Site icon BnBoi.Com

গোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ

গোল্ডেন লায়ন - উইলবার স্মিথ

গোল্ডেন লায়ন

১. মানুষ বলে গণ্য

গোল্ডেন লায়ন / উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান / ভাষান্তর : লুৎফুন নাহার

লেখকের উৎসর্গ

আমার স্ত্রী, নিসোর উদ্দেশে এ বইটি—

পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই সে আমার কাছে একটা দৃঢ় ও প্রগাঢ় অনুপ্রেরণার উৎস, ব্যর্থতার সময়ে সে আমার পথনির্দেশক আর সফলতার দিনগুলোতে সে এক অপার আনন্দ। আমি সত্যিই জানিনা, কি করতাম যদি সে আমার পাশে থাকতো। আমি আশা করি তেমন দিন কখনোই আসবে না।

আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী, আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি, সম্মান করি, তা ভাষায় প্রকাশে ব্যর্থ।

*****

.

তাদেরকে আর মানুষ বলে গণ্য করা যায় না। তারা এখন কেবল আফ্রিকা মহাদেশের ভেতর অবস্থিত ভারত মহাসাগরের উপকূলে এ পড়ে থাকা একদল মাংসপিণ্ড। অধিকাংশের শরীর শক্রর অবিরাম গুলির আঘাতে কিংবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। কারো কারো শরীর ডুবে গিয়েছে পানিতে। পেটে গ্যাস জমে তা আবার ভেসেও উঠেছে। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে কোনো ছিপি-আঁটা বোতল পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভেসে যাওয়া মাংসপিণ্ডগুলো মাংসখেকো সামুদ্রিক পাখি আর হাঙ্গরদের জন্য উৎসবের আমেজ বয়ে নিয়ে এসেছে। কোনো কোনোটা ভাসতে ভাসতে আবার সমুদ্রের পাড়ে চলে এসেছে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য কোনো মানুষখেকো প্রাণী।

দুটি ছোট ছেলে তাদের মা ও নানীর সাথে পানির কিনার ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে তারা চিৎকার করে উঠছে যেন তারা সমুদ্রের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। ওটা কতটা তুচ্ছ এবং অবাঞ্ছিত, সেটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়।

“ওইতো, আরেকটা দেখা যাচ্ছে,” বড় ছেলেটা সোমালি ভাষায় চিৎকার করে উঠে। জাহাজের মাস্তুলের একটি ভাঙ্গা টুকরোর দিকে ইশারা করল সে যেটার সাথে ছেঁড়া পালটা তখনো ঝুলছিল। পালটার সাথে অদ্ভুতভাবে পাক খেয়ে আটকে আছে একটি মৃতদেহ যেটা দেখে বোঝা যায় যে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে এটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তার মৃতদেহটা পড়ে আছে বালুকাবেলায়, যার সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেদুটি হাসছে।

“দেখ, পাখি তার একটি চোখ উঠিয়ে ফেলেছে, বড় ছেলেটি চিৎকার করে উঠল।

“সেই সাথে মাছেরা তার পুরো একটা হাত খেয়ে ফেলেছে,” ছোট ছেলেটি বলল। ছেঁড়াপালের এক টুকরো তার উপড়ে যাওয়া হাতের অবশিষ্টাংশকে ব্যান্ডেজের মতো করে প্যাচিয়ে রেখেছে, সেই সাথে তার সারা গায়ের কাপড় আগুনে পুড়ে গিয়েছে। তার কংকালসার শরীরের সাথে ঝুলে আছে ছেঁড়া টুকরোগুলো।

“ওইটা দেখ,” বড় ছেলেটি আবারো চিৎকার করে উঠল। “তার তলোয়ার এর বেল্টের বাকলটা দেখ। এটা নিশ্চয়ই সোনা বা রুপার তৈরি হবে। আমরা তো ধনী হয়ে গেলাম!” ছেলেটি হাঁটু গেড়ে লোকটার পাশে বসল, এরপর ধাতব বাকলটা ধরে টানতে লাগল। সাথে সাথেই লোকটা গোঙানির মতো আওয়াজ করে উঠল, তারপর মাথাটা ঘুরিয়ে অক্ষত চোখটা দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেদুটি ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বাকলটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসল তারা। এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল ছেলেদুটো, এরপর ভয়ে মায়ের স্কার্ট ধরে নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল।

ছেলেদুটিকে কাছে টেনে নিল তাদের মা, এরপর দৌড়ে অর্ধমৃত লোকটার কাছে চলে এল। ছেলেদুটির নানীও দৌড়ে ওদের পেছন পেছন আসতে লাগল। ছেলেদুটির মা মৃতদেহটার কাছে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল, সেই সাথে সজোরে মৃতদেহটার গালে একটা থাপ্পড় লাগাল। মৃতদেহটা আবারো গোঙ্গানির মতো আওয়াজ করে উঠল।

“জিংকি ঠিকই বলেছে। ফিরিঙ্গিটা এখনো বেঁচে আছে।”

মহিলা তার পকেটে হাত দিয়ে একটা কাস্তে বের করে আনল যেটা দিয়ে সে তার মুরগিদের খাবার জোগাড় করার জন্য ঘাস কাটে।

“তুমি কী করতে চাচ্ছ?” মহিলাটির মা হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে এসে বলল।

“আমি লোকটার গলা কাটতে যাচ্ছি।”

মহিলাটি মৃতপ্রায় দেহটার চুলের মুঠি ধরে পেছন দিকে টান দিল যেন গলাটা আরো সামনের দিকে এগিয়ে আসে। “বেল্ট এবং বাকলটা কে জিতে নিয়েছে, সেটা নিয়ে এখন কোনো তর্ক করতে চাই না।”

সে তার হাতের বাঁকানো কাস্তেটা লোকটার গলায় ধরল। লোকটা অল্প ককিয়ে উঠল, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেল না।

“দাঁড়াও?” ছেলেদুটোর নানী খুব জোরালোভাবে তার মেয়েকে আদেশ করল। “আমি এই বাকলটা আগেও দেখেছি…যখন আমি তোমার বাবার সাথে জিবুতিতে থাকতাম আরকি। এই লোকটা অনেক বড় একজন ফিরিঙ্গি লর্ড। তার নিজের জাহাজ আছে। প্রচুর সম্পদের মালিক সে। আমরা যদি তার জীবন রক্ষা করি, তাহলে সে হয়তো তার অঢেল সম্পদ থেকে আমাদেরকে একটা সোনার মোহর দিতে পারে-কিংবা কে জানে, হয়তো দুটোও দিতে পারে।”

মহিলাটিকে দ্বিধান্বিত মনে হল। সে তার মায়ের প্রস্তাবটা ভেবে দেখছে, যদিও সে কাস্তেটা এখনও লোকটার গলায় ধরে রেখেছে। “কিন্তু এই দামি ধাতব বাকলটার কী হবে?”

“স্বাভাবিকভাবেই, এটা আমরা রেখে দেব।” মা তার মেয়ের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখে হতাশ হল। “যদি সে কখনও এটার কথা জিজ্ঞেস করে, তো বলব যে, আমরা কখনও এটা দেখিইনি।”

অবশেষে মহিলাটি লোকটার গলা থেকে কাস্তে সরিয়ে নিল।

মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে…আমরা এখন তাকে নিয়ে কী করব?”

নানী বলল, “আমরা তাকে গ্রামের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”

মহিলাটি বলল, “কীভাবে?”

“আমরা তাকে ছেঁড়া পালটার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেব-” নানী ভাঙ্গা মাস্তুলের সাথে লাগানো পালের দিকে ইঙ্গিত করল। এবং বলল, “এরপর ওটা দুদিক দিয়ে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাব।” এরপর সে তার নাতীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদুরা, অবশ্যই এ কাজে আমাদের সাহায্য করবে, তাই না?”

যুদ্ধাহত মৃত প্রায় লোকটির মস্তিষ্ক চিৎকার করার বার্তা পাঠাচ্ছে। কিন্তু আগুনের শিখা ও ধোয়ায় তার স্বরযন্ত্র এতটাই ঝলসে গিয়েছে যে, সেখান থেকে বাঁশির মতো চিকন আওয়াজ বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তার গলায় কেউ একজন হারমোনিয়াম-এর ভাঙ্গা বেলোজ (হাপর) বসিয়ে রেখেছে।

অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়-প্রায় এক কী দুই মাস আগেও যখন সে সমুদ্রের ঝড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়াত, তখন তার দৃঢ় ও শক্ত মুখভঙ্গির কাছে সমুদ্রের বাতাস আর গর্জনও বোধহয় ভয়ে কুঁকড়ে যেত। তীব্র বাতাসও তখন তার কাছে কিছুই মনে হত না। আর এখন যখন খোলা জানালা দিয়ে তার ঘরে জেসমিন সুরভিত উষ্ণ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে, তার গায়ে কেউ কাঁটা ফুটিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রোগীর ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। তবুও ব্যথা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে বারবার। ডাক্তার যখন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার মুখ থেকে ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছিল তখন তার মনে হচ্ছিল যেন শক্রর ধারালো ছোঁড়ার আঘাতে সে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে। এছাড়াও প্রতিমুহূর্তে তার মনে ভেসে উঠছে যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। আগুনের লেলিহান শিখা। গুলির আওয়াজ, কাঠ পোড়ার শব্দ। আহত মানুষের তীব্র আর্তনাদ।

.

“আমি দুঃখিত! কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই,” ডাক্তারটা বিড়বিড় করে বলল। যদিও যার সঙ্গে সে কথা বলছে সে আরবি ভাষা খুব একটা ভাল বুঝতে পারে না। ডাক্তারের দাড়িগুলো পাতলা ও রুপালি রঙের এবং চোখের নিচে অনেকটা অগভীর গর্ত হয়ে গিয়েছে। সে তার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনের সাধনা ও সুনিপুণ নৈপুণ্য দিয়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছে তা যে কোনো রোগীকে আশ্বস্ত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই রোগীটি ব্যতিক্রম। তার আঘাত এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সে বাঁচবে, এই আশা ছেড়েই দেয়া হয়েছিল। তাকে একটা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল পুরোটা সময়। লোকটার একটা বাই পুরোপুরিভাবে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। কেবল পরম করুণাময় আল্লাহই জানেন কিভাবে এটা হয়েছে। একইপাশে বক্ষপিঞ্জরে শক্ত কোনো কুঠার বা অস্ত্র দিয়ে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে যে, বুকের অনেক হাড় ভেতরের দিকে বসে গিয়েছে। তার শরীরের বেশিরভাগ চামড়া পুড়ে গিয়েছে, সেই সাথে ফোঁসকা পড়ে গিয়েছে পুরো শরীরে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে যে ফুলের সুবাস আসছে তা এই পুড়ে যাওয়া মাংস, পচে যাওয়া চামড়া ও পুঁজের গন্ধের কাছে মিইয়ে যাচ্ছে।

আগুনে তার হাত-পায়ের চামড়াও পুড়ে গিয়েছে। তার বেঁচে যাওয়া হাতটাতে দুটো আঙুল এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে বিন্দুমাত্র মাংসও হাড়ের সাথে লাগানো ছিল না। ডাক্তারকে পরে সে অংশটুকুও কেটে ফেলতে হয়েছে। সামুদ্রিক শকুন তার বাম চোখটা উপরে ফেলেছে। অন্য চোখের পাপড়িগুলোও এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে, সে এখন শীতল দৃষ্টিতে চোখের পলক ফেলা ছাড়াই তাকিয়ে থাকতে পারছে।

কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হারানোটাই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়। তার পুরুষাঙ্গ এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে, সেখানকার চামড়ায় ক্ষতচিহ্ন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ, যদি সে কখনও বিছানা থেকে উঠতে পারে, তবে তাকে মহিলাদের মতো বসে মূত্রত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীলোকের সঙ্গম উপভোগ করার কোনো রাস্তাই আর তার সামনে খোলা রইল না।

শুধু উপরওয়ালার ইচ্ছাতেই সে এখনো বেঁচে আছে। ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর নিজে নিজে মাথা নাড়াল। ব্যান্ডেজ খোলা অবস্থায় ক্ষতটা দেখেই সে আন্দাজ করতে পেরেছিল-আল্লাহ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না। তিনি সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময়। এটা নিশ্চয়ই কোনো শয়তানের কাজ। তার পেছনে যে দানবটা লেগেছিল সেটা নিশ্চয়ই কোনো মানুষরূপী শয়তান ছিল। সেই শয়তানটাই নিশ্চয়ই একে এত কষ্ট দিচ্ছে। শয়তানের এই কাণ্ডকারখানা বন্ধ করে দেয়া ডাক্তারের জন্য এক মুহূর্তের ব্যাপার।

ডাক্তারের কাছে এক ধরনের মিষ্টি সিরাপ জাতীয় ওষুধ আছে। সেই ওষুধ যদি রোগীকে খাওয়ানো হয়, তবে তা ব্যথা কমিয়ে দেবে, সেই সাথে ধ্বংস করে দিবে নীরব ঘাতক ব্যাধি। এরপর নারীর কোমল স্পর্শের মতো তার হৃদস্পন্দন চিরতরে বন্ধ করে দিবে। কিন্তু ইথিওপিয়া থেকে মহারাজা সাদিক খান জাহান নিজ হাতে আদেশ লিখে পাঠিয়েছেন যেন এই রোগীকে জানজিবার-এ অর্থাৎ মহারাজার ব্যক্তিগত বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সে জন্যই, এই ব্যক্তির বিষেশ যত্ন নেয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।

মনে হচ্ছে জাহান একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছেন-যে ব্যক্তির পুরো শরীর আগুনে পুড়ে গিয়েছে, যার এক হাত বাহু পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে, সেই সাথে উপড়ে নেয়া হয়েছে একটি চোখ, দীর্ঘসময় ধরে যে মানুষটা পানিতে ডুবেছিল, এবং অবশেষে বালুকাবেলায় দুইজন কিশোর কর্তৃক আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে ব্যক্তি দিনের পর দিন তীব্র রোদে পুড়ে দগ্ধ হয়েছিল, তার বেঁচে থাকার পেছনে অবশ্যই স্বর্গীয় হাত রয়েছে।

ডাক্তারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই রোগী বেঁচে গেলে তাকে তার ধারণার চেয়েও বেশি পুরস্কার দেয়া হবে কিন্তু রোগী যদি মারা যায় তবে তার শাস্তিটাও এর চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। সে তার এই দীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে বহু রোগীকে তাদের সীমাহীন কষ্ট থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এটা অন্য সব কিছুর চেয়ে আলাদা। রোগীটিকে বেঁচে থাকতে হবে। আর এটা অবশ্যই ডাক্তারকে নিশ্চিত করতে হবে।

লোকটি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে চারপাশের আলোকিত জগৎ সে অনুধাবন করতে পারছে না। শুধু ডাক্তার যখন ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে তখন সে কেবল কয়েকটা আলোকরশি দেখতে পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে আরো বুঝতে পারছে, যে আলোক রশিাগুচ্ছ তার মস্তিষ্কে যাচ্ছে, সেগুলো আসছে ডান চোখ দিয়ে, বাম চোখ দিয়ে নয়। তার বাম চোখ পুরোপুরিই অন্ধ। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বাম চোখটি এখনো চোখের জায়গাতেই রয়েছে। ওখানকার স্নায়ুগুলো এখনো চোখের অস্তিত্বকে ভুলতে দিচ্ছে না। সে চোখের পলক ফেলতে চাচ্ছে কিন্তু শুধু ডানচোখের পাতাই কেবল তার সে ইশারায় সাড়া দিচ্ছে। বাম চোখ মোছার জন্য সে তার বাম হাতটি উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাম হাতটিও হাতের জায়গায় নেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে ভুলে গিয়েছিল যে সে তার বাম হাতটিও চিরতরে হারিয়েছে। চোখের স্নায়ুগুলোর মতো হাতের স্নায়ুগুলোও একই রকম চুলকানির মতো অনুভূতি মস্তিষ্কে নিয়ে যাচ্ছে। একারণেই তার মনে হচ্ছে যে বাম হাতটি এখনো হাতের। জায়গায়ই রয়েছে। সে তার ডান হাতটি উঠানোর চেষ্টা করে কিন্তু শুষ্ক ও শক্ত কোনো হাত তার ডান হাতটি ধরে রেখেছে। সে ডাক্তারের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার কি বলছে তার একটি কথাও সে বুঝতে পারছে না।

সে বুঝতে পারল তার ডান চোখের ওপর কেউ একজন ঠাণ্ডা কিছু একটা চেপে ধরে আছে এবং আস্তে আস্তে তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। যখন এটা উঠিয়ে ফেলা হল, সে তার দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে ফিরে পেতে শুরু করল। সে খোলা জানালা দেখতে পেল। জানালার পেছনে খোলা আকাশ দেখতে পেল। সে আরও দেখতে পেল সাদা রঙের আলখাল্লা ও পাগড়ি পরিহিত একজন বয়স্ক লোক তার পাশে বসে আছে, যে কি-না এক হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে এবং অন্য হাত দিয়ে তা সরিয়ে নিচ্ছে।

এছাড়াও কামরার মধ্যে অন্য একজন লোক রয়েছে। একজন অল্পবয়স্ক যুবক ডাক্তারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা, গায়ের রঙ সব ইস্ট ইন্ডিস-এর লোকদের মতো। কিন্তু তার পোশাক পরিচ্ছদ, স্টাইল সব ইউরোপিয়ানদের মতো। তার বংশে হয়ত কোনো সাদা রক্তের মিশ্রণ রয়েছে। তার গায়ের রঙে এশিয়ানদের বাদামি বর্ণের সাথে ধূসর গোলাপি রঙের আমেজ মিশে গিয়েছে।

বিছানায় শোয়া রোগীটি যুবক ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি কী ইংরেজি বলতে পার?”

তার একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছিল না শুধু ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সে তার ডান হাত দিয়ে ইশারা করে ছেলেটিকে আরও কাছে যেতে বলল। ছেলেটিও খুব সতর্কতার সাথে তা করল।

“তুমি ইংরেজি বলতে পার?” বিছানায় শোয়া রোগীটি আবার বলল।

“হ্যাঁ স্যার, আমি পারি।”

“তাহলে এই ব্যায়াদব আরব লোকটাকে বল…” সে আবারো নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য থামল। মনে হচ্ছে যেন তার বুকের খাঁচা বাতাসের অভাবে চুপসে গিয়েছে। … যাতে সে আমার ব্যান্ডেজ উঠানোর সময় এত আলগা দরদ না দেখায়…” লোকটা আবার থামল নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। মনে হল সে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। “…যত দ্রুত সম্ভব এই জঘন্য জিনিসগুলো সরাতে বলল ওকে…”

কথাগুলো আরবিতে ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলা হল। ফলে ডাক্তারের ব্যান্ডেজ খোলার গতি আরও দ্রুত হল। সে খুব তাড়াতাড়ি শক্ত হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল।

যদিও ব্যথা বাড়ছে, কিন্তু বিছানায় শোয়া লোকটি তার এই মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে একধরনের পাশবিক আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে নিজেকে বোঝাল যে এটাও একটা বাধা। সমুদ্র বা বাতাস এর সাথে এটার কোনো পার্থক্য নেই। এই বাধাটাকেও দমন করে তার আয়ত্তে আনতে হবে, কোনোভাবেই এটার কাছে হেরে যাওয়া যাবে না। তার শরীর থেকে রক্তমাখানো ব্যান্ডেজ-এর শেষ তন্ত্রটা উঠানোর আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। এরপর বলল, “তাকে বল আমার সামনে একটা আয়না নিয়ে আসতে।”

ডাক্তারের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। সে ডাক্তারকে কথাটা জানাল। ডাক্তার মাথা ঝাঁকাল, এরপর অস্পষ্ট এবং উচ্চস্বরে খুব দ্রুত কিছু একটা বলতে লাগল। যুবক ছেলেটি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে ডাক্তারকে বোঝনোর চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না।

অবশেষে সে বিছানার কাছে এসে লোকটিকে জানিয়ে দিল, “স্যার, সে বলেছে যে সে এটা করতে পারবে না।”

“তোমার নাম কী?” আহত লোকটি জিজ্ঞেস করল।

“এলথুদা, স্যার!”

“আচ্ছা, ঠিক আছে এলথুদা, তুমি এই হারামজাদা শয়তানটাকে বল যে আমি ওমান-এর রাজা আহমেদ এল গ্রেং এবং গ্রেট মোগল-এর ছোট ভাই মহারাজা সাদিক খান জাহান-এর সহযোদ্ধা ছিলাম। আমি তাদের জন্য যা করেছি তারা দুজন অবশ্যই সেটার মূল্য দিবে। তারা যদি জানতে পারে যে সামান্য একজন বৃদ্ধ শল্যচিকিৎসক আমার কথা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তবে সে তার যথার্থ প্রাপ্যটাই পাবে। ওকে তুমি শেষবারের মতো বল, সে যাতে আমাকে একটা আয়না এনে দেয়।”

উত্তেজিত হয়ে এতক্ষণ কথা বলার পর লোকটি আরও ক্লান্ত হয়ে গেল। বালিশের ওপর মাথাটি ছেড়ে দিয়ে সে দেখতে লাগল যে তার কথাগুলো ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলা হচ্ছে কি-না। সে দেখল কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তারের আচরণ হঠাৎ করেই বদলে গেল। সে মাথা নিচু করে বিছানায় শোয়া লোকটিকে কুর্নিশ জানাল, এরপর তৃরিত গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, তারপর উজ্জ্বল ফ্রেম-এ বাধাই করা একটা বড় গোলাকার আয়না নিয়ে ফেরত এল। আয়নাটি বেশ বড়, তাই সে এলথুদাকে সাহায্য করতে বলল, যাতে আয়নাটা আড়াআড়িভাবে বিছানার ওপর শোয়া লোকটির মুখের সামনে ধরা যায়।

আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য লোকটি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। উঠে যাওয়া বাম চোখের আইরিশ মরে একেবারে নীল হয়ে গিয়েছে। এর চারপাশে থকথকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাম চোখের নিচের গাল-এর চামড়া ও মাংস এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে দাঁত ও ম্যান্ডিবল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ডান কানের উপরে চুল পুড়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। মাথার কিছু অংশের চামড়া পুড়ে গাছের খোলসের মতো উঠে গিয়েছে। তাকে দেখতে অনেকটা পচে যাওয়া মৃতদেহের মতোই লাগছে। কিন্তু এরপরেই লোকটা আপনমনে ভাবতে লাগল-তাকে দেখতে আর কেমনই বা লাগা উচিত যেখানে তার বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না? অথচ এক সময় সে জীবনের ওপর দিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে বেঁচে ছিল। যখন যা মন চাইত তাই করত। আনন্দে ডুবে থাকত সবসময়। মদ খেত, জুয়া খেলত, ফুর্তি করত, যুদ্ধ করত। কিন্তু এখন সবকিছু তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার শরীর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তার হৃদপিণ্ড কবরের মতো নীরব হয়ে গিয়েছে। যদিও এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তার ভেতরে এখনও একটা শক্তি কাজ করছে যেটা তাকে আরো একটিবার উঠে দাঁড়াতে এবং সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিতে ক্রমাগত প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

লোকটি এলথুদার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তুমি কী আমার নাম জান?”

“না, স্যার।”

লোকটির থেতলে যাওয়া মুখে এক ধরনের হাস্যকর মুখভঙ্গি ফুটে উঠল। “তাহলে তো তোমাকে আমার নাম বলতেই হয়। আমি অ্যাংগাস কোকরান। একজন গর্বিত স্কটম্যান। আমার উপাধি ছিল আর্ল অফ কুম্বা।”

এলথুদার চোখ এত বড় বড় হয়ে গেল যে সে যেন ভয়ঙ্কর কিছু দেখছে। “আপনি… আপনিই সেই ব্যক্তি যাকে বুজার্ড নামে ডাকা হতো।”

“হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি। তুমি যদি সেটা জান তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জান যে, আমার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। হাল কার্টনি নামে এক ইংরেজ যুবক। আ-হা…! তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি যে তুমি আমাকে ভালভাবেই চিনতে পেরেছ, তাই না?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“আমি তোমাকে আরও বলে রাখি, যেভাবেই হোক এই হাল কার্টনিকে আমি খুঁজে বের করবই। সে যেখানেই থাকুক আর আমাকে যত দূরেই যেতে হোক। আমি তাকে ধ্বংস করেই ছাড়ব। তার রক্তে আমি আমার ঠোঁট রাঙাব।”

*

উত্তর-পূর্ব ইথিওপিয়ার কেবাসা ভূমির সর্বত্র যুদ্ধের ধামামা ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্য উঠার পর থেকে দিনের শেষ আলোকরশ্মিটি দেখা না যাওয়া পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলেছে। এখন যুদ্ধের ধামামা থেমে গিয়েছে, কিন্তু তার বদলে বিজয়ীদের হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে বাতাসে ভেসে আসছে পরাজিত শত্রুদের ক্ষমা প্রার্থনার আর্তনাদ। আহত যযাদ্ধাদের হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র। ক্রিশ্চিয়ান ইথিওপিয়ান সৈনিকেরা তৃতীয় বারের মতো মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে গ্রেট মোগল-এর নির্দেশেই। প্রথম দু’বারের যুদ্ধে তারা জিতলেও ওগুলোতে তাদের ভিত নড়ে উঠেছিল, সেই সাথে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কা জেগেছিল তাদের মনে। কিন্তু এবারের বিজয় তাদের কাছে পরিপূর্ণতা নিয়ে হাজির হয়েছে। শত্রু ঘটির মূলোৎপাটন করা হয়েছে। অস্ত্র-সরঞ্জামসহ যেসব রণতরী ইরিত্রিয়ান উপকূল দিয়ে রেড সী অতিক্রম করতে চেয়েছিল সেগুলোকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ কাজের নেতৃত্ব দিয়েছে গোল্ডেন বাউ নামক ইংরেজদের জাহাজ। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই গোল্ডেন বাউ সাগরে ভাসানো হয়েছিল। কিন্তু এর ক্যাপ্টেন জাহাজটাকে স্বাধীনতা রক্ষা, ইথিওপিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ বা সম্পদ এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী দেশসমূহকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে টেবারনেও রয়েছে সেখানে যিশু খ্রিস্ট মাউন্ট জিউন থেকে পাথর এনে রেখেছিল এবং ধারণা করা হয় হলি গ্রেইলও সেখানে রাখা আছে।

ইথিওপিয়ান লাইনের পেছনে বিশাল এক তাবু গড়ে উঠেছে। ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ ও বর্ম পরিহিত এক দল সৈনিক এটার প্রবেশপথ পাহারা দিচ্ছে। তাঁবুর ভেতরে ট্যাপেস্ট্রিতে খ্রিস্টের জীবনী সমৃদ্ধ বিভিন্ন দৃশ্য শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন রঙের সিল্কের সুতা দিয়ে এগুলো বোনা হয়েছে। অসংখ্য মোমবাতি ও মশালের আলোতে ওগুলো চকচক করছে।

তাবুর মাঝখানে টেবিলের ওপর যুদ্ধক্ষেত্রের একটা মডেল বা মানচিত্র রাখা আছে। পাহাড়, নদী, হ্রদ সমুদ্র, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী মডেলের নির্দিষ্ট জায়গায় এগুলোকে দেখানো হয়েছে। আইভরি পাথর দিয়ে তৈরি অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত যে সৈন্য, অশ্বারোহী এবং ছোট ছোট কামান-এর মডেল এখানে দেখানো হয়েছে সেগুলো দ্বারা যথাক্রমে পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী এবং আর্টিলারি ইউনিটকে বোঝানো হয়েছে। দিনের শুরুতে মডেলগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই বাহিনীর অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছিল, কিন্তু এখন আরব সৈন্যদের সংখ্যা কমতে কমতে টেবিল থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

তাঁবুর পরিবেশ এখন বেশ শান্ত রয়েছে। লম্বা আলখাল্লা পরিহিত একজন যাজক সিনিয়র এক অফিসারের সাথে ঠাণ্ডা আলোচনায় মশগুল রয়েছেন। তার ধূসর রঙের দাড়ি হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে, গলায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন মণিমুক্তা খচিত পুঁতির মালা ও মেডেল। লোকটির মৃদু মন্থর গলার স্বর টেবিলের আশপাশ থেকে আসা উত্তেজনার মাঝেও আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে।

“ব্যাং! ব্যাং! টেইক দ্যাট!” একটা ছোট ছেলে চিৎকার করে উঠল। তার হাতে ইথিওপিয়ান যোদ্ধার একটি ছোট্ট মূর্তি যেটা স্ট্যালিয়ন-এর ওপর বসে ছিল। ছেলেটা মূর্তিটাকে একবার টেবিলের একপাশে, পরমুহূর্তে আবার অন্যপাশে নিয়ে যাচ্ছে। এখনো যে সব আরব সৈন্যের মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোকে ছোট্ট স্ট্যালিয়ন আরোহীর সাহায্যে ফেলে দিচ্ছে সে।

গার্ড তাবুর প্রবেশ পথের পর্দাটা সরিয়ে দিলে একজন সৈন্য সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল যার ইউনিফর্মে বুকের ওপর সাদা রঙের লিলেন কাপড় ও বিভিন্ন ধাতব চেইন লাগানো রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এগুলো দেখেই বোঝা যায় যে কোনো রকম নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে এগুলো পরানো হয়নি। অন্য কোনোরকম বিশেষত্ব আছে এগুলোর।

“জেনারেল নাজেত!” ছোট্ট ছেলেটি চিৎকার করে উঠল। এরপর ছেলেটি তার খেলনা সৈন্যটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে আগন্তুকের ধাতব পোশাক পরিহিত পা জড়িয়ে ধরল-যে পোশাকে এখনো শত্রুর রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে আছে। সেও ছোট্ট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে দেখে মনে হচ্ছিল, ছেলেটি তার মায়ের নরম আলিঙ্গনে রয়েছে।

জেনারেল তার মাথা থেকে হেলমেটটি সরিয়ে ফেললে ঘন কালো কোকড়া চলগুলো বের হয়ে এল। জেনারেল যখন তাঁর মাথাটা এদিক ওদিক নাড়া দিল, তার কোকড়া চুলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে আন্দোলিত হতে লাগল। মোমবাতির আলো যখন তার কোঁকড়া চুলগুলোর ওপর পড়ল, তখন দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্ণালি আভা বিকিরিত হচ্ছিল ওখান থেকে। তার চেহারাই বলে দিচ্ছিল যে যুদ্ধের ক্লান্তি বা বিষণ্ণতা কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

নতস্বরে বলা শুরু করল সে, “ইউর মেজেসটি, আপনাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। শত্রু ভূপাতিত হয়েছে, সেই সাথে তাদের বাকি সৈন্যগুলো পালিয়েছে।”

ক্রিশ্চিয়ান অধিপতি, রাজাদের রাজা, গালা ও অ্যামহারার স্বত্বাধিকারী এবং খ্রিস্টীয় ক্রুসিফাইড-এর প্রতিরক্ষাকারী আইয়াসু, জেনারেল-এর পা ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল, এরপর আনন্দের আতিশয্যে উপরে-নিচে লাফাতে লাগল, সেই সাথে চিৎকার করতে লাগল। মিলিটারির সদস্যরা এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক এবং কাঁধে মৃদু চাপ দেয়ার মাধ্যমে তাদের কমরেডকে ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে অভিবাদন জানাল, একই সাথে সেখানে উপস্থিত যাজক হাত তুলে তাকে আশির্বাদ করল।

জেনারেল নাজেত শান্তভাবে মৃদু হাসি দিয়ে সবার ধন্যবাদ ও অভিনন্দন গ্রহণ করল। “মহারাজ, এখন আমি আপনার কাছে কিছু একটা চাইব। এর পূর্বে আমি কমান্ডার হিসেবে আপনার বাহিনী থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দেশ এবং আমার রাজ্যের টানে তখন আমি যেতে পারিনি। আমার বিবেক তখন আমাকে যেতে দেয়নি। তাই তখন আমি সৈনিকের পোশাক পরে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু মহারাজ, আমি শুধুই একজন সৈন্যই নই, একজন স্ত্রীলোকও বটে, যে একজন পুরুষের আমানত। সে তখন আমাকে আপনার আদেশ পালন করার অনুমতি দিয়েছিল। আর এখন, আমি আপনার কাছে অনুমতি চাইছি তার কাছে ফিরে যাবার।”

ছেলেটি তার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে চিন্তা করার পর বলল, “সেই লোকটি কী ক্যাপ্টেন কার্টনি?”

“হ্যাঁ, মহারাজ”, জুডিথ নাজেত জবাব দিল।

“গাছের পাতার মতো সবুজ রঙের চোখওয়ালা সেই ইংলিশ লোকটা?”

“ইয়েস, ইউর মেজেসটি। আপনার কী মনে আছে তার সাহস ও কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আপনি তাকে ‘গোল্ডেন লায়ন অফ ইথিওপিয়া হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, আমার মনে আছে” চেহারায় একটা অপ্রত্যাশিত দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে আইয়াসু জবাব দিল। এরপর সে আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী মাম্মি এবং ড্যাডি হতে যাচ্ছ?” ছোট্ট বালক রাজা ঠোঁটের ওপর ঠোঁট তুলে মুখ বাকা করে বোঝার চেষ্টা করল কেন সে এত কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ কেনই বা তার এত দুঃখ লাগছে। এরপর সে আবার বলল, “আমার যদি একটা মাম্মি এবং ড্যাডি থাকত। যদি তুমি এবং ক্যাপ্টেন কার্টনি চলে এসে প্রাসাদে থাক তাহলে আমি একটা মাম্মি এবং একটা ড্যাডি পেতাম।”

“এখন এসব থাক মহারাজা, আমার মনে হয় না…” যাজক বলতে শুরু করল। কিন্তু ছোট্ট মহারাজার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ জেনারেল নাজেত-এর দিকে। নাজেত ছেলেটির খুব কাছে চলে এল, এরপর হাত দিয়ে টেনে জড়িয়ে ধরল।

আইয়াসু দ্বিতীয় বারের মতো জেনারেল নাজেত-এর কাছে গেল। কিন্তু এবার আর রাজা হিসেবে নয়, একজন সন্তান যেভাবে মায়ের কাছে যায়, ঠিক সেভাবে গেল।

“আমি আপনার পাশেই আছি,” নাজেত ওকে বোঝাতে শুরু করল “কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে আপনি কার্টনির জাহাজ দেখতে চলে আসবেন। কী আসবেন না?”

ছোট্ট বালক জোরে জোরে হা-সূচক মাথা ঝাঁকাল।

“আপনি চাইলে কামানের গোলাও ফোঁটাতে পারেন। আপনার ভালই লাগবে,” নাজেত আবার বলল।

নাজেত টের পেল যে আইয়াসু তার কাঁধে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় মাথা নাড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে আইয়াসু তার মাথা সোজা করল, এরপর খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল, “তুমি ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে অনেক দূরে ভেসে যাবে তাই না?”

“হ্যাঁ, মহারাজা, আমাকে যেতে হবে।”

“প্লিজ, যেও না।” সে বলল, তারপর সে দৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “আমি তোমাকে আদেশ করছি তুমি যাবে না। তোমাকে আমার আদেশ মানতে হবে। তুমি বলেছিলে মানবে।”

এরপর ছোট্ট মহারাজা আরেকবার কাঁদতে কাঁদতে নাজেত-এর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। পাদরী এক-পা এগিয়ে এল তার ছোট্ট সাহেবটাকে বাধা দিতে। কিন্তু নাজেত তাকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল। “এক সেকেন্ড বিশপ, আমাকে এর সমাধান করতে দিন।”

সে আইয়াসুকে খানিকক্ষণ কাঁদতে দিল। কিছুক্ষণ পর সে তার চোখের পানি এবং নাক মুছে দিল। এপর সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন আপনাকে আমি অনেক পছন্দ করি। তাই না মহারাজা।”

“এখন আমি যেখানেই যাই, যত দূরেই যাই, আমি সব সময় আপনাকে মনে রাখব। আপনার কথা ভাবব। এখন মনে করুন আমি যদি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স এরকম দূরের কোনো দেশে যাই তাহলে আমি অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখতে পাব। আর যদি আমি দেখতে পাই তাহলে সেগুলো সম্পর্কে আপনাকে লিখে জানাতে পারব।”

“তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি আমাকে চিঠি লিখবে।”

“একজন সৈনিক হিসেবে আমি আমার মহারাজাকে কথা দিচ্ছি।”

“আর যদি আমি ক্যাপ্টেন কার্টনির জাহাজে যাই তাহলে সে কী আমাকে কামানের গোলা ফোঁটাতে দেবে?”

“আমি তাকে আদেশ করব। আমি জেনারেল আর সে সামান্য ক্যাপ্টেন মাত্র। আমার আদেশ তাকে মানতেই হবে।”

মহারাজা আইয়াসু কিছুক্ষণ চিন্তা করল, এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর সে জুডিথ-এর দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “বিশপ ফেসিলাইডস, আপনি কী দয়া করে জেনারেল জুডিথ নাজেতকে বলে দিবেন যে আমি তাকে যাবার অনুমতি দিয়েছি?”

*

আর্ল অফ কাম্বারল্যান্ড জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর-এর নামানুসারে যারা ইস্ট ইন্ডিস-এর লোকদের সাথে বাণিজ্য করেছিল। জাহাজটি চল্লিশ দিন পূর্বে বোষে (মুম্বাই) থেকে ছেড়ে যায় ১০০ টন খনিজ পদার্থ নিয়ে। লন্ডনের বন্দরে গিয়ে এটি নোঙর ফেলবে। সেখান থেকে খনিজ পদার্থগুলো নিয়ে যাওয়া হবে গ্রীনিচ প্যালেস-এর অস্ত্রাগারে। সেখানে এই মিনারেলগুলো সালফার ও কয়লার সাথে মিশিয়ে গান-পাউডার তৈরি করা হবে। সেই গান পাউডার সরবরাহ করা হবে চার্লস-টু-এর আর্মি এবং নেভীতে।

জাহাজের পেছন দিকে যেখানে ক্যাপ্টেন-এর থাকার ঘর সেখানে আরও কিছু কেবিন রয়েছে সিনিয়র অফিসার এবং গুরুত্বপূর্ণ যাত্রীদের থাকার জন্য। এরকমই একটা কেবিনে এক লোক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে দুই হাত জড়ো করে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে।

তার নাম উইলিয়াম পেট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিনিয়র অফিসার হিসেবে সমস্ত কাগজপত্র সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, ফলে কোম্পানির কাজে কোম্পানির যে-কোনো কর্মচারী তাকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে।

বোম্বের (মুম্বাইর) প্রথম গর্ভনর জেরাল্ড আংগিয়ার-এর আমন্ত্রিত এক ডিনারে পেট আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর নাবিক ক্যাপ্টেন রুপার্ট গোডিংস-এর সাথে আলোচনায় মগ্ন রয়েছে। সে এখন তাকে ব্যাখ্যা করছে যে ইন্ডিয়ায় তার কাজকর্ম সমাপ্ত হয়েছে। কাজটা অনেক সূক্ষ্ম এবং কঠিন ছিল, বিশেষ করে প্রসিদ্ধ ইন্ডিয়ান এবং পর্তুগীজ লোকদের সাথে উঠাবসা করা, টাকা-পয়সা আদান-প্রদান করা। যদিও এ ব্যাপারে খুব খোলামেলা আলাপ করার স্বাধীনতা তার নেই।

“পৃথক হয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন,” পেট অন্য লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল।

গোডিংস খুব লম্বা মোটাসোটা, উচ্ছ্বসিত এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তার নাকের নিচে কালো ঘন গোঁফ বেঁকে ঠোঁটের কোণ থেকে একটু উপরে উঠে গিয়েছে। এই গোফের কারণে তাকে আরও তরুণ লাগছে এবং প্রকৃত বণিক হিসেবে তার সমাদর বেড়েছে। তাকে একজন দক্ষ নাবিকই বলা যায়। এটার কারণ তার অসীম সাহসিকতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনোভাব। যদিও তার কাছের বন্ধুরা এটা মেনে নিতে নারাজ। লোকটা তার চেহারায় খুব চিন্তিত একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে জবাব দিল, “অবশ্যই, অবশ্যই…আমার মতে পর্তুগীজ এবং ইন্ডিয়ানরা খুব একটা সুবিধার না। এরা হচ্ছে সুস্বাদু খাবারের মতো। কিছু সময়ের জন্য রক্ত গরম করে।”–

“তাদের সাথে আমার যে কথাবার্তা হতো আমি প্রতিনিয়ত তার প্রোগ্রেস রিপোর্ট পেশ করতাম,” পেট বলতে লাগল। কিন্তু এখন যেহেতু তাদের সাথে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিরেক্টর-এর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতে হবে।”

‘বুঝতে পেরেছি। জন কোম্পানির যত দ্রুত সম্ভব সব কিছু জানা দরকার, তাই তো? আমার তো মনে হয়, তোমার জন্য সসেজ-এ একটা শোয়ার মতো বেঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে।”

অন্যমনস্কতার কারণে কথাটা বুঝতে পারলো না পেট। “আমি দুঃখিত ক্যাপ্টেন। সসেজ কী? আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।”

গোডিংস হাসতে হাসতে বলল, “ওহ্! দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম তুমি জানো। কাম্বারল্যান্ড জাহাজের অপর নাম এটা। তারা এখানে সসেজ বানায়। আমি নিজে একজন ডেভোনশায়ার-এর লোক। যাই হোক এই কারণেই আর্ল অফ কাম্বারল্যান্ড-এর নাম সসেজ। আমি খুব অবাক হলাম যে, কোম্পানির লোক হিসেবে তুমি এটা জান না।”

“আসলে আমি সবসময় অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু আপনার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। আমি খুবই খুশি হব যদি জাহাজে একটা বেঞ্চ পাই। আর যাত্রার খরচ বহন করার মতো টাকা আমার কাছে আছে। ষাট গিনিতে হবে না?”

“অবশ্যই হবে”, গোডিংস বলল এবং নিজে নিজে ভাবতে লাগল যে মি. পেট-এর ব্যাপারে কোম্পানির আরও মনোযোগ দেয়া উচিত। তাকে আরও সুযোগ সুবিধা দেয়া উচিত। “উপরে চল।”

পেট হাসল, সে মনে মনে ভাবছে, গোডিংসকে খুন করার জন্য তাকে যে পাঁচশ গিনি অফার করা হয়েছে সেটা উপার্জন করা এখন কতই না সহজ হয়ে গেল! অনেক নির্বোধ লোককে পেট যেরকম দেখেছে গোডিংসও তার ব্যতিক্রম নয়-সেও নিজেরই নির্বুদ্ধিতার শিকার। এরকম অজ্ঞতা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। গোডিংস মনে করছে যে ডিরেক্টর-এর অল্পবয়সি সুন্দরী বউ-এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে সে ডিরেক্টরকে ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সে বুঝতে পারবে যে কত বড় ভুল সে করেছিল।

আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর একেবারে উপরে উঠে পেট তার কাজ শুরু করার আগে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে নিজের ভারসাম্য রাখতে হয় এটা তাকে আরও ভালভাবে শিখতে হবে। জাহাজটা কিভাবে বানানো হয়েছে, কোথায় কোনটা আছে সেটা আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে হবে। বন্ধুত্ব, বৈবাহিক সম্পর্ক এবং জানা অজানা শত্রুর ব্যাপারে তাকে আরও সচেতন হতে হবে। এই সম্পর্কগুলো যাতে কোনোভাবে তার কাজে ব্যাঘাত না ঘটায়। সর্বোপরি, সে অদৃশ্য এক সংকেত এর জন্য অপেক্ষা করছে, যে সংকেত ছাড়া সে হত্যা করতে পারবে না। স্বর্গীয় এ সংকেত তার মস্তিষ্কে প্রেরিত হলেই সে বুঝতে পারবে যে তার হত্যা করার সময় এসেছে। ওর মাথার ভেতর যে লোকটি কথা বলেছিল, সে তাকে বলেছিল, যেই লোকটিকে তার হত্যা করতে হবে, তার মতো লোকের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। স্বর্গীয় কণ্ঠটা এও বলেছিল যে, সে যদি এই লোকটিকে হত্যা করে তবে সে দুনিয়া থেকে কিছু পাপ মুছে ফেলতে পারবে।

পেট এখন প্রতিরাতে কেবিনের উপরের পাটাতন থেকে ঝুলন্ত এক কাঠের দোলনায় ঘুমায়। জাহাজ নড়াচড়ার সময় সে যাতে পড়ে না যায় এ কারণেই সে এরকম ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন সে তার দোলনার ন্যায় বিছানায় হাঁটুগেড়ে বসে ধ্যানমগ্ন হয়েছে। কারণ সে জানে যে সমস্ত ফেরেশতা এবং স্বর্গীয় দূতেরা সবসময় তার কাজকর্ম দেখাশোনা করছে। ধ্যানরত অবস্থা যতক্ষণ তার মধ্যে এই অলীক দৃষ্টি স্থায়ী হয়, ততক্ষণ সে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে যে আনন্দ সে কোনো নারীর সঙ্গের চেয়েও বেশি উপভোগ করে। যখন সে এই দৃষ্টি থেকে জেগে উঠে, তার মন এক ধরনের স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে থাকে এই ভেবে যে সে তার সৃষ্টিকর্তার জন্য কাজ করছে।

সে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে সামান্য একটা ছুরি, যেটা সে গোডিংস আর তার সিনিয়র অফিসারদের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার সময় তুলে নিয়েছে। ছুরিটাকে সে আবার শান পাথর দিয়ে ধারালো করে নিয়েছে, তাই এখন এটাকে আর সামান্য ছুরি বলা যায় না। বরং এটাকে এখন ড্যাগার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই শান পাথরটা সে জাহাজের একটা স্টোর রুম থেকে নিয়েছে। যখন পেট গোডিংসকে ছুরি দিয়ে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঠিক তখনই সে একটা ফন্দি এঁটেছিল। গোডিংস-এর সাথে জাহাজের এক কর্মচারীর সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল তার দুর্ব্যবহারের কারণে। সে যদি এরকম একটা ছুরি দিয়ে গোডিংসকে খুন করে তবে খুব সহজেই এর দায়ভার ওই কর্মচারীর ওপর বর্তাবে। কারও মনে সন্দেহ থাকবে না যে ওই কর্মচারী প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই এই কাজ করেছে। তার পক্ষে একটা কথা বলার মতো কোনো বন্ধুও বেচারা খুঁজে পাবে না। পেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে নিজেই ঐ বেচারার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। তবে সেটা পরের ব্যাপার সে তার ডান পকেটে ছুরিটা রেখে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এল, এরপর হেঁটে গিয়ে ক্যাপ্টেন-এর দরজায় কড়া নাড়ল।

“ভেতরে এসো”, গোডিংস ডাক দেয়। জাহাজের ভেতর ভিন্ন সংস্কৃতির দুজন মানুষের সন্ধ্যাবেলা ব্রান্ডি পান করতে করতে গল্প করাটা তার কাছে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না। সেই সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরোত্তর সাফল্য এবং সম্পদ বৃদ্ধির কথা নিয়ে গল্প করাটাও তার কাছে সঠিক বলেই মনে হয়।

দুজন লোক তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলছিল, সেই সাথে অনবরত মদ্যপান করছিল। যদিও পেট অপেক্ষা করছিল আঘাত হানার সুযোগের জন্য। অপেক্ষা করতে করতে একসময় সেই মোক্ষম সময় চলে এল। এরইমধ্যে গোডিংস মদ্য পান করতে করতে মাতালের একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। পেট সচেতনভাবেই গোডিংস-এর মতো এতটা মদ্যপান করেনি। সে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা কাঠের বক্স থেকে ব্র্যান্ডি বের করতে গেল। ঐ কাঠের বাক্সে ছয়টা আলাদা কম্পার্টমেন্টে বিভিন্ন স্বাদের ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ডি রাখা আছে।

গোডিংসও উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে পেটকে খেয়াল না করে মদ ঢলবার পাত্র খুঁজতে লাগল। ছুরিটা বের করে আস্তে আস্তে তার দিকে এগুতে লাগল পেট। যখনই গোডিংস-এর ডান পাশের কিডনিতে আঘাত করতে যাবে সে, তখনই গোডিংস ফিরে তাকালো।

কিন্তু এতেও পেট-এর কাজে কোনো বাধা পড়ল না। সে তার ভিক্টিম-এর প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা অভিব্যক্তি এবং প্রতিটা নিঃশ্বাস সম্পর্কে সচেতন। গাডিংস চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে তার কপালে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে। পেট এরই মধ্যে গোডিংস-এর পেটে পরপর তিনবার ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এরকম আকস্মিক ঘটনায় ক্যাপ্টেন এতই বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়েছে যে সে অ্যালার্ম বাজাতে বা ব্যথায় চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছে। তার বদলে সে পেটে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো নিচে বসে পড়ে হামাগুড়ি দিতে লাগল। তার সাদা ওয়েস্ট কোট রক্তে ভিজে গিয়েছে। তার মূত্রথলি খালি হয়ে গিয়েছে ভয়ে।

গোডিংস তার সর্বশেষ শক্তিবিন্দু দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করল। মদের পাত্রটা শক্ত করে ধরে পেট-এর দিকে নিক্ষেপ করল সে। কিন্তু সচেতন পেট নিজেক সরিয়ে নিল আগেই। গোডিংস-এর নিক্ষেপ করা পাত্র ডেস্ক-এর উপরে ঝুলানো লণ্ঠনে গিয়ে আঘাত করল। সাথে-সাথে লণ্ঠনটা ভেঙে এর সমস্ত তেল পড়ে গিয়ে দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ডেস্ক-এর ওপর কাগজ-পত্র ছড়িয়ে থাকাতে সেগুলোতে আগুন লেগে বার্নিশ করা কাঠে এবং মেঝেতে আগুন ছড়াতে খুব একটা সময় লাগল না।

পেট একটুও নড়ছে না। সে এখনো অবাক হয়ে ভাবছে যে সে কী করেছে। স্থবির হয়ে কেবিন-এর ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল সে। যদিও আগুন তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেই সাথে নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে তার। পালস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, ঠিক যেভাবে গোডিংস তার জীবনের শেষ সময় পার করছে এখন। অবশেষে, গোডিংস যখন তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল তখন যেন পেট-এর হুশ হলো। তার কাছে মনে হলো যেন সে অনেক গভীর একটা ঘুম থেকে উঠেছে। নড়াচড়ার জন্য প্রস্তুত হল সে।

পেট খুব ভাল করেই জানে সমুদ্রের ওপর আগুন কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আর…কোনো জাহাজে যদি খনিজপদার্থ বোঝাই করা থাকে, সেই সাথে কামানের গোলাতে গান-পাউডার ভরা থাকে, তবে সেটাকে বিশাল আকৃতির একটা বোমা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। এতক্ষণে ফিউজ-এর মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছে। এখন যে করেই হোক পেটকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড ত্যাগ করতে হবে-যত দ্রুত সম্ভব। তার মতো গোডিংস কাঠের ঝুলানো বিছানায় ঘুমাত। সে যত দ্রুত সম্ভব হুক থেকে কাঠের বিছানাটা খুলে ফেলল। এরপর সেটা জানালা দিয়ে বহু কষ্টে সমুদ্রে নিক্ষেপ করল যাতে সে ওটার ওপর ভেসে থাকতে পারে। এরপর সে নিজে জানালায় উঠে লাফ দিল।

গরম বাতাসের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে পড়ার পর তার বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে সে এখন কোথায় আছে। তার মনে হল সে ইন্ডিয়া এবং কেপ অফ গুড হোপ-এর বাইরে অন্য কোথাও আছে। সে এখনও বুঝতে পারছে না যে সে ভেসে থাকার জন্য আদৌও কাঠের বিছানাটা খুঁজে পাবে। এমনও হতে পারে যে এটা ঢেউয়ের সাথে অন্য কোথাও ভেসে গিয়েছে। সমুদ্র তার ভাগ্যে কী পরিণতি রেখেছে এটাও সে জানে না। তাকে হত্যা করার জন্য কেউ ওত পেতে আছে, নাকি তাকে খাওয়ার জন্য কোনো কিছু ওত পেতে আছে, সে জানে না। সবচেয়ে বড় কথা, সে নিজে সাঁতার কাটতে জানে না।

যাই ঘটুক না কেন, সেটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। উইলিয়াম পেট সেই অলৌকিক বাণীর জবাব দিয়েছে। সে যা করছে, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই করছে। সে কারণে কোনো কিছুই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

*

দিনের প্রথম আলোকরশ্মি যখন মিতসিওয়ার হারবার পোতাশ্রয় অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ব্রিটিশ দ্বীপের ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ সময় উড়িয়ে খুব গৌরবান্বিত হয়ে ইথিওপিয়ান যুদ্ধ জাহাজটা নোঙর করল। গোল্ডেন বাউ জাহাজটি তৈরি করা হয়েছে জর্জ ভিসকাউন্ট উইন্টারটন এর আদেশে-দুই হাজার পাউন্ড দামের অবিশ্বাস্য খরচে। উইন্টারটন এরই মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জাহাজ এবং যুদ্ধ-জাহাজ-এর মালিক হয়েছেন। বাউ তৈরির ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল তার প্রাণপ্রিয় পুত্র ভিনসেন্টকে একটা গ্রহণযোগ্য জাহাজ উপহার দেয়া। সমুদ্র ভ্রমণে তাদের যে পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে সেটা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই এটা তৈরি করা হয়েছে। আর এটা তৈরির মাধ্যমে ইংল্যান্ড-এর ভাগ্যে এক নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে।

সেই মাননীয় ‘ভিনী” উইন্টারটন এখন কেপ অব গুড হোপ-এর উত্তরে ইন্ডিয়ান সাগরের পাশে এলিফ্যান্ট লেগুন-এর উপকূলে শায়িত রয়েছেন। তাকে ডুয়েল লড়ার সময় নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। যদিও তার বাবা টাকা-পয়সা খরচে কোনো কার্পণ্য করেনি। এমনকি এই গোল্ডেন বাউ যেটা আফ্রিকান নেভীদের প্রধান যুদ্ধ জাহাজ ছিল সেটাও তার পুত্রের মৃত্যুর চেয়ে। বড় না।

গোল্ডেন বাউ দেখতে রেসের ঘোড়ার মতই সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর। সে, যে কোনো গতিতে পানি কেটে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। বাতাসের সাহায্য পেলে পাল ভোলা অবস্থায় ওটা যেকোনো যুদ্ধ জাহাজকে ধোকা দিয়ে পালিয়ে আসতে পারে, সেই সাথে তার চেয়ে বেশ কিছুদূর সামনে এগিয়ে থাকা জাহাজকে তাড়া করে ধরে ফেলত পারে খুব সহজেই। রেসের ঘোড়ার দক্ষ জকির মতো গোল্ডেন বাউও এমন একজন যোগ্য ক্যাপ্টেন পেয়েছে যে কি-না ভয়ংকর দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও গোল্ডেন বাউকে দৃঢ়তার সাথে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে অন্য যুদ্ধ জাহাজগুলো তাদের ভারসাম্য ধরে রাখতেই রীতিমত হিমশিম খায়।

গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে হাল কার্টনিকে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে; কখনো বা বায়ুহীন পথে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিশাল জলরাশির বুকে, কিংবা কখনো ভয়াবহ মেইলস্টর্ম-এর রাতে একাকী হাতে জাহাজটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে সম্পূর্ণ সাহস আর দৃঢ়তার ওপর ভর করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, জাহাজের পাটাতন থেকে শুরু করে রাডার পর্যন্ত সবকিছুই তার ভালভাবে চেনা আছে। হাল খুব পরিষ্কারভাবেই জানত যে কঠিন বিপদের সময় জাহাজটাকে কিভাবে চালিয়ে নিতে হয়। হাল জানত যে জাহাজ ভাসানোর সময় কিভাবে এর কামানের গান-পাউডারগুলোকে ব্যালেন্স করতে হয়। কেউ কেউ হয়ত দ্রুত চালানোর জন্য অল্প কিছু বন্দুকের ওপর নির্ভর করে আবার কেউ কেউ ফায়ার পাউডার এর ওপর নির্ভর করে। গোল্ডেন বাউ-এর গতি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট কামান এবং গান পাউডার মজুদ রেখেছে হাল কার্টনি। তার জাহাজে যে মাপের কামান থাকা দরকার ঠিক সেই মাপের কামানই সে বেছে নিয়েছে। এক বাক্যে, মারাত্মক সব অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং কামানের সংগ্রহশালা বলা যায় তার জাহাজটাকে। যে-কোনো শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য তার জাহাজ সদা সর্বদা প্রস্তুত। বাউ-এর বাহুগুলো যেমন দ্রুতগামী দাঁতগুলোও তেমনি শক্ত। আর এ কারণেই জাহাজটার ক্যাপ্টেন ওটাকে এতটা সম্মান ও প্রশংসার চোখে দেখে।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই, ক্যাপ্টেন যখন তার এতদিনের ভালবাসার জাহাজটাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল তখন সে চাইছিল ওটা যেন তার সেরা রূপেই থাকে। চারমাস আগে হাল যখন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সমুদ্রভ্রমণে বের হয় তখন জুডিথ নাজেত তার সাথে গোল্ডেন বাউতেই ছিল। কিন্তু তখন অপ্রত্যাশিতভাবে জুডিথের ডাক আসে রাজার কাছ থেকে-তাকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। জুডিথ যদিও খুব অল্প সময় জাহাজে ছিল, কিন্তু ওইটুকু সময়েই জাহাজের সমস্ত নাবিকের প্রশংসায় ভেসে গিয়েছিল সে। যুদ্ধক্ষেত্রে তার অবদান যেমন নাবিকদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল ঠিক তেমনি আকর্ষণ করেছিল তার অপার সৌন্দর্য। সে যখন তার তলোয়ার এবং বর্ম নামিয়ে রাখতে, কেবল তখনই তাকে পরিপূর্ণ এক মানবী বলে মনে হতো।

জুডিথ চলে যাওয়ার পর হাল তার লোকদেরকে জাহাজ মেরামত করার আদেশ দিয়েছিল। ক্যাপ্টেনের আদেশ পেয়ে তার লোকেরা জাহাজ মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়।

পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে কর্মচারীরা জাহাজের পাশে দড়িতে ঝুলে ঝুলে কাজ করেছে। ঘষে ঘষে প্রতিটা কাঠ পরিষ্কার করেছে, রং করেছে, পেরেক ইকেছে। এতদিনের পুড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া অংশ, রঙের দাগ, ছিঁড়ে যাওয়া পাল, প্রতিটা চিহ্ন বাউ-এর নাবিকেরা নিশ্চিহ্ন করেছে নতুনভাবে মেরামতের মাধ্যমে। জাহাজটার প্রতিটা কাঠের প্রতি নজর দেয়া হয়েছে। যেটা বদলানোর প্রয়োজন সেটা বদলানো হয়েছে। ঘষে ঘষে সবকিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। গ্রিজিং করা হয়েছে, আলকাতরা লাগানো হয়েছে, রঙ করা হয়েছে, যেখান দিয়ে পানি ঢুকার মতো সম্ভাব্য ছিদ্র দেখা গিয়েছে সেটা বন্ধ করা হয়েছে খুব ভালভাবে। তারা তাদের সম্মানিত অতিথিদের জন্য যতটুকু করা দরকার তার একটুও বাদ রাখেনি। তারা জাহাজের প্রতিটা বন্দুক, প্রতিটা কুঠার, প্রতিটা বর্শা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেছে চকচক করার আগ পর্যন্ত।

সব পরিষ্কার করা সম্ভব হলেও এক জায়গায় বিশেষ রক্তের দাগ পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত সেই রক্তের দাগ ছিল এক আরব সৈন্যের যার উরুতে গুলি লেগে রক্তনালী ছিঁড়ে যায়, এরপর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মাস্তুলের কাঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। কাঠ সেই রক্ত এমনভাবে শুষে নেয় যে কাঠের রংটাই বদলে যায়। হাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের সেই রক্ত মুছতে বলে। কিন্তু রক্ত এমনভাবে কাঠে লেগেছিল যে ঘষতে ঘষতে যখন কাঠের একটা পরদ উঠিয়ে ফেলা হলো তখনও রক্তের দাগ থেকে গিয়েছিল।

মিতসিবা হারবার পোতাশ্রয়-এর চারপাশটা বালির চর দিয়ে ঘেরাও করা। হাল তার লোকদের নির্দেশ দেয় সেই বালি উঠিয়ে এনে রক্তের দাগের ওপর ফেলতে, তারপর বালি দিয়ে ঘষে সেই রক্ত পরিষ্কার করতে।

হাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে নিজেও হাটুগেড়ে বসে রক্ত পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। কারণ সে বিশ্বাস করে, যে কাজ কেউ নিজে করতে পারবে না, সে কাজ তার অধীনস্ত লোকদের করতে আদেশ দেয়া উচিত নয়। অবশেষে পরিষ্কার করতে করতে জাহাজের ডেকটা চাঁদের আলোতে চকচক করতে থাকে। জাহাজের ডেক থেকে যখন চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, যেন একটা রঙিন আভা জাহাজটাকে ঘিরে রেখেছে।

হাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ভালবাসার মানুষটির ফিরে আসাটাকে একটা আনন্দপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা খুব শক্ত হাতে জাহাজটাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধের ময়দানে তার সহকর্মীদের মরে যেতে দেখেছে, সাগরে ভেসে যেতে দেখেছে। এখন তাদের আনন্দ করার সময়। পেটপুরে খাওয়া দাওয়া করার সময়। হাল তাদের আনন্দের মাত্রাটা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করতে চায়। একারণে আজকের দিনটি সবার কাছেই আনন্দের দিন।

হাল সিদ্বান্ত নিয়েছে যখন সে বিয়ে করবে তখন কোনো ইংলিশ চার্চ-এ খ্রিস্টান পুরোহিতের দ্বারা বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবে। যদিও এখনো জানে না সে কবে বিয়ে করবে। সে এবং জুডিথ সারাজীবন একসাথে কাটানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হাল এর পূর্বেও ভালবেসেছে। সে ভালবাসার তিক্ততা বা হারানোর ব্যথা জানে। কিন্তু জুডিথ-এর মতো স্থায়িত্ব বা নিশ্চয়তা এর পূর্বে সে কারও জন্য অনুভব করেনি। সে শুধুই তার। এই মেয়েটিই একদিন তার ভবিষ্যৎ সন্তানের মা হবে। এইটুকুই একজন পুরুষের জন্য অনেক কিছু।

উষালগ্নে হালকে দেখা গেল পুপ রেইল-এর ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে যেখান থেকে সে জাহাজের প্রতিটা মাস্তুল এবং প্রতিটা বেঞ্চ দেখতে পাচ্ছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে সে পুরো জাহাজটিকে খুব সহজেই তার নির্দেশ অনুযায়ী চালাতে পারে। যদিও এখন পালগুলো গুটিয়ে রাখা হয়েছে, জাহাজটাও স্থির আছে। হাল একটু দূরে উপকূলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি দেখছে। তারা চামড়া ছাড়ানো মৃত ছাগল, গরুর মাংস আর মুরগি দিয়ে তাদের নৌকো বোঝাই করছে। সাথে আরও নানান ধরনের জিনিসপত্র তারা নৌকোয় তুলছে-ঝুড়ি ভর্তি সবজি, ফলমূল আর বড় বড় পোড়ামাটির পাত্র যেগুলো ভর্তি করা হয়েছে ওয়াট দিয়ে। ওয়াট হচ্ছে ইথিওপিয়ার জাতীয় খাবার। বিভিন্ন সবজি এবং মাংস সেদ্ধ করে এটা তৈরি করা হয়। ইনজেরা দ্বারা তৈরি পাউরুটি দিয়ে এটা পরিবেশন করা হয়। বস্তা ভর্তি কফির বীজ আর বাক্স ভর্তি রেড ওয়াইন-এর বোতলও নৌকোয় তুলছে তারা। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের চমৎকার সব ফুল এবং বাণ্ডিলও ওরা নৌকোয় তুলছে।

হাল বেশ কিছুক্ষণ ধরে দূরের এইসব হৈ হট্টগোল দেখল। যদিও তার বয়স মাত্র বিশ বছর কিন্তু পরিণত পুরুষের মতই ব্যক্তিত্ব বা বিচার বোধ সে এরই মধ্যে অর্জন করেছে। সমুদ্রযাত্রা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের কারণেই সে এসব অর্জন করতে পেরেছে। তাই তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সিরাও বিনা দ্বিধায় তার আদেশ পালন করতে বাধ্য হয়।

তার ধূসর দাগবিহীন ঘন কালো চুলগুলো-যেগুলো সে এখন মাথার পেছন দিকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে-একদম সেই আগের মতই আছে। ঠিক যেমনটা আছে সেই সবুজ রঙের চোখগুলো যেগুলো দেখে মহারাজা আইয়াসু বিস্ময়াবিভূত হয়েছিলেন। যদিও সবকিছু আগের মতো নেই; এই কয়েক বছর আগেও তার মধ্যে যে প্রায়-নারীসুলভ কোমল সৌন্দর্যটুকু ছিল, সেটার কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে তার পিঠে এখনো রয়ে গিয়েছে কালো কালো দাগ, যেগুলো সে উপহার পেয়েছিল ডাচদের বন্দি হয়ে থাকার। ডাচদের কাছে বন্দি থাকাকালে দাসত্বের চেয়েও বেশি কষ্টকর ছিল তার জীবন। তার অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে আরো কঠোর, আরো সহিষ্ণু বানিয়েছে যেটা তার ছায়া তার চোয়ালকে করে তুলেছে দৃঢ়, মুখের অভিব্যক্তিকে করেছে কঠোর, দৃষ্টিকে করেছে অন্তরভেদী।

জাহাজের পাশ কেটে যাওয়া জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে আপনমনেই বলে উঠল, “ইস! আজ যদি আমার বাবা-মা এখানে থাকতেন তাহলে তাদেরকে জুডিথকে দেখাতে পারতাম। যদিও আমি মায়ের চেহারা মনে করতে পারি নে। তিনি যখন মারা যান তখন আমি খুবই ছোট। কিন্তু আমার বাবা…” হাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। “আমার মনে হয়…তিনি বুঝতেন যে আমি সঠিক কাজটাই করছি…আশা করি…তিনি অন্তত আমাকে খারাপ ভাবতেন না।”

“অবশ্যই না,” পাশ থেকে একটা নতুন কণ্ঠ বলে উঠল। “সবসময়ই সে তোমাকে নিয়ে গর্বিত ছিল গান্ডওয়েন। শেষ সময়ে সে তোমাকে কী বলেছিলেন সেগুলো মনে করার চেষ্টা কর।”

হাল কথা বলতে পারছিল না। তার মনের চোখে শুধু ভেসে উঠছিল তার বাবার গলিত পচা লাশ কেপ কলোনীতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। স্যার ফ্রান্সিস কার্টনিকে জলপথে মিথ্যে ডাকাতির অভিযোগে ডাচরা এই শাস্তি দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল এইভাবে শাস্তি দিলে তারা গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে, কিন্তু স্যার ফ্রান্সিস ভেঙে পড়েননি। তিনি তার শত্রুদের মনের আশা পূরণ হতে দেননি। একদিকে স্যার ফ্রান্সিস ফাঁসিতে ঝুলছিলেন, আর অন্যদিকে ছোট্ট হাল তা অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

“মনে আছে তোমার, সে শেষ মুহূর্তে কী বলেছিল?” ভদ্র কিন্তু জোরালো কণ্ঠটা আবারো বলে উঠল।

উত্তরটা দেয়ার আগে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাল। “তিনি বলেছিলেন যে, আমি তারই রক্ত, তার স্বর্গীয় প্রতিজ্ঞা। এবং… এরপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “গুডবাই, মাই লাইফ।”

“আমার ধারণা, তুমি উত্তর পেয়ে গিয়েছ। তোমার বাবা তোমাকে দেখছেন। আমিই তাকে তার চিরবিদায়ের স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দেখেছিলাম যে কিভাবে সে খোলা চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। তুমি যেখানেই থাক সে সবসময়ই তোমাকে দেখছে।”

“ধন্যবাদ, অ্যাবোলি,” হাল বলল।

সে প্রথমবারের মতো তার পিতার খুব কাছের মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তাকে পিতৃস্নেহে আগলে রাখার মতো এখন একমাত্র এই লোকটিই আছে। অ্যাবোলি অ্যামাডোড়া উপজাতির সদস্য, যে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলবর্তী জঙ্গলে অনেক দিন কাটিয়েছে। তার মাথার প্রতিটি চুল আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। যে কারণে তার মাথার চামড়াটা চকচক করছে। তার মুখে অনেক শুকিয়ে যাওয়া কাটা দাগ আছে। শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এসব দাগ কাটা হয়। তার এবং তার ভাইয়ের মুখে একটা ঐতিহ্যবাহী চিহ্নও রয়েছে। চিহ্নের মাধ্যমে তাদেরকে মনোমাপাটাপির পুত্র হিসেবে চেনা যায়, যে হচ্ছে তাদের উপজাতির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। যখন তারা দুই ভাই-ই ছোট তখন একবার তাদের গ্রামে দাস বিক্রেতারা আক্রমণ চালায়। অ্যাবোলি’র ভাইকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু অ্যাবোলির সেই সৌভাগ্য হয়নি। এরপর স্যার ফ্রান্সিস মুক্ত করার আগ পর্যন্ত তার অনেক বছর দাসত্বের জীবন কাটাতে হয়েছে, আর সেকারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়েছে।

‘গান্ডওয়েন’ ডাকনামটা অ্যাবোলির দেয়া, যার অর্থ হচ্ছে- বনের ইঁদুর। হাল-এর বয়স যখন চার বছর তখন এই নামটা দেয়া হয়। অ্যাবোলি তাকে এখনো সেই নামেই ডাকে। গোন্ডেন বাউ-এর আর কেউই তাদের অধিনায়কের এত কাছাকাছি আসতে পারেনি শুধু অ্যাবোলি ছাড়া। পাতলা গড়নের লোকটা বেশ লম্বা, মাংসল পেশিসম্পন্ন। ভয়াবহ চেহারার কারণে তাকে অন্য সবার চেয়ে বেশ আলাদাভাবেই চেনা যায়। তলোয়ার চালানোর যত খুঁটিনাটি আছে সবকিছুই হাল শিখেছে অ্যাবোলির কাছ থেকে। তলোয়ার যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে শুধু পা চালানো শিখলেই হবে না। প্রথমে প্রতিপক্ষকে জানতে হবে। প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে প্রথমে তার যুদ্ধের নীতি জানতে হবে। এসবই সে শিখেছে অ্যাবোলির কাছ থেকে। যদিও শিক্ষাটা কঠিন ছিল। হালকে বেশ কয়েকবার আহত হতে হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে। কিন্তু অ্যাবোলি যদি সেই ছোট্ট বালকটির ওপর কঠোর হয়েও থাকে, সেটা হয়েছে কেবল ছেলেটির বাবার ইচ্ছেপূরণের জন্যই।

সেই সব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে মৃদু হেসে হাল বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন, আমি এই জাহাজের মাস্টার হতে পারি, কিন্তু যতবারই আমি এই পাটাতনের ওপর দাঁড়াই, আমার মনে হয় যেন আমি লেডী এডউইনাতে ফিরে গিয়েছি, অজানা ভুলের কারণে বাবার শাস্তি ভোগ করছি। আপনার কী মনে আছে সূর্য দেখে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করতে আমার কতটা সময় লেগেছিল? যখন প্রথমবার আমি চেষ্টা করতে যাই তখন ব্যাকস্টাফটা আমার চেয়ে বড় ছিল। আমি একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঘামছি তো ঘামছি। যতবার জাহাজ নড়ে উঠছিল মনে হচ্ছিল লাঠিটা আমাকে ছিটকে ফেলে দিবে।”

দূরে তাকিয়ে অ্যাবেলিও একটা বড় হাসি দিল যেটা দেখে হাল আবার বলতে শুরু করল, “আমাকে লাটিন শেখানোর কথা আপনার মনে আছে? ল্যাটিন শিখিয়েছিলেন কারণ এটা নাকি ভদ্রলোকদের ভাষা! আপনি ভাবতেও পারবেন না যে আপনি কতটা ভাগ্যবান। আপনাকে কখনো জেরাল্ড শিখতে হয়নি, কখনো অ্যাব্লেটিভ অ্যাবসলিউট শিখতে হয়নি। জাহাজের প্রতিটা পালের নাম মনে না রাখার অপরাধে কেউ আপনার কানের নিচে সজোরে লাগিয়ে দেয়নি। এমনকি আমি যদি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতামও, তিনি সাথে সাথেই আমার আরো একশটা ভুল ধরিয়ে দিতেন। ঠিক এই জায়গাটাতে…এই পাটাতনের ওপরেই ব্যাপারগুলো হতো…সমস্ত নাবিকদের সামনে।”

হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেল হাল। “আপনি জানেন, সত্যি সত্যিই সে সময় আমি তাকে খুব ঘৃণা করতাম।”

“হ্যাঁ, সে যা করেছে তা জেনে বুঝেই করেছে। সে জানে যে তুমি তাকে ঘৃণা করতে পারো, তবুও সে তোমার সাথে ইচ্ছে করেই ওরকম করেছে। এটাই তার ভালবাসার প্রমাণ।” অ্যাবোলি বলতে লাগল, “তোমার বাবা তোমাকে ভালভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। সে তোমার প্রতি কঠোর হয়েছে যাতে তুমি সময়ের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে হেরে না যাও।” আফ্রিকান লোকটা হেসে আবার বলল, “যদি সৃষ্টিকর্তা চান তাহলে তুমিও হয়তো একটা ছোট্ট কার্টনি পেতে যাচ্ছে, যার ওপর তুমি কঠোর হতে পারবে।”

হাল স্মিত হাসল। একজন স্বামী বা একজন পিতা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সেও কঠিন সময় পার করছে। “আমি পিতা হওয়ার জন্য প্রস্তুত কি-না আমি বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমি এটা ভেবেও অবাক হই যে, আমি কী ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য আদৌ প্রস্তুত কি-না?”

“হ্যা!” অ্যাবোলি খুব বিস্ময়াবিভূত হল এবং হাল-এর কাঁধে তার লম্বা হাতটা রাখল। “তুমি তোমার শত্রুদের হত্যা করেছ। টাবারনেকল আর হলি গ্রেইলকে রক্ষা করেছ। এমন একটি নারী হৃদয় জয় করেছ, যে তার চেয়েও শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে পারে।” অ্যাবোলি খুব আস্তে করে তার মাথাটা ঝুঁকিয়ে বলল, “অতএব, আমি মনে করি, তুমি তোমার কাঁধের ওপর একটা বাচ্চাকে রেখে ঘুম পাড়ানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে।”

অট্টহাসি দিয়ে হাল বলল, “সেক্ষেত্রে, আমাদের যত দ্রুত সম্ভব তার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত।”

.

ক্যাপ্টেন জানে যে তার জাহাজটা এখন এক অর্থে নাবিকদের জীবন্ত কঙ্কাল দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তার কাছে জমানো যা টাকা ছিল তা প্রায় শেষের পথে। যতটা সস্তায় সবকিছু চালানো সম্ভব সেই চেষ্টাই করছে সে।

বিস্কিট ও অন্যান্য শুকনো খাবার যা ছিল উপকূল ত্যাগ করার পূর্বেই তাতে ছত্রাক ধরে ফেলেছে। সবজি যা কিছু ছিল সব পচে গিয়েছে। শুকনো মাংস যা ছিল তা এতটাই শুকিয়ে গিয়েছে যে, তার চেয়ে ববং জুতোর চামড়া ছিঁড়ে খাওয়া ভাল। সে এবং তার নাবিকেরা অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন পার করছে। তারা এমন কোনো সভ্য বন্দরের খোঁজ পাচ্ছে না যেখানে জাহাজ থামিয়ে তারা কিছু কিনতে পারে বা নতুন কোনো যোগানদারের সন্ধান পেতে পারে যার টাকা পরে শোধ করা যাবে। সহজ কথায় ক্যাপ্টেন নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কিন্তু আরো একটা সমস্যা তার মাথার ওপর কড়া নাড়ছে। ক্যাপ্টেন বুঝতে পারে পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে যাচ্ছে যখন সে কাকের বাসস্থানের মতো কর্কশ স্বর শুনতে পায়। ক্যাপ্টেন! সমুদ্রে কিছু একটা ভাসতে দেখা যাচ্ছে। জাহাজের দক্ষিণ পাশে, সামনের দিকে। দেখতে কাঠের মতো…অথবা…উল্টানো নৌকোর মতো।”

ক্যাপ্টেন মাথা ঝাঁকাল, এরপর বিড়বিড় করে বলল, “আমাকে কেন এটা বলার প্রয়োজন পড়ল?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকবার চিৎকারের মাধ্যমে সে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। “ওখানে কিছু একটা নড়ছে। আরে…একটা মানুষ! সে আমাদের দেখতে পেয়েছে মনে হচ্ছে…আর…সে আমাদের দিকে হাত ইশারা করছে।”

ক্যাপ্টেন বুঝতে পারছিল যে পঞ্চাশ জোড়া ক্ষুধার্ত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোনো ইচ্ছেই হচ্ছিল না নতুন করে আরও এক জোড়া চোখ বাড়াতে। লোকটাকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছিল সে। জাহাজের সর্বশেষ যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে খাবার দেয়ার মতো আরেকজোড়া মুখ। এরপরেও, নিজেকে সে খুব সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে দাবি করতে না পারুক, কিন্তু একেবারেই খারাপ লোক সে নয়। সে পাষণ্ড হতে পারে, তবে এতটাও নিষ্ঠুর নয়।

ক্যাপ্টেন তার জাহাজটাকে ঘোরানোর নির্দেশ দিল, এরপর লোকটিকে উঠিয়ে আনার জন্য একটি নৌকো নিক্ষেপ করতে বলল। “দুঃখ পেও না বন্ধুগণ” সে বলল, “যদি আমাদের এই বাস্টার্ডটাকে পছন্দ না হয় তাহলে আমরা তাকে গুলি করে মেরে খেয়ে ফেলব।”

কিছুক্ষণ পরে কাদা-ময়লা কাপড় পরিহিত, রোদে পোড়া মাঝারি উচ্চতার একজন লোককে সাগর থেকে উঠিয়ে আনা হল। সেও তার নাবিকদের মতোই হাল্কা-পাতলা। ক্যাপ্টেন তার জায়গা থেকে নিচে নেমে এল লোকটির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। ক্যাপ্টেন হাল তার মাতৃভাষায় লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, “গুড ডে স্যার। আপনার পরিচয় জানতে পারি?”

লোকটি অল্প করে মাথা ঝাঁকিয়ে একই ভাষায় জবাব দিল, “গুড ডে টু ইউ ই ক্যাপ্টেন। আমার নাম উইলিয়াম পেট।”

*

হাল এর সাথে পুনর্মিলনীর দিন কী পোশাক পরা যায় সেটা জুডিথকে ক) বেশ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সে স্টীলের ব্রেস্টপ্লেট পরে যুদ্ধের যে দীক্ষা নিয়েছে সেটাতেই বরং সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেটাতেই বরং তার শারীরিক গঠন ভালভাবে এঁটে যায়, যেটার ওপর লাল, হলুদ, এবং সবুজ রঙের মিশ্রণের সিল্কের এক ধরনের কাপড় পরানো থাকে। সেটার ওপর বিভিন্ন রকমে জুয়েলারি পিন দিয়ে আটকানো থাকে। রাজা তাকে ডামাস্কাস স্টীলের তৈরি বিশেষ এক ধরনের তরবারি দিয়েছে যেটা মহিলাদের গঠন এবং শক্তির সাথে ঠিকভাবে মানিয়ে যায়। অলংকৃত। জিনিসটা যখন সে পেছন দিক থেকে ঝুলিয়ে রেখে গোল্ডেন বাউ-এর ডেকে গিয়ে দাঁড়াবে, তখন বোঝা যাবে যে সে শুধুই কোনো অসহায়, নমনীয় নারী নয়। বরং সে একজন শক্তিশালী যোদ্ধা।

আর একজন নারী যোদ্ধা হিসেবে সে যেমন চায় পুরুষেরা তাকে সম্মান করুক তেমনি চায় কোনো পুরুষ তাকে ভালবাসুক, তাকে প্রত্যাশা করুক। যদিও এটা প্রকাশ করতে সে কুণ্ঠাবোধ করে কিন্তু তার জন্য নিজেকে সে সুন্দর রাখতে চায়। এক মাস আগে যখন তাদের দুজনকে যুদ্ধের কাউন্সিলে ডাকা হয়েছে তখনও তারা দুজন একত্রে একঘণ্টা কাটিয়েছে। এমনকি যদি তারা এক মুহূর্ত সময়ও একত্রে কাটানোর সুযোগ পায় তারা চায় সেই মুহূর্তটাই যেন তাদের জীবনের সেরা মুহূর্ত হয়। এ কারণে আলাদা থাকার সময়টুকু তাদের কাছে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে চায় না যে হাল আর তার। মাঝখানে কোনো কিছু আসুক, তাই দূরে কোথাও যাওয়ার সময় যদিও তার সাথে অস্ত্র, মিলিটারি পোশাক ইত্যাদি থাকে কিন্তু এরপরেও সে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা রঙের ইথিওপিয়ান ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে থাকে যার গলায় আর হাতায় সোনালি রঙের এমব্রয়ডারি করা আছে। সে সোনার ওপর অ্যাম্বার পাথর বসানো নেকলেস পরিধান করে, কানে পাথর বসানো সোনার দুল পরে।

তার চুলগুলো মাথার পেছনে উপরের দিকে খোঁপা করা আছে যার ওপর মণিমুক্তা খচিত অলংকার লাগিয়ে রাখা হয়েছে। মাথার একপাশে ঝুলানো আছে এক ধরনের বড় দুলের মতো গহনা। কপালের ওপর দিয়ে সারা মাথা ঘুরিয়ে এক ধরনের মোটা সোনার চেইন আটকানো আছে যেটা থেকে বিভিন্ন রঙের পাথর ঝুলে আছে। এগুলো ছাড়াও তার মাথার ওপর থেকে কাঁধ পর্যন্ত একটা সাদা রঙের লিলেন কাপড় পরা আছে। শালীনতাস্বরূপ এই কাপড় তার ব্যক্তিত্বকে উজ্জ্বল করেছে। সে তার প্রিয় মানুষটির সামনে যাই করুক না কেন প্রকাশ্যে সে তার জাজ্বল্যমান ব্যক্তিত্বকে বজায় রাখতে চায়।

মিতসিওয়া পোর্ট-এ বহনকারী ক্যারিয়েজে সে উঠে বসেছে। রাজার ব্যক্তিগত সৈন্যদল তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সৈন্যদলের সবাই আনুষ্ঠানিক ইউনিফর্ম পরে আছে। কাঁধের ওপর থেকে লম্বা একটা কাপড় বাঁকা করে ঝুলানো আছে যেটার ওপর ইথিওপিয়ান সিংহের ছবি আঁকা আছে। জুডিথকে বহনকারী যানটা যখন ডকসাইডে গিয়ে থামে তখন সৈন্যদল ক্যারিয়েজের চারপাশে সুবিন্যস্তভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে যাতে জনগণ তাদের জাতীয় বীরের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়। তাদের সবার কাছেই পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো কারণ তাদের পৌরাণিক গল্পের নায়িকা জেনারেল জুডিথ তাদের মাঝে এসেছে! একজন অশ্বারোহী গার্ডম্যান তার অশ্ব থেকে নেমে জুডিথকে বহনকারী গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সে দরজা খুলে একটা সিঁড়ি নামিয়ে আনল। এরপরে সে সরে দাঁড়াল যাতে জুডিথকে সবাই দেখতে পায়।

শেষমুহূর্তে জুডিথ অনুমান করতে পেরেছিল যে তার উপস্থিতি অনেক লোকের আগমন ঘটাতে পারে। সেই সাথে সে চেয়েছিল তার বিজয়ের আনন্দের কিছু অংশ জনগণকে দিতে। তাই সম্মানসরূপ পাওয়া সব স্মারক এবং মেডেল সে সাথে করে নিয়ে বের হয়েছিল। যখন সে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখন মধ্যগগনের সূর্যের আলোতে তার গায়ে জড়িয়ে থাকা সমস্ত মণিমুক্তা ও ব্যাজ চকচক করতে থাকে। তাকে এতটাই উজ্জ্বল আর আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল যে ঐ মুহূর্তে তাকে যতটা না সাধারণ মানবী মনে হচ্ছিল, তারচেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় দেবীর মতো। সে গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই চারদিক থেকে উল্লাস ধ্বনির রব উঠল। যদিও সে স্মিত হেসে হাত নাড়িয়ে উপস্থিত জনতার সম্মান গ্রহণ করছিল কিন্তু তার দৃষ্টি এবং হৃদয় তখন অন্য আর একজনের কাছে পড়েছিল।

হাল কার্টনি সিঁড়ির ধাপের নিচে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। যদিও সে যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন কিন্তু সে কোনো পদমর্যাদার ব্যাজ পরা ছিলনা। যদিও সে গোল্ডেন লায়ন অব ইথিওপিয়ার সম্মানিত সদস্য, সেন্ট জর্জ-এর নউটিনিয়ার নাইট অব টেম্পল উপাধির অধিকারী, সেই সাথে তার বাবার মতো সেও হলি গ্রেইল-এর রক্ষাকারী কিন্তু তবুও সে কোনো পদমর্যাদার ব্যাজ পরেনি। তার পরিবর্তে সে শুধুই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তার প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করছে। তার চুলগুলো পেছনে রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বাঁধা এবং গায়ে একটা সাদামাটা লিলেন-এর জামা পরা, হাল-এর কোমড়ের পেছন থেকে টলেডো ব্লেড-এর তৈরি একটি তলোয়ার বাট-এ আঁটকানো আছে। তরবারির বাঁটটা সোনা ও রূপার মিশ্রণে নকশা করা এবং এর উঁচু অংশে একটা বড় স্যাফায়ার পাথর বসানো আছে। এই তরবারিটা হাল-এর গ্রেট গ্রান্ডফাদারকে এলিজাবেথান নৌ-সেনাধ্যক্ষ স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক দিয়েছিলেন।

যখন জুডিথ তার মনের মানুষটিকে দেখতে পেল সে এক ধরনের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।

যুদ্ধের দাবদাহে জুডিথ শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত। দুইগুণ বা তিনগুণ বয়সে বড় কাউন্সিল মেম্বারদের সামনে সে নিজেকে শক্তহাতে ধরে রাখত। যে কাউন্সিল মেম্বাররা শারীরিক গঠনে এবং সম্মানে তার চেয়ে অনেক এগিয়ে। তারা তো বটেই, এমনকি তার শত্রুরাও কখনও তাকে ভয় দেখাতে পারত না। অথচ এখন হাল কার্টনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব মনে হচ্ছে, পা দুটোর সমস্ত শক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে। সে কোনোভাবেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছিল তার চারপাশের সবকিছু ঘূর্ণায়মান। হাল যদি সময়মত ধরে না ফেলত তাহলে সে হয়ত মাটিতে পড়েই যেত। হাল তাকে ধরে ফেলার পর তাকে স্বাভাবিক হতে একটু সময় দিল। হয়তো বা তার এমন মধুর অসহায়ত্ব তাকে উপভোগ করার একটু সুযোগ দিল হাল! তাকে দেখে মনে হচ্ছিল চারপাশের এত লোকের ভিড়ে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এমন কি হাল যে কি বলছে সেটাও সে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছে না।

হাল তাকে উৎসুক জনতার মাঝখান দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়ায় চড়া গার্ডেরা জনতার মাঝে পথ করে দিয়ে তাদেরকে জেটির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। জুডিথ চারপাশ থেকে এল তাজার” দ্য বারাকুলা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। শত্রুর জাহাজ আক্রমণের বীরত্বের কারণে হাল-এই নামে পরিচিত ছিল। এরপর সে হাল-এর হাত শক্ত করে ধরল। হাল তাকে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। যখন জুডিথ গোল্ডেন বাউ-এর সিঁড়িতে পা রাখল, তখন দেখতে পেল যে এর প্রতিটা দাঁড়-এ একজন করে তোক দাঁড়িয়ে আছে তাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। জাহাজের একমাত্র পালটি গুটিয়ে রাখা আছে। জাহাজের রাডারের ওপর দাঁড়িয়ে বিগ ডেনিয়েল ফিশার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

“ম্যাম, আপনাকে জাহাজে স্বাগতম,” বিগ ডেনিয়েল বলতে লাগল। “আপনি হয়ত আমাকে খেয়াল নাও করতে পারেন কিন্তু আপনি অনেকদিন ধরেই আমাদের সবার কাছে অনেক প্রিয় মানুষ।”

“ধন্যবাদ ডেনিয়েল,” জুডিথ একটু হেসে জবাব দিল। এরপর সে এদিক সেদিক তাকিয়ে হাল-কে জিজ্ঞেস করল, “অ্যাবোলি কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এরকম একটা অনুষ্ঠানের দিন সে অনুপস্থিত।”

হাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে না জানার ভান করল। এরপর হাতের ইশারা করে কিছু একটা বোঝাল ডেনিয়েলকে। চোখ বড়বড় করে চেহারায় নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে বলল, “আমি জানি নে সে কোথায় আছে। ডেনিয়েল তুমি কিছু জান?”

“না স্যার, আমি কিছু জানি না।”

“কেউ কিছু জান?”

নাবিকেরা সবাই মাথা নাড়িয়ে চোখ বাঁকিয়ে জবাব দিল যে তারা কিছুই জানে না। নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছিল যে সবাই কিছু একটা লুকাচ্ছে এবং এই খেলাতে জুডিথ বেশ মজাই পাচ্ছিল।

“সে না আসায় আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি,” জুডিথ বলে উঠে। এরপর আস্তে আস্তে গিয়ে হাল-এর পাশে বসে। “কক্সওয়েল, এবার আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে চল।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে ম্যাডাম,” বিগ ডেনিয়েল বলে। এরপর সে সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কাজের তাগিদ দিতে থাকে।

“জাহাজটাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে” হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল জুডিথ। এরপর একদৃষ্টিতে গর্বিত হালকে দেখতে লাগল।

“আমি এবং আমার লোকেরা এটাকে নতুনভাবে সাজিয়েছি,” হাল বেশ আনন্দের সাথে জানাল।

“ম্যাম, আমরা সবাই মিলে গত এক সপ্তাহ জুড়ে দিন রাত পরিশ্রম করেছি, ডেনিয়েল জাহাজটার দিকে তাকিয়ে বলল।

“বেচারা ডেনিয়েল, আমার জানা ছিল না যে আপনাদের কাপ্টেন এতটা নিষ্ঠুর,” জুডিথও একটু মজা করে বলল।

“না ম্যাম, আপনি জানেন না ক্যাপ্টেন কার্টনি কি ধরনের মানুষ। উনি তার বাবার মতোই হয়েছেন। তার বাবার পরে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যে জাহাজটাকে শক্ত হাতে চালিয়ে নিতে পারেন।

হাল-এর প্রশংসার কথা হয়ত অনেকেই বলতে পারে কিন্তু জুডিথ জানে সে হালকে যতটা জানে অন্য কেউ তার চেয়ে বেশি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারবে না। জুডিথ হাল-এর হাতে জোরে চাপ দিয়ে তার সেই অনুভূতিটা হাল-এর মাঝে ছড়িয়ে দিল। তারা যখন গোল্ডেন বাউ-এর কাছাকাছি আসল ডেনিয়েল উপস্থিত জনতাকে চিৎকার চেঁচামেচি থামাতে বলল। জাহাজের ব্লেডগুলোকে থামিয়ে দাঁড়গুলোকে সোজা করে রাখতে বলল। এরপর জীবন রক্ষাকারী নৌকোগুলোকে নিরাপদে জাহাজের পাশে থামিয়ে রাখার আদেশ দিল, একইসাথে জাহাজ থেকে কতগুলো মোটা নেট নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিতে বলল যাতে নৌকোয় থাকা লোকগুলো নেট বেয়ে উপরে উঠে যেতে পারে। যখন জুডিথ উঠে দাঁড়িয়ে নেট-এর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল তখন হাল তাকে থামিয়ে দিল। এরপর চিৎকার করে বলল, “আস্তে আস্তে সুইং-টা নিচে নামাও।”

জুডিথ উপরে তাকিয়ে দেখল একটা কাঠের দোলনার মতো জিনিস নিচে নামানো হচ্ছে।

“আমরা এটাকে বড় আর ভারি জিনিসপত্র জাহাজে উঠানোর জন্য ব্যবহার করি। তবে মনে হচ্ছে আজকে এটার সঠিক ব্যবহার হবে,” হাল বলল।

কাঠের দোলনাটাকে নানানরকম স্থানীয় ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এটার নিচ থেকে নানান রকম সাজানো ফিতা ও কাপড় আর সিগন্যাল ফ্ল্যাগ ঝুলে আছে। স্লিংটা যখন নিচে নামানোর পর হাল ওটার ওপর জুডিথকে বসতে সাহায্য করল।

“দেখো, সে যেন নিরাপদে উঠতে পারে, সে ডেনিয়েলকে আদেশ দিল! তারপর জুডিথ-এর গালে টোকা দিয়ে বলল, “তোমার সাথে ডেক-এ দেখা হবে। মাই ডালিং।”

হাল-এরপর নেট-এর দিকে এগিয়ে গেল এবং এরপর নেট ধরে আস্তে। আস্তে উপরে উঠতে লাগল। হাল-এর উপরে উঠা দেখে সে গাছ বেয়ে উঠা বানরের কথা মনে করে মনে মনে হাসতে লাগল। এরপর সে যখন ব্লিংটা শক্ত করে ধরে বসল তখন ডেনিয়েল আদেশ দিল, “উপরে উঠাও।” জুডিথ-এর চেহারা থেকে জেনারেল নাজেত-এর সমস্ত চিহ্ন অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন তাকে শুধুই একজন সাধারণ নারী মনে হচ্ছে। যেন তার নতুন জীবনের শুরুতে সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে আছে। যখন কাঠের দোলনা উপরে উঠানোর এলার্ম বাজানো হল তখন জুডিথ অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। সে দেখতে পেল হাল উঠতে উঠতে একেবারে ডেক-এর কাছাকাছি চলে গিয়েছে। এরপর লাফ দিয়ে ডেক-এ নেমে পড়ল সে। জাহাজের অন্যান্য লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

“থ্রি চিয়ার্স ফর দ্য ক্যাপ্টেন লেডি” বাউ-এর বৃদ্ধ দাঁড়চালক নেড টেইলার চিৎকার করে উঠল।

ডেক-এর ওপরে যখন জুডিথকে উঠতে দেখা গেল তখন খুশির জোয়ার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। হুররে… বলে একজন তার মাথার ক্যাপটা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল।

দ্বিতীয়বারের মতো সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল যখন জুডিথকে বহনকারী কাঠের দোলনাটাকে জাহাজের ডেকের ওপর নামিয়ে আনা হল। নেড টেইলার যখন “হিপ হিপ হুররে…” বলে চিৎকার দিয়ে উঠল তখন জুডিথ দোলনাটা ছেড়ে দিয়ে দক্ষ দড়িবাজের মতো লাফ দিয়ে ডেক-এ নেমে এল এবং হাল এর বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করল। তৃতীয়বারের মতো সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল এবং এবারের চিৎকার বেশ কিছু সময়ের জন্য স্থায়ী হল। কারণ হাল জুডিথকে দুই হাত দিয়ে ধরে তার ঠোঁটে ছোট্ট করে চুমু খেয়েছে। সেটার রোমাঞ্চ জুডিথ-এর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু একই সাথে একটা হতাশা তাকে ঘিরে ধরছে, কারণ তাকে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

হাল জুডিথ-এর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে বলল, “তুমি অ্যাবোলির কথা জিজ্ঞেস করছিলে। দেখ, এটা তোমার ভাল লাগবে।”

এরপর হাল মুখে কিছু শব্দ উচ্চারণ করল যেগুলো শুনে জুডিথের মনে হলো যে ওগুলো আফ্রিকান শব্দ, কিন্তু সে যে কি বলছে সেটাই বুঝতে পারল না জুডিথ। কিছুক্ষণ পরে পেছন থেকে এর জবাব এল। কেউ একজন তীক্ষ্ণস্বরে স্তবগান গাইতে শুরু করেছে। এই কণ্ঠের উত্তরে আবার একটা গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ ‘হাহ্!’ বলে জবাব দিল। সাথে সাথে ডেক-এ দাঁড়ানো নাবিকেরা পায়ের তালে তালে ডেক-এ আঘাত করতে লাগল। প্রথম কণ্ঠটি তার স্তবগান চালিয়ে যেতে লাগল। জুডিথের সামনে দাঁড়ানো নাবিকেরা সরে গিয়ে সামনের রাস্তা ফাঁকা করে দিল। সামনের দৃশ্য জুডিথকে এত বেশি রোমাঞ্চিত করে তুলল যে সে শক্ত করে হাল-এর হাত ধরে ফেলল।

অ্যাবোলি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় সারস পাখির লম্বা পালক দিয়ে তৈরি এক ধরনের মুকুট পরে আছে সে। তাকে দেখে সাধারণ মানুষ বলে মনেই হচ্ছে না, বরং দেখতে অনেকটা জঙ্গলের দেবতার মতো লাগছে। তার হাতে বড় ব্লেডযুক্ত একটা বল্লম ধরে আছে এবং কোমড় থেকে চিতাবাঘের লেজ দিয়ে তৈরি একধরনের ঘাগরা পরে আছে।

তার পেছনে কয়েকজন অ্যামাডোড়াও রয়েছে। তার গোত্রের এই কয়জন অ্যামাডোডা গোল্ডেন বাউ-এর সেবায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরা সমুদ্রেও ঠিক ততটা শক্তিশালী ও মারাত্মক যতটা শক্তিশালী তারা বনে এবং তাদের নিজভূমিতে ছিল। তারাও মাথায় সারস পাখির পালক পরে এসেছে। যদি ওদেরকে অ্যাবোলির মতো ততটা লম্বা লাগছে না। অ্যাবোলিকে ওদের দলনেতা বলেই মনে হচ্ছে।

তারা সামনে এগিয়ে আসতে আসতে সমস্বরে গান গাইতে লাগল। তাদের গানে বীরত্ব, ভ্রাতৃত্ব এবং দায়িত্বের স্বার্থে ইচ্ছামৃত্যুর কথা ধ্বনিত হচ্ছে। জাহাজের অন্যান্য নাবিক অবাক হয়ে দেখছে, কারণ তারা অ্যামাছোঁড়াদের কখনও এভাবে দেখে নি। হাল এবং জুডিথ-এর কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত লোকগুলো পায়ের তালে এগিয়ে আসতে লাগল। অনেকটা নাচের তালে এবং অনেকটা প্রকৃত যোদ্ধার মতো পায়ের তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল।

তাদের গান শেষ হওয়ার পর সবাই তাদের প্রশংসা করতে লাগল। জুডিথ এর জন্য ব্যাপারটা সবার চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল। কারণ সে আফ্রিকান। যদিও সে গানের কথাগুলো খুব একটা ভাল বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওরা যে চেতনা দিয়ে গানটা গাইছিল সেটা বুঝতে পারছিল।

অ্যাবোলি সামনে এগিয়ে এল। এরপর মাথায় পরা পালাকের মুকুটটা পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে জুডিথ-এর সামনে বসল। জুডিথ-এর হাতটা আলতো করে টেনে নিয়ে চুমু খেল।

এটা অভিজাত বংশীয় কারও তার রানীর প্রতি সম্মান জানানোর রীতি। জুডিথও সম্মানের যথাযথ উত্তর দেয়। সে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে ঝুঁকে অ্যাবোলির হাতটা ধরে রেখে বলে, “ধন্যবাদ অ্যাবোলি। আমার হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে তোমাকে ধন্যবাদ।”

এরপর হালও অ্যাবোলি’র হাত ধরে বলল, “ধন্যবাদ পুরনো বন্ধু, সবকিছু অসাধারণ ছিল।”

অ্যাবোলি হেসে বলে, “আমি অ্যামাডোডাদের প্রিন্স। এর চেয়ে কমে আমার পোয় না।”

এরপর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। খাওয়া-দাওয়া আনন্দ ফুর্তি, গান-বাজনা চলতেই থাকে। জুডিথ হালকে ধরে ফ্লোর-এর বাইরে নিয়ে যায়, এরপর বাজনার তালে তালে নাচতে থাকে। কিছু স্থানীয় রাধুনীরা খাবার পরিবেশন করছে। নাচের জন্য কিছু মেয়েও রয়েছে। কিন্তু হাল কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে যাতে ওদের নিয়ে কোনোরকম বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা না করা হয়। যখন সূর্য প্রায় অস্তগামী তখন হাল সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়ায়, তারপর সবাইকে চুপ হতে বলে।

“সবাই থাম এবার। আমার কিছু কথা বলার আছে,” হাল চিৎকার করে বলতে থাকে। সে খুব উচ্চস্বরে চিৎকার করে নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করে, “আমার নাম…আমার সঠিক নাম স্যার হেনরি কার্টনি।”

“ক্যাপ্টেন, আমরা সবাই এটা জানি,” একজন নাবিক বলে উঠল।

“ভাল। তবে তোমাকে বুঝতে হবে যে আমার এটা বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণ আছে। কিন্তু প্রথমে আমি বলতে চাই যে, আগামীকাল আমরা ইংল্যান্ড-এর উদ্দেশ্য রওনা দিব।”

নাবিকদের মাঝ থেকে একটা তীব্র গর্জন শোনা গেল “অবশ্যই।” হাল আবার বলতে শুরু করল, “এই জাহাজের সদস্যদের মধ্যে যাদের বাড়ি এই আফ্রিকায় তারা বাড়ি ফিরে যেতে পার। কিন্তু তার আগে আমাদের একটা কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”

“তোমরা অনেকেই জানো, আমার বাবা স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি, এখানে তোমাদের অনেকের সহযোগিতায় ডাচদের পতাকাতলে অনেক জাহাজকে ভূপাতিত করেছেন,..”

সবাই সম্মতিসূচক চিৎকার দিল।

“…এবং এতে করে তিনি অনেক ধন সম্পদ আহরণ করেন। সেইসব সোনা, রুপা এবং মূল্যবান জিনিস আমরা খুঁজে বের করব। তোমরা সবাই বয়স এবং কাজের বিচারে তার ভাগ পাবে।”

হাল আনন্দের সাথে তার গলা আরও উপরে তুলে বলল, “তোমাদের প্রত্যেকেরই এই পুরস্কার প্রাপ্য। তোমাদের চেয়ে সাহসী, অনুগত নাবিক আমি আর কোথাও পাব না। তোমরা নাবিক এবং যোদ্ধা হিসেবে তোমাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। তোমরা তোমাদের প্রতিজ্ঞা রেখেছ। এখন আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব। আমি তোমাদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব। এবং সেখানে তোমরা যাতে ভালভাবে বাঁচতে পার সেই ব্যবস্থা করব। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদেরকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। তোমরা কী সেই রমণীর জন্য নিজেদের গ্লাস উঁচু করে ধরে উল্লাস জানাবে না যাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি? সেখানে সে হবে আমার মাননীয়া স্ত্রী। প্রিয় নাবিকরা, তোমাদের প্রিয় জেনারেল জুডিথ হবে ভবিষ্যতের লেডি কার্টনি।”

যখন মদ্যপান করতে করতে এক একজন নাবিক প্রায় মাতালের পর্যায়ে চলে গিয়েছে তখন হাল এবং জুডিথ তাদের কোয়ার্টারের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। এখন আর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নেই যেটার জন্য গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন বাঁকানো ডেস্ক-এর ওপর ক্যাপ্টেনদের লগবুক পূরণ করার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। পার্সিয়ান কার্পেট-এ অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য যথেষ্ট সুব্যবস্থাও রয়েছে।

“তুমি শেষবার বাউ-এ আসার পর আমি আমাদের ঘুমানোর জায়গাটা নতুনভাবে সাজিয়েছি,” হাল জুডিথকে নিয়ে এসে তার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল। একারণে কাঠুরেদের গত একটা সপ্তাহ অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এখন তুমি তোমার চোখ একটু বন্ধ কর…”

হাল যেভাবে বলল, জুডিথও তাই করল। হাল দরজা খুলে জুডিথ-এর হাত ধরে তার ব্যক্তিগত কামরায় নিয়ে আসে। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে আরও কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেল। হঠাৎ হাল তাকে থামতে বলে। “এখন তুমি তোমার চোখ খুলতে পার।”

তার সামনে একটা স্লিপিং কট ঝুলে আছে। সাধারণ বিছানার চাইতে দ্বিগুণ বড় ওটা। সচ্ছ সাদা রঙের পাতলা কাপড় দিয়ে চারদিকের ঝুলানো রশিগুলো প্যাচিয়ে রাখা হয়েছে, সিল্কের ধূসর রঙের বিছানায় চাদরের ওপর উজ্জ্বল সুতার কাজ করা এবং মিসরীয় সুতীর কাপড়ের বালিশ রাখা আছে।

“খুবই সুন্দর লাগছে, হাল”, জুডিথ একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে কথাটা বলল।

“আমি এই লিলেনগুলো পেয়েছিলাম আমাদের আঁটকে ফেলা একটা জাহাজে।” হাল হেসে ফেলে কথাগুলো বলল। “ক্যাপ্টেন বলেছিল এগুলো শেখের হারেমের জন্য নেয়া হচ্ছে। আমি বলেছিলাম এগুলোর এর চেয়ে ভাল ব্যবহার আমি করব।”

“ওহ, তাই?” জুডিথ একটু টিপ্পনি কেটে বলল। “তা এগুলোর কী ভাল ব্যবহারটা হচ্ছে শুনি…”

কিন্তু বেচারি তার প্রশ্নটা শেষ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই হাল তাকে দু’হাত দিয়ে উঠিয়ে বিছানার ওপর ছেড়ে দিল। সেই সাথে মনে মনে কাঠুরেদের প্রশংসা করতে লাগল। ওরা বেশ মজবুতভাবেই খাটটা বানিয়েছে। মনে হচ্ছে যেকোনো ধরনের ভার এটা বইতে পারবে।

*

নিজের ভাগ্য অন্বেষণে আরবের হয়ে যখন বুজার্ড ইথিওপিয়ার উদ্দেশ্যে উত্তরমুখী যাত্রা শুরু করে তখন তার মনে কোনো য়ৈ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। বরং এটার প্রধান কারণ ছিল অর্থ উপার্জন। অ্যারাবিক সে খুব সামান্যই বলে। সে এটাকে খুব নোংরা ভাষা মনে করত যেটা তার সম্মানের সাথে খাপ খায় না। কিন্তু অচিরেই সে তার ভুল বুঝতে পারে। তার এই অজ্ঞতাই তার জন্য অনেক অসুবিধা বয়ে আনে। কারণ তার আশেপাশের মানুষ তাকে ছাড়াই কথাবার্তা চালিয়ে যায়, যার কিছুই সে বুঝতে পারে না। তাই সে আরবি ভাষা শেখা শুরু করে। তার এই প্রচেষ্টা তার আরোগ্য লাভের সময়ও চলতে থাকে। সে কারণে মহারাজ সাদিক খান জাহান-এর চিঠি পড়া তার জন্য খুব একটা কষ্ট হয় না। চিঠিতে লেখা ছিল, “আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই আরোগ্য লাভের কারণে। স্বীকার করতেই হবে। তুমি যে সুস্থভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে এটা আমার কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু এখন শুধু একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ।”

প্রিন্স জাহানের রাজত্বে বুজার্ড-একসময় বেশ দম্ভসহকারে ঔদ্ধত্য নিয়ে চলাফেরা করত। তাই এমন মধুর বাণী শুনতে বা মেনে নিতে বুজার্ড-এর মন সায় দিচ্ছে না। সেই সাথে মণিমুক্তা হীরা জহরত খচিত পোশাক পরিহিত কারো সামনে একবাহু একচোখ বিশিষ্ট বুজার্ডের নিজেকে গারগেইল ভূত-এর চেয়েও কুৎসিত মনে হচ্ছে। কিন্তু বুজার্ড এখন ভিক্ষুক। নত তাকে হতেই হবে। তাই সে কোনোভাবে মাথাটা নিচু করে বলে, “আপনার অনেক দয়া, মহারাজা।”

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা তার অদম্য ইচ্ছেশক্তিরই একটা প্রমাণ। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় বুজার্ড তার শরীরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। সে শরীরের কী কী অংশ হারিয়েছে সেটার চেয়ে বরং কী কী অংশ অবশিষ্ট আছে সেটার প্রতিই ছিল তার সমস্ত মনোযোগ। তার পাদুটো এখনো ভাঙেনি যদিও বেশিরভাগ চামড়া পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু চামড়া ও ক্ষতের নিচে মাংসপেশিগুলো এখনো তার শরীরের ভার বয়ে বেড়াতে পারবে। যদিও তার বাম হাত উড়ে গিয়েছে কিন্তু ডান হাতটা এখনো অক্ষত আছে। ডান হাত দিয়ে এখনো শক্তভাবে কোনো কিছু ধরার সামর্থ্য আছে তার। অর্থাৎ সে হয়ত কোনোদিন শক্তহাতে তলোয়ার ধরতে পারবে না। তার এক চোখের দৃষ্টিশক্তি এবং এক কানের শ্রবণশক্তি এখনো অক্ষত আছে। সে হয়ত শক্ত কোনো কিছু চিবাতে পারবে না, কারণ তার খাদ্যনালীর অবস্থা এমন হয়েছে যে, শক্ত কোনো খাবার হয়ত সে হজম করতে পারবে না। সব খাবারই হয়ত তাকে তরল জাতীয় মিশ্রণ বানিয়ে খেতে হবে। তার জিহ্বা হয়ত তাকে আলাদা আলাদা খাবারের স্বাদ দিতে পারবে না। কিন্তু এটুকুই তার জন্য যথেষ্ট যে সে খেয়ে বাঁচতে পারবে।

এসব ভেবেই বুজার্ড মানসিকভাবে শান্ত আছে। কিন্তু তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা এবং সারা শরীরেও তা ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কেটে পড়ে পাওয়া অঙ্গগুলো থেকেও সে ব্যথা অনুভব করছে। তবুও সে চিন্তা করতে পারছিল, পরিকল্পনা করতে পারছিল, হিসাব করতে পারছিল আর…ঘৃণা করতে পারছিল।

এসবের মধ্যে যে জিনিসটা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তা হলো ঘৃণা। ওটাই তাকে উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। শরীরের হাল ধরতে শিখিয়েছে। তাকে শরীরের অবসন্নতা কাটিয়ে উঠতে শিখিয়েছে। এটাই তাকে খাবার তুলতে সাহস যুগিয়েছে যখন তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে এসিড তার ফুসফুসে প্রবেশ করছে।

বুজার্ড-এর মনের জ্বলন্ত আগুন জাহানকে বিমোহিত করেছে। “আমি আপনার কষ্ট দূর হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছি,” এইটুকু বলে সে আস্তে আস্তে তার অতিথির খুব কাছে এসে দাঁড়াল। অতিথির এমন পুড়ে যাওয়া আর পচে যাওয়া শরীর দেখে যাতে তার মুখভঙ্গিতে কোনোরকম বিতৃষ্ণা প্রকাশ না পায় সেদিকে খেয়াল রাখল সে।

বুজার্ড বুঝতে পারল মহারাজা জাহান তার দিকে তাকিয়ে আছে-এতে মনে মনে সে আরও কুণ্ঠাবোধ করল। সে তার হাতে ধরে রাখা বস্তাটা বার বার উপরে নিচে করতে লাগল। তার পেশিগুলো অবশ হয়ে আসছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তার ক্ষত থেকে পুঁজ এবং রক্তমিশ্রিত পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল কিন্তু তবুও সে থামছিল না। সে সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। জাহানের একজন কর্মচারী ভেতরে প্রবেশ করল সাথে সাথে। বুজার্ডকে দেখে সে তার বিস্ময় এবং হতবাক অবস্থা লুকাতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু অতি দ্রুত সে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলল, “মহারাজ, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। সে বলছে তার নাম আহমেদ এবং সে চামড়ার কাজ করে। কিন্তু কী কারণে এসেছে তা আমাকে বলেনি। সে বলেছে আপনি তাকে যে কাজ দিয়েছিলেন তা সে পূর্ণ করেছে। বলেছে সে শুধু আপনার কাছেই তা বলবে।”

জাহান হেসে বলল, “ঠিক আছে, তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।” এরপর সে বুজার্ড-এর দিকে তাকায়। বুজার্ড-এখনো তার হাঁটুতে হাত রেখে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রাণপণে চেষ্টা করছে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। জাহান বুজার্ডকে ডেকে বলে, “মহান সৈনিক, আমি আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আনিয়েছি। আশা করি সেটা আপনার ভাল লাগবে। যদিও একটু কষ্টকর।”

.

জাঞ্জিবারের সালতানাত-এর রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম গ্রে মহারাজা সাদিক খান জাহান আলীর প্রাসাদের বাইরে একজন অনুনয়কারী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাতে এসেছে যে কী দুর্ভাগ্য আর কী অবিচার-এর কারণে আজ তার এই অবস্থা হয়েছে। অথচ জাঞ্জিবার-এ থাকাকালীন সময়ে জাহানের প্রাসাদে সে কত সম্মানিত অতিথি ছিল। জাঞ্জিবার সমাজে সে সবচেয়ে ধনী শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল। শুধু ইউরোপের প্রতিনিধি হিসেবে গুরুতুপূর্ণ সম্রাটই ছিল না সে, বরং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতও হয়েছিল। সিদ্ধান্তটা ছিল তার ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নেয়া। সে ভেবেছিল খ্রিস্টিয়ান সমাজের বাইরে গিয়ে বহুদূর যেতে পারবে। তারপর জাঞ্জিবার-এর সেই দুরাত্ম আর্ল অব কামব্রা উপাধিপ্রাপ্ত অ্যাঙ্গাস কোকরান-এর আবির্ভাব ঘটে। এর পরপরই আসে তরুণ কুরশাবক হেনরি কাটনি। যে সহজ এবং সম্মানের জীবন অনেক বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তুলেছিলেন গ্রে, তা নিমিষেই গুঁড়িয়ে যায়।

বুজার্ড আসার পরপরই গ্রেকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করে, যেন সে ওমানের সুলতানের পক্ষ নিয়ে ইথিওপিয়ার রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। স্কটল্যান্ডের এই জলদস্যু যুদ্ধের বাজারে ক্রিশ্চিয়ানদের কাজ থেকে ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে ধনী হতে থাকে। সেই সাথে গ্রে-কে যথেষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া শুরু করে। গ্রে-ও এত পারিশ্রমিক পেয়ে বুজার্ড-কে দেয়া কথা রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। যখন শত্রুর জাহাজ আক্রমণ করার চিঠি তার হাতে পৌঁছায় সে হর্ন অব আফ্রিকার উদ্দেশ্যে পাল উড়ায় এবং তাকে দেয়া কাজ পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করে।

এর পাঁচ সপ্তাহ পরে যুবক কার্টনি ওখানে পৌঁছায়। সেও বুজার্ডের মতোই ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। সেও শত্রুর জাহাজ আক্রমণের জন্য চিঠি পায়। কার্টনি যুদ্ধের সবকিছু শোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। আর্ল অব কামব্রা তারই পথে যুদ্ধ করছে, এটা জেনে সে খুব বিস্মিত হয়। কিন্তু গ্রে, কার্টনির আগ্রহের ব্যাপারে খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না।

কেনই বা হবেন? মুসলিমরা এখানে বড় ধরনের যুদ্ধ করতে চায় যাতে অ্যারাবিয়া এবং আফ্রিকার উপকুলের মাঝে অবস্থিত বিশাল জলরাশির ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তার হয়। আর যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করবে তাকে তারা বন্ধু হিসেবেই আলিঙ্গন করে নেবে।

এর মধ্যে কার্টনি এসে জাঞ্জিবারে নোঙর গাড়ে, এরপর স্কটম্যানকে খুঁজে বেড়ায়। সেই সাথে ইথিওপিয়ার রাজা আর জেনারেল নাজেত-এর হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে অনেকটা অকৃতজ্ঞ, কপট, দ্বিমুখী বিশ্বাসঘাতক-এর মতো। খুব দ্রুতই এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কার্টনির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বুজার্ডকে ধ্বংস করা, কারণ সে আসলে তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিছু সময় পরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কার্টনি সেই স্কটম্যানকে খুঁজে পেয়েছে, এরপর তাকে যুদ্ধে আহবান জানিয়েছে। আরও গল্প তৈরি হতে থাকে যে বুজার্ড তার সর্বোচ্চটা দিয়ে যুদ্ধ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি, জীবন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে জাহাজের সাথেই পানিতে তলিয়ে গিয়েছে।

পুরনো দিনে হয়ত গ্রে এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পারত আর তাতে হয়ত আসল ঘটনা উন্মোচন হতে পারত। কিন্তু সেটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ কার্টনি আরব জাহাজগুলো আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়া শুরু করেছে। ফলে জাহাজ মালিকরা তাদের কার্গো থেকে কোনোরকম লভ্যাংশ পাচ্ছে না। এই লোকগুলো তাদের এই ক্ষতির জন্য গ্রে-কে দায়ী করছে, সেই সাথে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

জাঞ্জিবার-এর প্রতিটি দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে কফি শপ-এ বসে গল্প করা ছাড়া তার আর কোনো কাজই নেই। সবচেয়ে বেশি তার যা করার আছে তা হল মহারাজার প্রাসাদে আসা, অপেক্ষা করা, এরপর আশা করা যে মহারাজা সাদিক খান জাহান হয়ত একদিন তার দিকে সদয় দৃষ্টি দিবেন, তার অবস্থার উন্নতি করতে সচেষ্ট হবেন। এভাবেই একদিন মহারাজার জন্য অপেক্ষা করতে করতে গ্রে, নারী ব্যবসায়ী ওসমানকে দেখতে পায় যার সাথে এককালে সে ব্যবসা করেছিল। ওসমান-এর মতো দুপয়সার লোকও কিনা শেষ পর্যন্ত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে যে গ্রে-র মতো লোকের সাথে সে আর ব্যবসা করতে ইচ্ছুক নয়!

ওসমানকে যখন সে গেটের দারোয়ান-এর সাথে কথা বলতে দেখে তখন গ্রে রাগে টগবগ করছিল। লোকজনের ভিড়, তাদের চিৎকার চেঁচামেচি এবং শরীরের গন্ধ সবকিছুই তার কাছে অসহ্য লাগছিল। গ্রে অনেকদিন ধরেই উপকূলে বসবাস করে। ইংরেজদের আঁটসাট মোটা কোটের চেয়ে অ্যারাবিয়ানদের লম্বা আলখাল্লা তার কাছে বেশি আরামদায়ক মনে হয়। ধর্মীয় কারণের চেয়ে ভৌগোলিক পরিবেশগত কারণেই তার এমনটা মনে হয়। চামড়া ব্যবসায়ী আহমেদকে যখন প্রাসাদের ভেতরে যাবার অনুমতি দেয়া হলো তখন গ্রে লজ্জায় আর অপমানে ঘামতে থাকে, তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আহমেদ একটা বড় বক্স বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ওটা অনেকটা মহিলাদের হেডগিয়ার বহন করার বক্সের মতো দেখতে। গ্রে অবশ্য সেটার প্রতি ততটা মনোযোগ দিল না।

কিছু সময় পরে একজন প্রাসাদের কর্মচারী বেরিয়ে এসে গার্ডদের সাথে কথা বলতে থাকে। একসময় তিনজন লোক ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে তাদের হাতে ধরা কাঠের লম্বা লাঠি দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে থাকে। একসময় গ্রে দেখে যে তারা ওরই দিকে এগিয়ে আসছে। সে ভয় পেয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভিড়ের কারণে সে পালাতে পারে না। ঘর্মাক্ত অবস্থায় প্রচণ্ড ভয়ে সে চিৎকার করে উঠল যখন সে দেখল যে কয়েক জোড়া হাত তাকে টেনে-হিঁচড়ে প্রধান গেইটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। খানিক বাদেই সে নিজেকে প্রাসাদের টাইলস করা মেঝেতে আবিষ্কার করল।

গ্রে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। সেই কর্মচারীটি ওকে এখানে নিয়ে এসেছে যে একটু আগে আহমেদকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। “আমার সাথে আসুন, এফেন্দি, মহারাজা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।”

সে যখন উঠে আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে এগোতে থাকে তখন দেখতে পায় মধ্যদুপুরে ঝরনার পানি চকচক করছে। গ্রে বুঝতে পারে সেই গার্ড তিনটা তার পিছু পিছু আসছে। তাদের হাতে এখন আর সেই লম্বা কাঠের লাঠি নেই। কিন্তু তার বদলে কোমড়ের বেল্টে আটকানো আছে বাকানো তলোয়ার।

ঠিক ঐ মুহূর্তে কনসাল গ্রে বুঝতে পারে যে মহারাজার সাথে দেখা করতে পারাটাকে সে যতটা সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেছিল, সেটা হয়তো অতটা সৌভাগ্যের নাও হতে পারে।

*

বুজার্ডের সব ইদ্রিয় সময়মতো এখনো ভালভাবে কাজ করে না। কিন্তু তার নাকের নিচ দিয়ে একটি ইঁদুর হেঁটে গেলে সে সেটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে। এই নাস্তিক জাহানটা কিছু একটা করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী? এরকম স্বর্গীয় নামধারী একজন লোকের চামড়ার ব্যবসায়ীর সাথে কী কাজ থাকতে পারে?

প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। জাহান বলে উঠে, “আসুন।” এরপর যে ঘরে প্রবেশ করে ভয়ে তার চেহারা থকথকে জেলির মতো মনে হয়। জাঞ্জিবার-এর মাননীয় কনসাল ঘরে প্রবেশ করে। বুজার্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু জাহান আগন্তুককে স্বাগত জানায়। “গুড মর্নিং মি গ্রে। আপনার সাথে আবার দেখা হবে এটা কখনো ভাবিনি।”

মানুষ তাকে দেখার পর যে বিস্ময়, ঘৃণা আর বমি করার মতো এক্সপ্রেসান দেয়, তাতে বুজার্ড ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে দেখার পর গ্রে এর মুখের যে অবস্থা হলো, সেটা অন্য সবার এক্সপ্রেসানকেও ছাড়িয়ে গেল। বিস্ময়ে লোকটার মুখ হা হয়ে গেল, বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে যেন সে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কথা বলার জন্য যথেষ্ট বাতাস সে ফুসফুসে নিতে পারছে না। অবশেষে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয়। “কিন্তু…কিন্তু… আপনি তো মৃত।”

বুজার্ড তার ছেচে যাওয়া ঠোঁটের অংশটক দিয়ে হাসার চেষ্টা করে। “হয়ত সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সর্বশক্তিমান বিধাতা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

“সত্যিই আল্লাহ তাআলা অনেক দয়ালু ও সবজান্তা,” গ্রে বলে উঠে। এই ফাঁকে সে জাহান-এর দিকেও এক পলক তাকিয়ে নেয় তার অভিব্যক্তি বোঝার জন্য।

জাহান কথা বলা শুরু করে। “এখন আপনারা দুজন পুনরায় একত্রিত হয়েছেন। আমাকে এই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে দিন। হেনরি কার্টনির কারণে আপনাদের দুজনের এবং আমাদের লোকদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সম্পর্কে আমি জানি। আমি এবং আমার ভাই গ্রান্ড মোগল-এর ইচ্ছে আপনারা দুজন একত্রিত হয়ে এটার প্রতিশোধ নিবেন।”

“আমার ভাই কিছুদিন আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। চুক্তিটা ভূমি সংক্রান্ত বেশ বড় ধরনের চুক্তি। আমার ভাই মনে করে এই চুক্তি বেশ সুফল বয়ে আনবে। তাই এরকম সময়ে সে ইংল্যান্ডের এরকম একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকের পেছনে সরাসরি লাগতে চাচ্ছে না। এতে তার ধনী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।”

“কার্টনি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে,” বুজার্ড মনে মনে চিন্তা করল। কথাটা তাকে বেশ অবাক করল।

“একারণে আমাদের হয়ে কাজ করার জন্য মাধ্যম হিসেবে কোনো বিচক্ষণ ও ধূর্ত লোককে আমাদের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আপনাদের দুজনের চেয়ে বিশ্বস্ত আর কে হতে পারে? ক্যাপ্টেন কার্টনিকে ঘৃণা করার পেছনে আপনাদের দুজনেরই যথেষ্ট কারণ আছে। এই লোক সম্পর্কে আপনারা দুজনেই বেশ ভাল করেই জানেন। তার চিন্তাভাবনা গতিবিধি সবই আপনাদের জানা। আপনার উচিত, নিজেদের ব্যর্থতার জন্য অনুশোচনা করা, এবং নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করা, কারণ এই আমার জায়গায় যদি অন্য কোনো রাজা হতো, তাহলে ব্যর্থতার দায়ে আপনাদেরকে সে অনেক আগেই হত্যা করার আদেশ দিত।”

“তার মানে মহামান্য রাজা চাচ্ছেন আমাদেরকে দিয়ে ক্যাপ্টেন কার্টনিকে হত্যা করতে?” গ্রে-এর গলার স্বর শুনেই বোঝা গেল যে সে বিপদ টের পেয়েছে।

“অনেকটা তাই, তবে সেটা আপনাদের নিজেদের তলোয়ার দিয়ে না, জাহান তাদেরকে আশ্বস্ত করে। আমার মনে হয় আপনারা দুজনের কেউই সেটার জন্য উপযুক্ত না। আপনি তার সাথে পাত্তাও পাবেন না, গ্রে। আর আর্ল…উনি দুই হাত দিয়েও কার্টনির কিছু করতে পারেননি, এক হাত দিয়ে আর কিইবা করবেন। কিন্তু আপনারা অন্য কোনো উপায়ে তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারেন। আপনারা তাকে খুঁজে বের করে ফাঁদে ফেলুন। তখন অন্তত অন্য কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে। এরপর আপনি সবাইকে বলবেন যে কার্টনিকে আপনিই হত্যা করেছেন। আমার মনে হয়, আপনার বর্তমান অবস্থা দেখার পর সবাই একমত হবে যে কার্টনির উপর প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার আপনার আছে।”

“আর আমরা যদি আপনার হয়ে এই কাজটা করতে রাজি না হই, তবে?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করে।

জাহান উচ্চ হাসি হেসে বলে, “আপনারা অবশ্যই রাজি হবেন। প্রথমত, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যত সরঞ্জাম এবং মানুষজন প্রয়োজন হবে সবই আমি আপনাদের সরবরাহ করব। দ্বিতীয়ত, আপনি এবং কনসাল গ্রে উভয়েই এখানে এই বিল্ডিং-এর নিচে সেদিনই মারা যাবেন যেদিন আপনারা আমার প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানাবেন। আমি অনেক দয়ালু মানুষ। কিন্তু আমার হুকুম অমান্য করার অপরাধ আমি ক্ষমা করি না।”

গ্রে একলাফে মাটিতে শুয়ে পড়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে থাকে। আপনি অতি দয়ালু এবং মহানুভব যে আমার মতো একজনকে দয়া দেখিয়েছেন। আমি খুবই সম্মানিত বোধ করব, সেই সাথে কৃতজ্ঞ থাকব যদি আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত হতে পারি।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে কনসাল, দয়া করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ান।” জাহান উত্তর দেয়। এরপর সে বুজার্ড-এর দিকে তাকিয়ে বলে, “আর আপনি?”

“আমিও আপনার প্রস্তাবে রাজি। এমনকি আমি আপনাকে এটাও বলব যে তাকে এই মুহূর্তে কোথায় পাওয়া যাবে। এখন কেবল একটি জায়গাতেই সে যেতে পারে।”

“সময়মত জেনে নেব, এখন অন্য ব্যাপারে কথা বলি,” জাহান বলল। “প্রথমত, গত কয়েকদিন ধরে যে ব্যাপারটা দেখে অবাক হচ্ছি তা হল আপনার গায়ের চামড়া অনেক সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় বাইরের গরম রোদ কিংবা বাতাস কোনোটাই আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই আপনার জন্য বিশেষ একধরনের হেডগিয়ার বানানোর আদেশ দিয়েছিলাম যেটা আপনাকে রক্ষা করবে।”

দুই হাত দিয়ে তালি বাজাল জাহান। সাথে সাথে চামড়ার ব্যবসায়ী আহমেদ এসে তার বক্সটা খুলে একটা জিনিস বের করল। সেটা দেখতে অনেকটা চামড়ার ক্যাপ বা হুড-এর মতো মনে হচ্ছে। জিনিসটার ওপর বেশ কিছু নকশাও করা আছে। কিন্তু আহমেদ যেভাবে এটা ধরে আছে তাতে বুজার্ডের পক্ষে বুঝে উঠা সম্ভব হয় না যে এটা আসলে কী কাজে লাগতে পারে।

আহমেদ আস্তে আস্তে বুজার্ডের দিকে এগোতে থাকে। তার চোখ নিচের দিকে ফেরানো। যেন সে কাজের আগে দানবটার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে। যখন চামড়া ব্যবসায়ী বুজার্ড-এর কাছে পৌঁছায় তখন নতুন আরেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। দেখা যায় বুজার্ড চামড়া ব্যবসায়ীটির চেয়ে অনেক লম্বা। আহমেদ অনুগ্রহপূর্বক দৃষ্টিতে জাহান-এর দিকে তাকায়। জাহান তখন অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “যদি আপনি মাথাটা একটু নত করেন তো খুব ভাল হয়।”

“আমি এই লোকের দিকে মাথা নুইয়ে দাঁড়াব?” বুজার্ড ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠে।

“তাহলে তুমি এটা হারাবে,” জাহান একটু থামে। এরপর আবার শান্ত স্বরে বলতে শুরু করে, “দয়া করে অস্বীকার করবেন না। আপনি মাথা নত করুন, লোকটিকে তার কাজ করতে দিন। “আমি কথা দিচ্ছি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই আমি আপনাকে দিব। আমাকে বাধা দিলে আপনি মারা পড়বেন।”

বুজার্ড তার মাথা নোয়ায়। কিছু সময় পরে সে ব্যথায় ছটফট করতে করতে চিৎকার করে উঠে। কারণ একটি চামড়ার হুড তার মুখমণ্ডলের ক্ষতের ওপর দিয়েই পরানো হচ্ছে। বুজার্ড এখন শুধু চামড়ার ওপর দিয়ে কাটা এক চক্ষু দিয়ে পৃথিবীটা দেখছে। চামড়ার হুডটা খুব শক্তভাবে বুজার্ডের মুখমণ্ডলের ওপর লাগানো হয়েছে। চামড়ার ওপর দিয়ে নাকের সামনে করা দুটো ছিদ্রের মধ্যদিয়ে সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মুখের অংশটুকু ছাড়া সারা মুখমণ্ডল চামড়া দিয়ে ঢাকা। কিন্তু কিছু সময় পরে সে অংশটুকুও ঢেকে দেয়া হয় আরেকটা চামড়ার পদা দিয়ে। এই পদটিা অনেকটা কাপের আকৃতিতে তৈরি যেটা বুজার্ডের থুতনিতে আটকে গিয়েছে। এই কাপ আকৃতির ফ্ল্যাপ এবং মাস্কের অন্য অংশের মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। ফলে বুজার্ড মুখটা নাড়াতে পারছে। ফ্ল্যাপটা শক্তভাবে লাগানোর ফলে বুজার্ড মুখের দুইপাশে বেশ টান অনুভব করছে। কিছুক্ষণ পর ক্লিক করে একটা তালা লাগানোর মতো শব্দ শুনতে পায় সে।

ভয়ে আঁতকে উঠে বুজার্ড। সে তীব্রভাবে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করে দিল, এরপর আহমেদকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। আরেকবার আক্রমণ করার আগেই সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলল। তাকে টেনে হেঁচড়ে পেছনে নিয়ে যেতে থাকল তারা। শেষপর্যন্ত শরীর বাঁকিয়ে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া বুজার্ড-এর হাতে আর কোনো উপায় রইলো না।

আরেকবার কারিগর-এর হাত অনুভব করে বুজার্ড। চামড়ার বড় একটা কলার তার গলায় আটকিয়ে পেছনে তালা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। বুজার্ড শুনতে পায় জাহান বলছে, “যি. গ্রে, আপনি কী একটা আয়না এনে আপনার স্বদেশীর সামনের ধরবেন। আমার মনে হয় আর্ল নিজেকে আয়নায় দেখে বেশ খুশি হবেন।”

“উম…ম… আমি?” গ্রে তোতলামি করে জবাব দেয়।

“প্লিজ!” জাহান আবার ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দেয়। “আমাকে কী আবার মনে করিয়ে দিতে হবে যে, আপনি আমার অনুরোধ অস্বীকার করলে কী পরিণতি হবে?”

বুজার্ড শুনতে পায় গ্রে-র পায়ের শব্দ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সৈন্যরা তার হাত ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল বুজার্ড। সে যখন মাথাটা তোলে তখন সরাসরি আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। সে এখন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে পৃথিবী তাকে দেখছে। রাগে বিতৃষ্ণায় সে চিৎকার করে কেঁদে উঠে।

তার পুরো মাথাটা চামড়ায় ঢাকা। নানান দিক থেকে সেলাই করে মুখোশটা বানানো হয়েছে। চামড়ার ওপর আঁকা বড় বড় আইতে তাকে দেখতে ভয়াবহ লাগছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখটার ওপর সাদা কালো রঙ দিয়ে চোখ আঁকা রয়েছে, যেটা আরো কিছু ভয়াবহতা যোগ করেছে। মুখোশের নাকটা পাখির ঠোঁটের মতো ছুঁচালো যেটা সম্ভবত তার নামটাকে কটাক্ষ করার জন্যই বানানো হয়েছে। এছাড়াও সেলাই করা মুখোশের ওপর দাঁতাল দানবীয় হাসি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুই পাটি দাঁতের মাঝখানে অল্প একটু ফাঁক রয়েছে। এটুকু দিয়ে সে কথা বলতে আর খেতে পারবে।

বুজার্ড একসসময় পর্তুগীজ এক দাস বিক্রেতার বাড়িতে এরকম একটা মুখোশ ঝুলানো দেখেছিল। ঐ লোক ওটাকে এক উপজাতীয় জাদুকর ডাক্তার এর কাছ থেকে পেয়েছিল। আর এখন একইরকম একটা মুখোশ তাকে পরানো হয়েছে।

অসহ্য ব্যথা আর হতাশায় সে চিৎকার করতে থাকে। বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট আঙুলগুলো দিয়ে তালা ধরে এদিক সেদিক টানতে থাকে যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে এটা ভেঙে ফেলবে। এসময় সে অপমানের সর্বশেষ স্তরটাও দেখতে পায়। তার গলায় থুতনির নিচে একটা ধাতব রিং ঝুলানো আছে। মুহূর্তেই সে বুঝে ফেলে এটা লাগানোর অর্থ কি। সে যদি জাহান-এর কথামত না চলে কিংবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে এটাতে চেইন লাগিয়ে কুকুরের মতো রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।

বুজার্ড ভগ্ন হৃদয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। সে এমন এক মানুষ যে আগুনে পুড়ে এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার পরও এখনো বেঁচে আছে। সূর্য এবং সাগর যখন তাকে সম্মিলিতভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে তখনও সে জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছে। যেকোনো মরণশীল মানুষের চেয়ে বেশি কষ্ট সে সহ্য করেছে, সেই সাথে মানুষের ঘৃণা সহ্য করেছে। তার সর্বশেষ ধাক্কা হয়তো এটাই।

ধীরে ধীরে বুজার্ড-এর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে জাহান। তার হাতে নকশা করা একটা সাদা এনামেল-এর কাপ। সে এতটাই নরম সুরে কথা বলে উঠল যে, শুনে মনে হচ্ছিল সে যুদ্ধে আহত হওয়া রাগান্বিত কোনো ঘোড়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। “এই নাও এটা পান কর, ঠাণ্ডা মিষ্টি শরবত।”

বুজার্ড কাপটা হাতে নেয়, এরপর মুখে দেয়ার চেষ্টা করে। বুজার্ড কাত হয়ে যতবারই শরবত পান করার চেষ্টা করল ততবারই ওটা মুখোশের সাথে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। সে মাথা ঘুরিয়ে নানান রকম উপায়ে ওটা পান করার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু একফোঁটা শরবতও তার মুখে গেল না। ভিন্ন উপায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে, কিংবা মুখোশ নাড়িয়ে কোনোভাবেই এটা পান করার কোনো উপায় সে বের করতে পারছিল না।

ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অন্য লোকগুলো প্রথমে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। খানিক বাদে পুরো ব্যাপারটায় খুব মজা পেতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে সবাই খুব উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বুজার্ড এসব কিছু সহ্য করতে না পেরে হাতের কাপটা এত জোরে ছুঁড়ে মারল যে ঘরের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে। জাহান আবার কথা বলা শুরু করল বুজার্ডকে উদ্দেশ্য করে। “তুমি শুধু জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে শিখেছ। কর্তৃত্ব করতে শিখেছ। কিন্তু মানুষ হতে শিখনি। উঠে দাঁড়াও, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব কিভাবে পানি পান করতে হয়।”

আবারো দুই হাতে তালি বাজাল জাহান, আর সাথে সাথে কালো আফ্রিকান এক চাকর হাতে পিতলের একটা জগ নিয়ে হাজির হলো। পিতলের জগে এক ধরনের নল লাগানো আছে যেটা দেখতে অনেকটা গাছে পানি দেয়ার নলের মতো। চাকরটা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে বুজার্ডের দিকে তাকাতে তাকাতে এগুতে থাকে। এরপর সাধ্যমত দূরত্ব বজায় রেখে জগটা বুজার্ডের দিকে এগিয়ে দেয় যেন নলটা বুজার্ডের মুখের ভেতর যায়। বুজার্ড ঠোঁট দিয়ে নলটা ধরে তৃষ্ণার্ত পশুর মতো পানি পান করতে থাকে। জাহান পুনরায় যখন তালি বাজাল তখন এক ধাক্কায় নলটা বুজার্ভের মুখ থেকে সরিয়ে নেয়া হলো।

“তোমাকে খাওয়ানো এবং পানি পান করানো হবে দাসদের দ্বারা, যাদেরকে শাস্তিস্বরূপ এই দায়িত্ব দেয়া হবে আরকি। যখন তুমি রাস্তায় বের হবে মহিলারা তোমার দিক থেকে ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিবে। বাচ্চারা যারা দুষ্টামি করবে তাদেরকে রাতে তোমার ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হবে। যুবক ছেলেরা একজন আরেকজনের সাথে বাজি ধরবে যে কে তোমার দিকে সবার আগে পচা সবজি ছুরে মারতে পারবে। যখন তারা কেউ ভুলবশত এটা করে ফেলবে তখন আমার লোকেরা তাদেরকে শাস্তি দিবে। আর এভাবে…তুমি সত্যিকার অর্থে ভয় আর ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হবে।”

“কিন্তু পরবর্তীতে সেই ঘৃণা তোমার কাছে শূন্য মরুভূমিতে এক বিন্দু বালির মতো মনে হবে। একমাত্র আমিই সেই ঘৃণাকে বদলে দিতে পারি, তৃপ্ত করতে পারি যদি তুমি আমার কাজ কর।”

“এবং তোমার জন্যেও একই কথা মি গ্রে…” এরপর জাহান ঠাণ্ডা এবং কঠোর কণ্ঠে রাষ্ট্রদূত-এর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল। “তুমি এখনি আমার বাড়ি থেকে চলে যাবে। আর কখনো আসবে না-যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি হেনরি কার্টনির ছিন্নমস্তক একটা বড় পাত্রে করে নিয়ে আসতে পারবে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারবে। তুমি যখন এই দুটোর কোনো একটা করতে পারবে কেবল তখনি তুমি আবার এইখানে দাঁড়াতে পারবে। আবার সেই পূর্বের সম্মান ফিরে পাবে। এর আগ পর্যন্ত এখানে তুমি রাস্তার লোক বলেই গণ্য হবে। তুমি এখন যেতে পার।”

গ্রে-কে অবনত মস্তকে বের হয়ে যেতে দেখে বুজার্ড-একটু হাসার চেষ্টা করল। জাহান পুনরায় বুজার্ড-এর দিকে ফিরল। “আমার এই মাত্র মনে পড়ল যে তুমি এখন নপুংসক। আমি তোমাকে একটা সুযোগ দেব যেটা আমি কখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ পুরুষকে দেইনি। যখন আমি আমার প্রিয় উপপত্নীদের সাথে রাতের খাবার খেতে যাব তখন তুমি আমার সাথে থাকবে। তারা এক একজন নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী যাদেরকে ইন্ডিয়া, পার্সিয়া কিংবা রাশিয়া এমনকি তোমার নিজের উপকূলের দ্বীপ থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। তারা তোমার সাথে দেখা করতে পারলে আনন্দিত হবে। যদিও তুমি তাদের স্পর্শ করতে পারবে না, খাবার খেতে পারবে না, কোনো কিছু পান করতে পারবে না। কিন্তু তুমি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে এবং তোমার বেঁচে যাওয়া চোখটা দিয়ে সব কিছু দেখতে পারবে। যেদিন হেনরি কার্টনির মৃত্যু হবে সেদিন আমি তোমাকে আমার উপপত্নীদের মাঝ থেকে একজনকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেব। তুমি তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। তুমি ভেবে দেখ কিভাবে তুমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করবে। এবার তুমি ভেবে দেখ, ওদের মতো সুন্দর রমণীরাও কী তোমাকে হেনরি কার্টনির মৃত্যু দেখার চেয়ে বেশি আনন্দ দিতে পারবে?”

.

তিনদিন পর বুজার্ডকে প্রথমবারের মতো বাইরের পৃথিবীতে বের হওয়ার আদেশ দেয়া হয়। কালো রঙের এক ধরনের পোশাক পরিয়ে ছয়জন গার্ডসহ বুজার্ডকে বের করা হয়। এদের কাজ যেমন বুজার্ডকে রক্ষা করা, তেমনি যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা। তাদেরকে বলা হয়েছে যেন তারা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বুজার্ড-এর সাথে হাঁটে যাতে লোকজন বুজার্ডকে ভালভাবে দেখতে পায়।

জাহান যেমন ধারণা করেছিল তেমনি জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় বুজার্ড-এর উপস্থিতি সাধারণের মাঝে ভয়ের উদ্রেক করল। মহিলারা পালিয়ে যেতে থাকে, সাথে থাকা ছেলেমেয়েদের চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর বুজার্ড যখন পুরুষদের সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিল, তখন তাদের মাঝে কেউ কেউ মাটিতে থুতু দিতে থাকল, কেউবা শয়তানের কুনজর থেকে বাঁচার জন্য পকেট থেকে রক্ষা কবচ বের করে হাতে তুলে নিল। সবশেষে সে যখন একটা জায়গার চারপাশে গড়ে উঠা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন ওই মুহূর্তে তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল একটি অল্পবয়সি ছেলে। ছেলেটি পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা নর্দমার কাছে চলে যায়। নর্দমার পাশে। ফেলে রাখা ময়লা আবর্জনা থেকে বাম হাত দিয়ে একটা ময়লার ব্যাগ তুলে বুজার্ডের মুখে ছুঁড়ে মারে। সৌভাগ্যবশত সেই ময়লা বুজার্ডকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তবে খুব দ্রুত দুজন গার্ড ভিড়ের মধ্যে ছেলেটিকে ধরে ফেলে সে পালিয়ে যাওয়ার আগেই। রাগে অপমানে গজরাতে থাকে বুজার্ড, আর তাকিয়ে দেখে যে রাস্তার মাঝখানে জাহানের আদেশ পালনকারী সেনাপতি দাঁড়িয়ে আছে।

যখন বিছু শয়তানটাকে ধরে আনা হয় তখন দেখা যায় যে তার বয়স বড়জোড় চৌদ্দ কি পনের হবে। দেখেই বোঝা যায় সে তার তারুণ্যের ঝোঁকে পড়ে কাজটা করেছে। পরিণতি কি হতে পারে সেটার কিন্দুমাত্র চিন্তাও করে দেখেনি সে। সেনাপতি ইতস্তত করতে লাগল। তার নিজেরও একটি ছেলে আছে। এই বয়সের একটি ছেলেকে যে কোনো পরিবারের বুক থেকে আলাদা করতে তার বিবেকে বাধছে।

বুজার্ড সেনাপতির দোটানা মনোভাব বুঝতে পারে। সে ভিড়ের মধ্য থেকে ক্ষমা প্রার্থনার কান্না শুনতে পায়। বুজার্ডের সহজাত প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়ে উঠল। সে বেশ বুঝতে পারছিল যে এই সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এই মুহূর্তেই নির্ধারণ হবে যে লোকজন কী এখন থেকে তাকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করবে, নাকি ভয়ংকর দানবের মতো ভয় পাবে। আর বুজার্ড জানে যে দুটোর ভেতর সে কোনটা বেশি চায়।

“আমার তলোয়ারটা এদিকে দাও,” তীব্র গর্জন করে সেনাপতিকে আদেশ দিল সে। এরপর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল। সেনাপতি তর্ক করার আগেই তার হাত থেকে তলোয়ারটা নিয়ে নিল বুজার্ড।

তীক্ষ্ণ এবং জলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সে সৈন্য দুটির দিকে তাকাল যারা ছেলেটাকে ধরে আছে। “তোমরা দুজন ওর হাতদুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেল,” বুজার্ড আদেশ করল। “নিজেদের দায়িত্ব পালন করো, বুঝলে? নইলে মহারাজাকে গিয়ে বলে দেব।”

লোকদুটি ভয় পেয়ে অতি দ্রুত বুজার্ড-এর আদেশ পালন করে ফেলে। বুজার্ড শুনতে পায় যে ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন ছেলেটির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছে।

বুজার্ড যখন জলন্ত দৃষ্টি দিয়ে ভিড়ের দিকে তাকাল তখন আর কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেল না। তার কথা মতো ছেলেটাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হলো। তার বালকসুলভ দুঃসাহস চেহারা থেকে হারিয়ে গেল। তার বদলে ওখানে ফুটে উঠল ভয়ে কাঁপতে থাকা এক শিশুর চেহারা, যাকে সৈন্যরা জোর করে মাথা নিচু করাচ্ছে যেন তার ঘাড়ের পেছনে জায়গামত তলোয়ার বসাতে পারে বুজার্ড।

বুজার্ড নিচের দিকে তাকিয়ে তার নিশানা ঠিক করতে থাকে। এরপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ডানহাতে ধরে রাখা তলোয়ারটা ঘাড়ে বসিয়ে দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কিন্তু তার নিশানা ব্যর্থ হয়। তার বদলে তলোয়ারটা মেরুদণ্ডের দুটি কশেরুকার মাঝখানে আঘাত হানে। তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মেরুদণ্ডে আটকে যাওয়া তলোয়ারটা একটানে উঠিয়ে ফেলে বুজার্ড। এরপর পুনরায় আঘাত করে সে। তারপর আরো একবার।

নিশানামত তলোয়ারটা বসাতে তিনবার আঘাত করতে হয় তার। অবশ্য ততক্ষণে বালকটির দেহ নিথর হয়ে গিয়েছে।

এক পা পিছিয়ে আসে বুজার্ড। তার বুক ধরফর করছে। মাথাটা তিনশত ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরিয়ে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা দেখতে থাকে সে। এরপর সেনাপতিকে আদেশ করে, “আমাকে প্রাসাদে নিয়ে চল।”

সৈন্যরা যখন তার কথামত প্রাসাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন সে মনে মনে একটা কথাই বলছিল, “এতেই হবে। আমার যা দেখানোর, দেখিয়ে দিয়েছি আমি।”

২. কর্তব্যরত অবস্থায়

কর্তব্যরত অবস্থায় একজন জাহাজের ক্যাপ্টেনকে সবসময় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। রাত অথবা দিনের যে কোনো মুহূর্তে তার ডাক পড়তে পারে। হাল যখন সমুদ্রে জাহাজ ভাসায় তখন জুডিথ-এর উপস্থিতি তার কাজের ব্যাঘাত ঘটাক এটা সে চায়নি। একারণেই তার নাবিকেরা তাকে সম্মান আর প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখে। এমনকি জুডিথও সেটা চায় না। কারণ সে জানে একজন নেতাকে কি রকম হতে হয়। সে হাল এবং তার দায়িত্বের মাঝে আসতে চায় না। এমনকি হাল যদি তা চাইত তাহলে হয়ত বা সে হালকে এখনকার মতো এতটা সম্মান করত না।

কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত এক ঘণ্টা তারা একে অপরকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। এ সময় অন্য কোনো কাজ নয়, অন্য কোনো চিন্তা ভাবনা নয়। এই সময়টুকু তারা তখনই বেছে নেয় যখন জাহাজ শান্ত থাকে। বাতাস আর সমুদ্র নীরব থাকে। যেন শান্ত এবং নীরব পরিবেশে তারা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে-সেটা কথায় কিংবা কাজে অথবা উভয়ের মাধ্যমে।

জুডিথ-এর প্রতি তার ভালবাসা ছিল অপরিসীম-এ আকাক্ষা কখনোই পুরোপুরি মিটবার নয়। জুডিথের মাঝে ডুবে থাকতে তার খুব ভাল লাগে। আর সেই আদিম প্রেমের গভীরতা এতটাই বেশি যে কোথায় গিয়ে তার শরীর শেষ হয় আর জুডিথের শুরু হয় সেটাই সে মাঝে-মাঝে বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে যে এরকম আশীর্বাদপুষ্ট সময়ের সাথে পৃথিবীর আর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। এখন পর্যন্ত হাল-এর হৃদয়ের সবচেয়ে প্রশান্তির মুহূর্ত হলো জুডিথকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া। অন্ধকার কেবিনেও সে জুডিথের চেহারা দেখতে পায়। তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। জুডিথও হাল-এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করে। তার বিশ্বাস এবং ভালবাসার গভীরতা এতই বেশি যে হাল সারাজীবন তাকে রক্ষা করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

মিতসিওয়া থেকে এক হাজার মাইল দূরে আফ্রিকার উপকূলে যখন ওরা আট দিনের জন্য অভিযানে বের হয় তখন একদিন সকালে গোঙানির শব্দে হাল জেগে উঠে। সে চোখ খুলে দেখতে পায় জুডিথ তার পাশে শান্তিতে ঘুমিয়ে নেই। বরং বাঁকা হয়ে পাদুটো বুকের কাছে নিয়ে তার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে যে আওয়াজ করছে তা থেকে বোঝা যায় সে কোনো রকম শারীরিক অসুস্থতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

“ডার্লিং, তুমি কী ঠিক আছ?” হাল জিজ্ঞেস করল। কণ্ঠে দুশ্চিন্তার আভাস লুকোতে ব্যর্থ হয় সে।

“ এটা কোনো ব্যাপার না, ঠিক হয়ে যাবে”, জুডিথ উত্তর দেয়। কিন্তু তার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠে, এরপর বমি করার জন্য উদ্যত হয় সে। কিন্তু তার কণ্ঠ দিয়ে গরগর জাতীয় শব্দ ছাড়া কিছুই বের হয় না।

“তুমি তো অসুস্থ”, অস্থির হয়ে জুডিথের কপালে হাত রেখে বলে হাল। “তোমার শরীর গরম। তোমার কী জ্বর এসেছে?”

জুডিথ ঢোক গিলে হাল-এর দিকে পাশ ফিরে। সে কনুই-এ ভর দিয়ে বসে এবং অন্য হাতটা হাল-এর ওপর রাখে। “চিন্তা করো না। আমি অসুস্থ নই। এমনকি এর চেয়ে বেশি সুস্থ আমি জীবনে কখনো ছিলাম না।”

হাল জুডিথের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “প্লিজ, ডার্লিং”, আমি জানি তুমি অনেক সাহসী, কিন্তু…”

“শসস্” সে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে। “আমি তোমাকে বললাম তো, এখানে দুশ্চিন্তার কিছু নেই…” একটু মৃদু হাসার চেষ্টা করে আবারো বলে, “অবশ্য যদি তুমি তোমার পিতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত হও তো…”

“পিতৃত্ব…?” সে অবাক হয়ে বলে, “তুমি…তার মানে তুমি…?”

“হ্যাঁ, ডার্লিং। আমার মধ্যে তোমার সন্তান বেড়ে উঠছে। আমি তোমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি…”

“সত্যিই অসাধারণ একটা খবর দিলে,” হাল উল্লসিত হয়ে বলে উঠে। পরমুহূর্তেই আবার সন্দেহের সুরে বলে, “কিন্তু তুমি কী নিশ্চিত? তুমি কিভাবে জান যে এটা সত্যি খবর?”

“কারণ যুদ্ধের কাউন্সিল-এর জন্য দুইমাস আমরা একত্রে ছিলাম। তোমার কী মনে পড়ছেনা…”

“ওহ্, অবশ্যই আমার মনে আছে। বেশ ভালভাবেই মনে আছে…”

এরপর থেকে আমার ঋতুস্রাব হয়নি এবং আজকে সকালে আমি একরকম অসুস্থ বোধ করছি। আমি যদি বাড়িতে থাকতাম তাহলে মা, খালা কিংবা বাড়ির অন্যকোনো মহিলা আমাকে এই কথাটা বলে দিত যেটা এখন আমি তোমাকে বলছি,” সে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল। “সম্ভবত আমি তোমার মতো শক্তিশালী, সুদর্শন এবং দয়ালু কোনো ছেলের মা হতে যাচ্ছি।”

“কিংবা একটি মেয়ে যে কি-না তার মায়ের মতই সুন্দরী মায়াময় এবং সাহসী।”

কিছু সময়ের জন্য তারা দুজনেই একটা মোহের মধ্যে দিয়ে সময় পার করতে লাগল-অল্প বয়সি দুজন বালক-বালিকা প্রথম প্রেমের সন্ধান পেয়ে যেমন মোহের মধ্যে থাকে, অনেকটা সেরকম। পৃথিবীটাই তাদের কাছে এখন নতুন মনে হচ্ছে।

হাল-এর মোহাচ্ছন্ন ভাবটাই প্রথমে কাটে। হঠাৎ করেই সে মুখের অভিব্যক্তি বদলে ফেলে কেবিনের জানালা দিয়ে দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“তোমার হঠাৎ কী হল?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী কোনো সমস্যায় পড়েছ?” “তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমার সন্তানকে নিরাপদে রাখব।”

“না, ঠিক সেটা নিয়ে ভাবছি না”, হাল উত্তর দেয়। অন্য কিছু ভাবছি।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। এরপর দ্রুত জামাকাপড় আর জুতা পরতে শুরু করল। গায়ের জামা খোলা রেখেই নিচু হয়ে জুডিথ-এর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আমি অন্য একটা ব্যাপার দেখতে যাচ্ছি। চিন্তা করো না। এটা হয়ত তেমন কোনো ব্যাপার না।” জুডিথ-এর দুশ্চিন্তাভরা মুখ দেখে আশ্বস্ত করার জন্য ছোট্ট একটা হাসি দিল হাল। “আমাকে তুমি আজকে আমার জীবনের সেরা খবরটা দিয়েছ। আমি তোমাকে আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবাসি। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে ফিরে আসব।”

যদিও হাল জাহাজের ডেক-এর দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তার মনটা পড়ে রয়েছে বিছানায়।

দুইদিন আগে পাহারাদার একটা ডার্চ কারাভাল দেখতে পায় স্টারবোর্ড থেকে কয়েক কি. মি. দূরে। বাতাসের গতির পরিবর্তনের কারণে সেটা কখনো দেখা যাচ্ছিল আবার কখনো দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ওরা হয়ত গোল্ডেন বাউকে নজরে রাখছে। যদি যুদ্ধের সময় হত তাহলে এটা খুব দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। যদিও কারাভেলটা গোল্ডেন বাউ-এর চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু অনেক সময় অনেক বড় বড় শক্তিশালী জাহাজও ওত পেতে থাকলে দেখা যায় না। কিন্তু ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড-এর মধ্যে অনেকদিন ধরেই শান্তি বিরাজ করছে। তাই হাল দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখে নি। এছাড়া সকাল হওয়ার সাথে সাথেই কার্নিভেলটা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু হাল-এর মন থেকে সেই অস্বস্তির ভাবটা যায়নি।

এখন আবার হালের মনে সেই একই রকম অস্বস্তি কাজ করছে। কিছু একটা তাকে জানাচ্ছে যে সেই ডাচম্যানটা এখনো সেখানে আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কারাভেল-এর ক্যাপ্টেন-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। হাল জাহাজের ডেক-এ উঠেই একটা স্নিগ্ধ পরিবেশ অনুভব করে। ঠাণ্ডা নরম বাতাস বইছে। রুপালি চাঁদের আলোতে সাগরের পানি চকচক করছে। ডেক-এর পাশে অ্যামাড়োডা যোদ্ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এরা সবসময় এরকম খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। নেড টেইলর জাহাজের হালের মধ্যেই ছিল। সে ক্যাপ্টেনকে বলে, “এ সময়ে আপনি এখানে কেন ক্যাপ্টেন?” “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনি আপনার সঙ্গিনীর ওপর বিরক্ত হয়ে এত রাতে নিজের কেবিন ছেড়ে এখানে এসেছেন।”

“মোটেও না,” হাল একটু হেসে জবাব দেয়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সেই ডাচ্ কারাভেলটা এখনো সেখানে আছে।”

“টম ছেলেটা তো কোনোকিছুই বলেনি। সে খুবই ভাল ছেলে। ডিউটি বাদ দিয়ে ঘুমানোর মতো ছেলে সে নয়।”

টম মার্লি হচ্ছে নাবিকদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি। বেশ দুরন্ত কিন্তু দায়িত্ববান ছেলে। তবুও হাল নিশ্চিত হতে চায় যে সে সঠিক লোককে দায়িত্ব দিয়েছে। তাকে এখানে নিয়ে আসুন, মি. টেইলর।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

নেড মাস্তুলের ওপর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা চিকন শিস বাজাল। সাথে সাথেই টম মার্লি মাথা বাঁকিয়ে নিচের দিকে তাকাল। তাকে নিচে নেমে আসার জন্য ইশারা করল নেড়। টম মার্লি নির্ভয়ে খুব দ্রুত নামতে থাকল। টম মার্লিকে নামতে দেখে হাল-এর অতীত জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। বেশিদিন আগের কথা নয় যখন হালকে বাবার আদেশে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার এভাবে উঠা-নামা করতে হতো।

মার্লি ডেক-এ নেমে খুব দ্রুত নেড-এর কাছে চলে আসল। এরপর পেছনে হাত দিয়ে খুব বিচলিত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

“চিন্তার কিছু নেই, টম,” তুমি কোনো ভুল করনি। হাল এই কথা বলার পর ছেলেটির কাধ অনেকটা শিথিল হয়ে যায়। “আমি শুধু জানতে চাচ্ছি গত দুই-এক দিনের মধ্যে তুমি ডাচদের কোনো জাহাজ বা নৌকো দেখেছ কি-না। অথবা সন্দেহজনক কোনো কিছু?”।

টম মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না স্যার, আমি কিছু দেখি নি। আমি সবসময় আমার চোখ খোলা রেখেছি। কখনো একটুও ঘুমাই নি।”

“আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। এখন যাও দেখ, রাঁধুনি হয়ত এতক্ষণে কিছু বেঁধেছে। খেয়ে নাও।”

“কিন্তু আমার দেখা এখনো শেষ হয়নি স্যার।”

“সেটা নিয়ে চিন্তা করো না” হাল, বলল। হঠাৎ তার মনে হল নিজ চোখে একটু দেখা প্রয়োজন। অন্য কারো ওপর ভরসা করার চেয়ে নিজ চোখে দেখা ভাল।

“আপনার কী মনে হয় ওখানে উঠা আপনার উচিত হবে। একটু ভেবে দেখুন, নেড় জিজ্ঞেস করে।

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন যে আমি জাহাজের অন্য যে কারও চেয়ে দ্রুত উপরে উঠতে পারব না।”

“না, স্যার। আমি শুধু বলতে চাইছি…”

“আচ্ছা, তাহলে চেয়ে দেখুন। আমি উঠছি।”

আর তারপর হাল মাস্তুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা মোটা রশি ধরে আকাশের দিকে উঠতে থাকে।

*

পেট অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিল। যদিও জাহাজের প্রত্যেকেরই অনেক খিদে পেয়েছিল। জাহাজের ডেক এমনকি প্রতিটা আনাচে কানাচে হ অন্তত একটা ইঁদুর খুঁজে পাওয়ার জন্য তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। যদি কোনো গাংচিল বা সামুদ্রিক পাখি ভুলক্রমেও ডেক এর ওপর এসে বসেছে কিংবা ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছে তাহলে সেটাকে কোন তীর দিয়ে বা পাথর নিক্ষেপ করে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে সেটাকে হত্যা করা হয়েছে। যদি কোনো ডলফিন খেলার ছলে জাহাজের পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে গিয়েছে তবে সেটাকেও ছোট বন্দুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর কোনো হাঙর পাখিটাকে খেয়ে ফেলার আগেই জাহাজের নাবিকেরা সাঁতার কেটে সেটাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।

পেটও ক্ষুধার্ত ছিল তবে সেটা ছিল অন্যরকম। সে গত এক সপ্তাহ একটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ইঁদুরে কাটাকুটি করা ঘরে কাটিয়েছে। সে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলেছিল যে সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সিনিয়র অফিসার, সেই সাথে অনুরোধ জানিয়েছিল তাকে যেন একজন ভদ্রলোক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন তার কোনো কথা না শুনে তাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিল।

“আপনাকে বুঝতে হবে যে আমার লোকেরা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ শেষ করেছে সে বেশিদিন হয়নি। তাদের মনে হয়তো বা এখনো আপনাদের জন্য কোনো ভালবাসা নেই।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন ক্যাপ্টেন। “তাছাড়া এরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। খাদ্য এখন তাদের কাছে খুবই আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। আমি কিভাবে নিশ্চয়তা দিব যে খাবারের জন্য তারা কোনো অমানবিক কাজ করে ফেলবে না। আপনার ভাগ্য ভাল যে আমি আপনাকে উদ্ধার করার আদেশ দিয়েছি। আমার লোকের অনেকেই যেটা চায় নি। কারণ ওরা চায় নি আরেকটা ক্ষুধার্ত মুখ বাড়াতে। আমি সেসময় তাদেরকে একটা হাস্যকর প্রস্তাব দিয়েছিলাম যার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি ওদেরকে বলেছি যে যদি তোমরা ওকে পছন্দ না কর তাহলে তাকে খাবার হিসেবেও মজুদ রাখতে পার। আমার ভয় হচ্ছে যে তাদের মাঝে কেউ হয়ত বা সেটা করেও ফেলতে পারে।”

তখন থেকে ক্ষুধার চেয়ে বেঁচে থাকাটাই পেট-এর জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার শরীর শুকিয়ে একেবারে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে। মাংস চামড়া সবই একেবারে প্রায় হাড়ের সাথে লেগে গিয়েছে। কিন্তু পেট এমন মানুষ যার খাদ্যের প্রতি খুব একটা আগ্রহ কখনোই ছিল না। তাই খাদ্যের অভাবে তার বড় কোনো ক্ষতিই হয়নি। কিন্তু অন্য আরেকটা ক্ষুধা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কখন সেই স্বর্গীয় কণ্ঠ তাকে আদেশ দিবে পৃথিবীকে পাপমুক্ত করার, তার নিজেকে সেই কাজের জন্য প্রস্তুত করার। পেট জানে না কখন সেই স্বর্গীয় স্বর আবারো ভেসে আসবে। মাঝে মাঝে এমনও হয় যে একমাস যাবত সেই কণ্ঠের কোনো খোঁজ থাকে না, আবার মাঝে মাঝে একদিন বা একসপ্তাহ পরেই সেই কণ্ঠ ভেসে আসে। সেই কণ্ঠ যখন আসে তখন চিৎকার করে বারবার তাকে একই আদেশ দিতে থাকে। “হত্যা কর, এখুনি।”

এই জাহাজে বন্দি থাকা অবস্থায় পেটকে মুক্ত করার মতো কেউই ছিল না। আর তখনি, অন্য সব বারের মতোই, ঐ স্বর্গীয় কণ্ঠের অধিকারী তার জন্য একজন সঙ্গী পাঠিয়েছেন।

সে ছিল তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া একজন নাবিক। তার অপরাধ ছিল সে ক্যাপ্টেন-এর কোয়ার্টার-এর লকার থেকে একটা মূল্যবান ধাতব পাত্র চুরি করেছিল। পেট-এর মনে হয় লোকটা অনেকটা উন্মাদ। নয়ত সে গুলি করে লকার খুলতে যেত না, যেখানে জাহাজের একপ্রান্তে গুলি করলে অন্যপ্রান্ত থেকে শোনা যায়। এমনও হতে পারে সে হয়ত কি ঘটতে পারে সে ব্যাপারে পাত্তাই দেয়নি। গত বার ঘণ্টা ধরে সে পেট-এর সামনে বসে আছে। মাঝে মাঝে আবোল তাবোল কথা বলছে। কখনো কেঁদে উঠছে, আবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ছে। পেট অনেক চেষ্টা করছে লোকটাকে থামিয়ে তার মনে একটু শান্তি দিতে। যদিও তাদের দুজনকেই নির্দিষ্ট দূরত্বে শেকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। পেট-এর হাতে লাগানো রিংটাকে আবার আরেকটা শেকল দিয়ে পায়ের সাথে আটকে রাখা হয়েছে। যার ফলে লোকটার কাছে গিয়ে তাকে আঘাত করা পেটের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তবে পেট নিশ্চিত যে স্বর্গীয় দূত যেহেতু এই লোকটিকে এখানে এনেছে তাহলে নিশ্চয়ই এর কোনো একটা বিহিত হবেই। তবে এটা নিশ্চিত যে ঘটনা পেট এর দিকেই এগুচ্ছে।

জাহাজের দেয়ালগুলো এমনভাবে তৈরি যে সবকিছু পরিষ্কারভাবে শোনা না গেলেও বেশ ভালই শোনা যাচ্ছিল। অনেক দৌড়ঝাঁপ এবং চলাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। হয়ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বা মালামাল উঠানোর জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করছিল ওরা।

অবশেষে পেট শুনতে পায় যে একটা নৌকো নিচে নামানো হচ্ছে। যদিও অনেকটা নীরবতার সাথে করা হচ্ছে পুরো কাজটা যেন ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা কাউকে অবগত করতে চাচ্ছে না। কিন্তু যখনই নৌকোটা নিচে নামানো হলো তখন জাহাজে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের কথায় একটু বিতর্কের আভাস পাওয়া গেল। ব্যাপার যাই হোক, এটা নিশ্চিত যে তারা পেটকে নিয়ে কোনো কথা বলছে না বা পেট-এর দিকে কোনো মনোযোগ দিচ্ছে না।

আর তাই সে বিনা পরিশ্রমে তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সে আস্তে আস্তে সামনে এগোতে শুরু করেছে। তার পায়ের ব্যথাকে উপেক্ষা করে সে শিকারী চিতাবাঘের মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

পেট খুব নীরবে সতর্কতার সাথে এগিয়ে যেতে লাগল যেন শব্দ শুনে শিকার সজাগ না হয়ে যায়। লোকটা হঠাৎ পেট-এর আগমন দেখে শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল; সে বুঝতে পারছে যে সে কোনো একটা বিপদের ভেতর রয়েছে। সে পেট-এর দিক থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও লোকটার ভয়ার্ত সাদা চোখ চকচক করছিল। পেছনে যেতে যেতে লোকটা জাহাজের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলল, আর বুঝতে পারল যে খুন করার উদ্দেশ্যেই কেউ কারও দিকে এভাবে এগোয়।

পেট সামনে এগুতে থাকে। সে যখন তার ভয়ার্ত শিকার ধরে ফেলতে যাচ্ছিল তখনই তার পায়ের শেখলে টান পড়ে। সে বিপদ বুঝতে পেরে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত লোকটির পা ঝাঁপটে ধরে ফেলে সে। লোকটি পা নাড়া দিয়ে পেটকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু পেট শক্তভাবে ধরে লোকটিকে নিজের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করতে থাকে। লোকটিও খুব শক্তভাবে জাহাজের ডেক ধরে রাখার চেষ্টা করে। আঙুলগুলো হুক-এ ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে সে। কিন্তু এই বন্ধ ঘরে দেয়াল মেঝে সবকিছু ইঁদুরের বিষ্ঠায় পিচ্ছিল হয়েছিল। তাই লোকটির আর কিছুই করার ছিল না।

লোকটি আবারও জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। তার কণ্ঠ ভয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। সে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধহয় ওর প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তার হয়ত অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল। সেই স্বর্গীয় দূত আর অন্যান্য ফেরেশতারা হয়ত পেট-এর পক্ষ হয়ে প্রার্থনা করছিল। এখন পেট-এর মুখ লোকটির দুর্গন্ধময় উরুর কাছাকাছি চলে এসেছে। এরপরেও পেট ক্রমাগত তাকে নিজের দিকে টেনে আনছে। সত্যটা হচ্ছে যে তার নিজের জীবনও এটার ওপর নির্ভর করছে।

“চুপচাপ থাক। তাহলে আমি দ্রুত কাজ সেরে ফেলতে পারব,” পেট এমনভাবে বলল যেন সে তার নিঃশ্বাসের অপচয় করছে। লকলকে চিকন আঙুলগুলো পেট-এর মুখে থাবা দিল; লোকটি প্রাণপণে চেষ্টা করছিল পেটকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পেট লোকটির থাবা সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের হাত লোকটির শরীরের উপরের দিকে উঠাতে থাকে। একসময় লোকটির কণ্ঠনালী পেয়ে যায় সে। এরপর নিজের হাত দিয়ে লোকটির স্বরনালী চেপে ধরে।

অপুষ্টিতে ভুগলেও বন্দি নাবিকটির শক্তির অভাব ছিল না। অনেক বছর সমুদ্রে কাটানো, মাস্তুল বেয়ে উঠা-নামা করা, যুদ্ধ করা সবমিলিয়ে লোকটি বেশ শক্তিশালী ছিল। সে পেট-এর থাবা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে আততায়ীর হাত। কিন্তু উইলিয়াম পেট অত্যন্ত কৌশলী লোক। সে এর আগে বহুবার এই কাজ করেছে। সে জানে কোন মুহূর্তে কী ধরনের বাধা আসতে পারে। সে জানে যে এই মুহূর্তে শুধু আর একটু সময় হাতের থাবাটাকে আটকে রাখতে হবে। শুধু আর একটু সময়।

এই ধরনের কাজে পেট একজন বিশেষজ্ঞ বটে; অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার হাতে। দক্ষ লোকের মতোই সে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। লোকটির হাত আস্তে আস্তে শিথিল হতে থাকে। ধীরে ধীরে নীরব হয়ে যায় লোকটি।

পেট এখনো শক্ত করে ধরে আছে লোকটার গলা। মৃত লোকটি শেষবারের মতো কেঁপে উঠল। এরপর সবকিছু শেষ।

ভালভাবে কাজ সম্পন্ন করেছে, সেই স্বর্গীয় কণ্ঠটি ফিসফিস করে বলে উঠল, …”কিন্তু তুমি একটা জাহাজে আছ। এরপর থেকে কোনো একটা লম্বা কাঠের টুকরা বা ধাতব পিন কান-এর ভেতর দিয়ে ব্রেইন-এ ঢুকিয়ে দিবে। তাহলে আর সন্দেহ করার মতো কোনো চিহ্ন থাকবে না, আর কাজটাও দ্রুত সম্পন্ন হবে।”

স্বর্গীয় কণ্ঠটি ঠিকই বলেছে। এরপর থেকে এভাবেই ভাববে সে। কিন্তু এখন তাকে মুক্তির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

তার আগে মৃত লোকটিকে একপাশে এমনভাবে রেখে দিতে হবে যেন দেখে মনে হয় যে ঘুমের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শেকলে বাঁধা থাকার কারণে পেট লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারল না। তাই সে মৃত লোকটির শরীরটাকে উল্টিয়ে দেয়, যার ফলে সে উপুর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।

এরপর পেট নিজের জায়গায় সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

*

হাল আস্তে ধীরে অনেকটা নমনীয় নির্ভরতার সাথে মাস্তুলের উপরে উঠতে লাগল। যখন সে একেবারে চূড়ায় নাবিকের বসার জায়গাটিতে উঠে আসে তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় চাঁদের আলোর ফাঁকে এক চিলতে মেঘ দেখা যাচ্ছে। তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা দ্রুত হয়ে এসেছে যেটা এক সময় দিনে দুই-তিন বার মাস্তুলে উঠা-নামা করার সময়ও হত না। কিন্তু এখনো বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার আনন্দটা শেষ হয়ে যায়নি। স্নিগ্ধ, কোমল নরম বাতাসকে এখনো সর্বরোগের ওষুধ মনে হয়। জাহাজে পালের ভেজা, বাসি গন্ধ, সাগরের পানির ওপার থেকে ভেসে আসা আফ্রিকার মাটির মিষ্টি গন্ধ এখনো এক অন্যরকম অনুভূতি জাগায় হাল-এর মনে।

হাল উত্তর দিকে তাকিয়ে ডাচদের কোনো চিহ্ন দেখা যায় কি-না সেটা খুঁজতে থাকে। হঠাৎ করে সাদা রঙের কিছু একটা হাল-এর চোখে দৃশ্যমান হলো-পরমুহূর্তেই সে বুঝতে পারল যে ওটা আর কিছুই নয়, বরং মেঘ ভেদ করে চাঁদের আলো বেরিয়ে এসেছে। হাল-এর নিজের দৃষ্টি শক্তির প্রখরতার ওপর আত্মবিশ্বাস আছে। সে জানে জাহাজের অন্য কারও চেয়ে তার চোখের তীক্ষ্ণতা অনেক বেশি। একারণেই সে নিজ চোখে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যকারও ওপর ভরসা করে সে স্বস্তি পাচ্ছিল না। কিন্তু সে চাঁদের মৃদু আলোতে দূর থেকে দূরান্তে দৃষ্টি প্রসারিত করেও কিছু খুঁজে পেল না।

“তাহলে তুমি কোথায়?” সে বিড়বিড় করে নিজের মনে বলে উঠল। রাতের চাদরের কিনারায় লেগে থাকা এক চিলতে রক্তের দাগের মতো করে সকালের সূর্যটা উঁকি দিতে থাকে। জাহাজটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই একটু নড়ে উঠল যেন ওটা তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কুয়াশা জাহাজটার চারপাশটাকে ঘিরে রেখেছে। সামুদ্রিক ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে ধাক্কা খেয়ে এক ধরনের মৃদু শব্দ করছে। জাহাজটাও সেই ঢেউ-এর তালে তালে দুলতে থাকে। হাল হয়ত বাচ্চা ছেলের মতো তার কেবিন-এ ঘুমিয়ে থাকত যদি না নেড টেইলর তাকে হঠাৎ করেই ডাকত। সে চাচ্ছিল নোঙর ফেলে এখানেই থেকে যেতে। এরকম জোরালো ঢেউ-এর ভেতর যাত্রা শুরু করাটা ভয়ংকর ব্যাপার হবে, তার চাইতে জাহাজটা এখন যেখানে আছে সেখানে থাকাটাই অনেক নিরাপদ মনে করছে সে।

হাল-এর মনে এখন একটু অপরাধবোধ কাজ করছে। তারুণ্যের পতাকা বহন করে ছেলেমানুষের মতো এখানে উঠে না এসে ক্যাপ্টেন-এর মতো করে ডেক-এ থাকলেই বরং বেশি ভাল হত। কিন্তু সে এখনি হাল ছেড়ে দিতে নারাজ; তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় তাকে বলছে যে এখনো ডাচরা আশেপাশেই রয়েছে। তিনটা পালযুক্ত ছোট্ট একটা কারাভেল ছিল ওটা। হাল অনুমান করল যে ওটা স্পেনিশ বা পর্তুগীজদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে, কারণ ডাচদের এরকম কারাভেল দেখা যায় না। ওটা আকারে বড়জোর বাউ-এর অর্ধেক হবে তাই এরকম জাহাজ নিয়ে হাল দুশ্চিন্তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ যুদ্ধ করতে আসলে ওটাকে উড়িয়ে দেয়া বাউ-এর জন্য কোনো ব্যাপারই না।

সে চোখদুটোকে সরু করে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন কুয়াশা ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে অসীমে। যুদ্ধ শেষে ইংরেজ এবং ডাচদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যদিও হাল-এর তাতে কিছু যায় আসে না; তার বাবার মৃত্যুর জন্য ডাচরাই দায়ী। কেপ কলোনির ডার্চ গভর্নর-এর আদেশেই তার বাবার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। যুদ্ধ সে বৈধতা দিয়েছে। যে নিয়ম। বেঁধে দিয়েছে সেটা হাল মেনে নিয়েছে। কিন্তু সুযোগ পেলে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিবে সে। ডাচদের রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে।

হঠাৎ তার মনে হলো যে সে ডাদের জাহাজটাকে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু ওটা নিমিষেই কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। অ্যাবোলি ঠিকই বলে? স্যার ফ্রান্সিস হালকে জাহাজ পরিচালনার জন্য যথাযযাগ্যভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে যেটা হালকে তার বাবা শিখিয়ে দেয় নি। কিন্তু একজন যোদ্ধার সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে সেটা এমনিতেই তার মধ্যে তৈরি হয়েছে। হাল অনুভব করে সেই সহজাত প্রবৃত্তি যেটা তার রক্তের সাথে মিশে শিরায় প্রবাহিত হয়। সেই সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই সে তার নরম বিছানা এবং বিছানার ওপর সুন্দরী রমণী রেখে উঠে আসতে পেরেছে। সেই সহজাত প্রবৃত্তিটাই তাকে এখনকার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছে।”

গোল্ডেন বাউ-এর ডেক-এর ওপর উড়ে আসা হুকগুলোকে হাল প্রথমে দেখতে পায়নি ঠিকই, কিন্তু কুয়াশার মাঝ দিয়ে অন্ধকার ভেদ করে আসতে থাকা ছায়াগুলোকে সে-ই প্রথমে দেখতে পায়।

“তৈরি হও! তৈরি হও সবাই,” চিৎকার করে সতর্ক বাণী পাঠাল হাল। আর তখনই অন্ধকার ভেদ করে বন্দুকের গুলির শব্দ পাওয়া যায়। বন্দুকের গুলির আলোয় শত্রু পক্ষের মুখ সে প্রথমবারের মতো দেখতে পায়। হাল এরই মধ্যে ওপর থেকে নামতে শুরু করে দিয়েছে।

.

সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাল কারণ অ্যামাডোডা উপজাতিরা খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। আর তাই, সবার আগে এই লোকগুলো দ্রুত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে যেতে পারল। উপজাতীয়রা লাঠি, বর্শা, কুঠার এসব হাতে নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে। মাস্তুল থেকে প্রায় অর্ধেকটা পথ নেমে যার পর সে বুঝতে পারল যে যারা আক্রমণ করতে এসেছে তাদের হাতে ভারী অস্ত্র রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে পিস্তল আছে, সেই সাথে কাঁধে ঝুলানো আছে আরো এক জোড়া। যখন হাল নিচের দিকে তাকায়, সে দেখতে পায় যে শক্রর ছোঁড়া বুলেট একজন অ্যামাডোডার বুকে বিঁধেছে। লোকটি ডেক-এর ওপর পড়ে যায়, তার চোখের বল ঘুরে গিয়ে সাদা অংশ সামনে চলে আসে।

আর পাঁচ ফিট বাকি থাকতেই লাফ দিয়ে ডেক-এর ওপর নেমে আসল হাল। যখন সে পাটাতনের ওপর পা রাখল তখনই তার মনে হলো যে সে অস্ত্র শূন্য। কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় তার পিস্তল এবং তলোয়ার দুটোই আনতে ভুলে গিয়েছে সে।

“গান্ডওয়েন, এটা নাও!” হাল ঘুরে তাকিয়ে অ্যাবোলির ছুঁড়ে দেয়া তরবারির বাঁটটা দ্রুত ধরে ফেলে। এরপর তরবারি হাতে সে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমেই একজনের মুখে আঘাত করে, এরপর অন্য একজনের পেটে সজোরে ঢুকিয়ে দেয় ধারালো প্রান্তটা।

“গোল্ডেন বাউ-এর অধিবাসীরা কোথায়?” সে চিৎকার দিয়ে উঠে। তার সাথে সাথে অ্যামাডোডারাও হর্ষধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে ধেয়ে গেল। ততক্ষণে গোল্ডেন বাউয়ের বাকি ক্রু মেম্বাররাও চলে এসেছে।

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাল আর অ্যাবোলি শত্রুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ওদিকে গুলি ভরা পিস্তল হাতে ওলন্দাজরা এগিয়ে আসছে।

এক বিশাল আকারের ওলন্দাজ-যার ঘন কালো দাঁড়িতে সমস্ত মুখ প্রায় ঢেকে আছে-তার বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে, এরপর ওটা দিয়ে পেছন দিকে সজোরে আঘাত করে। তিনজন অ্যামাডোডা সৈন্য মাটিতে লুটিতে পড়ল। কিন্তু বিগ ডেনিয়েল এখনো টিকে আছে। তার তলোয়ার একটা মৃত মানুষের কাঁধে আটকে আছে। কিন্তু তার গায়ের শক্তিও কোনো ধারালো অস্ত্রের চেয়ে কম নয়। সে তার বাহু দিয়ে আঘাত করে এক ওলন্দাজের হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিল। এরপর লোকটার দাড়ি দুইহাত দিয়ে ধরে সামনে টেনে নিয়ে যেতে লাগল, এরপর নিজের মাথা দিয়ে ওলন্দাজটার নাকে আঘাত করে বসলো। হাড় ভেঙে যাওয়ার যে শব্দটা হলো তা এই বিশৃংখলার ভেতরেও শুনতে পেল হাল।

ওলন্দাজটার মুখ আর দাড়ি রক্তে ভিজে গিয়েছে। বিগ ডেনিয়েল অন্যদিকে তাকিয়ে মৃত লোকটার কাঁধ থেকে নিজের তলোয়ার ছাড়িয়ে আনে। এরপর কসাই যেভাবে মাংসের দিকে তাকায়, ঠিক সেভাবে ওলন্দাজটার দিকে তাকাল।

হাল চিৎকার দিয়ে বিজয়ের উল্লাস করে উঠে। হঠাৎ আক্রমণ করে ডাচ যে সুবিধাটা পেতে চেয়েছিল সেই সুবিধাটা ওদেরকে পেতে দেয়নি গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা। তারা অতিদ্রুত প্রস্তুত হয়ে দক্ষতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিজয় এখনো সম্পূর্ণ তাদের হাতে আসেনি। কিন্তু হাল সেই ছোটবেলা থেকেই জাহাজের ওপর যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখে শিখেছে যে বিজয় কার দিকে যেতে পারে। শেষ মুহূর্তের কোনো আক্রমণও যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সবাইকে একত্র করার উদ্দেশ্যে চিৎকার দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে সে অ্যাবোলির কণ্ঠ শুনতে পায়।

“গান্ডওয়েন!”

সে ঘুরে তাকায়-অ্যাবোলি তলোয়ার হাতে নিয়ে জাহাজের পেছনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

“না”, সে নিজের অজান্তেই বলে উঠে, “এটা হতে পারে না।”

*

জুডিথ অসুস্থ হওয়ার কারণে বিছানা থেকে উঠে বমি করার জন্য একটা বেডপেন খুঁজতে বের হয়। এই বমি বমি ভাবটাই তার জীবনকে বাঁচিয়ে দেয়। সে দেখতে পায় কুয়াশার মধ্যে কিছু ছায়াশরীর এগিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন-এর জানালা দিয়ে গোল্ডেন বাউ-এর ভেতরে ঢুকছিল লোকগুলো। এরপর ওদের মাঝেই একজন লোক পেন্ডুলাম-এর মতো দেখতে একটা মোটা রশি ঝুলিয়ে দেয় গোল্ডেন বাউ জাহাজ থেকে। সেই রশি বেয়ে আরো ছায়াশরীর উপরে উঠতে থাকে।

শত্রুর জন্য অপেক্ষা করছে জুডিথ। তার পরনে ছিল নাইট গাউন, হাতে শোভা পাচ্ছে ওর তলোয়ার যাকে সে কাস্কারা বলে ডাকে। ভাগ্যিস, গোল্ডেন বাউতে আসার সময় তার লাগেজের সাথে করে অন্যান্য মিলিটারি সরঞ্জামের সাথে ছোট্ট তলোয়ারটা এনেছিল!

যে ওলন্দাজটা সবার প্রথমে তার কেবিনে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়েছিল, তার পুরো শরীর ভেতরে আনার আগেই কাস্কারার এক কোপে গলাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল। লোকটি যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন জুডিথ অনেকটা নতত্যর ভঙ্গিতে খুব দ্রুত তার কাছ থেকে সরে গিয়ে দ্বিতীয় আক্রমণকারীর দিকে এগিয়ে যায়, এরপর লোকটির পেছনে গিয়ে কিডনি বরাবর শক্ত হাতে আঘাত করে। ওলন্দাজটা চিৎকার দিয়ে গোঙাতে গোঙাতে মুহূর্তেই ভূপাতিত হয়ে যায়।

আরও লোকজন জুডিথের কেবিনে ঢুকতে থাকে। জুডিথ বুঝতে পারে সে একটা বড় বিপদের মধ্যে রয়েছে। কেবিনের একপাশে সরে গিয়ে দরজাটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ করতে থাকে সে। দরজার কাছ থেকে দ্রুত সরে এসে তলোয়ারটাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘুরিয়ে শত্রুদের ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে জুডিথ। ক্রমাগত বাড়তে থাকা শক্ৰসংখ্যার বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে যে তার বাম কাঁধের ওপর দিক থেকে একটা আঘাত এগিয়ে আসছে। নিজেকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে আঘাতটা প্রতিহত করার চেষ্টা করে জুডিথ। সেই সাথে নিজের তলোয়ারটা আক্রমণকারীর বাহুতে বসিয়ে দিয়ে দু’টুকরা করে ফেলে। জুডিথ তার কঠোর যুদ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে যুদ্ধে টিকে থাকার প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে : শত্রুদের চিৎকার চেঁচামেচির ভেতর মাথা ঠাণ্ডা রেখে অস্ত্র চালনায় পূর্ণ মনোযোগ দেয়া, শান্তভাবে প্রতিটি হিসেব কষা, আশেপাশের শত্রুদের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করা, শত্রুর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করা।

যদিও জুডিথ নিজের জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে যুদ্ধ করছে তবুও সে শত্রুদের মধ্যে ভীষণ বেপরোয়া ভাব দেখতে পাচ্ছে। জুডিথের শত্রুদের চোখে মুখে বন্যক্ষুধা উপচে পড়ছে যখন তারা দেখছে যে তাদের তলোয়ার-এর আঘাতকে সে বারবার প্রতিহত করছে। কিন্তু প্রতিটা আঘাত ফিরিয়ে দেয়ার সাথে সাথে তার শক্তি একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে আসছে।

সে আফ্রিকায় বেড়ে উঠেছে। সে জানে ক্ষুধা কি জিনিস, আর তাই, একজন ক্ষুধার্ত মানুষ দেখেই সে চিনতে পারে। এই হানাদার বাহিনীরা যারাই হোক না কেন তারা এমনভাবে আক্রমণ করছে যেন তাদের হারানোর কিছুই নেই। ওপর থেকে যুদ্ধের গোলাগুলি, চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। জুডিথ বুঝতে পারে যে হাল এবং তার নাবিকেরা প্রাণপণে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছে। গোল্ডেন বাউ-এর ভবিষ্যৎ তলোয়ার-এর তীক্ষ্ণতা আর ধার-এর ওপর নির্ভর করছে।

তাদেরকে জিততে হবে। জুডিথকে বেঁচে থাকতে হবে। তার নিজের জন্য না হলেও তার ভেতরে বেড়ে ওঠা অনাগত সন্তানের জন্য বেচে থাকতে হবে। সে নিজের ভেতর যুদ্ধ করার এক ধরনের স্পৃহা, এক ধরনের প্যাসন অনুভব করে। সে জানে শত্রুপক্ষকে কখনো তার মুখোমুখি আসতে দেয়া যাবে না। তার আগেই যেভাবে হোক তাদের প্রতিহত করতে হবে। কেবিনের দরজার পাশে সে এরই মধ্যে দুই তিনজনকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। পরবর্তী আক্রমণের জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে থাকে সে। যখন দেখে কেউই আসছে না তখন সে আস্তে আস্তে কেবিনের বাইরে বের হয়। কোয়াটার ডেক এর দিকে এগুতে থাকে যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য।

জুডিথ-এক সেকেন্ডের জন্য থামে। কিন্তু সেই এক সেকেন্ড সময়ই তার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় হয়ে দাঁড়ায়। সে হঠাৎ বুঝতে পারে যে পেছন থেকে কেউ একজন তাকে ধরে ফেলেছে। একটা হাত তার কোমড় জড়িয়ে ধরেছে, আরেকটা হাত তার গলায়। পেছনের লোকটি তাকে আঁকড়ে ধরে উপরে উঠিয়ে ফেলে। হাত দিয়ে, তলোয়ার দিয়ে নানাভাবে লোকটিকে আঘাত করে মুক্ত হবার চেষ্টা করে জুডিথ, কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

লোকটি হাসতে হাসতে চিৎকার করে ওলন্দাজ ভাষায় কিছু একটা বলছিল।

জুডিথ ওলন্দাজ ভাষা জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারে লোকটি চিৎকার করে ক্যাপ্টেনকে ডাকছে। সে খুব ভালভাবেই জানে যে হাল কখনোই জুডিথের জীবনের ঝুঁকি নিবে না। এমনকি গোল্ডেন বাউ-এর জন্যও না। তার মানে হচ্ছে, জুডিথ যার কজায় থাকবে, গোল্ডেন বাউও তারই হবে।

জুডিথ অসহায়ভাবে তলোয়ার ফেলে দিয়ে হাল ছেড়ে দেয়। তলোয়ার নিচে পড়ার শব্দ তার কানে যায় না। সে শুধু বুঝতে পারে যে তার কারণেই গোল্ডেন বাউ আজকে যুদ্ধে হেরে যাবে।

.

জুডিথ-এর পেছনে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায় হাল। সাথে সাথে সে বুঝতে পারে যে জুডিথ কোনো একটা বিপদে আছে। তার এবং জুডিথ-এর মাঝখানে ওলন্দাজ আর অ্যামাডোডা যোদ্ধারা আছে। সবার মাঝখান দিয়ে জুডিথ-এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। জুডিথকে ধরে ফেলে লোকটি, এরপর ঝাঁপটে ধরে তার গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়।

তাদের সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে যাকে জুডিথ ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন বলে সনাক্ত করে। তার পোশাক অন্যান্য নাবিকদের চেয়ে একটু আলাদা। সিল্কের পাড় দেয়া সাদা রঙের ওয়েস্টকোট পরে আছে লোকটা। সামনে এগুতে এগুতে লোকজনকে আদেশ দিচ্ছে সে। হঠাৎ মাথার হ্যাটটা খুলে ডেক-এর ওপর ভেসে থাকা ধোয়ার মধ্যে ছড়িয়ে দিল ক্যাপ্টেন। পূর্ব দিকে আস্তে আস্তে সূর্য উঠতে থাকে। সকালের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো জাহাজের ওপর পড়তে শুরু করেছে। ওলন্দজরা যদি আর কিছুক্ষণ পর আসত তাহলে হাল ওদেরকে জাহাজে উঠার সুযোগই দিত না। কিন্তু ভাগ্য আজ শত্রুদের পক্ষে।

হাল সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ধারালো তলোয়ারটা এখনো তার হাতে ধরা। কিন্তু এটা ব্যবহার করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। সবাই আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। তাই এখন আর লড়াই করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। লড়াই বাদ দিয়ে কেউ কেউ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কেউ কেউ ব্যথায় চিৎকার করছে। একজন তার উড়ে যাওয়া ডান হাতটা বাম হাত দিয়ে ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে-ভাবছে, ওটা কিভাবে এখানে এল।

“আমি স্যার হেনরি কার্টনি। গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন।” হাল চিৎকার করে বলল, এরপর নিজের তলোয়ারটা ডাচ্ ক্যাপ্টেন-এর দিকে বাড়িয়ে দিল। “আর তুমি? তুমি একজন কাপুরুষ!” তুমি চোরের মতো একজন নারীকে পেছন থেকে আক্রমণ করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছ।’

ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকাল। পরমুহূর্তেই তার দৃষ্টি ফিরে এলো সামনের দিকে। “যে নারী পুরুষের মতো যুদ্ধ করতে পারে তাকে আমাদের সেভাবেই ভাবা উচিত। কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাপ্টেন, এরপর চেহারায় এক ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে বলল, “এসবে কী আসে যায়? চলুন আমরা এসব অর্থহীন যুদ্ধ বন্ধ করে ভাল মানুষের মতো কথা বলি।”

দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায় হাল। সে তার আগের প্রেমিকা সুকিনাকেও একই রকম পরিণতি বরণ করতে দেখেছে-ওই সময় সেও তার সন্তান-এর মা হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সুকিনা আর তার অনাগত সন্তান হাল-এর বাহুর উপরে মারা গিয়েছিল। সে জুডিথেরও একইরকম পরিণতি দেখতে চায় না। সে চায় না তার আরেকটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগে মৃত্যুবরণ করুক।

যে কারণে সে আর তার নাবিকেরা প্রাণপণে যুদ্ধ করেছে, সেটা সে এত সহজে কীভাবে ছেড়ে দেয়? একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে এখন তার কী আচরণ করা উচিত? কোয়ার্টার ডেক-এর দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ মনে মনে ভাবতে লাগল যে তার বাবা স্যার ফ্রান্সিস সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। গর্বিত, সোজা মস্তকে তার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, সেই সাথে হাল-এর মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

কিন্তু সেই প্রতিচ্ছায়া হালকে বলে দিল যে এখন কি করতে হবে। গোল্ডেন বাউ তারই জাহাজ ছিল। সে-ই এটার প্রথম ক্যাপ্টেন ছিল।

“আমি ডেফট-জাহাজের ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প। আর এখন দেখা যাচ্ছে…” ওলন্দাজটা মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলতে শুরু করল, “…এখন থেকে এই গোল্ডেন বাউ-এরও ক্যাপ্টেন।”

ট্রোম্পস-এর লোকেরা সাথে সাথে উল্লাসধ্বনি করে উঠল। গোল্ডেন বাউ এর নাবিকেরা হতবাক হয়ে হাল-এর দিকে তাকিয়ে রইলো। তাদের হাতে এখনো রক্তমাখা অস্ত্র। হাল আদেশ দিলেই তারা আরেকবার গর্জে উঠবে। গোল্ডেন বাউ-এ রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে। কিন্তু হাল-এর ভালবাসা আর তার আগত সন্তানের কারণে ওরা সেটা করতে পারছে না।

“আমরা এক থেকে পাঁচ গুনব”, ক্যাপ্টেন ট্রোম্প। হাল জুড়িথের প্রতি তার দুর্বলতা লুকোনোর চেষ্টা করে গর্জে উঠল। এবং আশা করল জুডিথও যেন সেটা বুঝতে না পারে। একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে জাহাজের প্রতি তার দায়িত্বকে সে সবকিছুর উপরে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করে।

“কিন্তু আপনি এখন আর যুদ্ধ করছেন না”, ট্রোম্প বলে উঠে। তাই আমি বলতে পারি যে, এই নারীকে বাঁচানোর জন্য আপনি যেকোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি আছেন, তাই না?” “ক্যাপ্টেন আমি মনে করি যে, আপনি একজন ভদ্রলোক। যে কারণে আপনি হাতের তলোয়ার ফেলে দিয়েছেন সেটা শুধুই একজন নারীর জীবন রক্ষা করার জন্য নয়। এই মেয়ের কাছে আপনার হৃদয় দিয়ে বসে আছেন, তাই না, ক্যাপ্টেন?”

জুডিথ-এর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল হাল। ভোরের সূর্যের আলোতে সে ঐ চোখের তেজ দেখতে পেল পরিষ্কারভাবে। জুডিথ-এর মধ্যে ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না সে। একজন লোক পেছন থেকে তার গলায় ছুরি ধরে থাকার পরেও জুডিথ স্থিরচিত্তে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

‘“আমার মনে হয় না ওরা জুডিথকে হত্যা করবে,” হাল-এর কাঁধের ওপর দিয়ে অ্যাবোলি ফিসফিসিয়ে বলে উঠে, “কারণ ওরা জানে যে ওরা যদি এটা করে তবে ওরা সকলেই এখানে মারা পড়বে।”

|“আমাদেরকে শুধু একবার আদেশ দিন। আমরা ওদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলব। রবার্ট মুন নামে গোল্ডেন বাউ-এর একজন সর্দার হালকে উদ্দেশ্য করে বলে।”

জন লোভেল নামে আরেকজন সর্দার ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠে, “আমরা ওদের কলিজা কেটে হাঙরকে খেতে দিব।”

হাল তার মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ অনুভব করে। এরকম মুহূর্তে তার কী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। একদিকে তার জাহাজ, তার নাবিকেরা আর অন্যদিকে তার ভালবাসার মানুষটা, যার পেটে তার সন্তান।

“আমি কীভাবে ওর ক্ষতি হতে দেই অ্যাবোলি?” হাল ফিসফিস করে বলে উঠে, সেই সাথে তার তলোয়ারটা নামিয়ে নিতে শুরু করে। ঠিক সেই মুহূর্তেই জুডিথ মাথা দিয়ে তার গলা ধরে থাকা লোকটার নাকে সজোরে আঘাত করে। লোকটার নাকে ডিমের খোলস ভাঙার মতো আওয়াজ পাওয়া গেল। ব্যথায় কাতরে উঠে লোকটি। নাবিকটি সাথে সাথে জুডিথকে ছেড়ে দিল, এরপর ছুরিটা ফেলে দিয়ে দুই হাত দিয়ে রক্তাক্ত নাকটা চেপে ধরল। মুহূর্তের মধ্যেই জুডিথ তার তলোয়ার উঠিয়ে নিল, এরপর তার দিকে এগিয়ে আসা লোকটির পেটে ঢুকিয়ে দিল বাটসহ। পরক্ষণেই ট্রোম্প-এর দিকে লাফ দেয় সে। ট্রোম্প-এর সমস্ত মনোযোগ ছিল হাল-এর দিকে। তার পেছনে কি ঘটে যাচ্ছে এটা বুঝতে তার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে। যতক্ষণে সে বুঝতে পারে ততক্ষণে জুডিথ তার তলোয়ার-এর লম্বা অগ্রভাগ ট্রাম্প-এর গলায় বসিয়ে দিয়েছে।

এটা দেখার সাথে সাথে ট্রোম্প-এর কিছু লোক হাল-এর লোকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে যুদ্ধ কিংবা মৃত্যু এই দুটোর যে কোনো একটি তাদের বেছে নিতে হবে। কিন্তু তারা টিকতে পারে না। ট্রোম্প-এর বাকি লোকেরা হাঁটু গেড়ে বসে হাতের তলোয়ার উঁচিয়ে ধরল-আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে ওরা।

“ইট ইজ ওভার, ক্যাপ্টেন”, অ্যাবোলি ট্রোম্প-এর গলায় জুডিথ-এর ধরে রাখা তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে।

এই লোকগুলো জুডিথকে কতটা বিপদের মুখে ফেলেছিল, সেই সাথে তার জাহাজকে আত্মসমর্পণের কতটা শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, এটা মনে আসা মাত্র হাল প্রচণ্ড রাগে, ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠে। হাল সামনের দিকে এগিয়ে ট্রোম্প-এর গলা কেটে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অ্যাবোলি তার কাঁধে হাত রেখে বাধা দিল।

“ইট ইজ ওভার”, সে আবারও বলে। ক্রোধ থামিয়ে নিজের শরীর আর পেশিকে শান্ত করতে হাল-এর কিছুটা সময় লাগে। তারপর সে হেঁটে হেঁটে জুডিথ আর ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর দিকে এগিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন ট্রোম্প আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তার তলোয়ার-এর বাটটা সামনের দিকে এগিয়ে রেখেছে। জুডিথ-এর কাস্কারার অগ্রভাগ এখনো ট্রোম্প-এর গলায় ঠেকানো আছে।

“আমি আত্মসমর্পণ করলাম, ক্যাপ্টেন কার্টনি”, ওলন্দাজটা তার নাকটাকে হাল-এর দিকে ঘুরিয়ে বলল। সে তার মাথাটাকে এক বিন্দুও এদিক সেদিক নাড়ানোর সাহস পাচ্ছে না।

“এত সহজ নয়”, হাল গর্জন করে উঠে এবং তলোয়ারটা তার হাত থেকে কেড়ে দিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাবোলির দিকে ছুঁড়ে মারে। “তোমার মতো বোকার পক্ষেই আমার জাহাজ কেড়ে নেয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করা সম্ভব।”

হাল জুডিথ-এর দিকে তাকায়। জুডিথ দ্রুত মাথা নাড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করে যে, সে আর তার সন্তান অক্ষত আছে। তার হয়ত একে অপরকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বিজয় উদযাপন করার সময় পাবে, কিন্তু সেটা এখন নয়।

ট্রোম্প তাকিয়ে তাকিয়ে তার সামনে ঘটে যাওয়া ব্যক্তিগত নাটক দেখতে লাগল। বিশালদেহী আফ্রিকান আর তারা ক্যাপ্টেন-এর মধ্যেকার নিবিড় বন্ধন অনুভব করতে পারল সে। সেই সাথে বুঝতে পারল সেই আত্মিক বন্ধন, যেটা ক্যাপ্টেন আর তার সেই প্রেয়সীর মাঝে বিদ্যমান, যে অপূর্ব রূপসী হয়েও অন্য যেকোনো বীর পুরুষের ন্যায় যুদ্ধ করতে পারে।

“আমি বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোক, ক্যাপ্টেন কার্টনি।” সে সাধারণভাবেই কথাটা বলল। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার কাছে ক্ষুধার মতোই ভয়ংকর, যে ক্ষুধা তাকে অল্প কয়েকজন নাবিক নিয়ে এত বড় অস্ত্রসজ্জিত জাহাজ আক্রমণে তাড়িত করেছে।

“তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূল্য এখন তোমাকে জীবন দিয়ে দিতে হবে।” হাল বলল। সে তার ঔদ্ধত্য, উগ্রতা থামিয়ে রাখার চেষ্টা করল। তার বাবা একসময় তাকে বলেছিল বিজয়ী যোদ্ধাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হয়। প্রতিশোধ স্পৃহাকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। সেই ধৈর্যশীলতাকে সে কোমলতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। একজন মহান যোদ্ধা হতে গেলে এই ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির যে চুক্তি হয়েছিল তুমি সেটা ভেঙে ফেলেছ, ক্যাপ্টেন ট্রাম্প।” নিজের তলোয়ারের রক্ত একটা রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে হাল ওলন্দাজটাকে বলল।

“চুক্তি হয়েছিল নাকি? ট্রোম্প চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে জানতে চাইল।”

“তুমি জান না? মাথা মোটা কোথাকার!” মাস্তুল-এর পেছনে লুকিয়ে থাকা হাল-এর একজন লোক চিৎকার দিয়ে উঠে।

“ক্যাপ্টেন ট্রোম্প, চুক্তি না হলেই বরং খুশি হতো, এখানে এমন লোক তুমি একা নও।” হাল বলতে থাকে। এই চুক্তি নাহলে আমি অন্তত খুশিমনে সীমান্তের ভেতরে, বাইরে, এমনকি নরকের দরজা থেকেও ওলন্দাজ ধরে এনে হত্যা করতাম। আমিও আমার বাবার মতো ওলন্দাজদের মৃত্যুর দূত হতাম। দুই দিন আগে যখন তোমার ছায়া দেখতে পাই আমি তখনই তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম।”

“শুনে ভাল লাগল যে, আমাদের দুই দেশ তাদের পুরোনো শত্রুতা ভুলে গিয়েছে। ট্রোম্প খুব ধূর্ত হাসি দিয়ে কথাটা বলল। যে হাসিটার জন্য হয়তো বা অনেক সুন্দরী নারী সারাজীবনের জন্য তার গোলাম হয়ে যেতে রাজি হয়ে যাবে।

ট্রোম্প-এর চেহারা ক্ষুধায় কুচকে যাচ্ছিল। তারপরও হালের মনে হলো যে মেটে রঙের চুল আর ইন্ডিয়ান মহাসাগরের মতো একই রঙের চোখ নিয়ে গঠিত টোম্প-এর চেহারাকে বেশ হ্যান্ডসামই বলা যায়। হাল বুঝতে পারে অ্যাবোলি ঠিকই বলেছে। ট্রোম্প কখনোই জড়িথকে হত্যা করতে পারত না। পাশার দান উল্টে দিতে গিয়ে সে নিজেই হেরে গিয়েছে। এখন সে হাল-এর বন্দি, আর সমুদ্রের নিয়ম অনুযায়ী তার জাহাজ ডেফটও এখন হলি-এর দখলে।

যখন হাল চারদিকে পরীক্ষা করে দেখছিল, তখন সে বুঝতে পারে যে ওলন্দাজরা বাউ আক্রমণ করার জন্য দুটি পানসিতে করে এসেছিল। তবে একদম সামনা সামনি এসে আক্রমণ চালানোর কারণে ওদের সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। ওরা হয়ত গোল্ডেন বাউ দখল করেই ফেলত যদি না অ্যামাডোডা সৈন্যরা খোলা আকাশের নিচে না ঘুমাত। তারা সবাই মিলে একসাথে। চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করেছে। আর সবশেষে জুডিথ-এর সাহস আর দক্ষতাই গোল্ডেন বাউকে ওলন্দাজদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছে। এখন জুডিথ-এর জন্য হাল-এর বেশ গর্ব হচ্ছে।

নাবিকেরা জুডিথকে তার সাহসের জন্য অভ্যর্থনা জানানোর পর সেই গর্ব আরও বেড়ে গেল। তারা জুডিথকে আগে থেকেই পছন্দ করত, তার খ্যাতির প্রশংসা করত। কিন্তু আজকে তারা স্বচক্ষে দেখল যে জুডিথ আসলে কি করতে পারে। জুডিথকে নিয়ে তাদের সমস্ত ভয় এখন গর্বে পরিণত হয়েছে।

“যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও”, হাল জুডিসকে বলে। ওদিকে বিগ ডেনিয়েল আর অ্যাবোলি, ট্রাম্প আর তাদের লোকদের ঠিক মতো বাঁধা হচ্ছে কি-না, তা দেখছে। উইলিয়াম স্টেলি আর অন্যান্য নাবিকরা মৃতদেহগুলো জাহাজ থেকে সরাচ্ছে।

“আমি প্রার্থনা করেছিলাম আমার যেন আর মানুষ খুন করতে না হয়।” জুডিথ তার একটা রক্তমাখা হাত পেটের ওপর রেখে কথাটা বলল। যদিও সে ভয় পাচ্ছিল যে তার পেটের ভেতর থাকা সন্তান যদি কোনোভাবে এসব দ্বারা প্রভাবিত হয়।”

“তুমি জাহাজটা রক্ষা করেছে। মাই হার্টু,” হাল খুব নরম সুরে বলে।

“আমি এক পর্যায়ে ভয়ই পাচ্ছিলাম যে আমার কারণে না আবার তোমাদেরকে জাহাজ হারাতে হয়”, জুডিথ উত্তর দিল। এরপর সে ওলন্দাজ বন্দিদের দিকে তাকিয়ে দেখে ওদেরকে জাহাজের একেবারে নিচের ডেক-এ বন্দিখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে হাল-এর হাতের ওপর একটা নরম ছোঁয়া দিয়ে বলে, “ওদের ক্ষতি করো না।”

“না, আজকে আর কোনো খুনোখুনি নয়।” সে তাকে আশ্বস্ত করে। এরপর হাল পূর্ব দিকে তাকায় যেদিকে সাগরের বুক চিরে সূর্যের সোনালি রঙ ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলে, “যদি ক্যাপ্টেন ট্রাম্প তার জাহাজ আমার হাতে দিয়ে দেয়, তো এসবের আর দরকার হবে না।”

“আপনি চিন্তা করবেন না, ম্যাম, লোকটা এটাই করবে। নাহলে যে তাকে হাঙর-এর মুখে তুলে দেয়া হবে, সেটা সে ভাল করেই জানে।” বিগ ডেনিয়েল ক্যাপ্টেন ট্রাম্পকে ধাক্কা দিয়ে জাহাজের ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল।

আবোলি তাকিয়ে দেখল পরাজিত ক্যাপ্টেন-এর মাথা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এরপর সে হাল-এর সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বলতে শুরু করল যেন অন্য কেউ তা বুঝতে না পারে। আমরা জাহাজ আক্রমণ করতে গেলে যদি ওদের নাবিকেরা আমাদের বাধা দেয় গান্ডওয়েন? আমরা আজকে আমাদের যথেষ্ট লোক হারিয়েছি। আমরা আক্রমণ চালালে হয়ত আরও লোক হারাব। আর বাতাসও আজকে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। যদি ওরা কোনোভাবে জানতে পারে আমরা আসছি তাহলে ওরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে।”

“হুম…”, হাল মাথা নাড়াল এবং ভাবতে লাগল অ্যাবোলির কথার কি জবাব দেয়া যায়। তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা কেবল সমুদ্রে রাজত্ব চালানোর জন্যই হয়েছে। সে কোনোভাবেই একজন পরাজিত ক্যাপ্টেন-এর জাহাজকে ছেড়ে দিতে পারে না।

সে অ্যাবোলির দিকে ফিরে শুদ্ধ ইংরেজিতে বলে উঠল, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। হাল কথাটা এমনভাবে বলল যেন নাবিকেরা শুনতে পায়, সেই সাথে তার কথা থেকে সাহস নিতে পারে।” “ডেনিয়েলকে বল ক্যাপ্টেন ট্রোম্পকে উপরে নিয়ে আসতে। তাকে আমাদের এখানে প্রয়োজন হবে।”

হাল-এর কথা শুনে জাহাজের অন্য সবার চেয়ে যে বেশি খুশি হলো সে হচ্ছে, অ্যাবোলি।

*

ডেফট জাহাজটার নোঙর এখনো ফেলে রাখা হয়েছে। নেড সে টেইলর গোল্ডেন বাউকে ঘুরিয়ে পূর্বদিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে যেন ডেফট-এর বামপাশে চলে যাওয়া যায় সহজেই। এতে করে ডেফট-কে উপকূলের মাটি আর গোল্ডেন বাউ-এর মাঝখানে আটকে ফেলা যাবে। কাছে যেতে যেতে গোল্ডেন বাউ যখন ডেট থেকে দুই নটিকেল মাইল দূরত্বে চলে এলো তখন হাল দেখতে পেলো যে কিছু নাবিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডেফট-এর ওপর অবস্থান করছে। কেউ কেউ মাস্তুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিছু নাবিক পাল ছাড়ার ব্যবস্থা করছে। হাল বুঝতে পারে ট্রাম্প গোল্ডেন বাউ আক্রমণ করতে যাওয়ার সময় কিছু কঙ্কালসার নাবিক জাহাজে রেখে গিয়েছিল। হাল বামহাতে তার চকচকে পাথর খচিত বন্দুক আর ডানহাতে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যেটার শরীর থেকে এই কিছুক্ষণ আগেই শত্রুর রক্ত পরিষ্কার করেছে সে।

“ক্যাপ্টেন, আমাদের পতাকা দেখে তারা হয়ত সহজেই বুঝে ফেলবে। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে ওরা,” বিগ ডেনিয়েল হালকে বলল।

বাউ-এর ডেক-এর ওপর শুধু অল্প কয়েকজন নাবিক রয়েছে যারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিজেদের লুকিয়ে রাখার। আর বাকি সবাইকে হাল নিচে থাকার আদেশ দিয়েছে যেন তারা হাল আদেশ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত ট্রোম্প-এর বন্দিদশা নিশ্চিত করতে পারে।

ট্রোম্প নিজে ডেকের পেছন দিকে হাল-এর কাছ থেকে আট ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর ডান হাতে হাল-এর কথা বলার সিঙাটা ধরে আছে।

সকালের ঠাণ্ডা বাতাস এখনো বইছে। যদিও ওলন্দাজটার চেহারা থেকে নদীর মতো করে বইছে ঘামের পানি। অ্যাবোলি ছুরি হাতে নিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা তরবারিটা সে এমনভাবে ধরে আছে যে যদি ওলন্দাজটা কোনোরকম নড়াচড়া বা চালাকি করার চেষ্টা করে তবে সে খুব সহজেই খোঁজা হয়ে যাবে।

“সবকিছ যদি আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়, তাহলে শক্ররা মনে করে বসবে যে ওদের ক্যাপ্টেন আমাদের জাহাজটা জিতে নিয়েছে, বিগ ডেনিয়েল প্ল্যানটা সবাইকে বুঝিয়ে বলল। “আর সেখানেই ভুলটা করবে তারা।”

হাল-এর বাকি সব লোক অস্ত্র হাতে এখানে সেখানে লুকিয়ে আছে। প্রস্তুত হয়ে আছে যে কখন তাদের এখান থেকে বের হওয়ার ডাক আসবে। জাহাজে লাগানো বন্দুকের মুখগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে বন্দুকের পেছনে লোক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্দুকে গান পাউডর ভর্তি করা হয়েছে যেন আদেশ করা মাত্রই ওরা ডেট-এ গুলি চালাতে পারে।

হাল-একটা গভীর শ্বাস নেয়। পাশে রাখা আলকাতরার ট্যাংক থেকে ভেসে আসা গন্ধ তার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রোম্প-এর দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠে, “এবার আপনাকে যা বলতে বলেছি তা বলুন, স্যার,নয়তো যেকোনো মুহূর্তে আপনি নপুংসক হয়ে যাবেন।”

ওলন্দাজটা বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করতে লাগল। থুতনিতে থাকা দাড়িগুচ্ছকে নাড়াচাড়া করতে লাগল হাত দিয়ে। নিচের দিকে তাকিয়ে তার দুই পায়ের মাঝখানে তাক করা তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ, এরপর কথা বলার সিঙাটা মুখের কাছে এনে সোজা সামনের দিকে তাকাল, এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা বলতে শুরু করল।

“ডেফট-এর লোকেরা আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমরা অনেক বড় একটা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি”, হাল খুব ভাল করেই জানে শান্ত পানির ওপর দিয়ে ট্রোম্প-এর কথা ভেসে গিয়ে ডেফট-এর লোকদের মনে কতটা আনন্দের জোয়ার বয়ে আনবে। “আমি তোমাদের জন্য ইংরেজদের জাহাজ গোল্ডেন বাউ জয় করে নিয়ে এসেছি। এর ভেতর যত ধন সম্পদ আর গুপ্তধন রয়েছে সব এখন তোমাদের।”

ডাচদের জাহাজ থেকে আনন্দ উল্লাসের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ট্রোম্প বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে তার হাতের মুষ্টি আকাশের দিকে তুলে ধরল। তাকে আর কিছু বলতে হবে না। তার কাজ শেষ হয়েছে। অ্যাবোলি হাল-এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। কৌশল কাজে লেগেছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের জাহাজটা ডেফট-এর সাথে গিয়ে ধাক্কা লাগল ততক্ষণ পর্যন্ত হাল অপেক্ষা করল।

“বের হয়ে এসো সবাই,” হাল গর্জে উঠার সাথে সাথেই জাহাজের পাটাতনগুলো খুলে দেয়া হল। সাথে সাথে অস্ত্রে সজ্জিত মুখোশ পরা সব ইংরেজ, স্কটিশ আর আইরিশ লোকেরা সমস্বরে যুদ্ধনিনাদ দিতে দিতে বের হয়ে এল। তাদের পেছনে অ্যামাডোড়া সৈন্যরাও কুঠার হাতে বের হয়ে এসে আরেকবার তাল মেলালো সবার সাথে।

নাবিকরা সবাই এসে ডেক-এ জমা হওয়ার পর হাল কথা বলার শিঙাটা আবার হাতে তুলে নিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রোম্পও ওটাকে হাল-এর হাতে দিয়ে দিল। অ্যাবোলির তাক করে রাখা ছুরিটার দিকে আবারো তার নজর গেল-সেটা যেকোনো মুহূর্তে তার বংশ উৎপাদনের অঙ্গটা কেটে ফেলতে পারে।

“ডেফট-এর নাবিকেরা মন দিয়ে শোন,” ডাচদের উদ্দেশ্যে হাল চিৎকার করে উঠল। “তোমাদের ক্যাপ্টেন কোনো বিজয় অর্জন করেনি। সে আর তার লোকেরা অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজনই বেঁচে আছে, যারা সবাই আমাদের বন্দি হিসেবে আছে। তোমরা যদি আমাকে তোমাদের জাহাজ দিয়ে দাও তাহলে আমি তোমাদের খাদ্য দিব। আর যদি না দাও তাহলে এক টুকরো রুটিও পাবে না। সেই সাথে আমি তোমাদের সাগরে নিক্ষেপ করব।”।

বাউ-এর নাবিকেরা জাহাজের কিনারায় যে অগ্নিমূর্তি ধরে দাঁড়িয়েছিল সেটার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ডেফট-এর লোকদের ভরপেটে খাবার দেয়ার আশ্বাসই যথেষ্ট ছিল। বিনা বাক্য ব্যয়েই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়ে দিল লোকগুলো।

.

যে লোকটি জাহাজের লণ্ঠন হাতে বন্দিশালায় প্রবেশ করল সে পায়খানার গন্ধে চোখ মুখ কুঁচকিয়ে ফেলল সাথে সাথে, এরপর মৃতদেহটি দেখতে পেয়ে ওটার ওপর আলো ফেলল। জুতার অগ্রভাগ দিয়ে দেহটাকে কয়েকবার তত দিয়ে পেছনে দাঁড়ানো লম্বা আফ্রিকান লোকটার দিকে তাকাল সে। আফ্রিকান লোকটার শক্ত, পেশিবহুল দেহ লণ্ঠনের আলোতে চকচক করছিল।

“এটা বরং কাঁকড়ার খাবার হিসেবেই থাক,” সে বলে উঠে। বাতির আলোতে পেট দেখতে পায় যে লোকটা অনেক অল্পবয়স্ক হলেও তার মধ্যে একটা নেতৃত্বের ভাব আছে। তার ঈগল পাখির ঠোঁটের মতো নাক দেখেই বোঝা যায় সে কোনো উচ্চ বংশীয় পরিবার থেকে এসেছে। দেখে মনে হয়, নিজের ওপর অগাধ আস্থা রয়েছে লোকটার ভেতর, যে ভরসার অর্ধেকটা এসেছে ওর আদেশ দেয়ার ক্ষমতার কারণে, যার ওপর মানুষের জীবন নির্ভর করে, আর বাকি অর্ধেকটা এসেছে স্বীয় আদেশ পালন হওয়ার নিশ্চয়তা সম্পর্কে সে পুরোপুরি সংশয়হীন বলে। দরজা থেকে যতদূর সম্ভব দূরে গিয়ে অবস্থান নেয় পেট। আগত লোকদুটি এখনো পেট-এর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেনি। এদের দুজনের আগমনই পেটকে বলে দিয়েছে যে অভিযাত্রী দল ডেফট ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাকে কি কি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে ডাচরা সফল হয়নি এবং তাদের এই ব্যর্থতার কারণে জাহাজটাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এখন ওর সামনে রয়েছে সেই জয়ী ক্যাপ্টেন। যদিও লোকটার প্রতি পেটের বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে, কিন্তু তার ব্যাপারে পেট এখনো কোনো কিছু ঠিক করে নি। সে কি লোকটাকে তার একজন মক্কেল হিসেবে দেখবে? নাকি সে এমন এক লোক যাকে পেটের অন্য মক্কেলরা মৃত অবস্থায় দেখতে চায়? পেট এখনো কিছু বুঝতে পারছে না।

“কাকড়াদের অবশ্যই এটা খাওয়া উচিত গান্ডওয়েন,” আফ্রিকান লোকটা তার তরবারি দিয়ে ঘৃণাসহকারে একটা খোঁচা দিয়ে বলল। এই লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে যথেষ্ট সাহসী যোদ্ধা, একই সাথে তার ক্যাপ্টেন-এর ডান হাত। পেট এই লোকটিকেই সম্ভাব্য প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করতে শুরু করে দিল। ক্যাপ্টেন-কে যদি কখনো হত্যা করার প্রয়োজন হয় তবে এই লোকটিই সবার আগে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া অন্য কোনো কারণে এই লোকটির ব্যাপারে পেট-এর কোনো আগ্রহই নেই।

“এ তো খুবই দুঃখের ব্যাপার স্যার, এই লোকটি মুক্তি পাওয়ার পূর্বেই মারা গেল।” হঠাৎ করেই কথা বলে উঠল পেট।

আরও দ্রুত মারা যেত। আরও দ্রুত। সেই স্বর্গীয় কণ্ঠটি পেট-এর মাথার ভেতর এত উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠে যে পেট-এর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে সে ছাড়া অন্য কেউ এই গর্জন শুনতে পাবে না। কিন্তু সাদা লোকটি শুধু তার কণ্ঠটিই শুনতে পায়। হাতের লণ্ঠন উঁচিয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে সে। এরপর চিৎকার করে উঠে, “কে ওখানে?”

“স্যার আমার নাম পেট। গত এক সপ্তাহ যাবত আমাকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে, যতদূর আমি মনে করতে পারি আরকি। অবশেষে আমার প্রার্থনা সফল হয়েছে। এই একটু আগে যখন আমি আবারো একজন ইংরেজ লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, আমি আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, স্যার।” সে তার শেকল লাগানো পা-সহ সামনে আগানোর চেষ্টা করে বলতে থাকে, “আপনারা কী সেই জাহাজের যেটাকে ঐ মাথা মোটা ক্যাপ্টেন ট্রাম্প ধরতে চেয়েছিল?”

“আমি স্যার হেনরি কার্টনি,” গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন। যুবক লোকটি বলে উঠে, “তুমি জেনে খুশি হবে যে তোমার বন্দিদশা শেষ হয়েছে।”

কার্টনি মত দেহটির দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে, “এই লোকটি কীভাবে মারা গেছে?”

“তুমি যখন তাকে শ্বাসরোধ করতে গিয়ে অনেক সময় নিচ্ছিলে, ঠিক তখনই সে মারা গিয়েছিল-তোমার উপর বিরক্ত হয়ে।” স্বর্গীয় কণ্ঠটি বলে উঠল।

“ক্ষুধা?” পেট একটা কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে জবাব দেয়। আমি কোনো কবিরাজ নই ক্যাপ্টেন। আমি যদিও এই গরিব লোকটিকে ভালভাবে চিনি না কিন্তু আপনি এখন যা দেখছেন সেটা হয়তো আমি আটকাতে পারতাম। এই জাহাজটা আসলে ক্ষুধার্ত নাবিকদের জাহাজ। তারা আমার প্রতি কোনোরকম মানবিকতা দেখায় নি। আরেকটি মুখ বাড়বে ভেবে তারা আমাকে এই অন্ধকার, পাতালপুরীতে নিক্ষেপ করে। কিন্তু এই লোকটিই আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল। এই লোকটিকে আমি আমার নিজের হাতে সমাধিস্থ করতে চাই, “ক্যাপ্টেন, যদি আপনার অনুমতি থাকে তো। অন্য কেউ এই লোকটির দুর্দশা দেখার আগেই ওটা করতে চাই আমি।”

“আমার কোনো আপত্তি নেই,” হেনরি কার্টনি বলে উঠে। এরপর কালো আফ্রিকান লোকটির দিকে ফিরে বলে, “ক্যাপ্টেন ট্রোম্পকে জিজ্ঞেস কর যে সে মি. পেট-এর শেকলের চাবিটা কোথায় রেখেছে। যদি খুঁজে না পাওয়া যায় তবে মিস্ত্রী আনিয়ে খোলার ব্যবস্থা কর।”

“ঠিক আছে, গান্ডওয়েন”, কালো লোকটি বলল। এরপর সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে হারিয়ে গেল।

“আপনার অনেক দয়া, ক্যাপ্টেন”, পেট-এর মাথায় এতক্ষণ ধরে যে সমস্যাটা ঘুরছিল সেটার সহজ সমাধান পেয়ে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে চায় না মৃত লোকটির গলায় চোখে মুখে তার খুনের চিহ্ন কেউ দেখতে পাক।

“কিন্তু তুমি ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর বন্দিশালায় কী করছো?” ক্যাপ্টেন কার্টনি জিজ্ঞেস করল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পেট। তবে যতটা নাটকীয় ভাব দেখাতে চেয়েছিল ততটা পারল না। “সে এক লম্বা দুঃখের কাহিনী ক্যাপ্টেন। সে কাহিনী বলার আগে আমার শূন্য পেটে কিছু খাবার পড়লে হয়তো আমার কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরুবে।”

“অবশ্যই!” কার্টনি মাথা নেড়ে বলল। “আজকে রাতের ডিনারে তোমাকে আমন্ত্রণ জানালাম আমি। কিন্তু এখন আমাকে জাহাজের বাকি অংশটুকু পরিদর্শন করে দেখতে হবে। ভয় পেয়ো না। আমার লোক এসে যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে মুক্ত করবে।”

“অবশ্যই, ক্যাপ্টেন”, পেট বলল। সে তার নিজের ভাগ্যকে সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সৃষ্টিকর্তা সত্যিই বেশ রহস্যময়ভাবে কাজ করে। ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ সে একা একা অন্ধকারে পড়ে রইল। যদিও সে পুরোপুরি একা নয়। সেই স্বর্গীয় কণ্ঠ আর সকল ফেরেশতারা তার সঙ্গে আছে। তাদের উপস্থিতিতে উইলিয়াম পেট-এর কাছে নিজেকে সত্যিই বেশ আশির্বাদ পুষ্ট বলে মনে হতে লাগল।

.

যখন ট্রোম্প বলেছিল যে তার কাছে সোনা বা মসলা জাতীয় কিছুই নেই তখনই হাল ধারণা করে নিয়েছিল যে ডেফট-এ মূল্যবান কিছু পাওয়া যাবে না। প্রথম দেখাতেই হাল-এর ধারণা পরিষ্কার হয়ে যায়। জাহাজের প্রতিটা খোল প্রায় শূন্যই বলা যায় যেগুলো এতদিন পর্যন্ত বড় বড় অফিসারদের কোয়ার্টার হিসেবে কিংবা অসুস্থ লোকদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো। জাহাজের একেবারে শেষদিকে বাঁকানো অংশে বারটা ব্যারেল রশি দিয়ে এমনভাবে আটকানো আছে যেন সাগরের ঢেউয়ের তালে এগুলো পড়ে না যেতে পারে। অ্যাবোলি তার তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে ব্যারেলগুলোর ভেতরে খোঁচা দিয়ে বুঝতে পারে এগুলোতে মিষ্টি জাতীয় পদার্থ আছে। হাল যখন ব্যারেলগুলো ধরতে পারল তখন সেগুলোর ভেতর হাত ঢুকিয়ে ঘোট ঘোট কতকগুলো বক্স বের করে আনল সে। সেগুলোর মাঝে একটা খোলার পর ওটার ভেতর একটা ছোট কাঁচের বোতল দেখতে পায় হাল যেটা লম্বায় তার বুড়া আঙুলের চেয়ে বড় হবে না।

“আমি ভাবতে পারি নি যে ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর ওয়াইন রাখার সেলার এরকম হতে পারে।” কথাটা মজা করেই বলল হাল। এরপর ছোট্ট কাঁচের বোতলটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লণ্ঠনের সামনে ধরে দেখতে থাকল।

“আমি ইন্ডিয়ান হিন্দু নাবিকদের মুখে অমৃত-এর কথা শুনেছি। যেটা খেলে নাকি অমরত্ব লাভ করা যায়।” অ্যাবোলি হাল-এর দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে বলে।

হাল হেসে ফেলে। ট্রাম্প যদি ওরকম কোনো মহৌষধ পেত তবে সে এই পর্তুগীজ জাহাজটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত।

“এটা টক স্বাদের কিছু হবে,” ছোট্ট বোতলে রাখা জিনিসটার গন্ধ শুঁকে বলে উঠল হাল।

“একজন মানুষ অমরণশীল কি-না সেটা পরীক্ষা করার খুব ভাল একটা উপায় জানা আছে আমার।” অ্যাবোলি তার তরবারিটা নাড়িয়ে বলে উঠল। কিন্তু হাল-এর হাসার মতো মনমানসিকতা ছিল না। বরং সে মনে মনে আশা করতে লাগল যে ট্রাম্প-এর নিশ্চয়ই এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কার্গো রয়েছে। সত্যি বলতে আসলেই তার জাহাজে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলনা। কিন্তু এই ছোট্ট বোতলগুলোর নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে, নাহলে এগুলো বাক্সে বন্দি করে রাখা হয়েছে কেন? ছোট্ট শিশিতে এমন কোনো সুগন্ধী রাখা নেই যেটা মহিলারা অনেক চড়া দামে কিনবে। কিংবা এটাতে যদি মূল্যবান কোনো ওষুধ থাকত তবে এটার গায়ে তা লেভেলিং করা থাকত। হাল-এর ভয় হতে লাগল যে, সে হয়ত না জেনেই কোনো বিষের গন্ধ নিয়ে ফেলেছে, হয়তো একটু পর নিজেই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল যে সে এখনো সুস্থ আছে। অ্যাবোলি পরবর্তী বোতলটার ছিপি খুলে ফেলার পর প্রহেলিকা কেবল আর গাঢ় হলো। বোতলটার ভেতর বুড়ো আঙুলের সমান লম্বা তিনটা কাঠের টুকরা দেখতে পায় তারা। যদিও প্রতিটা টুকরা দেখতে কাঠের গুঁড়ির মতো কিন্তু এগুলোকে শিপওয়ার্ম-এর মতো মনে হচ্ছিল না।

“তোমার কী কোনো ধারণা আছে যে এগুলো কী?” অ্যাবোলি হালকে জিজ্ঞেস করল। হাল বুঝতেই পারছিল না যে এগুলো কী হতে পারে। অ্যাবোলিও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তারও কোনো ধারণা নেই এগুলোর ব্যাপারে।

“আমার মনে হয় শুধু একজনই পারে এই সমস্যার সমাধান দিতে,” হাল বলে উঠল। “যাও গিয়ে ট্রোম্পকে ধরে আন। সে নিজের মুখে এগুলোর ব্যাখ্যা দিবে।”

কিছুক্ষণ পরই অ্যাবোলি ডেফট-এর পূর্বের মালিককে ধরে নিয়ে আসে। হাল একটা কাঠের টুকরো উঁচিয়ে ধরে বলে, “এগুলো কী?”

ট্রোম্প চোখে মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “এগুলো হচ্ছে সত্যিকার ক্রস-এর টুকরো।”

ক্রিশ্চিয়ান ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে এরকম কিছু অভিজ্ঞতা আছে হাল-এর। তাই প্রথম কয়েক সেকেন্ড তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে সেই সত্যিকার ক্রসের টুকরো হাতে ধরে আছে সে যেটার ওপর যিশু খ্রিস্ট মৃত্যুবরণ করেছিলেন। “কিন্তু যদি তাই হয় তবে ট্রোম্প কেন হাসছে। তার কী নিজের ভাগ্যের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস নেই। সে কিভাবে যিশুখ্রিস্টের মৃত্যু নিয়ে মজা করতে পারে?”

খানিকক্ষণ চুপ করে পর্যবেক্ষণ করে হাল। এরপর কাঠের টুকরোগুলোকে আবার আগের জায়গায় রেখে দেয় সে। তারপর সর্ব প্রথমে যে সবুজ রঙের কাঁচের বোতলটা পেয়েছিল তারা, সেটা তুলে ধরে।

“আহ!” ট্রোম্প আক্ষেপের সুরে মাথা নাড়ায়। “সবচেয়ে পুরনো গুপ্তধনটাই খুঁজে পেয়ে গেছেন আপনি। এই পুরনো বোতলটাতে ভার্জিন মেরীর বুকের দুধ রয়েছে। এরকম আরেকটা বোতল রয়েছে যেটাতে ভার্জিন মেরীর চোখের অশ্রু পাবেন, যে অশ্রু তার চোখ থেকে ঝরেছিল ছেলেকে পাওয়ার খুশিতে।”

অবশেষে কথা বলে উঠল হাল। বেশ রেগে আছে ও। “গড।” “তুমি আমাদের যিশু খ্রিস্টের নাম মুখে আনবে না। মাতা মেরীর নামও না। তোমার মুখে এসব কথা মানায় না। তুমি ঈশ্বরনিন্দা করবে আর আমি সেটা চুপচাপ শুনব, তা হবে না।”

ওলন্দাজটা বেশ দৃঢ়ভাবে হাত উপরে তুলে হালকে থামিয়ে দিল। “ক্যাপ্টেন কার্টনি।” “আমার তো মনে হয় না আপনি সহজে বোকা হওয়ার মতো লোক। আপনাকে তো বেশ বুদ্ধিমান লোকই বলা যায়। অথচ আপনি এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। আমি এই মূল্যবান জিনিসগুলো চড়া দামে বিক্রির উদ্দেশ্যেই রেখে দিয়েছিলাম।”

“আর বাকি যেগুলো রয়েছে সেগুলোতে কী আছে?” হাল বাকি ব্যারেলগুলো দিকে ইঙ্গিত করে বলে।

ট্রোম্প একজন দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার কাছে খ্রিস্টের দাঁত, চুল এবং রক্ত আছে। আমার কাছে সেই কাপড়ের টুকরা আছে যে কাপড় দিয়ে ছোট বেলায় যিশু খ্রিস্টকে মোড়ানো হয়েছিল। এরপর সে ঠোঁট কামড়ে মনে করার চেষ্টা করে যে তার কাছে আর কী কী আছে।” “আমার কাছে সেই স্বর্গীয় দূত-এর কাটা আঙুল রয়েছে। এমনকি আমার কাছে তার ফোরস্কিনও পাবেন, যেটা তার খানা করার সময় কাটা হয়েছিল। সে একটা হাত ব্যারেলগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এখন আমার জাহাজ যেহেতু আপনার তাই এই জিনিসগুলোও আপনার।”

হাল ঠোঁট বকিয়ে এক ধরনের মুখভঙ্গি করল, যা দেখে পুনরায় হাত উঠাল ট্রাম্প।

“আমি স্বীকার করি যে এই কার্গোটা খুবই অস্বাভাবিক আর ক্ষমার অযোগ্য” ট্রোম্প আবার বলতে থাকে। কিন্তু আমি যে অবস্থায় ছিলাম সেখানে থাকলে ধর্মীয় নৈতিকতা এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।”

“এমনিতেও তোমাকে দেখতে খুব একটা নৈতিকতাসম্পন্ন লোক বলে মনে হয় না”, হাল দ্রুত বলে উঠল।

“আপনার সাথে কথায় পারবো না।” ট্রোম্প একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে উঠল।

“ড্যাম, এই ওলন্দাজটাকে বেশিক্ষণ অপছন্দ করে থাকা যাচ্ছে না।” মনে মনে ভাবল হাল।

“এপাশের দুনিয়ার সম্পর্কে আপনারা ইংরেজরা সব সময় একটা কথা বলেন, ট্রাম্প বলল। কিভাবে যেন বলেন? ওহ? হ্যাঁ…অল ইজ ফেয়ার বিয়ন্ড দ্য লাইন। ঠিক না?”

হাল অ্যাবোলির দিকে তাকাল। তারা দুজনেই এই কথাটা প্রায়ই তার বাবার মুখে শুনত-যখন ছদ্মবেশে কিংবা কৌশল খাঁটিয়ে কোনো ডাচ্ জাহাজ ধরার চেষ্টা করা হত, তখন। আর ঠিক তখনি, তার মাথায় একটা ব্যাপার কাজ করল। আজ ট্রোম্প যেভাবে তার ডেটকে গোল্ডেন বাউ-এর পেছনে লাগিয়ে ছিল, হাল-এর বাবাও মাঝে মাঝে তার জাহাজ নিয়ে একই কাজই করতেন।

“হ্যাঁ, এরকমই বলি আমরা”, বাদে আর কিছুই বলতে পারল না হাল। এরপর সে জিজ্ঞেস করল, “কে এসব তুচ্ছ জিনিস কিনবে?”

ট্রোম্প চিন্তা করল কিভাবে এর সর্বোত্তম উত্তর দেয়া যায়। আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন, আপনি প্রোটেস্টট্যান্ট বাদে বিশ্বাসী।”

“তোমার ধারণা সঠিক।”

“যাক আমি তাহলে ঠিক ধরেছি। আপনি জানেন যে, আমরা ওলন্দাজরা ব্যবসায়ী। আমরা লাভের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়াই। আর সেই লাভ আমরা ইস্ট ইন্ডিয়ায় খুঁজে পেয়েছি। মশলার ওপর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করছে সেখানে।”

“ব্যতিক্রম ঘটে তখন, যখন ইংরেজরা কিছু মশলা নিজেদের সাথে করে নিয়ে যায়”, হাল বলে উঠে। সেই সাথে তার বাবার আটক করা কার্গোগুলোর কথা ভাবতে থাকে।

“ডাকাতি করছে বললে কি আরো ভাল হয় না, ক্যাপ্টেন কার্টনি?” ট্রোম্প আরেকটা হাসি দিয়ে বলে। “আপনি লক্ষ করবেন অনেক আগে থেকেই আমাদের দুই জাতির মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি চলছে। তাই ডাদের মশলা নিয়ে যাওয়াটা ডাকাতির সমপর্যায়ের অপরাধ।”

এই লোকটা তো বেশ ধূর্ত, হাল মনে-মনে চিন্তা করল। তারপর বলল, “এসবের সাথে তোমার এসব নকল ধ্বংসাবশেষ-এর কী সম্পর্ক রয়েছে?”

“সহজ হিসাব। আমরা ওলন্দাজরা ধর্মপ্রচারক নই। দেখুন স্পেনিস ও পর্তুগীজ যারা দীর্ঘদিন ইস্ট ইন্ডিজ-এ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তারা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মতোই ক্যাথলিক বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। জিউসরা ফিলিপাইন, চীনা এবং জাপানের দ্বীপগুলোতেও তাদের হাত প্রসারিত করছে যেখানে তাদের শাসকেরা নিজেদেরকে আড়াল করে রাখছে বিশ্ব থেকে। তারা যেখানেই যাচ্ছে সাথে করে ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ নিয়ে যাচ্ছে, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ওগুলোকে। এসব অস্ত্র নতুন বিশ্বাসীদের মনকে প্রভাবিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।”

“ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ যদি সত্যিকারের ধ্বংসাবশেষ হয় তবে তার অন্যরকম শক্তি থাকার কথা। আমি নিজে টেবারন্যাকল দেখেছি এবং নিজ চোখে এর তাৎপর্য অনুধাবন করেছি।” এখন বলন, “একজন মানুষ যে নিজেকে ধর্মযাজক বলে সে কী ধর্মীয় নিদর্শনের নামে মিথ্যে জিনিস ফেরি করে বেড়াতে পারে?”

ট্রোম্প কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে আবার বলা শুরু করল, “কথা হচ্ছে, যদি মিথ্যা জিনিসগুলো অবিশ্বাসীদের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে তবে ঈশ্বর নিশ্চয় রাগ করবেন না, করবেন? তবে সেটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। আমার কাছে চিন্তার বিষয় হচ্ছে টাকা। আমি আমার কাছে থাকা সর্বশেষ পেনিটা দিয়েও বাতাভিয়ার এক কারিগরের কাছ থেকে এসব তৈরি করেছি যেগুলো আপনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। আমি আর আমার নাবিকেরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছি কারণ আমাদের হাতে আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। তবে আমরা মনে করি আমাদের ক্ষুধার চেয়ে এগুলো বেশি মূল্যবান।”

চোখ তুলে তাকাল ট্রোম্প, ওর চোখগুলো বাজারের ব্যবসায়ীদের মতো চকচক করে উঠল। “একবার ভেবে দেখুন। ভেবে দেখুন, আফ্রিকার বাজারে এগুলোর কত চাহিদা রয়েছে। পর্তুগীজরা এখন মোজাম্বিক এবং সোফালার দায়িত্ব নিয়েছে। তারা উপকূলবর্তী এলাকায় আর বড় বড় নদীতে ব্যবসা চালাচ্ছে, আর যেখানেই ব্যবসা চার্চ সেখান থেকে বেশি দূরে নয়। জিউসরা তাদের প্রতি খুবই খুশি হয় যারা তাদের এসব যোগান দেয়। এসব বস্তু তাদের ধর্মপ্রচারের কাজে খুবই সহযোগিতা করে। ক্যাপ্টেন কার্টনি, আমি বলছি এগুলো ভাগ্য বদলে দিবে। এই কার্গো যে কোনো সোনাদানা পূর্ণ কার্গোর চেয়েও মূল্যবান।”

“এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।” হাল বিরক্তি সহকারে তার হাতের বোতলটা নিচে ছুরে মারে, এরপর পায়ের বুট দিয়ে সেটাকে আঘাত করে।

ট্রোম্প হাত দিয়ে এমনভাবে তুড়ি বাজায় যেন সে ব্যারেলগুলো অদৃশ্য করে দিবে। “আপনি একদম সঠিক বলেছেন। এগুলো অসৎ ব্যবসা। এসব মিথ্যে জিনিস বিক্রি করা আমাদের অনুচিত।” ব্যাপারটাকে ট্রোম্প এক মুহূর্তেই উড়িয়ে দেয়, ঠিক যেভাবে হাল ছোট্ট বোতলটাকে পিষে ফেলে, সেভাবে। কিন্তু ব্যাপারটাকে আপনি অন্যভাবে ভেবে দেখতে পারেন। আমি আমার ধারণা আপনাকে বলব।”

কিন্তু হাল ট্রোম্প-এর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তার একজন নাবিককে ডাক দেয়, “মি লোভেল।” “ক্যাপ্টেন ট্রাম্পকে তার লোকজনের কাছে নিয়ে যাও। আর খেয়াল রেখো ওরা সবাই যেন খাবার পায়, আমরা অন্তত সম্মানের সাথে ব্যবহার করতে জানি।”

“আসুন, ক্যাপ্টেন, লেভেল ক্যাপ্টেন ট্রোম্পকে সাথে নিয়ে চলে যায়। হাল আর অ্যাবোলি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে।

আফ্রিকানটি নিজের রাগকে ছাপিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তার স্বরে বলে, “তাহলে তোমাদের লোকেরা আফ্রিকায় দাস কিনতে আসে না বরং মিথ্যে ধবংসাবশেষ দিয়ে লোকজনকে বোকা বানাতে আসে। মিথ্যে হাড়, পুরনো সুতা আর গরুর দুধ দিয়ে, তাই না?”

“তারা আমার লোক নয়। তারা দাস ব্যবসায়ী, প্রতারক”, লজ্জিত হওয়ার ভাবটা নিজের পেটের মধ্যে আটকে রেখে কথাটা বলে হাল। এরপর সে সামনে এগিয়ে গিয়ে আফ্রিকান লোকটির কাঁধে হাত রেখে বলে, “আমার নাবিকেরা আমার লোক। আর অ্যাবোলি আমার ভাই, তাই না?” অ্যাবোলি হাল-এর দিকে এক পলক তাকায়। অন্ধকারে তার মুখোশ যদিও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ সে নিজের অনুভূতি চাপিয়ে রাখতে পারল না। হাসিতে ফেটে পড়ল।

“শয়তান, অ্যাবোলি”, হাল বলে। “আমি তো ভেবেছিলাম তোমার সাথে মারামারি করতে হবে এখন-আগে যেমন করতাম আরকি। অবশ্য, তোমাকে এখন বুড়ি মহিলাই বলা যায়।”

অ্যাবোলি হাল-এর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল। হালকে বললো, “গ্যান্ডওয়েন, তুমি আমাদের ক্যাপ্টেন, এর বেশি কিছু আমি পছন্দ করি না।” সে আরও বলল, “ভাবছি, তোমার লোকেরা যখন দেখবে যে তাদের ক্যাপ্টেন ছোট্ট মেয়ের মতো মুখ ঘুরিয়ে কাঁদছে, তখন তারা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে?”

অ্যাবোলির কথা শুনে হাসতে শুরু করে দিল হাল। এরপর তারা দুজন একসাথে ডেফট-এর বাকি অংশটুকু দেখার জন্য পা বাড়াল।

*

উইলিয়াম পেট হাতে এক পেগ ক্যানারি ওয়াইন নিল, এরপর বিস্ময়াবিভূত হয়ে কেবিন-এর চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ৰৈ এটার সাজসজ্জা, কাঠের আসবাবপত্র, ম্যাপ, টেবিল, ক্যাপ্টেন এর কোট, যেটা এখন হুক থেকে খুলে দেয়ালের পাশে রেখে দেয়া হয়েছে।

পেট বলল, “আপনার জাহাজটা অনেক সুন্দর ক্যাপ্টেন কার্টনি। যেটা তৈরি করতে আর মানসম্মতভাবে সাজাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়েছে।” পেট আরও বলতে থাকে, “অনধিকার চর্চা করছি মনে হলে ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার কৌতূহল হচ্ছে যে আপনি এত অল্প বয়সে এরকম একটা জাহাজের মালিক কীভাবে হলেন? উত্তরাধিকার সূত্রে নাকি অন্য কোনো উপায়ে?”

‘না, মি পেট”, হাল উত্তর দেয়। “আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ অন্য কোথাও আছে। একজন প্রতারক-এর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলাম এই গোল্ডেন বাউ জাহাজটা। সে এটাকে কোথাও থেকে চুরি করে এনেছিল।”

“আমার তো মনে হয় না, এরকম কাজ আপনার চরিত্রের সাথে যায়”, পেট বলল। “একারণেই এটার পেছনের গল্পের ব্যাপারে আমার আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।”

“আমি কোনো গল্পকার নই”, বেশ ভদ্র কিন্তু গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠল হাল। “আমি কাজ করি আর অন্য লোকেরা সেটা নিয়ে গল্প বানায়।”

পেট-এর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। এই যুবক ক্যাপ্টেন-এর জীবনে অন্তত একজন শত্রু আছে। আর যখন কারো নতুন শত্রু গজায়, পেট তখন একজন নতুন মক্কেল পায়। সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে এক অমায়িক হাসি দিয়ে বলে, “ওহ, আপনি একজন ন্যায় বিচারক স্যার। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে আপনার মতো মানুষের শ্বাসরুদ্ধকর আর রোমাঞ্চকর অভিযান সবসময়ই শ্রোতাদের মনে আগ্রহ জাগায়। আমাকে অন্তত বলুন যে কে সেই বদমাশ যার কাছ থেকে আপনি গোল্ডেন বাউ কেড়ে নিয়েছেন? আর সে-ই বা কার কাছ থেকে এটা চুরি করেছিল?”

হাল বিরক্তিসহকারে পেট-এর দিকে তাকায়। কিন্তু তখনই পেট-এর। কথায় সারা দিয়ে আলোচনায় যোগ দেয় জুডিথ। “মাই ডিয়ার, আমি তোমার গল্পের শেষটুকু খুব ভালভাবেই জানি। কিন্তু তুমি কখনো আমাকে এটার শুরুটা বলনি। আমিও সেটা শুনতে চাই। তুমি কী আমাকে গল্পটা বলবে না?”

“এরকম সুন্দর একজন মানুষের সুন্দর অনুরোধ কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন আপনি?” পেট বলে উঠে।

“বলুন স্যার”, বিগ ডেনিয়েলও যোগ দেয়। “মি. পেটকে বুজার্ড সম্পর্কে বলুন। তাকে বলুন যে আমরা কিভাবে বুজার্ডকে পরাস্ত করেছিলাম।”

হাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এরপর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলা শুরু করল, “আচ্ছা ঠিক আছে বলব। তার আগে আমাকে একটু ক্যানারির বোতলটা দিন তো মি পেট, গল্প শুরু করার আগে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়া প্রয়োজন।”

এরপর পুরো একগ্লাস ওয়াইন গলায় ঢেলে দিল হাল। “পুরো ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল শেষ রাতের দিকে, ঠিক ভোরের সূর্য উঠার পূর্বে। ঐ সময় হঠাৎ করেই আমি আমার নাকের মাধ্যমে জাহাজটার সন্ধান পাই।”

“আপনার নাকের মাধ্যমে স্যার?” পেট বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলে উঠে, “তখন কী এতটাই অন্ধকার ছিল যে জাহাজটা আপনার নাকে এসে ধাক্কা দেয়ার আগ পর্যন্ত আপনি জানতেনই না যে সেখানে একটা জাহাজ ছিল?”

হাল উচ্চস্বরে হেসে উঠে, “না স্যার, জাহাজটা আমার নাকে এসে ধাক্কা লাগায় নি। আসলে ওটার ভেতর থাকা মসলার তীব্র গন্ধ আমার নাকে এসে লেগেছিল। আমি তখন লেডি এডউইনার মাস্তুলের ওপর ছিলাম। লেডি এডউইনার নামকরণ করা হয়েছিল আমার মৃত মায়ের নামে। আমার বাবা স্যার ফ্রান্সিস-এর মালিকানাধীন থাকার পূর্বে এটা ওলন্দাজদের জাহাজ ছিল। স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি এটাকে দখল করে নিজের কাজে ব্যবহার করেন।”

“গন্ধটা পাওয়ার পর আমি দ্রুত মাস্তুলের নিচে নেমে এসে বাবাকে ঘটনাটা জানাই। আমরা দুই মাস যাবত সমুদ্রে ছিলাম শুধু এই সময়টারই অপেক্ষায়।

আমার বাবার কাছে শত্রুর জাহাজ আক্রমণ করার একটা অনুমতিপত্র ছিল যেটায় কিং চার্লস-এর পক্ষ থেকে লর্ড চ্যান্সেলর-এর স্বাক্ষর করা ছিল। সেটাতে বলা ছিল যে তিনি যেকোনো ওলন্দাজ জাহাজ আক্রমণ করার অধিকার রাখেন। ব্যাপারটা হচ্ছে, মি. পেট, ঐ সময় ইংল্যান্ড আর হল্যান্ড যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।”

হাল আর এক পেগ ওয়াইন খাওয়ার জন্য থামে। এ সময় কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। সেও চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে সেও গল্প বলায় খারাপ না।

“সেখানে আমাদের একা থাকাটা বিপজ্জনক ছিল। জায়গাটা ছিল ইন্ডিয়ান সাগরের দক্ষিণ দিকে। ক্যাপ্টেন কোকরান-যে কি-না বুজার্ড নামে পরিচিত ছিল-সমুদ্র অভিযানে আমার বাবার সাথে একসাথে কাজ করার ওয়াদা করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের অপেক্ষায় সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল, আর তাই, একদিন আগেই, সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল-ভেবেছিল আশেপাশে জাহাজ পেলে লুটপাট করে নেবে।”

“আপনি ‘গাল অব মেরে’-এর গন্ধ নিয়ে তাকে তাড়া করতে পারতেন।” বিগ ডেনিয়েল মন্তব্য করল। “বুজার্ড যে নোংরা দাসগুলোকে জাহাজে রাখত, এদের শরীরের দুর্গন্ধ হাজার ধুলেও যাবে না।”

“গন্ধ দাসদের শরীর থেকে আসে না”, অ্যাবোলি বলল। তার হাতে থাকা ছুরিটা সে শক্ত করে ধরে আছে এখন। “দুর্গন্ধটা আসে মানুষেরই আত্মা থেকে। যেটা ওদেরকে দাস বানিয়ে রাখে।”

“আরে শোন তো”, হাল দ্রুত বলে উঠে। “যে জাহাজটাকে আমরা প্রায় আক্রমণ করতে যাচ্ছিলাম সেটার নাম ‘স্ট্যান্ডস্টিগেইড, যেটার অর্থ হচ্ছে রিজলিউশন।” লেডি এডউইনার চেয়েও অনেক বড় জাহাজ ছিল ওটা, আর লোকসংখ্যাও ছিল বেশি। বাউ আক্রমণ-এর ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন ট্রাম্প-এর যেমন কোনো আশা ছিল না, আমাদেরও তখন এর চেয়ে বেশি সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমার বাবার কাছে ডাচদের পতাকা ছিল যেটাকে উনি তখন জাহাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে ডাচরা আমাদের জাহাজটাকে বন্ধু জাহাজ মনে করে। আর একারণেই আমরা নির্ভয়ে ওদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে আমার পিতা স্যার ফ্রান্সিস নিজের স্বল্প বাহিনী আর আপন বীরত্বের বলে ওদের জাহাজ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”

“আপনি যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত কাহিনী বললেন না, গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি বলে। ‘

“যেটুকু বলা প্রয়োজন আমি সবই বলেছি”, হাল উত্তর দেয়।

“আমি কি জানতে পারি কী কী বাদ দেয়া হয়েছে, পেট জিজ্ঞেস করে।

“স্যাম বাউলস নামে এক কাপুরুষের দ্বারা আমরা প্রতারিত হয়েছিলাম।” অ্যাবোলি বলতে শুরু করে। সে লেডি এডউইনাকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। আমরা যারা ডাচ্ জাহাজের উপরে ছিলাম তারা সেখানেই আটকা পড়ি। কিন্তু তখন আমাদের ক্যাপ্টেন-এর পুত্র তার বাবার মতোই সাহসের পরিচয় দেয়। সে লেডি এডউইনাকে পুনরায় ডাচ্ জাহাজের কাছাকাছি ফিরিয়ে নিয়ে আসে।”

“আমরা যারা সাগরে পানসিতে করে ভাসছিলাম তাদেরকেও উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল, এটা বলতে ভুলনা অ্যাবোলি।” বিগ ডেনিয়েল বলে।

“বিজয়ের গৌরব-এর পুরোটাই আমার বাবার, আমার নয়”, হাল বলে। যদিও সে বেশ বুঝতে পারছিল যে তার বীরত্বের কাহিনী শুনে জুডিথ যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছে।

“এই যুদ্ধের কাহিনী কবেকার ঘটনা, এটা বলেননি আপনি,” পেট বলে। “কতদিন আগের ঘটনা এটা।”

“১৬৬৭ সালের সেপ্টম্বর মাসের চার তারিখের ঘটনা এটা।” হাল উত্তর দেয়। “দিনটির কথা আমার মনে আছে কারণ, ঐদিনই আমি প্রথমবারের মতো জাহাজের লগ-এ প্রবেশ করেছিলাম।”

“তার মানে তিন বছর আগের ঘটনা?” পেট একটু চিন্তা করে বলল। “তখন আপনার বয়স কত ছিল?”

“সতেরো বছর, মি পেট।”

“ওই বয়সেই এরকম সাহসিকতা যে দেখাতে পারে, তাকে বেশ প্রশংসার দাবিদারই বলতে হবে। কিন্তু স্যার এরপর সেই বুজার্ভ ভদ্রলোকের কী হয়েছিল, বলবেন কী?”

“সে কোনো ভদ্রলোক ছিল না, আমি আপনাকে অন্তত এইটুকু বলতে পারি। কিন্তু তার গুপ্তধন সংগ্রহের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল বলতে হবে। তার সংগ্রহে তিন’শ টন বিরল প্রজাতির শক্ত কাঠ ছিল। টিক, বালু এবং অন্যান্য অনেক কাঠ যেগুলো খ্রিস্টান রাজত্বের বনগুলোতে কখনো খুঁজেই পাওয়া যায় না। ওগুলো এতই মূল্যবান ছিল যে আমরা ঐ কার্গোকে অন্য কোনো কার্গোর সাথে তুলনাই করতে পারব না। এছাড়াও জাহাজটাতে বিয়াল্লিশ টন নানা প্রজাতির মশলা ছিল-যেমন, ককিনিয়াল-এর ব্যারেল, পিপার, ভ্যানিলা, স্যাফ্রন, ক্লোভস, কার্ডামম। এগুলো এদের সম ওজনের রুপার চেয়েও বেশি মূল্যবান ছিল। সেখানে রুপাও ছিল দশ হাজার পাউন্ড ওজনের আর তিন’শ খাঁটি সোনার বার ছিল। মি. পেট আপনি আপনার মুখ বন্ধ করে এখানে বসুন। কথা শেষ হয়নি-সেখানে আরও অনেক কিছুই ছিল।”

“আরও?” পেট হাল-এর দেয়া আরও এক পেগ ড্রিংক দ্রুত শেষ করে বলল, “এটা কী করে সম্ভব?”

“খুব সহজ”, ওলন্দাজদের জাহাজে একজন যাত্রী ছিল। তার নাম ছিল পেট্রাস ভ্যান ডি ভেলডি। সে কেপ অব গুড হোপ-এর ডাচ্ কলনীর পরবর্তী গভর্নর হতে যাচ্ছে। আমার পিতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তার মুক্তিপণ হিসেবে দুইশ হাজার গিল্ডার সোনা অথবা চল্লিশ হাজার পাউন্ড স্টালিং চেয়েছিলেন।”

“ক্ষমা প্রার্থনা করছি ক্যাপ্টেন, কিন্তু আমার মনে হয় আপনি সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তধন-এর কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন। বিগ ডেনিয়েল খানিকটা আড়চোখে হাল-এর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।

“আমার মনে হয় রিজলিউশন-এ যা যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সবকিছুর কথাই আমি বলেছি।” হাল বেশ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল। যদিও সে বুঝতে পেরেছে যে বিগ ডেনিয়েল কিসের কথা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু ঐ ব্যাপারে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। ডেনিয়েল বুঝতে পারে যে, সে এবার একটা অদৃশ্য সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছে। আর কোনো কথা না বলে চুপ হয়ে গেল সে। হাল আবারও তার গল্প চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু নারী জাতির কৌতূহলের কারণে পুনরায় তাতে বাধা পড়ে।

“আপনার গল্পে বাধা দেয়ার জন্য দুঃখিত,” জুডিথ বলে উঠল। “যেহেতু আমার মনে হচ্ছে যে, আপনি ভুলে গিয়েছেন ব্যাপারটা, অতএব আমি আশা করব যে ডেনিয়েল-এর কাছ থেকে উত্তরটা পাবো আমি।”

“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ম্যাম।”

“অনেক ধন্যবাদ। আমার প্রশ্ন হল : সেখানে কী ভ্যান ডি ভেলডি’ নামে কোনো বিবাহিত লোক ছিলেন?”

ডেনিয়েল হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যে কখনও যুদ্ধের ময়দানে ভীত হয় না, এমনকি সমুদ্রের ঝড়ো বাতাসও কখনো তার মধ্যে ভয় জাগাতে পারে না। কিন্তু জুডিথ-এর এমন প্রশ্ন আর চোখে মুখে কোমল কৌতূহলের ছাপ তার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। সেই ভয় চোখে মুখের অভিব্যক্তিতেও প্রকাশ পায়।

“আ…আ…আমার যতদূর মনে পড়ে সে হয়ত বিবাহিত লোক ছিল, ম্যাম।”

“আপনি কী তার স্ত্রীর বর্ণনা দিতে পারবেন? যেমন, সে কী যুবতী ছিল নাকি বৃদ্ধা?”

“তাকে বুড়ি না বলে যুবতী বলাটাই ভাল হবে, ম্যাম।”

“উত্তর যেহেতু পাওয়া হয়েছে, অতএব…হাল বলতে শুরু করল, “মিস্টার পেট নিশ্চয়…”

কিন্তু পেট তাকে মাঝপথে বাধা দিয়ে বসল। “সমস্যা নেই, ম্যাডাম, আপনি আপনার প্রশ্ন চালিয়ে যান।” জুডিথের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলে উঠল সে।

“ধন্যবাদ স্যার,” জুডিথও ভদ্রতার সাথে জবাব দেয়। “ডেনিয়েল, এখন আমরা মি, ভ্যান ডি ভেলডি আর তার যুবতী স্ত্রীর সম্পর্কে কথা বলব।” কথাগুলো বলার সময় তার ঠোঁটে এক ধরনের বাঁকা হাসি খেলা করছিল। সে আসলে হালকে টিজ করছিল, ওরা মজা নিচ্ছিল। “আপনি কী তার নাম মনে করতে পারবেন?”

“আমম…ক্যাট জাতীয় কিছু একটা। সঠিক মনে করতে পারছি না।”

হাল-একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ক্যাটিংকা…মিসেস ভ্যান ডি ভেলডির ক্রিশ্চিয়ান নাম ছিল ক্যাটিংকা। এখন খুশি?”

“ধন্যবাদ, ডিয়ার,” জুডিথ বেশ লম্বা সুরে কথাটা বলে উঠল, “আমি খুবই খুশি যে আপনার স্মৃতিশক্তি এখনো নষ্ট হয়ে যায় নি। ডেনিয়েল ক্যাটিংকা ভ্যান ডি ভেলিডি নামটা অনেক সুন্দর।” “আচ্ছা, সে কী দেখতে সুন্দরী ছিল নাকি কুৎসিৎ?”

“ম্যাডাম সেটা তো সহজে বলা যায় না। সৌন্দর্য এক একজনের চোখে এক এক রকম। এটা কারও রুচির ব্যাপার। যেমন…।”

“সাদা রমণী হিসেবে বেশ সুন্দরীই ছিল সে।” অ্যাবোলি কথা বলে উঠল। “গান্ডওয়েন ওর প্রেমে পড়েছিল। সে তখন বালক ছিল। বেচারা তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি যে, একজন সত্যিকার পুরুষ যখন তার ভালবাসার নারীকে খুঁজতে থাকে, তখন তার আফ্রিকার দিকেই চোখ দেয়া উচিত। সৌভাগ্যবশত, পরবর্তীকালে সে তার ভুল সংশোধন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।”

“ধন্যবাদ অ্যাবোলি, ব্যাপারটাকে এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য।” এরপর জুডিথ একটু গম্ভীর কিন্তু শান্তভাবে বলল, “তুমি কী আমাদেরকে ক্যাটিংকা সম্পর্কে বলবে না, ডিয়ার…?”

আরেক গ্লাস ওয়াইন শেষ করে গ্লাসটা নিচে নামিয়ে রাখে হাল। “আরে, এটা কোনো ব্যাপার?” সে বলতে শুরু করে। “তার সোনালি রঙের চুল আর বেগুনি রঙের চোখ ছিল। সে এতই জঘন্য রকমের পাপাত্মা ছিল যে স্বয়ং শয়তানও তার সামনে উপস্থিত হলে ভয় পেয়ে যেত। একবারেই নষ্টা চরিত্রের একজন নারী। আর হ্যাঁ, সে আমাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বটে, আর আমিও তখন সেটাতে বাধা দিতে পারি নি। কিন্তু পরে আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে ফিরে আসি, আর আফ্রিকাতেই আমার প্রিয়জন খুঁজে নিই। আর সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, আমি তোমার সঙ্গে কাটানো একটা সেকেন্ডও ক্যাটিংকা ভ্যান ডি ভেলডির সঙ্গে বিনিময় করতে রাজি নই। এবার কী আমি আমার গল্পে ফিরে যেতে পারি?”

“অবশ্যই,” জুডিথ বলল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে শুরু থেকেই ঠিক যে উত্তরটা সে খুঁজছিল, ওটাই পেয়েছে সে।

“দ্রুত শেষ করে দিচ্ছি গল্পটা। নয়তো আজ রাতে আমরা কেউই ঘুমোতে পারব না”, হাল আবার শুরু করল। “এখন বুজার্ডের কথায় আসি। আমি যেমন মসলার গন্ধ পেয়েছিলাম, ঠিক তেমনি করে সেও বাতাসে গুপ্তধনের গন্ধ পেয়েছিল। আমরা যখনই রিজলিউশন দখল করে এর ধনসম্পদ নিয়ে ফেলি তখনই সে শূন্য থেকে উদিত হয়ে তার অংশ দাবি করতে থাকে।”

“কিন্তু গুপ্তধন পাওয়ার আগেই তো বুজার্ড তোমাদেরকে একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।” বুজার্ডের ঔদ্ধত্যে বেশ রেগে গেল জুডিথ।

“একদম ঠিক এটাই আমার বাবা তাকে বলেছিল। কিন্তু বুজার্ড কোনো কথাই মানে নি। সে সোজা গুড হোপ-এর দিকে রওনা করে, এরপর যেখানে আমরা রিজলিউশন মেরামত করছিলাম আর সোনা-রুপা লুকোচ্ছিলাম, ঐ জায়গাটা ডাচদেরকে দেখিয়ে দেয়…”।

“ডাচদের লোকবল আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সে বলতে থাকে, আমার বাবা আত্মসমর্পণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তার নিজের এতগুলো লোককে খুন হতে দেখতে চাননি। আর ঠিক তখনই, বুজার্ড দুইমুখী শয়তানের মতো কাজ করে। তারই মিথ্যে কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বাবাকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়। শেষে নিজের জীবনটাও হারাতে হয়।”

“সে কী বলেছিল?” পেট জিজ্ঞেস করে। স্যার ফ্রান্সিস-এর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করাতে সে যে উত্তেজনা অনুভব করছিল সেটা লুকোনোর চেষ্টা করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ওকে।

“আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে আমি বলেছিলাম ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড তখন যুদ্ধে লিপ্ত ছিল? আমার বাবাকে তার রাজা ডাচ্ জাহাজ আক্রমণ এবং লুট করার আদেশ দিয়েছিলেন।”

“আমার মনে আছে, পেট জবাব দিল।

“তো, যাই হোক, একারণেই আমার পিতা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী রিজলিউশন আক্রমণ করেন। তিনি যেটা জানতেন না, সেটা হচ্ছে, তিনমাস আগে ডাচ্‌দের নেভী জাহাজ আমাদের ডকইয়ার্ডে হামলা চালিয়ে অনেক জাহাজ পুড়িয়ে ফেলে, যার মধ্যে আমাদের জাহাজ রয়াল চালর্সও ছিল। তারা তখন আমাদের রাজাকে যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে আসতে বাধ্য করে।”

“লেডি এডউইনা যখন রিজলিউশন আক্রমণ করে তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই সেটা জানতাম না। আমার বাবা দ্রভাবে সেটা জানিয়ে দেন। ডাচ কমান্ডার কর্নেল শিউডার সেই কথা মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুতও ছিল। সে যদিও আমাদের পারিবারিক শত্রু ছিল আর শেষে আমি তাকে হত্যা করি, কিন্তু সে সবসময়ই আত্মসম্মানের সাথে যুদ্ধ করত। তো যাই হোক, সে আমার বাবার ব্যাখ্যা শুনে সন্তুষ্ট হয়। এরপর কথাগুলোর সত্যতা যাচাই-এর জন্য বুজার্ডকে জিজ্ঞেস করে, কারণ সে জানত যে বুজার্ড আমাদের সাথেই ছিল। কিন্তু বুজার্ড…” হাল হঠাৎ বুঝতে পারে এই গল্প শেষ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পূর্বের স্মৃতিগুলো তাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছিল।

বিগ ডেনিয়েল সামনে এগিয়ে আসে। “সেই মিথ্যেবাদী বাস্টার্ডটা বলে যে সে স্যার ফ্রান্সিসকে বলেছিল যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছে। সে আরও বলেছিল যে সব জানার পরও নাবিকদেরকে জাহাজ আক্রমণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন উনি। অথচ তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। কিন্তু এই মিথ্যেটাকে ঐ শয়তানটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। যার ফলে আমাদের ক্যাপ্টেনকে জীবন দিতে হয়। আমাদের সবাইকে গাল অব মোরের অন্যান্য দাসের সাথে বন্দি করা হয়। আমাদেরকে গুড় হোপ-এ নিয়ে যাওয়া হয়, সাধারণ বন্দিদের মতো অত্যাচার করা হয়। আমার পিঠে এখনো সেই চাবুকের দাগ আছে। অ্যাবোলির পিঠেও আছে। আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন-এর পিঠেও আছে।”

“হ্যা!”-হাল ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, “আমার পিঠেও আছে। কিন্তু আমরা ওখান থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।” “আপনি ভদ্রলোককে সেই গল্পটা বলুন।”

“কী ঘটেছিল এরপর?” পেট জিজ্ঞেস করে।

“আমার বাবার মৃত্যু দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর আমরা সবাই কোনোভাবে পালিয়ে যাই। আমরা সাগরের সেদিকে যেতে থাকি যেখানে আমাদেরকে প্রথম ধরা হয়েছিল।”

“ওরকম একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গার দিকে কেন যাত্রা করেছিলেন?”

“একটা কারণতো ছিলই। ভেবেছিলাম আমরা হয়ত বুজার্ডকে সেখানে পাব।”

“তারও সেখানে যাওয়ার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল?” পেট বলল। সে মনে-মনে একটা কথাই ভাবছিল: কার্টনির বিশ্বস্ত পুত্র যা-ই বলুক না কেন, সত্যটা হচ্ছে, গুপ্তধনের লোভ স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি আর বুজার্ডকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছিল।

“হ্যা”, হাল বলল। “কিন্তু ঘটনা আরও একটু জটিল হয়েছিল। আমরা পালিয়ে যাওয়ার কারণে শ্রিউডারকে দায়ী করা হয়েছিল, অসম্মান করা হয়েছিল তাকে। পরে আমি শুনেছি সে তার প্রেমিকা ক্যাটিংকা ভ্যান ডি ভেলডি’র কাছে গিয়েছিল। সেখানে সে ক্যাটিংকাকে স্লো জন নামে এক ঘাতকের সাথে এক বিছানায় পেয়েছিল।”

“তার মানে সে সত্যিই নষ্টা চরিত্রের অধিকারী ছিল।”

“নারীরূপী শয়তান ছিল সে”, হাল উত্তর দেয়। “মেসালিনা নামে রোমের এক সম্রাজ্ঞী ছিল যে নিজের আনন্দের জন্য বেশ্যাবৃত্তি বেছে নিয়েছিল। ক্যাটিংকাকে তার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু সে তার পাপের শাস্তি পায়। শিউডার প্রচণ্ড ক্রোধে অন্ধ হয়ে তাকে হত্যা করে। এরপর সে তার নিজের কাজের ব্যাখ্যা করার জন্য গোল্ডেন বাউ-এর দিকে যাত্রা করে। গোল্ডেন বাউ তখন ক্যাপ্টেন ক্রিস্টোফার লেয়োনিল-এর কমান্ডে গুড হোপ-এ অবস্থান করছিল।”

“আরেকজন ভালমানুষ খারাপ নারীর পাল্লায় পড়ে ভুল কাজ করল,” উইল স্ট্যানলি বলে উঠে, যে এতক্ষণ যাবত চুপচাপ হাল-এর গল্প শুনছিল। “আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, ম্যাম,” সে বলতে থাকে, “যখন মাথা মোটা কর্নেলটা গোল্ডেন বাউ আক্রমণ করে তখন আমি সেখানে কর্মরত ছিলাম।”

“তাহলে আমি কোনো ভুল বললে আপনি তা শুধরে দিতে পারবেন,” হাল বলতে শুরু করে। “ভিসকাউন্ট নামে বাউ-এর একজন অফিসার ছিল। সে আর শিউডার বাজি ধরে পাশা খেলতে বসেছিল একদিন। শিউডার পৃথিবীতে তার যত ধনসম্পদ আছে সবকিছুই বাজিতে রেখেছিল কিন্তু পাশার চাল উইন্টারটন-এর পক্ষে যায়। শ্রিউডার সেটা মেনে না নিয়ে উইন্টারটনকে ধোকাবাজ বলতে থাকে, এরপর তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানায়।”

“গাল অব মোরে” নোঙর করাই ছিল। হাল আবার বলতে শুরু করে। “দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষে উিডার উইন্টারটনকে হত্যা করে, এরপর বুজার্ড ক্যাপ্টেন লেয়ানেল-এর সাথে প্রতারণা করে তাকে গোল্ডেন বাউ থেকে বের করে দেয়। নিজেকে খুব চালাক মনে করে বুজার্ড তখন উল্লাস করছিল, কারণ সে ভেবেছিল যে তার এখন দুটো জাহাজ রয়েছে। কিন্তু আমরা যে কয়জন লেডি এডউইনার নাবিক বেঁচে ছিলাম তারা পরমুহূর্তেই সেখানে পৌঁছে যাই, এরপর বুজার্ডকে উপকূলে নিক্ষেপ করি…আর এভাবেই এই গুরুত্বপূর্ণ জাহাজটা সেদিন আমার হাতে চলে আসে। যদিও আমি সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এটাকে এর সঠিক মালিকের কাছে ফেরত দেব-যদি সে বেঁচে থাকে।”

“ক্যাপ্টেন কার্টনি আপনি যখন গোল্ডেন বাউ দখল করেন তখন কী কর্নেল শিউডারকে হত্যা করেছিলেন?”

“না, তখন নয়। ইথিওপিয়ায় অভিযানের সময় করি।”

“এরপর বুজার্ডের কী হয়েছিল? সে কী এখনো তার পাখা ছড়িয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, আর অন্যের ধন সম্পদে ভাগ বসাচ্ছে?”

“আমি এর উত্তর দিতে পারি,” জুডিথ বলে উঠে। “বুজার্ড মারা যায়। যখন গাল অব মোরে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হয় সেদিনই সে আগুনে পুড়ে মারা যায়। আমি জানি…আমি তাকে মরতে দেখেছি। আমি আশা করি সে এখনো পুড়ছে-নরকের আগুনে।

“তার উচিত শাস্তি হয়েছে। কিন্তু আপনার গল্পের ব্যাপারে আমি একটা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারছি নে। বুজার্ড কী সাগরে সেটা খুঁজে পেয়েছিল যা সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল?”

“আমি দুঃখিত, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি,” হাল বলল। যদিও হাল বুঝতে পেরেছিল পেট কী জানতে চায়। কিন্তু সেটার সঠিক উত্তর দেয়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না।

“আমার যতদূর মনে পড়ছে আপনি বলেছিলেন যে, মুক্তি পাওয়ার পর আপনারা যে উপসাগরের দিকে গিয়েছিলেন, বুজার্ডকে সেখানে পাওয়ার একটা কারণ আছে। আমার ভুলও হতে পারে অবশ্য…কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সেই একই সাগর যেখানে আপনার বাবা গুপ্তধনসহ রিজলিউশন নিয়ে গিয়েছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ, আমিও একই সাগরের কথা বলছিলাম।”

“আমার ধারণা, বুজার্ড হয়ত ভেবেছিল যে আপনার বাবা স্যার ফ্রান্সিস কিছু গুপ্তধন সেখানে লুকিয়ে রেখেছেন। আর সেটা খুঁজতেই বুজার্ড সেখানে গিয়েছিল।”

“বুজার্ড হয়তো তাই ভেবেছিল। সে তার লোকদেরকে দিয়ে ঐ স্থানের আশেপাশের দ্বীপগুলোর মাটি খুঁড়েছিল। হয়তো সে কিছু একটা খুঁজছিল। কিন্তু আমি যতদূর জানি, আমার বাবা ওই উপসাগরে কিছুই লুকোনোর চেষ্টা করেননি, আর আমাকেও কখনো এরকম কোনোকিছু বলেননি। তাই অন্য কেউ যদি পূর্বে সেখানে কোনো ধন সম্পদ লুকিয়ে না রেখে থাকে তবে বুজার্ড অযথাই তার সময় আর লোকবল নষ্ট করছিল। তাছাড়া…বুজার্ড তো এখন মৃত।”

“ঠিক আছে। তাহলে সবকিছু জানা হয়ে গেল।” টেবিলের চারদিকে বসা সবার দিকে তাকাতে থাকে পেট, বিশেষ করে যারা সেসময় ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে ছিল তাদের দিকে। ডেনিয়েল এবং স্ট্যানলির দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া তার চোখ এড়ায় নি। এরপর সে অ্যাবোলির দিকে তাকায় যদিও অ্যাবোলি শূন্যদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তারপর পেট-এর মনে হয় আফ্রিকান লোকটা কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।

এরপর হাল ডিনার-এর সমাপ্তি ঘোষণা করে, তারপর তার সিনিয়র নাবিকদের রাতের নির্দেশনা দিতে থাকে। পেটও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার জন্য নির্ধারিত কেবিন-এর দিকে রওনা দেয়। নিজের রুম-এ গিয়ে শুয়ে-শুয়ে একটা কথাই ভাবছিল সে : গুপ্তধন তাহলে আসলেই আছে! যদিও তার মনে হয়না যে হাল কার্টনি তার সব নাবিককে জায়গাটার সন্ধান দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এরপরেও…অন্তত একজন জানে। লোকটার দৃষ্টিই সব বলে দিচ্ছিল।

ঐ আফ্রিকান অ্যাবোলি, যাকে কার্টনি অসম্ভব বিশ্বাস করে।

৩. জাঞ্জিবার-এর রাস্তায়

আর জাহান বুজার্ডকে নিয়ে খোলা বাহনে চড়ে জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় বের হলো, যেন সারা পৃথিবীর মানুষ এই মুখোশ পরা দানবটাকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। একটা পুরো অশ্বারোহী সৈন্যদল তাদের বাহনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পাশাপাশি আরেকটা অশ্বারোহী সৈন্যদল তাদের পেছনে পাহারা দিয়ে যাচ্ছিল যেন কেউ কোনোরকম সমস্যা তৈরি করতে না পারে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে এক হাতওয়ালা দানবটাকে দেখছে। যারা সেই ছোট বালকটার অবস্থা দেখেছে তারা কেউই বুজার্ডকে অপমান করার কথা চিন্তাও করতে পারছে না। অনেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে যেন তাদেরকে এই অমানুষ প্রাণীটাকে দেখতে না হয়। তারা ওকে শয়তানের সৃষ্টি জিন বলেই মনে করে।

মাত্র একঘণ্টা আগে জাহান বুজার্ডকে পুরনো একটা মন্দির ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এর সমাধিস্থান আর আনুবিস এর ছবি দেখিয়েছে। আনুবিস হচ্ছে মিসরীয় শেয়ালের মাথাওয়ালা আন্ডারওয়ার্ল্ডের লর্ড। “এ হচ্ছে মৃত্যুর দেবতা” এটা বলার পর বুজার্ড মাথা ঘুরিয়ে এক চোখ দিয়ে ভালভাবে তাকিয়ে দেখল। “তাকিয়ে দেখ এর নাকটা দেখতে অনেকটা তোমার চামড়ার নাকের মতো। তুমি নিজেকে আনুবিস ভাবতে পার-মৃত্যুর দৃত, যে কি-না মানুষের আত্মাকে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে নিয়ে যায়।”

“যেটা বলতে চাচ্ছিলাম। তুমি তোমার মুখে ময়লা ছুঁড়ে দেয়া ছেলেটাকে যেভাবে হত্যা করেছে এতে আমি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি। এতে আমি আশ্বস্ত হয়েছি যে তোমার মানুষ হত্যা করার দক্ষতা বাড়বে। তুমি এক বাহু আর এক হাত নিয়ে আগের চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছ। তোমাকে আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সকাল থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু করা হবে।”

এখন বুজার্ডকে তার ট্রেইনিং-এর প্রথম সেশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শুধু সে এবং জাহান এই ভ্রমণে যাচ্ছে না। তাদের খোলা বাহনের পেছনে একটি বদ্ধ বাহনও রয়েছে। তাদের ভোলা বাহনের জানালার শাটারগুলো ফেলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভেতরে কে আছে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এর ভেতরের মানুষও বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কোচ তার জায়গায় বসে আছে এবং রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। খানিক বাদে বুজার্ডকে বহনকারী বাহন আর তার চারপাশের প্রহরীরা বড় একটা গেট-এর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে চতুষ্কোণ একটা জায়গার মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জাহান এবং বুজার্ডকে বাহনটা থেকে নামার পর প্রিজন গর্ভনর তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, এরপর বুজার্ডের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় লোকটা। এরপর সে দুই হাতে তালি বাজানোর পর তিনজন প্রিজন গার্ড তাদের হিংস্র চেহারা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। একজনের হাতে লম্বা একটা লোহার চেইন। বাকি দুইজন তার দুইপাশ দিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের হাত কোমড়ে ঝুলানো তলোয়ার-এর বাট-এর ওপর।

বুজার্ড দেখতে পায় শেকলটার একপাশে একটা তালা লাগানো। সবকিছুর অর্থ বুজার্ড একমুহূর্তে বুঝে ফেলে। তার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে যদি সে কোনো কিছুতে বাধা দেয়। তাই সে মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার গলায় লাগানো চামড়ার কলারের সামনের হুক-এ শেকলটা আটকানো হয়। এরপর জেলের ভেতর থাকা লোকগুলোর চোখের সামনে দিয়ে তাকে পশুর মতো টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বিশাল বড় এক উঠোনের মাঝখানে নিয়ে দাঁড় করানো হয় যেটার চারপাশে বড় বড় উঁচু দেয়াল তোলা। দাঁড়ানোর পর বুজার্ড তার মাথাটা যতদূর সম্ভব ঘুরিয়ে একচোখ দিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। চারপাশে লাল রঙ্গা উঁচু দেয়াল। দেয়ালের পেছনে দর্শকদের বসার জন্য এক ধরনের গ্যালারিও রয়েছে। সেই গ্যালারি থেকে দর্শকদের উল্লাস ধ্বনি ভেসে আসছে। চিৎকার দিয়ে কেউ একজন বলে উঠে, “জঘন্য লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি আমি!” কণ্ঠটা তার কাছে অনেক পরিচিত মনে হয়। জাহানের প্রিয় উপপত্নী এলিনা। উত্তর-পূর্ব উপকুলে সারকাশিয়ান জাতির মেয়ে সে। ওখানকার রমণীরা যেমন তাদের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল তেমনি পুরুষের চাহিদা মেটানোর দক্ষতার জন্যও কম বিখ্যাত ছিল না। কন্সট্যান্টিনোপাল-এ ওটোম্যান সুলতানের হারেমে সবচেয়ে বেশি ছিল সারকাশিয়ান রমণী। এদের মধ্যে যারা সবচেয়ে সুন্দরী তারা দিল্লীর লাল কেল্লায় গ্রেট মোগল-এর চাহিদা মেটাত।

এলিনা জাহানের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী নয়। এমনকি তার সঠিক মাপের চিকন ফিগারের শরীরও নয়। কিন্তু তার ঠোঁটে এক ধরনের কামুক ভাব খেলা করত। তার চোখে, তার শরীরের প্রতিটি ভজে এবং তার প্রতিটি চলাফেরায় সে যে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতো তাতে বলা যায় সে জাহানকে যে শুধু আনন্দই দিতে জানত, তা নয়, আনন্দ কিভাবে নিংড়ে নিতে হয় সেটাও জানত। সে অবশ্য কিছুদিন আগে বুজার্ডকে দেখে মোহিত হয়েছিল-যখন বুজার্ড প্রথমবারের মতো হারেমে গিয়েছিল, সাথে ছিল শক্ত পেশিবহুল দুজন হারেম-গার্ড, যাদের উচ্চতা আর মাংসল শরীর দেখে বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না যে তারা নপুংসক। যেখানে অন্যান্য উপপত্নী ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছিল সেখানে এলিনা স্বইচ্ছায় অদ্ভুত মুখোশ পরা বুজার্ডের দিকে এগিয়ে আসে। সে বুজার্ডের এত কাছে চলে আসে যে বুজার্ড তার শরীর থেকে আসা সুগন্ধ খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিল। তার নিজের নকশা করা মুখোশ, তার অর্ধনগ্ন শরীর বুজার্ডের শরীরের সাথে প্রায় লেগে ছিল।

“এই প্রাণীটা কী স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলে, মাই লর্ড?” সে নারীসুলভ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে জাহানকে জিজ্ঞেস করেছিল।

“না”, প্রিন্স জবাব দেয়। কিন্তু তোমার কথা ও বুঝতে পারবে।” বুজার্ড বুঝতে পারে এলিনা তার শরীরে। চাপ দিচ্ছে। বুজার্ড বুঝতে পারে তার ভেতরটা আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। যে রক্তের প্রবাহের কারণে একজন পুরুষ মানুষ পুরুষ হয়ে উঠে সেই প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার পরও তার কিছুই করার নেই। পুড়ে যাওয়া ক্ষত জায়গা থেকে সে শুধু মশার কামড়ের মতো এক ধরনের চুলকানি অনুভব করছে। এরপর উপপত্নীটা বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, “মাই লর্ড কী ঠিক বলেছে? তুমি কী বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাচ্ছি?”

বুজার্ড কি বলবে বুঝতে পারছে না। যেন মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। দুই পায়ের সন্ধিস্থল থেকে এক ধরনের অসহ্য যন্ত্রণা তার মস্তিষ্কে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। এমনকি হাত দিয়ে সেখানে চুলকানোরও অনুমতি নেই। সে অস্পষ্টভাবে শুনতে পায় জাহান বলছে, “তুমি মাথা নাড়াতে পার।” কিন্তু তার মনে হচ্ছিল জাহান-এর কণ্ঠ যেন অন্য কোনো দুনিয়া থেকে আসছে।

বুজার্ড মাথা নাড়ায়, সেই সাথে তার কোমর এদিক সেদিক নাড়া দেয়। “ওহ”, এলিনা বেশ চিন্তাশীলভাবে বলে উঠে, “এ তো দেখি অনেক কিছুই বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে?”

সে তার পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। এরপর বুজার্ডের মুখোশের কাছাকাছি এসে বলে, “একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক, কুৎসিৎ মানব, যদি তুমি বাঁচতে চাও। তার চেয়ে বড় কথা তুমি তোমার হাত নাড়ানোর চেষ্টা করবে না। যদি তুমি আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা কর তবে তোমার মৃত্যু অনিবার্য। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাও তাহলে আমি তোমাকে এবারের মতো ছেড়ে দেব।”

বুজার্ড খুব দ্রুত দুই বার মাথা নাড়ায়, যা দেখে এলিনা পেছনে সরে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। “তোমার এই অদ্ভুত ঠোঁট সাবধানে রাখ, জঘন্য জানোয়ার! নয়ত তোমার ওই সুচালো ঠোঁট আমাকেও তোমার মতো একচোখওয়ালা দানবে পরিণত করে দেবে। আমার প্রিন্স কোনোভাবেই সেটা মেনে নিবে না, মাথায় রেখে কথাটা।”

এলিনা আবারও বুজার্ডের দিকে এগিয়ে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে। বুজার্ড যে জেল্লাব পরে আছে সেটার একপাশে আস্তে আস্তে হাত দিয়ে উপরে তুলতে থাকে। তাহলে তুমি এটার নিচে কী লুকিয়ে রেখেছ?” এলিনা জিজ্ঞেস করে, এরপর সে বুজার্ডের পা, উরু নগ্ন করতে থাকে। একপর্যায়ে সে চিৎকার দিয়ে সরে আসে। তার চোখ মুখ বিরক্তিতে কুচকে আসে। এর চামড়া তো পুড়ে গিয়ে ক্ষত হয়ে আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ওখান থেকে।”

হারেম-এর মেয়েরা ভয়ে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠে। তবে ভয়কে ছাপিয়ে তাদের কৌতূহলটাই বড় হয়ে উঠে একটু পর। ব্যাপারটা ভাল করে দেখার জন্য তারা সামনে এগিয়ে আসে। মুখোশের পেছনে বুজার্ড লজ্জায় অপমানে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। এই অপমানের জ্বালা তার ক্ষত থেকে আসা ব্যথার চেয়েও বেশি তীব্র। তার হার্ট দ্রুত পাম্প করতে শুরু করেছে, নিঃশ্বাস এত হোট হয়ে আসছে যে সে ভয় পাচ্ছে; হয়তো সে যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস ফুসফুসে নিতে পারছে না।

এরপর আরো একবার তীক্ষ্ণ হাহাকার শোনা যায় যখন এলিনা বুজার্ড-এর কাপড়টা একেবারে উপরে উঠিয়ে ফেলে; ক্ষতটা একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল তখন। “দেখ,” সে অন্যান্য মেয়েকে দেখিয়ে বলে। “এই ঘৃণ্য জীবটা নারীও নয় আবার পুরুষও নয়।” এরপর সে বুজার্ড-এর পায়ের মাঝে লেগে থাকা ছোট্ট মাংসটুকুতে আঙুল দিয়ে বলল, “এটা দেখতে গোলাপের কুড়ির মতো, যেটা আমাদের এত আনন্দ দেয়, তাই না?” কিন্তু “এই ক্ষুদ্র জিনিসটা এই কুৎসিৎ লোকটাকে আনন্দ দিতে পারে কি-না, আমার সন্দেহ আছে।”

বুজার্ডের ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটার ওপর প্রতিশোধ নিতে কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। সে মেয়েটাকে শক্ত বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে কিন্তু তার শুধু একটি বাহু আছে। আর সে যদি এই বাহুটা দিয়েও কিছু করতে চায় তবে তার মৃত্যু অনিবার্য।

সে এখন যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে : দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তবে পা দুটোও মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে।

বুজার্ড তার একচোখ দিয়ে সবাইকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছে না, তাই পাখির মতো মাথা নাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করা তার জন্য স্বাভাবিক। তার এক চোখ দিয়ে সে কখনো কোনো সুন্দর মুখ, কোনো সুন্দর ঠোঁট বা চোখ, কখনো বা কারও শরীরের ভাজ দেখতে পাচ্ছে। সে কখনো একসাথে এতগুলো সুন্দরী রমণী দেখেনি। যদি সে কয়েকমাস আগেও এমন সুযোগ পেত তাহলে হয়ত নারীজাতির কাছে নিজের পৌরুষ প্রমাণের একটা সুযোগ পেত।

এখন যদিও নিজের হীনতা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া বুজার্ডের আর কিছুই করার নেই। এলিনা কিছুক্ষণ তার দিকে খুব কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এরপর উচ্চস্বরে বলতে থাকে, “আমি ভাবছি, এটা দিয়ে কী কোনো স্বাভাবিক নারী-পুরুষের মতো আনন্দ করা সম্ভব।” এরপর সে জাহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে থাকে, “আমি কী এটা নিয়ে খেলা করতে পারি, স্যার?”

মহারাজা উচ্চস্বরে হেসে উঠেন। “না, তুমি পার না। আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে খেলা কর। এদিকে এস। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে যে একজন প্রকৃত পুরুষ কেমন হয়।” সে গার্ডদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “একে নিয়ে যাও।” বুজার্ডকে তার নোংরা বন্দিখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর থেকে আজকের আগ পর্যন্ত জাহানের সাথে বুজার্ডের আর দেখা হয়নি। এমনকি হারেমে যাওয়ার অনুমতিও বুজার্ডের ছিলনা। এখন এলিনার কণ্ঠ তাকে আবার সেই পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। তার দুই পায়ের সন্ধিস্থল থেকে সেই তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে সে।

“এদিকে তাকাও”, কুৎসিৎ মানব এলিনা চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে। “তোমার জন্য আমার কাছে কিছু একটা আছে।”

বুজার্ড এদিক সেদিক তাকিয়ে কণ্ঠের উৎস খুঁজতে থাকে। তার উপরের দিকে দোতলা সমান উঁচু খোলা একটা গ্যালারি রয়েছে। সেটাতে শুধু এলিনা আর জাহান বসে আছে। এলিনার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা, যেন তার মনিব ব্যতীত বাইরের কেউ তাকে দেখতে না পায়। হারেম-এর বাইরে গেলে তাকে এইভাবেই থাকতে হয়।

“দেখ”, সে ডাক দিয়ে বলে। তার দুই হাত সামনে বাড়ানো। বুজার্ড দেখতে পায় তার হাতে লম্বা, বাঁকানো একটা তলোয়ার। এটার সঠিক ব্যবহার। কর। “তাহলে পুনরায় আমাদের দেখা হবে।”

এলিনা সামনের দিকে ঝুঁকে হাত দুটো নিচু করে তলোয়ারটা তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। বুজার্ড সেটা তুলে নেয়। এরপর জাহান তার উদ্দেশ্যে কথা বলে উঠে।

“যাও, পিছিয়ে গিয়ে মাঠের মাঝখানে দাঁড়াও। তুমি যে গেটটা দিয়ে ঢুকেছে সেটার দিকে তাকিয়ে দেখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা খুলে যাবে আর সেখান থেকে একজন মানুষ প্রবেশ করবে। সে হচ্ছে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামী। তোমার তাকে হত্যা করতে হবে।”

“তাকে হত্যা কর।” এলিনার কণ্ঠও প্রতিধ্বনিত হয়।

বুজার্ড তার দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এতবেশি ছড়ায়নি যাতে তার ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয়। গত এক মাসের মধ্যে সে এই প্রথম এতটা শক্তিশালী অনুভব করল। কোনো সুন্দরী রমণীর সামনে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেল। তাকে দেখানোর সুযোগ পেল যে সবকিছু সত্ত্বেও সে এখনো একজন পুরুষ।

কয়েক সেকেন্ড পরে গেট খুলে যায়। একজোড়া অপরিচিত হাত একজন বন্দিকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। রোগা চর্মসার, ছোট খাট একজন মানুষ ভেতরে প্রবেশ করে। লজ্জা নিবারণের জন্য তার কোমড়ে জড়ানো ছিল শুধু এক টুকরো কাপড়। তার রুক্ষ সোনালি চুলের ওপর একটা কাপড় বাঁধা ছিল। মাঠ পাড়ি দিয়ে তার যে চোখ বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল সে চোখে কোনো ভয় ছিল না। ছিল বিদ্বেষ।

বুজার্ড ভালভাবে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল এবং নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজতে লাগল। সেগুলো খুঁজে পাওয়া অবশ্য কঠিন কিছু নয়। তার বাম হাত নেই। বাম চোখ নেই। তার লম্বা ঠোঁট তার দৃষ্টির এক অংশ প্রায় ঢেকে রেখেছে। তাই তার শরীরের অন্যপাশ প্রতিপক্ষের জন্য অনেক দুর্বল অংশ। বুজার্ড নিশ্চিত যে বৃদ্ধ লোকটি তার বর্শা দিয়ে বুজার্ড-এর বাম পাশে আঘাত করার চেষ্টা করবে। তাই বুজার্ড লোকটির গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু লোকটি আস্তে আস্তে পেছনে সরে যাচ্ছে।

“তোমার পেছনে,” এলিনা আর্তনাদ করে উঠে।

“ঘুরে দাঁড়াও,” জাহান বলে উঠে।

বুজার্ড অতি দ্রুত বাম দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বৃদ্ধ লোকটির অল্প একটু অংশ ছায়ার মতো তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। গ্যালারি থেকে তীব্র চিৎকার শোনা যাচ্ছে এখন। সাথে-সাথে বুজার্ডের ভেতর নিজের যুদ্ধের স্পৃহা ফিরে আসল। সে ভুল পথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার ডানদিকে ঘুরা উচিত যেদিকে তার একটি হাত আর একটি চোখ ভাল আছে। তলোয়ার ধরা হাতটা সামনের দিকে দিয়ে সে ঘুরতে থাকে যাতে সামনে যা-ই পড়বে সব কেটে যাবে।

হাত ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকার ফলে তার ভারসাম্য রক্ষা করতে সহজ হয়। এক পর্যায়ে সে বুঝতে পারে তার তলোয়ারটা শক্ত কিছুর ওপর আঘাত করেছে। এরপরই সে ব্যথাতুর চিৎকার শুনতে পায়। বুজার্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দেখতে পায় বৃদ্ধ লোকটি তার ডান হাতটি বামহাত দিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর বুজার্ডের চোখ যায় মাটিতে। দেখতে পায় দুটো কাটা আঙুল মাটিতে নড়াচড়া করছে। এরপর সে মাথা তুলে দেখতে পায় বৃদ্ধ লোকটি পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যথার কারণে সে আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে না।

পিছিয়ে যেতে যেতে বৃদ্ধ লোকটি দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল। সাথে-সাথে বুঝতে পারে সে ফাঁদে আটকা পড়েছে। লোকটা বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। কয়েক মুহূর্ত পুজার্ড ইতস্তত করতে থাকে যে কি করবে। এরপরই সে জাহানের কণ্ঠ শুনতে পায়। “ও একজন খুনী। ওকে হত্যা কর।” আবেগহীন রুক্ষ কণ্ঠে জাহান আদেশ করে উঠল। এরপরই এলিনা চিৎকার দিয়ে উঠে। “ওকে হত্যা কর কুৎসিৎ মানব।”

এরপর আর কোনো চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন ছিল না। তার কাজ সে চালিয়ে যায়। নিজের তলোয়ারটা লোকটির পেটে ঢুকিয়ে দেয় সে। এরপর লোকটি যখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন তার উন্মুক্ত গলায় বুজার্ড তলোয়ার বসিয়ে দেয়। লোকটিকে হত্যা করার পর বুজার্ডের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। জাহানের হারেমে তাকে যে অপমানের শিকার হতে হয়েছে তাতে সে গত কয়েকদিন যাবত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। এখন কিছুটা হলেও সেটা কমেছে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আনন্দিত হওয়ার সময় নেই কারণ জাহান এরই মধ্যে তার নাম ধরে ডেকেছে। “গেট! গেট-এর দিকে তাকাও।”

বুজার্ড মাথাটা ঘুরিয়ে গেট-এর দিকে তাকিয়ে দেখে আরেকজন লোক প্রবেশ করছে। তার বয়স আগের লোকটির চেয়েও কম এবং তাকে বেশ শক্তিশালী মনে হচ্ছে। কিন্তু লোকটির পায়ে একধরনের অসংগতি আছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে। বুজার্ড বুঝতে পারে তার মাথাটা সবসময় নড়াচড়ার ওপর রাখতে হবে যেন তার দৃষ্টি লক্ষ বস্তুর ওপর থেকে সরে না যায়। শুধু যে তাকে মাথা নাড়াতে হচ্ছে তা-ই না। মাথার গতিবিধির সাথে তাল মিলিয়ে শরীরকেও নাড়াতে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে যে অস্ত্র হাতে ধেয়ে আসতে থাকা শত্রুর সামনে সে যদি একদিন য় দাঁড়িয়ে থাকে তবে তার মৃত্য অনিবার্য।

যদিও বুজার্ডের যুদ্ধ কৌশল আয়ত্তে আনতে একটু সময় লাগে তবুও শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মানুষটিকেও শায়িত করে ফেলে সে। তলোয়ার দিয়ে তার পেট চিরে ফেলে বুজার্ড। রক্তে ভেসে থাকা খাদ্যনালী এবং পেটের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে যায়।

এরইমধ্যে মাঠে তৃতীয় যোদ্ধার প্রবেশ ঘটে। বুজার্ড তার নিজস্ব গতিতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাকে কুপোকাত করে ফেলে।

“যথেষ্ট হয়েছে,” এলিনা বিরক্তির স্বরে বলে উঠে। “গুড”, জাহান উত্তর দেয়। আমরা একে নিয়ে আরও ভাল কিছু করতে পারি।”

এরপর তারা দুজন বুজার্ড-এর দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে উঠে চলে যায়। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে বুজার্ড তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এলিনার উদাসীনতায় বুজার্ড স্কুলপড়ুয়া বালকের মতো দুঃখ পেল। ওরা চলে যাওয়ার পরপরই গ্যালারি থেকে মোটা কণ্ঠের একজনের চিৎকারে সে সম্বিত ফিরে পায়

“হে মুখোশ মানব!” বুজার্ড দেখতে পায় বেশ লম্বা মোটাসোটা একজন লোক কথা বলছে। তার মাথার চুল ফেলে দেয়া, খালি গা, বাহুর প্রস্থ একজন সাধারণ মানুষের উরুর চাইতেও বেশি।

“আমার নাম আলী। আমি তোমার প্রশিক্ষক। তোমার আরো কাজ আছে। মহারাজার আদেশ অনুযায়ী তোমাকে একজন ভাল যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যা আমি অবশ্যই করব। তাই বলছি, সতর্ক থাকো, সেই সাথে চারপাশে নজর রাখো। যতগুলো শক্র সামনে আসবে তাদের বধ করতে হবে তোমাকে-যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি থামতে বলব। এটা আমার আদেশ এবং …একই সাথে উপদেশ। তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?”

বুজার্ড মাথা নাড়ায়।

“গুড”, আলী বলতে থাকে। “এখন তোমার যাদের সাথে দেখা হবে তারা আরও তরুণ এবং শক্তিশালী, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো-যদি তুমি তাদেরকে হত্যা না কর তাহলে তারা তোমাকেই হত্যা করবে।”

প্রশিক্ষক ঠিকই বলেছিল। পরবর্তী যে দুজন বন্দিকে তার দিকে ঠেলে দেয়া হয় তারা তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে সেখান থেকে যথেষ্ট কৌশলে তাকে সরে আসতে হয়েছে। তাদের প্রতিহত করে একদম প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। ছয় নাম্বার লোকটি বুজার্ডকে আঘাত করতে সক্ষম হয়। বুজার্ড যদি শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করতে না পারত তাহলে হয়ত সে-ই বুজার্ডকে হত্যা করত। সাত নাম্বার লোকটি বুজার্ডকে কয়েকটা ঘুষি মেরে বসে। কিন্তু মাঠের এখানে সেখানে পড়ে থাকা মৃত মানুষগুলোর দিকে নজর পড়ার পর তার সাহস আর আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিল। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে দুটো গুণ অনেক প্রয়োজন ছিল। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তলোয়ার-এর এক আঘাতে নিজের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করে দেয় সে। এর পরপরই হাঁটুগেড়ে মাঠের ওপর বসে পড়ে বুজার্ড। এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে তলোয়ার ধরে রাখা আঙুলগুলো অনুভবই করতে পারছিল না।

.

ক্ষুধার্ত এবং ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় বুজার্ড তার কোয়াটার-এ ফিরে আসে। আফ্রিকান চাকরটা যখন নল ঢুকিয়ে তাকে পানি খেতে দেয় সে একবারে সমস্ত পাত্র খালি করে ফেলে। তার জেল্লাবা খুলে দেয়া হয়, এরপর তাকে গরম পানিতে গোসল করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে তাকে গরম তেল মালিশ করে দেয়া হয়-পেশিগুলোকে শিথিল করার জন্য। গোসল শেষে তাকে দেয়া হয় শুকনো কাপড়। খেতে দেয়া হয় চিকপিস, শাকসবজি, এবং মিনস মিট-তার জন্য আজ বরাদ্দকৃত খাবার ওইগুলোই ছিল।

কিছুক্ষণ পর বুজার্ড যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন জাহান তার কক্ষে আসে। “তুমি আজ যথেষ্ট ভাল করেছ।” সে বলতে থাকে। “এখন থেকে আলী তোমাকে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিবে। মাঝে মাঝে সে আর তুমি একা কাজ করবে। অন্যসময় তোমাকে বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হবে-তুমি কী শিখেছো সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। সেখানে তোমাকে বন্দিদের সাথে যুদ্ধ করতে দেয়া হবে।”

জাহান বুজার্ডের দিকে এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে এবং সরাসরি তার চোখের দিকে তাকায়। “এলিনা খুবই অসাধারণ এক রমণী। তাই না?” সে এমনভাবে বলে যেন দুই বন্ধু মিলে গল্প করছে।

“হ্যা”, বুজার্ড উত্তর দেয়।

“মাঝে মাঝে আমি বুঝতে পারি না, সে ডাইনি, নাকি পরী, নাকি দেবী…অথবা সে সবই। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সে যেভাবে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে-এমনকি তোমার মতো কাউকেও”-তার তুলনাই হয় না। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে জাহান। “সে তোমার অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছিল। তাই না? মানে যতটা জেগে উঠা তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল আরকি।”

“হ্যা”, বুজার্ড অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দেয়। তার কণ্ঠে কেমন যে দোটনা ভাব চলে এসেছিল।

“তুমিও চাও সে তোমাকে আনন্দ দিক, তাই না?”

“হা…হা…অবশ্যই”, খুব দ্রুত জবাব দেয় বুজার্ড।

জাহান বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দেয়। আমি এটা নিয়ে চিন্তা করেছি। কিন্তু এলিনা অথবা আমার অন্যকোনো উপপত্নীর সাথে স্বর্গসুখ উপভোগ করতে চাইলে তোমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না তুমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। হেনরি কার্টনিকে হত্যা করতে পারবে।”

“কিন্তু এরপর…?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করে।

জাহান হেসে জবাব দেয়, “যদি তুমি কার্টনিকে হত্যা কর, সে আমাদেরকে যেভাবে অসম্মান করেছে, তোমাকে যেভাবে অপমান করেছে, আমাদের লোকদের ক্ষতি করেছে, সেগুলো তাকে কড়ায় কণ্ডায় হিসেব বুঝিয়ে দিতে পারো, তবেই তুমি আমার হারেমের কোনো এক রত্নকে পাবে। সেটা এলিনাও হতে পারে-যদি আমি ততদিনে তাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি আরকি। আমার উপহার হিসেবে তুমি তাকে রেখে দিতে পারবে অথবা যা খুশি করতে পারবে।”

*

উইলিয়াম পেট অনেকটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ, সেই সাথে সক বেশ অদ্ভুত। হাল তাকে নিজের অলিভ ওয়েল আর বেরিলা অ্যাসেস সোপ ব্যবহার করতে দিয়েছে। সাগর থেকে বালতি ভর্তি পানি তুলে গোসল করে লোকটা। ডেফট-এর বন্দিশালায় বন্দি থাকা অবস্থায় তার শরীরে যে ময়লা ও ধুলাবালি জমেছিল সেগুলো সে পরিষ্কার করে খুব ভালভাবে। শুধু শারীরিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্যই যে সে তা করে তা-ই নয়। বরং সবার মাঝে নিজেকে যেন আকর্ষণীয় মনে হয় সেদিকেও লক্ষ রাখে সে।

ক্যাপ্টেন-এর টেবিলের চারদিকে খেতে বসা সবার চেহারা যেখানে অপরিষ্কার বা অগোছালো থাকে সেখানে পেট-এর চেহারা উচ্চ গোত্রীয় ইউরোপীয়ানদের মতো চকচক করতে থাকে। যেভাবেই হোক সে বোম্বে (মুম্বাই) ভ্রমণ করে এসেছে, সেই সাথে আর্ল অব কাম্বার ল্যান্ডে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু তাতে তার চেহারার উজ্জ্বলতা খুব একটা মলিন হয়ে যায়নি। বন্দিদশা তার ধূসর রঙটাকে শুধু একটু বাড়িয়ে দিয়েছে।

হাল আর তার নাবিকেরা উঠে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তরতাজা খাবারের স্বাদ নিচ্ছিল। জুডিথ জাহাজের রাঁধুনীকে কিভাবে আরও ভাল রান্না করা যায় সে ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছিল একনাগাড়ে।

হাল তার গল্প বলার পর দুই রাত পার হয়েছে। এরই মাঝে সে একবার তার নাবিকদের মাঝে কয়েকজনকে জন লোভেল-এর নেতৃত্বে ডেট-এ পাঠিয়েছে। দুটি জাহাজই এখন অ্যাস্টার্ন লাইন-এর ওপর দিয়ে যাচ্ছে যদিও প্রতিকূল বাতাসের কারণে তারা খুব একটা দ্রুত এগুতে পারছে না। আটক করা ওলন্দাজ নাবিকদের এখনো বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে শেকলে বাঁধা হয়নি। জাহাজের অন্যান্য নাবিকের মতো তাদেরকেও একই খাবার এবং পানীয় দেয়া হচ্ছে। দিনে দুইবার তাদেরকে ডেক-এর ওপর যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে যেন তারা সূর্যের আলো পেতে পারে, নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারে। সেই সাথে পরাজিত নাবিকদের ব্যাপারে তার পিতা যে কৌশল অবলম্বন করতেন ট্রাম্প-এর ব্যাপারেও সে একই কৌশল অবলম্বন করেছে কার্টনি। তাকে প্রতিদিন রাতে ক্যাপ্টেন-এর খাবার টেবিলে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

জুডিথ-এর পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি করা আজকের মার্টনকারি বেশ সুস্বাদু হয়েছে বলা যায়। টেবিলে বসা প্রায় সবাই প্রাণভরে খেয়েছে শুধু পেট বাদে। পেট-এর খাবারের থালা প্রায় একইরকম রয়ে গিয়েছে। প্লেটের খাবার প্লেটেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার এই খামখেয়ালিপনা হয়ত উপস্থিত লোকদের কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারে কিন্তু পেট এরকম পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার মতো দক্ষতা তৈরি করে নিয়েছে নিজের ভেতর। তার উপস্থিতি অন্যদের কাছে যেন উপভোগ্য হয় সেটা নিশ্চিত করতে সে ভালই পারে।

হাল হাসতে হাসতে তার ওয়াইন-এর বোতল সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আপনার পালা ঘনিয়ে আসছে মি. পেট। গত দুইদিন আগে আপনি আমাকে গল্প বলতে বাধ্য করেছিলেন। এবার আপনি আপনার গল্প বলবেন। কোন ভাগ্যের প্যাঁচে পড়ে আপনি সাগরের এখানে এসে পৌঁছেছেন যে ট্রোম্প-এর মতো লোকের আপনাকে দয়া দেখিয়ে উদ্ধার করতে হয়েছিল।” আর “আমি একইসাথে আপনাকেও জানিয়ে রাখছি মি. ট্রাম্প। এরপর আপনার ভ্রমণকাহিনী শুনব আমরা।”

ওলন্দাজ নাবিকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, “দুই-একটা ঘটনা শুনে আপনারা মজা পেলেও পেতে পারেন।

একগ্লাস ওয়াইন পান করার পরও খালি গ্লাসে চুমুক দিতে থাকে পেট। এরপর সে গলা পরিষ্কার করে বলতে থাকে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এ চড়ে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে যাত্রা শুরু করি। আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে কিছু ব্যবসায়িক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গিয়েছিলাম। যখন আলোচনা শেষ হয় তখন গভর্নর-এর বাসস্থানে ক্যাপ্টেন গোডিংস-এর সাথে পরিচয় হয়। সে খুব খুশি মনে আমাকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এ জায়গা দিতে রাজি হয়েছিল। জাহাজটা তখন খনিজ পদার্থ বোঝাই করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল মাত্র।”

উইল স্ট্যানলি আর বিগ ডেনিয়েল-এর দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যায়। “আমার তো মনে হয় এরকম জাহাজে চড়া অর্ধেকটা মৃত্যুর সমতুল্য। যেকোনো মুহূর্তে আগুন লেগে বিস্ফোরিত হতে পারে ওটা।”

“আপনার ভয়ের যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে,” পেট বলতে শুরু করে। “যখন আমরা যাত্রা শুরু করি তখন সবই ছিল গুজব। ক্যাপ্টন গোডিংস ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক একজন মানুষ। সেই সাথে সে বেশ মজাদার মানুষও বটে।

আমার যতদূর মনে পড়ে তার জাহাজের নাবিকেরা তার নাম দিয়েছিল। সসেজ।”

চারপাশে মৃদু একটা হাসির রোল শোনা গেল। জুডিথ বলে উঠে, “মাফ করবেন মি. পেট। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এই নামের মধ্যে হাসির কী। আছে?”

“ম্যাডাম, ব্যাপারটাকে এত জটিলভাবে নেয়ার দরকার নেই। আমারও সঠিক ধারণা নেই যে এই নাম কিভাবে রটেছে। ক্যাপ্টেন গোডিংস-এর কাছ থেকে যতটুকু ধারণা পেয়েছি, ব্যাপারটা মাংস আর কসাইখানার সাথে সম্পর্কিত। সম্ভবত আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর লোকেরা বিশেষ পদ্ধতিতে সসেজ রান্না করতে পারে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।”

“তাহলে আমাদের সসেস সম্পর্কে বলুন। অথবা ঐ জাহাজ সম্পর্কে নেড টেইলর অনেকটা অধৈর্য হয়ে বলে উঠল। “জাহাজটা কী যথেষ্ট বড় ছিল?”

পেট মাথা নাড়ায়। “আমি তাই বলব। কারণ মি, গোডিংস আমাকে এটার গঠন সম্পর্কে বলেছিলেন যা শুনে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এমনকি ওটার ভেতর মজুদ করা ধন-সম্পদের কথা বলেও তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন এটার ভেতর দুইশরও বেশি রকমের গাছ রয়েছে। পাইন গাছের কাঠ রাখা হয়েছে জাহাজটার মাস্তুলের জন্য। স্পার কাঠ আনা হয়েছে বিভিন্ন কলোনী থেকে সংগ্রহ করে। এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হল ইংলিশ ওক কাঠ আনা হয়েছে ফরেস্ট অব ডীন থেকে-কিংবা অন্য কোনো বন থেকে যেটা আমার মনে নেই। কিন্তু মি. টেইলর আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এটার মাস্তুল, এটার পাল, আর এটার বন্দুক সবই ছিল অত্যন্ত গুণগত মানসম্পন্ন। কোম্পানির আদেশ অনুযায়ী অনেক উন্নতভাবে সাজানো হয়েছিল এটাকে। জাহাজটার লাভ নির্ভর করত এর কার্গোগুলো কতটা নিরাপদে পৌঁছাতে পারে সেটার ওপর।

“ক্যাপ্টেন গোডিংস নামটা আমার কাছে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।” হাল বলে উঠে। “আমি নিশ্চিত যে আমার পিতা তাকে চিনতেন। ওহ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। তারা দুজন একসাথে স্কেভেনিংজেন-এর যুদ্ধে লড়েছিলেন। আমার বাবা বলেছিলেন, “জাহাজের যুদ্ধে তাকে নিজের পক্ষে পাওয়াটা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।”

“আহ, স্কেভেনিংজেন”, নেড টেইলর তার ধূসর মাথাটা নাড়িয়ে বলতে থাকে। অনেক মানুষ সেদিন সাগরের তলায় হারিয়ে গিয়েছিল। সে তার বুকের শুকিয়ে যাওয়া রুপালি রঙের ক্ষতটাতে হাত লাগিয়ে বহুবছরের পুরনো স্মৃতিটার কথা মনে করতে থাকে। তার আগের রাতের ঝড়ো বাতাসটা ছিল আসলে ঈশ্বরের ক্রোধ। সবার বোঝা উচিত ছিল যে ঈশ্বর আমাদেরকে কিছু একটার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।”

“তোমার পুরনো গল্প বাদ দাও তো, টেইলর”, হাল বলতে শুরু করে, “নয়ত আমরা কখনোই পেট-এর গল্পের শেষটা শুনতে পারব না।”

“আরে, বলতে দাও তো। টেইলর বলতে শুরু করে।” “একবার কি হয়েছে শোন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, শুনে অবাক হবে। আমি তখন প্লাইমাউথ-এর এক সরাইখানা থেকে বের হয়ে আসছিলাম, এমন সময় লালচুলো এক সুন্দরী আমাদের মাল্লাদের সর্দারের কাছে এসে নিজে থেকেই তার সেবা দিতে চাচ্ছিল-সে কোনো কথা বলার পূর্বেই।”

“আরও কিছু বলার আছে?” অ্যাবোলী জোর গলায় বলে উঠল। এরপর জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ওর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”

“সেটার কোনো প্রয়োজন নেই,” জুডিথ হেসে জানাল। “আমি বহুবছর পুরুষ সৈন্যদলের মাঝে একমাত্র নারী ছিলাম। আমি এর চেয়েও বেশি কিছু শুনে অভ্যস্ত।”

“আমাকে ক্ষমা করবেন মি. টেইলর, কিন্তু মাঝি-মাল্লার সর্দারদের সাথে এসব নারীদের ঘটনা উল্লেখের কী কোনো সম্পর্ক আছে?”

“নেড বিশ্বাস করে যে এসব লাল চুলো রমণীদের আগমন জাহাজের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে, হাল তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝায়।

“ওহ, আচ্ছা”, পেট বলে উঠে। “কিন্তু সেই ঘটনার পর সেই যুবকটির কী হয়েছিল?”

“সে জাহাজ থেকে নামার সময় কাঠের পাটাতন উল্টে পাথরের মতো সমুদ্রে ডুবে যায়”, নেড জানায়।

“আমি আর কল্পনাও করতে পারছি না, মি. টেইলর, পেট বলে উঠে। “আমি প্রথমে সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখি, দ্বিতীয়ত, রাখি আমার নিজের ওপর। এবং সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা আমার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে। এই যে দেখুন না, এতদিন বন্দি হয়ে কাটানোর পরেও আমি আপনাদের সাথে এখন চমৎকার খাবার উপভোগ করছি। ওদিকে ক্যাপ্টেন গোডিংস আর তার লোকেরা পুড়ে ছাই হয়ে সাগরের নিচে ডুবে গিয়েছে।”

টেবিলের চারপাশ থেকে এক ধরনের আক্ষেপ ধ্বনি শোনা যায়। যারা সবসময় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, শত্রুর আশেপাশে বাস করে তাদের আর্তনাদ যেন কেবিন জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। নেড টেইলর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হাল তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যে সে মুখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হয়।

“এরপর আর কোনো বাধা আসবে না, আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি, মি পেট”, হাল বলে উঠে, “এখন দয়া করে, আপনি আপনার গল্প শেষ করুন।”

“অবশ্যই, ক্যাপ্টেন। তো যা বলছিলাম। ক্যাপ্টেন গোডিংস জাহাজে করে খনিজপদার্থ নিয়ে লন্ডনে ফিরছিল। মি স্ট্যানলি এরই মধ্যে লক্ষ করেছেন যে কাজটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভীরু ভাববেন না যদি আমি বলি যে আমি ইচ্ছে করে আর্ল অব কামব্ৰায় উঠিনি। আমার ইংল্যান্ডে ফেরা প্রয়োজন ছিল-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাই এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। জাহাজে আগুন লেগে গিয়েছিল।”

সে তার চোখের দৃষ্টি টেবিলের চারদিকে বসা সবার দিকে একবার ঘুরিয়ে আনে। “আপনারা সবাই আমার মতো একজন নির্বোধ ব্যক্তির জন্য আফসোস করতে পারেন। কেননা আপনারা সবাই জানেন যে সমুদ্রে আগুন লাগা কতটা বিপজ্জনক ব্যাপার। যদিও গতকাল রাতে ক্যাপ্টেন কার্টনির গল্প এরকমই একটা ঘটনার মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। তবুও অন্তত আপনারা সেই অগ্নিকাণ্ডের কারণটা জানতেন যেটাতে বুজার্ড নামের সেই লোকটা মারা গিয়েছে। কিন্তু আমি এখনো জানি না যে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এ কেন আগুন লেগেছিল। আমি শুধু বলতে পারি যে আমি ক্যাপ্টেন গোডিংস-এর সাথে তার কোয়াটারে এক মনোরম আলোচনায় মগ্ন ছিলাম। তখন আমরা সতর্কধ্বনি আর চিৎকার শুনতে পাই। এরপর একজন নাবিক চোখ বড় বড় করে আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে করতে এসে বলে, “তাড়াতাড়ি আসুন ক্যাপ্টেন, জাহাজে আগুন লেগেছে।”

“তারপর সেই সাহসী ক্যাপ্টেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। প্রথমে আমিও তার পিছু পিছু ডেক পর্যন্ত যাই। মানুষজন এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছিল। এদিকে অন্ধকারে আগুনের শিখা বেড়েই চলেছে। শিখা উঁচু হতে হতে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রধান মাস্তুলের অনেক উপরে উঠে পড়েছে সেই ধোয়া।”

“তো, আপনি সেখান থেকে কীভাবে মুক্ত হলেন?” ট্রোম্প জিজ্ঞেস করে “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি খুব একটা সাহসী নন।”

“কথাটা উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করছি আমি. পেট আপত্তি জানায়।

“তাহলে হয়তো আমি ভুল বুঝেছিলাম,” ট্রোম্প বলতে থাকে। আমি ভেবেছি আপনি খনিজ পদার্থ ভর্তি জাহাজে উঠতে চাননি কারণ আপনার সাহসের অভাব ছিল। সে টেবিলে বসা সবার দিকে তাকিয়ে সমর্থন লাভের আশায় বলে, “আমি কী ভুল বলেছি?”

ব্যাপারটা নিয়ে সবার মাঝেই একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে শুরু করে। হাল বুঝতে পারে এবার ব্যাপারটাতে তার মধ্যস্থতা করে দেয়া উচিত। “তুমি হয়ত পেট-এর কথাটা বুঝতে ভুল করেছে। সে আগেই বলে নিয়েছে যে আমরা যেন তাকে ভীরু না ভাবি। কিন্তু এটা সত্য যে খনিজপদার্থ ভর্তি একটা জাহাজে চড়া খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়, সেই সাথে অনেক বিপদজনকও বটে।” “আমি নিশ্চিত যে আমার ব্যাখ্যার পর কেউই মি. পেটকে আর কাপুরুষ ভাববেন না অথবা তার সেন্টিমেন্ট-এ আঘাত করবেন না।”

ট্রোম্প তার মুখে একটা অলস হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে, “উপস, আমি সম্ভবত আপনার ইংরেজি ভাষায় অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। এই অজ্ঞতার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। চিজহেড শব্দটা হয়ত বা আমার মতো ওলন্দাজ-এর জন্যই সঠিক।”

“আপনাকে ক্ষমা করব? পেট বলতে শুরু করে। এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু কোনো অপরাধ না করেও আমাকে যে বন্দি থাকতে হয়েছে…সেটা নিয়ে ক্ষমা পাওয়া অনেক দূরের ব্যাপার, অনেক দূরের।”

“আমি আপনাকে অনেক বার বলেছি কথাটা, এটা আমি আপনার নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য করেছি।”

যথেষ্ট হয়েছে ভদ্রমহোদয়গণ। আমার টেবিলে আমি এ ধরনের তর্ক বিতর্ক হতে দেব না। মি. পেট আপনি দয়া করে আরেকটা তথ্য দিয়ে আপনার গল্প শেষ করুন।” “এত লোকের মাঝে আপনি একা কিভাবে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড থেকে মুক্তি পেলেন?”

পেট কয়েক মুহূর্তের জন্য কিছুই বলল না। তার শীতল দৃষ্টি এখনো সে মি. ট্রোম্প-এর ওপর স্থির করে রেখেছে। এরপর স্বপ্ন দেখার পর মানুষ যেভাবে হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসে সেও সেভাবে চেতনা ফিরে পেয়ে বলতে শুরু করে। “আমি আগেই বলেছি যে আমি দুটো জিনিসের ওপর আস্থা রাখি : সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা এবং আমার পদক্ষেপ। আমি যদি নাবিকদের সাথে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতাম তাহলে হয়ত কোনো লাভই হতনা। যদি আমি তা করতাম তাহলে হয়ত আমার অবস্থাও তাদের মতো হত। এটা নিয়ে আমি উভয় সংকটের মধ্যে ছিলাম। আমার কী জাহাজে থাকা উচিত, তার সাথে সাথে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি নেয়া উচিত? নাকি আমি এই রাতের অন্ধকারে মাঝসমুদ্রে লাফ দিয়ে নিজেকে সম্ভাব্য মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিব?”

“এ সময় আমি সৃষ্টিকর্তার পথ প্রদর্শনের ওপর নির্ভর করতে থাকি। এবং আমাকে তিনি নিরাশা করেন নি। আমি তার উপস্থিতি বুঝতে পারি। তার কণ্ঠ আমার মাথায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। তিনি আমাকে সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বলেন। আমিও সেই অনুযায়ী কাজ করি। কিন্তু সেটা করার জন্য আমাকে ক্যাপ্টেন-এর বিছানাটা ব্যবহার করতে হয়েছিল যেটা অনেকটা ক্যাপ্টেন কার্টনির বিছানার মতো দেখতে, তবে অনেকটা সরু।”

সবার মুখে একটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠে কেননা সবাই বুঝতে পারে কেন ক্যাপ্টেন কার্টনির বিছানাটা চওড়া, পেট ব্যাপারটার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ না করে আবার বলতে শুরু করে। “আমি জানতাম যে আমাকে কী করতে হবে। আমি প্রথমে জাহাজের জানালাটা চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলি। এরপর আমি বিছানাটা সাগরের বুকে ছুঁড়ে দেই এবং এর পরপরই আমি নিজে লাফ দেই। কারণ আমি সাঁতার কাটতে জানি না…”

সবার হাসির উজ্জ্বলতা একটা বিস্ময়ে রূপ নেয়। কিন্তু কীভাবে…?” বিগ ডেনিয়ে বলে।

“আমি জানি। আমি নিজেকেও একই প্রশ্ন করেছি। আমি কিভাবে সাগরের বুকে এই বিছানা খুঁজে পাব, সেই সাথে নিজের পথ করে নিব? সত্যি বলতে, আমার কোনো পূর্বধারণাই ছিল না…”

এইটুকু অন্তত নির্ভেজাল সত্য, পেট মনে মনে চিন্তা করল। এরপর আবার বলতে শুরু করে দিল। আমি যেটুকু বলতে পারি তা হচ্ছে, “লাফ দেয়ার পর আমি নিজেকে ভাসমান বিছানার ওপর দেখতে পাই। এর কিছু সময় পর উজ্জ্বল আলো দেখতে পাই আমি। এতটাই উজ্জ্বল যে মনে হচ্ছিল সূর্য থেকে সরাসরি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমার চোখ প্রায় পুড়ে যাবার অবস্থা। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই খনিজপদার্থ বিস্ফোরণের তীব্র শব্দ পেয়েছিলাম। এত তীব্র যে আমার প্রায় বধির হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল আরকি। কিন্তু সময় যত যেতে থাকে শব্দের তীব্রতা ততই কমতে থাকে। একসময় সব চুপচাপ হয়ে গেল। অদ্ভুত রকমের শান্ত, নীরবতা চারদিকটাকে ঘিরে ফেলে। জাহাজ এবং জাহাজের সমস্ত মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের কোনো চিহ্নই আর সাগরের বুকে থাকে না।”

পেট-এর এরূপ ভয়াবহ বর্ণনা শুনে টেবিলের চারপাশে বসা সবার মাঝেও ভয়াবহ নীরবতা নেমে আসে। এরপর পেট তার গল্পের উপসংহারে চলে আসে। “বাতাস আর তরঙ্গের স্রোতে ভাসতে থাকি আমি-ডেফট-এর লোকদের চোখে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”

“আচ্ছা আমরা সবাই জানি যে এরপর কি ঘটেছিল।” হাল গল্পের সমাপ্তি টানতে চায় যেন আবার সবার মাঝে কোনোরকম তর্ক-বির্তক শুরু না হয়। “এখন আমরা সবাই এখান থেকে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি…।”

“এক্সকিউজ মি, ক্যাপ্টেন”, ট্রোম্প বাধা দেয়।

“বলুন?”

“আপনি আমাকে নিজের গল্প বলতে বলেছিলেন।”

“হা, কিন্তু সেটার জন্য আমাদেরকে আগামীকাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

“আমার গল্প খুবই ছোট্ট, ক্যাপ্টেন।”

“ক্যাপ্টেন তাকে এখনই সুযোগ দিন”, নেড টেইলর বলে উঠে।

“যদি বেশি ছোট হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই তার সাথে কিছু যোগ করে বড় করে নেব।” বিগ ডেনিয়েল বলল।

“যেহেতু ক্যাপ্টেন ট্রাম্প-এর গল্প খুবই ছোট তাহলে বরং আমরা এখনই তা শুনে ফেলি। সবাই মনে হচ্ছে এখনই শুনতে চাচ্ছে। শুরু করুন ট্রোম্প,” হাল ট্রোম্প-এর উদ্দেশ্যে বলে উঠল।

ট্রোম্প টেবিলের সবার দিকে একবার করে তাকায়। এরপর গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে। “বাতাবিয়ায় একটা মেয়ের সাথে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তার নাম ছিল ক্রিস্টিনা। সে ছিল এডমিরাল-এর কন্যা।”

টেবিলের অন্যান্যের মতোই হাল-এর কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। বাউ-এর নাবিকেরা তাদের নিঃশ্বাসের সাথে নানা রকম আওয়াজ করেই চলছিল। জুডিথ যদিও সেদিকে কান দিচ্ছিল না কিন্তু তার ঠোঠে হাসি খেলা করছিল।

“বলতে থাকুন”, হাল বলল।

ট্রোম্প আবার বলতে থাকে, “আমার পুরনো ভালবাসার গল্প। আমরা কখনো নাচতাম, কখনো বা হাসতাম, পরক্ষণেই আবার ভালবাসায় মেতে উঠতাম…সে তার এক চোখের ভ্রু উঁচু করে বলল। এরপর সে একদিন আমাকে বলে যে তার গর্ভে আমার সন্তান আছে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো সে এটা তার বাবাকেও বলে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম তার বাবা পাউডার ভর্তি শট ফিউজ-এর মতো ফেটে পড়বে। তিনি আমাকে জাহাজের একজন অফিসার হিসেবে পছন্দ করতেন। কিন্তু নিশ্চয়ই এমন একজন হিসেবে নয় যে তার মেয়ের গর্ভে বীজ বপন করবে।”

“তো, সে কি ওভাবেই ফেটে পড়েছিল?” হাল জিজ্ঞেস করে।

ট্রোম্প মাথা নাড়ায়। “না, তার চেয়েও খারাপ। তিনি বলেছিলেন যে আমাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নেয়ার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। কিন্তু এখন তার হাতে অন্য কোনো উপায় নেই। আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে সেই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।”

“তারপর আপনি পালিয়ে আসেন।”

“আমি ক্রিস্টিনাকে ভালবাসতাম না, আর ক্রিস্টিনাও আমাকে ভালবাসত না। আর তাই আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রথমে আমি এডমিরাল-এর কাছে গেলাম। গিয়ে তাকে বললাম যে, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করব। কিন্তু সেটা সঠিক নিয়মে কোনো চার্চে গিয়ে। উৎসব হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে। যেন লোকজন এটাকে সত্যিকার ভালবাসা মনে করে। আর এর জন্য অন্তত আমাদের দুটি সপ্তাহের প্রয়োজন হবে। সে প্রথমে রাজি হতে চাচ্ছিল না। কিন্তু পরে ভেবে দেখল যে আমার কথায় যুক্তি আছে। এটা তার এবং তার পরিবারের সম্মান বাঁচাবে।” এরপর আমি বাতাবিয়ার এক কারিগর-এর কাছে গিয়ে বললাম, “আমাকে এই নকশাগুলো বানিয়ে দিন। অন্তত প্রত্যেক রকমের ছয়টা করে। তারপর দশ দিনের মধ্যে আমি যে জাহাজে চাকরি করতাম সেখানে গেলাম। সেখানকার সব নাবিককেই আমি চিনতাম। তাদেরকে বললাম যে আমার একটা পরিকল্পনা আছে। আমার সাথে কাজ কর তাহলে ধনী হয়ে যেতে পারবে।”

“তারা তোমার কথা বিশ্বাস করল”, হাল বিস্ময়াবিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“ওহ, তারা সেটাই বিশ্বাস করে যেটা তারা চায়। তারা সবাই ইস্ট ইন্ডিস-এ পচে গলে মরতে চাচ্ছিল না। তারা সবাই বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিল। আমি তাদেরকে বলেছি যে আমি তোমাদেরকে হল্যান্ড-এ ফিরিয়ে নিয়ে যাব। অনেক সোনাদানা টাকা-পয়সা এবং মেয়ে মানুষ তোমাদের হাতে থাকবে।”

ট্রোম্প এমনভাবে কথা বলছিল যেন সবকিছু তার চোখের সামনে ভাসছে। হাল ধারণা করার চেষ্টা করছিল সেই নাবিকের দল কী পরিমাণ অশিক্ষিত ও মূর্খ ছিল, যাদেরকে ধনী করার আশ্বাস দিয়ে এভাবে ভোলানো সম্ভব।

“তারা সবাই কী ডেফট-এর নাবিক ছিল?” হাল জিজ্ঞেস করে।

“অবশ্যই”, ট্রোম্প উত্তর দেয়। “তো সেই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। আমার দুশ্চিন্তা বেড়েই চলল। আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম নেটিভটা যদি সময়মত ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ-এর প্রতিলিপিগুলো তৈরি করতে না পারে তাহলে আমি এখানে ক্রিস্টিনা ও তার বাবার কাছে ধরা পড়ে যাব। কিন্তু বিয়ের দুইদিন পূর্বে সেগুলো প্রস্তুত হয়ে যায়। আমি সেগুলো বক্সে ভরে জাহাজে উঠানোর জন্য প্রস্তুত করে রাখি। ডেট আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। জাহাজে উঠার পর যখন জাহাজ ছেড়ে দেয় তখন আমরা মুক্ত, ট্রোম্প টেবিলের চারদিকে সবার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে। সবাই একটু একটু করে ঝুঁকে বসে যাতে তারা গল্পের প্রতি আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে পারে। “ডেট একটা বিশেষ ধরনের জাহাজ ছিল। ওটা নেভী জাহাজও ছিল না আবার ইস্ট ইন্ডিয়ার জাহাজও ছিল না। সেটা ছিল এডমিরাল-এর জাহাজ, ত্রিস্টিনার বাবার অত্যন্ত পছন্দের জাহাজ।”

ট্রোম্প সবার মনে যে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল সেটা হাসিতে রূপ নেয়। টেবিলের চারদিক থেকে অট্টহাসির আওয়াজ শোনা যায়। “আমি তোমাকে স্যালুট করলাম, ক্যাপ্টেন,” অ্যাবোলি তার কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকে। “তুমি প্রথমে তার কন্যাকে হাত করলে। তার কুমারিত্ব নষ্ট করলে। এরপর তুমি…”

“আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই,” ট্রোম্প বলতে শুরু করে, “কেননা প্রথম দিকে সে যে ধরনের আচরণ করছিল তাতে আমার মনে হয়নি সে কুমারী।”

“তুমি তার পেটে তোমার বীজ বপন করেছ, এরপর তাকে অসম্মান করেছে তার মা-বাবা এবং তার সমগ্র জাতির সামনে। তারপর তুমি পালিয়ে এসেছ তার বাবার জাহাজ নিয়ে। তোমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিল। যদি তুমি এটা আমাদের উপজাতির প্রধান মনোমাতাপার সাথে করতে তবে সে তোমার পেছনে তার সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধাকে পাঠাত। তারা তোমাকে খুঁজে বের করে হত্যা করত এবং…” অ্যাবোলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “তারা তোমাকে আস্তে আস্তে মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করত-যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার প্রাণবায়ু বের হয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত।”

“বিশ্বাস করুন, ক্যাপ্টেন ট্রাম্প বলল। “ক্রিস্টিনার বাবাও ঠিক এমনটাই ভেবেছিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তিনি বাতাবিয়ার প্রত্যেকটা জাহাজকে বলেছেন আমাকে খুঁজে বের করার জন্য। তিনি আমার মাথার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। তাই এখন এটা আপনাদের বিবেচনার বিষয় ক্যাপ্টেন। যদি আপনি আমাদেরকে ওলন্দাজদের হাতে সমর্পণ করেন তবে মৃত্যু অনিবার্য। এদিকে আপনাদের জাহাজ বেশ কয়েক মাস যাবত যুদ্ধ করেছে। আপনারা অনেক মানুষ হারিয়েছেন। যে কারণে আপনারা জাহাজটা চালিয়ে নিতে পারছেন তা হলো আপনারা আফ্রিকান যোদ্ধাদেরকে নাবিক হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু তারা এখানকার অধিবাসী। আপনারা শিঘ্রই কেপ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। এরপরই রয়েছে আটলান্টিক। সেখান থেকে আপনারা ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন হয়তো বা। “আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে বলব, আপনারা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরতে চান ক্যাপ্টেন কার্টনি। আপনার নিশ্চয়ই এমন নাবিক প্রয়োজন যে কি-না উত্তরের ঠাণ্ডা পানি সম্পর্কে জানে। সেক্ষেত্রে আপনারা আমাকে এবং আমার নাবিকদের নিতে পারেন…যদি আপনারা আমাদেরকে নেন তাহলে আমরা আপনাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেব।”

*

পেট সেই কণ্ঠ শুনতে পায়। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওগুলো। সকখনো কখনো তারা একত্রে কথা বলে উঠে। আবার কখনো কত পার্লামেন্ট-এর মতো একের পর এক কথা বলতে থাকে। এসব কণ্ঠের চেয়েও তার মনে যে তীব্র বাসনা কাজ করছে তা হল কাউকে খুন করার বাসনা। যদিও দৈববাণীর উপস্থিতি এটার একটা অংশ। না, এর চেয়ে বেশি কিছু তার অনুভব করার প্রয়োজন নেই। এটা তার রক্তে মিশে আছে। তার হাড়ে গেঁথে আছে।

সে জানে না যে ঠিক কোন জিনিসটা তার মধ্যে এই অনুভূতি নিয়ে আসে। কিন্তু এটা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। “এত শীঘ্রই কেন?” সে নিজেকে প্রশ্ন করে। কিন্তু কোনো উত্তর পায় না শুধু মেনে নেয়া ছাড়া।

মাত্র কিছুদিন আগে ডেট-এ সে তার সাথে থাকা বন্দি লোকটাকে শ্বাসরোধ করে মেরেছে। এ ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে গোডিংস তার হাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। আস্তে আস্তে ঘটনাগুলোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাচ্ছে। সে যতই হত্যা করছে প্রতিটা মৃত্যু নিয়েই ততই অতৃপ্তি তার মধ্যে কাজ করছে। এখন আবার তার সেই ইচ্ছাশক্তি, তার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্পৃহা, তাকে সেই ঘটনা ঘটানোর দিকে ধাবিত করছে। সেটা এতই তীব্র যে একসাথে দুটি খুন করারও হয়তো প্রয়োজন পড়তে পারে। কেবল তাহলেই হয়ত সেটা কিছুদিন লুকিয়ে থাকবে। তার সেই শিকার দুটি তার কেবিন থেকে অল্প কিছু দূরে পাশাপাশি শুয়ে আছে। ক্যাপ্টেন কার্টনি আর নাজেতকে একত্রে হত্যা করা অবশ্যই একটা বড় ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে। প্রথমত, তারা দুজনেই খুব ভাল যোদ্ধা। নিজদেরকে রক্ষা করার ক্ষমতা আছে তাদের। এছাড়াও, তাদের তলোয়ার চালানোর দক্ষতা হয়ত পেট-এর দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যাবে। এরপর আসে আরেকটা ব্যাপার। ক্যাপ্টেন গোডিংস কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যায় নি। মারা গিয়েছিল তারই ছুরির আঘাতে। সেই ছুরির ব্যবস্থা তাকে সেই জাহাজের লোকদের কাছ থেকেই করতে হয়েছিল। এই ক্যাপ্টেন এবং তার লেডি জাহাজের নাবিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই সেই ব্যবস্থা করা এখানে খুব একটা সহজ হবে না।

অবশ্য পেটকে এসব ভাবলে চলবে না। তাকে যেভাবেই হোক এই কাজ করতে হবে। সেই দৈব বাণী যদিও এখন পর্যন্ত তার মস্তিষ্কে যে আওয়াজগুলো তুলছে সেগুলো বেশ অস্পষ্ট, কিন্তু সে জানে যে এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই গভীর ইচ্ছাটা সে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারে না। আর এই কাজ করা যে সম্ভব, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে এই কাজ সম্পন্ন করবে নীরবে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। সে ভাবছে যে গতবারের মতো একইরকমভাবে ক্যাপ্টেন-এর বিছানাটাকে সাগরের বুকে নিজের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করবে। গত কয়েকদিন ধরে সে আফ্রিকার উপকূল প্রত্যক্ষ করেছে। সে নিশ্চিত যে সে খুব সহজেই সেখানে পৌঁছাতে পারবে। ওটায় চড়ে ভাসতে ভাসতে সাগরের এক পাশে চলে যাবে। ক্যাপ্টেন কার্টনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই উপকূলে পৌঁছে যাবে সে।

কিন্তু একজন নারীকে হত্যা করাটা…এ ব্যাপারে সে একটু দুশ্চিন্তায় রয়েছে কারণ সে এর আগে কখনোই এই কাজ করেনি। সে নিজেকে একজন সভ্য মানুষ হিসেবে দাবি করে, এ নিয়ে গর্বও করে। পেট-এর মতে নারী জাতি অত্যন্ত কোমল এবং নমনীয় তাই তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মানায় না। সাথে-সাথে একটা কণ্ঠ তার সাথে তর্কে লিপ্ত হলো। “এই নারী মোটেও কোমল এবং নমনীয় নয়। সে তার নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধে গিয়েছে। সে পুরুষের পাশাপাশি কুচকাওয়াজ-এ অংশ নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। যদি সে এগুলো করতে পারে তবে তার সাথে খেলা ভালই জামবে।”

মেয়েটা হয়ত ভাবছে যে সে তার ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার দেশ, তার পবিত্র ভূমির জন্য লড়াই করতে এসেছে। কিন্তু পেট যেটা করছে সেটাও তার কাছে পবিত্র কাজ। আরও অনেকে আছে যারা মানুষ হত্যা করে। সে জানে এটা। কিন্তু তারা কেউই কাজটা তার মতো ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। সে তার কাজ নিয়ে গর্ববোধ করে। যখন অন্যান্য বাচ্চা পিন হেড বা অন্যকিছু নিয়ে খেলা করত সে তখন তলোয়ার চালনা বা স্টীল-এর স্লিং নিয়ে খেলা করত। ঐ বয়সে বিভিন্ন বিষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে খেলা করত সে। দক্ষ হাতে কিভাবে বিভিন্নভাবে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া যায় সেটা নিয়ে পড়াশোনা করত। ক্যাপ্টেন কাটনি আর জেনারেল নাজেত-এর জীবন কেড়ে নেয়া হচ্ছে তার কাছে অন্যরকম একটা পরীক্ষা।

এবং এখনও পর্যন্ত পেট কোনোটাতেই অকতকার্য হয়নি। এ কাজের জন্য সে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে মার্লিনস্পাইক নামক লম্বা স্টীলের পাত-এর মতো একটা জিনিস যেটা জাহাজের নাবিকেরা রশি বাঁধতে ব্যবহার করে। গোল্ডেন বাউ-এ আসার পরপরই সে এটা চুরি করেছে। প্রতিনিয়ত সে এটায় শান দেয়- যখনই সে একা থাকে। এটাকে এতটাই ধারালো করতে হবে যেন এটা খুব সহজেই মানুষের চামড়া এবং পেশি ভেদ করে কোনো অঙ্গের ভেতর ঢুকে যায়।

পেট এটাকে তার জামার ডান হাতার নিচে লুকিয়ে রাখে। এমনভাবে রাখে যেন একেবারে বাহুর সাথে লেগে থাকে। এছাড়া তার কাছে আরেকটা ছোট্ট অস্ত্র আছে-জাহাজের পেরেক, যেটা সে তার দুই ঠোঁটের মাঝে রেখে দিতে পারে। সে এখনই ক্যাপ্টেন-এর কোয়ার্টার-এর দিকে এগুতে চাচ্ছে না। ধীরে-সুস্থে ভেবে-চিন্তে তারপর এগুতে চায় সে। আগে জেনে নিতে চায় যে জাহাজের ওপর এমন কিছু বা এমন কেউ আছে কি-না যে তার কাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।

তারা ভরা রাতে পেট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাজের পরিকল্পনা করছে। জ্যোৎস্না রাতের মৃদু আলোতে সে যখন কোয়ার্টার ডেক-এ দাঁড়িয়ে ছিল তখন একটু দূর থেকে ফিসফিস করে কথা বলা কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায় সে। পেট সাথে-সাথেই চিনতে পারে-এটা অ্যাবোলি নামে সেই আফ্রিকান লোকটার কণ্ঠ। প্রধান মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে আফ্রিকান লোকটা অন্যান্য অ্যামাডোডা সৈন্যদের গল্প বলছে। দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো কথা বলা সিংহ সম্পর্কে গল্প করছে। বাহুদুটো ছড়িয়ে দিয়ে হাত দুটোকে থাবার মতো করে রেখেছে লোকটা।

এমন সময় সে কারও এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পায়। তার পেশি শক্ত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায় সে। কেউ একজন এগিয়ে আসছে। সম্ভবত উইল স্ট্যানলি তার রাতের ভ্রমণ শেষ করছে। পেট কোয়ার্টার ডেক এর মই-এর পেছনে লুকিয়ে পড়ে। ভয়ে জমতে থাকে ও। সে চায় না স্ট্যানলি এখন তাকে জিজ্ঞেস করুক যে এই মধ্যরাতে সে এখানে কি করছে।

স্ট্যানলি তাকে লক্ষ না করে রেলিং-এর দিকে এগিয়ে যায়। পেছন দিকে হাত দুটো রেখে সে কিছুক্ষণ সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই পেট তার কাছে চলে যেতে পারে। তার লম্বা স্পাইকটা লোকটার কিডনির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে মৃতদেহটা তার নিজের কেবিনে লুকিয়ে রাখতে পারে।

কিন্তু কোনোভাবে যদি স্ট্যানলি হাত থেকে ফসকে যায় আর সবাই সজাগ হয়ে উঠে, তবে কী হবে? তখন সে কার্টনি আর জুডিথকেও হত্যা করতে পারবে না।

স্ট্যানলি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে জাহাজের সম্মুখভাগের দিকে তাকায়। তার কপাল কুঁচকানো বিস্ময় ভাবটা অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পেট জানে না যে স্ট্যানলি আসলে কী দেখেছে বা কী দেখতে পায় নি। তার চেয়ে বড় ব্যাপার স্ট্যানলি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। একটু পর ডেক-এর নিচে নেমে গেল সে। পুরোটা সময় পেট তার নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল।

“এখনই সময়…” সেই সিদ্ধপুরুষ কণ্ঠটির প্রতিধ্বনি পেট অবশেষে শুনতে পায়। তার পথপ্রদর্শক এবং তার রক্ষাকর্তা তার সাথেই আছে। তাই সবকিছুই ভাল ভাবে সম্পন্ন হবে।

সিঁড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে আসে উইলিয়াম পেট, এরপর আস্তে আস্তে ক্যাপ্টেন কার্টনির কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। ডান বাহু উঁচু করে ধরে লম্বা পাতের মতো অস্ত্রটা তার জামার হাতার নিচে রেখে দেয় পেট। এরপর আঙুল দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝ থেকে মোটা পিনটা বের করে আনে, তারপর সেটাকে আস্তে আস্তে তালার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। খুট শব্দ করে তালা খুলে যায়।

সাথে-সাথে তার মনে একটা ভাবনার উদয় হয়। যখন ডেফট-এর নাবিকরা তাকে সাগর থেকে টেনে তুলেছিল তখন থেকেই কি তার রাস্তা পরিষ্কার ছিল না? আর যুবক কার্টনি কী সবার জন্য ভুরিভোজ-এর আয়োজন করেনি?

“তুমি কী মনে কর যে আমরা সবকিছু করি শুধু তোমার জন্যই?” কণ্ঠটি জিজ্ঞেস করল।

এরপর পেট খুবই ধীরে ধীরে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা ভেতরের দিকে খুলে ফেলল। ভুল ক্রমেও সে হাতল ধরে ধাক্কা দিল না। কারণ কোনরকম শব্দে যদি কার্টনির ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলেই সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।

ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পায় কার্টনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়ে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে। কোনো সন্দেহ নেই যে ক্যাপ্টেন কার্টনিও তার বাবার মতোই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প। তার স্ত্রী তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তার মুখ কার্টনির গলার বিপরীতে রাখা আছে। তার গায়ে থাকা সাদা রঙের পোশাক তার পা এবং বাহুতে একটা রঙের শেড তৈরি করেছে। পেট কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, তারপর আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যায়।

তার পায়ের নিচ থেকে কাঠের মড়মড় আওয়াজ হয়। সাথে-সাথে সে ঝুঁকে পড়ে স্থির হয়ে যায়।

জুডিথ নড়াচড়া করে উঠে, এরপর আরাম করে শোয়। কিন্তু সে জেগে উঠে না। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো অনভিজ্ঞ লোক হয়ত দুশ্চিন্তায় পড়ে যেত। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যেত। কিন্তু পেট-এর শ্বাসপ্রশ্বাস এখনো স্বাভাবিক আছে। বিছানার চারদিকে ঘুরতে-ঘুরতে কার্টনির মাথার পাশে এসে দাঁড়ায় পেট। কার্টনি তখন চিৎ হয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল।

পেট তার পেটের পেশি শিথিল করে নিঃশব্দে একটা গাঢ় শ্বাস নেয়। যেন রক্তে অক্সিজেন ঢুকিয়ে পরিপূর্ণ শক্তি পায়। সেইসাথে কাউকে খুন করার আগে যে দুশ্চিন্তা আসে সেটা দূর করার চেষ্টা করে।

কার্টনির শ্বাস-প্রশ্বাস আরও গম্ভীর হতে থাকে। এদিকে পেট তার জামার হাতার নিচ থেকে স্টীলের মারলিনস্পাইকটা বের করে। সেটাকে শক্ত করে ডান হাত দিয়ে ধরে আঘাত করার জন্য হাতটা পেছনে নেয়। যদিও মারলিনস্পাইকটা আঘাত করার জন্য বেশ উপযুক্ত কিন্তু এর তীক্ষ্ণতা কাউকে কাটার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই পেটকে যথেষ্ট শক্তি দিয়ে কাজটা করতে হবে। বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে বাম হাত দিয়ে কার্টনির মুখ বন্ধ করে ডান হাত দিয়ে খুঁতনির হাড়ের নিচে তীব্রভাবে আঘাত করতে হবে। কানের একটু নিচ দিয়ে যেন সরাসরি ক্যারোটিও আর্টারিকে ভেদ করে চলে যায় পাইকটা। তখন হয়ত তার শরীর, বিছানার চাদর, এমনকি পেট-এর শরীরও রক্তে ভেসে যাবে। তার পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটিও হয়ত রাতে দুঃস্বপ্ন দেখার মতো করে ভয়ে জেগে উঠবে। তখন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তাকেও একের পর এক আঘাত করতে হবে যেন সে চিৎকার করার সময়ও না পায়।

ঠিক তখনই এক চিলতে চাঁদের আলো কেবিন-এর ভেতরে প্রবেশ করল। পেট জাহাজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটা মেঘ খণ্ড হয়ে দুদিকে সরে গিয়ে কিছু তারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, রুপালি চাঁদের আলো ক্যাপ্টেন এর কোয়ার্টার-এ প্রবেশ করেছে যার প্রভাবে পেট-এর শিরায় প্রবাহিত রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তখনই পেট কার্টনির বিছানার পাশে টেবিলের ওপর সোনালি কভার-এ মোড়ানো একটা বাইবেল দেখতে পায়।

আর সাথে-সাথেই পেট-এর মনে একধরনের তছনছ শুরু হয়। সেই সাথে তার মন ভেসে যায় সেই সময়ে যখন সে জ্বলন্ত আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড থেকে সাগরে লাফ দিয়েছিল। এটা কী সেই দৈববাণী থেকে কোনোরকম ইঙ্গিত? এভাবেই কী ঈশ্বর হেনরি কার্টনিকে ছেড়ে দেয়ার কোনো ইশারা করছেন? অবশ্যই না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই দৈব কণ্ঠ এখনো পর্যন্ত চুপচাপ রয়েছে। সাধারণত এই সময়ে তার পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা যায়।

পেট দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, এরপর পা দিয়ে মেঝেতে মৃদু আঘাত করতে থাকে। একটু একটু করে ঘামতে থাকে সে। কপাল চুঁইয়ে সেই ঘামের পানি পড়তে থাকে মেঝেতে।

“কিছু একটা ইঙ্গিত করুন, যাতে আমি বুঝতে পারি যে আপনি কার্টনির হত্যার ব্যাপারে সায় দিচ্ছেন,” পেট মনে মনে বলে উঠল।

মেঘ খণ্ড দুটো আবারও জোড়া লেগে গিয়ে হাল-এর কেবিনকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল। কিন্তু পেট যা দেখেছে তা এখনো ভুলতে পারছে না। এরকম মুহূর্তে খ্রিস্টের ক্রস যেভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছে সেটা যে কোনো স্বর্গীয় ইঙ্গিত ছিল, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী কাউকে হত্যা করার জন্য নাকি কাউকে বাঁচানোর জন্য?

কিন্তু সে খুবই কাছাকাছি চলে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে কাজটা করে ফেলা সম্ভব। মাংস ভেদ করে দুটো তীক্ষ্ণ আঘাত করতে পারলেই তার কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু তার কাছে কিছু একটা ভুল মনে হচ্ছে। জীবনে সে বহুবার খুন করেছে। কিন্তু এই প্রথমবার তার মনে এমন সন্দেহ হচ্ছে। যদি ঈশ্বরের এমন কোনো ইচ্ছে থাকে যে তিনি এই লোকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছেন, তবে তাকে অবশ্যই থামতে হবে। কিন্তু সে যদি এখন খুন না করে তবে তার মনে কতটা গোলমাল দেখা দিবে কে জানে!

আস্তে আস্তে পেট তার মনকে শান্ত করতে থাকে। সে তার স্টিলের পাতটা আবারও জামার হাতার নিচে রেখে দেয়, এরপর প্রেমিক যুগলের বিছানার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সরে আসে। সে প্রায় দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে। দরজা খুলে এখনই বের হয়ে আসবে।

দরজার বাইরে পা রাখার ঠিক আগ মুহূর্তে কাঠের মেঝেতে একটা শব্দ করে ফেলে সে। আওয়াজটা খুব একটা জোরে হয়নি। কিন্তু হালকে জাগিয়ে ভোলার জন্য ঐ শব্দটুকুই যথেষ্ট ছিল। সে দ্রুত বিছানায় উঠে বসে, এরপর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সামনে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর ভয়ের পরিবর্তে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। “পেট? আপনি এত রাতে আমার কেবিনে কী করছেন?”

এরপর জুডিথও আস্তে আস্তে জেগে উঠে, তারপর মৃদুস্বরে বলতে থাকে, “তোমার কী হয়েছে হেনরি?”।

জুডিথ-এর উপস্থিতির কথা মনে পড়ায় কার্টনি রাগে ফেটে পড়ে। “আপনার এত বড় সাহস? এই মধ্যরাতে আপনি আমার কেবিনে প্রবেশ করেছেন যেখানে একজন নারী উপস্থিত আছে এই কেবিনে? ব্যাখ্যা করুন কেন করলেন এটা?”

পেট একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়। জীবনে এই প্রথমবারের মতো তার উপস্থিত বুদ্ধি ব্যর্থ হয়। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। তখনই দৈব বাণীটি তাকে বলতে থাকে, “ট্রোম্প, ট্রোম্প-এর কথা ভাব।”

পেট যেন হঠাৎ করেই তার জ্ঞান ফিরে পায়। “এই অনধিকার প্রবেশের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন ক্যাপ্টেন। আমি এখানে এসেছিলাম…কারণ… কারণ আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। আমার মাথায় একটা জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছিল যেটা আপনাকে বলা খুবই প্রয়োজন ছিল। জাহাজের অন্যান্য সদস্যদের আড়ালে।”

“তাই বলে এই মধ্যরাতে? আপনি কী পাগল নাকি?” কার্টনি তার দিকে তাকিয়ে ক্রু কুঁচকে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই অতিরিক্ত মদ্যপান করেন নি, তাই না?”

“না, ক্যাপ্টেন, এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমার কাজের সাথে মদ্যপান ব্যাপারটা যায় না। এটা শুধু…পেট তার চেহারায় এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে যেন সে তীব্র যন্ত্রণায় রয়েছে। …আমার মনের মধ্যে অসহ্যকর যন্ত্রণা কাজ করছে। আমি… আমাকে খুব তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে অপবাদের বোঝা মাথায় নিতে হয়েছে। স্যার! যেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।”

“কী অপবাদ দেয়া হয়েছে?”

“সেই ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প। ওহ, আমি জানি যে সে সবার সামনে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আমার কথার অর্থ ভুল বোঝার ভান করেছে এবং ইচ্ছেকৃতভাবে আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এই লোকটাকে আমি চিনি। তার দক্ষতা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে জানি। এরকম একজন লোকের কথা কিভাবে বিশ্বাস করা যায় যে কিনা ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ তৈরি করার আদেশ দেয়।”

কার্টনি এবং জুডিথ দুজনেই চুপচাপ শুনতে থাকে। এতে পেট-এর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় এবং সে বলতে থাকে। “কাউকে তার সমকক্ষ সভাসদ-এর সামনে কাপুরুষ বলাটা এক ধরনের অপরাধ। সেই সাথে এই লোকটি আমাকে সাধারণ অপরাধীর মতো কি অবস্থায় বন্দি করে রেখেছিল তা আপনি নিজের চোখে দেখেছেন। আপনি দেখছেন যে একজন মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আমাকে থাকতে হয়েছে। একজন ভদ্রলোক সেটা কিভাবে এতবড় অসম্মান মেনে নিতে পারে।”

কার্টনি তার চোখ থেকে ঘুমটুকু মুছে ফেলে বলল, “আপনি যথেষ্ট ভাল যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন মি. পেট।”

“আমি স্বীকার করছি আপনার খারাপ লাগার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এসব কারণে কেন আপনাকে এই মাঝরাতে আমার কেবিনে প্রবেশ করতে হবে?”

“কারণ হচ্ছে স্যার, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে এসেছি যেটা অন্যান্য নাবিক বা বন্দিদের সামনে করা যেত না। যে করেই হোক আপনি ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর সাথে মুষ্টিযুদ্ধ লড়াই-এর ব্যবস্থা করে দিবেন। আমি তার সাথে এই প্রতিযোগিতায় নামতে চাই।”

“মুষ্টিযুদ্ধ।” কার্টনি বিস্ময়াবিভূত হয়ে বলল।

“মি পেট, আপনি ঠিক আছেন তো?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, ম্যাডাম অবশ্যই। আমি কোনোভাবেই আমার এ ইচ্ছে থেকে এদিক সেদিক হব না। আমার সম্মান কোনোভাবেই এটা মেনে নিবে না।”

“কিন্তু মি. পেট”, কার্টনি বলতে থাকে। “আমি আপনাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বলছি যে আপনি কোনো মিলিটারি নন,..এরপর হাল কয়েক সেকেন্ড থেমে পেটকে তার কথাটা ভেবে দেখার সময় দেয়। তাই নয় কী মি. পেট?”

“না, স্যার, আমি একজন ব্যবসায়ী।”

“তাহলে আপনি জিনিস কেনা-বেচা বা হিসেব-নিকেশ এসব ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ। কিন্তু ক্যাপ্টেন ট্রাম্প একজন নেভাল অফিসার। সে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে অভ্যস্ত। তার কথার নৈতিকতা যাই থাকুক না কেন আমি বুঝতে পারছি তার আচরণ আপনার সম্মানে লেগেছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ হিসেবে আমি তার যুদ্ধ দেখেছি। মি. পেট আমি যদি আপনার এই অনুরোধ মেনে নিই তবে এটা অবশ্যই আপনার মৃত্যুকে মেনে নেয়ার সমান হবে।”

“সেটা অবশ্যই একটা যুক্তিযুক্ত আশঙ্কা ক্যাপ্টেন। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে আমার ব্যাপার নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। এক্ষেত্রে আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে ঈশ্বর আমার পাশে আছেন।”

“আমি সেরকম সৈন্যবাহিনীকেও পরাজিত করেছি যারা শুধু ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস করে বিজয় ছিনিয়ে নিতে এসেছিল মি পেট,” জুডিথ বলে উঠল। সে এক রহস্যময় পথে হাঁটছে। আমরা জানি না সে আমাদের জন্য কি পরিকল্পনা করে রেখেছে। “আমি বলছি না যে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস-এর ওপর আমি সন্দেহ পোষণ করছি। আমি শুধু আপনাকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।”

“ধন্যবাদ,” ম্যাডাম। কিন্তু তার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি। যখন আপনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যান এবং কোনো তীর্থস্থান বা পবিত্রস্থান-এর জন্য যুদ্ধ করেন তখন আপনার মনে হয়না যে অদৃশ্য স্বর্গীয় সৈন্যরা আপনার পাশে আপনার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করছে?”

“হ্যাঁ, তা মনে হয়।” জুডিথ বলল।

“এবং সেটা নিশ্চয়ই আপনার বিজিত হওয়ার দৃঢ়বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়?”

“হ্যা!”

“তাহলে সেক্ষেত্রে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে তবে আমার বিশ্বাস নিয়ে আমাকে থাকতে দিন। যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয় আমার অকাল মৃত্যু তবে আমি সেটাই মেনে নিব। কিন্তু নিজের নামের শেষে কাপুরুষ শব্দ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই আমার কাছে শ্রেয়। আমি যদিও ব্যবসায়ী তবুও আমি একজন মানুষ। প্রয়োজনমতো যে কোনো সময় আমিও যুদ্ধ করতে পারি।”

“ভাল বলেছেন, মি. পেট”, হাল বলল।

“আমার প্রার্থনা থাকবে আপনার বা ক্যাপ্টেন ট্রোম্প কারও ক্ষতি না হয়ে ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে থাকে। অনেক মুষ্টিযুদ্ধ দেখেছি সেটাতে দুপক্ষের কারোরই রক্ত না ঝরে ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে যায়। আমি আশা করব এটাও সেরকমই কিছু একটা হবে। আমি এখনও প্রত্যাশা করছি ব্যাপারটা অন্যকোনো উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা হয়ে যাক। তবে সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে অবশ্যই আপনি মুষ্টিযুদ্ধ করতে পারবেন।”

“তুমি কী নিশ্চিত, মাই লাভ? আমাদের তাহলে আরও ক্ষতি, আরও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবে হবে।”

“আমার সেটা মনে হয় না, মাই লাভ। এটা হচ্ছে সম্মানের ব্যাপার। আর সম্মানের ব্যাপার নিয়ে অবশ্যই পরিতপ্ত থাকা উচিত।”

পেট দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে এই রমণী হয়ত তার ব্যাপারটা মেনে নিবে না। কিন্তু সে তার যুক্তিগুলো দেখানোর পর আর কোনো তর্ক করেনি। সে সেই নারী যে কিনা হাজার হাজার পুরুষকে আদেশ করে অথচ এই পুরুষের কথা এক কথায় মেনে নেয়। পেট মনে মনে হাল-এর প্রশংসা করতে লাগল। সেই সাথে সে অদৃশ্য সিদ্ধপুরুষকে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল। কারণ তার কারণেই সে এবারের মতো রেহাই পেয়েছে। এর চাইতে ভাল কোনো উপায় বের করা সম্ভব হত না। সবশেষে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন।”

*

পেটকে মুষ্টিযুদ্ধের আশ্বাস দেয়ার পর বার ঘণ্টার মতো পার হয়ে = গিয়েছে। হাল আর চাচ্ছে না ব্যাপারটাকে অমীমাংসিতভাবে ঝুলিয়ে রাখতে। তাই সকালের সূর্য উঠার সাথে সাথেই ওটার আয়োজন করা হয়েছে। দুজন মানুষ বিশ গজ দূরত্বে জাহাজের ডেক-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পেট তার পেছন দিকটা জানালার দিকে দিয়ে রেখেছে, আর ক্যাপ্টেন ট্রোম্প ঠিক তার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিকেরা সবাই চারপাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে উৎসাহ নিয়ে। আটজন ওলন্দাজ বন্দিকে উপরে উঠিয়ে আনা হয়েছে দেখার জন্য। এছাড়াও যে সব নাবিককে বাউ জাহাজটি নোঙর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাও। দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে আজকের আয়োজন দেখার জন্য। অ্যামাডোডা সৈন্যরা যারা সবসময় জাহাজটার ওপর নজরদারি করে বেড়ায় তারাও আনন্দে উল্লাসধ্বনি করছে।

“তুমি চাইলে এখনও এটা বন্ধ করতে পার।” জুডিথ হালকে উদ্দেশ্য করে বলে। সে হাল-এর পেছনে জাহাজের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তারা দুজনেই আয়োজনের মধ্যমণি লোকদুটির দিকে তাকিয়ে আছে। যারা এই মুহূর্তে নিজেদের পিস্তল ঠিক জায়গামতো আছে কি-না দেখে নিচ্ছিল। সেই সাথে চোখ দিয়ে আশেপাশের প্রতিটা দূরত্ব মেপে নেয়ার চেষ্টা করছিল।

হাল মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে প্রথমে সে যতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল জুডিথ-এর কথায় সেটা অনেকটাই উবে গিয়েছে। এখন সে দোটানার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। পরামর্শের আশায় অ্যাবোলির দিকে তাকাল সে।

“তাদেরকে যুদ্ধ করতে দাও, গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি বলতে থাকে। মি. পেট যেহেতু তার আত্মসম্মান ফিরে পাওয়ার লড়াই করতে চাচ্ছে, তাকে তা করতে দিন। বিষ ছড়িয়ে পড়ার আগে ক্ষতটা কেটে পরিষ্কার করে ফেলাটা অনেক ভাল। নয়ত এই বিষ অন্যান্য নাবিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অনেক ক্ষতি করে ফেলবে। ডেনিয়েল এরই মধ্যে একজন ওলন্দাজ সৈন্যকে আধামরা অবস্থায় বাঁচিয়েছে, যাকে আমাদের দুজন নাবিক ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছিল।

“কিন্তু যদি ট্রোম্প মি. পেটকে হত্যা করে তখন কী হবে?” তখন কী ব্যাপারটা আরও খারাপ হবে না? আমাদের লোকেরা কী সেটা মেনে নিবে?

অ্যাবোলি কাঁধ ঝাঁকায়। “তোমার কি মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে তারা মাথা। ঘামাবে? পেট একজন ইংরেজ হতে পারে বটে কিন্তু সে আমাদের জাহাজের কোনো নাবিক নয়। কেউ তার জন্য কাঁদবে না। ওদেরকে যুদ্ধ করতে দাও।”

হাল অ্যাবোলির কথাগুলো ভেবে দেখল; যুক্তিগুলো মেনে নেয়ার মতোই। একটা অমীমাংসিত ব্যাপার-এর বিষ ছড়িয়ে পড়ার চাইতে সামনা সামনি যুদ্ধ হয়ে ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে যাওয়া ভাল। তাই মি. পেট-এর উচিত ট্রোম্পকে সামনা সামনি প্রতিহত করা।

ওলন্দাজ লোকটা কোনোরকম বিশৃঙ্খলা না করেই ব্যাপারটা মীমাংসা করতে চেয়েছিল।

“আমার নিশ্চয়ই এরকম প্রতিপক্ষের বিপক্ষে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না যার জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই?” সে এই কথাটা অনেকবার বলেছে। কিন্তু অনেকবার বলার পর যখন দেখেছে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাটা ওর কাপুরুষতা হিসেবেই দেখছে সবাই, তখন সেও এটা মেনে নিয়েছে।

ট্রোম্পকে অবাক করে দিয়ে অস্ত্র পছন্দের ভারটা তার ওপরই ছেড়ে দেয় পেট। “আমার পিস্তল হলেই চলবে।” ট্রাম্প জানালো।

“আমি তোমার সিদ্ধান্ত নেয়া দেখে অবাক হয়েছি।” অবাক হয়ে বলল হাল। “আমি তোমার তলোয়ার যুদ্ধ দেখেছি। ওটাতে তুমি বেশ ভাল। কিন্তু যেহেতু তুমি বন্দুক বেছে নিয়েছ সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা তোমার জন্য একটু কঠিন হয়ে গেল।”

“ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি জানি যে আমি তলোয়ার যুদ্ধে বেশ ভাল। সেক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। আমি যদি তলোয়ার নিয়ে সামনা সামনি যুদ্ধ করি তবে মাথা মোটা পেটকে হত্যা না করে থাকাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু অস্ত্র হিসেবে পিস্তল খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। সমতল ভূমিতে যে কোনো দূরত্বে পিস্তল দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু সাগরের ওপর দোদুল্যমান জাহাজে লক্ষ্যবস্তুর খুব কাছ থেকে গুলি করে টার্গেটে লাগাতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। যদি পেট আমাকে হত্যা করেই ফেলে তবে অবশ্যই মানতে হবে যে ঈশ্বর ওর পক্ষে ছিল। কে জানে, আমার সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ নিয়ে হয়তো বা তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন।”

হাল হাসতে লাগল। সমস্ত বদমায়েশী কাণ্ডকারখানার পরও হাল-এর কাছে ট্রোম্প ঠাণ্ডা, পাণ্ডুবর্ণ ও রক্তহীন পেট-এর চাইতে অধিক পছন্দের মানুষ। তবে পেট-এর অনুভূতি যেরূপই হোক না কেন তাকে অন্তত কাপুরুষ বলা যায় না। পিস্তল হাতে ডেক-এর ওপর যেভাবে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে তাতেই বোঝা যায় যে তার তেজ বা সংকল্পে কোনো ভীরুতা নেই।

ক্যাপ্টেন ট্রাম্প-এর নিজের লোকেরা স্টারবোর্ড-এর রেলিং-এর পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গোড়ালিতে শেকল পরানো আছে। ট্রোম্প তার নিজের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল যে, “সে যদি এই ইংরেজটার খুলিকে ফুটো করতে পারে তবে সে তাদের হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনতে পারবে। এই কথা শোনার পর ট্রোম্প-এর কিছু লোক চিৎকার করে উঠে, বাকিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

“এই লোক তো এখনই ঘামছে!” র‍্যালফ বিগ নামে একজন অভিজ্ঞ সৈনিক ট্রোম্পকে উদ্দেশ্য করে বিদ্রূপ করে উঠে।

“আরে তাই তো! ওর শরীর ঘামে ভিজে একদম একাকার হয়ে গিয়েছে।” পাশ থেকে আরেক নাবিক বলে উঠে। এরপর সবাই মিলে হাসতে থাকে একযোগে।

“কিন্তু মি. পেট-এর দিকে তাকিয়ে দেখ, আরেকজন নাবিক বলল। “একফোঁটা ঘামও নেই। বাধ দেয়া পুকুরের মতই শান্তশিষ্ট।”

প্রতিযোগী দুইজন কেবল একটাই জামা পরে আছে। তাদের পায়ে বা মাথায় অন্যকোনো কাপড় নেই। যেখানে সূর্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য জাহাজের প্রায় সবাই মাথায় কোনো না কোনো কাপড় পরে আছে। হাল তার মাথা থেকে বড় ছাউনিওয়ালা টুপিটা খুলে হাতের রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকে। এমনকি আফ্রিকার গরমের ভেতর বেড়ে ওঠা জুডিথও ঘামছিল প্রচণ্ডভাবে।

“আসলেই অনেক গরম পড়েছে। আর এই কারণেই ট্রোম্প ঘামছে, ভয়ের কারণে নয়।” হাল বলে উঠল।

আর ওদিকে ট্রাম্প ভেবে পাচ্ছিল না যে মি. পেট-এর মতো একজন ব্যবসায়ী মানুষ কিভাবে অস্ত্র পছন্দের ভার তার ওপর ছেড়ে দিতে পারল! এবং এখনও পর্যন্ত এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিভাবে লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার নখের ময়লা পরিষ্কার করছে যেখানে ট্রোম্প করার মতো কিছুই পাচ্ছে না।

“তোমরা কী তৈরি?” বিগ ডেনিয়েল জিজ্ঞেস করল। সে ডেক থেকে ছয় ফিট দুরে প্রধান মাস্তুলের রশি ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীই তাদের জায়গামত দাঁড়িয়েছে।

“আমি ফায়ার শব্দটা উচ্চারণ করার আগ পর্যন্ত তোমরা কোনো গুলি ছুড়বে না”, ডেনিয়েল বলতে থাকে। তারপর তোমরা তোমাদের ইচ্ছেমত যখন খুশি গুলি ছুড়বে। যেই মুহূর্তে কেউ একজন গুরুত্বর আহত হবে, গুলি করতে অক্ষম হয়ে পড়বে, তখন এই খেলা বন্ধ করতে হবে। বুঝতে পেরেছ তোমরা?

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদেরকে এবার শুরু করতে দিন।” ট্রোম্প জবাব দিল। পেট শুধু তার মাথাটা একটু নাড়াল।

হাল উঠে দাঁড়িয়ে জুডিথ-এর সামনে চলে আসলো। কারো পিস্তল থেকে ছুটে আসা গুলি কোন দিকে যাবে বলা তো যায়না। হয়ত তারা নিশানা ঠিক করেই গুলি ছুড়বে, তারপরও হাল কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায় না।

সাগরের মতো করেই সময় বয়ে যেতে লাগল। এরই মাঝে আশেপাশে কেউ একজন শব্দ করে বায়ু ছাড়ল-সশব্দে হেসে উঠল সবাই। দুর্গন্ধটা পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করিয়ে রাখল বিগ ডেনিয়েল। রঙ্গমঞ্চে প্রস্তুত দুজনই তাদের হাত সামনে টানটান করে রেখে পিস্তল ধরে আছে। ট্রাম্প-এর হাতের পিস্তলটা ইতোমধ্যেই কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

“ফায়ার”, বিগ ডেনিয়েল তীব্র গর্জন করে উঠে। কয়েক সেকেন্ড পর ট্রোম্প-এর পিস্তল থেকে এক ঝলক আগুন এবং ধোঁয়া পেট-এর দিকে ধেয়ে গেল। পেট-এর বাম কাঁধটা ঝাঁকুনি খেয়ে পেছনে সরে আসলো। কিন্তু তার পা স্থির হয়ে আছে এখনো। ভিড়ের মাঝ থেকে একটা গুঞ্জন ধ্বনি শোনা গেল। পেট-এর শার্টে রক্তের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। হাল ভাবল যে দুটো পিস্তল থেকেই হয়ত গুলি ছোঁড়া হয়েছে, কিন্তু পেট তার গুলিটা ট্রোম্প-এর গায়ে লাগাতে পারেনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। পেট এখন পর্যন্ত গুলিই ছোড়েনি। সে এখনও একইরকমভাবে পিস্তলটা ধরে রেখেছে।

পেট তার ক্ষতস্থানের ব্যথা খুব একটা অনুভব করতে পারছিল না। কারণ সে তার সুযোগের অপেক্ষায় বসে ছিল। তার লক্ষ্যবস্তুর নিশানা ঠিক করছিল। এতটুকু দূরত্ব থেকে কখনোই তার লক্ষ্যবস্তু ব্যর্থ হয়নি। তার সমস্ত মনোযোগ তার হাতে ধরা পিস্তল এবং তার সামনে দাঁড়ানো ট্রোম্প-এর দিকে যে কিনা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রোম্প বুঝতে পেরেছে যে সে বোকার মতো কাজ করেছে যেটার ফলাফল তাকে এখন ভোগ করতে হবে। এমনকি তার আশেপাশে যে সবাই পিনপতন নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটাও সে খেয়াল করছে না।

যখন পেট ট্রিগার-এ চাপ দিল তার পরপরই ট্রাম্প-এর বাম কাঁধ থেকে অল্প একটু মাংস ছিটকে পড়তে দেখা গেল। সেই সাথে পিছিয়ে পড়ল ট্রোম্প।

“জেসাস ক্রিস্ট”, সে বিড়বিড় করে বলে উঠে।

ক্রুদ্ধ চোখে নিজের পিস্তল-এর দিকে তাকিয়ে ছিল পেট যেন এটা তার সাথে বেইমানী করেছে।

“তলোয়ার হলেই ভাল হত লগওয়ার্ড নামে একজন নাবিক চিৎকার দিয়ে উঠে”, যদিও যুদ্ধের ফলাফলে হাল-এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। যদিও হাল জানে যে একটা সাধারণ দাগই একজন মানুষকে হত্যার জন্য যথেষ্ট-যদি সেটাতে পচন ধরে। যদি এরকম কিছু ঘটেও যায়, তবে তখন সেটার ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এখন ব্যাপারটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে।

“ইটস ওভার,” বিগ ডেনিয়েল বলে উঠে। দুজনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এটা পরিষ্কার যে দুজনের কেউই মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। যদিও তাদেরকে দেখে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে তারা একজন আরেকজনকে বেঁচে থাকতে দেখে স্বস্তি পেয়েছে নাকি আরেকবার চেষ্টা চালানোর ইচ্ছে পোেষণ করছে।

“আপনি কি সম্ভষ্ট, মি. পেট?” ট্রোম্প জিজ্ঞেস করল। যদিও সে জিজ্ঞেস করার সময় ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল।

পেট তার পিস্তলটা ডেনিয়েল-এর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি সন্তুষ্ট, ট্রাম্প।” কিন্তু তার শান্ত, অনুভূতিহীন চেহারা দেখে বোঝা গেল না যে তার মস্তিষ্কে কী খেলা করছে।

“অ্যাবোলি, আমার কেবিনে যাও। ওখান থেকে ফ্রেঞ্চ ব্রান্ডি খুঁজে বের করে নিয়ে এসো”, হাল অ্যাবোলির উদ্দেশ্যে বলে।

“আমরা কী আজকের ঘটনাটা উদ্যাপন করতে যাচ্ছি ক্যাপ্টেন?” উইল স্ট্যানলি জিজ্ঞেস করে উঠল।

“গাধা! লোকদুটোর ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য আনা হচ্ছে ওটা,” নেড টেইলর জবাব দিল।

“আমি সেই ব্রান্ডিতে হিসি করে দিলে অনেকটা ব্রান্ডি বেঁচে যাবে,” অ্যাবোলি এত জোরে বলল যে কথাটা সবার কানেই গেল। তার বিশ্বাস যে মানুষের মূত্র ক্ষতস্থানের ইনফেকশান রোধ করার জন্য খুবই কার্যকরী মহৌষধ-অ্যাবোলির এই বিশ্বাস সম্পর্কে জাহাজের সমস্ত নাবিকই জানে। এবং তাদের কেউ কেউ এই ব্যাপারটা মেনে নিতে বাধ্যও হয়েছে-ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণেই।

বাউ-এর নাবিকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হাল। তার মনে হলো, এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। যদিও কিছুটা রক্তপাত হয়েছে কিন্তু কেউ মারা যায় নি।”

“এটা শেষ হওয়ায় আমিও খুব খুশি হয়েছি,” জুডিথ তার দৃঢ়, শান্ত কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল। “পুরুষ লোকগুলোর গৌরব নিয়ে কি আর বলব।”

হাল-এর চোখ জুডিথ-এর স্নিগ্ধ কোমল চেহারা, মায়াময় চোখ, এবং বাঁকানো ঠোঁটের ওপর ঘুরতে থাকে।

“ক্যাথলিকদের মতে গর্ব হচ্ছে এক ধরনের পাপ”, হাল বলতে থাকে। কিন্তু আমি সেজন্য মি. পেটকে দোষারোপ করছি না। আমি জানি আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকাটা পশুর সমান। এইটুকু বলেই হঠাৎ করে নিশ্চুপ হয়ে গেল সে, কারণ ‘গাল অব মুরেতে সেইসব দিনের কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে যখন তাকে দাসদের মতো করে জীবন যাপন করতে হত। এরপর সে জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “মাঝে মাঝে এই গর্বটুকুই আমাদের শেষ সম্বল হয়।”

হাল ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রধান মাস্তুলের কাছে দাঁড়ানো মি. পেট-এর কাছে যেতে থাকে। পেট তার গায়ের জামা খুলছে ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য।

“শুধু একটু আচড় লেগেছে, ক্যাপ্টেন,” সে বলল।

হাল মাথা নাড়ায়। “আপনারা দুজনেই খুব ভাগ্যবান। আপনারা দুজন যেভাবে স্থির হাতে গুলি চালিয়েছেন তা দেখে আমি খুবই খুশি হয়েছি। আমি আমার নাবিকদের কাছ থেকেও হয়ত এর চাইতে বেশি কিছু প্রত্যাশা করতাম না। তবে তারা অনেক যুদ্ধ দেখেছে। আপনি সেরকম কিছু দেখেন নি।”

“চুয়াল্লিশ সালে নেসবি-তে চেরিটন-এর যুদ্ধে আমার বাবা যুদ্ধ করেছেন।” পেট জবাব দিল। আশেপাশে যারা এই যুদ্ধের নাম শুনতে পেল তারা সাথে সাথে রাগে দুঃখে আর হতাশায় ফেটে পড়ল। কারণ তাদের কারও না কারও মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব এই যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে বন্দুক চালনা করতে হয়। যখন ওলন্দাজটা পিস্তল বেছে নেয় তখন আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি। তলোয়ার বেছে নিলে আমি হয়ত খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারতাম না।”

হাল হেসে জবাব দেয়, তাহলে বলা যায় আপনার ভাগ্য এখনো আপনার পক্ষে আছে, মি. পেট।” এরপর হাল ট্রোম্প-এর দিকে তাকিয়ে দেখে সে বিগ ডেনিয়েলকে দিয়ে তার ক্ষত পরীক্ষা করাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, আপনার ক্ষতটাতে ফ্রেঞ্চ ব্রান্ডি দিলে অনেক উপকারে আসবে। তবে আপনি অ্যাবোলির দেয়া ওষুধটিও কাজে লাগাতে পারেন।”

“আমি কখনো সেটা ব্যবহার করিনি ক্যাপ্টেন কার্টনি, মি. পেট অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলে। “কার্যকরী ওষুধ হয়তো বা, আমি জানি না।”

“গুড”, হাল মাথা নাড়ায়। তাহলে আপনি থাকুন, আমি এই রাসকেল গুলোকে কাজে পাঠিয়ে দিয়ে আসি। বাতাস আবার এদিকে আসছে, মি. পেট”, পাল-এর ওপর দিয়ে আকাশের রঙ-এর বদলে যাওয়া দেখতে দেখতে বলে হাল। “আরও উপরে নোঙর করুন”, “মি. টেইলার। মি, মুন, মি. স্ট্যানলি! আপনারা বদমাশগুলোকে কাজে পাঠান, পাল ঠিক করতে বলুন।” কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গোল্ডেন বাউ ব্যস্ত ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়ে যায়। অ্যামাডোডারাও কাজে নেমে পড়ে। তরঙ্গাকারে পাল তুলে দেয়া হয়। জাহাজটাও মৃদুতালে দুলতে থাকে।

অ্যাবোলি মি. পেট-এর ক্ষতটাতে ফ্রেঞ্চ ব্যাক্তি ঢেলে দিচ্ছে। আর মি. পেট হাল-এর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে সেই দৈববাণী তার জন্য কী পরিকল্পনা করে রেখেছে।

ক্যাপ্টেন ট্রাম্পকে হাতের নাগালে পেয়েও মারতে পারেনি সে; এত কাছ থেকে ঠিক কী কারণে তার লক্ষ্যবস্তু ব্যর্থ হয়েছে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছে নাপেট। যদিও, তার মন বলছে, পুরো ব্যাপারটায় সেই অদৃশ্য সাধুর হাত রয়েছে।

পেট-এর দুইজন শিকার এখনো বেঁচে আছে, যাদেরকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সে। এর আগে তার সাথে কখনোই এ ধরনের কিছু ঘটেনি। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে। সে নিশ্চিত-খুব শীঘ্রই এর কারণ খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে সে।

*

মি. পেট এবং ট্রোম্প-এর দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দুই দিন পার হয়েছে। সমস্ত শত্রুতাকে নিঃশেষ করে দিয়ে বাউ আনন্দচিত্তে, স্নিগ্ধ বাতাসে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেছে। তাই ট্রোম্প-এর মনে হচ্ছে এই সময়টাই হাল-এর সামনে গিয়ে কথা বলার জন্য উপযুক্ত সময়।

“আমি কী আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি, ক্যাপ্টেন?”

“একটু নয়, পুরোপুরিই বলুন।” হাল জবাব দেয়। সে এই জাহাজের মালিক। তার পেছনে সূর্য এবং সামনে বাতাস রয়েছে। তার ভালবাসার নারী তার পাশেই আছে। তার মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীটাই তার কাছে আছে।

“আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে আমি এবং আমার নাবিকদের আপনার জাহাজে যোগদানের ব্যাপারে বলেছিলাম। অবশ্য অন্য কোনো ব্যাপারে ব্যস্ত থাকার কারণে আপনি এদিকে মন দেয়ার সময়ই পাননি।” ট্রোম্প একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে রেলিং-এ দাঁড়ানো পেটের দিকে তাকায়। “তাই নয় কি, মি. পেট?” এরপর আবার হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কী এ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখার সময় হবে?”

হাল হেসে ফেলল। “শয়তানও অস্বীকার করতে পারবে না যে তুমি তার চেয়ে কোনো অংশে কম। প্রথমে তুমি আমাদেরকে হত্যা করতে চেয়েছিলে। আর এখন তুমি আমাদের সাথেই যোগ দিতে চাচ্ছ।”

“আমি কখনোই আপনাদেরকে হত্যা করতে চাইনি।” ট্রোম্প বাধা দিয়ে বলল। “এই জাহাজটা আর তার খাবারগুলোর দিকেই শুধু চোখ ছিল আমার।”

অ্যাবোলি এগিয়ে এসে আলোচনায় যোগ দেয়। “আর সেটার জন্য তাকে ঠিক দোষারোপও করা যায় না।”

“আমাকে আপনার নাবিক হিসেবে যোগদানের সুযোগ দিন।” ট্রোম্প বলতে থাকে। “আমি একজন অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। কিন্তু আপনি এই জাহাজের মালিক। আমি জানি অ্যাবোলি আপনার ফাস্ট মেট, তো আমাকে আপনার সেকেন্ড মেট হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিন। আমি এখানকার জলরাশি সম্পর্কে ভাল করেই জানি। উত্তরে বহুদূর পর্যন্ত আমার চেনা-জানা আছে এবং দক্ষিণের কেপ-এর চারপাশটাও আমার পরিচিত। এই পথ দিয়ে আমি বহুবছর যাবত ব্যবসায়িক যোগাযোগ স্থাপন করেছি। আমার অনেক বন্ধুও আছে ক্যাপ্টেন।”

“সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক”, হাল বলতে থাকে। কারণ তোমার যে পরিমাণ শত্রু আছে বলে আমার মনে হচ্ছে, সে পরিমাণ শত্রুর হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে অনেক বন্ধু থাকতেই হবে।”

ট্রোম্প ভাবগম্ভীর দৃষ্টিতে হাল-এর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে সে কেন এই কথা বলছে। এরপর আবার বলতে শুরু করল, “আপনি সবসময় নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য স্থির রেখে চলতে পছন্দ করেন, ক্যাপ্টেন কার্টনি। সেই সাথে সবসময় সময়ের সদ ব্যবহার করেন। আপনার মতো একজন মানুষের সাথে কাজ করতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব।”

অ্যাবোলি আর নেড টেইলর জাহাজের হুইলের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিটি কথা শুনছিল এবং তাদের ক্যাপ্টেন-এর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ট্রোম্প-এর কথা শুনে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে। এখন ক্যাপ্টেন কার্টনি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়।

হাল কিছু একটা চিন্তা করতে করতে ট্রাম্প-এর কথার উত্তরে কী বলবে সেটা ভুলেই গিয়েছিল।

এরপর জুডিথ কথা বলে সেই নীরবতা ভেঙে দেয়। “হেনরি, তুমি একবার বলেছিলে যে তোমার নাবিকের ঘাটতি আছে তাই না।”

“হ্যাঁ বলেছিলাম।”

“তাহলে কেন তুমি এরকম একজন অভিজ্ঞ লোককে নাবিক হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছ না, সে জিজ্ঞেস করে।

ট্রোম্প জুডিথ-এর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। যার জীবন এক সময় সে বিপন্ন করতে চেয়েছিল এখন সে-ই তার পক্ষ হয়ে কথা বলছে।

“তুমি সত্যিই অবিশ্বাস্য, মাই ডিয়ার”, হাল জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলে।

“আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি।” জুডিথ ট্রোম্প-এর দিক থেকে হাল-এর দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে থাকে। এই লোকটি এবং তার নাবিকদের জীবন রক্ষা করা যদি তোমার সাধ্যের মধ্যে হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তোমার তা করা উচিত।”

“ধন্যবাদ ম্যাডাম,” ট্রোম্প জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলল। জুডিথ নীরবে মাথা নেড়ে তার কৃতজ্ঞতার জবাব দেয়।

“কিন্তু আমি কিভাবে নিশ্চিত হব যে তুমি প্রথম সুযোগেই আবার জাহাজটা দখল করতে চাইবে না।” হাল জিজ্ঞেস করে। “তোমাকে দেখে মনে হয়েছে কর্তৃপক্ষের প্রতি তোমার শ্রদ্ধাবোধ কম। তাহলে তুমি কীভাবে আমার নাবিক হিসেবে কাজ করবে?”

ট্রোম্প হেসে ফেলে, যে হাসি তার চোখে প্রতিফলিত হয়। “আমি আমার জীবনের জন্য আপনার কাছে ঋণী। আপনি চাইলে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়েই আমাকে হাঙরের মুখে নিক্ষেপ করতে পারতেন।” এরপর সে হাল এর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে। “সত্যি বলতে কী আপনার সাথে জাহাজ চালাতে পারলে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে করব।”

ট্রোম্প-এর কথাগুলো হাল অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনল। বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রোম্প যদি তার দেয়া কথা নাও রাখে তবুও বাউ-এর নাবিকদের কাছ থেকে জাহাজ কেড়ে নেয়া এই ওলন্দাজ লোকটার পক্ষে অসম্ভব। এছাড়াও তার জাহাজে এখন নাবিকের সংকট রয়েছে। তাই এমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নিলে খুব একটা মন্দ হয় না।

“আপনি কী মনে করেন মি. পেট? মি. ট্রাম্প এবং তার নাবিকদের কী আমার জাহাজে নাবিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত?”

পেট শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “এটা আমার মতামত দেয়ার বিষয় নয়। ক্যাপ্টেন।” এরপর সে চোখের জোড়া উপরের দিকে তুলে বলে। “কিন্তু আপনাদের নাবিকদের মধ্যে অনেক কুসংস্কারও রয়েছে। আপনি যদি এরকম ভাগ্যবান ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন তাহলে সেটা হয়ত জাহাজের জন্য ভাল বয়ে আনতে পারে।”

“ভাগ্যবান? কিন্তু কীভাবে মি. পেট?” হাল জিজ্ঞেস করে।

“অবশ্যই, ভাগ্যবান”, পেট তার কথায় জোর দিয়ে বলে। প্রথমত, সে আমাকে বিশ গজ দূর থেকে আঘাত করেছিল। আমরা দুজনেই চলন্ত ডেক এর ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। দ্বিতীয়ত, আমার গুলিটা এভাবে ব্যর্থ হওয়ার কথা। ছিল না। আমি সাধারণত এ ধরনের ব্যর্থতায় অভ্যস্ত নই।”

“একজন ব্যবসায়ীর তুলনায় কথাগুলো বেশ অদ্ভুত, মি. পেট, হাল পেটকে উদ্দেশ্য করে বলল।

“আমি তো আপনাদেরকে বলেছিলামই যে, আমার বাবা আমাকে বন্দুক চালনা শিখয়েছিলেন। তিনি খুব ভাল প্রশিক্ষক ছিলেন এবং আমাকে বেশ ভালভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আমাকে ব্যর্থ হতে দেখলে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হতেন না।”

“ও আচ্ছা, হাল পেট-এর দিকে তাকিয়ে বলল। এই লোকটার মাঝে এমন কিছু আছে যেটার কারণে হাল খুব বিরক্ত হচ্ছিল। শুধু যে সে-ই খুব বিরক্ত হচ্ছে তাই না। সে তার নাবিকদেরও পেট-এর ব্যাপারে আলোচনা। করতে শুনেছে। গুলি করার সময়ও সে ইচ্ছেকৃতভাবে সময় নিয়েছিল প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা না থাকা একজন ব্যবসায়ীর বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় এইরকম স্থিরচিত্ত মনোভাব একদমই মানায় না। স্বাভাবিকভাবেই হাল চায় না যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক মিনিটও লোকটা এই জাহাজে থাকুক।

“আচ্ছা ঠিক আছে মি. ট্রোম্প, আমি প্রস্তাবে রাজি,” হাল বলতে থাকে। “আমি তোমাকে আমার সেকেন্ড মেট হিসেবে নিয়োগ দিতে রাজি আছি। আমি খুব খুশি হব যদি তুমি তোমার লোকদের একটা তালিকা তৈরি করে তাদের বিশেষ দক্ষতা সম্পর্কে লিখে আমাকে দাও।”

ট্রোম্প-এর চেহারায় হাসি ফুটে ওঠে। “আপনি আপনার সিদ্বান্তের জন্য অনুতাপ করবেন না। ক্যাপ্টেন কার্টনি।”

হালও হেসে ফেলে, “তবে তার কথায় কোনো কৌতুক ছিল না। তুমি আশা করতে পার, আমি সেটা করব না। আমি তোমার ওপর বিশ্বাস রেখেছি। তবে তুমি যদি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ কর তবে মনে রেখ সেটার জন্য তোমাকে অনুতাপ করতে হবে।”

“আমার নজর সবসময় তোমার ওপর থাকবে, ডাচম্যান,” অ্যাবোলি বিড়বিড় করে বলতে থাকে।

“গুড, তাহলে অন্তত আপনি দুয়েকটা জিনিস শিখতে পারবেন।” ট্রোম্প অনেকটা বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল। এরপর যেতে যেতে অ্যাবোলির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল।

“সাবধানে কথা বল মি. ট্রাম্প,” হাল সতর্ক করে দিল সাথে-সাথে। “একটা ঝামেলা মাত্র শেষ হয়েছে। আমি চাচ্ছি না যে তোমার কারণে আরেকটা ঝামেলা হোক।”

“হা-হা ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প দ্রুত জবাব দিল।

.

হাল-এর জন্য স্বস্তির ব্যাপার এই যে মি. ট্রোম্প নিজের যোগ্যতা বেশ ভালভাবেই প্রমাণ করছে। তারা দুজনে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে চার্ট দেখছে। ওলন্দাজ লোকটি উপকূল সম্পর্কে তার সমস্ত অভিজ্ঞতা হাল-এর সাথে শেয়ার করেছে যেন তাদের দুজনের একত্রিত জ্ঞান ভবিষ্যতের জন্য অমূল্য কিছু বয়ে আনতে পারে।

তবে খুব শীঘ্রই ট্রোম্পকে এলিফ্যান্ট লেগুন এবং এর গুপ্তধন সম্পর্কে বলার ইচ্ছে নেই হাল-এর। কিন্তু তারা যে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, সেটা তাকে না বললেও সূর্যের দিকে একবার তাকিয়েই সে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। সে জাঞ্জিবার এবং কেপ-এর মাঝে নিরাপদ কিছু জায়গা চিনে যেখানে তারা নিরাপদে নোঙর ফেলতে পারবে। সেখানে ওমানি আরব সৈন্য বা মাদাগাস্কান দস্যুদের আক্রমণের কোনো ভয় থাকবে না।

ডেফট-এর নাবিকেরাও বেশ কাজ করছে। এমনকি নেড টেইলর-এর মতো অভিজ্ঞ নাবিকও বিরক্তির সাথে খেয়াল করল যে এই লোকগুলো আসলেই অনেক বেশি কর্মঠ। তারা সারা দিন কাজ করে; প্রধান মাস্তুলের ওপর উঠা-নামা করে, এরপর জাহাজ-এর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ায় কাজের খোঁজে, এরপর আবার নিচের ডেকে চলে যায় নতুন কাজ করার জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের শরীর বেয়ে ঘামের পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে, তাদের শরীর সোজা করেই দাঁড় করাতে কষ্ট হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা থামে না।

“এদেরকে দিয়ে হবে, মি. টেইলর,” হাল বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বলে। “আমাদের লোকেরা কী ওদের ভালভাবে গ্রহণ করেছে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।”

“ওদের নিয়ে অবশ্য কিছুটা হাসি ঠাট্টার ব্যাপার ঘটে। তবে সেটাও একদিক থেকে ভাল। তাই না ক্যাপ্টেন।”

কথার মধ্যে যদিও উৎফুল্লতা ছিল কিন্তু হাল-এর কেন জানি মনে হাল-এমন কিছু একটা আছে যেটা নেড টেইলর তাকে বলতে চাচ্ছে না।

“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা নিয়ে সমস্যায় আছ। সেটা কী আমাকে বল।”

“ওহ, তেমন কিছু না। ক্যাপ্টেন।”

“সেটা আমি বিচার করব। আমাকে বল।”

টেইলর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এরপর লম্বা টান দিয়ে পাইপ থেকে বুকভর্তি করে তামাকের ধোয়া টেনে নেয়। এরপর আস্তে আস্তে সেই ধোয়া ছাড়তে থাকে। হাল তাকে ভাবার সময় দেয়। অবশেষে নেড টেইলর বলতে থাকে, “ব্যাপারটা মি. পেটকে নিয়ে। আমি তাকে অসম্মান করছি না। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নাবিকরা মি. পেটকে মেনে নিতে পারছে না। একদমই না।”

হালকে তার পিতা এমনভাবে বড় করেছেন যেন সে তার লোকদের ভাল করে দেখাশোনা করতে পারে। “ধরো, তুমি ঝড়ো বাতাসের সময় তোমার লোকদের টপগ্যালান্ট-এ উঠতে বললে কিংবা কামানের গুলির মাঝে শত্রুর জাহাজ আক্রমণ করতে বললে”, স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি সবসময় এভাবে বলতেন, “যদি তোমার প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলেও তারা এই কাজগুলো করবে-কিন্তু তীব্র অনীহার সাথে। কিন্তু তুমি যদি তাদের পাশে থাকো, তাদের প্রয়োজন ঠিকমতো মেটাতে পারো, তাদের মতামতের গুরুত্ব দাও, তবে এই কাজগুলো করার সময় তারা একদম মন থেকেই করবে।”

অতএব, স্বাভাবিকভাবেই হাল টেইলার-এর কথাগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। “এমন বিশেষ কিছু কী আছে যেটা তারা পছন্দ করছে না?”

“প্রথমত তারা মনে করে যে পেট-এর মাথায় সমস্যা আছে। ডিনারের সময় বা লোকজনের সামনে থাকার সময় সে যথেষ্ট ভুদ্র থাকে, কারো সাথে কোনো কথা বলে না। কিন্তু সে যখন একা থাকে তখন সে আপন মনে বিড়বিড় করে, দেখে মনে হয়, সে অদৃশ্য কারও সাথে কথা বলছে। সেই অদৃশ্য কারো সাথে সৃষ্টিকর্তা, ফেরেশতা এই জাতীয় ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলে সে।”

“ক্রিশ্চয়ান ধর্মে অনুরাগী কারও এভাবে কথা বলাতে আমি অন্যায়ের কিছু দেখছি না।”

“হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, সেটা হয়ত সত্য।” “কিন্তু মি. পেট-এর ব্যাপারটা সেরকম না। এটা একেবারেই অন্যরকম…” টেইলর যেন সঠিক শব্দটা খুঁজে পাচ্ছে না “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,” টেইলর শুধু মন্তব্য করে। তবে তাকে ঠিক স্বাভাবিক বলা যায় না। বেশ অদ্ভুত বলতে পারেন।”

হাল কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলার চেষ্টা করে কিন্তু নেড তার কথা কেড়ে নিয়ে বলে। তারপর তাদের দুজনের সেই মারামারির ব্যাপারটাও স্বাভাবিক ছিল না। ট্রাম্প যখন তাকে গুলি করছিল সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন সে কিছুই অনুভব করতে পারছে না। আবার সে যখন ট্রাম্পকে গুলি করছিল তার চেহারা একেবারেই অভিব্যক্তিহীন ছিল যেন কোনোকিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। সে যে একজন মানুষকে গুলি করতে যাচ্ছে এটা তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে কোনো ইঁদুর বা অন্য কোনো ঘৃণ্য প্রাণীকে গুলি করছে। আর যখন সে দেখল যে তার গুলি মিস হয়েছে…

“তাকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল…হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি।” হাল বলতে শুরু করে। “আমি বুঝতে পারছি নাবিকরা তাকে পছন্দ না করার পেছনে কারণ আছে। আমিও লোকটার মাঝে অদ্ভুত কিছু একটা দেখেছি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝতে পারছি যে ব্যাপারটা ঠিক কী, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এই আরকি।” হাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।

“তো…আমরা এরপর কোথায় যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন?”

“জাঞ্জিবার। সমস্ত জায়গাটা ওমানি আরব লোকদের দ্বারা চালিত হয়। যাদের কিছু লোকের জাহাজ আমরা আনন্দের সাথে লাল সাগরে ডুবিয়েছি। তাই ওখানকার উপকূলে যাওয়ার পর পরিবেশটা আমাদের জন্য বন্ধুসুলভ নাও হতে পারে। কিন্তু তারপরও…”

হাল কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, “নেড, তুমি কী দয়া করে মি. অ্যাবোলি, মি. ট্রাম্প এবং মাস্টার ফিশারকে বলবে আজকে দুপুরে তারা যেন আমার কোয়ার্টারে এসে আমার সাথে দেখা করে। তুমিও সাথে থাকবে।”

যখন তারা সবাই একসাথে এলো, তখন জুডিথও সেখানে উপস্থিত ছিল। হাল বলতে শুরু করল, “ব্যাপারটা আমার নজরে এসেছে যে মি. পেট কোনো না কোনোভাবে নাবিকদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে, হোক সেটা অনিচ্ছাকৃতভাবে। একারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে জাঞ্জিবার-এ গিয়ে আমি মি. পেটকে সেখানকার মাননীয় রাষ্ট্রদূত-এর কাছে সমর্পণ করব, যেন তিনি সহজ রাস্তায় মি. পেটকে ইংল্যান্ড-এ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেন।এতে করে মি. পেট এরও সুবিধা হবে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও লাভ হবে। সে যদি সুয়েজ-এর উত্তর দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় যায় এবং সেখান থেকে লন্ডন-এ পৌঁছায়, তবে তার যাত্রা আরও দ্রুত হবে, এবং তাকে গোল্ডেন বাউ-এর সাথে কেপ-এ যেতে হবে না। আমি সবাইকে ডেকে এনেছি এই কারণে যে এতে কারও কোনো আপত্তি আছে কি-না। তাছাড়া মি. পেট চলে গেলে ট্রোম্প-এর সাথে তার চলমান তিক্ত সম্পর্কেরও অবসান হবে।”

“আমার দিক থেকে তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এটা আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প বলল।

“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তাছাড়া আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করেছি। পেটকে উদ্ধার করেছি। তাকে ভাল খাবার দিয়েছি। কিন্তু আমাদের এখন তাকে বাড়ি ফেরানোর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হবে। যদিও আমার ইংল্যান্ড-এ পাঠানোর মতো অনেক চিঠিপত্র ছিল, কিন্তু সেসব থাক।”

“আমরা কী বাউকে জাঞ্জিবার-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছি?” অ্যাবোলি জিজ্ঞেস করে। সেখানে নিশ্চয়ই অনেকেই আছে যাদের জাহাজ আমরা ধ্বংস করেছি। তারা নিশ্চয়ই সেগুলোর সাক্ষী দেবে, আমাদের জাহাজের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।”

“আমিও সেটা নিয়ে ভেবেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাউকে জাঞ্জিবার এর উপকূল থেকে এক দিনের দূরত্বে রেখে নোঙর করব। এরপর ডেফট জাহাজটাকে উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে যাব। ট্রোম্প, কিছু সময়ের জন্য হলেও তুমি তোমার নেতৃত্ব ফিরে পেতে পার। তুমি যদি মনে কর যে তোমার জাহাজকে আমরা বিপদের সম্মুখীন করতে যাচ্ছি তবে বলব যে এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। কারণ সেখানে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তোমার জাহাজকে ইস্ট ইন্ডিস-এর পানিতে দেখেছে। তাছাড়া, আমরা তোমার জাহাজের নাম বদলে ফেলব। ডেফট-এর নাম রাখব ক্রিস্টিনা। কারণ, আমি জানি এই নাম তোমার অনেক পছন্দের।”

সমবেত সবাই হেসে উঠে। তারা জানে যে এটা সেই অ্যাডমিরাল-এর কন্যার নাম যার সাথে ট্রোম্প প্রথমে প্রণয় গড়ে তুলে পরে বেইমানি করে পালিয়ে আসে। সবার সাথে সাথে ট্রোম্পও হেসে উঠে। “যখন বাতাভিয়া ছেড়ে এসেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম যে অবশেষে ক্রিস্টিনার কাছ থেকে পালাতে পেরেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, পুরোপুরি পারিনি।”

“বাউ-এর ভাল ভাল নাবিকেরা তোমার সাথে থাকবে,” হাল বলতে থাকে। “এর দুটো কারণ আছে। কারণ প্রথমত, এরা তোমার ওপর নজর রাখতে পারবে। দ্বিতীয়ত, আমি যখন উপকূলে থাকব সেখানে হয়ত আমি অস্ত্র নিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু আমার প্রয়োজন হলে সময়মত যেন ওরা চলে আসতে পারে, সেই জন্যই তাদেরকে নেয়া। রাষ্ট্রদূত গ্রে হয়ত আমাকে একবার দেখলেই চিনতে পারবে। আর সে নিশ্চয়ই এখনো আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আছে।”

“তুমি তার সাথে প্রতারণা করেছিলে, গান্ডওয়েন, অ্যাবোলি বলতে থাকে। “যদি কোনো লোক আমার সাথে এরকম করত তবে আমিও তাকে ক্ষমা করতাম না।”

“আমি তার সাথে সরাসরি প্রতারণা করি নি।” হাল যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। “আমি ওর মাধ্যমে একটা আদেশপত্র নিয়েছিলাম-আরব সৈন্যদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে। আর সেকারণে আমি তাকে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাও দিয়েছিলাম। তবে এটা আমি নিশ্চিত বলতে পারি যে আমি মুসলিমদের হয়ে কখনো ক্রিশ্চিয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতাম না। আর আমি বিশ্বাস করি না যে সে ব্যাপারটা জানত না। আমি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে আমার কাজের জন্য তাকে কখনোই দায়ী করা হয়নি। আর যদি করা হয়ও, তাহলে তার সম্পর্কে একটা কথা তোমাদের জানিয়ে দেই। কনসাল গ্রে হচ্ছে এমন একজন মানুষ যার কাছে টাকা-পয়সা হচ্ছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে আমি তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করব।”

অ্যাবোলিকে দেখে মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা এখনো তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু সে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল। সে জাহাজের অন্যান্য কর্মকর্তার সামনে কখনো হাল-এর কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে চায় না। তারা যতই বিশ্বাসী এবং সিনিয়র কর্মকর্তা হোক না কেন।

পরিকল্পনা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হলো। জুডিথ এবং হালকে রেখে সবাই আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল।

“আমি কী তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল।

“অবশ্যই, মাই লাভ”, হাল জবাব দেয়। এরপর সে জুডিথ-এর দিকে ভ্রু কুঁচকে অকিয়ে বলে, “তোমার কী শরীর ভাল না?”

সে হেসে হাল-এর কপালে হাত রাখে। “আমি ভাল আছি। কিন্তু আমার পেটে সন্তান। যতই দিন যাচ্ছে আমি আস্তে আস্তে দুর্বল এবং কাহিল হয়ে পড়ছি। আর কিছুদিন পর যখন সময় আসবে তখন হয়ত আমাকে তীব্র ব্যথার সম্মুখীন হতে হবে।”

“না, আমি সেটা হতে দিব না,” হাল জোর দিয়ে বলে উঠে।

জুডিথ হেসে ফেলে, “এমন অনেক কিছু আছে যেটা তোমার আদেশের বাইরে। এমনকি সেটা যদি তোমার জাহাজে ঘটে তবুও।” জুডিথ বলতে থাকে। “সন্তান জন্ম দেয়া হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন এবং বেদনাদায়ক কাজ। এ কারণেই এটাকে বলা হয় লেবার। আমার মনে হয়, আমাকে সাহায্য করার জন্য জাহাজে আরেকজন নারী থাকলে ভাল হত। অন্তত যখন সময় আসবে তখন যেন আমরা উপকূলে গিয়ে একজন ধাত্রী খুঁজে বের করতে পারি।”

“আফ্রিকায় এমন কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, ডালিং।”

“সেটা হত না যদি আমি বাড়িতে থাকতাম। সেখানে আমার বাড়ির সব মহিলা থাকত, চাকরবাকর থাকত। কিন্তু আমাদের এখন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু ঔষধি গাছ এবং লতাপাতা আছে যেগুলো দিয়ে মিশ্রণ প্রস্তুত করে খেলে আমার কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে। আমার মনে হয় জাঞ্জিবার-এ কোনো না কোনো কবিরাজ পাওয়া যাবে যার কাছে এসব পাওয়া যাবে।”

“অবশ্যই, আমি বুঝতে পেরেছি”, হাল মাথা নাড়ায়। এখন শুধু তুমি আমাকে সেগুলোর নাম বল। আমি যেখান থেকে পারি সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।”

“না হেনরী, মাই লাভ, তুমি পারবে না।” জুডিথ যদিও অনেক নমনীয় স্বরে বলে কিন্তু হাল বুঝতে পারছে জুডিথ তাকে বাধা দিচ্ছে। “তোমার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তুমি একজন পুরুষমানুষ। আমি যদি তোমাকে বলি তুমি সবকিছু বুঝতে পারবে না। এছাড়া তুমি একজন ইংরেজ। জাঞ্জিবার এর সবাই অ্যারাবিক কিংবা সওহিলি ভাষায় কথা বলে। তুমি তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না।”

“কিন্তু তুমি জাঞ্জিবার-এর লোকদের কাছে নিষ্ঠুর জেনারেল নাজেত হিসেবে পরিচিত যে কি-না দুটো মুসলমান সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করেছে। জাঞ্জিবার-এর প্রত্যেকে তোমাকে ঘৃণা করে।”

“তারা জেনারেলকে ঘৃণা করে এটা সত্য, জুডিথ উত্তর দেয়। তারা মনে করে জেনারেল নাজেত হচ্ছে একটা দানব। শয়তানের বউ, যে কি-না মানুষরূপে পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু আমি যদি একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্র রমণী রূপে রাস্তায় বের হই, কবিরাজ-এর কাছে যাই তাহলে তারা কী আমাকে চিনতে পারবে? আমার মুখ ঢাকা থাকবে কাপড়ের নিচে। তারা হয়ত ভাববে আমি প্রতিদিনকার কাজকর্ম সারতে যাচ্ছি।” তখন কেউ কী আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, “ওই দেখ জেনারেল নাজেত যাচ্ছে?”

হাল-একটা হাসি দিয়ে বলল, “খুব ভাল।” “আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি। জেনারেল নাজেত-এর যুক্তির কাছে আমি হেরে গেছি।” “আমরা একসাথেই যাব। কিন্তু এটুকুই প্রার্থনা আমরা যেন একত্রে ফিরতে পারি।”

৪. ডেফট নামে জাহাজটি

ডেফট নামে জাহাজটি-যেটি এখন ক্রিস্টিনা’ নামে পরিচিত-খুব ভোরে জাঞ্জিবার শহরের উপকূলে প্রবেশ করে। একটা লম্বা নৌকোয় করে হাল, জুডিথ আর অ্যাবোলি সাগর উপকূলে বের হয়। পেট বলেছে যে রাষ্ট্রদূত গ্রে-এর সাথে মিটিং না হওয়া পর্যন্ত জাহাজের ভেতরেই থাকতে চায় সে। যেতে যেতে উপকূলের পাশে সাদা রঙের বিল্ডিং-এ ওষুধের একটা দোকান দেখতে পেয়ে জুডিথ আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। হাল বলল, “দোকানীটা নিশ্চয়ই এখানে জমজমাট ব্যবসা করছে। অসহায় অসুস্থ ভ্রমণকারীদের যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে কায়দা করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে।”

হাল ভেতরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব করল না। জুডিথ-এর জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল সে। জুডিথ ভেতরে গিয়ে দেখল বৃদ্ধ দোকানদারটি ছোট ছোট বস্তায় ভরা গুল্ম, বিভিন্ন মিশ্রণের বোতল বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট ও নানান রকমের পাউডার আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখছে। আলমারিটা দেয়ালের একপাশ থেকে অপরপাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন বোতল এবং বয়ামের গায়ে পরিষ্কারভাবে ওষুধের নাম এবং রোগের নাম লেখা রয়েছে। রক্ত পরিষ্কার করার জন্য সাছাফ্রাস রুট-এর চা, বাতের ব্যথার জন্য জিমসনউইড, হাপানির জন্য চেস্টনাট লিফ-এর চা, এরকম আরও নানান রকমের ওষুধ।

জুডিথ ব্যাখ্যা করে বোঝাল যে সে একজন মিসরীয়। কপটিক চার্চের একজন সদস্য। সে এখানে তার ইংরেজ বণিক স্বামীর সাথে নতুন জীবন শুরু করতে এসেছে। জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকদিন থাকার জন্য তারা একটা জায়গা খুঁজছে। দোকানীটি থাকার জায়গা খুঁজে দেয়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাল। সে কারণে জুডিথও জানাল যে তার স্বামী থাকার জায়গার জন্য খুব ভাল দামই দিবে।

তাদের কাছে যে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা আছে, জিনিসপত্র কেনার মাধ্যমে সে ওটা এরইমধ্যে প্রমাণ করেছে। বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ কিনেছে সে। বিভিন্ন স্বাদের চা কিনেছে এবং প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু মিশ্রণ কিনেছে-বেশ ভাল দামেই। জুডিথকে দেখে মনে হচ্ছে সে যদি সমুদ্রযাত্রার মাঝপথে এরকম দুই-একটা দোকান পায় তবে বেশ আনন্দেই সমুদ্রযাত্রা করতে পারবে।

“আমার খোঁজে কিছু ঘর আছে যেগুলোতে আমি আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সেগুলো হয়ত খুব বেশি বড় নয়। আপনারা যেরকমটাতে থেকে অভ্যস্ত তার চেয়ে হয়ত একটু নিম্নমানের। তবে খুব একটা খারাপ নয়। নয়ত আমি আপনাদেরকে থাকার প্রস্তাব দিতাম না।”

“আমি কী ঘরগুলো দেখতে পারি?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল।

“অবশ্যই, অবশ্যই…আমাকে একটু সময় দিন। আমি এখুনি সেটার ব্যবস্থা করছি।”

ওষুধের দোকানীটা খুব দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। কিছু সময় পরে জুডিথ বৈবাহিক কলহের শব্দ শুনতে পেল। দোকানীটা তার বউকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা চাইলেই তাদের বাড়িটা কয়েকদিনের জন্য ভাড়া দিতে পারে। এই কয়েকদিন তারা বাড়ির রাস্তা থেকে একটু দূরে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থেকে আসলেই পারে।

জুডিথ বুঝতে পারল এই কলহের সমাধানে পৌঁছাতে একটু সময় লাগবে। তাই সে তার কেনা জিনিসপত্রগুলো বাইরে নিয়ে এল। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে লাগতে পারে এরকম দুই-একটা জিনিস রেখে দিল। হাল-কে মিষ্টি করে বাকি জিনিসগুলোর ব্যবস্থা করতে বলল। এই মিষ্টি করে বলার মানে হাল এতদিনে বুঝে ফেলেছে-”দিজ ইজ অ্যান অর্ডার।” হাল তার লোকদের বলল জিনিপত্রগুলো ডেট-এ নিয়ে যেতে।

জুডিথ ভেতরে ঢুকে আবার নানান রঙের বীজ, গুলু এবং সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা নানান রকমের পাতা দেখতে লাগল। এরইমধ্যে দোকানীটা ফিরে এসে বলল, “আসুন আমার সাথে।” এরপর গোমড়ামুখো বয়স্ক এক মহিলা তাকে মাঝারি ধরনের একটা ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল। তিনটি রুম পরিপাটি করে সাজানো এবং পুরনো পাল দিয়ে ছাদের নিচে সিলিং দেয়া। ঘরের সামনের দিকে শহরের কিছু অংশ দেখা যায় এবং পেছন দিকে সাগর। সে জানে হাল যদি ঘরে বসেই তার জাহাজের ওপর দৃষ্টি রাখতে পারে তাহলে বেশ খুশিই হবে। আর সে নিজেও দোকানীর বউয়ের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে বেশ খুশি হয়েছে। সবকিছু নিপুণ পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। একদিক থেকে সাগরের পরিচ্ছন্ন বাতাস এবং অন্যদিক থেকে বিভিন্ন গাছ গাছালি, লতাগুলুর সুবাস ঘরগুলোতে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে।

“হুম, চলবে,” সে দোকানীকে বলল। আবার খুব বেশি আগ্রহও দেখাল না। কারণ সে জানে, এতে ভাড়া আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। এরপর জিজ্ঞেস করল “ভাড়া কত পড়বে?”

দোকানীটা প্রথমে ভয়ানক এক দাম হাঁকাল। এরপর জুডিথও সেটা কমিয়ে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে ফেলল। কয়েক মিনিট দুই পক্ষের বাকৃবিতণ্ডের মাধ্যমে এমন একটা ভাড়া নির্দিষ্ট হল যেটাতে দুই পক্ষই খুশি।

হাল তার দুজন খালাসি দিয়ে এক সিন্দুক ভরা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে জাহাজ থেকে যেখানে কাপড়-চোপড়সহ আরও অনেক জিনিসপত্র রয়েছে। হাল জানে যে জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে অস্ত্রসস্ত্র ছাড়া থাকা সম্ভব না। সে একটা নেপচুন তলোয়ার এবং তার বাবার দেয়া একজোড়া পিস্তল সাথে করে নিয়ে এসেছে। সিন্দুকটা এনে রাখার পর জুডিথ সেটার জিনিসপত্র বের করতে লাগল। হাল প্রথমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রদূত গ্রে-কে চিঠি লিখতে বসল। চিঠির প্রথমেই সে ভুল বোঝাবুঝির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল। কিন্তু এখন ইথিওপিয়ার যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সে আশা করছে যে তার কোনো ভুলের জন্য বা ভুল বোঝাবুঝির জন্য কনসালকে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় নি। সে রাষ্ট্রদূত-এর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। রাষ্ট্রদূতকে ব্যাখ্যা করে বোঝায় যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মি, উইলিয়াম পেট বর্তমানে তার সাথেই আছে, যে তার দেশে ফিরতে চায়। লোকটা রাষ্ট্রদূত-এর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি তিনি তাকে এখান থেকে ইংল্যান্ড পৌঁছানোর সুব্যবস্থা করে দেন। হাল আর লিখল, “আমি নিশ্চিত যে আমরা প্রকৃত ইংলিশম্যান-এর মতই সাক্ষাৎ করব। আমাদের দেশ, আমাদের মাতৃভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ অতীতের ছোট খাট ভুলগুলোকে আমরা ভুলে যাবার চেষ্টা করব।” এইটুকুতে লেখা শেষ করে হাল। লেখাতে জুডিথ-এর ব্যাপারে কোনো কথার উল্লেখ ছিল না। জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো কথা গোপন থাকে না। তবে এমন কিছু করা যাবে না যাতে জুডিথ-এর উপস্থিতির কথা অন্যদের কানে পৌঁছে যায়।

সে তার লেখা চিঠিটা পুনরায় পড়তে লাগল। তার মনে হচ্ছে, এতেই হবে। সে তার একজন বিশ্বস্ত লোককে চিঠিটা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিল। তারপর সে জুডিথ, অ্যাবোলি এবং আরো দুজন পাহারাদার নিয়ে শহরটা ঘুরে দেখতে বের হলো।

“তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক”, এই কথা বলে কিচিরমিচির করতে করতে কয়েকটা ছোট ছেলে হাল এবং জুডিথকে জড়িয়ে ধরে ওদের পারিবারিক দোকানের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। অ্যাবোলি ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এতে খুব একটা লাভ হলো না।

তারা বিভিন্ন ধরনের রকমারি জিনিসপত্রের সামনে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। আইভরি পাথর এবং অ্যারাবিক আঠা জাতীয় বিভিন্ন পদার্থ রাখা আছে এরকম একটা দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু জিনিসপত্র কিনল ওরা। ঝুড়িতে করে বিভিন্ন স্পাইসি জিনিসপত্র নিয়ে ছোট ব্যবসায়ীরা বসে আছে। এছাড়াও চকচক করা সিল্ক এবং কার্পেট-এর দোকানীরা কার্পেট-এর ভাঁজ খুলতে খুলতে জুডিথকে দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো তাদের জিনিসপত্রের প্রলোভন দেখাতে লাগল। এরপর ওরা কিছু দাসও বিক্রি হতে দেখল। বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ, ছেলে, মেয়ে শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বিক্রেতার হাতে মোটা শেকল শোভা পাচ্ছে। দাস ব্যবসায়ীরা বা তাদের কোয়াটার মাস্টাররা ক্রেতাদের প্রলোভন দেখানোর জন্য পুরুষদের মাংসল বাহু এবং কাঁধ উঠিয়ে দেখাচ্ছে। মহিলাদের শক্ত হাত বা শরীরের আকর্ষণীয় অংশ এমনকি অল্প বয়সি মেয়েদের গোপনাঙ্গ দেখিয়েও ওরা ক্রেতাদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা হাল ও তার সঙ্গীদের কাছে এতটাই বিরক্তিকর মনে হলো যে ওরা বিক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করার জন্য ওদিকে ফিরেও তাকাল না।

যেতে যেতে রাস্তা একসময় এত সরু হয়ে গিয়েছে যে একজন আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন রক্তনালীর ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু তারপরও এখানকার আবহাওয়া ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে ওদের কাছে। কারণ সূর্যের আলো বড় বড় বিল্ডিং ভেদ করে এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। বিল্ডিংগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন একটার মাথা আরেকটা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কাকের ঝক উড়ে যাচ্ছে শব্দ করতে-করতে।

রাস্তাটার একটা সংকীর্ণ জায়গায় যেখানে দোকানীরা গ্রিল করা অক্টোপাস, স্কোয়াড় ওয়েস্টার এবং বিভিন্ন লোভনীয় সামুদ্রিক খাবার বিক্রি করছে তার পাশেই এক অন্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সেইসব লোকদেরকে অভিসম্পাত দিচ্ছে যারা সত্যিকার খোদা বাদ দিয়ে জেসাসকে মিথ্যে খোদা বানিয়েছে এবং নবি হযরত মোহাম্মদ (সা)-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

“তোমাদেরকে দিনের শেষটা দেখার জন্য হলেও বেঁচে থাকতে হবে!” লোকটি বলছে। লোকটির অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখটা দেখে হাল-এর খানিকক্ষণ আগের কথা মাথায় আসলো। একটা ছোট ছেলে লিচু বিক্রি করতে চাচ্ছিল ওদের কাছে। এই লোকটার চোখগুলো খোসা ছাড়ানো লিচুর মতোই সাদা। “স্রষ্টার সাথে বেইমানি করার দায়ে তোমাদের জন্য চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, নরকের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে তোমাদের।”

সেখানে অনেক মুসলমান অন্ধ লোকটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। না তারা অন্ধ লোকটির দিকে ফিরে তাকাচ্ছে, না তারা নিজেদের জীবনের কথা চিন্তা করে ভীত হচ্ছে।

“তার অবস্থা হয়েছে দেদা পাখির মতো,” অ্যাবোলি বলল। “সে এত বেশি চিৎকার করছে যে লোকজন একদম অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তারা এখন আর লোকটির চিৎকার-এ পাত্তা দিচ্ছে না।”

“এই দ্বীপটা সত্যিই অসাধারণ,” হাল এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল। কারও গায়ের রং কালো, কারোটা আবার সাদা। এমনকি বাদামি আর হলদে ভাব যুক্ত গায়ের রঙের মানুষও দেখা যায়। কারো চোখ আলমন্ড-এর মতো, কারোটা আবার কাকৃতি। নাক দেখতে কারওটা চেপ্টা, কারওটা বাঁকানো। চুলের রঙে এবং গড়নেও রয়েছে ভিন্নতা। কারও চুল উলের মতো, কারও সিল্কী, কারও চুলের রং কালো অথবা সোনালি। ইউরোপীয়ান, বান্টু এবং আরব উপমহাদেশে লোকদের রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে ইন্ডিয়া মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত এই দ্বীপটিতে।

“আইয়াসুর বাবার রাজত্বকালে আমার বাবা যখন ভেনিস-এর অ্যাম্বাসিতে ছিল যখন আমার বিভিন্ন জাতের মানুষ দেখার সুযোগ হয়েছে। তখন এদিক সেদিক বিভিন্ন ক্যানেল-এ ঘুরতে চলে যেতাম। কিন্তু সেখানে উপকূল বা দ্বীপগুলো এরকম ছিল না।” জুডিথ-একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে বলল, “কিন্তু ভেনিস ছিল ইউরোপ-এ আর জাঞ্জিবার হচ্ছে আফ্রিকায়। এটা উষ্ণ এবং বন্য একটা উপমহাদেশ।”

সে হাল-এর বাহু ধরে কাছে টেনে এনে বলল, “আমার সম্ভবত অস্ত্র নিয়ে আসা উচিত ছিল।” হাল মনে করার চেষ্টা করল যখন সে জুডিথকে হউবার্ক পরা অবস্থায় দেখেছিল তখন কত সুন্দরই না লেগেছিল। সুসজ্জিত কালো অ্যারাবিয়ান স্ট্যালিয়ন-এর উপরে চড়ে যাচ্ছিল। যখন হাল জুডিথকে এরকম যোদ্ধার বেশে দেখেছিল সে তাকে একজন পুরুষ বলেই মনে করেছিল। সে তাকে জেনারেল নাজেত নামেই চিনত। কিন্তু কখনও ভাবেনি যে এরকম বিখ্যাত যোদ্ধা একজন নারীও হতে পারে। আর এখন জুডিথের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি সম্পর্কে ভালভাবে জানার পর তার বেশ অবাকই লাগে যে প্রথম দেখায় তাকে কিভাবে সে পুরুষ ভেবেছিল! “তোমাকে আমার খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, ক্যাপ্টেন কার্টনি,” জুডিথ বলল। জুডিথের গরম নিঃশ্বাস হাল-এর কান ছুঁয়ে যাচ্ছে যেটা তাকে তাড়া দিতে লাগল জুডিথকে নরম বিছানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।

“কোনো ভয় নেই। মাই লাভ,” সে বলল। “আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি তোমাকে রক্ষা করব। আমার কাছে তুমি নিরাপদ।”

জুডিথ অল্প করে হেসে দিয়ে হাল-এর খুব কাছে এসে গালে ঠোঁট ছোঁয়াল, এরপর এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল কেউ তাদের দেখে ফেলেছে কি-না। হালও একটা হাসি দিল, এরপর সেও বিস্ময়াভিভূত হয়ে জাঞ্জিবার শহরটা দেখতে লাগল।

হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে তাদের ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাদের একটু সামনেই একটা জায়গায় দাস বিক্রেতার আশেপাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সেখানে পাতলা লম্বা অ্যামব্রয়ডারি করা গাউন এবং মাথায় স্কার্ফ পরা অ্যারাবিয়ানরা, দৃঢ়চেতা পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা, জাহাজের ক্যাপ্টেন, এজেন্ট এবং ক্রাফটম্যানরা সস্তায় শ্রমিক এবং কর্মচারী খুঁজতে এসেছে। সেখানে অনেক স্টলের দোকানীরাও তাদের দোকান ফেলে চলে এসেছে।

লোকটা একটা ছোট ছেলেকে লাথি মারছে যার চামড়ার নিচের বক্ষ পিঞ্জরের হাড়গুলো বের হয়ে আছে। কিন্তু ছেলেটা কাঁদতেও পারছে না। তার বদলে সে তার চিকন হাতগুলো দিয়ে খুব শক্তভাবে বিক্রেতার পা জড়িয়ে ধরে আছে। সে ছাড়াও আশেপাশে আরো তিনজন আফ্রিকান এবং একজন ইউরোপিয়ান দাস ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা অস্ত্র হাতে পাহারাদারেরা ওদেরকে বেঁধে রাখা দড়িগুলো হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

নারী ও পুরুষের সমবেত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা গণ্ডগোল সেখানে হয়েছে। দাস বিক্রেতাটা তার লম্বা পিস্তলের ব্যারেলটা দিয়ে দাস ছেলেটাকে আঘাত করছে। ছেলেটা বিক্রেতাটার পায়ের মাংসে কামড় বসিয়েছে, যে কারণে বিক্রেতটাও চিৎকার করছে এবং আরও জোরে প্রহার করছে।

“থাম। ছেড়ে দাও ওকে,” জুডিথ অ্যারাবিক ভাষায় চিৎকার করে উঠল। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দাস ছেলেটাকে ছাড়াতে চাইল সে। হাল এবং অ্যাবোলি তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

“এতে তোমার সমম্যাটা কী হচ্ছে?” দাস বিক্রেতাটা জানতে চাইল।

“চলে আস,” হাল জুডিথকে টান দিয়ে রাগত স্বরে বলল। কিন্তু জুডিথ নড়ল না।

“আমার সম্যাটা হচ্ছে যে আমি চাই না কেনার আগে আমার দাসের কোনো ক্ষতি হোক।”

“তুমি এই ছোঁকড়াটাকে কিনতে চাও?” দাস বিক্রেতা অবাক হয়ে জানতে চায়।

জুডিথ মাখা ঝাঁকাল, “কিন্তু আমি তোমাকে এক সিলভার রুপির একটুও বেশি দিব না।”

দাস বালকটি অবাক হয়ে জুডিথকে দেখতে লাগল। হালও তাকিয়ে তাকিয়ে জুডিথকে দেখছে। ছেলেটার বয়স বার বছরের বেশি হবে না। নোংরা, ময়লার নিচে ছেলেটার গায়ের রঙ একেবারে জুডিথের মতো।

“ঠিক আছে”, দাস বিক্রেতাটা খুব দ্রুত বলে উঠল। “এই দাসটি সুন্দরী মহিলাটির কাছে বিক্রিত হল। সে নিলামের কাঠের টেবিলে আঘাত করে বিক্রি নিশ্চিত করল।

হাল আর না পেরে হাল ছেড়ে দিল এবং তার পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে দাস বিক্রেতার দিকে নিক্ষেপ করল। এরপর বদমাসটা তার পা দিয়ে দাস ছেলেটাকে সজোরে একটা ধাক্কা মারল। ছেলেটা দ্ৰতু খরগোশের মতো লাফ দিয়ে জুডিথের বাড়ানো বাহুকে এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না।

অ্যাবোলি তার লম্বা কালো বাহু দিয়ে ছেলেটাকে ধরে ফেলল। অ্যাবোলি যখন ছেলেটাকে উপরে উঠাল তখন বাতাসে হাত-পা ছুড়ছিল সে।

“তুমি পালিয়ে কোথায় যাবে ভেবেছ?” সে দয়ামায়াহীনভাবে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল। “তুমি এখন এই ভদ্রমহিলার সম্পত্তি, মসি।”

“মসি?” হাল জিজ্ঞেস করল।

“মসি মানে হচ্ছে চড়ুই পাখি। আমার মনে হয় এটাই ওর জন্য উপযুক্ত নাম।” জুডিথ হেসে ফেলল। “যাই হোক, আমার মনে হয় না তুমি খুব বেশিদূর যেতে পারবে, মসি।” ছেলেটা হাত-পা ছোঁড়া ছেড়ে দিয়ে অ্যাবোলির মুষ্ঠির মধ্যে শরীরের ভার ছেড়ে দিল।

“আমি দাস হিসেবে খুব একটা ভাল না। তুমি দেখে নিও।” মসি জুডিথ এর দিকে তাকিয়ে বলল।

হাল-এর মনে হচ্ছিল, এবার কিছু একটা বলা উচিত। সে হাঁটুগেড়ে বসে ছেলেটার চোখের উচ্চতায় নিজেকে নামিয়ে আনল, এরপর বলতে শুরু করল, “আমার জাহাজে কোনো দাস নেই, ঠিক আছে? আর তুমি সেখানেই যাচ্ছ। এরপরেও তুমি যদি নিজেকে দাস ভাবো তাহলে আমি তোমাকে সাগরে নিক্ষেপ করব। ওখানকার হাঙ্গরগুলো সারাবছর ধরে তোমার মতো খাবারের জন্যই অপেক্ষা করে। তুমি কী তাই চাও, মসি?”

মসি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল কিন্তু তার ছোট চোখ দুটো জলে ভরে উঠল-পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তার মনে এরকম কিছুই কাজ করছে না। হাল এবার জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল-ব্যাপারটাতে এবার জুডিথ-এর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

“মসি, আমি তোমাকে প্রতিমাসে এক পেনী করে দেব যদি তুমি আমার বডিগার্ড হিসেবে কাজ কর। এবং আমি কথা দিচ্ছি যে তোমাকে কখনোই হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করা হবে না।” এবার ছেলেটি খুব আগ্রহ নিয়ে জুডিথ এর দিকে তাকাল।

হাল এবার একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না। সে বলল, “আমি তোমাকে দুই পেনী করে দিব যদি তুমি আমার বডিগার্ড হিসেবে কাজ

মসি মাথা নিচু করে হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “না।”

“কেন না?” হাল জানতে চাইল।

“কারণ সে আমার ভাষা তোমার চেয়েও ভাল জানে। এছাড়াও…” সে। থেমে গিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

“এছাড়াও কী?” হাল আবারও জানতে চাইল।

মসি মাথা নিচু করে তার খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “তার গন্ধ অনেক ভাল। আর…সে দেখতে তোমার চেয়েও অনেক সুন্দর।”

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জুডিথ ছেলেটার গল্প শুনতে চাইল। তার বাবা ছিল একজন জেলে। সোমালিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বারাবা গ্রামে তার জন্ম। অ্যারাবিয়ান দাস বিক্রেতারা একবার তাদের গ্রামে আক্রমণ করে তাকে নিয়ে যায় এবং এরপর জাঞ্জিবার-এ পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

“আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারব যাতে তোমরা হারিয়ে না যাও,” ছেলেটা খুব গর্বের সাথে বলল।

“সেটা তো খুবই ভাল কথা,” হাল উত্তর দিল।

“তুমি না। আমি মেমকে বলেছি,” মসি বলল। মেম হচ্ছে মেমসাহেব-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা হচ্ছে অনেক সম্মানের একটা সম্বোধন যেটা সে জুডিথকে উপহার স্বরূপ দিয়েছে। তারা সেই বৃদ্ধ দোকানীটার ঘরে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ছেলেটা এটা সেটা কথা বলেই যেতে লাগল।

যে নাবিকটাকে রাষ্ট্রদূত গ্রে-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য পাঠানো হয়েছিল সে ওখানে অপেক্ষা করছিল, উইলিয়াম পেটও তার সঙ্গে রয়েছে।

“আমাদের ভাগ্য বেশ ভাল বলতে হবে ক্যাপ্টেন,” পেট হালকে দেখে বলল। “রাষ্ট্রদূত আমাদের দুজনের সাথে সাক্ষাতের সম্মতি দিয়েছেন। তিনি আজ মধ্যাহ্ন ভোজনে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।”

“আজকেই?” এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া পেয়ে হাল খুব অবাক হলো। “তাহলে আমাদের আর বাইরে না যাওয়াই ভাল। অ্যাবোলি তুমি যদি জেনারেল জুডিথ এবং তার নতুন ছেলেটার দেখাশোনা করতে পার তবে আমি পেট-এর সাথে কনসাল গ্রে-এর সাথে দেখা করতে যেতে পারি। তাহলে আমাদের হয়ত আর থাকার জায়গার প্রয়োজনই পড়বে না। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই হয়তো আমরা ডেফটে ফিরে যেতে পারব যাতে খুব ভোরে বাট নিয়ে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারি।”

*

যখন থেকে গ্রে জানতে পেরেছে যে কার্টনি এই জাঞ্জিবার শহরেই আছে তখন থেকেই অস্বাভাবিক দ্রুত গতির সাথে সে নিজের কি কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। যে মাস থেকে তার দুর্ভাগ্য ও দারিদ্রতা শুরু হয়েছিল সে মাস থেকেই তার গৃহস্থালীর লোকজন কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখনো তার একটা রাঁধুনী আছে। তার দেয়ালে টাঙানো বেশ কিছু পেন্টিং আর কিছু পারসিয়ান কম্বল বন্ধক রাখার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সে তার পরিচিত একজন দালালের কাছে গেল, যাকে অনুরোধের পাশাপাশি এই কথাটাও বলে দিতে ভুলল না : “আমার ভাগ্য খুব শীঘ্রই বদলে যাবে স্যার, এই কথাটা মনে রাখবেন।”

তার হাতে যে ক্যাশ আছে তা দিয়ে অন্তত কয়েকজন স্টাফকে-যাদেরকে সে বাদ দিয়েছিল-ধার করে নিয়ে আসতে পারবে। তখন অন্তত বাড়িটাতে ধনী-ধনী ভাব ফুটিয়ে ভোলা যাবে। তার রাধুনীটাকে সে বাজারে পাঠিয়েছে যেন সে ভাল ভাল সব জিনিসপত্র কিনে আনে এবং শহরের ভাল দোকান আর রাধুনীদের মতো খাবার রান্না করতে পারে। হাল কার্টনি এবং তার সঙ্গী মি. পেট যখন পৌঁছাল তখন সেরা খাবারটাই পরিবেশন করল গ্রে-গরুর মাংস ও পটেটো দিয়ে রান্না করা এক ধরনের পিলাফ, পেয়াস, নারিকেলের দুধ, খোলা আগুনে পোড়ানো শার্ক-এর গ্রিল। পিজা ওয়া নাজি নামে একধরনের খাবার আছে যেটা বানানো হয় অক্টোপাস-এর মাংস সেদ্ধ করে। সেই সাথে দেয়া হয় নারিকেলের দুধ, কারি, সিন্নামন, কার্ডামম, গার্লিক, লেবুর রস।

গ্রে খাবারগুলো সব নামিয়ে রাখছিল। যদিও হাল খেয়াল করে দেখল যে পেট খুব একটা খাবার খাচ্ছে না। খাবার টেবিলে এরকম আচরণ তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবই প্রকাশ পাচ্ছে। গ্রে-কে অবশ্য বেশ আত্মবিশ্বাসীই মনে হচ্ছিল। সে যখন হালকে আশ্বস্ত করে যে উত্তরে অনধিকার প্রবেশের ব্যাপারে তার কোনো বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নেই, তখন হাল নিশ্চিন্ত মনেই সেই আশ্বস্ততা গ্রহণ করে।

হাল চলে যাওয়ার পর গ্রে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে যে সে উপকূলের কাছেই একটা ওষুধের দোকানে থাকার জায়গা বেছে নিয়েছে। কিন্তু জায়গাটা কোথায় সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু জানতে পারেনি। গ্রে আরও বুঝতে পারে যে গোল্ডেন বাউ নিয়ে হাল পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করেনি। এবং আগামীকাল জোয়ারের সময় সেটা ছাড়বে। কার্টনি চলে যাওয়ার আগে গ্রে এবং তার নিজের ব্যাপারে ভাল কিছুর আশাবাদ ব্যক্ত করে। সেই সাথে পেটকে বিদায় জানায়। সে পেটকে গ্রে-এর সাথে রেখে যায়, সেই সাথে রেখে যায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে লেখা কিছু চিঠিও।

ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর যখন বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যায় তখন গ্রে চিঠিগুলো একজন চাকরের হাতে দিয়ে তার টেবিলে রাখতে বলে। কার্টনির ঔদ্ধত্য ও সাহস দেখে সে মনে মনে বেশ ক্ষুদ্ধ হচ্ছিল। কোনো রকম অনুমতি পত্র ছাড়া সে জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় পা দেয়ার সাহস পায় কী করে।

এরপর গ্রে পেট-এর দিকে মনোযোগ দেয়। এই রসকষহীন বিরক্তিকর লোকটাকে নিয়ে সে কি করে। গ্রের মনে হচ্ছে হাল অপমানের মাত্রাটা আরও একটু বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই পেটকে তার কাছে দিয়ে গিয়েছে।

এখনো তাকে আরও একটু খেলা খেলতে হবে। স্টেজ-এর পর্দা এখনো নামিয়ে ফেলা হয়নি। তাই সে তার মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে সম্মানিত অতিথির দিকে তাকাল। হাতে তালি বাজিয়ে একজন চাকরকে ডেকে কফি দিতে বলল। এরপর সে পেটকে বলল, “জাঞ্জিবার-এর প্রতিদিনকার দুশ্চিন্তা থেকে সরে গিয়ে পুনরায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ শুরু করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। এখন বলুন স্যার আমি আপনার কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি? ক্যাপ্টেন কার্টনি বলেছে আমি যেন আপনার গল্প মনযোগ দিয়ে শুনি।

পেট কফি না নিয়ে গ্রে-র প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করল। “এটা সত্য যে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর যাত্রী হিসেবে যখন আমি যাত্রা করেছিলাম, তখনো আমি ভাবতে পারিনি যে আমি এখানে এসে পৌঁছাবো।”

“ও, হা, আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড। ওটাতে বেশ কয়েকবার জাঞ্জিবার-এ নোঙর ফেলেছে, গ্রে বলল। এরপর টেবিলের দিকে তাকিয়ে কফির পাশে রাখা প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিল। সেটাতে মিষ্টি জাতীয় এক ধরনের গোলাপি রঙের বল রাখা আছে। সে একটা বল চামচ দিয়ে মুখে তুলে নিল।

“আচ্ছা, আমি, জাহাজটার ক্যাপ্টেন-এর নাম মনে করার চেষ্টা করি।” মুখভর্তি গোলাপি রঙের বলটা নিয়েই সে বলল, “গিডিংস…গ্যাডিংস,..আমার যতদূর মনে আছে এরকমই কিছু একটা।”

“গোডিংস।”

“ওহ, হ্যাঁ। অত্যন্ত আমুদে লোক। নিজের আনন্দ ফুর্তি নিয়েই সবসময় ব্যস্ত থাকে। অনেকটা ইয়ং কার্টনির মতো। সে এখন কেমন আছে?”

“মারা গিয়েছে। তার জাহাজসহ আগুনে পুড়ে গিয়েছে। আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড বোম্বে (মুম্বাই) থেকে ছেড়ে আসার এক সপ্তাহ পর আগুনে পুড়ে যায়। সে জাহাজ ভর্তি সল্টপিটার নিয়ে রওনা হয়েছিল। এ কারণে আগুন লাগার পর কেউ রক্ষা পায়নি, শুধু আমি কোনোভাবে পালিয়ে বেঁচেছি।”

“আহারে বেচারা লোকগুলো কেউ বাঁচল না?” “আপনার বেশ সৌভাগ্যই বলতে হয়।”

“আমি জলন্ত জাহাজ থেকে এই বিশ্বাসে লাফ দেই যে আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে রক্ষা করবেন।”

“আল্লাহ তাআলা সর্বশক্তিমান এবং পরম করুণাময়,” গ্রে বিড়বিড় করে বলল।

“আমি এই সৃষ্টিকর্তার কথা বলিনি।” পেট খুব ঠাণ্ডা এবং ধীরস্থিরভাবে বলল। গ্রে তার অতিথির আসল প্রকৃতি সম্পর্কে একটু সচেতন হয়ে উঠল।

“যেভাবেই হোক আমি বেঁচে যাই,” পেট বলা শুরু করল। “ডাচদের একটা জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে, যদিও এই মহানুভবতার পেছনে একটা নিষ্ঠুরতম উদ্দেশ্য ছিল। আমাকে একটা নোংরা বন্দিখানায় আটকে রাখা হয়।”

“কী কারণে তারা এমনটা করেছিল?”

“জাহাজের ক্যাপ্টেন বলেছিল যে আমার নিজের নিরাপত্তার জন্যই তাকে এটা করতে হয়েছিল। জাহাজে তখন চরম খাদ্য সংকট ছিল এবং সবাই ক্ষুধার্ত ছিল। তার ভয় ছিল যে আগন্তুক হিসেবে যেহেতু জাহাজের লোকদের সাথে আমার কোনো বন্ধন নেই, তাই তারা হয়তো খিদের জ্বালায় আমাকে মেরে আমার মাংস রান্না করে খেয়ে ফেলতে পারে।”

এখন দেখা যাচ্ছে যেভাবেই হোক আপনি এরকম কিছুর শিকার হন নি।” গ্রে কিছুটা হাস্যরসাত্মকভাবে কথাটা বলল। কিন্তু পেট সেটা বুঝতে পারল না।

“আমি ক্যাপ্টেন কার্টনির কারণে এই কারাবাস থেকে মুক্তি পাই। সে-ই আমাকে আমার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেয়।”

“দেখা যাচ্ছে আপনি অক্ষত অবস্থায়ই কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আপনার মুক্তিটা আপনার জন্য একটা পুরস্কারই বলা যায় মি. পেট, গ্রে আরো একটু যোগ করল।

“আমি বেশ নিরাপদেই আছি। এখন যেভাবেই হোক আমার ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ টাকা-পয়সা দরকার তা আমার হাতে নেই। এমনকি আমি যে জামাকাপড় পরে আছি এগুলো ছাড়া আমার হাতে কোনো জামাকাপড়ও নেই। কিন্তু একটা কাজ করে দেয়ার সুবাধে ইংল্যান্ডে পৌঁছেই এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে পাঁচ’শ গিনী পাব।”

“পাঁচ’শ গিনী?” আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনি এতগুলো টাকা কীভাবে পাবেন। কী এমন কাজ করেছেন যার বিনিময়ে আপনি এতগুলো টাকা পাচ্ছেন?

পেট অভিব্যক্তিহীন চোখে গ্রে-র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি গোডিংস-কে হত্যা করেছি।”

গ্রে ক্ষিপ্ত হয়ে এক লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। “গেট আউট।” সে সরাসরি দরজার দিকে ইশারা করে বলল, “আমার মনে হয় কার্টনি ইচ্ছে করেই আপনার এইসব ফালতু গল্পসহ আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার সাথে এইসব ফালতু গল্প বলে লাভ নেই। আমি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার আগে আপনি বের হয়ে যান।”

পেট একটুও নড়ল না। এমনকি তার অভিব্যক্তিতেও কোনো পরিবর্তন আসল না। বরং গ্রে কথা শেষ করার আগ পর্যন্ত সে নীরবে অপেক্ষা করল। এরপর বলল, “আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি আমি আপনাকে যে কথাগুলো বলেছি তার একচুলও মিথ্যে নয়। আমি এগুলোর প্রমাণ দেখাতে পারি। কিন্তু সেজন্য আপনাকেও আমার খুন করতে হবে। এই ছোট্ট চামচটা যেটা আপনি একটু আগে ব্যবহার করেছেন, কিংবা এই ছোট্ট ট্রেটা যেটার ওপর মিষ্টির প্লেটগুলো রাখা আছে অথবা শুধু আমার হাত দিয়ে কাজটা আমি সহজেই করতে পারি।”

গ্রে-র মনে হল তার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বের হয়ে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। পেট-এর কথাবার্তার মধ্যেই ভয়ের কিছু একটা ছিল। সে কাউকে কত সহজে হত্যা করতে পারে শুধু সেই কথাটাই জানিয়েছে। এতে খুব স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে কাউকে বশে আনতে খুব বেশি পরিশ্রম করতে সে নারাজ।

“আমি তোমাকে প্রিন্স জাহান-এর কাছে ধরিয়ে দিতে পারি। তিনি তোমাকে শাস্তি দেবেন,” গ্রে খুব তর্জন গর্জন করে বলার চেষ্টা করলেও সে জানে তার কথাগুলোতে কতটা ভয় মিশ্রিত ছিল।

“না, মি. গ্রে, তুমি তা পার না,” পেট বলল। “আমি জাঞ্জিবার-এ কোনোরকম অন্যায় করি নি। এমনকি সে কিংবা তার ভাই গ্রেট মোগল দ্বারা শাসিত কোনো ভূমিতেও আমি কোনো অন্যায় করিনি। যদি আপনি বলেন যে এই কথাগুলো আমি নিজমুখে স্বীকার করেছি তাহলে আমি বলব যে, আপনি মিথ্যা বলছেন। ঠিক আপনার মতো করেই বলব যে এগুলো গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।”

“তাই আসুন শূন্য হাতে এসব হুমকি দেয়া আমরা বাদ দেই। আমি বিশ্বাস করি যে আমি বাড়ি ফেরার জন্য যথেষ্ট টাকা-পয়সা জোগাড় করতে পারব এবং আপনি বা আপনার লোকেরা সেই ফান্ড-এর ব্যবস্থা করে দিবেন। এখন আমাকে বলুন আপনি হাল কার্টনির ব্যাপারে কী ভেবেছেন?”

ব্যাপারটা খুব একটা কঠিন হবে না। গ্রে-কে ডিভান-এ হেলান দিয়ে বসতে দেখে পেট চিন্তা করল। সে কিছু বলল না কারণ সে জানে তার যা প্রয়োজন সব তথ্যই রাষ্ট্রদূত-এর কাছে আছে। এখন শুধু এটাই দেখার বিষয় যে রাষ্ট্রদূত গ্রে কিভাবে এগোয়।

আরেকবার গ্রে তুর্কিস মিষ্টিবলগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। এখনও পেট চুপচাপ আছে। আর গ্রে মিষ্টি বলটা খেয়ে ঠোঁটে লেগে থাকা মিষ্টিটুকু জিব দিয়ে চেটে খাওয়ার পর বলল, “যেহেতু আপনি আপনার গল্প বলেছেন। এবার আমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলতে দিন…?”

পেট হাত নাড়িয়ে ইশারা করল যার অর্থ। “আচ্ছা, শুরু করুন।”

“আমি একটা নম্র ও ভদ্র পরিবার থেকে এসেছি। সে জন্য আমি গর্ববোধ করি। আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা ইয়র্কশায়ার-এর হেবডেন ব্রিজ-এ। আমি জানি আমাকে দেখতে হয়ত সেরকমটা মনে হয় না। কিন্তু ইয়র্কশায়ার ম্যান হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। আমার বাবা-মা ভ্রমণকারীদের জন্য একটা সরাই খানা চালাত। মাঝে মাঝে আমাদের সরাইখানায় দক্ষিণ থেকে এমনকি লন্ডন থেকে ভ্রমণকারীরা আসত এবং তখন আমার মনে হত আমাকে আমার ভাগ্য অন্বেষণে বের হতে হবে। তাই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। তখন আমার পকেটে মাত্র কয়েক পেনী ছিল। তার দুই বছর পর আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কেরানি হিসেবে যোগদান করি। আমার মা-বাবার কাছে এটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছে এটা ছিল শুধু শুরু।”

“আপনি দেখেন মি. পেট। সব শ্রেণির মানুষের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার এক ধরনের ক্ষমতা আমার আছে। আমি ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করি। এমনকি সুলতান এবং মহারাজার সাথেও আমার বন্ধুত্ব আছে। আমি লর্ড আর লেডিসদের বিনোদনের ব্যবস্থা করি। আমি এমন সব পর্তুগীজদের সাথে আহার করি যাদের সম্পদ সম্পর্কে আপনি ধারণাই করতে পারবেন না। একটা অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের মহারাজার সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলাম আমি।”

আমার মনে হয় না অনুষ্ঠানটা মহারাজার কাছে এতটা স্মরণীয় ছিল। পেট মনে মনে ভাবল। গ্রে আবার বলতে শুরু করল, “জাঞ্জিবার-এর মতো শহরে কেউ শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচতে পারে না। ছিনতাই, পকেট মার, দাস ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো অন্যায়ের সাথে তাকে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হতেই হবে। বিশ্বের যেকোনো মানুষকে হয়ত দেখা যাবে কোনো গলিতে দাঁড়িয়ে এমন কারও সাথে ব্যবসা করছে যে কি-না কিছুক্ষণ আগে তার মেয়েকে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে।”

“এই স্বাতন্ত্র্য সবসময় দেখা যায় না,” পেট বলল।

“সেটা হয়ত ঠিক,” গ্রে ব্যাখ্যা করে বুঝাল। “আমার মতে একজন মানুষ সেরকম ব্যবহারই করে যেরকমটা পরিস্থিতি তাকে করতে বাধ্য করে। আমি হয়ত আমার আজকের অবস্থানে পৌঁছতে পারতাম না যদি ভীরু, কাপুরুষের জীবন বেছে নিতাম।”

“কিন্তু স্যার একটা কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না। কিছু মনে করবেন না যদি আমি বলি যে আপনার অবস্থা একসময় যতটা ঈর্ষণীয় ছিল এখন ততটা নেই। আমি এটাও না বলে পারছি না যে, আপনার দেয়ালটা দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে আরও কিছু ছবি ছিল যেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অথবা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যদিও আপনার বাড়ির সামনের জায়গাটুকু অনেক মনোরম এবং ঝরনাটার চারপাশে অনেক ফুলের গাছ লাগানো আছে। কিন্তু আমি এটাও উল্লেখ না করে পারছি না যে, আপনার চাকর-বাকরেরা এগুলোর সঠিক যত্ন নেয় না। যদিও তাদেরকে দেখে মনে হয় তারা তাদের মনিবের প্রতি যথেষ্ট বাধ্যগত কিন্তু তাদের কাজের মাধ্যমে সেটা প্রমাণিত হয় না।”

“পর্যবেক্ষক হিসেবে আপনার প্রশংসা না করে পারছি না, মি. পেট,” বেশ তীক্ষ্ণভাবেই গ্রে কথাটা বলল।

“আমার ব্যবসার স্বার্থেই আমাকে এটা করতে হয়।”

“তাহলে আপনাকে একজন দক্ষ ব্যবসায়ীই বলতে হয়। আমিও জানি অন্যায় ও অবিচার এর মধ্য দিয়ে গেলে কতটা দুর্ভোগ-এর স্বীকার হতে হয়। আমি স্যার হেনরি কার্টনির কথা বিশ্বাস করেছিলাম। উনি যে ভদ্রলোকের মুখোশ পরে থাকেন, ওটা আমি আগে বুঝতে পারিনি।”

“আমি জানতে পেরেছি যে, সে কৌশলে আপনার কাছ থেকে সব তথ্য আদায় করে নিয়েছিল।”

“সেটা সত্য। সে এখানে আমার বন্ধু হতে এসেছিল। কিন্তু আসলে সে তার জাহাজকে একজন সত্যিকার সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিয়ে এসেছিল। সেই সাথে যুদ্ধ করেছে সেই লোকটার বিরুদ্ধে, যাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিল সে।”

পেট অনেক কষ্ট করে লোকটির এই ব্লাসফ্যামী সহ্য করে যাচ্ছে। এই লোকটিকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে তার মাথার ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কারণ তাকে তার কাজ শেষ করতে হবে। আর সেজন্য মি, গ্রে’র সহযোগিতার প্রয়োজন পড়বে। তাই গ্রে’র আচরণ তার মনে যতই বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলুক তাকে চুপচাপ থাকতে হবে।

“আমি ধারণা করতে পারছি যে কার্টনির কৃতকর্মের জন্যে আপনাকে অন্যায়ভাবে দোষরোপ করা হয়েছে।”

“একদম ঠিক। আমার জন্য সব দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে পেট। একজন সম্মানীত ব্যক্তি হিসেবে যে দরজাগুলো একসময় আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য সদা প্রস্তুত থাকত, সব। আমার ভাগ্য একসময় যতটা সুপ্রসন্ন ছিল ঠিক ততটাই দুর্ভোগ চলছে এখন। আমার জীবনে এমন ভাটা এর আগে কখনো পড়েনি। কিন্তু কার্টনি আমার সঙ্গে এইরকম মিথ্যে বলার পরেও কীভাবে নির্লজ্জের মতো ধৃষ্টতাভরে এখানে নিজের চেহারা দেখাতে আসে? যদি সে এখানে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে আসত এবং পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপন করতে আসত আমি হয়ত দ্বিতীয় বারের মতো একটা সুযোগ দিতাম। কিন্তু ক্ষুদ্র অপরাধবোধ বা অনুশোচনাও তার মধ্যে দেখিনি আমি।”

“তার তারুণ্যই হয়ত এসব দমিয়ে রেখেছে। কার্টনি হয়ত এখনো তার ভুলের গভীরতা বুঝতে পারছে না। সে এমনভাবে চলছে যে দেখে মনে হচ্ছে, সে কোনো মজার খেলা খেলছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত দেখতে পারছি যে সে নিজের গলায় নিজেই ফাঁস পরতে যাচ্ছে।”

“এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, আপনি নিজ হাতে তার ফাঁসি দিতে চাচ্ছেন?”

“বেঁচে থাকার জন্য একজন লোককে কত কী করতে হয়, সেটা আপনি আমার থেকেও ভাল জানেন, মি. গ্রে।”

“অবশ্যই জানি। কিন্তু জাঞ্জিবার-এর সেই সব মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও এই কাজ করতে হবে যারা তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা খুবই খুশি হবে যদি তারা কার্টনির হাত থেকে মুক্তি পায়। সেই সাথে যে আমাকে এই কাজে সাহায্য করবে তার প্রতিও তারা কৃতজ্ঞ থাকবে।”

“আমি আপনার সহযোগী হতে পারলে খুশি হব। আমাদের আলোচনায় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আসা উচিত। জাঞ্জিবার-এ কার্টনি কিন্তু একা আসেনি। তার সাথে তার স্ত্রীও রয়েছে যে কি-না তার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে।”

গ্রে’র চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে বিস্ময়াবিভূত হয়ে খাবারের টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। “সে এখন এখানে আছে? যে গুজব শোনা গিয়েছিল সেটা কী তাহলে সত্যি? হাল কার্টনি জেনারেল নাজেতকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। সেই বিখ্যাত, শক্তিশালী ওমানী যোদ্ধা। যে কি-না জেনারেল এল গ্রেং-কে পরাজিত করে ছোট্ট আইয়াসুকে সিংহাসনে বসিয়েছে?” সে বাতাসে আঙুল দিয়ে তুরি মেরে বলল, “অথবা আমার বলা উচিত ক্রিশ্চিয়ান মহারাজা, রাজার রাজা, গালা এবং অ্যামহারার শাসন কর্তা, খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে আত্মসমর্পণকারী ব্লা ব্লা ব্লা…কার্টনি তাহলে ইথিওপিয়া থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য এই কালো মুক্তোকে বেছে নিয়েছে?”

“সে আসলেই জেনারেল জুডিথ নাজেত। এবং আমি জানি তাকে কোথায় পাওয়া যাবে। এখন আমাদের আলোচনায় আসতে হবে যে আমাদের কিভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমাকে অবশ্যই একটা পার্স জোগাড় করতে হবে এবং সেই সাথে লাগবে আরও কিছু জিনিস-আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর সাথে-সাথে আমার টুলবক্সও তলিয়ে গিয়েছে। আমি আপনাকে আরেকটা পরামর্শ দেই। যদি কার্টনি এবং নাজেতকে কোনোভাবে আলাদা করা যায় তাহলে আমাদের কার্য সম্পাদনে সুবিধা হবে। এক্ষেত্রে একটু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আর সে ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ আশা করব।”

গ্রে হেসে বলল, “ওহ আমি একটা জিনিস জানি যেটা আমাদের দুই বিশ্বাসঘাতক লাভবার্ডকে আলাদা করতে পারে। এটা এমন একটা জিনিস যেটার প্রতি ওরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এবং সেটার জন্যই ওরা যুদ্ধ করেছে।”

“আপনি কী সত্যিই আমার সঙ্গে ভাঙ খাবেন না? এটা স্রেফ ঠাণ্ডা শরবত যেটা ইন্ডিয়ানরা হরহামেশাই খেয়ে থাকে। খেতে অনেকটা মিষ্টি এবং সাথে একটু ঝাঁঝালো স্বাদও রয়েছে। এক ধরনের পাতার মিশ্রণে এটা তৈরি করা হয়। মনকে হালকা ও ফুরফুরে রাখতে সহায়তা করে। আমাদের এখন ঠাণ্ডা মেজাজে কাজ করাটা খুব জরুরি।”

পেট গ্রে-র আমন্ত্রণ অস্বীকার করল। কিন্তু কনসাল এক জগ ঠাণ্ডা আনতে আদেশ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিক্রিয়াও তেমনি হয় যেমনটা সে অনুমান করেছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা তাদের কাজের একটা পরিকল্পনা করতে সমর্থ হয়। এরজন্য কী কী জিনিসপত্র লাগবে সেটারও একটা তালিকা তৈরি করে ফেলে। জাঞ্জিবার-এর অবস্থান মেরুর খুব কাছাকাছি হওয়ায় সূর্য সবসময় সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে অস্ত যায়। পেট যখন আলোচনা শেষ করে বিল্ডিং থেকে বের হয় তখন সূর্যের কড়া রোদ-এ ভাটা পড়ে কোমল আলো ছড়িয়ে পড়েছে।

গ্রে-ও আলোচনা শেষ করে সতেজ মনে ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে প্রিন্স জাহান-এর প্রাসাদের দিকে যাত্রা শুরু করে। যখন সে গার্ডদের কাছে ব্যাখ্যা করে যে সে ক্যাপ্টেন কার্টনি এবং জেনারেল নাজেত-এর খবর নিয়ে এসেছে তখন তাকে বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েই ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অন্যদিনের চেয়ে বেশ দ্রুতই তার জন্য দ্বার উন্মোক্ত হয়ে যায়। প্রথমে জাহান তাকে একা স্বাগত জানায়। এরপর তার সামনে যে মূর্তিটি এসে দাঁড়ায় গ্রে প্রথমে তাকে মানুষ বলে মনে করেনি। সে মূতির্টি হচ্ছে অ্যাঙ্গাস কোকরান-এর পুড়ে যাওয়া শরীর। এরপর একজন বার্তাবাহককে এক থলে সোনার কয়েনসহ একটা নির্দিষ্ট কফিশপ-এ পাঠানো হয় প্রিন্স-এর পক্ষ থেকে। দোকানীকে জিজ্ঞেস করা হয় যে তাকে দিয়ে যদি কোনো কাজ করানো হয় তবে তাকে কী এর চেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে কি-না? দোকানী তাকে এতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দেখে বিস্মিত হয়! সে জানায় যে যেকোনো কাজ করে দিতে সে প্রস্তুত আছে। এর পরের প্রস্তুতিটুকু প্রাসাদের ভেতরেই নেয়া হয়।

যখন জাহান এবং বুজার্ড তাদের পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে এলো তখন গ্রে উঠে দাঁড়িয়ে বাকি দুজনকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। যাবার আগে সে মাননীয় প্রিন্সকে একটা অনুরোধ করতে ভুলল না। “মহামান্য প্রিন্স, আমি নিশ্চিত যে আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই আপনার পরিকল্পনামাফিক সব কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্টনির লোকেরা যখন জানতে পারবে যে তাদের ক্যাপ্টেন-এর কিছু ঘটেছে তখন তারা উত্তর খোঁজার জন্য আমার কাছে আসবে। তখন তারা আমাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে না। তাই আমি আপনার কাছে অনুরোধ করব যাতে আপনি অন্তত আপনার এক ডজন লোককে গার্ড হিসেবে আমার নিরাপত্তার জন্য নিয়োগ করেন।”

জাহান হেসে বলল, “তো, কনসাল, আপনি এখন আপনার নিজের দেশের লোকের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার কাছে নিরাপত্তা চাইছেন।”

“মহারাজা, আমি ব্যাপারটা নিয়ে ওভাবে চিন্তা করছি না। তবে আমার মনে হয় এতে আপনার একটু গুরুত্ব দেয়া উচিত।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি গার্ড পাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় ছয় জনই যথেষ্ট।”।

“আপনি কী ছয়কে কোনোভাবে দশ-এ উন্নীত করতে পারেন না মহারাজা?” গ্রে দরকষাকষি করতে লাগল।

“আট”, জাহান ইতি টেনে বলল। “এর বেশি একজনও নয়। তবে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার মনে হয় না কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে। কোনো গার্ডেরই হয়ত আপনার প্রয়োজন পড়বে না।”

“মহারাজা। আপনার অশেষ দয়ার কারণে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।”

এখন থেকে গ্রে জাহান-এর অফিসিয়াল সুরক্ষার আওতাভুক্ত হলো। সমাজে তার মর্যাদা এবং সম্মান অনেক উপরে উন্নীত হলো। গরমে একা একা বেশ খুশি মনে রাস্তা দিয়ে যেতে লাগল কনসাল গ্রে। অবশেষে সে হয়ত সুদিনের দেখা পেতে যাচ্ছে। তার অর্থনৈতিক অবস্থা দিনের শুরুতে যেমনটা ছিল সেটাও হয়ত বদলে যেতে শুরু করেছে।

সে বাড়ির ভেতর ঢুকতে না ঢুকতেই খাবার এবং পানীয় আনতে আদেশ করে। তাকে একটা লম্বা, ব্যস্ত রাত পার করতে হবে। এজন্য তাকে খেতে হবে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তির যোগান পাওয়ার জন্য। গ্রে একজন সচেতন মানুষ। রাতে হয়ত সবকিছু তার পরিকল্পনামত নাও ঘটতে পারে। তাই যেসব চাকর দিনের বেলায় তার বাড়িতে কাজ করে তাদেরকে সে রাতেও থাকতে বলে দিল। এরা সবাই তার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক। রাতের বেলায় গোল্ডেন বাউ-এর লোক যেন কোনো গণ্ডগোল বাধাতে না পারে সে কারণেই এই বাড়তি চেষ্টা।

*

হাল দোকানীর বাড়ির ছাদের ওপর খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে অ্যাবোলির সাথে কথা বলছিল। দুজনেই তাকিয়ে তাকিয়ে উপকূলবর্তী শহর দেখছিল। টর্চ আর লণ্ঠনের আলোতে জাহাজগুলো আলোকিত মনে হচ্ছিল। সেই আলোকরশ্মি পানির ঢেউয়ের ওপরও নাচানাচি করছিল। ডেট উপকূল থেকে যদিও বেশ দূরে নোঙর করা আছে কিন্তু এরপরেও একটা লম্বা নৌকো ঘাটে বাঁধা আছে। নৌকোয় সবসময় একজন লোক তৈরিই থাকে যেন যেকোনো জরুরি মুহূর্তে হালকে জাহাজে পৌঁছে দিতে পারে। হাল জুডিথকে সন্ধ্যায় জাহাজে পাঠানোর অনেক চেষ্টা করেছে। জুডিথ যখন জানতে চেয়েছে রাতের অন্ধকারেই তারা জাঞ্জিবার ত্যাগ করবে কি-না তখন হাল জানায় ভোর হওয়ার আগে তারা জাঞ্জিবার ত্যাগ করবে না।

“খুব ভাল হবে তাহলে,” জুডিথ বলে, “তাহলে আমি আরও একটা রাত উপকূলে কাটাতে পারব। সত্যিকারের বিছানায় আমার ঘুমটাও বেশ ভাল হবে, আর আরেকটা কাজও খুব ভালভাবেই করা যাবে…”

হাল ভেতরে গিয়ে দেখতে পায় জুডিথ ছোট ছোট কম্বল সেলাই করছে বাচ্চার জন্য। আর মসি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সেটা দেখছে। এমন সময়ে মি. পেট দেখা করতে আসল।

“গুড ইভিনিং মি. পেট,” হাল তাকিয়ে দেখে পরিচিত চেহারার চিকন চাকন লোকটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। “গ্রে কী আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়নি?”

“ঠিক তা নয় ক্যাপ্টেন,” হাল এবং অ্যাবোলি উভয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে পেট জবাব দেয়। বরং তিনি আমাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করতে একমত হয়েছে এবং অফিসিয়ালি কোম্পানির পক্ষ থেকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। এমনকি তিনি আমাকে কিছু অগ্রিমও দিয়েছেন যাতে আপনি আমাকে যে আতিথেয়তা দেখিয়েছেন আমি যেন তা কিছু প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে পারি। আপনি এবং অ্যাবোলি আমার সাথে ডিনার করবেন। যদি সেটাও সম্ভব না হয় তবে অন্তত এক কাপ চা বা পানীয় হলেও আহার করবেন।”

হাল উত্তর দেয়ার আগেই পেট সামনে ঝুঁকে আরও বিনয়ের সুরে বলতে শুরু করল, “যখন আমি রাষ্ট্রদূত-এর বাড়িতে ছিলাম তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর সেখানে পৌঁছায়। আমার মনে হয় সেই খবরটা আপনার শোনা উচিত। তবে আপনাকে অনুরোধ করব জেনারেল নাজেত-এর সামনে খরবটা না শুনতে।”

“এখন পর্যন্ত এমন কিছু নেই যেটা আমি জেনারেল নাজেকে বলি নি,” হাল উত্তর দেয়।

“এমনও হতে পারে যে এটা শোনার পর সে ইথিওপিয়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বে-এমনকি যদি আপনি তার সাথে না যান তবুও…”

হাল কঠোর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল, “এরকম কিছু ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি এসব হেয়ালিপনা বন্ধ করে সত্যি করে বলুন আসলে কী বলতে চান?”

পেট দীর্ঘশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক তাকিয়ে এরপর হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “দ্য গ্রেইল, ক্যাপ্টেন কার্টনি। আমি হলি গ্রেইল নিয়ে কথা করতে এসেছি। এরপরও কী আপনার মনে হয় না ব্যাপারটা নিয়ে গোপনে কথা বলা প্রয়োজন?”

হাল অদৃশ্য দৃষ্টি দিয়ে সুদূর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মন চলে গিয়েছে ইথিওপিয়ার অ্যাডেন-এর গালফ পাহাড় এবং রক পাহাড়ের বাইরে। অনেক রক্ত ঝরেছে সেখানে। অনেক মৃত্যু ঘটেছে শুধু গ্রেইল উদ্ধার করার জন্য। এটাই সেই পাত্র যেটার মধ্যে খ্রিস্টের ক্ষত থেকে ঝরে পড়া রক্ত জমা করা হত, খ্রিশ্চিয়ানদের জন্য যেটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ইথিওপিয়ার খ্রিশ্চিয়ান মহারাজার হয়ে জুডিথ এই হলি গ্রেইল রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছে। নউটনিয়ার নাইট হিসেবে হলও একই রকম শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইথিওপিয়া থেকে যখন এটা চুরি যায় তখন হাল এবং জুডিথ দুজনে মিলে এটা উদ্ধারে সহায়তা করে। পেট হয়ত ঠিকই বলেছে। এখন যদি আবার এটার কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে জুডিথ-এর সম্মান তাকে ইথিওপিয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য করবে।”

অ্যাবোলিও একই দিক বিবেচনা করে বলে, “আমাদের মি. পেট-এর সাথে যাওয়া উচিত। এমন অনেক সময় আসে যখন কোনো পুরুষের তার নারীর প্রতি মনোযোগ দেয়া দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আবার এমনও কিছু সময় আসে যখন নারীর স্বার্থেই কিছু-কিছু কথা তাকে না বলাটাই উচিত কাজ হিসেবে ধরা যায়। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে আমাদেরই আলোচনা করা উচিত।”

হাল হাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। “আচ্ছা ঠিক আছে মি. পেট। আমাদের আলোচনার পর আপনি আমাকে এবং অ্যাবোলিকে পথ দেখিয়ে এখানে ফিরিয়ে আনবেন, ঠিক আছে?” এরপর হাল বাড়ির ভেতর ফিরে যায় এবং জুডিথ-এর একটা হাত নিজের হাতের ওপর নিয়ে বলে, “মাই ডিয়ার, মি. পেট আমাকে এবং অ্যাবোলিকে নিমন্ত্রণ করার মাধ্যমে কিছুটা প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কথা দিচ্ছি, আমরা যতদ্রুত সম্ভব তোমার কাছে ফিরে আসব।”

জুডিথকে বেশ ভাল করেই জানে যে কোনো সম্মানিত নারীর এধরনের পুরুষালি আয়োজনে যাওয়া উচিত নয়। জুডিথ বলল, “খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” এবং এরপর পেটকে শুনিয়ে বলে, “ক্যাপ্টেন কার্টনিকে দ্রুত ছেড়ে দেবেন কিন্তু। কাল ভোরেই আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা। তাই যাত্রার আগে আমাদের অন্তত কিছুটা সময় একান্তে কাটানো দরকার।”

“আমি বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। আপনার কথার অন্যথা হবে না,” পেট উত্তর দিল। “তবে ম্যাডাম, ক্যাপ্টেন কার্টনি আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আমার যে উপকার করেছেন সেটুকুর কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ আমাকে দিন।”

হাল দেয়ালের কাছে গিয়ে হুক থেকে তলোয়ার লাগানো বেল্টটা খুলে নিয়ে কোমড়ে পরতে শুরু করল। হালকে অস্ত্র সাথে নিতে দেখে পেট বলল, “এসবের কোনো প্রয়োজন নেই ক্যাপ্টেন। আমার মনে হয় না আমরা মিষ্টি এবং পানীয় খেতে গিয়ে কোনোরকম বিপদের সম্মুখীন হব।”

“আমি রাতের বেলা একটা বিদেশি শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, স্যার। কে জানে কখন কী ঘটতে পারে?” হাল উত্তর দেয়।

পেট অদ্ভুত দৃষ্টিতে হাল-এর দিকে তাকায় এবং কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে। “আপনার যেমন ইচ্ছে, ক্যাপ্টেন। আমার সাথে আসুন।”

পেট হাল আর অ্যাবোলিকে সাথে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা বেশ কয়েকটা রাস্তার বাঁক ঘুরে একটা সরু রাস্তা দিয়ে এগুতে থাকে। অবশেষে তারা একটা কফি শপ-এ আসে যার ভেতর এবং বাইরে টেবিল পাতা আছে। কফিশপ-এর বাইরের একটা টেবিলে পেট তাদেরকে নিয়ে বসল। জাঞ্জিবার এর লোকেরা চারপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

পেট প্রথমে কথা বলতে শুরু করে, “কনসাল গ্রে আমাকে জানিয়েছেন যে এটা বেশ ভাল কফি শপ। বেশ ভাল খাবার-দাবার পাওয়া যায়। যে কেউ নির্ভয়ে এখানে খেতে পারে। এছাড়াও এটার দোকানীটা একটা দুটো ইংরেজি শব্দ বলতে পারে। যেটা আমার জন্য খুবই সহায়ক হবে।”

“চিন্তা করবেন না। যদিও আমি ওদের ভাষা তেমন জানি না। কিন্তু আমি মোটামুটি বুঝতে পারব,” হাল তাকে আশ্বস্ত করে। আর তখনই তার মনে পড়ে যে অ্যাবোলি খুব ভাল অ্যারাবিক বলতে পারে। কিন্তু সেই কথাটা সে চেপে গিয়ে অ্যাবোলির দিকে তাকায়-ওকে দেখে মনে হচ্ছে, সেও একই কথাই ভাবছে। হাল আবার বলল, “মি. গ্রে’র মতো একজন লোকের অনুগ্রহে আপনাকে পাঠিয়েছি বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

“আপনি যদি তার দাস ব্যবসার কথা বলে থাকেন তবে আমি বলব যে দাস ব্যবসার অর্থ হচ্ছে, সরাসরি খোদার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, যিনি আমাদেরকে তার নিজের আমেজে তৈরি করেছেন।”

হাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “দাস ব্যবসাকে ঘৃণা করলেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ওর সাথে যোগাযোগ রাখা ছাড়া আমাদের ইংরেজদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। কারণ এই জায়গার রাষ্ট্রদূত সে। কিন্তু এখন আমাকে বলুন হলি গ্রেইল সম্পর্কে সে কী খবর দিয়েছে?”

“আমি আপনাকে সব বলব,” পেট দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দেয়। কিন্তু প্রথমে আমাকে কিছু খাবার অর্ডার করার অনুমতি দিন। অ্যালকোহল যদিও ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ, কিন্তু মি. গ্রে আমাকে বলে দিয়েছেন যে এখানে কি অর্ডার করলে ভাল হবে। প্লিজ সেই ইংরেজি জানা লোকটাকে আমাকে খুঁজে বের করতে দিন। আমি অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে আসব।”

“কিন্তু মি. পেট…,” হাল বাধা দিল। কিন্তু সে বাক্য শেষ করার আগেই পেট কফি হাউজের ভেতর হারিয়ে যায়। হাল, হাল ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

“আমাদের চলে যাওয়া উচিত, গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি বলল। “আমি এই লোকটাকে বিশ্বাস করি না।”

“তুমি হয়ত ঠিকই বলেছ।” কিন্তু আমরা এখন চলে যেতে পারি না। হাল বলতে লাগল, “এত আতিথেয়তা অস্বীকার করে আমরা যদি চলে যাই তাহলে হয়তো ব্যাপারটা মি. পেট স্বাভাবিকভাবে নিবেনা। সে ধরনের মানুষ সে নয়। তাই আমাদের ধৈর্য ধরে এখানে অপেক্ষা করতে হবে।”

কিছু সময় পরে মি. পেট সাদা আলখাল্লা পরা, মাথায় টুপি পরা দাড়িসহ একজন অ্যারাবিয়ান লোককে সাথে নিয়ে হাজির হলো। অ্যারাবিয়ান লোকটি কিছুক্ষণ আগে ঘেউ ঘেউ করে তার একজন চাকরকে বকাবকি করছিল। “ইনি হাচ্ছেন মি, আজার, এই দোকানের মালিক,” পেট ব্যাখ্যা করল। “যখন আমি তাকে বললাম যে আমার অতিথি এক মহান ইংলিশ নাবিক তখন সে আপনাদের সম্মান জানাতে উঠে এসেছে।”

হাল উঠে দাঁড়িয়ে মি. আজার-এর সাথে পরিচিত হলো। চাকরগুলো একটা টেবিল টেনে এনে ওদের টেবিলের ঠিক নাক বরাবর রাখল। টেবিলটাতে বিভিন্ন রকম খাবার রাখা আছে-কফির কাপ, বিভিন্ন রকম চা, মিষ্টি এবং পেস্ট্রি। চাকরগুলো হাল, পেট এবং অ্যাবোলির সামনে একটা করে হুক্কার পাইপ রাখল।

পেট দেখতে পায় হাল বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নকশা করা পিতলের জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা লম্বা পাইপ পেতলের জিনিসটা থেকে বেরিয়ে আছে।

“আপনি কী এর আগে হুক্কাহ দেখেন নি?” পেট জিজ্ঞেস করে। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে আবার বলতে শুরু করে, “এটা দিয়ে ধূমপান করা হয়। আমি ইন্ডিয়ায় এটা প্রথম দেখেছি। বেশ মজার একটা জিনিস…”

“আমার বাবা সবসময় ধূমপান বিরোধী ছিলেন।” হাল বলতে শুরু করে। “আমার বাবা মনে করতেন ধোয়া দিয়ে ফুসফুস ভর্তি করলে তা কোনোরকম উপকার বয়ে আনতে পারে না। এরচেয়ে বরং সমুদ্রের বাতাস দিয়ে ফুসফুস ভর্তি করা ভাল।”

“আমি জানি আপনার বাবা খুব ভাল মানুষ ছিলেন ক্যাপ্টেন কার্টনি। কিন্তু তিনি এখন নেই। তাই সমস্ত সিদ্ধান্ত আপনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নিতে হবে। এছাড়া এই যন্ত্রটির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী করে বানানো বিশেষ ধরনের তামাক সেবন করা। এছাড়া বিভিন্ন রকম স্বাদ এবং গন্ধ এর সাথে মেশানো আছে। মি. আজার এর সাথে পুদিনা পাতা এবং লেবুর খোসার মিশ্রণ মিশিয়েছেন। ধোয়াটা একটা পানির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরফলে ক্ষতিকর পদার্থ দূরীভূত হয়। তাই আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এটার ধোয়া কোনো রকম ক্ষতি করবে না।”

“আমি একবার স্যার ফ্রান্সিস-এর সাথে হুক্কার ধোয়া টেনেছিলাম। অ্যাবোলি বলল। ওটা বেশ ভালই ছিল।”

“তাহলে সে আমার কাছে অস্বীকার করেছিল কেন?” হাল জিজ্ঞেস করল।

অ্যাবোলি হেসে বলে, “গান্ডওয়েন তুমি দেখবে খুব কম সময়ই মানুষ নিজে যা করে তা তার ছেলের কাছে প্রকাশ করে।”

“আমি একটা প্রস্তাব দেই,” পেট বলল। “আপনারা দুজন যদি আমার সাথে পাইপ টানায় যোগ দেন তাহলে আমি যা জানি সেটার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলব…” সে এদিক সেদিকে তাকিয়ে দেখে যে কেউ তাদের কথা শুনছে কি-না। “গ্রেইল-এর বর্তমান অবস্থা।”

হাল তার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আমি এখনো আমার বাবার কাছে দেয়া কথায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যখন আমি সেটা থেকে মুক্ত হতে পারব তখন আমি আপনার সাথে যোগ দেব। সেদিন আসার আগ পর্যন্ত অ্যাবোলি আপনাকে সঙ্গ দিবে…”

“অবশ্যই…তাহলে বলি,” শুনুন। “আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে গতকাল মার্কেটের সামনে অন্ধ ভবিষ্যদ্বক্তাটা কী বলছিল? আমার ধারণা সে আসলে ওমানের রাজা জেনারেল আহমেদ এল গ্রেং-এর অনুসারীদের কথা বলছিল, যারা আবারো হলি গ্রেইল আত্মসাৎ করেছে। আপনি এল গ্রেং-এর নাম শুনেছেন?”

“আমি ভাল করেই জানি এই এল গ্রেং-কে ছিল। আমি তার সাথে যুদ্ধও করেছি,” হাল বলল।

“ও আচ্ছা… আর সেই দিন ভবিষ্যদ্বক্তা অন্ধ লোকটি বলছিল যে এই ঘটনা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিবে। হলি গ্রেইল-এর চোর আমাদেরকে অন্ধকারে পতিত করবে।”

হাল একটা বিস্ময়সূচক অভিব্যক্তি দিয়ে বলে, “হুম… আমার মনে হয় না অন্ধ লোকটির ভবিষ্যদ্বাণী কোনো গুরুত্ব বহন করে।”

“গ্রে-ও তাই মনে করে, পেট উত্তর দেয়। “সে জানতে খুবই আগ্রহী ছিল যে সেই অন্ধ লোকটির কথায় আদৌ কিছু ছিল কি-না। আপনারা জানেন যে বিভিন্ন লোকজনের সাথে মি, গ্রে-র বেশ ভাল যোগাযোগ আছে। আমি আগেই বলেছি আমি সেখানে থাকাকালীন সময়েই সে বেশ কিছু খবর পায়। মি. গ্রে সেই লোকটির সাথে আরবিতে কথা বলছিলেন। কিন্তু লোকটির সাথে কথা বলার সময় তার চেহারা গম্ভীর হতে থাকে।” এরপর লোকটি চলে যাওয়ার পর তিনি আমার দিকে ফিরে বলেন, “আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, সেটা সত্য।” “ক্রিশ্চিয়ানদের সেই মূল্যবান গুপ্তধন যেটার জন্য ক্যাপ্টেন কার্টনি এবং জেনারেল নাজেত প্রাণপ্রণে সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছেন, সেটা পুনরায় এল গ্রেং-এর হাতে গিয়ে পড়েছে।”

“সে কী আপনাকে আরো কিছু বলেছে?” হাল ভ্রূ কুঁচকে বলল।

“হ্যাঁ বলেছে… সে বলেছে যে সেই ইথিওপিয়ান বালক রাজা অথবা তাকে যে বিশপটা উপদেশ দেয় সে বলেছে…”

“ফেসিলাইডস।”

“হ”, “ফেসিলাইডস-ই তার নাম”… “সেই ফেসিলাইস গুপ্তচর পাঠিয়েছে জেনারেল নাজেকে খুঁজে বের করার জন্য।”

হাল চোখ বড় বড় করে বলে, “আপনি কী তাকে কিছু বলেছেন? জেনারেল নাজেত এখানে আছে-আপনি কী তাকে একথা বলে দিয়েছেন?”

“মাই ডিয়ার ক্যাপ্টেন কার্টনি। আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনারা সেখানে উপস্থিত থাকার সময় যতটা বিচক্ষণ ছিলাম আপনারা চলে আসার পরও ঠিক ততটাই ছিলাম। কিন্তু আপনি যখন আমার বিচক্ষণতা এবং বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তখন ব্যাপারটা আমার মনে দাগ কেটেছে। আমার বিশ্বস্ততার কারণেই কোম্পানির পরিচালকরা খুবই সংবেদনশীল ব্যাপারে আমার ওপর ভরসা রেখেছেন, আর…”

“আমি ক্ষমাপ্রার্থী মি. পেট। একজন স্বামী হিসেবে স্ত্রীকে নিয়ে আমারও চিন্তা হয়। আমি কথাগুলো আপনাকে অপমান করার জন্য বলিনি। কিন্তু তারপরেও যদি আপনি সেরকম ভেবে থাকেন…”।

“না, না, আমি সেরকম কিছু ভাবছি না।” পেট ভ্রুকুটি করে বলে। “মি. অ্যাবোলি। আপনাকে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন?”

হাল খুব দ্রুত অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল, “অ্যাবোলি, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

অ্যামোডোডা যযাদ্ধার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছে। তার চোখ দৃষ্টিশূন্য, মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তার নিজের ভাষায় বনের লোকদের সাথে যেভাবে কথা বলে এখন সে ঠিক ওভাবেই কথা বলছে। হালকে ছোটবেলা থেকেই সে এই ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তবে ওর কথাগুলোর সারমর্ম বুঝতে পেরেছে হাল।

“তার অবস্থা ভাল নয়।” কিছু একটা তাকে এরকম অসুস্থ করে দিয়েছে। মি. পেট, আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, “আপনার এই উপকারী ধোঁয়া, যেটা আপনি তাকে নিতে বাধ্য করেছেন, সেটাই তার এই অবস্থা করেছে, হাল খুব ক্রুদ্ধস্বরে কথাগুলো বলে উঠল।

পেট একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে। “সেটা হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সমান করে তৈরি করলেও আমরা সবাই কিন্তু সমান নই। আমি অনেক ইন্ডিয়ান এবং অ্যারাবিয়ানদের দেখেছি কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই এই হুক্কা সেবন করতে।” “পার্সিয়ানরাও এটার উপাদানে অভ্যস্ত। কিন্তু সম্ভবত আফ্রিকানরা এটার উপাদানে অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে হয়ত এখানকার বাতাস ওর সহ্য হয়নি, বা সে এমন কিছু খেয়েছিল যাতে তার এই অবস্থা হয়েছে।”

“সে যাই হোক, সেটা নিয়ে আমি এখানে বিতর্কে জড়াতে চাই না। আমি দ্রুত তাকে নিয়ে আমাদের জায়গায় ফিরে যেতে চাই। তার সঠিক যত্ন প্রয়োজন। ওষুধের দোকানীটা হয়ত তার জন্য কোনো ঔষধী গাছ অথবা মিশ্রণ খুঁজে দিতে পারবে।”

“সেটাই ভাল হবে,” পেট বলল, “আমি আপনাকে সাহায্য করছি।”

সে এবং হাল উঠে দাঁড়ায়। অ্যাবোলির দুপাশ দিয়ে দুজনে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। মনে হচ্ছিল লম্বা কোনো গাছ ঝড়ের বাতাসে হেলে পড়ে যাচ্ছে। “উঠুন, মি. অ্যাবোলি,” পেট অ্যাবোলির বাহু নিজের কাঁধের ওপর ফেলে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। হালও অপর পাশ থেকে অ্যাবোলিকে ধরে রাখে। “আমরা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। আমাদের খাবারের মূল্য নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনাদেরকে পৌঁছে দিয়েই হিসাব চুকানোর জন্য আমি আবার এখানে ফেরত আসব।”

.

ওহ আমি আমার হিসাব তো চুকাবোই-এতে কোনো ভুল নেই, পেট মনে মনে চিন্তা করতে লাগল। তারা তিনজনে কফি শপ পার হয়ে সরু রাস্তা দিয়ে দোকানীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

যেতে যেতে মি. পেট মনে মনে হাসতে লাগল। বৃদ্ধ ব্লাসফেমার মি. গ্রে ঠিকই ধারণা করেছিল। হুক্কার ধোঁয়ায় মেশানো হাসিস এবং আফিমের মিশ্রণ বেশ ভালভাবেই কাজ করেছে।

সরু রাস্তা পার হয়ে তারা আরও একটি সরু গলির প্রবেশমুখে এসে দাঁড়াল। এদিক দিয়ে নিচে যেতে হবে। হাল এবং অ্যাবোলিকে দুটি উঁচু দেয়ালের মাঝপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছিল পেট।”

“আপনি নিশ্চিত এই পথ দিয়ে?” হাল জিজ্ঞেস করে। অ্যাবোলির ভারী শরীর বয়ে আনতে আনতে হাঁপিয়ে পড়েছিল হাল।

“অবশ্যই,” পেটও জবাব দেয়। সেও হাঁপাতে হাঁপাতে এমনভাবে কথা বলছিল যেন আর একটি কথা বলার শক্তিও তার নেই। যদিও তার সমস্ত মনোযোগ ছিল ভেতর মুখী। এখন সে তার মাথার ভেতর আরও স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর, যেমনটা শুনেছিল কয়েক সপ্তাহ আগে। “নাও! ডু ইট নাও!”

এটাই উপযুক্ত সময় এবং স্থান যেখানে ওপরওয়ালা হেনরি কার্টনিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। “তুমি দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছো, এখন অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। দ্রুত কাজটা সেরে ফেল।”

পেট-এর মনে এবং শরীরে এক ধরনের প্রশান্তির বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। সে মনে মনে চিন্তা করছিল এই অপ্রকৃতিস্থ মাতাল আফিসারটি তার জন্য কোনো অসুবিধাই বয়ে আনবে না। তার হাত পকেটে চলে যায় যেখানে সে একটি ধারালো ছুরি লুকিয়ে রেখেছে। এই ছুরিটা মি, আজার তার প্লেটের পাশে রেখেছিল। এখন যেহেতু তার ডান হাত মুক্ত রয়েছে, তাই সে এটা সহজেই ব্যবহার করতে পারবে। হাল যদিও শেষমুহূর্তে তলোয়ার আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু সেটা সে কোনো কাজেই লাগাতে পারবে না। কারণ সে ডান বাহু দিয়ে আফ্রিকান লোকটাকে বয়ে চলেছে। আফ্রিকান লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে সে কোনোভাবেই তার তলোয়ার-এর সঠিক ব্যবহার করতে পারবে না।

পেট শক্তভাবে ছুরিটার হাতল ধরে রাখল। সে তাড়াহুড়ো না করে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ছুরিটা পকেট থেকে বের করে হাতটা শরীরের পাশে ঝুলিয়ে রাখল সে। তারা গলিটার প্রায় অর্ধেকটা পার হয়ে গিয়েছে। এখন যে কোনো দিকে পালিয়ে যেতে হলে সমান দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এটাই সঠিক সময় কাজ সারার।

“ডু ইট!” অদৃশ্য কণ্ঠটি পেটকে আদেশ দেয়।

এবং উইলিয়াম পেট এত দ্রুততার সাথে আঘাত করে যাতে তার ভিকটিম কোনোভাবেই বুঝতে না পারে। অ্যাবোলিকে পাশ কাটিয়ে তার হাতটা সোজা কার্টনির বরারব নিয়ে আসে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবোধহীন হেনরীকে আঘাত করে।

.

“চোখের দিকে তাকাও, গান্ডওয়েন!” অ্যাবোলি সবসময় তাকে শিক্ষা দিয়েছে। তুমি যদি ব্লেড-এর দিকে তাকাও তাহলে তুমি অনেক দেরিতে প্রতিরক্ষা করতে পারবে। ব্লেড বলে দিবে প্রতিপক্ষ এখন কী করছে। কিন্তু চোখ বলে দেবে যে এরপর সে কী করবে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অ্যাবোলি তাকে এই শিক্ষা দিয়েছে-যতদিন পর্যন্ত না এটা তার স্বাভাবিক প্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাই কোন পরিস্থিতে তাকে কী করতে হবে এটা তাকে আর চিন্তা করে বের করতে হয় না। কারণ এখন এটা তার অভ্যাস-এ পরিণত হয়েছে।

সেই স্বাভাবিক নিয়মেই হাল পেট-এর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল-অনেক আগে থেকেই। যখন থেকে দোকান মালিকের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে তাদের টেবিলে এত খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল, যখন থেকে হুক্কার সুবিধার কথা বলে ওটা টানতে পেট তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, কিংবা যখন থেকে অ্যাবোলি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল-তখন থেকেই সে পেটের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মন বোঝার চেষ্টা করছিল।

আর এইভাবেই হাল গ্রে-এর সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং তার মনে জেগে উঠা সন্দেহকে যাচাই করছিল। সে মনে করেছিল গ্রে হয়তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুনজর পাওয়ার আশায় পেটকে দেশে পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহী হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই এই মুসলিম দাস ব্যবসায়ী লোকটির পেটের মতো একজন পাগলাটে লোকের সাথে এত বেশি বন্ধুত্ব দেখানোর ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও স্বাভাবিক মনে হয়নি।

এর একটাই অর্থ হতে পারে-গ্রে এবং পেটকে দেখতে যতটা সহজ-সরল মনে হয় আসলে তারা তা নয়। হাল-এর মনে ভয় কাজ করছিল যে সে নিশ্চয়ই গ্রে-কে চিনতে বড় কোনো ভুল করেছে। গ্রে নিশ্চয়ই গোল্ডেন বাউকে বড় কোনো সমস্যায় ফেলতে যাচ্ছে। সেই অনুমান এখন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। গ্রে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।

যেদিন হাল ঘুম থেকে উঠে পেটকে বিছানার পাশে দেখতে পেয়েছিল সেদিনই তার মনে হয়েছিল যে পেট কিছু একটা নিয়ে ফন্দি আঁটছে। সে নিশ্চয়ই ট্রোম্পকে কোনো কারণে যুদ্ধ করার জন্য বাধ্য করতে চাচ্ছিল। এরপর বন্দুক যুদ্ধের সময় ইচ্ছে করেই চুপচাপ থাকা, ট্রোম্প গুলি করার পর আস্তে ধীরে নিশানা ঠিক করে গুলি করা, এবং সেই গুলি যখন ট্রাম্পকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয় তখন তার ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গি, এগুলো মোটেও কোনো শান্তিপ্রিয় ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলো একজন খুনির বৈশিষ্ট্য।

আর তারপর এখন পেট হালকে অন্ধকার জায়গায় নিয়ে এসেছে। কোনো ভাল লোকই আলোকিত স্থান ছেড়ে অন্ধকারকে বেছে নেয় না।

হঠাৎ হাল-এর খেয়াল হলো যে তার ডান হাত এবং তলোয়ার-এর মাঝে অ্যাবালির দেহ আছে। সে বুঝতে পারল যে পেট কতটা সতর্কতার সাথে তার অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, সেই সাথে হাত মুক্ত রেখেছে। কিন্তু পেট-এর হাতে কোনো তলোয়ার নেই। নিশ্চয়ই তার কাছে কোনো লুকানো অস্ত্র আছে।

যতই তারা গলির ভেতর দিয়ে এগুতে লাগল অন্ধকার ততই বাড়ছিল। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, হাল মনে মনে ভাবল। আর যদি আমি দেখতে না পাই…

হঠাৎ তাদের উপরের দিকে কোথাও একটা শাটার খোলার শব্দ হলো। লাইটের আলোতে দেখা গেল, জানালা দিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ফেলা হচ্ছে। হাল সাথে-সাথে পেট-এর দিকে তাকাল। তীব্র আলোর ঝলকানিতে পেট-এর চোখ দেখতে পেল সে।

আর এরপরেই…সে দেখল।

সাথে-সাথেই প্রতিক্রিয়া দেখাল হাল-একজন প্রকৃত বুদ্ধিমান যোদ্ধার মতই। সে অ্যাবোলিকে ধাক্কা দিয়ে পেটের দিকে ঠেলে দিল। ধাক্কা খেয়ে পেট ডানে সরে গেল, ফলে ওর আঘাতটাও হাল-এর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। এরপর হাল অ্যাবোলির গোড়ালিতে এমনভাবে আঘাত করল যেন অ্যাবোলি হোঁচট খেয়ে পেটকে নিয়ে নিচে পড়ে যায়।

ভয় পেয়ে গেল হাল। সে হয়ত তার প্রিয় বন্ধুকে শত্রুর তলোয়ার-এর ওপরেই নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তখনই সে অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পায় যে পেট-এর হাত অ্যাবোলির শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে। ওর তলোয়ার এখন তার আওতার বাইরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এরপর সে পেট-এর হাতে আঘাত করে ওকে একেবারে পঙ্গু করে দিল। তখনই হাল পরিষ্কার উচ্চারণে সেই বন্য ভাষা শুনতে পায়, “ওকে হত্যা কর গান্ডওয়েন।”

পেট একেবারেই প্রতিরোধহীন হয়ে পড়েছে। এরকম মুহূর্তে প্রতিপক্ষকে সম্মান প্রদর্শন করা যেতে পারে অথবা ক্ষমা করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু উইলিয়াম পেট এ দুটোর কোনোটাই পাওয়ার যোগ্য না। আর তাই, হাল একটানে তার নেপচুন তলোয়ারটা খাপ থেকে বের করে আনলো।

না দেখেও পেট-এর অভিব্যক্তিহীন চোখগুলো অনুভব করতে পারছিল হাল। সেই চোখে ভয়ের কোনো ছিটে ফোঁটাও ছিল না। শুধু ছিল অনুভূতিহীন ঘৃণ্য দৃষ্টি। “তুমি নরকে যাবে, হেনরি কার্টনি! সেই সাথে তোমার বংশধররাও!”

হাল দুইহাতে তলোয়ারটা উঁচিয়ে ধরে সোজা নিচের দিকে তাক করে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচের দিকে আঘাত করে পেট-এর গলায় ঢুকিয়ে দেয়। গলার পেছনদিকে দুই ভার্টিব্রার মধ্যবর্তী জয়েন্ট তলোয়ার-এর অগ্রভাগ দিয়ে আলাদা করে দিল সে।

হাল চারদিকে তাকায়। গলিটা মরুভূমির মতোই নীরব অন্ধকার। সকালের সূর্য উঠার আগে কেউ এখান থেকে কিছু দেখতেও পাবে না বা শুনতেও পাবে না। তাদের উপরের দিক থেকে যে জানালা খোলার শব্দ হয়েছিল সেটাও ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অ্যাবোলি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সাহায্য ছাড়া সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় হাল-এর হাতে নেই। সে অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “জুডিথ।” তারপর অন্ধকার গলি ধরে দ্রুত দৌড়াতে শুরু করে।

*

“উঠে পড়ন, মাই লেডী, আপনাকে উঠতেই হবে,” জুডিথ জেগে উঠে দেখতে পায় মসি তাকে অনুনয়-এর সুরে আস্তে আস্তে S ডাকছে। তার গলার স্বরে ভয় উপচে পড়ছে। আমি ভয় পাচ্ছি। জিনটা আসছে। এখন আমরা কী করব?”

জুডিথ ঘুমের ঘোরে চোখ মিট মিট করতে থাকে। একমুহূর্তের জন্য তার মনে হয় ছেলেটি হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। পৃথিবীতে জিন বা প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই। এ কারণে তার বুঝতে একটু ভুল হয়েছিল। তাই দরজাটা যখন লাথি মেরে ধাক্কা দিয়ে খোলা হয় তখনও সে বিছানায় শুয়ে ছিল। এখনও সে চাইলে ঘুরে বালিশের নিচ থেকে কাসকারা তলোয়ারটা হাতে নিতে পারে। কিন্তু কম্বলটা এখনো তার গায়ের ওপরেই আছে। একটানে কাসকারা হাতে নিয়ে যখনই সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল তখনই পাঁচজন লোক ঘরের ভেতর প্রবেশ করে জুডিথ-এর দিকে তলোয়ার তাক করল।

এরপর আরও একজন প্রবেশ করে। তার দিকে তাকিয়ে জুডিথ মসির ভায়ের কারণ বুঝতে পারে। লোকটির মুখে অদ্ভুত রকমের চামড়ার মুখোশ পরানো আছে, চাঁদের আলোতে যেটাকে ভয়াবহই মনে হচ্ছে। মসি এটা দেখেই শয়তান ভেবে ভুল করেছে। : আরও একটা চিন্তা তার মাথায় উদয় হলো। মসি কোথায়? সে কোথায় গেছে? তবে এটা ভেবেই জুডিথ একটু নিশ্চিন্ত হলো যে এই আগমনকারীরা কেউই মসির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না।

কোনো মরিচা ধরা তলোয়ার তার খাপ থেকে বের করার সময় যেমনটা বিশ্রী, খসখসে শব্দ হয়, অনেকটা সেরকম কণ্ঠে মুখোশ পরা লোকটা কথা বলে উঠল, “যুদ্ধ করার কোনোরকম চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনি এবং আপনার পেটের ভেতর বেড়ে ওঠা সন্তান দুজনেই মারা যাবেন।”

জুডিথ জানে লোকটি ঠিকই বলেছে। সে একজন পুরুষের মতো করে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মনের গভীরে লুকোনো কোনো সত্তা তাকে মনে করিয়ে দিল যে একজন নারী যেভাবে প্রতিরোধ করে তাকেও এখন সেভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। আর সেটা যুদ্ধ করে নয়, সহ্য করে। একজন পুরুষকে শুধু তার নিজেকে নিয়ে ভাবলেই হয়। কিন্তু একজন মাকে তার নিজের চেয়ে তার সন্তানের কথা বেশি ভাবতে হয়।

সে তরবারিটা রেখে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। সে শুধু লিলেন এর পাতলা একটা নাইটগাউন পরে আছে। তাই সে জিজ্ঞেস করে, “আমি কী আমার গাউনটা পরে নিতে পারি?”

“না, ম্যাম। আপনি তা পারেন না,” মুখোশ পরা লোকটি মাথাটা নাড়িয়ে এমনভাবে জুডিথ-এর দিকে তাকাল যেন সে তার একচোখ দিয়ে জুডিথকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এই লোকটির ক্ষুধার্ত চোখ থেকে বাঁচার জন্য জুডিথ তার যুদ্ধের বর্মটাকে খুব অনুভব করতে লাগল। নিজেকে এখন খুব নরম ও দুর্বল মনে হচ্ছিল ওর। যে নারী এতদিন পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারতো, অজস্র উপায়ে শত্রুকে হত্যা করতে পারতো, সেই তারই কি-না এখন আকুল নয়নে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

না, আমি কোনোভাবেই এই লোকটিকে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে দেব না! জুডিথ চিন্তা করল এবং নিজেকে খুব জোরালোভাবে তাগিদ দিল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সরাসরি ওই ঈর্ষাপরায়ণ লোকটির দিকে তাকানোর।

“আপনি কী আমাকে চিনতে পেরেছেন?” কণ্ঠটি জিজ্ঞেস করল। “ওহ, কীভাবে আপনি চিনবেন? আমি তো মৃত। আপনি আমাকে মারা যেতে দেখেছেন।”

জুডিথের স্মৃতি যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেল। সে সাগরের প্রান্তরে যুদ্ধের ছবি মনে করতে লাগল এবং একজন মানুষকে তার জাহাজসহ আগনে পুড়ে ডুবে যেতে দেখল। না, এটা কী করে সম্ভব! কিন্তু এছাড়া..?

“বুজার্ড, সে তার কণ্ঠটাকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বলার চেষ্টা করল। কিছুতেই তার বিস্ময় এই লোকটার কাছে প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে সেটা হয়ত তার আরেকটা বিজয় হবে তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন।

“হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি…এটাকে যদি বেঁচে থাকা বলে তাহলে আমি বেঁচে আছি। আপনার বাস্টার্ড স্বামী যেভাবে আমাকে বেঁচে থাকতে বাধ্য করেছে। আমি সেভাবেই বেঁচে আছি। ওহ আমি সেটার প্রতিশোধ তার নারীর ওপর দিয়ে নিতে চাচ্ছিনা। তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার আরও অনেক রাস্তা আছে। কিন্তু আরো একজন আছে যে আপনার সাক্ষাৎ পেতে চায়। আপনি আপনার গাউন পরে নিন। আপনার তৈরি হওয়া শেষ হলে আমার সঙ্গে আসুন।”

বুজার্ড-একজন সম্ভ্রান্ত নারীকে সম্মান প্রদর্শনের মতো করে মাথা নিচু করে। বলল, “আপনার বাহন তৈরি, মাই লেডি…”

সে চলে গিয়েছে। কামরা খালি পড়ে আছে। বোকামির জন্য হাল নিজেকে অভিশাপ দিতে লাগল। হঠাৎ সে ঘর থেকে এক ধরনের শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ যেটা খাটের নিচ থেকে আসছে। হাল মেঝে পর্যন্ত নেমে আসা বিছানার চাদরটা উঠিয়ে দেখে সেখানে গুটিসুটি মেরে মসি বসে আছে।

হাল তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নরম সুরে বলল, “ভয় পেয়ো না। তুমি এখন নিরাপদ। বের হয়ে এসো।”

ছেলেটি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হাল আবার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। তাই সে এবার ভিন্ন পথ ধরে বলল, “তুমি কী আমাকে সাহায্য করবে, মসি? আমাকে বলবে এখানে কী ঘটেছিল? জুডিথকে কারা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে? তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর তবে আমি অতি দ্রুত জুডিথকে খুঁজে বের করতে পারব।”।

হাল-এর এই পন্থায় কাজ হয়। মসি নিচ থেকে বের হয়ে আসে এবং আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করে। যদিও হাল প্রথমে জুডিথ-এর মতোই মসির কথা বুঝতে পারে না। জিন কী জিনিস বা কোথা থেকে এসেছে কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু মসির পরের কথাগুলো এরকম ছিল : “জিনটা কথাও বলতে পারে! দানবটা আমার ম্যাডাম-এর সাথে কথা বলেছে এবং আমার মনে হয় ম্যাডাম ওকে চেনে। উনি তার নামও উচ্চারণ করেছেন। বোজুরড।”

হাল ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু মসির কথা বুঝতে পারছিল না সে। তাই ছেলেটা আবারো একই নাম বলল, “বজরড! বজরঙ!”

এবার হাল তা শুনতে পায়। মসির কথা শুনে অবিশ্বাস্যভাবে সে আঁতকে উঠে। মৃত শত্রুর কথা মনে পড়ে যায় তার। সে মসিকে জিজ্ঞেস করে, “সে কী বুজার্ড বলেছিল?”

ছেলেটি উপরে নিচে কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে বলতে থাকে। “হ্যাঁ, হ্যাঁ! বুজার্ড।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য হাল সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং ভাবতে চেষ্টা করল আসলে কী ঘটতে পারে। গ্রে এবং বুজার্ড দুই বিশ্বাসঘাতক একত্র হয়েছে শুধু ক্যাপ্টেন স্যার হেনরি কার্টনিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। তারা দুজন সম্ভবত তৃতীয় কোনো পক্ষের সহযোগিতায় জুডিথ এবং তার শেষ দেখতে চায়। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু সে এখনো বেঁচে আছে। এখন কেবল একজনই বলতে পারে জুডিথকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

“মসি, আমার পিস্তলটা নিয়ে এসো,” সে বলল। সেই সাথে মনে মনে প্রত্যাশা করতে লাগল যেন ওগুলো ঠিক জায়গাতেই পাওয়া যায়।

“তুমি কী করতে যাচ্ছ?” অ্যাবোলি জিজ্ঞেস করে।

“আমি মহামান্য রাষ্ট্রদূত-এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি,” সে বলল। “তুমিও আমার সঙ্গে যাচ্ছ। এমনকি জাঞ্জিবার-এ আমাদের যত লোক আছে সবাই যাবে আমার সাথে। আমি আশা করি সে আমাকে সবকিছু খুলে বলবে।”

“না,” অ্যাবোলি তার মাথা নাড়ায়। এটা সঠিক উপায় নয়। ভেবে দেখ গান্ডওয়েন। রাষ্ট্রদূত-এর বাড়ির চারপাশ গার্ড দিয়ে ঘেরা থাকবে। যখনই সে জানতে পারবে যে তুমি বেঁচে আছ তখনই সে তার দরজা বন্ধ করে দেবে। আমাদেরকে অন্য পন্থায় যুদ্ধ করতে হবে নয়ত শহরের গার্ডেরা হায়েনার মতো রক্তের গন্ধে ছুটে আসবে।”

হাল রাগে ফেটে পড়ছিল। কিন্তু সে জানে অ্যাবোলি ঠিক বলেছে। এভাবে তাদের গ্রে’র বাড়ির দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। গ্রে হচ্ছে জাঞ্জিবার-এর একজন শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। হাল যদি স্থানীয় ওমানী লোকজনের সাথে যুদ্ধ করতে যায় তাহলে গোল্ডেন বাউকে দুর্গের দেয়ালে রাখা বন্দুকের গুলির সম্মুখীন হতে হবে।

“তাহলে তুমি কী প্রস্তাব করছ অ্যাবোলি?” সে তার কোমড়ের বেল্ট বেঁধে তার মধ্যে মসির দেয়া পিস্তল দুটি আটকাতে আটকাতে বলে।

অ্যাবোলি ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমরা কত লোকজন নিয়ে যেতে পারব সেটা এখানে কথা নয়, কথা হচ্ছে, আমরা কত কম লোজন নিয়ে যেতে পারব।”

“তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ সম্মুখ যুদ্ধের চেয়ে নীরবে কাজ করলে আমাদের বেশি সুবিধা হবে?”

“ঠিক তাই”! অ্যাবোলি ঠোঁটজোড়া শক্ত করে জবাব দিল।

তারা দুজন আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। এরপর তারা মসিকে সাথে নিয়ে জাহাজের সেখানে আসে যেখানে লম্বা নৌকোগুলো লাগানো রয়েছে। সে মসিকে নৌকোর পেছনদিকে চুপচাপ অপেক্ষা করতে বলে। এরপর হাল এবং অ্যাবোলি বাউ-এর বাকি লোকদের বুঝিয়ে বলে যে তারা কী করতে যাচ্ছে। শহরের রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হয়ে যাওয়া এবং মানুষজন ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। এরপর হাল আর অ্যাবোলি বাউ-এর আরও দুজন শক্তিশালী যোদ্ধা বিগ ডেনিয়েল ফিশার এবং উইল স্ট্যানলিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।

*

জুডিথকে যে বাহনে করে জাঞ্জিবার-এর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেটার জানালাগুলো পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তাই কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে জুডিথ-এর কোনো ধারণাই নেই। একসময় সে শুনতে পায় দরজা খোলার আদেশ দেয়া হচ্ছে। এরপর বড় একটা দরজা খুলে যায়। ঘোড়ার খুর এবং চাকার শব্দে বোঝা যায় বাহনটা একটা বাঁকানো আর্চওয়ের নিচ দিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা দরজা পার হয়ে থেমে গিয়েছে।

বাহনটার দরজা খোলার পর মধ্যবয়স্ক একজন লোক দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার সমস্ত দাড়ি এবং মাথার চুল পরিষ্কার করে ফেলে দেয়া। অনেকটা মেয়েলি কণ্ঠে সে বলে উঠে, “আমার সাথে আসুন। মহামান্য রাজা আপনার সাথে দেখা করতে সম্মতি জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি আপনাকে ঠিক এই অবস্থায় দেখতে চান না।”

লোকটা নিশ্চয়ই হিজড়া! ওর কণ্ঠ শুনে মনে মনে চিন্তা করল জুডিথ। এরপর লোকটি তাকে একটি সুসজ্জিত কামরায় নিয়ে যায়। কামরাটির মেঝেতে মার্বেল পাথরের মোজাইক করা ছিল যেগুলো নানান রকমভাবে নকশা করা ছিল। গোলাপ এবং অ্যাম্বার-এর সুগন্ধিতে ঘরটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে। মোমবাতির সোনালি আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্ধনগ্ন নারীরা অলস ভঙ্গিতে ডিভান-এর ওপর হেলান দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। জুডিথ এক চমকেই বুঝতে পারে যে তাকে একটা হারেম-এ নিয়ে আসা হয়েছে।

লোকটি তাকে কামরার মাঝখানে নিয়ে আসে যেখানে নরম পানির ঝর্নাধারা সমৃদ্ধ একটি গোসলখানা রয়েছে, যেটাতে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। দুজন দাসী তাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। “মহামান্য রাজার জন্য একে প্রস্তুত কর,” হিজড়া লোকটি দাসীদের আদেশ করল।

“আপনার গোসলের সবকিছু প্রস্তুত রাখা হয়েছে, মাই লেডি।” দাসী মেয়েদুটির একজন বলে উঠে। “আমি কী আপনার গাউনটি নিতে পারি?”

জুডিথ অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে উত্তর দেয়, “না, তোমরা পার না।” কিন্তু যাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই তাদেরকে বাধা দেয়া বা তাদের সাথে যুদ্ধ করাটা বৃথা। তাকে যুদ্ধ করতে হবে সেই লোকটির সাথে যে এদেরকে শাসন করছে। আর সেই লোকটির কাছাকাছি পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এদের কথা মেনে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা। তাই জুডিথ ওদের কথা মেনে নেয়। তাকে গোসল করিয়ে শুকিয়ে শরীরে সুগন্ধি তেল মাখানো হয়। দাসী মেয়েদের একজন তাকে বসতে বলে। তার চোখে স্মোকি কাজল লাগানো হয়। ঠোঁটে লাল রঙ্গা কিছু একটা লাগানো হয়। চুলগুলো সুন্দরভাবে বেঁধে ওখানে নানানরকম মুক্তার গহনা বসানো হয়। মিতসিওয়ায় হাল-এর সাথে দেখা হওয়ার দিন যেগুলো পরেছিল, মুক্তার গহনাগুলো দেখতে অনেকটা সেরকম। দাসীদের একজন তার কানে দুল পরিয়ে দেয়। এরপর তাকে কাপড় পরানোর জন্য উঠে দাঁড়াতে বলে।

“ওহ্, মাই লেডি আপনি দেখতে অনেক সুন্দর।” জুডিথ যখন উঠে দাঁড়ায় তখন দাসীদের একজন বলে উঠে। “মহামান্য প্রিন্স আপনাকে পেয়ে অনেক অনেক তৃপ্ত হবেন।”

“এলিনা হিংসায় মরে যাবে”, অন্য মেয়েটি টিপ্পনী কেটে বলে উঠে।

“আপনি তার নতুন প্রিয়তমা হতে যাচ্ছেন।”

তাকে কাপড় পরানো হয়। যদি এটাকে কাপড় পরানো বলে তবেই। তাকে ছোট হাতার একটা ব্লাউজ পরানো হয় যেটা জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় ইন্ডিয়ান নারীদের শাড়ির নিচে পরতে দেখা যায়। ব্লাউজটা সুতা অথবা সিল্কের তৈরি এবং যেটার ওপর নানান রকম ছোট ছোট পাথর দিয়ে সোনালি রঙের সুতা দিয়ে নকশা করা রয়েছে। এটা কোনোরকমভাবে জুডিথ-এর বুকের অংশটা ঢেকে রেখেছে। এরপর তাকে কোনো শাড়ি পরানো হয় না। তার বদলে তাকে একজোড়া প্যানট্যালুন পরানো হয় যেটা তার কোমড় থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নেমে এসেছে। এটাতেও নানাধরনের চকচকে নকশা করা রয়েছে। সবশেষে তাকে সোনালি সুতা দিয়ে কাজ করা একজোড়া তুর্কিস পাদুকা পরানো হয়।

“আসুন…দেখুন, আপনাকে কতটা সুন্দর লাগছে, প্রথম দাস মেয়েটি জুডিথকে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা লম্বা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কথাটা বলল। জুডিথ নিজের প্রতিবিম্ব দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাল-এর জন্য নিজেকে নানান সময় নানানরকমভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু তার আজকের রূপটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার নিজেকে অনেকটা নর্তকী কিংবা হারেমের মেয়েদের মতো মনে হচ্ছে। তবে এই সাজেও সে মনে মনে রোমাঞ্চিত বোধ করত যদি এটা হাল-এর জন্য হতো। কিন্তু কোনো অচেনা অদ্ভুত মানুষের জন্য নিজেকে এইভাবে সাজানো অবস্থায় দেখে মনে মনে বিপদের গন্ধটা আঁচ করে ফেলল জুডিথ। ভয় এবং আতঙ্ক ইতিমধ্যে তাকে গ্রাস করা শুরু করে দিয়েছে।

তার চিন্তায় ছেদ পড়ল-হিজড়াটা আবারও তার ঘরে প্রবেশ করেছে। লোকটি তাকে ভালভাবে দেখে ঠোঁট ভাঁজ করে শুধু একটাই শব্দ করে : “হাহ।” যেন তার এই রূপ দেখে লোকটি খুব অবাক হয়েছে। এরপর বলল, “আসুন আমার সাথে।”

তাকে পুনরায় একটা সুবৃহৎ কক্ষের মাঝ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। কক্ষের ভেতর থাকা অন্যান্য রমণী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। হিজড়া লোকটি ওই মেয়েগুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে জুডিথকে জায়গা করে দেয়ার চেষ্টা করছে। এরপর তাকে নিয়ে একটা লম্বা করিডোর পার হয়ে একটা দরজার সামনে আসলো সে। তারা ভেতরে ঢোকার পর দরজাটা আবারও বন্ধ করে দেয়া হলো।

জুডিথ দেখতে পায় তাকে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু সুসজ্জিত কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে অন্যান্য উপপত্নীদের তাদের মনিবকে আনন্দ দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কক্ষটির প্রতিটা জায়গা অমূল্য সোনা, মার্বেল পাথর, অনিক্স, গাঢ় কালো রঙের অবসিডিয়ান এবং চকচকে আয়নায় সাজানো রয়েছে। যখন সে একটা করে আয়নার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন সে দেখতে পাচ্ছিল যে চকচকে পাথরের আলোক রশ্মিগুচ্ছ আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আয়নার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে যে পোশাক পরানো হয়েছে। সেটার পাথরগুলোও চকচক করে উঠছিল।

হিজড়া লোকটি সোনালি রঙের ডিভান-এ বসে থাকা একটা লোকের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “মহামান্য, প্রিন্স, এই সেই রমণী যাকে আজ সন্ধ্যায় নিয়ে আসা হয়েছে। আশা করি সে আপনার মনের আশা মিটিয়ে দেবে।”

এটা বলার পর লোকটি জুডিথকে তার মনিবের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। তার সামনে বসা লোকটি যাকে দাসী মেয়েরা প্রিন্স বলে সম্বোধন করেছিল সে নানারকমের অলংকার খচিত ঝাকজমকপূর্ণ পোশাক পরে আছে। উজ্জ্বল গোলাপি রঙের কোট পরে আছে লোকটা, যেটার সাথে মিলিয়ে ট্রাউজার পরেছে সে। তার পাগড়ির সামনের দিকে বেশ বড় আকারের ডায়মন্ড বসানো আছে। ডায়মন্ডটার পাশ দিয়ে আবার ছোট ছোট পালক আটকানো আছে।

জুডিথ লক্ষ করে মধ্য ত্রিশে গিয়েও লোকটিকে বেশ হ্যান্ডসামই বলা যায়। পুরুষ হিসেবে তাকে বেশ আকর্ষণীয় বলতে হয়।

একজন রমণী ডিভানে হেলান দিয়ে লোকটির পাশে বসে ছিল। রমণীটি তার সমস্ত নির্লজ্জতা বিসর্জন দিয়ে লোকটির কানে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াছিল সে, সেই সাথে নিজের আঙুলগুলো লোকটির ঊরুর ওপর দিয়ে টেনে আনছিল ক্রমাগত। জুডিথ-এর মনে হলো যে মেয়েটি নিজের কাজকে বেশ উপভোগই করছে।

জুডিথ ধারণা করেছিল সেখানে হয়ত আরও বডিগার্ড আছে। ঘরের একপাশ থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। কিন্তু সেখানে শুধু একজন মানুষই ছিল-বুজার্ড। সে ডিভান-এর পাশে দাঁড়িয়েছিল। তার একমাত্র হাতটি শরীরের পাশে ঝুলানো। তার নড়াচড়ার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে তা হল : এদিক সেদিক পাখির মতো মাথা দুলানো।

‘মাই ডিয়ার জেনারেল নাজেত।” প্রিন্স লোকটি বলে উঠে। জুডিথ আন্দাজ করল যে এটিই সেই এলিনা নামের মেয়েটি যার নাম সেই প্রথম দাসী মেয়েটি উল্লেখ করেছিল। মেয়েটা এখন তার কাজ বাদ দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিন্স লোকটি আবার বলতে শুরু করে। “গত দুই বছর ধরে যদিও আমাদের ভাগ্য একই সূত্রে বাঁধা ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এটাই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমি মহারাজা সাদিক খান জাহান। আপনার পুরনো শত্রু, ওমানী আরব নেতা সুলতান আহমেদ এল গ্রাং আমাকে সেভাবেই শ্রদ্ধা করতো যেভাবে আপনি সেই বাচ্চাটিকে করতেন যে কি-না নিজেকে ইথিওপিয়ার রাজা হিসেবে দাবি করে।” প্রিন্স লোকটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আপনি কী জানেন যে আপনার মতো সুন্দরী রমণী নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে স্রেফ অপচয় করছে?”

“না।” জুডিথ বলল, “আমার মতো অভিজ্ঞ যোদ্ধা নিজেকে এই হারেমখানাতেই বরং অপচয় করছে।”

“প্রিয়তম, আমি কিছু বুঝতে পারছি না, এলিনা নামের মেয়েটি সোজা হয়ে বসে বলে উঠল। তুমি কেন এই নারীটিকে জেনারেল বলছ? আর কেনই বা বলছো যে সে একজন যোদ্ধা।”

“কারণ সে শুধু সৌন্দর্যে তোমার সমকক্ষই নয়, সে এল গ্রং-এর সমকক্ষ যযাদ্ধাও বটে। তুমি যেভাবে গার্ডদের আদেশ কর তারচেয়ে কঠিনভাবে সে নিজের সৈন্যদের আদেশ করে। তুমি এখন যাও। আমি এই জেনারেল-এর সাথে কথা বলব। আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন আবার তোমাকে ডাকব।”

“এর সাথে বেশি সময় নষ্ট করো না, এলিনা অনুনয়ের স্বরে বলে উঠে। “তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটা মুহূর্তই শূন্য লাগে।” এরপর এলিনা ডিভান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় সে জুডিথ এর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেটাতে যুদ্ধের স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।

প্রিন্স একটা আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে সরাসরি জুডিথ-এর দিকে তাকাল। আমি একজন সভ্য জগতের মানুষ এবং আমি গর্বিত যে আমি ওপরওয়ালার নীতি অনুযায়ী চলি। কিন্তু আমি স্বীকার করছি যে আমার মধ্যে কিছু অদ্ভুত জিনিস রয়েছে। আপনি যদি জেনারেল সমমর্যাদার কোনো পুরুষ হতেন তবে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার মুখোমুখি হতাম এবং আপনাকে বন্দি করতাম। এরপর আপনাকে আপনার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করতাম। আপনার মতো কমান্ডার-এর মুক্তিপণ নিশ্চয়ই কল্পনার চেয়েও বেশি হত। ইথিওপিয়ার মহারাজা নিশ্চয়ই নিজের গুপ্তধন থেকে সেই মুক্তিপণটা মেটাতে চাইত। আর সে যদি সেটা মেটাতে না পারত তাহলে আপনাকে সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণ করতে হত।”

“কিন্তু আপনি কোনো পুরুষ নন এবং সেটাই ব্যাপারটাকে এত জটিল করে তুলেছে। আপনি আপনার জনগণের কাছে এমনকি আমার কাছেও অনেক সম্মানের পাত্রী। এমনকি যে কোনো পুরুষের কাছেই আপনি জাদুকরী মানবী। আপনার মতো যুবতী রমণীর-যাকে ঠিক বালিকাও বলা যায় না-কখনও এরকম বিশাল সৈন্য বাহিনীকে শাসন করা উচিত নয়। সত্যি বলতে, আপনার মতো নারীর অবস্থান সাধারণ মানুষের চেয়েও উর্ধ্বে। আমি জানি যে আপনার জনগণ বিশ্বাস করে আপনি স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো এঞ্জেল।”

“আর তুমি মনে কর আমি নরক থেকে নেমে আসা কোনো অপদেবী, তাই না।” জুডিথ বলে উঠে। “কিন্তু আমি কোনো এঞ্জেলও নই, কোনো অপদেবীও নই। আমি অতি সাধারণ একজন নারী। এখন তুমি কী করতে চাও সেটা বল?”

প্রিন্স অনেক চিন্তাপূর্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আহ, এখন সেটাই প্রশ্ন। আমি অনেক দিন ধরে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছি। আমি যদি আপনাকে হাতের কাছে পাই তাহলে আমি কী করব? আমি অনেকবার আমার মনকে পরিবর্তন করেছি। আবারও পরিবর্তন করতে পারি।”

“এবং…?”

সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যান যেটা ছিল সেটা হচ্ছে, আপনাকে কোনো দাস বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়া। কিন্তু আপনার মতো একজনকে এত চড়া দামে কে কিনতে পারে? কিন্তু আপনার হাতে যারা নির্যাতিত হয়েছে তারা কী এতে কোনো আনন্দ পাবে? আর আপনাকে এভাবে ছেড়ে দেয়া কী অনেক বড় অপচয় হবে না? এতে আমি কী কোনো আনন্দ পাব নাকি উপকৃত হব?”

“এছাড়ও আপনি আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের অধিকারী এবং প্রজননশীলও বটে। এসব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের বিচারে আমি আপনাকে একটা আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিতে পারি।”

আমার ভাই গ্রেট মোগল অথবা কনস্টান্টিনোপাল-এর সুলতান-এর উপপত্নী হিসেবে নিজের জীবন বেছে নিন। যদি তাদেরকে একটা পুত্র সন্তান দিতে পারেন তবে তাদের জন্য সেটা অনেক মূল্যবান কিছু হবে। কিন্তু এরপরেও…” জাহান আপনমনেই বলতে শুরু করে দিল, “কেনই বা আমি ওই দুইজন লোককে সেই সুবিধা নিতে দিব? যতদিন আমি আছি ততদিন আমার উচিত আপনাকে আমার উপপত্নী করে রেখে দেয়া।”

জুডিথ রাগে লোকটিকে প্রায় থাপ্পড় দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “তোমার উপপত্নী হওয়ার চেয়ে বরং মরে যাওয়া ভাল। এমনকি তোমার প্রাসাদে তোমার গড-এর আওতায় বড় হওয়ার আগেই আমি আমার সন্তানকে নিজ হাতে খুন করে ফেলব।”

“হাঁ, আমি সেটাই ভয় পাচ্ছিলাম।” প্রিন্স লোকটি তার মাথা নাড়িয়ে বলে উঠে। এক্ষেত্রে আমি আপনাকে বন্দি খানায় নিয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হারেমে রেখে দিতে পারি। কিন্তু এখানেও আপনি একজন শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন। সে হচ্ছে এলিনা। সে যেমন মুরগির বাচ্চার মতো কোমল তেমনি বাঘিনীর মতই হিংস্র। এছাড়া আমার অন্যান্য উপপত্নীর কথাও মাথায় রাখতে হবে। তারা যদিও বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে এসেছে কিন্তু তারা সকলেই অনুন্নত পরিবেশ থেকে এসেছে। তারা যে জীবন পেছনে ফেলে এসেছে সে জীবনের তুলনায় এখানে তারা স্বর্গে বসবাস করে। তার বদলে তাদের যেটা করতে হয় তা হলো আমাকে সম্মান ও সন্তুষ্ট করা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে তারা কখনোই আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে যাবেনা। তথাপি আপনি হয়ত তাদের মাথায় এমন সব ধারণা ঢুকিয়ে দিবেন যেটা তাদের মনে ঝড় তুলবে, আমাকে অসম্মান করতে বাধ্য করবে, তাদেরকে বিদ্রোহী করে তুলবেন। ব্যাপারটা আমাকে খুব অসুবিধায় ফেলে দিবে। তখন তাদের সবাইকে খুন করে আমাকে আবার নতুন উপপত্নী আনতে হবে।”

“আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমি তোমার জন্য এধরনের অসুবিধা বয়ে আনব না,” জুডিথ অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে। “কিন্তু এখন বল, তুমি আমাকে নিয়ে যে সম্ভাব্যতার কথাগুলো বলেছে, তার সবই প্রায় উড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে কী করতে চাও?”

“প্রথমত, আপনি আজকের রাতের ডিনারে আমার সংগে যোগ দিবেন। ইথিওপিয়ায় সামরিক অভিযান সম্পর্কে আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য আপনি অগ্রিম কী ধরনের যুদ্ধ কৌশল নিয়েছেন, আপনার সৈন্যবাহিনীকে কীভাবে সাজিয়েছেন সে ব্যাপারে শুনব। তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে কোনোরকম অসম্মান আপনার জন্য অপেক্ষা করে নেই। আপনি কী এতে সম্মত আছেন?”

“তুমি আশা করো না যে, আমি তোমার দেয়া ডিনার উপভোগ করব, প্রিন্স জাহান। কিন্তু হ্যাঁ আমি আলোচনায় অংশ নিব।”

“আপনি কত মহানুভব, ম্যাডাম। আলোচনা শেষে আপনাকে আপনার কোয়ার্টার-এ নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে আপনি আগামী তিন সপ্তাহ বন্দি থাকবেন। কিন্তু আপনি আপনার পদমর্যাদার জন্য আলাদা কোনো সুবিধা পাবেন না। দুঃখের বিষয় যে আমি আপনাকে দাসদের বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য। তবে ভয় নেই। আপনাকে অন্য কারো কাছে বিক্রি করার কোনোরকম ইচ্ছে আমার নেই।”

“তাহলে কেন আমাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন? শুধু আমাকে অপমান আর হেয় করার উদ্দেশ্যে?”

“ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। জেনারেল নাজেতকে অপমান করা অনেক বড় একটা ব্যাপার”, প্রিন্স বলতে শুরু করে। “এই খবরটা জাঞ্জিবার-এর সব ব্যবসায়ীরা লুফে নিবে। শুধু তা-ই নয়, এই খবরটা যখন আরও বহুদূর ছড়িয়ে পড়বে, যখন আপনার জনগণের কাছে পৌঁছবে তখন তাদের মনে কী পরিমাণ আঘাত হানবে এটা, বুঝতে পারছেন? কিন্তু আমার কাছে এটার সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যরকম। আপনাকে উক্ত স্থানে বিক্রয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে একটা টোপ ফেলা…”

“স্যার হেনরী কার্টনিকে নিয়ে আসার জন্য। যদি সে এখনো জীবিত থাকে।”

প্রিন্স-এর চেহারা চকচক করে উঠে, “একদম ঠিক। আহ! আপনার মতো বুদ্ধিমান রমণীর সাথে কথা বলা কতই না আনন্দের যে কি-না সবকিছু না বলতেই বুঝতে পারে। এরপর আমি দুজনকেই ক্রীতদাস বানিয়ে ছাড়ব। এবং তারপর কী করব সেটা অবশ্য এখনো ঠিক করিনি। কিন্তু যদি আমি হেনরি কার্টনিকে পাই তাহলে আপনার জন্য হিসেবটা সহজ হয়ে যাবে। আপনি নিজেকে আমার কাছে সপে দেবেন নতুবা আমি তাকে হত্যা করব।”

“না…, আমি কখনোই…।”

“নিজেকে খুন করবেন? কিন্তু আপনি যদি নিজেকে হত্যা করেন তাহলে আমিও তাকে হত্যা করব। কিন্তু আপনি যদি নিজেকে একরাতের জন্য আমার কাছে সঁপে দেন তাহলে সে শুধু বেঁচেই থাকবে না আপনাদের পুনরায় একত্র হওয়ার একটা সুযোগও মিলবে।”

“কী ধরনের সুযোগ দেয়া হবে?”

“সহজ হিসেব। স্যার হেনরি কার্টনিকে আমার সৃষ্ট এই দানবের সাথে লড়তে হবে। প্রিন্স অলস ভঙ্গিতে একটা হাত বুজার্ডের দিকে দেখিয়ে বলে। এরা দুই চিরশত্রু একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তলোয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন কে বিজয়ী হয়। আর যে বিজয়ী হবে, সে-ই পুরস্কার হিসেবে আপনাকে গ্রহণ করবে।”

চামড়ার মুখোশের ভেতরে গলা পরিষ্কার করার আওয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রিন্স লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে, “বুজার্ড, কোনো কথা বলবে না। তুমি জান তোমাকে কী শর্তে এখানে আনা হয়েছে। যদি তুমি কোনো কথা বল তবে তুমি নিজেই তোমার জীবন বিপন্ন করবে। তুমি শুধু তাকিয়ে দেখ তোমার জন্য কী পুরস্কার অপেক্ষা করছে। যাকে তুমি সবচেয়ে ঘৃণা করো তার মৃত্যু এবং সে যে নারীকে ভালবাসে তার শরীর, দুটোই পাবে তুমি।”

“এই দানবটা কোনোদিনই আমার শরীর পাবে না।”

“হাঁ হাঁ, তার আগেই আপনি মৃত্যু বেছে নিবেন। সেটা আপনি অনেকবার বলেছেন।” প্রিন্স অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে বলে উঠে। “কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। একজন মা কী তার নিজেকে এবং সন্তানকে হত্যা করতে পারে? একজন মা তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে…যে কোনো কিছু।” “আপনি কী সেটার ব্যতিক্রম?” “আর বুজার্ড তুমি আজকে অনেক ভাল কাজ করেছে। জেনারেল নাজেতকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। সেটার বিনিময়ে আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই। আজ রাতের জন্য তুমি শহরে বের হয়ে ফুর্তি করার মতো জায়গা খুঁজে বের কর। পান কর, পছন্দের নারী বেছে নাও। আজ রাতের জন্য প্রমাণ করে দাও যে তুমি এখনো একজন পুরুষই আছে।”

৫. জাঞ্জিবার দ্বীপ

জাঞ্জিবার যদি একটি দ্বীপ হয় এবং এটার উপকূলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বসবাস করে তবে ট্রেস ম্যাকাকোস অথবা থ্রি মাংকিস হচ্ছে– সেই জায়গা যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বাসস্থান। এটা হচ্ছে শহরের সবচেয়ে পুরনো, নোংরা অংশের মধ্যে থাকা একটা জায়গা যেটা একটা সরু গলির মধ্য দিয়ে শহরের এক পাশ থেকে অপর পাশে বয়ে গিয়েছে। এখানে আগে দেদারসে মদ বিক্রি করা হতো। ওমানি কর্তৃপক্ষ মদ হারাম বলে তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও এখনো কিছু অবিশ্বাসী অধার্মিক ব্যক্তিরা হরহামেশাই মদ বিক্রি করে এখানে অনেক ব্যক্তিই টেভার্ন এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে। তারা অনেক বড় অংকের টাকাও প্রদান করে। অনেক জাঞ্জিবারবাসির মতো তারা এখানে কাঁচা স্পিরিটকে রাম হিসেবে কিংবা বিশ্রী গন্ধ যুক্ত ভিনেগারকে ওয়াইন হিসেবে খাওয়ার জন্য নয়, বরং মোরগযুদ্ধ কিংবা ডগফাইট উপভোগ করার জন্য।

টেভার্নস-এর প্রধান অভ্যর্থনা কক্ষে বিভিন্ন ধরনের লোকের সমাগম হয়। জলদস্যু, চোরাকারবারী, দাস-ব্যবসায়ী বণিক, বিভিন্ন পদমর্যাদার জাহাজের লোক। যাদের স্বাগত জানানোর জন্য রয়েছে বিভিন্ন রকমের পোশাকে সুসজ্জিত নারী। খরিদদারদের আকর্ষণ করার জন্য রমণীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন রঙ-এর পাউডারের গন্ধে জায়গাটার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এরকম পরিবেশে বুজার্ড যখন তার একজন ব্যক্তিগত দাস এবং দুজন পাহারাদার নিয়ে হাজির হয়, তখন সেখানে হৈ চৈ পড়ে যায়। পাহারাদার দুজনের কাজ বুজার্ডকে শুধু রক্ষা করাই নয়, জাহানের হাত থেকে বুজার্ড যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেদিক লক্ষ রাখা। একজন মাতাল লোক বুজার্ডকে দেখে চিৎকার করে উঠে, “সরি, বার্ডম্যান। তোমার খাওয়ার জন্য এখানে কোনো পোকামাকড় নেই।”

এরপর যখন বুজার্ডের তলোয়ার এর মাথা তার গলায় ঠেকানো হয় তখন সে হাত জোড় করে মাফ চাইতে থাকে।

বুজার্ড বার-এর ওপর দাঁড়িয়ে তার পান করার পাত্রটা হাতে নিয়ে বলতে থাকে, “এটাতে মদ পূর্ণ করে দাও। আর যদি তোমাদের টাকার প্রয়োজন পড়ে তবে প্রিন্স জাহানের কাছে গিয়ে চাও।” যে দাসীটি সবাইকে পরিবেশন করছিল তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। জাঞ্জিবার-এর সবার মতো সেও জানে যে প্রিন্স জাহানের কাছে একটা জিন আছে যেটা দেখতে অর্ধেক মানব এবং অর্ধেক পাখির মতো। মেয়েটি সেই খুন হওয়া ছোট ছেলেটার কথাও শুনেছে যে কি-না দানবটার মুখে ময়লা ছুঁড়ে দিয়েছিল। এখন সেই দানব যদি মদ চায় তাহলে তর্ক করতে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। সে জানে তার মালিকও এটা নিয়ে কোনো কথা বলবে না।

বুজার্ডের সাথে আসা দাসটা মদের পাত্র পূর্ণ করে তার মনিবের সাথে সাথে গিয়ে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে। পূর্বের শেখানো পদ্ধতিতে সে বুজার্ডের মুখে নল এগিয়ে দেয়। বুজার্ডও মদের পাত্র খালি করতে থাকে।

ভেতরে কোনো এক খাবারের টেবিল থেকে চাপা হাসির আওয়াজ শোনা যায়। বুজার্ড অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। তার নাকটা জাহাজের পালদণ্ডের ন্যায় তার সামনে ঘুরতে থাকে। তার শকুনের ন্যায় দৃষ্টি একজনের পর একজনের ওপর পড়তে থাকে। সবরকম। হাসির আওয়াজ, শব্দ থেমে যায়। তখন বুজার্ড-এর মাথা ঘুরানোও থেমে যায়। সে একটা নির্দিষ্ট টেবিলের দিকে দৃষ্টিপাত করে। বুজার্ড তার শরীর ঘুরিয়ে সেইদিকে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বুজার্ড আস্তে আস্তে সেই টেবিলের দিকে অগ্রসর হয়।

বুজার্ড যে টেবিলের ওপর দৃষ্টি ফেলেছিল সেটার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছল। একজন মানুষ বসে আছে সেই টেবিলে। লোকটির সামনে একটি মদের বোতল আর একটি পানির পাত্র রাখা আছে। বুজার্ডের আগমনেও লোকটিকে ভীত বলে মনে হচ্ছে না। সে চুপচাপ বসে থেকে বুজার্ডের মুখোশের ওপর আঁকা চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর সে বুজার্ডকে বলে, “আমি তোমাকে দেখে পিছিয়ে পড়ব না। যদি তুমি কাউকে ভয় দেখাতে চাও তাহলে অন্য কাউকে খুঁজে বের কর।”

এরপর বুজার্ড যা করে সেটা উপস্থিত কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং একটা চেয়ার টেনে সেটাতে বসে পড়ে। এরপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যাপ্টেন হামিশ বেনবুরি, আমি বেঁচে আছি! তোমার কেমন চলছে?”

কামরার ভেতরকার নীরবতা আস্তে আস্তে গম্ভীর হতে থাকে। সবার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলেও ক্যাপ্টেন বেনবুরি যেমন ছিল তেমনই চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সে কয়েকমুহূর্ত মেঝের দিকে তাকিয়ে পা নড়াচড়া করতে থাকে। এরপর সোজা বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, “গুড ডে টু ইউ কোকরান।” আমার মা বলে, “তুমি অনেক আগেই মারা গেছ। কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে মিথ্যে।” এরপর সে যথেষ্ট পরিমাণ মদ পান করে এবং বলতে থাকে, “আমি ভেবেছিলাম, তুমি আগে দেখতে যেমন ছিলে, তোমাকে তার চেয়ে বেশি কুৎসিৎ বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আমার ধারণা ভুল।”

বুজার্ড উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। আর ঠিক তখনি, সে সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়; তার হাসি সামাল দিতে ফুসফুস যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস নিতে পারছে না। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই তার তীব্র কাশি শুরু হয়। সেই কাশি সামাল দিতে সে তীব্র হতাশা আর যন্ত্রণায় টেবিলের ওপর হাতের মুঠি দিয়ে চাপড় মারতে থাকে। এরপর সে ঘুরে তার সাথে আসা চাকরদের দিকে তাকায় যারা এখনো টেবিলে বসে আছে। বুজার্ড-এর ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে ওরা বুঝতে পারে বুজার্ড রাম-এর বোতল টেবিলে ফেলে এসেছে। তারা দ্রুত সেটা নিয়ে দৌড়ে আসে এবং বুজার্ডের মুখে নল ঢুকিয়ে দেয়।

সমস্ত ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যায় যে সবার মধ্যে ভয়ের রেশ কাটতে একটু সময় লাগে। সবাই আগের কথাবার্তা, কাজকর্মে ফিরতে শুরু করলেও থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে চারপাশে। আস্তে আস্তে সবাই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যায়। মোরগ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বুজার্ড এবং ক্যাপ্টেন বেনবুরি শান্তিতে তাদের গল্প শুরু করে।

পরবর্তী কয়েক মিনিট ধরে বুজার্ড তার গত কয়েকমাসের গল্প বলে যায়। কীভাবে সে বেঁচে যায়, কীভাবে উদ্ধার পায়, কীভাবে জাহানের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত হয়। কীভাবে সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে পূর্বের শক্তি, যুদ্ধ করার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে, এমনকি জাহানের হারেমের গল্পও বলে সে। জাহানের উপপত্নীরা কীভাবে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল সেটাও বলে।

“তাই নাকি?” বেনবুরি বলে উঠল। আমি সবসময় জানতাম অন্য কোনো পুরুষের জাহানের হারেমে প্রবেশের অনুমতি নেই। শুধু সুলতান নিজে এবং কোনো নপুংসক হিজড়া ব্যতীত। আমি হয়ত ভুল জানতাম। তুমি নিশ্চয়ই নপুংসক নও, কোকরান?”

বুজার্ড ব্যাপারটাকে অস্বীকার করে এবং বলে যে এটা তাকে দেয়া এক বিশেষ সুযোগ। “হ্যাঁ, তা হতে পারে,” বেনবুরি বলে। যদিও সে বুজার্ডের মুখোশ এবং গলায় লাগানো রিং দেখতে থাকে। পেছনে দাঁড়ানো গার্ডরা কীরূপে বুজার্ডের দিকে তাকাচ্ছে সেটাও সে দেখতে পায়।

অন্য মানুষ কী ধারণা করেছে সেটা বুজার্ড বুঝতে পারছে। সে বেনবুরির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল যে বেনবুরি তার রিং-এর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই সে বলে উঠল, “এটা নিয়তি। এগুলো লাগানো হয়েছে যেন আমাকে কুকুরের মতো টেনে নেয়া যায়।” “আচ্ছা যাই হোক, এখন এই বিষয় বাদ দেয়া যাক। অন্য কথা বল।”

“তো বেনবুরি তুমি আমার গল্প শুনেছে,” বুজার্ড আবার বলতে শুরু করে। “এখন বল তুমি এবং তোমার পেলিকান-এর কী অবস্থা?” “আমি আশা করব তুমি এখনো সেটার মালিক আছ। তাই না?”

“হ্যাঁ, আমি এখনো এটা গর্ব করে বলতে পারি যে, আমি পেলিকান-এর ক্যাপ্টেন,” বেনবুরি উত্তর দেয়। এখন আমি ব্যবসার ব্যাপারে চিন্তা করব। সেই ব্যবসায় আমরা দুজনেই কীভাবে লাভবান হতে পারি সেই চিন্তা করব।”

বুজার্ড সামনের দিকে ঝুঁকে বসে এবং মাথাটা এমনভাবে কাত করে যেন তার একমাত্র চোখটির দৃষ্টি সরাসরি সামনের লোকটির চোখে পড়ে। এরপর প্রশ্ন করে, “কীভাবে?”

“আমি এখানে এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হয়েছি। তুমি কী বালথাজার বোবো নামে কোনো পর্তুগীজ ব্যবসায়ীর নাম শুনেছ?”

“ঠিক বলতে পারছি নে।”

“সে হচ্ছে এক অন্যরকম ভদ্রলোক। আমি হয়ত তোমাকে বলেছিলাম যে বহুবছর ধরে সাহিলি উপকূলের বন্দরে পর্তুগীজদের জাহাজ নোঙর করা আছে। ওখানে তাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে। কিন্তু ওখানে সাদা লোকদের প্রবেশ নিষেধ। তারা সেখানে আশেপাশের রাজ্যে সোনা বিক্রি করে।”

“আমি এসব জানি বেনবুরি। আমি পর্তুগীজদের অনেক জাহাজ চালিয়েছি। তাদের জাহাজের ভেতর সোনা বোঝাই করা থাকে। কিন্তু পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে কোনোরকম যুদ্ধ করার অনুমতি না থাকায় আমি সেসব নিতে পারি নি।”

“এরপর বহুবছর যাবত পর্তুগীজরা সেই বন্দরে থেকে দ্বীপের ভেতর বাণিজ্য চালিয়েছে। এখানে সেখানে তাদের ব্যবসার কতগুলো স্থান রয়েছে। কিন্তু মিশনারীরা-যারা তাদের আত্মা শুদ্ধ করতে দ্বীপে যায়-স্থানীয় লোকদের সোনার আসল গ্রহণযোগ্যতা বা মূল্য বুঝিয়েছে। তাই এখন বালথাজার লোবো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সোনা ক্রয় করার জন্য আর উপকূলে অপেক্ষা করবে না। সে দ্বীপের ভেতরে যাবে। কিংডম অব মানিয়াকা নামে একটা জায়গায় সে খনিজ পদার্থের খনি খুঁজে পেয়েছে।”

“আমার মনে হয় না স্থানীয় প্রধান এতে খুশি হবে, তাই না।”

“লোবো স্থানীয় প্রধানের মুখ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সম্মানী দিয়েছে। সে একটা খনি উত্তোলনের কাজ শুরু করেছে এবং তাতে যথেষ্ট পরিমাণ সোনা পেয়েছে।”

“সে কী তোমাকে কিছু দেয়, বেনবুরি? এটাই কী তোমার ব্যবসা?”

“না, সে আমাকে কিছু দেয় না…এখনো পর্যন্ত। তবে আমি আশা করি যে। সে শীঘ্রই দিবে। দেখ, সেনর লোবোর একটা ছোট সমস্যা আছে। সে এমন কোনো নারী খুঁজে পাচ্ছে না যে তাকে একটা সন্তান দিতে পারে।”

“সম্ভবত সমস্যাটা মহিলাদের নয়।”

“হ্যাঁ, তুমি হয়ত ঠিকই বলেছ কোকরান। কিন্তু দেখ, যদি এমন কোনো রমণী খুঁজে পাওয়া যায় যার পেটে সন্তান আছে, আর তাকে যদি লোবোর হাতে তুলে দেয়া যায় এবং কিছুদিন পরে তাকে বিশ্বাস করানো যায় যে এ সন্তান তার নিজের তাহলে হয়ত এ ক্ষুদ্র সমস্যার সমাধান করা যায়।”

“তা অবশ্য করা যায়। আমার মনে হয় এতে সে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে।”

“এখন আমাকে এই ধরনেরই একটা নারী খুঁজে বের করতে হবে লোবোর কাছে বিক্রি করে দেয়ার জন্য। আমি জাঞ্জিবার-এ এসেছি এরকম কাউকে পাওয়ার আশায়। আমি সুলতান-এর হারেমে তোমার যাতায়াতের ব্যাপারে গল্প শুনেছি। আমি ভেবেছি যে সুলতান যখন তার কোনো উপপত্নীকে নিয়ে ক্লান্ত এবং একঘেয়ে হয়ে উঠে তখন কী করে? সে নিশ্চয়ই তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেয়। এবং এক্ষেত্রে তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পার। সুলতান যদি তার কোনো উপপত্নীকে বিক্রি করে দেয়, তবে সে যেন আমার কাছেই বিক্রি করে। তুমি তাকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করবে।”

এরপর বুজার্ডের লুকানো চেহারায় এক ধরনের হাসি ফুটে উঠে। মুখোশের ওপর আঁকানো হাসির ন্যায় প্রশস্ত সে হাসি। বেনবুরির কথায় সমস্ত সমস্যার সমাধান সে একটাই দেখতে পায়। একটা নতুন জীবন শুরু, প্রিন্স-এর কাছ থেকে মুক্তি এবং কার্টনির ওপর প্রতিশোধ।

“আমি তোমার জন্য এর চেয়ে অনেক অনেক ভাল কিছু করতে পারি। আমি তোমাকে এমন মহিলা এনে দিতে পারি যে কিনা লোবোর জন্য সন্তান ধারণ করবে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে একটা পেনীও খরচ করতে হবে না…তার চেয়ে বরং লোবো তোমাকে যে টাকাটা দেবে, ওটার অর্ধেকটা আমাকে দিও, তাহলেই হবে।”

“কিন্তু আমি তা কেন করব?”

“কারণ এই রমণীর মূল্য কোনো রাজার চেয়ে কম নয়। ওকে পেলে যে কেউই নিজেকে রাজা বলে ভাবতে শুরু করে দেবে।”

এরপর বুজার্ড সবকিছু বলতে শুরু করে। গল্প করতে করতে সামনে রাখা মদের বোতল শেষ করার পর বেনবুরির জন্য ওয়াইন-এর বোতল অর্ডার করে। যখন তাদের মদের বোতলগুলো খালি হয় তখন তারা হ্যান্ড শেক করে তাদের কথা পাকাঁপোক্ত করে নেয়। বুজার্ড তার দাসদের নিয়ে ট্রেস মেকাকোস ত্যাগ করে। এখানে আসার সময় যেরকম অনুভূতি নিয়ে এসেছিল সে, এখন তার চেয়ে অনেক ভাল অনুভব হচ্ছে ওর।

*

তিনজন মানুষ প্রেতাত্মার মতো শহরের একছাদ থেকে অন্যছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাল, বিগ ডেনিয়েল আর উইল স্ট্যানলি নীরবে এবং খালিপায়ে অনেকটা ছায়ার মতো করে কনসাল গ্রে’র ছাদের পেছনের একটা সমতল টেরেসে আস্তে করে লাফ দিয়ে চলে আসে। কাজটা যদিও সহজ নয়। কিছুকিছু ছাদের টাইলস এমনভাবে লাগানো যে তাদের পায়ের নিচে কটকট আওয়াজ করছে। আবার কিছু কিছু এমন হালকাভাবে লাগানো যে তাদের মনে হচ্ছিল এখনই পা পিছলে পড়ে যাবে। জাহাজের ঘূর্ণনের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবত চলাফেরার অভিজ্ঞতার ফলে আজকের মতো তারা রক্ষা পেয়ে যায়। যদিও এখনো তাদের আরও একটু সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছতে হবে। জায়গাটা গ্রে’র বাড়ির ছাদ থেকে পাঁচ ফিট উচ্চতায় আছে।

গ্রে’র বাড়ির সামনের দিকটা মেহগনি কাঠ দিয়ে অনেকটা শৈল্পিকভাবে সাজানো ইসলামিক স্তম্ভের ন্যায় বসানো আছে। দেয়ালে জানালা আছে। কিন্তু জানালার নিচে বেলকনি আছে যেগুলোতে আবার রেলিং দেয়া। এগুলো তাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করবে।

“তুমি কী তাকে দেখতে পাচ্ছ?” ডেনিয়েল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।

হাল-এর চোখ বাজপাখির মতো অন্ধকারে এদিক সেদিক অ্যাবোলিকে খুঁজছে। রাস্তার অদূরেও কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। রাতের আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। সেই মেঘ ভেদ করে চাঁদের আলোও খুব একটা প্রবেশ করছেনা।

“এখনো নয়,” হাল বলল, যদিও সে পাহারাদারদের দেখতে পাচ্ছে। দুজন আফ্রিকান লোক সাদা আলখাল্লা পড়ে দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত করছে যে শুধু ব্যবসায়ী আর চাকর-বাকর ছাড়া কেউই যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পাহরাদারদের হাতে একটা করে ব্লান্ডারবাস দেয়া আছে-এই মুহূর্তের জন্য একদম সঠিক অস্ত্র। কারণ এটা থেকে গুলি চালনা করলে তা এমন বিকট আওয়াজ করে যে সবাইকে জানিয়ে দেয় এখানে কোনো বিপদ হয়েছে।

ছাদের পাশ দিয়ে দুজনলোক একপাশ থেকে অন্যপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। হাল এবং পেট যখন লাঞ্চ করতে আসে তখন এখানে কোনো লোক ছিল না। গ্রে সবসময় তার নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে। সে নিশ্চিত করতে চেয়েছে রাতে যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে সে যেন নিরাপদে থাকে।

“ওখানে,” হাল ফিসফিস করে বলল। বিগ ডেনিয়েল এবং স্ট্যানলি হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে চলে আসে।

বিগ ডেনিয়েল হিসস জাতীয় আওয়াজ করে উঠে। কারণ ছাদের বিপরীতে অ্যাবোলিকে দেখা যায়। হাতে ছুরি নিয়ে বাঁকা হয়ে পেছন দিক থেকে পাখির মতো দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা গার্ডের দিকে।

হাল তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলেছে। কারণ গার্ড যেকোনো মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং তার ব্লান্ডারবাস থেকে গুলি চালাতে পারে। কিন্তু অ্যাবোলি ততক্ষণে চিতাবাঘের ন্যায় আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।

সে তার বাম হাত দিয়ে গার্ডটার নাক মুখ চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে ছুরিটা কানের নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাল ছুরিটার অগ্রভাগ গলার অন্যপাশ দিয়ে বের হতে দেখে। অ্যাবোলি ছুরিটা গলা কেটে বের করে ফেলে এবং লোকটি হাঁটু ভেঙে সামনের দিকে পড়ে যায়। অ্যাবোলি আবার দ্রুত চলতে শুরু করেছে। কিন্তু আরেকটা পাহারাদার ছাদের পূর্বদিক থেকে দৌড়ে আসছে। স্ট্যানলি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে।

“সে এবার ধরা খেয়ে যাবে…” বিগ ডেনিয়েল বিড় বিড় করে বলে।

লোকটি ব্লান্ডারবাস চালাতে উদ্যত হয় কিন্তু তার আগেই অ্যাবোলি দৌড়ে গিয়ে লোকটির বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়-পাজরের হাড়ের নিচ দিয়ে একেবারে হার্ট পর্যন্ত। ছুরিটা বের করে লোকটি চিৎকার করার আগেই তার গলায় বসিয়ে দেয় এক কোপ। অ্যাবোলি ব্লান্ডারবাসটা ধরে লোকটিকে কোনোভাবে নিচে ফেলে দেয়। এরপর সে পাহারাদারটার দেহ পাশ কাটিয়ে ছাদের এক কোণে চলে আসে যেখানে রশি টানানো আছে।

ডেনিয়েল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আমি তাকে ভাইয়ের মতো ভালবাসি। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, সে চিকেন পক্স-এর চেয়েও সাংঘাতিক।”

তারা দাঁড়িয়ে রশিটার এক পাশ ধরে রাখে এবং অন্য পাশটা অ্যাবোলি তার কোমড়ে বেঁধে ফেলে। এরপর আস্তে আস্তে রশিটা ধরে উপরে উঠতে থাকে। যদি জানালা দিয়ে কেউ অ্যাবোলির ছায়া দেখে ফেলে তবে সমস্ত পরিকল্পনা বিফলে যাবে এবং তারা কোনোদিন জানতেও পারবে না জুডিথ কোথায় আছে।

“ঈশ্বর তাকে রক্ষা করুন, বিগ ডেনিয়েল বলল।

“কোনো কিছুর সাথে রশিটা বাঁধতে পারলে বেশি সুবিধা হত,” স্ট্যানলি বলে। হাল বুঝল যে তার বন্ধু ঠিকই বলেছে। সেখানে শুধু একটা জানালা এবং জানালার নিচে একটা ছোট্ট জায়গা রয়েছে। জানালা দিয়ে হলুদ রঙের আলোক রশ্মি বের হয়ে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু যখনই কথাটা বলা শেষ হয় তখনই অ্যাবোলি প্রায় দশ ফিট নিচে ব্যালকনির এক কোণায় লাফ দেয়। রশিটা সে তার কোমড় থেকে খুলে ফেলে এবং কাঠের রেলিং-এ বেঁধে নেয়। তার পেছনের জানালা দিয়ে কোনো আলো আসছে না।

এখন আমাদের পালা। বিগ ডেনিয়েল নিজের রশির অংশটা কোমড়ে বাধতে বাঁধতে বলে। রশিটা টান টান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে পেছাতে থাকে। ছাদের ওপর শক্ত কোনো কিছু নেই যেটার সাথে রশিটা আটকে রাখা যায়। তাই বিগ ডেনিয়েল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেই সেই দায়িত্ব নিয়ে নিলো।

“তুমি কী নিশ্চিত যে তুমি পারবে?” স্ট্যানলি জিজ্ঞেস করে।

“তুমি শীঘ্রই সেটা জানতে পারবে।” মাঝি উত্তর দেয়।

“ডেনী তুমি নটটা শক্তভাবে ধরে রেখ। আমি প্রথমে যাব,” হাল বলল। সে তার এক বাহু এবং এক পা দিয়ে রশিটাকে জাপটে ধরে-হরিণ মারার পর যেভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয় অনেকটা সেভাবে। বিগ ডেনিয়েল তার শক্ত বাহু দিয়ে রশিটাকে টান টান রাখার চেষ্টা করছে।

“আপনি নামুন ক্যাপ্টেন,” সে বলল, হাল রাতের অন্ধকারের মধ্যে আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে থাকে। তার নেপচুন তলোয়ারটা পেছন থেকে ঝুলছে, দুটো পিস্তল তার কোমড়ে আটকানো। এখন কোনো কথা নয় শুধু মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। সে তার পা দুটো দিয়ে আড়াআড়ি করে রশিটাকে ধরে রাখে। তার জীবনের অর্ধেকটা সময় সে মাস্তুলের ওপর রশি বেয়ে উঠানামা করেছে। কিন্তু কোনো গার্ড যদি এখন বাড়ির পেছন থেকে বের হয়ে কিংবা জানালা দিয়ে কেউ দেখে ফেলে তবে তার সেই দক্ষতা তাকে– বাঁচাতে পারবে না।

অন্ধকারের মধ্যে স্কুলে থেকে হাল যদিও তার চারপাশের কিছু দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার নিজের হার্টবিট সে নিজ কানে শুনতে পাচ্ছে। জাঞ্জিবার এর রাস্তা থেকে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। সাগরের ঢেউ-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে অপেক্ষা করছে কেউ কোনো গানফায়ার-এর শব্দ করে কি-না। কিন্তু কোনো শব্দই এলো না। আস্তে আস্তে রশির শেষ মাথায় পৌঁছে যায় হাল।

হাল এক পা রেলিং-এর ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়ে সমস্ত শরীরটাকে টেনে বেলকনির ভেতরে নিয়ে আসে এবং অ্যাবোলির মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাল আর অ্যাবোলি একে অপরের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নেড়ে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল পরস্পরের কাছে-এখনো পর্যন্ত সব ঠিক-ঠিক মতোই চলছে। ওরা তাকিয়ে দেখল যে স্ট্যানলিও ততক্ষণে এগিয়ে আসছে। ঠিক তখনই জাঞ্জিবার-এর আকাশ থেকে মেঘ কেটে যায়। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে যায় শহরটা। স্ট্যানলি যে কি-না এতক্ষণ অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে নড়াচড়া করতে পারছিল না, সেও এগিয়ে আসছে রশি বেয়ে। কিন্তু হঠাৎ ঝাঁকুনিতে বিগ ডেনিয়েল তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। হাল শুনতে পায় ডেনিয়েল চিৎকার দিয়ে উঠেছে। স্ট্যানলি দ্রুত পড়তে থাকে, কিন্তু স্রেফ কপালগুণে শেষ পর্যন্ত ঝুলে থাকতে পারে; বিগ ডেনিয়েল-এর পা পিছলে যাওয়ার পরও পেছন দিকে ঝুঁকে রশি টান টান করে ধরে রেখেছিল সে।

এরইমধ্যে স্ট্যানলি বেলকনিতে পৌঁছে যায়। অ্যাবোলি ছুরি হাতে প্রস্তুত হয়ে যায়-যদি হঠাৎ করেই কোনো গার্ড চলে আসে। এরপর সে জানালার হাতলটা শক্তভাবে ধরে ধাক্কা দেয়। জানালা খুলে যায়। লাফ দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে অ্যাবোলি, সেই সাথে ছুরি হাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

কিন্তু ঘরে কেউ ছিল না। কিছু আসবাবপত্র চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। হাল আর স্ট্যানলি অ্যাবোলির সাথে যোগ দিয়ে দরজার দিকে এগুতে থাকে। হাল দরজার খিলটা আস্তে করে খুলে ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল। সে সেটাই দেখতে পায় যা সে প্রত্যাশা করেছিল।

বিল্ডিং-এর তিনপাশে একতলাসমান উঁচু যে স্তম্ভ শ্রেণিগুলো রয়েছে সেগুলো একেবারে উঠোন পর্যন্ত চলে গিয়েছে যার মাঝখানটায় যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা রয়েছে। এর বিপরীত দিকে যেদিকে হাল ও তার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কোনো স্তম্ভশ্রেণি নেই। একারণে তারা বিল্ডিংগুলোর পুরো অংশ দেখতে পাচ্ছে। বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর যে বিল্ডিংটা সেটার জানালাগুলো আয়রণ লিয়ন দিয়ে নকশা করা। সম্ভবত গ্রে তার নিজের ব্যবহারের জন্যই এটা সংরক্ষণ করে রেখেছে। হাল দেখতে পায় জানালা দিয়ে মোমবাতির মৃদু আলো বেরিয়ে আসছে যেটা থেকে বোঝা যায় যে গ্রে হয়ত এখনো জেগে আছে। ডেম! হাল চিন্তা করে, “সে যদি জেগে থাকে তাহলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে।”

হাল বাকিদের ইশারা করলে তারা হাল-এর সাথে সাথে স্তম্ভগুলোর ভেতর দিয়ে আসতে থাকে। হাল জানে প্রধান প্রবেশ পথের সামনে আরও দুজন গার্ড থাকতে পারে। কিন্তু এদিক সেদিক তাকিয়ে সে গার্ডদের কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না।

তারা তিনজনে মিলে ঘেরাও করা জায়গাটার চারদিকে ঘুরে-ঘুরে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। জায়গাটার মাঝখানে একটা নরম পানির ঝরণা পানির ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে। তাই টাইলস করা মেঝেতে পা যেন পিছলে না যায় সেদিকেও তাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে। পেয়াজের ন্যায় গোল জায়গাটায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা একটা কাঠের দরজা দেখতে পায়। হাল তার ডানহাতে ছুরিটা নিয়ে দরজার খিল খুলে ধাক্কা দেয়। দরজাটা খুলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে ভেতরে প্রবেশ করে সে। অ্যাবোলি আর স্ট্যানলিও তার সাথে ভেতরে প্রবেশ করে।

এমন সময় হাল চিকন স্বরের চিৎকার শুনতে পায়। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। দেখতে পেল, ঘরের ভেতরে গ্রে প্রায় নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“স্যার হেনরি,” গ্রে অনেকটা তোতলামি করে বলে উঠল। তার পেছনে একটা নগ্ন আফ্রিকান বালক শুয়ে আছে। তেল দেয়ার ফলে ছেলেটার কফি রঙা চামড়া চকচক করছে।

‘কনসাল গ্রে,” হালও তার নেপচুন তলোয়ারটা তাক করে সম্বোধনের জবাব দেয়।

“কেউ একজন আসছে গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি হালকে বলল। তারা পায়ের শব্দ শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে একটু আগে দেয়া গ্রের চিৎকারে তার লোকেরা এগিয়ে আসছে।

গ্রের দরজায় দু’বার টোকা মেরে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “কনসাল। সব ঠিক আছেতো? কনসাল!”

গ্রে একবার হাল, আরেকবার অ্যাবোলির মুখের দিকে তাকাল। এরপর তার দিকে তাক করা তলোয়ার-এর দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিয়েই দরজার দিকে চোখ দিল। তার চেহারা ভয় আর সিদ্ধান্তহীনতায় প্রায় জমে যাচ্ছে।

“আমাকে সাহায্য কর,” সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। ধড়াম করে দরজা খুলে গিয়ে দুজন লোক ভেতরে প্রবেশ করল।

বিদ্যুৎ বেগে অ্যাবোলি ওদের একজনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাহু দিয়ে গলা প্যাচিয়ে ধরে পেছনে নিয়ে যায়। হাল তার তলোয়ারটা লোকটার মুখে ঢেকিয়ে দিল। কিন্তু তলোয়ার সরিয়ে আরেকজন গার্ড হালকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তার আগেই স্ট্যানলি তাকে পেছন থেকে আঘাত করে বসলো। গার্ডটা মেঝেতে পড়ে যায়। তার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এরপর স্ট্যানলি বিছানার দিকে এগোয়। যে ছোট ছেলেটা বিছানায় ছিল সে চাদরের নিচে লুকোতে থাকে।

এদিকে দরজার পাশে থাকা অ্যাবোলি অন্য গার্ডটাকেও প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং বলে উঠে, “অনেক হয়েছে! তোমার গডের কাছে যাও এখন?”

এসব দেখে ভয়ে আর আতংকে প্যান্ট ভিজিয়ে দিল গ্রে। তার মূত্রের ধারা গড়িয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

“জুডিথ কোথায়? তারা জুডিথকে কোথায় নিয়ে গেছে?” হাল তার তলোয়ারটা গ্রে’র পেটের দিকে তাক করে জিজ্ঞেস করে। অ্যাবোলি ততক্ষণে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওটার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছে।

গ্রে বুঝতে পারল যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তার চেহারা থেকে ঘামের ফোঁটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। কিন্তু সে কোনোরকম কথা বলছে না।

হাল তার তলোয়ারের অগ্রভাগ গ্রে’র গালে ছোঁয়াল। পেছাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল কনসাল গ্রে। তার গালে লাল দাগ পড়ে গেল সাথে সাথে।

“ওরা জুডিথকে কোথায় নিয়ে গেছে?” হাল আবারো জিজ্ঞেস করল।

হাল এবার তার মুষ্টি দিয়ে গ্রে’র কানের ওপরে সজোরে ঘুসি লাগাল।

গ্রে’ প্রথমে মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল। কোনোরকমে ভারসাম্য রক্ষা করে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তীব্র ভয়ে ওর চোখগুলো বড় বড় হয়ে গিয়েছে।

“তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও তাই না হাল?” সে বলে উঠে। “তবে তাই কর।”

“আমি আপনাকে এরপর আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করব না,” হাল বলল। “আমাকে শুধু বলুন যে বুজার্ড এবং তার লোকেরা জুডিথকে কী করেছে?”

“এভাবে অনেক সময় লাগবে”, অ্যাবোলি বলে উঠল।

“তুমি গোল্লায় যাও, কার্টনি,” গ্রে ফোঁস ফোঁস করে বলে উঠে। হয় সে তার হারানো সাহস ফিরে পেয়েছে, নয়ত আজকে রাতে সে বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছে। হাল তার তলোয়ার তুলে লোকটাকে পুনরায় আঘাত করতে যাচ্ছিল।

“থাম, গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি বলে উঠল। হাল তলোয়ার নিচু করে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। “তাকে কীভাবে কথা বলাতে হবে সেটা আমার জানা আছে।”

ইতস্তত করছে হাল। কিন্তু অ্যাবোলি তাকে আবারো বলল, “তুমি যদি ওকে আমার হাত না দাও তাহলে ওর মুখ থেকে কথা শুনতে হলে আমাদেরকে এখানে সারা রাত অপেক্ষা করতে হবে।”

হাল-এর ইচ্ছে হচ্ছিল তার নেপচুন তলোয়ারটা বদমাশটার হার্টের ভেতর দিয়ে পার করে দিতে। কিন্তু তাতে তো জুডিথকে রক্ষা করা যাবে না। তাই বহু কষ্টে সে তার রাগ দমন করল। “সে এখন শুধুই তোমার, অ্যাবোলি।”

অ্যাবোলি বিছানা পার হয়ে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যায় যেটাতে কনসাল-এর জামা ভাজ করে রাখা আছে। অ্যাবোলি জামাটার একটু অংশ কেটে নিয়ে গ্রে’র মুখে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে কাপড়টা ভেতরে ঢুকাতে থাকে-লোকটার কাশি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত। এরপর চেয়ারটা টেনে ঘরের মাঝখানে নিয়ে আসে এবং গ্রেকে সেটাতে বসায়। তারপর বিছানার চাদর থেকে ফিতার মতো কিছু অংশ কেটে সেটা দিয়ে রশি তৈরি করে। সেগুলো দিয়ে কনসাল-এর পাদুটো চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলল সে। হাল জানে অ্যাবোলির মনে কী খেলা করছে। সে গ্রে’র নিজের বেল্টটা নিয়ে হাতদুটো চেয়ারের পেছনে বেঁধে ফেলল।

গ্রে তার ফুলে যাওয়া চোখগুলো দিয়ে হাল-এর দিকে তাকায়। তার চেহারার একপাশটা গাঢ় পার্পল রঙ ধারণ করেছে। তার মোটা পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে।

অ্যাবোলি গ্রে’র চেয়ারের পেছনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে। সে গ্রে’র দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়, এরপর ছুরি হাতে কাজে লেগে যায়। গ্রে ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠে। কিন্তু গড়গড় আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না কারণ তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া আছে। অ্যাবোলি যখন কাজ শেষ করে উঠে আসে তখন দেখা যায় তার বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনীর মাঝে গ্রে’র কাটা আঙুল ঝুলে আছে। এরপর সে চেয়ারের সামনে গিয়ে গ্রে-কে তার নিজের কাটা আঙুলটা দেখায়।

“ক্যাপ্টেনকে যা জানতে চাচ্ছে তাকে তা বলে দাও, গ্রে”, অ্যাবোলি ভয়ংকরভাবে বলল। “যদি না তুমি যোবা আর অন্ধ হয়ে যেতে চাও। কারণ তুমি যদি না বললো, তাহলে আমি তোমার জিব কেটে ফেলব, সেই সাথে চোখগুলোও তুলে নেব।”

গ্রে ভয়ে দ্রুত মাথা নাড়ায় এবং বোঝায় যে সে কথা বলবে। অ্যাবোলি কাটা আঙুলটা মেঝের ওপর রাখল। কনসাল-এর মুখে দেয়া কাপড়টা উঠিয়ে নেয়ার পর কনসাল মুখ হা করে শ্বাস নিতে থাকে। হাল এক জগ ওয়াইন গ্রে-র মুখের সামনে ধরে। গ্রে সেটা দ্রুত পান করতে গিয়ে অর্ধেকটা তার পেটের ওপর ফেলে দেয়।

“বুজার্ড জুডিথকে কোথায় নিয়ে গেছে?” হাল আবারো জিজ্ঞেস করে। গ্রে এবার দ্রুত মাথা নাড়ায় যদিও তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বেশিকিছু হালকে বলতে চাচ্ছে না।

“ক্যাপ্টেন কার্টনি, সত্যটা হল…” গ্রে ওয়াইন-এর জগ-এর দিকে ইঙ্গিত করল। তাই হাল আবারো সেটা গ্রে-এর মুখের সামনে ধরে ওটা পান করার সুযোগ করে দেয়। “সত্যটা হলো…” গ্রে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “আপনি আর কখনোই সেই বেয়াদব মেয়েটাকে দেখতে পাবেন না। কারণ সে এখন প্রিন্স জাহান-এর কাছে আছে।” “তাকে জাঞ্জিবার-এর দাস বাজারে বিক্রি করে দেয়া হবে।” সে এবার হাল-এর দিকে তাকাল। তার চেহারায় এক ধরনের চাতুর্য খেলা করছে। আর একবার বিক্রি করে দেয়া হলে তুমি আর কখনোই তাকে খুঁজে পাবে না। কারণ ক্রেতারা ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের যেকোনো অংশ থেকে আসে-সেটা উত্তর আফ্রিকা এমনকি ইন্ডিয়াও হতে পারে। অর্থাৎ কলকাতা থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল-এর যে কোনো অংশ থেকে আসতে পারে তারা। পরবর্তী কার্টনি একজন দাস হয়ে জন্ম নেবে এবং দাস হয়েই মৃত্যুবরণ করবে।

হঠাৎ করেই নড়ে উঠে গ্রে। চেয়ারসহ উঠে দাঁড়িয়ে হাল এবং অ্যাবোলিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করল সে। এরপর গলা ফাটিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে।

ঠিক তখনই হাল একজনের চিৎকার শুনতে পায়।

“ওই!”

কাঠের মেঝেতে একজন মানুষের ধপাস করে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল সে। তাকিয়ে দেখে, স্ট্যানলি মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে এবং আফ্রিকান বালকটি তার হাত থেকে ছুটে চলে যাচ্ছে।

“আমি বদমাসটাকে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে এতটাই পিচ্ছিল যে কোনোভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না,” স্ট্যানলি বলল।

আশপাশ থেকে আরও আওয়াজ ভেসে আসছিল।

“আরও অনেকেই এদিকে আসছে,” অ্যাবোলি বলল। তার কান দরজার বাইরের দিকে তাক করা ছিল।

“আমাদের এখন চলে যাওয়া উচিত,” হাল বলে উঠল।

দরজার কাছে গিয়ে থামল সে। অ্যাবোলি আর স্ট্যানলি ওকে পাস কাটিয়ে স্তম্ভশ্রেণির দিকে এগিয়ে গেল।

গ্রে এখনো তার চেয়ারে বাঁধা আছে এবং ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁসফাস করছে।

“জুডিথকে বলে বিশ্বাস রাখতে,” হাল তার দিকে তাকিয়ে বলল। যেভাবেই হোক আমি তাকে খুঁজে বের করব এবং মুক্ত করেই ছাড়ব।

হল ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে বাকি দুজনের পথ অনুসরণ করতে থাকে। প্রথমে তারা কিছু কণ্ঠের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায়। ওদের পেছনে কে যেন চিৎকার করে উঠল, এরপর গুলির শব্দ আর কিছু লোকের পদধ্বনি শুনতে পেল ওরা। যেই ঘর দিয়ে তারা এখানে এসেছিল, তার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ওরা।

“তাড়াতাড়ি! আমাকে দরজাটা আটকাতে সাহায্য কর,” হাল চিৎকার করে উঠল।

তিনজন মানুষ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে রুমে থাকা বড়-সড় ডেস্কটাকে দরজার সামনে নিয়ে এসে দরজাটা আটকে ফেলল। এরপর তারা জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে বের হয়ে বেলকনিতে আসার পর জানালা বন্ধ করে দিল ওরা। হাল এখন বিল্ডিং-এর মাঝ দিয়ে ডেনিয়েলকে দেখার চেষ্টা করছে। এতক্ষণের হৈ চৈ ও গণ্ডগোল-এ ডেনিয়েলও সতর্ক হয়ে গিয়েছে। ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে শক্তভাবে রশি ধরে আছে ও, সেই সাথে পা টান টান করে ওজনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। “তুমি প্রথমে, স্ট্যানলি,” হাল আদেশ করল।

কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে স্ট্যানলি রশির অর্ধেকটা পর্যন্ত উঠে গেল।

ঘরের দরজার ওপাশ থেকে ধুমধাম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, কারণ গ্রের লোকেরা দরজা খোলার চেষ্টা করছে। হঠাৎ জানালার দিকে কাঠের ছোট্ট একটা টুকরা ছিটকে আসলো; “কেউ একজন হয়ত আঘাত করে দরজাটায় ছোট্ট একটা গর্ত বানিয়ে ফেলেছে।”

“এরপর তুমি, অ্যাবোলি”, হাল বলল।

“কিন্তু, গান্ডওয়েন…”

“যাও। এটা আমার আদেশ। আমার হাতে এখনো এটা আছে…”

হাল-একটু ঝুঁকে তার কোমড়ে গুঁজে রাখা পিস্তলটার দিকে ইঙ্গিত করল। বাধ্য হয়ে অ্যাবোলিও মাথা নাড়ায় এবং রশিটা শক্তভাবে ধরে উপরে উঠতে শুরু করে। হাল জানালার দিকে পেছন ফিরে অ্যাবোলির রশি বেয়ে উঠা দেখতে থাকে, একই সাথে তাদের পেছন থেকে আগত লোকগুলোর শব্দ শুনতে থাকে। পিস্তলটা এখনো তার হাতেই ধরা আছে।

অ্যাবোলি যখন প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ঠিক তখনই কাঠের কিছু একটা ছিটকে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল হাল। সেই সাথে পেছন থেকে কয়েকজনের চিৎকার শোনা গেল। হাল এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনে জানালার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জানালাটায় শক্তভাবে একটা ধাক্কা মারল। তার পিস্তল তাক করাই। ছিল। তার লক্ষ্য বস্তু হচ্ছে ডেস্কের ওপর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করা লোকটা যে কি-না তার থেকে মাত্র দশ-বার ফিট দূরত্বে আছে এখন। হাল প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখার। পিস্তল তাক করে গুলি করে হাল। লোকটা তীব্র চিৎকার দিয়ে ডেস্ক-এর ওপর পড়ে গেল। হাল তার ফাঁকা পিস্তলটা আগের জায়গায় খুঁজে রেখে আরেকটা বের করে আনে। এবার সে দরজার ফাঁকা গর্তটুকু দিয়ে একাধারে গুলি ছুঁড়তে থাকে যেখানে দিয়ে মানুষের শরীরের অংশ দেখা যাচ্ছিল।

এরপর সে রেলিং-এর দিকে ফিরে তাকিয়ে রশিটা শক্তভাবে ধরে ফেলল। ওটাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলো হাল। ততক্ষণে গ্রে’র লোকেরা তাদের দু’জন গার্ড হারানোর ধকলটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। পেছনে আরও কিছু কাঠ ভাঙার শব্দ শুনতে পেল হাল। গ্রে’র লোকেরা দরজা ভেঙে তড়িঘড়ি করে ফাঁকা কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। ততক্ষণে হাল রশি বেয়ে দুই তৃতীয়াংশ উঠে পড়েছে।

“তাড়াতাড়ি করুন, ক্যাপ্টেন!” বিগ ডেনিয়েল বলে উঠল।

“তারা ছাদের উপরেও চলে এসেছে, স্যার!” উইল স্ট্যানলি চিৎকার দিয়ে উঠল।

গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেল হাল। একটা গুলি বাতাস ভেদ করে তার দিকে এগিয়ে এসে অল্প একটুর জন্য পাশ কাটিয়ে দেয়ালে আঘাত করল।

এরপর বেলকনি থেকে আরেকবার চিৎকার শুনতে পেল হাল। হঠাৎ সে নিজেকে ওজনহীন অনুভব করে; আস্তে আস্তে নিচে পড়তে থাকে হাল।

তারা হাল-এর রশি কেটে দিয়েছে!

এতক্ষণ ডেনিয়েল তার ওজন ধরে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল কিন্তু এখন তাকে নিজের চেষ্টায় টিকে থাকতে হবে। নিচের দিকে পড়তে পড়তে তীব্র ঝাঁকুনি খায় হাল।

“চিন্তা করবেন না, ক্যাপ্টেন!” ড্যানিয়েল বলে উঠে। আমরা আপনাকে ধরে ফেলেছি। শুধু একটু সময় দিন।

নিচে পড়তে থাকা কাউকে এভাবে ধরে ফেলাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। হাল নিচের রাস্তা থেকে আরও চিৎকার এবং গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায়। ততক্ষণে হাল ছাদের কিনারা ধরে ফেলেছে। “ওয়েল ডান ডেনী, হাল বলে উঠল। খুব দুঃসাহসিক কাজ করেছ।

হাল ছাদের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দ্রুত জাহাজে চল।”

এরপর তারা যত দ্রুত সম্ভব ডেট-এ পৌঁছানোর জন্য যাত্রা শুরু করল যেন তারা ওমানি সৈন্যদল জেগে উঠার আগেই পৌঁছাতে পারে। টাইলস করা ছাদের ওপর দিয়ে সাগরের দিকে দৌড়াচ্ছিল ওরা। পেছন থেকে তেড়ে আসা শত্রুদের চিৎকার ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে এখন। ওরা বুঝতে পারে যে ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছে। উপকূল থেকে দুই রাস্তা পেছনে একটা সিঁড়ির কাছে এসে থামল ওরা। চারজন মানুষ একত্রে হাঁটুভাজ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল।

এবং এরপর আবার দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা উপকূলের সামনে এসে থামে যেখানে তাদের জন্য লংবোট অপেক্ষা করছিল। তাদের বাঁ দিকে সমুদ্র মৃদু আলোতে চকচক করছে। কিন্তু একইসাথে এর মানে হচ্ছে, ওরা সমদ্র উপকূলকে পাহারা দিয়ে রাখা দুর্গের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে এখন সৈন্য গিজগিজ করছে। যার অর্থ হচ্ছে, এতক্ষণে ওদের খবরটা এদিকে পৌঁছে গিয়েছে।

যখন তারা দুর্গ থেকে মাত্র অল্প কিছু দূরত্বে ছিল, তখনই লোহার দরজাটা ধপাস করে খুলে যায়। সেই সাথে একঝাক ওমানি সৈন্য অস্ত্র হাতে বের হয়ে আসে। ওদের অফিসার হালকে চিহ্নিত করে এবং সবাইকে গুলি করার আদেশ দেয়। ওদের গুলি রাতের আকাশে ফুলকি ফুটাতে থাকে।

“দৌড়াতে থাক”, হাল আদেশ করল, “থেমে যেও না।” ওরা চারজন সাদা আলখাল্লা পরা সৈন্যদের দিকে দৌড়াতে থাকল যারা দুর্গের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে।

“গড এন্ড দ্য কিং”, হাল গর্জন করে উঠল। ডানহাতে নেপচুন তলোয়ার আর বাম হাতে ফ্লিনটক ধরে আছে সে। “গড় এন্ড দ্য কিং।”

হঠাৎ আরও বহুসংখ্যক লোকের হৈ চৈ শোনা গেল। কারণ গোল্ডেন বাউ এর লং বোটগুলো ততক্ষণে তীরে এসে পড়েছে। জাহাজের নাবিকরা সবাই এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। দুর্গের সৈন্যদের ওপর একাধারে গুলি ছুড়ছে ওরা। এরূপ হঠাৎ আক্রমণে সৈন্যরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে।

“গড এন্ড দ্য কিং এন্ড দ্য গোল্ডেন বাউ” বিগ ডেনিয়েল গর্জে উঠল। সে তার তলোয়ার দিয়ে একজন শত্রুর মস্তক শরীর থেকে ছিন্ন করে ফেলল। এরপর বাউ-এর অন্যান্য নাবিকেরাও তার সাথে যোগ দিল।

তলোয়ার-এর ব্লেড-এর টুংটাং শব্দ এবং মানুষের বেঁচে থাকার আর্তচিৎকারে জাঞ্জিবার-এর আকাশ ভারি হয়ে উঠল। হাল দেখতে পায় তার অতি পরিচিত একজন নাবিক মরে পড়ে আছে। তলোয়ার-এর আঘাতে তার গলার সামনের অংশ ছিন্ন হয়ে আছে। দেখতে পায় উইল স্ট্যানলি একজন আরব সৈন্যের বাহু উড়িয়ে দিয়েছে। আরো দেখতে পায়, একজন স্কুল ছাত্রের তিন পর্যন্ত গুনতে যতটুকু সময় লাগবে, সেই সময়ের ভেতরেই অ্যাবোলি তিনজন আরব সৈন্যকে খুন করে ফেলেছে।

কিন্তু আরও আরব সৈন্য দুর্গ থেকে বের হয়ে আসছে।

“নৌকার দিকে চল”, হাল তার নাবিকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল। এরপর সবাই একযোগে নৌকোর দিকে দৌড়াতে থাকে।

হাল যখন দ্বিতীয় নৌকোটায় উঠছিল তখন সে শুনতে পায় ওমানি অফিসার গুলি ছোঁড়ার আদেশ দিচ্ছে।

“আমাদের নৌকো ডেফট-এর কাছে নিয়ে যাও”, হাল বলল। সে তার শিরদাঁড়া সোজা করে শত্রুদের দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে।

তারা ডেফটে পৌঁছার পূর্বপর্যন্ত শত্রুর গোলাগুলি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

“মি. ট্রোম্প, ডেক্ট-কে উপকূলের বাইরে নিয়ে যাও। চ্যানেল-এর দিকে জাহাজ চালিত কর, যেন আমরা বাতাসের পূর্বে পৌঁছাতে পারি।”

ট্রোম্প ডেফট-এর নাবিকদের আদেশ দিতে থাকে দ্রুত কাজ করার জন্য। পাল তুলে দেয়ার সাথে সাথে ওটা রাতের বাতাসে উড়তে থাকে। ডেটও রেসের ঘোড়ার মতো তর্জন গর্জন করে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

শত্রুদের গুলি এড়িয়ে দুর্গের দেয়াল পাশ কাটিয়ে দ্রুত যেতে থাকে ডেট। অল্প সময়ের মধ্যেই ডেফট আওতার বাইরে চলে যায় এবং দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে।

“খুব ভালভাবে কাজ সম্পন্ন করেছ মি. ট্রোম্প”, হাল ট্রোম্পকে উদ্দেশ্য করে বলল। জাঞ্জিবার দ্বীপটাকে পেছনে ফেলে এসেছে ওরা। এখন আমাদেরকে বাউ-এর কাছে পৌঁছে দাও।”

*

উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ঝড় এগিয়ে আসছে। ইন্ডিয়া এবং হিমালয়ের পাদদেশে এ ঝড়ের উৎপত্তি বলে মনে হচ্ছে। যেন ঈশ্বরের ক্রোধের কারণে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে। হাল জাহাজের পশ্চাৎ দিক থেকে আস্তে আস্তে কোয়ার্টার ডেক-এ নেমে এলো, কারণ সেদিকের আকাশের রঙ আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। সেই বদলে যাওয়া রঙ আস্তে আস্তে গাঢ় হতে থাকে। যেন একটা কাল চাদর কেউ আকাশের ওপর বিছিয়ে দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। হাল টেলিস্কোপ ধরার পরপরই সাগর যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে।

“বাউকে আর সামনে এগুতে দেয়া যাবে না, মি. টেইলর,” হাল চিৎকার দিয়ে বলে উঠল। “খুব দেরিতে পাল গোটানোর চেয়ে খুব তাড়াতাড়ি খুঁটিয়ে ফেলা ভাল, তাই না মি. ট্রাম্প?”

ওলন্দাজটা হাল-এর কথায় হেসে জবাব দেয়, “আপনি যদি দেরিতে পাল গোটানোর চেষ্টা করেন তবে দ্বিতীয়বার আর তা করার সুযোগ পাবেন না, ক্যাপ্টেন।”

‘জাহাজটাকে পাল নিয়ে আর বেশিদূর এগুতে দেয়া যাবে না, মি, টেইলর!” হাল বলে উঠে। “জাহাজের সামনের দিকটাকে ঘুরিয়ে ফেল। এই মুহূর্তে যদিও কাজটা করা অনেক কঠিন, কিন্তু আমাদের পারতেই হবে।”

মি. টেইলর এই আদেশ অন্য নাবিকদের মাঝে পৌঁছে দিল। সেই সাথে পালের কিছু অংশ গুটিয়ে ফেলতে বলল যেন জাহাজটার সম্মুখ অংশ সহজে ঘুরিয়ে ফেলা যায়।

হাল আবার জাহাজের পশ্চাৎ ভাগের রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ ছেয়ে বিরাট আকারের মেঘটাকে এগিয়ে আসতে দেখে ও~একদম কাছ থেকে। দেখতে পায় জন লোভেল বাউ-এর সাথে তাল মিলিয়ে ডেট এর পালও নামানোর চেষ্টা করছে, যেন দুটো জাহাজ একই তালে টিকে থাকতে পারে।

এরপর হাল নিজের জাহাজের কাজ পরিদর্শনে ফিরে গেল। “মি, স্ট্যানলি জাহাজের পাটাতনের ফাঁকাগুলোতে যেন ঠিকমত ঢাকনা বসানো হয়। মাস্টার ডেনিয়েল, সব গান যেন রশি দিয়ে শক্তভাবে বাধা হয়।”

“ঝড়টা আমাদের দিকেই তীব্রভাবে এগিয়ে আসছে। তোমরা সবাই প্রস্তুত হও,” হাল আবারো সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে।

হাল তার জাহাজের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। একজোড়া অনভিজ্ঞ দৃষ্টির কাছে এটা চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ। কিন্তু যারা সমুদ্র ভ্রমণে অভ্যস্ত তাদের কাছে এটা অত্যন্ত সুন্দর দৃশ্য। নাবিকেরা সবাই যার যার নিজস্ব জায়গা থেকে কাজে নেমে পড়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ, হোক সে অ্যামাডোডা উপজাতির কিংবা দক্ষিণ হল্যান্ড থেকে আসা লিমবারগার অথবা ডেবোনশায়ার এর লোক, প্রত্যেকেই জাহাজের প্রয়োজনে নিজেকে কাজে লাগাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা যে করেই হোক এই ঝড়ের মোকাবেলা করে ছাড়বে।

“ক্যাপ্টেন, আপনি কী মনে করেন যে আমরা আমাদের কর্মফলের কারণে এই ঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছি?” রবটি মুন হালকে বলল। এরপর ডেক-এর দিকে ইশারা করল। “আমরা এখানে যা লুকিয়ে রেখেছি সেসবের কারণেই হয়তো বা আমাদেরকে উপরে ডেকে নেয়ার আয়োজন করা হচ্ছে।”

হাল বুঝতে পারে যে মুন ডেক-এর নিচে লুকিয়ে রাখা ট্রোম্পের সেই কার্গোর কথা বলছে, যেখানে নকল হাড়, ক্রস এর টুকরা, হলি গ্রেইল ইত্যাদি ছিল।

“মি. মুন, আমরা যদি বিচারের সম্মুখীন হই তবে লুকিয়ে রাখা সেসব জিনিসপত্রের জন্য হব না। আমাদের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা চিন্তা-ভাবনা এবং কাজকর্মের জন্য হব।”

মুন ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনি কী তাই মনে করেন ক্যাপ্টেন?”

“আমরা কী এর আগে একবার খ্রিস্টের সত্যিকার কাপকে অবিশ্বাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করি নি?” হাল জিজ্ঞেস করে।

‘ ডেফট-এর অদ্ভুত কার্গোগুলো গোল্ডেন বাউ-এ নিয়ে আসার পর থেকেই বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল হাল। কারণ সে জানে নাবিকদের মধ্যে অনেকেরই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব আছে। তারা হয়ত অনেকেই মনে করতে পারে যে এসব মিথ্যে রেপ্লিকা বয়ে বেড়ানোর জন্য তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। কথাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলে হাল তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ঝড়ের দিকে দেয়ার চেষ্টা করল।

“আচ্ছা, ঠিক আছে মি. মুন, আপনার হাতে কী এখন কোনো কাজ নেই?” হাল জিজ্ঞেস করল। লোকটি ক্ষমা প্রার্থনা করে লংবোটগুলোর বাধন ঠিক আছে কি-না সেটা পরীক্ষা করতে চলে যায়।”

“তাড়াতাড়ি করুন মি, টেইলার।” হাল-এর মনে হতে থাকে তার পেটের নাড়ীগুলো শক্ত হয়ে আসছে। কোনো বাজে কাজে নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।

হাল ঘুরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল, এরপর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি তোমার জন্য প্রস্তুত আছি।”

আর ঠিক তখনই তার চোখের দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে প্রধান মাস্তুলের দিকে গেল। সাথে-সাথে চিৎকার দিয়ে উঠল হাল। “নেমে আস অ্যাডি”

“ছেলেটা এখনো ওই জায়গায় উঠে বসে আছে! যুদ্ধের সময় প্রধান মাস্তুলের উপরের জায়গাটা হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা কিন্তু ঝড়ের সময় সেটা স্রেফ আত্মহত্যার সামিল।”

“ঝড় তো ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে,” অ্যাবোলি বলে উঠল। নেড টেইলর যখন জাহাজের সম্মুখভাগটাকে ঝড়ের দিকে এগিয়ে নিলো তখন ধমকা বাতাস এসে হাল-এর মুখে আঘাত করল।

“সবাই শক্তভাবে ধরে থাক”, হাল সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে। যদিও ঝড়ের কারণে কথা খুব একটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। ঝড়ো বাতাস গোল্ডেন বাউ-এর চারপাশটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। অসম্ভব তীব্র বাতাস-এর সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে যেন সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। হাল কোমড় বাকা করে শক্ত কিছু একটা ধরে রেখেছে।

“অ্যাবোলি, নেডকে সাহায্য কর।” হাল নেডের দিকে তাকিয়ে বলল। অ্যাবোলি বাধ্যগতভাবে এগিয়ে গিয়ে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জাহাজের হাল ধরে রাখতে সাহায্য করল। ঝড়ের বাতাসে জাহাজটা রক এন্ড রোলিং গতিতে এদিক সেদিক ঘুরছে। দুলতে দুলতে জাহাজের এক অংশ প্রায় পানির নিচে তলিয়ে গেল। ভয়াবহ কয়েক মুহূর্তের জন্য পানির নিচে ডুবতে থাকে হাল। এরপর আবারও জাহাজের তলদেশটা আস্তে আস্তে ভেসে উঠল। ঠিক তখনই হাল ওপর থেকে তীব্র চিৎকার শুনতে পেল। অ্যাডি নামের ছেলেটি মাস্তুলের ওপর থেকে এক ঝটকায় নিচে পড়ে সাগরের বুকে আঘাত করেছে। পরমুহূর্তেই সে অদৃশ্য হয়ে যায় যেন অ্যাডি নামে কারো অস্তিত্বই কখনো ছিল না। সাথে সাথে উন্মত্ত সাগর তাকে গ্রাস করে ফেলল।

এরপর আর ডেক-এর ওপর থেকে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল হাল। যার ফলে সে নিশ্চিন্ত হলো যে জাহাজটা এখনো নিরাপদ অবস্থানে আছে। কিন্তু তখনই সে নিচ থেকে ক্রমাগতা পাম্পের শব্দ শুনতে পেল জাহাজের ভেতরে প্রবেশ করা পানি সরানোর চেষ্টা করছে সবাই।

এরপরই উত্তর দিক থেকে বিশাল বিশাল পানির ঢেউ এগিয়ে এলো। হাল জানে যে সে যতই প্রস্তুতি নিক না কেন, এই ঢেউ-এ যদি তার জাহাজের পাল না ছিঁড়ে যায়, তবে সেটাকে অবিশ্বাস্য রকমের ভাগ্য হিসেবে মেনে নিতে হবে।

“বাবা, আপনি আমাদের সাথে থাকুন!” সে চিৎকার করে বলে উঠল। ঈশ্বর আর তার পিতা, উভয়ের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল সে। যে ঢেউটা এগিয়ে আসছে সেটা প্রায় প্রধান মাস্তুলের সমান। ওটা লবণাক্ত পানি আর ফেনায় সমস্ত জাহাজকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। অ্যামোড়োডা সৈন্যরা-যারা এর আগে কখনো এরূপ ঝড়ের সম্মুখীন হয়নি-ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের বন্য ঈশ্বরকে ডাকতে থাকল।

“আমার জাহাজ এটা সামলে উঠতে পারবে। তোমরা ভয় পেয়োনা। সে এরচেয়েও বড় ঝড় দেখেছে জীবনে।” হাল তার নাবিকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল।

কিন্তু অন্ধকার আরও বাড়ছিল, সেই সাথে আরও বড় বড় ঢেউ এসে জাহাজটাকে ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছিল।

অন্ধকার এবং উত্তাল ঢেউয়ের মাঝ থেকে হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায় হাল। তার সেই প্রিয় কণ্ঠটা বলছিল, “শক্তভাবে ধরে রাখ, যেন পানিতে হারিয়ে না যাও। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন। আমার এবং আমাদের সন্তান, দুজনেরই তোমাকে প্রয়োজন। প্লিজ আমাদেরকে ছেড়ে যেও না। আমাদের জন্য হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ।”

হাল সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের অনুরোধের উত্তর দেয়। “আমি বেঁচে থাকব। অবশ্যই বেঁচে থাকব জুডিথ। আমার জন্য অপেক্ষা কর, মাই লাভ। আর একটু অপেক্ষা কর।”

প্রায় বারঘণ্টার কাছাকাছি তাণ্ডব চালানোর পর থামল সেই উন্মাতাল ঝড়। যদিও গোল্ডেন বাউকে তছনছ করে দিয়েছে ওটা, কিন্তু তারপরও জাহাজটা টিকে আছে। স্যাম অ্যাডি বাদে অন্য কাউকে তাদের হারাতে হয়নি।

শুধু হাল হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ ঝড়ের কারণে তার জাহাজটা দক্ষিণ দিকে অনেকদূর ভেসে গিয়েছে। জাঞ্জিবার থেকে সে আরও দূরে সরে গিয়েছে। জুডিথ-এর কাছে পৌঁছতে তার অনেক সময় লেগে যাবে।

“বাতাস থেমে গেছে, গান্ডওয়েন, অ্যাবোলি তাকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করল।” “আমরা আবার উত্তর দিকে যাত্রা করতে পারব। জাঞ্জিবার-এ পৌঁছাতে পারব…” এইটুকু বলার পর অ্যাবোলি বলতে চেয়েছিল, “জুডিথ বিক্রি হওয়ার পূর্বেই পৌঁছতে পারব,” কিন্তু সময়মত সে নিজেকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল। “দাস নিলামের আগেই।”

“হয়ত জাঞ্জিবার-এর কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় নোঙ্গর করতে পারব,” হাল জবাব দিল। “কিন্তু আমরা জাঞ্জিবার-এ পৌঁছাতে পারব কী? জাহান এবং তার লোকেরা আমাদের প্রত্যাশায় বসে আছে। নিশ্চয়ই প্রতিটি উপকূলে, প্রতিটি বন্দরে, এমনকি প্রতিটি বাজারের লোকজনকে বলে দেয়া আছে আমাদের ব্যাপারে কিংবা জুডিথকে উদ্ধারের ব্যাপারে সন্দেহভাজন যে কারও ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া আছে।”

“সেক্ষেত্রে, আপনার অবশ্যই জেনারেল জুডিথ নাজেতকে উদ্ধার না করতে চাওয়াই উচিত,” ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় হালকে উদ্দেশ্য করে বলল।

“তুমি কী বোঝাতে চাইছ? আমি কেন জুডিথকে উদ্ধার করতে চাইব না? অবশ্যই আমি তাকে উদ্ধার করতে চাই”, হাল উত্তেজিত হয়ে জবাব দেয়।

“না স্যার, আপনার সেটা করা উচিত হবে না। আপনার তাকে কিনে নেয়ার চেষ্টা করা উচিত। একমাত্র সেটা করলেই নিজের জীবন না হারিয়েও আপনি জুডিথ নাজেকে পেয়ে যাবেন। সে আপনার সম্পত্তি হয়ে যাবে… যদিও…” সে তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিদ্রুপাত্মক হাসি দিয়ে বলল, “ঐ রমণী কোনদিনও কারও সম্পত্তি হবে না।”

“তাকে কিনব…?” হাল বিড়বিড় করে বলল। “হ্যা…আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কী বলতে চাইছ মি. ট্রোম্প।” প্রস্তাবটা বেশ ভাল। কিন্তু আসল সমস্যাটা থেকেই যাচ্ছে। আমাদেরকে বিশেষ করে আমাকে এবং অ্যাবোলিকে–ধরার জন্য নিশ্চয়ই লোক লাগিয়েছে ওরা? তাই আমরা যখনই জুডিথ-এর দর হাঁকানোর জন্য মুখ খুলব তখনই আমাদেরকে ধরে ফেলা হবে।”

“যদি আপনারা দর হাঁকানোর জন্য না যান? যদি এমন কাউকে পাওয়া যায় যার উপস্থিতি কোনো রকম প্রশ্ন উঠাবে না? এমন কেউ, যাকে জাঞ্জিবারে সবাই চেনে?”

হাল ট্রোম্প-এর দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে তুমি এমন কাউকে চেন যে এই কাজটা করতে পারবে?”

“হ্যাঁ, আমি এমন কাউকে চিনি। আমরা আর বেশি দূরে নই। তার কাছে পৌঁছতে দুই দিন লাগবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন, আমি তার ব্যাপারে আপনাকে একটু সতর্ক করে দিতে চাই। আপনি যদি আমাকে শঠ, বদমাশ মনে করেন তবে জেনে রাখবেন সে আমার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। সে একজন জলদস্যু। লাভের আশায় সে তার মাকেও বিক্রি করে দিতে রাজি আছে। যদি তার সাথে কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করা হয় তবে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা ছাড়া সে আপনার গলা কেটে নেবে।”

ট্রোম্প-এর সতর্কবাণীতে চারদিকে নীরবতা দেখা দেয়। তাহলে আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। অবশেষে হাল কথা বলে উঠল, “আমি যদি তোমার এই লোকের সাথে চুক্তিতে আসি তবে সে কী তা রক্ষা করবে?”

“আপনি যদি এক কথার মানুষ হন তবে সেও তার কথা রাখবে। কিন্তু এটুকু বলে রাখি, ওর সাথে কোনোরকম চালাকি করার চেয়ে নিজের মাথাটা হাঙরের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া উত্তম।”

“তাহলে মি. ট্রাম্প আমি তার সাথে কথা বলতে রাজি আছি। তুমি তাকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা কর।”

*

সতেরোটা গানযুক্ত একিলিস নামের মাঝারি আকারের এক জাহাজের মালিক হচ্ছে ক্যাপ্টেন জেবেদিয়াহ রিভারস। বড় একটা তাল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। তালগাছের বড় বড় পাতা ছায়া দিয়ে তার চারপাশ ঘিরে রেখেছে, সেই সাথে শুকিয়ে যাওয়া পাতার মড়মড় ও খসখসে আওয়াজ শুষ্ক বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আফ্রিকান আকাশে ক্রুদ্ধ সূর্যের নিচে মহাসাগর যেন চকচক ও জ্বলজ্বল করছে। সাগরের বড় বড় ঢেউগুলো ভেসে এসে উপকূলে বেড়াতে আসা মানুষগুলোর পা ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এদিকে এত চিৎকার চেঁচামেচি জেব রিভারসকে বিরক্ত করে তুলেছে। চার্চ মিটিং-এ জন মেকলি বেশ্যাদের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করছে। রিভারস অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে লোকটাকে দেখতে লাগল। এখনও লোকটার মধ্যে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সে ক্যাপ্টেন হতে চায়। রিভারস কিছুক্ষণ আগে তা জানতে পেরেছে।

“শেষ কবে আমরা ভাল দাম নিয়েছিলাম, বলতে পারবে?” মেকলি বেশ তর্জন গর্জন করে জেবকে বলল। “আমি শ্রমিকের মতো পাথর টানার জন্য এই নাবিকদলে যোগ দেইনি।” তার এই কথাটা বেশ কিছু লোকের সমর্থন পেল যা দেখে জন মেকলি আরো উৎসাহিত হলো। আমাদের এখন হিসাবটা মিলিয়ে দেখা দরকার। কারণ আমরা এখানে যোগ দেয়ার সময় স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব এই তিনটি জিনিস দেয়া হবে বলে ওয়াদা করা হয়েছিল। আমি এখন সবার কাছে জানতে চাই এই তিনটা ফালতু জিনিস কোথায় লুকায়িত আছে। কারণ আমি এখানে স্বাধীনতা, সাম্য বা ভ্রাতৃত্ব বলে কিছুই পাইনি।

সে সরাসরি রিভারস-এর দিকে তাকাল না। তাকানোর প্রয়োজনও নেই। কারণ সবাই বুঝতে পারল যে সে কোনদিকে চেলেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। “আমরা জানি আমাদের কাজগুলো কীভাবে হয়। শিকার নেই, তো টাকাও নেই। আর বিনা পরিশ্রমে কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় না। সে তার পেছনে অসীম নীল সমুদ্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “আমাদের শিকারে যেতে হবে। নয়ত সাধারণ শ্রমিকদের মতো আমাদের কষ্ট ভোগ করে মরতে হবে।”

“নির্বোধের মতো পান করে বেশ্যার বাহুডোরে পড়ে থাকাকে কঠোর পরিশ্রম বলা যায় তাহলে, মি মেকলি?” কোয়াটারমাস্টার জর্জ ডাউলিং তার কথার সাথে যোগ করল। ডাউলিং হচ্ছে এখানকার একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। সে বুল বাফেলোর মতোই শক্তিশালী।

“আমি অবাক হচ্ছি না, জর্জ ডাউলিং। আমি আমার কাছে থাকা পিতলের শেষ পয়সাটা পর্যন্ত বাজি ধরে বলতে পারি যে আপনি সবসময়ই তার পক্ষ নেবেন।” মেকলি কোয়ার্টারমাস্টার-এর দিকে তুড়ি বাজিয়ে বলে। তবে আপনার মনে রাখা উচিত, আপনি আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন মি. ডাউলিং, তার নয়।

ডাউলিং হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে আক্রমণ ভাগ পরিচালনা করে। এই মুহূর্তে মাথার হ্যাট খুলে টাক মাথায় বাতাস করছিল সে যেন যে করেই হোক এই পরিস্থিতিতে তাকে ঠাণ্ডা থাকতে হবে। এখানে যদি কোনো ভোট হয়, তার ফলাফল যার পক্ষেই আসুক না কেন, আমি সেটা মেনে নেব।”

মেকলি স্বস্তিতে মাথা নাড়ে। কারণ কোয়াটারমাস্টার ডাউলিং অবশেষে তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছে। জাহাজের ভেতর ডাউলিং অনেকটা সিভিল ম্যাজিস্ট্রেট-এর মতো কাজ করে। তাই তাকে পক্ষে পাওয়া কিংবা অন্তত বিপক্ষে যেতে না দেয়াটা মেকলির জন্য অনেক সুবিধার ব্যাপার।

ক্যাপ্টেন রিভারস-এর বাহিনীতে একশ পাঁচজন নাবিক রয়েছে। সাথে আরও ষাটজন যোগ হয়েছে। এর মধ্যে তার লুণ্ঠনকৃত তিনটা জাহাজের নাবিকও যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে একিলিস-এর বাহিনী শক্তিশালী একটা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। যেসব জাহাজ ইলহা মেতাভো দ্বীপ-এর অন্তরীপ এ নোঙর করে সেসব জাহাজ খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। সাগরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জাহাজ থেকে সেগুলোকে দেখা যায় না। দ্বীপের দক্ষিণ দিকের অংশটা অনেকটা লেজের মতো হয়ে আছে যেটা শুধু ভাটার সময় দেখা যায়। এটা থেকে অল্প কিছু দূরে আরেকটা ছোট্ট দ্বীপ রয়েছে ইলহা কুইফুকুই নামে। এই দুটি দ্বীপ সংযুক্ত হয়ে টরকুইস সাগরের ওপর দিয়ে হ্যামক-এর আকারে সংযুক্ত আছে। ক্যাপ্টেন রিভারস মনে করে, তার লাইনের মানুষের জন্য এই জায়গাটার চেয়ে চমৎকার বেইস আর হতেই পারে না।

“যা বলার বলে ফেল, মেকলি। আমার মাথার ভেতর ব্রেইন যেন টগবগ করে ফুটছে।” আর্থার ক্রাওয়েন নামে সাদা চুলের একজন বুড়ো লোক চিত্তার করে বলে উঠল। ভিড়ের মধ্য থেকে ‘আই’ এবং “চালিয়ে যাও”, বলে রব উঠতে থাকে।

মেকলি ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিল এবং আশ্বস্ত করল যে এরপর সে ঘটনার মাঝখানে প্রবেশ করবে। অনেক নারী ও শিশুরা যারা পুরুষদের সাথে দ্বীপে বাস করে তারাও জড়ো হয়েছে। মেকলির কথা শুনে তাদের মনে হচ্ছে পরদিন সকালে তারা মেকলিকে ক্যাপ্টেন-এর কেবিনে দেখতে পাবে।

“আমরা স্বীকার করছি যে ক্যাপ্টেন-এর বীরত্ব বা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন-এর সাহসিকতা অনুসরণীয়, এবং অনুকরণীয় হবে। মেকলি বলতে থাকে। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই কিন্তু অন্য সকল ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন-এর উচিত নাবিকদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর চলা।”

“আমরা আমাদেরটুকু করে দেখিয়েছি। ক্রামওয়েল মাথা নাড়ায়। কেউ বলতে পারবে না যে আমরা পারি নি। আমাদের কাছে সেটার প্রমাণও আছে।” সে তার হাত উঁচু করে দেখাল। তার বাহুতে দুটো ক্ষত রয়েছে। একটা পিস্তলের আরেকটা তলোয়ার-এর।

ক্যাপ্টেন রিভারস তার তামাকটা পাইপ-এর মধ্যে রেখে দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল। যদিও তাকে নিয়ে এখনো আজেবাজে কথা চলছে। সে ভান করছিল যেন আকাশে ঘুরে বেড়ানো পেট্রেল আর গাল পাখিদের শব্দে সে বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ম্যানগ্রোভ গাছের ওপর টিয়া এবং লাভবার্ড পাখিদের দ্বারা সৃষ্ট অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তাকে এতটাই মুগ্ধ করে রেখেছে যে সে অন্য কোনো দিকে খেয়াল করার সময়ই পাচ্ছে না।

ক্যাপ্টেন-এর দিকে ঘুরে তাকাল মেকলি। “এখন আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কে আমাদের ক্যাপ্টেন হবে।” একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কোবরা সাপের মতো ফনা তুলে সে আরো যোগ করল, আমি একটা ভোটের আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সাথে নিজেকে একজন ক্যাপ্টেন প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছি।

“গুড”, রিভারস তামাকের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল। তুমি আসল কথায় আসতে যথেষ্ট সময় নিয়েছ। এরপর সে তার তামাকের পাইপটা মেকলির দিকে তাক করে বলল, “তাহলে তুমি আমার জাহাজটা নিতে চাও?” লোকজনের ভিড়ের মধ্যে আসার পর এই প্রথম রিভারস কথা বলে উঠল।

“একিলিস আমাদের জাহাজ, মেকলি বাধা দিয়ে বলল। যদিও তার কথায় অতটা দৃঢ়তা ছিল না। তার চোখ এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে।

“একিলিস আমার,” রিভারস এতটা দৃঢ় কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে যে মেকলির একাগ্র সমর্থকরাও মাথা নিচু করে ফেলে। সবাই জানে যে ব্ল্যাক জেব রিভারস যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছে। অনেকে দাবি করে যে পক্স-এর কারণে যে পরিমাণ লোক মারা গিয়েছে তার চেয়ে বেশি লোককে হত্যা করেছে রিভারস।

মেকলি আবারো তার কথা সুপ্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। তার মনে আছে সে কোথায় থেমেছিল। তার চোখ এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে। তার ডান হাতটাকে সে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে অবশেষে কোমড়ে গোঁজা তরবারির বাঁটের ওপর হাতটা শক্তভাবে রাখল। রিভারস মনে মনে লোকটার প্রশংসা করতে থাকে। অন্য কারও এতটা দুঃসাহস নেই যে কি-না তার সামনে এভাবে ক্যাপ্টেন হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। সেই সাথে এটাও সত্য যে মেকলি যদি তাদের ক্যাপ্টেন হয় তবে তাদের সবাইকে ডুবে মরতে হবে নয়ত গুলি খেয়ে মরতে হবে।

“আমরা এখানে ভোটাভোটির আয়োজন করব,” মেকলি বলতে থাকে। কোয়ার্টারমাস্টার ডাউলিং দেখাশোনা করবে যে ভোটিং ঠিকমত হচ্ছে কি-না।

ডাউলিং মাথা নাড়াল। রিভারস তাকিয়ে দেখল যে মেকলির সমর্থনকারীরা আশেপাশের লোকজনের সাথে নিচু স্বরে কথা বলছে। তাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছে তারা যেন ভুল পথে ভোট না দেয়।

“তোমার সময় শেষ, ওল্ডম্যান,” মেকলি রিভারসকে উদ্দেশ্যে করে বলে।

লোকটা অর্ধেকটা সঠিক বলেছে। ছেচল্লিশ বছর বয়সে তাকে নিশ্চয়ই যুবক বলা যায় না। তার পাতলা হয়ে যাওয়া রুপালি রঙের চুলগুলো সবসময় পেছন দিকে বাঁধা থাকে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে তার হাড়ে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে তার সময় কি শেষ হয়ে গেছে? না, মেকলি এ কথাটা ভুল বলেছে।

রিভারস তার মাথার হ্যাট-এর কিনারা ধরে ঘুরাতে থাকে। এটা হচ্ছে এক ধরনের পূর্ব সংকেত। তার বিশ্বস্ত লোকেরা কাজে নেমে পড়ল। বেন্ডাল তার কোমড়ে গোঁজা তরবারি টান দিয়ে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু তার পূর্বেই ড্যাগার-এর আঘাতে তার হার্ট ছিদ্র হয়ে গেল। হাঁটু ভাজ করে নিচে পড়ে গেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশটা নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে রূপ নিলো। যখন রিভারস ভিড়ের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল তখন একজন তার পথ আগলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। রিভারস হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তার গলায় ছুরি বসিয়ে দিল।

এরপর রিভারস যখন সামনে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন লোকজন সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিচ্ছিল। মেকলির পাশ থেকেও লোকজন সরে যেতে থাকে। এদিক সেদিক আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মেকলি দেখতে পায় যে রিভারস এগিয়ে আসছে। সে তার পিস্তল বের করে।

“তোমাকে এখন নরকে যেতে হবে, ওল্ড ম্যান।” সে চিৎকার করে উঠে গুলি ছুঁড়তে থাকে। রিভারস বুঝতে পারে তার বাম কানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গুলি বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করেছে। এরপরে রিভারস-এর দিকে আরও অনেক গুলি ছুঁড়তে থাকে মেকলি কিন্তু কোনোটাই লাগাতে পারে না। অবশেষে মেকলি পিস্তলটাকে বালিতে ছুরে ফেলে দেয়। কোমরের বেল্ট থেকে বের করে আনে তার তলোয়ার। ব্লেডটা বেশ চওড়া। এটা শত্রুর জাহাজ আক্রমণের সময় খুব একটা কাজের না হলেও ভূমিতে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত।

মেকলি রিভারস-এর মাথায় আঘাত করতে গেল। রিভারস তাকে প্রতিহত করে নিজের তলোয়ার দিয়ে মেকলির মুখে আঘাত করল। দ্রুত পিছিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু রিভারস তাকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে গেল। মেকলি পুনরায় আঘাত করতে আসলে রিভারস তার তলোয়ার-এর অর্ধেকটা মেকলির ডান বগলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। মেকলির হাত থেকে তলোয়ারটা নিচে পড়ে গেল সাথে-সাথে। রিভারস মেকলির খুব কাছাকাছি গিয়ে বাম হাতদিয়ে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল, এরপর ডান হাতে তলোয়ারটা ধরে এদিক সেদিক নাড়িয়ে ক্ষতটা বড় করতে থাকল যেন হার্টটা দুখণ্ড হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।

যখন মেকলি হাঁটু ভাজ করে নিচে পড়ে গেল তখন সে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তলোয়ারটা তুলে ফেলল।

“আর কেউ আসবে?” রিভারস দৃঢ় কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে চেলেঞ্জ ছুরে দেয়।

তার সমর্থকেরা তার আশেপাশে জড়ো হতে থাকে। মেকলির সমর্থকদের সে খুব ভালভাবেই চিনে ছিল। এরা পুরো সপ্তাহ জুড়ে সবার কাছ থেকে মেকলির ব্যাপারে সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। এখন কাঁকড়া আর মাছের খাদ্য হওয়া ছাড়া এদের আর কোনো গতি নেই।

“ক্যাপ্টেন,” তার একজন লোক বলে উঠল। এক সেকেন্ড এর জন্য তার মনে হলো আজকের মতো হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়নি-আরো বাকি আছে।

“ক্যাপ্টেন। জাহাজ, লোকটি আবার বলে উঠল। সে সাগরের দিকে ইশারা করল। রিভারস আরও ভালভাবে দেখার জন্য ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল।

“ভেসে আসা রণতরীটা তো বেশ সুন্দর! ডাউলিং বেশ উফুল্ল হয়ে বলে উঠে।” বেশ জাঁকজমকপূর্ণ লাগছে ওটাকে। কী অসাধারণ উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ওটার ডেকে।

রণতরীটা যতদ্রুত চলার কথা ঠিক ততটা দ্রুত চলছে না। ওটার অর্ধেকটা পাল তোলা আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটার নাবিক বেশ সতর্কতার সাথেই জাহাজটা চালনা করছে। কিন্তু কেন সে এই দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসছে? রিভারস নিজেকেই প্রশ্ন করে। অধিকাংশ জাহাজই দ্বীপ থেকে অনেক দূরবর্তী চ্যানেল-এর মাঝ দিয়ে চলে যায়।

“কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্যাপ্টেন সম্ভবত যে কি-না ধনসম্পদের আশায় ক্যাপ্টেন রিভারস ও তার নাবিকদের পেছনে এসেছে, ডাউলিং ক্যাপ্টেন-এর চিন্তিত মুখ দেখে সম্ভাবনার কথা বলে দিল।

“সে যদি আমাদের জালে ধরা পড়ে তবে আমরা রাজার মতো ধনী হয়ে যাব,” আরেকজন তার মতামত প্রকাশ করল। রিভারস বুঝতে পারে তার নাবিকদের মধ্যে এগিয়ে আসা জাহাজটা নিয়ে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

“আমাদের থেকে অন্তত দ্বিগুণ বন্দুক রয়েছে তার। কোয়াটারমাস্টার ডাউলিং ক্ষুধার্ত চোখে জাহাজটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। ওদেরকে আটকানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমরা লোকবল হারাবো, নৌকো হারাব।”

রিভারস মাথা নাড়ে কারণ সে জানে কথাগুলো সত্যি। কিন্তু তার নাবিকেরা চাচ্ছে জাহাজটাকে আটক করতে। “তারা যদি আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তাহলে কোনোদিন জানতেও পারবে না যে আমরা এখানে আছি,” “সে এই মতামতটা দিয়ে নাবিকদেরকে আরো জাগ্রত করার চেষ্টা করল। অথবা…”

সে তার পরিবর্তিত প্রস্তাবটা শেষ করল না। সে জানে খুব শীঘ্রই ইলহা কুইফুকুই দ্বীপটা রণতরীর ক্যাপ্টেন-এর নজরে আসবে। তখন সে জাহাজের অগ্রভাগটা পশ্চিম দিকে ঘোরাবে দ্বীপের কিনারে নিয়ে আসার জন্য। তখন যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে জাহাজটাকে ফাঁদে ফেলার জন্য। “আমরা দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে পানসিতে করে নাবিকদের পাঠাব। ওদের বন্দুকধারীদেরকে চিন্তা করার একটু সময় দিব। যখন ওরা একিলিস-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তখন আমাদের নাবিকেরা পেছন থেকে ওদের জাহাজে আক্রমণ চালাবে।”

ডাউলিং মাথা নাড়ায়। পূর্বেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। ঈশ্বরের ইচ্ছে থাকলে আজকেও সেটা কাজে দিবে।

রিভারস তার নাবিকদেরকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু কিছু একটা তাকে থামিয়ে দেয়।

“জাহাজটা তার দিক পরিবর্তন করছে মি. ডাউলিং। সে জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। সেটা সূর্যের তাপের কারণে নয় বরং কিছু একটা তার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে। রণতরীটা তার সম্মুখভাগ দ্বীপের পশ্চিম দিকে নয় বরং পূর্ব দিকে নিয়ে যাচ্ছে-তাদের দিকেই আসছে ওটা। কিন্তু কেন?”

“সে আমাদেরকে দেখতে পেয়েছে। ডাউলিং বলে উঠল।”

রিভারস মাথা নাড়াল। সে নিশ্চয়ই জানে যে আমরা এখানে আছি। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে ওর।

“সম্ভবত কিং চার্লিং তার বদমাশ লোকগুলোকে আমাদের পেছনে লাগিয়েছে”, নাবিকদের একজন বলে উঠে।

“কিন্তু তারা কী এতদূরে আসার সাহস দেখাবে?” একজন রমণী চিৎকার দিয়ে বলে উঠল।

কিন্তু এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে জাহাজটি তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। জাঁকজমকপূর্ণ শক্তিশালী জাহাজটা তাদের উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছে। কিন্তু দ্বীপে আসতে হলে তাদেরকে বালির পাড় থেকে বেশ খানিকটা দুরে নোঙর ফেলতে হবে। আর একিলিস দ্বীপের কাছেও নোঙর ফেলতে পারে।

“আমাদেরকে এখনই পালাতে হবে, ক্যাপ্টেন ডাউলিং বলে উঠল। যেদিক দিয়েই সুযোগ পাই সেদিক দিয়েই আমাদেরকে যেতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।”

যদিও জাহাজটা তাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে রয়েছে তবুও কোয়ার্টার মাস্টার-এর কণ্ঠে এক ধরনের দ্রুততা এবং ভয়ার্ত ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

কিন্তু রিভারস তার জায়গা থেকে নড়ছে না। কেউ কাউকে পালানোর ব্যাপারে কোনো আদেশও দিচ্ছে না। রিভারস শুধু এক যুবক ছেলেকে বলল দৌড়ে গিয়ে তার টেলিস্কোপটা নিয়ে আসতে। যদিও বালকটা সেটা নিয়ে আসতে আসতে তার আর সেটার প্রয়োজনই পড়ল না। জাহাজটার মধ্যে একটা ব্যতিক্রম কিছু লক্ষ করা যাচ্ছে। জাহাজ এবং বালির পাড়-এর মাঝে যেটুকু ব্যবধান আছে তাতে জাহাজটার থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারপরও জাহাজটা এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ এই দ্বীপের পথ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন-এর ভালই ধারণা আছে।

অথবা, সে জাহাজের ক্যাপ্টেন নয়। অন্যকেউ জাহাজটার সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে আছে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাহাজের লোকগুলোকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।

এরপর রিভারস সেই চিহ্ন দেখতে পায়-জাহাজটার মাস্তুলের চূড়ায় দুটি পতাকা উড়ছে। একটি হচ্ছে কমলা, সাদা এবং নীল-এর মিশ্রণে ডাচ রিপাবলিক-এর পতাকা। অন্যটা হচ্ছে ইউনিয়ন-এর পতাকা। কিন্তু ক্যাপ্টেন কেন দুটি পতাকাই উড়িয়েছে। ইংরেজরা হয়ত ডাচদের সাথে শান্তিচুক্তিতে আছে। কিন্তু রিভারস কখনো একসাথে দুই দেশের পতাকা উড়াতে দেখেনি, আর দেখবে বলেও মনে হয় না।

তারপর শোনা যায় সেই শব্দ। পর পর তিনটা কামানের গর্জন। কামানের ধোয়া বাতাসে মিশে যেতে থাকে।

ডাউলিং বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে, তারপর হেসে উঠে আপনমনে। এটা কোনো আক্রমণের ইঙ্গিত নয়। এটা হচ্ছে স্যালুট। যারা একিলিসের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্যে সে চিৎকার করে উঠল। তাদেরকে সে জানাল যে আজকে আর কোনো যুদ্ধ হবে না।

“গুড ডে, মিজনহিয়ার,” রণতরীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল রিভারস। এই তিন কামানের স্যালুট ক্যাপ্টেন মাইকেল ট্রোম্প-এর নিজস্ব অভ্যর্থনা স্টাইল। ক্যাপ্টেন ট্রোম্প অতীতে বিভিন্ন দরকারে যতবারই এসেছিল, এইভাবেই স্যালুট জানিয়ে নিজের আগমনী বার্তা দিয়েছিল।

“এই চিজ-হেড লোকটা এখানে কী করছে?” ডাউলিং নিজের মনে বলতে থাকে। সেই সাথে মনোযোগ দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখতে থাকে।

রিভারস মাথা নাড়িয়ে বলল, “এটা তার জাহাজ নয়। সে হচ্ছে অত্যন্ত লোভী মানুষ। কিন্তু সে এতটা বোকা নয় যে মহামান্য রাজার এই চিহ্ন সে বহন করবে। সে ভ্রু কুঁচকায় যেন সে নিজের যুক্তি নিজেই মেনে নিতে পারছে না। “কিন্তু কেন সে এটা করেছে”, সে রণতরীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রণতরীর অগ্রভাগটা তাদের দিকেই তাক করা।

“তাহলে সম্ভবত…” জন ব্লাইটন ভ্রু কুঁচকে বলল, “সম্ভবত ট্রাম্প বেইমানি করে ইংরেজদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়ার জন্য।

“শান্ত হও, বালক”, রিভারস তার মাথা নাড়ায়। ট্রোম্প তা করবে না। যদিও সেরকম বেইমানির কথা মনে করে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। “সে জানে যে সে যদি এই কাজ করে তবে আমি তাকে ফাঁসিতে ঝুলাব। এরপর সে তার কোয়ার্টারমাস্টার-এর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “মি, ডাউলিং তুমি জান এখন কী করতে হবে?”

লোকটি মাথা নাড়িয়ে মার্চ করতে করতে বিচ-এর দিকে এগিয়ে গেল।

*

ব্যাপারটা এমন নয় যে এই প্রথমবারের মতো হাল এমন কারও ওপর তার আস্থা ও বিশ্বাস সমর্পণ করেছে যে কি-না কিছুক্ষণ আগেও তার শত্রু ছিল। পূর্বের মতো এবারও ট্রোম্প তার নৌবিদ্যা এবং জাহাজ পরিচালনার দক্ষতা দিয়ে হালকে মুগ্ধ করল। জায়গাটা বেশ বিপদজনক। ট্রোম্প তার পূর্বের স্মৃতি মনে করে সেইভাবে জাহাজকে চালিয়ে নিয়ে গেল। বর্তমানে টেইলারকে জাহাজের হাল ধরার ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছে সে। হাল এবং জন লোভেল জাহাজের পালের দিকে নজর রাখছে। অ্যামাড়োডাদেরকে মাস্তুলের ওপর উঠিয়ে রাখা হয়েছে যেন তারা বাতাসের গতি পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে।

বাকি সব নাবিক যেন তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে, একইসাথে জিহ্বাও শক্ত করে রেখেছে। শুধু কান দুটোই সজাগ রেখেছে এখনো। কারণ বাউ যদি প্রবাল পাথরের সাথে বিন্দুমাত্র ধাক্কা খায় সেই শব্দটাও তাদের শুনতে হবে। এছাড়াও তারা তাদের পা দুটো ডেক-এর ওপর এমনভাবে স্থির করে রেখেছে যেভাবে কোনো মাকড়সা তার জালের ওপর পা দিয়ে আটকে থাকে। জাহাজে যদি বিন্দুমাত্র কম্পনও হয় সেটাও তারা অনুভব করতে পারবে এখন।

কিন্তু জাহাজের ভেতরে তারা কোনো কম্পন অনুভব করল না। কোনো কম্পন না থাকায় হাল এবং অফিসারগণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। এই জায়গাটা বেশ বিপজ্জনক। জাহাজের বেসটা যে-কোনো সময় পানির নিচের কোনো বড় পাথর খরে সাথে ধাক্কা লাগতে পারে।

“দশ ফ্যাদম, ক্যাপ্টেন,” একজন নাবিক পানির গভীরতা মেপে হালকে জানাল।

“আমাদের জাহাজের গন্তব্য এই পর্যন্তই।” ক্যাপ্টেন ট্রাম্প হাল-এর দিকে আসতে আসতে বলল। তার কপাল চুঁইয়ে ঘামের ফোঁটা নিচে পড়ছে। “আমাদের এখান থেকে সংবোট-এ করে যেতে হবে।”

“ধন্যবাদ, মি, ট্রাম্প”, হাল ট্রোম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে এরপর অন্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। “উপরের পাল গুটিয়ে রাখার ব্যবস্থা কর।” বলার সাথে সাথে অ্যামোডোডারা নিচে নামতে থাকে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন একদল কাঠবিড়ালী ওক গাছ বেয়ে নিচে নামছে।

“মি. টেইলার নোঙর ফেলার ব্যবস্থা কর। যতদূর আসা সম্ভব আমরা চলে এসেছি।” এখান থেকে দুই ক্যাবল সমান পরিষ্কার নীল পানি পার হলেই বী। সেই বী সমুদ্রতল থেকে সাত ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। হাল এই জায়গাটার প্রশংসা না করে পারছে না। কোনো জাহাজ যাওয়ার সময় হয়ত এই জাহাজটাকে দেখতে পারে,” হাল বলতে থাকে। কিন্তু সেটা যদি এখানে এসে নোঙর না ফেলে তবে ইলহা মাতন্ডকে অন্যান্য দ্বীপের মতই মরুভূমি মনে হবে।”

ডেফট-এর পালও নামিয়ে ফেলা হলো। গোল্ডেন বাউ-এর গতি থামিয়ে দেয়া হলো সেই সাথে। ওটা আস্তে আস্তে মৃদু তালে দুলতে শুরু করল। জাহাজের নোঙরটা যখন সাগরের গরম পানিতে ফেলে দেয়া হলো তখন এটা চতুর্দিকে পানি ছিটিয়ে দিল। শেকলে যখন টান পড়ল তখন শেকলটাও পানির ভেতর মৃদু কম্পনে দুলতে শুরু করল।

“ওই দেখ, ওদের ঘোট রণতরী দেখা যাচ্ছে। হাল হাত দিয়ে ইশারা করে একটা জাহাজ দেখায় যেটার পাশে তিনটা পানসি নৌকো রাখা আছে।

“এটা হচ্ছে একিলিস নামক জাহাজটা, ট্রোম্প বলতে শুরু করে। “এটাকে দেখে হয়ত মনে হচ্ছে না যে ক্যাপ্টেন একে নিয়ে নির্বিগ্নে সাগরে চলাচল করতে পারে। কিন্তু খালি চোখে দেখে ওর আসল সৌন্দর্য বোঝা সম্ভব না।”

“আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি,” হাল বলে উঠল। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা অনেক দ্রুত চলে।”

একিলিস জাহাজের বন্দুকগুলো গোল্ডেন বাউ-এর বন্দুক-এর মতো আট ফুট লম্বা নয়। কিন্তু সেটার প্রয়োজনও নেই কারণ একিলিস-এর বন্দুকগুলোতে রাউন্ডশট-এর বদলে গ্রেপশট লোড করা আছে।

ট্রোম্প আবারও ক্যাপ্টেন রিভারস-এর ব্যাপারে বলতে শুরু করে। তার নাবিকগুলো হচ্ছে এক একটা শয়তান, ক্যাপ্টেন কার্টনি। অধিকাংশ নাবিক যুদ্ধ করার চেয়ে বরং সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি আছে।”

হাল মনে মনে এই দস্যু ক্যাপ্টেন-এর কথা ভাবতে থাকে যার সাথে সে আজকে দেখা করতে এসেছে। নামটা তার কাছে বেশ পরিচিত ঠেকছে। তার বাবার বন্ধু অন্য ক্যাপ্টেনদের মুখে সে এই নাম শুনেছে। লোকটা সামরিক যুদ্ধ থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। এখন সে ইন্ডিয়ান সাগরের কেপ অফ গুড হোপ থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে মাদাগাস্কার পর্যন্ত চষে বেড়ায়। সেই সাথে বণিক এবং দাস বিক্রেতাদের জাহাজ-তা সে যেই পতাকাই বহন করুন না কেন-লুণ্ঠন করে।

“সে একজন খুনি, স্যার হেনরী”, ট্রোম্প তাকে সতর্ক করে দেয়।

“সেটা আমি শুনেছি”, হাল বেশ চিন্তাপূর্ণভাবে মাথা নাড়ায়। কিন্তু এই লোকটার সাথে দেখা করার ব্যাপারে হাল-এর মনে কোনো দ্বিধা নেই। যে করেই হোক দেখা করতেই হবে।

“কিন্তু এই লোকটার সাথে আমার একটা বোঝাঁপড়া আছে, ট্রাম্প তাকে আশ্বস্ত করল।

“কারণ তুমি নিজেও একজন দস্যু,” হাল চোখ বাঁকা করে ট্রোম্প-এর দিকে তাকিয়ে বলল।

সমুদ্রের পানির ওপর জমে থাকা তেলের স্তর যেভাবে সরিয়ে দেয়া হয়, ঠিক সেভাবেই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে কথাটা সরিয়ে দিল ট্রোম্প। “ব্যবসায়িক স্বার্থে দুজন মানুষ একসাথে চলতে গেলে কিছুটা তাল মিলিয়ে চলতেই হয়।” নয়ত চাকা সমানতালে ঘুরে না। এরপর হাল-এর অস্বস্তি ভাব বুঝতে পেরে বলল, “তথাপি আমি বুঝতে পারছি যে আপনার মতো সম্ভ্রান্ত ইংরেজ-এর এরকম লোকের সাথে ডিল করতে যাওয়া কতটা অরুচিকর ব্যাপার।”

হাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বীচ-এর ওপর দস্যুদের সমাগম দেখতে থাকে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে নেড টেইলরকে নোঙর তুলে ফেলার আদেশ দেয়, সেই সাথে পাল উঠাতে বলে। বাতাসে পাল ভাসিয়ে দিয়ে সে আবারও জাহাজ নিয়ে ফেরত যেতে চায়। কিন্তু বহু কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করল সে।

“আমি ভাবছি, আমার পিতা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতেন।”

“এসব আমার ওপর ছেড়ে দিন,” স্মিত হাসি দিয়ে বলল ট্রোম্প। “ক্যাপ্টেন রিভারের সাথে সব ব্যাপার আমি মীমাংসা করব। এ ব্যাপারে আপনি আপনার হাত পরিষ্কার রাখবেন।”

হাল তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। হাত উঠিয়ে আশ্বস্ত করল ট্রোম্প।

“সবকিছু কী আমি পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পেরেছি?” ওলন্দাজ লোকটা বলল।

হাল হ্যাঁ-সূচক দৃষ্টি দিয়ে আবার বীচ-এর দিকে ফিরে তাকায়। সে মনে মনে ভাবতে লাগল যে তারা যখন এখানে এসে পড়েছে তখন কি ঘটে দেখাই যাক।

সাথে-সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে-এই ব্যাপারটা তার নিজস্ব পন্থায় করবে সে।

“মি. লোভেল, পানসি তৈরি কর,” সে হাঁক ছাড়ল। ট্রোম্প হয়ত দস্যু রিভারসকে বিশ্বাস করতে পারে কিন্তু সে তার ওপর একবিন্দুও বিশ্বাস রাখতে পারছে না। সে লংবোট-এ করে তার লোকদের নিয়ে এভাবে দস্যুর কাছে যেতে পারে না। সে অন্তত পানসিতে করে যেতে পারে। পানসিতে নিজেদের বন্দুক এবং অস্ত্রসস্ত্র রাখা থাকবে। অস্ত্র হাতে লোকেরা প্রস্তুত থাকবে।

“এই কী সেই লোক, মি. ট্রোম্প?” হাল জিজ্ঞেস করল। যদিও সে জানে। যে তার এই কথা জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজনই নেই। ধূসর রঙের চুলগুলো পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা লম্বা লোকটাই যে রিভারস এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যান্য সবার মতো সেও সুতি শার্ট এবং পেটিকোট জাতীয় একটা পোশাক পরে আছে।

“হ্যাঁ, এই সেই ব্যক্তি।”

“সে নিশ্চয়ই এরকম একটা পানসিতে করে আমাকে এখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসাটা পছন্দ করবে না। তুমি যে শুধু আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছ তাই না। আমি চাইলে এই দূরত্ব থেকে স্লিন্টার দিয়ে তার একিলিসও উড়িয়ে দিতে পারি।”

“সে হয়ত আমাকে দেখে খুশি হবেনা,” ট্রোম্প বলতে থাকে। কিন্তু এক শিশি পরিমাণ ভার্জিন টিয়ার সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট, তার চোখ চকচক করে উঠল। এই রকম একটা গুপ্তধন একশ পাউন্ডে বিক্রি করতে পারবেন আপনি। কিংবা এত সোনা আর রুপা পাবেন যে আপনার যেকোনো একটা নৌকো ভরে যাবে।

হাল একটা বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি দিল। এরপর তার মাঝিমাল্লাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “মাস্টার ড্যানিয়েল, বন্দুক হাতে আমার চল্লিশজন ভাল মানুষ চাই। আর ডেন্ট থেকে আমরা যে ব্যারেলগুলো নিয়েছি সেগুলো এখানে নিয়ে এস।”

“ক্যাপ্টেন” বিগ ডেনিয়েল একটা সমর্থনপূর্ণ দৃষ্টি দিল। এরপর সে অ্যামাডোডা সৈন্যদের সেই সব ধর্মীয় ধংসাবশেষগুলো নিয়ে আসতে বলল।

“মি. টেইলর, বন্দুক হাতে নাবিকদের প্রস্তুত থাকতে বলুন এবং আমার টেলিস্কোপটা হাতে নিন। গোলমাল-এর ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথে রণতরীটা ডুবিয়ে দিয়ে দস্যুদের জন্য নরকের দরজা খুলে দেবেন।”

নেড টেইলর তার চোয়াল শক্ত করে বলল, “ক্যাপ্টেন আপনার কাছে যদি ওইসব দস্যুদেরকে সুবিধাজনক মনে না হয় তবে শুধু বন্দুকের একটা গুলি ছুড়বেন। এরপর দেখবেন ওদের জাহাজের ছোট ছোট টুকরা ওপর থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে।”

“ভেরি গুড”, হাল তাদের দিকে বেশ আস্থাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এরপর আস্তে আস্তে সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে দেখে নিল যে কে কীভাবে প্রস্তুত আছে। আজকে যদি রিভারস কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করে তবে আজকের দিনটিই হয়ত হবে তার জীবনের শেষ দিন।

.

“তারপর…ট্রোম্প…এখানে কেন এসেছ, সেটা বলল।” রিভারস তার নিজের হ্যাট খুলে অন্য একজন হ্যাট পরা নাবিকের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল-সূর্যের আলো থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য ক্ষুদ্র প্রয়াস আরকি। “সেই সাথে এরকম সুন্দর একটা জাহাজ সাথে করে নিয়ে এসেছ। মাই গড!” বেশিক্ষণ ঝুঁকে থাকতে না পেরে নিজের হ্যাটটা পরে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।

বাউ-এর বেশিরভাগ নাবিক সাগরের এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এসে তাদের পা ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চারজন নাবিক পানসির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গ্রেপশুট লোড করা কামান থেকে গুলি ছোঁড়ার জন্য তাদেরকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হাল-এর ডান কাঁধের পাশে অ্যাবোলি একটা বড় কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

“এটা কী আমার জন্য নিয়ে এসেছ, ক্যাপ্টেন?” রিভারস জিজ্ঞেস করে।

“হাহ,” ট্রাম্প হাসি দিয়ে বলল। “এমনকি এটা যদি আমারও হত তবুও তুমি এটা পেতে না।” হাল এখনো নিজেকে চুপ রেখেছে। দস্যুটার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ট্রোম্প। “আমি এখন আর ক্যাপ্টেন নই।” সে কোনোরকম ইতস্তত বোধ না করেই বলল। “আমি এখন গোল্ডেন বাউ-এর সেকেন্ডমেট।” এরপর সে হাল-এর দিকে ঘুরে বলল, “আমি কী আমাদের ক্যাপ্টেন-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি? উনি হচ্ছেন, স্যার হেনরি কার্টনি। আমাদের ক্যাপ্টেন।”

রিভারস তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আগে হাল-এর নীল চোখের দিকে তাকিয়ে তার ওজন বোঝার চেষ্টা করল। হালকে দেখে মনে হচ্ছে সে হ্যান্ডশেক করতে নারাজ। কারণ তাহলে হয়ত তার নিজেকে এবং তার রক্তকে অসম্মান করা হবে। হাল বুঝতে পারছে যে তার পেছনে ট্রাম্প অত্যন্ত দুশ্চিন্তামগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল। হাল সামনে এগিয়ে দস্যু ক্যাপ্টেন-এর সাথে হ্যান্ড শেক করল।

“আপনি খুব কুখ্যাত, ক্যাপ্টেন,” সে বলে ফেলল।

দস্যুটা হাল-এর কথায় খুব একটা বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হল না। “আমার ব্যবসায়িক কাজে কুখ্যাতি হচ্ছে সোনা কিংবা আইভরি পাথরের মতই মূল্যবান। মাঝে-মাঝে কিছু বণিক কিংবা নৌযাত্রী আমার জাহাজ চিনতে না পেরে বোকার মতো যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বসে। আর তাদের পরিণতি খুব একটা ভাল হয় না।”

সে ট্রাম্প-এর দিকে এক নজর তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল। “এরকমটা সচরাচর না হলেও মাঝে-মাঝে ঘটে আরকি। কোনো-কোনো ক্যাপ্টেন মাঝে মাঝে তার লোকদের জীবনের চেয়ে তার সম্মানকেই বেশি মূল্য দিয়ে ফেলে। আর সেটাই তার জীবনের শেষ ভুল হয়ে দাঁড়ায়। সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে ঐ কুঁচকে বলল। কিন্তু আমি আপনার নাম শুনেছি সম্ভবত। আপনি নিশ্চয়ই ফ্রাঙ্কি কার্টনির ছেলে। কিন্তু সে নিজে এই মূল্যবান জাহাজটা চালাচ্ছে না কেন? নাকি সে এরচেয়ে বড় কোনো একটা পেয়েছে?”

“আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, হাল বলতে থাকে। “কেপ অব গুড হোপ-এ মিথ্যে জলদস্যুতার অভিযোগে ওলন্দাজ ঔপনিবেশকরা তাকে অত্যাচার করে এবং…ফাঁসি দেয়।”

রিভারস তার পাইপ-এর অগ্রভাগটা ট্রোম্প-এর দিকে উঠিয়ে বলল, “ওলন্দাজরা আপনার বাবাকে হত্যা করেছে আর আপনি এখানে একজন ওলন্দাজ-এর সাথে মৈত্রী গড়ে তুলেছেন?”

“ট্রোম্প কখনোই আমার পিতার হত্যার ব্যাপারে যুক্ত ছিল না।”

“বাজি ধরে বলতে পারি যে, সে ঐ সময় এর চেয়েও জঘন্য কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল। আমি ঠিক বলেছি না, মিজনহর ট্রোম্প?”।

ওলন্দাজ লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে জবাব দিল, “আপনি আমাকে খুব ভালভাবে চিনেন, ক্যাপ্টেন রিভারস।”

“তা অবশ্য চিনি…। আচ্ছা, এখনো বলছ না কেন যে তোমরা কী কারণে এখানে এসেছ। আমি এখন দুশ্চিন্তায় আছি। তোমাদের যেকোনো ক্ষতি হতে পারে এখন। তোমাদের জাহাজগুলো আর তোমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি-না এটা নিয়েও আমি বেশ সংকিত।”

“এরকম কোনো কিছু করার চিন্তা মাথায়ও আনবেন না। আমার জাহাজের বন্দুক এবং কামানগুলো প্রস্তুত রয়েছে, সেই সাথে আমার নাবিকেরাও প্রস্তুত রয়েছে,” হাল বেশ দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল।

“আপনি বেশ তরুণ, ক্যাপ্টেন কার্টনি,” রিভারস তার চেহারায় বিন্দুমাত্র আতঙ্ক বা দুশিন্তা ফুটিয়ে না তুলে বলল। “আপনার মতো একজন বালকের এরকম একটা জাহাজ থাকা আসলেই বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার। এখন আমি বুঝতে পারছি। লাল সাগরে ইথিওপিয়ার যুদ্ধে আরবদের সেই বিভীষিকাময় অবস্থার কাহিনী আমি শুনেছি। যে করুণ পরিণতি আপনি তাদের করেছিলেন আমি তা শুনেছি। তারা আপনার নাম কী যেন দিয়েছে-এল তাজার, যার অর্থ হচ্ছে বারকুড়া নামক সামুদ্রিক মাছ।”

“আমি বুঝতে পারছি না, বর্তমান অবস্থার সাথে সেসব কাহিনীর কী সর্শক?”

“কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু এটুকু বোঝানোটাই উদ্দেশ্য যে বারাকুডার মতো মুখে শক্ত দাঁতযুক্ত মাছও কখনও কখনও জালে আটকা পড়ে যায়। বলতে পারেন ফাঁদে পড়ে যায় ঠিক এখনকার মতো।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?” হাল খুব বিস্ময়াবিভূত হয়ে তাকাল। সাথে-সাথে বাউ-এর কামানের গর্জন পানির ওপর দিয়ে ভেসে আসলো।

হাল ঘুরে দাঁড়িয়ে তার জাহাজের দিকে তাকাল। একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উপরে উঠছে এখন। নেড টেইলার সতর্কতাস্বরূপ একটা কামান চালিয়েছে। কারণটাও পরিষ্কার হয়ে গেল সাথে-সাথে। একসারি ডাগআউট অন্তরীপ-এর দিকে ছিল সেগুলো এখন বাউ-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাল চারটা পর্যন্ত গুনতে পেরেছে যেগুলোর এক একটাতে পাঁচ থেকে ছয়টা পর্যন্ত মানুষ ছিল। এগুলো অনেক সরু নৌকো। স্প্যানিশ ভাষায় যেগুলোকে পিরাগুয়া বলা হয়।

“তারা আমাদের বন্দুকের নিচ দিয়ে আসছে,” অ্যাবোলি বিড় বিড় করে বলল। এ কারণেই মি, টেইলার এগুলোকে গুলি করে উড়িয়ে দিতে পারছে না।

হাল-এর জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। যে ডাগআউট ডিঙ্গিগুলো বাউ-এর দিকে যাচ্ছে সেগুলোতে থাকা প্রত্যেকের হাতে একটা করে লম্বা ব্যারেলযুক্ত বন্দুক আছে। বন্দুকগুলো বাউ-এর রেলিং-এর দিকে তাক করা আছে। ওরা গুলি ছুরে যে কোনো মুহূর্তে বাউ-এর নাবিকদের উড়িয়ে দিতে পারে। হাল আবার রিভারস-এর দিকে তাকিয়ে দেখল যে রিভারস বেশ বড় আকারের একটা বাসকেট হিলটেড তলোয়ার নিচ থেকে উঠিয়ে বালির মধ্যে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখছে। সে এমনভাবে হাল-এর সামনে তলোয়ারটা বালিতে গেঁথে রাখল যেন সে বুঝাতে চাইলে যে এরপর সে ঠিক এইভাবেই ওটাকে হাল-এর পেটে ঢুকিয়ে দেবে।

“আমার কোয়ার্টার মাস্টার মি. ডাউলিং এবং তার লোকদের হাতে গ্রেনেড আছে।” তারা যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো বাউ-এর ওপর কাজে লাগাবে।

হাল অ্যাবোলির দিকে সতর্কতা মূলক দৃষ্টি দিয়ে তাকাল।

“এরপর তোমার লোকেরা যখন ডেক-এর ওপর এদিক থেকে সেদিক দৌড়াদৌড়ি করবে তখন আমার লোকেরা তোমার রাডার অকেজো করে দেবে।”

এই কথা শুনে রিভারস-এর লোকেরা আনন্দে উল্লাসধ্বনি করে উঠল। তাদের প্রত্যেকের সাগরে নামা ছাড়াই যদি এত সহজে বিজয় তাদের পক্ষে চলে আসে, তাহলে আনন্দে আত্মহারা হওয়াই স্বাভাবিক।

হাল ভাবতে থাকে। কোনোরকম উত্তর দেয়া ছাড়া এভাবে রিভারস-এর হুমকি মেনে নেয়া যায় না।

“আপনি হয়ত মি. ট্রাম্প-এর সাবেক জাহাজ ডেফট-এর কামানগুলোর কথা ভুলে গিয়েছেন। “আর…এটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না যে পানসিতে থাকা আমার লোকগুলোকে বেশ ভালভাবেই মানুষ খুন করার প্রশিক্ষণ দেয়া আছে।” অতএব, “ক্যাপ্টেন রিভারস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমরা দুজনেই একে অপরের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারি। এখন এসব বাদ দিয়ে আসুন, কথা বলি। আপনার অন্তত জানা উচিত যে আমি কেন এখানে এসেছি।”

রিভারস একনজর সাগরের দিকে তাকিয়ে আবারও হাল-এর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তারপর হা হা করে হাসতে শুরু করে দিল। “বাই গড, তুমি ফ্রাঙ্কির যোগ্য সন্তান। ফ্রাঙ্কিও তোমার মতোই ঠাণ্ডা রক্তের মানুষ ছিল। কিন্তু আমাকে টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করো না। তুমি হয়ত নিজেকে “স্যার” ভাবতে পার কিন্তু এখানে সেটা তোমার কোনো কাজেই আসবে না। তোমার পিতাও হয়ত কিং চার্লস-এর সেই কল্পিত আদেশপত্র হাতে নিয়ে ভেবেছিল যে সে যেকোনো পর্তুগীজ জাহাজকে উড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু সত্যিটা হল, তোমার পিতাও আমার মতোই দুস্য ছিল। সেও ধন-সম্পদ লুট করতে চেয়েছিল।”

“আমার পিতা একজন সম্মানিত মানুষ ছিলেন। নটোনিয়ার নাইট অব দ্য টেম্পল অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য…”

“ব্ল-ব্লা-ব্লা।” রিভারস তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। “তোমার পিতা একজন ভাল নাবিক ছিল এবং কৌশলে অন্যের জাহাজ ছিনিয়ে নিতে পারত। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে তুমিও ঠিক সেভাবেই এই জাহাজটাকে অন্য কারো কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলে।”

“আমি যার কাছ থেকে এই জাহাজটা কেড়ে নিয়েছিলাম, তার এই পরিণতি প্রাপ্য ছিল।”

“হাহ! সবার ক্ষেত্রেই এটা সত্য, তাই না?” রিভারস হাল এর-দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি হচ্ছ একজন বদমেজাজি, উদ্ধত বালক। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে এই বয়সেই তুমি বহু লোকের সাথে শত্রুতা করেছে যারা তোমাকে হত্যা করতে পারলে খুবই খুশি হবে।”

“কিন্তু, তারপরও আমি বেঁচে আছি।”

“হ্যাঁ, তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছ।” ক্যাপ্টেন রিভারস তার পাইপটা নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আমি আজকে অনেক কঠিন একটা দিন পার করেছি। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এখন আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। তুমি তোমার লোকদের জাহাজে ফিরে যেতে বল এবং আমি আমার লোকদের উপকূলে ফিরে যেতে বলব। কোনো রক্তারক্তি হবে না।” “যুবক কার্টনি তোমার ওপর কী এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে যে তুমি কোনো রকম মদপান করতে পারবে না?”

“আমি একজন নাইট, মুসলমান নই। আমি আপনার সঙ্গে যোগ দিতে রাজি আছি”, হাল কষ্ট করে তার মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল।

“খুব ভাল। তাহলে সূর্য ডোবার পরে এখানে এসো। একা। এরপর আমরা কথা বলবো। এরপর তুমি আমাকে বলবে যে তুমি কেন এখানে এসেছে। কী চাও তুমি? এরপর আমি বলবো যে, তুমি সেটা পাবে, কী পাবে না।”

এরপর রিভারস তার তলোয়ারটা বালি থেকে তুলে কোমড়ের বাঁট-এ গুঁজে রাখল। এরপর আর একটাও কথা না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিচ ধরে হাঁটতে শুরু করে দিল।

টর্চলাইটগুলো বালির ওপরেই রাখা ছিল। টর্চের আলো রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। হাল-এর ফ্লিন্টক দুটো লোড করা আছে এবং তলোয়ারটা ওর বট-এ রাখা আছে। ক্যাপ্টেন রিভারস-এর মনে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করার কোনোরকম ইচ্ছে থাকে তবে তা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত আছে ও।

যেভাবে অনুরোধ করা হয়েছে হাল একদম সেভাবেই এসেছে-একা। এমনকি অ্যাবোলি এবং অন্যান্য অফিসারকেও সাথে নিয়ে আসা হয় নি। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই হাল ধারণা করতে পেরেছে যে রিভারস সবকিছুই নিজের রাস্তায় করে, যা আগে থেকে আঁচ করা যায় না।

হাল আর রিভারস বিচ-এর ওপর পেতে রাখা ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর বসে আছে। টেবিলের ওপর মাদেইরা ওয়াইন-এর একটা বোতল এবং দুটো ক্রিস্টাল গ্লাস রাখা আছে। এসবই এক পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন-এর সম্পত্তি ছিল যার জাহাজ এখন দ্বীপের দক্ষিণ দিকে পড়ে আছে।

তাদের দুজনের চারপাশে এখন স্বর্গীয় সৌন্দর্য বিরাজ করছে। রাতের আকাশে তারাগুলো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। হাল তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল জুডিথ কী এই তারাগুলো দেখতে পাচ্ছে, নাকি কোনো অন্ধকার কারাগারে বন্দি আছে যেখানে দিনের আলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না?

“তাহলে ট্রোম্প তোমার জাহাজ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল?” জলদস্যুটা ক্যাপ্টেন হাল-এর গ্লাসে রাম ঢেলে দিতে দিতে বলে।

“চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়”, হাল জানালো।

“অ্যাবোলি, ট্রাম্প এবং বিগ ডেনিয়েল তাদের লংবোট নিয়ে পানির ধারে অপেক্ষা করছে। পানসিটা পুনরায় বাউ-এর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেই সাথে হাল এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে রিভারস-এর ডাগআউট ডিঙ্গিগুলো পুনরায় আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। রিভারস-এর লোকদের কাউকে হাল আশে পাশে দেখতে পাচ্ছে না। যদিও অন্ধকারে লুকিয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না।

“এরপর থেকে ট্রোম্প নিজেকে আমার কাছে বেশ বিশ্বস্ত হিসেবে প্রমাণ করেছে,” হাল বলতে থাকল।

সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। আশে পাশে প্রাণের চিহ্ন বলতে কেবল বালির ওপর দিয়ে দ্রুত চলে যাওয়া কাঁকড়া আর ঝোঁপের ঐ পাশে থাকা লোকজনের হাসি-ঠাট্টার শব্দ।

“আপনি হয়ত শুনেছেন যে, শত্রুরা আমার কাছ থেকে কাউকে কেড়ে নিয়েছে।” কথাগুলো বলতেও হাল-এর বেশ কষ্ট হচ্ছিল। “এমন কাউকে যে আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে প্রিয় মানুষ। যে করেই হোক আমি তাকে ফেরত পেতে চাই। যারা তাকে নিয়ে গিয়েছে আমি তাদেরকে হত্যা করতে চাই। কিন্তু আমি নিজে সেই কাজটা করতে পারছি না।”

পরবর্তী কয়েক মিনিট হাল রিভারসকে সব গল্প খুলে বলল। সে জানায় যে জাঞ্জিবার-এর পরবর্তী বাজারের দিনে জুডিথকে বিক্রির উদ্দেশ্যে আনা হবে। জুডিথকে পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে তাকে কিনে আনা। কিন্তু হাল নিজে সেই ক্রেতা হতে পারছে না।

রিভারস মনোযোগ দিয়ে শুনল। সে ভাবছে যে তার এখন কি বলা উচিত। এরপর সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে যে, তাকে সেখানে সে সময় বিক্রির জন্য আনা হবে?”

“আমি রাষ্ট্রদূত গ্রে-এর কাছ থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেছি।”

“সেই লোক, যে তোমার সাথে প্রথমবার প্রতারণা করেছিল?”

হাল মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ,”

“তাহলে এখন কেন তুমি তাকে বিশ্বাস করছ? এমনও তো হতে পারে সে তোমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য এরকম প্রলোভন দেখাচ্ছে।”

“অবশ্যই সেরকম হতে পারে। কিন্তু তারপরও…এতে কিই বা আসে যায়। আমি যদি সেই বাজারে উপস্থিত থাকি তবে তাকে ফিরে পাওয়ার আশা আছে-তা সে যতই ক্ষীণ, হোক। কিন্তু যদি আমি সেখানে উপস্থিত না থাকি তবে সেই আশা একেবারেই নেই।”

“কিন্তু এখানে আমি কী করতে পারি?”

“আমি চাই, আপনি আমার পক্ষ হয়ে নিলামে সাড়া দিবেন। আমি বা আমার সাথে সম্পৃক্ত কেউই সামনা সামনি দর হাঁকাতে পারবে না। কিন্তু আপনার এবং আমার মাঝে কোনো যোগাযোগ আছে এটা দ্বীপের বাইরে কেউই জানে না। আমি জানতে পেরেছি যে বাজারের দাস বিক্রেতাদের সাথে আপনার পরিচয় আছে।”

“হুম।”

“সেই সাথে জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে আপনার কৃতকর্মের জন্য আপনাকে বন্দি করার কোনো আদেশ দেয়া হয়নি।”

“আমি জাঞ্জিবার-এর নিয়ম না ভাঙার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। সেকারণেই হয়ত আমি মুক্তভাবে সেখানে যেতে পারি। এছাড়া তুমি নিশ্চয়ই এটাও জান যে জাঞ্জিবার চলে তার নিজের নিয়মে। পৃথিবীর নিয়ম সেখানে খাটে না। জায়গাটা অনেকটা গ্র্যান্ড বাজারের মতো। তুমি সেখান থেকে যে-কোনো কিছু এমনকি যে কাউকে কিনতে পার। এই যে দেখ তুমি তোমার প্রিয় নারীকে সেখান থেকে কিনতে যাচ্ছ।”

“অথবা আমার হয়ে আপনি যাচ্ছেন।”

“কিন্তু কী কারণে আমি সেটা করতে যাব, যেখানে তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক বা চুক্তি নেই? আমার যদি কোনো লাভ না থাকে তাহলে আমি নিশ্চয়ই আমার নিজের চামড়ার ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যাব না, তাই না?”

হাল তার সামনে বসা রিভারস-এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রিভারস নিমগ্নচিত্তে তার পাইপ টানছে। হাল জানে যে খুব অনুনয় করে কিংবা বেপরোয়া হয়ে এর কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। তাকে শান্ত থাকতে হবে-যত নিষ্ঠুর সময়ের মধ্য দিয়েই সে সময় পার করুক না কেন।

“ট্রোম্প কী কখনো আপনাকে ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ-এর ব্যবসা সম্পর্কে কিছু বলেছে?” হাল জিজ্ঞেস করল।

রিভারস মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ কিছুটা বলেছে। বলেছে যে ক্যাথলিকরা জেসাস কিংবা কুমারী ম্যারি সম্পর্কিত যেকোনো পুরনো রেলিক-এর জন্য অনেক মূল্য দেবে। একসময় আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য কমপোস্টেলার আশেপাশে সমস্ত তীর্থস্থান আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। কিছু রেলিক দেখে আমার কাছে শুকিয়ে যাওয়া মুরগির হাড়ের মতো মনে হয়েছে। এরকম ধ্বংসাবশেষ বিক্রি করে টাকা বানাতে হলে লোকজনকে বোকা বানাতে হবে। ট্রোম্প সেটা কখনোই পারবে না। আমাকেই সেটাতে হাত লাগাতে হবে।”

“আপনি এখনো সেটা পারেন, হাল বলল। “যখন ট্রোম্প আমার জাহাজ আক্রমণ করতে যায় তখন সে এবং তার লোকেরা অভুক্ত ছিল। বাতাভিয়া ছেড়ে আসার পর সঠিকভাবে সে তার জাহাজের লোকদের খাবার যোগাতে পারছিল না। কারণটা পরিষ্কার। সে তার সমস্ত টাকা-পয়সা ও সম্পদ সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ তৈরি করতে নষ্ট করেছে। আমি যখন ডেফট পরিদর্শনে যাই তখন সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষসহ ব্যারেলগুলো খুঁজে পাই। কুমারী মেরীর অশ্রু, সত্যিকার ক্রসের টুকরা এমনকি জেসাস-এর সুন্নতে খানা করার সময় যে ফোরস্কিন বেঁচে গিয়েছিল সেটাও রয়েছে। আমি এইসব প্রতারণাপূর্ণ ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে চাই না। কিন্তু আমি জানি ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকদের কাছে এসব জিনিসের অনেক মূল্য আছে। এসব জিনিস আমি আপনার হাতে তুলে দিতে রাজি আছি যদি আপনি আমার হয়ে জাঞ্জিবার-এর বাজারে যান।”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ, আমার কোনো নৈতিকতা নেই?”

“অত্যন্ত সম্মানের সাথেই বলছি, ক্যাপ্টেন রিভারস, আপনার অস্তিত্ব সেটাই প্রমাণ করে।”

“সম্মানের সাথে! যদিও তুমি তোমার পশ্চাৎদেশ দিয়ে কথাগুলো বলেছ, কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ। আমি বেশ খুশি হয়েই এসব ধ্বংসাবশেষ খ্রিস্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের কাছে, তীর্থযাত্রীদের কাছে এমনকি সম্ভব হলে পোপ-এর কাছেও বিক্রি করব। আমি ক্যাথলিক-এ বিশ্বাসীদেরকে সম্মান করি একজন এনটিক্রিস্ট হিসেবে। অতএব, আমি আমার মতো করেই কাজটা করব।”

পার্লামেন্টের হয়ে আমি যুদ্ধ করেছি। আমি স্টুয়ার্টদের ঘৃণা করি একজন টাইরান্ট হিসেবে নয় বরং একজন প্যাপিস্ট হিসেবে। তাই আমি এসব ধ্বংসাবশেষ নে এবং বিক্রি করে আমার পুরস্কার আদায় করব। কিন্তু এসব ধ্বংসাবশেষই যথেষ্ট নয়।

“ট্রোম্প আমাকে নিশ্চিত করেছে যে এসবের মূল্য কয়েকশ এমনকি হাজার পাউন্ডও হতে পারে।”

“এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মাথার দাম এর চাইতেও বেশি।”

“তাহলে আপনার মাথার মূল্যায়ন করতে হলে আপনাকে কী পুরস্কার দিতে হবে?”

রিভারস তার পাইপ-এ মগ্ন হয়ে গভীরভাবে প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। এরপর পেছনে হেলান দিয়ে বসে রাতের আকাশে ধোয়া ছাড়ল কিছুক্ষণ। এরপর সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ধ্বংসাবশেষগুলো আমি নেব। সেই সাথে তারা যে জাহাজে করে এসেছে সেটাও আমার চাই।”

“কিন্তু ডেফট-এর মূল্য অন্তত পাঁচ’শ গিনি হবে?”

“ডেফট-কে চুরি করে আনা হয়েছে তাই না?” তুমি তো আমাকে তা-ই বলেছ। ট্রোম্প তার সমস্ত টাকা-পয়সা এসব ধ্বংসাবশেষ তৈরি করতে খরচ করেছে। সে যদি খাবারই জোগাড় করতে না পারে তাহলে সে নিশ্চয়ই এরকম সুন্দর একটা জাহাজ কিনতে পারেনি, তাই না?”

“ট্রোম্প বোটটা কীভাবে পেয়েছে, সেটা তার ব্যাপার, আমার না।”

“ভাবো একবার। তুমি ডাচ্ নেভীদের জাহাজ দখল করেছ যখন কি-না ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড-এর মধ্যে শান্তি চুক্তি বিরাজ করছে। তোমাকে তো ডাকাতির জন্য ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। বুঝতে পেরেছ?”

রিভারস-এর যুক্তিগুলো হাল বুঝতে পেরেছে, কিন্তু তার চাহিদা পূরণে হাল খুব একটা অগ্রসর হলো না। রিভারস যেন হাল-এর মনের কথা বুঝতে পেরেছে এমনভাবে বলতে থাকে, “শান্ত হও বালক।” আমি জানি তুমি ব্যাপারটা পছন্দ করছ না। একজন নাইট হয়ে আমার মতো একজন দস্যুর সাথে দর কষাকষি করাটা তোমার জন্য অসম্মানের। কিন্তু ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখ। তুমি সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষগুলো চাও না। আর জাহাজটা তুমি চাইলেও ব্যবহার করতে পারবে। আমি তোমার স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার বদলে এমন দুটো জিনিসই তোমাকে দিতে বলেছি যে দুটো জিনিস তঅমার কোনো কাজেই আসবে না। এখন চিন্তা করে দেখ ব্যাপারটা কী খুব একটা খারাপ হবে?”

“সম্ভবত না”, হাল বলল।

“আমি তোমার কথা বিবেচনা করব শুধু এই কারণে যে একসময় আমিও কাউকে হারিয়েছিলাম।” রিভারস তার গ্লাসের শেষ ওয়াইনটুকুও পান করে নিলো। এরপর কিছুক্ষণ নিজের পেছনের গল্পের মধ্যে হারিয়ে গেল। “কী নাম তার?” অবশেষে সে জিজ্ঞেস করল।

“জুডিথ,” নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে হাল-এর মনে অন্যরকম একধরনের অনুভূতি হচ্ছিল।

“খুব ভাল মেয়ে, তাই না?”

“আমার দেখা সবচেয়ে ভাল মেয়ে।”

“একজন পুরুষের জন্য সবচেয়ে ভাল উপহার হচ্ছে এমন একজন নারী, যে তাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবাসবে।”

বুড়ো শয়তানটার তাহলে হৃদয়ও আছে। মনে মনে চিন্তা করল হাল।

অবশেষে রিভারস রাজি হলো। “আমি তোমার সঙ্গে জাঞ্জিবার-এ যেতে রাজি আছি। সেখানে গিয়ে আমি তোমার স্ত্রীকে কিনে আনার ব্যবস্থা করব।”।

৬. মানুষ কেনা-বেচার বাজারে

জাঞ্জিবার-এ মানুষ কেনা-বেচার বাজারে এযাবত কালের সবচেয়ে দামি পণ্য আজকে বিক্রয়ের জন্য আনা হয়েছে। জাঞ্জিবারের লোকেরা গর্ব সহকারে বলাবলি করছে, পৃথিবীর কোথাও এত উচ্চদামের মানুষ পাওয়া যায় না। বিক্রয়ের পূর্বে জুডিথকে একটা আবদ্ধ ঘরে নিয়ে রাখা হলো যেখানে সব দাসকেই বিক্রয়ের পূর্বে রাখা হয়। এতদিনে জুডিথ প্রিন্স জাহানের হারেমের জামাকাপড় পরতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ সেসব জামাকাপড় খুলে তাকে একটা এপ্রনের মতো কাপড় পরতে দেয়া হয়েছে। কাপড়টা শুধু তার গলা থেকে সামনের দিকে ঝুলে আছে। তার হাতদুটো পেছন দিকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মাথায় একটা রশি বাঁধা যেটা ধরে তাকে টেনে একদল বিক্রেতার মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যারা বিক্রয়ের পূর্বে তাদের পণ্যগুলোকে ভালভাবে দেখে নিচ্ছিল।

জুডিথকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করা হলো। সে তার বুকের ওপর একটা শক্তহাত অনুভব করল। মহিলারা সবজি কেনার পূর্বে যেভাবে পরীক্ষা করে দেখে অনেকটা সেরকমভাবেই হাতদুটো তাকে পরখ করে দেখছিল। পা দুটোর মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান রেখে তাকে বাঁকা হয়ে দাঁড়াতে বলা হলো। তার পেছন দিকটা বিক্রেতাদের দিকে ফেরানো আছে যেন তারা তার গোপন অঙ্গগুলো ভালভাবে দেখতে পারে। এরপর লোকগুলো তার ঠোঁটদুটো সরিয়ে দাঁতগুলো পরীক্ষা করে দেখল। ঘোড়া কেনার সময় যেভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয় অনেকটা সেরকমভাবে।

হাল এবং অ্যাবোলির সাথে কিছুদিন আগের এক আলাচনার কথা মনে পড়ল ওর। ওলন্দাজদের কেপ কলোনীর দাসদের ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করছিল ওরা।

“তোমার সমস্যা কী জান, গান্ডওয়েন? তুমি সবসময় লড়াই করতে চাইতে। কিন্তু দাসদের প্রথম যে জিনিসটা শিখতে হয় তা হলো লড়াই করে কিছু পাওয়া যায় না। মনিব তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তোমাকে চাবুক মারবে। এরচাইতেও খারাপ যা করবে তা হাল তোমাকে কোনো খাঁচায় বা মাটির নিচে কোনো গর্তে বন্দি করে রাখা হবে। সূর্যের খরতাপে তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলবে। বৃষ্টিতে ভিজতে বলবে। তাই তাদেরকে সেই আনন্দটা পেতে দিও না। তাদের নিষ্ঠুরতা, আর তাদের অপমানকে সহ্য করতে হবে, কিছুই বলা যাবে না। সহ্য করতে হবে এই কারণে যে কেবল এইভাবেই তুমি বেঁচে থাকতে পারবে, তোমার সন্তান বেঁচে থাকতে পারবে। সেই সাথে প্রার্থনা করতে হবে, মনে মনে আশা করতে হবে যে একদিন তুমি মুক্ত হবে।”

সে কারণেই জুডিথ চুপচাপ সবকিছু সহ্য করে রইলো। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে সে হালকে খুঁজতে থাকল। অবশ্য সে বুঝতে পারছে না যে সে কী সত্যিই হালকে এখানে প্রত্যাশা করছে কি-না। সে শুধু জানতে চায় হাল তার জন্য এখানে এসেছে, নাকি আসেনি। জুডিথকে এই অবস্থায় দেখতে পাওয়াটা তাদের দুজনের জন্যই অনেক অসম্মানের ব্যাপার। কিন্তু তার চাইতেও বেশি অসম্মানের ঘটনা ঘটছে এখানে। লোকগুলো খুঁটিয়ে দেখার পর আবার তা নিয়ে জনসম্মুখে আলোচনা করছে যেন সে কানে শুনতে না পাওয়া কোনো পশু।

কুটনৈতিক মিশনে তার বাবার সফরসঙ্গী হিসেবে জুডিথ শুধু ভেনিসেই যায়নি, বরং ইউরোপের অন্যান্য অনেক শহরেও ঘুরে বেড়িয়েছে। তরুণ বয়সের কারণে এবং ভাষার দক্ষতার কারণে সে সেসব শহরের মানুষের সাথে মিশে যেতে পেরেছে খুব সহজে। বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ভাষা, অ্যামহারিক এবং অ্যারাবিক ভাষা ছিল তার নখদর্পণে। কিন্তু সেই ভাষার দক্ষতাটাকেই এখন তার কাছে অভিশাপ মনে হচ্ছে। কারণ আশেপাশের লোকগুলোর কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে।

একটা ওলন্দাজ তার বন্ধুকে বলছে, “তুমি কী জান এই গাভীটা তার পেটে একটা বাছুর বহন করছে? তাও আবার একটা সাদা চামড়ার লোকের!”

এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ী আরেক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করছে। “সুলতান কেন এই কালো রত্নটাকে বিক্রি করছে? এই রত্ন যদি আমার কাছে থাকত তবে আমি তাকে বিছানার সাথে বেঁধে রাখতাম।”

“আমি জানতে পেরেছি যে এটা নাকি একধরনের প্রতিশোধ,” উত্তরে আরেকজন বলল। “তার জন্ম নিশ্চয়ই কোনো উচ্চ সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ওর হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখ। অন্যান্য দাসদের মতো নয়। তাকে যখন ব্লক-এ উঠানো হবে তখন নিশ্চয়ই তার পরিচয় উন্মোচিত হবে। তারা বলছে শুধু এর নাম উচ্চারিত হলেই দাম দশ হাজার সিলভার রুপি বেড়ে যাবে।”

“তাহলে এ কে, সেবার রানী?”

“তার নাম যাই হোক না কেন, আমি সেটা পরোয়া করি না। সপ্তাহের যেকোনো একদিন আমি শুধু এর জন্যই বরাদ্দ রাখবো।”

“এরপর দ্বিতীয়বার যখন তাকে বাঁকা হয়ে দাঁড়াতে বলা হলো তখন একটা অ্যারাবিক কণ্ঠ বলে উঠল, তার ঠোঁটগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ। এরকম নারী যে-কোনো পুরুষের জন্যই আকাঙ্ক্ষিত বস্তু।”

“তুমি কী এর জন্য দর হাকাবে?”

“কী দরকার টাকা নষ্ট করার? এরকম নারী বিনামূল্যেই নিজেকে তোমার হাতে সমর্পণ করবে।”

এরকম অসহ্যকর পরিস্থিতি এবং অস্থিরতার মধ্যে সে রাত পার করল। সকালে তাকে এক বাটি মণ্ড জাতীয় খাবার এবং এক বালতি পানি খেতে দেয়া হলো। এরপর এক আফ্রিকান নারী তার সারা শরীরে তেল মেখে চকচকে করে দিল।

সময় যেন জুডিথ-এর জন্য থমকে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক দাসকে তুলে দেয়া হচ্ছে বিক্রয়ের মঞ্চে। নিলামদার আরবি ভাষায় একের পর এক নতুন পণ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সবার কাছে। দাস ব্যবসায়ীরা তাদের মক্কেলদের আকর্ষণ করার জন্য পণ্যের বিভিন্ন ভাল দিকগুলো উল্লেখ করছে। এরপর নিলামদারের নিজস্ব একজন দাস এসে জুডিথ-এর গলার রশি ধরে টেনে নিয়ে গেল। হঠাৎ সে শুনতে পায় নিলামদার তার বর্ণনা দিচ্ছে। “মাননীয় ভদ্রমহোদয় গণ, আমি আপনাদের সামনে এখন এক কালো রত্নকে হাজির করব। সে হচ্ছে সুলতান সাদিক খান জাহান-এর নিজস্ব সম্পত্তি। এই কালো রত্ন বোকার মতো ভেবেছিল যে সে জাঞ্জিবার-এ এসে গোয়েন্দাগিরি করবে কিন্তু সাদিক খান জাহান তাকে ধরে ফেলে। এই রমণীর নাম হচ্ছে জেনারেল জুডিথ নাজেত।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ গুঞ্জন ধ্বনি শুরু হলো। সেই গুঞ্জন ধ্বনি বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যে নিলামদারকে চিৎকার করে সবাইকে থামাতে হলো। “সে হচ্ছে ইথিওপিয়ার নাস্তিক লোকদের গর্ব। কিন্তু আস্তিকদের ক্লেশের কারণ। যারা আল্লাহ তায়ালায় বিশ্বাস করে তাদের হত্যাকারী। কিন্তু আমাদের গ্রেট প্রিন্স তাকে অবশেষে ধরেছেন। কিন্তু তার অসীম মহানুভবতার কারণে তিনি এখন একে যে কারো হাতে তুলে দিতে রাজি আছেন।”

গুঞ্জন আবারো বাড়তে থাকে। সেটা থামার পূর্ব পর্যন্ত নিলামদার অপেক্ষা করল, এরপর আবারও বলতে শুরু করল, “এই রমণী শুধু একটা মহিলা শয়তানই নয়। সে একটা বেশ্যাও বটে। এক ইংরেজ-এর জন্য সে তার শরীর পেতে দিয়েছে। শুধু তাই নয় সেই ইংরেজ-এর সন্তান সে পেটে ধারণা করে আছে। সেই ইংরেজটার নাম হচ্ছে ক্যাপ্টেন হেনরি কার্টনি। সে কি-না এল তাজার নামে পরিচিত। খোদায় বিশ্বাসীদের জাহাজ সে বাজেয়াপ্ত করত নির্দয়ভাবে। ভদ্রমহোদয়গণ আমাদের পরবর্তী পণ্য হচ্ছে জেনারেল জুডিথ নাজেত এবং তার পেটের সন্তান!”

এরপর গুনগুন, শোরগোল বাড়তেই থাকে। জুডিথকে নিয়ে বিক্রি করার ব্লক-এর ওপর দাঁড় করানো হয়।

.

হাল তার কপাল থেকে ঘাম মুছছে বারবার, সেই সাথে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তার হার্টকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। বাজারের একপাশে ছোট একটা ঘেরাও করা জায়গা আছে। সেখানে দুটো বেঞ্চ রাখা আছে। ধনী ক্রেতারা যেন আরামে বসে থাকতে পারে সেকারণেই এই ব্যবস্থা। এর থেকে একটু দূরে পর্দা দিয়ে ঘেরা আরেকটা বিশেষ জায়গা আছে। সুলতান এবং বিশেষ বিশেষ অতিথিদের সেখানে বসতে দেয়া হয়।

হাল নিজেকে সূর্যের খরতাপের নিচে সাধারণ জনগণের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। বাইরের দরজার দিকে হৈ চৈ-এর মাঝে সে মিশে আছে। দাস বিক্রয়ের জায়গাটা চার ধাপ বিশিষ্ট মঞ্চের মতো মনে হচ্ছে। একেবারে উপরের ধাপে রয়েছে বিক্রয়ের জন্য আনা দাসগুলো। যেন আগত ক্রেতারা এবং সাধারণ দর্শনার্থীরা তাদেরকে খুব ভালভাবে দেখতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে নিলামদার। ভিড়ের মাঝে কোনো বিডারকে ভালভাবে খেয়াল করার জন্য সে মাঝে মাঝে তৃতীয় ধাপে নেমে আসছে। এরপর শেষ ধাপে রয়েছে নিলামদারের শক্তিশালী দুজন দাস। যদি কেউ পালিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তবে দাস দুজন তাদেরকে আটকে ফেলবে।

হাল মাঝামাঝি অংশের একপাশে অবস্থান করছে। জাঞ্জিবার-এ যে রাতে জুডিথকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সে রাত থেকে এখনো পর্যন্ত হাল শেভ করেনি। এমনকি চুলও কাটেনি। চুল দাড়ি লম্বা হয়ে তার মুখের প্রায় সবটুকু ঢেকে রেখেছে। সেই সাথে সে এমন ছদ্মবেশ ধারণ করেছে যে তাকে যেন একজন ক্যাপ্টেন মনে না হয়। তাকে একজন দাস ব্যবসায়ীর মতই লাগছে এখন।

হাল-এর জন্য আরও একটা চিন্তার ব্যাপার আছে–আবোলি রিভারস-এর জাহাজ একিলিস-এ রয়ে গিয়েছে। অ্যাবোলির সাথে বিগ ডেনিয়েল এবং বাউ এর অন্যান্য বিশ্বস্ত নাবিক রয়েছে। ওদেরকে রাখা হয়েছে এই কারণে যাতে দস্যু ক্যাপ্টেনটা হালকে রেখে পালিয়ে যেতে না পারে কিংবা কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

“আমি দুঃখিত পুরনো বন্ধু,” হাল তাকে বলেছিল। তুমি যদি আমার সাথে থাক তাহলে তারা সহজেই আমাকে চিনে ফেলবে। কারণ তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব বহু দিনের। এ যাত্রায় মি, ট্রোম্প আমাকে সঙ্গ দিবে। এটাই বরং নিরাপদ।

অবশ্য হাল জানে যে সেও যদি অ্যাবোলির মতো উপকূলে না যেত সেটা তার জন্য অনেক নিরাপদ হত। কিন্তু রিভারস-এর মতো কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। রিভারস যে তার জুডিথকে কিনে আবার জাহাজে ফেরত আসবে এতটা আস্থা রাখার মতো লোক সে নয়। কারণ পেশাগতভাবে সে একজন চোর এবং দস্যু। সে যে আবার জুডিথকে চুরি করে নিয়ে যাবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দিবে।

একের পর এক সব দাস নিলামে বিক্রি হয়ে গেলে সবশেষে জুডিথ-এর জন্য ডাক দেয়া হয়। দিনের সবচেয়ে সেরা পণ্য হিসেবে জুডিথ-এর নাম উল্লেখ করা হলো, সেই সাথে তার রসালো বর্ণনা দেয়া হলো। হাল যে তার সন্তানের পিতা এটাও উল্লেখ করতে ভুলল না তারা। জুডিথ-এর হাতদুটো পেছন দিকে বাঁধা আছে। তাই সামনের লোকগুলোর লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার কোনো রাস্তাই তার সামনে খোলা ছিল না।

হাল-এর ক্রোধ বাড়তে বাড়তে এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে যেমনটা সে তার জীবনে কোনোদিন অনুভব করেনি। তার রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়েছে। তার নিঃশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তার দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে শুরু করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে কোনো শত্রুকে বধ করার জন্য সে উন্মত্ত হয়ে আছে। তার ডান হাতের মুষ্টি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে যেন সে যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ার-এর বাট ধরে আছে।

“না,” ট্রোম্প হাল-এর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “মোটেও না! আমি আপনার অনুভূতি বুঝতে পারছি। আমি জানি আপনি তাদের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। রিভারসকে তার কাজ করতে দিন। আপনি যদি এখন আপনার নিজের দিকে সমস্ত আকর্ষণ টেনে আনেন তাহলে সব পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে যাবে।”

ট্রোম্প কি বলছে তার একটি কথাও হাল ভালভাবে বুঝতে পারল না। কিন্তু তার শারীরিক বাধা এবং কণ্ঠের আওয়াজে হাল-এর রাগ কিছুটা শান্ত হলো।

হাল তার শরীর ও মনকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে বোঝনোর চেষ্টা করতে লাগল যে নিলামদার দর হাঁকানোর পূর্ব পর্যন্ত হলেও তাকে শান্ত থাকতে হবে। দস্যু রিভারসকে তার কাজ করতে দিতে হবে। নয়ত সব কিছু বিনষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু তারপরও সে সরাসরি জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে চিৎকার করে উঠে, চিন্তা করো না, প্রিয়তমা। আমি এখানে আছি। তোমার সাথেই আছি।

.

জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় কিছু কিছু পুচকে ছোরা দেখা যায় যারা ক্ষুধার্ত পথচারীদের কাছে ফলমূল কিংবা অন্যান্য খাবার বিক্রি করে। পথচারীদের পকেট থেকে কিছু টাকা আদায় করাই এদের উদ্দেশ্য।

সেরকমই একটা ছেলে নিলামের বাজারে এখানে সেখানে ঘুরছে। কিন্তু, সে কারো কাছ থেকে কোনো টাকা আদায় করার চেষ্টা করছে না। সে চুরি করার চেষ্টা করছে। বিক্রয়ের দিকে যে তার মনোযোগ আছে সেটাও বলা যায় না। মাঝে মাঝে সে করুণ চোখে জুডিথ-এর দিকে তাকাচ্ছে। তবে তার সমস্ত মনোযোগ একজনের দিকেই নিবিষ্ট আছে। তাকে সেভাবেই পরিষ্কারভাবে আদেশ দেয়া আছে। সে যাই করুক যেখানেই যাক তাকে অনুসরণ করবে। তার ওপর থেকে তোমার চোখ সরাবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত না সে এবং তুমি উপকূল থেকে চলে আসবে অথবা তাকে এই দ্বীপের বাইরে কোথাও নিয়ে যাবে।”

.

গ্রে প্রিন্স জাহানকে প্ররোচনা দিয়েছে যে তার উচিত ভিড়ের মাঝে কার্টনিকে খুঁজে বের করা। এটা সত্য যে বুজার্ড ক্যাপ্টেন কার্টনিকে আমার চেয়ে ভাল চিনে। সে বলতে থাকে, কিন্তু তার আগমনই ভিড়ের মধ্যে সবাইকে এলোমেলো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। “আমি বহুবছর যাবত মানুষের ব্যবসা করে আসছি। মানুষ চেনার উপায় আমি জানি। আমি ক্যাপ্টেন কার্টনিকে খুঁজে বের করার মতো যথেষ্ট চিনি, কিন্তু ভিড়ের দিকে না তাকিয়ে আমি ক্যাপ্টেন কার্টনিকে খুঁজে বের করার উপায় জানি।”

আর তাই সে পর্দা দিয়ে ঘেরা জায়গাটার প্রথম সারিতে বসল। তার দুই পাশে সুলতান-এর গার্ডরা দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে জুডিথ, এর দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। গ্রে-র মনে ক্ষীণ ইচ্ছে জাগছিল একবার দর হাঁকানোর। এমন সুন্দরী রমণীর জন্য যে কোনো পুরুষের মনেই ইচ্ছে জাগতে পারে। কিন্তু জুডিথ-এর দিকে সে একজন ক্রেতার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না কিংবা একজন প্রেমিক পুরুষের দৃষ্টিতেও তাকাচ্ছে না। তার অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে একারণেই সে জুডিথ-এর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

জুডিথ চায় না পশুর ন্যায় নিচু জাতের কোনো লোক তাকে কিনে নিয়ে যাক। সে জেনারেল পদমর্যাদার অধিকারী এবং তার শরীরে উচ্চবংশীয় রক্ত বইছে। যত কঠিন পরিস্থিতিই আসুক না কেন সে সেই সম্মান এবং স্পিরিট রক্ষা করার চেষ্ট করবে। সেই সাথে সে জানে যে যত বাধাই আসুক না কেন হাল তার জন্য এখানে আসবে। কিন্তু কোথায় সে?

জুডিথ বুঝতে পারছে যে হাল ছদ্মবেশে আসবে। তাই জুডিথ ভিড়ের ভেতর সেই সবুজ চোখের গভীরতা খুঁজে বেড়াতে থাকে যা তাকে হালের উপস্থিতির নিশ্চয়তা দেবে। একইসাথে সে খুঁজতে থাকে হাল-এর নাকের বাঁকানো অংশটাকে, কিংবা সেই ভঙ্গিমা বা চেহারার সেই চিহ্নটা, যার কারণে তাকে যুবক রাজার মতো মনে হয়।

এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে একসময় সে তার প্রিয় মানুষটির দেখা পেয়ে গেল সে। ভিড়ের মাঝে দুটি চোখের দৃষ্টি তার অক্ষিপটে ধরা পড়ে। সে জানে এই সেই ব্যক্তি, কারণ এই চোখের দৃষ্টি সে অন্তরের অন্তস্তল থেকে চেনে। দেখা পাওয়া মাত্র মনের ভেতরের সেই খুশি সে ধরে রাখতে পারে না। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

জুডিথ-এর মুখে হাসি ফুটতে দেখে গ্রে’র মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সে জুডিথ এর দৃষ্টি অনুসরণ করে ভিড়ের দিকে তাকাল। অগোছালো কিছু সম্ভ্রান্ত কাপড় পরা শ্যামবর্ণের লম্বা একজন পুরুষ ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রে সেই পুরুষের দৃষ্টি অনুসরণ করে আবারও জুডিথ-এর দিকে তাকাল। এরপর সে গার্ডদের দিকে ফিরে অন্য কোনোরকম আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি বলল, “ওই যে তোমাদের সেই লোক, ক্যাপ্টেন কাটনি। এখন তোমাদের লোকদের বল তাকে ধরে আনতে।”

বুজার্ড প্রিন্স জাহানের ঘেরাও করা জায়গার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে তার সব সময়কার সঙ্গী দাসটিও দাঁড়িয়ে আছে। বুজার্ডকে পেছনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই কারণে যে তার কারণে যেন জনগণের মাঝে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়। কিন্তু গতকাল সন্ধের ঢেউয়ে যখন একিলিস জাহাজ জাঞ্জিবার এসে পৌঁছায় এর কিছু সময় পরই বুজার্ড এবং বেনবুরি কার্টনির অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে এবং মনে মনে পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে।

রিভারস যখন ট্রেস ম্যাকোকোস-এ পৌঁছে এক বোতল রাম-এর অর্ডার দিয়েছিল তখন বুজার্ড বেনবুরিকে সাথে নিয়ে ট্রেস ম্যাকোকোস-এর মালিক এর সাথে আলোচনায় মগ্ন।

তিনজন ক্যাপ্টেন-াদের কার্যকলাপ ও কুকীর্তি একই সূত্রে গাথা-কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়ল। তারা তিনজন একে অপরকে বহু আগে থেকেই চিনে। রিভারস জানায় যে সে জাঞ্জিবার-এ একটি দাস কিনতে এসেছে। তিন নাম্বার রামের বোতল শেষ করতে করতে সে আরো জানায় এই দাস সাধারণ কোনো দাস নয়, সুলতান-এর প্রিয় দাস।

কিন্তু রিভার একজন দস্যু। কোনো দাস ব্যবসায়ী নয়। একজন মানুষ হঠাৎ করে ছুতার মিস্ত্রী থেকে মুদ্রণকারী হয়ে যেতে পারে না। কেউ যদি এভাবে হঠাৎ করে পেশা বদলে ফেলে তবে তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ আছে। বেনবুরি তার দুজন বিশ্বস্ত লোককে একিলিস-এর ওপর নজর রাখতে পাঠায়। তারা যা দেখতে পায় এতে করে বেনবুরির কাছে কারণটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

এরপর নিলাম যখন ক্লাইমেক্সের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল তখন অবশেষে রিভারস বিডিং করা শুরু করে। এটা দেখে বুজার্ড কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায়। প্রিন্স-এর ঘেরাও করা জায়গার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল সে। বুজার্ড তার মাথাটা এদিক সেদিক নাড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল সবার কাছে। এরপর সে আবারও পিছিয়ে গেল। এরপর আর একটিও কথা না বলে প্রিন্স জাহান-এর ব্যক্তিগত বক্স-এর পেছন দিকের সিঁড়ি দিয়ে মাটিতে নামতে শুরু করল বুজার্ড। ওর জন্য ঠিক করা দাসটা ওর পেছনে-পেছনে আসছিল। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডরা সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল, কারণ তারা জানে যে বুজার্ড প্রিন্স জাহানের সৃষ্টি। এবং সে তাদের মনিবের কথা অনুযায়ীই সব কাজ করে। তাই বুজার্ড যখন জনগণের সামনের দিয়ে হেঁটে ঘেরা দেয়া জায়গাটার পেছনে চলে গেল, তখনো তাদের মনে কোনো সতর্কতা সংকেত বেজে উঠল না।

রিভারস নিলামের দর নিজের দিকে টেনে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু একজনই আছে এখন। মূল্য প্রায় তিন লাখ সিলভার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এত বেশি দামে এ পর্যন্ত কোনো দাসই বিক্রি হয়নি। এই পরিমাণ দর পরিশোধ করতে হলে হয়ত কার্টনিকে তার জাহাজ, পারিবারিক সম্পত্তি সব বিক্রি করতে হবে। কিন্তু তাতে রিভারস-এর কিছু যায় আসে না।

সে যখন নিলামে জয় প্রায় নিশ্চিত করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই সে অনুভব করল যে কেউ একজন পেছন থেকে এসে তার গলায় ছুরি বসিয়েছে। মাফ করবেন ক্যাপ্টেন, লোকটি তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে থাকে। ক্যাপ্টেন বেনবুরি আপনাকে তার অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন, এবং বলেছেন যে আপনি যদি এখান থেকে বেরিয়ে শান্তিপূর্ণভাব আপনার জাহাজে ফেরত যান তবে আমরা আপনাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকব।

“তোমাদের ক্যাপ্টেনকে গিয়ে বলবে …” রিভারস বলতে শুরু করল। এরপর সে মাঝপথে থেমে গেল এবং চিন্তা করে দেখল যে ডেট জাহাজটা এরমধ্যে তার দখলে চলে এসেছে। এখন সে যদি বেঁচে থাকে তবে সে তার সম্পদ উপভোগ করতে পারবে। তাই সে তার কথার সুর বদলিয়ে ফেলল। “তাকে বলবেন যে আমি তাকে শুভকামনা জানিয়েছি। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব যদি তোমরা এখন আমাকে জাহাজে যেতে সাহায্য কর।”

গ্রে তার একচোখ নিলামের দিকে এবং অন্যচোখ দিয়ে কার্টনির ওপর নজর রাখার চেষ্টা করছে। গার্ডদের একটা দল সাধারণ পোশাকে জনগণের মাঝে মিশে আছে। এরা কার্টনির কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে কি-না এটা বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাল-এর সমস্ত মনোযোগ নিলাম-এর দিকে। নিলাম-এর দর নিয়ে তার দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য এমনকি সারাজীবনের জন্য হয়ত তাকে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু জুডিথ এবং তার সন্ত নি যদি তার কাছে থাকে তবে এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ।

সাহস পাওয়ার জন্য সে ট্রোম্প-এর দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু ওলন্দাজটা তার পাশে নেই। সে এটা নিয়ে বেশি কিছু ভাবল না। লোকজনের ভিড়ের মাঝে হয়ত কোথাও দূরে সরে গিয়েছে লোকটা।

এরপর সে আবার নিলাম-এর দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু নিলাম ডাকা যে শেষ হয়ে গিয়েছে এটা বুঝতে তার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। নিলামদার জনৈক ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞেস করছে যে সে দর আরও বাড়াবে কি-না। সে নিশ্চয়ই রিভারসকে জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু রিভারস করছেটা কী?

ঠিক তখনই হাল-এর পেটে কেউ একজন আঘাত করল। ব্যথায় উঠল সে। এরপর সে মাথায় আরও একটা আঘাত অনুভব করল।

দাস নিলাম-এর সামনের ঘটনাগুলো তার আর জানা হলো না।

*

গেট খুলে দেয়ার পরপরই সর্বপ্রথম যারা নিলামের মাঠে প্রবেশ করে নিলাম-এর মঞ্চের পাশে জায়গা করে নিয়েছিল তারা এ জানতো যে তাদেরকে এখানে অনেকটা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে। নিলাম শেষ হওয়ার পূর্বে তারা এখান থেকে বেরুতে পারবে না। অনেকে পানির বোতল, শুকনো খাবার এবং রাম-এর বোতল নিয়ে এসেছে। কয়েকজন মিলে মঞ্চের সামনের অংশের একদিকে একটা ছোটখাট ক্যাম্প তৈরি করেছে। সেখানে রয়েছে নানারকম খাদ্য সম্ভার, কাঠের পিপা ভর্তি বিয়ার। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা পিপা শেষ হয়ে গেল। আরেকটা পিপা সামনের সারিতে লোকজনের বসার জায়গার নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঐ পিপাটার ছিপি খোলা ছিল। ওটার ভেতর গান পাউডার ভর্তি করে গড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সকলের অজান্তে।

ক্যাম্পে আসা লোকজন সবাই মনোযোগ দিয়ে নিলাম ডাকা দেখছিল, কেউ খাচ্ছিল, কেউ পাইপ টানছিল।

কিন্তু একজন নাবিক নিলাম-এর দিকে তাকিয়ে ছিল না। সে প্রিন্স-এর ঘেরাও করা জায়গার দিকে তাকিয়ে ছিল। বুজার্ড যখন সামনে এগিয়ে এসে তার মাথা নাড়াল, তখন সেই নাবিকটি তার পাইপে লম্বা টান দিয়ে একটা কাগজে আগুন ধরিয়ে দিল।

এরপর লোকটা সেই আগুন গান পাউডার-এর লাইনে ধরিয়ে দেয়। তারপর যা হওয়ার তাই হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিৎকার শোনা যায়। আগুন! বাঁচাও! আগুন।

বিক্রি এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু নিলামদার শেষ দর-এর জন্য অপেক্ষা করল না। সে জুডিথকে টেনে স্টেজ থেকে নামিয়ে পেছনের দিকে একটা ঘরে নিয়ে গেল।

মুখোশ পরা লোকটা সেখানে অপেক্ষা করছিল। “আমি একে নিয়ে যাচ্ছি,” সে বলল।

নিলামদার অনেকটা দোটানার মধ্যে পড়ে যায়। তার বিশ্বাসভাজন লোকেরা মুখোশ পরা লোকটাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। “কিন্তু আমার টাকা,” নিলামদার মুখোশ পরা লোকটাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে বলল। “আমাকে বলা হয়েছিল যে এই দাস কোনোভাবেই বিক্রি করা যাবে না। আর আমাকে এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কমিশনও দেয়ার কথা ছিল।”

“কাল সকালে প্রাসাদে যেও, তুমি তোমার কমিশন পাবে। কিন্তু এখন আমি একে নিয়ে যাচ্ছি,” বুজার্ড বলল। এরপর সে জুডিথ-এর গলায় বাধা দড়ি ধরে টান দিয়ে বলল, “তুমি যদি স্বাভাবিক মানুষের মতো দৌড়ে আমার সাথে যেতে না চাও তবে আমি তোমাকে এটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাব।”

জুডিথ বাইরে এলোমেলোভাবে ছুটে পালানো লোকজনের চিৎকার শুনতে পেল। “তুমি কী আমাকে প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ?” সে জিজ্ঞেস করল।

বুজার্ড মাথা নাড়াল। জুডিথ বুজার্ড-এর পেছন পেছন দৌড়ে ভিড় থেকে পালিয়ে বাইরে চলে আসলো। ওখানে এসে দেখল, প্রিন্স-এর বাহন বাইরে অপেক্ষা করছে। “উঠে বস,” বুজার্ড বলল। “কেউ যদি দেখতে না পায় তবে আপনি নিরাপদ থাকবেন।”

জুডিথকে যেমনটা বলা হলো, তেমনটাই করল সে। আগুন লাগার পূর্বেই জুডিথ-এর মনে অদ্ভুত একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। এখানে অনেক রকম মানুষ সমবেত হয়েছে। তাই অনেক রকম লোভ-লালসা এবং প্রতিহিংসাও একত্রিত হয়েছে। সে অনেকটা সময় ধরে সৈন্যদের মাঝে কাটিয়েছে। সে জানে যেকোনো মুহূর্তে এসব উপাদান বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

“ঈশ্বর, হালকে নিরাপদে রেখ, সে প্রার্থনা করতে থাকল। যদি সে নিরাপদে থাকে এবং আমি প্রিন্স এর প্রাসাদে ফিরে যাই তাহলে হয়ত আমরা মিলিত হব না। কিন্তু তারপরও একটা আশা থেকে যাবে।

বাহনে উঠে বসার পর সে খেয়াল করল যে, এখনো তার হাত পেছনে বাধা। এমনকি গলায়ও রশিটা বাধা আছে। প্রিন্স এর বন্দি থাকা অবস্থায় কখনো তার সাথে এমনটা করা হয়নি। তাহলে কেন বুজার্ড তার সাথে এমনটা করছে এখন?

বুজার্ড দেখতে পেল যে জুডিথ পেছনে উঠে বসেছে। সে তার দাসটাকেও পেছনের সিটে বসতে বলল। এরপর সে হেঁটে বাহনের সামনে এসে ডাইভারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। “তুমি কী আমাকে উঠতে সাহায্য করবে? সে ড্রাইভারেরর পাশের সিটের দিকে ইশারা করে বলল।”

ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বুজার্ডকে টেনে তোলার চেষ্টা করল।

বুজার্ড লোকটির হাত শক্তভাবে ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচের দিকে টান দিল। চালকটি তার আসন ছেড়ে মাটিতে পড়তে শুরু করল।

চালকটি যখন নিচে পড়ে গেল তখন বুজার্ড তার তলোয়ারটি লোকটির গলায় বসিয়ে শক্তভাবে টান দিল। লোকটি যখন রক্তশূন্য হয়ে মারা যেতে শুরু করল তখন বুজার্ড কোনোভাবে ড্রাইভারের আসনে উঠে বসলো। সে তার তিন আঙুলবিশিষ্ট একমাত্র হাতটি দিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে শক্তভাবে টান দিল। প্রাণী দুটো তার কণ্ঠের তীব্রতা বুঝতে পেরে বাহনটাকে সর্বোচ্চ বেগে রাস্তা বরাবর ছুটিয়ে নিয়ে গেল।

যেখান থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল তার কাছাকাছিই ছিল গ্রে’র অবস্থান। তাই যারা প্রথম এলার্ম শুনতে পেয়েছিল, তাদের মধ্যে সে একজন।

গার্ডদের ক্যাপ্টেন-এর প্রধান দায়িত্ব প্রিন্স-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তার মালিককে বাহন-এ উঠিয়ে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা নিশ্চিত করার পর এদিকে কী ঘটেছে সেটা দেখার জন্য সে আবারও নিলাম-এর বাজারে ফিরে আসলো। কয়েক মিনিট পরে গ্রে তাকে খুঁজে পায়। প্রিন্স নিরাপদে পৌঁছেছে কি-না এটা জিজ্ঞেস করার পর সে তার আসল দুশ্চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাইলো। “তোমরা কী কার্টনিকে খুঁজে পেয়েছ?”

ক্যাপ্টেন না-সূচক মাথা নাড়াল, “না,” “আপনি যেখানে বলেছেন আমার লোকেরা সে জায়গার দিকেই যাচ্ছিল। ঠিক তখনই আগুন ধরে গেল। এরপর তারা সেখানে পৌঁছে আর কার্টনিকে খুঁজে পায়নি।”

“তাহলে, সে নিশ্চয়ই লোকজনের সাথে এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছে।”

গার্ড ক্যাপ্টেন মাথা নাড়ায়। “না, আমার লোকেরা সেদিকে নজর রেখেছে। লোকজন যখন বেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছেছে আমার লোকেরা সেখানেও এল তাজারকে খুঁজে পায়নি।”

“তাহলে আমি তাকে খুঁজে বের করব।” কনসাল গ্রে বলল। সেই সাথে সে মনে মনে আরো বলল, “আমার নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”

বাহনটা ঠকঠক করে যেতে যেতে একসময় থেমে গেল। বুজার্ড চালকের আসন থেকে নেমে এসে পেছনের দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠল, “বেরিয়ে আসুন।”

জুডিথ ভ্রুকুঁচকে তাকাল। বুজার্ড সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় যদিও বাইরের অংশটা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না। তবুও তার মনে হলো যে এটা প্রিন্স-এর প্রাসাদ নয়।”

“আমি কোথায়?” সে জিজ্ঞেস করল। বুজার্ড উত্তর দিল না। তার পরিবর্তে শুধু বলল, “একে ধর।”

সে সামনে থেকে সরে গেলে সেখানে দুজন লোক এসে হাজির হলো। একজন আফ্রিকান এবং একজন সাদা চামড়ার লোক পূর্বেই সেখানে দাঁড়িয়ে। ছিল। তারা জুডিথ-এর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। জুডিথ ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে অন্যপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করল।

কিন্তু ঐপাশেও সে অন্য একজন লোকের বাহুতে গিয়ে পড়ল। লোকটি তাকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে। এরপর এমনভাবে জুডিথকে কাঁধের ওপর তুলে ফেলল যেন জুডিথ স্রেফ ছোট্ট শিশু। এরপর সে জুডিথকে নিয়ে দ্রুত দৌড়াতে থাকে। ছোট পাথর বসানো পথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে সে পানির ধারে পৌঁছে যায়। এরপর পানির ওপর বসানো কতগুলো পাতলা নৌকোর ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে থাকে লোকটা। যখন তারা লংবোট-এ গিয়ে পৌঁছে তখন দ্রুত লংবোট ছাড়ার আদেশ দেয় সে।

গ্রে তার নিজের বাড়িতে পৌঁছে তার চাকরদেরকে ডাক দেয়। তাদের হাতে কিছু নামের তালিকা ধরিয়ে দেয়। সেখানে সম্মানিত কার্পেট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অনেক ক্রিমিনালও রয়েছে। তাদেরকে বলে দেয় কোথায় এসব লোকদের পাওয়া যাবে। এরপর ওদেরকে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে বলে। সে নিজেও বেরিয়ে পড়ে।

সে যেসব ধনী ব্যবসায়ী এবং ওমানী অভিজাত লোকদের সাথে কথা বলল তারা ক্যাপ্টেন কার্টনির ব্যাপারে খুব বেশি কিছু তথ্য দিতে পারল না। কিন্তু তার চাকরেরা ফিরে আসার পর তাদের মাঝে দু-একজন তাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সে কিছু নতুন নাম খুঁজে পেল এবং সেসব লোকদের ঠিকানায় খোঁজ নেয়া শুরু করে দিল। এরপর কনসাল গ্রে আবিষ্কার করল যে ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে কী ঘটেছে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে। আপনমনে কিছুক্ষণ চিন্তা করল সে। তার প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে এখন কারো সাহায্যের প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে কেবল একজনই তাকে সাহায্য করতে পারে। একথা মনে আসা মাত্রই সে প্রিন্স জাহানের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।

*

ধীরে-ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করল হাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না সে। কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু না, পারছে না। এরপর সে বুঝতে পারল যে তার মাথায় পট্টি বাঁধা এবং মুখটা কাপড় দিয়ে আটকানো আছে। সে তার পেছন দিকটা দেয়ালে ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে। তার হাত বাঁধা, গোড়ালিতে শেকল পরানো। এককথায় তাকে অসহায় জীবই বলা যায়।

যদিও সে শুনতে পাচ্ছে এবং গন্ধ শুঁকতে পারছে। এই দুটি ইন্দ্রিয়ই তাকে আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে বলে দিচ্ছে। কুকুরের ময়লা, আবর্জনা যুক্ত স্থানে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এবং একটু দূর থেকে সে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

হাল-এর ভয় হচ্ছে কুকুরটি যদি এসে তাকে আক্রমণ চালায় তবে তার কিছুই করার থাকবে না। কুকুরের চিৎকার-এর সাথে সাথে আরেকজন লোকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সে কুকুরটাকে থামানোর চেষ্টা করছে। লোকটার হাতে ধরা চাবুক দিয়ে সে বাতাসে আঘাত করছে-সেই শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবকিছু নীরব হয়ে যায়, হাল-এর চিন্তা-ভাবনা তখন আশে পাশের জগৎ থেকে সেই লোকটির কাছে চলে যায় যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। রিভারস নিশ্চয়ই তার সাথে প্রতারণা করেছে। কিন্তু সেটার ব্যাখ্যা কী হতে পারে। এরপর তার স্মৃতি সেই পুরনো মুহূর্তটায় ফিরে যায়। সে পাশে তাকিয়ে দেখে যে ট্রোম্প তার পাশে নেই।

“আমি কি চরম বোকা। কেন আমি ব্যাপারটা বুঝলাম না? ট্রাম্প আমাকে রিভারস-এর কাছে নিয়ে গিয়েছে। তাদের দুজনের নিশ্চয়ই একত্রে কোনো পরিকল্পনা ছিল আমার বিরুদ্ধে, হাল মনে মনে ভাবতে লাগল।

ওদের দুজনের প্রতারণার কথা মনে করে হাল-এর পেটের ভেতর সবকিছু যেন মোচড় দিয়ে উঠছে। হাল যেখানে বসে আছে তার কিছু দূর থেকে সে লোকজনের অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। লোকটির কথার সাথে সাথে চিৎকার এবং হৈ হুল্লোর-এর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য হাল-এর মনে হলো যে সে সম্ভবত এখনো নিলাম-এর বাজারে রয়েছে।

তাকে ব্লক-এর পেছনে আনা হয়েছে। কিন্তু কথাগুলো নিলাম-এর লোকগুলোর মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা আবদ্ধ জায়গায় কয়েকজন লোক কথা বলছে। এরপর গোলমাল আবার হঠাৎ করে বাড়তে থাকে। হাল-একটা দরজা খোলার শব্দ শুনতে পায়। কুকুরটি আবারও ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে। এবার পূর্বের চেয়ে বেশি উচ্চস্বরে। সেই সাথে কুকরটির মালিকের ক্রমাগত চিৎকার এবং চাবুকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কিছু চাবির ঝনঝন আওয়াজ শুনতে পায় হাল। এরপর চাবির আওয়াজ আর কুকুর-এর ঘেউ ঘেউ শব্দ তার কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে। কিন্তু তবুও সে কুকুরের শব্দ এবং চিৎকার আর হৈ হুল্লোর শুনতে পাচ্ছে।

ডগফাইট। হাল চিন্তা করল, কিন্তু আমি এখানে কী করছি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই কেউ একজন হাল-এর বাহু খামচে ধরে তাকে দাঁড় করানোনার চেষ্টা করল। ওদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল হাল। ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে পিছিয়ে গেল। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। লোকগুলো তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে হালকে ধরে রেখেছে।

এরপর হাল আর লড়াই করার চেষ্টা করল না। এখন আর কিছুই করার নেই। ভাল কোনো সুযোগের জন্য নিজের শক্তিটুকু জমিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আরেকবারের জন্য ভয় তাকে ঘিরে ধরে। এই ভয় তার বর্তমান অবস্থার চেয়ে বরং ভবিষ্যতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে সেই কারণে। কিন্তু এই লোকগুলোকে কিছুতেই দুর্বলতা বুঝতে দেয়া যাবে না। তার নিঃশ্বাসের গতি আস্তে আস্তে কমানোর চেষ্টা করল সে। একই সাথে তার মনোযোগ এই পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে অন্যকোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। সে সাগরের কথা চিন্তা করল, তার জাহাজের কথা মনে করল, তার বাবার সেই অমানবিক কষ্ট এবং দুঃসহ জীবনের কথা ভাবল যে জীবন মৃত্যুর পূর্বে তার বাবাকে কাটাতে হয়েছে। তবুও তার পিতা তার সম্মান এবং মর্যাদাকে বিসর্জন দেন নি। হাল বুঝতে পারছে এখন তাকে সেই পথই অনুসরণ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার হৃদস্পন্দন বুঝতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দেবে না।

সে বুঝতে পারছে কেউ একজন এসে তার হাতের বাঁধন কেটে দিচ্ছে। হাতের বাঁধন কাটা শেষ হলে একজন তার বাম হাত সামনে টেনে নিয়ে একটা লোহার রিং পরিয়ে দিল। রিং-এর সাথে লাগানো শেকলের কারণে হাতটাকে তার বেশ ভারী মনে হচ্ছে।

আবারো তার মনে ভয় ফিরে আসতে শুরু করলে সে উচ্চস্বরে বলে উঠল, “আমার নাম কার্টনি” যতটা না লোকগুলোকে শোনানোর জন্য, তারচেয়ে বরং নিজের উদ্দেশ্যেই কথাটা বলল সে। লোকগুলো তার কথার উত্তরে কিছুই বলল না। লোকগুলো হয়ত বুঝতেই পারেনি হাল কী বলেছে।

বাইরের দিক থেকে আসা লোকগুলোর গোলমাল এবং হৈ চৈ বাড়তেই থাকে। শেষবারের মতো চিৎকার এবং বশির আওয়াজ শোনা যায়। হাল বুঝতে পারে ডগফাইট শেষ হয়েছে।

হাল অনুভব করে তার গলার শেকল ধরে কেউ টানছে এবং তার মাথাটাকে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে। তার উচ্চতার প্রায় অর্ধেকটা বাকা হতে হয় তাকে। তখন সে বুঝতে পারে যে এই দরজাগুলো নিশ্চয়ই কুকুরগুলোর প্রবেশের জন্য রাখা হয়েছে।

বাইরে বেরিয়ে আসার পর তার পৃথিবী হঠাৎ করেই হৈ চৈ এবং লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরে উঠল।

বাতাসে তাজা রক্তের গন্ধ পেয়ে তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। মানুষের আনন্দের জন্য এখানে হত্যাকাণ্ড ঘটছে এটা সে মনে স্থান দিতে চাচ্ছে না। ঠিক তখনই সে কাছাকাছি আরেকটা শব্দ শুনতে পায়। অন্য একজন মানুষ গার্ডদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য তর্জন গর্জন করছে।

“ভদ্রমহোদয়গণ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম,” অ্যারাবিক ভাষায় একজন চিকন লোক উচ্চস্বরে আনুষ্ঠানিক উপস্থাপনা শুরু করল। তার কথা শুরু হতেই ভিড়ের মাঝে সবাই চিৎকার শুরু করে দিল। “নতুন কিছু দেখার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করুন। এরকম রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা এর পূর্বে কখনও আপনারা উপভোগ করেননি। এখানে কোনো দৌড়াদৌড়ি হবে না। লুকোচুরি হবে না। শুধু রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।”

হাল শুনতে পায় একটি কষ্ঠ তার পাশ থেকে বলছে, “এই নাও, এটা ধর” এবং একটি তলোয়ার-এর বাট তার ডান হাতের তালুতে চাপ দিতে থাকে। সে যখন তলোয়ার-এর বাটটা ধরে তখন অ্যাবোলির কথাগুলো তার মাথায় বাজতে থাকে। তলোয়ার শিক্ষা দেয়ার সময় অ্যাবোলি এই কথাগুলো তাকে বলেছিল।

“তলোয়ারটাকে হাত দিয়ে গাছের ডাল ধরার মতো শক্ত করে ধরবে না গাল্ডওয়েন। তাহলে তলোয়ারটা তোমার কাছে ভারী এবং মৃত অস্ত্র বলে মনে হবে। আঙুল দিয়ে তলোয়ারটাকে খুব আলতো করে ধরবে। তাহলে আঙুল দিয়ে তলোয়ারটাকে তরল পদার্থের ন্যায় নাড়াচাড়া করতে পারবে।”

সে তলোয়ারটা তুলে ধরে হাতের মধ্যে এর অবস্থান নিশ্চিত করল। তলোয়ারটা একবার উঠিয়ে একবার নামিয়ে, নাড়াচাড়া করে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবে সেটা ঠিক করে নিল সে।

“গুড, গান্ডওয়েন,” হাল অ্যাবোলির কণ্ঠ শুনতে পায়, “এখন তুমি খুব সহজেই তোমার আক্রমণের দিক পরিবর্তন করতে পারবে। এভাবে ধরে রাখলে তলোয়ারটা তোমার হাতে জীবন্ত থাকবে।”

সে তলোয়ারটা মুখের সমান উচ্চতায় তুলে আনল। চোখবাধা অবস্থাতেই কিছুক্ষণ তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। তলোয়ারটা গালের সাথে লাগিয়ে এর ধার এবং গঠন বোঝার চেষ্টা করল। এরপর বাতাসে কয়েকবার তলোয়ার চালিয়ে অনুশীলন করার চেষ্টা চালালো। সেই সাথে এটাও ভাবতে লাগল যে তার সামনের প্রতিদ্বন্দ্বীও নিশ্চয়ই একই কাজ করছে।

“আজকে দাসের বাজারে আপনারা নিশ্চয়ই অনেকে নাস্তিক বেশ্যা নাজেকে দেখেছেন,” সমবেত জনতা চিৎকার করে উঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আগুন লেগে যাওয়ার কারণে তার বিক্রি শেষ হয়নি। কিন্তু নাজেত হুত করেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বাতাসে হারিয়ে গিয়েছে।”

“না”, কাপড় মুখে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠল হাল। “সে হারিয়ে যেতে পারে না। তাকে পুনরায় কেউ আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারবে না। আমরা যখন মিলিত হব তখন একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। তাকে আর দৃষ্টির আড়াল হতে দেব না।”

“কিন্তু আমরা আপনাদের জন্য এরচেয়ে ভাল কিছুর আয়োজন করেছি : এল তাজার-এর হত্যাকাণ্ড। আপনারা জানেন বা দেখেছেন যে সে একজন ভাল যোদ্ধা। এখানেও তার জন্য যুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছে। একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সে যুদ্ধ করে যাবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। জনতার চিৎকার থেমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘোষণাকারী অপেক্ষা করল। এরপর আবার বলতে শুরু করে দিল। তোমরা কেউ যদি চোখের বাধন এবং মুখের গ্যাগ খোলার চেষ্টা কর তবে তোমরা যেখানেই দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই তোমাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হবে এবং কুকুরকে খেতে দেয়া হবে।”

এরপর অনুষ্ঠানের প্রধান আহ্বায়ক তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “প্রস্তুত হও।”

হাল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। পা দুটোর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে এক পা সামনে এগিয়ে নিল সে। এরপর হাঁটু দুটোকে সমকোণে বাঁকিয়ে দাঁড়াল যেন অভিকর্ষজ তুরণের কেন্দ্রবিন্দু পায়ের গোড়ালি বরাবর থাকে।

হাল চিৎকার সমবেত জনতার চিৎকার শুনতে পায়, “ফাইট,” “ফাইট”, “ফাইট।”

হাল জানে তার প্রতিপক্ষ এগিয়ে আসছে তার দিকে। তাই সে ডানদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মুখটাকে আঘাতের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তলোয়ারটাকে মুখ বরাবর তুলে ধরে। প্রতিপক্ষের তলোয়ারটা ঝনঝন শব্দে হাল-এর তলোয়ার এ আঘাত করল। এরপর লোকটি আবারও দূরে সরে যায় এবং হাল-এর শেকলে টান পড়ে।

হাল চারদিকে এত আওয়াজ-এর মাঝেও কান পেতে রাখে যদি এমন কিছু শুনতে পারে যেটা তাকে সাহায্য করবে। প্রতিপক্ষের পদধ্বনি এবং নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু শুনতে পায় না সে। তবে এ থেকেই সে প্রতিপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে কিছু ধারণা পায়। সে সামনের দিকে এগোতে থাকে যেন তার শেকলটা কিছুটা শিথিল হয়। এরপর কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সে পিছিয়ে পড়ে এবং শরীরটাকে বাঁকাতে থাকে। এতে করে শেকলে পুনরায় টান পড়ে; প্রতিপক্ষের শরীর এটাকে বাধা দিচ্ছে। এরপর সে তার তলোয়ারটাকে বাতাসের মধ্যে ডানে বায়ে উপরে নিচে সবদিকে চালনা করতে থাকে।

কিন্তু সে কোনো কিছুকেই আঘাত করতে সমর্থ হয় না। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারে না যে প্রতিপক্ষ কী তার কাছাকাছি এসেছে? প্রতিপক্ষের তলোয়ার কী তাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছে?

“কোথায়, তুমি বন্ধু? এদিকে আস, আমরা খেলা শেষ করি।” হাল তার ডানপাশে একটা কিছুর নড়াচড়া বুঝতে পারে। তলোয়ারটা ভূমির সমান্তরালে ডান থেকে বামে ঘোরাল; প্রতিপক্ষের মাথা কেটে ফেলার চেষ্টা করছে সে। তখনই সে দুই তলোয়ার-এর ঘর্ষণ-এর আওয়াজ শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে তার প্রতিপক্ষও তার কাছাকাছি অবস্থানে থেকে আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে।

এরপর হাল নিজের তলোয়ারটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের গতিরোধ করে দ্রুত তার মাথায় আঘাত করল। এবার সে ঘোঙানির মতো আওয়াজ শুনতে পায়, সেই সাথে তার তলোয়ারটা নরম কিছু একটাকে আঘাত করেছে। প্রতিপক্ষ তার তলোয়ার দিয়ে হাল-এর তলোয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।

তার প্রতিপক্ষ আঘাত পেয়েছে। এই সুযোগ তাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিপক্ষ এই আঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই তাকে আঘাত করতে হবে। সে শেকলের লাইন বরাবর এগিয়ে যায় এবং তলোয়ারটা ডানে বায়ে দ্রুত ঘোরাতে থাকে।

ক্লান্তিতে তার বুক ধরফর করতে থাকে, পেশিগুলো অবশ হয়ে আসছে। তার ওপর মুখে গ্যাগ লাগানো থাকায় সে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। শুধু নাক দিয়ে বাতাস নিতে পারছে যেটা তার শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারছে না। একদিকে তার শরীর অক্সিজেন নেয়ার জন্য যুদ্ধ করছে আর অন্যদিকে তার মন দৃষ্টিহীনতার জন্য ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। তার মন তাকে চিৎকার করে বলছে তলোয়ার দিয়ে মাংস কেটে নিজেকে ছোট করে ফেলতে যেন সে সহজেই কোথাও লুকিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এখানে লুকানোর কোনো জায়গা নেই, নেই কোনো রাস্তা।

অ্যাবোলি তাকে শিখিয়েছে তলোয়ার হচ্ছে হাতের বাড়তি একটা অংশ। তাই তলোয়ার হচ্ছে জীবন্ত একটা কিছু যেটা রক্তের জন্য হাহাকার করে। কিন্তু এইবার তার তলোয়ার মাংস নয় শক্ত কোনো স্টীল বা লোহাকে আক্রমণ করল যার কম্পন তার বাহুতে কাঁপিয়ে পুরো পেশিতে ছড়িয়ে পড়ল। এবার অন্যলোকটি শেকলটা উপরের দিকে টানতে থাকে। এতে করে হাল সামনের দিকে ধাক্কা খায়। লোকটি হাল-এর ডান বাহুর পাশ দিয় এসে শেলকটা হাল এর গলায় প্যাচিয়ে ফেলল।

মাটিতে পড়ে গেল হাল। সে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। সে বুঝতে পারে যে লোকটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে, তার অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। লোকটির কনুই হাল-এর পেছনে ধাক্কা দিচ্ছে। লোকটি নিজের পা দিয়ে হালকে প্যাচিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তার প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী। হাল লাথি দেয়ার চেষ্টা করল, এরপর গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করল। হাল-এর মুখ ফুলে গেল। এখন সে মাথায় অনেক চাপ অনুভব করছে যেন যে-কোনো মুহূর্তে মাথাটা ফেটে যাবে। চোখগুলো বের হয়ে আসবে।

চারপাশে কোনো কোলাহল বা হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে না। চারদিকে নীরবতা বিরাজ করছে। নিজের হার্টের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছে হাল যেটা আস্তে আস্তে ধীরগতি সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।

“আমি মারা যাচ্ছি।”

“না, হেনরি। তুমি এখানে মারা যাবে না।” আমি নিষেধ করছি।

“বাবা?”

“উঠ, উঠ হেনরি। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াও। এই লোকটিকে হত্যা কর। তোমাকে পারতেই হবে।”

এখনো কী সে তলোয়ার হাতে ধরে আছে? হ্যাঁ। কিন্তু তার শক্তি আস্তে আস্তে কমে আসছে। তাকে এখনি শক্তভাবে আঘাত করতে হবে। সে তার তলোয়ার ধরা হাতের মুষ্টি আস্তে-আস্তে আলগা করল। আঙুল দিয়ে তলোয়ার এর হিল্ট শক্তভাবে অনেকটা হাতুরির মতো করে ধরল। এরপর মুখে গ্যাগ লাগানো অবস্থাতেই সে চিৎকার করে তরবারির পমেল দিয়ে লোকটির মাথায় আঘাত করল।

যেভাবেই হোক লোকটি এখনো হাল-এর গলায় শেকল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শেকলের টান আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে। হাল-একটার পর একটা আঙুল শেকলের নিচ দিয়ে গলার চামড়ার ওপর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটুকুই নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য যথেষ্ট। তার শরীরে নতুনভাবে রক্তচলাচল শুরু হয়েছে। ভাল হাত দিয়ে আবারো সে তলোয়ারটা উপরে উঠিয়ে আনে এবং লোহার হিল্ট দিয়ে লোকটির মাথায় দ্বিতীয়বার আঘাত করে। বাম হাতের পুরোটাই সে শেকলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে এবার একটানে শেকলটা গলা থেকে উপরে ফেলে দিয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। যদিও এখনো তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

হাল মাটিতে পড়া শেকলের লাইন অনুসরণ করতে থাকে। গ্যালারিতে সমবেত জনতার চিৎকার বাড়ছে। যতই সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই চিল্কারের তীক্ষ্ণতা বাড়ছে। আর তখনই, শেকলের ঝনঝন আওয়াজ পাওয়া গেল। হাল বুঝতে পারে লোকটি কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাই সে তার তলোয়ারটা সামনের দিকে চালনা করল। প্রতিপক্ষের তলোয়ার-এ আঘাত করল ওটা। এরপর কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। রক্তের ছিটেফোঁটা এসে ওর শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাল বুঝতে পারল যে তার প্রতিপক্ষের শক্তি শেষ হয়ে আসছে।

পরবর্তী আক্রমণটা প্রতিপক্ষের মাংস ভেদ করে হাড়-এ গিয়ে লাগল। হাল শক্তভাবে তলোয়ারটা পুনরায় পেছন দিকে টান দিয়ে সরিয়ে ফেলল। আশেপাশের চিৎকার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। হাল বুঝতে পারে খেলা শেষ হয়েছে। জিতে গিয়েছে সে। তাই সে রক্তমাখা তলোয়ারটা বাম বাহুর নিচে রেখে ডানহাত দিয়ে চোখের বাঁধন মাথার ওপর উঠিয়ে ফেলল।

এরপর সে তলোয়ারটা ফেলে দিয়ে দুহাত দিয়ে মুখের গ্যাগ খামচে ধরে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। কারণ তার পেটের সবকিছু উল্টে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে।

গ্যাগ সরে যাওয়ার পর তার চোখের সামনে সে যা দেখল সেটার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

তার সামনে পড়ে থাকা আহত ব্যক্তিটা হচ্ছে ক্যাপ্টেন ট্রোম্প।

ওলন্দাজ লোকটা হাঁটুগেড়ে বসে আছে। তার কপাল থেকে রক্ত ঝড়ছে। হাল তরবারির পমেল দিয়ে যে আঘাত করেছিল সেখানে থেকে রক্ত পড়ছে। তার কাঁধে আঘাত লেগেছে। নাকের হাড় ভেঙে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ক্ষতটা তার শরীরে হয়েছে সেটা তার বুকের ওপর। বুকের খাঁচার কয়েকটা হাড় বের হয়ে আছে।

হাল-এর মনে মিশ্র ধরনের অনুভূতি কাজ করতে থাকে। ভয় এবং অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করল। সে তার বন্ধুসম মানুষটাকে শেষ করে দিয়েছে। তার মধ্যে লজ্জাবোধও কাজ করছে এই কারণে যে এই লোকটাকে সে প্রতারক ভেবেছিল। অথচ ট্রোম্প তার বিশ্বস্ততার পুরস্কার এইভাবে পেল। হাল-এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে ট্রোম্প-এর সামনে বসে পড়ল। ট্রোম্প প্রাণপণে চেষ্টা করছে চোখের বাধন খুলে ফেলতে। হাতের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কারণেই হোক কিংবা কৌশল না জানার কারণেই হোক সে সেটা খুলতে পারছে না। হাল বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। ট্রাম্পের চোখের বাঁধন খুলে দিতে যে খুব লজ্জা বোধ করছে সে। ট্রোম্প যদি এভাবে মৃত্যুবরণ করে তাহলে অন্তত সে কোনোদিন জানতে পারবে না কে আসলে তার হত্যাকারী।

“তাকে এভাবেই মরতে দাও,” হাল আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে চিৎকার করে উঠল। আকাশটাও মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।

সে যুদ্ধক্ষেত্রের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকল যেন সে তার মনে জমা অজস্র প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতে পারে আশেপাশে। কিন্তু অপরিচিত কতকগুলো শক্রর চেহারা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত চারজন মানুষকে সে দেখতে পায় যারা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছে। এরপর হাল একটা শিশুর অপূর্ণ চোখ দেখতে পায়। চোখদুটি তার কাছে পরিচিত মনে হয়। কিন্তু এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে তার মস্তিষ্ক কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছে না যে কোথায় দেখেছে সে শিশুটিকে। তার বদলে এখন তার কি করা উচিত সেই দিকে মনোনিবেশ করল সে। হাল কাঁপা কাঁপা হাতে ট্রোম্প-এর কাছে পৌঁছায়, এরপর তার চোখের বাধন খুলে দেয়।

“আমি দুঃখিত,” হাল বিড়বিড় করে বলল। আমি খুবই দুঃখিত…ঈশ্বরের দোহাই আমাকে ক্ষমা কর…বন্ধু।

ট্রোম্প তীক্ষ্ণভাবে হাল-এর দিকে তাকানোর চেষ্টা করল কিন্তু তার চোখের পাতার শক্তি আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। সে সামনের দিকে পড়ে যেতে শুরু করে, কিন্তু তার আগেই হাল তাকে ধরে ফেলল। হাল ট্রোম্প-এর মাথার পেছনের বাঁধন খুলে ওর মুখ থেকে গ্যাগটা সরিয়ে ফেলল। কোনো কথা না বলে ট্রোম্পকে সে মরতে দিতে চায় না। কিন্তু ট্রোম্প-এর মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না।

হাল তার বন্ধুকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে যখন অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা সোজা করল, তখন সে দেখতে পেল অস্ত্র হাতে চারজন লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

“তাকে কেনেল-এর ভেতরে নিয়ে যাও। অনুষ্ঠানের প্রধান আহবায়ক ঘোষণা করল। দুজন লোক তাকে টানতে টানতে সোজা করে দাঁড় করাল। হাল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে তীব্র কণ্ঠে গর্জন করে বলে উঠল, “আমি এখনো বেঁচে আছি। তোমরা আর কী করতে চাও? ইউ বাস্টার্ডস?”

প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভিড়ের মধ্যে থাকা জনতা চিৎকার করে উঠল, নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে শুরু করল, সেই সাথে আধখাওয়া মাংসের টুকরা তারদিকে ছুঁড়ে দিতে লাগল প্রবল আক্রোশে।

ঠিক তখনই তীব্র এবং তীক্ষ্ণ এক চিৎকার শোনা গেল। জনতা এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে দিল। এমনকি যে গার্ডরা হালকে নিয়ে যেতে এসেছিল, তারাও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। তখনই সে বুঝতে পারে কেন সবাই এমন করছে। অন্তত ত্রিশ জনের মতো একটা সৈন্যবাহিনী মাঠে প্রবেশ করেছে। ভিড়ের মধ্যদিয়ে চাবুক চালিয়ে তারা তাদের জায়গা করে নিচ্ছে। হালকে ধরে রাখা গার্ডরাও এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে দিয়েছে। হালও দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিল। কিন্তু তার পূর্বেই সৈন্য দল তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলল। কমান্ডর-এর পোশাক পরিহিত লোকটি সামনে এগিয়ে এসে মাথার হেলমেট খুলে বলল, “ক্যাপ্টেন কার্টনি। দয়াকরে আমাদের সঙ্গে চলুন। মাননীয় মহারাজা সাদিক খান জাহান আপনার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।”

*

প্রিন্স জাহান আসার পূর্বের কয়েক ঘণ্টা হালকে একটা সেল-এ বন্দি করে রাখা হলো। কঠিন এবং নিষ্ঠুর প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার জন্য হাল নিজেকে প্রস্তুত করছিল কিন্তু জাহানের প্রথম প্রশ্ন শুনে তাকে বেশ অবাক হতে হলো।

“তোমার স্বদেশী, প্রিন্স শুরু করল, “বুজার্ড নামে সেই লোকটার কথা বলছি। সে কি আগে থেকেই এরকম শুকরের মতো নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে? এমনকি সে যখন মানুষ ছিল তখনও?”

হাল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। “সে জন্যই নিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা এবং চৌর্যবৃত্তির প্রবণতা নিয়ে। এটা তার রক্তে মিশে আছে।”

“হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। সে জুডিথ নাজেতকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। এতে আমি খুবই রাগান্বিত হয়েছি কারণ সে আমার সম্পত্তি ছিল…”

“সে কারও সম্পত্তি ছিল না। সে একজন স্বাধীন মানুষ।”

“কিন্তু স্যার হেনরী, সে আর স্বাধীন নয়। জাহান বলতে থাকে, সে এখন বুজার্ডের জাহাজের একজন বন্দি, যে জাহাজ দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেছে। এটা। আমার ভুল। আমার তাকে আরও ভালভাবে জানা উচিত ছিল, যে লোক এধরনের কাজ করতে পারে তার কোনো লজ্জা-শরম থাকে না। সে যদি একজন মুসলমান হত তাহলে তার এটা জানার কথা যে সে নবি ও পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার সাথে প্রতারণা করেছে। সে যদি হাজার বারও মৃত্যবরণ করত তবুও তার পাপের শাস্তির। সমান হত না। কিন্তু তুমি আলাদা। তুমি তোমার ঈশ্বরের জন্য যুদ্ধ করেছ।”

“আমার ঈশ্বরের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এবং সেই রমণীর জন্য যাকে আমি ভালবাসি।”

জাহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়াতে থাকে। “আহ, আমি সেজন্য তোমাকে দোষারোপ করছি না। রমণীদের মধ্যে সে হচ্ছে রাণী। সে যখন আমার হারেমে ছিল আমার সেরা উপপত্নীটাও তাকে হিংসা করত। তার সৌন্দর্যকে হিংসা করত। ভয় পেয়ো না, আমি তাকে কলুষিত করি নি। যদিও আমি অন্য যে কোনো জীবিত পুরুষের মতোই প্রলুব্ধ হয়েছিলাম।”

“তাহলে কেন করেন নি? আপনি চাইলেই তাকে কলুষিত করতে পারতেন। কী আপনাকে বাধা দিয়েছে?”

“এটা একটা ভাল প্রশ্ন করেছ,” জাহান বলল। “তুমি ঠিক বলেছ। এই দেয়ালের ভেতরে এমনকি বাইরে আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করতে পারি। কিন্তু আমি ঠিক কি চিন্তা করছিলাম…?” প্রিন্স কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল, এরপর আবার বলতে শুরু করল। আমি তার সাথে কথা বলেছি। আমি তাকে বলেছি যে তোমাকে ধরার পূর্ব পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। আমি বলেছি সে যদি বাধা দেয় তাহলে আমি জোর করবো। তখন তুমি এবং সে দুজনেই মারা যাবে। কিন্তু সে নিজের জন্য মোটেও চিন্তিত ছিল না।”

“অনেক পুরুষের চেয়েও সে বেশি সাহসী। কিন্তু সে চায় না যে তুমি তার জন্য কষ্টভোগ কর।”

ঘৃণায় হাল-এর কণ্ঠ ভারী হতে শুরু করে। আপনি কী নারীদের এভাবেই প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করেন? তারা যদি অস্বীকার করে তবে তাদেরকে এভাবেই হুমকি দেন?”

জাহানের অমায়িক প্রতিক্রিয়া বরফের মতো ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। “তুমি হয়ত খুব সাহসী নয়ত খুব বোকা যে কারণে তুমি এ ধরনের কথা বলতে পারছ। তুমি জানো, এ কথার কারণে আমি তোমাকে হত্যা করতে পারি?”

“কোনো কারণ ছাড়াই আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি কী এটাই চান?”

“হ্যাঁ,” প্রিন্স একমত হয়। “কিন্তু তুমি যাই চিন্তা কর না কেন আমি জীবন মৃত্যুর ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হতে চাই না। এমনকি আমি আমার ইচ্ছে পূরণের জন্য নারীদের বাধ্য করি না বা আঘাতও করি না। যেমন ধর, আমার হারেমের নারীরা আমার সম্পত্তি। আমার খুশির জন্য তাদেরকে রাখা হয়েছে। এটা তাদের দায়িত্ব এবং অবশ্যই তাদের এটা পালন করতে হবে। কিন্তু আমি তাদেরকে কখনও আঘাত করিনি বা হুমকি দেইনি। বরং আমি যখন একজনকে বেছে নেই, তখন অন্যরা হিংসাবোধ করে। তাই জুডিথ নাজেতকে বাধ্য করে আমি কোনো আনন্দ পেতাম না। যদিও আমার বাহিনীকে পরাজিত করায় তার প্রতি রুষ্ট ছিলাম আমি কিন্তু সে কারণে আমি তাকে ঘৃণা করি না। আমি তাকে সম্মান করি। একজন নারী হয়েও সে সত্যিকার যোদ্ধার মতো যুদ্ধ করেছে। আমি যদি তাকে হুমকি দিতাম কিংবা বাধ্য করতাম তবে আমি নিজের অবস্থানটা অনেক নিচুতে নামিয়ে ফেলতাম।”

“সেটা অবশ্য ভাল কথা। কিন্তু তারপরও আপনি তাকে বিক্রির জন্য দাসদের অবস্থানে নামিয়ে এনেছেন।”

“সেটা করা হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। তোমাকে জাঞ্জিবার-এ ফিরিয়ে আনার জন্য বাধ্য করতে। আমি তোমাকে এখানে আমার সামনে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি সেই বারাকুডাকে দেখতে চেয়েছিলাম যে কি-না আমার জাহাজগুলোকে সারডাইনস মাছের মতো নিঃশেষ করে দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার নিজ হাতে তৈরি একহাত ওয়ালা দানবটার যুদ্ধ করাতে। লড়াইটা আমাকে অনেক বিনোদন দিত।” প্রিন্স নিজের চেহারায় একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল যেন সে হাল-এর সমবেদনা পাওয়ার চেষ্টা করছে। “তুমি জান, এই বয়সে আমার জন্য বিনোদন-এর নতুন কোনো উপাদান খুঁজে বের করাটা কতটা কঠিন?”

“কিন্তু আপনার দানব আপনার সাথে প্রতারণা করেছে।”

“হ্যাঁ, সে করেছে। এখন তোমাকে যা করতে হবে তা হলো তাকে হত্যা করতে হবে।”

“প্রথমে আমার তাকে খুঁজে বের করতে হবে।”

“সেটাতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।” জাহান বলে উঠে, “বেনবুরি নামে আরেক ইংরেজ-এর সাথে তার যোগাযোগ আছে।”

“আমি তাকে চিনি। পেলিকান নামে একটা জাহাজের মালিক সে। হাল জাহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু সে ইংরেজ নয়। সে স্কটিশ।”

“সেটা কী একই হল না?”

“না, একই ব্যাপার নয়।”

“হাহ, প্রিন্স খুব অবাক হলো। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে এইমাত্র নতুন কিছু শিখেছে। যাই হোক, আমরা বেনবুরির একজন নাবিককে ধরতে পেরেছি। তার মাস্টার-এর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা তাকে বলতে বাধ্য করেছি। একটা পানশালায় আক্রমণ করে আমরা তাকে ধরেছি। আর তোমাকেও সেখানেই পেয়েছিলাম।”

“আমি রাতের বেলায় চিৎকার শুনেছিলাম,” হাল বলল।

“ভদ্র ভাষায় বোঝাতে গেলেও লোকে ওমনই করে। সে যাই হোক, আমরা লোকটার কাছ থেকে জানতে পেরেছি ক্যাপ্টেন বেনবুরি এবং বুজার্ড তোমার স্ত্রীকে লোবো নামে এক পর্তুগীজ-এর কাছে বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে। আমি লোকটিকে চিনি। তার একটি সোনার খনি আছে। আমি তোমাকে সেখানে পৌঁছে দিতে পারি।”

“কীভাবে?”

“তোমাকে এখান থেকে এমন এক অভিযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হবে সেটাতে তুমি কোনো আনন্দ পাবে না। কিন্তু লোবোর কাছে যাওয়ার এটাই একমাত্র সম্ভাব্য পথ। তুমি যদি তাকে আক্রমণ করতে চাও তবে ব্যর্থ হবে। তার খনিতে পৌঁছার একটাই রাস্তা খোলা আছে। যদি তুমি যেতে চাও তবেই পাঠানো হবে। তার খনিতে নিয়ে যাওয়া লোকদের সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কাজ করায়। একারণে তার সবসময় নতুন নতুন লোকের প্রয়োজন হয়,..”

হাল এমনভাবে কাধ ঝাঁকায় যেন পরিশ্রম তার কাছে কিছুই না। “আমি জানি কঠোর পরিশ্রম কাকে বলে। প্রমাণস্বরূপ আমি আমার পিঠের চাবুকের দাগগুলো দেখাতে পারি। এরপরও আমি বেঁচে আছি।”

“হতে পারে,” জাহান বলল। “কিন্তু প্রথমে তোমাকে সেখানে যেতে হবে। সেটা কোনো সহজ কাজ নয়। যে লোকেরা তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবে তারা তোমাকে দেখামাত্র আনন্দের সাথে হত্যা করতে রাজি হয়ে যাবে।”

“আমার তো মনে হচ্ছে আমার মৃত্যুটা আপনি বুজার্ড-এর চেয়েও বেশি করে চান”, হাল বলল।

“ফুউউহ, প্রিন্স জাহান এমনভাবে শব্দ করল যেন কেউ তার পছন্দের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করছে। “আমি চাই তোমরা সবাই মৃত্যুবরণ কর। তোমার মতো ইংরেজ কিংবা সেই স্কটম্যান… তোমরা সবাই আমার কাছে সমান। এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে একটা জাহাজে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তোমার জীবন মৃত্যুর দায়দায়িত্ব আমি নিব না। তোমার বিচারের দায় দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা’-র হাতে।”

.

দাস বিক্রয়ের বাজার শেষ হওয়ার পর বিকেল বেলা মসি গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন-এর কেবিনে বসে আছে। গোল্ডেন বাউ জাহাজটি শহর থেকে বেশ দূরে জাঞ্জিবার-এর উপকূলে নোঙর করা আছে। সে মাথাটা নিচু করে কাঁদছে আর সবাইকে কাহিনী শোনাচ্ছে।

“আমার কিছু একটা করা উচিত ছিল। লেডি জুডিথকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন হেনরিকে বন্দি করা হয়েছে এবং মি, ট্রোম্প মারা গিয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত ছিল!”

“নিজেকে দোষ দিও না লিটল স্পেরো।” অ্যাবোলি ছেলেটাকে সান্তনা দিয়ে বলে, “আমি তোমাকে যা বলেছিলাম তুমি ঠিক তাই করেছ। ক্যাপ্টেন দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তুমি তাকে অনুসরণ করতে পেরেছ। তোমার কারণেই আমরা জানতে পেরেছি যে, কার্টনিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোমার কারণেই আমরা ক্যাপ্টেন কার্টনির খোঁজে লোক পাঠাতে পেরেছি। সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এখন আমরা জানি যে ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মার্দি ডি ডিউস জাহাজটি কোয়েলিম্যান-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। আমরা জানি যে তাকে দাস হিসেবে সোনার খনিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তুমি না থাকলে আমরা এসব কিছুই জানতে পারতাম না, বুঝতে পেরেছ মসি?”

বালকটি মাথা নাড়াল যেন সে আবোলির কথা শুনতে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।

“গুড,” অ্যাবোলি বলতে থাকে। মসি এখন শোন, “তোমাকে বলছি যে আমরা কিভাবে ক্যাপ্টেন কার্টনিকে উদ্ধার করব।”

ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে যেন কোনো ছোট্ট শিশু রূপকথার গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।

“প্রথমে, যে জাহাজে আমাদের ক্যাপ্টেনকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমরা সেটা অনুসরণ করব। যদি আমরা সাগরের মাঝে জাহাজটাকে ধরতে পারি তবে আক্রমণ চালাবো এবং ক্যাপ্টেনকে ফিরিয়ে আনব,” অ্যাবোলি বলতে থাকে।

“তোমরা কী সেই খারাপ লোকটাকে হত্যা করবে যে আমার ক্যাপ্টেনকে ধরে নিয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, আমরা তাদের দিকে এই ভাবে তাকাব…” অ্যাবোলি তার চেহারায় এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল যে মসিও ভয় পেয়ে যায়।

“তারপর আমরা তাদের শরীরে এইভাবে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিব,” সে তার হাতটা সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে দেখাল। “এভাবে”, “এভাবে।”

“কিন্তু আমরা যদি সময় মতো তাদের জাহাজটা ধরতে না পারি?”

“তাহলে আমি আমার অ্যামোডোডা ভাইদের নিয়ে উপকূলে যাব। যে খনির দিকে আমাদের ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা আমাদের জন্মভূমি কিং ডম অব দ্য মনোমাটাপা থেকে বেশি দূরে নয়। তাই ওখানকার সবকিছু আমরা ভালভাবে চিনি। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে নিয়ে উপকূলে ফিরে আসব। উপকূলে তুমি, মি. টেইলার, মি. ফিশার, এবং বাউ-এর অন্যান্য নাবিক অপেক্ষা করবে।”

“তাহলে তুমি বলছ যে ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে তুমি নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে”, মসি জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ

“তুমি প্রতিজ্ঞা করছ?”

অ্যাবোলি খুব ভাবগম্ভীর হয়ে মসির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ক্যাপ্টেনকে সেই সময় থেকে চিনি যখন সে ছোট্ট বালক ছিল। সে আমার নিজের ছেলের মতো। আমি তার কোনো ক্ষতি হতে দেবনা। তাই লিটল স্প্যারো, আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবই।”

*

“ম্যাডাম, আপনার এবার খাওয়া উচিত, মেয়েটি খুব অনুনয়ের স্বরে বলতে লাগল। জাঞ্জিবার-এর বাজার থেকে কিনে আনা খাসির পনির, ফলমূল এবং অন্যান্য হরেক রকমের খাবার অনেকক্ষণ যাবত টেবিল-এ রেখে দেয়া হয়েছে। জুডিথ এর কিছুই স্পর্শ করে দেখেনি। যদিও তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে ক্ষুধায় সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু ওই লোকটির দেয়া খাবার খাওয়ার মানে হচ্ছে তার কাছে আত্মসমর্পণ করা। মেয়েটি করুণ চেহারা নিয়ে জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ভেতরে যে বেড়ে উঠছে তার কথা অন্তত চিন্তা করুন। তার জন্য হলেও আপনাকে শক্ত হতে হবে।”

জুডিথ এক টুকরো পনির উঠিয়ে মুখে দেয়। মেয়েটি জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। পরক্ষণেই ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে তাকাল। যে কোনো মুহূর্তে যে কেউ হয়ত চলে আসতে পারে।

সময়টা ছিল গোধূলি বেলা। পেলিকান নোঙর করেছে। তার মানে বুজার্ড যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে।

যখন তারা জুডিথকে জাঞ্জিবার-এ নিয়ে আসে তখনই তাকে জাহাজের একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে আটকে রাখা হয়, যেটাতে প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেজন্য তাকে একটা বালতি ধরিয়ে দেয়া হয়। তাকে পরতে দেয়া হয় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত এক কেবিন বয়-এর জামা কাপড়। বাইরের পৃথিবীর সাথে তার সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তাকে শুধু মাঝে মাঝে বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ করা হত। হাল তাকে শিখিয়েছিল জাহাজের ঘণ্টা হিসেব করে কীভাবে সময় নির্ধারণ করতে হয়। তাই সে জানে দুই দিন দুই রাত যাবত সে এখানে আছে। এবং সকাল দশটা বাজার সাথে-সাথে একজন নাবিক এসে তার সাথে যাওয়ার জন্য জুডিথকে নির্দেশ দিয়ে গেল। তাকে জাহাজের ফোরক্যাসেল-এ নিয়ে যাওয়া হলো। বন্দিখানাটা যদিও অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে তবুও বরং এটাই ভাল। কারণ এখানে অন্তত তার একজন নারীসঙ্গী আছে। তাকে এখানে নিয়ে আসার কিছু সময় পরেই মেয়েটিকে এখানে ঠেলে দেয়া হয়।

“আমি আপনার খাবার প্রস্তুত করে দেব এবং আপনার দেখাশোনা করব,” মেয়েটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, কারণ বুজার্ড তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। “জাহাজের উপরে আপনি যেমনটা আরামে থাকতেন আমি আপনাকে ঠিক ততটা আরামে রাখার চেষ্টা করব।”

“ধন্যবাদ,” জুডিথ মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল। এরপর বুজার্ড-এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”

তার চোখদুটো বন্দিখানার চারদিকে ঘুরতে থাকে। সে এমন থাকে যেটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বুজার্ডের মুখোশের বাইরে থেকেও তার তিরস্কারমূলক হাসি জুডিথ বুঝতে পারছিল। তার ওপর কি ধরনের আক্রমণ আসতে পারে সেটার আভাস সে আগে থেকেই পাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল যে কতটা দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়েছে। সে বুজার্ডকে এ সময় যতটা ভয় পাচ্ছিল এতটা ভয় সে এর আগে কোনো পুরুষকে পায়নি। এই ভয় পাওয়ার কারণে জুডিথ মনে মনে নিজেকে ঘৃণা আর তিরস্কার করছিল। সে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। সে তার গর্ভের সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। তার ভয় হচ্ছে বুজার্ড হয়ত যে-কোনো মুহূর্তে তার হাতের ছুরি তুলে নিয়ে ওর পেট চিরে বাচ্চা বের করে নিয়ে আসবে।

“এই মেয়ে, তোমার মুখ বন্ধ কর,” বুজার্ড রুক্ষ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠে। “তুমি খুশি থাক যে তোমার সাথে একজন দাসী দেয়া হয়েছে। নয়ত তোমাকে এখানে একা একা মরতে হত।” এরপর আর কোনো কথা না বলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল সে।

কিছু সময় পার হওয়ার পর মেয়েটি কথা বলতে শুরু করল। “ওরা বলেছে যে আপনার গর্ভে সন্তান আছে। বেশিদিন হয়নি যে আমার নিজেরও একটি সন্তান ছিল।” মেয়েটি কথা শেষ করার পূর্বেই তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

জুডিথ মেয়েটিকে ডেকে তার সাথে খেতে বলল। প্লেট-এর খাবার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়েটি থামল না। এটা দেখে জুডিথ তার নিজের অংশটুকুও সেই মেয়েটিকে খেতে দিল। তার নাম হচ্ছে অ্যান মিসেন। সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক বণিক-এর জাহাজে ছিল। সেই জাহাজ বোম্বের (মুম্বাই) পথে যাত্রা করছিল। মাদাগাস্কার-এর দক্ষিণাংশে এসে তারা পেলিকান জাহাজের পাশ দিয়ে যেতে থাকে। তাদের জাহাজটি মনে করে পেলিকান জাহাজ হয়ত কোনো বিপদে আছে। তারা ক্যাপ্টেন বেনবুরিকে আশ্বস্ত করে যে তারা তাকে যে কোনো রকম সাহায্য করতে রাজি আছে। ইন্ডিয়াম্যানদের জাহাজটি যখন পেলিকান জাহাজের খুব কাছে চলে আসে তখন পেলিকান-এর নাবিকের ইন্ডিয়াম্যানদের জাহাজ আক্রমণ করে। ধনসম্পদ লুট করে তারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। অ্যানের স্বামী-যে কিনা কোম্পানির একজন কেরানি ছিল আরও উচ্চপদে যোগদানের জন্য বোম্বে (মুম্বাই) যাচ্ছিল। সে তার স্ত্রীর সামনে খুন হয়ে যাওয়ার পূর্বে প্রচণ্ড বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল।

“আমি কখনো জানতামই না যে তার এত সাহস আছে,” অ্যান জুডিথকে বলতে থাকে। তার গল্প বলা দেখে জুডিথ বুঝতে পারে সেই ঘটনার কারণে অ্যান এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গিয়েছে। জুডিথ-এর আর সাহস হয়নি বাচ্চাটির কথা জিজ্ঞেস করার। তারা নতুন জীবন শুরু করার জন্য ইংল্যান্ড ছেড়ে আসার পূর্বেই হয়ত বাচ্চাটি মারা গিয়েছে।

তারা যখন খাবার শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, তখন তাদের মনে হচ্ছিল যে তারা পাঁচ বারের খাবার একবারে খেয়ে ফেলেছে। এরপর অ্যান বলল, “এবার আমাকে আপনার জীবনের গল্প বলুন।”

এর আগে একবার বুজার্ড জুডিথকে দেখতে এসে তাকে জেনারেল নাজেত বলে সম্বোধন করেছিল। আর তখন থেকেই জুডিথের অতীত জীবনের গল্প শোনার ব্যাপারে অ্যান-এর আগ্রহ বেড়েই চলছে। ইথিওপিয়ায় বেড়ে উঠা তার শৈশব। তার ইউরোপ ভ্রমণ, এরপর তার সৈনিক জীবন সবকিছুর ব্যাপারেই অ্যান-এর আগ্রহ। “আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে আপনি কিভাবে জেনারেল হলেন। মানে পুরুষরা কীভাবে তাদের পরিচালনার ভার আপনার হাতে তুলে দিল।”

“কারণ সম্ভবত এটাই যে আমি শুধু একজন নারীর জীবন বেছে নেয়ার জন্য বড় হইনি।” জুডিথ বলতে থাকে। “আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। তার কোনো ছেলে সন্তান ছিলনা। তাই তিনি একটা ছেলেকে যা কিছু শেখাতে পারতেন তার সব কিছুই আমাকে শিখিয়েছেন। আমি ঘোড়ায় চড়তে শিখেছি। তলোয়ার চালনা করতে শিখেছি, যুদ্ধ করতে শিখেছি। বন্দুক চালাতে শিখেছি। আমাকে যখন রাতের বেলা গল্প শোনানো হত সেগুলো কোনো রাজপুত্রের গল্প ছিল না। সেগুলো ছিল মহাবীরদের গল্প-আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, হান্নিবল এবং আফ্রিকান বিখ্যাত জেনারেলদের গল্প।

“এবং আপনিও। অ্যান বলল। কারণ ইতোমধ্যেই জুডিথ তার হিরোইন” এ পরিণত হয়েছে।

জুডিথ হেসে বলল, “আমি হানিবল নই! কিন্তু আমি শিখেছি কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়। কীভাবে যুদ্ধে জয়লাভ করতে হয়। কারণ, আমার বাবা ছিলেন উপজাতীয়দের প্রধান। তারা আমাকে আমার পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাই আমার পিতা অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে যদি কখনো রাজার পক্ষ থেকে আরব আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার জন্য সৈন্যদলে ডাক পড়ত তখন আমি তাদের পরিচালনা করে নিয়ে যেতাম। প্রধান সেনাদলের সাথে যোগ দেয়ার পূর্বেই আমরা এল গ্যাং-এর কিছু লোকদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের প্রতিহত করেছিলাম। এই বিজয়ের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আমরা যখন প্রধান সৈন্যদল-এর কাছে পৌঁছে যাই তখন সবাই আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে উল্লাসধ্বনি করতে থাকে। প্রধান সৈন্যদল আমাকে গ্রহণ করে অত্যন্ত আনন্দের সাথে। আমি হয়ে যাই তাদের নেতা। তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। একসময় আমি নিজেকে দেখতে পেলাম সমগ্র সৈন্যদলের প্রধানরূপে। দেখলাম যে তারা সবাই আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অনুসরণ করতে চাইছে না।”

“আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি সেসময়ে যেসব বৃদ্ধ জেনারেল ছিল তারা সবাই আপনাকে হিংসে করতো”, অ্যান বলতে শুরু করল। কিন্তু জুডিথ উত্তর দেয়ার আগেই তালা খোলার শব্দ পেলো। কেবিন-এর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছে বুজার্ড, সেই সাথে তার শরীর থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধও।

“ঝড় আসছে,” বুজার্ড বলল। তার পেছনে কেবিনের দরজাটা দুলতে শুরু করে দিল। সে টেবিলের ওপর রাখা খালি প্লেট-এর দিকে একনজর তাকিয়ে দেখল, এরপর জুডিথ-এর দিকে তাকাল। অ্যান তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে কেবিনের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায় যেন সে আগুন থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বুজার্ড তার দিকে লক্ষ করছে না।

“তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?” প্রতিবারের মতো এবারও জুডিথ একই প্রশ্ন করল।

“যেখানেই যাই না কেন, আপনি সেটা উপভোগ করবেন না, এটা নিশ্চিত।” বুজার্ড উত্তর দেয়। সে জুডিথকে এমনভাবে দেখতে থাকে যেন কোনো ক্রেতা নিলামে উঠা কোনো দাসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

“হাল কার্টনি তোমাকে খুন করে ফেলবে”, জুডিথ বলল। “সে তোমাকে খুঁজে বের করবে। এরপর তোমার অস্তিত্বকে বিলীন করে দেবে।”

এবার বুজার্ড সামনে এগিয়ে এলো-কিন্তু জুডিথ-এর দিকে নয়, অ্যান-এর দিকে। সে তার থাবা দিয়ে অ্যান-এর গলা প্যাচিয়ে ধরে তাকে কেবিনের দেয়ালের সাথে আটকে ফেলল। অ্যান চিৎকার করতে চাইছিল কিন্তু তার সে সামর্থ্য ছিল না। এরপর বুজার্ড তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত মুঠ করে অ্যান-এর পেট-এ আঘাত করে বসলো। ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল অ্যান।

মুখোশ পরা দানবটা এবার জুডিথ-এর দিকে এগিয়ে এলো। জুডিথ তার পেট-এ হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে রেখেছে যেন সে তার পেট বাঁচিয়ে মুখে আঘাত করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

“যতবার আপনি আমার কথার অবাধ্য হবেন, ততবার মেয়েটার এই অবস্থা হবে।” বুজার্ড-এর কথা তার মুখোশের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তার পেছনে অ্যান ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার।

“আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার বেশ বড়সড় কারণ আছে। কিন্তু…” বুজার্ড পেছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “সে আমার কাছে কিছুই না। ওর কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে। ওকে আমি যা খুশি করতে পারি।”

“তুমি একটা কাপুরুষ,” জুডিথ চিৎকার করে উঠল।

বুজার্ড ঘুরে আবারও মেয়েটির দিকে গেল। মেয়েটি উপুড় হয়ে এক হাত উঁচিয়ে নিজেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুজার্ড নিচু হয়ে বসে এবার মেয়েটির মুখে আঘাত করে বসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবারো জুডিথ-এর দিকে গেল দানবটা।

“আর কিছু বলবেন?”

জুডিথ দানবটার সাথে যুদ্ধ করার জন্য, ওকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। কিন্তু খালি হাতে চোখের পানি ফেলা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

আর তাই, সে মাথা নাড়াল।

“গুড।” “যখন ঝড় আঘাত হানবে তখন আপনি নিরাপদে থাকার জন্য মেঝেতে বসে শক্তভাবে বিছানার খুঁটি ধরে রাখবেন। তাহলে কোনো ক্ষতি হবে না।” সে জুডিথ-এর বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল। “অ্যান-এর কোনো বিছানা নেই। শুধু মেঝেতে একটা কম্বল পাতা আছে। অথবা আপনারা একজন আরেকজনকে ধরে রাখতে পারেন। এরপর সে দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজায় পৌঁছে আবার একটু দাঁড়িয়ে জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “আপনি শুধু শুধু প্রার্থনা করে আপনার সময় অপচয় করবেন না। যদি মনে করেন আপনার নায়ক এসে আপনাকে উদ্ধার করবে, তো বলে রাখলাম, সে আশা কোনোদিনও পূরণ হবে না। সে বলতে থাকে, কারণ কার্টনি হয়ত এতক্ষণে মারা গিয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য তাকে অনেক আগেই ষাড়ের মতো বেঁধে কসাই খানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

আর এইটুকু বলেই সে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।

*

মাদ্রি দি ডিয়াস হচ্ছে তিন মাস্তুলযুক্ত পর্তুগীজ জাহাজ। সাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় এ জাহাজ। এই জাহাজের মাধ্যমে দাস থেকে শুরু করে হরেক রকম জিনিসপত্র ইস্ট ইন্ডিয়া, ওটোম্যান সাম্রাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। আর এত বড় ব্যবসার বাহক হওয়ার কারণে একে নিয়ে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন এর মালিক ক্যাপ্টেন জা’আও বারোসকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।

মহারাজা সাদিক খান জাহান কার্টনি নামের এই ইংরেজটাকে কোয়েলিমান এ নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনোরকম সম্মানী দেন নি। তিনি শুধু একজন কর্মচারীকে এই লোকটার সাথে পাঠিয়েছেন। কর্মচারিটি ইংরেজটাকে জাহাজের ডেক-এর ওপর ছেড়ে দিয়ে বারোসকে আরবিতে বলেছে যে মহারাজা এই লোকগুলোকে আপনার জাহাজে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন।

“আচ্ছা, ঠিক আছে।” মুখের ওপর থাকা পুরনো দাগটার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দিল সে। এই পুরোনো অভ্যাসটা সে এখনো ছাড়তে পারেনি।

“সেনর লোবো খনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য ওদেরকে কিনে নিয়েছেন।”

“বুঝলাম।”

“খুব ভাল, আর…একেও ওদের সাথে যোগ কর। কর্মচারী লোকটি হালকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল। সে একজন ইংরেজ। মহারাজা একে সেনোর লোবোর জন্য বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দিয়েছেন-যদি সে এই ভ্রমণে বেঁচে থাকে আরকি।”

“খুবই ভাল পুরস্কার।” বারোস বলতে শুরু করল। “সে একজন সাদা চামড়ার মানুষ বলে বলছি না, এই লোকটা দেখতেও খুবই শক্তিশালী আর স্বাস্থ্যবান। ভাল দাঁতও রয়েছে। আমি নিশ্চিত সেনোর লোবো এর কাছ থেকে ভাল ফলন ঘটাতে পারবে।”

“সেটার খুবই সম্ভাবনা আছে। কর্মচারীটি একমত হয় এবং আবার বলতে শুরু করে, “মহামান্য রাজা জানিয়েছেন যে সমুদ্র যাত্রায় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এবং এই লোকের কোনো ক্ষতি হয় তবে এটার দায়ভার তোমাদেরকে নিতে হবে না।”

“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন একে নিয়ে আমরা যা খুশি করতে পারি?”

“ঠিক তাই”। “মহামান্য রাজা এই লোকের ভাগ্য আল্লাহ তাআলার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী এবং অসীম দয়ালু।”

“বেশ মজার একটা বিধান জারি করেছেন উনি,” বারোস বলে উঠল। “আমি বিধানটা মনে রাখার চেষ্টা করব।”

এরপর হাল তার ছোট্ট জীবনে দ্বিতীয়বার-এর মতো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। তাকে একটা অন্ধকার, উষ্ণ, মানুষের বিসর্জনকৃত তরল পদার্থের দুর্গন্ধময় স্থানে দাসদের থাকার জায়গায় আবদ্ধ করে রাখা হলো।

হাল ভেবে দেখল ছয়দিন যাবত তারা জাঞ্জিবার থেকে বাইরে আছে।

“এই বদমাশটা এখন আবার কী খুঁজে বেড়াচ্ছে?” হাল আড়চোখে জাহাজের লণ্ঠন বাতিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে জিজ্ঞেস করল।

পর্তুগীজ নাবিকেরা তাদের কনুই-এর বাকে নাক টেকে সামনে এগুতে থাকে। শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে যাওয়া একজন আফ্রিকান লোক মাথা নিচু করে বসেছিল। পর্তুগীজ নাবিকেরা তার কাছাকাছি চলে আসলেও যখন দেখতে পায় লোকটি নড়ছে তখন নিচু হয়ে লোকটিকে পরীক্ষা করে দেখতে থাকে। এরপর মাথায় ধাক্কা দিলে লোকটি চোখ বড় বড় করে নড়েচড়ে উঠে। এরপর তাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা অন্য একটা আফ্রিকান-এর দিকে এগুতে থাকে।

“একে দেখতে বেশ ঋষ্টপুষ্ট মনে হচ্ছে,” চাবুক হাতে নেয়া একজন পর্তুগীজ অন্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলে।”

“দেখ, আমি এইখানে আরেকটা পেয়েছি”, অন্য নাবিকটি বলে উঠে। একে দেখতে বেশ শক্ত সামর্থ্য মনে হচ্ছে। হাল পর্তুগীজদেরকে খুব ভালভাবে জানত। তাই সে কোনোরকম নড়াচড়া করল না বা খুব একটা অগ্রাহ্য ভাব নিয়ে তাকাল না। নাবিকটি তার আরও কাছে এসে বলল, “আরে, এ তো দেখি সাদা চামড়ার লোক।”

“এদেরকে নিয়ে এস,” চাবুক হাতে লোকটি বলল।

হাল এবং আফ্রিকান লোকটি পর্তুগীজ নাবিকদের পিছু পিছু যেতে থাকে। পায়ের শেকল না খুলেই মই দিয়ে ওদের দুজনকে উপরে উঠতে বলা হয়।

“আহ, এ যে দেখছি সেই ইংরেজটা,” ক্যাপ্টেন বারোস বলে উঠে।। এরপর সে পেশিবহুল অন্য দুজন দাস-এর দিকে ফিরে বলল, “বাহ এদেরকে দেখতে বেশ শক্তিশালী ও ঋষ্টপুষ্ট মনে হচ্ছে। খুব ভাল, অসাধারণ পছন্দ। সাদার বিপরীতে কাল…”

ক্যাপ্টেন বায়োস তার অফিসার এবং তার কেবিন বয়-এর সাথে প্রধান মাস্তুলের পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের প্রত্যেকের মাথায় সূর্য থেকে বাঁচার জন্য বড় হ্যাট পরা রয়েছে। বালকটি দেখতে অনেকটা বাতোস-এর মতই দেখতে এবং বারোস-এর মতই মাথা টান টান করে ঔদ্ধত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাল প্রায় নিশ্চিত যে এটা বারোস-এর ছেলে।

“তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে চল, ফার্নান্দেজ, বায়োস একটা ধূসর চুলের খোঁড়া লোককে ইঙ্গিত করে বলল, যার একটা পা কৃত্রিমভাবে লাগানো। আমি প্রতিজ্ঞা করছি তুমি যদি এর চাইতে আস্তে চল তবে তোমার আরেকটা পা কেটে ফেলা হবে।”

“আমি কী সার্জনকে বলব তার কাটার যন্ত্র নিয়ে আসতে?” একজন লম্বা চেহারার অফিসার বলতে থাকে। এরপর আমরা সেটাকে বাজি হিসেবে ব্যবহার করব।” অন্যান্যের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায় এমনকি সেই বালকটাও হাসতে থাকে।

খোঁড়া লোকটি ছয় তারযুক্ত একটা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। পর্তুগীজ-এর স্পানিশ ভাষায় যেটাকে ‘ভায়োলা ডা ম্যানো বলা হয়। যার অর্থ হচ্ছে হাতের বেহালা। এরূপ নামকরণের পেছনে কারণ হচ্ছে এটা কাঠির বদলে আঙুল দিয়ে বাজানো হয়। খোঁড়া লোকটি রাগে ফেটে পড়ে জবাব দেয়,” আমি যতটা দ্রুত সম্ভব তত দ্রুতই আসছি, বারোস।” সে রাগে গজ গজ করতে করতে প্রধান মাস্তুলের কাছে পৌঁছে যায়।

ক্যাপ্টেন বারোস ক্লান্ত দৃষ্টিতে হাল-এর দিকে তাকায়। নোংরা ভিখারীর মতো লোকটা কেন তার সাথে এভাবে কথা বলছিল সেটা হল বুঝে উঠতে পারে না। আমি তার এইভাবে কথা বলার দুঃসাহস মেনে নিয়েছি কারণ সে আমার বাবার বন্ধু ছিল এবং সে খুবই ভাল একজন মিউজিশিয়ান, “বারোস ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধ লোকটার হাতে ধরা বাদ্যযন্ত্রটা ভালভাবে তাকিয়ে দেখল। ওটার বাকানো পাশে ছয় জোড়া তার লাগানো আছে। “সে সম্ভবত এই ভায়োলা ডা ম্যারোস এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। আমি যতদূর জানি এটা তার দাদার ছিল।”

“গ্রেট গ্রান্ডফাদার। এমনকি উনার সময়ও এটা প্রায় পুরানোই ছিল।” ফার্নান্দেজ তাকে শুধরে দেয়।

ক্যাপ্টেন বারোস হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয় না আমাদের যুবক ইংরেজটা কখনো এ ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেখেছে, তাই নয় কী?”

“শুধু ছবিতে দেখেছি”, হাল জবাব দেয়। তাদের কথোপকথন দেখে মনে হচ্ছে দুজন ভদ্রলোক বড় কোনো বিশ্রামাগারে বসে কথা বলছে, একজন বন্দি এবং একজন ক্যাপ্টেন-এর মধ্যকার কথোপকথন বলে মনেই হচ্ছে না।

বারোস মাথা নাড়াল। “হ্যাঁ, এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার যে ভায়োলা ডা ম্যানো অনেক দিন যাবতই ফ্যাশন জগতের বাইরে রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো এটা ব্যবহার করি তাই না। ভদ্রমহোদয় গণ?” পাঁচজন অফিসার মাথা নাড়ায় এবং দাঁত বের করা হাসি দেয়। “তোমরা ইংরেজরা হচ্ছ সভ্য জাতি। যে কোনো সভ্যতার চিহ্ন হচ্ছে সংগীতের প্রতি তার ভালবাসা। তুমি কী তাই মনে কর না ইংলিশম্যান?”

এরপর বারোস ক্যাট ও টেইলার নামক চাবুকটি হাতে ধরা লোকটির দিকে তাকায়, এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে হাল-এর গোড়ালিতে লাগানো লোহার বেড়ির দিকে ইঙ্গিত দেয়। লোকটি তার কোমড় থেকে চাবি বের করে লোহার বেরি খুলে দিয়ে হালকে বন্ধনমুক্ত করে দিল

“তোমরা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ,” বারোস পেশিবহুল কালো চামড়ার দাসটাকে দেখিয়ে বলল। “সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমার শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলবে।”

“এখন খুব সূক্ষ্ম একধরনের প্রতিযোগিতা হবে, তার সামনে দাঁড়ানো আরেকজন অফিসার ভ্রূ কুঁচকে বলে।

হাল তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে দাসরা সবসময় একধরনের নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে যেন কোনোভাবেই তাদের জীবন বিপন্ন না হয়। সবসময় মাথা নিচু করে চলার চেষ্টা করে, চোখদুটোকে অবনত করে রাখে। কিন্তু এই লোকটি সরাসরি ক্যাপ্টেন-এর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পেশিবহুল পুরো শরীরই প্রায় নগ্ন। শুধু কোমড়ের নিচের অংশে এক টুকরো কাপড় প্যাচানো আছে। হাল মনে মনে ভাবতে লাগল এর বিপরীতে সে কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন বারোস-এর মনে যে প্রতিযোগিতার কথা খেলা করছে সেটা কোনো শারীরিক যুদ্ধ ছিল না।

হাল এবং পেশিবহুল দাসটার চারপাশ থেকে লোকজন দূরে সরে যেতে থাকে। ওদের দুজনের জন্য ডেকের ওপর বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়। ওরা দুজনেই বেশ গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। এই নিঃশ্বাস ভয় কিংবা পরিশ্রমের জন্য নয়। এতদিন বন্দী থাকার পর মুক্ত বাতাস পেয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে দুজনেই।

“তোমরা আমাদের জন্য নাচবে,” বারোস বলতে শুরু করল। “তোমরা ফার্নান্দেজ-এর সুরের তালে তালে নাচবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সুর বাজানো বন্ধ করবে ততক্ষণ তোমরা নাচতেই থাকবে।”

“তবে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে নাচ থামিয়ে দিতে পার। তবে মনে রেখ যে আগে নাচ থামাবে সে তার ফল পাবে।”

হাল-এর পেছনে দাঁড়ানো দাসটি ক্যাপ্টেন বাতোস-এর একটি কথাও বুঝতে পারে নি। জাহাজের একজন আফ্রিকান নাবিককে ডেকে এনে বারোস এর কথাগুলো তার ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া হলে দাসটি সবকিছু বুঝতে পারে।

“কী ফল পাবে?” হাল জিজ্ঞেস করে।

বারোস একজন অফিসার-এর দিকে তাকাল যে তার একটা পা রেলিং এর পাশে রাখা একটা রশির কুণ্ডলীর ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যে প্রথম নাচ থামাবে তাকে রশির এক প্রান্তে বেঁধে জাহাজ থেকে পানিতে ছেড়ে দেয়া হবে। এরপর বারোস তার লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা যারা এই নাচের ফলাফলের বাজিতে হেরে যাবে তারা মাছ ধরে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবে।” এরপর সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে দুই বাহু প্রসারিত করে বলল, “আমি ওদের বিনোদনের দিকটা সবসময় খেয়াল রাখি, দেখেছ? একারণেই আমার নাবিকেরা আমাকে এত ভালবাসে।”

তার পেছনে এরই মধ্যে বাজির পণ নিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছে।

হাল মাদ্রি দি ডিয়াস-এর প্রধান মাস্তুল-এর দিকে তাকায়। একই সাথে বারোসও সেদিকে তাকায়।

“আহ!” বারোস আক্ষেপ করে বলে উঠে।” “আপনি মনে করছেন আট নটের এই স্পিড আমরা ধরে রাখতে পারব না, তাই না?”

হাল মনে মনে এই জাহাজের পেছনে আসা হাঙরগুলোর কথা চিন্তা করতে লাগল।

“আমরা হিসাব করে দেখেছি যে সাধারণত হাঙরদের গতি হচ্ছে দুই নট। ক্যাপ্টেন বারোস বলতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে সে তার গতি অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। এরপর সে তার অফিসারদের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমরা কী মনে কর?”

“আমরা হাঙরের গতি আট নটের উপরে পর্যন্ত রেকর্ড করেছি, ক্যাপ্টেন। কিন্তু এই গতি হাঙর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না,” কোয়ার্টারমাস্টার বলে উঠে।

বারোস মাথা নাড়ায়, এরপর হাল-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। “অবশ্য এসব আপনাদের চিন্তার বিষয় নয়। আপনারা যতদূর সম্ভব নেচে যাবেন। এরপর বারোস পায়ের গোড়ালি বাঁকিয়ে ফার্নান্দেজ-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং হাত ছড়িয়ে ইশারা করে। ফার্নান্দজ আপনি শুরু করুন। তবে এমন সুর বাজাবেন যেন ইংলিশম্যান-এর পছন্দ হয়।”

ফার্নান্দেজ তার বাদ্যযন্ত্রের তারে আঙুল চালানো শুরু করে।

আফ্রিকান লোকটি আর হাল উভয়েই পরস্পরের দিকে তাকাল।

“শুরু করুন”, ক্যাপ্টেন বায়োস বলে উঠে।

চাবুক হাতে ধরা লোকটি হাল এবং আফ্রিকান লোকটাকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। কোনো উপায় না দেখে নাচতে শুরু করে দিল হাল।

.

“আমার তো মনে হচ্ছে কোয়েলিম্যান অথবা উপকূলের কাছাকাছি কোনো বন্দরেই আমরা নোঙর ফেলতে পারব না। বেনবুরি বুজার্ড-এর দিকে তাকায়। তারা দুজনেই পেলিকান-এর কোয়ার্টার পেক-এর রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকিয়ে তাকিয়ে বুজার্ডের মাথা নাড়ানো এবং বোট উঠানামা দেখছে, “প্রায় সব বন্দরই পর্তুগীজদের নিয়ন্ত্রণে। তারা নিজেরা এবং আরবদের ছাড়া অন্য কাউকে সেখানে বাণিজ্য করতে দিবে না। উপকূলে একটা দাস নিয়ে যাওয়াও তাদের কাছে ব্যবসা।”

“চুরি করে কোনো দাসকে উপকূলে নিয়ে যাওয়াটা এখানকার আইন অনুযায়ী মারাত্মক ধরনের অপরাধ,” বুজার্ড তার ফেসফেসে কণ্ঠে বলে উঠে। “তুমি কী চিন্তা করেছো তাহলে?”

“পেরেরিয়া নামে আমার আরেকজন সঙ্গী আছে। সে জানে খনিগুলো কোথায় অবস্থিত। যদি তার কাছে একটা সেক্সট্যান্ট যন্ত্র থাকত তবে সে বলে দিতে পারত যে খনিগুলো কোথায় অবস্থিত। একবার যদি তুমি সেখানে যাও তবে সে তোমাকে ভাষাও বুঝিয়ে দেবে। আমি জানতে পেরেছি যে এই লোবা লোকটার পর্তুগীজ এবং স্থানীয় কিছু ভাষা ছাড়া অন্য কোনো মাতৃভাষা নেই। ডেল্টা নদী হয়ে আমি তোমাকে উপকূলে রেখে আসব। সেখানে সাদা চামড়ার কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না। আমি তোমাকে কোয়েলিম্যান এ নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বরং এদিক দিয়ে গেলে তুমি খনির অনেক কাছাকাছি চলে যেতে পারবে।”

“আমাদের কাউকে না কাউকে যেতেই হবে”, বেনবুরি যুক্তি দেখাল। ‘‘আমি এই জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাব।”

“আমার মনে হয় না আফ্রিকার আবহাওয়ায় এই ভ্রমণে জুডিথ নাজেত এর সৌন্দর্যের কোনো উন্নতি হবে। বরং অবনতি হবে।” বুজার্ড অজুহাত দেখাল।

“ওহ, সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। সে সাদা চামড়ার কোনো মানুষ নয়। অন্যান্যের মতো সেও কালো চামড়ার অধিকারী। সে ওখানে ভালই থাকবে।”

*

হাল ফার্নান্দেজ-এর সুরের তালে তালে নাচতে আরম্ভ করে। যদিও ক্যাপ্টেন সুরটাকে আরও মেলোডিয়াস করতে বলছিল। ধূসর দাড়িযুক্ত বৃদ্ধ লোকটি তার চিকন নড়বড়ে হাতের আঙুলগুলো বাদ্যযন্ত্রের তারের ওপর দিয়ে ছন্দের তালে-তালে নাড়িয়ে যাচ্ছে। সে এতটাই সহজে সুর উঠাচ্ছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো রমণী বাথটাবের গরম পানিতে গোসল করতে করতে বাদ্যযন্ত্রের তারগুলোকে স্রেফ নাড়িয়ে যাচ্ছে, আর ওগুলো নিজে থেকেই মেলোডি সৃষ্টি করে ফেলছে।

হাল নিজেও এই সুরের তালে তালে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অপমান ভুলে পেশিতে শক্তি আনার চেষ্টা করছে। হাল বাধ্য হয়ে এসব কিছু করছে শুধু একটা কারণেই। সেটা হচ্ছে জুডিথ। ওর জন্য তাকে বেঁচে থাকতেই হবে।

হাতদুটো পেছনে নিয়ে ক্রমানুসারে পায়ের গোড়ালি এবং আঙুলের ওপর ভর দিয়ে নাচার চেষ্টা করছে সে। এভাবে তালে তালে পায়ের পাতা উঠা-নামা করাতে জাহাজের ডেক-এর ওপর এক ধরনের মৃদু ছন্দ তৈরি হয়েছে।

তবে ফার্নান্দেজ-এর বাজানো সুরটা হাল-এর পরিচিত হওয়াতে তার জন্য একটু সুবিধাই হয়েছে। কিন্তু আফ্রিকান দাসটাকে দেখে মনে হচ্ছে ভায়োল ডি ম্যানো নামক বাদ্যন্ত্রটি সে ইতপূর্বে কখনো দেখেনি।

বাদ্যযন্ত্রটিতে নতুন এক ধরনের সুর তোলা হয় যেটা হাল চিনতে পারছে না। কিন্তু এরপরেও সে সহজতালে এলোমেলোভাবে নৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে। নাবিকেরা সারাদিন পরিশ্রমের পর যেভাবে ঘুমে ঢুলতে থাকে, এই নাচ অনেকটা সেরকম। সে তার শরীরটাকে শক্তভাবে ধরে রেখে সুদক্ষ কৌশলে হাতদুটো উঠা-নামা করানোর চেষ্টা করছে। সে তার পাদুটোকে এক-দুই-তিন তালে উঠিয়ে-নামিয়ে এমনভাবে নাচার চেষ্টা করছে যেন দর্শকরা দেখে মুগ্ধ হয়। এরপর সে যখন আফ্রিকান লোকটির দিকে তাকাল, তখন দেখতে পেল যে সে পাখি যেভাবে ডানা ঝাঁপটায় অনেকটা সেরকম ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে। এমনকি আফ্রিকান লোকটিকে দেখে খুব একটা ঘর্মাক্তও মনে হচ্ছে না। অথচ হাল-এর শরীর থেকে ঘাম-এর ফোঁটা ডেক-এর ওপর এসে পড়ছে।

পর্তুগীজ অফিসাররা এসব দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল। তাদের কেউ কেউ হাসছিল এবং হাততালি দিচ্ছিল সুরের তালে তালে। তাদের মাঝে কেউ হাল এর দিকে তাকাচ্ছে আবার কেউ আফ্রিকান লোকটির দিকে তাকাচ্ছে, সেই সাথে নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে কেন তার বাজিতে জেতা উচিত। ক্যাপ্টেন বারোস-এর মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে। বাকি নাবিকেরা রেলিং-এর পাশে জড়ো হয়ে নাচ দেখছে।

হাল যেন গানের তালে হারিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের তাল দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ডেক-এর ওপর আছড়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটা ফার্নান্দেজ-এর আঙুলগুলো বাদ্যযন্ত্রের তারের ওপর দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে নেচে বেড়াচ্ছে।

“নিগ্রো লোকটা যেন কোবরার মতো নেচে যাচ্ছে, পর্তুগীজ একজন অফিসার বলে উঠে।

“দেখে মনে হচ্ছে সে তার ঈশ্বরের জন্য ধ্যান করতে করতে নাচছে।” আরেকজন অফিসার বলে উঠে। সূর্য এখন মধ্য আকাশ থেকে কিরণ দিচ্ছে। সাগরের ওপর দিয়ে ভেসে আসা উত্তাপ মাদ্রি দি ডিয়াস-এর স্টারবোর্ড-এর ওপর পড়ছে। এতটাই তাপ অনুভূত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছে, স্টারবোর্ড-এর ওপর জলন্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। হাল-এর নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। তার পাদুটি আস্তে আস্তে ভারী হয়ে আসছে। পানির জন্য তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। তার ঘর্মাক্ত শরীর থেকে পানি পড়ে পায়ের কাছে ডেকের অংশটা ভিজে যাচ্ছে। সে ভয়ে আফ্রিকান লোকটার দিকে তাকাচ্ছে না। যদি সে দেখতে পায় যে লোকটা এখনো তার চেয়ে শক্তিশালী এবং দৃঢ় অবস্থায় রয়েছে তাহলে হয়ত তার আত্মবিশ্বাসটুকু আরও ক্ষীণ হয়ে যাবে। সে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। যদিও এখনো সে আফ্রিকান লোকটার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।

এরপর সে আবারো মনোযোগ দিয়ে নাচতে লাগল।

ব্যথা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। পায়ের ছোট ছোট হাড় থেকে শুরু করে উরুর শক্তিশালী পেশিতে, এমনকি গলা পর্যন্ত। মাথাটা তার কাছে বিশাল ভারী কোনো বস্তু মনে হচ্ছে। তারপরও আফ্রিকান লোকটার জন্য তার মায়া হচ্ছে। কারণ হাল নাচছে তার স্ত্রী এবং আগত সন্তানের জন্য। এছাড়া সাগরের বুকে থাকতে থাকতে তার শরীর শক্তিশালী এক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তার পেশি এবং টেনডন যে কোনোরকম শারীরিক পরিশ্রম মেনে নিতে পারে।

কিন্তু তবুও সেই যন্ত্র এখন আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। কিছুতেই নাচের গতি এবং তাল ধরে রাখতে পারছে না। ভায়োলা ডা মানো থেকে যে সুর বের হচ্ছে সেটার সাথে কিছুতেই ছন্দ মিলছে না। সে শুনতে পাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে সবাই হাসছে। সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে। তাকে কেমন দেখাচ্ছে আসলে? মনে-মনে ভাবল হাল। ব্যথায় এবং তৃষ্ণায় তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে ভাবতে লাগল যে তাকে হয়ত সাহারা মরুভূমি দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনো নেতিয়ে পড়া বুড়োর মতো লাগছে। যদিও তার শরীর তাকে থামিয়ে দিতে চাচ্ছে কিন্তু তার হাঁটু থামছে না। তার নড়াচড়া যদিও কোনো প্যারোডি নাচের মতো হচ্ছে তবুও কেবল মৃত্যুই এটাকে একেবারে থামিয়ে দিতে পারে।

তবে এটা খুবই অবাক করার বিষয় যে ফার্নান্দেজ এখনো সমান তালে বাজিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে মোটেও ক্লান্ত মনে হচ্ছে না। তবে সেটা হাল-এর চিন্তার বিষয় না। হাল-এর হাত দুটো যেন অকেজোভাবে শরীরের পাশে লেগে আছে এবং থুতনিটা সে কিছুতেই বুকের কাছ থেকে উঠাতে পারছে না।

“চালিয়ে যা কুত্তা!” কেউ একজন গর্জে উঠল। সাথে-সাথে একটা চাবুক আফ্রিকান লোকটার পেছনে এবং কাঁধে এসে আঘাত করল। লোকটার রক্তের ছিটেফোঁটা হাল-এর ঠোঁটে এসে লেগেছে।

“মনে হচ্ছে আজকে রাতের ডিনারের জন্য হাঙরগুলো কিছু কালো মাংস পেতে যাচ্ছে। একজন অফিসার বলে উঠে।

“এখনো খেলা শেষ হয়নি,” আগেরজনকে থামিয়ে দিয়ে আরেক অফিসার বলল, “তোমার ইংরেজকেও খুব একটা তরতাজা মনে হচ্ছেনা।”

দর্শকরা সবাই কথা বলছিল, সেই সাথে চিৎকার দিয়ে উঠছিল। কিন্তু সেসব শোনার মতো শক্তি হাল-এর ছিল না। তার লম্বাচুলগুলো পেছনে থেকে সরে এসে তার মুখের ওপর পড়ছিল। তার পাদুটো কী নড়ছিল নাকি দাঁড়িয়েছিল সেটা অনুভব করার সামর্থ্য যেন তার ছিল না। সে আবারো বাতাসে চাবুক দিয়ে আঘাত করার শব্দ শুনতে পায়। এবার হয়ত চাবুক তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তারপরই সে হোঁচট খায় এবং এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে কোনোমতে পতন ঠেকিয়ে দেয়। তার মন চিৎকার করে উঠে : যে করেই হোক দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সে তাই করে। কিন্তু যখন সে উঠে দাঁড়িয়ে তার বাঁ দিকে তাকায়, তখন সে দেখতে পায় আফ্রিকান লোকটি নিচে পড়ে যাচ্ছে। তার মাথা ঝুলে পড়েছে এবং সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য হাহাকার করছে।

হাল চারদিক থেকে আনন্দধ্বনি শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে এই চিৎকার তার জন্য। কিন্তু তারপরও সে নাচতে থাকে।

প্রথমে পায়ের গোড়ালি, এরপর পায়ের বুড়ো আঙুল। বাম পা সামনে, ডান পা সামনে, বাম পা পেছনে, ডান পা পেছনে। এভাবে সে তালে তাল মিলিয়ে এখনো নেচে যাচ্ছে।

“যথেষ্ট হয়েছে, কোয়ার্টারমাস্টার চিৎকার দিয়ে উঠে।

“আচ্ছা, এবার থাম, ইংলিশম্যান, তুমি জিতে গেছ”, ক্যাপ্টেন বারোস তার হ্যাটটা খুলে উপরের দিকে ধরল-খেলা শেষ হওয়ার ইংগিত। “তোমার দেশীয় লোকজন নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে গর্বিত হবে।”

“পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াও। তোমাকে হাঙরের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হবে আজ।” চাবুক হাতে থাকা লোকটি আফ্রিকান-এর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে। “আমি বলছি”, উঠে দাঁড়াও। চাবুক-এর আঘাত পুনরায় আফ্রিকান লোকটির ওপর পড়ল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল হাল, এরপর চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রবল আক্রোশে। তারা দুজনেই নিচে পড়ে গেল। লোকটির গলা প্যাচিয়ে ধরল হাল।

“কাপুরুষ”, হাল চিৎকার দিয়ে উঠে। রাগে এবং ক্ষুধায় তার মনে হচ্ছিল সে এই ঘৃণ্য শয়তানটাকে খুন করে ফেলবে। আফ্রিকান লোকটির প্রতি তার প্রতিযোগিতার চেয়ে বরং সহমর্মিতা বেশি প্রখর হয়ে উঠেছে। সে মাথা নিচু করে চাবুক হাতে ধরে রাখা লোকটির নাকে জোরে আঘাত করল।

“আমাকে ছেড়ে দাও,” লোকটি চিৎকার করে উঠে। তবুও হাল তাকে ছাড়ল না। লোকটিকে শূন্যের ওপর তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। এরপর আবার তার ওপর গিয়ে পড়ল হাল।

“তাকে এভাবে ধরে রাখ”, বারোস চিৎকার করে উঠল। ইতোমধ্যেই কয়েকজন অফিসার এসে হালকে টেনে চাবুকওয়ালার কাছ থেকে সরিয়ে এনেছে। তাদের মাঝে একজন লোক হাল-এর চুলগুলো নিজের হাতে প্যাচিয়ে পেছন দিকে টেনে ধরল।

“বদমাশ ইংরেজ”, বাতোস আবারো চিৎকার দিয়ে উঠে। “তুমি কী চাও এই নিগ্রোটার সাথে তোমাকেও খুন করা হোক?” এরপর সে হালকে আঘাত করে বসলো। হাল-এর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়তে থাকে দরদর করে।

“আমি তোমাকে খুন করে ফেলব,” হাল গর্জে উঠল। তার মাথা থেকে জুডিথ এবং তার সন্তানের চিন্তা কিছু সময়ের জন্য দূর হয়ে যায়। সে কেবল আফ্রিকান লোকটির কথাই ভাবতে থাকে।

সে জানে এরপর তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। সে তার পেটের পেশি শক্ত করে ফেলে যখন দেখে বারোস-এর মুষ্টি তার দিকে এগিয়ে আসছে। বাতাস ভেদ করে বারোস-এর মুষ্টি হালকে আঘাত করে। কিন্তু তারপরও হাল বারোসকে স্প্যানিশ বেশ্যার দুগ্ধজাত সন্তান বলে গালি দিতে থাকে।

বারোস কোনো জবাব না দিয়ে রেলিং-এর দিকে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে মোটা কাঠের টুকরো তুলে এনে হাল-এর কানের উপরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল সে।

হাল-এর দৃষ্টিসীমার মধ্য থেকে সাদা আলো সরে গিয়ে সবকিছু অন্ধকার হতে শুরু করল। “ইংলিশম্যান, তোমার মধ্যে একজনকে পেলে সামুদ্রিক প্রাণীরা বড় খুশি হবে,” এরপর সে তার লোকদের দিকে ফিরে বলল, “আরেকটা রশির ব্যবস্থা কর।”

তারা হাল এবং আফ্রিকান লোকটার বুকের ওপর খুব শক্ত করে রশি বেঁধে ফেলল। হাল এরপর আর কোনোরকম প্রতিরোধ গড়ে না তুলে আত্মসমর্পণ করাটাই উত্তম বলে ভাবল। কিন্তু আফ্রিকান লোকটা এরপরও বাধা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এরপর হাল এবং আফ্রিকান লোকটাকে নিচে নামাতে লাগল ওরা। রশির একপাশ জাহাজের নাবিকেরা ধরে আছে এবং অন্যপাশে হাল আর আফ্রিকান লোকটা ঝুলে আছে। হাল তার হাতের এবং পায়ের পেশি ব্যবহার করে রশি ধরে জাহাজে আটকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু রশি নামাতে নামাতে যখন তাকে সাগরের পানিতে পৌঁছে দেয়া হলো, তখন সে তীব্র চিৎকার করে উঠল।

মাদ্রি দি ডিয়াস-এর লোকেরা যখন রশিটাকে ছাড়তে ছাড়তে সাগর পর্যন্ত নামিয়ে ফেলল তখন হাল এবং আফ্রিকান লোকটি সাঁতার কাটার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ। সাগরের পানি দুদিকে সরিয়ে মাথাটা ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করা ছাড়া ওদের আর কিছুই করার ছিল না। হাল শরীর বাঁকিয়ে লাথি দিয়ে পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না।

সে অন্যদিকে তাকিয়ে যখন দেখল যে আফ্রিকান লোকটি এখনো ডুবে যায়নি তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আফ্রিকান লোকটি এতটাই টানটানভাবে রশিটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে যে দেখে মনে হচ্ছে তার হাতের পেশি ফুলে গিয়েছে।

“ধরে রাখ”, সে চিৎকার করে উঠল। সে তার হাত দিয়ে কোনো কিছু শক্তভাবে ধরে রাখার মতো ইশারা করে দেখাল যাতে লোকটি যদি তার কথা শুনতে না পায় তবুও যেন তার ইশারা দেখে বুঝতে পারে। “ভালভাবে ধরে রাখ। তারা শীঘ্রই আমাদেরকে উপরে উঠিয়ে নেবে।” হাল-এর মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন বায়োস নিশ্চয়ই এতটা বোকা লোক নয় যে তাদের মতো শক্তিশালী দুজনকে দাস হিসেবে খাটানোর বদলে হাঙরের খাবার হতে দেবে।

জাহাজের অফিসাররা তাদের মাথার হ্যাট খুলে সামনের দিকে ঝুঁকে হাল এবং আফ্রিকান লোকটাকে দেখছে। তারা সবাই জাহাজের পেছন দিকে রেলিং এ জড়ো হয়েছে। হাল তাদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। সেই সাথে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর পালও দেখছে পাচ্ছে সে। অন্তত দুই ডজন নাবিক মাস্তুলের রশি বেয়ে উপরে উঠছে এখন।

সে হয়ত জাহাজের গতি কমানোর চেষ্টা করছে, হাল ভাবল। সাথে-সাথে সে সতর্ক হয়ে পড়ল, কারণ সে জানে যে জাহাজের গতি দুই থেকে তিন নট কমে গেলে কী হবে। কিন্তু সে জাহাজের উপম্যাস্টম্যানকে প্রধান মাস্তুলের ওপরে দেখতে পায়। তারা সবাই উপগ্যালান্ট গোটানোর চেষ্টা করছে। যখন তা সম্পন্ন হয় তখন জাহাজের গতি অনেকটা কমে যায়। এরফলে সহজেই হাল তার মাথাটা পানির ওপর ভাসিয়ে রাখতে পারে। সে যখন আফ্রিকান লোকটির দিকে তাকায় তখন দেখল যে লোকটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।

বোকাটা ভাবছে আমরা বেঁচে গিয়েছি! আপন মনে ভাবল হাল। ও এখনো মনে করছে যে আমরা কোনোমতে এই ট্রায়ালটা পার হয়ে আবারো জাহাজে ফেরত যেতে পারব!

আর এরপরই, হালের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে পেছনে ফিরে তাকানোর ইশারা করল। রশিটাকে শক্ত করে ধরে পেছনে ঘুরে তাকাল হাল।

আর ঠিক তখনই সে তার পেছনে কয়েক গজ দূর থেকে ভেসে আসা হাঙরের ডানাটাকে দেখতে পেল।

ওপর থেকে জাহাজের লোকেরা চিৎকার করছে। তারা সবাই জাহাজের রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়েছে দেখার জন্য।

“গড, হেল্প আস”, হাল বিড়বিড় করে বলতে থাকে। টাইগার শার্ক-এর ঝক এখন তার থেকে মাত্র কয়েক হাত পেছনে আছে।

সমুদ্রে ভ্রমণের ফলশ্রুতিতে সে বিভিন্ন প্রজাতির শার্ক দেখেছে ইন্ডিয়ান। সাগরে : ব্ল্যাক টিপ শার্ক, হ্যাঁমারহেড শার্ক, দ্য গ্রেট হোয়াইট শার্ক। এর মধ্যে গ্রেট হোয়াইট শার্ক আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলতে পারে। তবে নাবিকদের কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে এই নাক বোচা টাইগার শার্ক। কারণ এরা হচ্ছে সবচেয়ে অতৃপ্ত এবং অসন্তুষ্ট। হাল পঁচিশ ফিট লম্বা টাইগার শার্কও দেখেছে। সে এই টাইগার শার্কদের পুরো লংবোট তছনছ করে সবাইকে খেয়ে ফেলতেও দেখেছে।

আফ্রিকান লোকটি ভয়ে চিৎকার করছে। কিন্তু তাকে দেয়ার মতো কোনো উপদেশ হাল-এর কাছে নেই। এখন আর করার মতো কিছুই নেই শুধু আশাকে জিইয়ে রাখা ছাড়া। যদি ওটা এগিয়ে আসে, তবে সামথ্যের শেষটা দিয়ে লড়াই করব। হাল ভাবল।

মাদ্রি দি ডিয়াস-এর গতি অন্তত চার নট-এর মতো কমেছে, যার ফলে হাল-এর মনে হলো, বারোস হয়ত ফোরমাস্ট থেকে কিছুটা ক্যানভাস নামানোর আদেশ দিয়েছে। তবে যাই ঘটুক না কেন, এতে করে হাল-এর রক্ত সাগরের পানির চাইতে আরও অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে আশা করতে থাকে যে পর্তুগীজরা হয়ত তার সাথে মজা করছে। হাঙর আক্রমণ করার পূর্বেই তাদেরকে হয়তো উপরে উঠিয়ে নিবে ওরা।

কিন্তু বণিক নাবিকেরা এখনো তাদেরকে নিয়ে বাণিজ্য করা বন্ধ করেনি। তাদেরকে বাজির পণ বানিয়ে জুয়া খেলছে ওরা।

হাল টেরও পেল না যে কখন একটা হাঙর তাকে আক্রমণ করে বসেছে। একটা বড় পাখার মতো মাথা হঠাৎ করেই তার ডান উরুতে আঘাত করল। এরফলে হাল-এর শরীর ডানদিকে পুরোটা ঘুরে গেল। তার হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে এখন। হাল আবার ভেসে উঠে ফুসফুসটা বাতাসে পূর্ণ করে নিল। হাঙরটা তাকে আরো একবার ধাক্কা দিল। হাল পানির নিচে ডুবে গিয়ে হাঙরটাকে খুঁজতে থাকে।

পানির নিচে ওটাকে দেখতে পেল সে। প্রায় ত্রিশ গজ পেছনে মাথা নাড়িয়ে সাঁতার কাটছে ওটা।

এখন নিশ্চয়ই লোকগুলো তাকে জাহাজের ওপর উঠিয়ে নেবে? তারা নিশ্চয়ই হাঙর-এর আক্রমণ দেখতে চেয়েছে। এবার যারা বাজিতে জিতে গিয়েছে তারা নিশ্চয়ই তাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য করবে।

কিন্তু তারা এখনো তা করছে না। আর তখনই হাল-এর ভয় চরমে পৌঁছে। গেল। কারণ আরও একটি হাঙর এগিয়ে আসছে আক্রমণ করার জন্য। এটার লেজ হালকে এমনভাবে চাপা দিতে থাকে যেন হালকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। পানির নিচেই চিৎকার করে উঠল হাল, এরপর পুরো শরীরটাকে বাকিয়ে দানবটার কাছ থেকে সরে আসলো। সে তার বা পায়ের গোড়ালি দিয়ে হাঙরটার লম্বা নাকে আঘাত করে বসলো। ফলে হাঙরটা সরে গিয়ে জাহাজের কাত হওয়া অংশের নিচে তলিয়ে গেল।

এরপর আরেকটা হাঙর এগিয়ে আসতে থাকে ওর দিকে। ওর খর্ব আর বলিষ্ঠ গড়ন, চওড়া আর পাতলা নাক দেখে হাল বুঝতে পারে যে এটা বুল শার্ক। ওটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে হাল-এর দিকে এগিয়ে আসে। হাঙরটা যখন হালকে আঘাত করতে উদ্যত হলো, সে তখন আবারো পানির নিচে চলে গেল। হাঙরটা হাল-এর এত কাছাকাছি ছিল যে সে ঐ বিস্ময়কর সৃষ্টির চোখদুটো খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিল। তারপর হাঙরটা আরো দূরে সরে গেল। হাল তার শরীরটাকে বাঁকিয়ে উপরে তুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো পানির নিচে ডুব দিল।

এর পরের হাঙরটা মুখ খুলে হালকে আক্রমণ করতে আসলো। এর করাতের মতো দাঁতগুলো পানির ভেতরেও চকচক করছিল। এইরকম ভয়ের মুহূর্তেও হাল-এর জুডিথ-এর কথা মনে পড়ে গেল। কারণ এটাই হয়ত তার জীবনের বেঁচে থাকার শেষমুহূর্ত। তবুও সে মৃত্যুর কাছে এত সহজে হার মেনে নিল না। সে চিৎকার করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঙরটাকে লাথি দেয়ার চেষ্টা করল। এরপর কোনো না কোনোভাবে হাঙরটা ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে পড়ল।

এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হালকে প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি সময় পার করতে হয়েছিল। সে হাঙরগুলোর নাকে আর চোখে আঘাত করছিল। কোনো না কোনোভাবে হাঙরগুলোর হা করা গ্রাস থেকে হাল বেঁচে গেল। হালের এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যে আফ্রিকান লোকটিও হয়তো তার মতো একইভাবে প্রতিহত করে যাচ্ছে। কিন্তু যখন তার বাম কাঁধে তীব্র আঘাত লাগল তখনই তার সেই ভাবনা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। লোকটি আর চিৎকার করছে না। হয়ত সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হয়ত সে হাঙরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েছে, হাল ছেড়ে দিয়েছে। হাল যখন নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য পানির ওপর ভেসে উঠল তখন জাহাজের ওপর থেকে তীব্র চিৎকার শুনতে পেল। ক্যাপ্টেন বারোস আফ্রিকান লোকটির রশি ধরে রাখা নাবিকদের ওপর চিৎকার করছিল। শুনে মনে হচ্ছিল যে ওকে হাঙরদের খাবার হতে দিয়েছে বলে ক্ষেপেছে সে। বোকা লোকটা কী প্রত্যাশা করেছিল?

হাল তখন শুধু নিজের কথাই ভাবছিল। পানিতে আফ্রিকান লোকটির রক্ত আর মাংস হাঙরগুলোকে যেন পাগল করে তুলেছে, তারা শিকারের জন্য আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি হালকে সময়মত উঠিয়ে ফেলা না হত তাহলে হয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হত না।

এরপর সে বুঝতে পারে যে সে আস্তে আস্তে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর কাছাকাছি যাচ্ছে। তারা হালকে উপরে উঠিয়ে নিচ্ছে। উপরে উঠাতে উঠাতে হালকে যখন লারবোর্ড-এর উপরে টেনে তোলা হয় সে তখন প্রায় মৃত। তার খুব একটা বোধশক্তিও ছিল না।

হাল-এর পায়ে যখন লোহার বেড়ি পরানো হচ্ছিল তখন বাধা দেয়ার মতো বিন্দুমাত্র শক্তিও ছিল না ওর শরীরে।

“অভিনন্দন, ইংলিশম্যান, তুমি অনেক সাহসিকতার সাথে হাঙরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে,” বারোস হালকে উদ্দেশ্য করে বলল।

উত্তর দেয়ার মতো কোনো সামর্থ্য হাল-এর ছিল না। কিন্তু সে বেঁচে আছে এখনো-এটাই দেখার বিষয়।

৭. খোলা আকাশ দেখার জন্য

জুডিথ খোলা আকাশ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। দীর্ঘদিন যাবত সে এরূপ নোংরা কর্দমাক্ত জায়গায় আটকে আছে। সূর্যের আলো এখানে প্রবেশ করে না। মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে না সে।

তারা মোট দশ জন এই ভ্রমণে অংশ নিয়েছে : পেরেরিয়া নামে পেলিকান এর সেই পর্তুগীজ, আর তার সাথে আছে তিনজন পর্তুগীজ নাবিক যাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে বন্দুক আর একটা করে চাবুক রয়েছে; দুজন আফ্রিকান নাবিক যাদেরকে দারোয়ান-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে; জুডিথ আর অ্যান; সবশেষে রয়েছে মুখোশ পরা সেই লোকটা এবং তাকে সেবা প্রদানকারী দাস। জুডিথ কিছুতেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না যে, কেন এই লোকটা এরূপ মুখোশ পরেছে। কেন এইরকম অদ্ভুত কদাকার মুখোশের ভেতর চেহারাকে বন্দি করে তালা লাগানো হয়েছে। তবে জুডিথ নিশ্চিত যে লোকটি ইচ্ছে করে এরূপ মুখোশ পরেনি। কোনো কিছুর শাস্তিস্বরূপ তাকে এটা পরানো হয়েছে। এমনকি তার একহাতে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করার মতো শক্তি থাকার পরও খাবার এবং পানির জন্য সে দাসের ওপর নির্ভরশীল।

একদিন সন্ধ্যায় জুডিথ তার অন্ধকার জগতে কোনরকমে একটু আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিল। হালকা ধোয়ার মধ্যে সময় কাটাচ্ছিল সে। এমন সময় বুজার্ড আসলে সে বুজার্ডকে জিজ্ঞেস করে যে কেন সে তার এই মুখোশ খুলে ফেলে নি, “অসহ্য গরম পড়েছে। এই গরমে এটা পরে থাকা অসম্ভব। এ অবস্থায় তুমি কীভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছ?”

“ওহ। আমি যদি এটা খুলে ফেলি তখন কী হবে? আমি হয়ত এটা দিয়ে কাউকে ভয় দেখাতে পারি। কিন্তু এটা ছাড়া আমি চেহারাবিহীন এক পঙ্গু ছাড়া আর কিছুই নই।”

“তোমার জন্য বেশ আফসোস হচ্ছে,” জুডিথ তার কণ্ঠে কোনোরকম অনুভূতি না ফুটিয়ে তুলেই কথাটা বলল।

বুজার্ড সামনে ঝুঁকে জুডিথ-এর কথার উত্তর দিল। আমার জন্য আফসোস করা বাদ দিন। আপনার আফসোেস আপনার নিজের জন্য যত্ন করে রেখে দিন।

.

তারা পেলিকান থেকে ছোট্ট একটা পানসিতে করে যাত্রা শুরু করে। সাগর এবং ভূমির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট উপনদী দিয়ে তারা অগ্রসর হতে থাকে। স্থলপথের চেয়ে জলপথের আঁকাবাঁকা রাস্তায় পথ চিনে নেয়াটা মানুষের জন্য আরও বেশি দুর্বোধ্য। কিন্তু বুজার্ড এবং সোনালি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ পেরেরিয়া সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সঠিকপথে নৌকো চালানোর। তারা ম্যানগ্রোভ গাছের ডাল ভেঙে পথের চিহ্নস্বরূপ সেগুলোকে নদীর পাশে পুঁতে রেখে যাচ্ছে যাতে ফেরার সময় তারা যেন পথ ভুলে অন্য কোনো উপনদীতে প্রবেশ না করে। মাঝে মাঝে তারা তর্কে লিপ্ত হচ্ছে যে তাদের কোনপথে যাওয়া উচিত। আর অন্য সময় তারা যেকোনো একটা পথের ব্যাপারে একমত হয়ে লোকজনকে সেই পথে নৌকো চালাতে নির্দেশ দিচ্ছে।

যেখানে পানির গতি কমে গিয়েছে সেখানে তারা কিছু বিশাল আকারের জলহস্তী ভেসে থাকতে দেখে। বুজার্ড তার নাবিকদেরকে অস্ত্র হাতে নিতে বলে এবং জন্তুগুলোকে এড়িয়ে যেতে বলে। জুডিথ জলজ এসব প্রাণীকে খুব ভালভাবেই চিনত। দক্ষিণ ইথিওপিয়ায় যাত্রার পথে সে এগুলোকে প্রায়ই দেখতে পেত। অ্যান এগুলোকে প্রথম বারের মতো দেখছে। সে বুঝতে পারছে না যে মুখোশ পরা লোকটা হঠাৎ করে এত সতর্ক হয়ে উঠেছে কেন আর আফ্রিকান লোকগুলোও এই প্রাণীগুলোকে এত বেশি ভয় পাচ্ছে কেন।

“ওগুলোরে দিকে তাকিয়ে দেখুন,” অ্যান মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলে। “ওগুলো ওখানে শুয়ে শুয়ে মাথাটাকে একবার ভাসাচ্ছে একবার ডুবাচ্ছে। এদের অর্ধেকটা পানির নিচে আর অর্ধেকটা পানির উপরে। চোখ আর নাকগুলো যেন একটু পর পর পানির নিচ থেকে উঁকি মেরে ভেসে উঠছে। ওদের কান নাড়ানোর ভঙ্গিটাও দেখতে বেশ মজার। দেখুন ওদের একটার মাথায় পাখি বসে আছে।”

“ওরা যদি একবার আক্রমণ করে তবে তোমার সব হাসি বন্ধ হয়ে যাবে।” জুডিথ বলতে থাকে। “একটা রাগান্বিত ষাড় কিংবা একটা গরু যদি আক্রমণ করে তাহলে হয়ত তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। ভূমির ওপর অনেক লোক ওদেরকে চষে বেড়ায়। কিন্তু এগুলোর একটা যদি একবার আক্রমণ করে তবে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে।”

ঠিক তখনই একটা জলহস্তী বিশাল এক হাই তুলে তার বাঁকা দাঁতগুলো দেখিয়ে দিল। অ্যান-এর মুখ থেকে সমস্ত হাসি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সাথে সাথে।

কিন্তু তারপরও ওদের জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা বিশাল আকারের পশুগুলোর কাছ থেকে আসেনি, বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা-মাকড়ের কাছ থেকে এসেছিল। বিশেষ করে রাতের বেলা বন্য পোকামাকড়ের কামড়ে শরীরের খোলা অংশ লাল হয়ে যাচ্ছিল। যে করেই হোক সমস্ত শরীর কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছিল সবাইকে।

অন্তত স্বস্তির ব্যাপার এই যে ওদের খাবারের কোনো কমতি পড়েনি। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, ঝিনুক এবং কাঁকড়ার কোনো অভাব ছিল না আশেপাশে। পাখি শিকারীরা কিছু সামুদ্রিক পাখি শিকার করে নিয়ে আসে। সেই সাথে বন্য মধু। জুডিথ আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করে কিছু সবুজ রঙের জলপাই পাতা জোগাড় করে নিয়ে এলো। পেটের পীড়া কমানোর জন্য এগুলোর মিশ্রণ সে পান করবে। কিছু অপরিপক্ক ঔষধি ফলও জোগাড় করল সে; এগুলোর রস সে পোকামাকড়ের কামড়ের ওপর লাগাবে।

নদীর মোহনায় দ্বিতীয় দিন কাটানোর সময় একজন নাবিক একটা অদ্ভুত প্রাণী হত্যা করে নিয়ে আসে, যেটার লেজ এবং ভদ্র চেহারা দেখতে অনেকটা ডলফিনের মতো। আবার প্রাণীটি দেখতে অনেকটা কুকুরের মতোও বটে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন মুখটা বাঁকা হয়ে হাসি ফুটে আছে। “এটার নাম হচ্ছে ডুগং,” বুজার্ড এতই সামাজিকভাবে কথাটা বলল যেটা ঠিক ওর চরিত্রের সাথে। যাচ্ছিল না। এরা ঘাস খায়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এটার মাংস তোমরা বেশ উপভোগ করবে।

অদ্ভুত প্রাণীটাকে টেনে আনতে তাদের পাঁচজন লোক প্রয়োজন হয়। তারা এটার চামড়া ছাড়িয়ে মাংসে লবণ মাখিয়ে রাখে। পরবর্তী কয়েক দিনের জন্য তাদের নিশ্চিত খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। বুজার্ড-এর কথা সত্য প্রমাণ করে সবাই প্রাণীটার মাংস বেশ উপভোগ করল। অনেকে তর্ক করতে থাকল। তর্কের বিষয় : ওটার স্বাদ কী গরুর মাংসের মতো নাকি শূকরের মাংসের মতো।

সময়ের সাথে সাথে ডুগং-এর মাংসের শেষ অংশটুকুও শেষ হয়ে যায়। এক সময় তারা নৌকো ছেড়ে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে যাত্রা শুরু করল। নদীর নাব্যতা এতটাই কমে এসেছে যে নৌকোকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তাদেরকে পায়ে হেঁটে পথ চলতে হচ্ছে। নোংরা কর্দমাক্ত পথে অনেক সময় তাদের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিল। এক সময় তারা একটু জায়গা পেয়ে গাছের ডালপালা জোগাড় করে আগুন জ্বালাল, এরপর সেই আগুনে মাছ পুড়িয়ে তাদের খাবার জোগাড় করল।

সাদা রঙের বানর তাদের আশেপাশে গাছের ওপর কিচিরমিচির করতে থাকে। সাপ এবং অন্যান্য সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী ফোঁস-ফাস শব্দ করতে করতে তাদের পথ ধরে চলে যাচ্ছে। সারারাত ধরে এখানে সেখানে বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর পতপত আওয়াজ পাওয়া যায়। দিনের আলোতে উজ্জ্বল রঙের মাছরাঙা পাখি দেখা যায়।

কিন্তু দিনের পর দিন চলে গেলেও কেউই বুঝতে পারে না যে বুজার্ড তাদেরকে আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিংবা বুজার্ডের আসল উদ্দেশ্যে কি। জুডিথ শুধু এটুকুই জানে যে সে যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই হাল-এর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এই কর্দমাক্ত পথ দিয়ে যেতে যেতে কিছু একটা খুঁজে পেল সে। একজন পর্তুগীজ নাবিক গাছের ডাল কেটে কেটে তলোয়ার দিয়ে তীক্ষ্ণ করে মাছ ধরার যন্ত্র বানাচ্ছিল। একটা ভাল যখন সে বেশি তীক্ষ্ণ করে ফেলেছিল তখন সেটার মাথাটা ভেঙে যায়। সেই ডাল ফেলে দিয়ে নাবিকটি তখন আরেকটা ডাল খুঁজতে চলে গিয়েছিল। জুডিথ তখন সেই তীক্ষ্ণ ডালটা নিজের কাছে রেখে দেয়।

এটাকে যদিও অস্ত্র বলা যায় না। এটা তাকে বুজার্ডের তলোয়ার থেকে বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু তারপরও…তার হাতে অন্তত একটা কিছু তো রইলো যেটা থেকে ক্ষীণ আশা জাগতে পারে।

.

মাদ্রি দি ডিয়াস কোয়েলিম্যান-এর বন্দরে এসে নোঙর ফেলল। দাসেরা সবাই ভয় আর অনিশ্চয়তা নিয়ে ডেক-এর ওপর অপেক্ষা করতে থাকে। তাদেরকে বণিকদের নিজস্ব নৌকোয় করে উপকূলে নিয়ে যাওয়া হলো না বরং আলাদা একটা নৌকোয় একসাথে বারজন করে নিয়ে যাওয়া হলো।

হাল সাগরের কোমল শান্ত পানির দিকে তাকিয়ে আছে এখন। সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে : যদি একবার সে সুযোগ পায় তবে বারোস-এর শরীর থেকে হাড়-মাংস আলাদা করে ফেলবে।

তারা যখন উপকূলে পৌঁছাল তখন হাল এবং অন্যান্য দাসকে লাইন করে দাঁড়ানোর জন্য বলা হলো। তাদের প্রত্যেকের হাতে এবং গলায় শেকল দিয়ে বাঁধা আছে। সেই শেকলগুলো আবার আরেকটা শেকল দিয়ে সংযুক্ত, একজনের গলায় বাঁধা শেকল থেকে আরেকটা শেকল বেরিয়ে পেছনের জনের হাতের শেকল-এর সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। শুধু মাঝের দুজন এভাবে সংযুক্ত নয়। তাদের দুজনের মাঝে একটা কাঠের ভারী খণ্ড লাগানো আছে। সেই খণ্ড থেকে আবার একটা জোয়াল দুজনের কাঁধে এমনভাবে লাগানো আছে যেন তারা একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বাধ্য হয়।

প্রথম নৌকোতে চড়েই বারোস উপকূলে পৌঁছে যায়। দাসদের সারির দিকে তাকিয়ে সে হ্যাট মাথায় একজন লোকের সাথে কথা বলতে থাকে। হ্যাট মাথায় লোকটাকে দেখে হাল-এর কন্সাল গ্রে-এর কথা মনে পড়ে যায়।

“তাকিয়ে দেখুন, সেনোর কাপেলো,” বারোস তাকে বলতে থাকে। জাঞ্জিবার-এর বাজার থেকে আমরা খাঁটি জিনিসই কিনেছি। আমার মনে হয় সেনোর লোবো এদের কাজের গতি এবং শক্তি দেখে বেশ সন্তুষ্ট হবে।

“এদের মধ্যে একজন সাদা, কাপেলো হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। সাদারা বেশিদিন টেকে না।”

“ওকে নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই,” বারোস তাকে আশ্বস্ত করে। “ওটা বেশ খাঁটি জিনিস। ষাড়ের মতোই শক্তিশালী।”

কাপেলো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু বারোস-এর কথা কিছুটা মেনেও নেয়। সে মিউল-এর ওপর থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং হাল-এর দিকে এগিয়ে যায়। এরপর ভালভাবে হালকে পরীক্ষা করে দেখে। হাল-এর ঊরু, বাইসেপস, চোখ, জিহ্বা সব ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখে। “আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার কথায় আমি একে নিচ্ছি।” কাপেলো বলতে থাকে। কিন্তু সে যদি ঠিকমতো কাজ করতে না পারে তবে আমি একে ফিরিয়ে দেব এবং তুমি আমাকে এর বদলে অন্য একজন কালো দাস দেবে। কিন্তু তখন তোমাকে কোনো পয়সা দেয়া হবে না।”

“অবশ্যই, অবশ্যই। বারোস বলতে থাকে। কিন্তু এখন কী আপনি একে নিতে চান?”

“অবশ্যই,” কাপেলো তার মিউলটার দিকে এগিয়ে যায়, এরপর মিউল এর পিঠের বস্তা থেকে একটা থলে বের করে নিয়ে আসে। সেই থলে ভর্তি পয়সা ঝনঝন করতে থাকে। যা বলা হয়েছিল তার সবটুকুই এটাতে আছে। তুমি চাইলে গুনে নিতে পার”।

“কোনো প্রয়োজন নেই,” বারোস একটা হাসি দিয়ে বলল। “আমি জানি আপনি কিংবা মাননীয় লোবো কখনোই আমার সাথে বেইমানি করবেন না। তাহলে আমি এখন আপনাকে বিদায় জানাচ্ছি। খনির দিকে আপনার যাত্রা শুভ হোক সেই প্রত্যাশা রইল।”

বারোস সরে আসে। কাঁপোলো তার মিউল-এর ওপর চড়ে বসে। এরপর গার্ডদেরকে নির্দেশনা দেয়। এর কিছুক্ষণ পরেই হাল তার পিঠে সেই পরিচিত চাবুকের আঘাত অনুভব করে। সে বুঝতে পারে তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হচ্ছে। এরপর দাসদের লাইন আফ্রিকার বুকের ওপর দিয়ে যাত্রা শুরু করে দেয়।

শেকল দিয়ে বাঁধা একসারি মানুষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও একটু সময় লাগে। তাড়াহুড়ার কারণে অনেকে পড়ে যেতে থাকে। সেই সাথে আরেকজনের হাতেও টান পড়তে থাকে। গার্ডরা যদিও আফ্রিকান কিন্তু তারা স্বজাতির প্রতি কোনো মায়া-মমতা দেখাচ্ছে না। যাদের নড়াচড়া কিংবা হাঁটা তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না, তাদের পিঠেই চাবুক দিয়ে আঘাত করছে লোকগুলো।

*

জুডিথ-এর সমস্ত শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে। তার শরীরের প্রতিটা মাংসপেশি ব্যথায় টনটন করছে। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। মাথাটাকে তার পাথরের মতো ভারী মনে হচ্ছে। সে অন্যান্য দাসের সাথে একটু দূরত্ব রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।

উপকলের কাদামাটি এবং জলাভূমির অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শুষ্ক পথের দেখা পাওয়া গিয়েছে। দীর্ঘসময় পানিতে এবং নরম কাদামাটিতে থাকার ফলে জুডিথের পাদুটো পানিতে ভেজানো পাউরুটির মতো নরম হয়ে গিয়েছে। তাই সে যখন প্রথম শুষ্ক মাটিতে পা রাখে তার পায়ে ফোঁসকা পড়ে যায় এবং রক্ত ঝড়তে থাকে। কিন্তু সেগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। কখনো কখনো সারাটা দিন হাঁটার পর শেষদিকে তার মনে হচ্ছিল যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তবুও সে এগিয়ে চলছিল। কারণ যে করেই হোক তার পেটের মূল্যবান সম্পদকে তার বাঁচাতে হবে।

সে সামনে এগিয়ে যায়, পেটের বাচ্চাটা যেন তাকে বলতে থাকে : ওদের কাছে হেরে যেও না। আমরা বিপদ কাটিয়ে উঠব। আমি যদি লড়তে পারি তবে তুমি কেন পারবে না।

অ্যানকেও অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে, যদিও তার নিজের এই করুণ অবস্থা তারপরও সে অ্যানকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। সাহস দেয়ার চেষ্টা করছে। অ্যান যখন হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে শুরু করে তখন তাকে ধরে ফেলল সে। এরপর অ্যান আবার চলতে শুরু করে। অ্যানকে দেখে মনে হচ্ছিল সে শুয়ে পড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত তবুও আর হাঁটতে রাজি নয়।

মুখোশ পরা লোকটা প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর সবাইকে আধা ঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়। অ্যান জুডিথের পেছনে বসে আছে। সে হাঁটুদুটো ভাঁজ করে হাঁটুর ভাঁজে মুখ ঢেকে বসে আছে।

“আজকে রাতে”, জুডিথ তার কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আজকে রাতে আমরা কাজটা সম্পন্ন করব।”

আস্তে আস্তে করুণ চেহারা নিয়ে অ্যান তার মুখটা উঠায়। ক্লান্তিতে তার চোখদুটি মিটি মিট করতে থাকে। আপনি কী এবার সত্যি সত্যি বলছেন?”

তারা এর আগেও বহুবার পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা-ভাবনা করেছে। কিন্তু শুধু আলোচনা করা ছাড়া বেশিদূর এগুতে পারেনি।

“এই আমি সত্যি বলছি। আমরা কাজটা করেই ছাড়ব,” জুডিথ তাকে আশ্বস্ত করল। গলার স্বর বেশি উপরে উঠাল না সে, কারণ পেলিকান-এর নাবিকেরা কিছুদর সামনে বসে পানি খাচ্ছে এবং অশ্লীল গল্পে মগ্ন রয়েছে।

“কীভাবে?” অ্যান-এর চোখ আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

জুডিথ নাবিকদের দিকে একবার নজর দিল এরপর বুজার্ডের দিকে তাকাল যে কিনা এরইমধ্যে তার কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। তলোয়ারটা তার মাথার কাছে বেশ সতর্কভাবে রাখা আছে। মুখোশের কারণে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না যে সে কী জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে গিয়েছে।

এরপর কোনোরকম আগাম বার্তা না দিয়ে হঠাৎ করেই উঠে বসল বুজার্ড। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে জুডিথদের প্রতিটি কথা শুনতে পাচ্ছে। তার ভয়ার্ত এক চোখ দিয়ে সে তাদেরই দিকে তাকিয়ে আছে এটা বেশ বোঝ যাচ্ছে।

“ওর দিকে তাকিও না,” জুডিথ নিচু স্বরে অ্যানকে বলল। সে দেখতে পায় অ্যান কাঁপছে। জুডিথ মেয়েটার হাত নিজের হাতে তুলে নেয় এবং পেটের ওপর রাখে। “ভান কর যেন আমরা বাচ্চা নিয়ে কথা বলছি, সে বলতে থাকে। অ্যান এখনো মুখোশ পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। “অ্যান,” জুডিথ আবারো ফিসফিস করে ডাকতে থাকে। মেয়েটি তার মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁট শক্ত করে জুডিথ-এর পেটের দিকে তাকাল যেন সে বাচ্চার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে।

আর এদিকে জুডিথ তাকে কীভাবে পালাবে সেই পরিকল্পনার কথা বলতে থাকে।

মধ্যরাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে তখন জুডিথ আর অ্যান তাদের থাকার জায়গা থেকে আস্তে আস্তে বের হয়। খুব সাবধানে পা ফেলে তারা। আগুনের আশেপাশে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা কেউ যেন ঘুম থেকে জেগে না উঠে। রাতে পাহারাদারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পেরেরিয়া নামের সেই লোকটিকে যে তাদের নৌকোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। লোকটি বেশ সতর্ক পাহারা দিচ্ছে, জুডিথ তার চোখ এড়িয়ে যেতে পারল না।

“অ্যানকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতে হবে,” জুডিথ ব্যাখ্যা করল “সে একা যেতে ভয় পাচ্ছে।”

পেরেরিয়া ক্যাম্পের পাশে একটা ভোলা জায়গা দেখিয়ে বলল, “ওখানে যাও।”

জুডিথ মাথা নেড়ে জবাব দিল, “না, না, মানুষের সামনে নয়।”

পেরেরিয়া খুব দ্রুত তাদের কথার প্রতিক্রিয়া দেখাল। “এখানে থাক, সে তার স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণে আদেশ করে, এরপর আগুনের দিকে এগিয়ে যায়।

তারা অপেক্ষা করতে থাকে। জুডিথের ভয় হয় পেরেরিয়া হয়ত বুজার্ডকে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু না, স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে পেরেরিয়া তা করে না। বরং সে সামনে এগিয়ে গিয়ে একজন পেলিকান নাবিককে জাগিয়ে তোলে। আগুনের আলোয় জুডিথ লোকটার ঘুমঘুম চেহারা দেখতে পায়। নাবিকটা তখন তার কম্বলটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে আস্তে আস্তে জুডিথদের দিকে এগিয়ে আসে।

একহাতে তার বন্দুকটি ধরে অন্যহাতে জুডিথদেরকে ইশারা করে তাকে অনুসরণ করার জন্য।

“তুমি কী কোনোভাবেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না?” জুডিথ অ্যানকে জিজ্ঞেস করে। এসব সাজানো কথামালা তাদের পূর্বেই পরিকল্পনা করা।

“না, আমাকে এখনই যেতে হবে।” অ্যান তার কণ্ঠে জোর দিয়ে বলে।

জুডিথ মাথা নাড়ায়। সে অ্যান-এর কাছ থেকে এরকম উত্তরই প্রত্যাশা করছিল।

নাবিকটি তাদেরকে পথ দেখিয়ে জায়গা মতো নিয়ে যায়। ক্যাম্প থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে। লম্বা লম্বা আগাছা জন্মে বেশ জঙ্গলের মতো একটা জায়গা হয়েছে। চাঁদের আলোয় পথঘাট বেশ পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পের আগুনের আলো দেখা যাচ্ছে না যদিও কিন্তু আকাশে ধোঁয়া উড়ছে সেটার কিছুটা বোঝা যাচ্ছে।

“ওখানে গেলে চলবে?” নাবিকটি লম্বা লম্বা ঘাস যুক্ত একটা জায়গা দেখিয়ে বলল।

অ্যান লজ্জাবনত হয়ে একবার লোকটির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার জুডিথ-এর দিকে তাকাচ্ছে। এরপর মাথা নাড়ল এবং বোঝাল, যে লোকটিকে এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। লোকটিও কোনো বাক্য ব্যয় না করে একটু দূরে সরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। অ্যান তার স্কার্ট ভাঁজ করে হাঁটু গেড়ে বসার ভান করল।

ওদিকে নাবিকটিও তার হাতের বন্দুকটা মাটিতে রেখে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বসে গেল।

লোকটির তরল পদার্থ বিসর্জনের শব্দ শুনতে পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জুডিথ অপেক্ষা করে। এরপর সে নিঃশব্দে লোকটির পেছনে চলে যায় এবং তার স্কার্টের নিচে পায়ের সাথে বেঁধে রাখা তীক্ষ্ণ কাঠের ফলাটা আস্তে আস্তে বের করে। লোকটি উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর পূর্ব পর্যন্ত জুডিথ চিতাবাঘের মতো অপেক্ষা করতে থাকে। যখনই সে ঘুরে দাঁড়ায় তখনই জুডিথ তার অস্ত্রটা লোকটির গলায় ঢুকিয়ে দেয়। সেই সাথে পা দিয়ে লোকটির পায়ে আঘাত করে। এরপর বাম হাত দিয়ে এমনভাবে গলা প্যাচিয়ে ধরে আঘাত করে যে লোকটি কোনোরকম শব্দ করতে পারে না, শুধু গলা দিয়ে গার্গল করার মতো আওয়াজ বের হয়। আর সেটাও কিছুক্ষণ পর বন্ধ হয়ে যায়।

চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। জুডিথ মৃতদেহটার কাছ থেকে দূরে সরে আসে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাঁপাতে থাকে ও। সে যুদ্ধে বহু মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম ব্যাপার হয়েছে। তার নিজেকে ফিরে পেতে কিছুটা সময় লাগল।

“তাড়াতাড়ি,” সে অ্যান-এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল। “বন্দুকটি নাও।” অ্যান ঘাসের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে মৃত লোকটির অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করে নিল।

জুডিথ লোকটির কোমড় থেকে বেল্ট খুলে নেয়। বেল্ট-এর সাথে আটকানো গুলির বক্স এবং ফ্লাক্স খুলে নিল সে। লোকটির তরবারিটাও নেবে বলে ভাবল, কিন্তু এটা আসলে তাদের জন্য বেশ ভারীই হয়ে যাবে। ভারী কোনো জিনিসই এখন নেয়া যাবে না। বন্দুক এবং গুলিই তাদের জন্য যথেষ্ট।

“পানি,” সে ফিসফিস করে বলে উঠে। অ্যান মাথা নাড়ায়, এরপর পানির ফ্লাস্কটা জুডিথ-এর ঠোঁটের কাছে ধরে। যদিও জুডিথের নিজের ফ্লাস্ক আছে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে যুক্তিতর্কে যাওয়ার সময় নয়।

জুডিথ আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে সবকিছু একটু বোঝার চেষ্টা করে। আর তারপর দৌড়াতে শুরু করে একযোগে। তারা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। মুখোশ পরা লোকটা হয়ত ধারণা করবে যে তারা পূর্বদিকে গিয়েছে যেদিক দিয়ে তারা এসেছে। জুডিথ-এর উদ্দেশ্যও পূর্বদিকেই যাওয়া কিন্তু সেটা সে কেবল তখনই করবে যখন একটা নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করতে পারবে ওরা।

পালানোর উত্তেজনায় তাদের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তারা বন্যপ্রাণীর মতো দৌড়াতে থাকে।

*

পানসিটা অ্যাবোলি এবং আরও আটজন অ্যামাডোডা সৈন্যকে কোয়েলিমান-এর উত্তরে একটা বীচ-এ এনে নামিয়ে দেয়। তারা থে তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসই নিয়ে আসে নি। তারা যে ভূমিতে নেমেছে সেটা হয়ত সাদা লোকদের কাছে বৈরী পরিবেশ হতে পারে। কিন্তু তাদের কাছে এটা বন্ধুসুলভ পরিবেশ। অস্ত্র হিসেবে হয়ত তাদের কাছে কোনো বন্দুক ও গুলি নেই। কিন্তু তাদের কাছে বল্লম, শিল্ড, তীর ধনুক রয়েছে যেগুলোর সাথে তারা ছোট বেলা থেকেই পরিচিত।

ওপাশের পৃথিবী থেকে অ্যাবোলি শুধু একটা জিনিসই নিয়ে এসেছে। একটা লম্বা প্যাচানো রশির মাথায় একটা বাঁকানো লোহা। গোল্ডেন বাউ-এর নাবিক হিসেবে সে এটা শত্রুর জাহাজে ওঠার কাজে ব্যবহার করত। জুডিথ কিংবা হালকে উদ্ধার করার জন্য শত্রুর বিল্ডিং-এ উঠতে হলে হয়ত এটা তার প্রয়োজন পড়বে।

বিগ ডেনিয়েল পানসির লোকদেরকে আদেশ করেছে তারা যেন অ্যামাডোডা সৈন্যদের উপকূলে নামিয়ে দিয়ে আসে। নিজের আবেগের বহিঃপ্রকাশ করা হয়ত ডেনিয়েল-এর স্বভাববিরুদ্ধ, কিন্তু যখন সে দেখতে পায় অ্যামাডোডারা চলে যাচ্ছে তখন সে অ্যাবোলিকে জড়িয়ে ধরে। এরপর পেছনে সরে গিয়ে অ্যাবোলির কাঁধ চাপড়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে, “ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও, যেখান থেকে পার আমাদের ক্যাপ্টেন এবং তার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসো।”

অ্যাবোলি কিছু বলল না। শুধু মাথাটা এদিক ওদিক নাড়াল। এরপর অ্যামাডোডা সৈন্যরা দৌড়াতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পাম গাছের আড়ালে হারিয়ে যায়।

*

সেই রাতে পর্তুগীজ নাবিককে হত্যা করার পর জুডিথ এবং অ্যান যেন পাখির মতো উড়ে বেড়িয়েছে। ভয়ে আতংকিত হয়ে নিজেদের এ জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজে বেড়িয়েছে। শারীরিক পরিশ্রম তখন তাদের কাছে কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু পরবর্তী দিনটা ছিল আরও কঠিন; সূর্যের তাপ এত বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল মাটি থেকে ছয় ফিট উঁচুতে সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুন করার সেই উত্তেজনা উধাও হয়ে যায় নিমিষেই। দুর্বলতা এবং ক্লান্তিবোধ তাদেরকে ঘিরে ধরে। কথা বলে শক্তি অপচয় করার মতো সামর্থ্যও যেন তাদের নেই। তারা দুজন দুজনের চিন্তায় মগ্ন থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না জুডিথ বলে যে তাদেরকে এখন বিশ্রাম নিতে হবে।

দ্বিতীয় রাতে তারা একটা খাট গাছের নিচু ডালে জড়োসডো হয়ে বসে ছিল। ঠাণ্ডা বাতাস এবং শীতে কাঁপছিল ওরা। এমন সময় হঠাৎ তারা দূর থেকে কান্নার মতো আওয়াজ শুনতে পায়। কান্নার আওয়াজগুলো তীক্ষ্ণ চিৎকারে গিয়ে শেষ হয়। অ্যান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জুডিথ-এর বাহু খামচে ধরে। তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

“এটা শেয়ালের শব্দ,” জুডিথ অ্যানকে বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রাণীটা দেখতে কুকুরের মতো কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। সে ব্যাখ্যা করে বলতে থাকে। “এরা ইদুর, পাখি এবং ফলমূল খায়। এমনকি পোকামাকড়ও খায়। জুডিথ এটা উল্লেখ করে না যে শেয়াল ছোট ছোট হরিণও খেয়ে ফেলতে পারে। এরপরও অ্যান জুডিথের বাহু খামচে ধরে আছে। যতবার শেয়াল চিৎকার দেয় ততবার তার নখ জুডিথের মাংসের মধ্যে যেন গেঁথে যাচ্ছে।

জুডিথের তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল আগুন জ্বালিয়ে নিজের শরীরকে গরম করতে। তাদের কাছে যে বন্দুক আছে সেটা দিয়েই আগুন জ্বালানো যেতে পারে। কিন্তু গুলির শব্দ কিংবা আগুনের শিখার আলোতে তাদের উপস্থিতি হয়ত কেউ না কেউ টের পেয়ে যাবে। তাই সে কাঁপতে থাকে এবং সূর্য উঠার জন্য প্রার্থনা করতে থাকে।

জুডিথ অ্যান-এর ওপর ভরসা করতে পারছে না যে অ্যান জেগে থাকবে এবং পাহারা দেবে। তার নিজেকেই এ কাজ করতে হবে। তাই সে খাট গাছ থেকে একটু বাকল ছিঁড়ে মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে। ইংরেজ মেয়েটি তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে এখন।

“আমি কখনো কোনো মানুষকে গাছ খেতে দেখিনি,” অ্যান মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলে উঠল।

“আমার দেশে এই গাছ হচ্ছে বিখ্যাত,” জুডিথ জবাব দেয়। এমনকি এই গাছ পুরো আফ্রিকা জুড়েই বিখ্যাত। সে গাছের একটা পাতা ছিঁড়ে অ্যান-এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই নাও। এটা মুখে নিয়ে দেখ!”

অ্যান গাছের পাতাটা নেয়। সেটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখে। এরপর সে এটা মুখে নিয়ে আস্তে আস্তে এমনভাবে চিবাতে থাকে যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। জুডিথ হেসে বলে, “ছাগল যেভাবে জাবর কাটে ঠিক সেভাবেই আমাদের দেশের লোকদের সবসময় খাট গাছের পাতা চিবাতে দেখা যায়।”

“আমি বুঝতে পারছি না কেন”, অ্যান তার ঠোঁটগুলোকে নিচের দিকে বাকিয়ে বলল, “এটার স্বাদও তেমন একটা ভাল মনে হচ্ছে না।”

জুডিথ মাথা নাড়ায়। কিন্তু এটা তোমাকে শক্তি দেবে। তুমি বেশ ভাল অনুভব করবে। একটু অপেক্ষা কর তবেই দেখেতে পাবে।”

তাদেরকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। অ্যান-এর পাতা চিবানো দেখে জুডিথ-এর গ্রামের সেই টিয়া পাখিটার কথা মনে পড়ে যায়, যে টিয়া পাখিটা লম্বা গাছের ওপর বসে বসে পাতা খেত। এরপর যান তার সাহসী স্বামীর গল্প বলে, তার স্বামী তাকে কতটা ভালবাসতো সেই গল্প বলে, তাদের কীভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল সেই গল্প বলে।

এরপর কোনো শিশু যেভাবে বারবার তার ঘুমপাড়ানি রূপকথার গল্প শুনতে চায় অ্যানও জুডিথ-এর কাছে ঠিক সেভাবে হাল-এর গল্প শুনতে চাইলো।

জুডিথ তাদের প্রথম পরিচয়ের গল্প বলল। সে যখন ইথিওপিয়ার ক্রিশ্চিয়ান সৈন্যদের নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল তখন তাদের প্রথম পরিচয় হয়। অ্যান-এর অভিব্যক্তি সব সময়ের মতো অবিশ্বাস্য এবং শ্রদ্ধাভক্তি মিশ্রিত। তার অবিশ্বাসের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন সে জানতে পারল যে “জুডিথ একসময় হলি গ্রেইল-এর গার্ডিয়ান ছিল।”

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আপনার মতো এক মানবীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।” অ্যান বলতে থাকে। এছাড়া আমরা দুজন এখানে এভাবে বনের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। দুই বোনের মতো পাশাপাশি আছি। যদিও ব্যাপারটা বেশ মজার কারণ আমাদের গায়ের রং আলাদা। নিরাপদ জায়গামত পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত আমরা একসাথে থাকব। ঘটনা যাই ঘটুক না কেন।

“ঘটনা যাই ঘটুক না কেন।” জুডিথ সম্মতি জানায়।

কিছু সময়ের জন্য জুডিথ অ্যানকে কথা বলতে দেয়। যদিও এরপর তাকে আর কোনো পাতা খেতে দেয় না সে। তাহলে হয়ত সে সারারাত কথা বলতেই থাকবে। অ্যান-এর একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। জুডিথও একটু ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু সে জানে শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই সে অ্যান-এর চাইতে শক্তিশালী। তারমধ্যে দুটি জীবনশক্তির স্পিরিট কাজ করছে। এক, তার পেটের সন্তান যে কি-না পৃথিবীর আলো দেখার জন্য লড়াই করছে। আর এক তার নিজের জীবন যে কি-না তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করছে।

এখানে শুধু মুখোশ পরা লোকটাই ভয়ের বস্তু নয়। এই জঙ্গলে আরও অনেক জন্তই তাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই জুডিথকে এক চোখ খোলা রেখে হলেও সারারাত জেগে থাকতে হবে।

সূর্যের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথেই তারা প্রস্থান করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। রাতের তীব্র ঠাণ্ডা কিছুটা কমতে থাকে। ফ্লাক্স থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অল্প একটু পানি দিয়ে তারা গলাটা ভিজিয়ে নেয়। নিরাপদ খাবার পানি পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটুকুই হচ্ছে তাদের অবলম্বন। জুডিথ মনে-মনে অ্যান এর ধৈর্য এবং সামর্থ্যের প্রশংসা করল। জুডিথ-এর মতো এই মেয়েটি এতটা কঠিন পরিশ্রম করতে প্রস্তুত নয়। তবে আজকে তাকে দেখে বেশ সতেজ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। তাকে দেখে জুডিথ-এর মনে একটু আশা জাগে যে তারা শেষ পর্যন্ত হয়তো বা উপকূলে পৌঁছাতে পারবে। তারপর তারা কোনো না কোনো জাহাজের দেখা পাবে যেটাতে করে মুখোশ পরা লোকটার কাছ থেকে বহুদূর চলে যেতে পারবে।

“আমরা কোনো না কোনো ইংরেজ ক্যাপ্টেনকে খুঁজে পাব। কিংবা কোম্পানির কোনো জাহাজ, অ্যান বেশ উৎফুল্ল হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। সে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার জুতোজোড়াও যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। বাম পায়ের একটা আঙুল বের হয়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে। আমি তাকে আমাদের গল্প বলব। সে নিশ্চয়ই আমাদের কলকাতা পৌঁছে দেবে কিংবা সরাসরি ইংল্যান্ডে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে। এরপর সে জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল যে তার পেটের সন্তান সেখানে নিরাপদ থাকবে। তার চেহারায় পূর্বের খুশি খুশি ভাব অব্যাহত রেখে বলল। তোমরা দুজনেই সেখানে আমার সাথে থাকবে। “ব্রিস্টল-এর কাছেই আমার পরিবার থাকে। সেটা বেশ শান্তিপূর্ণ আর নিরাপদ জায়গা”, সে আশেপাশে তাকিয়ে এই জায়গার সাথে তুলনা করে বলল। তার চোখে যেন সেই জায়গাগুলোর ছবি ভাসছে।

দক্ষিণ দিকে তারা কয়েকশ মহিষের পাল দেখতে পায়। পুরো জায়গাটা কালো করে সেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেই সাথে মাথা নিচু করে ঘাস খাচ্ছে। জুডিথ প্রথমে ভাবে এদেরকে অনুসরণ করলে হয়ত খাবার পানির দেখা মিলবে। কিন্তু পরে আবার সিদ্ধান্ত বদল করে। তাদেরকে পূর্বদিকে যেতে হবে। আলো থাকতে থাকতে যে করেই হোক তাদেরকে উপকূলে পৌঁছতে হবে। মহিষের পাল এখনো তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে আছে।

“ওয়েস্টবারিতেও নিরাপদ”, অ্যান পূর্বের কথার জের ধরে আবার বলতে শুরু করে। সেখানে হলি ট্রিনিটি নামে একটা চার্চ আছে। যেখানকার যাজক আমাকে বেল টাওয়ার-এর চূড়া পর্যন্ত উঠতে দিত। বেলটা দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। জুডিথ মেয়েটাকে হতাশা করে না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বাড়ির কথা চিন্তা করাটা তার মনে সাহস যোগাচ্ছে। একারণে জুডিথ তাকে কল্পনার জগতে বসবাস করতে দেয়। সে হয়ত অ্যান-এর ইচ্ছে সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে পারবে না।

তাছাড়া তারা যদি উপকূলে পৌঁছে কোনো ক্যাপ্টেনকে তাদের কষ্টের কথা বলে এবং সেই ক্যাপ্টেন যদি তাদেরকে তাদের জন্মভূমিতে পৌঁছে দেয় তবেই কী জুডিথ সুখী হবে? হালকে ছাড়া একা একা পৌঁছে সে কী সুখী হতে পারবে?

আমি কী বোকার মতো কাজ করেছিলাম, জুডিথ মনে মনে চিন্তা করল। জাঞ্জিবার-এ গিয়ে আমি যদি বাউ-এর উপরে থাকতাম তবে কতই না– নিরাপদে থাকতে পারতাম। হাল যদি তার জন্য ভুল ওষুধ নিয়ে আসত তবে এমন কী আর ক্ষতি হত। সে তখন যদি অসুস্থ হয়েও পড়ত তবে সেটা কী আজকের অবস্থার চেয়ে খারাপ হত?

কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করার সময় ফুরিয়ে গিয়েছে। সে তার শত্রুর ফাঁদে পড়েছে। তার সন্তান কোনোদিন তার বাবাকে চিনবে না। তার বোকামির জন্য তাকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।

“ওই দিকে তাকিয়ে দেখুন,” অ্যান-এর কথায় জুডিথের শোকাত্মক চিন্তা ভাবনায় বাধা পড়ল। অ্যান উত্তর-পূর্ব দিকে হলুদ ঘাসের মাঝে কালো কিছু একটা নড়াচড়া করতে দেখল। “এটা কী?” সে জিজ্ঞেস করল। “দেখতে অনেকটা পাখির মতো। কিন্তু বেশ বড়,” সে সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচিয়ে ভালভাবে দেখার চেষ্টা করছে।

“শকুন”, জুডিথ চোখ বড় বড় করে দেখল। যখন সে দেখল যে একসাথে থাকা বড় কালো বস্তুটা ভেঙে কয়েকটা পাখি হয়ে গিয়েছে, তখন জুডিথ-এর হার্ট প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হলো।

এরপরই অ্যান কয়েকটা সিংহ দেখতে পেল। অ্যানও ভয়ে জুডিথ-এর মতো বরফ হয়ে যেতে শুরু করল।

তাদের দুজনের পা যেন মাটির সাথে আটকে আছে। একটুও নড়াতে পারছে না।

একটা সিংহ মাথাটা ঘুরিয়ে দুটো শকুনের দিকে হুঙ্কার দিচ্ছে, কারণ শকুন দুটোও তাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। শকুন দুটো একটু দূরে সরে গেল-যদিও বেশিদূর না। জুডিথ এক-দুই করে পাঁচটা পর্যন্ত সিংহ গুনতে পারল। কিন্তু ঘাসের মধ্যে আরও দুই একটা শুয়ে থাকতে পারে যেগুলো হয়তো দেখা যাচ্ছে না।

“তারা তাদের নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। তারা যেন কিছুতেই আমাদেরকে দেখতে না পায়।” জুডিথ অনেক আশা নিয়ে কথাটা বলতে থাকল। একটা বুশবাক এবং ছোট কুড়ুর মৃতদেহ নিচে পড়ে আছে। সিংহদুটো তাদের মাংস টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এখনো বেশ অনেকটা মাংস বাকি আছে। “খাও ভালমত খাও। এতটা ভালভাবে যেন নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়,” অ্যান সিংহগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে।

জুডিথ এবং অ্যান দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাদের যাত্রা চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের খাবার পানি প্রায় ফুরিয়ে আসছে। শরীর বেয়ে ঘাম চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। অ্যান-এর সাদা শরীর লাল হয়ে যেন ফোঁসকা পড়ে যাচ্ছে তবুও অ্যান কোনো কথা বলছে না।

যেতে যেতে একসময় তারা একটা উঁচু জায়গার পাশ দিয়ে চলা শুরু করল। উঁচু জায়গাটা যেখানে ডানদিকে মোড় নিয়েছে সেখানে তারা একটা ঝর্নাধারা দেখতে পেল। আনন্দে ভরে উঠল তাদের মন। তারা ফ্লাক্স ভর্তি করে পানি নিল।

“আমরা এখানে ক্যাম্প বানাতে পারি। এখানে খাবার পানিও আছে,” অ্যান বলল।

“না”, জুডিথ তার মাথা নাড়াল। “ওদিকে তাকিয়ে দেখ।” জুডিথ দক্ষিণ দিকে হাত উঠিয়ে বলল যেদিকে ঝরনাটা অনেক চওড়া হয়ে গিয়েছে। সেদিকে একডজন বা তারও বেশি সরীসৃপ জাতীয় বন্য প্রাণী পানি পান করছে। জুডিথ এবং অ্যান যতটা তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি পান করছে ওরাও ঠিক ততটা পিপাসা নিয়েই পান করছে। “চিতাবাঘ কিংবা সিংহ যেকোনো সময় এই প্রাণীগুলোর খোঁজ পেয়ে এখানে চলে আসবে। তাই এই জায়গাটা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।”

এত কষ্টের ভেতরেও অ্যান মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। “ওয়েস্টবেরীতে থাকলে আমাদেরকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হত না।” “আমার মায়ের বিশাল টম ক্যাট সবকিছু একাই সামাল দিয়ে দিত।”

অ্যান-এর কথা শুনে জুডিথও না হেসে পারল না।

তারা যখন তার বানানো শেষ করল তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। জুডিথ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আগুন জ্বালাবে। যদি সিংহের ভয় না থাকত সে কখনোই এই ঝুঁকিটা নিত না। তাছাড়া সে আর আন অনেকটা সময় ধরে সামনে এবং পেছনে তাকিয়ে দেখেছে কোথাও মুখোশ পরা লোকটার চিহ্ন দেখা যায় কি-না। কিন্তু তারা কোনো চিহ্ন দেখতে পায় নি।

জুডিথ মৃত পর্তুগীজ সৈন্যটার কাছ থেকে ধনুক এবং তরবারি নিয়ে এসেছে সেগুলোর সাহায্য নিয়ে কোনোভাবে একটা পাখি শিকার করল। সেই পাখির চামড়া ছাড়িয়ে মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়ার ব্যবস্থা করল। জুডিথ মাটিতে বেশ খানিকটা গর্ত করে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে যেন আগুনের আলো বেশিদূর না যায়। সেই সাথে আগুনের চারপাশটা ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেয়ার ব্যবস্থা করল।

“কী অদ্ভুত কাণ্ড দেখেছেন, ছোট্ট একটু আগুন চারপাশটাকে কেমন জীবন্ত করে তুলেছে,” অ্যান বলে উঠল। তার মুখের হাসিটা আগুনের আলোতে জ্বলজ্বল করছে। বন্য পোকামাকড়ের গুনগুন শব্দে চারপাশটা মুখরিত হয়ে উঠেছে। জুডিথের মনে হচ্ছে সে আগুন জ্বালিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছে।

তারা বিভিন্ন গাছ থেকে সংগ্রহ করা ফলমূল খেতে থাকে। জুডিথ অ্যানকে বলে যে এটার নাম হচ্ছে মাঙ্কি বেড। এরপর জুডিথ কিছু রেখে দেয়া খাট গাছের ছাল চিবুতে থাকে। কিন্তু সেগুলো জুডিথকে জাগিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো।

আগুনের শেষ শিখাটা নিভে যাওয়ার পরও অনেকটা সময় বাকি ছিল সূর্য উঠার।

আর ঠিক তখুনি হায়েনারা এলো।

*

দ্বিতীয় দিনের মতো তাদের পিছু ধাওয়া করা শেষ হয়েছে। জুমু নামে বুজার্ডের ব্যক্তিগত দাস বুজার্ডের শুষ্ক মুখে পানি তুলে দিচ্ছে। শুধু এই সময়টাতেই বুজার্ডকে খুব অসহায় মনে হয়। জুমু এটা জানে। অন্য সময় বুজার্ড যতই তার ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন এ সময় সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। পানি পান করার শত ইচ্ছে থাকার পরও সে পানি পান করতে পারে না যদি না কেউ তার মুখে তুলে দেয়। এই সময়টা তার সাথে কথা বলার জন্য বা কোনো অনুরোধ করার জন্য উপযুক্ত সময় নয়। কিন্তু মুটে দুজন জুমুকে কথা বলার জন্য এতবার করে প্ররোচনা দিতে থাকে যে জুমুর আর কিছুই করার থাকে না।

“মাস্টার, সে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে। সুবিধার ব্যাপার এই যে নল মুখে নিয়ে বুজার্ড পানি পান করা শুরু করলে অনেকক্ষণ যাবত কথা বলতে পারবে না। এই সময়ের মধ্যে কথাটা বলে ফেলা যাবে। “আমাকে মাফ করবেন। কিন্তু আমি আমার ভাইদের হয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমরা সেই মেয়েটার খুব কাছাকাছি রয়েছি। আমরা যদি আরও একটু সামনে এগিয়ে যাই তবে এই অন্ধকারেও আমরা তাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।”

বুজার্ড তার মাথা ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। “তুমি বলছ, আমরা তাদেরকে হয়ত খুঁজে পাব?”

“হ্যাঁ, মাস্টার।”

“যদি তাকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তখন?”

“মাস্টার, ভবিষ্যতে কী ঘটবে এটা বলাটা অসম্ভব। সেটা ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ীই হবে। কিন্তু আমার এমনটাই মনে হচ্ছে।”

“তোমার কী মনে হচ্ছে না যে তাদেরকে সকালে খুঁজে বের করাটা আরো সুবিধাজনক হবে?”

“হ্যাঁ, মাস্টার।”

“তাহলে আমরা তা-ই করব। এখন কালো বেলুনের মতো আমার সামনে বকবক না করে খাবারের ব্যবস্থা কর, যাও।”

জুমু তার মনিবের জন্য নরম খাবার প্রস্তুত করতে চলে গেল।

কয়েক ঘণ্টা পর সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। দেখল যে বুজার্ড গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। তার কাঁধ ঝাঁকিয়েও তাকে জাগানো যাচ্ছে না। অবশেষে দানবটা ঠোঁট ঘুরিয়ে জ্বলন্ত চোখে জুমুর দিকে তাকাল।

বুজার্ড কথা বলার পূর্বেই জুমু দ্রুত বলে উঠল। “মাস্টার! মাস্টার! আমাদের এখনই যেতে হবে…সেই মেয়েটা!”

“তুমি কী বলতে চাইছ?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করল।

“শুনুন, মাস্টার! কান পেতে শুনুন।”

বুজার্ড কিছুক্ষণ চুপ করে শোনার চেষ্টা করে। এরপরই সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। উঠ! উঠ!…সবাই তৈরি হও। সে চিৎকার করতে করতে তার তলোয়ার হাতে নেয় এবং রাতের অন্ধকারের ভেতর দৌড়াতে শুরু করে।

.

দুটি হায়েনার গোঁ গোঁ আওয়াজ এবং হুঙ্কারে জুডিথ জেগে উঠে। এত বড় হায়েনা জুডিথ-এর পূর্বে কখনও দেখেনি। সে এবং অ্যান যেখানে শুয়ে আছে। তার সামনেই হায়েনা দুটো উত্তেজিত হয়ে সামনে পেছনে লাফাচ্ছে। হায়েনা দুটোর উত্তেজনা দেখে জুডিথ-এর রক্ত প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।

অ্যান জেগে উঠে হায়েনা দেখে চিৎকার করে উঠে, “দূর হ এখান থেকে।” সে হামাগুড়ি দিয়ে পেছনে যেতে থাকে। “দূর হ এখান থেকে শয়তান।”

তার এই চিৎকার বা ধমক হায়েনাগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়া তো বহু দূরের কথা বরং সেগুলোকে আরও উত্তেজিত করে তুলল। সেগুলো রাগে গজরাতে থাকল।

ভয়ে এবং শীতে কাঁপতে কাঁপতে জুডিথ আগুনের দিকে এগিয়ে গেল। সে একটা কাঠি তুলে ছাইগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে কিন্তু সেটাতে সে কোনো অঙ্গার দেখতে পায় না।

“ওদেরকে গুলি করুন,” অ্যান চিৎকার করে উঠল। “একটাকে গুলি করলে অন্যটা পালিয়ে যাবে।”

কিন্তু আগুনের শিখা ছাড়া হাত বন্দুকটা একদম অকেজো; ওটার ম্যাচ কর্ড-এ আগুন না ধরালে শুট করা যায় না।

সে তার কোমড়ে গুঁজে রাখা চামড়ার থলেটা হাতে নিয়ে সেটা থেকে পাথরের টুকরা এবং স্টীলের পাতটা বের করে আনল। হাঁটুর ওপর পাতটা রেখে পাথর দিয়ে ঘষে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করতে লাগল সে।

আগুনের গন্ধ তার নাকে আসতে থাকে।

“তাড়াতাড়ি,” অ্যান বলে উঠল। জুডিথ আশপাশ থেকে দ্রুত কয়েকটা শুষ্ক খড়খুটো নিয়ে সেটার ওপর স্টীলের পাত এবং পাথর রেখে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাতাসে কয়েকটা স্ফুলিঙ্গ দেখা গেলেও সেটা আগুন জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

“জুডিথ, দয়া করে তাড়াতাড়ি করুন।”

অধিকাংশ হায়েনাই মানুষের সামনে আসলে ভীত হয়ে যায়। বিশেষত যেগুলোর গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। কিন্তু এগুলোর গায়ে ধূসর চামড়ার কোট পরানো আছে। তার ওপর গাঢ় বাদামি রঙের দাগ আছে। একটা হায়েনা অ্যান-এর খুব কাছাকাছি চলে এসে ওপর নিজ মাথা নাড়াচ্ছে আর হাসছে।

অ্যান চিৎকার দিয়ে উঠে। অ্যান-এর চিৎকারে জম্ভটা নড়ে উঠে কিছুটা পিছিয়ে যায়।

“ওহ, গড”, অ্যান কেঁদে ফেলল। “ও গড, আমাদেরকে সাহায্য কর।”

হঠাৎ রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বন্য চিৎকার শোনা যায়। জুডিথ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখার চেষ্টাও করল না। আসলে তাকিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজনও নেই। সে জানে প্রথম হায়েনা দুটি চিৎকার দিয়ে তাদের দলকে ডাকছে এই হত্যাযজ্ঞে যোগ দেয়ার জন্য।

পাথর ঘষতে ঘষতে জুডিথ-এর হাত কাঁপতে থাকে।

“আমরা মারা যাচ্ছি।” সে অ্যান-এর ফোপানো কান্না শুনতে পায়। এরপর… অবশেষে…বহুচেষ্টার পর একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ খড়খুটোর গায়ে লাগল। খড়খুটোর কুণ্ডলীটাকে সে হাতের ওপর উঠিয়ে নিয়ে ফুঁ দিতে শুরু করল। জুডিথ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দম আটকিয়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে।

“জুডিথ!”

পুরনো খড়খটোর মধ্যে অবশেষে আগুনের শিখা জ্বলে উঠল। আগুন দেখে হায়েনার দল কিছুটা পিছিয়ে পড়ল। জুডিথ মাথা তুলে আশেপাশে তাকাল কিন্তু অ্যানকে দেখতে পাচ্ছে না সে। দুই ডজন কিংবা তারও বেশি হায়েনা অ্যান-এর আশেপাশে পাক খাচ্ছে। ছাই-এর পাশে আরেকটা ছোট কাঠি পড়ে আছে। কিন্তু এটা দিয়ে আগুনকে বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখা যাবে না।

কিন্তু জুডিথ-এর কাছে এখনো হাত বন্দুকটা রয়েছে।

“ঈশ্বর আমাদের সাহায্য কর,” জুডিথ মনে মনে এই প্রার্থনা করতে থাকে। এরপর সে হাত বন্দুকে আগুন লাগানোর ম্যাচ কর্ডটাকে আগুনের শিখায় ধরল। একই সাথে হাত বন্দুকটা এবং পাউডার ফ্ল্যাক্সটা শক্ত হাতে তুলে নিল। হাতবন্দুক-এর প্রিমিং প্যানটা খুলে ফেলে ফ্ল্যাক্স-এর স্টপারটা দাঁত দিয়ে টেনে ধরে যথেষ্ট পরিমাণ পাউডার প্যান-এর মধ্যে ঢেলে দিল। এরপর প্যান-এর কভার লাগিয়ে অতিরিক্ত পাউডার সরিয়ে ফেলল, তারপর সে হাত বন্দুক-এর বাটটা মাটিতে রেখে সেটার মাজুল-এ পাউডার প্রবেশ করালো।

“আমি আসছি, অ্যান”, সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কিছু ঘাস হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে নিল। এরপর সেই ঘাসগুলো মুখে দিয়ে চিবাতে থাকল। তাকে যেহেতু নিচের দিকে তাক করে গুলি করতে হবে তাই শুট করার আগেই গুলিটা বন্দুক থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। আর তাই শুট করার আগ পর্যন্ত গুলিটাকে ওখানে ধরে রাখার জন্য কিছু একটা দরকার। চিবানো ঘাসটা মুখ থেকে বের করে মাজল-এর মুখ আটকে দিল জুডিথ, যাতে শুট করার আগ পর্যন্ত বুলেটটা ব্যারেল থেকে বেরোতে না পারে।

“ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও”, অ্যান জুডিথকে অনুনয় করে বলতে থাকে। জুডিথ জ্বলতে থাকা কাঠিটাকে বন্দুকের স্টক-এ লাগিয়ে গুলি করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করল। বন্দুকটা নিজের বুকে ঠেকাল সে। কিন্তু সমস্ত গান পাউডার ঢেলে দেয়ার ফলে একবারই সে গুলি করতে পারবে। আরেকবার গুলি করার জন্য বন্দুকটাকে হয়ত সে প্রস্তুত করার সময় পাবে না।

“ওর চিন্তা বাদ দাও! জন্ম না নেয়া বাচ্চাটা যেন জুডিথ-এর পেটের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠে। আমরা হয়ত একবারই গুলি করার সুযোগ পাব। ওই মেয়েটার জন্য সেটা নষ্ট করো না। এটা রেখে দাও। তাকিয়ে দেখ হয়েনাগুলো আমাদের দিকেও এগিয়ে আসছে।

জুডিথ আবারও অ্যান-এর দিকে তাকায়। ওর চারপাশে হায়েনাগুলো ঘোরফেরা করছে। কোনোটা তার শক্ত থাবা অ্যান-এর গায়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছে আবার কোনোটা পিছিয়ে আসছে।

সে ক্যাম্পের মধ্যে ম্যাচকর্ডটা ঠিকমত লাগিয়ে টিগার ধরে টান দেয়। এরপর চোখের দৃষ্টিতে দূরত্ব মাপতে থাকে।

“দূর হ।” সে চিৎকার দিল। “দূর হ।” একপা সরে গিয়ে জুডিথ তার খুব কাছের হায়েনাটার দিকে ব্যারেল তাক করল। সে তার বন্দুকটাকে চারদিকে ঘুরিয়ে হায়েনাগুলোকে সরে যেতে হুমকি দিল যদিও সে গুলি ছুড়ল না।

এখনো পর্যন্ত গুলি ছুঁড়েনি জুডিথ। সে আবারো অ্যান-এর দিকে তাকায়। অ্যানের দিকে এগিয়ে আসা সবচেয়ে বড় হায়েনাটার দিকেই তার নজর। এটাই নিশ্চয়ই দলনেতা। সে যদি এটাকে হত্যা করতে পারে তাহলে বাকিগুলো নিশ্চয়ই পালিয়ে যাবে।

“কিন্তু তুমি যদি ব্যর্থ হও? পেটের বাচ্চা আবারও বলে উঠল। তখন কী ঘটবে?”

“হত্যা করুন”, অ্যান চিৎকার করে উঠল। “এটাকে গুলি করুন।”

জুডিথ বন্দুকটা তার কাঁধের ওপর রেখে বড় হায়েনাটার দিকে তাক করল। সে জানে তার পেছনেও হায়েনাগুলো ওত পেতে আছে। হায়েনাগুলো সবখানেই আছে। এরা চারদিকটা ঘিরে ফেলেছে। জুডিথ হায়েনাগুলোর নিঃশ্বাস অনুভব করছে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস ভেদ করে গরম বাতাস এসে জুডিথ-এর গায়ে লাগছে।

কিন্তু বড় হায়েনাটা এক জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে নেই। এখানে সেখানে ঘুরছে ওটা। তাই সেটার দিকে লক্ষ্য স্থির করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“এই দিকে তাকা, শয়তান”, জুডিথ তার মাতৃভাষা অ্যামহারিক-এ চিৎকার করে উঠল। এই দিকে তাকিয়ে দেখ তোর জন্য কী অপেক্ষা করে আছে।” সে এবার অ্যানকেও দেখতে পাচ্ছে। অ্যান-এর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখে ভয়ের আতঙ্ক উপচে পড়ছে। ঠিক তখনই সে পায়ের নিচে কিছু একটা অনুভব করল। নিচে তাকিয়ে দেখল যে অ্যান-এর ফ্ল্যাক্সটা নিচে পড়ে আছে। সেটা নিচের থেকে তুলে সমস্ত শক্তি দিয়ে বড় হায়েনাটার দিকে ছুঁড়ে মারল।

হায়েনাটা গর্জন করে তার দিকে ফিরে তাকাল।

এটাই জুডিথ চেয়েছিল। তার হার্টবিট বাড়তে থাকে। সে জানে এর চেয়ে ভাল সুযোগ সে হয়ত আর নাও পেতে পারে। তাদের ভাগ্যের চাকা হয়ত ঘুরেও যেতে পারে। এ যাত্রায় হয়ত তারা বেঁচেও যেতে পারে। ইতোমধ্যেই বন্দুকের টিগারে জুডিথ-এর আঙুলগুলো বাকা হতে শুরু করেছে।

ঠিক তখন অ্যান তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। দৌড় দিল মেয়েটা।

হায়েনাটা তার পিছু পিছু যেতে থাকে। “না,” জুডিথ চিৎকার করে উঠল, এরপর টিগার-এ টান দিল। বন্দুকটা গর্জে উঠল সাথে-সাথে।

অন্ধকার ভেদ করে আগুনের গুলি এগিয়ে যেতে থাকে। আগুন দেখে হায়েনাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তারপরও জুডিথ-এর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ অ্যান দৌড় দেয়ার ফলে তার স্থির লক্ষ্যবস্তু চলন্ত লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাই সে ব্যর্থ হয়। সে দেখতে পায় হায়েনাটা দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় অ্যান-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, এরপর বাম উরুতে কামড়ে ধরল শক্ত করে। অ্যান-এর চিৎকার হায়েনাগুলোর গর্জন এবং হুড়োহুড়ির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। বন্দুকের গর্জন ভুলে গিয়ে হায়েনাগুলো তাদের দলনেতাকে অনুসরণ করা শুরু করে দিল।

জুডিথ বন্দুকটা হাতে নিয়ে ব্যারেলটা দুহাত দিয়ে ধরে হায়েনাটার পেছনে তীব্রভাবে আঘাত করল। সেটা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে অ্যানকে ছেড়ে দিয়ে জুডিথ-এর দিকে তাকায়। বাকি হায়েনাগুলো অ্যান-এর রক্তের নেশায় মগ্ন হয়ে আছে। সেগুলোর সমস্ত মনোযোগ এখন অ্যান-এর দিকে। একটা প্রাণী ভিড়ের মাঝ থেকে মুখ তুললে জুডিথ দেখতে পায় সেটার মুখে রক্ত লেগে আছে।

“ওর কথা ছেড়ে দাও,” পেটের শিশুটি আবার বলতে শুরু করে। “আমাদের আর কিছুই করার নেই। কিন্তু আমরা যদি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকি তবে আমাদেরকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে এরা।”

“হেল্প মি”, এখনো অ্যান-এর চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

অ্যান-এর চারদিকে হায়েনাগুলো একটা ক্ল্যান তৈরি করে ফেলেছে। জুডিথ তার এই জীবনে অনেক যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখেছে। কিন্তু কোনোটাকেই এটার সাথে তুলনা করা যায় না। হঠাৎ তার বমি বমি ভাব শুরু হলো। সে বাঁকা হয়ে ঘাসের ওপর বমি করে দিল। একটা হায়েনা তার বমির গন্ধে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। সে বন্দুকটা দিয়ে হায়েনাটাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু হায়েনাটার মনোযোগ তার দিকে না, মাথা নিচু করে হায়েনাটা ঘাসের ওপর থেকে বৃমি চেটে চেটে খাচ্ছে।

ঠিক তখনই একটা তলোয়ার এসে হায়েনাটার মাথা ভেদ করে দিল। হায়েনাটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। জুডিথ মাথা ঘুরিয়ে দেখে যে মুখোশ পরা লোকটা এসে উপস্থিত হয়েছে ওখানে।

“ওকে সাহায্য কর”, জুডিথ বলতে থাকে।

জুডিথ এবং হায়েনার মাঝে এসে দাঁড়াল তলোয়ার হাতে লোকটা। এরপর অন্যান্য পর্তুগীজ নাবিক এবং দুজন উপজাতি জুডিথকে রক্ষা করার জন্য রুখে দাঁড়াল। জুডিথ চিৎকার করে উঠল, “কেউ ওকে সাহায্য কর,” ঈশ্বরের দোহাই লাগে কেউ ওকে বাঁচাও।”

মুখোশ পরা লোকটা কোনো কথাই বলল না। সে তার মাথাটা ঘুরিয়ে তাদের সামনে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার দিকে তাকিয়ে দেখছিল।

“তোমার তলোয়ারটা আমাকে দাও,” “আমি ওকে সাহায্য করব,” জুডিথ বলল।

লোকটি আড়চোখে জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মুখ বন্ধ করে শুধু দেখে যাও।” এরপর সে একজন নাবিককে ইশারা করল জুডিথ-এর হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেয়ার জন্য।

একটা হায়েনা লাফ দিয়ে অ্যান-এর বাহুতে কামড় দিয়ে ধরেছে। হায়েনাটার ভারে অ্যান চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। জুডিথ শেষবারের মতো আকুতিভরা অ্যান-এর চোখদুটো দেখতে পায়। এরপর সব শেষ হয়ে যায়, “প্লিজ।” জুডিথ কাঁদতে থাকে। কিন্তু সে জানে এখন আর কোনো আশা ভরসাই নেই। হায়েনাগুলো তাকে জীবন্ত খেয়ে ফেলল। জুডিথ হায়েনাগুলোর মুখের কচুমচ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত না মুখোশ পরা লোকটা সবাইকে যাওয়ার জন্য আদেশ করল ততক্ষণ পর্যন্ত সে তাকিয়েই রইলো।

“আপনার ভাগ্য ভাল যে, আমাদের একজন আপনার বন্দুকের আগুন দেখতে পেয়েছিল, “ধূসর দাঁড়িওয়ালা অফিসারটা বলল। নয়ত ওই শয়তানগুলো আপনাকে এবং আপনার পেটের সন্তানকে খেয়ে ফেলত। জুডিথ কিছু বলল না। এ মুহূর্তে তার বলার মতো কোনো কথা নেই। সে শুধু হাতদুটো তার পেটের ওপর রাখল। সে হাত দিয়ে পেটের ওপর চাপ দিতে থাকে যেন সে বাচ্চাটার হাত-পা ছুঁড়ে নিশ্চিত হতে চাচ্ছে যে বাচ্চাটা এখনো নিরাপদে আছে।

যদিও তার মন এই নির্ভরতা মেনে নিতে চাচ্ছে না। প্রতিটা ইন্দ্রীয় তাকে বলছে যে এ পর্যন্ত সে যত কষ্ট ভোগ করেছে সেই কষ্টগুলো সামনে এগিয়ে আসা কষ্টের তুলনায় কিছুই না।

*

হাল সময়ের নিশানা হারিয়ে ফেলেছে। সে এখন বলতে পারবে না যে কতটা সময় তারা দ্বীপের ভেতর দিয়ে হেঁটেছে। যদিও সে স রাতের বেলা চাঁদের আলোর দিকে খেয়াল রাখতে পেরেছে। চাঁদের আবার দুই তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। এ থেকে সে ধারণা করতে পারল যে প্রায় তিন সপ্তাহ যাবত তারা সামনের দিকে এগুচ্ছে।

সামনে এগুতে এগুতে তারা ভূমির ওপর বড় বড় গ্রানাইট পাথর দেখতে পায়, পূর্বদিকে বড় বড় পাহাড়ও তাদের নজর এড়ায়নি। তারা বুঝতে পারে যে তারা মিয়েম্বো ফরেস্ট-এ পৌঁছে গিয়েছে।

মাঝে মাঝে রাতের বেলা বৃষ্টি তাদের পথ রুখে দাঁড়ায়। তারা তখন গাছের ডালপালা দিয়ে অস্থায়ী তাবু বানিয়ে আশ্রয় নেয়। আগুন ছাড়া তারা কখনোই বিশ্রাম নিত না কারণ বহুদূর থেকেও বন্য পশুপাখিরা আগুনের গন্ধ পায়, ভয় পায়।

“শুধু সিংহ বাদে,” অ্যাবোলি তাকে একসময় বলেছিল। “সিংহ ক্যাম্প ফায়ার-এর কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করে দেখার চেষ্টা করে যে সেখানে কী ঘটছে?”

যদিও বেশ গরম পড়েছিল তবুও চাঁদ এবং তারার আলোতে রাতের পরিবেশ ভালই দেখা যাচ্ছিল। তখন তারা স্বর্গীয় এসব জিনিসের মহত্ত্ব বুঝতে পারছিল। একদিন সকাল বেলা দেখতে পায় হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা লেক-এর ধারে চলে এসেছে। যদিও শুকনো মৌসুমের কারণে পানি নিচে নেমে এসেছে, ফলে জায়গাটা বন্য জলহস্তীদের জন্য বেশ ভাল আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে। লেক-এর ধারে কুমিরও রয়েছে। এরা সম্ভবত ঊষালগ্নে সূর্যের তাপ সেবন করার জন্য জল থেকে উঠে এসেছে। এগুলোকে আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে খুব একটা সংবেদনশীল মনে হচ্ছে না। যখন সাদারঙের এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে দক্ষিণ দিকে উড়ে যায় তখন কুমিরগুলো পানিতে নেমে আসে।

অবশেষে কাপেলো ক্যাম্প বানিয়ে রাতটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। হাল এবং অন্যান্য দাসের হাতের শেকল আলগা করে দেয়া হয় যেন তারা কাজ করতে পারে। ক্যাম্পের চারপাশে শক্ত বেড়া প্রস্তুত করতে বলে যেন অকস্মাৎ শিকারীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আরও সুরক্ষার জন্য তারা ক্যাম্প ফায়ার প্রস্তুত করে। মোটা লোকটার মনের ভাব এখনো খুব একটা ভাল মনে হচ্ছে না। তাই দেখে একজন গার্ড জিজ্ঞেস করে বসলো, “আপনার কী হয়েছে সেনোর?”

“আমাদের কেউ অনুসরণ করছে,” কাপেলো জবাব দিল।

“আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন, স্যার?” গার্ড প্রশ্ন করল। “আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।”

“কেউ আমাদের পেছনে আসছে এটা বোঝার জন্য কাউকে দেখার প্রয়োজন নেই।”

ওদের থেকে দশ গজ দূরে অ্যাাবোলি তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন পূর্বেই সে কৃতদাসদের এই সারিটাকে খুঁজে পেয়েছে। এখন আক্রমণ চালিয়ে কাপেলোর দলবল এবং গার্ডদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়া কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তারপর কী ঘটবে?

শুধু হালকে উদ্ধার করাই যথেষ্ট নয়। জুডিথকেও উদ্ধার করতে হবে। অ্যাবোলি এরইমধ্যে তার দুজন লোককে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল। তারা জানিয়েছে যে খনি এখান থেকে প্রায় একদিনের পথ। তারা একজন রমণীসহ আটজনের একটা দল খুঁজে পেয়েছে যারা ঐদিনই খনিতে পৌঁছেছে।

আর একদিনের মধ্যে হাল এবং জুডিথ একই জায়গায় পৌঁছাবে। তখনই তাদেরকে উদ্ধার করার উপযুক্ত সময়। ততক্ষণ পর্যন্ত অ্যাবোলি তার উপস্থিতি গোপন রাখছে। হালকে আরও কিছুটা সময় দাস হয়ে জীবনযাপন করতে হবে-যত কষ্টই হোক না কেন।

.

বুজার্ড এবং জুডিথ কোনো ব্যাপারে একমত হয়েছে খুব কমই। যদিও কেউ কোনো কথা বলছে না তবুও তারা জানে যে অপরজনের মনেও ঠিক একই প্রশ্ন উদয় হয়েছে : “এটাই কী বালথাজার লোবো?”

এই কী সেই ব্যক্তি যে আফ্রিকার বুকে নিজের রাজত্ব তৈরি করেছে? পাহাড়ের নিচে সোনা খুঁজে পেয়েছে এবং দাসদেরকে কিনে এনে বাধ্য করছে সোনার খনিতে কাজ করার জন্য? জুডিথ ভেবেছিল লোবো হয়ত কোনো শক্ত সামর্থ্য মোটাসোটা, দেখতে বিদঘুঁটে ধরনের লোক হবে। তার বদলে চিকন পাতলা রোগা একটা মানুষকে দেখতে পেল সে। লোবোর নিচের চোয়ালটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। জুডিথ তার ইউরোপ ভ্রমণের সময় হাবসবার্গ বংশের লোকদের গল্প শুনেছে যারা বিভিন্ন সময় স্পেইন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া এমনকি সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেছে। এই বংশের লোকেরা সামনের দিকে বাড়ানো কুৎসিৎ রকমের নিচের চোয়ালের জন্য বিখ্যাত ছিল। লোবো হয়ত সেই হাবসবার্গ লাইনের কোনো জারজ সন্তান। বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যই হয়তো বা আফ্রিকায় এসে ঘাঁটি বসিয়েছে।

“তা হলে,” জুডিথ-এর দিকে বেশ সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলা শুরু করল লোকটা। জুডিথ দেখতে পায় লোকটার মুখের কোণা থেকে একটা চিকন লালা গড়িয়ে পড়ছে। “তুমিই তাহলে সেই সুন্দরী রমণী যে আমার পরবর্তী বউ হতে যাচ্ছ? কিন্তু এতটা রাস্তা ভ্রমণ করে আসার ফলে তোমাকে খুব একটা ভাল দেখাচ্ছে না। তুমি ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নাও প্রিয়তমা। তোমার ঘর প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। তোমার জন্য বিয়ের পোশাক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এটা এর পূর্বে মাত্র দুবার ব্যবহার হয়েছে। তোমার ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হবে। যাও আজকের মধ্যে গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত কর। বিশ্রাম নাও ইচ্ছেমতো। কাল সকালে প্রস্তুত হয়ে আমার সামনে হাজির হবে। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নেব যে তোমাকে নিয়ে কী করা যায়।”

সে পুনরায় জুডিথ-এর ওপর দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। জুডিথ হঠাৎ করেই বুঝতে পারল যে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ইচ্ছে পূরণের জন্য কতটা বল প্রয়োগ করতে পারে এই লোক, সেই সাথে কতটা নির্মম হতে পারে।

“হুম,” সে তার মাথাটা একপাশে বকিয়ে দেখতে থাকে। “বেশ সুন্দর বুক, গোলগাল পেট, পাগুলো বেশ চিকন। আচ্ছা, তুমি আবার গর্ভবতী নও তো, মেয়ে?”

জুডিথ কিছু বলল না।

“সে গর্ভবতী কি-না তাতে কী এসে যায়?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করল। আমি ব্যাপারটা নিয়ে হাইপোথিটিক্যালভাবে কথা বলছি। ধরুন সে কোনো সাদা লম্বা কোনো ইংরেজের বাচ্চা পেটে ধরেছে। ধরুন আপনার বিয়ের পর সে সেই বাচ্চার জন্ম দিল। তাহলে সেই বাচ্চা আপনার হবে। আপনি তার পেটে বীজ বপন করেছেন কি-না সেটা কী বড় কোনো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে?”

লোবো জুডিথ-এর আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখতে থাকে, এরপর বলে উঠল, “না, আমার তা মনে হয়না। ভালভাবে ঘুমাও ইয়ং লেডি, তুমি কালকে তোমার সেরাটাই আমাকে দেখাবে।”

*

অ্যামাডোডারা নিচের দিকে তাকিয়ে বালথাজার-এর লোকদের বাসস্থান দেখছে, যেখানে থেকে লোবো তার বাসস্থান গড়ে তুলেছে। তার বাড়িটা অনেকটা গভীর চারকোণা জায়গায় গড়ে উঠেছে। দেয়ালগুলো বেশ চওড়া করে মাটি দিয়ে উঠানো হয়েছে। দেয়ালগুলোতে কোনো জানালা নেই এবং উচ্চতা প্রায় একজন মানুষের উচ্চতার দ্বিগুণ। বাড়ির ভেতর দিকটায় বেশ খানিকটা খোলা জায়গা রয়েছে যেখানে নানা ধরনের উজ্জ্বল ফুলের বাগান আছে। “সে নিশ্চয়ই জুডিথকে ওখানে নিয়ে গেছে, অ্যাবোলি মনে মনে চিন্তা করে দেখল।

অ্যাবোলি অনুভব করল যে কেউ একজন তার পিঠে টোকা দিচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেল যে তার একজন সঙ্গী হাত দিয়ে নিচের দিকে ইশারা করে দেখাচ্ছে। কয়েকজন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সাদা চামড়ার একজন মোটাসোটা লোক লোবোর কমপ্লেক্স-এ প্রবেশ করছে। অ্যাবোলি নিশ্চিত যে এই লোকটিই কাপেলো এবং ওদের মাঝে যে সাদা চামড়ার দাসটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই হচ্ছে হাল কার্টনি।

“আই সি ইউ, গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি বলে উঠল। এই কথাটার অন্যরকম একটা অর্থ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার লোকজন একে অন্যের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় “আই সি ইউ”, কথাটা ব্যবহার করে। আর একটু ধৈর্য ধর ক্যাপ্টেন, তোমার কাছে পৌঁছাতে আর বেশি দেরি নেই।”

এরপর অ্যাবোলি আরো একটা জিনিস দেখতে পায়। সেটা দেখার পর সে নিজে নিজে ফিসফিস করে উঠে, “ফারো?”

.

সেদিনের সূর্য উঠার পর কাপেলো তার দাসদের সবকিছু বুঝিয়ে বলে। তারা কোথায় যাচ্ছে, কে তাদের নতুন মনিব হবে, মনিবের কথা অমান্য করলে তাদেরকে কী শাস্তি দেয়া হবে ইত্যাদি। দাসদের সারি যখন খনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন হালও একটা সাদা রঙের দুর্গ দেখতে পেল। এটাই সেই লোবোর বাসস্থান। এটা থেকে সে যেমন দাসদের সামনে উন্মুক্ত করেছে ঠিক তেমনি দাসরা যদি কখনো বিদ্রোহ করে তবে এই দুর্গই তাকে রক্ষা করবে।

সামনে এগিয়ে যেতে যেতে তারা একটা প্রবেশপথ অতিক্রম করে। প্রবেশপথটার নিচের দিকে বার ফিট গভীর এবং বিশ ফিট চওড়া আর অনেকটা প্রাসাদের চারদিকে গভীর পরিখার মতো আছে। তারা দেখতে পায় এই পরিখাঁটি অতিক্রম করার জন্য দুটি রাস্তা রয়েছে। একটি হচ্ছে রশি দিয়ে টানানো ব্রিজ যেটার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য খুবই সরু একটা রাস্তা রয়েছে। অন্যটি হচ্ছে প্রাসাদের গেট থেকে ঝুলানো একটা সিঁড়ি যেটা পুনরায় টেনে উঠিয়ে ফেলা যায়।

হাল ভ্রু কুঁচকে গোলকধাঁধার ন্যায় দুর্গটার দিকে তাকায়। যদিও দুৰ্গটার চারপাশে গভীর পরিখা খনন করে রাখা হয়েছে তবুও এটা বেশ বিপজ্জনক। শিকারী চিতাবাঘ কিংবা সিংহ যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে। লোবো সম্ভবত হাতি পোষ মানিয়ে রেখেছে। হাল জানে বহুবছর ধরে হাতি আনুষ্ঠানিক কাজে কিংবা সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। কিন্তু যদি তাই হয়, তবে কোথাও ওগুলোকে দেখা যাচ্ছে না কেন?

তখনই হাল পরিখার ধারে অদ্ভুত এক প্রাণী দেখতে পায়। দুটি শিংযুক্ত বিশাল আকারের, ধূসর চামড়াযুক্ত প্রাণীটা অপরিচিত মানুষের গন্ধ পেয়ে এখানে চলে এসেছে। দাসের সারি থেকে কয়েকগজ দূরে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক মাথাটাকে নাড়াচ্ছে।

কাপেলো হালকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “তুমি কী এই প্রাণীগুলোর মতো প্রাণী দেখেছ কখনো, ইংলিশম্যান?”

হাল হয়ত বহুবার দেখেছে এগুলোকে, কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের জ্ঞান জাহির করার চাইতে যতই নিজের অজ্ঞতাকে প্রচার করবে ততই তার জন্য মঙ্গলজনক।

“এটা হচ্ছে রাইনোসোরাস। যদিও এখানকার লোকেরা এটাকে বলে “ফারো।” কাপপলো তাকে আরও জানায়, “পৃথিবীতে সেনোর লোবোই একমাত্র ব্যক্তি যে কি-না রাইনোসোরাস বন্দি করতে পেরেছে। বহু মানুষ মারা গিয়েছে এটা ধরতে গিয়ে। কিন্তু যতদিন সেনোর লোবোর কাছে এই ফারো আছে ততদিন তার কথাই হচ্ছে আইন।”

কাপেলো জানোয়ারটার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে। “ওটার সামনের শিংটা বেশ বড়। লম্বায় একটা তলোয়ার-এর দ্বিগুণ। ওটা দিয়ে জানোয়ারটা যে কোনো মানুষকে কাবাবের ন্যায় টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। ওটার দিকে ভালভাবে তাকিয়ে দেখ এবং প্রার্থনা কর যেন তোমাকে কখনো ওটার নিচে পড়তে না হয়।”

কাপেলো হাল-এর শেকল ধরে টান দেয় যেন হাল এগিয়ে এসে কাপেলোর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। যখন তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে তখন কাপেলো নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে থাকে, “যদি কোনো দাস অবাধ্য হয়, যদি তার মনিবকে সম্মান না করে, যদি সে কঠোর পরিশ্রম করতে ব্যর্থ হয় তবে তাকে শুধু চাবুকই মারা হয় না। তাকে ঐ ঘেরাও করা পরীখার দিকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখান থেকে কেউ জীবিত ফেরত আসে না। তুমি কী আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”।

“হ্যাঁ, মালিক”, হাল জবাব দেয়।

“তুমি তার কথার অবাধ্য হবে না কিংবা নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করবেনা, বুঝেছ?”

“হ্যাঁ, মালিক।”

“আমার বুটটা চেটে পরিষ্কার কর ইংলিশ ম্যান”, কাপেলো বলে উঠল, এরপর তার পা-টা এমনভাবে বাড়িয়ে দিল যেন একজন বিশপ তার আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে।

হাল কাপেলোর কথার কোনো রকম প্রতিবাদ করার চেষ্টা না করে তাকে যা বলা হয়েছে তাই করল।

“চালিয়ে যাও। আমাকে অপমান করে তুমি যদি নিজেকে বড় মনে কর তবে তাই কর। আমি এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে টিকে ছিলাম”, হাল মনে মনে ভাবতে থাকে।

.

পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন প্রায় হেলে পড়ছে তখন তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে কীটগছি যুক্ত পথের ওপর দিয়ে হাঁটতে বলা হয়। দাসরা সেখানে কাঠের লরি ঠেলে একটা নালার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। লরিগুলোকে খনির ভেতর থেকে ধাতব পদার্থে ভর্তি করে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ধাতব পদার্থগুলোকে এরপর নালার ভেতর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এই নালা বা টানেল পাহাড়ের ভেতর দিয়ে অনেক দূর বয়ে গিয়েছে। টানেলের অন্যপাশ থেকে এই ধাতব পদার্থ অন্যদাসেরা আবার সংগ্রহ করছে। এরপর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে সোনাগুলো আলাদা করছে। এই কাজ চলার সময় কয়েকজন দাস মিলে জলন্ত কাঠের পাত্র বা জলন্ত কাঠ বয়ে বেড়াবে। এতে করে কর্মরত দাসরা আলোও পাবে এবং উষ্ণতাও পাবে।

এখানে সেখানে প্রত্যেক জায়গায় সাদা এবং কালো চামড়ার লোকেরা দাসদেরকে পাহারা দিচ্ছে। তাদের হাতে চাবুক, বন্দুক, ছুরি এবং নানা রকম অস্ত্র রয়েছে। তারা দাসদের কাজ দেখাশোনা করছে, সেই সাথে কেউ যেন সোনা নিজের পকেটে ভরতে না পারে সেদিকে নজর রাখছে।”

স্টকেড-এর ভেতরে লম্বা কাঠ দিয়ে তৈরি কতগুলো কুড়েঘর রয়েছে। দাসদের দলকে সেই কুড়েঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। এটাই হচ্ছে। তোমাদের থাকার জায়গা।” কাপেলো তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এটাই তোমাদের শেষ বাড়ি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তোমাদের এখানেই থাকতে হবে। শীঘ্রই তোমাদের শেকল খুলে দেয়া হবে। তারমানে এই নয় যে তোমরা মুক্ত। আমি তোমাদেরকে শেষবারের মতো মনে করিয়ে দিচ্ছি যে তোমরা কেউ যদি পালানোর চেষ্টা কর তবে সেটার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। শীঘ্রই তোমাদের খাবার দেয়া হবে। যতটা পার খেয়ে নাও। কারণ আগামীকাল সকাল পর্যন্ত তোমাদের কোনো খাবার দেয়া হবে না। বরং ঐ অবস্থাতেই সকাল বেলা তোমাদেরকে কাজে লাগিয়ে দেয়া হবে।”

এরপর তাদের হাত এবং গলা থেকে শেকল খুলে দেয়া হয়। কাঠের বাটিতে তাদেরকে তরল জাতীয় এক ধরনের মিশ্রণ খেতে দেয়া হলো। হাল কেপ কলোনীতে থাকার সময় এইটুকু শিখেছে যে শ্রমিকদের কখনো খাবার ফিরিয়ে দিতে নেই তা সে যতই খারাপ হোক না কেন। সেই সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে খাবার শেষ করে ফেলতে হয় যেন খাবারের বিস্বাদটা মুখে লেগে না থাকে।

কুড়েঘরের ভেতরে কোনো বিছানা বা কোনো বাঙ্ক দেখতে পেল না সে। শুধু প্রায় ছয়ফিট লম্বা দুটো কাঠের টেবিল রাখা আছে ওখানে। টেবিল দুটি ঘরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন তারা সেখানে উপস্থিত হলো, তখন জায়গাটা তাদের সবার জন্য অপ্রতুল মনে হচ্ছিল। কিন্তু এরপর যখন আরও পঞ্চাশ জন দাস প্রবেশ করে নতুন আগত দাসদের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নিতে থাকে তখন কুড়ে ঘরটার অবস্থা দাসভর্তি জাহাজের চেয়েও খারাপ মনে হচ্ছিল। হাল নিজেকে সরাতে সরাতে একেবারে দেয়ালের কাছে নিয়ে যায়। তার পাশের লোকটা তাকে এমনভাবে ধাক্কা দিতে থাকে যে একটি পেশিও নাড়াতে পারছে না সে।

কিন্তু এটাও তার কাছে কোনো ব্যাপার মনে হয় না। কারণ অবশেষে হাল সেই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে যেখানে তার জুডিথকে নিয়ে আসা হয়েছে। যদিও তাদের মাঝে এখন মাত্র কয়েকগজের দূরত্ব; কিন্তু হাল-এর মনে হচ্ছে দূরত্বটা কয়েক হাজার মাইলের। কিন্তু হাল এই দূরত্ব দূর করবে। হয়ত কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে, এমনকি কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে কিন্তু সে জুডিথকে উদ্ধার করেই ছাড়বে।

এসব চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে রেখে সে দুচোখ বন্ধ করে ফেলে। কেপ কলোনীতে থাকার সময় সে আরেকটা শিক্ষা লাভ করেছে তা হলো যেখানেই বা যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। বেচে থাকার জন্য ঘুম খাবারের মতই জরুরি।

.

বুজার্ড এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিবাদী বিয়ের পাত্রীর সম্মুখীন হয়েছে। “এই পোশাকটা পরে নিন, নয়ত…”

“নয়ত কী?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল। তুমি তোমার এক হাত দিয়ে কী করতে পারবে? আঘাত করবে? আমি তোমাকে এড়িয়ে যেতে পারব। তুমি কোনো দাসকে ডেকে আনবে চাবুক মারার জন্য? কিন্তু তাতে সেনোর লোলবার কাজের অপচয় হবে, যেটা সে হতে দেবে না। আমাকে হত্যা করবে? কিন্তু আমার মৃতদেহ থেকে তুমি কত টাকা আয় করতে পারবে?”

“এসব অনর্থক কথা বলা বন্ধ করুন। আপনি এখন কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই। শুধু বিছানা ছাড়া অন্য কোনো কাজে মাননীয় লোবোর নারীর প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটা দাসকে সে কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। যখন বিয়ের ঘণ্টা বাজানো হবে তখন তৈরি হয়ে নিচে নেমে পড়বেন। নয়ত আপনি আপনার ফল ভোগ করবেন।”

এরপর বুজার্ড চেয়ারে বসে পড়ল। আঙুল দিয়ে শব্দ করে তার দাসকে ডেকে বলল আরও ওয়াইন দিয়ে যাওয়ার জন্য। “তাহলে”, বুজার্ড উচ্চ স্বরে আবারও বলতে শুরু করল। “আর মাত্র একঘণ্টার মধ্যে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন জীবন বেছে নেবেন। মাননীয় লোবোর সাথে বিলাসী জীবন নাকি সেই নোংরা ব্রিটিশ দাসটার সাথে কঠিন জীবন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনার মনকে ঠিক করতে এতটা সময় লাগছে। আমি যদি আপনার জায়গায় হতাম তবে এমন বিলাসী জীবন পেলে বৃদ্ধ মাতাল লম্পটটাকে যা খুশি করতে দিতাম।”

দাসদেরকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তার প্রবেশপথে দুজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। তারা বিপরীত দিক থেকে হেঁটে একজন আরেক জনকে অতিক্রম করছে। অ্যামাডোডা সৈন্যরা একটু দূরে বাওবাব গাছের আড়ালে লুকিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের হাতে শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি তীক্ষ্ণ ছুরির ন্যায় অস্ত্র রয়েছে যেটাকে বলা হয় নবকেরি। গার্ডটা হাঁটতে হাঁটতে যখন বাওবাব গাছের সামনে আসলো তখন একজন অ্যামাডোডা তার হাতের তীক্ষ্ণ কাঠের টুকরাটাকে গার্ডটার মাথা বরাবর ছুরে দিল। মাথায় আঘাত লাগার ফলে লোকটি নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করল।

এরপর একজন অ্যামাডোডা ছায়া থেকে বের হয়ে এসে গার্ডটাকে টানতে টানতে গাছের পেছনে নিয়ে গেল। তারপর গলায় ছুরি বসিয়ে দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করল সে।

কয়েক মিনিট পরে দ্বিতীয় গার্ডটা যখন হাঁটতে হাঁটতে বাওবাব গাছের কাছাকাছি চলে আসলো তখন সে হতভম্ব হয়ে এদিকে সেদিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ করে তার সহযোদ্ধা কোথায় হারিয়ে গেল সেটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

ঠিক তখনই একজন অ্যামাডোডা তার হাতে ধরা নবকেরিটা পূর্বের ন্যায় গার্ডটার দিকে ছুরে দিল। ফলাফল একই হলো।

গেট-এর অন্যপাশে দাঁড়ানো গার্ডগুলোও অ্যামাডোডাদের উপস্থিতি বুঝতে পারল না-যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিঃশব্দে গিয়ে গার্ডগুলোর গলায় ছুরি বসিয়ে দিল। মৃতদেহগুলোকে টানতে টানতে কাটাগাছের ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেল ওরা। এরপর দুজন অ্যামাডোডাকে বাইরে পাহারায় দাঁড় করিয়ে অ্যাবোলি বাকি অ্যামাডোডাদের নিয়ে কুড়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। তারা সবাই ঘুমন্ত দাসদের ভেতরে তাদের ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে থাকে।

অ্যাবোলির উপস্থিতিতে দু-একজন দাস ঘুম থেকে জেগে উঠে।

“তোমাদের কোনো ভয় নেই”, অ্যাবোলি পরিষ্কার সাওহিলি ভাষায় নিচুস্বরে দাসদের উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে। যদিও এটা তাদের মাতৃভাষা নয় কিন্তু আফ্রিকার প্রায় সব লোক এই ভাষা বুঝতে পারে। “আমি সেই সাদা লোকটাকে খুঁজছি যে আজকে এখানে এসে পৌঁছেছে। আমাদের মনিব মাননীয় লেবো তার ব্যাপারে খুবই কৌতূহলী। তিনি তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তোমরা কী বলতে পার আমি তাকে কোথায় পেতে পারি?”

সবাই দেয়ালের পাশে ঘুমিয়ে থাকা দাসটাকে দেখিয়ে দেয়। আরও কয়েকজন দাস জেগে উঠে এবং কথা বলতে শুরু করে। দু-একজন এতরাতে বিরক্ত করার জন্য রেগে উঠে এবং উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকে।

“চুপ কর সবাই”, তোমাদের কথায় অন্য কুড়েঘরে, ঘুমিয়ে থাকা তোমাদের ভাইয়েরা জেগে উঠবে। একথা বলার পর অ্যাবোলি হাল-এর বাহু ধরে টানতে টানতে বের করে নিয়ে আসে।

“আমরা যদি চুপ না করি তাহলে কী হবে? ওরা কেউ আমাদের ভাই নয়।” একজন তর্ক করতে থাকে। “তোমরা কারা? আমি তোমাদেরকে চিনি না।”

পরিস্থিতি আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঠিক আছে, “ঠিক আছে। আমরা এখন যাচ্ছি।” অ্যাবোলি এই কথা বলার পর হালকে নিয়ে দরজার দিকে এগুতে থাকে। একজন দাস উঠে এসে তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পেছন থেকে একটা নবকেরি এসে তার মাথাটাকে এফোড় ওফোঁড় করে দিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অ্যামাপোড়া সেই নবকেরিটা নিক্ষেপ করেছিল।

“দৌড়াও!” অ্যাবোলি ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলে উঠল। তাদের দুজনের দেখা হওয়ার অনুভূতি বা আবেগ প্রকাশ করার সময় এখন নয়। পরে হয়ত সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু তার পূর্বে তাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে।

অ্যাবোলির হাতে একটা পাঙ্গা ছোরা রয়েছে যেটা সে একটু আগেই হত্যা করা একজন গার্ডের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। সেই পাঙ্গাটা সে হাল-এর হাতে দিল। এই সময়ের মধ্যে হাল আর অ্যাবোলি গেট-এ পৌঁছে গেল। হাল পেছন থেকে শুনতে পায় যে কুড়ে ঘরে সে ছিল সেখান থেকে দাসেরা বের হয়ে চিৎকার করছে, “আমরা মুক্ত। আমরা এখন মুক্ত।”

চিৎকার-এর শব্দ ছাপিয়ে বন্দুকের গুলির আওয়াজ পেল সে। হাল আর অ্যাবোলি এতক্ষণ কোনো সমস্যা ছাড়াই ব্যারাকের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দাসদের চিৎকার-চেঁচামেচির কারণে তা আর হলো কই? সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠা গার্ডদের একজন পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল, “ওদেরকে ধরতে হবে। ঘোড়া নিয়ে আস।” যদিও ওদের কয়েকজন ঘোড়া আনতে চলে গেল, তবুও পায়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল। এরপর আরেকটা গুলির শব্দ শোনা যায়, সেই সাথে একজন অ্যামোডোডা চিৎকার করে উঠে মাটিতে পড়ে যায়।

“থামবে না, গাল্ডওয়েন!” অ্যাবোলি চিৎকার করে উঠল। “আমাদের এখন তার জন্য কিছুই করার নেই।”

হাল কোনো উত্তর দেয় না। তারা পেছন থেকে একের পর এক বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায়। সম্ভবত দাসেরা বিদ্রোহ শুরু করেছে এবং এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। তবে এসব কিছু নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা হাল-এর নেই। এখন তার একমাত্র চিন্তা হচ্ছে একের পর এক পা ফেলে কীভাবে সামনে এগুবে। তার পায়ের পেশিগুলো জ্বালাপোড়া করছে। বুক ধড়ফড় করছে। সে তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

আর ঠিক তখনই সে দেখতে পেল লম্বা কিছু একটা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে। তার উদ্যম ফিরে এলো। এখনো তাহলে আশা আছে!

*

লোবোর ব্যক্তিগত দুর্গে বাধ্য হয়ে বিয়ের পোশাক পরতে রাজি হয়েছে জুডিথ। যদিও বার বার ব্যবহারের ফলে পোশাকটাতে নোংরা কাদামাটি, ময়লা লেগে আছে। কিন্তু সেটা খুব বেশি কিছু নয়। বুজার্ড যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে-যদিও তার এটা মানতে ঘৃণা হচ্ছে সেটা তর্কের বাইরে। যতদিন পর্যন্ত সে এই ব্যক্তিগত রাজত্বের শাসন মেনে নিবে সে ততদিন পর্যন্ত একটা আশা বেঁচে থাকবে। কিন্তু সে যদি এই দাসত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে তাহলে আর কোনো আশাই অবশিষ্ট থাকবে না।

কিন্তু তখনই সে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায়। মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে যে এটা গুলির আওয়াজ। এরপর একের পর এক কয়েকটা গুলির আওয়াজ হয়। তারপর অনেক গুলির আওয়াজ একত্রে পাওয়া যায়। আস্তে আস্তে গুলির আওয়াজের শব্দ, কম্পন এবং সংখ্যা বাড়তে থাকে। হঠাৎ জুডিথ-এর মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো। সারা আফ্রিকাতে সে-ই সম্ভবত একমাত্র মেয়ে যে বিয়ের সাজে বসে বসে গুলির আওয়াজের হিসাব করছে।

বাইরে কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। বুজার্ড তাকে বলল, “এখানে থাকুন। আপনার নিরাপত্তার জন্য আমি গিয়ে দেখে আসছি বাইরে কী ঘটছে। আবারো বুজার্ডের কথার সাথে তর্ক করার মতো কোনো কিছু সে খুঁজে পেল ।

হাল সামনের দিকে ইশারা করল। অ্যাবোলি বুঝতে পারল যে হাল কী। দেখাতে চাচ্ছে। ড্রব্রিজটার দুপাশে যে গেটপোস্ট রয়েছে সেটা রাইনোর খাঁচা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। টানা দেয়া ব্রিজটা থেকে একটা রশি ঝুলে আছে যেটাতে টান দিয়ে ব্রিজটাকে উপরে উঠানো যায় এবং নিচে নামানো যায়। দড়িটা আবার একটা কপিকল-এর সাথে প্যাচানো আছে। হাল কোনোভাবে কপিকলের কাছে। পৌঁছে দড়িটা টান দিয়ে ধরল। অ্যাবোলি আর অ্যামাডোডারা সবাই মিলে হাল-এর চারদিকে প্রাচীর তৈরি করল।

অনেকদিন এর রোদ, বৃষ্টিতে রশির তণ্ডুগুলো আরও শক্ত এবং মজবুত হয়েছে। বারবার চেষ্টা করেও পাঙ্গার ব্লেড দিয়ে সে রশিটা কাটতে পারছিল না। ওদিকে প্রায় বিশগজ দূরে প্রতিপক্ষের সৈন্যরা তাদের মাক্সেটকে গুলি করার জন্য প্রস্তুত করছে।

কার্তুজ-এর মুখে ওরা কামড় বসিয়েছে তাড়াতাড়ি। প্যান-এর মধ্যে গান পাউডার ভরছে। কিন্তু দড়িটা এখনো কাটছে না।

মাক্সেট-এর ব্যারেল-এ হাত বসিয়েছে শক্ররা। আর এরপরেই গান ফায়ার-এর শব্দ শোনা গেল।

“ইয়েস!”

তারা অবশেষে দড়িটা কাটতে পেরেছে। ড্রব্রিজটা নিচে নেমে এসেছে। অ্যামাডোডারা ওদের অবস্থান ছেড়ে বিজ্রের ওপর দিয়ে দৌড়ে রাইনোর খাঁচার দিকে যেতে থাকে।

ওদের পেছনে একের পর এক বন্দুকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

ওরা কাজটা করতে পেরেছে। ওদের উদ্দেশ্য এখন একটাই-রাইনোটাকে জাগিয়ে তোলা।

.

রাইনোসোরাস-এর চোখের দৃষ্টি খুবই ক্ষীণ। কিন্তু তার শ্রবণ এবং ঘ্রাণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। তাই এটা দিনের বেলায় যেমন বিপদজনক রাতের বেলায়ও ঠিক তেমনই। দিন এবং রাতের যে-কোনো ঘণ্টায় যে-কোনো মুহূর্তে এটা সমান তালে আক্রমণাত্মক এবং ভয়ঙ্কর।

ওটা হয়ত অ্যাবোলির তলোয়ার-এর নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আফ্রিকান লোকটার বনের ভাষা তার ইন্দ্রিয়কে ঠিকই জাগিয়ে তুলেছে।

সম্ভবত রাইনোটা বুঝতে পেরেছে যে তাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। তাই সে তার পাঁচ ফিট লম্বা শিংটা নাড়িয়ে অ্যাবোলিকে স্যালুট জানিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। এরপর ওটা অ্যাবোলির দিকে সোজা তেড়ে এলো। চিতাবাঘের মতো লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল অ্যাবোলি, এরপর উদ্ধত চিতার ন্যায় আবারো দাঁড়িয়ে পড়ল। জানোয়ারটা হয়ত হাল-এর সমস্ত হাড় মাংস গুড়ো করে দিত যদি না সে সময় মতো সরে যেত।

জন্তুটা কাদামাটির ওপর দিয়ে বিশালকার পা ফেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অ্যামাডোডাদের মাঝখান দিয়ে ড্রব্রিজটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ওদিকে হাল এবং অ্যামাড়োডোদের খুঁজতে আসা লোকগুলো ততক্ষণে দেরি করে ফেলেছে। তারা বুঝে ফেলেছে যে তাদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে। তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পেছন থেকে এগিয়ে আসা জনতার ভিড়ে সেটা সম্ভব হলো না।

ব্রিজটার ওপর যখন রাইনোর পা ফেলার শব্দ লোবোর লোকদের কানে গিয়েছিল তখনই তারা বুঝে ফেলেছিল যে তাদের জীবনের শেষ ঘণ্টাধ্বনি বেজে গিয়েছে। জটা তার শিংটা নিচু করে একজনের পেটে ঢুকিয়ে তাকে ছুরে ফেলে দিল। রাইনোটা কিছুসময়ের জন্য থেমে চারপাশটা বোঝার চেষ্টা করল। এরপর ওটা নাক দিয়ে শব্দ করতে করতে চারদিকে ঘুরতে থাকে। তারপর জন্তুটা তার মাথা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে থাকে যেন ওটা মাথা দিয়ে সমস্ত মাটি সরিয়ে ফেলবে।

লোবোর একজন লোক চিৎকার করে উঠল “এখনি!” এরপর তারা অনেক বল্লম একের পর এক নিক্ষেপ করল। কিন্তু বল্লমগুলো জন্তুটাকে আরো বেশি উত্তেজিত করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারল না। জন্তুটা রেগে গিয়ে আগত লোকজনের ওপর এমনভাবে শিং চালাতে থাকল যেন মাটির ওপর দিয়ে লাঙল চষে যাচ্ছে।

এরপর আরেকবার লোবোর লোকেরা বন্দুক চালাতে শুরু করল। এতে করে জটা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। গার্ড এবং দাসদের ছাউনির দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে সে।

হাল, অ্যাবোলি এবং অ্যামাডোডারা দেখতে পায় তাদের আশেপাশে লোবোর কোনো লোক নেই। লোবোর দুর্গ এবং তাদের মাঝে এখন আর কোনো বাধা নেই। তারা ফিরে এসে পুনরায় টানা দেয়া ব্রিজটার ওপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। হাল অ্যাবোলির দিকে দেখিয়ে বলল, “দেখ! ওরা সবাই উপরে জড়ো হয়েছে।”

অ্যাবোলি মুখে একটা আফ্রিকান হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, “তারা নিচে রাইনোটার দিকে তাকিয়ে আছে আর দেখছে যে কিভাবে তাদের লোকেরা রাইনোটার নিচে পদদলিত হয়ে মারা যাচ্ছে।”

“হ্যাঁ, ওদের কপাল ভাল যে এসময় তারা নিচে নেই। কিন্তু ওরা এখানে জড়ো হওয়ার কারণে দুৰ্গটার তিন দিকেই এখন আর কোনো পাহারা নেই।”

তারা দুর্গের দূরের পথ দিয়ে দৌড়াতে থাকে। তাদেরকে এখনো কেউ দেখতে পায়নি। দাস বিদ্রোহ কতক্ষণ স্থায়ী হবে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা হালকে অতিরিক্ত সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা দুর্গের কাছাকাছি চলে এসেছে। এমন একটা দেয়ালের কাছে তারা পৌঁছল যেখানে কোনো পাহারাদার দেখতে পাচ্ছে না সে। অ্যাবোলি বলল, “আমাকে প্রথমে যেতে দাও, গান্ডওয়েন। আমার গায়ের রং দেখে কেউ বুঝতে পারবে না।”

হাল সম্ভবত সেটা শুনতে পায় নি। “আমার প্রথমে যাওয়া উচিত অ্যাবোলি।” হাল বলে উঠল, যেন বুঝাতে চাইলে যে সে সবার সামনে না থেকে সবাইকে ভালভাবে গাইড করতে পারবে না। সে দড়ি এবং হুকটা অ্যাবোলির কাছ থেকে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে দিল। এরপর সে পাঙ্গাটা কোমড়ের বেল্টে খুঁজে রাখল। তারপর সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে পরবর্তী মেঘের খণ্ডে চাঁদটা ঢেকে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল।

মেঘ চলে এসেছে। এখনই তাকে কাজটা করতে হবে।

সে অমসৃণ মাটির ওপর দিয়ে দুর্গের দেয়ালের দিকে দৌড়াতে থাকে। যে লোক মাস্তুলের ওপর উঠে অভ্যস্ত তার কাছে এটা কোনো উচ্চতাই নয়। সে জানে সে এটার ওপর উঠতে পারবে। সে হোয়াইটওয়াশ করা মাটির দেয়ালের দিকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় লাফ দিল।

হাল কান পেতে কোনো মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কি-না তা শোনার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু, সৌভাগ্যবশত দেয়ালের উপরের লোকেরা তাদের পেছনের বিপদ সম্পর্কে অসচেতন। হাল ছায়ার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। তার বক্ষপিঞ্জরের নিচে হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। হাল পেছন ফিরে অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে হা-সূচক মাথা নাড়ায়। এরপর রশিটা নিয়ে হুকটাকে এক, দুই, তিনবার ঝুলিয়ে ওপর দিকে ছুঁড়ে দেয় দেয়ালের উপরে।

সতর্কতার সাথে রশিটাকে টানতে থাকে হাল। রশিটা আসতে আসতে এক পর্যায়ে থেমে যায়। তার মানে হুকটা দেয়ালের সাথে আটকে গিয়েছে। আর এটাই হাল-এর প্রয়োজন। সে উঠতে শুরু করে। উঠতে উঠতে যখন একেবারে দেয়ালের চূড়ায় পৌঁছে যায় তখন সে তার পাঙ্গাটা কোমড় থেকে টেনে হাতে নেয়। এরপর সে তার বামহাতটা মুখের ওপর গোল করে রেখে নিশাচর পাখির মতো ডাক দেয়-এটা এক ধরনের সিগন্যাল যার অর্থ হল তারা এবার হালকে অনুসরণ করতে পারে। হাল মাথা নিচু করে একা একা দেয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে এবং মাথা ঘুরিয়ে দেখে যে অ্যাবোলিরা প্রায় সবাই দেয়ালের ওপর উঠে গিয়েছে।

কিন্তু তখনই দেয়ালের ওপারের উঠোনে দাঁড়ানো লোবোর একজন লোক সবকিছু দেখতে পেল। সে দেখতে পেল যে দেয়ালের ওপর দিয়ে ছায়ার মতো কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। সে চিৎকার দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। সাথে সাথে বন্দুকের গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। দেয়ালের শেষ মাথায় হাল একটা সিঁড়ি দেখতে পায়। সিঁড়ির নিচ থেকে লোবোর সৈন্যদের একজন তলোয়ার হাতে হাল-এর দিকে এগিয়ে আসছে। হাল দেয়াল থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে লোকটির তলোয়ার ধরা হাত নিজের বাম হাত দিয়ে ধরে ডান হাতে লোকটির মুখে আঘাত করল। এরপর পাঙ্গা দিয়ে লোকটিকে মেরে বসলো সে।

“গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি চিৎকার দিয়ে ওঠে। হাল ঘুরে তাকিয়ে দেখে দ্বিতীয় আক্রমণকারী তার দিকে তেড়ে আসছে। সে যদি সময়মত সরে না যেত তাহলে আক্রমণকারীর তরবারি তার বুকের পাঁজর ভেদ করে চলে যেত। সে ভেতরের দিকে সরে গিয়ে নিজের তরবারির বাঁট দিয়ে আক্রমণকারীর মুখে আঘাত করল। এরপর আরও একজন তার দিকে তেড়ে আসতে থাকল। একপাশে সরে গিয়ে নিজের তরবারিটা লোকটির গলায় বসিয়ে দিল হাল। অ্যাবোলি তিনজন আক্রমণকারীকে প্রতিহত করল, আর একজনকে মেরেই ফেলল। তখনই হাল শুনতে পেল বুজার্ড তার নাম ধরে গর্জন করে উঠছে এবং একজনের মাথার ওপর দিয়ে নিজের তলোয়ারটা তাক করে আছে। লোবোর লোকেরা তাদের দুজনের মাঝে ভিড় করে হাল–এর সাথে যুদ্ধ করছে। হাল যদি যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে না যায় তবে বুজার্ড তার কাছে আসতে পারবে না।

তখনই দুটি গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। হাল-এর পেছন থেকে এগিয়ে আসা গুলি দুটি তার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। সেই সাথে বন্দুক হাতে লোবোর দুজন লোক ছাদের ওপর থেকে পড়ে গেল।

হাল ঘুরে তাকিয়ে গুলির আওয়াজ-এর উৎস খুঁজতে থাকে। আর সাথে সাথে তার মন আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল।

সেখানে জুডিথ দাঁড়িয়ে আছে!

জুডিথ তার রুমের ছাদের ওপর দিয়ে পায়ের আনাগোনা শুনেই বুঝতে পেরেছিল যে তাকে উদ্ধার করতে হাল পৌঁছে গিয়েছে। সে তখন আশেপাশে খুঁজে সুবিধামত পোশাক পেয়ে নিজের পোশাকটা দ্রুত পাল্টে ফেলল। কারণ সে জানে তাকে যদি আফ্রিকার জঙ্গল দিয়ে দৌড়াতে হয় তবে এই পোশাক মোটেও উপযুক্ত নয়।

সে যখন দরজা খুলে বাইরের দিকে উঁকি দেয়, তখন দেখতে পায় হাল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পাশে অ্যাবোলিও ছিল। আশেপাশে পরিচিত অ্যামাড়োডাদের মুখ দেখতে পায় জুডিথ।

জুথিড-এর পায়ের কাছেই লোবোর একজন লোক মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। তার হাতে একটা তলোয়ার এবং বেল্টে দুটি পিস্তল আটকানো আছে। জুডিথ একটা পিস্তল উঠিয়ে চল্লিশ ফিট উপরে ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন সৈন্যকে গুলি করে দিল। সে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পূর্বেই দ্বিতীয় পিস্তলটি উঠিয়ে আরেকজনকে গুলি করল জেনারেল জুডিথ নাজেত।

এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, স্বয়ং হাল! জুডিথকে দেখে আনন্দে চিৎকার করছে সে। অ্যাবোলি এবং অ্যামাডোডারা যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। যদিও লোবোর সারা দুর্গেই যুদ্ধ লেগে গিয়েছে কিন্তু এ অংশটুকু তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

বুজার্ড সবসময়ই একটু সুবিধাবাদী চিন্তা-ভাবনা করে-ঠিক যেমনটা সে এতদিন করে এসেছে। সে বুঝতে পারছে যে পরিস্থিতি কার্টনির পক্ষে চলে যাচ্ছে। নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য এখন তার যার কথা মাথায় আসছে সে হচ্ছে বালথাজার লোবো। প্রিন্স জাহানের সাথে শত্রুতা তৈরির পর এখন তার একজন শক্তিশালী বন্ধু প্রয়োজন। সে যদি বিয়ের পাত্রী এনে দিয়ে লোবোর মন জয় করতে না পারে তাহলে অন্তত তার রোগা চর্মসার ঘাড়টা বাঁচিয়ে তার মন জয় করতে হবে।

সে উঠান পার হয়ে লোবোর শোবার ঘরের দিকে দৌড়াতে থাকে। বুড়ো ছাগলটা কোথায় লুকিয়েছে কে জানে, কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু লোকটাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আর ঠিক তখনই সে কতগুলো কাঠের ডেস্কের পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেল। “ক…কে ওখানে?”

“আমি স্যার, আর্ল অব কাম্রা। আমি আপনাকে বাঁচাতে এসেছি স্যার!” বুজার্ড উত্তর দেয়। তারপর লোবো যেখানে লুকিয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি স্যার”, “সময় থাকতে আমাদের এই বিল্ডিং ছেড়ে পালাতে হবে।”

বুজার্ড বৃদ্ধ খনির মালিককে নিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে পা দিয়ে প্রথমেই কার্টনি এবং তার লোকেরা কোনদিকে আছে সেটা দেখে নিল।

মালিকের আগমনে লোবোর লোকেরা সাহস ফিরে পায়।

তারা আবারও নতুন উদ্যমে কার্টনি আর তার লোকদের পেছনে ধাওয়া করা শুরু করে দেয়।

হাল তাদেরকে দেখতে পেয়ে জুডিথ-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। জুডিথ মৃত লোকটির কাছ থেকে গান পাউডার এবং পিস্তল নেয়ার চেষ্টা করছে। “না, ডালিং, ওটা ছেড়ে দাও”, সে বলে উঠে। “অস্ত্রের চেয়ে আমাদের এখন বেশি প্রয়োজন। হচ্ছে দ্রুত গতিতে পালিয়ে যাওয়া। চল এখনই পালাতে হবে এখান থেকে।”

“হ্যা”, অ্যাবোলিও যোগ দেয়। “আমাদের এখনই দৌড়ানো উচিত।”

.

যে দাস বিদ্রোহের সূচনা অ্যাবোলি করেছিল সেই দাস বিদ্রোহ সমাপ্ত হতে প্রায় সারাটা রাত লেগে যায়। যখন ভোরের আলো দেখা দেয় তখন বুজার্ড, লোবো এবং কাপেলোকে নিয়ে আলোচনায় বসে। সে বুঝতে পারে, যে লোকেরা কার্টনির পরে এখানে এসেছিল তারা সবাই নিশ্চয়ই কার্টনির জাহাজের লোক। তারা নিশ্চয়ই জাঞ্জিবার থেকে কার্টনির পিছু পিছু এসেছে। কোন উপকূলে কার্টনিকে নামানো হয়েছিল?”

“কোয়েলিম্যান-এ,” কাপেলো জবাব দেয়।

“তাহলে সেখানেই নিশ্চয়ই কোথাও গোল্ডেন বাউ নোঙর করা আছে। কাপেলো তুমি কী কোয়েলিম্যান-এর রাস্তা চেন?”

“অবশ্যই।”

“তাহলে, মাননীয় লোবো, আমি আপনার অনুমতি সাপেক্ষে বলছি যে আমাদের সেদিকে যাত্রা করা উচিত। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য কার্টনিকে ধরে ফেলা। সেজন্য বাউ ছাড়ার পূর্বেই আমাদেরকে তার কাছে পৌঁছাতে হবে। আমি আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি সেই মেয়েটাকে আপনার কাছে ফিরিয়ে আনবই।”

“তাহলে, আমার বিয়ের আশা এখনো আছে?” লোবো বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল।

“অবশ্যই স্যার”, বুজার্ড তার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করল। কিন্তু “যদি কোনো কারণে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে আমরা তার কাছে পৌঁছাতে না পারি তাহলেও আমরা আশা ছেড়ে দেব না। কারণ আমি জানি সে কোথায় যাবে। মাননীয় লোবো আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যদি আমি তাকে তার গন্তব্যস্থলে গিয়েও ধরতে পারি তবে কার্টনির মাথা, তার স্ত্রী আর সেই সাথে কার্টনির সমস্ত সোনাদানা আপনার সামনে হাজির করব।”

লোবোর মুখে ঝকঝকে হাসি ফুটে উঠে। “তার সোনাদানা? ওহ, তাহলে তো ভালই হয়।”

৮. বুজার্ড তার দলবল নিয়ে

বুজার্ড তার দলবল নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সামনে এগুতে লাগল। কিন্তু কোথাও অ্যামাডোভাদের কোনো নিশানা খুঁজে পেল না। কারণ অ্যামাডোডারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছে। সেইসাথে জুডিথ-এর উপরেও আজকে অসীম শক্তি ভর করেছে। সেও সমানতালে দৌড়াচ্ছে। একপাও পিছিয়ে পড়ছে না। হালও দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আজকে দৌড়বিদের মতো শক্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে, কারণ তার সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। তাছাড়া জুডিথ পাশে থাকায় তার পাদুটোতে যেন পাখা গজিয়েছে।

দৌড়াতে দৌড়াতে তারা উপকূলে পৌঁছে গেল, যেখানে বিগ ডেনিয়েল, ফিশার, জন লোভেলকে সাথে নিয়ে পানসিতে করে হাল এবং অ্যাবোলির ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত তারা সেখানেই অবস্থান করছে।

হাল আর জুডিথ যখন গোল্ডেন বাউ-এর কাছাকাছি পৌঁছল, তখন চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেল তারা। সেই চিৎকার আরও বেড়ে যায় যখন হাল বাউ এ পৌঁছে সবার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করে, “তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে আমি তোমাদেরকে পুরস্কার-এর কথা বলেছিলাম। সেই পুরস্কারের উদ্দেশ্যেই আমরা এখন যাত্রা করব। মি. টেইলর, আমাদের সবাইকে নিয়ে এলিফ্যান্ট লেগুন-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করুন।”

অবশেষে বুজার্ড যখন কাপেলোকে নিয়ে কোয়েলিম্যান-এ পৌঁছে তখন প্রায় চারদিন পর্যন্ত তারা একটি জাহাজ খুঁজতে থাকে ধার নেয়ার জন্য।

যে রহস্যময় দ্বীপের চিহ্ন কোনো মানচিত্রে নেই সেরকম দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা অনেক বড় ঝুঁকির ব্যাপার। তাছাড়া সময়মত সেখানে পৌঁছানো যাবে কি-না সেটাও চিন্তার বিষয়। যখন এসব ভেবে কাপেলো এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছিল তখনই সে বারোসকে দেখতে পেল। লোকটা তার জাহাজ মাদ্রি দি ডিয়াস থেকে নেমে আসছিল।

বারোসকে দেখার পর থেকে কাপেলোর রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। এই সেই লোক যে তার সমস্ত সমস্যার জন্য দায়ী। সে তাকে খুন করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে। কোয়েলিম্যান সেই ঘটনা ঘটানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়। সব ক্রোধ পেছনে ফেলে কাপেলো বারোসকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

“পুরনো বন্ধু তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চেন। আমি পেটের ব্যাপারে কতটা যত্নশীল। কিন্তু আফ্রিকার কোনো শহরে আমি ভাল কোনো খাবার খুঁজে পাই নি। কিন্তু ব্লু এলিফ্যান্ট নামে একটা জায়গা আছে। সেখানকার মতো ভাল খাবার কোথাও পাওয়া যায় না। আমি কয়েক বোতল আলভারেলহাও ওয়াইন এবং এক কৌটা ট্রাস-ওস-মনটেস জোগাড় করেছি। তুমি একটু জিবে নিয়ে দেখতে পার।”

কাপেলের কথায় প্ররোচিত হয়ে দুটো থেকেই একটু একটু খেয়ে দেখে। বারোস। কাপেলোর কথার সত্যতা স্বীকার করে নেয় সে। এরপর বুজার্ড-এর দিকে তাকিয়ে দেখে সে কিছুই খেতে পারছে না।

“এই অদ্ভুত সৃষ্টিটাকে দেখে বড় অবাক লাগে। বেচারা কোনো কিছুরই স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না।”

“তুমি যদি তোমার আজেবাজে কথা বন্ধ কর তবে আমরা কাজের কথায় আসতে পারি।” কাপেলো হঠাৎ বেশ গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করল।

“তুমি যে সাদা দাসটাকে নিয়ে এসেছিলে-ঐ যে বলেছিলে কালোদের মতোই কাজ করতে পারে-সে সেনোর লোহোর অনেক বড় ক্ষতি করেছে। তার নাম হচ্ছে কার্টনি। সে একজন ক্যাপ্টেন। সবাই তাকে এল তাজার নামে চেনে। আমার মনে হয় তুমি এটা জানো। আমি আশা করব যে সেনোর লোবোর ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য তাকে ধরতে তুমি আমাদেরকে সাহায্য করবে।”

“কার্টনি কী করেছে?” বারোস জিজ্ঞেস করল।

কাপেলো যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্তভাবে কার্টনির পালিয়ে যাওয়া এবং জুডিথকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুলে বলল। বুজার্ড-এর চামড়ার নাকের সামনে দিয়েই ওরা পালিয়ে গিয়েছে এটাও বলতে ভুলল না। গল্প শুনতে শুনতে বাতোস আরও একপেগ ওয়াইন পান করল। অবশেষে নিজের ঊরুতে চাপড় দিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে সে।

“এখন তোমরা চাচ্ছ আমি যেন তোমাদেরকে আমার জাহাজে করে নিয়ে কার্টনি আর তার নাজেকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করি?” আচ্ছা তাহলে শোন, “আমিও ওদিকেই যাচ্ছি।” আমি চল্লিশ জোড়া হাতির দাঁত একজন ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি। সে কেপ অব গুড হোপ-এ অপেক্ষা করবে এবং সেগুলো নিয়ে হল্যান্ড-এ ফিরে যাবে। কিন্তু তোমরা এইসব প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি ভুলে যাও। সমুদ্র থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বাস করা বৃদ্ধ লোবোকে আমি ভয় পাই নে। এখন আমাকে যথাযোগ্য কারণ দেখাও যে কেন আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করতে যাব?”

কাপেলো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বুজার্ড তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল, “কার্টনির পিতা ফ্যাঙ্কিকে আমি খুব ভালভাবেই চিনতাম। তার দুটি গুণ ছিল। গুপ্তধন সমৃদ্ধ কোনো জাহাজ যদি সাগরের ওপর দিয়ে ভেসে যেত তবে গন্ধ শুঁকেও সে সেটা খুঁজে বের করতে পারত। দ্বিতীয়ত, সেই জাহাজের প্রতিটা পেনীও সে রেখে দিত। কত গুপ্তধন মজুদ করেছে সেটা সে কোনোদিন কাউকে বলেনি। এমনকি আমি, যে কি-না তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলাম এবং যার সেই গুপ্তধন-এ ভাল রকমের ভাগ ছিল, তাকেও সে কোনোদিন কিছু বলেনি।”

বারোস কথা বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু বুজার্ড তার তিন আঙুল বিশিষ্ট হাতটা উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কার্টনির গুপ্তধনের পরিমাণ কত হতে পারে? আমি তোমাকে বলছি শোন। শেষ যে জাহাজটা কার্টনি আটকিয়েছিল সেটা ছিল রিজলিউশন নামের একটা ওলন্দাজ জাহাজ।”

“ওহ, হ্যাঁ…আমার মনে পড়েছে।” বারোস বলতে শুরু করে। “কেপ কলেনিতে তখন এটা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু রিজলিউশন তত আবারও দখল করেছিল ওরা-সমস্ত কাঠ আর মশলাসহ।”

“হ্যাঁ, স্টুপিড ওলন্দাজগুলো আবারও তাদের জাহাজ ফেরত পেয়েছিল, কাঠ আর মশলাগুলো সহই। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি জাহাজে আরও অনেক কিছু ছিল। পঞ্চাশ হাজার ডাচ্ গিল্ডার মুদ্রা এবং তিনশত…” “তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছ…তিনশত খাঁটি সোনার বার যার একটাই একজন মানুষের সারাজীবন সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট।”

কার্টনির এত গুপ্তধনের কথা শুনে বারোস একধরনের শব্দ করে উঠল। তখন বুজার্ডের মনে হলো যে আর বলা উচিত হবে না। বাকি যেগুলো আছে সেগুলো নিজের জন্য রেখে দেওয়া উচিত।

“আচ্ছা ঠিক আছে”, পরিস্থিতি বুঝতে পারল বায়োস। কিন্তু তুমি কী জান সেই গুপ্তধন কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে?”

“খুবই মজার একটা প্রশ্ন। এর উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না। আমি জানি যে কার্টনি যে উপকুলে গিয়ে থেমেছিল সেখান থেকে গুপ্তধনের দূরত্ব প্রায় অর্ধেক দিনের। আমি এটাও জানি যে বিচের কোথায় কোথায় এটা নেই। কারণ আমি সারা বীচ ঘুরে দেখেছি। কোথাও এর চিহ্ন খুঁজে পাইনি।”

“বীচটা কোথায়?” বাবোস জিজ্ঞেস করল।

“জায়গাটার নাম এলিফ্যান্ট লেগুন। কিন্তু আমাকে ডিঙিয়ে ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করো না ক্যাপ্টেন। কারণ তুমি এটা কোনো চার্ট-এ খুঁজে পাবে না। কিন্তু আমি জানি এটা কোথায় আছে এবং কীভাবে সেখানে যেতে হয়। আমি কার্টনিকে সেখানে যেতে দেব। এমনকি গুপ্তধনও উদ্ধার করতে দেব”, এরপর বুজার্ড টেবিলের ওপর শক্তভাবে ঘুসি মেরে বলল, “আমরা তখনই আক্রমণ করব যখন সে ভুলেও সেটা প্রত্যাশা করবে না। তখন আমরা তার গুপ্তধন এবং নারী দুটোই ছিনিয়ে আনব।”

“আমি গুপ্তধনের অধের্কটা চাই”, বারোস বলে উঠে।

“দ্য হেল ইউ ডু”, বুজার্ড ফোঁসফোঁস করে বলল।

“প্লিজ, দ্রমহোদয়গণ, থামুন”, কাপেলো ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করে। বলল। “আমরা এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ওপর নির্ভরশীল, ক্যাপ্টেন বারোস, তোমার হয়ত জাহাজ আছে। কিন্তু এখানে একমাত্র আমাদের মুখোশওয়ালা বন্ধুই গুপ্তধনের খোঁজ জানে। ক্যাপ্টেন বারোস, খাবার, পানি, গানপাউডার এসবের জন্য তোমাকে কোনো খরচ করতে হচ্ছে না। আর আইভরি থেকে তুমি তোমার লাভ পেয়ে যাবে। এখানে একমাত্র আমাকেই সেনোর লোবোর হয়ে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তাই এসব নিয়ে বাদ-বিবাদ না করে আমরা তিনজনই যদি সেটা সমান ভাগ করে নেই, তাহলেই তো ব্যাপারটা মিটে গেল।”

“তার ওপর আমি কার্টনির স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে লোবোর কাছে হস্তান্তর করব। আর ক্যাপ্টেন তুমি কার্টনির মাথাটা নিয়ে প্রিন্স জাহানের নিকট দেবে আর যথেষ্ট পুরস্কার পাবে এর জন্যে। আর কার্টনির জাহাজটা পাবে বুজার্ড।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রাজি।” বারোস বলতে থাকে। কিন্তু “কার্টনি কয়েকদিন পূর্বেই যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। আমাদের যাত্রা শুরু করতে আরও দুই দিন লাগবে। আমরা কীভাবে কার্টনিকে ধরব?”

“এটা নিয়ে ভেবো না”, বুজার্ড জবাব দেয়। “কার্টনি ভেবেছে সে নিরাপদ-এ আছে। তাই সে আস্তে ধীরে এগুতে থাকবে। কিন্তু আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এগুব। তাই আমরা ঠিকই সময়মত তাকে ধরে ফেলব।”

অবশেষে তারা তিনজন তদারকি করে জাহাজটাকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করে ফেলল। আর তারপর ঠিক পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে জাহাজ চালু করে দিল তারা। যখন আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল তখন বুজার্ড নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আরও পাল তুলে দিল। গন্তব্যে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত একটানা চলতেই থাকল তারা।

*

“আমার চোখের দৃষ্টি খুব ভাল”, মসি বলল। “এবং আমি খুব উচ্চস্বরে চিৎকার করতে পারি। আপনি জাহাজের যে কোনো প্রান্ত থেকে আমার কণ্ঠ শুনতে পাবেন। এই যে শুনুন…” এই কথা বলার পরপরই মসি চিকন স্বরে এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে তার পাশে দাঁড়ানো হাল দুহাত দিয়ে কান বন্ধ করে ফেলল।

মসি আনন্দে হেসে উঠে। “এইতো দেখেছেন, স্যার। আমি বেশ ভাল পাহারাদার হতে পারব।”

হাল চোখমুখ শক্ত করে না-সূচকভাবে মাথা নাড়াল। সে এই ব্যাপারটা নাবিকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। গোল্ডেন বাউ কোয়েলিম্যান পার হওয়ার কিছু সময় পরেই মসি এসে পরবর্তী পাহারাদার হওয়ার জন্য হাল-এর কাছে আবেদন জানায়। হাল তাকে সোজা না করে দিয়েছে। এরপর একটার পর একটা কারণ বের হতে থাকে যে কেন সে পাহারাদার হতে পারবে না। মসির বয়স অল্প, সে খুব ছোট, সে দ্রুত উপরে উঠানামা করতে পারবে না, সে বিভিন্ন জাহাজের পার্থক্য বুঝতে পারবে না এবং চিৎকার করে নিচের সবাইকে জানাতে পারবে না ইত্যাদি।

গোল্ডেন বাউ বর্তমানে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করছে। আজকের দিনের জন্য গোল্ডেন বাউয়ের প্রধান আলোচনার বিষয় হচ্ছে, জাহাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি এবং সবচেয়ে ছোট ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব। অনেকে এটা নিয়ে বাজি ধরা শুরু করেছে। কেউ বলছে যে ক্যাপ্টেন ছোট্ট বালকটির কথা মেনে নেবে, কেউ বলছে, কোনো সম্ভাবনাই নেই।

“আমি তোমাদেরকে বলে রাখছি, এটা কোনোদিনও সম্ভব হবে না।” বিকেলবেলা গল্প করতে বসে বিগ ডেনিয়েল একদল নাবিককে উদ্দেশ্য করে বলল। এবং “কেন সেটা ভেবে দেখ। পৃথিবীতে একমাত্র একজনই আছে যে ক্যাপ্টেনকে তার কথামত কাজ করাতে পারে কিংবা কোনো কাজে নিষেধ করতে পারে। ক্যাপ্টেন খুব ভাল করেই জানে মসি তার খুব প্রিয় পাত্র। সে কোনোভাবেই মসিকে প্রধান মাস্তুলের ওপর থেকে পড়ে চেপ্টা হতে দেবে না।”

“হ্যা”, একজন নাবিক বিগ ডেনিয়েল-এর কথার সাথে সহমত পোষণ করল। “ক্যাপ্টেনস লেডি যে শুধু রাগ করতে পারে তাই না। সে তলোয়ার দিয়ে কী করতে পারে সেটা আমি দেখেছি।”

সেই ব্যাপারটাই এখন ক্যাপ্টেন-এর মনে বেশি করে খেলা করছে। তাই কার্ড-এর শেষ চাল দেয়ার সময়ও তাকে দেখে বেশ উতলা মনে হচ্ছিল। “লেডী জুডিথ-এর কথা চিন্তা করে দেখ”, হাল বলল। সে জানে যে মসি জুডিথ-এর কাছে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ঠিক যতটা জুডিথ তার কাছে। যদি তুমি ওপর থেকে পড়ে যাও তখন…” হাল প্রধান মাস্তুলের একেবারে চূড়ায় ইশারা করে দেখায়। তাহলে তুমি ডেক-এর ওপর পড়ে চেপ্টা হয়ে যাবে। মারা যাবে তুমি। এতে জুডিথ খুব দুঃখ পাবে। তুমি নিশ্চয়ই তোমার লেডি জুডিথকে দুঃখ দিতে চাও না, তাই না?”

মসি ব্যাপারটা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করল, এবং তারপর পরই সে মুখে হাসি ফুটিয়ে পূর্ণোদ্যমে বলতে শুরু করল, “কিন্তু আমি পড়ে যাব না ক্যাপ্টেন কার্টনি স্যার। আমাদের গ্রামে গাল পাখির ডিম আনার জন্য আমাকে উঁচু পাহারে উঠতে বলা হতো। আপনি আমাকে একটা লম্বা রশি দিলে আমি চাদেও উঠতে পারব।”

মসির কথা শুনে অবোলি হেসে উঠে। সে তখন প্রধান ডেক-এর ওপর দাঁড়িয়ে অ্যামাডোডাদের কাজ পরিদর্শন করছিল। হাল তাকে ইশারায় ডেকে পাঠালে সে এগিয়ে এলো।

“তুমি কী মনে কর একে আমার উপরে উঠতে দেয়া উচিত?” হাল জিজ্ঞেস করল।

“সে যদি ওপর থেকে পড়ে না যায় তাহলে ঠিক আছে”, আবোলির আগেই নেড টেইলার জবাব দিয়ে বসলো। “আমি চাইনা, আমার এই পরিষ্কার ডেকটা নোংরা হয়ে যাক।”

অ্যাবোলি হেসে ফেলল। এরপর তার দুই হাত একবার উপরে আরেকবার নিচে নামিয়ে বলল, “এই ছেলে হচ্ছে স্প্যারো, গান্ডওয়েন। সে যদি পড়ে যেতে শুরু করে তবে সে তার ডানা ছড়িয়ে দেবে। তাছাড়া তুমি যখন প্রথম মাস্তুলের ওপর উঠেছিলে তখন এর বয়সি কিংবা এর চেয়েও ছোট ছিলে। যদিও আমি যতদূর মনে করতে পারছি তোমার বাবা তখন তার কেবিন-এ ঘুমিয়ে ছিলেন।”

সেই স্মৃতি মনে পড়ে হাল-এর মুখে হাসি ফুটে উঠল। অ্যাবোলির সে সময়ের নির্দেশনাগুলো এখনো তার কানে বাজে। “নিচের দিকে তাকিও না, গান্ডওয়েন। যেভাবেই হোক নিচের দিকে তাকানোর ইচ্ছে প্রতিহত কর।” প্রধান মাস্তুল বেয়ে উপরের দিকে উঠার সময় তার পাগুলো কাঁপছিল, বুকটা ধড়ফড় করছিল। কিন্তু একবার যখন সে চূড়ায় পৌঁছল তখন সেখানে বসে নিজেকে তার রাজা বলেই মনে হচ্ছিল।

“সেই মাস্তুল এটার মতো অতটা লম্বা ছিল না, অ্যাবোলি”, হাল বলল।

“না, তা ছিল না।” অ্যাবোলি স্বীকার করে নিল। এরপর মসির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু সে যদি পড়ে যায় আমি তাকে ধরে ফেলব-ঠিক যেভাবে তোমাকে ধরতাম, গান্ডওয়েন।”

হাল মসির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকায় এবং বুঝতে পারে অ্যাবোলি ছেলেটাকে বেশ সমীহ করছে। হালও মনে মনে ছেলেটার সাহসের প্রশংসা করতে লাগল। কারণ এই বয়সে সে যে পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেছে বা শিকার হয়েছে এরপরও এতটা সাহস ধরে রাখা প্রশংসার দাবিদার বটে।

“আর যদি আমি তাকে ধরে ফেলতে না পারি তবে মাই লেডি দেখে ফেলার পূর্বে ডেকটা পরিষ্কার করে ফেললেই চলবে”, অ্যাবোলি চেহারায় যথেষ্ট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল। যদিও তার চোখে হাসি হাসি ভাব খেলা করছিল।

“মাই লেডি দেখে ফেলার পূর্বে কী হবে?” পেছন থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলে উঠল।

“ওহ, কিছু না, ডার্লিং”, জুডিথ-এর কৌতূহল-এর ওপর প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা চালালো হাল। কিন্তু মসি হাল-এর সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বলে উঠল, “ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল যে আমি প্রধান মাস্তুলের ওপর উঠতে পারব কি-না…।”

“আমি কখনোই একথা বলিনি, হাল বিস্ফোরিত হয়ে বলে উঠল।

“আর আমি যদি পড়ে যাই তবে অ্যাবোলি আমাকে ধরে ফেলবে বলেছে।”

“এসব কী সত্যি?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল। হাসি চেপে রেখে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছে সে।

“এটা সত্য যে সে আমাকে অনেকক্ষণ ধরেই রাজি করানোর চেষ্টা করছে যেন আমি তাকে প্রধান মাস্তুলের উপরে উঠতে দেই। কিন্তু আমি তাকে উঠতে বলেছি এটা কখনোই সত্য নয়। তুমি যাচাই করে দেখতে পার।”

‘ক্যাপ্টেন ঠিকই বলেছে, মাই লেডি”, নেড টেইলার বলে উঠল। “তিনি। বরং ছেলেটাকে উঠতে দিতে চাচ্ছেন না।”

“সত্যি?” চেহারায় একটা নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল জুডিথ। “কিন্তু কেন? আমি চাই ছেলেরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোক। তাদেরকে যদি পরীক্ষার মধ্যে ফেলা না হয় তাহলে তারা কীভাবে শক্তিশালী হবে? কীভাবে সাহসী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে?”

“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম…তুমি বলেছিলে…” হাল কথা বলার জন্য সঠিক শব্দ খুঁজতে থাকে। জুডিথ-একসময় পরিষ্কার করে বলেছিল যে সে চায় না মসির কোনো ক্ষতি হোক এবং হালের সেটা ভালই মনে আছে।

জুডিথ বুঝতে পারে যে সে হাল-এর জন্য যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে ফেলেছে।

হেঁটে গিয়ে হাল-এর পাশে দাঁড়াল সে। এরপর হাল-এর একবাহু ধরে সরাসরি তার দিকে তাকাল। “আমি জানি আমি যা চাই, তুমি তাই করবে। সেজন্য তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এটা তোমার জাহাজ। তোমার মতমতের ওপর ভিত্তি করেই এই জাহাজ চলবে। যদি তুমি মনে কর মসি মাস্তুলের ওপর উঠার উপযুক্ত তবে আমি কিছুতেই মানা করব না।”

“প্লিজ, ক্যাপ্টেন। প্লিজ-প্লিজ!” মসি লাফিয়ে লাফিয়ে বলতে থাকে।

হাল ভেবে দেখে অ্যাবোলি এবং জুডিথ ঠিকই বলেছে। সে অনেক ছোটবেলাতেই একাজ শুরু করেছিল। আর এটাই তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তাই সে মসির দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু খুব সাবধানে উঠবে। আর একবার যখন তুমি উপরে উঠতে শুরু করবে তখন নিচের দিকে তাকাবে না।”

“ঠিক আছে স্যার, তাকাব না”, মসি বলে উঠল। তার চেহারায় বিকেলের সূর্যের মতো ঝকমকে হাসি ফুটে উঠে। সেই সাথে সে তার ছোট্ট পা আঁকাবাকা করে নাচতে থাকে।

“যখন আমি উপরে সামুদ্রিক পাখির দেখা পাব তখন আমি তাদের বলব যে আমি কে। আমি তাদের কাছে আপনার কথাও বলব, ক্যাপ্টেন।”

“আমি নিজেই তাদেরকে আমার কথা বলব”, হাল বলে উঠল। “কারণ আমিও তোমার সঙ্গে উপরেই যাচ্ছি।”

“কী?” জুডিথ অবাক বিস্ময়ে বলে উঠল।

“তোমাকে নিশ্চয়ই একজন আদর্শ নেতার বৈশিষ্ট্য বলে দিতে হবে না, মাই ডিয়ার জেনারেল? একজন আদর্শ নেতা কখনই তার অধীনস্থ কাউকে এমন কোনো কাজ করতে বলে না যেটা সে নিজে করতে পারে না।”

সবাই ওর কথাটাকে আনন্দধ্বনি আর চিৎকার এর মাধ্যমে সম্মান জানালো। ক্যাপ্টেন কার্টনির জন্য গর্বে তাদের বুক স্ফিত হয়ে গেল।

“সে একেবারে তার বাবার মতই হয়েছে।” নেড টেইলার বিগ ডেনিয়েল এর পাশে দাঁড়িয়ে বলল।

“বৃদ্ধ ফ্রাঙ্কি নিশ্চয়ই ওপর দেখে বেশ খুশি হচ্ছে, বিগ ডেনিয়েল জবাব দিল।

হাল তার গায়ের জামা খুলে ফেলল; খালি গায়ে আর খালি পায়ে তাকে একজন সাধারণ নাবিকের মতই মনে হচ্ছে এখন। তার পিঠের চাবুকের দাগ আর ক্ষতগুলো বের হয়ে গেলে মসি বিস্ময়ের সাথে মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে।

“আমিও একসময় সাধারণ একজন দাস ছিলাম, মসি”, হাল বালকটির কৌতূহল বুঝতে পেরে তাকে জানালো।

“আপনি নিশ্চিতভাবেই খুবই অবাধ্য দাস ছিলেন, মাই লর্ড।” মসি হাসতে হাসতে বলল।

হালও হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ, তোমার চেয়েও অনেক বেশি।” সে তার চুলগুলোর বাধন খুলে আবারও পেছনে নিয়ে শক্ত করে বাঁধল। এতে করে লম্বা কালো পিগটেইলটা পেছনে দুই কাঁধের মাঝে পড়ে রইলো।

“আমরা কী প্রস্তুত?” সে মাস্তুলের দিকে ঝুঁকে এমনভাবে মসিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল যেন সে কোনো নারীকে সূর্যাস্ত দেখানোর জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

“ক্যাপ্টেন। দেখিয়ে দিন এখনো আপনার মাস্তুলের ওপর উঠার ক্ষমতা রয়েছে আগের মতই”, একজন নাবিক চিৎকার করে উঠে।

“আমি বাজি ধরে বলতে পারি ছেলেটি ক্যাপ্টেন-এর আগে মাস্তুলের ওপর উঠে পড়বে।” একজন নাবিক তার পাশের জনকে বলছিল।

“নাহ”, ক্যাপ্টেন কার্টনির জন্মই হয়েছে মাস্তুলের ওপর উঠার জন্য। সে সবসময় ওখানে রাজার মতই থাকবে”, অন্য লোকটি জবাব দিতে শুরু করল।

“তোমাকে আমার জন্য হলেও জিততে হবে, ডালিং”, জুডিথ ফিসফিস করে বলে উঠল।

“তোমরা সবাই কাজে যাও, বদমাশের দল”, হাল অলসভাবে বসে থাকা নাবিকদের উদ্দেশ্যে খেঁকিয়ে উঠল। যদিও সে খুব ভালভাবেই জানে যে ওরা কেউ ক্যাপ্টেন-এর মাস্তুলে উঠা না দেখে যাবে না।

অ্যাবোলি প্রতিযোগীদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা সবাই তৈরি?” সে তার দুই হাত বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিযোগীদের উদ্দেশ্যে তাকাল। দুজন প্রতিযোগই তার দিকে তাকিয়ে হাঁ-সূচক মাথা নাড়াল যদিও তখন দুশ্চিন্তায় তাদের শরীর কাঁপছিল।

“গো!” অ্যাবোলি চিৎকার দিয়ে উঠল। মসি এত দ্রুত দৌড়াতে শুরু করে যে দেখে মনে হয় কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে মাস্তুলের ওপর উঠে যাবে। সত্যিটা হচ্ছে, অ্যাবোলির মুখের শব্দ শেষ হওয়ার পূর্বেই সে দৌড়াতে শুরু করে দিয়েছিল।

দুর্ভাগ্যবশত হাল তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে অল্প একটু সময় পরে দৌড়াতে আরম্ভ করেছিল। ইতোমধ্যেই গরমের কারণে ঘামের পানি তার কপাল চুঁইয়ে পড়ছে। তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। সে মাস্তুলটাকে তার এবং সূর্যের মাঝে রাখার চেষ্টা করছে। তারপরও সে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সে যে চেষ্টাটা করছে তা হাল ছোট ছেলেটার সাথে তাল মিলিয়ে উপরে উঠতে।

“ছোকরা জন্মগতভাবেই একজন উপমাস্টারম্যান”, নেড টেইলার মসির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে বলল যে শুনে মনে হচ্ছিল, কোনো শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর প্রশংসা করছে।

নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই প্রতিযোগীদের উৎসাহ দেয়ার জন্য চিৎকার করছে।

“সেটা বুঝলাম। কিন্তু আমাদের ক্যাপ্টেন এখনও পাছায় আগুন লাগা বানরের মতো তড়তড় করে মাস্তুলের ওপর উঠতে পারে”, বিগ ডেনিয়েল গর্বের সাথে বলল।

ডেক-এর যথেষ্ট উপরে থাকায় তাদের কারো কথাই হাল-এর কানে পৌঁছাচ্ছে না। এখন শুধু তার সামনে একটাই চিন্তা : মসিকে কীভাবে ধরে ফেলা যায়। কিন্তু ঠিক তখনই…মসি নিচের দিকে তাকাল।

“চোখ উপরের দিকে উঠাও”, হাল বলে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। মসি প্রায় জমে বরফ-এ পরিণত হয়েছে। তার সারা শরীর কাঁপছে।”

“আমি আটকে গেছি, স্যার!”

“একটা গভীর শ্বাস নাও। এটা তেমন কোনো ব্যাপার না”, হাল বলতে থাকে। “উঠ, আরও উপরে উঠ।” হাল ছেলেটাকে বলতে পারত নিচে নেমে আসতে। কিন্তু সে সেটা করে নি। কারণ সে জানে একবার যদি ছেলেটার মনোবল ভেঙে যায় তাহলে সে আর কোনোদিনও উপরে উঠতে পারবে না।

নিচের সব মানুষ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সমস্ত উত্তেজনা এখন ভয়ে রূপ নিয়েছে। তারা বুঝতে পারছে ছেলেটি এখন কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে। প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে গিয়েছে এরইমধ্যে, কিন্তু মসি-এর চেয়েও বড় এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে আছে।

“আমার পা আমার সাথে প্রতারণা করেছে, স্যার।”

“তুমি যা বলবে ওগুলো ঠিক তা-ই করবে। এখন আর কথা না বাড়িয়ে উপরে উঠতে থাক।”

“আমি নড়তে পারছি না। কান্নার সুরে কথাগুলো বলল ছেলেটা। তার হাঁটুদুটো যথেষ্ট দূরে সরে গিয়েছে। পেট ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়ায় হাল তার বুকের পাঁজরের প্রতিটা হাড় গুনতে পারছে।

“তুমি যদি মাস্তলের চূড়ায় উঠতে না পারো তবে পরবর্তী বন্দরে আমি তোমাকে দাসের বাজারে বিক্রি করে দেব”, হাল ছেলেটাকে হুমকি দিল। হাল জানে এটা একটা নিষ্ঠুর হুমকি। কিন্তু উচ্চতার চেয়েও বড় ভয়ের কোনো কিছু তার সামনে দাঁড় করাতে হবে। আর হুমকিতে কাজ হলো। যদিও মসি কাঁপছে, কিন্তু এরপরেও সে আস্তে আস্তে উপরে উঠার চেষ্টা করছে।

“এইতো কাছাকাছি পৌঁছে গেছ, আর বেশি দূরে নয়”, হাল বলল।

“হ্যাঁ স্যার”, মসি বলল। পা কাঁপুনিকে অনেক কষ্টে দমিয়ে রেখে উপরে উঠছে সে।

অবশেষে ছেলেটা তার পা বাঁকিয়ে রেটলাইন-এর ওপর উঠিয়ে দিতে সক্ষম হলো। এরপর মাস্তুলের চূড়ায় উঠে বসলো সে।

“আমরা তোমাকেই টপমাস্টারম্যান বানাব”, হাল উঠে মসির পাশে বসার পর বলল। ওরা উপরে বসার পর নিচ থেকে সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠেছে।

কিন্তু মসি এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

“তুমি বেশ ভাল করেছ”, হাল মসিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে বলল। হাল নিজের কাজেও বেশ খুশি। কারণ এতদিন পর উপরে উঠার চেষ্টা করে তার নিজেকেও বেশ ধকল সইতে হয়েছে। “জাহাজের সব লোক তোমার কাজ দেখেছে। তুমি সবার আস্থা অর্জন করেছে। তাকিয়ে দেখ, সবাই তোমার কাজে খুশি হয়ে চিৎকার করছে।”

“কিন্তু আমি…আমি কিছুতেই নড়তে পারছিলাম না।”

“তুমি নিচের দিকে তাকিয়েছিলে”, হাল বলল। “আমি তোমাকে সেটা করতে মানা করেছিলাম।”

নিজের কাজের জন্য মসি বেশ লজ্জিত হয়ে পড়ল। কিন্তু হাল ছেলেটার প্রতি আদুরে ভাব না দেখিয়ে আবারও তাকে পরীক্ষায় ফেলার চেষ্টা করল। “আমরা তোমার উপরে উঠার পরীক্ষা নিয়েছি। এখন আমরা তোমার চোখের দৃষ্টির পরীক্ষা নেব।”

অনেক দূরে একটা জাহাজ খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটার নিশ্চয়ই কোনো তাড়াহুড়ো আছে, হাল মনে মনে চিন্তা করল। জাহাজটার বাইরের দিকটা দেখে পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু সে চিনতে পারছে না। ড্যাম! আমার দৃষ্টিশক্তি কী আমার সাথে প্রতারণা করছে নাকি, হাল মনে মনে ভাবল।

“বলতো ওটা কী রঙের পতাকা উড়িয়ে যাচ্ছে?” সে মসিকে জিজ্ঞেস করল।

“কোনো রঙেরই না, ক্যাপ্টেন”, মসি তার চোখের শেষ পানির ফোঁটাটাও মুছতে মুছতে জবাব দিল।

“অদ্ভুত”, হাল বিড়বিড় করে উঠল। ব্যাপারটা ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য তার আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত কিন্তু প্রথমবার উঠার চেয়ে নামাটা মসির জন্য কঠিন হতে পারে। তাই তাকে গাইড করে নিচে নামিয়ে নিতে হবে এখন।

“ঠিক আছে, মসি, চল এখন আমরা ডেক-এ নেমে যাই।”

“আমার পা আমার সাথে আর কখনো এরকম বেইমানি করবে না, ক্যাপ্টেন”, মসি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল।

“আমি জানি সেটা”, হাল মসিকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল। “চল, আমরা এখন নিচে নামব।”

*

এলিফ্যান্ট লেগুন-এর পাথরের ওপর বেড়ে উঠা গাছের আড়ালে লুকিয়ে বন্দুক তাক করে রেখেছে বুজার্ড। তার পাশেই কামান বসানোর সেই পুরনো জায়গা দেখা যাচ্ছে যেখানে বহুদিন পূর্বে কার্টনি আস্তানা বানিয়েছিল নেভীদের হাত থেকে নিজের বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য।

আশেপাশে নৌকো বা মানুষের বসবাসের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তার বদলে চকচকে সাদা বালি দেখা যাচ্ছে। তিনটা হাতি পানির ধারে খেলা করছে। কিন্তু এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো মন মানসিকতা বারোস-এর নেই।

“ড্যাম ইউ! আমি আমার লোকদেরকে বিদ্রোহের জন্য জাহাজটাকে প্রস্তুত করতে বলেছি এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু তার ফল কী হল? কিছুই না। কার্টনি পালিয়েছে। আমি সোনাদানার কোনো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না।”

“নাকি কান্না বন্ধ কর। তোমার জাহাজের তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। পালের কয়েকটা জায়গায় একটু ছিঁড়ে গিয়েছে এবং কয়েকটা কাঠ নষ্ট হয়েছে। কেপ-এর বোটইয়ার্ড-এ একদিনেই সেটা ঠিক করে ফেলা যাবে। আর এই যাত্রার শেষে যখন তোমার লোকেরা ভালকিছু জিনিস হাতে পাবে তখন তারা এমনিতেই খুশি হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আমি এখানে ভাল খারাপ কিছুই দেখতে পাচ্ছি না”, বারোস-এর গলার স্বর আস্তে আস্তে উঁচুতে উঠতে থাকে।

“তোমার কী মনে হয় সবকিছু তোমার জন্য বীচ-এ ছড়ানো থাকবে?” বুজার্ড তার মুখোশের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বারোস-এর দিকে তাকাল। “আমার সঙ্গে এসো।”

“নিচে নামা কী ঠিক হবে?” বায়োস জিজ্ঞেস করল। এই প্রথম বারোসকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। যে প্রাণীগুলোর কারণে এই জায়গাটার নামকরণ করা হয়েছে তারা বারোস-এর মনে ভয় জাগাতে পেরেছে।

তারা পাথরের উপরের দিয়ে ভেতর দিকে এগুতে থাকে। ওরা সেই পুরনো কুড়েঘরগুলো দেখতে পেল যেগুলোতে বুজার্ড আর কার্টনি উভয়েই একসময় ঘুমিয়েছিল এককালে।

“তখন আমি পরিপূর্ণ মানুষ ছিলাম। আমার দুটো হাত ছিল এবং আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পারতাম”, বুজার্ড মনে মনে ভাবতে থাকে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা ছাই-এর চিহ্ন দেখতে পায় সে যেগুলো পুরনো ক্যাম্পফায়ার-এর চিহ্ন বহন করছে।

“অনেক দিন যাবত এখানে কেউ আসে না”, বুজার্ড নিজের মতামত ব্যক্ত করল।

“যদি আমি কার্টনি হতাম তবে আমি কখনোই আমার লোকদেরকে উপকূলে নিয়ে আসতাম না। বারোস বলতে থাকল। তাদেরকে জাহাজে রেখে দুই একজন বিশ্বস্ত অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করতে চলে আসতাম।”

বুজার্ড বেশ উচ্চস্বরে হেসে উঠল। “ইয়ং কার্টনি তা করবে না। সে তার ছেলেদেরকে জাহাজ ছেড়ে বাইরে যেতে দেবে, মাছ ধরতে দেবে কিংবা খাবার সংগ্রহে যেতে বলবে অথবা জাহাজ ঠিক করার জন্য কাঠ সংগ্রহ করার আদেশ জারি করবে।”

“এটা ওর অনেক বড় দুর্বলতা”, বারোস তার মাথা নেড়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল।

“আহ, আর এটাই তার মৃত্যু ডেকে আনবে”, বুজার্ড হাসতে হাসতে বলল। “আর তা খুব শীঘ্রই হবে।”

“তাহলে আমরা এখন কী করব?”

“আমরা আমাদের জাহাজটাকে দক্ষিণ দিকে পরবর্তী সমুদ্র সৈকতে নোঙর করাব। তাহলে কার্টনি আমাদের সন্ধান পাবে না। কারণ সে আসবে। উত্তর দিক থেকে। কার্টনি পৌঁছেই প্রথম যে কাজটা করবে তা হলো লংবোট নিয়ে গুপ্তধনের সন্ধানে বের হয়ে যাবে। সে যখন ফিরে আসবে জাহাজের সবাই তাকে অভিনন্দন জানানোর ব্যবস্থা করে রাখবে।” আমরা যা করব তা হচ্ছে, “ওদের আনন্দ উৎসবের পরপরই হাল-এর শেষকৃত্য আয়োজনের ব্যবস্থা শুরু করে দেব।”

*

নরম শীতল পানির ওপর দিয়ে শক্তভাবে দাঁড় বেয়ে তারা নৌকোটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তাদের আগমনে শান্ত পানিতে ঢেউ ও এর সৃষ্টি হয়। সেই সাথে পানিতে বসে থাকা বন্য পাখির ঝাঁক ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে আকাশে উড়ে যায়। বুনো হাঁসের ডাক চারদিকে ধ্বনিত হতে থাকে।

কিন্তু জায়গাটার নীরবতা নিয়ে তাদেরকে বেশিক্ষণ হতাশ থাকতে হয় নি। যখনই গোল্ডেন বাউ বীচ-এ নোঙর ফেলে, তখন তারা দেখতে পায় কতগুলো বিশালাকার বন্য হাতি দূরে দাঁড়িয়ে আছে। যখন হাতিগুলো এরকম নীরব বনের মাঝে মানুষ দেখতে পেল, তখন তারা তাদের বিরাটাকার মাথাগুলো তুলে কুলার ন্যায় কানগুলো নাড়াতে থাকল, যেন তারা মানুষগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছে।

“ওহ, কী বিশাল জন্তু!” জুডিথ জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে হাতিগুলোকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল।

“সেই সাথে আমার দেখা অনেক মানুষের চেয়েও এরা বেশি চালাক।” অ্যাবোলি তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ধরে রেখে যোগ করল।

“আমরা এগুলোর কয়েকটাকে গুলি করে মারছি না কেন?” বিগ ডেনিয়েল বেশ আগ্রহভরে প্রস্তাব উত্থাপন করল। হাতির দাঁত-এর অনেক দাম, জানোই তো। ওগুলো দিয়ে আমাদের ভাগ্য ফিরে যেতে পারে।

“আমরা এর চেয়ে সহজে অনেক গুপ্তধন পাব, ড্যান”, হাল তার মাথাটা ড্যান-এর দিকে নাড়িয়ে বলল। “আমার মনে হয় ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”

পুরনো দুর্গের ধ্বংসাবশেষ-এর কাছাকাছি এসে হাল তার গোল্ডেন বাউকে নোঙর করল। সবাইকে বন্দুক বের করে গ্রেপশট-এর গুলি লোড করতে আদেশ দিল সে যাতে করে বন্য কোনো উপজাতি বা অন্য কেউ যদি হঠাৎ করে আক্রমণ চালিয়ে বসে, তাহলে সেটা প্রতিহত করতে পারা যায়। এরপর সে জুডিথকে টেনে একপাশে নিয়ে এলো।

“আমি চাই যে তুমি আমার সঙ্গে নৌকোয় না গিয়ে এখানে থাকবে। আমি না থাকলেও এখানে পঞ্চাশজন লোক থাকবে তোমার সঙ্গে। তারা তোমার দেখাশোনা করতে পারবে। তাছাড়া “তোমার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন, পানসির বিরক্তিকর জার্নি তোমার জন্য ক্ষতির কারণ হবে।”

“বাচ্চার জন্য হলেও আমাকে তাই করতে হবে।” তবে “আমাকে কথা দাও যে, তুমি যত শীঘ্রই সম্ভব ফিরে আসবে। আমি তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব”, জুডিথ বলল।

হাল বার জনের একটা দল নিয়ে লংবোট-এ করে পাহাড়ের মধ্যখান দিয়ে বয়ে চলা উপনদীর মাঝ দিয়ে যাত্রা শুরু করল। যাত্রার শুরুর পরই তারা দেখতে পায় যে ধূসর চামড়ার বিশালাকার জম্ভগুলো তাদের দিক থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে।

লম্বা, সোজা একটা রাস্তা পার হওয়ার পর তাদেরকে একটা নদীর বাঁক ঘুরতে হলো। তখন হাল, অ্যাবোলি এবং ডেনিয়েল পাহাড়ের চূড়ায় একঝাঁক বেবুন দেখত পায় যেটা তাদের জন্য একটা নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

গোল্ডেন বাউ যেখানে নোঙর করা আছে সেখান থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে তাদেরকে যেতে হয়। নদীর পানির ধারা আস্তে আস্তে সরু হতে থাকে। যদিও সময়ের সাথে পাহাড়ের চূড়া তাদের দিক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে যেন থর দেবতা তার হাতুড়ি দিয়ে পাহাড় ভেঙে দূরে সরিয়ে দিয়ে গিয়েছে।

“এই সেই জায়গা, মাস্টার ডেনিয়েল”, হাল অন্য নৌকোটির উদ্দেশ্যে বলল। এরপর নৌকোটা দক্ষিণ প্রান্তে ভেড়ানোর জন্য রাডার স্থাপন করল। তার বাবার স্মৃতি বিজড়িত পাথরটার সাথে নৌকোদুটো নোঙর করল সে।

এরপর সেই লোকটির স্মৃতির উদ্দেশ্যে দুই মিনিট নীরবতা পালন করল সে যিনি তাকে জন্ম দিয়েছেন এবং তাকে এই কঠিন বন্ধুর পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত করেছেন। হাল চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল অ্যাবোলি তার দিকে চেয়ে আছে।

তারা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল, এরপর মাথা নাড়ল হাল; এখন কাজ শুরু করার সময় হয়েছে।

হাল উঠে দাঁড়িয়ে দুটো রশির কয়েল তার কাঁধে ঝুলিয়ে রাখল। “আমি প্রথমে যাব, এরপর তুমি”, সে অ্যাবোলির উদ্দেশ্যে বলল। এরপর ডেনিয়েল এর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি চারজনকে সঙ্গে নিয়ে নৌকোয় থাকবে। আমি এখান থেকে যা কিছু নামিয়ে দেব সেগুলো নৌকোয় রাখবে। বাকিরা সতর্ক দৃষ্টি রেখে চারদিক পাহাড়া দেবে, ঠিক আছে?”

পাথরটার পাশে লাফ দিয়ে নামল হাল, তারপর আস্তে আস্তে উপরে উঠতে শুরু করল।

“সাবধানে উঠ, গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি পেছন থেকে বলে উঠল। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

হাল অ্যাবোলির কথা কানে তুলল না। হঠাৎ করেই সে নিজের ভেতর এক ধরনের তাড়না অনুভব করছে। এতদিন পর্যন্ত কী গুপ্তধনগুলো অরক্ষিত অবস্থায় আছে নাকি অন্য কেউ সেটা খুঁজে পেয়েছে?

যদিও সে এখন পর্যন্ত পাথরের মুখে কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছে না। সে উপরে উঠেই যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নৌকোদুটো দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। একসময় গুহার মুখের পাথরগুলো খুঁজে পেল সে। পাথরগুলো আগের মতোই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঠিক যেমনটা বহুবছর আগে সে আর অ্যাবোলি রেখে গিয়েছিল। তার মন আনন্দে ভরে উঠল। এরপর সে আস্তে আস্তে একটার পর একটা পাথর সরাতে থাকল।

গর্তের মুখটা যখন যথেষ্ট বড় হয়ে গেল তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে সেটার ভেতর প্রবেশ করল। আস্তে আস্তে গুহার ভেতর উঠে দাঁড়াল সে। গুহার ছাদটা অমসৃণ এবং বেশ নিচু। সে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল যতক্ষণ পর্যন্ত না তার চোখ অল্প আলোতে মানিয়ে চলতে সক্ষম হয়।

আস্তে আস্তে মাথার উপরের দেয়াল হাতড়ে দেয়ালের পাশে রাখা মশালদুটো খুঁজে পায় সে। মশাল দুটো বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল হাল; সে আর তার পিতা শেষবার এখানে আসার সময় এ দুটো জিনিস এখানে রেখে গিয়েছিল। ওর বাবার স্পর্শ লেগে আছে ওগুলোতে।

গুহার মেঝেতে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল হাল। স্টীলের পাত আর পাথর বের করে সে দুটোয় ঘষে মশালে আগুন জ্বালাল সে।

হাল মশালের আলোতে গুহার চারদিকটা ভাল করে দেখতে থাকে।

এখনো সবকিছু অক্ষত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটা ব্যাগ, প্রত্যেকটা ব্যারেল, প্রত্যেকটা থলে এবং বাক্সগুলো একই রকমভাবে রয়ে গিয়েছে-ঠিক যেভাবে সে আর তার বাবা রেখে গিয়েছিল। রুপার পাত আর সোনার পিণ্ডগুলোও এখনো একই রকমই আছে।

হাল বসে বসে তার বাবার সেই কথাগুলো মনে করতে থাকে।

“ঈশ্বর আমাদের সবার জন্য মৃত্যু লিখে রেখেছেন। যখন আমার মৃত্যুর সময় আসবে তখন আমি প্রার্থনা করব আমার উত্তরাধীকার সূত্রে তুমি যেন এই গুপ্তধনের মালিক হও।”

“এই গুপ্তধন প্রয়োজনের চেয়েও অনেক-অনেক বেশি, বাবা। এত বেশি সম্পত্তি দিয়ে আমি এখন কী করব?” হাল বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠল। প্রায় সাথে সাথে আরেকটি কণ্ঠ জবাব দিল।

“যেমন ধরো : ভিসকাউন্ট উইন্টারটন-এর কাছে গোল্ডেন বাউ-এর জন্য যে ঋণ রয়েছে তোমার সেটা সবার প্রথমেই শোধ করতে পারো। এরপর ইংল্যান্ড-এর ঝকঝকে উপকূল এলাকায় কয়েক হাজার একর ভূমি কিনতে পারো। সেখানে বাড়ি বানিয়ে তোমার ভালবাসার মানুষ এবং এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার শুরু করে দিতে পারো।”

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল হাল। পেছনে তাকিয়ে দেখল, অ্যাবোলি দাঁড়িয়ে আছে। সে এই বয়সে এতটা উপরে উঠার কারণে হাঁপাচ্ছে। হাল এগিয়ে গিয়ে ওকে আলিঙ্গন করল। এরপর দুজনে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, যেন তারা দুজন তাদের অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা সেই লোকটির উদ্দেশ্যে নিবেদন করছে যে তার ছেলের ভাগ্য নিজের জীবন দিয়ে গড়ে দিয়ে গিয়েছে। তারা দুজন তার সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা মনে করতে থাকে যে মৃত্যুযন্ত্রণা ডাচ কলোনীর গভর্নর ভ্যান ডি ভেলডির আদেশে স্লো জন তাকে দিয়েছিল।

“এই সম্পত্তিগুলোর জন্য উনার ঐ অমানুসিক নির্যাতন সহ্য করার কোনো প্রয়োজন ছিল, অ্যাবোলি?” হাল অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

“তোমার পিতা তা-ই ভাবতেন।” অ্যাবোলি কাঁধ ঝাঁকাল। তিনি তার জীবন দিয়েছেন এই সম্পদের জন্য। এখন তোমার দায়িত্ব হচ্ছে তা গ্রহণ করা যেন তার ত্যাগ সার্থক হয়।

“ধন্যবাদ, অ্যাবোলি”, হাল নরম সুরে অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে বলল। “আপনার এই উপদেশটুকু ছাড়া আমি হয়ত এই সম্পদ গ্রহণ করার সাহস পেতাম না। আর সেজন্য আমাকে সারাজীবন আফসোস করতে হত।”

.

সমস্ত গুপ্তধন আর সোনা-দানা পাহাড়ের চূড়া থেকে নামিয়ে নৌকোয় উঠাতে তাদের দুই দিন লেগে যায়। যখন সব নৌকোয় উঠানো শেষ হয়, তখন দেখা যায় নৌকোয় বসার জন্য কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। তারপরও তারা কোনোভাবে নৌকোয় উঠে বসল। রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে পরদিন সূর্য উঠার পূর্বেই তারা বাউ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দিল।

গোল্ডেন বাউ যেখানে নোঙর করা আছে সেখান থেকে অল্প কিছু দূরত্বে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করেই আকাশে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পেল ওরা। তারা সবাই চমকে গিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। যদিও আকাশ মেঘে ঢেকে আছে কিন্তু ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস নেই।

“বজ্রপাত?” ডেনিয়েল চমকে উঠে চিৎকার করে অন্য নৌকোর উদ্দেশ্যে বলল।

“না”, অ্যাবোলি চিৎকার করে পেছনের নৌকোকে জবাব দিল। “এটা বজ্রপাত নয়। কামানের গুলি।”

“গোল্ডেন বাউ বিপদের সংকেত পাঠাচ্ছে!” হাল চিৎকার করে উঠল। “জাহাজটাকে নিশ্চয়ই কেউ আক্রমণ করেছে!”

সে বুজার্ড নয়। যদি কেউ সেটা ভেবে থাকে তবে সে ভুল করছে। সে এখন পুরনো সেই অ্যাঙ্গাস কোকরান, আর্ল অব কামব্রা এবং নটনিয়ার নাইট অব দ্য টেম্পল অব দ্য অর্ডার অব দ্য জর্জ এন্ড দ্য হলি গ্রেইল। ঠিক যেমনটা হাল কার্টনি আর তার পিতা ছিল।

তাদের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে এই যে তারা দুইজন নিজেদের সম্মান ও সুনামের ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিল এবং ক্রিস্ট ও হলি গ্রেইলের জন্য যুদ্ধ করেছে সব সময়, অথচ অ্যাঙ্গাস কোকরান শুরু থেকেই জানতো যে এইসব হচ্ছে অর্থহীন মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা। প্রিন্স জাহান যেভাবে তাকে মুখোশ পরিয়ে অপমান করেছিল এবং দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য করেছিল, ঠিক সেভাবেই, তারাও তাকে অপমান করার জন্য একটা নাম দিয়েছিল-বুজার্ড, যার অর্থ, তীক্ষ্ণ নাকওয়ালা বাজপাখি।

কিন্তু এই বাজপাখির ন্যায় লম্বা নাকওয়ালা মুখোশই তাকে এখন শক্তিশালী করে তুলেছে। এটা তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। এটা তার নষ্ট হয়ে যাওয়া মুখচ্ছবিকে ঢেকে রেখেছে এবং তাকে রহস্যময় এক নতুন সৃষ্টিতে পরিণত করেছে। এটাই তার শত্রুর মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। এই মুখোশই তাকে আরেকবার এর মতো শক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত করেছে।

সে তার ফাঁদ পেতে দিয়েছে এবং হাল কার্টনিও ভালভাবেই সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।

কোকরান হয়ত তার একটি হাত, একটি চোখ এবং লিঙ্গের অধিকাংশ অংশ হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু তার ব্রেইন এখনো কাজ করছে। তার ডান হাতের তলোয়ার এখনো মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করার জন্য যথেষ্ট।

গোল্ডেন বাউ-এলিফ্যান্ট লেগুন-এ পৌঁছার পর থেকেই মাদ্রি দি ডিয়াস যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। এখন টপমাস্টম্যান তার স্টেশনে প্রস্তুত আছে, গানরা কামানে গুলি লোড় করে এর পেছনে অপেক্ষা করছে।

বুজার্ড-এর স্পাইরা তাকে খবর দিয়েছে যে তারা দুটো পানসিকে গোল্ডেন বাউ থেকে ছেড়ে যেতে দেখেছে। পানসি দুটো লেগুন-এর চূড়ার দিকে গিয়ে নদী পথের বাঁকের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে। টেলিস্কোপ দিয়ে তারা হাল কার্টনি আর অ্যাবোলিকে চিনতে পারল। কিন্তু ফেরার সময় আর তাদেরকে দেখতে পায়নি ওরা। হয়ত রাতের বেলা পাহারাদার ঘুমিয়ে পড়েছিল একারণে দেখতে পায়নি।

কিন্তু তাদেরকে না জানিয়েই ওরা এলিফ্যান্ট লেগুন ছেড়ে যেতে পারবেনা।

অপেক্ষা করতে করতে চতুর্থ দিন সূর্য উঠার পূর্বে বুজার্ড তার ফাঁদ গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার নাবিকদেরকে নিয়ে রণতরী সাজিয়ে ইন্ডিয়ান সাগরে এলিফ্যান্ট লেগুন-এর প্রবেশ পথ দিয়ে এগুতে থাকে। সে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর সম্মুখভাবে টেলিস্কোপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। মুখোশ-এর ভেতর থেকে এক চোখের দৃষ্টি টেলিস্কোপ-এর ভেতরে নিবিষ্ট করে রাখল। সে দেখতে পেল, গোল্ডেন বাউ লেগুন-এর ভেতরের দিকে নোঙর করা আছে। এর গানপোর্টগুলো বন্ধ এবং মাস্তুলে কোনো পাল লাগানো নেই। জাহাজের ডেকটা খালি পড়ে আছে এবং মাস্তুলের চূড়ায় শুধু একজন পাহারাদারকে দেখা যাচ্ছে।

একটা পানসি তীরে ভেড়ানো আছে। নাবিকেরা নিশ্চয়ই খাবার পানি সংগ্রহ করছে। আরেকটা পানসিতে করে নাবিকেরা আগুন জ্বালানোর কাঠ সংগ্রহ করছে। কয়েকজন নাবিক তীরে আগুন জ্বালিয়ে বসে বসে নাস্তা খাচ্ছে।

সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে হাল লম্বা নদীপথ পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে নিশ্চয়ই কেপ অফ গুড হোপ-এর পাশ দিয়ে আটলান্টিক সাগর হয়ে ব্রিটিশ দ্বীপে যাবে। কিন্তু তার নাবিকেরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাই তিন মাস্তুল বিশিষ্ট যুদ্ধ জাহাজ নীরবেই এলিফ্যান্ট লেগুন-এর প্রবেশ পথ দিয়ে এগুতে লাগল।

বুজার্ড ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন বারোস-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওদের উদ্দেশ্যে অন্তত একটা গুলির আওয়াজ করুন যেন বোকা বানরগুলো অন্তত সজাগ হতে পারে, প্লিজ, ক্যাপ্টেন।”

বাবোস তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা গানার মাস্টার-এর উদ্দেশ্যে একটা হাততালি দিল। এরপর তীব্র কামানের শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।

ব্রিটিশ নাবিকেরা হতবাক হয়ে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর আগমন দেখতে থাকল।

“গোল্ডেন বাউ-এর দিকে জাহাজ চালনা কর, বুজার্ড তার পরবর্তী আদেশ দিল। ওটাকে এখন সহজেই আক্রমণ করা যাবে। কারণ ওর নাবিকেরা এখন দূরে দূরে রয়েছে।” সে তার গলা পরিষ্কার করে আরও পরিষ্কার কণ্ঠে বলতে থাকল, “আমি কার্টনিকে চাই। তোমরা কী শুনতে পেয়েছ? কার্টনি যদি জাহাজের ওপর না থাকে তবে আমি তার স্ত্রীকে চাই।”

জুডিথ নাজেত তার এবং হাল-এর কেবিনটাতে বসে বিশ্রাম করছিল। সে জানালার পাশে লেখার ডেস্কটাতে বসে ছিল। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে তাকিয়ে দেখল যে মসি তার কোঁকড়া চুল নাড়িয়ে কেবিন-এ প্রবেশ করছে।

“গুড মর্নিং, মাই কাইন্ড মিসট্রেস, আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে এসেছি। চিনি এবং দুধ ছাড়া।”

“ধন্যবাদ”, মসি। কিন্তু “তুমি কীভাবে জান যে আমি এটা পছন্দ করি?”

“কারণ আপনি সবসময় এভাবেই কফি পান করেন।” সে চেহারায় একটা ঝকমকে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল। এটা তাদের নিত্য নৈমত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মসি সবসময়ই চুপচাপ কেবিন-এ প্রবেশ করে কফি হাতে জুডিথ-এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না জুডিথ টের পায়।

“আমি কী বাতিগুলো নিভিয়ে দেৰ, মাই লেডি?” সে হাত বাড়িয়ে মাথার উপরের বাতিগুলো নেভানোর জন্য উদ্যত হলো।

“না থাক, ধন্যবাদ মসি। এখনো বাইরে বেশ অন্ধকার। সূর্যের আলো পুরোপুরি উঠেনি।”

মসি মাথা নাড়াল এবং কপালের সামনের কেশগুচ্ছ সরাতে সরাতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। জুডিথ নিজের মনে হেসে উঠল। সে ছেলেটিকে সত্যিই বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছে। এরপর সে কলমের নিবটা কালির দোয়াতে ডুবিয়ে লিখতে শুরু করল, “ছোট্ট বর্বরটা আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করেছে, সেই সাথে আমাকে সারা রাত জাগিয়ে রেখেছে ও। সে যখন বের হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে, কেবল তখনই আমি স্বস্তি পাব।”

কামানের গুলির শব্দটা এতটা কাছে হলো যে মনে হচ্ছে, সে যে কেবিনে বসে আছে সেটাতেই শব্দটা হয়েছে। সে এতটাই চমকে যায় যে হাত থেকে কলম পড়ে গিয়ে কাগজে কালি ছড়িয়ে পড়ে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে।

জুডিথ যেখানে বসে আছে জাহাজটি সরাসরি সেদিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু জাহাজটি সে এর পূর্বে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু জাহাজের লোকদেরকে দেখে মনে হচ্ছে তারা যুদ্ধের ধামামা বাজিয়ে কোনো ক্ষতি সাধনের জন্যই এগিয়ে আসছে।

জাহাজটাতে যুদ্ধের সবরকম প্রস্তুতিই দেখা যাচ্ছে। সব গানপোর্টই ভোলা দেখা যাচ্ছে। কামানের লম্বা নল বের হয়ে আছে।”

জুডিথ-এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ডেস্ক-এর উপরের ড্রয়ারটা টান দিল। ওটাতে দুই জোড়া পিস্তল সাজানো আছে। একজোড়া পিস্তল সে কোমড়ের হলুদ ফিতায় আটকে রেখে আরেকজোড়া পিস্তল দুই হাতে নিয়ে গুলি করার জন্য উদ্যত হলো। এরপর কেবিন-এর দরজাটা পিঠ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে ডেক-এর দিকে উঠতে শুরু করল।

সে ডেক-এর ওপর পৌঁছার পূর্বেই তার পায়ের নিচে জাহাজটা কাঁপতে থাকল এবং এরপর আরও একটা শক্ত ধাক্কা লাগল ওর শরীরে। ক্রমাগত বন্য চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে আশেপাশে। সে দ্রুত ডেক-এর ওপর উঠে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে থাকল।

আরেকটা জাহাজ গোল্ডেন বাউ-এর পাশে দাঁড় করানো আছে। ওই জাহাজটা থেকে অনেক হুক বেরিয়ে ওটাকে বাউ-এর সাথে আটকিয়ে রেখেছে। গানেল-এর ওপর দিয়ে একটা লোকের মাথা দেখা যাচ্ছে। হাল-এর বর্ণনা শুনে-বিশেষ করে ওর মুখের কোণায় গোলাপি কাটা দাগ দেখে-সে লোকটাকে চিনতে পারল।

সেই পর্তুগীজ জাহাজের মালিক যে জাহাজে করে হালকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। লোকটির নাম জাও বারোস এবং জাহাজটির নাম হচ্ছে মাদ্রি দি ডিয়াস, সে এই মুহূর্তে নিশ্চিত যে বাউ-এর পাশে দাঁড় করানো জাহাজটিই হচ্ছে সেই জাহাজ।

এরপর আর কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করে ডান হাতে পিস্তলটা নিয়ে তাক করে গুলি ছুঁড়ে দিল জেনারেল জুডিথ নাজেত। গুলিটা গিয়ে বারোস-এর কপালের মাঝখানে আঘাত করল। বারোস এমনভাবে কেঁপে উঠল যে দেখে মনে হচ্ছে, গুলিটা তার মাথা ভেদ করে চলে গিয়েছে। বাতোস কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার সাথে-সাথে তার মাথার জায়গায় আরেকটা মাথা ভেসে উঠল।

এই মাথাটা হচ্ছে মানুষের চেহারা বিহীন একটা মাথা, যেখানে মুখের পরিবর্তে চামড়ার একটি মুখোশ পরানো আছে। মুখোশে একটিমাত্র চোখ আর ঈগলের ঠোঁটের মতো নাক রয়েছে। নাক-এর নিচে সাদা দাঁতের কতগুলো চিহ্ন আঁকা আছে যেগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে সার্কাস-এর পাপেট শো করার জন্য কাউকে সাজানো হয়েছে।

“বুজার্ড,” জুডিথ এমনভাবে বলে উঠল যে মনে হচ্ছিল তার হার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং সমস্ত শরীর প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। সে ডান হাতের ফাঁকা পিস্তলটা ফেলে দিয়ে বাম হাতের পিস্তলটা নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বুজার্ড এত দ্রুত এগিয়ে এসে ব্লেডটা চালনা করল যে পিস্তলটা তার হাত থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। পিস্তলটা গড়াতে গড়াতে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। সেই সাথে আঘাতের ফলে তার হাতটা যেন জমে বরফ-এ পরিণত হয়েছে। তাই সে হাত দিয়ে কোমড়ের ফিতায় আটকানো পিস্তলটা ধরারও চেষ্টা করল না। কারণ তাহলে হয়ত দানবটা তলোয়ার দিয়ে তার হাতই কেটে ফেলবে। যখন সে বুঝতে পারে যে সে বুজার্ড-এর তলোয়ার-এর নিচে আটকা পড়ে যাচ্ছে তখন সে আস্তে আস্তে পেছাতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে পেছন দিকে নামতে নামতে তার পা গাউনের নিচের অংশের ওপর গিয়ে পড়ে। হ্যাঁচকা টানের কারণে কোমড় থেকে পিস্তল দুটো খুলে মাটিতে পড়ে গেল। ওগুলোর একটা থেকে গুলি বের হয়ে কাঠের দেয়ালে গিয়ে লাগল।

সে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে উপরে তাকিয়ে দেখতে পেল বুজার্ড অগ্নিমূর্তি ধারণ করে নিচে নেমে আসছে। কিন্তু সে অন্যান্য মানুষের চেয়ে বেশ উঁচু এবং তার কাধ বেশ চওড়া, তাই তাকে বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে হচ্ছে।

জুডিথ ঘুরে দাঁড়িয়ে তার কেবিন-এর দরজার দিকে দৌড়াতে থাকে। কেবিন-এ প্রবেশ করে সে ঝনাৎ করে দরজা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করল।

কিন্তু ততক্ষণে বুজার্ড তীব্র গতিতে দরজার গায়ে ধাক্কা বসিয়ে দিয়েছে। ছিটকে বিছানার ওপর পড়ে গেল জুডিথ।

বুজার্ড জুডিথ-এর মাথা বরাবর তলোয়ার দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করল কিন্তু জুডিথ গড়িয়ে অন্যপাশে সরে যাওয়ায় অল্পের জন্য শেষ রক্ষা হলো। বুজার্ড-এর তলোয়ারটা বিছানার কাঠের সাথে আটকে গেল। এক হাত দিয়ে তলোয়ারটা ছুটানোর চেষ্টা করতে-করতে মুখ দিয়ে নোংরা ভাষা ছুঁড়ে মারছিল সে।

“নোংরা বেশ্যা, আমি তোর পেট কেটে ওটার ভেতর থাকা জারজটাকে বের করে আনব। এরপর আমি ওটাকে টুকরা টুকরা করে ফেলব। তারপর মাংসগুলো তোকে খাইয়ে দেব।” এখনো সে ব্লেডটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না।

জুডিথ বিছানা থেকে গড়িয়ে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার কিছু একটা করা উচিত। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই এবং বুজার্ড একমাত্র দরজাটি আগলে দাঁড়িয়ে আছে। এখন তার একমাত্র পালাবার পথ হচ্ছে কেবিনের জানালা। সে যদি জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে সাগরে পড়তে পারে তাহলে অন্তত সাঁতরে তীরে উঠার একটা সুযোগ থাকবে।

জুডিথ পাটাতনের কাছ থেকে সরে এসে জাহাজের স্টার্ন-এর দিকে এগুতে থাকে। বুজার্ড দেখতে পায় জুডিথ-এগিয়ে আসছে। তাই সে তলোয়ার-এর বাঁট ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে জুডিথকে আটকাতে যায়। জুডিথের কাঁধ লক্ষ্য করে ঘুসি চালিয়েছে বুজার্ড, যেটা তার লক্ষ্য মিস করেনি। পিছলে নিজের ডেস্কের ওপর পড়ে গেল জেনারেল জুডিথ নাজেত। এরপর লাফ দিয়ে ডেস্কের ওপর উঠে দাঁড়াল বুজার্ড। সে তার তিন আঙুল বিশিষ্ট হাত দিয়ে জুডিথকে ধরতে গেল।

“প্লিজ”, জুডিথ আর্তনাদ করতে থাকল, “আমার বেবীকে বেঁচে থাকতে দাও।”

আর ঠিক তখনই সে মাথার পেছনে গরম কিছু একটা অনুভব করল। এক হাত উঠিয়ে সেটা থেকে বাঁচতে চাইলো সে। অয়েল ল্যাম্প-এর কাঁচের ফানেলের স্পর্শ লাগল হাতে, সেই সাথে আগুনের শিখায় হাতের চামড়ার কিছু অংশে ফোঁসকা পড়ে গেল। জুডিথ-এর মনে হঠাৎ করেই একটা আশা জেগে উঠল। সে তেলের পাত্রটা দুই হাত দিয়ে শক্তভাবে ধরে ব্র্যাকেট থেকে ছুটিয়ে আনল। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে তেলের পাত্রটা দিয়ে বুজার্ড-এর মাথায় আঘাত করে বসলো জুডিথ।

বুজার্ড-এর মাথায় আর সমস্ত শরীরে তেল ছড়িয়ে পড়ল। সাথে-সাথেই ধপ করে আগুন ধরে গেল ওর দেহে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের শিখা বুজার্ডের চামড়ার মুখোশকে পুড়িয়ে দিয়ে ওর ক্ষতবিক্ষত মুখকে আরো একটিবারের জন্য উন্মোচন করে দিল। পাগলের মতো লাফাতে লাফাতে পেছাতে চেষ্টা করল জুডিথ। একপর্যায়ে বিছানার ওপর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। বিছানার চাদরে আগুন লেগে গেল নিমিষেই। চোখের পলকেই সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল।

দরজা ফাঁকা পেয়ে দৌড়ে বের হয়ে এলো জুডিথ। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডেকের ওপর চলে এলো সে। খোলা ডেক-এর ওপর এসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার পাশাপাশি ফোঁপাতে শুরু করল ও।

একজোড়া শক্ত বাহু পেছন দিক থেকে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে সিক্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করল, “ঈশ্বরের দোহাই লাগে, তোমার কী হয়েছে তা কী একটু বলবে? তুমি এভাবে ফোপাচ্ছ কেন?”

জুডিথ ঘুরে দাঁড়াল। হাল দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। সাথে-সাথে হাল এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। “থ্যাংকস গড় যে তুমি এখানে চলে এসেছ! ও আমাকে আর আমার বেবীকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল!”

“কে?”

“বুজার্ড।”

“কোকরান?” “সে এখন কোথায়? তাকে থামাতেই হবে।”

“সে আমাদের কেবিন-এ আছে। কিন্তু জাহাজে আগুন ধরে গিয়েছে। আ…আমি দুঃখিত…এছাড়া তাকে থামানোর আর কোনো রাস্তা ছিল না আমার হাতে…”

হাল আশেপাশে তাকিয়ে বিপদটা বোঝার চেষ্টা করল। সে তাকিয়ে দেখল যে আগত জাহাজটা তাদের জাহাজ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে-যে পথে ওটা এসেছিল, ঠিক সেই পথে।

“ওদেরকে চলে যেতে দাও”, হাল সিদ্ধান্ত নিল। “আগুন কোথায়? তুমি বলছিলে আমাদের কেবিনে।”

জুডিথ দ্রুত মাথা নাড়াল। “হ্যাঁ, সত্যিই। আমাদের কেবিনে।”

হাল জুডিথকে ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। “অ্যাবোলি! বিগ ড্যান! আগুন লেগেছে! আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কর! জলদি!”

.

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পুরো জাহাজের সব পাম্প, সমস্ত নাবিকের শ্রম আর পুরো অর্ধেকটা দিন লেগে গেল। অবশেষে হাল যখন জুডিথকে সাথে নিয়ে কেবিন-এর ভেতরে গেল তখনও ধোয়ার গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। পুড়ে কুকড়ে যাওয়া মৃতদেহটা ওদের সামনেই বিছানার ওপর পড়ে আছে।

“এটা কী বুর্জাড?” জুডিথ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তাকে দেখতে বেশ ছোট মনে হচ্ছে।”

“আগুন তার এই অবস্থা করেছে। হাল তার বাহু দিয়ে জুডিথকে জড়িয়ে ধরে বলল। “প্রথমবার সে কোকরান হিসেবে পুড়েছিল। এখন সে বুজার্ড হিসেবে পুড়েছে।”

হাল-এর বাহুবন্ধনে মাথা রেখেও কাঁপছিল জুডিথ। তাই হাল তাকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এর ওপর উঠতে থাকল সে। সিঁড়ির চুড়ায় বিগ ডেনিয়েল ফিশার অপেক্ষা করছিল।

“আদেশ করুন। ক্যাপ্টেন।”

“প্রথমত” হাল জবাব দিল, “নৌকো থেকে কার্গোগুলো নিরাপদে নামিয়ে জায়গামত রাখ।”

গুপ্তধনের কথা বলায় সাথে-সাথে বিগ ডেনির মুখে হাসি ফুটে উঠল।

“আই, আই, ক্যাপ্টেন। এরপর কী করতে হবে বলুন।”

“কাঠুরেদের বল পুড়ে যাওয়া কেবিনটা ঠিকঠাক করতে। এবার তাদেরকে বলবে যে তারা যেন সাদা রং করে। আমি আর জুডিথ আকাশী রং দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”

ডেনি হাল-এর আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে চলে গেল। এরপর হাল জুডিথ-এর দিকে ঘুরে দাঁড়াল, সেই সাথে তার হাত ধরে পুপ ডেক-এর ওপর নিয়ে এলো। এখন একমাত্র এই জায়গাটিতেই তারা একটু নীরবে সময় কাটাতে পারবে।

তারা দুজন রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। জুডিথ হাল-এর কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। অবশেষে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আস্তে ধীরে কথা বলতে শুরু করল জুডিথ।

“গ্রেইল রক্ষা পেয়েছে। আমার দায়িত্ব শেষ। আমি যুদ্ধ করতে করতে আর হত্যাযজ্ঞ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আমাদের জন্য কী এমন কোনো জায়গা খুঁজে নিতে পারবে না যেখানে তুমি, আমি আর আমাদের সন্তান বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারব?”

“তুমি এইমাত্র যে জায়গাটার কথা বললে, ওটার নাম হাই ওয়েল্ড,” হাল শব্দ করে হেসে বলল।

“হাই ওয়েল্ড? কী অদ্ভুত নাম রে বাবা! কী এটা? আর এটা আছেই বা কোথায়?”

“ইংল্যান্ডের দক্ষিণেই আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা বলতে পায়রা ওটাকে। আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি।”

“আমাকে এখুনি সেখানে নিয়ে চল! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব! আমি আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে চাই নে!” “প্লিজ!” হাল-এর বাহুর মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল জুডিথ।

 

Exit mobile version