুতেই ভেঙে পড়া চলবে না। নিকি’র জন্য আমাকে শক্ত হতেই হবে। সুতরাং আর কোনো কান্না নয়।”

বৃষ্টির মাঝে কাদোগান স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে পৌঁছাল বেলা। লাগেজ খুলতে খুলতে মনে হল বাবার কাছে করা প্রমিজের কথা। আর কী যে হল, হাতের ড্রেস ছুঁড়ে ফেলে দুদ্দাড় করে দৌড় দিল ড্রইং রুমে।

“আমি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে একটা ইন্টারন্যাশনাল কল করতে চাই।”

রাত হয়ে যাওয়াতেও মাত্র দশ মিনিটেরও কম সময়ে লাইন পাওয়া গেল। ওপাশে পরিচারকদের কেউ একজন ফোন তুলতেই আর বাবাকে চাইতে পারল না হতভম্ব বেলা। এটা সে কী করতে যাচ্ছিল। মনে পড়ে গেল রামোনের হুমকি। “অবাধ্য হলে নিকি’র পরিণাম হবে ভয়াবহ।”

কোনো কথা না বলেই ক্রেড়লে রিসিভার নামিয়ে রাখল বেলা।

পাঁচ দিন কেটে গেল। কিছুই ঘটল না। আশায় আশায় ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, ফোনের আশপাশ থেকেই সরলো না। কিন্তু হাউজকীপার ছাড়া আর কারো সাথেই কথাও বলে না। শুধু বই পড়ে আর টিভি দেখে। যদিও তাকিয়ে থাকাই সার হয়। নিজের ব্যথা ছাড়া বাকি সবকিছুই এখন অর্থহীন।

কিছুই খেতে ইচ্ছে না করাতে তিন দিনের ভেতর বুকের দুধ শুকিয়ে গেল। ওজন কমতে লাগল হু হু করে। তার সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় একটি অংশ চুলগুলো শুকিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে একটুও ভাল লাগে না। চোখের চারপাশে গভীর দাগ, সোনালি দেহত্বক এখন হলুদ হয়ে দেখায় ম্যালেরিয়া রোগীর মত।

শাস্তির মতো মনে হচ্ছে এই অপেক্ষার পালা। একেকটা ঘণ্টা যেন অনন্ত কাল। অবশেষে ষষ্ঠ দিনে বেজে উঠল ফোন। দ্বিতীয় রিং’র সাথে সাথেই ছো মেরে কানে দিতেই শুনল মধ্য ইউরোপীয় এক নারীর স্বর।

“আমার কাছে রামোনের একটা মেসেজ আছে। এখনি বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে রয়্যাল হাসপাতাল জংশনে চলে যান। ওয়েস্ট মিনিস্টার পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। এরপর কেউ একজন এসে “লাল গোলাপ : নাম ধরে ডেকে জানাবে বাকি নিদের্শনা। এবারে কী শুনেছেন বলুন।”

এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বস বলে গেল ইসাবেলা। “গুড” বলেই কানেকশন কেটে দিল নারী কণ্ঠ।

টেমস এর উপর দিয়ে একশ গজও যায়নি; এমন সময় ছোট্ট একটা ভ্যান ওর পাশে চলে এলো। ধীরে ধীরে চলতে লাগল একই দিকে। একটু পরে পেছনের দরজা খুলতেই দেখা গেল গ্রে ওভারঅল পরে বসে আছে এক মাঝ বয়সী রমণী।

“লাল গোলাপ” কণ্ঠ শুনেই বেলা চিনে নারীকে। “উঠে বসো!”

দ্রুত ভ্যানে উঠে মহিলার বিপরীত দিকে বসে পড়ল বেলা। চলতে শুরু করল ভ্যান।

জানালা বিহীন ভ্যানটার অন্য কোন দরজাও নেই। কেবল মাথার উপরে ভেন্টিলেটর ছাড়া। তাই টার্ন আর স্টপ গুনে গুনে কোথায় যাচ্ছে আন্দাজ করতে চাইলেও একটু পরেই ক্ষান্ত দিল সে চেষ্টায়।

“আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?” বিপরীত পাশে বসা নারীকে প্রশ্ন করতেই উত্তরে শুনল, “একদম চুপ।” তাই করল বেলা। হাতঘড়িতে তেইশ মিনিট কেটে গেছে এমন সময় আবার থেমে গেল ভ্যান। বাইরে থেকে খুলে গেল পেছনের দরজা।

একটা পার্কিং গ্যারেজে এসে থেমেছে ভ্যান। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল জায়গাটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গ্রে ওভারঅল পরিহিত নারী হাত ধরে বেলা’কে নামতে সাহায্য করল। স্পর্শেই এই রমণীর শক্তি টের পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল বেলা। ঠিক যেন একটা গরিলা’র থাবা। মাংসল কাঁধ নিয়ে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে আছে ওর মাথার উপরে। হাত ধরা অবস্থাতেই ওকে ভ্যানের বিপরীত দিকের লিফটে নিয়ে গেল। চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল বেলা। ডজনখানেক আরো অন্যান্য ভেহিকেল দেখা গেল যেগুলোর অন্তত দু’টোতে ডিপ্লোম্যাটিক প্লেট লাগানো আছে।

লিফটের দরজা খুলে যেতেই ইসাবেলা ধাক্কা খেয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কন্ট্রোল প্যানেলের আলো দেখে বোঝা গেল ওর সন্দেহই সঠিক। বেসমেন্ট লেভেল-২। থার্ড ফ্লোরের বোতামে চাপ দিল গরিলা। নিঃশব্দে দু’জনে উঠে এলো লেভেল-থ্রি’তে। খালি করিডোরের দু’পাশের সবক’টি দরজাই আটকানো।

একেবারে শেষ মাথার দরজাটা খুলে বের হয়ে এলো আরেক স্লাভিক নারী। একই রকম গ্রে ওভারঅল পরনে। ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ছোট্ট একটা লেকচার রুমে, কিংবা বলা যায় মুভি থিয়েটার। উঁচু মঞ্চের দিকে মুখ করে পাতা হয়েছে দুই সারি ইজি চেয়ার, দূরের দেয়ালের সাথে লাগানো হয়েছে পর্দা।

সামনের সারির মাঝখানে ইসাবেলা’কে বসিয়ে দেয়া হলো।

নরম প্লাস্টিকের চেয়ারে ডুবে গেল যেন। দুই নারী এবার ইসাবেলার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর্যন্ত কিছুই ঘটল না। এরপরই মঞ্চের ডানদিকের ছোট দরজাটা খুলে গিয়ে ভেতরে এলেন এক পুরুষ।

ভদ্রলোক অসুস্থ মানুষের মতো আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করছেন। চুলগুলো সব সাদা, প্রায় হলুদও বলা চলে, লেপ্টে আছে কানে-কপালে। বয়স আর রোগের ভারে লোকটাকে এতটাই কাবু মনে হল যে খারাপই লাগল; আলো পড়ল চোখের উপর।

বিতৃষ্ণার ঝাঁকি খেয়েই মনে পড়ে গেল ওই চোখ জোড়া। একবার কৃষ্ণ সাগরে বাবার সাথে চার্টার করা ফিশিং বোটে গিয়েছিল বেলা। মরিশাসের দ্বীপে বাবা’র বঁড়শিতে গেঁথে যায় দানবীয় এক হাঙর। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর তীরে তোলা হয়েছিল প্রাণীটাকে। রেইলের কাছে ঝুঁকে হাঙরের চোখ দেখেছিল বেলা। মায়া মমতাহীন কালো চোখ দুটোতে কোনো পিউপিল ছিল না। শুধু দুইটা গর্ত যেন নরকের অতল তল পর্যন্ত চলে গেছে। ঠিক সেরকম দুটো চোখ এখন তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

নিঃশ্বাস আটকে বসে রইল বেলা। অবশেষে কথা বললেন লোকটা। নিচু আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা অবাকই হলো। সামনে ঝুঁকে এলো শব্দগুলো ভালভাবে শোনার জন্য।

“ইসাবেলা কোর্টনি, এখন হতে যোগাযোগ করার জন্য এই নামটা আর কখনোই ব্যবহার করব না। তুমি নিজে এবং অন্যরাও তোমাকে সম্বোধন করবে লাল গোলাপ নামে। বুঝতে পেরেছো?”

মাথা নাড়ল বেলা। হাতে ধরা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মেঘের মধ্য দিয়ে আবারো কথা বললেন লোকটা। জানালেন,

“তোমার জন্য একটা মেসেজ এনেছি। ভিডিও টেপ রেকর্ডিং।” এরপর মঞ্চ থেকে নেমে সারির একেবারে শেষ চেয়ারে, বেলা থেকে দূরে গিয়ে বসে পড়লেন।

মাথার উপরের বাতিগুলোর আলো কমে গেল। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের খানিকটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আলো জ্বলে উঠল পর্দায়। সাদা টাইলসের একটা রুমে দৃশ্য দেখা গেল-হতে পারে কোনো ল্যাবরেটরি কিংবা অপারেশন থিয়েটার।

রুমের মাঝখানে একটা টেবিল টেবিলের উপর কাঁচের অ্যাকুয়ারিয়াম টাইপের ট্যাঙ্ক। উপরের কয়েক ইঞ্চি বাদে পুরো ট্যাঙ্কটাই পানিতে ভর্তি। টেবিলের উপরে ট্যাংকের পাশে একটা ইলেকট্রনিক কেবিনেট আর কিছু যন্ত্রপাতি। শুধু পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার আর মাস্ক দুটোকে চিনতে পারল বেলা। মাস্কুটা দেখে মনে হচ্ছে একেবারে দুধের বাচ্চা কিংবা খুব ছোট ছেলে মেয়ের জন্য তৈরি।

টেবিলে ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে এক লোক। ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পরনে সাদা ল্যাবরেটরি কোট। এবারে ক্যামেরার দিকে তাকাতেই দেখা গেল মুখে’ও সার্জিক্যোল মাস্ক পরে আছে।

পূর্ব ইউরোপীয় টানে যান্ত্রিক স্বরে কথা শুরু করল লোকটা। মনে হলো পর্দার ভেতর থেকেও সরাসরি ইসাবেলার দিকে তাকিয়েই কথা বলছে। “তোমাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল মালাগা কিংবা অন্য কোথাও কারো সাথে কথা না বলতে। ইচ্ছে করেই তা অমান্য করেছ।”

একদৃষ্টিতে বেলা’কে দেখছে লোকটা।

“আমি দুঃখিত। এতটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে, আসতে উঠিৎ-”

“চুপ!” পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল এক নারী। কাঁধের উপর হাত দিয়ে এত জোরে চাপ দিল যে নখ বসে গেল মাংসের ভেতর।

ওদিকে পর্দায় এখনো কথা বলছে লোকটা। “তোমাকে সাবধান করা হয়েছিল যে অবাধ্যতার কারণে তোমার ছেলের পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই এ ধরনের অবাধ্যতা কী ধরনের পরিণাম নিয়ে আসতে পারে তার একটা নমুনা এখনি দেখতে পাবে।”

কাউকে ইশারা করতেই পর্দায় দেখা গেল এগিয়ে এসেছে আরেক জন নারী কিংবা পুরুষ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কারণ শুধু চোখ দুটো ছাড়া বাকি সব ঢাকা মাস্ক আর ক্যাপ দিয়ে “ইনি একজন ডাক্তার। পুরো ব্যাপারটাই তিনি মনিটর করবেন।”

দ্বিতীয় লোকটার হাতে একটা পুটুলি দেখা যাচ্ছে। ট্যাঙ্কের পাশে টেবিলের উপর পুটুলিটা’কে রাখতেই কাপড় ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা পা। দক্ষ হাতে দ্রুত শিশ্যুটার সব কাপড় চোপড় খুলে নিল ডাক্তার। টেবিলের উপর শুয়ে শুন্যে হাত পা ছুঁড়তে লাগল নিকি।

মুখের ভেতর এক হাতের সবকটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে কামড়ে ধরল বেলা; নিজেকে সামলাতে চাইল যেন আবার চিৎকার করে কেঁদে না উঠে।

নিকি’র নগ্ন বুকের উপর দুটো কালো সাংশন কাপ লাগিয়ে দিল ডাক্তার। কাপের পাতলা দুটো তার নিয়ে এরপর লাগানো হলো ইলেকট্রনিক কেবিনেট। সুইচ অন্ করে দেয়ার পর প্রথম জন একঘেয়ে গলায় বলে উঠল : “বাচ্চাটার নিঃশ্বাস আর হার্টবিট রেকর্ড করা হবে।”

ডাক্তার মাথা নাড়তেই এভাবে প্রথম লোকটা গিয়ে দাঁড়াল ক্যামেরার সামনে।

“তুমি হচ্ছ লাল গোলাপ” কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে নামের উপর জোর দিল লোকটা।” ভবিষ্যতে এই নাম ধরে তোমাকে যা যা করতে বলা হবে, তুমি তাই করবে।”

এরপর নিচু হয়ে এক হাতে নিকি’র দুই গোড়ালি ধরে তুলে ফেলে, আবার জানালো, “এবারে দেখ অবাধ্যতার পরিণাম।”

নিকি’কে ধরে দোলাতে দোলাতে মাথা নিয়ে পানিতে চুবিয়ে দিল লোকটা। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল নিকি’র খিলখিল আওয়াজ। ভিডিও ক্যামেরা জুম করতেই দেখা গেল পানির নিচে ছোট্ট মাথা।

উন্মাদের মতো চিৎকার করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে চাইল ইসাবেলা। পেছন থেকে দুই নারী কাঁধ চেপে আবার ওকে জোর করে বসিয়ে দিল।

ওদিকে পর্দার লোকটার হাতের মধ্যে যুদ্ধ করছে নিকি। নাকের থেকে উঠে আসছে রুপালি বুদবুদ। ফুলে কালো হয়ে গেল চেহারা।

তখনো সমানে চিৎকার করছে ইসাবেলা এমন সময় পর্দার মাস্ক পরিহিত ডাক্তার হার্ট মনিটরের দিকে তাকিয়েই স্প্যানিশে চিৎকার করে উঠলঃ “থামোয় যথেষ্ট হয়েছে কমরেড়!”

সাথে সাথে নিকি’কে ট্যাঙ্ক থেকে তুলে ফেলল প্রথমজন। নিকি’র নাক মুখ থেকে গলগল করে পানি বেরিয়ে এলো। বহুক্ষণ পর্যন্ত একটাও শব্দ করতে পারল না ছোট্ট শরীরটা।

এরপর ডাক্তার ওর ভেজা মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিয়ে বুকে চাপ দিল নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করার জন্য। মিনিট খানেকের মধ্যে ইলেকট্রনিক মনিটরের রিড আউট নরম্যাল হয়ে গেল। নিকি আবার হাত পা ছুঁড়তে লাগল। ভয় পেয়ে মুখের মাক্স ধরে টানছে আর চিৎকার করে কাঁদছে।

মাস্ক সরিয়ে নিয়ে টেবিলের কাছ থেকে চলে গেল ডাক্তার। প্রথম লোকটাকে মাথা নেড়ে ইশারা দিতেই আবারো নিকি’র গোড়ালি ধরে ট্যাঙ্কের উপর নিয়ে গেল লোকটা। কী ঘটবে বুঝে গেল নিকি। জোরে কেঁদে উঠে, ছুঁড়তে চাইল।

“হি ইজ মাই সন!” কেঁদে উঠল ইসাবেলা, “আপনি থামুন ওর সাথে এরকম কেন করছেন!”

আবারো ছোট্ট মাথাটাকে পানিতে চুবিয়ে দিল প্রথম লোকটা। প্রাণপণে লড়াই করছে নিকি। আবারো রঙ হারালো ওর চেহারা।

চিৎকার করে উঠল ইসাবেল, “থামুন। যা যা বলবেন আমি সব করব, শুধু আমার ছোট্ট বাবুটাকে কষ্ট দেবেন না। প্লিজ! প্লিজ!”

আরো একবার ডাক্তারের তীঃ স্বর শুনে নিকি’কে উপরে তুলে ফেলল লোকটা। এবারে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে ছোট্ট দেহটা। বমি মেশানো পানি বেরিয়ে এলো খোলা মুখ থেকে। ফুলে যাওয়া নাক থেকে গড়িয়ে পড়ল রুপালি সিকনি।

খুব দ্রুত হাতে কাজ শুরু করল ডাক্তার। বোঝাই যাচ্ছে যে কোন কারণে ভয় পাচ্ছেন। ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে সরাসরি ইসাবেলার দিকে তাকালো প্রথম লোকটা।

“আরেকটু হলেই হিসেবের গড়বড় হয়ে যাচ্ছিল। সেফটি লিমিট ক্রস হয়ে গেছে।” এরপর ডাক্তারসহ দু’জনে মিলে খানিক আলাপ সেরে নিলেও কিছুই বুঝল না ইসাবেলা। তারপর আবারো কথা বলে উঠল প্রথম জন, “আজ তাহলে এটুকুই থাক। আশা করছি আর কখনো দেখার প্রয়োজন পড়বে না তোমার। অ্যানেশথেসিয়া ছাড়াই বাচ্চাটার একের পর এক অঙ্গ কেটে ফেলা কিংবা ক্যামেরার সামনে গলা টিপে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। তারপরেও সবকিছু নির্ভর করবে তোমার উপর। তুমি আমাদের সাথে কতটা সহযোগিতা করবে তার উপর।”

ঝাপসা হতে হতে খালি হয়ে, গেল পর্দা। ইসাবেলার ফোপানির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেল না অন্ধকার থিয়েটারের ভেতরে। এভাবেই কেটে গেল বহুক্ষণ। এরপর আস্তে আস্তে থেমে গেল সব শব্দ। বাতি জ্বলে উঠতেই ইসাবেলা’র কাছে এলেন জোসেফ সিসেরো।

“এহেন কাজে আমরা কেউই আসলে কোনো আনন্দ খুঁজে পাইনা। তাই ভব্যিষৎতেও চেষ্টা করব যাতে পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে চলা যায়।”

“কেমন করে এটা পারলেন!” ভগ্ন হৃদয়ে বলে উঠল বেলা, “ছোট্ট একটা বাচ্চার সাথে কোনো মানুষ কিভাবে এমনটা করতে পারে?”

“আমি আবারো বলছি, এতে আমরা কোনো আনন্দ পাই না। তুমি নিজেই অপরাধী, লাল গোলাপ। তোমার অবাধ্যতার কারণেই কষ্ট পেয়েছে তোমার ছেলে।”

“কষ্ট! একটা অবুঝ শিশুর উপর নির্যাতন করে একে কষ্ট বলছেন…?”

“সামলাও নিজেকে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিসেরো’র গলা।

‘সন্তানের খাতিরে নিজের অবাধ্যতা কমাও।”

“আমি দুঃখিত।” অপোবদনে জানাল ইসাবেলা। “আর কখনো এরকম করব না। শুধু নিকি’কে আর আঘাত করবেন না, প্লিজ।”

“তুমি যদি সহযোগিতা করো, তাহলে ওর কিচ্ছু হবে না। দক্ষ সিস্টার ওর দেখা শোনা করছেন। এতটা যত্ন পাবে যা হয়ত তুমিও দিতে পারতে না। পরবর্তীতে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হবারও সুযোগ পাবে যা কেবল তরুণেরা স্বপ্নেই দেখে।”

হাঁ করে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা, “এমনভাবে কথা বলছেন যেন ওকে আমার কাছ থেকে চিরতরের জন্য নিয়ে গেছেন। যেন আমি আমার সন্তানকে আ র কখনো দেখতে পারব না।”

কাশি দিয়ে মাথা নাড়লেন সিসেরো, “ব্যাপারটা তা নয়’ লাল গোলাপ। ছেলের কাছে যাবার সুযোগও তোমাকে দেয়া হবে। শুরুতে নিয়মিত সব খবর পাবে। ভিডিও রেকর্ডিং এর মাধ্যমে দেখবে ও কিভাবে বড় হয়ে উঠছে, একা একা বসতে পারে, হামাগুড়ি দিতে পারে, হাঁটতে শিখবে।”

“ওহ্! না! এভাবে তো মাসের পর মাস লেগে যাবে। এতদিন তো ওকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেন না।”

এমনভাবে কথা বলে চলল সিসেরো, যেন বেলা কিছুই বলেনি, “এরপর প্রতি বছর ওর সাথে কিছু সময় কাটাতে পারবে। এমনো হতে পারে যে তোমার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে ছেলের সাথে হলিডে কাটাবার সুযোগও দেয়া হবে-দিন এমনকি সপ্তাহ’ও কাটাতে পারবে ছেলের সঙ্গে।”

“না!” আবারো ফোঁপাতে লাগল বেলা।

“কে জানে কোন একদিন হয়ত সব বাধা তুলে নেয়া হবে। যখন তখন ছেলেকে কাছে পাবে। তবে এসব কিছুর জন্য তোমাকে অর্জন করতে হবে আমাদের বিশ্বাস আর কৃতজ্ঞতা।”

“কে আপনারা?” আস্তে করে জানতে চাইল ইসাবেলা, “রামোন মাচাদো’ই বা কে? ভেবেছিলাম বুঝি ওকে চিনি অথচ সেটা একটু’ও সত্যি না। কোথায় রামোন? ও’ ও কি এই দানবীয় কাজের অংশ…?” গলা ধরে গেল। শেষ করতে পারল না বেলা।

“এ জাতীয় চিন্তা মাথা থেকে বের করে দাও। আর আমরা কে এর উত্তরও খুঁজতে যেও না।” সাবধান করে দিলেন সিসেরো। “রামোন মাচাদো’ও আমাদের হাতের মুঠোয়। ওর কাছ থেকে কোনো সাহায্যের আশা করো না। সন্তান তার’ও; একই নির্দেশ পালন করতে তোমার মতই বাধ্য সে।

“আমাকে কী করতে হবে?” শান্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইল বেলা। তপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিসেরো। যাক আর কোনো সম্ভাবনা নেই যে এই মেয়ে কোনোদিন মাথা তুলবে কিংবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। মনোবিজ্ঞানীর রিপোর্টও তাই বলে; তারপরেও ক্ষীণ যে দুশ্চিন্তা ছিল তা আজ কেটে গেল। যেভাবে তাকে বঁড়শিতে গাঁথা হয়েছে তা কখনো ছিঁড়বে না। বাচ্চাটা যদি মারাও যায়, আরেকটাকে ধরে এনে ভিডিও গেম খেলা যাবে। ওদের ইশারাতেই এখন নাচবে মেয়েটা।

“সবার প্রথমে তোমার ডক্টরেট প্রাপ্তিতে অভিনন্দন জানাচ্ছি, লাল গোলাপ। আমাদের জন্য কাজ করতে এখন আরো সুবিধা হবে তোমার।”

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। এরকম ভয়ংকর মানসিক যাতনার পর হঠাৎ করে একথা শুনে মনে হলো তাল হারিয়ে ফেলবে। যাই হোক বুঝতে পারল মন দিয়ে শুনতে হবে লোকটার কথা।

“অনুপস্থিত অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী গ্রহণের ব্যবস্থা করে যত দ্রুত সম্ভব কেপটাউন তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবে, বুঝতে পেরেছ?”

মাথা নাড়ল বেলা। “বাড়িতে ফিরে পারিবারিক সব কাজে আগ্রহ দেখাবে। বিশেষ করে বাবার কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলবে। সব কিছুতেই ওনার সহাযযাগিতা করব। বিশেষ করে আর্মামেন্টস করপোরেশনের হেড হিসেবে যে দায়িত্ব তিনি পালন করছেন। এর পাশাপাশি যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়বে।”

“আমার বাবা আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ। আমাকে উনার কোনো প্রয়োজন নেই।”

“ভুল বলছ। তোমার বাবা খুব একা আর অসুখী একজন মানুষ। তোমার দাদীমা আর তুমি ছাড়া আর কোনো রমণীর সাথেই উনার দীর্ঘমেয়াদে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। আর এই প্রয়োজন মেটাবে তুমি।”

“আপনি চান আমি নিজের বাবাকে ব্যবহার করব?” ভীত স্বস্ত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেলা।

“যদি তোমার সন্তানকে বাঁচাতে চাও।” মোলায়েম স্বরে একমত হলেই সিসেরো। “তোমার বাবার কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু তুমি যদি সাহায্য না করো, ছেলের মুখ আর কোনোদিন দেখবে না।”

হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নাক মুছল ইসাবেলা।

“তার মানে বাবার কাছ থেকে তথ্য এনে আপনাকে দিতে হবে তাই তো?”

“তুমি তো বেশ তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখে ফেলো। যাই হক, এটুকুই যথেষ্ট না। দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনালিস্ট রেজিমের ভেতর বাবার যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও গড়ে তুলবে।”

মাথা নাড়ল বেলা, “আমি তো রাজনীতির কিছুই বুঝি না।”

“উঁহু-হু বোঝ?” বেলা’কে থামিয়ে দিলেন সিসেরো।

“পলিটিক্যাল থিওরীর উপর তোমার ডক্টরেট আছে। ক্ষমতার সিঁড়ি বাবা-ই দেখিয়ে দেবেন তোমাকে।”

আবারো মাথা নাড়ল বেলা। “রাজনীতিতে বাবার অবস্থান তো আগের মতো শক্ত নেই। অতীতের কিছু ভুলের জন্য এখানে কূটনৈতিক হিসেবেও আসতে হয়েছে।”

“লন্ডনে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখানোর বদলে গেছে এ চিত্র। এর প্রমাণ হল আর্মসকোর’এ এত বড় পদ পাওয়া। আমাদের ধারণা শীঘ্রিই দলেও ডাক পাবেন। জোর সম্ভাবনা হচ্ছে দুই বছরের মধ্যেই কেবিনেটে আবো একবার সদস্য হবার সুযোগ পাবেন। আর তাকে কাজে লাগিয়ে, লাল গোলাপ তুমি হয়ত বছর বিশেকের মধ্যেই সরকারের মন্ত্রী হয়ে যাবে।”

“বিশ বছর!” অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠল ইসাবেলা, “এত বছর ধরে আমাকে আপনার দাস হয়ে থাকতে হবে?”

“তুমি এখনো বুঝতে পারোনি?” এবারে অবাক হলেন সিসেরো, “শোন, লাল গোলাপ, তুমি, তোমার পুত্র, রামোন মাচাদো, তোমরা সকলেই আমাদের সম্পত্তি।”

বহুক্ষণ ধরে কালো পর্দাটার দিকে দৃষ্টিহীনের মতো তাকিয়ে রইল ইসাবেলা।

অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গলেন সিসেরো। প্রায় বিনয়ীর সুরে জানালেন, “এখন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে। যেখান থেকে এসেছিলে, সেখানে। নির্দেশগুলো মেনে চলো। আখেরে মা-ছেলে দুজনেরই লাভ হবে।”

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নারী ইসাবেলা’কে ধরে দাঁড় করিয়ে নিয়ে গেল দরজার দিকে।

মেয়েরা বেরিয়ে যেতেই লেকচার থিয়েটারের পাশের দরজাটা খুলে ভেতরে এলো রামোন। “তুমি দেখেছ সবকিছু?” সিসেরোর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল মাচাদো।

“ভালোভাবেই চলছে সবকিছু। এই অপারেশন থেকে মনে হচ্ছে বেশ লাভ হবে। বাচ্চাটা কেমন আছে?”

“একেবারে সুস্থ। নার্স ওকে নিয়ে হাভানাতে পৌঁছে গেছে।”

আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লেন সিসেরো।

হয়ত…মনে মনে ভাবলেন, সারা জীবনের সাধনার ধন ডিপার্টমেন্টের ভার দক্ষ হাতেই দিয়ে যেতে পারব।

***

অ্যাম্বার জয় বুঝি এবার হেরেই গেল। মাঠের সবার ভেতর ছড়িয়ে গেল প্রত্যাশা আর টেনশন।

প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে শিকার করা পাখি ফিরিয়ে আনার সাউথ আফ্রিকার রিট্রিভার চ্যাম্পিয়নশীপের আসর বসেছে ওয়েল্টেভেদেন এস্টেটের পশ্চিমে কাবোনকেল বার্গের পাদদেশে। দুই দিন শেষে এখন টিকে আছে অবশিষ্ট চারটি কুকুর।

এবারই হয়ত বুনো হাঁস ব্যবহার করার শেষ সুযোগ পাওয়া গেল; মনে মনে ভাবলেন শাসা কোর্টনি। এ মাসের শেষ দিক থেকেই এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ডিপার্টমেন্ট অব নেচার কনজারভেশন। এরপর থেকে বাধ্য হয়ে তাই ঘুঘু কিংবা গিনি ফাউল ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এই পাখিগুরো পানির উপর তেমন ভাসতে পারে না।

যাই হোক আসরে মন দিলেন শাসা কোর্টনি। এবার ওয়েন্টেত্রেদেন কাপের আশার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধী হল এই বিশার হলুদ ল্যাব্রাডার কুকুরটা। গত দুদিনে একবারও পরাজিত না হওয়া অ্যাম্বার জয়ের আজ ভাগ্যটাই খারাপ। খাঁচা থেকে বের হয়েই বাঁধের কিনারে উড়ে গেল বুনো হাঁস। এবারে গুলি করার দায়িত্ব গ্যারি আর শাসা কোর্টনি’র। বুনো হাঁস বাম দিকে গ্যারির নিশানায় যেতেই পরিষ্কারভাবে মেরে ফেলল গ্যারি। পাখি ভজ করে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পানিতে নেমে গেল পাখিটা।

জাজ অ্যাম্বার জয়ের নাম্বার ধরে ডাক দিতেই কুকুরটাকে পাঠিয়ে দিল মালিক বান্টি চার্লস। বাঁধের দেয়ালের কাছে ভিড় করে এলো উৎসুক জনতা। কুকুরটাকে পানির কাছে নিয়ে যেতেই সাঁতরে চলে গেল বুনো হাঁসটা যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেখানে।

কিন্তু মাঝে মাঝে পানির নিচে ডুব দিলেও প্রতিবারেই খালি চোয়াল নিয়ে ফিরে আসছে কুকুরটা। হতাশায় নাচানাচি করছে বান্টি চার্লস। কাঙিক্ষত জায়গাটা থেকে খানিকটা সরে’ও গেছে কুকুরটা। তবে হুইসল দিয়ে এটাকে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনারও উপায় নেই। তাহলে পয়েন্ট হারাবে মালিক। এদিকে সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বারে বারে স্টপ ওয়াচ দেখছেন তিন বিচারক। তিন মিনিটেরও বেশি সময় ধরে পানিতে আছে অ্যাম্বার জয়।

উদ্বিগ্ন মুখে লাইনের পরবর্তী কুকুর আর মালিকের দিকে তাকালো বান্টি চার্লস। তার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ওয়েল্টেভেদেন থেকে আসা সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম আর ড্যান্ডি ল্যাস। এদের চেয়ে মাত্র দশ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও এবার বুঝি আর পারল না অ্যাম্বার জয়।

ওদিকে সেনটেইন কোর্টনি নিজেও বেশ টেনশনে আছেন। মাত্র কিছুদিন আগেই যোগ দিয়েছেন এ খেলাতে; তাই বান্টির মতো ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু বেশ যত্নে গড়ে তুলেছেন ড্যান্ডি ল্যাসকে। অত্যন্ত গভীর কিংবা ঠাণ্ডা পানিও কোনো বাধাই নয় এই হিরোইনের কাছে। বাতাসের পালকের হালকা গন্ধকেও ঠিকই শুঁকে নেয় ড্যান্ডির নাক। এছাড়া সেনটেইন আর ড্যান্ডির মাঝের সম্পর্ক তো প্রায় টেলিপ্যাথির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

চুপচাপ। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছেন সেনটেইন কোর্টনি। যা ঠিকই টের পেয়েছে ড্যান্ডি ল্যাস। মৃদু শব্দ কিংবা জোরে গর্জন, যে কোনো ক্ষেত্রেই সাথে সাথে খেলা থেকে বের করে দেয়া হবে। তাই অ্যাম্বার জয়ের নাকানি চুবানি দেখে বহুকষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে ড্যান্ডি ল্যাস। কিন্তু আগ্রহ আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তখন আসবে তার টান। কয়েক সেকেন্ড পর পরই সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে ছুটে যাওয়ার অনুমতি চাইছে।

গান-লাইন থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শাসা কোর্টনি। বরাবরের মতই প্রশংসায় মুগ্ধ হলেন শাসা। গত নিউ ইয়ারস ডে’তে সত্ত্বর পূর্ণ করা সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এখনো দেখতে ঠিক টিন এজ ছেলেদের মত। পরিহিত উলের পোশাক ভেদ করেও ফুটে বের হচ্ছে অনিন্দ্য দেহ সৌষ্ঠব।

শাসা’র জন্মের আগেই ফ্রান্সের যুদ্ধে মারা গেছেন শাসা’র বাবা। তখন থেকেই একা হাতে ছেলেকে বড় করে তুলেছেন সেনটেইন। মরুভূমির বুকে একাকী খুঁজে পেয়েছেন প্রথম হীরা, যা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হানি খনি। ত্রিশ বছর ধরে এই খনি সামলে গড়ে তুলেছেন এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য যা আজকের কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। শাসা আর তার পরে গ্যারি কোর্টনি এখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেলেও এখনো নিয়মিত বোর্ডের সভায় আসেন সেনটেইন। সকলে অত্যন্ত মনোযোগ আর শ্রদ্ধা নিয়ে মেনে চলে তার প্রতিটি বাক্য।

শাসা থেকে শুরু করে গ্যারি’র ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত সকলেই এক বাক্যে মানতে বাধ্য তার প্রতিটি আদেশ।

বয়স কেড়ে নিতে পারেনি তার সৌন্দর্য; বরঞ্চ এক অন্যরকম মহিমা। লেপন করে দিয়েছে। গর্বিত গাল, বুদ্ধিদ্বীপ্ত উন্নত কপাল। কালো জোড়া চোখ; যা এখন যদি হয় নিষ্ঠুর শিকারীর মতন, পর মুহূর্তেই তা ভরে উঠে কৌতুক আর প্রজ্ঞায়।

বিচারকদের একজন হুইসেল দিতেই অসন্তুষ্টিতে ঝুলে পড়ল বান্টি চার্লসের কাঁধ। ব্যর্থ হওয়াতে তুলে আনা হল অ্যাম্বার জয়’কে।

এরই মাঝে প্রস্তুত হয়ে গেছে ড্যান্ডি ল্যাস। আগ্রহের চোটে রীতিমতো কাঁপছে। জানে এরপর কাকে ডাকা হবে।

কুকুরটার দিকে না তাকিয়েও নিজের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মনে হল পশুটাকে শান্ত করে রেখেছেন সেনটেইন। ইচ্ছে করে দেরি করছেন বিচারকেরা, একে অন্যের সাথে পরামর্শ করার ভান করছেন, নোট লিখছেন; আদতে ড্যান্ডি লেসের ধৈর্য পরীক্ষা করছেন। যে কোনো ধরনের শব্দ করলেই বাদ্য দিয়ে দেয়া হবে কুকুরটাকে।

বাস্টার্ড! মনে মনে ক্ষেপে উঠলেন সেনটেইন।

অবশেষে নোট বুক থেকে চোখ তুলে তাকালেন সিনিয়র জাজ।

“থ্যাঙ্ক ইউ, নাম্বার থ্রি।” জাজের চিৎকার শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন সেনটেইন; “যা!” সোনালি বর্শার মতো করে ছুটে গেল ড্যান্ডি ল্যাস।

পানির কাছে এসে সামনের পাগুলোকে ভাজ করে লাফ দিল ড্যান্ডি। গর্বে সেনটেইন কোর্টনির বুক ভরে গেল একেই বলে চ্যাম্পিয়ন।

কিন্তু একটু পরেই ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড়। অ্যাম্বার জয়ের মতো একই ভুল করতে যাচ্ছে ড্যান্ডি। হয়ত অতিরিক্ত দেরি হওয়াতেই জায়গাটা ভুলে গেছে কুকুরটা।

একবারের জন্য মনে হল হুইসল বাজিয়ে ড্যান্ডিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবেন, তাতে কিছু পয়েন্ট খোয়া গেলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু এরই মাঝে বিজয়ের ভাবনায় বিভোর সেনটেইন দাঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মতো মুখ করে।

পানির মাঝে ঘুরপাক খেতে খেতে তীরে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে তাকাল ড্যান্ডি ল্যাস।

ইচ্ছে করেই নিজের বাম হাত’কে কোমরের কাছের পকেটে ঢোকালেন– সেনটেইন। ঈগলের মতো শ্যেন দৃষ্টিঅলা বিচারকদের কেউই বুঝতে পারল না এই ইশারা; কিন্তু শাসা’র চোখ এড়ালো না।

“এই বুড়ী আর বদলাবে না। মনে মনে হাসলেন শাসা। যুদ্ধে জেতার জন্য যে কোনো অস্ত্র ব্যবহারে প্রস্তুত।”

ওদিকে পানির মধ্যে সাথে সাথে বাম দিকে ঘুরে গেল ড্যান্ডি ল্যাস। স্রোতের বিপরীতে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এগোতে এগোতেই গন্ধ পেয়ে নাক উঁচু করে ফেলল পশুটা। বুনো হাসের রক্তের গন্ধ পেয়েই মাথা ডুবিয়ে দিল ঠাণ্ডা বাদামি রঙা পানির ভেতরে।

অন্যদিকে তীরের দর্শকেরা হাত তালি দিয়ে উঠল। আবারো মাথা তুলল ড্যান্ডি, কান দুটো লেপ্টে গেছে মাথার সাথে, দাঁতের ফাঁকে ঝুলছে বুনো হাঁস।

তীরে উঠে একটুও গা ঝাড়া দিল না ড্যান্ডি; এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে দৌড়ে এলো ডেলিভারী পৌঁছে দিতে।

ড্যান্ডি মায়ের সামনে এসে এমনভাবে বসে গেল যে দেখে শাসা’র চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কেমন অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই নারী আর কুকুরটার মাঝে।

ড্যান্ডি’র মুখ থেকে বুনো হাঁসের মৃতদেহটা নিয়ে বিচারকদের কাছে। গেলেন সেনটেইন। পাখা সরিয়ে খুব সাবধানে “দাঁতের দাগ দেখা যায় কিনা খুঁজে দেখলেন বিচারকেরা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন, যতক্ষণ পর্যন্ত না শুনলেন, “ধন্যবাদ, নাম্বার থ্রি।”

***

সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম শুধু যে প্রতিযোগীতার জন্য ভেন্যু ঠিক করে দিয়েছেন তাই না, প্রাইজ গিভিং সেরেমনির’র হোস্টেজ’ও তিনিই।

এস্টেটের মেইন পোলো ফিল্ডের উপর পাঁচশো অতিথি বসার মতো তবু টানানো হল। ওয়েল্টে ভ্রেদেরনর রান্নাঘর থেকে এলো সুস্বাদু, মুখরোচক সব খাবার। বিজয়ীকে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দিতে রাজি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জন ভরসটার।

ভারউড কেবিনেটের একটা অংশের সদস্য থাকাকালীন, জন ভরসটারের ক্ষমতায় আরোহণের বিরোধিতা করেছিলেন শাসা কোর্টনি। ফল হিসেবে লন্ডনে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু পুত্রের হারানো জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য নিজের দক্ষতা আর ক্ষমতা দিয়ে লড়ে গেছেন সেনটেইন। এমনকি শাসা’র আর্মসকোরের নিয়োগ প্রাপ্তির পেছনেও কাজ করেছে সেনটেইনের হার না মানা মনোভাব, অক্লান্ত পরিশ্রম আর রাজনৈতিক আর আর্থিক প্রভাব।

ভেবে দেখেছেন, কোর্টনিদের জন্য নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা করবে এস্টেটে জন ভরস্টারের আগমন। ক্ষমতাবানদের প্রায় প্রত্যেকেই আজ এখানে। উপস্থিত। এদের কেউই সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম’কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাবার সাহস না করলেও শাসা লন্ডনে থাকাকালীন অনেকেই বেশ শীতল আচরণ দেখিয়েছে। ভিড়ের মাঝে এদের দেখে তাই চিনে রাখলেন সেনটেইন।

কাকতালীয়ভাবে তাঁর আত্মতৃপ্তি যেন টের পেয়ে গেলেন সাউথ আফ্রিকান কেনেল ইউনিয়নের সভাপতি। মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করলেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিযোগিতা সম্পর্কে খানিক আলোচনার পর বিজয়ীদেরকে একে একে ডাকলেন সামনে আসার জন্য। সবার শেষে টেবিলের মাঝখানে পড়ে রইল সবচেয়ে লম্বা আর সুন্দর কারুকার্য করা রুপার ট্রফিটা।

“এখন আসরের চ্যাম্পিয়নকে ডাকার সময় হয়েছে।” তাঁবু’র চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিবারসহ একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে তাকালেন সভাপতি।

লেডিস অ্যাস্ত জেন্টলম্যান, আসুন সবাই, ওয়েল্টেভ্রেদেনের ড্যান্ডি ল্যাস আর মিসেস সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস’কে স্বাগত জানাই।”

ড্যান্ডি ল্যাসের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ইসাবেলা, এবারে কুকুরটাকে এগিয়ে দিল দাদীমার দিকে। হাততালি দিয়ে উঠল সমস্ত দর্শক।

ড্যান্ডির শরীরে কোর্টনিদের পারিবারিক চিহ্ন রুপার ডায়মন্ডের নকশা করা ফিটেও ব্লাঙ্কে। সেনটেইনের সাথে সাথে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে। দেখে হাসতে হাসতে হাত তালি দিল দর্শকের দল।

মঞ্চের উপর প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে মনিবের নির্দেশে ডান পা বাড়িয়ে দিতেই হট্টগোলে ফেটে পড়ল জনতা। জন ভরসটার নিজেও খানিক নিচু হয়ে আদর করে দিলেন ড্যান্ডি ল্যাসকে।

এবারে রুপার বিশাল ট্রফিটা সেনটেইনের হাতে দিয়ে হাসলেন প্রধান মন্ত্রী। নিষ্ঠুর ক্ষমতা আর গ্রানাইটের মতো মনোবলের অধিকারী বিখ্যাত মানুষটার বালক সুলভ হাসির সাথে ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁর নীল চোখ জোড়া।

সেনটেইনের সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, “এরকম নিরবচ্ছিন্ন সফলতা তোমাদের কাছে একঘেয়ে লাগে না সেনটেইন?”

“আমরা বরঞ্চ একে টিকিয়েই রাখতে চাই, আংকেল জন।” নিশ্চয়তা দিলেন সেনটেইন।

এরপর সেনটেইনকে অভর্থনা জানিয়ে খানিক বক্তৃতা দিয়ে তাঁবুর নিচে ঘুরে ঘুরে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর এগিয়ে গেলেন একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে।

“তোমার বিজয় উদ্যাপনের জন্য আরেকটু বেশি সময় থাকতে পারলে ভালই লাগত, সেনটেইন।” হাতঘড়ির দিকে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।

“এরই মাঝে আপনি আমাদেরকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, কিন্তু যাবার আগে আমার নাতনীর সাথে দেখা করবেন না?” কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ইসাবেলাকে ডাকলেন সেনটেইন। “শাসা লন্ডনে থাকাকালীন হোস্টেজের দায়িত্ব পালন করেছে আমার নাতনী ইসাবেলা।”

ইসাবেলা সামনে এগিয়ে আসতেই প্রধানমন্ত্রীর বুলডগ মার্কা চেহারাটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেন সেনটেইন। জানেন ত্রিশ বছর ধরে সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করলেও ইসাবেলা কোর্টনি’কে দেখে স্থির থাকতে পারবেন না। কোনো পুরুষ। চোখে আগ্রহ ফুটে উঠলেও কেমন করে ভ্রুকুটি করে তা আড়াল করলেন প্রধানমন্ত্রী, এর সবই দেখলেন সেনটেইন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার ইসাবেলা’র আগ্রহটা হঠাৎ হলেও মুগ্ধ হয়েছেন শাসা আর সেনটেইন। আর তারপরই নাতনীকে সাথে নিয়ে খুব সাবধানে এই মিটিং এর প্ল্যান করেছেন।

“ও ঠিকই পারবে।” শাসার ভবিষ্যৎ বাণী শুনেও মাথা নেড়েছিলেন সেনটেইন।

“বেলা অনেক বদলে গেছে। তোমার সাথে লন্ডনে যাবার পরেই কিছু একটা হয়েছে নয়ত যে মেয়েটা আগে ছিল বখে যাওয়া আর

“ওহ্! মা মেয়ের স্বপক্ষে বলতে চাইলেন শাসা।

“কিন্তু ফিরে এসেছে এক পরিণত নারী। তার চেয়েও বেশি। কেমন ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে গেছে। কিছু একটা নিশ্চিত ঘটেছে।” দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন। “জীবন নিয়ে এখন আর রোমান্টিক কিছুভাবে না; ঠিক যেন ভয়ংকর কোনো আঘাত পেয়ে ঘৃণা করা শিখে গেছে। সংকটে পড়ে জেনে গেছে নিজের কঠিন ভবিষৎ।”

“তুমি তো কখনো এমন উদ্ভট সব কল্পনায় বিশ্বাস করতে না।” মাকে থামাতে চাইলেন শাসা।

“আমার কথা মনে রেখো, বেলা নিজের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে আর আমাদের মতই শক্ত আর নির্দয় হয়েই নিজেকে প্রমাণ করে দেখাবে।”

“তোমার মতো এত বজ্রকঠিন নয় নিশ্চয়ই?”

“মাকে নিয়ে মজা করলেন শাসা।”

“সময় হলে দেখবে আমার কথাই সত্যি হয়েছে শাসা কোর্টনি। নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলেন সেনটেইন। মায়ের এই আত্মপ্রত্যয় ভালোই চেনেন শাসা। “ও অনেক দূর যাবে শাসা-এতটা, যতটা হয়ত তুমি আর আমি কেবল স্বপ্নই দেখেছি। যাই হোক, আমি আমার সাধ্যমতো ওকে সাহায্য করব।”

আর এখন নাতনীর মাঝে সেই ঋজুতাই দেখতে পেলেন সেনটেইন।

“তো ইংল্যান্ডের শীতকাল কেমন লাগল তোমার?” ইসাবেলার কাছে জানতে চাইলেন ভরসটার। মনে মনে আশা করলেন চপল কোনো উত্তর শুনবেন। কিন্তু চমককৃত হয়ে গেলেন বেলার জবাব শুনে বুঝতে পারলেন এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে অদম্য মেধা। গলার স্বর নামিয়ে খানিক আলোচনা সেরে নিলেন বেলার সাথে। এরপর আবারো তাগাদা নিলেন সেনটেইন, “এই তো কদিন আগে মাত্র লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল থিওরীর উপরে ডক্টরেট করেছে ইসাবেলা।”

“ওহ! তাই নাকি। তো আমাদের মাঝে আরেকজন হেলেন সুজমান আসছেন!” মাথা নেড়ে সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্টের একমাত্র নারী সদস্যের কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী।

হেসে ফেলল ইসাবেলা। তার সেই বিখ্যাত যৌনাবেদনময়ী হাসি। যা দেখে সবচেয়ে কঠিন নারী বিদ্বেষী’ও টলে উঠতে বাধ্য।

“সম্ভবত। হাউজে একটা আসন পাওয়া আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও হতে পারে। কিন্তু সে তো এখনো বহু দূর। তাছাড়া আমার বাবা আর দাদীমা’র নীতিতেই বিশ্বাসী আমি, প্রধানমন্ত্রী। তার মানে মেয়েটা কনজারভেটিভ! এবারে আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ভরসটারের নীল চোখ।

“দুনিয়া বদলাচ্ছে। মিঃ প্রাইম মিনিস্টার। কোনো একদিন হয়ত আপনার কেবিনেট মেম্বারও হবে নারী, তাই না?” আলতো করে আগুনে ঘি ঢাললেন সেনটেইন।

হেসে ফেললেন ভরসটার। দ্রুত আবার ইংরেজ থেকে আফ্রিকান হয়ে গেলেন।

“ডক্টর কোর্টনি নিজেও সে দিন’কে বহু দূর হিসেবে ভাবছে। যাই হোক আমাদের মতো বুড়োদের ভিড়ে এমন সুন্দর মুখ দেখতে খারাপ লাগবে না।”

ভাষার এই পরিবর্তন অনেকটা ইচ্ছাকত। কেননা আফ্রিকান ভাষা জানা ব্যতীত রাজনৈতিক উচ্ছাকাঙ্ক্ষা পূরণ অসম্ভবই বলা চলে।

কিন্তু এই পরীক্ষাও উৎরে গেল ইসাবেলা। ওর নিখুঁত ব্যাকরণ, শব্দ ভাণ্ডার আর সুললিত কণ্ঠস্বর শুনে যে কেউ মুগ্ধ হবে।

এবারে আনন্দ নিয়েই হাসলেন ভরসটার। আরো খানিক কথা বলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেনটেইনকে জানালেন, “এবারে আমাকে যেতে হবে। আরেকটা ফাংশন আছে।”

তারপর ইসাবেলাকে বললেন, ‘আবার দেখা হবে ডা. কোর্টনি।

গাড়ি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে দিলেন শাসা আর সেনটেইন।

ফিরে আসতেই দেখা গেল ইসাবেলার চারপাশে পুরুষদের ভিড় জমে গেছে।

“দেখ কাণ্ড! বেলাকে দেখে সবকটা কুকুর ছানার মতো হাপাচ্ছে। মনে মনে হাসি চেপে নাতনীর দিকে তাকালেন সেনটেইন। সাথে সাথে দাদীর দিকে এগিয়ে এলো ইসাবেলা। আদর করে ওর হাত ধরলেন সেনটেইন। “ওয়েল ডান, বাছা, আংকেল জন তো খুবই খুশি। আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। কী বল?

***

ওয়েল্টেভ্রেদেনের মেইন ডাইনিং রুমের লম্বা টেবিলটাতে ডিনার করতে বসেছে পুরো কোর্টনি পরিবার। চারপাশ সুরভিত করে রেখেছে মোমাবাতি আর একগাদা হলুদ গোলাপ।

এহেন পারিবারিক সন্ধ্যায় সরাচর যা হয়, পুরুষেরা কালো টাই আর নারীরা লম্বা ড্রেস পরে এসেছে।

শুধু শন্ অনুপস্থিত। শ’কেও ডেকেছিলেন সেনটেইন; কিন্তু শিকার অভিযানে ক্লায়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অপারগতা জানিয়েছে শন।

জ্যেষ্ঠ পৌত্রকে বেশ মিস করছেন সেনটেইন। তিন ভাইয়ের মধ্যে শন হচ্ছে সবচেয়ে সুদর্শন আর স্বভাবে’ও বন্য। নিজের চারপাশে সবর্দা বিপদ আর উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি করে রাখে শন্। আর এ কারণে মাঝে মাঝেই শত শত ডলার গুণতে হয় কোর্টনি পরিবারকে। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ না করলেও সেনটেইনের একমাত্র চিন্তা কবে না ছেলেটা এমন এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে যে, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সত্যিই কঠিন হবে। যাই হোক জোর মাথা থেকে এ জাতীয় চিন্তা সরিয়ে দিলেন সেনটেইন।

আজ রাত শুধুই আনন্দের।

লম্বা টেবিলটার একেবারে মাঝখানে আলো ছড়াচ্ছে রুপার ট্রফি। অজস্র ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রমের যথার্থ ফসল এই ট্রথি।

টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা শাসা রুপার চামচ দিয়ে ক্রিস্টালের গ্লাসে টুং টাং করে ভাঙ্গলের নীরবতা। স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে শুরু করলেন বক্তৃতা-এতটা সহজ আর বুদ্ধিদ্বীপ্ত, কৌতুকে ভরা থাকে এ অংশ যে ক্ষণিকের মধ্যেই হাসির হল্লার সাথে সাথে গভীর চিন্তা করতেও বাধ্য হয় সকলে।

পুত্রের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে অন্যদের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

ডান দিকে বসে আছে কোর্টনি সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, গ্যারি। ছোটবেলায় মায়োপিয়া আর প্যাজমা’তে ভুগতে থাকা ছেলেটা তার কিংবা অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই আত্মবিশ্বাসের জোরে আজ কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান হয়ে গেছে। বহন করে চলেছে পারিবারিক সৌভাগ্যের বিশাল দায়িত্ব। মাথার উপর মুরগির ঝুরির মতো চূড়া হয়ে আছে কালো ঘন চুল। মোমবাতির আলোতে চমকাচ্ছে চোখের চশমা। গ্যারির সাথে হাসছে পুরো ডাইনিং রুম।

এরপর ওর স্ত্রীর দিকে নজর দিলেন সেনটেইন। টেবিলের ওদিকে শাসার পাশে বসে আছে হোলি। গ্যারি’র চেয়ে না হলেও প্রায় দশ বছরের বড়। এই বিয়ে আটকানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন সেনটেইন। কিন্তু সফল হতে পারেন নি। এখন স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তখন ভুল করেছিলেন। নয়ত এখন মেয়েটাকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কেননা গ্যারির স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পারফেক্ট প্রমাণ করেছে হোলি।

সেনটেইন কিংবা অন্য কেউ যা পারেনি, গ্যারি’র সেসব গুণ’কে যথাযথভাবে মর্যাদা গিয়েছে হোলি আর সেগুলো বিকশিত হতে সাহায্যও করেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে গ্যারির সফলতার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ওর স্ত্রী। পত্নীর সাহস। সহযোগিতা আর ভালোবাসা পেয়ে তিন পুত্র আর এক কন্যার জনক হয়েছে গ্যারি।

কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের হেড অফিস, স্টক একচেঞ্জ সবই জোহানেস বার্গে হওয়াতে পরিবারসহ সেখানেই থাকে গ্যারি। কিন্তু সেনটেইনের ধারণা হোলিই তাদেরকে উনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। গ্যারি’র মতো করে সন্তানদেরকেও নিজের ছত্রছায়ায় রেখে গাইড করতে চান সেনটেইন। তাই বুঝতে পারলেন পার হতে হবে হোলি নামাক বৈতরুণী। লম্বা টেবিলের ওপাশে বসে থাকা হোলি’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন উষ্ণতা,মেশানো প্রশ্রয়ের হাসি। নীল আর বেগুনি দু’চোখে দুই রঙ নিয়ে হাসি ফিরিয়ে দিল হোলি।

এই ফাঁকে শাসা কিছু একটা বলে ফেললেন যা শোনেননি সেনটেইন। হঠাৎ করেই প্রত্যেকে তার দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়া শুরু করল। হাসি মুখে প্রশংসা হজম করে নিলেন সেনটেইন; আবারো কথা বলতে লাগলেন শাসা।

মায়ের সকল গুণ আর পূর্ব বীরত্বের সাত কাহন শোনাতে লাগলেন। বাকিরাও বহুবার শোনা কাহিনী এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে যেন আগে আর জানত না।

আর এসব কিছুর ভিড়ে উশখুশ করছে কেবল একজন।

সেনটেইনের আত্মতৃপ্তির মাঝে বিরক্তি উৎপাদন করার সাহস কেবল একজনেরই আছে। নাতী-নাতনীদের মাঝে এই একজনের প্রতিই তেমন কোনো টান অনুভব করেন না সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস। ছেলেটার চরিত্রের এমন কিছু গভীরতা, এমন গোপনীয় কয়েকটা দিক আছে যা তিনি আজও ঠাওর করতে পারেননি। বিরক্তি তাই বেড়েই যাচ্ছে দিনকে দিন।

তারা’র কাছ থেকে মাইকেলকে সরিয়ে রাখতে ব্যর্থ হওয়াটাও এর আরেকটা কারণ। তারা-ওই মার্কসিস্ট, বিপথগামী, বিশ্বাসঘাতকটার নাম মনে আসার সাথে সাথে পেটের মাঝে পাক খেয়ে উঠল ঘৃণা।

এতটাই তীব্র যে হঠাৎ করেই চোখ তুলে দাদী’র দিকে তাকালো মাইকেল আর সেনটেইনের কালো চোখ জোড়াতে তীব্র ঘৃণা টের পেয়ে সাথে সাথে প্রায় অপরাধীর ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নিল।

সেনটেইনের নিষেধ সত্ত্বেও পুত্রের পছন্দের পেশায় তাকে প্রতিষ্ঠা লাভে সাহায্য করার জন্য গোল্ডেন সিটি মেইলে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছেন শাসা। যাই হোক মাত্র ডেপুটি এডিটর অব্দি পৌঁছেছে মাইকেল। শাসা’র কনজারভেটিভ মতাদর্শের কেবল বাম দিকেই ঘেষছে। তাই সরকারই শুধু নয় বরঞ্চ শিল্পপতিরাও এর পিছনে লেগেছে। এর আগে তিন বার নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়াতে মেইলের আর্থিক লোকসান নিয়ে গ্যারি আর সম্মান হারিয়ে বেজায় ক্ষেপে আছেন সেনটেইন।

মাইকেলের সুন্দর মুখখানা দেখে তিক্ত স্বাদ এলো মনের ভেতর। ভাবলেন এই ছেলে আসলে সত্যিকারের কোর্টনি নয়।

আগন্তুক আর পরাজিতদের জন্য মাইকেলের দরদ দেখে তাই ক্ষুব্ধ সেনটেইন। কত বড় সাহস যে বেলাকেও দলে ভেড়াতে চায়। দু’ ভাইবোনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একত্রে বণর্বাদের র‍্যালিতে যাবার কথা ভালই জানেন সেনটেইন।

ভাগ্য ভালো যে সময় মতো সব সামলাতে পেরেছেন। লোথার ডি লা রে’র সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর সাউথ আফ্রিকান ইন্টেলিজেন্সের জন্য আন্ডারকাভার হিসেবে কিছু কাছ করেছিল বেলা। সেই লোথার এখন সংসদের সদস্য আর ল’ অ্যান্ড অর্ডার মিনিস্ট্রির ডেপুটি মিনিস্টার।

ব্যক্তিগতভাবে লোথারকে ডেকে পাঠিয়েছেন সেনটেইন। তাকে আশ্বস্তও করেছে ছেলেটা; জানিয়েছে, “র্যালিতে ওর উপস্থিতির স্বপক্ষে সবকিছু লিখে রাখব ইসাবেলা’র ফাইলে। ওতো আগেও আমাদের জন্য কাজ করেছে। কিন্তু মাইকেলের ব্যাপারে কিছু প্রমিজ করতে পারব না। এরই মাঝে ওর ফাইলে বহু কালো দাগ জমে গেছে।

অবশেষে শেষ করেছেন শাসা। সকলে আবার উৎসুক ভঙ্গিতে তাকাল সেনটেইনের দিকে। বক্তা হিসেবে পুত্রের চেয়েও এক কাঠি সরেস হলেও আজ সকলে আশা হত হল সেনটেইনের কথা শুনে।

সরাসরি নিজের দর্শন তুলে ধরার চেয়ে অন্যদের প্রশংসাই আজ বেশি করে করলেন। গ্যারি’র আর্থিক সাফল্য, ইসাবেলা’র অ্যাকাডেমিক অর্জন, জুলুল্যান্ডের উপকূলে কোর্টনি লাক্সারী হোটেলের জন্য হোলিসহ সকলেই দাদীমা’র প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেল। এমনকি মাইকেল’ও বাদ গেল না। নতুন বই প্রকাশের জন্য তাকেও বাহবা দিলেন সেনটেইন।

এরপর সকলকেই উঠে দাঁড়িয়ে পরিবারের সাফল্য কামনা করে টোস্ট করার আদেশ দিতেই বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রত্যেকে। শাসা এসে মা’র হাত ধরে নিয়ে গেলেন ড্রইং রুমে।

ইসাবেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তাড়াতাড়ি ওর পাশে চলে এলো মাইকেল। বোনের হাত ধরে জানালো, তোমাকে অনেক মিস্ করেছি বেলা। আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন? রামোন আর নিকি, বেলা’র অভিব্যক্তি বদলে যেতেই সচকিত হলো মাইকেল।

“কিছু হয়েছে?”

“এখন না, নিকি” তাড়াতাড়ি ভাইকে সাবধান করে দিল বেলা। নিকি চলে যাবার পর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে এই প্রথম কথা বলছে দু’জনে। আজ সকালে ওয়েল্টেভ্রেদেনে পৌঁছানোর পর থেকেও মাইকেলকে এড়িয়ে চলছে বেলা।

“নিশ্চয় কিছু হয়েছে, আমাকে বলছ না।” চাপ দিল মাইকেল।

“চুপ! মুখ হাসি হাসি করে রাখো! কোনো ঝামেলা করো না। আমি পরে তোমার রুমে আসব।” ভাইয়ের হাতে চাপ দিয়ে দুজনে মিলে হাসতে হাসতে ড্রয়িং রুমে চলে গেল বেলা আর মাইকেল।

প্রথাগতভাবে ফায়ার প্লেসের দিকে মুখ করে রাখা লম্বা সোফাটাতে বসলেন সেনটেইন।

“আজ রাতে আমার সাথে মেয়েরা বসবে।” ঘোষণা করলেন কোর্টনি সম্রাজ্ঞী। হোলিকে ডেকে নিজের পাশে বসিয়ে আরেক পাশে বসার জন্য ডাকলেন বেলাকে।

যুক্তি ছাড়া খুব কমই কোনো কাজ করেন সেনটেইন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। পরিচারকেরা কফি দিয়ে যাবার পর বের করলেন নিজের তুরুপের তাস।

“আমি অনেক দিন ধরেই এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম হোলি।” সকলে মনোযোগ দিল এদিকে। “আর এর জন্য তোমার জন্মদিনের চেয়ে আর ভালো কিইবা হতে পারে। নিজের গলা থেকে হাজার ক্যারেটের চেয়ে বেশি নিখুঁত হলুদ হীরের হার খুলে হোলি’র দিকে তাকালেন; কালো চোখে দেখা গেল সত্যিকারের অশ্রু বিন্দু। “এত চমৎকার একটা হার অসম্ভব সুন্দরী কারো গলাতেই কেবল শোভা পাবার যোগ্য।” মূর্তির মতো বসে থাকা হোলির গলায় হার পরিয়ে দিলেন সেনটেইন। দশ বছর ধরে একটা একটা করে পছন্দের হীরে জমিয়ে, লন্ডনের গ্যারাজ থেকে প্লাটিনাম আর নকশার পর সৃষ্টি করেছেন এই অসাধারণ অলংকার।

বিস্ময়ে থ বনে গেল সকলে। সবাই জানে সেনটেইনের কাছে এই নেকলেসের কতটা গুরুত্ব আছে।

ডান হাত দিয়ে নিজের গলায় বসে থাকা নেকলেসটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না হোলি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরল দাদী শ্বাশুড়িকে। একে অন্যকে ধরে বসে রইল দুই নারী, এরপর আস্তে করে হোলিই প্রথম কথা বলল,

“ধন্যবাদ, নানা।” সেনটেইনের একেবারে কাছের মানুষেরাই কেবল এতদিন এ নামে সমোধন করত; হোলি এর আগে কখনোই এই ডাক ব্যবহার না করাতে সেনটেইন চোখ বন্ধ করে হোলি’র সোনালি চুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। কেউই তাই তার চোখে সন্তুষ্টির আভা আর ঠোঁটে বিজয়ীর হাসিটা দেখতে পেল না।

***

ইসাবেলা’র স্যুইটে অপেক্ষা করছে ন্যানি।

“একটা’র বেশি বাজে। আমি তো বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করো না

বুড়ি!” চিৎকার করে উঠল বেলা।

“পঁচিশ বছর ধরেই তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। কাছে এসে বেলার ড্রেস খুলে দিল ন্যানি।

“আমার একটুও ভাল লাগে না।”

“আমার তো লাগে। তোমাকে নিজ হাতে গোসল না করানো পর্যন্ত আমার একটুও শান্তি হয় না।”

“এখন! রাত একটায় গোসল!” ফেরার পর থেকে ন্যানি’র সামনে কখনোই নিজেকে নিরাভরণ করেনি বেলা। কিন্তু এই বুড়ির ঈগলের মতো চোখ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সন্তান ধারণের যে কোনো তুচ্ছ চিহ্নও এই শকুনির চোখ এড়াবে না।

বুঝতে পারল ওর আচরণে ন্যানি সন্দেহ করছে। তাই কাটাবার জন্য বলে উঠল, “এখন তুমি যাও তো ন্যানি, গিয়ে বস্মি’র বিছানা গরম করো।”

শোকের চোটে বধির হয়ে গেল ন্যানি, “কে তোমাকে এসব বলে?”

“ওয়েল্টেভ্রেদেনে কী হচ্ছে না হচ্ছে তুমি একাই সেসব খবর রাখো না, বুঝলে? ভালোভাবেই জানি বম্মি বুড়াটা তোমার পেছনে লেগে আছে আর তুমি’ও তাকে নিয়ে খেলছ।”

“হু, হু, ভদ্র মেয়েরা এসব আজে-বাজে কথা বলে না। “ দরজার দিকে যেতে যেতে বলে উঠল ন্যানি আর স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেলা।

দ্রুত নিজের বেডরুমে গিয়ে মেক-আপ তুলে সিল্কের বাথরোব পরে নিল। রোবের বেল্ট লাগাতে লাগাতে হাত রাখল দরজার হ্যান্ডেলে।

“মিকি’কে আমি কী বলব?” তিনদিন আগে হলেও উত্তরটা নিয়ে এত ভাবতে হত না; কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। প্যাকেটটা এসে গেছে। লন্ডন ছাড়ার আগের দিন জো সিসেরোর সাথে শেষ কথা হয়েছিল।

“লাল গোলাপ, তোমাকে তোমার কনট্যাক্ট এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। শুধু এমারজেন্সি হলেই ব্যবহার করবে। হফম্যান,

C/o ম্যাসন এজেন্সি, ১০ ব্লাশিং লেন, সোহো। মুখস্থ করে নাও কোথাও লিখে রেখো না।”

“ঠিক আছে।” ফ্যাসফ্যাসে গলাটা শুনে সবসময় আতঙ্কে জমে যায় বেলা।

“বাড়িতে ফিরে ওয়েল্টেলেদেন থেকে দূরে ছদ্মনামে একটা পোস্ট অফিস বক্স খুলবে। তারপর লোহোর ঠিকানায় আমাকে নাম্বার পাঠিয়ে দেবে ঠিক আছে?”

ওয়েল্টেভ্রেদেনে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই ক্যাম্পস বে’তে এলে গিয়েছিল গাড়ি চালিয়ে। বহু দূরে হওয়াতে স্টাফরা কেউই তাকে চেনেনি। মিসেস রোজ কোহেন নামে বক্স ভাড়া করে সিসেরোকে নাম্বার পাঠিয়ে দিয়েছে।

মধ্য কেপ টাউনের নিজের অফিস সেনটেইন হাউজ থেকে ফেরার সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্স চেক্ করে আসে বেলা। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাক্সটা খালি পড়ে থাকলেও রুটিনের একটুও নড়চড় হয় না।

নিকি’র কোনো খবর না পেয়ে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছে বেলা। প্রতিদিনের জীবনে মনে হচ্ছে কেবল অভিনয় করে যাচ্ছে। যদিও নিজের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে শাসার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে তারপরেও যতটা ভেবে ছিল ততটা লাঘব হচ্ছে না এ যন্ত্রণার ভার।

হেসে, খেলে, নানা আর পুরনো বন্ধুদের সাথে দিন কাটালেও কিছুতেই কাটতে চায় না একাকী দীর্ঘ রাত। একেক বার মাঝরাতে মনে হয় বাবার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে; কিন্তু দিনের বেলা মনে পড়ে : “বাবা’ই বা কি করতে পারবে? আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না।” মনে পড়ে যায় পানির নিচে নিকি’র নাক থেকে বেরিয়ে আসা রুপালি বুদবুদগুলোর কথা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো সময়ের সাথে সাথে আরো বেড়ে যাচ্ছে এই বেদনা মনে হচ্ছে সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

আর এরপরই শুনতে পেল যে মাইকেল জোহানেসবার্গ থেকে ওয়েন্ট্রেদ্রেদেন আসছে। একমাত্র ওর সাথেই সবকিছু শেয়ার করতে পারবে বেলা। জানে মিকি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

মাইকেলের আসার আগের শুক্রবারে আবারো ক্যাম্পস বে’তে বক্স চেক করতে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় ছয়টা বেজে যাওয়াতে পোস্ট অফিসের মেইন বিল্ডিং ছুটি হয়ে গিয়েছিল। এক জোড়া টিন এজার হলে থাকলেও ইসাবেলাকে দেখে অপরাধীর ভঙ্গিতে দূরে সরে গিয়েছে ছেলে-মেয়ে দুটো। যাই হোক, কখনো কারো সামনে নিজের বক্স খোলে না বেলা।

পঞ্চম সারির নিজের বক্সের ছোট্ট স্টিলের দরজার তালাতে চাবি ঢুকাতেই কেঁপে উঠল সারা শরীর।

সবসময়কার মতো এবারেও খালিই দেখবে ভেবেছিল। নিঃশ্বাস আটকে মরে যাবার জোগাড় হলো।

মোটা বাদামি খামটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই কাঁধের ঝোলা ব্যাগে রেখে দিল বেলা। আর তারপর প্রায় চোরের মতো করে হেঁটে হেঁটে চলে এলো পার্ক করে রাখা মিনির কাছে। হাত এতত কাঁপছে যে গাড়ির দরজাও খুলতে পারছে না।

পাম গাছের সারির নিচে সৈকতের উপরে পার্ক করল গাড়ি। এই সময়ে বী প্রায় পুরোটাই খালি।

গাড়ির সব জানালা নামিয়ে দরজাগুলো লক করে বাদামি খামটাকে বের করে কোলের উপর রাখল বেলা।

ট্রাফালগার স্কোয়ার পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প লাগানো খামটা খুলতেও যেন ভয় হচ্ছে। না জানি ভেতরে কী আছে! ফিরতি ঠিকানার জায়গায় কিছুই লেখা নেই। দেরি করার জন্যই ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে পেননাইফ বের করে চোখা মাথা দিয়ে খুলে ফেলল খামের মুখ।

রঙিন একটা ছবি গড়িয়ে পড়তেই কেঁপে উঠল বুক। নিকি!

একটা বাগানের লনে নীল ব্লাঙ্কেটের উপর শুধু একটা ন্যাপকিন গায়ে দিয়ে বসে আছে নিকি! কারো সাহায্য ছাড়াই বসে আছে, বয়স প্রায় সাত মাস হয়ে গেছে। ফোলা ফোলা গাল, লম্বা ঘন কালো-কোকড়া চুল, এমেরাল্ডের মতো সবুজ চোখ জোড়া নিয়ে হাসছে নিকি। “ওহ্ ঈশ্বর! কী সুন্দর হয়েছে দেখতে!” আলোর সামনে ছবিটাকে ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখল বেলা, “এত বড় হয়ে গেছে যে একা একাই বসতে পারে, আমার ছোট্ট বাবাটা?”

ছবিটার উপর হাত বুলাতেই মনে হলো আঙুলের ছাপ পড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাই কাপড় দিয়ে মুছে ফেলল।

ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল বুকের ভেতর, “ওহ মাই বেবি!”

আটলান্টিকের দিগন্তে পাল্টে যেতে বসেছে সূর্য। নিজেকে বহুকষ্টে সামলালো বেলা। ছবিটাকে খামের ভেতরে ঢুকাতে গিয়ে দেখল বাকি কাগজগুলোকে।

প্রথমটা থেকে বোঝা গেল কোনো শিশু ক্লিনিকের মেডিকেল রেজিস্টার কপি’র ফটোকপি। নাম আর ঠিকানা গাঢ় কালি দিয়ে ঢেকে রেখে শুধু নিকি’র নাম, ডেথ অব বার্থ আর ক্লিনিকে উইকলি ভিজিটের রেকর্ড লেখা আছে। জানা গেল চার মাসের সময় নিক্রির প্রথম দুটো দাঁত দেখা গেছে আর ওজন প্রায় ষোল কিলো।

ভাঁজ করা দ্বিতীয় কাগজটা খুলতেই চিনতে পেল আদ্রা’র গোটা গোটা হাতের লেখা।

সিনোরিটা বেলা,
দিনকে দিন নিকি বেশ শক্ত-পোক্ত আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে। আর রাগ তো একেবারে ক্ষাপা মোষের মত। আর আমি যত জোরে দৌড়াতে পারি নিকি ঠিক ততটা গতিতে হাত আর হাঁটু দিয়ে হামাগুড়ি দেয়; হয়ত কিছু দিনের মাঝেই হাঁটতে শুরু করবে।
ওর মুখের প্রথম কথা ছিল “মাম্মা”; আপনি কত সুন্দর, প্রতিদিন আমি ওকে সেই গল্প শোনাই; এও বলি যে একদিন ঠিকই ওর কাছে আসবেন। এখন হয়তো বুঝতে পারে না, তবে ভবিষ্যতে বুঝবে।
আপনার কথা প্রায় মনে হয়, সিনোরিটা। বিশ্বাস করুন, আমি নিজের জীবন দিয়েই নিকি’র সেবা-যত্ন করব। প্লিজ, এমন কিছু করবেন না। যা ও’কে বিপদে ফেলবে।
বিশ্বস্ত
আদ্রা অলিভারেস

শেষ লাইনটা পড়ে যেন বুকের হাড়ে ছুরির খোঁচা খেল বেলা। বুঝে গেল কাউকে বলা যাবে না ওর কষ্ট, বাবা, নানা কিংবা মাইকেল, কাউকে না।

আবারো দ্বিধা ভরে নিজ বেডরুমের হাতলে হাত রাখল বেলা। “তোমাকে মিথ্যে বলার জন্য দুঃখিত মিকি। হয়ত কোনদিন সত্যিটা জানাতে পারব।”

এত বড় বাড়িটা একেবারে ভূতের বাড়ির মতই নিঝুম হয়ে আছে। পারশিয়ান কার্পেটের উপর দিয়ে খালি পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে এলো বেলা। রুমে ঢুকতেই দেখল বিছানায় বসে বই পড়ছে মাইকেল। বোনকে দেখে বেড় সাইড টেবিলে বই রেখে চাদর সরিয়ে দিল বসার জন্য

ভাইয়ের পাশে উঠে বসল বেলা। কিছু একটা টের পেল মাইকেল। জানতে চাইল, “আমাকে বলল, বেলা।

আদ্রা’র সাবধান বাণী মনে পড়া সত্ত্বেও নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না ইসাবেলা। রামোন আর নিকি’র অস্তিত্ব তো মাইকেল জানে। ইচ্ছে হচ্ছে ভাইকে সব খুলে বলতে।

কিন্তু ভিডিওতে দেখা নিকি’র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চুপসে গেল বেলা। ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে কেবল জানালো, “নিকি মারা গেছে।”

সাথে সাথে কোনো উত্তর দিল না মাইকেল।

“সত্যি।” মনে মনে নিজেকে বোঝাল বেলা, “নিকি আমাদের মাঝে আর নেই।” কিন্তু কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়েই এমনটা করছে বেলা।

“কিভাবে?” মাইকেলের প্রশ্নটা তো প্রথমে বুঝতেই পারল না।

“খাওয়াতে গিয়ে দেখি যে ঠাণ্ডা হয়ে আছে।”

বোনের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল মাইকেল, “ওহ্ ঈশ্বর! কী বলছ বেলা? কী ভয়ংকর!”

বাস্তবটা তার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুর আর ভয়ংকর; কিন্তু মাইকেলকে তা বলার কোনো উপায় নেই।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর মাইকেল আবারো জানতে চাইল, “রামোন? ও কোথায়? ওর তো এখন তোমার পাশে থাকার কথা ছিল।”

“রামোন” নামটা আউরাতে গিয়ে কণ্ঠের ভয় লুকাতে চাইল বেলা।” নিকি চলে যাবার পর রামোন পুরোপুরি বদলে যায়। আমাকেই দোষারোপ করে সবকিছুর জন্য। নিকি’র সাথে সাথে আমার জন্য ওর ভালোবাসাও মরে গেছে।” বহুদিন ধরে জমিয়ে রাখা কান্না এবারে বেরিয়ে এলো অঝোর ধারায়। “নিকি নেই, রামোন নেই। আমি আর কোনোদিন ওদেরকে দেখব না।”

বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিকি। এরকম একটা নির্ভার আশ্রয়ই প্রয়োজন ছিল।

বহুক্ষণ বাদে কথা বলতে পারল মাইকেল। ভালোবাসার, যন্ত্রণা, আশা; একাকীত্ব আর সবশেষে মৃত্যু নিয়ে অনেক সুন্দর সব কথা শোনাল মাইকেল।

ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল বেলা।

ভোরের আগে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখে যে একইভাবে বসে আছে মাইকেল; যেন বেলার ঘুম না তুটে যায়।

“থ্যাঙ্ক ইউ, মিকি। আমি যে কতটা একা ছিলাম।”

“আমি জানি বেলা। জানি একাকীত্ব কাকে বলে।” বুঝতে পারল এবারে ভাইকে সান্ত্বনা দেয়ার পালা এসেছে। বেলা তাই বলে উঠল, “তোমার নতুন বইয়ের কথা বলো মিকি। আমি আসলে এখনো পড়ি নি। সরি।”

“আমি রালেই তাবাকা’র সাথে কথা বলেছি।” হঠাৎ করে মাইকেলের মুখে নামটা শুনে অবাক হয়ে গেল বেলা।

“কোথায়? কোথায় দেখা করেছ?”

মাথা নাড়ল মাইকেল। “আমি দেখা করি নি। ফোনে খানিক কথা বলেছি। মনে হয় অন্য কোন দেশ থেকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু শীঘ্রিই দেশে ফিরবেন। ছায়ার মতই বর্ডার পারাপার করেন।”

“দেখা করার ব্যবস্থা করেছ?”

“হ্যাঁ, নিজের কথা রাখতে জানেন লোকটা।”

“সাবধানে, মিকি। প্রমিজ করো যে নিজের খেয়াল রাখবে। উনি অনেক ভয়ংকর।”

“চিন্তা করো না।” বোনকে আশ্বস্ত করল মাইকেল। “আমি তো শন কিংবা গ্যারির মতো হিরো নই। প্রমিজ করছি সাবধানে থাকব।”

***

জোহানেসবার্গ টু-ডারবান মেইন হাইওয়ের পাশের একটা রেস্টোরেন্টে গাড়ি। থামাল মাইকেল কোর্টনি।

ইগনিশন সুইচটা বন্ধ করলেও খানিক সময় লাগত পুরোপুরি স্তব্ধ হতে। সতুর হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়া গাড়িটা আরো দুই বছর আগে বিক্রি করে দেয়া উচিত ছিল।

ডেপুটি এডিটর হিসেবে প্রতি বারো মাসে নতুন লাক্সারী কার পাবার কথা থাকলেও পুরনো ভাঙ্গা-চোড়া ভ্যানিয়ান্টের মায়া কিছুতেই ছাড়তে পারে না মাইকেল।

কার পার্কের অন্য গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকে দেয়া বর্ণনার সাথে মেলাতে চাইল। না, কাক্ষিত গাড়িটা নেই। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল বিশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছে। তাই সিগারেট ধরিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে রইল।

নিজের গাড়ি আর ঘড়ির কথা ভাবতে গিয়ে মনে মনে হেসে ফেলল মাইকেল। কোর্টনি পরিবারের মধ্যেও আসলেই বেমানান। নানা থেকে শুরু করে বেলা সকলেই কেবল পার্থিব সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত। নানা প্রতি বছর নতুন মডেলের ডেইমলার কেনে; বাবা ক্লাসিক কার বিশেষ করে রেসিং গাড়ি কিনে ভর্তি করে ফেলেছে গ্যারাজ। গ্যারি ফেরারি, ম্যাজেরাতি আর শন্ নিজের টা-গাই ইমেজ রক্ষার জন্য চালায় ফোর হুইল ড্রাইভ হান্টিং ভেহিকেল। এমনকি বেলা’র গাড়িও নতুন ভ্যালিয়ান্টের ডাবল দামি হবে।

“বস্তু”, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ভাবল মাইকেল, “সবাই কেবল বস্তুটাকেই দেখে, ব্যক্তিকে নয়। এটাই এদেশের প্রধান অসুস্থতা।”

গাড়ির পাশের জানালায় টোকা দেয়ার শব্দ শুনে আশা নিয়ে তাকাল মাইকেল।

কিন্তু কেউ কোথাও নেই।

অবাক হয়ে গেলেও আবার এগিয়ে এলো ছোট্ট কালো একটা হাত।

জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে দিল মাইকেল। ছেঁড়াফাড়া শাটস গায়ে। খালি পায়ে দাঁড়িয়ে হাসছে বছর পাঁচ কি ছয়েকের একটা কৃষাঙ্গ শিশু। নাকের নিচে সর্দি শুকিয়ে থাকলেও হাসিতে একেবারে ঝলমল করছে চারপাশ।

“প্লিজ” ভিখারীর মতো হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, “আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। প্লিজ এক সেন্ট দিন!”

মাইকেল দরজা খুলতেই অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সরে গেল বাচ্চাটা। সিটের উপর থেকে নিজের কার্ডিগান নিয়ে ছেলেটার মাথায় পরিয়ে দিল মাইকেল।

দেখা গেল পা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে কার্ডিগান। জানতে চাইল, “কোথায় থাকো তুমি?”

শ্বেতাঙ্গ একজনের এই ব্যবহার পেয়ে আর তার মুখে নিজের ভাষা ‘জোসা’ শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল শিশুটা। ছয় বছর আগে যখন থেকে মনে হয়েছে যে আপন ভাষা ব্যতীত কারো কাছে পৌঁছানো অসম্ভব তখন থেকে এ ভাষা শিখছে মাইকেল। এখন সে জোসা আর জুলু দু’ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারে।

“ড্রেস ফার্মে থাকি, নকোসী।” এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠা এ শহরটাতে না হলেও এক মিলিয়ন কৃষাঙ্গ বাস করে। প্রতিদিন বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে উইটওয়াটার স্ট্রান্ডের শ্বেতাঙ্গ এলাকায় যায় শ্রমিকের কাজ করার জন্য।

বৃহত্তর জোহানেসবার্গের বাণিজ্যিক আর খনি সমৃদ্ধ এই এলাকার চারপাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট শহর ড্রেকস্ ফার্ম, সোয়েটো আর আলেকজান্দ্রিয়া, সেখানে কেবল কৃষাঙ্গ উপজাতি গোষ্ঠীগুলোই বাস করে।

‘শেষবার কখন খেয়েছে?” বাচ্চাটার কাছে নম্রভাবে জানতে চাইল মাইকেল।

“গতকাল সকালে।”

নিজের ওয়ালেট খুলে পাঁচ অঙ্কের একটা ব্যাংক নোট বের করল মাইকেল। বাচ্চার ছোট্ট চোখ জোড়া একেবারে বিস্ময়ে থ।

মাইকেল হাত বাড়িয়ে দিতেই নোটটা ছোঁ মেরে নিয়ে হাচোড়-পাচোড় করে দৌড় লাগালো ছোট্ট ছেলেটা। ধন্যবাদ দিতেও দাঁড়াল না; ভয় পেল পাছে না যাতে ওর এই উপহার আবার ফিরিয়ে নেয় শ্বেতাঙ্গ লোকটা।

হা হা করে হেসে ফেলল মাইকেল আর তারপরই প্রচণ্ড রাগও হল। আধুনিক এই বিশ্বের আর কোনো দেশ কি আছে সেখানে ছোট্ট শিশুরাও রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়? মনে ছেয়ে গেল হতাশা।

“একটু যদি কিছু করতে পারতাম!” অনুতপ্ত হয়ে ভাবতে গিয়ে এত জোরে সিগারেটে টান দিল যে পুরো এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাই গড়িয়ে পড়ল। সাথে টাইয়ের উপর আগুনের ফুলকি বানিয়ে দিল ছোট একটা ফুটো।

এ সময়ে মেইন হাইওয়ে থেকে কারপার্কের দিকে মোড় নিল ছোট্ট নীল একটা ডেলিভারী-ভ্যান। এটাই সেই গাড়ি।

নির্দেশ মতো নিজের গাড়ির লাইট জ্বালালো মাইকেল। ভ্যানটা সোজা চলে এলো মাইকেলের গাড়ির সামনে। ভ্যালিয়ান্ট থেকে নেমে দরজা লক করে ভ্যানের দিকে এগোল মাইকেল। পেছনের খোলা দরজা দিয়ে উঠে বসল ভেতরে। ভ্যানের ভেতরে ভর্তি হয়ে আছে ঝুড়ি ভর্তি কাঁচা মাংসের প্যাকেট আর মৃত ভেড়া।

“এদিকে আসুন।” জুল ভাষায় ডাইভার নির্দেশ দিতেই ঝুলিয়ে রাখা ভেড়ার নিচ দিয়ে এসে দুটো মাংসের ঝুড়ির মাঝখানে বসে পড়ল মাইকেল। ইন্সপেকশনের সময় তাই ধরা পড়ার ভয় নেই।

“ব্যস, আর কোনো ঝামেলা হবে না।” জুলু ভাষায় নিশ্চয়তা দিল ড্রাইভার। “এই ভ্যানকে কেউ কখনো থামায় না।”

গাড়ি চলতেই নোংরা, আঘোয়া মেঝেতে বসে পড়ল মাইকেল। এ ধরনের নাটকীয় সাবধানতাগুলো বিরক্তিকর হলেও গুরুত্বপূর্ণ। টাউনশিপ ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলের সাথে আলোচনা আর লোকাল পুলিশ স্টেশনের পারমিশন ছাড়া কৃষাঙ্গ শহরে যেতে পারে না কোনো শ্বেতাঙ্গ।

সাধারণভাবে এ ধরনের পারমিশন জোগাড় করা কঠিন না হলেও মাইকেল কোর্টনি বিখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়াতে ফ্যাকড়াটা বেঁধেছে। এছাড়াও পাবলিকেশন কন্ট্রোল অ্যাক্টের আওতায় তিন বার নিষিদ্ধ হয়ে মোটা অংকের ফাইল গুনেছে সে আর তার সংবাদপত্র।

কোনো রকম বাধা ছাড়াই ড্রেকস্ ফার্মের মেইন গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কেল নীল ভ্যান। আফ্রিকান লুডু খেলাতে ব্যস্ত কৃষাঙ্গ গার্ডেরা একবার চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত।

“আপনি এবার সামনে আসতে পারেন।” ড্রাইভারের কথা শুনে মাংসের ঝুড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে ক্যাবের প্যাসেঞ্জার সিটে চলে এলো মাইকেল।

এই শহরতলীগুলো ওকে সবসময়ই বিস্মিত করে। মনে হয় যেন কোন ভিনগ্রহে চলে এসেছে।

১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো পা রেখেছিল ড্রেকস্ ফার্মে; যেখান থেকে ফিরে গিয়ে লিখেছে “রেজ” সিরিজ। সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি প্রাপ্তি আর পাবলিকেশন কন্ট্রোল অ্যাক্টের হাতে নিষিদ্ধ হওয়া উভয়েরই শুরু তখন থেকে।

স্মৃতি মনে করতে করতে চারপাশ দেখতে লাগল মাইকেল। শহরতলীর প্রাচীন অংশটা দিয়ে এগিয়ে চলেছে নীল ভ্যান। আশপাশে গলির পর গলি, ভাঙ্গা চোড়া দালান, পলেস্তারা ওঠা বস্তির দেয়াল, লাল মরচে পড়া করোগেটেড টিনের ছাদ।

চিকন রাস্তাটার মাঝে মাঝেই উঁচু নিচু গর্ত। চড়ে বেড়ানো মুরগিগুলো বিষ্টাতে ভর্তি হয়ে আছে চারপাশ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। আবর্জনা পঁচা গন্ধের সাথে মিশে গেছে খোলা ড্রেন আর মাটির টয়লেটের গন্ধ।

সরকারের স্বাস্থ্য পরিদর্শক বহু আগেই ড্রেকস্ ফার্মের পুরাতন অংশের সাফ সুতরো করার আশা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো একদিন বুলডোজার এসে সব গুঁড়িয়ে দেবে আর মেইলের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হবে ভয়ংকর মেশিনটার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা কৃষাঙ্গ পরিবারগুলোর ছবি। ডার্ক স্যুট পরিহিত কোনো সিভিল সার্ভেন্ট স্টেট টেলিভিশন নেটওয়াকে জানাবে “স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে তৈরি নতুন আরামদায়ক বাংলোর” কথা। সেদিনটার কথা কল্পনা করেই রাগে ফুঁসতে লাগল মাইকেল।

এরপর ভ্যান নতুন অংশে ঢুকতেই ফ্রান্সের সামরিক সমাধি ক্ষেত্রের কথা মনে পড়ে গেল। বৃক্ষহীন প্রান্তরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছাই রঙা করোগেটেড অ্যাসবেস্টস ছাদ লাগানো হাজার হাজার ইটের বাক্স।

তারপরেও, কেমন করে যেন নিজেদের রঙচটা জীবনের খানিকটা রঙের ছোঁয়া নিয়ে এসেছে এলাকার কৃষাঙ্গ অধিবাসীরা। এখানে-সেখানে লাগানো গোলাপি আকাশী নীল আর জমকালো কমলা, আফ্রিকার উজ্জ্বল রঙ প্রীতিকেই মনে করিয়ে দেয়। এরকমই একটা বাড়িতে উত্তরের নেডেবল উপজাতির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সুদৃশ্য জ্যামিতিক নকশা দেখতে পেল মাইকেল।

সামনের ছোট্ট বাগানটাতে ফুটে আছে বাড়ির বাসিন্দার ব্যক্তিত্ব। কোনটাতে একেবারে রুক্ষ ধূলিমলিন মাটি; কোনটাতে ভূট্টা গাছের সাথে সাথে দুধ দেয়া ছাগলও চড়ে বেড়াচ্ছে। কোনোটাতে আবার জিরেনিয়াম লতা: আরেকটাতে তো আগাছা ভরা বাগানে ভয়ংকর দর্শন কুকুর গার্ডও চোখে পড়ল।

কোনো কোনো প্লট কংক্রিটের দেয়াল গেঁথে কিংবা পুরনো ট্রাকের পেইন্ট করা টায়ার ঝুলিয়ে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সীমানা বানিয়েছে। বেশির ভাগ কুটিরের আবার বাড়তি অংশ বানানো হয়েছে আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। আবার বাতিল জিনিস রাখার কাজও দিব্যি চলে যাচ্ছে।

এখানকার এই মানুষগুলোকেই নিজের শ্রেণি কিংবা জাতির চেয়েও বেশি ভালবাসে মাইকেল। এদের জন্যই হাহাকার করে ওর হৃদয়। মুগ্ধ হয় এদের সামর্থ্য, সহিষ্ণুতা আর বেঁচে থাকার আকাঙ্খা দেখে।

কালো ল্যাব্রাডর কুকুর ছানার মতো সর্বত্র খেলে বেড়াচ্ছে শিশুদের দল।

মাইকেলের শ্বেতাঙ্গ চেহারা দেখে ধীর গতিতে এগোনো ভ্যানের পাশে পাশে দৌড়াতে থাকে কিশোর-কিশোরীর দল। “সুইটি! সুইটি!” মাইকেল’ও তৈরি হয়ে এসেছে পকেট ভর্তি সুগার ক্যান্ডি মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দেয় জানালা দিয়ে। তরুণেরা প্রতিদিন শহরে কাজ করতে গেলেও বৃদ্ধ, বেকার আর মায়েদের দল এখানেই রয়ে যায়।

মোড়ে মোড়ে দল পাকিয়ে আড্ডা দিতে থাকা টিনএজারদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায় মাইকেল। ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে, জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই এ মুখগুলো জেনে যায় ভালো কিছুর প্রত্যাশা করা ওদের সাজে না।

আর আছে গৃহকর্ম কিংবা ভেজা কাপড় দড়িতে ঝুলিয়ে দিতে ব্যস্ত নারীরা। কালো উঠানে তেপায়া পাত্রে তৈরি করছে ভূট্টার পরিজ। ধূলা আর চুনার ধোয়া একত্রে মিশে দীর্ঘস্থায়ী মেঘ জমে থাকে শহরতলীর উপরে।

চারপাশের এত দৈন্য দশা আর দারিদ্রতা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি কোণা থেকে কানে ভেসে আসছে হাসি আর গানের শব্দ। উজ্জ্বল আর আনন্দমাখা হাসি দিয়েই একে অন্যকে অভ্যর্থনা জানায় সকলে। প্রাণখোলা এই আফ্রিকান হাসিমুখ দেখে অন্তর আর্দ্র হয়ে উঠে বেদনার ভারে।

মাইকেলের মনে হয়, গানই মূল প্রেরণাশক্তি জাগায় এই কৃষাঙ্গদের মাঝে। নিজেকে ওদেরই একজন ভাবতে ভালবাসে; বয়স, জাতি কিংবা সেক্স নয়, এদের প্রত্যেকেই তার বড় আপন।

“আমি তোমাদের জন্য কী করব বলল তো?” ফিসফিস করে নিজের কাছেই উত্তর জানাতে চায় মাইকেল। আমি যাই চেষ্টা করেছি ব্যর্থ হয়েছি। মরুভূমির বুকে বাতাসে চিৎকারের মতই হারিয়ে গেছে আমার সব প্রচেষ্টা।

একটা যদি কোনো রাস্তা খুঁজে পেতাম!”

হঠাৎ করেই গাড়ি উপরে যেতেই নিজের আসনে সিধে হয়ে বসল মাইকেল।

এগারো বছর আগে এখানকার ঘাসের জমিতে ছাগল চড়ে বেড়াতে দেখেছিল।

“নবস পাহাড়।” ওর বিস্ময় দেখে মিটিমিটি হাসছে ভ্যানের ড্রাইভার। “সুন্দর, না?”

যাত্রাপথের হাজারো কাটা অতিক্রম করে কেবল স্থির সংকল্প আর ধৈর্যের কল্যাণে একজন মানুষ যে কোথায় পৌঁছে যায় কল্পনা, করা যায় না। ড্রেকস ফার্মের এ অংশে বাস করে তেমনই কৃষাঙ্গ ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল আর সফল অপরাধী। যে বাড়ি তারা এখানে বানিয়েছে তা অনায়াসে শ্বেতাঙ্গদের স্যান্ডটন, লা লুসিয়া কিংবা কনস্টানশিয়ার মতো অভিজাত পাড়ার শোভা বর্ধন করতে পারত।

“দেখুন!” গর্বিত ভঙ্গিতে একের পর এক বাড়ি চেনাতে লাগল ভ্যানের ড্রাইভার। “বড় বড় জানালাঅলা গোলাপি বাড়িটাতে থাকেন জোশিয়া জুবু। সিংহের এমন হাড় বিক্রি করে যা আপনাকে ব্যবসা কিংবা আর্থিক কাজে সফলতা এনে দেবে। চোখের জন্য শকুনের চর্বির মলম। নতুন চারটা ক্যাডিলাক মোটর গাড়ির মালিক এই কবিরাজের ছেলেরা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে।”

“আমাকেও তো তাহলে সিংহের হাড় নিয়ে যেতে হবে।”

মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। গত চার বছরে মেইলে’র কারণে এত ক্ষতি হয়েছে যে বেজায় ক্ষেপে আছে নানা আর গ্যারি।

“এবারে ওই সবুজ ছাদ আর উঁচু দেয়ালঅলা বাড়িটা দেখুন। এখানে পিটার গোনিয়ামা বাস করে। উনার উপজাতির লোকেরা ক্যানাবিস উৎপন্ন করে। পাহাড়ের গোপন জায়গায় এগুলোর চাষ করে ট্রাকে করে পাঠিয়ে দেয় কেপ টাউন, ডারবান আর জোহানেসবার্গ। উনার আছে এত এত টাকা আর পঁচিশ জন স্ত্রী।”

পুরনো এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা ছেড়ে ভ্যান এবার উঠে এলো মসৃণ নীল অ্যাসফাল্ট লাগানো বুলেভাদের উপর।

এরপর হঠাৎ করে বিলাসবহুল এক ম্যানশনের স্টিলের গেইটের সামনে এসে থেমে গেল গাড়ি। নিঃশব্দে ইলেকট্রিক গেইট খুলে যেতে ভেতরে সবুজ লনে ঢুকে গেল ভ্যান। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল গেইট। মাঝখানে পাথরের ঝরণাঅলা একটা সুইমিং পুল দেখা যাচ্ছে। ওভারঅল পরিহিত দুই কুষাঙ্গ মালি কাজ করছে বাগানে।

হাল আমলের নকশা করা বিল্ডিংটাতে প্লেট-গ্লাস, পিকচার-উইনডো আর কাঠের কাজ সবই আছে। ড্রাইভার মূল চত্বরে গাড়ি পার্ক করতেই মাইকেলকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি।

“মাইকেল!” রালেই তাবাকার সম্ভাষণ শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল মাইকেল। লন্ডনে শেষ মিটিং এর চেয়ে সবকিছুই আলাদা মনে হল। রালেই’র মতো এত সুপুরুষ আর কখনো দেখেনি।

“সু-স্বাগতম।” চারপাশে চোখ বুলিয়ে–কুঁচকালো মাইকেল।

“এখানেও আপনি বেশ ঠাট-বাট নিয়েই চলেন দেখছি রালেই; নট ব্যাড!”

“এগুলোর কিছুই আমার নয়।” মাথা নাড়লেন রালেই। “পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই আমার নিজের নয়।”

“তাহলে কার?”

“প্রশ্ন, শুধু প্রশ্ন।” খানিকটা তিরস্কারের সুরে বলে উঠলেন তাবাকা।

“ভুলে যাবেন না আমি একজন সাংবাদিক। প্রশ্ন আমার হাড়-মজ্জায় মিশে গেছে।” পরিবেশ হালকা করতে চাইল মাইকেল

“ঠিক আছে। যে নারীর সাথে এখন আপনার দেখা হবে তার জন্য এই বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে ট্রান্স আফ্রিকা ফাউন্ডেশন অব আমেরিকা।”

“ট্রান্স আফ্রিকা-আমেরিকান সিভিল রাইটস গ্রুপ?” সবিস্ময়ে জানতে চাইল মাইকেল, “এটি কি শিকাগোর কৃষাঙ্গ ইভানজেলিস্ট ধর্মেপ্রচারক ডা. রোন্ডাল চালান?”– “আপনি তো সব খবরই রাখেন। মাইকেলের হাত ধরে খোলা আঙ্গিনাতে নিয়ে গেলেন তাবাকা।

“না হলেও এর মূল্য অর্ধ মিলিয়ন ডলারস।” মাইকেলের প্রশ্ন শুনে কাঁধ আঁকিয়ে প্রসঙ্গ বদল করলেন রালেই, “আমি আপনাকে বর্ণবাদের সন্তানদেরকে দেখানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মাইকেল; কিন্তু তার আগে চলুন জাতির মাতা’র সাথে দেখা করি।”

উজ্জ্বল রঙা মাশরুমের মতো চারপাশে ছড়িয়ে আছে বীচ আমবেলা। সাদা প্লাস্টিকের টেবিলের চারপাশে বসে কোকাকোলা খেতে খেতে ট্রানজিস্টর থেকে জ্যাজ মিউজিক শুনছে আট থেকে নয় বছর বয়সী ডজনখানেক কৃষাঙ্গ ছেলে। সকলেরই গায়ের হলুদ রঙা টি-শার্টের বুকে গামা অ্যাথলেটিক ক্লাব” লেখা। মাইকেলকে দেখে কেউই উঠে না দাঁড়ালেও কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।

মূল দালানের কাঁচের দরজা খুলে মাইকেলকে লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন তাবাকা। দেয়ালে কারুকার্য করা কাঠের মুখোশ, পাথরের মেঝেতে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি কার্পেট।

“কোন ড্রিংক নেবেন মাইকেল? কফি অথবা চা?”

মাথা নাড়ল মাইকেল। “না; কিন্তু সিগারেট খেলে কিছু মনে করবেন?”

“আপনার অভ্যাস আমার মনে আছে।” হেসে ফেললেন তাবাকা। “ঠিক আছে; কিন্তু দুঃখিত কোনো দিয়াশলাই দিতে পারব না।”

হাতে লাইটার নিয়ে বড়সড় রুমটার উপরের দিকে তাকালো মাইকেল।

সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন এক নারী। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাইকেল। খুব ভালো করেই চেনে এ মুখ। ব্ল্যাক ইভিটা, জাতির মাতা নামেই সকলে তাঁকে চেনে। যাই হোক এই নারীর দৈহিক সৌন্দর্য আর রাজকীয় উপস্থিতি ফুটিয়ে তোলার সাধ্য কোনো ফটোগ্রাফের নেই।

“ভিক্টোরিয়া গামা” পরিচয় করিয়ে দিলেন তাকা, “ইনি মাইকেল কোর্টনি, যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”

“ইয়েস” সায় দিলেন ভিকি গামা। “আমি মাইকেল কোর্টনিকে ভালোভাবেই চিনি।”

স্থির আত্মপ্রত্যয় নিয়ে মাইকেলের কাছে এগিয়ে এলেন ভিক্টোরিয়া। পরনে নিষিদ্ধ ঘোষিত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের উজ্জ্বল সবুজ, হলুদ আর কালো কাফতান; মাথায় জড়ানো পান্না সবুজ পাগড়ি; উনার ট্রেডমার্ক’ই হলো এই পাগড়ি আর কাফতান।

মাইকেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন গাঢ় বাদামি রঙা হাত, দেহত্বক ঠিক ভেলভেটের মতই মসৃণ।

“আপনার মা আমার স্বামীর দ্বিতীয় পত্নী ছিলেন।” নরম স্বরে মাইকেলকে জানালেন ভিকি। “আমার মতই তিনিও মোজেস গামা’কে পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন। আপনার মা সত্যিই অসাধারণ, আমাদেরই একজন।”

“কেমন আছেন তারা?” মাইকেলকে সোফার কাছে নিয়ে যাবার পর বসতে বসতে জানতে চাইরৈন ভিকি গামা, “বহু বছর দেখা হয়নি উনার সাথে। এখনো ইংল্যান্ডেই আছেন? আর মোজেসের পুত্র-বেনজামিন?”

“হ্যাঁ, ওরা এখনো লন্ডনে থাকে।” জানাল মাইকেল। “এই তো কয়েকদিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। বেনজামিন তো বেশ বড় হয়ে গেছে। লিড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

“ইস যদি কখনো আবার আফ্রিকাতে ফিরে আসত”? বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবে খানিকক্ষণ গল্প করলেন দুজনে। অবশেষে জানতে চাইলেন,

“তো আপনি আমার সন্তানদেরকে দেখতে চেয়েছেন? বণর্বাদের সন্তানদেরকে?”

ভীষণ রকমভাবে কেঁপে উঠল মাইকেল। নিজের আটিকেলের জন্য ঠিক এই টাইটেলটাই ভেবে রেখেছে মনে মনে।

“ইয়েস, মিসেস গামা, আমি আপনার সন্তানদের সাথে দেখা করতে চাই।”

“প্লিজ আমাকে ভিকি নামে ডাকবেন। আমরা একই পরিবারের মাইকেল। আশা করছি আমাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশাগুলোও একই?”

“হ্যাঁ, অনেক বিষয়েই আমাদের বেশ মিল, ভিকি।”

আবারো মাইকেলকে সঙ্গে নিয়ে খোলা চত্বরে চলে এলেন ভিকি গামা। চারপাশের ছেলেদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাইকেলের সাথে।

“উনি আমাদের বন্ধু। তাই সহজভাবে সবকিছু খুলে বলবে, যা যা জানতে চাইবেন সবকিছুর উত্তর দিবে।” সংক্ষিপ্ত নির্দেশও দিয়ে দিলেন ভিকি।

নিজের জ্যাকেট আর টাই ছুঁড়ে ফেলে একটা ছাতার নিচে বসে পড়ল মাইকেল। চারপাশ ঘিরে ধরল ছেলেরা। মাইকেলের মুখে নিজেদের ভাষা শুনে অভিভূত ছেলেগুলো কলকল স্বরে কথা বলতে লাগল; কোনো রকম নোটপ্যাড ব্যবহার করারও প্রয়োজন বোধ করল না মাইকেল জানে কখনোই ভুলবে না এসব শব্দ; তরুণ কণ্ঠ।

কারো কারো গল্প বেশ মজার। কারোটা ভয়াবহ বেদনার। শার্শভিলের সেই দিনে শিশু অবস্থায় মায়ের পিঠের সাথে বাধা ছিল একটা ছেলে। মায়ের বুক ভেদ করে চলে যাওয়া বুলেটটা ওর এক পাও গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। অন্যরা ওকে “খোঁড়া পিট” বলে ক্ষ্যাপায়। শুনতে শুনতে মনে হল কেঁদে ফেলবে মাইকেল।

চোখের পলকে কেটে গেল পুরো বিকেল। ছেলেদের কেউ কেউ উলঙ্গ হয়ে পুলে নেমে গেল সাঁতার কাটতে।

ভিকি গামার পাশে বসে পুরো দৃশ্যই দেখলেন রালেই তাবাকা। মাইকেলের অবস্থা দেখে ভিকিকে জানালেন, “উনাকে আজ রাতে এখানেই রেখে দাও।” মাথা নাড়লেন ভিকি। রালেই বলে চললেন, “উনি ছেলে পছন্দ করেন। কেউ আছে নাকি?”

নরম হয়ে হাসলেন ভিকি। “উনি যেটা ইচ্ছে বেছে নিতে পারেন। আমার ছেলেরা যা বলব তাই করবে।”

উঠে দাঁড়িয়ে মাইকেলের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলেন ভিকি গামা।

“আপনি এখানে থেকেই আর্টিকেল লিখুন না? আজ রাতে আমাদের সাথেই থাকুন। উপরে আমার টাইপ রাইটার আছে, ব্যবহার করতে পারবেন। আগামী কালটাও কাটিয়ে যান। ছেলেরা তো আপনাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে…”

টাইপরাইটারের উপর উড়ে চলেছে মাইকেলের আঙুল। যেন তৈরিই ছিল এমনভাবে আপনা থেকেই মাথায় চলে আসছে একের পর এক লাইন। হৃদয়ের গভীর থেকেই অনুভব করল এর শক্তি। সত্যিই ভালো হয়েছে। লেখাটা। পৃথিবীকে জানাতে হবে এই “ছেলেমেয়েদের কথা।

আর্টিকেল লেখা শেষ হতেই উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপতে শুরু করল মাইকেল। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখা গেল প্রায় মধ্যরাত; অথচ জানে বাকি রাত একটুও ঘুম হবে না। শ্যাম্পেনের মতই রক্তে নাচন তুলেছে এই গল্প।

হঠাৎ করেই দজায় মৃদু টোকা শুনে অবাক হয়ে গেল মাইকেল। তাপরেও নরম স্বরে বলে উঠল, “দরজা খোলা আছে। ভেতরে এসো!” এক জোড়া নীল সকার শর্টস পরিহিত ছেলেটা বেডরুমে ঢুকে এগিয়ে এলো মাইকেলের দিকে।

“আমি আপনার টাইপ করার শব্দ শুনেছি। ভাবলাম হয়ত চা খেতে পছন্দ করেন।”

বিকেলের সুইমিং পুলে, মাইকেলের দেখা সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটা এখন দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। নিজের বয়স ষোল বলে জানালো ছেলেটা কালো একটা বিড়ালের মতই যেন নিমন্ত্রণ করছে।

“থ্যাঙ্ক ইউ।” ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিল মাইকেল, “ভালই লাগবে তাহলে।”

“কী লিখছেন আপনি?” চেয়ারের পেছনে এসে মাইকেলের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল ছেলেটা, “এটাই আপনাকে বলেছিলাম আজকে?”

“হ্যাঁ।” ফিসফিস করে উঠল মাইকেল। মাইকেলের কাঁধে হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হেসে ফেলল।

“আই লাইক ইউ।”

***

ভোরভেলায় পুলের পাশে বসে মাইকেলের আর্টিকেল শুনলেন রালেই তাবাকা। শেষ হতে বহুক্ষণ পর্যন্ত কেউই কোনো কথা বলতে পারল না।

“আপনি আসলে এক অসাধারণ জিনিয়াস।” অবশেষে জানালেন তাবাকা, “আমি আর কখনো এতটা শক্তিশালী কোনো লেখা পড়িনি। এটা কি ছাপাবেন?”

“এই দেশে না।” একমত হলো মাইকেল। “লন্ডনের গার্ডিয়ান আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদেরকে এ লেখা দেয়ার জন্য।”

“তবে তো বেশ ভাল হয়।” খুশি হলেন রালেই। “অত্যন্ত ধন্যবাদ। যত শীঘি পারেন পুরোটা শেষ করুন। অন্তত আজকের রাতটাও এখানে থাকুন। সাবজেক্টের কাছাকাছি থাকলে হাত খুলে লিখতে পারেন দেখছি!”

***

কী কারণে যে ঘুমটা ভেঙে গেল মাইকেল নিজেও জানে না। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল পাশে শুয়ে থাকা ছেলেটার উষ্ণ দেহ। ঘুমের ভেতরেই নড়ে উঠল ছেলেটা। হাত তুলে দিল মাইকেলের বুকে।

এরপরই আবারো শব্দটা শোনা যেতেই ঘুমন্ত ছেলেটার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল মাইকেল। নিচের তলা কিংবা বহু দূর থেকে ভয়ংকর কষ্ট পেয়ে কেউ আর্তনাদ করছে। আস্তে করে আন্ডারপ্যান্ট পরে নিঃশব্দে বেডরুম থেকে বের হয়ে প্যাসেজওয়েতে এলো মাইকেল। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করল।

আবারো অসম্ভব তীক্ষ্ণ স্বরে কে যেন আর্তনাদ করে উঠতেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল মাইকেল। কিন্তু নিচ পর্যন্ত যাবার আগেই শোনা গেল তাবাকা’র গলা।

“মাইকেল, কী করছেন ওখানে?” রালেই’র তীব্র চিৎকার শুনে থতমতো খেয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে থেমে গেল মাইকেল।

“শব্দ শুনলাম, ঠিক যেন-”

“কিছু না। আপনার রুমে চলে যান মাইকেল।”

“কিন্তু মনে হচ্ছে”

“আপনার রুমে যান।”

তাবাকা নরম স্বরে জানালেও উনার কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল যে অগ্রাহ্য করতে পারল না মাইকেল। ঘুরে আবার নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে তাবাকা আবার মাইকেলের হাত ধরে জানালেন, “মাঝে মাঝে রাতে চেনা শব্দ’ও অচেনা মনে হয়। আপনি কিছুই শোনেন নি মাইকেল। হতে পারে বিড়াল কিংবা বাতাস। সকালে কথা হবে। এখন ঘুমোতে যান।”

মাইকেল রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তাবাকা। তারপর সোজা রান্নাঘরে গিয়ে খুলে ফেললেন দরজা।

টাইলস্ করা মেঝের ঠিক মাঝখানে অর্ধ অনাবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জাতির মাতা, ভিক্টোরিয়া গামা। কোমর পর্যন্ত নিরাভরণ থাকাতে ফুটে রয়েছে সুদৃশ্য স্তন।

অথচ করছেন অত্যন্ত পৈশাচিক এক আচরণ। এক হাতে ভয়ংকর আফ্রিকান গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি চাবুক, আরেক হাতে জিনের গ্লাস। পেছনে সিংকের উপর রাখা বোতল।

রান্না ঘরে ভিকির সাথে গামা অ্যাথলেটিকস ক্লাবের আরো দুই সদস্যও আছে। মাত্র কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়া ছেলেগুলোও কোমর পর্যন্ত অনাবৃত। রান্নাঘরের লম্বা টেবিলটার উপর শোয় আরেকটা দেহকে দু’পাশে থেকে আটকে রেখেছে দু’জনে।

বোঝা গেল বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চলছে এই ধোলাই পর্ব। চাবুকের আঘাতে মাংস থেকে রক্ত ঝরছে কৃষাঙ্গ দেহ থেকে। শুয়ে থাকা লোকটার দেহের নিচে রক্ত জমে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে টাইলসের মেঝেতে।

“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?” হিসহিস করে উঠলেন তাবাকা, “বাড়িতে সাংবাদিক আছে খেয়াল নেই?”

“ও একটা পুলিশ স্পাই।” ঘোৎ ঘোৎ করে উঠলেন ভিকি। “বিশ্বাসঘাতক–টাকে আমি শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব।”

“তুমি আবারো মদ খেয়েছ?” ভিকির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে মারলেন তাবাকা। “গা গরম না করে এসব কাজে আনন্দ পাও না, না?”

ধকধক করে জ্বলছে ভিকির চোখ, হাতের চাবুক তুললেন রালেইকে মারবেন বলে।

কিন্তু কোনো কষ্ট ছাড়াই তার কব্জি ধরে চাবুকটাকে খসিয়ে সিঙ্কের উপর ফেলে দিলেন তাবাকা।

“একে সরাও এখান থেকে।” ইশারায় টেবিলের উপর শুয়ে তাকা রক্তাক্ত দেহটাকে দেখালেন রালেই। “এরপর পুরো জায়গা পরিষ্কার করে ফেলে। শ্বেতাঙ্গ লোকটা যতদিন আছে, এমন আর কিছু যেন না দেখি বাড়ির ভেতরে। বুঝতে পেরেছ?”

কাৎরাতে থাকা লোকটাকে টেবিল থেকে তুলে ধরে ধরে দরজার দিকে নিয়ে গেল ভিকি’র দুই বডিগার্ড।

এবারে ভিকি’র দিকে নজর দিলেন তাবাকা। “তোমার নামের সাথে কতবড় সম্মান জড়িয়ে আছে জানো না? এরকম যা তা কাজ করলে আমি নিজের হাতে তোমাকে খুন করব। এখন যাও, রুমে যাও।”

মদ খাওয়া সত্ত্বেও বেশ দৃঢ় ভঙ্গিতেই রুম ছেড়ে চলে গেলেন ভিকি। এভাবে যদি মিডিয়ার কাছে নিজের ইমেজটাকেও ধরে রাখতে পারে!

মাত্র কয়েক বছরেই এতটা বদলে গেছে ভিকি। মোজেস গামার সাথে বিয়ের সময় এই বহ্নি শিখাই ছিল স্বামী আর লড়াইয়ের প্রতি নিবেদিত। এরপরই আমেরিকার বামগুলো তাকে খুঁজে পেয়ে দেদারসে অর্থ আর প্রশংসা বিলোতে থাকে।

তখন থেকেই শুরু হয়েছে অধঃপতন। লড়াইটা যদিও কম ভয়াবহ নয় আর রক্তের নদী বিনা স্বাধীনতা পাওয়া যায় না; তারপরেও ভিকি গামা এখন যেন আনন্দ লাভেই বেশি ব্যস্ত থাকে; তাই খুব সাবধানে ভেবে বের করার সময় হয়েছে যে এই নারীকে নিয়ে কী করা যায়।

***

৪. কারপার্কে

কারপার্কে নিজের পরিত্যক্ত ভ্যালিয়ান্টের কাছে আবার মাইকেলকে ফিরিয়ে আনা হল। এবারে ভ্যানের সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন তাবাকা। আর পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে ছিল মাইকেল। নিজের পুরনো গাড়িটাকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাইকেল তো রীতিমতো বিস্মিত।

“কেউ এটা চুরি করার কষ্টও করেনি!”

“না” একমত হলেন রালেই। আমাদের লোকেরা পাহারা দিয়ে রেখেছিল। নিজেদের জিনিস আমরা ভালই দেখ ভাল করতে পারি।”

হ্যান্ডশেক করে মাইকেল ঘুরতে যেতেই থামালেন রালেই, “আপনার তো একটা প্লেন আছে তাই না মাইকেল?”।

“আরে ধূর!” হেসে ফেলল মাইকেল। “পুরনো একটা সেঞ্চুরিয়ন, এরই মাঝে তিন হাজার ঘণ্টা উড়ে ফেলেছে।”

“আমাকে একটু উপকার করতে হবে তাহলে।”

“আমি রাজি। বলুন কী করতে হবে?”

“বৎসোয়ানায় যাবেন?” জানতে চাইলেন তাবাকা।

“প্যাসেঞ্জার নিয়ে?”

“না। একা যাবেন-একাই ফিরবেন।”

“দ্বিধায় পড়ে গেল মাইকেল। “এটাও কী লড়াইয়ের অংশ?”

“অবশ্যই।” হৃষ্টচিত্তে উত্তর দিলেন রালেই, “আমার জীবনের প্রতিটি কাজই হলো লড়াই।”

“কখন যাবো?” নিজের সন্তুষ্টি ঢেকে রাখতে চাইলেন তাবাকা।

যাক লন্ডনের ফ্ল্যাটে ভিডিও করা ফুটেজ ব্যবহারের হুমকি দিতে হলো না!

“কখন আপনি সময় পাবেন?”

***

বাবা কিংবা অন্য ভাইদের মতো উড়ে বেড়ানোটাকে প্রথম দিকে আমল দেয়নি মাইকেল। এখন বুঝতে পারে যে আসলে মনে মনে ওদের কারও মতো না হতে চাওয়াটাই তাকে বিতৃঞ্চ করে তুলেছে এসবের প্রতি। যেমন চায়নি বাবার ইচ্ছে মতো নিজের জীবন পরিচালনা করতে।

পরবর্তীতে অবশ্য ফ্লাই করতে নিজেরই ভাল লাগত। নিজের সেভিংস থেকেই সেঞ্চুরিয়ন কিনেছে। বুড়ো হওয়া সত্ত্বেও দ্রুতগতির আরামদায়ক প্লেনটা মাত্র তিন ঘণ্টাতেই উত্তর বৎসোয়ানায় পৌঁছে দিল মাইকেলকে।

পুরো আফ্রিকাতে এই একটাই মাত্র গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি নিয়মিত নির্বাচনও হয়। আফ্রিকার অন্যান্য জায়গার তুলনায় দুর্নীতি প্রায় নেই বললেই চলে। বর্ণবাদ কিংবা জাতি বিদ্বেষও তেমন নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার পর এটাই আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ।

মন’য়ে নেমে এক কামরার ছোট্ট দালানটাতে কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে আবারো প্লেনে চড়ে বসল উত্তরে ওকাভাঙ্গো ব-দ্বীপের উদ্দেশ্যে।

বেশ বড় একটা দ্বীপের এয়ারস্ট্রিপে সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে ল্যান্ড করল মাইকেল। ক্যানোতে করে জলপদ্ম ভরা লেগুন পার করে দিল দু’জন মাঝি। ক্যাম্পে পৌঁছে গেল মাইকেল। ক্যাম্পের নাম গে গুজ লজ। ছবির মতো ছোট্ট কুঁড়ে ঘরগুলোতে চল্লিশ জন অতিথি থাকার মতো ব্যবস্থা আছে। এদের কাজ হল পড়াশোনা কিংবা চারপাশের জীব জগতের ছবি ভোলা। কৃষাঙ্গ মাঝিরা এসে প্রাচীন ক্যানোতে করে নিয়ে যায় খালে।

অতিথিদের বেশিরভাগই পুরুষ। সাউথ আফ্রিকা থেকে আগত এক রাজনৈতিক শরণার্থী এই ক্যাম্পের পরিচালক। মধ্য তিরিশের ব্রায়ান সাসকিন্ড দেখতেও বেশ সুদর্শন। লম্বা সোনালি চুল রোদে পুড়ে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। অলংকার পরতেও বেশ ভালবাসেন।

মাইকেলকে দেখেই এগিয়ে এলেন,

“গড ডার্লিং, আপনাকে দেখে সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। রালেই আমাকে সব জানিয়েছে। দেখবেন এখানে কত ভাল লাগবে। এত মজার সব লোক আছে এখানে। ওরাও আপনাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে আছে।”

অত্যন্ত রূপবান, তরুণ সোয়ানা স্টাফদেরকে দেখে বোঝা গেল সার্থক হয়েছে গে গুজ নাম।

উত্তেজনায় ভরপুর এক উইকেন্ড কেটে গেল ক্যাম্পে। ফেরার সময় মাকোরো ক্যানু পর্যন্ত সঙ্গে এলেন ব্রায়ান।

“বেশ ভাল লেগেছে, মিকি। মাইকেলের হাতে চাপ দিয়ে জানালেন, “আরো নিশ্চয় দেখা হবে। তবে সাবধানে টেক অফ করবেন। খানিকটা ভারিই হয়ে গেছে বোধহয়।”

প্যাসেঞ্জার সিটের নিচে গোপন কম্পার্টমেন্টে একবারও না তাকিয়ে টেক অফ করল মাইকেল।

ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টের কাস্টমস পার হবার সময় তো দম বন্ধ হয়ে আসছিল। যদিও ভিত্তিহীন ছিল ভয়। আগেও বহুবার দেখা হওয়াতে কাস্টমস অফিসার ওকে ভালোভাবেই চেনে। তাই লাগেজ কিংবা সেঞ্চুরিয়ন চেক্ করার কোন কষ্টই করল না।

সে রাতেই ল্যানসেরিয়ার হ্যাঙ্গারে কৃষাঙ্গ পাহারদার সেঞ্চুরিয়ন থেকে ভারি একটা বক্স নিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তুলে দিল নীল ডেলিভারি ভ্যানের ড্রাইভারের হাতে।

ড্রেকস ফার্মের নবস হিলের রান্নাঘরে ক্রেটের সীল পরীক্ষা করে দেখলেন তাবাকা। পুরোপুরি ইনট্যাক্ট। কেউ কার্গোতে হাতও দেয়নি। সন্তুষ্ট হয়ে ঢাকনা খুলে ফেললেন তাবাকা। পাওয়া গেল সন্তুর কপি পবিত্র বাইবেল। আরেকটা পরীক্ষায় উৎরে গেল মাইকেল কোর্টনি।

পাঁচ সপ্তাহ পরে আবারো গে গুজু ক্যাম্পে এলো মাইকেল। এবার ফেরার পথে নিয়ে এলো রাশিয়ায় তৈরি বিশটা মিনি লিম্পেট মাইন ভর্তি বাক্স। পরের দুই বছরে আরো নয়বার আসতে হল এই ক্যাম্পে। ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টে সাউথ আফ্রিকান কাস্টমস্ পার হতে আর কোনো খারাপ লাগে না।

পাঁচ বছর পরে আবারো দেখা হল রালেই তাবাকা’র সাথে। মাইকেলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আফ্রিকান ন্যাশন্যাল কংগ্রেসের সামরিক শাখায় যোগ দান করার জন্য।

“কয়েকদিন ধরেই আসলে ভাবছিলাম।” রালেইকে উত্তর দিল মাইকেল। “শেষ পর্যন্ত মনে হল কলম আসলে যথেষ্ট নয়। বুঝতে পেরেছি কখনো কখনো তলোয়ার’ও ধরতে হয়। এক বছর আগে হলেও হয়ত আপনার কথায় রাজি হতাম না। কিন্তু এখন, সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।”

***

“অল রাইট বেলা-” দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম। “তুমি রাস্তার ওই মাথা থেকে শুরু করবে-আমি এই মাথা থেকে। এরপর শফারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্লোনকি, আমাদেরকে মোড়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে যাও। লাঞ্চটাইমে আবার নিয়ে যাবে।”

বাধ্য ছেলের মতো হলুদ ডেইমলার’কে স্লো করল ক্লোনকি।

গাড়ি থেকে নেমে এলো দুই নারী। “তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে ভোটাররা তোমাকে এত দামি আর বিশাল কোনো ওয়াগনে চড়তে দেখুক।” বুঝিয়ে বললেন সেনটেইন। নাতনীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুব সাবধানে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।

শ্যাম্পু করা লাল রঙা চুলগুলো মাথার উপরে চূড়া করে বাঁধা। ময়েশ্চারাইজার ক্রীম লাগানো মুখখানা দেখতে স্কুল গার্লদের মতো লাগছে। সন্তুষ্ট হলেন সেনটেইন।

“ঠিক আছে, বেলা, চলো। মনে আছে তো, আজ তুমি নারীদের সাথে কথা বলবে!” দিনের এই সকাল দিকটায় ঘরের পুরুষেরা বাইরে চলে যায়; বাচ্চারা স্কুলে থাকায় লোয়ার মিডল ক্লাস হাউস ওয়াইভরা ব্যস্ত থাকে গৃহকর্ম নিয়ে।

এর আগের দিন সন্ধ্যায় স্ িপয়েন্ট ম্যাসোনিক হলে পুরুষ দর্শকদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছে ইসাবেলা। বেশির ভাগই আগ্রহ নিয়ে এসেছিল ন্যাশনাল পার্টির প্রথম নারী ক্যান্ডিডেটের কথা শোনার জন্য।

হলে’র কেউ কেউ বেলা’র ড্রেস আর মেক-আপ দেখে হুইসেল দিয়ে উঠতেই খেপে উঠল, নার্ভাস বেলা। ফলে একদিকে লাভও হলো। সাপের মতো ফনা তুলে ছোবল হানল প্রথম সুযোগেই, “জেন্টলম্যান, আপনাদের ব্যবহার কারো কোনো লাভ হবে না। বরঞ্চ খেলার মানসিকতা থাকলে, আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন কী হয়।”

লজ্জিত মুখে হেসে নীরব হয়ে গেল উপস্থিত দর্শক।

অন্যগুলোর চেয়ে খানিকটা দূরত্ব রেখে বানানো হয়েছে করাগেটেড টিনের ছাদঅলা নাম্বার টুয়েলভ কটেজ। সামনের বাগানে ফুটে আছে চমৎকার সব ডালিয়া। বাড়ির সামনে এসে চিৎকাররত ফক্স টেরিয়ারকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিল ইসাবেলা। কুকুর আর ঘোড়ার সাথে ওর কোনো সমস্যাই হয় না কোনোদিন।

দরজার কাছে এসে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে উঁকি দিয়ে দেখছে ঘরের গৃহিণী জানতে চাইল,

“ইয়েস? কী চান?”

“আমি ইসাবেলা কোর্টনি। আগামী মাসের বাই-ইলেকশনে ন্যাশনাল পার্টির ক্যান্ডিডেট। কিছুক্ষণ আপনার সাথে কথা বলতে পারি?”

“দাঁড়ান।” ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেও একটু পরেই মাথায় স্কার্ফ চাপিয়ে ফিরে এলো।

“আমরা ইউনাইটেড পার্টির সমর্থক।” দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা করল মহিলা। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ইসাবেলা।

“ডালিয়াগুলো কী সুন্দর!”

বোঝাই যাচ্ছে এটা প্রতিদ্বন্দীদের গোড়া সমর্থকের আখড়া। তার নিজের পার্টিও কোনো নিরাপদ আসনে লড়তে দেবে না। এসব আসন কেবল তাদের জন্যই বরাদ্দ যারা এরই মাঝে সফল হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। নানা। গত সাধারণ নির্বাচনে পাঁচ হাজার মেজরটি নিয়ে এই আসন জিতেছে ইউনাইটেড পার্টি।

“যদি আমরা একে তিন হাজারে নামিয়ে আনতে পারি তাহলে পরের ইলেকশনে ওদেরকে বাধ্য করতে পারব তোমাকে আরো ভালো আসন দেয়ার জন্য।” হিসাব করে ফেলেছেন নানা।

নিজের ডালিয়ার দিকে ইসাবেলা’কে মুগ্ধ চোখে তাকাতে দেখে এবারে নরম হয়ে গেল ঘরের স্ত্রী।

“আমি কি একটু ভেতরে আসতে পারি?” নিজের সবচেয়ে চমৎকার হাসি হাসল বেলা; একপাশে সরে দাঁড়াল মহিলা।

“ঠিক আছে, কিন্তু শুধু কয়েক মিনিটের জন্য।”

“আপনার স্বামী কী করেন?”

“মোটর মেকানিক।”

“ট্রেড ফ্রাগমেন্টেশন আর ব্ল্যাক ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে উনি কি কিছু ভাবেন?” মোক্ষম জায়গায় আঘাত হেনেছে ইসাবেলা। পরিবারের সমৃদ্ধি আর ছেলে-মেয়েদের অন্নের কথা মনে পড়ে গেল।

“আপনাকে এক কাপ কফি দেব মিসেস কোর্টনি?” মহিলার ভুল ভাঙ্গালো না বেলা।

পনের মিনিট পরে মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করে বের হয়ে এলো ছোট্ট বাগান থেকে। নানা’র কথা মতই কাজ করেছে : “চাপ দেবে কিন্তু সংক্ষেপে।”।

মনে হচ্ছে, জিতে গেছে। প্রথমে “না” বললেও ধীরে ধীরে “হয়ত” তে নেমে এসেছে মহিলা।

রাস্তা পেরিয়ে এগারো নাম্বার দরজার কাছে আসতেই খুলে দিল ছোট্ট একটা ছেলে।

“তোমার মা বাসায় আছেন?”

জ্যাম লাগানো আধখানা পাউরুটি এক হাতে নিয়ে, ইসাবেলাকে দেখে লাজুক হাসি হাসল সোনালি কোঁকড়া চুলঅলা ছেলেটা।

নিকি’র কথা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল বেলা।

“আমি ইসাবেলা কোর্টনি, আগামী মাসের বাই ইলেকশনে ন্যাশনাল পাটি ক্যান্ডিডেট। এরই মাঝে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে বাচ্চাটার মা।

তিন নম্বর ঘর শেষ হবার পর অবাক হয়ে আপন মনেই নিজের আনন্দ অনুভব করল বেলা। বেশ মজা তো! জীবনের এমন একটা দিক দেখছে যার অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। সাধারণ সব কথাবার্তার মাধ্যমেই বুঝতে পারছে ওদের সমস্যা আর ভয়গুলো। কী করা যায় ভেবে এরই মাঝে চিন্তায় পড়ে গেছে।

বাবা প্রায়ই একটা কথা বলেন, “ক্ষমতাবানদের দায়িত্বও বেশি।” কথাটা বুঝতে পারলেও কখনো তেমন করে ভাবেনি বেলা। ব্যস্ত ছিল নিজের জগৎ, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।

আর এখন মেশার পর অনুভব করছে সত্যিকারের এক সহানুভূতি আর ওদের নিরাপত্তা দেয়ার এক আত্মিক টান।

মা হবার ফলেই হয়ত এ পরিবর্তন এসেছে; ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে হল সে এদেরকে সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে চায়।

খানিকটা বিরক্ত লাগল, যখন আট নম্বর ঘর ভিজিট করার পর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নানার সাথে দেখা করার সময় হয়ে গেছে।

রাস্তার কোণায় নাতনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন নানা।

যে কোনো তরুণীর মতই সতেজ আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর নানা বেলাকে দেখেই জানতে চাইলেন, “কেমন কাটল দিন? কয়টা সাড়া পেয়েছ?”

“আট।” সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তর দিল বেলা।”দুটো-ইয়েস আর একটা-হয়ত। তোমার কী খবর?”

“চৌদ্দটার মাঝে পাঁচটাতে ইয়েস। হয়ত কিংবা হতে পারে’কে আমি কখনো গণনায় ধরি না।”

হলুদ ডেইমলার এগিয়ে এসে গতি ধীর করতেই গাড়িতে উঠে বসল দু’জনে।

“এবার কাজ হলো, ঘরে ফেরার পরেই প্রত্যেককে নিজ হাতে নোট লিখে পাঠিয়ে দেবে। বাচ্চাদের নাম, বয়স, কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নোট করে এনেছ না?”

“প্রত্যেককেই লিখতে হবে?”

“হ্যাঁ, সবাইকে। হ্যাঁ, না, হয়ত, প্রত্যেককে। এরপর নির্বাচনের আগে আরেকবার মনে করিয়ে দেবে নোট পাঠিয়ে, ঠিক আছে?”

“এত কাজ করতে হবে, নানা?” প্রতিবাদ করতে চাইল বেলা।

“পরিশ্রম বিনা কিছুই অর্জন করতে পারবে না, ডিয়ার।” ক্রীম রঙা চামড়ায় সোফায় আরাম করে বসে আরও জানালেন, আজ সন্ধ্যায় মিটিং’র কথা মনে আছে না? বক্তৃতা লিখে ফেলেছ? কী বলবে সব ঠিক করে নাও। একসাথে যাবো দুজনে।”

“নানা, বাবা’র এখনো একগাদা কাজ জমে আছে আমার হাতে।”

“এসব বাতিল করে দাও।”

সেক্রেটারিকে দিয়ে প্রত্যেক ভোটারের জন্য নোট টাইপ করিয়ে নিজের হাতে চেক করে সাইন করে দিল বেলা।

***

সেনটেইন হাউজের কোণার একটা স্যুইট বেলা’কে অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন শাসা। বেলা’র নতুন সেক্রেটারি গত বিশ বছর ধরে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজে কাজ করছে। ইসাবেলা’র ইনার অফিস সাজানো হয়েছে দুইশ বছরের পুরাতন একটা বিল্ডিং থেকে খুলে আনা কাঠের প্যানেল দিয়ে। উজ্জ্বল মাখন রঙা কাঠের কাজ ছাড়াও শাসা মেয়েকে কানেকশন থেকে চারটা পেইন্টিংস দিয়েছেন। পিয়ারনিফ আর হুগো নড়ের আঁকা।

স্যুইটের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে পার্ক আর সেন্ট জর্জ ক্যাথেড্রাল। বহুদূরের টেবল মাউন্টেনও অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।

সবশেষ চিঠিটাতে সাইন করেই সেক্রেটারি’র অফিসে গেল বেলা। দেখা গেল শূন্য অফিসে কেউ নেই। হাত ঘড়িতে সময় দেখেই আঁতকে উঠল, “ওহ্ ঈশ্বর! এরই মাঝে পাঁচটার বেশি বাজে।”

নিকি’কে হারাবার পর থেকে এত দ্রুত সময় আর কখনো যায়নি। কঠোর পরিশ্রম করেই নিজের দুঃখ ভুলে থাকে বেলা।

ওয়েল্টেভ্রদেনে ডিনার হয় সাড়ে আটটায়, আধ ঘণ্টা আগে ককটেল। সময় আছে এখনো, তাই আবারো নিজের ডেস্কে ফিরে এসে দেখল ড্রাফট কফি রেখে গেছেন বাবা। উপরে নোট : “কাল সকালেই এটা ফেরৎ চাই। লাভ ইউ, বাবা।”

অ্যামব্যাসিতে থাকার সময় থেকেই বাবার লিখিত বক্তব্য কিংবা রিপোর্ট চেক করে দেয় বেলা। এ সাহায্যটুকু শাসা’র না হলেও চলে। তারপরও পিতা কন্যা দুজনেই আনন্দ পায় এ কাজটুকু করতে।

বারো পাতার রিপোর্টটা খুব সাবধানে চেক করে একটা মাত্র পরিবর্তনের সুপারিশ করে নোট লিখল বেলা : “আমার বাবা’টা কত বুদ্ধিমান!” জানে মেয়ের প্রশংসা বেশ উপভোগ করেন শাসা।

বাবা’র অফিস লক করা থাকলেও নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বেলা।

বাবার এই অফিস তার নিজের অফিসের চেয়েও চারগুণ বেশি বড় আর

ভার্সেইলেসের ডফিন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে লিনামে কেনা ১৭৯১ সালের ডেস্কের উপর রিপোর্টটাকে রাখতে গিয়েও থেমে গেল বেলা। দেশের নিরাপত্তার সাথে জড়িত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ফাইলটা এভাবে ভোলা রাখা ঠিক হবে না।

বাবা’র পার্সোনাল সেফে রাখতে গিয়ে ফলস্ বুককেস সরিয়ে ফেলল বেলা। বুককেসের উপরে থাকা বাম্বের ব্রাকেটের সাথে লাগানো আছে এর হুড়কো। ব্রাকেটটা ঘোরাতেই ফলস বুককে খানিকটা সরে গেল।

শাসা নিজে ছাড়া এর কম্বিবেশন আর জানে একমাত্র বেলা; নানা কিংবা গ্যারি’ও জানে না।

কম্বিনেশন সেট করে ভারি স্টিলের দরজাটা খুলে ভেতরে পা রাখল বেলা। রুমটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রায়ই বাবার সাথে চিৎকার করে। আর এখন তো দেখে হযবরল অবস্থা। দুটো সবুজ আর্মসকোর ফাইল স্তূপ হয়ে আছে মাঝখানের টেবিলের উপর। তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে সে হাউজ লক করে লেডিস ওয়াশরুম ঘুরে এলো বেলা।

এরপর মিনি’তে বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, এত ক্লান্তিকর একটা দিন কাটালেও রক্ষে নেই। ডিনারের পর ইলেকশন মিটিং আছে। মাঝরাত পার হয়ে যাবে বিছানায় যেতে যেতে।

একবার ভাবল শর্টকাট ধরে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে যাবে। কিন্তু গাড়িটা মনে হল কোনো এক অদৃশ্য শক্তির টানে চলে এলো ক্যাম্পস বে পোস্ট অফিসে।

প্রতিবারের মতো এবারেও পেটের মাঝে পা দিয়ে উঠল; বক্সের সামনে এসে দাঁড়াতেই মনে হল আজও শূন্যই দেখবে? কতদিন নিকি’র কোনো খবর পায় না।

কিন্তু বাক্সটা খুলতেই মনে হল বুকের ভেতর লাফ দিল হৃদপিণ্ড। চোরের মতো ছোঁ মেরে চিকন খামটা তুলে নিয়েই চালান করে দিল জ্যাকেটের পকেটে।

অভ্যাস মতো সৈকতের উপরে গাড়ি পার্ক করে খাম খুলে পড়ে ফেলল চার লাইনের টাইপ করা নির্দেশিকা।

নতুন কাজ দেয়া হয়েছে।

অর্ডার মুখস্থ করেই চিঠিটা পুড়ে ছাই বানিয়ে ফেলল বেলা।

***

লাল গোলাপের চিঠি পাবার তিন দিন পর শুক্রবার সকালবেলা ক্লেয়ারমেন্টের নতুন পি এন পে সুপারমার্কেটের সামনে মিনি পার্ক করল ইসাবেলা।

ড্রাইভারের দরজা বন্ধ করলেও নির্দেশ মতো ইঞ্চিখানেক ভোলা রাখল।

দ্রুত সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়ে বাম দিকে মোড় দিল বেলা। ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেল নতুন পোস্ট অফিসে।

বামদিকের প্রথম পাবলিক টেলিফোন বুথের কাঁচের কিউবিকলে কথা বলছে এক জোড়া কিশোরী।

ঘড়িতে সময় দেখল বেলা। এক ঘণ্টা হতে পাঁচ মিনিট বাকি। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে খুব।

কাঁচের দরজায় নক করল বেলা। অসম্ভব বিরক্ত হয়ে রিসিভার নামিয়ে রেখে বের হয়ে এলো মেয়ে দুটো। তাড়াহুড়া করে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল বেলা।

রিসিভার না তুলেই পার্সের ভেতর কিছু খোঁজার ভান করল। চোখ কিন্তু হাতঘড়ির দিকে। বারোটার ঘরে কাটা যেতেই বেজে উঠল টেলিফোন।

“লাল গোলাপ” এক নিঃশ্বাসে ফিসফিস করতেই শুনতে পেল, “এখনি গাড়ির কাছে ফিরে যাও।” কেটে গেল কানেকশন। মানসিক এক অস্থিরতার মাঝেও, প্রায় তিন বছর আগে টেমস্ নদীর তীরে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়া বিশালদেহী সেই নারীর ভারি কণ্ঠস্বর চিনতে পারল বেলা।

ক্রেডল রিসিভার রেখেই বুথ থেকে বেরিয়ে এলো বেলা। তিন মিনিটে পৌঁছে গেল কারপার্কে। চাবি ঢুকিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই দেখা গেল ড্রাইভারের সিটের উপর খাম পড়ে আছে।

কারপার্কের চারপাশে দ্রুত একবার চোখ বোলাল বেলা। নিশ্চিতভাবেই জানে যে, কেউ একজন তার উপর নজর রেখেছে। কিন্তু শপিং ট্রলি ঠেলতে থাকা ক্রেতার দল, ভিখারি আর স্কুল ফেরত অলস ছেলে-মেয়ের ভিড়ের মাঝে তাকে খুঁজে পাবার কোন উপায় নেই। তাই গাড়িতে উঠে সাবধানে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে এলো বেলা। চিঠিটা নিশ্চয়ই এতটা গুরুত্পূর্ণ যে পোস্টাল সার্ভিসকেও ভরসা করা যায়নি। নিজের বেডরুমের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাঝে বসে খামটাকে খুলে ফেলল।

সবার প্রথমে চোখে পড়ল নিকির একেবারে লেটেস্ট রঙিন একটা ছবি। প্রায় তিন বছর বয়সী নিকি বাথিং ট্রাংকস্ পড়ে, পেছনে সমুদ্র নিয়ে দাঁড়িয়ে সৈকতের সাদা বালির উপর।

ছবির সাথে আসা চিঠির লেখাগুলো যেন দৈব বাণী :

“যত দ্রুত সম্ভব কেপ পোনিনসুলাতে সিলভার মাইন নেভাল হেডকোয়াটার’স এর উপর লাগানো সিমেন্স কম্পিউটার লিঙ্কড কোস্টাল রাডার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করো।

পুরো পরিকল্পনা আমাদেরকে ডেলিভারী দেয়ার পরপরই ছেলের সাথে প্রথমবারের মতো দেখা করার সুযোগ পাবে।”

কোনো সিগনেচার নেই স্পষ্ট ভাষায় লেখা চিঠিতে।

বাথরুমের টয়লেটের বোলের ভেতরে চিঠিটা পুড়িয়ে ছাই ফেলে দিল বেলা। কাজ শেষ করে টয়লেট কাভারের উপর বসে তাকিয়ে রইল বিপরীত দিকের টাইলস করা দেয়ালের দিকে।

অবশেষে এলো সেই কাজ জানত যে কখনো না কখনো আসবেই। তিন বছর অপেক্ষার পর এবার এলো বিশ্বাসঘাতকতার পালা।

ফেরার আর কোনো পথ নেই। চাইলে এখনো পরিত্যাগ করতে পারে ছেলের আশা অথবা এগিয়ে যেতে পারে বিপদজনক অনিশ্চিতের দিকে।

“ওহ ঈশ্বর! আমাকে সাহায্য করো।” জোরে জোরে চিৎকার করে উঠল। বেলা, “এখন আমি কী করব?”

বুঝতে পারছে ভয়ংকর এক অপরাধবোধ সাপের মতো। ফেলছে; তারপরেও প্রশ্নের উত্তরটা ঠিকই জানে।

এই মুহূর্তে সেনটেইন হাউজের বাবা’র সেফ রুমে পড়ে আছে সিমেন্স রাডার ইনস্টলেশন রিপোর্টের কপি। সোমবারের মধ্যেই ফাইলটাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে সিলভার মাইন মাউন্টেলের নিউক্লিয়ার প্রুফ বাঙ্কারে।

যাই হোক, আনন্দের সংবাদ হচ্ছে ছুটি কাটাতে বাবা ক্যামডি শীপ র‍্যাঞ্চে যাবে। কাজের কথা বলে এরই মাঝে এড়িয়ে গেছে বেলা। গ্যারি ইউরোপে আর নানা গান-ডগ ট্রায়ালনিয়ে ব্যস্ত। তাই সেনটেইন হাউজের পুরো টপ্ ফ্লোর বেলা’র জন্য খালি পড়ে থাকবে।

***

উত্তুরে হাওয়া বইছে চারপাশে। ধূসর রঙা আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে রুপালি তুষার কণা।

সমাধি ক্ষেত্রে ডজনখানেক পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই কোনো নারী। এখনকার মতো বেঁচে থাকা কালীনও জো সিসেবোর জীবন ছিল নারীশূন্য। জো সিসেরোর কোনো বন্ধুও ছিল না। সবাই তাকে হয় ভয় পেত, নতুবা শ্রদ্ধা করত।

রাইফেল আকাশের দিকে তুলে মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে এলো গার্ডের দল।

শোক প্রকাশের জন্য আসা অফিসাররা এতক্ষণ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে গার্ডের দল অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ফিরে যেতেই একে অন্যের সাথে হ্যান্ডশেক করে গাড়িতে ফিরে গেল সকলে।

রয়ে গেল কেবল একজন। রামোন মাচাদো। কেজিবি কর্নেলের ফুল ইউনিফর্মের নিচে মাথায় ঘুরছে কয়েকটা লাইন, “এতদিনে তোমার খেলা ফুরোল বুড়ো শূয়োর, কিন্তু বড় দেরি করে ফেললে।” দুই বছর আগে থেকেই সেকশন হেড হলেও জো সিসেরো বেঁচে থাকাকালীন পদবীটা কখনোই পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেনি রামোন।

বীরত্বের সাথে মারা গেছে বুড়োটা। বহু মাস ঠেকিয়ে রেখে ছিল ক্যান্সারকে। এমনকি শেষ দিনও অফিসে এসেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে গেছেন রামোনকে।

“গুডবাই জো সিসেরো। এবার শয়তান তোমাকে মজা দেখাবে।”

হেসে ফেলল রামোন। ঠাণ্ডায় ঠোঁট জোড়া মনে হল ফেটেই যাবে।

অপেক্ষমাণ শেষ গাড়িটাতে এসে চড়ে বসল রামোন। পদাধিকার বলে কালো চাইকা আর কর্পোরাল ড্রাইভারও পাচ্ছে। ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই ব্যাক সিটে বসে কাঁধ থেকে তুষার কণা ঝেড়ে ফেলল রামোন।

“ব্যাক টু দ্য অফিস।”

মস্কো’কে ভালবাসে রামোন। ভালবাসে জোসেফ স্ট্যালিনের বানানো চওড়া বুলেভাদগুলোকে। উত্তেজিত হয়ে উঠে সোভিয়েত বিশালতা দেখে।

কোথাও কোন ধরনের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন নেই। কোকাকোলা, মার্লবোরো। ইনস্যুরেন্স কিংবা সান।

চাইকার ব্যাকসিট থেকে রাস্তায় রাশান জনগণকে দেখে একধরনের আত্মতৃপ্তি বোধ করল রামোন। এরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের উন্নতির কথা ভাবে, ব্যক্তির কথা নয়। ধৈর্য ধরে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাস স্টপে, খাবারের সারিতে।

মনে মনে এদের সাথে আমেরিকানদের তুলনা করে দেখল। সেখানে সারাক্ষণ একে অন্যের পেছনে লেগে থাকে। লালসা যেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ আর ধৈর্য হল সর্বনিকৃষ্ট। ইতিহাসে আর কোনো জাতি কি আছে যারা গণতন্ত্রের আদর্শকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা আর অধিকার রক্ষা মানে হল বাকি সমাজকে অবজ্ঞা করা? এমন কোনো জাতি আছে যেখানে আছে বনি অ্যান্ডক্লাইড, আল-কাঁপোন, বিলি দ্য কিড, মাফিয়া আর ব্ল্যাক ড্রাগ লর্ডদের মতো অপরাধী?

ট্রাফিক লাইট দেখে থেমে গেল চাইকা।

দুটো পাবলিক বাস ব্যতীত এটাই রাস্তায় একমাত্র গাড়ি। প্রতিটি আমেরিকানের নিজস্ব অটোমোবাইল থাকে; কিন্তু রাশান সমাজে অর্থকে এভাবে খোলামকুচির মতো ছিটানো হয় না। গাড়ির সামনে দিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলে যাওয়া পথচারীদের দিকে তাকাল রামোন, সুদর্শন আর বুদ্ধিদীপ্ত মুখগুলোতে ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার ছাপ। পোশাক নিয়ে আমেরিকান রাস্তার মতো বন্য উন্মাদনা চোখে পড়ল না। মিলিটারি ইউনিফর্ম বিনা নারী-পুরুষ সকলেরই পোশাক বেশ মার্জিত আর রুচিসম্পন্ন।

এহেন শিক্ষিত আর বিদ্বানদের তুলনায় আমেরিকানগুলো তো অশিক্ষিত গোঁয়ার। রাশান খামারে কাজ করা যেসব শ্রমিক, তারাও পুশকিন থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারবে। ব্ল্যাক মার্কেটে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয় এসব বস্তুগুলোর মাঝে ক্লাসিক বইও আছে। লেলিনগ্রাডের আলেকজান্ডার নেভস্কি সমাধিক্ষেত্রে গেলেই দেখা যায় দেস্তরভস্কি আর চাইকোভস্কির সমাধি সাধারণ মানুষের দেয়া তাজা ফুলে ছেয়ে আছে। এর তুলনায় আমেরিকানদের অর্ধেক গ্র্যাজুয়েট বিশেষ করে কালোরা ব্যাটমান কমিকু বুক’ই ভালো করে পড়তে পারে না।

এমনকি রাশান অর্থনীতিও পশ্চিমাদের চোখে ধোয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়। খাবারের সারিতে দীর্ঘ লাইন আর দানবীয় জি ইউ এম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কনস্যুমার গুডসের অভাব দেখে আমেরিকানরা ভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়েছে পুরো সিস্টেম। অথচ তাদের চোখে পড়েনি-সামরিক উৎপাদন মেশিনের গোপন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। আমেরিকান পুঁজিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীকে যা বহু আগেই পিছনে ফেলে গেছে।

তেমনভাবে রামোন এও জানে যে রাশান সামারিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যাখ্যান হবার কিংবা “সমান অধিকারের” নামে শিফটিং হবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে শুধু সর্বশ্রেষ্ঠরাই থাকে; সে নিজে যেমন একজন, সর্বশ্রেষ্ঠ একজন।

ঝরঝিনস্কি স্কোয়ারে চাইকা পৌঁছাতেই নিজের আসনে সিধে হয়ে বসল রামোন।

পাহাড়ি পথ বেয়ে লুবিয়াঙ্কা’র দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি।

অন্যান্য কেজিবি ভেহিকেলগুলোর সারিতে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। দরজা খুলে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করল রামোন। তারপর বিশাল কাস্ট আয়রনের গ্রিলের দরজা খুলে দালানের ভেতর ঢুকে গেল।

সামনের সিকিউরিটি ডেস্কে আরো দু’জন কেজিবি অফিসার আছে। অপেক্ষা করল ক্লিয়ারেন্সের জন্যে নিজের টার্ন আসার। সিকিউরিটি গার্ডের ক্যাপটেন ব্যাটা মহা শয়তান। রেজিস্টারে সাইন করতে দেয়ার আগে তিনবার রামোনের চেহারা মিলিয়ে দেখল আইডেনটিটি ডকুমেন্টের ছবি’র সাথে।

কাঁচ আর পলিশ করা ব্রোঞ্জেরও অ্যান্টিক লিফটে চড়ে সেকেন্ড ফ্লোরে উঠে এলো রামোন। বিপ্লবের আগে এ বিল্ডিংও ছিল বিদেশি অ্যামব্যাসী। সেখান থেকেই এসেছে লিফট আর ঝাড়বাতিগুলো।

অফিসে ঢুকতেই ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে গেল সেক্রেটারি।

“গুড মর্নিং, কমরেড, কর্নেল।” দেখতে পেল সারা রাত জেগে চুল ঠিক করে শক্ত পোক্ত কোঁকড়া বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। খোলা আর মসৃণ থাকলেই বরঞ্চ বেশি ভালোবাসে রামোন। এয়ারফোর্সের মৃত টেস্ট পাইলটের বিধবা পত্নী ক্যাটরিনার বয়স চব্বিশ।

ডেস্কের কোণায় থাকা কার্ডবোর্ডের বাস্কের দিকে নির্দেশ করে মেয়েটা জানতে চাইল, “এটা দিয়ে আমি কী করব কমরেড় কর্নেল?”

ঢাকনা খুলতেই রামোন ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল জেনারেল সিসোরো’র ব্যবহৃত কিছু জিনিস। ডেস্কের ড্রয়ার পরিষ্কার করে ফেলায় এবারে সবকিছু রামোন একাকী ভোগ করতে পারবে।

বক্সে একটা পার্কার বলপেন আর ওয়ালেট ছাড়া আর কোনো পার্সোনাল আইটেম নেই। ওয়ালেটটা তুলে নিল রামোন। খুলতেই দেখল ভেতরে আধ ডজন ছবি। বিখ্যাত আফ্রিকান লীডারদের সাথে পোজ দিয়েছেন জো সিসেরো।

বক্সে ওয়ালেটটা রাখতে গিয়ে ক্যাটরিনার নরম আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল রামোনের হাতে। খানিকটা কেঁপে উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল মেয়েটা।

“এগুলো সব আর্কাইভে নিয়ে যাও। ওদের কাছ থেকে রশিদ নিয়ে আসবে।”

“এখনি যাচ্ছি” কমরেড কর্নেল।”

রামোন আর এই আকর্ষণীয় মেয়েটার সম্পর্ক মোটামুটি সবাই জানে। বুড়ো বাপ-মা আর তিন বছর বয়সী পুত্র সন্তান থাকলেও ক্যাটরিনার ফ্ল্যাটই ছিল মস্কোতে থাকাকালীন রামোনের আবাস স্থল।

“আপনার ডেস্কে একটা সবুজ রাঙা প্যাকেজও আছে কমরেড কর্নেল।” আজ রাতেই মস্কো ছেড়ে যেতে হবে বলে বিরক্ত হলো রামোন। দুই বছর হয়ে গেলেও ক্যাটরিনার আবেদন এখনো পুরোপুটি-অটুট, অক্ষত।

রামোনের মনের কথা নিশ্চয় টের পেয়ে গেছে মেয়েটা, তাই গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে জানালো, “যাবার আগে আজ ফ্ল্যাটে খাবেন? মাম্মা বেশ ভালো একটা সসেজ আর ভদকা পেয়েছে।”

“ঠিক আছে; তবে সামান্য” নিজের অফিসে ঢুকে গেল রামোন।

নিজের টিউনিক খুলে ডেস্কে থাকা সবুজ রঙা বাক্সটার সিকিউরিটি সীল ছিঁড়ে ফেলল।

লাল গোলাপ কোড পড়তেই দ্রুত হয়ে গেল হৃদপিণ্ডের গতি। ব্যাপারটাতে নিজেই উপরই যারপরনাই বিরক্ত হলো।

তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য শত শত এজেন্টের মতই একজন লাল গোলাপ। কিন্তু বক্স থেকে কোল্ডার তুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল স্প্যানিশ পাহাড়ি নদীর বুকে কালো পাথরের উপর শুয়ে থাকা এক অনাবৃত নারী দেহের ছবি। দশ্যটা এতটাই স্পষ্ট যে গভীর নীল চোখ জোড়া’ও দেখা যাচ্ছে।

ফাইল খুলতেই দেখা গেল সাউথ আফ্রিকান নেভাল রাডার চেইনের রিপোর্ট। লন্ডন অ্যামবাসী ব্যাগের মাধ্যমে এখানে এসেছে। সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়ল রামোন। সামনে ল বুক খুলে ডিপার্টমেন্টাল ইন্টারকমের হ্যান্ডসেট তুলে ডায়াল করল।

“একটা প্রিন্টআউট। রেফারেন্স প্রোটিয়া, আইটেম নাম্বার-১১৭৮। খুব জরুরি।”

প্রিন্টআউটের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল রামোন। বাইরের দৃশ্য অত্যন্ত নান্দনিক হলেও বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো স্মৃতি। একই সাথে চিন্তায় এলো মাঝ রাতে শেরিমেতইয়েভো এয়ারপোর্টে শুরু হওয়া ভ্রমণ আর তার শেষে অপেক্ষারত বাচ্চাটার কথা।

দুই মাস কেটে গেছে, নিকোলাসের সাথে ওর দেখা হয়নি। এতদিনে নিশ্চয় আরেকটু বড় হয়ে গেছে। এই বয়সেই ওর শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পিতা সুলভ কোনো অনুভূতি মনের মাঝে স্থান দিতে চায় না রামোন। তাই জানালায় দাঁড়িয়ে দিবা-স্বপ্ন দেখারও কোনো মানে হয় না। হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে হলো আটচল্লিশ মিনিট পরের মিটিংটা হয়তো আগামী দশকের জন্য ওর ক্যারিয়ারটাকেই বদলে দেবে।

ডেস্কের কাছে ফিরে এসে উপরের ড্রয়ার থেকে মিটিং’র জন্য প্রস্তুত করে রাখা নোট বের করল।” পাতা উল্টাতে গিয়ে মনে হলো সময় নষ্ট হবে। কেননা প্রতি শব্দ এরই মাঝে আত্মস্থ হয়ে গেছে। বার বার রিভাইস দিলে বরঞ্চ স্বতস্ফূর্ততা নষ্ট হবে। একপাশে সরিয়ে রেখে দিল রির্পোট।

দরজায় নক হতে ঘুরে তাকাল রামোন। রেকর্ডস ক্লার্ককে নিয়ে এসেছে ক্যাটরিনা। রেডকস্ বুকে সাইন করে দিল রামোন। ক্যাটরিনা আর ক্লার্ক বের হয়ে যেতেই খাম ছিঁড়ে প্রিন্টআউট বের করে ডেস্কের উপর রাখল।

প্রোটিয়া নামে আরেক জন সাউথ আফ্রিকান এজেন্ট আছে। জার্মান নাগরিক এই প্রোটিয়ার আসল নাম ডায়েটার রিনহাউট। বার্লিন ওয়াল থেকে পশ্চিমে পালিয়ে আসার সময় প্রোটিয়াকে পুরো সাহায্য করেছেন জো সিসেরো। ১৯৬০ সালে সাউথ আফ্রিকাতে অভিবাসন হিসেবে ঢোকার কিছুদিন পর নাগরিক বনে যাওয়া ডায়েটার এখন সিলভার মাইন কমান্ড বাঙ্কারের চিফ অব সিগনলস।

ক্লার্কের এনে দেয়া প্রিন্টআউট ‘রা তিন সপ্তাহ আগে প্রোটিয়া পঠিয়েছে; রোডার চেইনের উপর আসা লাল গোলাপের রিপোর্ট নিয়ে এবারে দুটোর তুলনা করল রামোন। মিলিয়ে দেখল লাইনের পর লাইন। দশ মিনিট পরেই সন্তুষ্টির হাসি ফুটল চেহারাতে। ফাইল দুটি হুবহু একই রকম।

ক্লাস ওয়ান রেটেড প্রোটিয়ার বিশ্বস্ততা দশক আগে থেকেই বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।

আর প্রথম সিকিউরিটি চেক পার হল লাল গোলাপ। মেয়েটাকে এখন অনায়াসে ক্লাস থ্রি রেটিং দেয়া যায়। চার বছর ধরে নজরে রাখার পর এবারে ও’কে পুরস্কার দেয়ার সময় হয়েছে।

প্রাইভেট লাইনে ফোন করল ক্যাটরিনা। “কমরেড কর্নেল, ছয় মিনিটের মধ্যে আপনাকে টপ ফ্লোরে যেতে হবে।”

“ধন্যবাদ কমরেড। ডক্যুমেন্ট নষ্ট করা দেখার জন্য নেমে এসো।”

ক্যাটরিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কাগজ কাটার মেশিন দিয়ে প্রোটিয়া রিপোর্টকে কুচি কুচি করে ফেলল রামোন। তারপর ডে-বুকে কাউন্টার সাইন করে অ্যাটেস্টেড় করে দিল।

টিউনিকের বোম লাগিয়ে ছোট্ট ওয়াল-আয়নাতে নিজের মেডেলগুলো ঠিক করে নিল রামোন।

“গুডলাক্ কমরেড কর্নেল” মুখ উঁচু করে প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্যাটরিনা।

“থ্যাংক ইউ।” মেয়েটাকে না ছুঁয়েই বের হয়ে গেল রামোন। অফিসে কখনোই এমন কিছু করে না মিঃ মাচাদো।

***

দশ মিনিট ধরে উপর তলায় কনফারেন্স রুমে অপেক্ষা করছে রামোন। সাদা দেয়ালের কোথাও কোন প্যানেল নেই; যেন লুকানো মাইক্রোফোনের কোনো সম্ভাবনাই না থাকে। লম্বা কনফারেন্স টেবিলের সাথে ডজন খানেক লাগোয়া চেয়ার থাকলেও ঝাড়া দশ মিনিট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে রামোন।

অবশেষে খুলে গেল ডিরেক্টরের সুইটের দরজা। কোর্থ ডিরেকটরেটের হেড জেনারেল ইউরি বোড়োদিনকে রামোন একই সাথে ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে।

এর পরে যিনি কনফারেন্স রুমে এলেন তিনি আরো বেশি শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য। বোয়োদিনের চেয়ে বয়সে ছোট এই লোকটা ডিপার্টমেন্টস অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স’র ডেপুটি মিনিস্টার।

রামোনের রিপোর্ট শুনে যতটা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সকলের মাঝে। তাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী একশ মানুষের একজনের সামনে নিজের থিসিস ডিফেন্ড করার জন্য।

আলেক্সেই ইউদিনিচ মানুষটা দেখতে ছোট-খাটো হলেও ভদ্রলোকের রহস্যময় অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটাও দেখে নিতে পারে। বোরোদিন দু’জনের পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় রামোনের সাথে হ্যান্ডশেক করে মুহূর্ত খানেক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন দেখলেন আলেক্সেই। এরপর দু’পাশে সহকারীদেরকে নিয়ে বসে গেলেন টেবিলের একেবারে মাথায়।

“তোমার আইডিয়াগুলো বেশ মহৎ টাইপের, ইয়াংম্যান।” তারুণ্যকে এরা তেমন পাত্তা দেয় না বলেই তো জানে রামোন। “দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের লং-স্ট্যান্ডিং সাপোর্টকে তুমি পরিত্যাগ করতে বলছ-শুরু করতে চাইছ স্বশস্ত্র আন্দোলন।

“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু” খুব সাবধানে উত্তর দিল রোমোন, “এটি আসলে আমার অভিপ্রায় নয়।”

“তার মানে তোমার পেপার আমি ঠিক মতো পড়িনি। তুমি লেখোনি যে, আধুনিক ইতিহাসে এএনসি হলো সবেচেয় অনুৎপাদনশীল গেরিলা অর্গানাইজেশন?”

“আমি এর পেছনের কারণগুলো আর পূর্বের ভুলগুলোকে কিভাবে শোধরানো যায় যেসব পথও তুলে ধরেছি।”

সম্মতি জানিয়ে নিজের রিপোর্টের কপি উল্টালেন ইউদিনিচ, “বলে যাও ব্যাখ্যা করো। দক্ষিণ আফ্রিকাতে তে সশস্ত্র বিপ্লব কেন সফল হবে না, যেমনটা হয়েছে ধরো আলজেরিয়াতে।”

“মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে মিনিস্টার। আলজেরিয়াতে বসতি স্থাপনকারীরা সকলেই ফরাসি’ চাইলে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে চলে যেতে পারে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের এমন কোনো পথ নেই। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার জন্যে-তাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে। আফ্রিকাই তার মাতৃভূমি।”

“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন ইউদিনিচ।

“বলে যাও।”

“এছাড়াও আলজেরিয়ার এফ.এল.এন গেরিলাদের ধর্ম আর ভাষা একই। জিহাদ করেছে একসাথে। কিন্তু কৃষাঙ্গ আফ্রিকানদের এমন কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আর গোত্রভিত্তিক শত্রুতা আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। এ এনসি’তে বিশেষভাবে ঝোসা উপজাতি আছে অথচ সংখ্যায় এদের চেয়ে বেশি জুলু’রা নেই।”

কোনো বাধা না দিয়েই পনের মিনিট চুপচাপ রামোনের কথা শুনলেন ইউদিনিচ। একবারের জন্যেও ওর মুখের উপর থেকে চোখ সরালেন না। অবশেষে নরম স্বরে জানতে চাইলেন, “তো বিকল্প হিসেবে তুমি কী ভাবছ?”

“বিকল্প নয়।” মাথা নাড়ল রামোন। “সশস্ত্র বিপ্লব চালিয়েই যেতে হবে। অনেক তরুণ আর মেধাবী-রাও এখন এগিয়ে আসছেন যেমন রালেই তাবাকা। এদের কাছ থেকেই ভবিষ্যতে দারুণ সফলতা আসবে। আমি যেটা প্রস্তাব করেছি তা হল লড়াইয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা, বয়কট আর বিভিন্ন নীতি মেনে নীতে বাধ্য করা…।”

“দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আমাদের অর্থনৈতিক কোনো যোগাযোগ নেই।” তিরস্কার করে উঠলেন ইউদিনিচ। “আমার প্রস্তাব হলো, এই কাজটা আমাদের জাত-শত্রুরাই করে দিক না কেন। আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপ দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ক্যাম্পেইন করবে। বিপ্লবের বীজ ওরাই বুনে দেবে, আমরা কেবল ফসল তুলব।”

“এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কী?”

“আপনি তো জানেন যে আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরে আমাদের লোক আছে। আমেরিকান মিডিয়াতেও একই অবস্থা। এনএএসিপি আর ট্রান্স আফ্রিকা ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠনের উপরেও আমাদের প্রভাব বিশাল। আমরা যেটা করব দক্ষিণ আফ্রিকা আর বর্ণবাদের ইস্যু নিয়ে আমেরিকান বাম দলগুলোকে মাথা ঘামাতে বাধ্য করব। ফলে সেটা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার রাজনৈতিক ইস্যুই হয়ে যাবে। কৃষাঙ্গ আমেরিকানদের ভোট পাবার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টিও ওদের অনুসরণ করবে। ফলে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা সাংশন চাপিয়ে দেয়া হলে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি আর সরকার উভয়েই ভেঙে পড়বে। আর তখন মঞ্চে প্রবেশ করে নিজের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে আমাদের আর কোনো বাধা থাকবে না।

কনফারেন্স রুমের সকলে চুপ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে অনুভব করতে চাইল পুরো পরিকল্পনার বিশালতু। নীরবতা ভাঙ্গলেন আলেক্সেই-ইউদিনিচ। কাশি দিয়ে জানতে চাইলেন, “কত খরচ পড়বে এতে?”

“বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।” রামোন স্বীকার করতেই শক্ত হয়ে গেল ইউপিনিচের চেহারা।” ডেমোক্রেটিক পার্টি আমাদের হয়ে সুর বাজাবে; কিন্তু বংশীবাদকে পয়সা দেবে আমেরিকান জনগণ।”

সারা বিকেলে প্রথমবারের মতো হাসলেন মিনিস্টার ইউদিনিচ। আরো দুই ঘণ্টা আলোচনার পর বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডাকলেন ইউরি বেরোদিন।

“ভদকা” অর্ডার করলেন ইউরি।

রূপার ট্রে’তে করে এলো ঠাণ্ডা বোতল।

আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টির নামে প্রথম টোস্ট করলেন আলেক্সেই হাসতে হাসতে একে অন্যের পিঠ চাপড়ে দিল সকলে।

আস্তে আস্তে রামোনের কাছে সরে এসে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন ডিরেক্টর বোরোদিন। মেধাবী এই সাব অর্ডিনেটের প্রতি যে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।

***

শহরের সবচেয়ে সুন্দর অংশগুলোর একটাতে ক্যাটরিনার ফ্ল্যাট। জানালা দিয়ে দেখা যায় গোকিং পার্ক। লিফট না থাকায় সিঁড়ি বেয়ে ছয় নম্বর ফ্লোরে উঠে এলো রামোন। মাথা থেকে ভদকার নেশা কাটাতেও সাহায্য করেছে এই এক্সারসাইজ।

বাধা কপির সাইড ডিশ দিয়ে পোর্কের সসেজ বানিয়েছেন ক্যাটরিনার মা; পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক বাধাকপি সেদ্ধর গন্ধে ম-ম করছে।

ক্যাটরিনার পিতা-মাতা রামোনকে তাদের মনিবের মতই সম্মান করে। প্রতিবেশীর অ্যাপার্টমেন্টে নাতাঁকে নিয়ে টেলিভিশন দেখতে চলে গেলেন বুড়ো-বুড়ী; যেন পরস্পরকে বিদায় জানাবার জন্যে অখণ্ড অবসর পায় ক্যাটরিনা আর রামোন।

“আপনাকে অনেক মিস করবো।”

ফিসফিস করে উঠল ক্যাটরিনা। পায়ের উপর খসে পড়ল টিউনিকের স্কার্ট। নিজের ছোট্ট রুমটার একমাত্র বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আহলাদী স্বরে রামোনকে জানালো, “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, কিন্তু।”

এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। নরম ভেলভেটের মতো মসৃণ দেহতুক স্পর্শ করে মেয়েটাকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য তাই যথেষ্ট সময় পাওয়া গেল।

নিঃশেষিত অবসন্ন দেহে, মাথায় এলোমেলো চুল নিয়ে রামোনকে বিদায় জানালো ক্যাটরিনা, “আমার কাছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, প্লিজ!”

রাস্তাতে ট্রাফিক জ্যাম না থাকাতে আধ ঘণ্টারও কম সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল রামোন।

সবসময় এত ট্রাভেল করতে হয় যে জেট-ল্যাগ এখন আর টের পায় না। বললেই চলে। কিছুই না খাওয়া আর অ্যালকোহল স্পর্শ না করার নিয়মও মেনে চলে। এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতেই ঘুমিয়ে পড়ার টেকনিক ও শিখে নিয়েছে। যে মানুষটা ইথিওপিয়ায় বেয়াল্লিশ ডিগ্রি গরমের মাঝে কিংবা মধ্য আমেরিকার রেইনফরেস্টে গায়ের উপর শুয়োপোকা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, তার জন্যে ইলুশিন প্যাসেঞ্জার সিটের অত্যাচার কিছুই না।

হাভানা’র জোসে মারতি এয়ারপোর্টে নেমে পুরাতন ডাকোটা’তে চড়ে পৌঁছে গেল সিয়েনফুগোস। অতঃপর পুনরায় এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে বহুত দর-কষাকষির শেষে ডেট্রয়েট মডেলের ট্যাক্সিতে চড়ে বসল বুয়েনাভেনতারার মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে।

পথে পার হয়ে এলো বাহিয়া ডি কোচিনোস্ আর বে অব পিস যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত যাদুঘর। আমেরিকান বর্বরগুলোকে হঠানোর ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকার কথা স্মরণ করে মনের মাঝে সবসময় সন্তুষ্টি বোধ করে। রামোন।

বিকেলের দিকে বুয়েনে ভেনতারা ক্যাম্পের কাছে এসে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি। দিনের কাজ শেষ করে চেগুয়েভার প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের সৈন্যরা সার্চ করে ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছে। হাভানা’তে পোলিত বুরোর শেষ মিটিং এর পর থেকে এদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে আফ্রিকাতে পাঠানোর জন্য।

এরকম এক ইউনিট পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় খানিক দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখল রামোন। এসব তরুণ তরুণীর মুখে বিপ্লবের একটা গান শুনে মনে পড়ে গেল সিয়েরা মায়েস্ত্রা’র সেসব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা। “ভূমিহীনের ভূমি” গানটার কথা শুনে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এরপর হেঁটে গিয়ে পাশ দেখলো ম্যারেড অফিসারদের কোয়ার্টারের গেইটে।

রামোন স্পোর্টস শার্ট আর পায়ে খোলা স্যান্ডাল পরে থাকলেও নাম আর। পদবী চিনতে পেরে স্যালুট করল গার্ড। বিরাশি জুন হিরো’র মাঝে একজন হলো এই রামোন মাচাদো। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে গানের পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত সর্বত্র উচ্চারিত হয় এসকল হিরোদের নাম।

সৈকতের উপরে পাম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুই বেডরুম অলা সারি সারি কর্টেজ। এরই একটাতে থাকে আদ্রা আর নিকি। পামের নিচে এসে আঁচড়ে পড়ে বে অব পিগ’র শান্ত জল।

রামোন একশ কদম দূরে থাকলেও সামনের বারান্দা থেকে চোখ তুলে ওকে ঠিকই দেখতে পেল আদ্রা অলিভারেস।

“ওয়েলকাম কমরেড কর্নেল” আস্তে করে রামোনকে স্বাগত জানালেও দৃষ্টি থেকে ভয় লুকাতে পারল না আদ্রা।

“নিকোলাস কোথায়?”

কংক্রীটের মেঝেতে ধপ করে নিজের কিট ব্যাগটা রেখেই জানতে চাইল রামোন। উত্তরে সৈকতের দিকে তাকাল আদ্রা।

পানির কিনারে খেলা করছে একদল ছেলে-মেয়ে, এতদূর থেকেও শোনা যাচ্ছে ওদের চিৎকার-চেঁচামেচি।

অন্যদের থেকে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। ছেলেকে দেখতে পেল রামোন, বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। মাত্র গত বছর থেকে জন্ম নেয়া এই অনুভূতি এর আগে সীমাবদ্ধ ছিল “দ্য চাইল্ড” কিংবা “লাল গোলাপের সন্তান” নামে। এখন আমার ছেলে” ভাবলেও তা কোথায় উচ্চারণ করা কিংবা লিখে রাখা হয় না।

কটেজের বারান্দা থেকে নেমে সৈকতের দিকে এগিয়ে গেল রামোন। নিচু একটা দেয়ালের উপর বসে দেখতে লাগত ছেলের কাণ্ড কারখানা।

বয়স মাত্র তিন হলেও নিকোলাসকে এর চেয়েও বড় দেখায়। ইতিমধ্যেই বেশ লম্বা হয়ে উঠতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা দেখে মনে পড়ে গেল মাইকেল অ্যাঞ্জোলর ‘ডেভিড”-এর কথা।

ছেলেটার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পাবার পর থেকেই বেড়ে গেছে রামোনের আগ্রহ। ক্যাম্প নার্সারি স্কুলের টিচার রিপোর্টে লিখেছে, নিকোলাসের ড্রেয়িং আর কথা-বার্তা বড় বয়সী বাচ্চাদেরই মতন। এরপর থেকেই নিকোলাসের বেড়ে উঠা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে রামোন। হাভানা’র ডিজিএ’র মাধ্যমে আদ্রা আর নিকোলাসের জন্য এ জায়গার ব্যবস্থা করেছে।

স্টেট সিকিউরিটিতে এখন আদ্রার পদবী লেফটেন্যান্ট। এ ব্যবস্থাও রামোনেরই করা। নতুবা বুয়েনেভনতারার কটেজ কিংবা মিলিটারি নার্সারি স্কুলে নিকোলাসকে ভর্তি করা যেত না।

প্রথম দুই বছর বাচ্চাটাকে একবারও দেখেনি রামোন। কেবল লাল গোলাপকে পাঠানোর জন্য তৈরি করা মিলিটারি ক্লিনিক আর এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টগুলো পড়ত। ধীরে ধীরে এসব রিপোর্ট আর ছবি দেখে মনের মাঝে আগ্রহ জন্মে উঠে।

প্রথমবার, মনে হলো ওকে দেখার সাথে সাথে চিনে ফেলেছিল নিকোলাস। আদ্রা’র পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল রামোনের দিকে। বুয়েনেভেনতারা’র সামরিক ক্লিনিকের সাদা অপারেটিং রুমে শেষবার দেখেছিল পিতার মুখ। নিকোলাসকে তখন আংশিকভাবে ডুবিয়ে রাখার নাটক করা হয়েছিল লাল গোলাপকে বশে আনার জন্যে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ বয়সের নিকোলাসের তো এ স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়-তারপরেও রামোনকে দেখে ওর প্রতিক্রিয়া কাকতালীয় হতে পারে না।

বাচ্চাটার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রামোন নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিল।

নিজের মা আর কাজিন ফিদেল ছাড়া আর কোনো মানুষের প্রতিই তার তেমন কোনো গভীর সহানুভূতি নেই। আর সবসময় এটাকে নিজের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবেই ভেবে এসেছে। পুরোপুরি যুক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে তাই কোনো সমস্যাও হয় না। প্রয়োজন হলে সঙ্গী কমরেডকে বলি দিতেও দ্বিধা করে না। কোন রকম মায়া মমতার স্থান না দিয়ে নিজেকে ইস্পাত কঠিন হিসেবে গড়ে তোলার পরেও আজকাল হৃদয় ভরে উঠে আর্দ্র সব অনুভূতিতে।

রৌদ্রস্নাত উজ্জ্বল ক্যারিবীয় সৈকতে বসে ছেলেটাকে দেখে আপন মনেই হাসল রামোন। “তলোয়ারের গায়ে চুল সমান চিকন একটা ফাটল; কেননা ও আসলে আমারই অংশ। আমার রক্ত মাংস দিয়ে গড়া অমরত্বের প্রত্যাশা।”

আবারও মনে পড়ে গেল মিলিটারি ক্লিনিকের কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠল ডাক্তারের হাতে ধরা ছটফট করতে থাকা ছোট্ট শরীর আর্ত চিৎকার করতে করতে ট্যাংকে ডুবে যাওয়া ছোট্ট একটা মাথা।

সে সময় আসলে সেটাই জরুরি ছিল; যা নিয়ে এখন মনস্তাপের কিছু নেই। আর বুদ্ধিমানরা তাই করে।

নিচু করে পায়ের কাছ থেকে ঝিনুকের খোসা কুড়িয়ে নিল নিকোলাস। হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল।

ঘন আর কালো কোকড়া চুলগুলোতে লেগে আছে সামুদ্রিক নোনা জল। মায়ের সাথে বেশ মিল দেখা যাচ্ছে ছেলেটার। ক্ল্যাসিক্যাল নাক আর চোয়ালের পরিষ্কার মিষ্টি রেখা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রামোন। কিন্তু সবুজ চোখগুলো ঠিক তার নিজের মত।

হঠাৎ করেই শান্ত জলে হাতের ঝিনুক ছুঁড়ে মারল নিকোলাস। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পানির কিনার দিয়ে একা একা হাঁটতে শুরু করল। ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলে-মেয়েদের হট্টগোলের মাঝে থেকে চিৎকার শুরু হল। ছোট্ট একটা মেয়ে সাদা বালির উপর গড়িয়ে পড়ে গর্জন করে উঠল, “নিকোলাস!”

কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে কাছে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করালো নিকোলাস। ছোট্ট সুন্দরীর বিশাল কালো চোখ জোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, গালে বালি, গায়ের পোশাক খুলে হাঁটুর উপর নেমে এসেছে।

মেয়েটার বাথিং স্যুট ঠিক করে দিয়ে, হাত ধরে পানির কাছে নিয়ে গেল নিকোলাস। গাল থেকে বালি আর চোখ থেকে পানি ধুয়ে দিল। অবশেষে চিৎকার থামালো মেয়েটা।

নিকোলাসের হাত ধরে পাশাপাশি দৌড়ে দুজনে উঠে এলো সৈকতে।

“চলো তোমাকে তোমার মাম্মার কাছে দিয়ে আসি।” কথা বলতে বলতেই চোখ তুলে বাবাকে দেখে থেমে গেল নিকোলাস।

রামোন দেখল চোখে ভয়ের আভা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলল ছেলেটা। চিবুকটাকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে তুলে ধরে অভিব্যক্তি শূন্য হয়ে গেল চেহারা।

যা দেখল তাতে খুশিই হল রামোন। কেননা ছেলেটার ভয় থেকেই জন্ম নিবে শ্রদ্ধা আর বাধ্যতা। আবার এটাও ভালো যে নিজের ভয়কে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নেতৃত্ব দিতে পারার প্রধান গুণগুলোর একটি হলো, ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা।

ও আমার ছেলে; ভাবতে ভাবতেই এক হাত উঁচু করে আদেশ দিল রামোন,  “এখানে এসো।”

নিকোলাসের হাত ছাড়িয়ে সৈকতের দিকে চলে গেল ছোট্ট মেয়েটা। স্পষ্ট দেখা গেল শরীর শক্ত করে বাবার দিকে এগিয়ে এলো নিকোলাস; হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানালো, “গুড ডে, পাত্রে।”

“গুড ডে, নিকোলাস।” ছেলের বাড়ানো হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল রামোন।”

“পাদ্রে” শব্দটা নিশ্চয়ই আদ্রা শিখিয়েছে। এতদূর পর্যন্ত মেনে নেবে বলে কখনো ভাবেইনি রামোন। কিন্তু অবশেষে খুশিই হলো। যাই হোক এতটা সামাল দেবার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা তার আছে।

“এখানে বসো।” দেয়ালের উপর নিজের পাশে ছেলেকে জায়গা দেখিয়ে দিল রামোন। ছোট্ট পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল নিকোলাস।

পিতা-পুত্র দু’জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রামোন জানতে চাইল,

“কী করেছিলে?”

প্রশ্নটাকে গভীরভাবে ভেবে নিকোলাস জানাল, “সারাদিন স্কুলে ছিলাম।”

“স্কুলে কী পড়ায়?”

ড্রিল শিখি আর বিপ্লবের গান।” খানিক ভেবে যোগ করল। “ছবিও আঁকি।”

আবারো চুপ হয়ে গেল বাপ-বেটা। একটু পরে নিকোলাসই আবার শুরু করল, “বিকেল-বেলা সাঁতার কাটি, ফুটবল খেলি। সন্ধ্যাবেলা আদ্রাকে ঘরের কাজে সাহায্য করি। এরপর দুজনে একসাথে টিভি দেখি।

ওর বয়স মাত্র তিন; নিজেকে মনে করিয়ে দিল রামোন। কোনো পশ্চিমা বাচ্চাকে একই প্রশ্ন করা হলে উত্তরে হয়ত বলত কিছুই না।” কিংবা “এমনিই’ অথচ নিকোলাস একেবারে বিজ্ঞের মতো ভেবে চিন্তে উত্তর দিচ্ছে। ছোট্ট একটা বুড়া।

“তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি।” জানাল রামোন।

“ধন্যবাদ, পাদ্রে।

“জানতে চাও না, কী?”

“তুমি আমাকে দেখাবে, তাহলেই জেনে যাব।”

একে অ্যাসল্ট রাইফেলের প্লাস্টিক মডেল। মিনিয়েচার হলেও আসলের মতো বুলেট। ম্যাগাজিন সবকিছু আছে।

চকচক করে উঠল নিকোলাসের চোখ। কাঁধে তুলে সৈকতের দিকে নিশানা করল। রামোন আসার পর এতক্ষণে স্বতস্ফূর্তভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করল ছেলেটা। ট্রিগার টিপতেই খেলনা রাইফেল যুদ্ধের মতো কটকট শব্দ করে উঠল। “বেশ সুন্দর। ধন্যবাদ, পাদ্রে।” খুশি হলো নিকোলাস।

“বিপ্লবের সন্তানের জন্য এটা সত্যিই ভাল একটা খেলনা।” জানাল রামোন।

“আমি সত্যিই বিপ্লবের সাহসী সন্তান?”

“একদিন হবে।”

“কমরেড কর্নেল, ওর গোসলের সময় হয়েছে।” এগিয়ে এলো আদ্রা।

নিকোলাসকে নিয়ে কটেজের ভেতর চলে গেল আদ্রা। ওদের সাথে যাবার ইচ্ছে করলেও বুর্জোয়া অনুভূতি ভেবে সে চিন্তা বাতিল করে দিল রামোন। তার বদলে বারান্দার কোণে রাখা টেবিলের উপর থেকে লাইম জুস আর বিশ্বসেরা হাভানা ক্লোব রাম নিল। সাথে মিগেল ফারনানদেজ সিগার। ওর পছন্দ জানে আদ্রা। সব জায়গামতই আছে।

বাথরুম থেকে ভেসে আসছে আদ্রা আর তার পুত্রের আনন্দোচ্ছল হুটোপুটির শব্দ। নিজেকে যোদ্ধা ভাবতেই ভালোবাসে রামোন। অথচ বাচ্চাটা থাকতে মনে হচ্ছে আপন গৃহে ফিরেছে।

খাবারে চিকেন সাথে ব্ল্যাকবিন আর হোয়াইট রাইস এনে দিল আদ্রা। ডিজি’এর মাধ্যমে রেশনের ব্যবস্থাও করেছে রামোন। যেন ছেলের বেড়ে উঠায় কোনো অভাব না থাকে।

“কদিন পরেই আমাদের সাথে বেড়াতে যাবে তুমি।” খেতে খেতে নিকোলাসকে জানাল রামোন, “সমুদ্রের ওপারে। তোমার ভাল লাগে ভ্রমণ?”

“আদ্রাও কি আমাদের সাথে আসবে?”

প্রশ্নটা শুনে খানিক বিরক্ত হয়ে গেল রামোন। বুঝতে পারল না যে এটি ঈর্ষা। সংক্ষেপে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

“তাহলে ভাল লাগবে।” মাথা নাড়ল নিকোলাস, “কোথায় যাবো?”

“স্পেন। তোমার পূর্বপুরুষের ভূমি, তোমার জন্মস্থানে।”

ডিনারের পর নিকোলাসকে এক ঘণ্টা টিভি দেখার অনুমতি দেয়া হয়। তারপর চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে গেলেই ওকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয় আদ্রা।

এরপর লিভিং রুমে ফিরে এলো আদ্রা। রোমোনের কাছে জানতে চাইল, “আমাকে দরকার আজ রাতে?”

মাথা নাড়ল রামোন। আদ্রার বয়স চল্লিশেরও বেশি। কখনো সন্তানের মা না হওয়া এই নারী রামোনকে উত্তেজিত করে তোলার বিভিন্ন কৌশল জানে। আর মাঝে মাঝেই তা প্রয়োগও করে। এরকম সহজাত প্রেমিক স্বভাবের আর কাউকে দেখেনি রামোন-এছাড়াও সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আদ্রা ও’কে ভয় পায়; যা দু’জনের আনন্দই বাড়িয়ে তোলে।

***

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্রোতের বিপরীতে প্রায় দুই মাইল সাঁতার কেটে এলো রামোন।

ফিরে এসে দেখল, স্কুলের যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে নিকোলাস। বাদামি প্যারাট্রুপারের পোশাক আর নরম টুপি পরে নিল রামোন। অপেক্ষারত জিপে গিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বাবার পাশে বসল নিকোলাস। এরপর মেইন গেইটের পাশে নার্সারী স্কুল।

আখের ক্ষেত্রে কাজ চলাতে হাভানা’তে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি। লেগে গেল। পাহাড়ের উপর আকাশ ছেয়ে আছে আখের ধোয়ায়।

শহরে পৌঁছে বিশাল প্লাজা ডি লা রেভোলিউশন এর কোণায় রামোনকে নামিয়ে দিল ড্রাইভার। পাশেই আছে জনগণের হিরো জোসে মারতির ওবেলিস্ক।

ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বক্তৃতা শোনার জন্য এ জায়গাতেই এসে জড়ো হয় হাজার হাজার কিউবান।

প্রেসিডেন্টের অফিসও এখানে। এই অফিসেই রামোনকে স্বাগত জানালেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো।

কাগজপত্র-আর রিপোর্ট দিয়ে ভর্তি বিশাল ডেস্কের ওপাশ থেকে উঠে এসে রামোনকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যাস্ট্রো।

“মি জোরো ডোরাডো” খুশিতে হেসে উঠলেন ফিদের ক্যাস্ট্রো।” মাই গোল্ডেন ফক্স, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।”

“ফিরে এসে আসলেই ভাল লাগছে এল জেফে। সত্যিকথাই বলল রামোন। সবার চেয়ে বেশি এই মানুষটাকেই সে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।

রামোনের চেহারাতে কী যেন দেখলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, “তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে কমরেড। বেশি বেশি পরিশ্রম করছ?”

“রেজাল্ট তো ভাল পাচ্ছি।” আশ্বস্ত করল রামোন।

“চলো, জানালার পাশে বসি।”

ডেস্কের উপরে কোণার বাক্স থেকে দুটো সিগার পছন্দ করে এনে রামোনের হাতে দিলেন। রামোনকে সিগারেট জ্বালাতে সাহায্য করে নিজেরটাও ধরালেন; তারপর মুখের এক কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট রেখে জানতে চাইলেন,

“তো মস্কোর কী-খবর?

ইউদিনিচের সাথে দেখা হয়েছে?”

“হ্যাঁ। আর মিটিংটাও ভাল হয়েছে…”।

নিজের রিপোর্ট সম্পর্কে খুলে বলল রামোন। দুজনের চরিত্রে বেশ কিছু মিল আছে। কেউই কোনো পদবী কিংবা সুবিধার জন্য লালায়িত নয়। রামোন জানে তার অবস্থান কোথায়। দুই ভাইয়ের মাঝে আছে রক্ত আর আত্মার সম্পর্ক।

হ্যাঁ, ক্যাস্ট্রো বদলে যেতে পারেন। যেমনটা হয়েছে চে গুয়েভারার ক্ষেত্রে; গ্রনমা থেকে আসা সেই হিরো; বিরাশি জনের মাঝে তিনিও একজন। কিন্তু ক্যাস্ট্রোর অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করায় দু’জনের আর বনিবনা হয়নি। কিন্তু রামোনের সাথে কখনো এমন কিছু হবে না।

‘রপ্তানি পরিকল্পনার নতুন অংশকে সহায়তা করতে রাজি হয়েছেন ইউদিনিচ।” রামোনের কথা শুনে মিটিমিটি হাসলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।

তিনটি মাত্র শস্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কিউবার সম্পদ; চিনি, কফি, তামাক। কিন্তু সামাজিক সমৃদ্ধি আর শহরায়ণের জন্যে ক্যাস্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে যথেষ্ট অর্থের যোগান দিতে অক্ষম এসব সম্পদ।

বিপ্লবের পরের সময়ের চেয়ে এখনকার জনসংখ্যাও দ্বিগুণ। আগামী দশ বছর আরো বেড়ে যাবে। এসব সমস্যারই সমাধানের পরিকল্পনা করেছে রামোন। অর্থের পাশাপাশি বেকারত্ব দূর হবে।

“নতুন রপ্তানিযোগ্য এই পণ্য হলো মানুষ। নারী এবং পুরুষ যোদ্ধা। পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় এদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বিপ্লবের বীজ বপনের জন্য। আর এভাবে দ্বীপের প্রায় দশ শতাংশ জনশক্তি রপ্তানি হয়ে যাবে। একবারের ধাক্কাতেই বেকারত্ব দূর হয়ে যাবে।

প্রথম যেদিন রামোনের মুখে এ পরিকল্পনা শুনেছেন সেদিন থেকেই তা পছন্দ করে ফেলেছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এ ধরনের অর্থনীতি তিনি সহজেই বোঝেন আর প্রশংসাও করেন।

“ইউদিনিচ। ব্রেজনেভকে জানাবেন” নিশ্চয়তা বিড়ালের গায়ে হাত বোলানোর মতো করে নিজের দাঁড়িতে হাত বোলালেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।

“যদি ইউদিনিচ সুপারিশ করেন, তাহলে আমাদের আর ভয় নেই।” হাঁটুর উপর হাত রেখে সামনে ঝুঁকলেন ক্যাস্ট্রো,

“আর আমরা তো জানিই যে তুমি ওদেরকে কোথায় পাঠাতে চাও।”

“আজ বিকেলে তানজানিয়ার অ্যামব্যাসিতে মিটিং করব” জানাল রামোন।

হাবানা’তে আফ্রিকার সতেরটি দেশের দূতাবাস আছে। এদের মধ্যে। সবচেয়ে বড় মার্কসিস্ট হলেন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে।

আফ্রিকার অন্যান্য যেসব কলোনিয়াল স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে, তাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা করে তানজানিয়াবাসী। পর্তুগিজ, অ্যাংগোলা, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইথিওপিয়া সব দেশের মুক্তিযযাদ্ধারাই তানজানিয়াতে আশ্রয় পেয়েছে।

“ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর সাথেও আমি মিটিং করেছি। মাকর্সিস্ট সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ সৈন্যরা রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত।”

“হ্যাঁ, মাথা নাড়লেন ক্যাস্ট্রো।”

“ইথিওপিয়া আমাদের বেশ কাজে লাগবে।”

নিজের সিগারের দিকে তাকিয়ে দেখল রামোন। ছাই প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে। জানাল, “আমরা সবাই জানি যে ভাগ্য কী চাইছে? আফ্রিকা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”

সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন ক্যাস্ট্রো, বলে চলল রামোন : “মাদার রাশিয়াকে আফ্রিকানরা অন্তর থেকে অবিশ্বাস করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে অসংখ্য-গুণ থাকা সত্ত্বেও রাশানরা বর্ণবাদী। বহু আফ্রিকান নেতা রাশিয়াতে পড়াশোনা করেছেন। আবার প্যাট্রিস লুমাম্বা ইউনিভার্সিটি করিডর দিয়ে হাঁটার সময় “বানর” খেতাবও শুনেছেন। শ্বেতাঙ্গ রাশানদেরকে তাই কোন মতেই বিশ্বাস করেনা আফ্রিকা।”

সিগারেটে টান দিয়ে চুপ করে গেল রামোন। নীরবতা ভাঙ্গলেন ক্যাস্ট্রো’ “তারপর”

“অন্যদিকে এল জেফে আপন হচ্ছেন আফ্রিকার পৌত্র….কিন্তু মাথা নাড়লেন ক্যাস্ট্রো।

“আমি স্প্যানিশ।” শুধরে দিলেন।

হেসে ফেলে রামোন বলে চলল, “যদি আপনি বলেন যে, আপনার পিতৃপুরুষকে হাভানা’তে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল, তাহলে কেই-বা, সন্দেহ করবে?” পরামর্শ দেবার মতো করে আরো যোগ করল, “আর তাহলে ভাবুন তো আফ্রিকার’র উপরে আপনার কতটা প্রভাব পড়বে?”

নিঃশব্দে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেন ক্যাস্ট্রো। ওদিকে রামোন মোলায়েম স্বরে জানালো, “আমরা আপনার জন্যে একটা ট্যুরের ব্যবস্থা করব। মিশর থেকে শুরু করে এই বিজয়ে যাত্রা দক্ষিণ বিশটা দেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে, আর আপনি প্রচার করবেন আফ্রিকার জনগণ নিয়ে উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা। এক্ষেত্রে নিজেকে যদি ওদের একজন হিসেবে তুলে ধরতে পারেন তাহলে দু’শ মিলিয়ন আফ্রিকান কতটা প্রভাবিত হবে, বলতে পারেন?” সামনে ঝুঁকে ক্যাস্ট্রোর কব্জি স্পর্শ করল রামোন। “আর নয় ছোট্ট একটা দ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা আমেরিকার হাতের পুতুল, হয়ে উঠবেন মহান আর শক্তিশালী এক বিশ্বনেতা।”

“মাই গোল্ডেন ফক্স” মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন, ক্যাষ্ট্রো, “কেন যে তোমাকে এত ভালোবাসি!”

***

পুরাতন শহরের স্প্যানিশ কলোনিয়াল দালানগুলো একটাতে সাময়িক তানজানিয়ার দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে।

এখানেই ইথিওপিয়ার লোকেরা রামোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনজন তরুণই সম্রাট হালি সেলেসি’র রাজকীয় সেনা বাহিনীর অফিসার। এদের মাঝে একজনকে যথেষ্ট পছন্দ করে রামোন মাচাদো। ক্যাপ্টেন গেটাশ আবিবি’র সাথে এর আগেও কয়েকবার আদ্দিস আবাবা’তে দেখা হয়েছে।

ক্যাপ্টেন গেটাশ’র মাঝে ঐতিহ্যবাহী খাঁটি আফ্রিকান এভাবে পুরোপুরি ভাবে বিদ্যমান আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও লেকচারার হিসেবে। জো সিসেরো আমেরিকান এবং ব্রিটিশ মার্সিস্ট ভাবধারা ছড়িয়ে কিছু শিষ্য তৈরি করে গেছেন। যেসব প্রতিভাবান ছাত্রদের একজন গেটাশ আৰিবি হয়ে উঠেছে নিবেদিত প্রাণ মাকর্সিস্ট লেনিনিস্ট।

লোকটাকে নির্বাচন করার আগে বহু বছর ধরে তাকে পরখ করে দেখেছে রামোন। প্রমাণ পেয়েছে বুদ্ধিমান, নিষ্ঠুর আর কঠিন হৃদয়ের এক কর্মে বিশ্বাসী সৈনিককে।

‘গেটাশ’র বয়স ত্রিশের খানিকটা উপরে হলেও তাকেই ইথিওপিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে পছন্দ করে রেখেছে রামোন।

তাই তানজানিয়া দূতাবাসের পেছন দিকে আবদ্ধ এক সিটিং রুমে হাত মেলানোর সময় চোখ পাকিয়ে ইশারা করে সাবধান করে দিল গেটাশ’ কে। দেয়ালে ঝোলানো আফ্রিকার উপজাতির মুখোশগুলোর যেকোনটাতে লুকিয়ে থাকতে পারে গোপন মাইক্রোফোন।

মাত্র আধ ঘন্টার সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করে বিদায়ক্ষণে আবারো হাত মেলাতে গিয়ে আবিবি’র কানে ফিসফিস করে মাত্র চারটা শব্দ বলে দিল রামোন-একটা জায়গা আর সময়।

এক ঘণ্টা পরে আবারো বোদোগিটা ডেল মিডিওতে দেখা করল দু’জনে। এটিই পুরাতন শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত বার। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতির মাঝে দেখা গেল সাধারণ থেকে শুরু করে বহু বিখ্যাত মানুষের সিগনেচার : হেমিংওয়ে, স্পেনসার ট্রেসি অ্যান্ড এডওয়ার্ড, ডিউক অব উইন্ডসর সবাই এসেছিলেন এখানে ডিংক করতে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন লম্বা রুমটাতে কাস্টোমারদের চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাজছে “বেম্বে” ফোক মিউজিক। দুজনে একেবারে কোণার দিকে বসে মোজিতে অর্ডার করেছে। গ্লাসের গা বেয়ে পড়ে টেবিলের উপর গোলকার বৃত্ত রচনা করেছে।

কিন্তু কেউই ড্রিংক ছুঁয়েও দেখেনি।

“কমরেড সময় প্রায় হয়ে গেছে।” রামোনের কথা শুনে মাথা নাড়ল আবিবি।

“আমহারার’র সিংহের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, দাঁত ও পড়ে গেছে; আর ছেলেটা তো মহাগাধা শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার জ্বালায় ধুকছে। সুতরাং এখনই উপযুক্ত সময়।”

“তবে দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে।” সাবধান করে দিল রামোন। “ প্রথমটা হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লব পরিহার করতে হবে। যদি সেনাবাহিনী এখনই ক্ষেপে গিয়ে সম্রাটকে মেরে ফেলে, তোমার কোনো লাভ হবে না। র‍্যাঙ্কিং এর দিক থেকে জুনিয়র হওয়াতে তোমাকে টপকে কোনো জেনারেল ক্ষমতায় বসে যাবে।’

“তাহলে?” জানাতে চাইল আবিবি, “এর সমাধান কী?”

“নিঃশব্দ বিপ্লব।” রামোনের মুখে উচ্চারিত শব্দদুটো জীবনে এই প্রথমবার শুনলো আবিবি।

“তাই নাকি!” বিড়বিড় করে উঠল আবিবি। অন্যদিকে রামোন ওকে বুঝিয়ে বলল,

“এখন যেটা করতে হবে তা হল, ডার্গ হালি সেলসি’কে জানিয়ে দেবে সিংহাসন ত্যাগ করার দাবি। তোমার কথা মত। বুড়ো সিংহ তার দাঁত হারিয়ে বাধ্য হবে এ দাবি মেনে নিতে। আর এপাশ থেকে তুমি ডার্গকে প্রভাবিত করবে অন্যপাশ থেকে আমি।”

বিভিন্ন গোত্র আর সেনাবাহিনী, সরকারের সব ধরনের ডিপার্টমেন্ট আর ধর্মীয় প্রধানদের নিয়ে গঠিত ডার্গ হচ্ছে ইথিওপিয় সংসদ। আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কসিস্ট এসব সদস্যের বেশির ভাগ রামোনের চতুর্থ ডিরেকটরেটের কথায় উঠে আর বসে। গেটাশ আবিবিকেও সবাই নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে।

“এরপর প্রভিশনাল মিলিটারি বেসড জান্তা বসিয়ে কিউবা থেকে সৈন্য নিয়ে আসবো। যাতে করে শক্ত হবে তোমার অবস্থান। সবকিছু একবার খাপে খাপে বসে গেলেই শুরু হবে পরবর্তী পদক্ষেপ।”

“সেটা কী?” জানতে চাইল আবিবি।

“সম্রাটকে সরিয়ে দিতে হবে; নচেৎ রাজপরিবারের সমর্থকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।”

“মেরে ফেলা?”

“এটা আসলে একটু বেশিই পাবলিক আর আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।” মাথা নাড়ল রামোন।

“তারচেয়ে বৃদ্ধ হওয়াতে এমনিই মারা যাবে আর এরপর…”

“আর এরপর একটা নির্বাচন?” বাধা দেয়াতে আবিবি’র দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রামোন। ইথিওপিয়াটার পুরু বেগুনি ঠোঁটে কৌতুকের হাসি দেখে কেবল নিজেও হাসল।

“তুমি তো আমাকে চমকে দিয়েছ কমরেড।” স্বীকার করল রামোন। “এক মুহূর্তের জন্য তো মনে হয়েছিল যে তুমি সত্যি সিরিয়াস। নতুন প্রেসিডেন্ট আর সরকার গঠন করার আগে এটাই হবে আমাদের শেষ কাজ। জনগণ নিজেদেরকে চালানো তো দূরের কথা ব্যক্তিটাকেও পছন্দ করতে পারে না। তাই তাদের হয়ে এ দায়িত্ব আমরাই পালন করব। এরও বহুদিন পরে তোমাকে মার্কসিস্ট সোশালিস্ট সরকার হিসেবে ঘোষণা করার পরেই নিয়ন্ত্রিত আর সুশৃঙ্খল নির্বাচন দেয়া হবে।”

“আদ্দিসে আপনাকে আমার দরকার, কমরেড।” আকুতি করল-আবিবি। “সামনের বিপদজনক দিনগুলোতে আপনার গাইডেন্স আর কিউবার ডান হাত প্রয়োজন আমার।”

“আমি ঠিক পৌঁছে যাব, কমরেড।” প্রতিজ্ঞা করল রামোন।

“তুমি আর আমি একসাথে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব যে কিভাবে বিপ্লব হয়।”

***

সবকিছুতেই ঝুঁকি আছে, কিন্তু সম্ভাব্য পুরস্কারের কথা ভেবে খুব সাবধানে সেগুলোকে সামাল দিতে হবে, ভাবল রামোন। ঝুঁকিগুলোকে কমানোর জন্য তাই পূর্বসতর্কতাও নিতে হবে।

সন্তানের কাছে লাল গোলাপকে নিয়ে যাবার সময় হয়েছে; যেভাবে তাকে জনোর পর সময় দেয়া হয়েছিল নিকোলাসের সথে সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য। তিন বছর পার হয়ে যাওয়ায় খানিকটা ফিকে হয়ে যাওয়া এই বন্ধনকে আবারো দৃঢ় করে তুলতে হবে। এর মাঝে নিয়মিত ক্লিনিক আর নার্সারী স্কুলের রিপোর্ট ফটোগ্রাফ পাঠানো হলেও লাল গোলাপের উপর নিজের প্রভাব দুর্বল হয়ে গেছে বলে ভাবল রামোন।

সিমেন রাডার রিপোর্ট পাঠানোর ফলে পুরস্কৃত করে মেয়েটাকে জানিয়ে দিতে হবে যে সহযোগিতা বিনা ওর সামনে আর কোনো পথ নেই। একই সাথে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো হঠকারিতা না করে বসে। ওর ভেতরে এমন একটা প্রত্যয় আর শক্তি আছে যে রামোন ‘ও ভয় পায়। খানিক সময়ের জন্যে কাজে লাগানো গেলেও চিরতরে কি দাস বানানো যাবে? এখনো নিশ্চিত নয় রামোন। খুব সাবধানে এগোতে হবে।

মাতা-পুত্রের মিলন হলে সম্ভাব্য কী কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আগেই ভেবে রেখেহে রামোন। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হল বোকার মতো লাল গোলাপ হয় সন্তানকে নিয়ে পালাতে চাইবে।

তাই পূর্ব সতর্কতা হিসেবে পরিবার নিয়ে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাওয়া স্প্যানিশ কনিস্ট পার্টির এক সদস্যের প্রপার্টি হাসিয়েন্দা মিটিং প্লেস হিসেবে নির্বাচন করে কেজিবি সদস্যদের পাহারা বসাল রামোন।

হাসিয়েন্দার চারপাশে আর ভেতরে পজিশন নিল বাগোন সশস্ত্র গার্ড। টু-ওয়ে রেডিও আর সন্তানকে দেখে লাল-গোলাপ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লে ব্যবহার করার জন্য ড্রাগসহ সমস্ত অস্ত্র ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে ভরে মাদ্রিদে নিয়ে আসা হলো।

স্পেনকে বেছে নেয়ার আরেকটা কারণ আছে। নিকোলাসের সঠিক আস্তানা লাল গোলাপ কখনোই জানবে না। কোর্টনি পরিবারের প্রভাব আর ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রামোন জানে লাল গোলাপ যদি বাবার কাছে গিয়ে সব জানায় তাহলে কী ঘটবে। হয়ত ভাড়া করা সৈন্যদের দল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সিকিউরিটি ফোর্স কিডন্যাপ অভিযান চালিয়ে বসবে।

তাই ইসাবেলাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে নিকোলাসকে স্পেনে রাখা হয়েছে। এখানে অবাক হবার কিছু নেই; নিকলাসের জন্য আর রামোনের পরিচয় স্প্যানিশ হিসেবেই জানে-সে, তাই আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে নিকোলাসের অন্য কোথাও নেবার কথা ভাবতেই পারবে না।

হাসিয়েন্দার বেল টাওয়ারের বন্ধ জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রামোন। ট্র্যাডিশনাল নকশায় তৈরি দালানের মাঝখানের আঙ্গিনার চারধারে মোটা সাদা প্লাস্টার করা দেয়াল। আঙ্গিনার মাঝখানে আবার সুইমিং পুল। পুলের চারধারে চারটা ফল ভর্তি পাম গাছ।

টাওয়ারে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু আঙ্গিনা নয়, আশপাশের মাঠ আঙ্গুর ক্ষেত’ও দেখতে পাছে রামোন, এস্টেটের চারপাশে আটজন গার্ড বসিয়েছে। আঙ্গিনার দিকে তাকিয়ে একেকটা জানালার ওপাশে বসে আছে প্রত্যেকে। একজনের কাছে আছে সাইপার রাইফেল, আরেকজনের কাছে ডার্ট গান। তবে মনে হয় না কাউকে রেডিওতে ডাকতে হবে।

এয়ারফেয়ার আর গার্ডদের খরচ মিলিয়ে পুরো অপারেশনটা বেশ কস্টলি হলেও মাদ্রিদের রাশান অ্যামব্যাসি থেকে গার্ড আর ভেহিকেল পাওয়ায় এবং হাসিয়েন্দার মালিক কোনো অর্থ না নেয়া গাটের পয়সা খরচ করতে হচ্ছে না এ যাত্রায়। ফিনান্স সেকশনের কড়াকড়ির কথা মনে এলে এখনো গা জ্বালা করে উঠে।

একটা কিপটে অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিভাবে বুঝবে ফিল্ড অপারেশনের প্রয়োজন আর গুরুত্ব?

রেডিওতে নরম স্বরে শব্দ হতে থাকায় ছেদ পড়ল-চিন্তার জগতে।

“দা? ইয়েস?” মাইক্রোফোনে রাশান বলে উঠল রামোন।

“নাম্বার থ্রি বলছি, গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে।” জানিয়ে দিল এস্টেটের সর্ব দক্ষিণের গার্ড।

টাওয়ারের দক্ষিণ দিকের জানালায় দৌড়ে গেল রামোন। দেখতে পেল আঙ্গুর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসা গাড়ির হলুদ ধুলা।

“ঠিক আছে।” নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে অ্যামবাসির ফিমেল সিগনাল ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ইলেকট্রনিক কনসোলের সামনে বসে থাকা মেয়েটার কাজ হলো নিচের আঙ্গিনার প্রতিটি শব্দ আর দৃশ্য রেকর্ড করা।

টয়লেট আর বাথরুম সহ লাল গোলাপ যেতে পারে এমন সর্বত্র গোপন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন লাগানো আছে।

এস্টেটের গেইটের কাছে এসে মোড় নিল গাড়িটা। ডিপ্লোমেটিক প্লেট লাগানো নীল কার্টিনা এসে থামল হাসিয়েন্দার সদর দরজার সামনে।

এয়ারপোর্ট থেকে এসকার্ট করে আনা নারী অ্যামব্যাসি গার্ডের সাথে সাথে এগিয়ে এলো ইসাবেলা কোর্টনি। হঠাৎ করেই পায়ে চলা ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের বদ্ধ জানালার দিকে তাকাল বেলা। মনে হল যেন টের পেল রামোনের অস্তিত্ব। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মেয়েটার ঊর্ধ্বমুখ দেখল রামোন।

শেষবার দেখার পর থেকে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে মেয়েটা। বালিকাসুলভ চপলতা ঝেড়ে ফেলে এক পুরোপুরি নারী। চলাফেরায় যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। এতদূর থেকেও দেখা যাচ্ছে চোখের নিচের কালি আর চোয়ালের দৃঢ়তার রেখা। এমন একটা করুণ কিছু দেখতে পেল যে মায়াবোধ করল রামোন। আগের মতো সুন্দরী না হলেও আরো আকষর্ণীয় হয়ে উঠেছে। বেলা।

আর হঠাৎ করেই মনে হল এ মেয়েটা নিকোলাসের মা, ভাবতেই কেমন আর্দ্র হল হৃদয়। কিন্তু একই সাথে এহেন অনুভূতি হওয়ায় রেগেও উঠল ভেতরে ভেতরে। আগে কখনো কোন সাবজেক্টের প্রতি এমনটা আর হয়নি। নিজের উপরের রাগ এবার গিয়ে পড়ল বেলার উপর। এই দুর্বলতার জন্য মেয়েটাই দায়ী। শীতের রাতে আগুনের তাপের উপর হাত মেলে দেয়ার মতো করে নিজের রাগকে দমিয়ে ফেলল রামোন।

অন্যদিকে নিচ থেকে তাকিয়ে ইসাবেলার মনে হলো বদ্ধ জানালার ওপাশে কারো অস্পষ্ট নাড়াচাড়া দেখা যাচ্ছে। যাই হোক ওর মনের ভুলও হতে পারে।

এসকর্ট করে নিয়ে আসা মেয়েটা ওর বাহুতে হাত রেখে বলল, “চলুন, ভেতরে যেতে হবে।”

বেল টাওয়ার থেকে চোখ নামিয়ে খোদাই করা কাঠের দরজার দিকে নজর দিল ইসাবেলা। দরজা খুলে যেতেই দেখা গেল আরেকটা মেয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের ছাই রঙা বিজনেস স্যুটের বোম আটকে কাঁধ উঁচু করে এগিয়ে গেল ইসাবেলা।

শীতল অন্দরে বেশ মনমরা একটা ভাব। হঠাৎ করে থেমে যেতেই ছোট্ট একটা অ্যান্টিচেম্বারের দিকে পথ দেখিয়ে মেয়েটা বলল, “এইদিকে!” ইসাবেলার স্যুটকেস আর বড়সড় একটা পার্সেল সাথে বয়ে আনছে এসকর্ট মেয়েটা। ভারী ওক কাঠের টেবিলের উপর পার্সেল আর স্যুটকেশ রেখে দরজা বন্ধ করে দিল।

“চাবি” হাত বাড়িয়ে দিতেই হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে পেতে চাবি বের করে মেয়েটার হাতে দিল বেলা।

দুটো মেয়ে মিলে আতিপাতি করে খুঁজে দেখল পুরো স্যুটকেস। বোঝাই যাচ্ছে এ কাজে তারা বেশ দক্ষ। প্রতিটি কাপড়ের লাইনিং, ক্রীম আর অয়েন্টেমেন্টে সুই ঢুকিয়ে চেক করে দেখল। একস্ট্রা জুতার হিল চেক করে ইলেকট্রিক শেভারের ব্যাটারি খুলে নিল। এরপর নজর দিল পার্সেলের দিকে। একজন আবার হাত বাড়াল হ্যান্ডব্যাগের দিকে।

“প্লিজ কাপড় খুলে ফেলুন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ড্রেস খুলে ফেলল ইসাবেলা। প্রতিটি আইটেম সহ জ্যাকেন্টের সোল্ডার-প্যাড পর্যন্ত চেক করে দেখল মেয়ে দুটো।

পুরোপুরি উলঙ্গ হবার পরে একজন আদেশ দিল : হাত তুলুন।

কথা মতো কাজ করেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল বেলা। মেয়েদের একজন হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস্ পরে ভ্যাসলিনের পটের মধ্যে-দুটো আঙুল চুবিয়ে দিল।

“ওদিকে ঘুরুন।” আদেশ দিতেই মাথা নাড়ল বেলা, “না।”

“আপনি ছেলেটাকে দেখকে চান?” ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতেই ভ্যাসলিন মাখা হাত তুলে ধরল মেয়েটা। “ঘুরে যান।”।

কাঁপতে কাঁপতে ইসবেলা টের পেল হাতের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে।

“ওদিকে ঘুরুন।” একটুও বদলায়নি মেয়েটার গলা। ধীরে ধীরে ওদিকে ফিরল বেলা।

“উপুড় হয়ে হাত টেবিলের উপর রাখুন।”

সামনে ঝুঁকে শক্ত করে টেবিলের কিনারা আঁকড়ে ধরল বেলা।

“পা দুটো আলগা করুন।”

বুঝতে পারল ইচ্ছে করেই তাকে অপমান করা হচ্ছে। জানে এসবই প্রক্রিয়াটার অংশ। মনটাকে জোর করে অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেও মেয়েটার হাত নিজের ভেতরে টের পেয়ে নড়াচড়া শুরু করে দিল।

“নড়বেন না।”

ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা। বেশ খানিক সময় বাদে মেয়েটা পিছিয়ে দাঁড়াল,

“ঠিক আছে, কাপড় পরে নিন।”

গালের উপর কান্নার ফোঁটা টের পেল বেলা। জ্যাকেটের পকেট থেকে ক্লিনেক্স নিয়ে মুছে ফেলল। এগুলো আসলে ক্রোধের অশ্রু।

“এখানেই অপেক্ষা করুণ।” হাত থেকে গ্লাভস খুলে ওয়েস্টপেপার বিনে ছুঁড়ে মারল মেয়েটা।

দুজনেই দরজা আটকে চলে গেল। রয়ে গেল একা।

তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বেঞ্চে বসে পড়ল ইসাবেলা। হাতগুলো এখনো। কাঁপছে। জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে দিল মুষ্টিবদ্ধ হাত।

প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো।

***

রিমোট ভিডিও ক্যামেরাতে সার্চের পুরো অংশটুকু দেখল রামোন। ক্যামেরাটা এমনভাবে বসানো হয়েছিল যেন ইসাবেলার মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু যা দেখল তাতে খচখচ করছে মনের ভেতরে। ভেবেছিল হয়ত মেয়েটাকে বশে আনা গেছে; অথচ তার বদলে বেলার চোখে দেখেছে শীতল ক্রোধের আগুন; চোয়ালের শক্ত, একরোখা ভাবা। এই ক্রোধ কি হত্যা না আত্মহত্যা ডেকে আনবে? নিশ্চিত হতে পারেনি রামোন।

ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ তুলে লুকানো ক্যামেরাতে সরাসরি রামোনের চোখের দিকে তাকাল বেলা। নিজেকে সামলে নিল। গাঢ় নীল চোখের উপর যেন পর্দা পড়ে ঢেকে গেল মেয়েটার অভিব্যক্তি।

সোজা হয়ে বসল রামোন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। যেমনটা ভেবেছিল তাই হলো, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেবল ওকে রুখে রাখা যাবে। এসে গেছে সেই সময়। ভেঙে পড়ার সময় এসেছে মেয়েটার, ঠিক আছে, রামোনও কৌশল পরিবর্তন করতে জানে। এ পরিবর্তনটুকু ও’কে দ্বিধায় ফেলে দেবে। এসব রামোনের কাছে কোনো ব্যাপারই না।

পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মোলায়েম স্বরে আদেশ দিল : “বাচ্চাটাকে নিয়ে এসো।”

নিকোলাসের হাত ধরে পাশের রুম থেকে এদিকে এলো আদ্রা।

মায়ের মতো খুব সাবধানে ছেলের হাবভাবও লক্ষ করল রামোন। আজ সকালেই চুল ধুয়ে দিয়েছে আদ্রা। কপালের উপর লুটিয়ে পড়েছে উজ্জ্বল কোকড়ানো চুল। সাদাসিধা ড্রেস পরিয়ে দেয়ায় ফুটে উঠেছে শরীরের মসৃণ ভাব, গোলাপি ঠোঁট, বড় বড় চোখের উপরে বাকানো। যে কোনো মায়ের অন্তর বিগলিত করার জন্য যথেষ্ট।

“মনে আছে আমি কী বলেছি নিকোলাস?”

“হ্যাঁ পাদ্রে।”

“খুব লক্ষ্মী একজনের সাথে দেখা হবে এখন। উনি তোমাকে অনেক পছন্দ করেন। একটা উপহার’ও এনেছেন। ভদ্র ব্যবহার করবে আর মাম্মা” ডাকবে।”

“উনি কি আমাকে আদ্রার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবেন?”

“না, নিকোলাস। শুধু তোমার সাথে খানিক গল্প করতে আর উপহার দিতে এসেছেন। এরপর চলে যাবেন। যদি তার সাথে ভালভাবে আচরণ করো তাহলে সন্ধ্যায় আদ্রা উডি উডপোর কাটুন দেখতে দেবে। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে, পাদ্রে।” খুশি হয়ে হাসল নিকোলাস।

“এখন যাও।”

বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাল রামোন। নিচের আঙ্গিনাতে বেলাকে নিয়ে এসেছে কেজিবি নারী সদস্য। সুইমিং পুলের পাশের বেঞ্চ দেখিয়ে বেলা’কে আদেশ দিতেই গমগমে গলা মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পৌঁছে গেল রামোনর কাছে।

“প্লিজ এখানে অপেক্ষা করুন। বাচ্চাটাকে নিয়ে আসা হবে।”

মেয়েটা চলে যেতেই বেঞ্চে বসে পড়ল বেলা। চোখের উপর সানগ্লাস পরে নিল। ডার্ক লেন্সের ওপাশ থেকে দেখতে লাগল চারপাশ।

টু-ওয়ের রেডিও’র বোতাম টিপে দিল রামোন।

“অল-স্টেশনস্, ফুল অ্যালার্ট।”

ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স ইকুপমেন্ট ছাড়াও ইসাবেলার উপর তা করা হল ৭.৬২ মিলিমিটার ড্রাগোনভ স্নাইপার-রাইফেল আর ডার্ট গান। টোনল ঢোকানো ডার্ট গান দু’মিনিটে অচল করে দিতে পারে যেকোনো মানব শরীর। তারপরেও শেষ কথা হল লাল গোলাপের মতো সম্ভাবনাময় অপারেটিভ হারাতে চায় না রামোন।

হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গিনার ওপাশে তাকাল বেলা। নিচে তাকাল রামোন। টাওয়ারের ঠিক নিচেই দেখা গেল নিকোলাস আর আদ্রার মাথা।

বহুকষ্টে দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে দমন করল বেলা। জানে তাহলে হতবাক হয়ে যাবে ছোট্ট মানুষটা।

আস্তে আস্তে সানগ্লাস খুলে ফেলল বেলা। আদ্রার হাত ধরে আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস।

ছেলের দুই মাস বয়সের শেষ ছবি দেখেছিল বেলা। মনে মনে নিকি’র গড়নের কথাও চিন্তা করে রেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সবকিছুই ভিন্ন। ওর গায়ের রং, দেহতত্ত্বের মাধুর্য আর ওই কোকড়ানো চুল-চোখজোড়া! ওহ, চোখজোড়া তো!

“ঈশ্বর!” ফিসফিস করে উঠল বেলা, “আমার বাবুটা এত সুন্দর হয়েছে দেখতে! প্লিজ, গড়, ও যেন আমাকে পছন্দ করে।”

নিকোলাসের হাত ছেড়ে দিয়ে ওকে সামনে ঠেলে দিল আদ্রা; সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে দু’জনে এসে দাঁড়াল বেলার সামনে।

“বুয়েনস ডায়াস, সিনোরিটা বেলা” স্প্যানিশে বলে উঠল আদ্রা। “নিকোলাস সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। আপনাদের দুজনের জন্যে সুইমিং কস্টিউম রাখা আছে। যদি চান তো ওর সাথে সাঁতার কাটতে পারবেন।” বাথ হাউজের বদ্ধ দরজার দিকে ইশারা করল আদ্রা, “ওখানে চেঞ্চ করতে পারবেন। এরপর নিকোলাসের দিকে তাকাল,

‘মা’কে অভ্যর্থনা জানাও।” ঘুরে দাঁড়িয়ে এস্ত পায়ে আঙিনা ছেড়ে চলে গেল আদ্রা।

নিকোলাস এখন পর্যন্ত একবারও হাসেনি কিংবা বেলা’র উপর থেকে চোখ সরায়নি। এবারে দায়িত্ব পেয়ে খানিক সামনে এসে ডান হাত এগিয়ে দিল।

“গুড ডে, মাম্মা। আমার নাম নিকোলাস মাচাদো আর তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালই লাগছে।”

ইসাবেলার ইচ্ছে হল হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। “মাম্মা” শব্দটা যেন বেয়নেটের মতো ঢুকে গেছে বুকের ভেতরে। কিন্তু তার বদলে ছেলের সাথে হাত মেলাল কেবল।

“তুমি তো দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছ, নিকোলাস। শুনেছি নার্সারি স্কুলেও বেশ ভালো করছ।”

“হ” মাথা নাড়ল নিকি।

“আগামী বছর ইয়াং পাইওনিয়ারদের সাথে যোগদেব।”

“তাহলে তো খুবই ভাল হবে। কিন্তু এরা কারা?”

“সবাই জানে।” মায়ের অজ্ঞতা শুনে মজা পেল নিকোলাস।” তারা সকলে বিপ্লবের সন্তান।”

ও, ওয়ান্ডারফুল। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে তাড়াহুড়া করে উত্তর দিল ইসাবেলা, “আমি তোমার জন্য একটা প্রেজেন্ট এনেছি।”

“থ্যাংক ইউ, মাম্মা।” প্যাকেজের দিকে তাকাল নিকোলাস।

বেঞ্চে বসে ছেলের হাতে উপহার তুলে দিল বেলা। সাবধানে খুলে ফেলল নিকোলাস। আর তারপরই কেমন চুপ করে গেল।

“তোমার পছন্দ হয়েছে?” নার্ভাস ভঙ্গিতে জানতে চাইল বেলা।

“সকার বল।” অস্ফুটে বলে উঠল বেলা।

“হ্যাঁ, পছন্দ হয়নি?”

“এত সুন্দর গিফট আগে আর কেউ দেয়নি আমাকে।”

চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাতেই ছেলের দৃষ্টিতে সত্যিকারের খুশি দেখতে পেল বেলা। এই বয়সেই কতটা রিজার্ভ ছেলেটা। কতটা ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন ওকে এরকম বানিয়ে দিয়েছে?

“আমি কখনো ফুটবল খেলিনি।” বলে উঠল বেলা। “তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে?”

“তুমি তো মেয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল নিকোলাস।

“তারপরেও আমি চেষ্টা করতে চাই।”

“ঠিক আছে।” এক হাতের নিচে বল নিয়ে উঠে দাঁড়াল নিকি। “কিন্তু তোমাকে জুতা খুলে ফেলতে হবে।”

মিনিটখানেকের ভেতরে কেটে গেল নিকোলাসের আড়ষ্ঠতা। বলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা ইঁদুর ছানার মতো পুরো আঙ্গিনা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ইসাবেলা’ও ওর পিছনে ছুটছে, ওর কথা শুনছে, বেঞ্চের নিচে পাঁচটা গোল দিয়ে ফেলল নিকোলাস।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই বসে পড়ল লনের উপর। এবারে নিকি মাকে জানাল-”মেয়ে হলে-তুমি ভালই খেলেছ।”

সুইমিং কস্টিউম পরে নিল দু’জনে আর মা’কে নিজের নানা কসরৎ দেখাল নিকি। বিভিন্নভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে একেবারে লাল হয়ে উঠল চেহারা।

কোমর সমান পানিতে সিঁড়ির শেষ ধাপের উপর বসে কঁকি দিয়ে উঠল ইসাবেলার শরীর; মনে পড়ে গেলো ট্যাংকের মাঝে ছেলের ডুবে যাবার দৃশ্য। তারপরেও নিজেকে সামলে হেসে ফেলল, নিকিকে প্রশংসা জানিয়ে বলে উঠল,

“ওহ, ওয়েলডান নিকোলাস।”

হাপাতে হাপাতে মায়ের কাছে এসে হঠাৎ করে কোলে উঠে গেল।

“তুমি বেশ সুন্দরী। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”

যেন মূল্যবান কোনো ক্ৰিসালস্ট একটু আঘাতেই ভেঙে যাবে; এমনভাবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল বেলা। ছোট উষ্ণ দেহটাকে ধরে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে উঠল বেলার হৃদয়। “নিকোলাস, মাই বেবি, আমি তোকে কত ভালবাসি, কত মিস করি!”

চোখের পলকে কেটে গেল পুরো বিকেল। এরপর এলো আদ্রা, “নিকোলাসের ডিনারের সময় হয়েছে। আপনি ওর সাথে খেতে বসবেন সিনোরিটা?

আঙ্গিনাতে ওদের জন্যে পাতা টেবিলের উপর বসে আল ফ্রেসকো খেলো-মাতা-পুত্র। নিকোলাসের জন্য এলো ফ্রেস কমলার রস আর বেলার জন্য শেরী। ইসাবেলা ব্রিমের কাটা বেছে দিলেও নিকোলাস একাই খেল।

নিকোলাস যখন আইসক্রীম খাচ্ছে, তখন চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে বেলা। কানের কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে শুনতে যেন ফেটে পড়ল নিকোলাসের মুখ।

চেয়ার থেকে পড়ে যাবার আগেই বেলা’কে ধরে ফেলল আদ্রা। পেছনের দরজা দিয়ে আঙ্গিনাতে নেমে এলো রামোন; সাথে কেজিবি’ ফিমেল মেম্বার।

“তুমি বেশ লক্ষ্মী হয়ে ছিলে, নিকোলাস। এখন আদ্রার সাথে ঘুমাতে যাও।”

“উনার কী হয়েছে?”

“কিছুই হয়নি।” জানাল রামোন। “উনার ঘুম পেয়েছে। তোমারও তো ঘুম পেয়েছে নিকোলাস।”

“হ্যাঁ। পাদ্রে। হাই তুলতে তুলতে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মছুল নিকি। আদ্রা ওকে নিয়ে যেতেই কেজিবি নারী সেনাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রামোন।

“রুমে নিয়ে যাও।”

ডিনার টেবিল থেকে খালি শরীর গ্লাস তুলে রুমাল দিয়ে ওষুধের শেষ কোণাটুকুও মুছে ফেলল রামোন।

***

অদ্ভুত একটা বেডরুমে ইসাবেলার ঘুম ভেঙে গেল। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। ঘুম ঘুম চোখে কাঁধের উপর টেনে নিল চাদর।

হঠাৎ করেই খেয়াল হল যে চাদরের নিচে ওর শরীরটা পুরোপুরি নগ্ন। মাথা তুলতেই দেখতে পেল বাথরুমের দরজার পাশে পরিষ্কারভাবে ওর ভাজ করা কাপড় রাখা আছে। লাগেজ র‍্যাকে সুটকেস।

চোখের কোণে কেউ একজনকে নড়তে দেখে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠল দৃষ্টি। বেডরুমে ওর সাথে একজন পুরুষও আছে। চিৎকার করার জন্য মুখ খুলতেই তাড়াতাড়ি লোকটা ওকে চুপ করার জন্য ইশারা করল।

“রাম-” নাম উচ্চারণ করার আগেই দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে ওর মুখে হাত চাপা দিল রামোন।

হা করে তাকিয়ে রইল হতভম্ব। বাকরুদ্ধ বেলা। ভেতরে উৎলে উঠেছে। আনন্দ। রামোন!

বেলাকে ছেড়ে আবারো কাছের একটা দেয়ালের দিকে চলে গেল রামোন। গোঁয়ার স্টাইলে একটা অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে। পেইন্টিংটা সরাতেই দেয়ালের গায়ে আটকানো গোপন মাইক্রোফোনটাকে দেখা গেল।

আবারো চুপ থাকার ইশারা করে কাছে এগিয়ে এলো রামোন। বেডসাইড টেবিলের ল্যাম্পের শেড় ছড়িয়ে দেখাল দ্বিতীয় মাইক্রোফোন।

এরপর বেলা’র এত কাছে এসে বসল যে ওর গালে লাগল রামোনের উষ্ণ নিঃশ্বাস।

“এসো।” কেমন লাজুক হয়ে গেল বেলা। কতদিন কেটে গেছে!

“আমি সব বলছি এসো।”

রামোনের কষ্ট মাখা দু’চোখ দেখে উবে গেল বেলা’র আনন্দ

ওর হাত ধরে বিছানা থেকে নামাল রামোন। তারপর নগ্ন অবস্থাতেই নিয়ে গেল বাথরুমে ড্রাগের কল্যাণে এখনো পুরোপুরি মতিচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি বেলা।

বাথরুমের গ্লাস ওয়ালড কেবিনেটের শাওয়ার ছেড়ে দিল রামোন।

এখনো ওকে স্পর্শ করতে ভয় পাছে বেলা, “এসব কী হচ্ছে? তুমিও কি ওদেরই একজন? রামোন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ বলল কী ঘটছে!”

হাহাকার করে উঠল রামোন, “আমার অবস্থাও তোমার মত। আমাকে এসব করতে হচ্ছে, নিকির খাতিরে। এখন সব বুঝিয়ে বলতে পারব না–তবে এদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি। আমরা তিনজনেই এদের কাছে বাঁধা। ওহ মাই ডার্লিং, আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে সব বলি, কিন্তু সময় যে নেই।”

“রামোন। শুধু এটুকু বলল যে তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো।” ফিসফিস করে উঠল বেলা।

“ইয়েস, মাই ডার্লিং। জানি, তোমার উপর দিয়ে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমারও ঠিক একই অবস্থা। জানি তুমি আমাকে কি ভাবছ, কিন্তু একদিন ঠিকই জানতে পারবে যে আমি সবকিছু নিকি আর তোমার জন্যেই করেছি।”

রামোন’কে বিশ্বাস করতে চাইল বেলা। মন বলছে ওর কথাই যেন সত্যি হয়।

“শীঘ্রিই হাতের মাঝে বেলার মুখখানা ধরে জানাল, রামোন, “আবার আমরা একসাথে হবো-শুধু আমরা তিনজনে। তুমি, আমি, নিকি। বিশ্বাস করো।”

“রামোন!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে সর্বশক্তি দিয়ে রামোনের গলা জড়িয়ে ধরল বেলা। কোনো যুক্তিবোধের তোয়াক্কা না করেই আজও ওকে বিশ্বাস করে বসল।

“আর কয়েক মিনিট মাত্র একসাথে কাটাতে পারব। এর বেশি ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। নতুবা বিপদ হয়ে যাবে। তুমি জানোও না যে নিকি কতটা বিপদের মাঝে আছে।”

“আর তুমিও।” ধরে এলো বেলা’র গলা।

“আমার জীবন কোনো ব্যাপার না; কিন্তু নিকি…”

“তোমাদের দুজনেরই জীবন অনেক মূল্যবান, রামোন।” তাড়াতাড়ি বলে। উঠল বেলা।

“আমাকে প্রমিজ করো যে নিকি’র ক্ষতি হবে এরকম কিছু করবে না।” বেলা’কে কিস করল রামোন।” ওরা যাই বলুক, প্লিজ করো। আর বেশিদিন এসব সইতে হবে না। তুমি সাহায্য করলে আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আমাদেরকে মুক্ত করতে চেষ্টা করব। কিন্তু আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে।”

“ওহ মাই লাভ, আমি জানতাম যে কোনো একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। অবশ্যই আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।”

“আমি জানি, ডার্লিং, আমি জানি।”

“আমাদের জন্যে তোমাকে শক্ত হতে হবে।”

“তোমার নামে শপথ কেটে বলছি, ঈশ্বর জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, কবে থেকে সবকিছু কেবল বুকের মাঝে জমিয়ে রেখেছি।” ভীষণ ভাবে মাথা নাড়ছে বেলা। “প্লিজ আমাকে আদর করো রামোন। কবে থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। আর পারছি না। চলে যাবার আগে আমাকে আদর করো।”

হারিকেনের মতো হাওয়া এসে বেসামাল করে দিল দু’জনকে।

রামোন চলে যাবার পর দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তিটুকুও পাচ্ছে না বেলা। টাইলসের দেয়াল ঘেষে বসে পড়ল মেঝের উপর। বাথরুম ভরে গেল পানিতে। মাথায় যেন কিছুতেই ঢুকছে না। শুধু দুটো নাম রামোন। আর নিকি।

“ওহ্ থ্যাঙ্ক গড।” ফিসফিস করে নিজেকে শোনাল বেলা, “ভয়গুলো সব আসলেই মিথ্যে। রামোন এখনো আমাকে ভালবাসে। আবার আমরা তিনজনে একসাথে হবো। কোনো একদিন, কোনো না কোন ভাবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল বেলা। “এখন আমাকে ধৈর্য ধরতে হবে; ওদের যেন সন্দেহ না হয়…” শাওয়ার নিল টলতে টলতে।

শুধু অন্তর্বাস পরে দাঁড়িয়ে আছে বেলা, এমন সময় একবারও নক না করে দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়ল এয়ারপোর্ট থেকে এসকর্ট করে আনা দুই নারীর একজন। এমনভাবে বেলা’র শরীরের দিকে তাকালো যে তাড়াহুড়ো করে স্কার্ট পরে নিল বেলা।

“কী চান?”

“বিশ মিনিটের মাঝে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।”

“নিকি কোথায়? আমার ছেলে?”

“চলে গেছে।”

“আমি আরেকবার ওকে দেখতে চাই, প্লিজ।”

“সম্ভব না। বাচ্চাটা চলে গেছে।”

রামোনের সাথে দেখা হবার পর থেকে মনের মাঝে যে ক্ষীণ আশার জন্ম হয়েছিল তা সাথে সাথে উবে গেল।

আবারো শুরু হচ্ছে সব দুঃস্বপ্ন। নিজেকে বোঝাল বেলা, “আমাকে শক্ত হতে হবে। রামোনকে বিশ্বাস করতে হবে।”

এয়ারপোর্টে যাবার সময় কটিনার ব্যাক সিটে বেলার পাশে বসল কেজিবি’র সেই নারী সেনা। এয়ার কন্ডিশনড় না থাকায় কেজিবি’র গায়ের গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়ল। সাইড উইন্ডো খুলে দিতেই ঠাণ্ডা বাতাসে জুড়িয়ে গেল অন্তর।

ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার টার্মিনালে গাড়ি থামার পর প্রথমবারের মতো কথা বলে উঠল কেজিবি; হাসিয়েন্দা ছাড়ার পর এতক্ষণ টু শব্দও করেনি। বেলা’র হাতে তুলে দিল ঠিকানা বিহীন খাম।

“এটা আপনার জন্য।”

হ্যান্ডব্যাগ খুলে খামটাকে রেখে দিল বেলা। কটিনা থেকে বের হয়ে স্যুটকেস তুলে নিল; ড্রাইভার সাথে সাথে দরজা আটকে চলে গেল গাড়ি নিয়ে।

হাজারো প্যাকেজ-টুর ট্রাভেলারদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একা মনে করল বেলা, নিকি আর রামোনকে দেখার আগেও যেন এতটা একা ছিল না।

“ওকে আমার বিশ্বাস করতেই হবে। নিজেকে আবারো মনে করিয়ে দিয়ে ডেস্কের দিকে পা বাড়ার বেলা।

ফার্স্টক্লাস লাউঞ্জের উইমেন ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা আটকে ছিঁড়ে ফেলল খাম। লাল গোলাপ,

আর্মসকোর আর পেলিনড়াবা নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথভাবে বানানো নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের কাজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে জানতে পারার সাথে সাথে টেস্ট সাইট আর ডেট জানিয়ে দেবে।

এ ডাটা পাবার পরেই পুত্রের সাথে তোমার পরবর্তী সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। তথ্যের গুরুত্বের উপর নির্ভর করবে সাক্ষাতের সময় সীমা।

সাদা পৃষ্ঠার উপর টাইপ করা মেসেজটাতে কোনো স্বাক্ষর নেই। দৃষ্টিশূন্য-ভাবে তাকিয়ে রইল বেলা।

“আরো চাই, আরো চাই।”

ফিসফিস করে উঠল বেলা, “প্রথমে রাডার রিপোর্ট। সেটা ততটা খারাপ ছিল না। ডিফেন্সিভ উইপন-কিন্তু এখন? অ্যাটম বোমা? কখনো কি এর শেষ হবে?”

মাথা নাড়ল বেলা, “আমি পারব না-বলে দেব-পারব না, ব্যাস।”

পেলিনডাবা ইনস্টিটিউট নিয়ে বাবার কখনো কোনো আগ্রহই দেখেনি। এতদসম্পর্কিত কোনো ফাইল তো দূরে থাক। প্রাইম মিনিস্টার নিজে কয়েকবার বলেছেন যে সাউথ আফ্রিকা নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে না।

অথচ এর উপরে আবার ওকে খবর নিতে হবে প্রথম ডিভাইসটা কবে কোথায় ফাটবে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে মেসেজটাকে ছিঁড়ে ফেলল বেলা।

“আমি পারব না।” টয়লেট সিট থেকে উঠে প্রতিটি টুকরা পানিতে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দিল। “বলে দেব পারব না।” কিন্তু মনে মনে আবার বাবাকে কিভাবে কাবু করা যায় সেই প্ল্যান করা শুরু করে দিল।”

***

স্পেনে যাওয়ায় মাত্র পাঁচদিন দেশে ছিল না বেলা। কিন্তু ইলেকশন ক্যাম্পেইন মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ায় অসম্ভব রেগে আছেন নানা। নির্বাচনের আগের দিন শুক্রবারে প্রধানমন্ত্রী জুন ভরসটার সী পয়েন্ট টাউন হলে ন্যাশনাল পার্টি ক্যান্ডিডেটদের সমর্থনে মিটিং ডাকলেন।

এখানে বক্তৃতা করার জন্য ছেড়ে এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ বাকি দুই প্রোগ্রাম। আর এসবই সম্ভব হয়েছে সেনটেইন কোর্টনি-ম্যালকমসের বদান্যতায়।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার জন্যে পুরো ভর্তি হয়ে গেল টাউন হল। কোথাও তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই।

প্রথম বক্তা ইসাবেলা। মাত্র দশ মিনিটেই শেষ করে দিল অবশ্য! পুরো ক্যাম্পেইনে এটাই হল ওর শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। গত কয়েক সপ্তাহে বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে মেয়েটা আর স্পেন থেকে আসার পর তো যেন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। নানা আর শাসা দু’জনের সামনেই প্র্যাকটিকস করে এসেছে বেলা।

হলভর্তি দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা’র তারুণ্যমাখা সৌন্দর্যে। বক্তৃতার শেষে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো বেলা’কে; অন্যদিকে ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত হাততালি আর মাথা নেড়ে সমর্থন দিল লাল মুখো জনে ভরসটার।

পরের বুধবার সন্ধ্যাবেলা ইসাবেলা’র দু’পাশে পার্টি সাজে এসে দাঁড়িয়েছেন শাসা আর নানা। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে।

যেমন আশা ছিল তেমন হয়েছে। বিজয়ী দলের মূল্যবান বারোশ ভোটার কেড়ে নিয়েছে ইসাবেলা কোর্টনি, সমর্থকেরা ওর চেয়ার কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করে দিল।

পরের সপ্তাহে পার্লামেন্টে বিল্ডিংয়ে নিজের অফিসে বেলা’কে মিটিং করতে ডাকলেন জন ভরসটার। বাবা যখন কেবিনেট মিনিস্টার ছিল, তখন থেকেই বিল্ডিংটা চেনে বেলা।

নিজের মেয়াদকালে মেয়েকে অফিসের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাসা। আর মধ্য কেপ টাউনে এলেই একে ক্লাব হিসেবে ব্যবহার করত বেলা। চওড়া করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল বহু স্মৃতি। টিন এজার থাকার সময়ে কখনো মাথা ঘামায়নি জমকালো দালানটার ইতিহাসের মহিমা নিয়ে।

মাত্র পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন প্রধানমন্ত্রী। বেলা অফিসে ঢোকার পর ডেস্ক থেকে বের হয়ে এলেন ওকে অভিবাদন জানানোর জন্য।

“আমাকে ডেকে পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ, ওওম জন।” বিশুদ্ধ আফ্রিবান ভাষায় কথা বলে উঠল বেলা। যাই হোক, ওওম অথবা আংকেল ডেকে বেশ সম্মান দেখানোয় মনে মনে মেয়েটার নার্ভের প্রশংসা করলেন জন।

“সী পয়েন্টে তোমার পারফরম্যান্সের জন্য কনগ্রাচুলেশন্স বেলা।” পেট নেইম ব্যবহার করায় নিশ্চিন্ত হল বেলা।

“এখন আমার কফি-ব্রেক চলছে।” সাইড টেবিলের উপর রাখা সিলভার আর পোর্সেলিন সার্ভিসের দিকে ইশারা করলেন প্রধানমন্ত্রী, “আমাদের দু’জনের জন্য কফি ঢেলে নেবে?”

কাপের উপর দিয়ে তাকালেন বেলার দিকে, “নাউ ইয়াং লেডি, এমপি তো হলে না, এখন কী করবে?”

“ওয়েল, ওওম জন, আমি বাবা’র হয়ে কাজ-”

“আমি জানি” বেলা’কে থামিয়ে দিলেন জন। “কিন্তু ফ্রেশ ইয়াং পলিটিক্যাল ট্যালেন্টকে’তো এমনই পড়ে থাকতে দিতে পারি না। সিনেটে একটা সিটের কথা কখনো ভেবেছ?”

“সিনেট?” হকচকিয়ে যাওয়ায় কফি’তে পুড়ে গেল ইসাবেলার জিহ্বা। “না, আমি কখনো এ ব্যাপারে ভাবিইনি। কেউ তো বলেওনি-”।

“ঠিক আছে। এখন বলছে। আগামী মাসেই-রিটায়ার করবেন বুড়ো ক্লেইনহান। উনার আসনের জন্যে কাউকে মনোনীত করতে হবে; তাই লোয়ার হাউজে তোমার জন্যে সেইফ সিট না পাওয়া পর্যন্ত এতে কাজ চালাতে হবে।”

রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকার দুটো লেজিসলেটিভ হাউসের আপার লেভেল হল সিনেট। আপার হাউসের কয়েকটা সিট প্রধানমন্ত্রীর গিফট হিসেবে গণ্য করা হয়; যার একটা এখন বেলা’কে দেয়া হলো।

কফি কাপ নামিয়ে রেখে নির্বাক হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। সহসা এতটা উপরে যাবার সিঁড়ি পেয়ে মাথা যেন কাজ করতে চাইছে না। “তুমি রাজি…?” জানতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী।

এতটা শর্ট কাটের কথা নানা কিংবা শাসা’ও কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি।

হেড্রিক ভারউড নিজে সিনেটে তাঁর পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সিনেটের হিসেবে। মাত্র আটাশ বছর বয়সে বেলা’ই হতে যাচ্ছে আপার হাউজের সবচেয়ে তরুণ, বুদ্ধিমান আর আকর্ষণীয় সিনেটর।

ন্যাশনাল পার্টি থেকে কিছুদিনের মাঝেই ও হয়ে উঠবে প্রাইম ফেমিনিস্ট পলিটিক্যাল ফিগার। ক্ষমতার একেবারে ভেতরের অংশে, রাষ্ট্রের গোপন সব অলিগলিতে ওর বিচরণ কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

“এতটা সম্মানিত আর কখনো বোধ করিনি, মিঃ প্রাইম মিনিস্টার।” প্রায় ফিসফিস করে জানিয়ে দিল বেলা।

“জানি তুমি দেশের জন্য এরচেয়েও বেশি সম্মান বয়ে নিয়ে আসবে। হাত বাড়িয়ে দিলেন ভরসটার, কনগ্রাচুলেশন্স সিনেটর।”

প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরতেই বেলা’র মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল অপরাধবোধের শীতল স্রোত; বিশ্বাসঘাতকতার বোধ। কিন্তু সাথে সাথে চিন্তার ঝড় বইতে লাগল মাথার মধ্যে; লাল গোলাপ এখন হয়ে উঠবে ওদের তুরুপের তাস। তাই শীঘিই ওর সব দাবি পূরণ করতে হবে ওদেরকেও।

নিকি আর রামোন। আর বেশি দিন দূরে নেই-সেদিন। আবার আমরা একসাথে হবো।

***

নিরাভরণ আর বিশাল কারু’কে কখনোই তেমন পছন্দ করত না বেলা। কিন্তু কৈশোরে ইভ পালমা’রের লেখা ‘দ্য প্লেইনস্ অব ক্যামডিবু পড়ার পর থেকে কারু’র বিস্ময়কর দুনিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। ওর ছোট্ট বেলাতেই এই বিশাল র‍্যাঞ্চটাকে কিনে নিয়েছেন শাসা।

এখানেই বাবার সাথে খুঁজে বেরিয়েছে দানবীয় সরীসৃপদের ফসিল।

ভয়ংকর যেসব প্রাণীর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে খামারবাড়ির নাম রাখা হয়েছে ড্রাগন’স ফাউন্টেন। এছাড়াও টেবিল টপড় মাউন্টনের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে মিষ্টি পানির ঝরনা। এর পানি থেকেই পুষ্টি পায় প্রাসাদের সামনের বাগান আর সবুজ লন।

ষাট হাজার একরেরও বেশি জমি নিয়ে ছড়িয়ে আছে এই র‍্যাঞ্চ। এখানে একসাথে চড়ে বেড়ায় লম্বা পশম অলা ভেড়ার দল আর সুদৃশ্য ছোট ছোট স্প্রিংবক হরিণের পাল। দেখে মনে হয় বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূলিকণা। দারুচিনি রঙা শরীরে মিশে গেছে চকোলেট আর সাদা রঙ। চমৎকার প্যাটার্নের মাথা আর শিংয়ের কারণে ক্যামডিবুর সমভূমিতে চড়ে বেড়ানো অসংখ্য প্রাণের মধ্যে এগুলোই হয়ে উঠেছে। ইসাবেলার সবচেয়ে প্রিয়। আর মরুভূমির ছোট ছোট ঝোঁপ থেকে আহার খুঁজে নেয়ায় ভেড়া আর অ্যান্টিলোপগুলোর সুস্বাদু মাংসে পাওয়া যায় ভেষজ স্বাদ।

প্রতি শীতে, হান্টিং সিজন শুরু হবার আগে বার্ষিক স্প্রিংবক নিধন প্রতিযোগিতার জন্যে ড্রাগন’স ফাউন্টেনে পার্টি দেন শাসা। চার ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হলেই কারু’তে বেড়ে যায় এদের সংখ্যা। তাই এগুলোর বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বছরে অন্তত হাজার খানেককে মেরে ফেলতে হয়।

জোহানোবার্গ থেকে নিজের বন্ধু আর তাদের পরিবারকে নিয়ে আসে গ্যারি। নতুন লিয়ার জেট নামার মতো করে সম্প্রসারণ করা হয়েছে ল্যান্ডিং স্ট্রিপ। কেপ টাউন থেকে বাকি অতিথিদেরকে জোড়া ইঞ্জিনের কুইন এয়ারে করে নিয়ে আসেন শাসা।

সিনেটের অধিবেশন শেষ করে ঊনত্রিশতম জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে পাওয়া ছাই রঙা পোরেশে’তে নানা’কে সাথে নিয়ে পৌঁছে গেল বেলা। লং ড্রাইভের লম্বা ঘন্টাগুলো কিভাবে যেন পার হয়ে যায় এই বুড়ীর গল্প শুনতে শুনতে। স্পিডমিটারের দিকে তেমন খেয়ালই করেন না নানা। তাই বুফোর্ট ওয়েস্ট আর র‍্যাঞ্চের মাঝখানের রাস্তায় গিয়ে গাড়ির স্পিড ১৬০ মাইল পর্যন্ত তুলে ফেলল বেলা।

ড্রাগনস ফাউন্টেনের রান্না ঘরের আঙ্গিনাতে যখন গাড়ি থামল তখন প্রায় মাঝদুপুর। ভৃত্য আর কুকুরদের দল এগিয়ে এলে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। অবশেষে বেলা যখন নিজের রুমে যাবরার ফুরসৎ পেল ততক্ষণে তার তিনটা স্যুটকেস খুলে ফেলতে শুরু করেছে ন্যানি।

“গড ন্যানি, আমি শেষ। আগামী এক সপ্তাহ শুধু ঘুমাবো।”

“অকারণে তোমার প্রভুর নাম নিওনা।” সর্তক করে দিল ন্যানি।

“তুমি তো মুসলিম ন্যানি। এভাবে বলছ যে?”

“নিয়ম তো সবার জন্যই এক।” ঘোঘোৎ করে উঠল ন্যানি।

“পুরুষেরা সব কই?” বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বেলা।

“শিকারে গেছে, আর কি!”

“সুদর্শন কেউ আছে নাকি?”

“হ্যাঁ, কিন্তু সকলেই বিবাহিত। তোমারটা তোমারই খোঁজা উচিত মিস বেলা।” থেমে গেল ন্যানি। “একজন আছে যার স্ত্রী নেই।” পরক্ষণে মাথা নেড়ে জানাল। “কিন্তু তুমি তাকে পছন্দ করবে না।”

“কেন?”

“ওর তালুতে একটাও চুল নেই।” হাসতে লাগল ন্যানি, “একেবারে ডিমের খোসার মতো টাক।”

“ঠিকই বলেছে ন্যানি। চোখ জোড়া আর চেহারাটা খানিক সহৃদয় হলেও মাথা একেবারে ন্যাড়া। পেছন দিকে ফ্রায়ার টাকের মতো কোকড়ানো।

ডিনারের আগে ককটেলের জন্য নিচে নেমে এসে বেশ ভাল বোধ করল বেলা। উষ্ণ জলে স্নান করে এরই মাঝে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়েছে। আর পরনের নীল সিল্কের ড্রেসটা’র কল্যাণে সৌন্দর্য যেন ফুটে বের হচ্ছে। বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত সকলেই কাৎ।

প্রথমেই গ্যারি’র কাছে গেল বেলা। বহুমাস দু’জনের দেখা হয়নি। “মাই বিগ টেডি বিয়ার” ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা।

বোনের কোমর ধরে টাকলুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল গ্যারি। “বেলা, উনি প্রফেসর অ্যারন ফ্রাইডম্যান। অ্যারন এ হচ্ছে আমার ছোট্ট বোন সিনেটর ডক্টর ইসাবেলা কোর্টনি।”

“ওহ, কাম অন গ্যারি!” ভাইকে মৃদু ভর্ৎসনা করে অরনের সাথে হাত মেলালো বেলা। পিয়ানিস্ট কিংবা সার্জনের মতো শক্ত হাত। জেরুসালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অ্যারন এখন ছুটিতে আছেন।”

“ওহ, আই লাভ জেরুসালেম।” নম্রভাবে উত্তর দিল বেলা।” বলতে গেলে ইসরয়েলকেই ভালেবাসি।”

এরপর আরো মিনিট খানেক থেকে বাবার খোঁজে বারান্দার দিকে গেল বেলা। আগত অতিথি স্ত্রীদের মাঝে সবচেয়ে তিনজন ঘিরে ধরে আছে শাসা’কে।

“মাই বিউটিফুল ড্যাডি” বাবাকে কিস্ করল বেলা। এরপর বাবার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে গেল। আর সবসময়ে যেটা হয় ওদেরকে ঘিরে শুরু হয়ে গেল জটলা।

শ্যাম্পনে চুমুক দিতে দিতে হাসছে সকলে, গল্প করছে। বাইরে অস্তাচলে বসেছে কারুর সূর্য। মেঘের গায়ে যেন আগুন ধরে গেছে।

হঠাৎ করেই কে যেন বলে উঠল: “ড্রেস পরার সময় রেডিওতে শুনেছি ইথিওপিয়ানরা হালি সেলাসিকে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য করেছে।”

“আর যতসব ভক্কর-চক্কর; ডাকাতের দল।” বলে উঠল আরেকজন। “যুদ্ধের সময় সিক্সস ডিভিশনের সাথে ওখানে ছিলাম-পায়ে হেঁটে গেছি, আর শাসা তো হারিকেন নিয়ে ঘুরেছে।”

চোখের কালো পট্টিটা স্পর্শ করলেন শাসা, “তখন এর নাম ছিল আবিসিনিয়া।”

আবারো হাসতে শুরু করল সকলে, এরই মাঝে কেউ বলে উঠল : “হালি সেলাসি কিন্তু বুড়ো হলেও খারাপ ছিল না। এখন কী হবে কে জানেন!”

“কৃষাঙ্গ আফ্রিকার সর্বত্র তো একই অবস্থা-দ্বন্দ্ব, কম্যুনিজম, গুম, অরাজকতা, হত্যা আর মার্কসিজম।”

বিড়বিড় করে অনেকেই সম্মতি জানালেও সবাই এবারে মন দিল সূর্যাস্তের অনিন্দ্র সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার জন্য।

মঞ্চের পর্দা নামার মতো করে হঠাৎ করেই ঝুপ করে নেমে এলো রাত। এতক্ষণে ঠাণ্ডা এসে কাঁপিয়ে দিল সকলকে। ঠিক সময়ে বেজে উঠল ডিনারের মূৰ্ছনা। বারান্দার শেষ মাথায় নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন, ফ্রেঞ্চ-উইনডো দিয়ে পথ দেখিয়ে সকলকে নিয়ে গেলেন লম্বা ডাইনিং রুমে; যেখানে সিলভার আর ক্রিস্টালের উপর মোমবাতির আলো পড়ে চমকাচ্ছে পলিশ করা অ্যান্টিক ওয়ালনাট টেবিল।

নিজের আসনের দু’পাশে গ্যারি আর অ্যারনকে পেল ইসাবেলা। বোঝাই যাচ্ছে এটা নানার চাল।

তাড়াহুড়ো করে এসে ওর চেয়ার টেনে দিল অ্যারন। ধুভ্যোরি। কিন্তু একটু পরেই অ্যারনের মজার সব কথা শুনে বিস্মিত বেলা ভুলেই গেল লোকটার টাকের কথা।

গ্যারি এতক্ষণ অন্যপাশে ব্যস্ত থাকলেও এবারে ইসাবেলার দিকে ফিরে অ্যারনের সাথে কথা বলা শুরু করে দিল।

“বাই দ্য ওয়ে অ্যারন, তুমি যদি সত্যিই সোমবার বিকেলে পেলিনড়াবাতে ফিরতে চাও, তাহলে আমি লিয়ারে করে পৌঁছে দেব।”

নামটা শুনেই চমকে উঠল বেলা। গালদুটো যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পোলিনডাবা। “তুমি ঠিক আছ তত বেলা?” উদ্বেগ নিয়ে বলল গ্যারি।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছি।”

“অথচ মুহূর্তের জন্য কেমন অদ্ভুত লাগছিল তোমাকে দেখতে।”

“কিছু না। গ্যারি, তোমার কল্পনা।” কিন্তু চিন্তার ঝড় চলছে বেলার মাথায়। গ্যারি আবার অন্যদিকে তাকাতেই নিজেকে সামলে নিল বেলা।

‘আমি তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি প্রফেসর, আপনার পড়নোর বিষয় কী?”

“আমাকে অ্যারন ডাকা যায় না ডক্টর?”

হেসে ফেলল বেলা, “তাহলে আমাকেও ইসাবেলা ডাকতে হবে।”

“আমি একজন ফিজিসিস্ট, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। বেশ বোরিং, তাই না?”

“মোটেই না, অ্যারন।” হালকাভাবে ওর কব্জি ছুলো বেলা।” এটাই তো ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, শান্তি কিংবা যুদ্ধ যাই হোক না কেন।”

অ্যারনকে ধরা অবস্থাতেই ওর দিকে খানিক ঝুঁকে গেল বেলা। অন্তর্বাস না থাকায় দেহের উপরের অংশ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে গেল। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইল অ্যারন। মিনিট দুয়েক দেখার সুযোগ দিয়ে সোজা হয়ে বসল বেলা। ছেড়ে দিল আরনের কব্জি।

এই দুই সেকেন্ডেই বদলে গেছে অ্যারন ফ্রাইডম্যান। সম্মোহিত হয়ে বেলার বংশদব হয়ে গেছে যেন।

“আপনার স্ত্রী কোথায় অ্যারন?”

“প্রায় পাঁচ বছর আগে আমাদের ডির্ভোস হয়ে গেছে।”

“ওহ্, আই অ্যাম সো সরি।”

আদুরে গলায় চোখে সহানুভূতি নিয়ে তাকিয়ে রইল বেলা।

সন্ধ্যা শেষে নিজ রুমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেক-আপ তুলতে তুলতে আপন মনে হাসল বেলা, “ইস্রায়েল, পেলিনডাবা, নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে…আমাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।”

গত দুই বছরে প্রতি মাসেই কোনো না কোনো তথ্য পাঠিয়েছে লাল গোলাপ। অবশেষে সময় এসেছে নিকোলাসের সাথে ওর সাক্ষাতের সুযোগ তৈরি করার।

ডিনারের সময় জানা গেল আরনের ঘোড়া প্রীতির কথা। তাই পরের দিন খুব ভোরবেলা রাইডে যাবার প্ল্যান করল দুজনে।

“আর কতদূরে যাবে তুমি?” আয়নায় নিজেকে শুধোল ইসাবেলা। উত্তর দেবার আগে বেশ খানিকক্ষণ ভেবে নিল।

“ওয়েল, লোকটা সত্যি বেশ মজার আর মিষ্টি চেহারার অধিকারী; সবাই তো বলে যে টাকলুদের কামনা-বাসনাও বেশি হয়।” আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো বেলা, “তুমি এত বিচ্ছু, মাতা হারি একটা।”

চৌদ্দ বছর বয়সে বড় ভাই শন মাতা হারি’কে নিয়ে একটা ছড়া শিখিয়েছিল।

“মেয়েটা জেনে গেছে সে জায়গা।
গভীর গোপনে আছে যা,
তেইশতম অবস্থানে গিয়ে,
নিগর্তকরণ”।

“নিগতকরণ” এর মানে জানতে চাইলে দুর্বোদ্ধভাবে হেসেছিল শন। ডিকশনকারী দেখেও তেমন সুরাহা করতে পারেনি। এবারে তাই হেসে ফেলে ভাবল,

“সত্যি এতদূর যাবে? যাইড হোক তেইশতম অবস্থান পর্যন্ত যেতে হবে না। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কোন কৌশলেই কাজ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তবে মনের গভীরে ঠিকই টের পেল যে নিকি আর রামোনের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত আছে।

ঠিকভাবে ভোরও হয়নি, আস্তাবলে নেমে এলো বেলা। আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল অ্যারন। সহিসকে অ্যারনের জন্য একটা শান্ত স্বভাবের বুড়ো, খাসি করা ঘোড়া আনার অর্ডার দিল বেলা। অস্বস্তি নিয়ে ভাবলো এটাকে নিশ্চয় সামলাতে পারবে অ্যারন। কিন্তু স্বচ্ছন্দেই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে গেল প্রফেসর।

দিগন্তে সূর্য দেখা দিতে দিতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে এলো দুজনে। মরুভূমির অদ্ভুত আলো খেলার জন্য মনে হল পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে বেলা।

মাথার উপর পাখা ছড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে শকুনের দল। গতদিনের শিকারের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সন্ত্রস্ত প্রিংকের পাল। পরিষ্কার মিষ্টি বাতাস ঠিক যেন শ্যাম্পেনের মতো নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। বাঁধনহারা বেলা আজ কোনো কিছুতেই দমবে না।

ঘোড়া দু’টোর ওয়ার্ম আপ শেষ হতেই টবগ করে গতি বাড়ালো দু’জনেই। নেমে গেল বাঁধের নিচে শুকনো নদীর বুকে। তীরে পৌঁছাতেই দেখা গেল কর্দমাক্ত বাদামি পানি থেকে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে মিশরীয় রাজহাঁস।

ঘোড়া থেকে নেমে নাটকীয়ভাবে স্কার্ফের কোণা দিয়ে চোখ মুছলো বেলা। উদ্বিগ্ন মুখে নেমে এলো অ্যারন।

“আপনি ঠিক আছেন তো ইসাবেলা?”

“মনে হচ্ছে চোখে কিছু পড়েছে।”

“আমি দেখব?”

অ্যারনের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিল বেলা। আলতো করে দু’হাত দিয়ে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল অ্যারন।

“আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

চোখ পিটপিট করে উঠল বেলা। লম্বা আর ঘন পাপড়ি ভেদ করে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করে উঠল বিশুদ্ধ নীলকান্তমণি।

“আপনি নিশ্চিত?” অ্যারনের পুরুষালি গন্ধ আর নিঃশ্বাসের মিষ্টি ভাব এসে লাগল বেলার গালে। পোড়া মধুর মতো গাঢ় রঙা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।

আস্তে করে ওর চোখ ম্যাসাজ করে দিল অ্যারন।

“এখন কেমন লাগছে?” আবারো চোখ পিটপিট করে উঠল বেলা।

“আপনার হাতে তো যাদু আছে। এখন বেশ ভাল লাগছে।”

অ্যারনকে কিস করল বেলা।

প্রথমে খানিক হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল অ্যারন। বেলা’র কোমর জড়িয়ে ধরতেই কয়েক সেকেন্ড ওর স্বাদ নেয়ার সুযোগ দিল মেয়েটা। যখনই বুঝতে পালর যে অ্যারন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল বেলা।

“চলুন, আস্তাবলে কে আগে যায় দেখি।” কামুক হাসি হেসে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল বেলা। ওর চেস্টনাট ঘোটকীর ধারে কাছেও আসতে পারবে না। বুড়ো খোঁজা।

পরবর্তী তিনদিনে অ্যারন ফ্রাইডম্যানের জীবন অতিষ্ট করে তুলল বেলা। সুইমিং পুলে ওয়াটার পোলো খেলা, ডিনার টেবিলের নিচে অ্যারনের ঊরুতে হাত রাখা, লনে শুয়ে ওর সামনে বিকিনির টপ ঠিক করা; অ্যারনের মাথা খারাপ হবার যোগাড়। উপরন্তু হান্টিং ল্যান্ড রোভারে উঠার সময় সাহায্য করতে গিয়ে নিজের স্বচ্ছ প্যান্টি দেখারও সুযোগ করে দিল বেলা। বারান্দায় ডান্স করার সময় অলস ভঙ্গিতে ঘুরতে থাকা বেলা’র কোমর দেখে তো রীতিমতো দমবন্ধ করে ফেলল অ্যারন।

ড্রাগনস ফাউন্টেন ছেড়ে গ্যারির সাথে ট্রান্সভ্যালে যাবার আগের দিন নিজের রুমে অ্যারনকে অনুমতি দিল বেলা; এমনকি করিডোরে দাঁড়িয়ে গুড নাইটও জানালো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে কিস করতে গিয়ে নিজের আকুতিও আবিষ্কার করল বেলা। অ্যারনের মতই সেও প্রচণ্ড ভাবে কামনা করছে তার সান্নিধ্য। চাইছে না থামুক ওর স্কার্টের নিচে ঘুরে বেড়ানো সেই স্পর্শ। পিয়ানিস্টদের মতো হালকা চালে দুলছে অ্যারনের স্পর্শ।

“আজ রাতে দরজা খোলা রাখবে না?” ফিসফিস করে বেলা’র কানে কানে বলল অ্যারন। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে অ্যারনকে দূরে সরিয়ে দিল বেলা।

“তুমি পাগল?” ফিসফিস করেই জানালো, “ঘর ভর্তি সব আমার পরিবারের লোকজন বাবা, ভাই, দাদিমা আর ন্যানি।”

“হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি- তুমি আমাকে পাগল করে দিয়েছ। আই লাভ ইউ; আই ওয়ান্ট ইউ। আর সইতে পারছি না এই নির্যাতন। এভাবে আর পারছি না।”

“আমি জানি। আমারও একই অবস্থা। জোহানে বার্গে চলে আসব, ভেবো না।

“কবে? ওহ, প্লিজ বলো কবে ডালিং?”

“তোমাকে ফোন করে জানাবো। নাম্বার রেখে যাও।”

***

৫. সিনেটের সিভিল সার্ভিস

সিনেটের সিভিল সার্ভিস পেনশনের এনকোয়ারি কমিটিতে কাজ করছে ইসাবেলা। পরের মাসে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তাই আরো দু’জন সদস্যসহ ট্রান্সভ্যাল যেতে হল। জোহানেসবার্গে হোলি এবং গ্যারির বাসায় উঠে সকালবেলা ফোন করল অ্যারনের কাছে।

ছোট্ট একটা রেস্টোরেন্টে দেখা করল দু’জনে। ক্রেফিস আর ককটেল খেতে খেতে হালকা চালে জানাতে চাইল নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউড সম্পর্কে।

“ওহ, আর বলো না। সবকিছু আসলেই অনেক বোরিং। এন্টি পার্টিকেল আর প্রাথমিক সব কণা হাসতে হাসতে এড়িয়ে যেতে চাইল অ্যারন।” তুমি জানো কোয়ার্ট নামটা জেমস জায়েসের উক্তি থেকে এসেছে, “থ্রি কোয়ার্কস ফর মাস্টার মার্ক, কোয়ার্ট বলা উচিত আসলে।”

“বাহু, বেশ মজা তো।” টেবিলের নিচে অ্যারনের উরুতে হাত রাখল বেলা; অ্যারনও হাত ধরল, “তোমার কাজ নিশ্চয়ই বেশ কঠিন?”

“হ্যাঁ, তা বলতে পারো।” কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে গেল অ্যারনের আঙুলগুলো।

“হুম, বুঝতে পেরেছি।” চোখ বড় বড় করে ফেলল বেলা, “ডিনারের পর ডান্স করবে?”

“তার বদলে কফি খেতে আমার অফিসেও যেতে পারি।”

“আমার আসলে তেমন ক্ষিধে নেই। ক্রে ফিস্ খেয়েই পেট ভরে গেছে। পরের কোর্সটা বাদ দেই। কী বলো?”

“ওয়েটার, বিল প্লিজ।”

পোলিনডাবাতে কম্পাউন্ডের ভেতরে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে অ্যারনের ফ্ল্যাট আছে। ফ্যাসিলিটির মেইন রিসার্চ আর রিঅ্যাকটর এরিয়ার মতো এখানে সিকিউরিটি তেমন কড়া না হলেও ভিজিটর বুকে সাইন করতে হল বেলা’কে। তাকে’ও ভিজিটর পাশ দিয়ে দিল গার্ড।

বহুদিন পুরুষ সঙ্গ থেকে বঞ্চিত বেলা’কে তৃপ্ত করে দিল অ্যারন। প্রথমে খানিক ভদ্র আচরণ করলেও বেলা’র আকাঙ্ক্ষা টের পেয় সে নিজেও বেশ তৎপর হয়ে উঠল।

শীর্ষ সুখের সন্ধিক্ষণে জানতে চাইল তৃপ্ত বেলা :

“তোমার রাশি কী?”

“বৃশ্চিক।”

“আহ্, সে জন্যেই-বৃশ্চিক রাশির জাতকেরা প্রেমিক হিসেবে অসাধারণ। কোন দিন?

“সাতই নভেম্বর।”

ডিম আর হাসি দিয়ে সকালবেলা একসাথে ব্রেকফাস্ট সারল দুজনে। অ্যারনের পাজামা পরে ওকে অফিসের জন্য বিদায় জানাল বেলা।

“মেইন গেইটের গার্ডের সাথে আমি কথা বলে নেব। তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বের হতে হবে না।” বেলা’কে কিস করল অ্যারন, “আর যদি লাঞ্চ পর্যন্ত ও থেকে যাও, আমি কিছুই মনে করব না।”

“নাহ, উপায় নেই।” মাথা নাড়ল বেলা। “আজ আমার অনেক কাজ।”

অ্যারন চলে যেতেই ভালভাবে দরজা আটকে দিল বেলা। স্টাডিতে সেটা আগেই দেখেছে। এটাকে লুকিয়ে রাখার কথা কেউ ভাবেইনি। অ্যারনের ডেস্কের পাশে চৌকানো একটা বাক্সের গায়ে ছয় সংখ্যার কম্বিনেশন ল।

হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল বেলা।

“নভেম্বরের সাত তারিখ” বিড়বিড় করে আপন মনেই হিসাব করে নিল,

“আর বয়স তেতাল্লিশ কিংবা চুয়াল্লিশ। তার মানে ১৯৩১ কিংবা ১৯৩২

চারবারের চেষ্টাতে ক্লিক করে ভাগ্য খুলে গেল।

“সত্যিকারের ব্রিলিয়ান্ট লোকগুলো কেন এত বোকা হয়?” হেসে ফেলল বেলা। তবে পুরু স্টিলের দরজাটা খোলার আগে সিলের গায়ে আঙুল বোলালো বেলা। একপাশে ছোট্ট একটা সেলোটেপ। “নাহু একেবারে বোকা তো নয়।”

বোঝাই যাচ্ছে যে অ্যারন বাসাতেই কাজ করতে পছন্দ করে। ফাইলগুলো সুন্দরভাবে গোছানো আছে। বেশির ভাগই অবশ্য আর্মসকোরের পরিচিত সুবজরঙা ফাইল।

মাদ্রিদ এয়ারপোর্টে লাল গোলাপকে এই অ্যাসাইনমেন্ট দেবার পর থেকে নিউক্লিয়ার উইপন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে বেলা।

লণ্ডনে বাড়তি দু’দিন কাটিয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে পড়াশুনা করে। ছাত্রাবস্থায় করা লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার করে জোনে গেছে বুদ্ধিমান মানুষের তৈরি সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র সম্পর্কে সবকিছু।

স্তূপের সবচেয়ে উপরের সবুজ ফাইলটাতে হাইয়েস্ট সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্সের স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে। আটটা কপির মধ্যে এটা হলো চতুর্থ। ক্লিয়ার্যান্সের মাঝে ডিফেন্স মিনিস্টার, বিভিন্ন বিজ্ঞানি, অ্যারনসহ ওর বাবার নামও আছে।

সবুজ কাভারের উপরে কোড় নেইমের জায়গায় লেখা আছে, প্রজেক্ট স্কাইলাইট”। খুব সাবধানে ফাইলটাকে তুলে নিল বেলা; খেয়াল রাখল যেন সেইফের অন্য কোনো কিছুর ক্ষতি না হয়। নিজের থিসিসের ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করার সময়েই দ্রুত পড়ার টেকনিক বের করে নিয়েছিল বেলা আর আজও কাজে লাগল সেই বিদ্যা।

বেশিরভাগ অংশই অবশ্য বেশ দুর্বোধ্য ঠেকল; যার কিছুই সে বুঝতে পারল না। তবে এটা বুঝতে পারল যে পোলিনড়াবা’র প্রগ্রেস সম্পর্কে এখানে সিরিজ আকারে রিপোর্ট লেখা হয়েছে।

কালানুক্রমিকভাবে সাজানো রিপোর্টগুলো পড়ে শেষ পৃষ্ঠায় যাবার আগেই জেনে গেল যে প্রায় তিন বছর আগেই সফলতা নিশ্চিত হয়ে গেছে আর এজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ইউরেনিয়াম ২৩৫ প্রস্তুত করা হয়েছে প্রায় ২০০ এক্সপ্লোসিভ ২০৬ ডিভাইস তৈরি করার জন্য যার প্রায় ৫০ কিলোটন ওজন হবে। এগুলোর বেশির ভাগই চলে যাবে ইস্রায়েলের কাছের। কেননা ইস্রায়েল টেকনিক্যাল সহায়তা ছাড়াও ইউরেনিয়াম উৎপাদনে সাহায্য করেছে। তথ্যটা হজম করতে খানিক সময় নিল বেলা। বিশ কিলোটনের হিরোশিমা বোমা এগুলোর কাছে। কিছুই না।

ফাইলটাকে একপাশে রেখে পরেরটাতে হাত দিল বেলা। ঠিকঠাক জায়গামতো ফাইলগুলোকে রাখতে গিয়ে রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে। প্রজেক্ট স্কাইলাইটের মূল উদ্দেশ্য হল এমন সব ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার অস্ত্র বানানো যেন এয়ারক্রাফট কিংবা গ্রাউন্ড আর্টিলারি উভয় স্থান থেকেই সেগুলোকে নিক্ষেপ করা যায়। রিপোর্টে জিফাইভ ক্যাটাগরির নিউক্লিয়ার উইপন তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

নিউক্লিয়ার উইপনের মূল নীতিটা তো সবারই জানা। তারপরেও রিপোর্ট গুলো পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে নোট নিতে লাগল ইসাবেলা। নিজেকে যেন এই ডেভেলপমেন্ট টিমেরই একজন মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকবার এই বিশাল কাজের মাঝে খুঁজে পেল বাবা’র প্রভাব; যাতে চূড়ান্তভাবে সফল হতে চলেছে এহেন গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট।

ফাইলের শেষ রিপোর্টটাতে মাত্র পাঁচদিন আগের তারিখ দেয়া আছে। দ্রুত একবার পড়ে নিয়ে আবারো রিপোর্টটা পড়তে শুরু করল বেলা।

আজ থেকে দুই মাসেরও কম সময়ের মাঝে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হবে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার অ্যাটোমিক বোমা।

“কিন্তু কোথায়?” মরিয়া হয়ে উত্তর খুঁজে চলেছে বেলা, পরের ফাইলটাতেই অবশ্য পেয়েও গেল।

ফাইলগুলোকে ঠিকঠাক জায়গা মতে রেখে দিয়ে সেলোটেপ আটকে কম্বিনেশনের সিকোয়েন্স ঠিক করে উঠে দাঁড়াল বেলা।

***

টেস্ট সাইট খুঁজতে গিয়ে পণ্ড হতে বসেছে মূল্যবান দুটো বছর। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যেন রেডিও অ্যাকটিভের কারণে কোনো ক্ষতি না হয়।

অ্যান্টর্কটিকার গাফ দ্বীপে দক্ষিণ আফ্রিকার আবহাওয়া অফিস থাকলেও ধোপে টিকল না এ আইডিয়া। কেননা অন্যেরা নাক গলাতে পারে। বিশেষ করে

অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর পাদদেশে অবস্থিত এই মহাদেশটাকে বেশ মায়া করে।

নিরাপত্তার খাতিরে তাই দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশ সীমা কিংবা এর মাটিতেই যা করার করতে হবে। তবে এরিয়াল টেস্টের চিন্তাও বাদ দিতে হল। কেননা উপর থেকে ঝড়ে পড়া আবর্জনা আত্মহত্যার সামিল হবে।

অবশেষে সবাই একত্র হলো আন্ডারগ্রিউন্ড টেস্ট করতে। দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনিগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরে অবস্থিত। ষাট বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকানদেরকেই ডিপমাইনিং কৌশলের অগ্রদূত ধরা হয়। ডিপ ড্রিলিংকে তারা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

ওরিয়ন এক্সপ্লোরেশন নামক ড্রিলিং কোম্পানির মালিক হলো কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। ওরিয়নের বুড়ো যাদুকরের দল মাটির নিচে দুই-মাইল পর্যন্ত গত করে তুলে আনতে পারে রাশি রাশি পাথর। গর্তকে সোজা কিংবা যে কোনো দিকে বাঁকাতেও এরা খুবই ওস্তাদ। অথবা দেড় মাইল গর্ত খুঁড়ে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি বেঁকে যেতেও এদের জুড়ি মেলা ভার।

আজ, রৌদ্রস্নাত চমৎকার ঝকমকে দিনটাতে টেস্ট সাইটে দাঁড়িয়ে গভীর শ্রদ্ধা ভরে এই অবিশ্বাস্য দক্ষতার নিরীক্ষণ করছেন শাসা কোর্টনি।

আধুনিক কালের ফায়ার ইঞ্জিনের মতো দেখতে একটা ট্রাকে বসানো হয়েছে পুরো পাওয়ার প্ল্যান্ট। আরেকটা ট্রাকে কন্ট্রোল রুম আর ইলেকট্রনিক মনিটরিং ইকুপমেন্ট রাখা হয়েছে। তৃতীয়টাতে আছে সত্যিকারের ড্রিল আর বেসপ্লেট। চতুর্থটাতে হাইড্রলিক লিফট আর ক্রেন।

ড্রিল সাইটের চারপাশে জড়ো হয়েছে ক্যারাভ্যান আর সাপ্লাই ট্রাকের বহর। আশেপাশের বহু একর নিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে রড। রাত হলে পুরো এলাকায় জ্বলে উঠে নীল সাদা-আলো। ঘড়ির কাটা ধরে এগিয়ে চলেছে পুরো কাজ। কাজটা শেষ হলে প্রায় বলা যায় পানিতেই ডুবে যাবে পুরো তিন কোটি ইউ এস ডলার।

টুপি খুলে হাত দিয়ে ভ্রু’র উপরে মুছলেন শাসা। কালাহারি মরুভূমির এ অংশে আজ বেশ গরম পড়েছে।

নিচু আর ছোট ছোট লাল বালিয়ারীগুলোকে দূর থেকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। শুকিয়ে রূপালি হয়ে আছে মরুভূমির ঘাস। সবচেয়ে কাছের গাছটাতে বাসা বেঁধেছে বাবুই পাখির দল। শত শত জোড়া মিলে তৈরি করেছে এ কলোনি। প্রতি জোড়ার জন্য আছে পৃথক খোপ আর সবাই মিলে প্রতিবছর এর রক্ষণাবেক্ষণও করে। অরেঞ্জ রিভারে উপিংটনের কাছে এরকমই একটা বাসায় শত বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরভাবে বাস করছে বাবুই পাখির ঝাঁক।”

কোর্টনি মিনারেল এক্সপ্লারেশন কোম্পানির মালিকানাধীন ১ লক্ষ ৫০ হাজার একর জমির পুরোটাতেই বেড়া দিয়ে ঘিরে পাহারা বসানো আছে। এখানেই চলছে ড্রিলিং-এর কাজ। কোম্পানির বাইরের কেউ কখনোই এখানে আসতে পারে না-যদি কেউ এসেও পড়ে….তাহলে শুরু হবে আরেকটা ড্রিলের কাজ।

আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন শাসা। মেঘের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। কালাহরির এই অংশ সংরক্ষিত সামরিক এলাকা হওয়াতে কর্মাশিয়াল কিংবা প্রাইভেট কোনো ধরনের এয়ারক্রাফটই উড়তে পারে না। দক্ষিণে মাত্র কয়েকশ মাইল দূরে অবস্থিত কিম্বার্লি আর্টিলারী আর ট্যাঙ্ক স্কুল প্রায়ই এখানে সামরিক মহড়া বসায়।

তারপরেও উদ্বেগে আছেন শাসা। ডি মাইনাস এইট। শনিবার সন্ধ্যায় বিজ্ঞানীদের দল আর রোমানকে নিয়ে ভারী কনভয় রওনা হয়ে যাবে পেলিনডাবা থেকে, পৌঁছবে রবিবার দুপুরে। তার আগেই গর্তটা তৈরি হওয়া চাই।

সোমবার সন্ধ্যার ভেতরে গর্তে বসানো হবে টেস্ট বোমা। কেপটাউন থেকে ডিফেন্স মিনিস্টার আর জেনারেল মালান ডি মাইনাস ওয়ানে ফ্লাই করবেন।

মাথা নাড়লেন শাসা। “নাহ, সবকিছু তো সুন্দর মতই এগোচ্ছে।”

চিফ ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার গত বারো বছর ধরেই কাজ করছে ওরিয়নে। শাসা’কে মোবাইল কন্ট্রোল রুমের সিঁড়িতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা।

“সব কেমন চলছে মাইক?”।

“জবরদস্ত, মিঃ কোর্টনি!” খুশি খুশি গলায় জানাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার, “আজ সকালে নয়টায় তিন হাজার মিটারের মার্ক ছুঁয়েছি আমরা।”

ডিসপ্লে স্ক্রিনে পুটটাকে ইশারায় দেখাল মাইক। বিস্ফোরণ গিলে খেতে সাহায্য করবে এই লাইন।

“আমি তোমাকে বিরক্ত করবনা।” লোকটার পাশে বসলেন শাসা, “তুমি কাজ করে যাও।”

আবারো, পূর্ণ মনোযোগে কন্ট্রোল কসসোল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাইক।

চরুট ধরিয়ে নিলেন শাসা আর কল্পনার চোখে স্টিলের একটা কীটকে মাটির গভীর নেমে যেতে দেখলেন-একেবারে ম্যাগমা পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে পোকাটা। যেখানে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাসা বাড়িতে ব্যবহৃত ওভেনেরই সমান।

কন্ট্রোল রুমে ফোন বেজে উঠল, কিন্তু আপন কল্পনায় বুঁদ হয়ে আছেন শাসা। জুনিয়ার টেকনিশিয়ান তাই দু’বার ডাকার পর সাড়া দিলেন মিঃ কোর্টনি।

“কে জিজ্ঞাসা করে মেসেজ রেখে দাও।” খানিকটা বিরক্ত হলেন শাসা।

“মিঃ ভরসটার স্যার।”

“কোন মিঃ ভরসটার?”

“প্রধানমন্ত্রী স্যার; ব্যক্তিগত লাইনে আছেন।”

ছোঁ মেরে রিসিভার টেনে নিলেন শাসা। হঠাৎ করেই অমঙ্গলের আশংকায় কেঁপে উঠল বুক।

“জ্যা, ওম জন?”

“শাসা গত এক ঘণ্টায় নিজ নিজ সরকারের পক্ষে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে ব্রিটেন, আমেরিকা আর ফরাসি কূটনীতিকগণ।”

“কেন?”

“আজ সকাল নয়টায় একটা আমেরিকান স্যাটেলাইট ড্রিল সাইটটার ছবি তুলে ফেলেছে। আমরা তো গভীর গাঁজায় পড়ে গেলাম! ওরা কোনো না কোনো ভাবে স্কাইলাইট সম্পর্কে জানতে পেরে দাবি করছে এখনি যেন এই টেস্ট বন্ধ করা হয়। কেপ টাউনে ফিরতে তোমার কতক্ষণ লাগবে?

“স্ট্রিপে আমার জেট পঁড়িয়ে আছে। চার ঘণ্টার ভেতরে আপনার অফিসে পৌঁছে যাবো।”

“ফুল কেবিনেট মিটিং ডেকেছি, তুমি ওদেরকে ব্রিফ করবে।”

“ঠিক আছে।”

জন ভরসটারকে আর কখনো এতটা উদ্বিগ্ন আর রেগে যেতে দেখেননি। শাসা। হাত মেলানোর সময় তো রীতিমতো গর্জন করে উঠলেন, “তোমার সাথে যখন কথা বলছি তখন নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি সভা বসিয়েছে রাশানরা যদি টেস্ট অব্যাহত রাখি তাহলে জোরপূর্বক স্থগিতাদেশেরও হুকমি দিয়েছে।”

“আমেরিকান আর বিট্রিশরাও সতর্ক করে দিয়েছে যে টেস্ট করলে আমাদের হয়ে ভেটো দিতে পারবেনা।”

“আপনি কিছু স্বীকার করেননি তো মিঃ প্রাইম মিনিস্টার?”

“আরে নাহ মাথা খারাপ।” ঘেউ ঘেউ করে উঠলেন ভরসটার।

“কিন্তু ওরা সকলেই ড্রিল সাইট দেখতে চায়। তাদের কাছে এরিয়াল ফটোগ্রাফ আছে-এমনকি কোডনেইমটাও জানে স্কাইলাইট।”

“আমাদের কোড জানে?” হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন শাসা। মাথা নাড়লেন ভরসটার।

“হ্যাঁ”

“আপনি বুঝতে পারছেন এর মানে কী? কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে-একেবারে টপ লেভেলের কেউ।”

***

জাতিসংঘ তৃতীয় বিশ্ব আর জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একের পর এক উঠে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নিন্দা জ্ঞাপন করল। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান মন্ত্রীর নিশ্চয়তা সত্ত্বেও গ্রেট ব্রিটেন আর ইউনাইটেড স্টেটস এর কূটনীতিকেরা ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাইল টেস্ট সাইট। তবে তারা পৌঁছানোর আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে সব যন্ত্রাংশ।

“ড্রিলিং এর উদ্দেশ্য কী ছিল” এনিয়ে কয়েকবার শাসা’কে প্রশ্নটা করলেন ব্রিটিশ কূটনীতিক।

“তেল অনুসন্ধান।” সরাসরি লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন শাসা।–কুঁচকে তাকালেও আর কোনো মন্তব্য করলেন না স্যার পার্সি। যাই হোক তিনদিন পরে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ভেটো দিল ব্রিটেন। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এলো ঝড়।

ইস্রায়েলের উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে ইসাবেলাকে ফোন করল অ্যারন ফ্রাইডম্যান। গো ধরল বেলাও যেন ওর সাথে যায়।

“তুমি অনেক লক্ষ্মী, অ্যারন।”

জানালো ইসাবেলা। “কিন্তু আমাদের দুজনের জীবনধারাই ভিন্ন। হয়তো অন্য কোনো একদিন আবার আমাদের দেখা হবে।”

“আমি তোমাকে কখনো ভুলবো না। বেলা।”

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটে ফর স্টেট সিকিউরিটি সাড়াশি অভিযান চালানো বিশ্বাসঘাতকের খোঁজে। কিন্তু মাস পার হয়ে গেলেও কিছুই না পেয়ে ধরে নেয়া হল যে দেশ ছেড়ে যাওয়া চারজন ইস্রায়েল বিজ্ঞানীদের কেউ একজন নিশ্চয়ই এমনটা ঘটিয়েছে।

তদন্তের গোপন রিপোর্টটা পড়ে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন শাসা; জানতে পারলেন তার আদরের কন্যাও একরাত কাটিয়ে এসেছে পেলিনডাবাতে।

“ওয়েল, তুমি নিশ্চয় ভাবোনি যে বেলা এখনো কুমারী নাকি? সেনটেইন চাইলেন ছেলেকে সান্তনা দিতে।

“নাহ, সেটা না।” স্বীকার করলেন শাসা। “তারপরেও এমনটা হবে ভাবিনি।”

“বেলা হয়তো একটা চেঞ্জও চেয়েছিল।”

“যাই-হোক, ভালই হয়েছে যে প্রফেসর-ব্যাটা চলে গেছে।”

“কিন্তু একেবারে খারাপ ছিল না।” খোঁচা দিলেন সেনটেইন।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন শাসা।

“কী বলছ, লোকটার বয়স জানো?”

“বেলা’রও ত্রিশ চলছে। প্রায় বুড়ি।”

“সত্যি?” বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা, “বছর যে কোথা দিয়ে কেটে যায়।”

“ও’কে এখনই একটা হাজব্যান্ড খুঁজে দেয়া উচিত।”

“এত তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই।” মেয়েকে হারাতে চান না শাসা, মন চাইছে সব এভাবেই চলুক যেভাবে চলছে।

***

খুব দ্রুত পুরস্কার পেয়ে গেল ইসাবেলা। মাসখানেকের ভেতর নিকি’র সাথে হলিডে কাটানোর অনুমতি পেয়ে গেল। ওকে আরো জানানো হলো যেন দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে নেয়; দেশের বাইরে কাটানোর জন্য।

“দুই সপ্তাহ!” আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল বেলা, “উইদ মাই বেবি! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

এক ফুয়ে উড়ে গেল সব অপরাধবোধ। স্কাইলাইট দুনিয়াতে হেডলাইন হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে এই বলে সান্তনা দিয়েছিল যে মানবজাতিকে বড় একটা হুমকির হাত থেকে বাঁচিয়েছে ওর বিশ্বাসঘাতকতা।

পরিবারের সদস্যদের সাথে কিংবা পার্লামেন্টে অন্য সিনেটরদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময় দেশপ্রেমের ফুলকি ছোটালেও গভীর গোপনে ঠিকই জানে-বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

নানা আর শাসা’কে জানালো যে হ্যারিয়েট ব্যচ্যাম্পের সাথে দেখা করতে জুরিখ যাচ্ছে। কম্বি ভাড়া করে দুই সপ্তাহ সুইজারল্যান্ডে কাটানোর কথা এই বলে শেষ করল যে,

“ফিরে আসার আগে আর কোনো সংবাদ আশা করো না।”

“তোমার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ আছে?” জানতে চাইলেন শাসা।

“অহেতুক বাজে বকো না তো বাবা-” শাসা’কে কিস করে বেলা জানাল, “আমার ট্রাস্ট ফান্ড তত তুমিই করে দিয়েছ, সিনেটের ডাবল বেতন দিচ্ছ।”

“তারপরেও লুজানের ক্রেডিট সুইসের একজনের দাম দিচ্ছি, যদি প্রয়োজন পড়ে”

“ইউ আর সো সুইট, কিন্তু আমি তো কিশোরী নই আর!”

“মাঝে মাঝে মনে হয় তা হলেই ভাল হত, মাই লাভ।”

জুরিখের উদ্দেশ্যে সুইস এয়ারফ্লাইট ধরলেও নাইরোবিতে নেমে গেল বেলা। নরফোক হোটেলে চেক ইন করে নানা’কে ফোন করল; ভান করল যেন জুরিখেই আছে।

“হ্যাভ ফান আর চোখ-কান খোলা রেখো যদি কোনো মিলিওনিয়ারকে পাকড়াও করতে পারো।”

“তোমার জন্য নানা?”

“তোমার বয়সও তো কম হলো না মিসি”।

নির্দেশ মতো এয়ার কেনিয়া ফ্লাইটে চড়ে জামিয়ার লুসাকা’তে চলে এলো বেলা। এয়ারলাইন বাস ধরে পৌঁছে গেল রিজওয়ে হোটেল।

ডিনারের আগে সুইমিং পুল টেরাসে বসে জিন আর টনিকের অর্ডার দিল বেলা। কয়েক মিনিট পরে সুদর্শন আর কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণ এলো তার টেবিলে।

“লাল গোলাপ?”

“বসুন।” মাথা নাড়লেও ধুপধুপ করে উঠল বুক, ঘামতে লাগলো হাতের তালু।

“আমার নাম পল।” ড্রিংকের অফার প্রত্যাখ্যান করে বলে চলল কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ, “প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো রকম বিরক্ত করব না আপনাকে। কাল সকাল নয়টার মাঝে রেডি হতে পারবেন? হোটেলের সদর দরজায় ট্রান্সপোর্টে দেখা করব।”

“কোথায় নিয়ে যাবেন?”

“আমি জানি না।” উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল তরুণ, “আর আপনিও জানতে চাইবেন না।”

পরদিন কথামতো তৈরি হয়ে গেল বেলা। দোমড়ানো একটা ভক্সওয়াগানে করে ওকে এয়ারপোর্টে ফিরিয়ে নিয়ে এলো সুদর্শন কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু কর্মাশিয়াল টার্মিনাল ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল সংরক্ষিত সামরিক এলাকার দিকে।

ঝাঁ ঝাঁ রোদের মাঝে অ্যাপ্রন পরে দাঁড়িয়ে আছে জাম্বিয়ার অবশিষ্ট মিগ ফাইটারস স্কোয়াড্রন। মাত্র গত মাসেই চারবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। অর্থের অভাবে ধুঁকতে থাকা ফাইটার স্কোয়াড্রনকে সকলে তাই ডাকে “দ্য ফ্লাইং বম্বস।”

ফাইটারদের পেছনেই দেখা গেল বিশাল একটা আনমাকর্ড এয়ারক্রাফট। চারটা টার্বো-ফ্যান ইঞ্জিন অলা প্লেনটার লেজ দোতলা বাড়িয়ে চেয়েও বড়। ইসাবেলা চিনতে না পারলেও এর নাম হল আইলুশিন আই ওয়ান-৭৬ ন্যাটো যাকে ডাকে “ক্যান্ডিড”। স্ট্যান্ডার্ড রাশান মিলিটারি হেভি ক্যারিং ট্রান্সপোর্ট।

গেইটের গার্ডদের সাথে কথা বলে ব্রিফকেস থেকে কয়েকটা ডকুমেন্ট দেখাল পল। কাগজগুলোকে পরীক্ষা করে টেলিফোনে সুপিরিয়রকে ফোন করল গার্ড কম্যান্ডার। তারপর পলকে আবার কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে গেইট খুলে দিল।

ক্যান্ডিডের রিফুয়েলিং-এর কাজ তদারকি করছে ওভারঅল পরিহিত দুই পাইলট। মেইন-হ্যাঙ্গারের পাশে গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে গেল পল। পাইলটের সাথে কথা বলে বেলা’কে ইশারা করল এগিতে যেতে। অথচ স্যুটকেশ নিয়ে গলদৰ্ঘম ইসাবেলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না একজন পাইলট’ও; বদলে পল জানাল,

“প্লেনে উঠে বসুন।”

লাগেজ? জানতে চাইল বেলা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভারী স্বরে জানাল চিফ পাইলট, “ওখানেই থাক। আমি দেখব। আসুন।”

কার্গো দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে প্লেনের পুরো হোল্ড। বিভিন্ন সাইজের ভারী ভারী সব কাঠের বাক্স। বিশাল কম্পার্টমেন্টের পাশের একটা সিঁড়ি দিয়ে বেলা’কে ফ্লাইট ডেকে নিয়ে এলো পাইলট।

“বসুন। ভাজ করে রাখা একটা ফোল্ডিং জাম্প সিট দেখিয়ে দিল বেলা’কে বসার জন্যে আর কোনো রকম ফর্মালিটি ছাড়াই ঘণ্টা খানেক পর আকাশে উঠে পড়ল ক্যান্ডিড।

নিজের আসনে বসেও পাইলটের কাঁধের উপর দিয়ে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বেলা। ৩০০ ডিগ্রি কোর্স ধরে ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় লেভেল হয়ে আছে উড়োজাহাজ।

হাতঘড়িতে সময় দেখল বেলা। ঘন্টাখানেক পর মনে হল প্লেন জাম্বিয়া ছাড়িয়ে অ্যাঙ্গোলা পৌঁছে গেছে। খানিকটা কেঁপে উঠল বেলা। এখানে হলিডে কাটানোর কোনো ইচ্ছেই নেই তার। সিনেটের আফ্রিকান অ্যাফেয়ার্স কমিটির মেম্বার হওয়াতে অ্যাঙ্গোলা সম্পর্কে মিলিটারি গোয়েন্দাদের পাঠানো সব ধরনের রিপোর্টই পড়েছে বেলা। সমস্যা জর্জরিত দেশটার সবকিছুই তাই তার জানা আছে।

বহুকাল যাবৎ পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের মুক্তো ছিল অ্যাঙ্গোলা। দক্ষিণ আফ্রিকার পরে এটাই হচ্ছে আফ্রিকার সবচেয়ে সুন্দর আর বিত্তবান দেশ।

মেরিন রিসোর্চে সমৃদ্ধিশালী দেশটাতে কদিন আগেই তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার খুঁজে পেয়েছে আমেরিকান অফশোর ড্রিলিং কোম্পানি। তেল ছাড়াও হীরা। সোনা আর আকরিক লোহা উৎপাদন করে অ্যাঙ্গালা। উর্বর সমভূমি আর উপত্যকায় রা দেশটাতে অসংখ্য নদী আর বনাঞ্চলও আছে।

প্রকৃতির এহেন আশির্বাদ সত্ত্বেও ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ প্রায় দর্শক ধরে রক্তাক্ত হয়ে আছে অ্যাঙ্গোলা। পাঁচশো বছরের পুরাতন কলোনিয়াল শাসন ব্যবস্থা উপড়ে ফেলার জন্যে যুদ্ধ করেছে দেশটির জনগণ।

কিন্তু এক্ষেত্রেও একতার অভাব আছে। বিভিন্ন গালভরা নামধারী সেনাবাহিনী কেবল পতুগিজদের বিরুদ্ধে নয়; লড়াই করছে একে অন্যের সাথে। আছে এম পি এল, এফ এন এল এ, ইউনিট। এছাড়া আছে অসংখ্য প্রাইভেট আর্মি আর গেরিলা আন্দোলন।

এরপর হঠাৎ করেই পর্তুগালে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়াতে অ্যাঙ্গোলা’কে স্বাধীনতা দেয়া হয়। নতুন সরকার ও সংবিধানের জন্য শুরু হয় নির্বাচন।

এখন নির্বাচনের নামে নতুন করে টালমাটাল হয়ে উঠেছে পুরো দেশ। ক্ষমতা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিভিন্ন অংশ। অন্যদিকে আফ্রিকার অন্যা দেশগুলোও নিজ নিজ সমর্থকের জন্য বিভিন্ন চাল চলছে। সামরিক গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্ট পড়ে বেলা’র তাই মনে হয়েছে পাহাড়-জঙ্গল দূরে থাক, খোদ রাজধানী লুয়ান্ডা’তে যে কী ঘটছে তা কেউই জানে না।

বর্তমানে এম পি এল এর রাজা কোটিনহো গর্ভনর জেনারেল হলেও আমেরিকান সি আই এ, চীন আর উত্তর কোরিয়া সকলেই এফ এন এ’র পক্ষে।

***

ক্রেমলিন দুর্গের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে ব্ল্যাক চাইকা’র মোটর শোভাযাত্রা।

একেবারে সামনের লিমুজিনে আছে দু’জন কিউবান জেনারেল। দ্বিতীয় গাড়িতে প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রোর সাথে বসে আছে জেনারেল রামোন মাচাদো।

ইথিওপিয়াতে সফলভাবে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ফেরার সাথে সাথে পদোন্নতি পেয়েছে রামোন।

কেজিবি’র সবচেয়ে তরুণ জেনারেল এখন রামোন। ওর ইমিডিয়েট সিনিওয়ের বয়সও তিপান্ন। জন্মসূত্রে রাশান না হওয়াতে আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ পদোন্নতি।

ইথিওপিয়ার সাফল্যের পরপরই অ্যাঙ্গোলাহো’ও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছে রামোন। গর্ভনর জেনারেল রোজা কোটিনহো’র সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থাপন করেছে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব।

“যে কোনো মূল্যে নির্বাচন ঠেকাতে হবে।” রামোনকে জানিয়েছে রোজা, “তাহলে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ী হয়ে যাবে জোনাস সাভিষি; যেহেতু তার গোত্রই দেশটাতে সবচেয়ে বড়।”

“ঠিক তাই।” একমত হলো রামোন। অ্যাঙ্গোলার গেরিলা লিডারদের মাঝে সবচেয়ে সফল জোনাস। কিন্তু মার্কসিস্ট কিংবা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা অনুসরণ না করায় তাকে ক্ষমতায় বসানোর ঝুঁকি নিতে পারে না রামোন।

“এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমাধান হলো, ঘোষণা করে দিন যে অরাজকতা অব্যাহত থাকাতে এখন কোনোমতেই নির্বাচন সম্ভব নয়। এম পি এল এর সামর্থ্যকে তুলে ধরে লিসবনকে বাধ্য করুন অগাস্টিনহো নেটো’র হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে।”

বলা বাহুল্য যে, নেটো’কে নির্বাচন করেছে সোভিয়েত; কেননা দুর্বল আর শঠ চরিত্রের নেটোকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে; সাভিম্বি’কে নয়।

“আমি রাজি।” মাথা নাড়ল কোটিনহো।” কিন্তু রাশিয়া আর কিউবা থেকে সমর্থন পাবো তো?”

“যদি আমি এই সমর্থন দেবার প্রতিজ্ঞা করি তাহলে কি আপনাদের মিলিটারি বে ও এয়ারফিল্ডে সেনাবাহিনী আর সামরিক রসদ জড়ো করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত আছেন?”

“এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।” ডেস্কের ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দিল অ্যাডমিরাল। বিজয়ীর চোরা আনন্দ নিয়ে হাত মেলাল রামোন।

সোভিয়েতের হাতে দুই দুটো দেশকে তুলে দিল কয়েকদিনের ব্যবধানে। আফ্রিকাতে এতটা সফলতা আর কেউ পায়নি।

“এখান থেকে আমি সরাসরি হাভানা’তে চলে যাবো।” কোটিনহোকে নিশ্চয়তা দিয়েছে রামোন।” আশা করি কয়েকদিনের মাঝেই কিউবা আর মস্কোর উত্তর পেয়ে যাবো। এ মাসের শেষেই তা আপনাকে জানিয়ে দেব।”

উঠে দাঁড়াল কোটিনহো, “আপনার মতো মানুষ হয় না, কমরেড কর্নেল জেনারেল। সমস্যার, এতটা গভীরে যেতে আর দক্ষ সার্জনের মতো পদক্ষেপ নিতে আমি আর কাউকে দেখেনি।”

চাইকাতে প্রেসিডেন্ট ফিদের ক্যাস্ট্রোর-পাশে বসে এখন এগোচ্ছে রামোন।

মিউজিয়ামের গেইটে লাইনে দাঁড়ানো বিদেশি পর্যটকেরা তাকিয়ে আছে। তাদের মোটর শোভাযাত্রার দিকে। দ্বিতীয় গাড়িতে বসা ক্যাস্ট্রোকে চিনতে পেরেই কৌতূহলী হয়ে উঠল সকলে।

স্কোয়ার পার হয়ে মিনিস্টারস বিল্ডিং-এর সদর দরজায় এসে থামল গাড়ির বহর।

ডেপুটি মিনিস্টার আলেক্সেই ইউদিনিচ এগিয়ে এসে ক্যাস্ট্রোকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর নিয়ে গেলেন মিনিস্টারদের কাউন্সিলে। হল অব মিরর’য়ে লম্বা টেবিলের মাথায় নিজ আসনে বসে বক্তব্য শুরু করলেন কাস্ত্রো।

পরিষ্কারভাবে কথা বলে চললেন ক্যাস্ট্রো মাঝে মাঝে থেমে রাশান দোভাষীকে সুযোগ দিলেন। উপস্থিত সকলে তো বটেই এমনকি রামোন নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেল তার আফ্রিকান জ্ঞান দেখে; বিস্তারিতভাবে তুলে ধরলেন সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি আর সফলতার ক্ষেত্র। বোঝাই যাচ্ছে রামোনের কথা তিনি কতটা আত্মস্থ করেছিলেন।

“পশ্চিম ইউরোপের কোনো মেরুদণ্ড নেই আর ন্যাটো তো সামরিকভাবে আমেরিকার উপরেই নির্ভরশীল তাই অ্যাঙ্গোলা’তে আমাদেরকে ঠেকানোর কেউ নেই।”

“কিন্তু আমেরিকা?” ভাবে জানতে চাইলেন ইউদিনিচ।

“ওদের ভিয়েতনাম ক্ষত এখনো শুকায়নি। তাই তাদের সিনেট কখনো সৈন্য পাঠাতে রাজি হবে না। তাই লেজ গুটিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। তবে তো একটা ভয় রয়ে যায় যে, তারা হয়ত কোনো সারোগেট আর্মি বেছে নেবে ওদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্যে।”

“দক্ষিণ আফ্রিকা।” ভবিষ্যৎ বাণী করে দিলেন ইউদিনিচ।

“ঠিক তাই। আফ্রিকাতে একমাত্র এরাই সবচেয়ে ভয়ংকর। কিসিঞ্জার হয়ত এদেরকে নিয়োগ করে অ্যাঙ্গোলা সীমান্তে পাঠিয়ে দিতে পারে।”

“দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়াটা কী ঠিক হবে?” ওদের সৈন্যরা তো আফ্রিকার সবচেয়ে দক্ষ বুশ ফাইটার আর সাথে যদি পায় আমেরিকান অস্ত্র আর রসদ…”

“ওদের সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে না” প্রতিজ্ঞা করলেন ক্যাস্ট্রো।

“সীমান্ত আর দক্ষিণ আফ্রিকা কিউবা কিংবা সোভিয়েতের জোরে নয়, বর্ণবাদ নীতির কারণে।”

“ব্যাখ্যা করে বলুন মিঃ প্রেসিডেন্ট।”

“পশ্চিমে, আমেরিকান লিবারেল পার্টি আর ইউরোপে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন মুখিয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারকে উৎখাত করার জন্য। তাই প্রথমজন দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্য সীমান্ত ক্রস করার সাথে সাথেই আমরা জিতে যাবো। আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আর ইউরোপ তথাকথিত গণতান্ত্রিকগণ এমন চিৎকার জুড়ে দেবে যে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়ে যাবে প্রতিবাদ। দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেই তখন সরে দাঁড়াবে। অ্যাঙ্গোলা হয়ে যাবে আমাদের।”

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রামোন আর একবার মুগ্ধ হল ক্যাস্ট্রোর সম্মোহন শক্তি দেখে। এ কারণেই তাঁকে মস্কোতে নিয়ে এসেছে সে। এমনভাবে বলার ক্ষমতা কাস্ট্রোর আর কোনো মিনিস্টার কিংবা জেনারেলের ছিল না।

“উনি আমাকে গোল্ডেন ফক্স ডাকেন।” আপন মনেই হাসল রামোন, “কিন্তু তিনিই হচ্ছেন সবচেয়ে বড় শিয়াল পণ্ডিত।”

যাই হোক এখনো শেষ করেননি ক্যাস্ট্রো। কোকড়ানো দাঁড়িতে হাত বুলাতে গিয়ে হাসলেন, “অ্যাঙ্গোলা আমাদেরই হবে; কিন্তু এটা তো কেবল সূচনা। এর পরের পালা খোদ দক্ষিণ আফ্রিকার।”

এতটা সাগ্রহে সবাই সামনে ঝুঁকে এলো যেন রক্তের গন্ধ পেয়েছে একদল নেকড়ে।

“একেবারে অ্যাঙ্গোলা হাতে এসে গেলেই কৃষাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে ঘিরে ফেলব দক্ষিণ আফ্রিকা। আফ্রিকা রত্ন ভাণ্ডার আর অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস দক্ষিণ আফ্রিকাকে কজা করতে পারলেই পদানত হবে পুরো মহাদেশ।”

বিশাল হাতের তালুদুটো টেবিলের উপর বিছিয়ে এবার সামনে ঝুঁকলেন ক্যাস্ট্রো নিজে।

“এ কাজের জন্য যত সৈন্য প্রয়োজন আপনি নিতে পারেন। আর অস্ত্রশস্ত্র ও ট্রান্সপোর্ট যদি দিতে পারেন তাহলে পাকা টসটসে ফল ঘরে তোলার সময় হয়েছে। রাজি আছেন কমরেড়স? তৈরি আছেন এই সাহসী পদক্ষেপ নেবার জন্যে?”

***

এই মিটিং এর মাত্র এক মাস পরেই পতুর্গিজ মিলিটারি অফিসারদের এক দল, সোরিমো’তে অবস্থিত মিলিটারি এয়ারফোর্স বেস কিউবান এয়ারফোর্সের লজিস্টিকস চিফের হাতে হস্তান্তর করে দেয়।

চব্বিশ ঘণ্টা পর সোরিমো’তে ল্যান্ড করে প্রথম আইলুশিন ক্যান্ডিড ট্রান্সপোর্ট। যাত্রী হিসেবে আসে পঞ্চাশজন কিউবান পরামর্শক আর মিলিটারি অস্ত্র-শস্ত্র ভর্তি বিশাল এক কার্গো। একই এয়ারক্রাফটে আসে রাশান মিলিটারি অবজার্ভার কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদো।

প্রচণ্ড ক্লান্তি আর উত্তেজনা নিয়ে রামোনের দিন কাটছে। মহাদেশের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ওর নাম।

“এল জোরো” বিদেশেও সবাই ফিসফিস করে বলে,” এল জোরো পৌঁছে গেছে। বল এখন তাই দ্রুত গড়াতে থাকবে।”

ঠিক শিয়ালের মতই সারাক্ষণ দৌড়ের উপরে আছে রামোন। একই বিছানায় পরপর দু’রাত কখনোই ঘুমানো হয় না। কখনো কখনো তো বিছানাই থাকে না। ঘাসের কুড়ে ঘরের মাটির মেঝে; কিংবা হালকা কোনো এয়ারক্রাফটের দোমড়ানো সিট অথবা নোংরা কোনো নদীতীরেই ঘুমিয়ে পড়তে হয়।

অন্যদিনকে এল জোফের ধারণাই সঠিক। পশ্চিমাদের কোনো নড়চড় নেই। সাংবাদিকেরাও কোনো ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি কোটিনহো’র কল্যাণে। সোরিমো কিংবা কঙ্গোর ব্রোজাভিলেতে অস্ত্র আর সৈন্য এনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এম পি এল এ ক্যাডারদের হাতে।

তবে অ্যাঙ্গোলা হল রামোনের একগাদা দায়িত্বের একটি। এছাড়াও ইথিওপিয়া মোজাম্বিক, এজেন্টদের নেটওয়ার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কো-অর্ডিনেশন সবকিছু নিয়েই তাকে মাথা ঘামাতে হয়। কিন্তু অ্যাঙ্গোলা’তেই-সোয়াপো আর এ এন সি’র ট্রেনিং ক্যাম্প বসিয়েছে রামোন।

দেশের পৃথক দুটি অংশে স্থাপন করা হয়েছে এই দুই সংগঠনের হেডকোয়াটার। তবে রামোন এএনসি’র ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না যে পুরো মহাদেশের প্রবেশ পথ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা আর এএনসি তাদের মুক্তিযোদ্ধা। রালেই তাবাকা, তার পুরনো কমরেড এখন অ্যাঙ্গোলা’তে এএনসি লজিস্টিকস চিফ।

দুজনে মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চষে বেরিয়েছে পুরো দেশ। তারপর খুঁজে পেয়েছে চিকাম্বা নদী তীরে অবস্থিত ছোট্ট জেলে গ্রাম। ঠিক হয়েছে এখানেই হবে তাদের বেস্।

যুদ্ধের সময় পরিত্যক্ত এই গ্রামটা দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত কিংবা যে কোনো বেস্ থেকেও বহুদূরে অবস্থিত। ইস্রায়েলীয়দের মতো দক্ষিণ আফ্রিকানরা’ও গেরিলাদের ধাওয়া করার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সীমানার পরোয়া করে না কিন্তু আউট অব রেঞ্জ হওয়াতে চিকাষাতে কোনো হেলিকপ্টার নামতে পারবে না। হাজার হাজার কি.মি. জঙ্গল আর পাহাড় পর্বতের বাধা পেরিয়ে স্থলবাহিনী পাঠানোও সম্ভব নয়। বেসের নাম রাখা হল টার্সিও।

প্রথম পাঁচশো এএনসি ক্যাডারকে নিয়ে টার্সিও’তে পৌঁছে গেলেন তাবাকা। শুরু হলো এয়ারস্ট্রিপ আর ট্রেনিং ক্যাম্পের কনস্ট্রাকশনের কাজ। দশ দিন পরেই এলো রামোন। ততদিনে প্রায় তৈরি হয়ে গেছে এয়ারস্ট্রিপ।

দ্বিতীয়বার পরিদর্শনে এসে পুরো এলাকাটা চক্কর দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল রামোন। ঠিক করল নদীর মুখে তৈরি করবে আলাদা কম্পাউন্ড; আর এটাকে ব্যবহার করবে প্রাইভেট হেডকোয়াটার হিসেবে। সবসময় এরকম একটা নিরাপদ জায়গা চেয়েছিল যেখানে কেজিবি’র ট্রেনিং, প্ল্যানিং নির্বিঘ্নে সারা যাবে আর বন্দিদের ইন্টোরোগেশন আর হাপিশ করে ফেলাও কোন ব্যাপার হবে না। কেউ জানতেই পারবে না।

রালেই তাবাকা’র নির্মাণকর্মীদেরকে আদেশ দেয়ার কিছুদিনের মাঝেই এগিয়ে গেল কাজ।

হাভানাতে ফিরে গিয়ে প্রয়োজনীয় রেডিও আর ইলেকট্রনিক ইকুপমেন্টের ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিল টার্সিও’র হেডকোয়ার্টারে।

***

হাভানা আর মস্কোতে দৌড়াদৌড়ি করলেও আফ্রিকা মহাদেশের নিজের আরো ডজনখানেক প্রজেক্টের কথাও ভুলে যায়নি রামান। এদের মাঝে বিশেষ একটি হলো লাল গোলাপ অপারেশন। লন্ডন আর স্পেনের দিনগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যে বুঝতেও পারেনি কোনো একদিন মেয়েটা কত মূল্যবান হয়ে উঠবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার সিনেটে যোগ দেবার পর থেকে অসাধারণ সব গোয়েন্দা রিপোর্ট আর সুপারিশ ডেলিভারী দিয়েছে লাল-গোলাপ। এরপর ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তো আফ্রিকান অ্যাফেয়াস এর সিনেট অ্যাডভাইজারি বোর্ডেরও সদস্য হয়ে গেছে। ওর মাধ্যমেই রামোন জেনে গেল যে দক্ষিণ অ্যাঙ্গোলাতে সাউথ আফ্রিকা সামরিক অভিযান চালালেও নাক গলাবে না প্রেসিডেন্ট ফোর্ড আর হেনরী কিসিঞ্জার। লুবিয়াঙ্কাতে সুপিরিয়রদেরকে জানিয়ে দিয়ে ক্যাস্ত্রোর সাথে পরামর্শ করার জন্যে হাভানাতে উড়ে এলো রামোন।

“আপনি ঠিকই ধরেছিলেন এল জোফ” প্রশংস ভঙ্গিতে বলে উঠল রামোন, “ইয়াংকি তাদের নোংরা ঘাটাবার জন্য বোয়াদেরকে পাঠাবে।”

“তাহলে আমরাও চাই ওরা ফাঁদে পা দিক।” হেসে ফেললেন কাস্ট্রো।” এখনি অ্যাঙ্গোলাতে ফিরে যাও, আমাদের বাহিনীকে তুলে এনে রাজধানীর দক্ষিণে নদীতীরে ডিফেন্সিভ পজিশনে বসাও। এগিয়ে আসতে দাও আংকেল স্যামের বাহিনীকে।”

অক্টোবার সাউথ আফ্রিকান অশ্বারোহী বাহিনী কুনিন নদী পার হয়ে দিন কয়েকের মাঝে রাজধানীর দেড়শ মাইলের ভিতরে চলে এলো। সুপ্রশিক্ষিত, তরুণ যোদ্ধারা অবশ্য নদীর ওপারে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র আনতে ব্যর্থ হল।

এদিকে সিগন্যাল পাঠিয়ে দিল রামোন।

“এবারে, বলে উঠলেন কাস্ট্রো, “সময় হয়েছে আমাদের খেলা দেখাবার।”

নদীতীরে দক্ষিণ আফ্রিকার বাহিনীকে রুখে দিল রাশান টি-৫৪ ট্যাংক আর অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার। পশ্চিমা গণমাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার উপস্থিতির কথা ছড়িয়ে দিল রামোন। আর সফল হলো কাস্ট্রোর ভবিষ্যৎ বাণী। শুরু হয়ে গেল ডিপ্লোম্যাটিক ঝড়।

এর কিছুদিন পরেই নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিল সোভিয়েত সমর্থিত এমপিএলএ সরকার। ইউনাইটেড স্টেটসের সিনেটে আইওয়ার ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি ডিক ক্লার্ক সিআইএ’কে অভিযুক্ত করলেন অবৈধভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সহযোগিতা করার জন্য; ফলে মুখ ফিরিয়ে নিল কিসিঞ্জার আর সিআইএ। জয়েন্ট চিফ মেম্বারস এর পদত্যাগের হুমকির ফলে তুলে নেয়া হলো নেয়া হল সমস্ত আমেরিকান সাপোর্ট। ডিসেম্বরের মধ্যেই সিনেটে পাস হয়ে গেল ডিক ক্লার্ক এর সংশোধনী। ফলে অ্যাঙ্গোলাতে দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক সহায়তা বন্ধ হয়ে গেল। আর এসবই ঘটল ঠিক যেভাবে চেয়েছিলেন ক্যাস্ট্রো।

আরেকটি আফ্রিকান দেশ পেয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর হাজার হাজার কৃষাঙ্গ অ্যাঙ্গোলানস্ বাধ্য হলো দশক জুড়ে গড়িয়ে চলা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে। অর্ডার অব লেনিন অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেল কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদো। এদিকে আবার ছুটতে হল ইথিওপিয়ার উদ্দেশ্যে।

***

আদ্দিস আবাবা’তে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আইলুশিন। রাশান পাইলটের পেছনে বসে পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে ঘেরা দেশটার দিকে তাকিয়ে আছে রামোন।

শত শত বছর ধরে রাজধানীর চারপাশে গাছগুলোকে কেটে ফেলতে পাহাড়গুলো হয়ে পড়েছে শূন্য। প্রাচীন এই ভূমিতেই একদা দাস, আইভরি আর অন্যান্য সম্পদের খোঁজে মিশরীয় ফারাওরা পাঠিয়েছিলেন তাদের প্রথম সেনাবাহিনী।

স্বভাবে উদ্ধত আর যোদ্ধা প্রকৃতির ইথিওপীয় জনগণকে ১৯৩০ সাল থেকে শাসন করে আসছেন সম্রাট হালি সেলসি। নিজের হাতে সর্বময় ক্ষমতা ধরে রাখলেও এই দয়ালু আর সহৃদয় একনায়ককে জনগণ ভালবাসে। ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত সম্রাট সেলাসির একমাত্র চিন্তা ছিল নিজের জনগণের সমৃদ্ধি। সিংহাসনে আরোহণের পাঁচ বছরের মধ্যেই মুসোলিনি জেনারেলরা এসে তাঁর রাজ্যকে তছনছ করে দিলেও তাদেরকে রুখে দেয় ইথিওপিয়রা। ট্যাংক, হাল আমলের এয়ারক্রাফট আর বিষাক্ত গ্যাসের সাথে এরা লড়েছে রাইফেল, তরবারি কখনো বা শূন্য হাত দুটো নিয়ে।

অক্ষ শক্তির পরাজয়ের পর আবারো ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ইথিওপিয়া সিংহাসনে বসেন হালি সেলাসি। কিন্তু দেশকে আধুনিক করার বাসনা নিয়ে বিংশ শতাব্দীর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের ছোট রাজ্যে ভাইরাস ঢোকার অনুমতি দিয়ে বসেন সম্রাট।

আদ্দিস আবাবা’তে স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়েছে ইনফেকশন। লম্বা চুলের বন্য দৃষ্টি মাথা ইউরোপীয়রা এসে তরুণ ছাত্রদেরকে শেখাতে থাকে সকল মানুষই সমান; রাজা কিংবা অভিজাতরা কোনো স্বর্গীয় অধিকার নিয়ে জন্মায়নি। এদিকে ফুরিয়ে আসতে থাকে বৃদ্ধ সম্রাটের শারীরিক শক্তি; অন্যদিকে মাথা চাড়া দিতে থাকে ষড়যন্ত্র। এরপর ইথিওপিয়াতে শুরু হয় প্রচণ্ড খরা আর দুর্ভিক্ষ। মাটি শুকিয়ে যায়, গবাদি পশু মারা যায়, মায়ের কোরে শুয়ে থাকে হাড় জিরজিরে শিশু; কঙ্কালসার দেহে ভেসে থাকে বড় বড় চোখ।

তারপরেও টনক নড়ে না সভ্য জগতের। অতঃপর টেলিভিশন ক্রু নিয়ে ইথিওপিয়াতে আসে বিবিসি’র রিচার্ড ডিম্বেলবি। তুলে ধরে গ্রামগুলোর ভয়াবহ দুর্দশার চিত্র। খুব সাবধানে দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর ছবি প্রচার করা হয় রক্ত লাল আর সোনালি লেস লাগানো সাদা আলখাল্লা পরিহিত আনন্দে মত্ত অভিজাতদের ছবির পাশাপাশি; এবারে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় দুনিয়া। বিদ্রোহে ফেটে পড়ে আদ্দিস আবাবা’র শিক্ষার্থীরা। চার্চ আর মিশনারীরাও আওয়াজ তোলে একনায়কের বিরুদ্ধে।

এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল আর পুরাতন হিসাব মেলাতে বসে ডার্গ। একই সাথে আরবীয় তেল উৎপাদনকারীরাও বাড়িয়ে দেয় তেলের দাম। ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষের সাথে দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি। অনাহারী উপোসী মানুষ শুরু করে লুটতরাজ।

আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বহু তরুণ অফিসারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে বসে সেনাবাহিনী। এদের হাতে চলে যায় ডার্গের নিয়ন্ত্রণ।

প্রধানমন্ত্রী আর রাজপরিবারের সদস্যদেরকে বন্দি করে প্রাসাদে আলাদা করে ফেলা হয় সম্রাট সেলাসিকে। অর্থ আত্মসাতের গুজব ছড়িয়ে দেয়ায় জনগণ দাবি করে সম্রাটের পদত্যাগ ডার্গের মাধ্যমে সম্রাটকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয় মিলিটারি কাউন্সিল।

প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনার সময় বলে উঠেন বৃদ্ধ সম্রাট; “তোমরা যা করছ তাতে যদি আমার জনগণের উপকার হয় তাহলে আমি সানন্দে চলে যাবো আর এও প্রার্থনা করব যেন তোমরা সফল হও।”

শহরের বাইরে ভাঙ্গাচোড়া একটা কুঁড়েঘরে বন্দি করে রাখা হয় সম্রাটকে কিন্তু ছোট্ট ঘরটার সামনে জড়ো হয় হাজার হাজার ইথিওপিয়। প্রকাশ করতে চায় নিজেদের বিশ্বস্ততা আর সমবেদনা।

বেয়নেট দেখিয়ে তাদেরকে ছঙ্গভঙ্গ করে দেয় মিলিটারি কাউন্সিল।

আদ্দিস আবাবা এয়ারেপোর্টের মাটিতে নেমে এলো আইলুশিন। বিশটা জিপ আর ইথিওপিয় সেনাবাহিনী বোঝাই ট্রাক এগিয়ে এলো এটিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

লোডিং র‍্যাম্প দিয়ে এয়ারক্রাফট থেকে নেমে এলো রামোন।

“ওয়েলকাম কর্নেল জেনারেল জিপে থেকে নেমে এগিয়ে এলো কর্নেল গেটাশ আবিবি।

একে অন্যের সাথে হাত মিলিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল দ্বিতীয় আইলুশিন। একের পর এক মাটিতে নেমে এলো বিশাল চারটা এয়ারক্রাফট।

ইঞ্জিন বন্ধ হতেই আইলুশিনগুলোর গহ্বর হতে বেরিয়ে এলো চে গুয়েভারা রেজিমেন্টের সৈন্যদল।

“লেটেস্ট পজিশন কী?” সংক্ষেপে জানতে চাইল রামোন।

“ডার্গ আনদামের জন্য ভোট দিয়েছি।” আবিবি জানাতেই সিরিয়াস হয়ে গেল রামোন। জেনারেল আমান আনাদাম হলেন সেনাবাহিনী প্রধান। অত্যন্ত বুদ্ধিমান আর সৎ এই লোকটাকে সাধারণ মানুষও বেশ পছন্দ করে। তাই এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে তিনিই হবেন জাতির নতুন নেতা।

“তিনি এখন কোথায়?”

“উনার প্রাসাদে- এখান থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূর।”

“সাথে কতজন আছে?”

“পঞ্চাশ কিংবা ষাটজন দেহরক্ষী…”

নিজের প্যারাসুপারদের দিকে তাকালো রামোন।

“ডার্গের কতজন তোমার সমর্থন করে?”

ডজন খানেক নাম আউরে গেল আবিবি। সকলেই বাম ঘেষা তরুণ অফিসার।

“টাফু?” রামোন জানাতে চাইলে মাথা নাড়ল আবিবি। কর্নেল টাফু হচ্ছেন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে আধুনিক ইউনিট আর রাশান টি-৫৩ ট্যাংক স্কোয়াড্রনের কমান্ডার।

“অল রাইট” মোলায়েম স্বরে বলে উঠল রামোন, “এটা আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না-কিন্তু খুব দ্রুত এগোতে হবে।”

কিউবান প্যারাস্টপারদের কমান্ডারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পরপরই কাঁধে অস্ত্র নিয়ে সারি বেঁধে অপেক্ষারত ট্রাকের দিকে এগোল রামোনের বাহিনী।

আবিবি’র পাশে রামোন উঠে বসার পরপরই শহরের দিকে এগোল পুরো বহর।

শহরের বাইরে দেখা মিলল উট আর খচ্চরের ক্যারাভান। ভাবলেশহীন চোখে সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে রইল যাত্রীরা। সম্রাটের পতনের পর থেকেই রাস্তায় সেনাবাহিনী দেখা যেন নিত্যদিনের দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমহারিক ভাষায় দ্রুত রেডিওতে কথা বলে নিল আবিবি; তারপর রামোনকে অনুবাদ করে শোনাল।

“আমার লোকেরা আনদোমের প্রাসাদের উপর নজর রেখেছে। মনে হচ্ছে তিনি ডার্গের সমর্থনকারীদের মিটিং ডেকেছেন। সবাই এসে জড়ো হচ্ছে, প্রাসাদে।”

“গুড। সবকটা মুরগিকে একসাথে খাঁচায় পোরা হবে।”

শহর থেকে মোড় নিয়ে খোলা মাঠ দিয়ে ছুটল সেনা বহর। খরার প্রভাবে চারপাশে সবুজের কোনো অস্তিত্বই নেই। ধুলির মতো সাদা হয়ে আছে খটখটে মাটি।

“এই তো এসে গেছি।” সামনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল আবিবি।

লাল টেরাকোটার মোটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা জেনারেলের প্রাসাদ দেখে এক নজরেই রামোন বুঝতে পারল এর ক্ষমতা। দেয়াল ভাঙ্গার জন্যে গোলন্দাজ বাহিনী লাগবে।

ওর মনের কথা পড়ে ফেলল আবিবি। “আমাদেরকে দেখে ওরা এমনিতেই ভড়কে যাবে। তাই গেইট দিয়ে ঢোকা হয়তো কঠিন হবে না…”

“না” বলে উঠল রামোন। “ওরা এয়ারক্রাফটগুলো আসতে দেখেছে। এ কারণেই হয়ত জরুরি সভা ডেকেছে আনদোম।”

ওদের সামনে দিয়েই প্রাসাদের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেল একটা স্টাফ কার।

“এখানেই থামো।” রামোনের নির্দেশে থেমে গেল পুরো বহর। খোলা জিপের পেছনের সিটে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার দিয়ে দূরের প্রাসাদের দিকে তাকাল রামোন।

“টাফু আর তার ট্যাংকগুলো কোথায়?”

“শহরের অন্য প্রান্তে ব্যারাকে।”

“এখানে আসতে কতক্ষণ লাগবে?”

“দুই ঘণ্টা।”

“প্রতিটি মিনিটই গুরুত্বপূর্ণ।”

বাইনোকুলার না নামিয়েই বলে উঠল রামোন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর যুদ্ধযান নিয়ে আসতে বলে দাও টাফু’কে-কিন্তু আমাদেরও হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না।”

রেডিও নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবিবি। বুকে বাইনোকুলার ঝুলিয়ে জিপে থেকে নেমে এলো রামোন। প্যারাট্রুপারস কমান্ডার আর কোম্পানি লিডাররা ওর চারপাশে জড়ো হতেই জানিয়ে দিল বিভিন্ন নির্দেশ।

মাইক্রোফোন রেখে এগিয়ে এলো আবিবি, “শহরে সম্রাটের প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে একটা টি-৫৩। ওটা ঘন্টাখানেকের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে। বাকি স্কোয়াড্রন নিয়ে রওনা হচ্ছেন কর্নেল টাফু।”

“ভেরি গুড।” মাথা নাড়ল রামোন।

“এখন আনদোমের প্রাসাদের নকশা বলো। ওকে কোথায় পাবো?”

ধুলার মাঝে স্কেচ এঁকে অভ্যন্তরের নকশা বুঝিয়ে দিল-আবিবি। রামোনের নির্দেশে আবারও এগোতে শুরু করল সেনা বহর। তবে এবারে কমান্ড জিপের উপর উড়তে লাগল সাদা পতাকা। স্ট্রপ ক্যারিয়ারের হুডের নিচে লুকিয়ে পড়ল প্যারাট্রুপার বাহিনী আর অস্ত্র-শস্ত্র।

প্রাসাদের কাছাকাছি হতেই গেইটের দেয়ালের উপর বেশ কয়েকটা মাথা দেখা গেলেও সাদা পতাকা থাকায় কোনো গুলি উড়ে এলো না এদিকে।

গেইটের সামনে জিপ পৌঁছাতেই এর শক্তি পরীক্ষা করে দেখল রামোন। এক ফুট মোটা কাঠের গায়ে রট আয়রন লাগানো গেইটে ট্রাক চালিয়ে দেয়া পাগলামি ছাড়া কিছু হবে না।

মাথার উপরে বিশ ফুট উঁচু দেয়াল থেকে চ্যালেঞ্জ করে বসল গার্ডদের ক্যাপ্টেন। নেমে এলো আবিবি। বেশ কয়েক মিনিট বাগবিতণ্ডা চললো দু’জনের মাঝে।

রামোন যখনি বুঝতে পারল যে সব গার্ডদের মনোযোগ কেবল জিপের দিকে নিবিষ্ট, তাড়াতাড়ি রেডিওতে নির্দেশ দিতেই ট্রাকগুলো গর্জন করে ছুটে এসে ডানে-বামে দাঁড়িয়ে গেল লাইন করে। ছাদে চড়ে বসল লুকিয়ে থাকা প্যারাট্রুপারদের দল। গ্রাপলিং হুক লাগানো দশ জন সশস্ত্র প্যারাট্রুপার দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল।

“ওপেন ফায়ার!” রামোন রেডিওতে চিৎকার করে উঠতেই শুরু হয়ে গেল গুলিবর্ষণ। সাথে সাথে সরে গেল গার্ডদের মাথা; তবে অন্তত একজনের গায়ে লাগল গুলি। বাতাসে গোত্তা খাওয়া হেলমেট দেখতে পেল রামোন।

বানরের মতো দাড়ি বেয়ে উঠে সেকেন্ডের ভেতরেই জনা ত্রিশেক প্যারাট্রুপার নেমে গেল প্রাসাদের বাগানে। অটোমেটিক ফায়ার আর গ্রেনেড ফাটার আওয়াজ কানে আসার একটু পরেই খুলে গেল কাঠের দরজা। জিপ নিয়ে আগে বাড়ল রামোন।

আঙ্গিনাতে ছড়িয়ে আছে প্রাসাদের গার্ডদের মৃতদেহ। ড্রাইভারের সিটের উপর রাখা ৫০ ক্যালিবার ব্রাউনিং হেভিমেশিন গানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো রামোন। শুইয়ে দিল ভুট্টা খেতে দৌড়াতে থাকা খরগোশদের মতো পলায়ন পর গার্ডদেরকে।

কিন্তু হঠাৎ করেই হাঁটু গেড়ে বসে আর পি জি ৭ রকেট লঞ্চার তুলে নিল এক গার্ড।

জিপের দিকে নিশানা করতেই ব্রাউনিং ঘুরিয়ে নিল রামোন। ঠিক সেসময় পড়ে থাকা মৃতদেহে আটকে গেল জিপের চাকা। ফলে এইম হারিয়ে ফেলল রামোন।

হুশ করে এগিয়ে এসে জিপের মাঝখানে রেডিয়েটরে ধাক্কা খেল রকেট। বিস্ফোরণের সাথে সাথে ঘুরে গেল পুরো জিপ।

রামোনেরা চারপাশে লাফিয়ে নামলেও প্রবেশ মুখে গিয়ে আটকে গেল জিপ। ফলে পিছোতে বাধ্য হল ট্রাক বহর।

এরই মাঝে ডিফেন্সে নেমে পড়ল প্রাসাদের বাহিনী। সমস্ত দরজা আর জানালা দিয়ে শুরু হয়ে গেল অটোমেটিক ফায়ার।

কিউবান সেনারা তাড়াহুড়া করে ট্রাক থেকে নেমে আগে বাড়ল। কিন্তু এগিয়ে এলো দ্বিতীয় রকেট। রামোনের মাথা থেকে মাত্র ইঞ্চি খানেক উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আঘাত করল ট্রাকের বনেটে। ডিজেল ফুয়েলের কালো ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল পুরো আঙিনা।

কোনো একটা জানালা থেকে শুরু হল ভারী মেশিন গানের গর্জন। গড়িয়ে গড়িয়ে সরাসরি জানালার মাটির দেয়ালের নিচে চলে এলো রামোন। মেশিন গানের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়।

পকেট থেকে ছোঁ মেরে গ্রেনেড তুলে নিয়ে পিন টেনে ছুঁড়ে দিল জানালা দিয়ে; সাথে সাথে আবার উপুড় হয়ে কান ঢেকে বসে পড়ল।

উন্মত্ত একটা আর্তচিৎকারের সাথে সাথে নীরব হয়ে গেল মেশিন গান।

“তাড়াতাড়ি এসো।” চিৎকার করে আদেশ দিল রামোন। হাফ ডজন প্যারাট্রুপার নিয়ে ঢুকে পড়ল খোলা জানালার ভেতরে। মেশিন গানটা জায়গা মতো থাকলেও রক্তে থকথক করছে মেঝে।

শুরু হয় গেল এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়ে দৌড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ। কিন্তু ধীরে ধীরে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে রামোনের স্যৈরা। মনে মনে প্রমাদ শুনল রামোন। এখন যদি আরো সৈন্য সমাবেশ করে আনদোম তাহলে শেষ হয়ে যাবে ওর বিপ্লবের স্বপ্ন।

অন্যদিকে হতোদ্যম সৈন্যদেরকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আবিবি। ধোয়া আর ধুলার মধ্য দিয়ে চিৎকার করে কথা বলছে সৈন্যদের সাথে। এমন সময় হামাগুড়ি দিয়ে ওর কাছে গেল রামোন।

“ব্লাডি ট্যাংকটা আর কতদূর?”

“আমি ফোন করেছি কতক্ষণ হয়ে গেল?”

“প্রায় ঘণ্টাখানেকেরও বেশি।” এত আগে! মনে হচ্ছে মাত্র মিনিট খানেক আগে শুরু হয়েছে আক্রমণ।

“রেডিওতে আবার খবর পাঠাও…”

ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনেই শুনতে পেল যান্ত্রিক একটা শব্দ।

“কাম অন!” লাফ দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রামোন। একসাথে দৌড় দিল দু’জনে। মাথার পাশ দিয়ে শিষ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট।

আঙিনাতে এসে দেখতে পেল প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাংক। ডান হাত উইন্ডমিলের মতো ঘুরিয়ে সামনে এগোবার নির্দেশ দিল রামোন।

কাছেরই একটা মাটির দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে এগোতে শুরু করল টি-৫৩। রামোন আর তার কয়েকজন সৈন্য ঢুকে পড়ল খোলা ব্রিচ দিয়ে ভেতরে। সামনে যা পেল দেয়াল, কাঠ, মানুষের শরীর সবকিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দুমড়ে মুচড়ে এগোতে লাগল যান্ত্রিক দানব।

বন্দুক ছেড়ে এদিক সেদিক পালাতে লাগল আনদোম বাহিনী। ভাঙ্গা দালান ছেড়ে অনেকেই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

“আনদোম কই?” ধূলি-আর চিৎকারের চোটে খসখসে হয়ে উঠল রামোনের গলা, “ওকে পেতেই হবে; কিছুতেই পালাতে দেয়া যাবে না।”

সবার শেষে এসে আত্মসর্মপণ করলেন জেনারেল। মেইন হলের পুরু মাটির দেয়াল গুঁড়িয়ে দিল টি-৫৩; চারজন সিনিয়র অফিসারকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন আনদোম। কপাল আর বাম চোখের উপর রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ। দাড়িতেও লেগে আছে রক্ত আর ধুলা।

কিন্তু ধকধক করে জ্বলছে অক্ষত চোখ। আহত সত্ত্বেও গমগমে স্বরে বলে উঠলেন,

“কর্নেল আবিবি, এটা বিদ্রোহ আর বিশ্বাসঘাতকতা। আমিই ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট-আজ সকালেই ডার্গ আমার নিয়োগকে বৈধতা দিয়েছে”।

প্যারাট্রুপারদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রামোন। তারা জেনারেলের বাহু ধরে হাঁট গেড়ে বসে পড়তে বাধ্য করল। নিজের হোলস্টার থেকে টোকারেভ পিস্তল নিয়ে আবিবি’র হাতে তুলে দিল রামোন।

বন্দির দু’চোখের মাঝখানে পিস্তল তাক করে ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল আবিবি, প্রেসিডেন্ট আমান আনদোম, জনগণের বিপ্লবের নামে আমি তোমাকে পদত্যাগ করতে বলছি।” আর উড়িয়ে দিল জেনারেলের খুলি।

সামনের দিকে ঝাঁকি খেয়ে পড়ে গেল নিষ্প্রাণ দেহ; হলুদরঙা মগজ এসে ছিটকে পড়ল আবিবি’র পায়ে।

ধন্যবাদ কর্নেল-জেনারেল।” টোকারে আবার রামোনকে ফিরিয়ে দিল আবিবি।

“এই দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।” আনুষ্ঠানিকভাবে মাথা নোয়ালে রামোন।

“আনদোম ডার্গের কতজন সদস্য ভোট দিয়েছিল?” সেনা বহর আবার ছুটে চলেছে আদ্দিস আবাবার দিকে।

“তেষট্টি জন।”

“তাহলে বিপ্লবকে নিরাপদ করার জন্য এখনো বহু কিছু করতে হবে।”

রেডিও নিয়ে কর্নেল টাফুকে মেসেজ পাঠালো, আবিবি। নির্দেশ দিল যেন ডার্গের মেইন বিল্ডিংকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়। সেনাবাহিনীর অন্যান্য অংশকে নির্দেশ দেয়া হলো সমস্ত বিদেশি দূতাবাস আর কনস্যুলেটগুলোকে বন্ধ করে দেয়ার জন্যে।

দেশের মাঝে অবস্থানরত সমস্ত বিদেশি বিশেষ করে সাংবাদিক আর টেলিভিশন পার্সোনেলদেরকে তৎক্ষণাৎ এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো প্লেনে তুলে দেয়ার জন্য। যা ঘটবে তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকা চলবে না।

আবিবি’র সবচেয়ে বিশ্বস্ত কয়েকজন সৈন্যের ছোট্ট একটা ইউনিট আর কিউবান প্যারটুপাররা মিলে ঢুকে পড়ল মিলিটারি কাউন্সিলে আর ডার্গের সেসব সদস্যদের বাড়িতে যারা আনদোমকে ভোট দিয়েছিল। হেঁটে হিঁচড়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে তুলে সকলকে নিয়ে আসা হলো মেইন অ্যাসেম্বলি চেম্বারের বিপ্লবী আদালতে। দালানের উঠানে ফায়ারিং স্কোয়াড একের পর এক নিশ্চিহ্ন করে দিল সকলকে।

সবকটি মৃতদেহের পা একসাথে করে বেঁধে টেনে নিয়ে ভোলা হলো ট্রাকের উপরে। তারপর রাস্তা ধরে ট্রাক চলে গেল শহরের বাইরের ডাস্টবিনে।

“জনগণকে বিপ্লবের ন্যায়বিচার আর অবাধ্যতার শাস্তি কিরূপ তা দেখাতে হবে।” এহেন প্রদর্শনীর প্রয়োজন বুঝিয়ে বলল রামোন।

মৃতদেহ না সরানোর পক্ষে এবং পরিবারের সদস্যদের কোনোপ্রকার শোক পালনের বিপক্ষে আদেশ জারি করল কোর্ট।

মাঝরাত পর্যন্ত চলল এই হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু অসম্ভব পরিশ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ঘুমোবার ফুরসৎ পেল না রামোন কিংবা ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট। রেডিওর পাশে বসে রিপোর্ট শুনতে শুনতে নিজের প্যাকের ভদকা আবিবি’কে এগিয়ে দিল রামোন।

সকাল নাগাদ এয়ারপোর্ট, রেলওয়ে স্টেশন, রেডিও-টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং-স্টুডিও, মিলিটারি দুর্গ আর ব্যারাক সমস্ত কিছু নিজেদের দখলে নিয়ে নিল আবিবির বিশ্বস্ত অফিসারদের দল। এরপরই মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমালো দু’জনে। কিন্তু দুপুরের মাঝেই আবার ইউনিফর্ম পরে তৈরি হতে হল ডার্গের মিটিংএর জন্যে।

আবিবিকে কনগ্রাচুলেট করতে গিয়ে কর্নেল জেনারেল মাচাদো বলে উঠল, “যদি তুমি ব্রুটাসকে মেরে ফেলো তাহলে তার ছেলেদেরকেও মেরে ফেলতে হবে। ১৫১০ সালে নিকোলো মেকিয়াভেলী বলে গেলেও আজও এটা সমান তাৎপর্যপূর্ণ, মিঃ প্রেসিডেন্ট।”

“তার মানে এখনি শুরু করতে হবে।”

“হ্যাঁ।” একমত হল রামোন।”

“রেড টেরর’কে থামতে দেয়া যাবে না।”

***

“দ্য রেড টেরর শ্যাল ফ্লারিশ” শহরের প্রতিটি রাস্তার কোণায় কোণায় টাঙ্গিয়ে দেয়া হলো চার ভাষায় লেখা, তাড়াহুড়া করে প্রিন্ট করা শোস্টার।

“জানি কারা পরবর্তীতে খাঁটি মার্কসিজমকে অবজ্ঞা করে বসবে। তাই এখনই তাদেরকে উপরে ফেলতে হবে।” টুপি খুলে মাথার ঘন কালো কোকড়া চুলে আঙুল ঢুকিয়ে দিল রামোন মাচাদো। শারীরিক অবসাদ সত্ত্বেও একটুও দিশেহারা হয়নি ভয়ংকর সবুজ চোখ জোড়া। এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল আবিবি।

“শুধু বিরোধিতাকারীদেরকে নয়। বরঞ্চ বিরুদ্ধ মতকেও সমূল্যে উৎপাটন করে ফেলতে হবে। যেন আত্মমর্যাদার কোন বোধই-অবশিষ্ট না থাকে। আর তখনই-একদম নতুন করে দেশকে পুনর্নির্মাণ করে তোলা সম্ভব হবে।” রাস্তার মোড়ে মোড়ে জমে উঠল লাশের পাহাড়। এমনকি গলিতে খেলতে থাকা শিশুদেরকে তুলে নিয়েও বাবা-মায়ের সামনেই হত্যা করা হলো।

কয়েকজন বৃদ্ধ সৈনিক আর তাদের পরিবার-পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে পড়লেও এড়াতে পারল না ডেথ স্কোয়াড। পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলল ট্যাংক। মাঠে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য করা হলো পুরুষদেরকে। গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল যান্ত্রিক দানব। খরা শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে মিশে গেল মৃতদেহের পেস্ট।

“এবারে সময় হয়েছে ধর্ম প্রচারকদের মোকাবেলা করা।” ঘোষণা করল রামোন।

“রাজতন্ত্রকে উৎখাতের ব্যাপারেও কাজ করেছে এরাই।” মনে করিয়ে দিল আবিবি।

অমানুষিক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হলো এদের পুত্র-কন্যাদেরকে।

“ব্রুটাসের সমস্ত ছেলেরাই মৃত্যুবরণ করেছে।” রামোনকে জানাল আবিবি।

“না, সবাই নয়।” রামোনের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইল নতুন প্রেসিডেন্ট।

“এখন আর ফিরে আসার কোনো পথ নেই; ঠিক যেমনটা হয়েছিল রাশান সেলারে, জার-নিকোলাস আর তার পরিবারের সাথে কেবল তখনই নিরাপদ হবে বিপ্লব।”

“কে করবে?” কোনো দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দিল রামোন, “আমি।”

“এটাই সবচেয়ে ভাল হবে। নিজের স্বস্তি লুকাতে অন্যদিকে তাকাল আবিবি। “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলুন।”

একা একটা খোলা জিপ চালিয়ে শহরের পুরোন অংশে চলে এলো। রামোন। মৃতদেহ পচনের গন্ধে রাস্তা দিয়ে চলা দায়। মানুষ নয়, শহরের জীবন্ত প্রাণী হিসেবে কেবল কাক আর শকুন চিলদের দেখা মিলেছে।

সিল্কের স্কার্ফ মুখে, মাথায় পেঁচিয়ে ভাবলেশহীন মুখে এগিয়ে চলল বিজয়ী জেনারেল।

কুঁড়েঘরটার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দু’জন গার্ড। রামোনকে দেখে চিনতে পেরে সাথে সাথে স্যালুট করল।

“আজকের মতো তোমাদের ডিউটি শেষ। এখন যাও।” আদেশ দিল রামোন।

দরজা খোলার আগে নিশ্চিত হয়ে নিল যে গলির শেষ মাথায় উধাও হয়ে গেছে গার্ড দু’জন। আলো আধারী মাখা রুমটাতে ঢুকে সানগ্লাস খুলে ফেলল রামোন। পুরো রুমে ছড়িয়ে আছে অসুস্থতার গন্ধ। বিছানার উপর ঝুলছে একটা রুপার কপাটিক ক্রস। মেঝেতে বসে থাকা এক নারী রামোনকে দেখে মাথায় কাপড় দিল।

“যাও।” ইশারায় দরজা দেখিয়ে দিতেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মেঝের উপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেল বাইরে।

কমব্যাট বুট পরিহিত পা দিয়ে দরজাটা আটকে দিল রামোন।

“নেগাস নেগাস্তি, রাজাদের রাজা রামোনের গলা শুনে নড়ে উঠল বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ।

কংকালসার এই দেহের সুস্থ চেতনা সম্পর্কে ভালই জানে রামোন। টলটল করছে পরনের সাদা আলখাল্লা। মোমের মতো দেহত্বক ভেদ করে দেখা যাচ্ছে প্রতিটা হাড়। প্লাটিনামের মতো জ্বলজ্বল করছে বহুদিনের নাকাটা চুল আর দাড়ি। উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে নবিদের মতো বড় বড় ঘন কালো চোখ জোড়া।

“আমি তোমাকে চিনেছি।” মোলায়েম স্বরে জানালেন সম্রাট হালি সেসি।

“আমাদের কখনো দেখা হয়নি। শুধরে দিল রামোন।

“তারপরেও আমি জানি তুমি কে। আমি তোমার গন্ধ চিনি। তোমার চেহারার প্রতিটি রেখা, কণ্ঠস্বরের গভীরতা সব আমি জানি।”

“তাহলে বলুন, আমি কে?”

“তোমার নাম মৃত্যু।”

“আপনি তো বেশ জ্ঞানী” কথা বলতে বলতে বিছানার দিকে এগোল রামোন।

“আমার সাথে যা করেছ তার জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম” জানালেন ইথিওপিয়ার সম্রাট হালি সেলসি, “কিন্তু আমার জনগণের সাথে যা করেছ তার জন্য কখনোই তোমাকে মাফ করব না।”

“ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিন বুড়ো।” বিছানার উপর থেকে বালিশ তুলে নিল রামোন, “দুনিয়া আপনার জন্য নয়।”

বুড়োর মুখে বালিশ চেপে ধরল রামোন।

ফাঁদে আটকে পড়া পাখির মতো ছটফট শুরু করলেন হালি সেলসি। লাথি মারতে শুরু করতেই আলখাল্লা উঠে এলো হাঁটুর উপরে। আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ল শুকিয়ে যাওয়া সিগারেটের মতো দুটো পা।

তারপরেও আরো পাঁচ মিনিট পর্যন্ত বালিশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয় রইল রামোন। ভেতরে ভেতরে অনুভব করল একধরনের ধর্মীয় পরমানন্দ। ঠিক যেন তার সিদ্ধিলাভ হয়েছে। এতটা সন্তুষ্টি আর কখনো কোনো কাজেই পায়নি আগে।

এইমাত্র একজন রাজাকে খুন করেছে।

সোজা হয়ে সরিয়ে ফেলল হাতের বালিশ। আলখাল্লাটাকে সুন্দর করে পা পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে ছোট্ট হাত দুটোকে বুকের উপর ভাজ করে বসিয়ে দিল। এরপর বুড়ো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে নামিয়ে দিল চোখের পাতা।

কী ভেবে যেন বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখল মৃত সম্রাটের চেহারা। বুঝতে পারল এটা তার জীবনের অন্যতম সন্ধিক্ষণ। পৃথিবীতে যা যা কিছু ও ধ্বংস করতে চায় তার প্রতীক হলো এই কংকালসার দেহ।

তাই সারা জীবনের জন্য ধরে রাখতে চাইল এই স্মৃতিচিহ্ন।

***

সম্ভাব্য সকল বিরুদ্ধমতই ধ্বংস হয়ে গেছে। মৃত্যুবরণ করেছে ব্রুটাসের পুত্রেরা। বিপ্লব এখন তাই সম্পূর্ণ নিরাপদ।

এবারে আফ্রিকার অন্যান্য বিষয়ের দিকে মন দিতে হবে। তাই ইথিওপিয়া। সরকারের সামরিক পরামর্শকের পদটি হস্তান্তর করে দিল জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকের এক সিকিউরিটি পুলিশের হাতে; যে কিনা প্রায়ই রামোনের মতই দক্ষ হাতে সিধে করতে পরে অবাধ্য জনগণ।

আবিবি’কে জড়িয়ে ধরে আবারো আইনুশিনে চড়ে বসল রামোন। গন্তব্য টার্সিও বেস। নীল আটলান্টিকের বুকে সূর্য ডুবে যেতে না যেতেই পৌঁছে গেল রামোন।

এয়ারস্ট্রিপ থেকে হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত যেতে যেতে তার অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া সব সংবাদ জানিয়ে দিল রালেই তাবাকা।

খড়ের ছাদঅলা রামোনের প্রাইভেট কোয়ার্টারটা দেখতে অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। মেঝে কার্পেট শূন্য হলেও স্থানীয় কাঠুরেদের তৈরি আসবাবগুলো বেশ আরামদায়ক। আধুনিক বলতে একমাত্র লাগানো হয়েছে ইলেকট্রনিক কম্যুনিকেশন ইকুমেন্ট। মস্কো, গুয়ান্ডা, লিসবন আর হাভানার সাথে সরাসরি স্যাটেলাইট লিঙ্ক স্থাপন করা হয়েছে।

ভেতরে পা দেবার সাথে সাথে মনে হলো আপন ঘরে পৌঁছে গেছে। রালেই তাবাকা চলে যাবার সাথে সাথেই কমব্যাট ইউনিফর্ম খুলে ফেলে মশারীর ভেতরে ঢুকে পড়ল রামোন। খোলা জানালা দিয়ে উষ্ণ বাতাস এসে পরশ বুলিয়ে দিল নগ্ন দেহে।

কঠিন একটা কাজ অত্যন্ত দক্ষতা আর সফলতার সাথে শেষ করলেও এখনো ঠিক যেন তৃপ্তি পাচ্ছে না। মোজার্ট কিংবা মাইকেল এনজেলো’কেও ছাড়িয়ে গেছে ওর সৃষ্টি। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেছে একটা দেশ আর এর জনগণ, পর্বত, উপত্যকা, নদী, লেক, সমভূমি আর হাজার হাজার মানুষ, রক্ত, ধোঁয়া আর গুলি থেকে গড়ে তুলেছে মাস্টারপিস। এই দুনিয়াকেই ঈশ্বর মানে রামোন। আর রামোন তাঁর দূত। কাজ তো সবে শুরু হয়েছে। প্রথমে একটা দেশ, তারপর আরেকটা, অন্য একটা; এভাবে পুরো মহাদেশ।

কিন্তু হঠাৎ করেই মনে এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। হতে পারে এটা কুঁড়ে ঘর, বাতাস কিংবা সমুদ্রের গর্জনের জন্য-যেটাই হোক না কেন; মনে পড়ে গেল নিকোলাসের কথা। ঘুমের মাঝে ছেলেকে স্বপ্নেও দেখল রামোন। লাজুক হাসি ওর কণ্ঠস্বর…জেগে উঠার পর তো মনে হল কিছুতেই আর তর সইছে না। খানিকক্ষণের জন্যে হাভানা আর মস্কো থেকে পাওয়া কোডেড মেসেজ নিয়ে ভুলে থাকলেও কাজ শেষে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই কল্পনায় ভেসে এলো রোদে পোড়া ছোট্ট একটা দেহ।

হতে পারে-আদ্দিস আবাবা’র রাস্তায় দেখা মৃতদেহ কিংবা আবুনা’র পুত্রদের নির্যাতনের চিত্র থেকেই জন্ম নিয়েছে এ অবসেশন। কিন্তু টার্সিও বেস ছেড়ে এখন নড়ার উপায় নেই। বল গড়াতে শুরু করেছে; হাতে প্রচুর কাজ বাকি। তাই হাভানাতে স্যাটেলাইট মেসেজ পাঠিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেকের মাঝে উত্তরও চলে এলো।

ইথিওপিয়ার পরে ওকে আর অবজ্ঞা করার সাহস নেই কারো। পরের ফ্লাইটেই রামোনের কাছে পৌঁছে গেল নিকোলাস আর আদ্রা।

আইলুশিনের র‍্যাম্প বেয়ে ছেলেকে নেমে আসতে দেখে উদ্বেল হয়ে উঠল রামোনের বুক। মাথা উঁচু করে চোখ ভর্তি আগ্রহ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে, ওর ছেলে। বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।

সানগ্লাসের পেছনে চোখ লুকিয়ে সৈন্যদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে বহুক্ষণ ধরে ছেলেকে দেখল রামোন। কিন্তু উদ্ধত মন কিছুতেই এই অনুভূতিকে স্বীকার করতে রাজি নয়। “ভালোবাসা” শব্দটা নিয়ে মোটেই কোনো আগ্রহ নেই তার।

এরপরই ওকে দেখতে পেল নিকোলাস। প্রথমে দৌড় শুরু করলেও খানিক পরেই থেমে গেল। ঢেকে ফেলল অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানাতে ফুটে উঠা আনন্দ। ভাবলেশহীন মুখে হেঁটে এলো রামোনের জিপের কাছে।

“গুড ডে পাদ্রে,” নরম স্বরে বলে উঠল নিকোলাস, “কেমন কাটছে। তোমার দিন?”

হঠাৎ করেই ইচ্ছে হল বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে; কিন্তু নিশ্চল হয়ে বসে রইল রামোন। খানিক বাদে কেবল হাত মেলালো।

বাবার পাশের সিটে উঠে বসল নিকোলাস। গেরিলা ক্যাম্প পার হয়ে চলে এলো কম্পাউন্ডে। আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছে নিকোলাস। বেশ দ্বিধা নিয়ে বলে উঠল- প্রথম প্রশ্ন,

“এখানে এত মানুষ কেন? ওরাও কি আমাদের মতো বিপ্লবের পুত্র, পাছে?”

রামোন বিরক্ত না হওয়ায় সাহস পেয়ে গেল নিকি। এবারেও উত্তর পাওয়ায় বেশি সহজ হয়ে গেল ওর আচরণ।

জিপ থেকে রাস্তার সবাই স্যালুট করতেই নিজের সিটে শক্ত হয়ে গেল নিকোলাস; তারপর আবার সেও স্যালুট করে ফিরিয়ে দিল উত্তর। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল রামোন। হেসে ফেলল বাকিরাও।

কম্পাউন্ডে ফেরার পর দ্রুত কয়েকটা মেসেজের কিনারা করে আদ্রা আর নিকোলাসের জন্য বরাদ্দ করা কুঁড়েঘরে গেল রামোন। এতক্ষণ উত্তেজিত হয়ে গল্প করলেও ওকে দেখে থেমে গেল নিকি। সর্তক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। “তোমার বাথিং সুট এনেছ?” জানতে চাইল রামোন।

“হ্যাঁ, পাদ্রে।”

“গুড। চট করে পরে নাও। আমরা একসাথে সাঁতার কাটব।”

একসাথে সাঁতার কাটা শেষ করে পাথরের উপর উঠে বসল পিতা-পুত্র। গল্প করার ছলে খুব সাবধানে ছেলেটাকে পরখ করে দেখল রামোন। বয়সের তুলনায় যথেষ্ট লম্বা আর শক্তিশালী নিকির কথা বলার টঙ একেবারে পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতন।

বারান্দাতে বসে একসাথে ডিনার করল দু’জনে। বহুদিন পর পেট পুরে খেল আদ্রা’র রান্না। পানি মিশিয়ে নিকোলসাকে হাফ গ্লাস ওয়াইনও দিল। বেশ বড় বড় ভাব নিয়ে চুমুক দিয়ে খেল নিকোলাস।

এবারে আদ্রা ঘুমাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলে বিনা বাক্য ব্যয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও চলে এলো বাবার কাছে।

“এখানে এসে আমার অনেক ভাল লাগছে, পাদ্রে?” ফর্মালি হাত বাড়িয়ে দিল নিকি।

হাত বাড়িয়ে দিতেই বুকর ভিতর রীতিমতো ঝড় অনুভব করল রামোন।

সপ্তাহখানেকের ভেতর টার্মি ক্যাম্পের সবার আদর কেড়ে নিল নিকোলাস। কয়েকজন এএনসি প্রশিক্ষক পরিবার নিয়ে বাস করাতে তাদেরই একজনের স্ত্রী ক্যাম্পের বাচ্চাদের জন্য স্কুল খুলে বসল। নিকি’কেও পাঠিয়ে দিল রামোন।

সাথে সাথেই বোঝা গেল যে নিকোলাস নিজের চেয়েও তিন চার বছরের বড় বাচ্চাদের মতনই বুদ্ধিমান। ইংরেজি এখানে শেখানের ভাষা হওয়াতে দ্রুত রপ্ত করে নিল নিকোলাস। আর সাথে করে নিয়ে আসা সকার-বলটার কল্যাণে সঙ্গীদের মাঝে প্রেস্টিজও বেড়ে গেল। কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদোর নির্দেশে স্কুলেই তৈরি করা হলো ফুটবল খেলার জায়গা আর গোল পোস্ট। নিকোলাসের দক্ষতা দেখে ওকে পেলে পেলে ডাকতে শুরু করল সকলে আর রোজকার ম্যাচে তো প্রতিদিনের দৃশ্য হয়ে উঠল।

জেনারেলের পুত্র হিসেবে সবকিছুতে বাড়তি খাতির পায় নিকোলাস। অস্ত্র নাড়াচাড়া করতেও বাধা দেয় না প্রশিক্ষকের।

একে ‘৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল সম্পর্কে নতুনদেরকে শিক্ষা দেয় নিকি আর গর্বিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখে রামোন; কেমন করে বিশটার মাঝে বারো রাউন্ড নিশানা মতো লাগাতে পারে নিকোলাস।

রামোনের অজান্তেই নিকিকে জিপ চালানো শিখিয়েছে কিউবা ড্রাইভার জোসে। জানতে পারে যখন কুশনের উপর বসে জিপ চালিয়ে বাবাকে এয়ারস্ট্রিপে নিয়ে যায় নিকি।

তাদের গাড়ি দেখলেই “ভাইভা পেলে!” বলে চিৎকার জুড়ে দেয় দু’পাশের লোকেরা।

ক্যাম্পের টেইলার নিকোলাসকে ক্যামোফ্লেজ কমব্যাট পোশাক আর কিউবান স্টাইলের নরম টুপি বানিয়ে দিল। বাবার মতই এক চোখের উপর খানিকটা হেলিয়ে টুপি পরে নিকি। রামোনের আনঅফিসিয়াল ড্রাইভার নিকোলাস বাবার প্রতিটি হাবভাব যেন নকল করে;

মাঝে মাঝে বিকেল বেলা পঞ্চাশ হর্সপাওয়ার আউটবোর্ড মটরঅলা নৌকাটাকে নিয়ে চলে যায়, নীল আটলান্টিকের শৈলশিরায় মাছ ধরতে। হ্যান্ড লাইনস ব্যবহার করে কোরালের মাছ ধরে। ময়ূরকণ্ঠী নীল, সবুজ, হলুদ আর উজ্জ্বল লাল রঙা মাছগুলো মাঝে মাঝে এত বড় হয় যে পানি থেকে টেনে তুলতে নিকোলাসকে সাহায্য করে রামোন। কিন্তু কারো সহায়তা নিতে চায় না। নিকি। এমনকি বাবা’র সাহায্যও না আর দিন শেষ হয়ে গেলেও ওর মাছ ধরার নেশা যায় না। “আরেকটা পাত্রে জাস্ট একটা,” অবশেষে জোর করে বঁড়শি কেড়ে নেয় রামোন।

একদিন একটু বেশিই সন্ধ্যা হয়ে গেল। চারপাশে অত্যন্ত শীতল বাতাস বইছে। শিরশির করে নিকোলাসের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল ঠাণ্ডা আর উত্তেজনায়।

এক হাতে নৌকার স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে ছেলের কাধ ধরল রামোন। প্রথমে শক্ত হয়ে গেলেও একটু পরে গুটিসুটি মেরে বাবার বুকের ভেতর সেধিয়ে গেল নিকোলাস।

হাতের মাঝে কাঁপতে থাকা ছোট্ট দেহটাকে নিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল রামোন। আবারো মনে পড়ে গেল আদ্দিস আবারা’তে দেখা আবুনা’র ছেলেদের মৃতদেহের কথা। সকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে চোখ, আঙুলের সমান কর্তিত পুরষাঙ্গ ঝুলছে মৃত ঠোঁটে। তবে এসব কিছুরই প্রয়োজন ছিল; যেমন ছিল বুকের কাছে লেপ্টে থাকা বাচ্চাটাকে পানিতে ডুবিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে কঠিন আর নিষ্ঠুর দায়িত্ব পেলেও পিছপা হয় না। রামোন। তারপরেও এখনকার মতো আর কখনো সন্তানপ্রেমে আপ্লুত হয়নি।

নৌকা থেকে নেমে লণ্ঠনের আলোয় ক্যাম্পে ফেরার সময়েও রামোনের হাত ধরে রইল নিকোলাস। কম্পাউন্ডের গেইটে না পৌঁছানো পর্যন্ত পিতা-পুত্র কেউই কোনো কথা বলল না। এরপর আস্তে আস্তে নিকি জানালো : “আমার ইচ্ছে করছে তোমার সাথে সবসময় এখানেই থাকতে।”

রামোন এমন ভাব করল যেন কিছুই শুনতে পায়নি;

কিন্তু বুকের মাঝে কেমন যেন টনটন করে উঠল।

মাঝ রাতের পরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল সিগন্যাল ক্লার্ক। ঘরের দরজায় হালকা একটা টোকার শব্দ শুনলেই টোকারেভ পিস্তল নিয়ে পুরোপুরি সজাগ হয়ে যায় রামোন।

“কী হয়েছে?”

“মস্কো থেকে লাল গোলাপের মেসেজ এসেছে।” লাল গোলাপ যখনই যোগাযোগ করুক না কেন দিনে কিংবা রাতে সাথে সাথে রামোনকে ডেকে তোলার নির্দেশ দেয়া আছে ক্লার্কের উপর।

“আমি এখনি আসছি।”

স্কাইলাইট প্রজেক্টের সিডিউল ডেট আর প্লেস জানিয়ে দিয়েছে লাল গোলাপ।

মেইন এএনসি ক্যাম্পে ড্রাইভার পাঠিয়ে দিল রামোন। চল্লিশ মিনিটের মাঝে রাতেই তাবাকা চলে এলো।

“আমাদেরকে এখনি লন্ডনে যেতে হবে।” রালেই মেসেজটা পড়তে পড়তে জানালো রামোন। “এটা এত গুরুত্বপূর্ণ যে এখান থেকে কো-অর্ডিনেট করা যাবে না। লন্ডন অ্যামব্যাসি আর ইউকে এএনসি অফিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে।”

তৃপ্তির হাসি হাসল রামোন। সপ্তাহ শেষ হবার আগেই নিরাপত্তা পরিষদের সামনে পাটি পেতে বসে পড়বে বোয়ারা।”

নিকোলাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বিদায় জানাল রামোন।

“তুমি কখন ফিরে আসবে পাদ্রে?” কোনো রকম দুঃখবোধ না দেখিয়েই জানতে চাইল নিকি।

“জানি না, নিকি।” প্রথমবারের মতো ডাকনামটা ধরে ছেলেকে ডাকল রামোন। ওর ঠোঁটে কেমন যেন আজব লাগল শব্দটা।

“তুমি ফিরে আসবে তো পাদ্রে?”

“হ্যাঁ। প্রমিজ করছি।”

“হ্যাঁ, নিকি তুমি আর আদ্রা এখানেই থাকবে।”

“আর আমাদেরকেও এখানে থাকতে দেবে? তাই না?”

“থ্যাংক ইউ। আমি খুব খুশি হয়েছি।” জানাল নিকোলাস, “গুড বাই পাদ্রে।”

একে অন্যের সাথে হাত মিলিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে অপেক্ষারত জিপে, উঠে বসল রামোন।

***

স্কাইলাইট টেস্টকে ভণ্ডুল করে দেয়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কারণ প্রায় তিন বছর আগে থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রচেষ্টা সম্পর্কে সবকিছুই তারা জানে।

যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া; রাজনৈতিক অঙ্গনে দক্ষিণ আফ্রিকার ললাটে কালিমা লেপন করে দেয়া।

সোভিয়েত অ্যামব্যাসির সেলারে অ্যামব্যাসাডরের সেইফ রুমে জড়ো হলো সকলে। মস্কো থেকে উড়ে এসেছেন জেনারেল বোরেদিন আলেক্সেই ইউদিনিচ। বোঝাই যাচ্ছে ফরেন মিনিস্ট্রি কেজিবি’র আফ্রিকান সেকশনকে কতটা গুরুত্ব দেয়। ফলে বহুগুণে বেড়ে গেল কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদোর পার্সোনাল প্রেস্টিজ।

আসছে সপ্তাহেই স্কাইলাইট টেস্ট করা হবে। তাই পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু বেশ বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছে লাল গোলাপ। বোমার স্পেসিফিকেশন, নতন ডিফাইভ আর্টিলারী রাউন্ডের ডেলিভারী, টেস্ট হোলের গভীরতা আর অবস্থান; এমনকি ডিটোনেট করার ইগনিশন সিস্টেম পর্যন্ত সমস্ত কিছুই রিপোর্টে লেখা আছে।

“আজ ঠিক করতে হবে যে আলোচনা শুরু করলেন ইউদিনিচ, “এই তথ্যকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়।”

“আমার মনে হয় কমরেড়” আগ্রহ নিয়ে যোগ করল রালেই লন্ডনে একটা প্রেস কনফারেন্স করার অনুমতি দিয়ে দিন।”

রামোনের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি।

“কমরেড সেক্রেটারী-জেনারেল চওড়া হাসি হাসলেন ইউদিনিচ, “আমার মনে হয় ঘোষণাটা যদি সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দেন, তাহলে ব্যাপারটা যথোচিত গুরুত্ব পাবে।” বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠলেন ইউদিনি। তিনি আবার কালোদেরকে পছন্দ করেন না।

এই মিটিং-এর আগে ব্যক্তিগতভাবে রামোনকে জানিয়ে ছিলেন- এসব “বানর” কে আলোচনা থেকে বাদ দেয়ার কথা। আপনার তো ওদের সাথে মেশার ভালো অভিজ্ঞতা আছে, কমরেড। এক প্যাকেট বাদাম নিয়ে আসব নাকি, কী বলেন?; মিটি মিটি হেসেছেন ইউদিনিচ।

ঝাড়া বিশ মিনিট ধরে কোনো কথা বলল না রামোন। বাকি দুজনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় দেখে অবশেষে মধ্যস্থতা করলেন বোরোদিন : “আচ্ছা কমরেড জেনারেল মাচাদোর রায় জানলে হয় না? উনার সোর্সের কাছ থেকে তো তথ্যটা এসেছে- হয়তো উনিই ভাল বলতে পারবেন যে এ থেকে কতটা ফায়দা লোটা যায়।”

সকলে এবার রামোনের দিকে তাকাল। উত্তরটা আগেই তৈরি করে রেখেছে কর্নেল জেনারেল।

“কমরেড আপনাদের সবার কথাতেই যুক্তি আছে। কিন্তু এএনসি হোক কিংবা সোভিয়েত রাশিয়া উত্তেজনা একদিনেই ফুরিয়ে যাবে। তাই আমার মনে হয় খানিকটা করে তথ্য চাউর করে দেখা যাক কী ঘটে।”

সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। রামোন বলে চলল, “আমার মনে হয় নিজেরা না বলে এই ঘোষণা দেবার দায়িত্ব আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠের উপর ছেড়ে দিলেই ভালো হবে; যা ইউনাইটেড স্টেটসহ শাসন করে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব।”

দ্বিধায় পড়ে গেলেন ইউদিনিচ, জেরাল্ড ফোর্ডঃ ইউনাইটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্ট?”

“না, কমরেড মিনিস্টার। গণমাধ্যম। আমেরিকার সত্যিকারের সরকার। ফ্রিডম অব স্পিচের মতো শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র নেই। আমরা কোনো প্রেস কনফারেন্স কিংবা অ্যানাউসমেন্ট কিছুই করব না। যা করার করবে আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্কস। খানিকটা গন্ধ ছড়িয়ে দিলে তারা নিজে থেকেই খুঁজে বের করবে। খরগোশের গর্ত। এটা যে কতটা কার্যকরী তা তো আপনারা নিজেরাই জানেন, হাউন্ডের মতো তাদের উত্তেজনা বেড়ে যাবে যখন জানতে পারবে যে শিকার পুরোপুরি একা। “ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম” নামে আদর করে ডাকে যারা তাদের সরকার। সরকারের মিত্র আর ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমের সবচেয়ে ক্ষতি করতে পারে। অথচ তাদেরকেও সাহায্য করে এই সিস্টেম।”

এক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললেন ইউদিনিচ “আমি শুনেছি আফ্রিকাতে আপনাকে নাকি সবাই ফক্স ডাকে কমরেড জেনারেল।”

“দ্য গোল্ডেন ফক্স।” বোরোদিন শুধরে দিতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ইউদিনিচ।

“নিজের নামের সার্থকতা আপনি যথেষ্টই প্রমাণ করেছেন কমরেড জেনারেল। তাহলে আরো একবার আমাদের হয়ে কাজ করে দিক আমেরিকা আর ব্রিটেন।”

***

স্কাইলাইট অপারেশনের সফলতা শতগুণে বাড়িয়ে দিল লাল গোলাপের মূল্য। কিন্তু কিছু সমস্যাও দেখা দিল।

দক্ষ হাতে এখন মেয়েটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সাথে উৎসাহও দিতে হবে। স্কাইলাটের জন্য ওকে এখনই পুরস্কার অর্থাৎ নিকোলাসের কাছে আসার সুযোগ দিতে হবে।

সম্প্রতি তার মাঝে বসতি করা বুর্জোয়া মনোভাবের কারণে দায়িত্বের অবহেলা করতে মোটেই রাজি নয় রামোন। ভালই জানে যে প্রয়োজন পড়লে নিকোলাসকেও উৎসর্গ করতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবে না।

তার আগ পর্যন্ত কোনো ভাবেই নিকোলাসকে কোনো বিপদের মুখে পড়তে দেয়া যাবে না। বিশেষ করে লাল গোলাপ কিংবা অন্য কেউই যাতে ছেলেটাকে রামোনোর কাছ থেকে নিয়ে যাবার চেষ্টা না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তাই আবারো স্পেনে হাসিয়েন্দার কথাই মনে এলো। কিন্তু যদি দক্ষিণ আফ্রিকার এজেন্টের মাধ্যমে মাদ্রিদে ব্রিটিশ অ্যামবাসিতে নিকিকে নিয়ে চলে যায় লাল গোলাপ? না স্পেনও নিরাপদ নয়।

হ্যাঁ মস্কো কিংবা হাভানা’তে দেখা করার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তাতেও তার প্রভুদের অস্তিত্ব জেনে যাবে লাল গোলাপ। তারমানে এই পথও বন্ধ।

হাতে বাকি রইল চিকাৰ্মা নদীর ধারে। টাসিও বেস। এখানে হাজার মাইলের ভেতরে কোনো বিদেশি দূতাবাস নেই। নিকোলাস তো আছেই। লাল গোলাপকে আনতেও তেমন ঝামেলা হবে না। টার্সিওতে এলে পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই

লাল গোলাপকে রামোনের হাত থেকে বাঁচায়।

সুতরাং টার্সিওই সই।

***

ঘুম থেকে জেগে উঠলেও ইসাবেলা প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কোথায় আছে। এরপরই বুঝতে পারল যে বদলে গেছে আইলুশিনের ইঞ্জিনের শব্দ না ঘুমানোর মতো চেষ্টা সত্তেও জাম্প সিটের উপর বসে চোখ বুজে ফেলেছিল।

দ্রুত একবার হাতঘড়ি দেখে নিল। লুসাকা ছাড়ার পর দুই ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট পার হয়ে গেছে। সিটের উপর খানিক উঠে বসে পাইলটের কাঁধের, উপর দিয়ে ইনস্টমেন্ট প্যানেল চেক করল বেলা। একই হেডিং’য়ে থাকলেও নামতে শুরু করেছে প্লেন।

ককপিটের উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখা গেল অলস সন্ধ্যাতে পানির মাঝে ডুবে যাচ্ছে সূর্য।

লেক? স্মৃতি হাতড়ে এতবড় কোনো আফ্রিকান লেকের কথা মনে করতে না পারলেও আচমকা চিন্তাটা এলো মাথায়।

“দ্য আটলান্টিক! আমরা পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে গেছি।” আবারো চোখ বন্ধ করে আফ্রিকার ম্যাপ মনে করতে চাইল বেলা, “অ্যাঙ্গোলা, কিংবা জায়ারে।”

নীল আটলান্টিকের বুক চিরে ফুটে উঠেছে সাদা কোরাল সৈকত।

বেশ চওড়া আর বাদামি রঙা একটা নদীর মুখ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কঙ্গো কিংবা লুয়ান্ডা নদী নয়। হৃদের উপরে কয়েক মাইল গেলেই নদী জোড়া এসের রূপ নিয়েছে। এর সামনেই লাল কাদামাটির ল্যান্ডিং স্ট্রিপ। নদীর মোড়ে এখানে গড়ে উঠেছে খড়ে ছাওয়া কুঁড়ে ঘরের বিস্তৃত বসতি।

মাটিতে নেমে ট্যাক্সি করে স্ট্রিপের শেষ মাথা পর্যন্ত চলে গেল ক্যান্ডিড। পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ করতেই এগিয়ে এলো কয়েকটা ট্রাক। দেখা গেল ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরিহিত অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্য।

“এখানেই-অপেক্ষা করুন।” জানাল পাইলট, “আপনাকে নিতে আসবে।”

ফ্লাইট ডে’কে প্রবেশ করল দুই অফিসার। এদের মাঝে একজন মেজর। ব্যাজ কিংবা ব্যাঙ্ক ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই।

কোন দেশি হতে পারে ভাবতে ভাবতেই মেজর স্প্যানিশ বলে উঠল, “ওয়েলকাম সিনোরা, প্লিজ আমাদের সাথে আসুন।”

“আমার স্যুটকেস” দেখিয়ে দিতেই একজন লেফটেন্যান্ট অপেক্ষারত ট্রাকে নিয়ে এলো বেলার লাগেজ।

চুপচাপ নিঃশব্দে বিশ মিনিট ধরে গাড়ি চালিয়ে নদীর মুখে ইসাবেলাকে নিয়ে এলো মেজর। পথিমধ্যে আকাশ থেকে দেখা কুঁড়েঘরগুলো দেখতে পেল বেলা। সশস্ত্র গার্ডেরা গেইট পাহারা দিচ্ছে। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে আকাশ।

অপেক্ষাকৃত ছোট্ট একটা কম্পাউন্ডে এসে ঢুকলো গাড়ি। পাশ দেখাতেই ভেতরে ঢুকতে দিল গার্ড। এখানকার ঘরগুলো ছোট হলেও অন্যগুলোর চেয়ে পরিষ্কার। সবমিলিয়ে সৈকতের ধারে নয়টা ঘর আছে।

ট্রাক থেকে নেমে চারপাশে তাকালো বেলা। মন্দ নয়-সমুদ্র বালি, তাল গাছ আর কুঁড়ে ঘর হলিডে কাটানোর জন্য মোটামুটি আদর্শ বলা চলে।

অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সবচেয়ে বড় কুঁড়েঘরটার কাছে নিয়ে গেল সাথে আসা মেজর। কিন্তু ইউনিফর্ম পরিহিত দুই নারীকে দেখেই বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। আবারো সেই ভয়ংকর শারীরিক লাঞ্চনার মাঝে দিয়ে যেতে হবে এখন।

কিন্তু এবারে ভয় অমূলক। প্রায় অপরাধীর ভঙ্গিতে বেলার স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ চেক করে দেখল দু’জনে; এমনকি পোশাক খোলার কথাও বলল না। শুধু কোডাকের সুইংগার টাইপ ক্যামেরা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল দুই নারী। ক্যামেরাটা বোধহয় হারাতেই হবে। তাড়াতাড়ি তাই বেলা বলে উঠল,

“এটা তেমন দামি কিছু না। যদি চান তো নিয়ে যান।”

অবশেষে বাড়তি দু’টো ফিল্মসহ ক্যামেরা নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল নারীদ্বয়।

দেয়ালের পিপ হোল দিয়ে এতক্ষণ সবকিছুই দেখতে পেয়েছে রামোন। সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেও অনর্থক খোঁচাখুঁচি বারণ করে দিয়েছিল। হাতে ক্যামেরা নিয়ে এবারে তাই মাথা নাড়ল নারী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে। খুব দ্রুত একবার চেক করে আবার ফিরিয়ে দিল।

ক্যামেরাটা ফিরে পেয়ে অসম্ভব খুশি হলো বিস্মিত ইসাবেলা। অন্যদিকে মনোযাগ দিয়ে মেয়েটাকে দেখছে রামোন। চুলগুলো লম্বা হয়েছে আর চেহারাতেও এসেছে পরিণত ভাব। হাবে ভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ মেয়েটা ভালো ভাবেই জানে কতটা সফল হতে পেরেছে।

শারীরিকভাবে স্লিম হলেও ফিট। প্রটেশনাল অ্যাথলেটদের মতো পেশিবহুল দেহত্বক। বেশ ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে রামোনের দেখা শত শত নারীর মাঝে বিশেষ ভাবে আকষর্ণীয় তিন থেকে চার জনের মাঝে বেলাও থাকবে। যাই হোক বেশ সন্তুষ্ট হলো রামোন। এই মেয়েটার জন্যই ওর নিজের ক্যারিয়ারেও বেশ কিছু সফলতা এসেছে।

এতক্ষণে সার্চ শেষ করে আবারো ইসাবেলার স্যুটকেসের ডালা আটকাল দুই নারী। এদের একজন এবারে সুটকেস তুলে বেলাকে নিয়ে গেল কম্পাউন্ডের শেষের গেইটের কাছে। দেয়াল ঘেরা জায়গাটার মাঝে মাত্র দুটো কুঁড়ে ঘর।

একপাশে মশারি টানানো বিছানা অলা বড়সড় একটা লিভিং রুমে বেলা’কে রেখে চলে গেল উর্দিধারী নারী।

খুব দ্রুত আশপাশ দেখে নিল বেলা। পেছন দিকে একটা শাওয়ার রুম আর মাটির টয়লেট আছে। সব দেশে শুনে চিজোরা কনসেশনে শ’নের হান্টিং ক্যাম্পের কথা মনে পড়ে গেল।

পর্দা ঘেরা শেলফ দেখা যেতেই স্যুটকেস খুলতে শুরু করল বেলা। কিন্তু কাজ শেষ হবার আগেই চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি খোলা জানালা দিয়ে সৈকতের দিকে তাকাল।

যেখানে কিংবা যখনই শুনুক না কেন এই আনন্দ মাখা কণ্ঠস্বর চিনতে কখনো ভুল হবে না।

নিকোলাস!

বাদিং ট্রাঙ্ক পরা নিকোলাস আগের চেয়েও ইঞ্চি খানেক বেড়ে গেছে।

সাদা-কালো ডোরাকাটা একটা মনগ্রেল পাপি’র সাথে খেলছে নিকি। হাসতে হাসতে কান ফাটানো চিৎকার করছে নিকি, অন্যদিকে কুকুরের বাচ্চাটাও হিস্টিরিয়ার মতো তীক্ষ্ণ স্বরে ঘেউঘেউ করছে।

হাতে থাকা লাঠিটা সজোরে সমুদ্রে ছুঁড়ে মারল নিকি। আর চিৎকার করে কুকুর ছানাকে আদেশ দিল, “নিয়ে আয়।” খুব দ্রুত সাঁতার কেটে ঠিকই চোয়ালে করে লাঠিটাকে নিয়ে ফিরে এলো কুকুরটা।

“গুড বয়। কাম অন” উৎসাহ দিল নিকোলাস। কিন্তু কুকুরছানাটা তীরে এসে গা ঝাঁপটা দিতেই নিকি’র শরীরে এসে পড়ল পানির ছিটে। লাঠির এক মাথা ধরে ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল নিকি। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল কুকুর আর মনিব।

ঝাপসা হয়ে এলো ইসাবেলা’র চোখ। ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্নেত চলে এলো পানির কিনারে। কিন্তু খেলায় ব্যস্ত নিকোলাস খেয়ালই করল না যে দশ মিনিট ধরে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে বেলা।

যখন দেখতে পেল সাথে সাথে বদলে গেল ওর আচরণ। কুকুর ছানাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে আদেশ দিল “সিট।” জলের ধার রেখে এগিয়ে এলো বেলার কাছে।

“গুড ডে, মাম্মা।” শ্রদ্ধাভরে হাত বাড়িয়ে দিল নিকি, “কেমন কাটছে দিন?”

“তুমি জানতে যে আমি আসব?”

“হ্যাঁ, আর তোমার সাথে লক্ষ্মী হয়েই থাকতে হবে।” সহজভাবে উত্তর দিল নিকি।

“কিন্তু এ কয়দিন স্কুলে যেতে পারব না।”

“তুমি স্কুল পছন্দ করো নিকোলাস?”

“হা, মাম্মা, অনেক। আমি তো এখন পড়তেও পারি। ইংরেজিও শিখছি।” এই ভাষাতেই উত্তর দিল নিকি।

“তোমার ইংরেজি তো বেশ ভালো মজার ব্যাপার হচ্ছে আমিও তোমার জন্য কয়েকটা ইংরেজি বই এনেছি।” নিকি’র দুঃখ কমাতে চাইল বেলা, “মনে হয় তোমার ভাল লাগবে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে বলে ভাবল বেলা।

“তোমার কুকুর ছানার নাম কী?”

“জুলাই ছাব্বিশ।”

“এটা তো বেশ অদ্ভুত নাম। কেন এই নামে ডাকো?”

মায়ের অজ্ঞতা দেখে অবাক হয়ে গেল নিকি। “জুলাই ছাব্বিশেই তো বিপ্লব শুরু হয়েছিল। সবাই জানে।”

“ওহ্, আচ্ছা তাই তো। আমি কী বোকা।”

“আমি অবশ্য শুধু ছাব্বিশ ডাকি।” শিষ বাজাতেই দৌড়ে এলো নিক্রি ছাব্বিশ। “সিট” হ্যান্ড শেক কর।”

একটা পা তুলে এগিয়ে দিল ছাবিশ।

“তোমার ছাব্বিশ তো বেশ চালাক। ভালই ট্রেনিং দিয়েছ।”

“হ্যাঁ।” শান্ত স্বরে মেনে নিল নিকি। “ও হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে চালাক কুকুর।”

“মাই বেবি।” আপন মনে ভাবল বেলা, “ওরা তোমার কী হাল করেছে? ছোট্ট মনটার উপর কতটা ছাপা ফেলেছে যে ভয়ংকর কোনো এক রাজনৈতিক ঘটনার নামে নিজের কুকুরের নামে রেখেছ?” নিকোলাস কোন বিপ্লবের কথা বলছে বুঝতে না পারলেও বেলা’র চোখে মুখে ফুটে উঠল নিদারুণ যন্ত্রণা। বিস্মিত নিকি তাই জানতে চাইল, “তুমি ঠিক আছে, মাম্মা?”

“ওহ! হ্যাঁ, ঠিক আছি।”

“চলো আদ্রার কাছে নিয়ে যাই।” হাঁটতে গিয়ে ছেলের হাত ধরতে চাইল বেলা; কিন্তু আস্তে করে সরিয়ে নিল নিকি।

“তুমি যে সকার বল দিয়েছিলে, সেটা এখনো আমার কাছে আছে।” বেলা’কে প্রবোধ দিতে চাইল নিকি। আবারো তাকে ছেলের সাথে ভাব করার জন্য শুরু থেকে চেষ্টা করতে হবে ভাবতেই ভিজে উঠল চোখ।

“আমাকে সবকিছু সহজভাবেই নিতে হবে।” নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল বেলা। “ওকে বেশি চাপ দেয়া যাবে না।”

বেলার কোনো ধারণাই ছিল না যে ছেলেকে কমব্যাট পোশাকে দেখবে। এক চোখের উপর হেলানো টুপি আর বেল্টে পোড়া বুড়ো আঙুল নিয়ে নিকি চাইল মায়ের মনোযোগ পেতে। নিজের মানোঃকষ্ট লুকিয়ে রেখে তাই মাঝে মাঝেই প্রশংসা করতে বাধ্য হলো বেলা।

সাথে করে এমন কিছু বই নিয়ে এসেছে যা নিকোলাসের বয়সী ছেলেরা পছন্দ করে। ভাগ্য ভালো এর মাঝে ফক অব দ্য বুশভেল্ড আছে; একজন লোক আর তার পোষা কুকুর নিয়ে রচিত আফ্রিকান ক্লাসিক।

মলাটের ছবিটা দেখে সাথে সাথে খুশি হয়ে গেল নিকি। কাহিনী সহজভাবে লেখা হলেও বেশ সুন্দর। আর নিকোলাসের মেধা দেখে অবাক হয় বেলা। একটা কি দুটো অপরিচিত শব্দ বাদে একাই পড়ে ফেলল পুরো গল্প।

এরপর আদ্রা এসে ওকে ঘুমাতে নিয়ে যাবার মাঝেই আবারো বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল দু’জন।

গুডনাইট জানিয়ে মায়ের সাথে হাত মেলাতে এসে আচমকা বলে উঠল নিকি : “গল্পটা বেশ ভালো। জা দ্য ডগ’মে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। আর তুমি আসাতেও ভালো লাগছে। তাই স্কুলে না গেলেও কোনো ক্ষতি নেই।” নিজের বক্তব্যে নিজেই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে চলে গেল ছোট্ট বুড়া।

নিকি’র বেডরুমের আলো নিভে যেতেই আদ্রা’র খোঁজে বের হলো বেলা। জানতে ইচ্ছে করছে রামোন কোথায়, নিকি’কে অপহরণের ব্যাপারে ওর ভূমিকাটাই বা কতটা ছিল।

রান্নাঘরে ডিনারের ডিশগুলো ধুতে ব্যস্ত আদ্রা বেলা’কে দেখেই একেবারে চুপ মেরে গেল। এক শব্দে ইসাবেলার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেও চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। চেষ্টা ছেড়ে তাই নিজের ঘরে চলে এলো বেলা।

ভ্রমণের ক্লান্তি সত্ত্বেও আরাম করে ঘুমোল। ভোরবেলা তাড়াতাড়ি উঠে গেল পুত্রের সঙ্গ পাবার জন্য। তবে সারাদিন ছাব্বিশ’কে নিয়ে সৈকতেই কাটিয়ে দিল দু’জন। ব্যাগ ভর্তি উপহারের মধ্যে নিকোলাস একটা টেনিস বল পেয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটা নিয়ে আনন্দ করল নিকি আর টুয়েন্টি-সিক্স।

এরপর রীফে সাঁতার কাটল দুজনে মিলে; মা’কে কোরালের গর্ত থেকে সী-ক্যাট বের করে আনার কৌশল দেখাল নিকি। ছোট ছোট অক্টোপাসগুলোকে নিয়ে মায়ের ভয় দেখে হেসে বাঁচেনা নিকি।

“আদ্রা। ডিনারে রান্না করে দেবে, কোন সমস্যা নেই।” প্রমিজ করল। নিকোলাস।

“তুমি আদ্রা’কে বেশ ভালোবাসো, তাই না? জানতে চাইল বেলা।

“অবশ্যই। আদ্রা তো আমার মা।” কী বলেছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল নিকি মানে তুমি আমার মাম্মা; কিন্তু আদ্রা’ই তো আমার আসল মা।”

বেলা’র ইচ্ছে হল চিৎকার করে কেঁদে উঠে।

দ্বিতীয় দিন বাইরে ভোরের আলো না ফোঁটার আগেই ওর ঘরে এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলল নিকি। “চলো, আমরা মাছ ধরতে যাবো। জোসে আমাদেরকে বোটে করে নিয়ে যাবে।”

আসার সময়ই ক্যাম্পের গার্ডদের মাঝে জোসে’কে দেখেছে বেলা। মনে হচ্ছে নিকি’র সাথে এই কৃষাঙ্গ তরুণের বেশ ভাব। নৌকা আর ফিশিং লাইন ঠিক করার সময় গল্পে মেতে উঠল দু’জন।

“তুমি ওকে পেলে কেন ডাকো?’ স্প্যানিশ জোসে’কে কে জিজ্ঞেস করল বেলা; কিন্তু উত্তর দিল নিকি।

“কারণ স্কুলে আমিই হচ্ছি সকার প্লেয়ার চ্যাম্পিয়ন, তাই না জোসে?”

সেদিন সন্ধ্যায় একসাথে বসে ফকের আরেকটা চ্যাপ্টার পড়ল নিকি আর বেলা।

নিকোলাস ঘুমিয়ে পড়ার পর আবারো আদ্রার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল বেলা; কিন্তু চেষ্টাই সার; কোনো লাভ হলো না। কিন্তু রান্নাঘর থেকে চলে আসার সময় অন্ধকারে ওর পিছু নিল আদ্রা। তারপর আচমকা হাত ধরে প্রায় বেলা’র কানের কাছে বলে উঠল, “আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারব না; ওরা সবসময় নজর রাখছে।”

বেলা কিছু বোঝার আগেই আবারো রান্নাঘরে ফিরে গেল আদ্রা।

সকালবেলা নিকোলাসের কাছ থেকে আরেকটা সারপ্রাইজ পাওয়া গেল। সৈকতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যোসে। নিকি বলা মাত্রই ওর হাতে অস্ত্র তুলে দিল। দ্রুত আর দক্ষ হাতে একে এমে’র সবকটি অংশ খুলে নিল নিকি।

“কত দূর?” জোসে’র কাছে জানতে চাইল নিকি।

“পঁচিশ সেকেন্ড পেলে।” শ্রদ্ধা ভরে হেসে উঠল ক্যাম্পের গার্ড।

“পঁচিশ সেকেন্ড মাম্মা” গর্বিত ভঙ্গিতে ইসাবেলাকে জানাল নিকি।

“জোসে, আমার লাগানো শেষ হলেই আবার সময় জানাবে ঠিক আছে? আর তুমি আমার ছবি তুলবে মাম্মা।” আদেশ দিল নিকি।

রাইফেল নিয়ে পোজ দিল নিকি, তারপর আরেকটা ছবি ভোলার বায়না করল। লেন্সের মধ্য দিয়ে ছেলের মুখ দেখে ভিয়েত-কঙ্গের শিশু যোদ্ধাদের কথা মনে পড়ে গেল। বেলা’র আরো মনে পড়ে গেল এই ছোট্ট মানুষগুলোই কী কী ঘটায়। নিকোলাসও কী এদের মতই হয়ে যাচ্ছে? মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

“গুলি করব জোসে?” খানিক বাকবিতণ্ডার পর নিকোলাসকে অনুমতি দিয়ে দিল জোসে।

খালি একটা বোতল লেগুনে ছুঁড়ে মারতেই পানির কিনারে দাঁড়িয়ে গুলি করল নিকি। গান ফায়ারের শব্দে কম্পাউন্ড থেকে দৌড়ে এলো হাফ ডজন প্যারাট্রুপার আর নারী সিগন্যালার। সকলে মিলে সোল্লাসে উৎসাহ দিল নিকি’কে পঞ্চম বারের মাথায় বোতলটা বিস্ফোরিত হতেই” ভাইভা পেলে?” ‘সাহসী পেলে?” চিৎকারে কান পাতা দায় হয়ে উঠল।

“আর আরেকটা ছবি তোল মাম্মা।” দু’পাশে সমর্থকের দল আর বুকের কাছে রাইফেল নিয়ে পোজ দিল নিকি।

আদ্রা’র বেঁধে দেয়া ফল আর ঠাণ্ডা স্মোকড ফিশ দিয়ে সৈকতে পিকনিক লাঞ্চ করল বেলা আর নিকি। গালভর্তি খাবার নিয়ে হঠাৎ করেই নিকোলাস বলে ফেলল : “জোসে অনেক যুদ্ধ করেছে। রাইফেল দিয়ে পাঁচটা মানুষও মেরেছে। একদিন আমিও হব বিপ্লবের সত্যিকারের সন্তান-ওর মত।”

সে রাতে মশারির নিচে শুয়ে ছটফট করে উঠল বেলা। “আমার ছেলেটাকে ওরা দানব বানিয়ে ফেলছে। কিন্তু কী করব? কিভাবে ওদের হাত থেকে নিকি’কে বাঁচাবো?”

ওরা যে কে সেটাও তো জানে না বেলা।

“ওহ, রামোন তুমি কোথায়? শুধু ওর সাহায্য পেলেই কিছু করা সম্ভব। ও পাশে থাকলে আমি সবকিছু পারব।”।

আবারো আদ্রা’র সাথে কথা বলতে চাইল, কিন্তু ওর শীতলতা কিছুতেই কাটে না।

নিকোলাসও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। এখনো বেশ নম্র আর বন্ধুভাবাপন্ন থাকলেও বেলা বুঝতে পারল ছেলেটা কেবল ওর সঙ্গ আর তেমন পছন্দ করছে না। বারে বারে শুধু স্কুল, ওর বন্ধু, সকার ম্যাচের কথা বলে। গল্পের বইয়ের মাঝে আর আটকে রাখা যাচ্ছে না ওকে।

বেলার মাঝেও মরিয়ামভাব চলে এসেছে। শুধু ভাবছে কেমন করে এইসব থেকে নিকি’কে নিয়ে যাওয়া যায় ওয়েল্টেভ্রেদেনের সভ্য আর নিরাপদ জগতে। ফার্স্ট ক্লাস পাবলিক স্কুলের ড্রেসে কেমন দেখাবে নিকি!

“আমার ছোট্ট বেবি’কে যদি ফিরিয়ে দেয়-ওরা যা বলবে করব।” আপন মনে স্বপ্ন দেখলেও বেলা জানে যে কোনো লাভ নেই।

রাত নেমে এলে ভয়ংকর নব চিন্তা এলো বেলা’র মাথায়। নাহ, কিছ একটা করতেই হবে।

জোসের রাইফেলটা নেয়া যায়। নিকোলাসকে বললেই ওকে দেখতে দেবে…কিন্তু না।

কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদো ভালোভাবেই ধরতে পারল বেলার এ পরিবর্তন। এই ভয়টাই পাচ্ছিল।

গত দশ দিন ধরে খুব কাছ থেকেই বেলা’র উপর নজর রেখেছে। কুড়ে ঘরে বেলা’র অজান্তে লাগানো আছে বহু ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। সৈকতে কিংবা নৌকায় থাকলেও হাই পাওয়ার টেলিস্কোপিক লেন্স দিয়ে ওদের ছবি ভোলা হয়।

অনুমান করল মেয়েটা এমন একটা স্টেজে পৌঁছে গেছে যে উন্মাদের মতো কিছু করে বসতে চাইবে।

আদ্রাকে তাই নতুন নির্দেশ দেয়া হলো।

সন্ধ্যায় ডিনার সার্ভ করার সময় কয়েক মিনিটের জন্য নিকি’কে বাইরে পাঠিয়ে দিল আদ্রা। তারপর ইসাবেলার’র বাটিতে ফিশ স্যুপ দেয়ার সময় ইচ্ছে করে এমন ভাবে দাঁড়াল যে বেলা’র গালে এসে পড়ল আদ্রা’র চুল।

‘কথা বলবেন না কিংবা আমার দিকে তাকাবেন না।” ফিসফিস করে উঠল আদ্রা, “মার কুইসের মেসেজ আছে। উনি জানিয়েছেন যে আপনার কাছে আসতে চেষ্টা করবেন; কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কঠিন আর বিপদজনক। এও জানিয়েছেন যে হি লাভ ইউ। সাহস রাখুন প্লিজ।”

আত্মঘাতী সমস্ত চিন্তা নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। রামোন আশেপাশেই কোথাও আছে। রামোন ওকে ভালবাসে। অন্তরের অন্তঃস্থলে ঠিকই জানে যে রামোন সাহায্য করলে ও সবকিছু পারবে।

বাকি দুই দিন এ চিন্তাতেই বিভোর হয়ে রইল বেলা। নিকোলাসের সাথে নতুন উদ্যমে মিশতে তাই কোনো সমস্যাই হলো না।

রাত হলেই একা একা জেগে বসে থাকে; দ্বিধা কিংবা ভয়ে নয়, রামোনের অপেক্ষাতে।”

“ও আসবে, আমি জানি ও আসবে।”

কিন্তু রামোনোর পরিবর্তে মেসেজ নিয়ে এলো লাগেজ সার্চকারী নারী কেজিবি’র একজন।

“আগামীকাল সকাল নয়টায় আপনার ফ্লাইট।”

“দ্য চাইল্ড?” জানতে চাইল বেলা, “নিকোলাস-পেলে?”

মাথা নাড়ল কেজিবি। “ও থাকবে। আপনার সময় শেষ। ঠিক আটটায় আপনাকে নিতে লোক চলে আসবে তৈরি থাকবেন।”

ছেলের সাথে কাটানো স্মৃতি হিসেবে কিছু নিয়ে যেতে চাইল বেলা। শাওয়ার করে ডিনারের জন্য তৈরি হবার পর বারমুডার ভেতরে লুকিয়ে নিল এক জোড়া নেইল সিজার। ডিনার টেবিলে নিকি বসতেই কিছু না বলে ওর পিছনে গিয়ে ঘন কোকড়ানো চুল কেটে নিল বেলা।

“হেই, তুমি কী করছ?”

“চলে যাবার পর যেন তোমাকে স্মরণ করতে পারি।”

খানিকক্ষণ কী যেন ভেবে লাজুক স্বরে নিকি জানতে চাইল। “তাহলে আমিও কী ভোমার কয়েকটা চুল রাখতে পারি?

বিনা বাক্যব্যয়ে ওর হাতে কাঁচি তুলে দিল বেলা। মায়ের সামনে দাঁড়াল নিকি ”বেশি না কিন্তু।” বেলা’র সাবধান বাণী শুনে হেসে ফেলল নিকি।

“তোমার চুল বেশ নরম-আর সুন্দর। তোমাকে কি যেতে হবে মাম্মা?”

“হুম।”

“আবারো আসবে আমাকে দেখতে?”

“ইয়েস, আই উইল। প্রমিজ।”

“আমি আমার ফক বইতে এই চুলগুলো রেখে দেব। যখনি বইটা পড়ব। তোমার কথা ভাবব।”

কুঁড়েঘরের খোলা অংশ দিয়ে ঘরে ঢুকেছে চাঁদের রুপালি আলো। সময়ের সাথে সাথে সরেও যাচ্ছে মেঝের উপর দিয়ে।

“ও নিশ্চয়ই আসবে” শক্ত ম্যাট্রেসের উপর আশা নিয়ে শুয়ে রইল বেলা, “প্লিজ ওকে আসতে দাও।”

হঠাৎ করেই সিধে হয়ে গেল বেলা। কিছুই দেখেনি কিংবা শোনেইনি তারপরেও নিশ্চিতভাবে অনুভব করছে যে ও কাছেই কোথাও আছে। নাম ধরে ডেকে উঠার ইচ্ছে বহুকষ্টে সংবরণ করল। সবটুকু ইন্দ্রিয় সজাগ করে বসে রইল বেলা। আর তারপরেই বিনা কোনো শব্দে চলে এলো রামোন।

গলার কাছে উঠে আসা কান্না গিলে ফেলল বেলা। মশারি থেকে বের হয়ে দ্রুত তিন কদম হেঁটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রামোনের বুকে। নিঃশব্দে ও’কে নিয়ে বাইরে চলে এলো রামোন।

“আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।” নরম স্বরে ওকে সাবধান করে দিল। আরো জোরে আঁকড়ে ধরল বেলা।

“আমাদের সাথে এসব কী হচ্ছে ডালিং?” অনুনয় করে উঠল বেলা,

“আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন তুমি আমাদের সাথে এমন করছ?”

“তুমি যেই কারণে আদেশ মানতে বাধ্য হচ্ছ! নিকোলাসের জন্য, তোমার জন্য!”

“আমি বুঝতে পারছি না; কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। একেবারে শেষ হয়ে গেছি।”

আর বেশি দেরি নেই। ডার্লিং। আমি প্রমিজ করছি শীঘ্রিই আবার আমরা তিনজন একসাথে হবো।

“গতবারেও তুমি একথাই বলেছিলে ডার্লিং, যতটুকু পেরেছি আমি করেছি…।”

“আমি জানি বেলা, এটাই আমাদেরকে বাঁচিয়েছে। আমাকে আর নিকোলাসকে। তুমি না থাকলে আমরা কবেই খতম হয়ে যেতাম। তুমি আমাদেরকে বাড়তি সময় আর জীবন দিয়েছ।”

“ওরা আমাকে দিয়ে জঘন্য সব কাজ করাচ্ছে রামোন। আমি আমার পরিবার আর দেশের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।”

“ওরা তোমার উপরে সন্তুষ্ট হয়েছে বেলা। এই ভ্রমণই তার প্রমাণ। নিকোলাসের সাথে কাটানোর জন্যে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছে। যদি পারো তাহলে আরেকটু-আর খানিকটা কাজ করে দাও।”

“ওরা আমাকে কখনোই ছাড়বে না, রামোন, আমি জানি আমার শেষ রক্তটুকুও শুষে নিবে।”

“বেলা, ডার্লিং” সিল্কের নাইট গাউনের উপর দিয়ে ওর পিঠে আলতো করে চাপড় দিল রামোন, “আমার প্ল্যান শোন, যদি তুমি ওদেরকে আরেকটু খুশি করতে পারো, তাহলে আগামীবার ওরা আরো নরম হবে। তোমাকে বিশ্বাস করবে। অসাবধান হলেই-প্রমিজ করছি নিকিকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব।”

“কারা ওরা?” ফিসফিস করে উঠল বেলা; কিন্তু ওকে আদর করতে শুরু করল রামোন। প্রশ্নের তাই উত্তরটা আর জানা হলো না।

“চুপ করো, মাই লাভ। তুমি না জানলেই ভাল হবে।”

“প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম এরা রাশানস; কিন্তু আমার স্কাইলাইট মেসেজ তো আমেরিকানদের কাজে লেগেছে আর অ্যাঙ্গোলা’তেও কাজে লেগেছে। এরা কী তবে সি আই-এ?”

“হয়ত তুমি সত্যি; কিন্তু নিকির খাতিরে এদেরকে ঘাটাতে যেও না।”

“ওহ গড, রামোন। আমার কিছু ভাল লাগছে না। বিশ্বাসই হচ্ছে না সভ্য কোনো লোক অন্যদের সাথে এমন করতে পারে।”

“আর বেশি দিন নয়।” ফিসফিসিয়ে জানাল রামোন। “ধৈর্য ধরো। ওদের আরেকটু কাজ করে দাও; তারপরেই আমি আর নিকি তোমার কাছে চলে আসব।”

“আমাকে অনেক আদর করো রামোন। না হলে আমি পাগল হয়ে যাবো।”

***

পরের দিন সকাল বেলা মা’কে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল নিকোলাস। জিপের পেছনে বসে আছে জোসে আর রেগুলার ড্রাইভার। হঠাৎ করেই ওদের কথা কানে যেতে চমকে উঠল বেলা। “পেলে হচ্ছে সত্যিকার শিয়াল ছানা। এল জোরো।”

আইলুশিনের র‍্যাম্পে একে অন্যকে বিদায় জানাল নিকি আর বেলা।

“তুমি প্রমিজ করেছ যে আবার আমাকে দেখতে আসবে, মাম্মা।” মনে করিয়ে দিল নিকি।

“অফ কোর্স নিকি। এবারে কোন উপহার আনব?”

“আমার সকার বলটা মিইয়ে যাচ্ছে। ম্যাচের সময় বারে বারে পাম্প করতে হয়।”

“ঠিক আছে আরেকটা এনে দেব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ মাম্মা।” হাত বাড়িয়ে দিল নিকি। কিন্তু নিজেকে সালমাতে পারল না বেলা, ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরল।

প্রথমে মুহূর্তখানেক চুপ করে থাকলেও হঠাৎ করেই জোর করে হাত ছাড়িয়ে খানিক মায়ের দিকে তাকিয়েই দৌড় দিল নিকি। রাগে পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। খালি হয়ে গেল বেলা’র ভেতরটা।

লিবিয়া’তে নেমে সুইস এয়ার ফ্লাইট ধরে জুরিখে চলে এলো বেলা। ন্যানি সহ বাসার সবাইকে পোস্টকার্ডও পাঠাল আর সুইজারল্যান্ডেই আছে। বোঝানোর জন্য নিজের ক্রেডিট কার্ডও ব্যবহার করল। এমনকি লুজানে’তে পরিচিত ব্যাংকার’কে ফোন করেও দশ হাজার ফ্র্যাংক তুলে নিল। যেন কারো কোন সন্দেহ না থাকে ওর অবকাশ যাপন নিয়ে।

নিকোলাসের ছবিগুলো অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। এমনকি রাইফেল হাতে ধরা ভয়ংকর ছবিগুলো’ও প্রাণ ভরে দেখল বেলা। নিকোলাসের জন্য একটা জার্নাল বানিয়েছে বেলা। কাভারের ভেতর পকেট অলা মোটাসোটা একটা বই। বছরের পর বছর ধরে জড়ো করা বিভিন্ন জিনিস এখানে রেখেছে বেলা।

লন্ডনে একটা ফার্ম হায়ার উদ্ধার করা নিকোলাসের স্প্যানিশ বার্থ সার্টিফিকেট আর অ্যাডপশন পেপারস; মালাগার’র ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া ছোট্ট মোজা; নার্সারী স্কুল আর ক্লিনিকের রিপোর্টসহ ওকে পাঠানো প্রতিটি ছবি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পাতায় লিখে রেখেছে ওর নিজস্ব মন্তব্য, আশা, হতাশা আর ভালোবাসার কথা।

ওয়েল্টেভ্রেদেনে গিয়ে এবারে যোগ করল নিকি’র চুল আর একসাথে কাটানো দিনগুলোর গল্প।

যখনই খুব মন খারাপ হয়ে যায়, নিজের রুমে চুপচাপ বসে বসে জার্নালের পাতা ওল্টায়।

এভাবেই পায় টিকে থাকার শক্তি।

***

সোজা ছুটে গিয়ে মোড় নিল বীচক্রাফট। পেছনের সিটে বসে মাধ্যাকর্ষণের চাপে কেমন যেন হালকা বোধ করল বেলা।

“ওই তো” পাইলটের বামপাশের সিট থেকে চিৎকার করে উঠল গ্যারি, “দেখেছ? পাহাড়ের নিচে, তিনটা।”

নিচে জঙ্গলের মাথার দিকে তাকাল বেলা। পাথরে দুর্গ, উপত্যকা দিয়ে ভরে আছে পুরো বনানী।

আকাশে উন্মত্ত চিৎকার করে ঘুরপাক খেতে লাগল একদল সবুজ রঙা কবুতর; এতটাই কাছে যে ওগুলোর লাল ঠোঁট আর পুঁতির মতো চকচকে চোখ জোড়াও দেখা যাচ্ছে। এরপর হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল অরণ্য। নিচে বিছিয়ে আছে শীতের ধূসর ঘাস। গর্জন করতে করতে সোজা দূরের পাহাড়চূড়ার দিকে ধেয়ে গেল বীচ ক্রাফট।

“ওই তো! বেলা দেখেছ?” আবারো বলে উঠল গ্যারি।

“ইয়েস! ইয়েস! কত্ত বড় না?” পাল্টা চিৎকার করে উঠল বেলা।

পরিষ্কার জায়গাটুকুর শেষ মাখা গিয়ে একসাথে দৌড়ে যাচ্ছে তিনটা মন্দা হাতি। আরবীয় নৌকার পালের মতো ছড়িয়ে আছে কান। বাকানো আইভরি উঠে গেছে উপরের দিকে।

একেবারে সামনের হাতিটার বিশ ফুট উপরে প্লেন যেতেই তেড়ে এলো স্থল দানব। লম্বা শৃড় উঁচিয়ে এমন ভাব করল যেন তাদেরকে আকাশ থেকে পেড়ে ফেলবে। কন্ট্রোল কলাম টেনে ধরল গ্যারী। মেঘ বিহীন আফ্রিকান আকাশে উঠে গেল বিমান।

“সবচেয়ে বড়টার ওজন সত্ত্বর পাউন্ডের কম হবে না।” সিটের উপর বসে ঝুঁকে দেখে হাতিটার ওজন আন্দাজ করল গ্যারি।

“এগুলোও কি আমাদের এলাকা। বাবা?” কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে বাবার কাছে জানতে চাইল।

“এর কিনারেই।” গ্যারির ডান পাশের আসনে বসে আছেন শাসা। গ্যারি’কে তিনিই বিমান চালানো শিখিয়েছেন; জানেন ওর দক্ষতা।

“ওদিকে ন্যাশনাল পার্ক দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি লাইনও দেখতে পাবে।”

“ওই বুড়ো জাম্বোগুলো তো এদিকেই আসছে।” বাবা’র দিকে হেলে এলো বেলা; হাসলেন শাসা।

“হুম, এতে কোনো সন্দেহ নাই।”

“তার মানে ওরা জানে যে কোনটা শিকারির জায়গা আর কোনটা ওদের জন্য নিরাপদ?”

“যেভাবে তুমি তোমার নিজের বাথরুম চেনো; যে কোনো সমস্যার গন্ধ পেলেই ওরাও ঘরের দিকেই ছোটে।”

“ক্যাম্প দেখতে পাচ্ছো?” জানতে চাইল গ্যারি।

“ওই তো দক্ষিণে। ধোয়াও দেখতে পাবে।”

খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান। ছোট্ট একটা জেবরা’র দল নিচে ঘাসের চাদরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু উড়োজাহাজের শব্দ পেয়েই দিল দৌড়।

নিচে পার্ক করে রাখা খোলা ট্রাক দেখতে পাচ্ছে বেলা। হুইলে বড় ভাইকে দেখার আশা নিয়ে তাকালেও দেখা গেল বসে আছে কৃষাঙ্গ ড্রাইভার। দু’বছরের উপর হয়ে গেল; শন’কে দেখে না।

জোড়া ইঞ্জিনের বীক্রাফট’কে শেষবারের মতো ঘোরাল গ্যারি। ড্যাসবোর্ভে জ্বলে উঠল তিনটা সবুজ বাতি। কন্ট্রোলের উপর ঘুরে বেড়ালো শক্তিশালী আর নিশ্চিত আগুলগুলো।

“ওতো বেশ ভালোই প্লেন চালায়।” ভাইয়ের কৌশলের প্রশংসা করল বেলা, “প্রায় বাবা’র মতই ভালো।”

কোনো রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই বীচক্রাফট’কে মাটিতে নামিয়ে আনল গ্যারি। স্ট্রিপের শেষ মাথার গাছগুলো দ্রুত এগিয়ে আসতেই ম্যাক্সিমাম সেইফ ব্রেকিং’য়ে চাপ দিল। এরপর ট্যাক্সিং করে এগিয়ে গেল অপেক্ষারত ট্রাকের দিকে।

মোটরের গুঞ্জন শেষ হতেই চারপাশে ভিড় করে এলো ক্যাম্পের স্টাফ। হ্যাচ খুলে নিচে নেমে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন শাসা। কোম্পানির শুরু থেকেই এখানে কাজ করছে বেশিরভাগ সাফারি স্টাফ।

কিন্তু ওদের খুশি দ্বিগুণ হয়ে গেল ইসাবেলা’কে দেখে। মেয়েটাকে সকলেই ভালবাসে কোয়েজি দ্য মর্নিং স্টার নামে ডাকে।

“তোমার জন্য তাজা টমেটো আর লেটুস রেখে দিয়েছি কোয়েজি।”

নিশ্চিত করল মালিদের প্রধান, লট। মহিষ আর হাতি’র গোবরের সার পাওয়াতে উর্বর হয়ে থাকে চিজোরা ক্যাম্পের বাগান। আর বেলা’র সালাদ প্রীতিও সকলের জানা আছে।

“তোমার তাবুটা ক্যাম্পের একেবারে শেষে পেতে দিয়েছি, কোয়েজি।” জানালো ক্যাম্পের বাটলার। আইজ্যাক। “যেন সকালবেলাতে পাখিদের গান শুনতে পাও আর শেফ তোমাকে স্পেশাল চা এনে দেবে।”

বীচক্রাফটকে নিয়ে জ্যাকেল-ওয়্যার হ্যাঙ্গারে রেখে দিল গ্যারি; যেন রাতের বেলা সিংহ কিংবা হায়েনা এর টায়ারে দাঁত বসাতে না পারে।

এরপর খোলা ট্রাকের উপর লাগেজ উঠিয়ে নিল স্টাফেরা আর হুইলে বসল গ্যারি।

শনের কঠোর নিয়ম হলো ক্যাম্পের দু’মাইলের মধ্যে কোনোরূপ গোলাগুলি চলবে না। বর্ষার পরে পানি শুকিয়ে গেলে খেলাও ফুরিয়ে যায়। পুরো ক্যাম্প গুটিয়ে দলবল নিয়ে তখন কারি লেকের তীরে ক্যাম্পে চলে যায় শন।

জঙ্গলের মাঝে পাতা হয়েছে সবুজ তাঁবুর সারি। প্রতিটার পিছনেই আছে। শাওয়ার রুম আর মাটির শৌচাগার। খড়ের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে ডাইনিং টেন্ট। দিন-রাত জ্বলতে থাকা ক্যাম্প ফায়ারের চারপাশে রাখা হয়েছে। ক্যানভাসের চেয়ার।

বাতি জ্বালানো আর রেফ্রিজারেটর সচল রাখার দায়িত্ব পালন করে পোর্টেবল জেনারেটর। খড়ে ছাওয়া রান্নাঘরে বসে মুখরোচক সব খাবার তৈরি করে শেফ। বার টেবিলের উপর বরফ কুচি ছাড়াও আছে সারি সারি লিকার বোতল। পাওয়া যাবে পৃথক পৃথক পাঁচটা ব্রান্ডের প্রিমিয়াম হুইস্কি আর তিনটা সিংগল সল্ট। প্রতিটি গ্লাস স্টয়াট ক্রিস্টালের তৈরি।

স্নান সেরে, তরতাজা হয়ে ক্যাম্প ফায়ারের কাছে এসে বসল পুরো পরিবার। হাতঘড়ির দিকে তাকালেন শাসা।

“এক পেগের জন্যে কি বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেল নাকি?”

“কী যেন বলো না। আমরা তো ছুটিতে এসেছি।” বারম্যান’কে ডেকে অর্ডার দিল গ্যারি।

ঠাণ্ডা হোয়াইট ওয়াইনে চুমুক দিল ইসাবেলা। গত দু’বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মনে হলো কেমন যেন নিরাপদ মনে হচ্ছে নিজেকে বেশ শান্তি শান্তিও লাগছে। কেবল মাইকেল’কে মিস করছে। অন্যদিকে বাবা আর গ্যারি মিলে শনে’র ক্লায়েন্টের কথা আলোচনা করছে। জার্মান ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট অটো হায়দার।

“শনের চেয়ে বছর বিশেকের বড় হলেও দুজনে যেন হরিহর আত্ম; একসাথে যে তারা কী করে, গড।” বলে উঠলেন শাসা, “বিপদের গন্ধ এতটাই ভালবাসে লোকটা যে শন ছাড়া আর কারো সাথেই শিকার করতে চায় না।”

“আমি স্পেশাল সার্ভিসকে দিয়ে ওর উপর পুরো রিপোর্ট তৈরি করেছি।” মাথা নাড়ল গ্যারি। কোম্পানির সিকিউরিটি থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর দেখভাল করে এই ইন্টিলিজেন্স সিস্টেম। “অটো হায়দারের সম্পত্তির বিবরণ চার পাতা ছাড়িয়ে গেলেও লোকটা বেশ বুনো প্রকৃতির। আমার মনে হয় আর্থিকভাবে উনার সাথে জড়িয়ে পড়াটা ঠিক হবে না।”

“আমারও তাই মনে হয় মাথা নাড়লেন শাসা। “কিন্তু লোকটা বেশ ইন্টারেস্টিং। জানো উনি সাথে করে ব্লান্ড-ব্যাংক ও নিয়ে আসেন; যদি হাতি পাড়া দেয় কিংবা ষাঁড়ের গুঁতো খান!”

“এটা তো জানি না।” ক্যাম্প চেয়ারের সামনে ঝুঁকে এলো গ্যারি।

হেসে ফেললেন শাসা, “সেল্ফ অ্যাডমিনিস্টারিং ট্রান্সফিউশনস্।”

“মানে? ইসাবেলা’ও এবারে আগ্রহী হয়ে উঠল।

“সাথে দু’জন কোয়ালিফায়েড নার্স নিয়ে আসেন। দুজনেই যথেষ্ট সুন্দরী বয়স পঁচিশ আর রক্তের গ্রুপ এবি পজিটিভ। রক্ত লাগলেই দু’জনের কাছ থেকে নেবার পাশাপাশি সেবাও পাওয়া যাবে।”

“আর রক্ত যদি নাও লাগে সাফারি’তে ওদের সঙ্গ’ও মন্দ হবে না।”

“ইউ আর ডিসগ্যাস্টিং, গ্যারি।” গ্যারির মন্তব্য শুনে হেসে ফেলল বেলা।

“আমি! ওই ব্যাটা অটো’র বুদ্ধি দেখেছ; আমার মনে হয় ওর সাথে ব্যবসা খারাপ হবে না।”

“বাদ দাও। সকালেই নার্সদেরকে নিয়ে চলে যাবেন অটো। আমাদের আসল ক্লায়েন্ট আসবেন কাল দুপুরবেলা। শন্ অটো’কে সালিশ ব্যুরিতে নামিয়ে দিয়ে উনাকে নিয়ে ফিরবেন” হঠাৎ করে কথা থামিয়ে ক্যাম্পের সামনের অংশে তাকালেন শাসা।

“শনের ট্রাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, ওই তো ও আসছে।”

মাইল খানেক দূর থেকে খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে হান্টিং ভেহিকেল।

“মাস্টার শনের তো মনে হচ্ছে বেশ তাড়া আছে।”

গর্জনের মতো শোনা গেল ট্রাকের ইঞ্জিনের আওয়াজ। পানি খেতে আসা জন্তুগুলো ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

কাছে এগিয়ে আসতেই খোলা টয়েটার আরোহীদেকে স্পষ্ট দেখা গেল। ইঞ্জিনে বনেটের উপর ফেলে রাখা হয়েছে উইন্ডস্ক্রিন। পেছনের উঁচু আসনে বসে আছে চারজন। শনের কৃষাঙ্গ দুই টাকার আর দু’জন শ্বেতাঙ্গ নারী। এরাই হয়তো জার্মান নার্স, ভাবল ইসাবেলা।

সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছেন মধ্য বয়স্ক এক পুরুষ। চোখে গোল্ড রিমের চশমা। ইনিই নিশ্চয়ই অটো।

হুইলে বসে থাকা শন’কে দেখে ক্যাম্প চেয়ার ছেড়ে দৌড় দিল ইসাবেলা।

বুশ শার্ট পরিহিত শনের অনাবৃত বাহুদ্বয় একেবারে তেল চকচক করছে, পেশি আর স্বাস্থ্যের আভায়। কাধ পর্যন্ত লম্বা চুল।

দ্রুত জোরে ব্রেক কষল যে গাড়ির পেছন পেছন উড়ে আসা ধূলিঝড়ের মাঝখানে থেমে গেল হেভি ভেহিকেল। লাফিয়ে নেমেই ওদের দিকে দৌড়ে এলো শন। পরনে থাই পর্যন্ত লম্বা খাকি শর্টস আর মোজা বিহীন চামড়ার জুতা।

“শন?” ভাইকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল বেলা। কিন্তু চোখে মুখে ভয়ংকর একটা ভাব নিয়ে বোন’কে এড়িয়ে চলে গেল শন। হা হয়ে তাকিয়ে রইল বেলা।

একই ভাবে বাবাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ছোট ভাইয়ের সামনে।

“নিজেকে কী ভাবো তুমি। বলোতো?” শীতল ক্রোধ নিয়ে জানতে চাইল শন; মুছে গেল গ্যারি’র হাসি।

“তোমাকে দেখে খুশিই হয়েছি।” আস্তে করে জানালো গ্যারি।

কিন্তু সামনে এগিয়ে গ্যারির শার্ট চেপে ধরল শন। ঝাঁকি দিতেই ক্যানভাস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্যারি।

“শোন তাহলে” হিসহিস করে উঠল শন, “পুরো সিজনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন মদ্দাটার পেছনে আমি চারদিন ধরে ঘুরে মরছি। অথচ তুমি এসে সব ভণ্ডুল করে দিলে!”

“দেখ, শন্ আমি তো…”গ্যারি চাইল ভাইকে শান্ত করতে; কিন্তু কিছুই শুনছে না শন।

“ধুত্তোরি, কাকে মুগ্ধ করতে চাও, অ্যাঁ?”

“শন” হাত বাড়িয়ে দিল- গ্যারি,

বুঝতে চেষ্টা করো, আমি তো জানতাম না যে এমন হবে।”

“বুঝতে চেষ্টা করব? আমার সবকিছু ভেস্তে দিয়েছ আর শান্ত হবো? আমার ক্লায়েন্টকে চটিয়ে সাফারির শেষ সুযোগটাকে হারিয়ে ঠাণ্ডা হবো?”

“বলেছি তো আমি দুঃখিত।”

“যদি এখনি সরি হও, তাহলে আগামী পাঁচ মিনিটে কেমন দশা হবে” বলে উঠল শন। বাম হাত দিয়ে পেছন দিকে ধাক্কা দিল গ্যারি’কে, কিন্তু গ্যারি নিজেকে সামলাতেই আবার চড়াও হল শন।

পাঁচ ইঞ্চি দূর থেকে শনের ঘুষি খেয়ে গ্যারি’র দাঁতে দাঁতু ঠেকে গেল। পেছনে হেলে যেতেই চোখ থেকে খসে পড়ল চশমা। ক্যাম্প চেয়ারে হাঁটু গেথে ধপাস করে পেছন দিকে পড়ে গেল গ্যারি।

“থাক, এখন বেশ ভালো লাগছে।” পড়ে থাকা চেয়ার সরিয়ে মুঠি পাকিয়ে ভাইয়ের দিকে দৌড়ে গেল শন।

“শন” এতক্ষণে হুশ ফিরে পেল বেলা। “স্টপ ইট, শন! ওকে ছেড়ে দাও!” ভাইদের মারামারি থামাতে দৌড়ে গেল বেলা, কিন্তু হাত ধরে ওকে থামালেন শাসা। মুক্তি পাবার জন্য ছটফট শুরু করল বেলা।

বসে থেকেই নিজেকে সালমাতে চাইল গ্যারি। নাক টেনে চেষ্টা করল রক্ত পড়া থামাতে; হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে উপরের ঠোঁট মুছে চোখের সামনে এনে ভালোভাবেই তাকাতেই অবিশ্বাসে হা হয়ে গেল চোখ।

“উঠে এসো, বেকুব কোথাকার।” গ্যারি’র সামনে গিয়ে দাঁড়াল শন।” উঠে দাঁড়াও।”

“ওকে ছাড়ো শন, প্লিজ।” ওর অত্যন্ত প্রিয় দু’জন মানুষ এমনভাবে মারামারি করছে দেখে ভয় পেয়ে গেল বেলা, “স্টপ ইট! স্টপ প্লিজ।”

“চুপ করো, বেলা! মেয়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিলেন শাসা, “ওদেরকেই সামলাতে দাও।”

ধুলার মাঝে বসে বড়সড় সেন্ট বানার্ড ডগের মতো নিজেকের ঝাঁকি দিল গ্যারি।

“কাম অন, মিঃ ব্লাডি চেয়ারম্যান অব দ্য বোর্ড।” ভর্ৎসনা করে উঠল শন। “চলো, তোমার স্টাইল দেখাও মিঃ ফরচুন ম্যাগাজিন ৫০০।”

“ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দাও, বেলা।” এখনো হাত ধরে রেখেছেন শাসা, “বিশ বছর ধরে জমানো রাগ এবারে বেরিয়ে আসছে। ওরাই মিটিয়ে ফেলবে।” হঠাৎ করেই সবকিছু বুঝতে পারল বেলা। সারা জীবনের জমানো রাগ উগরে দিচ্ছে শন।

প্রথম সন্তান হিসেবে সমস্ত সম্মান আর পদবী ওরই প্রাপ্য ছিল। কিন্তু শন্ কিছুই পায়নি।

“পিস্-বেড” বলে উঠল-শন,”

“ফোর আইজ।” ছোট্টবেলায় এসব বলে গ্যারি’কে অপমান করা হত। বড় ভাই হওয়াতে সবসময় গ্যারি’কে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করাত শন্। শীতকালে ঘুম থেকে টেনে তুলে টয়লেটে পাঠিয়ে দিত ওর জন্য সিটটাকে গরম করে তোলার জন্য; সবকিছু মনে করল বেলা। মনে পড়ে গেল এরকম আরো হাজারো অজুহাত যার মাধ্যমে গ্যারি’কে অপমান করত শন্।

উঠে দাঁড়াল গ্যারি। বিশ বছর পরিশ্রম আর সাধনা করে সারিয়ে তুলেছে নিজের দুর্বল শরীর। গড়ে তুলেছে পেশি বহুল বুক আর মনোভাব। তারপরেও দাঁড়াবার পর দেখা গেল বড় ভাইয়ের চেয়ে অন্তত ইঞ্চি চারেক খাটো।

“এটাই” আস্তে করে বলে উঠল গ্যারি,” শেষবার। এরপর এরকম আর হবে না, বুঝেছ?”।

“না” মাথা নাড়ল শন্। “আমি কিছুই বুঝিনি বিছানায় মুতুকারী। আমাকে বোঝাও।”

টয়োটা থেকে নেমে শনে’র পিছু পিছু এলো তার জার্মান ক্লায়েন্ট আর সুন্দরী নার্স দু’জন। বোঝা গেল বেশ মজা পাচ্ছে।

চশমা ছাড়া, পেঁচার মতো চোখ পিটপিট করে উঠল গ্যারি। কিন্তু চোয়ালের সাথে দাঁতগুলো এত জোরে আটকে ধরল যে কানের নিচে ওয়ালনাটের মতো ফুলে উঠল পেশি। সুখে হাসি নিয়ে আগে বাড়ল শন্ এগিয়ে এলো গ্যারি।

মদ্দা ষাঁড়ের মতই দ্রুত এগিয়ে এলো নিজের ভারী শরীর নিয়ে; কিন্তু চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র শন্। গ্যারি’র পেটের বামদিকে দিল গুঁতো। যুদ্ধ ট্যাংকের গায়ে যেন ইট ছোঁড়া হলো। একচুলও নড়ল না গ্যারি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার ছুটে এলো।

ঠোঁটে গা জ্বলানো হাসি নিয়ে ওর সামনে লাফাচ্ছে শন। গ্যারি’কে কাছে এগিয়ে আসার সুযোগ দিয়ে কেবল তো মেরে যাচ্ছে।

কিচকিচ করে উঠল জার্মান নাসদ্বয়। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসেছে ক্যাম্পের ভৃত্যেরা। চোখ বড় বড় করে দেখছে সবকিছু।

“ওদেরকে থামাও। ড্যাডি।” ইসাবেলা’র আকুতি কানেই তুললেন না শাসা। যেরকমটা হবেন ভেবেছিলেন সবকিছু সেভাবেই এগোচ্ছে।

প্রতিবার পাঞ্চ মেরে দর্শকদেরকে দেখে নিচ্ছে শন্। বিশেষ করে নার্সদেরকে। নিজের স্টাইল নিয়েও বেশ সচেতন।

অন্যদিকে, গ্যারি বাঁচিয়ে চলছে ওই ভয়ংকর ঘুসিগুলো। কিন্তু ওর মাথায় কিছুতেই আঘাত করতে পারছে না শন। পেশি বহুল কাঁধ দিয়ে প্রতিবার ওকে ঠেকিয়ে দিচ্ছে গ্যারি।

একই সাথে দ্রুত নিজের হাতও চালাচ্ছে। মাথা বরাবর এগিয়ে আসা শনের বেশ কিছু ঘুসি বাইসেপে আটকে গেল।

প্রথমে মনে হচ্ছিল গ্যারি বুঝি এমনি এমনিই তেড়ে আসছে। কিন্তু একটু পরে শাসা খেয়াল করলেন যে শন’কে দেয়ালের দিকে কোণঠাসা করে ফেলছে গ্যারি। শন্ সরে গেলেও ধৈর্য ধরে ঠিকই নিজের কাজ করে যাচ্ছে গ্যারি। নাকের রক্ত মুখ বেয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে খাকি শার্ট।

এবারে মুছে গেল শনের হাসি; তিরস্কারের ধারও কমে গেছে। অন্যদিকে একই ছন্দে ও’কে ক্রমাগত পেছন দিকে ঠেলছে গ্যারি। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো করে ঘুসি ছুড়ছে শন। এতক্ষণে গ্যারির চাল ধরতে পেরে গোত্তা খেয়ে ডান দিকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু পথ আটকে দিল গ্যারি। নিচু হয়ে গ্যারি’র হাতের নিচে দিয়ে বের হয়ে যেতে চাইল শন; কিন্তু এবারে ঘুষি মেরে বসল গ্যারি।

দম বদ্ধ করে তাকিয়ে রইল সমস্ত দর্শক। দু’শ পাউন্ড ওজনের পেশি হাড় আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বজ্রকঠিন আঘাত করল গ্যারি। বাতাসে শিস কেটে গিয়ে আঘাত লাগল শনে’র চুল ছাড়িয়ে মাথার খুলিতে।

এক মুহূর্তের জন্য যেন অন্ধ হয়ে গেল শন। হাঁটু দুটো কাঁপতে শুরু করল। কোন মতে সামলালেও মুখে ব্যথা ফুটে উঠে আতঙ্কও দেখা দিল। ভালুকের মতো ওর দিকে তেড়ে আসছে গ্যারি।

এতক্ষণ ধরে এর অপেক্ষাতেই ছিল গ্যারি। পুরোন বন্ধুর মতো দুহাত ছড়িয়ে এগোলেও সবাইকে বিশেষ করে শন’কে বোকা বানিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে বসল। ঠিক যেমন করে শিকার ধরতে এগিয়ে যায় মদ্দা ষাড়।

স্তম্ভিত শন্ কিছুই করতে পারল না। ডাইনিং টেন্ট ছিঁড়ে একসাথে জড়াজড়ি করে পড়ে গেল দু’জনে। মূল্যবান আর প্রাচীন সব ওয়াইন, ক্রিস্টাল নিয়ে উপুড় হয়ে গেল বার টেবিল। ফেনার মেঘের ভেতরে ডুবে গেল দুই ভাই।

ডাইনিং টেবিল ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল দামি বাসন-কোসন। সারা শরীরে দড়িদড়া আর ক্যানভাস পেঁচিয়ে তাঁবুর পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এলো দু’জনে। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় ছুটাছুটি শুরু করে দিল ভুত্যের দল।

বৃত্তের মতো করে একে অন্যকে ধাওয়া শুরু করল দুই ভাই। কিছুতেই ছাড়তে রাজি নয় গ্যারি। শনের পেছনে ডাবল লক করে ধরে রেখেছে। পাইথনের মতই পিষে ফেলতে চাইছে শিকার।

শনের একটা হাত ভয়ংকরভাবে বেঁকে গেছে। খোলা হাতটা দিয়ে দুরমুশের মতো গ্যারি’র মাথায় পেটাতে লাগল; কিন্তু আগের মতো তেমন জোর নেই। যদিও গ্যারি’র ঠোঁটও কেটে গেল।

একে অন্যকে ধরা অবস্থাতেই আবারো সকলের মাঝখানে চলে এলো শন আর গ্যারি। নার্সদের একজন কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। স্কার্ট উল্টে আন্ডারওয়্যার বেরিয়ে গেলেও কেউ তাকিয়ে দেখল না।

শন’কে মাটি থেকে তুলে ফেলতে চাইছে গ্যারি। বুকে গ্যারি’র মোচড়ের চোটে শনের চেহারা ঘেমে নেয়ে অন্ধকার হয়ে উঠলেও বিড়ালের মতো ঠিকই প্রতিবার ঘোরার পরেও মাটিতে নেমে আসছে। একেবারে ক্যাম্প ফায়ারের মাঝখানে ভাইকে নিয়ে এলো গ্যারি। শনে’র শূন্য পায়ের নোম পুড়ে গেল; চামড়ার জুতায় আগুন ধরে গেল।

ভয়ংকর গর্জন করে লাফ দিল শন আগুন এড়াতে পারলেও গ্যারি’র মুঠি সরাতে পারল না। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল শন্! ঝুঁকে এলো গ্যারি।

শনে’র ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে গেল; মুখে ভরে গেল রক্ত। এরপরেও মুঠি আলগা করল না গ্যারি। শনে’র চোখজোড়া মনে হচ্ছে সকেট থেকে বেরিয়ে যাবে; চোয়াল হা হয়ে ঝুলে পড়ল।

“গ্যারি! তুমি ওকে মেরে ফেলছ?” আর্তচিৎকার করে উঠল ইসাবেলা। কিন্তু শাসা কিংবা গ্যারি, মনে হলো কেউই ওর কথা শুনতে পায়নি।

এবারে শনে’র পাজর ভেঙে যাবার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল সবাই। চিৎকার করে গমের খালি বস্তার মতো আছড়ে পড়ল গ্যারি’র হাতের উপর। ওকে ছেড়ে পিছিয়ে এলো গ্যারি। এতক্ষণের পরিশ্রমে ওর নিজের চেহারাও ঘেমে নেয়ে একাকার।

উঠে বসতে চাইলেও বুক চেপে ধরে গোঙ্গাতে লাগল শন্। দুই-হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করছে গ্যারি।

“রাইট!” শান্ত স্বরে জানিয়ে দিল গ্যারি, “এবার থেকে সমঝে চলবে বুঝেছ?”

এক হাতে বুক ধরে কোনমতে উঠে দাঁড়াল শন।

“শুনেছ আমার কথা?” এগিয়ে এলো গ্যারি।

“গোল্লায় যাও।” ফিসফিস করে বললেও বুকে ব্যথা পাচ্ছে শন্।

খানিকটা ঝুঁকে মোটাসোটা শক্ত বুড়ো আঙুল দিয়ে ভাইয়ের বুক স্পর্শ করল গ্যারি,

“আমার কথা শোননি?”

ওকে, ওকে। শুনেছি।” হাল ছেড়ে দিল শন।

“গুড।” মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সদের দিকে তাকাল গ্যারি, “ফ্রাউলেইন” যথাসাধ্য জার্মানে বলে উঠল “আপনাদের সাহায্য দরকার।”

দুজনেই দৌড়ে গিয়ে দুপাশ দিয়ে শকে ধরে ওর তাবুর দিকে নিয়ে গেল।

ইসাবেলা’র হাত ছেড়ে দিলেন শাসা।

“তো” বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, অবশেষে সব সাঙ্গ হল।” ডাইনিং টেন্টের ভগ্নদশা’র দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন, “ওরে কে কোথায় আছিস, চিভাস নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি।”

***

৬. ক্যাম্প-বেডের উপর বসে

ক্যাম্প-বেডের উপর বসে আছে গ্যারি। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে মলম নিয়ে ওর ক্ষতের উপর লাগিয়ে দির বেলা। শনে’র ঘুসি খেয়ে গ্যারির হাত আর উর্ধাঙ্গে জিরাফের মতো দাগ পড়ে গেছে। ফুলে ঢোল হয়ে গেছে নাক আর ঠোঁট।

“মনে হয় ভালই হয়েছে” হেসে ফেলল ইসাবেলা, “আগে তোমার নাকটা অর্ধেক ছিল; এখন পুরো মুখ জুড়েই নাক দেখা যাচ্ছে।”

মিটিমিট হেসে গ্যারি বলে উঠল, “মাস্টার শন’কে তো এক হাত নিয়েছি। এবার দেখছি তোমাকে শিক্ষা দেবার পালা এসেছে।”

ভাইয়ের মাথায় কি করল বেলা। টেডি বিয়ার, তুমি জানো হোলি কতটা লাকি যে তোমাকে পেয়েছে।” লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।

গ্যারি। ভাইয়ের প্রতি স্নেহে বেলা’র বুক ভরে গেল।

***

একটু পরপরেই ব্যথায় কাতরাচ্ছে শন আর হেসে গড়িয়ে পড়ছেন অটো।

“এই যে নাও!” বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা টাম্বলার গ্লাসে ঢেলে দিলেন তিন আঙুল পরিমাণ হুইস্কি “ব্যথার জন্য এটা ক্লোরোফর্মের কাজ করে।”

কাত হয়ে গ্লাসটাকে নিয়ে সবটুকু হুইস্কি গলায় ঢেলে দিল শন! “ষাড়ের দৌড় আর-জাম্বো পুঁতো খেলেও এবারে! ওই টুডি সামালকে মেরি মা।”

হাতে সার্জিক্যাল টেপ নিয়ে থেমে গেল স্টুডি। হেসে শনের ঠোঁটে কিস্ করল।

“চুপ করে বসে থাকো। আমি সব ঠিক করে দেব।”

“হুম, এ কাজে তো তুমি দক্ষ।” স্বীকার করল শন। টেপ বাড়িয়ে দিল কিং-সাইজ বেড়ে। শনের পিছনে বসে থাকা এরিকার দিকে।

“আর কোনো গুঁতোগুতি করা চলবে না।” তীব্র শব্দে হেসে ফেলল এরিকা। আরেক হাতের নিচ দিয়ে টেপ চলে এলো ট্রডির কাছে।

আবারো হাসতে লাগলেন অটো হায়দার। “তুমি কী এভাবেই পড়ে থাকবে? আর দুই মাদী শিয়ালকে কে সামলাবে? আমি একা?” শন তার বহুদিনের পুরোন দোস্ত। চারজন মিলে-অটো, স্টুডি, এরিকা আর শন-শুধু শিকারই করে না আরো অনেক বেশি মজা করে।

“তোমার আর কিছু বাকি নেই। কিন্তু তোমার ভাই, বাপরে, ঠিক একটা ষড়। চোখ পাকালো ট্রডি। “ও যেমন ভালো ফাইট করে তেমনি কি বিছানাতেও ভালো?”

মুহূর্ত খানিক ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল শন, আমার ভাই কিন্তু যেমন তেমন না। বিয়ে করার সময় তো বলতে গেলে কুমারীই ছিল। সন্দেহ আছে তোমাকে খুশি করতে পারবে কিনা।”

“আমরা দেখিয়ে দিব। কী করতে হবে। এরিকা আর আমি।” প্রমিজ করল ট্রুডি।

“তোমার কী মনে হয় অটো?” ক্লায়েন্টের দিকে তাকাল শন। “ওদেরকে আজ রাতের জন্য ধার দেবে? মাঝরাতের আগেই আবার তোমার তাবুতে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”

মাথা নাড়লেন অটো,

“মাই ফ্রেন্ড। তুমি এত মজার সব জোকস বলল না! গালর্স তোমরা কী বলো?

আহত বুক খামচে ধরে ওদের সাথে হেসে ফেলল শন।

আজ কী ঘটে গেছে তা সবার চেয়ে ওই ভালো বুঝেছে। ভাই সুলভ হাতাহাতি নয়; যেন ফাইনাল ব্যাটল লড়েছে অধিকার পেতে মরিয়া দুটো আঁড়।

ও হেরে গেছে আর বেদনাটাও অনেক ভারী।

জানে আর কখনোই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। গ্যারি ওকে সবদিকে হারিয়ে দিয়েছে। বোর্ডরুম থেকে শুরু করে পেশির’র যুদ্ধে। শন শুধু এখন একটাই কাজ পারে। ওর ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করা।

***

স্বপ্ন দেখছে গ্যারি। কিন্তু এতটাই স্পষ্ট যে মনে হচ্ছে সত্যি। একদল নৃত্যরত বনপরীর হাত থেকে বাঁচার জন্য তৃণভূমির উপর দিয়ে যেন ছুটছে গ্যারি। কিন্তু এত কষ্ট হচ্ছে! যেন গরম গুড়ের ভেতর ডুবে যাচ্ছে পা।

তৃণভূমির ওপারে হোলি আর দাঁড়িয়ে থাকা সন্তানদেরকেও দেখতে পাচ্ছে। হোলি চিৎকার করে কিছু বললেও বুঝতে পারছে না গ্যারি। কাঁদছে। ওর স্ত্রী।

যতবার ওর কাছে যেতে চাইছে, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরছে বনপরীদের উষ্ণ হাত। ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল হোলি আর বাচ্চারা। ছোট্ট বাবুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তৃণভূমির ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল সকলে।

মন চাইল চিৎকার করে ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে; কিন্তু নিজের ভাবনা চিন্তাও কেমন যেন এলোমেলো ঠেকছে। হঠাৎ করে কী হলো। আর পালাতে চাইছে না গ্যারি। ঘুমের মাঝেও বুঝতে পারল যে এটা স্বপ্ন; অথচ চাইছে যেন এ ঘোর না ভাঙ্গে কোনদিন।

চারপাশ থেকে ওকে ঘিরে ধরল নরম তুলতুলে উষ্ণ শরীর। নাকে ধাক্কা খেল নারী দেহের মিষ্টি গন্ধ। শুনতে পাচ্ছে হাসির রিনরিনে আওয়াজ।

হোলি আর বাচ্চারা চলে গেছে, ওদেরকে ভুলে লালসায় ডুবে গেছে গ্যারি।

এরপর হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বুঝতে পারল যে এটা স্বপ্ন নয়; ওর বিছানায় সত্যি সত্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা হাত। মুখের উপর সমূদ্রের জালের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সিল্কি চুল। নরম শরীর দু’টো ওকে পেচিয়ে ধরেছে বনদেবীদের মতন।

খানিকক্ষণ শুয়ে থেকেই তড়াক করে এক লাফ দিয়ে বসে পড়ল গ্যারি। ওপাশে পাথরের মতো জ্বলছে নগ্ন নারী দেহ।

বিছানার কিনারে বসে আছে শন। বুকে সাদা টেপ হলেও মুখে হাসি। “ফার্স্ট প্রাইজটা তুমিই পেয়েছ গ্যারি; এনজয় ল্যাড এনজয়!”

“ইউ বাস্টার্ড!” ওকে ধরতে এগিয়ে গেল গ্যারি।

কিন্তু দ্রুত পায়ে সরে পড়ল শন। মেয়ে দুটোও তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গেল। বিড়াল চানার মতো করে দু’হাতে দু’জনকে ধরে তুলে ফেলল গ্যারি। তাঁবুর বাইরে নিয়ে আসতেই চিৎকার জুড়ে দিল নার্সদ্বয়।

ড্রেসিং গাউনের বেল্ট লাগাতে লাগাতে তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন শাসা,

“কী হয়েছে?”

“আমার ডার্লিং ব্রাদার, বিছানাতে সাপ ছেড়ে দিয়েছে। ওগুলোকে তাড়িয়ে এলাম।” নম্রভাবে উত্তর দিল গ্যারি।

“ধুর!” বলে উঠলেন শাসা, “অযথাই সুযোগ হারালে।”

মিটিমিটি হাসতে হাসতে ছেলের পিছু নিলেন শাসা।

ঘুম কাতুরে চোখ নিয়ে লেসের শর্ট নাইটি পরে নিজের ভঁবু থেকে বের হয়ে এলো বেলা,

“গ্যারি, কী হয়েছে?”

“আমিও তো তাই ভাবছি।”

“দু’জন গ্যারি? একটু বেশিই হয়ে গেল না?”

“শন’কে জিজ্ঞেস করো, এটা ওর আইডিয়া।”

“এখন কী করবে? আমি আসব?”

“সানন্দে। হোলি’র কাছে তুমি আর বাবা রিপোর্ট করো।”

ছোট্ট দলটাকে নিয়ে ক্যাম্পের বাইরে পানির কিনারে চলে এলো গ্যারি। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে বাইরে; পায়ের নিচে বরফ ভাঙছে।

“প্লিজ, আমরা কেবল মজা করতে চেয়েছিলাম।” গ্যারির হাতের নিচে ঠকঠক করে কাঁপছে ট্রডি।

“সত্যিই মজা করেছি।” কাঁদো কাঁদো স্বরে জানাল এরিকা।

“প্লিজ যেতে দিন।” বাতাসে যেন সাইকেল চালাচ্ছে এমন ভাবে দুলছে ওর পা।

“আমিও মজাই করছি।” বলে উঠল গ্যারি। কিন্তু মনে হয় তোমাদের চেয়ে আমারটাই ভাল হবে।”

প্রথম থ্রোটা তেমন ভালো হলো না। মাত্র বিশ ফুট। কিন্তু এরিকা ভারী হওয়াতে এমনটা হয়েছে। ট্রডি গিয়ে পড়ল পাক্কা ত্রিশ ফুট দূরে চিল্কারে কান পাতা দায় হলেও ঠাণ্ডা পানিতে পড়ার সাথে সাথে থেমে গেল সবকিছু।

গায়ে কালো মাটি মেখে ভয়ংকরভাবে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলো দু’জনে।

“এবারে” বলে উঠল গ্যারি, “দেখ, সত্যিকারে মজা কাকে বলে?”

***

ব্রেকফাস্টে দেরি করে ফেলল শন। ডাইনিং টেন্টে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল। চোখ সরু করে তাকাল চারপাশে।

ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই মেরামতো করে ফেলেছে ভূতেরা। ভাঙ্গা ফার্নিচারগুলো মেরামত করা হয়েছে। ট্রডি আর এরিকাও ধুয়ে ফেলেছে মাটি। কিন্তু এসবে মনোযোগ দিচ্ছে না শন।

তাকিয়ে আছে লম্বা টেবিলের মাথায় নিজের চেয়ারের দিকে। এটা ওর ক্যাম্প। বহুদিন ধরেই এ জায়গাটা ওর। সবাই জানে। ক্যানভাসের চেয়ারের পেছনেও ওর নামটাই প্রিন্ট করা আছে।

অথচ এখন কিনা সেখানে বসে আছে গ্যারি। চশমা ঠিক করে নিয়েছে। নাকের ফোলা ভাবটাও কমেছে। শাওয়ার নেয়াতে চুল এখনো ভেজা। বড়সড় আত্মতৃপ্ত মানুষটা বসে আছে শনের চেয়ারে।

চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকাল গ্যারি। নাস্তায় নিয়েছে ইম্পালা লিভার, অনিয়ন আর স্ক্যমবেলড এগস। “মর্নিং, শন,” আনন্দ চিত্তে চিৎকার করে উঠল গ্যারি,” এসে পড়েছ যখন আমাকে এক কাপ কফি এনে দাও।”

হঠাৎ করেই টেবিলের সকলে একেবারে চুপ করে গেল। সবাই তাকিয়ে আছে শনের দিকে। ধীরে ধীরে হেসে ফেলল শন।

“চিনি কতটা দেব?” আইজ্যাকের হাত থেকে কফি-পট নিয়ে এলো।

‘দুই-চামচেই কাজ হবে।” আবারো খেতে শুরু করল গ্যারি। টেবিলের অন্যরাও স্বস্তি পেল। সকলেই খেতে শুরু করল।

ছোট-ভাইকে কফির মগ এনে দিল শন। মাথা নাড়ল গ্যারি, “থ্যাংক শন। বসো।” পাশের খালি-চেয়ারটা দেখিয়ে দিল গ্যারি, “কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে।”

‘আলোচনাটা শোনার জন্য মরিয়া হয়ে গেল বেলা; কিন্তু সমানে কিচির মিচির করে চলেছে দুই নার্স। শাসা আর অটোর সাথে টাংকি মারছে। জানে এই ক্যাম্পে কয়েকদিন পরেই যে মিটিং হবে তার কথা বলছে গ্যারি। যেটির ভিজিটরস আর প্রতিটা ডিটেইল নিকি আর বেলার জন্য অত্যন্ত দামি।

“আর এই ইটালিয়ান নারী? আগেও তো তোমার ক্লায়েন্ট হিসেবে এখানে এসেছিল। কেমন উনি?” বেলা গ্যারির প্রশ্নটা শুনতে পেল। কাঁধ ঝাঁকাল শন।

“এলসা পিগুটেলি? সুইস ইটালিয়ান। গুলি চালাতে ওস্তাদ। ট্রিগার টিপলেই কিছু না কিছু পড়বে। কখনো মিস্ করতে দেখিনি।”

খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল গ্যারি, “আর কিছু?”

“বেশ রগচটা। সবকিছু নিজের মতো করেই চায়। মনে হয় মাথার পেছনেও চোখ আছে। কিছু লুকাতে পারবেনা। বিল খানিকটা বাড়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলছে।”

আবারো মাথা নাড়ল গ্যারি। “আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ইউরোপের অন্যতম ধনবান নারী। ফার্মাসিউটিক্যালস আর কেমিকেল’র ব্যবসা আছে। হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং। জেট ইঞ্জিন, আর্মামেন্টস্ সাত বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই খেলা দেখাচ্ছে। অসম্ভব রকম বিখ্যাত।”

“গত সিজনে আহত একটা জাম্বোর উপর ফুল আউট চার্জের সময়ে মাত্র বিশ কদম দূর থেকে ব্রেইনের একেবারে সামনের অংশে গুলি করেছেন মহিলা। অথচ এরপর আমার উপরে সে কী চোটপাট। আমিই নাকি তাঁর হাতিকে মেরেছি। বেশ কঠিন ধাতু দিয়ে গড়া।”

“আর কিছু? কোন দুর্বলতা? মদ?” জানতে চাইল গ্যারি।

মাথা নাড়ল শন্। “প্রতি সন্ধ্যায় এক গ্লাস করে শ্যাম্পেন। প্রতিবার ডম পেরিগননের ফ্রেশ বোতল। এক গ্লাস খেয়ে বাকিটা দিয়ে দিতেন। প্রতি বোতল পঞ্চাশ ডলার।”

“আর কিছু?” মোটা চশমা’র ভেতর দিয়ে গ্যারি’কে একদৃষ্টে তাকাতে দেখেই হেসে ফেলল শন।

“কাম অন গ্যারি। আন্টির বয়স না হলেও-পঞ্চাশ।”

“আসলে উনার বয়স বেয়াল্লিশ।” জানিয়ে দিল গ্যারি।

কাঁধ ঝাঁকাল শন। “ওকে। আমি অফারটা দিয়েছিলাম। এটা সার্ভিসের অংশ। কিন্তু তিনি হেসেছেন। জানিয়েছেন, শিশুকে লাঞ্চনার দায়ে গ্রেফতার হতে চান না।”

মাথা নাড়ল শন। শারীরিকভাবে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে চায় না।

“পিটি! আমরা উনার সাথে ব্যবসা করতে চাই। তা যা কিছু সম্ভব করতে হবে।” বলে উঠল গ্যারি।

“আজ বিকেল পাঁচটায় উনাকে নিয়ে আসব।” প্রমিজ করল শন। “তারপর তুমি যা খুশি করো।”

সকলে মিলে এয়ারস্ট্রিপে এলো অটো আর নার্সদেরকে বিদায় জানাতে। জার্মান মেয়ে দুটো যে গ্যারি’কে ক্ষমা করে দিল তাই নয়, মনে হলো ওদের শ্রদ্ধাও জিতে নিল গ্যারি। যাবার আগে ওর চুল টেনে। কি করে এমন অবস্থা করল যে লজ্জায় লাল হয়ে গেল গ্যারি।

গর্জন করতে করতে এয়ারস্ট্রিপ ছেড়ে উঠে গেল বীক্রাফট। দু’শ ফুট ওপরে উঠে আধ মাইল দূরে গিয়েও আবার ঘুরে সোজা ওদের দিকে ধেয়ে এলো প্লেন। মাথার উপর মাত্র বিশ ফুট উপরে ঝুলে রইল। পাগলের মতো হাত নাড়ছে প্লেনের পেটে বসে থাকা স্টুডি আর এরিকা।

“কাউবয়!” টয়েটার হুইলে উঠে বসল গ্যারি, “আসবে বেলা?”

“আমি বাবার সাথে আসছি।” উত্তরে জানাল বেলা। জানে ভাইয়ের চেয়েও বাবারর পেট থেকে কথা বের করা বেশি সহজ হবে।

ক্যাম্প থেকে তখনো প্রায় অর্ধেক দূরত্বে, এমন সময় সুযোগ পেল বেলা,

“তো এই এলসা পিগনাটেলীকে বাবা? আগে তো কখনো উনার কথা শুনিনি?”

বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা, “তুমি কিভাবে জানলে?”

“আমাকে বিশ্বাস করো না? আমি তো তোমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি?” অত্যন্ত বুদ্ধি করে বাবাকে অপরাধবোধে ফেলে দিল বেলা।

বুঝতে পারলেন শাসা, বলে উঠলেন, “মাফ করো, বেলা। এমন না যে তোমাকে বিশ্বাস করি না।”

“উনার কারণেই তো আমরা এখানে এসেছি, তাই না?”

তারপরেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন শাসা।

“এলসা পিগনাটোলি গত তিন সিজন ধরে এখানে আসছেন। সিংহ আর চিতা বাঘ শিকার করতে অসম্ভব পছন্দ করেন। তুমি তো জানোই এসব কাজে শন কতটা দক্ষ।”

“আমরা নিশ্চয় উনার শিকার করা দেখতে আসিনি?” বাবাকে জোর দিল বেলা।

“এলসাল’র সম্পত্তির ভেতরে কেমিকে ফ্যাক্টরী’ও আছে কীটনাশক, প্লাস্টিক, পেইন্টস। আর এসবের পেটেন্টের ব্যাপারেই আমাদের যত আগ্রহ।”

“তাহলে গ্যারি’ই তো জেনেভা কিংবা রোমে, উনি যেখানে থাকেন, চলে। যেতে পারে?”

“লুজানে’তে থাকেন মহিলা।”

“তাহলে টারজানের মতো জঙ্গলে আস্তানা গাড়ার কী দরকার? রহস্যটা কী? লোক পাঠালেই তো হত?”।

ট্রাকের গতি ধীর করে নদীর দিকে মনোযোগ দিলেন শাসা। ফোরহুইল ড্রাইভ নিয়ে সোজা বিপরীত দিকে না উঠা পর্যন্ত কোনো কথা বললেন না।

“ঠিক আছে, সবকিছুই বলছি তোমাকে। এসব কীটনশাক নয়, আসলে আমাদের আগ্রহ পিগটেলি ইন্ডাস্টিজ আর আর্মসকোর নিয়ে।”

“আহ, তার মানে অস্ত্র-শস্ত্র?”

“মেয়ের দিকে তাকালেন শাসা। পাগড়ির মতো করে রঙিন স্কার্ফ পেচানো বেলা’কে দেখে অপরাধবোধে দগ্ধ হলেন শাসা। মেয়েটা তো তার নিজেরই অংশ। কেমন করে তিনি ওকে অবিশ্বাস করতে পারলেন!

“নিউক্লিয়ার বোমা নিশ্চয় নয়?” বলে উঠল বেলা, “তোমার কাছে তো এটা এখনি আছে।”

“না, নিউক্লিয়ার নয়।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাসা। “তুমি তো জানই যে তোমার মতো আমিও এসব মারণাস্ত্র পছন্দ করি না যাই হোক। এদের অস্তি তুই যথেষ্ট।”

“কিন্তু যদি হাতের নাগালে থাকে। তাহলে কোনো না কোনো পাগল ঠিকই ব্যবহার করে ফেলবে।” মাথা নাড়লেন শাসা। কিন্তু ডার্লিং আমার দায়িত্ব হলো দেশকে নিরাপত্তা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা।”

“এরকম আর কিছুর কি সত্যি দরকার আছে?” জোর দিল বেলা।

“ছোট্ট একটা শত্রুর দল, আমাদের দেশটাকে নিয়ে সবার ভেতরে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। তরুণদের মাঝে আমাদেরকে দানব বানিয়ে ব্রেইনওয়াশ করছে। শীঘ্রিই হয়ত এরাই ক্ষমতায় বসে যাবে। এরাই হবে আগামীকালের সিদ্ধান্ত প্রণেতা। কোনো একদিন হয়ত দেখা যাবে আমেরিকান নেভাল টাস্কফোর্স এসে আটকে দেবে আমাদের উপকূল। এমনকি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা আর কমনয়েলথ এর সমর্থন নিয়ে ভারতীয় বাহিনীও এসে চড়াও হতে পারে।

“ওই পাপা, এসব তো বহুদূরের ব্যাপার, তাই না?”

“হুম। কিন্তু লন্ডনে থাকার সময়ে তুমিও তো ব্রিটিশ লেবার পার্টি নেতাদের সাথে দেখা করেছ; আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির টেডি কেনেডি’র সাথে কথা বলেছ। মনে আছে উনি কী বলেছিলেন?”

“হ্যাঁ। মনে আছে।”

“আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেউ যেন নাক গলাতে না পারে সর্বদা সেই চেষ্টা করতে হবে।”

“আমাদের কাছে তো ইতিমধ্যেই তা আছে।” মনে করিয়ে দিল বেলা।

“নিউক্লিয়ার অস্ত্র বেশ মূল্যবান। আর এর প্রভাব ঠেকানোটাও দুঃসাধ্য। তাই বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।”

“এলসাই কি এর জোগানদার হবেন? কেন?”

“সিগনোরা পিগনাটোলি বেশ সহানুভূতিশীল। তিনি ইটালিয়ান সাউথ আফ্রিকা সোসাইটির’ও সদস্য। উনার পিতা ১৯৩৫ সালে জেনারেল ডি বোনোর স্টাফ ছিলেন। পশ্চিম মরুভূমিতে রোমেনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে বেনগাজীতে বন্দি হয়েছিলেন উনার স্বামী। আফ্রিকার প্রতি তার ভালোবাসা ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর মাঝেও বপন করে গেছেন। আমাদের সমস্যাও তাই তিনি ভালই বোঝেন। এই মিটিং এর পরামর্শও তিনিই দিয়েছেন।”

আরো কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিল বেলা; কিন্তু মনে হলো থাক। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

চুপচাপ বসে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।

“এই মিটিং সম্পর্কে মাত্র চারজন লোক জানেন। সিগনোরা পিগনাটেলি’তো নিজের স্টাফদেরকেও বিশ্বাস করেন না। গ্যারি আর আমি ছাড়া এই মিটিং এর কথা আর একজনেই মাত্র জানেন-প্রধানমন্ত্রী।”

নিজের বিশ্বাসঘাতকতায় অসুস্থ বোধ করল বেলা। মন চাইল বাবাকে নিষেধ করে যেন তাকেও না বলেন। কিন্তু নিকি’র কথা মনে পড়তেই পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল বেলা।

“পাঁচ বছর আগে, নার্ভ গ্যাস তৈরির জন্য পশ্চিম ইউরোপের দু’টি কেমিকেল কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছিল ন্যাটো। কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর হল্যান্ডের সোশ্যালিস্ট সরকারের চাপে গত শরতে এ চুক্তি ক্যানসেল হয়ে যায়। তবে কাজ অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ায় একটা কোম্পানি গ্যাস উৎপাদন ও পরীক্ষা করে দেখেছে।”

“কারা? পিগনাটোলি কেমিকেলস্?” ইসাবেলার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লেন শাসা, বেলা আবার জানতে চাইল,

“ন্যাটোর মাপকাঠিগুলো কী কী?”

‘ট্রান্সপোর্ট আর স্টোর করার জন্যে সেইফ হবে। পিগনাটোলির উদ্ভাবিত পৃথক দুটি পদার্থ যদি একসাথে মেশানো হয় তাহলে তা আমেরিকান এক্সিকিউশন চেম্বারে ব্যবহৃত সায়ানাইড গ্যাসের চেয়েও বিষাক্ত হবে।”

ফুলে ফুলে ভরা কিগেলিয়া গাছের নিচে ট্রাক পার্ক করলেন শাসা।

হাতে তুলে নিলেন, শনের ডাবল ব্যারেলড পয়েন্ট পাঁচ সাত সাত গিবস রাইফেল।

“চলো জলহস্তীদের দেখে আসি।” বাবা’র পিছু নিল বেলা। রাইফেলের ইনস্যুরান্স করা আছে; কেননা আফ্রিকাতে মাপ, সিংহ আর ষাঁড়ের চেয়েও বেশি মারাত্মক জলহস্তী।

মরা গাছের গুঁড়ির উপরে পাশাপাশি বসে পড়ল পিতা-কন্যা। হাতের কাছেই রাইফেলটাকে রেখে দিলেন শাসা। খানিক পরেই নদী তীর থেকে নেমে গেল মদ্দা জলহস্তী। পানির উপরে শুধু চোখ জোড়া ভেসে রইল।

“সায়ানাইড গ্যাসের চেয়েও এগারো গুণ বেশি বিষাক্ত।” মন্তব্য করলেন শাসা’ “বেশ ভয়ংকর, না?”

“তাহলে কেন এটা দরকার বাবা?” কাঁধ ঝাঁকালেন শাসা।

“ঘৃণা থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য।” পায়ের কাছ থেকে নুড়ি পাথর নিয়ে জলহস্তীটার দিকে ছুঁড়ে মারলেন শাসা। বিশ ফুট দূরে পড়লেও পানির ভেতরে পুরোপুরি ডুবে গেল জলহস্তী। শাসা আবারো বলে উঠলেন, “গ্যাসের কোড নেইম হল সিনডেক্স-২৫। দ্রুত আর নিঃশব্দে হত্যা করা ছাড়াও এটার আরো অনেক গুণ আছে।”

“কী বলছ তুমি?” বিড়বিড় করে উঠল বেলা।

“গন্ধ বিহীন গ্যাসটার কল্যাণে কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যু ঘটবে। তবে চাইলে যে কেউ যে কোনো গন্ধ মেশাতে পারে-যেমন টসটসে আপেল, জেসমিন কিংবা চ্যালেন ফাইভ।”

“তুমি তো এমন ভয়ংকর ছিলে না, বাবা।”

কিছুই বললেন না মেয়েকে। “অবশ্য মিক্সিং এর তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেলে আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এই গ্যাস। ফলে সুবিধা হলো বিপক্ষেরও আর্মির উপরে গ্যাস ছেড়ে দিলেও তিন ঘণ্টা পরেই তোমার নিজের বাহিনী দিয়ে সে জায়গা দখল করে নিতে পারবে।”

“বেশ মজা তো।” ফিস করে বলে উঠল বেলা।

“রাজনৈতিক ভাবে সম্ভাব্য সবকিছু নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছেন মিঃ প্রাইম মিনিস্টার?”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন শাসা। বেলা আবারো জানতে চাইল, ন্যাটো চুক্তি প্রত্যাহার করে নেয়ার পর একমাত্র পিগনাটেলি কেমিক্যালস এই সিনডেক্স-২৫ উৎপাদন করছে?”

“না, ওরা পরীক্ষা করে দেখেছে। কিন্তু ন্যাটোর চুক্তি শেষ হবার পরেই সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। অরিজিন্যাল স্টকও নষ্ট হয়ে গেছে।”

বাঁকা চোখে বাবার দিকে তাকাল বেলা। “নষ্ট হয়ে গেছে?” বেশ ক্ষণস্থায়ী গ্যাস। মাত্র ছয় মাস অটুট থাকে সমস্ত গুণ। তাই তারপরেই আবার নতুন করে তৈরি করতে হয়।”

“ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেলস্-এর জন্যে বেশ লাভজনক হবে।” মেয়ে’র মন্তব্য এড়িয়ে গেলেন শাসা।

“প্ল্যান্টের জন্যে ব্লু-প্রিন্ট-সাপ্লাই করবেন সিগনোর পিগটেলি। উৎপাদন প্রক্রিয়াও বেশ জটিল হবে।”

“কবে থেকে উৎপাদন শুরু করবে তোমরা?” ইসাবেলা’র প্রশ্ন শুনে মিটিমিটি হাসলেন শাসা।

“ধীরে ব্যস ধীরে। মহিলা এহেন প্রস্তাবে রাজি হবেন কিনা সেটাই তো এখনো নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে মাত্র কথা শুরু হবে আজ।” হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন শাসা। “লাঞ্চ টাইম প্রায় হয়ে গেছে; অথচ ক্যাম্প এখনো আধা ঘণ্টা দূরত্বে।”

***

শনে’র আগমন সংবাদ পেয়ে সন্ধ্যা থেকেই এয়ারস্ট্রিপে জড়ো হয়েছে সকলে।

হাত দিয়ে চোখের উপর ছায়া বানিয়ে উইন্ডস্কিনের ভেতর দিয়ে শনের ডান দিকে বসে থাকা আরোহীকে দেখতে পেলেন শাসা। দুজনে একই দুনিয়ার বাসিন্দা হলেও অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে শাসা আর এলসা। আগে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন প্রোগ্রামে দু’জন একই সাথে উপস্থিত থাকলেও কখনো দেখা হয়নি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। দু’জনের সম্পদ আর ক্ষমতা।

সেনটেইন আর ইসাবেলা প্রোগ্রাম গিলে খায় এমন সব চকচকে উইমেন ফ্যাশন ম্যাগাজিনে এলসা’র ছবি দেখেছেন শাসা। গত বিশ বছর ধরে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে কোর্টনি ইন্ডাস্টিজ। তাই এই মিটিং এর আগে স্পেশাল সার্ভিসের তৈরি করা ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এসেছেন শাসা।

বীচক্রাফর্টের ইঞ্জিন বন্ধ করল শন। মাটিতে নেমে এলেন এলসা পিগটেলি। লম্বা গড়নের এলসা’র চালচলন ঠিক তরুণ জিমেন্যাস্টদের মত; ব্রুনো পিগনাটেলি’কে বিয়ে করার আগে ভেস সেন্ট লরেন্টের মডেল হয়েছিলেন-এই নারী।

পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেও মনে মনে বোকা বনে ইলেকট্রিক শক খেয়েছেন। গলা আর হাত দুটো কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। গ্যারি। ইসাবেলা, ভুত্যের দল পেরিয়ে এবারে শাসা’র উপরে স্থির হলো এলসা’র দৃষ্টি। 1

এলসা পিগটেলি’র কেশরাজি এতটাই কালো যে নীল আভা ছড়াচ্ছে। মাথার পেছনে কয়েলের মতো বেঁধে রাখাতে স্পষ্ট হয়ে আছে উন্নত কপাল। পূর্ণ যৌবনা এই নারীর ঠোঁট দুটো বেশ নরম।

মডেল সুলভ ভঙ্গিমা নিয়ে শাসা’র দিকে এগিয়ে এলেন এলসা, “শাসা কোর্টনি” হাসতেই ফুটে উঠল পরিষ্কার চোয়াল। আগামী জুলাইতে তেতাল্লিশতম জন্মদিন হবার কথা থাকলেও এখনো নিভাজ নিখুঁত চামড়া।

“সিগনোরা পিগনাটেলি” এলসা’র হাত ধরলেন শাসা। ঠাণ্ডা আর দ্রুত গতি’র হলেও হাত বেশ শক্তিশালী উজ্জ্বল চোখ জোড়া থেকে ঝরে পড়ছে বুদ্ধির দীপ্তি। ঘন পাপড়ির নিচ থেকে বাদামি সোনারি আভা বিকিরণ করছে চোখের মণি।

“আরো আগেই আমাদের দেখা হওয়া উচিত ছিল।” শাসা’র অদ্ভুত ইটালীয় ভাষা শুনে চোস্ত ইংরেজিতে উত্তর দিলেন এলসা, “ওহ, দেখা তো হয়েছে।”

“কোথায়?” বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা।

“উইন্ডসর পার্ক। দ্যা গার্ডস্ পোলো ক্লাব।” মজা পেলেন-এলসা, “ডিউক অব এডিনবার্গের নিমন্ত্রিত দলের দুই নম্বর খেলোয়ার ছিলেন আপনি।”

“মাই গুডনেস, সেটা তো দশ বছর আগের কথা।”

“এগারো।” শুধরে দিলেন এলসা।” পরিচয় না থাকলেও ম্যাচের পরে ব্যুফেতে দেখা হয়েছিল তিন সেকেন্ডের জন্য। আমাকে স্মোকড স্যামন স্যান্ডউইচ অফার করেছিলেন।”

“আপনার স্মৃতি শক্তি তো দেখছি অসাধারণ।” হার মানলেন শাসা।

“তো স্যান্ডউইচ নিয়েছিলেন?”

“ইস্ কেন যে আপনার মনে নেই।” অন্যদের দিকে তাকালেন এলসা,

“তুমি নিশ্চয়ই গ্যারিক কোর্টনি? প্রথমে গ্যারি তারপর ইসাবেলা’র সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন শাসা।

একগাদা লাগেজসহ চারটা গার কে ট্রাকে তুলে নিল পরিচারকদের দল। মানুষ কেবল প্রাইভেট জেটে ভ্রমণের সময় এতসব ভারী লাগেজ নিয়ে আসে।

“আপনি আমার সাথে আসুন, সিগনোরা” নিজের হান্টিং ভেহিকেলের উঁচু ড্রাইভার সিটে চড়ে বসল শন। কিন্তু ওর কথায় কর্ণপাত না করে দ্বিতীয় ট্রাকে শাসা’র পাশে গিয়ে চড়ে বসলেন এলসা। ইসাবেলা ওদের পিছু নিতেই ওর হাত ধরে থামাল গ্যারি।

“কাম অন বেলা; এবারে বড়ো হও!” বিড়বিড় করে উঠল গ্যারি, “থ্রি ইজ ক্রাউড।”

হা হয়ে গেল বেলা। এটা তো মাখাতেই আসেনি। গ্যারির হাতে হেলান দিয়ে বলে উঠল, “আমি তো বুঝতেই পারি নি যে তোমার ম্যাচ মেকিং এ ট্যালেন্টও আছে ভাই।”

***

সূর্য ডোবার সময়ে টিউলিপ শেপড গ্লাসে করে এলসা পিগনাটেলি’কে এক গ্লাস ডম পেরিগগন এনে দিল আইজ্যাক। রেগুলার ক্লায়েন্টদের সমস্ত অভ্যাসই ওর জানা আছে।

ক্যাম্প ফায়ারের চারপাশে হাফ সার্কেল করে বসল সকলে; নিজের দু’জন ট্র্যাকারকেও ডেকে নিল শন। অ্যাভারেজ ক্লায়েন্টরা বিশেষ করে যারা প্রথমবারের মতো আসেন, তারা শন্ আর তার ট্র্যাকারদের সোয়াহিলি শুনে মুগ্ধ হন।

মাও মাও বিপ্লবের দিনগুলোতে কেনিয়াতে থাকাকালীন সময় থেকেই এ দু’জন শনের সাথে আছে। এদের একজন লম্বা, নাইলোটিক গড়ন, আরেকজন পুঁতির মতো চকচকে চোখের এক ভূত।

অরণ্যের ডোরোবো উপজাতির জীবিত সদস্যদের একজন হলো মাতাতু।

যাদুটোনার জন্য বিখ্যাত এ সম্প্রদায়ের মাত্র কয়েকজনেই বেঁচে আছে। শই মাতাতু নাম দিয়েছে। কারণ ওর আসল নাম বলতে গেলে দাঁত ভেঙে যাবার সম্ভাবনা আছে। শনের জীবনের প্রায় অর্ধেক কাল জুড়েই ওর সাথে আছে মাতাতু। এলসা’কে ওর ভাষা অনুবাদ করে দিল শন “এক সপ্তাহ আগে আমি পাঁচটা চিতাবাঘের টোপ ফেলেছি। নদীর ধারে দু’টো আর বাকিগুলো ন্যাশনাল পার্কের কাছে।”

মাথা নাড়লেন এলসা; আগে ও আসায় এলাকাটা তিনি ভালই চেনেন।

মাতাতু’র দিকে ফিরে আরেকটা প্রশ্ন করল শন। ছোটখাটো ডোবোবো এত বড় একটা উত্তর দিল যে বোঝাই যাচ্ছে সকলের মনোযোগ উপভোগ করছে।

“আজকেও টোপগুলোকে চেক করে এসেছে মাতাতু! আপনার ভাগ্য ভালো সিগনোরা। নদীর ধারের টোপে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। মাতাতুর ধারণা এটা বেশ ভালোই হবে। সপ্তাহ খানেক ধরে ঝুলছে হরিণের টোপগুলো। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও ভালো আছে। যদি আজ রাতেও আসে টুম ব্যাটা। তাহলে কাল সন্ধ্যাতেই গিয়ে হাজির হব।”

“হুম” মাথা নাড়লেন এলসা। “গুড”

“তো কাল সকালে টোপগুলোকে চেক করে আরো কয়েকটা ইম্পালা হরিণ মেরে নেব। যদি প্রয়োজন পড়ে তো ব্যবহার করা যাবে। লাঞ্চ করে খানিক রেস্ট নিয়ে বিকেল তিনটায় বের হয়ে যাব।”

“টোপ চেক্ করা, হরিণ মারা সবকিছু তুমিই করবে।” জানিয়ে দিল এলসা, “কারণ সকালবেলায় আমার মিটিং আছে।” পাশের চেয়ারে বসে থাকা শাসা’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন পিগনা টেলি, “আমাদেরকে অনেক কিছু আলোচনা করতে হবে।”

***

সকালের বেশির ভাগটাই খেয়ে নিল আলোচনা। খুব সাবধানে সবকিছু ঠিক করল গ্যারি। শনের সাথে টয়োটা নিয়ে বেলা’কেও পাঠিয়ে দিল। ক্যাম্প থেকে খানিক দূরে মাসাসা গাছের নিচে তিনটা চেয়ার আর ফোল্ডিং টেবিল পেতে দিল আইজ্যাক।

দুনিয়ার আর কোনো জায়গাতেই এতটা নিরাপত্তা পাওয়া যাবে না। শাসার কাছে পুরো ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ঠেকল। এত সুন্দর একটা জায়গা আর আলোচনার বিষয়টাও ততটাই ভয়ংকর।

অন্যদিকে গ্যারি কিংবা শাসা’র আশানুরূপ কিছুই ঘটলনা। এলসা পিগটেলি সাথে করে হ্যান্ডসাম একটা অ্যাটাচি কে নিয়ে এলেও এটার তালা আর খোলাই হলো না।

বোঝাই যাচ্ছে এখনো সিনডেক্স-২৫ এন্টারপ্রাইজের ব্যাপারে মন ঠিক করতে পারেননি এলসা। একই সাথে বেশ কিছু বিষয়ে সন্দেহও করছেন।

“ন্যাটো তাদের চুক্তি প্রত্যাহার করাতে আমি যার পরনাই খুশিই হয়েছি। কেননা এমন কোন দুনিয়াকে আমি অস্ত্র দিতে চাই না, যার উপরে আমার কোন প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।”

পুরো সকাল জুড়েই মহিলার ভয় দূর করার চেষ্টা করল গ্যারি আর শাসা।

“যদি আপনার উৎপাদন শুরু করে দেন; তাহলে এ গ্যাসের স্যাম্পেল অ্যানালাইস করা কোনো ন্যাটো এক্সপার্ট নির্ঘাৎ টের পেয়ে যাবে এর উৎপত্তিস্থল আর সমস্ত দোষ এসে পড়বে পিগটেলি’র ঘাড়ে…”

এখনো নাছোড়বান্দা এলসা। আলোচনা চলতে চলতে চেয়ার ঘুরিয়ে শাসা’র মুখোমুখি হয়ে গেলেন মহিলা। নিজের সমস্ত মন্তব্য আর প্রশ্ন কেবল শাসা’র দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছেন।

যেন গ্যারি’র কোনো অস্তিত্বই নেই। সবার আগে গ্যারিই ব্যাপারটা ধরে ফেলল। বুঝতে পারল-শাসা’র কাছ থেকেই নির্ভরতা চাইছেন এলসা পিগটেলি। অত্যন্ত সাবধানে তাই একেবারে চুপ করে গেল গ্যারি। তাকিয়ে দেখল দুজনের প্রেমকাতর চাহনি, যদি বুঝতে পারল না যে ঠিক কী ঘটছে।

***

টয়েটোর ফিরে আসার শব্দে সকলের ঘোর ভাঙ্গল। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন শাসা।

“ওহ্, ঈশ্বর, প্রায় লাঞ্চটাইম হয়ে গেছে। আর এখনো আমরা কিছুই ঠিক করতে পারি নি।”

“আমাদের হাতে এখনো দু’সপ্তাহ আছে।” মনে করিয়ে দিলেন এলসা, কাল সকালে আবার এখান থেকেই শুরু করব।”

তিনজনে মিলে ডাইনিং টেন্টে ফিরে এসে দেখল ক্রিস্টালের জগে পিমস নাম্বার ওয়ান মিক্স করছে শন; নিজের রেসিপি নিয়ে সে রীতিমতো গর্বিত।

“গুড নিউজ আছে সিগনোরা” খুশি খুশি গলায় বলে উঠল, শন, “পিমস্ দিয়েই উৎসব শুরু করা যাক?

হাসি দিয়ে শনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন এলসা। আমি শুধু লেবু দিয়ে পানি খাবো। কিন্তু গুড নিউজটা কী?”

“চিতাবাঘটা কাল রাতেও এসেছিল। সবকিছু দেখে মনে হয়েছে সূর্য ডোবার ঘণ্টাখানেক আগে আসে। দু’দিনেই বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে।”

ধন্যবাদ শন্। তুমি সবসময় আমার জন্য ভালো ভালো শিকার নিয়ে আসো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নয়। আজ মাত্র সাফারির প্রথম দিন।”

“লাঞ্চের পরে নার্ভাস ঠিক রাখার জন্য খানিক ঘুমিয়ে নিন। আমরা তিনটায় বেরোব।”

রুপার ট্রে’তে করে এলসা’র মিনারেল ওয়াটার এনে দিল আইজ্যাক বরফ দিয়ে পিমস পান করল অন্য সকলে। টোস্ট করল শন।

“গাছের নিচে মরে পড়ে থাকা চিতাবাঘের উদ্দেশ্যে।”

কিন্তু এর সাথে সাথেই ইয়াং কোর্টনিদেরকে ভুলে অন্তরঙ্গভাবে আলাপ শুরু করে দিলেন শাসা আর এলসা। বড় ভাইয়ের হাত ধরে আড়িপাত সুযোগ নষ্ট করে দিয়ে বাইরে বের করে আনল গ্যারি।

“তুমি কেমন আছো, শন?”

“ভালই তো।” ভাইয়ের উদ্বেগ দেখে অবাক হয়ে গেল শন্।

“কিন্তু তোমাকে তো ভাল দেখাচ্ছে না।” মাথা নাড়ল গ্যারি, “বোঝাই যাচ্ছে যে তুমি ম্যালেরিয়ায় ভুগছ আর পাজরের ব্যথা।”

“এর মানে কী?” বিরক্ত হল শন।

“আজ সন্ধ্যায় সিগনোরার সাথে তুমি শিকারে যেতে পারবে না।”

“কে বলেছে পারব না। টোপাতো আমি পেতেছি আর বাঘটা-”

“সন্ধ্যাবেলা এক বোতল ক্লোরো কুইন নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবে। কেউ কিছু জানতে চাইলে বলবে একশ চার ডিগ্রি জ্বর।”

“লিসেন, বিগ শট, তুমি আমার হাতিটাকে ভাগিয়েছে। এবারে চিতাবাঘটাও শেষ করে দিও না।”

“বাবা যাবেন ক্লায়েন্টের সাথে।” সাফ জানিয়ে দিল গ্যারি। “তুমি ক্যাম্পেই থাকবে।”

“বাবা?” দীর্ঘ এক মুহূর্ত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল শন্। “দুজনের খুব জমে গেছে, অ্যাঁ?”

‘তুমি সব সময় এভাবে কথা বলো কেন?” ঠাণ্ডা স্বরে জানতে চাইল গ্যারি, “মহিলার সাথে আমরা ব্যবসা করতে চাই আর বাবা চেষ্টা করছেন এক ধরনের বিশ্বস্ততার সম্পর্ক গড়ে তুলতে, ব্যস এইটুকুই।”

“আর যখন এই দুই ভূত মিলে চিতা বাঘের দফা-রফা করবে তখন শ গিয়ে তা পরিষ্কার করবে, তাই না?

“তুমিই তো বলেছ যে পিগটেলি কখনো মিস করেন না। আর বাবাও তো তোমার মতই দক্ষ শিকারি। আর এছাড়া তুমি নিশ্চয়ই আহত চিতাবাঘ চাও না, তাই না নির্ভীক শন কোর্টনি?”

খানিক পরে উত্তর দিল শন, “ঠিক আছে। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি” হেসে ফেলে বলল, “না গ্যারি, আমি কোন কিছুকেই ভয় পাই না; মনে রেখো কথাটা।”

***

ক্যাম্প বেডের উপর বই নিয়ে শুয়ে আছেন শাসা। একমাত্র সাফারি ক্যাম্পে এলেই আনন্দের জন্য কোনো কিছু পড়ার সুযোগ পান; নয়ত সারাক্ষণ তো ব্যবসা কিংবা রাজনৈতিক লেখাই পড়তে হয়। এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো পড়ছেন অ্যালান মুরহেডের লেখা ব্লু নাইল; তারপরেও গোগ্রাসে গিলছেন এর প্রতিটি শব্দ। এমন সময় তাঁবুর মাঝে উঁকি দিল গ্যারি।

“আমাদের ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে বাবা; শনের ম্যালেরিয়া হয়েছে।”

হন্তদন্ত হয়ে বসে বই ফেলে দিলেন শাসা। “খুব খারাপ নাকি?” জানে শন্ কখনোই রোগ-বালাইয়ের ধার ধারে না। অথচ এদিকে আবার জাম্বোজি’তে কী নাকি একটা ‘পি ফালসিপারাম: দেখা দিয়েছে। “আমি এখনি ওর কাছে যাচ্ছি।”

“ডোন্ট ওরি বাবা; ক্লোরোকুইন খেয়ে ও এরই মাঝে শুয়ে পড়েছে। তাই ও’কে আর ডিস্টার্ব করো না।”

“স্বস্তি পেলেন শাসা। অন্যদিকে হালকা চালে গ্যারি জানাল, “কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সিগানোরা পিগনাটেলি’র সাথেও তো কাউকে না কাউকে যেতে হবে। আমার চেয়ে তোমার অভিজ্ঞতাই বেশি।”

***

বন্য আবলুস কাঠের নিচু একটা ডালের উপর বানানো হয়েছে হাইড-আউট। মাটি থেকে মাত্র দশ ফুট উপরে। শন্ এটাকে উঁচুতে বানিয়েছে বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়; বরঞ্চ টোপ আটকানো গাছটাকেও স্পষ্ট দেখা যাবে।

বেশ যত্ন করেই টোপ আটকেছে শন। সব দেখে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন-শাসা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্ধ্যার পূর্বমুখী বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাবে শিকারির গায়ের গন্ধ। আর চারপাশে ঝোঁপ-ঝাড় থাকতে চিতা বাঘটাও নিশ্চিন্তে চলে আসবে।

টোপ আটকানো গাছটা থেকে এই হাইড-আউটের দূরত্ব কাটায় কাটায় পয়ষট্টি গজ। টেপ দিয়ে মাপ দিয়ে দেখেছে শন। এর আগে মেইন-ক্যাম্পের বাইরে পয়ষট্টি গজ দূরের টার্গেট ফুটো করে দিয়েছিলেন এলসা।

হাইড আউটটা খুড়ে ছাওয়া আরামদায়ক ছোট্ট একটা ট্রি-হাউজ। ভেতরে আছে দুটো ক্যাম্প চেয়ার। মাতা আর সামবুরু ট্র্যাকার ব্লাঙ্কেট আর স্লিপিং ব্যাগসহ স্ন্যাকস বক্স আর গরম কফি ভর্তি থার্সোস রেখে গেছে।

সূর্যোদয় পর্যন্ত থাকতে হতে পারে; তাই সঙ্গে অত্যন্ত শক্তিশালী বারো ভোল্টের গাড়ির ব্যাটারীর ফ্লাশলাইটও আছে। ট্র্যাকারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য আছে টু-ওয়ে রেডিও।

হাইড আউটের গোছগাছ শেষ করে মই বেয়ে নিচে নেমে এলো মাতাতু; তারপর টয়োটার পাশে দাঁড়িয়ে শাসা’র সাথে শেষ মিনিটের কথাবার্তা সেরে নিল।

“আমার মনে হয় অন্ধকার নামার আগেই চলে আসবে চিতাবাঘ।” সোয়াহিলি ভাষায় বলে উঠল মাতাতু; “ক্ষুধা থাকায় লোভ সামলাতে পারবে না।”

“যদি না আসে তাহলে আলো না ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। রেডিওতে না ডাকা পর্যন্ত এখানে আসবে না। ঠিক আছে? এবার যাও, মাতাতু।

“ভালো থাকবেন, বাআনা। আশা করি মেমসাহিব চমৎকার ভাবেই মেরে ফেললেন। এই শয়তানটা আমার লিভার খাক চাই না।”

শিকারি দু’জন হাইড আউটে ঢুকে না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ট্র্যাকারেরা; তারপর টয়েটো নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল। দুই মাইল দূরত্বে পার্ক করে অপেক্ষা করবে গানফায়ার কিংবা রেডিও কলের জন্য।

ক্যাম্প চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন শাসা আর এলসা। পেছনেই ছড়ানো আছে স্লিপিং ব্যাগ। দু’জনেরই গায়ে লেদার জ্যাকেট, শুধু যে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তা নয়; এমারজেন্সিতে তীক্ষ্ণ নখের আঁচর থেকেও এড়িয়ে বাঁচা যাবে।

ফায়ারিং অ্যাপাচারে লম্বা রাইফেলের নল ঢুকিয়ে অপেক্ষা করছেন এলসা। যে কোনো নড়াচড়া দেখলেই বন্দুক কাঁধে তুলে নিতে প্রস্তুত। দু’জনের কনুই প্রায় পাশাপাশি থাকলেও এখনো স্পর্শ করেনি।

টয়েটোর শব্দ দূরে মিলিয়ে যেতেই ঝপ করে নৈঃশব্দের চাদর নেমে এলো চারপাশে। এতটাই নিশ্চুপ যে শোনা যাচ্ছে সব তুচ্ছ শব্দও; মাথার উপরে পাতার গায়ে বয়ে যাওয়া বাতাস; নদীর তীরে কোনো একটা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ; বহুদূরে কোথাও একঘেয়ে স্বরে ডেকে চলেছে একটা মদ্দা বেবুন।

দু’জনের সাথেই বই থাকলেও কেউ খুলেও দেখেনি। শাসা এতটাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন যেন বহুদিনের পুরনো আর বিশ্বস্ত কোনো বন্ধুর সাথে বসে আছেন। হঠাৎ করে এলসা’র দিকে তাকাতেই দেখলেন হাসছেন পিগনাটেলি।

দুজন দুজনের চেয়ারের হাতল তুলে ফেললেন। এমনভাবে একে অন্যের হাত ধরে বসে রইলেন যেন টিনএজার। নিজেকে দেখে শাসা নিজেই অবাক হয়ে গেলেন; বহু বছর ধরেই এরকমভাবে আর কাউকে অনুভব করেননি।

অরণ্যের মাঝে রাত কাটালেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন শাসা। চোখের সামনে দিয়ে সেলুলয়েডের মতো ভেসে গেল। একের পর এক স্মৃতির ছবি। এ জীবনে বহু নারীর সঙ্গ পেয়েছেন কিন্তু মাত্র কয়েকজনের কথাই এখনো মনে রেখেছেন।

প্রথম যেবার সেনটেইনের কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়েছিলেন, লাইজল আর কার্বোলিক সাবান মেশানো পানিতে চুবিয়ে রেখেছিল মা। মনে পড়তেই হেসে ফেললেন শাসা।

আরেক জনের স্মৃতি এখনো বেশ জ্বলজ্বল করে মনের মাঝে; তারা; তার সন্তানদের মা। কিছু সময়ের জন্য হলেও একত্রে বেশ সুখের দিন কাটিয়েছেন। তারপরেই বনে গেছেন শত্রু।

তারা’র পরে আরো শ’খানেক নারীর সাথে অন্তরঙ্গতা হলেও কেউই তাঁর একাকীত্ব ঘোচাতে পারেনি।

আর একেবারে সম্প্রতি তরুণী নারী দেহের মাঝে অবিনশ্বরতা খুঁজতে গেলেও হার মেনেছেন শাসা। অর্থহীন সঙ্গীতের মাঝে হারিয়ে গিয়ে এরা হয়ত নিজেরাই জানে না যে কী খুঁজছে। তাই তিনি আবারো একা হয়ে গেলেন।

একজন সৎ ভাই থাকলেও তাকে সহোদর হিসেবে কখনো ভাবেননি শাসা আর সেনটেইনও তাকে একমাত্র সন্তান হিসেবেই মানুষ করে তুলেছেন।

পরিচারকদের দল, ব্যবসায়ের অংশীদার, নিজের ছেলে-মেয়ে পরিচিত অপরিচিত এমন অসংখ্য মানুষের ভিড়ে কেবল মাত্র একজনের সাথেই তিনি সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। সর্বক্ষণ যিনি তাঁকে ভালোবাসা আর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।

মা; কিন্তু সেনটেইনেরও ছিয়াত্তর চলছে। আর নিজের একাকীত্বে আজকাল নিজেই চমকে উঠেন, সামনের দিনগুলোর কথা ভাবলেই কেমন যেন বিবশ হয়ে আসে সবকিছু।

ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে বসে থাকা নারী এমনভাবে তার হাতে চাপ দিল যেন বুঝতে পেরেছে শাসা’র অন্তরের বেদনা। মাথা ঘুরিয়ে সেই মধুর মতো সোনালি রঙা চোখ দুটোর দিকে তাকাতেই দেখা গেল কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই তাকিয়ে আছেন এলসা। কেটে গেল সব বিষণ্ণতা; এতদিনে শান্তি খুঁজে পেয়েছেন শাসা।

ছোট্ট ট্রি-হাউজের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকান চাঁদের নরম আলো। এমন একটা মুহূর্ত যখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে পুরো দুনিয়া আর রঙ ছড়ায় অরণ্য।

সামনের দিকে ঝুঁকে খুঁড়ের দেয়াল ভেদ করে ফায়ারিং অ্যাপারচারের ভেতর দিয়ে তাকালেন শাসা। খানিকটা শব্দ শুনেই বলে উঠলেন, “সাবধান! একটা কিলার ক্যাটকে দেখতে পাচ্ছি।”

শুনতে পেলেন এলসা। আফ্রিকান বন্য জগৎ সম্পর্কে তিনিও জানেন। তাই বুঝতে পারলেন শাসার কথা। আস্তে আস্তে করে কাঁধে তুলে নিলেন রাইফেল। সোনালি একটা ছায়ার মতই নিঃশব্দে গোপনে এগিয়ে আসছে চিতাবাঘ। কেউই শুধু চোখের পাতা ফেলা ছাড়া আর কোনো ধরনের নড়াচড়া করছে না। এমনকি নিঃশ্বাস পর্যন্ত মেপে মেপে ফেলছেন; কানের কাছে ড্রাম বাজাচ্ছে হৃদপিণ্ড।

দ্রুত আলো সরে যাওয়ায় ফাঁদ পাতা গাছটার চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে চিতাবাঘ। কল্পনার চোখে যেন জটাকে পরিষ্কার দেখতে পেলেন শাসা।

গুলি ছোঁড়ার মতো আলো প্রায় নেই বললেই চলে। হঠাৎ করেই গাছে উঠে গেল চিতা। কোনো রকম শব্দ হল না। এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে গেছে যে মনে হলো দুজনেরই হৃদপিণ্ড অচল হয়ে গেছে। এরপরই শুরু হলো উন্মাদের মতো দুরু দুরু কাঁপুনি।

ডালের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে চিতা। অন্ধকারের মাঝে আরো গাঢ় অন্ধকার তৈরি করেছে এটার দেহের গড়ন। পলিশ করা ওয়ালনাট কাঠ দিয়ে তৈরি রাইফেলের বাটে গাল ঠেকিয়ে অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিলেন এলসা। এবারে চিতাটা’কে স্পষ্ট দেখা আর যাচ্ছে না।

রাইফেল নামিয়ে রাখলেন এলসা। মাথা ঘুরিয়ে এলসার কানে কানে ফিসফিস করে উঠলেন শাসা, “কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।” শাসা’র গাল স্পর্শ করে নিজের মত দিলেন এলসা।

বাইরে শোনা যাচ্ছে হরিণটাকে আটকে রাখা শিকল ধরে টানার শব্দ। কল্পনার চোখে চিতাটাকে দেখতে চাইলেন শাসা। ঠিক যেন ডালের উপর পেট দিয়ে শুয়ে আছে জটা; এক পা আগে বাড়িয়ে হুকের মতো হরিণটাকে আকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে খেতে লাগল ক্ষুধার্তের মত।

অন্ধকারের মাঝে স্পষ্ট শোনা গেল মাংসের গায়ে চোখা দাঁত বসিয়ে ছিঁড়ে খাওয়ার শব্দ।

রাতটা অসম্ভব দীর্ঘ হলেও একটুও ঘুমাতে পারলেন না শাসা। শিকারি হিসেবে উনার দায়িত্ব হলো চিতা বাঘটার দিকে লক্ষ রাখা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা। পরেই কাঁধে ধাক্কা খেল এলসার ঘুমন্ত মুখ। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন শাসা; যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন এলসা।

ক্লান্ত, ছোট্ট একটা শিশুর মতই অঘোরে ঘুমালেন এলসা। শাসা’র গালে এসে লাগছে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। নিজের হাত দুটো একেবারে অবশ হয়ে গেলেও একটুও নড়লেন না শাসা।

অন্যদিকে বাইরে থেমে থেমে একটু পরপরই হাড় চিবোচ্ছে চিতা। একবারও শব্দ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গেলেন শাসা। চলে গেল নাকি! কিন্তু নাহ, একটু পরেই আবার শিকল টানার শব্দ হলো।

তিনি চাইলেই স্পটলাইট ফেলে চিতার চারপাশে আলোকিত করে তুলতে পারতেন; কিন্তু শাসা’র মাথায় এরকম কোনো দুই নম্বরী বুদ্ধি আসেইনি।

শাসা নিজে কিন্তু ফাঁদ পেতে পশু মারা পন্দ করেন না। এভাবে কখনোই শিকার করেন নি।

জীবনে তিনি যত চিতা কিংবা সিংহ মেরেছেন সব সময় পায়ে হেঁটেই ওগুলোকে অনুসরণ করেছিলেন। অবশ্য এতে করে শ’খানেক ব্যর্থতার দায় বহন করতে হয়েছে। তবে সফল ডজন খানেক শিকারই এখন পর্যন্ত জ্বলজ্বল করছে স্মৃতির মণিকোঠায়।

তাই বলে এলসা কিংবা অন্য ক্লায়েন্টরা টোপ ফেলে শিকার করলেও কিছু মনে করেন না শাসা। এরা কেউই তার মতো আফ্রিকান নয়; এছাড়া বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করেই এ সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু তিনি আলাদাভাবেই ভাবেন।

অন্ধকার হাইড আউটে এলসার পাশে বসে কেন যেন মনে হলো যে তিনি আর কোনদিন শিকার করতে পারবেন না। তিনি তার শেষতম হাতি, সিংহ আর চিতা মেরে ফেলেছেন। চিন্তাটা মাথায় আসতেই একই সাথে আনন্দ আর বিষণ্ণতা উভয়ই অনুভব করলেন। কল্পনা করলেন ভবিষ্যতে এই নারীকে পাশে নিয়ে আনন্দ ভ্রমণগুলো কেমন কাটবে! রাশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল আর তানজানিয়া; পোলার বিয়ার থেকে শুরু করে পঞ্চাশ ইঞ্চি চওড়া শিং অলা ষাড় শিকার করতেই বা কতটা রোমাঞ্চ উপভোগ করবেন। এসব সুখচিন্তা করতে করতেই কেটে গেল সারা রাত।

খানিক বাদে নদী তীর থেকে ভেসে এলো এক জোড়া রবিনের ডুয়েট কোরাস! ঠিক যেন বলতে চাইছে “করো না! এটা করো না।”

উপরের দিকে তাকিয়ে প্রভাতের আগমনী আলো দেখতে পেলেন শাসা। আর ঠিক পনের মিনিটের মাঝেই গুলি ছোঁড়ার মত আলোকিত হয়ে যাবে চারপাশ।

এলসা’র গাল ধরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন শাসা। অথচ সাথে সাথে জেগে গেলেন মহিলা। তার মানে বহু আগেই ঘুম ভাঙ্গলেও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলেন শাসা’র সান্নিধ্য।

“চিতাটা কী এখনো আছে?” প্রায় শাসা’র কানে কানে জানতে চাইলেন এলসা।

“জানি না।” একই রকম মোলায়েম স্বরে উত্তর দিলেন শাসা। প্রায় দুই ঘন্টা আগে শেষ শব্দ শুনেছেন। “তৈরি হয়ে যান।”

চেয়ারে বসে সিধে হয়েই রাইফেলের হাতল ধরলেন এলসা। এতক্ষণে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে শাসার হাতে আর কাঁধে। অথচ কেমন যেন আনন্দে ভরে উঠল বুক।

আবলুস গাছের ঘন পাতার চাঁদোয়া সরিয়ে উঁকি দিলেন শাসা। নাহ, ফাঁদ পাতা গাছটার ডালগুলো তো শূন্যই মনে হচ্ছে। এলসা’র জন্য দুঃখ হলো। চলে গেছে চিতা।

মাথা ঘুরিয়ে যেই না বলতে যাবেন তখনই আবার উত্তেজনায় দুরু দুরু করে উঠল বুক।

ইম্পালা হরিণটার বেশির ভাগ অংশই উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু একই সাথে সাপের মতো কিছু একটাও ঝুলছে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলেন, “লেজ চিতা’র লেজ।” ছবির ধাঁধা মেলাবার মতো করেই মিলে গেল পুরো চিত্র।

গলা আগে বাড়িয়ে ডালের গায়ে সমান হয়ে শুয়ে আছে চিতা। পেটভর্তি খাবার থাকায় একেবারে অলস ভঙ্গিতে চিবুক ঠেকিয়ে পড়ে আছে। কেবল লেজটা ঝুলছে।

এলসাও বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আস্তে করে উনাকে থামালেন শাসা। বাইরে আরেকটু আলো ফোঁটার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু টেনশনে পড়ে গেছেন এলসা।

একটু পরেই বেশ আলো দেখা গেল চারপাশে। চিতাটাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথাখানিক তুলে কিছু একটা শোনার জন্য কান পেতে ছিল। চোখে এসে পড়েছে আলো আর ঠিক যেন শাসাদের দিকে তাকিয়েই রাজকীয় ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করে তাকাল। পুরো ভঙ্গিমাটা এতটাই সুন্দর যে শাসা’র বুকে মোচড় দিয়ে উঠল।

এবারে সময় হয়েছে। এলসা’র হাতে আলতো করে টোকা দিলেন শাসা। রাইফেলের টেলিস্কোপিক সাইটের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছেন এলসা। শাসা মনে মনে আশা করলেন গুলিটা যেন ঠিক চিতার হৃদপিণ্ডে গিয়ে ঢোকে।

কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল।

পুরো শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল চিতা। আড়মোড়া ভাঙ্গতেই বেঁকে গেল পেছন দিক। “নাউ!” আস্তে করে নিঃশব্দে এলসা’কে আদেশ দিলেন শাসা। “গুলি করুন!”

হাই তুলল চিতা। দেখা গেল গোলাপি জিহ্বা।

“নাউ!” টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে শাসা মনে মনে চাইলেন এলসা’কে দিয়ে গুলি ছুঁড়তে। কথা বলতে কিংবা স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছেন। পাছে এলসা’র একাগ্রতা ভঙ্গ হয়।

হঠাৎ করেই লেজ নাড়িয়ে কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই এক লাফ দিয়ে বিশ ফুট উঁচু থেকে মাটিতে নেমে এলো চিতা। একটুও কোনো শব্দ হলো না।

ঝাড়া এক মিনিট ধরে নিঃশব্দে বসে আছেন শাসা আর এলসা। অবশেষে ছোট্ট একটা ক্লিক করে সেফটি ক্যাচ অফ করে রাইফেল নামিয়ে রাখলেন এলসা। চোখ ঘুরিয়ে শাসার দিকে তাকালেন। প্রভাতের আলোয় দেখা গেল মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু “এত সুন্দর!” ফিসফিসিয়ে উঠলেন এলসা, “আমি মারতে পারব না, অন্তত আজকে তো নয়ই।”

সাথে সাথে বুঝে ফেললেন শাসা। আজ তাদের দিন। দু’জনেই দুজনের প্রেমে পড়ে গেছেন।

“চিতাটাকে তোমাকে উৎসর্গ করলাম।” জানালেন এলসা।

“আমাকে এতটা সম্মান দেবার জন্য-” এলসা’কে কিস করলেন শাসা। প্রায় শিশুর মতই সরলভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন দুজনে। এই মিলন হল আত্মিক। তাই আজকের মতো আশীর্বাদ ধন্য এই দিনে কোনো হত্যা নয়।

***

ঠিক যেন কাকতালীয় ভাবে সম্পূর্ণ সেরে উঠল শন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে শিকারীদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সাফারি কোম্পানির খ্যাতিই নির্ভর করে ক্লায়েন্টের অর্জনের উপর।

তাই টয়োটা ঢুকতেই আশা নিয়ে পেছনে তাকালেও অসন্তুষ্টিতে বেঁকে গেল মুখ। প্রথমেই কথা বলল মাতাতু’র সাথে। বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল জোরাবো ট্র্যাকার,

“শয়তানটা দেরিতে এসে তাড়াতাড়ি চলে গেছে।”

“আই এম সরি, সিগনোরারা।” ট্রাক থেকে এলসা’কে নামতে সাহায্য করল শন্।

“এটাই তো শিকার।” বিড়বিড় করে উঠলেন এলসা। মহিলার এমন দার্শনিক মার্কা চেহারা আগে আর কখনো দেখেনি শন। সাধারণত ব্যর্থ হলেই তার মতই ক্ষেপে উঠেন।

“যেমনটা পছন্দ করেন, সেভাবে হট শাওয়ার তৈরি করা আছে। নাশতা’ও এসে যাবে।”

ডাইনিং টেন্টে এলসা আর শাসা’কে ঢুকতে দেখেই সকলের চেহারায় ফুটে উঠল সান্তনা। দু’জনেই স্নান সেরে পরিষ্কার পোশাক পরেছেন। শাসা’তো একেবারে শেভ করে লোশনও লাগিয়েছেন।

“ব্যাড লাক্ বাবা; সো সরি সিগনোরা” সকলে মিলে বলে উঠলেও শাসা আর এলসা’র তৃপ্তি মাথা চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল প্রত্যেকে। যাই হোক এমনভাবে নাশতা সারা হলো যেন বিশ্ব রেকর্ড হয়ে গেছে, চিতা মারা প্রতিযোগিতাতে।

“ব্রেকফাস্টের পরেই আমরা মিটিং শুরু করতে পারি।” পরামর্শ দিল গ্যারি।

“আর আমিও নতুন করে ফাঁদ পাতবো।” যোগ দিল শন্।

“মাতাতু বলেছে। চিতা’রা কখনোই আতঙ্কিত হয় না। তাই আজ রাতে আবার চেষ্টা করা যাবে। এইবার আপনার সাথে আমি যাবো। যার যার কাজ আসলে তাকেই করতে দিতে হয়।”

কিছু না বলে শাসার দিকে তাকালেন এলসা। তারপর চোখ নামালেন কফি-কাপে।

“আসলে, হয়েছে কী শুরু করলেন শাসা, “সত্যি কথা বলতে, আমি আর এলসা মানে সিগনোরা পিগটেলি আর আমি…” শব্দ খুঁজতে লাগলেন শাসা। হা করে বেকুব বনে যাওয়া বাবার দিকে তাকিয়ে রইল তিন ইয়াং কোর্টনি।

“তোমাদের বাবা আমাকে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন।” শাসা’কে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন এলসা। কোন মতে বাঁচলেন শাসা।

“আমরা বীচক্রাফট নিয়ে যাবো।” তাড়াতাড়ি অজুহাত বানালেন, “সিগনোরা পিগটেলি কখনো জলপ্রপাতটা দেখেননি। তাই এ সুযোগটাই ভাল মনে হলো।”

পরিবারের অন্য সদস্যরাও হাফ ছেড়ে বাঁচল। “বাহু, আইডিয়াটা তো চমৎকার। এত সুন্দর একটা জায়গা, আপনার বেশ ভালো লাগবে। সিগনোরা।”

“মাত্র এক ঘণ্টার জার্নি।” মাথা নাড়ল গ্যারি। “আপনারা ভিক ফলস্ হোটেলে লাঞ্চ করে নাশতার আগেই এখানে ফিরতে পারবেন।”

“আর তারপরে চারটায় আবার চিতার খোঁজে হাইড আউটে যেতেও কষ্ট হবে না।” এমত হল শন্। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে এলসা’র সম্মতির জন্য।

আবারো চকিতে শাসা’র দিকে তাকালেন এলসা। বড় করে শ্বাস নিয়ে শাসা জানালেন, “আমরা আসলে ভিক ফলস হোটেলে দুই-একদিন বেড়াব।”

আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা এসে ভর করল তরুণ মুখগুলোতে।

“ঠিক তাই। ঘুরে দেখতে তোমাদের তো সময় লাগবে। সবার আগে সম্বিত ফিরে পেল বেলা।

“বেলা ঠিকই বলেছে। তিন থেকে চারদিন লেগে যাবে সবটুকু ঘুরে দেখতে।”

“গ্যারি সপ্তাহ লেগে যাবে বললেই তো পারো।” শনে’র দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল গ্যারি আর বেলা।

***

পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাসের মাঝে ছড়ানো ছিটানো মেঘপুঞ্জ ভেদ করে আট মাইল দূরে দেখা দিল ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। দুই হাজার ফুট উঁচুতে সোজা আকাশের বুকে উঠে যাওয়া রুপালি পর্বতমালা ঠিক তুষারের মতই সাদা দেখাচ্ছে।

সামনেই সূর্যের আলো পড়ে চমকাচ্ছে বিশাল জাম্বোজি। একটু পরেই দেখা দিল প্রধান গিরি সংকট। নিচে তাকিয়ে নদীটা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা আর এলসা। এক মাইলেরও বেশি চওড়া বড় সড় নদীটা তীব্র বেগে এসে নেমে গেছে ঝাড়া সাড়ে তিনশ ফুট নিচে। ফেনা আর ফেনা চারপাশে; ফোয়ারার মতো আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। গভীর খাদের কিনারে কালো পাথরের দুর্গ দু’ভাগ করে দিয়েছে নদী। এর উপরে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে আছে ফোয়ারার মেঘ; চট করে তাকালে রংধনুর সাত রঙ দেখা যাবে।

জলপ্রপাতের নিচে নদীর সবটুকু পানি সেকেন্ডে আটত্রিশ হাজার কিউবিক ফুট হিসেবে পাথরের চূড়া দিয়ে ধেয়ে এসে পড়ছে গিরিখাদের ভেতরে।

ডান হাতি মোড় নিয়ে এয়ারক্রাফট চালাচ্ছেন শাসা; যেন নিচের দৃশ্য পুরোটাই উপভোগ করতে পারেন এলসা।

প্রতিবার ঘূর্ণনের সাথে আরো নিচে নেমে আসছে বীচ ক্রাফট। একবার তো রুপালি পানির ফোয়ারা এয়ারক্রাফটের গায়ে এমন ভাবে আচড়ে পড়ল যে খানিকের জন্য মনে হলো দুজন অন্ধ হয়ে যাবেন; আবার উর্বকাশে সূর্যের আলোয় উঠে গিয়ে রংধনুর হার দেখতে পেলেন শাসা আর এলসা।

গ্রামের বাইরে ছোট্ট এয়ার স্ট্রিপে ল্যান্ড করলেন শাসা। ইঞ্জিন বন্ধ করে তাকালেন এলসা’র দিকে। বিস্মিত চোখ জোড়া প্রায় ধর্মীয় ভাবাবেশের মতই বিভোর হয়ে আছে। “এবারে আফ্রিকা ক্যাথেড্রালে তোমার উপাসনার পালা।” মোলায়েম গলায় জানালেন শাসা।

“এই একটামাত্র জায়গায় খুঁজে পাবে পুরো মহাদেশের সত্যিকারের রহস্য আর বিশালতা।”

***

ভাগ্য ভালো যে হোটেলে লিভিংস্টোন সুইট খালি পেয়ে গেলেন শাসা আর এলসা।

প্রাচীন আমলের নকশা মেনে তৈরি করা হয়েছে পুরো দালান। দেয়ালগুলো পুরু আর রুমগুলোও বেশ বড় বড়; একই সাথে ঠাণ্ডা আর আরামদায়য়কও বটে।

ডেভিড লিভিংস্টোনের প্রথমবার আবিষ্কারের মাত্র কিছু বছর পরেই-জলপ্রপাতটা খুঁজে পান অভিযাত্রী থমাস বেইনস; উনার আঁকা ড্রইং এর প্রিন্ট আউট দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো সুইট। সিটিং রুমের জানালা দিয়ে তাকাতেই গিরি সংকর আর উপরকার রেলওয়ে সেতু দেখা গেল। পুরো কাঠামোটা এতটা হালকা দেখাচ্ছে যে ঠিক যেন একটা উড়ন্ত ঈগলের পাখা।

সুইট থেকে বের হয়ে হাতে হাত রেখে পায়ে হাঁটা পথ ধরে দুজনে ঘুরে দেখল গিরিখাদ, রেইন ফরেস্ট পানির ফোয়ারা। নিরন্তর পানি পাওয়ায় এখানকার উদ্ভিদ প্রজাতি অত্যন্ত সবুজ। আছড়ে পড়া পানির ভার কাঁপছে পায়ের নিচের জমিন। পানির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিল দুজনের পোশাক, মাথা, চুল। আনন্দে হেসে ফেললেন শাসা আর এলসা।

একেবারে কিনারের কাছে পড়ে থাকা পাথরের উপর দু’জনে পাশাপাশি বসে গিরিখাদের উপর পা ঝুলিয়ে দিলেন; ঠিক নিচেই সবুজ রঙা ঘূর্ণি বানিয়েছে উন্মত্ত জল।

“দেখো!” আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন শাসা। সূর্যের কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা শিকারি পাখি; ছুরির ফলার মতো পাখাগুলো সোজা তীরবেগে নেমে আসছে নিচে।

“টাইটা’র বাজপাখি।” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শাসা, “আফ্রিকার সবচেয়ে রেয়ার পাখিগুলোর একটি।”

উড়ন্ত অবস্থাতেই শিকার ধরে নিল বাজপাখি, পালক ছড়িয়ে সাথে সাথে মেরেও ফেলল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল বহু নিচে।

কুমিরের লেজের স্টেক দিয়ে ডিনার সারলেও স্বাদটা মনে হলো লবসটারের মতোই। কিন্তু স্যুইটে ঢুকতেই রাজ্যের লজ্জা এসে ঘিরে ধরল দু’জনকে। সিটিং রুমে বসে ক্যানাকে খেলেন শাসা। অবশেষে সাহস করে বেডরুমে ঢুকতেই দেখতে পেলেন বালিশের উপর শুয়ে থাকা এলসা। চকচকে কালো চুল ছড়িয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে; কিন্তু হঠাৎ কেন যেন আতঙ্কে জমে গেলেন শাসা। শেষ বার দুয়েকের ঘটনাতে আত্মবিশ্বাসের অনেকখানিই টলে গেছে। আর বয়সও তো কম হল না।

অন্যদিকে হেসে ফেললেন এলসা। হাত দুটো তুলে আমন্ত্রণ জানালেন শাসা’কে। মনে মনে নিজেকে সামলালেন শাসা। চিন্তার কিছু নেই; এমনভাবে আর কোনো নারীকে দেখে এত আকর্ষণ বোধ করেননি আগে।

সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গার পরে পরস্পরকে একে অন্যের বাহুতে আবিষ্কার করলেন দুজনে। ততক্ষণে উঁচু জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে রোদ।

আত্মতৃপ্তিতে হেসে ফেললেন এলসা : “মাই ম্যান।”

***

একদিন পার হয়ে গেলেও শেষ হলো না তাদের হানিমুন। গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল দিনের পর দিন। ছোট ছোট তুচ্ছ কাজগুলোও দুজনে মিলে একত্রে করে ফেলেন। এতদিন যেগুলো নিয়ে শাসা কোন চিন্তাই করতেন না। কিংবা সময়ও পেতেন না।

প্রতিদিনি দেরি করে ঘুম থেকে উঠেও বাকি সময়টা পুলের পাশে বসেই কাটিয়ে দেন শাসা আর এলসা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরস্পরের সান্নিধ্যে বসে বই পড়ে পার করে দেন আর সান ট্যান অয়েল লাগাবার অযুহাতে স্পর্শ করেন একে অন্যের দেহ।

এলসা’র পরিপূর্ণ নারী দেহে খুঁত বলতে শুধু সন্তান ধারণের চিহ্নগুলোই ফুটে আছে। কিন্তু এতে আরো বেশি করে আকৃষ্ট হন শাসা। ফুটে উঠেছে তার অভিজ্ঞতা আর জীবনবোধের নিদর্শন।

কথা বলার সময়ে যা আরো বেশি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। গল্প করতে করতে কোথা দিয়ে যে অলস সময় ফুরিয়ে যায় কেউই টের পান না।

ব্রুনোর ক্যানসারে মৃত্যু আর তাঁর নিজের অসহায়তার কথা বলে যান এলসা। এরপর কেটে গেছে সাতটি বছর। ভেবেছিলেন সেই একাকীত্ব বুঝি আর কখনোই পূরণ হবে না; এরপর শাসা’র হাত ধরে বুঝিয়ে দেন যে, এবারে তিনি হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছেন।

ছেলেমেয়েদের কথা জানিয়ে ছেলের ব্যাপারেও আপেক্ষ করেন পিতার মতো পরাক্রশালী হয়নি ব্রুনেনা।

নিজ পুত্রদের কথা স্মরণ করেন শাসা। দু’জনেই ভালবাসেন গান, বই আর থিয়েটার। দু’জনেরই আছে ঘোড়া আর শিকার প্রীতি। সবশেষে একে অন্যের কাছে স্বীকার করেছেন অর্থ আর ক্ষমতার প্রতি পরস্পরের দুবর্লতা।

কোনো কিছুই বাদ না দিয়ে এক পর্যায়ে তো এলসা বলেই ফেললেন যে, “আমার মনে হচ্ছে তুমি আর আমি মিলে চমৎকার একটা জুটি হবো।”

“আমিও তাই বিশ্বাস করি” গভীরভাবে বলে উঠলেন শাসা; যেন পরস্পরের কাছে প্রতিজ্ঞা করছেন।

“ওহ, ঈশ্বর!” সত্যিকার অর্থেই অবাক হয়ে গেছেন শাসা, “আজ বৃহস্পতিবার। চারদিন কেটে গেছে যে আমরা এখানে। বাচ্চারা নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়ে গেছে।” খোলা ছাদে বসে নাশতা করছেন দু’জনে।

“আমার মনে হয় ওরা অনুমান করে নিয়েছে। শাসা’র জন্য আমের টুকরো কাটতে গিয়ে চোখ তুলে তাকালেন এলসা। হাসলেন।” আর আমার তো মনে হয় তোমার ভয়ংকর ছেলে-মেয়েগুলোকে বাচ্চা বলারও কিছু নেই।”

“ভ্যান উইক কালকেই চিজোরো’তে পৌঁছে যাবেন।” মনে করিয়ে দিলেন শাসা।

“জানি।” বড় করে শ্বাস টানলেন এলসা, “কিছুতেই যেতে মন টানছে না; তারপরেও উনার সাথে দেখা করতে হবে।”

***

স্যার ক্লারেন্স ভ্যান উইক একজন খাঁটি আফ্রিকান। ব্রিটিশ রাজত্বের অংশ থাকাকালীন তাঁর চিফ জাস্টিস বাবা পেয়েছিলেন এই টাইটেল আর উত্তরাধিকার সূত্রে তা বর্তেছে ভ্যান উইকের উপর।

স্যার ক্লারেন্স উটন আর স্যান্ডহার্সের ছাত্র’ও ছিলেন। ইয়ান স্মিথ সরকারের মন্ত্রী হলেন স্যার ক্লারেন্স।

চিজোরা’তে যাবার পথে সালিসব্যুরো থেমে এই মিটিং-এর আয়োজন করেছেন শাসা আর গ্যারি। আলোচনা ছাড়াও শিকারি স্যার ক্লারেন্সের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছে।

রোডেশিয়ান এয়ারফোর্স হেলিকপ্টারে চড়ে চিজোরা’তে পৌঁছেছিলেন স্যার ক্লারেন্স। সাথে আরো দু’জন সহকারী আর এক জোড়া বডিগার্ড। শন’কে আগে থেকেই খবর দিয়ে রাখার সালিসবুয়ো থেকে বাড়তি স্টাফ, রসদ আর ইকুপমেন্ট নিয়ে আসা কোনো সমস্যাই হলো না।

মাসালা গাছের নিচে বড় কনফারেন্স টেবিল পেতে দিয়ে স্যার ক্লারেন্স আর তার দলের জন্যে বাড়তি চেয়ারও আনা হলো। বাবার পার্সোনাল অ্যাসিসট্যনান্ট হিসেবে যোগ দিল ইসাবেলা।

ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার স্যার ক্লারেন্স শাসা কিংবা শনের চেয়েও লম্বা। তার রাজনৈতিক আর আর্থিক মেধার পাশাপাশি নারী প্রীতিও সকলেরই জানা।

মাসালা গাছের নিচে বসে দেশের সম্পদ, উৎপাদন, কমিশন আর হ্যান্ডলিং ফিস্ নিয়ে আলোচনা করলেন সকলে।

রোডেশিয়া’র খনিজাত দ্রব্য, তামাক, আর ক্রোমের মতো দুর্লভ পদার্থ বিশ্ব বাজারে ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে গ্যারি কোর্টনি আর কোর্টনি এন্টারপ্রাইজেস। মূলত রোডেশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে একেবারেই কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। এক্ষেত্রে আরো সাহায্য করছে ডারবান আর কেপ টাউন পর্যন্ত চলে যাওয়া রেলপথ।

এবারে এর সাথে যুক্ত হলো আরো নতুন সব উচ্চাকাক্ষা। পিগনাটেলি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাজকর্ম খুব সাবধানে পরীক্ষা করার পর এই এন্টি সাংশনস অ্যাকটিভিটিজে যোগ দেবার জন্য এলসা পিগনাটেলি’কে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাক্যের পর পিগটেলি ইন্ডাস্ট্রিজ হলো ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম টোবাকো কোম্পানি। এছাড়াও টারান্টো আর কানাডাতেও খনি আর স্টেইনলেস স্টিল মিল আছে।

ফলে রোডেশিয়া’র পণ্যের জন্য এ বাজার অত্যন্ত লাভজনক হলেও দর কষাকষি থামছে না।

অত্যন্ত সভ্য আর বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হলেও কেউই নিজেদের এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও রাজি নয়। বিস্মিত হয়ে গেল বেলা।

সুন্দরী এলসা পিগনাটেলি ভালভাবেই জানেন কিভাবে নিজের সৌন্দর্য কাজে লাগাতে হয়।

স্যার ক্লারেন্স অত্যন্ত ভদ্র হলেও প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব করছেন নিখুঁত তালে।

অন্যদিকে টেবিলে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে দরকষাকষির পুরো দায়িত্ব গ্যারির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন শাসা। যাই হোক মাঝে মাঝে আবার মন্তব্য করে সাহায্য করছেন খেই হারিয়ে ফেলা আলোচনাকে পথভ্রষ্ট হবার হাত থেকে বাঁচাতে।

আলোচনাকৃত অর্থের পরিণাম শুনে বেলা’র দম বন্ধ হবার যোগাড়। তিন বিলিয়ন ওভারস থেকে আড়াই পারসেন্ট শেয়ার পাবে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই আগামী বারো মাসে ভরে উঠবে তাদের ডালা। শ্রদ্ধা মেশানো দৃষ্টি নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল বেলা।

আলোচনা শেষে লাঞ্চটাও হলো বেশ জমকালো আর অত্যন্ত উপাদেয়। অ্যালোয়েট হেলিকপ্টারে করে স্যার ক্লারেন্স উকৃষ্ট রোডেশিয়ান বীফও নিয়ে এসেছেন। পুরো সকাল জুড়েই বার-বি-কিউ নিয়ে ব্যস্ত ছিল শন আর তার শেফ।

খাবার টেবিলেও ইসাবেলার প্রতি নিজের আকর্ষণ নিয়ে কোনোই রাখ ঢাক করলেন না স্যার ক্লারেন্স। অন্যদিকে এমন একজন মানুষের মনোযোগ পেয়ে ইসাবেলাও খুশি। পছন্দ করে ফেলল স্যার ক্লায়েন্সের ঢেউ খেলানো ঘন কালো চুল, চোখ আর বুদ্ধিমানের মতো রসিকতা করার ক্ষমতা।

চোখ নামিয়ে স্যার ক্লারেন্সের পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল বেলা। মাথা খারাপের মতো হলেও মনের মাঝে উঁকি দিয়ে গেল নানা সম্ভাবনা।

প্রায় সাথে সাথে মনে পড়ে গেল ন্যানীর সতর্কবাণী।

“কোর্টনিদের রক্ত বেজায় গরম। তোমাকে তাই সাবধানে থাকতে হবে মিসি আর ভুলে যেও না যে তুমি একজন নারী।”

বেলা জানে যে স্যার ক্লারেন্স বিবাহিত; কিন্তু বহুদিন হয়ে গেল, সে নিজেও কোনো পুরুষের বুকে মাথা রেখে শোয়নি। সুতরাং দেখা যাক!

লাঞ্চ শেষ করে আবারো কনফারেন্স টেবিলে ফিরে এলেন সবাই। আর বেলা’র কাছে মনে হল ডম পেরিগনন তাদেরকে মাতাল করে দেবার পরিবর্তে আরো বেশি করে চাঙ্গা করে দিয়েছে।

ঠিক চারটায় ঘড়ির দিকে তাকাল গ্যারি। “সবকিছু তাহলে আগামীকাল সকালের জন্য মুলতবি করা যাক।”

গোলগলা ঘুঘু মারার জন্য সকলে মিলে ট্রাকে করে পুলের কাছে চলে এলো।

সামনের ট্রাকে ইসাবেলার পাশে উঠে বসলেন স্যার ক্লারেন্স। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে নেমে দ্বিতীয় ট্রাকে গ্যারি’র পাশে গিয়ে উঠে বসল বেলা। স্যার ক্ল্যারেন্স’কে নিয়ে না হয় একটু খেলা করেই দেখা যাক না কী হয়! অন্যদিকে উচ্ছ্বাস ঝড়ে পড়ছে, গ্যারির কণ্ঠে। বোনের কাঁধের উপর এক হাত তুলে দিয়ে বলে উঠল,

“গড আই লাভ ইট। নিষেধাজ্ঞা আরোপের জাতিসংঘের এই আহাম্মকি সিদ্ধান্ত বেশ রোমান্টিক তাই না। নিজেকে যেন ক্যাপ্টেন ব্লাড মনে হচ্ছে। ইয়ো হো হো অ্যান্ড আ বোতল, অব রাম। দেশপ্রেমের সাথে সাথে পকেটে ঢুকে যাবে। পচাত্তর মিলিয়ন পাউন্ডস হার্ড ক্যাশ, ট্যাক্সম্যানেরা যার খোঁজও পাবে না। বেশ মজা না?”

হেসে ফেলল বেলা, “তুমি আর কত ধনী হতে চাও?”

এবারে হাত সরিয়ে নিল গ্যারি, “তুমি কি বলতে চাও যে আমি অর্থ লোলুপ? সেটা না বেলা, আমি শুধু এই মহান খেলার একজন খেলুড়ে। পুরস্কারের জন্যে খেলছি না, জেতার আনন্দেই খেলছি। জীবনের অনেকটা সময়েই কেবল ব্যর্থতা পেয়েছি। এখন আমাকে জিততেই হবে।”

“তাই তো” এবারে বেলাও বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠল,

“তুমি সম্পদ নিয়ে খেলছ আর হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হবে তোমার ইগো সামলাতে।”

“যদি আমি জিতে যাই; তাহলে ওরাও জিতে যাবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীগণ নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য সাধারণ মানুষকে অনাহার আর অভাবের দিকে ঠেলে দেন। তাই আমার মতে, এটা হল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ওদের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়ে আমি দুঃস্থদের হয়েই লড়াই করছি।”

“ওহ, গ্যারি নিজেকে হোয়াইট নাইট ভেব না প্লিজ-”

“অবশ্যই, আমি তাই-না।” বেলা’কে থামিয়ে দিল গ্যারি। আমি হচ্ছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার হোয়াইট নাইট, বুঝলে? দক্ষিণ আফ্রিকার উভয় সংকট কাটাবার একমাত্র উপায় হলো জনগণের অবস্থার উন্নতি সাধন বিশেষত শিক্ষা আর সম্পদ প্রাপ্তি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, প্রথা নয় বরঞ্চ মেধার জোরে গড়ে তুলতে হবে সমাজ। কৃষাঙ্গদেরকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করতে হবে। এমন একটি সমাজ যেখানে সবাই তার প্রাপ্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেই মতো অর্জন করবে-এটাই হলো পুঁজিবাদী।”

“গ্যারি, তোমাকে তো কখনো এভাবে আর কথা বলতে শুনিনি।”

“লিবারেল কিংবা ক্যাপিটালিস্ট নই। বর্ণবাদ একটা প্রাগৈতিহাসিক সামন্ত ব্যবস্থা। যে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরাপকারীদের চেয়েও এটাকে আমিই বেশি ঘৃণা করি। মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল পুঁজিবাদ। শ্রম আর পণ্যের অবাধ বাজার হরণকারীকে পছন্দ করে না পুঁজিবাদ। তাই সুযোগ পেলে বর্ণবাদেকেও ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে মানতে চান না নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীদের দল। তাদের উত্তম অভিপ্রায়ের পন্থা হলো ভুল।”

হা করে তাকিয়ে রইল বেলা, “এভাবে তো কখনো ভাবিনি।”

“দারিদ্রতাই দমননীতি তৈরি করে। গরিবদেরকে দমিয়ে রাখা সহজ। কিন্তু একজন শিক্ষিত আর সমৃদ্ধিশালী কাউকে চিরতরে দমিয়ে রাখা অসম্ভব।”

“তার মানে তুমি রাজনৈতিকভাবে নয় বরঞ্চ অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বলছ?”

“ঠিক তাই।” মাথা নেড়ে হা হা করে হেসে উঠল গ্যারি।

“আর বছরে পচাত্তর মিলিয়ন পাউন্ড কামিয়ে আমি তার উদাহরণও সেট করে দেব।”

শনের পিছু পিছু ট্রাক নিয়ে পুলের কাছে চলে এলো গ্যারি।

দুই মাইল দূরের নদীর পরিষ্কার পানি অসম্ভব পছন্দ করে ঘুঘু পাখি। সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে তাই বাতাসে ধূসর নীল ধোয়ার মতো করে ঝাঁকে ঝকে ধেয়ে আসে এদিকে।

পানি থেকে পাঁচ কিংবা ছয়শ মিটার দূরে বন্দুক রেডি করল শন্। কিন্তু পাখিগুলোকে ভড়কে দিতেও চায় না। তার বদলে চায় পাখিগুলো যেন নির্বিঘ্নে পানি খেতে নদীতে এগিয়ে যায়।

জোড়ায় জোড়ায় সেট করা হল বন্দুক। আশা করা যায় প্রতিটি বন্দুক পঞ্চাশটা করে পাখি মারতে পারবে; তবে কেবল ফ্লাইং ডাভস।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে শাসা’র সাথে জোড়া বাধলেন এলসা; আকাশ বাতাস ছাপিয়ে শোনা গেল একে অন্যকে উৎসাহ দেয়ার চিৎকার; “বেলো! মন্টো বেলো!”

“জলি গুড শট! ওয়েল ডান!”

গ্যারি আর শন একসাথে পশ্চিমে পড়ে থাকা লম্বা কাঠের আঁড়ালে চলে গেল। একবার শন্ মিস্ করাতে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে হেসে ফেলল গ্যারি; নিয়ে এলো বেঁচে যাওয়া পালক ছেঁড়া পাখিটাকে। মাথার চুল ঝাঁকিয়ে গ্যারিকে অগ্রাহ্য করতে চাইল শন; কিন্তু ক্রোধে কালো হয়ে গেল মুখ।

বাকিদের কাছ থেকে দূরে দক্ষিণ দিকে স্যার ক্লারেন্সের সাথে এলো ইসাবেলা। গুলি ছুঁড়তে ব্যবহার করছে বাবার দেয়া বিশ গজ হল্যান্ড এন্ড হল্যান্ড। কিন্তু প্রায় এক বছর যাবৎ প্র্যাকটিস না থাকাতে তেমন সুবিধে করতে পারছে না।

পর পর তিনটা পাখি মিস করে একটাতে গুলি লাগাতে পারল বেলা; কিন্তু নিজের উপরই বিরক্তি লাগল, আহত পাখি একদম সইতে পারে না, “ধুত্তোরি!”

জোড়া পাখি মেরে বেলার দিকে এগিয়ে এলেন স্যার ক্লারেন্স। “বলছি কি, তোমাকে যদি কয়েকটা টিপস্ দেই, তাহলে কিছু মনে করবে?”

বেলা হাসি দিতেই ওর পেছনে চলে এলেন স্যার ক্লারেন্স। “ডান হাত দিয়ে বন্দুক ধরতে হবে।” বেলা’কে প্রায় জড়িয়ে ধরে হাত দুটো নিজের বিশাল মুঠিতে নিয়ে নিলেন স্যার ক্লারেন্স। “কিন্তু মনে রাখবে সব কাজ করবে বাম হাত। ডান হাত শুধু ট্রিগার টিপবে।”

বেলা’র কাঁধে বন্দুক তুলে দিলেন, “মাথা তোল। দুই চোখ মেলে তাকাও। পাখিটাকে দেখো, বন্দুক নয়।”

আফটার শেভ লোশন’ও ঢাকতে পারেনি স্যার ক্লারেন্সের পুরুষালি গন্ধ।

“ওহ, তাই নাকি?” আস্তে করে নিজের পেছন দিক আন্দোলিত করে তুলল বেলা।

“ঠিক তাই।” ভারী কণ্ঠে উত্তর দিলেন স্যার ক্লারেন্স, “এই তো তুমি বুঝতে পেরেছ।”

“ওহ, ঈশ্বর আমাকে বাঁচাও!” মনে মনে নানা’র মতো স্বগতোক্তি করে উঠল বেলা। “থাক আজকের জন্য যথেষ্ট।” আস্তে করে স্যার ক্লারেন্সের বাহুজোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল বেলা।

“আমি একবার চেষ্টা করে দেখি” বলেই এত পরিষ্কারভাবে গুলি ছুড়ল যে ঘুঘুটা ডানা ঝাঁপটানোর সময়টাও পেল না।

“ইউ আর ন্যাচারাল” বিড়বিড় করে উঠলেন স্যার ক্লারেন্স; হাসি চাপতে চট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল বেলা।

“তোমার ভাইদের কাছে শুনেছি তুমি নাকি ঘোড়া চালাতেও ওস্তাদ।” বেলা’র পিছ নিলেন স্যার ক্লারেন্স। “কয়েকদিন আগেই একটা অসাধারণ আরবীয় স্ট্যালিয়ন কিনেছি। আফ্রিকাতে আর দ্বিতীয়টা আছে কিনা সন্দেহ। তোমাকে খুব দেখাতে ইচ্ছে করছে।”

“ওহ?” তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না বেলা; শর্ট গান লোড করতে বেশি ব্যস্ত, “কোথায় আছে?”

“রুসাপে’তে আমার র‍্যাঞ্চে। কাল বিকেলে ফেরার সময় চাইলে অ্যালোয়েট আমাদেরকে ওখানে নামিয়ে দেবে।”

“হয়ত ভালই লাগবে” একমত হলো বেলা।” আপনার স্ত্রীর সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”

একটুও অপ্রস্তুত হলেন না স্যার ক্ল্যারেন্স, “ধূর, আমার স্ত্রী’তো এখন ইউরোপে বেড়াচ্ছে। এবার হেসে ফেলল বেলা।

“আমাকে একটু ভাবতে হবে স্যার ক্লারেন্স।”

এবারে হেসে ফেললেন স্যার ক্লারেন্সে, “ওখানে এমন কিছু নেই যা তুমি হ্যাঁন্ডেল করতে পারবে না, মাই ডিয়ার।”

ওদিকে ঝড়ের মতো চিন্তা করে চলেছে বেলা। মনে মনে ভাবছে। অ্যান্টিসাংশন স্ট্র্যাটেজিসহ রোডেশিয়ার সম্পূর্ণ কাহিনী জানতে পারলে না জানি কি পুরস্কার দেবে তার রহস্যময় প্রভু। “কর্তবের খাতিরে সবকিছুই সই।” নিজেকে আশ্বস্ত করল বেলা।

“ব্যাগ ভরে গেছে।” চিৎকার করে এলসা’কে জানালেন শাসা। শটগান গুটিয়ে নিয়ে নিলেন হাতের মাঝে। কৃষাঙ্গ দুই শিশুকে ডেকে আদেশ দিলেন এলসা, “পাকামাইসা! দুটোকে তুলে নাও!”

শেষ দুটো পাখিকে তুলে আনার জন্য দৌড় লাগাল ছেলেরা। পার্ক করে রাখা ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেলেন শাসা আর এলসা। ইতিমধ্যে গাছের মাথায় নেমে এসেছে সূর্য।

“অলরাইট” হঠাৎ করেই যেন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এমন ভাবে বলে উঠলেন এলসা,

“মাফ করো-” অবাক হয়ে গেলেন শাসা, “কী হয়েছে?”

“আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি।” ঘোষণা করলেন এলসা, “ শতসাপেক্ষে তোমাকে সিনডেক্স ২৫-এর ফর্মুলা আর প্ল্যান্টের ব্লু-প্রিন্ট দেয়া হবে।”

আস্তে করে শ্বাস ফেললেন শাসা, “আমি তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার জন্য সবটুকু চেষ্টা করবো।”

সন্ধ্যাবেলা বাকি সদস্যদের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্যাম্প-ফায়ারের পাশে এলে বসেছেন শাসা আর এলসা। নিজের শর্তগুলো জানিয়ে দিলেন সিগনোরা।

“ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী কিংবা অফিস উনার প্রত্যক্ষ কর্মকর্তা ব্যতীত কেউ সিনডেক্স ব্যবহার করতে পারবে না।”

চারপাশে তাকিয়ে কেউ আড়ি পাতছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিলেন শাসা। “আমি তোমার নামে শপথ করে বলছি, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সম্মতিপত্র নেয়া হবে।”

“এবারে আসা যাক ব্যবহার নীতির ক্ষেত্রে, সিনডেক্স কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো জনগণের উপর ব্যবহার করা যাবে না।” খুব সাবধানে বলে চললেন এলসা, “অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিংবা গৃহযুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি ভবিষ্যতেও কোনো গৃহযুদ্ধ অথবা ঠেকানোর জন্য কোনো আন্দোলনের উপরেও ব্যবহার করা যাবে না।”

“আমি রাজি।”

“তবে হ্যাঁ, বিদেশি কোনো সামরিক বাহিনীকে পর্যদুস্ত করার জন্য চাইলে ব্যবহার করা যাবে; তখনই যখন প্রথাগত অস্ত্র দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে।”

“আমিও একমত।”

“আরেকটা শর্ত আছেএকটু বেশিই ব্যক্তিগত।”

“বলো।”

“লুজানে’তে তুমি নিজে এসে সবকিছু ঠিক করে যাবে।”

“তাহলে তো আমার চেয়ে বেশি খুশি আর আর কেউ হবে না।”

সাফারিতে আজকেই শেষ সকাল। লাগেজ প্যাক করে চিজোরা ছাড়ার জন্য সকলেই প্রস্তুত। নিজ নিজ তাঁবুর বাইরে তৃপ হয়ে পড়ে থাকা লাগেজগুলো একটু পরে ক্যাম্প স্টাফেরা এসে নিয়ে যাবে।

ব্যবসা শেষ; চুক্তিগুলোও সাইন করা হয়ে গেছে। এলসা গিগনাটেলি রোডেশিয়ান তামাক আর ক্রোমের মার্কেটিভের ব্যাপারে সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। অন্যদিকে শিপিং আর ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা বন্দরে পণ্য খালাসের দায়িত্ব নিয়েছে গ্যারি।

পুরো দলটাকেই স্যালিসব্যরিতে পৌঁছে দেবে রোডেশিয়ান এয়ারফোর্স হেলিকপ্টার। কিন্তু ত্রিশ মিনিট আগেই ক্যাম্পের কাছে নামার কথা থাকলেও এখনো আসেনি হেলিকপ্টার। সবাই তাই খানিটা চিন্তিত।

পিমস্ নাম্বার ওয়ানে চুমুক দিতে দিতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে ক্যাম্প ফায়ারের কাছে।

একসাথে দাঁড়িয়ে আছে বেলা আর শন

“তুমি কেপ টাউনে আসবে না?” বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করল বেলা।

“এই সিজনের শেষে চেষ্টা করবো, যদি তুমি আমার জন্যে সুন্দরী নারী লাইন বসাতে রাজি থাকো। “তোমারও সাহায্য লাগে?” ভাইয়ের সাথে মজা করল বেলা। হেসে ফেলল শন্।

“দেখো আমি তো বাবার মতো খারাপ নই। বিধবাটার সাথে এখন ইউরোপে দৌড় দেবে।”

দু’জনেই তাকাল শাসা আর এলসা’র দিকে।

বাবা’র পক্ষ নিয়ে বলতে চাইল বেলা, ড্যাডি তো এখনো বেশ আকর্ষণীয়-”

“থামো, বেলা।” বোনের হাতে চাপ দিল শন। “স্যার ক্লারেন্সের কথা ভাবো। লোকে তাকে এমনি এমনি ক্যান্টরিং ক্লারেন্স মানে ঘোড়া দৌড়ানো ক্ল্যারেন্স ডাকে না!”

মনে হলো নিজের নামের খ্যাতি অটুট রাখতে বদ্ধপরিকর স্যার ক্লারেন্স। হঠাৎ করেই ছুটে এসে বেলাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।

“অন্যদেরকে স্যালিসব্যুরিতে নামিয়ে দেব।” বেলা’র কাছে ঝুঁকে বিড়বিড় করে জানালেন স্যার ক্লারেন্স। “তারপর হেলিকপ্টার আমাদেরকে র‍্যাঞ্চে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে?”

“হুম ঠিক আছে।” মিষ্টি স্বরে রাজি হয়ে গেল বেলা, “পাপা কিংবা লেডি ভান উইক না থাকলেই বেশি মজা হবে।”

“ঠিক তাই।” একমত হলেন স্যার ক্লারেন্স; আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। শ’নের তাঁবুতে কর্কশ শব্দে বেজে উঠল রেডিও।

দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল শন্।

“টাগবোট, দিস ইজ বিগ ফুট, গো এহেড।”

“বিগ ফুট, আমাদের প্ল্যান খানিকটা চেঞ্জ হয়েছে। প্লিজ মিনিস্টারকে জানিয়ে দিন যে হেলিকপ্টার নিয়ে অপারেশনে যেতে হবে। মোল মিনিটের মাঝে অন্য হেলিকপ্টার পৌঁছে যাবে। আমার কপ্টারে দশ জন স্কাউট আছে। ওভার।”

“রজার টাগবোট। আমরা পিক আপের জন্যে তৈরি থাকবো।”

“যুদ্ধ যে এত বাজে!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্যার ক্লারেন্স। রেডিও’র আলাপচারিতা সবকিছুই সকলে শুনতে পেয়েছে। “আরেকটা চপার না আসা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকতে হবে।”

“কী হয়েছে?” জানতে চাইল বেলা।

“সন্ত্রাসী হামলা।” ব্যাখা করলেন স্যার ক্লারেন্স। “সম্ভবত শ্বেতাঙ্গদের কোনো খামারে আক্রমণ হয়েছে। ওদের পিছু ধাওয়া করছে হেলিকপ্টার। এসব বেজন্মাদের তো এমনিই ছেড়ে দেয়া যায় না-কৃষকদের মনোবল ঠিক রাখতে হবে।”

রোডেশিয়ান এয়ারফোর্সে মিলিটারি হেলিকপ্টারের কমতি’র কথা না বলে কাঁধ ঝাঁকালেন স্যার ক্লারেন্স।

“মনে হচ্ছে ভাগ্যও আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।”

“হয়ত তাহলে আমাদের ট্রিপটাকেও স্থগিত-” তাবু থেকে শনকে বেরোতে দেখেই থেমে গেল বেলা। হালকা পারস্যুট হার্নেশ পরে আছে শ ক্যানভাসের পকেটে অ্যাম্বুনিশন গ্রেনেড আর পানির বোতল রাখার জায়গা আছে। এক কাঁধে ঝুলছে এফ এন রাইফেল। চিৎকার করে উঠল শন “মাতাতু, গণ্ডারের চামড়া জলদি, এখানে আয়। এবারে আমাদের সত্যিকারের কাজ পেয়েছি। বদমাইশগুলোর পিছু নিতে হবে।”

মুখে একরাশ হাসি নিয়ে হাজির হয়ে গেল জোয়োবো ট্র্যাকার। “আজ রাতে ক্যাম্প ফায়ারে কয়েকটা জানালার (ZANLA) রোস্ট খাওয়া যাবে।”

“তুমি তো খালি সে মজাতেই আছে। শয়তানের বাচ্চা, হাসতে হাসতে অন্যদের দিকে তাকাল শন।

“সরি, গাইজ। সালিসব্যুরিতে ফেরার রাস্তা তোমাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে। আমি আর মাতা প্রেম করতে যাচ্ছি।” এবারে গ্যারির উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “তুমি ওদেরকে বীচক্রাফটে করে নিয়ে যাও। লাগেজ থাকাতে কয়েকবার যাওয়া আসা করতে হবে। কিন্তু হেলিকপ্টারের আশায় বসে থাকার চেয়ে তো সেটাই ভালো। কান পেতে কি যেন শুনল শন্।” ওই তো আসছে।”

খুব দ্রুত গিয়ে সকলের সাথে হাত মেলালো শন।

“আগামী সিজনে আবার আপনার সাথে দেখা হবে। সিগনোরা? পরের বার, প্রমিজ করছি এত বড় একটা চিতা…”

“ডিয়ার ড্যাড। ঝামেলা থেকে দূরে…” এবারে এলসা পিগটেলিকে ইশারা করে বাবাকে বলে উঠল শন।

“বাই, লিটল সিস্টার” ইসাবেলাকে বিদায় জানাতে গেল শন; কিন্তু ভাইকে আঁকড়ে ধরে বেলা,

“সাবধানে থেকো শন। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।”

বোনকে জড়িয়ে ধরে এসব অনর্থক কথা শুনে যেন হাসল শন্। “স্যার ক্লারেন্সের কাছ থেকে আসা ইনকামিং ফায়ারের জন্য তুমিই বরঞ্চ বেশি বিপদে আছে।” মিটমিটিয়ে হাসল শন্।

আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই গাছের উপরে কালো পোকার মতো দেখা গেল হেলিকপ্টার।

ছোট ভাইয়ের সাথে হাত মেলালো শন্। “ধুত্তোরি গ্যারি, কে চায় তোমার চাকরি-যখন আমি এসব করতে পারি?”

ইসাবেলার গলা ধরে এলো। তার লম্বা চাওড়া বীরের মতো ভাই ছোট খাটো মাতাতুর কাঁধে এমনভাবে হাত রাখল যেন এই দুই শিকারি যোদ্ধার মাঝে ভরসা নামক বিশেষ একটা সম্পর্ক আছে।

ধুলার মেঘ উড়িয়ে আকাশে উঠে গেল হেলিকপ্টার। চলে গেল দক্ষিণ পশ্চিমে।

***

হেলিকপ্টারের মেইন কেবিনে পাশাপাশি বসে আছে দশজন স্কাউট। সবারই কাছে ভারী সব অ্যামুনিশন, ওয়াটার বোটল, গ্রেনেড।

সকলেই জানে যে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষাঙ্গ যখন কমরেড হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে তখনই ফুটে উঠে মানুষ হিসেবে আসল সৌন্দর্য। যোদ্ধা হিসেবেও একে অন্যের দক্ষতা দেখাতে তখন মরিয়া হয়ে উঠে সবাই।

ব্যালান্টাইন স্কাউটেরা রোডেশিয়ার সবচেয়ে উত্তম ফাইটিং ফোর্স হলেও কথাটা স্বীকার করতে চায় না স্পেশাল এয়ার সার্ভিস, সেলাস স্কাউট কিংবা রোডেশিয়ান রেজিমেন্ট।

কেবিনে উঠে সকলকে দেখেই চিনতে পারল শন; নাম ধরে ধরে ওদের খোঁজ খবর নিল। শ্রদ্ধাভরে উত্তর দিল স্কাউটের দল। স্কাউটদের মাঝে শন আর মাতাতু এমনিতেই বেশ বিখ্যাত। তার উপরে আবার তরুণ সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে শন্ আর মাতুত।

স্কাউটদের প্রতিষ্ঠাতা আর কমান্ডিং কর্নেল রোলান্ড ব্যালানটাইন শনকে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বানাবার জন্যে বহু চাল চেলেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। তাই যে কোনো প্রয়োজনেই দুজনকে ডেকে পাঠাতে দ্বিধা করেন না।

কর্নেলের পাশে ধপ করে বসে পড়ল শন। সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে মুখে ক্যামোফ্লেজ ক্রীম ঘষতে ঘষতে চিৎকার করে উঠল, “গ্রিটিংস, স্কীপার। এবারে কী করেছে শয়তানগুলো?”

“গতকাল সন্ধ্যার দিকে কারোই’র একটা তামাক খামারে ঢুকে পড়েছে বদমাইশের দল। গেইটের কাছে কৃষককে আটকে ফেলে গুলি করে। ঠিক সেই সময় খামারির স্ত্রী আবার বারান্দায় এসেছিল স্বামীকে অভর্থনা জানানোর জন্য। তবে মহিলা একাই সারা রাত ওদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছে- এমনকি রকেট ফায়ার ছোঁড়া হলেও ভয় পায়নি। সাহস বটে! মাঝরাতের খানিক পরে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে এসেছে।”

“কত জন?”

“বিশজনের বেশি।”

“কোন দিকে?”।

“উপত্যকার উত্তরে।”

“যোগাযোগ?”

“এখনো না।” মাথা নাড়লেন রোল্যান্ড। ক্যামো ক্রিম মাখা সত্ত্বেও ঢাকতে পারেননি উজ্জ্বল আর সুদর্শন দেহসৌষ্ঠব। শনের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় কর্নেল বুশ ওয়ার শুরুর কিছুদিনের মাঝেই সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত হয়ে গেছেন।

“লোকাল ইউনিট অনুসরণের চেষ্টা করলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে এগোতে পারছে না।”

“বোমা ফাটিয়ে শয়তানগুলো নিশ্চয় স্থানীয় কৃষাঙ্গদের মাঝে মিশে যেতে চাইবে, ট্রাইবাল ট্রাস্ট এরিয়াই এক্ষেত্রে ওদের লক্ষ্য হবে। আমাদেরকে ফলোআপ ইউনিটের কাছে নিয়ে চলো স্পিকার।” ভবিষ্যৎবাণী করে উঠল শন।

“হুম, যে কোনো মুহূর্তেই রেডিওতে আপডেট পাবো-” ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সত্যি সত্যি রেডিও হ্যান্ডসেট নিয়ে হাজির হলো, “কাম অন।” সেফটি বেল্ট খুলে বেঞ্চের ফাঁকে চলে গেলেন কর্নেল। শন নিজেও তার পিছু নিয়ে কান পেতে শুনতে চাইল মাইক্রোফোনের আলাপচারিতা। “বুশ বা দিস্ ইজ স্ট্রাইকার ওয়ান।” মাউথপিসে কথা বলছেন রোল্যান্ড।

“কোনো যোগাযোগ হয়েছে?”

“স্ট্রাইকার ওয়ান, নেগেটিভ। আবার বলছি নেগেটিভ।”

“কোনো পদচিহ্ন খুঁজে পেয়েছ বুশ-বাক?”

“অ্যাফারমেটিভ; কিন্তু অতর্কিত আক্রমণ করা হচ্ছে বারবার। তার মানে সন্ত্রাসী দলটা পিছু ধাওয়াকারীদেরকে সরিয়ে দিতে চাইছে। “রজার, বুশ বাক, আমাদের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা মাত্রই হলুদ ধোঁয়া ছাড়বে।”

“কনফার্ম ইয়েলো স্মোক, স্ট্রাইকার ওয়ান।“

পয়তাল্লিশ মিনিট পরেই জঙ্গলের ঘন সবুজ ছাদের উপর ক্যানারি হলুদ ধোয়ার সিগন্যাল দেখতে পেল পাইলট। গাছের উপর গিয়ে পুলিশ ইউনিটকে খুঁজতে লাগল হেলিকপ্টার। এক নজর দেখেই বোঝা গেল যে এরা কারোই গ্যারিসনের সৈন্য। মাসিক বেতনভুক্ত এসব শহুরে সৈন্য ডাক পেলেই কেবল দায়িত্ব পালন করতে আসে; সন্ত্রাসী দলে’র পিছু নেয়া এদের কর্ম না।

ছয় ফুট উপর থেকে একসাথে মাটিতে লাফিয়ে নামল শন আর মাতাতু; ঠিক যেন এক জোড়া বিড়াল। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কাভার নিল দু’জনে; দুইশ ফুট উপরে পাখা ঘুরিয়ে চলে গেল হেলিকপ্টার।

পনের সেকেন্ডের মাঝেই নিশ্চিত হওয়া গেল যে ড্রপ এরিয়াকে নিরাপত্তা দিয়ে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। লিডারের দিকে এগিয়ে গেল শন।

“ওকে সার্জেন্ট, বোতল খুলুন। ড্রিংক ম্যান ড্রিংক।”

অতিরিক্ত ওজনের সার্জেন্টের লাল মুখটা সূর্যের তাপে একেবারে পুড়ে গেছে। শার্টের উপর সাদা সাদা রিং হয়ে জমে আছে নোনা ঘাম। বোঝা গেল ডিহাইড্রেশন সম্পর্কে কিছু জানেন না; ঘণ্টাখানের মাঝেই চোখে মুখে অন্ধকার দেখবেন।

“পানি শেষ।” বলে উঠল তিতিবিরক্ত সার্জেন্ট। ওয়াটার বোতল ছুঁড়ে দিয়ে শন জানতে চাইল, “পদচিহ্ন কোথায় পাওয়া গিয়েছিল?”

সামনের দিকে ইশারা করলেন সার্জেন্ট কিন্তু এরই মাঝে পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে মাতাতু। মাথা নামিয়ে এমনভাবে দেখতে লাগল যা খুঁজে পাওয়া তার মতো ট্যালেন্টেড কারো পক্ষেই কেবল সম্ভব। পঞ্চাশ কদম পর্যন্ত অনুসরণ করে দৌড়ে দৌড়ে ফিরে এলো শনের কাছে।

“পাঁচজন। একজনের আবার বাম পা আহত হয়েছে…”

“ফার্মারের বউ নিশ্চয় এমন ধাওয়া দিয়েছে যে।”

“…কিন্তু চিহ্নগুলো একেবারে ঠাণ্ডা। স্প্রিং হেয়ার খেলতে হবে।” মাথা ঝকালো শন। সে আর মাতাতু আগেও কাজে লাগিয়েছে এই স্প্রিং হেয়ার কৌশল। আর মাতাতুর মতো দক্ষ কোনো ট্র্যাকারই পারে এথেকে আসল জিনিস খুঁজে পেতে।

তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে সন্ত্রাসীদের দলটা উত্তরে জাম্বোজি আর ট্রাইবাল ট্রাস্ট অঞ্চলের দিকেই গেছে; যেখানে খাবার আর পানির পাশাপাশি আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসাও করানো যাবে। একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলের নল দেখলে সবাই বাধ্য হবে তাদেরকে সাহায্য করতে।

তার মানে শনদেরকেও এখন উত্তরেই যেতে হবে। কিন্তু সামনে পড়ে আছে অত্যন্ত বন্য এক অরণ্য। দুর্গম এই অঞ্চলে কেউ লাইন থেকে কয়েক ডিগ্রি সরে গেলেই হলো, তার নাম-নিশানাও আর পাওয়া যাবে না।

খোলা জায়গায় দৌড়ে গিয়ে হাত দিয়ে ক্রুশ বানিয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকা অ্যালোয়েটকে সিগন্যাল দিল শন। সাথে সাথে হেলিকপ্টার থেকে উত্তর পাওয়া গেল,

“ওকে সার্জেন্ট” চিৎকার করে উঠল শন, “তাদের পিছু নিন। আমরাও সামনেই যাচ্ছি। রেডিওতে কন্ট্রাক্ট করবেন-আর পানি খেতে যেন ভুলবেন না।”

“রাইট অন, স্যার!” হেসে ফেলল সার্জেন্ট। শনে’র সঙ্গ পেয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠছে পুরো দল।

“ওদেরকে নরক দেখিয়ে দিন-স্যার!” শন’কে আকুতি জানালো সার্জেন্ট। অ্যালোয়েটের খোলা হ্যাচ থেকে হাত নাড়ল শন্।

বুকে চিনচিনে ব্যথা হওয়ায় পাজরের ক্ষত সামলাতে হাফ ডজন কোডেইন ট্যাবলেট গিলে নিল শন। মাতাতু’র সাথে হামাগুড়ি দিয়ে তাকিয়ে আছে পাঁচশ ফুট নিচের জঙ্গলের দিকে। এমনিতে উচ্চতা ভীতি থাকলেও এরকম উত্তেজনার মুহূর্তে সবকিছু ভুলে যায় ডোরোবো ট্র্যাকার।

এখন তো খোলা হ্যাচের এতটাই কিনারে চলে গেছে যে কোমর ধরে রেখেছে শন্ যেন আবার টুপ করে পড়ে না যায়। নাকের নিচে পাখির গন্ধ পেলে যেভাবে কেঁপে উঠে শিকারী কুকুর, ঠিক সেভাবেই কাঁপছে মাতাতু।

হঠাৎ করেই কিছু একটা ইশারা করতে, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে হাঁক দিল। শন, “দশ ডিগ্রি বামে ঘুরে যান।”

ইন্টারকমে পাইলটকে জানিয়ে দিল ইঞ্জিনিয়ার।

মাতাতু’র কথা মতো পশ্চিমে ঘুরে গেলেও নিচে তাকিয়ে চোখে পড়ার মতো কিছুই দেখতে পেল না শন। একইরকম পাথুরে একঘেয়ে বনানী।

কিন্তু দু’মিনিট পরেই আবারো মাতাতু’র ইশারা মতো নির্দেশ দিল শন। “পাঁচ ডিগ্রী ডানে ঘুরে যাও।”

বাধ্য ছেলের মতো ঘুরে গেল অ্যালোয়েট। নিজের যাদু দেখাচ্ছে মাতাতু। পাঁচশ ফুট উপর থেকে গাছের চাঁদোয়া ভেদ করে কাউকে দেখা না গেলেও ঠিকই টের পাচ্ছে মাতাতু; আর বিগত বছরগুলোতে আরো শ’খানেক সফলতার নজির না থাকলে অন্ধের মতো এরকম বিশ্বাস করত না শন।

মাস্টারের দিকে তাকিয়ে হাসছে মাতাতু; উত্তেজনায় তির তির করে কাঁপছে ঠোঁট; গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখ ভর্তি জল।

“নিচে!” আবারো ইশারা করল মাতাতু।

“ডাউন!” ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে আদেশ দিয়েই রোলান্ড ব্যালানটাইনের দিকে তাকালো শন্।

“হট গানস!” নিজের লোকদেরকে সিগন্যাল দিলেন রোলান্ড। শক্ত বেঞ্চের উপর সোজা হয়ে বসে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল সকলে। যার যার অস্ত্র তুলে নিয়ে লক অ্যান্ড লোড করে নিল প্রত্যেকে।

খটখটে শুকনো মাটির ছয় ফুট উপরে চক্কর কাটতে লাগল হেলিকপ্টার। একসাথে লাফিয়ে নামল শন আর মাতাতু। ক্লিয়ার করে ফেলল ড্রপ জোন।

কাভার দিয়ে কাঁধে এফ এন ঝুলিয়ে চারপাশে ঝোঁপ দেখে নিচ্ছে শন। হ্যাচওয়ে থেকে নেমে এলো একের পর এক স্কাউট। নাক ঘুরিয়ে চলে গেল শূন্য হেলিকপ্টার।

সেকেন্ডের মাঝেই সৈন্যরা যার যার পজিশন নিয়ে নিল হাতমুঠি করে শন’কে সিগন্যাল দিলেন রোল্যান্ড, “গো!”

খানিক দূরত্ব বজায় রেখে একসাথে আগে বাড়ল শন আর মাতাতু। ছড়িয়ে পড়ে কাভার দিল স্কাউটেরা সকলেরই সবকটি আঙুল ট্রিগারে প্রস্তুত। ফানেলা আকৃতির খাড়া পাথরের ঢালে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো মাতাতু। বহু শতাব্দীর ঝড়-জল এসে তৈরি করে দিয়েছে প্রাকৃতিক সিঁড়ি। আর হাতির পাল নিয়মিত যাতায়াত করা’তে মাটিও প্রায় সমান হয়ে গেছে।

আঙুল ভাঁজ করে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাবার জন্য শনের মতো দক্ষ ট্র্যাকারই প্রয়োজন এখন।

সূর্যের আলোয় আড়াআড়িভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শন। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে নিচে; মাটির দিকে। জানে ওকে কাভার দিচ্ছে বিশ্বস্ত স্কাউটেরা; শন্ নিজে ওদেরকে ট্রেনিং দিয়েছে।

কিছু একটা খুঁজে পেতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। গোলাকার একটা পাথর নিজ জায়গা থেকে খানিকটা সরে পড়েছে। তবে তৎক্ষণাৎ মাতাতু’কে ডাকল না শন।

“আগে আমি চেক করে দেখি; নয়ত সপ্তাহভর ক্ষেপাতে থাকবে পিচ্ছি। শয়তানটা?”

তার মাথার সমান সাইজের বোল্ডারটা আঙুলের টোকা দিতেই নড়ে উঠল। তার মানে এরই মাঝে অন্য কেউ এসেও একটাকে নাড়িয়ে গেছে। হুইসেল দিতেই আলাদীনের দৈত্যের মতো এসে হাজির মাতাতু। কিছুই বলতে হয়নি, যা দেখার দেখে বুঝে গেল মাতাতু।

নিজেদের পায়ের ছাপ ঢাকতে সন্ত্রাসীর দল পাথরের বোল্ডারগুলোকে ব্যবহার করলেও কেউ একজনের ভারে জায়গা থেকে খানিকটা সরে গেছে একটা পাথর।

ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে আগে বাড় মাতাতু। শখানেক কদম গিয়েই সাদা বালিতে দেখতে পেল পায়ের ছাপ। নির্ঘাৎ পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল আহত কেউ। রঙের এই তারতম্য শুধু দক্ষ কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বালির আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, হাওয়ার গতি আর সবচেয়ে বড় কথা সময়।

“দুই ঘণ্টা” ঘোষণা করল মাতাতু। বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল শন।

“আমরা ওদের চেয়ে দুই ঘণ্টা পিছিয়ে আছি।” রোলান্ডকে রিপোর্ট করল শন।

“কিভাবে বুঝতে পারল?” বিস্ময়ে মাথা নাড়ছেন রোল্যান্ড। “এখানে নিয়ে এলো তারপর সময়টাও ঠিকঠাক বলে দিল। পনের মিনিটে আট ঘণ্টার কাজ এগিয়ে দিয়েছে। কিভাবে শন?”

“বাজি ধরুন” একমত হলো শন।

“ও হচ্ছে একটা চকলেট মোড়া যাদুকর। অলৌকিক সবকিছুই ওর জানা আছে।”

“আবারো কি স্প্রিং হেয়ার খেলতে হবে?” রোল্যান্ড সোয়াহিলি না জানায় ভাষান্তর করে দিল শন।

খুশি খুশি মাথা নাড়ল মাতাতু। কর্নেলের প্রশংসা পেয়ে তো বেজায় খুশি।

“মাটিতে অনুসরণের জন্য চারজন রেখে যান।” পরামর্শ দিল শন। “জলের রেখা ধরে গেলে উপরে গিয়ে পায়ের ছাপ খুঁজে পাবার জোর সম্ভাবনা আছে।”

রোলান্ডের আদেশ পেয়ে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে গেল চারজন স্কাউট। হেলিকপ্টার আসতেই চড়ে বসল শসহ বাকি সৈন্য।

আবার উত্তরমুখে উড়ে চলল অ্যালোয়েট। কিন্তু দশ মিনিট যেতে না যেতেই শনের হাত ধরে টান দিল মাতাতু, “টার্ন! টার্ন ব্যাক!”

শনের আদেশ মতো আকাশেই ঘুরে গেল হেলিকপ্টার, খোলা হ্যাচ থেকে প্রায় ঝুলে কেবল এপাশ ওপাশ মাথা নাড়াচ্ছে আর এই প্রথমবারের মতো দ্বিধা দেখা গেল ডোয়রীবো ট্র্যাকারের চোখে।

“ডাউন” হঠাৎ করেই চিৎকার জুড়ে দিল মাতাতু। ঘন-জঙ্গল ভেদ করে সামনেই দেখা যাচ্ছে কিডনির মতো গড়নের অগভীর ভূমি।

খুব সাবখানে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো অ্যালোয়েট। গর্তের পাশে ল্যান্ডিং জোন দেখিয়ে দিল মাতাতু।

উই-টিবিতে ভর্তি মাটির ঝোঁপ-ঝাড়গুলোও বেশ ঘন। ঠিক যেন একটা কবরস্থান। এখানে ল্যান্ডিং ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। পিচ্ছি শয়তানটা এ কোন জায়গা বেছে নিল, মনে মনে রাগ করল শন।

হেলিকপ্টার মাঝ আকাশে থাকতেই রোল্যান্ডের দিকে তাকাল শন, “হট গানস্ ম্যান!”

মাতাতুর সাথে মাটিতে লাফিয়ে নেমেই উইটিবির পেছনে কাভার নিল শন।

অন্য স্কাউটদের দিকে দৃকপাত না করেই তাক করল এফএন; বুড়ো আঙুল দিয়ে ধরে রেখেছে সেফটি লক। ল্যান্ডিং জোনের পাঁচ মাইলের মাঝে কোনো সন্ত্রাসী থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত হলেও এটাই ওদের ল্যান্ডিং ড্রিল।

“একটার’ও পাত্তা নাই।” আপন মনে ভাবল শন; আর ঠিক তখন শুরু হল গুলি বর্ষণ।

বামপাশের কাঁটাঝোঁপ থেকে ছুটে আসছে একে’র গুলি। মাথার উপর দিয়ে অবিরাম শিষ কেটে যাচ্ছে মৃত্যুদূত। শ’নের থেকে মাত্র ইঞ্চি খানেক দূরের উই ঢিবি থেকে ছিটকে উঠল ধুলা আর লাল মাটির দলা।

হেলিকপ্টারের হ্যাচ গলে মাটিতে নেমে আসা শেষ স্কাউটের পেট এফোড় ওফোড় করে দিল একে রাইফেলের গুলি। গড়িয়ে গিয়ে তিন কদম পেছনে পড়ে গেল অসাড় দেহ। গোলাপি মাংসের দলা হয়ে চলে গেল ঝোঁপের আড়ালে।

চট করেই বুঝতে পারল শন; মাতাতু একেবারে খোদ শয়তানগুলোর মাঝে এনে ফেলেছে। চিন্তাবাদ দিয়ে এফএন দিয়ে গুলি ছুড়ল শন্। পিচ্ছি শয়তানটা এবারে দেখিয়েছে বটে!

একই সাথে কনট্যাক্টদের কথাও ভাবছে। কোনো ভুল নেই যে তারাও ভড়কে গেছে। তাই ডিফেন্স কিংবা অ্যামবুশ কিছুরই সময় পায়নি।

অভিজ্ঞতা থেকে শন জানে যে শোনা গেরিলারা সৈন্য হিসেবে একেবারে ফাস্ট ক্লাস, বলব, সাহসী আর প্রাণ দিতেও পিছপা হয় না। কিন্তু দুর্বলতাও আছে। প্রথমত তাদের ফায়ার কন্ট্রোল ভালো না আর দ্বিতীয়ত খুব দ্রুত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। শন ভালো করেই জানে যে, মিনিট খানেকের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে কাঁটা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে থাকা গেরিলা দল।

কোমরের বেল্ট থেকে ফসফরাসের গ্রেনেড় টেনে নিল শন। পিন খুলতে খুলতেই রোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে জানাল, “কাম অন রোল্যান্ড, কিছু বোঝার আগেই ঘাসগুলোকে সমান করে দিতে হবে।”

একই চিন্তা নিশ্চয়ই রোল্যান্ডের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। “টেক দেম বয়েজ! অন দ্য চার্জ!”

লাফ দিয়ে দাঁড়িয়েই হাত ঘুরিয়ে গ্রেনেডটাকে ছুঁড়ে মারল শন। ত্রিশ গজ দূরে পড়েই কাটা ঝোঁপটাকে ফসফরাসের সাদা মেঘে ঢেকে দিল গ্রেনেড। পুরো এলাকায় শুরু হলো অগ্নি বৃষ্টি।

সামনের দিকে ছুটল শন, পায়ের কাছে কালো ছায়ার মতো অনুসরণ করছে মাতাতু।

রাইফেল-টাইফেল ফেলে প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছে সন্ত্রাসী দল। শ’নের দশ কদম সামনে ঝোঁপের ভেতরে উবু হয়ে বসে আছে এক কিশোর। পরনে রঙচটা ব্লু জিন্স আর নরম ক্যামোফ্লেজ ক্যাপ। হাতে আর মাথায় ধোঁয়া উঠা কালো দাগ; গন্ধ মনে হচ্ছে মাংসের বার-বি-কিউ করা হচ্ছে।

গুলি ছুড়ল শন; কিন্তু খানিকটা নিচে লাগায় বাম কোমরে আঘাত পেয়ে পড়ে গেল ছেলেটা। রাইফেল ফেলে দিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলে উঠল,

“না, ম্যাম্বো! ডোন্ট কিল, মি! আমি খ্রিস্টান-ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে ছেড়ে দাও!”

“মাতাতু” কোন দিকে না তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল শন’

“কুফা!”

পঙ্গু গেরিলার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মাতাতু। এফএনের ম্যাগাজিন প্রায় খালি হয়ে যাওয়ায় গুলি নষ্ট করতে চায় না শন্। তারচেয়ে ছুরি দিয়েই কাজ চালিয়ে দেবে মাতাতু। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ফলাটাতে শান দেয় ডোরাবো ট্যাকার। ছোট্ট এই কিশোর ওদের কোনো কাজে লাগবে না; উপরন্তু মেডিকেল অ্যাটেনশনও পাওয়া যাবে না।

দুই মিনিটেরও কম সময়ে ময়দান ছেয়ে ফেলল স্কাউটের দল। পুরোটাই হয়ে গেল এক তরফা। মনে হল বন্য কুকুরের সামনে পড়েছে একদল পিকেনিজ কুকুর ছানা।

“পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে।” আদেশ দিলেন রোল্যান্ড ব্যালানটাইন। শনের কাছ থেকে বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে রাইফেলের মাজল তাক করেছেন আকাশে। “ওয়েল ডান, শন। তোমার ছোট্ট কালো বামনটা খেল দেখিয়েছে একখানা।” আড়চোখে তাকালেন মাতাতুর দিকে।

কোমরের গুলি খাওয়া সন্ত্রাসীর মৃতদেহ রেখে উঠে দাঁড়াল মাতাতু। গলার একপাশ দিয়ে ছুরি ঢুকিয়ে টেনে নিয়ে গেছে কানের করোটিড আর্টারি পর্যন্ত।

ঊরুতে নিজের ছুরির ফলা মুছতে মুছতে শনের পাশে এসে দাঁড়াল মাতাতু। রোল্যান্ড ব্যালান্টাইনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ভালই বুঝেছে যে কর্নেল কী বলেছেন।

ফসফরাসের আগুন লেগে মাংস আর কাপড়ের দলা হয়ে পড়ে আছে আরো কয়েকজন গেরিলা। একবার’ও না তাকিয়ে পাশে দিয়ে হেঁটে গেলেন রোল্যান্ড ব্যালান্টাইন।

***

কিন্তু হঠাৎ করে নড়ে উঠল একজন। গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বুকের নিচে লুকিয়ে রেখেছে একটা তোকারেভ পিস্তল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু একত্র করে রোলান্ডের দিকে তাক করল নিশানা।

“রোল্যান্ড!” দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠল শন। রোল্যান্ড নড়ে উঠলেও দেরি হয়ে গেল; মাত্র তিন ফুট দূরত্ব থেকে এখনি ধ্বংস হয়ে যাবেন রোল্যান্ড।

কিন্তু তার আগেই কোমরের কাছে ধরা এফএন থেকে ফায়ার করল শন্। গুলি গিয়ে লাগল গেরিলা’র মুখে। টসটসে পাকা একটা তরমুজের মতো করে বিস্ফোরিত হয়ে গেল পুরো চেহারা। অসাড় আঙুল থেকে পড়ে গেল তোকারেভ।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ এক মুহূর্ত মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে রইলেন রোল্যান্ড। ঝাঁকি খাচ্ছে লোকটার পা; ভয়ংকরভাবে ফুলে উঠা চোখ দু’টোতে দেখছেন নিজের মৃত্যুযন্ত্রণা।

দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে শনে’র দিকে তাকালেন।

“তোমার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। আস্তে করে বলে উঠলেন রোল্যান্ড। “যখন ইচ্ছে চেয়ে নিও।” এরপরই অন্যদিকে ঘুরে চিৎকার করে স্কাউটদেরকে বিভিন্ন আদেশ দিলেন। মাথার উপর ঘুরতে থাকা অ্যালোয়েট থেকে নেমে এলো সবুজ রঙা বডি ব্যাগস।

***

৭. আগ্নেয়গিরির কালো লাভা

এখন চার মাইল দূরত্ব হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির কালো লাভা দিয়ে তৈরি লে মর্ন ব্রাব্যান্ট পর্বত মালার সুউচ্চ চূড়া। মরিশাস দ্বীপের চারপাশে বসে চলা স্বচ্ছ নীল জলের প্রবাহ এমন এক সমৃদ্ধিশালী মেরিন লাইফের সৃষ্টি করেছে যে দুনিয়া জোড়া মৎস্য প্রেমিদের কাছে এ জায়গা “হটস্পট।” ছিপ দিয়ে মাছ ধরার জন্য এমন দ্বিতীয়টি নেই।

শাসা কোর্টনি সবসময় দ্বীপের পূর্ব-পরিচিত ক্রু আর একই বোটংকেই চার্টার করতে পছন্দ করেন। ইঞ্জিনে প্রপেলার আর হাল মিলিয়ে পানিতে প্রতিটি নৌকার আছে নিজস্ব এক ছন্দ, যা মাছের ঝাককে আকর্ষণও করতে পারে আবার তাড়িয়েও দিতে পারে।

লে বনহুর এরকম একটি ভাগ্যবান নৌকা। এর স্কিপারের চোখ দুটো ঠিক সামুদ্রিক পাখি গ্যানিটের মতোই শ্যেন। এক মাইল দূর থেকে দেখলেও চিনে ফেলে দশ কিলো ওজনের মার্লিন।

কিন্তু আজ কী যে হয়েছে, টোপের মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কেটে গেছে দুই ঘণ্টা।

ভারত মহাসাগরের চারপাশে আজ থিকথিক করছে মাছের আঁক। জেলেদের জীবনে এ এক ট্র্যাজেডি মাখা দিন; যখন আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছোট ছোট মাছ। লে বনহুর ক্রুদের ফেলে রাখা পালক লাগানো বঁড়শিটা এগুলোর নজরেই পড়ছে না, ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে ঝকের মাঝে ঢুকে পড়া দানবীয় মাছগুলোর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য।

ডেকের পনের ফুট উপরের ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে নিচের স্বচ্ছ পানি পরিষ্কারভাবেই দেখতে পাচ্ছেন শাসা। লে বনহুরের পাশ দিয়ে ছোটাছুটি করা মাছের ঝাঁক দেখে প্রায় আকুতির মতো করে বলে উঠলেন, “আমাদের একটা দরকার শুধু, একটা টোপ ফেলার মাছ। গ্যারান্টি দিচ্ছি যে মার্লিন ধরা পড়বেই।

তাঁর সাথে পাশেই ব্রিজের রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এলসা পিগটেলি। পরনে রক্তলাল সংক্ষিপ্ত বিকিনি; মোলায়েম দেহতত্ত্ব দেখে মনে হচ্ছে যেন সদ্য ওভেন থেকে বের করে আনা হানি ব্রেড।

“দেখো!” এলসার চিৎকার শুনে একেবারে সময় মতো মাথা ঘোরালেন শাসা। লে বনহুরের পাশে চক্কর কাটছে একটা মার্লিন। পানি কেটে এত দ্রুত বেগে চলে গেল যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বোনিত ঝক। সূঁচালো মুখটা পুরোপুরি একটা বেস বল ব্যাট। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া গায়ের রঙ ইলেকট্রিক ব্লু আর লাইল্যাক হয়ে যেন আকাশের নীলের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

“কত্ত বড় আর সুন্দর!” হা হা করে উঠল শাসার অন্তর।

কামানের গোলার মতো পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল মার্লিন।

“একটা টোপ!” মনে হলো যেন তছনছ হয়ে গেছে জীবন; এমনভাবে মুষড়ে পড়লেন শাসা।

“আমার পুরো রাজ্য দিয়ে দেব একটা টোপ পেলে।”

দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা আরো আধ ডজন নৌকার অবস্থাও এক জাহাজের রেডিও’তে শোনা যাচ্ছে স্কিপারদের হতাশা ভরা কণ্ঠস্বর। কারো কাছে কোনো ফাঁদ নেই; অথচ সুইসাইডের জন্য অপেক্ষা করছে মার্লিন।

“আমি কী করব?” জানতে চাইল এলসা, “তুমি কী চাও আমি আমার যাদু দেখাই?”

“ঠিক হবে কিনা জানি না” হেসে ফেললেন শাসা, “কিন্তু আমি রাজি, দেখাও তোমার যাদু সুন্দরী!”।

পার্স খুলে লিপস্টিক হাতে নিলেন এলসা। “এ্যাবড়া কা জ্যাবড়া, এ্যাবড়া কা জ্যাবড়া!” ভক্তি ভরে মন্ত্র উচ্চারণ করে শাসা’র নগ্ন বুকে রক্তরাঙা হায়ারোগ্লিফিক আঁকলেন এলসা; আপন মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন কোনো মন্ত্র।

“ওহ ইয়েস! আই লাভ ইট।” অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন শাসা, “আমার মনে হচ্ছে সত্যিই কাজ হবে! কী বলো?”

“তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।” সাবধান করে দিলেন এলসা, “নতুবা যাদু কাজ করবে না।”

‘বিশ্বাস করছি বাবা!”

হঠাৎ করেই নিচ থেকে শোনা গেল এক নাবিকের চিৎকার। ছোট্ট একটা বঁড়শিতে আটকা পড়েছে মাছ।

হাসি মুছে গেল শাসা’র মুখ থেকে; মুহূর্তখানিক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন এলসা’র দিকে। “ধুত্তোরি, তুমি তো দেখছি সত্যি একটা ডাইনি।” বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেলেন শাসা।

তড়পাতে থাকা বোনিতো’কে আদর করে হাতের মাঝে ধরে রেখেছে এক ক্রু। বুকের কাছে ঝাপটে ধরে রাখায় সুবিধে করতে পারছে না মাছটা। স্বস্তি পেলেন শাসা; চোয়ালের কাছে আটকে আছে বঁড়শি। ফুলকার কোনো ক্ষতি হয়নি।

বঁড়শিটা খুলে ফেলে ক্রু’কে আদেশ দিলেন, “টার্ন হিম!” উল্টো করেই ধরতেই সাথে সাথে স্থির হয়ে গেল বোনিতো/ টুনি মাছ।

সার্জনের মতো করে টোপ ফেলার যন্ত্রপাতি মেলে বসলেন শাসা। কাপড়ে ফুল তোলার লম্বা হুক নিয়ে সাবধানে ঢুকিয়ে দিলেন বোনিতো’র চোখের গহ্বরে। আইবলটা একপাশে সরিয়ে দিলেও একটু’ও কোনো ক্ষতি করল না হুক। মাছের খুলি ভেদ করে বিপরীত দিকের চোখের একই অংশ দিয়ে বের হয়ে এলো সুই। ১২০ পাউন্ড ড্যাকরন লাইন দিয়ে আটকে দিলেন বোনিতো’র চোখ। এরপর তুলে নিলেন বিশাল ১২/০ মারলিন হুক। কয়েকবার ফাঁস লাগিয়ে গিটের মতো আটকে দিলেন বোনিতো’র চোখে, জীবিত মাছের দৃষ্টিশক্তিও অক্ষুণ্ণই রইল বলা চলে।

এরপর উঠে দাঁড়িয়ে কু’র দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন শাসা গানওয়েলের পাশে হাঁটু গেড়ে পাশ দিয়ে ছেড়ে দিল বোনিতো। মুক্তি পাবার সাথে সাথে ডারকন লাইন নিয়ে পালিয়ে গেল বোনিতো। হারিয়ে গেল গভীর নীল মহাসমুদ্রের মাঝে।

ফাইটিং চেয়ারে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন শাসা। ফিন-এর টাইকুন রীল মেরিন গ্রেড অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হয়েছে। পাঁচ কিলো ওজনের রীলটাতে জড়ানো আছে এক কি.মি’র বেশি ডারকনলাইন। হিস হিস শব্দে রীল থেকে ছুটে যাচ্ছে লাইন। বোনিততর সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের বুক। টেনশন কমাতে আঙুলের ডগা দিয়ে লাইন স্পর্শ করলেন শাসা।

প্রতি পঞ্চাশ গজ পরপর সিল্কের সুতা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে লাইন। একশ গজ ছাড়ার পর রীলের লিভার টেনে দিলেন।

এরই মাঝে লাইনকে সেপারেট রাখা আর মারলিন গেঁথে গেল টেনে তোলার জন্য বিশ ফুট লম্বা আউটরিগার বের করে আনল নৌকার ত্রু। কিন্তু চিৎকার করে উঠলেন শাসা,

“না, এটাকে আমিই ধরবো।”

ফাঁদের গভীরতা আর ড্রপ ব্যাকের সম্পর্কে জানার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো উপায় নেই। তবে এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য। অভিজ্ঞতা আর সামর্থ্য।

খুব সাবধানে রীল থেকে একশ ফুট লাইন বের করে ডেকের উপর পেঁচিয়ে রেখে দিলেন শাসা। তারপর সে বনহুর’র স্টার্নে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলেন স্কিপারকে “আলিজ!”

স্পিপার গিয়ার লিভার এনগেজ করে দিতেই প্রপেলার অলসভাবে ঘোরা শুরু করল। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে লাগল লে বনহুর।

ধীরে ধীরে হাঁটার গতিতে বেড়ে চলল স্পিড। শাসা’র হাতে ধরা লাইনের ওজনও বেড়ে গেল। বেল্ট বাঁধা কুকুরের মতো বোটটাকে অনুসরণ করছে বোনিতো। পানিতে লাইনের অ্যাংগেল দেখে গভীরতা আন্দাজ করে নিলেন শাসা। তিনি মাছের অবস্থাও বলে দিতে পারবেন লেজের বাড়ি, টার্ন কিংবা ডাইভ দেখে।

মিনিট খানেকের মাঝেই হাতে ঝি ঝি ধরে গেলেও পাত্তা দিলেন না শাসা। বরঞ্চ ব্রিজে ডেকে পাঠালেন এলসা’কে : “তোমার কালা যাদু আরেকবার দেখাও তো পাখি।”

“এটা শুধু একবারই কাজ করে।” মাথা নাড়লেন এলসা।” বাকিটা এবার নিজের কাজ নিজেই সামলাও।”

শাসা’র নির্দেশে উত্তর দিকে টার্ন নিল লে বনহুর।

মোড় ঘোরার অর্ধেকে শাসা’র হাতের লাইন টান টান হয়ে পড়ায় দ্রুত সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন শাসা।

“কী হয়েছে?” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন এলসা।

“বোধহয় কিছু না।” স্বীকার করলেন সমস্ত মনোযোগ দিয়ে লাইনটাকে ধরে আছেন শাসা।

আবারো টান পড়লেও এবার বদলে গেল বোনিতো’র আচরণ। সমানে খাবি খাচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, ঘুরে যেতে চাইছে; কিন্তু সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লে বনহুর।

“অ্যাটেনশন!” নাবিকদেরকে সতর্ক করে দিলেন শাসা।

“কী হচ্ছে?” আবারো জানতে চাইলেন এলসা।”

“কিছু একটা বোনিতো’কে ভয় দেখাচ্ছে” উত্তর দিলেন শাসা, “নিচে মাছটা কিছু দেখেছে।”

ঠিক যেন উপলব্ধি করতে পারছেন গভীর মহাসমুদ্রের নিচে দানবীয় ছায়া দেখে আঁতকে উঠা ছোট্ট মাছটার ভয়। কিন্তু বোনিতো’র হাবভাব দেখে হয়ত সাথে সাথে চলে যাবে মারলিন। মিনিট কেটে গেল। তারপর আরেক মিনিট। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে বসে আছেন শাসা।

হঠাৎ করেই আঙুলের ফাঁক গলে চলে যেতে শুরু করল লাইন। মুহূর্ত খানেকের জন্য বিশাল মাছটার ওজন অনুভব করলেন শাসা।

মাথার উপর দু’হাত তুলে গর্জন করে উঠলেন, “স্ট্রাইক! স্টপ ইঞ্জিনস?”

বাধ্য ছেলের মতো গিয়ার লিভার নিউট্রাল করে দিল স্কিপার। পানির মাঝে স্থির হয়ে গেল লে বনহুর। লাইনটাকে তুলে পরীক্ষা করলেন শাসা। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই-মার্লিনের এক আঘাতেই মৃত্যুবরণ করেছে বোনিতে।

কল্পনার চোখে যেন পুরো দৃশ্যটাই দেখতে পেয়েছেন শাসা। বোনিতো’কে। মেরে চারপাশে চক্কর দিচ্ছে মার্লিন। এখন প্রয়োজন হচ্ছে লাইনটাকে একেবারে নাড়াচাড়া না করা; যেন ভয় পেয়ে পালিয়ে না যায় মার্লিন।

সেকেন্ডগুলো যেন হয়ে উঠল অনন্তকাল।

“মার্লিন নিশ্চয়ই আরেকবার চক্কর মারতে আসছে।” কিছুই না ঘটাতে নিজেই নিজেকে উৎসাহ দিচ্ছেন শাসা।

স্কিপার কিছু একটা বলতেই খেঁকিয়ে উঠলেন।

হঠাৎ করেই আঙুলের নিচে কেঁপে উঠল লাইন। স্বস্তির চোটে চিৎকার দিয়ে উঠলেন শাসা,

“ওই তো আছে! এখনো আছে।”

হাততালি দিয়ে উঠলেন এলসা, “মাছটাকে খেয়ে ফেল মার্লিন, মিষ্টি মাছটাকে খেয়ে ফেল।”

মাঝে মাঝেই আলতোভাবে দুলে উঠছে লাইন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে আরো কয়েক ইঞ্চি ছেড়ে দিলেন শাসা। মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন বোনিতো’কে গিলে খাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মারলিন।

“ও যেন বঁড়শিটা না দেখতে পায়।” মনে মনে প্রার্থনা করে ফেললেন শাসা। বোনিতো’র মাথার ভেতর গেঁথে যাওয়া হুক এতক্ষণ মার্লিনের পেটে চলে যাওয়ার কথা; কিন্তু যদি তা না হয়-আর ভাবতে চাইলেন না শাসা।

খানিকক্ষণ কেটে যাবার পর আবার নড়ে উঠল লাইন।

“টোপটা গিলে ফেলেছে” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শাসা। ডেক থেকে আড়কাঠের উপর দিয়ে একের পর এক লাইন চলে যাচ্ছে পানিতে।

সুইভেল চেয়ারে বসে ঝাঁকুনি খেলেন শাসা। ফিন-এর রীলের হার্নেশ চেয়ারের সাথে পেঁচিয়ে আরেকটু হলেই পাঁচশ ফুট নিচে ফেলে দিচ্ছিল তাঁকে। শুধু নিজের ব্যালান্স আর শক্তির ভারে টিকে গেলেন শাসা। নতুবা হাজার পাউন্ডের বেশি ওজনের মাছটা মেরিন ডিজেল ইঞ্জিনের মতো টেনে নিয়ে জাহাজের পাশ দিয়ে টুপ করে শাসা’কে পানিতে ফেলে দিলেও কেউ টের পেত না।

বেক এনগেজ করতেই প্যাচানো লাইন খানিকটা থেমে গেল। ফটবোর্ডের উপর পা দিয়ে আটকে রাখলেন শাসা। তাড়াতাড়ি চিৎকার করে স্কিপার মাটির্নকে ডাকলেন, “আলেজ গো!”

থ্রটল খুলে দিতেই কালো তেলতেলে ডিজেলের মেঘ একজস্ট থেকে বের হতে লাগল। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল লে বনহুর।

বোটের শক্তি আর গতিকে কাজে লাগিয়ে মাছের ভেতরে বঁড়শিটাকে গাঁথার চেষ্টা করলেন শাসা।

“আরেতেজ ভওস! “বঁড়শিটা বিধে গেছে বুঝতে পারলেন শাসা। “স্টপ?” চিৎকার করতেই থ্রটল বন্ধ করে দিলো মার্টিন।

পানির ভেতর স্থির হয়ে রইল লে বনহুর। এখনো ব্রেক থাকায় আটকে আছে রীল।

নিচে হঠাৎ করেই নড়ে উঠল মারলিন।

“এইরে চলে যাচ্ছে!” গর্জন করে উঠলেন শাসা। রীলের রডটা ভেঙে গেছে। আর লাইন ছুটে যাওয়াতে ভড়কে গেছে মাছটা। কোথাও কোনো গণ্ডোগোল হয়েছে বুঝতে পেরে পাগলের মতো দৌড় শুরু করেছে মারলিন। আরো একবার ঝাঁকুনির চোটে নিজের সিট থেকে লাফিয়ে উঠলেন শাসা। বিশাল ফিন-এর পর্যন্ত সহ্য করতে পারল না; ধোঁয়া উঠল রীলের ভেতর থেকে। বীয়ারিভের গ্রিজ গলে গলে পড়তে লাগল।

শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে চেয়ারে চেপে বসে রইলেন শাসা। দুই হাত দিয়েও ধরে রাখতে পারছেন না রীল। কসাইয়ের চাকু’র মতই ধারাল ড্যাকরন লাইন- অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠেছে; যে কোনো মুহূর্তে আঙুল কেটে যেতে কিংবা মাংস থেলে যেতে পারে।

কিন্তু বিনা বাধায় ছুটে যাচ্ছে মারলিন। সেকেন্ডের মাঝে পানির ভেতর উধাও হয়ে গেল আধা কি.মি. লাইন।

“হতচ্ছাড়া চায়নাম্যান বাবার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে” দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন শাসা, “মনে হচ্ছে জীবনেও থামানো যাবে না!”

হঠাৎ করেই দু’ভাগ হয়ে গেল মহাসমুদ্রের সাদা জল দেখা দিল মারলিন। মনে হলো সবকিছু স্লো মোশন হয়ে গেছে। লাফ দিয়ে ঠিক যেন আকাশে উঠে গেল মারলিন। সাবমেরিনের মত গা থেকে ছিটকে পড়ল পানির ফোয়ারা। লে বনহুর থেকে পাঁচশ গজ দূরে থাকলেও মনে হলো যেন গোটা আকাশ ঢাকা পড়ে গেল।

“আরেব্বাস, কত বড়! আর্তচিৎকার করে উঠল মার্টিন। শাসা’ও জানেন কথাটা কতটা সত্য-এত বড় মারলিন আগে আর দেখেননি। নীলের ছটায় যেন স্বর্গও আলোচিত হয়ে উঠল।

একইভাবে সমুদ্রের বুকে আঁছড়ে পড়ল মারলিন। চারপাশে শক ওয়েভ ছড়িয়ে চলে গেল, নিজের রাজসিক স্মৃতি রেখে।

রীল থেকে ছুটে যাচ্ছে লাইন। ভারী ব্রেক দেয়া থাকলেও কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না।

‘টার্নি! টর্নি!” ধাতস্থ হতেই আতঙ্কের চিৎকার জুড়ে দিলেন শাসা। স্কিপারের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন, “টার্ন অ্যান্ড চেস হিম!”

সর্বশক্তি দিয়ে মারলিনের পিছু নিল লে বনহুরের ইঞ্জিন। বাতাস আর ঢেউ কেটে সাদা ফোয়ারা ছিটিয়ে তরতর করে এগোচ্ছে লে বনহুর।

চেয়ারে বসে সমানে এপাশ ওপাশ করছেন শাসা। শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরে রাখলেও স্থির থাকতে পারছেন না। এদিকে লে বনহুর ফুল থ্রটলে ছুটতে লাগলেও লাইন থামছে না। তাদের চেয়েও দশ নট গতিতে এগিয়ে আছে মারলিন। অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলেন শাসা।

“শাসা!” ব্রিজ থেকে ভেসে এলো এলসার চিৎকার “মারলিন ঘুরে গেছে।” উত্তেজনায় ইতালি ভাষা বলছেন এলসা।

“স্টপ!” স্কিপারের উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়লেন শাসা।

কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ঘুরে গিয়ে নৌকার পেছন দিকে ছুটতে শুরু করল মারলিন।

কোন এক ভাবে পানির ভেতরে লাইন ফাঁস দিয়ে ফেলেছে মারলিন। ঠিক সময়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছেন এলসা।

মারলিন নৌকার নিচে আসার আগেই ফাসটাকে খুলতে চাইছেন শাসা। হ্যাঁন্ডেল ঘোরাতে লাগলেন। আস্তে আস্তে ভেজা লাইন উঠে আসছে নৌকার উপরে। লাইনের গিটও উপরে উঠে এসেছে আর একই সময়ে নৌকার নিচে এসেছে মারলিন। আবারো টান টান হয়ে গেল লাইন।

কিন্তু মরিয়া হয়েও রীল আর লাইন টানতে পারছেন না শাসা।

“টার্ন নাউ।” কোন মতে আদেশ দিলেন। খোলা বুক থেকে টপটপ করে ঝড়ে পড়ছে ঘাম। এলসা’র এঁকে দেয়া লিপস্টিকের নকশা ধুয়ে মুছে শটর্সের উপর পড়তে লাগল।

“টার্নং কুইকলি! কুইকলি!”

দ্রুত গতিতে বিপরীত দিকে ছুটে যাচ্ছে মারলিন আর লাইনটা টাইট হতেই লে বনহুরকেও ঘুরিয়ে নিল স্কিপার। রডের মাথায় মাছটার পুরো ওজন পড়াতে ঝড়ে কাত হয়ে থাকা উইলো গাছের মতো বেঁকে গেল রড।

এতক্ষণ কষ্ট করে যতটুকু লাইন গুটিয়ে এনেছিলেন তার সবটুকুই আবার পানিতে টেনে নিয়ে গেল মারলিন। হতাশা ভরে তাকিয়ে রইলেন শাসা।

ঘণ্টা খানেক কেটে গেলেও থামল না এই পিছু নেয়া। ড্যাকরন লাইনের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। রীলের উপর চেয়ার রেখে তার উপরে দাঁড়িয়ে পড়লেন শাসা।

বালতি থেকে নোনা জল নিয়ে শাসা’র কাঁধে ছিটিয়ে দিল এক ত্রু। কোমরের কাছে হার্নেসের নাইলন’কে পেঁচিয়ে নিয়েছেন শাসা; ফলে টাইট হয়ে বসে যাওয়া জায়গাটার চামড়া কেটে রক্ত বের হতে লাগল। মাছটার ছোটার সাথে সাথে গম্ভীর হচ্ছে ক্ষত।

দ্বিতীয় ঘণ্টা হলো আরো বিভীষিকাময়। মারলিনের ছোটার গতি একটুও ক্ষীণ হলো না। শাসা’র মাথা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ে পড়ছে। ব্রিজ থেকে নিচে নেমে এলেন এলসা; হার্নেস আর শাসা’র রক্তাক্ত কোমরের মাঝে কুশন। রেখে একমুঠো সল্ট ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন; সাথে দু’ক্যান কোক। মুখের উপর ক্যান ধরতেই ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন শাসা।

“আচ্ছা বলতো তো” এক চোখ ভর্তি আকুতি নিয়ে এলসা’র দিকে তাকালেন শাসা,

“এসবের কোনো দরকার আছে?”

“কারণ তুমি যে একটা পাগল। আর পুরুষদেরকে কিছু কাজ করতেই হয়।” ভোয়ালে দিয়ে শাসা’র মুখে ঘাম মুছে কি করলেন এলসা; বোঝাই যাচ্ছে শাসা’কে নিয়ে কতটা গর্বিত বোধ করছেন।

তৃতীয় ঘণ্টার মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলেন শাসা। কেমন যেন অসাড় হয়ে হালকা হয়ে গেল পা; টের পেলেন না কোমরের ব্যথা। ফুটবোর্ডের উপর যেন দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেল পা।

“তো ঠিক আছে”, মোলায়েম স্বরে বলে উঠলেন শাসা, “এবারে তোমার পালা শেষ। এখন আমার টান এসেছে।” বুঝতে পারলেন দুর্বল হয়ে পড়েছে মার্লিন।

চাঙ্গা হয়ে উঠলেন শাসা, “তো বাছা, এখন তো তুমিও ব্যথা পাচ্ছো তাই না?” লাইন টেনে টেনে রীলের গায়ে পেঁচাতে গিয়ে বানিয়ে ফেললেন চারটা কয়েল। জানেন এবার আর ছুটবে না লাইন। অবশেষে মারলিনকে বাগে পেয়েছেন।

চতুর্থ ঘণ্টা শেষে একেবারেই কাবু হয়ে গেল মারলিন। শুধু তিনশ ফুট গভীর চক্কর কেটে চলল বেচারা। কাঁধের কাছে প্রায় চার ফুট চওড়া মাছটার ওজন হবে এক টনের চার ভাগের তিন ভাগ। আধা অন্ধকারে ওপালের মতো জ্বলছে চোখ। দেহ ছড়াচ্ছে লাইলাক আর নীল রঙা শিখা।

ফাইটিং চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে আছেন শাসা কোর্টনি। পা ভাঁজ করে আবার মেলে ধরতেই নিজেকে মনে হলো আথ্রাইটিসের রোগী। প্রতিটি নড়াচড়ার সাথে টের পাচ্ছেন ব্যথা।

মাছ আর মানুষ মিলে ভয়ংকর এক লড়াই করেছে শেষাংশে পৌঁছে। খুব দ্রুত দু’বার লাইন গুটিয়ে নিলেন শাসা। মাছটার প্রতিটা চক্করের সাথে একটু একটু করে লাইন টেনে আনলেও ব্যথা আর ঘামে সিক্ত হয়ে গেছে শরীর। তবুও টের পাচ্ছেন যে শেষ হয়ে আসছে এই প্রতীক্ষা। বুকের মাঝে লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ড; মেরুদণ্ডে যেন আগুন জ্বলছে। ভেতরে মনে হচ্ছে কোন একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাবে; তারপরেও সর্বশেষ শক্তি দিয়ে মারলিনকে দিলেন টান।

“প্লিজ” ফিসফিস করে উঠলেন শাসা।

“তুমি আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলছ। এবার ক্ষান্ত দাও, প্লিজ।”

আবারো লাইন ধরে টানলেন শাসা; এবারে রণ ভঙ্গ দিল মারলিন। ধীরে ধীরে উঠে এলো ভারী মাছ। স্টার্নের এত কাছে দিয়ে মারলিনের মাথা দেখে শাসা’র মনে হলো ইচ্ছে হলেই বিশাল চোখ দুটোকে ছুঁয়ে দেখা যায়।

আকাশের দিকে নাক উঁচিয়ে মারলিন মাথাটাকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দিল যে মনে হলো পানি থেকে উঠে এসে কান ঝাড়ছে একটা স্প্যানিয়েল কুকুর।

পানিতে থেকেই তেকোণাকার বিশাল ঠোঁটটা খুলে মাথা নাড়তে লাগল মারলিন; এতটা ভীষণ শক্তির সামনে অসহায় হয়ে পড়লেন শাসা। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। হাতের মাঝে ঝাঁকি খাচ্ছে রড।

মারলিনের খোলা চোয়ালের ভেতর বেঁকে যাওয়া বঁড়শি দেখে মন খারাপ করে ফেললেন শাসা।

“স্টপ ইট!” মাছটাকে টেনে ধরতে চাইলেন শাসা। কিন্তু বঁড়শিটাকে ধরার আগেই বার বার পিছলে যাচ্ছে। মারলিন হা করতেই কালো ঠোঁটের গায়ে দেখা গেল হালকাভাবে ঝুলছে বঁড়শি। আরেকটাবার মাথা ঝাঁকালেই স্টিলের দড়ি ছুঁড়ে ফেলে দেবে মারলিন।

চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে নিজের অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করলেন শাসা। ফেনার মাঝে সমুদ্রে হারিয়ে গেল মারলিন।

“দড়ি” চিৎকার করে ডে’কের কু’কে ডাকলেন শাসা, “দড়ি ধরো” স্টিলের দড়ি ধর সরাসরি টানলে তবেই যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় মারলিনের শক্তি!

লড়াইয়ের পুরো চার ঘণ্টাতে স্বয়ং জেলে ব্যতীত আর কারো বঁড়শি কিংবা লাইন ধরার অনুমতি নেই। ইন্টারন্যাশনাল গেম ফিশিং অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছে এ নীতি।

কিন্তু মারলিন যাতে হাতছাড়া না হয় তাই কু’দেরকে অনুমতি দেয়া হলো ত্রিশ ফুট স্টিলের পঁড়ি ধরার জন্য।

“দড়ি!” আকুতি জানালেন শাসা। ভারী লেদারের গ্লাভস্ পরে চটপট করে স্টার্নের কাছে চলে গেল নাবিকদের দল।

আবারো উপরে উঠে এলো মারলিন। যেন একটা মরা কাঠ।

“আর একবার উঠে দাঁড়ালেন শাসা। এত হালকাভাবে গেঁথে আছে বঁড়শিটা যে একটু ঝাঁকুনি লাগলেই খুলে গিয়ে মারলিনকে মুক্ত করে দেবে।

ডে’কের উপর এনে রাখা হল স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি বিশাল একটা বঁড়শি। খুলে ফেলা যায় এমন একটা পোলের শেষ মাথায় লাগানো হয়েছে বঁড়শিটা আর একবার মারলিনের কাঁধে বিধিয়ে দিতে পারলেই সব ঝামেলা শেষ।

গ্লাভস্ পরিহিত ক্রু’র হাত মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে থাকতেই শেষবারের মতো লেজের বাড়ি মাল মারলিন; রডের মাথা খানিকটা বেঁকে যেন সম্মতি দিল আর খুলে গেল বঁড়শি-মুক্ত হয়ে গেল মারলিন।

তড়াক করে সোজা হয়ে গেল রঙ আর বঁড়শিটা বাতাসে শিষ কেটে গিয়ে বিধল লে বনহুরের গানওয়েলে। চেয়ারে লাগতেই উলটে পড়ে গেলেন শাসা। মাত্র চল্লিশ ফুট দূরেই সমুদ্রে ভেসে রইল মার্লিন। মুক্তি পাবার পরেও সাঁতার কেটে সরে যাবার শক্তি পাচ্ছে না।

হা হয়ে তাকিয়ে রইল বিস্মিত নাকিবেরা; তবে সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেল স্পিকার মার্টিন। লে বনহুর’কে রিভার্স করে নিয়ে চলল মারলিনের দিকে।

“আমরা এটাকে ধরবোই!”

বঁড়শিযুক্ত লাঠি হাতে থাকা ক্রু’র দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন-স্কিপার। স্টানের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে মারলিন। রেলিং এর কিনারে দৌড়ে গিয়ে চকচকে বঁড়শিটা মারলিনের পিঠে ছুঁড়ে মারবে –এমন সময় টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ালেন শাসা। সীসার মতো ভারী পা দুটোতে যেন কোনো শক্তিই নেই। কিন্তু ঠিক সময় মতো ধরে ফেললেন নাবিকটার কাধ।

“না” ভাঙ্গা গলায় জানালেন শাসা। “না” বঁড়শিটা নিয়ে ডেকের উপর ফেলে দিলেন; মন খারাপ করে তাকিয়ে রইল ডে’কের নাবিক। এতক্ষণ ধরে মাছটার জন্য প্রায় শাসা’র মতই পরিশ্রম করেছে সকলে।

কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না। পরে সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন যে স্বাধীন একটা মাছের গায়ে লাঠির বঁড়শি ফেলা ঠিক না। যে মুহূর্তে মারলিন হুকটাকে ছুঁড়ে ফেলেছে সে মুহূতেই লড়াইয়ে জিতেও গেছে। এখন এটাকে মেরে ফেললে সেটা খেলুড়ে সুলভ হবে না।

দেহের ওজন আর ধরে রাখতে পারছে না তার পা। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ালেন শাসা। স্টার্নের কাছেই ভেসে রইল মারলিন। একটু কাত হয়ে মারলিনের কুচকুচে কালো পিঠের পাখনাটা স্পর্শ করলেন শাসা। প্রান্তগুলো প্রায় তরবারির মতই ধারালো।

“ওয়েল ডান ফিশ” ফিসফিস করে উঠলেন শাসা। নিজের স্বেদবিন্দুর লবণ আর জলে ভরে উঠল চোখ। “ফাইট একটা দেখিয়েছে বটে।”

এমনভাবে মারলিনের পিঠে হাত বোলালেন যেন কোনো সুন্দরী রমণী শাসার স্পর্শে যেন প্রাণ ফিরে পেল মারলিন। লেজটা আরো দ্রুত নাড়তে শুরু করল। নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়ল।

প্রায় আধা মাইল পর্যন্ত মারলিনকে অনুসরণ করল লে বনহুর। রেইলের কিনারে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন শাসা আর এলসা। তাকিয়ে দেখলেন আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে এসেছে বিশাল মারলিনের দেহে।

নিজের মহিমা দেখিয়ে পানির গভীরে চলে গেল মারলিন। বহু নিচে নিয়ে গেল অন্ধকার একটা ছায়া। চলে গেছে মারলিন।

দীর্ঘ পথটুকু পাড়ি দিয়ে আবারো বন্দরে ফিরে এলো লে বনহুর। পুরো পথটুকু জুড়েই কাছাকাছি বসে রইলেন শাসা আর এলসা। মন ভরে উপভোগ করলেন দ্বীপের সৌন্দর্য আর মাঝে মাঝে এক কী দু’বার একে অন্যের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলেন যেন দু’জনেই পড়তে পেরেছেন দু’জনের হৃদয়ের কথা।

ব্ল্যাক রিভার হারবারে লে বনহুর ফিরে আসতে আসতে ড’কে চলে এলো অন্য নৌকাগুলো। ক্লাবহাউজের সামনে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। দুটো মৃত মার্লিনের দেহ। তবে কোনটাই শাসা’র হৃত মাছের অর্ধেকও নয়। চারপাশে জটলা করছে মানুষ। বঁড়শি নিয়ে পোজ দিচ্ছেন সফল অ্যাংলার। বোর্ডে লেখা হয়েছে তাঁদের নাম আর মার্লিনের ওজন। পোর্ট লুইসের ইন্ডিয়ান ফটোগ্রাফার ট্রাইপডের উপর উপুড় হয়ে তুলছে বিজয়ীদের ছবি।

“কখনো চাওনি যে তোমার মাছটাও এখানে ঝোলানো থাকুক?” জানতে চাইলেন এলসা।

“জীবিত থাকলেই তো মারলিনকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়।” বিড়বিড় করে উঠলেন মাসা। “আর মারা গেলেই কুৎসিত হয়ে যায়।” মাথা নেড়ে জানালেন, “আমার মার্লিন এর চেয়ে বেশি কিছুরই যোগ্য।”

“আর তুমিও।” পথ দেখিয়ে শাসা’কে ক্লাব হাউজের বারে নিয়ে গেলেন এলসা। বুড়োদের মতো খানিক শক্ত হয়ে হাঁটলেও কেমন একটা অদ্ভুত গর্ব অনুভব করছেন শাসা।

গ্রিন, আইল্যান্ড রাম আর লাইমের অর্ডার দিলেন এলসা। “এবারে নিশ্চয় বাড়ি ফিরে যাবার শক্তি পাবে, তাইনা?” ভালোবেসে ভর্ৎসনা করে উঠলেন পিগটেলি।

বাড়ি মানে মেইসন ডেস্ আলিজেস ট্রেডইউন্ডস্ হাউজ। প্রায় শত বছর আগে নির্মাণ করে গেছে এক ফরাসী ব্যারন। শাসা’র আর্কিটেক্টের দল এটির পুনর্সংস্কার করলেও প্রাচীন আবহ পুরোপুরি বজায় রেখেছে।

বিশ একর বিস্তৃত বাগানের মাঝে চকচকে ওয়েডিং কেকের মতো লাগে পুরো দালান। ব্যারনের ট্রপিক্যাল গাছ সগ্রহের আগ্রহকে টিকিয়ে রেখেছেন শাসা। এসব গাছের মাঝে শাসা’র অন্যতম গর্ব হল রয়্যাল ভিক্টোরিয়া ওয়াটার লিলিস। ফিশ পন্ডে ভাসমান ওয়াটার লিলি’র পাতাগুলোর চার ফুট চওড়া আর কিনারের কাছটা বাঁকানো। ফুল’তো ঠিক যেন একটা মানুষের মাথা। এত বড় সাইজ।

ব্ল্যাক রিভার হারবার থেকে মাত্র বিশ মিনিট ড্রাইভ করলেই মেইসনে পৌঁছে যাওয়া যায়। গাছের চাঁদোয়ার নিচ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে গিয়ে শাসা বলে উঠলেন, “ওয়েল, বাকি দলটাও মনে হচ্ছে নিরাপদে পৌঁছে গেছে।”

হাউজের মেইন পোর্টালের সামনের ড্রাইভওয়েতে দেখা গেল ডজন খানেক পার্ক করা গাড়ি। এলসা’র পার্সোনাল জে’টে করে জুরিখ থেকে এসেছেন দুইজন ইঞ্জিনিয়ার। পিগটেলি কেমিক্যালস এর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে সিনডেক্স-২৫ এর প্ল্যান্টের নকশা’ও উনারাই করবেন। জার্মান ডিরেক্টর ওয়ার্নার স্টলজ’র সাথে ইউরোপে দেখা করেছেন শাসা।

এই সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গ থেকে উড়ে এসেছেন ক্যাপরিক কেমিক্যালস’র টেকনিক্যাল ডিরেকটর আর ইঞ্জিনিয়ারদের দল। এর মালিক কোর্টনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল হোল্ডিংস।

ট্রান্সভ্যালের জার্মিস্টন শহরের কাছেই রয়েছে এ কোম্পানির প্রধান প্ল্যান্ট। বর্তমান প্ল্যান্টের অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি অংশ তৈরি করা হয় উচ্চ পর্যায়ের বিষাক্ত কীটনাশক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে বড় করার মতো যথেষ্ট জায়গা খালি পড়ে থাকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে স্থাপন করা হবে সিনডেক্স প্ল্যান্ট।

পিগটেলি আর ক্যাপরিকর্নের প্রতিনিধিরা এই নতুন প্ল্যান্টের ব্লু-প্রিন্ট আর প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতেই এখানে জড়ো হয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকাতে মিটিংটা করা হচ্ছে না; কিংবা এলসাও এও চেয়েছেন যেন তার কোনো স্টাফ প্ল্যান্টে নাই যাক; যাতে করে পিগটেলিকে কোনো ভাবেই দোষারোপ করা না যায়।

অবশেষে মরিশাসকেই বেছে নেয়া হয়েছে। শাসামেইন কেনার পরেও দশ বছর পার হয়ে গেছে। মরিশাস সরকার আর দ্বীপের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথেও উনার চমৎকার সম্পর্ক আছে।

অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত ব্রুনো পিগটেলি নিজেও নিয়মিত মরিশাসে মাছ ধরতে আসতেন। তাই দ্বীপের সকলেই এলসা’কে চেনে আর সম্মান করে। মেইসন ডেস আলিজোসে এলসা’র আগমন নিয়ে তাই কারো কোন মাথা ব্যথাই নেই।

টপ ফ্লোরে পৃথক হলেও ইন্টারকানেকটেড দু’টি স্যুইটে থাকেন শাসা আর এলসা। লোক দেখানো এই ব্যাপারটাতে বেশ মজা পায় পুরো পরিবার। পুলের পাশের লনে সকলে তাই এ জুটিরই অপেক্ষা করছে। ইভনিং ককটেলের সময় হয়েছে।

শাসাকে গোসল করিয়ে ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দিয়েছেন এলসা। তাই খানিকটা খুঁড়িয়ে হাঁটলেও বেশ তরতাজা বোধ করছেন শাসা। একসাথে দু’জনকে সিঁড়ি বিয়ে নামতে দেখে চোখে দুষ্টুমি নিয়ে জানতে চাইল গ্যারি, “শয়তানগুলোর দিকে দেখো, মনে হচ্ছে যে তারা শুধুই ভালো বন্ধু?” একে অন্যের দিকে তাকালো হোলি আর বেলা। এমনকি হাসি লুকোতে জাপানিজ পাখা দিয়ে মুখ ঢাকলেন সেনটেইন কোর্টনি।

সিনেটের অধিবেশন চললেও মেইসন ডেস আলিজেসে ইসাবেলার না। আসার কোনো কারণ-ই নেই। চিজোরা ট্রিপের পর থেকেই সি সি আই’র ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে বেলা। সিনেটের এগ্রিকালচার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে নিয়োগ পাবার পর গ্যারি’কে কিছু হিন্টস্ দিতেই সি সি আই বোর্ডে জায়গা পেয়ে যায় বেলা। ক্যাপরিকর্নের ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্য হিসেবে অত্যন্ত সক্রিয় বেলা একটিও মিটিং মিস করে না। সিনডেক্স নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করাতে বাধা দেয়নি গ্যারি।

একই সাথে হোলি আর বাচ্চাদেরকেও নিয়ে এসেছে। টেকনিক্যাল ডিসকাশনস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও পরিবারের সাথে অবকাশ যাপনের সুযোগও হারাতে চায় না গ্যারি। পৌত্র-পপৗত্রিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে নারাজ সেনটেইনও তাই ল্যানসেরিয়া প্রাইভেট এয়ারপোর্ট থেকে লিয়ারে চড়ে বসেছেন।

বস্তুত পুরো পরিবার আর তাদের লাগেজ থাকায় জায়গাই পাননি ক্যাপরিকর্নের ডিরেক্টরের দল। বাধ্য হয়েছেন কমার্শিয়াল ফ্লাইট ধরতে।

শাসা আর এলসা নেমে আসতেই ক্রুগের ফোয়ারা ছুটল পুরো পার্টি জুড়ে; একই সাথে পিঠ চাপড়ানো, হ্যান্ডশেক আর চিৎকার চেঁচামেচির জ্বালায় কান পাতা দায় হয়ে উঠল।

লিয়ার পাঠিয়ে জোহানেসবার্গ থেকে ইমপেরিয়াল ক্যাভিয়ার, ক্রুগ, ফ্রেশ ফুট আর বেবী ফুড আনিয়েছেন সেনটেইন। সাথে এনেছেন ফাইব স্টার বীচ রিসোর্টের সুপ্রশিক্ষিতি স্টাফ।

আগের দিন সন্ধ্যায় সেনটেইনের সাথে দেখা করেছেন এলসা। ক্লান্ত থাকলেও একে অন্যের সাথে সহজেই মিশে গেছেন সেনটেইন আর এলসা। প্রথমে খানিক জরিপ করে নিয়ে হেসে হাত বাড়িয়েছেন সেনটেইন, “তোমার ব্যাপারে শাসা অনেক ভালো ভালো কথা বললেও বুঝতে পারছি সত্যিটুকুর অর্ধেকও জানায় নি।” সেনটেইনের ইটালিয়া ভাষায় দক্ষতা আর প্রশংসা শুনে হেসে ফেললেন এলসা।

“আমি জানতাম না যে আপনি ইটালীয় ভাষা জানেন সিগনোরা কোর্টনি ম্যালকমস।”

“দু’জনের এমন আরো অনেক কিছুই জানে যা আমরা জানি না।”

মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“আই লুক ফরওয়ার্ড টু দ্যাট “ উত্তর দিলেন এলসা। এখন পাটিতে এসে তাই সহজভাবেই সেনটেইনের দিকে এগিয়ে গেলেন এলসা।

ওয়েল, এলসা’র সাথে হাত মিলিয়ে ভাবলেন সেনটেইন, খুঁজে পেতে অনেক দেরি করলেও শাসা’র অপেক্ষা সার্থক হয়েছে।

একে অন্যের পেছনে ছোটাছুটি করে খেলছে গ্যারির ছেলেমেয়েরা। তাদের আনন্দ দেখে যারপরনাই বিরক্ত শাসা। “আমার মনে হচ্ছে দিনকে দিন আমি অষ্টম হেনরীর মতো হয়ে যাচ্ছি-ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে বেশি ভালো লাগে না।”

“আমার যতদূর মনে পড়ে এই বয়সে তুমিও এমন চঞ্চল ছিলে।” নাতি নাতনীদের সমর্থনে জোর গলায় বলে উঠলেন সেনটেইন।

“তাহলে তুমি আমাকে তেলের মাঝে সেদ্ধ করে ফেলার কথা ছিল। আর মা, তুমিও দিনকে দিন বেশি বেশি স্নেহ প্রবণ হয়ে যাচ্ছ।”

হেসে ফেললেন সেনটেইন। পিগটেলি ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে গল্পে ব্যস্ত ইসাবেলার দিকে এগিয়ে গেলেন শাসা।

চারপাশে তাকিয়ে কেমন বিবমিষা বোধ করল বেলা। সবাই হাসছে। চিৎকার করছে। সম্রাজ্ঞীর মতো সবকিছুর দরবার বসিয়েছেন সেনটেইন। হোলি আর এলসা’র পরনের মহামূল্যবান সিঙ্ক আর শিফনের দাম যে কোনো শ্রমিকের এক বছরের বেতনের সমান। অথচ ওর ছোট্ট নিকোলাস কমব্যাট ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরে হাতে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা করে; সেন্য আর সন্ত্রাসীরা-ই হলো তাঁর সঙ্গী।

বেলা নিজে ফ্লার্ট করছে মাঝ বয়সী এক টাকলুর সাথে; যার সাথে মুদি দোকানদার কিংবা বার ম্যানের কোনো তফাৎ নেই। অথচ এই মুখোশের আড়ালে মৃত্যু নিয়ে খেলছে লোকটা আর এটাই হলো বাস্তবতা।

টেডি বিয়ার বড় ভাই আর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে বেলা অথচ মনে মনে ষড়যন্ত্র করছে কিভাবে তার পরিবার আর দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা যায়। এই সুন্দরী আর সফল বুদ্ধিমান তরুণীর হাতেই আছে ভবিষ্যৎ আর তার চারপাশের পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ।

“একবারে মাত্র একটি দিন নিজেকে সাবধান করল বেলা,

“প্রতি পদক্ষেপে মাত্র এক পা।” আর পরের পদক্ষেপ হলো সিনডেক্স ২৫ প্রজেক্ট।

হয়ত রামোনের প্রতিশ্রুতি মতো এটাই হলো তার শেষ কাজ। একবার তাদের হাতে সিনডেক্স পৌঁছাতে পারলেই হয়ত চিরতরে মুক্তি পাবে এই মাকড়সার জাল থেকে-সে, রামোন আর নিকোলাস। হয়ত তখন শেষ হবে এই দুঃস্বপ্ন।

***

পরের দিন সকালবেলা মেইসন ডেস্ আলিজেসের ডাইনিং রুমে শুরু হলো কনফারেন্স। লম্বা ওয়ালনাট টেবিলের দু’পাশে বসে থাকা ত্রিশজন মানুষের আলোচনার বিষয় হলো মৃত্যু। এমনভাবে এর মেকানিকস, কেমিকেল স্টাকচার প্যাকেজিং আর কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হলো যেন সকলে ব্যস্ত কোনো পটেটো চিপস কিংবা ফেইস ক্রিম নিয়ে।

কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না স্ট্রিলের মতো শক্ত হয়ে বসে থাকা ইসাবেলা; ভালোভাবেই জানে যে গ্যারির পর্যবেক্ষণ শক্তি কতটা তীক্ষ্ণ। চশমার ওপাশে থাকা চোখ দুটো প্রায় কিছুই মিস করে না। বেলার বিতৃষ্ণা কিংবা ভীতি নিমিষেই টের পেয়ে যাবে গ্যারি। আর তাহলেই শেষ হয়ে যাবে ওর সব প্রচেষ্টা।

ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত প্রত্যেকের সামনে একটি করে চামড়ার ফোল্ডার রাখা হয়েছে; ভেতরে পিগটেলি টেকনিশিয়ানদের তৈরি সংক্ষিপ্ত দলিল। তুলে ধরা হয়েছে নার্ভ গ্যাসের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি সমস্যা।

প্রতিবারে একটি করে প্যারা পড়ছেন ওয়ানার স্টলজ। শুনতে শুনতে নিজের অভিব্যক্তি নিরপেক্ষ রাখার জন্য হিমশিম খাচ্ছে আতঙ্কিত ইসাবেলা।

“নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের উপস্থিতি থাকাতে পূর্বের নার্ভ গ্যাসগুলোর তুলনায় সিনডেক্স-২৫ অনেকটাই পৃথক…” বৈশিষ্ট্যগুলোর নাম শুনতে গিয়ে মনে হলো কাক্ষিত শব্দটাই হয়তো বেশি যুক্তিযুক্ত হবে; কিন্তু কিছুই না বলে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল বেলা।

“সিনডেক্স-২৫ এর বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যন্ত অভিনব ও মৌলিক বিষাক্ততা, দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা; মানব শরীরের ফুসফুস আর মিউকাস মেমব্রেন দ্রুত শোষণ করে নেয় এ গ্যাস। এছাড়া ম্যানুফ্যাকচার, স্টোর আর হ্যান্ডেলের জন্য বেশ কার্যকর এই গ্যাস। সিনডেক্স-২৫ এর প্রধান দুটি উপাদান একত্রে মেশানোর পর এই গ্যাসের আয়ু হয়ে পড়ে স্বল্প। তাই কার্যক্ষেত্রে একে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।”

“এবারে এসব বৈশিষ্ট্য আরো সবিস্তারে আলোচনা করা যাক। যেমন বিষাক্ততা। এই গ্যাস এতটাই ক্ষতিকর যে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসলেন ওয়ার্নার-দুই মিনিটে শত্রু পক্ষের ৫০ শতাংশ আর দশ মিনিটে পুরো ১০০ শতাংশ মেরে ফেলতে সক্ষম। সারিনের চেয়েও গ্যাসকে দ্রুত শুষে নেয় দেহতুক, চোখ, নাক, গলা আর পরিপাকতন্ত্র, এক মাইক্রোলিটার পরিমাণ সিনডেক্স গ্যাস নগ্ন দেহত্বকে লাগানো হলে দুই মিনিটে অসাড় হওয়া সত্ত্বেও পনের মিনিটেই মৃত্যুবরণ করবেন আক্রান্ত ব্যক্তি। তাই সারিনের চেয়েও চারগুণ বেশি সম্ভাবনাময়। এবারে আলোচনার বিষয় উৎপাদনের খরচ প্রসঙ্গে। প্লিজ বারো নম্বর পাতা খুলুন সকলে।”

বিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়ের মতো বাধ্য ভঙ্গিতে আদেশ পালন করলেন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তি আর ওয়ার্নরা বলে চলেছেন, “প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে প্ল্যান্টের পেছনে ব্যয় হবে বিশ মিলিয়ন ইউএস ডুলারস আর ম্যানুফ্যাকচার খরচ প্রতি কিলো বিশ ডলার।”

ভাষার ব্যবহার শুনে এই অবস্থাতেইও বেলা’র হাসি পেল; যাই থোক বলে চলেছেন ওয়ার্নার,

“তুলনা করলে দেখা যাবে যে গোটা প্ল্যান্টের খরচ পড়বে ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস থেকে একটা সিংগেল হ্যারিয়ার জেট কেনার সমান। আর সিনডেক্সের এক স্টক উৎপাদনের অর্থ দিয়ে বারো মাস যে কোনো দেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় মেটানো যাবে; কেনা যাবে পঞ্চাশটা সাইডউন্ডার এয়ার স্টু-এয়ার মিসাইলস…”।

“এ ধরনের প্রস্তাব আসছে অগ্রাহ্য করার কিছু নেই।” মিটমিট করে হেসে উঠল গ্যারি, ভাইয়ের প্রতি মনের মাঝে এতটা ঘৃণার সঞ্চার হলো যে অবাক হয়ে গেল বেলা।

এমন কোনো কিছু নিয়ে কেউ কিভাবে তামাশা করে? চোখ তুলে তাকাবার সাহস করল না বেলা। যদি গ্যারি বুঝে ফেলে! মাথা নেড়ে গ্যারি’র সাথে একমত হলেন ওয়ার্নার।

“সিনডেক্স প্রয়োগ করার জন্য কোনো বিশেষ ভেহিকেলের প্রয়োজন নেই। সাধারণ শস্য ছিটানোর এয়ারক্রাফটসহ আর্টিলারী প্রজেক্টাইলকেও কাজে লাগানো যাবে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আদর্শ হচ্ছে আর্মসকোরের নতুন জি-ফাইভ লংরেঞ্জ ছোট কামান।”

দুপুরবেলা পুলে সাঁতার কাটা আর ছাদে ব্যুফে লাঞ্চের জন্য বিরতি ঘোষণা করা হলো। অবশেষে আবার সবাই ডাইনিং রুমে ফিরে এলো সিনডেক্স-২৫ এর উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করার জন্য।

“কখনো হিউম্যান সাবজেক্টের উপর প্রয়োগ করা না হলেও সিনডেক্স অ্যারোসলের উপসর্গগুলো অন্যান্য জি এজেন্টে নার্ভ গ্যাসের চেয়ে তেমন ভিন্ন কিছু নয়।” জানালেন ওয়ার্নার। “এগুলো হলো বুকে ব্যথা হওয়াসহ নাক আর চোখ জ্বালাপোড়া আর দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।”

শোনার সাথে সাথে ভিজে উঠতে চাইল ইসাবেলা’র চোখ জোড়া; তারপরেও ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।

“এই উপসর্গগুলোই ধীরে ধীরে রূপ নেবে মাথা ঘোরানো। ঘেমে যাওয়া, হার্টের ব্যথা, পাকস্থলী খামচেধরাসহ বমি আর ডায়রিয়া’তে সাথে শুরু হবে চোখ, নাক, মুখ আর যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্তপাত। প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কারণ হবে শ্বাসতন্ত্রের অকার্যকারীতা সেন্ট্রাল নাভার্স সিস্টেমের ক্ষতি করবে সিনডেক্স।”

ওয়ার্নার শেষ করার পর পুরো এক মিনিট ধরে চুপ করে রইলেন বিমুগ্ধ শ্রোতার দল। অবশেষে মোলায়েম স্বরে গ্যারি জানতে চাইল, “যদি কখনো হিউম্যান সাবজেক্টের উপর না-ই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তাহলে এ সকল উপসর্গ কিভাবে নিরূপণ করা হয়েছে?”

“প্রাথমিকভাবে সারিনের কথাই ধরা হয়েছে প্রথমবারের মতো খানিক অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন ওয়ার্নার, “এরপর ল্যাবরেটরীতে শিম্পাঞ্জির উপর পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।” খক খক করে গলা পরিষ্কার করলেন জার্মানস ডিরেক্টর।

বহু কষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করল ইসাবেলা। কিন্তু নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়ে উঠল যখন শুনল, “ল্যাবরেটরিতে শিম্পাঞ্জিরা অত্যন্ত দামি হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকাতে সহজলভ্য চাকমা বেবুনের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে।

“আমরা তো জীবিত প্রাণীদের উপর পরীক্ষা করতে পারি না?” নিজের কানেই বেখাপ্পা ঠেকল ইসাবেলা’র চিৎকার; সাথে সাথে নিজেকে শান্ত করে ফেলল বেলা, “আমি বলতে চাইছি যে এর কী সত্যি কোনো দরকার আছে?”

সকলেই এক দৃষ্টিতে বেলা’কে দেখছেন। ভেতরে ভেতরে নিজের উপর অসম্ভব রেগে উঠল বেলা। অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গল গ্যারি।

কথাগুলো হালকাভাবে বললেও চশমার ওপাশের চোখ জোড়া হয়ে উঠল অত্যন্ত কঠিন। “বেবুন আমার পছন্দের কোনো প্রাণী নয়।” ক্যামডিবু’তে এগুলোকে আমি সদ্যজাত মেষের বাচ্চা খুন করতে দেখেছি। নানা জানবেন কিভাবে উনার গোলাপ আর সবজি বাগান তছনছ করেছে বেবুন। তবে আমি নিশ্চিত যে কোনো বন্যপ্রাণীর উপর অহেতুক নির্যাতনের ব্যাপারে তোমার সাথে আমরাও একমতো হবো।” থেমে গেল গ্যারি।

“তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে মুখ্য হলো দেশের প্রতিরক্ষা, জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর মিলিয়ন মিলিয়ন কোর্টনি অর্থের ব্যয়।”

শাসার দিকে তাকাতেই মাথা নেড়ে পুত্রের কথায় সায় দিলেন মিঃ কোর্টনি।

“সংক্ষেপে বলতে গেলে, হ্যাঁ আমাদেরকে টেস্ট করতেই হবে। এটি অত্যন্ত জরুরি। আমি দুঃখিত বেলা। যদি তোমার ভাল না লাগে তাহলে এই প্রজেক্ট নিয়ে আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করো না। ক্যাপকির্ন বোর্ড থেকে রিজাইন দিলেও কেউ তোমাকে কিছুই বলবে না। তোমার অনুভূতিকে আমরা শ্রদ্ধা করি।”

“না” দ্রুত বেগে মাথা নাড়তে শুরু করল বেলা, “আমি প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝতে পেরেছি। দুঃখিত যে প্রসঙ্গটা তুলেছি।” মনে মনে প্রমাদ গুণল বেলা। আরেকটু হলেই হারিয়ে যাচ্ছিল রামোন আর নিকোলাস। তাদের নিরাপত্তা আর মুক্তির জন্যেও যেন কিছু করতে পারবে। জোর করে হেসে উঠল বেলা। হালকা স্বরে জানাল, “তুমি এত সহজে আমাকে তাড়াতে পারবে না। আমার সিট আমি ছাড়ব না, থ্যাঙ্ক ইউ।”

খানিকক্ষণ বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল গ্যারি; তারপর ভাল হলো যে ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেল।” এবারে ওয়ার্নার স্টলজের দিকে তাকাল গ্যারি।

কোলের উপর দু’হাত রেখে চোখে-মুখে মনোযোগী ভাব ফুটিয়ে বসে রইল বেলা, “এই প্রজেক্টের রিপোর্ট করতে লাল গোলাপের একটুও হাত কাঁপবে না।” মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল বেলা।

***

কেপ টাউনে ফিরে আসার তিনদিন পর রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল লাল গোলাপ।

বছরের পর বছর ধরে রুটিনের মতো দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা, লন্ডনের ঠিকানাতে লাল গোলাপ টেলিগ্রাম পাঠানোর চব্বিশ ঘণ্টা পরেই পোরশে পার্ক করার জন্য তাকে জানিয়ে দেয়া হয় সময় আর স্থান। বেশির ভাগ সময় জায়গাটা হয় কোন পাবলিক কার পার্ক।

গাড়ির দরজা লক না করে ড্রাইভারের সিটের নিচে ওয়ান টাইম প্যাডে লেখা মেসেজটা খামে ভরে রেখে দিল বেলা। ঘণ্টাখানে পরে ফিরে এসে দেখল উধাও হয়ে গেছে খাম! আর ওর জন্য টাইপ করা ইনস্ট্রাকশন পড়ে আছে।

সিনডেক্স প্রজেক্ট সম্পর্কিত কোনো লেখাই যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে সে ব্যাপারে বেশ সাবধান ছিল গ্যারি। আলোচনা চলাকালে ইসাবেলা কয়েকটা : নোট নিলেও চেয়ে নিয়েছে গ্যারি।

“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না, টেডি বিয়ার?” মিটিমিটি হাসলেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল গ্যারি,

“আমি এমনকি নিজেকেও বিশ্বাস করি না।” বেলা’র নোট প্যাডের জন্য হাত বাড়াল গ্যারি, “তুমি যদি কোনো কিছু জানতে চাও, তাহলে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করো; কিন্তু কোথাও কিছু লিখবে না-মানে কিছুই না।”

আর কোনো কথা বাড়াল না বেলা।

তাই সিনডেক্স-২৫ এর যথাযথ অ্যাটোমিক উপাদান কিংবা উৎপাদনের প্রক্রিয়া জানাতে না পারলেও অনেকটুকুই রিপোর্ট হিসেবে পাঠিয়ে দিল লাল গোলাপ। তবে প্ল্যান্টের সম্ভাব্য অবস্থান আর নির্মাণ কাজের সময় জানাতে ভুলল না। তার মাস সাতেকের ভেতর উৎপাদন শুরু করবে প্ল্যান্ট।

এছাড়া কেমিকেল গ্রেড স্টেইনলেস স্টিল দক্ষিণ আফ্রিকাতে উৎপাদিত না হওয়ায় বাইরে থেকে আমদানি করতে হবে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত আই এস সি ও আর-এর ব্যাপারে কাজ শুরু করায় ধরে নেয়া হচ্ছে যে আঠারো মাস পরে থেকে বাইরে থেকে আর কিছুই আনতে হবে না। সিনডেক্স উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে উঠবে দক্ষিণ আফ্রিকা। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে প্রি কারসর সাপ্লাই করবে তাইপেতে অবস্থিত পিগটেলি কোম্পানি।

তবে এ সমস্যা ছাড়াও আরেকটা সমস্যা হলো প্ল্যান্ট চালাবার জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব। পিগটেলি কেমিকেলস আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে তারা কোন কর্মী সরবরাহ করবে না, তাই ধারণা করা হচ্ছে এখানে ব্রিটেন কিংবা ইস্রায়েল থেকে লোক নেয়া হবে। এক্ষেত্রে সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্সের ব্যাপারেও মাথা ঘামাতে হবে।

রিপোর্টে ইসাবেলা আরো জানাল যে পুমা হেলিকপ্টারস আর ইম্পালা জেট ফাইটারস ডেলিভারী ভেহিকেল হিসেবে কাজ করবে। দুটিই দক্ষিণ আফ্রিকা এয়ারফোর্সের অংশ। এছাড়া খুব শীঘ্রই শুরু হবে ১৫৫ গ্রাম এম এম সি ডব্লিউ ই আর এফবি কার্গো তৈরির নকশা আর টেস্ট করার যাবতীয় প্রস্তুতি। সর্বোচ্চ পঁয়ত্রিশ কি.মি. রেঞ্জে এগারো কিলো সিনডেক্স-২৫ ডেভিভারী করবে এই শেল।

এহেন তথের গুরুত্ব কতটা তা খুব ভালো ভাবেই জানে লাল গোলাপ। তাই ছাব্বিশ পৃষ্ঠা রিপোটের একেবারে শেষ লাইনে লিখল,

“যত দ্রুত সম্ভব ছেলের সাথে দেখা করতে চায় লাল গোলাপ।”

উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করল উত্তর পাবার জন্য। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না।

সময় যাবার সাথে সাথে কোনো রিপ্লাই না পেয়ে সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়ে গেল বেলা। তাই ভাবল দেখা করতে চাওয়াটা হয়ত তার অধৈর্য আর উদ্ধত আরচণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। তাই দ্বিতীয় মাস শেষে ক্ষমা চেয়ে মেসেজ পাঠিয়ে দিল লন্ডনের ঠিকানাতে।

“লাল গোলাপ সাক্ষাতের জন্য পীড়াপীড়ি করাতে যারপরনাই অনুতপ্ত। অপেক্ষা করছে পরবর্তী নির্দেশ পাবার জন্য।”

আরো এক মাস কেটে যাবার পর এলো সেসব আদেশ।

ইসাবেলাকে যে কোনো মূল্যে সিনডেক্স প্ল্যান্টের জন্য কর্মী নিয়োগ আর বাছাই কল্পে ব্রিটেন আর ইস্রায়েলে পাঠানো ক্যাপরিকন টিমে নিজের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে।

কেমন করে এই অসাধ্য সাধন করা যায় ভেবে অস্থির হয়ে গেল বেলা। গ্যারি’কে কী এমন বলবে যাতে করে বোনের উপর কোনো সন্দেহও করবে না? তবে পরবর্তী বোর্ড মিটিঙে ব্যাপারটার এত সুন্দর একটা সমাধান হয়ে গেল যে বিস্মিত হলো বেলা।

এজেন্ডাতে না থাকলেও মিটিঙে রিক্রুটমেন্টের ইস্যু উঠতেই পুরো বিষয়টা নিয়ে বেলা এত সুনিপুণ ভাষা আর যুক্তি দিয়ে সাজানো নিজের মতামত তুলে ধরল যে গ্যারি আপনা থেকেই বলে ফেলল : “সম্ভবত তোমাকেই এ দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে হবে, কোর্টনি।”

অতিরিক্ত আগ্রহ না দেখিয়েই কাঁধ ঝাঁকাল ইসাবেলা, “কেন নয়? আমার কিছু শপিংও হয়ে যাবে কয়েকটা নতুন ফ্রক কিনতে হবে।”

“টিপিক্যাল উম্যান” দীর্ঘশ্বাস ফেলল গ্যারি; ছয় সপ্তাহ পরেই আবার কাভোগন স্কয়ারের ফ্ল্যাটে চলে এলো বেলা। ফ্ল্যাটের চাইনিং রুমে নেয়া হলো সব ইন্টারভিউ।

যে রাতে লন্ডনে পৌঁছালো, উড়ো একটা ফোন কল পেল বেলা। তবে মেসেজটা স্পষ্ট, “লাল গোলাপ, কাল তুমি বেনজামিন আফ্রিকার ইন্টারভিউ নেবে আর সে যেন অবশ্যই সিলেক্ট হয়ে যায়।”

ফাইলের অ্যাপ্লিকেশনগুলো চেক করতেই দেখা গেল বেনজামিন আফ্রিকার জন্ম হয়েছে কেপ টাউনে অন্যতম দাবিদার সে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন থাকা সত্ত্বেও ছোকরা একেবারেই ইয়াং। যাই হোক জুনিয়র পোস্ট থাকাতে বেলার জন্য কাজটা সহজ হয়ে গেল।

কিন্তু কাতোগান স্কয়ারের ফ্ল্যাটে সকাল এগারোটায় বেনজামিন আফ্রিকাকে দেখে আতঙ্কে জমে গেল বেলা।

কৃষাঙ্গ এই যুবক আর কেউ নয়, তার সৎ ভাই যাকে সে বেন গামা নামে চেনে।

এতটাই আতঁকে উঠল যে মুখ থেকে কোনো কথাই বের হল না। ওয়েভ্রেদেনের এক অন্ধকার ছায়ার নাম তারা কোর্টনি-কেউই সেখানে এ নাম উচ্চারণও করে না; তাই বেলা’কে কিনা তারই সন্তানকে কোর্টনি কোম্পানিতে চাকরি দিতে হবে? নানার তো হার্নিয়া হয়ে যাবে, বাবা আর গ্যারি…।

ভাগ্য ভালো যে ইসাবেলা’র সঙ্গী সি সি আই পার্সোনেল ম্যানেজার নিজেও বেনজামিনের গায়ের রঙ নিয়ে বিরক্ত হওয়াতে খানিকটা সময় পাওয়া গেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো বেলা। অন্যদিকে চুপচাপ রইল বেনজামিন।

হঠাৎ করেই নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনাস্বরূপ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সি সি আই ম্যানেজার। বেনজামিনের সাথে হাত মিলিয়ে জানালেন,

“আমি ডেভিড মিকীন, সিসিআই পার্সোনাল হেড। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।” লোকটা বিড়বিড় করতে করতে বেনজামিনের দিকে চেয়ারও এগিয়ে দিল,

“আপনার সি ভি পড়ে আমরা মুগ্ধ-সত্যি মুগ্ধ।”

বেনজামিনকে সিগারেট অফার করল মিকীন। “ইনি হচ্ছেন সি সি আই ডিরেক্টর ড. কোর্টনি।”

সিট থেকে খানিকটা উঠে মাথা নোয়ালো যেন, “হাউ ডু ইউ ডু, ম্যাম?”

কথা বলার সাহস পেল না বেলা। মাথা নেড়েই বেনজামিনের আবেদন পত্রে চোখ নামিয়ে নিল। ইন্টারভিউ নিলেন মিকীন।

এরই মাঝে নিজের প্ল্যান সাজিয়ে ফেলল বেলা। আফ্রিকা পদবী যদি সেই চিনতে না পারে তাহলে কোর্টনি পরিবারের আর কারো চেনার কথাই নয়। উপরন্তু মাইকেল ব্যতীত বেন গামা’কে ওয়েল্টেভ্রেদেনের আর কেউ দেখেওনি। সুতরাং একটা শহরের শত শত ফ্যাক্টরির একটাতে জুনিয়র অ্যামপ্লয়ী হিসেবে ঢোকা বেন’কে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হবে না।

আর কোনো প্রশ্ন না থাকাতে ইসাবেলার দিকে তাকালেন মিকীন। “আপনি তো কেপ টাউনে জন্মগ্রহণ করেছেন মিঃ আফ্রিকা, তাহলে কি এখনো সে দেশের নাগরিকত্ব আছে? নাকি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন?”

“না, ড, কোর্টনি মাথা নাড়ল বেন।

“আমি এখনো একজন সাউথ আফ্রিকান। লন্ডনের সাউথ আফ্রিকা হাউজ আমার জন্য পাসপোর্ট ইস্যু করে।”

“গুড। আপনার পরিবার সম্পর্কে কী কিছু বলা যাবে? তারা কি এখনো দক্ষিণ আফ্রিকাতেই থাকেন?”

“আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন স্কুলটিচার। ১৯৬৯ সালে কেপ টাউনে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন।”

“অ্যাম সরি” চোখ নামিয়ে ফাইলের দিকে তাকাল বেলা। নির্ঘাৎ মিথ্যে কোনো বার্থ সার্টিফিকেট নিয়েছেন তারা। যাই হোক আবারো বেনের দিকে তাকাল বেলা, “আশা করছি আমার পরবর্তী প্রশ্নটা নিয়ে আপনি কিছু মনে করবেন না মিঃ আফ্রিকা। যাই হোক, ক্যাপরিক কেমিকেল আর্মসকোরের ডিফেন্স কন্ট্রাকটর। তাই এর সমস্ত কর্মী সম্পর্কেই তদন্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকান সিকিউরিটি পুলিশ। তাই খুব ভালো হয় আপনি আমাদেরকে জানান যে কখনো কি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য ছিলেন কিংবা আছেন?”

হেসে ফেলবেন। সৌভাগ্যক্রমে পূর্ব-পুরুষদের সৌন্দর্যের সবটুকুই পেয়েছে এই সুদর্শন তরুণ।

“আপনি কি জানতে চাইছেন যে আমি এএনসি’র সদস্য কিনা?” বিরক্ত হল বেলা।

“অথবা অন্য কোন কট্টর রাজনৈতিক সংগঠন?” বাকা স্বরে উত্তর দিল বেলা।

“আমি কোনোরকম রাজনীতি করি না। ড, কোর্টনি। আমি শুধু একজন বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলী। সোসাইটি অব ইঞ্জিনিয়ারস্ এর সদস্য। ব্যস।” আর “ মানে বেন রাজনীতিতে আগ্রহী নয়?

“এরকম সোজাসাপ্টা উত্তরের জন্য ধন্যবাদ যা কিনা পরবর্তীতে যে কোনো করনের অস্বস্তি থেকে আমাদের উভয়কেই রক্ষা করবে। দক্ষিণ আফ্রিকা’তে ভোট দিতে না পারলেও ইংল্যান্ডে আপনি কোনো রকম বর্ণবাদের স্বীকার হচ্ছেন না।”

“হ্যাঁ, আমি জানি।” একমত হল বেন।

“তাহলে এমন একটি দেশে কেন ফিরে যেতে চাইছেন যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে হবে আর যে কোনো অর্জনের পরিমাপক হবে আপনার গাত্রবর্ণ?”

“আমি একজন আফ্রিকান ড, কোর্টনি। আই ওয়ান্ট টু গো হোম। নিজের দেশ আর জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। বিশ্বাস করি যে জন্মস্থানে আমার জন্য সুন্দর একটা জীবন অপেক্ষা করছে।”

দীর্ঘক্ষণ একে অন্যের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বেলা মোলায়েম স্বরে জানাল, “আমি এতে কোনো ভুল দেখছি না মিঃ আফ্রিকা। আমাদের সাথে কথা বলতে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা রইল। সময় মতো যোগযোগ করা হবে।”

বেন চলে যাবার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত বেলা কিংবা মিকীন কেউ কোনো কথা বলল না। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে গেল বেলা। নিচে তাকাতেই বেন’কে দেখতে পেল। ওভারকোট খুলে উপরে তাকিয়ে বেলা’কে দেখল বেন। বিদায়ের ভঙ্গিতে এক হাত তুলে চলে গেল বেন।

“ওয়েল”, পাশ থেকে বলে উঠলেন মিকীন, “আমরা এর নাম লিস্ট থেকে কেটে দিতে পারি।”

“কেন?” জানতে চাইল বেলা; অবাক হয়ে গেল মিকীন। ভেবেছিল বেলাও তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যাবে।

“ছেলেটার কোয়ালিফিকেশন, অভিজ্ঞতা…”

“গায়ের রঙ?” বলে উঠল বেলা।

“হ্যাঁ, সেটাও। মাথা নাড়লেন মিকীন। “ক্যাপরিকর্নে হয়ত তার নিচে শ্বেতাঙ্গ’রা কাজ করবে। তাই শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদেরকে আদেশ দেয়া, শ্বেতাঙ্গ নারীদের সাথে কাজ করা; ব্যাপারগুলো তেমন ভাল দেখাবে না।”

“কিন্তু অন্যান্য কোর্টনি কোম্পানিতেও না হলেও আরো ডজন খানেক কৃষাঙ্গ ম্যানেজার আছেন।” মনে করিয়ে দিল বেলা।

“হ্যা” তাড়াতাড়ি মেনে নিলেন মিকীন।

“কিন্তু তাদের অধস্তন সকলেই তো কৃষাঙ্গ; শ্বেতাঙ্গ নয়।”

“আমার বাবা আর ভাই কালো’দের উন্নতির ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট। বিশেষ করে আমার ভাইয়ের মতে, দেশের মাঝে শান্তি আর ঐক্য স্থাপন করার জন্য, প্রয়োজন সকলের মাঝে দায়িত্ব বোধ গড়ে তোলা আর সমৃদ্ধি অর্জন।

‘আমি’ও এ মত’কে একশ ভাগ সমর্থন করছি।”

“আমার তো মনে হয়েছে মিঃ আফ্রিকা বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন তরুণ। তবে হ্যাঁ বয়সে একটু বেশিই তরুণ। আর অভিজ্ঞতারও ঘাটতি আছে। তাই সিনিয়র পোস্ট হয়ত দেয়া যাবে না, কিন্তু-”।

নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সাথে সাথে অবস্থান বদলে ফেললেন-মিকীন “আমার ধারণা মিঃ আফ্রিকাকে ডিরেক্টর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পোস্টের জন্য শর্ট লিস্টেড করা যায়।”

“আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। নিজের সবচেয়ে চমৎকার হাসিটা হাসল বেলা।

বিকেল চারটায় শেষতম ক্যান্ডিডেন্ডের ইন্টারভিউ নেয়ার পর বার্কলে হোটেলে ফিরে গেলেন মিকীন। সাথে সাথে মাকে ফোন করল বেলা,

“দ্যা লর্ড কিচেনার হোটেল, গুড আফটারনুন” মায়ের গলা চিনতে পারল। বলে উঠল, “হ্যালো তারা, আমি ইসাবেলা” খানিকটা থেমে আরো জানালো, “ইসাবেলা কোর্টনি, তোমার মেয়ে।”

“বেলা, মাই বেবি। কতদিন হয়ে গেছে অন্তত আট বছর। আমি তো ভেবেছিলাম যে তুমি তোমার বুড়ি মাকে ভুলেই গিয়েছে” ইসাবেলাকে সবসময় অপরাধবোধে ফেলে দেন এই নারী। আমতা আমতা করে বেলা জানাল, “অ্যায়াম সরি, তারা। এত ব্যস্ততা, জানোই তো…”

“হ্যাঁ। মিকি জানিয়েছে যে তুমি কতটা বুদ্ধিমান আর সফলতার সাথে দায়িত্বও পালন করছ। তুমি তো নাকি এখন ড, কোর্টনি আর একজন সিনেটর” হঠাৎ করেই ফেটে পড়লেন তারা, “কিন্তু বেলা, এসব বর্ণবাদী হামবড়া ভাব দেখানো জাতী পার্টির বুড়োরগুলোর সাথে তুমি কী করো? কোন সভ্য সমাজ হলে এতদিনে জন ভরস্টারের কোনো পাত্তাই থাকত না।”

“তারা, বেন আছে?” মা-কে থামিয়ে দিল বেলা।

“আমি তো ভেবেছিলাম যে আমার মেয়েটা হয়ত আমার সাথেই কথা বলতে চেয়েছে তারা’র কণ্ঠে ঝড়ে পড়ল বিষণ্ণতা। “ঠিক আছে বেন’কে ডেকে দিচ্ছি।”

“হ্যালো বেলা।” প্রায় সাথে সাথে উত্তর দিল বেন।

“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।” জানাল বেলা।

“কোথায়?” দ্রুত ভেবে নিয়ে জানাল “হ্যাচাডস।”

“পিকাডোলি’র বুক শপ? ঠিক আছে, কখন?”

“কাল সকাল দশটায়।”

আফ্রিকান ফিকশন সেকশন দাঁড়িয়ে আছে বেন। পাশে দাঁড়িয়ে শেল্ফ থেকে বই তুলে নিল বেলা।

“বেন, আমি এসব সম্পর্কে কিছুই জানি না।”

“আমি শুধু একটা চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছি বেলা, ব্যস। সহজ হিসাব।” হেসে ফেলল বেন।

“আমি অন্যকিছু জানতেও চাইনা।” দ্রুত বলে উঠল বেলা, “শুধু এটুকু বল যে আফ্রিকা নামে তোমার সব কাগজ-পত্র বৈধ তো?”

“তারা তার কৃষাঙ্গ এক বন্ধু সম্পত্তির নামে আমার বার্থ সার্টিফিকেট বের করেছে। আমার বাবাকে কখনোই বিয়ে না করতে তাদের সম্পর্কটা বৈধ ছিল না। হয়তো মোজেস গামা’কে বিয়ে করা আর আমাকে জন্মদানের জন্য তাকে জেলেও যেতে হত।” বেশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানাল বেন। ছেলেটার মুখে রাগ কিংবা তিক্ততার কোনো ছায়াই দেখল না বেলা। “অফিসিয়ালি তাই আমি বেনজামিন আফ্রিকা। এই নামেই বার্থ সার্টিফিকেট আর সাউথ আফ্রিকান পাসপোর্টও আছে।”

“তোমাকে খানিকটা সাবধান করে দিচ্ছি বেলা। কোর্টনি পরিবার এ বিষয়টা নিয়ে বেশ ক্ষেপে আছে। তোমার বাবা নানা মানে সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এর স্বামীকে খুন করেছেন।”

“হ্যাঁ, আমি জানি।”

“দক্ষিণ আফ্রিকা তুমি আর আমি কেউ কখনো পরিচিতের মতো আচরণ করতে পারব না।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“যদি নানা অথবা বাবা কেউ কখনো তোমার সম্পর্কে জানতে পারে-ওয়েল, কী যে ঘটবে আমি কল্পনাও করতে পারছি না।”

“আমার কাছ থেকে উনারা কিছুই জানতে পারবেন না।”

“যদি আমার কথা বলো তো, আমিও…” গলার স্বর নিচু করে বেলা জানাল, “বেন, সাবধানে থেকো। আমরা কখনই পরস্পরের তেমন কাছে আসতে পারি নি। তারপরেও তুমি আমার ভাই; তোমার কিছু হোক আমি চাই না।”

“থ্যাঙ্ক ইউ বেলা।” বেনে’র মুখে এখনো হালকা হাসি দেখে বেলা বুঝতে পারল যে এ দূরত্ব কিছুতেই ঘোচাবার-নয়।

তাই বলে চলল, “মাইকেল’কেও জানাব যে তুমি দেশে ফিরছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, সম্ভাব্য সব রকমভাবে তোমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি; তাই দরকার হলেই মাইকেলকে জানাবে। সরাসরি যোগাযোগ না করাই ভালো।”

হঠাৎ করেই হাতের বইটা ফেলে দিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা, “ওহ, বেন বেন! আমরা কতটা ভয়ংকর এক পৃথিবীতে বাস করি। ভাই-বোন হয়েও… এতটা নিষ্ঠুরতা যে কী বলল, আমি ঘৃণা করি। সত্যিই ঘৃণা করি এ সিস্টেম।”

“হয়ত পৃথিবীকে বদলানোর জন্য আমরা সাহায্য করতে পারি।”

বোনের আলিঙ্গনে সাড়া দিয়েই আবার চট করে আলাদা হয়ে গেল বেন আর বেলা।

“অনেক ব্যাপারই আছে, যা কখনো তোমাকে বলতে পারব না বেন। এ শক্তি আমাদের নাগালের বাইরে। বিরোধিতা করতে চাইলেই ধ্বংস হয়ে যাব। ওরা অনেক শক্তিশালী।”

“তারপরেও আমাদের কাউকে না কাউকে তো চেষ্টা করতেই হবে।”

“ওহ, গড, বেন। তুমি তো এভাবে কথা বলে আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ।”

“গুড বাই, বেলা।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বলে উঠল বেন। “যদি সবকিছু খানিকটা অন্য রকম হত, আমাদের সম্পর্কটাও হয়ত মধুর হত।” হাতের বই শেঙ্কে রেখেই গট গট করে হেঁটে বের হয়ে গেল বেন। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।

***

জোহানেসবার্গ এলেই গ্যারি আর হোলির বাসায় উঠে ইসাবেলা; কয়েক বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে।

ফুল-টাইম মা আর স্ত্রী হবার আগে হোলি ছিল দেশের প্রথম সারির স্থপতিদের একজন। ওর নকশা আন্তর্জাতিকে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ও পেয়েছে। তাই নিজেদের বাড়ি করার সময়ে তাকে উদার হস্তে বাজেট দিয়েছে গ্যারি। তাই অনিন্দ্য সুন্দর এই বাড়ি ওয়েন্টেভেদ্রেনের চেয়েও বেশি পছন্দ করে বেল।

ছোট্ট লেকের মাঝখানে বানানো মনুষ্য নির্মিত দ্বীপে বসে ব্রেকফাস্ট করে পুরো পরিবার। ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি গ্যারির ছেলে-মেয়েরা আর সবচেয়ে ছোটজন। এক বছর বয়সী নিজের গড-ডটারকে ফিডার খাওয়াচ্ছে বেলা। আর ভেতরটা হাহাকার করছে নিজের অতৃপ্ত মাতৃত্বের জন্য।

টেবিলের মাথায় বসে উজ্জ্বল পোশাক পরিহিত গ্যারি দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়েছে। “কে আমাকে কমজোরি বলতে চায়? আমি বুঝি সামান্যতেই আহত হই?” গড ডটারের মুখে চামচ ভর্তি ডিম ঢুকিয়ে দিল বেলা।

“ব্যাপারটা তা না।” বোনকে তোষমোদ করে উঠল গ্যারি। “আজ সকালে আমার পাঁচটা মির্টি আছে, সন্ধ্যায় হোলি’র চ্যারিটি বল।”

তুমি চাইলেই যে কোনো একটা কিংবা সবকিছুই বাতিল করে দিতে পারো।” মনে করিয়ে দিল বেলা।

“দেখো, সেখানে এত এত রাজনীতিবিদ আর জেনারেলরা থাকবেন যে আমি চাইলেই যে কোনো কিছু করতে পারবনা।

“শুধু শুধু বাহানা বানিও না, টেডি বিয়ার, সত্যিটা আমরা সকলেই জানি।”

হোলি’র দিকে তাকাল গ্যারি, “সন্ধ্যায় কখন যেতে হবে যেন?” কিন্তু ননদের পক্ষ নিল হোলি।

“কেন তুমি বেলা’কে দিয়ে এসব জঘন্য ব্যবসার কাজ করাচ্ছ?”

“আমি কিছুই করছি না।” অবাক হয়ে গেল গ্যারি।” এটা পুরোপুরি ওর সিদ্ধান্ত।” হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে ফাঁকা গর্জন করে উঠল, “এই যে দুষ্ট ছেলে-পেলের দল, স্কুলের জন্য দেরি হচ্ছে তো!” সারি বেঁধে বাবাকে কিস করে ব্রিজের উপর দিয়ে সৈন্যদের মতো সার্চ করতে করতে চলে গেল পিচ্চিরা।

“আমিও যাচ্ছি।” গড় ডটারের মুখ মুছে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বেলা; কিন্তু বোনকে থামালো গ্যারি।

“লুক বেলা, মাফ চাইছি। জানি আমি বলেছিলাম যে তুমি পারবে না। কিন্তু তুমি যে, যে কোন পুরুষের মতই শক্ত তা-ও আমি জানি। “তোমাকে তার প্রমাণ দিতে হবে না।”

“তার মানে স্বীকার করছ যে তুমি আমাকে হাঁদারাম ভেবেছ?” জানতে চাইল বেলা।

“অল রাইট” হার মানল গ্যারি।

“আমি নিজেই তো এসব দেখতে চাই না। তাই ভেবেছিলাম তোমারও দরকার নেই।”

“আমি ক্যাপরিকর্নের ডিরেকটর” হাত ব্যাগ আর ব্রিফকেস গুছিয়ে নিল বেলা, “আটটায় দেখা হবে, তোমার সাথে।”

পোরশে’তে চড়ে বসতেই অপরাধ বোধে ছেয়ে গেল বেলার মন। কিন্তু এবার যদি সিনডেক্স-২৫-এর টেস্ট সফলভাবে হয়েছে কিনা জানিয়ে রিপোর্ট করতে পারে তাহলেই নিকি’র কাছে যেতে পারবে।

নতুন হাইওয়ে ধরে জার্মিস্টনে পৌঁছাতেও প্রায় এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। ক্যাপরিক কেমিকেলস্ প্রান্টের আর্কিটেক্ট হোলি হওয়াতে এটাকে মোটই কোনো ফ্যাক্টরি বলে মনে হয় না। এখানে লন্ আছে, গাছপালা আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিংগুলোকে আড়ালে রেখে কাঁচ আর ন্যাচারাল স্টোন দিয়ে ঢেকে রাখা দালানগুলোকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েকশত একর নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে পুরো স্থাপনা।

নিজের ইলেকট্রনিক কী-কার্ড দিয়ে গেইটের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বেলা। গাড়ি দেখে স্যালুট করল গার্ড। কারপার্ক ভর্তি গাড়িগুলোর বেশির ভাগই কালো লিমুজিন; মিনিস্টারিয়াল কিংবা মিলিটারি নাম্বার প্লেট লাগানো আছে প্রায় প্রতিটিতে।

লিফটে চড়ে ডিরেকটরস্ স্যুইটে ঢুকেই দ্রুত পুরো রুমে চোখ বোলালো বেলা। মাত্র বিশ জনের দলটাতে সে একাই নারী।

উপস্থিত কর্তা ব্যক্তিদের বেশির ভাগকেই চেনে বেলা। রিফ্রেশমেন্ট টেবিলে অ্যালকোহল থাকলেও কেউ কফি ছাড়া আর কিছু নেয়নি। কিন্তু তারপরেও এত নগ্ন বিভক্তি দেখে চমকে উঠল বেলা। ইংলিশ সেকশনের আলোচনার বিষয় হলো ফিন্যান্স আর কমার্স। অন্যদিকে হলে উপস্থিত আফ্রিকানারদের বিষয় রাজনৈতিক আর সামরিক শক্তি। কোর্টনিদের তুলনায় একেবারেই গরীব হলেও এদের রাজনৈতিক প্রভাব পুরো সমাজের উপর ছড়িয়ে আছে।

সেকেন্ডের মাঝেই রুমের মাঝে উপস্থিত সবচেয়ে প্রভাবশালীদের চিহ্নিত করে তাদের দিকেই এগিয়ে গেল বেলা। হ্যান্ড শেক আর হাসি বিনিময় করল। অন্যদের সাথে।

ডিফেন্স মিনিস্টারের সাথে হাত মিলিয়ে তাঁর ডেপুটির দিকে ফিরল বেলা।

“গুড মর্নিং জেনারেল ডিলারে” চোস্ত আফ্রিকান ভাষায় সম্ভাষণ জানাল বেলা। লোথার ডিলারের সাথে ছয় মাস লিভ টুগেদার করার পর বেলা’কে ছেড়ে ম্র ভদ্র একটা আফ্রিকান মেয়েকে বিয়ে করেছে লোকটা। নচেৎ এখন আর ডেপুটি মিনিস্টার হওয়া হত না।

“গুড মর্নিং, ডঃ কোর্টনি।” নম্র স্বরে জানালেও লোহার প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখছে বেলা’র শরীর।

নিজের মাঝে অভিমান থাকা সত্ত্বেও বেলাও আপন মনে সুদর্শন লোহারের প্রশংসা না করে পারল না। এখনো দশ বছর আগের মতই হালকা পাতলা রয়ে গেছে।

তোমার উপর আমি প্রতিশোধ নেবই। মনে মনে ভাবল বেলা; একবার তো লোথারের জন্য সুইসাইডও করতে গিয়েছিল। তাই তাকে লাল গোলাপের ইনফর্মার বানাতে পারলেই কলজে ঠাণ্ডা হবে। এরপর হঠাৎ করেই রামোনের কথা মনে পড়ল; ওর রামোন আর চোখের সামনে থেকে মুছে গেল লোথার।

আর ঠিক সময়ে চোখ পড়ল ক্যাপরিকর্নের জেনারেল ম্যানেজারের দিকে; চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির জন্য ক্ষমা চেয়ে স্বাগত বক্তব্য দিল বেলা। এরপর প্রজেকশন রুমে সকলকে আমন্ত্রণ জানাল।

আগে থেকেই হাই কোয়ালিটি প্রফেশনাল ভিডিও ফিল তৈরি করে রেখেছে ক্যাপরিক। অন্ধকার রুমের চারপাশে চোখ বোলালো বেলা। উপস্থিত সামরিক কর্তাব্যক্তিদের মাঝে এই নতুন অস্ত্র নিয়ে উত্তেজনার শেষ নেই। হা করে গিলছেন পর্দার প্রতিটি দৃশ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে সিনডেক্ট-২৫ প্রয়োগের চলমান চিত্র দেখাচ্ছে, ভিডিও ফিল্ম।

পল সালে, তেল আবিবের ইস্রায়েলী টেকনিক্যাল ডিরেকটর, উঠে দাঁড়াতেই একের এক এক প্রশ্নবানে ভদ্রলোককে জর্জরিত করে ফেললেন সবাই। ইসাবেলা খেয়াল করে দেখলেন যে বেন নেই। রুমের পেছনে কোথাও লুকিয়ে আছে সেই বাদামি মুখ। হঠাৎ করেই বেলার মতো করেই একজন জেনারেল জানতে চাইলেন,

“এই গ্যাস কী কখনো মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল? আমাদেরকে সবিস্তারে জানান।”

“হয়ত জেনারেল আমাদেরকে অ্যাংগোলা থেকে ধৃত কয়েকজন কিউবিনা যুদ্ধবন্দি দেখাতে পারবেন।” ডিরেকটরের কথা শুনে হেসে কুটি কুটি হলো পুরো রুম। “সিরিয়াসলি জেনারেল, আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো না। কিন্তু ল্যাবরেটরি কন্ডিশনে দারুণ রেজাল্ট পাওয়া গেছে। আর সত্যি কথা বলতে আজই আপনাদের জন্য প্রথম টেস্ট চাক্ষুষ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

মিনিস্টারের কালো ক্যাডিলাককে সামনে রেখে পুরো দলটা চলল হাফ মাইল দূরের পেস্টিসাইড আর পয়জন ডিভিশনের উদ্দেশ্যে। মিনিস্টারের সাথে পেছনের সিটে বসে প্ল্যান্টের সম্পর্কে জানাচ্ছে ইসাবেলা।

ডিফেন্স মিনিস্টারের মেজাজ অত্যন্ত কড়া স্বভাবের হলেও তার সাথে বেলা’র সম্পর্ক বেশ সহজ আর লোকটার রাজনৈতিক সফলতাকে শ্রদ্ধা করে বেলা। অবশেষে মেইন কমপ্লেক্সের ভেতর পৃথক অংশটার সামনে এসে থামল গাড়ির বহর।

বারো ফুট বেড়া দিয়ে ঘেরা এলাকার গেইটে ঝুলছে তিন ভাষায় লেখা সতর্ক সংকেত। মেইন গেইটের গার্ডদের সাথে রটওয়েলার জাতের কুকুরও আছে। সকলকেই এমনকি মিনিস্টারকেও যেতে হলো ইলেট্রিক স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে।

একগাদা কার্পেট পাতা করিডোরের মাঝে দিয়ে পথ দেখালেন ইস্রায়েলী ডিরেক্টর অবশেষে নতুন সিনডেক্স এক্সটেনশন এলো। পুরো দালানটা এতটাই নতুন যে কাঁচা কংক্রীটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ছোট্ট এন্ট্রান্স লবিতে এসে সকলেই জড়ো হবার পর স্বাগতম জানালেন ডিরেক্টর।

“দালানের এই অংশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত জোরদার করে তোলা হয়েছে। এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, সর্বদা পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাতাসের কোয়ালিটি। দশ সেকেন্ডের মাঝেই বাতাস পাম্প করে ফেলে দিয়ে পরিবর্তন করে দেয়াও সম্ভব এখন।” আরো কয়েক মিনিট ধরে কেবল নিরাপত্তা নিয়েই বক বক করলেন ডিরেকটর। “কিন্তু তারপরেও সুরক্ষার নিশ্চয়তার জন্য মেইন প্ল্যান্টে ঢোকার আগে প্রটেকটিভ স্যুট পরতে হবে।

পৃথক পৃথক চেঞ্জিং রুমে সকলের জন্য রাখা আছে সাদা প্লাস্টিকের ওভারঅল, জুতা গ্লাভস্ আর হেলমেট। স্যুট পরে নিয়ে লবি’তে এসে বাকিদের সাথে যোগ দিল বেলা।

“যদি আমরা সকলেই প্রস্তুত থাকি মাই লেডি অ্যান্ড জেন্টেলমেন” দেয়ালের দিকে দরজা বরাবর হাঁটতে শুরু করলেন ডিরেকটর। অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে চারজন টেকনিশিয়ান। ইসাবেলা খেয়াল করে দেখল যে টেকনিশিয়ানদের ড্রেসের রঙ হলুদ আর ডিরেকটর পরে আছেন লাল। হলুদ স্যুট পরা একজন টেকনিশিয়ান সকলকে পথ দেখিয়ে আরেকটা চিকন করিডোরে নিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বেলা’র পাশে চলে এলো সেই তরুণ।

“গুড মর্নিং। ডঃ কোর্টনি” মোলায়েম গলার স্বরটা চিনতে পেরেই লোকটার দিকে তাকাল বিস্মিত বেলা।

“হ্যালো, মিঃ আফ্রিকা” বিড়বিড় করে উঠে জানতে চাইল, “ক্যাপরিকর্নের চাকরি কেমন লাগছে?” লন্ডন থেকে আসার পর এই প্রথম তাকে দেখল বেলা।

“ইন্টারেস্টিং থ্যাঙ্ক ইউ।” টেস্ট রুমে ঢোকার আগে দু’জনের মাঝে কেবল এটুকুই কথা হল। কিন্তু বেলা’কে খেয়াল করছিলেন লোথার। চামড়ার আর্মচেরারে বসার পর বেলার পাশে বসে পড়ে লোথার জানতে চাইলেন” কে এই নিগার?”

“উনার নাম আফ্রিকা। কেমিকেল ইঞ্জিনিয়াভের ডিগ্রি আছে।”

“আপনি কিভাবে চেনেন?”

“আমি সিলেকশন কমিটিতে ছিলাম।”

“সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স আছে নিশ্চয়ই?”

“অবশ্যই। আপনার ডিপার্টমেন্ট-ই তো দিয়েছে।” কাটা কাটা জবাব শুনে ডিরেকটারের দিকে তাকালেন লোথার।

“এগুলো হলো টেস্ট কিউবিকলস” ছোট ছোট চারটা কেবিনেটের সাথে টেলিফোন ব্যুহের চেয়ে টয়লেট কেবিনেটেরই মিল বেশি। ভাবল বেলা।

“কেবিনেটের দেয়ালে লাগানো জানালাতে ডাবল আমারড গ্লাস লাগানো আছে। প্রতিটির উপরে আবার মনিটরও আছে।” ইলেকট্রনিক প্যানেল দেখিয়ে দিলেন ডিরেকটর।

জানালার পেছনে সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে চারটা মানবসদৃশ জীব। এক মুহূর্তের জন্য ইসাবেলার’র মনে হলো যে এগুলো হয়ত মানব শিশু।

“টেস্ট সাবজেক্ট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে বেবুন। লোম হেঁটে এগুলোকে মানুষের কাছাকাছি আদল দেয়া হয়েছে। নাম্বার ওয়ান গায়ে প্রায় কিছুই নেই।”

“নাম্বার টু সাধারণ মিলিটারি ইউনিফর্মের মতো পোশাক পরে আছে।”

“নাম্বার থ্রীর চোখ, নাক আর মুখ ব্যতীত প্রায় পুরো শরীরটাই ঢাকা।”

“আর নাম্বার ফোর ঠিক আপনাদের মতোই প্রটেকটিভ স্যুট পরে আছে।”

ইসাবেলার পেটের মাঝে গুড়গুড় শব্দ শুরু হলো। আর পরিষ্কার বাতাস পাওয়া সত্ত্বেও মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

“সিনডেক্স-২৫ এর কোন রঙ কিংবা গন্ধ নেই। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের গ্যাসে আমন্ডের গন্ধ মেশানো হয়েছে। মনিটরিং ইকুপমেন্ট ছাড়া কোনো ধরনের কুয়াশা কিংবা কিছুই দেখা যাবে না।” খানিক বিরতি দিলেন ডিরেক্টর। গলা পরিষ্কার করে বলে উঠলেন, “নাউ জেন্টেলমেন অ্যান্ড মাই লেডি, আপনারা তৈরি থাকলে আমরা ডেমনস্ট্রেশন শুরু করছি।”

হেলমেট পরিহিত মাথা নাড়লেন মিনিস্টার। ডেস্কে থাকা মাইক্রোফোনে কী যেন অর্ডার দিলেন ডিরেকটর। পেছন দিককার রুমে কন্ট্রোল নিয়ে কিছু একটা করছে হয়তো বেন কিংবা অন্য টেকনিশিয়ান; ভাবলো বেলা।

কয়েক সেকেন্ড কিছুই ঘটল না। স্বাভাবিকভাবেই নিঃশ্বাস নিচ্ছে বেবুনগুলো। এরপরই বাতাসে সিনডেক্স-২৫ পরিমাপক প্যানেলটা ধপ করে জ্বলে উঠল। জিরো থেকে রেঞ্জ উঠে গেল পাঁচ পর্যন্ত।

পর মুহূর্তেই বদলে গেল দৃশ্য। সারা শরীর আবৃত্ত বেবুনটা ছাড়া বাকীগুলোর হার্টবিট দ্রুত বেড়ে গেল; ডিসপ্লে প্যানেল দেখাচ্ছে সবচেয় ভয়ানক অবস্থায় পড়ল নগ্নদেহ বেবুন।

প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়েও তাকিয়ে রইল বেলা। বেবুনটার চোখের পাতা কেঁপে উঠতেই চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝড়তে লাগল। মুখের ভেতর দুলছে জিহ্ববা আর বুকের উপর গড়িয়ে পড়ল লালা।

“পনের সেকেন্ড” ডিরেকটরের গলা শোনা গেল, সাবজেক্ট নাম্বার ওয়ান পুরোপুরিভাবে অর্থ হয়ে পড়লেও অক্ষত আছে নাম্বার ফোর। দ্বিতীয় আর। তৃতীয় জনের অবস্থা’ও মিডিয়াম মাত্রার।”

শরীরে এঁটে বসে থাকা স্ট্র্যাপ খোলার জন্য প্রাণপণে লড়ছে নগ্নদেহী বেবুন। হঠাৎ করেই মুখ খুলে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল। জোড়া পাল্লা লাগানো জানালা ভেদ করেও পরিষ্কার শোনা গেল সে শব্দ। ইসাবেলা মনে হলো আর সহ্য করতে পারছে না; পেটের মধ্যে কী যেন পাঁক দিয়ে উঠছে। দু’হাত মুঠি করে শক্ত হয়ে বসে রইল। পাশে বসে থাকা লোথারসহ অন্যরাও অস্বস্তিতে পড়েছে। এরা সকলেই সৈন্য আর পুলিশের লোক হলেও এতটা করুণ দৃশ্য সকলকেই নাড়া দিয়েছে।

উদোম গায়ে থাকা তিনটা বেবুনই মাথা নাড়ছে, পা ছুঁড়ছে। জিভ আর খোলা মুখ পুরোপুরি রক্ত লাল ধারণ করেছে। আই বলের চারপাশে রক্ত জমে ফুটে উঠেছে শিরা। বমি শুরু করে দিল বেবুনের দল। প্রথমে বেলুনের পরনে থাকা ন্যাপি ভিজে গেল। প্রস্রাব পায়খানা করে দিচ্ছে অবলা জীবগুলো।

ইসাবেলার ইচ্ছে হলো চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যায় এ আতঙ্ক থেকে।

“এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ড; এরপরই জীবনের সমস্ত স্পন্দন হারিয়ে ফেলেছে নাম্বার ওয়ান।” ঝুলতে লাগল ছোট্ট শিশুর মতো দেহ।

“দুই মিনিট পনের সেকেন্ড। নাম্বার টু টার্মিনেটেড।”

“তিন মিনিট আট সেকেন্ড। নাম্বার থ্রি টার্মিনেডেট।”

“আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে নাম্বার ফোরের বিন্দুমাত্র কোনো ক্ষতি হয়নি। পরনের স্যুট এটিকে সুরক্ষিত রেখেছে।”

উঠে দাঁড়াল বেলা।” এক্সকিউজ মি, ছুটে বের হয়ে গেল ইসাবেলা। ধুপধাপ করে করিডোর পার হয়ে উইমেন চেঞ্জিং রুমে ঢুকে পড়ল।

মাথা থেকে হেলমেট খুলেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে আঁকড়ে ধরল পোর্সেলিনের তৈরি ঠাণ্ডা টয়লেট বোল। হড়হড় করে বমির সাথে বেরিয়ে এলো যত আতঙ্ক, অনুশোচনা আর অপরাধবোধ।

***

এইমাত্র যে অভিজ্ঞতা হলো এরপর গ্যারি আর হোলি’র ওই চমৎকার বাসায় ফিরতে মোটেই ইচ্ছে করছে না।

মিনিস্টার লোথার কিংবা অন্য কারো সাথে দেখা না করেই ক্যাপরিক প্ল্যান্ট ছেড়ে চলে এলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে কেবল পোরশে’তে তুলল। গতির ঝড়। ঘণ্টাখানেক পর আবারো জোহানেসবার্গে ফিরে পোরেশে’র গতি কমাতে বাধ্য হলো।

ফুয়েল-ট্যাঙ্ক বলতে গেলে একেবারে খালি। সার্ভিস স্টেশনে আসতেই বুঝতে পারল রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। অ্যাটেনড্যান্টের কাছে জানতে চাইল স্যান্ডটনে ফেরার পথ। ছেলেটা রাস্তার নাম জানাতেই বেলা’র মনে হলো ওর অবচেতন মন কিংবা ভাগ্যদেবীই তাকে নিয়ে এসেছেন এখানে। আর মাত্র দুই কি তিন মাইল দূরেই মাইকেলের বাসা। কয়েক বছর আগে পঞ্চাশ একরের উপর তৈরি ভাঙ্গাচোরা একটা ফার্ম হাউজে নিয়ে এসেছিল মাইকেল। গোল্ডেন সিটি মেইলের অফিসও কাছেই। বাড়ি ভর্তি শখানেক ফলের গাছ লাগিয়েছে মিকি আর ছেড়ে দিয়েছে এক পাল মুরগী। “ওয়েল এটা ওগুলোর’ও বাসা।” রান্নাঘর। সিঙ্ক আর ফ্রিজের দরজায় মুরগির হাগু দেখে আঁতকে উঠা বেলাকে বুঝিয়েছে মাইকেল।

“মাইকেল!” ভাইয়ের কথা মনে হতেই খুশি হয়ে উঠল বেলা। হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখর মাত্র ছয়টা। এতক্ষণে নিশ্চয় বাসায় চলে এসেছে। এখন আমার আসলে মাইকেলকেই দরকার।”

আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে মাইকেলের এস্টেটের সামনে উঠে এলো পোরশে। পার্ক করে রাখা ভোক্সওয়াগন কোমবি দেখে বোঝা গেল যে অবশেষে বিদায় নিয়েছে মিকি’র বহুদিনের সাথী ভ্যালিয়ান্ট। মনে পড়ল মাইকেল বলেছিল কিভাবে রাশ আওয়ারে রাস্তার মাঝে শর্ট সার্কিট হয়ে জ্বলে উঠে পাঁচ মাইল লম্বা ট্রাফিক জ্যাম বাধিয়ে দিয়েছিল গাড়িটা; তবে কোমরি’র অবস্থাও তার চেয়ে বেশি পদের বলে মনে হলো না।

মাইকেলের বাড়ির টিনের ছাদের অর্ধেকের রং ফ্রেশ আপেলের মতো সবুজ আর বাকি অর্ধেক মরচে পড়া। মেরাতের মাঝপথেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে মিকি।

নিজের প্রপার্টির মাঝে ল্যান্ডিং স্ট্রিপও বানিয়েছে মাইকেল। ফল বাগানের শেষ মাথায় হ্যাঙ্গারে থাকে সেসনা সেঞ্চুরিয়ন এয়ারক্রাফট।

সাদা-নীল এয়ারক্রাফটের ভেতরে ভাইকে খুঁজে পেল বেলা। ওভারঅলের পা ধরে টান দিতেই হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো বিস্মিত মিকি। দু’ভাই-বোন পরস্পরকে প্রায় বছর খানেক হলো দেখেনি।

পুরনো রেফ্রিজারেটর থেকে ওয়াইনের বোতল এনে দুই গ্লাসে ঢালল মাইকেল। আর তখনই বেলা’র মনে হলো যে কোনো কারণে নার্ভাস হয়ে আছে মাইকেল। বারে বারে নিজের ঘড়ি আর হ্যাঙ্গারের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে অসন্তুষ্ট হলো বেলা।

“তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছ?” জিজ্ঞেস করল বেলা, জানাল, আই এম সরি মিকি; তোমাকে আগেই ফোন করা উচিত ছিল। আশা করি রাগ করোনি।”

“আরে নাহ্, তা না। তাড়াতাড়ি বলে উঠল মিকি “কিন্তু কেন যেন স্বস্তিও পেল, “আসলে…সত্যি কথা বলতে…” আটকে গেল মিকি’র কথা। আবারো গলা বাড়িয়ে দরজার দিকে তাকাল।

নিশ্চয় ওর লাভার, তিক্ততায় ছেয়ে গেল বেলা’র মন। মিকি ভয় পাচ্ছে যে আমি ওর ছেলে বন্ধুকে দেখে ফেলব। নাহ্ ভাল লাগছে না। ভাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো বেলা।

গাড়ি চালিয়ে চলে আসার সময় রিয়ারভিউ মিররে ভাইয়ের একাকী দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখে অবশ্য বেলার রাগ পানি হয়ে গেল।

বেচারা মিকি, ভাবল বেলা; তুমিও আমার মতই ছন্নছাড়া।

মেইনরোডে এসে পূর্ব দিকে গাড়ি ছোটাল; গন্তব্য স্যান্ডটন। সামনে। থেকে আসছে আরেকটা গাড়ি। ধূসর রঙা ভ্যান। পাশাপাশি আসতেই ড্রাইভারকে দেখে সিধে হয়ে বসল বেলা। বেন। বেলা’কে দেখতে পায়নি বেন, পাশে বসে থাকা কৃষাঙ্গের সাথে মশগুল হয়ে গল্প করছে।

পোরশে’র গতি ধীর করে রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে রইল বেলা। হঠাৎ করেই মোড় ঘুরে ভ্যানটা চলে গেল মাইকেলের বাড়ির দিকে।

“যাক, রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।” পোরশে’র গতি বাড়াল বেলা। “যদিও বুঝতে পারছি না, মাইকেল কেন চায়নি যে আমি বেনকে দেখে ফেলি। কিন্তু পাশের লোকটা কে?”

প্রায় আটটার দিকে স্যান্ডটনে গ্যারি বাড়ির গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করল বেলা। ততক্ষণে অস্ত গেছে সূর্য।

“ড্যাম ইট” লিভিং রুমে ঢুকতেই খেঁকিয়ে উঠল গ্যারি, “কোন চুলায় ছিলে এতক্ষণ? জানো কয়টা বাজে?” গ্যারি আর হোলি দু’জনেরই পরনে ইভনিং ড্রেস। গ্যারিকে কখনো এতটা রাগ করতে দেখেনি বেলা।

“ওহ মাই গড! দ্য বল! আয়্যাম সরি!”

এরপরই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে গলে গেল গ্যারি, “আহারে বেচারি, চোহারার কী হাল হয়েছে দেখ। যাও, আমরা অপেক্ষা করছি, চেঞ্জ করে এসো।”

“না” তাড়াতাড়ি বলে উঠল বেলা, “তোমরা রওনা দাও, আমি আসছি।”

সারা সন্ধেটা মাটি হলো। একটা বোরিং ইউনিভার্সিটি প্রফেসরকে ওর পার্টনার করে দিল হোলি। বেলা সিনেটর হওয়াতে সারা সন্ধ্যা নোকটা শুধু রাজনীতি নিয়েই বকবক করল।

তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলো বেলা। সারারাত ঘুমের মাঝেও অসহায় বেবুনগুলোকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখল। কখন যেন আবার বেবুনের চেহারা মুছে গিয়ে ভেসে উঠল ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরা নিকির মুখ। আতঙ্কে ঘামে নেয়ে উঠল বেলা’র শরীর।

সারা শরীর এতটাই কাঁপছে যে ঘুমোতেও ভয় লাগছে। ভোর না হওয়া পর্যন্ত চেয়ার নিয়ে জানালার কাছেই বসে রইল। এরপর হাতের বই রেখে গোসলে যাবার জন্য উঠতেই দরজায় টোকার শব্দ শুনে খুলতেই দেখল ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে গ্যারি। মাথার সব চুল এলোমেলো, চোখ ভর্তি এখনো ঘুম।

“এই মাত্র ওয়েন্ট্রেভেদেন থেকে বাবা ফোন করেছিল” জানাল গ্যারি।

“এই সময়ে? সব ঠিক আছে? নানা?

“না। আমাকে জানিয়েছে যে তোমাকে বলি যে ওরা দুজনেই সুস্থ আছে।”

“তো, কেন ফোন করেছে?”

“আমি আর তুমি যেন এক্ষুণি ওয়েল্টেভ্রেদেন যাই।”

“আমরা দুজনেই?

“হ্যাঁ। তুমি আর আমি। এক্ষুণি।” !

“কেন বলেনি?

“বলতে চায়নি, শুধু জানিয়েছে এটা নাকি জীবন আর মৃত্যুর প্রশ্ন।”

একদৃষ্টে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা, “কী হতে পারে?”

“কত দ্রুত রেডি হতে পারবে? আধা ঘণ্টা?”

“হ্যাঁ, ঠিক আছে।”

“আমি ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টে ফোন করে লিয়ার রেডি করে পাইলটকে স্ট্যান্ডবাই রাখার জন্য ফোন করে দিচ্ছি।” হাতঘড়ির দিকে তাকাল গ্যারি, “দশটার আগেই কেপ টাউনে পৌঁছে যাব।”

কেপ টাউনের ডি এফ মালান এয়ারপোর্টে নামতেই দেখা গেল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে ক্লোনকি।

গান রুমে অপেক্ষা করছেন শাসা আর সেনটেইন। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী এই রুমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কদর্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাই রুমে ঢোকার আগে খচখচ করে উঠল বেলা’র মন।

পুরাতন ডেস্কের পেছনে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নানা আর বাবা। দু’জনের অভিব্যক্তিতে এমন একটা কিছু ছিল যে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল বেলা, ওর সাথে পিছন থেকে ধাক্কা খেল গ্যারি।

“কী হয়েছে?” ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল বেলা আর ঠিক তখন বুঝতে পারল ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ন্যানি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন বুড়ি মহিলা। চোখ দুটো পুরো লাল, এক হাতে ভেজা রুমাল ধরে বলে উঠল,

“ওহ মিস বেলা, নাক টানল ন্যানি, “অ্যায়াম সো সরি, চাইল্ড, তোমার জন্যই এটা করতে বাধ্য হয়েছি…”

“কী বলছ ন্যানি? “ন্যানি’র দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল বেলা।

ডেস্কের উপর পড়ে থাকা জানাল দেখে মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাব।

বেলা’র চামরায় মোড়া জার্নাল ন্যানি ওর সেইফে হাত দিয়েছে।

“এটা তুমি কী করেছ ন্যানি?” হতাশায় গুমড়ে উঠল বেলা, “তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছ।”

“মাই বেবি! ওহ্, ন্যানি তুমি এটা কিভাবে করলে!”

জার্নালের খোলা পাতায় দেখা যাচ্ছে নিকি’র চুল। পাশেই পড়ে আছে ওর ছোট্ট বেলার জুতা আর বার্থ সার্টিফিকেট।

“হতচ্ছাড়া বুডি” ক্ষেপে উঠল বেলা, “এটা তুমি কী করলে, তমি আমার নিকি’কে মেরে ফেলেছ। এর জন্য কক্ষনো মাফ করব না, কক্ষনো না।”

দু’হাতে মুখ ঢেকে রুম থেকে চলে গেল ন্যানি।

“এটা করেছে কারণ ও তোমাকে ভালবাসে, বেলা।” তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন শাসা।” ও যেটা আজ করেছে সেটা তোমার আট বছর আগেই করার কথা ছিল।”

“এটা মোটেই ওর মাথা ব্যথা নয়। তোমাদের কারোও নয়। আসলে বুঝতেই পারবে না তোমরা কেউ। তাহলে ভয়ংকর বিপদে পড়ে যাবে নিকি আর রামোন।”

দৌড় দিয়ে ডেস্কের কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে জার্নালটা তুলে বুকের কাছে ধরে রাখল বেলা।

“এটা আমার। তুমি এর ভেতরে নাক গলাতে এসো না।”

“কী হচ্ছে? কী এসব?” বেলার পাশে এসে দাঁড়াল গ্যারি।

“কাম অন, বেলা। উই আর আ ফ্যামিলি। উই স্ট্যান্ট টুগেদার।”

হ্যাঁ বেলা, গ্যারি সত্যি কথাই বলছে।”

“যদি তুমি আমাদেরকে তাই মনে কর” শাসাকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন; ডেস্কের পিছনে বসে পড়ে বললেন, “একে অন্যের উপর দোষ ছুঁড়লেই কোনো লাভ হবে না। সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে হবে। বসো, বেলা। বেশিরভাগটাই অনুমান করতে পারছি; বাকিটা আমাদেরকে তুমিই না হয় জানাও। নিকি আর রামোন সম্পর্কে সব খুলে বলল।”

ইসাবেলার মনে হল হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। পায়ের নিচে কাঁপছে পুরো দুনিয়া। বোনের কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিতে চাইল গ্যারি।

“ইটস্ ওকে বেলা; আমরা সবাই তোমার সাথে আছি। এখন বলো নিকি কে? আর রামোনই বা কে?”

“নিকি আমার সন্তান আর রামোন ওর পিতা।” নরম স্বরে বলে উঠল বেলা; ভাইয়ের বিশাল বুকে মুখ লুকিয়ে শক্ত করতে চাইল নিজেকে।

খানিকক্ষণ বেলা’কে মন ভরে কাদার সুযোগ দিয়ে টেলিফোন তুললেন সেনটেইন।” আমি ডাক্তার মন্তারস’কে ফোন দিচ্ছি। এসে বেলা’কে ওষুধ খাইয়ে শান্ত করবেন।”

তড়িৎ বেগে দাদীর দিকে তাকাল বেলা, “না, নানা, আমার কিছুই দরকার নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে শুধু এক মিনিট দাও।”

ক্রেডলে ফোন রেখে দিলেন সেনটেইন। চামড়ার গদি আটা সোফাতে বোন’কে ধরে বসিয়ে দিল গ্যারি; নিজেও ওর পাশে বসে পড়ল। অন্য পাশে এসে বসলেন শাসা। দু’পাশ থেকে দুজন মিলে বেলাকে ধরে রাখলেন।

“অল রাইট” অবশেষে বলে উঠলেন সেনটেইন “যথেষ্ট হয়েছে। তুমিও পরে কাদার বহু সময় পাবে; এখন কাজের কথায় আসা যাক।”

সোজা হয়ে বসল বেলা; বুক পকেট থেকে রুমাল বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন শাসা।

“বলো যে কিভাবে এসব ঘটেছে” আদেশ দিলেন সেনটেইন।

বড় করে একটা শ্বাস নিল বেলা, “ড্যাডি আর আমি লন্ডনে থাকাকালীন হাইড পার্কের কনসান্টে রামোনের সাথে পরিচয় হয়েছিল।” ফিসফিস করে জানাল বেলা। ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে এলো। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে একটানা কথা বলে জানাল কেন সে আর রামোন বিয়ে করেনি আর কিভাবেই বা স্পেনে নিকি’র জন্ম হলো। “আমি ওকে এখানে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম। প্ল্যান ছিল রামোন মুক্তি পাবার সাথে সাথে আমরা বিয়ে করব।”

এরপর একের পর এক বলে গেল রামোন আর নিকি’র অপহরণের কাহিনী, শিশু অবস্থায় নিকি’র উপর অত্যাচার আর তারপর থেকে দুঃস্বপ্নের মতো পার করা প্রতিটি দিনের কথা।

“এই রহস্যময় লোকগুলো তোমার কাছ থেকে কী চায়? রামোন আর নিকির নিরাপত্তার জন্য তোমাকে কোনো মূল্য দিতে হচ্ছে? নিকি’কে দেখতে পাবার সুযোগের পরিবর্তে তুমি তাদেরকে কী দিচ্ছ?” তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইলেন শাসা।

কাঠের মেঝেতে নিজের হাতের বেতের লাঠি ঠুকলেন সেনটেইন, “এ মুহূর্তে এসব তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়; এগুলো নিয়ে আমরা পরে ভাবব।”

“না” মাথা নাড়ল বেলা, “উত্তর দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ওরা আমার কাছ থেকে কিছুই চায় না। আমার ধারণা উনারা রামোনকে দিয়ে জোর করে কিছু করিয়ে নিচ্ছে। তার পরিবর্তে আমার আর নিকোলাসের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে।”

“তুমি মিথ্যে বলছ বেলা” কর্কশ হয়ে উঠল শাসার গলা।” রামোন মাচাদো তোমাকে ব্যবহার করছে। তুমি বাধ্য হচ্ছ তার আর তার প্রভুদের ফরমায়েশ পূর্ণ করতে।”

“না” এক অর্থে খুশিই হলো বেলা যে বাবা ওর মিথ্যে এত সহজে টের পেয়ে গেছে। “রামোনও আমার মতই অসহায়। আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে ব্লাকমেইল করা

“স্টপ ইট, বেলা” মেয়েকে থামিয়ে দিলেন শাসা, “তুমিই একমাত্র মূল্য চুকাচ্ছো। নিকোলাস হলো ওদের তুরুপের তাস। রামোনই হলো সেই শয়তান যার হাতে আছে আসল নাটাই”

আর্তচিৎকার করে উঠল বেলা : “না! তুমি জানো না! রামোন তো”

“আমি তোমাকে বলছি যে কে এই রামোন ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো; তুমিই আমাদেরকে ওর পারিবারিক নাম জানিয়েছ” শাসা ইশারা করতেই জার্নালটাকে আগলে ধরল বেলা। “তুমি তো জানই যে ইস্রায়েলে আমার বন্ধুরা আছেন। এদেরই একজন মোসাদের ডিরেকটর। আমি ফোন করাতে ওদের কম্পিউটারে খুঁজে দেখেছে রামোনের নাম। সি আই’এর সাথে যুক্ত ওদের কম্পিউটার। আমাদের নিজেদের সিকিউরিটি ফোর্সেরও রামোনের উপর ওপেন ফাইল আছে। ন্যানি তোমার জার্নাল নিয়ে আসার তিন দিনের মাঝে তোমার রামোন সম্পর্কে বেশ মজার কিছু তথ্য খুঁজে পেয়েছি; সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে ডেস্কের কাছে গেলেন শাসা। একটা ড্রয়ার খুলে বের করলেন বেশ মোটাসেটা একটা ফাইল। ঠাস্ করে ছুঁড়ে ফেললেন বেলা’র সামনে রাখা কফি টেবিলের উপর। পুরু ফাইলের কাভার উপচে ছড়িয়ে পড়েছে প্রেস কাটিং ছবি। ডকুমেন্টস আর একতাড়া কম্পিউটার শীট।

“গত রাতে তেল আবিব থেকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে ভরে ইস্রায়েল থেকে এসেছে এটি। নিজে না দেখা পর্যন্ত আমি তোমাকে ডাকিনি। পড়ে অবশ্য ভালই লেগেছে।” স্কুপের মধ্য থেকে একটা ছবি টেনে নিলেন শাসা।” বিজয়ীর বেশে ১৯৫৯ এর জানুয়ারিতে হাভানা’তে ঢুকছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রেী। দ্বিতীয় জিপে একসাথে চে গুয়েভারা আর রামোন।” আরেকটা চকচকে সাদা কালো ছবি তুলে নিয়েছেন শাসা।” কঙ্গো ১৯৬৫। প্যাট্রিস লুমাম্বা ব্রিগেড। বাম পাশ থেকে দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গটিই হলো রামোন। সাথে সিম্বা বিদ্রোহীদের মৃতদেহ।” আরেকটা ছবি হাতে নিয়ে জানালেন, বে অব পিগস’র পরে কাজিন ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে রামোনল্যান্ডিং এর বুদ্ধি বের হয়েছে রামোনের মাথা থেকে।” একগাদা ছবির মধ্যে হাতড়াচ্ছেন শাসা; “এই ছবিটা মাত্র কদিন আগে ভোলা। কর্নেল জেনারেল রামোন ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো, কেজিবি’র ফোর্থ ডিরেকটরের আফ্রিকান সেকশন হেড, জেনারেল সেক্রেটারি ব্রেজনেভের কাছ থেকে অর্ডার অব লেনিন অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করছে। ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় বেশ সুদর্শনই লাগছে। তাই না বেলা? ওই মেডেলগুলো দেখো”।

এমন ভাবে ছবিটার কাছ থেকে সরে গেল বেলা যেন বাবা কোনো কালো মাম্বা ধরে রেখেছে।

শাসা’র হাত থেকে ছবিটা নিল গ্যারি, “এই লোকটা রামোন?” বোনের মুখের সামনে ছবি ধরে জানতে চাইল গ্যারি। চোখ নামিয়ে নিল বেলা; কিছু বলল না।

“কাম অন, বেলা। তোমাকে বলতেই হবে, এই লোকটাই তোমার রামোন?” এবারেও কোনো উত্তর দিল না বেলা; মেয়েকে ধরে ঝাঁকুনি দিলেন শাসা। এর সবই হচ্ছে সাজানো নাটক, বিরাট বড় একটা থোকা। ওই তোমাকে ভিকটিম বানিয়েছে। আমি প্রায় নিশ্চিত যে অপহরণ আর তোমার ছেলেকে পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করার বুদ্ধিও তার। তখন থেকেই তোমাকে নিয়ে খেলছে। তুমি কি জানো যে ওর নিক নেইম হল এল জোরো ভোরাডো? ও নির্ঘাৎ ক্যাস্ট্রো নিজেই দিয়েছে এই নাম, দ্য গোল্ডেন ফক্স।”

ঝট করে মুখ তুলে তাকাল বেলা। মনে পড়ল জোসের কথা, “পেলে হলো শিয়াল ছানা, এল জোরো”। এই ছোট্ট একটা বাক্যের জন্যই সত্যিটাকে স্বীকার করতে বাধ্য হলো বেলা।

“এল জোরো ইয়েস।” শক্ত হয়ে গেল বেলা’র অভিব্যক্তি। চোখে ফুটে উঠল ঘৃণার আগুন। অবচেতন ভাবেই তাকাল দাদি’র দিকে। “এখন আমরা কী করব, নানা?”

“ওয়েল আমাদের প্রথম কাজ হলো নিকোলসাকে উদ্ধার করা।” সোজা সাপটা উত্তর দিলেন সেনটেইন।

“তুমি জানো না যে কী বলছ, নানা বাধা দিল গ্যারি। হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। দাদির কথা শুনে।

“কী বলছি তা আমি সব সময় জানি।” দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্।

“এ কাজের দায়িত্ব তোমাকেই দিচ্ছি গ্যারি; এটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তুমি যা যা প্রয়োজন সব কিছুই পাবে। খরচ নিয়ে আমি মাথা ঘামাবো না। শুধু আমাকে বাচ্চাটা এনে দাও। এটাই হলো আসল কথা। আমি কি পরিষ্কার ভাবে বোঝাতে পেরেছি ইয়াং ম্যান?”

ধীরে ধীরে কেটে গেল গ্যারির চেহারার মেঘ; মিটিমিটি হেসে বলে উঠল, “ইয়েস নানা, সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।”

৮. অপারেশন রুম

ওয়েল্টেভ্রেদেনের গান রুমকে নিজের অপারেশন রুম বানিয়ে ফেলল গ্যারি।

অন্য আরো ডজন খানেক কোর্টনি কনফারেন্স সেন্টার কিংবা বোর্ড রুম থাকলেও এই রুমের মতো নিরাপদ পারিবারিক আবহ আর কোথাও নেই। তাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই ঘর।

“এটা পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাক। একান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরে থেকে কাউকে ডাকা হবে না।” সবাইকে সর্তক করে দিল গ্যারি।

ডেস্কের দু’পাশে বড় বড় দুটো ইজেল এনে রাখল। একটাতে ঝুলছে আফ্রিকার মানচিত্র। দ্বিতীয় বোর্ডটাতে কয়েকটা ছবি ছাড়া আপাতত আর কিছু নেই।

নিকোলাসের সৈকতে ভোলা ছবিটা বোর্ডে পিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

“এটাই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেবে আসল গন্তব্য” জানাল গ্যারি। “মনের মাঝে গেঁথে নিতে চাই এই চেহারা। যেমনটা নানা জানিয়েছে, দ্যাট ফেইস, দ্যাট চাইল্ড। ব্যস আর কিছু না।”

ছবিটার উপর ঝুঁকে বলে উঠল গ্যারি, “অল রাইট ইয়াং নিকি, বল তো বাছা তুমি কোথায়?”

ডেস্কের উপর জেনে’স অল দ্য ওয়ার্ল্ডস এয়ারক্রাফট’র ভারী ভলিউম খুলে ডেস্কের ওপাশে বসে আছে বেলা।

“ও’কে বেলা। ধরে নিচ্ছি তুমি একটা রাশান মিলিটারি পরিবহন বিমানে করেই লুসাকা থেকে নিকি’র কাছে গেছ। দেখা যাক, এটা দেখতে কেমন।” বলে উঠল গ্যারি।” একের পর এক বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগল।

“এই তো” নির্দিষ্ট একটা ছবি দেখে বলে উঠল বেলা।

“তুমি নিশ্চিত?” কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে তাকাল গ্যারি।

“আই-লুশিন। ন্যাটো রিপোর্ট নেইম ক্যান্ডিড।” জোরে জোরে নামটা পড়ল গ্যারি।

নেভিগেশন প্যাডের উপর খসখস করে লিখে চলল গ্যারি। “ওকে, তুমি বলেছ কোর্স ছিল ৩০০ ডিগ্রি ম্যাগনেটিক আর ফ্লাইং টাইম দুই ঘণ্টা ছাপান্ন মিনিট। এছাড়াও আমরা জানি যে এটা আটলান্টিক উপকূলে অবস্থিত- চলো এবার চার্টে দেখা যাক।”

মানচিত্রের উপর ডিভাইডার আর প্রটেক্টর নিয়ে কাজ শুরু করে দিল গ্যারি।

“গ্যারি”-চিন্তায় পড়ে গেল বেলা, “নিকি গত বছর ওখানে ছিল, এর মানে তো এই নয় যে এ বছরেও এখানেই থাকবে?”

“অবশ্যই না।” চার্ট থেকে চোখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিল গ্যারি। “কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে নিকি স্থায়িভাবেই ক্যাম্পে আবাস গড়েছে। ওখানকার স্কুলে যাচ্ছে বন্ধু বানাবার মতো দীর্ঘ সময় ধরে থেকেছে; এমনকি সকার প্লেয়ার হিসেবেও বিখ্যাত হয়ে গেছে পেলে। তাই না?”

বেলার দিকে তাকাল গ্যারি; চশমার ফাঁক দিয়ে হাস্যরত চোখ জোড়া মনে হলো গোল্ডফিশের মত। “ইস্রায়েল আর সাউথ আফ্রিকান গোয়েন্দা বিভাগের ধারণা তোমার বন্ধু এল জোরে এখনো অ্যাংগোলা’তেই আছে। মাত্র চৌদ্দ দিন আগেও লুয়ান্ডাতে দেখেছে এক সি আই-এ এজেন্ট। আর পরিকল্পনা শুরু করার জন্যও একটা জায়গা দরকার। তাই নিকি ওখানে নেই নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ধরে নিচ্ছি ওখানেই আছে।”

মানচিত্রের কাছে সরে এলো গ্যারি, “তাহলে মনে হচ্ছে জায়গাটা উত্তরে লুয়ান্ডা আর দক্ষিণে জায়ারে সীমান্তের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গা। একে অনোর কাছ থেকে শ’খানেক দূরে দূরে ছয়টা নদী মুখ আছে।”

ডেস্কের কাছে ফিরে এসে দেখল বড় সড় একা আর্ট পেপারের উপর স্মৃতি হাতড়ে এয়ারস্ট্রিপ আর রিভার মাউথের ছবি এঁকেছে বেলা। মন দিয়ে দেখে মাথা নাড়ল গ্যারি, “মানচিত্রে দেখানো ছয়টা নদী মুখের যে কোনো একটা হতে পারে; কিছুই নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না।” আবারো খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করল মানচিত্র, ‘টারি, আমাবিক্স, কাটাকানহা, চিকাম্বা, মাবুবাস আর কুইকাবো-নামগুলো শুনে কোন কিছু মনে পড়ছে বেলা?”

মাথা দোলালো বেলা, “বেস টাকে নিকি টার্মিও নামে ডেকেছিল।”

“এটা কোনো কোড নেইম সম্ভবত।” দ্বিতীয় বোর্ডে নিকি’র ছবির পাশে বেলার স্কেচটাকে পিন দিয়ে আঁটকে রাখল গ্যারি। “আর কোনো মন্তব্য?” সেনটেইন আর শাসার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “বাবা কী বলো?”

“আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি বন্ধু ভাবাপন্ন রাষ্ট্র নামিবিয়া থেকেও জায়গাটা প্রায় হাজার খানেক কি.মি দূর। তাই নিকি’র কাছে পৌঁছানোর জন্য স্থলপথের চিন্তা বাদ।”

“হেলিকপ্টারস?” সেনটেইনের প্রশ্ন শুনে গ্যারি আর শাসা একসাথে মাথা দোলালেন।

“আউট অব রেঞ্জ; রিফুয়েলিভেরও অপশন নেই।” গ্যারির মন্তব্যে একমত হলেন শাসা।

“যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে উড়ে যেতে হবে। গোয়েন্দাদের তথ্যনুযায়ী নামিবিয়া সীমান্ত পর্যন্ত কিউবানদের সলিড রাডার চেইন আর বর্ডারের উত্তরে লুবাঙ্গো বেসে পুরো এক স্কোয়াড্রন মিগ-২৩ ফাইটারস আছে।”

“লিয়ার ব্যবহার করলে কেমন হয়?” সেনটেইনের কথা শুনে হেসে ফেললেন পিতা-পুত্র।

“মিগের হাত থেকে পালাতে পারব না। নানা।” বলে উঠল গ্যারি। “আর ওদের কাছে আমাদের চেয়ে বেশি অস্ত্র আছে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি চাইলে ওদের চারপাশে ঘুরে আটলান্টিকের উপর দিয়ে চলে আসতে পারো; আমি জানি ফাইটারস’রা বহু দূর দূরান্ত পর্যন্ত চলে যায় আর লিয়ার মরিশাসেও যেতে পারে।”

হাসি থামিয়ে একে অন্যের দিকে গকিয়ে রইলেন শাসা আর গ্যারি। “তোমার কি ধারণা সে এমনি এমনিতেই এত ধনী হয়েছে?” বাবার কাছে জানতে চাইল গ্যারী, তারপর সরাসরি তাকাল দাদি’র দিকে।

“আচ্ছা ধরে নিলাম আমরা লিয়রে চেপে ওখানে পৌঁছেও গেলাম, তারপর? আমরা না ল্যান্ড করতে পারব না টেক অফ-হাজার মিটার রানওয়ে ছাড়া লিয়ার একচুল নড়তে পারবে না। বেলার কথা মতো স্ট্রিপ’টা ছোট আর গেরিলা ট্রেনিং বেস হওয়াতে দক্ষিণ আমেরিকান, না, না, কিউবান প্যারাট্রুপার গার্ডস থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তর্কাতর্কি করা ছাড়া নিশ্চয়ই এমনি এমনি নিকি’কে আমাদের হাতে তুলে দেবে না।”

“হ্যাঁ, আমি জানি ফাইট করতে হবে” মাথা নাড়লেন সেনটেইন, “এবারে তাই শন’কে ডেকে পাঠাবার সময় হয়েছে।”

“শন?” চোখ পিটপিট করলেন শাসা, “অফকোর্স!”

“নানা, আই লাভ ইউ” তাড়াহুড়া করে টেলিফোন তুলে নিল বেলা।” ইন্টারন্যাশনাল, রোডেশিয়ার বুলাওয়েতে ব্যালান্টাইন ব্যারাকে আর্জেন্ট কল করতে চাই।”

উত্তর আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। এরই মাঝে এয়ারপোর্টে ফোন করে পাইলটদের সাথে কথা বলে নিল গ্যারি। অবশেষে শন যখন লাইনে। এলো ততক্ষণে বুলাওয়ের দিকে উড়ে যাচ্ছে লিয়ার।

“আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দাও” বলে ইসাবেলার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে নিল গ্যারি। মিনিট খানেকের মধ্যে দুই ভাই চিৎকার চেঁচামেচি শেষ করতেই খেঁকিয়ে উঠল গ্যারি : “আমাকে অজুহাত দেখিও না শন। নেক্সট আওয়ারেই তোমাকে তুলে নেবার জন্য বুলাওয়েতে থাকবে লিয়ার দরকার হলে জেনারেল ওয়ালস কিংবা ইয়ান স্মিথের সাথেও কথা বলব। উই নিড ইউ। দ্যা ফ্যামিলি নিডস্ ইউ।”

ফোন রেখে সেনটেইনের দিকে তাকাল গ্যারি, “সরি নানা।”

“এই কথা আগেও শুনেছি।” বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন, “আর মাঝে মাঝে আসলে ঝাড়িতেই কাজ হয়।”

***

ওয়েল্টেভ্রেদেনের গান রুমে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ভাগনের ছবি দেখছেন ব্যালান্টাইন স্কাউটস মেজর শন কোর্টনি। মাত্র তিন মাস হলো রোলান্ড ব্যালান্টাইনি তাকে ফুল টাইম রেজিমেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

“হুম, ওযে বেলা’র ছেলে তাতে কোনো সন্দেহই নেই। একেবারে বেলা’র মতো হয়েছে। উজবুক একটা।” বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল শন্।

ভাইকে জিভ বের করে ভেংচি কাটল বেলা। কিন্তু আসল কথা হলো শনকে দেখে আবার আশা ফিরে পেয়েছে। শন এতটা আত্মবিশ্বাসী পরিশ্রমী আর স্বাবলম্বী যে ওকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বেলা।

“ওরা আবার তোমাকে কবে নিকির কাছে যেতে দেবে?” শনের প্রশ্ন শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইল বেলা। সিনডেক্স-২৫ এর টেস্টের সফলতার কথা জানালেই যে সুযোগ পাবে সে কথা তো ওদেরকে বলা যাবে না; তাহলে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে বেলা কতটা বিশ্বাসঘাতক।

“মনে হয় শীঘিই। প্রায় বছর খানেক হলো নিকি’কে দেখিনি। সপ্তাহ কিংবা দিনও হতে পারে।”

“তুমি যাবে না।” তাড়াতাড়ি বাধা দিল গ্যারি। “তোমাকে আর ওই বদমাশগুলোর খোঁয়ারে যেতে দেব না।”

“ওহ, শাট আপ গ্যারি” খেঁকিয়ে উঠল শন। “বেলা অবশ্যই যাবে তা না হলে নিকি কোথায় আছে আমরা কিভাবে জানব?”

“আমি ভেবেছিলাম…রাগে গন গন করছে গ্যারির মুখ।

“ওকে মেটি। চলো আগেই কিছু জিনিস ঠিক করে নেই। অপারেশনের ভার আমার-আর সমস্ত লজিস্টিকস আর ব্যক আপের দায়িত্ব তোমার। ঠিক আছে?”

“গুড!” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন। “এভাবেই সব হবে। শ এবারে জানাও তুমি রেসকিউ অপারেশন কিভাবে করবে?”

“ওকে। আপাতত এটুকুই ঠিক হলো। ডিটেইলস নিয়ে পরে আলোচনা করব। তবে প্রথমেই বলে রাখছি এটা কিন্তু পুরোপুরি একটা আফেন্সিভ অপারেশন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিপক্ষ দল নরক নিয়ে হাজির হবে। ওরা আমাদেরকে নির্ঘাৎ খুন করতে চাইবে-তবে আমাদেরকেই আগে কাজ সারতে হবে। যদি নিকি’কে চাই। তাহলে ফাইট করতেই হবে। কিন্তু যদি কিছু গড়বড় হয় তো দেশে আর বিদেশে রাজনীতি আর আইনি বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। সন্ত্রাসী কিংবা হত্যাকাণ্ড যে কোনো কিছুর অভিযোগ উঠতে পারে আমাদের বিরুদ্ধে। এর জন্য কি প্রস্তুত আছি আমরা?”

চারপাশে মনোযোগী শ্রোতাদের দিকে তাকাল শন। কোনো দ্বিধা ছাড়াই সকলে একসাথে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

“গুড। তো তাহলে এদিকটা নিশ্চিত। এখন আসো প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারগুলোতে। ধরে নিচ্ছি নিকি’কে উত্তর অ্যাংগোলার কোনো উপকূলীয় বেসে রাখা হয়েছে। যেমনটা প্রতিবার গেছে, এবারেও সেভাবেই যাবে বেলা। পজিশন মতো পৌঁছে গেলেই ও আমাদেরকে খবর পাঠাবে।”

“কিভাবে?” জানতে চাইল গ্যারি।

“এটা তোমার সমস্যা। পুরো কোর্টনি কম্যুনিকেশন ডিপার্টমেন্ট তোমার হাতে। ওদেরকে দিয়ে কোনো একটা মিনিয়েচার রেডিও কিংবা ট্রান্সপন্ডার বানিয়ে নাও। ভেতরে ঢুকেই বেলা এটাকে অ্যাকটিভেট করে দিলে আমরা সিগন্যাল পেয়ে যাবো।”

“ওকে।” রাজি হলো গ্যারি।

“আকাশ পথে জিওলজিক্যাল সার্ভে করার সময় যে ইলেকট্রনিক পজিশন মার্কার ব্যবহার করি সেগুলোর কোনো একটা নেয়া যাবে। কিন্তু বেলা এটা কিভাবে সাথে করে নিয়ে যাবে?

“আবারো বলছি এটা তোমার সমস্যা। কাট কাট করে জবাব দিল শন। “তত বেলা আমাদেরকে টার্গের এরিয়া জানালেই আমরা রওনা হয়ে যাব।”

“কিভাবে?” আবার প্রশ্ন করল গ্যারি।

“একটাই পথ আছে। সমুদ্র।” দক্ষিণ আটলান্টিক থেকে আফ্রিকা মহাদেশের মুখ পর্যন্ত আঙুল রেখে মানচিত্র দেখাল শন।

“ওয়ালবিস বে’তে আমাদের ট্রলিং অ্যান্ড ক্যানিং ফ্যাক্টরি আছে। তোমার নতুন লং রেঞ্জ ট্রলারগুলোর একটা গ্যারি, ওই যে যেটা ভীমা সী-মাউন্টে পাঠিয়েছিলে। ত্রিশ নট গতিতে চার হাজার মাইল যেতে পারে।”

“তাই তো ইয়েস!” খুশি হয়ে উঠল গ্যারি। “এই তো কদিন আগেই কেপ টাউন ড’কে ল্যান্সার মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে। ওয়ালবিস বে’তে ফিরে যাবে। ওদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি রিফুয়েল করে যাত্রার জন্য তৈরি করে রাখতে। স্কিপার, ভ্যানডার বার্গের কোনো তুলনা হয় না।”

“ওদেরকে বলো সমস্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস যেন আনলোড় করে ফেলে।” যোগ করল শন।

“রাইট। ইনস্যুরেন্স পলিসিতে ওয়্যার আর অন্যান্য রিস্কগুলোকেও যোগ করে নেব। তুমি যে এগুলোর কী হাল করবে আমি ভালো ভাবেই জানি।” প্রশ্রয়ের হাসি হাসল গ্যারি। “গত বছর তো চারটা ল্যান্ডক্রুজারের দফা-রফা করেছ।”

“ব্যাস যথেষ্ট হয়েছে।” নাতীদেরকে খানিক বকনী দিলেন সেনটেইন-” শন এবারে বলো। তুমি কি এই নদীতেই ল্যান্সার নিয়ে চলে যাবে?”

“না, নানা। আউট বোর্ড মোটর লাগানো, ফোলানো ল্যান্ডি! ক্রাফট নিয়ে সৈকতে যাবো। সিমন্সটাউন-ন্যাভাল বেসের কাউকে চেনো তুমি?”

“ডিফেন্স মিনিস্টার আর অ্যান্ডমিরাল কেইটার’কে চিনি” আলোচনায় যোগ দিল বেলা।

“বিউটি!” মাথা নাড়ল শন “যদি তুমি বোট পাও তাহলে তো ডজন খানেক ভলান্টিয়ার ও যোগাড় করতে পারবে। কিছু একস্ট্রা কারিকুলার ফান গেমস হয়ে যাবে। ওদের কমান্ডোগুলো একেকটা হট বেবি তাই শয়তান কিউবানগুলোকে ছিঁড়ে খাওয়া কোনো ব্যাপারই না। এএনসি ট্রেনিং বেসের তলা ফুটো না করে আর আসছি না।”

মিনিস্টারকে আমিও চিনি। বেলা-র সাথে আমিও যাবো।” রাজি হলেন সেনটেইন। “স্পেশাল যত ইকুপমেন্ট দরকার তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। শুধু গিভ মি আ লিস্ট, শন।”

“কাল সকালের ভেতরে রেডি করে ফেলব।”

“কিন্তু অস্ত্র-আর সৈন্য?”

“স্কাউটস” ঘোষণা করল-শন।

“এর চেয়ে ভালো আর কোনো অপশন নেই। আমি নিজে ওদেরকে ট্রেনিং দিয়েছি। প্রায় বিশ জন হলেই হয়ে যাবে। জানি কাকে কাকে চাই। রোলান্ড ব্যালান্টইনের সাথে এখনি কথা বলব। রোডেশিয়াতে এখন বর্ষা থাকায় মনে হচ্ছে আপত্তি করবেন না। তবে তার একটা পা ভাঙ্গতে হতে পারে; কিন্তু দেবেন সমস্যা নাই। স্কাউটদেরকে কয়েকদিন বোট ট্রেনিং দেব; ব্যস, আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ তৈরি হয়ে যাবে।” এবারে ইসাবেলার দিকে তাকাল শন। “এখন সবকিছু তোমার উপরে ডিপেন্ড করছে বেলা; তুমিই আমাদের হান্টিং ভগ; ওদের কাছে নিয়ে চল, ল্যাস।”

***

এগারো দিন পরেই সিনডেক্স-২৫ এর সফল টেস্টের কোডেড কনফার্মেশন পাঠিয়ে দেয়ায় নিকোলাসের সাথে দেখা করার পারমিশন আর ইনস্ট্রাকশন পেয়ে গেল লাল গোলাপ। এবারের গন্তব্য কিনশাসা এয়ারপোর্ট।

“লুকিং গুড” মানচিত্রের উপর আঙুল রাখতেই শনের চেহারায় ফুটে উঠল হাসি, “এই যে কিনশাসা। এক্সপেকটেড টার্গেট এরিয়ার তিন থেকে চারশ কি.মি ভেতরে। শেষবারের মতো নাইরোবি কিংবা লুসাকা ঘোরাবে না। এবারে সরাসরি নিয়ে যাচ্ছে।” ইসাবেলার দিকে তাকাল শন, “তো তোমাকে পরের শুক্রবারের ফ্লাইট ধরতে বলেছে? তার মানে সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে শনিবার কিংবা রবিবারেই পজিশনে পৌঁছে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব ওয়াল ভিস বে’তে গিয়ে ল্যান্সার নিয়ে রওনা হয়ে যাব আমি। ছেলেরা তাদের ট্রেনিং শেষ করে ফেলেছে। সব ইকুপমেন্টস্ ভোলা হয়ে গেছে। প্রায় সপ্তাহ খানেক আলসের মতো ঘুরে বেড়ানোতে এবারে সবাই খুশিই হবে।”

আবারো ঝুঁকে পড়ে মনোযোগ দিয়ে মানচিত্র দেখল শন। তারপর ক্যালকুলেটরে খানিক খটখট করে জানাল, “বারো তারিখ সোমবারে কঙ্গো নদীমুখ থেকে একশ নটিক্যাল মাইল দূরের পজিশনে পৌঁছে যাব। ঠিক আছে গ্যারি?”

উঠে দাঁড়িয়ে মানচিত্রের কাছে গেল গ্যারি।” আমি লিয়ার নিয়ে উইন্ডহক এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করব। সোমবার রাতে প্রথম ফ্লাই করব। ফিরে আসার আগের অন্তত পাঁচশ মাইল ঘুরে আসতে হবে। দক্ষিণ অ্যাংগোলাতে এটাই কিউবান রাডার রেঞ্জ। লুবাঙ্গোর মিগ স্কোয়াড্রনের জন্যও এরেঞ্জ কোন ব্যাপার না।” মানচিত্রে কিউবান বেস্ স্পর্শ করল গ্যারি, “বেলা’র ট্রান্সপন্ডারের সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত কঙ্গো নদী মুখ ধরে দক্ষিণের উপকূল বরাবর সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে বেড়াব।”

“দাঁড়াও গ্যারি, এক মিনিট” বলে উঠলেন শাসা, “এটা কি সত্যিই কাজ করবে?”

“মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই অসাধারণ কাজ দেখিয়েছে কোর্টনি ক্যুটিকেশনের ছেলেরা।” ব্রিফ কেস খুলল গ্যারি, “এই যে!”

“বাইসাইকেল পাম্প?” অবাক হয়ে গেলেন শাসা।

“সবাই জানি নিকি একজন সকার স্টার। বেলা’র কাছে নতুন বল চেয়েছে আর এও জানিয়েছে যে পুরোন বলটাকে শুধু পাম্প করতে হয়। তাই বলের সাথে পাম্প দেখলে কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। কয়েকবার চাপ দিতেই হিস হিস করে বাতাস বেরোল পাম্পের মুখ দিয়।

“পাম্পের হ্যান্ডেলের ভেতরে ট্রান্সপন্ডারটা বসানো হয়েছে। ব্যাটারি লাইফ ত্রিশ দিন। হ্যাঁন্ডেলটাকে একটু মোচড় দিলেই অ্যাকটিভেট হয়ে যাবে।” সবাইকে কারসাজিটা দেখাল গ্যারি। তবে একটাই সমস্যা। হ্যান্ডেলের মতো ছোট জায়গায় বসানোতে সিগন্যালের পাওয়ার কমে গেছে। বারো কি.মি-এর ও কম সিগন্যাল রেঞ্জ। লিয়ারের সেন্সিটিভ অ্যান্টেনা নিয়েও এর বেশি কিছু করা যায় নি। তাই বারো কি.মি কাছাকাছি যেতে হবে। যেন সিগন্যাল ধরতে সমস্যা না হয়।”

“উত্তরের কিউবান ফাইটারদের কী অবস্থা? উদ্বিগ্নমুখে জানতে জানতে চাইলেন শাসা।

“সাউথ আফ্রিকান গোয়েন্দাদের মতে সবচেয়ে কাছের বেস্ হলো সোরিমো। উপকূর দিয়ে তাই দ্রুত ঘুরে আসতে হবে। বেলা’র সিগন্যাল পেলেই নাক ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে আসব। খুব ভালোভাবে হিসাব করে দেখেছি; যদি অ্যাংগোলান এয়ারস্পেসে আমাকে পেয়ে কিউবান রাডার সোরিমো থেকে মিগ পাঠিয়ে দেয়, তারপরেও আমার ফিরে আসতে কোনো সমস্যা হবে না।”

“কিন্তু এস এ এম?” এখনো দ্বিধায় ভুগছেন শাসা।

“ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী কিউবান এসএএম রেজিমেন্টের আস্তানা এখন দক্ষিণে।”

“যদি ওদের রিপোর্ট ভুল হয়?”

“কাম অন বাবা শন আমার চেয়েও বেশি রিস্ক নিচ্ছে।”

“শনের কাজই এটা। আর তাছাড়া ওর তো তোমার মতো বউ আর এক পাল ছেলে-পেলে নেই।”

“আমরা কি নিকি’কে ফেরত আনতে চাই-নাকি? বাবা’র দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল গ্যারি।

“অল রাইট, কোথায় যেন ছিলাম? হ্যাঁ, বেলার সিগন্যাল পেলাম; ঘুরে গিয়েই সাথে সাথে কঙ্গো নদী মুখে থাকা ল্যান্সারকে রেডিওতে জানিয়ে দিব। ওদেরকে ঘাঁটির নির্দিষ্ট অবস্থানটা বলে দিয়েই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে।”

“আমার মনে হয়” নির্লিপ্ত স্বরে ঘোষণা করলেন শাসা,

“তোমার সাথে আমিও যাচ্ছি গ্যারি!”

“কাম অন, বাবা। তুমি সেই কবে যুদ্ধ ছেড়েছ। বয়সের কথাটাও ভাবো।”

“তোমাকে তো আমিই উড়তে শিখিয়েছি, মাই বয় আর সপ্তাহের যে কোনো দিন তোমার চারপাশে ঘুরে আসা এখনো আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।”

সাপোর্টের আশায় নানা’র দিকে তাকাল গ্যারি। কিন্তু পাথরের মতো মুখ করে বসে আছেন দাদি। বাতাসে হাত ছুঁড়ে তাই হেসে ফেলল গ্যারি।

“ফ্লাইটে, স্বাগতম স্কিপার।”

***

“গুড বাই, নানা, শক্ত করে দাদীকে জড়িয়ে ধরল-”বেলা, “আমাদের জন্যে প্রার্থনা করো।”

“তুমি শুধু আমার প্রপৌত্রকে নিয়ে এসো সোনা। দু’জনে মিলে এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে।”

বাবা’র দিকে তাকাল বেলা, “আই লাভ ইউ ড্যাডি।”

“আমি যতটা ভালোবাসি ততটা নয়।”

“আমি এত বোকা। আরো আগেই আমার তোমার কাছে আসা উচিত ছিল।” ঢাক গিলল বেলা, “আমি অনেক ভয়ংকর সব কাজ করেছি, ড্যাডি। এখনো যা তোমাকে জানাইনি। জানি না শুনলে তুমি আমাকে মাফ করবে কিনা।”

“ইউ আর মাই গার্ল,” আবেগে কেঁপে উঠল শাসার গলা, “আমার সবচেয়ে আদরের ছোট্ট সোনা। নিজের খেয়াল রেখো-আর সাথে করে নানু ভাইকে নিয়ে এসো।”

বাবা’র গালে কিস্ করে জড়িয়ে ধরল বেলা। এরপরই কোনো কথা না বলে ঘুরে প্রায় দৌড় দিয়ে ঢুকে গেল এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার গেইটের ভেতরে।

বেলা চলে যাবার পরেও বহুক্ষণ ধরে ওদিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন আর শাসা। মাথার উপরে ফ্লাইটের নাম ঘোষণা করছে লাউডস্পিকার।

শাসার হাত ধরলেন সেনটেইন। কোনো কিছু নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করলে পায়ের ব্যথা বেড়ে যায়। এখনো লাঠির উপর ভর দিয়েই হাঁটছেন।

মেইন এন্টার কাছে অপেক্ষারত গাড়িতে গিয়ে বসলেন শাসা আর সেনটেইন।

“একটা ব্যাপারে আমাদের এখনো কথা বলা হয়নি।” শাসার দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“হ্যাঁ। আমি জানি তুমি কি জিজ্ঞেস করবে। ওরা বেলা’কে দিয়ে কী করিয়েছে? বেলা তাদেরকে কতটা মূল্য দিয়েছে?”

“বাচ্চাটার জন্মের পর থেকে ও তাদের হয়ে কাজ করছে। এত বছর ধরে। আর এটা তো এখন স্পষ্ট।”

“আমি আসলে এটা নিয়ে ভাবতেই চাই না।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাসা। “কিন্তু জানি আজ না হয় কাল এর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। এই জানোয়ারের বাচ্চাটা কেজিবি জেনারেল তার মানে বোঝাই যাচ্ছে কারা বেলাকে এতদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে।”

“শাসা” প্রথমে খানিকটা দোনোমোনো করলেও স্পষ্ট স্বরে জানাতে চাইলেন-সেনটেইন, “তোমার স্কাইলাইট স্ক্যান্ডালের কথা মনে আছে?”

“আমি এটা কখনোই ভুলব না?”

“কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল-” একগুয়ের মতো বলে উঠল সেনটেইন।

“বেলা স্কাইলাইট সম্পর্কে কিছুই জানত না; আমি খুব সাবধানে ওকে এ ব্যাপারটা থেকে দূরে রেখেছিলাম।” খানিকটা উত্তপ্ত হলেন শাসা।

“ড্রাগনস্ ফাউন্টেনে আসা সেই ইস্রায়েলি বিজ্ঞানীর কথা মনে নেই? কী যেন নাম ছিল-অ্যারন বোধ হয়? বেলা উনার সাথে খানিকটা জড়িয়ে পড়েছিল। তুমিই তো বলেছিলে যে পেলিনডাবার সিকিউরিটি রেজিস্টারে ওর নাম ছিল। ও লোকটার সাথে রাত কাটিয়েছে।

“মা, তুমি কী বলতে চাইছ…” শেষ করতে পারলেন না শাসা।

“মাই গড চিন্তা করতে পারছ এত বছর ধরে ও তাহলে কতটা তথ্য পাচার করেছে? সিনেটর আর আমার অ্যাসিস্টান্ট হিসেবে আমর্সকোরের বেশির ভাগ সেনসিটিভ প্রজেক্ট ফাইলই ওর ডেস্ক ঘুরে এসেছে।”

“ক্যাপরিকর্নের সিনডেক্স প্রজেক্ট” মাথা নাড়লেন সেনটেইন। “মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ও টেস্টও দেখেছে। এখন ওকে কেন নিকোলাসের কাছে যেতে দেয়া হলো? তোমার কী মনে হয়, কোনো স্পেশাল ইনফর্মেশন দিয়েছে নিশ্চয়?”

দীর্ঘ সময় ধরে চুপচাপ বসে রইলেন শাসা আর সেনটেইন। অবশেষে স্তব্ধ শাসা জানতে চাইলেন, “কোথায় রইল তাহলে পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ততা আর দেশের প্রতি দেশপ্রেম?

“আমার মনে হয় শীঘ্রিই তুমি আর আমি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হবো” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন, “তবে আগের কাজ আগে সামলানো যাক।”

***

ওয়ালবিস বে’তে কোর্টনি ক্যানিং ফ্যাক্টরির পাশেই হসপিটাল জেটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে ল্যান্সার। ল্যান্সার ২৫০ ফুট লম্বা একটা ট্রলার হলেও লাইন আধুনিক ক্রুশ লাইনারের মত। যে কোনো মহাসাগরে তীর বেগে ছুটতে পারে ল্যান্সার। মাছ ধরার কাজে মাসের পর মাস সমূদ্রে কাটাতে হলেও ফিরে আসে আবার একই গতি আর ছন্দ নিয়ে।

জেটিতে দাঁড়িয়ে ল্যান্সারের দিকে তাকাল শন্। উজ্জ্বল হলুদ পেইন্টওয়াকটা তেমন ভাল লাগছে না। বড্ড বেশি চোখে পড়ছে। কিন্তু ল্যান্ডিং উঠানো নামানোর পক্ষে ল্যান্সারের স্টার্ন একেবারে যুৎসই হওয়াতে রঙ নিয়ে আর মাথা ঘামাল না শন্।

ট্রলারের রেইল ধরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা স্কাউটেরা তাকে দেখেই কোরাম গেয়ে উঠল, “হোয়াই ওয়াজ হি বর্ন সো বিউটিফুল?”

আঙুল তুলে শাসাল শন; হতচ্ছাড়াগুলো একটুও শ্রদ্ধা দেখায় না! গ্যাংওয়ে ধরে উঠে গেল উপরে। সকলে মিলে ভিড় করে এলো শনের সাথে হাত মেলাবার জন্য; বোঝাই যাচ্ছে যে ওরা বেশ খুশি হয়েছে। কারণ দিনের পর দিন বসে থাকতে থাকতে একেবারে বোর হয়ে গেছে হাইলি ট্রেইনড় এসব যোদ্ধা।

সকলেরই-পরনে ট্রলারের নাবিকদের মতই রঙচটা ধূসর জিন্স। উলের জার্সি আর আটসাট পশমি টুপি।

ম্যাটাবেলে গোত্রের রক্তবহনকারী সার্জেন্ট মেজর ইসাড গনডেলে এর আগেও বহু বিপদজনক যুদ্ধে শনের সঙ্গী হয়েছিল। এবারে তাই বস’কে দেখে স্যালুট করল সাথে দাঁত বের করা হাসি।

“এখন তো তোমার শরীরে ইউনিফর্ম নেই ইসাউ, টেক ইট ইজি, ব্রাদার।” হাত ঝাঁকিয়ে জানাল শন!

শনে’র বাছাইকৃত বিশ জনের স্কাউটের বারোজনই ম্যাটাবেলে, বাকিরা তরুণ শ্বেতাঙ্গ রোডেশীয়।

স্কাউটদের মাঝে দেহতৃক নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। ইসাউ একবার শন’কে বলেছিল : বর্ণবাদ ঘোচাবার উপায় হলো কারো গুলির মুখে পড়া। ম্যান তখন এটা কোনো ব্যাপারই না যে কোন শালা তোমাকে বাঁচাতে এসেছে। কালো কিংবা ধলা যেই হোক না কেন ফটাস করে তাকে একটা কিস দিতে তোমার কোন সমস্যাই হবে না।”

শ’নের একমাত্র দুশ্চিন্তা হলো ফোলানো ল্যান্ডিং বোটগুলো হ্যাঁন্ডেল করতে সিমন্সটাউন থেকে আসা ন্যাভাল কমান্ডোরা। এরাও সকলেই তরুণ আফ্রিকান। হয়ত এরকম বহু গোত্রীয় দলে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে সমস্যায় পড়ে যাবে।

“রক স্পাইডারদের সাথে কেমন দিন কাটছে?” আফ্রিকান একটা স্ল্যাং বলে উঠল শন।

“তাদের কেউ কেউ এরই মাঝে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলেও এদের কারো সাথেই আমি আমার বোন বিয়ে দেব না।” মিটি মিটি হাসছে ইউ। “না, সিরিয়াসলি শন নিজেদের কাজ ওরা ভালই জানে। আমি বলেছি’ও যে আমাকে বাসি (Bassic) ডাকার দরকারই নেই; তা শুনে ওরা হাসে।”

“ওকে, সার্জেন্ট মেজর। রাত নামলেই আমরা বন্দর ত্যাগ করব। এখানকার কেউ হয়ত আমাদেরকে খেয়াল করছে না; তারপরও কোনো চান্স নিতে চাই না। পাল তোলার আগে তুমি আর আমি সব ইকুপমেন্ট চেক করে নেব; তারপর সমুদ্রে ভেসে যাবার পর ছেলেদেরকে সব জানাব।”

মেঝের টেবিল আর বাঙ্কে একসাথে জড়ো হয়েছে সব স্কাউটস আর কমান্ডোদের দল। বোট প্রেট্রোলিঙে সিদ্ধহস্ত শনের স্কাউটেরা আগেও লেক কারিবার পরিবর্তনশীল পানিতে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু এদের মাঝে মাতাতু নেই। তাই অপারেশনটা কেমন যেন একটু আজব ঠেকছে। পিচ্ছি নোভজারোবো মাতাতু শনের গুডলাক চার্ম। মনে হলো সেন্ট ক্রিস্টোফারকে ছাড়াই ভ্রমণে বেরিয়েছে। জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিল শন। তাকালো ভিড়ের দিকে।

বাল্কহেডের মাথায় লাগানো ম্যাপ ইশারা করল শন, “সবাই দেখতে পাচ্ছ?”

সমস্বরে হা শোনা গেল।

“আমরা এদিকে যাচ্ছি” মানচিত্রে গন্তব্য দেখাল শন্। “আর মিশনটা হচ্ছে দু’জন বন্দিকে উদ্ধার করা একজন নারী আর এক শিশু।”

কপট অসন্তুষ্টির চিৎকার শুনে হাসল শন।

“ইটস ওকে। ভয় পেও না। ওখানে অনেক মজা হবে। চারপাশে হট গানস পাবে জেন্টেলম্যান আর এটা ওপেন সিজন।”

আনন্দে হুল্লোড় করে উঠল সকলে। চিৎকার থামার জন্য অপেক্ষা করে শন আবার শুরু করল।

“এটা হচ্ছে টার্গেট এরিয়ার স্কেচ ম্যাপ। জায়গাটা বেশ রাফ হলেও বুঝতেই পারছ কী আছে সামনে। আশা করছি বন্দিদেরকে এই কম্পাউন্ডে আটকে রাখা হয়েছে। সম্ভবত এই কুঁড়েঘরে। রেসকিউ পার্টি আমি লিড করব। তিনটা বোট নিয়ে আমরা সৈকতে নেমে পড়ব; ঠিক আছে।”

দেখতে পেল দু’পাশে দু’জন দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাভাল কমান্ডো নিয়ে সিগারেট শেয়ার করে খাচ্ছে ইসাউ। কথা শুনতে শুনতে সিগারেটটা ঘুরছে তিনজনের হাতে। “কোথায় গেল বর্ণবাদ?” মনে মনে হেসে ফেলল শন।

“যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে তা নেমে আসবে এই রাস্তা দিয়ে এয়ারস্ট্রিপের কাছের টেরোরিস্ট ক্যাম্প থেকে। এই যে এখানে আর এখানে। সাপোর্ট ইউনিটের নেতৃত্ব দেবে সার্জেন্ট মেজর গনডেল। বোড় ব্লকস তৈরি করে খেয়াল রাখবে যেন কোনো শালা এপাশে না আসতে পারে। প্রথম গুলির আওয়াজ পাবার পর ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরই মাঝে আমরা বন্দিদেরকে নিয়ে চলে আসব। এরপর তোমরাও পিছিয়ে দ্রুত পায়ে আরজে করে ল্যান্সারে চলে আসবে। বেশ সহজ ব্যাপার; কিন্তু খুব দ্রুত করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক সেকেন্ডও থাকা যাবে না। কিন্তু পথিমধ্যে যদি এক দুটাকে খতম করে দিতে হয় কেউ কিছু বলবে না। এবারে ডিটেইলে আলোচনা শেষ করে আগামীকাল পানির মাঝে বোট লঞ্চিং আর রিকোভারী প্র্যাকটিস হবে। প্রতিদিন এটা প্রাকটিস করতে হবে, সাথে উইপনস্ ড্রিল আর ইকুপমেন্ট চেস। তের তারিখ মঙ্গলবার রাতে সৈকতে নামছি; সুতরাং তারিখটাকে মনের মাঝে গেঁথে নাও।”

***

প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে কিনশাসা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল কর্মাশিয়াল ফ্লাইট। প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্টের বাসে উঠার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ভিজে একশা হয়ে গেল বেলা।

কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন ব্যারিয়ার থেকে বের হতেই দেখল সাধারণ খাকি ফ্লাইং ওভারঅল পরে দাঁড়িয়ে এক সুদর্শন তরুণ পাইলট। স্প্যানিশে বেলা’কে সম্বোধন করে উঠতেই কিউবান টান টের পেল বেলা। এয়ারপোর্টের মেইন বিল্ডিং থেকে ট্যাক্সিতে করে প্রাইভেট আর চাটার্ড সেকশনে আসতে আসতেই থেমে গেল বৃষ্টি সারা পৃথ ওর সাথে ফ্লার্ট করল তরুণ পাইলট। পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও বেশি ভ্যাপসা গরম হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। এরই মাঝে ছোট্ট একটা সিংগল ইঞ্জিন এয়ারক্রাফটের ব্যাক কম্পার্টমেন্টে বেলা’র লাগেজ তুলে ফেলল পাইলট।

“এই আবহাওয়াতেই আমরা রওনা হবো?” জানতে চাইল বেলা, “কোনো বিপদ হবে না তো?”

“আহ্, সিনেরা, মারা গেলেও আমার হাতের উপর আপনার মৃত্যু হবে কতটা রোমান্টিক হবে, না?”

প্লেন আকাশে উঠতেই বেলা’র উরুতে হাত দিল পাইলট।

“হুইলের উপর হাত রাখো। সামনের রাস্তার দিকে চোখ দাও।” পাইলটের হাত সরিয়ে দিল বেলা। লোকটা এমন ভাবে দাঁত বের করে হেসে ফেলল যেন কোনো রাজ্য জয় করে ফেলেছে।

বেশিক্ষণ অবশ্য রাগ করে থাকতে পারল না বেলা। যতই সামনে এগুচ্ছে নিশ্চিত হচ্ছে যে গতবারের জায়গাতেই আছে নিকি।

দু’ঘণ্টা পরে উপকূল রেখা দেখে নিজ আসনে সিধে হয়ে বসল বেলা। চিনতে পেরেছে নদী মুখ। লাল কাদা মাটির স্ট্রিপে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে এয়ারক্রাফট।

নিকি, মনে মনে ভাবল বেলা, শীঘ্রিই আমরা আবার মুক্ত হয়ে যাব।

ট্র্যাক্সিং এর সময়ে জিপের সামনের সিটে ছেলেকে দেখতে পেল বেলা। না হলেও আরো দুইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে। চুলও বেশ বেড়ে গেছে কিন্তু চোখ দুটো ঠিক আগের মতই আছে। এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখা গেল সবুজাভ চোখের দ্যুতি। বেলা’কে উইন্ডস্ক্রিনের পেছনে দেখার সাথে সাথে মাথার উপর দুহাত তুলে নাড়তে শুরু করল নিকি। চমৎকার মুখখানায় ছড়িয়ে পড়ল হাসি।

জিপে নিকি’র সাথে কিউবান প্যারাট্রুপার আর ড্রাইভার জোসে’ও আছে। নিকি’র মতই হাসছে দু’জন।

লাফ দিয়ে জিপ থেকে নেমে দৌড়ে মায়ের কাছে এলো নিকি। এক মুহূর্তের জন্য বেলা’র মনে হলো হয়তো মায়ের বুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে ছেলেটা; কিন্তু না নিজেকে সামলে হাত এগিয়ে দিল নিকি।

“ওয়েলকাম মাম্মা” মনে হচ্ছে আবেগে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে বেলা, “তোমাকে দেখে ভাল লাগছে।”

“হ্যালো নিকি” কেঁপে উঠল বেলা’র গলা, “তুমি তো বেশ লম্বা হয়ে গেছ; আমি তো চিনতেই পারিনি। পাক্কা একটা পুরুষ।”

ঠিক কথাটাই বলেছে মা। বেল্টের মাঝে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে ড্রাইভার আর জোসের দিকে তাকাল নিকি, “এসো আমার মায়ের লাগেজ নিয়ে যাও।”

“এক্ষুণি যাচ্ছি, জেনারেল পেলে। কপট ভঙ্গিতে স্যালুট দিয়ে ইসাবেলার দিকে তাকাল জোসে, “গ্রিটিংস সিনোরা আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।”

আমি সবার ফেবারিট আন্টি হয়ে গেছি; মনে মনে হাসল বেলা।

নিজের বিশাল লটবহর থেকে ড্রাইভার আর জোসে’কে মার্লবোরো সিগারেটের দুইশ প্যাকেটের একেকটা কার্টন দিল আর যায় কোথায়। বেলার সুখ্যাতি বেড়ে গেল কয়েকশ গুণ।

গাড়ি চালাতে চালাতে খুশি মনে গল্প করে চলল নিকি। বেলাও আগ্রহ নিয়ে শুনল লাস্ট মিটিঙের পর থেকে নিকি’র করা যত কেচ্ছা কাহিনী; কিন্তু একই সাথে খুব সাবধানে চোখ বোলালো চারপাশে, যা আগে কখনো করেনি। বুঝতে পারল শ’নের জন্য যে স্কেচ ম্যাপ দিয়ে এসেছে সেখানে কত ভুল হয়েছে। ট্রেনিং এর ঘাটিটাও আগের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। না হলেও কয়েক হাজার সৈন্য আছে এখানে; একই সাথে চোখে পড়ল ক্যামোফ্লেজ নেটের নিচে থাকা আর্টিলারী ভেহিকেল। লং ব্যারেল্ড অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান মনে হলো। পার্ক করা কিছু ট্রাকের উপরে ডিশ অ্যান্টেনার মতো রাডারও দেখা যাচ্ছে। ওহ, খোদা লিয়ার নিয়েই তো আসবে বাবা আর গ্যারি। এসব পরিবর্তনের ব্যাপারে ওদের সর্তক করার কোনো উপায় নেই।

সৈকতের কম্পাউন্ডে পৌঁছাতেই স্পিডোমিটারের দিকে তাকাল বেলা। এয়ারস্ট্রিপ থেকে সৈকত মাত্র ৩.৬ কি.মি-যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক কাছে। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল যে রেসকিউ অপারেশনটা কতটা বিপদজনক হতে যাচ্ছে। শ’নের ভাবনার চেয়েও দ্রুত পৌঁছে যাবে রিইনফোর্সমেন্ট।

গার্ড হাউজে লাগেজ নিয়ে গেল জোসে। আগের বারের দেখা দুই নারীই এবারো আছে। তবে তাদের অভিব্যক্তি আগের চেয়ে বেশ সহজ।

“আমি তোমাদের জন্য গিফট এনেছি। সুগন্ধের কথা না ভেবে সাইজ দেখেই মেয়ে দুটোর জন্য দুইটা পারফিউমের বোতল এনেছে বেলা। আনন্দের চোটে একে অন্যের গায়ে এমন স্প্রে করা শুরু করল যে রুমের বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়াই কষ্ট হয়ে পড়ল। বেশ কয়েক মিনিট পার করে তারপর বেলা’র লাগেজ সার্চ করতে আসল কেজিবি’র দুই নারী।

এবার ক্যামেরা নিয়ে কেউ কিছু বলল না; যদিও কসমেটিকস্ নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করল। নিজের লিপস্টিক ট্রাই করে দিল বেলা। মেয়েরা তো যার পরনাই খুশি। ঠোঁটে লাগিয়ে আবার বেলা’র কম্প্যাক্টের আয়নায় চেক করে নিল। মনে হল যেন বহুদিনের পুরোন বান্ধবীরা আজ একত্রিত হয়েছে।

নিকোলাসের গিফট বক্স চেক করতে তাই তাদের তেমন আর আগ্রহ দেখা গেল না। সকার বল তুলে নিয়ে একজন শুধু বলল,

“আহ, পেলে এটা বেশ পছন্দ করবে।” পাম্পে হাত দিতেই বেলার বুক ধুকপুক করে উঠল।

“বলের জন্য।” বুঝিয়ে দিল।

“বুঝতে পেরেছি। বাতাস ভরার জন্য, তাই তো।” খানিক বার কয়েক চাপ দিয়ে আবার বক্সে রেখে দিল পাম্প।

‘“আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত সিনোরা। আমরা কেবল আমাদের ডিউটি পালন করছি।”

“অফ কোর্স। কোন সমস্যা নাই, আমি বুঝতে পেরেছি।” একমত হলো বেলা।

“আপনি দু’সপ্তাহ থাকবেন। ভালই হলো। আপনি আসবেন শুনে পেলে তো বেশ উত্তেজিত। ও খুব ভালো ছেলে। সবাই ওকে বেশ পছন্দ করে। ওকে নিয়ে গর্ব করে।”

ঘর পর্যন্ত বেলা’র লাগেজ বয়ে আনতে সাহায্য করল মেয়েটা। গতবারেও এই ঘরেই ছিল বেলা।

এরই মাঝে সুইমিং ট্যাঙ্ক পরে বিছানার উপর বসে আছে নিকোলাস।

“কাম। মাম্মা। চলো সাঁতার কেটে আসি।”

ভোদরের মতো সাঁতার কাটছে নিকি; ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বেলা’র জান বের হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় মাতা-পুত্র দুজন একসাথে বসার পর গিফট বক্স খুলল বেলা। সকার বলটা বেশি পছন্দ করলেও মায়ের আনা বই আর কাপড়-চোপড় দেখেও খুশি হল নিকি। সনি ক্যাসেট প্লেয়ার আর মিউজিক ক্যাসেটও নিয়ে এসেছে বেলা।

“রক এন রোল করতে পারো?” জানতে চাইল বেলা। প্লেয়ারে বাজিয়ে দিল জনি হ্যাঁলিডে।

আদ্রা এসে ডিনারে ডাকার আগ পর্যন্ত বাদিং স্যুট পরেই খুব নাচল মা আর ছেলে। আদ্রা বরাবরের মতই চুপচাপ থাকলেও পাত্তা দিল না বেলা। নিকি’কে শোনাবে বলে একগাদা হাতির জোকস শিখে এসেছে।

নিকি’কে একটা শোনানোর পর ছেলে মাকে পাল্টা একটা জোকস বলল। জোসের কাছ থেকে শিখেছে। শুনে তো বেলা’র ভিরমি খাবার জোগাড়। “তুমি জানো এর মানে কী?” ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল বেলা। “অফকোর্স। স্কুলে বড় একটা মেয়ে আমাকে দেখিয়েছে।” সোজা সাপ্টা উত্তর দিল নিকি। এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই সমীচিন, ভাবল বেলা।

নিকি ঘুমোতে যাবার পর আদ্রা’র কাছে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল বেলা : “রামোন কোথায়, দ্য মারকুইস? এখানে আছে?”

উত্তর দেবার আগে খুব সাবধানে চারপাশ দেখে নিল আদ্রা, “না। তবে শীঘিই আসবে। মনে হয় আগামী কাল কিংবা তার পরের দিন। তবে বলেছেন যে, আসবেন। এও জানিয়েছেন যে আপনাকে অনেক ভালোবাসেন।

নিজের ঘরে একাকী শুয়ে বেলা বুঝতে পারল যে রামোনের সাথে দেখা। হবে ভাবতেই কতটা ভয় লাগছে। কারণ এখন জানে ও’কে সহজভাবে আচরণ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু রামোন যদি একবার ওর পরিবর্তন টের পায় তাহলে নির্ঘাৎ নিকি’কে সরিয়ে বেলা’কে বন্দি করে ফেলবে।

“প্লিজ গড, রামোনোর আগে যেন শন এসে পড়ে। শন না আসা পর্যন্ত ও’কে দূরেই রাখো।” সে রাতে আর ঘুমোতেই পারল না বেলা। মনে হলো এই বুঝি চলে আসে রামোন।

পরের দুটি দিনও আগের মতই সাঁতার কেটে মাছ ধরে আর সৈকতে টুয়েন্টি সিক্সের সাথে খেলা করে কাটিয়ে দিল নিকি আর বেলা। কুকুর ছানাটা এখন নিক্রির সাথে এক বিছানাতেই ঘুমায়। কিন্তু মানা করতে পারে না বেলা।

সোমবার রাতে, নিকোলাস বিছানায় ঘুমাতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে; এমন সময় স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উঠে গিয়ে শেঙ্ক থেকে বাইসাইকেল পাম্পটা তুলে নিল বেলা। হ্যাঁন্ডেল ঘোরাতেই ট্রান্সপন্ডার অন হবার হালকা একটা ক্লিক শুনতে পেল। আবার আগের জায়গায় রেখে দিল পাম্প। কেপ টাউন থেকে আনা পিপারমিন্ট টুথপেস্টের গন্ধ ছড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো নিকি।

বিছানার উপর মশারি ঠিক করতে গেল বেলা। হঠাৎ করে উঠে বসে দু’হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল নিকি। “আই লাভ ইউ মাম্মা।” লাজুক স্বরে। ফিসফিস করল নিকোলাস। ছেলের গালে কিস্ করল বেলা।

স্নেহের ভারে উদ্বেল হয়ে উঠল হৃদয়। কিন্তু নিজের আচরণে নিকি নিজেই এত লজ্জা পেয়ে গেল যে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ফিরে গলা অব্দি চাদর টেনে নাক ডাকার ভান করল।

“স্লিপ ওয়েল, নিকি।

আই লাভ ইউ টু-উইদ অল মাই হার্ট।” ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল বেলা।

নিজের ঘরে ফিরে আসতে আসতে শুনল গুরুগম্ভীর মেঘের ঢাক; রাতের আকাশ চিরে দিল বিদ্যুৎতের চমক। মুখ তুলে তাকাতেই কপালের ঠিক মাঝখানে পড়ল উষ্ণ বৃষ্টির ফোঁটা।

***

একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে লিয়ারের ককপিট। চল্লিশ হাজার ফুট উপরে আকাশে ভেসে আছে বিশাল এয়ারক্রাফট।

“শত্রু উপকূল সামনেই!” নরম স্বরে ঘোষণা করলেন শাসা, শুনে হেসে ফেলল গ্যারি।

‘কাম অন, বাবা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুভিগুলোতে মানুষ এসব সংলাপ বলে।”

মেঘের দেশের বহু উপরে চাঁদের আলোয় ভাসছে লিয়ার। নিচের মেঘের স্তূপ ঠিক আল্পসের তুষারের মতই অদ্ভুত সাদা দেখাচ্ছে।

“কঙ্গো নদীমুখ থেকে একশ নটিক্যাল মাইল দূর।” স্যাটেলাইট ন্যাভ সিস্টেমের পর্দায় নিজেদের পজিশন চেক করলেন শাসা, “আমরা ঠিক ল্যান্সারের মাথার উপরে আছি।”

“ওদের একটা কল দিয়ে দেখো, তাহলে।”

গ্যারি’র কথা শুনে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করলেন শাসা। “হ্যালো ডোনাল্ড ডার্ক। ম্যাজিক ড্রাগন বলছি, শুনতে পাচ্ছো?”

“হ্যালো, ড্রাগন। ডাক বলছি। জবরদস্ত শুনছি। বলে যাও।”

উত্তরটা এত দ্রুত এলো যে বড় ছেলের কণ্ঠস্বর শুনে হাসলেন শাসা।

“শন বোধহয় বোতামের উপর বুড়ো আঙুল দিয়েই বসেছিল” বিড়বিড় করতে করতে মাইক্রোফোনের কী-তে চাপ দিলেন শাসা, “স্ট্যান্ড বাই ডাক, আমরা ডিজনীল্যান্ড যাচ্ছি।”

“হ্যাভ আ নাইস ট্রিপ। ডাক বসেই আছে।”

কো-পাইলটের আসনে বসে প্যাসেঞ্জার কেবিনের দিকে ঘুরে গেলেন শাসা। ইকুপমেন্টের উপর ঝুঁকে বসে আছে কোর্টনি কমুনিকেশনের দুই টেকনিশিয়ান। দশ দিন ধরে সমস্ত স্পেশাল ইলেকট্রনিকস ইনস্টল করেছে এই দুজন। তারপর লিয়ারের কেবিনে স্ট্যাম্প আর ভ্রু দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। ডিসপ্লে প্যানেলের সবুজ আলো পড়াতে একেক জনের চেহারা দেখাচ্ছে ডাইনীর মতো আর বিশাল হেডফোন লাগানোতে মাথা দুটোও হয়ে গেছে বিকট।

ইন্টারকমের সুইচ টিপলেন শাসা, “হাউ ইউ ডুয়িং লেন?”

চোখ তুলে তাকাল হেড ইঞ্জিনিয়ার, “কোনো বাড়ার পিছু নেয়নি। কিংবা টাগের্ট থেকেও সিগন্যাল পাচ্ছি না। কেবল নর্মাল রেডিও ট্রাফিক

“ক্যারি অন।” আবারো সামনের দিকে তাকলেন শাসা! জানেন চিন্তার কিছু নেই। লিয়ারের পেটে থাকা অ্যান্টিনা কোনো শত্রু রাডারের দেখা পেলে তাদেরকে আগেই সাবধান করে দেবে। স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষতা থাকাতে লেনকে নির্বাচন করা হয়েছে। কিউবান রেডিও ট্রাফিকও সাথে সাথে মনিটর করতে পারবে।

“ওকে, গ্যারি, ছেলের হাত স্পর্শ করলেন শাসা। “কঙ্গো নদীমুখের উপরে চলে এসেছি। তোমার নতুন হোডিং হচ্ছে ১৭৫।”

সম্মত হয়ে উপকূল রেখা বরাবর প্লেন ভাসিয়ে দিল গ্যারি।

লিয়ারের নিচের মেঝের স্তূপে হঠাৎ করেই দেখা দিল গভীর একটা গর্ত। মাথার ঠিক উপরে থাকা চাঁদ দুদিন পরেই পূর্ণ হয়ে যাবে। চল্লিশ ফুট নিচে চাঁদের আলোতে চকচক করছে প্লাটিনামের মতো স্বচ্ছ পানি। দেখা যাচ্ছে আফ্রিকান উপকূলের গাঢ় অবয়ব।

“চার মিনিটের মাঝে আমব্রিজ নদী মুখে পৌঁছে যাবো।” সতর্ক করলেন

“টার্গেট সিগন্যালের জন্য আমরা সার্চ শুরু করেছি” হেডফোনে কনফার্ম করল লেন।

“ওভারহেড আমব্রিজ” ঘোষণা করলেন শাসা।

“কোনো সিগনাল নেই।”

“কান্টাকানহা নদীমুখ ছয় মিনিট দূর।” আবারো জানালেন শাসা।

কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন শাসা। তাদের নাক বরাবর সোজা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কালো মেঘের বিশাল এক পর্বত। উচ্চতায় না হলেও ষাট থেকে সত্তুর হাজার ফুট।

“এই চার্লিকে দেখে কী মনে হচ্ছে?” গ্যারি’র কাছে জানতে চাইলেন শাসা। মাথা নেড়ে ওয়েদার রাডার সেটে চোখ নামাল গ্যারি। ভয়ংকর এক টকটকে লাল ককন্টের ন্যায় স্ক্রিন জুড়ে দেখা যাচ্ছে ট্রপিক্যাল থান্ডারস্টর্ম।

“এখনো ছিয়ানব্বই মাইল দূর হলেও ব্যাটা সত্যিকারের বদশাম। ঠিক আমাদের টার্গেট রিভার মাউথ চিকাঘার উপর গিয়ে বসে আছে।”

“যদি তাই হয় তাহলে তো বেলার ট্রান্সপন্ডারের সিগন্যাল ধুয়ে মুছে ফেলবে।” চিন্তায় পড়ে গেলেন শাসা।

“এটার মধ্য দিয়ে তো যাওয়ার কোনো উপায়ই দেখছি না।” ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল গ্যারি।

“কাটাকানহার উপরে চলে এসেছিলেন কিছু পেলে?”

“নেগেটিভ মিঃ কোর্টনি।” আর তার পরই পাল্টে গেল লেনের গলা, “হোল্ড অন! ওহ শিট! কেউ একজন পেছনে রাডার জুড়ে দিয়েছে।”

“গ্যারি” ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন শাসা, “ওরা আমাদেরকে পেয়ে গেছে।”

“ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিকোরেন্সির সুইচ অন্ করে শোন” জানাল গ্যারি।

বরফের মতো জমে গেল সকলে যার যার আসনে বসে। হঠাৎ করেই ক্যারিয়ার ব্যান্ড হিস হিস করে উঠতেই শোনা গেল, “আনআইডেন্টিফায়েড এয়ারক্রাফট। লুয়ান্ডা কন্ট্রোল। তোমরা সংরক্ষিত আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছ। এখনি নিজের পরিচয় জানাও। আবারো বলছি, এটা সংরক্ষিত আকাশ সীমা অঞ্চল।”

“লুয়ান্ডা কন্ট্রোল, এটি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ফ্লাইট বিএ ০৫১। আমাদের ইঞ্জিনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। পজিশনের জন্য রিকোয়েস্ট করছি।” লুয়ান্ডার সাথে আলোচনা শুরু করলেন শাসা। এতে যতটুকু সময় পাওয়া যায়। ততটুকুই লাভ। প্রতিটি সেকেন্ড এখন গুরুতুপূর্ণ। লুয়ান্ডাতে নামার জন্য ক্লিয়ার্যান্স চাওয়ার পাশাপাশি এমন একটা ভাব করলেন যেন তাদের কথার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারছেন না।

“এতে তাদের মন গলেনি মিঃ কোর্টনি। “মিলিটারি ফ্রিকোয়েন্সি ধরতে পেরে সতর্ক করে দিল লেন। “সারিমো এয়ারফিল্ড থেকে মিগ আসছে আমাদেরকে ধরতে।”

“চিকাম্বা পার হতে কতক্ষণ বাকি আছে?” জানাতে চাইল গ্যারি।

“চৌদ্দ মিনিট।” সাথে সাথে উত্তর দিলেন শাসা।

“ওয়েল ঈশ্বর, ঈশ্বর!” হেসে ফেলল গ্যারি। তার মানে মিগ ও ঠিক সামনে থেকেই আসছে। বেশ মজাই হবে কী বলো।”

রুপালি চাঁদের আলোয় ভেসে দক্ষিণে উড়ে চলল লিয়ার।

“মিঃ কোর্টনি, আমার মনে হয় মিগ আমাদেরকে ওদের অ্যাটক রাডারে পেয়ে গেছে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, লেন। আর এক মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড গেলেই চিকাম্বা নদী।”

“মিঃ কোর্টনি” আতঙ্কিত লেনে’র গলা কাঁপছে, “মিগ লিড়ার টার্গেট কনফার্ম করছে। আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে স্যার।”

“আমার মনে হয় তুমি বলেছিলে যে ওরা আমাদেরকে দেখতেই পারবে না” নরম স্বরে গ্যারিকে জানালেন শাসা। “আমি ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় ওদের অপারেশন্যাল রেঞ্জের বাইরে থাকব।”

“হেল, ড্যাড। বাদ দাও। যে কেউই তো ভুল করতে পারে।”

“মিঃ কোর্টনি” ভয়ে লেনে’র আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড়। “খানিকটা দুর্বল হলেও টার্গেট সিগন্যাল পাচ্ছি সামনে। ছয় কি.মি দূর।”

“তুমি নিশ্চিত লেন?”

“এটা আমাদের ট্রান্সপন্ডার, কোনো ভুল নেই!”

“তার মানে চিকাম্বা নদী মুখ। বেলা এখন চিকাষা তে!” চিৎকার করে উঠলেন শাসা। “চলো গ্যারি, এবার এই নরক থেকে বেরোও।”

“মিঃ কোর্টনি মিগ উইপনস্ ফ্রি হয়ে গেছে। অ্যাটাক করতে আসছে।”

“হোল্ড অন্” ঘোষণা করল গ্যারি, “গ্রাব ইউর হ্যাটস!”

লিয়ার নিয়ে ডাইভ দিল গ্যারি।

“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?’ কো-পাইলটের সিটু আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন শাসা, “এখনি নাক ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে যাও।”

“এক মাইলও যেতে পারব না, তার আগেই খতম করে দেবে।”

“ক্রাইস্ট গ্যারি। লিয়ারের পাখা খসে যাবে।”

এয়ারস্পিড ইনডিকেটর দ্রুত উপরে উঠে “নেভার এক্সিড” ব্যারিয়ার ছুল।

“কোনটা চাও বেছে নাও বাবা। লিয়ারের পাখা ভাঙ্গবে নাকি মিগের তো খাবে?”

“মিঃ কোর্টনি মিগ লিডার মিসাইল লক করার রিপোর্ট দিচ্ছে।” আতঙ্কে প্রায় উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে লেন।

“কী করবে গ্যারি?” গ্যারি’র হাত ধরলেন শাসা।

“আমি ওখানে যাবো।” থান্ডারস্টার্মের পাহাড়টাকে ইশারা করল গ্যারি। “মেঘের ভেতরে বাতাস অনেক জোরে বইছে। ঝড়ের ঠিক মাঝখানে গজরাচ্ছে বিদ্যুতের ঝলকানি।

“ইউ আর ক্রেজি” ফিসফিস করে উঠলেন শাসা।

“এর ভেতরে কোন মিগ আমাদেরকে ধরতে আসবে না।” জানাল গ্যারি। “চারপাশের এত এনার্জি আর ইলেকট্রিকাল ডিসচার্জের ভেতরে কোনো মিসাইল পাত্তা পাবে না।”

“মিঃ কোর্টনি মিগ লিডার একটা মিসাইল ছুঁড়েছে-আর আরেকটা। দুটো মিসাইল একসাথে আসছে…”

“প্রে ফর আস, সিনারস।” লিয়ার নিয়ে যেন মৃত্যুর মাঝে ঝাঁপ দিল গ্যারি। “আমারও তাই মনে হচ্ছে।” শাসার কথা শুনেই কিনা কে জানে কিছু একটা এসে লিয়ারকে ধাক্কা দিল। ঝড়ের মুখে ঢুকে গেল লিয়ার।

সাথে সাথে মুছে গেল সমস্ত দৃশ্য। চারপাশে কেবল তুলোর বলের মতো ধূসর রঙা মেঘ। সেফটি হার্নেসের ভেতরেও ঝাঁকি খাচ্ছে সকলে। লিয়ার নিয়ে যেন খেলছে কোনো হিংস্র পশু।

মরা পাতার মতই বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে লিয়ার। কন্ট্রোল প্যানেলের ইনস্ট্রমেন্টগুলো আপনা থেকেই ঘুরছে।

***

শূন্যে পড়ে ইয়ো-ইয়ো করছে অলটিমিটারের কাটা। হঠাৎ করেই লিয়ারের উচ্চতা নেমে গেল মাত্র দুই হাজার ফুট।

বজ্রপাতে এয়ারক্রাফটের ধাতব শরীরে নাচছে নীল আলোর শিখা, যেন লিয়ারে আগুন ধরে হেছে। ঝড়ের প্রচণ্ড শক্তি মনে হচ্ছে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে লিয়ার।

অসহায়ের মতো বসে আছে গ্যারি। জানে নিজের জান বাঁচাতে লড়ছে লিয়ার। হালকা করে স্পর্শ করে রেখেছে কন্ট্রোল হুইল। যেন ভালবাসা দিয়ে উৎসাহিত করতে চাইছে তার প্রিয় লিয়ার’কে আর চেষ্টা করছে নাকটা যাতে কোনভাবে সোজা রাখা যায়।

“এই তো ডার্লিং, হিম্মত রাখো। ইউ ক্যান ডু ইট” ফিসফিস করে লিয়ারকে শোনাল গ্যারি।

নিজের আসনের হাতল চেপে ধরে অলটিমিটারের দিকে তাকিয়ে আছেন শাসা। পনের হাজার ফুট নেমে গেছেন; তার পরেও থামছে না পতন। আর কোন ইলুট্রমেন্ট কোনো কাজ করছে না।

একদৃষ্টে অলটিমিটার দেখছেন শাসা। দশ হাজার সাত, চার হাজার। এখনো বাড়ছে ঝড়ের শক্তি। সমানে আগু পিছু করছে সবার মাথা; ভয় হচ্ছে স্পাইন্যাল কর্ড না ভেঙে যায়। সোল্ডার স্ট্রাপ গেঁথে বসাতে ব্যথা করছে মাংস।

এরই মাঝে ফিউজিলাজের সাথে লেগে কিছু একটা ভেঙে যাবার শব্দ হলো। সেদিকে না তাকিয়ে অলটিমিটারের ফোকাস করলেন শাসা।

দুই হাজার ফুট, এক হাজার জিরো। নিশ্চয় তারা মাটিতে নেমে গেছে; কিন্তু বায়ুমণ্ডলের প্রচণ্ড পবির্তনের ফলে ঝড়ের মুখে রিডিং কোনো কাজ করছে না।

হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল লিয়ার। থেমে গেল ঝড়। রাডার আর স্টিকে চাপ দিল গ্যারি। সাড়া দিল লিয়ার। মেঘের পেট থেকে বের হয়ে এলো এয়ার-ক্রাফট।

অভূতপূর্ব এই পরিবর্তন। ঝড়ের কোনো শব্দই নেই আর; কেবল জেট প্লেনের মৃদু গুঞ্জন, ককপিট ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয় দেখে অবাক হয়ে গেলেন শাসা। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

সমুদ্রের ঠিক উপরে মাছের মতো ভাসছে লিয়ার। আর মাত্র শখানেক ফুট নিচে নামলেই এতক্ষণে পৌঁছে যেতেন সবুজ আটলান্টিকের অতল তলে।

“ভালোই কাজ দেখিয়েছে বাছা” ককশ শব্দে বলে উঠলেন শাসা। হাসতে চেষ্টা করলেন কিন্তু চোখের পট্টি ঢিলে হয়ে কানের নিচে ঝুলছে। কাঁপা কাঁপা পট্টি আঙুলে আবার জায়গামতো বসিয়ে দিলেন শাসা।”কাম অন, নেভিগেটর” মিটিমিটি হাসলেও গ্যারি নিজেও ভয় পেয়েছিল। “একটা কোর্স তো বলো।”

“নতুন কোর্স ২৬০ ডিগ্রী।

“কী অবস্থা বেটির?”

“বাতাসের মতই।” নতুন হেডিংয়ে ঘুরে গেল গ্যারি। আটলান্টিকের উপর দিয়ে তীর বেগে উড়তে লাগল লিয়ার।

“লেন” সিটে বসেই ঘুরে গিয়ে কেবিনের দিকে তাকালেন শাসা, টেকনিশিয়ানদের পান্ডুর চেহারা থেকে এখনো পুরোপুরি কাটেনি ভয়। “মিগগুলোর কী খবর, কিছু জানো নাকি?”

পেঁচার মতো চোখে তাকিয়ে রইল লেন; বুঝতে পারছে না বেঁচে আছে না কি?”

“আরে হলো টা কি তোমার?” শাসা’র ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি কন্ট্রোল প্যানেলেনের উপর উপুর হয়ে পড়ল লেন।

“হ্যাঁ, এখনো কনট্যাক্ট পাওয়া যাচ্ছে। মিগ লিডার টার্গেট ডেস্ট্রয়েডের রিপোর্ট করছে। ফুয়েল শর্টেজের কারণে ঘটিতে ফিরে যাচ্ছে।”

“বিদায় ফিদেল। থ্যাংস লর্ড।” বিড়বিড় করল গ্যারি। লিয়ারকে নিচেই রাখল যেন তীর থেকে কোনো রাডার সহজে খুঁজে না পায়। “ল্যান্সার কোথায়?”

“নিশ্চয় ঠিক সামনে।” মাইক্রোফোনে বুড়ো আঙুল চেপে ধরলেন শাসা।

“ডোনাল্ড ডাক, ম্যাজিক ড্রাগন বলছি।”

“গো এহেড, ড্রাগন।”

“চিকাম্বা। আবারো বলছি চিকাম্বা। ডু ইউ কপি দ্যাট? ওভার।”

“রজার, চিকাম্বা। আবারো বলছি চিকাম্বা। কোনো সমস্যা হয়েছিল নাকি? দক্ষিণ পূর্বে পম পম এয়ার ট্রাফিকের শব্দ শুনেছি। “ওভার।”

“তেমন কিছু না। সানডে স্কুল পিকনিক। এবারে তোমার পালা। যাও ডিজনি ল্যান্ড ঘুরে এসো। ওভার।”

“উই আর অন আওয়ার ওয়ে, ড্রাগন।”

“পা ভেঙে দিও, ডাক। ওভার অ্যান্ড আউট।”

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে পাঁচটায় লিয়ার নিয়ে উইন্ডহক এয়ারপোর্টে নামল গ্যারি। সিঁড়ির পাদদেশে এসে গোল করে দাঁড়ালো পুরো দল। এখনো কাটেনি। হতভম্ব ভাব। কাছের ইঞ্জিনটার দিকে এগিয়ে গেল গ্যারি।

“বাবা, এসে একটা জিনিস দেখে যাও।” শাসা’কে ডাকল গ্যারি।

টার্বো ফ্যান ইঞ্জিনের গায়ে অদ্ভুত আর অচেনা একটা ধাতব জিনিসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শাসা। তীরের মতো দেখতে লম্বা টিউবটার রং হলুদ।

“এটা আবার কী?” জানতে চাইলেন শাসা।

“এটা হলো” শাসার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে লেন, “একটা সোভিয়েত অ্যাটোল মিসাইল যেটা বিস্ফোরিত হতে পারে নি।”

“ওয়েল গ্যারি” বিড়বিড় করলেন শাসা, “ফিদেল একেবারে আহাম্মক নয়, কী বলো।”

“রাশান কারিগররা দীর্ঘজীবী হোক।” হেসে উঠল গ্যারি, “কিন্তু বাবা, একটু আগে ভাগে হয়ে গেলেও এক গ্লাস শ্যাম্পেন খাবে নাকি?”

‘তা আর বলতে।” জানালেন শাসা।

***

চিকাম্বা নদী” কাঁধে কাধ ঠেকিয়ে চার্ট টেবিলের উপর ঝুঁকে আছে শন আর ইসাউ গনডেলে।

“এই তো এখানে।”

বিশেষতৃবিহীন ছোট্ট একটা লাইনের উপর আঙুল রাখল শন, “কাটাকানহার ঠিক দক্ষিণে।” ট্রলার স্কিপারের দিকে চোখ তুলে তাকাল। ভ্যান দার বার্গা’কে দেখাচ্ছে ঠিক সুমো কুস্তিগীরদের মত; এতটাই ভারি আর চওড়া শরীর।

“চিকাম্বা সম্পর্কে কী জানো ভ্যান?” জানতে চাইল শন। “এতটা কাছে কখনো যাইনি।” কাঁধ ঝাঁকাল ভ্যান। কিন্তু আপনি যতটা কাছে চান। নিয়ে যাবো।”

“শৈলশিরা থেকে মাইলখানেক দূর হলেই চলবে।”

“তাই হবে” প্রমিজ করল ভ্যান। “

“কখন?” জানতে চাইল ভ্যান। “কালকের ভেতরে দিগন্তের নিচ পর্যন্ত গেলেই ভালো। তারপর রাত নামলে ভেতরে নিয়ে যাবে। ০২০০ আওয়ার।”

স্কাউটদের জন্য রাত দুটো হলো সবচেয়ে আদর্শ সময়। ঠিক এসময়ে শত্রু তার মানসিক আর শারীরিক শক্তির সর্বনিম্ন সীমানায় থাকে।

রাত একটায় ল্যান্সারের মেসে ক্রুদেরকে ফাইনাল ব্রিফিং করল শন। সবাইকে পৃথক পৃথকভাবে চেক করে দেখল। সকলেরই পরনে জেলেদের নেভি ব্লু জার্সি জিন্স আর কালো ক্যানভাসের বাবার সোল কমব্যাট বুটস্। মাথায় কালো উলের টুপি আর ক্যামো ক্রিম কিংবা নিজস্ব রঙের প্রভাবে সকলেরই চেহারা আর হাত দুটো একেবারে কুচকুচে কালো।

ইউনিফর্ম বলতে দক্ষিণ অ্যাংগোলাতে বন্দি কিউবানদের কাছ থেকে পাওয়া বেল্ট ঝুলছে সকলের কোমরে। অস্ত্র হিসেবে প্রত্যেকের কাছে আছে সোভিয়েট একে এম অ্যাসল্ট রাইফেলস, তোকারেভ পিস্তল আর বুলগেরিয়ান এম ৭৫ অ্যান্টি-প্যার্সোনেল গ্রেডেন। ইসাউ গনডেলের সেকশনের তিনজনের কাছে থাকবে আর পি জি ৭ অ্যান্টি ব্যাঙ্ক রকেট লঞ্চার। দক্ষিণ আফ্রিকানদের সহযোগিতা পাবার ক্ষেত্রে একটা চুক্তি হলো কিছুতেই যেন তাদেরকে চিহ্নিত না করা যায়।

এবারে একজন একজন করে টেবিলের উপর রেখে গেল সমস্ত ব্যক্তিগত অলংকার আর ব্যবহার্য জিনিস। যেমন আংটি, ওয়ালেট। প্রত্যেকের জিনিস আলাদাভাবে খামে পুরে সবাইকে একটা করে ডিজিটাল রিস্টওয়াচ দিল ইসাউ গনড়ে।

এরই ফাঁকে ব্রিজ থেকে ইন্টারকমে খবর দিল ট্রলার ক্যাম্পের : “আমরা নদীমুখে থেকে সাত নটিক্যাল মাইল দূরে আছি। পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে বালুচর সময়ের চেয়ে কয়েক মিনিট আগেই পজিশনে পৌঁছে যাব।”

“গুড অন্ ইউ।” জানাল শন। এরপরই তাকাল কালো কালো মুখগুলোর দিকে। “ভেরি ওয়েল জেন্টলম্যান। জানো আমরা কিসের পেছনে ছুটছি। শুধু ব্যস্ততার ভেতরে কারো গলা কাটার সময়ে মেয়েটা আর বাচ্চাটার দিকে খেয়াল রাখবে। ও আমার বোন।” মুহূর্তখানেক সময় দিল সবার মনে কথাটা গেঁথে নেয়ার জন্য।

“দ্বিতীয় বিষয় হল, তোমাদেরকে যে স্কেচ ম্যাপ দেখিয়েছি তা সত্যের চেয়ে কল্পনা বেশি। এর উপর ভরসা করো না। তৃতীয় ব্যাপার হলো, ফিরে আসার সময় কেউ সৈকতে থেকে যেও না। চিকাম্বা হলিডে কাটাবার জায়গা না। খাবার আর আবাসস্থল সবই জঘন্য।” বাঙ্ক থেকে নিজের রাইফেল তুলে নিল শন’ “তো আমার বাছারা, চলো দেখি ব্যাটারা কী করছে।”

নিভিয়ে দেয়া হয়েছে ল্যান্সারের সব বাতি। রাডার আর আর ডেপথ সাউন্ডারের উপর ভর করে এগিয়ে চলেছে তীরের দিকে। ইঞ্চিন বন্ধ থাকায় ভরসা কেবল ক্যাপ্টেনের দক্ষতা। সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সামুদ্রিক শৈল শ্রেণির উপর আছড়ে পড়া সফেন তরঙ্গপুঞ্জ দেখতে পেল শন। তীরের উপরেও কোন আলো দেখা গেল না। ঘুমিয়ে আছে যেন পুরো ঘাঁটি। আকাশে নিশ্চিদ্র মেঘের আস্তরণ থাকাতে নেই কোনো তারা কিংবা চাঁদের আলো।

রাডার হুড থেকে সিধে হয়ে বসল ভ্যান ডার বার্গ, “এক মাইল দূর” আস্তে করে ঘোষণা করল ক্যাপ্টেন। “পানির গভীরতা ছয় ফ্যাদম আর বালুচর আছে।”

গাছের গুঁড়ির মতো ভাসছে ল্যান্সার। “থ্যাংকস ভ্যান” জানাল শন্। “তোমার জন্য চমৎকার কোনো একটা উপহার নিয়ে আসব।” হালকা পায়ে কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে মেইন ডে’কে নেমে এলো শন।

নিজ নিজ কালো রাবারের ল্যান্ডিং বোট নিয়ে স্টার্নের কাছে অপেক্ষা করছে প্রতিটা দল। বাতাসে মাদকের গন্ধ পাওয়াতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল শন্। সে পছন্দ না করলেও এটা স্কাউটদের ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। হামলা করার আগে “বুম” করা চাই।

“সার্জেন্ট-মেজর, স্মোকিং লাইট আউট হয়ে গেছে” শনের কথা শুনে স্কাউটেরা যার যার ক্যানাবিস সিগারেট ডে’কের উপর পিষে নিভিয়ে ফেলল। শন বুঝতে পারে যে ধূমপানের মাধ্যমে ভয় কাটিয়ে উঠে বেপরোয়া সাহসী হয়ে উঠে তার ছেলেরা; কিন্তু সে নিজে কখনো এর চর্চা করেনি। বরঞ্চ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে এ ভয়; রক্তে মিশে গিয়ে মাথার মাঝে সবর্দা তাড়না জাগায়। মরণের মুখে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার আগেই যেন নিজেকে বড় বেশি জীবিত বলে মনে হয়। তাই এই নিখাদ ভয়ের শিখাকে আড়াল করার কোনো চেষ্টাই করে না।

মসৃণভাবে পানির মাঝে নেমে গেল একের পর এক রাবারের বোট। সাথে ইকুপমেন্ট আর স্কাউটেরা। টয়েটো আউটবোর্ড চালু করে অন্ধকারে কলকল করতে লাগল নাবিকেরা। বাতাসহীন নিঃশব্দ রাতেও এ শব্দ শ’খানেক গজের বেশি পৌঁছাবে না।

লম্বা কালো একটা সাপের মতো এগিয়ে চলল বোটের সারি নিজের শ্রেষ্ঠ তিন সঙ্গীকে নিয়ে সবার আগে আছে শন। স্টানের উপর ঢাকনিঅলা একটা পেন লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে যেন প্রতিটি রাবার বোট আলো দেখে পিছু নিতে পারে।

স্টার্নের কাছে দাঁড়িয়ে আছে শন্। গলার কাছে ছোট্ট লুমিনাসে কম্পাস ঝুললেও নাইটস্কোপের উপর ভরসা করেই সকলকে তীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে অনেকটা প্লাস্টিক কোটেড বাইনোকুলারের মত।

জিইস লেন্সের ভেতরে দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মেঘের গাঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছের সারি। সামনেই নদীর খোলা মুখ। পাশে চলে এলো ইসাউ গনডেন্সর বোট। “এই যে পেয়ে গেছি” খানিকটা ঝুঁকে ম্যাটাবেলে’কে ফিসফিস করে জানাল শন্।

“আমিও দেখতে পাচ্ছি।”

নিজের চোখের নাইটসস্কোপ ঠিক করে নিল গনডেল। “চলো ব্যাটাদের তেল বার করি।” পাশাপাশি চলল তিনটা অ্যাটাক বোট। ল্যান্ডের দিকে এগিয়ে হারিয়ে গেল নদীর মাঝে। মাটির সাথে সমান্তরাল পথে ছুটে চলল।

বোটম্যানের কানে ফিসফিস করতেই আড়াআড়ি সৈকতের দিকে ছুটল শনের বোট। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশ দেখছে শন। নদীমুখ থেকে আধা মাইল দূরে থাকতেই পাম বিথীর মাঝে কুঁড়ে ঘরের চৌকোণা আউটলাইন চোখে পড়ল। এর পেছনেই আছে দ্বিতীয়টি। “এটা বেলা’র বণনার সাথে মিলে যাচ্ছে।” নিশ্চিত হলো শন্।

সৈকতের দিকে ধেয়ে চলল রাবার বোটের আরোহীরা। কাছাকাছি কুঁড়েঘরের উপর দেখা গেল ধাতব ক্রিস্টমাস ট্রি অ্যানটেনা আর ডিশ। স্যাটেলাইট কমুনিকেশন সেন্টার।

“তার মানে, এটাই। কোন ভুল নেই।”

বালিতে গেঁথে গেল রাবার বোটের মসৃণ তলা। হাঁটু সমান পানিতে নেমে পড়ল শনে’র দলবল। তীরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল শন। সৈকতের বালি এতটাই সাদা যে কাঁকড়াগুলোকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাভার নিল প্রত্যেকে; তাল গাছের সারির নিচে হাই ওয়াটার রিজের কাছে।

বিয়ারিং চেক করার জন্য কয়েক মিনিট সময় নিল শন। বেলা’র প্রথমবার ভ্রমণের স্মৃতি অনুযায়ী কম্যুনিকেশন সেন্টারেই ওকে সার্চ করেছিল দুই তিনজন নারী অপারেটর। সেন্টারটাও তারাই চালায়। পেছনের ব্যারাকেই থাকে প্রায় বিশ জন প্যারা গার্ডস।

সূর্যাস্তের সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে যায় কম্পাউন্ডের দরজা। এব্যাপারে বার বার সাবধান করে দিয়েছে বেলা। একজন সেন্ট্রি থাকে। প্রতি চার ঘণ্টার বদল হয় পাহারাদার।

“ওই যে মহাশয় আসছেন” তারের বেড়ার পেছনে সেন্ট্রির গাঢ় অবয়ব দেখতে পেল শন। নাইটস্কোপ নামিয়ে পাশেই শুয়ে থাকা স্কাউটকে ফিসফিস করে জানাল; “বিশ কদম সামনে পোর্কি, বাম থেকে ডানে যাচ্ছে।”

“বুঝেছি।” পর্তুগিজ রোডেশিয়ান গোর্কি শোভস্ এর বিশেষত্ব হলো সে ছুঁড়ে মারতে ওস্তাদ। পঞ্চাশ মিটার দূর থেকে ঘুঘুর পাখা খসিয়ে দিতে পারে। দশ মিটার দূর থেকে ওর ছোঁড়া স্টিলের বল-বিয়ারিং যে কোনো মানুষের খুলি’র ভেতর ঢুকে যাবে কোনো সমস্যা ছাড়াই।

এক হাঁটু গেড়ে উঠে দাঁড়াল পোর্কি। কিউবান সেন্ট্রি সমান্তরালে আসতেই ডাবল সার্জিকাল রাবারের দড়ি লাগানো গুলতি ছিটকে উঠল। একটুও শব্দ না করে সাদা বালির উপর ঢলে পড়ল সেন্ট্রি। “গো!” নরম স্বরে আদেশ দিল শ আর তার কান্টার মেশিন নিয়ে ছুটে গেল দ্বিতীয় স্কাউট। টুংটাং গানের মতো শব্দ করে কেটে গেল কাটা তারের বেড়া! খোলা মুখ দিয়ে দৌড় দিল শন্।

পেছনে আসা প্রতিজন স্কাউটের কাঁধে চাপড় মেরে যার যার টার্গেট দেখিয়ে দিল সকলকে। দু’জন গেল মেইন গেইটের সেন্ট্রিদের খবর নিতে। দু’জন গেল কমুনিকেশন সেন্টার বন্ধ করতে; বাকিদের কাজ হলো কম্পাউন্ডের পেছন দিকের ব্যারাক আর গ্যারিসন গার্ডদের মুন্ডপাত করা।

প্রথমবারের সমস্ত কিছু যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে রেডিও রুমের ডানদিকে প্রথম ঘরটাতেই বেলা’র রুম। দ্বিতীয়টাতে কিউবান নার্স আদ্রার সাথে থাকে নিকি। শ’নের ধারণা অনুযায়ী নার্সটা হলো আসল শয়তান। তাই প্রথম সুযোগেই ওর গলা কাটতে চায় শন।

কুঁড়ে ঘরের সারির দিকে দৌড় দিল শন। কিন্তু পৌঁছাবার আগেই কমুনিকেশনস রুমে চিৎকার শুরু করল এক নারী কণ্ঠ। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চিৎকার করছে কেউ; শুনে মনে হলো সহ্য করতে পারবে না। শন্। সাথে সাথে অটোমেটিক ফায়ারের শব্দে চাপা পড়ে গেল চিৎকার।

হেয়ার উই গো! শুরু হল জীবন মরণ বাজি রাখার যুদ্ধ। রাতের আকাশ চিরে দিল আগ্নেয়াস্ত্রের শিখা।

***

ইসাবেলার ঘুম হলো চমৎকার। কিন্তু মাঝরাতের খানিক আগে বজ্রপাত আর মাথার উপরে জেট ইঞ্জিনের আওয়াজে ভেঙে গেল ঘুম। মশারি থেকে বের হয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে এলো বাইরে।

দক্ষিণ দিক থেকে বইছে শক্তিশালী ঝড়ো হাওয়া। বাতাস আর মেঘের মাঝে হারিয়ে গেল জেট ইঞ্জিনের শব্দ। বেলা’র কাছে মনে হলো আকাশে একটা নয় বরঞ্চ তার চেয়েও বেশি এয়ারক্রাফট উড়ে বেড়াচ্ছে। আশা করল। অন্তত একটাতে থাকবে বাবা আর গ্যারি।

“তোমরা কী সিগন্যাল পেয়েছ?” নিকষ কালো আকাশের দিকে মুখ তুলে সবিস্ময়ে ভাবলো বেলা; “আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ড্যাডি? জানো আমি এখানে?”

কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না; ছোট্ট একটা তারাও না। আস্তে আস্তে মিইয়ে গেল মাথার উপরে ইঞ্জিনের আওয়াজ। চারপাশে কেবল শো শো শব্দে বইছে ঝড়ো বাতাস।

আবারো শুরু হল বৃষ্টি। দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলো বেলা। মাথা আর পা মুছে জানালাতে গিয়ে তাকিয়ে রইল সৈকতের দিকে।

“প্লিজ গড। ওদেরকে জানিয়ে দাও যে আমরা এখানে। শকে সাহায্য করো যেন আমাদেরকে খুঁজে পায়।” সকালবেলা নাশতার সময় নিকোলাস জানাল : “আমি তো আমার নতুন সকার বলটা খেলার সুযোগই পেলাম না।”

“কিন্তু আমরা তো প্রতিদিনই এটা দিয়ে খেলছি নিকি।”

“হ্যাঁ, কিন্তু…মানে ভালো খেলেয়ারদের সাথে।” আর তারপরই বুঝতে পার কী বলে ফেলেছে, “তুমিও ভাল খেলো-মেয়ে হিসেবে। আমার মনে হয় আরেকটু প্র্যাকটিস করলেই তুমি ভালো গোলকীপার হতে পারবে। কিন্তু মাম্মা, আমি আমার স্কুলের ফ্রেন্ডদের সাথে খেলতে চাই।”

“আমি তো জানি না।” আদ্রার দিকে তাকাল বেলা। “তোমার বন্ধুরা এখানে আসে?” আদ্রা উড-স্টোভ থেকে তাকালো না পর্যন্ত। শুধু জানাল, “জোসে’কে জিজ্ঞেস করুন। হয়ত অনুমতি মিলবে।”

সেদিন বিকেলেই জিপ ভর্তি কৃষাঙ্গ বাচ্চা ছেলেদের নিয়ে কম্পাউন্ডে চলে এলো জোসে আর নিকি। তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটা ম্যাচ হলো সৈকতে।

জোসে আর ইসাবেলা এসে তিনবার ছেলেদের যুদ্ধ থামাল। কিন্তু প্রতিবার আবার এমনভাবে খেলা শুরু হল যেন একটু আগে হাতাহাতি কিংবা মারামারির কোনো ঘটনাই ঘটে নি।

বিপ্লবের পুত্রদের গোলকীপার হলো ইসাবেলা। কিন্তু পাঁচ গোল খাওয়ার পর ক্যাপ্টেন নিকোলাস এসে কৌশলে জানালো, “মাম্মা তুমি বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, একটু রেস্ট নাও।” ফলে সাইড লাইনে চলে আসল বেলা।

অতঃপর ফলাফল হত ২৬ : ৫ অর্থাৎ ছাব্বিশ গোলে জিতে গেল বিপ্লবের পুত্র’রা। ওই পাঁচটা গোল খাওয়াতে মনে মনে অপরাধ বোধ ভোগল বেলা। ফাইনাল হুইসেল বাজার পর নিজের গিফট বক্স খুলে দুই কিলো টফি আর চকোলেট বিলিয়ে দিল দোষ ঢাকার জন্য। দুই দলই অবশ্য সাথে সাথে তাকে মাফ করে দিল।

ডিনারের সময়েও সহজভাবেই গল্প করল নিকি। বেলা নিজেও স্বাভাবিক থাকতে চাইল; কিন্তু চোখ বারবার চলে যাচ্ছে জানালার দিকে। মন পড়ে আছে সৈকতে; শন্ যদি আসে, তো আজ রাতেই আসবে। এদিকে বেলা বুঝতে পারল যে আদ্রাও তাকে খেয়াল করছে।

তাই নিকির কথায় মনোযোগ দিতে গিয়ে ভাবতে লাগল আদ্রা’র কথা।

মহিলাকে কি সাথে করে নিয়ে যাবে? আদ্রা যদি না আসতে চায়? সবসময় এত গোমড়া হয়ে থাকে যে ওর মনের কথা বেলা কখনোই আঁচ করতে পারেনি। তবে নিকি’কে জান প্রাণ দিয়ে ভালবাসে এতে কোন সন্দেহ নেই।

আচ্ছা আদ্রা’কে কি রেসকিউ অপারেশনের কথা বলবে নাকি? আপন মনেই ভাবল বেলা। একবার জিজ্ঞেস করবে নাকি? হয়ত যেতে চাইবে। এত বছর দেখ ভাল করার পরে এখন ওর কাছে থেকে নিকি’কে এভাবে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কিন্তু কেবল নিকি কিংবা বেলা’র ভয় নয় তাহলে ওর ভাই আর সেসব সাহসী সৈন্যগুলোকেও যদি কোনো চড়া মূল্য দিতে হয়?

এভাবে খেতে খেতে বহুবার আদ্রার সাথে কথা বলতে চাইল বেলা; কিন্তু প্রতিবারই সরে গেল আদ্রা।

নিকি’কে বিছানায় তুলে দিতে এসে ছেলে’র গালে চুমো খেল বেলা। মুহূর্তখানেক শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল নিকি।

“তুমি আবারো চলে যাবে, মাম্মা?”

“যদি সম্ভব হয় তুমি আসবে আমার সাথে?” পাল্টা প্রশ্ন করল বেলা।

“পাদ্রে আর আদ্রা’কে ছেড়ে?” গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল নিকি এবারেই প্রথম রামোনের কথা বেলা’কে বলল নিকি বেলা নিজেও চিন্তায় পড়ে গেল। ছেলেটার গলার স্বরে কি ভয় নাকি শ্রদ্ধা নিশ্চিত হতে পারল না বেলা।

তাড়াহুড়া করে শুধু বলল : “নিকি আজ রাতে-যদি কিছু হয় তুমি ভয় পেওনা, ঠিক আছে?”

“কী হবে?” আগ্রহ নিয়ে উঠে বসল নিকি

“জানি না। হয়ত কিছুই না।” নিরুৎসাহিত হয়ে আবার বালিশের উপর শুয়ে পড়ল নিকি।

“গুড নাইট, নিকি।”

ঘরগুলোর মাঝখানের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্রা। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল বেলা।

‘আদ্রা।” ফিসফিস করে বলে উঠল, “আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, আজ রাতে…” শেষ করতে পারল না বেলা।

“আজ রাতে?” আদ্রা বেলা’কে তাড়া দিলেও কোনো কথা না শোনায় বলে উঠল : হ্যাঁ, আজ রাতে উনি আসবেন। উনি জানিয়েছেন যেন আপনি অপেক্ষা করেন। আগে আসতে না পারলেও আজ রাতে অবশ্যই আসবেন।”

হঠাৎ করেই তীব্র আতঙ্কে হেঁয়ে গেল মন। “ওহ গড় তুমি নিশ্চিত?” এরপরই সামলে নিল নিজেকে-”যাক ভালই হলো, আমি অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলাম।

আদ্রা’কে রেসকিউ অপারেশনের বিষয়ে সাবধান করার সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে গেল। মনের মাঝে কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে-কেমন করে রামোনের মুখোমুখি হবে?

“আমাকে এখন যেতে হবে” আবারো অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেল আদ্রা। বেলা ভেবেছিল নাইটড্রেসের নিচে জিন্স আর জার্সি পরে তৈরি হয়ে বসে থাকবে। কিন্তু এখন আর তার উপায় নেই। নগ্ন আতঙ্কে প্রায় জমে যাবার দশা।

অন্ধকারে মশারির ভেতরে শুয়ে অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে মনে হলো, না রামোনের আগে হয়ত শন চলে আসবে; নতুবা তোর এসে বাঁচাবে ও’কে।

হঠাৎ করেই বুঝতে পারল এসে গেছে রামোন। রামোনের কথা শোনার আগেই ওর দেহের ঘ্রাণ পেল বেলা। শক্ত হয়ে গেল শরীরের সব মাংস পেশি। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে বুঝি।

কুঁড়েঘরের মেঝেতে শুনতে পেল রামোনের পদশব্দ আর তারপরই বিছানাতে ওর স্পর্শ।

“রামোন” ফুস করে বেরিয়ে গেল বুকের সব বাতাস।

“হ্যাঁ, আমি।” রামোনের গলা শুনে যেন প্রচণ্ড ঠাক্কা খেল বেলা।

মশারি তুলছে রামোন। শক্ত হয়ে পড়ে রইল বেলা। মুখে রামোনের হাতের ছোঁয়া পেতেই মনে হলো গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। বুঝতে পারছে না কী বলবে, কী করবে। “ও জেনে যাবে” বেলা বুঝতে পারলেও বড় বেশি ভয় পাচ্ছে। তাই নড়াচড়া কিংবা কথা বলার সাহস পেল না।

“বেলা?” কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে রামোন। এস্ত পায়ে হঠাৎ করেই উঠে বসে ওকে জড়িয়ে ধরল বেলা।

“কথা বলো না” তীব্র স্বরে জানাল বেলা, “আমি আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারব না-আমাকে আদর করো, রামোন।”

জানে ও অস্বাভাবিক কিছু করছে না। অতীতের সুখের দিনগুলোতে প্রায়ই রামোনের কাছে এমন আবদার জুড়ে দিত বেলা-একটুও দেরি সহ্য করতে পারত না।

উঠে বসে রামোনের বুকে কান্না শুরু করে দিল বেলা। ও যেন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না পায়। এমন ভাব করতে হবে যেন কিছুই বদলায়নি।

ভয়ে বুক কাঁপতে থাকলেও কিছুই বুঝতে দিল না বেলা। রামোন ওর নাইট ড্রেস খুলে নিয়ে নিজেও নিরাভরণ দেহে শুয়ে পড়ল বেলার পাশে।

“বেলা, ফিসফিস করে উঠল রামোন, “আমিও কতদিন ধরে তোমার প্রতীক্ষা করছি।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেহের খেলায় মেতে উঠল বেলা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই নিষ্ঠুর জানোয়ারটার সাথেও রতিক্রিয়া তেমন খারাপ লাগল না। আর সবশেষে নিজের উপরই ঘেন্যা হতে লাগল। মনে হলো রামোনের দেহের ভার আর তার নিজের অপরাধবোধ মিলে এখন গলা টিপে বেলা’কে মেরে ফেলবে।

“আগে তো আর কখনো এমন হয়নি” ফিসফিস করে জানাল রামোন, “আগে তো কখনো এমন করে ভালবাসনি।”

উত্তর দেবার সাহস করল না বেলা। ভয় হলো না জানি কী বেরিয়ে আসে মুখ ফসকে। বুঝতে পারল কতটা উন্মাদ হয়ে গেছে-তারপরও শর মতো সাড়া দিল রামোনের স্পর্শ পেয়ে।

বেলা’র পাশে শুয়ে নরম স্বরে কথা বলছে রামোন। জানালো ও বেলাকে কতটা ভালবাসে। বলল ভবিষ্যতের কথা; যখন ওরা তিনজন মিলে চলে যাবে কোনো নিরাপদ আর গোপন জায়গায়। এত সুন্দর করে মিথ্যে বলে রামোন; একের পর এক কল্পনা ভেসে বেড়াল বেলা’র চোখে। জানে এগুলোর এক বর্ণও সত্যি নয়। তারপরেও কেন জানি মন চাইল বিশ্বাস করতে

অবশেষে বেলা’র নগ্ন বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল রামোন। ওর কোকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে নিজের জন্য দুঃখই করল বেলা। এতটাই হতাশায় ডুবে গেল যে ভুলে গেল বাকি সবকিছু। আর তখনই হঠাৎ করে নারী কণ্ঠের চিৎকারে খান খান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা।

জেগে গেল রামোন। আর সাথে সাথেই উলঙ্গ দেহে ঠিক একটা জংলী বিড়ালের মতই লাফ দিয়ে নামল বিছানা থেকে। বিছানার পাশের মেঝে থেকে হোলস্টার খুলে পিস্তল বের করল রামোন। ধাতব একটা ক্লিক শব্দ শুনতে পেল বেলা। বিস্ফোরণের আলোতে রাতের আকাশ যেন জ্বলছে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসা আলোতে রামোনের দিকে তাকাল বেলা। চোখ বরাবর পিস্তল ধরে আকাশের দিকে তাক করে রেখেছে রামোন; যে কোনো মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত।

এরপরই জানালার বাইরে শনে’র অতিপ্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে পেল বেলা, অন্ধকারে বোনে’র নাম ধরে ডাকছে : “বেলা, কোথায় তুমি?”

জানালার কাছে নড়ে উঠল রামোনের দেহ। গ্রেনেডের আলোয় নিশানা ঠিক করল রামোন। দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠল বেলা : “লুক আউট, শন! ম্যান উইদ আ গান!”

দু’বার গুলি করল রামোন। কিন্তু জানালার কাছ থেকে কোনো প্রতি উত্তর এলো না। বেলা বুঝতে পারল শন্ বেলা আর নিকি’র কথা ভেবে গুলি করার সাহস পাচ্ছে না।

বিছানা থেকে গড়িয়ে নেমেই মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে লাগল বেলা। কোনো কিছু না ভেবেই কেবল দরজার দিকে যাচ্ছে। ওকে নিকি’র কাছে পৌঁছাতেই হবে।

মাঝপথেই টের পেল গলা’র উপর পিছন থেকে চেপে বসেছে রামোনের হাত। জোর করে দাঁড় করিয়ে দিল বেলা’কে। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল বেলা : “শন! ও আমাকে ধরে ফেলেছে।”

“কুত্তী” কানের কাছে হিসহিস করে উঠল রামোন, “আমার সাথে চালাকি!” আর তারপরেই গলা উঁচিয়ে শনকে শোনাল, “আমি ওকে মেরে ফেলব! গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেব!”

টানতে টানতে বেলা’কে নিয়ে জোর করে সিঁড়ির উপর বসিয়ে দিল রামোন, “আগে বাড়, শয়তানি” হাঁটতে থাক। আমি জানি শন কে। তোকে শিল্ড হিসেবে ধরলেও গুলি করবে না। মুভ!” রামোন গলা টিপে ধরাতে নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হল। কিন্তু বেলা অসহায়। রামোন ওকে ধরে নিকি’র ঘরের দিকে দৌড়াচ্ছে। কমুনিকেশন রুমে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাতের আকাশে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে গেল খড়ের ছাউনির শিখা।

দৌড়ে গিয়ে নিকির ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মেঝেতে মাঝখানে বসে আছে আদ্রা আর নিকি। নিজের শরীর দিয়ে নিকি’কে ঢেকে রেখেছে আদ্রা।

“পাদ্রে!” ভয়ে আর্তচিৎকার শুরু করল নিকি।

“আদ্রা’র সাথে এসো।” খেঁকিয়ে উঠল রামোন।” ওর কাছেই থাকবে, আমার পিছু পিছু এসো।”

দল বেঁধে ঘর থেকে বের হয়ে কারপার্কের কাছে গেল রামোন। পিছন থেকে বেলা’কে ধরে রেখেছে রামোন আর মুক্ত হাত দিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে রেখেছে পিস্তল। “আমি ওর খুলি উড়িয়ে দেব” নাচতে থাকা তাল গাছের ছায়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল রামোন, “সুতরাং দূরেই থাকো।”

“প্লিজ পাদ্রে, মাম্মা’কে মেরো না” ফুঁপিয়ে উঠল নিকি। “চুপ, একদম চুপ!” আবারও খেঁকিয়ে উঠল রামোন। এরপর বলে উঠল, “তোমার কুত্তাগুলোকে ডেকে পাঠাও শন, যদি বোন আর বোনপো’কে মারতে না চাও।”

মুহূর্তখানেক পর অন্ধকার থেকে শোনা গেল শ’নের কণ্ঠস্বর : “হোল্ড ইউর ফায়ার স্কাউটস! ব্যাক অফ স্কাউটস।”

সবাইকে হটিয়ে জিপের কাছে নিয়ে গেল রামোননিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করছে বেলা। কানের কাছে পিস্তলের নল এত ঠেসে বসে গেছে যে নরম চামড়া কেটে গলা অব্ধি রক্ত গড়িয়ে পড়ল।

“প্লিজ। আমি ব্যথা পাচ্ছি’ হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো রকমে বলল বেলা।

“মামাকে মেরো না” চিৎকার করেই আদ্রা’র হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল নিকি ইসাবেলা’র পাশে চলে আসতেই এক মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল আদ্রা।

পেছনের অন্ধকারে জ্বলে উঠল হলুদ আলোর ফুল। বিশ গজ খোলা জায়গা পেরিয়ে ছুটে এলো একটামাত্র বুলেট।

উড়ে গেল আদ্রা’র মাথার একপাশ। দু’হাত ছড়িয়ে পেছন দিকে পড়ে গেল আদ্রা।

“আদ্রা!” চিৎকার করে উঠল নিকি। কিন্তু ও দৌড় দেয়ার আগেই নিকি’রকোমর ধরে ফেলল রামোন।

“না, আদ্রা থাকুক। এখন আমার কাছাকাছি থাকো নিকি।”

ওদের তিনজন ব্যতীত আশেপাশে জীবিত আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত দালানের দেয়ালে কাত হয়ে পড়ে আছে এক কিউবান নারী সিগন্যালারের মৃতদেহ; কম্পাউন্ডের গেইটে শুয়ে আছে দু’জন প্যারাট্রুপার।

যদি কোন প্যারাট্রুপার এখনো বেঁচে থাকে সেই আশাতে স্প্যানিশে অর্ডার দিল রামোন; কিন্তু জানে এর সম্ভবনা নেই বললেই চলে। আক্রমণকারীদের সামর্থ্যও ভালোই জানা আছে। ইসাবেলা’র মুখে শোনার সাথে সাথেই ওর ভাইয়ের নাম চিনতে পেরেছে রামোন। স্কাউটদেরকে চিৎকার করে আদেশ দেয়ার সময় শনে’র গলা শুনে আরো নিশ্চিত হয়েছে। এতক্ষণে প্যারাট্রুপাররা নিশ্চয় সব শেষ হয়ে গেছে। সম্ভবত আক্রমণের শুরুতেই প্রাণ হারিয়েছে সকলে।

এরা যে কুখ্যাত ব্যালান্টাইন স্কাউটস্ এতে কোনো সন্দেহই নেই; কিন্তু রামোন অবাক হলো এই ভেবে যে এখানে তারা এলো কেমন করে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে যে কোনো না কোনোভাবে বেলাই তাদেরকে ডেকে এনেছে। ছায়ার পেছনেই লুকিয়ে আছে স্কাউটেরা, রামোন জানে সামান্যতম সুযোগ পেলেই আদ্রার মতো দ্রুত আর নির্ভুল একটা বুলেট পাঠিয়ে মেরে ফেলবে তাকে।

তাই তার একমাত্র ভরসা হলো সময়। জানে রালেই তাবাকা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেই এয়ারফিল্ড থেকে রিলীফ গেরিলা সৈন্য নিয়ে রওনা দিয়ে দেবে। কয়েক মিনিটের মাঝেই পৌঁছে যাবে এখানে। সবচেয়ে কাছেই পার্ক করে রাখা তিনটা জিপের কাছে চলল রামোন।

একে এমের সাইটস দিয়ে ওদেরকে দেখছে শন। একটা তাল গাছের নিচে শুয়ে আছে এখন। এই রেঞ্জ থেকে চল্লিশ গজ দূরে কারো খুলিতে দুই ইঞ্চি গর্ত করে দেয়া কোনো ব্যাপারই না অ্যাসল্ট রাইফেলের কাছে। আদ্রার নাক বরাবর নিশানা করে বাম কানে গুলি করেছে। খুলির একপাশ তছনছ করে দিয়ে গেছে শনে’র বুলেট।

কিন্তু রামোন মাচাদোর ক্ষেত্রে এমন নিশ্চিন্তে কিছু করার উপায় নেই। বক্সারের মতো মাথা নিচু করে বেলা আর নিকির আড়ালে হাঁটছে রামোন। তাই ঠিকমতো ওর মাথাই দেখতে পাচ্ছে না শন।

তবে বোনের নগ্ন দেহ দেখে যারপর নাই বিরক্ত। জানে স্কাউটেরাও তাকিয়ে আছে। যুদ্ধের এই জাড়াডোলের ভেতরও রামোন মাচাদো বেলাকে নিজের উলঙ্গ শরীরের সাথে এমনভাবে লেপ্টে ধরে আছে যে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই গুলি করে বসে। একটা শট নিতে চাইলেও বেলা’র কাঁধে মাথা লুকিয়ে জিপে চড়ে বসল রামোন।

কোন মতে ড্রাইভারের সিটে বসেই বেলা আর নিকি’কে টেনে নিল পাশে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন, গেইটের কাছে ছুটতেই পেছনের হুইল থেকে ছিটকে উঠল বালির ফোয়ারা। ফায়ার করল শন। কাছাকাছি থাকা পেছনের হুইলের নিকে। লাগল গুলি। ব্যারিয়ার গেইটের কাছে গিয়ে দুলে উঠল জিপ। ধাক্কা লাগাতে উঠে গেল একটা পোল। দুমড়ে মুছড়ে গেল গেইট। ভাঙ্গা আর্বজনা নিয়েও রাস্তায় নেমে এলো জিপ। পেছনে ভাঙ্গা পোল আর তারের বেড়া সান্টার স্নেই গাড়ির মতো ঝুলছে।

লাফ দিয়ে উঠে দ্বিতীয় জিপের দিকে ছুটল শন্। স্কাউটদের চারজনও একইভাবে দৌড়ে এসে গাদাগাদি করে উঠে বসতেই ইঞ্জিন চালু করল শন। বৃত্তাকারে ঘুরে গিয়েই ছুটল ভাঙ্গা গেইটের দিকে। রামোন আর তার বন্দিদের পিছু নিল।

যদি ইসাবেলা’র স্কেচ ম্যাপ সত্যি হয় তাহলে নদী বরাবর এই রাস্তাটা চলে গেছে এয়ারস্ট্রিপের দিকে; সেখানে রোড় ব্লক বসিয়েছে ইসাউ গনডেল।

রাস্তা দিয়ে ধেয়ে আসা যে কোনো গাড়িকে উড়িয়ে দেবে ইসাউ; সেটা যেদিক থেকেই আসুক না কেন। একটা আর পিজি রকেট ইসাবেলা আর তার ছেলেকে মাংসের তাল বানিয়ে ছাড়বে।

হর্ণের গায়ে হাতের তাল চেপে ধরল শন্। আশা করল এত দীর্ঘ হর্ণ শুনে ইসাউ হয়ত বুঝতে পেরে রকেট ছোঁড়া বন্ধ রাখবে। কিন্তু এতটা আশা করতেও ভয় হচ্ছে। গাঁজা খেয়ে শরীর গরম করে আসা স্কাউটদের হাতগুলো নিশপিশ করছে ট্রিগারের উপর।

তাই রামোনদেরকে ওভারটেক করতে হবে। হঠাৎ করেই পথটা ডান দিকে ঘুরে যাওয়ায় গতি ধীর করল শন্।

মোড়ে ঘুরে যেতেই বদলে গেল বাতাসের গতি। একপাশে সরে গেল বালি। মাত্র পঞ্চাশ গজ সামনে দেখা গেল রামোনের জিপের আলো।

সামনের সিটে বসে একহাতে গাড়ি চালাচ্ছে রামোন। অন্য হাত দিয়ে বাঁকিয়ে ধরে রেখেছে বেলা’র কাঁধ। ঘাড়ের সাথে ঝুলছে বেলা’র মাথা। এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে; চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে তীব্র ভয়। চিৎকার করে কিছু একটা বললেও বাতাসের তোড়ে কিছুই শুনতে পেল না রামোন।

ইসাবেলা’র সিট আঁকড়ে ধরে পিছনে বসে আছে নিকি। পরনে সাদা টি-শার্ট আর শটস্। চোখ ঘুরিয়ে বারবার পিছনের জিপের দিকে তাকানোতে মায়ের সাথে ছেলেটার চেহারার এত মিল দেখে অবাক হয়ে গেল শন্। ওদেরকে বিপদে ফেলেছে। যে লোকটা তাকে হাতের কাছে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।

এরপরই খেয়াল করল যা একপাশে কেমন যেন কাৎ হয়ে পড়ছে রামোনের জিপ। পেছনের টায়ার ফুটো করে দিয়েছে ওর গুলি। সাথে করে নিয়ে আসা ভাঙ্গা গেইটের অংশ আর বেড়া থাকায় পথের ধুলা আর বালিতে গতি হয়ে পড়ল আরো ধীর।

দ্রুত ওদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে শন। এবারে সৈকত থেকে দূরে সরে গেছে রাস্তা। ছুটছে খাড়া নদী তীর ধরে। দ্রুতগামী দুটো গাড়ির আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্থির কালো পানি।

কাঁধের উপর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে মাত্র তিন ফুট দূরে থাকা জিপটাকে দেখল রামোন। সাথে সাথে আবার মাথা নামিয়ে বেলা’কে ছেড়ে দিল। কোলের কাছে থাকা পিস্তল ছোঁ মেরে তুলে শ’নের মাথায় নিশানা করল। রেঞ্জ বারো ফুটেরও কম। কিন্তু এবড়ো খেবড়ো রাস্তাতে দুটো জিপে-ই সমানে ঝুঁকি দিচ্ছে। উইন্ডস্ক্রিনের সাইড পোস্টে লেগে অন্ধকারে হারিয়ে গেল বুলেট।

পাল্টা গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করল একজন স্কাউট; কিন্তু ব্যারেল আকাশে তুলে দিল শন।

“হোল্ড ইউর ফায়ার” চিৎকার করে আদেশ দিয়েই ছুটল রামোনের পিছু পিছু।

শনের জিপের গুতো খেতেই দুলে উঠল রামোনের জিপ। শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছনের সিটে গিয়ে বাড়ি খেল নিকি।

“জ্যাম্প” ইসাবেলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল শন। কিন্তু বেলা নড়ে উঠার আগেই আবার ওকে ধরে ফেলল রামোন।

আবার এসে রামোনের জিপের পিছনে ধাক্কা দিল শন। টেইল গেইট চুড়মাড় হয়ে যাওয়ায় রাস্তা থেকে খানিক সরে এলো রামোনের জিপ।

এক হাত দিয়ে জিপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রামোন। পেছনদিক পুরোপুরি ঝুলছে। ধুলার মেঘ এসে মনে হল শন’কে অন্ধ করে দিবে। ওদিকে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে বেলা আর পেছনের সিটে উবু হয়ে বসে আছে নিকি। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে চেহারা।

আরেকটা মোড় এসে পড়াতে গাড়ির উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা শুরু করল রামোন। শন দেখল এইই সুযোগ; নিজের গাড়ি নিয়ে রামোনের পাশেই চলে এলো। সেকেন্ড খানেকের জন্য পাশাপাশি ছুটল দুটো গাড়ি।

ছয় ফুট দূরত্বে পরস্পরের দিকে তাকাল রামোন মাচাদো আর শ কোর্টনি। বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো ঝলকে উঠল একে অন্যের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এটা এমন এক আদিম অনুভূতি যে প্রতাপশালী দু’জন পুরুষই উপলব্ধি করল যে অপরজনকে মেরে ফেলতে হবে।

হুইলের উপর চাপ দিয়ে বাম দিকে রামোনের জিপের গায়ে নিজের গাড়ি উঠিয়ে দিল শন। একইভাবে পিছিয়ে এসে শন’কে আঘাত করল রামোন। তাল গাছের গুঁড়িতে লাগায় উঠে গেছে রামোনের জিপের পেইন্টওয়াক।

আবারো ইসাবেলাকে ছেড়ে দিল রামোন। ছোঁ মেরে কোলের কাছে পড়ে থাকা পিস্তল তুলে গুলি ছুড়ল শ’নের মুখে। ক্রোধে জ্বলছে রামোনের চেহারা।

কিন্তু একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরে ফেলল বেলা। রামোন ফায়ার করতেই সর্বশক্তি দিয়ে পিস্তল টেনে ধরল বেলা। রাতের আকাশে উড়ে গেল বুলেট। বিপদজনক গতিতে ঝাঁকি খেল জিপ; ধুপ করে পড়ে গেল নদীর তীরে।

গাড়িটা উধাও হবার আগ পর্যন্ত বেলা আর রামোন’কে দুজনকেই উইন্ডস্ক্রীনের ওপারে দেখতে পেল শন আর পেছনের সিট থেকে নিকির ছোট দেহটা শূন্যে উঠে আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এরপরই জায়গাটা পেরিয়ে এলো শ’নের জিপ। কিন্তু প্রচণ্ড কষ্ট করে ব্রেক কষে গাড়িটার উপর কন্ট্রোল এনে গিয়ার লিভারকে পেছনে ঘোরাল শন্ আর গর্জন করতে করতে পিছিয়ে এলো রামোনের গাড়ির সন্ধানে।

আকাশে এখনো ভাসছে ধূলিকণা, টায়ারের ঘর্ষণে এখনো ডেবে আছে কিনারার মাটি। ড্রাইভারের সিট থেকে লাফ দিয়ে পড়ে তীরের দিকে দৌড় দিল শন। নিচেই নদীতে পড়ে আছে বেলা’র জিপ। ডুবে যাওয়া চাঁদের মতো এখনো দেখা যাচ্ছে হেডলাইটের আলো। পানির একেবারে কিনারে নদীতীরে পড়ে আছে নিকি’র ছোট্ট শরীর।

আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল শন। হোঁচট খেতে খেতেও সামলে নিল নিজেকে। বিড়ালের মতো মাটি আঁকড়ে নেমে এলো লং ক্লিন রেসিং ডাইভ দেবার মতো দুরত্ব পর্যন্ত তারপর অলিম্পিক রেসারের মতই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল শন্।

এক ডুবে একেবারে গভীর পর্যন্ত চলে গেল। পানির নিচে তেমন ভালো দেখা যাচ্ছে না। পানির নিচে জিপের ডুবে যাওয়া দেহের ভেতরে চলে গেল শন। ফুয়েল ট্যাংকের বাতাস পেয়ে তলাতে গিয়ে ঠেকার হাত থেকে বেঁচে গেছে জিপ।

সামনেই লম্বা মতন কী একটা দেখে হাত বাড়াল শন্। ইসাবেলার লম্বা চুলের মুঠি ধরে টেনে ওকে বের করে উপরে নিয়ে এলো। নিচে পড়ে রইল জিপের ধ্বংসস্তূপ।

পানির উপরে উঠে বেলা’কে দুর্বলভাবে নড়ে উঠতে দেখে স্বস্তি পেল শন। নদী তীরে বেলা’কে নামিয়ে দিল। স্কাউটদের একজন আবার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি খাঁটিয়ে জিপ চালিয়ে নিয়ে এসেছে একেবারে তীরের ডগায়। ফলে হেডলাইটের আলোতে নিচ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠল।

হামাগুড়ি দিয়ে ভেজা গায়ে নিকি’র কাছে চলে এলো বেলা। ছেলেকে কোলে তুলে নিল। ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল নিকি।

“মাই ফাদার” ফোঁপাতে লাগল নিকি। “মি পাদ্রে!”

হাঁটু পর্যন্ত কাদায় দাঁড়িয়ে নিচের পানির দিকে তাকাল শন্। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে ওখানেই আটকে রেখে দিয়েছে জিপ আর গভীরে হেডলাইট দুটো এখনো জ্বলছে।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও রামোন মাচাদোকে খোঁজার তাগিদ অনুভব করলন শন। ভাল করেই জানে যে এতক্ষণে গেরিলা ক্যাম্প থেকে রওনা হয়ে গেছে বাড়তি সৈন্য। হয়ত মাত্র কয়েক মিনিট মাত্র আছে হাতে। ঘুরে দাঁড়িয়েই বেলা’র কাছে যাবে শন এমন সময় পানির মাঝে কী যেন একটা নড়ে উঠল। তার আর হেডলাইটের আলোর মাঝ দিয়ে যেন চলে গেল গাঢ় একটা ছায়া।

বাস্টার্ড! তীরে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের স্কাউটদেরকে আদেশ দিল শন : “আমার রাইফেলটা দাও।”

একজন সাথে সাথে নেমে এলো। কিন্তু শনের হাতে একে এম দেবার আগেই পানির মাঝে আলোড়ন শুরু হল। বেশ খানিকটা দূরে ভেসে উঠল রামোনের মাথা।

“ধরো ওকে!” গর্জন করে উঠল শন। “বাস্টার্ডটাকে ধরো।”

চোখের উপর লেপ্টে আছে রামোনের চুল। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে চেহারা থেকে গড়িয়ে নামছে জলের ধারা। নদীতীর থেকে একজন স্কাউটের ছোঁড়া গুলি রামোনের মাথার চারপাশ থেকে পানির ফোয়ারা বানিয়ে দিল। গভীরভাবে দম নিয়ে আবার পানির মাঝে ডুবে গেল রামোন।

“বাস্টার্ড! বাস্টার্ড!” চিৎকার করে একে এম টেনে নিল শন। রামোন যেখানে হারিয়ে গেছে সেখানে বুলেট বৃষ্টি সৃষ্টি করল শন্। কিন্তু রামোন মাচাদো’র গায়ে একটাও লাগলো না। উধাও হয়ে গেছে কেজিবি কর্নেল জেনারেল।

আবারো রামোনোর মাথা ভেসে উঠার বৃথা আশা করল শন। ম্যানগ্রোভের বনে রামোনের লুকোবার জায়গার অভাব নেই।

আরেকটা মিনিট কেটে যাবার পর শন্ বুঝতে পারল যে হাওয়া হয়ে গেছে রামোন। নিজের ঘৃণা আর হতাশা চেপে বেলার দিকে তাকাল শন। ভেজা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। উইন্ডস্ক্রিনের কাঁচে কেটে গেছে হেয়ারলাইন।

কাঁধ থেকে নিজের ভেজা জার্সি খুলে বোনের গায়ে পরিয়ে দিল শন।

হাত ঢুকাতে ঢুকাতে ফোঁপাতে লাগল বেলা। “রামোনের কী হয়েছে?”

“বাস্টার্ডটা পালিয়ে গেছে।” বেলাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল শন। ‘সময় নষ্ট হচ্ছে, আমাদেরকে এখান থেকে সরে পড়তে হবে।”

মায়ের হাত ছাড়িয়ে পানির দিকে দৌড় দিতে চাইল নিকি, “মাই ফাদার আমি আমার বাবাকে ছেড়ে যাব না।”

এক হাত দিয়ে নিকিকে জাপটে ধরল শন, “কাম অন নিকি?” ঘুরে দাঁড়িয়েই শ’নের কব্জিতে কামড় দিল নিকি।

“ইউ লিটল সোয়াইন” খোলা হাত দিয়ে নিকি’র মাথাকে তুলে ধরল শন। “তোমার এসব ফাজলামো বাদ দাও, বন্ধু।”

কাঁধের উপর বস্তার মতো নিকি’কে ফেলে নিয়ে হাঁটা ধরল শন। ওদিকে নিকি সামনে হাত-পা ছুঁড়ছে। “আমি যাবো না, আমি আমার বাবার সাথে থাকতে চাই।”

ইসাবেলা’র হাত ধরে এগোতে লাগল শন। হঠাৎ করে জিপের চারপাশে আরো কয়েকজনকে দেখে আচমকা বুঝতে পারল না লোকগুলো কারা। বেলা কে ছেড়ে দিয়ে আবার একে এম তুলে নিল শন্।

“হোল্ড ইট, শন” দৌড়ে এসে ওকে শান্ত করতে চাইল ইসাউ। “তুমি আবার কোত্থেকে এলে?”

“আরেকটু হলেই তুমি আমাদের অ্যামবুশের মাঝে পা দিতে।” জানাল ইউ। “আর এক সেকেন্ড এগোলেই পিছনে আর পিজির রকেটের বাড়ি খেতে। আমরা এখানেই ছিলাম।” রাস্তার দিকে ইশারা করল ইসাউ।

“তোমাদের নৌকা কই?”

“নদীতে দুইশ গজ দূর।”

“তোমার লোকগুলোকে নিয়ে এসো-তোমার সাথে আমরাও ফিরে যাবো।” মাথা উঁচু করে তাকাল শন।

“লাইটগুলোকে নিভিয়ে দাও” নিজের একজন লোককে আদেশ দিল ইসাউ। পার্ক করা জিপের গায়ে ঝুঁকে সুইচে হাত লাগাতেই নিভে গেল হেডলাইট।

চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কান পাতল সকলে।

“এয়ারস্ট্রিপের দিক থেকে দ্রুত নেমে আসছে ট্রাক।”

“আরো কয়েকটা বাঞ্চোত” ঘোষণা করল ইসাউ।

“নৌকায় চলো” আদেশ দিল শন।

দল বেঁধে একসঙ্গে এগোল সবাই। একশ গজ যাবার পর হুইসেল দিল ইসাউ; সামনের অন্ধকার থেকে একইভাবে উত্তর পাওয়া গেল। কিন্তু রোড ব্লক দেবার জন্য পথের মাঝখানে টেনে আনা মরা তাল গাছের গুঁড়ির গায়ে পা। বেঁধে হোঁচট খেল শন।

“কাম অন রাস্তা থেকে ডেকে পাঠাল ইউ। “নৌকা এইদিকে।”

কথা বলার মাঝখানেই সামনের গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে হেডলাইটের আলো দেখা গেল। এয়ারস্ট্রিপ থেকে নেমে আসছে পুরো এক কনভয়।

শনের হাতের মাঝে সমানে নড়ছে নিকি। ওকে থামানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে বেলা। “ঠিক আছে নিকি ডার্লিং, এরা সকলে আমাদের বন্ধু। ওরা আমাদেরকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।”

“এটাই আমার ঘর-আমি বাবাকে চাই। ওরা আদ্রাকে মেরে ফেলেছে। আই হেইট দেইম! আই হেইট ইউ! আই হেইট দেইম!” স্প্যানিশে চিৎকার করে উঠল নিকি।

এবারে রেগে গিয়ে নিকি’কে খুব জোরে ঝাঁকি দিল শন। “আর একটাও যদি কোনো কথা বলে, তোমার ঘাড় থেকে ছোট্ট মাথাটা আলাদা করে দেব কিন্তু।”

“এই পথে এসো।” রোড ব্লক থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এলো ইসাউ। আর পঞ্চাশ গজ গেলেই পৌঁছে যাবে নোঙ্গর করে রাখা নৌকাগুলোর কাছে।

চট করে একবার পিছনে তাকিয়ে রাস্তার মোড়ে পৌঁছে যাওয়া গাড়ি বহরের দিকে তাকাল শন। হেডলাইটের আলো দেখা গেলেও নদীর কিনার শ’দেরকে আড়াল করে রেখেছে। প্রতিটি ট্রাকের পেছনে গাদাগাদি করে থাকা সশস্ত্র লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পেল শন।

সবচেয়ে কাছের বোটে বেলা’কে তুরে দিল শন। পায়ের চারপাশে ঝুলতে থাকা ভেজা জার্সিতে পা বেঁধে উল্টে পড়ে গেল বেলা।

বিরক্তিতে ঘোৎ ঘোৎ করে ওর পাশেই নিকিকে নামিয়ে দিল শন। কিন্তু বড় একটা ভুল করে ফেলল।

রাবার বলের মতো গোল হয়ে শ’নের হাতের নিচ দিয়ে তীরে নেমেই দৌড় দিল নিকি।

“ইউ লিটল ডেভিল” ঘুরে দাঁড়িয়েই ওর পিছু নিল শন্।

“মাই বেবি” কাঁদতে কাঁদতে নৌকা থেকে লাফিয়ে নামল বেলা কাদার ভেতর পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়িয়ে দু’জনের পিছনে দৌড় দিল সেও।

“ফিরে এসো নিকি-ওহ্ প্লিজ ফিরে এসো।”

বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা কনভয়ের দিকে এগোচ্ছে নিকি। খরগোশের মতই আঁকাবাকা হয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে শন’কে। রাস্তা থেকে মাত্র বিশ ফুট দূরে থাকতেই শূন্যে ডাইভ দিয়ে নিকি’র পা ফেলল শন। সেকেন্ডখানেক পরেই ওদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল বেলা।

হেডলাইটের আলো সোজা এসে ওদের উপর পড়লেও ছোট একটা কাটাঝোঁপের আড়ালে শুয়ে থাকায় তিনজনকে দেখতে পেল না প্রথম ট্রাকের সৈন্যরা। আবারো চিৎকার করে বেরিয়ে যেতে চাইল নিকি; কিন্তু এক হাত দিয়ে মুখ চেপে বজ্রমুষ্টিতে ওকে আটকে রাখল শন।

ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল ট্রাক। কিন্তু তাল গাছের গুঁড়ি দেখে বাধ্য হলো রাস্তার মাঝে থেমে যেতে। অন্ধকারে শন বোন আর বোনপো’কে নিয়ে যেখানে লুকিয়ে আছে তা থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে গেরিলা ভর্তি ট্রাক।

নিকি’কে ধরে রেখেই ইসাবেলা’র মুখখানা মাটিতে চেপে ধরল শন। অন্ধকারে এতক্ষণ আয়নার মতই চকচক করছিল ইসাবেলা’র ফর্সা চেহারা।

ট্রাকের ক্যাব থেকে একজন লাফিয়ে নেমে রোড ব্লক দেখে এলো; তারপর চিৎকার করে কোন একটা আদেশ ও দিল। সাথে সাথে কমব্যাট ক্যামোফ্লেজ পরিহিত ডজন খানেক গেরিলা ট্রাক থেকে নেমে গাছের গুঁড়ি ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।

একটু পরেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যেতেই আদেশ দাতা’র চেহারার উপর পড়া হেড লাইটের আলোতে লোকটাকে দেখে চিনে ফেলল বেলা। এই চেহারা একবার দেখলে কখনো ভুলে যাবার মতো নয়। এই লোকটাকেই সৎ ভাই বেন আফ্রিকার সাথে ভ্যানে বসে থাকতে দেখেছিল বেলা। বেন আর এই লোকটা মিলেই মাইকেল কোর্টনির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। আর আরেকটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে এতটা সুদর্শন আর কোনো কৃষাঙ্গ তরুণ দেখেনি বেলা। লম্বা-চওড়া রাজকীয় চেহারার অধিকারী যুবক ঠিক একটা শকুনের মতই হিংস্র।

মাথা ঘুরিয়ে এদিকেই তাকাল কৃষাঙ্গ তরুণ আর মনে হল ঠিক বেলার চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। আর তারপরই আবার ঘুরে নিজের লোকদের দিকে ফিরে গেল। রাস্তা পরিষ্কার হবার সাথে সাথে ট্রাকে উঠে চলে গেল সকলে।

এরপর বাকি ট্রাকগুলোও একের পর এক চলে গেল বেলা’র সামনে দিয়ে। শেষ জোড়া হেডলাইটের আলো দূরে চলে যেতেই নিকি’কে হাতের নিচে ধরে বেলা’কে তুলে দাঁড় করাল শন। তারপর নিয়ে এলো নদী তীরে।

নৌকাতে উঠেও নিকি’র ঘাড় ছাড়ল না শন। জ্বলন্ত কুড়ে ঘরগুলোর শিখা’র ছায়া পৌঁছে গেছে মেঘের পেট অব্দি। আউটবোর্ড মোটরের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে চিৎকার আর অটোমেটিক গান ফায়ারের আওয়াজ।

“ওরা কা”কে গুলি করছে?” ভাইয়ের উষ্ণ বুকে আশ্রয় নিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইল বেলা।

“হয়তো ছায়ার দিকে-কিংবা একে অন্যের গায়ে নরম স্বরে হাসল শন।

অনুকূল স্রোত পাওয়াতে দ্রুত হৃদের মুখে পৌঁছে গেল নৌকা বহর। নিজের নাইটস্কোপ লাগিয়ে তীর থেকে ছুটে আসা অপর বহর টাকে দেখতে পেল ইসাউ গনডেল। শৈলশিরার কাছে এসে পাশাপাশি হয়ে গেল দুই দল। তারপর সারি বেঁধে চলল খোলা সমুদ্রে।

মাত্র আধা মাইল দূরেই চকচক করে জ্বলছে হলুদ রঙা ল্যান্সার।

সর্বশেষে বোটের আরোহীরা উপরে উঠে আসার সাথে সাথেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। খোলা আটলান্টিকের দিকে ছুটল ল্যান্সার।

ইসাউ গনডেলের দিকে তাকাল শন, “এবারে লাভ-লোকসানের হিসাব দাও সার্জেন্টমেজর গনডেল।

“আমরা একজনকে হারিয়েছি মেজর কোর্টনি” স্বাভাবিকভাবেই রিপোর্ট দিল গনডেল, “জেরেমিয় মাসোগা। আমাদের সাথে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।” স্কাউটেরা কখনো মত সঙ্গীকে ফেলে আসে না।

সেই চির পরিচিত শূন্য হয়ে যাবার, অনুভূতিটা বোধ করল শন; আরেকটা ভালো মানুষ চলে গেল। জেরেমিয়ের বয়স ছিল মাত্র উনিশ। ওকে সেকেন্ড স্ট্রাইপ দেয়ার ব্যাপারে এরই মাঝে মনস্থির করে ফেলেছিল শন। কিন্তু সে সুযোগ আর পাওয়া গেল না। কেন যে কদিন আগেই করল না কাজটা। মৃতদের কাছে তো ক্ষমা চাইবারও কোনো সুযোগ নেই। “তিনজন আহত; তবে এতটা ব্যথা পায়নি যে আজ রাতের পার্টি মিস করবে।”

“রেফ্রিজারেটেড হোন্ডে জেরেমিয়’কে রেখে দাও।” আদেশ দিল শন। “কেপ টাউনে পৌঁছাবার সাথে সাথেই ওকে ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় জেরেমিয়কে সমাহিত করা হবে।”

টেবিল বে থেকে দুইশ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকতেই শন, ইসাবেলা আর নিকি’কে তুলে নেবার জন্য কোর্টনি হেলিকপ্টার পাঠালেন সেনটেইন কোর্টনি। গ্রেট-গ্র্যান্ডসনকে দেখার জন্য বুড়ি’র কিছুতেই তর সইছে না।

***

৯. স্রোতের টান

স্রোতের টান থেকে বাঁচার জন্য একটা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরল রামোন। ধারালো শামুকের খোসায় কেটে গেল হাত। কিন্তু একটুও ব্যথা টের পেল না রামোন মাচাদো। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে নদীর দিকে।

জ্বলন্ত কম্পাউন্ডের ছায়া পড়েছে পানিতে; সোনার মত চকচক করছে নিকষ কালো নদী।

মাত্র পঞ্চাশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল শনে’র নৌকা বহর। চিবুক পর্যন্ত কাঁদায় ডুবিয়ে গাছ আঁকড়ে বসে রইল রামোন। রাতের বীরবতার মাঝে নরম গুণগুণ এক ধরনের আওয়াজ করছে মোটর। অন্ধকারে কারো চেহারাই আলাদাভাবে বোঝা না গেলেও কল্পনার চোখে ধূসর রঙা টি-শার্ট পরা ছোট্ট একটা দেহ দেখতে পেল সামনের নৌকায়।

আর তখনই অনুভব করল যে ও নিজেও আসলে একজন বাবা। জীবনে প্রথমবারের মতো স্বীকার করতে বাধ্য হলো এই ভালোবাসার অস্তিত্ব। নিজের ছেলেকে হারিয়ে গুঙ্গিয়ে উঠল রামোন।

ভেতরে দানা বেঁধে উঠা ক্রোধের কাছে হেরে গেল বাকি সব অনুভূতি। এর জন্য দায়ী সকলের উপর প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল। সামনের শূন্য আঁধারের দিকে তাকিয়ে সর্বাঙ্গে যেন আগুন ধরে উঠল। ইচ্ছে করে চিৎকার করে অভিশাপ দেয়, মেয়েটাকে চুলের মুঠি ধরে নামিয়ে আনে, কিন্তু কিছুই করল না। এভাবে কখনো করে’ও না। এখন তাকে হতে হবে লোহার মতই শীতল আর তীক্ষ্ণ। প্রতিশোধ নেবার জন্য পরিষ্কারভাবে ভাবতে হবে সবকিছু।

প্রথমেই মনে হলো যে লাল গোলাপের উপর আধিপত্য হারিয়ে গেল। তার মানে রামোনের কাছে মেয়েটার এখন আর কোনো মূল্য নেই। এখন ও’কে তাই উৎসর্গ করার সময় এসেছে। রামোন ভালো করেই জানে কিভাবে তাকে আর তার চারপাশকে ধ্বংস করতে হবে।

ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ ছেড়ে দিয়ে পানিতে ভেসে পড়ল রামোন। নদীর মোড়ে এসে ব্রেস্ট-স্ট্রোক দিয়ে ফিরে এলো তীরে।

পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কমুনিকেশনস সেন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে রামোনের জন্য অপেক্ষা করছে রালেই তাবাকা। দ্রুত হাতে ট্রাউজার আর জ্যাকেট শরীরে জড়িয়ে নিল রামোন। ভেজা চুলে এখনো লেগে আছে নদীর কাদা।

অঙ্গার হয়ে যাওয়া দালানের ধোঁয়ার মাঝেই দেখা গেল প্রভাতের প্রথম সূর্য রশ্মি। রালেই তাবাকা’র লোকেরা মৃতদেহগুলো জড়ো করে তাল গাছের নিচে এক সারিতে রেখে দিয়েছে। যেভাবে মৃত্যু হয়েছে সে ভঙ্গিতেই পড়ে আছে মৃতেরা। প্যারাট্রুপার জোসে, মুখের উপর এক হাত এমনভাবে ফেলে, রেখেছে যেন চোখ দুটোকে বাঁচাতে চাইছে। গ্রেনেডের শার্পনেল টুকে মোরব্বা হয়ে গেছে ওর বুক। আদ্রা হাত দুটোকে এমনভাবে ছড়িয়ে রেখেছে। যেন ওকে ক্রুশে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার মাথার এক পাশ নেই হয়ে গেছে। আবেগহীন চোখে তাকিয়ে দেখল রামোন; যেন পুরোন কোনো কাপড়ের ছেঁড়া অংশ যার এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই।

“কতজন?” রালেই তাবাকা’কে প্রশ্ন করল রামোন।

“ছাব্বিশ জন। উত্তরে জানালেন রালেই। “সবাই মারা গেছে। কেউ বেঁচে নেই। যেই এসে থাকুক না কেন, পরিষ্কার একটা কাজ করে গেছে। জানেন ওরা কারা?”

“হ্যা” মাথা নাড়ল রামোন। “ভালো করেই জানি।” রালেই তাবাকা আর কিছু বলার আগেই জানাল : “এখন থেকে সিনডেক্স প্রজেক্টের সব দায়িত্ব আমার।”

“কমরেড জেনারেল”-গ্রুকুটি করে উঠলেন রালেই, “প্রথম থেকেই তো এটা আমার অপারেশন। দুই ভাইকে এতদিন আমিই সামলে এসেছি।”

“হ্যা” অধৈর্য হয়ে মাথা নাড়ল রামোন, “ভাল কাজ দেখিয়েছেন। এর সমস্ত কৃতিত্বই আপনার। কিন্তু এখন থেকে এ দায়িত্ব থেকে আপনাকে অব্যাহতি দেয়া হলো। এয়ারক্রাফট পাওয়া গেলেই আমি দক্ষিণে উড়াল দিব আর আপনিও আমার সাথে যাবেন।”

***

“এখানেই এর শেষ নয় বেলা” চিন্তিত ভঙ্গিতে জানালেন শাসা, “এমন ভাব করে লাভ নেই যে আর কিছু কখনো ঘটেনি। যাই হোক, এখন যেহেতু নিকোলাস ওয়েল্টেভ্রেদেনের নিরাপত্তায় চলে এসেছে তখন এ ব্যাপারে আরো কথা বলা প্রয়োজন। তোমার আর নিকোলাসের জন্য পারিবারের সকলেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে শ’নের রেজিমেন্টের একজন ট্রুপার অপরিচিত টগবগে সেই তরুণ তোমাকে বাঁচাবেই প্রাণ দিয়েছে। এখন তাই আমাদেরকে সত্যি কথাটা খুলে বলো।”

আরো একবার গান রুমে এসে জড়ো হলো পুরো কোর্টনি পরিবার।

ফায়ারপ্লেসের একপাশে চেয়ারে বসে আছেন দাদি। একেবারে সিধে হয়ে বসে আছেন বৃদ্ধা। পাতলা দেহত্বক ভেদ করে দেখা যাচ্ছে হাতের নীল শিরা। একদা ঘন চুলের গোছা এখন রুপালি রঙ ধারণ করেছে; কিন্তু অভিব্যক্তি এতটুকু নরম হয়নি।

“আমরা সবকিছু শুনতে চাই ইসাবেলা। বিস্তারিতভাবে সবকিছু না বলা পর্যন্ত তুমি এ রুম থেকে বাইরে যেতে পারবে না।”

“নানা, আমি অনেক লজ্জিত; কিন্তু কিছু করার ছিল না।”

“আমি তো কোন অজু হাত কিংবা অনুশোচনা শুনতে চাইনি, মিসি। আমি শুধু সত্যটা জানতে চাই।”

“বুঝতে চেষ্টা করো বেলা, আমরা জানি যে তুমি দেশের স্বার্থ, পরিবার কিংবা নিজের ব্যাপারেও কোনো কিছুই চিন্তা করো নি। কিন্তু এবারে এই ক্ষতির ভরপাই করা আমাদের দায়িত্ব।” মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শাসা। এবারে খানিকটা নরম করলেন গলার স্বর, “আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই বেলা; কিন্তু সেটা করতে হলে সত্যটা অবশ্যই জানতে হবে।”

ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাল বেলা, “আমি, তুমি আর নানা একাকী কথা বলতে পারি না?” ভাইদের দিকে তাকাল, বেলা। জানালার নিচে আর্মচেয়ারে বসে আছে গ্যারি। আগুন না ধরিয়েই মুখের একপাশ থেকে আরেক পাশে নাড়াচাড়া করছে সিগার। জানালার নিচে বসে গ্যারি’র সামনে পা ছড়িয়ে দিয়েছে শন্। বুকের উপর আড়াআড়ি করে রেখেছে রোদে পোড়া পেশি বহুল দুই হাত।

“না”, দৃঢ় স্বরে জানালেন সেনটেইন। “তোমার আর নিকি’র জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখেছে ওরা। যদি তুমি নিজের আর পরিবারের জন্য আরো কোনো ক্ষতির ব্যবস্থা করে রাখো তাহলেও ওরাই এগিয়ে যাবে তোমাকে বাঁচাতে। তাই এত সহজে তোমাকে ছাড়া যাবে না। ওদেরও সবকিছু শোনার অধিকার আছে। কিছুই বাদ দেবে না-বুঝেছ?”

আস্তে আস্তে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিল বেলা, “ওরা আমার কোড নেইম দিয়েছিল লাল গোপাল। “

“ঠিক করে কথা বলো, আমতা আমতা করবে না” বেলা’র পায়ের কাছে নিজের লাঠি ঠুকলেন সেনটেইন, সন্ত্রস্ত্র ইসাবেলা চোখ তুলে তাকিয়েই গড়গড় করে বলে দিল, “ওরা আমাকে যা যা বলেছে আমি করেছি” তাকিয়ে আছে দাদিমার মুখের দিকে, “নিকি তখনো একেবারে ছোট, মাত্র এক মাস বয়স; ওরা একটা ফিল্ম বানিয়ে আমাকে দেখিয়েছে। আরেকটু হলে আমার বেবি ডুবিয়েই মেরে ফেলেছিল। পা ধরে ওকে চুবিয়ে…থেমে গেল বেলা। তারপর গভীরভাবে দম নিয়ে আবার শুরু করল, “আমাকে সতর্ক করে দিয়েছে যে পরের ফিল্মে নিকির একেকটা অংশ কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে-ওর আঙুল, পা, হাত আর তারপর…” বহুকষ্টে উচ্চারণ করল বেলা, তারপর ওর মাথা।”

বিমূঢ় হয়ে শুনছে সবাই। অতঃপর নীরবতা ভাঙ্গলেন সেনটেইন, “বলে যাও।”

“আমাকে ড্যাডির সাথে কাজ করার কথা বলেছে। যেন আর্মসকোরের কাজে পুরোপুরি যোগ দেই।” শাসা চোখ কুঁচকে তাকাতেই নিজের আঙুল মোচড়াতে লাগল বেলা, “অ্যায়াম সরি, ড্যাডি। আমাকে আরো বলেছে পারিবারিক কানেকশন কাজে লাগিয়ে যেন রাজনীতিতে ঢুকে পড়ি, সংসদের আসনের জন্য লড়াই করি।”

“হঠাৎ করেই রাজনীতিতে তোমার আগ্রহ দেখে আমার আসলে সন্দেহ করা উচিত ছিল।” উত্তপ্ত কণ্ঠে মন্তব্য করলেন সেনটেইন।

“আই অ্যাম সরি, নানা।”

“বারে বারে সরি বলো না তো।” খেঁকিয়ে উঠলেন শাসা, “এতে এখন আর কিছু যাবে আসবে না। বরঞ্চ শুনতেই বিরক্ত লাগছে। শুধু যা বলার বলে যাও।”

“কিছুদিনের জন্য আমার কাজ থেকে ওরা আর কিছুই চায়নি। প্রায় দুই বছর। এরপরই একের পর এক আদেশ আসতে লাগল। প্রথমটা ছিল সিমেন্স রাডার চেইন।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন শাসা। হাত বাড়িয়ে ব্লেজারের বুক পকেট থেকে রুমাল তুলে নিলেন।

“এরপর আরো বেশি বেশি অর্ডার দিতে লাগল।”

“দ্যা স্কাইলাইট প্রজেক্ট?” জানতে চাইলেন শাসা। বেলা মাথা নাড়তেই মায়ের দিকে তাকালেন শাসা।

“তুমি ঠিকই ধরেছিলে, মা?” আবারো মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি এক কাজ করো, সবকিছু লিখে ফেলো। যা যা ওদেরকে দিয়েছ, সব। আমি একটা লিস্ট চাই-তারিখ, কাগজপত্র, মিটিং সবকিছু। আমাদের কী কী গেল তার সবকিছু জানা প্রয়োজন।”

“ড্যাডি… ইসাবেলা বলা শুরু করলেও কেন যেন খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না।

“চুপ করে আছে কেন? বলো” সাপের মতো ফণা তুললেন সেনটেইন।

“সিনডেক্স-২৫” উচ্চারণ করল বেলা।

“ওহ্ গড!” মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন শাসা।

“এই কারণেই নিকি’র কাছে যেতে পেরেছি এবার-সিনডেক্সের বিস্তারিত বিবরণ আর বেন।”

“বেন?” নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসল গ্যারি। “বেন কে?”

“বেন গামা” কর্কশ স্বরে জানালেন সেনটেইন, “তারা’র লিটল ব্ল্যাক বাস্টার্ড, মোজেস গামা’র ছেলে। যে লোকটা আমার ব্লেইনকে মেরে ফেলেছে, এই পরিবারকে কলঙ্কিত করেছে।” ইসাবেলার দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“হ্যাঁ, নানা। আমার সৎ ভাই বেন।” ভাইদের দিকে তাকাল বেলা, “তোমাদেরও সৎ ভাই। শুধু পার্থক্য হলো এখন আর নিজেকে বেন গামা বলে না; ওর নাম এখন বেনজামিন আফ্রিকা।”

“এই নাম জেনে আমি কী করব?” জিজ্ঞেস করল গ্যারি। “কারণ ও তোমার জন্যই কাজ করে।” জানাল বেলা। “ওরা আমাকে দিয়ে বেনের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছে। লন্ডনে থাকার সময়েই ওকে আমি ক্যাপরিকর্ণে নিয়োগ দিয়েছি। পয়জনস ডিভিশনে ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানের কাজ করছে।”

“সিনডেক্স প্ল্যান্টে?” বিশ্বাস করতে পারছেন না শাসা। “তুমিই তাকে এখানে ঢুকিয়েছো?

“হ্যাঁ, বাবা।” আবারো ক্ষমা চাইতে গিয়ে দাদিমার মুখের দিকে তাকাল বেলা।

লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই জেস্কর দিকে দৌড় দিল গ্যারি। টেলিফোন তুলে নিয়ে কথা বলল ওয়েল্টেভ্রেদেনের একচেঞ্জের সঙ্গে।

“ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেলসে ফোন করতে চাই-নাম্বার আছে তো, তাই না? এক্ষুণি আমি ম্যানেজিং ডিরেকটরের সাথে কথা বলতে চাই-খুব দরকার, আর্জেন্ট। লাইনে পাবার সাথে সাথে আমাকে ফোন করবে।”

টেলিফোন আবার আগের জায়গায় রেখে দিল গ্যারি। “বেন’কে এখনি ধরতে হবে। তারপর জিঙ্গাসাবাদ করতে হবে। যদি ওরা তাকে প্ল্যান্টে ঢুকিয়ে থাকে নিশ্চয় এর পেছনে কোনো জঘন্য কারণ থাকবে।”

“ও তাদেরই একজন।” ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। কেউই এর আগে কখনো বৃদ্ধার কণ্ঠস্বরে এতটা তিক্ততা কিংবা চেহারাতে এতটা ঘৃণা দেখেনি। আতঙ্ক নিয়ে সবাই সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে রইল। “ও’ ও সেসব ধ্বংসকারী বিপ্লবীদের একজন। ওই কালো শয়তানটা ওর বাবা আর এত বছর ধরে তারা ওর মানসিক জগৎ দখল করে থাকাতে ও ওদের না হয়ে আর পারেই না। এটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছে যে বদমাশগুলোর ভয়ংকর কোন বদমতলব থাকলেও আমরা তা নসাৎ করে দেব।”

ব্যাপারগুলো কল্পনা করে শিউরে উঠল উপস্থিত সকলে। বুঝতে পারলো কতটা নিষ্ঠুর এরা।

টেলিফোনের শব্দে সবার ঘোর কাটতেই ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিল গ্যারি। “আমি ক্যাপরিকর্ণের ম্যানেজিং জিরেকটর’কে লাইনে পেয়েছি।”

“গুড। হ্যালো পল। থ্যাঙ্ক গড় যে তোমাকে পেয়েছি। হোল্ড অন ওয়ান সেকেন্ড” বলেই টেলিফোনের কনফারেন্স কী চেপে ধরল গ্যারি। ফলে রুমের সবাই শুনতে পেল পুরো আলাপচারিতা।

“শোন পল, পয়জনস্ ডিভিশনে তোমার একজন কর্মচারী আছে, নতুন কীটনাশক প্ল্যান্টে, বেনজামিন আফ্রিকা।”

“ইয়েস, মিঃ কোর্টনি, আমি ওকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও নামটা পরিচিত। হোল্ড অন, ওর উপরে কম্পিউটার প্রিন্ট নিয়ে আসি। ইয়েস, পেয়েছি, বেনজামিন আফ্রিকা। এপ্রিলে জয়েন করেছে।”

“ও’কে পল। কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ডস দিয়ে ওকে এখনি অ্যারেস্ট করাও। তবে খেয়াল রাখবে যেন কোথাও যোগাযোগ করতে না পারে। বুঝতে পেরেছ? কোনো ফোন কল, ল, ইয়ার, প্রেস কিছু না।”

“সত্যি এটা করব মি: কোর্টনি?”

“আমি যা করতে চাই তাই আমি পারব, পল। এটা মাথায় রাখবে সবসময়। এখন ওকে অ্যারেস্ট করার অর্ডার দাও। আমি লাইনে অপেক্ষা করছি।”

“দুই সেকেন্ড লাগবে মাত্র।” সম্মত হলেন ম্যানেজিং ডিরেকটর। ফোনের এ পাশ থেকে গ্যারি শুনল ইন্টারন্যাল সার্কিটে সিকিউরিটির সাথে কথা বলছেন ভদ্রলোক। “অল রাইট মিঃ কোর্টনি, ওরা আফ্রিকাকে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে।”

“এখন শোন, পল, সিনডেক্সম্যানুফ্যাকচারির প্রোগ্রামের বর্তমান অবস্থা কী? সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানো শুরু করেছ?”

“এখনো না, মি: কোর্টনি। আমাদের প্রথম শিপমেন্ট যাবে পরবর্তী মঙ্গলবার। সেনাবাহিনী নিজেদের ট্রাক পাঠাবে।”

“ওকে পল। এ মুহূর্তে তোমার হাতে কতটুকু স্টক আছে?”

“আচ্ছা, কম্পিউটার চেক করে দেখছি। এই মুহূর্তে পাঁচ কিলো আর্টিলারী ক্যানিস্টারের মাঝে ৬৩৫টা ফর্মুলা এ আর বি আছে। এছাড়া পঞ্চাশ কিলো এরিয়াল সিলিন্ডারের মাঝে উভয় ফর্মুলাই আছে ছাব্বিশটা করে। আগামী সপ্তাহ শেষে এয়ার ফোর্সের কাছে”।

পলকে থামিয়ে দিল গ্যারি। “পল, আমি প্রতিটি ক্যানিস্টার আর সিলিন্ডারের হিসাব চাই। তোমার কয়েকজন সিনিয়র কর্মীকে এখনি স্টোরেজ এরিয়াতে পাঠিয়ে দাও যেন প্ল্যান্ট ম্যানিফেস্টের সাথে মিলিয়ে দেখে প্রতিটা সিরিয়াল নাম্বার আর এক ঘণ্টার মধ্যেই এ কাজ শেষ হওয়া চাই।”

“কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে মিঃ কোর্টনি?”

“তুমি তোমার স্টকের হিসাব জানালেই তোমাকে জানাব আমি। এই নাম্বারেই অপেক্ষা করছি। যত দ্রুত সম্ভব আমাক জানাও-অথবা পারলে তার চেয়েও দ্রুত।”

গ্যারি ফোন রাখার সাথে সাথেই জানতে চাইল শন্ : “তুমি আমাদেরকে কত দ্রুত ক্যাপরিকর্ণে পৌঁছে দিতে পারবে?”

“লিয়ার এখন পুরোপুরি অকেজো। মিসাইল স্ট্রাইকের পরে ডিসি এ পুরো এয়ারফ্রেম পাল্টে আকাশে উড়ার উপযোগী হবার সার্টিফিকেট চাইছে।

“কত দ্রুত, গ্যারি?” চাপ দিল শন; চিন্তায় পড়ে গেল গ্যারি, “কুইন এয়ার বেশ ধীর গতির হলেও জোহানেসবার্গের শিডিউল ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে তাড়াতাড়ি হবে। অন্তত সোজা ক্যাপরিকর্ণের এয়ারস্ট্রিপে নামা যাবে। যদি ঘণ্টাখানেক পরেই রওনা হতে পারি তাহলে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবো।”

“পুলিশকে জানাতে হবে না?” শাসার প্রশ্ন শুনে অধৈর্যভাবে নিজের লাঠি ঠুকলেন সেনটেইন। “নো পুলিশ। এখনি না আর যদি আমরাই সামাল দিতে পারি। তাহলে কখনোই না। তারা’র কালো বদমাশটাকে ধরে দরকার হলে সত্যিই ওর পেট থেকে বের করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে পুরো ব্যাপার।” টেলিফোনের শব্দে থেকে গেলেন বৃদ্ধা।

রিসিভার তুলে কয়েক সেকেন্ড ওপর প্রান্তের কথা শুনল গ্যারি। তারপর উত্তর দিল : “আই সি, থ্যাঙ্ক ইউ পল। আমি এখনি প্লেনে উঠছি। দুপুর একটার মাঝে ক্যাপরিকর্ণের এয়ারস্ট্রিপে থাকব।” ফোন রেখে উদ্বিগ্ন চেহারাগুলোর দিকে তাকাল গ্যারি। “ছোট্ট পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে। গত চারদিন ধরে বেনজামিন আফ্রিকা প্ল্যান্টে আসছে না। কেউ জানে না কী হয়েছে। কিংবা কোথায় আছে জানতে চাইলেন শাসা।

“ওরা এখনো চেক করছে। আমরা ক্যাপরিকর্ণে ল্যান্ড করার মধ্যে পেয়ে যাবে।” জানাল গ্যারি। “বাবা আর নানা এখন তোমরা ওয়েল্টেভ্রেদেনেই থাকো। যদি কিছু জানাতে চাও তো জ্যান সুটস্ এয়ারপোর্ট কন্ট্রোলে টেলিফোন করলে ওরা আমার কাছে রিলে করে দিবে।” ভাইয়ের দিকে তাকাল গ্যারি। “শন আমার সাথে আসুক। মনে হচ্ছে বাহুবলের দরকার পড়তে পারে।”

বাবার সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল শন। “গান সেফের চাবি দাও, বাবা?”

শাসা চাবি দিতেই তালা খুলে ফেলল শন। হাট করে খুলে গেল ভারী স্টিলের দরজা।

সেফের ভেতরে ঢুকে রিভলবার আর পিস্তলের তাকগুলোকে খানিক পরীক্ষা করে তুলে নিল পয়েন্ট ৩৫৭ ম্যাগনাম স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলবার। এক প্যাকেট গুলিও নিয়ে জিন্সের বেল্টে গুঁজে নিল রিভলবার।

“আমারও একটা নেয়া উচিত” সেফে ঢুকে পড়ল গ্যারি।

“গ্যারি” পেছন থেকে বলে উঠল বেলা, “আমিও যাবো তোমাদের সাথে।”

“ভুলে যাও, যা বলেছ।” হেকলার অ্যান্ড কোর্চ ৯ মিলিমিটার বেছে নিতে ব্যস্ত গ্যারি মুখ ফিরিয়ে বোনের দিকে তাকালো না পর্যন্ত। “ঐ ব্যাপারে তোমার আর করার কিছু নেই।”

“হ্যাঁ আছে। তুমি জানোনা বেন দেখতে কেমন। আমি ওকে দেখলেই চিনে ফেলব-আর আরেকটা কথা বাকি আছে, যা আমি এখনো তোমাদেরকে বলিনি।

“তো এখন বলো”।

“আমাকে সাথে নিলে যেতে যেতে বলব।”

***

টুইন ইঞ্জিন বীচ ক্রাফট কুইন এয়ারের হেডিং উত্তরদিকে ঠিক করে নিল গ্যারি। এরপর নিজের সিটে বসেই তাকাল মেইন প্যাসেঞ্জার কেবিনে বসে থাকা বেলা’র দিকে।

সিট বেল্ট খুলে ককপিটে উঠে এলো বেলা। গ্যারির সিটের উপর ঝুঁকে তাকাতেই শুনতে পেল ভাই বলছে,

“ওকে বেলা। এবারে তাহলে ঝটপট বলে ফেলো আর কী বলতে চাও।”

কো-পাইলটের সিটে বসে থাকা শনের দিকে তাকাল বেলা। “সে রাতের কথা মনে আছে যখন চিকাম্বা নদী তীরে নিকি হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইল আর তুমি আর আমি মিলে তাকে ধরে ফেললাম?”

শন মাথা নাড়তেই বেলা বলে চলল, ফাস্ট ট্রাকের গেরিলা অফিসারটার কথা মনে আছে যে রোড ব্লক সুপারভাইজ করছিল? যাই হোক, আমি লোকটাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি যে আগেও তাকে দেখেছি। আমি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত হলেও এখনকার মতো গুরুত্ব দিয়ে আর ভাবিনি।”

“কবে আর কোথায় দেখেছিলে?”

“বেনের সাথে ছিল-কিন্তু যাচ্ছিল ফারগ্রোভে মাইকেলে’র ফার্মে।”

“মাইকেল?” বেলা’কে থামিয়ে দিল গ্যারি, “আমাদের মাইকেল?”

“হ্যা” ঘোষণা করল বেলা, “মাইকেল কোর্টনি।”

“তোমার ধারণা এসবের মাঝে মাইকেলও জড়িত আছে?”

“হ্যাঁ, তাই যদি না হয় তো এএনসি টেরোরিস্ট কমান্ডার আর বেনের সাথে কী করছিল সে?”

খানিকক্ষণের জন্য চুপ করে গেল সকলে। আর তারপর বেলা আবারো শুরু করল : “গ্যারি তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে বেন সিনডেক্সের একটা কী দুটো সিলিন্ডার চুরি করেছে? যদি সে টেরোরিস্টদের সাথে মিলেও যায় তাহলে এটা কিভাবে ব্যবহার করবে? নিশ্চয়ই কোনো এয়ারক্রাফট থেকে স্প্রে করবে?”

“হ্যাঁ, এটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।”

“ফারগ্রোভে মাইকেলের প্লেন আছে।”

“ওহ শিট” ফিসফিস করে উঠল গ্যারি, “প্লিজ, এমনটা যেন না হয়। মিকি নয়–অন্তত মিকি নয়।”

“মাইকেল গত কয়েক বছর ধরেই এসব ছাইপাশ পাবলিস করছে আর এ কারণে নিশ্চয় এ ভূতগুলোর সাথেও হাত মেলাতে হয়েছে।” কঠোর হয়ে উঠল শনের চেহারা।

বাকিরা কেউই কোনো উত্তর দিল না। বদলে গ্যারি বলে উঠল, ‘বেলা, আমাদের প্রত্যেকের জন্য কোক নিয়ে এসো, প্লিজ।”

বারের রেফ্রিজারেটরে গিয়ে দুটো ক্যান নিয়ে এলো বেলা। কোক শেষ করার পর ক্যান নামিয়ে শন্ মোলায়েম স্বরে জানাল, “আজ সকালে দেখছি র‍্যান্ড ইস্টার শো শুরু হলো।” ভাইয়ের দিকে তাকাল গ্যারি।

“এর সাথে ওটার কী সম্পর্ক?”।

“কিছুই না” গ্যারি’র দিকে তাকিয়ে হাসল শন। “এই শো’তে এক জায়গাতেই জড়ো হয় হাফ মিলিয়ন লোক। ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত পণ্য, কৃষক আর ব্যবসায়িদেরকে দেখানো হয়-গয়না বিক্রেতা, টেইলর এমনকি ইন্ডিয়াল চিফ পর্যন্ত থাকে। সন্ধ্যা আটটায় গ্র্যান্ড অপেনিং হবার কথা। সাথে থাকবে ফায়ারওয়ার্কস ডিসপ্লে, মিলিটারি ট্যাটু আর স্টক কার রেসিং। বক্তব্য দেবেন প্রাইম মিনিস্টার। সাথে থাকবে কালো স্যুট পরা সব হোমড়া-চোমড়া। হেল, এর মানে তো কিছু নয়, তাই না।”

“এরকম হেয়ালি করে কথা বলো না, শন।” ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে গ্যারি।

“তুমি ঠিকই বলেছ, গ্যারি” এখন হাসছে শন্। “মানে, এ এনসি বদমাশগুলোর মনোভাব আসলে খারাপ নয়। ওরা কয়েকটা কার বোমা ফাটালো কি মোটর কার জ্বালিয়ে দিল তার মানে তো এই যে ওরা সবাই খারাপ। কিন্তু ভেবে দেখো তো, একটা ভিড়ে ভিড়াক্কার সুপারমার্কেটে রাশান’রা লিস্পেট মাইন ছুড়লেও কখনো নিশ্চয় ব্যান্ডইস্টার শো’তে সিনডেক্স-২৫ স্প্রে করেনি। তাই না?”

“না” মাথা দোলালো গ্যারি। “মানে বেন আর মিকি তো আমাদেরই ভাই। ওরা নিশ্চয়-না…” কথা শেষ করতে পারল না গ্যারি। কিন্তু একটু পরেই রেগে উঠল, “ধুত্তোরি, লিয়ার থাকলে এতক্ষণে সেখানে পৌঁছে যেতাম।”

মাথার উপরে রেডিও খসখস করে উঠতেই হেডফোন অ্যাডজাস্ট করে নিল গ্যারি। “চার্লি সিয়েরা এক্স-রে, জান সুটস ইনফর্মেশন থেকে বলছি, ক্যাপরিকর্ণ থেকে তোমার জন্য রিলে আছে। কপি করার জন্য তৈরি আছো?”

“গো অ্যাহেড, ইনফর্মেশন।”

“মেসেজে লেখা আছে : ট্যালি অনুযায়ী মিলে গেছে সমস্ত স্টক আর সিরিয়াল নাম্বার। মেসেজ শেষ।”

“থ্যাঙ্ক গড?” জোরে শ্বাস ফেলল গ্যারি।

“তাদেরকে বলো সিলিন্ডারের ভেতরে কী আছে সেটাও যেন চেক করে দেখে নেয়। পরামর্শ শুনতেই বদলে গেল গ্যারির চেহারা।

“ইনফর্মেশন, প্লিজ ক্যাপরিকর্ণকে মেসেজ পাঠাও : সবকটি কন্টেইনারের স্যাম্পল চেক করো। মেসেজ শেষ।”

হেডফোন নামিয়ে ফেলল গ্যারি। “ওহ্, ঈশ্বর এটা যাতে কোনো মতেই সত্য না হয়। কিন্তু তোমার কথাই ঠিক শন্। ওরা বোকা নয়। কয়েকটা খালি সিলিন্ডারের গায়ে ফলস্ নাম্বার লিখে স্টক রুমে ফেলে রাখা ওদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।”

“আর কত দেরি আছে?” নেভিগেশন চেক করল গ্যারি। “আরো এক ঘণ্টা-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে হাওয়া পেছন দিক থেকে বইছে।”

ঘুরে বোনের দিকে তাকালো শন। “আমার একটা উপকার করো সুইট হার্ট। এর পরের বার কারো সাথে রোমাঞ্চ করতে চাইলে জ্যাক দ্য রিপার টাইপের কাউকে ধরো।”

দূর থেকেই চেনা যায় ক্যাপরিকর্ণের এয়ারস্ট্রিপ। সাদা কোয়াটজের উপর পড়ে আছে একটা ছাগল। পাঁচ মাইল দূর থেকেই দেখা যায় এ দানবাকৃতির স্ট্রিপ। মসৃণভাবে মাটি স্পর্শ করল গ্যারি। হ্যাংগারের দিকে যেতে যেতে দেখা গেল চারটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানেজিং ডিরেক্টর পলসহ ক্যাপরিকর্ণের একদল কর্মচারী।

কুইন এয়ার থেকে লাফ দিয়ে নামল শন্ আর গ্যারি। তারপর বেলা’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ছুটে এলো পল।

“মি: কোর্টনি, ইউ ওয়্যার রাইট। ছোট দুটো ক্যানিস্টারে কেবল কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ঢোকানো আছে। উধাও হয়ে গেছে দশ কিলো সিনডেক্স ২৫।

আতঙ্কিত হয়ে পলের দিকে তাকিয়ে রইল সকলে। দশ কিলো সিনডেক্স পুরো একটা সেনাবাহিনীকে মুছে দিতে পারবে।

“পুলিশে ফোন দেয়ার সময় হয়েছে। ওরা বেন আফ্রিকাকে ধরে ফেলুক। ওর কোন ঠিকানা আছে আমাদের কাছে?” জানতে চাইল শন্।

“আমি এরই মাঝে ওর বাসায় লোক পাঠিয়েছিলাম।” উত্তর দিলেন পল। “বেন নেই, বাড়িঅলা জানিয়েছেন গত কয়েকদিন ধরেই ওকে দেখছেন না। বাড়িতে বেন খেত’ওনা ঘুমাতোও না।”

নরম স্বরে “ফারগ্রোভ” বলে উঠল বেলা।

“রাইট” চড়া গলায় বলে উঠল গ্যারি। “শন তুমি এখনি ওখানে চলে যাও। বেলা’কেও সাথে নিয়ে যাও। বেন’কে দেখিয়ে দেবে; যদি পিছু নিতে হয়। আমি এদিককার কাজ সামলাচ্ছি। বোর্ডরুমেই থাকব। ফারগ্রোভে যাবার সাথে সাথে কল করবে। তোমাদের জন্য পুলিশ ব্যাক আপের ব্যবস্থা করছি। মিসিং ক্যানিস্টারগুলোকে পেতেই হবে।”

পলের দিকে তাকাল শন, “আমার খুব দ্রুত গতির একটা গাড়ি লাগবে।”

“আমারটা নিয়ে যান।” হ্যাঁভারের পাশেই পার্ক করে রাখা নতুন বি এম ডব্লিউ দেখালেন পল। “ট্যাঙ্ক ফুল আছে, এই যে চাবি।”

“কাম অন বেলা, লেটস গো।” বি এম ডব্লিউ’র দিকে দৌড় দিল ভাই বোন।

“ট্রাফিক পুলিশ দেখলেও থামবে না” সতর্ক করে দিল বেলা। বি এন ডব্লিউ ছোটাল শন। “কেপ টাউন ছাড়ার আগেই ফারগ্রোভের পুলিশকে পাঠিয়ে দেয়া উচিত ছিল। গড়, এরই মাঝে তিনটা বেজে গেছে।”

“কিন্তু কেউ সিনডেক্সের ট্যাঙ্ক নিয়েছে নিশ্চিত হবার আগে আমরা কিছু করতে পারব না।” বুঝিয়ে বলল শন।

ঝুঁকে পড়ে কার রেডিও অন করল শন্। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেলা।

“বেলা তিনটার খবর।” হাই ভেল্ডের রেডিও ছাড়ল।

“আজ সকাল থেকেই দলে দলে মানুষ ঢুকছে র‍্যান্ড ইস্টারের গেইট দিয়ে। আজই অপেনিং হবে। শো কমিটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, দুপুরের ভেতরে পৌঁছে যাবে দুই কোটি দর্শক।”

রেডিও’র সুইচ অফ করে বি এম ডব্লিউ’র ড্যাশবোর্ডে ঘুষি মারল শন।

“মাইকেল!” চিৎকার করে উঠল শন, “মরিয়া হলেই মানুষ কেবল দুঃসাহসী হয়ে উঠে। ঈশ্বর, শান্তি আর মানুষে মানুষে সম্প্রীতির নামে কত যে নিরপরাধ মানুষের জীবন গেছে?” আবারো মুঠি পাকিয়ে ড্যাশবোর্ডে ঘুষি মারল শন। ভাইয়ের বাহুতে হাত রাখল বেলা।

“স্লো ডাউন শন। সামনে গিয়ে ডানে মোড় নাও।” রাস্তার বাঁকে গিয়ে শন এত জোরে টার্ন নিল যে ডোর হ্যাঁন্ডেল ধরে নিজেকে সামলাল বেলা।

“আর কত দূর?”

“আর কয়েক মাইল মাত্র।”

কোটের প্রান্ত সরিয়ে বেল্ট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন খুলে নিল শন। বুড়ো আঙুল দিয়ে চেক করে খেল চেম্বার।

“তুমি এটা দিয়ে কী করবে?” নার্ভাস হয়ে গেল বেলা। “বেন আর মিকি

“বেন আর মিকি’র কয়েকজন চমৎকার দোস্ত আছে।” আবারো বেল্টের সাথে রিভলবার ঝালিয়ে নিল শন।

“এই তো এসে গেছি” নিজের সিটে এগিয়ে বসল বেলা। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই তো মিকি’র বাড়ির গেইট দেখা যাচ্ছে।”

বি এম ডব্লিউ’র গতি ধীর করে কাদামাটির রাস্তায় নেমে গেল শন। বিল্ডিং’এর সামনে এসে তারপর আবার আড়াআড়ি ঘুরিয়ে ফেলল বি এম ডব্লিউ’র নাক। “কেন এরকম করছ?” জানতে চাইল বেলা।

“আমি পায়ে হেঁটে যাবো। আমার আগমনবার্তা জানাবার কোনো মানে হয় না।” জানাল শন্।

“কিন্তু তুমি রাস্তার উপর পার্ক করছ কেন?”

“যাতে কেউ তাহাহুড়া করে পালাতে না পারে।” ইগনিশন থেকে চাবি বের করে লাফ দিল শন্।

“তুমি এখানেই থাকো। না, গাড়ির ভেতরে না। ওদিকের গাছগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকো। আর আমি না ডাকা পর্যন্ত মাথা বের করবে না, ঠিক আছে?”

“ইয়েস শন।”

“আর দরজা ঠাস করে আটকাবে না।” প্যাসেঞ্জার সিট থেকে পিছনে বের হয়ে গেল বেলা। “এখন বলল, মিকি ওর প্লেন কোথায় রাখে?”

“ফুল বাগানের শেষ মাথায়, বাড়ির পেছনে।” বুঝিয়ে দিল বেলা, “এখান থেকে না দেখতে পেলেও ভেতরে গিয়ে মিস্ করার উপায় নেই। বেশ বড় করোগেটেড টিন শেড আর সবকিছুই ভাঙ্গা-চোড়া, জং ধরা।”

“ঠিক আমাদের মিকির মত।” দাঁত কিড়মিড় করে উঠল শন্। “আমি যা বলেছি মনে রাখবে কিন্তু। যাও, এখন সরে যাও।” দৌড় দিল শন।

রাস্তার থেকে নেমে ফল বাগান আর চিকেন শেডের ওপাশ দিয়ে দৌড়াতে লাগল শন। এপাশে মূল দালান। মাত্র কয়েকশ গজ গেলেই মেইন বারান্দা। দেয়ালের পিছনে হামাগুগি দিয়ে বসে খুব দ্রুত পুরো বিল্ডিং দেখে নিল শন্। সদর– দরজা আর সবকটি জানালা হাট করে খোলা; কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

দেয়ালের উপর চড়ে বসে সহজেই এপাশে নেমে এলো শন। তারপর সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সিটিং রুম আর কিচেন শূন্য হলেও সিঙ্কের উপর পড়ে আছে নোংরা বাসন কোসনের স্তূপ। তিনটা বেডরুমের প্রতিটা দেখেই বোঝা গেল যে বাসিন্দারা মাত্রই কোথায় গেছে বিছানা এলেমেলো। মেঝের উপর ছড়িয়ে আছে কাপড়। বাথরুম আর ড্রেসিং টেবিলের উপর মেনস টয়লেট আইটেমস। ‘

একটা শার্ট তুলে নিয়ে কলার দেখল শন্। ভেতরের দিকে লাল সুতা দিয়ে নাম সেলাই করা আছে : “বি. আফ্রিকা।”

শার্ট ফেলে দিয়ে নিঃশব্দে রান্নাঘরের দরজায় গেল শন পোকায় খাওয়া ফল বাগানের গাছগুলোর দিকের দরজাটা খোলা। এগুলোর পেছনেই দেখা গেল করোগোটেড শেড়অলা বিশাল শেড।

দৌড় দিয়ে ফল বাগানের ভেতর গিয়ে গাছগুলোর পেছনে লুকিয়ে পড়ল শন। তারপর এভাবেই চলে গেল শেড় অব্দি। পাতলা করোগেটেড গ্যালভানাইজড শিটের গায়ে কান পাততেই শোনা গেল কয়েকজন পুরুষের গলা। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। বেল্টের রিভলবার চেক করে নিল শন। দরকার পড়লেই যেন দ্রুত টেনে নিতে পারে হাতল। এরপর সহজ ভঙ্গিতে শেডে’র পিছনের দেয়াল ধরে এগিয়ে গেল ছোট্ট সবুজ দরজাটার দিকে। কিন্তু শন পৌঁছবার আগেই খুলে গেল দরজা। ঝকমকে রোদে বেরিয়ে এলো দু’জন পুরুষ।

***

নিজের কর্মদক্ষতা নিয়ে বেশ গর্ব বোধ করে বেন আফ্রিকা। সেসনা সেঞ্চুরিয়ন এয়ারক্রাফটের পাইলটের সিটে হাটু গেড়ে বসে ডান দিকের প্যাসেঞ্জার সিটের সামনের ডেকে বেধে ফেলল জোড়া সিলিন্ডার।

বোল্ট-হোলগুলো খুব সাবধানে ড্রিল করল যেন কন্ট্রোল কেবলস্ এর কোনো ক্ষতি না হয়। চাইলে সিরিল্ডারগুলোকে কেবিনের ফ্লোরে এমনিতেই শুইয়ে রাখতে পারত; কিন্তু তার ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা এ কাজ করতে দেয়নি। ফ্লাইটের সময় জোর বাতাসের ধাক্কা খেলেই ভালব অথবা টিউবের ক্ষতি হবে। স্টিলের বোতলগুলোকে এমনভাবে বসালো যেন পাইলট কিংবা তার প্যাসেঞ্জার যে কেউ চাইলেই ভালব-হ্যান্ডেল ধরতে পারবে।

যে বোতলটাতে এলিমেন্ট এ আছে সেটার গায়ে, মাঝখানে তিনটা লাল রিংঅলা সাদা-কালো চেক প্যাটার্নের রঙ করা হয়েছে। আর এলিমেন্ট বি হল শুধু একটা কালো রিংঅলা লাল টকটকে সিলিন্ডার। প্রতিটি বোতলের গায়েই লেখা আছে নির্দিষ্ট সিরিয়াল নাম্বার।

মেডিকেলের দুটো সাধারণ অক্সিজেনের বোতলকে এমনভাবে কাজে লাগানোর বুদ্ধিও বে’নের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। নিজ হাতে খোদাই করেছে সিরিয়াল নাম্বার। এছাড়া বোতলগুলো এতই ছোট যে বিশেষভাবে সেলাই করা ওভারকোর্টের পকেটে করে ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেলস থেকে বের করে আনতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। অসম্ভব চতুরতার আশ্রয় নিয়েই পার করে এনেছে প্ল্যান্টের মেইন গেইটের সিকিউরিটি চেক।

দু’টো বোতলকে স্টেইনলেস স্টিলের টি-পিস দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে যা আবার মুখের কাছে স্পেশ্যাল লেফট-হ্যান্ড থ্রেড দিয়ে আটকে দেয়া আছে। এগুলোকে ব্যবহার করার জন্য প্রথমেই স্কুর গায়ে টোকা দিয়ে খুলে যাবে প্রতিটা বোতল। তারপর ভালব হ্যাঁন্ডেল ধরে হাফ-টার্ন দিলেই টি-পিসের মাধ্যমে একসাথে মিশে যাবে দুই বোতলের গ্যাস। হোসের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে নার্ভ গ্যাস। পেছনের লাগেজ কম্পার্টমেন্টের সামনের দুটো সিটের মাঝখানে লাগানো হয়েছে হোস।

কম্পার্টমেন্টের ফ্লোরবোর্ডস আর সেঞ্চুরিয়নের আউটার মেটাল স্কিনের গায়ে তিন সেন্টিমিটার গর্ত করেছে বেন! গ্যাস হোসের শেষাংশ এই ড্রিল করা গর্তের মাঝখান দিয়ে পৌঁছে গেছে দশ সেন্টিমিটার রাস্তা; ফিউজিলাজ। প্রাটলি’র পুডিং লাগিয়ে হোস’কে জায়গামতো বসিয়ে রাখা ছাড়াও ছোটখাট গ্যাপ ভরে দিয়েছে। শুকিয়ে যা লোহার চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে।

এয়ারক্রাফটের নিচ থেকে গ্যাসটাকে স্প্রে করতে কোন সমস্যাই হবে না। একই সাথে অক্ষত থাকবে সেঞ্চুরিয়নের আরোহীরা। তবে বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে সেফটি স্যুট পরা ছাড়াও গ্যাস ছাড়ার মুহূর্তে বোতল ভর্তি অক্সিজেন থেকে নিঃশ্বাস গ্রহণ করবে সেঞ্চুরিয়নের প্যাসেঞ্জার।

হ্যাঙ্গারের দেয়ালে ঝুলতে থাকা সুট যে কোনো মুহূর্তে চাইলেই গায়ে চাপানো যাবে। ফায়ার ডিপার্টমেন্টের অ্যাপ্রুভ করা এসব সুট গোল্ড মাইনে রেসকিউ টিম হরহামেশা ব্যবহার করে থাকে।

দ্বিতীয় বারের মতো হোসের ভেতরে কোন লিক আছে কিনা চেক্ করে দেখল বেন। অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে খোলা কেবিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তুলার মাঝে হাত মুছে কাছাকাছি দেয়ালের সাথে লাগানো ওয়ার্কবেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।

অন্য দু’জন বেঞ্চের উপর ঝুঁকে পড়ে ম্যাপ স্টাডি করছে। মাইকেল কোর্টনির পিছনে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখল বেন। “অল সেট,. মিকি।” দক্ষিণ লন্ডনি টানে জানাল বেন।

এরপর মনোযোগ দিল রামোন মাচাদোর দিকে। এই লোকটাকে প্রায় পূজা করে বেন; রামোনের এতটাই অন্ধ ভক্ত সে। মাঝে মাঝে যখন মাইকেলের সাথে একা থাকে তখন তো যেন ধর্মীয় বিশ্বাসের মতই রামোনকে নিয়ে আলোচনা করে। অন্যদিকে মাইকেল অনুভব করে তাদের মিশনের বিভৎস দিক। লড়াইকে সফল করার জন্য যে এরকম কিছু করার প্রয়োজন আছে সে কথা নিজের মনকে বোঝাতেই তার লেগে গেছে বহু মাস।

মাইকেলের বিতৃষ্ণা অনুভব করে ওর দিকে তাকাল রামোন। মাইকেল, তুমি মেটকে ফোন করে আজ সন্ধ্যায় ফাইনাল ওয়েদার ফোরকাস্টটা জেনে নিও।”

সামনের বেঞ্চে থাকা টেলিফোন তুলে জান সুটস্ এয়ারপোর্টের ওয়েদার ইনফর্মেশনের নাম্বার ডায়াল করল মাইকেল। প্রি-রেকর্ডেড অ্যানাউসেমন্টটা শুনল মন দিয়ে, “বাতাস এখনো পাঁচ নট গতিতে ২৯০ ডিগ্রি কোণে বইছে; উত্তর দিল মাইকেল। “সকাল থেকে কোনো পরিবর্তন নেই। বায়ুমণ্ডলের চাপও স্থির আছে।”

“যাক, ভালোই হল।” নিজের রেড় মার্কার পেন্সিল তুলে নিল রামোন। লার্জ স্কেল অ্যারোনটিক্যাল ম্যাপের উপর পডিশন সার্কেল করল। তারপর বাতাসের গতিপথও মার্ক করল। “ওকে। এটাই হবে তোমার লাইন অব অ্যাপোচ। টার্গেটের এক মাইল পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী বাতাস পাবে। চেষ্টা করবে মাটি থেকে হাজার ফুট উঁচুতে থাকতে। ওয়াটার টাওয়ার পার হয়ে গেলেই গ্যাস ভালব খুলে দেবে। এগুলোর গায়ে বেশ স্পষ্ট নেভিগেশনলি ওয়ার্নিং লাইটস জ্বলছে।”

“ইয়েস” জানাল মাইকেল। “আমি ওই এলাকা দিয়ে গতকালও উড়ে এসেছি। স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট জ্বলবে। লেজার শো’ও হবে-মিস্ করার কোনো মানেই হয় না।”

“ওয়েল ডান, কমরেড।” নিজের সবচেয়ে দুস্পাপ্য হাসিগুলোর একটি মাইকেলকে উপহার দিল রামোন, “তুমি বেশ অসাধারণ প্রস্তুতি নিয়েছ।”

নিচের দিকে তাকাল মাইকেল আর বেন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আমি তো একটা’র খবরে শুনেছি যে দুপুরের মধ্যেই ওখানে আরো দুই কোটি দর্শক জমে যাবে। তাই ভরসটার ওপেনিং স্পিচ দিতে আসতে আসতে আরো হাফ মিলিয়ন। স্বাধীনতার জন্য আমাদের আজকের আঘাত কেউ ঠেকাতেই পারবে না।”

“সন্ধ্যা সাতটায় ভরস্টারের বক্তৃতা দেবার কথা।” শো কমিটির ইস্যু করা বিজ্ঞাপনের পুস্তিকাৰ্প তুলে নিল রামোন। বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ল শুরুর দিককার প্রোগ্রামগুলো। কিন্তু কয়েক মিনিট দেরি তো হতেই পারে। আর সম্ভবত চল্লিশ মিনিট থেকে শুরু করে ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দেবে। মিলিটারি ট্যাটু শুরু হবে রাত আটটায়। তুমি কখন রওনা দেবে?”

“যদি আমি ১৮৪৫ ঘণ্টায় রওনা দেই তাহলে আটচল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাবো। গতকালও সময় হিসাব করে দেখেছি। তার মানে সাতটা তেত্রিশে টার্গেটের উপর থাকব।”

“তাহলেই চলবে।” একমত হলো রামোন। “ভস্টার নিশ্চয় তখনো কথা বলতে থাকবে। দু’বার ঘুরে যাবে রেঞ্জের মধ্যে। তারপর পশ্চিমে ঘুরে সোজা বতসোয়ানা বর্ডার। রালেই তাবাকা’র সাথে কতটা নাগাদ দেখা করতে পারবে?”

“তিন ঘণ্টা পনের মিনিট” উত্তরে জানাল মাইকেল। “আজ রাতে প্রায় এগারেটার দিকে পৌঁছে যাবো। এই সময়ের মধ্যে বাড়তি কোনো গ্যাস থাকলেও তা নষ্ট হয়ে যাবে।”

“ফ্লেয়ার ছেড়ে এয়ারস্ট্রিপে আলো জ্বালিয়ে রাখবে রালেই তাবাকা। ল্যান্ড করার সাথে সাথে গ্যাস ইকুপমেন্ট সরিয়ে প্লেনে আগুন ধরিয়ে দিও। সেখান থেকে রালেই তোমাকে জাম্বিয়া দিয়ে বের করে টার্সিও বেসে নিয়ে যাবে।

দুই ভাইয়ের দিকে তাকালো রামোন। “তো, তাহলে এই হলো ব্যাপার। জানি এরই মাঝে ডজনখানেক বার বলা হয়ে গেছে, তবুও আর কোনো প্রশ্ন আছে?”

মাথা নাড়ল ভাতৃদ্বয়। মুখ বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল রামোন। গায়ের রঙ আর চুলের দিক থেকে আলাদা হলেও এ দুই ভাইয়ের মাঝে অদ্ভুত কিছু মিল আছে।

এই ধরনের বাধ্যতা আর দ্বিধাহীন বিশ্বাস ব্যতীত বিপ্লব আসলে কখনো সফল হতে পারত না; আপন মনেই ভাবল রামোন। কেমন যেন ঈর্ষা হলো ওদের দেখে। থাকুক, ওরা না হয় বিশ্বাস করুক যে এই একটামাত্র দায়িত্ব পালন করলেই বদলে যাবে পৃথিবী আর সমাজতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হবে। কিন্তু রামোন জানে যে কোনো কিছুই এত সহজ নয়।

দুই ভাইয়ের অন্ধ বিশ্বাস দেখে খুশি হলেও রামোন বুঝতে পারছে না যে হাফ মিলিয়ন মানুষ মেরে ফেলে এর পরের ধাপ রেড টেরর হজম করার মতো এদের কলজের জোর আছে কিনা।

শক্তিশালীরাই কেবল টিকে থাকবে। কিন্তু এই দুজনের মনোভাব ততটা শক্ত নয়। তাই আজ রাতের পরে তাদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে।

আস্তে করে মাইকেলের কাঁধে হাত রাখল রামোন। ভালভাবেই জানে যে পুরুষের স্পর্শ কতটা উপভোগ করে মাইকেল।

“তুমি আসলেই চমঙ্কার কাজ করেছ। এখন গিয়ে খেয়ে রেস্ট নাও। সন্ধ্যায় তুমি টেক অফ করার আগেই আমি চলে যাব। দুজনের জন্যই রইল আমার স্যালুট।”

তিনজন মিলে একসাথে এগোল শেডের দরজার দিকে; কিন্তু খানিক গিয়ে থেমে গেল মাইকেল।

“আমি একবার নিজের হাতে বেনের কাজ চেক করে দেখতে চাই।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল মাইকেল। কোনো অনিশ্চয়তা রাখতে চাই না।”

“তোমার এটা অধিকার কমরেড। সম্মত হলো রামোন। “এই ফাঁকে আমরা তোমার খাবার তৈরি করে ফেলছি।”

সেঞ্চুরিয়নের ককপিটে উঠে গেল মাইকেল আর বাকি দুজন এগোল দরজার দিকে।

“হ্যাঙ্গারের দেয়ালের গায়ে লাগানো ছোট্ট দরজাটা খুলে ফেলল রামোন। আর বেনসহ বের হতেই দেখল তাদের দিকে তাকিয়ে আছে শন কোর্টনি।

মাত্র ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে, শন্ আর রামোন। প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মত। কোর্টের নিচে হাত দিয়েই বিশাল ম্যাগনাম রিভলবার বের করে আনল শন। সেকেন্ডেরও কম সময় লাগল ট্রিগার কাজ করতে আর এরই ফাঁকে বেন আফ্রিকাকে টেনে এনে নিজের দেয়াল বানিয়ে ফেলল রামোন। উজ্জ্বল দিনের আলোতে আরো অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল মাজলের ফ্ল্যাশ; শনের গুলি ছিন্নভিন্ন করে দিল বে’নের শরীর।

বাম কনুই ভেদ করে হলো-পয়েন্ট বুলেট চলে গেল হাত থেকে দেহের এক পাশ পর্যন্ত। শেষতম পাঁজরে ঢুকতেই ভাঙ্গতে শুরু করল বুলেট। ফুসফুসে ভরে গেল বুলেটের খানিক অংশ। একটা তামার জ্যাকেট পরা স্পিন্টার মেরুদণ্ডের ভাট্রেবার মাঝখানে ঢুকে স্পাইনাল কর্ডকে প্রায় চুরমার করে দিল।

বুলেটের আঘাতে একপাশে দেয়ালের উপর ছিটকে পড়ল বেন। জং ধরা কারাগেটেড টিনের গায়ে ছিটিয়ে পড়ল রক্ত। শন আবারো রিভলবার ভোলার আগেই মাথা নিচু করে হ্যাঙ্গারে চলে গেল রামোন মাচাদো। লাথি মেরে পেছনে দরজা আটকেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে তুলে নিল তোকারেভ পিস্তল।

পাতলা দেয়াল লক্ষ্য করে দ্রুত দু’বার গুলি ছুড়ল রামোন; ভাবল শন্ বুঝি এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আগে থাকতেই সন্দেহ করে মেঝের উপর সোজা হয়ে পড়ে গড়িয়ে গেল শন। গুলির শব্দ আর টিনের দেয়ালে বুলেটের গর্ত দেখে আন্দাজ করে নিল রামোনের অবস্থান। জোড়া হাতে ফায়ার করতেই ভারী বুলেটের আঘাতে দেয়ালে গর্ত হয়ে গেল; তবে এক ফুটের জন্য মিস্ হলো রামোনের মাথা।

হ্যাঙ্গারে কয়েকটা ড্রামের পেছনে লুকিয়ে থাকা রামোন এয়ারক্রাফটের কন্ট্রোলে বসে থাকা মাইকেলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, স্টার্ট আপ!”

সেঞ্চুরিয়নের পাইলটের সিটে বসে আতঙ্কে যেন জমে গেল মাইকেল। কিন্তু রামোনের নির্দেশ শুনেই সম্বিত ফিরে পেয়ে দুটো মাস্টার সুইচ জ্বেলে চাবি ঘুরিয়ে দিল। খক খক করে কাশতে লাগল সেঞ্চুরিয়নের ইঞ্জিন, থ্রটল খুলে দিল মিকি গর্জন করে উঠল সেঞ্চুরিয়ন।

“গেট হার রোলিং” চিৎকার করে উঠেই দেয়াল লক্ষ্য করে এলোপাথারি আরো দুবার গুলি ছুড়ল রামোন।

খোলা হ্যাঙ্গারের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেঞ্চুরিয়ন; গতি বাড়ছে দ্রুত। দৌড় দিল রামোন। উইং এর নিচে লুকিয়ে খুলে ফেলল প্যাসেঞ্জার জোর।

“বেন কোথায়?” রামোন’কে দেখেই চিৎকার করে জানতে চাইল মাইকেল।

“বেন শেষ” চিৎকার করেই উত্তর দিল রামোন, “স্কীপ গোয়িং।”

“শেষ মানে কী?” সিটের উপর মোচড় দিয়ে বসে থ্রটল বন্ধ করে দিল . মাইকেল, “আমরা ওকে এভাবে রেখে যেতে পারি না।”

“বেন মারা গেছে, ম্যান।” খ্রটলের উপর মাইকেলের হাত ধরল রামোন। “বেনের গায়ে গুলি লেগেছে। আমাদেরকে দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

“বেন-”

“প্লেন চালাও।”

আবারো থ্রটল খুলে দিল মাইকেল। রানাওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল সেঞ্চুরিয়ন। প্রচণ্ড শোকে কাতর হয়ে পড়েছে মাইকেল।

“বেন” ফিসফিস করেই সেঞ্চুরিয়নের ট্যাক্সিইং শুরু করল মিকি। একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছে ব্রেক আর ইঞ্জিন ব্যবহার করে রানওয়ে ছেড়ে ওঠে পড়ল বাতাসে। “ইঞ্জিন একেবারে ঠাণ্ডা” জানাল মাইকেল, “ওয়ার্ম। আপের চান্স পায়নি তো।”

“কিন্তু ওকে চলতেই হবে” জোর গলায় বলে উঠল রামোন। “এখুনি এসে পড়বে পুলিশ। কে জানে কিভাবে খবর পেয়েছে।”

“বেন?”

“বেনের কথা ভুলে যাও” খেঁকিয়ে উঠল রামোন, “প্লেন চালাও।”

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?-বতসোয়ানা?” এখনো দ্বিধা করছে মাইকেল।

“হ্যা” জানাল রামোন, “কিন্তু তার আগে এই অপারেশন শেষ করতে হবে। শো-গ্রাউন্ডের দিকে চলো।”

“কিন্তু…তুমি তো বললে যে পুলিশ আমাদের পিছু নিয়েছে” প্রতিবাদ করে উঠল মাইকেল। “এখন ওরা আর কিভাবে থামাবে? এয়ারফোর্স ইম্পালা আকাশে উঠতেও ঘন্টাখানেক লেগে যাবে। গো-ম্যান-গো!”।

এমন সময় হ্যাঙ্গারের পিছন থেকে দৌড়ে এলো কেউ একজন। ভাইকে দেখে চিনতে পারল মাইকেল।

“শন!” সবিস্ময়ে বলে উঠল মিকি।

“কিপ গোয়িং” আদেশ দিল রামোন।

রানওয়ের শেষ মাথায় এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল শন। সামনে থেকে ছুটে আসা সেঞ্চুরিয়নকে লক্ষ্য করে ক্ল্যাসিক ডাবল-হ্যান্ডেড গ্রিপ করে তিনবার গুলি করল।

একেবারে শেষ গুলিটা উইন্ডস্ক্রিনে লাগতেই মাথা নিচু করে ফেলল মাইকেল আর রামোন। সেঞ্চুরিয়নের নাক ঘুরিয়ে ফেলল মাইকেল। সীমানা প্রাচীর দুমড়ে-মুচড়ে স্বচ্ছ নীলাকাশে উড়ে গেল এয়ারক্রাফট।

দুইশ ফুট উপরে উঠেও খানিক কাশি দিয়ে তোতলাতে লাগলো শীতল মোটর। এরপরই মসৃণ গতিতে ছুটে চলল।

“শো-গ্রাউন্ডসের দিকে চলো” আবারো বলে উঠল রামোন, “ভরসটার’কে না পেলেও টার্গেট একেবারে খারাপ না। এখনো দুইশ কোটি মানুষ আছে ওখানে।”

এক হাজার ফুট উপরে উঠে এয়ারক্রাফট লেভেলড করল মাইকেল! উড়ে চলল নিজ গন্তব্যের দিকে।

***

মাথার উপর দিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া সেঞ্চুরিয়নের পেট লক্ষ্য করে রিভলবার খালি করে ফেলল শন। কিন্তু কোথাও লাগল না তার বুলেট; বরঞ্চ ল্যান্ডিং হুইলস তুলে ফেলে অক্ষতভাবে ভেসে গেল সেঞ্চুরিয়ন।

ঝট করে দাঁড়িয়ে হ্যাঁঙ্গার ধরে ছুটল শন। ওয়াকবেঞ্চের উপরে থাকা টেলিফোনটাকে দেখতে পেয়েছে। “থ্যাঙ্ক গড়!” বেঞ্চের কাছে গিয়েই ছো মেরে ফোন তুলে নিল শন্।

ক্যাপরিকর্ণের নাম্বার ডায়াল করতে করতেই হাতের নিচে খোলা ম্যাপ আর ব্যান্ড ইস্টার শো’র ব্রোশিউর দেখতে পেল। শো-গ্রাউন্ডের লোকেশন আর বাতাসের গতি’কে রেডমার্ক দিয়ে সার্কেল করা আছে।

তৃতীয় বার রিং হতেই উত্তর দিল সুইচবোর্ডের অপারেটর “ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ’ গুড ডে, হাউ মে আই হেল্প ইউ?”।

“আমি বোর্ডরুমে মি: গ্যারি কোর্টনির সাথে কথা বলতে চাই। আমি উনার ভাই আর দিস ইজ অ্যান ইমারজেন্সি।”

“উনি আপনার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এক্ষুণি লাইন দিচ্ছি।”

অপেক্ষা করতে করতে দ্রুত হ্যাঙ্গারের চারপাশে চোখ বোলালো শন্। দরজার পাশে দেয়ালে ঝুলে থাকতে দেখল সেফটি স্যুটস।

“শন, তুমি?” গ্যারির গলায় টান টান উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল।

“হ্যাঁ, আমি। এখনো ফারগ্রোভে। যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হয়েছে। মাইকেল, বেন আর শিয়ালটা। টার্গেট হচ্ছে শো-গ্রাউনড।”

“ওদেরকে থামাতে পারোনি শন?”

“না। মাইকেল আর ফক্স প্লেন নিয়ে ভেগে গেছে। দুই মিনিট আগেই টেক অফ করেছে। নিশ্চিত শো-গ্রাউন্ডের দিকেই যাচ্ছে।”

“তুমি নিশ্চিত, শন?”

“অফ কোর্স অ্যায়াম ব্লাডি সিউর। আমি এখন মিকি’র হ্যাঙ্গারে, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে আছি। শো, গ্রাউন্ডস আর বাতাসের গতি মার্ক করে রাখা হয়েছে। দেয়ালে ঝুলছে দুটো স্মোক-প্রুফ স্যুট। এগুলোকে তুলে নেয়ার সুযোগ পায়নি।”

“আমি পুলিশ আর এয়ারফোর্সকে সতর্ক করে দিচ্ছি।”

“বোকার মতো কথা বলো না, গ্যারি। ফাইটার অথবা হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠানোর জন্য ডিফেন্স ফোর্সের চিফ আর মিনিস্টারের অর্ডার লাগবে আর তা করার জন্য মাসখানেক কেটে যাবে। এই ফাঁকে মারা যাবে দুই কোটি মানুষ।”

“এখন তাহলে কী করব, শন?” এতক্ষণে পথে এসেছে গ্যারি! “কুইন এয়ার নিয়ে আকাশে উঠে পড়ো” জানাল শন। “ছোট্ট সেঞ্চুরিয়নের চেয়ে এটা বেশি বড়, শক্তিশালী আর দ্রুত। তাই সেঞ্চুরিয়নের গতি রোধ করে নিচে নামতে বাধ্য করতে পারবে।”

“মিকি’র সেঞ্চুরিয়ন দেখতে কেমন?” ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল গ্যারি।

“উপরে নীল। পেট সাদা। মার্কিংস হলো জেড এস-আর আর ডব্লিউ। রোমিও রোমিও হুইস্কি। ফারগ্রোভের লোকেশন জানো তুমি, আর সেই কোর্স ধরে শো’র দিকে যাও।”

“আমি এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি।” ক্লিক করে কেটে গেল গ্যারির কানেকশন।

বেঞ্চের উপর থেকে নিজের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন তুলে নিল শন চেম্বার থেকে ফেলে দিল খালিকেস। পকেট থেকে গুলির বক্স বের করে দ্রুত আবার রিলোড করে নিল। হাতে উদ্যত রিভলবার নিয়েই দৌড়ে দিয়ে লাথি মেরে খুলে ফেলল দরজা। আর সাথে সাথে হাটু গেড়ে বসে বসে রিভলবার তাক করল সামনের দিকে।

মারা যাবার আগে অথর্ব পা দুটোকে টেনে নিয়ে মাত্র কয়েক গজ যেতে পেরেছে বেন। তারপরই দলা মোড়া পাকিয়ে পড়ে গেছে পিচ গাছের নিচে। অসম্ভব রক্তপাত হওয়াতে ভিজে গেছে শার্ট আর ট্রাউজারের উপরিভাগ। তাল পাকানো মাংসের মতো ঝুলছে বাম হাত কাটা চামচের মতো দেহের মাঝে গেঁথে গেছে ভাঙ্গা হাড়ের টুকরো।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন তুলে নিল শন্। দরজা দিয়ে বেরিয়ে তাকাল বে’নের দিকে।

এখনো বেঁচে আছে বেন। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে তাকালো শনের দিকে। পোড়া চিনির মতো বাদামি চোখ জোড়া যেন জ্বলছে।

“ওরা চলে গেছে, তাই না?” ফিসফিস করে বলে উঠল বেন, “ওরা সফল হবেই, তুমি আমাদেরকে থামাতে পারবে না। ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে।”

গাছপালার মধ্য দিয়ে দৌড়ে এলো বেলা। শ’কে দেখতে পেয়েই ওর দিকে দৌড় লাগালো।

“আমি না তোমাকে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম” গর্জন করে উঠল শন্। “কথা শোন না কেন কখনো?”

বেন’কে দেখতে পেয়েই থেমে গেল বেলা।

“ওহ্ গড! ইটস বেন। তুমি ওর সাথে কী করেছ?” শনের পায়ের কাছে পড়ে থাকা বে’নের দিকে এগোতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পড়ল বেলা।

আস্তে করে কোলের উপর বে’নের মাথা তুলে নিল; কিন্তু এই সামান্য নড়াচড়াতেই আহত ফুসফুস নিয়ে কাশতে শুরু করল বেন। ভোলা মুখ আর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল মুখ ভর্তি রক্ত।

“ওহ্ গড, শন। তুমি ওকে মেরে ফেলেছ!” ফুফিয়ে উঠল বেলা।

“তাই তো মনে হচ্ছে” নরম স্বরে জানাল শন। “সমস্ত হৃদয় দিয়েও আমি তাই চাই।”

“শন, ও আমাদের ভাই”

“না” সোজা-সাপ্টা জবাব দিল শন, “ও আমার ভাই নয়; কেবল একটা জঘন্য মাংসের দলা।”

***

কুইন এয়ারের ইঞ্জিন চালু করতে করতেই হিসাব করে ফেলল গ্যারি কোর্টনি।

ফারগ্রোভের চেয়েও শোগ্রাউন্ডস ক্যাপরিকর্ণের ষাট মাইল কাছাকাছি আর কুইন এয়ার সেঞ্চুরিয়নের চেয়ে সতুর কিংবা আশি নট দ্রুততর হওয়াতে মাত্র নয় মিনিটে মিকি আর কতটা গেছে!

তার মানে প্রায় মাইকেলের কাছে চলে এসেছে। অন্য কোনো কথা ভাবার দুঃসাহস না করে সোজা শো গ্রাউন্ডের কোর্স ধরল গ্যারি। তারপর ঘুরে গিয়ে মাইকেলের গতি রোধ করার চেষ্টা করবে।

থ্রটল খুলে রানওয়ে ধরে কুইন এয়ার নিয়ে ছুটতে গিয়েও খানিকটা আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল যে দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে হাফ স্মোকড় সিগার। এয়ারক্রাফটের পিছু ধাওয়া করার কথা ভাবতে ভাবতে ভুলে গেছে বাকি সবকিছু। জোড়া ইঞ্জিনের বিশাল মেশিন আকাশে তুলেই গভীরভাবে সিগারে টান দিল গ্যারি। হাভানা থেকে অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের সিগারাটা যেন ভাগ্যেরই পরিহাস। ধোয়ার সুগন্ধে খানিকটা শান্ত হলো নার্ভ।

“শনের মতো এ ব্যাপারে আমি ততটা দক্ষ নই” নিজেকেই যেন শোনাল গ্যারি, “এর চেয়ে স্টক একচেঞ্জ কিংবা ব্লাডি টেক ওভার ডি দিয়েই দেখুক না।” ম্যানুয়ালের উপর চাপ দিয়ে কুইন এয়ারের ভেতর থেকে নিংড়ে বের করে নিল আরো বাড়তি পনের নট।

প্রায় সাত মাইল দূর থেকেই দেখতে পেল শো গ্রাউন্ডস। রঙিন তিমি’র মতো উড়ছে বেলুনের বিশাল একটা স্তূপ। কারপার্কে থাকা হাজার হাজার গাড়ির গা থেকে ঠিকরে পড়ছে সূর্যরশ্মি।

ঘুরে গিয়েই কুইন এয়ার নিয়ে সোজা ফারগ্রোভের দিকে ছুটল গ্যারি। নিজের আসনে ঝুঁকে বসে উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে আর কষে টান দিচ্ছে পুরু সিগারে। মাথার ভেতরে বইছে চিন্তার ঝড়। এখনো হিসাব করছে গতি, সময় আর দূরতু। “যদি ওদের সাথে দেখা হয় তাহলে সেটা পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যেই হবে-” গ্যারি’র চিন্তায় ছেদ পড়ল। সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসা কিছু একটাতে সূর্যের আলো পড়তেই ঝলসে উঠল চোখ। নাকের উপরে ভালো করে বসিয়ে দিল হর্ণ-রিমড় চশমা। ভেতরে ভেতরে মায়োপিক চোখজোড়া নিয়ে রেগে উঠলেও চেষ্টা করল বস্তুটাকে খোঁজার।

আবাসিক এলাকা পেছনে ফেলে এসে এখন খোলা গ্রাম্য এলাকা দিয়ে উড়ে চলেছে গ্যারি। নিচে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট গ্রাম আর আঁকাবাঁকা রাস্তা। ফসলের জমি আর গাছপালার জন্য ফোকাস করতে কষ্ট হচ্ছে। উম্মাদের মতো চারপাশে খুঁজছে গ্যারি; আর তারপরই বুঝতে পারল সেঞ্চুরিয়ন ঠিক তার নিচে।

প্রথমেই দেখতে পেল ছায়া। মাঠের উপর ঘাসফড়িং’র মতো লাফ দিচ্ছে। এর খানিক পরেই ছোট্ট নীল এয়ারক্রাফটটা চোখে পড়ল গ্যারি’র চেয়ে হাজার ফুট নিচে থাকলেও ঠিক দু’মাইল সামনে। বিপদজনকভাবে কুইন এয়ারের নাক নিচের দিকে নামিয়ে ডাইভ দেয়ার জন্য তৈরি হলো গ্যারি।

প্রায় পাঁচশ নট গতিতে পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে দুটো এয়ারক্রাফট। কিন্তু কুইন এয়ার সেঞ্চুরিয়নের মতই একই উচ্চতাতে নামার আগেই নীল একটা আলোর ঝলকানির মতো পার হয়ে গেল মিকি’র এয়ারক্রাফট।

একটা উইং’কে যতদূর সম্ভব ঘুরিয়ে সেঞ্চুরিয়নের পিছনে চলে এলো গ্যারি। চাইছে কুইন এযারের সর্বোচ্চ গতি ব্যবহার করে ছোট্ট এয়ারক্রাফটের নাগাল পেতে।

***

“দশ মিনিটের ভেতরেই পৌঁছে যাবো” রামোন’কে সতর্ক করে দিল মাইকেল। “তৈরি হয়ে যাও।”

সামনের দিকে ঝুঁকে পায়ের ফাঁকে আটকে থাকা সিলিন্ডার দুটো ধরল রামোন। খুব সাবধানে প্রতিটা বোতলের গলার কাছে থাকা ট্যাপ খুলে ফেলল। টের পেল কানেকটিটি-পিসের মেইন ভালভের গেইটে গিয়ে আটকে গেল ভেতরের বাতাস।

এবারে ভালব-লিভারে বুড়ো আঙুল ছড়িয়ে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘোরালেই নার্ভ গ্যাস মিক্সড হয়ে হিসহিস করে লম্বা হোস দিয়ে ছুটে সেঞ্চুরিয়নের পেট থেকে ছিটিয়ে পড়রার জন্য তৈরি হয়ে যাবে।

সিধে হয়ে বসে পাশেই পাইলটের সিটে বসে থাকা মাইকেলের দিকে তাকাল রামোন।

“অল সেট-” বলতে গিয়েও কথা শেষ করতে পারল না রামোন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল মাইকেলের মাথার পাশের সাইড উইন্ডোর দিকে।

পুরো জানালা জুড়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল বড় একটা রুপালি ফিউজিলাজ। তাদের সাথে একই সমান্তরালে উড়ছে আরেকটা এয়ারক্রাফট। এদিকেই তাকিয়ে আছে পাইলট। বাচ্চাদের মতো চেহারার বড়-সড় মানুষটার চোখে হর্ণ-রিমড চশমা আর মুখের এক কোণায় ঝুলছে সিগার।

“গ্যারি?” চিৎকার করে উঠল আতঙ্কিত মাইকেল। ডান হাত তুলে বুড়ো আঙুল দিয়ে নিচের দিকে ইশারা করল গ্যারি।

হঠাৎ করেই সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে নিচের দিকে টার্ন নিল মাইকেল। উপর থেকে ছেঁড়া পাথরের মতো ধপ করে নেমে এলো গাছের মাথা বরাবর।

রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে দেখল মাত্র একশ গজ দূরে থাকা কুইন এয়ারের রুপালি নাকটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। এরপর এক ধাক্কায় সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে উপরে উঠেই আবার ঘুরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে পাশ থেকে গুতো দিল রুপালি মেশিন। পাইলট হিসেবে গ্যারি ওর চেয়ে অনেক দক্ষ আর কুইন-এয়ারের উইং’কেও এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।

“ওর কাছ থেকে কিছুতেই পালাতে পারব না।”

“সোজা টার্গেটে উড়ে যাও।” রূঢ়ভাবে আদেশ দিল রামোন, “ওর আর কিছুই করার নেই।”

মাইকেল আশা করেছিল যে রামোন হয়ত অপারেশনটা বাতিল করবে। কিন্তু তা না করে নিজের প্ল্যানেই অটল আছে। সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে সবচেয়ে লম্বা গাছটারও দুইশ ফুট নিচে নেমে এলো মাইকেল। ওকে অনুসরণ করে পাশেই চলে এলো গ্যারি। মাত্র এক গজ দূরত্বে সমান হয়ে আছে দুটো এয়ারক্রাফটের ডানা।

আবারো মাইকেলকে ল্যান্ড করার সিগন্যাল দিল গ্যারি। কিন্তু ওকে উপেক্ষা করে নিজের রেডিও মাইক্রোফোনটা ছোঁ মেরে তুলে নিল মাইকেল। জানে গ্যারি’র রেডিও হল ১১৮.৭ মেগাহার্টজ। “অ্যায়াম সরি, গ্যারি।” চিৎকার করে উঠল মাইকেল, “আমাকে এটা করতেই হবে, অ্যায়াম সরি।”

কেবিনের মধ্যে রেডিও স্পিকারে গর্জে উঠল গ্যারির গলা,

“এক্ষুণি ল্যান্ড করো, মিকি, একটুও কোনো দেরি হয়নি। তোমাকে এখনো এর ভেতর থেকে বের করে আনতে পারব আমরা। বোকার মতো কাজ করো না। ম্যান।”

প্রচণ্ডভাবে মাথা নাড়ল মাইকেল। ইশারায় সামনের দিক দেখাল।

শক্ত হয়ে গেল গ্যারির চোখ-মুখ। খানিকটা পিছিয়ে এসেই মাইকেল কিছু করার আগে কুইন-এয়ারের ডানার মাথা ঢুকিয়ে দিল সেঞ্চুরিয়নের লেজের ভেতর। এরপর কন্ট্রোল হুইল চেপে ধরে লম্বালম্বিভাবে সামনের দিকে ডাইভ দিল।

সেঞ্চুরিয়ন অসম্ভব নিচে থাকাতে আর ডাইভটাও বেশ খাড়া হওয়াতে কোনো কিছু করার আগেই লম্বা একটা ব্লু-গাম গাছের ডালে আছড়ে পড়ল ছোট্ট প্লেন।

হাত দুটো বাড়িয়ে দিল মাইকেল। কিন্তু পুরুষের পেশিবহুল হাতের মতই শুকনো আর মোটা একটা ডাল এসে বাড়ি খেল উইন্ডস্ক্রিনের গায়ে একটু আগেই সেখানে লেগেছিল শ’নের বুলেট। মাইকেলের গলার নিচে ঢুকে গেল গাছের ডাল। কলার বোনসের ভেতরে ঢুকে বেরিয়ে এলো শোল্ডার ব্লেডের মাঝখান দিয়ে।

এয়ারক্রাফট নিচে পড়ে যেতেই আবার সাৎ করে বাইরে বেরিয়ে গেল গাছের ডাল।

দুর্বার গতিতে গাছের মাথা দুমড়ে মুছড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেঞ্চুরিয়ন। প্রথমে একটা আর একটু পরেই খসে পড়ল দ্বিতীয় ডানা। কমে গেল গতি। অবশেষে মাটিতে আছড়ে পড়ল ডানাবিহীন ফিউজিল্যাজ। তারপরেও ঘষে ঘষে চলে গেল ভুট্টা ক্ষেত্রে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।

বহুকষ্টে হাচোড় পাচোড় করে সিটের উপর উঠে বসল রামোন মাচাদো। এখনো বেঁচে আছে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। মাইকেলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নিঃশব্দে চিৎকার করছে খোলা মুখ। তছনছ হয়ে যাওয়া উইন্ডস্ক্রিনের উপর রক্তের ফোয়ারা ছুটছে।

সিট বেল্ট খুলে সিট থেকে উঠে পড়তে চাইল রামোন। কিন্তু না পেরে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল বাম পা ভেঙে গেছে সিট আর গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর মাঝখানে জড়িয়ে আছে সেদ্ধ স্প্যাগেটির মত। হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে ট্রাউজারের পা আর গোড়ালির ভেতরে এটে বসেছে স্টেইনলেস স্টিলের ভালব-হ্যান্ডেল।

নিচের দিকে তাকাতেই গ্যাস নির্গত হওয়ার হিসহিস শব্দ শুনতে পেল রামোন। ভাঙ্গা পা খুলে দিয়েছে ভালব-হ্যান্ডেল। হোস পাইপের ভেতর দিয়ে গিয়ে ফিউজের নিচের নজল দিয়ে স্প্রে হচ্ছে সিনডেক্স-২৫।

ডোর হ্যান্ডেল ধরে নিজের সারা শরীরের ভার দিয়ে ধাক্কা দিল রামোন। কিন্তু একেবারে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আটকে গেছে দরজা।

আহত পায়ের হাঁটুর নিচে দুই হাত রেখে বহুচেষ্টা করল বের করে আনতে। কিন্তু কোনো কাজ হল না। হাড় ভেঙে যাবার শব্দ শুনতে পেলেও ভাল-হ্যান্ডেল ছেড়ে বের হল না পা।

হঠাৎ করেই রামোনের নাকে ধাক্কা দিল আমন্ডের গন্ধ। জ্বালা করে উঠল নাক। রুপালি মিউকাস ঝরতে লাগল নাকের ফুটো দিয়ে। ঠোঁট বেয়ে চিবুকে গড়িয়ে পড়ল সিকনি। কয়লার মতো জ্বলে উঠল চোখ জোড়া, ম্লান হয়ে গেল দৃষ্টিশক্তি।

অন্ধকারের ভেতর গুঙ্গিয়ে উঠল। আর কখনো বোধ করেনি এরকম ব্যথা। আত্ম-চিৎকার শুরু করল রামোন মাচাদো। পড়ে রইল নিজের মল মূত্রের মাঝে। আর এভাবে চিৎকার করতে করতে একসময় নিঃশেষ হয়ে গেল ফুসফুসের শক্তি। নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ।

***

বনের কিনারে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির উপর বসে আছেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়ে খেলছে। নিকি।

এই কুকুর ছানাটা ওয়েল্টেভ্রেদেনের ড্যান্ডি ল্যাসের সর্বশেষ নিদর্শন। বয়স হয়ে যাওয়ায় সেনটেইন বাধ্য হয়েছেন মাদী কুকুরটাকে কবর দিতে। তবে মায়ের সমস্ত ভালো দিকগুলোই পেয়েছে ছানাটা। একদিন যে এটাও চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।

পাপি’র মতই দ্রুত সব কিছু শিখে নিতে পারে নিকি আর কুকুর। ঘোড়ার সাথে বেশ মিশে যেতে পারে।

আসলে এটা ওর রক্তেই আছে, আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন। ও হচ্ছে সত্যিকারের কোর্টনি, হাস্যকর স্প্যানিশ একটা নাম আর পদবী থাকলেই বা কি আসে যায়।

অন্যান্য কোটনিদের কথা ভাবতে লাগলেন সেনটেইন।

অত্যন্ত যত্ন সহকারে মেরামত করে নেয়া ছোট্ট স্লেভ চার্চে আগামীকাল বিয়ে করবেন শাসা আর এলসা পিগনাটেলি। অন্তত এক দশকের মাঝে এত বড় আর কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি উত্তমাশা অন্তরীপে। ইংল্যান্ড, ইউরোপ, ইস্রায়েল আর আমেরিকা থেকেও আসবেন সব অতিথি।

মাত্র কয়েক বছর আগে হলেও বিয়ের সমস্ত পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনা সেনটেইন নিজ হাতে করতে চাইতেন; কিন্তু এবারে সবকিছু বেলা আর এলসা’র হাতে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

“ওরাই সামলাক সবকিছু” দৃঢ় কণ্ঠে নিজেকে শোনালেন সেনটেইন। “এবারে আমি আমার গোলাপ, কুকুর আর নিকি’কে নিয়েই ব্যস্ত থাকব।”

বেলার কথা ভাবলেন সেনটেইন। নিজের কাজের জন্য অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছে বেলা। কিন্তু মাত্র এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হননি সেনটেইন। নিজের এবং শাসা’র সাথে বহু তর্ক-বির্তকের পর সম্মত হয়েছেন আইনের হাত থেকে মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য।

তারপরেও ওকে প্রায়শ্চিত করতেই হবে। এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর সেনটেইন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বেলা নিজের বাকি জীবনটা বিভিন্ন ভালো কাজ করেই শোধরাবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য আর এই সুন্দর দেশটা যার সাথে ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তার সেবা করেই নিজের জীবন কাটাবে বেলা। প্রতিটি ঋণ যেন কানায় কানায় পরিশোধ হয়, সে ব্যাপারে আমি নিজে দেখভাল করব। ভাবলেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্। নিকি’র দিকে তাকাতেই দেখলেন ওর লুকিয়ে রাখা পালকের ব্যাগটা ঠিকই খুঁজে বের করেছে কুকুর ছানা। বিজয়নীর ভঙ্গিতে লম্বা সিল্কের লেজখানা নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এলো ইয়াং মাস্টারের কাছে।

অবশেষে কুকুর ছানা আর নিকি এসে বসল সেনটেইনের পায়ের কাছে। রোদে পোড়া উদোম হাত দিয়ে পাপি’র গলা ধরে আছে নিকি। আরেক হাত দিয়ে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরল। “তুমি পাপি’র জন্য এখনো কোন নাম ঠিক করোনি?” জানতে চাইলেন সেনটেইন। প্রায় দুই বছর লেগে গেছে ছেলেটার মন পেতে আর এখন অনুভব করলেন যে অবশেষে আদ্রা আর তার গত জীবনের স্মৃতি ভুলতে পেরেছে নিকি

“হ্যাঁ, নানা। আমি ওকে টুয়েন্টি সিক্স ডাকতে চাই” ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স জুনিয়র স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবার পর থেকে নিকি’র ইংরেজি খুব দ্রুত আরো উন্নত হচ্ছে।

“এটা তো বেশ অদ্ভুত একটা নাম, এই নামটাকেই কেন বেছে নিলে?”

“অনেক আগে আমার একটা কুকুর ছিল-ওটার নাম ছিল টুয়েন্টি সিক্স।” অথচ সে সময়কার স্মৃতি আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে।

“হুম, ঠিক আছে-বেশ সুন্দর নাম। ড্যান্ডি টুয়েন্টি সিক্স অব ওয়েল্টেভেদেন।”

“ইয়েস! ইয়েস!” টুয়েন্টি সিক্সের গলা জড়িয়ে ধরল নিকি? “ড্যান্ডি টুয়েন্টি সিক্স।”

নিকি’র প্রতি স্নেহে আদ্র হয়ে উঠল সেনটেইনের হৃদয়। ছেলেটার মানসিক অবস্থা এখনো বেশ অগোছাল হলেও ওর শিরা-উপশিরায় বইছে চ্যাম্পিয়নদের রক্ত।

খানিকটা সময় লাগবে, ভাবলেন সেনটেইন। ওর সাথে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে হবে।

“তোমাকে একটা গল্প শোনাব, নিকোলাস?” সেনটেইনের কাছে আছে মজার সব পারিবারিক কাহিনী; সিংহ আর হাতি শিকারের গল্প; বোয়া, জুলু আর জার্মানদের সাথে যুদ্ধের কথা; হারিয়ে যাওয়া হীরের খনি আর ফাইটার প্লেন সহ এমন হাজারো ঘটনা যা ছোট্ট একটা ছেলের মাঝে গড়ে তুলবে উত্তেজনা আর বিস্ময়বোধ।

এবারে নিকি’কে এক ভাঙ্গা জাহাজ আর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প শোনালেন সেনটেইন। শোনালেন নিষ্ঠুর মরুভূমির মধ্যে ছোট ছোট হলুদ খুদে পরীদের ভ্রমণের কাহিনী-আর ওদের সাথে সাথে হেঁটে গেল গল্পে বিভোর নিকি।

অবশেষে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন সেনটেইন : “আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে, ইয়াং মাস্টার নিকোলাস। আমাদের কী হয়েছে ভেবে ভেবে চিন্তায় পড়ে যাবে তোমার মা।”

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নানা’কে উঠতে সাহায্য করল নিকি। দু’জনে মিলে পাহাড়ের নিচ দিয়ে হেঁটে চলল বিশাল বড় বাড়িটার দিকে। মাঝখানে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে টুয়েন্টি সিক্স।

সেনটেইনের পায়ে ব্যথা থাকাতে সকলেই আস্তে আস্তে হাঁটছে। উঁচু নিচু পথে নানা’র হাত ধরে সাহায্য করছে নিকি।

 

Exit mobile version