Site icon BnBoi.Com

ডেজার্ট গড – উইলবার স্মিথ

ডেজার্ট গড - উইলবার স্মিথ

ডেজার্ট গড

১. চর্বির ভাঁজে

ডেজার্ট গড – উইলবার স্মিথ
ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন

চর্বির ভাঁজে থাকা ছোট ছোট চোখদুটো পিট পিট করে, এটন বাও খেলার ছক থেকে মাথা তুলে একপাশে তাকালো। একটু দূরে ত্যামোস রাজবংশের দুই রাজকুমারি উদোম গায়ে উপহ্রদের স্বচ্ছ পানিতে খেলা করছিল। নিরাসক্তভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে সে মন্তব্য করলো, ওরা আর ছোটটি নেই।

নীল নদের ভাটিতে একটি উপহ্রদের পাশে পামপাতার ছাউনির নিচে আমরা মুখোমুখি বসেছিলাম। আমাদের দুজনের মাঝে একটা বাও খেলার ছক পাতা ছিল। খুঁটির পরবর্তী চাল থেকে আমার মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দেবার উদ্দেশেই সে মেয়েগুলো সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছে তা বুঝতে পারলাম। এটন হারতে পছন্দ করে না, কাজেই কীভাবে জিতবে সে বিষয়ে তার খুব একটা মাথা ব্যথা নেই।

এটন আমার সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রিয় বন্ধু। আমার মতো সেও একজন খোঁজা, সেও এককালে ক্রীতদাস ছিল। তবে তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক দৃঢ়তার কারণে, কৈশোরেই তার প্রভু তাকে অন্যান্য ক্রীতদাসের কাছ থেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। এটন সবসময় তার এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতো, তবে সবধরনের কামনাবাসনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতো। সে ছিল বহুমূল্য সম্পদের মতো। তাই তার প্রভু তাকে খোঁজা করার জন্য মিসরের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসককে নিযুক্ত করেছিলেন। এখন সে থিবসে ফারাও রাজপ্রাসাদের ব্যবস্থাপনার প্রধান ব্যক্তি। একইসাথে গুপ্তচরদেরও প্রধান। সমস্ত সভ্য জগতজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সংবাদবাহক আর গুপ্তচরদের এক বিশাল চক্রকে সে পরিচালনা করছে। কেবল আরেকটি সংগঠন এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আর সেটি হচ্ছে আমার সংগঠনটি। আর প্রায় সবকিছুর মতো এই ক্ষেত্রেও আমরা পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বমূলকভাবে প্রতিযোগিতা করি আর একজন আরেকজনকে টপকাতে পারলে যে পরিমাণ আনন্দ লাভ করি, তা আর কোনো কিছুতে পাই না।

তার সঙ্গ আমি খুব পছন্দ করি। তার সুপরামর্শ আর উপলব্ধি ক্ষমতা অনেক সময় আমাকে বেশ অবাক করে। আবার মাঝে মাঝে বাও খেলার ছকে সেও আমার দক্ষতা পরীক্ষা করে। সাধারণত উদারভাবেই সে আমার প্রশংসা করে, তবে বেশিরভাগ সময় আমার বুদ্ধির কাছে হার মানে।

এই মুহূর্তে আমরা দুজনেই বেকাথাকে লক্ষ্য করছিলাম। দুই রাজকুমারির মাঝে সে বড় বোনের চেয়ে দুই বছরের ছোট। তবে বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা আর ইতিমধ্যেই তার বুক দুটো সামান্য উঁচু হয়ে উঠেছে। মেয়েটি বেশ চটপটে আর সবসময় হাসিখুশি। বেশ উপস্থিতবুদ্ধিও আছে। কাটাকাটা চেহারায় সোজা আর খাড়া নাক, কঠিন চিবুক আর পাতলা ঠোঁট। তামাটে ঘন চুল রোদে ঝিলিক দিচ্ছে। ওর বাবার কাছ থেকে সে এসব পেয়েছে। এখনও তার রজোদর্শন হয়নি, তবে মনে হয় আর বেশি দিন নেই।

আমি তাকে খুব ভালোবাসি, তবে সত্যি বলতে কী তার বড় বোনটিকে একটু বেশি ভালোবাসি।

দুজনের মধ্যে বড়-বোন তেহুতি আরও সুন্দর। যখনই আমি তার দিকে তাকাই তখনই আমার মনে হয় যেন আমি আবার তার মাকে দেখছি। রানি লসট্রিস ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। হ্যাঁ, একজন পুরুষ যেমন একজন নারীকে ভালোবাসে সেরকমই আমি তাকে ভালেবাসতাম। আমার বন্ধু এটনকে যেমন ছোট থাকতে খোঁজা করা হয়েছিল, আমার বেলায় তা হয়নি। আমাকে যখন খোঁজা করা হয় তখন আমি পুরোপুরি যৌবনে পৌঁছে নারী দেহের আনন্দ বুঝতে শিখেছি। তবে এটা সত্যি, রানি লসট্রিসের সাথে আমার ভালোবাসা কখনও সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি, কেননা তার জন্মের আগেই আমাকে খোঁজা করা হয়েছিল। তবে কখনও কামনা-বাসনা মেটাতে না পারলেও তার প্রতি আমার প্রবল ভালোবাসা ছিল। শৈশবে আমি তাকে লালন পালন করেছি, তারপর বড় হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘকাল তার চলার পথে উপদেশ দিয়েছি। কোনো ধরনের কার্পণ্য না করে নিজেকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছি। সবশেষে আমার হাতে মাথা রেখেই সে মারা যায়।

নিচের পৃথিবীতে যাওয়ার আগে লসট্রিস ফিসফিস করে আমাকে কিছু কথা বলেছিল, যা আমি কখনও ভুলতে পারবো নাঃ আমি জীবনে কেবল দুজন পুরুষকে ভালোবেসেছি। আর তার মাঝে তায়তা, তুমি হলে একজন।

এরকম মিষ্টি কথা আমি আর কখনও শুনিনি।

তার রাজকীয় সমাধির পরিকল্পনা আর নির্মাণের তত্ত্বাবধান আমিই করেছিলাম। তারপর সমাধির মাঝে সেই সুন্দর নিথর দেহটি রেখে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আমি নিজেও সেই নিচের পৃথিবীতে চলে যাই। তবে জানতাম তা হবার নয়; কেননা আমাকে তার সন্তানদের দেখাশুনা করতে হবে, যেরকম তারও করেছিলাম। সত্যি বলতে কী এই দায়িত্বটি গুরুভার ছিল না, কেননা এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার জীবন আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

ষোল বছর বয়সে তেহুতি একজন পুরোপুরি নারীতে পরিণত হয়েছে। তার গায়ের ত্বক চকচকে আর মসৃণ। সরু, নিটোল বাহু আর পাদুটো ছিল একজন নৃত্যশিল্পীর মতোই সুগঠিত। কিংবা বলা যায় তার বাবার সেই বিখ্যাত যুদ্ধের ধনুকের মতো, যা আমি নিজে বানিয়েছিলাম আর তার মৃত্যুর পর সেটা তার শবাধারের ঢাকনির উপর রেখে সমাধিটি সিলমোহর করে দিয়েছিলাম।

তেহুতির নিতম্ব চওড়া হলেও কোমর ছিল একটি সুরার জগের গলার মতো সরু। বুকদুটো গোলাকার আর নিটোল। মাথাজুড়ে সোনালি কোঁকড়া চুল ছিল তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। মায়ের মতো তার চোখদুটোও ছিল সবুজ। তার সৌন্দর্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না আর যখনই সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতো আমার বুক ধক করে উঠতো। তার স্বভাব ছিল কোমল, সহজে রাগতো না তবে একবার রেগে উঠলে সে অকুতোভয় আর কঠিন হয়ে উঠতো।

আমি তাকে প্রায় সেরকমই ভালোবাসি যেমনটি তার মাকে এখনও ভালোবাসি।

এটন মুক্তকণ্ঠে আমার প্রশংসা করে বললো, তুমি ভালোভাবেই ওদের মানুষ করছো তায়তা। ওরাই হচ্ছে সেই সম্পদ যা আমাদের মিসরকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

এই বিষয়টিসহ আরও অনেক বিষয়ে এটন আর আমি সম্পূর্ণ একমত ছিলাম। আর এটিই আসল কারণ যেজন্য আমরা দুজন এই সূদুর নির্জন স্থানে এসেছি। যদিও স্বয়ং ফারাওসহ রাজপ্রাসাদের সবাই জানে আমরা এখানে বাও খেলার প্রতিযোগিতা করছি।

তার এই মন্তব্যের তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিয়ে আমি চোখ নামালাম বাও ছকের দিকে। আমি যখন মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন এটন ওর শেষ চালটা দিয়েছিল। মিসরের এই ভীষণ সুন্দর খেলায় সে ছিল অত্যন্ত কুশলি একজন খেলোয়াড়, কিংবা সমগ্র সভ্য জগতেরও একজন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় বলা চলে। শুধু আমি ছাড়া। আমি সাধারণত চারটি খেলার মধ্যে তিনটিতেই তাকে হারিয়ে দিতাম।

এখন একবার নজর দিয়েই বুঝতে পারলাম সেই তিনটি জিতের একটি এবার হতে যাচ্ছে। তার শেষ চালটা বেশ দুর্বল ছিল, খুঁটির বিন্যাস

এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। কোনো কোনো সময় যখন সে ভাবতে শুরু করে যে, এই দানে তার জয় নিশ্চিত হবে তখন প্রায়ই সে এই ভুলটি করে ফেলতো। বাতাসে তার অসাবধানতা টের পাওয়া যেত আর তখন সে সাতটি খুঁটির নিয়ম মেনে চলতো না। এরপর সে দক্ষিণ দিকের নৌকা থেকে পূর্ণ আক্রমণে মনোযোগ দিতে গিয়ে পুর্ব কিংবা পশ্চিম দিকের দখল নিতে আমাকে সুযোগ করে দিত। এবার পূর্বদিক ভোলা ছিল। আমি আর দ্বিতীয় সুযোগের জন্য অপেক্ষা না করে গোখরা সাপের মতো একটা ছোবল মারলাম।

আমার আচমকা এই চালটা যখন সে বুঝতে পারলো তখন হতবাক হয়ে পেছন দিকে হেলে পড়তেই টুলের পেছন দিকে প্রায় উল্টে পড়লো। আমার এই চাতুরিটি বুঝতে পেরে রাগে তার মুখ কালো হয়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে তার গলা ভেঙে গেল, আমার তোমাকে ঘৃণা করা উচিত তায়তা। আগে না করলেও এখন অবশ্যই করা উচিত।

আমি যদুর সম্ভব আবেগ দমন করে বললাম, শোন তুমি আমার পুরোনো বন্ধু। আসলে আজ আমার ভাগ্য ভালো ছিল। যাইহোক এটাতো শুধু একটা খেলা।

সে রাগে গাল ফুলিয়ে বললো, এ যাবত যত ফাঁকাবুলি তোমার কাছ থেকে শুনেছি, তার মধ্যে এটা হচ্ছে সবচেয়ে মোটাদাগের। এটা শুধু খেলা নয়। এটা হচ্ছে বেঁচে থাকার একটা কারণ। এবার সে আসলেই রেগে গেছে। মনে হল।

আমি টেবিলের নিচে থেকে তামার মদের জগটা বের করে তার কাপটা ভরে দিলাম। এটা সর্বোৎকৃষ্ট মদ, পুরো মিসরের মধ্যে সেরা। আমি নিজে ফারাওর প্রাসাদের নিচের মদ্য-ভান্ডার থেকে সরাসরি নিয়ে এসেছিলাম। এটন আবার গাল ফুলিয়ে রাগটা আমার উপর ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে যাবে, কিন্তু তার আগের মোটা মোটা আঙুল দিয়ে কাপের হাতলটা ধরতেই সে কাপটা ঠোঁটের কাছে তুললো। দুই ঢোক গিলতেই সুখের আমেজে তার চোখ মুদে এল। তারপর কাপটা নামিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

তারপর বাও খেলার খুঁটিগুলো চামড়ার থলেতে ভরতে ভরতে বললো, হয়তো তোমার কথাই ঠিক তায়তা। বেঁচে থাকার আরও ভালো কারণ নিশ্চয়ই আছে। উত্তরদিক থেকে কী খবর পেলে? তোমার গোয়েন্দা বুদ্ধির চমক আরেকবার আমাকে দেখাও দেখি।

এবার আমাদের এই সাক্ষাতকারের আসল উদ্দেশ্যে আমরা পৌঁছেছি। উত্তরদিকটা সবসময়ই বিপজ্জনক ছিল।

একশো বছর আগে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিদ্রোহের কারণে শক্তিশালী মিসর বিভক্ত হয়ে পড়ে। লাল দাবীদার নকল ফারাও, ইচ্ছে করেই আমি তার নাম নিচ্ছি না–অনন্তকাল সে অভিশপ্ত হোক। এই বিশ্বাসঘাতক লোকটি আসল ফারাওয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসিউতের উত্তরে পুরো অংশ দখল করে নেয়। তারপর থেকে আমাদের এই মিসরে একশো বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে।

পরবর্তীতে এই লাল দাবীদারের উত্তরাধিকারী সিনাইয়ের ওপারের তৃণভূমি থেকে আসা বন্য এবং যোদ্ধা এক উপজাতির আক্রমণের শিকার হল। ঘোড়া আর রথের সাহায্যে এই বর্বররা পুরো মিসর জয় করে নিল। এমন অস্ত্রের কথা আমরা আগে কখনও শুনিনি। লাল দাবীদারকে পরাজিত করার পর এরা মধ্য সাগর থেকে শুরু করে আসিউত পর্যন্ত মিসরের সম্পূর্ণ উত্তরাংশ দখল করে নিল। তারপর এই হাইকসোরা দক্ষিণে আমাদের উপর হামলা চালাল।

আমরা অর্থাৎ আসল মিসরীয়রা তাদের হামলা প্রতিহত করতে পারলাম। আমরা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হলাম। তারপর আরও দক্ষিণে নীলনদের জলপ্রপাতের ওপারে এলিফ্যান্টিনি দ্বীপ আর পৃথিবীর শেষ সীমানার জঙ্গলে পালিয়ে গেলাম। যখন আমরা ক্রমশ নির্জীব আর অবসন্ন হয়ে পড়ছিলাম তখন আমাদের প্রভু, রানি লসট্রিস নতুন করে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করছিলেন।

এই নবজন্মলাভে আমার ভূমিকাও খুব একটা তুচ্ছ ছিল না। নিজের ব্যাপারে আমি সাধারণত বেশি বলি না, তবে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, আমার পরামর্শ আর পথনির্দেশ ছাড়া আমার প্রভু এবং তার পুত্র যুবরাজ মেমনন, যিনি এখন ফারাও ত্যামোস হয়েছেন, কোনদিন তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারতেন না।

প্রভুর জন্য আমি যেসব কাজ করেছিলাম, তার মধ্যে প্রথমটি ছিল স্পোকওয়ালা চাকা দিয়ে তৈরি উন্নত প্রযুক্তির রথের গাড়ি। হাইকসোদের নিরেট কাঠের চাকা থেকে এগুলো অনেক হালকা আর দ্রুতগামি ছিল। এই রথ টেনে নেবার জন্য ঘোড়া খুঁজে আনলাম। তারপর যখন আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত হলাম, তখন নতুন ফারাও নবযুবা ত্যামোসের নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী জলপ্রপাতের মধ্য দিয়ে উত্তরে মিসর অভিযানে বের হল।

হানাদার হাইকসো নেতা নিজেকে রাজা স্যালিটিস নামে পরিচয় দিত, তবে সে মোটেই রাজা ছিল না। বড়জোর সে ছিল একজন দস্যুসর্দার এবং একজন অপরাধী। তবে তার সেনাবাহিনী সংখ্যায় মিসরীয়দের দ্বিগুণ ছিল। এরা ছিল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং দুর্ধর্ষ প্রকৃতির।

আমরা হঠাৎ থিবস আক্রমণ করে ওদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করলাম। ওদের রথগুলো চুর্ণবিচুর্ণ করে প্রচুর সৈন্য হত্যা করলাম। আর বাদবাকিদেরকে উত্তরদিকে তাড়িয়ে দিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রে দশহাজার মৃতদেহ আর দুই হাজার ভাঙা রথ ফেলে ওরা পিছু হটে গেল।

তবে আমাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হল। আর সেজন্যই তাদেরকে অনুসরণ করে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারলাম না। তখন থেকেই হাইকমোরা নীলনদের বদ্বীপে লুকিয়ে থাকতে শুরু করলো।

সেই লুটেরা রাজা স্যালিটিস এখন মৃত। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মিসরীয় যোদ্ধার তরবারির আঘাতে সে মারা যায়নি, যা তার জন্য সঠিক বিচার হত। চারপাশে একগাদা অতিকুৎসিৎ স্ত্রী আর বীভৎস অগুণতি সন্তান নিয়ে বার্ধক্যের কারণে সে মারা গিয়েছিল। এর মধ্যে তার সবচেয়ে বড় ছেলে বিওনও ছিল। এই বিওন এখন নিজেকে রাজা বিওন নামে উচ্চ এবং নিম্ন মিসর সাম্রাজ্যের ফারাও ঘোষণা করেছে। আসলে সে একজন হত্যাকারী ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তার বাবার চেয়েও নিকৃষ্ট। আমার গুপ্তচরেরা নিয়মিত আমাকে জানাতে যে, থিবসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া হাইকসো সেনাবাহিনীকে সে আবার পুনর্গঠন করছে।

এই খবরগুলো বেশ অস্বস্তিকর ছিল, কেননা একই যুদ্ধে আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে উঠার রসদ সংগ্রহ করতে আমাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। চতুর্দিকে স্থলবেষ্টিত আমাদের দক্ষিণ রাজ্যটি বিশাল মধ্যসাগর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল আর সভ্যজগতের বিভিন্ন দেশ এবং নগর রাষ্ট্রের সাথেও বাণিজ্য হচ্ছিল না। যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ চামড়া, কাঠ, তামা, খাদ, টিন এবং শক্তির অন্যান্য উৎস এই দেশগুলোতে প্রচুর ছিল, অথচ আমাদের এগুলোর অভাব ছিল। এছাড়া আমাদের মানবসম্পদেরও কমতি ছিল। আমাদের এখন মিত্র প্রয়োজন।

অন্যদিকে আমাদের শত্রুপক্ষ হাইকসোদের নীল নদের মোহনায় চমৎকার বন্দর ছিল। এছাড়া আমার গুপ্তচরেরা আমাকে আরও জানিয়েছে যে, হাইকসোরাও অন্য যোদ্ধা দেশের সাথে মিত্ৰতা করার চেষ্টা করছে।

এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই এটন আর আমি এই নির্জন জায়গায় মিলিত হয়েছিলাম। আমাদের প্রিয় মিসরের অস্তিত্ব এখন তরবারির ডগায় ঝুলছে। এটন আর আমি এনিয়ে অনেকবার দীর্ঘ আলাপ করেছি, তবে এই শেষবার আলাপআলোচনা করে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ফারাওর সামনে তুলে ধরবো।

তবে রাজকুমারিদের উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। ওরা লক্ষ্য করেছিল এটন বাও খেলার খুঁটি তুলে নিচ্ছে আর এটাকেই ওরা একটা ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়েছিল যে, এবার আমাকে পুরোপুরি ওদের দখলে নিতে পারবে। আমি ওদের দুজনের প্রতি আত্মনিবেদিত হলেও ওদের চাহিদা ছিল খুব বেশি। উপহৃদের পানি চতুর্দিকে ছিটিয়ে ওরা দ্রুত আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। বেকাথা ছোট হলেও সে ছিল খুব দ্রুত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য সে যে কোনো কিছু করতে পারত। তেহুতিকে পেছনে ফেলে সে ভেজা আর ঠাণ্ডা শরীর নিয়ে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে ওর লাল চুলো মাথাটা খুঁজে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি তাতা। আমাদেরকে একটা গল্প শোনাও, তাতা।

এদিকে তেহুতিও ছুটে এলো, তবে সে জায়গা পেল আমার পায়ের কাছে। ভেজা শরীরে মাটিতে বসে সে আমার পা তার বুকে চেপে ধরলো, তারপর আমার হাঁটুর উপর থুতনি রেখে উপরের দিকে মুখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ, তাতা। আমাদের মায়ের কথা বল। বল, মা কীরকম সুন্দরী আর বুদ্ধিমতি ছিল।

আমি প্রতিবাদের সুরে বললাম, আগে আমাকে এটন চাচার সাথে কথা বলতে হবে।

বেকাথা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। তবে বেশি সময় নিও না। এটা খুবই বিরক্তিকর।

ঠিক আছে, কথা দিলাম, বেশি সময় নেব না। তারপর এটনের দিকে ফিরে হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শুরু করলাম। আমরা দুজনেই আমাদের শত্রুর ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারতাম।

আমি সবসময় আমার শত্রুকে জানার চেষ্টা করতাম। শব্দ আর ভাষার ব্যাপারে আমার বেশ পটুত্ব ছিল। থিবসে ফেরার পর লেখাপড়ার জন্য আমি অনেক বছর সময় পেয়েছিলাম। এটন নুবিয়ার শরণার্থীদলের সাথে যোগ দেয় নি। অভিযানের প্রতি তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। সে মিসরেই রয়ে যায় আর হাইকসোদের অত্যাচার সহ্য করে। তবে ভাষাসহ হাইকসোদের কাছ থেকে শেখার যা কিছু ছিল সব শিখে নেয়। রাজকুমারিরা এই ভাষার এক বর্ণও বুঝতে পারে না।

বেকাথা রেগে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, তোমাদের এই বিশ্রী ভাষায় কথা বলা শুনলে আমার ঘেন্না করে। তেহুতিও মাথা নেড়ে তার সাথে সুর মিলিয়ে বললো, যদি তুমি আমাদের ভালোবাস তাহলে মিসরি ভাষায় কথা বল তায়তা।

আমি বেকাথাকে জড়িয়ে ধরে তেহুতির মাথায় হাত রেখে আদর করলাম। তবে তারপরও এটনের সাথে সেই ভাষায় কথা বলে চললাম, যা মেয়েরা ভীষণ অপছন্দ করে। বাচ্চাদের কথায় কান না দিয়ে যা বলার বলে যাও বন্ধু।

এটন হাসি চেপে বললো, তাহলে সেই কথাই রইল তায়তা। আমাদের মিত্র প্রয়োজন আর সেই মিত্রদের সাথে বাণিজ্য করতে হবে। তবে সেই সাথে এসব বিষয় হাইকসোদের কাছে গোপন রাখতে হবে।

আমি মাথা নেড়ে গম্ভীরস্বরে বললাম, সবসময়ের মতো তুমি সঠিক জায়গায় পৌঁছেছ আর সত্যিকার সমস্যাটির কথাও উল্লেখ করেছ। মিত্র এবং বাণিজ্য। খুব চমৎকার বলেছ। তাহলে বল বাণিজ্য করার মতো কী আছে আমাদের কাছে, এটন?

জলপ্রপাতের ওধারে নুবিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটাবার সময় আমরা খনি থেকে যে সোনা পেয়েছি সেগুলো আছে। যদিও এটন কখনও মিসর ছেড়ে যায়নি, কিন্তু তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সে সেই দলবদ্ধ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে আমার হাসি পেলেও আমি গাম্ভীর্য বজায় রাখলাম। তারপর সে বললো, যদিও এই হলুদ ধাতুটি রূপার মতো তেমন মূল্যবান নয় তবুও মানুষ এর জন্য লালায়িত। ফারাও যে পরিমাণ সোনা তার কোষাগারে জমা করেছেন তা দিয়ে আমরা সহজেই বন্ধু আর মিত্র কিনতে পারবো।

আমি একমত হয়ে মাথা নাড়লাম। যদিও আমি জানতাম এটন কিংবা ওর মতো অন্য যারা আমার মতো রাজার এত কাছাকাছি নয়, তারা ফারাওয়ের সম্পদ সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে। বিষয়টার আরও ব্যাপ্তি দেবার জন্য আমি তাকে মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, তবে প্রত্যেকবছর প্লাবনের সময় আমাদের মা নীলনদ থেকে যে কালো দোঁআশলা মাটি আমরা দুই তীরে পাই সেকথা ভুলে যেও না। মানুষকে খেয়েপড়ে বাঁচতে হবে এটন। ক্রিট, সুমেরিয় আর হেলেনিয় নগর রাষ্ট্রগুলোর চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুব কম। ওদের জনগণের মুখে খাবার তুলে দেবার মতো শস্য জোগাতে ওদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়। আর আমাদের প্রচুর শস্য রয়েছে।

আরে তাইতো তায়তা। বাণিজ্য করার মতো আমাদের কাছে শস্য আর ঘোড়া আছে। আমাদের ঘোড়া পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এছাড়া এর চেয়েও আরও দুর্লভ এবং মূল্যবান কিছু বস্তু আমাদের কাছে আছে। এই কথা বলে এটন একটু থামলো, তারপর আমার কোলে বসা যে শিশুটিকে আমি আদর করছিলাম আর আমার হাঁটুর কাছে বসা সুন্দর শিশুটির দিকে সে তাকাল।

এই বিষয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মাঝের এলাকার ক্রিট আর সুমেরিয়রা ছিল আমাদের সবচেয়ে কাছের এবং অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিবেশি। এই দুই জাতের মানুষেরাই সাধারণত শ্যামবর্ণ হত আর ওদের মাথার চুলও ছিল কালো। ওদের শাসক গোষ্ঠির কাছে এজিয়ান গোত্র আর মিসরের রাজপরিবারের সুন্দর চুল আর ফর্সা ত্বকের মেয়েদের ভীষণ কদর রয়েছে। তবে ফ্যাকাসে চেহারার কাঠখোট্টা হেলেনিয় মেয়েদের সাথে আমাদের নীল নদের অববাহিকার উজ্জ্বল রত্নের মতো লাবণ্যময়ী মেয়েদের কোনো তুলনাই করা যায় না।

আমার এই দুই রাজকুমারির বাবা তানুসের ছিল আগুনে রঙের কোঁকড়ানো চুল আর মা রানি লসট্রিস ছিলেন উজ্জ্বল স্বর্ণকেশি। তাদের বংশধর, এই দুই রাজকন্যার সৌন্দর্যের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন দেশের দূতেরা ইতিমধ্যেই অতিকষ্টে বিশাল মরুভূমি এবং গভীর সমুদ্র পেরিয়ে থিবসের রাজপ্রাসাদে এসে ফারাও ত্যামোসের কাছে তাদের প্রভুদের আগ্রহ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, তারা ত্যামোস রাজপরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে স্থাপন করতে আগ্রহী। সুমেরিয় রাজা নিমরদ এবং ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ তাদের দূত পাঠিয়েছিলেন।

আমার পরামর্শ মোতাবেক ফারাও এই দুই রাজ্যের দূতকে সাদরে বরণ করেছিলেন। রূপা আর সিডার কাঠের যেসব চমৎকার উপহারসামগ্রী ওরা এনেছিল তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। তারপর মনোযোগ দিয়ে তার একজন কিংবা উভয় বোনের সাথে বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনলেন। তবে ফারাও জানালেন দুই বোনই এখনও অনেক ঘোট, সুতরাং বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা এখনই বলা যাবে না। বরং ওরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আবার এ-বিষয়ে আলাপ করা যেতে পারে। তবে এটা বেশ কিছুদিন আগের কথা আর এখন পরিস্থিতি বদলেছে।

সে-সময় ফারাও আমার সাথে সুমেরিয় কিংবা ক্রিটের সাথে মিসরের সম্ভাব্য মৈত্রী বন্ধন নিয়ে আলাপ করেছিলেন আর আমি তাকে সুকৌশলে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, সুমেরিয়দের চেয়ে ক্রিটের সাথে মৈত্রি করাটাই বরং ভালো হবে।

প্রথমত সুমেরিয়রা সমুদ্রগামি জাতি নয়। অশ্বারোহী সেনা এবং রথসহ ওদের শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী থাকলেও তাদের তেমন কোনো নৌবাহিনী ছিল না। আমি ফারাওকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমাদের সাগরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। হাইকসো শত্রুরা উত্তর দিকে নীল নদের যাওয়ার পথটি নিয়ন্ত্রণ করছে আর আমরা মূলত একটি ভূ-বেষ্টিত দেশ।

সুমেরিয়দেরও সমুদ্রপথের যাত্রা সীমিত ছিল আর তাদের নৌবহরও ছিল অন্যান্য দেশ, যেমন ক্রিট এবং পশ্চিমের মরিতানিয়দের তুলনায় বেশ ছোট। সুমেরিয়রা জাহাজবোঝাই মালামাল নিয়ে সমুদ্রপথে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে সবসময় অনিচ্ছুক ছিল। ওরা জলদস্যু এবং সমুদ্রঝড়ের তাণ্ডবে আতঙ্কিত ছিল। তাছাড়া দুইদেশের মাঝে স্থলপথও বিপদসঙ্কুল ছিল।

মধ্য এবং লোহিত সাগরের মধ্যেকার যোজকটি হাইকসোদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আর মিসরের সাথে উত্তরে সিনাই মরুভূমির সংযোগ ছিল। সেক্ষেত্রে সুমেরিয়দের সিনাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে আরও দক্ষিণে গিয়ে জাহাজে চড়ে লোহিতসাগর পার হয়ে আমাদের কাছে আসতে হবে। এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের সেনাবাহিনীকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে, এছাড়া পানির কষ্ট আর লোহিতসাগরে জাহাজ চলাচলের অপ্রতুলতার কথা ছেড়ে দিলেও এই পথে যাত্রা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

ইতিপূর্বে যে প্রস্তাবটি আমি ফারাওকে দিয়েছিলাম, এখন এটনকে তার কিছুটা ধারণা দিলাম, সেটা হল মিসর আর ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের মাঝে একটি মৈত্রি চুক্তি। বংশপরম্পরায় ক্রিটের শাসকের উপাধি ছিল সর্বাধিরাজ মিনোজ। তিনি ছিলেন আমাদের ফারাওয়ের সমকক্ষ। অবশ্য তাকে আমাদের ফারাওয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলাটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। তবে এটুকু অন্তত বললে যথেষ্ট হবে যে, তার নৌবহরে দশহাজারেরও বেশি রণতরী এবং এমন উন্নত ধরনের বাণিজ্যপোত ছিল যে, আর কোনো জাহাজ তাদেরকে সাগরে ধরতে কিংবা পরাজিত করতে পারতো না।

ক্রিটবাসীরা যা চায় তা আমাদের কাছে আছে: শস্য, সোনা এবং সুন্দরী বিয়ের কনে। আর আমাদের যা প্রয়োজন ক্রিটে তা আছে: অত্যন্ত দুর্ধর্ষ রণতরী বহর। যার সাহায্যে নীলনদের বদ্বীপের মোহনায় হাইকসোদের বন্দরগুলো অবরোধ করা যায়। আর সৈন্য বোঝাই সুমেরিয় জাহাজগুলোকে পাহারা দিয়ে মধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলে পাঠিয়ে হাইকসোদের উপর একটি ভয়ঙ্কর সাঁড়াশি আক্রমণ করে, এই দুই শক্তির মাঝে ওদের সেনাবাহিনীকে চেপে ধরে পিষে ফেলা যায়।

এটন করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললো, চমৎকার পরিকল্পনা! প্রায় নির্ভুল একটি পরিকল্পনা। তবে প্রিয় তায়তা, একটা ছোট বিষয় তোমার নজর এড়িয়ে গেছে। সে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো আর একটু আগে বাও খেলায় আমি যে তাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম তার একটা শোধ নিতে পেরেছে ভেবে বেশ আত্মতৃপ্তির ভাব দেখাতে লাগলো। আমি কখনও প্রতিহিংসা পরায়ণ ছিলাম না, তবে এই ঘটনার সুবাদে একটু নির্দোষ আনন্দ নেবার সুযোগও হারালাম না। একটু হতবাক হবার ভঙ্গি : করে বললাম।

আহা, দয়া করে বলনা কী সেটা! আমিতো খুব সাবধানে সবদিক ভেবে এই পরিকল্পনা করেছি। এতে ভুলটা কোথায় বল?

এটন জিহ্বায় চুকচুক শব্দ করে তার হাতির মতো বিশাল এক উরুতে চাপড় মেরে বললো, তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো বন্ধু। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ ইতিমধ্যেই হাইকসো রাজা বিওনের সাথে একটা গোপন মৈত্রিচুক্তি করে ফেলেছে। একথা বলে এটন মনে করেছে সে আমার পরিকল্পনায় একটা বিরাট খুঁত বের করে ফেলেছে।

উত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ ঠিকই বলেছো! আমার মনে হয় পাঁচমাস আগে তামিয়াতে ক্রিটরা বিওনের সাথে বাণিজ্য করার জন্য যে দুর্গ স্থাপন করেছে তুমি তার কথা বলছে। এটাতো নীল বদ্বীপের একেবারে পূর্বদিকের মোহনায় অবস্থিত, তাই না?

এবার এটনের হতাশ হবার পালা। তুমি কখন এটা জানলে? কীভাবে জানলে?

আমি দুই হাত দুদিকে মেলে বললাম, এটন! তুমি নিশ্চয়ই এটা আশা করতে পারো না যে আমার গোপন খবরের সমস্ত সূত্রগুলো আমি প্রকাশ করে দেব?

এবার এটন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, সমর চুক্তি না হলেও সর্বাধিরাজ মিনোজ আর বিওনের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা গোপন সমঝোতা হয়েছে। সবাই জানে তুমি খুব বুদ্ধিমান তায়তা। তবে এখানে তুমি তেমন কিছু করতে পারবে না।

আমি রহস্যময়ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর যদি বিওন প্রতারণা করার পরিকল্পনা করে থাকে?

সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রতারণা মানে? বুঝতে পারলাম না তায়তা। এখানে কী ধরনের প্রতারণা হবে?

তোমার কোনো ধারণা আছে এটন, ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ কী পরিমাণ রূপা হাইকসো এলাকার মাঝে তাদের এই নতুন দুর্গে জমা করেছে?

নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। যদি সর্বাধিরাজ মিনোজ বিওনের কাছ থেকে আগামী মৌসুমের বেশিরভাগ শস্য কিনতে চান তাহলে তাকে প্রচুর পরিমাণে রূপা হাতে রাখতে হবে। তারপর এটন একটু সাবধানে হিসেব করে বললো, সম্ভবত দশ কিংবা বিশ লাখও হবে।

তোমার কল্পনাশক্তি খুবই ভালো বলতে হয়, প্রিয় বন্ধু। তবে সর্বাধিরাজ মিনোজ যে সমস্যাগুলোর সম্মুখিন হতে যাচ্ছেন, তুমি তার সামান্য অংশ বলেছ। ঝড়ের মৌসুমে তিনি খোলা সাগরে এত সম্পদ বোঝাই জাহাজ পাঠাবার ঝুঁকি নেবেন না। কাজেই বছরের পাঁচমাস তিনি মধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলে রূপার পিণ্ডগুলো পাঠাতে পারছেন না। আর শীতকালে তার দ্বীপ থেকে পাঁচশো লিগেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে।

এটন দ্রুত বলে উঠলো, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! আমি তোমার যুক্তিটা বুঝতে পেরেছি। তার মানে সেই সময়ে সর্বাধিরাজ মিনোজ বিশাল সমুদ্রে আফ্রিকার উপকূলের দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করতে পারবেন না!

আমি একমত হয়ে বললাম, পুরো শীতকালে অর্ধেক পৃথিবীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তিনি মিসরীয় উপকুলে একটি নিরাপদ নৌঘাঁটি স্থাপন করতে পারেন তবে তার নৌবহর শীতকালের ঝড়ের ধাক্কাটা সামলাতে পারবে। তারপর সারা বছর ধরে স্থলভূমির নিরাপদ আচ্ছাদনে তার জাহাজগুলো মেসোপটেমিয়া থেকে মরিতানিয়া পর্যন্ত বাণিজ্য করে যেতে পারবে। একটু থেমে আমি তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজ কী পরিকল্পনা করতে যাচ্ছেন তার বিশালত্ব পুরোপুরি বুঝার সুযোগ দিলাম। তারপর বললাম, এই ধরনের কার্যক্রমের একশোভাগের এক অংশও বিশ লাখ রূপার বাটে পোষাবে না। কমপক্ষে পাঁচশো লাখ রূপা তাকে তামিয়াতের নতুন দুর্গে জমা রাখতে হবে যদি তাকে শীতকালে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হয়। তোমার কী মনে হয় এই বিপুল পরিমাণ রূপার জন্য যে কোনো লোক কি প্রতারণা করতে পারে না? বিশেষত সেই লোক যদি হয় বিওনের মতো বিশ্বাসঘাতক, লুণ্ঠনকারী এবং অসৎ একজন মানুষ?

আমার কথাগুলো শোনার পর পুরো বিষয়টা উপলব্ধি করে এটন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল। তারপর আবার ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে তোমার কাছে প্রমাণ আছে যে, সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে করা প্রাথমিক মৈত্রি চুক্তি উপেক্ষা করে বিওন তামিয়াত দুর্গ আক্রমণ করবে আর সর্বাধিরাজ মিনোজের সমস্ত সম্পদ লুট করে নেবে? এই কথাই কি তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছ তায়তা?

আমি এটা বলিনি যে, বিওন একাজ করবে তার কোনো প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি শুধু তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি। আমি কোনো উক্তি করিনি। এবার তার হতভম্ব চেহারা দেখে আমি মুখ টিপে হাসলাম। একটু বেশি নির্দয় হয়ে গেছে, তবে দুষ্টুমিটা করা থেকে নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমাদের এতদিনের পরিচয়ে এই প্রথম দেখলাম আমার কথার পিঠে সে কিছুই বলতে পারছে না। এবার সত্যি তার জন্য আমার করুণা হল।

দেখ এটন, আমরা দুজনেই জানি বিওন একজন জংলি আনাড়ি-গেঁয়ো ভূত। সে রথ চালাতে পারে, তলোয়ার ঘোরাতে পারে, তীর ছুঁড়তে পারে আর একটা নগরে লুটতরাজ করতে পারে। তবে আমার মনে হয়, গদাইলস্করি চাল আর যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতি ছাড়া সে গোপন কোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারবে না।

এটন বললো, তাহলে কে সর্বাধিরাজ মিনোজের কোষাগার আক্রমণ করবে? তার কথার তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিয়ে আমি টুলে আরাম করে বসে মৃদু হাসলাম। এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, নিশ্চয়ই তুমি নও তায়তা! সর্বাধিরাজ মিনোজের পাঁচলাখ রূপা লুট করার পরিকল্পনা করে কীভাবে তুমি ক্রিটের কাছে সহায়তা আর মৈত্রী আশা করবে?

আমি তাকে বললাম, অন্ধকারে কে হাইকসো আর কে মিসরী তা বুঝা বেশ কঠিন। বিশেষত মিসরীয়রা যদি হাইকসো যোদ্ধার পোশাক পরে, হাইকসো অস্ত্র হাতে নিয়ে হাইকসো ভাষায় কথা বলে। সে মাথা নাড়লো, মুখে কোনো কথা জোগাল না। তারপরও আমি আবার বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একমত হবে যে, এ-ধরনের একটা বিশ্বাসঘাতক আক্রমণের পর আমাদের বিরুদ্ধে ক্রিট আর হাইকসোদের মাঝে কোনো ধরনের সমঝোতা হবার আদৌ আর কোনো আশা থাকবে?

এবার এটন মৃদু হেসে বললো, তুমি সত্যিই খুব চতুর, তায়তা। ভাবছি তোমাকে কখনও বিশ্বাস করতে পারবো না। তারপর সে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তামিয়াতে ক্রিটের গ্যারিসন কত বড় হবে?

এ-মুহূর্তে সৈনিক আর তীরন্দাজ মিলিয়ে হাজার দুয়েক হবে। তবে এদের বেশিরভাগই ভাড়াটে সৈনিক।

এবার সে আগ্রহ দেখিয়ে বললো, আচ্ছা! তারপর একটু থেমে বললো, তোমার কত লোক লাগবে কিংবা এভাবেও বলতে পারি, বিওনের কত লোক লাগবে এই কাপুরুষচিত পরিকল্পনা কাজে লাগাতে?

আমি বাধা দিয়ে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। সবকিছু আমি এটনকে বলতে পারি না আর সেও তা বুঝতে পেরে আর চাপাচাপি করলো না। তবে ঘুরিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করলো।

তামিয়াত দুর্গে তুমি কাউকে জীবিত রাখবে না? সবাইকে মেরে ফেলবে?

তার এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ওদের বেশিরভাগকেই পালিয়ে যাবার সুযোগ দেব। আমি চাই যেন বেশিরভাগ লোক ক্রিটে ফিরে গিয়ে সর্বাধিরাজ মিনোজকে বিওনের বিশ্বাসঘাতকতার কথাটা জানিয়ে তাকে সাবধান করে।

এটন বললো, আর ক্রিটের সম্পদ? ঐ পাঁচ লাখ রূপার কী হবে?

ফারাওয়ের সিন্দুক প্রায় খালিই বলা চলে। সম্পদ ছাড়া আমরা মিসরকে রক্ষা করতে পারবো না।

তারপর সে জিজ্ঞেস করলো, এই অভিযান কে চালাবে? তুমিই কি নেতৃত্ব দেবে তায়তা?

আমি চেহারায় দুঃখ নিয়ে বললাম, তুমি জানো আমি যোদ্ধা নই, এটন। আমি একজন চিকিৎসক, কবি এবং একজন শান্তিপ্রিয় দার্শনিক। যাইহোক যদি ফারাও নির্দেশ দেন তবে অধিনায়কের একজন উপদেষ্টা হিসেবে অভিযানে অংশ গ্রহণ নেবো।

তাহলে কে নেতৃত্ব দেবে? ক্রাটাস?

ক্রাটাসকে আমি পছন্দ করি, সে একজন ভালো সৈনিক। তবে লোকটা বুড়ো, মাথামোটা আর কোনো ধরনের যুক্তি কিংবা মতামতের ধার ধারে না।

এবার এটন চুক চুক করে বললো, হে শান্তিপ্রিয় কবি! তুমি জেনারেল ক্রাটাসের একেবারে সঠিক বর্ণনা দিয়েছ। সে না হলে ফারাও কাকে নিযুক্ত করবেন?

সম্ভবত জারাসকে নিযুক্ত করবেন।

ও আচ্ছা! রাজকীয় রক্ষিবাহিনীর নীল কুমির ডিভিশনের সেই বিখ্যাত ক্যাপ্টেন জারাস? তোমার পছন্দের লোক, তাই না তায়তা?

আমি তার কথায় টিটকারির সুর উপেক্ষা করে বললাম, আমার কোনো বিশেষ পছন্দের লোক নেই। তবে এই কাজের জন্য জারাস সবচেয়ে উপযুক্ত।

.

ফারাওকে আমার এই পরিকল্পনা জানালাম, কীভাবে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছে রাজা বিওনকে অবিশ্বাসি করে তোলা হবে আর দুজনের মাঝে এমন সন্দেহের বীজ ঢুকানো হবে, যার ফলে ওরা পরস্পরকে অবিশ্বাস করবে। অথচ এই দুজনই পৃথিবীতে আমাদের চরম শত্রু। আমার এই চমৎকার আর অত্যন্ত সহজ পরিকল্পনা শুনে ফারাও ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন।

আমি একান্তে তার সাক্ষাত প্রার্থনা করতেই তিনি সাথে সাথে রাজি হয়েছিলেন। আমরা দুজনে তার সিংহদরবারের চারপাশ ঘিরে থাকা দুপাশে পামগাছশোভিত চওড়া বারান্দায় হাঁটছিলাম। দক্ষিণ মিসরের নীল নদের সবচেয়ে চওড়া তীরে এর অবস্থান। অবশ্য আসিউতের পরই নদী আরও চওড়া হয়ে যখন হাইকসোদের অধিকৃত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় তখন এর স্রোত প্রবাহ ধীর হয়ে আসে। তারপর বদ্বীপের মধ্য দিয়ে নদী মধ্যসাগরে উপনীত হয়।

শক্ৰমিত্র কেউই যাতে আমাদের দেখতে কিংবা আমাদের কথা শুনতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য বারান্দার দুই মাথায় প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে। এরা বিশ্বস্ত কর্মকতার সরাসরি অধীনস্থ ছিল, তবে এরা ফারাও আর আমার দৃষ্টির আড়ালে অবস্থান নিয়েছিল। মার্বেল পাথরে ছাওয়া পায়ে চলা পথ দিয়ে আমরা পায়চারি করছিলাম। এখন যেহেতু আমরা দুজন একা, তাই তার কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে চলা আমার জন্য সম্ভব ছিল। কেননা তার জন্ম মুহূর্ত থেকেই আমি তার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম।

প্রকৃতপক্ষে আমার হাতেই তার জন্ম হয়। যখন রানি লসট্রিস এক টানে তাকে গর্ভ থেকে বের করে আনেন তখন আমিই প্রথম এই নবজাত শিশুর দেহটি হাতে ধরেছিলাম। আর প্রথম যে কাজটি এই রাজকুমার করেছিলেন, তা হল আমার গায়ে প্রস্রাব করা। এই কথা মনে পড়তেই আমি মৃদু হাসলাম।

সেদিন থেকেই আমিই ছিলাম তার শিক্ষক এবং গুরু। আমিই তাকে শিখিয়েছিলাম কীভাবে শৌচকর্ম করতে হয়, তারপর লেখাপড়া, তীর ঘোড়া আর যুদ্ধরথ চালনা শিখিয়েছিলাম। আমার কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন কীভাবে একটি জাতিকে শাসন করতে হয়। অবশেষে এখন তিনি একজন চমৎকার যুবক, সাহসী ও বলবান যোদ্ধা আর এই মিসরের একজন পরিশীলিত শাসক হয়েছেন। তবে আমরা এখনও খুব ভালো বন্ধু। অন্তত এতটুকু আমি বলতে পারি, ফারাও আমাকে একজন পিতার মতো ভালোবাসেন, যে পিতাকে তিনি কখনও দেখেননি। আর আমিও তাকে সেই পুত্রের মতো ভালোবাসি যে পুত্র আমার কখনও ছিল না।

শত্রুসৈন্যকে বোকা বানাবার জন্য আমি যে কৌশল উদ্ভাবন করেছি, তার বিবরণ শুনতে শুনতে তিনি পায়চারি করা থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমার বলা শেষ হলে তিনি তার ইস্পাত কঠিন হাত দিয়ে আমার দুই কাঁধ চেপে ধরলেন। তলোয়ার ঘুরিয়ে, তীর ছুঁড়ে আর একটি চার ঘোড়ার রথের লাগাম সামলিয়ে তার হাতদুটো কঠিন আর ব্রোঞ্জের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, তায়তা, তুমি একটি বুড়ো পাজির পা ঝাড়া! সবসময় আমাকে অবাক করে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ এ-রকম সাংঘাতিক পরিকল্পনা করতে পারে না। আমার মনে আছে যখন তুমি আমাকে হাইকসো ভাষা শেখার জন্য জোরজবরদস্তি করেছিলে তখন আমার খুব রাগ হয়েছিল; আর এখনতো এটা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। এ-ধরনের অভিযানে আমাদের শত্রুদের একজন হিসেবে চলতে না পারলে তো আমি কখনও এই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারতাম না।

এরপর আমার কয়েকঘন্টা লাগলো তাকে বুঝাতে যে ইতিহাসের এরকম চরম একটি মুহূর্তে একজন নেতার মিসর ছেড়ে যাওয়াটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে আর তামিয়াতে মিনোজের দুর্গ দখল কিংবা সেখানকার সম্পদের চেয়ে তার দেশে থাকাটা অনেক জরুরী। আমি হোরাসকে ধন্যবাদ দিলাম এজন্য যে, তার বয়স কম হওয়ায় তার মত বদলাতে অসুবিধা হয় না, আবার অন্যদিকে ভালোমন্দ বুঝার মতো বয়সও তার হয়েছে। অনেক আগে থেকে আমি শিখেছি কীভাবে তাকে বুঝতে না দিয়ে তার মত আমার দিকে ফেরাতে হয়। পরিশেষে প্রত্যেকবারই আমি আমার মতো করতে পারি।

যাইহোক আমার প্রস্তাব মতো ফারাও জারাসকেই এই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে নির্দেশ দিলেন। ফারাওয়ের মতো জারাসের বয়সও মাত্র পঁচিশ বছর হলেও–সে ইতিমধ্যেই তার সামরিক পদবী অনুযায়ী যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। আমি ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার তার সাথে কাজ করেছি এবং জানতে পেরেছি যে তার সুনাম যথার্থ। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে শ্রদ্ধা করে।

যাইহোক বিদায় নেবার আগে ফারাও ত্যামোস আমার হাতে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহরটা তুলে দিলেন। এর মানে হচ্ছে এটি বহনকারীর হাতে ফারাও তার পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দিচ্ছেন। এই সীলমোহর যার হাতে থাকবে সে কেবল ফারাওকে জবাবদিহি করবে। রাজকীয় দায়িত্ব পালনকালে কোনো মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হলেও সীলমোহরধারীকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে কিংবা তার কাজে বাধা দিতে পারবে না।

প্রথানুযায়ী ফারাও কেবলমাত্র যথাযথ পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজদরবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে কারও হাতে এই সীলমোহর তুলে দেন। তবে আমি বুঝতে পারলাম এ-ধরনের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার মধ্যে এটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাইহোক আমার প্রতি তার এই আস্থা দেখানোর কারণে আমি অত্যন্ত বাধিত হলাম।

হাঁটুগেড়ে বসে তার সামনে মাটিতে কপাল ঠেকালাম। তবে ফারাও নিচু হয়ে আমাকে ধরে দাঁড় করালেন।

তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে কখনও বিফল করনি, তায়তা। জানি এবারও করবে না।

.

আমি জারাসকে খুঁজে বের করে তাকে এই মিশনের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললাম। আর এও বললাম ফারাওয়ের কাছে নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তুলে ধরার এটি একটি সুযোগ। এই মিশনের সফলতা তাকে উন্নতির সোপানে দৃঢ় পদক্ষেপ রাখা আর রাজার সুনজরে থাকার পথ খুলে দেবে। আমার কথা শুনে সে অভিভূত হল।

অভিযানের জন্য আমরা দুজন মিলে দুইশোজনের একটি তালিকা ঠিক করলাম। প্রথম দিকে জারাস প্রতিবাদ করেছিল যে, এত কম লোক দিয়ে ক্রিট সেনা ছাউনির প্রায় দুই হাজার সেনার মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তখন আমি তাকে মিশনের বিশেষ অংশটি বুঝিয়ে বললাম, যা এটন আর ফারাওকেও বলিনি। তারপর সে আমার পরিকল্পনা পুরোপুরি বুঝতে পেরে তা গ্রহণ করলো।

আমি তাকে নিজের পছন্দ মত লোক বেছে নেবার সুযোগ দিয়েছিলাম। শুধু একটা বিষয়ে জোর দিয়েছিলাম, আর তা হল যাদেরকে সে পছন্দ করবে তাদের প্রত্যেককে হাইকসো ভাষা জানতে হবে। হাইকমোরা যখন দক্ষিণ মিসর আক্রমণ করেছিল তখন জারাস খুব ছোট ছিল, তাই সে অন্যান্যদের সাথে নির্বাসনে নুবিয়ায় যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তার যখন ষোল বছর বয়স তখন তাকে জোর করে হাইকসো সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল। ফলে সে এত চমৎকার হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শিখেছিল যেন সে তাদেরই একজন। যাইহোক সে একজন প্রকৃত মিসরী ছিল। আর তাই ফারাও ত্যামোস যখন আমাদের সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে জলপ্রপাতের মধ্য দিয়ে এসে থিবসের যুদ্ধে হাইকসোদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেন, তখন সেই প্রথম তার আসল

জাতির কাছে ফিরে আসে।

জারাস যে লোকগুলোকে বেছে নিয়েছিল, তারা বেশিরভাগই তার অধীনস্থ প্রশিক্ষিত এবং কুশলী যোদ্ধা ছিল। তারা যেমন নাবিক ছিল তেমনি যোদ্ধাও ছিল। আর যখন ওরা যুদ্ধের রথ টানতো না তখন নদীর বুকে নৌযোদ্ধা হিসেবে সময় কাটাত। জারাসের তাদেরকে আর কিছুই শেখাবার বাকি ছিল না।

আমি তাকে বললাম লোকগুলোকে পনেরো বিশজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে নিতে, যাতে থিবস শহর থেকে বের হবার সময় কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না হয়।

নগরের মূল ফটকে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহর দেখাতেই প্রহরীদলের অধিনায়ক আমাকে কোনো প্রশ্ন করলো না। পরপর তিন রাত ধরে জারাসের বাহিনীর লোকগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শহর থেকে বের হয়ে পূর্বদিকের জঙ্গলের দিকে চললো। ওরা প্রাচীন আকিতা নগরীর ধ্বংসাবশেষ এলাকায় এসে আমার সাথে মিলিত হল। আমি ওদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলাম।

আমি সেখানে কয়েকগাড়ি বোঝাই আসল হাইকসো শিরস্ত্রাণ, বর্ম, যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্র এনে রেখেছিলাম। থিবসের যুদ্ধে শত্রুর কাছ থেকে আমরা যেসব যুদ্ধ উপকরণ দখল করেছিলাম, এগুলো তার সামান্য কিছু অংশ ছিল।

আকিতা থেকে পুবে লোহিত সাগরের উত্তরদিকের শেষ মাথায় সুয়েজ উপসাগরের সৈকতের দিকে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। উর্দি আর অস্ত্রের উপর সবাই বেদুইন আলখাল্লা পরে নিল।

জারাস আর আমি ঘোড়ায় চড়ে মূল দলের আগেই রওয়ানা দিয়েছিলাম। আমরা দুজন উপসাগরের সৈকতে আল নাদাস নামে একটি ছোট্ট জেলে পল্লীতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, দলের বাকিরা সেখানে এসে আমাদের সাথে যোগ দিল।

জারাস তার পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত একজন পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করেছিল। লোকটির নাম আল-নামজু। একচোখবিশিষ্ট দীর্ঘদেহী লোকটি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতো। সে আল নাদাসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমাদেরকে পুবদিকের সৈকতে নিয়ে যাবার জন্য আল-নামজু গ্রামের সমস্ত মাছ ধরা নৌকা ভাড়া করেছিল। এই জায়গায় উপসাগর বিশ লিগেরও কম চওড়া, আমরা ওপারে সিনাই এলাকার নিচু পাহাড়গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।

রাতে তারার আলোয় পথ দেখে ওপারে গেলাম। উপসাগরের পূর্বসৈকতে আরেকটা ছোট জেলে পল্লীর কাছে পৌঁছলাম। জুবা নামে এই গ্রামটিতে আল নামজুর ছেলেরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভারী মালপত্রগুলো বহন করার জন্য ওরা একশো গাধা ভাড়া করেছিল। উত্তরদিকে মধ্যসাগরে পৌঁছাতে আমাদেরকে আরও দুইশো লিগ পথ হেঁটে যেতে হবে। তবে আমাদের লোকেরা যে কোনো পরিস্থিতিতে চলার মতো প্রশিক্ষিত ছিল, কাজেই আমরা দ্রুত চলতে শুরু করলাম।

হাইকসো সেনাচৌকি এড়াতে আল নামজু আমাদেরকে নিয়ে আফ্রিকা আর এশিয়ার সংযোগকারী সিনাই যোজকের পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করলো। শেষপর্যন্ত আমরা মধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরের ফোনিশিয় বন্দর উশুর কাছে পৌঁছলাম। এই স্থানটি সুমেরিয় সীমান্ত আর হাইকসো হানাদারদের অধিকৃত উত্তর মিসরের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল।

বন্দরের বাইরে জারাস আর তার লোকজনদের রেখে আমি দুটি গাধার পিঠে শস্য আর গমের চামড়ার থলেতে সোনার বাট লুকিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। সাহায্য করার জন্য সাথে চারজন লোক বেছে নিলাম। বন্দরের বণিকদের সাথে তিনদিন দরকষাকষির পর তিনটি মাঝারি মাপের একতলা পাল তোলা জাহাজের ব্যবস্থা করলাম। জাহাজ ফোনিশিয় মেলকার্ট মন্দিরের নিচে সমুদ্র সৈকতে আনার ব্যবস্থা করা হল। প্রচুর অর্থ ব্যয় হল, থিবস থেকে শস্যের থলেতে লুকিয়ে আনা আর কয়েকটা মাত্র সোনার বাট অবশিষ্ট রইল।

স্থলভাগের দিক থেকে আসা হালকা বাতাস আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিল। বড়পালগুলো খাঁটিয়ে মাল্লাদের মাঝে মাঝে বিশ্রাম দেওয়া হল। আবার উশু পার হলাম, তবে এবার বিপরীত দিকে। আমি নৌকাগুলো দিগন্তসীমার নিচে আর বন্দরের নজরের বাইরে রাখার চেষ্টা করলাম।

এক একটা নৌকায় সত্তর জনেরও বেশি মানুষ বসলেও আমরা বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চললাম। পরদিন বিকেলে আমি হিসাব করে দেখলাম তামিয়াতের ক্রিট দুর্গ সামনে একলিগেরও কম দূরত্বে রয়েছে।

আমি অবশ্য জারাসের সাথে সামনের নৌকাতেই ছিলাম। এবার তাকে জানালাম যেহেতু উশু অনেক পেছনে ফেলে এসেছি, কাজেই এখন আমরা সবাই কাছাকাছি হয়ে সৈকতের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকতে পারি। কেননা স্থলভূমি দেখে আমার পক্ষে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে নৌকা চালানো সুবিধা ছিল। শেষবেলায় সূর্য সামনের সাগরের পানি ছুঁতেই আমি কান্ডারীকে একটা নির্জন বালুকাবেলা দেখালাম। নৌকার তলভাগ মাটি ছুঁতেই লোকজন লাফিয়ে নেমে বালুর উপর দিয়ে নৌকাটি টেনে নিয়ে গেল।

থিবস থেকে এত দূর আসতে অনেক কষ্ট হলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। সন্ধ্যায় আমাদের শিবিরের সবার মাঝে বেশ উত্তেজনা, উদ্দীপনা জেগে উঠলো।

জারাস তার সবচেয়ে চৌকশ দুইজন লোকের উপর অন্যান্য জাহাজের নেতৃত্বের ভার দিয়েছিল। প্রথমজনের নাম দিলবার। দীর্ঘদেহী সুন্দর চেহারার এই লোকটির পেশিবহুল, শক্তিশালী দুটি হাত ছিল। প্রথম সাক্ষাতেই সে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল আর আমিও তাকে পছন্দ করেছিলাম। তার কালো চোখদুটো তীব্ৰভেদী হলেও ডানদিকের গালে আড়াআড়িভাবে তলোয়ারের একটা দগদগে ক্ষত ছিল। এতে অবশ্য তার সুন্দর চেহারায় বিরূপ প্রভাব রাখেনি। সে কোনো আদেশ দিলে লোকজন সাথে সাথে তা পালন করতো।

তৃতীয় জাহাজের অধিনায়ক ছিল গাট্টাগোট্টা চেহারার বৃষকন্ধ এক লোক। এর নাম আকেমি। হাসিখুশি এই লোকটি উচ্চকণ্ঠে কথা বলতো। তার পছন্দের হাতিয়ার ছিল লম্বা হাতলওয়ালা একটা কুঠার। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর আকেমি আমার কাছে এলো।

আমাকে অভিবাদন করে সে বললো, প্রভু তায়তা। লোকজন আমাকে বলেছে আজ রাতে আপনি কি গান গেয়ে আমাদেরকে সম্মানিত করবেন? প্রথম প্রথম লোকজন আমাকে এই সম্বোধন করায় আমি মৃদু প্রতিবাদ করেছিলাম, কেননা আমি এর যোগ্য নই। কিন্তু কেউ তা মানেনি আর আমিও আর এরপর থেকে বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি।

আমার কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ আর আমার হাতের আঙুলে বীণাও প্রায় স্বর্গীয় সুর নিয়ে বাজতো। আমি খুব কমই এ-ধরনের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতাম।

সেই রাতে তামিয়াত যুদ্ধের আগে আমি তাদের জন্য বেছে নিলাম রানি লসট্রিসের শোকসঙ্গীত। এটা ছিল আমার বিখ্যাত একটি রচনা। আমার চারপাশে সবাই আগুন ঘিরে বসলো। আমি পুরো ১৫০টি চরণই গেয়ে শোনালাম। ওদের মধ্যে যারা ভালো গান গাইতো ওরা আমার সাথে কোরাসে গলা মেলাল আর অন্যরা গুণগুণ করলো। গানের শেষে সবার চোখ সজল হল। আমার চোখের জল অবশ্য আমার গান গাওয়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটায় নি।

.

পরদিন ভোরে প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথেই আমাদের শিবিরে কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠলো। এখন আমাদের লোকজন বেদুঈন পোশাক আর মাথার আবায়া খুলে হাইকসো উর্দি, বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্রভরা গাটরি খুললো। বর্মটি মূলত চামড়ার তৈরি তবে শিরস্ত্রাণটি ছিল ব্রোঞ্জের আর নাকের উপরিভাগ ধাতুর টুকরা দিয়ে ঢাকা। প্রত্যেকে একটা করে শক্তিশালী বাঁকা ধনুক আর তূণ ভর্তি চকমকি পাথরের মাথাওয়ালা তীর নিয়ে সজ্জিত হল। তীরগুলোর গোড়ায় হাইকসো রীতিতে বিভিন্ন রঙের পালক লাগানো ছিল। তলোয়ারগুলো পিঠের খাপে ভরা ছিল, হাতল ছিল উপরের দিকে যাতে সহজে হাত দিয়ে টেনে বের করা যায়। তলোয়ারের পাতগুলো মিসরীয় তলোয়ারের মতো সোজা ছিল না, এগুলো প্রাচ্যের রীতিতে বাঁকা ছিল।

বর্ম আর অস্ত্রগুলো খুব ভারী ছিল আর প্রচণ্ড রোদে খুব গরম হয়ে যাওয়ায় এগুলো পরে দাঁড় বাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। কাজেই আমাদের। লোকেরা পরনের কাপড় খুলে শুধু লেঙটি পরলো আর যুদ্ধের পোশাক-আশাক সবকিছু পায়ের কাছে ডেকে বিছিয়ে রাখলো।

এদের বেশিরভাগেরই গায়ের রঙ ফর্সা আর চুল সোনালি। আমি ওদের সকলকে বলালাম চুলার ছাই নিয়ে মুখে আর দাড়িতে মেখে নিয়ে কালো করতে যাতে ওদের দেখে হাইকসো সৈন্য মনে হয়।

তিনটি জাহাজ সৈকত থেকে উপসাগরের পানিতে ভাসলো। আমি জারাসের সাথে সবার আগের জাহাজে থাকলাম। কাণ্ডারীর পাশেই দাঁড়ালাম, সে লম্বা হাতটা ধরেছিল। উশু বন্দরে যে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জাহাজগুলো কিনেছিলাম, তার কাছ থেকে একটা প্যাপিরাস মানচিত্রও সাথে নিয়েছিলাম। এতে জেবেল আর ওয়াদি আল নিলামের মাঝে মধ্য সাগরের দক্ষিণাংশের বিশদ বিবরণ তুলে ধরা ছিল। লোকটি দাবী করেছিল সে তার প্রত্যক্ষ

অভিজ্ঞতা থেকে নিজ হাতে মানচিত্রটি তৈরি করেছে। মানচিত্রটা ডেকে বিছিয়ে চারকোণায় চারটি নুড়ি পাথর দিয়ে চাপ দিলাম। আর সাথে সাথে সৈকতের কিছু বৈশিষ্ট দেখে মানচিত্রের সাথে মেলাতে পারলাম। দেখে মনে হল মানচিত্রটা নিভরযোগ্য।

সকালে দুইবার আমরা দিগন্ত রেখার কাছে অন্যান্য জলযানের পাল দেখতে পেলাম। তবে আমরা সরে গিয়ে ওগুলোকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিলাম। তারপর সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর তখন জাহাজের সামনের গলুই থেকে দাঁড়ি চিৎকার করে সকলকে সাবধান করে সামনের দিকে দেখাল। আমি চোখে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে সে যেদিকে দেখিয়েছিল সেদিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম দিগন্তজুড়ে সাগরের পানি সাদা হয়ে ভারী ঝড়ো বাতাসের মতো আমাদের উপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু এখনতো ঝড়ের ঋতু নয়।

আমি জারাসকে বললাম, পাল নামিয়ে ফেলতে বল! দাঁড়গুলো তুলে ভেতরে রেখে নোঙর তৈরি করে রাখতে বল।

প্রচণ্ড বেগে পানি আমাদের দিকে ছুটে আসছিল। বাতাসের ধাক্কা সামলাবার জন্য আমরা তৈরি হলাম। সাদা পানি প্রচণ্ড গর্জন করে এদিকে ছুটে আসছে। আমি শক্ত হাতে নৌকার একপাশ ধরে থাকলাম। সাগরের ঢেউ পাটাতনের উপর আছড়ে পড়লো। লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি আর জাহাজের দুইধারে ঢেউ ভেঙে পড়ার হট্টগোলে কানে তালা লেগে গেল। কিন্তু কোন হাওয়া নেই দেখে অবাক হলাম। সাথে সাথে আমার মনে হল হাওয়া ছাড়া ঝড় মানে নিশ্চয়ই অতিপ্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার। এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য আমি চোখ বুজে মহান দেবতা হোরাসের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।

তারপর একটি হাত আমার কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলো আর সেই সাথে কানের কাছে প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেলাম। আমি জানি এটা জারাসের গলা কিন্তু তারপরও চোখ খুললাম না। আমি অপেক্ষা করছিলাম দেবতা আমাদেরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু জারাস অনবরত আমাকে ধরে ঝাঁকিয়েই চলেছে, আমি সাবধানে চোখ খুললাম কিন্তু সেই সাথে প্রার্থনাও করে চললাম। তখনই বুঝলাম জারাস কিছু বলতে চাচ্ছে আর তখন একপাশে সাগরের দিকে তাকালাম।

সাগর জীবন্ত হয়ে উঠেছে তীরের ফলার মতো বিশাল চকচকে কতগুলো দেহ নিয়ে। তারপর একমুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম এগুলো জীবন্ত প্রাণী আর এক একটা প্রাণী একটা ঘোড়ার সমান আকৃতির। দানবাকৃতির এই মাছগুলো এতঘন হয়ে এক সাথে ছিল যে, নিচেরগুলো উপরেরগুলোকে ঠেলে উপরের দিকে ভেসে উঠতে চেষ্টা করায় বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করে পানি ছিটিয়ে চলছিল।

জারাস চেঁচিয়েই চলেছে, টুনা! এগুলো টুনা মাছ।

উচ্চ মিসর একটি স্থলবেষ্টিত দেশ হওয়ায় খোলা সাগরে যাওয়ার আমার তেমন সুযোগ হয়নি। আর এত বিশাল পরিমাণে টুনা মাছও দেখিনি। তবে এগুলো সম্পর্কে অনেক লেখা পড়েছি, তাই আমার বুঝা উচিত ছিল কী হচ্ছে। সাথে সাথে চোখ খুলে আমিও জারাসের মতো চিৎকার করে উঠলাম। অবশ্যই এগুলো টুনা মাছ! হারপুন নিয়ে লোকজনকে তৈরি হতে বল!

জাহাজে উঠার সময়েই আমি হারপুন লক্ষ্য করেছিলাম। এগুলো দাঁড়িদের বসার বেঞ্চের নিচে রাখা ছিল। আমার ধারণা ছিল জলদস্যুদের হামলা ঠেকাতে এগুলো ব্যবহৃত হয়। একজন মানুষের দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের সমান লম্বা বল্লম। ডগা ধারালো সংকর ধাতুর। ডগার পেছনে একটা চোখের মতো ছিদ্র দিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার আঁশের দড়ি ঢোকানো ছিল। আর দড়ির অপর প্রান্তে একটা বাঁকা কাঠের ফাত্না বাঁধা ছিল।

আমার নির্দেশের সাথে সাথে সবচেয়ে আগে জারাস কাজে লেগে পড়লো। তারপর অন্যরা তাকে অনুসরণ করলো।

সে লম্বা অস্ত্রটা বেঞ্চের তলা থেকে তুলে নিয়ে দড়ির গিঁট খুলে রশি ছাড়তে ছাড়তে জাহাজের এক পাশে ছুটে চললো। লম্বা হারপুনটা কাঁধে রেখে রশিবাধা মাথাটা নিচে ঝাঁক বেঁধে চলা টুনার চকচকে রূপালি স্রোতের দিকে তাক করলো। বিশাল গোল গোল চোখ নিয়ে মাছগুলো মনে হচ্ছে আতঙ্কিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

আমি লক্ষ্য করলাম, সে লক্ষ্য স্থির করে হারপুনের মাথা নিচু করে সোজা পানিতে ছুঁড়ে মারলো। ভারী হারপুনের ডগাটা বিশাল মাছের শরীরে সজোরে বিধতেই মাছটি একটা ঝটকা মারতেই হারপুনটা একটু কেঁপে পানিতে তলিয়ে গেল।

জারাস এক লাফে ডেকে নেমে লম্বা রশিটা ধরে ফেললো। আরও তিনজন নাবিক এগিয়ে এলো ওর সাহায্যে, তারপর সবাই মিলে রশিটা সামলে টানতে টানতে মাছটা টেনে তুললো।

চারজন লোক জারাসকে অনুসরণ করে বেঞ্চের নিচ থেকে হারপুন তুলে নিয়ে জাহাজের একপাশে ছুটে গেল। একটু পর জাহাজের দুইপাশেই লোকজন ছুটাছুটি করে হারপুন গেঁথে বিশাল মাছগুলো জাহাজের ডেকে টেনে উঠাতে লাগলো। লোকজনের উত্তেজিত চিৎকার, চেঁচামেচি, নির্দেশ আর হট্টগোলের শব্দে জাহাজের পুরো পরিবেশে কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠলো।

একটার পর একটা মাছ ডেকে উঠিয়ে হাতুড়ির আঘাতে মেরে ফেলা হল। হারপুনে গেঁথে শেষ মাছটা তুলে কেটে ফেলার পর বাদবাকি মাছের দল হঠাৎ যেরকম উদয় হয়েছিল সেরকম হঠাৎ আবার গভীর পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেই রাতে আমরা আবার সৈকতে নামলাম, তারপর বেলাভূমিতে আগুন জ্বেলে মাছ রান্না করে খেলাম। এটি ছিল সাগরের সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ। স্বাদ বাড়াবার জন্য ওরা একটু লবন মেখে নিল। সবাই পেটপুরে খেল তারপর চামড়ার মশক থেকে মদ খেল।

আমি জানতাম শক্তি সঞ্চয়ের পরদিন সকালে ওরা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবে। মাংস খেলে একজন যোদ্ধার মনে যে দানবটি থাকে তা জেগে উঠে।

সেই রাতে আমি গাইলাম তানুস এবং নীল তরবারির গাথা। এটা ছিল সাগরের রণসঙ্গীত। আর এই গান ওদের মনে চরম উদ্দীপনা জাগিয়ে তুললো। সবাই আমার সাথে গলা মিলিয়ে গানটা গাইতে লাগলো, এমনকি যার গলা একেবারে বেসুরো সেও বাদ গেল না। তারপর আমি লক্ষ্য করলাম ওদের চোখে লড়াই করার মানসিকতা তীব্র হয়ে উঠেছে। এখন ওরা যেকোনো শত্রুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।

.

পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমরা জাহাজগুলো পানিতে ভাসালাম। হালকা আলোয় পানির নিচে ডুবো পাহাড়ের চূড়া সামলে নিরাপদ পথ বেছে নিয়ে চলতে লাগলাম।

নীলনদের বদ্বীপের মুখের কাছাকাছি আসতেই আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হলাম। শেষবিকেলে একটা মোহনা পার হলাম, এর পূর্বপাশে নিচু জঙ্গল আর পশ্চিমে খোলা মাটির তীর। একটু ভেতরে সাগরের দিকে মুখ করা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটিতে একটি কাদামাটির ইটের তৈরি চুনকামকরা দুর্গ দেখা গেল। দুর্গের চূড়াটা প্রায় ভেঙে পড়েছে আর সাগরের দিকের অধিকাংশ দেয়ালেরও ভগ্ন দশা। তবে আমি বুঝতে পারলাম এটা হচ্ছে তামিয়াত প্রণালীর নৌচলাচলের সংকেত কেন্দ্র। সম্ভবত অনেক আগে মৃত কোনো মিসরী নাবিক এটা তৈরি করেছিল।

আমি একছুটে আমাদের জাহাজের একমাত্র মাস্তুলের কাছে গিয়ে খুঁটি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। উপরে পালের খুঁটি পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সামনে তাকালাম। এখান থেকে সামনে তীরভূমি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে তীরভূমির আরও ভেতরে গাছের মাথার উপর দিয়ে একটি আয়তাকার স্থাপনা পরিষ্কার দেখা গেল। এটাও সাদা চুনকাম করা। এবার আমি নিঃসন্দেহ হলাম মিনোয়ানদের যে বাণিজ্য-দুর্গ আর কোষাগার আমরা খুঁজছি এগুলো তার সূরক্ষিত পর্যবেক্ষণ চৌকি। আমি মাস্তুলের খুঁটি বেয়ে সর সর করে নিচে নেমে চিৎকার করে কাণ্ডারীকে বললাম, জলদি হাল ধর! জাহাজ সামনের ডানদিকে তিন পয়েন্ট ঘোরাও!

জারাস দৌড়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, তাই করবো?

আমি মৃদু হেসে কাণ্ডারীর দিকে ঘাড় কাত করে বললাম, হ্যাঁ, তাই করতে বল। আমরা আবার সাগরের দিকে ঘুরে চললাম। অন্য জাহাজ দুটোও আমাদের অনুসরণ করলো। এখন আমরা সৈকত থেকে বেশ দূরে সরে চলতে লাগলাম। তারপর কিছুদূর সামনে গিয়ে তামিয়াত দুর্গের পাহারা চৌকির নজর এড়ালাম। আবার গতিপথ বদলালাম। এরপর সোজা বদ্বীপের গোলকধাঁধার মতো জলাভূমির দিকে এগোলাম।

মানচিত্র থেকে আমি জেনেছিলাম কোথায় নোঙর বাধার মতো নিরাপদ স্থান পাওয়া যেতে পারে। পালগুলো নামিয়ে ডেকে বিছিয়ে রাখা হল, তারপর প্যাপিরাস আর নলখাগড়ার ঘন বনের মধ্য দিয়ে পথ করে আমার পছন্দমতো একটা উপদের দিকে চললাম। এখানে পৌঁছে আমরা গাছপালার ঘন জঙ্গলে পুরোপুরি ঢাকা পড়লাম। অগভীর পানিতে নোঙর ফেলা হল, জাহাজের তলা সাগরের নিচে কাদার একটু উপরে রইল। থুতনি পর্যন্ত শরীর পানিতে ডুবিয়ে আমরা এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে আসা যাওয়া করতে লাগলাম।

সূর্যাস্তের পর চাঁদ উঠতেই সবাই অবশিষ্ট টুনা মাছ দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। জারাস নিঃশব্দে তিন জাহাজ থেকে আট জন লোক বেছে নিল। ওদেরকে জানাল পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার সাথে সাথে আমাদের সাথে শত্রুপক্ষের অবস্থান পরীক্ষা করার অভিযানে যেতে হবে।

ভোর হবার ঘন্টা খানেক আগে আমরা সবাই দুটো এক বৈঠার ডিঙিতে চড়লাম। এদুটো জাহাজের পেছনে বেঁধে আনা হয়েছিল। চওড়া উপহ্রদের মধ্য দিয়ে বৈঠা বেয়ে অন্তরীপের যে জায়গায় দুৰ্গটা দেখেছিলাম তার একটু কাছে পৌঁছলাম।

অন্ধকারে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া জলাভূমির পাখির ডাক আর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার হালকা হতেই আবছা আলোয় জলচর জংলি হাঁস, রাজহাঁস, লম্বা ঠ্যাং আর গলার বক, সুন্দর পালক আর লেজ বিশিষ্ট বিভিন্ন ধরনের অন্তত পঞ্চাশটারও বেশি সারসজাতীয় পাখি দেখা গেল। আমরা উপহ্রদের মধ্য দিয়ে ডিঙ্গি বেয়ে এগোতেই হাঁসগুলো ঝাঁক বেঁধে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে পানির উপর থেকে শূন্যে উড়াল দিল। দিগন্তের উপর সূর্য উঠতেই দেখা গেল চারপাশের জায়গাটি পুরোপুরি জংলি আর মনুষ্যবসতির অনুপযোগী একটি স্থান।

শক্ত মাটিতে পৌঁছার পর ডিঙি দুটো টেনে নিয়ে নলখাগড়ার ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর ঘন ঝোঁপের মধ্য দিয়ে সাবধানে এগিয়ে চললাম।

তারপর হঠাৎ একটা গভীর খালের কাছে এসে পৌঁছলাম। প্যাপিরাসের মধ্য দিয়ে খালটা দক্ষিণ দিকে সোজা সাগরের দিকে চলে গেছে। প্রায় একশো কদম চওড়া খালটা বেশ গভীর, হেঁটে পার হওয়া সম্ভব নয়। খালের অপর তীরে পাহারা চৌকির সমতল ছাদ দেখা যাচ্ছে। ছাদের পাচিলের উপরে কমপক্ষে তিনজন পাহারাদারের শিরস্ত্রাণপরা মাথা দেখা যাচ্ছে।

এরপর হঠাৎ সাগরের দিক থেকে একটা জলযান আসার পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল। আমি সবাইকে সাবধান করলাম। জাহাজ চলার কাঁচকোচ, মাঝিমাল্লাদের বৈঠা বাওয়ার শব্দ বেড়ে চলেছে। তারপর হঠাৎ খালের বাঁকে একটা সমুদ্রগামি বিশাল জাহাজ দেখা গেল।

এত বড় আর এ-ধরনের জাহাজ আমি কখনও দেখিনি। তবে আমার গুপ্তচরদের পাঠানো বর্ণনা থেকে আমি নিশ্চিত হলাম এটা ক্রিটদের তিন সারিতে দাঁড় বাওয়া একটা রণতরী। এতে যেমন মাল বহন করা যায়, তেমনি যুদ্ধজাহাজ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। একটার পর একটা তিনতলা ডেকে তিন সারি দাঁড় রয়েছে।

জাহাজের সামনের লম্বা সরু ডগাটি ব্রোঞ্জের পাত দিয়ে মোড়ানো, যাতে শত্রুপক্ষের জাহাজকে গুঁতো দেওয়া যায়। দুটি মাস্তুলে বেশ বড় জায়গা জুড়ে পাল খাটানো যায়। তবে পালগুলো এখন গোটানো রয়েছে, যেহেতু সংকীর্ণ খালের মধ্য দিয়ে দাঁড় বেয়ে আসতে হচ্ছে। জাহাজটি বেশ সুন্দর, দড়িদড়া পরিষ্কার আর উঁচু বরগা। এই জাহাজটি দেখে সহজেই বুঝা যায় ক্রিটের নৌবাহিনী কেন পৃথিবীর মধ্যে সেরা। মাল বোঝাই হওয়ার কারণে এখন একটু নিচু হলেও অন্য কোন জাহাজই এর মোকাবেলা করতে পারবে না। ভাবলাম জাহাজের খোলে কি মাল বোঝাই করা হয়েছে কে জানে।

নলখাগড়ার ঝোঁপের যে জায়গায় আমরা লুকিয়েছিলাম, জাহাজটি তার সমান্তরাল হতেই আমি নাবিকদের চেহারা দেখতে পেলাম। সামনের দিকে তিনজন নৌ-কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছে আর পাশেই চারজন মাঝি লম্বা দাঁড় সামলাচ্ছে। তিন নৌযোদ্ধার মুখের বেশিরভাগ বর্ম দিয়ে ঢাকা থাকলেও বুঝা যাচ্ছে লোকগুলো গড়পরতা মিসরীয়দের চেয়ে বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠ। ওরা যে বাণিজ্যপোতের নাবিক নয় বরং যোদ্ধা, তা সহজেই বুঝা যায়।

জাহাজটি আমাদের পাশ কাটাবার সময় লক্ষ করে বুঝতে পারলাম, সবচেয়ে উপরের সারিতে যারা লম্বা দাঁড় বাইছে তারা মোটেই ভারবাহী পশুর মতো মাঝিমাল্লা নয়, ওরা অবশ্যই যোদ্ধা। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই দাঁড় ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে রাখা অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

তবে নিচের সারিগুলোতে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসেরা দাঁড় বাইছিল। ওদের শরীরের গন্ধ থেকে আমি বুঝতে পারলাম ওরা সেই হতভাগ্যের দল যারা সারা জীবন এই দাঁড় বাওয়ার বেঞ্চেই জীবন কাটিয়েছে। যেখানে ওরা বসে রয়েছে, সেখানে বসেই দাঁড় টানে, খায়, ঘুমায়, মল ত্যাগ করে আর শেষপর্যন্ত সেখানেই মারা যায়।

জাহাজটি আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় নৌকর্মকর্তাদের চেঁচিয়ে নির্দেশ দিতে শোনা যাচ্ছিল। উপরের সারির দাঁড়গুলো একটা রূপালি চিলের ডানার মতো এক সাথে পানি থেকে উঠছিল আর নামছিল। আর নিচেরগুলো ঝপঝপ করে পানিতে পড়ছিল আর পেছনে টানছিল। খালের শেষমাথার বাঁক পার হয়ে জাহাজটি একটু দূরে চকচকে চুনকাম করা দুর্গের দিকে ভেসে চললো।

তারপর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো, যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঠিক প্রথমটির মতোই আরেকটি জাহাজ সাগর থেকে মোহনার মধ্য দিয়ে খালে ঢুকলো, তারপর আমাদের পাশ কাটিয়ে একই পথে সামনে চলে গেল। এই জাহাজটিও মাল বোঝাইয়ের কারণে নিচু ছিল।

তারপর আবার হতবাক আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে লক্ষ্য করলাম ঠিক একই রকম তৃতীয় আরেকটি জাহাজ খাল বেয়ে এসে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। এটিও আগের দুই জাহাজকে অনুসরণ করে দুর্গের পথে চলে গেল।

এবার আমি বিষয়টা বুঝতে পারলাম। তিনমাস আগে আমার চর আমাকে খবর দিয়েছিল যে, ধনরত্ন বোঝাই তিনটি জাহাজ ক্রিটের প্রধান সমুদ্র বন্দর আগাফের থেকে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এই খবরটা আমার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে কয়েক মাস লেগে যায়। ইতিমধ্যে কোনো কারণে এই নৌবহরের সমুদ্র যাত্রা বিলম্বিত হয়ে যায়, সম্ভবত প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটা হয়েছে। তবে দেরি হওয়ার খবরটা গুপ্তচরেরা আমাকে জানাতে পারেনি।

আমার ধারণা ছিল, জাহাজগুলো তামিয়াত দুর্গে মাল খালাস করে আবার ফিরতি যাত্রায় আগাফের বন্দরের দিকে রওয়ানা দেবার অনেক পরে আমি তামিয়াতে পৌঁছাবো।

কিন্তু এই জাহাজগুলো যখন তামিয়াতে পৌঁছাবে তখন আমিও সেখানে পৌঁছব এরকম আশা আমি করিনি, সম্ভবত কোন দেবতার অনুগ্রহে এটা সম্ভব হয়েছে। ছোটকাল থেকে আমি জেনে এসেছি যে আমি দেবতার প্রিয়পাত্র। বিশেষত প্রধান দেবতা হোরাসের, যার কাছে আমি সবসময় প্রার্থনা করি। তা নাহলে জন্মের পর থেকেই আমার মধ্যে এত বুদ্ধি আর গুণের সমন্বয় কী করে হল? কী কারণে আমি এতবার ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি, যেখানে অন্য কোনো সাধারণ মানুষ হলে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত? কী করে আমি এত তরুণ আর সুন্দর থাকতে পারলাম আর এত তীক্ষ্ণধী থাকলাম। অথচ আমার আশেপাশের সবারই বয়সের সাথে সাথে চামড়া কুঁচকে গেল, চুল সাদা আর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল? নিশ্চয়ই আমার মাঝে এমন কিছু আছে যা, অন্যান্য সাধারণ মানুষ থেকে আমাকে আলাদা করেছে।

এটাও নিশ্চয়ই হোরাস দেবতার অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত। আমি মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম প্রথম সুযোগেই তার কাছে একটি বড় ধরনের উৎসর্গ নিবেদন করবো। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে জারাসের কাছে গিয়ে তার জামার হাত ধরে টান দিয়ে বললাম,

খাল পার হয়ে আমাকে ক্রিস্টানদের দুর্গের কাছে যেতে হবে।

আমাদের এই মিসরের দুটো বিষয় আমার কাছে বেশ হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হয়, যার কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাই না। প্রথমটি হল ঘোড়াকে আমরা মাল বহন করার জন্য আর যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র, রথ টানার কাজে ব্যবহার করলেও প্রায় কোনো মিসরিই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় না। আর দ্বিতীয় ধাঁধাটি হল বিশাল একটি নদীর তীরে বাস করলেও কেউ সাঁতার কাটতে জানে না। কাউকে এ-বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কেবল কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলবে, এ ধরনের আচরণ দেবতাদের পছন্দ নয়।

তবে আমি আগেই বলেছি অন্যদের চেয়ে আমি আলাদা। অবশ্য একথা বলবো না যে, সবদিক দিয়েই আমি শ্রেষ্ঠ। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি একজন চৌকস ঘোড়সওয়ার আর সেই সাথে একজন শক্তিশালী এবং অক্লান্ত সাঁতারু।

আমি জানতাম জারাসের এদুটো গুণের কোনোটাই নেই, তবে রথের রশি যখন তার হাতে থাকে, তখন তাকে হারাবার মতো কেউ নেই। তাই তাকে আমি নির্দেশ দিলাম কর্ক গাছের ছাল দিয়ে বয়া বানিয়ে নিতে যার সাহায্যে সে পানিতে ভেসে থাকতে পারবে। তারপর আমরা দুজনে কোমর পর্যন্ত পোশাক খুলে খালের পানিতে নেমে পড়লাম। জারাস ওর তলোয়ারটা কর্কের বয়ার সাথে বেঁধে নিয়েছিল, আমি আমারটা পিঠে বেঁধে নিলাম। একটা ভোঁদড়ের মতো দ্রুত সাঁতার কেটে আমি খালের অপর তীরে পৌঁছে গেলাম, এদিকে জারাস তখনও দম নিতে নিতে কেবল অর্ধেক পথ পার হয়েছে।

সে খালের এপারে পৌঁছার পর আমি তাকে তীরে উঠতে সাহায্য করলাম। তারপর সে একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আমরা নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চুপিসারে ক্রিটান দুর্গের দিকে রওয়ানা দিলাম। তারপর একটা সুবিধামতো জায়গায় পৌঁছে দালানটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম ওরা কেন এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিল। চুনাপাথর পাহাড়ের একটা লম্বা আর সরু চূড়ার উপর শক্ত ভিত্তির উপর দুৰ্গটা খাড়া করা হয়েছে।

মূল খালটা ভাগ হয়ে দুর্গের চারপাশ ঘিরে একটা দুর্গপরিখা তৈরি করেছে। দুর্গের চতুর্দিকে নদীর প্রবাহটি যে পোতাশ্রয় সৃষ্টি করেছে সেখানে বিভিন্ন ধরনের বেশ কয়েকটি জলযান নোঙর করা রয়েছে। বেশিরভাগই বজরা, যা দিয়ে সম্ভবত ক্রিটানরা নির্মাণ সামগ্রী বয়ে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একটিও সমুদ্র চলাচলের উপযোগী জাহাজ নয়। কেবল সেই তিনটি চমৎকার তিনতলা দাঁড় বাওয়া জাহাজ রয়েছে, যেগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে এসেছে।

এই জাহাজগুলো তামিয়াত দুর্গের মূল ফটকের ঠিক নিচে একটা পাথরের জেটিতে নোঙর করা রয়েছে। ফটকটি ভোলা আর নবাগতদের স্বাগত জানাতে কয়েকজন উর্দিপরা সৈন্য সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পালকদিয়ে সাজানো শিরস্ত্রাণ আর সোনার সাজসজ্জা দেখে আমি বুঝতে পারলাম সেখানে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাও রয়েছে।

আমি আর জারাস সাঁতার কেটে খাল পার হয়ে এখানে পৌঁছার আগেই প্রথম জাহাজের নাবিকেরা জাহাজের খোল থেকে মাল নামানোর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। শিকলে বাঁধা একদল অর্ধনগ্ন ক্রীতদাস জাহাজ থেকে মাল নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। অর্ধেক বর্মপরা আর কোমরবন্ধে গোঁজা ছোট তরবারি নিয়ে কয়েকজন তত্ত্বাবধায়ক এদের কাজ দেখাশুনা করছিল। এদের সবার হাতে কাঁচা চামড়ার বিনুনি করা চাবুক রয়েছে।

লম্বা একটা তক্তার উপর দিয়ে ক্রীতদাসেরা একইরকম ভারি কাঠের সিন্দুকগুলো নিয়ে তীরে যাচ্ছিল। খুব বড় না হলেও সিন্দুকগুলো বেশ ভারি, তাই এর ওজনের ভারে ক্রীতদাসেরা টলমল করে হাঁটছিল। পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছিল বেশ ধীরগতিতে আর বিরক্ত তত্ত্বাবধায়করা কর্মরত ক্রীতদাসদেরকে চিৎকার করে তিরস্কার করছিল।

তারপর আমরা লক্ষ্য করলাম একজন ক্রীতদাস কাঠের তক্তা থেকে তীরে নামার সময় পা ফসকে নিচে পড়ে গেল আর মাথার উপর থেকে ভারি কাঠের সিন্দুকটা নিচে পাথরের স্ল্যাবের উপর পড়তেই এর ডালা ভেঙে খুলে গেল আর ভেতরের রূপার বাটগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো। মাটিতে স্তূপ হয়ে পড়া চকচকে উজ্জ্বল রূপার বাটগুলোর উপর রোদ পড়ে ঝিকমিক করে উঠলো। দৃশ্যটি দেখে আমার বুক ধক করে উঠলো। এক হাতের চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যের রূপার চারকোণা প্রায় কুড়িটা বাট কাঠের সিন্দুকটিতে ঠেসে ভরা ছিল। যে জাহাজে এই সিন্দুকগুলো মধ্য সাগর দিয়ে বয়ে আনা হয়েছে, সেরকম একটি বিশাল জাহাজ তৈরি করার খরচ এক সিন্দুক ভরা এই রূপার বাট দিয়ে মেটানো যাবে। আমার সমস্ত আশা পূর্ণ হয়েছে। এটিই সেই বিশাল ধনভাণ্ডার যা আমি প্রত্যাশা করেছিলাম।

তিনজন তত্ত্বাবধায়ক একযোগে মাটিতে পড়ে যাওয়া ক্রীতদাসের ঘর্মাক্ত শরীরের উপর চাবুক মারতে শুরু করলো। লোকটা চিৎকার করে ছটফট করছিল আর দুইহাত দিয়ে মুখ ঢাকতে চেষ্টা করছিল। একটা চাবুকের আঘাতে তার মুখে পড়তেই লোকটির ডান চোখটি কোটর থেকে ছিটকে বের হয়ে স্নায়ুতন্ত্রির সাথে গালের উপর ঝুলতে লাগলো। ছটফট করতে করতে শেষপর্যন্ত ক্রীতদাসটি জ্ঞান হারালো, আর নিজেকে বাঁচাবার শক্তি অবশিষ্ট রইল না। একজন সৈন্য তার এক পা ধরে টানতে টানতে জেটির কিনারায় নিয়ে এক টানে নদীতে ফেলে দিল। ঝপ করে কাদাভরা পানিতে পড়ে দেহটা নিচে তলিয়ে গেল।

এই ঘটনার পর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অর্ধনগ্ন অন্যান্য ক্রীতদাসরা মুখ বুজে কাজ করে যেতে লাগলো, যেন কিছুই হয়নি।

জারাসের কাঁধে টোকা দিয়ে আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। তারপর দুজনে আবার নলখাগড়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ফিরে গেলাম। এবার ঘুরে দুর্গের অন্যধারে নদীর অপর তীরের কাছে পৌঁছলাম। একঘন্টা ধরে সাবধানে চতুর্দিক লক্ষ্য করার পর একটা জায়গা খুঁজে পেলাম, যেখান থেকে দুর্গ আর আশপাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি বুঝা যায়। দুর্গ সম্পর্কে আমার গুপ্তচরেরা যেসব তথ্য দিয়েছিল এবার তা সরেজমিনে যাচাই করতে পারলাম।

দুর্গ ঘিরে থাকা দেয়ালগুলো দুর্ভেদ্য মনে হলেও এলাকাটা খুব বেশি বড় নয়। যেটুকু জায়গা রয়েছে তাতে কেবল কোষাগার আর একটা ব্যারাকের স্থান সংকুলান হবে। সাগর থেকে খাল দিয়ে এসে ছোট আকারের আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার মতো কিছু সংখ্যক সৈন্য সেখানে থাকতে পারবে।

তবে ক্রিটানরা নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছিল, বড় ধরনের শত্রুর আক্রমণ হলে অন্তত কয়েকহাজার সেনা হাতে রাখতে হবে। আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য ওরা নদীর উপর দিয়ে পন্টুন সেতু তৈরি করেছিল, যাতে নদীর মাঝখানে দ্বীপে অবস্থিত দুর্গ রক্ষার জন্য নদীর যেকোনো তীর থেকে সেনারা দ্রুত নদী পার হয়ে দুর্গের দিকে ছুটে যেতে পারে।

আমি মাটিতে যেখানে শুয়েছিলাম, সেখান থেকে পূর্বদিকের একেবারে শেষ মাথায় নদীর তীরে ক্রিটানরা তাদের সৈন্যদের মূল শিবির স্থাপন করেছিল। শিবিরের চারপাশ ঘিরে দুই মানুষ সমান উচ্চতার কাঠের খুঁটি দিয়ে প্রতিরক্ষা বেড়া তৈরি করেছে। কাঠের খুঁটিগুলোর মাথা কেটে চোখা করা হয়েছে। আন্দাজ করলাম এখানে দুই থেকে তিনহাজার সৈন্য থাকতে পারে।

শিবির এলাকার চারকোণে উঁচু পাহারা মাচা স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষ্য করলাম খুঁটি দিয়ে ঘেরা জায়গাটির মাঝে দালানের ছাদ নদীতীরের শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া কালো মাটি দিয়ে ঘন করে লেপা হয়েছে। দেয়ালের উপর দিয়ে শত্রুসেনারা অগ্নিবাণ ছুঁড়লে এটি তা প্রতিরোধ করবে।

ফটক থেকে নদী তীরের যে জায়গায় পন্টুন সেতুটি রয়েছে সে জায়গা পর্যন্ত ক্রিটানরা শুকনো কালো মাটি দিয়ে ইটের রাস্তা তৈরি করেছে। এটাও শত্রুর তীরের আক্রমণ থেকে ক্রিস্টানদের রক্ষা করবে।

ওরা একটার পর একটা লম্বা নৌকা পাশাপাশি বেঁধে নদীর দুই খালের উপর পন্টুন সেতুটি তৈরি করেছে। সেতুর উপর তক্তা ফেলে একটা পথ করা হয়েছে। যাতে প্রয়োজন মতো অনেক সৈন্য শিবির থেকে ছুটে যেতে পারে।

পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর জারাস মন্তব্য করলো, ওরা সবদিক বিবেচনা করেই পরিকল্পনা করেছে।

আমি একমত পোষণ করে বললাম, এর জন্যই ক্রিটানরা বিখ্যাত সবদিক বিবেচনা করা। তারপরও আমি জায়গাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম, ক্রিটানদের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোনো দুর্বল দিক বের করা যায় কি না। অনেক খুঁজে একমাত্র পন্টুন সেতুটাই আমার মনে হল একমাত্র পথ যা আমি সামলাতে পারবো।

এরপর মনোযোগ ফেরালাম জেটির দিকে, সেখানে তখনও জাহাজ তিনটি নোঙর করা রয়েছে। ক্রিটানরা যে পদ্ধতিতে প্রথম জাহাজটি থেকে মাল নামাচ্ছিল, তা বিবেচনা করে বুঝতে পারলাম পদ্ধতিটা খুব একটা কার্যকর নয়। আমি হলে জাহাজের খোলের মুখে তেপায়া টেবিল আর কপিকল লাগিয়ে সিন্দুকগুলো ডেক বরাবর বারকোশের উপর রাখতাম। তারপর সেখান থেকে ঠেলাগাড়িতে সিন্দুকগুলো জেটির মধ্য দিয়ে দুর্গের ফটক পর্যন্ত নিয়ে যেতাম।– অথচ ক্রিটান ক্রীতদাসগুলো একটা একটা করে কাঠের সিন্দুক জাহাজের নিচের খোল থেকে বের করে মই বেয়ে উপরে ডেকে নিচ্ছিল। এভাবে কাজ শেষ করতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে।

এবার আমি একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলাম। কাজটা যে এমন বিশাল আকার ধারণ করবে তা আমি আগে বুঝে উঠতে পারিনি। লাখ লাখ রূপার বাট নাড়াচাড়া করার কথা বলা সহজ, তবে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের আসল ওজন আর পরিমাণ এখন চোখে দেখার পর এগুলো এখান থেকে জব্দ করে সমুদ্র, পর্বত আর মরুভূমির উপর দিয়ে শত শত লিগ দূরত্ব পার করে নিয়ে যাওয়ার কাজটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। তার উপর পেছন পেছন থাকবে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ সেনাবাহিনী।

এবার সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়লাম, মনে হচ্ছে কাজটা অসম্ভব। একবার ভাবলাম কোনোমতে সিন্দুকগুলো কজা করতে পারলে সাগরে ডুবিয়ে দেব। সর্বাধিরাজ মিনোজ কিংবা রাজা বিওন-কেউ আর তার নাগাল পাবে না। তারপর ক্রিস্টানদের প্রতিশোধ থেকে পালিয়ে আমার লোকজনদের নিয়ে আমি থিবসে ফিরে যেতে পারি। হয়তো সর্বাধিরাজ মিনোজকে বুঝিয়ে বলতে পারবো যে, রাজা বিওনই হচ্ছে মূল অপরাধী। তবে এতে আমার সন্দেহ হচ্ছে।

সমস্যাটির তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান মনে এলো না। প্রায় ঘন্টাখানেক আমি আর জারাস ঘাসের উপর শুয়ে সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় একটা সমাধানের সূত্র ভেসে এলো। এত সহজ আর সুন্দর একটা সমাধান কীভাবে আমার মাথায় এলো ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

ভাবলাম সবকিছু জারাসকে খুলে বলি। তারপর আবার একটু চিন্তা করে থামলাম।

সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মধ্য গগন পার হয়ে পশ্চিমে প্রায় অর্ধেক পথে ঢলে পড়েছে। এবার তিনটি যুদ্ধ জাহাজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলাম। অনুভব করলাম জারাস নিবিষ্টমনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হল সে বুঝতে পেরেছে, আমার মনে নিশ্চয়ই কোনো একটা পরিকল্পনা এসেছে। যাইহোক এখনও সবকিছু তাকে বলার সময় আসেনি।

শেষপর্যন্ত বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। এবার চল যাই।

কোন দিকে, তায়তা?

আমাদের নৌকায় ফিরে যেতে হবে। রাতের আগেই অনেক কাজ সারতে হবে।

.

উপহ্রদের যে জায়গায় আমাদের ছোট নৌকা তিনটা ছেড়ে এসেছিলাম, সাঁতার কেটে সেখানে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাকি লোকজন আমাদের দুজনকে ফিরতে দেখে খুব খুশি হল। ওরা হয়তো ভেবেছিল আমরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম আর ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে। যাইহোক এখন ওরা আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে রইল।

সবার আগে যে কাজটা নিয়ে আমি ভাবছিলাম, তা হল ভারি বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত আমার সৈন্যদেরকে কীভাবে এই গভীর খাল পার করিয়ে দুর্গের কাছে নিয়ে যাবো। অথচ এদের বেশিরভাগই সাঁতার জানে না।

এটা করতে গিয়ে প্রথমে সবচেয়ে ছোট আর হালকা নৌকাটা বেছে নিলাম। তারপর আমার লোকদের বললাম অন্যদুটোর তলা ফুটো করে উপহ্রদের সবচেয়ে গভীর অংশে ডুবিয়ে দিতে। একবার অবশ্য আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম ধুয়া চোখে পড়লে ক্রিটানদের সন্দেহ হলে বিষয়টা তদন্ত করার জন্য ওরা খোঁজ নিতে কাউকে পাঠাতে পারে।

তারপর ছোট নৌকাটা অগভীর পানির উপর দিয়ে টেনে দুর্গের কাছাকাছি উপহ্রদের পূর্বতীরে পৌঁছলাম। তারপর ডাঙার উপর দিয়ে নৌকাটা টেনে খালের কাছে নিয়ে যাবার কাজে সমস্ত লোক নিযুক্ত করলাম। অন্য নৌকা দুটো থেকে যে দড়িগুলো খুলে নিয়েছিলাম সেগুলো দিয়ে বেঁধে নৌকাটা টানার ব্যবস্থা করা হল।

এক একটা রশি একশোজন করে টানার কারণ নৌকার তলি একটা পিছলের মতো হল আর নৌকার কাঠামোর ওজনের ভারে প্যাপিরাসের ঘাস চ্যাপ্টা করে তার উপর দিয়ে সহজেই চলতে লাগলো। যাইহোক নদীর মূল প্রণালীতে পৌঁছতে আমাদেরকে প্রায় অর্ধেক লিগ ডাঙা পার হতে হল। এই কাজ শেষ করতে করতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল আর আকাশের অনেক উপরে কুঁজো চাঁদ দেখা গেল।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই কিছু ঠাণ্ডা খাবার খেলাম আর সৈন্যদেরকে বর্ম আর উর্দি পরার সময় দিলাম। তারপর যতদুর সম্ভব নিঃশব্দে দাঁড় বেয়ে একেক বার পঞ্চাশজন লোক নৌকায় নিয়ে খাল পার হলাম।

একশো পঞ্চাশ জনের বড় দলটি নিয়ে জারাসকে নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহারা চৌকির নজর এড়িয়ে যতদূর সম্ভব দুর্গের মূল ফটকের কাছাকাছি পাঠালাম। আমার কাছ থেকে সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ওরা সেখানেই লুকিয়ে থাকবে।

দুজন আলাদা হওয়ার আগে জারাসকে আমার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বললাম। পঞ্চাশজন লোকসহ আমি নৌকা নিয়ে উজানের দিকে যাব। আমার উদ্দেশ্য হল পন্টুনসেতুটা ধ্বংস করা। এটাই শক্রর মূল শিবিরের সাথে যে দ্বীপে কোষাগারটি রয়েছে সেখানে যাওয়ার একমাত্র পথ। আলাদা হওয়ার আগে জারাসকে আলিঙ্গন করে আবার কয়েকবার আমার নির্দেশগুলো তাকে বুঝিয়ে বললাম, যাতে কোনো ধরনের ভুলবুঝাবুঝি না হয়।

তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর আমি নৌকায় বসে মাল্লাদের দাঁড় বাওয়ার নির্দেশ দিলাম। খরস্রোতা হলেও আমার মাল্লারা প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে চললো। বেশ দ্রুত আমরা উজানের দিকে এগিয়ে চললাম। একটুপরই চাঁদের আলোয় চকচকে সাদা চুনাপাথরের দুর্গের চূড়াটা নজরে পড়লো। দুর্গ চোখে পড়ার সাথে সাথেই আমার লোকেরা দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁড় বাইতে লাগলো।

এবার শেষ বাকটার কাছে পৌঁছলাম, এরপর সামনেই দুর্গ। তিনতলা জাহাজ তিনটি এর আগে যেরকম দেখে গিয়েছিলাম সেরকম এখনও পাথরের জেটিতে নোঙর করা রয়েছে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম দুটো জাহাজ এখনও পানিতে একটু দেবে রয়েছে। তার মানে এখনও এগুলোর খোলে রূপার বাটভরা রয়েছে। তৃতীয় জাহাজটা একটু উঁচু মনে হল। এর বেশিরভাগ মাল হয়তো খালাস করা হয়েছে। তারপরও আমার আন্দাজ মতো এটিরও অর্ধেকের বেশি মাল এখনও জাহাজে রয়ে গেছে।

আশেপাশে কোন ক্রিটান পাহারাদার দেখা গেল না। বিশাল জাহাজগুলোতেও কোনো আলো নেই। যাইহোক জেটির এক মাথায় একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে রাখা হয়েছে। আর দুর্গের ফটকের দুই পাশে দুটো ব্রাকেটের মধ্যে মশাল জ্বলতে দেখা গেল।

মাথা থেকে ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণটা খুলে কোলের উপর রাখলাম। তারপর গলায় পেঁচানো উজ্জ্বল হলুদ কাপড়ের টুকরাটা দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকলাম। এটা অত্যন্ত দামি অসাধারণ একটি কাপড়, যাকে রেশমি কাপড় বলা হয়। অত্যন্ত দুর্লভ এই কাপড়টি রূপার চেয়েও দামী। পৃথিবীর অন্য এক কোণ থেকে এটা আসে। সেখানে মানুষ নয়, গুটিপোকা এই কাপড় বুনে। এর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা রয়েছে। এটি অশুভ শক্তিকে দূর করে, এছাড়া প্লেগ আর হলুদ ফুলের মতো রোগকে দূরে রাখে। যাইহোক এখন এটা দিয়ে আমি আমার মুখ ঢাকলাম।

আমার চেহারায় এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, শত্রু মিত্র যে কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে। আসলে সৌন্দর্যের জন্য মূল্য দিতে হয়। ফারাওয়ের পর সম্ভবত আমার মুখই সারা বিশ্বে সুপরিচিত। অবশ্য বিশ্ব বলতে আমি মিসরকে বুঝাচ্ছি। এবার শিরস্ত্রাণটি আবার মাথায় পরতেই অন্যান্য সৈন্যদের মাঝে আমি মিশে গেলাম।

স্বভাবতই আমরা ধরে নিয়েছিলাম ক্রিস্টান সেনাকর্মকর্তারা এত লোকজনের ভীড়ে এই দুর্গে নিশ্চয়ই রাত কাটাবে না। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই ওরা বেশিরভাগ সেনাসহ সেতু পার হয়ে খালের অন্য তীরে তাদের আরামদায়ক শিবিরে রাত কাটাতে চলে গেল।

তারপরও জেটি থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে আমরা নিঃশব্দে নোঙর বাঁধা জাহাজগুলো আর দুর্গের দেয়াল পার হলাম। এগুলো পেছনে ছেড়ে আসার পর সামনে দূরে সারিবধা লম্বা নৌকাগুলো দেখা গেল, এগুলো পাশাপাশি বেঁধে পন্টুন সেতুটা তৈরি করা হয়েছে।

আমরা দাঁড় বেয়ে উজানের দিকে এগিয়ে পন্টুন সেতুর প্রায় দুইশো গজের মধ্যে পৌঁছলাম। তারপর স্রোতের দিকে নৌকা ঘুরিয়ে সরু লম্বা পন্টুন সেতুর দিকে তীর তাক করলাম। দাঁড়িদের বললাম দাঁড় ছেড়ে দিয়ে কোনো নড়াচড়া না করে স্রোতের হাতে নৌকা ছেড়ে দিতে। স্রোত আমাদেরকে সেতুর কেন্দ্রে নিয়ে যাবে।

শেষ মুহূর্তে আমি হাল ঘুরিয়ে দিয়ে সেতুর গায়ে নৌকা ঠেকালাম।

আমার লোকেরা প্রস্তুত ছিল। তিনজন তিনজন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ওরা নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সেতুর দিকে ছুটলো। বাদবাকিরা কুঠার আর তলোয়ার নিয়ে পন্টুন সেতুর দিকের জাহাজের পাশে দাঁড়াল। আর কোন নির্দেশের অপেক্ষা না করে ওরা একটার সাথে আরেকটা বেঁধে রাখা লম্বা নৌকাগুলোর রশির বাঁধন কাটতে শুরু করলো।

কুঠারের আঘাতের শব্দ নিশ্চয়ই খালের অন্য তীরে শত্রু শিবিরে পৌঁছে গিয়েছিল, কেননা প্রায় সাথে সাথেই শুনলাম সৈন্যদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আহবান জানাতে ক্রিটানরা ঢাক পিটানো শুরু হয়েছে। শত্রু শিবিরে হৈ চৈ, হট্টগোল শুরু হল, সার্জেন্টরা চিৎকার করে নির্দেশ দিতে লাগলো, ঢালের সাথে তলোয়ারের ঝনঝনানি, বর্মের ঠোকাঠুকি, খটখট আর ঢাকের শব্দ এখানেও পৌঁছে গিয়েছে। তারপর মশাল জ্বালতেই চারদিক আলোয় ভরে গেল, পলিশকরা ধাতব ঢাল আর বুকের বর্মের উপর আলো প্রতিফলিত হল।

ঘুমচোখে পদাতিক সেনার দীর্ঘ একটি সারি খুঁটির বেড়ার মাঝখানে যে পথটি ছিল তার মুখ থেকে বের হয়ে পন্টুন সেতুর গোড়ায় এসে দাঁড়াল। প্রথম চারজন ক্রিটান সেনা একযোগে সরু সেতুটির উপর লাফিয়ে পড়তেই তাদের পায়ের স্যান্ডেলের চাপে সেতুটি দুলে উঠলো।

শত্রু সেনার প্রথম সারিটি আমাদের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। মশালের আলোয় পুরো দৃশ্যটি পরিষ্কার দেখা গেল। তখনও পন্টুন সেতুর কয়েকটা রশি কাটা বাকি ছিল। পঞ্চাশ পা দূরত্ব থাকতেই শুনলাম আক্রমণের নেতৃত্বে থাকা ওদের একজন সেনাকর্মকর্তা চিৎকার করে কিছু একটা নির্দেশ দিল। ভাষাটা পরিষ্কার না বুঝলেও তার অর্থটা সাথে সাথেই পরিষ্কার হল।

ছুটন্ত অবস্থাতেই ক্রিটান সৈন্যরা পেছনে দিকে হেলে এক যোগে বল্লম ছুঁড়লো। বল্লমগুলো আমার লোকজনের মাঝে এসে পড়লো, ওরা তখনও কুঠার দিয়ে লম্বানৌকাগুলো বেঁধে রাখা দড়ির বাঁধন কাটছিল। আমি দেখলাম একটা বল্লম আমার একজন লোকের পিঠ দিয়ে ঢুকে ডগাটা সামনের দিকে প্রায় একগজ বুক থেকে বের হল। সে নৌকাটির একপাশ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল আর কালো পানিতে দেহটা তলিয়ে গেল। তবে তার সাথে কাজ করে যাওয়া অন্যান্য সেনারা একবারও কাজ ছেড়ে তার দিকে ফিরে তাকাল না। ওরা একমনে পন্টুন বেঁধে রাখা রশির উপর কুঠার চালিয়ে গেল।

রশিটা ছিঁড়তেই বেশ জোরে কট করে একটা শব্দ শুনলাম, তারপর কাঠের সাথে কাঠ ঘসাঘসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আরও রশি ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হতেই লম্বা নৌকাগুলো আলাদা হতে শুরু করলো।

তারপর একসময় সেতুটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তবে বিচ্ছিন্ন অংশ দুটি আমাদের নৌকার দুইপাশে লেগে থাকলো। আমি চিৎকার করে আমার লোকদের নৌকায় উঠে আসতে বললাম। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত ছিলাম না, আমার দুর্ভাবনা ছিল কেবল আমার দুঃসাহসী লোকদের নিরাপত্তা নিয়ে।

বর্মপরা ক্রিটানরা কোন ধরনের বাধা ছাড়াই ঝড়ের মতো পন্টুনের উপর দিয়ে ছুটে এল। যুদ্ধংদেহী আর গগন বিদারি চিৎকার করতে করতে ওরা বল্লম ছুঁড়তে লাগলো। আমার লোকেরা নৌকার পাটাতনের আড়ালে বসে পড়লো। সড়কিগুলো নৌকার কাঠের গায়ে এসে বিঁধলো।

সেতুর দুই অংশের মাঝখানে বেঁধে রাখা আমাদের নৌকার দড়িগুলো কাটার জন্য চিৎকার করে আমি নির্দেশ দিলাম। তবে হৈচৈ আর প্রচণ্ড কোলাহলের মাঝে কেউ আমার নির্দেশ শুনতে পেল না। আমার একজন লোকের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে আমি নৌকার সামনের দিকে ছুটে গেলাম।

একজন ক্রিস্টান সৈন্যও আমার দিকে ছুটে এল। আমরা দুজনে একইসাথে নৌকার সামনের দিকে পৌঁছলাম। ছুটতে ছুটতে সে তার হাতের বল্লমটা আমার দিকে ছুঁড়লো, তারপর কোমরের খাপ থেকে তলোয়ারটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা মুখোমুখি হতেই সে তলোয়ারটা খাপ থেকে বের করে হাতে নিল।

দেখলাম শিরস্ত্রাণের নিচে সে দাঁত বের করে হাসছে। হয়তো ভাবছিল আমার আর রক্ষা নেই, এবার নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করবে। তারপর তলোয়ারটা একবার পিছিয়ে আগাটা সোজা আমার বুক বরাবর চালাল। তবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঠিক সময়মতো শরীরে একটা মোচড় দিলাম। ফলে তলোয়ারের ডগাটা আমার বগলের নিচ দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে আমি এক হাতে তার তলোয়ার ধরা হাতটির কনুই চেপে ধরলাম।

তারপর তাকে শক্ত করে সামনে খাড়া করে ধরে রাখলাম। সে ছাড়া পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু নড়াচড়ার কারণে তার পায়ের নিচে পন্টুনের অংশটা দুলে উঠতেই সে ভারসাম্য হারাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি তার তলোয়ার ধরা হাতটা ছেড়ে দিলাম। এর জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, সাথে সাথে পেছনের দিকে ঢলে পড়তেই দুই হাত সামনে বাড়িয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করলো।

সাথে সাথে আমি তার তলোয়ার ধরা ডান হাতের কব্জির উপর কুড়ালের এক কোপ মারলাম, শরীরের শুধু এই অংশটাই ধাতব বর্ম দিয়ে ঢাকা ছিল না। নৌকার দুলুনির কারণে আমিও ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলাম না, তাই কোপটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। তলোয়ার ধরা হাতটা সম্পূর্ণ কাটা না পড়লেও কব্জির হাড় কেঁটে গিয়ে আঙুলগুলো আলগা হয়ে পড়লো। হাতের আঙুলগুলো খুলে যেতেই তলোয়ারটা তার হাত থেকে নিচে কাঠের তক্তার উপর পড়তেই ঠনঠন ধাতব শব্দ হল। টলমল পায়ে সে তার পেছনের সঙ্গির গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জড়াজড়ি অবস্থায় দুজনেই পন্টুন সেতু টপকে ঝপাং করে নিচে পানিতে পড়ে গেল। পরনের ভারী বর্মের ওজনের কারণে সাথে সাথেই দুজনেই পানির নিচে তলিয়ে গেল।

কুড়ালটা তখনও আমার হাতে ধরা ছিল, আর যে দুটো মুরিং রশি দিয়ে আমাদের নৌকাটা পন্টুন সেতুর সাথে বাঁধা ছিল, সেগুলো ঠিক আমার সামনে শক্ত হয়ে টান টান হয়েছিল। রশির গিটের উপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আমি কুড়ালটা মাথার উপর তুলে সর্বশক্তি দিয়ে সবচেয়ে মোটা রশিটার উপর লক্ষ স্থির করে এক কোপ দিলাম। ধনুকের ছিলার মতো রশিটা কেটে দুই টুকরা হয়ে গেল। তারপর আবার কুড়ালটা তুলে অন্য রশিটার উপর কোপ মারতেই এটিও কেটে গেল। রশিগুলো আলাদা হতেই ওজন আর টান ছুটে যেতেই নৌকার মাথাটা একবার উপরের দিকে উঠেই আবার নামলো। আর আমরা বাঁধন মুক্ত হয়ে স্রোতের অনুকূলে ভেসে চললাম।

এর ফলে ভাঙা সেতুর উপরে নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সেতুর প্রত্যেকটি অংশ তখনও নদীর তীরে বাঁধা ছিল। তবে নদীর মাঝে অন্য দুই অংশ সংযুক্ত ছিল না আর স্রোত দুই মাথাকে আরও দূরে সরিয়ে দিল। লক্ষ্য করলাম একসাথে দল বেঁধে থাকা বেশ কয়েকজন ক্রিটান সৈন্য টলমল অবস্থায় ভাঙা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করছে।

ভারী ওজন নড়াচড়ার কারণে ভাসমান পন্টুন স্থিতিশীলতা হারাতে শুরু করলো। ওজনদার বর্মপরা লোকগুলো ভারসাম্য হারিয়ে মাতালের মতো একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়তে লাগলো, তারপর পন্টুন থেকে ছিটকে পানিতে পড়তে শুরু লাগলো।

আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা পন্টুন পানিতে ডুবে যেতেই প্রায় বিশজন মানুষ একধার দিয়ে খালের পানিতে ছিটকে পড়ে গেল। কয়েকমিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ ক্রিটান সৈন্য কালো পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে ইঁদুরের মতো পানির নিচে তলিয়ে গেল।

বিষয়টা আরও বেদনাদায়ক মনে হল, কেননা এরাতো আসলে আমাদের শত্রুও ছিল না। আমি ইচ্ছা করে কারসাজি করে এদেরকে আমাদের মিত্র বানিয়েছিলাম। আমার দেশ মিসর আর ফারাওয়ের জন্য একাজটা করছি জেনেও মনে কোন সান্ত্বনা পেলাম না। আমার কৃতকর্মের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখার পর আমি মর্মাহত হলাম।

যাইহোক অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আমার মনের অপরাধবোধ আর বিবেকদংশন একপাশে সরিয়ে দিলাম। জানি যা ঘটেছে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর কথা মন থেকে দূর করবার চেষ্টা করে নিজেদের মানুষের কথা ভাবতে শুরু করলাম। আর কী কী ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব শুরু করলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে যেখানে রশিগুলো কেটেছিলাম সেদিকে এগোলাম। অকারণে চিৎকার করে আমার লোকদের উপর রাগ ঝাড়তে শুরু করলাম। ওদেরকে বললাম দাঁড় নিয়ে বেঞ্চে বসতে, কাউকে কাউকে ঠেলা দিলাম, লাথি দিলাম আর ইতস্তত করার কারণে দুএকজনকে চড়চাপড়ও দিলাম। ওরা সবাই হতবাক হল আমার কাজকারবার দেখে।

অবশেষে আমি নৌকার হাল নিজের হাতে তুলে নিলাম। দাঁড়িরা একসাথে দাঁড় বেয়ে চললো। এরপর দুর্গের মূল ফটকের নিচে পাথরের জেটির দিকে নৌকার মুখ ঘুরালাম। সেখানেই রূপার বাটভরা জাহাজগুলো নোঙ্গর করা ছিল।

.

আমাদের ছোট্ট নৌকাটির গলুই পাথরের জেটির সিঁড়ির গায়ে ঠেকতেই আমি এক লাফে নেমে পড়লাম। খোলা তরবারি হাতে জারাস সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। উত্তেজনায় সে হাঁপাচ্ছিল আর দাঁত বের করে বোকার মত হাসছিল।

রক্তমাখা তরবারি ডগা দুর্গের খোলা ফটকের দিকে নির্দেশ করে সে বললো, রত্নভাণ্ডার ভরা তিনটা জাহাজ আর দুর্গটাও আমরা দখলে নিয়েছি! পন্টুন সেতুর কাছে আপনি যে গোলমাল সৃষ্টি করেছিলেন তাতে বেশ চমৎকারভাবে ওদের মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। দুর্গের রক্ষীরা যখন আপনাদের লড়াই দেখছিল, তখন আমরা আচমকা আক্রমণ করে ওদেরকে কাবু করে ফেলি। আমাদের আসা ওরা মোটেই টের পায়নি। মনে হয়না কেউ পালাতে পেরেছে আর পালাতে চেষ্টা করলেও বেশি দূর যেতে পারবে না। তারপর একটু থেমে দম নিয়ে আবার বললো, সেতুর কাজটি আপনি কীভাবে সামলালেন তায়তা? আমি বেশ খুশি হলাম শুনে যে, লড়াইয়ের উত্তেজনার মধ্যে আর বিজয়ের পরও হাইকসো ভাষায় কথা বলার কথা তার মনে আছে।

আমি তাকে সংক্ষেপে জানালাম, সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে আর অর্ধেকের বেশি শত্রুসেনা নদীতে ডুবে গেছে। তারপর পেছন দাঁড়িয়ে থাকা আকেমির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই নৌকাটি আর দাঁড় বাওয়ার জন্য বারোজন লোক সাথে নাও। তারপর একটু দূরে একসারিতে নোঙর করা ছোট ছোট কয়েকটা নৌকা দেখিয়ে বললাম, মশাল আর আগুনের পাত্র নিয়ে ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেল। নইলে ক্রিটানরা ওগুলো দখল করে ওদের সৈন্যদের খাল পার করিয়ে আবার আজ রাতে আমাদের উপর আক্রমণ চালাতে পারে।

আকেমি উত্তর দিল, এখুনি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে, প্রভু।

আমি বললাম, সবচেয়ে বড় নৌকাটা রেখে দিও। সারির একেবারে শেষ মাথায় ঐ চতুষ্কোণ পাল-বিশিষ্ট ছোট জাহাজটা পুড়িও না। ওটা এখানে নিয়ে এস, আমরা যখন চলে যাবো তখন এটা জেটিতে বেঁধে রেখে যাবো।

আকেমি আর জারাস, উভয়েই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। শুধু জারাস সাহস করে আমার এই নির্দেশ সম্পর্কে জানতে চেয়ে বললো, ক্রিটানদের জন্য এটা এখানে রেখে যাবো? কেন এটা করবো আমরা?

এটা এজন্য রেখে যাবো, যাতে ক্রিস্টানদের সেনা কর্মকর্তারা ক্রিট দ্বীপে ফিরে গিয়ে তাদের রাজাকে হাইকসো মিত্রদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানাতে পারে। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ এই পাঁচলাখ রূপার বাট হারিয়ে নিশ্চয়ই মনে খুব কষ্ট পাবেন। তারপর আবার যখন এই ঘটনার সংবাদ পাবেন, তখন তিনি রাজা বিওনের রক্ত পান করতে চাইবেন।

তারপর আমি জেটিতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আকেমি আর তার লোকজনের নদীর মোহনার দিকে যাওয়া লক্ষ্য করলাম। সে চারজন লোককে বড় চারকোণা পালওয়ালা জাহাজে তুলে দিল। ওরা একটা তিনকোণা পাল তুলে জাহাজটা জেটির নিচে যে জায়গায় আমি আনতে বলেছিলাম, সেখানে এনে রাখলো।

তারপর দেখলাম আকেমি আমাদের ছোট্ট নৌকাটির সামনের গলুইর কাছে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার লোকেরা দাঁড় বেয়ে তাকে সারিবদ্ধ ছোট ছোট নৌকাগুলোর কাছে নিয়ে গেল। যেতে যেতে সে একটা একটা জ্বলন্ত মশাল প্রত্যেক নৌকার উপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। সবগুলো ভালোভাবে জ্বলতে শুরু করার পর আমি সন্তুষ্ট হলাম। তারপর ফিরে জারাস যেখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ফিরে গেলাম।

তাকে বললাম, বাকি লোকজনদের নিয়ে আমার সাথে এসো। তারপর সবচেয়ে কাছে ধনভাণ্ডারভরা ক্রিস্টানদের তিনতলা বড় জাহাজটার দিকে ছুটতে ছুটতে বললাম, এই জাহাজটা দখল করো জারাস। আমি তোমার সাথেই যাব।

সে উত্তর দিল, অবশ্যই, প্রভু। আমার কিছু লোক ইতোমধ্যেই এই জাহাজে চড়েছে।

দ্বিতীয় তিনতলা জাহাজটা দেখিয়ে বললাম, দিলবার এটা তার অধীনে নেবে। আর আকেমি তৃতীয় জাহাজটা নেবে।

আপনার নির্দেশ যথারীতি পালন করা হবে, প্রভু। মনে হচ্ছে শুধু তায়তা হতে জারাস এবার আমাকে প্রভুর পর্যায়ে উন্নীত করেছে। যাইহোক আমার সাথে তার এখনও তেমন সখ্যতা রয়েছে যাতে সে এখনও উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে পারে। আর সাথে সাথে করলোও তাই।

খোলা সাগরে পৌঁছার পর আমরা কোনদিকে যাব? আমরা কি পূর্বদিকে সুমেরিয়া না পশ্চিমদিকে মরুতানিয়া উপকূলের দিকে যাবে? তারপর সে আগবাড়িয়ে একটু উপদেশ দিতে চেষ্টা করলো। এই দুইদেশেই অবশ্য আমাদের মিত্র আছে। পুবে আছে দুই নদীর রাজ্যের রাজা নিমরদ। আর পশ্চিমে মরিতানিয়াতে আনফার রাজা শান-ডাকির সাথে আমাদের একটা মৈত্রী চুক্তি রয়েছে। আপনি কোনদিকে যেতে চাচ্ছেন তায়তা?

আমি সাথে সাথে তার কথার কোন উত্তর দিলাম না। বরং তাকে আমি আমার নিজের প্রশ্নটাই করলাম, আচ্ছা তুমিই বল জারাস। এই পৃথিবীর কোন রাজাকে তুমি এই পাঁচ লাখ রূপার সম্পদ নিয়ে বিশ্বাস করবে?

জারাস একটু হতবুদ্ধি হল। এ-ধরনের প্রশ্নের কথা সে ভাবেনি। সম্ভবত না, শান-ডাকিকে অবশ্যই বিশ্বাস করা যায় না। তার লোকেরা সবাই জলদস্যু আর তিনি হচ্ছেন চোরদের রাজা।

আমি বললাম, আর নিমরদ সম্পর্কে কি বলবে? আমি অবশ্য তাকে আমার বুড়ো আঙুলের সমান একটা রূপার টুকরা দিয়েও বিশ্বাস করতে রাজি নই।

সে প্রতিবাদ করে বললো, কিন্তু কাউকে না কাউকে তো আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে। আর নয়তো রূপাগুলো আমরা কোনো নির্জন সৈকতে বালুর নিচে চাপা দিয়ে রেখে, পরে সুবিধামতো সময়ে এসে আবার উদ্ধার করতে পারি।

আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম, পাঁচ লাখ রূপার বাট? এতবড় একটা গর্ত করতে তো প্রায় একবছর লেগে যাবে আর এগুলো ঢাকতে পর্বত পরিমাণ বালু লাগবে। তার হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম। তারপর তার জন্য যে জাহাজটা বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটার মাস্তুলের মাথায় ক্রিটের সোনালি আঁড়ের ছবিওয়ালা মিনোজের পতাকার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাতাস আমাদের অনুকূলে আছে! আর দেবতা সবসময় সাহসী এবং উচ্চভিলাষী মানুষকে পছন্দ করেন।

সে আমার কথার প্রতিবাদ করে বললো, না তায়তা। বাতাস আমাদের অনুকূলে নেই। এটা সাগর থেকে খালের উপর দিয়ে সরাসরি এদিকে আসছে। বাতাসটা আমাদেরকে ডাঙার দিকে চাপ দিচ্ছে। মধ্য সাগরের খোলা পানিতে যেতে আমাদেরকে সবগুলো দাঁড় বাইতে হবে। আর আপনি যদি শান-ডাকি আর নিমরদকে বিশ্বাস না করেন, তাহলে কাকে বিশ্বাস করেন? কার কাছে যাব আমরা?

আমি তাকে বললাম, আমি শুধু ফারাও ত্যামোসকে বিশ্বাস করি। এই প্রথম সে সত্যি আমার উপর হতাশ হল।

তারপর একটু অবজ্ঞাভরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তবে যে পথ ধরে আমরা এখানে এসেছি, সেই পথেই আপনি ফারাওয়ের কাছে ফিরে যেতে চান? তাহলে কি উশু থেকে মাথায় করে রূপার পেটিগুলো আমরা বয়ে নিয়ে যাব। তারপর সাঁতার কেটে লোহিত সাগর পার হব? অবশ্য সেখান থেকে থিবস অল্প হাঁটা দূরত্বে রয়েছে। ফারাও কিন্তু আপনাকে দেখে বেশ অবাক হবেন, এ-বিষয়ে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন।

আমি একটু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে তাকে বললাম, না জারাস। এখান থেকে আমরা দক্ষিণে নীল নদী দিয়ে যাব। বিশাল এই তিনটি ক্রিস্টান জাহাজ আর এগুলোর খোলে যে রূপা আছে তা সবশুদ্ধ নিয়ে সরাসরি আমরা থিবসে ফিরে যাব।

এবার সে হাসি থামিয়ে বললো, আপনি কি পাগল হয়েছেন তায়তা? এখান থেকে আসিউত পর্যন্ত নীলনদের প্রতিটি ইঞ্চি বিওনের অধীনে। হাইকসোদের মধ্য দিয়ে তিনশো লিগ আমরা নদী পথে যেতে পারবো না। এটা সত্যি পাগলামি। উত্তেজনার চোটে সে হাইকসো ভাষা বাদ দিয়ে মিসরী ভাষায় কথাটা বলছিল।

আমি এ কথার প্রতিবাদে তাকে তিরস্কার করে বললাম, তুমি যদি হাইকসো ভাষায় কথা বল, তাহলে সবকিছু সম্ভব হবে। যাইহোক আমাদের দুটো নৌকাতো আগেই ডুবিয়ে দিয়েছি আর তামিয়াত ছাড়ার আগে তৃতীয়টাও পুড়িয়ে যাব। নিশ্চিত করে যাব, যাতে আমাদের প্রকৃত পরিচয়ের কোনো ধরনের চিহ্ন এখানে না থাকে।

এবার সে আবার দাঁত বের করে হেসে বললো, মহান মাতা আসিরিস আর তার প্রিয় পুত্র হোরাসের নামে শপথ করে বলছি তায়তা, আমার মনে হয় আপনি যা বলছেন তা আপনি বিশ্বাস করেন। আবার সে দুইগাল হাসিতে ভরিয়ে দিয়ে বললো, তার মানে আপনার পরিকল্পনা ছিল যে, এসব কথা বলে আমাকে আপনার মতোই পাগল বানিয়ে ছাড়বেন, যাতে আমিও পাগল হয়ে আপনার কথায় রাজি হই, তাই না?

যুদ্ধের সময় পাগলামিই হয়ে যায় মতিস্থিরতা। আমার পিছু পিছু এসো। আমি তোমাকে দেশে নিয়ে যাব। একথা বলে আমি সিঁড়ি বেয়ে সামনের জাহাজের ডেকে উঠলাম। জারাসের বিশজন লোক সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা ইতোমধ্যেই নাবিকসহ পুরো জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ক্রিটান জাহাজটির নাবিকেরা ডেকের উপর এক সারিতে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে, হাত পেছন দিকে বাঁধা। বেশিরভাগেরই শরীরের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। মোট ছয়জন ক্রিটান নাবিকের পেছনে জারাসের লোকেরা খোলা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি ওদেরকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, ভালো কাজ করেছ। তারপর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, তোমার লোকদের বল, বন্দীদের সবার পরনের উর্দি আর বর্ম খুলে নিতে। সে নির্দেশ জারি করতে করতেই আমি ডেক থেকে সিঁড়ি দিয়ে সবচেয়ে উপরের দাঁড় বাওয়া ডেকে নামতে শুরু করলাম। বেঞ্চে কেউ নেই আর লম্বা দাঁড়গুলো এমনি পড়ে রয়েছে। তবে এই দাঁড়গুলো বাওয়ার জন্য আমার কাছে পঞ্চাশজন মানুষ আছে। এখানে সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ক্রীতদাসদের ডেকে নামলাম। সাথে সাথে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ নাকে এল। দুর্গন্ধটা এমন শক্তিশালী যে প্রায় দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরও নামতে লাগলাম।

নিচু ছাদে আটকানো ব্রাকেটে তেলের প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। এই আলোয় দেখতে পেলাম সারিবদ্ধ প্রায় অর্ধনগ্ন ক্রীতদাসেরা বেঞ্চে বসে ওদের সামনের লম্বা দাঁড়ে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। যারা জেগেছিল, তারা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ওদের নড়চড়ার সাথে সাথে শিকলের ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

ভাবলাম একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে বলি, যদি ওরা ভালোভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় বেয়ে চলে, তবে থিবসে পৌঁছে ওদেরকে মুক্তি দেব। কিন্তু এই চিন্তাটা বাদ দিলাম, কেননা ওরা এখন আর পুরোপুরি মানুষের পর্যায়ে নেই। জঘন্য বন্দী জীবন আর নির্মম ব্যবহারের ফলে ওরা প্রায় পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমার ভালো কথা ওদের কাছে কোনো অর্থই বয়ে আনবে না। চাবুক ছাড়া আর কিছুই ওরা এখন বুঝে না।

নিচু ছাদ থেকে মাথা বাঁচাতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ক্রীতদাসের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে শেষমাথায় একটা দরজার কাছে গেলাম। নিশ্চিত এটাই মাল রাখার খোল। দরজায় একটা ভারি পিতলের তালা ঝুলছিল। জারাস আমার পিছু পিছু আসছিল। আমি একপাশে সরে তাকে জায়গা করে দিতেই সে তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে তালাটা খুলে এক লাথি মেরে দরজাটা খুললো।

ব্রাকেট থেকে একটা তেলের প্রদীপ নিয়ে আমি মালখানায় ঢুকলাম। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত রূপার বাক্সগুলো সাজানো রয়েছে। অবশ্য মাঝখানে একটা বড় ফাঁক দেখা যাচ্ছে। মনে মনে একটা হিসাব কষে বুঝলাম ক্রিটানরা প্রায় একশোটা বাক্স এখান থেকে দুর্গে নিয়ে গেছে।

একবার ভাবলাম, এই বিশাল ধনভাণ্ডারের এই সামান্য অংশটুকু ফেলে রেখে তিনটি জাহাজে আর যা আছে তা নিয়ে চলে যাই। তারপর ভাবনাটা সরিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, দেবতা মৃদু হেসেছেন তায়তা, এখন এর পুরোপুরি সুযোগ নাও, কখন আবার দেবতা ভ্রুকুটি করে কে জানে। তারপর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, এসো আমার সাথে। তোমার কাছে যতলোক আছে, সেখান থেকে যতজন পার নিয়ে এসো।

এবার কোথায় যাব?

আমি সারিবদ্ধ করে রাখা রূপার বাক্সগুলোর মাঝখানের ফাঁকটা দেখিয়ে বললাম, দুর্গে গিয়ে আমরা খুঁজে বের করবো বাদবাকি রূপার পেটিগুলো ক্রিটানরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। ওখানে যত রূপা আছে তা দিয়ে একটা পুরো সেনাবাহিনীকে সজ্জিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো যায়। যে করেই হোক বিওনের হাতে যেন এটা না পড়ে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর আমরা দ্রুত ডেকে ফিরে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে জেটিতে নামলাম, জারাসও তার দশজন লোক নিয়ে আমাকে অনুসরণ করলো। সাথে সে বন্দী ক্রিটান নাবিকদেরও নিয়ে এলো। ওদের পরনের সমস্ত পোশাক খুলে প্রায় নগ্ন করেছে। দুর্গের ফটকের ভেতরে আমরা দিলবার আর তার ত্রিশজন লোকের দেখা পেলাম। তীরে যেসব শত্রুদেরকে ওরা বন্দী করেছিল তাদেরকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।

আমি দিলবারকে নির্দেশ দিলাম তার অধীনস্থ বন্দীদেরও পোশাক খুলে নিতে। ক্রিটান সৈন্যদের পোশাক আর বর্ম যতবেশি পাওয়া যায় তা আমাদের প্রয়োজন হবে। মিনোয়ান সেনা কর্মকর্তারা রূপা, সোনা আর মূল্যবান পাথরের নেকলেশ, আংটি, বাজুবন্ধ, বালা পরেছিল।

আমি দিলবারকে নির্দেশ দিলাম ওগুলোও খুলে নিতে। সেখান থেকে দুটো অসাধারণ ধরনের অলংকার তুলে নিয়ে আমি আমার চামড়ার থলেতে ভরে নিলাম। বেশিরভাগ মেয়েদের মতো আমার দুই ছোট রাজকুমারিও সুন্দর আর চকচকে ছোটখাট গহনা পছন্দ করে।

তারপর নজর ফেরালাম শিকলে বাঁধা বন্দীর সারির দিকে। ওরা  সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক নজর দেখেই বুঝলাম এখানে বিভিন্ন জাতের মানুষ রয়েছে, যার মাঝে লিবিয়, হুরিয়, সুমেরিয় আছে। তবে বেশিরভাগই মিসরী। সম্ভবত হাইকসোরা এদের বন্দী করেছিল, তারপর এই দুর্গ নির্মাণ করার কাজে সাহায্য করার জন্য ওরা এদেরকে ক্রিস্টানদের হাতে তুলে দিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। লোকটির বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে এখনও হতাশায় ভেঙে পড়েনি।

দিলবারকে বললাম, এই লোকটাকে পাশের কামরায় নিয়ে যাও। সে লোকটাকে জাপটে ধরে টানতে টানতে পাশের ছোট কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আমি তাকে বললাম আমাদের দুজনকে একা রেখে কামরা ছেড়ে চলে যেতে। তারপর কিছুক্ষণ নিরবে ক্রীতদাসটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো আচরণ করলেও তার চোখে একটু অবাধ্য ভাব  আছে যা সে লুকাতে চেষ্টা করছিল।

ভালো! আমি ভাবলাম, তার মানে সে এখনও মানুষ আছে।

তারপর আমি আমাদের নিজেদের সুমিষ্টভাষায় নরম সুরে তাকে বললাম, তুমি একজন মিসরী। কথাটা শুনেই সে চমকে উঠল, বুঝলাম সে আমার কথা বুঝেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, কোন পল্টন? কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে সে শুধু কাঁধ ঝাঁকালো। এমন ভান করলো যেন আমার কথা বুঝতে পারেনি, তারপর নিচে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

এবার তাকে হুকুমের সুরে বললাম, তাকাও আমার দিকে! একথা বলে শিরস্ত্রাণ খুলে মুখের নিচের অংশ ঢাকতে যে হলুদ কাপড়টা পেঁচিয়ে রেখেছিলাম, সেটা খুলে ফেললাম। তারপর আবার বললাম, তাকাও আমার দিকে!

লোকটি মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কে?

সে অবাক বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললো, আপনি তায়তা। ছোটবেলায় আমি আপনাকে লুক্সরের হাথোর মন্দিরে দেখেছিলাম। বাবা বলেছিলেন জীবিত মিসরীয়দের মধ্যে আপনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তারপর সে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। আমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাবার এই ধরন দেখে আমি অভিভূত হলাম। তারপরও কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্থির রেখে বললাম,

হ্যাঁ সৈনিক, আমি তায়তা। তুমি কে?

আমি ছাব্বিশতম রথবাহিনীর রহিম। পাঁচবছর আগে হাইকসো কুকুরগুলো আমাকে বন্দী করে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমাদের প্রিয় মিসরে ফিরে যেতে চাও? উত্তরে সে মৃদু হাসতেই দেখা গেল তার একটা দাঁত নেই আর মারের চোটে মুখে কালশিটে দাগ পড়েছে। প্রচুর মার খেলেও সে একজন মিসরীয় যোদ্ধা, দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল, যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ আমি আপনার লোক!

গতকাল ক্রিটানরা জাহাজ থেকে যে সিন্দুকগুলো তোমাদেরকে দিয়ে নামিয়ে এনেছে সেগুলো কোথায় রেখেছে?

সিঁড়ির নিচে ইস্পাতের ভারি দরজাওয়ালা একটা গোপন কুঠরিতে রেখেছে। তবে দরজায় তালা দেওয়া আছে।

চাবি কার কাছে?

কাঁধে সবুজ পট্টি দেওয়া মোটা লোকটার কাছে। সে ক্রীতদাসদের তত্ত্বাবধায়ক।

লোকটাকে আমি অন্যান্য বন্দীদের সাথে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখেছি। তার কাছে কি তোমাদের শিকলের তালার চাবি আছে, রহিম? এগুলো তোমাদের দরকার পড়বে, কারণ এখন থেকে তুমি আবার মুক্ত মানুষ। কথাটা মনে করে সে দাঁত বের করে হাসলো।

সমস্ত চাবি সে তার কোমরে একটা শিকলে ঝুলিয়ে রাখে। তার পোশাকের নিচে চাবির গোছাটা লুকিয়ে রাখে।

রহিমের কাছ থেকে জানতে পারলাম আশিজনেরও বেশি মিসরীয় তিরন্দাজ আর রথীসেনা ওরা বন্দী করেছে। ওদের পায়ের শিকল খুলে দিতেই ওরা খুশিমনে রূপার বাক্সগুলো দুর্গ থেকে জারাসের জাহাজের খোলে বয়ে নিয়ে চললো।

রূপার বাক্সগুলো যখন স্থানান্তর করা হচ্ছিল তখন রহিম আমাকে দুর্গের অস্ত্রভাণ্ডারে নিয়ে গেল। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে থরে থরে সাজানো সামরিক উর্দি, বর্ম আর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখে আমার আনন্দ হল।

সবকিছু জাহাজে নিয়ে গিয়ে মূল ডেকে রাখার নির্দেশ দিলাম যাতে প্রয়োজনে সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়।

সবশেষে বন্দী ক্রিটানদের তাদের নিজেদের ক্রীতদাস ব্যারাকে তালা বন্ধ করে রেখে আমরা অপেক্ষামান তিনটি তিনতলা জাহাজে চড়লাম।

.

সমস্ত লোকজনকে আমি তিনটি জাহাজে সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছিলাম, যাতে সবগুলো বৈঠা চালানো যায়। আমার নিদের্শে নিচের ডেকে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসদেরকে শক্ত রুটি, শুকনো মাছ আর বিয়ার খেতে দেওয়া হল। এগুলো আমরা দুর্গের ভাঁড়ার ঘরে পেয়েছিলাম। ময়লা কড়াপরা হাত দিয়ে ওদের গোগ্রাসে খাওয়ার দৃশ্যটা খুবই করুণ ছিল। খাবার আর ভালো ব্যবহার ওদেরকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। আমি জানি ওরা খুশিমনে আমার কাজে লাগবে।

পুবআকাশে ভোরের আলো দেখা দিতেই আমাদের যাত্রার সময় হল। সবচেয়ে আগের জাহাজের হালে জারাসের পাশে আমি আমার জায়গা করে নিলাম। মাথায় হাইকসো শিরস্ত্রাণ পরলাম আর সিল্কের হলুদ স্কার্ফটা দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকলাম।

জারাস নোঙর তুলে ফেলার নির্দেশ দিতেই প্রত্যেক দাঁড় বাওয়া ডেকে ঢাক পেটানো শুরু হল। ঢাক পেটানোর তালে তালে লম্বা দাঁড়গুলো পানিতে একবার ডুবিয়ে আবার তুললো, এভাবেই দাঁড় বাওয়া শুরু হল। একটু পরই আমরা নদীর মূল ধারায় এলাম। বাকি দুটো জাহাজও আমাদের অনুসরণ করলো। আমরা সোজা দক্ষিণদিকে হাইকসো রাজধানীর দিকে ভেসে চললাম, এরপরই সামনে দুশো লিগ নদীপথ শত্রুর অধীনে রয়েছে।

এদিকে আগুনে জ্বলতে থাকা নৌকাগুলো থেকে বয়ে আসা ঘন ধুয়া নদীর উপর দিয়ে দুরে ক্রিটান সেনাশিবির ঢেকে ফেলছিল। তবে উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসে ধুয়ার পর্দাটা সরে যেতেই আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম যেসব ক্রিস্টান সৈন্য পন্টুন সেতুর ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচেছিল, ওরা সবাই নদীর তীরে যুদ্ধসাজে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ওদের সেনাপতিরা সৈন্য নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থান নিয়েছিল। তীরন্দাজরা উদ্যত তীর-ধনুক নিয়ে নদীর তীরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা উত্তর দিকে খোলা সাগরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেই ওরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। প্রত্যেক তীরন্দাজের ধনুকের ছিলা টান টান হয়ে আছে আর ধনুকে তীর জোতা রয়েছে। ওরা কেবল তীর ছুঁড়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

ওদের উচ্চপদস্থ চারজন সেনানায়কের শিরস্ত্রাণে লম্বা পুচ্ছ আর বুকে কাঁধে অনেক পদক চকচক করছে। তীরন্দাজদের সারির পেছনে ঘোড়ার পিঠে বসে ওরা আক্রমণের নির্দেশ দেবার জন্য অপেক্ষা করছে।

তবে ওরা হতবাক হয়ে গেল, যখন দেখলো আমরা দক্ষিণ দিকের খালের দিকে মোড় ঘুরে ওদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। প্রথমে ওদের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তারপর যখন দিলবারের অধীনে দ্বিতীয় তিনতলা জাহাজটিও মোড় ঘুরে আমাদের জাহাজকে অনুসরণ করতে শুরু করলো, তখন ওরা আক্রমণে এলো। এরপর বহরের শেষ জাহাজটি আকেমির অধীনে খালের মোড় ঘুরতেই ক্রিটান সেনানায়কদের নিদেশের রাগি চিৎকার শোনা গেল। তীর ঘেঁষে ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা আমাদের পিছু নিল। দৃশ্যটা দেখে আমার হাসি পেল।

ক্রিটান সৈন্যরা শৃঙ্খলা ভেঙে ছত্রভঙ্গ হয়ে তাদের সেনানায়কদের পিছু পিছু ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু যখন দেখলো আমরা কিছু না বলে চলে যাচ্ছি, তখন ওরা থেমে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে একনাগাড়ে উঁচু করে তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। তবে কোনটাই আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারলো না।

অশ্বারোহী সেনানায়করা অবশ্য হাল ছেড়ে দিল না, ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের নৌবহরকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। যখন আকেমির জাহাজ বরাবর এলো তখন ওরা তলোয়ার কোষমুক্ত করলো। তারপর ঘোড়ার পাদানির উপর দাঁড়িয়ে অজস্র গালিগালাজ করতে করতে আকেমির লোকজনের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে শুরু করলো।

আকেমির প্রতি আমার কঠোর নির্দেশ ছিল মিনোয়ানদের লক্ষ্য করে তীর না ছোঁড়ার। তিনতলা জাহাজের উপরের ডেক থেকে ওরা আকেমির তীরন্দাজদের সহজ লক্ষ্য ছিল, কিন্তু ওরা তাদেরকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলো। এতে মিনোয়ানরা আরও ক্রদ্ধ হল। ওরা নদীর তীর দিয়ে আরও দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে প্রথমে আকেমি তারপর দিলবারের জাহাজ পার হয়ে আমার জাহাজের কাছাকাছি এলো।

আমার নির্দেশ মোতাবেক আমার লোকজন লুকোবার কোনো চেষ্টাই করলো না। আমাদের জাহাজের সাথে তাল মিলিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে ঘোড়া ছুটতে ছুটাতে সেই চার সেনানায়ক মাত্র একশো পা দূরত্ব থেকে আমাদের পরনে আসল হাইকসো সামরিক উর্দি আর সাজসরঞ্জাম পরিষ্কার দেখতে পেল।

আমাদের অনুসরণ করে ইতোমধ্যে ওরা প্রায় তিনলিগ দূরত্ব চলে এসেছে। ঘোড়াগুলোও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরপর তীর থেকে জোর বাতাস বইতেই আমাদের জাহাজগুলো ওদের কাছ থেকে দ্রুত সরে পড়লো। নদীর তীর এবার জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। কালো কাদায় ঘোড়াগুলোর পা দেবে যেতেই ওরা ঘোড়ার রাশ টেনে থামাতে বাধ্য হল। আর আমরা বেশ দ্রুত ওদের কাছ থেকে ভেসে চললাম ভোলা সাগরের দিকে।

পুরো ঘটনাটা যেভাবে ঘটলো, তা দেখে আমি বেশ খুশি হলাম। মিনোয়ান সেনানায়করা দেখেছে, যা আমি ওদের দেখাতে চেয়েছিলাম–অর্থাৎ হাইকসো জলদস্যুরা তিন জাহাজ ভর্তি সর্বাধিরাজ মিনোজের পাঁচ লাখ রূপার বাঁট নিয়ে দক্ষিণ দিকের নদী হয়ে রাজা বিওনের রাজধানী মেমফিসের দিকে ভেসে চলেছে।

২. পরবর্তী ভূমিকা

 

এখন আমাদের পরবর্তী ভূমিকা পালন করার সময় হয়েছে। তামিয়াত দুর্গ থেকে ক্রিটানদের যেসব সামরিক উর্দি আর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছি, সেগুলো ডেকে এনে রাখার নির্দেশ দিলাম। তারপর হাসি তামাশার মধ্য দিয়ে আমাদের লোকেরা হাইকসো উর্দি খুলে মিনোয়ান সামরিক উর্দি পরলো। ওদের চকচকে শিরস্ত্রাণ আর কারুকাজ করা তলোয়ার থেকে শুরু করে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পাতলা নরম চামড়ার বুট জুতা পরলো।

আকেমি আর দিলবার উভয়ের উপর আমার কড়া নির্দেশ ছিল, ওদের লোকেরা যেন হাইকসো উর্দি আর সাজসরঞ্জামের একটা টুকরাও নদীতে ছুঁড়ে

ফেলে। স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগুলোর কোনো একটি টুকরাও যদি তামিয়াত দুর্গের মিনোয়ান সেনাদের হাতে পড়ে তাহলে আমার সব কৌশল ফাঁস হয়ে যাবে।

ক্রিটানরা সহজেই বুঝতে পারবে কীভাবে তাদের বোকা বানানো হয়েছে। কাজেই খুলে ফেলা সমস্ত হাইকসো সামরিক উর্দি আর অন্যান্য সাজসরঞ্জাম বোঁচকা বেঁধে নিচের ডেকে লুকিয়ে রাখা হল।

পেছন থেকে অনুকুল বাতাস পেয়ে আমাদের পালগুলো ফুলে উঠেছে, সারিবদ্ধ দাঁড় চালিয়ে বেশ দ্রুত আমরা দক্ষিণদিকে ভেসে চললাম। মিনোয়ানদের এই জাহাজ তিনটি ছিল সমুদ্রের বুকে সবচেয়ে দ্রুতগামী জাহাজ। এতো মানুষ আর রূপার বিশাল ওজন সত্ত্বেও জাহাজগুলো বেশ দ্রুত চলছিল।

বদ্বীপ আর অসংখ্য শাখানদী পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত আমাদের জাহাজ তিনটি মূল নদীতে চলে এলো। তিনটি জাহাজ একটি অন্যটির সাথে পাল্লা দিয়ে ভেসে চললো। এক জাহাজের নাবিকেরা অন্য জাহাজের নাবিকদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারতে লাগলো আর রসিকতা করতে লাগলো।

নোঙর করা মাছধরা নৌকা আর মালামাল বোঝাই ছোট ছোট নৌকার পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে চললাম। নৌকাগুলো পাশ কাটিয়ে যাবার সময় আমি উপরের ডেক থেকে নিচে নৌকাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। মাঝিমাল্লাদের মধ্যে হতবাক চেহারার কয়েকটা মিসরীয় মুখ চোখে পড়লেও বেশিরভাগই ছিল হাইকসো।

এই দুই জাতির পার্থক্য আমি সহজেই ধরতে পারি। আমার মিসরীয় ভাইদের সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, উঁচু কপাল, বড় বড় চোখ আর নিখুঁত চেহারা। অর্থাৎ একবার তাকালেই বুঝা যায় এরা উচ্চ জাতি।

আর হাইকসোদের মধ্যে এই ধরনের চেহারা খুব কম দেখা যায়। অবশ্য আমি শুধু শুধু পক্ষপাতিত্ব করে ওদের বিরুদ্ধাচরণ করছি না। তবে ওদেরকে ঘৃণা করার আমার অনেক কারণ আছে। ওরা সবাই চোর-ডাকাত। নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচার করাতেই ওদের আনন্দ। ওদের নিকৃষ্টমানের আর অশ্লীল ভাষা শুনলে যেকোনো সভ্য মানুষের কানে শ্রুতিকটু মনে হবে। ওরা সবচেয়ে বিশ্রী দেবতা শেঠের পূজা করে। আমাদের দেশ দখল করে ওরা আমাদের দেশের মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়েছে।

তবে আমার মধ্যে কোনো গোঁড়ামি নেই। যাদের তা আছে তেমন লোকদের আমি ঘৃণা করি। আসলে আমি অনেক চেষ্টা করেও হাইকসো জাতির মধ্যে প্রশংসনীয় কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই নি। দেবতারা জানেন এটা আমার দোষ নয় যে, আমি তেমন কিছু ওদের মাঝে খুঁজে পাইনি।

এই জাতির মানুষগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে আমার মনে একটা ভাবনা জাগলো যে, ভবিষ্যতে কোনো এক সময় ওদের প্রতি আমার বিরাগ ভাবটি আরও সঠিক আর দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করাটাই সঠিক হবে। কিছু একটা করে ওদেরকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে রাজা বিওনও বুঝতে পারবে কাজটা সঠিক হয়েছে।

সেই দিনটি হবে সকল মিসরীয়দের জন্য একটি খুশির দিন। কথাটা ভাবতেই আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। চিন্তাটায় আরেকটু শান দিয়ে ভাবলাম আর দেরি করে লাভ কি? পুরো পরিকল্পনার ছকটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার মনে ভেসে উঠলো।

নিচের ডেকে ক্যাপ্টেনের কেবিনে একটা লেখার টেবিল আর কিছু পাকানো প্যাপিরাস কাগজ দেখেছিলাম। ক্রিটানরা শিক্ষিত জাতি। ওরা কীলককার হস্তলিপি পদ্ধতি ব্যবহার করে যা সুমেরিয়দের সাথে মিলে না। এই সঙ্কেতগুলো আমি পড়তে আর চিনতে পারলেও সেসময়ে মিনোয়ানদের ভাষার সাথে পরিচিত ছিলাম না।

জানা কথা হাইকসোরা পুরোপুরি অশিক্ষিত। তবে আমার গুপ্তচরেরা আমাকে জানিয়েছিল ওরা কয়েকজন মিসরীয় লেখককে বন্দী করে ক্রীতদাস বানিয়ে, তাদেরকে দিয়ে আমাদের লিপি পড়ে, লিখে আর অনুবাদ করিয়েছে।

আমি আরও জেনেছি ওরা এই লিপিকারদের কাছ থেকেই শিখেছে, কীভাবে পাখির সাহায্যে অনেক দূরে বার্তা পাঠানো যায়। বানরের মতো হাইকলোরাও নকল করতে পটু। কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে ওরা কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। অন্য লোকের মহৎ ভাবনাকে ওরা নিজেদের বলে চালিয়ে দেয়।

জারাসের সাথে কথা শেষ করে আমি দ্রুত মূল ডেকের নিচে কেবিনে গেলাম। লেখার সরঞ্জামগুলো আমি যেখানে দেখে গিয়েছিলাম সেখানেই রয়েছে। সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাসকেটের মধ্যে এগুলো রাখা ছিল। কাসকেটের উপরে আইবিস পাখির মাথাওয়ালা লেখার দেবতা থথের একটা ছোট চিত্র আঁকা রয়েছে।

আমি ডেকে আসন গেড়ে বসে লেখার বাক্সটা খুললাম। খুশি হয়ে দেখলাম, ভেতরে বিভিন্ন আকারের প্যাপিরাস কাগজ ছাড়াও বেশ কয়েকটি তুলি আর কালির ব্লক রয়েছে। এছাড়া ঘোড়ার কেশর বুনে তৈরি করা চারটে ছোট ছোট গুটলিও বাক্সটায় রয়েছে। খাওয়ার জন্য আমরা যে-ধরনের সাধারণ কবুতর পালন করি তার পায়ে এই গুটলিগুলো বাঁধা যায়। এই কবুতরগুলোর আশ্চর্য ধরনের একটি অভ্যাস আছে, যে-জায়গায় ওরা ডিম ফুটে বের হয় সেখানে ওরা ফিরে যেতে পারে। আর পায়ে ছোট্ট বার্তাবহনকারী গুটলি বেঁধে দিলে তাও বহন করে নিয়ে যায়।

আমি দ্রুত হাতে কবুতরের পায়ের বার্তাবহনকারী গুটলিতে বাধার মত ছোট একটা প্যাপিরাসের টুকরা নিলাম। তারপর একটা সরু তুলি আর লেখার কালি গুড়া করে নিলাম।

লেখার বিষয়টিবস্তু আমার মনেই ছিল, তাই নতুন করে ভাবনা চিন্তা করার দরকার পড়েনি। খুব ছোট ছোট অক্ষরে পরিষ্কার লেখার হাত ছিল আমার।

শুরু করলাম যথারীতি সম্ভাষণ দিয়ে, উচ্চ ও নিচের মিসরের ফারাও হে, মহাপরাক্রমশালী বিওন। যদিও সে এই ধরনের কিছু নয়, তবুও এই ধরনের পদমর্যাদার প্রতীক সে পছন্দ করে। আমি, ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ আপনাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছি। আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আমি মহামান্যের জন্য রূপাভর্তি তিনটি বিশাল জাহাজ পাঠাচ্ছি। এপিফি মাসের দ্বিতীয় দিনে নীল নদের বদ্বীপে তামিয়াতে আমার ঘাঁটি থেকে জাহাজগুলো রওয়ানা দেবে। আশা করি একই মাসের পঞ্চম দিনে মেমফিসে আপনার রাজধানীতে এগুলো পৌঁছে যাবে। এই ঘটনার খবর আপনার নজরে আসার আগে যাতে কোনো দুষ্ট লোকের হাতে না পড়ে সেজন্য শেষ মুহূর্তে খবরটি বিলম্বিত করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস যে সম্মান প্রদর্শন করে এই উপহারসামগ্রীগুলো আপনার বরাবর পাঠানো হয়েছে, তা আপনি যথাযথ আগ্রহের মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করবেন।

কালি শুকাবার সাথে সাথে কাগজটা পাকিয়ে কবুতরের পায়ে বাঁধার গুটলিতে রেখে এরাবিক আঠা দিয়ে সিল করলাম। তারপর কেবিন থেকে বের হয়ে নিচের ডেকে নেমে মালামাল রাখার খোলের দরজায় কাছে গেলাম।

জারাস লাথি মেরে দরজার তালা ভেঙে ফেলার পর আর মেরামত করা হয়নি। হাতে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। পেছন ফিরে দরজাটা বন্ধ করলাম। যে সিন্দুকটা খুলে ভেতরের মালামাল দেখছিলাম, সেটার ডালা তখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। আমার ড্যাগার দিয়ে চাড় দিয়ে ডালাটা খুললাম। তারপর সিন্দুকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতর থেকে একটা রূপার বাঁট বের করলাম। ভারি বঁটটা আমার কোমরবন্ধের সাথে বাঁধা ছোট থলের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম। তারপর উপরে ডেকে গিয়ে জারাসের পাশে আমার জায়গায় পৌঁছলাম। চুপিচুপি তার সাথে কথা বললাম যাতে কেউ না শুনতে পারে।

এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা কুনটুস নদীবন্দরে পৌঁছে যাবো। সেখানে বিওনের শুল্ক ফাঁড়ির লোকেরা চলাচলকারী সমস্ত জাহাজ থেকে শুল্ক আদায় করে

জারাস আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বললো, এসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না প্রভু তায়তা। আমাদের ওরা দেরি করাতে পারবে না। আমরা মশা তাড়াবার মতো ওদেরকে তাড়িয়ে দেব

না, জারাস। তুমি তোমার বৈঠা আর পাল গুটিয়ে রাখবে। আর শুল্কদপ্তরের নৌকা কাছে আসতে স্বাগত জানাবে। ওরা কাছে এলে যথাযথ সম্মান দেখাবে। শুল্ক কর্তাকে বায়না দিয়ে রাখতে হবে। কেননা তার সহযোগিতা প্রয়োজন পড়বে। তারপর জারাসকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে আমি জাহাজের অন্যপাশে সরে গেলাম। আসলে আমি নিজেও নিশ্চিত নই কুনটুসে পৌঁছার পর কী হতে পারে।

নদীতে ভাসমান সমস্ত নৌকা পাশ কাটিয়ে আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম। এই নীল নদীর বুকে আমরাই সবচেয়ে দ্রুতগামি জলযান ছিলাম। আশেপাশের সমস্ত নৌকা আমাদের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে সরে পড়লো। ওরা কেউ জানেনা আমরা কে, তারপরও তখনকার অস্থিতিশীল অবস্থায় যে কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষ কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাইবে না।

নদীর আরেকটা চওড়া বাঁক পেরোতেই সামনে পূর্বদিকের তীরে কুনটুস নদীবন্দর দেখা গেল। শহরের উপরে একটা পাহাড়ে উঁচু পাথরের পাহারা একটা চৌকি টাওয়ার দেখেই আমি চিনতে পারলাম। টাওয়ারের মাথায় বড় এটা কালো পতাকা উড়ছে। এটা হচ্ছে শুল্কদপ্তরের প্রতীক। আমি জানি টাওয়ারের উপরে নজরদারি লোক থাকবে লক্ষ্য রাখতে যেন কোনো জলযান শুল্ক না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে না পারে।

আমরা বন্দরের কাছাকাছি হতেই বন্দরের পাথরের জেটি থেকে কালো পতাকা উড়িয়ে একটা শুল্ক নৌকা আমাদের পথ আটকাতে এগিয়ে এলো। আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম পাল আর বৈঠা গুটিয়ে নিচে নামিয়ে রাখতে যাতে ওরা আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে। শুল্ক নৌকার ডেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত কয়েকজন হাইকসো সেনা দাঁড়িয়েছিল। নৌকাটা জাহাজের কাছে ভিড়তেই জারাস একপাশে ঝুঁকে চিৎকার করে ওদের একজনের সাথে আলাপ শুরু করে জানতে পারলো, লোকটার নাম গ্রাল–সে প্রাদেশিক শুল্ক কর্মকর্তা।

আলাপচারিতা হাইকসো ভাষায় হতে দেখে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। গ্রাল নামে এই লোকটি মিনোয়ান ভাষায় কথা বললে, আমরা কীভাবে ওদেরকে বুঝাতাম যে একটি মিনোয়ান জাহাজে কেন কেউ তাদের ভাষায় কথা বলতে পারছে না। ঠিক তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথম সুযোগেই এই ভাষা শিখে নেবো। বিদেশি ভাষা শেখার ব্যাপারে আমার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। আমি স্থির নিশ্চিত যে, কয়েকমাসের মধ্যেই ক্রিটের অধিবাসীদের মতোই ওদের ভাষায় আমি কথা বলতে পারবো।

শুল্ক নৌকার ডেক থেকে রাজা বিওনের নামে গ্রাল দাবি করলো, তাকে যেন আমাদের জাহাজে উঠার অনুমতি দেওয়া হয়। আমার শেখা মতো জারাস কোনো আপত্তি না করে নাবিকদের নির্দেশ দিল একটা দড়ির মই নামিয়ে দিতে যাতে গ্রাল জাহাজে উঠতে পারে। ছোটখাট লোকটি একটা বানরের মতো ক্ষিপ্রগতিতে দড়ির মই বেয়ে উঠতে লাগলো।

জারাসকে সে জিজ্ঞেস করলো, আপনিই কি এই জাহাজের ক্যাপ্টেন? আমার দায়িত্ব আপনাদের মালামালের তালিকা পরীক্ষা করা।

জারাস সম্মতি জানিয়ে বললো, অবশ্যই স্যার। তবে এর আগে দয়া করে আমার কেবিনে এসে আমাদের চমৎকার মিনোয়ান ওয়াইনের স্বাদ নিন, তারপর আপনার কাজ শুরু করুন। তারপর সে বন্ধুসুলভভাবে ছোটখাট লোকটির বাহু ধরে তাকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে মাস্টারের কেবিনে নিয়ে চললো।

এ পর্যন্ত আমি নিজেকে ওদের কাছ থেকে আড়ালে রেখেছিলাম। নিচে কেবিনের দরজা বন্ধ হওয়ার জোরে শব্দ পাওয়ার পর আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম।

জারাস আর আমি এই সাক্ষাতকারের ব্যাপারে আগেই পরিকল্পনা করেছিলাম। কেবিনের দেয়ালে একটা ছিদ্র করেছিলাম, যাতে ভেতরে কী কথাবার্তা হয় তা দেখা আর শোনা যায়। এখন দেখলাম আমার উঁকি দেবার ছিদ্রটার দিকে মুখ করে জারাস লোকটিকে বসিয়েছে। লোকটির সারা মুখে আঁচিল। জারাসের দেওয়া ওয়াইন মুখ ভরে পান শুরু করতেই তার গলা এমনভাবে ফুলে গেল যেন একটি বিশাল ব্যাঙ তার প্রিয় খাবার, জল-ইঁদুর গিলে খাচ্ছে। এই দৃশ্যটি দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।

জারাস অত্যন্ত ভদ্রতা দেখিয়ে তাকে বললো, আপনি নিশ্চয়ই জানেন রাজা বিওন আমাদের জাহাজের চলাচলের জন্য শুল্ক মওকুফ করেছেন।

গ্রাল তার মদের গ্লাস নামিয়ে বললো, সেটা আমি বিবেচনা করবো, ক্যাপ্টেন। তবে সেক্ষেত্রেও আমি আমার খরচ দাবি করবো। তারপর একটা ধূর্ত হাসি দিয়ে বললো, অবশ্য পরিমাণটা নগণ্য, এব্যাপারে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

জারাস ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললো, অবশ্যই। আমাদের সকলকে বাঁচতে হবে। তবে আপনার সাথে একান্তে আলাপ করার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ। আমাদের আসার খবর দিয়ে মেমফিসে রাজা বিওনের কাছে আমার একটা বার্তা পাঠানো দরকার। তাকে জানাতে হবে সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছ থেকে আমি উপহার হিসেবে বিপুল পরিমাণে রূপার বাট নিয়ে যাচ্ছি। একথা বলে জারাস টেবিলের নিচ থেকে একটা রূপার বাঁট বের করলো। এটা আমি তাকে আগেই দিয়ে রেখেছিলাম। টেবিলের উপর বাঁটটা রেখে সে বললো, এটা তার একটা নমুনা।

গ্রাল ধীরে ধীরে হাতের মগটা টেবিলে রেখে রূপার বাটটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখদুটো মনে হচ্ছে কোটর বের হয়ে আসছে। মুখ হা করতেই তার চোয়াল ঝুলে পড়লো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি বেয়ে মুখ থেকে মদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে লাগলো। মনে হল সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সম্ভবত জীবনে কখনও সে এ-ধরনের সম্পদ চোখে দেখেনি।

জারাস বলে চললো, এখানে কুনটুসে কি আপনার কাছে বার্তাবহনকারী কবুতর আছে? যে পাখি মেমফিসে উড়ে গিয়ে রাজা বিওনের কাছে আমার আগমন সংবাদ নিয়ে যেতে পারবে?

গ্রাল ঘোৎ ঘোৎ করে মাথা নাড়লো। তার উত্তর দেবার মতো অবস্থা ছিল না আর চকচকে রূপারপিণ্ডটি থেকে সে চোখও সরাতে পারছিল না।

জারাস রূপারপিণ্ডটি আরেকটু তার দিকে ঠেলে দিয়ে বললো, এই পিণ্ডরূপাটিকে আপনার অমূল্য সেবার পারিশ্রমিক হিসেবে ধরে নিতে পারেন। আমাদের মহান দুই জাতির মধ্যে যে মতৈক্য রয়েছে এটা তার একটি নিদর্শন। তারপর সে আমার পত্রসহ পায়রার পায়ে বাধার গুটলিটা পিণ্ডরূপার পাশে রাখলো। এই বার্তাটি দয়া করে রাজা বিওনের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।

একটা বড় মাকড়সার মতো হাত বাড়িয়ে সে টেবিলের উপর থেকে পিণ্ডটা তুলে নিয়ে তার দাগেভরা চামড়ার জ্যাকেটের সামনে দিয়ে ভেতরে গলিয়ে দিল, তারপর কোমরের দড়িটা কষে বাঁধলো। প্রচণ্ড আবেগে তার হাত কাঁপছিল। পিণ্ডরূপারটার কারণে জ্যাকেটের পেটের নিচের দিকটা ফুলে রইল, তবে সে এক হাত দিয়ে সেটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রইল।

টলমলে পায়ে কোনো মতে উঠে দাঁড়াল আর অন্য হাতে আমার পত্রটা নিল। জারাসের দিকে ঝুঁকে অভিবাদন করে বললো, এবার আমি বুঝতে পেরেছি মহামান্য, আপনি উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রিয় কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। আমার এই অনধিকার চর্চার জন্য ক্ষমা করুন। তবে এই পত্রটি আমার একটি বার্তাবহনকারী পাখির মাধ্যমে রাজা বিওনের কাছে পাঠাবার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আজ সূর্যাস্তের আগেই এটি রাজার হাতে পৌঁছে যাবে। আর আপনাদের এই চমৎকার জাহাজেও আপনারা পরশুর আগে মেমফিস পৌঁছতে পারবেন না।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আসুন আপনাকে নিরাপদে আপনার নৌকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। এই কথা বলে জারাস তার দিকে হাত বাড়াবার আগেই সে সিঁড়ি বেয়ে উপরের ডেকের দিকে চলতে শুরু করলো।

জারাস আর আমি লক্ষ করলাম নৌকাটা কুনটুসের দিকে চলেছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলাম গ্রাল তার নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। এরপর আমি জারাসকে ইশারা করতেই সে পাল তুলে বৈঠা হাতে নিয়ে মাল্লাদের দক্ষিণের পথে যাবার জন্য তৈরি হতে বললো।

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কুনটুসের দালান কোঠার মধ্য দিয়ে একজন ঘোড়সওয়ার উপরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে ছুটে চলেছে। আমি চোখে হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে দেখলাম সে টাওয়ারের নিচে অপেক্ষামান সহিসের হাতে ঘোড়ার রাশটা দিয়ে উঁচু ভবনের ভেতরে অদৃশ্য হল।

একটু পরই একই লোককে দেখা গেল ভবনের চূড়ায় প্লাটফর্মে। সে দুই হাত উপরের দিকে তুলতেই তার হাত থেকে একটা বেগুনি রঙের পায়রা ডানা পতপত করতে করতে আকাশে উড়ে গেল।

তিনবার টাওয়ারটি চক্কর দিয়ে পাখিটি দক্ষিণমুখি উড়তে শুরু করলো। উপরের দিকে দ্রুত উড়তে উড়তে নদীর মাঝখানে এল। আমাদের একটা জাহাজের ঠিক উপর দিয়ে যাওয়ার সময় আমার মনে হল এর একটি পায়ে সেই পত্রসহ গুটলির আকৃতির কিছু একটা বাঁধা রয়েছে।

.

সারাবিকেল আমরা দক্ষিণমুখি চলতে লাগলাম। তারপর পশ্চিমতীরের পাহাড়গুলোর পেছনে সূর্য ডুবে যেতেই একটা নিরাপদ জায়গায় রাতের জন্য জাহাজ নোঙর করতে জারাসকে নির্দেশ দিলাম। সে একটা বাঁক পেরিয়ে নদীর একটা অগভীর জায়গা খুঁজে নিল।

আমি জানতাম গ্রাল ঠিকই হিসেব করে বলেছিল। মেমফিস থেকে আমরা এখনও প্রায় দেড়দিনের দূরত্বে রয়েছি। নোঙরের দিকে লক্ষ্য রাখতে জারাস প্রতি জাহাজে একজন করে লোক বসাল আর রাতের আঁধারে যাতে কোনো দস্যুদল হামলা করতে না পারে সেজন্য তীরেও পাহারা বসাল।

রাতে অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে খাবার খেতে খেতে আমি আমার তিন অধিনায়কের সাথে কীভাবে আমাদের জাহাজের মাথায় স্থাপিত ব্রোঞ্জের তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে শত্রুর একটা জাহাজ গুঁতা মেরে ফুটো করা যায়, সেই কৌশল নিয়ে আলোচনা করলাম। নৌযুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে আমার রচিত বিখ্যাত গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনার সময় আমি এই কৌশলটি নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। আমি তাদেরকে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করলাম, কীভাবে নিজেদের জাহাজ আর লোকজনের ক্ষতি না করে শত্রুর জাহাজের ব্যাপক ক্ষতি করা যায়। আরও বললাম, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে সংঘর্ষের আগে নিজেদের লোকদেরকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে হবে।

কোনোধরনের অঘটন ছাড়াই শান্তিতে রাত কেটে গেল। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম আর ভোর হতেই নোঙ্গর তুলে পাল তুলে আবার নদীতে ভাসলাম। আগের রাতে উত্তর পূর্ব থেকে জোর বাতাস বইতে শুরু করেছিল, সেই বাতাসের তোড়ে আমাদের জাহাজ আরও দ্রুতবেগে চলতে লাগলো। আমাদের লোকদের মাঝে প্রবল উৎসাহ জেগে উঠলো। এমনকি শিকলে বাধা ক্রীতদাসেরাও ভালো খাবার আর থিবসে পৌঁছার পর মুক্তি পাওয়ার আশ্বাসে দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁড় বাইতে লাগলো। জাহাজের হালে দাঁড়িয়ে আমিও শুনতে পেলাম ওরা গান গাইছে।

আমার মনে হল জাহাজে একমাত্র আমার মনেই আমাদের এই দুঃসাহসিক উদ্যোগের ব্যাপারে কিছু সন্দেহ ছিল। থিবস ছেড়ে আসার পর সবকিছু এত মসৃণভাবে হয়ে চলেছিল যে, সবাই ভাবতে শুরু করেছিল আমি সকল ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে আর ওরাও অপরাজেয়। আমি জানতাম দুটি ধারণাই মিথ্যা। এমনকি আমিও জানিনা মেমফিস পৌঁছে কি দেখবো। মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে ভাবতে শুরু করলাম, কেন বিওনকে আমাদের আসার আগাম খবর দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখালাম। হয়তো এটাই ভালো হতো যদি চুপি চুপি রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড় বেয়ে তার রাজধানীতে পৌঁছাতে পারতাম। জাহাজের একপাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় এতো মগ্ন ছিলাম যে জারাস পাশে এসে আমার পিঠে জোরে একটা চাপড় দিতেই চমকে উঠলাম।

আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি তায়তা, কিন্তু কখনও বুঝতে পারিনি যে আপনি এতো বেপরোয়া। আমি জানি আপনি ছাড়া আর কেউ এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসিক কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারবে না। আপনার এই বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড উদযাপন করার জন্য আপনার একটা বীরত্ব। গাঁথা রচনা করা উচিত। আর আপনি না করলে আপনার হয়ে আমি তা করবো। এই কথাটি শেষ করে সে আবার আমার পিঠ চাপড়ালো।

এই জায়গাটা মিসরীয় এলাকা হলেও অনেক বছর আগে শত্রুরা এটা দখল করে নিয়েছিল। ছোটবেলার পর আর কখনও আমি এখানে আসিনি। তাই সবকিছু আমার কাছে অচেনা মনে হচ্ছিল, আর বাকি সবাইও তাই ভাবছিল কেবল একজন ছাড়া।

সে ছিল ছাব্বিশতম রথীবাহিনীর মিসরীয় ক্রীতদাস রহিম, যাকে আমি তামিয়াত দুর্গেই মুক্তি দিয়েছিলাম। পাঁচ বছর আগে হাইকসোরা তাকে বন্দী করেছিল আর তারপর বাকি সময়ের অর্ধেক সে শেকলে বাঁধা অবস্থায় এই এলাকায় নৌকায় দাঁড় বাইতো।

আমার আর জারাসের পাশে দাঁড়িয়ে সে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। নদীপথের প্রতিটি বাঁক আর পানির নিচে লুকানো প্রতিবন্ধকতা সে আমাদেরকে দেখিয়ে নিয়ে চললো।

রাত হতেই আবার আমরা নোঙ্গর ফেলে সেখানেই থামলাম। তবে পরদিন সূর্য উঠার সাথে সাথেই আবার পাল তুলে নীল নদী বেয়ে এগিয়ে চললাম। আজ এপিফি মাসের পঞ্চম দিন, আমাদের আসার খবর দিয়ে এদিনটির কথাই আমি বিওনকে আগাম জানিয়েছিলাম।

ঘন্টা চারেক চলার পর উঁচু দুই তীরের মধ্যে একটা সরু বাঁকের ভেতরে ঢুকলাম। এর ভেতর থেকে বের হয়ে সামনে দুই লিগ পর্যন্ত বয়ে যাওয়া শান্ত প্রণালীরপানির প্রবাহের মধ্যে চলে এলাম।

রহিম বললো, মেমফিস পৌঁছার এটাই শেষ পর্ব। নদীর বামদিকের বাকের পর সামনের দুই তীর জুড়ে মেমফিস নগর ছড়িয়ে রয়েছে।

আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম, জাহাজ থামাও। যারা বৈঠা বাইছে তাদেরকে বল, সামনের বাঁকে পৌঁছা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে আর একটু পানি খেয়ে নিতে। এরপর আমি যখন গোত্তা মারার জন্য জোরে বাইতে বলবো তখন ওরা প্রস্তুত হবে। বাকি দুটি জাহাজও আমাদের নির্দেশ অনুসরণ করলো। তিনটি জাহাজই এখন প্রণালীর মধ্য দিয়ে কেবল পালের সাহায্যে ভেসে চলেছে।

নদীতে বিভিন্ন ধরনের জলযান দেখা যাচ্ছে। ছোট ডিঙি থেকে শুরু করে চেটালো একতলা পাল-তোলা জাহাজ, চারকোণা পালের জাহাজ আর এর সাথে বাধা বড় নৌকা পর্যন্ত। এর আগে নদীতে যেসব নৌকা আমরা পাশ কাটিয়ে এসেছি, তা থেকে এদের ব্যবহারর সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হচ্ছে। যদিও সম্মান দেখিয়ে আমাদের পথ ছেড়ে দিচ্ছে, তবে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। আমাদের দেখে এই নৌকাগুলোর মাঝিমাল্লারা হাত উঠিয়ে স্বাগত জানালো।

আমি জারাসকে বললাম, আমাদের আগমন ওদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। মনে হয় কবুতরটি ঠিকই পথ চিনে ফিরে এসেছে।

জারাস আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, এটাই তো আপনি পরিকল্পনা করেছিলেন তাই না? অন্য কিছু তো আপনি আশা করেননি, প্রভু? তার কথা শুনে আমি মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকালাম। আমি জানি অধিকাংশ মানুষের তুলনায় আমি অনেক বিচক্ষণ আর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, তবে বুদ্ধির চেয়ে ভাগ্য আমার কাছে পছন্দনীয়, তবে ভাগ্যদেবী খুবই চঞ্চল। কখন কাকে ছেড়ে ভাগ্যদেবী চলে যান কেউ তা জানে না।

আমি নিচে দাঁড়ীদের বসার বেঞ্চের দিকে নামলাম। ওরা সবাই আমার দিকে হাসি মুখে তাকালো। কেউ কেউ দুএকটা হাসিখুশি মন্তব্য করলো, আমিও প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলাম। তবে এখানে আসার মূল লক্ষ্য ছিল বেঞ্চের নিচে লুকানো ধনুকগুলোতে গুণ লাগান আছে কি না আর তূণভর্তি তীর আছে কি না তা দেখা।

পেছন দিক থেকে বয়ে আসা জোর বাতাসের তোড়ে আমরা নদীর বুক চিরে দ্রুত এগিয়ে চললাম আর এদিকে সামনের বাঁকও দ্রুত এগিয়ে আসছে। কোনো ধরনের অস্থিরতা না দেখিয়ে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে আবার জাহাজের হালে আমার জায়গায় ফিরে গেলাম।

দুপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম আকেমি আর দিলবার আমাদের জাহাজের পেছনে দুইপাশে একটা তীরের ফলার মতো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রয়েছে। ওরা দুজনেই হাত তুলে আমাকে সম্মান জানাল আর সংকেত দিল যে আক্রমণের জন্য ওরা প্রস্তুত রয়েছে।

বাঁকে পৌঁছার সাথে সাথেই আমি জারাসের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নির্দেশ দিলাম, বৈঠা হাতে নাও!।

সাথে সাথে আমাদের দুই পাশে রূপালি ডানা গজাল-বৈঠার পাতলা ডগাগুলো পানির উপরে চকচক করে উঠলো।

তারপর নির্দেশ দিলাম, বাওয়া শুরু কর! বলার সাথে সাথে একসাথে সমস্ত বৈঠা পানিতে নামলো আর বৈঠা টানা শুরু হল দ্বিগুণ বেগে। ঢাক বাদকরা বৈঠা বাওয়ার তালে তালে দ্রুতলয়ে ঢাক বাজিয়ে চললো।

হঠাৎ বাঁক পার হয়ে নদীর দুই তীরে বিস্তৃত মেমফিস নগরীর মুখোমুখি হলাম। মার্বেল পাথরের দেয়াল আর সুউচ্চ দালানের ছাদ থেকে সূর্য কিরণ ঠিকরে পড়ছে।

জাঁকালো রাজপ্রাসাদ আর মন্দিরগুলো দেখে মনে হল আমাদের প্রিয় থিবসের মতোই জমকালো একটি নগরী।

নদীর উভয় তীরেই তিন থেকে চার সারি নৌযান দেখা যাচ্ছে। আর প্রতিটি নৌযানে মানুষ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ নৌযান সাদা আর লাল পতাকা দিয়ে সাজানো। আমি জানতাম এটা হচ্ছে হাইকসোদের আনন্দ আর উৎসবের প্রতীক। উৎফুল্ল জনতা পামপাতা নেড়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। সবার কণ্ঠে উজ্জ্বলতা আর উম্মাতাল গানে ভরপুর।

তবে আমাদের জাহাজ সামনে এগোবার জন্য নীল নদীর মাঝ বরাবর জায়গাটি সম্পূর্ণ খালি রাখা হয়েছে। জলপথের শেষ মাথায় সুসজ্জিত আর রং করা বেশ কয়েকটি বজরা আর ছোট ছোট নৌকা নোঙর করা রয়েছে। আর মাঝখানে রয়েছে সবচেয়ে বড় রাজকীয় বজরা। তবে এটিও আমাদের তিন জাহাজের তুলনায় ছোট।

জনতার কোলাহলের মাঝে আমি চিৎকার করে জারাসকে বললাম, আঘাত করার জন্য আরও জোরে বৈঠা বাইতে বল। মাঝখানের লাল বজরাটি বিওনেরই, এটা লক্ষ্য করে জাহাজ চালাও।

দুইহাত তুলে আমি রেশমি কাপড়ের টুকরাটি দিয়ে চোখের নিচ পর্যন্ত মুখ ঢেকে ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণটা মাথায় পরলাম। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাই। যেন অসতর্ক কোনো মুহূর্তে বিওনের রাজদরবারের কেউ আমাকে চিনতে না পারে।

আমাদের জাহাজের হাল ধরে রাখা দুই নাবিক জাহাজের ব্রোঞ্জের ডগাটা রাজা বিওনের রাজকীয় বজরা বরাবর লক্ষ্য স্থির করে রয়েছে। পেছনে বাকি দুই জাহাজ অর্ধেক জাহাজ দূরত্বে রয়েছে যেন আমরাই প্রথম আঘাত হানতে পারি। বাদকরা ঢাকের ছন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আর আমি অনুভব করলাম ঢাকের তালে তালে আমার হৃৎস্পন্দনও চলেছে।

আমাদের সাথে লাল বজরার দূরত্ব দ্রুত গতিতে চারশো থেকে দুইশো কদম কমে এসেছে। আমি দেখতে পেলাম বজরারি চওড়া দিকটা নদীর স্রোত বরাবর রেখে নোঙর করা। উপরের ডেকে উঁচু ধাপের একটা পিরামিডের চারপাশে তাঁবুর মতো শামিয়ানা টানানো হয়েছে। শামিয়ানার নিচে একটা সিংহাসন আর তার উপর বসা একটা মানুষের মূর্তি দেখতে পেলাম। তবে এতদূর থেকে সবকিছু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।

সিংহাসনের চতুর্দিকে বর্শাধারী পাইক-বরকন্দাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবাই বর্ম আর অস্ত্রসজ্জিত। তাদের শিরস্ত্রাণ আর বুকের বর্ম দেখে মনে হচ্ছে রণসাজে সজ্জিত হয়ে প্রদর্শনী করছে।

রাজকীয় বজরার দুই পাশে আরও কিছু ছোট জলযান সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা রয়েছে। এগুলোতে বিওনের সভাসদরা ভীড় করে রয়েছে। মনে হচ্ছে কয়েকশো হবে, তবে এত গাদাগাদি করে রয়েছে যে, প্রকৃত সংখ্যা গণনা করার কোনো উপায় নেই। মেয়েরা বেশিরভাগ দীর্ঘদেহী পুরুষের পেছনে ঢাকা পড়ে গেছে। সবাই হাসিখুশিতে মত্ত আর উল্লাসে হাত নাড়ছিল। কিছু কিছু পুরুষ উৎসব উপযোগী বর্ম আর ধাতব শিরস্ত্রাণ পরে রয়েছে। আর অন্যদের পরনে বিভিন্ন ধরনের রঙিন পোশাক।

বিশাল রাজকীয় তরীর পাশেই একটি ছোট জলযানে বাদকদল বর্বর ধরনের হাইকসো সুর বাজিয়ে চলেছে। ঢোলক, বীণা, ক্লারিওনেট, পশুর শিং, তুর্য, কাঠের বাঁশি সবমিলিয়ে বেসুরো আর বিকট আওয়াজ করে চলেছে।

আমরা এতো দ্রুত রাজকীয় তরীর দিকে ছুটে চলছিলাম যে, কাছাকাছি আসার পর এখন প্রায় সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। পিরামিড আকৃতির মঞ্চের উপর রঙিন শামিয়ানার নিচে পেটানো রূপার সিংহাসনে বিওন বসে রয়েছে। তার পিতা রাজা সালিটিসের মৃত্যুর পর সে এই সিংহাসন দখল করেছে।

দেখার সাথে সাথেই আমি তাকে চিনতে পারলাম। এর আগে থিবসের যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে আমি দেখেছিলাম। সে ছিল হাইকসো সেনাবাহিনীর বামবাহু, তার অধীনে চল্লিশ হাজার পদাতিক আর তিরন্দাজ ছিল। এমন লোককে সহজে ভোলো যায় না।

বিশালদেহী লোকটির বিরাট ভূড়ি জুড়ে বিপুলায়তন সাদা আল্লাখাল্লাটা একটা তাঁবুর মতো ফুলে রয়েছে। বেণি পাকানো কালো দাড়ি লম্বা হয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে। বেণি পাকানো দাড়িতে উজ্জ্বল রূপা আর সোনার অলংকার লাগানো রয়েছে। সে একটা উঁচু মুকুটসহ পলিশ করা রূপার শিরস্ত্রাণ পরে রয়েছে, যাতে বিভিন্ন ধরনের উজ্জ্বল রত্ন লাগানো আছে। তাকে দেখতে একজন দেবতার মতো মনে হচ্ছিল। হাইকসোদের সবকিছু ঘৃণা করলেও তার সাজসজ্জা দেখে আমিও অবাক হলাম।

রাজা বিওন একহাত উঁচু করে হাতের তালু সামনের দিকে মেলে সম্ভবত আমাদের স্বাগত কিংবা আশীর্বাদ জানাচ্ছে। সঠিক বুঝা মুশকিল, তবে সে মৃদু হাসছিল।

আমি জারাসকে সংক্ষেপে কয়েকটা শব্দে রাজকীয় বজরার সবচেয়ে দুর্বল দিকটা দেখালাম। সেটা ছিল উঁচু মঞ্চের একটু সামনে।

ঐ জায়গাটা লক্ষ্য করে আঘাত হানবে।

এখন আমরা এতো কাছে এসে পড়েছি যে, এবার দেখতে পেলাম রাজা বিওনের মুখে আর হাসি নেই। মুখ হা করাতে তার চোয়াল নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে, বাদামি ছোপ ছোপ ময়লা সামনের দাঁত দেখা যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ সে মুখ বন্ধ করলো। শেষ মুহূর্তে সে আমাদের বৈরী মনোভাব টের পেয়েছে। লোমশ দুই থাবা সিংহাসনের হাতলে ঠেস দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে খুব ধীরে উঠছিল।

রাজকীয় তরীর দুইপাশে নৌকাগুলোর উপর ভীড় করে থাকা সভাসদরা হঠাৎ তাদের দিকে ছুটে আসা জাহাজগুলোর ধাক্কার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হল। মেয়েদের ভয়ার্ত চিৎকার আমাদের কানে ভেসে এলো। কিছু কিছু পুরুষ বজরার কিনারায় যাওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি করতে করতে তরবারি কোষমুক্ত করে আমাদের উদ্দেশ্যে রণহুঙ্কার দিতে শুরু করলো। যারা সামনে ছিল তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মাঝে পর্বতের তুষারধ্বসের মতো আমরা তাদের উপর এসে পড়লাম।

হাইকসোদের সমস্ত চিৎকার আর হট্টগোল ছাপিয়ে জারাসের নির্দেশ শোনা গেল, বৈঠা সামলাও! আমাদের জাহাজের দুইপাশের দাড়ীরা পানি থেকে বৈঠা তুলে খাড়া করে জায়গামত সামলে রাখলো যাতে জাহাজের সংঘর্ষে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। নদীর শেষ কয়েকগজ খোলা জায়গা আমরা একই গতিতে পার হলাম।

আমি জারাসকে যে জায়গাটা দেখিয়েছিলাম ঠিক সেই জায়গাটি লক্ষ্য করে আমরা রাজকীয় বজরায় আঘাত হানলাম। বিকট মচমচ আওয়াজ তুলে ব্রোঞ্জের বিশাল ডগাটা সামনের বজরাটির কাঠ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সংঘর্ষের সাথে সাথেই দাড়ী বেঞ্চে বসা আমাদের বেশিরভাগ লোক ডেকে ছিটকে পড়লো। আমি শক্ত কাঠের বেঞ্চ ধরে নিজেকে সামলালাম। আমার চারদিকে কী ঘটছে সব আমি দেখতে পেলাম।

লক্ষ্য করলাম আমাদের জাহাজের পুরো শক্তি আর ওজন রাজকীয় বজরার এক পাশে ছোট একটি জায়গায় কেন্দ্রিভূত হয়ে আঘাত করেছে। একটা ভারি কুড়ালের ফলা যেমন এবটি কাঠের গুঁড়ি ফেড়ে ফেলে সেরকমভাবে আমরা এটা ফেড়ে ফেললাম। আমাদের জাহাজের ডগা বজরাটি চাপা দিতেই এর হালের কয়েক টুকরা আমাদের জাহাজের সামনের অংশের নিচে তলিয়ে গেল।

আমাদের জাহাজ ওদের উপর চড়াও হতেই আমি দেখলাম, শীতকালের ঝড়ো বাতাসের তোড়ে যেমন চিনার গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা ঝরে পড়ে, ঠিক তেমনি হাইকসো প্রহরীদলের সদস্যরা রাজকীয় পিরামিডের সিঁড়ির ধাপ থেকে ছিটকে পড়লো। আর রাজা বিওন সবচেয়ে উঁচু থেকে পড়লো। তার বিশাল দেহজুড়ে আলখাল্লাটা ফুলে গেল আর জটপাকানো দাড়ির বেণিগুলো মুখে আছড়ে পড়তে লাগলো। শূন্যে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সে নদীতে পড়লো। আমাদের থেকে ত্রিশ কদম সামনে সে পানিতে ভাসছিল, পানি আটকে থাকায় তার আলআল্লাটা ফুলে গিয়ে তাকে ভাসিয়ে রেখেছিল।

আমার দুই পাশে বাকি দুটি জাহাজও হাইকসোদের অন্যান্য ছোট ছোট বজরাগুলোর গায়ে ধাক্কা মেরেছে। ওরা বেশ সহজেই বজরাগুলোর কাঠ চিড়ে ফেললো, বজরার উপরের যাত্রীরা আতঙ্কে চিৎকার করে ডেক থেকে পানিতে পড়ে গেল।

রাজকীয় বজরার ভাঙা অংশগুলো আমাদের তিনতলা জাহাজের দুইপাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়লো। পাল ঘেঁড়ার প্রচণ্ড চড়চড় শব্দ, দড়ি ছিঁড়ে ফট ফট শব্দ, কাঠ ফেটে যাওয়ার শব্দ আর জাহাজের হালের ধাক্কায় পিষে যাওয়া মানুষের আতঙ্কিত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের ডেকও একপাশে হেলে যাওয়ায় মানুষজন আর ডেকের উপরের বিভিন্ন জিনিসপত্র একদিকে সরে গেল।

তারপর আমাদের সুন্দর জাহাজটি ভাঙা বজরার ভাঙা অংশগুলো থেকে ছাড়া পেয়ে আবার ভারসাম্য ফিরে পেল এবং পানির উপর সোজা হয়ে দাঁড়াল।

জারাস আবার চিৎকার করে উঠলো, বৈঠা হাতে নাও! আমাদের লোকেরা আবার বেঁধে রাখা বৈঠাগুলো তুলে নিয়ে বাওয়ার জন্য আংটায় বসালো। জারাস আবার বলে উঠলো, পেছনে বাইতে শুরু কর! কেবল পেছনের বেঞ্চিতে বসা দাঁড়িরা বৈঠা পানিতে পৌঁছাতে পারছিল। সামনের বেঞ্চিতে বসা দাঁড়িরা রাজকীয় বজরার ভাঙা অংশগুলোর কারণে দাঁড় বাইতে পারছিল না।

যারা দাঁড় বাইতে পারছিল, তারা জোরে জোরে কয়েকবার বৈঠা চালিয়ে আমাদেরকে আটকে থাকা ভাঙা বজরার অংশ থেকে ছাড়িয়ে আনলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভাঙা টুকরাগুলো পানিতে তলিয়ে গেল।

আমি অন্য তিনতলা জাহাজ দুটোর দিকে তাকালাম। দিলবার আর আকেমি তাদের অধীনস্থ লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছিল। ওদের জাহাজের নাবিকরাও ঢাক পেটানোর তালে তালে দ্রুত বৈঠা চালিয়ে জাহাজদুটোকে জায়গামত ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল।

নদীর পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকা মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে, বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টারত মানুষ আর ভাঙা টুকরায় নদী ভরে রয়েছে। ডুবন্ত নারী পুরুষের মরণপণ চিৎকার আর আর্তনাদ চারপাশে এক করুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

দীর্ঘ এক মিনিট আতঙ্কিত হয়ে আমি এই বিভিষিকাময় হত্যাযজ্ঞ লক্ষ্য করলাম। অপরাধবোধ আর অনুতাপে আমি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম। বিপর্যস্ত এই প্রাণীগুলোর দিকে শুধু হাইকসো পশু মনে করে আর তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এরাও মানুষ, যারা নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

তারপর রাজা বিওনের দিকে নজর পড়ার সাথে সাথেই আমার এই অনুভূতি বদলে গেল। মনে পড়ে গেল নাকুয়াদার যুদ্ধে হাইকসো পশুরা যখন আমাদের চমৎকার আর সাহসী দুইশো তিরন্দাজকে বন্দী করেছিল তখন বিওন তাদের সাথে কী আচরণ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে শেঠ দেবতার মন্দিরের ভেতরে ওদেরকে আটকে রেখে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে সেই দানবীয় দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করেছিল।

এখন বিওন রাজকীয় বজরার একটা কাঠের তক্তা একহাতে ধরে রেখেছে আর অন্য হাতে তার রত্নখচিত তলোয়ার নিয়ে তার হেরেমের যে সব নারী কাঠের টুকরাটিতে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছিল তাদের মাথায় কোপ মারছিল। নির্দয়ভাবে সে তাদেরকে তাড়াচ্ছিল, কাউকেই সেই কাঠের খণ্ডটি ধরে ভেসে থাকার সুযোগ দিতে রাজি নয়। আমি লক্ষ্য করলাম সে আমার আদরের বেকাথার সমবয়সি একটি শিশুর মতো মেয়ের উপর তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলো। তলোয়ারের ধারাল ফলার আঘাতে পাকা ডালিমের মতো মেয়েটির মাথা কেটে গেল। দরদর রক্ত ঝরতে লাগলো, তারপরও বিওন অশ্লীল ভাষায় মেয়েটিকে গালি দিয়ে আবার তলোয়ার দিয়ে কোপ মারলো।

আমি দ্রুত নিচু হয়ে সামনের বেঞ্চির নিচে রাখা গুন লাগান ধনুকটি তুলে নিলাম। তীরগুলো তূণ থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, একটা তীর নিয়ে ধনুকের ছিলায় লাগিয়ে ছিলাটা টেনে টান টান করলাম, তারপর সোজা হয়ে পূর্ণশক্তিতে তীর ছুঁড়লাম। যেকোনো নিপুণ তিরন্দাজের মতো ধনুকের ছিলা আমার ঠোঁট ছুঁতেই সেটা ঢিল করে দিতাম। কিন্তু আজ প্রচণ্ড রাগে আমার হাত কাঁপছিল, তাই তীরটা ছুঁড়ার সময় বাঁকা হয়ে ছুটলো।

লক্ষভ্রষ্ট হয়ে তীরটা বিওনের গলার বদলে কাঠের টুকরাটা ধরে রাখা হাতে বিধলো।

জারাস আর অন্যান্য যারা এটা লক্ষ করছিল, তারা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো। ওরা ভেবেছিল আমি ইচ্ছা করে বিওনের হাতটা কাঠে বিধিয়েছি। এবার আরেকটা তীর তুলে নিয়ে ওদেরকে দেখাবার জন্য লক্ষ্য স্থির করে বিওনের অন্য হাতটাও কাঠের খণ্ডটার গায়ে বিধলাম। ক্রুশবিদ্ধ হবার মতো অবস্থা হয়ে সে একটা নেকড়ের মতো চিৎকার করে উঠলো।

মুলত আমার স্বভাব করুণাময়, তাই তাকে আর কষ্ট না দিয়ে তৃতীয় তীরটা ছুঁড়তেই তার গলা ভেদ করে চলে গেল।

আমার জাহাজের নাবিকেরাও আমাকে অনুসরণ করলো। ওরাও ধনুকে তীর জুড়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে নিচে পানিতে শক্রর উদ্দেশ্যে বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়তে শুরু করলো।

যা ঘটছিল তা থামাবার মতো শক্তি আমার ছিল না। আমার লোকদের অনেকে এই জঘন্য হাইকসোদের হাতে তাদের বাপ আর অনেকে ভাই হারিয়েছে। তাদের মা বোনদের এরা বলাৎকার করেছিল।

কাজেই কিছুক্ষণ হাইকসো অভিজাতদের এই দুর্দশা তাকিয়ে দেখলাম, তারপর তীরবিদ্ধ শেষ মৃতদেহটা স্রোতে ভেসে যাওয়ার পর আমি আমার লোকদের থামতে বললাম।

অনুতপ্ত না হয়ে আমার লোকেরা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে আবার দাঁড় হাতে নিল। হাইকসোদেরকে তাদের জঘন্য শেঠ দেবতার করুণায় ছেড়ে দিয়ে আমরা দক্ষিণদিকে থিবসে আমাদের আসল মিসর রাজ্যের দিকে এগিয়ে চললাম।

.

আমাদের বর্তমান মিসর রাজ্য আর হাইকসো গোত্র আমাদের দেশের যে এলাকা দখল করেছিল তার মাঝে কোনো পরিষ্কার সীমানাচিহ্নিত করা ছিল না। প্রায় প্রতিদিন সীমান্তে দুই পক্ষের মাঝে আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ আর লড়াই হতো।

পেয়াইনি মাসের পঞ্চম দিনে আমরা থিবস ছেড়ে এসেছিলাম। এর মধ্যে সেনাপতি ক্রাটাস হাইকসো হামলাকারীদেরকে শেখ আবাদা নগরী থেকে বিশ লিগ দূরত্বে হটিয়ে দিয়েছিলেন। যাইহোক এখন এপিফি মাস চলছে, আমাদের অবর্তমানে অনেক পরিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটেছে। তারপরও ওদেরকে অবাক করে দেবার মতো ব্যাপার আমরা ঘটিয়েছি।

হাইকসোদের সামনের সারির সৈন্য কিংবা সেনাপতি ক্রাটাসের অধীনে যুদ্ধরত আমাদের সৈন্যদের কেউ আশা করবে না যে মধ্যসাগরের তীর থেকে চারশো লিগ নদীপথ পাড়ি দিয়ে একটি মিনোয়ান রণ-নৌবহর হঠাৎ এসে হাজির হবে। তাই পরিচিত এলাকায় পৌঁছার পর তিনতলা জাহাজগুলোর মাস্তুলের ডগায় হাতে বানানো ফারাও ত্যামোজের নীল পতাকা উড়িয়ে দিলাম।

নীল নদীর দক্ষিণপ্রান্তে আমাদের তিনতলা জাহাজগুলোর মোকাবেলা করার মতো হাইকসো কিংবা মিসরীয় কোনো জাহাজই নেই। আমরা প্রমাণ করেছি যে, কেউ আমাদেরকে থামাতে পারবে না। অবশ্য হাইকসোরা পায়রা উড়িয়ে খবর পাঠিয়ে আমাদের আর মিসরের মাঝে অবস্থান করা তাদের সেনাবাহিনীকে সাবধান করে দিতে পারে। তবে পায়রা শুধুমাত্র তাদের ডিম থেকে ফোঁটার স্থানেই ফিরে যেতে পছন্দ করে, অন্য কোথাও কেউ পাঠাতে চাইলে তারা সেখানে যাবে না।

.

হাইকসসারা যখন আমাদেরকে নিজ ভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তার আগে আমাদের শাসক ছিলেন ফারাও ম্যামোজ। সে-সময়ে আমি, তায়তা ছিলাম প্রধান উজির ইনতেফের ক্রীতদাস। তিনি ছিলেন কারনাক মন্দিরের নোমার্ক বা প্রধান তত্ত্বাবধায়ক এবং উচ্চ মিসরের সকল বাইশটি নোম বা প্রদেশের প্রধান উজির। এছাড়াও তিনি নেক্রোপলিস এবং রাজকীয় সমাধিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণের প্রশাসক ছিলেন।

জীবিত এবং মৃত সকল ফারাওয়ের সমাধি দেখাশোনার দায়িত্ব তার উপর ছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি ফারাও ম্যামোজের সমাধিরও সরকারি স্থপতি ছিলেন।

তবে প্রভু ইনতেফের জন্মগত কোনো সৃষ্টিশীল প্রতিভা ছিল না। তিনি বরং ধ্বংসাত্বক কাজে পটু ছিলেন। তিনি একটি গরুবাছুরের খোয়াড় কিংবা কবুতরের খোপও তৈরি করতে পারতেন কিনা আমার সন্দেহ। তিনি শুধু রাজকীয় সেবায় সময় কাটাতেন আর কঠিন যে কাজগুলো নিজে করতে পারতেন না সেগুলো আমার কাঁধে চাপিয়ে দিতেন।

প্রভু ইনতেফের সাথে আমার তেমন সুখকর স্মৃতি ছিল না। তার অধীনস্থ লোকদের একজন গোলাম আমার উপর খোঁজা করার ছুরিটা চালিয়েছিল। সে ছিল একজন নিষ্ঠুর, নির্দয় মানুষ। তবে শেষপর্যন্ত অবশ্য আমি তার সাথে শেষ বোঝাঁপড়াটা করতে পেরেছি।

তবে সেই খুশির দিনটির অনেক আগে আমিই ফারাও ম্যামোজের চমৎকার সমাধিসৌধের সমস্ত কক্ষ, গুহাপথ আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ঘরের নকশা করেছিলাম। তারপর এই বিশাল সৌধ নির্মাণ কাজে শ্রম দেওয়ার জন্য যেসব নির্মাতা, রাজমিস্ত্রি, শিল্পী আর কারিগরদের ডাকা হয়েছিল, তাদের সকলের কাজ আমি তত্ত্বাবধান করেছিলাম।

ফারাও ম্যামোজের বিশালাকায় পাথরের শবাধারটি একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরখণ্ড কেটে তৈরি করা হয়েছিল। এর ভেতরে অনায়াসে একটির মাঝে আরেকটি, এভাবে মোট সাতটি রূপার কফিন রাখার জায়গা ছিল। সবচেয়ে মাঝখানের কফিনে ফারাওয়ের মমিকরা দেহটি রাখার কথা ছিল। এতে পুরো জিনিসটা অনেক ভারি আর বড় হয়ে যেত। এই জিনিসটি যথাযথ শ্রদ্ধার সাথে নীল নদীর তীরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মন্দির থেকে দুইশো গজ দূরত্বে রাজার উপত্যকার পাদদেশে সমাধিসৌধে নেওয়ার কথা ছিল।

এই স্থানান্তরের কাজটি করার জন্য আমি নীল নদীর তীর থেকে কালো মাটির সমতল জমির উপর দিয়ে তীরের মতো সোজা একটা খাল খনন করেছিলাম। ফারাওয়ের বজরা চলার মত খালটা যথেষ্ট চওড়া আর গভীর করা হয়েছিল।

দুর্ভাগ্যবশত হাইকসোরা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার আগে ফারাও ম্যামোজ একদিনের জন্যও তার সমাধিতে শুয়ে থাকতে পারেন নি। যখন আমরা দেশ ত্যাগ করে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখন তার স্ত্রী রানি লসট্রিস আমাদেরকে ফারাওয়ের মমিকরা দেহটি সাথে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এর অনেক বছর পর রানি লসট্রিস আরও দক্ষিণে কয়েক হাজার লিগ দূরে জঙ্গল এলাকা নুবিয়ানে আরেকটি সমাধিসৌধ নির্মাণের নকশা বানাতে নির্দেশ দিলেন। এখন সেখানেই ম্যামোজ শায়িত রয়েছেন।

এতোবছর যাবত রাজার উপত্যকায় মূল সমাধিসৌধটি শূন্য পড়ে রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, আমার নকশা অনুযায়ী নীল নদীর তীরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মন্দির থেকে রাজকীয় সমাধি পর্যন্ত যে খালটা আমি খনন করিয়েছিলাম, তা এখনও চমৎকার অবস্থায় রয়েছে। আমি এটা জানতাম, কেননা মাত্র কিছুদিন আগে আমি আমার ছোট্ট দুই রাজকুমারিকে তাদের বাবার শূন্য সমাধি দেখাবার জন্য নদীর তীরে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম।

এতোগুলো বছর কেটে যাবার পরও আমি ম্যামোজের শবাধারবাহী বজরার সঠিক আয়তন মনে করতে পেরেছি। আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। আমি কখনও কোনো বিষয়, সংখ্যা কিংবা মুখ ভুলি না।

এবার আমি মিনোয়ান সম্পদবাহী তিনতলা জাহাজ তিনটির আয়তন পরিমাপ করলাম। তারপর জারাসকে বললাম জাহাজগুলো শান্ত পানিতে নোঙর করতে। এরপর সাঁতার কেটে জাহাজের তলায় গিয়ে অনুমান করলাম খোলে মূল্যবান সম্পদের ওজনসহ জাহাজটির কতটুকু পানি প্রয়োজন পড়বে। এই পরিমাপটি এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে একেক রকম হল।

সবকিছু দেখার পর খুশিমনে পানির উপরে ভেসে উঠলাম। এখন আমি ফারাও ম্যামোজের শববাহী বজরার সাথে আমাদের জাহাজের আয়তন মেলাতে পারবো। এই খালে আমাদের সবচেয়ে বড় জাহাজটি চলাচলের সময় দুই পাশে দশ কিউবিট জায়গা আর তলদেশে পনেরো কিউবিট জায়গা খালি রাখতে পারবে। আরও স্বস্তিদায়ক ব্যাপারটা হল এতো বছর ধরে আমি খালের দুইপাশে গ্র্যানাইট পাথরখণ্ড লাগিয়েছিলাম আর খালে সবসময় নীল নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য একধরনের জলকপাট আর পানি উত্তোলনের জন্য সেচযন্ত্র-শাডুফ তৈরি করেছিলাম।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি জেনেছি, যদি তুমি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে দেবতাকে সম্মান করে তার কাছে কিছু আশা কর, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই তার প্রতিদান পেতে পার। যদিও দেবতারা অনেকসময় খামখেয়ালি হন, তবে এবার তারা ঠিকই আমাকে মনে রেখেছেন।

ঠিক করলাম সূর্যাস্তের পর খালে ঢুকবো। অন্ধকারে ফারাও ম্যামোজের অন্ত্যেষ্টি মন্দিরের নিচে পাথরের জেটিতে জাহাজ বেঁধে রাখলাম। অবশ্য ম্যামোজ এখন একজন দেবতা আর তার নিজের মন্দিরও নীল নদীর তীরে রয়েছে। এখান থেকে হেঁটেই জেটিতে পৌঁছা যায়।

মন্দিরটা বেশি বড় নয়। যখন আমরা থিবসের যুদ্ধে হাইকসোদের পরাজিত করে ফিরে এসেছিলাম তখন রানি লসট্রিস তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির সম্মানে একটি মন্দির নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তার স্বামীর প্রতি সম্মান দেখান আর নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার জন্য দেবতার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।

নিশ্চিতভাবে আমাকেই তিনি এই মন্দির নির্মাণের আহ্বান জানালেন। তার ইচ্ছা ছিল এমন একটি বিশাল আর জমকালো মন্দির নির্মাণ করা, যা মিসরের আর সবকিছুকে ম্লান করে দেবে। তিনি চেয়েছিলেন মন্দিরটিতে চারশো পুরোহিত থাকবে, তবে আমি অনেক বলে তাকে সংখ্যাটি কেবল চারজন পুরোহিতে নামিয়ে এনেছিলাম।

এখন আমি আর জারাস কাউকে না জানিয়ে নদী থেকে মন্দিরের পেছন দিক দিয়ে চক্রনাভি বা মূল অংশে ঢুকলাম। সেখানে পৌঁছে আমরা আবিষ্কার করলাম সেই চার পুরোহিত পাম থেকে তৈরি সস্তা মদ পান করে একটু মাতাল হয়ে আছেন। ওদের সাথে আরও দুইজন অল্পবয়সী নারীও ছিলেন। ওরা সবাই নগ্ন হয়ে একসাথে কাদামাটির ইটের তৈরি মেঝেতে গোল হয়ে হাঁটছিলেন আর পুরোহিতরা হাততালি দিয়ে জোরে জোরে কিছু মন্ত্রোচ্চারণের মতো চিৎকার করছিলেন।

আমরা পৌঁছার কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের উপস্থিতি টের পেলেন, মেয়েদুটো দ্রুত দেবতা ম্যামোজের মূর্তির পেছনের গোপন দরজা দিয়ে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর আর তাদের আমরা দেখিনি।

ম্যামাজের এই চার পুরোহিতের আমার প্রতি যথেষ্ট ভক্তি রয়েছে। রানি লসট্রিসের মৃত্যুর আমি তাদের মাসিক মাসোহারা নিশ্চিত রেখেছিলাম। ওরা চারজনই আমার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে আমাকে ভক্তিশ্রদ্ধা জানিয়ে দেবতার নামে আমার মাথায় আশীর্বাদ বর্ষণ করলো।

ওদের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থায় আমি রাজকীয় বাজপাখির সিলমোহরটা বের করে ওদের দেখালাম। এটা দেখে ওদের মুখে আর কথা জোগাল না। প্রধান পুরোহিত হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে আমার পায়ে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলো। আমি পিছিয়ে গেলাম আর জারাস তাকে আর সামনে এগোতে দিল না।

তারপর আমি ঐ চার পুরোহিতকে সংক্ষিপ্তভাবে আর কঠোরভাবে বললাম ফারাও ত্যামোস ছাড়া আর কাউকেই যেন ঘুণাক্ষরেও এই তিনতলা ট্রাইরেম জাহাজ সম্পর্কে কিছু না বলা হয়। এছাড়া সারা দিনরাত মন্দিরে, শূন্য সমাধিসৌধ আর খালের দুইপাশে সশস্ত্র প্রহরা থাকবে। এরপর থেকে এই পবিত্র স্থানে কেবল ক্যাপ্টেন জারাসের অধীনস্থ লোকেরা ঢুকতে পারবে। আর একই প্রহরীরা নিশ্চিত করবে যেন এই চার পুরোহিত এই জায়গার মধ্যেই নিজেদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে।

পরিশেষে আমি প্রধান পুরোহিতকে সমাধি আর অন্যান্য স্থাপনায় ঢোকবার সমস্ত চাবির গোছা আমার হাতে দিতে নির্দেশ দিলাম। তারপর আমি আর জারাস জাহাজে ফিরে গেলাম।

রাজার উপত্যকার প্রবেশ পথ থেকে নদীর তীর পর্যন্ত জায়গাটি বিশ হাত ঢালু ছিল। তবে আমাদের প্রত্যেকটা জাহাজ এই উচ্চতায় তুলতে চারটি আলাদা জলকপাট বা গ্লুইস গেট প্রয়োজন। তারপরই এগুলোকে সমাধিসৌধে আনা যাবে। আমরা প্রথম জাহাজটি দাঁড় বেয়ে মন্দিরের নিচে জলকপাটের মধ্যে এনে এর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এই জলাধারের মধ্যে পানির উচ্চতা বাইরের খালের চেয়ে পাঁচ হাত নিচু ছিল।

আমি আমার তিন জাহাজের অধিনায়কদের দেখালাম কীভাবে মাটির কপাটটি খুলতে হয়। উপরের খাল থেকে নিচের জলাধারে পানি নেমে ধীরে ধীরে বিশাল জাহাজটিকে উপরের জলাধারের সমান উচ্চতায় তুলে আনলো। কপাটটি বন্ধ হয়ে যাবার পর গুণ টেনে জাহাজটিকে পরবর্তী জলাধার পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য আমাদের পঞ্চাশজন মানুষ অপেক্ষা করছিল। এর পেছনে দ্বিতীয় জাহাজটি উপরে তোলার জন্য একই প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হল।

এ-ধরনের কোনোকিছু আমার লোকেরা কখনও দেখেনি, অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কেননা এই পদ্ধতি আমিই আবিষ্কার করেছিলাম। সারা পৃথিবীতে এরকম পদ্ধতি আরেকটিও নেই। ওরা এতো অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, ওদের মনে হয়েছিল এটা একধরনের জাদুকরী ব্যাপার।

সৌভাগ্যবশত এই কাজের জন্য আমার কাছে দুইশো মানুষ ছিল। মিনোয়ানরা যে ক্রীতদাসদের শিকলে বেধে নিচের ডেকে রেখেছিল ওরাও ছিল এদের মধ্যে। অবশ্য ওরা এখন মুক্ত মানুষ, তবে ওরা কৃতজ্ঞতাবশত সব কাজ করে যাচ্ছিল।

জাহাজটি উপরে তোলার জন্য উপরের জলাধার থেকে যে পানি সরানো হয়েছিল তা আবার ভর্তি করার প্রয়োজন ছিল। কয়েকটা সেচ করার শাদুফ যন্ত্র দিয়ে আমি নদী থেকে নতুন পানি পাম্প করে তোলার ব্যবস্থা করলাম। এগুলো ছিল দুই বিপরীত প্রান্তে ওজন রাখা বাকেট শিকল বা কপিকল, যা দুইজন মানুষ চালাতে পারে। এটি একটি পরিশ্রম সাধ্য কাজ যা, প্রত্যেক জাহাজের জন্য চারবার করে করতে হয়েছিল।

প্রথম জলকপাটের মধ্যে তোলার আগে প্রত্যেক জাহাজের পাল আর মাস্তুল উপরের ডেকে সমান করে বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর জাহাজটি নলখাগড়া দিয়ে বুনা মাদুর দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছিল, যাতে দেখে মনে হচ্ছিল এটা একটি আকৃতিহীন ময়লার স্তূপ। পরদিন সকালে থিবসের লোকজন ঘুম থেকে উঠে নদীর এপারে তাকালে অস্বাভাবিক তেমন কিছু দেখতে পাবে না। তিনটি তিনতলা জাহাজই অদৃশ্য হয়ে গেছে, যেন কখনও এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না।

পরদিন সূর্যোদয়ের সময় আমরা সমতল ভূমির উপর দিয়ে জাহাজগুলো টেনে নিয়ে ম্যামোজের সমাধিসৌধের প্রবেশ পথের কাছে এসে বাঁধলাম। লোকগুলো এত পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম ওদের সবার খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে আরও কিছু শুকনো মাছ, বিয়ার আর রুটি দিতে আর দিনের বাকি গরম সময়টা বিশ্রাম নিতে বললাম।

পায়ে চলার পথ দিয়ে হেঁটে আমি মন্দিরে ঢুকলাম। মনে হল পুরোহিতরা গত সন্ধ্যার কষ্টসাধ্য যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ধকল কাটিয়ে উঠেছে। মন্দিরের ডিঙিতে করে ওরা আমাকে নদীর উপর দিয়ে নিয়ে চললো। আমার অভিযানের সফলতার খবর দেবার জন্য আমি ফারাওয়ের কাছে যাচ্ছি।

এই দায়িত্বটি আমি খুবই পছন্দ করি। ফারাওয়ের প্রতি আমার পরম ভক্তি ছিল, তবে এর চেয়েও বেশি ছিল তার মা লসট্রিসের প্রতি। তবে এইটুকুই শুধু বলবো যে, রাজপরিবারের সকল সদস্যের প্রতি আমার ভক্তি ছিল।

আমার অনুগত পুরোহিতরা আমাকে শহরের বাজারের কাছে নদীর তীরে সিঁড়ির কাছে নামিয়ে দিল। সকাল হলেও বাজারে লোক সমাগম যথেষ্ট ছিল। সরু গলি দিয়ে প্রাসাদের ফটকের দিকে হেঁটে চললাম। ভাঙাচোরা শিরস্ত্রাণ আর মুখ ঢাকা ময়লা মুখোশের কারণে কেউ আমাকে চিনতে পারেনি।

প্রাসাদের ফটকে পৌঁছার পর মুখ থেকে ছদ্মবেশ সরাতেই প্রাসাদ রক্ষীদলের অধিনায়ক সাথে সাথে আমাকে চিনতে পেরে শ্রদ্ধার সাথে অভিবাদন জানালো।

আমি তাকে বললাম, আমাকে এখনি ফারাওয়ের সাথে দেখা করতে হবে। একজন বার্তাবাহক পাঠিয়ে তাকে জানাও আমি তার সাথে দেখা করার জন্য আনন্দের সাথে অপেক্ষা করছি।

ক্ষমা করুণ প্রভু তায়তা। ফারাও থিবসে নেই। খুব শিগ্রি ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না।

আমি মাথা নাড়লাম। একটু হতাশ হলেও খুব একটা অবাক হই নি। জানতাম ফারাও অধিকাংশ সময় উত্তরে হাইকসোদের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযানে সময় আর শ্রম ব্যয় করেন। তাহলে আমাকে প্রাসাদ সরকার প্রভু এটনের কাছে নিয়ে চল।

এটনের কামরার দরজায় পৌঁছতেই সে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, কী খবর বন্ধু? তোমার অভিযান কেমন হয়েছে?

আমি মুখ অন্ধকার করে বললাম, খবর বেশ গুরুতর। তামিয়াত দুর্গে সর্বাধিরাজ মিনোজের ধনভাণ্ডার লুট হয়েছে। আর রাজা বিওনকে হত্যা করা হয়েছে।

সে আমাকে দুই হাতে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আমার সাথে মজা করছো, তায়তা। যেকোন সৎলোক এটা শুনলেই কেঁদে ফেলবে! এমন জঘন্য কাজটা কে করলো?

আমি একটি হাত তার মুখের সামনে তুলে ধরে বললাম, হায়! একই হাত দুটো কাজই করেছে, এটন। যে হাতটি দেখলে তুমি চিনতে পারবে। সে

ধোকা খাওয়ার মত ভান করে হাতটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এতোকাল। প্রাসাদ সরকার পদে টিকে থাকতে গেলে একজনকে অবশ্যই পাকা অভিনেতা হতে হয়।

তারপর সে মাথা নাড়তে নাড়তে প্রথমে মৃদুভাবে চুকচুক করলো, তারপর তার খুশির মাত্রা বেড়ে যেতেই হাসিতে ফেটে পড়লো। তার ভুড়ি থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ হাসির দমকে কাঁপতে শুরু করলো। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে পাশের প্রস্রাবখানায় ঢুকলো। প্রথমে একটু নীরবতা, তারপর জলপ্রপাত থেকে নীলনদের উপর পানির প্রবাহ পড়ার মতো শব্দ শুরু হল। বেশ কিছুক্ষণ এরকম চলার পর এটন ফিরে এলো।

তোমার ভাগ্য ভালো বন্ধু যে, আমি সময়মত প্রস্রাবখানায় পৌঁছতে পেরেছিলাম, আর নয়তো রাজা বিওনের মত তুমিও ডুবে মরতে।

তুমি কীভাবে জানলে যে, বিওন পানিতে ডুবে মরেছে?

তুমি সামনে যা দেখছো, তা ছাড়াও আমার অন্য কান আর চোখ আছে।

এতোই যদি জানো তবে মিনোজের সম্পদ সম্পর্কে কিছু বল?

সে অনুতপ্তভাবে মাথা নেড়ে বললো, এ-সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তুমি হয়তো জানো।

আমি শুধু জানি যে, তুমি ভুল বলেছিলে।

কী ধরনের ভুল সেটা?

তুমি বলেছিলে এই সম্পদের পরিমাণ এক লাখ হবে, তাই না? সে মাথা নেড়ে সায় দিল।

পরিমাণটা দুঃখজনকভাবে ভুল বলেছিলে।

সে বললো, একথা প্রমাণ করতে পারবে?

আমি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম, এর চেয়েও ভালো কিছু বলতে পিরবো, এটন। আমি তোমাকে এটি ওজন করতে দেবো। যাইহোক প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি ফারাওকে একটা বার্তা পাঠাতে চাই।

কামরায় এককোণে রাখা লেখার সরঞ্জামের দিকে দেখিয়ে এটন বললো, তুমি তোমার বার্তাটা লিখে ফেল, সন্ধ্যার আগেই ফারাও তার হাতে এটা পাবেন।

আমার বার্তাটি ছিল ছোট আর সাংকেতিক ভাষায় লেখা। এটনের হাতে বার্তাটা দিয়ে তাকে বললাম, কিছু মনে করো না। প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত আমি স্নান করিনি আর পোশাক বদলাইনি। আমাকে এখনি নিজের ঘরে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।

নিজের ঘরে পৌঁছাবার সাথে সাথে আমি একজন ক্রীতদাসকে রাজকীয় জেনানা মহলে পাঠালাম রাজকুমারিদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছাতে।

মাত্র আমি উষ্ণ পানির চৌবাচ্চায় পা দেব, ঠিক তখনই দুই রাজকুমারি মরুর খামসিন ঝড়ের বেগে এসে পৌঁছাল। এই পৃথিবীতে একমাত্র তাদের সামনেই আমি পোশাক না পরা অবস্থায় দাঁড়াই। আর আমার ক্রীতদাসদের সামনে, ওরা অবশ্য আমার মতোই খোঁজা।

এখন তেহুতি আর বেকাথা আমার মার্বেল পাথরের স্নানের চৌবাচ্চার কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসলো। বেকাথা তার ছোট্ট সুন্দর পাদুটো দোলাতে দোলাতে অনুযোগ করলো, তুমি যাওয়ার পর সবকিছু একেঘেয়ে লাগছিল। কী এমন তুমি করছিলে যে এতো দেরি হল ফিরতে তোমার? এখন কথা দাও, এরপর কোথাও গেলে আমাদের সাথে নিয়ে যাবে। এই কঠিন প্রতিজ্ঞা এড়াতে আমি গরম পানি মাথায় ঢালতে শুরু করলাম।

এবার তেহুতি কথা শুরু করলো, আমাদের জন্য কোনো উপহার এনেছো তায়তা? নাকি আমাদের কথা ভুলে গিয়েছিলে? বড়বোন হিসেবে খাঁটি জিনিসের মূল্য সে ঠিকই বুঝে।

আমি উত্তর দিলাম, অবশ্যই এনেছি। কী করে আমি আমার ছোট্ট দুই রাজকুমারির কথা ভুলে যেতে পারি। আমার কথা শুনে দুজনেই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো।

বিকাথা কিচমিচ করে বললো, দেখাও।

যাও পাশের কামরায় কৌচের উপর থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে এসো। বেকাথা একছুটে চলে গেল, তারপর নাচতে নাচতে চামড়ার ব্যাগটা হাতে ঝুলাতে বুলাতে ফিরে এলো।

তারপর ব্যাগটা কোলে নিয়ে মার্বেলের মেঝেতে আসন গেড়ে বসলো।

আমি বললাম, খোল! আমার রাজকুমারিদের কথা মনে রেখেই আমি তামিয়াত দুর্গে বন্দী মিনোয়ান সেনাকর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া অলংকার থেকে দুটি অলংকার বেছে নিয়েছিলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, দেখোত লাল কাপড়ে মোড়া একটা জিনিস আছে কি না?

হ্যাঁ, আছে তায়তা, এটা কি আমার? লালটা কি আমার জন্য এনেছ?

হ্যাঁ, অবশ্যই তোমার জন্য।

ছোট কাপড়ের পুটলিটা খুলতে গিয়ে উত্তেজনায় ওর হাত কাঁপছিল। সোনালি হারটা তুলে ধরতেই তার চোখ খুশিতে ঝিকমিক করে উঠলো। ফিসফিস করে সে বলে উঠলো, এতো সুন্দর জিনিস আমি কখনও দেখিনি।

হারটি থেকে ছোট ছোট দুটি মূর্তি ঝুলছে। ছোট হলেও মূর্তিদুটোর খুঁটিনাটি সবকিছু পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। বড়টি ছিল একটি আক্ৰমণদ্যোত ষাঁড়ের মূর্তি। শিং দুটো বাঁকা করে আক্রমণের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ান। সবুজ পাথরের ছোট ছোট দুটো চোখ। বঁড়টি একটি সুন্দর মেয়ের মূর্তিকে আক্রমণ করছিল। ভয়ংকর শিংদুটোর আওতার বাইরে মেয়েটি নাচছে। মাথায় ফুলের মালা আর বুকে দুটো লাল রুবি। মাথা পেছনে হেলিয়ে মেয়েটি হাসছিল।

হারটা দুই হাতে দোলাতে দোলাতে বেকাথা বললো, মেয়েটি এতো দ্রুত ছুটছে যে ষাঁড়টি কখনও তাকে ধরতে পারবে না।

ঠিক বলেছ তুমি। ভয়ঙ্কর বিপদের বিপরীতে মেয়েটি হল সৌন্দৰ্য্য। তুমি এটা পরলে বিপদ তোমাকে ছুঁতে পারবে না। এটা তোমাকে সবধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। ওর হাত থেকে হারটা নিয়ে ওর গলায় পরিয়ে পেছনের হুকটা লাগিয়ে দিলাম। সে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁধে ঝাঁকুনি দিতেই মূর্তিদুটো নেচে উঠলো। হেসে উঠতেই তাকে আরও সুন্দর দেখালো।

তেহুতি এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে চুপ করে বসেছিল। আমি একটু অপরাধবোধ করে তার দিকে ফিরে বললাম, রাজকুমারি, তোমার উপহারটা ঐ নীল কাপড়ে মোড়ানো আছে।

সাবধানে কাপড়ের ভাঁজটা খুলতেই একটা আংটি ঝিকমিক করে উঠলো। সে দম আটকে চেঁচিয়ে উঠলো। এতো উজ্জ্বল জিনিস আমি কখনও দেখিনি।

আমি বললাম, এটা তোমার মধ্যমায় পর।

এটা খুব বড়। খুলে যায়।

তার কারণ এটা একটা বিশেষ ধরনের পাথর। তুমি এটা কোনো পুরুষকে দেখাবে না, শুধু...

শুধু কি?

শুধু যদি তুমি চাও সে তোমার প্রেমে পড়ক। আর নয়তো এটা তোমার হাতের তালুতে লুকিয়ে রাখবে। মনে রেখো এর জাদু শুধু একবারই কাজে আসবে। কাজেই খুব সাবধানে এটা কাউকে দেখাবে।

সে আঙুল দিয়ে আংটিটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল, আমি চাই না কোনো পুরুষ আমাকে ভালোবাসুক।

কেন?

কারণ, ওরা শরীরে একটা বাচ্চা ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করে। আর একবার বাচ্চাটা ভেতরে ঢুকলে আর বের হতে চায় না। আমি হেরেমে অনেক মহিলাকে চিৎকার করে আর্তনাদ করতে শুনেছি। আমি এরকম করতে চাই না।

আমি মৃদু হেসে বললাম, একদিন তুমি তোমার মত বদলাবে। তবে এই পাথরের আরও কিছু গুণের কারণে এটা বিশেষ ধরনের হয়েছে। বেকাথা বলে উঠলো, বল, কী এমন বিশেষ গুণ আছে এটার তায়তা?

একটা গুণ হল এটা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত জিনিস। কোনো কিছু দিয়ে এটা কাটা যায় না, আর সবচেয়ে ধারালো ব্রোঞ্জের ড্যাগার দিয়েও এটার গায়ে আঁচড় কাটা যায় না। এজন্য এটাকে বলা হয় হীরা–সবচেয়ে কঠিন জিনিস। পানিতে ভিজে না। তবে যে মেয়ে এটা পরবে তার গায়ে এটা জাদুর মতো লেগে থাকবে।

সন্দেহের সুরে তেহুতি বললো, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না তায়তা। এটা তোমার বানানো আরেকটা গল্প।

ঠিক আছে, দেখো আমার কথা ঠিক হয় কি না। তবে মনে রেখো, যদি তুমি কাউকে সত্যিকার ভালোবাস আর চাও যে সেও তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসুক, তাকে ছাড়া আর কোনো পুরুষকে এটা দেখাবে না। জানি না কেন তাকে একথা বললাম, তবে মেয়েদুটো আমার কাছে গল্প শুনতে পছন্দ করে আর আমি কখনও তাদের হতাশ করি না।

টাব থেকে উঠে গা মুছার জন্য আমার প্রধান দাস রুস্তিকে ডেকে একটা তোয়ালে আনতে বললাম।

এবার তেহুতি অনুযোগ করে বললো, তুমি আবার চলে যাচ্ছো তায়তা। এখন সে বেশ বড় হয়েছে আর একজন সাবালিকার মতোই ভেবেচিন্তে কথা বলতে শিখেছে। মাত্র এক ঘন্টার জন্য এসে আবার চলে যাচ্ছ। এবার হয়তো চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছ। তার চোখে পানি চলে এসেছে।

আমি তোয়ালেটা ফেলে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, না! না! এটা সত্য নয়। আমি শুধু পূর্ব তীরে তোমার বাবার শূন্য সমাধি পর্যন্ত যাচ্ছি।

বেকাথা বললো, যদি এ কথা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকেও সাথে নিয়ে চল।

কথাটা শুনে ভেবে দেখলাম প্রস্তাবটা মন্দ নয়। ওদের মতো আমারও ভালো লাগবে।

ছদ্ম অনিচ্ছা দেখিয়ে বলো, একটা সমস্যা আছে। আমরা খুব গোপন একটা কাজ করতে যাচ্ছি। তোমাদেরকে কথা দিতে হবে যা দেখবে তা কাউকে বলতে পারবে না।

কথাটা শুনে বেকাথার দুচোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো, সে বললো, গোপন ব্যাপার! সমস্ত দেবতার নামে আমি শপথ করছি তায়তা, কাউকে কিছু বলবো না।

.

দুই রাজকুমারি, এটন আর আমি যখন ফারাও ম্যামোজের সমাধির ফটকের কাছে পৌঁছলাম, তখনও রত্নবোঝাই জাহাজ তিনটি এর কাছেই জেটিতে বাঁধা ছিল।

আমার অনুপস্থিতিতে জারাস ওর লোকজন নিয়ে কাজ করে চলছিল। আশেপাশের পাহাড়গুলো থেকে যেন আমাদেরকে না দেখা যায়, সেজন্য ওরা সমাধির চারপাশ ঘিরে নলখাগড়ার বেড়ার পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আমার ইচ্ছা ছিল রাত জেগে সমস্ত জাহাজগুলো থেকে রতুগুলো নামিয়ে ফেলা। রাতের অন্ধকারের আড়ালে হাইকসো গুপ্তচরেরা এসে উঁকিঝুঁকি দিতে পারে। তাছাড়া আমাদেরকে মশাল জ্বালিয়ে কাজ করতে হবে, কাজেই গোপনীয়তা রক্ষার জন্য পর্দা খুবই জরুরী।

তামিয়াতে আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম, তা কাজে লাগিয়ে এখনকার মাল খালাসের বিষয়টা পরিকল্পনা করলাম। দিলবার আর তার লোকজনকে প্রথম জাহাজের ডেক থেকে কাঠের তক্তা খুলে বারকোশের মত কাঠামো বানাতে বললাম। আট হাত চওড়া এই কাঠামোটি জাহাজের খোলের মুখে এঁটে যাবে। তারপর প্রতিটি জাহাজের খোলের মুখের ঠিক উপরের ডেকে তেপায়া টুল আর কপিকল স্থাপন করলাম। সেখান থেকে আমার লোকেরা ভারি কাঠের বারকোশগুলো নিচে নামিয়ে জাহাজের খোলে ঢুকালো। আর খোলের ভেতরে থাকা অন্য দল সিন্দুকগুলো কাঠের বারকোশের উপর সাজিয়ে রাখলো।

বিশটা করে সিন্দুক এভাবে খোল থেকে বের করে উপরে ডেকে তোলা হল, তারপর সেখান থেকে ঝুলিয়ে জেটিতে নামিয়ে রাখা হল।

তেহুতি জিজ্ঞেস করলো, এই সিন্দুকগুলোতে কী আছে তায়তা? আমি নাকে হাত রেখে খুব গোপনীয়তার ভাব দেখিয়ে বললাম, এটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। তবে শিঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাবো কী আছে এগুলোর ভেতরে। আর একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর।

বেকাথা আমাকে মনে করিয়ে দিল, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারবো না।

সার বেঁধে থাকা অনেক মানুষ সিন্দুকগুলো বারকোশ থেকে তুলে নিল। জেটি থেকে শুরু করে মানুষের সারি সমাধির প্রবেশ পথ দিয়ে চারধাপ সিঁড়ি নেমে রং করা সুসজ্জিত সুড়ঙ্গে ঢুকলো, তারপর বিশাল তিনটি কামরা পার হয়ে চারটি ধনাগারে পৌঁছলো। ফারাওয়ের শূন্য সমাধির চারপাশ ঘিরে ধনাগারগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। বিশাল একটি পাহাড় কেটে আমি বিশ বছর ধরে দুই হাজার শ্রমিক লাগিয়ে এই প্রশস্ত দালানটি নির্মাণ করেছিলাম। কাজটি করতে পেরেছি বলে আমি এখনও গর্ববোধ করি।

দুই রাজকুমারিকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম, এই যে মেয়েরা, তোমরা আমাকে আর এটন চাচাকে সাহায্য করতে পারো। তোমরা দুজনেই গুণতে আর লিখতে পারো, যা এই বোকা লোকগুলোর একশো জনের মধ্যে একজনও পারে কি না সন্দেহ। কথাটা বলে আমি মাথা ঝাঁকিয়ে কাজ করা সারিবদ্ধ অর্ধনগ্ন লোকগুলোর দিকে দেখালাম।

এবার দুই বালিকাই হিসাব রক্ষকের কাজে লেগে পড়লো, যেন এটা একটা খেলা।

আমার নির্দেশ অনুযায়ী জারাস প্রথম ধনাগারে দুটো ভারী দাড়িপাল্লা স্থাপন করেছিল। আমি আর এটন এই দুটো পাল্লার ব্যবস্থাপনায় বসলাম। একটা একটা সিন্দুক পাল্লায় ঝুলাতেই আমি ওজনটা উচ্চারণ করতেই মেয়েরা লিখে রাখতে শুরু করলো। বেকাথা এটনের সাথে আর তেহুতি আমার সহকারী হিসেবে কাজ করতে লাগলো। ওরা একটা একটা সিন্দুকের ওজন একটা লম্বা প্যাপিরাস কাগজে লিখতে লাগলো আর দশটা সিন্দুকের ওজন হতেই সবগুলোর ওজন যোগ করে লিখতে লাগলো।

প্রথম কোষাগারে মোট ২৩৩ লাখ খাঁটি রূপা রাখা হল। এরপর আমি লোকজনদের একঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে উপরে পাঠিয়ে দিলাম। আমরা একা হবার পর আমি আমার প্রতিজ্ঞামতো মেয়েদেরকে সিন্দুকের ভেতরে যে ধনরত্ন আছে তা দেখালাম। একটা সিন্দুকের ঢাকনা খুলে একটা রূপার পিণ্ড দেখার জন্য ওদের হাতে তুলে দিলাম।

বেকাথা ওরা গলার হারটায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, এটা আমার গলার হারের মত সুন্দর নয়।

চারপাশের সিন্দুকগুলোর দিকে তাকিয়ে তেহুতি জিজ্ঞেস করলো, এগুলো সব তোমার তায়তা?

আমি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলাম, এগুলো সব ফারাওয়ের। আমার কথা শুনে সে মাথা নাড়লো। তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিমাণটা আন্দাজ করতে লাগলো। গণনা শেষ হওয়ার পর তার ঠোঁটে মৃদ হাসি দেখা গেল। তারপর সে বললো, আমরা তোমার কাজে খুবই খুশি তায়তা!

.

লোকজন আবার ফিরে এলে আবার ওদেরকে কাজে লাগালাম। ওরা

দাঁড়িপাল্লাটা দ্বিতীয় কোষাগারে নিয়ে চললো। এটা আগেরটার চেয়ে একটু ছোট, এতে আমরা আরও ২১৬ লাখ রূপা রাখলাম।

এমন সময় জারাস জেটি থেকে ফিরে এসে জানাল প্রথম দুটি তিনতলা ট্রাইরেম জাহাজের মাল সম্পূর্ণ খালাস করা হয়ে গেছে। এখন কেবল শেষ জাহাজে কিছু রূপা রয়ে গেছে।

সে একটু সতর্কসুরে বললো, ভোর হয়ে আসছে তায়তা। লোকজন সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসলে কাজ করতে করতে আমার খেয়ালই ছিল না যে কখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তবে অধিকাংশ লোকের তুলনায় আমার কর্মক্ষমতা অনেক বেশি ছিল।

তোমরা সবাই বেশ ভালো কাজ করেছ জারাস। তবে আমি তোমাদেরকে আরেকটু থাকতে বলবো। এখন জেটিতে গিয়ে দেখতে চাই আর কতটুকু কাজ বাকি আছে।

আর তখনই আমি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেললাম।

পেছন ফিরে দেখলাম তেহুতি টুলে বসে মাথা নুইয়ে প্যাপিরাস কাগজ নিয়ে হিসেবের কাজ করছিল। একমাথা সোনালি চুল ঢেউয়ের মত নিচে নেমে তার মুখ ঢেকে ফেলেছিল। কাজের চাপে সে চুল আঁচড়াবারও সময় পায় নি।

তাকে বললাম, তেহুতি, তুমি একজন ক্রীতদাসির মতো অনেক পরিশ্রম করেছ। এখন আমার সাথে উপরে চল। রাতের শীতল বাতাসে একটু সতেজ হয়ে নেবে।

তেহুতি উঠে দাঁড়াল। মাথা ঝাঁকিয়ে মুখ থেকে চুল সরিয়ে জারাসের দিকে তাকাল। জারাসও তার দিকে তাকাল।

মশালের আলোয় আমি দেখলাম তেহুতির সবুজ চোখের মনিদুটো বড় হয়ে উঠেছে। আর একই সাথে শুনতে পেলাম অন্ধকারের দেবতার হাসি।

ওরা একজোড়া মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি তেতির চোখ দিয়ে জারাসের দিকে তাকালাম। যদিও আমি পুরুষের চেয়ে একজন নারীর সৌন্দর্য্যের সঠিক পরিমাপ করতে পারি, তবে আজ প্রথম লক্ষ্য করলাম যে, জারাস সাধারণের চেয়ে অনন্য। তার বংশ পরিচয় তেমন আহামরি না হলেও তার চতুর্দিক ঘিরে একধরনের কর্তৃত্বব্যঞ্জক আভা রয়েছে। তার ভাবভঙ্গি এবং আচরণ অভিজাত শ্রেণীর।

আমি জানি তার বাবা থিবসের একজন বণিক, নিজ প্রচেষ্টায় বিশাল ভাগ্য গড়ে তুলেছেন। ছেলেকে মানুষ করতে যথাসাধ্য করেছেন। জারাস বুদ্ধিমান। এবং রসজ্ঞান সম্পন্ন। একজন ভালো সৈনিক। তারপরও তার বংশ পরিচয়ের কারণে সে ত্যামোস রাজবংশের একজন রাজকুমারির সমকক্ষ হতে পারে না। যাইহোক ফারাও সিদ্ধান্ত নেবেন কে হবে রাজকুমারির উপযুক্ত পাত্র, তবে

আমার কাছ থেকে অবশ্যই এ বিষয়ে উপদেশ নেবেন।

অতিদ্রুত আমি ওদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে তাদের চোখাচোখি হওয়ার সুযোগটা ভেঙে দিলাম। তেহুতি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি একজন আগন্তুক, যাকে সে আগে কখনও দেখেনি। তার হাত ছুঁতেই সে কেঁপে উঠে এবার আমার চোখে চোখ রাখলো।

আমি বললাম, এসো আমার সাথে তেহুতি। তারপর তার মুখের দিকে লক্ষ্য করলাম, সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আমাকে বললো,

হ্যাঁ, অবশ্যই যাবো তায়তা। ক্ষমা কর, আমি একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। চল যাই।

আমি পথ দেখিয়ে তাকে কোষাগার থেকে বের করে আনলাম, জারাসও অনুসরণ করলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল যেন, সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। আমি তাকে ভালোকরেই জানতাম, তবে তার এরকম অবস্থা কখনও দেখিনি।

আবার আমি সেই তরুণ যুগলের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, তুমি নয় ক্যাপ্টেন জারাস। তুমি দাঁড়িপাল্লাটা পরের কামরায় নেবার ব্যবস্থা কর। তারপর তোমার লোকজন একটু বিশ্রাম নিতে পারে।

কেবল এখন বুঝতে পারলাম এদের দুজনের এর আগে কখনও দেখা হয়নি। তেহুতি রাজপ্রাসাদের হেরেমের ছোট্ট পৃথিবীতে বিচরণ করতো। সেখান থেকে সে উপযুক্ত সহচরী পরিবেষ্টিত হয়ে বাইরের জগতে পা রাখতো। সম্ভবত আমিই ছিলাম সেই প্রতিরক্ষামূলক শৃঙ্খলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

একজন সুন্দরী হিসেবে তার কুমারীত্ব রাজা এবং রাজ্যের জন্য অমূল্য। হয়তো কোন রাজকীয় অনুষ্ঠানের সময় দূর থেকে জারাস তাকে দেখেছে। তবে সে কখনও রাজপ্রাসাদের রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে ছিল না। তার সমস্ত সামরিক জীবন কেটেছে দূর রণাঙ্গণে কিংবা সামরিক প্রশিক্ষণে। আমি নিশ্চিত আজকের আগে এতো কাছ থেকে রাজকুমারির অসামান্য সৌন্দর্য্য দেখার সুযোগ তার কখনও হয়নি।

আমি তাকে দ্রুত নির্দেশ দিলাম, তোমার লোকজনদের খাওয়া দাওয়া করতে বল আর প্রত্যেককে অতিরিক্ত এক মগ বিয়ার দাও। আমি আবার নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওদেরকে বিশ্রাম নিতে বল। একথা বলে আমি দুই রাজকুমারিকে নিয়ে উপরে চললাম। জারাস পেছন থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

সমাধিগর্ভের ফটক থেকে বের হয়ে একটু থেমে পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ভোরের গোলাপি লাল আভা পুব আকাশে ফুটে উঠেছে। তারপর নিচে তাকিয়ে দেখলাম জারাস ঠিকই বলেছিল, সমস্ত লোকজন পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

দ্রুত পায়ে তৃতীয় জাহাজটির সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠতেই নদীর ওপার থেকে তুর্যধ্বনী শোনা গেল, আর সেই সাথে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসা রথের চাকার শব্দও শোনা গেল। আমি জাহাজের রেলিং ধরে সামনে অন্ধকার নদীর তীরের দিকে তাকালাম।

অগুণতি মশালের আলো আর হট্টগোল থেকে বুঝা গেল ফারাও ফিরে এসেছেন। আমার বার্তা পেয়ে তিনি থিবসে ফিরেছেন। রাজার কাছাকাছি হলেই আমার বুক খুশিতে নেচে উঠে। আমি দ্রুত জাহাজের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে আরও মশাল জ্বালতে আর রাজকীয় সম্মানের জন্য সৈন্যদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলাম।

একটুপরই অনুচরদের অনেক পেছনে ফেলে অন্ধকার ভেদ করে ফারাও নিজে রথ চালিয়ে উপস্থিত হলেন। আমাকে দেখার সাথে সাথে উল্লাসে চিৎকার করে আমাকে সম্ভাষণ জানিয়ে রথের রাশে হেলান দিলেন।

রাশটা তার সহকারীর হাতে ছুঁড়ে দিয়ে চাকা চলন্ত অবস্থায় রথ থেকে একলাফ দিয়ে মাটিতে নেমে বললেন, খুব ভালো লাগছে তায়তা তোমাকে দেখে। অনেক দিন দেখা হয় নি তোমার সাথে। তারপর একজন দক্ষ রথীর মতো মাটিতে পা ফেলে দ্রুত কয়েক পদক্ষেপে আমার কাছে পৌঁছালেন। সমস্ত লোকজনের সামনেই আমাকে বুকে জাপটে ধরে শূন্যে তুললেন। তার ছেলেমি দেখে আমার হাসি পেল।

একেবারে সত্যি কথা মহামান্য। অনেক দিন হয়ে গেল। এক ঘন্টা আপনি না থাকলে মনে হয় এক সপ্তাহ সূর্য উঠেনি।

এবার তিনি আমাকে মাটিতে নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম তার সারা দেহ ধূলিধূসরিত আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে। বুঝা যাচ্ছে কষ্টকর একটি অভিযান থেকে সদ্য এসেছেন। তবে তার মাঝেও ফারাওয়ের মর্যাদা পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। পাশেই অপেক্ষারত বোনদের দেখে একের পর এক দুজনকেই বুকে জড়িয়ে আদর করার পর আবার আমার কাছে এলেন।

জেটিতে বাঁধা বিশাল তিনতলা জাহাজ তিনটে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কি জাহাজ? মাস্তুল আর দাঁড় ছাড়াই এগুলো আমার দেখা যে কোনো জাহাজের চেয়ে দ্বিগুণ বড় মনে হচ্ছে। এগুলো কোথায় পেলে তায়তা? তাকে আমি যে বার্তা পাঠিয়েছিলাম তা ছিল সাংকেতিক আর সেখানে বিশদ বর্ণনা ছিল না। যাইহোক আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সাথে সাথে আবার বললেন, ষণ্ডা-গুণ্ডার মতো চেহারার ওই লোকগুলোর পরিচয় কী? আমি তোমার সাথে মাত্র কয়েকজন লোক দিয়েছিলাম, আর এদিকে তুমি দেখছি তোমার নিজস্ব ছোট্ট একটা সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে এসেছ তায়তা।

তিনি জেটি থেকে সমাধির ফটক পর্যন্ত সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালেন। তার কাছাকাছি যারা ছিল তারা কাঁধের বোঝা মাটিতে নামিয়ে নতজানু হয়ে তার প্রতি সম্মান দেখাতে শুরু করলো।

এদের চেহারা দেখে ভুল বুঝবেন না, মহামান্য। এরা ষণ্ডা-গুণ্ডা নয়। এরা মিসরের সাহসী তোক আর প্রকৃত যোদ্ধা।

আবার জাহাজ তিনটির দিকে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু এই জাহাজগুলোর বিষয়টা কী? এগুলো সম্পর্কে কী বলবে?

আমি তাকে অনুরোধ জানিয়ে বললাম, দয়া করে আমার সাথে আসুন, নিরালায় বসে সবকিছু খুলে বলছি।

ঠিক আছে তায়তা। তুমিতো আবার সবসময় গোপনীয়তা পছন্দ কর, তাই না? তারপর তিনি সমাধির প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে চললেন। আমিও ফারাও ত্যামোসকে অনুসরণ করে তার বাবার অনুমিত সমাধির দিকে এগোলাম।

প্রথম কোষাগারে ঢুকে কামরাভর্তি সারি সারি সাজানো কাঠের বাক্সগুলোর দিকে তাকালেন। তবে কোনো মন্তব্য করলেন না।

দ্বিতীয় কামরায় যাওয়ার আগে কেবল বললেন, আশ্চর্য, সমস্ত বাক্সের গায়ে সর্বাধিরাজ মিনোজের মার্কা মারা রয়েছে দেখছি। তৃতীয় কামরায় পৌঁছতেই এটন তাকে দেখে হাঁটুগেড়ে সম্মান জানাল।

আরও অবাক লাগছে তায়তা, আমার রাজপ্রসাদের পরিচালকও দেখছি তোমার এই গোপন ক্রিয়াকলাপের সাথে নিজেকে জড়িয়েছেন। তারপর ফারাও একটা কাঠের বাক্সের উপর বসে দুপা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, এবার বল তায়তা। সবকিছু খুলে বল।

আমি বললাম, তার চেয়ে ভালো হবে জিনিসটা আপনাকে দেখালে। তারপর আমি একটা বাক্সের ডালা খুলে চকচকে রূপার একটা পিণ্ড বের করে এক হাঁটু গেড়ে বসে রূপার পিন্ডটা তার হাতে তুলে দিলাম। তিনি জিনিসটা আমার হাত থেকে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। আঙুলের ডগা দিয়ে ধাতুর উপর ছাপমারা চিহ্নটার উপর বুলিয়ে দেখলেন। ক্রিটের প্রতীক আক্রমণোদ্যত ষাঁড়ের মূর্তি আঁকা রয়েছে।

তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, জিনিসটার চেহারা আর ওজন দেখেতো মনে হচ্ছে আসল রূপা। আসলেই কি তাই?

অবশ্যই এটা তাই ফারাও। এখানে আপনি যে-কটি সিন্দুক দেখছেন তার সবকটি এই রূপার বাটে ভরা।

আবার বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলেন। তার ধূলিধূসরিত মুখের নিচে আমি দেখতে পেলাম প্রচণ্ড আবেগ। তারপর রুদ্ধকণ্ঠে বললেন।

এখানে কতটুকু আছে তাতা? এবার তিনি আমার সেই ছোটবেলাকার পুরোনো নাম ব্যবহার করলেন। যখনই আমার প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন তখন এই নামে ডাকতেন।

আমিও আবার তার শিশুকালের নামে ডেকে বললাম, প্রত্যেকটা সিন্দুক ভরা, মেম। আমি ছাড়া আর কারও এই নামে ডাকার অধিকার নেই।

এসব কথা ছেড়ে আসল কথা বল তায়তা। বল কতটুকু রূপা তুমি আমার জন্য এনেছ? তার গলায় বিস্ময়ের সুর।

আমি উত্তর দিলাম, এটন আর আমি দুজনে মিলে এর বেশিরভাগ অংশ ওজন করেছি।

এতে আমার কথার উত্তর পাওয়া গেল না তাতা।

আমরা প্রথম দুটি জাহাজের পুরো অংশ আর তৃতীয়টার কিছু অংশ ওজন দিয়েছি। হিসেব করে মোট চার শো ঊনপঞ্চাশ লাখ পাওয়া গেছে। সম্ভবত আরও এক লাখের ওজন নিতে হবে। অবশ্য দেড়লাখও হতে পারে।

আবার তিনি চুপ করে মাথা নেড়ে ভ্ৰ কুঁচকালেন। তারপর বললেন, প্রায় ছয়শো লাখ। এতে থিবসের চেয়ে দ্বিগুণ বড় একটা নগরী গড়ে তোলা যাবে এর সমস্ত মন্দির আর প্রাসাদসহ।

একমত হয়ে আমিও মৃদুকণ্ঠে বললাম, আর দশ হাজার জাহাজ নির্মাণ করার পরও বেশ কয়েকটা যুদ্ধের খরচ যোগানোর মতো যথেষ্ট রূপা রয়ে যাবে মহামান্য ফারাও। এই পরিমাণ সম্পদ দিয়ে আপনি বর্বর হাইকসোদের কবল থেকে মিসরকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।

বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরে ফারাও একমত হলেন, আবেগে তার কণ্ঠস্বর উঠানামা করতে লাগলো, তুমি আমাকে প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়েছ, যা দিয়ে আমি বিওন আর তার পুরো শক্তি ধ্বংস করতে পারবো।

এটন উঠে আমাকে আড়াল করে ফারাওয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন ফারাও। হাইকসোর বিওন ইতোমধ্যেই পানিতে ডুবে মরেছে। তারপর এক পাশে সরে গিয়ে আমার দিকে আঙুল তুলে বললো, তায়তা তাকে মেরে ফেলেছে।

এবার ফারাও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটন যা বললো তা সত্যি? দেশের জন্য এতোকিছু করার পর তুমি বিওনকেও মেরে ফেলেছে?

আমি মাথা ঝুঁকে সায় দিলাম। গর্ব করাটা আমি ঘৃণা করি, বিশেষত আমার নিজের মধ্যে তা নেই।

সবকিছু খুলে বল তায়তা। ঐ দানবকে কীভাবে মারলে তার সবকিছু আমি জানতে চাই।

আমি উত্তর দেবার আগেই এটন মাঝখান থেকে বলে উঠলো, দয়া করে আর একবার আমার কথা শুনুন ফারাও। তারপর সে রাজার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, এই কাহিনী আপনার পুরো রাজদরবারের সবার শোনা উচিত। জালিম হাইকসোদের উপর পূর্ণ বিজয়ের পর এটা আমাদের গৌরবময় সামরিক ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সন্তানদের এই কাহিনী শোনাবে। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আজ বিকেলে একটা বিজয়োৎসবের আয়োজন করবো। এতে রাজ্যের সমস্ত সভাসদ আর রাজপরিবারের সমস্ত সদস্য উপস্থিত থাকবেন। আর এই বিজয়োৎসব আমাদের ইতিহাসের এমন একটি সামরিক বিজয়কে সম্মান জানাবে যা আর কখনও হয়নি।

আপনি ঠিক বলেছেন এটন। তায়তা আমার জন্য এমন একটি কাজ করেছে যার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। এই অভূতপূর্ব সৌভাগ্যের কথা আমি এখুনি আমার সভাসদদেরকে জানাবো। আটজন সভাসদ এখন থিবসেই আছেন। সেনাপতি ক্রাটাস শিঘ্রই উত্তর থেকে আসছেন। আর আপনারা দুজনেই আছেন। আশা করি তিন চার ঘন্টার মধ্যেই রাজদরবারের সমস্ত সদস্যকে একত্রিত করতে পারবো।

ফারাওয়ের পোশাকের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আমি বললাম, এই সময়ের মধ্যে মাহামান্য ফারাও স্নান সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারবেন।

ঠিক বলেছ তায়তা। তবে গায়ের এই ময়লা কিন্তু পরিশ্রম আর হাইকসোদের রক্তের মূল্যে হয়েছে। যাইহোক দাসদের বল স্নানের পানি গরম করতে।

.

মিসরের পুরো রাজদরবার এক হওয়ার আগেই তৃতীয় তিনতলা জাহাজটি থেকে সমস্ত রূপার বাঁট নামিয়ে এনে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হয়েছে। বিজয়োৎসবের প্রস্তুতি শেষ করার সাথে সাথে সূর্য অস্ত গেল।

আমি ফারাওকে খবরটা দিতে এলাম যে, অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত। প্রাসাদে ফিরে যাবার কষ্ট লাঘব করার জন্য আমি তার বাবার সমাধি কক্ষেই তার থাকার জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা করেছিলাম। এই কক্ষে কখনও কোনো মৃতদেহ আনা হয়নি, তাই এখানে মৃত্যুর গন্ধও নেই। শীতল এই জায়গাটি বেশ নীরব আর আরামদায়ক। তার দাসেরা তার জন্য বিছানা আর বহনযোগ্য কিছু আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করেছিল।

তবে কোনো ধরনের বিশ্রাম না নিয়ে তিনি কামরায় পায়চারি করছিলেন আর তার তিনজন সচিবকে পত্রের তলিপি করছিলেন। পরিষ্কার পোশাকের উপর বুকে পোলিশ করা ব্রোঞ্জের বর্ম পরেছেন। এর উপরে সোনার কাজ করা। পরিষ্কার আর আঁচড়ানো কোঁকড়ানো চুল দেখে তাকে তার মায়ের মতোই সুন্দর দেখাচ্ছিল।

আমি নতজানু হতেই আমার কাঁধে এক হাত রেখে বাধা দিয়ে বললেন, না তায়তা। আমার একান্ত ইচ্ছা তোমাকে একজন মহান সদস্য করে আমার ভেতরের সভাসদদের একজন করে নেওয়া। তুমি আর আমার সামনে নতজানু হবে না।

আমি আমার নিজস্ব ভূমিকা নিয়ে বললাম, ফারাও অত্যন্ত দয়াশীল। আমি এমন সম্মানের যোগ্য নই।

তিনি একমত হয়ে বললেন, অবশ্যই তুমি তা নও। তবে আমি শুধু আমার সামনে তোমার এই নিচু হওয়াটা বন্ধ করতে চাই। শেঠের দিব্যি দিয়ে বলছি, তোমার এই কাজ দেখলে আমার মাথা ঝিম ঝিম করে। সোজা হয়ে দাঁড়াও তারপর বল মোট কত রূপা আমার জন্য এনেছ।

আমি আপনাকে বলেছিলাম ৬০০ লাখ ফারাও। তবে গণনার পর এই পরিমাণ থেকে বিশ লাখ কম পাওয়া গেছে।

আমার রাজ্য ফিরে পাবার জন্য আর তোমার মাথা উঁচু করার জন্য এটা অনেক বেশি। দরবারের সবাই কি এসেছেন?

সেনাপতি ক্রাটাসসহ সকলেই এসেছেন। তিনি এক ঘন্টা আগে থিবসে পৌঁছেছেন।

আমাকে সেখানে নিয়ে চল।।

সমাধিক্ষেত্রের ফটক থেকে বের হতেই আমি বুঝতে পারলাম এটন আমার সম্মানে কী বিশাল আয়োজন করেছে। উৎসবের পোশাক পরা রাজকীয় রক্ষিবাহিনীর মধ্য দিয়ে ফারাও আমাকে নিয়ে খালের তীরে স্থাপন করা বিশাল তাঁবুর দিকে এগিয়ে চললেন।

সেখানে পৌঁছেই দেখলাম রাজদরবারের সকল সদস্য সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত রয়েছেন। সেখানে পুরো রাজপরিবার ছিল: তার দুই বোন, তার বাইশজন স্ত্রী আর ১১২ জন উপপত্নী। এছাড়া আরও ছিল অভিজাত সভাসদগণ, সেনাপতি, রাজ্য সদস্য আর অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারি।

আমরা ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়াল আর পুরুষরা তাদের তরবারি উঁচু করে আমার আর ফারাওয়ের যাওয়ার পথে একটা খিলান রচনা করলো। একইসাথে তাঁবুর বাইরে বাদকদল বীণা আর বাঁশির সমন্বয়ে একটি বিজয় সঙ্গীতের সুর বাজাতে শুরু করলো।

নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসতে আমাদের বেশ সময় লাগলো। সমবেত প্রত্যেকে চাচ্ছিল আমাকে স্পর্শ করতে, আমার হাত ধরতে আর আমাকে অভিনন্দন জানাতে।

তাঁবুর ভেতরের দেয়ালের চারপাশে একটু পর পর এক মানুষ সমান উঁচু বিরাট মদের পাত্র সাজানো রয়েছে। সবাই যার যার আসনে বসার পর ভৃত্যরা লম্বা জার থেকে বড় বড় গ্লাসে লাল মদ ভরে দিল। একটা বড় মদ ভর্তি গ্লাস ফারাওয়ের সামে রাখতেই তিনি হাত দিয়ে সেটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললেন।

এখানে আমরা তায়তাকে সম্বর্ধনা জানাতে এসেছি। তাকে ভালো লালমদ পরিবেশন কর, আজ গ্লাসে সেই প্রথম চুমুক দেবে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে ফারাওয়ের উদ্দেশ্যে তুলতেই বিশাল তাঁবুর মাঝে সবার চোখ তখন আমার দিকে ফিরলো।

সকল প্রশংসা ফারাওয়ের। তিনিই আমাদের মিসর। ফারাও আর মিসর ছাড়া আমরা কেবল ধূলোবালু। এছাড়া কোনো কিছুই সুন্দর নয়। তারপর গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বড় একটি চুমুক দিলাম। সমবেত নারীপুরুষ সবাই দাঁড়িয়ে আমার নামে হর্ষধ্বনি দিল। এমনকি ফারাও মৃদু হাসলেন।

আমি অনুভব করলাম আমি যত কম বলবো ওরা ততই আমাকে ভালোবাসবে, কাজেই আমি ফারাওয়ের উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে আমার আসনে বসে পড়লাম।

ফারাও উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত আমার কাঁধে রেখে পরিষ্কার দৃপ্ত কণ্ঠে তার বক্তব্য শুরু করলেন।

তিনি কেবল বললেন, সম্মানিত রাজ-সদস্য তায়তা আমাকে অনুগ্রহ করেছেন। তিনি আমার এবং মিসরের জন্য বিরাট একটি কাজ করেছেন, এতো বড় কাজ তার আগে আর কেউ করেনি। আমিসহ প্রত্যেক জীবিত মিসরীয় আর পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম গ্রহণ করবে তাদের সবার উচিত তাকে সম্মান জানানো।

আমি তাকে রাজকীয় উচ্চমর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছি। এখন থেকে তিনি মেসিরের জমিদার তায়তা নামে পরিচিত হবেন। একথা বলার পর ফারাও একটু থামলেন। সবাই ভদ্রভাবে নীরব হয়ে রয়েছে। মেসির হচ্ছে নীল নদীর পুবতীরে একটি গ্রাম। থিবস থেকে ৩০ লিগ দক্ষিণে। কতগুলো মাটির কুঁড়েঘর আর সাধারণ কিছু মানুষ সেখানে বসবাস করছে। ফারাও এই ধাঁধাটা নিয়ে সবাইকে কিছুক্ষণ ভাবতে দিলেন।

এছাড়া আমি তাকে চিরকালের জন্য নীলনদের পূর্বতীর আর থিবসের দক্ষিণ দেয়ালের মাঝে যত রাজকীয় জমিদারি আছে সব কিছুর মালিকানা তাকে দিলাম।

এটা শোনার পর সমবেত সবাই অবাক হল আর সকলের মধ্য থেকে একটা গুঞ্জন উঠলো। মেসিরের নদীর তীর থেকে থিবস পর্যন্ত ত্রিশ লিগ জমি হচ্ছে পুরো রাজকীয় জমিদারির মধ্যে সবচেয়ে উর্বর।

তার এই মহৎ কর্ম দেখে আমি হতবাক হলাম। যাইহোক তার ডান হাতে চুম্বন দেবার সময় আমার মনে একটা দুষ্ট চিন্তা জাগলো যে, যেহেতু আমি তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাজা বানিয়েছি কাজেই আমার প্রতি এই অনুগ্রহ দেখিয়ে তিনি কোনো মন্দ কাজ করেননি।

এবার ফারাও রূপার মদের গ্লাসটি হাতে তুলে নিয়ে সমবেত সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমার রানি, আমার রাজকুমার আর রাজকুমারি, সম্মানিত সভাসদ এবং ভদ্রমহিলাগণ, আমি তায়তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আর তার দীর্ঘ জীবন কামনা করে এই সুরা পান করছি।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পেয়ালা হাতে নিয়ে সমস্বরে বলে উঠলো, প্রভু তায়তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, সম্মান আর দীর্ঘজীবন কামনা করছি।

মিসরের ইতিহাসে এটা সম্ভবত প্রথম কোন ঘটনা যে, মিসরীয় একজন ফারাও তার এক প্রজাকে সম্মান দেখিয়ে পান করলেন। তারপর তিনি নিজ আসনে বসে সকলকে বসার ইঙ্গিত করলেন।

খ্যাতি সবসময় সবার জন্য আসে না। এটন ভালো তবে শ্রেষ্ঠ নয়। নীল নদের পার্চ মাছের যে কাটাহিন পেটি পরিবেশন করা হয়েছিল, তাতে লবণ কম ছিল। আর মরুভূমির পাখির মাংসের কাবাব বেশি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া রাজকীয় পাঁচককে সে বাহারাত মশলা খুব বেশি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিল। আমি হলে কাজটা আরও ভালো হত, যাই হোক মদটি মোটামুটি ভালো হওয়ায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

ভোজের পর যখন সবাই ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে তখন চারণকবির নাম ঘোষণা করার জন্য এটন উঠে দাঁড়াল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ জায়গায় আমি হলে কোন কবির নাম বলতাম। যেহেতু কবিতার বিষয়বস্তুই আমি নিজে, সুতরাং কবি পছন্দ করার কাজটা স্বভাবতই আমার করার কথা নয়। কাজেই আমি ধারণা করলাম রেজা কিংবা থোইয়াককেই এটন এই সম্মানসুচক কাজের জন্য বেছে নেবে।

কিন্তু সে সকলকে হতবাক করে দিল। প্রথমে সে মিসরের প্রখ্যাত চারণিকদের প্রশংসা করলো, তারপর বললো সে এমন একজনকে বেছে নিয়েছে যে আসল ঘটনার একজন চাক্ষুস সাক্ষী। অবশ্যই এটি একটি উদ্ভট চিন্তা। কখন এই ঘটনার বিবরণ একটা ভালো কাহিনীর উপাদান হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেছে?

মহান ফারাও এবং উপস্থিত রাজপরিবারের সম্মানিত নারী সদস্যগণ, অনুগ্রহ করে সামনে এগিয়ে আসুন আর নীল কুমির রক্ষীবাহিনীর একজন সাহসী সেনাকর্মকর্তার কথা শুনুন, যিনি প্রভু তায়তার সাথে সাগরপাড়ি দিয়েছিলেন। তারপর সে একটু থেমে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, এবার আসছেন ক্যাপ্টেন জারাস।

তাঁবুর পর্দা সরিয়ে জারাস ভেতরে ঢুকে ফারাওয়ের সামনে এসে নতজানু হল। সমবেত সকলেই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল, এমনকি অন্যান্যদের মতো ফারাও নিজেও অবাক হলেন। আমি ভেবেছিলাম সমবেত সবার মাঝে একমাত্র আমিই নীল কুমির রক্ষীবাহিনীর ক্যাপ্টেন জারাসকে চিনতাম। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা আমার মনে এলো।

আমি দ্রুত রাজকুমারী তেহুতির দিকে তাকালাম। সে সেনাপতি ক্রাটাস আর ফারাওয়ের কোষাধ্যক্ষ ম্যাডালেকের মাঝে বসেছিল। এখন সে টুলে বসে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে অত্যন্ত আগ্রহসহকারে আর উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে জারাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে এমন বোকা নয় যে, হাততালি দিয়ে বা তেমন কিছু করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যাতে বুঝা যায় যে, এটনের এই পছন্দে তার হাত আছে। তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম এটা তারই কাজ। যে কোনোভাবেই হোক সে এটনকে বাধ্য করেছে এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিতে।

আমি কখনও আমার দুই রাজকুমারির কূটনৈতিক দক্ষতাকে ছোট করে দেখিনি, কিন্তু এটা তো রীতিমতো ডাকিনীবিদ্যা। বেকাথার দিকে দৃষ্টি ফিরাবার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম সেও এতে জড়িত রয়েছে।

ভোজ টেবিলের উল্টোদিকে বসে সে চোখ ঘুরিয়ে আর নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে তার বড়বোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তেহুতি তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলেছে।

আমার বেশ রাগ হল। আবার জারাসের জন্য করুণাও হল। সে একজন চমৎকার যুবক, ভালো সৈনিক আর বাবা যেমন একজন ছেলেকে ভালোবাসে তেমনি তাকে আমি ভালোবাসতাম। আর এখন সে পুরো দুনিয়ার সামনে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুলতে যাচ্ছে। হৃদয়হীনা দুই রাজকীয় শৃগালী এই ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ফন্দী এঁটেছে।

জারাসের দিকে ফিরে তাকালাম। যে ভয়ঙ্কর বিপদে সে পড়তে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তাকে উদাসীন মনে হল। সৈনিকের সাজ পরে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল কিছু একটা করে তাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাই, কিন্তু আমি অসহায়। হয়তো একটা স্কুল ছাত্রের মতো হোঁচট খেতে খেতে সে আবৃত্তি করে যাবে, তবে তার সমস্ত প্রচেষ্টা এই কঠিন বিচারক কিংবা সমজদাররা রেজা কিংবা থোইয়াকের সাথে তুলনা করবে।

তারপর হঠাৎ আমি সচেতন হলাম মেয়েলি কণ্ঠের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, যেন আমার বাগানে বসন্তের ফুলের কেয়ারির উপর মৌমাছির ঝাঁক মধু আহরণ করতে করতে গুণগুণ করছে। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম শুধু তেতি নয়, আরও অনেক বয়স্ক মহিলাও খোলাখুলি তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। হাতপাখার আড়ালে ওরা মৃদু হাসছিল আর ফিসফিস করছিল। জারাস কখনও রাজদরবারে আসেনি, তাই ওরা কখনও ওদের কামুক নজর তার উপর ফেলতে পারেনি।

তারপর জারাস একবার কেশে প্রস্তুত হওয়ার ইঙ্গিত করতেই তাঁবুর মাঝে সবাই নিশ্চুপ হল। আমি দূরে মরুভূমি থেকে একটা শেয়ালের ডাক শুনতে পেলাম।

জারাস বলতে শুরু করলো। আমি জারাসকে যুদ্ধক্ষেত্রে তার অধীনস্থ লোকদেরকে নির্দেশ দিতে শুনেছি, কিন্তু কখনও তার কণ্ঠস্বরের গভীরতা কিংবা সুরেলা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনোকিছু বুঝতে পারিনি। তার কণ্ঠস্বর একটা ঘন্টাধ্বনির মতো আর মরুভূমির বালুর ঢিবির উপর উড়ে বেড়ানো পাখির মতো ভেসে উঠলো। সমুদ্রতীরের পাথরের গায়ে ঝড়ের মতো আছড়ে পড়লো, আর উঁচু সিডার গাছের শাখায় হাওয়ার ঝাঁপটার মতো শোনাল।

প্রথম কয়েকটা স্তবক বলেই সে সকলকে মোহাবিষ্ট করে ফেললো।

তার শব্দচয়ন ছিল অপূর্ব। এমনকি আমি নিজেও হয়তো তেমন করতে পারতাম না। তার সময়জ্ঞান আর বর্ণনা ছিল দুর্নিবার। জলদগম্ভীর স্বরে সে নীলনদের বন্যার পানির মতো সবকিছু ধুয়েমুছে নিয়ে চলেছে।

যখন আমি হাইকসো ভণ্ড বিওনকে তিনটি তীর ছুঁড়ে মেরে ফেড়ে ফেলেছিলাম, সেই তিনটি তীর ছোঁড়ার ঘটনার বর্ণনা দেবার সময় মিসরের সমস্ত সভাসদ আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে উল্লাসে হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠলেন। আর ফারাও এমন জোরে আমার বাহু চেপে ধরলেন যে, এরপর অনেকদিন তার দাগ রয়ে গিয়েছিল।

বাকি সবার সাথে আমি নিজেও হাসি আর কান্নার মাঝে রইলাম আর সবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলাম।

সমাপ্তিতে পৌঁছার সময় সে বিশাল প্রবেশ পথের দিকে ঘুরে দুই হাত দুই দিকে মেলে ধরে বলতে লাগলো।

তারপর মহান তায়তা মিসরের সমস্ত দেবতা আর ফারাও ত্যামোসের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কেঁদে বলতে শুরু করলেন, এটা কেবল সামান্য একটি নমুনা আমি আপনার জন্য অর্জন করেছি। সেই সম্পদের কেবল এক হাজার ভাগের একভাগ আমি আপনার সামনে হাজির করেছি। হে ফারাও ত্যামোস, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আর কর্তব্যের এটি একটি প্রমাণ।

বাইরে মরুভূমিতে একটি মাত্র ঢাক বাজতে শুরু করলো আর তাঁবুর প্রবেশ পথ দিয়ে শিরস্ত্রাণ আর বর্মপরা দশজন সৈন্য ভেতরে ঢুকলো। ওরা একটা কাঠের তক্তা বহন করে নিয়ে এলো, যার উপর কতগুলো চকচকে রূপার বাট পিরামিড আকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

সবাই একযোগে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশংসা আর হর্ষধ্বনি করতে লাগলো।

ওরা চিৎকার করে বলে উঠলো, জয় হোক ফারাও রাজার! সকল প্রশংসা তায়তার!

জারাসের বলা শেষ হওয়ার পর তাকে ওরা যেতে দিচ্ছিল না। ফারাও কয়েকমিনিট তার সাথে কথা বললেন। পুরুষেরা তার সাথে হাত মেলালো আর কেউ কেউ তার পিঠ চাপড়ালো। আর কয়েকজন মহিলা যারা মদ পান করেছিল তারা ফিক ফিক করে হেসে তার গায়ের সাথে বেড়ালের মতো নিজেদের গা ঘসতে লাগলো।

যখন সে আমার সামনে এলো, আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার প্রশংসা করে বললাম, খুব ভালো লিখেছ আর চমৎকার বলেছো, জারাস। তুমি একজন যোদ্ধা আবার একজন কবিও বটে।

সে উত্তরে বললো, আপনার মতো একজন বিখ্যাত কবির কাছ থেকে একথা শুনে আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে। আন্তরিকভাবে তার এই কথা বলাটা আমার মন ছুঁয়ে গেল। তারপর সে সমবেত দর্শকশ্রোতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললল। সবশেষে রাজকুমারি তেহুতির সামনে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল।

ওরা তাঁবুর অন্য প্রান্তে আমার কাছ থেকে বেশ দূরে ছিল। তবে কারও ঠোঁট নাড়া দেখে আমি তার কথা বুঝতে পারি, যেরকম একটা প্যাপিরাস থেকে পড়তে পারি।

তেহুতির প্রথম কথাটা ছিল, ধিক আপনাকে ক্যাপ্টেন জারাস! আপনার কবিতা শুনে আমার কান্না পেয়েছিল। তার এই কথার সাথে সাথে জারাস তার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো। তার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাই তার কথাও বুঝতে পারিনি। তবে তার কথা শুনে তেহুতি হেসে উঠলো।

আপনি একজন বীর, ক্যাপ্টেন। তবে এক শর্তে আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারি। তাহল, কথা দিতে হবে যে আরেকদিন আপনি আমাদেরকে গান গেয়ে শোনাবেন। একথার উত্তরে জারাস হয়তো সম্মতি জানিয়েছিল, তাই তেহুতি আবার বললো, তাহলে এই কথাই রইল। এরপর জারাস উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সম্মান দেখিয়ে পেছন দিকে হটলো।

হায় ঈশ্বর! আমি ভাবলাম! হায় রে বোকা ছেলে, ফিরে এসো ওখান থেকে। তুমি ওদের সমকক্ষ নও। যুদ্ধের ময়দান থেকেও ভয়ঙ্কর বিপদে তুমি এখন পড়েছ। কিন্তু তেহুতি আবার তাকে থামাল।

আমি ওর ঠোঁট নাড়া দেখে কথাগুলো বুঝতে পারলাম, কী ঝামেলা হল। আমার আংটিটা মনে হয় মাটিতে পড়ে গেছে। একটু আগেই এটা আমার আঙুলে ছিল। দয়া করে একটু খুঁজে দেখুন না ক্যাপ্টেন জারাস?

একাজ করার জন্য সে এক পায়ে খাড়া ছিল। তেতির সামনে আবার মাটিতে ঝুঁকে সে আংটিটা খুঁজতে শুরু করলো আর প্রায় সাথে সাথে ওটা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত সামনে বাড়িয়ে ধরে বললো, এটাই কি আপনার হারানো সেই আংটি, মহামান্য? এবার সে আমার দিকে একটু ঘুরে দাঁড়াতে আমি তার ঠোঁট নাড়া পড়তে পারছিলাম।

হ্যাঁ, এটাই তো। একজন বিশেষ মানুষ আমাকে এটা উপহার দিয়েছেন। যার প্রশংসা আজ সন্ধ্যায় আপনি করেছেন। তবে সে সাথে সাথে আংটিটা জারাসের হাত থেকে ফেরত নিল না।

আপনি প্রভু তায়তার কথা বলছেন?

সে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, অবশ্যই! আপনার হাতে ধরা আংটিটার পাথরটার দিকে তাকিয়ে দেখুন তো। দেখুন কী স্বচ্ছ।

কাছাকাছি একটা মশালের কাছে আংটিটা নিয়ে সে সায় দিয়ে বললো, পানির মতো পরিষ্কার। তেহুতি তাকে বাধ্য করলো আংটিটা খুঁটিয়ে দেখতে, তারপর সে হাত বাড়িয়ে বললো।

ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন জারাস। তারপর জারাস আংটিটা তেহুতির বাড়ানো হাতে তুলে দিতেই তেহুতি তার মুঠো বন্ধ করলো।

আমি মনে মনে ভাবলাম, আংটিটার মধ্যে কোনো যাদু না থাকলেও, রাজকুমারি তেহুতি, তোমার হাসিতে যে জাদু আছে তাতে মেমফিস আর থিবসের দেয়াল দুপাশ থেকে চেপে পিষ্ট করে ফেলতে পারবে। জারাসের মতো একজন অপরিপক্ক যুবক কী করে তোমার ছলনা ঠেকাতে পারবে?

.

এখন সবচেয়ে প্রথম আর জরুরী কাজটি হল, কোনো ধরনের চিহ্ন না রেখে এই বিশাল তিনটি ক্রেটান তিনতলা জাহাজ গায়েব করে ফেলা। সর্বাধিরাজ মিনোজের মনে যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকে যে, হাইকসো বিওনই তার রত্নভাণ্ডারসহ জাহাজগুলো চুরি করেছে। ক্রোধে সে উম্মুক্ত হয়ে যাবে যখন জানবে যে, তার কথিত মিত্ৰই আসল অপরাধী।

প্রথমে ভাবলাম জাহাজ তিনটা পুড়িয়ে ছাইগুলো নীলনদে ভাসিয়ে দিই। যাতে এগুলো অদৃশ্য হওয়ার রহস্যটা চিরকালের জন্য মুছে যায়। তারপর আবার বিপুল পরিমাণে কাঠ বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টা বিবেচনা করলাম।

মিসরে বনাঞ্চল খুব বেশি নেই। আমাদের কাছে কাঠ, সোনা রূপার মতোই মূল্যবান। এই বিপুল পরিমাণ কাঠ থেকে কতগুলো যুদ্ধ জাহাজ আর রথ তৈরি করা যাবে, এই বিষয়টা ভাবতেই এরকম দামি জিনিস পুড়িয়ে ফেলার চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম।

বিষয়টা নিয়ে ফারাও আর আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রভু কাটাসের সাথে আলোচনা করলাম।

ক্রাটাস বললো, কিন্তু তায়তা, মিসরের কোথায় তুমি এতো কাঠ লুকিয়ে রাখবে? এই কথাটা কি ভেবে দেখেছো?

ফারাও আমার পক্ষ নিয়ে বললেন, একটা বিষয় আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, ক্রাটাস। সেটা হল তায়তা নিশ্চয়ই তা ভেবে রেখেছে। তায়তা সবসময় সবকিছু ভেবে নিয়ে বলে।

আমি বিড়বিড় করে বললাম ফারাও আমার প্রতি অতি দয়াশীল। তবে আমি যথাসাধ্য বিনীতভাবে চেষ্টা করি। একথা শুনে ক্রাটাস হাসিতে ফেটে পড়লো।

ফারাও ঠিক বলেছেন। এ-বিষয়টা নিয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা আছে। তবে আসল কথা হচ্ছে রূপারর্বাটগুলো পাহারা দেবার জন্য আপনার দেবত্বপ্রাপ্ত বাবা প্রয়াত ফারাও ম্যামোজের শূন্য সমাধিতে পুরো এক পল্টন সৈন্য রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই সৈন্যদেরকে দুই কাজে ব্যবহার করা যাবে।

এবার ক্রাটাসও মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতে লাগলো।

ফারাও বললেন, বলে যাও।

দেখুন, আমি সমাধিকক্ষের পাশের কামরাগুলোর আয়তন আবার মেপে দেখেছি।

তিনতলা জাহাজগুলো ভেঙে যে কাঠের তক্তা পাওয়া যাবে সেগুলো সবই এই মাটির নিচের কুঠরিগুলোতে লুকিয়ে রাখা যাবে। তারপর সুবিধামতো যুদ্ধের প্রয়োজনে এগুলো আবার ব্যবহার করা যাবে। তারপর আমি ক্রাটাসের দিকে তাকিয়ে একটু টিটকারির সুরে বললাম, হয়তো প্রভু ক্রাটাসের এ-বিষয়ে আরও ভালো কোনো প্রস্তাব থাকতে পারে। তিনি হয়তো কাঠের তক্তাগুলো শুধু তার মুখের কথার ভারে লোহিত সাগরের নিচে ডুবিয়ে রাখতে পারবেন।

কিন্তু ক্রাটাস হাসতে হাসতে গর্জন করে বললো, তায়তা, তুমি আমার সাথে ভালোই রসিকতা করলে।

অর্ধেক পল্টন সৈন্যের কয়েক সপ্তাহ খাটুনির পর জাহাজগুলোর সমস্ত তক্তা খুলে প্রতিটার গায়ে সংখ্যা দেওয়ার পর মাটির নিচের কামরাগুলোয় সাজিয়ে রাখা হল। শেষপর্যন্ত আমার কৌশল কাজে লেগে গেল, বিশাল জাহাজগুলো সম্পূর্ণরূপে গায়েব হয়ে গেল।

এতে অবশ্য অতিরিক্ত একটা ঝামেলা এড়ানোর কাজের সুবিধা পেলাম। ফারাওকে দিয়ে আমি জারাসকে এই জাহাজ ভাঙার কাজের নেতৃত্বের ভার দিয়েছিলাম। কড়া নির্দেশ ছিল সম্পূর্ণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে এই সমাধি এলাকার মধ্যেই থাকতে হবে। কাজেই যখন দুই রাজকুমারি, তেহুতি আর বেকাথা তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো তখন আমি ভালোমানুষের মতো বলতে পারলাম যে, ফারাও তাকে একটি গোপন সামরিক অভিযানে পাঠিয়েছেন। তার ফিরতেও আরও বেশ কিছুদিন লাগবে।

হাইকসো যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও থিবসের রাজপ্রাসাদ জারাসের জন্য অনেক ভয়ঙ্কর। আমি রাতে শুয়ে আমার অনুগ্রহভাজন এই ছেলেটির কথা ভেবে আতঙ্কে ঘামতে লাগলাম। তাকে আমি একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবতাম, যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, এছাড়াও সে ছিল একজন অকুতোভয় সেনানায়ক, একজন শিক্ষিত মানুষ আর এখন নিজেকে একজন কবি হিসেবে পরিচিত করেছে। আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তবে তার সমবয়সী অন্যান্য যুবকের মতো তার মধ্যেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে যা সে এড়াতে পারে না।

আমি এটাও জানতাম একজন যুবতি মেয়ের কামনা তাকে কী রকম নির্মম আর বেপরোয়া করে ফেলে। তাকে প্রথম দেখার সাথে সাথে আমার আদরের তেহুতির দেহ-মনে আগুন জ্বেলেছে। এই আগুন নেভাবার আর কোনো পথ আমি ভেবে পেলাম না।

৩. একের পর এক পরিস্থিতি

 

থিবিসে ফেরার এরপরের দিনগুলোতে পর একের পর এক পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে জড়িয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

হাইকসো আর সর্বাধিরাজ মিনোজের মধ্যে যে রাজনৈতিক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ফারাও সর্বক্ষণ আমাকে তার কাছে থাকতে বাধ্য করলেন।

পরিস্থিতির গুরুত্ব আর বিপদ বিবেচনা করে এটন আর আমি একমত হলাম যে, আমাদের সমস্ত গোয়েন্দা অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর এখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিরতী ঘোষণা করে সাময়িকভাবে একে অন্যের সহযোগিতা করতে হবে। নিজেদের বাঁচামরা আর মিসরের অস্তিত্ব রাখার প্রয়োজনে আমাদের এটা করতে হবে।

উত্তর দিক থেকে তথ্য আর খবরাখবর বয়ে নিয়ে আসা নাম না জানা বিভিন্ন নারী পুরুষ সারারাত আমাদের আলাদা আলাদা দরজা দিয়ে ঢুকে আবার অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে লাগলো। এছাড়া সংবাদবাহক কবুতরও সংবাদ নিয়ে আসতে লাগলো।

এটন আর আমি গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিটা তথ্য সাবধানে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর ফারাও আর তার নিজস্ব কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাতাম।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজা বিওনের শবদাহ করার খবরটি। আমি তীর ছুঁড়ে তাকে মেমফিসের একটু আগে নীল নদীতে মেরে ফেলেছিলাম। বর্বর হাইকমোরা তাদের নিহত বীরদের দেহ আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতো, ওরা আমাদের মতো উন্নত আর সভ্য জাতির মত মৃতদেহ মমি করতো না।

আর একই সাথে ওরা তাদের দানবীয় দেবতা শেঠকে খুশি করার জন্য নরবলিও দিত। এটন আর আমি জানতে পারলাম ওরা একশো বন্দী মিসরীয় যোদ্ধাকে জীবন্ত অবস্থায় রাজা বিওনের চিতায় ছুঁড়ে পুড়িয়ে মেরেছে। তারপর বিওনের পরবর্তী জীবনের আনন্দের সঙ্গী হিসেবে আরও একশো কুমারীকেও একই চিতায় পুড়িয়ে মেরেছে।

থিবসে একমাত্র আমিই প্রথম খবর পেলাম যে বিওনের শবদাহ সম্পন্ন করার পর তার ভাই গোরাব হাইকসোদের নতুন রাজা হয়েছে।

গোরাবের প্রথম চিন্তা ছিল তার বড়ভাইয়ের মৃত্যু প্রতিশোধ নেওয়া। শেখ আবাদা আর আসিউতের মাঝের সীমান্তে মিসরীয় বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান করা তার প্রথম সারির সেনাবাহিনী থেকে সে দশ হাজার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিল। গোরাবের এই সিদ্ধান্ত মিসরের জন্য আনন্দের বিষয় ছিল। সম্পূর্ণ সীমান্তে ফারাওকে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। এখন পর্যন্ত বিওনের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও মিসরীয় পক্ষেও কম প্রাণহানি হয়নি।

এখন ফারাওয়ের উপর থেকে চাপটা কমে যাওয়াতে তিনি তার অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ পেলেন আর এদিকে গোরাব তার একচতুর্থাংশ সেনাকে উত্তরে তামিয়াতে আমার ফেলে আসা অক্ষত ক্রেটান সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিল।

গোরাব তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ছিল। সেসময়ে সে রাজকীয় বজরায় রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক ছিল। সে দেখেছে কীভাবে ক্রিটের তিনটি তিনতলা জাহাজ তাদের উপর চড়াও হয়েছিল আর সে এও লক্ষ্য করেছিল মিনোয়ান সেনাবাহিনীর পোশাক পরা সেনাকর্মকর্তা আর সৈন্যরা সেই অকারণ আর বিশ্বাসঘাতক হামলা চালিয়েছিল।

গোরাব দেখেছে যখন তার বড়ভাই পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, তখন একজন ক্রেটান তিরন্দাজ তার নিরস্ত্র ভাইকে তিনটি তীর ছুঁড়ে মেড়েছিল। তারপর সে তীরবিদ্ধ রাজা বিওনের মৃতদেহ পানি থেকে তুলে এনে চিতায় মশাল দিয়ে আগুন দেবার সময় কাঁদছিল। এরপর সে নিজহাতে হাইকসো রাজমুকুট মাথায় পরে ক্রিটের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

ক্রিটের বিরুদ্ধে গোরাবের যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা শুনে এটন আর আমি উল্লসিত হলাম। গুপ্তচরদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম, আমি যে ছোট জাহাজটি তামিয়াতে রেখে এসেছিলাম, তাতে করে ক্রিটের উচ্চপদস্থ কয়েকজন সেনাকর্মকর্তা ক্রিটে ফিরে গিয়েছে। ছোট জাহাজটিতে চল্লিশজনের বেশি মানুষের জায়গা না হওয়ায় বাকিরা তামিয়াতেই রয়ে গিয়েছিল। জাহাজটি ক্রিটে পৌঁছার পর তাদের অধিনায়ক তামিয়াত দুর্গে হাইকসোদের অতর্কিত হামলা আর পুরো সম্পদসহ তিনটি বিশাল জাহাজ লুট করে নিয়ে যাওয়ার কথা সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছে সবিস্তারে খুলে বললো। সে আরও জানালো জলদস্যুরা তাদের পরিচয় গোপন করার কোনো চেষ্টাই করেনি। তারা পুরোপুরি হাইকসো সেনা-পোশাক পরেছিল আর সে তাদেরকে হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শুনেছে।

সর্বাধিরাজ মিনোজ সাথে সাথে তামিয়াতে আটকে পড়া বাদবাকি দুই হাজার ক্রেটান সৈন্য উদ্ধার করতে একটি রণতরী-বহর তামিয়াতে পাঠালেন। তবে জাহাজগুলো অনেক দেরিতে সেখানে পৌঁছালো।

তার আগেই রাজা গোরাব তার দশ হাজার সৈন্য নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ক্রেটানরা প্রাণপণ চেষ্টা করলো বাধা দিতে, কিন্তু গোরাব অধিকাংশ ক্রেটান সেনা হত্যা করলো। যারা বেঁচে ছিল তারা আত্মসমর্পণ করলো, গোরাব তাদের সবার মাথা কেটে নিয়ে কাটা মুণ্ডগুলো দিয়ে একটা পিরামিড বানিয়ে দুর্গের নিচে জেটিতে সাজিয়ে রাখলো। গোরাব চলে যাবার পর ক্রেটান রণতরীগুলো সেখানে পৌঁছে দেখতে পেল পিকৃত মানুষের মাথাগুলো রোদে পঁচছে আর শকুন সেগুলো ঠোকড়াচ্ছে। ওরা ফিরে গিয়ে সর্বাধিরাজ মিনোজকে সংবাদটি জানাল।

সর্বাধিরাজ মিনোজ তার দেবতার বেদিতে দাঁড়িয়ে এর প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করলেন। তারপর যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে পুরো উত্তর আফ্রিকার উপকূল জুড়ে সমস্ত হাইকসো বন্দর আর নৌঘাটির উপর হামলা চালিয়ে সবকিছু তছনছ করতে লাগলেন।

এদিকে রাজা বিওনও উত্তর মিসরে তার অধীনস্থ এলাকায় বসবাস করা সকল মিনোয়ানদের উপর হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নিতে শুরু করলো। মিনোয়ানরা পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান জাতি। এরা সবধরনের শিল্পকর্ম আর ব্যবসা বাণিজ্যে পটু ছিল। তবে ওরা অন্যান্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। যেখানেই কোনো লাভের সুযোগ সেখানেই ওরা এসে হাজির হত।

এছাড়া আর কীভাবে ক্রিটের মতো ছোট্ট একটি দ্বীপের অধিবাসীরা মধ্য সাগরের চতুর্দিকের স্থানগুলোতে প্রধান শক্তি হতে পেরেছিল?

উত্তর মিসরে কয়েক হাজার মিনোয়ান বসবাস করতো। রাজা গোরাব সমস্ত শক্তি আর নিষ্ঠুরতা নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের উপর চড়াও হল। ওরা মিনোয়ানদের ঘর থেকে টেনে বের করে আনলো। নারী আর এমনকি কমবয়সী মেয়েদেরকেও ধর্ষণ করলো। তারপর নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সকলকে মিনোয়ান মন্দিরে আটকে রেখে আগুনে পুড়িয়ে মারলো।

কেউ কেউ দেশ থেকে পালাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খুব কমসংখ্যক মিনোয়ান সফল হল। যারা মধ্য সাগরের উপকূলের কাছাকাছি শহর আর বন্দরগুলোতে বসবাস করতো, তাদের মধ্যে সৌভাগ্যবান কিছু মিনোয়ানকে সর্বাধিরাজ মিনোজের জাহাজ উদ্ধার করলো। অন্যান্য যারা বেশি ভেতরে থাকতো তারা আরও ভেতরে মিসরের চারপাশের মরুভূমিতে পালিয়ে গেল। সেখানে পিপাসায় কাতর হয়ে আর নৃশংস বেদুঈনদের হামলায় ওরাও মারা গেল।

যাইহোক কয়েকশো মিনোয়ান পরিবার দক্ষিণের মেমফিস আর আসিউত থেকে পালিয়ে হাইকসো রথ এড়িয়ে আমাদের যুদ্ধ সীমান্তরেখা পর্যন্ত পৌঁছলো। সেখানে সেনাপতি ক্রাটাসের নির্দেশে আমাদের লোকজন শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে সদয় ব্যবহার করলো।

এই খবর শোনার সাথে সাথে আমি ঘোড়ায় চড়ে যত দ্রুত সম্ভব হাইকসোদের মুখোমুখি আমাদের সীমান্ত বাহিনীর কাছে গেলাম।

এই বাহিনীর কয়েকজন পদস্থ সেনাকর্মকর্তাকে আমি অনেক আগে থেকে চিনতাম। ওরা আমার কাছেই বিজ্ঞান, যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিল আর আমার সুপারিশেই ওরা বর্তমান সামরিক পদবী লাভ করতে পেরেছিল।

এদের মধ্যে সেনাপতি রেমরেমকে থিবসের যুদ্ধ ক্ষেত্রেই ফারাও সম্মানিত করেছিলেন আর এখন সে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ক্রাটাসের অধীনে একটি পল্টনের অধীনায়কত্ব করছে।

আমি যখন হুইকে পাকড়াও করি তখন সে ছিল একজন অপরাধী আর এখন সে পাঁচশো রথীর এক ঊর্ধ্বতন অধিনায়ক। পুরোনো এইসব বন্ধু আর পরিচিতরা আমাকে তাদের শিবিরে পেয়ে খুব খুশি হল, এমনকি সেই তিরষ্কারযোগ্য অত্যন্ত দুশ্চরিত্র বুড়ো সর্বাধিনায়ক ক্রাটাসও। সন্ধ্যায় জেনারেল ক্রাটাস আমাকে মদ খাইয়ে মাতাল করার চেষ্টা করলো। পরে আমিই তাকে কোলে করে তার বিছানায় নিয়ে গেলাম আর যখন সে বমি করে সব বের করছিল তখন আমিই তার মাথা ধরে রেখেছিলাম।

পরদিন সকালে সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার অধীনস্থ এক কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিল যেসব শরণার্থী রাজা গোরাবের কবল থেকে বেঁচে পালিয়ে এসেছে, তাদেরকে আমার সামনে হাজির করার জন্য।

হতভাগ্য এই চল্লিশজন মানুষ কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে, সাথে কিছুই আনতে পারেনি। তাদের পরিবারের কাউকে না কাউকে হাইকসোরা হত্যা করেছে।

সারিবদ্ধ লোকগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলাম, সম্মান দেখিয়ে মাঝে মাঝে দুএকটা প্রশ্ন করলাম।

সারির একেবারে শেষ মাথায় তিনজনের একটি পরিবার জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরিবারটির কর্তা আমিথায়ন থেমে থেমে মিসরীয় ভাষায় কথা বললো। তিন সপ্তাহ আগে সে মেমফিসে শস্য, মদ আর চামড়ার ব্যবসা করতো। সফল এই ব্যবসায়ীর নাম আমিও এতদুর থেকে আমার লোকজনের কাছে শুনেছিলাম। হাইকমোরা তার বাড়িঘর আর গুদাম পুড়িয়ে ফেলে আর তার স্ত্রীকে তার চোখের সামনেই ধর্ষণ করেছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মহিলাটি সেখানেই মারা যায়।

তার উনিশ বছর বয়সি ছেলেটির নাম ইকারিওন। তাকে দেখার সাথে সাথেই আমার ভালো লাগলো। লম্বাচওড়া বলিষ্ঠ গড়ন। ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল আর সুন্দর মুখ। এতে ঘটনার পর তার বাবার মতো সে এতোটা ভেঙে পড়েনি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নিশ্চয়ই তোমার নিজের হাতে বানানো ডানায় ভর করে উড়ে এসেছো?

ইকারিওন হেসে উত্তর দিল, অবশ্যই। তবে আমি সূর্য থেকে অনেক দূরে ছিলাম প্রভু। তার নাম নিয়ে আমার রসিকতা করাটা সে ঠিকই বুঝেছিল।

তুমি কি লেখাপড়া জান ইকারিওন?

হ্যাঁ জানি। তবে আমার বোনের মত তেমন পছন্দ করি না।

আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম, সে তার বাপভাইয়ের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দর। লম্বা কালো চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল মুখ। তবে আমার রাজকুমারিদের মতো সুন্দর নয়। অবশ্য সুন্দর চেহারা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না।

প্রায় তেহুতির সমবয়সী মেয়েটি বললো, আমার নাম লক্সিয়াস, বয়স পনেরো। পরিষ্কার মিসরী ভাষায় সে কথাগুলো বললো, যেন সে জন্মসুত্রে একজন মিসরী।

তুমি কি লিখতে পার লক্সিয়াস?

হ্যাঁ পারি প্রভু। প্রাচীন পারসিক কুনিলিপি, মিসরীয় গূঢ়লিপি আর মিনোয়ন লিপি–তিন পদ্ধতিতেই লিখতে পারি।

তার বাবা আমিথায়ন মাঝখান থেকে বলে উঠলো, সে আমার ব্যবসার হিসাবপত্র আর চিঠিপত্র লেখার কাজ করতো। খুবই বুদ্ধিমতি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে মিনোয়ান ভাষা শেখাতে পারবে?

কয়েকমুহূর্ত ভেবে সে বললো, পিরবো, তবে এটা নির্ভর করবে আপনার শেখার ক্ষমতার উপর প্রভু তায়তা। মিনোয়ান সহজ ভাষা নয়। আমি লক্ষ্য করলাম সে আমার পুরো নাম আর উপাধি ব্যবহার করেছে। এতে বোঝা গেল মেয়েটি আসলেই বুদ্ধিমতি।

আমি তাকে আহ্বান জানিয়ে বললাম, একবার আমাকে পরীক্ষা করে দেখো। মিনোয়ান ভাষায় কিছু একটা বল।

সে রাজি হয়ে বললো, ঠিক আছে। তারপর সে মিনোয়ান ভাষায় দীর্ঘ একটা বাক্য উচ্চারণ করলো।

আমি তা পুনরুক্তি করলাম। শব্দ শুনে মনে রাখার আমার একজন। সংগীতশিল্পির মতো কান ছিল। যেকোনো মানুষের কথা শুনলে আমি তা সহজেই নকল করে বলতে পারি। এই ক্ষেত্রে আমি কী বলছি সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না তবে যা আমি বলেছিলাম তা সঠিকভাবেই বলেছিলাম। ওরা তিনজনেই আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকাল আর লক্সিয়াসের মুখ বিরক্তিতে লাল হল।

সে আমাকে বললো, আপনি আমার সাথে তামাসা করছেন প্রভু তায়তা। আমার আপনাকে শেখাবার প্রয়োজন নেই। আপনি আমার মতোই বলতে পারেন। কোথায় শিখেছেন এই ভাষা? আমি কোনো উত্তর না দিয়ে একটা রহস্যময় হাসি হেসে চলে এলাম।

হুইয়ের কাছ থেকে চারটি ঘোড়া ধার নিয়ে আমরা চারজন সেদিনই দক্ষিণে থিবসের পথে রওয়ানা দিলাম। ছোট এই পরিবারটির জন্য আমি শহরের দেয়ালের বাইরে মেশির নামে যে নতুন ভূ-সম্পত্তি লাভ করেছি তার একটি ছোট গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম।

প্রতিদিন কয়েকঘন্টা লক্সিয়াসের কাছে মিনোয়ান ভাষা শেখা শুরু করলাম। কয়েক মাসের মধ্যেই লক্সিয়াস বললো, আমাকে আর শেখাবার। মতো তার কাছে আর কিছু নেই।

ছাত্র তার শিক্ষকের চেয়ে বেশি জেনেছে। আমার মনে হয় আপনি বরং আমাকে কিছু শেখাতে পারেন প্রভু তায়তা।

আমার দুই রাজকুমারী আমার মতো এতো আগ্রহী ছাত্রী ছিল না। প্রথমে ওরা দুজনেই গোঁ ধরে জানাল, মিনোয়ান ভাষার মতো এমন একটি নীরস আর গেঁয়ো ভাষার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাছাড়া একটা মিনোয়ান চাষির মেয়ের সাথেও তাদের কোনো কাজ-কারবার নেই। ওরা জানাল এটাই ওদের দুজনের শেষ কথা। তেহুতি বলে চললো আর বেকাথা পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চললো।

আমি ওদের বড় ভাই ফারাও ত্যামোসের সাথে এ-বিষয়ে কথা বলতে গেলাম। আমি তাকে জানালাম আমাদের মিসরীদেরকে ক্রিটের সাথে সদ্য বেড়ে ওঠা সম্পর্ক থেকে সুবিধা নিতে হবে। আর এর অনেক কিছুই নির্ভর করছে আমাদের দুই রাজকুমারীর সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার রাজদরবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করার উপর। তারপর তাকে জানালাম তার বোনদের বিষয়ে আমি কী পরিকল্পনা করেছি।

ফারাও তার দুই বিদ্রোহী ছোট বোনকে ডেকে অনেকক্ষণ তাদের সাথে বিতর্ক করলেন। অবশ্য এই একতরফা বিতর্ক এমন কড়াভাবে করলেন আর এমন ভয় দেখালেন যে আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম যে তিনি হয়তো আসলেই তা করবেন। রাজকুমারীরা এরপর তাদের শেষ সিদ্ধান্ত পাল্টালো। তবে এরপর বেশ কিছুদিন আমার সাথে মুখভার করে রইল।

তবে বেশিদিন এই মুখভার রইল না, যখন আমি ওদের জন্য একটা পুরষ্কার ঘোষণা করলাম। প্রতি সপ্তাহ শেষে তাদের নতুন ভাষা শিক্ষক লক্সিয়াসের মতে যে বেশি উন্নতি করবে তাকে এই পুরষ্কার দেওয়া হবে। পুরষ্কারগুলো ছিল মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় জিনিস। এমিথায়ন শহরের বাজার থেকে আমার জন্য এগুলো খুঁজে আনতো।

কিছুদিনের মধ্যেই ওরা পরিষ্কার মিনোয়ান ভাষায় বক বক আর তর্কবিতর্ক শুরু করলো। আর লক্সিয়াস ওদেরকে সরাইখানা আর বস্তির উপযোগী কথ্য ভাষা শেখাল। কয়েক মাস পর এই তিনকন্যা এই সমস্ত কথা শব্দ উচ্চারণ করে আমাকে অবাক করে দিতে শুরু করলো।

এরপর ঐ ত্রিমূর্তি পরস্পরের এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো যে ওদের সাথে থাকার জন্য রাজকুমারীরা লক্সিয়াসকে রাজকীয় হেরেমে নিয়ে এলো।

.

মেশির জমিদারির মালিকানার পাওয়ার পর মাঝে মাঝে আমি রাজপ্রাসাদ  থেকে মুক্তি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতাম। সাথে দুই রাজকুমারী আর তাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী লক্সিয়াসও থাকতো। আমি ওদেরকে দুই পা দুইদিকে ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চড়া শেখালাম। এটা যেকোনো মিসরী নারী পুরুষের জন্য একটা কৃতিত্বপূর্ণ কাজ, বিশেষত ফারাওয়ের বোনদের জন্যতো বটেই।

এছাড়া আমি তিনকন্যার জন্য ওদের সামর্থ্য অনুযায়ী ধনুক বানিয়ে দিলাম। তীর ছোঁড়া শিখে নেবার পর ওরা ধনুকের ছিলা ঠোঁট পর্যন্ত টেনে আনতে পারতো আর একশো পা দূরত্বে ওদের জন্য যে লক্ষ্য আমি স্থির করে দিয়েছিলাম, সেই লক্ষ্যে তিনটির মধ্যে দুটো তীর লাগাতে পারতো। তীর ছোঁড়ার খেলায় আমি ওদের উৎসাহ যোগাতাম আর দিনের শেষে সবচেয়ে চৌকশ নারী তিরন্দাজের জন্য ভালো পুরস্কারের ব্যবস্থা করলাম।

আমার লোকেরা যখন জমিতে ফসলের বীজ বুনতো তখন ঝাঁকে ঝাঁকে বন্য পাখি এসে বীজগুলো খেয়ে ফেলতো। তীর ছুঁড়ে শিকারের জন্য প্রতিটি পাখি বাবদ আমি মেয়েদেরকে অতিরিক্ত উপহার দিতে শুরু করলাম। শিঘ্রই ওরা প্রত্যেকে দক্ষ শিকারীতে পরিণত হল।

আমি জানতাম ঘোড়ায় চড়া আর তীর ছোঁড়ার দক্ষতা পরবর্তী জীবনে ওদের খুব কাজে আসবে।

যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম আমার দুই রাজকুমারীর সাথে ভালো সময় কাটাতে কেননা একবার রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলে ফারাওয়ের কাজে আমাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হত। এমন কোনো দিন ছিল না যে কোনো না কোনো সমস্যা সমাধানে কিংবা কোনো বিষয়ে তাকে আমার উপদেশ কিংবা মতামত না দিতে হত। আমার কোনো মতামত তিনি প্রত্যাখান করলে আমি কিছুই মনে করতাম না, কেননা আমি জানি একটু পরেই একই বিষয়ে আমার মতকেই তিনি তার নিজের মত হিসেবে চালাবেন।

.

এসময়ে আমি আরেকটি সমস্যার সম্মুখিন হলাম। তামিয়াত দুর্গ থেকে ফারাও ত্যামোসের জন্য যে সম্পদ এনেছিলাম তার যথাযথ ব্যবহার কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করে এখনও কোনো উপায় বের করতে পারিনি।

ফারাও অবশ্য এই সম্পদ তার প্রজাদের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য উগ্রীব ছিলেন। তবে আমি ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের ছাপ মারা রূপার বাঁট দিয়ে জাতীয় ঋণ পরিশোধ করা থেকে তাকে বিরত রেখেছিলাম।

আমি তাকে বললাম, হে মহান ফারাও, আপনি আর আমি দুজনেই জানি মিনোয়ান গুপ্তচরেরা আমাদের মিসরের প্রত্যেক নগরে রয়েছে। ওদের যে কারও খুব বেশি সময় লাগবে না ক্রিটে খবর পাঠাতে যে থিবসের প্রতিটি দোকান আর সরাইখানায় ক্রিটের ষাঁড়ের প্রতাঁকের ছাপমারা রূপার বাঁটে ছেয়ে গেছে।

ফারাও আঙুল তুলে তার বাবার সমাধিক্ষেত্রের দিকে নির্দেশ করে তিক্ত স্বরে বললেন, তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছ যদি কোনোভাবে মিনোয়ানরা এই সম্পদের কথা জেনে ফেলে সেক্ষেত্রে এই কোষাগারের সম্পদ আমি কখনও খরচ করতে পারবো না?

আমাকে মার্জনা করুন মহামান্য মিসর অধিপতি। আপনি মিসরীয় জাতির পিতা। এই সম্পদ আপনার, যেভাবে ইচ্ছা আপনি এটা খরচ করতে পারেন। তবে তার আগে এর চেহারা এমনভাবে বদলে নিতে হবে যেন, জীবিত কোনো মানুষ বিশেষত সর্বাধিরাজ মিনোজ যেন এটা চিনতে না পারে।

এবার তিনি একটু সুর নরম করে বললেন, সেটা কীভাবে সম্ভব তায়তা?

আমাদেরকে প্রতিটা রূপার বাট ভেঙে অর্ধেক ডেবেন সমান ওজনের ছোট ছোট মুদ্রার টুকরা তৈরি করতে হবে। তারপর প্রতি টুকরা মুদ্রার উপর আপনার মুখের ছবির ছাপ মারতে হবে।

এবার ফারাও বিড়বিড় করে বললেন, হুমম! তাহলে তা আমার এই রূপার নতুন মুদ্রার নাম কী হবে? আমি জানতাম তার নিজের ছবি রূপার ছোট টুকরাগুলোর উপর থাকার কথা শুনে ফারাও খুশি হবেন।

ফারাও অবশ্যই একটি নতুন নামের কথা ভেবে থাকবেন। তবে আমার একটা ধারণা এই মুদ্রাগুলোর নাম রূপার মেম দেওয়া যেতে পারে।

এবার তিনি খুশি হয়ে মৃদু হেসে বললেন, আমার মনে হয় এটাই সঠিক হবে তাতা। আর নতুন এই রূপার মুদ্রায় অপর পিঠে কী ছবি থাকবে?

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, অবশ্যই ফারাও সে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তিনি একমত হয়ে বললেন, অবশ্যই আমি তা নেব, তবুও তোমারও একটা মতামত আছে, তাই না?

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, আপনার জন্মক্ষণ থেকে আমি আপনার সাথে আছি তাই না মহামান্য?

হ্যাঁ, দেবতা হোরাস জানেন তুমি কতবার একথা আমাকে শুনিয়েছ। যখনই তুমি বর্ণনা কর প্রথম যে কাজটি আমি করেছিলাম, তা হল আমি তোমার উপর পেচ্ছাব করে দিয়েছিলাম, তখন ভাবি কেন আমি তখন আরও জোরে আর অনেকক্ষণ ধরে পেচ্ছাবটা করলাম না।

আমি তার কথার শেষাংশটা না শোনার ভান করে বললাম, আমি সবসময় আপনার কাছাকাছি আর পেছনে বিশ্বাসী এবং অনুগত ছিলাম। আমার মনে হয় এই ঐতিহ্য বজায় রাখাই মঙ্গলজনক। একথা বলে আমি থামলাম কিন্তু ফারাও আমাকে কথাটা শেষ করতে বলে বললেন, বলে যাও। তবে আমি মনে হয় বুঝতে পারছি তুমি কোন দিকে যাচ্ছ।

আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলছি, হয়তো সবদিক বিবেচনা করে ফারাও রূপার মেম মুদ্রার পেছনে আহত বাজপাখির ছবি লাগাবার নির্দেশ দিতে পারেন। আমার কথা শেষ হতেই ফারাও জোরে হেসে উঠলেন।

সত্যি তুমি কখনও আমাকে হতাশ করোনা তাতা। তুমি প্রথম থেকেই সবকিছু ভেবে রেখেছিলে! একটিা ভাঙা ডানাসহ বাজপাখির ছবি আমার ব্যক্তিগত গূঢ়লিপি।

রাজানুকূল্যে আর কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে আমি ম্যামোজের সমাধিক্ষেত্র এলাকায় একটি টাকশাল বসালাম। এই রূপার টুকরাগুলো বর্ণনা করার জন্য আমি মুদ্রা নামে একটি নতুন শব্দ ঠিক করলাম। ফারাও সাথে সাথে এর অনুমোদন দিলেন।

এই মুদ্রা ব্যবস্থাটি ছিল আমার আরেকটি অর্জন যা আমাদের মিসরের উন্নতি আর অগ্রগতির জন্য অসাধারণ একটি সহায়তা হিসেবে প্রমাণিত হল। একটি সুষম মুদ্রানীতি আজকাল সরকার পরিচালনা আর ব্যবসা-বাণিজ্যের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি হাতিয়ার। এটা ছিল মিসরের প্রতি আমার অন্যতম একটি উপহার আর এটিই অন্যতম প্রধান একটি কারণ যেজন্য আমরা সবসময় পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগণ্য জাতি হয়ে থাকবো। অবশ্য এরপর থেকে অন্যান্য জাতিও আমাদের অনুকরণ করেছে আর রূপার মেম এখন এমন একটি মুদ্রা যা পৃথিবীর সব দেশে স্বীকৃত এবং সানন্দে গৃহীত হয়েছে।

আমার কনুইয়ের মৃদুস্পর্শ পেয়ে ফারাও তার পিতার সমাধিক্ষেত্রের নাম পরিবর্তন করে রাজকীয় টাকশাল নাম দিলেন। এরপর ফারাও আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন। এটা আমার অন্যান্য দায়িত্বের বাইরে বাড়তি আরেকটি দায়িত্ব। তবে যে কোনো দায়িত্ব পালনে আমি কখনও অনুযোগ করি না।

প্রশাসক পদে আসীন হওয়ার পর আমার প্রথম কাজটি ছিল জারাসকে রাজকীয় টাকশালের অভিভাবক ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা। এ দায়িত্ব পালনে সহায়তার জন্য জারাসকে অধিনায়ক করে তার অধীনে এক পল্টন সেনা দিতে আমি ফারাওকে অনুরোধ জানালাম। অবশ্য এতে জারাস পুরোপুরি আমার অধীনে চলে আসবে।

রাজকুমারী তেহুতি কৌশল করে জারাসকে তার হীরার আংটিটি পরীক্ষা করতে বাধ্য করেছিল আর এতে তার উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছিল। তাই আমি অত্যন্ত সাবধানে তাকে নীলনদের পশ্চিম তীরে পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমি জানি আমার আদরের রাজকুমারী যখন কোনোকিছু করতে মনস্থির করে তখন সেখান থেকে তাকে সরানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আমার শুধু একটাই চিন্তা ছিল যতক্ষণ তার যথোপযুক্ত নিয়তি নির্ধারণ করতে না পারি ততক্ষণ রাজকুমারী তেহুতি আর জারাসের মাঝে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। এটা পরিষ্কার, তার নিয়তি হচ্ছে একজন রানি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ব্যক্তির সঙ্গিনী হওয়া। একজন সাধারণ সৈন্য সে যতই সুন্দর আর ভালো হোক না কেন, তেহুতি তার খেলার সাথী আর তাঁবুর সহগামি হতে পারে না।

একটা বিষয় আমি জানতাম যে, রাজরক্তের সুন্দরী নারীর প্রতি সর্বাধিরাজ মিনোজের বিশেষ অনুরাগ আছে। তবে সত্যি বলতে কী কথাটা প্রমাণিত সত্য নয়। এটা আসলে একটা গুজব যা বার বার রটানোর ফলে সত্যে পরিণত হয়েছে।

তবে আমার বিশ্বাস ছিল যে, এই অসীম শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব আমার দুই রাজকুমারীর অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ নিশ্চয়ই এড়াতে পারবেন না। আর এর মাধ্যমে আমি মিনোয়ানদেরকে আমার আর মিসরের মঙ্গলের কাজে লাগাত পারবো। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, রাজসিংহাসনে আসীন হওয়া আর এই বর্বর হাইকসোদের হাত থেকে আমাদের প্রিয় মিসরকে রক্ষা করার চেয়ে অধিক সম্মানিয় আর উচ্চতর আর কোনোকিছুই তেহুতি আশা করতে পারে না। এটা যখন সে বুঝতে পারবে তখন জারাসের মতো সাধারণ মানুষের প্রতি তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে।

তবে ইতোমধ্যে এই চমৎকার যুবকটিকে রাজকীয় টাকশালের কাজে সমাধিক্ষেত্রের এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে হবে যাতে সে নদী পার হয়ে রাজকীয় হেরেমের চারপাশে ঘুর ঘুর করার কোনো সুযোগ না পায়।

.

এ যাবত ফারাও আর রাজপরিষদের সমস্ত সদস্য সর্বাধিরাজ মিনোজ আর হাইকসো রাজা গোরাবের মাঝে বেড়ে উঠা সংঘর্ষের প্রতি খুবই আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আর যতদূর সম্ভব তাদের দুজনের মাঝে এই শত্রুতায় ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত তা যথেষ্ট ছিল না। ক্রিট অনেক দূরে অবস্থিত আর এর শাসকের সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না।

তেহুতি আর বেকাথাকে এই কাজে লাগাবার যথোপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি ক্রিট আর সর্বাধিরাজ মিনোজ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করলাম। একাজে এমিথাওন আর তার মেয়ে লক্সিয়াস আমাকে ঐ দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাস, জনগণ, প্রাকৃতিক সম্পদ আর বিশেষত এর শাসকদের সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য জানিয়ে সহায়তা করলো।

ক্রিটের রাজা ছিল চারজন, আর সর্বাধিরাজ মিনোজ তার পদবী অনুযায়ী অন্য তিন রাজার উপর কর্তৃত্ব করতেন। তারা আলাদা আলাদা প্রাসাদে থাকতেন তবে এগুলো কুনুসসে প্রধান রাজপ্রাসাদের সাথে মার্বেল পাথরে ছাওয়া রাস্তার মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। মিসরে আমরা এদেরকে সাতরাপ কিংবা গভর্নর বলতাম, রাজা বলা হত না।

আমার প্রশ্নের উত্তরে এমিথাওন জানাল সর্বাধিরাজ মিনোজের নগরদুর্গ কুনুসসের দেয়ালের বাইরে তিনলিগ দূরে একটি গ্রামে তার জন্ম হয়েছিল। তার বাবা রাজপ্রাসাদের একজন কর্মকর্তা ছিলেন আর ছোটবেলায় সে মিনোজের বিভিন্ন উৎসব আর শোভাযাত্রা দেখেছে। এ-যাবত যাদের সাথে আমি এ-বিষয়ে কথা বলেছি তাদের মধ্যে সেই প্রথম ব্যক্তি যে মিনোজকে সচক্ষে দেখেছে।

এমিথাওন জানাল তিনি একজন জাঁকজমকপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যিনি জনসমক্ষে বের হবার সময় মুখোশ পরে থাকতেন। ষাড়ের মাথার আকৃতিতে তৈরি মুখোশটি ছিল খাঁটি রূপার। প্রজারা কখনও তার মুখ দেখেনি।

এমিথাওন জানাল, তিনি অমর। সেই আদিকালে যখন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন থেকেই তিনি শাসন করে আসছেন।

আমি মাথা নেড়ে ভাবলাম, তার প্রজারা কেউ যদি তার মুখ নাই দেখে থাকে তাহলে কীভাবে ওরা জানবে যে, একই ব্যক্তি এতোকাল শাসন করেছেন? আমার মনে হল দায়িত্বে থাকা একজন সর্বাধিরাজ মিনোজ মারা যাবার পর তার উত্তরাধিকারী রূপার ষাঁড়ের মুখোশটি পরে শাসনকাজ চালায়।

এমিথাওন বলে চললো, তার একশো স্ত্রী রয়েছে। কথাটা শুনে আমি অবাক হবার ভান করলাম। সে আবার বলতে শুরু করলো, এজিয়ান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপে অবস্থিত নগর রাষ্ট্রগুলো থেকে সর্বাধিরাজ মিনোজ স্ত্রী পেয়ে থাকেন। বছরে চারবার ঋতু পরিবর্তনের সময় যে উৎসব হয়, তখন উপঢৌকন হিসেবে এদের পাঠানো হয়।

সর্বাধিরাজ মিনোজের কয়টি করদ রাজ্য আছে এমিথাওন?

সে বললো, হে প্রভু, তিনি একজন পরাক্রমশালী শাসক। ক্রিট দ্বীপের তিনটিসহ তার অধীনে মোট ছাব্বিশটি করদ রাজ্য আছে।

ক্রিট দ্বীপের ভৌগলিক বিবরণ আর এর লোকসংখ্যা সম্পর্কে এমিথাওন আমাকে অনেক কিছু জানাল। আমার কাছে এই দ্বীপের বেশ কয়েকটা মানচিত্র ছিল, কিন্তু প্রত্যেকটি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এমিথাওন এই মানচিত্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, তারপর বিভিন্ন ভুল বিবরণ সংশোধন করে সঠিক একটি মানচিত্র বানাতে সহায়তা করলো। পূর্ণাঙ্গ এই মানচিত্রটিতে বিভিন্ন নগর, গ্রাম, বন্দর, জেটি, রাস্তাঘাট আর ক্রিটের পর্বতের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া গিরিপথগুলো দেখান ছিল।

পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে এমিথাওন আমাকে মিনোয়ান সেনা আর নৌবাহিনী সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান জানাতে পারলো।

পদাতিক সৈন্য ছিল প্রচুর। তবে এদের বেশিরভাগই ছিল অন্যান্য হেলেনিয় দ্বীপ, মেডেস এবং পূর্ব এশিয়ার ভাড়াটে আর্য সৈন্য। সে জানাল ক্রিট দ্বীপটি পার্বত্য এলাকা হওয়ার কারণে হাইকসো কিংবা মিসরের ফারাওয়ের তুলনায় মিনোয়ানদের রথের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

মনে হচ্ছে এই অভাব মেটাবার জন্য সর্বাধিরাজ মিনোজ একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তুলেন যা, মধ্য সাগরের যেকোনো নৌবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। এমিথাওন এই নৌবাহিনীর বিভিন্ন ধরনের জাহাজের সংখ্যা আমাকে জানাতে পারলো।

তবে এমিথাওন জাহাজের সংখ্যাটি এতো বেশি বলেছিল যে, আমার মনে হল সে অনেক বাড়িয়ে বলেছে। আবার ভাবলাম যদি আমার ভুল হয়ে থাকে আর এমিথাওনের কথিত সংখ্যাটিই সঠিক হয়, তাহলে বুঝতে হবে আসলেই সর্বাধিরাজ মিনোজ অত্যন্ত শক্তিশালী একজন শাসক।

.

এইসব খবরা-খবর সংগ্রহ করার পর আমি ভাবলাম এখন আমাদের সময় হয়েছে, মিনোয়ন আর হাইকসোদের মধ্যেকার এই লড়াইয়ে ক্রিটের পক্ষে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। আর এতে হয়তো আমরা যথেষ্ট চাপ প্রয়োেগ করে বর্বর হাইকসোদেরকে পরাস্ত করে আমাদের মাতৃভূমি থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে পারবো।

এটন আর আমি যেসব তথ্য আমাদের গুপ্তচরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম তা সমস্ত একত্রিত করে পরীক্ষানিরীক্ষা করলাম। আমার গবেষণা কর্মের বিশালতা দেখে সে খুবই অভিভূত হল, কেননা তার নিজেরগুলোর চেয়ে আমার তথ্য অনেক বেশি ছিল।

অনেক তর্কবিতর্কের পর আমরা সবাই একমত হলাম যে, এখন সবচেয়ে ভালো হবে মিনোয়ানদের সাথে সরাসরি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। আর ওদের সাথে একটি কার্যকর মৈত্রি চুক্তি করার দিকে এগিয়ে যাওয়া যাতে, এই

দুই জাতি মিলে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী একটি শক্তিতে পরিণত হয়, যে শক্তিকে হাইকসোরা কখনও চ্যালেঞ্জ করার আশা করবে না।

ঠিক তখনই উৎসাহের আতিশয্যে আমি একটা ভুল করে ফেললাম। এটনকে বললাম, আমার যদূর মনে পড়ে হাইকমোরা আকস্মিকভাবে মিসরে : হামলা করার আগে আমরা সবসময় ক্রিটের সাথে মোটামুটি একটি কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিলাম। যাইহোক হাইকসোরা উচ্চ মিসর দখল করে নেওয়ার পর আমাদের দেশের দক্ষিণাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে ক্রিটের সাথে আর যোগাযোগ বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। হাইকসোরা আমাদের মাঝখানে ঢুকে দুটি দেশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

আমার কথা শুনে এটন কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। আমি থামার পরও সে কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। আমি বাধ্য হয়ে তাকে বললাম, তোমার কী মতামত এটন? আমার কথাটি কি তোমার মনঃপুত হয়নি?

সে আমার প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর না দিয়ে বরং আমার প্রথম কথাটায় ফিরে গিয়ে বললো, আমি কি ঠিক শুনেছি তায়তা? তুমি কি আসলেই একথা বলেছে যে, হাইকসোদের মিসর আক্রমণের আগের কথা তোমার মনে আছে?

আমার বয়স নিয়ে আমি সাধারণত খুবই সাবধানতা অবলম্বন করি। এমনকি এটনের মতো যারা আমার কাছের মানুষ তারাও আমার আসল বয়সের চেয়ে অনেক কম জানে। যদি আসল বয়সটা ওদের জানাতাম, তাহলে ওরা আমাকে একজন পাগল মানুষ কিংবা খুব বেশি হলে একজন মিথ্যাবাদী মনে করতো। হাইকমোরা প্রায় নব্বই বছর আগে মিসর আক্রমণ করেছিল আর ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু এখন ভুলটা আমাকে শোধরাতে হবে।

প্রশ্নটা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, কথাটা বলতে গিয়ে আমি একটু ঘোট পাকিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যতটুকু আমি পড়েছি আর শুনেছি, হাইকমোরা মিসর আক্রমণ করার আগে ক্রিটের সাথে আমাদের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ছিল। তারপর তাড়াতাড়ি বললাম, এখন যদি আবার তাদের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে চাই কিংবা কোনো ধরনের পারস্পরিক প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি করার উদ্যোগ নিতে চাই, তাহলে তা সরাসরি করাটা খুবই শক্ত হবে। তুমি কি এতে একমত এটন?

সে সাথে সাথে কোনো উত্তর দিল না। কেবল অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমার গলা থেকে নিয়ে লেখার টেবিলের উপর রাখা দুইহাত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। এটন জানে বয়সের রেখা একজন মানুষের এই দুই জায়গার উপর বেশি পড়ে।

তবে এ-বিষয়ে আমি ব্যতিক্রম। থুতনিতে এখনও দাড়ি উঠেনি এমন একজন বালকের মতো আমার সারাদেহের চামড়া মসৃণ আর দাগহীন। সেখানে এটন আমার আসল বয়সের কোনো আলামত খুঁজে পেল না। সে চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার আমাদের পূর্বের আলাপের বিষয়ে ফিরে এলো।

এবার গলার সুর নরম করে সে বললো, বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে তুমি যা বলছে তা একেবারে সঠিক তায়তা। এখন সরাসরি মিনোজের সাথে যোগাযোগ করা প্রায় অসম্ভব। সমস্যাটা তুমি ঠিকই ধরেছো, এখন বল সমাধান কীভাবে করা যাবে।

তুমি নিশ্চয়ই জানো আক্কাদ আর সুমের-এর রাজা নিমরদের রাজধানী ব্যবিলনে সর্বাধিরাজ মিনোজের একটা দুতাবাস আছে।

এটন সায় দিয়ে বললো, অবশ্যই জানি। কিন্তু ব্যবিলনে ক্রিট রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগোযোগ করার জন্য আমাদের দূত পাঠাতে চাইলেও, সেই সফরও তোমার সেই তামিয়াত দুর্গ আক্রমণ করার চেয়েও অনেক দুর্গম হবে।

ঠিকই বলেছ এটন। এর দূরত্ব প্রায় দ্বিগুণ আর খুবই বিপজ্জনক আর অনিশ্চিত হবে। আমাদের দূতকে পূর্বদিকে লোহিতসাগর উপকূলের দিকে যেতে হবে। তারপর সাগর পার হয়ে বিশাল আর দুর্গম আরব মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে। এটি এমন একটি জায়গা যা সমস্ত দয়ালু দেবতারা ত্যাগ করেছেন, এখানে বৈরী বেদুঈন গোষ্ঠিরা ঘুরে বেড়ায় আর বিচারের হাত এড়িয়ে চলা গলাকাটা দস্যু আর সমাজতাড়িত লোকজনদের বিচরণ রয়েছে। থিবস থেকে ব্যবিলনের দূরত্ব দেড় হাজার লিগেরও বেশি। আর সমস্যার এখানেই শেষ নয়।

কেন নয় তায়তা? আমরাতো জানি ব্যবিলনে মিনোজের একটি দুতাবাস আছে?

হ্যাঁ, তা আছে। তবে ক্রিট আর থিবসের মধ্যে একটা মৈত্রী চুক্তি করার মতো আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সেই রাজদূতের থাকার কথা নয়। সে বড়জোর একটা বার্তাসহ আমাদের দূতকে ক্রিটে সর্বাধিরাজ মিনোজের রাজদরবারে পাঠিয়ে দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে আমাদের দূতকে মধ্য সাগরের একেবারে পুবপ্রান্তে গিয়ে টায়ার কিংবা সিডন বন্দরে গিয়ে একটা জাহাজ খুঁজতে হবে। তারপর সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন নিতে রাজি হলেও তাকে শীতকালীন ঝড়, জলদস্যু আর হাইকসো যুদ্ধ জাহাজ এড়িয়ে মধ্য সাগরের অর্ধেক পর্যন্ত যেতে হবে। তারপরই সে ক্রিট দ্বীপের কুনুসসে সর্বাধিরাজ মিনোজের দুর্গে পৌঁছতে পারবে।

এতে কত সময় লাগতে পারে বলে তোমার ধারণা তায়তা?

ভাগ্য ভালো হলে আর দেবতা সহায় হলে প্রায় একবছর লাগবে আর নয়তো এর দ্বিগুণ সময় লাগবে।

এটন একটু চিন্তা করে বললো, দুই বছরে অনেককিছু ঘটে যেতে পারে।

আমি বললাম, এখানেই শেষ নয়। ফারাওয়ের কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পর সর্বাধিরাজ মিনোজ তার মন্ত্রণাপরিষদের সাথে বিষয়টা নিয়ে পরামর্শ করবেন, তারপর তার উত্তর নিয়ে একই পথে দূতকে থিবস ফিরতে হবে। পুরো সফরটা শেষ করতে প্রায় তিনচার বছর লেগে যাবে।

এটন বললো, না! এতোদিন আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। এর মধ্যে তো রাজা গোরাব তার এক লক্ষ হত্যাকারী দস্যু সৈন্য নিয়ে থিবস আক্রমণ করে বসবে। অন্য কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

তুমি ঠিক বলেছ প্রিয় বন্ধু এটন। এ-বিষয়ে তোমার মনে আর কোনো ভাবনা আছে? আমি সমস্যাটা আবার তার কাছে ফিরিয়ে দিলাম।

বোকার মতো মুখ করে সে মৃদু হেসে বললো, তোমার মতো এই সমস্যাটা নিয়ে আমি ভাবিনি। আমার মনে হয় তোমার মনে কোনো পরিকল্পনা আছে, তাই না?

আচ্ছা ধর, ফারাও একজন মিসরীয় রাষ্ট্রদূতকে নিয়োগ দিয়ে তার সাথে এমন একটি বিশাল বাহিনী দিলেন যা তাকে দ্রুত লোহিত সাগর আর এরপরের মরুভূমির দস্যুদল আর বেদুঈন গোষ্ঠীদের এড়িয়ে নিরাপদে সফর করতে সহায়তা করবে। আর যদি এই রাষ্ট্রদূতকে যথেষ্ট পরিমাণ রূপা দেওয়া হয়, যা দিয়ে সে টায়ার বন্দর থেকে বেশ বড় আর দ্রুতগামি একটা জাহাজ ভাড়া করতে পারবে। তারপর এই দ্রুতগামি জাহাজে সাগর পাড়ি দিয়ে জলদস্যু আর হাইকসো যুদ্ধ জাহাজকে এড়াতে পারে, তাহলে কেমন হয়?

এবার এটনের চোখ উজ্জ্বল হল, সে বললো, হ্যাঁ ঠিক!

আর এই চমৎকার জাহাজটি যদি সোজা ক্রিটের কুনুসসে পৌঁছাতে পারে? আর এই রাষ্ট্রদূতের কাছে যদি এমন উপঢৌকন থাকে যা সর্বাধিরাজ মিনোজ খুবই পছন্দ করেন? তারপর একদিকে মাথা হেলিয়ে চোখ সরু করে বললাম, তোমার কী কোনো ধারণা আছে কী ধরনের উপহার মিনোজের সবচেয়ে পছন্দ?

এবার এটন হেসে বললো, মনে হয়, আছে বন্ধু। আমি যতদুর শুনেছি মিনোজের এমন এক জোড়া অণ্ডকোষ আছে যা আমাদের দুজনের মিলিয়ে নেই। অর্থাৎ যা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তার চেয়ে ওগুলো কয়েকগুণ বেশি ওজনে ভারি। আর যে জিনিস নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না তার প্রতি তার তৃপ্তিহীন ক্ষুধা রয়েছে।

তার কথা শুনে আমিও হাসলাম, যেন হাসা দরকার তাই। তবে আমার এই দৈহিক অসম্পূর্ণতার বিষয়টি আমার কাছে খুব একটা রসিকতা করার মতো বিষয় মনে হয় না।

কিন্তু তায়তা এতে আমাদের কী লাভ বল? রাজা গোরাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটা আমাদের কি কাজে আসবে? মিসরের সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব থিবসে ফারাওয়ের হাতেই থাকবে। তার প্রতিটা নির্দেশ এতো দূরে জানাতে হবে, যে কথা আমরা দুজনে এতোক্ষণ আলোচনা করলাম।

আমি তার কথার উত্তরে মন্তব্য করলাম, আবারো তুমি সমস্যাটির ঠিক আসল জায়গায় হাত দিয়েছ। যাইহোক এ-বিষয়েও আমার কিছু চিন্তা আছে। যদি ফারাওয়ের এই রাষ্ট্রদূত রাজকীয় সীলমোহর বহন করে, তাহলে সে সময় নষ্ট না করে ক্রিটে মিনোজ আর তার সভাসদদের সাথে মিলে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রায়ই যুদ্ধে জয় এনে দেয়।

এটন খুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, কখনও না! যাকে তিনি সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করেন, তাকে ছাড়া আর কারও হাতে ফারাও সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব আর যুদ্ধ পরিচালনা করার ক্ষমতা তুলে দেবেন না।

আচ্ছা বলতো এটন! তোমার কি মনে হয় মিসরে কি এমন কেউ নেই যাকে ফারাও ত্যামোস নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করেন?

না, আমার বিশ্বাস তেমন কেউ নেই। তারপর হঠাৎ কথা থামিয়ে সে আমার দিকে অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে বললো, এই তায়তা! তুমি নিশ্চয়ই একথা বলছো না যে রাজকীয় সীলমোহরসহ ফারাও তোমার হাতেই মিসরীয় সেনাবাহিনীর উত্তরাঞ্চলের পুরো কর্তৃত্ব তুলে দেবেন? তুমি তো একজন সৈনিক নও তায়তা! যুদ্ধের কী জান তুমি?

তুমি যদি আমার লেখা যুদ্ধের কলাকৌশল গ্রন্থটি না পড়ে থাক তাহলে এ-বিষয়ে আমার যোগ্যতা নিয়ে তোমার কিছু বলার অধিকার নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলতে পারি। সেনা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রকে এ-বিষয়ে সর্বশেষ জ্ঞান হিসেবে এই গ্রন্থটি পড়ানো হয়।

আমি স্বীকার করছি এটা আমি কখনও পড়িনি। তোমার এই বিখ্যাত গ্রন্থটি খুব বেশি বড় আর এই বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহও নেই; কেননা আমার মনে হয় না আমাকে কখনও কোনো সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে হবে। তবে আমি যা বলছি, তাহল পার্চমেন্ট কাগজে কিছু হিজিবিজি লেখা আর প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একরকম ব্যাপার নয়। তোমার কি কোনো সেনাবাহিনীকে সরাসরি নির্দেশ দেবার অভিজ্ঞতা আছে?

এবার আমি গলার স্বর নরম করে বললাম, বেচারি এটন, তুমি আমার সম্পর্কে কত কম জান। এ-বিষয়ে কথা শেষ করার আগে আমি তোমাকে শুধু জানাচ্ছি আমাদের সেনাবাহিনীর প্রথম রথটি আমিই বানিয়েছিলাম। আর থিবসের যুদ্ধে ফারাও ত্যামোসের রথের চালকও ছিলাম আমি। আর যুদ্ধ চলাকালে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবার সময় ফারাও আমার পরামর্শের উপর নির্ভর করতেন। যুদ্ধে আমার বিশেষ অবদানের জন্য ফারাও আমাকে সাহসিকতা আর প্রশংসার সোনার পদক দিয়েছিলেন। সেদিন তার জীবন রক্ষার দায়িত্ব তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আবারও তা করতে পারেন।

আমি এতোকিছু জানতাম না তায়তা। আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করো বন্ধু। তুমি সত্যি অনেক গুণের আঁধার।

আমি অনেক সময় বিভিন্ন বিষয়ে এটনের নিজের অবস্থানটা তাকে মনে করিয়ে দেওয়াটা প্রয়োজনবোধ করতাম। তবে ক্রিট অভিযানের বিষয় নিয়ে ফারাওয়ের কাছে পেশ করার জন্য যে প্রতিবেদন তৈরি করতে যাচ্ছিলাম সে বিষয়ে তার সাহায্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একবার সঠিক পথটা জানিয়ে দিলে সে খুঁটিনাটি সবকিছু খুব ভালো বুঝতে পারে।

.

এটনের মতো ফারাও আমার যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো অবজ্ঞা দেখালেন না। বিশেষত তামিয়াত দুর্গে আমার সাম্প্রতিক সাফল্যের পর তিনি বরং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। পুরো দুই দিন মিনোজের সাথে আমার যোগাযোগের পরিকল্পনাটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আমার সাথে কথা বললেন। মাঝে মাঝে দুএকটা বিষয়ে প্রশ্ন তুললেন, তারপর আলোচনা শেষে বললেন, আমি তো তোমার পরিকল্পনায় কোনো খুঁত দেখতে পাচ্ছি না তাতা। তবে আমার মনে হয় জেনারেল ক্রাটাস আর তার সহকর্মীরা কোনো কোনো বিষয়ে আপত্তি করতে পারে।

ফারাও আর তার পূর্ণ সভাসদদের উপস্থিতিতে আমি জেনারেল ক্রাটাসের সামনে আমার পরিকল্পনা তুলে ধরলাম। আমার কথা শোনার পর ক্রাটাস রেগেমেগে মুখ লাল করে লাফ দিয়ে উঠে পুরো রাজদরবারে দাপাদাপি করে বেড়াতে লাগলো। আমার নাকের সামনে আঙুল নেড়ে টেবিলের উপর ঘুসি মেরে চিৎকার করে সমস্ত দেবতাদের উদ্দেশ্যে সে ভবিষ্যৎ বিপদাশঙ্কা আর সর্বনাশের সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে লাগলো। প্রকৃতিগতভাবে ক্রাটাস একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি হলেও সে একজন ভালো যোদ্ধা।

চিৎকার, দাপাদাপি, দেবতাদের উদ্দেশ্যে শপথ ইত্যাদি করতে করতে মুখে ফেনা তুলে যখন সে আর কথা বলতে পারছিল না, ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করলাম। তারপর আমি শান্তকণ্ঠে বললাম, একটা কথা আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম জেনারেল ক্রাটাস। হুই আর রেমরেমকে আমি আমার সাথে ক্রিটে নিয়ে যেতে চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি তাদের বদলি উপযুক্ত সেনাকর্মকর্তা খুঁজে নিতে পারবেন।

ক্রাটাস বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে রইল, তারপর হঠাৎ সে হাসতে শুরু করলো। হাসির দমকে তার সারা শরীর কেঁপে উঠলো, টলতে টলতে পিছু হটে তার বিশাল বপু নিয়ে সে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো। এই চেয়ারটা বিশেষ করে তার জন্যই তৈরি করা হয়েছে আর সে যেখানেই যায় এটা সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন তার ওজনের ভারে চেয়ারের জোড়গুলো শব্দ করে প্রায় আলগা হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে।

যেভাবে সে হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিল, ঠিক সেরকমভাবে হঠাৎ হাসি থামিয়ে নিচু হয়ে পোশাকের ঘের উঠিয়ে মুখ মুছতে লাগলো। এতে তার পুরুষাঙ্গ পুরোপুরি অনাবৃত হয়ে সবার চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো। এরপর টিউনিকের ঘের হাঁটুর কাছে নামিয়ে দিয়ে সে স্বাভাবিক কণ্ঠে ফারাওকে উদ্দেশ্যে করে বলতে শুরু করলো, মহামান্য, তায়তার পরিকল্পনায় কিছু ভালো দিক দেখা যাচ্ছে। একমাত্র সে এই পরিকল্পনার কথা ভাবতে পারে এবং সভাসদদের সামনে তুলে ধরার মতো বুকের পাটা একমাত্র তারই আছে। তারপর সে গভীর অনুশোচনার ভান করে নিজের কপাল খামচে ধরে গভীরভাবে বললো, আমাকে ক্ষমা করুন ভদ্রমহোদয়গণ, আমি হয়তো ভুল রূপক ব্যবহার করে ফেলেছি। তারপর আবার সে হাসিতে ফেটে পড়লো।

আমার বিশেষ অঙ্গটির অভাবের দিকে ইঙ্গিত করে তার রসিকতা করা সত্ত্বেও আমি ভাবলেশহীন চেহারা করার চেষ্টা করে বললাম, তাহলে আমি মনে করতে পারি যে, হুই আর রেমরেম আমার সাথে ক্রিট যাচ্ছে?

নিয়ে যাও তায়তা। সামরিক যশ অর্জনের প্রতি তোমার উচ্চাভিলাষ প্রশংসার যোগ্য। আমার আশীর্বাদসহ আমার সর্বশ্রেষ্ঠ লোকদুজনকে নিয়ে যাও। হয়তো তোমাকে তোমার হাত থেকে ওরা রক্ষা করতে পারবে। যদিও আমার সন্দেহ কেউ হয়তো তা পারবে না।

.

ব্যবিলন যাত্রার প্রস্তুতি শেষ করতে প্রায় দুইমাস লেগে গেল।

আমার বেশি দুশ্চিন্তা ছিল দুই রাজকুমারী আর তাদের সফরসঙ্গীদের স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপত্তা নিয়ে। তাদের নিত্যকার প্রয়োজন মেটাবার জন্য ক্রীতদাস আর ভৃত্যের ৮৩ জনের একটি দল ছিল। এদের মধ্যে ছিল পাঁচক, রান্নাঘরের দাসী, শয়ন কক্ষের পরিচারিকা, পোশাকভাণ্ডারের কত্রী, প্রসাধন ও কেশপরিচর্যাকারী, শরীর মালিশকারী, বাদকদল এবং অন্যান্য পেশাদার আনন্দদানকারী। এছাড়া একজন গণক আর তাদের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য মেয়েরা আনন্দ, ভালোবাসা আর মাতৃত্বের দেবী হাথোরের তিনজন নারী পুরোহিত নেবার জন্য বায়না ধরলো। আমার আপত্তি সত্ত্বেও ওদের বড়ভাই তাদের কোনো আবদারই বিফলে যেতে দিলেন না।

ফারাওয়ের ধনভাণ্ডার এখন উপচে পড়ছে আর তিনি অকৃপণভাবে টাকা ঢালতে লাগলেন। এতোবছর হিসেব করে চলার পর এখন ইচ্ছামতো খরচ করতে পেরে তার বোনদের চেয়েও তিনি বেশি উপভোগ করছেন।

এতে মেয়েরা উৎসাহিত হয়ে তাদের পোষা বেড়াল, বানর, পাখি আর শিকারী কুকুরের পরিচর‍্যা করার জন্য আলাদা লোক নিল। এগুলো ছিল রাজকীয় আস্তাবল থেকে যে বিশটি ঘোড়া বেছে নেওয়া হয়েছিল তার সহিস আর অন্যান্য লোকবলের অতিরিক্ত।

আমি চেয়েছিলাম মেয়েদের পোশাকপরিচ্ছদ যেন সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের হয়, যাতে ক্রিটে পৌঁছাবার পর সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার রাজদরবারের অমাত্যদের সামনে ওদের খুবই সুন্দর দেখায়। এ-বিষয়ে ফারাও আমাদের সাথে পরামর্শ করলেন, তারপর আমি দুই রাজকন্যার প্রত্যেকের জন্য যে চমৎকার পোশাকগুলো নকশা করেছিলাম, সেগুলো কাটা আর সেলাই করার জন্য মিসরের সর্বশ্রেষ্ঠ দর্জিদের নিয়োগ দেওয়া হল।

মেয়েদেরকে সাথে নিয়ে আমি থিবসের বাজারের বিভিন্ন দোকান ঘুরে। প্রচুর চোখধাঁধানো গহনা কিনে নিয়ে এলাম। এগুলো দেখলে মিনোজ আর তার সভাসদরা আমাদের রাজ্যের সম্পদ আর গুরুত্ব বুঝতে পারবে। থিবস থেকে যাত্রা শুরু করার এক সপ্তাহ আগে তেহুতি আর বেকাথা একে একে সমস্ত পোশাক আর গহনা পরে ফারাও আর আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি ওদের দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ভাবলাম, যে কোনো মানুষ, সে রাজা হোক আর সাধারণ মানুষ হোক এদের দুজনের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।

সফরের প্রস্তুতির এ-পর্যায়ে এসে মেয়েদুটোর উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে গেল। তাছাড়া লক্সিয়াস যখন ওদেরকে ক্রিট দ্বীপের বর্ণনা দিল তখন ওরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ওরা জীবনে কখনও সমুদ্র দেখেনি আর সমুদ্র পাড়িও দেয়নি। উঁচু পর্বত কিংবা উঁচু গাছের ঘন জঙ্গলও দেখেনি। ওরা কখনও সেই পর্বত দেখেনি যার মুখ দিয়ে ধূঁয়া আর আগুন বের হয়। ওরা আমাকে আর লক্সিয়াসকে এসব বিষয়ে রাতজেগে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলো।

পশ্চিমতীরে অবস্থিত রাজকীয় টাকশাল রাত দিন কাজ করে একশো বড় ক্রেটান রূপার বাট ভেঙে কয়েকগাড়ি রূপার মেম মুদ্রা তৈরি করা হলো। এগুলো দিয়ে আমাদের সফর আর ক্রিট আর বিদেশের অন্যান্য জায়গায় অবস্থানের খরচ জোগানো হবে।

ব্যবিলন পর্যন্ত আমাদের কাফেলা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নীল কুমির রক্ষীদলের দুটো অশ্বারোহী পল্টন গঠন করা হল। এটি ছিল মিসরীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে চৌকশ পল্টন। ফারাও প্রত্যেক সৈন্যকে বর্মসহ নতুন সমরসাজ, উঁচু চূড়াওয়ালা শিরস্ত্রাণ আর ঘোড়াসহ হাঁটুতে পরারও বর্ম দিলেন। এছাড়া অস্ত্র হিসেবে ওরা নিল বাঁকা ধনুক, তৃণ, তরবারি এবং ঢাল। এসব অস্ত্র আর বর্ম তৈরির খরচ পড়লো দুই হাজার রূপার ডেবেনেরও বেশি। যাইহোক এই জাঁকালো অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি দেখার পর যে কেউ চমকে যাবে।

আমি খরচের কথাটা বলার পর ফারাও বললেন, আমাদের মিসরের অস্তিত্বের খাতিরে এটি সামান্য খরচ। এ-বিষয়ে আমার সাথে এখন অভিযোগ তুলে লাভ নেই। এগুলো সব তোমার পরিকল্পনা তায়তা। এরপর আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না।

সফরের প্রস্তুতি এতো সুন্দরভাবে চলছিল যে, আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি যে রাজকুমারী তেহুতি এতে গভীরভাবে নিজেকে জড়িয়েছিল আর সেকারণেই সবকিছু এতো সুন্দরভাবে হচ্ছিল।

.

এপিফি মাসের শেষ দিনে আমি থিবস থেকে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলাম, কেননা এই মাসটি সবসময় আমার জন্য শুভ ছিল। যাইহোক মল ত্যাগ করার পর সদ্য ত্যাগ করা মলের সামান্য নমুনা যখন আমি একটি পাত্রে আমার পছন্দের ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে দিলাম, তিনি এটি পরীক্ষা করে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বললেন যে, এই তারিখটি শুভ নয়। এটা এড়াতেই হবে।

তিনি আমাকে মেসোর মাসের প্রথম দিন পর্যন্ত যাত্রা বিলম্বিত করতে উপদেশ দিলেন। এ-যাবত তার ভবিষ্যদ্বাণী সবসময় বিশ্বাসযোগ্য ছিল। তাই আমি তার উপদেশ মতো আমার দুই রাজকুমারীসহ কাফেলার সকলকে সফর পিছিয়ে দেয়ার কথা জানিয়ে দিলাম।

কোনো খবর না দিয়েই এক ঘন্টার মধ্যেই দুই রাজকুমারী ঝড়ের বেগে প্রাসাদে আমার বাসস্থানে এসে হাজির হল। দলনেতা ছিল তেহুতি আর সবসময়ের মতো বেকাথা একনিষ্ঠভাবে তার বড়বোনের অনুগামি হিসেবে হাজির হল।

তুমি কথা দিয়েছিল তাতা! আর এখন কীরকম নিষ্ঠুরভাবে আমাদের আনন্দ মাটি করতে পারলে তাতা? কত যুগ ধরে আমরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। তুমি কি আমাদেরকে আর ভালোবাসো না?

আমি দুর্বলচিত্ত নই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে আমার দুই রাজকুমারীর ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। ওরা যখন একত্রে আক্রমণ করে, তখন কোনো মানুষের পক্ষে তা প্রতিহত করা সম্ভব নয়, এমনকি আমিও পারি না।

পরদিন ভোর হতেই আমি নীলনদ পার হয়ে ঘোড়ায় চড়ে রাজকীয় টাকশালের দিকে চললাম। রাজকুমারীদের দাবীমতো আমি সেখানে যাচ্ছিলাম সফরের পেছানো তারিখটা জারাসকে জানাতে আর তাকে বলতে যে সফর শুরুর আগেই যেন সে শেষ দশ বস্তা রূপার মেম মুদ্রা রাজপ্রাসাদের রাজকীয় ভাণ্ডারে জমা দেয়।

সফরের জন্য আমরা দশ লাখের বেশি রূপা নিয়ে যাচ্ছিলাম। এপরিমাণ রূপা দিয়ে একটি রণতরী-বহর আর ভাড়াটে সেনার পুরো একটি বাহিনী গড়ে তোলা যায়।

টাকশালে ঢোকার পর দেখলাম একটা কামারশালার মতো ভেতরে ভীষণ গরম আর প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। কামারের হাপরের আগুনের শিখার গর্জন আর হাতুড়ির শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে।

জারাসকে মেঝেতে দেখতে পেলাম। খালি গায়ে সে মাথার উপর একটা ব্রোঞ্জের হাতুড়ি তুলে ঘুরাচ্ছে। পেশিবহুল বাহু ঘামে চকচক করছে আর মুখ গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। এই ছেলেটি এমন চরিত্রের যে, কোনো কাজ থাকলে তা না করে অলস বসে থাকতে পারে না। একজন উচ্চ পদস্থ সামরিক পদধারী হওয়া সত্ত্বেও সে টাকশালের একজন সাধারণ শ্রমিকের মতো মনেপ্রাণে পরিশ্রম করছে।

তাকে দেখে আমি খুশি হলাম। বেশ কয়েক সপ্তাহ তার সাথে দেখা হয়নি আর আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে, তামিয়াতে অভিযানে একসাথে থাকার সময় আমি তার কতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আমার মনে দুঃখ হল যে ব্যবিলন আর কুনুসসের দীর্ঘ অভিযানে তাকে আমার ডান হাত হিসেবে নিতে সাহস পাচ্ছি না।

জারাস আমাকে দেখেই আমার দিকে তাকাল। তারপর হাতুড়িটা পাথরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে হাত উঁচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।

দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও আমাকে তার স্বাগত জানাবার আন্তরিক ভঙ্গি দেখে আমি অবাক হলাম। সে সামনে এগিয়ে এসে বললো, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভূলে গিয়েছ আর এখানে পঁচতে ফেলে রেখে গেছ। তবে আমার জানা উচিত ছিল যে, তোমার মতো একজন মানুষ কখনও তার বন্ধুকে ভুলে যেতে পারে না। আমি আমার বর্ম পলিশ করে রেখেছি আর তরবারিও ধার দিয়ে রেখেছি। এখন তুমি হুকুম করলেই আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম আর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে তাকে সাথে না নেওয়ার কথাটা সরাসরি বলতে পারলাম না।

একটু হাসার চেষ্টা করে বরলাম, আমিও তোমাকে কম আশা করিনি। কিন্তু তুমি কী করে জানলে আর কোনো কথা বলতে পারলাম না, কেননা আমার নিজেরই কোনো ধারণা নেই সে কি বলতে চাচ্ছে।

আজ সকালেই যুদ্ধ পরিষদ থেকে আর্দালি নির্দেশটা নিয়ে এসেছিল। তবে আমি জানতাম তুমি নিশ্চয়ই আমাকে নেবার কথা বলেছে। তারপর একটু হেসে আবার বললো, উপরের মহলে তুমি ছাড়া আমারতো আর কোনো বন্ধু নেই।

নির্দেশে কার সীলমোহর ছিল জারাস?

নামটা জোরে উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছি না, তবে তারপর চারপাশে তাকিয়ে বেশ গোপনীয়তা নিয়ে সে তার কোমরের পেছনে ঝুলানো থলিটা থেকে সাবধানে একটা ছোট প্যাপিরাস কাগজ বের করলো। তারপর খুব যত্ন আর সম্মানের সাথে কাগজটা আমার হাতে দিল।

কাগজটার উপর সীমাহরটা দেখেই চিনতে পেরে আমি চমকে উঠলাম। ফারাও? আমি অবাক হলাম যে এতে সামান্য বিষয়ে ফারাও নিজেকে জড়িত করেছেন।

আর কে? এই কথা বলে জারাস আমার দিকে তাকাল, আমি কাগজটির ভাঁজ খুলে পড়লাম। পরিষ্কার আর বেশ ছোট একটি নির্দেশ।

এখনি প্রভু তায়তার সরাসরি অধীনে নিজেকে উপস্থিত কর। এরপর থেকে তিনি তোমাকে যেসব নির্দেশ দেবেন, শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত তা নিসংকোচে পালন করবে।

এবার জারাস গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললো, এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি তায়তা? আর সেখানে গিয়ে কী করবো আমরা। নিশ্চয়ই জোর লড়াই হবে তাই না?

আমি দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বললাম, সময় হলেই এই প্রশ্নের উত্তর দেব। এমুহূর্তে এর বেশি কিছু বলতে পারবো না। তবে প্রস্তুত থেক।

সে হাতমুঠো করে আমাকে অভিবাদন করলো। তবে দাঁত বের করা হাসিটা থামালেও চোখদুটো চকচক করছিল।

মুদ্রা সরবরাহের বিষয়ের আলাপটা শেষ করার পর দ্রুত প্রাসাদে ফিরে গেলাম। আমাকে এখুনি ফারাওয়ের সাথে দেখা করে জারাসকে দেওয়া তার নির্দেশটা বাতিল করাতে হবে। তবে আগাম খবর না দিয়ে আমিও সরাসরি রাজার সামনে যেতে পারি না। যেকোনো লোকের ফারাওয়ের সাথে সাক্ষাত করার একটি কঠোর নিয়ম পালন করা হয়।

রাজপ্রাসাদে ফারাওয়ের প্রাসাদকক্ষের পাশের একটি কামরায় বেশ কয়েকজন লেখক মাটিতে বসে তুলি দিয়ে ঈজেলের উপর বিভিন্ন রাজকীয় বার্তা আর নির্দেশ লিখছিল। প্রধান লেখক আমাকে দেখেই চিনতে পেরে

এগিয়ে এলো, তবে সে কোনো সাহায্য করতে পারলো না।

ফারাও ভোরেই প্রাসাদ থেকে বের হয়ে গেছেন। কখন ফিরবেন কেউ জানেনা। আমি জানি এখানে থাকলে তিনি অবশ্যই আপনার সাথে কথা বলতেন প্রভু তায়তা। আমার মনে হয় আপনি একটু অপেক্ষা করে দেখতে পারেন।

একথার উত্তরে কিছু বলার আগেই করিডোরের শেষ প্রান্ত থেকে ফারাওয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। পেছনে একদল রাজকর্মকর্তা আর অমাত্য নিয়ে ফারাও দৃঢ়পদক্ষেপে লেখার কামরায় ঢুকলেন। আমাকে দেখেই কাছে এসে আমার কাঁধে এক হাত রেখে বললেন, তোমাকে এখানে পেয়ে ভালোই হল। আবার তুমি আমার মনের কথা টের পেয়েই এসেছ তাতা। আমি নিজেই অবশ্য তোমাকে আসার জন্য খবর পাঠাতাম। এসো আমার সাথে। কাঁধে হাত রেখেই তিনি আমাকে ভেতরের কামরায় নিয়ে গিয়ে কতগুলো জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করলেন। তারপর হঠাৎ আমার সাথে কথা শেষ করার পর তার সামনে নিচু একটি টেবিলের উপর রাখা কতগুলো কাগজের দিকে মনোযোগ ফেরালেন।

আমি আপনার সাথে একমুহূর্ত কথা বলতে চাই মেম। তিনি কাগজ থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন। ক্যাপ্টেন জারাস আর তার প্রতি নির্দেশের বিষয়টা

ফারাও একটু হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে বললেন, কে? কিসের নির্দেশ?

ক্যাপ্টেন জারাস, যে আমার সাথে তামিয়াত গিয়েছিল।

এবার তিনি উত্তর দিলেন, ওহ, সেই লোক! হ্যাঁ, যাকে তুমি ক্রিটে তোমার সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছ। আমি বুঝলাম না তাকে সাথে নেবার জন্য আমার অনুমতির কি প্রয়োজন আর তুমি নিজেই বা কেন এ-ব্যাপারে আমার সাথে সরাসরি কথা বললে না। আমার বোনদেরকে কোনো বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য বলাতে তোমার চরিত্র নয়। তারপর আবার কাগজের দিকে নজর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, যাইহোক কাজটা হয়ে গেছে। আশা করি তাতা তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ, তাই না?

আমি অবশ্যই সন্দেহ করেছিলাম এই নির্দেশের পেছনে কে আছে, তবে আমার রাজকুমারীদের বুদ্ধিমত্তা আর কূটকৌশল নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় নি। এবারই সে প্রথম সামরিক নির্দেশের শৃঙ্খলায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। এখন আমাকে তড়িৎ যে কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হয় কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করতে হবে আর নয়তো রাজকুমারী তেহুতির সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হবে, যে কোনোদিন নিজ স্বার্থে তার উচ্চ রাজকীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেনি। কাজেই আমি মাথা নোয়ালাম।

যা অনিবার্য তা মেনে নিয়ে বললাম, আপনি সত্যি মহান, হে মিসরাধিপতি, আমি সত্যি কৃতজ্ঞ।

.

সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবার পর কাফেলা থিবসে থেকে যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হতেই আমি এটনকে একটা বার্তাবহ কবুতর ছাড়তে বললাম। এটি এর জন্মস্থান ব্যবিলনে মিসরীয় দূতাবাসের উদ্দেশ্যে উড়ে যাবে। এতে আমি আমাদের রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানিয়ে বার্তা পাঠালাম, যেন তিনি আক্কাদ আর সুমেরের রাজা নিমরদকে খবর দেন যে, রাজকুমারীরা একটি কূটনৈতিক সফরে তার রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। আর ফারাও ত্যামোস অত্যন্ত খুশি হবেন যদি মহামান্য রাজা নিমরদ রাজকুমারীদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।

চারদিন পর আরেকটি কবুতর ব্যবিলন থেকে রাজা নিমরদের বার্তা নিয়ে থিবসে ফিরে এলো।

দুই দেশের মাঝে সুসম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাজা জানিয়েছেন তিনি অবশ্যই রাজকুমারীদের সাদর অভ্যর্থনা জানাবেন এবং আশা করছেন যে, রাজকুমারীরা নিশ্চয়ই এখানে তাদের অবস্থান উপভোগ করবেন।

এই বার্তা পাওয়ার সাথে সাথে আমি জারাসকে একটি শক্তিশালী অগ্রগামী দল নিয়ে থিবস থেকে লোহিত সাগরের সবচেয়ে কাছের উপকূল পর্যন্ত পথটি নিষ্কন্টক করার জন্য পাঠালাম। অজুহাত দেখালাম যেন আমাদের পথে কোনো দস্যুদল হামলা করার জন্য ওঁত পেতে নেই তা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। তবে আসল উদ্দেশ্যে ছিল তাকে আমার প্রিয় তেহুতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

আমি বুঝতে পারলাম না তেহুতি কী করে আমার সব পরিকল্পনা জেনে ফেলে। সবজায়গায় তার গুপ্তচর আছে আর হারেম হচ্ছে ষড়যন্ত্র আর গুজবের একটি উর্বর ক্ষেত্র।

অগ্রগামী দল নিয়ে যাবার জন্য জারাসকে সকালেই নির্দেশ দিয়ে আমি বাগানে বসে এককাপ চা খেতে খেতে গতকালের বিভিন্ন কাজের খতিয়ান নিয়ে ভাবছিলাম। ঠিক তখনই একটা ছায়ার মতো নীরবে সে আমার পেছন দিয়ে এসে দুই ঠাণ্ডা হাত দিয়ে আমার চোখ ঢেকে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, কে বলতো?

আমি বলতে পারবো না কে এটা মহামান্য।

ওহহ! তুমি নিশ্চয়ই উঁকি দিয়ে দেখেছ! সে প্রতিবাদ করে উঠলো তারপর আমার কোলে বসে দুই হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি তায়তা। তুমি যা বল তাই আমি করতে পারি। এবার আমার একটা কথা রাখবে?

অবশ্যই রাখবো, রাজকুমারী। যে কাজে তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় আর মিসরের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, সে কাজ ছাড়া আর যেকোনো কাজ আমি করতে রাজি।

আমার এ-ধরনের কথা শুনে সে আতঙ্কিত হয়ে বললো, না না, এরকম কোনো ধরনের অনুরোধ আমি কখনও করবো না। যাইহোক এই ভয়ঙ্কর মরুভূমি উপর দিয়ে সুমের আর আক্কাদ যেতে অনেক সময় লাগবে। কোনো ধরনের আনন্দ না পেয়ে আমার বোন আর আমার খুবই একঘেয়ে লাগবে। তবে খুব মজা হতো যদি একজন কবি সাথে থেকে আমাদের গান আর কবিতা শোনাতো।

এজন্যই কি তুমি ক্যাপ্টেন জারাসকে এই অভিযানে নেবার জন্য তোমার ভাই ফারাও ত্যামোসকে বলেছিলে?

সে চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বললো, ক্যাপ্টেন জারাস! তিনিও কি আমাদের সাথে যাচ্ছেন? কি চমৎকার তাই না? তিনি তো একজন জন্মগত কবি আর কী চমৎকার তার গানের গলা। আমি জানি তুমি তাকে পছন্দ কর। তিনি তো আমার আর বেকাথার সাথে দিনের বেলা ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে আমাদের গান আর কবিতা শোনাতে পারেন, তাই না?

প্রথম কথা হল ক্যাপ্টেন জারাস একজন প্রথম সারির সেনাকর্মকর্তা এবং যোদ্ধা, কোনো ভ্রাম্যমাণ চারণ কবি নন। আমাদের কাফেলায় একদল পেশাদার গায়ক-বাদক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ভাড়, যাদুকর, আর একটি ভল্লুকসহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য পশুও আছে। জারাস আমাদের কাফেলার আগে আগে অগ্রগামী দলের দায়িত্বে থাকবে। সে আমাদের সবার নিরাপত্তার স্বার্থে সামনের পথে কোনো বাধা বিপত্তি থাকলে তা দূর করবে। বিশেষত তোমার আর তোমার ছোট বোনের নিরাপত্তার স্বার্থেই তা করবে।

এবার তেহুতির ঠোঁট থেকে মন গলানো হাসিটা মুছে গেল। সে একটু পেছনে হেলে শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কেন এমন করছো আমার সাথে তায়তা? আমি তো সামান্য একটা আবদার করেছি।

আমি তার ডান হাতটি উপুড় করে ধরে হিরার আংটিটার দিকে দেখিয়ে বললাম, এটাই আমার কারণ, রাজকুমারী।

সে এক ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে পেছনে লুকাল। আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

বুঝা গেল সে যুদ্ধের সীমানা মেলে ধরেছে আর তার রূপক ছুরিও বের করেছে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একবারও পেছন না ফিরে চলে গেল।

.

মেসোর মাসের প্রথম দিনে জারাস অগ্রগামী দলটি নিয়ে লোহিত সাগরের তীরে সাগাফা বন্দরে পৌঁছলো। সেখানে পৌঁছেই সে একটা কবুতর উড়িয়ে দিয়ে খবর পাঠাল যে, সাগরের তীরে ধাউ আর বজরার একটি বহর সে খুঁজে পেয়েছে। এগুলো আমাদের পুরো কাফেলাটি সাগর পার করে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি সামনে এগোবার নির্দেশ দিলাম।

কাফেলার একেবারে সামনে থেকে ফারাও ঘোড়ায় চড়ে আমাদের সাথে চললেন। নীল নদীর কাছে পাহাড়টির কাছে পৌঁছেই সবাই ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো।

ফারাওয়ের দুই পাশে কুশন লাগানো টুলে দুই রাজকন্যা বসলেন। সভাসদ আর উচ্চপদস্থ রাজকর্মকর্তারা এই তিনজনকে ঘিরে একটি বৃত্ত তৈরি করলো। তারপর ফারাও আমাকে ডাকতেই আমি তার কাছে এসে হাঁটুগেড়ে বসলাম। তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

আমি আমার সকল প্রিয় এবং অনুগত প্রজাদেরকে এই অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে আহ্বান জানাচ্ছি।

তেহুতি আর বেকাথাসহ সকলে বলে উঠলো, ফারাওয়ের জয় হোক! তার ইচ্ছাকে সম্মানিত আর মান্য করা হোক!

ফারাও দুই হাত দিয়ে শিকারী বাজপাখির ছোট্ট একটি সোনার মূর্তি মাথার উপর তুলে ধরলেন।

এটা আমার বাজপাখির সীলমোহর আর আমার প্রতীক। এর বহনকারী ঈশ্বর-প্রদত্ত আমার সকল অধিকার নিয়ে কথা বলবে। উপস্থিত সকলে এটি লক্ষ্য করুন আর আমার ক্ষমতা আর আমার ভয়ানক রোষ সম্পর্কে সতর্ক হোন।

তখনও হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায় থেকে আমি দুই হাত পেতে সামনে ধরতেই ফারাও ঝুঁকে বাজপাখির সীলমোহরটা আমার হাতে দিলেন।

বিচক্ষণতার সাথে এটা ব্যবহার করুন সম্মানিত তায়তা। আবার পরবর্তী সাক্ষাতের সময় এটা আমাকে ফেরত দিন।

আমি পরিষ্কার কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললাম, হে মিসরাধিপতি, আপনার আদেশ শিরোধার্য।

তিনি আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হোরাস এবং মিসরের অন্যান্য সকল দেবতার শুভ দৃষ্টি আপনার উপর বর্ষিত হোক।

তারপর তিনি ঘুরে তার বোনদেরকে বিদায় জানালেন। এরপর তিনি ঘোড়ায় চড়তেই দেহরক্ষীর দল তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর ঢাল বেয়ে নেমে দ্রুত দলবলসহ নীলনদের তীরে থিবসের দেয়ালের দিকে চললেন। কাফেলার শেষ অংশটুকু পার হয়ে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

টিলার উপরে ক্রীতদাসেরা আমাদের বসার জন্য উটের লোমের তৈরি আসন বিছাল আর রোদ থেকে ছায়া দেবার জন্য মাথার উপর চাঁদোয়া টাঙাল। আমরা নিচে দূরে ফারাও আর তার সভাসদদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইতোমধ্যে কাফেলার অগ্রভাগ আমাদের কাছে এসে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে চললো।

প্রথমে ছিল কুমির রক্ষীদলের একটি পল্টন। তাদের ঠিক পেছন পেছন চলেছে পঞ্চাশটি উট আর এগুলোর আরব চালক। প্রতিটা উটের পিঠের কুঁজের দুই পাশে দুটো করে চারটি পানিভরা বিশাল চামড়ার মশক ঝুলছে। এগুলোর উপর নির্ভর করেই আমাদেরকে আরবের বিশাল মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে।

পানির মশকবহনকারী উটের সারির পেছনেই ঘোড়ায় চড়ে চলেছে কুমির রক্ষীবাহিনীর আরেকটি পল্টন। এরা পানির সরবরাহটি রক্ষা করবে আর যদি আমাদের উপর কোনো শত্রুর হামলা হয় তখন প্রয়োজন পড়লে পেছনে রাজকুমারীদের নিরাপত্তার কাজে সহায়তা করবে।

যদিও আমি সিনাই উপদ্বীপ থেকে অনেক দূরে দক্ষিণ আর পূর্ব দিকে দিয়ে আমাদের যাত্রাপথ পরিকল্পনা করেছিলাম, তারপরও আমি কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নই। হাইকসোরা এই জায়গাটি তাদের অধীনস্থ এলাকা মনে করে আর গোরাব কোনোভাবে আমাদের পরিকল্পনা জানতে পারলে তার রথিবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের যাত্রায় বাধা দিতে পারে।

এই দুই রক্ষীবাহিনীর পেছনে আরও পঞ্চাশটি উট তাঁবু, আসবাবপত্র আর অন্যান্য সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে চলেছে। যাত্রাপথে প্রতিটি বিশ্রাম নেবার জায়গায় তাবু গাড়তে এগুলো প্রয়োজন হবে।

এর পেছনে পায়ে হেঁটে চলেছে তবু অনুসরণকারী, ভৃত্য আর ক্রীতদাসের দল। কাফেলার পরের অংশে রয়েছে আরও বিশটি এক কুঁজওয়ালা উট। এগুলো রূপার মুদ্রার ভারী বস্তাগুলো বহন করছে।

সবার শেষে ছিল কাফেলাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া কুমির রক্ষীবাহিনীর তৃতীয় পল্টন, অতিরিক্ত ঘোড়া, উট আর মালবাহী গাড়ি। আমরা যেখানে বসেছিলাম তার সমান সমান এগুলো আসতেই আমি আমাদের তবু গুটিয়ে নিতে নির্দেশ দিলাম।

ঘোড়ায় চড়ে সামনে এগিয়ে আমরা মরুভূমির উপর দিয়ে চলা এক লিগ দীর্ঘ এই মিছিলের ঠিক মধ্যখানে আমাদের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছলাম। বেয়াড়া রকম আকৃতির আর ধীর গতিতে চলা মানুষ আর পশুর এই দীর্ঘ মিছিলটি দশ দিন পর লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরে পৌঁছল।

.

সাগাফা বন্দর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে জারাস আমাদের সাথে দেখা করলো। সে আর তার প্রহরী ঘোড়ায় চড়ে কাফেলার পেছন দিকে একটু পিছিয়ে রাজকীয় দলের কাছে পৌঁছতেই দুই রাজকুমারীকে দেখতে পেয়ে ঘোড়া থেকে নামলো।

তেহুতির সামনে এক হাঁটুগেড়ে বসে সে এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকে অভিবাদন জানাল। প্রত্যুত্তরে তেহুতিও তার দিকে তাকিয়ে একটি প্রাণোচ্ছল হাসি দিল।

ক্যাপ্টেন জারাস, আমি খুবই খুশি যে, ব্যবিলন পর্যন্ত সফরে আপনাকে আমরা পাবো। তামিয়াত দুর্গ থেকে আপনি আর প্রভু তায়তা ফেরার পর, আবৃত্তির ঢঙে সেখানে অভিযানের যে চমৎকার ধারা বর্ণনা আপনি দিয়েছিলেন, তা আমার ভালো মনে আছে। আমি খুব খুশি হবো যদি আপনি আমাদের সাথে আজ নৈশভোজে অংশ নেন আর কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। আর ব্যবিলন পর্যন্ত সফরের বাকি অংশের বিষয়ে আমার ইচ্ছা এবং নির্দেশ যে, আপনি কাফেলা পাহারা দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব অন্য কর্মকর্তার হাতে দিয়ে সরাসরি আমার বোন আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেন।

আমি তাকে শোনাবার জন্য বেশ জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম কিন্তু সে আমার চাপা প্রতিবাদ পুরোপুরি উপেক্ষা করে সমস্ত মনোযোগ জারাসের দিকে দিল। জারাসকে বেশ অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল আর উত্তর দিতে গিয়ে সে একটু তোতলাতে লাগলো। এই প্রথম তাকে এরকম করতে দেখলাম।

মহামান্য রাজকুমারী, আপনার নির্দেশ শোনা মানেই তা পালন করা। তবে অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমাকে এখুনি প্রভু তায়তার কাছে হাজির হতে হবে, যার হাতে ফারাও এই কাফেলার নেতৃত্ব দিয়েছেন আর যাকে রাজকীয় বাজপাখির সীল মোহর দিয়ে বিশ্বাস করেছেন।

আমার প্রতি জারাসের বিশ্বস্ততা আর কার হাতে পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে, তা তেহুতিকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করতে দেখে আমি খুশি হলাম। সে বেচারা এখন তেহুতির কাছ থেকে পালিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।

তার মাথার উপর আঘাত হানা এই রাজকীয় ঝড়ের তাণ্ডব থেকে তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখলাম। তার কোনো নির্দেশ অমান্য হোক, তেহুতি তা মোটেই সহ্য করে না। তবে সে আবার আমাকে অবাক করলো। জারাসকে থামিয়ে না দিয়ে সে বরং মৃদৃ হেসে মাথা নেড়ে বললো, অবশ্যই তাই করুন ক্যাপ্টেন জারাস। একজন সৈনিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

জারাস আমার পাশে আসতেই আমি একটু পিছিয়ে রাজকুমারীদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে এলাম, যাতে ওরা আমাদের কথা শুনতে না পারে। টিলার নিচেই সাগরের তীরে সাগাফার দালানকোঠাগুলো দেখা যাচ্ছে।

আমার ইঙ্গিত পেয়ে জারাস গলা নামিয়ে জানাল যে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করার সময় সে সুযোগ পেয়ে একটি দ্রুতগামি ধাউ নিয়ে দূরের সাগর সৈকতে এলো–কুম জেলে পল্লীতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল যে, আমাদের বেদুঈন পথপ্রদর্শক আমাদের নির্দেশ পেয়ে তার লোকজন নিয়ে আমাদেরকে আরব মরুভূমি পার করাবার জন্য অপেক্ষা করছে কি না।

সে একই লোক আল-নামজু, যে আমাদেরকে সিনাই উপদ্বীপ পার করে মধ্য সাগরের তীর আর তামিয়াত দুর্গে নিয়ে গিয়েছিল।

জারাস খুশি হয়ে বললো, আপনি জেনে খুশি হবেন যে, আমাদের আসার খবর পাওয়ার পর গত দুই মাস ধরে আল-নামজু এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তার সাথে তার দুই ছেলেও রয়েছে। তবে সে তাদেরকে সামনে কাফেলা চলার পথে পানির উৎস আর মরুদ্যানগুলো দেখতে পাঠিয়েছে।

আমি তাকে বললাম, শুনে আস্বস্ত হলাম। তারপর এক পাশে তাকিয়ে আবার বললাম, বলে যাও জারাস। মনে হয় তোমার আরও কিছু বলার আছে। সে একটু চমকে তাকাল।

তারপর বললো, আপনি কী করে জানলেন তার কথা থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, আমি কীভাবে জানলাম? আমি এজন্য জেনেছি যে, আমি জানি তুমি কোনো কথা লুকিয়ে রাখতে পারো না। এটাকে একটা দোষের চেয়ে বরং আমি গুণ বলবো।

সে মাথা নেড়ে বললো, আমরা অনেকদিন ধরে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি প্রভু। আমি ভুলে গিয়েছিলাম কীভাবে আপনি মানুষের মনের ভাবনা পড়তে পারেন। তবে আপনার কথাই ঠিক। আমি আরেকটি বিষয় আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম, তবে ভয়ও পাচ্ছিলাম, হয়তো আপনি মনে করতে পারেন যে, আমি শুধু শুধু আতঙ্কে ভূগছি।

আমি তাকে নিশ্চিত করে বললাম, তোমার কোনো কথাই আমাকে এ ধরনের ধারণা করতে দেবে না।

তাহলে বলছি শুনুন, যখন আমরা আল-নামজুর শিবিরে ছিলাম, তখন তিনজন শরণার্থীকে মরুভূমি থেকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভীষণ আহত আর পিপাসায় কাতর লোকগুলো খুবই দুর্দশাগ্রস্ত ছিল। সত্যি বলতে কী আল-নামজুর তাঁবুতে আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মারা গেল, আর আরেকজন কথা বলতে পারছিল না।

আমি বললাম, কেন? কী হয়েছিল ওদের?

প্রথমজনের সারা শরীরে গরম তলোয়ারের হ্যাঁকার দাগ ছিল। তার সারা শরীর পুড়ে গিয়েছিল। মরতে পেরে বরং সে দারুণ কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে। অন্য লোকটির জীব কেটে ফেলা হয়েছিল, সে একটা পশুর মতো গোঙাছিল।

আমি জারাসকে বললাম, দয়াশীল হোরাসের দিব্যি, কী হয়েছিল ওদের?

তৃতীয় লোকটির তেমন যখম হয়নি। সে জানাল, সে ছিল একটি কাফেলার প্রধান ব্যক্তি। পঞ্চাশটি উট আর সমসংখ্যক নারীপুরুষসহ সে তুরক নগর থেকে লবণ আর তামা নিয়ে আসছিল। পথে দস্যু জাবের আল-হাওয়াসাঈ তাদের উপর হামলা করে। এই লোকটি শেয়াল নামেই পরিচিত।

আমি বললাম, আমি তার কথা শুনেছি। আরবের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লোক সে।

তাকে ভয় করার অনেক কারণ আছে। শুধু খেলাচ্ছলে সে কাফেলার অন্যান্য নারীপুরুষদের খাসী করে আর নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে। অবশ্য এই শেয়াল আর তার লোকেরা বন্দীদেরকে হত্যা করার আগে নারীপুরুষ সবার। উপর যৌন নির্যাতন চালায়।

এই শেয়াল এখন কোথায়? এই লোক কী জানে সে কোথায় গেছে?

না। সে আবার মরুভূমির বুকে হারিয়ে গেছে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, সে কাফেলার পথে ওঁৎ পেতে থাকবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তেহুতি ঘোড়ায় চড়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে জিনে বসে ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, এতো মনোযোগ দিয়ে তোমরা দুজন কী আলাপ করছো? এখানে এসে আমার আর বেকাথার পাশাপাশি চল। আর যদি তুমি জারাসকে গল্প শুনিয়ে থাক তবে আমরাও তা শুনবো।

তার কথা আমিও দুবার না মেনে পারি না।

আমরা দুজনেই ঘোড়া নিয়ে দুই রাজকুমারীর পাশাপাশি চলতে শুরু করলাম। বেশ কৌশল করে তেহুতি আমার আর জারাসের মাঝে তার ঘোড়াটা নিয়ে এলো, যাতে আমরা তাকে না শুনিয়ে কোনো আলোচনা করতে না পারি। সেই মুহূর্তে এবড়োথেবড়ো পাথুরে পথটি একটি পাহাড়ের চূড়ায় এসে শেষ হতেই তেহুতি ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো।

দেখো! ঐ যে তাকিয়ে দেখো! এতো চওড়া আর এতো নীল কোনো নদী কখনও দেখেছ? শিংওয়ালা দেবতা হোরাসের দিব্যি, এটা আমাদের নীলনদের চেয়ে একশো গুণ বেশি চওড়া হবে। আমি তো এর অন্য পারও দেখতে পাচ্ছি না।

জারাস তাকে জানাল, এটা নদী নয় মহামান্য। এটি লোহিত সাগর।

তেহুতি সোৎসাহে বললো, কী বিশাল। জারাস তাকে ভালোভাবে চেনে, সে বুঝতে পারেনি যে তেহুতি না জানার ভান করছে। এটি নিশ্চয়ই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাগর?

জারাস তার ভুল সংশোধন করে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বললো, না রাজকুমারী। এটা সমস্ত সাগরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। মধ্যসাগর সবচেয়ে বড় আর জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনুমান করে বলেছেন, বিশাল অন্ধকার মহাসাগর, যার উপর পৃথিবী ভাসছে তা আরও বড়।

তেহুতি চোখ বড় বড় করে প্রশংসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে, ক্যাপ্টেন জারাস, আপনি তো অনেক কিছু জানেন, প্রায় প্রভু তায়তার মতো। আপনাকে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা বেকাথা আর আমার সাথে ঘোড়ায় চড়ে এসব বিষয় জানাতে হবে।

তেহুতিকে এতো সহজে তার মত থেকে ফেরানো সম্ভব নয়।

.

আরব মরুভূমি পাড়ি দেওয়া গত বছরের তামিয়াত দুর্গের অভিযানের চেয়ে অনেক কষ্টকর আর দুর্গম প্রমাণিত হল। সেবারের অভিযানে দুশো জনের চেয়ে কম লোক নিয়ে দ্রুত কম লটবহর নিয়ে গিয়েছিলাম। মিসর আর সিনাই উপদ্বীপের মাঝে কেবল সুয়েজ উপসাগর পার হতে হয়েছিল। সেটা পঞ্চাশ লিগের চেয়ে কম চওড়া ছিল।

এবার আমাদেরকে সিনাই উপদ্বীপে না ঢুকে যতদূর সম্ভব দক্ষিণ দিক দিয়ে যেতে হচ্ছে। সিনাই উপদ্বীপে ঢুকলে গোরাব তার রথি বাহিনী পাঠিয়ে আমাদেরকে বাধা দিতে পারতো।

বাধ্য হয়েই আমাদেরকে লোহিত সাগরের মূল অংশের সবচেয়ে চওড়া জায়গা দিয়ে পার হতে হচ্ছে। পঞ্চাশটি ভোলা ধাউয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ আর পশু নিয়ে প্রায় দুশো লিগের চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। ছোট নৌকাগুলোতে এক সাথে কেবল দশটা উটের জায়গা হয়। এতে বেশ কয়েকবার পারাপার করতে হবে।

সমস্তু কিছু বিবেচনা করে আমি ধারণা করেছিলাম পুরো কাফেলা আরবে নিতে আমাদের কমপক্ষে দুইমাস লাগবে।

রাজপরিবারকে মিসরীয় তীরে রেখে কাফেলার মূল অংশ সাগর পার হতে শুরু করলো। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম রাজকুমারীদেরকে যাতে একঘেয়েমিতে পেয়ে না বসে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে, কিংবা ওদের হাতে বেশি অবসর সময়ও দেওয়া যাবে না।

রাজপরিবারকে কাফেলার বাদবাকি অংশ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। আমাদের কাফেলাটি আকারে একটি ছোট গ্রামের মত হলেও এখানে একটি বড় শহরের সবধরনের সুবিধা আর আরাম আয়েশ ছিল।

কয়েকদিন পর পর রাজকুমারীদের নিয়ে আমি শিকারে যেতাম। আমরা মরুভূমির চ্যাপ্টা পায়ের ছোট হরিণ শিকার করতাম কিংবা পাহাড়ে উঠতাম, যেখানে দীর্ঘ বাঁকানো শিংয়ের পাহাড়ি বুনো ছাগলের বিচরণ ছিল। এগুলোতে বিরক্তি ধরে গেলে মেয়েরা সাগরতীরে ঝাঁক বেঁধে থাকা অসংখ্য বুনো হাস আর রাজহংসির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিকারি বাজ উড়িয়ে দিত।

অনেকসময় ছোট দ্বীপে বনভোজনের আয়োজন করতাম। মেয়েরা সেখানে সাঁতার কাটতে কিংবা পানির নিচে প্রবাল জঙ্গলে তলোয়ার মাছ আর বড় সামুদ্রিক মাছের উপর বর্শা ছুঁড়ে শিকার করতো।

তবে সকালে আমি ওদেরকে পড়াশুনা করতে বাধ্য করতাম। কাফেলার সাথে দুজন পণ্ডিত নিয়ে এসেছিলাম, যারা ওদেরকে লেখা, গণিত আর জ্যামিতি শেখাত। শ্রেণীকক্ষের কঠিন অধ্যয়নের ফাঁকে ফাঁকে আমোদ ফুর্তি আর মেয়েলি হাসি ঠাট্টাও চলতো। সারাদিনে এটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। ওরা লক্সিয়াসের সাথে মিনোয়ান ভাষায় আড্ডা দিত। আমাকে বাদ দিত যেন আমি এই ভাষার একটি শব্দও বুঝি না। তিন জনের মধ্যে বয়সে লক্সিয়াস সবচেয়ে বড় হওয়ায় সে ওদের মেয়েলি নিষিদ্ধ আলাপগুলোতে সবজান্তা ভূমিকা পালন করতো। তবে পরিষ্কার বোঝা যেত তার সমস্ত বিদ্যা ছিল পুঁথিগত, তাই বিশদ বিবরণগুলো সে বানিয়ে বানিয়ে বলতো।

এইসব আলোচনার মধ্য দিয়ে আমি ওদের মনে কী ভাবনা চলছে তা জানতে পারতাম।

ওরা ওদের ভালোবাসার গল্প বলতো। লক্সিয়াস রেমরেমকে পছন্দ করতো। তবে তার সামনে হাজির হলে সে একেবারে পাথরের মূর্তির মতো হয়ে যেত। চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যেত, মুখে কোনো কথা যোগাত না। আমার মনে হয় রেমরেম রাজকীয় পরিষদের একজন সম্মানিত-সদস্য আর সে নিজে একজন সাধারণ মানুষ এবং বিদেশি, এই সত্যটুকু তার মনে সম্ভ্রম মিশ্রিত ভয় জাগিয়ে তুলতো। তবে রেমরেম যে বয়সে তার চেয়ে দ্বিগুণ বড়, তিনটে বউ আছে আর তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসিন এতে সে কিছু মনে করতো না।

এদিকে বেকাথা বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার আর রথি হুইয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। সে মোটেই জানতো না যে, যখন তাকে আমি বন্দী করেছিলাম, তখন সে কুখ্যাত অপরাধি বস্তির রক্তের সম্পর্কের ভাই ছিল। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে সভ্য করে তুলেছিলাম। কিন্তু তারপরও অনেক সময় সে বর্বরোচিত আচরণ করতো, বিশেষত কৌতুক করার সময়। বেকাথা তার সাথে রথে চড়তে ভালোবাসতো। যখন সে এবড়োথেবড়ো জমির উপর দিয়ে রথ চালিয়ে নিয়ে যেত, তখন সে দুহাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতো। ওরা অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের অর্থহীন রসিকতা করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়তো। আর অনেক সময় ভোজ টেবিলে বসে খাওয়ার সময় বেকাথা তার দিকে রুটির টুকরা কিংবা ফল ছুঁড়ে মারতো।

তেহুতি এসমস্ত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতো আর কেউ এ বিষয়ে তাকে চাপাচাপি করতো না।

সন্ধ্যায় আমরা বিভিন্ন রকম ধাঁধা, কবিতা, গান গেয়ে আর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সময় কাটাতাম।

এভাবেই আমার তত্ত্বাবধানে থাকা এই তিন বালিকাকে আমি বিপজ্জনক কোনো কিছু করা থেকে বিরত রেখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত মূল কাফেলা সাগর পার হওয়ার পর আমাদের যাওয়ার সময় এলো।

আথির মাসের পনেরোতম দিনে সূর্য উঠার আগে আমরা সাগর সৈকতে সমবেত হলাম। তেহুতি আর বেকাথার সাহায্যে তিন নারী-পুরোহিত হাথোর দেবীর উদ্দেশ্যে একটি সাদা ভেড়া বলি দিল।

দেবীর কাছে আমরা প্রার্থনা করলাম–যদি তিনি আমাদের প্রতি সদয় হোন এবং নিরাপদে সাগর পার করে দেন তাহলে আমরা তার উদ্দেশ্যে একটি উট বলি দেবো। এই মানতের পর আমরা ধাউয়ে চড়ে রওয়ানা হলাম।

দেবী নিশ্চয়ই আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন মিসরের দিক থেকে একটি দমকা হাওয়া পালে লেগে আমাদের নৌবহরকে দ্রুত ভাসিয়ে নিয়ে চললো। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই আফ্রিকা আমাদের পেছনে ঢেউয়ের নিচে মিলিয়ে গেল।

অন্ধকার হতেই প্রতিটি জাহাজের মাস্তুলের ডগায় একটা করে তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হল, যাতে একে অপরকে দেখতে পারি। আকাশের তারা দেখে পথ ঠিক রেখে আমরা পুবমুখি চলতে লাগলাম। ভোর হতেই দূরে পরিষ্কার নীল আকাশের বিপরীতে আরবের তটরেখা নজরে পড়লো। সারাদিন দাঁড় বেয়ে চলার পর যখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তের এক হাত উপরে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন কুমিররক্ষীবাহিনীর পঞ্চাশজন সদস্য হাঁটু পানিতে নেমে ধাউগুলো টেনে সৈকতের শুকনো বালুভূমিতে নিয়ে তুললো। মেয়েরা তাদের সুন্দর ছোট ছোট পা না ভিজিয়ে এশিয়ার মাটিতে পা রাখতে পারলো। আমাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আমার পূর্বনির্দেশ মতো রাজকীয় শিবির উঁচুভূমিতে স্থাপন করা হয়েছিল।

তবে এখানে বেশি দেরি করলাম না, কেননা প্রতিদিন প্রচুর মূল্যবান সুপেয় পানি খরচ হচ্ছিল।

মূল কাফেলাটি আর মালপত্র বেশ কয়েকদিন আগেই চলে গেছে। ইতোমধ্যে ওরা নিশ্চয়ই একশো লিগেরও বেশি দূরত্ব পার হয়েছে। আরবভূমিতে নামার পরদিন আমরা ঘোড়া আর উটে চড়ে রওয়ানা দিলাম।

.

সাগর থেকে যতই দূরে এগিয়ে চললাম, ততই সূর্য মাথার উপর প্রচণ্ড তাপ ছড়াতে শুরু করলো। দূপুরের রোদে চলা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। এরপর থেকে আমরা শেষ বিকেলের দিকে যখন সূর্যের তাপ কমে আসে তখন চলতে লাগলাম। সারারাত চলার পর ঘোড়া আর উটগুলোকে পানি দেওয়ার জন্য মধ্যরাতে কেবল এক ঘন্টা থামলাম। মূল কাফেলা থেকে পথের পাশে এগুলো আমাদের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিল। তারপর আবার ভোরে সূর্য ওঠার পর চলতে লাগলাম। এরপর যখন দুপুরের দিকে সূর্যের তাপ অসহনীয় হয়ে উঠলো, তখন আবার সেখানেই তাঁবু গেড়ে ছায়ার নিচে শুয়ে ঘামতে লাগলাম। সূর্য অস্তাচলে নামতেই আবার যাত্রা শুরু করতাম। এভাবেই চক্রাকারে চলতে লাগলো।

পনেরো দিন আর রাত এভাবে চলার পর, শেষ পর্যন্ত মূল কাফেলার কাছে এসে পৌঁছলাম। ইতোমধ্যে চামড়ার পানির মশকগুলো অর্ধেকেরও বেশি খালি হয়ে এসেছে। শুধু তলানিতে কয়েক গ্যালন সবুজ রঙের কটু স্বাদের পানি পড়ে রয়েছে। আমি জনপ্রতি প্রতিদিন বাধ্যতামূলক চার মগ পানি বরাদ্দ করলাম।

এবার আমরা আসল মরুভূমিতে ঢুকেছি। সামনে একের পর এক অসংখ্য বালিয়াড়ি যতদূর দেখা যায় চলে গেছে। আমাদের ঘোড়াগুলোর মধ্যে নিদারুণ যন্ত্রণার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পিঠে খুব হালকা ভার নিলেও নরম বালিতে পা ডেবে গিয়ে ঘোড়াগুলোর চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি ঘোড়াগুলো আরোহী মুক্ত করে অন্যান্য মুক্ত ঘোড়ার দলের সাথে কাফেলার সামনের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। আর কয়েকটি শক্তিশালী উট বেছে নিয়ে মেয়েদেরকে আর দলের অন্যান্যদেরকে তাতে চড়তে বললাম।

আল-নামজু আমাকে নিশ্চিত করলো সামনের পানির উৎসটি আর মাত্র কয়েকদিনের পথ। কাজেই আমি মেয়েদেরকে নিয়ে জারাস আর তার দলের লোকদের সাথে নিয়ে পানির কাছে পৌঁছাবার জন্য মূল কাফেলা ছেড়ে আগে আগে চলতে শুরু করলাম।

আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আল-নামজু তার বড় ছেলে হারুনকে সাথে দিয়েছিল। মূল কাফেলা থেকে দ্রুত এগিয়ে আমরা সারারাত চললাম, তারপর ভোরের প্রথম আলো দেখা দিতেই হারুন বিশাল একটি লাল ইট রঙা বালিয়াড়ির উপরে এসে থেমে দাঁড়াল। তারপর সামনের দিকে হাত তুলে দেখাল।

সামনেই একটা পাহাড়ের চূড়া দেখা গেল। লম্বা লম্বা দাগযুক্ত পাহাড়টির অনুভূমিক স্তরগুলো ছিল বিভিন্ন রংয়ের, সোনালি থেকে শুরু করে চকের মতো সাদা তারপর লাল, নীল আর কালো। কয়েকটি স্তর বাতাসে ক্ষয়ে গিয়ে অন্যান্য স্তর থেকে আরও গাঢ় রং ধরেছে। এগুলো কতগুলো ঝুল বারান্দা আর গভীর দীর্ঘ গুহা তৈরি করেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে যেন একজন উন্মাদ স্থপতি এগুলো তৈরি করেছে।

হারুন জানাল, এর নাম ময়াগুহা। আরবি এই নামটি অনুবাদ করে আমি বুঝলাম এর নাম, পানির গুহা।

হারুন আমাদেরকে এই খাড়া পাথুরে দেয়ালের নিচে নিয়ে গেল। একেবারে গোড়ায় এক পাশে একটা নিচু ছাদওয়ালা ফাটল চলে গেছে। একজন লম্বা মানুষ বাঁকা না হয়েও ঢুকতে পারবে, তবে একশো কদমের বেশি চওড়া আর গভীর। আর এমন অন্ধকার যে, আমি উপর থেকে দেখে বুঝতে পারলাম না এটা কতদূর পর্যন্ত চলে গেছে।

হারুন বললো, এই গুহার নিচে পানি রয়েছে। রাজকুমারীরা আর লক্সিয়াস তাদের উটগুলোকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে কাঠের বাকা জিন থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামলো। আমি ওদেরকে গুহামুখ দিয়ে ভেতরে নিয়ে চললাম। আর জারাস তার লোকজনসহ বাইরেই অপেক্ষামান থাকলো।

আমাদের পায়ের নিচে পাথরের মেঝেটি ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়ে নেমে গেছে, আর যতই আমরা নিচে নামলাম ততই দিনের আলো কমতে লাগলো আর বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এল। একসময় বাইরের সূর্যের তাপের তুলনায় তাপমাত্রা এমন কমে গেল যে আমরা কেঁপে উঠলাম।

এবার আমি পানির গন্ধ অনুভব করলাম, আর পানি পড়ার ঝির ঝির শব্দও শুনতে পেলাম। আমার গলা পিপাসায় কাঠ হয়ে রয়েছে, ঢোক গিলতে পারছিলাম না। মুখে কোনো লালা নেই। মেয়েরা আমার হাত ধরে টেনে আমাকে নিচের দিকে নিয়ে চললো।

সামনেই বিরাট একটা জলাধার দেখা গেল। গুহা মুখ থেকে আসা আলো পানির উপর পড়ে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে। সেই আলোর কারণে মনে হল পানির রং একদম কালো। আর ইস্ততত না করে কাপড়চোপড় আর স্যান্ডেলসহ আমরা সবাই পানির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি হাঁটু গেড়ে বসে পানির কাছে চিবুক নামিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম আর দেখলাম পানির রং কালো তো নয়ই বরং তেহুতিকে যে হীরাটি দিয়েছিলাম, সেই হীরার মতো টলটলে পরিষ্কার। মুখ ভরে পানি নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।

মেয়েরা জলাধারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার আর ওদের পরস্পরের গায়ে পানি ছিটিয়ে উল্লাসে আর ঠাণ্ডায় চেঁচিয়ে উঠলাম। ওদের চেঁচামেচি শুনে জারাস ওর লোকজনসহ ঢালু মেঝে বেয়ে নিচে নেমে এলো। চিৎকার করে হাসতে হাসতে ওরাও অন্ধকার পানিতে নেমে পড়লো।

পেটপুরে পানি খাওয়ার পর জারাসের লোকেরা সাথে যে পানির মশক নিয়ে এসেছিল, সেগুলো ভরে বাইরে উটের জন্য নিয়ে গেল।

.

হারুন হিসাব করে আমার সাথে একমত হল যে, মূল কাফেলার এখানে আসতে আরও তিনদিন লাগবে। এতে আমি খুব একটা উদ্বিগ্ন হলাম না, কেননা ক্লান্ত মেয়েরা একটু বিশ্রাম নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে।

তবে আমার আসল দুশ্চিন্তা ছিল এই জায়গাটির অরক্ষিত অবস্থানটি নিয়ে। চারপাশের একশা লিগের মধ্যে যেসব বেদুঈন গোষ্ঠি রয়েছে তাদের সবার নিশ্চয়ই এই পানির গুহার অবস্থান জানা আছে। আমাদের দলটি ছোট হলেও, সাথের পশু, অস্ত্রশস্ত্র আর বর্মগুলো বেদুঈন গোষ্ঠিদের কাছে খুবই দামী, বিশেষত দস্যুদের কাছে অবশ্যই আকর্ষণীয়। ওরা যদি জানতে পারে আমরা এই পানির গুহার কাছে রয়েছি আর আমাদের দলটি ছোট, তাহলে বেশ বিপদের সম্ভাবনা আছে। আমাদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে যেন কেউ অতর্কিতে আক্রমণ করে বসতে না পারে।

জারাস তার লোকজনসহ পানি থেকে উঠে এলে আমি চতুর্দিকে পাহারা বসালাম।

তারপর জারাস আর হারুনকে নিয়ে চারপাশে সম্প্রতি কোনো মানুষজনের আনাগোনা হয়েছিল কিনা তার চিহ্ন দেখতে বের হলাম।

আমরা তিনজনেই অস্ত্র নিলাম। আমি এক কাঁধে আমার লম্বা ধনুকটি আর অন্য কাঁধে ত্রিশটি তীরভর্তি তূণ ঝুলিয়ে নিলাম। আর ডান কোমরের খাপে ব্রোঞ্জের তরবারিটাও নিলাম।

সবচেয়ে কাছের বালিয়াড়ির মাথায় পৌঁছে আমরা আলাদা হলাম। তবে ঠিক করলাম, এক ঘন্টা পর সূর্য যখন মধ্য গগনে আসবে তখন আবার সবাই ময়াগুহায় ফিরে আসবো। জারাসকে উত্তরদিকে চক্রাকারে ঘুরে আসতে পাঠালাম। হারুন গেল উপত্যকার নিচে যে কাফেলা পথটি রয়েছে সেটা পরীক্ষা করতে। আর আমি দক্ষিণে উঁচু বালিয়াড়িগুলোর দিকে চললাম।

চারদিক খোলা, লুকাবার কোনো জায়গা নেই। তারপরও আমি চেষ্টা করলাম এমনভাবে চলতে যাতে দূর থেকে কোনো শত্রু দেখতে না পায়।

চারপাশের দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধ হলাম, রুক্ষ হলেও প্রকৃতি খুবই সুন্দর। শান্ত সাগরের বোবা ঢেউয়ের মতো একের পর অন্তহীন বালিয়াড়ি চলে গেছে। বাতাসের ঝাঁপটায় বালুর ঢেউয়ের এই চূড়াগুলো ক্ষয় হয়ে আমার চোখের সামনেই আকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। কোনো মানুষের পায়ের ছাপ কিংবা পশুর ক্ষুরের চিহ্ন থাকলে দ্রুত মুছে যাবে।

বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেও সাম্প্রতিক কোনো মানুষ কিংবা পশুর আসার চিহ্ন এই অন্য জগতে দেখতে পেলাম না। হঠাৎ পায়ের কাছে চোখে পড়লো বালুর ভেতর থেকে রোদেপোড়া একটা হাড়ের টুকরা চকচক করছে। নিচু হয়ে হাড়টা বালু থেকে বের করে দেখলাম সোয়োলোর মতো একটা রাতের পাখির মাথার খুলি আর হা করা ঠোঁট। বাতাস নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে।

আমি আবার ঘুরে বালিয়াড়ির একপাশ দিয়ে গড়িয়ে নামলাম। নিচে নেমে ভূগর্ভস্থ পানির গুহাটির কাছাকাছি আসতেই ভেতর থেকে মেয়েলি গলার হাসাহাসির চিৎকার শুনতে পেলাম।

জারাস আমার আগেই ফিরে এসেছে। সে আর তার লোকজন উটের পিঠ থেকে নেমে পশুগুলোকে গুহামুখের কাছেই প্রাকৃতিক ঝুলবারান্দার নিচে ছায়ায় বেঁধে রাখলো। তারপর ওরা উটগুলোকে দানাপানি দিতে শুরু করলো। আমি জারাসকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,

কিছু পেলে?

না, কিছুই নেই।

হারুণ কোথায়? সে এখনও ফেরেনি?

সে উত্তর দিল, এখনও আসেনি। শিঘ্রই হয়তো এসে যাবে। আমি গুহামুখটার কাছে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করলাম। সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক আর মনে হচ্ছে ঠিক আছে। তারপরও বুঝতে পারলাম না কী কারণে আমার মন অস্থির হয়ে উঠেছে, আর কোনোমতেই এই উদ্বেগের ভাবনাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না।

গুহায় না ঢুকে পাহাড়ের একপাশ দিয়ে ঘুরে বিপরীত দিকে চললাম। গুহা মুখের কাছ থেকে সরে আমি পেছন দিকে এমন একটা জায়গায় এলাম যেখানে খাড়া পাহাড়ের গায়ে আরেকটি ফাটল দেখা গেল। এই ফাটলটা আগে দেখিনি। এক মুহূর্ত এটা পরীক্ষা করে ভাবলাম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখা যাক অন্য পাশে কী আছে। হাত বাড়িয়ে সামনে পাহাড়ের গায়ে হাত রাখলাম।

সূর্যের তাপে পাহাড়ের পাথর এতো গরম হয়ে রয়েছে যে, মনে হল জ্বলন্ত কয়লার উপর হাত রেখেছি। তাড়াতাড়ি ছ্যাকা লাগা হাতটা সরিয়ে নিতেই হাত থেকে পাখির মাথার খুলিটা নিচে পড়ে গেল। ছ্যাকা লাগা আঙুলটা চুষতে চুষতে পাখির মাথার খুলিটা নেবার জন্য হাত বাড়িয়েই থেমে গেলাম।

একটা পায়ের ছাপ, তবে আমার মেয়েদের কারও পায়ের ছাপ নয়। মসৃণ চামড়ার তলিওয়ালা স্যান্ডেল পরা একজন বড় পুরুষ মানুষের পায়ের ছাপ। এখনও পেছন থেকে মেয়েলি গলার আওয়াজ আর হাসিঠাট্টা আর জারাস আর তার লোকজনের কথা বলার অস্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে এমন একটি জায়গায় দাঁড়ালাম, যেখান থেকে গুহামুখের সামনে দাঁড়ান আমাদের লোকদের দেখা যায়। এক ঝলক তাকিয়েই যা জানতে চেয়েছিলাম, তা নিশ্চিত হলাম। আমাদের সব লোকেরা সামরিক বিধিসম্মত পিতলের গজালখচিত তলিওয়ালা স্যান্ডেল পরে রয়েছে।

তার মানে আমাদের মাঝে একজন আগন্তুক রয়েছে।

আমার পরবর্তী চিন্তা হল মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে গুহার ভেতর থেকে মেয়েদের কথা বলার আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করলাম। দুটো কণ্ঠ সাথে সাথে চেনা গেল, তবে তৃতীয়টি চিনতে পারলাম না। লোকদেরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে গুহায় ঢুকলাম। পিছল পাথরের মেঝে বেয়ে দ্রুত জলাধারের কাছে পৌঁছলাম। অন্ধকার সয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করে তাকিয়ে দুটো মেয়ের ফ্যাকাশে রমণীয় শরীর আবছা দেখতে পেলাম। ওরা পানি নিয়ে খেলছে। তবে শুধু দুজনকে দেখা গেল।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, বেকাথা! তেহুতি কোথায়?

পানি থেকে মাথা তুলে সে বললো, সে শেঠ দেবতার কাছে অর্ঘ্য দিতে গিয়েছে, তাতা! লাল-সোনালি চুলগুলো তার মুখে লেপ্টে রয়েছে।

দৈহিক নিত্যকার ক্রিয়াকর্ম অর্থাৎ মলমুত্র ত্যাগ করার কথা বলতে গিয়ে ওরা এ-ধরনের মেয়েলি ভাষা ব্যবহার করতো।

কোন দিকে গিয়েছে?

আমি দেখিনি। সে শুধু জানাল সে এটা করতে বাইরে যাচ্ছে।

তেহুতি একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের মেয়ে। আমি জানি এ-ধরনের শারীরিক ক্রিয়াকর্ম করার জন্য সে গোপন জায়গায় যাবে। এজন্য নিশ্চয়ই তার গুহার ভেতরে থাকার কথা নয়। নিশ্চয়ই বাইরে মরুভূমিতে গিয়েছে। আমি গুহামুখের কাছে ছুটে গেলাম। জারাস তার লোকজনসহ গুহামুখের বামদিকে জটলাবেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইরে পৌঁছেই আমি চিৎকার করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজকুমারী তেহুতিকে গুহা থেকে বের হতে দেখেছ?

না, প্রভু।

আর কেউ দেখেছে? তোমরা কেউ তাকে দেখেছ? সবাই মাথা নাড়লো।

তেহুতি হয়তো ওদেরকে এড়িয়ে গেছে, মনে মনে ভাবলাম। ঘুরে পেছন দিকে যেখানে নতুন পায়ের ছাপটা দেখেছিলাম সেদিকে ছুটলাম।

মিনতিভরে দেবতার কাছে প্রার্থনা করলাম, হে হোরাস, দয়া কর আমাকে! তারপর মনপ্রাণ দিয়ে দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলাম, আমার চোখ খুলে দাও, হে হোরাস। আমাকে দেখিয়ে দাও। হে আমার প্রিয় দেবতা, আমাকে দেখতে দাও!

কয়েকটি মুহূর্ত শক্ত করে চোখ বন্ধ করে রইলাম। তারপর যখন চোখ খুললাম, আমার দৃষ্টিশক্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মহান দেবতা হোরাস আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমি আমার অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে লাগলাম। চারপাশের রঙ আরও পরিষ্কার হল, আকৃতিগুলো আরও ধারালো হয়ে উঠলো।

পাহাড়ের দেয়ালের নিচের দিকে তাকিয়েই আমি তাকে দেখতে পেলাম। এটা তেহুতি নয়, তবে একটু আগে যেখানে সে ছিল এটা তার স্মৃতি। অনেকটা তার নিজের প্রতিধ্বনি কিংবা ছায়া। উজ্জ্বলতার পাশে একটু ময়লা দাগ, ধরা-ছোঁয়া যায় না এমন একটি ছোট মেঘ। এমনকি একজন মানুষের আকৃতিও নয়, কিন্তু আমি জানি এটা সে। নেচে নেচে দূরে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ আমার মনে হল তাকে কেউ তাড়া করছে, আর সে বিপদ থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করছে। আমার বুকের মাঝে তার আতঙ্ক আমি অনুভব করতে পারলাম।

গর্জে উঠলাম, জারাস, অস্ত্র হাতে নাও! পাঁচজনকে বেকাথা আর লক্সিয়াসের পাহারায় রেখে বাকিদের নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে আমার পিছু পিছু এস!

জানি জারাস আমার কথা শুনেছে, তাই আর পেছন দিকে না তাকিয়ে সোজা তেহুতির যে ছায়া অনুভব করেছিলাম, সেদিকে ছুটলাম।

হঠাৎ আমার দুই পায়ে যেন পাখনা গজাল। আমি দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ছুটতে লাগলাম। কিন্তু ছোট্ট মেঘটিও আমার দৌড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাকে এর পথে গ্রাস করে নিয়ে চলেছে। হঠাৎ সামনে যেখানে রেখাঙ্কিত দেয়ালটা ঘুরেছে সেখানে এটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

উজ্জ্বল দীপ্তিটা আমার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার পা ভারী হয়ে চলার গতি কমে এলো। যে জায়গাটি থেকে সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল খুব চেষ্টা করে সেখানে পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছেই দম নিতে লাগলাম।

পাগলের মতো চারপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।

তারপর নিচে মাটির দিকে তাকাতেই বালুর উপর তার খালি পায়ের ছাপ চোখে পড়লো। দেয়ালঘেরা জায়গায় বাতাস পায়ের ছাপটি উড়িয়ে নিতে পারেনি। ছাপটা অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখলাম আরেকটু সামনে এগিয়েই ছাপটা আবার মুছে গেছে, তবে এবার বাতাসে মুছে যায় নি। বালুর উপর পুরুষ মানুষের স্যান্ডেলের মসৃণ তলির একাধিক ছাপ তার উপর পড়ে ছাপটা মুছেছে। বুঝা গেল না কতজন লোক, তবে মনে হল ১০/১২ জনেরও বেশি। এটা পরিষ্কার যে, এই লোকগুলো তেহুতিকে তাড়া করছে। যখন ওরা তাকে ধরবার চেষ্টা করেছিল, তখন সে নিশ্চয়ই লড়াই করেছিল। রেগে গেলে তেহুতি বন্য বেড়ালির মতো হয়ে যায়, তবে শেষ পর্যন্ত ওরা নিশ্চয়ই তাকে কাবু করে ফেলেছিল।

তাকে টেনে পাহাড়ের এই প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসে। এখানে পাহাড়ের চূড়ার গায়ে আরেকটা ফাটল দেখা গেল, তবে এটা আগেরটার মতো বেশি চওড়া কিংবা এতো খাড়াও নয়।

এটা অনেকটা একটা সিঁড়ির মতো, চিমনির মতো নয়। আমি সহজেই এটা বেয়ে উঠতে পারবো, তবে চূড়ায় উঠতে হলে উটের অন্য পথ খুঁজতে হবে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম জারাস প্রথম উটে চড়ে আমার কাছাকাছি এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে চিৎকার করলো, কী হয়েছে তায়তা? আমাদের কী করতে হবে?

তেহুতিকে ধরে নিয়ে গেছে। ওরা হয়তো এখানে ওৎ পেতে ছিল। তেহুতি বাইরে ঘোরাফেরা করতেই ওরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর উপরের দিকে চূড়ার ফাটলটার দিকে দেখিয়ে বলো, ঐখানে টেনে নিয়ে গেছে, আমাদের উটগুলো ওখানে উঠতে পারবে না।

এরা কারা? কোথা থেকে এসেছে?

জানি না জারাস। নিরর্থক প্রশ্ন করো না। পাহাড়ের নিচ দিয়ে গিয়ে উপরে উঠার একটা পথ খুঁজে বের করো। আমি এদিক দিয়ে সোজাসুজি ওদের পেছনে যাচ্ছি।

আমি আমার অর্ধেক লোক আপনার পিছু পিছু পাঠাব। আর অন্যদেরকে নিয়ে বিকল্প পথ দিয়ে উপরে উঠে আপনার সাথে দেখা করবো।

তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আমি উপরে উঠতে শুরু করলাম। শুনতে পেলাম পেছনে জারাসের লোকেরা আসছে। ওরা আমার চেয়ে বয়সে তরুণ হলেও আমি ওদের আগে আগে চলতে লাগলাম।

দেয়ালটি অর্ধেক চড়ার পর উপর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ শোনা গেল। কয়েক সেকেন্ড থেমে শুনতে চেষ্টা করলাম। আরবি ভালো বলতে না পারলেও, কী বলছে তার সারাংশ বুঝতে পারি।

উপরের লোকগুলো বেদুঈন, ওরা দ্রুত চলার জন্য একজন আরেকজনকে তাড়া দিচ্ছে। তারপর তেহুতির অস্ফুট অর্তনাদ শুনতে পেলাম। যে কোনো পরিস্থিতিতে এই কণ্ঠস্বর আমি চিনতে পারি। : আমি চিৎকার করে উঠলাম, তেহুতি, ভয় পেওনা! আমি আসছি, জারাসও তার লোকজনসহ আসছে।

তার গলার আওয়াজ আমাকে তাড়না যোগাল। পূর্ণশক্তিতে আমি উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। তারপর উপর থেকে ঘোড়ার জেষা ধ্বনি, মাটিতে খুরের শব্দ আর লাগামের টুংটাং শব্দ শুনতে পেলাম। লোকগুলো তাকে ঘোড়ার পিঠে চড়াচ্ছে।

তেহুতি আবার চিৎকার করে উঠলো, তবে আরবদের চেঁচামেচিতে তার কথা বুঝা গেল না। তারপর ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারার শব্দ শোনা গেল। ঘোড়ার ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস আর নরম বালুতে খুরের থপথপ শব্দ শোনা গেল।

বুঝতে পারলাম দস্যুরা এখানেই তাদের ঘোড়াগুলো বেঁধে রেখে গিয়েছিল। ওরা জানতে এখানে ওরা দ্রুত ফিরে আসতে পারবে, অথচ উটে চড়ে অন্য পথ দিয়ে আসতে আমাদের অনেক সময় লাগবে।

শেষ কয়েক গজ হুমড়ি খেয়ে চললাম, তারপর চূড়ার কিনারায় পৌঁছে। একটু থেমে পরিস্থিতিটা বুঝার চেষ্টা করলাম।

আমার সামনেই রোদে পোড়া ধূলিময় পোশাক আর মাথায় কেফায়া পরা ত্রিশ চল্লিশ জন আরব বেদুঈন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশিরভাগই ইতোমধ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসেছে আর অন্যান্যরা ছুটে চলেছে। বন্য চিৎকারে ওরা একে অন্যকে বিজয়ীর সুরে তাড়া দিচ্ছে।

একজন দস্যু তখনও তেহুতির সাথে ধস্তাধস্তি করছিল। সে তেহুতিকে ঘোড়ার জিনের সামনে উপুড় করে শুইয়ে নিজে তার পেছনে উঠেছে। শক্তিশালী দেহের অধিকারী লোকটির কালো কোঁকড়ানো দাড়ি। শেয়াল ওরফে ডাকাত আল-হাওয়াসাঈর চেহারার যে বর্ণনা আল-নামজুর কাছ থেকে শুনেছিলাম, তার সাথে এর চেহারা বেশ মিলে যায়। তবে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না, এই সেই লোক কি না।

তেহুতি দুই পা ছুঁড়ে চিৎকার করছিল, তবে লোকটি বেশ সহজেই এক হাত দিয়ে তার দুই হাত ঘোড়ার জিনের উপর চেপে রেখেছে। দেখলাম তার। পোশাক আর চুল তখনও জলাধারের পানিতে ভেজা।

পেছনে তাকিয়ে সে চূড়ার কিনারায় আমাকে দেখতে পেল আর সাথে সাথে আশায় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমি তার ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝতে পারলাম সে আমার নাম উচ্চারণ করছে।

তাতা! আমাকে বাঁচাও!

মুক্ত হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে দস্যুটি ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পেটে গুঁতো দিয়ে ঘোড়াটিকে পাথুরে পথের উপর দিয়ে ছুটাতে শুরু করলো। একবার পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বিজয়ীর হাসি দিল। এখন আমি নিশ্চিত হলাম এই লোকই শেয়াল। আমার কেন জানি মনে হল সে আগে থেকে জানতো যে, আমরা ময়াগুহায় আসবো।

তার দলটি চতুর্দিক দিক থেকে ঘিরে তাকে অনুসরণ করলো। আমি গুণতে পারলাম না ওরা কজন। এভাবে ওদেরকে চলে যেতে দেখে রাগে আমার সারা শরীর জ্বলে উঠলো।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁধ থেকে লম্বা ধনুকটা নামিয়ে হাতে নিলাম। তিনটি দ্রুত প্রক্রিয়ায় ধনুকের গুণ টেনে সোজা করে তূণীর থেকে একটা তীর বের করে নেবার জন্য পেছনে হাত বাড়ালাম।

লক্ষ বস্তুটি দ্রুত সরে যাচ্ছিল। আমি জানি আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তেহুতি আর দস্যুটি ধনুকের তীরের আওতার বাইরে চলে যাবে। বাম কাঁধ সামনে এগিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, তীর ছোঁড়ার জন্য সঠিক ভঙ্গি নিয়ে প্রস্তুত হলাম। দিগন্তের উপরের দিকে চোখ তুলে আন্দাজ করতে চেষ্টা করলাম, তীরটি কতটুকু উঁচু করে ছুঁড়লে শেয়াল দস্যুর কাছে পৌঁছবে।

বুঝতে পারলাম তেহুতি আর আমার মাঝে শেয়ালের দেহটি তেহুতিকে আড়াল করে রেখেছে। অর্থাৎ তার অজান্তে তীরের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য সে তার দেহটিকে তেহুতির জন্য ঢাল করে রেখেছে। এবার আমি নির্ভয়ে তেহুতিকে আঘাত না করে তীর ছুঁড়তে পারবো। গুণ টেনে ঠোঁটে ছোঁয়ালাম। আমার বাহু আর দেহের উপরের প্রতিটি পেশি গুণটানা ধনুকের প্রচণ্ড ওজনের ভারে টান টান হয়ে রয়েছে। খুব কম লোকই আমার ধনুকটি পুরোপুরি টানতে পারে। এটা শুধু পাশবিক শক্তির বিষয় নয়। এর জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট ভঙ্গি, সঠিক ভারসাম্য আর ধনুকের সাথে একাত্ম হওয়ার মতো অনুভূতি অর্জন করা।

যখন আমি ধনুকের গুণ ধরে থাকা তিনটি আঙুল ছেড়ে দিলাম, এটা ঝটকা মেরে পেছন দিকে আমার বাহুর ভেতরের দিকে কেটে বসলো। সাথে সাথে ক্ষত স্থানটি থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। আমি আঘাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য চামড়ার হাতবন্ধনী লাগাবার সুযোগ পাইনি।

কোনো ব্যথা অনুভব করলাম না। বরং উড়ে যাওয়া তীরের পিছু পিছু আমার হৃদয়ও ছুটে চললো। বুঝলাম নিখুঁতভাবে তীরটি ছুঁড়েছি। আমি জানি যে কুকুরটি তেহুতিকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে সে এখুনি মরবে।

তারপর হঠাৎ হতাশ হয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম লক্ষ্যবস্তুর ঠিক পেছন পেছন ছুটে চলা ঘোড়সওয়ারটি হঠাৎ লাইন থেকে সরে গেল। দেবতা হোরাস জানেন কেন সে এটা করলো, সম্ভবত পথে কোনো গর্ত এড়াবার জন্য সে এটা করেছে। কারণ যাই হোক সে আমার লক্ষ্যবস্তুকে আড়াল করে দিয়েছে। তাকিয়ে দেখলাম আমার তীরটা একটা ছো মারা বাজপাখির মতো তার পিঠের উপরের অংশে আঘাত করলো। সে পেছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো। হাত বাড়িয়ে তীরের ফলাটা ধরবার চেষ্টা করতে লাগলো। তবে এখনও সে আমার লক্ষ্যবস্তুকে আড়াল করে রেখেছে।

আরেকটি তীর ছুঁড়লাম এই আশায় যে, হয়তো আহত লোকটি ঘোড়া থেকে পড়ে যাবে আর আলহাওয়াসাঈর দেহ উড়ন্ত তীরের আওতায় এসে যাবে। তবে আহত আরব লোকটি লাগাম আঁকড়ে ধরে ঘোড়ার পিঠেই বসে রইল। তারপর দ্বিতীয় তীরটি তার ঘাড়ের পেছনে আঘাত করার পর তার নিশ্চল দেহ ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে ধূলায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো।

ইতোমধ্যে আল-হাওয়াসাঈ তীরের আওতার বাইরে চলে গেছে। আমি তার দিকে আরেকটি তীর ছুঁড়লাম, যদিও জানি এটা তাকে স্পর্শ করার সুযোগ পাবে না। নিজেকে আর সমস্ত অন্ধকারের দেবতাদের অভিসম্পাত করতে শুরু করলাম, যারা আল-হাওয়াসাঈকে আমার তীরের লক্ষ্য থেকে বাঁচিয়েছে। তীরটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তার ঘোড়ার বিশ কদম পেছনে মাটিতে পড়ে গেল।

আমার দুটো তীর বেঁধা মাটিতে পড়ে থাকা লোকটির দিকে আমি দৌড়ে গেলাম। সে মরার আগে তাকে দুএক ঘা দিয়ে তার কাছ থেকে তথ্য বের করতে হবে। কপাল ভালো থাকলে হয়তো যে লোকটি তেহুতিকে অপহরণ করেছে তার আসল পরিচয় আর কোথায় তাকে খুঁজে পাবো তা জানা যাবে।

তবে তা হল না। আমি পৌঁছার আগেই নামহীন লোকটি মারা গেল। একটা চোখ উল্টে শুধু সাদা অংশটা দেখা যাচ্ছে, আর অন্য চোখটি প্রচণ্ড আক্রোশে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারপরও আমি দুইতিনবার লাথি কষালাম। তারপর লোকটির পাশে বসে হাথোর, ওসিরিস আর হোরাস দেবতার কাছে আকুল প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন, আমি পৌঁছা পর্যন্ত তেহুতি নিরাপদ থাকে।

দেবতাদের বিষয়ে যে জিনিসটা আমি অপছন্দ করি তা হল যখন তাদের খুব প্রয়াজন হয় তখন তাদেরকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না।

সেখানে বসে জারাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মৃত দস্যুটির দেহ থেকে আমার তীরটি কেটে বের করলাম। পুরো মিসরে আমার তীরের ফলার মতো আর কোনটি নেই।

.

প্রায় এক ঘন্টা পর জারাস পৌঁছল। বেদুঈন দস্যুদলটি ইতোমধ্যে দিগন্তের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সাধারণত যে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আমি আমার আবেগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। এটা বলতে আমি বুঝাচ্ছি কোনো শহরকে ধ্বংস করা, শত্রু সেনাদলকে নিশ্চিহ্ন করা এ-ধরনের পরিস্থিতি ইত্যাদি। তবে তেহুতিকে হারিয়ে আমি ভীষণভাবে রেগে রয়েছি, আমার সারা শরীর কাঁপছিল। যত দেরি হচ্ছে ততই আমার আবেগ উথলে উঠে টগবগ করে ফেটে পড়ছে।

আমার সম্পূর্ণ রাগ জারাসের লোকদের উপর ঝাড়তে লাগলাম। ওরা ভিতু, কাপুরুষ, প্রয়োজনের সময়ে কোনো সাহায্য করতে পারলো না, এসব বলে চিৎকার করলাম।

তারপর দূরে জারাসের উটগুলো আসতে দেখে আর দেরি না করে ছুটে তার দিকে গিয়ে চিৎকার করে তাকে দ্রুত আসতে তাগাদা দিলাম।

সে কাছে আসতেই তিক্তকণ্ঠে তাকে তাড়াতাড়ি করতে বললাম, আবার সেও সমানভাবে চিৎকার করে তেহুতি কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না জানতে চাইল।

ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম এই দুই তরুণ হৃদয়ের মাঝে যা চলছে, তা সাময়িক কোনো ধরনের মোহ নয় এটা অন্য কিছু। এটি সেই একই ধরনের আবেগ আর ভালোবাসা যা আমি তেতির মা রানি লস্ট্রিসের ক্ষেত্রে অনুভব করতাম। আমি দেখলাম তেহুতিকে হারিয়ে জারাস যে-রকম শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে, সে রকম আমিও এককালে তার মায়ের জন্য শোকাগ্রস্ত হয়েছিলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি বুঝলাম আমাদের তিনজনের জন্য এই পৃথিবী বদলে গেছে।

 ৪. শক্তিশালী উটগুলো

জারাস আর তার লোকজন শক্তিশালী উটগুলো নিয়ে আমার কাছে এলো। অল্পদূরত্বে বেদুঈনের ঘোড়াগুলো আমাদের উটগুলো থেকে এগিয়ে থাকলেও দুই তিন ঘন্টার বেশি তা পারবে না। তাছাড়া আমাদের উটগুলো সারাদিন বালুর উপর চলতে পারে। উটগুলো মাত্র পানি খেয়েছে। কাজেই আরও দশ কিংবা তার চেয়েও বেশি দিন পানি ছাড়া চলতে পারবে। এই পরিস্থিতিতে পানির পিপাসা, গরম আর পিঠে আরোহি নিয়ে বালুর উপর দিয়ে চলতে গিয়ে ঘোড়াগুলো কাল ভোরের আগেই নেতিয়ে পড়বে। অথচ উটগুলো আরও এক সপ্তাহ ছুটতে পারবে।

জারাস আসতেই তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। অস্ত্রসহ উট থেকে নেমে তার অর্ধেক লোককে হেঁটে গুহায় ফিরে যেতে বললাম। ওরা সেখানে বাকি দুই মেয়েদেরকে পাহারা দেবে।

জারাস বুদ্ধি করে প্রত্যেক উটের পিঠে পানি ভর্তি মশক নিয়ে এসেছিল। এর জন্যই তার আসতে দেরি হয়েছিল। এখন আমাদের অর্ধেক উট সওয়ারিহীন হল। এতে সুবিধামতো উটগুলোকে বিশ্রাম দেওয়া যাবে। জারাস আমাদের প্রধান পথ প্রদর্শক আল-নামজুকে সাথে নিয়ে আসায় আমি খুশি হলাম। তার চেয়ে ভালো কেউ এই পথ চিনতে পারবে না।

সবাই যার যার উটে চড়ে পেছন পেছন একটি করে খালি উট দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। অতিরিক্ত পানির মশকগুলো থাকায় আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম।

সূর্যের অবস্থান দেখে সময় আন্দাজ করলাম। আর তিন ঘন্টা পর দেখলাম খুব একটা বেশি এগোতে পারিনি। একটু থেমে উট বদল করলাম আর প্রত্যেককে দুই মগ পানি খেতে দিলাম। তারপর আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে শুরু করলাম।

আরও দুই ঘন্টা চলার পর প্রমাণ পাওয়া গেল যে, আমরা পলাতকদের তুলনায় দ্রুতই চলছি। পথের পাশে দেখলাম দস্যু-শেয়ালের পরিত্যক্ত একটি ঘোড়া খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আমাদের অগ্রগতি দেখে খুশি হলাম আর জারাসকে বললাম আশা করি রাতের আগেই ওদেরকে ধরে ফেলতে পারবো।

তবে আমার আন্দাজ সঠিক হল না। এটা বলার এক ঘন্টা পর আমরা দস্যুরা যেখানে দুটি অংশে ভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছলাম। জারাসকে বললাম, লোকদেরকে বল এবার একটু থেমে জিরিয়ে নিতে। প্রত্যেককে দুই মগ করে পানি দাও। তবে সাবধানে পিছিয়ে বসতে বল যেন পায়ের ছাপগুলো নষ্ট না হয়। আমি ওগুলো পরীক্ষা করবো।

অনুসরণ করার সময় সমান দুই ভাগে ভাগ হয়ে চলা বেদুঈনদের একটি পুরোনো কৌশল। এরপর দুটি দল আলাদা হয়ে দুই দিকে যাবে। এতে আমাদের বুঝা অসম্ভব হবে কোন দলটির সাথে তেহুতি রয়েছে। তাদের দুই দলের পিছু নিতে গিয়ে আমাদেরকেও বিভক্ত হতে হবে।

উট থেকে নেমে লাগামটি জারাসের হাতে দিয়ে হেঁটে সামনে এগোলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর খুঁজে পেলাম, কোন জায়গায় ওরা দুই দলে আলাদা হয়েছে। দেখলাম ওরা ঘোড়া থেকে নামেনি। কাজেই তেহুতির পায়ের ছাপ খুঁজে পেলাম না। আমি আবার মাটিতে বসে দেবতার শরণাপন্ন হলাম।

হে মহান হোরাস, আমাকে দেখিয়ে দাও। এই দুর্বল অন্ধ চোখদুটো খুলে দিয়ে আমাকে পথ দেখাও। মিনতি করছি আমার দুচোখ খুলে দাও হে দেবী হাথোর। তোমার নামে আমি একটি বলি দেব।

চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজের হৃৎস্পন্দন শোনার পর চোখ খুললাম। চারপাশে সাবধানে তাকালাম। কোনো স্বচ্ছ আলো এসে বালুকে আলোকিত করলো না, কোনো ছায়া নেচে নেচে এসে আমাকে পথ দেখাল না।

তারপর একটা গলার আওয়াজ শুনে কান খাড়া করলাম। তবে এটা ছিল বালিয়াড়ির মধ্য দিয়ে যাওয়া বাতাসের শন শন শব্দ। ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে বাতাসটাকে কানের পাশ দিয়ে যেতে দিলাম। তারপর মৃদু পরিষ্কার কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম।

তেহুতির কণ্ঠস্বর, হাথোর তোমাকে পথ দেখাবে। দ্রুত চতুর্দিকে তাকালাম, তবে তাকে দেখতে পেলাম না। চোখ বুজে অলৌকিক কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। নিঃশব্দে মাথা নত করে হাথোর দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।

হে দেবী হাথোর, তোমাকে এখন চাই। আমার আর তেহুতির দুজনেরই এখন তোমাকে প্রয়োজন।

অনেক বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একদিন তেহুতি আর আমি নলখাগড়ার নৌকায় চড়ে পবিত্র নীল নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। তার প্রথম রজঃদর্শনের দিনটিতে আমি তাকে যে উপহারটি দিয়েছিলাম, সেটা পেয়ে হাতে ধরে খুশিতে সে মৃদু হাসছিল। এটি ছিল একটি চমকার রত্ন যাতে আমি আমার সমস্ত ভালোবাসা আর কারিগরি ঢেলে দিয়েছিলাম। একটা চিকন হারের মাথা থেকে ভালোবাসা ও কুমারীত্বের দেবী হাথোরের ছোট্ট একটি শিংওয়ালা সোনালি মাথা ঝুলছে।

মৃদু মৃদু হেসে তেহুতি হারটা গলায় পরলো। তার বুকের মাঝখানে সোনালি মাথাটা ঝুলছিল আর দেবীর মাথাটাও আমার দিকে তাকিয়ে হেঁয়ালীপূর্ণ হাসি দিচ্ছিল।

তেহুতির কথাগুলো আমার মনে পড়লো, আমি এটা সবসময় পরে থাকবো তায়তা। যখনই এটা আমার চামড়ার সাথে লেগে থাকবে তখনই তোমার আর তোমার ভালোবাসার কথা আমার মনে পড়বে। আর তোমার প্রতিও আমার ভালোবাসা দিন দিন বেড়ে যাবে। সে কথা রেখেছিল। কয়েকদিন দেখা না হওয়ার পর যখন দেখা হত তখনই হারের মাথায় ঝুলন্ত লকেটটা দেখাত, তারপর ঠোঁটে ছোঁয়াত।

এমন একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে এই কথাটা কেন এখন আমার মনে পড়লো, বুঝে উঠতে পারলাম না। মন থেকে চিন্তাটা ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। তারপরও স্মৃতিটা জেগে রইল। হঠাৎ একটি উত্তেজিত ভাবনা মনে জেগে উঠলো, এই রত্নটিই এখন তেহুতিকে পাইয়ে দেবে। তারপর বাতাসে ভেসে আসা একটি কণ্ঠস্বর আমি যা মনে মনে ভেবেছিলাম তা নিশ্চিত করলো।

হাথোরকে খুঁজো, তাহলে আমাকে পাবে।

এক লাফ দিয়েই দেখলাম, দস্যুরা যেখান থেকে দুদলে আলাদা হয়েছিল সেখানে তখনও আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। এবার লক্ষ্য করে দেখলাম একটি দল উত্তরদিকে ঘুরে গেছে। আমি প্রথমে এইদিকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘোড়ার খুরের ছাপের একপাশ দিয়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলাম।

তেহুতি কিংবা হাথোরের কাছ থেকে পথ নির্দেশ পাওয়ার জন্য আমি আমার মনের ভেতরের অনুভূতি মেলে ধরলাম। তবে কিছুই অনুভব করলাম না। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে হতাশা আর একাকীত্ব আমাকে গ্রাস করতে শুরু করলো।

ঘুরে আবার যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম সেদিকে চললাম। সাথে সাথে অপ্রীতিকর ভাবনাটা মন থেকে সরে যেতে লাগলো, যখন আগের জায়গায় পৌঁছলাম তখন খারাপ ভাবনাটা উবে গেল।

দস্যুদের দ্বিতীয় দলটি দক্ষিণদিকে গিয়েছিল, এবার সেই পথ ধরলাম।

প্রায় সাথে সাথে মনে একটি ইতিবাচক ভাবনা জেগে উঠলো। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে মন হালকা হতে লাগলো আর অনুভব করলাম যেন একটি ছোট্ট উষ্ণ হাত আমার হাতের মুঠো চেপে ধরেছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কিছুই নেই, কিন্তু আমার মনে স্থির বিশ্বাস ছিল, কেউ আমার পাশে থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।

দৌড়ে সামনের দিকে একশো পা যাওয়ার পর দেখলাম সামনে মাটিতে কিছু একটা চক চক করছে। অর্ধেকটা হলুদ বালুতে চাপা পড়ে আছে, দেখেই সাথে সাথে জিনিসটা চিনতে পারলাম। হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে আলগা বালু এক পাশে সরালাম। তারপর ছোট হলুদ সোনার টুকরাটি তুলে ঠোঁটে ছোঁয়ালাম।

ঘুরে জারাসের দিকে তাকালাম। সে তার উটের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। এক হাত উঠিয়ে তাকে ডাকলাম। সাথে সাথে সে উটে চড়ে এক হাতে রশি ধরে আমার উটটা নিয়ে আসতে শুরু করলো।

উটের রশি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বললো, আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে, তেহুতি এই পথ দিয়েই গেছে?

তুমি এই ছোট্ট অলঙ্কারটা চেনো? তারপর হাতের মুঠো খুলে হাতের তালুতে দেবীর মাথাটা দেখালাম। সে নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।

সে চিহ্ন হিসেবে এটা আমার জন্য রেখে গেছে।

সে শ্রদ্ধামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, তিনি কী অপূর্ব মানুষ। এই পৃথিবীতে তার সাথে তুলনা দেবার মতো আর কোনো নারী নেই।

এরপর আমরা দুই ঘন্টা চলার পর বেদুঈনদের আরেকটা অচল ঘোড়া পথে পেলাম। মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, এক পাও চলতে পারছে না। পরিত্যক্ত করে ফেলে যাবার আগে এর আরোহী নির্দয়ভাবে এর পিঠে চাবুক মেরেছে। ঘোড়াটার পাছায় চাবুকের দাগ দেখা যাচ্ছে, আর ক্ষতস্থানগুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে চকচক করছে।

আমি বললাম, এটাকে পানি দাও। জারাস নিজে নেমে একটা চামড়ার বালতিতে পানি ভরে সামনে এলো। একই সাথে আমিও নেমে পশুটির কাঁধের পেছনে অবস্থান নিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তলোয়ার বের করলাম। জারাস পানির পাত্রটি পশুটির মুখের কাছে ধরতেই এটি মুখ নামিয়ে দিল। কয়েক চুমুক পানি খেতে দিলাম, তারপর আমি দুইহাতে তলোয়ারটা ধরে মাথার উপর তুললাম। পশুটি তখনও পানি পানরত অবস্থায় সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে তলোয়ার তুলে একটা কোপ মারলাম।

কাটা মাথাটা দেহ থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর হাঁটু ভেঙে দেহটাও মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

তলোয়ারের ধারালো পাতটার রক্ত ঘোড়ার কাঁধে মুছে নিয়ে জারাসকে বললাম, বাকি পানিটা নষ্ট করো না।

লক্ষ্য করলাম জারাস বাকি পানিটা মশকে ঢেলে রাখলো। নিজেকে ঠিক করে নিতে আমার কয়েকটি মুহূর্ত দরকার। আমার নির্দয় আঘাতের আগে ঘোড়াটি যে যন্ত্রণা ভোগ করছিল ঠিক একই রকম মানসিক যন্ত্রণা আমিও ভোগ করছিলাম। বিনা কারণে নিষ্ঠুরতা আর কাউকে যন্ত্রণা দেওয়াটা আমি অপছন্দ করি। যাইহোক বর্তমান পরিস্থিতিতে মনের এই ভাব চেপে রাখলাম।

সূর্য দিগন্ত ছুঁতেই আমরা পথে আরও তিনটা অচল ঘোড়া পার হলাম। আর বালুতে খুরের গভীর ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম, কিছু আরব দস্যু এক ঘোড়ার পিঠে দুজন করে সওয়ার হয়েছে। অন্যরা হেঁটে চলেছে।

প্রতি ঘন্টায় আমরা আরও দ্রুত ওঁদের কাছাকাছি হচ্ছিলাম। সূর্যাস্তের পরও আমি অনুসরণ চালিয়ে গেলাম। পরিশেষে পূর্ণচন্দ্র এসে আমাদের পথ আলোকিত করলো। উজ্জ্বল রূপালি আলোয় আরবদের ফেলে যাওয়া খুরের ছাপ পরিষ্কার দেখা গেল। এবার আরও দ্রুত চলতে শুরু করলাম।

এরপর পথের ধারে আরও দুটো বিধ্বস্ত ঘোড়া পেলাম। তবে এবার আর ওগুলোর পেছনে সময় নষ্ট করলাম না। তারপর পথের মাঝখানে একটা মানুষের দেহ পড়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। লোকটাকে দেখে পরিচিত মনে হচ্ছিল। আমি উট থামিয়ে নিচু হয়ে লক্ষ্য করলাম।

জারাস উদ্বিগ্ন কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো, সাবধান তায়তা, এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। হয়তো সে মারা যাবার অভিনয় করছে। সম্ভবত হাতে একটা ছুরি ধরে রয়েছে।

আমি তার সাবধান বাণী উপেক্ষা করে তলোয়ার বের করলাম। লোকটার কাছাকাছি আসতেই সে নড়ে উঠলো আর মাথা তুলে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ঠিক তখনই আমি তাকে চিনতে পারলাম।

তার দিকে তাকিয়ে আমি এতো হতবাক হলাম যে, আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছিল না।

জারাস চিৎকার করে উঠলো, কী হয়েছে তায়তা? আপনি এতো চিন্তিত কেন? লোকটাকে চেনেন নাকি? সাথে সাথে তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না।

জারাসের দিকে না তাকিয়ে বললাম, আল-নামজুকে আমার কাছে পাঠাও। পায়ের কাছে পড়ে থাকা লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল। তারপর সে ছেঁড়া কেফায়ার একটি অংশ দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢেকে মুখটা অন্য দিকে ফেরাল।

জারাস আল-নামজুকে ডাকতেই সে উট নিয়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল।

আমি কঠিন কণ্ঠে বললাম, আমার কাছে এসো। সে আমার কাছে এসে দাঁড়াতেই পেছনে বালুতে তার পায়ের মচমচ শব্দ শোনা গেল। আমি ফিরে তাকালাম না।

মৃদুকণ্ঠে সে বললো, আমি এখানে প্রভু।

স্যান্ডেলের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটাকে স্পর্শ করে বললাম, এই লোকটাকে চেন?

না প্রভু, লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছি না সে বিড়বিড় করে বললো, তবে তার গলা কেঁপে গেল, বুঝলাম সে মিথ্যা বলছে। আমি নিচু হয়ে কেফায়ার এক প্রান্ত ধরে টান দিয়ে লোকটার মুখ থেকে তুলে নিলাম। আল নামজু আঁতকে উঠলো।

এবার আমি বললাম, এবার মুখটা দেখতে পাচ্ছো? কে সে?

কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর লোকটি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। আমাদের দিকে আর তাকাতে পারছিল না।

বল আল-নামজু, এই শুওরের মলটি কে? আমার রাগ আর তিক্ততার পরিমাণ বুঝাতে আমি ইচ্ছা করেই এই শব্দটা ব্যবহার করলাম।

বুড়ো লোকটি ফিসফিস করে বললো, সে আমার ছেলে হারুন।

সে কেন কাঁদছে, আল-নামজু?

আমি যে বিশ্বাস তার উপর রেখেছিলাম তা সে ভঙ্গ করেছে তাই কাঁদছে।

কীভাবে সে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? সে শেয়াল আল-হাওয়াসাঈকে জানিয়ে দেয় কোথায় আমাদেরকে পাওয়া যাবে। তারপর ওদেরকে পথ দেখিয়ে পানির গুহার কাছে নিয়ে আসে।

এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি কী হওয়া উচিত আল-নামজু?

তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আপনি হারুনকে মেরে ফেলুন প্রভু।

আমি তলোয়ারটা বের করে বললাম, না বুড়ো। আমি তাকে মারবো না। সে তোমার সন্তান। তুমিই তাকে হত্যা করবে।

সে ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো, আমি আমার নিজের ছেলেকে মারতে পারবো না প্রভু। এটা হবে অচিন্তনীয় খারাপ এবং ঘৃণ্য একটি কাজ। আমি আর আমার ছেলে অনন্তকাল শেঠের অন্ধকার নিম্ন জগতে দণ্ডিত হয়ে পড়ে থাকবো।

তুমি তাকে মেরে ফেল, তারপর আমি তোমার আত্মার জন্য প্রার্থনা করবো। তুমি তো জান আমার ক্ষমতা আছে। তুমি জানো দেবতাদের সাথে মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা আমার আছে। হয়তো ওরা আমার প্রার্থনা শুনবেন। এই সুযোগটা তোমাকে নিতে হবে।

এবার সে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বললো, হে প্রভু, অনুগ্রহ করে এই ভয়ঙ্কর দায়িত্ব থেকে আমাকে রেহাই দিন। তার দাড়ি বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে আমার পায়ে চুমু খেল।

কিন্তু তার অনুনয় বিনয়ে আমার মন গললো না। আমি বললাম, পিতার হাতে মৃত্যুই তার উপযুক্ত শাস্তি। ওঠো আল-নামজু। তাকে মেরে ফেল, আর নয়তো আমি প্রথমে তোমার ঘোট দুই ছেলে তালাল আর মুসাকে মারবো। তারপর হারুন আর সবশেষে তোমাকেও হত্যা করবো। তোমার বাড়িতে আর কোনো পুরুষ থাকবে না। তোমাদের জন্য প্রার্থনা করার মতো কেউ বেঁচে থাকবে না।

সে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল, আমি তার হাতে আমার তরবারিটা ধরিয়ে দিলাম। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরপর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে চোখ নিচের দিকে নামাল।

আমি আবার জোর দিয়ে বললাম, চালাও এটা! সে দুই হাত দিয়ে মুখ থেকে চোখের পানি মুছলো। মন শক্ত করে চিবুক উঁচু করলো। তারপর আমার হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে শক্ত হাতে বাঁটটা ধরলো। আমাকে পাশ কাটিয়ে হারুনের উপর এসে দাঁড়াল।

আবার আমি বললাম, চালাও! সে তলোয়ারটা উঁচু করলো তারপর আঘাত করলো একবার, দুবার এবং তিনবার। তারপর তলোয়ারটা মাটিতে ফেলে দিয়ে তার বড়ছেলের মৃতদেহের উপর লুটিয়ে পড়লো। ছিন্ন মুণ্ডটা বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।

তলোয়ারটা তুলে আমি রক্তের দাগ লাশের দেহে মুছলাম। তারপর আমার উটের কাছে ফিরে গিয়ে উটের পিঠে চড়ে বসলাম। আল-নামজুকে তার পুত্র শোক করার সুযোগ দিয়ে আবার দস্যু শেয়ালের পেছনে ছুটার জন্য তৈরি হলাম।

আমার সমবেদনার অনুভূতি সমগ্র মানজাতিকে ঘিরে নেই। আর যারা আমার বিরুদ্ধে অপরাধ করে তাদের সব অপরাধের প্রতি আমি মহানুভবতা দেখাতে পারি না।

.

ভোরের প্রথম আলো দেখা দিতেই আমরা সেই জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে দস্যু আল-হাওয়াসাঈ দ্বিতীয়বার তার দলকে বিভক্ত করেছিল। এবার সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে প্রথমবার দুদলে বিভক্ত হওয়ার পরও আমি তার পিছু ছাড়িনি।

মাটিতে নেমে বেদুঈনদের সংখ্যাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম।

এবার এক দলে ছয়টি ঘোড়া আর অন্য দলে চারটি ঘোড়া রয়েছে। প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে দুজন করে সওয়ারি ছিল। তার মানে মোট বিশজন লোক। এছাড়া পাঁচজন লোক হেঁটে চলছিল।

উত্তর দিকে যে বড় দলটি মোড় নিয়েছিল আমি সেটার পথরেখা পরীক্ষা করলাম। তারপর আমার মন নেচে উঠলো যখন দেখলাম একটি ছোট সুন্দর পায়ের ছাপ তাদেরকে অনুসরণ করছে। এরাই তেহুতিকে তাদের সাথে নিয়েছে।

অবশ্য এবার ওরা তাকে মাটিতে নামিয়ে হাঁটাচ্ছে আর চিহ্নগুলো দেখে। আমি বুঝতে পারলাম দুজন আরব জোর করে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। দৌড়ে সামনে এগিয়ে কাছ থেকে তার পায়ের ছাপগুলো পরীক্ষা করলাম। রেগে ফেটে পড়লাম যখন দেখলাম একটা খালি পা থেকে রক্ত ঝরছিল। বালুতে ছোট ছোট পাথরের ধারাল টুকরায় তার পা কেটে গেছে।

পায়ের ছাপগুলো পরিষ্কার। আর কোনো সন্দেহ নেই যে উত্তরমুখি দলটির সাথেই তেহুতি গিয়েছে। তারপরও আমি ভাবলাম রাগের বশে হয়তো আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারি। আমাকে ভালোভাবে নিশ্চিত হতে হবে।

জারাসকে ডেকে বললাম, আমি ডাকা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করো। তাকে সেখানে রেখে পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে চললাম। একশোবিশ পা যাওয়ার পর তেহুতির পায়ের ছাপ আর দেখা গেল না। তবে এনিয়ে আমি বেশি কাতর হলাম না।

বুঝতে পারলাম সম্ভবত আল-হাওয়াসাঈ কিংবা অন্য কোনো আরব তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়েছে। শুধু পায়ের ছাপগুলোই যে পরিষ্কার তা নয়, আমার ডান হাতে ধরা হাথরের সোনার মাথা থেকে যে অলৌকিক আভা বের হচ্ছে সেটিও এতে সমর্থন দিচ্ছে।

পেছন ফিরে জারাসকে কাছে আসতে ইশারা করলাম। সে আমার উট নিয়ে এলো। উটের পিঠে চড়ে আমি তেহুতিকে নিয়ে উত্তরমুখি চলা আরবদের ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম।

মরুভূমির সামান্য উঁচুনিচু জমির উপর দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর পরবর্তী বালিয়াড়ির উপর উঠার পর অনুভব করলাম, তেহুতির সোনার অলঙ্কারটির আভার বিচ্ছুরণ কমে এসেছে। সাথে সাথে লাগাম টেনে ধরে উটটি থামালাম। ধীরে ধীরে চারপাশের বিশাল বালিয়াড়িগুলোর দিকে তাকালাম।

জারাস কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে প্রভু?

তেহুতি এপথে আসেনি। শেয়াল আমাদের সাথে চালাকি করেছে।

সে বললো, এটা কী করে সম্ভব তায়তা? আমিও তার পায়ের ছাপ দেখেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

উটের মুখ ফিরিয়ে আমি বললাম, অনেক সময় মিথ্যা পরিষ্কার দেখা যায় আর সত্য লুকিয়ে থাকে।

বুঝতে পারলাম না, প্রভু।

আমি বললাম, আমি ভালোভাবেই বুঝেছি জারাস। অনেক বিষয় আছে। যা তুমি কখনও বুঝতে পারবে না। কাজেই এ-বিষয়ে তোমার কাছে ব্যাখ্যা দিয়ে সময় নষ্ট করবো না।

আমার লোকেরা বিরক্ত হলেও কোনো কথা না বলে পেছনে ঘুরলো।

যে জায়গায় তেহুতির খালি পায়ের ছাপটি হারিয়ে গিয়েছিল সেই জায়গায় আবার ফিরে এলাম। উটের পিঠ থেকে নেমে লাগাম একজনের হাতে তুলে দিলাম।

আমি জানি কিছু একটা আমার নজর এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কি তা ধরতে পারছি না।

আরও পিছিয়ে যেখানে বেদুঈনরা দুইদলে ভাগ হয়েছিল সেখানে পৌঁছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। উল্টো দিকে যাওয়া কোনো পথরেখা কি দেখা যাচ্ছে? একটু থেমে ভাবলাম। উত্তর হল, না নেই। এই জায়গাটি থেকে ওরা দুই দলে ভাগ হয়ে দুই দিকে সোজাসুজি চলে গেছে; কেউ আর পেছন ফিরে আসেনি।

যাইহোক এই অস্বাভাবিকতার উত্তর খুঁজার চেষ্টা করেও ঠিক ধরতে পারছিলাম না।

মনে মনে বললাম, সে নিশ্চয়ই ফিরে গেছে। দ্বিতীয় দলটির সাথে সামনের দিকে আর যায় নি, তার মানে সে নিশ্চয়ই পেছন দিকে গিয়েছে।

আবার একটু থামলাম, আচ্ছা আমি, পেছন দিকে গিয়েছে এই কথাটা কেন ব্যবহার করলাম? এই পরিস্থিতিতে এই কথাটা ঠিক নয় আর আমি তো সাধারণত ভুল বাক্য ব্যবহার করি না।

সমাধানটির খুব কাছাকাছি পৌঁছার পর এবার জোরে জোরে বলে উঠলাম, একজন মানুষ পেছন দিকে যায় না। হয় পেছন দিকে ঘুরে কিংবা পেছন পেছন হাঁটে আবার থামলাম। হুঁ, আচ্ছা! এবার বুঝেছি!

যেখানে তেতির খালি পায়ের ছাপটি শেষ হয়েছিল সেইজায়গায় আবার ছুটে গেলাম।

এবার আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি কী খুঁজতে হবে। সাথে সাথে তা পেয়েও গেলাম। এখানে আরেক জোড়া পুরুষ মানুষের পায়ের ছাপ ছিল যা আপাত দৃষ্টিতে দলটির অন্যান্যদের মতো উত্তরদিকেই যাচ্ছিল। তবে এখানে কিছু পার্থক্য ধরা পড়লো।

তেহুতির পায়ের ছাপ যেখানে শেষ হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকেই এই একটি পুরুষ মানুষের পায়ের ছাপ শুরু হয়েছে। পায়ের এই ছাপজোড়া অন্য সব পায়ের ছাপ মাড়িয়ে চলেছে। যে লোকের এই পায়ের ছাপ, সে ভারি কোনো ওজন বহন করছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রতি পদক্ষেপে এই লোকটির স্যান্ডেলের পেছনে গোড়ালির দিকে ধুলা উড়িয়ে চলছিলঅথচ সামনের দিকে হাঁটলে স্যান্ডেলের বুড়ো আঙুলের সামনের দিকে ধূলা উড়ার কথা।

মনে মনে ভাবলাম, সম্ভবত শেয়ালই এই পায়ের ছাপ ফেলেছিল। প্রথমে যেখানে দলটি দুই ভাগ হয় সেখানে সে তেহুতিকে মাটিতে নামিয়ে দেয়। তারপর উত্তরমুখি দলটির ঘোড়াগুলোর সামনে তাকে জোর করে কয়েক পা হাঁটায়। দুইশো পা যাওয়ার পর সে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে। তার ঘোড়াটি উত্তর দিকে যাওয়া দলটির সাথে পাঠিয়ে দেয়। তারপর মাটি থেকে তেহুতিকে তুলে নিয়ে যেখানে প্রথম দলটি তার জন্য পেছনে অপেক্ষা করছিল সেখানে ফিরে যায়। তবে এক্ষেত্রে সে তেহুতিকে কাঁধে তুলে পেছন দিকে হেঁটে চলে। প্রথম দলটি তার আর তেহুতির জন্য আরেকটি ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এইখানে এসে সে তেহুতিকে নিয়ে দক্ষিণমুখি দলটির সাথে চলে যায়। আর আমাদেরকে উত্তরমুখি দলটির অনুসরণ করতে বাধ্য করে। অত্যন্ত শয়তানি বুদ্ধির জটিল একটি ধূর্তামি। আমি মৃদু হাসলাম।

তারপর খুশি হয়ে বেশ জোরে বলে উঠলাম। তবে অতো চালাক নয়।

জারাস আর তার লোকজন হতবুদ্ধি হয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল, ওরা আরও অবাক হয়ে গেল যখন আমি তেতির খালি পায়ের ছাপগুলো পেছনে ফেলে উল্টো দিকে বেদুঈনরা দুই দলে ভাগ হয়ে যে জায়গা থেকে দুই দিকে যেতে শুরু করেছিল সেদিকে ফিরে চললাম।

দিক বদল করে দক্ষিণ দিকে যাওয়া শুরু করার পর জারাস কিংবা তার লোকজন কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না। এদিকে প্রতি লিগ দূরত্ব পার হওয়ার সাথে সাথে আমার হাতে ধরা দেবীর মাথার সোনার অলঙ্কারটি থেকে বিচ্ছুরিত উষ্ণ আভা আরও শক্তিশালী হতে লাগলো।

.

আমি জানি তেহুতি এখন কীরকম দুর্দশায় আছে। দস্যুরা যখন তাকে অপহরণ করেছিল তখন তার পরনে কেবল একটি সুতির জামা ছিল। উটের পিঠের কাঠের জীনের উপর বসা কিংবা উপরে প্রখর রোদের তাপে এই পোশাক কোনো কাজে আসবে না। যখন সে খালি পায়ে হাঁটছিল তখন তার পা কেটে যে রক্ত ঝরছিল তা আমি দেখেছি। একজন মিসরীয় রাজকুমারীর পা একটি কৃষক কন্যার পায়ের চেয়ে অনেক নাজুক।

আমার মনে শুধু এইটুকু সান্ত্বনা ছিল যে, শেয়াল তার দস্যুদলের কাউকেই তেহুতির গায়ে হাত তুলতে অনুমতি দেবে না। একটি কুমারী মেয়ে হিসেবে তার মূল্য অনেক বেশি। এতোটুকু বুদ্ধি তার নিশ্চয়ই আছে যে, তেহুতির দামে সে দশ হাজার সুন্দরী ক্রীতদাসী কিনতে পারবে। ইচ্ছা হচ্ছিল উটগুলোকে আরও জোরে চালিয়ে নিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে একদুই ঘন্টা কষ্ট পাওয়া থেকে রেহাই দেই।

তবে ভাবলাম শেয়াল নিশ্চয়ই আরও কিছু চালাকি করার চেষ্টা করবে আর সেক্ষেত্রে আমাকে তা সামলাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কাজেই স্বাভাবিক গতিতেই উট চালিয়ে নিয়ে চললাম। তবে পানি খাওয়ার জন্য কোথাও না থেমে সারা সকাল চললাম।

একঘন্টা পর দুপুরের সূর্য যখন মাথার উপর, তখন আমি একটা বেলেপাথরের পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে বেশ চওড়া কয়েক লিগ দীর্ঘ একটি খাড়ি দেখতে পেলাম। পুরো উপত্যকাটি জুড়ে বহুকাল থেকে বাতাসের আঘাতে দৈত্যাকৃতির প্রাকৃতিক স্থাপত্য গড়ে উঠেছে। লাল বেলে পাথরের সুউচ্চ চূড়াগুলো যেন নীল আকাশের পেট ছুঁয়ে রয়েছে। তবে গোড়ারদিকে বাতাসে ক্ষয়ে যাওয়ায় সরু স্তম্ভগুলোর উপর বিশাল মাথাগুলো ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দলের মধ্যে আমি সবচেয়ে বয়স্ক হলেও আমার দৃষ্টিশক্তি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ছিল। সবার আগে আমিই পলাতকদের দেখতে পেলাম। বেলেপাথরের দৈত্যাকৃতির একশিলা স্তম্ভগুলোর গোড়ার ছায়ায় মানুষগুলোকে আমিই প্রথম জারাস আর তার লোকজনদের দেখালেও প্রথমে ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। রোদে পোড়া পাথরগুলো থেকে গরম বাষ্প উঠে মরীচিকা হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর এতে ওদের দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছিল।

তারপর একটি বর্শা বা তলোয়ালের পাতে রোদ প্রতিফলিত হয়ে ঝিকমিক করে উঠতেই ওদের চোখে পড়লো। আমার পেছন থেকে দলের সবাই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো। তবে আমি জানি আরও খারাপ ঘটনা ঘটার বাকি আছে। এখন আমরা মরিয়া হয়ে ওঠা এক লোকের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আর শেয়াল তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তেহুতি এখন আরও বিপদের মধ্যে রয়েছে।

সবাইকে চুপ করতে বলে নিঃশব্দে পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে নামতে শুরু করলাম। বেদুঈনদের গতিবিধির প্রতি নজর রাখার জন্য দুজন লোকসহ একজন বিশ্বাসী সার্জেন্টকে পাহাড় চূড়ায় রাখলাম। তারপর অন্যদেরকে নিয়ে নিচে নামার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রস্তুত হতে বললাম।

উটের পিঠে বেধে রাখা আমার পোটলাটা থেকে চামড়ার ব্যাগে রাখা যুদ্ধের ধনুক আর তূণীর বের করে আনলাম। জারাসকে সাথে নিয়ে একটা পাথরের উপর বসে তাকেও পাশে বসতে বললাম।

তারপর তাকে নির্দেশ দিতে শুরু করলাম, ওদের ঘোড়াগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে, আর চলতে পারবে না। এবার শেয়াল শেষ লড়াই চালাবার জন্য অবস্থান নিয়েছে। তারপর তাকে বুঝিয়ে বললাম শেয়ালের কবল থেকে তেহুতিকে আহত না করে উদ্ধার করতে হলে আমাদেরকে কী করতে হবে। একবার বলার পর তাকে বললাম পুরো পরিকল্পনাটা আমাকে শুনাতে যাতে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে।

কথা বলতে বলতে আমি আমার ধনুকের ছিলা টেনে পরীক্ষা করছিলাম। তূণীর থেকে সবচেয়ে ভালো তিনটি তীর বেছে নিলাম। হাতের তেলোতে গড়িয়ে নিয়ে দেখে নিলাম কোনো ধরনের অমৃসণতা আছে কিনা। খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করার পর তীর তিনটি কোমরবন্ধে খুঁজে নিলাম। বাদবাকি তীরগুলো তূণীরে ঢুকিয়ে কাঁধে বেঁধে নিলাম। হয়তো একবারের বেশি তীর ছুঁড়ার সুযোগ পাবো না, তাও আবার এতো দূরের নিশানায়। আর যদি দ্বিতীয় সুযোগ আসে তখন তীর বাছাই করতে গিয়ে একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চাই না।

উঠে দাঁড়িয়ে জারাসের পিঠে একটা চাপর দিয়ে বললাম, আমি প্রস্তুত জারাস। তুমি তৈরিতো?

সে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ তায়তা! রাজকুমারীর জন্য আমি প্রাণ দিতে প্রস্তুত। নাটুকেপনা হলেও তার কথাটির মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল। তরুণ হৃদয়ের ভালোবাসার নিজস্ব একধরনের চমৎকারিত্ব রয়েছে।

আমি শুষ্ক মন্তব্য করলাম, আমার মনে হয় রাজকুমারী তেহুতি আর আমি দুজনেই তোমার জীবিত থাকাটাই শ্রেয় মনে করবো।

জারাস তার লোকজনদেরকে যথারীতি নির্দেশ দিতে শুরু করলো। আর আমি একটা কুমিরের চামড়ার বর্ম আর ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পরে নিলাম যাতে আমার বিশেষ আলখাল্লা আর লম্বা চুল ঢাকা পড়ে। আমি আমার লোকজনের মাঝে নিজেকে আলাদা করে দেখাতে চাই না।

সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পর আমরা উটের পিঠ থেকে নেমে উটগুলোকে টেনে নিয়ে পাহাড়ের পেছন দিকে গেলাম। তারপর নিচে বেলেপাথরের একশিলা স্তম্ভের উপত্যকায় নামতে শুরু করলাম। শেয়াল তার দস্যুদের নিয়ে সেখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

এবার আমার বামবাহুতে চামড়ার বাহুবন্ধনীটিা লাগিয়ে নিলাম, যাতে ধনুকের ছিলার আঘাতে গতবারের মতো কেটে না যায়।

দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল জারাস। তার বিশ পা পেছনে অন্যান্যরা একজোট হয়ে চলেছে। এবার আমি জারাসের পাশাপাশি নেই।

কুমিরের বর্ম পরে আমি দ্বিতীয় সারির বামদিকে একেবারে শেষ প্রান্তে রয়ে গেলাম। ধনুকটা উটের গদির কাপড়ের মাঝে লুকালাম, যাতে একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন এটা তুলবো, তার আগে শত্রুপক্ষের কারও চোখে না পড়ে।

আমাদের অবস্থান থেকে জারাস খানিকটা সামনে এগিয়ে গেল, যাতে তার উপর শেয়ালের নজর পড়ে। সে তলোয়ারটা উল্টো করে তলোয়ারের হাতল মাথার উপরে উঁচু করে রেখেছে। এটা ছিল সাময়িক যুদ্ধবিরতীর সর্বজনীন প্রতীক।

আমি জানতাম শেয়াল এটাকে শর্তসাপেক্ষে আলোচনার একটা আমন্ত্রণ হিসেবে ধরে নেবে, কেননা আমরা সবাই ইতোমধ্যেই অচলাবস্থায় আটকে পড়েছি। সে পালাতে পারছে না, কেননা তার ঘোড়াগুলো অচল হয়ে পড়েছে, আর তার লোকদেরও খেলা সাঙ্গ হয়েছে।

আবার আমরাও সরাসরি আক্রমণ করে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারছি না, কেননা সে তেহুতির গলায় একটা ছুরি ধরে রেখেছে।

আমি জারাসের উপর নির্ভর করছিলাম, যাতে সে শেয়ালকে আমার তীরের পাল্লার মধ্যে নিয়ে আসে। আরেকটু কাছাকাছি হতেই, আমি পরিস্থিতিটা আরও ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলাম।

পায়ের ছাপ থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম, দুই দলে ভাগ হয়ে আর মরুভূমির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে আল-হাওয়াসাঈর দস্যুদের সংখ্যা এখন পনেরোতে নেমে এসেছে। আর এদিকে জারাসসহ আমার রয়েছে ছাপান্নজন রক্ষী। ওরা সবাই এখন সতেজ আর লড়াই করার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

শেয়াল বেশ সর্তকতার সাথেই বেলেপাথরের বিশাল একশিলা স্তম্ভটির নিচে তার শেষ অবস্থানটি বেছে নিয়েছিল। শিলাটি দুই দিক দিয়ে তাকে আড়াল করে রেখেছে। তারপরও এটি তাকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে। তার মাথার উপরে সামনের দিকে ছড়ানো একটি তাকের মতো বেলেপাথরের ছাদটি আমার তীর ছোঁড়ার পাল্লাকে সীমাবদ্ধ করেছে। এই দূরত্ব থেকে উঁচু করে তীর ছুঁড়লে সেটা শেয়ালের গায়ে বেঁধার আগে তার মাথার উপরে ছাদের পাথরে লেগে যেতে পারে। আমাকে আরেকটু এগিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বাঁকা পথে তীর ছুঁড়তে হবে যা ছাদ এড়িয়ে তার গায়ে বিঁধতে পারে।

তবে পাহাড়টি শেয়ালের জন্য একটি কারাগারের দেয়ালও হয়েছে। তার পালাবার আর কোনো পথ নেই। তাকে আমাদের সাথে একটা বোঝাঁপড়ায় আসতেই হবে: তার নিজের আর লোকজনের জীবনের বদলে আমাদের রাজকুমারীর জীবন অদলবদল করতে হবে।

জারাসকে অনুসরণ করে আমরা ধীরে ধীরে যেখানে শেয়াল অপেক্ষা করছে সেদিকে এগোতে লাগলাম।

এবার আমি দেখলাম বেদুঈন সর্দারের ঘোড়াগুলো পিপাসায় কাতর হয়ে আর অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে মারা পড়েছে। আরবরা কয়েকটি ঘোড়ার মৃতদেহ সামনের দিকে টেনে এনে অর্ধচন্দ্রাকার দেয়ালের মতো সাজিয়ে রেখেছে। এর আড়ালে ওরা হামাগুড়ি দিয়ে অবস্থান নিয়েছে। লোকগুলোর শুধু মাথার উপরের অংশ, বর্শার ডগা আর বাকা তলোয়ারের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে।

আরেকটু কাছে এগিয়ে আমি লক্ষ্য করলাম যে, অন্তত তিনজন আরব ধনুকে তীর জুড়ে আমাদের দিকে ছুঁড়বার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তবে বেদুঈনরা ভালো তীরন্দাজ নয়। এগুলোর পাল্লা অত্যন্ত দুর্বল, আমার হাঁটুর কাছে উটের গদীর কাপড়ের নিচে যে শক্তিশালী বাঁকা যুদ্ধের ধনুকটি রয়েছে তার তুলনায় এর পাল্লা অর্ধেক হবে।

এখন সবকিছু নির্ভর করছে আল-হাওয়াসাঈ আমাদেরকে থামতে বলার আগে জারাস কতোটুকু দুরত্ব কমাতে পারবে। উটের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে আমি কমে আসা দূরত্বের পাল্লাটা পরিমাপ করছিলাম।

তারপর আমরা ঠিক মোক্ষম জায়গায় পৌঁছলাম, যেখান থেকে আমার ধারণায় উপরের দিকে বাঁকা করে তীর ছুঁড়লে তীরটি নিচু হয়ে ওদের মাথার উপরের ছাদে না লেগে যে কোনো একজন আরবের কাছে পৌঁছাবে। এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এরপর সামনের দিকের এগিয়ে যাওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে চলেছে।

আমার সামনে যে রক্ষীরা ছিল, ওরা আমাকে আড়াল করে রেখেছিল। আমি নিচু হয়ে ধনুকটা ধরলাম। তারপর নিচের দিকে না তাকিয়ে অন্য হাত দিয়ে কোমরবন্ধ থেকে একটা তীর বেছে নিলাম। ধনুকটা যেখানে হাতে ধরেছিলাম তার উপর তীরের মাথা রেখে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে তীরটা চেপে ধরে রাখলাম।

আমার উটটি আমাকে নিয়ে ধীরে ধীরে আরও পাঁচ পা সামনে এগোল। ঠিক তখনই বেদুঈনদের সারি থেকে একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি হল। সে মুখটাকা কাপড়টি সরিয়ে আরবীতে গর্জে উঠলো।

থামো! আর কাছে এগোবে না! তার কণ্ঠস্বর মাথার উপরের ছাদে প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে গমগম করে উঠলো।

কালো দাড়িওয়ালা শয়তান লোকটাকে দেখেই আমি চিনতে পারলাম। তিনদিন আগে তেহুতিকে ঘোড়ার পিঠে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছিল। সে চিৎকার করে বলে উঠলো,

আমি আল-হাওয়াসাঈ, বেদুঈন সর্দার। সবাই আমাকে ভয় পায়!

তারপর সে নিচু হয়ে ঘোড়ার মৃতদেহগুলোর পেছনে যেখানে তেহুতিকে লুকিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকে তাকে টেনে দাঁড় করাল।

সে এমনভাবে তেহুতিকে ধরে রাখলো যেন আমরা তার মুখ দেখে তাকে চিনতে পারি। একহাত দিয়ে সে তেহুতির গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে, যাতে সে নড়াচড়া বা চিৎকার করতে না পারে। তার ডান হাতে একটা নাঙ্গা তলোয়ার ধরা রয়েছে। তেহুতির দেহ দিয়ে সে নিজের দেহ আড়াল করে রেখেছে।

আল-হাওয়াসাঈ তেহুতির পরনের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলেছে। আমি জানি সে এটা করেছে তাকে অপমান করার জন্য আর দেখাতে যে সে সম্পূর্ণভাবে তার উপর কর্তৃত্ব খাঁটিয়েছে। তার গলা পেঁচিয়ে ধরা দস্যুর বিশাল লোমশ হাতের তুলনায় তেহুতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কীরকম কমনীয় আর শিশুর মতো দেখাচ্ছে। ভয়ে তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে রয়েছে।

জারাস এক লাফে উটের পিঠ থেকে নামলো। তখনও উল্টো করে ধরা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে সে আল-হাওয়াসাঈয়ের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলো। আল-হাওয়াসাঈসের মতো সেও তার শিরস্ত্রাণের মুখের ঢাকনা খুলে নিজের চেহারা প্রকাশ করে রেখেছে।

জারাসকে চেনার সাথে সাথে তেহুতির মুখ থেকে আতঙ্ক সরে গিয়ে আশার আলো জেগেছে আর তার সাহস ফিরে এসেছে। জারাসের নাম নিতে চেষ্টা করে তার ঠোঁট নড়ে উঠলো, তবে দস্যু শেয়াল শক্তহাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরায় কোনো শব্দ বের হল না।

তার জন্য আমি গর্ব বোধ করলাম, যেরকম তার মায়ের জন্যও করতাম। তবে এখন এসব ভাবনা থেকে আমার মন সরিয়ে নিলাম। দুই চোখ দিয়ে দূরত্বটা মেপে আমার উড়ন্ত তীরের উচ্চতা আর তারপর নিচু হয়ে লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার গতিপথটি মনে মনে পরিমাপ করলাম।

অনুভব করলাম বাম কাঁধের পাশ দিয়ে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, তবে দেখলাম যেখানে আল-হাওয়াসাঈ দাঁড়িয়ে রয়েছে সে স্থানটি বড় একটি পাথরের টুকরা দিয়ে আড়াল করা রয়েছে। শুধু মাত্র একজন ওস্তাদ তীরন্দাজই এখানে তার লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। প্রথমে হাওয়ায় ডান দিকে মোড় নেবে, তারপর বাতাসহীন জায়গাটিতে গিয়ে তীরটি নিচের দিকে শেষ কয়েক কিউবিট নিচে নেমে লক্ষ্যে আঘাত হানবে।

আল-হাওয়াসাঈ প্রচণ্ড আক্রোশে জারাসের উদ্দেশ্যে গালি দিতে দিতে তাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলছিল আর সামনে না এগোতে সাবধান করছিল। ডান হাতে ধরা ছোট তরোয়ালের ব্রোঞ্জের ধারাল পাতটি সে তেহুতির চিবুকের নিচে নরম গলার সাথে চেপে ধরে রেখেছিল।

সে চিৎকার করে জারাসকে বললো, ওখানেই থাম আর নয়তো আমি এই কুত্তির গলা কেটে পুরো দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলবো।

জারাস শান্ত কণ্ঠে বললো, কারও মারা যাবার প্রয়োজন নেই। আমরা কথা বলতে পারি। সে আরও এগোতে লাগলো। জারাস আমাকে মূল্যবান সুবিধা দিচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে আমার তীরের পাল্লা আরও সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছাচ্ছে।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার মুখোমুখি হতে গিয়ে আল-হাওয়াসাঈ একটু সরে গিয়ে আমার তীরের লক্ষ্য আরও উন্মুক্ত করে দিচ্ছিল।

এখন শুধু দরকার শেয়ালের মনোযোগ কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্য দিকে সরানো যাতে সেই ফাঁকে আমি ধনুকে তীর লাগিয়ে গুণ টেনে তীরটি ছুঁড়তে পারি।

মাথা না সরিয়ে আমি একটি শিকারী বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে উঠলাম। আমার জীবনের প্রতীক হচ্ছে আহত বাজপাখি আর আমি এই ডাকটি নিপুণভাবে আয়ত্ব করেছিলাম। এমনকি সবচেয়ে অভিজ্ঞ বাজপাখির শিকারীও আমার ডাক আর আসল পাখির ডাকের মধ্যে পার্থক্য বের করতে পারবে না। চতুর্দিকে পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিতৃ হয়ে শব্দটি আরও জোড়ালো হয়ে উঠলো।

সমস্ত বেদুঈন বাজপাখি খুব পছন্দ করে। আর আল-হাওয়াসাঈও এই স্মৃতি জাগানিয়া ডাকটি শুনে নিজেকে সামলাতে পারলো না। গালাগালি থামিয়ে সে উপরের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো কোথা থেকে এই ডাকটি এসেছে। মুহূর্তের জন্য সে মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়েছিল, তবে সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল।

আমি ধনুক আর ভালো তীরটি এক সাথে করে ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। ধনুকের গুণ টেনে ছেড়ে দিতেই তীরটা উড়ে গেল। লক্ষ্য করলাম তীরটা উপরের দিকে উঠে এর সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছলো। শেয়ালের মাথার উপরের পাথরের ছাদটি না ছুঁয়ে এর উপর দিয়ে পার হল, তারপর নিচের দিকে পড়তে শুরু করলো।

আমার মনে হচ্ছিল যেন এটি একটি রাজকীয় ভঙ্গিতে চলছে, তবে আমি জানি কেবল আমার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন লোকই তা জানতে পারে।

তারপর আমি লক্ষ্য করলাম শেয়ালের দুই চোখ তার কোটরে ঝির ঝির করে কেঁপে উঠলো। অসম্ভব ব্যাপার, হয় সে এটা সে দেখেছে কিংবা একটি বন্য পশুর মতো অনুভব করেছে যে, আমার ছোঁড়া তীরটা তাকে আঘাত করতে যাচ্ছে। সে মাথাটা সামান্য ঝাঁকি দিল আর তার শরীরটি ঘুরতে শুরু করলো। তারপর আমার তীরটি তার বুকের উপরের অংশের এক পাশে বিধলো। আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য সে একটু নড়েছে, আমি বুঝতে পারলাম তীরটি তার হৃৎপিণ্ডে লাগেনি।

তবে যাই হোক তীরের ধাক্কায় সে পেছনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সাথে সাথে দুই হাত উপরের দিকে তুলে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলো। তারপর তার পা দুটো ভেঙে পড়তেই সে মাটিতে পড়ে গেল।

তেহুতি তার হাত থেকে ফসকে ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আমি দেখলাম সে হাওয়ার মাঝে এক পাক ঘুরে একটি বিড়ালের মতো ক্ষিপ্রগতিতে মাটিতে দুপা রেখে দাঁড়াল। তাৎক্ষণিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুহূর্তের জন্য একটু হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলিয়ে নগ্ন দেহে সুন্দর মেয়েটি একটি মোহনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল।

আমাদের আগেকার পরিকল্পনা মোতাবেক জারাস বাজপাখির ডাকটির জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি পাখির ডাক শুরু করার সাথে সাথে সে যেখানে তেহুতি দাঁড়িয়েছিল সেদিকে ঝাঁপ দিল।

শিকারী চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে সে লাফ দিয়েছিল। তেহুতির কাছে পৌঁছাবার জন্য তাকে মাটিতে পড়ে থাকা শেয়ালের দেহ পার হতে হচ্ছিল। সে দেখতে পেল আমার তীরটি শেয়ালের বুকের উপরের অংশে বিধে রয়েছে, তাই সে মনে করলো দস্যুটি মরে গেছে। তাই সে তার দিকে আর মনোযোগ দিল না। কী ঘটছে, অন্য বেদুঈনরা তা বুঝে উঠার আগেই সে তেহুতির কাছে পৌঁছে গেল। তেহুতিকে জাপটে ধরে পেছনে ঠেলে নিয়ে তার সামনে নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে দাঁড়াল। সাথে সাথে উল্টো করা তলোয়ারটা শূন্যে ছুঁড়ে আবার মাটিতে পড়ার আগেই তলোয়ারের বাট ডান হাতে ধরে তেহুতির সামনে প্রহরীর মতো দাঁড়াল। সামনের দিকে থেকে আরবরা আক্রমণ করলে তাদের মোকাবেলার করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

ওদেরকে রক্ষা করার জন্য আমি রক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলাম, এগিয়ে যাও! আক্রমণ কর! উট নিয়ে সামনের দিকে এগোতে এগাতে আমি ধনুকে আরেকটা তীর জুড়লাম। লক্ষ্য করলাম একজন আরব তীরন্দাজ জারাসের দিকে তীর ছুঁড়ার জন্য তার ধনুক উঁচু করেছে।

আরব লোকটির আগেই আমি তীর ছুঁড়লাম। ঠিক সময়ে আমার তীরটা তার গলায় বিঁধলো। তার তীরটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে যেতেই সে হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে দুই হাত দিয়ে গলায় বেঁধা আমার তীরটা আঁকড়ে ধরলো। মুখ থেকে গল গল করে লাল টকটকে রক্ত বের হতে লাগলো।

আরেকজন আরব জারাসের দিকে ছুটে গিয়ে মাথার উপর তলোয়ার তুলে জারাসকে আঘাত করতে উদ্যত হল। জারাস এক ধাক্কায় লোকটির তলোয়ারটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে তার নিজের তলোয়ার দিয়ে লোকটির তলোয়ার ধরা হাতটা এক কোপে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আরব লোকটি আর্তচিৎকার করে কাটা হাতের মুড়োটি অন্য হাতে ধরে পেছনের দিকে পড়ে গেল। সে গলায় তীর বেঁধা অন্য আরবটির গায়ের উপর উল্টে পড়লো।

আমি তৃতীয় তীরটি ছুঁড়ে আরেকজন বেদুঈন দস্যুকে ঘায়েল করলাম। জারাস আমার দিকে ফিরে দাঁত বের করে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। মনে হল বোকা ছেলেটি এই লড়াই বেশ উপভোগ করছে।

আমি চিৎকার করে তাকে বললাম, তেহুতিকে নিয়ে এখানে চলে এসো!

সে দুহাত দিয়ে তেহুতিকে ছোট্ট একটি শিশুর মতো মাটি থেকে তুলে তার বাম কাঁধে ফেলে নিয়ে চললো।

তেহুতি পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করতে লাগলো, আমাকে নামিয়ে দাও! জারাস তার প্রতিবাদে কোনো কান না দিয়ে তাকে কাঁধে নিয়ে আমার কাছে আসতে শুরু করলো। আমরাও তার দিকে এগোতে লাগলাম।

আল-হাওয়াসাঈ তখনও তীর বেঁধা অবস্থায় একই জায়গায় মাটিতে পড়েছিল। তার দিকে কোনো খেয়াল না করে আমরা আক্রমণরত অন্যান্য বেদুঈনদের সামলাতে ব্যস্ত ছিলাম। অন্যান্যদের মতো আমিও সমান দোষী। আমি জানতাম আমার তীরটি শেয়ালের হৃদপিণ্ডে আঘাত করেনি, হয়তো সে এখনও জীবিত আছে। তবে আমি ভেবেছিলাম তাকে আমি পঙ্গু করে ফেলায় তার তরফ থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। হাতপা দুই দিকে ছড়িয়ে সে মাটিতে পড়েছিল আর তার তলোয়ারটিও তার দেহের নিচে আটকা পড়েছিল।

তাকে পার হয়েই জারাসকে তেহুতির কাছে পৌঁছতে হয়েছিল। এখন সে আবার পিছিয়ে তার দিকেই আসছিল। জারাসের সমস্ত মনোযোগ ছিল তার চারপাশ ঘিরে থাকা অন্যান্য আরবদের দিকে।

হঠাৎ আল-হাওয়াসাঈ মাটিতে এক গড়ান দিয়ে ঘুরে বসলো। ডান হাতে তলোয়ারটি ধরা রয়েছে, তবে তার উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, সাবধান জারাস! পেছনে দেখো জারাস! শেয়াল তোমার পেছনে!

লড়াইয়ের কোলাহলে হয়তো সে আমার চিৎকার শুনতে পায় নি কিংবা আমার সাবধান বাণীর অর্থও ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। তাই সে আরেক কদম পিছোতেই আল-হাওয়াসাঈয়ের তলোয়ারের আওতায় চলে এলো।

হতাশায় অসংলগ্ন এক চিৎকার করে শেয়াল তাকে আঘাত করলো। আঘাতটা এলো নিচে আর পেছন দিক থেকে। আঘাতটি সেরকম জোরদার না। হলেও তলোয়ারের ধারাল ডগাটি জারাসের চামড়ার পোশাক ভেদ করে তার দুই পায়ের মাঝখানে ঢুকে গেল।

আল-হাওয়াসাঈ দুর্বল হাতে তলোয়ারটি জারাসের শরীর থেকে টেনে বের করতে চেষ্টা করলো, কিন্তু টেনে বের করার মতো শক্তি তার ছিল না। সে পেছন দিকে হেলে এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে বসলো। তারপর নিঃশ্বাস নেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেই বুকে বেঁধা তীরটি ঠিক তখনই এক হ্যাঁচকা টানের চোটে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিল। মুখের এক পাশ দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

এদিকে জারাসের পুরো দেহ বেঁকে উঠে তারপর শক্ত হয়ে দাঁড়াল। তার ডান হাত থেকে তলোয়ারটা মাটিতে খসে পড়লো। তেহুতি তার বাম হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মাটিতে পা রেখে দাঁড়াল।

যন্ত্রণার মাঝে সে কোনোরকমে তেহুতিকে বললো, তায়তার কাছে চলে যান। আমি মারা যাচ্ছি। তায়তা আপনাকে রক্ষা করবে। তারপর সে বাঁকা হয়ে তলপেটের যে জায়গায় তলোয়ারের ডগাটা বিঁধেছে তা অনুভব করলো।

তেহুতি তার উপদেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো। সে জারাসের পাশে অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো জারাসের পোশাকের নিচ দিয়ে তলোয়ারের ডগাটা বের হয়ে রয়েছে আর দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছে।

জারাস হাঁটু ভেঙে সামনের দিকে পড়ে গেল। মাথা নিচু করে কপাল মাটিতে ঠেকাল।

তার সামনে দাঁড়িয়ে তেতির মুখ রাগে কাঁপছিল, সে আল হাওয়াসাঈর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলো, তুমি জারাসকে মেরে ফেলেছ! তুমি আমার মানুষকে মেরে ফেলেছ! সে মাটি থেকে জারাসের তলোয়ারটা তুলে নিল। তারপর এমন প্রচণ্ড শক্তিতে শেয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, যা তার কমনীয় দেহের তুলনায় সম্পূর্ণ অসম্ভব বলা চলে। তলোয়ারের ডগাটি সোজা শেয়ালের কণ্ঠনালীর মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দিল।

শেয়ালের গলা থেকে হিশশ করে নিঃশ্বাস বের হল, সে দুই হাতে তলোয়ারের ধারাল ফলাটা ধরে থামাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে চললো। পাগলের মতো শক্তিতে তেহুতি তলোয়ারটি তার গলা থেকে টান দিয়ে বের করতেই, ধারাল ফলায় শেয়ালের হাড় শুদ্ধ দুটো আঙুল কেটে গেল।

তারপর শেয়ালের দেহের উপর দাঁড়িয়ে তেহুতি একের পর এক তলোয়ারের কোপ মেরে চললো বুকে, পাঁজরের মাঝে আর অন্যান্য জায়গায়।

আমার লোকেরা তেহুতিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে বাদবাকি জীবিত বেদুঈনদেরকে তাদের বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করতে লাগলো।

আমি তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে তেহুতির পাশে এসে উটের পিঠ থেকে নামলাম। তাকে বুকে জড়িয়ে চেপে ধরে রাখলাম যতক্ষণ না সে শান্ত হয়, তারপর হাত থেকে তলোয়ারটা নিলাম।

তাকে বললাম, তুমি তাকে দশবার মেরে ফেলেছ। এখন জারাসের আমাদের সাহায্য দরকার। আমি জানি তার নামটি তার রাগ শান্ত করবে আর মনকে স্থির করতে সাহায্য করবে।

.

আমি জারাসকে নড়াচড়া করতে চাচ্ছিলাম না, কেননা তার যখমের যে অবস্থা, এতে অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। লোকজনের সাহায্যে সে যেখানে শুয়েছিল তার উপরে একটা আচ্ছাদন তৈরি করলাম।

তারপর রক্ষীবাহিনীর সার্জেন্টকে বললাম মৃত আরবদের শরীর থেকে পরিষ্কার আর খুব কম রক্তমাখা আলখাল্লাগুলো খুলে নিয়ে আসতে। এগুলো দিয়ে তেহুতির জন্য সূর্যের প্রচণ্ড তাপ আর আমার লোকদের নজর থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটা মোটামুটি আলখাল্লার মতো তৈরি করে দিলাম।

তারপর মৃত ঘোড়া আর শেয়ালসহ আরবদের দেহগুলো টেনে নিয়ে একলিগ দূরে মরুভূমিতে ফেলে আসতে বললাম। প্রচণ্ড তাপে এক ঘন্টার মধ্যেই এগুলোতে পচন ধরবে।

আমি আমার জিনিসপত্রের সাথে চিকিৎসার সাজসরঞ্জাম, সামান্য পরিমাণ ভেষজ আর ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম। এগুলো সবসময় আমি যেখানে যাই সেখানে আমার সাথেই থাকে, যেন এগুলো আমার দেহের একটি অংশ। তবে জারাসের ক্ষতটি পরীক্ষা শুরু করার আগেই আমি বুঝতে পারলাম, যে কঠিন কাজ আমার হাতে রয়েছে তার জন্য ওষুধের এই পরিমাণ যথেষ্ট নয়।

এখানে কেবল তেহুতির উপর আমার আস্থা আছে। আহত ঘোড়া আর অন্যান্য গৃহপালিত পশুর চিকিৎসার সময় সে আমাকে সাহায্য করেছিল। তারপরও তাকে আমি নিতান্ত শিশুই মনে করি। জারাসের মৃত্যু হবে আর আমি চাই না যে সে তা তাকিয়ে দেখুক। তবে আমার হাতে কোনো উপায় ছিল না।

লাল শেপ্পেন (আফিম) ফুলের এক ঢোক রস বানাতে বানাতে আমি তাকে বললাম, রাজকুমারী, আমাকে তোমার সাহায্য করতে হবে। শক্তিশালী এই রসটি একটি ষাঁড়কেও অচেতন করে ফেলতে পারে।

অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সে উত্তর দিল, পিরবো। শুধু বল কী করতে হবে।

একটা তামার পেয়ালায় মাদক তরলটি তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, প্রথমে এই রস পুরোটা তাকে খাওয়াতে হবে। সে জারাসের মাথা তার কোলে তুলে নিল। পাত্রটি তার ঠোঁটের কাছে ধরে তার নাক চেপে ধরলো যাতে সে পুরো তরলটা গিলে ফেলে। এদিকে আমি অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি সাজালাম।

জারাসের দুই চোখ বুজে এলো আর শক্তিশালী মাদকের প্রভাবে সে প্রায় অসাড় হয়ে পড়তেই আমরা তার গায়ের বর্ম আর কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পরনের আঁটোসাট চোগাটা খুলে ফেললাম। মাটিতে ঘোড়ার জিনের কম্বলের একটা বিছানা পেতে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে উপুড় করে শুইয়ে দিলাম। আমি আগেও জারাসকে নগ্নদেহে দেখেছি, তবে সবসময়ের মতো এবারও তার চমৎকার দেহসৌষ্ঠব দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে মনে দুঃখ পেলাম ভেবে যে, এতো শিগগরই প্রকৃতির এই অপূর্ব সুন্দর কীর্তিটিকে আবার মাটিতেই শুইয়ে দিতে হবে।

আমি তার দুই পা ফাঁক করলাম, যাতে শেয়ালের তলোয়ারের ডগাটি যেখান দিয়ে ঢুকেছে সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারি। তলোয়ারের ডগাটি তখনও ক্ষতস্থানের মুখে রয়েছে। আমি জানি শল্যচিকিৎসক দাবীদার অনেকেই কোনো কিছু না ভেবে এই অবস্থায় তলোয়ারের ডগাটি টেনে খুলে ফেলবে। এটা করার সাথে সাথে ওরা রোগীর ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলবে।

তলোয়ারের ডগাটির ঢোকার মুখে এর কোণ আর গভীরতা পরীক্ষা করতে করতে আমি দেখলাম তলোয়ারটি তার পুরুষাঙ্গকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমার মিশ্র অনুভূতি হল।

জারাস আর তেহুতির জন্য মনে আনন্দ হল। তবে আমার নিজের সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। ভালোই হতো যদি জারাসের এই অঙ্গটি তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তাহলে অনেক বিষয়ে আমার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যেত। তবে এই অশুভ চিন্তাকে মন থেকে দূর করে দিয়ে ক্ষতস্থানটি থেকে তলোয়ারের ডগাটি বের করার দিকে মনোযোগ দিলাম।

এটি তার বাম নিতম্বের পাশ দিয়ে চলে গেছে। মেরুদণ্ডের নীচের অংশে শ্রোণীর ভারী অস্থিকাঠামোতে আঘাত করলে হয়তো ডগাটি বেশি দূর যেতে পারতো না।

তবে তা হয়নি। একটা পথ করে নিয়ে ডগাটি জারাসের নাড়িভূঁড়ি পাকস্থলীর যে অস্থি-গামলায় থাকে সেখানে ঢুকেছে। আমার শত শত মানব শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে পরীক্ষা করার সুযোগ হয়েছিল। আমি জানি আমরা যে খাবার গ্রহণ করি তা কীভাবে, এই মোটা বা মাংসল নলের ভেতর দিয়ে ঢুকে নিচের দিকে যায়। তারপর নিতম্বের মাঝে স্থাপন করা ভিত্তিগত বহির্মুখ দিয়ে বর্জ্য ত্যাগ করে খালি হয়।

এবার আমি আতঙ্কিত হলাম। শেয়ালের তলোয়ারটি যদি জারাসের নাড়িভূঁড়ির এই নলগুলির কোনো একটি ছিদ্র করে থাকে, তাহলে বর্জ্যগুলো তার পাকস্থলিতে ঢুকে পড়তে পারে। এই বর্জ্য যাকে আমরা সাধারণত পশুর মল বলে থাকি, এতে বিশেষ ধরনের দুর্গন্ধময় দূষিত রস বা ধাতু থাকে। এই রসটি মারাত্মক বিষাক্ত, দেহে ছড়িয়ে পড়লে জখম স্থানের মাংসে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়। পরিণতিতে মৃত্যু অবধারিত।

তলোয়ারটি এক টানে বের করতে হবে। আমি ছয়জন শক্তিশালী লোককে ডেকে আনলাম, কেননা তার যে যন্ত্রণা হবে তাতে আমি যে শক্তিশালী আফিম খাইয়েছিলাম তাও অকার্যকর হয়ে পড়বে।

তেহুতি তার মাথা কোলে নিয়ে বসলো। সে জারাসের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে একজন মা যেমন তার শিশুকে গুণগুণ করে গান শোনায় সেরকম করতে লাগলো। অন্যরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে তার হাত পা মাটিতে চেপে ধরলো। আমি তার দুই পায়ের মাঝে হাঁটুগেড়ে বসে শক্ত করে দুই হাতে তলোয়ারের হাতলটা ধরলাম।

আমি নির্দেশ দিলাম, ধরে থাক! তারপর একটু পেছনে হেলে শরীরের সমস্ত ভার আর শক্তি প্রয়োগ করলাম। তলোয়ারের পাতটা যখমের মুখে একটু বাঁকা করে রাখলাম যাতে মাংসপেশিতে আর ভেতরে কোনোধরনের ক্ষতি না হয়।

জারাসের পুরো দেহ শক্ত হল। তার সমস্ত মাংসপেশি মার্বেলের মতো শক্ত হল আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে একটা আহত ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো। ছয়জন বলশালী মানুষও তাকে চেপে ধরে রাখতে পারছিল না। দীর্ঘ একটি মুহূর্ত কিছুই হল না। ব্রোঞ্জের তলোয়ারের পাতটি ভেতরের মাংসপেশিতে আটকে রয়েছে। তারপর হঠাৎ ঝটকা মেরে তলোয়ারটি বের হয়ে আসতেই আমি পেছন দিকে উল্টে পড়লাম।

কাঁপতে কাঁপতে জারাস শেষ আরেকবার গোঙানী দিয়ে জ্ঞান হারাল। আমি একটা ভেড়ার লোমের পট্টি বানিয়ে রেখেছিলাম। এবার পট্টিটা ক্ষতস্থানের উপর রেখে তেহুতিকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত শক্তি দিয়ে এটা এজায়গায় চেপে ধরে রাখ, যেন রক্ত বের না হয়। তারপর জারাসকে ধরে রাখা লোকদেরকে বললাম, এবার ছেড়ে দাও ওকে।

তারপর হাতে ধরা তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে পরিমাপ করলাম ডগাটা কতটুকু ভেতরে ঢুকেছিল।

পরিমাপটি আন্দাজ করার পর বললাম, দেড় হাত পর্যন্ত ভেতরে ঢুকেছিল। বেশ গভীরই মনে হচ্ছে।

ক্ষতস্থানে তেহুতি যে পট্টিটা ধরে রেখেছিল সেটা তুলে নিচু হয়ে জখমটা পরীক্ষা করলাম।

বেশ মোটা হয়ে কেটেছে। পট্টি সরাতেই রক্তের চিকন ধারা গড়িয়ে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে পরিষ্কার আর স্বাস্থ্যকর রক্ত। একটু কাছে মুখ নিয়ে শুকলাম। কোনো পুঁজের গন্ধ নেই।

এবার একটু ক্ষীণ আশার আলো অনুভব করলাম। হয়তো তলোয়ারের ধারাল ফলাটি কোনো নাড়িভূড়ি কাটে নি।

তেহুতি জিজ্ঞেস করলো, কী দেখছো?

দেখছি কতটুকু আশা আছে।

ভেড়ার লোমের পট্টিটা জখমের উপর রেখে একটা শক্ত বাঁধন দিলাম আর বদ রস প্রতিরোধ করতে সামান্য কয়েকফোঁটা মদ ছড়িয়ে দিলাম। এরপর জারাসের পেছন দিকে গিয়ে দুই নিতম্বের উপর হাত রাখলাম। তারপর শরীর শক্ত করে নিতম্ব দুদিকে টেনে ফাঁক করলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মলদ্বার পরিষ্কার আর এঁটে রয়েছে।

আরেকটি পরীক্ষা করতে হবে। ওর পেছনে হাত রেখে নিচের দিকে জোরে চাপ দিলাম। অন্ত্র থেকে ফুত ফুত শব্দ করে বায়ু বের হল, তারপর মলদ্বার থেকে ফিনকি দিয়ে তরল বিষ্ঠা আর তাজা রক্ত বের হল। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই আমি আর তেহুতি দুজনেরই মুখ কুঁচকে উঠলো।

এবার আমি নিশ্চিত হলাম তলোয়ারটি আসলেই অন্ত্রে আঘাত করেছে। এতে বেশ হতাশা অনুভব করলাম। জারাসের আর কোনো আশা নেই। পৃথিবীর কোনো শল্যচিকিৎসক, এমনকি আমিও তাকে বাঁচাতে পারবো না। সে এখন দেবতা শেঠের হয়ে গেছে।

তেহুতির দিকে না তাকালেও অনুভব করছিলাম, সে ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ফিসফিস করে সে বললো, তায়তা দয়া কর। তুমি কি তার প্রাণ বাঁচাতে পারো না? আমার জন্য কি জারাসকে বাঁচাতে পারো না? একটা উত্তর তাকে আমার দিতে হবে। এভাবে তাকে আর যন্ত্রণা দেওয়া যায় না।

মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম। তার চেহারায় এমন দুঃখ বেদনা কখনও দেখিনি।

মনে আর ঠোঁটের ডগায় না বলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, এমনকি মাথাও নাড়লাম। তবে না শব্দটি আর উচ্চারণ করা হল না। এই দুই তরুণ-তরুণীকে পরিত্যাগ করতে পারলাম না।

হ্যাঁ! তোমার জন্য আমি তাকে বাঁচাতে পারবো তেহুতি। জানি একথা বলাটা অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা। মিথ্যা আশ্বাসের চেয়ে চূড়ান্ত অবস্থা অবশ্যই ভালো। তবে আমি তার দুঃখ সহ্য করতে পারছিলাম না।

তাই মিথ্যা বলার জন্য নীরবে ভালো দেবতার কাছে ক্ষমা চাইলাম। তারপর জারাসের আত্মার জন্য শেঠের সাথে লড়াই শুরু করলাম।

.

এটুকু আমি নিশ্চিত জানতাম যে, আমাকে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। কোনো মানবদেহই দীর্ঘক্ষণ নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। কীভাবে কি করতে হবে তার কোনো নির্দেশনামা আমার কাছে নেই। আমি এখন যা করতে যাচ্ছি পৃথিবীর আর কোনো শল্যচিকিৎসক তা কখনও করতে সাহস করেনি।

আর যে এক পাত্র লাল শ্যাপ্পেন আছে তা দিয়ে জারাসকে বড়জোর এক ঘন্টা অজ্ঞান রাখা যাবে। এর পুরোটাই এখন লাগবে।

তলপেট কেটে দেখতে হবে জারাসের নাড়িভূঁড়ির কোনো জায়গায় কেটেছে। তারপর তলোয়ার কাটা অংশটিতে সেলাই করতে হবে। আর অন্ত্র থেকে পেটে যে বদ রসটি ঢুকেছে তা ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

সৌভাগ্যবশত ময়াগুহা থেকে বের হবার সময় অন্য সবার মতো জারাসও কম খাবার খেয়ে বের হয়েছিল। খাবার কম থাকায় সবার খাবারের পরিমান কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার অন্ত্রে খুব বেশি বর্জ্য থাকার কথা নয়। আমার কাছে উইলো গাছের ছাল আর সেডার গাছের নির্যাসের মিশ্রণ ছিল, তবে বিষ ধুয়ে ফেলার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। তবে সবচেয়ে ফলপ্রসু ছিল চোলাই করা মদের পাতন। কেবল ছোট একটি চামড়ার মশক ভর্তি চোলাইকরা মদ ছিল। মূল্যবান এই তরল একটি ছোট বাটিতে ঢেলে আমি আর তেহুতি হাত ধুয়ে নিলাম।

আমি অনেক আগে আবিষ্কার করেছিলাম তাপে জীবদেহ নিঃসৃত রস ধ্বংস না হলেও পরিমাণে কমে যায়। আমার নির্দেশে দুজন লোক বড় একটি পাত্র আগুনে চড়াল। পানি যখন টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো তখন আমি আমার ব্রোঞ্জের শল্য কাঁচি, সুচ আর যন্ত্রপাতি আর ক্ষতস্থান সেলাইয়ের সুতা ফুটন্ত পানিতে ডুবালাম।

বড় আরেক মাত্রা লাল শ্যাপ্পেন ফুলের রস জারাসের গলা দিয়ে জোর করে ঢুকালাম। আর এদিকে তেহুতি চোলাই মদ দিয়ে তার পেট স্পঞ্জ করতে শুরু করলো।

তারপর রক্ষীরা আবার জারাসকে শক্ত করে মাটিতে শুইয়ে ধরলো। তার দাঁতের ফাঁকে দুই স্তর চামড়ার ফালি রাখলাম, যাতে প্রচণ্ড বেদনা উঠলে তার দাঁত কপাটি লেগে দাঁত ভেঙে না যায়। সবকিছুই প্রায় প্রস্তুত হয়েছে, আর দেরি করার কোনো কারণ নেই।

প্রথমে নাভির ঠিক নিচে থেকে শুরু করে তলপেটের নিচের হাড় পর্যন্ত লম্বা করে কাটলাম। চামড়ার ফালির মধ্য দিয়ে জারাস গোঙাতে শুরু করলো আর মাথা এপাশওপাশ করতে লাগলো।

তেহুতিকে দেখালাম কীভাবে লম্বা কাচির দুই প্রান্তে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ক্ষতস্থানের মুখটা টেনে খুলে রাখতে হবে। এবার আমি কব্জিসহ দুই হাত তার পেটের ভেতরে ঢুকালাম। তলোয়ারের ফলাটি কোন পথ দিয়ে ঢুকেছিল, তার একটা ছবি আমি মনে মনে এঁকেছিলাম। এখন সেই পথে হাত চালিয়ে কাজ শুরু করলাম।

প্রায় সাথে সাথেই অন্ত্রের পিচ্ছিল দড়ির মতো অংশে আমার কড়ে আঙুলের সমান একটি ছিদ্র খুঁজে পেলাম। ছিদ্রটা দিয়ে তীব্র কটু গন্ধ ছড়ানো পরিপাক করা খাদ্যকণা বের হয়ে আসছিল।

বাঁকা ব্রোঞ্জের উঁচ আর শল্যসুতা দিয়ে কয়েকটা সেলাই দিয়ে কাটা অংশটা বন্ধ করলাম। আর কোনো ছিদ্র রয়ে গেল কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাবারের সাপের মতো অন্ত্রটা দুই হাতের মাঝে ধরে চিপলাম। আমার সেলাই পানি নিরোধক হলেও চাপের ফলে অন্ত্রের আরও গভীরে তিনটি কাটা জায়গা থেকে বাদামি রংয়ের ঘোলা ময়লা চুঁইয়ে বের হতে লাগলো।

এই ছোট কাটা জায়গাগুলোতেও দ্রুত সেলাই করে ছিদ্রগুলো বন্ধ করলাম। আমি দেখতে পেলাম এই কঠিন শল্য চিকিৎসার চাপে জারাস ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে।

যখন আমি সন্তুষ্ট হলাম যে, তলোয়ারের আর কোনো জখম নেই তখন আমার আর তেহুতির উভয়েরই বিষ্ঠার দুর্গন্ধ সয়ে এসেছে। তবে এতে সচেতন হলাম যে, কাটা পেট আবার সেলাই করে বন্ধ করার আগে তার দেহ থেকে সমস্ত দূষিত রস ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এরকম দুর্গন্ধময় রস নিশ্চয় খারাপই হবে।

তেহুতি তখনও তার পেট ফাঁক করে ধরে থাকা অবস্থায় আমি মুখভর্তি চোলাই মদ নিয়ে তার অন্ত্রের গর্ত আর কুণ্ডলীগুলোর মধ্যে কুলি করে ফেললাম। তারপর তাকে একপাশে কাত করে তরলটি পেট থেকে বের করে দিলাম।

তারপর পানি ফুটিয়ে শরীরের তাপমাত্রার সমমাত্রায় ঠাণ্ডা করার পর সেই পানি দিয়ে আমরা তার নাড়িভূড়ি ধুয়ে পানিটা আবার পেট থেকে বের করে দিলাম।

সবশেষে আমরা আমাদের প্রস্রাব দিয়ে তার পেটের ভেতরটা ধুয়ে দিলাম। দেহনিঃসৃত রসের জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর একটি ঔষধ। তবে প্রস্রাবটি টাটকা হতে হবে এবং অন্য কোনো তরল অথবা শরীরের অন্য কোনো বস্তুর মিশ্রণ দিয়ে দূষিত হওয়া চলবে না। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি এটি একটি সুস্থ মুত্রথলি থেকে আসে আর দাতার দেহের বাইরের যৌনাঙ্গ: অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ এবং লিঙ্গের অগ্রভাগের আবরক তৃক কিংবা নারীর ওষ্ঠ্যের সাথে স্পর্শ না হয়।

আমার জন্য তেমন সমস্যা হল না। তবে তেহুতি প্রথমে একটা পশমের পট্টি চোলাই করা মদে ভিজিয়ে সেটা দিয়ে তার গোপনাঙ্গ ধুয়ে নিল। তারপর আমি অন্যপাশে সরে দাঁড়ালে সে জারাসের উপর বসে তার ভোলা পেটের ভেতরে প্রস্রাব করলো। তারপর তৃতীয়বারের মতো আবার জারাসের অচেতন দেহটি এক পাশে কাত করে শেষবারের মতো তার পেট থেকে তরলটি বের করে দিলাম।

এবার পেট সেলাই করে বন্ধ করলাম, প্রতিটা সেলাই করার সময় তার জখম শুকাবার জন্য প্রার্থনা করলাম।

হে অশুভ বিষয়ের দেবতা শেঠ, আমি তোমার নিষ্ঠুর রক্ত লাল মুখ বন্ধ করে দিলাম! এ স্থান থেকে চলে যাও। আমি আদেশ দিচ্ছি যাও!

কবরের দেবতা শেয়ালমাথাওয়ালা আনুবিস, আমার কাছ থেকে সরে যাও। একে বাঁচতে দাও।

হে দয়ালু হৃদয় হাথোর, এর জন্য কাঁদো। এর প্রতি দয়া দেখাও আর তার যন্ত্রণার উপশম কর। একে বাঁচতে দাও!

সবশেষে আমার লিনেনের আলখাল্লা ছিঁড়ে সেই টুকরা দিয়ে তার পেট বাঁধার পর তাকে বহন করার জন্য একটা পালকির মতো বানিয়ে তার উপর তাকে শোয়াতে শোয়াতে অন্ধকার হয়ে এলো। তেহুতি আর আমি তার দুই পাশে বসে থাকলাম, তাকে আরাম দিতে কিংবা যদি কোনো প্রয়োজন হয়।

জ্বরের প্রকোপে জারাস যখন প্রলাপ বকতে লাগলো আর তার শয্যার চতুর্দিকে কল্পিত আর আসল দানবের সাথে লড়াই করতে শুরু করলো, তখন তেহুতি তার পাশে শুয়ে তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকলো। সে তাকে শক্ত করে ধরে ঘুম পাড়ানি গান শুনাতে লাগলো।

আমি গানটি চিনতে পারলাম। এটি সেই ঘুম পাড়ানি গান যা গেয়ে রানি লসট্রিস ছোটবেলায় তেহুতিকে ঘুম পাড়াতেন। ধীরে ধীরে জারাস শান্ত হল।

আমাদের আশ্রয় শিবির ঘিরে জারাসের লোকেরা আগুন জ্বেলে তার চতুর্দিকে গোল হয়ে বসলো। আমার মনে হল ওরাও আমাদের মত তার জন্য প্রার্থনা করছে। সারাত রাত আমি ওদের গুণগুণ করা শুনলাম।

ভোরের দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

ছোট্ট গরম একটি হাত আমার কাঁধ ধরে টানাটানি করতেই ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের অস্থায়ী আশ্রয়ের ছাদের ফাঁক দিয়ে দেখলাম ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। মাত্র কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছি, তারপরও অপরাধবোধে মন ছেয়ে গেল; মনে হল যেন আমি একটা খুন করেছি।

বহুকষ্টে কান্না থামিয়ে তেহুতি আমাকে বললো, তায়তা ওঠো। আমাকে সাহায্য কর।

কী হয়েছে রাজকুমারী?

ওর সারা শরীর আগুনের মতো গরম। মনে হচ্ছে ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। এমন গরম যে গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

চুঙির মতো একদিকে সরু হয়ে যাওয়া একটা সেডার কাঠের টুকরা আমার কাছে ছিল। এর ডগাটা নিভু নিভু আগুনের কাঠকয়লার উপর ঠেসে ধরে ফুঁ দিলাম। আগুন ধরতেই বিছানার মাথার কাছে একটা তেলের প্রদীপ জ্বেলে জারাসের উপর কুঁকলাম।

সারা মুখ ঘামে চকচক হয়ে আছে। চোখ খোলা তবে জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন। হয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আমরা তাকে ধরে স্থির করার চেষ্টা করতেই সে এক ঝটকা মেরে আমাদেরকে সরিয়ে দিল। মাথা এপাশ ওপাশ করতে করতে চিৎকার করে আমাদেরকে অভিশাপ দিতে লাগলো।

আমি এটা আশা করেছিলাম। আমি ভালোভাবেই জানতাম খারাপ রসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে জ্বর খুব বেড়ে যেতে পারে। এরকম আরও কয়েকটি ঘটনা আমি আগে দেখেছিলাম। সব ক্ষেত্রেই রোগী শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। তবে এর জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি আমি আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলাম।

আবার ছয়জন বলিষ্ঠ রক্ষীকে ডেকে সবাই মিলে জারাসকে ঘোড়ার কম্বলগুলো দিয়ে পেচিয়ে জোরে চেপে ধরলাম যেন সে মাথা ছাড়া আর কিছু নড়াচড়া করতে না পারে। তারপর বালতি দিয়ে পানি ঢেলে কম্বলগুলো ভেজালাম আর হাওয়া দিতে থাকলাম যাতে পানি শুকিয়ে যায়। এতে জারাসের গায়ের তাপ কমতে কমতে এক পর্যায়ে সে ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করলো।

এভাবে সারা সকাল করে চললাম, তবে দুপুরের দিকে তার শক্তি কমে এল। এর আগে আমার এ-ধরনের রোগীদের যা হয়েছিল সেসব লক্ষণ তার মাঝে ফুটে উঠলো। আমি যে চিকিৎসা পদ্ধতি তার উপর জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছিলাম তা সহ্য করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে।

মুখ দিয়ে কোনো শব্দ না বললেও সে দাঁতে দাঁত লেগে কিড়মিড় করছিল। গায়ের চামড়া বিবর্ণ নীল হয়ে যাচ্ছিল।

গা থেকে কম্বল সরিয়ে দেবার পর তেহুতি আবার তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি বলেছিলে তাকে বাঁচিয়ে তুলবে তায়তা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা হয়তো পারবে না।

তার হতাশার গভীরতা আমাকে ছুরির মতো বিদ্ধ করলো।

হাইকসোদের মিসর আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে পালাবার সময় আমরা আফ্রিকার দূরতম প্রদেশের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম। অনেক বছর ধরে আমরা গহীন জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপর আবার শক্তি সঞ্চয় করে নিজভূমিতে অধিকার রক্ষায় ফিরে এসেছিলাম। সে সময়ে আমি কালো উপজাতিদের সাথে মিশে ওদেরকে জানতে আর শিখতে পেরেছিলাম। তাদের শক্তি আর বিশেষ দক্ষতা দেখে আমার ঈর্ষা হত। বিশেষত আমি শিলুক উপজাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের অনেকের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম।

এদের মধ্যে উমতাগ্নাস নামে প্রাচীন এক ওঝা ছিল। আমাদের দলের লোকেরা তাকে একজন আদিম ডাকিনীবিদ্যা চর্চাকারী ওঝা মনে করতো যে প্রেত সাধনা করতো। তাকে ওরা বন্য পশুর চেয়ে এক ধাপ উঁচু মনে করতো। এ-ধরনের লোক দূর দক্ষিণাঞ্চলে অনেক রয়েছে। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে ছিল একজন জ্ঞানীলোক যার অনেক বিষয়ের জ্ঞান রয়েছে, যা উত্তর থেকে আসা আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। সে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল।

বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যখন সে মৃত্যুর কাছাকাছি হয়েছিল তখন সে। আমার হাতে একটা চামড়ার থলে গুঁজে দিয়েছিল। এতে রোদে শুকানো একধরনের কালো ব্যাঙের ছাতা ছিল যা, আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এটি গাঢ় মোটা সবুজ ছত্রাক জাতীয় বস্তু দিয়ে মোড়ান ছিল। সে আমাকে সতর্ক করে বলেছিল উপরের আবরণটি যেন না সরানো হয়, কেননা এটি এই ওষুধের রোগ নিরাময় ক্ষমতার একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তারপর সে আমাকে শেখালো এই ছত্রাক দিয়ে কীভাবে এক ফোঁটা তরল তৈরি করা যায়। আরও সাবধান করে জানাল যতটা না রোগ নিরাময় করা যায় তার চেয়ে বেশি এই তরলটি বরং মানুষের প্রাণহানি করতে পারে। এটি তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন রোগী আর শূন্যতার মাঝে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

মিসরে ফেরার পর এত বছরে আমি কেবল সাতবার এই ঔষধটি ব্যবহার করেছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার রোগী মরণোন্মুখ ছিল। আরেকটু হলেই শেষ হয়ে যেত। ঠোঁটের ফাঁক গলে এক ফোঁটা তরল যাওয়ার প্রায় সাথে সাথে পাঁচজন মারা যায়। ষষ্ঠজন দশ দিন মরণাপন্ন অবস্থায় থাকার পর ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে, তারপর হঠাৎ একসময় সে মারা যায়।

ফুসফুঁসে তীর বেঁধা সপ্তম রোগীটি কেবল বেঁচে উঠে। সে আবার সুস্থ এবং শক্তিশালী হয়ে উঠে। এখন থিবসে রয়েছে। প্রতিবছর তার আরোগ্য হওয়ার এই অলৌকিক দিনটিতে সে তার সমস্ত নাতিনাতনিসহ আমার সাথে দেখা করতে আসে।

আমি জানি সাতজনের মধ্যে একজন রোগী ভালো হওয়ার পরিসংখ্যান গর্ব করার মতো বিষয় নয়। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি জারাসের জীবনের আয়ু আর মাত্র এক ঘন্টা রয়েছে আর তেহুতি আমার দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।

হরিণের চামড়ার থলেটিতে আর একমুঠো মাত্র ছত্রাক রয়েছে। একটা তামার পাত্রে পানি নিয়ে তাতে ছত্রাকটি ফুটাতে শুরু করলাম। নির্যাসটা একেবারে কালো আর থকথকে হওয়া পর্যন্ত ফুটালাম। তারপর ঠাণ্ডা হতে দিলাম। এর আগে জারাসের চোয়ালের ফাঁকে একটা কাঠের গেজ দিয়ে মুখটা খোলা রেখে তারপর চামচ দিয়ে নির্যাসটা তার মুখের ভেতরে ঢেলে দিলাম। এর আগে একবার এই মহৌষধের এক ফোঁটা আমি স্বাদ নিয়েছিলাম। এটি ছিল একটি পরীক্ষা তবে আর দ্বিতীয়বার এটা করার ইচ্ছা আমার নেই।

আরকটা মুখে দেওয়ার পর জারাসের প্রতিক্রিয়া আমার মতোই হল। সে এমন ছটফট করতে শুরু করলো যে, ছয়জন শক্তিশালী মানুষ আর তেহুতি মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারছিল না। জোর করে যতটুকু গেলান হয়েছিল তার অর্ধেকের বেশি আরক সে বমি করে মুখ থেকে ফেলে দিল। ফেলে দেওয়া অংশটুকু কাচিয়ে নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার তার মুখে ঢেলে দিলাম। তারপর চোয়ালের মধ্য থেকে কাঠের গোঁজটা বের করে তার মুখ বন্ধ করে ধরে রাখলাম যাতে দ্রবণটা গলা দিয়ে নিচে চলে যায়। তবে সে বেশ কয়েকবার ছটফট করে বমি করার চেষ্টা করলো।

তারপর তেহুতি আর আমি দুজনে তাকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে অন্যদেরকে সরে যেতে বললাম। আমরা দুজনে তার দুই পাশে বসে তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ভোরের দিকে তার অবস্থা প্রায় মৃতপ্রায় হল। কম্বল মুড়ি দেওয়া সত্ত্বেও তার তাপমাত্রা নেমে এল আর জালে আটকানো একটা কই মাছের মতো সে ছটফট করতে লাগলো। নিঃশ্বাসের শব্দ প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। আমরা দুজনেই একজন একজন করে তার মুখের কাছে কান রেখে তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করছিলাম।

মাঝরাতের একটু পর যখন চাঁদ ডুবে গেল, তখন তেহুতি আমাকে বললো, তার শরীর একটা মরা মানুষের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, তার শরীর গরম রাখতে হলে আমাকে তার সাথে শুতে হবে। সে তার পোশাকটা খুলে জারাসের পাশে কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়লো।

গত তিনদিন আমরা ঘুমাইনি, তবে এখনও ঘুমালাম না আর কোনো কথাও। বললাম না। বলার মতো আর কিছু নেই। সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছি।

সমাধিক্ষেত্রের সময় এলো: রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়। আমাদের মাথার উপর দুটো কম্বল জোড়া দিয়ে যে আচ্ছাদন তৈরি করা হয়েছিল তার মাঝে একটা ছিদ্র ছিল। উপরের দিকে তাকিয়ে আমি বিশাল লাল তারা দেখতে পেলাম–আমি জানি এটা শেঠের চোখ।

অশুভের দেবতা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার মনে ভয় এলো। আমি জানি জারাস লড়াইয়ে হেরে গেছে আর শেঠ তাকে নিতে আসছে।

তারপর একটি আজব এবং চমৎকার ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ তারার আলোটা নিভে গেল। আমার বুক ধক করে উঠলো। ঠিক বুঝতে পারলাম না এটা কি, তবে বুঝলাম যে এটা শুভ কিছু। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। তেহুতিকে না জাগিয়ে কম্বলের আচ্ছাদনের নিচ থেকে বাইরে এসে উপরে রাতের আকাশের দিকে তাকালাম।

সমস্ত আকাশে অসংখ্য তারা জ্বল জ্বল করছে-কেবল ঠিক আমার মাথার উপরে যেখানে আমি দেবতা শেঠের লাল চোখটি দেখেছিলাম সেই স্থানটি ছাড়া। এখন সেই চোখটি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।

ছোট্ট কালো একটি মেঘ একে ঢেকে ফেলেছে। পুরো আকাশে এটিই একমাত্র মেঘ। আমার হাতের মুঠোর চেয়ে বড় হবে না, তবে এটিই এই ক্ষতিকর শেঠের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে।

তারপর একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। উপরের তারাভরা আকাশ থেকে নয়, শব্দটা আসছে নিচে কম্বলের আচ্ছাদনের ভেতর থেকে।

জারাস ফিস ফিস করছে, আমি কোথায়? আমার পেটে কেন এতো ব্যথা করছে?

তারপর আমার অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বরটি সাথে সাথে উত্তর দিল, দাঁড়াতে চেষ্টা করো না বোকা জারাস। চুপ করে শুয়ে থাকো। তোমার খুব বড়ধরনের জখম হয়েছে।

জারাসের কণ্ঠস্বর সচকিত আর হতবাক শোনাল, রাজকুমারী তেহুতি! আপনি আমার বিছানায়। আর আপনার গায়ে কোনো পোশাক নেই। তায়তা এঅবস্থায় আমাদেরকে দেখতে পেলে দুজনকেই মেরে ফেলবে।

খুশিতে নাচতে নাচতে আমি আবার কম্বলের ছাউনির নিচে ঢুকে তার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে আস্বস্ত করে বললাম, এবার নয় জারাস। তবে এরপর হলে কিন্তু ছেড়ে দেবো না।

.

দিনের আলোয় জারাসকে আবার ভালোমত পরীক্ষা করলাম। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় তার শরীর আমার হাতের মতো ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। পেটের বিরাট ক্ষতের উপরে যে সেলাইটা আমি দিয়েছিলাম সেখান থেকে ফুলে ওঠা কমে এসেছে। গন্ধ শুঁকে দেখলাম, পরিষ্কার মনে হল।

জারাসের খুব পানি পিপাসা পেয়েছিল, তেহুতি ওর জন্য বড় একজগ পানি নিয়ে এলো। সে পুরোটা খেয়ে শেষ করে আরও পানি চাইলো। আমি স্বস্তিবোধ করলাম। এটা একটা নিশ্চিত লক্ষণ যে তার অবস্থা উন্নতি লাভের পথে রয়েছে। তবে সেই সাথে মনে পড়ে গেল পানির বোতলগুলো প্রায় খালি আর সবচেয়ে কাছে পানি রয়েছে কেবল গুহায়, যেখানে বেকাথা আর অন্যান্যদের ফেলে এসেছি।

জারাস প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও আমরা তাকে হাঁটতে বা উটে চড়তে দিলাম না। ওর জন্য একটা ঠেলাগাড়ির মতো বিছানা তৈরি করলাম। দুটো লম্বা বর্শার মাঝে ঘোড়ার কম্বল দিয়ে এটা তৈরি করলাম। একটা উটের হাওদার দুইপাশে পেছন দিকে বর্শাদুটার ডগা আটকিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম। জারাসকে এই ঠেলার বিছানায় শোয়ালাম।

তেহুতি সেই উটে চড়ে বসলো। সে পেছনদিকে মুখ করে বসলো, যাতে জারাসের প্রতি নজর রাখতে পারে। উঁচুনিচু কিংবা পাথুরে জায়গা এলেই সে উটের পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে জারাসের পাশে এসে তাকে ধরে রাখলো যাতে তার বেশি ঝাঁকুনি না লাগে।

সারাপথ সে জারাসকে ধমকে চললো তাকে সাবধান হওয়ার জন্য।

তৃতীয়দিন বিকেলে জারাস জোর করে বিছানা থেকে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটার চেষ্টা করলো। দু-দুবার হোঁচট খাওয়ার পর একজন বুড়ো মানুষের মতো হাঁটতে লাগলো। ঠেলার গায়ে একহাত আর অন্য হাত তেহুতির কাঁধে রেখে সে চলার চেষ্টা করলো। তেহুতি নানারকম উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলো। হাসি উঠলেই সে থেমে দুইহাতে পেট চেপে ধরলো, তবে সেজন্য হাসি থামাল না।

আবার বিশ্রামের জন্য থামতেই আমি আবার উদ্বিগ্ন হয়ে তার ক্ষত পরীক্ষা করে দেখলাম, না ঠিক আছে। শেষ একঢোক আফিমের যে আরকটা ছিল সেটা তাক খাইয়ে দিতেই সে একটা শিশুর মতো ঘুমাল।

পরদিন আরও শক্তিসঞ্চয় করে বেশ দ্রুত অনেকদুর হাঁটলো। আমি জানতাম তেতির সঙ্গ তাকে যথেষ্ট শক্তি যোগাচ্ছে, তাই আমি সামনে এগিয়ে দলের মাথায় গিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। ওদের কথা শুনতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম কি নিয়ে ওরা কথা বলছে।

ওরা জানতো না যে আমি খুব ভালোভাবে ঠোঁট নাড়া দেখে কথা বুঝতে পারি। কাজেই ওরা মনখুলে কথা বলছিল। মাঝে মাঝে তাদের রসিকতা এমন পর্যায়ে পৌচ্ছাছিল যা তার মতো একজন উচ্চবংশীয় মেয়ের জন্য মানানসই। ছিল না। তবে এ-মুহূর্তটা ওদেরকে উপভোগ করতে দিলাম, কেননা আর হয়তো এরকম সুযোগ নাও আসতে পারে।

জারাসের অবস্থার কারণে আমাদের ময়াগুহায় ফিরতে দেরি হচ্ছিল। পঞ্চম দিনেও আমরা সেখানে পৌঁছতে পারিনি। পানি আনার জন্য পাঁচটি উট আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো এখনও ফিরে আসেনি অথচ এদিকে আমাদের পানিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমি সবার পানি আর খাবার কমিয়ে দিয়ে প্রতিদিন ছোট মগে তিন মগ পানি আর অর্ধেক রুটি বরাদ্দ করলাম। অবশ্য রাজকুমারীর জন্য নয়। সে যত ইচ্ছা খেতে পারবে। শুধুমাত্র তার জন্য আমি আধা টুকরা পনির আর সামান্য শুকনো লোনা গরুর মাংস বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সে এই সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে সবার মতো সমানভাবে খেতে লাগলো।

চতুর্থদিন সন্ধ্যায় আমি লক্ষ্য করলাম তেহুতি সবার নজর এড়িয়ে একটুকরা শক্ত পনির আর কিছু গরুর শুকনো মাংস তার আলখাল্লার হাতা থেকে বের করে জারাসকে খেতে সাধলো।

তুমি অসুস্থ জারাস। তোমার শক্তি সঞ্চয়ের জন্য এগুলো দরকার।

সে প্রতিবাদ করে বললো, আমি একজন সাধারণ সৈনিক, রাজকুমারী। আপনি আমার প্রতি অশেষ দয়া দেখিয়েছেন। আমি সত্যি কৃতজ্ঞ আপনার দয়ার জন্য, তবে আমার মোটেই ক্ষিদে পায়নি।

সে খুব মৃদুকণ্ঠে বললো, বীর জারাস, তুমি আমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলে। তুমি যা চাও আমি খুশি মনে তা দিতে চাই।

আমার মন নরম হয়ে এল। ওদের অঙ্কুরিত ভালোবাসা দেখতে খুব চমৎকার মনে হচ্ছিল। জানি কিছুকাল পরই কঠিন দায়িত্বের কারণে তা ভেঙে চুরমার করে ফেলা হবে।

.

শেষ পর্যন্ত আমরা ময়াগুহায় এসে পৌঁছলাম। আমাদের দলের যারা  আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সবাই ছুটে এলো আমাদের স্বাগত জানাতে। উল্লাসে চিৎকার করতে করতে চারপাশ থেকে আমাদেরকে ঘিরে ধরলো, তারপর রাজকুমারী তেহুতির পায়ের কাছে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর ওরা তাকে কাঁধে উঠিয়ে তার বোন বেকাথা, সেনাপতি রেমরেম আর কর্নেল হুই যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেখানে নিয়ে চললো।

পর পর তিনরাত ভোজ চললো। তিনটি বাচ্চা উট জবাই করে সুস্বাদু মাংসগুলো পঞ্চাশটা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে তাতে ঝলসানো হল। প্রতি সন্ধ্যায় রাজকুমারী তেহুতি পনেরোটি বিয়ারের বড় পিপা খুলে সবার মধ্যে বিতরণ করতে নির্দেশ দিলেন। আমার কাছে এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলেও, কিছু বললাম না। বরং আমি নিজেও দুএক মগ খেলাম। তবে ফারাওয়ের প্রাসাদের মাটির নিচের ভাণ্ডার থেকে আনা মদের ব্যাপারে আমি যত্নবান ছিলাম। কেননা আমি জানি এই অমৃত সুধা সাধারণ সৈন্যদেরকে দেওয়া মানে শুধু শুধু অপচয় করা।

রাজদরবারের যন্ত্রীরা আমাদের জন্য যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করলো আর সবাই আগুনের চারপাশে নেচে গেয়ে কাটাল। রাজকুমারীরা আমাকে গান গাইতে অনুরোধ করতেই আমি জারাসকে ডেকে নিলাম। এর আগে যখনই সুযোগ পেতাম তখনই আমি তাকে গানের তালিম দিতাম। গান গাওয়ার তার যে স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল, আমি তা ঘসে মেজে আরও পরিশীলিত করে তুলেছিলাম। যখন আমরা যুগলবন্দী গান গাইতে শুরু করলাম তখন শ্রোতারা বাকরুদ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো। ওরা নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল পাছে গানের একটা কলিও বাদ না যায়।

.

বেশ খুশিমনে আমি ঘুমাতে গেলাম। প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সাধারণত আমার গভীর ঘুম হয় না। যেহেতু আমার মন সবসময় কর্মতৎপর আর সতর্ক থাকে তাই গভীর ঘুম হওয়ার মতো বিলাসিতা আমার পোষায় না।

একটু পরই ঘুম ভেঙে যেতেই বুঝতে পারলাম কেউ চুপিচুপি আমার তাঁবুতে ঢুকেছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে সে আমার বিছানার উপর ঝুঁকে রয়েছে। আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। দরজার পাহারা এড়িয়ে যে লোক রাজকীয় তাবুর মধ্যে ঢুকতে পেরেছে সে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক লোক এবং তার উদ্দেশ্য ভালো হওয়ার কথা নয়।

কোনো ধরনের শব্দ কিংবা নড়াচড়া না করে আমার বিছানার মাথার কাছে সবসময় বিশেষ খাপে যে ড্যাগারটা ঝুলছে তার দিকে হাত বাড়ালাম।

তাঁবুর কাপড়ের মধ্য দিয়ে তারার আলো ভেতরে ঢুকেছে আর রাতের বেলা আমার দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর হওয়ায় আমি আততায়ীর মাথার অবয়ব আন্দাজ করতে পারলাম। ডানহাতে ড্যাগারটা খাপ থেকে টেনে বের করার সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে আততায়ীর গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলাম।

আমি তাকে সাবধান করে বললাম, নড়াচড়ার চেষ্টা করলেই আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। আগুন্তুক একটি ছোট মেয়ের মতো গুঙিয়ে উঠলো। সেই সাথে তার নিঃশ্বাসের মিষ্টি গন্ধ আর বুকের স্ফিতি অনুভব করলাম।

আমাকে মেরো না তায়তা। আমি বেকাথা! আমি এমনিতেই মরে যাচ্ছিলাম। তোমার কাছে এসেছি যাতে তুমি আমাকে বাঁচাও। রক্তপাত হয়ে আমি মরে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে মরতে দিও না।

সাথে সাথে তাকে ছেড়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। একমিনিটের মধ্যে তেলের প্রদীপটা জ্বালালাম। বেকাথা ইতোমধ্যে আমার বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে তলপেট চেপে ধরে কাতরাতে শুরু করেছে। খুব ব্যথা করছে তায়তা। দয়াকরে ব্যথাটা ভালো করে দাও।

আমি তাকে দুইহাতের মধ্যে যত্ন করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় রক্ত ঝরছে বল?

আমার দুপায়ের মাঝখানে রক্ত ঝরছে। এটা বন্ধ করে দাও। আমি মরতে চাই না।

এবার আমি মনেমনে গুঙিয়ে উঠলাম। তাহলে এবার আমাকে একজনের জায়গায় দুজন রজঃস্বলা চঞ্চলা স্বাস্থ্যবতী বালিকাকে সামলাতে হবে।

তার মানে খুব শিগগিরই খাবার টেবিলের ওপার থেকে ছুঁড়ে মারা রুটির টুকরা আর খেজুরের বদলে কর্নেল হুইকে অন্য কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে।

.

জারাসের জখম পুরোপুরি নিরাময় হওয়া পর্যন্ত আমি ময়াগুহায় অপেক্ষা করলাম। সে সুস্থ হলে দুই নদীর দেশ আর ব্যবিলনের পথে শেষ যাত্রাটি শুরু হবে। আমাদের সফরের এই অংশটুকু হবে সবচেয়ে দীর্ঘ আর কষ্টকর, তাই আমি তার শরীরের অবস্থা নিয়ে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইনি।

আমি অনেক সময় অবাক হতাম দেখে যে, একটি তরুণ শরীর কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারে আর কত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। মাত্র কয়েকদিন আগে শেয়াল তার নিতম্ব বরাবর তরবারি চালিয়ে দিয়েছিল, তারপর আমি তার পেট ফেঁড়ে নাড়িভূঁড়ি বের করে আবার সেলাই করে দিয়েছিলাম, অথচ তা সত্ত্বেও জারাস এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে থিবসে ফসল কাটার উৎসবে ফারাও যে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তাতে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

প্রথম প্রথম সে তেহুতিকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে হাঁটতো। পঞ্চাশ পদক্ষেপ যাওয়ার পরই পেট চেপে ধরে থামতে বাধ্য হত। তেহুতি সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ালেও সরিয়ে দিত। আমি বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও সে প্রতিদিন হাঁটার মাত্রা বাড়িয়ে দিত। কিছুদিন পর পুরো বর্ম পরে কাঁধে বেলেপাথরের একটি বড় টুকরা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

প্রতিদিন আমি তাকে পুরোপুরি নগ্ন করে তার ক্ষতের অবস্থা পরীক্ষা করতাম। মনে হল ক্ষতটা শুকিয়ে একটা হালকা দাগের মতো হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তার। জোর করে সে তার আহত পেশিগুলো সঞ্চালন করতো, এতে আরও দ্রুত সে আরোগ্যলাভ করে উঠতে লাগলো।

জারাসের প্রতি আমার এক ধরনের সহজাত স্নেহ জেগে উঠছিল আর সে আমার রোগ নিরাময় ক্ষমতার একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার শারীরিক দুর্বলতার কারণে আমি ভাবলাম ওরা আমার পরিকল্পনা বানচাল করার আগেই আমি এই সুযোগে তাকে রাজকুমারী তেহুতির কাছ থেকে আলাদা করে নিতে পারবো। অর্থাৎ মিসরের অস্তিত্বের স্বার্থে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ আর ফারাও ত্যামোসের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সযত্নে যে পরিকল্পনা করেছিলাম মাঝ পথে এসে তা যেন আবার ভেস্তে না যায়।

সুতরাং ময়াগুহায় পুনরায় ফেরার পঞ্চম দিনে আমি সেনাপতি রেমরেম আর কর্নেল হুইকে আমার নতুন নির্দেশ জানাবার জন্য আমার তাঁবুতে ডেকে পাঠালাম। জারাসকেও সভায় উপস্থিত হতে বললাম। স্বভাবতই আমার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে আর হুই কেবল শ্রোতা হিসেবে থাকবে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিতে পারবে না।

আমরা চারজন সবেমাত্র আলোচনার টেবিলে বসে চমৎকার মদের গ্লাসে চুমুক দিতে যাবো, ঠিক তখনই আমি অনুভব করলাম কেউ আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন ফিরে দেখলাম রাজকুমারী তেহুতি তার বিশেষ সুগন্ধী গায়ে মেখে যেন ভাসতে ভাসতে তাবুর দরজা দিয়ে ঢুকেছে।

আমার কারণে আপনাদের আলোচনা থামাবেন না। আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আপনাদের আলোচনা চালিয়ে যান। আমি একটি কথাও বলবো না। চুপ করে বসে থাকবো, আপনারা টেরও পাবেন না যে আমি এখানে রয়েছি।

সে একটি চমৎকার সোনালি রঙের মিহি রেশমী পোশাক পরে রয়েছে। এটা আমি অনেক দাম দিয়ে থিবসের বাজার থেকে তার জন্য কিনেছিলাম। তখন সে নিজেই আমাকে বলেছিল ক্রিটে পৌঁছার পর যখন তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজের সামনে প্রথম হাজির করা হবে, তখন সে এই পোশাকটি পরবে। হয়তো আমাদের মধ্যেকার সেই চুক্তিটি সে ভুলে গেছে।

তার পায়ে রূপার স্যান্ডেল। গলায় ঝুলছে একটি হাথোরের হার আর অন্য আরেকটি উজ্জ্বল চকচকে, সম্ভবত নীলকান্ত মণি আর পান্নার হার। সুন্দর পরিপাটি চুল আর মুখে চমৎকার হাসি।

এরকম সুন্দর তাকে আমি আর কখনও দেখিনি।

সোনালি পোশাকের ঘের উড়িয়ে সে আমার পায়ের কাছে বসলো। দুই কনুই হাঁটুতে রেখে চিবুক দুই হাতের মাঝে রাখলো, যাতে আমি যে হীরার আংটিটা দিয়েছিলাম তার উপর আলো ঠিকরে পড়ে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তারপর এক পাশে জারাসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিরীহ চেহারা নিয়ে মৃদু হাসলো।

বুঝি না মেয়েরা কীভাবে সবকিছু আগেভাগে জেনে ফেলে? এই সভা সম্পর্কে আমি তাকে জানাইনি; সত্যি বলতে কী সভার মাত্র এক ঘন্টা আগে অন্যদের ডেকেছিলাম। আর কী আলোচনা হবে তাও বিন্দু বিসর্গ কাউকেই জানাইনি। সে নিশ্চয়ই জানতো না এখানে কী হতে যাচ্ছে। তারপরও সে এখানে যুদ্ধের সাজে সেজে এসেছে আর তার চোখের দৃঢ় দৃষ্টি দেখে আমার তাই মনে হল।

তোমাদের যা আলোচনা চালিয়ে যাও তায়তা। আমি কথা দিচ্ছি মাঝখানে কিছু বলবো না।

আমি ইতস্তত করে বললাম, ধন্যবাদ, মহামান্য রাজকুমারী। ভাবলাম তার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াবার কি কোনো উপায় আছে? অবশ্যই আছে। আমি ফারাওয়ের সিলমোহর বহন করছি। আমি একজন রাজার কন্ঠ হয়ে কথা বলছি। কেউ আমার বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস করবে না? কাজেই সাহস সঞ্চয় করলাম।

ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আমাদের পথপ্রদর্শক আল-নামজু আর রাজকীয় আস্তাবলের প্রধান রক্ষকের সাথে কথা বলেছি। ওরা সবাই আমার সাথে একমত হয়েছে যে আমাদের এই বিশাল দলটি আর বেশিদিন ময়াগুহায় থাকতে পারবে না। মনে রাখবেন আমাদের সমস্ত লোকজন আর রাজকুমারীরা ছাড়াও তিনশোর বেশি ঘোড়া আর উট রয়েছে। প্রতিদিন যে হারে আমরা এই পানি ব্যবহার করছি তাতে আর কিছু দিন পরই এই কুপের পানি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে। বুঝতেই পারছেন এর কী ভয়াবহ পরিণতি হবে।

দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে রেমরেম বললো, অবশ্যই! এ-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, আমাদের এগোতেই হবে। তার দাড়ি রূপালি ধূসর রঙের হলেও আমি জানি তার আসল বয়স লুকোতে সে মেহেদি কলপ ব্যবহার করে উজ্জ্বল আদা রঙ করে রেখেছে। সে একজন মহান ব্যক্তি। একজন কুশলী আর সাহসী যোদ্ধা। একজন ভাইয়ের মতো তাকে আমি ভালোবাসি।

আমি তার দিকে তাকিয়ে সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বলে চললাম, তবে ব্যাপারটা এতো সহজ নয় সেনাপতি রেমরেম। আল-নামজু আমাকে জানিয়েছে এর পরবর্তী মরুদ্যানের নাম হল জয়নাব অর্থাৎ দামী রত্ন। এটা আমাদের দুইশো লিগ সামনে রয়েছে। এই দূরত্ব যেতে দশদিন লাগবে। তার মানে যখন আমরা সেখানে পৌঁছাবো তখন আমাদের পশুগুলো পথশ্রমে ক্লান্ত আর তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে। ফলে তাদেরকে আবার যাত্রার উপযোগী করতে অন্তত দুই সপ্তাহ জয়নাব মরুদ্যানে বিশ্রাম দিতে হবে। কিন্তু জয়নাব একটি ছোট মরুদ্যান। ওতে যে পরিমাণ পানি আছে তা দিয়ে আমাদের মতো একটি বিশাল কাফেলার কয়েকদিনের বেশি চলবে না। কথাটা বলে এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার একটি যৌক্তিক সমাধান বাতলাবার জন্য আমি রেমরেমের প্রতি তাকালাম। এতে হয়তো কিছুটা দোষ আমি অন্যের ঘাড়ে চপাতে পারবো, যখন রাজকুমারী তেহুতি আমার পরিকল্পনার সবদিক আঁচ করতে পেরে তুমুল হট্টগোল শুরু করবে। তবে সবাই নিশ্চুপ থাকায় বাধ্য হয়ে আমাকে সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজ ঘাড়ে নিয়ে বিষয়টা খোলসা করতে হল।

এর একমাত্র সমাধান হল আমাদের দলকে দুই ভাগ করে অর্ধেক মানুষ আর পশুর দলটিকে আগেই জয়নাব পাঠিয়ে দেওয়া। অন্যদলটি এখানে আরও দুই সপ্তাহ থেকে আগের দলকে তৈরি হওয়ার সুযোগ দেবে। সফরের অবশিষ্ট অংশে আমাদেরকে এই বিভক্তি চালিয়ে যেতে হবে। দুই নদীর দেশে পৌঁছাবার পর আমরা আবার একত্রিত হব। এই উপায়ে আমরা কখনও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বো না আর পুরো দলকে একটি মাত্র মরুদ্যানে গিয়ে পানি নিয়েও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।

আবার সবাই চুপ থেকে বিষয়টা নিয়ে ভাবলো। শেষ পর্যন্ত রেমরেম তার ভারী গলায় বললো, আপনার পরিকল্পনাটা বেশ ভালো তায়তা। আর আমার বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই দলকে বিভক্ত করার পরিকল্পনাটাও ঠিক করে ফেলেছেন। আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

সেনাপতি রেমরেম, আপনি অগ্রবর্তী দলের অধিনায়কত্ব নিয়ে যাবেন। এই দলে অর্ধেক মানুষ আর উটগুলো থাকবে। এছাড়া রাজকুমারী তেহুতি আর বেকাথাও আপনার সাথে যাবেন। ক্রেটান মেয়েটি-লক্সিয়াসও ওদের সাথে যাবে।

রেমরেম গদগদ কণ্ঠে বললো, আমি সত্যি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ মহান তায়তা। আমার প্রতি আস্থা স্থাপন করে আপনি আমাকে বাধিত করেছেন।

তারপর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বললাম, দুই সপ্তাহ পর ঘোড়াগুলো নিয়ে আমি আপনাদের অনুসরণ করবো। দ্বিতীয় দলে আমার সাথে ক্যাপ্টেন জারাস আর কর্নেল হুই থাকবেন। ঘোড়াগুলো সামলাতে আমার হুইকে প্রয়োজন হবে। তার দিকে তাকাতেই সে ঘাড় কাত করে সায় দিল। তার প্রিয় ঘোড়াগুলো থেকে আলাদা হওয়াটা তার সহ্য হবে না। তারপর জারাসের দিকে তাকিয়ে বললাম, আর এখন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আশা করি নিরাপদ সফরের জন্য তোমার ক্ষত ভালোভাবে সেরে উঠবে।

আর এটাই ছিল আমার পরিকল্পনার ভেতরের বৈশিষ্ট্য। রাজকুমারীরা রেমরেমের সাথে আগেই চলে যাবে। আর আমি দ্বিতীয় দলে আমার সাথে ক্যাপ্টেন জারাস আর কর্নেল হুইকে রাখবো। এক চালে আমি মেয়েদেরকে ছেলেদের কাছে থেকে আলাদা করলাম আর সেই সাথে জারাস আর সমস্ত পশু সঠিক পরিমাণে পানি পান করে ভালো অবস্থায় ব্যবিলন পৌঁছাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমার রাজকুমারীও গায়ে কারোও স্পর্শ না নিয়ে সেখানে পৌঁছাবে।

আমি তেহুতির দিকে তাকাতে চাচ্ছিলাম না। আশা করছিলাম এখানে সে কোনো ধরনের চালাকি খাটাতে পারবে না।

তবে পরিষ্কার কণ্ঠে সে বললল, না। আমার মনে হয় এটা মোটেই ভালো পরিকল্পনা হল না তায়তা। আবার সে আমাকে তাতা না বলে তায়তা বলে সম্বোধন করলো।

আমি জামার হাতার ভেতর থেকে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহরটা বের করলাম। এটা সবসময় আমার সাথেই রাখি। যখনই প্রয়োজন তখনই সর্বোচ্চ ক্ষমতাটি দেখাতে হবে।

কথাটা শুনে দুঃখিত হলাম রাজকুমারী। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, সেনাপতি রেমরেমের মতো আপনিও এই ব্যবস্থা গ্রহণের গুরুত্বটি বুঝতে পারবেন। এই কথাটি বলার সময় বাজপাখির সীলমোহরটা হাতের দুই আঙুলের মাঝে নিয়ে ঘষতে লাগলাম।

ওহো, তুমি এই বাচ্চাদের খেলনাটা আমাকে দিতে চাচ্ছো? আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই সে হাত বাড়িয়ে ছোঁ মেরে সীলমোহরটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল। হঠাৎ এই কাণ্ডে আমি এততাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম যে কোনো বাধা দেওয়ার আগেই জিনিসটা আমার হাতছাড়া হয়ে গেল।

এটার সম্পর্কে লোকে যা বলে তা কি সত্যি তায়তা?

লোকে কী বলে রাজকুমারী?

ওরা বলে এটা যার হাতে থাকে সে ফারাওয়ের কণ্ঠস্বরে কথা বলে।

হ্যাঁ, রাজকুমারী, কথাটা সত্যি।

তাহলে দেখো, এটা এখন কার হাতে আছে তায়তা।

ইতোমধ্যে তাঁবুর মাঝে থাকা অন্য তিনজনও বুঝতে পারলো যে এখানে একটা ইচ্ছাশক্তির লড়াই চলছে। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর আমিও বুঝতে পারলাম আমাকে কীরকম হাস্যকর দেখাচ্ছে। অনুভব করলাম আমার ভ্রু কুঁচকাতে শুরু করছে, সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে কপাল মসৃণ করে তেহুতির দিকে মাথা নত করে বললাম, আমি আপনার কাছ থেকে মহান ফারাওয়ের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অপেক্ষা করছি রাজকুমারী। রসিকতার সুরে কথাটা বলার চেষ্টা করলেও তা খুব একটা কাজে এলো না। এবার তেহুতির মুখের হাসি মুছে গিয়ে দুচোখ ভরে পানিতে টলটল করে উঠলো।

সে ফিস ফিস করে প্রায় বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বললো, ওহো, তায়তা। আমার প্রতি এমন নিষ্ঠুর হয়ো না। তোমাকেই আমি আমার বাবা হিসেবে জানি। দয়া করে এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তুমি আমার ভাই আর আমার মাকে কথা দিয়েছিলে যে, সবসময় আমার দিকে খেয়াল রাখবে। তুমিই একমাত্র মানুষ যাকে আমি ভালোবাসি আর বিশ্বাস করি। তারপর সীলমোহরটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ফুপাতে ফুপাতে, নাও এটা ধর! দরকার মনে হলে আমাকে দূরে পাঠিয়ে দাও। তুমি যা আদেশ করবে তাই আমি পালন করবো।

ৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে থাকা উপস্থিত শ্রোতাদের মুখের হাসি মুছে গেল। এবার ওদের চেহারায় হতাশার অনুভূতি আর আতঙ্ক দেখা গেল। সবাই একযোগে পাল্টা অভিযোগের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। হঠাৎ আমি একজন দুর্জন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি।

অবশ্য ওরা কেউ ধারণাই করতে পারেনি যে, আসলে সে কি নিখুঁত একজন অভিনেত্রী। আমাকে পুরোপুরি একজন কাপুরুষ বানিয়ে ছেড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে আমি প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছি।

আমাকে ক্ষমা করো তেহুতি। বল তুমি কী চাও, আমি তাই দেবো তোমাকে।

সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, বেকাথা আর আমি আমাদের আসল বাবা, শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই। ব্যস এই। তবে সে জানে সে জিতেছে। যে লোককে নিয়ে আসল দ্বন্দ্ব চলছে, তার নাম উচ্চারণ না করেই সে তার কার্যোদ্ধার করতে পেরেছে।

.

চারদিন পর বিকেলে সেনাপতি রেমরেম দলের অর্ধেক মানুষ আর পশু নিয়ে দুইশো লিগ উত্তরে জয়নাব মরুদ্যানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। তেহুতিকে সাথে নিয়ে আমি পাঁচ লিগ পর্যন্ত রেমরেমকে এগিয়ে দিলাম। তারপর তাকে বিদায় জানিয়ে আমরা দুজন ময়াগুহার দিকে ফিরে চললাম। একটু পেছনে আমাদের দেহরক্ষী দল-নীল কুমির বাহিনীর বিশজন সদস্য আমাদের অনুসরণ করছে।

ময়াগুহা ছেড়ে বের হওয়ার সময় আমি বেকাথাকেও আমাদের সাথে ঘোড়ায় চড়ে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে সে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছিল, আমি তাকে যে প্রাচীন মিসরীয় লিপির লেখ্যপট দিয়েছিলাম, সে তা নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছে। বেকাথা খুব একটা মনোযোগী কিংবা পরিশ্রমী ছাত্রী নয়, তাই তার একথায় বেশ অবাক হয়েছিলাম। অবশ্য এখন আমি জানতে পেরেছি কে তাকে হঠাৎ লেখার দিকে মনোযোগ দিতে আগ্রহী করেছে।

প্রথম লিগ আমি আর তেহুতি পাশাপাশি নীরবে ঘোড়ায় চড়ে চলতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার বাবাকে খুব ভালো করে জানো তাই না? অথচ আমি কিছুই জানি না। তুমি এর আগে কখনও তার সম্পর্কে কিছুই বলে নি। এখন বল না তায়তা।

মিসরের সবাই তোমার বাবা সম্পর্কে ভালো করেই জানে। তিনি ছিলেন স্বর্গীয় দেবতা ফারাও ম্যামোস। বংশধারার অষ্টম পুরুষ। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের স্তম্ভ, ন্যায়পরায়ণ, মহান, সর্বদ্রষ্টা, দয়ালু

সে সরাসরি অস্বীকার করে বললো, না, তিনি তা ছিলেন না। দয়া করে। আমাকে মিথ্যা বলো না তায়তা। হঠাৎ এই অভিযোগে আমি হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে ঘুরে তাকালাম।

হেসে বিষয়টার পরিসমাপ্তি করার চেষ্টা করে বললাম, তাহলে আমি হয়তো ভুল জেনেছি! ফারাও না হলে তোমার মতো একজন মেয়ের পিতা তাহলে কে সেই সৌভাগ্যবান লোক। আমার সত্যি তাকে হিংসা হচ্ছে।

আমার আসল বাবা ছিলেন মহান তানুস। আর তার বাবা ছিলেন পিয়াংকি, প্রভু হারাব। তার মা ছিলেন একজন মুক্ত তেহেনু ক্রীতদাসী। যার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আমি সোনালি চুল আর নীল চোখ পেয়েছি। লোকে বলে তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন। আমার বাবাও তার মায়ের কাছ থেকে অপরূপ দৈহিক সৌন্দৰ্য্য পেয়েছিলেন। সবাই বলে তিনি ছিলেন মিসরের সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।

আমি বললাম, কে তোমাকে এসব আজেবাজে কথা বলেছে?

আমার নিজের মা লসট্রিস বলেছেন। এখন বল তিনিও মিথ্যা বলেছেন।

আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। ফারাওয়ের সিংহাসন আর মিসরের অস্তিত্বের ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠতে শুরু করেছে। আর আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। এমন বিপজ্জনক কথা আমি কখনও শুনিনি।

হা করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, একথা আর কাকে বলেছে?

কাউকেই না; শুধু তোমাকেই বললাম।

তুমি কি জানো একথা আর কাউকে বললে কি পরিণতি হতে পারে?

ঘোড়ার জিন থেকে ঝুঁকে এক হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরে সে সান্ত্বনার সুরে দিয়ে বললো, প্রিয় তায়তা। আমি এতো বোকা না।

এবার আমি বেশ জোরে বললাম, তুমি কি নিশ্চিত যে, তোমার ভাইকে একথা বলনি? ফারাও কি একথা জানেন? আর বেকাথা? তাকে বলেছো?

এবার সে শান্ত কণ্ঠে আমাকে আস্বস্ত করে বললো, না। বেকাথা এখনও ছোট্ট একটি মেয়ে। আর মেমতো মরেই যাবেন, যদি তিনি জানতে পারেন যে তিনি সত্যিকার ফারাও নন।

এবার আমি সত্যি আতঙ্কিত হলাম। তার হাত ধরে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে বললাম, একথাও তোমার মা তোমাকে বলেছিলেন? তিনি তোমাকে

সবকিছু বলেছিলেন? দয়া করে বল আমি তোমার কথা ভুল শুনছি, তাই না?

তুমি আমার কথা ঠিকই বুঝেছো। আমার মা আমাকে বলেছেন যে, আমরা তিনজনই ফারাও ম্যামোসের নয়–মহান তানুসের সন্তান। আমরা তিনজনই অবৈধ সন্তান।

এসব কথা এখন আমাকে কেন শোনাচ্ছো তেহুতিঃ

কেননা আমিও শিঘ্রই একই অবস্থায় পড়তে যাচ্ছি যাতে আমার মা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আর তুমি তাকে বাঁচিয়েছিলে। সে আমার দিকে তাকাতেই আমি অস্বীকৃতি জানিয়ে মাথা নাড়লাম।

সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ো না তায়তা। তুমি আমার মাকে বাঁচিয়েছিলে, এবার একই কাজ আমার জন্যও করবে।

এতোটুকু আসলে সত্যি। রানি লসট্রিস ছিলেন আমার জীবনের একমাত্র সত্যিকার ভালোবাসা। তবে এখন তিনি আর নেই আর তার জায়গায় তেহুতি রয়েছে। তার কোনো অনুরোধই ফেলতে পারবো না। তবে এক্ষেত্রে অন্তত আমার নিজের মতো শর্ত আরোপ করতে পারবো। নিশ্চিত তার মায়ের মতোই সে তা উড়িয়ে দেবে। তবে আমাকে অন্তত চেষ্টা করতে হবে।

বল আমার কাছ থেকে তুমি ঠিক কি চাও তেহুতি? আমার মার একজন রাজার সাথে বিয়ে হয়েছিল, তবে তার নিজের পছন্দমতো স্বামী ছিল। রাজার নয়, তিনি তার সন্তান গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তবে তার নিজের পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। তুমিই তাকে এসব করতে সাহায্য করেছিলে। তাই না?

আমি স্বীকার করলাম, হ্যাঁ তাই হয়েছিল। একথা বলা ছাড়া আর কোনো পথ আমার জন্য ভোলা ছিল না।

তেহুতি বলে চললো, জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি আমার ভাইয়ের হেরেমে কাটিয়েছি। তার দুইশো জন স্ত্রী রয়েছেন, অথচ তিনি কেবল একজনকে ভালোবাসেন। মাসারা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম স্ত্রী। তিনি তাকে তিনটি পুত্রসন্তান দিয়েছেন। তিনি যা পেয়েছেন সেরকম পেলে আমিও সন্তুষ্ট থাকতাম। তবে আমি অন্যান্য স্ত্রীদের দূরবস্থা দেখেছি। ওরা স্ত্রী হওয়ার পর বেশির ভাগের ক্ষেত্রে সারা জীবনে ভাই একবার কি দুবার তাদের কাছে গিয়েছেন। তুমি জান ওরা কী করে, তায়তা? একথা জিজ্ঞেস করতেই আমি মাথা নেড়ে না করলাম। ওরা নিজেদের মধ্যে খেলা করে। নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য একজন পুরুষ না পেয়ে জঘন্য কাজকারবার করে। তার গা শিউরে উঠলো। তারপর সে বললো, কী দুঃখজনক। আমি ওদের মতো হতে চাই না।

আমি দেখলাম দুঃখে আর হতাশায় তার চেহারা বদলে যাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম হঠাৎ তার চোখের কোনে পানি টলটল করে উঠছে। এখন আর সে অভিনয় করছে না।

আমি জানি তুমি আমাকে অচেনা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে একজন বৃদ্ধলোকের হাতে আমাকে তুলে দেবে, যার সারা শরীরের চামড়া কুঁচকানো আর বিবর্ণ; হাতগুলো ঠাণ্ডা। আর তার নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধে বমিতে আমার পেট গুলিয়ে উঠবে। সে আমার সাথে নোংরা কাজ করবে আবার কান্নার দমক থামিয়ে বলে চললো, এগুলো ঘটার আগে আমার মাকে তুমি যা দিয়েছিল তা আমি একবারের জন্য চাই। আমি এমন একটি মানুষকে চাই, যে আমার মুখে হাসি এনে দেয় আর যার কারণে আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়। আমি এমন একজন মানুষকে চাই যে আমাকে সত্যিকার ভালোবাসে আর যাকে আমিও সত্যিকার ভালোবাসি।

আমি মৃদু কণ্ঠে বললাম, তুমি জারাসকে চাও। সে চিবুক তুলে সজল চোখে আমার দিকে তাকাল।

হ্যাঁ আমি জারাসকে চাই। শুধু একবার ভালোবেসে সেই মূল্যবান বস্তুটিকে বুকে চেপে ধরে রাখতে চাই। আমি জারাসকে আমার স্বামী হিসেবে চাই। শুধু সামান্য সময়ের জন্য যদি তুমি এটুকু আমাকে দাও, তাহলে আমি সানন্দে গিয়ে ফারাও, মিসর আর তোমার জন্য আমার অতি প্রিয় তায়তার জন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবো।

তাহলে প্রতিজ্ঞা কর তেহুতি। একথা কখনও কাউকে বলবে না, এমনকি তোমার নিজ সন্তানদেরও বলবে না।

সে শুরু করলো, কিন্তু আমার মা কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার মায়ের বেলায় ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল। তোমার বেলায় তা হবার নয়। তোমাকে কথা দিতে হবে।

তারপর সে রাজি হয়ে বললো, ঠিক আছে আমি কথা দিচ্ছি। তার কথা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হল।

তবে তোমাকে বুঝতে হবে তুমি কোনোদিন জারাসের সন্তান গর্ভে নিতে পারবে না।

এরকম না হলে ভালো হত তায়তা। ছোট্ট একটি নিজের জারাস পেলে আমি খুবই খুশি হতাম। কিন্তু আমি জানি তা হবার নয়।

প্রত্যেক মাসে যখন তোমার নারীত্বের লাল ফুলটি ফোঁটার সময় হবে, তখন আমি তোমাকে একটি নির্যাস খেতে দেবো। শিশুটি তখন তোমার রক্তস্রাবের সাথে বের হয়ে আসবে।

একথা ভেবে আমি কাঁদবো।

সর্বাধিরাজ মিনোজের স্ত্রী হওয়ার পর জারাসকে সারাজীবনের জন্য ভুলে যেতে হবে। তুমি ক্রিটের রাজকীয় হেরেমে থাকবে। জারাস মিসরে যাবে। তুমি আর কখনও তার দেখা পাবে না। বুঝতে পেরেছ তেহুতি? সে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

আমি আদেশের সুরে বললাম, উচ্চারণ করে বল, যে আমার কথা বুঝেছ।

সে পরিষ্কার কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ বুঝেছি।

মিনোজের সাথে বিয়ের রাতে আমি ভেড়ার রক্ত ভরে একটা রবারের ব্যাগ তোমাকে দেবো। সে যখন তোমাকে বিছানায় নেবে তখন এটা ফেটে যাবে। এটা তাকে তোমার কুমারীত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ করবে।

সে ফিসফিস করে বললো, বুঝতে পেরেছি।

আমি জোর দিয়ে বললাম, কাউকে একথা বলো না। বিশেষ করে বেকাথাকে অবশ্যই বলবে না। তার ছোট বোনটি সারাদিন গল্প করে বেড়ায় আর কোনো কথা গোপন রাখতে পারে না।

সে বললো, ঠিক আছে, কাউকে একথা জানাবো না। এমনকি আমার ছোট বোন বেকাথাকেও না।

তুমি কি জানো কি বিপদের মধ্যে তুমি পড়তে যাচ্ছো তেহুতি? তোমার জীবন মরণ তখন মিনোজের হাতে থাকবে। একজন রাজার সাথে প্রতারণা করা খুবই হঠকারিকতাপূর্ণ ব্যাপার। তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে যাতে ব্যাপারটা কোনোদিন জানাজানি হয়।

আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জানি তুমিও আমার মতো একই ঝুঁকি নিচ্ছ। আর তাই আমি তোমাকে আরও ভালোবাসি।

অবশ্যই এই কাজটা একটা পাগলামি, তবে জীবনে আমি অনেক পাগলামো করেছি। শুধু একটি সান্ত্বনা যে এখনও হাতে প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু সময় আছে। জারাসের জখম এতে একটি বাধা হয়ে আছে। ভালোবাসার এই উন্মাদনার কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সুস্থ সে এখনও হয়নি। তবে যাইহোক সে দ্রুত আরোগ্যের পথে রয়েছে।

 ৫. কথা বলার অনুমতি

দুইদিন পর জারাস আমার কাছে এসে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইল।

কখন থেকে তোমার আবার কথা বলার জন্য অনুমতির দরকার পড়লো? এর আগে তো অনুমতির কারণে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ থাকেনি? এবার তাকে একটু বিব্রত মনে হল।

রাজকুমারী তেহুতি আমার কাছ থেকে অস্ত্র চালনার নিয়ম-কানুন আর তরবারি চালানো শিখতে চাচ্ছেন। আমি তাকে বলেছি এর জন্য আমাকে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

এটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হলো না জারাস। মহামান্য রাজকুমারী যা চান, তা তিনি পান।

সে আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে তাড়াতাড়ি বললো, আমি তাকে কোনো অসম্মান করার জন্য একথা বলছি না। তার অবস্থা দেখে আমার হাসি পেল।

আমি বললাম, রাজকুমারী অত্যন্ত দক্ষ একজন তীরন্দাজ। খুব দ্রুত তীর ছুঁড়তে পারেন। তার দৃষ্টিশক্তি প্রখর আর বাহুতেও খুব জোর আছে। আমি নিঃসন্দেহ তিনি শিঘ্রই খুব ভালোভাবে তলোয়ার চালানো শিখতে পারবেন। আর এই দক্ষতা তার ভবিষ্যৎ জীবনে কোনো না কোনো সময় অবশ্যই কাজে আসবে। কে জানে? এটা হয়তো এক সময় তার জীবন বাঁচাতে পারে। আমি জানিনা কেন একথাটা বললাম। তবে ঘটনা যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে মনে হয় আমার এই কথাটাই আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তার এই অনুরোধ রাখতে তোমার কি কোনো অসুবিধা আছে জারাস?।

জারাস আবার আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, না, না মোটেই না। কোনো অসুবিধা নেই প্রভু। বরং এটাকে আমি বিরাট একটি সম্মান আর বিশেষ অনুগ্রহ মনে করবো।

তাহলে শুরু করে দাও। আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে জানতে যে, তুমি তাকে দিয়ে কি করতে যাচ্ছ। এনিয়ে আর চিন্তা করার দরকার নেই, তবে কথাটা আক্ষরিক অর্থে ঠিক ছিল না। বরং এটা ছাড়া অন্য বিষয়ে খুব কম চিন্তা করেছি। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে জারাস আর তেহুতিকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় কাটালাম।

জারাস প্রতিদিন আরও শক্তিসঞ্চয় করতে লাগলো।

রোজ সকালে সূর্য উঠার সময় থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত তার লোকদেরকে নিয়ে উঁচুনিচু ময়দানে দৌড়াত। আমিও ওদের সাথে দৌড়াতাম। আমার অসাধারণ শক্তি এবং সহিষ্ণুতা ছিল আর আমি আমার চেয়ে বয়সে অর্ধেক লোকদের সাথে প্রতিযোগীতা করতে পারতাম।

প্রথম প্রথম আমি দেখতাম সে কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করছে আর অবাক হলাম লক্ষ করে যে, আমি ছাড়া আর সবার কাছ থেকে সে তার কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে কিছুদিন পরই আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আর তার পল্টনের লোকদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে গান গাইতে গাইতে দৌড়াতে লাগলো। অনেক সময় আমার রসিকতায় মনখুলে হাসতেও লাগলো।

তার অধ্যবসায় আর আত্ম-উন্নতির ক্রমাগত প্রচেষ্টাকে সমর্থন করলাম। তবে সবকিছুরই একটা পরিমিতি বোধ থাকা দরকার। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যে আচরণ স্বাভাবিক, তা আমাদের মতো সমাজের উপরের স্তরের মানুষের জন্য শোভনীয় নয়।

যখন আমার সাথে পরামর্শ না করে সে সিদ্ধান্ত নিল যে, এখন থেকে প্রতিদিন সকালে সবাই পিঠে একটা করে বালুর বস্তা নিয়ে দৌড়াবে, তখন আমি বুঝতে পারলাম অন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমি অবহেলা করে চলেছি। মরুভূমির মধ্য দিয়ে নির্বোধের মতো ছুটাছুটি করে কতগুলো তরুণ ষণ্ডার সাথে প্রতিযোগীতা করার চেষ্টা না করে, আমাকে রাজকুমারীদেরকে গণিতের বিজ্ঞান আর জ্যোতিষতত্ত্ব শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া দেবতাদের বংশবৃত্তান্ত নিয়ে রচিত গবেষণাকর্মটির শেষ অধ্যায়গুলো রচনার কাজটিও সমাপ্ত করা দরকার।

তাছাড়া আমি মনে করি পেশিশক্তির চেয়ে মনকে সবসময় প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

.

সেনাপতি রেমরেম জয়নাব মরুদ্যানের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর, ময়াগুহায় অপেক্ষা করার সময় আমি পড়াশুনা আর ব্যবিলনে পৌঁছার আগে সমস্ত পরিকল্পনা সেরে নিচ্ছিলাম। সময় সুন্দরভাবে দ্রুত বয়ে যাচ্ছিল।

তবে এসময়ে আমাদের দলের মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য আর বিস্ফারোন্মুখ কিছু ঘটনা ঘটে চলেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজকুমারী বেকাথা আর কর্নেল হুইয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবসান।

বেকাথার অনুরোধে কর্নেল হুই রোজ বিকেলে তাকে অশ্বক্রীড়ার বিভিন্ন কলাকৌশল শেখাচ্ছিল। তার প্রশিক্ষণে বেকাথা দ্রুত একজন অসমসাহসিক অশ্বারোহীতে পরিণত হচ্ছিল। সে সবসময় নির্ভীক ছিল। ভারসাম্য বজায় রাখা আর ঘোড়ার জিনে বসা, এই সবদিকে দিয়ে সে হুইয়ের সেনাদের থেকে অনেক পারদর্শীতা অর্জন করেছিল। এরা বেশিরভাগ ছিল রথের চালক, তাই ঘোড়ার পিঠে চড়ার চেয়ে বরং ঘোড়ার পেছনে থাকতেই পছন্দ করতো।

অন্যদিকে বেকথা ঘোড়ায় চড়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করতো। এটা আমিই তাকে শিখিয়েছিলাম। ঘোড়ার চড়ার সময় সে সবসময় তার দক্ষতা দেখাতে পছন্দ করতো আর কোনো দর্শক থাকলে, তার কলাকৌশলগুলোও দেখাতে ভালোবাসতো।

এক বিকেলে হুই তাকে একটা গোলক নিয়ে খেলা শেখাচ্ছিল। গোলকটি ছিল ওজনে ভারী আর কাঁচা চামড়ার ফালি দিয়ে বানানো একটা বড় বল। এই খেলায় দুই দলে চারজন করে ঘোড়সওয়ার থাকে আর দুজন ঘোড়সওয়ার ডগা বাঁকানো একটি লাঠির ডগায় গোলকটা ধরে মাঠের শেষ প্রান্তে একটি চিহ্নিত করা জায়গায় নিয়ে যাবে। আর ওদের প্রতিদ্বন্দ্বিরা ওদেরকে বাধা দেবে। এটি ছিল হৈচৈ আর জোর জবরদস্তি করে খেলার মতো একটি প্রতিযোগীতা। অনেক দর্শকের চিৎকার আর হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে এটা চলতো।

সেদিন বিকেলে হুই বেকাথাকে শেখাচ্ছিল কীভাবে ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচু হয়ে বালুতে গড়ানো বলটা তুলে নেওয়া যায়। রোজকার মতো গোটা পঞ্চাশেক সৈন্য আর শিবিরের অলস কিছু লোক মাঠের দুইধারে সারবেঁধে দাঁড়িয়ে খেলাটা উপভোগ করছিল।

বেকাথার ঘোড়া টগবগিয়ে মাঠে ঢুকলো। তার দুই হাত মুক্ত ছিল আর সে হাঁটুর গুঁতো দিয়ে ঘোড়াকে সামলাচ্ছিল।

হুই মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে গোলকটা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বেকাথা মাঠে ঢুকতেই সে গোলকটা তার সামনে মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। বেকাথা ঘোড়ার গদি থেকে একদিকে ঝুঁকে নিচু হয়ে গোলকটা তুলতে চেষ্টা করলো; তার দেহের সমস্ত ওজন জিনের একপাশের রেকাবের উপর ছিল। আমার মতে এটা ছিল অতি চমৎকার একটি ক্রীড়াশৈলী। সমস্ত দর্শক চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিয়ে চললো, আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম।

বিশাল ঘোড়াটির পিঠে বেকাথাকে দেখতে ডাইনিসুলভ মনে হলেও সে অনায়াসে নিচের দিকে ঝুঁকে মাটিতে গড়ানো গোলকটির চারটি পালকের হাতলের একটি ধরে ফেললো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সে বলটি তুলতে শুরু করলো।

তারপর হঠাৎ তার জিনের রেকাবের চামড়া ছিঁড়ে গেল আর সে ঘোড়ার জিন থেকে শূন্যে ছিটকে পড়লো। তবে সে মাটিতে পড়ার আগেই আমি তার দিকে ছুটে গেলাম। ভাবলাম হয় সে মরেই গেছে আর নয়তো সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছে। অন্যদিকে হুই আমার আগেই দ্রুত তার দিকে ছুটে গেল।

তারপর আমি স্বস্তি পেলাম যখন দেখলাম বেকাথা মাটিতে দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আর প্রচণ্ড রাগে আর লজ্জায় কাঁপছে। আসলে সে মাটিতে এক জায়গায় স্তূপ করা ঘোড়ার বিষ্ঠার উপর পড়েছিল। একারণে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়লেও তার হাতপা ভাঙেনি আর সম্ভবত এজন্যই তার জীবন রক্ষা পেয়েছে। তবে ঘোড়ার নাদি মাখামাখি হয়ে তার চেহারা বিশ্রী হয়ে এক অপমানকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তার পা থেকে মাথার লাল চুল পর্যন্ত ঘোড়ার সবুজ নাদিতে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। হুই ছুটে তার কাছে পৌঁছাবার পর কেবল তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না এ পরিস্থিতিতে তার কী করা দরকার। আর বেকাথাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি তার কাছে পৌঁছার আগেই, হুই এমন একটি কাজ করলো যাতে বিষয়টা জটিল হয়ে দাঁড়াল। সে বেকাথার অবস্থা দেখে হেসে ফেললো।

সাথে সাথে বেকাথা তার স্বভাবসুলভ প্রতিক্রিয়া দেখাল। প্রচণ্ড রাগে সে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। তখনও তার ডান হাতে গোলকটা ধরা ছিল। সে সোজা এটা হুইয়ের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। হুই হঠাৎ এ-ধরনের আক্রমণ আশা করেনি, তাই সে নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। ভারী গোলকটার চামড়া রোদে শুকিয়ে হাড়ের মতো শক্ত হয়ে ছিল। এটা তার চওড়া নাকের বাঁশির উপর আঘাত হানতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। এতেও বেকাথা ক্ষান্ত হলো না।

সে যে ঘোড়ার বিষ্ঠার গাদার উপর দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে নিচু হয়ে দুই হাত ভরে নাদি তুলে নিয়ে হুইয়ের দিকে ছুটে গিয়ে তার ভাঙা নাকের উপর ঘসে দিল।

তারপর শীতল কণ্ঠে বললো, তুমি যদি মনে কর আমাকে দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে, তাহলে এবার নিজের চেহারাটা দেখো কর্নেল হুই। তারপর সে ঘুরে মাঠ থেকে বের হয়ে সোজা রাজকীয় শিবিরের দিকে হেঁটে চললো। দর্শকদের মধ্যে কেউ আর হাসার সাহস করলো না, এমনকি আমিও না।

হুইকে আর কখনও রাজকীয় খাবার টেবিলে আমন্ত্রণ করা হয়নি আর রাজকুমারীদের ঘোড়ায় চড়া শেখানোর জন্য ডাকা হয়নি।

এর কয়েকদিন পর যখন বেকাথা আর লক্সিয়াস নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন আড়াল থেকে আমি তাদের কথা শুনে ফেললাম। রাজকুমারীদের লেখাপড়ার জন্য শ্রেণিকক্ষ হিসেবে একটা তাঁবু আলাদা করে রাখা হয়েছিল। ওরা সেখানে মিনোয়ান ভাষায় কথা বলছিল। আমি এই তাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে বাইরে পাহাড়চূড়াগুলোর বিভিন্ন রঙের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। অবশ্যই আমি আমার ছাত্রীদের কথোপকথন আড়ি পেতে শুনছিলাম না। তবে তাঁবুতে ঢোকার মুখে এই জায়গায় এসে একটু থামতেই ওদের কিছু কথা অসাবধানতাবশত আমার কানে এলো।

লক্সিয়াস বেকাথাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এখনও কর্নেল হুইকে ক্ষমা করোনি?

বেকাথা উগ্রকণ্ঠে উত্তর দিল, আমি কোনোদিনই তাকে ক্ষমা করবো না। সে একজন অসভ্য গেয়ো ভূত। যখন আমি ক্রিটের রানি হব তখন তার মাথা কেটে ফেলার নির্দেশ দেবো।

ইস কী মজা হবে। আমাকে দেখতে দেবে?

এটা ঠাট্টা নয় লক্সিয়াস। আমি সত্যিই বলছি।

কিন্তু তুমি তো আমাকে আর তেহুতিকে বলেছিলে যে এই পৃথিবীতে সেই তোমার উপযুক্ত একমাত্র লোক?

এবার বেকাথার গলায় অহঙ্কারের সুর, আমি মত পাল্টেছি। তার মতো একজন বয়স্ক লোক দেখতে বিশ্রী, যে আচার ব্যবহার জানে না তার সাথে। আমার কী? যার আবার চল্লিশটা বিশ্রী চেহারা বউ আছে।

সে তেমন বয়ষ্ক নয় বেকাথা আর সে দেখতেও বেশ সুন্দর। আমি যদুর জানি থিবসে তার কেবল পাঁচজন বউ আছে আর ওরা দেখতেও বেশ সুন্দর।

বেকাথা দৃঢ়কণ্ঠে বললো, সে খুবই বুড়ো, এমনকি তায়তার চেয়েও বুড়ো। ভাঙা নাক আর মুখে ঘোড়ার নাদিসহ তাকে আমার মোটেই সুন্দর মনে হয় না। তার পাঁচ বউ তাকে নিয়ে থাকুক। আমার আর তাকে দরকার নেই।

বেকাথার এ-ধরনের রুঢ় শব্দ চয়ন আর আমার বয়স নিয়ে মানহানিকর মন্তব্য করাটা আমি ক্ষমা করলাম। এবার অন্তত একটা সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখন থেকে তার বড় বোনের সাথে সাথে তারও কুমারীত্ব রক্ষা করতে আমাকে আর পাহারা দিতে হবে না।

আমি একটু গলা খাঁকারি দিতেই ওদের কথা থেমে গেল। তাবুর দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকে দেখলাম দুজনেই টেবিলে মাথা ঝুঁকে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছে। আমি ওদেরকে প্যাপিরাসে লেখা মিসরের ইতিহাসের কয়েকটি অধ্যায় দিয়েছিলাম, সেগুলো ওরা ক্রেটান ভাষায় অনুবাদ করছে। আমি পাশে এসে দাঁড়ালেও বেকাথা মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল না।

তোমার অধ্যবসায় আর প্রাচীন মিসরীয় লিপিতে চমৎকার হাতের লেখা দেখে আমি সত্যি খুশি হয়েছি রাজকুমারী। তবে তোমার বোন তোমার সাথে নেই কেন?

সে তার তুলিটি সামনের দিকে তুলে বললো, সে ওদিকে খুব ব্যস্ত রয়েছে। আমাকে বললো একটু পরেই এখানে আসবে। একথা বলেই সে আবার তার লেখার কাজে মনোনিবেশ করলো।

শিবিরের শেষ প্রান্তে কুচকাওয়াজের ময়দান থেকে রক্ষীদের গুঞ্জন আমি শুনছিলাম, তবে খুব একটা খেয়াল করিনি। এবার বেকাথার কথা শুনে আমার একটু কৌতূহল জাগতেই বিষয়টা কি জানার জন্য তাঁবু থেকে বের হয়ে সেদিকে চললাম। কুচকাওয়াজের ময়দানের চারপাশ ঘিরে বেশ কয়েকজন ঘোড়ার সহিস, পেশাদার চিত্তবিনোদনকারী, চাকরবাকর, ক্রীতদাস আর অন্যান্য অসামরিক লোক দল বেধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা এমন মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, আমার লোকজন কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে ভীড় সরিয়ে আমার এগোবার জন্য পথ করে দিল। ময়দানের কিনারায় দাঁড়িয়ে আমি চারদিকে তাকিয়ে সাথে সাথে তেহুতিকে দেখতে পেলাম না।

সেখানে জারাস তার অধীনস্থ লোকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। ওরা সবাই অর্ধেক বর্ম পরেছিল, তবে শিরস্ত্রাণের মুখের ঢাকনি উপরের দিকে উঠানো থাকায় সবার মুখ দেখা যাচ্ছিল। তলোয়ার খাড়া করে ঠোঁটে চুঁইয়ে ওরা সবাই ঋজু আর স্থির হয়ে অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

জারাস গর্জে উঠলো, লড়াই শুরু! সামনের বারোজন তলোয়ার হাতে দ্রুত সামনে বামদিকে ঝুঁকে পড়। এক

লোকগুলো সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, এক! তারপর নিখুঁতভাবে সকলে তলোয়ার বাগিয়ে একযোগে সামনে বামদিকে শরীর বাঁকিয়ে ঝুঁকে পড়লো, তারপর আবার আগেকার অবস্থানে ফিরে এলো। রোদে তলোয়ারের পাতগুলো সোনার মত চকচক করে উঠলো।

তারপর হঠাৎ সামনের সারির মধ্যখানে একটি ছোটখাট মানুষের দিকে আমার নজর পড়লো। প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি কী দেখছি। তারপর বুঝলাম না ঠিকই দেখেছি, এটা তেহুতি। সে রক্ষীবাহিনীর আঁটোসাটো পোশাক পরে রয়েছে। তার নুবিয় উপজাতীয় পরিচারিকাদের মধ্যে অন্তত তিনজন সূচিশিল্পে পটু ছিল, ওরা নিশ্চয়ই এক বেলাতেই পোশাকটা সেলাই করে দিয়েছে। আর সেনাবাহিনীর সাথে থাকা কামার তার হালকা পাতলা গড়নের সাথে খাপ খাইয়ে বর্মটি তৈরি করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর নিয়মিত একটি ভারী তলোয়ার হাতে ধরে রয়েছে, যা বিশেষত তার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

মুখে রক্তিমাভা, ঘামে ভেজা চুল লেপ্টে রয়েছে আর গায়ে সেঁটে থাকা আঁটো জামাটাও ঘামে ভেজা। আমি আতঙ্কিত হলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটি চাষার মেয়ে, যে সারাদিন তার স্বামীর ক্ষেতে কাস্তে হাতে ফসল কেটেছে কিংবা নিড়ানি দিয়েছে। তাকে ঘিরে রয়েছে একদল রুক্ষ চেহারার সৈন্য। আর সে এমন আচরণ করছিল যেন, তার চেহারা বা রাজকীয় পদমর্যাদা নিয়ে এদের মাঝে থেকে সে মোটেই লজ্জিত নয়।

আমি অবশ্য তাকে জারাসের কাছ থেকে তলোয়ার চালানো শিখতে বলেছিলাম। এমনকি এই পরিকল্পনায় উৎসাহও জুগিয়েছিলাম। তবে আমার ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে নিভৃতে এই প্রশিক্ষণ চলবে আর কেউ তা দেখতে পাবে না।

দেবতারা সাক্ষী দেবেন যে, সাধারণ মানুষদের আমি অবজ্ঞার চোখে দেখি না। কিন্তু তাই বলে এতো উচ্চ মর্যাদার আসন থেকে নিচে নেমে সাধারণ মানুষের কাতারে এসে তাদের প্রতি সৌজন্য দেখানোরও একটা সীমা আছে।

আমার প্রথমে ইচ্ছা হচ্ছিল কুচকাওয়াজের ময়দানের মধ্য দিয়ে ছুটে গিয়ে তেহুতির ঘাড় ধরে টেনে রাজকীয় শিবিরের ভেতরে নিয়ে যাই। আর তাকে ধমক দিয়ে বলি যেন সে যথাযথ পোশাক পরে আর জনসাধারণের মাঝে গেলে তার আচরণ যেন আরও শোভন হয়।

তারপর আমার মাঝে সুবুদ্ধির উদয় হল। আমি জানি পুরো পল্টনের মাঝেও আমার কথা অমান্য করতে সে মোটেই ইতস্তত করবে না, যার ফলে ওরা যে সম্মানের চোখে আমাকে দেখতো তা ম্লান হয়ে যাবে।

আমি লক্ষ করলাম অস্ত্রধারীদের মধ্য দিয়ে সে এমন সাবলিল আর নিপুণতার সাথে মসৃণভাবে এগিয়ে চলেছে যে, তার চারপাশের শক্তিশালী যোদ্ধাদেরকে মনে হচ্ছিল হেঁচড়িয়ে চলা হাল চাষ করা কৃষক। সে একবারও ভুল পদক্ষেপ ফেলেনি কিংবা ছন্দ হারায়নি। সাবলীলভাবে তলোয়ারটি এক হাত থেকে অন্য হাতে নিচ্ছে আর লাফ মেরে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে দ্রুত তলোয়ার চালাচ্ছে। বাম আর ডান, দুই হাতেই সমানতালে তলোয়ার চালাচ্ছে। তার চোখেমুখে পূর্ণ মনোযোগ এবং দৃঢ় সংকল্প ফুটে উঠেছে। সে অত্যন্ত চমৎকার এবং উচ্চপর্যায়ের দক্ষতা প্রদর্শন করছিল। ভারী তলোয়ার ধরা সরু হাতে যে প্রচণ্ড শক্তি আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তলোয়ার ঘুরাবার সময় বাতাসে সাঁই সাঁই শব্দ উঠছে। সবশেষে সে তলোয়ারটি এমনভাবে সামনে বাড়িয়ে ধরলো, যেন এটি পালকের মতো হালকা, ভারী কোনো ধাতু নয়। তারপর একটি হাতির দাঁতের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়াল।

জারাস নির্দেশ দিল, আরামে দাঁড়াও! সাথে সাথে দর্শকরা খুশিতে ফেটে পড়ে একযোগে হাততালি দিয়ে আর পা মাটিতে দাপিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। তারপর একটি কণ্ঠ তার নামের প্রতিটি অক্ষর আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করলো:

তে-হুঁ-তি! সাথে সাথে আর সবাই তার সাথে গলা মিলিয়ে ডেকে উঠলো, তে-হুঁ-তি!

তারপর শুরু হল সম্মিলিত কণ্ঠে স্তব। আমিও এই বীর বন্দনায় সামিল হলাম। তে-হুঁ-তি।

প্রশান্ত গাম্ভীর্য আর পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে আমিও ওদের সাথে গলা মিলিয়ে স্তব শুরু করলাম।

.

পরিশেষে উত্তর থেকে একজন বার্তাবাহক উটে চড়ে ময়াগুহায় এলো। সে সেনাপতি রেমরেমের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছে যে, দুই সপ্তাহ বিশ্রাম নেওয়ার পর তার অগ্রবর্তী দলটি জয়নাব মরুদ্যান থেকে সামনের দিকে যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

সে জানিয়েছে সবকিছু ঠিক আছে। তার দলের কারও কোন ক্ষতি হয়নি কেবল একটি উট সে হারিয়েছে। সে আমাকে তাড়াতাড়ি জয়নাব মরুদ্যানের দিকে রওয়ানা হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছে মরুদ্যানটি এখন খালি এবং এর মাটির নিচের ঝরণা থেকে প্রচুর পানি এসে জলাধারটি পূর্ণ হয়েছে।

যথারীতি আমি জারাসকে নির্দেশ দিলাম, তবে শিবির উঠিয়ে সমস্ত মালামাল ভারবাহি পশুর উপর তুলতে দুইদিন লেগে গেল। এর ফাঁকে জারাসকে আমার তাঁবুতে ডেকে পোশাক খুলে তার ক্ষতটা পরীক্ষা করলাম। দেখলাম সে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে। যে জায়গায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল সেজায়গাটি ঘন কালো লোমে ঢাকা পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে আমাকে আশ্বস্ত করলো যে পেটের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি হলেও এখন তার পাকস্থলী ঠিক আগের মতো কাজ করছে। সেদিন সকালেই আমি দেখেছিলাম সে পুরো বর্ম পরে আর কাঁধে একটি বালুর বস্তা নিয়ে দশ লিগ লম্বা একটি দৌড় থেকে সবার আগে ফিরে এসেছিল।

বিকেলে সূর্যের তাপ কমে আসার পর আমরা ময়াগুহা থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ক্ষয়িষ্ণ চাঁদের আলোয় পথ দেখে সারারাত চললাম। তারপর সকালে রোদের তাপ বেড়ে যাওয়ার পর আবার তাঁবু খাটালাম। ইতোমধ্যে বিশ লিগ দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছি। মন প্রফুল্ল হল। নিজে বিশ্রাম নেবার আগে পুরো শিবিরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা ঘুরে দেখলাম। আমি সবসময় অবাক হতাম শুধু দুএকটা ভালো কথায় কীভাবে দলের সবচেয়ে নিম্নস্তরের সদস্যও কি-রকম খুশি হয়। একজন মানুষ অনেক সময় ভুলে যায় যে, তার চেয়ে কম বুদ্ধিমান লোক তাকে কীরকম সম্মান করে।

কিন্তু রাজকীয় শিবিরে ফিরে আসার সাথে সাথে মনের সমস্ত প্রশান্তি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আসলে একটু দূর থেকেই আমি শোরগোল আর চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিলাম। অবিরাম ক্রন্দন, কিছু হারাবার বিলাপ সবকিছু পরিষ্কার মরুর বাতাসে ভেসে আসছিল। সাথে সাথে ছুটতে শুরু করলাম, না জানি কী অঘটন ঘটেছে। নিশ্চয় কোন মৃত্যু কিংবা তেমন কোনো বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছে।

রাজকীয় শিবির এলাকায় ঢুকে দেখলাম সমস্ত দাসদাসি আতঙ্কে হতভম্ব হয়ে রয়েছে। তারা আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ওদের বোকামী দেখে অধৈর্য হয়ে একজন নুবিয় পরিচারিকার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তার স্বন্বিত ফেরাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এতে কোনো কাজ হলো না। বরং চারপাশের হট্টগোল এখন একটি পাগলাগারদে পরিণত হল।

তাড়াতাড়ি আমি মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, আমি তার সতীত্ব হানি করতে যাচ্ছি না, তারপর দ্রুত তেহুতির তাবুর দিকে গেলাম। তাঁবুর ঢোকার মুখে উচ্চস্বরে বিলাপরত বেশ কয়েকজন মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রাজকুমারীর কাছে পৌঁছলাম। সে তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার দমকে তার পুরো শরীর কেঁপে উঠছিল।

আমার গলার আওয়াজ শোনার সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

কী হয়েছে বাছা? কে মরেছে? এমন কী হয়েছে যে, তুমি কাঁদছো?

আমার আংটি! আমি আংটিটা হারিয়ে ফেলেছিনিশ্চয়ই কেউ এটা চুরি করেছে।

প্রথমে আমি তার কথা বুঝতে না পেরে বললাম, কোন আংটি?

আড়ষ্টভাবে আঙুলগুলো ছড়িয়ে বামহাত সামনে বাড়িয়ে বললো, আমার আংটিটা নেই। যেটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। সেই জাদুর হীরার আংটিটা, যেটা তুমি তামিয়াত দুর্গ থেকে আমার জন্য এনেছিলে।

সমস্যাটি তেমন গুরুত্ব নয় বুঝতে পেরে আমি বললাম, ঠিক আছে তুমি শান্ত হও। আমরা এটা খুঁজে বের করবো।

কিন্তু যদি খুঁজে না পাও? এটাই একমাত্র জিনিস যা আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসি। এটা হারিয়ে গেলে আমি আত্মহত্যা করবো।

প্রথমে এই মেয়েগুলোকে এখান থেকে তাড়াতে হবে, তারপর আমরা শান্তভাবে নিজেদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারবো। হাতের ছড়ি আর মুখের সুন্দর ভাষা ব্যবহার করে ওদের সবাইকে তাবু থেকে বের করলাম। তারপর বিছানায় তেহুতির পাশে বসে ওর এক হাত ধরে বললাম,

এখন বল কখন, কোথায় এটা শেষ দেখেছ। আমার প্রশ্নটা শুনে সে একটু ভাবতে লাগলো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, এতো কান্নাকাটি, ফুপানো আর আত্মহত্যার হুমকি ইত্যাদি সত্ত্বেও তার সুন্দর চোখদুটো পানি শূন্য। এখন আমরা দুজন একা হওয়ার পর তাকে বেশ নিরুদ্বেগ মনে হচ্ছে। এমনকি মনে হচ্ছে যেন বিষয়টা সে বেশ উপভোগ করছে। সাথে সাথে আমার মনে সন্দেহ জাগলো।

বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতেই সে বললো, হ্যাঁ, এবার ঠিক মনে পড়েছে! কোথায় হারিয়েছে এবার মনে পড়েছে। কাল বিকেলে ময়াগুহা ছেড়ে আসার আগে লক্সিয়াস, বেকাথা আর আমি শেষবারের জন্য জলাধারে সাঁতার কাটতে গিয়েছিলাম। মনে পড়েছে পানিতে নামার আগে আমি আংটিটা খুলে যে পাথরটার উপর সবসময় রাখতাম তার উপরে রেখেছিলাম। নিশ্চয়ই সেখানেই আংটিটা ফেলে এসেছি।

তার গুল মারা আর কল্পনার সাথে তাল মিলিয়ে বেশ গম্ভীরভাবে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বলছো তো? অন্য কোথাও ফেলোনি তো?

সাথে সাথে সে আমাকে আস্বস্ত করে বললো, হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। অন্য কোথাও অবশ্যই পড়েনি।

এবার আমি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, তাহলে তো ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে গেল। তোমার দুশ্চিন্তা শেষ তেহুতি। আমি কর্নেল হুইকে ময়াগুহায় পাঠাবো। সে তার সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে সেখানে গিয়ে কাল সকালের আগে ফিরে আসতে পারবে।

একথায় সে হঠাৎ হতচকিত হয়ে গেল। সঙ্কটে পড়ে হাত কচলাতে কচলাতে বললো, কিন্তুনা, তুমি হুইকে সেখানে পাঠাতে পারবে না।

আমি সরলভাবে বললাম, কিন্তু কেন? হুইতো ভালো লোক।

সে একটু ইতস্তত করে তারপর বললো, জিনিসটা কোথায় ফেলে এসেছি সেটা হুইকে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারবো না। হুই একজন বিদেশী। সে ভালোভাবে মিসরীভাষা বলতে পারে না।

আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকালেও সে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছিল না। উচ্চারণ বিদেশি ঢংয়ের হলেও একটি পল্টনকে নেতৃত্ব দেবার মতো মিসরি সে ভালোই বলতে পারে। সে যে ওজর দেখিয়েছে আমি তা খন্ডন করা সত্ত্বেও তেহুতি বললো, আমি হুইকে বিশ্বাস করি না। মনে নেই সে কীভাবে আমাদের ছোট্ট বেকাথাকে নাজেহাল করেছিল। সে আংটিটা চুরি করে ফেলতে পারে। তাকে কোন কিছু দিয়ে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

তাহলে তোমার নিজেকেই ঐ গুহায় গিয়ে আংটিটা খোঁজ করা উচিত।

এতক্ষণ নিজে যে কথাটা সে ভাবছিল সেটার দিকে আমাকে ঠেলে দিয়ে এবার সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো, আরে একথাটা তো আমি আসলেই ভাবিনি! তুমি ঠিকই বলেছো তায়তা। আমারই যাওয়া উচিত।

কিন্তু তুমি তো একা যেতে পারো না। তোমার সাথে আমার কাউকে পাঠাতে হবে। হুই তো অবশ্যই নয়, কেননা তুমি তো আবার বিদেশিদেরকে বিশ্বাস করো না। তারপর বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করার ভান করে বললাম, সেনাপতি রেমরেমকে পাঠানো যেত, কিন্তু সে তো এখন এখানে নেই। অন্য সময় হলে আমি যেতাম, কিন্তু আমার পিঠ ব্যথা করছে আর আমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। একথাটা বলে আমি কোমরের পেছনের দিকে হাত রেখে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম।

সে আমার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আহা, আমার তায়তা! আমি আর তোমাকে শরীরে কোনো ধরনের কষ্ট নিতে দেবো না।

আমি বললাম, পেয়েছি পেয়েছি! ক্যাপ্টেন জারাসকে তোমার সাথে পাঠাব।

কথাটা শোনার সাথে সাথে সে চোখ নামিয়ে নিল। বুঝতে পেরেছে। আমি তাকে পরীক্ষা করছিলাম। এবার সে আমার দিকে তাকিয়ে ভান করা ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠলো, তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো।

আমি তোমাকে ভালোবাসি, সত্যি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি তায়তা।

আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললাম, ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয় যদি সেই দুষ্টু আংটিটা আমার কাছে রেখে যাও, কারণ এবার হয়তো সত্যিই এটা তোমার আঙুল থেকে পড়ে যেতে পারে।

সে তার আস্তিনে হাত ঢুকিয়ে যখন আবার বের করলো তখন হাতটা মুষ্টিবদ্ধ ছিল। তবে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বললো, এটা ছাড়া আর সবকিছু দিয়ে আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি।

তারপর মুঠোটা খুলতেই সেই বিখ্যাত হীরার আংটিটা তার তালুতে দেখা গেল।

যখন আমি ফিরে আসবো তখন এটা আমার হাতের আঙুলে থাকবে আর কখনও আঙুল থেকে খুলবো না। এটা সবসময় জারাসের প্রতি ভালোবাসার চিহ্ন হয়ে থাকবে। এমনকি কর্তব্যের খাতিরে যদি তাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করতে হয়, তারপরও এই আংটি তার স্মৃতি হয়ে আমার কাছে থাকবে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে সে আর জারাস দুটো ঘোড়ায় চড়ে দক্ষিণদিকে ছুটে চললো। তাদের দেহরক্ষীদলও একটু পর তাদের অনুসরণ করলো।

কর্তব্য থেকে এ-ধরনের গহিত বিচ্যুতি আমার মনে একটু অপরাধ বোধ জাগাল। তারপর যখন মনে পড়লো আমার অতি প্রিয় দুইজন তরুণ মানুষকে খুশি হওয়ার সামান্য সুযোগ দিতে পেরেছি তখন মন থেকে এই অপরাধবোধ ভাবটি ম্লান হয়ে গেল।

.

আমি আশা করিনি যে ওই দুইজন খুব শিঘ্রই ময়াগুহা থেকে ফিরে আসবে। তবে ওরা আমাকে হতাশ করেনি। জয়নাব মরুদ্যানে প্রায় এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার আগেই ওরা ফিরে এল।

আমার তাঁবুর সামনে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামার সময় তেহুতি ফিসফিস করে জারাসকে বললো, তুমি এখানে অপেক্ষা কর। আমাকে তার সাথে একা কথা বলতে হবে।

ওরা রৌদ্রে দাঁড়িয়েছিল আর তাই আমি যে তাঁবুর ছায়া থেকে ওদের লক্ষ্য করছিলাম, তা ওরা দেখতে পায় নি। সেজন্য তেহুতির ঠোঁট নড়া দেখে আমি তার কথা বুঝতে পারছিলাম।

সে দৌড়ে তাবুতে ঢুকলো। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে খুশিতে অস্ফুট চিৎকার করে আমার বাহুর মাঝে এলো। তাকে জড়িয়ে ধরার পর আমি বুঝতে পারলাম এই অল্প সময়ের মধ্যেই সে অলৌকিকভাবে শৈশব অবস্থা থেকে পূর্ণ নারীতে পরিণত হয়েছে, অপরিশোধিত ধাতু থেকে রাজকীয় স্বর্ণ হয়েছে।

তাকে চেপে ধরেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, যা খুঁজতে গিয়েছিলে তা কি পেয়েছো?

ও হ্যাঁ, পেয়েছি। এই কথা বলে তার হাতের মুঠো আমার সামনে খুলে ধরলো। হীরাটা চমকাচ্ছে, তবে তার চোখের মতো উজ্জ্বল নয়। আমি এটা ভালোবাসি, তবে গুহায় অন্য যে সম্পদ পেয়েছি তা আরও ভালোবাসি।

তারপর সে অকপটভাবে বললো, আমি তোমাকে সবকিছু খুলে বলবো। যা যা হয়েছে সব বলবো।

তাঁবুর ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বেচারি জারাস তখনও সেখানে চাপা আর লজ্জিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক একটি ছোট্ট ছেলের মতো যে, আপেল বাগানে আপেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে আর এখন মার খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি এটা নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে তাকে যেতে দিলাম।

পুরো শিবিরটি হাসি ঠাট্টায় ভরে গিয়ে এখন একটি আনন্দের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, জারাস আর তেহুতি বেশ সতর্কতার সাথে তাদের রোমান্সের বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছে। মনে হল আমি ছাড়া সম্ভবত আর কেউ তা জানেনা। এমনকি বেকাথাও নয়। মনে বেশ পরিতৃপ্তি অনুভব করলাম যে, এই দুজনের ভালোবাসার আমি অভিভাবক হয়েছি। মনে পড়লো অনেক আগে তেহুতির বাবা-মার ব্যাপারেও একই ভূমিকা আমি পালন করেছিলাম।

জয়নাব মরুদ্যানে আমাদের বেশিদিন থাকা হয়নি। আমরা এগিয়ে চললাম। বিশাল এই ধু-ধু প্রান্তরে রেমরেম আর দলবল আমাদের জন্য যে পথ নির্দেশনা রেখে গিয়েছিল তা অনুসরণ করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতে লাগলাম। মরুভূমিতে এমন এক সৌন্দর্য আর মহিমা আছে যা, পৃথিবীর অন্য কোথাও নই। এই স্থান উত্তেজিত মনে প্রশান্তি এনে দেয় আর দেবতার কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়। এটা ছিল আমার জীবনের অত্যন্ত স্মরণীয় আর তৃপ্তিদায়ক একটি সময়।

এভাবে উত্তরে যেতে যেতে একসময় আমরা রেমরেম আর দলের অন্য অংশের দেখা পেলাম। পূর্ব পরিকল্পনামতো ইউফ্রেটিস নদীর কেবল দশ লিগ দক্ষিণে আমাদের দুই দলের মিলন হল। অবশ্য এতো কাছে যে এরকম বিশাল একটি নদী রয়েছে তার কোনো চিহ্ন এখনও দেখা যাচ্ছে না। এখনও আমাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে রুক্ষ পাথরের পাহাড় আর ধূলিধূসর রোদে পোড়া উপত্যকা।

আমাদের এক চোখওয়ালা পথ নির্দেশক, আল-নামজু এবার আমাদেরকে শেষ মরুদ্যানে নিয়ে এলো। এই জায়গাটির নাম ধ্রুস। এখানে পনেরোটি কূপ রয়েছে, সবগুলোতে পরিষ্কার মিঠে পানি। এখান থেকে একটি জনবহুল গ্রাম, একটি খেজুর বাগান আর অন্যান্য কৃষিখামারে পানি সরবরাহ করা হয়। আমাদের এতো বড় একটি কাফেলার কয়েকদিনের প্রয়োজন মেটাবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ পানি এখানে রয়েছে।

এখানে শিবির স্থাপন করার কিছুক্ষণ পর আল-নামজু আমার সামনে এসে নতমস্তকে দাঁড়াল।

তারপর বললো, পরম শ্রদ্ধেয় প্রভু তায়তা। এখান থেকে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে শালদিসে উর নগরীর কাফেলা চলার পথটিতে প্রচুর লোকচলাচল হয় আর এপথে পরিষ্কার দিক নির্দেশনা রয়েছে। নদীও কাছে। এপথে যেতে আপনাদের তেমন অসুবিধা হবে না।

সেক্ষেত্রে চুক্তি মোতাবেক উর পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে তোমারতো কোনো অসুবিধা হবার কথা নয় আল-নামজু, তাই না?

হে মহান প্রভু তায়তা। আপনার উপলব্ধি আর অনুকম্পার মিনতি করছি। আমার উর নগরীতে ঢোকার সাহস নেই, সেখানে আমার শত্রু রয়েছে। এখানকার আক্কাদিয়রা ভীষণ প্রতিহিংসাপরায়ণ আর বিপজ্জনক লোক। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি দয়া করে আমাকে এখানেই ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণে জুবায় ফিরে যাবার অনুমতি দিন। সেখানে আমার বড় ছেলে হারানোর শোক পালন করবো। একথা বলার পর তার শূন্য চোখের কোটর থেকে এক বিন্দু চোখের পানি মুছলো। দৃশ্যটা দেখতে বেশ বিসদৃশ।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি তুমি চুক্তি মোতাবেক পুরো পারিশ্রমিক দাবী করছো? একথা শোনার সাথে সাথে সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

আপনি আমার বাবা এবং প্রভু। যা আপনার মর্জি। আমি একজন গরীব মানুষ, আমাকে আমার ছেলে হারুন আর তার পুরো পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে হবে। এটা আমার দুর্ভাগ্য।

তার দুঃখদুর্দশার ফিরিস্তি শুনতে শুনতে তার অনুরোধটি বিবেচনা করলাম। এটা সত্যি যে সে একজন বিশ্বাসঘাতক ছেলের বাবা আর একটি ছেলে তার জনকের মতো একই ছাঁচে হয়ে থাকে। অন্যদিকে তার নিজের ছেলেকে হত্যা করতে আমি তাকে বাধ্য করেছিলাম। এতেই কি তার ঋণ শোধ হয়নি? নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম। মনে হয় সে যথেষ্ট ভুগেছে।

চরিত্রগতভাবে আমি একজন দয়ালু মানুষ, তবে এটা হয়তো গুণের চেয়ে একটা দোষই হবে। আমি তাকে বললাম, তুমি আমাদের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছে আল-নামজু। আমার আশীর্বাদ নিয়ে তুমি এবার যেতে পার। তারপর আমার থলে থেকে দুটি রূপার মেম মুদ্রা নিয়ে তার বাড়ানো হাতে তুলে দিলাম। তারপর সে আমার পায়ে চুমু খেয়ে চলে গেল।

চারদিন পর আমি শালদিসের উর নগরীর উপরে নিচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এই প্রথমবারের মতো নিচে নগর আর সবুজ ইউফ্রেটিস নদীর দিকে তাকালাম। এই নদীটি যে আমাদের মা নীল নদের চেয়েও চওড়া এই সত্যিটি উপলব্ধি করতে পেরে আমি একটু বিরক্তি বোধ করলাম। কেননা এর আগে আমি মনে করতাম নীল নদই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী।

ইউফ্রেটিস নদীর দুই তীরে যতদূর চোখ যায় গভীর বনানী দেখা যাচ্ছে। বন কেটে বড় বড় কৃষি জমি তৈরি করা হয়েছে। রুক্ষ মরুভূমি পার হওয়ার পর প্রচুর গজিয়ে উঠা এই বিশাল শ্যামলিমা দেখে আমার মন ভরে গেল। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার নিচেই নদীর তীরে উর নগরীর অবস্থান। এর ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ইশতার দেবীর বিশাল মন্দির। ইনি সুমেরিয় আর আক্কাদিয়দের প্রধান দেবী। এটি একটি পিরামিড আকৃতির ইমারত। একটির উপর একটি পাঁচটি চত্বর ধাপে ধাপে উপরের দিকে ছোট হয়ে চলে গেছে। এটি শুধু একটি মন্দির নয়, বন্যার সময় যখন নদীর কূল ছাপিয়ে নগরী আর আশপাশের সবজায়গা প্লাবিত হয়ে যায় তখন মন্দিরের পুরোহিত আর যাজিকারা এখানে আশ্রয় নেন।

আমরা নগরীর দিকে রওয়ানা দিলাম। দলের সবার আগে রেমরেম আর রাজকুমারীদের নিয়ে আমি ঘোড়ায় চড়ে চললাম। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছার আগেই লাল কাদামাটির ইটের তৈরি শহরের প্রধান ফটকের ভেতর থেকে একদল নারী পুরুষ পুরোহিত আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে সামনে এগিয়ে এলো।

নদীর উজানে ব্যবিলন আর মাত্র একশো বিশ লিগ সামনে রয়েছে। সবেমাত্র বিশাল মরুভূমি পার হয়ে এসেছি, আর এখুনি রাজা নিমরদের রাজধানীতে পৌঁছাতে চাচ্ছিনা। আমি চাই আমাদের সম্পদ আর জাঁকজমক দেখিয়ে সুমেরিয়দের মাত করে দিতে। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তির পর আমাদের চেহারার যে অবস্থা হয়েছে তাতে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং সম্পদশালী রাষ্ট্রের প্রতিনিধির বদলে আমাদেরকে মরুভূমির একটি বেদুঈন যাযাবরের দল মনে হচ্ছে।

শোভাযাত্রাটি কাছে আসতেই আমি সামনের সারিতে পুরোহিত আর যাজিকাদের মাঝে রাষ্ট্রদূত ফাট তুরকে দেখেই চিনতে পারলাম। ফাট তুর হচ্ছেন সুমেরিয়ায় মিসরের রাষ্ট্রদূত। তার বর্তমান পদে আসার অনেক আগে থেকে আমরা পরস্পরকে চিনতাম। একজন পরিশ্রমী আর বিশ্বস্ত রাজকর্মকর্তা। সুতরাং আমি নিশ্চিত হলাম যে, ব্যবিলনে আমাদের পৌঁছার জন্য সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক মতোই করা হয়েছে। তাকে স্বাগত জানাবার জন্য আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলাম। তারপর দুজনে একসাথে নগরীর ফটকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো বন্ধুর মতো কথা বলে চললাম।

আপনার অনুরোধ মতো নদীপথে যাওয়ার জন্য আমি দশটি বড় আর আরামদায়ক বজরা ভাড়া করেছি। যাত্রার জন্য আপনি যখনই তৈরি হবেন তখনই এই বজরাগুলো রাজকুমারী আর আপনার প্রতিনিধি দলের বর্ষীয়ান সদস্যসহ আপনাকে নিয়ে নদীর উজানে ব্যবিলনের দিকে রওয়ানা দেবে। স্বভাবতঃ আমিও আপনাদের সাথে যাবো। তবে অত্যন্ত সম্মানের সাথে আমি আপনাকে জানাতে চাই, কাফেলার বড় অংশটির আগেই হাঁটাপথে ব্যবিলনে পৌঁছে সেখানে আপনার আগমনের জন্য অপেক্ষা করা উচিত।

ফাট তুর সেই বিশাল জিগুরাট অর্থাৎ সিঁড়ি-পিরামিড আকৃতির মন্দির এলাকায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে পৌঁছে সবাই স্থির হতে না হতেই সূর্যাস্তের সময় হল। থিবস থেকে যেসব সুন্দর পোশাক-আশাক, অলংকার ইত্যাদি সাজগোজের জিনিসগুলো আনা হয়েছে, আমি রাজকুমারী আর মেয়েদেরকে এবার সেগুলো বাক্স থেকে বের করতে বললাম। ব্যবিলনে রাজা নিমরদের দরবারে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ওরা এবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর ফিটফাট হওয়ার সুযোগে পেয়েছে।

রাজকুমারীদেরকে বুঝিয়ে বললাম, ওদের সাজসজ্জা আর সুন্দর চেহারা দিয়ে রাজা নিমরদ আর ক্রিটের রাষ্ট্রদূতকে মুগ্ধ করে দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেননা এই রাষ্ট্রদূতই আবার সমস্ত বিষয় তার প্রভু সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছে তুলে ধরবে।

সুবিশাল মন্দির চত্বরে বসে তারাভরা আকাশের নিচে ফাট তুর আর রেমরেমের সাথে নৈশভোজ করলাম। সকালেই ইউফ্রেটিস নদী থেকে ধরা এক হাত লম্বা পার্চ মাছ দিয়ে উদর পূর্তি করলাম। সেই সাথে নদীর তীরবর্তী বাগানের আঙুর চোলাই করে তৈরি করা লাল মদ পান করলাম।

খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের মূল উদ্দেশ্য–হাইকসোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনার আলোচনায় মনোযোগ দিলাম।

আপনারা জানেন আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজা নিমরদ আর সর্বাধিরাজ মিনোজ, উভয়কেই যেকোনো ভাবেই হোক ভুলিয়ে ভালিয়ে ফারাওয়ের সাথে একটি সামরিক মিলনের মধ্যে আনা। এটা অর্জন করতে পারলে আমরা রাজা গোরাবকে কামারের নেহাইয়ে ফেলে তিনটি হাতুড়ি দিয়ে পিষে তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারবো।

রেমরেম বললো, আপনার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলেও আমার নৈতিক উন্নতি হল না তায়তা। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কামারের। নেহাইটি কে আর হাতুড়িগুলোইবা কারা। আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। অনেক সময় রেমরেমের সাথে আলোচনা করার সময় মনে হয়, যেন একজন পঙ্গুকে পর্বতের উপরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে সাহায্য করতে হয়।

দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি একটি রূপক ব্যবহার করছিলাম। বিষয়টা আমার আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল। এখানে কামারের নেহাই হচ্ছে সাহারা মরুভূমি আর ক্রিট, সুমেরিয়া আর আমাদের মিসরের সেনাবাহিনী হচ্ছে হাতুড়ি।

রেমরেম বললো, তাহলে আপনার বলা উচিত ছিল গোরাবকে আমরা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবো। এই হাতুড়ি আর নেহাইয়ের কথা বলার বিষয়টা বেশ বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছিল। সরলভাবে সোজাসুজি কথা বললেই সবসময় ভালো হয়, তাই না?

কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম, আপনার পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশের জন্য ধন্যবাদ রেমরেম। তারপর প্রসঙ্গ পালটে বললাম, আসলে আমি যে বিষয়টা বলতে চাচ্ছি তা হল, হাইকসোদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমরা যেরকম অঙ্গীকারবদ্ধ সেরকম মনোভাব ক্রিট কিংবা সুমেরিয়ার নাও থাকতে পারে। তারপর ফাট তুরের দিকে ফিরে বললাম, আপনার কাছ থেকে এ-বিষয়ে রাজা নিমরদের অবস্থান জানতে পারলে আমি খুশি হব। সম্ভবত আপনি এব্যাপারে আরও কিছু আলোকপাত করতে পারবেন।

ফাট তুর সায় দিয়ে মাথা কাত করে বললো, আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আপনার মুখোমুখি হয়ে বিষয়গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার এই সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কেননা কবুতরের পায়ে বেধে যে বার্তা পাঠানো হয় তাতে সবকিছু খুলে বলা যায় না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ১৪ বছর আগে তারা বাবা রাজা মারদক মারা যাওয়ার পর নিমরদ উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনের অধিপতি হয়েছেন।

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি তা জানি।

রাজা মারদকের রাজত্বের শেষ ত্রিশ বছর ব্যবিলন পুণর্নির্মাণের কাজে কেটে যায়। তিনি একে সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর আর জমকালো নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

আসলেই আমি শুনেছিলাম যে মারদক বিশাল একটি কাজ করেছেন। তবুও আমার সন্দেহ থিবসের সৌন্দর্যের সাথে এর তুলনা চলে না।

এবার ফাট তুর মৃদু হেসে বললো, তাহলে আপনি সত্যি এবার অবাক হবেন। শোনা যায় রাজা মারদক এই পুনর্নির্মাণ কাজে ছয় লাখের উপর রূপা ব্যয় করেছেন। তবে এটি নিশ্চিত তার এই বাতিকের খরচ মেটাতে গিয়ে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যায়।

একথা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। উত্তর দিতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তারপর সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, আমি তো ভেবেছিলাম সুমেরিয়া ক্রিটের চেয়েও সম্পদশালী একটি রাষ্ট্র।

হ্যাঁ, অধিকাংশ লোক তাই মনে করে। আমি গত পাঁচ বছর ধরে ব্যবিলনে বসবাস করছি আর প্রথম প্রথম আমিও সুমেরিয়ার অতুল সম্পদের কাহিনী বিশ্বাস করতাম। মাত্র কিছুদিন হল আসল সত্যিটা জেনেছি। মন্ত্রীদের বেতন দেওয়ার মতোও যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজা নিমরদের নেই। তার বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন। অস্ত্রশস্ত্র আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে সামরিক বাহিনী অথর্ব হয়ে রয়েছে। বেতন না পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি হয়তো হাইকসোদের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য যথাযথ সৈন্য সমাবেশ করতে পারবেন না, যদিও তিনি ভালোভাবেই জানেন তার দেশে বিপদের আশঙ্কা আছে।

রেমরেম আর আমি উভয়েই নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

রেমরেমের মুখের ভাব বদলে গেল। আমি জানি সে বুঝতে পেরেছে তার সমস্ত আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সে নিশ্চিত ছিল যে সুমেরিয়ার রাজা নিমরদ আমাদের একজন শক্তিশালী মিত্র হবে। তার সে আশায় ফাট তুর পানি ঢেলে দিয়েছে।

এদিকে আমি অবশ্য অনুপ্রাণিত হলাম। আমার কাছে এখন সামনে যাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়েছে। নিমরদ এখন দেউলিয়া হয়েছে। সে তার দেশ আর সেনাবাহিনী হারাবার পথে। নিদারুন হতাশায় সে নিশ্চয়ই এখন ভয়ভাবনাহীন এবং যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে অকুণ্ঠিত। আমার কাছে প্রায় দশ লাখ রূপা আছে। চারচাকার ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে কাঠের নকল তক্তার নিচে আর উটের দুইপাশে ঝুলানো থলেতে এগুলো লুকানো রয়েছে। এছাড়া রাজার উপত্যকায় ফারাওয়ের রাজকোষে শত শত লাখ রূপা মজুত রয়েছে। সুতরাং রাজা নিমরদ আর সুমেরিয়া এখন আমাদের। আমি তাকে যে কোনো দাম হাঁকতে পারবো, সে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।

প্রথম হাতুড়িটি এখন আমার হাতে এসে গেছে। যদিও আমার শব্দচয়নে রেমরেম বেশ কিছুক্ষণ গাইগুই করলো। অন্য হাতুড়িটি ক্রিট দ্বীপে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপার বিনিময়ে এর মূল্য সামান্য। তবে কৃপণতা আর হৃদয়বিদারণের মূল্য অনেক বেশি হতে পারে।

.

পরদিন সকালে নতুন প্রেরণা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। আমার প্রধান ক্রীতদাস রুস্তি প্রাতরাশ নিয়ে এল। আর সেই সাথে আমার প্রিয় মদও আনলো। মদের গোলাপজল মিশিয়ে চত্বরে পায়চারি করতে করতে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নিচের বিশাল নদীর দিকে তাকালাম। সময়ের শুরু থেকেই এই নদীটি ছিল ইতিহাসের একটি কেন্দ্রবিন্দু।

রাজা নিমরদের আর্থিক দূরবস্থার সংবাদ, চোখের সামনে বিশাল নদী আর দূরের বরফাচ্ছাদিত পর্বত চূড়ার সৌন্দর্য আর হাতে সুস্বাদু মদের গ্লাস থাকা সত্ত্বেও আমি অনুভব করলাম আমার মনের ফুর্তি উবে যাচ্ছিল। আমি জানি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। মাথার চারদিকে একটা মশার মতো এটি গুঞ্জন করছে তবে আমি তাড়াতে চেষ্টা করেও তা করতে পারছিলাম না।

অরেকবার পায়চারি করে ঘুরতেই দেখলাম রুস্তি আমার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সে বললো, কিছু হয়েছে প্রভু?

আমি তাকে আস্বস্ত করে বললাম, এমন কিছু নেই যা সামলানো যায় না। তারপর লেখার টেবিলে গিয়ে এক টুকরা প্যাপিরাসে কিছু লিখলাম। কাগজটা ভাঁজ করে রুস্তির হাতে দিয়ে বললাম, এখুনি এটি মহামান্য রাজকুমারী তেহুতির কাছে গিয়ে শুধু তার হাতে দেবে। তারপর প্রধান সহিসের কাছে গিয়ে বলবে দুটো ভালো ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে বাইরে উঠানে প্রস্তুত করে রাখতে। আমি এখুনি সেখানে যাচ্ছি, সে যেন আমাকে অপেক্ষা করিয়ে না রাখে। রুস্তি আমার নির্দেশ পালন করতে ছুটে গেল।

আমি যা করতে চাই তা এই মন্দির এলাকায় সম্ভব নয়। কোনো সন্দেহ নেই এখানে পাথরের দেয়ালে ছোট ছোট কুঠরি, গোপন জানালা আছে আর কথা শোনার মতো গুপ্ত স্থানে রাজা নিমরদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা, নিদেন পক্ষে পুরোহিতদের চরেরাও কান পেতে রয়েছে।

পেয়ালার বাকি মদটুকু শেষ করে দ্রুত পাশের কামরায় গিয়ে ঘোড়ায় চড়ার পোশাকটা পরলাম। তারপর নিচে নেমে ভবনটির পেছনে আস্তাবলে গেলাম। তেহুতি প্রায় আধা ঘন্টা পর এলো। তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল। হাসি হাসি মুখে তার সুন্দর চেহারায় এমন একটি রূপ ধারণ করেছে যা আর কখনও দেখা যায় নি। সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, তারপর পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বললো, রুস্তি বললো, তুমি নাকি আমাকে একটা গোপন কথা বলবে। তাই সে জানাল অন্য মেয়েদেরকে যেন না জানাই যে আমি তোমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তারপর সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এবার বল! কী বলবে তায়তা। তুমি তো জানো গোপন বিষয় জানার জন্য আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি না।

সে বার বার অনুরোধ করলেও আমি তার কথায় কান না দিয়ে বললাম, চল এমন কোথায় যাই যেখানে আমরা একা হতে পারি। তারপর তাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দিলাম। দুজনে ঘোড়ায় চড়ে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে পৌঁছার পর আমি ঘোড়ার গতি কমিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চললাম। দুজন পাশাপাশি চলতে লাগলাম।

তুমি এমন নিষ্ঠুর কেন হচ্ছো? আমি জানি তুমি আমার জন্য একটা উপহার এনেছো। অসিরিসের দিব্যি আমি আর এক মুহূর্ত দেরি সহ্য করতে পারছি না।

এবার তোমার জন্য আমি কোনো উপহার আনিনি। আমার শুধু একটা সহজ প্রশ্ন আছে। ময়াগুহা থেকে তুমি আর জারাস ফিরে আসার কত দিন হল?

ওহ, এটা তো বেশ সহজ প্রশ্ন। তারপর মাথার উপরে সূর্যের উচ্চতা অনুমাণ করে বললো, তেতাল্লিশ দিন আর প্রায় নয় ঘন্টা।

আমি মাথা নেড়ে বলো, তারপর কখন তুমি কিছু হারিয়েছ?

না তো এই যে দেখো! আংটিটা এখনও আমার আঙুলে রয়েছে। এই কথা বলে সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হীরাটা তার আঙুলে জ্বলজ্বল করছে।

আমি কোনো কথা না বলে ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে তাকালাম। আমি চুপ করে থাকায় কিছুক্ষণ পর তার মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর অভিব্যক্তি ধারণ করলো। তারপর হঠাৎ সে বুঝতে পারলো আমার প্রশ্নটা কোনদিকে যাচ্ছে। এবার সে চোখ নামিয়ে নিল।

একটু কঠিন স্বরে আমি বললাম, তুমি আমাকে বলতে ভুলে গেছ যে তাই না তেহুতি? প্রায় এক মাস হল তোমার রজঃস্রাব হয়নি, অথচ আমাকে কথা দেওয়া সত্ত্বেও তুমি এই সত্যটা আমার কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করেছ।

সে ফিসফিস করে বললো, আমি তোমার সাথে প্রতারণা করতে চাই নি। আমি শুধু আর কিছুদিন বাচ্চাটাকে আমার ভেতরে জীবিত রাখতে চেয়েছি। আমি অবশ্যই তোমাকে বলতাম তায়তা। বিশ্বাস কর সত্যি বলতাম।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলতে, তবে অনেক দেরি করে। তোমার এই হঠকারিতা আর স্বার্থপরতা দিয়ে তুমি নিজের জীবন আর মিসরের রাজপরিবারকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছ।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বললো, আর কখনও এরকম করবো না তায়তা। তারপর চোখের পানি লুকাতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

আমি রাগত স্বরে বললাম, তা তো বলবেই। এসো আমার সাথে।

কোথায় যাবো?

মন্দির প্রাঙ্গণে আমার কামরায়।

নিচে আস্তাবলে তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে আমি একটা আরক তৈরি করে রেখেছিলাম। এক ধরনের বুনো কাটা গাছের শুকনো ছাল পানিতে ফুটিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। এটা নীল নদীর উৎসের ওপারে অনেক দূরের পতিত জায়গা থেকে এনেছিলাম। ফিরে আসার পর দেখলাম বিষাক্ত রসটা ইতোমধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তেহুতিকে শোবার ঘরের একটা কৌচে বসতে বললাম। তারপর পেয়ালাটা এনে কালো চোলাইকরা রস পুরোটা তাকে খাওয়ালাম। রসটা পিত্তকোষের মত তিক্ত কিন্তু তারপরও রেহাই দিলাম না। তিনবার সে বমি করে রসটা উগড়ে ফেলতে চেষ্টা করলো কিন্তু আমি শক্ত রইলাম।

পেয়ালাটা শূন্য হওয়ার পর তার চেহারা দেখে মায়া হল। ইতোমধ্যে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে প্রায় সাদা হয়ে গেছে, চোখদুটো রক্তলাল আর পানিতে টলটল করছে।

আমি সত্যি দুঃখিত তায়তা। খুব বোকামি করেছি। আমি তোমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি, জানি আর কখনও তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।

তার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, তারপর তার কান্না থামা পর্যন্ত তাকে ধরে দোলাতে থাকলাম। যখন সে ঘুমিয়ে পড়লো তখন একটা পশমি কম্বল দিয়ে তার শরীর ঢেকে দিলাম। তারপর নিচে গিয়ে বাকি দুটি মেয়ের সাথে দেখা করলাম। ওদেরকে বুঝিয়ে বললাম তেহুতি হঠাৎ একধরনের সংক্রামক আর ক্ষতিকারক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। ছোঁয়াচে এই জ্বর যাতে ওদের মধ্যে সংক্রমণ না হয় তাই তেহুতি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে দেখা করা যাবে না।

তারপর তেহুতি যেখানে শুয়েছিল সেখানে ফিরে গেলাম। এরপরের যন্ত্রণাদায়ক দুটি দিন তার পাশেই কাটালাম। দিনের বেলা গল্প বলে, বীণা বাজিয়ে আর তার প্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনালাম। আর রাতে একটা অসুস্থ শিশুর মতো তার সেবাশুশ্রূষা করতে লাগলাম যতক্ষণ না অষুধের প্রভাবে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

তৃতীয় রাতে তার গোঙানী আর প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরানি শুনে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমি তাকে দুহাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দোলাতে লাগলাম আর নানারকম প্রবোধবাক্য শোনাতে লাগলাম। তারপর একসময় অনুভব করলাম তার গর্ভে মোচড়ানি শুরু হয়েছে। আমি তার পেট মালিশ করতে লাগলাম যাতে ব্যথা কম হয় আর মরা জিনিসটি বের করাতে ভালো দেবতার কাজে সহায়তা করে।

শেষ পর্যন্ত হঠাৎ তীব্রবেগে এক ঝলক রক্ত আর শ্লেষ্মর সাথে এটা বের হতেই সে কোনোমতে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসে এটা দেখতে চাইল।

গর্ভের ফুলের সাথে শ্লেষ্ম আর রক্তমাখা এমন নোংরা একটি ছোট্ট মানব স্ক্রন লেগে রয়েছে যে, এটা দেখলে সে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন দেখবে। তার অনুরোধ উপেক্ষা করে প্রাণহীন ছোট্ট জিনিসটি কাচিয়ে নিয়ে আমার রূপার মদের পাত্রে ভরলাম। তারপর রাত হতেই গোপনে আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নদীর তীরে গভীর জঙ্গলে গেলাম। সেখানে নদীর তীরে একটি বড় গাছের নিচে সেই ছোট্ট রূপার শবাধারে ভ্রুণটি মাটি চাপা দিলাম। তারপর সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসে এই ছোট্ট আত্মাটির মঙ্গল কামনা করে শিশুদের দেবী আইসিসের কাছে প্রার্থনা করলাম।

আমার কামরায় ফিরে গিয়ে ভাবলাম তেহুতি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তার পাশে গিয়ে দেখলাম সে তখনও কাঁদছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম।

.

এরপর আর বারোটি রাত উরের মন্দির এলাকায় কাটালাম। ইতোমধ্যে তেহুতি তার ধকল সামলে সুস্থ হয়েছে আর চেহারায় আগের সৌন্দর্য ফিরে এসেছে।

শেষদিন রেমরেমকে নিয়ে আমি নগরীর ফটক দিয়ে বের হলাম। তাঁবুগুলো গুটিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে ভারবাহি পশুগুলোর পিঠে তুলে ফেলা হয়েছে। এখন আমরা ব্যবিলনের পথে দীর্ঘ সফরের শেষ অংশ পাড়ি দেবার জন্য তৈরি।

রেমরেমের দেহরক্ষী দল তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি তাকে বিদায় জানালাম। সে একজন দক্ষ সেনানায়ক এবং ভদ্রলোক।

আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম সে তার কাফেলার একেবারে সামনে গিয়ে অন্যান্য সেনানায়কদের মাঝে অবস্থান নিল। তারপর ডান হাত উপরে তুলতেই সামনে এগোবার নির্দেশ দিয়ে শিঙা বেজে উঠলো। ঢাক পেটাবার তালে তালে ওরা হেঁটে চললো। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আমি উরের দিকে ফিরে চললাম।

নদীর তীরে এসে দেখলাম রাজকুমারীরা দলের অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে জাহাজঘাটে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ফাট তুর আমাদের জন্য যে বজরাগুলো ভাড়া করেছিল সেগুলো মাঝ নদীতে নোঙর করা রয়েছে। রঙিন পতাকা আর কাগজ দিয়ে এগুলো সজ্জিত করা হয়েছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আমি রাজকুমারীদেরকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে প্রথম বজরাটি নোঙর তুলে জাহাজঘাটে এলো। ফাট তুর পেশাগত দক্ষতার সাথে মাঝিমাল্লাদের যথাযথ নির্দেশ দিয়ে তৈরি করে রেখেছিল। সে রাজকুমারীদেরকে প্রথম বজরায় উঠিয়ে পেছনের দিকে একটি চমৎকার ডেকে বসাল। পরিচারকরা সোনার পাত্রে তাদেরকে শীতল মধূর শরবত পরিবেশন করলো। বিশেষভাবে সংরক্ষিত তাপনিরোধক বাক্সে জাগরোস পর্বতচূড়া থেকে দ্রুতগামি রথে করে বরফ এনে এই শরবত ঠাণ্ডা করা হয়েছে। রাজকুমারী কখনও এরকম সুশীতল এবং সুমিষ্ট শরবত পান করেনি। ওরা খুশিতে মাতোয়ারা হল।

জোর হাওয়া এসে পাল ফুলিয়ে নিয়ে বিশাল নদীর বুকে বজরাটি দ্রুত ভেসে চললো। খোলা ডেকে শিল্পীরা যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগলো, ভাঁড় আর হাতের ভেল্কি দেখিয়ে অন্যান্য পেশাদার বিনোদনকারীরাও তাদের পরিবেশনা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলো। বেকাথা আমাকে বাও খেলায় হারাল আর জারাস তেহুতিকে তার সাম্প্রতিক কবিতা আবৃত্তি করে শোনাল। এসব কবিতা অবশ্য যুদ্ধ জয়ের বর্ণনা আর মৃত্যুর কথা ছিল না। এতে ছিল ভগ্ন হৃদয় আর প্রতিদানহীন আবেগের কথা, যা রাজপরিবারের অন্তত একটি সদস্যের চোখে অশ্রু এনে দিয়েছিল।

বিনোদনের পাশাপাশি আমি ফাট তুরের সাথে পরামর্শ করতে লাগলাম কীভাবে রাজা নিমরদের সেনাবাহিনী আর রথীদের কাজে লাগানো যায়।

.

আমার জীবনে এমন অবাক খুব বেশি হই নি। নগরীর যে বর্ণনা শুনে আমি মনে করেছিলাম অতিশয়োক্তি এখন মনে হল তা আসলে কম বলা হয়েছিল।

নদীর দুই তীর জুড়ে বিস্তৃত এই উজ্জ্বল চকচকে নগরীর তুলনায় একশো ফটকসহ আমার সুন্দর থিবসকে একটি সাদামাটা গ্রাম মনে হল। এর আগে বিভিন্ন অট্টালিকার যেসব চিত্র আর স্কেচ আমি দেখেছিলাম এখন সেই স্থাপনাগুলো দেখে চিনতে পারলাম। তবে এই বিস্ময়বহ কর্মগুলোকে প্যাপিরাসে তুলে ধরাটা অনেকটা এক বালতি লোনা পানিতে মধ্য সাগরকে দেখানোর মতো মনে হল।

চকচকে সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি মারদুকের প্রাসাদটি নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। ফাট তুর গলুইয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার সন্দেহ নিরসন করে তা নিশ্চিত করলো।

পুব থেকে পশ্চিমে প্রাসাদটি অর্ধলিগ পর্যন্ত বিস্তৃত আর থিবসের ফারাওয়ের প্রাসাদের তিনগুণ উঁচু। এর সামনের দিকে নদীর উত্তর দিকে রয়েছে ঝুলন্ত উদ্যান। মারদুক এমনভাবে এটি তৈরি করেছে যাতে প্রাসাদের প্রত্যেক অলিন্দ আর বারান্দা থেকে এই চমৎকার জিনিসটি সম্পূর্ণভাবে দেখা যায়।

প্রাসাদের সামনে অনেক উঁচুতে কতগুলো খোলা গ্যালারির সমন্বয়ে বাগানটি গড়ে উঠেছে। মারদুকের স্থপতিরা তাদের সৃজনী ক্ষমতা দিয়ে এমন একটি দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করেছিল যেন বাগানগুলো মাটির উপর দাঁড়িয়ে নেই, এগুলো অলৌকিকভাবে আকাশ থেকে ঝুলে রয়েছে। এগুলো এমন কোণে কাত করা রয়েছে যে, নদীর বিপরীত তীরে প্রাসাদ থেকে একজন পর্যবেক্ষক গ্যালারি জুড়ে একটি অরণ্য সৃষ্টি করা প্রতিটি গাছ আর চারা দেখতে পাবে।

নীল নদীর তীরে মেশিরে বিরাট এলাকা জুড়ে ফারাও আমাকে যে জমি দান করেছিলেন, তারপর থেকেই বৃক্ষরোপনের বিষয়ে আমার আগ্রহ আচ্ছন্নতার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এখন আকাশের বুকে এই চমৎকার বাগানটি দেখে আমার নিজের উর্বর জমিগুলোকে নগণ্য মনে হল।

শূন্যে এই বাগানগুলো দেখে আমি ফাট তুরকে বললাম, আমি গাছ আর সবুজ বনানী ভালোবাসি। এটি আমার মনে আনন্দ দেয় আর আত্মার প্রশান্তি এনে দেয়।

ফাট তুর শুষ্ক মন্তব্য করলো, রাজা মারদুক নিশ্চয়ই আপনার মতোই গাছপালা ভালোবাসতেন। তবে এই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তিনি তার জাতিকে দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেন।

ভাবলাম প্রসঙ্গটা এখন পরিবর্তন করলেই ভালো হবে। রাষ্ট্রদূত জানে না যে আমার উটের হাওদার থলেগুলোতে বিশাল রূপার ভান্ডার আছে। তার একটি অসতর্ক মন্তব্য রাজা নিমরদকে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সাবধান করে দিতে পারে। প্রত্যেক শাসকই অর্থের জন্য ভেতরে ভেতরে লোলুপ দস্যু আর হিংস্র শিকারী হয়ে উঠে। আর নিমরদও যে সেরকম হয়ে উঠবে না তা ভাবার কোনো কারণ নেই।

আমি ফাট তুরকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা এই গাছগুলোতে কীভাবে পানি দেয়?

নদীর বুক থেকে বাগানের উপরের গ্যালারির সর্বোচ্চ বিন্দুতে বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া ব্রোঞ্জের স্তম্ভগুলো দেখিয়ে সে বললো, রাজা মারদকের প্রকৌশলীরা ঐ পানির প্যাঁচকলগুলো বানিয়েছে। আমি আরও ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম স্তম্ভগুলো আসলে কতগুলো ফাপা নল, ধীরে ধীরে ঘুরছে।

এগুলো কীভাবে ঘুরছে?

ফাট তুর ব্যাখ্যা করলো, আপনি তাকালে দেখতে পাবেন, এগুলোর উপরে বাতাস কল রয়েছে। আর নদীতে পানি চালিত পাম্প আছে। নলের মধ্যে যে প্যাঁচগুলো আছে নদীর স্রোতের টানে তা ঘুরতে থাকে। ঘূর্ণায়মান প্যাঁচগুলো হাতার মতো পানি উপরের দিকে নলের একেবারে মাথায় উঠিয়ে নেয়। তারপর উপরের দিকে নির্দেশ করে বললো, ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন?

আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম নদীর পানি উপরে উঠে নলের মাথার শেষ প্রান্ত থেকে একটি নালার মাধ্যমে থেকে নিচে গ্যালারীর সবজায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। কী সহজ পরিকল্পনা অথচ কি সুন্দর। এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় কেন আসেনি ভেবে আমি লজ্জিত হলাম। মেশিরে আমার বাগানে ফেরার সাথে সাথে এই পরিকল্পনাটি কাজে লাগাবো। আমার জমিতে সার ব্যবহার করে উৎপাদন চারগুণ বাড়িয়েছি। আর এরকম পাঁচকলের মাধ্যমে জমিতে পানি ঢেলে তা আরও দ্বিগুণ করে তুলতে পারি। অবশ্য থিবসে কাউকেই বলার দরকার নেই যে এটা আমার আবিষ্কার নয়। মিসরে সবাই আমার সৃজনী ক্ষমতাকে সম্মানের চোখে দেখে। তাদের এই ধারণা বদলে দেবার কোনো দরকার নেই।

খুব উঁচু একটা পাথরের অট্টালিকা দেখিয়ে আমি বললাম, বাগানের পেছনে ঐ অট্টালিকাটা কী? এটা এতো উঁচু যেন পারস্য উপসাগর থেকে ভেসে আসা মেঘের পেটের সাথে এটা ঘষা খাচ্ছে।

এটা হচ্ছে দেবী ইশতারের পবিত্র মেঘের অট্টালিকা। নিজেকে দেবত্বের পর্যায়ে উন্নিত করার পর রাজা মারদুক এটি বানিয়েছিলেন। তিনি দেবী ইশতারকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আপনিতো জানেন তায়তা, ইশতার হচ্ছেন ভালোবাসা, যৌনতা এবং যুদ্ধ জয়ের দেবী। এগুলোই মারদকের সবচেয়ে আকাঙ্খিত বস্তু ছিল। তিনি এই সূউচ্চ অট্টালিকাটি নির্মাণের নির্দেশ দেন যাতে ইশতার তার সম্পদ এবং ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে নিচে নেমে এই অট্টালিকার মাথায় অবতরণ করেন আর তিনি তাকে বিয়ে করতে পারেন। তারপর স্বামী স্ত্রী হিসেবে ওরা দুজন সমস্ত সৃষ্টিকে শাসন করতে পারেন। তবে দুঃখের বিষয়, এই অট্টালিকা এর পরিকল্পিত উচ্চতায় পৌঁছাবার আগেই মারদক মৃত্যু বরণ করেন। অতএব ইশতারেরও আর পৃথিবীর বুকে নামা হল না। অদৃষ্টের এই পরিহাসের কথা চিন্তা করে ফাট তুর জিহ্বা চুক চুক করলো আর আমিও মৃদু হাসলাম।

আমি বললাম, এখন এই অট্টলিকার কি হবে?

মারদক এটি তার ছেলে, বর্তমান রাজা নিমরদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একটু পরই তার সাথে আপনার দেখা হবে। তবে নিমরদের এতো সম্পদও নেই আর ইচ্ছাও নেই, যে তার বাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী ইশতারকে প্রলুব্ধ করে তার স্বর্গীয় আবাস থেকে নিচে নামিয়ে আনে।

আমি বললাম, আমি শুনেছি লোকে বলাবলি করছে যে, নিমরদ একজন মস্ত শিকারী। তিনি নাকি জাগরোস পর্বতে একশো সিংহ আর একশো বিশাল বাইসন মেরেছেন। এতো বড় একজন শিকারী হলে তো তার নিশ্চয়ই নারীর প্রতিও আকর্ষণ আছে? তাহলে তিনি কেন দেবীর সাথে প্রেমবিলাসের এই সুযোগটি ছেড়ে দিলেন?

আমার বিশ্বাস দেবীকে শয্যা সঙ্গিনী হিসেবে পেতে তিনি নিশ্চয়ই ভালোবাসবেন। শোনা যায় একজন দক্ষ শিকারীর মতো একাজেও তিনি একজন ভালো খেলোয়াড়। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তার কোষাগারের অর্থের পরিমাণ তার বিশেষ অঙ্গের মতো প্রসারিত হয় না।

রাজা নিমরদের প্রাসাদটি ভালোভাবে দেখার জন্য আমি ফাট তুরের হাত ধরে তাকে বজরার অন্য পাশে নিয়ে গেলাম। বিশাল ভবনটির আকার আর জাকজমক দেখে আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর একটু সামনে প্রাসাদের পাশেই একটি বিশাল মন্দিরের দিকে আমার চোখ পড়লো।

ইউফ্রেটিস নদীর তীরে পৌঁছার পর শালদিসের উরের যে মন্দির চত্বরে আমরা থেকেছিলাম তার চেয়ে তিনচারগুণ বড়। পিরামিড আকৃতির না হয়ে এটি গোলাকার। মূল ভবনটির চতুর্দিক ঘিরে চত্বর মাটি থেকে একেবারে চূড়া পর্যন্ত উঠে গেছে।

আমার নজর এই ভবনটির দিকে লক্ষ্য করে ফাট তুর বললো, এটি হচ্ছে ইশতার দেবীর মন্দির। তবে দেবীর অট্টালিকার সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে ফেলবেন না। এটি একটি চমৎকার স্থান। এর চারদেয়ালের মাঝে যে ধরনের উৎসব হয় তা বর্ণনা করা যায় না। বরং আমি আমি প্রথম সুযোগেই এর ভেতরে নিয়ে যাবো যাতে আপনি তা চাক্ষুষ উপভোগ করতে পারেন।

আমি বললাম, আপনি আমার মাঝে বেশ কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছেন ফাট তুর।

সে রহস্যজনকভাবে হেসে বললো, আপনার কৌতূহলে সন্তুষ্টি জোগাতে পারলে আমি খুশি হব। তারপর সে প্রাসাদের দেয়ালের নিচে নদীর তীরে পাথরের জেটিতে ভীড় করে থাকা জমকালো পোশাক পরা একদল লোককে দেখিয়ে বললো:

ফারাওয়ের দূত এবং রাজকীয় বাজপাখির সিলমোহরের ধারক হিসেবে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাজা নিমরদের রাজদরবারের প্রধান ব্যক্তি সম্মানিত রাজসদস্য তুগার্টা আর অন্যান্য বিশিষ্ট সভাসদগণ সমবেত হয়েছে। এটি অত্যন্ত সম্মানসূচক একটি ঘটনা। মহামান্য রাজা নিজে আপনাকে স্বাগত জানাতে প্রাসাদের রাজদরবারে অপেক্ষা করছেন।

আমি দ্রুত হেঁটে ডেকের অন্যধারে যেখানে রাজকুমারীরা তাদের ক্রীতদাস-দাসীদের দ্বারা ঘিরে ছিলেন সেখানে গেলাম। জেটিতে অভ্যর্থনা দলের সদস্যদের দেখাবার জন্য আমি বেশ নিচু হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাদেরকে অভিবাদন করলাম আর সেই সাথে ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিলাম মিসরের ফারাও রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে যথাযথ আচরণ করতে যা, আমি তাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমি ফাট তুরকে পাশে নিয়ে তাদের পেছনে অবস্থান নিলাম।

বজরা জেটির কাছাকাছি আসতেই আমি সুমেরিয় অভিজাত দলটির সদস্যদের লক্ষ্য করার সুযোগ পেলাম।

প্রথমেই আমার চোখে পড়লো মেয়েরা এমনকি বয়স্করাও তাদের পুরুষ সহযোগীদের চেয়ে বেশ সুন্দর। তাদের তামাটে রংয়ের চামড়া উজ্জ্বল চকচকে এবং মসৃণ। গভীররাতের মতো কালো চুল আর নীলচে-কালো দুইচোখে রঙ মাখা। সবার মাঝে একধরনের সহজাত মর্যাদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কঠিন চেহারার পুরুষেরা বেশ লম্বা। লম্বা নাক বাঁকা। উঁচু চিবুক। আর কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। দীর্ঘ ঢেউ খেলানো দাড়ি কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। নারী পুরুষ সবাই গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা বিভিন্ন ধরনের নকশা করা পশমী পোশাক পরে রয়েছে।

কোনো ভুল নেই এখানে অভিজাত, যোদ্ধা এবং শক্তিশালী নারী পুরুষের সমাবেশ হয়েছে।

পাথরের জেটি থেকে একটি সুসজ্জিত কাঠের সিঁড়ি বজরায় নামিয়ে দেওয়া হল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে তীরে নেমে রাজসদস্য তুগার্টার সামনে এলাম। ফাট তুর আমাদের দোভাষী হিসেবে কাজ করলো। আমি প্রশান্ত গাম্ভীর্য বজায় রেখে পেছনেই রইলাম। আমি চাই না যে আমাদের আতিথ্যকর্তারা জানুক যে, আমি তাদের ভাষা জানি। সামনে অনেক কঠিন দর কষাকষির ব্যাপার আছে কাজেই যতটুকু সম্ভব সুবিধা পাওয়া যায় তা আদায় করতে হবে।

জেটি থেকে তুগার্টার নেতৃত্বে শোভাযাত্রা করে আমরা প্রাসাদের রাজদরবার কক্ষের দিকে এগোলাম। উঁচু ছাদওয়ালা গুহার মতো একটা কামরা। যুদ্ধক্ষেত্র এবং শিকারের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন দেয়ালে ঝুলানো রয়েছে। এসব প্রদর্শনী থেকে আপাত বুঝা যাচ্ছে যে, রাজা নিমরদ একশোরও বেশি সিংহ এবং বাইসন শিকার করেছেন। শিকারের পশুর মাথা ও চামড়া আর মানুষের ঘাম মিশ্রিত দুর্গন্ধে কামরাটির পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে রয়েছে। ফাট তুর অবশ্য আমাকে আগেই বলেছিল যে, সুমেরিয়রা স্নান করাটাকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মনে করে।

রত্নখচিত সাদা মার্বেল পাথরের বেদীর উপর সোনা ও হাতির দাঁতের সিংহাসন থেকে রাজা নিমরদ উঠে দাঁড়াতেই আমি লক্ষ্য করলাম, তার প্রজাদের চেয়ে তিনি অনেক লম্বা। চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল হাত। প্রত্যেক আঙুলে আংটিপরা ডান হাত উঠিয়ে তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। চওড়া হাতটি দেখে আমার মনে হল এই হাত দিয়ে তিনি আমার মাথা ঢেকে ফেলতে পারবেন। আমার দুই রাজকুমারীর দিকে যখন তাকালেন, তখন তার কালো চোখে লালসা ফুটে উঠলো। সাথে সাথে আমি বুঝতে পারলাম সে যেমন একজন শক্তিশালী শিকারী সেই সাথে একজন লম্পটও বটে।

পরবর্তী কয়েক ঘন্টা দোভাষীর মাধ্যমে আমরা কেবল গতানুগতিক আর কৃত্রিম সৌজন্যসূচক কথা এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে কাটালাম। তারপর রাজা নিমরদ বিশ্রামের জন্য চলে যাওয়ার পর আমাদেরকে প্রাসাদে আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল।

আমার থাকার জন্য যে কামরাগুলো নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, তা দেখে আমি বুঝতে পারলাম ওরা আমার গুরুত্ব এবং পদমর্যাদা বুঝতে পেরে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়েছে। বড় বড় কামরাগুলো নদীর দিকে মুখ করা, যথেষ্ট আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। আর সামনেই ইশতার দেবীর মন্দির। দামী কাঠের আসবাব দিয়ে কামরাগুলো সজ্জিত। পর্দাগুলো পশমী এবং দামী রেশমি কাপড়ের। বিশাল আর অস্বাভাবিক আকারের বিছানাটি দেখে আমি ঠিক করলাম অন্য কোথাও শোবো।

ফাট তুরের সাহায্য নিয়ে প্রাসাদের কয়েকজন কর্মীকে দিয়ে গরম পানির বড় বড় কয়েকটা বালতি ঘরের বাইরে বারান্দায় আনার ব্যবস্থা করলাম। তারপর পোশাক খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসতেই আমার ক্রীতদাসেরা আমার মাথা আর শরীরে পানি ঢালতে শুরু করলো। স্নান শেষ করতেই সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়লো। তারপরও গরম তখনও কমেনি। সন্ধ্যায় পূর্ব দিগন্তে বরফে ঢাকা জাগোস পর্বত চূড়া থেকে মিষ্টি শীতল বাতাস বইতে শুরু করলো।

স্নান সমাপনের পর ক্রীতদাসদের বিদায় দিয়ে আমি নগ্ন অবস্থায়ই আরও কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। অস্তমান সূর্য আর নিচে নদীর বুকে আলোর খেলা দেখে আনন্দে সময় কাটালাম।

হঠাৎ মনে হল কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে। দ্রুত ঘুরে সামনে রাজপ্রাসাদের পাশেই উঁচু মন্দিরের দিকে তাকালাম। মন্দিরের চত্বরগুলো আমার খুব কাছ দিয়ে ঘুরে ঘুরে মাটি থেকে চূড়া পর্যন্ত উঠে গেছে। এতো কাছে যে আমি বেশ সহজেই এর উপর একটা পাথর ছুঁড়ে মারতে পারি।

আমার ঠিক উল্টো দিকে চত্বরে আপাদ মস্তক আলখাল্লায় ঢাকা একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথা ঢাকা কাপড়ের ছায়ায় চোখদুটো দেখা না গেলেও অনুভব করলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে দেখা সত্ত্বেও আমি স্বচ্ছন্দেই রইলাম। তবে অচেনা মানুষটির পরিচয় জানতে আমার ভীষণ কৌতূহল হল। আমি যথেষ্ট সচেতন যে, অনেক আগের কয়েকটা ক্ষতের দাগ ছাড়া আমার দেহ দীর্ঘ এবং অত্যন্ত সুগঠিত। প্রচুর ঘোড়দৌড় আর ব্যায়ামের ফলে দেহের পেশিগুলো শানানো রয়েছে। বিনয়ের কারণে সাধারণত আমি নিজেকে সুন্দর হিসেবে বর্ণনা করি না, তবে সতোর কারণে এই মুহূর্তে নিজেকে তাই বলা দরকার।

অচেনা মানুষটি আর আমি দুজনেই শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। তারপর আপাদমস্তক আলখাল্লা ঢাকা মূর্তিটি দুই হাত তুলে মাথা ঢাকা কাপড়টি কাঁধের চারদিকে ফেলে দিল। প্রথমে আমার ধারণা ছিল লোকটি একজন পুরুষ, কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হল।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপূর্ব সুন্দরী একজন নারী। দিব্যকান্তি অপরূপ সুন্দর মুখটি দেখে আমার তীব্র মানসিক কষ্ট হল। এই রূপ বর্ণনা করার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমাদের মহান ভাষার অতিশয়ার্থবাচক সমস্ত শব্দ এর সামনে ম্লান আর গতানুগতিক মনে হল। এমন হৃদয় বিদীর্ণ করা ভাবোচ্ছ্বাস আমি কখনও অনুভব করিনি। এযাবত যার জন্য ক্ষুধার্ত ছিলাম কিন্তু কখনও তা পাই নি তা এখানেই রয়েছে। অমূল্য যে বস্তুটি ভাগ্য সবসময় আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছিল। নারীত্বের মহত্তম রূপটি এখানে উপস্থিত।

নিষ্ফল প্রয়াস জেনে বুঝেও ধীরে ধীরে তার দিকে হাত বাড়ালাম। ভালো করেই জানি এমন অপূর্ব বস্তু সবসময় আমার ধরাছোঁয়ার অনেক দূরে রয়ে যাবে। তবে চিরদিন আমার স্মৃতিতে অম্লান থাকবে।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কষ্টের হাসি হাসলেন। আমার প্রতি যে কষ্ট আর গভীর অনুতাপ বয়ে এনেছেন তার জন্য সমবেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। তারপর আবার মুখমাথা ঢাকা কাপড়টা দিয়ে মাথা ঢেকে আমার দিক থেকে ঘুরে মন্দিরের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমাকে শোকে নিমজ্জিত করে চলে গেলেন।

.

ভাবলাম আর কখনও হয়তো ঘুমাতে পারবো না। এখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি রাত সেই মাথা ঢাকা নারীর প্রতিমূর্তি চোখে ভেসে থাকবে। অবশ্য তা হল না।

সেই সন্ধ্যায় তারাভরা আকাশের নিচে বারান্দায় পাতা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বুজার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। তারপর ফাট তুর হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙালো।

আমি উঠে বসে বুঝলাম সূর্য দিগন্তের উপরে এসেছে। ফাট তুরের পেছনে আমার পরিচর্যার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চাকরবাকর আর ক্রীতদাসেরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ফাট তুর বললো, উইন তায়তা! রাজা নিমরদ তার সমরপরিষদ ডেকেছেন আর সেখানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

সকালের উজ্জ্বল রোদে আমার চোখ পিট পিট করে উঠলো। গতরাতের বেদনাময় স্মৃতির পরও আমার সারা শরীর ঝরঝরে হয়ে রয়েছে।

মহামান্য রাজা যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তাহলে এখানে আর সময় নষ্ট করে লাভ কী ফাট তুর? চলুন কাজে লেগে পড়ি। আসলে এমন সময়ে একটুখানি রসিকতা করে আমি বুঝাতে চেয়েঠিলাম যে আমার মন হালকা হয়ে আছে।

সমরপরিষদ কক্ষে পৌঁছার পর দেখলাম বেশির ভাব সুমেরিয় সামরিক নেতৃবৃন্দ পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক এবং বুকে বিভিন্ন সম্মানসুচক পদক লাগিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। কেবল রাজা নিমরদ এখনও এসে পৌঁছাননি।

যথারীতি সম্ভাষণের পর অভ্যর্থনামূলক বক্তৃতার জবাবে আমি উত্তর দিলাম, তবে দোভাষি ফাট তুরের মাধ্যমে। আমি এখনও অপর পক্ষকে জানাতে প্রস্তুত নই যে তাদের ভাষা আমার ভালোভাবেই জানা আছে। তারপর আলোচনা শুরু করলাম।

ভদ্রমহোদয়গণ, আমি সম্পূর্ণরূপে অবগত যে আপনাদের নৌবাহিনী সমস্ত সাগরের মাঝে অজেয়। আপনাদের রণতরীগুলো মহাশক্তিশালী, আপনাদের নৌবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষ এবং সাহসী। মনে হল এসব প্রশংসাসূচক কথাবার্তা শুনে ওরা সবাই খুশি হয়েছে, যদিও তা অতিশয়োক্তি ছিল। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের এর চেয়েও শক্তিশালী নৌবহর রয়েছে। তাদের সমুদ্র বাণিজ্যের পরিমাণ সুমেরিয়দের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তারপর আমি আমার প্রস্তাবটি উপস্থাপন করলাম, আমি আপনাদের ছয়টি বড় জাহাজ কিনে নিয়ে হাইকসো ভণ্ড জবরদখলকারি গোরাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজে লাগাতে চাই।

সুমেরিয় নৌবাহিনীর প্রধানের নাম নৌ-অধ্যক্ষ এলোরাস। লম্বা ছিপছিপে দেহের অধিকারি এই ব্যক্তিটির দাড়ি সযত্নে পাকানো। চোখের নিচে কালি আর দাঁতে ক্ষয়ের দাগ। আমার অনুরোধ শুনে লোকটি ভ তুলে মুখে চুকচুক করলো। যেন খুব একটা মজা পেয়েছে।

তারপর সে বললো, সম্মানিয় তায়তা, আমি জানি আমাদের উভয়েরই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে আপনার যুদ্ধের সদিচ্ছাকে রাজা নিমরদ প্রশংসা করেন। তবে রাজা নিমরদের হয়ে আমি আপনাকে জানাচ্ছি একটি মাত্র জাহাজের দামই অনেক। আর ছয়টি জাহাজ এখানে সে থেমে গেল।

আমি তার সাথে একমত হয়ে জানালাম, যুদ্ধের কোনো উপকরণই সস্তা নয়। রাজা নিমরদের মতো আমাদের ফারাও তা ভালো করেই জানেন। মিসর একটি অনাকাঙ্খনীয় অবস্থানে রয়েছে। হাইকসোরা উত্তরে আখেনতন থেকে মধ্যসাগর পর্যন্ত নীল নদী নিয়ন্ত্রণ করছে। হাইকসো জবরদখলকারি গোরাবের বিরুদ্ধে লড়ার মতো সমুদ্রগামি যুদ্ধ জাহাজ আমাদের কাছে নেই। আমাদের আছে কেবল নদীপথে চলাচলকারী বড় নৌকা। এগুলো নীল নদীতে আটকে রয়েছে। খোলা সাগরে যদি আমরা তার নৌবহরে আকস্মিক হামলা করতে পারি তাহলে আমরা কী ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারবো, ভেবে দেখুন।

জামার হাতার ভাঁজ থেকে একটা প্যাপিরাসের টুকরা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলাম। এডমিরাল প্রথমে কাগজটার উপর চোখ বুলালেন কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন এতে আমি সুমেরিয় ছয়টি প্রধান যুদ্ধ জাহাজের নামধাম আর পুরো বিবরণ লিখে রেখেছি, তখন কাগজটা টেবিল থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে নিবিষ্টভাবে দেখতে শুরু করলেন। তারপর কাগজের উপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

তারপর জানতে চাইলেন, এসব গোপনীয় তথ্য আপনি কোথায় পেলেন? আমি মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইলাম যে, তার কথা আমি বুঝতে পারিনি। আসলে ফাট তুরের চরেরা এই তালিকাটা আমার জন্য তৈরি করেছিল।

বরং আমি ভদ্রভাবে তাকে বললাম, আপনারা এই জাহাজগুলো বিক্রি করতে পারবেন? আর কত দামে বলুন?

এলোরাস উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, মার্জনা করবেন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার আগে আমাকে অবশ্যই মহামান্য রাজার সাথে পরামর্শ করতে হবে। একথা বলে সে দ্রুত পরিষদ কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তারপর দেয়ালে দাঁড় করানো পানির ঘড়িতে প্রায় এক ঘন্টা পার হওয়ার পর ফিরে এলো।

তারপর এডমিরাল এলোরাস বললো, রাজা নিমরদ আপনাকে জানাতে বলেছেন, যে জাহাজগুলোর কথা আপনি বলেছেন সেগুলো প্রতিটি নির্মাণ করে পানিতে ভাসাতে একশো পঞ্চাশ রূপার ডেবেন পড়েছে। এখন যদি তিনি এগুলো বিক্রিও করতে চান, যার হয়তো কোনো সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে এর চেয়ে কম দাম হতে পারে না। সে যে দর হেঁকেছে ফাট তুর তা তর্জমা করতে করতে আমি দ্রুত একবার হিসাব করে নিলাম। এক লাখ রূপায় দশ হাজার ডেবেন হয়। আমার উটের পিঠে যে থলেগুলো আছে তা দিয়ে চল্লিশটা যুদ্ধ জাহাজ কেনা যায়। কিন্তু আমি এলোরাসকে বললাম প্রতিটি জাহাজের জন্য আমি পঁচাত্তর রূপার ডেবেন দিতে পারবো।

রাজার সাথে কথা বলার জন্য এলোরাস দ্বিতীয়বার কামরা ছেড়ে চলে গেল। আর ফেরার সময় রাজা নিমরদ তার সাথে এলে আমি বুঝলাম আমার দামে জাহাজগুলো বিক্রির জন্য তার আগ্রহ আছে।

এরপর সারা সকাল আর বিকেলের শেষ প্রহর পর্যন্ত রাজা নিমরদ আর আমি দুজনে আরবি ঘোড়ার ব্যবসায়ীর মতো দর-কষাকষি করলাম। শেষপর্যন্ত আমরা ছয়টি জাহাজের দাম পাঁচশো রূপার ডেবেনে একমত হলাম। ফামেনথ মাসের শেষে মধ্যসাগরের পূর্ব উপকুলে সুমেরিয় বন্দর সিডনে জাহাজগুলো হস্তান্তর করা হবে।

তুঘোড় একটি ব্যবসা করতে পেরেছেন এই খুশিতে রাজা নিমরদ আমাদের চুক্তি উদ্যাপন করার উদ্দেশ্যে আমাদের সকলকে সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ভোজে আমন্ত্রণ জানালেন।

.

পরিষদ কক্ষ বের হয়ে আসার পর ফাট তুর আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমাকে বেশ জোরে বললেন, আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম ইশতারের মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবো। মন্দিরটি কখনও বন্ধ হয় না, কাজেই আপনি যখন ইচ্ছা সেখানে যেতে পারেন। সন্ধ্যায় রাজকীয় ভোজের আগে আমাদের হাতে কাটাবার মত কয়েক ঘন্টা সময় আছে।

নিমরদ যেরকম বিক্রি ব্যবসায়ে খুশি হয়েছিল তেমনি আমিও যুদ্ধ জাহাজগুলো অর্জন করতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিলাম। আসলে আমি এর দ্বিগুণ দাম দিতে প্রস্তুত ছিলাম। ফলে আমার মনে খুশি খুশি ভাব থাকায় আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বললাম, আপনি যেরকম বলছেন যে, মন্দিরটি বেশ চমৎকার আর এটা দেখে শেখার মতো কিছু আছে তাহলে চলুন এখুনি সেখান থেকে ঘুরে আসি।

প্রাসাদ থেকে বের হয়ে নদীর তীর দিয়ে হেঁটে আমরা ইশতার দেবীর মন্দিরের দিকে এগোলাম। যেতে যেতে ফাট তুর এর ইতিহাস বর্ণনা করলো, আমি আগেই আপনাকে বলেছি রাজা মারদুকের একশোরও বেশি স্ত্রী এবং রক্ষিতা ছিল, তারপরও দেবী ইশতারের প্রতি তার প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল। তার মন জয় করার জন্য প্রথমে এই মন্দিরটি নির্মাণ করলো। কিন্তু এতেও দেবীকে প্রলুব্ধ করতে না পেরে নদীর অপর তীরে বিশাল অট্টালিকাটি নির্মাণ শুরু করলো। দুজনেই ঘুরে অট্টালিকাটির অসমাপ্ত চূড়াটির দিকে তাকালাম, যা সেই চমকপ্রদ শূন্যদ্যানের সর্বোচ্চ মঞ্চের উপরে দেখা যাচ্ছে। আমি আপনাকে ইতোমধ্যে বলেছি দেবীকে লাভ করার ইচ্ছা চরিতার্থ করার আগেই মারদুক মৃত্যুবরণ করে। রাজা মারদুকের একটি বস্তুর প্রতি আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হলেও তার পুত্র রাজা নিমরদের আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন দিকে। সে গর্ব করে বলে মৃত্যুর আগে সে সুমেরিয়ার সমস্ত আবেদনময়ী নারীর সাথে তার কামবাসনা মেটাবে: সে তরুণি হোক কিংবা বয়ষ্ক হোক, বিবাহিতা হোক কিংবা কুমারি হোক।

আমি মন্তব্য করলাম, একজন রাজার পক্ষে এ-ধরনের ইচ্ছা পোষণ করা খুব একটা অযৌক্তিক বলা চলে না। তবে তার শিকার করার ব্যাপারটি দেখে মনে হচ্ছে রাজা নিমরদ গুণগত মানের চেয়ে সংখ্যার প্রতি বেশি মনোযোগ দেন। তবে তার চোখ দুটো কি দেহের অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে খুব বেশি বড় না?

ফাট তুর মাথা নেড়ে বললো, এটি সুবিদিত যে রাজা নিমরদ সদা অতৃপ্ত।

আমি বললাম, কিন্তু এর সাথে তার বাবার মন্দিরের সম্পর্ক কি?

সিংহাসনে আরোহণ করার ছয় মাসের মধ্যে রাজা নিমরদ একটি নির্দেশ জারি করলেন যে, তার রাজ্যের প্রত্যেক নারী জীবনে একবার মন্দিরে এক দিন কাটাবে। সেখানে শত্রু মিত্র কিংবা অচেনা যে পুরুষ তার সাথে যৌন মিলন করতে চাইবে সে তা করতে বাধ্য। কোনো নারী এই আদেশ অমান্য করতে পারবে না আর কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে এই মিলনে বাধা দিতে পারবে না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে রাজা নিমরদ কী তার প্রজাদের সাথে এক সারিতে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গিনী বাছাই করবেন? ফাট তুর মৃদু হেসে মাথা নাড়লো।

রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী মেয়েরা সূর্যোদয়ের আগে মন্দিরে তাদের জায়গায় বসে পড়বে, তবে কেবল একজন পুরুষ তার সঙ্গিনী বাছাই করতে দুপুরের আগে মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পাবে। নিঃসন্দেহে এবার আপনি আন্দাজ করতে পারছেন সেই লোকটি কে হতে পারে। তারপর সে আবার মৃদু হেসে বললো, দুপুরের পর অবশ্য যে কোনো সুমেরিয় পুরুষ মন্দিরে ঢুকে তার পছন্দমতো সঙ্গিনী বাছাই করতে পারবে।

মন্দিরের সামনের প্রবেশ পথে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। পবিত্র অঙ্গনের মূল দ্বারে ঢোকার জন্য পঞ্চাশ জনেরও বেশি পুরুষ সার বেঁধে অপেক্ষা করছে। সৈনিক, নাবিক থেকে শুরু করে সাদাটুপি পরা আইনবিদ এবং রক্ত মাখা কালো আলখাল্লা পরা শল্য চিকিৎসকও সারিতে রয়েছে।

এক দিকে আঙুল তুলে ফাট তুর বললো, দেবীর পুরোহিত এবং যাজিকারা সবুজ আলখাল্লা পরে আলাদা রয়েছেন। ঐ যে একজন পুরোহিত এদিকে আসছেন। তার নাম অনিওস। তিনি আমাদেরকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবেন। আর এর রহস্য ব্যাখ্যা করবেন।

অনিওস বেশ সম্মান দেখিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন, তারপর মূল ফটকের পাশে একটি ছোট বন্ধ দরজার দিকে নিয়ে গেলেন। আমরা এগোতেই দরজাটা ভেতর থেকে কেউ খুলে দিতেই আমরা মন্দিরের মূল অংশে ঢুকলাম।

এটি এতো বিশাল যে মাথার উপরে সূউচ্চ ছাদ অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। ছাদ থেকে কেবল এক ফালি সূর্য রশ্মি নিচে নেমে এসে মেঝের কেন্দ্রস্থলে দেবীর সোনালি মূর্তিটিকে আলোকিত করেছে।

আমার মনের প্রশ্নটি বুঝতে পেরে ফাট তুর বললো, মন্দিরের ছাদের উপরে একটি বিশাল ব্রোঞ্জের আয়না স্থাপন করা আছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সূর্যের চলার পথ অনুসরণ করে দশজন ক্রীতদাস চাকার উপর দিয়ে এটি টেনে নিয়ে যায়। যার ফলে সূর্যরশ্মি মূর্তির উপর প্রতিফলিত হয়। এর উদ্দিষ্ট পরিণতিটি ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। আলোকচ্ছটায় প্রজ্বলিত মূর্তিটির গা থেকে চলমান আলোক রশ্মি চারপাশের দেয়ালে ঠিকরে পড়ে এক অপূর্ব আবহ সৃষ্টি করেছে।

ফাট তুর জিজ্ঞেস করলো, প্রাচীরচিত্রগুলো লক্ষ্য করেছেন তায়তা? এখানে লেখা রয়েছে দুইশো শিল্পী বিশ বছরে এগুলো এঁকেছে।

আমি বললাম, সত্যি আশ্চর্যজনক। আমি যত মন্দির দেখেছি কোনোটাই এর সাথে তুলনা হয় না, এমনকি ফারাও ম্যামোসের সমাধি মন্দিরও নয়।

বিষয়বস্তুটি অপূর্ব তাই না, আপনি নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত? ফাট তুর এমন গর্বভরে কথাগুলো বলছিল যেন সেই এগুলোর মালিক। তারপর সে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললো, দেবী ইশতারের জ্বলন্ত অনুভূতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

মন্দিরের উঁচু দেয়ালে যুদ্ধসাজে সেনাদল হেঁটে চলেছে। ধূলির ঝড় উড়িয়ে রথ ছুটে চলেছে। আকাশ জুড়ে উড়ন্ত তীর ছড়িয়ে রয়েছে। লোকালয় আগুনে পুড়ছে আর যুদ্ধংদেহী সৈন্যদের আগে আগে শরণার্থীরা প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। মৃত শিশু কোলে নিয়ে ক্রন্দনরত নারী বিজয়ী সেনাদলের কাছে করুণা ভিক্ষা করছে। বিশাল যুদ্ধজাহাজ ব্রোঞ্জের হাল দিয়ে ছোট ছোট নৌযানের পাশে গুতো মারছে আর ধ্বংসপ্রাপ্ত নৌযানের নাবিকেরা সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পানিতে মৃতদেহ আর ভাঙা নৌযানের টুকরা ভাসছে। যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে দেবী উড়ে বেড়াচ্ছেন আর বিজয়ীর দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন আর পরাভূত শক্তিকে নিন্দা করছেন।

ফাট তুর ধীরে ধীরে ঘুরে অন্যান্য দেয়াল আর তারপর তার শরীর পেছনে বাঁকিয়ে পঞ্চাশ কিউবিট উপরে ধনুকাকৃতির খিলান আর ছাদের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, যুদ্ধ, প্রেম আর যৌনতাআর কোনো মন্দিরে এ ধরনের যৌনসংসর্গঘটিত দেয়াল চিত্র আছে কি না আমি জানিনা।

আমি তাকিয়ে দেখলাম নারী ও পুরুষের অন্তরঙ্গ এবং আলিঙ্গনবদ্ধ দৃশ্য। দেবদেবীর যৌনলীলার দৃশ্য।

সবকিছুর উপরে উজ্জ্বল সাদা ডানাসহ দেবী ইশতার মাথার চারপাশে অগ্নিবৃত্ত নিয়ে তাদের উপর ঝুঁকে রয়েছেন।

আমি আর ফাট তুর ধীরে ধীরে গির্জার মূল অংশটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দুইশোজন প্রশ্নসাপেক্ষ শিল্পীর বিশ বছর ধরে আঁকা এই বিশাল কাল্পনিক চিত্রকর্ম দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলাম।

প্রতিটি দেয়ালের একটু পর পর চারদিক দেয়ালঘেরা বড় বড় কামরা রয়েছে। আমি গুণে দেখলাম, একেক দিকে সাতটি করে দুই দিকের দেয়াল মিলে মোট চৌদ্দটি কামরা রয়েছে। ভেতরে কি আছে দেখা যাচ্ছে না, কেননা দরজায় অনেক নারী পুরুষ ভীড় করে রয়েছে।

আমি জানি ভেতরে কী হচ্ছে তা জানতে চেয়ে আমার প্রশ্নের জন্য ফাট তুর অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমি আমার পদমর্যাদা বজায় রেখে নিচুপ থাকলাম। পরিশেষে সে সবুজ আলখাল্লা পরা একজন পুরোহিতের সাথে কথা বললো, সে তার সঙ্গিসাথীদের নিয়ে কাছের কামরার দরজার সামনে জটলা বেঁধে থাকা লোকজনদের হটালো। স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে মুখ কালো করে লোকেরা আমাদের জন্য পথ করে দেওয়ার পর আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

গোলাকার কামরাটির দেয়াল ঘেঁসে মেঝেতে উজ্জ্বল রঙের চাদর দিয়ে ঢাকা বিছানা পাতা রয়েছে।

ফাট তুর ব্যাখ্যা করলো, চৌদ্দটি আলাদা আলাদা কামরায় চৌদ্দটি বিছানায় চৌদ্দজন নারী অবস্থান করছে। চৌদ্দ হচ্ছে দেবী ইশতারের ঐন্দ্রজালিক সংখ্যা, যার উদ্দেশ্যে এই ক্রিয়াকর্মটি উৎসর্গ করা হচ্ছে।

আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম সংখ্যাটি সঠিক। সেখানে চৌদ্দজন মধ্য বয়ষ্কা অসুখি চেহারার নারী রয়েছে। সবার মাথায় লাল গোলাপের মুকুট, পরনে আর কিছু নেই। সবাই মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।

ফাট তুর আবার ব্যাখ্যা করলো, লাল গোলাপ দেবী ইশতারের ফুল।

আমার পেছনে দাঁড়ান একজন নাবিক আমাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে হটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। গোলাপের মুকুট পরা একজন মহিলার সামনে গিয়ে সে বললো, আমি তোমাকে দেবীর ঋণ শোধ করার আহ্বান জানাচ্ছি। এই কথাটি বলে সে একটি মুদ্রা মহিলার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মহিলাটি ঘৃণাভরে তার দিকে তাকাল।

এরপর আমি আর সেখানে থাকতে পারলাম না, ফাট তুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। সুন্দর একটি বিষয়কে এই নোংরা লোকগুলো এমন বিকৃত রূপ দিয়েছে, যা আমার মনকে আনন্দের বদলে বিষণ্ণ করে তুলেছে।

.

পরদিন বিকেলে রাজা নিমরদ ইশতার দেবীর মন্দির থেকে নিত্যদিনের পূজা শেষে ফিরে আসার পর আমি তার সাথে আলোচনায় বসলাম। রাজার সাথে তার সামরিক কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন।

সেনাপতি রেমরেম আর আমি দুজনে মিলে হাইকসোদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছিলাম।

সবকিছু আটকে রয়েছে নিমরদের অর্থাভাবের কারণে। ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ কেনা বাবদ যে টাকা আমি দিয়েছিলাম, তা তার প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই ছিল না। প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের পরও গত দুই বছরে সেনা আর নৌবাহিনীর বেতন মেটানো যায় নি। অস্ত্রশস্ত্র, রথ থেকে শুরু করে অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আর অন্যান্য সেনারা বিদ্রোহের পথে রয়েছে।

ফারাও আর মিসরের জন্য পরিস্থিতি বিপর্যয়ের দ্বারে টলমল করছে। সুমেরিয়া ব্যর্থ হলে আমাদের পূর্ব সীমান্ত সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। যে করেই হোক রাজা নিমরদকে এই সঙ্কটাবস্থা থেকে বের করে আনতে হবে। তার জন্য নয়, বরং আমার জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে এটা করতে হবে।

আমি হিসেব করে দেখেছি সুমেরিয়াকে আবার একটি সামরিক শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে রাজা নিমরদের কমপক্ষে ত্রিশ লাখ রূপা লাগবে।

আমাকে দ্বিমুখি সঙ্কট এড়াতে হবে। নিমরদ হচ্ছে এই দ্বিমুখি সঙ্কটের একটি কাঁটা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছেন আমার প্রিয় ফারাও। নিমরদ নিঃস্ব আর এদিকে মেমনন ত্যামোস রূপার সমুদ্রে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। তিনি প্রায় ছয়শো লাখ রূপার সম্পদের উপর বসে রয়েছেন। একা আমি যে আর কারও সহায়তা ছাড়াই তার জন্য এই সম্পদ এনেছি তার কোনো অর্থ নেই। কোষাগার তার, তবে আমি আমার মেমকে ভালোকরেই জানি। ছোটবেলা থেকে আমিই তাকে মানুষ করেছি আর তিনি যা কিছু জানেন তা সমস্ত আমিই তাকে শিখিয়েছি। আমিই তাকে শিখিয়েছি রূপা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন তবে খরচ করা বড়ই সহজ। এখন যে করেই হোক তাকে আমার এই শিক্ষা ভুলাতে হবে। তাকে রাজি করাতে হবে যাতে তিনি ত্রিশ লাখ রূপা এমন একজন মানুষকে দেন যাকে তিনি চেনেন না এবং বিশ্বাস করেন না। জানি আর কোনো উপায় নেই। মিসরকে বাঁচাতে হলে তাকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে।

সারাদিন রাজা নিমরদ আর তার সভাসদদের সাথে আলোচনার পর সন্ধ্যায় আমার ঘরে ফিরে এলাম। খুব একটা খিদে না থাকায় একটি পাকা ডুমুর, একটু পনির আর শক্ত রুটি দিয়ে একা রাতের খাবার সেরে নিলাম। কয়েক ফোঁটা মদ ঢেলে নিলাম তবে প্রথম চুমুকটি ভিনেগারের স্বাদের মতো মনে হল। গ্লাস সরিয়ে মেমকে পাঠাবার জন্য একটা বার্তা মুসাবিদা করার দিকে মনোযোগ দিলাম। এমন একটি বার্তা যা কবুতরের পায়ে বাধা পাতলা একটি পার্চমেন্টে জায়গা হয়। এমন একটি বার্তা লিখতে হবে যা ফারাও ত্যামোসের মনে এমন একটি কাজ করতে বিশ্বাস যোগায় যা করাটা তিনি পুরোপুরি নির্বুদ্ধিতা মনে করেন।

অনেক ঘন্টা পার হয়ে গেল, ইতোমধ্যে আমি ছয়টি খসড়া ছিঁড়েছি। তারপরও কাজ হচ্ছে না। বুঝতে পারলাম শুরু করার আগেই আমি ব্যর্থ হয়ে বসেছি। ভাঁজ করা পা সোজা করে লেখার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার সামনে গিয়ে বারান্দার বাইরে তাকালাম। নতুন চাঁদের উচ্চতা দেখে বুঝলাম মাঝরাত পার হয়ে গেছে।

হঠাৎ ছোট এক টুকরা মেঘ ভাসতে ভাসতে এসে চাঁদকে ঢেকে ফেললো। আমার চতুর্দিক সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেল। ভেবেছিলাম চাঁদের আলো চলে যাওয়ায় আমার কষ্ট হয়তো আরও বেড়ে যাবে। তবে অলৌকিকভাবে বরং উল্টোটি হল। অনুভব করলাম এক মুহূর্ত আগেই আমার মনে যে অশান্তি ছিল তা দূর হয়ে গভীর প্রশান্তিতে মন ভরে গেছে।

তারপর শুনলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। পরিষ্কার কন্ঠে কেউ আমাকে ডেকেছে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কে ডাকছে। কিন্তু কেউ নেই, আমি একা।

তারপর হঠাৎ আমার সঙ্কটের একটি সমাধান আমার সামনে ভেসে উঠলো। আমি ভেবে পেলাম না কেন আমি এতোক্ষণ ইতস্তত করেছি।

আমার কাছে বাজপাখির সিল মোহর রয়েছে। আমার হাতে ফারাওয়ের সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে। আমি জানি বিপদ থেকে দেশকে উদ্ধার করতে আর ধ্বংসের হাত থেকে ফারাওকে রক্ষা করতে আমাকে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতেই হবে। এমনকি তা ফারাওয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও করতে হবে।

সিদ্ধান্তটি নেওয়ার পর আমি ভাবলাম কোথা থেকে আর কে আমাকে পথ দেখিয়েছে। আমার গভীর আনুগত্যের বিপরীতে স্বভাব বিরোধি এই সমাধানটি এমন যে, আমি বুঝতে পারলাম এই সিদ্ধান্তটি আমার একার ছিল না।

ছোট্ট মেঘটি সরে গিয়ে নরম চাঁদের আলো মধ্যরাতের পৃথিবীকে নরম আলোয় স্নাত করলো। ইশতারের মন্দিরের মার্বেল পাথরের দেয়ালে আলো পড়ে জ্বল জ্বল করে উঠলো।

আলখাল্লা ঢাকা নারী মূর্তিটি আবার আমার উল্টোদিকে মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ঠিক যেখানে এর আগে তাকে দেখেছিলাম। আগের মতোই রূপালি-ধূসর আলখাল্লায় তার মুখ ঢাকা। এবার আমি জেনেছি কোথা থেকে আমার অনুপ্রেরণা এসেছে।

আবার তার মুখ দেখতে আমার খুব ইচ্ছা হল। মনে হল কোন অলৌকিক বলে তিনি তা বুঝতে পেরেছেন। মাথা একবার হেলাতেই মুখ-মাথা ঢাকা আলখাল্লার অংশটি কাঁধের উপর খসে পড়তেই তার মুখ অনাবৃত হল। মুখটি চাঁদের চেয়েও স্নিগ্ধ। তাকে আগের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছে, এর আগে এমন সুন্দর কোনোকিছু আমি আর দেখিনি।

আমি শূন্যে তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম। তবে তার চেহারা দেখে মনে হল তিনি মনে দুঃখ নিয়ে আরও দূরে চলে যাচ্ছেন। আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন আর তার সাথে চাঁদের আলোও ম্লান হয়ে এলো।

.

পরদিন সকালে আমি পোশাক পরে সম্পূর্ণ তৈরি হবার পর ফাট তুর আমার কামরায় এলো। পূর্ণ শক্তি আর দৃঢ়সংকল্প মনোভাব নিয়ে আর আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে আমি প্রস্তুত। লঘু পায়ে খুশিতে এমন দ্রুত হেঁটে চললাম যে, আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে রেমরেম, ফাট তুর আর দলের অন্যান্য সদস্যদের রীতিমতো ছুটে চলতে হচ্ছিল।

পরিষদ কক্ষে ঢোকার পর দেখলাম নিমরদের সিংহাসন তখনও শূন্য। তবে অন্যান্য সভাসদ আর পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন। তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে লম্বা টেবিলে বসালো। একটু পরই মূল দরজার বাইরে তূর্য ধ্বনি শোনা গেল।

ধীর ভাবগাম্ভীর্য পদক্ষেপে রাজা নিমরদ কামরায় ঢুকলেন। এতো সকালে তাকে এখানে দেখার সাথেই সাথেই আমার প্রথম চিন্তা ছিল, তিনি নিশ্চয়ই ইশতার দেবীর মন্দিরে তার নিত্যকার প্রেমলীলা বাদ দিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন।

তার প্রতি আমার যে সম্মান দেখানো প্রয়োজন সে বিষয়ে আমি সচেতন হলাম আর এতে আরাধ্য কাজটি শুরু করতে আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। যথারীতি রাজকীয় সৌজন্য প্রদর্শনের পর আমি দাঁড়িয়ে সরাসরি রাজার উদ্দেশ্যে কথা বলতে শুরু করলাম।

মহামান্য, আমি এমন একটি স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় প্রস্তাব দিতে চাই যা কেবল আপনি এবং আপনার একান্ত একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে বলা যেতে পারে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমার প্রস্তাবটি আমাদের পারস্পরিক উপকারে আসবে এবং সেই সাথে এই মুহূর্তে আমরা যে সঙ্কটাবস্থার সম্মুখীন হয়েছি তা দূর করতে সূদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে।

একথা শোনার পর নিমরদ একটু থমকে গেলেন এবং মনে হল সিদ্ধান্ত নেওয়াটা এড়াবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না এবং অন্য কোনো বিকল্পে রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে রাজি হলেন।

আমি সেনাপতি রেমরেমকে আমার ডান দিকে আর দোভাষি হিসেবে ফাট তুরকে বামে নিলাম। নিমরদ এডমিরাল এলোরাসকে টেবিলে থাকতে ইশারা করলেন, বাকিরা কামরা ছেড়ে চলে গেল।

কামরায় যখন কেবল আমরা পাঁচজন রইলাম তখন আমি রাজকীয় বাজপাখির সিলমোহরটা বের করে টেবিলে আমাদের মাঝে রাখলাম।

আমি নিশ্চিত মহামান্য নিশ্চয়ই এই বস্তুটির গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত আছেন।

যদিও এই প্রথম এটা দেখলাম তবে আমি বুঝতে পেরেছি এই সিলমোহর নিশ্চিত করছে যে আপনি মিসরের ফারাও ত্যামোসের কণ্ঠ এবং কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলছেন।

আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য।

রাজা নিমরদ তার ঠাণ্ডা কালো চোখ আমার উপর নিবদ্ধ করলেন। আর কিছু না বললেন না, কেবল পানির দিকে শিকারের আসা টের পেয়ে একটি চিতাবাঘের তীক্ষ্ণতা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমিও সেভাবে তার দিকে লক্ষ্য রাখলাম।

মহামান্য, আপনি এবং আমি দুজনেই অভিজ্ঞ যোদ্ধা। অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান থেকে আমরা জানি শুধু মনোবল আর ক্ষুরধার তলোয়ারের পাত দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না, এর সাথে প্রয়োজন কী পরিমাণ রূপা আমরা শত্রুপক্ষের দিকে ছুঁড়ে মারতে পারি।

নিমরদ বললেন, বিষয়টি এভাবে কাউকে কখনও প্রকাশ করতে শুনিনি, তবে আপনি একজন বিবেচকের মতো সত্যি কথাটিই বলেছেন।

মিসরের ফারাও ত্যামোসের নামে আর যে বাজপাখির সিলমোহরটি আমি বহন করছি তার কর্তৃত্ববলে আমি আপনাকে ত্রিশ লাখ রূপা অর্পণের প্রস্তাব করছি শুধুমাত্র এই শর্তে যে, আপনি মিসরের সাথে একটি সামরিক চুক্তিতে আসবেন আর এই পরিমাণ অর্থ কেবল রাজা গোরাব এবং হাইকসো গোত্র বিনাশের কাজে ব্যবহার করবেন।

আমি শুনতে পেলাম আমার পাশে বসে রেমরেম একবার দ্রুত নিঃশ্বাস নিল। সে জানে আমি এই প্রস্তাবের জন্য ফারাওয়ের অনুমোদন নেই নি আর এও জানে এতে আমি কী ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছি। তবে আমি মোটেই তার দিকে তাকালাম না। এদিকে নিমরদ সিংহাসনে বসে সামনে পেছনে দুলতে লাগলেন আর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। লক্ষ্য করলাম তার মুকুটের নিচে কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিচে পড়ছে।

শেষ পর্যন্ত যখন তিনি কথা বললেন তখন চরম অবিশ্বাস আর ধনতৃষ্ণায় তার গলার স্বর ফ্যাসফ্যাস করে উঠলো, এতোগুলো টাকা দিয়ে দেবার মতো সম্পদ কি আসলেই আপনার ফারাওয়ের কাছে আছে?

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মহামান্য যে, হ্যাঁ সে পরিমাণ সম্পদ তার আছে। আমাদের দুই রাষ্ট্রের মধ্যে এই বন্ধন সুনিশ্চিত করার জন্য এই মুহূর্তে আপনার হাতে তিন লাখ রূপা তুলে দেবার জন্য ফারাও আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর যা আসছে এটি তার সামান্য একটি নিদর্শন মাত্র।

কোনো কথা না বলে রাজা নিমরদ বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অকস্মাৎ লাফ দিয়ে উঠে কামরার এক দিক থেকে অন্যদিকে পায়চারি শুরু করলেন। মুখ কুঁচকে রুষ্ট চেহারা নিয়ে এতোজোরে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন যে এক ফোঁটা রক্ত চিবুক থেকে এমব্রয়ডারি করা রাজপোশাকে পড়লো।

তারপর হঠাৎ আমার সামনে এসে থেমে জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, এখন তিন লাখ আর আরও সাতাশ লাখ এক বছরের মধ্যে? কথাটা ফাট তুর তরজমা করার পর আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম।

মহামান্য যা বলেন। তবে বাকি রূপা গ্রহণ করার জন্য আপনার সবচেয়ে চৌকশ একটি সেনা-পল্টন থিবসে পাঠাতে হবে। এতো রূপা ফারাও তার নিজের লোক দিয়ে পাঠাবার ঝুঁকি নেবেন না।

নিমরদ আবার ঘুরে পায়চারি শুরু করলেন। তার স্যান্ডেলের নিচে ব্রোঞ্জের তলি হাঁটার তালে খটখট শব্দ করছিল। এবার তিনি সুমেরিয় ভাষায় নিজের সাথে তর্ক শুরু করলেন।

কেমন করে আমি এই চতুর খোঁজা লোকটিকে বিশ্বাস করবো? একথা আর গোপন নেই যে, সে শেঠ আর অন্ধকারের অন্যান্য দেবতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আবার কেউ কেউ এমনও বলে যে, সে নিজেও শূন্যতার ওপারের অন্ধকার আত্মার একজন। এতোটুকু বিড়বিড় করে বলার পর যখন বুঝলেন তিনি কী বলেছেন তখন ঘুরে ফাট তুরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, আমার কথাগুলো তরজমা করলেই তোমার সর্বনাশ ডেকে আনবে! যদি করো তবে তোমার নিজের নাড়িভূড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে তোমাকে শ্বাসরোধ করে মারবো, বুঝতে পেরেছো?

ফাট তুরের মুখ ফ্যাকাশে হল, সে দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বললো, মহামান্য যা হুকুম করেন। নিমরদ আবার পায়চারি শুরু করলেন আর নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগলেন। তারপর আবার সামনে এসে থামলেন।

ফাট তুরকে নির্দেশ দিলেন, বল আমি তাকে বিশ্বাস করি। তবে কোনো মৈত্রিবন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি হওয়ার আগে আমি মিসরের ফারাও ত্যামোসের কাছ থেকে একটি অঙ্গিকার নামা চাই। এই শর্তটি বলার সময় আমি লক্ষ্য করলাম তার চোখে লালসাপূর্ণ ধুর্তামি ফুটে উঠেছে।

সরাসরি জবাব এড়িয়ে আমি সতর্কতার সাথে বললাম, যদি আদৌ তা সম্ভব হয়, আমি জানি ফারাও তা মেনে নেবেন।

তারপর নিমরদ বললেন, আমি আমার নিজের পরিবারের সাথে মিসরের রাজপরিবারকে একত্রিত করতে চাই। আমি ফারাওয়ের দুই বোন তেহুতি আর বেকাথাকে আমার স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই। তাহলে ফারাও আর আমি পরস্পরের ভগ্নিপতি হব।

তার লোভ, ধৃষ্টতা আর কামুকতার সীমা দেখে আমি হতবাক হলাম। পাজি লোকটি টাকা আর খাবার দুটোই চায়। এই নোংরা জীবটি আমাকে উদ্দেশ্য করে যথেষ্ট অপমানজনক কথা বলেছে আর এখন খোলাখুলিভাবে আমার আদরের রাজকুমারীদের দিকে লালসাপূর্ণ হাত বাড়িয়েছে।

রাগ দমন করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে আমি বললাম, এই প্রস্তাবটি করে মিসরের প্রতি আপনি অশেষ সম্মান দেখিয়েছেন। অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি জানি ফারাও আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে একমুহূর্ত দ্বিধা করতেন না। তবে ফারাও ইতোমধ্যেই আমাদের দুই জাতির সামরিক মৈত্রি নিশ্চয়তা করার উদ্দেশ্যে তার দুই বোনের সাথে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের বিয়ে দেবার কথা দিয়েছেন। মিনোয়ানরা এই অপমান সহ্য করবে না।

নিমরদ কাঁধে একটি ঝাঁকি দিয়ে বিড়বিড় করে একটা অশ্লীল মন্তব্য করলেন।

তবে আমি বুঝলাম আমার প্রত্যাখ্যানে তিনি খুব একটা বিরক্ত হননি। আমরা দুজনেই জানতাম আমাদের চুক্তি থেকে যতটুকু সম্ভব সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার এটি একটা শেষ প্রচেষ্টা ছিল। আসলে কিছু কিছু মানুষ আছে, তাদেরকে যতই দেওয়া হোক না কেন ওরা আরও কিছু পেতে চায়।

নিমরদ আরেকবার কামরার চতুর্দিকে চক্কর দিয়ে আমার সামনে এসে থামলেন তারপর শেষ একবার চেষ্টা করে বললেন, আপনি যে তিনলাখ রূপার কথা বলেছেন তা আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই। কেননা আমি বিশ্বাস করি না যে, আপনি আর আপনার ফারাও চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাবেন। তবে আমি শুধু দেখতে চাই কীভাবে রূপাগুলো এতোক্ষণ পর্যন্ত আপনি লুকিয়ে রেখেছেন…. কথাগুলো নিমরদ সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন এই আশায় যে, হয়তো আমি তার ফাঁদে পা দিয়ে ফাঁস করে দেই যে আমি সুমেরিয় ভাষা জানি। তবে আমি তাকে আবার হতাশ করে কথাগুলো তরজমা করার জন্য ফাট তুরের দিকে তাকালাম। নিমরদের ফাঁদগুলো এড়িয়ে যাওয়াটা আমি বেশ উপভোগ করছিলাম। অনেকটা এটনের সাথে বাও খেলার মতোই মনে হচ্ছিল।

নগরীর দেয়ালের বাইরে আমাদের পল্টনের শিবির থেকে রূপা আনার জন্য জারাস আর হুইকে পাঠালাম। পঞ্চাশজন লোক দুটি চার চাকার গাড়িতে রূপাগুলো আনলো। শেষ পর্যন্ত সভা কক্ষের মেঝেতে যখন এগুলো স্তূপ করে রাখা হল তখন দৃশ্যটি দেখতে বেশ সুন্দর লাগছিল। চকচকে রূপার স্কুপটির চারদিকে ঘুরে ঘুরে নিমরদ পিণ্ডগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলেন আর এমনভাবে এগুলোর সাথে কথা বলতে লাগলেন যেন এগুলো তার পোষা প্রিয় কোনো প্রাণী।

সেই সন্ধ্যায় আবার নিমরদ আমাদের সম্মানে একটি ভোজের আয়োজন করলেন। এবার মদটি আগের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। তবে এই মদ খাওয়ার ফলে অতিথীকর্তা আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের আচরণ খুব একটা প্রশংসার যোগ্য ছিল না। ভোজে যেসব মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অর্ধেকেই নিমরদ আর তার লোকদের বিকৃত কামনার শিকার হল।

সৌভাগ্যবশত আমার দুই রাজকন্যাকে তাদের কামরায় তালা বন্ধ করে রেখেছিলাম আর জারাস বারোজন সৈন্য নিয়ে তাদের দরজায় পাহারায় ছিল।

.

যে ছয়টি রণতরী নিমরদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল, সিডন বন্দরে সেগুলোর মেরামত কাজ চলছিল। ফামেনথ মাসের শেষে ওগুলো আমাদের হাতে আসবে।

এই সময়টুকু আমি রাজা নিমরদ আর তার উপদেষ্টাদের সাথে হাইকসোদের বিরুদ্ধে আসন্ন যৌথ হামলার বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা চালিয়ে গেলাম। আমি সেনাপতি রেমরেমকে ব্যবিলনে ফারাওয়ের সামরিক দূত হিসেবে থাকার জন্য মনোনীত করেছিলাম।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কর্নেল হুইকে রেমরেমের সহকারী হিসেবে থাকার জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম। আমার অভিভাবকত্বে হুই রথযুদ্ধের বিজ্ঞানে সবচেয়ে দক্ষ নায়ক হয়ে উঠেছিল। আমি জানি যখন মধ্যসাগরের উপকূল জুড়ে উত্তর মিসরে আমরা হাইকসোদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবো তখন তার অভাব খুব অনুভব করবো। কিন্তু বেকাথা তার প্রতি যেরকম বিরূপতা দেখাচ্ছে সেক্ষেত্রে তাকে আমাদের সাথে ক্রিটে নিতে গেলে সে হৈ চৈ শুরু করে দেবে।

.

রূপাগুলো পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিমরদের সেনাবাহিনীর কারখানাগুলোতে পুনর্দোমে কাজ চলতে লাগলো। নতুন বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন শুরু হল, পুরোনো রথগুলো মেরামত করা হল আর আমার দেওয়া নকশা মোতাবেক উন্নত প্রযুক্তির শত শত নতুন রথ তৈরি হতে লাগলো। নতুন যোগদান করা সেনাসদস্যদের পদচারণায় ব্যবিলনের রাস্তাগুলো প্রকম্পিত হয়ে উঠলো হল আর বাজারগুলোও ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষিতে মুখরিত হল।

ফাট তুর এবং তার গুপ্তচরদের কাছ থেকে আমি জানতে পারলাম সুমেরিয়ার প্রতিটি শহরে একই রকম সমর প্রস্তুতি নতুন জীবন দান করেছে। বেকার প্রাক্তন হাজার হাজার সুমেরিয় যোদ্ধা আবার রাজার সেনাদলে যোগ দিতে ফিরে এলো।

যে কাজটি আমি শুরু করেছিলাম তা অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল ছিল, আর সুমেরিয়া ভাষা না জানার ভান করায় বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়লো। কাজেই আমি আমার আতিথ্যকর্তাদের সাথে শিশুর মতো ভাঙা ভাঙা সুমেরিয় বলতে শুরু করলাম। দিনে দিনে তা আরও সাবলিল এবং ব্যাকরণগতভাবে সঠিক হতে লাগলো। এমনকি রাজা নিমরদও সভাসদদের সাথে কথা বলার সময় আমার উপস্থিতিতে আমাকে লক্ষ্য করে অপমানজনক উক্তি করা থেকে বিরত হলেন। শিঘ্রই আমিও তাদের ভাষায় তাদের সাথে বিভিন্ন রকম শব্দ কৌতুক আর শব্দের খেলা শুরু করলাম।

বিকেলগুলোতে আবহাওয়া একটু ঠাণ্ডা হয়ে এলে আমি আমার দুই রাজকুমারীকে সাথে নিয়ে ইউফ্রেটিস নদীতে সাঁতার কাটতে যেতাম কিংবা শহরের সীমানার বাইরে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ি এলাকায় ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতাম। অনেক সময় অনেক দূবরর্তী জায়গায় এসেও হঠাৎ জারাসের মুখোমুখি হলে আমার বেশ মজা লাগতো। মনে হত কেউ যেন তাকে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে যে আমরা এখানে আসবো। তবে এটা অবশ্যই তেহুতি হতে পারে না। কেননা তাকে আমাদের পথে দেখতে পেয়ে সে আমার থেকেও বেশি অবাক হত বা অবাক হওয়ার ভান করতো।

সন্ধ্যায় প্রায়ই আমাদের আতিথ্যকর্তা কিংবা আমার সেনাপতিদের সাথে নৈশভোজের আমন্ত্রণ থাকতো। এই সব ভোজে নিমরদ উপস্থিত থাকলে আমি দুই রাজকন্যাকে আমার কাছাকাছি বসাতাম যাতে তাদের উপর নজর রাখতে পারি।

সমস্ত কাজকর্ম সারার পর রাতে বারান্দায় একা বসে সেই ঘোমটায় ঢাকা নারীমূর্তির ফেরার অপেক্ষা করতাম। রাতের পর রাত তিনি আমাকে হতাশ করলেন।

ব্যস্তভাবে দিনগুলো দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। তারপর একদিন সিডন বন্দরের নৌঘাঁটি থেকে খবর এলো নিমরদের কাছে কেনা ছয়টি রণতরী বেঁধে দেওয়া সময়সীমার বিশদিন আগেই পানিতে ভাসাবার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। লটবহরসহ আমাদের কাফেলা মধ্য সাগরের উপকূলে সিডন বন্দর পৌঁছাতে প্রায় দশ দিন লেগে যেতে পারে। আমি জারাস আর হুইকে ব্যবিলন থেকে উপকূল যাত্রার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় রাজকুমারীদেরকে প্রাসাদের পূর্ব পাশে তাদের কামরায় পৌঁছে দিয়ে চাঁদ ডুবে যাওয়ার আগে আমার কামরায় ফিরে এলাম আমি। ক্রীতদাসেরা কামরায় আর বারান্দায় বিছানার পাশে তেলের প্রদীপে জ্বালিয়ে রেখেছিল। আমার নির্দেশমতো ওরা প্রদীপের তেলে ভেষজ মিশিয়ে দিয়েছিল। এতে যেমন মশা আর অন্যান্য কীটপতঙ্গ দূরে রইল তেমনি আমার সুনিদ্রা আর সুখস্বপ্ন দেখায় সহায়ক হল।

রুস্তি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে পরনের পোশাক খুলে নিয়ে একটি রূপার পানপাত্র বিছানার পাশে রাখলো।

দীর্ঘদিনের সঙ্গী ক্রীতদাস রুস্তি আমার সেবাযত্নের ভার নিজ হাতে তুলে নিয়েছিল। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল গত এক সপ্তাহ আমি রাতে কয়েক ঘন্টার বেশি ঘুমাই নি। সূতরাং আমার বেশি রাত জাগা ঠিক নয়।

সে চলে যাবার পর বারান্দার বিছানার কাছে গিয়ে মদের পানপাত্রটি তুলে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তৃপ্তির শ্বাস নিলাম। মেশিরে আমার জমিদারিতে নিজের আঙুর বাগান থেকে চোলাই করা আনা দশ বছরের পুরোনো উৎকৃষ্ট মদ। তারপর ফিরে দেবীর মন্দিরের বারান্দার দিকে তাকালাম। তবে সেখানে কেউ নেই। ঘোমটায় মুখ ঢাকা সেই নারীমূর্তিটিকে দেখার পর কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে।

মার্বেল পাথরের মেঝের উপর পায়চারি করতে করতে সেদিন সন্ধ্যায় রাজার সাথে যে আলোচনা হয়েছিল তার বিশেষ দিকগুলো মনে মনে ভাবতে লাগলাম।

হঠাৎ মাঝপথে থেমে পড়লাম। চাঁদের আলোর রং বদলে গিয়ে অতিসূক্ষ সোনালি জ্যোতি ছড়িয়েছে। মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকালাম। সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এখানে কোনো অনৈসর্গিক শক্তি কাজ করছে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হতে পারলাম না এই শক্তি মঙ্গলকর না ক্ষতিকর। অমঙ্গল এড়াতে দুই আঙুলে হোরাসের চিহ্ন আঁকলাম, তারপর এই রহস্যময় শক্তির নিজেকে প্রকাশিত করার জন্য নীরবে অপেক্ষা করে রইলাম।

ক্রমশ সচেতন হলাম রাতের উষ্ণ বাতাসে একটি অতিসুক্ষ এবং বিস্মৃতিপ্রবণ সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছে। এ-ধরনের সুগন্ধ এর আগে কখনও অনুভব করিনি। তারপরও আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে উঠছে। অনুভব করলাম আমার ঘাড় আর কাঁধ থেকে অস্বাভাবিক কিন্তু প্রীতিকর একটি চাঞ্চল্য জেগে উঠে মেরুদণ্ড বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। এটি আমার কাছেই একটি শক্তির উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করলো।

আমি ঘুরে এর মুখোমুখি হতেই চমকে উঠতেই আমার হাত থেকে মদের পানপাত্রটি সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। একটি মুহূর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হল, তারপর আবার একটি ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দের মতো ধকধক করে উঠলো।

মন্দিরের সেই রহস্যময়ী নারীটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন; এতো কাছে যে মাথা ঢাকা কাপড়ের ছায়ার নিচে আমি তার চেহারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারবো, কিন্তু আমি কোনো নড়াচড়া করলাম না।

শেষপর্যন্ত কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে চাপাস্বরে বললাম, আপনি কে?

আমার নাম ইনানা।

তার উত্তর শুনে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। তার কণ্ঠের আওয়াজটি আমার কানে স্বর্গীয় সঙ্গীতের মতো অনুরণিত হল। আমি সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এতো সুন্দর শব্দ কোনো মানব কণ্ঠ থেকে বের হতে পারে না। আর যে কথাটি তিনি বলেছিলেন তার অর্থও অত্যন্ত লক্ষণীয়। ইনানা ছিল সেই সময়ের শুরু থেকে দেবী ইশতারের প্রাচীন নাম।

আমি শুধু বললাম, আমার নাম তায়তা।

নাম ছাড়া নিজের সম্পর্কে আর কিছু জানো তুমি? এমনকি তোমার বাবা মারও নাম জানো না। একথাটি বলে সহানুভূতি সহকারে মৃদু হাসলেন।

আমি বললাম, না জানি না। সমবেদনা নিয়ে তিনি আমার দিকে এক হাত বাড়ালেন আর কোনো ইতস্তত না করে আমি তার হাত ধরলাম। সাথে সাথে অনুভব করলাম তার দেহ থেকে উত্তাপ আর শক্তি আমার দেহে সঞ্চারিত হল।

ভয় পেয়োনা তায়তা। আমি তোমার বন্ধু, আর বন্ধুর চেয়েও বেশি।

না, আমি ভয় পাইনি ইনানা। তিনি আরেক হাত বাড়িয়ে দিলেন আর হাতটি ধরতেই আমাদের মাঝে রক্ত এবং মনের একটি শক্তিশালী বন্ধনের অস্তিত্ব অনুভব করলাম।

সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, আমি আপনাকে চিনি! মনে হচ্ছে সেই শুরু থেকেই চিনি। বলুন আপনি কে।

আমার সম্পর্কে বলার জন্য এখানে আসিনি। তোমার সম্পর্কে বলার জন্য এসেছি আমি। আমার সাথে এসো তায়তা। তখনও আমার দুই হাত ধরে তিনি আমাকে নিয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বারান্দা থেকে আমার শয়নকক্ষের দিকে চললেন। তার পায়ের চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। কেবল তার পরনের ঘাগরার মৃদু খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমার মনে হল তার পা মাটি ছুঁয়ে চলছে না, মাটি থেকে একটু উপরে শূন্যে তিনি ভেসে চলেছেন।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত সুন্দর যে কামরায় আমি থেকে এসেছি তার প্রতি ইঞ্চি জানতাম। তবে এখন দেখলাম বিপরীত দিকের দেয়ালে একটি দরজা দেখা যাচ্ছে যা এর আগে আমার চোখে পড়েনি। ইনানা আমাকে নিয়ে দরজাটির দিকে এগোতেই এটি আপনাআপনি খুলে গেল। দরজার ওপাশে ভীষণ অন্ধকার। তারপরও হাত ধরাধরি করে আমরা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়তেই অন্ধকার চারদিক থেকে আমাদেরকে গ্রাস করে ফেললো। আমরা নিচের দিকে নামতে লাগলাম, তবে তিনি আমার হাত ধরে রইলেন আর আমার মনে কোনো ভয় এলো না। নিচের দিকে নামার সময় এতো জোর বাতাস আমার মুখে ঝাঁপটা মারছিল যে আমাকে চোখ বন্ধ করে রাখতে হল। মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে আমরা অন্ধকারে উড়ে চলেছি, তবে আমি জানি সময় এখানে একটি মায়া। তারপর একসময় পায়ের নিচে শক্ত মাটি অনুভব করলাম, আর নড়াচড়া করছি না। সেখানে প্রথমে একটু মৃদু আলো দেখা গেল। আমি আবার ইনানার মাথার আকার দেখতে পেলাম, তারপর ধীরে ধীরে এর নিচে তার পুরো অবয়ব ফুটে উঠলো। দেখলাম আমার মতো তিনিও পুরোপুরি নগ্ন।

আমার দীর্ঘ জীবনে আমি অনেক সুন্দরি নারীর শরীর দেখেছি। তবে ইনানা তাদের সকলকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছেন। চওড়া নিতম্বের উপর সরু কোমর তার সুগঠিত দৈহিক সৌন্দর্যকে মনোরম করে তুলেছে। তিনি আমার মতোই লম্বা আর তার সারা দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গ এমন নিটোল আর মসৃণ যে আমি হাত বাড়িয়ে তাকে না ছুঁয়ে পারলাম না। হালকাভাবে তার কোমরের কাছ থেকে বাহু বেয়ে আমার আঙুলের ডগা কাঁধ পর্যন্ত বুলিয়ে নিলাম। রেশমের মতো মসৃণ চামড়া তবে তার নিচের পেশি অনমনীয়।

চুল উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা ছিল, তবে মাথা একবার ঝাঁকাতেই ঢেউ খেলানো লম্বা চুল কাঁধের দুপাশ দিয়ে ঝলমলিয়ে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এলো। সারা দেহে কোনো পশম নেই।

আলো তখনও বেড়ে চলছিল আর এবার আমি বুঝতে পারলাম আমরা ব্যবিলন নগরীর বাইরে অনেক উঁচুতে শূন্যোদ্যানের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছি। চতুর্দিকে চমৎকার লতাগুল্ম আর ফুলগাছ আমাদেরকে জড়িয়ে রয়েছে, তবে ইনানার সৌন্দর্যের কাছে এগুলো ম্লান হয়ে রয়েছে। তিনি কাঁধ থেকে আমার হাত নিয়ে একটার পর একটা হাতে চুম্বন করলেন। আবেশে আমার সারা দেহ শিহরিত হল।

আপনি আমার কাছ থেকে কী চান, ইনানা? কণ্ঠস্বরটি শুনে মনে হল এটি আমার নয়।

আমি তোমার সাথে মিলিত হতে চাই।

আমি লজ্জায় ফিসফিস করে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি একজন পূর্ণ মানুষ নই। অনেক দিন আগেই আমাকে খোঁজা করা হয়েছে।

শান্ত ভাবে সমবেদনার স্বরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। যখন এটা করা হয় তখন আমিও সেখানে ছিলাম। তুমি যেমন ছুরির ধার অনুভব করছিলে তেমন আমিও তা অনুভব করছিলাম। আমি তোমার জন্য কেঁদেছিলাম তায়তা। তবে নিজের জন্য আনন্দিত হয়েছিলাম। যুগলে হওয়া মানে মিলিত হওয়া নয়। আমি শুধু ক্ষণস্থায়ী দৈহিক মিলনের কথা বলছি না।

তাহলে আর কিসে একজন নারী আর পুরুষের মধ্যে মিলন হয় ইনানা?

দেহের পরিবর্তে আত্মার মিলনের কথা বলছি। দুটি উচ্চতর মনের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার কথা বলছি। আর তাই হচ্ছে অস্তিত্বের একটি প্রকৃত অলৌকিক দৃষ্টান্ত–যা খুব কমই পূর্ণতা পায়।

তিনি আমাকে রহস্য উদ্যানের সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে টেনে নামালেন। রেশমের মতো নরম। তিনি দ্রুত সপীল ভঙ্গিতে আমার উপর এলেন আর আষ্টেপিষ্টে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের দুজনের দেহ এক হয়ে মিশে গেল। আমার বুকে তার হৃৎস্পন্দন অনুভব করলাম।

ক্রমশ আমাদের দুটি হৃদপিণ্ড একটি অঙ্গ হয়ে স্পন্দিত হতে লাগলো। দুজনের মিলিত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঐকতানে দুটি ফুসফুসকে ধারণ করলো। এরকম আবেগ জনিত এবং তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি আমি আর কখনও অনুভব করিনি। আরও গভীরভাবে তার দেহের সাথে আচ্ছন্ন হয়ে আমার দেহের মাঝে তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলতে চাচ্ছিলাম যাতে আমরা দুজন একটি মাত্র দেহে পরিণত হই।

অনুভব করলাম তার মন আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এই অনুভূতি আমাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুললো, আমি অসহায়বোধ করতে লাগলাম। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তবে বুঝতে পারলাম তার মতো আমিও তার মনের দখল নিতে চেষ্টা করছি। তিনি আমার সকল স্মৃতি নিয়ে নিতেই আমিও তারগুলো সঞ্চিত করলাম। দুজনের মাঝে কোনোকিছুই আর হারালো না কিংবা মন থেকে মুছে গেল না। আমরা এমন একটি অস্তিত্বের অংশীদার হলাম যা সুদূর অতীত থেকে শুরু হয়েছে।

ফিসফিস করে বললাম, এখন আমি জেনেছি কে আমার বাবা?

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কে? প্রশ্নটি করলেও তিনি উত্তরটি জানতেন। আর উচ্চারণ না করলেও আমি প্রশ্নটি শুনেছিলাম।

স্বর্গীয় নীরবতার মাঝে আমি উত্তর দিলাম, তিনি হচ্ছেন রাগ এবং নৈতিকতার দেবতা, মেনিওটস।

ইনানা জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তোমার মা কে?

আমরা দুজনে যে একটি মাত্র মনের অংশীদার ছিলাম, সেই মন থেকে উত্তরটি খুঁজে নিয়ে আমি বললাম, সেলিয়া ছিলেন আমার মা। তিনি একজন মরণশীল মানুষ ছিলেন। আমাকে জন্ম দেওয়ার পর তিনি মারা যান।

তুমি একজন নর-দেবতা তায়তা। পুরোপুরি মানুষও নও আবার সম্পূর্ণ দেবতাও নও। দীর্ঘজীবি হলেও তোমাকে একদিন মরতে হবে। তিনি শক্ত করে তার আত্মা দিয়ে আমার আত্মাকে চেপে ধরে বললেন, যদিও তার অনেক দেরি। যেদিন এটা হবে তখন আমি তোমাকে ধরে রাখবো। তারপর তুমি চলে যাবার পর হাজার বছর তোমার জন্য শোক করবো।

তুমি কে ইনানা? কেন আমি তোমাকে দেহমনে এতো আপন মনে করছি? তোমারা বাবা কে?

এবার তিনি সরাসরি উত্তর দিলেন, আমার বাবা হলেন আলোর দেবতা, হাইপেরিয়ন। তিনি মেনিওটসের ভাই। কাজেই তুমি আর আমি, দুজনেই একই দেবসূলভ রক্তধারার।

আমি নীরবে উত্তর দিলাম, প্রশ্নটি করার আগেই উত্তরটি আমি পেয়েছি। আর তোমার মা? তিনি কী একজন মরণশীল মানবী না দেবী ছিলেন?

ইনানা উত্তর দিলেন, আর্টেমিস আমার মা।

আমি বললাম, আর্টেমিস হচ্ছেন শিকার এবং সমস্ত বন্য প্রাণীর দেবী। আবার তিনি একজন কুমারী দেবী এবং কুমারীদেরও দেবী। কী করে তিনি একজন কুমারী আবার সেই সাথে তোমার জন্মদাত্রী মা হতে পারলেন?

তুমি তো জানো তায়তা, আমাদের মতো দেবদেবী এবং উপ-দেবতার পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। আমার জন্মের এক ঘন্টা পর আমার বাবা হাইপেরিয়ন আমার মায়ের কুমারীত্ব ফিরিয়ে দেন।

তার বাবা যে চমৎকার সমাধান দিয়েছিলেন তার বাস্তবতার কথা ভেবে আমি মৃদু হাসলাম আর অনুভব করলাম ইনানাও মৃদু হেসেছেন। তারপর বললেন, তবে আমার মায়ের মতো আমিও একজন কুমারী এবং সকল দেবতার পিতা জিউসের এক অধ্যাদেশ বলে আমি চিরকাল কুমারীই থাকবো। এটা হচ্ছে আমার জন্য একটি শাস্তি, কেননা আমার পিতামহ জিউস যখন আমার সাথে অজাচারী হয়ে যৌনসঙ্গম করতে চেয়েছিলেন তখন আমি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম।

আমি তাকে সমবেদনা জানিয়ে বললাম, সামান্য অপরাধে এটি একটি নিষ্ঠুর শাস্তি।

কিন্তু আমি তা মনে করি না তায়তা। আমার মনে হয় এটি অত্যন্ত সদয় এবং মধুরতম একটি শাস্তি। আর নয়তো এতোগুলো বছর যে চলে গেল আর আগামী আরও অনেক বছর কীভাবে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা থাকবো। আর তারপরও আমাদের কৌমার্য আর পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রেখে?

কে আমাদের ভবিতব্য বলতে পারবে ইনানা? তুমি যে সময়ের কথা বলছো সেই সুদূর অতীতে তো আমার জন্মও হয় নি।

তোমার যখন জন্ম হয় তখন আমি সেখানে ছিলাম তায়তা। আর যখন তোমার পুরুষত্ব তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তখনও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন কেঁদেছিলাম, যদিও জানতাম সেই ভয়ঙ্কর কর্মটির কারণে হাজার বছর ধরে আমরা কীভাবে উপকৃত হব।

তুমি হাজার বছরের কথা বলছো? এতোকাল কি আমরা একসাথে থাকবো ইনানা?

তিনি সরাসরি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, তুমি হয়তো জানেনা, তবে তোমার জন্মের পর থেকেই আমি খুব কাছে থেকেই তোমার গতিবিধি অনুসরণ করেছি। তোমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তা সবই আমি জানি। তোমার ছোটখাট প্রতিটি আনন্দ-বেদনা আমি লক্ষ্য করেছি।

কিন্তু কেন আমি, ইনানা?

কারণ আমরা এক সত্তা তায়তা। আমরা একই রক্তের এবং আমাদের নিঃশ্বাস একই।

আমি বললাম, তোমার কাছে লুকাবো না। তোমার মতো আমি কিন্তু বিশুদ্ধ নই। আমার জীবনে আমি অন্য নারীর সাথে দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছি।

ইনানা দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, তুমি একজন নারীর সাথেই মিশেছো তায়তা। যখন এটা হয় তখনও আমি সেখানে ছিলাম। আমি তোমাকে সাবধান করতে পারতাম, কেননা এই ক্ষণিকের আনন্দের কারণে তুমি চরম মূল্য দিয়েছে, তোমার উপর খোঁজা করার ছুরি চালানো হয়েছিল। তার নিঃশ্বাস আমার মুখে অনুভব করছিলাম আর আমার হৃদয়ে তার মনের দুঃখ অনুভূত হল। তারপর তিনি বলে চললেন, আমি এই কষ্ট থেকে তোমাকে রেহাই দিতে পারতাম। কিন্তু যদি তা করতাম, অর্থাৎ এর পরিণতি কী হবে তা তোমাকে জানাতাম, তাহলে এখন তুমি আর আমি অনন্তকাল ধরে যে স্বর্গীয় শুদ্ধতায় যুগল হতে পেরেছি তা কখনও পারতাম না।

তার কথাটি শুনে আমি একটু ভাবলাম তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, তিনিও আমার সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আমি স্বীকার করলাম, এটা অনেকদিন আগে ঘটেছিল, মেয়েটার চেহারাও আমার মনে নেই। এমনকি তার নামটাও মনে পড়ছে না।

তিনি ফিসফিস করে বললেন, এর কারণ আমি তোমার মন থেকে সেই স্মৃতি মুছে ফেলেছি। যদি তুমি চাও, তবে সেই স্মৃতি আবার ফিরিয়ে দিতে পারি আর তুমি পরবর্তী পাঁচ হাজার বছর তা তোমার মনে রাখতে পারো। তবে তা তোমার মনে কোনো খুশি বয়ে আনবে না। তুমি কি তা চাও?

সেই দুঃখি বেচারিকে আমি এখন অস্বীকার করে বললাম, তুমি জানো যে আমি তা চাই না। একসাথে ভাগাভাগি করে দুঃখকষ্টের দিনগুলো কাটাবার সময় আমরা একে অপরকে একটু স্বস্তি দিয়েছিলাম। সে আমাকে ভালোবাসা দিয়েছিল। তবে অনেকদিন আগে স্থান ও কালের অতল গহ্বরে সে হারিয়ে গিয়েছে। যেখানে সে চলে গেছে সেখানে কেউ তাকে অনুসরণ করতে পারে না; এমনকি একজন খোঁজা উপদেবতাও নয়।

এই মুহূর্তটির কাছে নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলাম। দুজনের দেহ আর মন পরস্পর সংবদ্ধ হওয়ার পর সময় আর নদীর মতো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে না। এটি একটি প্রশান্ত সমুদ্রে পরিণত হল, যেখানে আমরা একত্রে ভেসে বেড়াতে লাগলাম; প্রতিটি মুহূর্তের আমেজ উপভোগ করতে লাগলাম যেন তা অনন্তকালের একটি অংশ। তিনি আমার আত্মার প্রতিরোধকে সমর্থন দিয়ে অশুভের বিরুদ্ধে একে আরও জ্ঞানী এবং অভেদ্য করে তুললেন।

দুজনে মিলে আমরা একটি আধ্যাত্মিক মর্যাদার অবস্থান অর্জন করলাম।

এক অনন্তকাল পর আমার আত্মা তার সাথে কথা বললো, এটা শেষ হোক, তা আমি চাই না ইনানা। আমি এভাবেই তোমার সাথে চিরকাল থাকতে চাই।

তারপর আমি আমার ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বরকে উত্তর দিতে শুনলাম:

তুমি আমার একটি অংশ আর আমিও তোমার একটি অংশ তায়তা। তবুও একই সাথে আমরা আলাদা এবং নিজেকে নিয়ে সম্পূর্ণ। আমাদের নিজেদেরও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, যেখানে আমাদেরকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। আমাদের নিজেদের আলাদা আলাদা নিয়তি রয়েছে আর তা আমাদের একাই সমাপন করতে হবে।

আমি মিনতি করে বললাম, দয়া করে আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।

এবার আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে তিনি বললেন, এখন আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। এখন আমার যাওয়ার সময় হয়েছে।

আবার কি ফিরে আসবে?

হ্যাঁ আসবো।

আমি বললাম, কোথায়?

যেখানেই তুমি থাক।

কখন ইনানা? কখন আবার তোমাকে দেখতে পাবো?

একদিন, এক বছর কিংবা হাজার বছর পর। অনুভব করলাম আমার আলিঙ্গন থেকে তার বাহু আলাদা হল।

আমি আবার অনুনয় করলাম, আরেকটু থাকো। কিন্তু তিনি ততক্ষণে চলে গেছেন। আমি উঠে বসলাম। হতবুদ্ধি হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রাসাদের বারান্দায় ছোট খাটে আমি শুয়ে আছি। এক লাফে উঠে দৌড়ে শয়নকক্ষে গেলাম। বড় কামরাটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে দরজাটা খুঁজলাম, যার মধ্য দিয়ে সেই রহস্যময় উদ্যানে ইনানা আর আমি উড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেখানে কোনো দরজা দেখতে পেলাম না।

ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে তন্ন তন্ন করে দেয়ালটা পরীক্ষা করতে শুরু করলাম। আঙুল বুলিয়ে দরজার ফাঁক খুঁজার চেষ্টা করলাম। দেয়ালে মসৃণ পলেস্তারা করা রয়েছে। মনে পড়লো ইনানা কী বলেছিলেন।

তোমাকে জানতে হবে তায়তা, আমাদের মতো দেবতা আর উপ-দেবতার পক্ষে সবকিছু সম্ভব।

মনে হল শেষ যখন এই জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সময়ের মাঝে এমন কী কোনো মাত্রা আছে, সুদূর সেই যে জায়গায় ইনানা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন? ভাবলাম, যদি তেমন কোনো জায়গা থাকে, যখন আমি সেই জগতে ছিলাম তখন কি এই পৃথিবীতে সময় নিশ্চল হয়ে ছিল?

যখন বাস্তবতা থেকে কল্পনা আর মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার চেষ্টা করছিলাম, তখন আমার চোখ পড়লো কামরার ঠিক মাঝখানে মেঝেতে দাঁড় করে রাখা বড় একটি ব্রোঞ্জের কলসের মতো আকৃতির ফুলদানির দিকে। ফুলদানিটিতে বড় এক গুচ্ছ গোলাপফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সামনে এগিয়ে কাঁটাওয়ালা উঁটিতে ফুটন্ত গোলাপগুলো পরীক্ষা করলাম। শেষ যেরকম তাজা দেখেছিলাম, এখনও সেরকমই রয়েছে।

আমি জোরে জোরে বলে উঠলাম, আমার অবর্তমানে হয়তো এগুলো বেশ কয়েকবার বদলানো হয়েছে। তারপর নিচে তাকালাম। মার্বেল পাথরের মেঝেতে একটি লাল গোলাপ পড়ে রয়েছে। মনে পড়লো গত সন্ধ্যায় ফুলের সুগন্ধ নেবার জন্য গোলাপের গুচ্ছ থেকে এই ফুলটি বোঁটা থেকে ছিঁড়েছিলাম, তারপর এটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলাম যাতে পরে প্রাসাদের পরিচারকেরা তা পরিষ্কার করতে পারে।

আমি মেঝে থেকে ফুলটা তুলে গন্ধ শুঁকে দেখলাম আগের মতোই সুগন্ধ। তারপর আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম পানি না দেওয়া সত্ত্বেও ফুলটি বোঁটা থেকে ছেঁড়ার সময় যেরকম ছিল এখনও ঠিক সেরকমই তাজা আর অমলিন রয়েছে।

তাহলে আমি যে ধারণা করেছিলাম স্বর্গীয় আলিঙ্গনে আমি আর ইনানা এক জীবন কাটিয়েছি, আসলে তার বদলে কেবল এক রাত কাটিয়েছি? ভাবলাম, এটি কী করে সম্ভবপর। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলাম।

দরজার বাইরে মিসরি ভাষায় মানুষের কথা বলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, বাইরে কে?

রুস্তির কণ্ঠ শোনা গেল, আমি রুস্তি প্রভু।

কয়েক মুহূর্ত পর সে দরজার কাছে উদয় হল।

আমি বললাম, তুমি কোথায় ছিলে?

সে বললো, আপনি তো আমাকে বলেছিলেন সূর্য দিগন্তের উপরে উঠার পর আপনাকে জাগাতে।

কখন একথা বলেছি?

কেন গতরাতে আমাকে বিদায় দেবার সময় বলেছিলেন? তার মানে আমি কেবল এক রাত দূরে ছিলাম। কিংবা হয়তো এটা আদৌ ঘটেনি। হয়তো পুরোটাই একটি স্বপ্ন ছিল, তবে আমি মরিয়া হয়ে আশা করছিলাম এটা তা হতে পারে না। এর মধ্যেই আমার আবার ইনানার সাথে অভিসারের আকাঙ্খ হচ্ছে, অবশ্য যদি সে আমার মনের অলীক কল্পনা না হয়ে আসলেই বাস্তব হয়। কল্পনা না বাস্তব, ইনানা কি আর সে কে; এই রহস্যের উত্তর কি কখনও পাবো?

আমি ভুলে গিয়েছিলাম রুস্তি, আমাকে ক্ষমা কর।

অবশ্যই প্রভু। তবে আপনি নন বরং আমিই ক্ষমা চাইবো। রুস্তি চমৎকার একজন মানুষ আর আমি তাকে সত্যি ভালোবাসি। যাইহোক তাকে আবার মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, ভুলো না, আর পাঁচ দিনের মধ্যে আমরা সিডন রওয়ানা দিচ্ছি। সবকিছু গোছগাছ করে আবার সফরের প্রস্তুতি নাও।

আমি বেশিরভাগ জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিয়েছি। এক ঘন্টার মধ্যেই আমি রওয়ানা দিতে প্রস্তুত।

৬. পরবর্তী পাঁচটি দিন

পরবর্তী পাঁচটি দিন ব্যবিলনে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। নিমরদ আর তার সভাসদদের সাথে শেষ বারের মতো সাক্ষাতকার, দুই জাতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর আর চুক্তি মোতাবেক আমি যে কথা দিয়েছিলাম বাকি রূপা থিবসে নিমরদের প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হবে, তার ব্যবস্থা করা। মনে মনে খুশি হলাম যে, বাহককে বাকি ২৭ লাখ রূপা প্রদানের জন্য বাজপাখি সীলমোহর দিয়ে স্বাক্ষরিত আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পত্রটি যখন ফারাও ত্যামোসের সামনে উপস্থিত করা হবে তখন আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না।

সর্বোপরি আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে ক্রিটে নিয়ে যাবার জন্য সর্বাধিরাজ মিনোজ ব্যবিলনে যে দূত পাঠিয়েছেন তার আগমন। উচ্চপর্যায়ের সফরসঙ্গি নিয়ে কুমুসস বন্দর থেকে রণতরীর বহর নিয়ে সে রওয়ানা দিয়েছিল। জাহাজগুলো সিডন বন্দরে রেখে সফরসঙ্গীদের নিয়ে স্থলপথে দূত আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে।

তার নাম তোরান, মিনোয়ান ভাষা থেকে অনুবাদ করার পর এর অর্থ হয় যাঁড়ের পুত্র। সে একজন সুদর্শন ব্যক্তি আর পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী একজন রাজার প্রতিনিধি হিসেবে বেশ জাঁকজমকের সাথে সফরে এসেছে। রাজা নিমরদ তার সফরসঙ্গীদের থাকার জন্য প্রাসাদের পুরো একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছেন। ক্রিটের অতিথিদের আপ্যায়ন এবং আহার বিহারের ব্যবস্থা করার জন্য নিমরদকে আমার দেওয়া তিন লাখ রূপার বেশ কিছু অংশ খরচ করতে হচ্ছিল। তাই তিনি চাচ্ছিলেন তোরান যেন অতি শিঘ্রই ক্রিটে ফিরে যায়।

সুন্দর চেহারা এবং রাজকীয় আচার আচরণ ছাড়াও তোরান ছিল তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন এবং বিচক্ষণ একজন লোক। এযাবত আমি যত বুদ্ধিমান মানুষের মোকাবেলা করেছি সে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের মধ্যে একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধার বন্ধন সূচিত হল; আর সেই সাথে আমরা একে অপরের উচ্চস্তরের গুণাবলি শনাক্ত করতে পারলাম।

একটি বিষয়ে অবশ্য আমরা উভয়ে এক মত ছিলাম, আর তা হল বর্বর হাইকসোদের প্রতি চরম ঘৃণার মনোভাব পোষণ করা। কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই গর্হিতভাবে তামিয়াতে ক্রেটান দুর্গে বর্বর হাইকসোদের হামলা আর পরবর্তীতে সেখানে বন্দী ক্রিট সেনাদের উপর নৃশংসতার ঘটনাটি নিয়ে প্রায় একঘন্টা সমবেদনা জানিয়ে কাটালাম। তোরানের সবচেয়ে ছোট ছেলেটিও সেখানে ছিল, আত্মসমর্পণের পর ওরা তার মাথা কেটে ফেলে।

অবশ্য আমরা কেউই বিশাল তিনটি ক্রেটান যুদ্ধ জাহাজ আর হাইকসোরা যে সর্বাধিরাজ মিনোজের ৫৮০ লাখ রূপার পিণ্ড লুট করে নিয়েছিল তা উল্লেখ করলাম না। ব্যাপারটি এমন, যেন এই বিশাল সম্পদের কখনও অস্তিত্বই ছিল না।

মিসরীয় ভাষায় তোরানের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ লক্ষ্য করে পরিশেষে আমার মনে তোরানের উচ্চ প্রতিভা এবং প্রাগ্রসর ধীশক্তি সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো। বিভিন্ন বিষয়ে আমার বেশ কিছু লেখাও সে পড়েছে এবং তা নিয়ে গবেষণাও করেছে। সে জানালো নৌযুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে আমার গবেষণামূলক প্রবন্ধটি অবশ্যই একটি প্রতিভামূলক কর্ম। এছাড়া আমার বেশকিছু কবিতা সে মিনোয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছে।

দ্বিতীয় দিনে আমরা দুই পরাক্রমশালী জাতির মাঝে প্রস্তাবিত মৈত্রির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। কীভাবে চুক্তিটি সম্পাদিত হবে তার নানা দিক নিয়ে তিন দিন আলোচনা চললো। তারপর চতুর্থ দিনে সন্ধিচুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল। আমি অবশ্য চুক্তিটি মিসরীয় গূঢ়লিপি এবং মিনোয়ান রৈখিক এ-হরফে লিখে রেখেছিলাম।

আমি ভাবলাম এবার রাজকুমারীদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবার উপযুক্ত সময় এসেছে। পরদিন সন্ধ্যায় তাকে আমাদের সাথে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালাম।

মদ এবং খাবারের বিভিন্ন পদগুলো বাছাই প্রক্রিয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধান করলাম। খাবারের তালিকাটি ক্রিটের সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তিটির মতো দীর্ঘ ছিল। তারপর সারা বিকেল আমার দুই রাজকুমারীর অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার প্রস্তুতি নিয়ে কাটালাম। তোরানকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে হবে যাতে সে কুনুসসের রাজপ্রাসাদে রাজকুমারীদের রূপগুণ সম্পর্কে ইতিবাচক বর্ণনা পাঠায় আর এই বিষয়টি আমার জন্য না হলেও মিসরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অত্যন্ত সর্তকতার সাথে থিবস থেকে আনা পোশাকের বিশাল সম্ভার থেকে এমন কাপড় আর রং বাছাই করা হল যা রাজকুমারীদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলে। বেকাথার জন্য গোলাপি আর তেহুতির জন্য সবুজ রং বাছাই করা হল।

যে দুই সৌন্দর্যবিশারদ তাদের রূপসজ্জা করছিল, আমি তাদের পাশে বসলাম। আমি চাচ্ছিলাম রূপসজ্জায় যেন কোনো খুঁত না থাকে। সমস্ত প্রচেষ্টার পর যখন আমি সন্তুষ্ট হলাম, তখন ওদের প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তবে ফলাফল সত্যি চমৎকার হয়েছিল। আমার মেয়েদের চেয়ে বেশি সুন্দর কেবল দেবী ইনানার চেহারাই সেদিন সন্ধ্যায় দেখেছিলাম। আমি জানি তোরান আর ক্রিটে তার প্রভু আমার দুই রাজকুমারীর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারবে না।

সেদিন সন্ধ্যায় নৈশ ভোজের জন্য সুন্দর করে সাজানো টেবিলে তোরান আর অন্যান্য অতিথিরা বসার পর তাদের মদ পরিবেশন করা হল। তারপর আমি দুই রাজকুমারীকে কামরায় প্রবেশ করার সঙ্কেত দিলাম।

বড় দরজা দিয়ে ওরা পাশাপাশি প্রায় ভাসতে ভাসতে ভেতর ঢুকতেই ভোজকক্ষে একটি গভীর নীরবতা নেমে এলো। ওরা ঢোকার সাথে সাথে পুরুষেরা মুগ্ধ হয়ে গেল আর মেয়েরা ঈর্ষান্বিত হল।

রাজকুমারীরা তোরানের সামনে এসে উভয়েই মার্জিতভাবে অভিবাদন করলো।

ওদের পেছন পেছন লক্সিয়াসও এসে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলো। অবশ্য এই ক্রেটান মেয়েটির সাজসজ্জার দিকে আমি তেমন মেনোযোগ দেইনি। সে বরং একটি সাধারণ হাঁটু বের করা বেশ খাটো মেটে রংয়ের পোশাক পরেছিল। তার মুখ আর হাঁটুও অবশ্য দেখতে বেশ সুন্দর, তবে তেমন অসাধারণ কিছু নয়। সে নিজেই তার রূপসজ্জা আর চুলের পরিচর‍্যা করেছে। সে অবশ্যই একজন পরিচারিকা আর এটা তার সৌভাগ্য যে ভোজে তাকেও আমি যোগদান করার অনুমতি দিয়েছিলাম।

এতোগুলো সুন্দরী মেয়ের আগমনে তোরানের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা দেখার জন্য আমি এক পাশে তাকালাম। লক্ষ্য করলাম আমার দুই রাজকুমারীর মাথার উপর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে সে মৃদু হাসছে। সাথে সাথে আমি সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লক্সিয়াস তার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হাসি দিচ্ছে। এবার আমি বুঝতে পারলাম এর আগে কেন সে রেমরেমের প্রশংসা করেছিল, বুঝা গেল বয়ষ্ক পুরুষের প্রতি মেয়েটির ঝোঁক রয়েছে।

সাথে সাথে তোরানের প্রতি আমার মতের বদল হল। সাহিত্যে উন্নত রুচিসহ আচরণে মধুর ও বিনয়ী এবং সেইসাথে পাণ্ডিত্যপূর্ণ একজন কূটনীতিবিদ হলেও মেয়েদের ব্যাপারে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা তার নেই।

আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাদেরকে তোরানের দুইপাশের আসনে বসার জন্য ইশারা করলাম। তাদের প্রতি আমার নির্দেশ ছিল মিনোয়ান ভাষায় তাদের দক্ষতা দেখিয়ে তোরানকে চমকে দিতে হবে। তারপর হলের শেষ মাথায় তার সমবয়সী আমার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বসার জন্য লক্সিয়াসকে ইশারা করলাম।

.

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ তোরান, সেনাপতি রেমরেম আর ঊর্ধ্বতন সুমেরিয় সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আমি রাজা গোরাবের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা আর অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় কাটালাম। ব্যস্ত দিনগুলো দ্রুত উড়ে যেতে লাগলো আর মনে হলো আর কখনও হয়তো আমি একমুহূর্তও অবসর পাবো না।

ব্যবিলন থেকে কাফেলা সিডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার দুদিন আগে শেষ বারের মতো একবার ইশতার দেবীর মন্দিরে যাবার ইচ্ছা হল। আমার মনে খুব আশা ছিল হয়তো মন্দিরে ইনানার কোনো ধরনের চিহ্ন, তার কাছ থেকে কোনো গুপ্ত বার্তা আর নয়তো তার সেখানে উপস্থিতির কোনো দুর্বোধ্য চিহ্ন হলেও পেয়ে যেতে পারি।

ওনিস নামে সবুজ আলখাল্লা পরা দেবীর একজন পুরোহিতের সাথে বন্দোবস্ত করলাম যেন সমস্ত পূজারিরা মন্দির ছেড়ে চলে যাবার পর যখন মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন যেন আমি সেখানে ঢুকতে পারি। ইনানার মতোই ধূসর একটি মাথা ঢাকা আলখাল্লা পরে একাকী সেখানে গেলাম। ছোট পকেট দ্বারের কাছে পৌঁছে দেখলাম ওনিস আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

তার হাতে একটি রূপার মেম মুদ্রা গুঁজে দিয়ে আমি বললাম, আমি একাই যেতে চাই। সে একটু পিছিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে আমাকে সম্মান জানিয়ে গীর্জার মূল অংশের ছায়ার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছাদের উপরের বিশাল সূর্য-আয়নার প্রতিফলিত আলো না থাকায় মন্দিরটি একটি অন্ধকার ভূতুড়ে জায়গায় পরিণত হয়েছে। সবুজ আলখাল্লা পরা কয়েকজন পুরোহিত আর যাজিকা ছাড়া আর কেউ নেই। ছোট ছোট যে কামরাগুলোতে মেয়েরা দেবীর উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক সেবা দেবার জন্য অপেক্ষা করতো সেগুলো সব শূন্য। কয়েকটি জমকালো ফ্রেস্কোর সামনে তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করা রয়েছে।

আঁকা ছবিগুলোর উপর ঢেউ খেলানো আলো নেচে নেচে এগুলোকে রোমাঞ্চকর জীবন দান করছে। আমি কয়েকটা চিত্রের সামনে একটু থেমে এই ছবিগুলো যে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে–সেই পবিত্র ও শুদ্ধ দেবতাদের আসল চরিত্রের সাথে এগুলোর দুস্তর ব্যবধানের কথা ভাবলাম। জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে যখন ইনানা আমাকে শূন্যপথে দীর্ঘ ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন আমি জেনেছি মানুষ দেবতাদের সম্পর্কে যা ভাবে তা বেশিরভাগ তাদের মনের অভিলাসী কল্পনা। প্রার্থনা, উৎসর্গ কিংবা ধার্মিক স্বীকারোক্তির মাধ্যমে দেবকূলকে মানুষ তার ইচ্ছার দিকে ফেরাতে পারে বলে যে কথা বলা হয় তা অত্যন্ত হাস্যকর একটি ধারণা। দেবকূল যা ভালো মনে করেন তাই করেন আর তা শুধু নিজেদের ক্ষমতা আর আনন্দের কারণেই করেন।

গুহাসদৃশ কামরাটির সব জায়গা ধীরে ধীরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এগুলোতে ইনানার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। দেবীকে প্রলুব্ধ করে এখানে এনে তাকে জিতে নেওয়ার প্রচেষ্টায় রাজা মারদুক এই বিশাল স্বপ্ন সৌধটি গড়ে তুলেছিলেন, তবে আমি জানি দেবী কখনও শিকার হন না; বরং তিনিই শিকারী।

মন্দিরের বাইরের দেয়াল ঘিরে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে যাওয়া বারান্দায় উঠলাম। এখানেই মাঝে মাঝে তাকে দেখা গিয়েছিল কিন্তু এখানে কিছুই নেই। উপরে সমতল ছাদে উঠে বিশাল ধাতব আয়নাটির পাশে বসলাম। এখান থেকেই দিনের বেলা নিচে গীর্জার মূল অংশে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করা হয়।

উপরে মধ্যরাতের তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজলাম। কিন্তু সেখানেও তিনি আমার জন্য কিছুই রেখে যান নি। আমার কাছে শুধু তার স্মৃতি আর তিনি যে কথা দিয়েছিলেন আবার ফিরে আসবেন এটিই আছে।

.

নগরীর মূল ফটকের বাইরে রাজা নিমরদ একটি রাজকীয় প্যাভিলিয়ন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পতাকা, ফুল আর পাম পাতাদিয়ে এটি সাজানো হল। যেদিন আমরা সিডনের পথে যাত্রা শুরু করবো সেদিন রাজা এখানে উঁচু মঞ্চে এসে তার স্থান নিলেন।

তাকে ঘিরে দাঁড়াল সুমেরিয় অভিজাত সম্প্রদায়, তার ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতৃবৃন্দ এবং নগরীর বিশিষ্ট নাগরিকগণ। সেনাপতি রেমরেম, কর্নেল হুই আর অন্যান্য যেসব মিসরীয় কর্মকর্তাদের এখানে থাকার কথা তারাও মঞ্চে ছিলেন।

মূল দলের আগেই আগের দিন আমি চাকরবাকর, ক্রীতদাস আর অন্যান্য অসামরিক লোকজনদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাদের সাথে মালপত্র বোঝাই চারচাকার গাড়ি, অতিরিক্ত ঘোড়া আর উটগুলোও ছিল। এখন শুধু রয়েছে কর্মকর্তা আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

আমাদের সমস্ত রথ, অস্ত্রশস্ত্র আর বর্ম মেরামত করা হয়েছে। পলিশকরা জিনিসগুলো রোদে চকচক করছে। ঘোড়া আর উটগুলোকে দানাপানি খাইয়ে, বিশ্রাম দিয়ে পুষ্ট করে তোলা হয়েছে। জারাসও তার লোকজনের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিল যেন তাদের প্রতিও সমান যত্ন নেওয়া হয়। এখন আমাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে পুরোপুরি সজ্জিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত একটি সেনাবাহিনী, যা আমরা আসলেও তাই।

আমাদের দলের অনেকের সাথে স্থানীয় অধিবাসিদের মাঝে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাই এখন এখানে অনেক ক্রন্দনরত নারী দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন আবার পেটে বাচ্চাসহ ফুলো পেট নিয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে একটি উত্তেজনাময় এবং নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তোরান ছিল আমার বাম পাশে আর ডান পাশে আমার দুই রাজকুমারী। লক্সিয়াস মিনোয়ান রাষ্ট্রদূতের পেছনে জায়গা করে নিয়েছিল। এতে আমি খুব একটা অবাক কিংবা বিরক্ত হইনি। অমি জানতে পেরেছি সে আর এখন রাজকুমারীদের সাথে একই কামরায় শোয় না। তোরান বাগদাদে আসার পর থেকেই সে নিজের জন্য আলাদা একটি থাকার জায়গা করে নিয়েছে।

দুই পাশে রাষ্ট্রদূত আর রাজকুমারীদের নিয়ে আমি ঘোড়ায় চড়ে এগোলাম। আমাদের ঠিক পেছন পেছন সেনা-পল্টনের বাদকদল শিঙা, বাঁশি আর ঢাক নিয়ে এলো। নগরীর ফটক পার হয়ে রাজকীয় মঞ্চ বরাবার এসে আমরা থামলাম। আমি ঘোড়া থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠলাম।

রাজা নিমরদের সামনে এসে আমি এক হাঁটু গেড়ে বসার সাথে সাথে বাজনা থেমে গেল আর জনতা শ্রদ্ধাভরে নিশ্চুপ হল। রাজা আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে একজন ভাইয়ের মতো আমাকে আলিঙ্গন করলেন। এটা এজন্য করেছেন, কেননা আমি তার রাজ্য আর সেনাবাহিনী পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনেছি। এছাড়া তাকে আমি একজন ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত করেছি আর তার পিতা রাজা মারদুক যে সম্পদ তছনছ করেছিলেন তার কিছু অংশ পুনস্থাপন করেছি।

আমরা চিরকাল বন্ধুত্বের শপথ নিলাম, আমার পক্ষ থেকে যা ছিল অকৃত্রিম। তারপর আমি বিদায় নিলাম।

ঘোড়ার পিঠে চড়ার পর ডান হাত তুলে আমি যাত্রা শুরু করার ইঙ্গিত করতেই বাদকদল সেনাবাহিনীর নিজস্ব প্রারম্ভিক সুর বাজাতে শুরু করলো।

এমন এক মুহূর্তে আমার বাম পাশ থেকে একটি আদুরে গলা এমনভাবে চিৎকার করে উঠলো যা নগরীর বিশাল দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।

রাজকুমারী বেকাথা চিৎকার করে উঠলো, থামো! সাথে সাথে বাদকদল তাদের বাজনা আর তার সাথে জনতার হৈহুল্লোরও অস্বস্তিকরভাবে থেমে গেল। আমিসহ সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালাম।

শান্ত কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, বাছা? লক্ষ্য করলাম তার সেই পুরোনো বিখ্যাত বদমেজাজে ফেরার উপক্রম করছে। সম্ভবত তার এই মেজাজ হারিয়ে ফেলার পেছনে আমিও কিছুটা দায়ী। অতীতে বেশি বেশি আদর দিয়ে আমি তার এই অবস্থার সৃষ্টি করেছি।

ডান হাত বাড়িয়ে বেকাথা হুইয়ের দিকে নির্দেশ করে সে বললো, হুই কী মনে করেছে, মঞ্চে সেনাপতি রেমরেমের পেছনে লুকিয়ে সে কী করছে অথচ এদিকে আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে বিরান আর হতচ্ছাড়া এক জায়গায় রওয়ানা দিয়েছি। দেখো কী রকম কাপুরুষের মতো ওখানে লুকিয়ে রয়েছে!

লক্সিয়াস বেকাথাকে মনে করিয়ে দিল, তুমিতো বলেছিলে হুইকে আর কখনও দেখতে চাও না।

বেকাথা তার দিকে ফিরে বললো, তুমি এখানে নাক গলাতে এসো না। নইলে কিন্তু খুব পস্তাবে!

এবার তেহুতি লক্সিয়াসের সাহায্যে এগিয়ে এসে বললো, লক্সিয়াস ঠিকই বলেছে। তুমি নিজে বলেছো তুমি হুইকে ঘৃণা করো।

আমি কখনও একথা বলিনি। কখনও ঘৃণা শব্দটা ব্যবহার করিনি।

এবার দুজনেই একসাথে বলে উঠলো, হ্যাঁ তুমি বলেছো। আর তেহুতি আরেকটু এগিয়ে বললো, তুমি একথাও বলেছিলে যে তার মাথা কেটে ফেলবে।

রাগে বেকাথার চোখে পানি এসে গেল। সে বললো, আমি কখনও মাথা কেটে ফেলার কথা বলিনি। আমি শাস্তি দেবার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম তাকে আমি শাস্তি দেবো।

মঞ্চে যারা পেছনদিকে ছিল, তারা সামনের দিকে যারা একটু আধটু মিসরী ভাষা জানে এমন লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলো, সে কী বলছে?

মেয়েটি বলেছে সে কোনো একজনের মাথা কেটে ফেলবে। একথা শুনে ভীড়ের মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চারা আবদার শুরু করলো তাদেরকে বাবামার কাঁধে উঠাতে যাতে ওরা ভালোভাবে মাথা কাটার দৃশ্যটা দেখতে পারে।

এবার আমিও ওদের কথার মাঝে ঢুকে সতর্কভাবে বললাম, আমিও শুনেছি, তুমি বলেছিলে, হুই একজন গেঁয়ো ভূত আর বর্বর লোক।

আমি শুধু বলেছিলাম আমার দিকে তাকিয়ে তার হাসা উচিত হয়নি।

তাহলে তুমি মনে করো সে দেখতে বিশ্রী নয়?

এবার সে চোখ নামিয়ে নিচু কণ্ঠে বললো, এটা সত্যি না। আসলে সে একজন মজার ধরনের সুন্দর মানুষ।

আর তার পাঁচজন স্ত্রী?

সে আমাকে কথা দিয়েছে সে ওদেরকে বাড়িতে ওদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে।

আমি চোখ পিটপিট করলাম। তাহলে ব্যাপার অনেকদূর এগিয়েছে। তারপর বললাম, তাহলে এটা ভালোই হয় তাকে আমরা এখানে ব্যবিলনে রেখে যাই কিংবা তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা মতো তার মাথা কেটে ফেল।

এমন ভয়ানক কথা বলো না তাতা। ঠিক বলছো তো, তুমি কি তাহলে চাও হুই আমাদের সাথে ক্রিট চলুক?

সে হেসে ঘাড় কাত করলো। রেকাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে আমি সবার মাথার উপর দিয়ে চিৎকার করে বললাম, হুই! তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে কুঁচকাওয়াজের জন্য সারিতে দাঁড়াও। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবো না। সূর্যাস্তের আগে পল্টনে যোগদান না করলে তোমাকে বিনা ছুটিতে অনুপস্থিত দেখাবো।

জুতার গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পাঁজরের কাছে লাথি দিতেই ঘোড়া চলতে শুরু করলো। চোখের এক কোণ দিয়ে লক্ষ্য করলাম হুই ব্যস্তসমস্ত হয়ে মঞ্চ থেকে দ্রুত নেমে পড়ছে। রেমরেমের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সে তার বাক্সপ্যাটরা আনার জন্য নগরীর ফটকের দিকে ছুটলো।

মনে মনে বেশ খুশি হলাম। একটি কঠিন পরিস্থিতি থেকে মাত্র উতড়েছি। এতে আমার ব্যক্তিগত কোনো লাভ না হলেও মিসরের শ্রেষ্ঠ রথিকে আবার অধীনে আনতে পেরেছি আর আমার আদরের বেকাথাকে আবার খুশি করেছি।

.

পরবর্তী ছয়টি দিন ইউফ্রেটিস নদীর তীর ধরে উত্তর-পশ্চিমে চলতে লাগলাম। তারপর রেসাফা শহরে পৌঁছে রাজার প্রধান জনপথে পৌঁছলাম। তারপর ঘুরে এই জনপথ ধরে পর্বতের মধ্য দিয়ে উঁই ফুলের শহর আশ-শাম পর্যন্ত গেলাম।

লোহিত সাগর ছেড়ে আসার পর আমরা এক বিশাল বৃত্ত জুড়ে চলছিলাম, যার কারণে একবারও হাইকসো অধিকৃত এলাকার সাতশো লিগের কাছাকাছি হই নি।

জেসমিন শহর থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সরাসরি পশ্চিমে সিডন বন্দরে পৌঁছলাম। এর অবস্থান ছিল মধ্য সাগরের পূর্ব উপকূলের শেষ প্রান্তে। এই অংশটি ছিল আমাদের সফরের সবচেয়ে চমৎকার আর আনন্দদায়ক অংশ। এপথে আমাদের লেবাননের পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছিল।

জনপথের দুইপাশে প্রকাণ্ড সেডার গাছের সারি। কোনোকালেও এসব গাছে কুঠারের কোপ পড়েনি। উঁচু স্তম্ভের মতো গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন এর উপর আকাশ হেলান দিয়ে রয়েছে, তারপর উপরে দেবতাদের বাড়ির দিকে চলে গেছে। বছরের এই সময়ে মাত্র বরফ পড়তে শুরু করেছে, গাছের উপরের শাখাগুলো শুভ্র তুষারের মালা পরে সেজে রয়েছে আর বাতাসে গাছের আঠার তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।

নিচে উপকূলের দিকে এগোতেই আবহাওয়া উষ্ণ হতে লাগলো, গা থেকে আমরা পশমি পোশাক আর জেসমিন শহর থেকে কেনা ভারী পশমি শাল খুলে ফেললাম। সেডার বন থেকে বের হয়ে আবিষ্কার করলাম সামনে আরেকটি পর্বত দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার পথ প্রদর্শক জানালো এর নাম রানা পর্বত, কেনানি ভাষায় যার অর্থ নিখুঁত সৌন্দর্য। ফোনিশিয় বন্দর টায়ার আর সিডনের মাঝে মধ্য সাগরের উপকূলে এর অবস্থান। বন্দর দুটির মাঝে দূরত্ব প্রায় দুশো লিগ।

এই পর্বতের কাছে এসে বাণিজ্য পথটি দুই দিকে চলে গেছে। আমরা ডানদিকের পথ ধরে রানা পর্বত ঘুরে এই প্রথম সাগরের দেখা পেলাম। দিগন্ত বিস্তৃত বিস্ময়কর ঘন আকাশনীল জলরাশি ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকি উঁচু হয়ে থাকা মেঘের পেটও নিচের পানির নীল রঙে প্রতিফলিত হয়ে নীল হয়ে রয়েছে।

সিডন বন্দর উপকূলের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী এবং অন্যতম ব্যস্ত বন্দর নগর। বন্দরে প্রচুর জাহাজ ভীড় করে রয়েছে। এমনকি দূরেও বড় বড় জাহাজের পালে ক্রিটের দুই মাথাওয়ালা কুঠারের প্রতীক দেখা যাচ্ছে। এই জাহাজ বহর নিয়েই তোরান ক্রিট থেকে এখানে এসেছে। সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার জাহাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য আগেই চলে গিয়েছিল। আমাদের ক্রিটে পৌঁছার সংবাদ সর্বাধিরাজ মিনোজকে জানাবার জন্য সে জাহাজ নিয়ে আগেই চলে গিয়েছিল।

বন্দরের পাথরের দেয়ালের বাইরে অর্ধ লিগ দূরত্বে রাস্তার পাশে একটি খোলা জায়গা আমি বেছে নিলাম। রানা পর্বতের ঢাল বেয়ে নেমে আসা একটি নদীর পানি আমাদেরকে যথেষ্ট পানি যোগাবে। আমি জারাসকে এখানে তাঁবু গাড়তে নির্দেশ দিলাম। তাঁবু গাড়ার আগেই নগরী থেকে একটি প্রতিনিধি দল আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।

দলটির নেতৃত্বে ছিল আলখাল্লা পরা একজন উচ্চপদস্থ সুমেরিয় রাজকর্মকর্তা। ঘোড়ায় চড়ে আমার কাছে এসে সে ঘোড়া থেকে নামলো।

সম্মান জানাবার প্রতীক হিসেবে মুষ্টিবদ্ধ হাত বুকের কাছে চেপে ধরে বললো, আমি সিডন প্রদেশের শাসনকর্তা নারাম সিন। আমি জানি আপনি প্রভু তায়তা। আপনার সুনাম ইতোমধ্যেই সারা সুমেরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমার প্রতি রাজা নিমরদের কঠোর নির্দেশ রয়েছে আপনাকে যথাযথ সম্মান জানাতে এবং আপনার প্রতিটি নির্দেশ সাথে সাথে পালন করার। আমি এখানে এসেছি নিশ্চিত করতে যাতে আপনার এবং রাজপরিবারের মহিলাদের প্রতি সঠিক যত্ন নেওয়া হয়।

আপনার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ। আমার প্রথম অনুরোধ হল গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য, বিচালি যোগানো।

নারাম সিন ঘুরে তার অধীনস্থদের প্রতি যথারীতি নির্দেশ দিল। ওরা চলে যাবার পর গভর্নর আমার দিকে ফিরে বললো, আপনার আর কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকলে অনুগ্রহ করে বলুন প্রভু তায়তা।

দয়া করে আমাকে জাহাজ নির্মাণের জায়গায় নিয়ে চলুন, যেখানে আমার নৌবহরের মেরামত কাজ চলছে। মেরামত কাজগুলো দেখার জন্য আমি অধীর হয়ে আছি।

.

যে ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ নিমরদের কাছ থেকে কিনেছিলাম, প্রথমদৃষ্টিতে সেগুলো দেখে আমি হতাশ হলাম। জাহাজগুলো নির্মাণ কাঠামোর উপর দাঁড় করানো থাকায় জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে তা পরীক্ষা করতে পারলাম। আসলে আমি এগুলোর সাথে তামিয়াত দুর্গ থেকে নিয়ে আসা বিশাল মিনোয়ান তিনদাঁড়ি যুদ্ধ জাহাজের তুলনা করে ভুল করেছিলাম। এই

সুমেরিয় জাহাজগুলো আকারে মিনোয়ান জাহাজের অর্ধেক আর এগুলোর নকশা দেখে বুঝতে পারলাম তেমন দ্রুতগামিও নয়।

মন থেকে সমস্ত অলীক ধারণা ঝেড়ে ফেলে হাতে যা আছে তা থেকে ভালো কিছু করার দিকে মনোযোগ দিলাম।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ দিনের বেশিরভাগ সময় জারাস আর জাহাজ মেরামতকারীদের সাথে কারখানায় কাটালাম। ওরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ভালো কিছু করতে, কিন্তু আমি তাতে সন্তুষ্ট হচ্ছিলাম না। আমি বার বার নিখুঁত কাজের জন্য তাগাদা দিতে থাকলাম।

প্রতিটি কাঠের তক্তা আর মাস্তুল পরীক্ষা করলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে পেরেক তুলে দেখলাম জং ধরেছে কিনা। জাহাজের মাথায় লাগানো ব্রোঞ্জের পাত পরীক্ষা করলাম। যে আঠা দিয়ে জাহাজের পাটাতনের মধ্যেকার ফাঁকগুলো বন্ধ করা হয়েছে তাতে তলোয়ারের ডগা বিঁধিয়ে দেখলাম কী ধরনের কাজ করা হয়েছে। সমস্ত পাল খুলে তীরে বিছিয়ে পালের মোটা ক্যানভাস কাপড়টি তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে দেখলাম কোথাও কোনো ছেঁড়া ফাটা কিংবা দুর্বল জায়গা আছে কি না।

তারপর জাহাজের কাঠামোতে বেশ কিছু পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলাম। ব্যবিলন থেকে আসার সময় জারাস আর আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ এসব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমার আঁকা নকশাগুলো দেখে জাহাজ মেরামতকারী সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তি তুললেও আমি তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলাম।

আমার উদ্দেশ্য ছিল যখন আমরা মিসরের উত্তর উপকূলে হাইকসো বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণে যাব তখন এই জাহাজগুলো আমাদের স্থলবাহিনীর সাথে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করবে। আগে সংশয় থাকলেও এখন নিশ্চিত হলাম এই জাহাজগুলোতে বহন করে যখনই প্রয়োজন প্রচুর সেনা দ্রুত নীল নদীর বদ্বীপের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যাবে। তবে রথী-সেনারা তাদের রথ আর ঘোড়া ছাড়া অকার্যকর হয়ে পড়ে।

শেষপর্যন্ত জাহাজ মেরামত কারখানার তত্ত্বাবধায়ক আমার দাবী মেনে নিয়ে জাহাজের পেছন দিক দিয়ে ঢাল বেয়ে মাল উঠা নামার জন্য সিঁড়ির পরিবর্তে ঢালু পথ বা র‍্যাম্প তৈরি করতে রাজি হল। আর ডেকের দুই পাশের, দাঁড় টানার বেঞ্চির মাঝে পাটাতনটি মজবুত করতে বললাম, যাতে এতে ঘোড়াসহ বারোটি রথ নিয়ে এমনকি তরঙ্গক্ষুব্ধ সাগরেও যাওয়া যায়।

সত্তরটি ঘোড়ায় টানা রথ বহন করে জাহাজগুলো উল্টোদিকে চালিয়ে নিয়ে যে কোনো তীরে ভিড়ানো যাবে আর রথীসেনারা তাদের ঘোড়ায় টানা রথ নিয়ে সরাসরি জাহাজ থেকে নেমে সাথে সাথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে। আবার উদ্দেশ্য সাধনের পর তাদেরকে আবার একইভাবে তীর থেকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যাবে।

মেরামত কাজ চলার সময় সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছ থেকে তোরানের কাছে নির্দেশ এলো, সে যেন আরও কিছু দিন এখানে থেকে আমাদেরকে সাথে নিয়েই ক্রিটে আসে। মিসরীয় রাজকুমারী আর তাদের প্রতিনিধিদলকে সবচেয়ে বড় ক্রেটান জাহাজে চড়িয়ে নিয়ে আসবে যাতে ওরা সবাই আরামে সাগর পাড়ি দিতে পারেন।

সৌভাগ্যবশত ক্রিটের শাসক আমার প্রতি এই সৌজন্য দেখিয়েছিলেন; নয়তো তোরান আমার এই ছোট্ট সেনাবাহিনীর লড়াই করার ক্ষমতা দেখার সুযোগ পেত না।

জাহাজগুলোর পাটাতনে পরিবর্তনের কাজগুলো শেষ করার সাথে সাথেই ঝড়ের ঋতুও শেষ হল। দেবতাদের কৃপায় আমরা সুন্দর আবহাওয়া আর মোটামুটি শান্ত সাগর পেলাম। তবে ক্রিট যাত্রার আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম জাহাজের কাঠামোতে যে পরিবর্তন করা হয়েছে তা সাগরে কতটুকু কার্যকর তা একবার পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার। আবার সেই সাথে রথীসেনাদেরও জাহাজের পেছনের ঢালু পথ বা র‍্যাম্প বেয়ে ঘোড়ায় টানা রথ উঠানামার কাজটি অনুশীলন করাতে পারবো।

পাল তুলে আমরা সাগরে ভাসলাম তারপর উপকূলের বেশ কয়েক জায়গায় তীরে জাহাজ ভেড়াবার মতো উপযুক্ত স্থানে জাহাজ ভেড়াবার পর রথীসেনারা ঘোড়ায় টানা রথগুলো নিয়ে সরাসরি জাহাজ থেকে স্থলভূমিতে নেমে গেল। কিছুক্ষণ স্থলভূমিতে ঘুরে ফিরে আবার রথগুলো জাহাজে উঠল। এরকম কয়েকদিন অনুশীলন করা হল। বার বার অনুশীলন করে সৈন্য আর ঘোড়াগুলোকে এই কৌশলী পরিচালনায় দক্ষ করে তোলা হল। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবার পর আমরা আবার সিডনে ফিরে এলাম।

ক্রিট যাত্রার দুই দিন আগে শেষবারের মতো কাজের অগ্রগতি দেখতে জারাস আর হুইকে সাথে নিয়ে আমি ভোরবেলা শিবির থেকে জাহাজঘাটার দিকে হেঁটে রওয়ানা দিলাম। পথে এক চক্ষু একজন ভিখারি গায়ে পড়ে আমার সাথে আলাপ করতে এলো। আমি তাকে এড়িয়ে জারাস আর হুইয়ের সাথে কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু নোংরা লোকটি নাছোড়বান্দা হয়ে আমার জামার হাতা খামচে ধরলো। আমি ঘুরে তাকে আঘাত করার জন্য হাতের লাঠি তুললাম। কিন্তু সে মোটেই ভয় পেলো না, বরং দাঁত বের হেসে বললো, প্রভু এটন আপনাকে এক দান বাও খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কথাটি শুনে আমি হাতের লাঠি নামিয়ে আমি হা করে তার দিকে তাকালাম। এই কথাটি দাঁতহীন, নোংরা আর দুর্গন্ধযুক্ত এমন একটি লোকের কাছ থেকে আসাটা এমন অসঙ্গতিপূর্ণ যে আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম। নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই লোকটি একফাঁকে আমার হাতে একটি প্যাপিরাসের টুকরা গুঁজে দিয়েই পেছনের গলি দিয়ে লোকের ভীড়ে মিশে গেল। জারাস তার পিছু নিতে উদ্যত হতেই আমি তাকে থামিয়ে বললাম, যেতে দাও জারাস। সে একজন বন্ধুর বন্ধু।

জারাস থেমে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চিত তো সে আপনার পকেট মারে নি? আপনি বললে আমি লোকটিকে ধরে দু-এক ঘা লাগিয়ে সত্য কথাটা তার মুখ থেকে বের করতে পারি।

আমি তাকে বললাম, যা বলছি তাই করো! তাকে যেতে দাও! এখানে ফিরে এসো!

আমি তাড়াতাড়ি তাঁবুতে ফিরে গিয়ে প্যাপিরাসটা খুলে একবার চোখ বুলাতেই বুঝলাম এটা এটনেরই পাঠানো একটি বার্তা। দাম্ভিকতা পূর্ণ চরিত্রের মতো তার হাতের লেখাও দেখলে আমার ভুল হয়না।

দেয়ালের গর্তে থাকা আহত বাজপাখির নতুন দ্বীপের বাসায় উড়াল দিয়ে চলে যাওয়া বাধা দিয়ে থামাতে শকুন পূর্বদিকে জানাত থেকে প্যাঁচন মাসের পঞ্চম দিনে দুইশো শেয়াল পাঠিয়েছে।

বার্তার বিষয়বস্তুও স্পষ্ট লেখকের পরিচিতি নিশ্চিত করেছে। আমাদের নিজস্ব গোপন সংকেতে এটন আর আমি গোরাবের নাম দিয়েছিলাম শকুন। দুইশো শেয়ালের অর্থ দুইশো হাইকসো রথীসেনা। জানাত হচ্ছে উত্তর মিসর আর সিনাইয়ের মাঝের সীমান্ত শহর নিল্লোর। দেয়ালের গর্ত হল সিডন। নতুন দ্বীপ হচ্ছে ক্রিট। আর অবশ্যই আহত বাজপাখি হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত সংকেতলিপি।

সরল ভাষায় বলা যায়, এটন আমাকে সাবধান করে জানাচ্ছে যে, ষোল দিন আগে গোরাব নেল্লোর থেকে সিডন পর্যন্ত উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া পথ দিয়ে দুইশো রথীসেনার একটি দল পাঠিয়েছে। এদের উদ্দেশ্য আমার ক্রিট যাত্রা থামানো।

এটা খুব একটা অবার হবার বিষয় নয় যে, গোরাব আমার পরিকল্পনা জেনেছে। থিবস থেকে ব্যবিলন হয়ে এখন এই সিডন পর্যন্ত সফরের এই বিশাল কাফেলায় কেউ না কেউ বেফাঁস মুখ খুলেছে কিংবা অন্য কারও কান খুব খাড়া ছিল। দীর্ঘ দিনের এই সফরে সহজেই এই খবর মেমফিসে গোরাবের কানে গিয়ে পৌঁছেছে আর সেও যথারীতি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। চলার পথে আমার পরিচয় গোপন রাখার যতদূর সম্ভব চেষ্টা সত্বেও গোরাব জেনে ফেলেছে এই মিশন আমার অধীন হচ্ছে। আমার সুখ্যাতি আমার আগে আগে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সে নিশ্চয়ই এটিও জানে যে আমি একজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।

এটন কীভাবে এই খবর জেনেছে আর তার সত্যতাও বা কতটুকু আর কীভাবে সে এখবর আমার কাছে পাঠিয়েছে তা ভেবে আমি এক মুহূর্তও নষ্ট করলাম না। আমার মতো এটনেরও অনেক পথ জানা আছে। আবার আমার মতো সেও কোনো ভুল করে না।

তাঁবুর ভেতর থেকে মাথা বের করে চিৎকার করে জারাসকে ডাকলাম। সে কাছেই ছিল, হুইকে সাথে নিয়ে সে প্রায় সাথে সাথে হাজির হল।

তাকে বললাম, লোকজনসহ রথগুলো নিয়ে এখুনি জাহাজে চড়। আমি দুপুরের আগেই রওয়ানা দিতে চাই।

হুই জিজ্ঞেস করলো, এবার কোন দিকে? নতুন কোন অনুশীলন?

জারাস তার দিকে ফিরে রাগতো স্বরে বললো, বোকার মতো প্রশ্ন করোনা। তায়তা যা নির্দেশ দিচ্ছেন তা করো, খুব তাড়াতাড়ি।

.

দুপুরের একটু আগে নৌ-বহর নিয়ে আমরা সিডন বন্দর ত্যাগ করলাম। আমার আমন্ত্রণে তোরান আমার জাহাজে উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি এই জাহাজটির নাম দিয়েছিলাম নির্মম। জাহাজটি প্রথমে চোখে পড়তেই এটিই ছিল আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।

পোতাশ্রয় রক্ষার বাঁধ পার হওয়ার সাথে সাথেই আমি দক্ষিণ দিকে জাহাজের মুখ ঘুরালাম। বাকি জাহাজগুলোও আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো। আমরা তীরের সমান্তরাল চলতে লাগলাম। এটনের পাঠানো সংক্ষিপ্ত তথ্যরে উপর ভিত্তি করে আমি দ্রুত কিছু হিসাব করেছিলাম।

এটনের কথামতো হাইকসো আক্রমণকারীরা নিশ্চয়ই শেমু মাসের পঞ্চম দিন জানাত থেকে রওয়ানা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে সিডন পৌঁছতে ওদের চারশো লিগ দূরত্ব অতিক্রম করার কথা। এতো লম্বা দূরত্বে রথীসেনা আর অন্যান্য মালসহ একটি রথ দিনে বিশ লিগের বেশি দূরত্ব চলতে পারবে না। অবশ্য যদি ঘোড়া অচল না হয়ে পড়ে। ঘোড়াকে বিশ্রাম আর বিচালি দিতে হবে। তাহলে সবমিলিয়ে ওদের প্রায় বিশ দিন লাগর কথা। এটনের গুপ্তচরদের তথ্য অনুযায়ী ষোলদিন হল ওরা পথে রয়েছে। তাহলে ওরা সম্ভবত সামনে কেবল আট লিগ কিংবা এর কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে। সূর্য ডুবতেই আমি জাহাজের নোঙর ফেললাম।

যখন তোরান জানতে চাইলো কেন আমি অন্ধকারে জাহাজ নিয়ে যেতে চাচ্ছি না তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, অন্ধকারে আমি শত্রুদেরকে পার হয়ে যেতে চাই না। আর জাহাজ নোঙর করাতে আমাদের সাক্ষাত হতে খুব বেশি দেরি হবে না। হাইকসো রথগুলো বেশ দ্রুত আমাদের দিকে আসছে। সেক্ষেত্রে আশা করি আগামী কাল দুপুরের দিকে ওদের দেখা পাবো।

এই হিসাব তোরানকে জানাতেই সে আরেকটি কঠিন প্রশ্ন করলো আমাকে।

ওরা আমাদের পাশাপাশি এলে আমরা কী করে তা বুঝবো? জাহাজের ডেক থেকে তো কেবল মাঝে মাঝে উপকূলের রাস্তা দেখা যাবে।

আমি তাকে বললাম, ধূলা আর ধূঁয়া।

বুঝলাম না।

দুইশো রথ টেনে নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলার পথে ঘোড়ার খুর ধূলি উড়িয়ে ধূলার মেঘ সৃষ্টি করবে। সাগরে অনেক দূর থেকে তা দেখা যাবে।

তোরান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার প্রশ্ন করলো, আর ধূঁয়া?

হাইকসোদের মর্মস্পর্শী একটি অভ্যাস হল চলার পথে ওর প্রতিটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। অনেক সময় বাসিন্দাদের ঘরের ভেতরে আটকে রেখে। বুঝতেই পারছেন ওদের এগিয়ে আসাটা জানা যাবে ধূলার মেঘ আর ধূঁয়ার স্তম্ভ থেকে। এজন্যই ওদেরকে আসলেই কেউ ভালোবাসে না।

আমার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্বিতীয় দিন দুপুরের ঘন্টা খানেক পর তীরভূমির কয়েকশো কদম ভেতরে গাছের জঙ্গলের পেছন থেকে ধূঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেল।

আমি মাস্তুলের ডগায় চড়ে সেখান থেকে দেখলাম মাত্র আগুন জ্বালানো হয়েছে। প্রথম ধূঁয়ার কুণ্ডলীর পেছনে আরও তিনটি আলাদা জায়গায় ধূঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে শুরু করলো।

আমি বিড়বিড় করে উঠলাম, গেল আরেকটি গ্রাম আর তার মধ্যেকার সমস্ত জীবিত প্রাণী। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম দুজন নারী ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে প্রাণভয়ে সাগরের দিকে ছুটে আসছে। এদের মধ্যে একজন একটি ছোট্ট শিশু কোলে নিয়ে ছুটছিল আর মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। তীরের হলুদ বালুর উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে ওরা পানির কিনারায় এসে আমাদের জাহাজ দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে বার বার ইশারা করে ডাকতে লাগলো।

এরপর হঠাৎ ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একটি হাইকসো রথ এদিকে আসতে দেখা গেল। এতে তিনজন লোক ছিল। ওরা সবাই হাইকসো বর্ম আর গোল বাটির মতো আকৃতির ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পরে ছিল। সাগরের কিনারায় নরম চোরাবালিতে পৌঁছার আগেই রথচালক রাশ টেনে ঘোড়া থামাল। তিনজনই রথ থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটন্ত নারীদের পিছু নিল। আমাদের জাহাজের দিকে ফিরেও তাকাল না। আমরা তীর থেকে অনেক দূরে থাকায় ওরা মোটেই ভীত হয়নি। ওরা কেবল ছুটে পালানো নারীদুটোর দিকে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে রেখেছিল। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি মেয়েগুলোর সাথে যা করার তা করার পর ওরা শিশুটির উপরও বর্বর আচরণ করবে।

তোরান কোয়ার্টারডেক থেকে চিৎকার করে বললো, আপনি কি মেয়েগুলোকে উদ্ধার করবেন না?

আমি উত্তর দিলাম, এখানে নিরাপদে জাহাজ ভেড়াবার কোনো জায়গা নেই। হাইকসো কুকুরগুলো এখন কিছুক্ষণ বাঁচুক, তারপর ওদের দুইশোজনকে কচুকাটা করবো। তারপর কাণ্ডারিকে নির্দেশ দিলাম তীর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে যেতে। তোরান জাহাজের পেছনের রেলিং ধরে তীরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলো মেয়েগুলোকে ধরার পর হাইকসো রথীসেনারা কীরকম অত্যাচার করছে। দৃশ্যটি দেখে প্রচণ্ড রাগে আর আতঙ্কে সে চিৎকার শুরু করলেও আমি তা উপেক্ষা করলাম।

তীরে কী হচ্ছে তা একবারও আমি ফিরে তাকালাম না। এরকম শত শত দৃশ্য আমি দেখেছি। তার চেয়ে বরং আমার ছোট্ট নৌবহরটি নিয়ে স্থলভূমি থেকে দূরে সরে যাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম। সাগরে বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর আবার ঘুরে তীরের সমান্তরাল হয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথেই ফিরে চললাম।

কয়েক ঘন্টা আগে আমরা পাথরবেষ্টিত একটি ছোট পোতাশ্রয় পার হয়ে এসেছিলাম। একটি বড় নদী মূলভূমি থেকে এখানে এসে মিশেছে। এই শুষ্ক মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে একটি ক্ষীণ জলধারায় পরিণত হয়েছে। উপকূল দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গিয়েছে, তা নদীর অগভীর একটি অংশে এসে আবার অপর পার দিয়ে চলে গেছে। এই অংশটি হেঁটে বা রথ নিয়ে পার হয়ে আবার রাস্তায় উঠা যায়। নদীর এই অংশের দুই তীর বেশ খাড়া পাথুরে। হাইকসোদের রথগুলো রাস্তা দিয়ে এসে এখানে পৌঁছে বেশ কঠিন বাধার সম্মুখিন হবে। তাদেরকে প্রতিটি রথ হাতে ধরে নদীর এই অগভীর অংশ পার হতে হবে। এতে তারা অরক্ষিত হয়ে পড়বে।

সকালে এই পোতাশ্রয়টি পার হওয়ার সময় আমি হলুদ বালুর একটি সঙ্কীর্ণ বেলাভূমি দেখেছিলাম। উত্তরের শেষ মাথায় একটি অন্তরীপের পেছনে বেলাভূমিটির অবস্থান। এখানে সৈকতের বালু বেশ শক্ত ছিল, আমাদের রথগুলো সহজেই এখান দিয়ে এগিয়ে সামনের শক্ত মাটিতে গিয়ে পড়বে।

উপকূল ধরে পেছন দিকে চলে আমি এই প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের দিকে চললাম। অতর্কিত আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকার একটি সুন্দর জায়গা। আমার অন্য জাহাজগুলোর কাছাকাছি গিয়ে চিৎকার করে সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিলাম। তীরে নামার জন্য যে জায়গাটি আমি বেছে নিয়েছিলাম ওরা আমার জাহাজকে অনুসরণ করে সেই দিকে চললো। দাঁড়িরা গতি বাড়িয়ে আক্রমণের গতিতে বৈঠা বাইতে শুরু করলো। স্বাভাবিক গতিতে দাঁড়িরা কোনো বিশ্রাম না নিয়ে এক নাগাড়ে তিন ঘন্টা পর্যন্ত বৈঠা বাইতে পারে। আর আক্রমণাত্মক গতিতে বৈঠা বাইলে একঘন্টাতেই ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৈঠা বেয়ে আমরা অতি শিঘই সামনেই পোতাশ্রয়টি দেখতে পেলাম।

ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম, আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও জায়গাটি আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনেক উপযুক্ত। সৈকতটি যথেষ্ট চওড়া, একসাথে পাশাপাশি দুটো জাহাজের জায়গা হবে। এর ফলে অতি দ্রুত সৈন্যদেরকে তীরে অবতরণ করাতে পারবো।

এছাড়া আরেকটি সুবিধা এখানে পাওয়া যাবে। দেখলাম যে পথ দিয়ে হাইকসোরা আসবে, সেই পথে নদীর অগভীর অংশটি পার হওয়ার জন্য রথ নিয়ে এখানে ওরা থামতে বাধ্য হবে। পথটির দুইদিকে ঘন ঝোঁপ আর গাছের সারি রয়েছে। এতে পেছনের সারির রথগুলো সামলানো খুব মুশকিল হবে। সামনে এগোতে পারবে না, কেননা নদী পারাপারের এই অংশে সামনের রথগুলো টেনে নেওয়ার কারণে রাস্তাটি বন্ধ থাকবে। দ্রুত পিছিয়ে যেতেও যেতে পারবে না, কেননা রাস্তাটি খুব সঙ্কীর্ণ হওয়ায় রথগুলো হাতে ঠেলে বা টেনে পেছন দিকে নেওয়া সম্ভবপর নয়। এখন আমি যদি রাস্তার দুই পাশে ঝোঁপের আড়ালে আমার তিরন্দাজদের লুকিয়ে রাখতে পারি, তবে ওরা খুব কাছ থেকে আটকে পড়া রথগুলোর উপর তীর ছুঁড়তে পারবে।

তীরের দিকে এগোতেই আমি হুইকে ইশারা করলাম তার জাহাজটি আমার পাশে আনতে। কাছাকাছি আসতেই চিৎকার করে বিষয়টি বুঝিয়ে নির্দেশ দিলাম। আমি কী চাচ্ছি সে সাথে সাথে তা বুঝতে পারলো। অন্তরীপের পেছনে পৌঁছতেই আমরা একসাথে জাহাজের পাল গুটিয়ে আর বৈঠা চালিয়ে অর্ধবৃত্তে ঘুরালাম, যাতে জাহাজের পেছনদিকটি সৈকতের দিকে মুখ করে থাকে। এখন রথগুলো জাহাজের পেছনে মাল নামাবার র‍্যাম্পের দিকে মুখ করে রইল। ঘোড়াগুলো লাগামে ছিল আর রথিসেনারা অস্ত্রশস্ত্র আর বর্মে সজ্জিত হয়ে তৈরি অবস্থায় রথে অবস্থান নিল।

শেষ মুহূর্তে তোরান উপরের ডেক থেকে ছুটে এসে আমার রথে আমার সাথে তীরে যেতে চাইল। আমি তার সাহসের প্রশংসা করলাম, তবে সে যোদ্ধা নয়। তীরে গেলে সে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া সে ছিল সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে আমার একমাত্র যোগসূত্র। সুতরাং তার কোনো ক্ষতি হোক কিংবা সে মারা যাক এই যুদ্ধে তা আমার কাম্য নয়।

তার আবদার প্রত্যাখ্যান করে আমি বললাম, আপনি বরং জাহাজে থেকে সবকিছু প্রত্যক্ষ করুন যাতে পরবর্তীতে সর্বাধিরাজ মিনোজকে জানাতে পারেন! ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজের পেছনের গলুই ভেজা বালুর সাথে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা লাগতেই তোরান পা ফসকে উল্টে পড়ে গেল। ব্যস এতেই আমার সমস্যার সমাধান হল।

পেছনের র‍্যাম্পটি সশব্দে নিচের দিকে খুলে যেতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, যাও! যাও! যাও! চাবুক মেরে আমার দলটিকে জাহাজ থেকে ঢালু পথ বেয়ে নিচে নামার পথের দিকে এগিয়ে নিলাম। ঘোড়াগুলো পানি ছিটিয়ে ছুটে চললো। শুকনো বালুতে পৌঁছার সাথে সাথে আমি রথ থেকে লাফিয়ে নেমে কাঁধ দিয়ে ঠেলে রথটিকে শক্ত শুকনো ডাঙায় টেনে উঠাতে সাহায্য করলাম। তারপর আবার লাফ দিয়ে রথে চড়ে হালকা চালে স্থলভূমির দিকে এগোলাম। একটার পর একটা রথ জাহাজ থেকে নেমে আমাকে অনুসরণ করলো।

উপকূলের রাস্তায় পৌঁছার আগে কয়েকটি জীর্ণকুটিরসহ একটি ছোট্ট গ্রামের উপর দিয়ে যেতে হল। আমাদের দেখেই গ্রামবাসীরা ছুটে এলো। বাচ্চাসহ মেয়েরা আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল। এদের মধ্যে ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দশজন পুরুষ ছিল। এতে নোংরা আর হতশ্রী লোকগুলোকে মানুষ মনে হচ্ছিল না। তবে এরা হাতে কাঠের মুগর নিয়ে আমাদের প্রতিরোধ করার জন্য দাঁড়িয়েছিল।

না থেমে আমি সুমেরিয় ভাষায় চিৎকার করে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, নারী আর শিশুদের নিয়ে দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকাও। দক্ষিণদিকের রাস্তা দিয়ে একদল লুটেরা আর ধর্ষক সৈন্য আসছে। দুপুরের আগেই ওরা পৌঁছে যাবে। দৌড়াও! যত শিঘ্রি পার এখান থেকে পালাও। আমি জানতাম একটু দূরে জঙ্গলে গিয়ে ওরা লুকাবার জায়গা পাবে। এছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ওরা আমার সাবধান বাণী মেনে বাচ্চাদের নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। সামান্য যা কিছু সম্বল আছে তা নিয়ে ঘরবাড়ি ফেলে আতঙ্কগ্রস্ত বন্যপশুর মতো জঙ্গলের দিকে ছুটছে। ওদের দিকে আর মনোযোগ না দিয়ে আমি সামনের রাস্তার দিকে এগিয়ে চললাম।

রাস্তায় পৌঁছে একটু থামলাম। সত্তরটি রথই নিরাপদে তীরে নেমে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জাহাজবহরটি ইতোমধ্যেই উপকূলের প্রায় এক লিগ দূরত্বে চলে গিয়ে পরবর্তী অন্তরীপের আড়ালে নোঙর ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েকজন দাঁড়ি আর পাল টানার লোক ছাড়া সমস্ত লোক অস্ত্র হাতে নিয়ে জারাসের অধীনে তীরে নেমে এসেছে। ওরা আমার রথীবাহিনীর পিছু পিছু ছুটে আসছে।

ধারণা করলাম হাইকসোদের এখানে পৌঁছতে বড় জোর দুই থেকে তিন ঘন্টা লাগবে। এসময়ের মধ্যে আমি ওদের মোকাবেলা করার জন্য মোটামুটি একটা অবস্থান নিতে পারবো। পদাতিক সেনাদের নিয়ে জারাস আসা পর্যন্ত জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি নদীর দুই তীরের জায়গাটি সতর্কভাবে নিরীক্ষণ করলাম।

নদীর অপর তীরে জঙ্গল খুব ঘন, রথ যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে জারাস তার পদাতিক বাহিনী নিয়ে ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করবে। অবশ্য নদীর এই তীরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আছে। এখানে আমরা সুবিধামতো রথগুলো সাজাতে পারবো।

মনে মনে ছক কাটার করার পর আমি হুইকে নির্দেশ দিলাম রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে তার রথগুলো নিয়ে লুকিয়ে থেকে আমার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবে। হুই রথীবাহিনীর একজন চৌকশ নায়ক। লক্ষ্য করলাম সে তার রথিসেনাদের রথ থেকে নেমে ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হবার নির্দেশ দিল। যাতে ঘোড়ার খুর ধূলির মেঘ উড়িয়ে হাইকসোদেরকে আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করতে না পারে।

রাস্তা পার হবার পর ওরা ঘাসের জমি উপর দিয়ে সামনে গিয়ে রথের মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকাল। তারপর পেছনে গিয়ে ডালপালাসহ গাছের ডাল কেটে টেনে নিয়ে এসে রথগুলোর সামনে একটা পর্দার আড়াল তৈরি করলো। হুইকে সাথে নিয়ে আমি রাস্তার কিনারায় এসে নিশ্চিত হলাম যেন রথগুলো সম্পূর্ণ লুকানো থাকে।

ইতোমধ্যে তীরন্দাজবাহিনীসহ জারাস এসে পৌঁছালো। শক্তিশালী একটি বাঁকানো ধনুক ছাড়াও প্রত্যেকে কাঁধে অতিরিক্ত একটা ধনুকের ছিলার ফেটি ঝুলিয়ে নিয়েছিল। আর প্রতি তূণীরে পঞ্চাশটি তীরসহ তিনটি চামড়ার তৃণিরও কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছিল।

ওদেরকে দম নিতে কয়েকমিনিট সময় দেওয়ার পর জারাসকে দেখালাম। নদীর অপর তীরের কোনো জায়গায় সে অবস্থান নেবে। ওরা চলে যেতেই নদীর উঁচু পার থেকে আমি লক্ষ্য করলাম ওরা উঁচু পাড় থেকে দুইশো গজ নিচে নেমে হেঁটে নদী পার হল।

অপর তীরে উঠার আগে ওরা প্রত্যেকে মুখে আর হাতে নদীর কালো মাটি লেপে নিল। সবশেষে জারাস আর তার বিশ্বস্ত সহকারী আকেমি পার বেয়ে তীরে উঠলো।

নদীর অপর তীরের রাস্তায় পৌঁছার পর জারাস তার লোকদেরকে রাস্তার দুই পাশে বিশ কদম পর পর ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে রাখলো। মুখে লেপা কালো মাটির মুখোশের কারণে ঘন লতাপাতার জঙ্গলে কাছ থেকেও ওদেরকে দেখা যাবে না। হাইকসোদেরকে অত্যন্ত সুদক্ষ এই দুই সারি তীরন্দাজের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

জারাসের লোকজন রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে অবস্থান নেবার পর আমি দ্রুত আমার রথিসেনাদের কাছে ফিরে গেলাম।

সবাই ঠিকমতো লুকিয়েছে নিশ্চিত হবার পর আমি রথের সারির একটু পেছনে একটা উঁচু গাছ বেছে নিয়ে তার উপরের একটি ডালে চড়ে বসলাম। এখান থেকে নদীর দুই তীরের রাস্তা পরিষ্কার দেখা গেল। এমনকি এই উচ্চতা থেকেও জারাসের লোকদের কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেল না।

সমস্ত প্রস্তুতি সুচারু রুপে সম্পন্ন হওয়ার পর আমি দূরে সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার নৌবহরও অন্তরীপের পেছনে অদৃশ্য হয়েছে। এবার হাইকসো হামলাকারীদের মোকাবেলা করার জন্য আমি প্রস্তুত।

অনেকক্ষণ গাছের ডালে বসে অপেক্ষা করে সূর্যের অবস্থান লক্ষ্য করে বুঝলাম প্রায় এক ঘন্টা পার হয়েছে। তারপর আমার দৃষ্টিসীমার কিনারায় জারাস যেখান তীরন্দাজদের নিয়ে অপেক্ষা করছে সেখান থেকে বেশ দূরে জঙ্গলের উপরে হালকা ধূলি উড়ছে লক্ষ্য করলাম।

ধূলির মেঘটি ধীরে ধীরে কাছে আসতেই আরও স্পষ্ট হলো। তারপর হঠাৎ ধূলির মেঘের নিচে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পালিশ করা ধাতব কোনো কিছু চকচক করে উঠলো। সম্ভবত কোনো শিরস্ত্রাণ কিংবা তরবারির ফলা।

একটু পরই আমি দূরে রাস্তার বাঁকে প্রথম রথজোড়া দেখতে পেলাম। নিঃসন্দেহে ওরা হাইকসো। উঁচু রথের গাড়ি আর প্রান্তে চাকু লাগানো জবরজং ধরনের চাকাগুলো দেখে পরিষ্কার বুঝা গেল এরা হাইকসো।

জারাস রাস্তার যে জায়গায় তার তীরন্দাজদের নিয়ে অপেক্ষা করছিল; হাইকসো রথের সারি সেখানে পৌঁছল। সামনের দিকে হাইকসো রথীসেনাদলের প্রধান নদীর অগভীর অংশের কাছে পৌঁছতেই দাস্তানাপরা মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে পেছনের রথগুলোকে থামার নির্দেশ দিল।

তারপর হাইকসো সেনানায়ক সতর্কভাবে নিচে নদীর তলদেশ আর আমাদের দিকের এলাকা পর্যবেক্ষণ করলো। এতোদূর থেকে তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম সে একজন শৌখিন ফুলবাবু। তার আলখাল্লাটি নীল রংয়ের। গলায় তিনচারটে চকচকে হার ঝুলছে। পালিশ করা ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণের মুখের অংশটি সুন্দর কারুকাজ করা রূপার। জিনিসটা দেখে আমার খুব লোভ হল।

যখন হাইকসো সেনানায়কটি সন্তুষ্ট হল ভয়ের তেমন কিছু নেই, তখন সে এক লাফ দিয়ে রথ থেকে নেমে পাথুরে পথ দিয়ে নিচে নদীতে নেমে পড়লো। ইতস্তত না করে নদীতে নেমে সে আরও তিনজনসহ হেঁটে নদী পার হয়ে অপর তীরে পৌঁছল। যখন বুঝতে পারলো নদীটি পার হওয়া যাবে তখন সে আবার ফিরে তার রথের কাছে গেল। রথে উঠে চিৎকার করে ঘোড়া ছুটিয়ে নদীর পাড় বেয়ে নামতে শুরু করলো।

নদীর কাছে এসে ঘোড়াগুলো একটু থমকালেও সে চাবুক হাঁকিয়ে ঘোড়াগুলোকে পানিতে নামালো। সামনে এগোতেই পানি পেট পর্যন্ত ছুঁলো। তারপর হঠাৎ একটা ডুবো পাথরে একটা চাকা ধাক্কা লেগে রথটা উল্টে গেল। ডুবে যাওয়া রথের ওজনে আর স্রোতের টানে লাগামে ধরা ঘোড়াগুলো হাঁটু ভেঙে সেখানেই আটকে পড়লো। রথচালক আর অন্য দুজন রথীসেনা রথ থেকে ছিটকে পড়লো। বর্ম আর সাজসরঞ্জামের ভারে ওরা পানিতে তলিয়ে গেল।

সাথে সাথে পেছনের রথের সেনারা তাদের রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পানি ঠেলে হেঁটে অগভীর পানিতে নাকানিচোবানি খাওয়া মানুষ আর ঘোড়াগুলোর দিকে এগিয়ে এলো। চিৎকার চেঁচামেচি করে ওরা ডুবে যাওয়ার আগে ওদেরকে ডাঙায় তুলে নিয়ে এলো। তারপর উল্টেপড়া রথটি আবার চাকার উপর দাঁড় করালো। ঘোড়াগুলো ঠিকমতো দাঁড়াবার পর নদীর খাড়া পাড় বেয়ে রথটি টেনে উপরে তুললো। ঝোঁপের আড়ালে ঠিক যেখানে আমরা রথ নিয়ে লুকিয়ে ছিলাম তার সামনে এসে দাঁড়াল।

এরপর শত্রুদের অন্যান্য রথচালকরা বেশ সাবধানে রথ চালিয়ে নদীর বুকে নামলো, সেখানে অপেক্ষামান অন্যান্যরা ঠেলে ধরাধরি করে রথগুলো অপর তীরে উঠিয়ে দিল। গাছের ডালে বসে আমি পরিষ্কার পেছনের রথের সারি দেখতে পাচ্ছিলাম। গুণে দেখলাম সেখানে ১৬০টি রথ রয়েছে। যদিও এটন বলেছিল ২০০ টি রথ আসবে। বুঝতে পারলাম উত্তর মিসর থেকে ষোল দিনের দীর্ঘ যাত্রায় পথে কিছু রথ ওরা হারিয়েছে। ওদের রথগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে সহজেই চাকা ভেঙে পড়তে পারে। এছাড়া দীর্ঘ পথে উঁচুনিচু পথে ঘোড়াও অচল হয়ে পড়তে পারে।

প্রতিটি রথ নদী পার হয়ে এপাড়ে ডাঙায় পৌঁছার পর রথীরা ঘোড়াগুলোর দুই পা আলগা করে বেঁধে ঘাস খেতে চরে বেড়াতে দিল। তারপর লোকগুলো কেউ ঘাসে শুয়ে পড়লো আর কেউ কেউ আগুন জ্বেলে গরম খাবার রান্না করতে শুরু করলো।

এরকম অপরিচিত আর বৈরী এলাকায় ওদের সেনাপতি সৈন্যদেরকে এরকম ঢিলেঢালা আচরণ করতে অনুমতি দিয়েছে–দেখে আমি অবাক হলেও খুশি হলাম। কোনো পাহারা বসানো হল না কিংবা সামনে রাস্তায় কোনো শত্রুপক্ষের অবস্থান খুঁজে দেখার জন্য কাউকে পাঠালো না। বেশিরভাগই মনে হল বেশ ক্লান্ত। আর জঙ্গলে যেখানে আমাদের রথগুলো লুকানো আছে তার সীমানায় কেউ দেখতে এলো না। এমনকি যারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিল তারাও খুব বেশি দূরে গেল না। এই অচেনা বিদেশে হাইকসোসেনারা স্বভাবতই আত্মরক্ষার স্বার্থেই কাছাকাছি থাকছে।

নদীর অপর তীরে জঙ্গলের পথ বেয়ে আসা মানুষ, রথ আর ঘোড়ার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছিল। এপাড়ে আসা রথের সংখ্যা আমি গুণছিলাম। আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই মুহূর্তটির যখন শত্রুরা সমান দুইভাগে বিভক্ত হবে আর আপাত কোনো ধরনের আশঙ্কা না দেখে শান্ত হবে। মাহেন্দ্রক্ষণটি কাছে আসতেই আমি পকেট থেকে উজ্জ্বল হলুদ রঙের রুমালটা বের করে ভাঁজ খুললাম।

নীল কোট আর চমৎকার শিরস্ত্রাণপরা হাইকসো অধিনায়ক তখনও নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সৈন্য পারাপার তত্ত্বাবধায়ন করছিল। অবশ্য তখনও জারাস আর তার লোকজনের দেখা গেল না, যদিও আমি জানি ওরা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে।

পরবর্তী হাইকসো রথটি নদীর বুক থেকে উঠে এলো। এটি হল পঁচাশিতম রথ যা নদী পার হয়েছে। এখন হাইকসো সেনারা প্রায় সমান দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। এখন কোনো অংশই অন্য দলকে সহায়তা করার অবস্থায় নেই।

যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে রচিত আমার বিশাল পুস্তকে আমি লিখেছিলাম: ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত্রু মানে কোনঠাসা হওয়া শত্রু। এখন আমার এই শিক্ষার কার্যকারিতা প্রদর্শনের সুযোগ এসেছে।

গাছের ডালে ভারসাম্য বজায় রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর উজ্জ্বল হলুদ রুমালটা তিনবার মাথার চারপাশে দোলালাম। নদীর অপর তীরে জারাস সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আমার দিকে তুলে সেও উল্টো ইশারা করলো। রণধনুকে তীর জুড়ে সে অন্য হাতে ধরে রয়েছে।

রাস্তার দুই পাশের ঘন ঝোঁপের আড়াল থেকে তীরন্দাজ বাহিনীর সবাই বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। ওরা সবাই একযোগে তীরধনুক তুলে নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে রইল।

প্রথমে জারাস তীর ছুঁড়লো। শূন্যে উঠে তীরটা নিচের দিকে নামার আগেই আমি বুঝতে পারলাম কাকে লক্ষ্য করে তীরটা ছোঁড়া হয়েছে। হাইকসো অধিনায়ক তখনও জারাসের দিকে পেছন ফিরে নদীর তীরে দাঁড়িয়েছিল। তীরের প্রচণ্ড আঘাতে সে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, তারপর নদীর খাড়া পাড় বেয়ে পড়ে নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জারাস ইতোমধ্যেই দ্রুত আরও তিনটি তীর ছুঁড়ে মারলো। তার সেনারা তাকে অনুসরণ করলো। এক ঝাঁক তীর দ্রুত কালো মেঘের মতো শূন্যে উড়লো তারপর দুই পাশের তীরন্দাজদের মাঝে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাইকসো রথীবাহিনীর উপর আঘাত হানলো।

গরমে বেশিরভাগ হাইকসো রথীসেনারা শিরস্ত্রাণ আর বর্ম খুলে রেখেছিল। ঘোড়াগুলোর পিঠে কেবল মোটা কম্বল ছাড়া বাকি শরীর আর পেছন খোলা ছিল। তীরের পাথুর ফলার নরম মাংসে আঘাত হানার পরিষ্কার উফ! উফ্! শব্দ আমি শুনতে পেলাম।

এরপর পরই আহত মানুষের আর্তচিৎকার আর তীরের আঘাতে আহত ঘোড়াগুলোরও দীর্ঘ চিৎকার শোনা গেল। কাছাকাছি ভীড় করে থাকা শত্রুপক্ষের সেনাদের মধ্যে হৈচৈ আর চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হল।

আতঙ্কিত ঘোড়াগুলো লাগাম টেনে ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাচ্ছিল। যেসব ঘোড়ার পেছনে তীর আঘাত করেছিল যন্ত্রণায় সেগুলো পেছনের পা ছুঁড়ে রথের গায়ে আঘাত করে রথিসেনাদের রথ থেকে ফেলে দিল।

রথচালকরা নিয়ন্ত্রণ হারাতেই যন্ত্রণায় প্রায় উম্মাদ ঘোড়াগুলো ছুটে পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু বের হবার কোনো পথ না পেয়ে তাদের সামনের রথের গায়ে আছড়ে পড়লো। ফলে দ্রুত একের পর রথগুলো উল্টে পড়লো, চাকা খুলে গেল, ঘোড়া আর চালক যখম হল আর এইভাবে সামনের সারির রথগুলোর উপর গিয়ে পড়লো। ফলে এগুলোও নিচে নদীর গর্ভে পড়ে গেল।

নদীর কোমর পানিতে ডুবে থাকা ঘোড়া, রথ আর মানুষের গায়ে উপর থেকে আরও ঘোড়া, রথ আর মানুষ গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সবাই আপ্রাণ। চেষ্টা করছে নদী পার হয়ে অপর তীরে উঠতে। উম্মাদ ঘোড়া, মানুষ আর বিধ্বস্ত ভাঙা রথ মিলে নদীর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিকে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।

জারাসের তীরন্দাজদের প্রত্যেকের কাছে পঞ্চাশটা তীর ছিল আর এতো কাছের লক্ষ্যে খুব কমই লক্ষভ্রষ্ট হয়েছিল। আমি দেখলাম একটি শত্রু সৈন্য রথ থেকে বের হয়ে ছুটে পালাতে চেষ্টা করছিল, তবে কয়েক কদম যেতেই তিনটি তীর তার পেছনে আঘাত করতেই সে মাটিতে পড়ে গেল।

আমার দিকে নদীর পাড়ে যেসব হাইকসো রথিসেনারা মাটিতে শুয়ে বসেছিল বা রান্না করছিল, ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে অপর তীরে তাদের সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

আর দেরি না করে আমি গাছ থেকে নেমে আমার রথের দিকে ছুটলাম। আমার দলের একজন সহযোদ্ধা ঝুঁকে আমার হাত ধরে রথে উঠালো। ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়েই আমি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলাম। দল সামনে এগোও। আক্রমণ কর! আমার রণহুঙ্কার সারির সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়লো।

রথ টানা ঘোড়াগুলো টগবগিয়ে রথ টেনে নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। হুই আর আমি মাঝখানে পাশাপাশি ছিলাম। একটা তীরের আকৃতিতে রথগুলো ছুটে চললো।

আমাদের সামনে বেশিরভাগ হাইকসো সেনা, যারা মাটিতে অলসভাবে শুয়ে বসেছিল ওরা সবাই নদীর তীরের দিকে ছুটে গিয়েছিল। এখন ওরা আতঙ্কিত হয়ে নিচে নদীর বুকে আর অপর তীরে জঙ্গলের রাস্তায় সহযোদ্ধাদের দুরবস্থার দিকে তাকিয়ে রইল। জারাসের তীরন্দাজবাহিনী তখনও তাদের উপর তীর বৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলছিল।

নদীর এপারে হাইকসোদের একটিও রথে কোনো রথিসেনা ছিল না। আর রথ টেনে নেওয়ার মত কোন ঘোড়াও লাগামে জোতা ছিল না। ঘোড়াগুলো মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘাস খাচ্ছিল। ওদের বেশিরভাগ রথচালক নদীর তীর থেকে ছুটে এসে ঘোড়াগুলো ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত হয়ে ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো।

আমি আর হুই দুজনেই হেসে উঠলাম। চাকার সাথে চাকা লাগিয়ে একটি দুর্ভেদ্য ব্যুহ সৃষ্টি করে আমরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মাঝখানে কোনো জায়গা নেই যার মধ্য দিয়ে হাইকসোরা পালাতে পারবে। তখনও মনে হচ্ছিল ওরা আমাদের আক্রমণ সম্পর্কে সচেতন নয়। বেশির ভাগই অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। যারা দেখলে তারা আতঙ্কিত হয়ে আমাদের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিল। ওরা বুঝলো আমাদের আক্রমণ ওরা ঠেকাতে পারবে না। আমরা ধনুকে তীর জুড়ে ধনুক উঁচু করে রেখেছিলাম।

সত্তর কদম আগে থাকতেই আমি তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দিলাম। চলন্ত রথ থেকেও আমার ছেলেরা পঞ্চাশ কদম দূরত্ব থেকে একজন ছুটন্ত মানুষের গায়ে তীর লাগাতে পারে। রথে পৌঁছার আগেই অধিকাংশ শত্রু সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

শুধু একজনকে দেখলাম যে তার রথের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। সে রথের ভেতর থেকে একটা ধনুক আর এক মুঠো তীর তুলে নিল। তারপর আমাদের দিকে ফিরলো। লোমশ শরীরের বিশালদেহী লোকটি রাগে উন্মুক্ত হয়ে একটা বুনো ভালুকের মতো কুঁসছিল। আমরা তাকে আঘাত করার আগেই সে ধনুক তুলে একটা তীর ছুঁড়লো। আমার সারির তৃতীয় রথচালকের গায়ে তীরটি আঘাত করলো। সে ছিল জেনারেল ক্রাটাসের ছেলে। চমৎকার ছেলেটি তার বাবার মতোই সাহসী আর পঞ্চাশ গুণ বেশি সুন্দর ছিল। সে ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তীরের আঘাতে সাথে সাথে সে মারা গেল।

হাইকসো পশুটি আরেকটি তীর ধনুকে জোতার আগেই আমি তিনটি তীর ছুঁড়লাম। তারপর তার সারা দেহে সজারুর কাটার মতো তীর বেঁধা পর্যন্ত আমাদের তীরন্দাজদের প্রায় সবাই তার গায়ে তীর ছুঁড়লো। তারপর সে দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটা তীর ছুঁড়লো। তীরটা আমার শিরস্ত্রাণের কপালে লেগে টং শব্দ করে একপাশে ছিটকে চলে গেল। তবে আঘাতের ধাক্কায় আমি পেছনের দিকে টলে রথ থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম।

আমি কখনও বলিনি যে হাইকসেরা কাপুরুষ, তবে এই লোকটিকে মারতে সতেরোটি তীর ছুঁড়তে হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচটি ছিল আমার, পরে গুণে দেখেছিলাম।

তারপর কসাইয়ের মতো কচুকাটা চললো। এরকম পরিস্থিতিতে সুযোগ এলে আমি সামান্য কশাইগিরির বিরুদ্ধে নই। তবে কশাইগিরির চেয়ে দাস বানানো অনেক লাভজনক। কাজেই আমি পলায়নরপর হাইকসোদের উদ্দেশ্যে তাদের ভাষায় চিৎকার করে বললাম, গোরাবের কুকুরেরা আত্মসমর্পণ করো, আর নয়তো মরো!

আমার দলের সবাই আমার সুরে চেঁচিয়ে উঠলো, আত্মসমর্পণ করো নয়তো মরো! আত্মসমর্পণ করো নয়তো মরো!

বেশিরভাগ হাইকসো সেনা মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই হাত তুললো। কয়েকজন তখনও ছুটে পালাতে চেষ্টা করছিল, তবে আমাদের রথিবাহিনী চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেললো। ভয়ে আর ছুটাছুটির ক্লান্তিতে ওরা হাঁপাতে শুরু করলো। চারদিকে তাকিয়ে যখন দেখলো উদ্যত ধর্নবাণ তাদের দিকে তাক করে রয়েছে তখন ওরা ভেঙে পড়ে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো, সকল দেবতার নামে দয়া করো! আমাদেরকে প্রাণে মেরো না হে মহান প্রভু তায়তা। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। দেবতা হোরাসের দিব্যি আমি যশের কাঙাল নই। তবে সত্যি বলতে কী যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর তরফ থেকে এরকম স্বীকৃতি লাভ করে একটু খুশি অবশ্যই হয়েছি।

হুইকে নির্দেশ দিলাম, এদের সবাইকে রশি দিয়ে বাঁধো। আর ময়দান থেকে ঘোড়াগুলো নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করো। কেউ যেন পালাতে না পারে।

এদিকে জারাসের লড়াইও শেষ হয়েছে আর সে যুদ্ধবন্দীদেরকে বেঁধে রেখে লুষ্ঠিত মালামাল একত্রিত করছিল। এক নজর দেখে বুঝতে পারলাম তাদেরও আমাদের মতো নামমাত্র ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। জারাস নিজে অক্ষত রয়েছে, সে বন্দীদের আর ঘোড়াগুলো সামলানোর কাজ তত্ত্বাবধায়ন করছে। ঘোড়াগুলোও মানুষের মতো মূল্যবান।

হঠাৎ এদিকে আমাকে দেখে জারাস অভিবাদন জানিয়ে মুখে দুইহাত দিয়ে চোঙা বানিয়ে চিৎকার করে বললো, আপনার তরবারিতে আরও শক্তি সঞ্চিত হল প্রভু তায়তা! সত্যি চমৎকার শিকার হল আজ। শিঘ্রই আমি ঘরে বউ আনতে পারবো।

এটি একটি হালকা রসিকতা। তামিয়াত দুর্গে অভিযানের পর পুরষ্কারের অর্থে তাকে আগেই আমি ধনী বানিয়েছি। যাইহোক প্রত্যুত্তরে আমিও মৃদু হেসে হাত নাড়লাম।

জাহাজগুলো যেখানে লুকিয়ে ছিল সেই অন্তরীপের কাছে গিয়ে নীল পতাকা উড়িয়ে ওদেরকে ডেকে আনতে একজন ঘোড়সওয়ারকে পাঠালাম।

এবার বিজয়ানন্দ দ্রুত উবে যেতে শুরু করলো, কেননা দিনের সবচেয়ে খারাপ কাজটি এখন বাকি রয়ে গেছে। আহত হাইকসো ঘোড়াগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই প্রাণীগুলোর প্রতি সবসময় আমার গভীর ভালোবাসা রয়েছে। মিসরে আমিই প্রথম একটি বুনো ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিলাম।

দশটি ভালো ঘোড়ার খালি পিঠে চড়ে আমাদের সহিসরা অন্যান্য বেশি আহত ঘোড়াগুলো থেকে এদেরকে আলাদা করলো। তারপর এদেরকে উপকূলের রাস্তা ধরে সিডনের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। প্রশিক্ষপ্রাপ্ত এই রথের ঘোড়াগুলো যথেষ্ট মূল্যবান।

যেসব ঘোড়া মারাত্মক আহত হয়েছিল সেগুলোর যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম। প্রথমে এগুলোর মুখের সামনে গুড়োকরা বজরা ধরলাম। তারপর যখন মাথা নিচু করে একমুঠো বজরার দানা মুখে পুরলো তখন আমার লোক ব্রোঞ্জের মাথাওয়ালা একটা ভারী মুগর পশুটির দুই কানের মাঝে মাথায় জোরে আঘাত করে মাথার খুলি গুঁড়িয়ে দিল। এতে এদের দ্রুত শান্তিপূর্ণ মৃত্যু হল।

বীভৎস এই কাজটি শেষ করার পর হাইকসো বন্দীদের দিকে নজর ফেরালাম। ঘোড়া ভালোবাসলেও এগুলোর মালিকদের প্রতি আমার প্রবল ঘৃণা ছিল। বন্দীদের সারির মাঝ দিয়ে হেঁটে তাদের অবস্থা দেখলাম। যারা আহত হয়নি কিংবা সামান্য আহত হয়েছে তাদেরকে সৈকতে পাঠালাম আমাদের জাহাজগুলো সেখানে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে।

তবে অনেক বন্দী মারাত্মভাবে আহত হয়েছিল, তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। বুকের গভীরে তীর বেঁধা অবস্থায় একজন মানুষ বৈঠা বাইতে পারবে না। এদেরকে ছায়ায় নিয়ে সামান্য পানি দিতে বললাম। আর বেশিক্ষণ এরা বাঁচবে না। এদের সময় ঘনিয়ে এসেছে।

একেবারে শেষে আমার নিজের আর রাজকুমারীদের কথা ভাবার এক মুহূর্ত সময় হল। আবার রথে চড়ে নদী পারাপারের উঁচু তীরের কাছে গিয়ে রথ থামালাম। ঘোড়ার লাগামে রথ চালকের হাতে দিয়ে গিরিখাতের ধারে হেঁটে গেলাম। যুদ্ধক্ষেত্রের এই জায়গায় কেউ জীবিত নেই। শত্রু বাহিনীর অধিনায়কের মৃতদেহটি কোথায় খুঁজতে হবে ঠিক জানতাম। তারপর নদীর অপর তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা লাশ, ভাঙা রথের অংশ আর অন্যান্য সরঞ্জামের মাঝে খুঁজতে খুঁজতে নীল রঙের আলখাল্লাটি দেখতে পেলাম। নদীর একেবারে কিনারায় দেহটি পড়ে রয়েছে।

সাবধানে খাড়া পাড় বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নিচে নেমেই নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেঁটে ওপাশের তীরে চললাম।

দুটো বড় পাথরের মাঝে হাইকসো অধিনায়কের লাশটি খুঁজে পেলাম। নিচু হয়ে তার এক পা টেনে পাথরের মাঝ থেকে দেহটি বের করলাম। আলখাল্লাটি রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে, তবে আমার চাকর ধুয়ে নিতে পারবে। তাই এটা ভাঁজ করে একপাশে রাখলাম। তারপর শিরস্ত্রাণটি খুঁজতে লাগলাম। ঢাল বেয়ে একটু উপরে উঠে একটি ভাঙা রথের পেছনে জিনিসটা পেলাম।

মাটিতে বসে শিরস্ত্রাণটি কোলে নিয়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে এর কারুকার্য দেখলাম। এর গালের অংশে মিসরীয় দেবতা হাথোর আর অসিরিসের চমৎকার প্রতিমূর্তি খোদাই করা রয়েছে আর কপালে রয়েছে হোরাসের প্রতিকৃতি। হাইকসো অধিনায়ক নিশ্চয়ই অন্য কোনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আমাদের মিসরীয় বাহিনীর উচ্চপদস্থ কোনো সামরিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এটা নিয়েছিল। এটি একটি অমূল্য সম্পদ। এ তুলনায় আমার শিরস্ত্রাণটিকে খুবই সাধারণ মানের মনে হচ্ছে। এছাড়া হাইকসো তীরের আঘাতে এর এক জায়গা বিশ্রীভাবে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।

কিছু না ভেবে আমার শিরস্ত্রাণটি ফেলে দিয়ে সোনা আর রূপার তৈরি এই সুন্দর জিনিসটি তুলে নিলাম। ভেতরে চামড়ার আস্তরণ দেওয়া আছে আর বেশ সুন্দরভাবে খাপে খাপে আমার মাথায় লেগে যেতেই মনে হল যেন এটি আমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এখন একটি আয়না পেলে ভালো হত।

আবার হাইকসো অধিনায়কের মৃতদেহের কাছে গিয়ে দেখলাম গলায় তিনটি সুন্দর হার ঝুলছে। তবে একটা হারে স্ফটিক পাথরের তৈরি দেবতা শেঠের মাথা ঝুলছিল, এটা নদীতে ছুঁড়ে ফেললাম। অন্যদুটোয় সাদা পাথরের তৈরি হাতি আর উটের চমৎকার প্রতিকৃতি ঝুলছিল। রাজকুমারীরা এগুলো খুব পছন্দ করবে, যদিও ওরা কখনও হাতি দেখেনি।

আবার নদীর খাড়া তীর বেয়ে উপরে আমার রথের কাছে গেলাম। আমার রথচালক নতুন শিরস্ত্রাণটি দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তাড়াতাড়ি আমরা সৈকতে ফিরে গেলাম। সবাই হাতের কাজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে নিশ্চয়ই আজব দেখাচ্ছিল।

.

আমার নৌবহরের জাহাজগুলো অন্তরীপ হয়ে উপসাগরে ঢুকলো। জাহাজের পেছন দিক সৈকতের দিকে মুখ করে তীরে ভিড়লো। তারপর মালামাল উঠানামার ঢালু র‍্যাম্পটি নামিয়ে দিল।

বন্দীদেরকে হটিয়ে জাহাজে উঠানো হল, তারপর সবচেয়ে নিচের ডেকে নিয়ে দুই পায়ে শিকল বেঁধে দাড়ির বেঞ্চে বসিয়ে দেওয়া হল। ওরা সেখানেই থাকবে যতক্ষণ ওদের দেবতা শেঠ তার অন্ধকারের দেবদুত পাঠিয়ে ওদেরকে কয়েদ থেকে মুক্ত না করে।

সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগেই সমস্ত লোকজন আর রথ জাহাজে তুলে আমরা সিডন যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাম। তোরান উপরের ডেকে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে তীরের দিকে তাকাল আর সৈকতের যেখানে আমি আহত হাইকসোদেরকে রেখে এসেছিলাম সেদিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললো, দেখা যাচ্ছে আহত শত্রুদেরকে আপনি জীবিত রেখে এসেছেন। আমি কখনও শুনিনি কোনো বিজয়ী সেনাপতি এরকম ক্ষমাশীলতা দেখিয়েছে।

আপনাকে হতাশ করেছি সেজন্য দুঃখিত। তবে ওদেরকে ওখানে রেখে এসেছি যাতে আর কেউ তাদের ব্যবস্থা নিতে পারে। ঐ দেখুন ওরা আসছে।

হাইকসো রথগুলো আসার আগে গ্রামের যে বাসিন্দাদেরকে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম ওরা এখন ফিরে এসেছে। লোকগুলোর হাতে তখনও সেই কাঠের কোদাল আর নিড়ানি রয়েছে যা দিয়ে আমাদেরকে ভয় দেখাতে এসেছিল।

এবার ওরা আমাদের দিকে একবারও তাকাল না। আমরা লক্ষ্য করলাম ওদের মধ্যে যে লোকটি নেতা ছিল সে একজন আহত হাইকসো সৈন্যের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর হাতের কোদালটা দুহাতে ধরে মাথার বেশ উপরে তুললো, যেন চুলার জন্য লাকড়ি ফাড়ছে। এতোদূর থেকেও আমরা শুনতে পেলাম পাথরের মেঝেতে পাকা তরমুজ থপ করে পড়ে যাওয়ার মতো শব্দ করে লোকটির মাথার খুলি ফেটে গেল। তারপর কোদাল হাতে লোকটি সামনে এগিয়ে গেল। মৃত্যু যন্ত্রণায় হাইকসো যোদ্ধার দেহটি ঝুঁকি মেরে চললো আর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।

পরবর্তী আহত যোদ্ধাটি কোদাল হাতে লোকটিকে আসতে দেখে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করলো। তার বুক ভেদ করে একটা তীরের ফলা পিঠ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে। লোকটির পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটি পা তার পেছনে পিছলে পিছলে আসছিল। সে একজন সন্তান প্রসবের যন্ত্রণায় কাতর নারীর মতো চিৎকার করছিল। কৃষকটি তার দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠলো, তারপর হাতের কোদালটি দিয়ে ঠেলে সুবিধামতো কোদালের কোপ মারার জন্য কাত করলো।

তাদের পেছন পেছন নোংরা চেহারার মহিলা আর বাচ্চাগুলো হাইকসো মৃতদেহের উপর মাছির মতো হেঁকে ধরলো। রক্তমাখা পরনের কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে সামান্য দামি যা পেল সব ছিনিয়ে নিল। তাদের উত্তেজিত হাসির শব্দ আমরা এতোদূরের জাহাজ থেকে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম।

তোরান আমার দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, প্রভু তায়তা, এখন বুঝা যাচ্ছে চেহারা যাই হোক আপনার মতো মানুষের সাথে হেলাফেলা করা যাবে না।

.

পরদিন দুপুরের ঘন্টাখানেক আগে যখন সিডন বন্দরে আমার জাহাজ নির্মম ভিড়লো, তখন আমার দুই রাজকুমারীই জেটিতে উপস্থিত ছিল। দুজনেই হাত নাড়ছিল আর আনন্দে আর উত্তেজনায় নাচছিল। যখনই আমি বেশিদিন বাইরে থেকে ফিরে আসি তখনই ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় কে আগে আমাকে স্বাগত জানাবে। তেহুতি সাধারণত নিজেকে একটু গম্ভীর রেখে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতো, তবে আজ সে আমাকে আর তার বোনকে অবাক করে দিল। সম্প্রতি জারাস তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন অসাধারণ মক্রীড়াবিদ এবং অসিচালনায় সুদক্ষ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

এবার তার প্রশিক্ষণের কিছু নমুনা সে দেখাল। জাহাজ জেটিতে ভেড়ার আগেই লাথি দিয়ে পা থেকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে ফেলে সামনের পাথরের জমিনের উপর দিয়ে খালি পায়ে প্রায় উড়ে কিছু দূর এগিয়ে জাহাজ আর জেটির মাঝখানের ফাঁকের উপর দিয়ে এক লাফ মারলো। পুরো পাঁচ গজ হবে দূরত্বটা। একবার পা ফসকালেই সে জাহাজের কাঠামো আর জেটির মাঝে পিষ্ট হয়ে ডুবে মরতো।

যখন সে শূন্যে ঝাঁপ দিল তখন আমার জান প্রায় বেরিয়ে গেল। তবে যখন সে জাহাজের ডেকে দুপা রেখে দাঁড়াল তখন আতঙ্ক চলে গিয়ে স্বস্তি ফিরে এলো। এ-ধরনের অশোভন আচরণ করার কারণে তাকে কষে বকে দেবার জন্য আমি ডেকের উপর দিয়ে ছুটে গেলাম।

তবে সে এক নিঃশ্বাসে বলা শুরু করলো, ইশ তায়তা, নতুন আলখাল্লা আর শিরস্ত্রাণে তোমাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। কোথায় পেলে এগুলো? তোমাকে তো একজন রাজার মতো দেখাচ্ছে! আমাদের জন্য কোনো উপহার এনেছো? সাথে সাথে আমার সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেল, আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

অবশ্যই তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি। তবে আগে বল, যে কদিন আমি ছিলাম না তখন ঠিক ছিলে তো?

সে দুষ্টুমির হাসি দিয়ে জাহাজের উপর বন্দরের দিকে তাকাল। তুমি তো তার কোনো সুযোগ রেখে যাওনি। আমার সমস্ত প্রলোভন সাথে নিয়ে গিয়েছ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি দেখলাম দূরে চালকের ডেকে জারাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর এতো দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের দুজনের মাঝে বিদ্যুত চমকের মতো দৃষ্টি বিনিময় হল।

ক্রিটের কুনুসসের উদ্দেশ্যে শেষ সমুদ্র যাত্রা শুরু করার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করতে আরও চারদিন লেগে গেল। তোরান আমাদেরকে তার জাহাজে চড়ার আমন্ত্রণ জানালো। সুবিশাল তিনস্তরের দাঁড়বাহী জাহাজটি আকারে আমার সুমেরিয় জাহাজগুলোর দ্বিগুণ বড়।

সে বললো, আপনার ঐ চারকোণা পালের ছোট্ট জাহাজের তুলনায় আমার এই বড় জাহাজ পবিত্র ষাঁড়ে চড়ে আপনি আর রাজকুমারীরা অনেক আরাম পাবেন। ওহ আচ্ছা জাহাজটির নামটি তাহলে এই। ভাবলাম গালভরা নামটি থেকে বেশ দম্ভ ফুটে উঠছে। তবে একটু আগেই আমার যে যুদ্ধ জাহাজের কৃতিত্বে আমরা হাইকসোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছি, সেটি সম্পর্কে তার এই তাচ্ছিল্যভাব দেখানোটা আমার পছন্দ হয়নি। তাই আমি একটু ইতস্তত করতে লাগলাম।

সে বলেই চললো, আমরা এক সাথে গেলে কুনুসসে পৌঁছে আপনারা যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন সে সম্পর্কে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করার সময় এবং সুযোগ পাবো। সর্বাধিরাজ মিনোজের রাজদরবারের কূটনীতি এবং আদব-কায়দা অত্যন্ত জটিল আর সেগুলো অবশ্যই মানতে হবে। তারপরও আমাকে ইতস্তত করতে দেখে সে বললো, আমার প্রধান পাঁচক হেলেনিয় জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ। এছাড়া আপনাকে আরেকটি কথা বলতে চাই, এই জাহাজে সাইক্লেড থেকে আনা বিশ পিপা সর্বোৎকৃষ্ট লাল মদ রয়েছে। আমি জানি দুই সপ্তাহ আমার সাথে কাটাতে আপনার জন্য এগুলো কিছুই না, তবে আপনার বুদ্ধিমত্তা, গভীর জ্ঞান এবং পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনুগ্রহ করে আমার আতিথ্য গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করুন প্রভু তায়তা। এরকম অনুরোধের পর আমি আর না করতে পারলাম না।

তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে আমি বললাম, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মহামান্য রাষ্ট্রদূত। তবে মনে মনে ভাবলাম, আসলেই কী সে আমার সঙ্গ এতো দাম দিচ্ছে নাকি আমার রাজকুমারীদের মিনোয়ান পরিচারিকা লক্সিয়াসের জন্য এতোসব করছে।

তবে তেহুতি আর বেকাথা দুজনেই তোরানের সাথে তার জাহাজে যাওয়ার বিষয় নিয়ে আপত্তি তুললো। ওরা আমার জাহাজে এসে আমার কাছে তাদের আপত্তির এক বিশাল তালিকা তুলে ধরলো। তবে সবগুলোই ছিল খুব দুর্বল ধরনের।

সমস্ত কথা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে শোনার পর আমি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুজনেই কাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তাহলে তোমরা কি রাষ্ট্রদূত তোরানকে বিশ্বাস করো না? তোমাদের কি ধারণা তিনি তোমাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তার জাহাজে নিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাদের হত্যা করবেন? দুজনেই বিব্রতভাবে গা মোচড়াতে লাগলো।

আর কী করে এই ধারণা তোমাদের মাথায় এলো যে পবিত্র ষাঁড়ের মতো বিশাল আকারের জাহাজ পানিতে ভাসবে না আর আমাদের সকলকে নিয়ে ডুবে যাবে?

দুজনেই চুপ করে রইল। আর হঠাৎ বেকাথার চোখ ভরে পানি দুই গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। আমি আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতো দুঃখ পাবে জানলে এমন কঠিন প্রশ্ন করতাম না। আমি লাফ দিয়ে টুল থেকে উঠে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সে হাত দিয়ে ঠেলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখলো।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করলো, আর তাকে কখনও দেখতে পাবো না। তার কথা শুনে আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, কাকে আর কখনও দেখতে পাবে না? তুমি কি রাষ্ট্রদূত তোরানের কথা বলছো?

সে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গড়গড়িয়ে বলে যেতে লাগলো, তুমি তেহুতিকে কথা দিয়েছিলে অন্তত ক্রিটে পৌঁছা পর্যন্ত আমরা একসাথে থাকতে পারবো। তারপরই আমাদেরকে সর্বাধিরাজ মিনোজের হারেমের অন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তুমি কথা দিয়েছিলে যতক্ষণ আমরা সতর্ক থাকবে ততক্ষণ আমরা ক্রিটে পৌঁছানো পর্যন্ত মেলামেশা করতে পারবো। কিন্তু আর কখনও ওদের দেখা পাবো না। আমার জীবন এখানেই শেষ হচ্ছে।

তাকে থামিয়ে আমি বললাম, ব্যাপারটা আমার বুঝা দরকার বেকাথা। তুমি কার কথা বলছো এখানে?

বেকাথা আবার আমার দিকে মুখ ঘোরালো, তবে এবার সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রয়েছে। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমরা কার কথা বলছি। আমরা আমার হুইয়ের কথা বলছি।

তেহুতিও তার ছোট বোনের মতো পরিষ্কার কণ্ঠে বললো, আর আমার জারাসের কথা বলছি।

আসলেই আমার পরিকল্পনা ছিল ক্রিটে পৌঁছে মিনোজের রাজপ্রাসাদে থাকতে শুরু করার আগে ওরা যে ভয়ঙ্কর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তা থেকে ধীরে ধীরে ওদেরকে সরিয়ে আনা। তবে আমার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে।

আমি বার বার নানানভাবে চেষ্টা করলাম ওদেরকে খুশি করতে, তবে ওরা মোটেই তাতে মন বসালো না। শেষ পর্যন্ত আমি ওদের কাছে হার মানলাম।

শেষ পর্যন্ত সিডন বন্দর ছাড়ার সময় জারাস আর হুই দুজনেই পবিত্র ষাঁড় নামে জাহাজটিতে চড়লো।

.

সাতটি জাহাজ নিয়ে নৌবহরটি গঠিত। পবিত্র ষাঁড় ঠিক মাঝখানে রয়েছে। চারকোণা পালের যে দুটি জাহাজ আমার আর জারাসের অধীনে ছিল সে দুটো দুপাশে পাহারা দিয়ে চললো। তবে এখন দিলবার আর আকেমির নেতৃত্বে এগুলো ভেসে চলেছে।

আমার বাকি চারটি জাহাজও এই নৌবহরের পেছনে পাহারাদার হিসেবে অনুসরণ করছে। জাহাজগুলো একে অন্যের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। এভাবে ওরা চারদিকে সাগরের ষাট লিগ ব্যাপী নজর রাখতে পারবে। আমি একটি সহজ পতাকা দিয়ে সঙ্কেত দেবার পদ্ধতি প্রবর্তন করলাম, যাতে কোনো ধরনের বিপদ দেখা দিলেই প্রধান জাহাজ থেকে আমি তা জানতে পারি।

এসব সাবধানতার প্রয়োজন ছিল। কেননা মধ্যসাগর ছিল সাগরের মানুষের বিচরণ কেন্দ্র। এরা ছিল সমস্ত সভ্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন দলত্যাগী এবং সমাজ তাড়িত ব্যক্তি। নির্বাসিত হওয়ার পর এরা সকলে মিলে জলদস্যুর দল তৈরি করেছে। কেউ কারও অধীনে নয়, কাউকেই এরা প্রভু মানে না। কোনো ধরনের নৈতিকতা বোধ, বিবেক কিংবা অনুতাপের বালাই নেই। ওরা ক্ষুধার্ত সিংহ, বিষাক্ত সাপ কিংবা বৃশ্চিকের মতোই ভয়ঙ্কর। সাগরের ডুবন্ত পাহাড় কিংবা মানুষ খেকো হাঙ্গরের চেয়েও ওদের বিচরণ বেশি ছিল। মিসরে আমরা ওদের নাম দিয়েছিলাম, ইয়ামের সন্তান। ইয়াম হচ্ছে উত্তাল হয়ে সাগর যখন ফুঁসে উঠে তখন সেই সাগরের দেবতার নাম। এই দেবতা অত্যন্ত নিষ্ঠুর।

তবে বছরের এই সময়টি সাগরের এই অংশে পাড়ি দেবার জন্য সবচেয়ে অনুকূল ছিল। মধ্যসাগরের এই অংশের মিসরীয় নাম বিশাল সবুজ। আবহাওয়া শান্ত প্রকৃতির, সুন্দর বাতাস আর সাগরও শান্ত। পবিত্র ষাঁড়ের যাত্রীরা সবাই সমুদ্র যাত্রা উপভোগ করছিল।

জারাস তেহুতিকে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দিয়ে চললো। সে তেতির তীর ছোঁড়ার জন্য ভাসমান লক্ষ্য বস্তু তৈরি করেছিল। জাহাজের পেছনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের দড়িতে বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

এছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য সে কাঠের তরবারিও নিয়ে এসেছিল। এর পাতগুলো ছাগলের চামড়া দিয়ে মোড়ানো ছিল আর কাঠের ঢালও এনেছিল। খোলা ডেকে ওরা মহড়া দিত। মাঝে মাঝে তেহুতির বিজয়োল্লাস শুনে বুঝা যেত সে লড়াইয়ের মহড়ায় জিতেছে। প্রচণ্ড জোরে আঘাত করতে সে মোটেই পিছপা হত না। সে এমন জোরে আঘাত করতো, যা সামলাতে জারাসের মতো একজন দক্ষ অসিচালকও তা হিমশিম খেয়ে যেত। তবে সে কখনও তার তরবারি দিয়ে উল্টো তেহুতির উপর আক্রমণ চালাতো না।

বেকাথা তীর ছোঁড়া প্রশিক্ষণে অংশ নিত। তবে সে তার বড় বোনের মতো একই ওজনের ধনুকের ছিলা টানতে পারতো না, ফলে সে তার বোনের মতো অনেক দূরে সঠিক লক্ষ্য বস্তুতে তীর ছুঁড়তে পারতো না। তাই সারা দিন মুখ গোমড়া করে রইল। তারপর তেহুতিকে তার সাথে কাঠের তরবারি দিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালো। তবে বোনের তরবারির আঘাতে তার গায়ে যে কালশিরে দাগ পড়েছিল তা মেলাতে এক সপ্তাহ লাগলো।

এবার এই অস্ত্র প্রতিযোগীতা থেকে সরে গিয়ে সে কর্নেল হুইকে বাও খেলা শেখাতে শুরু করলো। তবে হুই ছাত্র হিসেবে ব্যর্থ প্রমাণিত হল। বেকাথা নির্দয়ভাবে তাকে পেটাতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হুই বিদ্রোহ করতে চাইলো, তখন বেকাথা তাকে নাচ, গান আর ধাঁধা শেখাতে শুরু করলো।

তবে হুইয়ের কণ্ঠস্বর ছিল চমৎকার আর নাচেও সে বেশ পারদর্শিতা দেখালো। প্রথম দুটো নাচ শিখতে গিয়ে সে বেশ কুশলতার পরিচয় দিল। তবে ধাঁধায় সে সবচেয়ে দক্ষতা দেখাল। বেকাথাকে তার সাথে তাল সামলাতে কষ্ট হত।

একবার সে বেকাথাকে প্রশ্ন করলো, দুই জন মা আর তিনজন মেয়ে ঘোড়ায় চড়তে বের হল। ওরা কয়টি ঘোড়া নিয়েছিল?

অবশ্যই পাঁচটি।

হুই বললো, ভুল। ওদের তিনটি ঘোড়া দরকার ছিল। ওরা ছিল দাদিমা, মা এবং মেয়ে।

বেকাথা অর্ধেক খাওয়া ডালিমটি তার মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরে বললো, উহ তুমি একটা বোকা লোক! হুই ডালিমটা ধরে এক কামড় দিয়ে ফের তার দিকে ছুঁড়ে মারলো।

রাষ্ট্রদূত তোরানের প্রধানপাঁচক তার কথামতোই চমৎকার আর সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করলো। জাহাজের পেছনের খোলা ডেকে ক্যানভাসের ছাউনির নিচে আমরা একের পর এক সুস্বাদু খাবার খেয়ে চললাম, সেই সাথে চললো বাঁশি এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে চারজনের বাদকদলের সঙ্গীত পরিবেশনা।

দিনগুলো আনন্দেই কেটে চললো আর বাধাবন্ধনহীন ছোট ছোট বাচ্চার মতো আমরা হাসিখুশিতে মেতে রইলাম।

অবশ্য সবকিছুই একেবারে নিখুঁত ছিল না। রাতে এই জাহাজে ভীষণ ইঁদুরের উৎপাত হত। যখনই আমরা বাংকে শুয়ে পড়তাম তখনই শোনা যেতে কেবিনের বাইরের পথ দিয়ে কিচ কিচ আর ছুটাছুটির শব্দ। তবে মেয়েরা গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত।

এমনকি রাষ্ট্রদূত তোরানের প্রধান কেবিনেও এই উৎপাতের কমতি ছিল না।

.

সাগরে আমরা চৌদ্দদিন কাটালাম। একদিন জাহাজের সামনের ডেকে বড় পালের ছায়ার নিচে আমি আর তোরান বসেছিলাম। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমরা গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় পেছনের ডেক থেকে হঠাৎ গণ্ডগোল শুনে আমাদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটলো।

আমি তাকিয়ে দেখলাম পবিত্র ষাঁড়ের ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস মাস্তুলের ডগায় সঙ্কেতের পতাকা উড়িয়েছে। সাথে সাথে তোরানের কথা মাঝপথে থামিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে। তারপর দুজনেই দ্রুত পেছনের ডেকে গিয়ে এক জায়গায় জড়ো হওয়া জাহাজের কর্মকর্তাদের কাছে গেলাম। ওরা সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তোরান ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার হাইপ্যাটস? সে সামনের দিকে দেখিয়ে বললো, আমাদের সাথে আসা ছোট একটা জাহাজ থেকে সঙ্কেত বার্তা এসেছে। তবে বেশি দূরত্বের কারণে সঙ্কেতটি বুঝা যাচ্ছে না।

আমি তাকিয়ে দেখলাম দীগন্ত রেখার কাছে আমার নির্মম জাহাজটি দেখা যাচ্ছে। এখন আকেমি এর নেতৃত্বে রয়েছে। পতাকার সঙ্কেত বার্তার অর্থ বিশ্লেষণ করে আমি ওদেরকে জানালাম, ওরা জানাচ্ছে ওদের সহযোগী জাহাজটির উপর একটি জলদস্যু জাহাজ হামলা করেছে আর জলদস্যুরা ওদের জাহাজে চড়েছে। আকেমি এখন দিলবারকে সাহায্য করার জন্য ওর জাহাজের দিকে যাচ্ছে।

হাইপ্যাটস অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এসব কথা আপনি কী করে বুঝতে পারলেন প্রভু তায়তা?

আমি ধৈর্য সহকারে তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমি কেবল আকেমির সঙ্কেত বার্তাটি পড়েছি।

তোরান বললো, এতোদূর থেকে? এটা তো আমার কাছে ভেল্কিবাজি মনে হচ্ছে তায়তা।

আমি হালকাভাবে বললাম, বাজপাখি হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত গূঢ়লিপির প্রতিকৃতি। ঐ পাখি আর আমার, উভয়েরই সূক্ষ দৃষ্টিশক্তি রয়েছে। এখন দয়া করে হাইপ্যাটসকে বলুন পাল তুলে দাঁড়িদের পূর্ণ শক্তিতে বৈঠা বাইতে।

ঘন্টা খানেক পর আমরা আমাদের পাহারাদার জাহাজের কাছে পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম ওরা দাঁড় উঠিয়ে আর পাল গুটিয়ে জাহাজ থামিয়ে রেখেছে। আর একটি আরবী ধাউয়ের সাথে লড়াই করছে। এই জাহাজটি আমার জাহাজের চেয়েও বড়, এর দুটো ছোট আর বড় একটি পাল পেছন দিকে হেলে এলোমেলো হয়ে রয়েছে। স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে লড়াই প্রায় শেষের পথে, কেননা ধাউয়ের নাবিকেরা তাদের হাতের অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত উপরে তুলে ধরেছে।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা জাহাজদুটোর কাছে এসে আমি দেখলাম আরবী জাহাজটির গায়ে এর নাম মিসরীয় লিপিতে লেখা রয়েছে। নামটি হল শান্তির প্রতীক। মনে মনে হাসলাম। সে মোটেই শান্তির প্রতীক পায়রা নয়।

হাইপ্যাটসকে নির্দেশ দিলাম, শত্রুর জাহাজের পাশে আমাদের জাহাজ ভেড়াও! সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশাল জাহাজটি ঐ আরবী ধাউয়ের গায়ে লাগাতেই আমি দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ধাউটির ডেকে নামলাম। জারাস আমাকে অনুসরণ করলো। আমি অনুভব করলাম লড়াইয়ে সামিল হতে না পেরে সে বেশ হতাশ হয়েছে। এদিকে দিলবার আর আকেমি খোলা তলোয়ার হাতে আমার কাছে এলো।

ওরা আমাকে অভিবাদন করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এখন কী অবস্থা? রক্তমাখা তরবারি তুলে দিলবার দেখালো ডেকের উপর বন্দীরা হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। হাত পেছনে বাঁধা, ঘাড় আর মাথা ডেকের তক্তার গায়ে ঠেকানো।

দিলবার বললো, ঐ বদমাশগুলো মনে করেছে আমরা সাগরে একা রয়েছি। ওরা এসে বললো সাগরে ওরা পথ হারিয়েছে তাই আমাদের সাহায্য কামনা করছে। ডেকে তখন কয়েকজন মাত্র লোক দেখা যাচ্ছিল। যে মুহূর্তে আমরা ওদের পাশাপাশি হলাম সাথে সাথে যারা নিচে লুকিয়ে ছিল ওরা লাফ দিয়ে বের হয়ে আমাদের জাহাজের গায়ে হুক ছুঁড়ে মারলো। তারপর সবাই আমাদের জাহাজে চড়লো। অবশ্য আমরাও তৈরি ছিলাম। আকেমি পৌঁছা পর্যন্ত ওদেরকে আটকে রাখলাম তারপর দুজনে মিলে ওদেরকে কাবু করলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কতজনকে বন্দী করেছ?

আকেমি ক্ষমা চেয়ে বললো, দুঃখিত, কয়েকজনকে মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারপর অবশ্য ওরা সবাই আত্মসমর্পণ করেছে। যাইহোক তারপরও আটত্রিশজনকে বন্দী করতে পেরেছি। সে জানে আমি মৃত লোকের চেয়ে বন্দী ক্রীতদাস পছন্দ করি।

দুজনেই ভালো কাজ দেখিয়েছে। এখন এদেরকে দুইভাগ করে তোমাদের জাহাজে দাঁড় টানার কাজে লাগাও।

আমার লোকেরা বন্দীদেরকে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে আমার জাহাজের ক্রীতদাস বেঞ্চে তাদের নতুন কর্মক্ষেত্রের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া শুরু করতেই পেছনের সারিতে একজন বন্দীর দিকে আমার নজর পড়লো। তার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বুঝা যাচ্ছিল সে এই জলদস্যু দলের নেতা। আর তার চেহারায় এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠেছে। লোকটি আমার চোখেচোখে না তাকাতে চেষ্টা করছিল।

আমি তার দিকে তাকিয়েই ডেকে বললাম, তুমি নাকাতি! সাথে সাথে সে পিঠ সোজা করে চিবুক তুলে আমার দিকে তাকাল।

তারপর আমাকে বললো, প্রভু তায়তা, আমি আশা করিনি যে আবার আপনার দেখা পাবো।

আমি বললাম, দেবতা সবসময় আমাদের প্রার্থনার দিকে মনোযোগ দেন না।

আমাদের কথার মাঝে দিলবার এসে বললো, আপনি এই জানোয়ারটাকে চেনেন, প্রভু?

সে ছিল ফারাওয়ের রক্ষী বাহিনীর লাল ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন। পাঁচ ছয় বছর আগে সে আবিডসের একটি গুঁড়িখানার একজন প্রমোদবালাকে নিয়ে কলহ করার সময় তার কর্নেলকে ছুরিকাঘাত করে মেরে ফেলে। তারপর তাকে ধরে ফাঁসি দেবার আগেই সে পালিয়ে যায়।

এখন কি তাকে মেরে ফেলবো?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, দেখা যাক কী হয়। এটা পরেও করা যাবে। ততক্ষণ তাকে দাঁড় টানার কাজে লাগাও।

একসময় নাকাতি একজন দুর্ধর্ষ সেনাকর্মকর্তা ছিল। তার অনেক উপরের দিকে পদোন্নতি হবার সুযোগ ছিল।

তাকে কি চাবুক মারবো না?

নিয়মমাফিক যা করার কর দিলবার। তবে দেখো সে যেন একজন ক্রীতদাসের খাবার পুরোপুরি পায়।

তারপর একজন নৌকর্মকর্তাকে ইশারা করলাম তাকে অন্যান্য বন্দীদের সাথে এখান থেকে নিয়ে যেতে।

তারপর শান্তির পায়রা জাহাজটির মূল খোলের দিকে গেলাম।

দিলবারকে বললাম, তোমার লোক দিয়ে এই খোলের দরজাটা খুলে ফেল। খোলের দরজাটা ভেঙে খুলে ফেলার পর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, পুরো খোলটি তামা আর টিনের পিণ্ড দিয়ে ভর্তি। বুঝা গেল আমাদের আগে নাকাতি অন্য কোনো জাহাজ লুট করেছে।

দিলবারকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত মাল আমার জাহাজে নির্মম-এ নেবার ব্যবস্থা করো। তারপর আমাদের বিজয়ী নাবিকদের দিয়ে জলদস্যুদের জাহাজটি আমাদের সাথে ক্রিটে নিয়ে চলো। মনে মনে আমি একটা পরিকল্পনা করছিলাম। তবে তার আগে নাকাতি কিছুক্ষণ দাঁড় টানার কাজ করে নিক, তারপর সে ঠিকই আমার প্রস্তাব পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

ক্রিট দ্বীপে পৌঁছার চার পাঁচদিন আগে নাকাতিকে আমার কেবিনে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম।

এতোদিনে তার অবস্থা পালকখসা ঝড়োকাকের মতো হয়েছে। পরনে কেবল একটি নেংটি আর পায়ে শিকল বাঁধা। উদ্ধতভাবটি আর নেই। পিঠে চাবুকের আঘাতে ঘা হয়েছে। একটানা দাঁড়টানার কাজ করতে করতে বাহুদুটো শক্ত হয়ে রয়েছে। একটা ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো পেট ভেতরের দিকে ঢুকে রয়েছে। পেটে আর চর্বি নেই।

তবে বুঝা গেল চাবুক পেটালেও মারধোর করা হয়নি। এখনও তার চোখে মুখে গর্বিত ভাবটি লুকিয়ে রয়েছে। সে আমাকে হতাশ করেনি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বউ কী এখন থিবসে আছে নাকি আর কারও সাথে ভেগে গেছে? সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের চাউনি কঠিন আর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

ছেলেমেয়ে কয়জন? ছেলে না মেয়ে? তারা কি তোমার কথা মনে করে? তুমি কি তাদের কথা ভাবো?

সে বললো, আপনি জাহান্নামে যান! আমি মৃদু হাসি চাপলাম। তার বড়াই ভাবের প্রশংসা করলাম। তার কথাটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলাম, যেন সে এটি বলেনি।

আমার ধারণা মনে মনে তুমি এখনও মিসরের একজন সন্তান; একজন সভ্য মানুষ এবং জলদস্যু নও। একথা শুনে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তারপরও আমি বলে চললাম, তুমি একটি ভুল করেছে আর তার মাশুল দিতে গিয়ে অনেক কিছু হারিয়েছ। এবার সে মুখ কুঁচকাল, ঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছি।

রেগে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তাতে আপনার কী?

আমি বললাম, আমার কিছুই আসে যায় না। তবে আমার মনে হয়। তোমার স্ত্রী আর সন্তানদের অবশ্যই কিছু আসে যায়।

এবার তার গলার স্বর পাল্টে গেল, এক সমুদ্র হতাশা নিয়ে সে বললো, এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন কেউ আর এর কিছু করতে পারবে না।

আমি বললাম, আমি তোমাকে ক্ষমা করার ব্যবস্থা করতে পারি। সে একটি তিক্ত হাসি হেসে বললো, আপনি ফারাও নন।

না, তা নই আমি। তবে আমি বাজপাখির সীলমোহর বহন করছি। আমার যেকোনো কথাই এখন ফারাওয়ের কথা। এবার তার চোখে আশার আলো দেখা দিল। আর এটা দেখে বেশ ভালো লাগলো।

এবার সে বেশ নরম হয়ে ক্ষমাপ্রার্থীর সুরে বললো, আপনি আমাকে কী করতে বলেন প্রভু তায়তা?

হাইকসোদের কবল থেকে মিসরকে মুক্ত করতে আমি তোমার সাহায্য চাই।

আপনি একথাটি বেশ সহজভাবে বলছেন, অথচ এই নিষ্ফল প্রয়াসে আমি আমার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়েছি।

এটা স্পষ্ট যে থিবসে থেকে পালিয়ে যাবার পর তুমি সাগরের মানুষের রাজা হয়েছ। আমি নিশ্চিত তোমার সাথীদের অনেকেই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া মিসরীয়। স্বদেশে ফিরে আসার সুযোগ পেতে ওরা নিশ্চয় লড়াই করবে।

নাকাতি সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বললো, সামান্য রূপা আর চাষ করার মতো একটুখানি কালো মিসরীয় জমির জন্য আরও কঠিন লড়াই করবে।

এবার আমি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম, কথা দিচ্ছি তোমরা সবাই এই পুরষ্কার পাবে। তোমার এই শান্তির পায়রা জাহাজের মতো পঞ্চাশটি জাহাজ আর লড়াই করার মতো লোকজন নিয়ে এসো, আমি তোমাদের হারানো সম্মান আর মুক্ত জীবন ফিরিয়ে দেবো।

আমার কথাটি শুনে সে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, পঞ্চশটা জাহাজ আনতে পারবো না। তবে আমাকে আমার লোকজনসহ আমার শান্তির পায়রা জাহাজটা ফিরিয়ে দিন, তিনমাসের মধ্যে আমি এরকম আরও পনেরোটা জাহাজ নিয়ে ফিরে আসবো। ঈশ্বরের নামে শপথ করছি।

আমি কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে দরজাটি খুললাম। জারাস তার তিনজন লোকসহ আমাকে উদ্ধার করার জন্য উদ্যত তলোয়ার নিয়ে অপেক্ষা করছিল।

আমার জাহাজে গিয়ে পাঁচককে খাবার আর মদ নিয়ে আসতে বল।

যখন জারাস ফিরে এলো তখন আমি নাকাতিকে নিয়ে টেবিলে বসে রয়েছি। আমার কেবিনের বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে সে চুল আঁচড়ে নিয়েছিল। আমি যে পোশাক দিয়েছি তা পরেছে। সে বেশ লম্বাচওড়া হলেও আমার পোশাক তার গায়ে মোটামুটি মানানসই হয়েছে।

জারাসের পিছু পিছু কেবিনের পরিচারক এক বোল শুকরের লোনা মাংস নিয়ে এসে নাকাতির সামনে রাখলো আর আমি একটা গ্লাসে একটু লাল মদ ঢেলে জারাসকে পাশে বসতে ইশারা করলাম। আমরা কথা শুরু করলাম, কথা বলতে বলতে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল।

.

ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস পাল নামালো আর আমাদের বিজয়ী নাবিকেরা শান্তির পায়রা জাহাজটি এর পাশে ভেড়ালো। নাকাতি তার জাহাজের ডেকে নেমে গেল, তারপর এর কর্তৃত্ব নিয়ে আমাদের যে জাহাজদুটোতে তার লোকদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে গেল। সেই জাহাজদুটোর নিচের ক্রীতদাসদের ডেকে গিয়ে বেঞ্চে শিকল দিয়ে বাঁধা তার লোকদেরকে তুলে নিয়ে এলো। তারপর ওদেরকে বাইরে রোদে নিয়ে এলো।

লোকগুলো বেশ শোচনীয় অবস্থায় ছিল। পরনে একটি নেংটি আর নাকাতির মতো সারা গায়ে চাবুকের দাগ। আমার নির্দেশ মোতাবেক আকেমি আর দিলবার ওদের উপর কড়া চাবুক চালিয়েছিল। ওরা হতাশা আর আত্মসমর্পণের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমি জানি একমাত্র নাকাতিই ওদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে।

শান্তির পায়রার পেছনের ডেক থেকে নাকাতি আমাকে অভিবাদন জানাল। তারপর সে জাহাজের হাল ঘুরিয়ে উত্তরমুখি রওয়ানা হল। জলদস্যুদের জাহাজগুলো সেদিকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এজিয়ান উপসাগরের নির্জন দ্বীপগুলোতে লুকিয়ে রয়েছে।

জারাস জিজ্ঞেস করলো, আর কখনও কি তার দেখা পাবেন? উত্তরে আমি কেবল কাঁধ ঝাঁকালাম। এর ইতিবাচক উত্তরের জন্য অন্ধকারের দেবতাদের কাছে ধন্না দেবোনা। যাইহোক নাকাতির সাথে আমার একটি চুক্তি হয়েছে আর আমি একজন মানুষের ভালোমন্দ বিচার করে তার উপর আস্থা রাখতে পারি যে, সে তার কথা রাখবে।

একটি বিষয় প্রমাণ করে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি যে, হাইকসোদের যে কোনো দুর্বল অবস্থানে অনেকগুলো রথ জাহাজ থেকে নামিয়ে গোরাবের সেনাবাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ করে তাদের মরণ দশা এনে দিতে পারি। তারপর শত্রু প্রতিআক্রমণ করার আগেই রথগুলো নিয়ে আবার আমার জাহাজে ফিরে যেতে পারি। অবশ্য আমার এই ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়ে এই স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ লড়াই চালানো সম্ভব নয়, তবে আমি তার মূল বাহিনীর বড় একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করে মিসরের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে সরিয়ে উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য সরিয়ে নিয়ে আনতে পারবো।

আমি নাকাতিকে কথা দিয়েছিলাম, যদি তারা লুটতরাজের কাজ ছেড়ে আমার অধীনে সাগরে অভিযানে যায়, তাহলে তার দলের প্রত্যেককে এক হাজার রূপার মেম পুরষ্কার দেবো। তারপর হাইকসোদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সম্পূর্ণ মিসর মুক্ত করার পর জলদস্যুতা আর খুনসহ তার লোকদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করা হবে। প্রত্যেককে সম্মানজনকভাবে নৌ-বাহিনীর চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে মিসরের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এছাড়া এদের প্রত্যেককে থিবস নগরীর দক্ষিণে নীল নদ বরাবর তায়তার মেশির এস্টেটে পাঁচশো কাঠা উর্বর এবং সেচযোগ্য জমি দেওয়া হবে।

শান্তির পায়রা জাহাজটির চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি ভাবলাম নাকাতিকে যে উদার দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তার কতোটুকু ফারাওয়ের কোষাখানা থেকে পাওয়া যাবে আর কতোটুকুই বা আমার নিজের সঞ্চয় থেকে যোগাড় করতে পারবো। নিঃসন্দেহে ফারাও কৃতজ্ঞ হবেন, তবে সেই কৃতজ্ঞতা অর্থের ভাষায় প্রকাশ করবেন কি না, সে ব্যাপারে আমি খুব একটা আশাবাদি নই। আমার মেম আর তার রূপা এতো সহজে বিচ্ছিন্ন হবার নয়।

.

আমি জানি ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটর এর আগে সুমেরিয়া আর ক্রিটের মাঝে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছেন। কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম কখন কুনুসসে পৌঁছাবো বলে আশা করি, তখন সে উত্তরটি একটু এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে বললো।

অবশ্যই সবকিছু নির্ভর করে বাতাস আর স্রোতের উপর, তবে আমার ধারণা ষোল দিনের মধ্যে আমরা পবিত্র ক্রিট দ্বীপে পৌঁছতে পারবো।

তার অনুমান জানার পর আমি খুশি হলাম। আমাদের রথের ঘোড়াগুলো দীর্ঘদিন যাবত খাঁচার মাঝে আটকা রয়েছে। দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। গায়ের পশম উঠে যাচ্ছিল আর ওজন কমে গিয়ে উদাসী হয়ে যাচ্ছিল। হুই অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল আর সেই সাথে আমিও।

চৌদ্দতম দিনে নৈশভোজের সময় আমি তাকে ষোল দিনের অনুমানের কথাটি স্বরণ করিয়ে দিতেই সে বললো:

প্রভু তায়তা আপনি নিশ্চয়ই জানেন সমস্ত নাবিক মহান দেবতা পসেইডনের মর্জি আর খেয়াল খুশির উপর নির্ভরশীল। আমি হিসাব করেছিলাম ষোল দিন আর সেটা খুব ভালো একটি হিসাব ছিল।

একটি বিষয়ে হাইপ্যাটস আর আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে, আর হয়তো জলদস্যুর আক্রমণ হবে না। কোনো জলদস্যু জাহাজই সাগরের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবহরের মূল বন্দরের এতো কাছে ঘেঁষার ঝুঁকি নেবে না। কাজেই আমি আমার জাহাজগুলোর কাছে সঙ্কেত বার্তা পাঠালাম, যেন ওরা পবিত্র ষাঁড় জাহাজটির কাছাকাছি অবস্থান নেয়।

পরদিন ভোরের বেশ আগে আমি কেবিন থেকে বের হয়ে মাস্তুলের ডগায় চড়লাম। ভোরের আগের কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর আলোয় দিগন্তের চতুর্দিক লক্ষ্য করে কিছুই দেখা গেল না, ডাঙার কোনো চিহ্নই নেই।

মাস্তুলের উপর থেকে নেমে কেবিনে ফিরতে যাব এমন সময় দেখলাম একটি অ্যালবাট্রস পাখি কুয়াশার ভেতর থেকে বের হয়ে আমার মাথার উপরে দুই ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে লাগলো। মাথা এদিক ওদিক করে পাখিটা আমাকে দেখার চেষ্টা করছিল। সবধরনের পাখি আমার পছন্দ আর এতো কাছ থেকে এমন সুন্দর একটি পাখি দেখার সুযোগ এই প্রথম পেলাম। পাখিটিরও মনে হল আমার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে আর তাই সে এতো কাছ থেকে আমার মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে। চকচকে কালো দুচোখ দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। আমি তার দিকে এক হাত বাড়াতেই পাখিটি দ্রুত সরে গিয়ে আবার সেই কুয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেখান থেকে সে এসেছিল।

মাস্তুল থেকে নামতে শুরু করার আগে নিচে ডেকের দিকে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম, যখন আমি বিশাল পাখিটিকে নিয়ে নিমগ্ন ছিলাম তখন দুজন মানুষ নিচের ডেক থেকে এসে জাহাজের রেলিংএর কিনারায় দাঁড়িয়ে দূরে দিগন্তের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলাম তারা কে, কেননা ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওদের দেহ ভারী পশমি পোশাকে ঢাকা ছিল আর মুখও আমার দিক থেকে অন্য দিকে ফেরানো ছিল।

অবশেষে যখন ওরা ঘুরে মুখোমুখি হল তখন আমি চিনতে পারলাম ওরা হল জারাস আর তেহুতি। ওরা ডেকের চারপাশ চোখ বুলালেও মাস্তুলের উপরের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। যখন বুঝলো কেউ ওদেরকে লক্ষ্য করছে না, তখন জারাস তাকে দুই বাহুর মাঝে টেনে নিয়ে চুম্বন করলো। পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তেহুতিও তাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি নিশ্চুপ রইলাম। তবে আমি চোখ ফেরাবার আগেই তেহুতি একটু পিছিয়ে কথা বলা শুরু করতেই আমি তার ঠোঁট নাড়া পড়তে পারলাম।

তায়তা ঠিকই বলেছেন। ডাঙার কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। চিরদিনের জন্য আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার আগে একসাথে থাকার জন্য দেবতা আমাদেরকে আরও একটি মূল্যবান দিন দিয়েছেন। তার প্রকাশভঙ্গিটি খুবই করুণ ছিল।

জারাস তাকে মনে করিয়ে দিল, তুমি একজন রাজকুমারী আর আমি একজন যোদ্ধা। যে কোনো মূল্যেই হোক আমাদের দুজনকেই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদেরকে সহ্য করতেই হবে।

তেহুতি আবার এগিয়ে তাকে চুম্বন দিয়ে বললো, আমি জানি তুমি যা বলছো তা সত্যি, তবে যখন তুমি চলে যাবে তখন আমার হৃদয় আর বেঁচে থাকার বাসনা তোমার সাথে নিয়ে যাবে। আমাকে সম্পূর্ণ শূন্য করে তুমি চলে যাবে।

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আর একমুহূর্তও তাদের এই আকুতির গভীরতা সহ্য করতে পারলাম না। আমাকেও একটি পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেবতারা যে বিশাল জাল আমাদের জন্য বুনেছেন আমরা তাতে আটকা পড়া কীটাণুকীট। এখান থেকে পালাবার কোনো উপায় নেই।

ওরা ডেকে থেকে চলে যাবার পর আমি মাস্তুলের ডগা বেয়ে নেমে আমার কেবিনে চলে গেলাম।

তেতির মায়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন আমি কাঁদিনি। তবে আজ আমার কান্না পেল।

.

পরদিন ভোরে আবার মাস্তুলের ডগায় চড়লাম। এবার হতাশ হলাম না। ভোরের আলোয় দিগন্তরেখায় নিচু আর নীল ক্রিট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। তবে এখানে নয় আমি আরও পঞ্চাশ লিগ সামনে এবং আরও উত্তরে দ্বীপটি দেখবো বলে আশা করেছিলাম।

তবে এতে তেমন অখুশি হই নি। সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে সাক্ষাতের জন্য আমি খুব তাড়াহুড়া করতে চাচ্ছি না, কারণ এতে আমার আদরের রাজকুমারীদেরকে আরও কয়েকটি আনন্দের দিন থেকে বঞ্চিত করা হবে। অপ্রত্যাশিতভাবে এই সুযোগ পেয়ে কল্পনা আর রূপকথার এই রাজ্যটি যতটুকু পারা যায় দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কেউ বাধা দেবার আগেই দৃশ্যটি পুরোপুরি উপভোগ করতে চেয়েছিলাম, তবে তা হল না। আমাদের সামনে ভেসে চলা আমার জাহাজ থেকে চিৎকার ভেসে এলো, ঐ যে ডাঙা দেখা যায়!

সাথে সাথে আমার নিচে ডেক আনন্দ উৎসাহে মানুষের ভীড়ে মুখরিত হয়ে উঠল। ওরা জাহাজের রেলিংয়ে ঝুঁকে আরও ভালোভাবে ডাঙা দেখার চেষ্টা করলো।

একটু পরই রাষ্ট্রদূত তোরানও মাস্তুল বেয়ে উপরে উঠে আমার পাশে এল। তাকে আমার চেয়েও বেশি অনুপ্রাণিত মনে হল।

সে বললো, দীর্ঘদিন ডাঙা না দেখে পানিতে ভেসে থেকে সাগরে সঠিক যাত্রাপথ নির্ধারণ করতে গিয়ে হাইপ্যাটস যে ভুল করেছে তা ক্ষমাযোগ্য। এছাড়া বাতাস আর স্রোতের ব্যাপারও আছে। সাগরে যাত্রাপথ সঠিকভাবে পরিচালনা করা কখনও সঠিক বিজ্ঞান নয়। এটা অনেকটা অনুমান নির্ভর। আসলে হাইপ্যাটসের ভুলটি আমাদের জন্য শুভ হতে পারে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, দয়া করে একটু খুলে বলবেন? আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যখন আমরা সিডন থেকে যাত্রা শুরু করি তখন আপনাকে বলেছিলাম, সর্বাধিরাজ মিনোজের একটি অধ্যাদেশ অনুসারে রাজ্যের উত্তর উপকূলে কুমুসস বন্দরে কোনো বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ঢোকা নিষেধ। সেখানে আমাদের যুদ্ধ জাহাজের ঘাঁটি রয়েছে।

হ্যাঁ ঠিক মনে পড়েছে। আপনি বলেছিলেন আমাদের জাহাজগুলো দক্ষিণ উপকূলে ক্রিমাদ বন্দরে নোঙর করবে। আসলে এই অবস্থানটি আমাদের জন্য বরং আরও সুবিধাজনক হবে। এখান থেকে নীল নদীর ব-দ্বীপে হাইকসো অবস্থানে যেতে বেশি দূরত্ব পার হতে হবে না।

এরপর দূরে স্থলভূমির দিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে তোরান বললো, ইডা পর্বতের নিচে ঐ সাদা দালানগুলো দেখতে পাচ্ছেন? ওগুলো হল ক্রিমাদ বন্দরের জাহাজঘাটা। আপনি এখুনি আপনার নৌবহরকে সেখানে গিয়ে যার যার নির্দিষ্ট জায়গায় নোঙর করতে বলুন। ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটসের একজন নৌকর্মকর্তা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, চমৎকার! সর্বাধিরাজ মিনোজ কি আমাকেও আমার নৌবহরের সাথে ক্রিমাদে থাকতে বলেছেন?

সে আমাকে আস্বস্ত করে বললো, না না তায়তা! সর্বাধিরাজ মিনোজ খুব ভালো করেই জানেন যে, আপনি ফারাও ত্যামোসের প্রতিনিধি আর তাই সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। একান্তভাবে আপনার বসবাসের জন্যই কুমুসস নগরীর উপরে ইডা পর্বতের ঢালে একটি সুরম্য প্রাসাদ আলাদা করে রাখা হয়েছে। তারপর একটু থেমে সে বললো, তবে এই জাহাজে আপনার দলের মধ্যে কিছু সদস্য আছেন যাদের থাকার ব্যবস্থা কুনুসসের বদলে ক্রিমাদে করলেই ভালো হবে।

কিছু না জানার ভান করে আমি বললাম, তাই নাকি! এরা কারা বলবেন একটু?

আমি বলতে চাচ্ছি না যে কেউ খারাপ আচরণ করেছেন, তবে এদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ সর্বাধিরাজ মিনোজের ভবিষ্যৎ স্ত্রীদের সাথে একটু বেশি মেলামেশা করছেন।

আপনি নিশ্চয়ই রাজপরিচারিকা লক্সিয়াসের কথা বলছেন না? একথা শুনে তোরান সাথে সাথে তার চোখ নামিয়ে ফেললো। আমি তাকে কৌশলে মনে করিয়ে দিলাম আমাদের উভয়েরই কিছু কিছু গোপন ব্যাপার আছে যা আমরা লুকিয়ে রাখি।

সুচতুরভাবে এই আলোচনা থেকে সরে গিয়ে তোরান বললো, সবকিছু আমি আপনার নিখুঁত বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম।

.

মূল ডেকে নামতেই ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস কাছে এসে হাসিমুখে বললো, শেষ পর্যন্ত ষোল দিনই হল তাহলে, প্রভু তায়তা।

আমি তাকে প্রশংসা করে বললাম, সত্যি, চমৎকার জাহাজ পরিচালনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ হাইপ্যাটস। দয়া করে আমার জাহাজের ক্যাপ্টেনদের এখুনি এখানে আসার জন্য সঙ্কেত পাঠান।

হাইপ্যাটস সমস্ত ক্যাপ্টেনদের উদ্দেশ্যে সঙ্কেত বার্তা পাঠাবার নির্দেশ দিল।

আমার নৌ-বহরের সমস্ত অধিনায়ক যার যার জাহাজ থেকে ডিঙ্গি নামিয়ে পবিত্র ষাঁড়ের পাশে এলো। প্রথমে দিলবার আর আকেমি, তারপর ওদের পেছন পেছন অন্যরা এলো। আমি সামনে ক্রিমাদ বন্দর দেখিয়ে ওদেরকে বললাম, এরপর এটাই হবে তাদের ভবিষ্যতে সমস্ত অভিযান পরিচালনার প্রধান কেন্দ্র।

এরপর জারাস আর হুই তাদের নিজ নিজ জাহাজের নেতৃত্ব নিয়ে এই জাহাজ থেকে চলে যাবার জন্য তৈরি হল। ওদের সমস্ত জিনিসপত্র ডিঙিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি ইচ্ছা করেই খুব অল্প সময় দিয়ে ওদেরকে বদলি করা কথা বলেছিলাম; আর বলেছিলাম তেহুতি আর বেকাথাকে একথা না জানাতে। যে কোনো উপায়ে হোক আমি চাচ্ছিলাম সবার সামনে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে।

তবে আমার মেয়েদেরকে এতো সহজে বোকা বানানো যায় না। ওরা সাথে সাথে বুঝেছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। দুজনেই ওদের কেবিন থেকে বের হয়ে কী হচ্ছে দেখতে পেছনের ডেকে এলো। দুজনেই হালকা মেজাজে ছিল, তবে জারাস আর হুইকে মূল ডেকে ওদের লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার সাথে সাথে ওদের মুখের ভাব বদলে গেল।

তেহুতির চেহারা একটি লাশের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল, বেকাথার ঠোঁট কাঁপছিল আর সে চোখের পাতা মিটমিট করে চোখের পানি সামলাতে চেষ্টা করলো।

এদিকে মূল ডেকে জারাস তার লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেই ওরা পেছনের ডেকের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন করলো। আমি দেখলাম বেকাথা এতো জোরে ওর বড় বোনের হাত চেপে ধরলো যে, ওর আঙুলের গাঁটগুলো সাদা হয়ে গেল।

তেহুতির ঠোঁট নাড়া দেখে আমি বুঝতে পারলাম সে ফিসফিস করে তাকে বলছে, বুকে সাহস আনো বেকাথা। সবাই আমাদেরকে দেখছে।

লক্সিয়াস ওদের পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। এবার সে সামনে এসে বেকাথার পাশে দাঁড়িয়ে তার অন্য হাত চেপে ধরলো।

জারাস ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটসকে উদ্দেশ্য করে আনুষ্ঠানিকভাবে বললো, জাহাজ থেকে নামার অনুমতি দিন ক্যাপ্টেন? আর হাইপ্যাটসও আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর দিল, অনুমতি দেওয়া হল, ক্যাপ্টেন।

জারাস জাহাজের কিনারায় গিয়ে তার লোকজনদের নিয়ে দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ডিঙিতে নামলো। হুই তাকে অনুসরণ করলো। কেউ লক্ষ্য করেনি যে মেয়েরা পেছনের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরাও পেছন ফিরে তাকায়নি।

হুইকে চলে যেতে দেখে বেকাথা একটু টলে উঠেছিল আর মৃদু স্বরে কাতরে উঠেছিল। তারপর তিনজনই হাতধরাধরি করে তাদের কেবিনের দিকে চলে গেল। বেকাথা প্রথম পদক্ষেপে একবার হোঁচট খেলেও তেহুতি তাকে ধরে তার পতন থামাল।

তোরান আমার উল্টোদিকে ডেকের অন্যধারে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েরা নিচে নেমে যেতেই সে আমার দিকে একবার তাকিয়ে সমর্থনসূচকভাবে সামান্য মাথা নাড়লো।

এই সামান্য ইঙ্গিত থেকেই আমরা পরস্পরের সহযোগী হলাম। আমি জানি ভবিষ্যতে আমরা একে অন্যের উপর আস্থা রাখতে পারবো।

.

ডিঙ্গিগুলো পবিত্র ষাঁড়ের পাশ থেকে সরে গিয়ে আমার নৌ-বহরের দিকে

চলে যেতেই হাইপ্যাটস তার জাহাজের দিক পরিবর্তন করে দ্বীপের পূর্বদিকের অন্তরীপের দিকে রওয়ানা দিল।

আমি ক্রিমাদ বন্দরের দিকে সরাসরি চলে যাওয়া আমার জাহাজগুলোর দিকে রইলাম। আমার মেয়েদের কষ্টের কথা ভেবে তখনও আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল, তাই তোরানের কাছে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে মন হালকা করার চেষ্টা করলাম।

ক্রিমাদ থেকে কুনুসসের দূরত্ব কত?

তোরান বললো, মূল দূরত্বটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা মোটোমুটি চল্লিশ লিগের কাছাকাছি হবে। তবে সমস্যা হল ইডা পর্বতের পাদদেশ ঘুরে যাওয়া পথটি খাড়া এবং বিপদসঙ্কুল। ঘোড়ায় যেতে দুই দিন লাগবে। এর চেয়ে দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করলে ঘোড়াগুলো টিকে থাকতে পারবে না।

আমি জানি আমার জাহাজের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হলে আমাকে নিয়মিত এই পথ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া রাজার হেরেমে আমার মেয়েদের সাথেও যোগাযোগ রাখতে হবে। আবার তোরান পথে যে দেরি হবার কথা বলেছে তা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দ্বীপের মধ্য দিয়ে আমাকে একটি সরবরাহ শৃঙ্খলের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পথের মাঝে দশ লিগ পর পর সরবরাহ চৌকিতে তাজা ঘোড়া অপেক্ষামান রাখতে হবে যাতে ঘোড়াগুলো জোরে ছুটতে পারে। এইভাবে সাত ঘন্টা কিংবা তার চেয়েও কম সময়ে দ্বীপ পার হতে পারবো। মেয়েদেরকে তাদের নতুন বাড়িতে তুলে দেবার পর এটিই হবে আমার প্রথম কাজ।

মেয়েদেরকে সান্ত্বনা দেবার জন্য নিচে তাদের কেবিনে গেলাম। কিন্তু ওরা আমার সাথে উপরে আসতে রাজি হল না। গভীর দুঃখে কাতর হয়ে ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে এক বাঙ্কে বসেছিল। আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরে মুখ খুলতে চাচ্ছিল না। লক্সিয়াস ওদের পায়ের কাছে আসন পেতে বসেছিল। এই মিনোয়ান মেয়েটির বিশ্বস্ততা দেখে আমি আবারও মুগ্ধ হলাম।

নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর দেবতার হৃদয়হীনতার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে ওদেরকে আরও সময় দিতে হবে। তরুণ বয়সে জীবনের দাবী শতগুণ বেড়ে যায়, তবে বয়সের সাথে সাথে তা কমে আসে। কীভাবে সহ্য করতে হয় তা অবশ্যই আমাদেরকে শিখতে হবে।

ওদেরকে ছেড়ে আমি ডেকে ফিরে এলাম।

৭. সাগরের এই পথ

সাগরের এই পথ হাইপ্যাটসের খুব চেনা। সে বিভিন্ন ডুবো চর আর অন্তরীপ এড়িয়ে বেশ সহজে জাহাজ নিয়ে এগোল।

স্থলভূমির পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমি অবাকবিস্ময়ে তাকালাম। সারা জীবন মরুভূমিতে কাটিয়েছি, তাই এতো পর্বতময় স্থান আর সবুজ বনানী দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

দুপুরের একটু পর দ্বীপের পূর্বদিকের প্রান্তসীমা ঘুরে উত্তর উপকূল ধরে কুনুসসের দিকে চললাম। সূর্যের আলোর কোণ বদলে যেতেই সাগরের পানির রং অপূর্ব নীল হল।

সামনের সাগরে নোঙর করা ছোট ছোট মাছধরা নৌকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রঙের পালসহ বিশাল তিনস্তরের দাঁড়ওয়ালা বাণিজ্যপোত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

উপসাগরের প্রবেশ পথ আর বন্দর পার হতেই আমরা দেখলাম এখানেও প্রচুর নোঙর করা জাহাজ ভীড় করে মাল উঠানামা করছে। বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করে এই বাণিজ্যপোতগুলো যে সম্পদ আহরণ করছে, তা এই ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে সভ্য জগতের সামনে এক বিশাল আকারে পরিণত করেছে।

আমি জানি এই স্থানটি পর্বতময় আর এবড়োথেবড়ো। মাটি ভালো নয়, মূল্যবান কোনো খনিজ নেই আর চাষেরও আযোগ্য। বিশাল বনএলাকা থাকলেও, গাছের শিকড় মূল্যবান ফসল চাষের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে মিনোয়ানরা তাদের জাহাজ পাঠিয়ে অন্যান্য দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ক্রিটে নিয়ে এসেছে। তারপর তাদের প্রযুক্তি আর নব উদ্ভাবনী কৌশল কাজে লাগিয়ে এইসব কাঁচামাল দিয়ে উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করেছে, যার জন্য বাকি বিশ্ব বুভুক্ষ হয়ে রয়েছে।

অন্যান্য আদিম জাতিরা ধারালো গাছের ডাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে যেসব আকরিক ধাতু বের করে, ওরা তা শোধন করে এবং এই ধাতু দিয়ে যোদ্ধাদের জন্য তলোয়ার, ছুরি, শিরস্ত্রাণ, বর্ম আর কৃষকদের জন্য নিড়ানি, খড় তোলার জন্য লম্বা হাতলওয়ালা কাটা লাগানো দণ্ড এবং লাঙলের ফলা তৈরি করে।

ওরা পাথর-বালি আর অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিখুঁতভাবে পুড়িয়ে কাঁচ উৎপাদন করে। এটি একটি অসাধারণ পদার্থ যা দিয়ে থালা, বাসন এবং বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করে রাজামহারাজাদের খাবার টেবিলে ব্যবহৃত হয়। আর ধনী ব্যক্তিদের স্ত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন রঙের গহনা ও অলঙ্কার; আর কিছু কিছু গোষ্ঠির মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুঁতি তৈরি করা হয়। কোনো কোনো আদিম দেশে এইধরনের একটি কাঁচের পুঁতির মালা দিয়ে একটি তেজস্বী ঘোড়া কিংবা একজন সুন্দরী কুমারিকে কেনা যায়।

মিনোয়ানরা এসব পণ্যের বিনিময়ে অন্যান্য দেশের সাধারণ কৃষকদের দ্বারা উৎপাদিত ভাং, তুলা,পাটের কাপড় এবং পশমি সুতা কিনে নেয়। এই সুতা বুনে তৈরি করা কাপড় এবং ক্যানভাস দিয়ে পোশাক, তাবু এবং জাহাজের পাল তৈরি করা হয়।

আবার এগুলো দিয়েও বাণিজ্য করা হয়; এভাবে চক্রাকারে বার বার এটি নিরন্তর চলতে থাকে যতদিন না আর কোনো জাতি তাদের সম্পদের সমকক্ষ হয়। এমনকি আমাদের মিসরও নয়।

অন্তহীন সম্পদ আহরণের অন্বেষণের কারণে একটি গোপন মূল্যও দিতে হয়েছে।

পবিত্র ষাঁড় নামে জাহাজটির উঁচু স্থানটি থেকে আমি স্থলভূমির দিকে। তাকিয়ে দেখতে পেলাম অসংখ্য কামারশালা আর চুল্লি থেকে ধূঁয়া বের হচ্ছে। এসব জায়গায় আকরিক পরিশুদ্ধ করা হচ্ছে, ধাতুতে খাদ মেশানো হচ্ছে আর বালু থেকে কাঁচ উৎপাদন করা হচ্ছে।

নগরী এবং কারখানা এলাকার উপরিভাগে পাহাড়ি অঞ্চলের অনেকখানি জায়গাজুড়ে ক্ষতবিক্ষত জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। এখানে কুঠার দিয়ে জঙ্গলের গাছ কেটে মিনোয়ান জাহাজের জন্য কাঠের কড়ি-বরগা কিংবা কারখানার চুল্লিতে পোড়ানোর জন্য কাঠকয়লা তৈরি করা হত।

আমি দেখলাম তটসংলগ্ন সাগরের পানির রং বিবর্ণ আর কলুষিত হয়ে আছে। কারখানাগুলোতে বিষাক্ত রঙ আর ক্ষয়কারী তরল ব্যবহার করার পর তরল বর্জ্য সরাসরি সাগরে নিষ্কাশন করার ফলে এটি হয়েছে।

অন্য জীবিত যে কোনো মানুষের মতো আমিও আমার হাতে সোনা রূপার ওজন এবং এর ঔজ্জল্য পছন্দ করি। তবে আদি-অকৃত্রিম প্রকৃতির এই অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়ে আমি অবাক হয়ে ভাবি যে, মানুষকে তার সীমাহীন লোভের পরিণামে চরম মূল্য দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

নিচে থেকে হঠাৎ কারও চিৎকার শুনে আমার চিন্তার সূত্র ভেঙে গেল। নিচে তাকিয়ে দেখলাম নিচের ডেক থেকে রাষ্ট্রদূত তোরান আমাকে নিচে যাওয়ার জন্য ডাকছেন। আমি তার কাছে পৌঁছতেই সে দুঃখ প্রকাশ করে বললো, কিছু মনে করবেন না, আমি বেশিক্ষণ উঁচুতে থাকতে পারি না। আর মাস্তুলের উপরে উঠলে জাহাজের ঘূর্ণন খুব বেশি মনে হয়। আসুন পাঁচক আমাদের জন্য যে চমৎকার প্রাতরাশ তৈরি করে রেখেছে তার গ্ল্যবহার করি। তারপর সে আমার হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে চলতে চলতে আবার বললো, চলুন জাহাজের সামনে থেকেও সবকিছু ভালোভাবে দেখা যাবে। আর ড্রাগোনাদা দ্বীপ পার হতে হতে আমি আপনাকে কয়েকটি সুন্দর দৃশ্য দেখাবো। এর সাথে কুনুসস আর ক্রোনাস পর্বতও পুরোপুরি দেখা যাবে। সামনের পালের ছায়ার নিচে আমরা আরাম করে বসলাম। জাহাজটি দ্বীপের মাথা দিয়ে ঘুরতেই ক্রিটের উত্তর উপকূলের নতুন একটি দৃশ্য আমাদের সামনে ছড়িয়ে পড়লো।

একদিকে ইডা পর্বতের চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়লো, এর আগে দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে যখন দেখেছিলাম এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখছি। এখান থেকে পবর্তটি আরও উঁচু, খাড়া আর খুব বেশি রুক্ষ মনে হচ্ছে। এর নিচেই কুমুসস নগরী আর বন্দর আমাদের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে।

বন্দরটি বিশাল আর এখানে বেশ কয়েকটি মিনোয়ান রণতরী আর বাণিজ্যপোত নোঙর করা রয়েছে। কিছু কিছু জাহাজ এতো বিশাল যে, এগুলোর তুলনায় আমাদের পবিত্র ষড় জাহাজটিকেও মনে হচ্ছে বেশ ছোট।

বন্দরের উপরেই নগরীর দালানকোঠা দেখা যাচ্ছে। দেখার সাথে সাথেই আমি বুঝলাম যে, এই নগরীটি থিবস আর ব্যবিলন মিলে যা হবে তার চেয়েও কয়েকগুণ বড়। তবে কুনুসসের তুলনায় ঐ ছোট ছোট শহরগুলো বেশ সুন্দর, উচ্ছল এবং প্রীতিকর ছিল।

উঁচু পর্বতমালা আর এর বিশাল পরিসরের স্থাপত্যশিল্পের প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও কুমুসস একটি বিষণ্ণ অন্ধকারময় স্থান। আমার অত্যন্ত সুক্ষ অনুভূতি দিয়ে আমি সাথে সাথে বুঝতে পারলাম যে, কুমুসস এমন একটি বিরল ক্ষমতার ক্ষেত্রের উপর গড়ে তোলা হয়েছে যার উপর দেবতারা তাদের সমস্ত শৌর্যবীর্য কেন্দ্রিভূত করেছিলেন।

আলোকপ্রাপ্ত এই যুগে একজন শিক্ষিত মানুষ মেনে নিয়েছেন যে, পৃথিবী একটি জীবন্ত এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া প্রাণী। একটি বিশালকায় কচ্ছপের মত এটি অনন্তকালের কালো সমুদ্রে চিরদিন সাঁতার কেটে চলেছে। শক্ত খোলসের যে ফলকগুলো দিয়ে কচ্ছপটির পিঠ ঢাকা রয়েছে, সেগুলো এই ক্ষমতার রেখার সাথে সমান্তরালভাবে সংযুক্ত রয়েছে। যখনই পৃথিবী নড়াচড়া করে তখন এই জোড়গুলোর কারণে এর দেহ আর অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো বেঁকে যায়। এগুলো অকল্পনীয় শক্তির কেন্দ্র, কিছু কিছু শক্তি শুভ আর অন্যগুলো অশুভ।

এখানে অশুভ শক্তি রয়েছে; আমি আমার জীহ্বার পেছনে এর অতিমাত্রায় দোষযুক্ত স্বাদ আর নাকে পূতিগন্ধটি অনুভব করলাম।

এর বিশালতা বুঝার চেষ্টা করতেই আমার সারা দেহ কেঁপে উঠলো।

তোরান উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি শীত করছে?

মাথা নেড়ে মৃদু হাসলেও আমার চেহারায় মনে হল তা প্রকাশ পায় নি। আমি ঘুরে সরাসরি সাগরের দিকে তাকালাম। তবে চোখের সামনেই ক্রোনাস পর্বতের জোড়া চূড়া চোখে পড়তেই মন আরও অশান্ত হয়ে উঠলো। আমার উত্তেজিত চেহারা চোখে পড়তেই মুখে চুচুক শব্দ করে তোরান আমার পিঠ চাপড়ে বললো, মন খারাপ করবেন না তায়তা! বেশিরভাগই লোকেরই প্রথমবার সকল দেবতার পিতা ক্রোনাস নগরদুর্গ দেখার সাথে সাথেই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। আপনি এই জায়গার ইতিহাস আর কীভাবে এই রহস্যগুলো ঘটে চলেছে তার কাহিনী জানেন?

আমি বললাম, তেমন কিছু জানি না। আসলে আমি এ-বিষয়ে তোরানের চেয়েও বেশি জানতাম, তবে অনেক সময় না জানার ভান করাই ভালো। এতে আরও কিছু রহস্য জানার সুযোগ থাকে, যা হয়তো আমি জানতাম না।

আমার একথার পর তোরান উৎসাহ নিয়ে বললো, একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই একমত হবেন যে ক্রোনাস হচ্ছেন সকল দেবতার পিতা। তার আগে কেবল গয়া নামে পৃথিবী এবং ইউরেনাস নামে আকাশ ছিল। এদের মিলনের ফলেই ক্রোনাসের জন্ম হয়।

সতর্কভাবে তার কথা মেনে নিয়ে আমি বললাম, এটুকু অবশ্য আমি জানি। তারপরও আপনি বলে যান তোরান। আমি কোনো তর্কে গেলাম না, যদিও আমি জানি এর সৃষ্টির পেছনে আরও কিছু যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে।

একসময় ক্রোনাস তার পিতা ইউরেনাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে তাকে পরাজিত করেন। তারপর খোঁজা বানিয়ে তাকে নিজের ক্রীতদাস করেন। দেবতাদের সম্পূর্ণ স্বর্ণযুগে ক্রোনাস রাজত্ব করেন। তবে তিনি সেই ভবিষ্যদ্বাণীটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন যে, তিনি যেরকম তার পিতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সেরকম তারও কোনো এক সন্তান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কাজেই তা রোধ করার জন্য জন্মাবার সাথে সাথে তিনি তার সমস্ত সন্তানকে খেয়ে ফেলতেন।

আমি সরল চেহারায় ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, এই পরিস্থিতিতে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নিশ্চয়ই ছিল না। আমি এরকম অনেক মরণশীল পিতার কথা জানি যারা এই ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তবে তোরান আমার কথাটি সত্যি মনে করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, ঠিকই বলেছেন। তবে ক্রোনাসের জ্যেষ্ঠ স্ত্রী রিয়া ষষ্ঠ পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে তার নাম দেন জিউস এবং তাকে তার পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে ইডা পর্বতের একটি গুহায় রাখেন। পর্বতের পাশে উপসাগরের ওপার দেখিয়ে সে বলে চললো, এরপর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সে ক্রোনাসের সাথে লড়াই করে। তাকে পরাজিত করার পর তার পেট চিরে ফেলতেই তার সকল ভাই পেট থেকে বেরিয়ে মুক্তি পায়।

তোরান একটু পণ্ডিতি ভাব দেখানোতে এবার আমি তার বক্তৃতাটিকে একটু দ্রুত স্তরে নিয়ে বললাম, তারপর জিউস তার ভাই-বোনদের নিয়ে উড়ে অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এখনও ওরা সেখানে আছেন আর উদ্ধতভাবে আমাদের জীবন শাসন করে চলেছেন। জিউস এখন সকল দেবতার পিতা এবং ঝড়ের প্রভু। তার বোন হেস্টিয়া হচ্ছেন গৃহ এবং ভিটেমাটির দেবী; দেমেতার হচ্ছেন কৃষি এবং সুন্দর ফসলের দেবী; হেরা হচ্ছেন বিয়ের দেবী; হেইডস পাতালের প্রভু এবং পসেইডন হচ্ছেন সাগরের দেবতা।

তোরান একটু ক্ষুব্ধ চেহারা নিয়ে বললো, আপনি বলেছিলেন যে এদের ইতিহাস আপনি জানেন না। তারপর আমি বাকিটুকু বলার আগেই বলতে শুরু করলো, তবে তার পিতা অমর হওয়ার কারণে জিউস তাকে হত্যা করতে পারেনি। সেজন্য অলিম্পাস পর্বতে যাওয়ার আগে সে ক্রোনাসকে ঐ আগ্নেয়গিরির অগ্নিগর্ভে আটকে রেখে যায়। আর এখন এটি তার নামেই পরিচিত।

আমরা দুজনেই নিরবে পর্বতটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তোরান নীরবতা ভঙ্গ করে বললো, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী আগ্নেয়গিরি। এর সমস্ত শক্তি ক্রোনাস নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এর দ্বারা তিনি বিদেশি রাজাদের ঈর্ষা এবং কমসভ্য জাতির বিষয়-লালসা থেকে আমাদের রক্ষা করেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, যখন ইউবোয়িআনরা আমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য নৌবহর পাঠায়, তখন ক্রোনাস তার পর্বতের চূড়া থেকে বড় বড় জ্বলন্ত পাথরের টুকরা তাদের উপর নিক্ষেপ করে। ফলে ওদের বেশিরভাগ জাহাজ ডুবে যায় আর যারা বেঁচে ছিল তারা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে পালিয়ে যায়।

আমি পর্বতটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটি আসলেই মনে হচ্ছে একটি রুদ্র দৃশ্য। খাড়া পিরামিড আকৃতির বাঁধে কোনো উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। উজ্জ্বল কালো আর চকচকে লাল জমাটবাধা কঠিন ও ভঙুর লাভার স্রোতের দেয়াল সোজা সাগরে নেমে গেছে।

পর্বত চূড়াটিকে ভেদ করে পথ করে নেওয়া জোড়া ফাটল দিয়ে এখনও গলিত লাভা ধীরে ধীরে নির্গত হয়ে নিচের দিকে চুঁইয়ে পড়ছে। প্রচণ্ড উত্তপ্ত অবস্থায় ঝিকমিক করা আগুনের নদী পর্বতের গোড়ায় নেমে পানির ছোঁয়া পেতেই ধূঁয়ার মেঘে বিস্ফোরিত হচ্ছে।

তোরান ব্যাখা করে বললো, যখন ক্রোনাস খুব বেশি খুশি কিংবা অত্যন্ত উত্তেজিত হন তখন তিনি ধূঁয়া এবং আগুন নির্গত করেন। তার অগ্নিময় নিঃশ্বাসের পরিমাণ এবং শক্তি থেকে তার রাগ কিংবা আনন্দের তীব্রতা পরিমাপ করা যায়। এখন মৃদু নিঃশ্বাসের সাথে গ্যাস বাষ্প নিঃসারণ করা দেখে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন যে, তিনি ঘুমাচ্ছেন কিংবা হাসিখুশি মেজাজে রয়েছেন। যখন সত্যি সত্যি জেগে উঠেন তখন গলিত লাভা উপরের দিকে ছুঁড়ে মারেন আর গন্ধকযুক্ত ধূঁয়ার মেঘ আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে মেঘের সাথে মিশে যায়। আর তার হাকডাক, গর্জন সমগ্র ক্রিট থেকে শোনা যায়। তার প্রচণ্ড কম্পন সাগর পেরিয়ে অনেক দূর দেশে অনুভূত হয়।

আমি তোরানকে জিজ্ঞেস করলাম, কী কারণে তিনি ক্রুদ্ধ হন?

সমস্ত দেবতার মধ্যে তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। ক্রুদ্ধ হতে ক্রোনাসের কোনো কারণ দরকার পড়ে না আর তার খেয়ালখুশি আর বাতিকের বিষয়ে তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তিনি রেগেছেন কেননা তিনি রেগেছেন; এটা সহজ কথা।

বিশেষ একজন দেবতার ক্ষমতার উচ্চ প্রশংসা আর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া আচরণের স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো কথাগুলো কথা শুনে আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগলাম। আমি সকল দেবতার ইতিহাস আর তাদের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করেছি। এরকম শতশত দেবতা আছেন। মরণশীল মানুষ আর উপ-দেবতার মতো এদেরও শক্তি, প্রকৃতি আর এদের সগুণ আর অবিচারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে।

তবে আমি হতবুদ্ধি হলাম একারণে যে তোরানের মতো একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ কী করে হোরাসের মতো একজন মহান এবং দয়াশীল দেবতার বদলে ক্রোধে উম্মক্ত এরকম একটি দানবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তার আনুগত্য স্বীকার করছে।

আমি ক্রোনাস কিংবা শেঠ কাউকেই বিশ্বাস করি না। এছাড়া জিউসের ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। কী করে আপনি এমন একজনকে বিশ্বাস করবেন, যিনি দেবতা হয়েও, মানবজাতি এবং নিজে পরিবারের সাথেও নোংরা ছলচাতুরি করে আনন্দলাভ করেন?

না ভাই, আমি সম্পূর্ণভাবে একজন হোরাস সমর্থক।

.

কুনুসস বন্দরে বিভিন্ন জাহাজের এতো ভীড় ছিল যে, আমরা বন্দরের দিকে এগোতেই বন্দরের পরিচালক একটি ডিঙি পাঠিয়ে আমাদেরকে জানালেন যে, এই মুহূর্তে আমাদেরকে বন্দরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। বন্দরের ভেতরের এলাকায় জায়গা খালি হওয়া পর্যন্ত আমরা যেন বাইরেই নোঙর করি।

রাজপ্রাসাদে আমাদের আগমনের খবর জানাতে রাষ্ট্রদূত তোরান বন্দর পরিচালকের ডিঙিতে চড়ে তীরে গেলেন।

তোরান যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর এক মাস্তুল বিশিষ্ট একটি নৌযান আমাদের জাহাজের কাছে এলো। এর পালে ক্রিটের রাজকীয় পতাকা উড়ছিল। একদিকে ছিল সোনালি ষাঁড়ের প্রতিকৃতি আর উল্টোদিকে ছিল দুই পাতওয়ালা ঘাতকের কুঠার; এটি সর্বাধিরাজ মিনোজের ব্যবহৃত জীবন মৃত্যুর ক্ষমতা প্রকাশ করছে।

তীরে যাওয়ার আগে তোরান আমাকে সাবধান করে বলেছিল যে, আৰু ছাতক রাজপরিবারের ভাবী বধূ হিসেবে তেহুতি আর বেকাথাকে পুরুষের নজরের আড়ালে কেবিনের ভেতরেই থাকতে হবে। যখন ওরা জনসমক্ষে বের হবে তখন তাদের মুখ ভারী ঘোমটায় ঢাকা থাকবে এমনকি হাত-পাও পুরোপুরি ঢাকা থাকবে। রাজার হেরেমে ঢোকা পর্যন্ত ওদেরকে পর্দার মাঝেই থাকতে হবে।

মেয়েদেরকে মিনোয়ানদের পোশাক সম্পর্কিত এসব নিয়ম-কানুনের কথা বলতেই ওরা রেগে গেল। ওরা যখন ইচ্ছা তখন সম্পূর্ণ নগ্ন থাকতে অভ্যস্ত ছিল। অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদেরকে মিনোয়ান আচার-আচরণ এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে নিতে রাজি করালাম। ওদেরকে বুঝালাম যে, এখন থেকে ওদেরকে মিনোয়ান রাজপরিবারের সদস্যদের মতো আচরণ করতে হবে।

এসব কঠিন নিয়ম-কানুনের কথা মনে রেখে আমি পবিত্র সঁড়ের পেছনের ডেকে দাঁড়িয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

রাজপ্রাসাদের তিনজন কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রদূত তোরান এক মাস্তুল বিশিষ্ট একটি নৌযানে চড়ে এদিকে আসছিলেন। কাছাকাছি হতেই ঐ তিনজনের একজন কর্মকর্তা সর্বাধিরাজ মিনোজের নামে চিৎকার করে আমাদের জাহাজে উঠার অনুমতি প্রার্থনা করলো। ক্যাপ্টেন হাইপ্যাটস সাথে সাথে তাদেরকে উঠার অনুমতি দিয়ে উত্তর দিলেন।

আপাদমস্তক কালো আলখাল্লা পরা লোকগুলো ধীরে ধীরে ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে এলো। তাদের আলখাল্লার প্রান্ত ডেকের উপর দিয়ে লুটাতে লুটাতে চলছিল। ওরা মাথায় কালো ফিতা জড়ানো উঁচু কানাবিহীন টুপি পরেছিল। কুচকুচে কালো দাড়ি আংটা দিয়ে কোঁকড়ানো রয়েছে। মুখে চকের গুড়ো মেখে সাদা করা হয়েছে, তবে চোখের চারপাশে গোল করে সুর্মা লাগানো রয়েছে। আশ্চর্যরকম বৈপরীত্য। চোখমুখে বিষণ্ণ ভাব।

ওরা আমার সামনে এসে থেমে দাঁড়াতেই রাষ্ট্রদূত তোরান তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। তোরান একে একে তাদের লম্বা-চওড়া নাম আর উপাধি উচ্চারণ করে যেতেই আমি মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলাম।

জ্যেষ্ঠ দূত আমাকে অভিবাদন করে বললো, সম্মানিয় তায়তা, সর্বাধিরাজ মিনোজের আদেশক্রমে আমি আপনাকে ক্রিটে স্বাগত জানাচ্ছি। তারপর সে জানালো প্রাসাদে সবাই আমাদের জন্য সাগ্রহে প্রতিক্ষা করছেন। তবে আনন্দের অনুষ্ঠানটি উদযাপনের সঠিক সময় ও তারিখ নিয়ে এখনও একটু অনিশ্চয়তা রয়েছে। সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে বাগদত্তা মিসরীয় রাজপরিবারের নারীদের স্বাগত জানাবার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে আরও চব্বিশ ঘন্টা লাগবে।

তারপর সে বললো, আগামীকাল দুপুরে একটি রাজকীয় বজরা এই জাহাজের কাছে আসবে। এটা আপনাকে এবং ভাবী রাজবধূদেরকে রাজপ্রাসাদে বহন করে নিয়ে যাবে। আপনাদেরকে রাজ পরিবারে স্বাগত জানাবার জন্য সর্বাধিরাজ মিনোজ সেখানে অপেক্ষা করে থাকবেন।

আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, সর্বাধিরাজ মিনোজ অত্যন্ত সৌজন্যময়। আমি জানি কূটনীতির ভাষার এই আমন্ত্রণ আসলে রাজার নির্দেশ।

মহানুভব রাজা আরও জানিয়েছেন, মিসরীয় রাজপরিবারের মহিলাদের আগমনে তিনি আনন্দিত। তিনি তাদের জন্য এই উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছেন। এই কথা বলে সে তার সাথে আসা সহকারীদের হাতের ভারী রূপার কৌটার দিকে ইঙ্গিত করলো। ওরা উপহারগুলো আমার সামনে ডেকের উপর রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে পিছু হটলো।

সাক্ষাতকারের এখানেই পরিসমাপ্তি হল। ওরা আবার এক মাস্তুলবিশিষ্ট নৌযানটিতে ফিরে গেল। আমি জানছিলাম যে মিনোয়ানরা অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কোনো ধরনের সৌজন্যমূলক আনুষ্ঠানিকতায় ওরা বেশি সময় নষ্ট করে না। রাষ্ট্রদূত তোরানও ওদের সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে সে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত নাড়লো।

আমি আশা করেছিলাম সর্বাধিরাজ মিনোজ যে উপহার পাঠিয়েছেন তা দেখে আমার রাজকুমারীদের মন একটু হালকা হবে। উপহারগুলো দেখেই বুঝা গেল এগুলো আসলেই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাজার উপযুক্ত জিনিস বটে। সোনা-রূপা চকচক করে উঠলো আর মূল্যবান রত্নের বিভিন্ন রংয়ের দূতির ছটায় কেবিন ভরে গেল। তেহুতি আর বেকাথা জিনিসগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই আবার বিষণ্ণতায় ফিরে গেল।

এযাবত আমার কঠিন নির্দেশ ছিল যে, আমার মেয়েরা যেন আঙুরের মদ পানের সুযোগ না পায়। তবে আমি বুঝলাম এখন এটাই একমাত্র তাদের মন ভালো করার সঠিক প্রতিষেধকের কাজ করবে। নিচে নেমে জাহাজের খোলে গিয়ে রাষ্ট্রদূত তোরানের একটি মদের পিপা খুললাম। তারপর তিনটি তামার বড় মদের ঘড়ার অর্ধেক অংশে অতীব সুমিষ্ট লাল সিক্লডস মদ ঢালোম। তার উপর পানি ভরে জাহাজের পরিবেশনকারীকে মেয়েদের কেবিনে নিয়ে যেতে বললাম।

তেহুতি বললো, তুমি আমাদেরকে এই বিষ পান করতে বলছো? অথচ তুমি বলেছিলে এটা খেলে আমাদের চুল পড়ে যাবে?

আমি ব্যাখ্যা করে বললাম, খুব কম বয়সে খেলে এটা হয়। দেখো আমার দিকে? আমার কি টাক পড়েছে? অনিচ্ছা নিয়ে ওরা আমার একথা মেনে নিল।

এবার বেকাথা মনে করিয়ে দিল, তুমি বলেছিল এটা খেলে দাঁত পড়ে যাবে? সাথে সাথে আমি আমার পুরো দাঁতের সারি ওদের দেখালাম। ওরা নিরবে এটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো।

এরপর আমি বললাম, এটা তোমাদের মন খুশিতে ভরে দেবে?

বেকাথা দৃঢ়ভাবে বললো, আমি হাসিখুশি হতে চাই না। আমি শুধু মরতে চাই।

আমি বললাম, অন্তত খুশি হয়ে মরতে পারবে।

মিনোয়ন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করে তেহুতি বললো, প্রথমে লক্সিয়াসকে দিয়ে শুরু করা যাক। কথাটি বলে সে একটি মদের পাত্র টেবিলের উপর দিয়ে লক্সিয়াসের দিকে ঠেলে দিল। লক্সিয়াস একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কম আনন্দদায়ক আর মোটামুটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে পেয়ালাটি তুলে ঠোঁটের কাছে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিল; তারপর পেয়ালাটি মুখের কাছে ধরে সোজা হয়ে বসলো।

তেহুতি আদেশ দিল, গিলে ফেল! সে তার নির্দেশ পালন করলো। আর ওরা সতর্কচোখে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো দেখার যে, তার চুল কিংবা দাঁত পড়ে যাচ্ছে কিনা।

লক্সিয়াস মৃদু হেসে আবার পেয়ালার উপর মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, এটা বেশ সুস্বাদু।

তেহুতি প্রতিবাদ করে বললো, যথেষ্ট হয়েছে! তোমার সবটুকু খাওয়ার দরকার নেই। একথা বলে সে গ্লাসটা তার হাত থেকে নিল। তারপর গ্লাসটি টেবিলের চারদিকে একজন থেকে আরেকজনের হাতে ঘুরেফিরে চললো। হাতপা নেড়ে ওরা এর স্বাদ বর্ণনা করতে শুরু করলো। বেকাথা মনে করলো এর স্বাদ বড়ইয়ের মতো, তবে তেহুতি বললো এর স্বাদ অবশ্যই পাকা ডালিমের মতো। লক্সিয়াস কোনো মন্তব্য করলো না, তবে তার অংশ খেতে . ছাড়লো না। প্রথমে সেই হাসতে শুরু করলো। বাকি দুজন তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বেকাথা খিলখিল করে হেসে উঠলো।

এক ঘন্টার মধ্যে তিনজনেই সমস্ত পোশাক খুলে সর্বাধিরাজ মিনোজ যে অলঙ্কারগুলো পাঠিয়েছিল সেগুলো পরে সাজলো। আমি আমার বীণায় ওদের প্রিয় একটা সুর বাজাতে শুরু করলাম। ওরা হাসাহাসি করতে করতে কেবিনের চারদিকে তিড়িং বিড়িং করে লাফালাফি করতে লাগলো। শেষপর্যন্ত মধ্যরাতের একটু আগে বেকাথা তার বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। বাকি দুজনও আর দেরি করলো না। আমি ওদের গায়ে চাদরটাকা দিয়ে প্রত্যেকের কপালে চুমু খেয়ে শুভ রাত্রি বলে আলো নিভিয়ে বিদায় নিলাম। তারপর ডেকের সিঁড়ি বেয়ে উপরের ডেকে উঠে রাতের খোলা হাওয়ার মাঝে এসে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পর মনটা বেশ খুশিখুশি লাগছে।

.

পরদিন দুপুরবেলায় একটি রাজকীয় বজরা বন্দর থেকে বের হয়ে পবিত্র ষাঁড়ের দিকে আসতে শুরু করলো। আমার রাজকুমারীরা মিনোয়ান রীতিতে পোশাক পরে তৈরি হয়ে মূল ডেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। নড়চড়া না করলে বুঝার উপায় নেই যে কালো কাপড়ের কয়েকটি স্তর আর ঘোমটার নিচে কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। রাষ্ট্রদূত তোরান আজ সকালেই এই পোশাকআশাকগুলো পাঠিয়েছিল। অনেক অনুনয়বিনয় আর ছলচাতুরির পর মেয়েদেরকে এই অদ্ভুত ভিনদেশি পোশাকগুলো পরতে রাজি করেছিলাম। লক্সিয়াসের বেলায়ও তেমন অমর্যাদা করা হয়নি। যদিও তার পোশাকটিও লম্বা আর কালো ছিল আর টুপিটি ছিল উঁচু আর কৌণিক আকারের, তবুও তার মুখ আর হাত খোলা ছিল। সে কেবল একজন পরিচারিকা হওয়াও আমার বিশ্বাস যদি সে বুক উন্মুক্তও রাখে তারপরও কেউ তার দিকে তেমন লক্ষ্য করবে না।

ডেকে বসা চারজন যাজকের মৃদু তালে ঢোলক বাজনার তালে তালে আমি মেয়েদেরকে নিয়ে নিচে বজরার দিকে এগিয়ে নিয়ে চললাম। তারপর বৈঠা বেয়ে বজরাটি বন্দরের দিকে এগিয়ে চললো। এই ফাঁকে আমি পোতাশ্রয়ের চারদিক ঘিরে থাকা উঁচু উঁচু অট্টালিকাগুলো ভালোমতো দেখার সুযোগ পেলাম।

পাহাড় থেকে আনা মেটে-ধূসর রঙের পাথরের বড় বড় টুকরা দিয়ে এই অট্টালিকাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। একটি দালানের সাথে আরেকটি দালানের খুব একটা তফাৎ নেই। সবগুলো দেখতে বিশ্রী। ছাদগুলো সমতল। আর সরু জানালাগুলো আলোনিরোধক ধূসর কাঁচ দিয়ে ঢাকা।

সবচেয়ে বড় ভবনটি বন্দরের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত। এর ছাদে ক্রিটের সোনালি ষাঁড়ের প্রতিকৃতি না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এটি সর্বাধিরাজ মিনোজের চারটি প্রাসাদের একটি।

অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দাঁড় টেনে দাঁড়িরা বজরাটিকে প্রাসাদের সামনের জেটিতে এনে রাখলো। তীরে কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমাদের ছোট দলটিকে স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। এরা সবাই একইরকম কালো পূর্ণদৈর্ঘ্য পোশাক আর উঁচু কোণিক আকারের টুপি পরে ছিল। সবার মুখ চুনা-পাথরের মতো সাদা আর চোখের চারপাশে গোল করে সূর্মা লাগানো। কয়েকজন পোশাকের উপর সোনা আর রূপার হার পরে রয়েছে।

আমিও রাষ্ট্রদূত তোরানের পাঠানো লম্বা কালো আলখাল্লা পরেছিলাম। তবে আমি আমার সেই পাখির পালক লাগানো জমকালো সোনার শিরস্ত্রাণটি পরেছিলাম আর আমার মুখে কোনো চুন কিংবা সূর্মা লাগানো ছিল না।

সমবেত লোকজনের মধ্যে কেবল চারজনের পরনে কালো পোশাক ছিল না। এরা ছিল উজ্জ্বল সবুজ আঁটোসাঁটো জ্যাকেটপরা নমনীয় শরীরের চারজন কালো যোদ্ধা। এদের বুকের উপর আড়াআড়ি চামড়ার ফিতা বসানো আর মাথায় চামড়ার শিরস্ত্রাণ পরা। রাজকুমারীরা তীরে পা রাখতেই ওরা চটপটে সামনে এগিয়ে এসে ওদের দুজনের পাশে অবস্থান নিল। ওরা সবাই ছোট তরবারি আর ছুরি বহন করছিল। দুজনের হাতে চাবুকও ছিল।

সবুজ পোশাকপরা দেহরক্ষীদলটির মাঝে আজব ধরনের মেয়েলি কিছু একটা ছিল। মসৃণ মুখে দাড়ি নেই। সুগঠিত কমনীয় দেহ আর হাতগুলোও সেকরম। শুধু নারীসুলভ স্তনের প্রস্ফীতি নেই। যে কোনো বালকের মতো ওদের বুকও সমান। আমার মনে হল এরা উভলিঙ্গ জাতীয় মানুষ যা এর আগেও এই আজব দেশে দেখেছি। যাইহোক এদের নিয়ে চিন্তা মন থেকে বাদ দিয়ে আমার রাজকুমারীদের অনুসরণ করে প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রাসাদের গুহার মতো লবিতে ঢুকলাম।

এই স্থানটিতে কালোপোশাকপরা চুন-সাদা মুখের মানুষ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল। তবে পুরো জনসমাবেশের মধ্যে একজনও নারী দেখা গেল না। আমরা মিসরীয়রা আমাদের নারীদের নিয়ে গর্বিত আর সবসময় আশা করি যে নারীরা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি প্রধান এবং অত্যন্ত প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করুক। এই নারী বিচ্ছিন্নতা দেখে আমার খুবই অস্বাভাবিক এবং অপছন্দনীয় মনে হল।

মানুষের ভীড়ের মাঝখানে মার্বেল পাথরের মেঝের উপর দিয়ে যাওয়ার জন্য আমার মেয়েদের আর তাদের সবুজ পোশাক পরা দেহরক্ষীদলের জন্য একটি পথ খোলা ছিল। এটি সোজা চলে গেছে হলের শেষ মাথায় আরেকটি দরজার কাছে। এই গলি দিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করতেই, কয়েক কদম যাওয়ার পর ভীড়ের মধ্য থেকে একজন লোক এসে আমার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি লোকটি রাষ্ট্রদূত তোরান। সেও আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত ছিল আর তার মুখও একজন মরামানুষের মতো সাদা রং আর চোখে গোল করে সূর্মা লাগানো ছিল। তবে সে একটি সোনার হার পরেছিল, যা দেখে আমি চিনতে পারলাম। বিষাদময় স্বরে কথা বললেও আমি তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম।

সামনের বন্ধ দরজাটি দেখিয়ে সে বললো, সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। ঐ দরজার পেছনেই বন্ধ কামরাটিতে সর্বাধিরাজ মিনোজ তার সভাসদদের নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাণীমাতাও তার সাথে আছেন। এটি একটি বিরল সম্মান। আজকের অনুষ্ঠানে আপনার অংশগ্রহণ করার মতো কিছু নেই। তবে কাল থেকে নৌ-বাহিনী প্রধান এবং যুদ্ধপরিষদের সাথে আপনি হাইকসোদের বিরুদ্ধে অভিযানের পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করবেন।

আমিও তার মতো নিচুস্বরে বললাম, শুনে খুব খুশি হলাম। তবে বিয়ের উৎসবটি কখন হবে? এতোবছরের পরিকল্পনা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পর এই পর্যায়ে এসেছি। আমরা প্রায় সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছি। তাই আমার আস্বস্ত এবং খুশি হওয়াটা স্বাভাবিক।

সূর্মা লাগানো চোখে তোরান আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই চকচকে পলিশ করা সিডার কাঠের দরজাটি নিঃশব্দে খুলে গেল। একটি ঢাকের কাঠির আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা রাজদরবারে ঢুকলাম। ঢুকার পর একটু থামতেই পেছনে দরজাটি আবার নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

ভেতরে স্লান আলো। কোনো প্রদীপ দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটি মাত্র সরু জানালা কালো রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। ছাদ এতো উঁচু যে উপরে ছায়াছন্ন হয়ে আছে। তবে আবছা আলোয় আমার চোখ সয়ে এলে প্রায়ান্ধকারে বিভিন্ন বস্তুর আকৃতি আর মানুষের অবয়ব বুঝতে পারলাম।

কামরাটির মাঝখানে একটি উঁচু মঞ্চের উপর সিংহাসনটি স্থাপন করা রয়েছে। এর নিচে চারদিক ঘিরে রয়েছে কয়েকজন মানুষ। সিংহাসনের বামদিকে ক্রোনাস দেবতার যাজকরা সমবেত হয়ে রয়েছেন। এরা ঢিলা লম্বা আস্তিনহীন টুপিযুক্ত আলখাল্লা পরে রয়েছে। এতে তাদের শরীরের আকার কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। পোশাকের রং ছিল ষাঁড়ের রক্তের মতো লাল।

সিংহাসনের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকদল সভাসদ আর অভিজাত ব্যক্তি। এরা কেউ কেউ ঐতিহ্যগতভাবে লম্বা কালো আলখাল্লা আর উঁচু টুপি পরেছিল।

এদের মুখোমুখি ছিল উচ্চপদস্থ সামরিক এবং নৌকর্মকর্তারা। এদের পোশাক বেশ জমকালো এবং রঙচঙে হলেও সভাসদদের পোশাক ছিল মেটে রঙের।

সিংহাসনটি বিশাল। আবলুশ কাঠের উপর মুক্তার কাজ। বসার জায়গায় বেশ চওড়া, পাঁচজন বড় বড় মানুষ বসতে পারে। তবে এখন দুজন বসে রয়েছে। একজন ছিলেন নারী, রাজদরবারে উপস্থিত আমার রাজকুমারী আর লক্সিয়াস ছাড়া তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা।

আমি অবিশ্বাসি চোখে তার দিকে তাকালাম। এমন অতি প্রবীণা নারী আমি কখনও দেখিনি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সময়ের সমবয়সী এক বৃদ্ধা। হাড্ডিসার দেহটি ধূলিমলিন কালো লেস কাপড়ে আবৃত, তবে হাতে কোনো দাস্তানা নেই। বাতরোগ আর বয়সের কারণে আঙুলগুলো অদ্ভুতভাবে বেঁকে রয়েছে। কঙ্কালসার হাতের পিঠে নীল শিরাগুলো জট পাকিয়ে রয়েছে।

পাণ্ডুর মুখের চামড়ার বলিরেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন গাছ থেকে পড়ে যাওয়া একটি আপেল রোদে শুকিয়ে রয়েছে। এটা দেখে আর মানুষের মুখ মনে হচ্ছে না। মাথার কয়েকগাছি চুল উজ্জ্বল লাল রঙ করা। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে রয়েছে। একটা চোখ কালো রঙের কাঁচের মতো আগ্নেয় শিলার মতো চকচকে। আর অন্যটি অনচ্ছ আর সেই চোখ থেকে পানি চুঁইয়ে শুকনো গাল বেয়ে পড়ছে। চোখের পানিতে দেহের উপরের কালো লেসের পোশাক ভিজে যাচ্ছে।

নীরবতা ভঙ করে বৃদ্ধা হুউক করে কেশে উঠলো আর সবুজ আর হলুদ রঙের একদলা কফ মুখ থেকে বের করে মার্বেলের মেঝেতে থুক করে ফেললো। মুখ খুলতেই আমি তার কালো দাঁতগুলো দেখলাম।

তোরান ফিসফিস করে বললো, রানি মাতা, পাসিফে।

রূপার ঝালরের কারুকাজকরা আলখাল্লা আর বুকে সোনার বর্মপরা দানবীয় একজন মানুষ তার পাশে বসে রয়েছে। তবে প্রাণীটিকে দেখে মানুষের চেয়ে অনেক বড় মনে হল। ভাবলাম এটি কি মিনোয়ান অমর সর্বদেবতার মন্দির থেকে আসা কোনো প্রকৃতিক্রমবহির্ভূত জন্তু কিংবা মানব?

এর হাতদুটো কালো লোমশ চামড়ার দাস্তানায় ঢাকা। মনে হল বন্য মহিষের চামড়া। এর নিচের অঙ্গও একই চামড়ার তৈরি উঁচু বুটজুতা দিয়ে ঢাকা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের জিনিস হল এর মাথা। মাথাটি সম্পূর্ণ মূল্যবান ধাতুর মুখোশে ঢাকা। মুখোশটির আকার ছিল নাকের ছিদ্র আর রুক্ষ কেশরসহ একটি বন্য ষাঁড়ের মাথার মতো। মুখোশে লাগানো বিশাল শিংগুলো ছিল আসল। সম্ভবত একই প্রাণীর কোনো মৃতদেহ থেকে আনা। লম্বা শিংগুলো সামনের দিকে বাঁকা আর ডগাগুলো ভয়ঙ্কর রকমের সুচোলো। এ-ধরনের মহিষের শিং আমি ব্যবিলনে রাজা নিমরদের প্রাসাদের দেয়ালে ঝোলানো দেখেছি।

মুখোশের চোখের ছিদ্রগুলো মনে হল কালো এবং শূন্য। তবে আমি একপাশে একটু সরতেই মুখোশের মাথাটিও সেইদিকে ঘুরলো। আর এতে জানালা থেকে আলো পড়তেই আমি চোখের গর্তের গভীরে জীবন্ত চোখের নড়াচড়া বুঝতে পারলাম। এটা কি মানুষের চোখ নাকি কোনো জন্তু কিংবা দেবতার চোখ? তবে জানার কোনো উপায় নেই।

আড়াল থেকে ঢাকিরা দুবার ঢাক পিটিয়ে নীরব হল। হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়া কামরায় কেউ নড়চড়া করছে না। তারপর সিংহাসনে বসা মুখোশ পরা মানব-মূর্তিটি উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাত দুপাশে মেলে ধরলো। তারপর সে একটি বন্য ষাঁড়ের মতো গর্জন করে উঠলো। শব্দটি এই প্রাণীর মাথার মুখোশের মধ্যে এমন প্রচণ্ডভাবে প্রতিধ্বনিত হল যে, আমার মনে হল মিনোয়ান প্রকৌশলীরা নিশ্চয়ই এই মুখোশের মধ্যে এমন কোনো ব্যবস্থা করেছে যার কারণে শব্দটি অসম্ভব জোরে শোনা যাচ্ছিল।

সাথে সাথে পুরোহিতসহ উপস্থিত সমস্ত মানুষ শ্রদ্ধা দেখিয়ে গম্ভীরভাবে গোঙানির মতো একটি শব্দ করে মুখ নিচের দিকে করে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। দুই রাজকুমারীর দুইপাশে দাঁড়ানো সবুজ পোশাক পরা প্রহরীরা রাজকুমারীদেরকে জোর করে মুখ নিচু করে মার্বেল পাথরের মেঝেতে প্রণত হতে বাধ্য করলো।

রাষ্ট্রদূত তোরান আমার কব্জি ধরে আমাকে নিচের দিকে টেনে মাটিতে প্রণত করে হিশশ করে বললো, চুপ করে শুয়ে থাকুন! প্রাণ বাঁচাতে হলে উপরের দিকে তাকাবেন না!

আমি তার কথা মান্য করলাম। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে, তবে এটুকু বুঝতে পারলাম এখন তর্ক করার সময় নয়। চুপ করে শুয়ে রইলাম; অন্যরা যখন মেঝেতে কপাল ঠুকে গোঙানির মতো শব্দ করছে, তখন তাদের মতো আমিও মেঝেতে কপাল ঠুকে গুঙিয়ে উঠলাম। এদিকে সিংহাসন থেকে আগের মতোই প্রচণ্ডভাবে ক্রোধদ্দীপ্ত বক্তৃতা হয়ে চলেছে। শব্দটি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার মাথা দপদপ করতে লাগলো।

যদিও মিনোয়ান ভাষা আমি ভালোভাবেই শিখেছিলাম, তবুও সর্বাধিরাজ মিনোজ যা বলছিলেন তার একবর্ণও বুঝতে পারলাম না। হয় তিনি কোনো রহস্যময় ভাষায় লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিচ্ছেন কিংবা শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে বিকৃত হওয়ায় আমি তা বুঝতে পারছি না।

ডানহাতে আমি একটি ব্রেসলেট পরেছিলাম। চিকণ একটি চেইন থেকে ছোট্ট একটি সোনার চাকতি ঝুলছে। চাকতিটা পলিশ করে আয়নার মতো চকচকে করেছিলাম। হাত না উঠিয়ে আমার সামনে বা পেছনে কোনো জিনিস বা মানুষের ছবি এতে প্রতিফলিত হলে আমি দেখতে পারতাম। এভাবে আমি অনেক কিছু দেখেছিলাম আর কয়েকবার এর মাধ্যমে মৃত্যুও এড়াতে পেরেছি।

হঠাৎ আমার ছোট্ট আয়নায় দেখা গেল ছাদের ছায়া থেকে একটি কালো গোলাকার পর্দা নিঃশব্দে পড়ে গেল। যে মঞ্চের উপর সিংহাসনটি বসানো ছিল পর্দাটির আকার ঠিক তার সমান। পর্দাটি নিচে নেমে সম্পূর্ণভাবে সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার মা, পাসিফেকে ঢেকে ফেললো।

তারপর এটা যেমন নেমেছিল সেরকম দ্রুত আবার উপরের দিকে উঠে গেল। সিংহাসন আর মঞ্চটি শূন্য পড়ে রইল। সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার মা অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এ-ধরনের চাতুর্যপূর্ণ মঞ্চাভিনয়ের শৈলী আমি আর কখনও দেখিনি।

আড়াল থেকে ঢাকিরা আবার ঢাক পেটাতে শুরু করলো। এই ইঙ্গিতটি পাওয়ার পর সবাই হাঁটু গেড়ে বসে মাথা তুললো। সর্বাধিরাজ মিনোজ আর তার মা অদৃশ্য হয়েছেন বুঝতে পেরে সবাই অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো। আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম। ক্রিটের রাজার আশ্চর্য ক্ষমতার প্রদর্শনী দেখে আমার বিস্ময় প্রকাশ করার পর আমি দাঁড়িয়ে তোরানকে জিজ্ঞেস করলাম, আশা করি সর্বাধিরাজ মিনোজ বিয়ের অনুষ্ঠানের একটা দিনক্ষণ ঠিক করেছেন, তাই না?

সে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বললো, ক্ষমা করুন প্রভু তায়তা। আমার আগেই আপনাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা উচিত ছিল। আমি মনে করেছিলাম কী ঘটছিল তা আপনি বুঝতে পেরেছিলেন। এতোক্ষণ যা দেখলেন তা ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান।

প্রথমে আমার মুখে কোনো কথা জোগাল না, তারপর কোনোমতে বললাম, কিছু বুঝতে পারছি না তোরান। আমিতো মিসরী রাজকুমারীদের বিয়ের কথা বলছিলাম।

সে বললো, এটাই তো বিয়ে। এরা আর রাজকুমারী নেই। ওরা এখন মিনোয়ান রানি। আপনি আর আমি যা সম্পন্ন করতে চেয়েছিলাম তা এখন সাফল্যের সঙ্গে শেষ করা হয়েছে। তারপর সে আমার হাত ধরতেই আমি তার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখন আমার মেয়েদের কী হবে?

মাথা ঘুরিয়ে সবুজ পোশাকপরা দেহরক্ষীদলটিকে দেখিয়ে সে বললো, ঐ রণচণ্ডীরা এখন ওদেরকে রাজকীয় হেরেমে নিয়ে যাবে।

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, আমি এখনও ওদের সাথে যাওয়ার জন্য তৈরি হই নি। আগে আমাকে পবিত্র আঁড় থেকে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিতে হবে।

আমি অত্যন্ত দুঃখিত তায়তা। রাজমহিষীদের প্রাসাদে কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই।

আপনিতো জানেন তোরান যে, আমি একজন পুরোপুরি পুরুষ নই। আমাকে কখনও আমার মেয়েদের কাছ থেকে জোর করে আলাদা করা হয়নি।

সে বললো, মিনোয়ান আইনে আপনি একজন পুরুষ।

সবুজ পোশাকপরা যে দেহরক্ষীরা রাজকুমারীদেরকে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওদের বিষয়টা কি তোরান? ওরা কি পুরুষ নয়?

না তায়তা। ওরা পশ্চিম আফ্রিকার বেলালা গোত্রের নারী।

আমি প্রতিবাদ করলাম, কিন্তু ওদেরতো স্তন নেই!

বয়ঃসন্ধির সময়ে এগুলো কেটে ফেলা হয় যাতে ওরা ভালোভাবে তরবারি চালাতে পারে। তবে এর নিচে ওরা পুরোপুরি নারী। আপনাকে প্রমাণ করে দেখাচ্ছি। একথা বলে সে দেহরক্ষীদের অধিনায়কদের দিকে ফিরে কিছু বললো। সাথে সাথে সে তার সবুজ ঘাগড়ার প্রান্ত তুলে তার স্ত্রী অঙ্গ দেখাল।

আমি প্রায় অনুনয়ের স্বরে বললাম, আবার কখন আমি আমার মেয়েদের দেখা পাবো?

তোরান চূড়ান্তভাবে বললো, আমাকে যে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে সেজন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। কেননা উত্তরটি হল কখনও না। ওদের মৃত্যু পর্যন্ত সর্বাধিরাজ মিনোজ ছাড়া আর কোনো পুরুষ তাদের দেখতে পাবে না।

পরে তার কথাটি ভাবতে গিয়ে আমার মনে হল শেষ কথাটি একধরনের সতর্কবার্তা ছিল। তবে এই বিশাল ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে তখন আমি এতো মনোকষ্টে ছিলাম যে এই কথাটি আগে ভাবার সময় পাইনি।

চার রণচণ্ডি নারী দেহরক্ষী ঘোমটায় ঢাকা রাজকুমারীদের নিয়ে চললো, লক্সিয়াস তাদের অনুসরণ করলো। তবে যাবার আগে আমার দিকে ফিরে ফিসফিস করে বললো, আমি জীবন দিয়ে ওদের রক্ষা করবো। কথাগুলো না শুনলেও ওর ঠোঁটনাড়া পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম।

আর সামলাতে না পেরে ওদেরকে বাধা দেবার জন্য আমি এগোতেই তোরান আমার হাত টেনে ধরে থামিয়ে বললো, আপনি নিরস্ত্র তায়তা। ঐ রণচণ্ডি নারীগুলো প্রশিক্ষিত হত্যাকারী। ওদের মনে কোনো দয়ামায়া নেই।

আমি দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলাম। লক্ষ্য করলাম বেকাথা কাঁদছিল, ঘোমটার নিচে তার সারা শরীর কাঁপছিল। তবে তেহুতি একজন বীর নারীর মতো অজানার পথে পা বাড়ালো।

সিংহাসনের পেছনে দেয়ালে একটি কালো রঙের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। হতাশা নিয়ে আমি দেখলাম ওরা সেই দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

মনে হচ্ছিল যেন আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। ওরা চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে চলে গেছে। যাদের জন্য এতোবছর বেঁচে ছিলাম তারা আর নেই।

রাষ্ট্রদূত তোরান জানতো কত গভীরভাবে রাজকুমারীদের সাথে আমি জড়িত ছিলাম আর ওদেরকে হারিয়ে আমি কতটুকু আহত হয়েছি। এবার সে প্রমাণ করলো যে, সে আমার সত্যিকার বন্ধু হয়েছে। প্রাসাদের পেছনের উঠানে আমার জন্য একটা ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষা করছিল। রাষ্ট্রদূত তোরান আর আমি সেই গাড়িতে চড়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে কুনুসস নগরীর উপরে পাহাড়ের ধারে এক বিশাল অট্টালিকায় গেলাম। এটিই এখন থেকে মিসরীয় দুতাবাস হবে আর আমি হলাম রাষ্ট্রদূত।

উপরে উঠবার সময় তোরান শহরের বিভিন্ন দৃশ্য দেখিয়ে আমার মন চাঙ্গা করার চেষ্টা করতে লাগলো। এর মধ্যে ছিল নৌবাহিনীর সদর দপ্তর আর সরকারি বিভিন্ন ভবন, যেখান থেকে সর্বাধিরাজ মিনোজ দূর-দূরান্তে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন।

তোরান বললো, সরকারের সর্বোচ্চ দপ্তর হচ্ছে রাজ্য পরিষদ, সর্বাধিরাজ মিনোজ এর দশজন সম্মানিত সদস্য নিয়োগ দেন। এদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনের সকল দিক দেখাশুনা করা। যেমন, সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক ক্রোনাস দেবতার উপাসনা থেকে শুরু করে কর আদায় পর্যন্ত, এটা অবশ্য ঐচ্ছিক নয়। এই সামান্য রসিকতাটা করে সে চুকচুক করলো, তারপর বললো, এরপর আছে নৌপরিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনী।

অনেক চেষ্টার পর আমি আমার হারানোর ব্যথা একপাশে সরিয়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোর দিকে মনোযোগ দিলাম।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অবশ্যই সারা পৃথিবী মিনোয়ান নৌবাহিনীর কথা জানে, তবে আমি জানতাম না যে আপনাদের একটি সেনাবাহিনীও আছে।

তোরান গর্বভরে উত্তর দিল, আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা সদস্য রয়েছে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হোরাসের দিব্যি, তার মানে এটাতো আপনাদের জনসংখ্যার অধিকাংশ।

সমস্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মিনোয়ান তবে সাধারণ সেনারা ভাড়াটে সৈন্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ হচ্ছে দক্ষকর্মী, ওরা সেনাসদস্য নয়।

এই তথ্যটি জেনে আমি খুব অবাক হলাম। তারপর বললাম, এবার আমি বুঝেছি। আর নিশ্চিত হয়েছি যে, আপনাদের এই চমৎকার নৌবহরের জাহাজে অত্যন্ত দ্রুত এই যোদ্ধাদেরকে বহন করে যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিতে পারবেন।

তোরান সকল জ্যেষ্ঠ সেনাপতি আর তাদের যার যার দায়িত্বের বিশদ বিবরণ জানাল। তারপর সে এদের প্রত্যেকের ক্ষমতা আর দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করলো। কেউ কেউ অত্যন্ত কুশলী এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন যোদ্ধা। তবে অন্যান্যদের বেশিরভাগই শুধু তাদের সম্পদ, পেট আর জৈবিক কামনা মেটাবার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত।

তবে তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজ আর সোনার মুখোশের পেছনে মানুষটি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করতেই সে তা এড়িয়ে গেল আর হালকা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বললো, সর্বাধিরাজ মিনোজ সম্পর্কে আলোচনা করা মানেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার সামিল অপরাধ। আপনি কেবল এটা জেনে সন্তুষ্ট হতে পারেন যে, তিনি হলেন আমাদের জাতির আত্মার মূর্তপ্রকাশ। এবারকার মতো আমি মনে করবো আপনি না জেনে একথা জিজ্ঞেস করেছেন, তবে আমি আপনাকে এ-বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছি তায়তা।

দুজনেই কিছুক্ষণ বিব্রতকর নীরবতায় কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড় ঘুরতেই হঠাৎ আমার থাকার অট্টালিকার সামনে পৌঁছলাম। বিশাল ভবনটি অন্যগুলোর মতোই সাদামাটা, কোনো ফুলের বাগান নেই। শুধু চারপাশে একটি আঙুরের মাচা দেখা যাচ্ছে।

এই আবাসনের পরিচারকবৃন্দ আমাকে স্বাগত জানাবার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে মুল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তোরান বললো, এরা সবাই ক্রীতদাস। এদের জিহ্বা কেটে ফেলা হয়েছে, কাজেই কোনো ধরনের অনর্থক বকবকানি আপনাকে শুনতে হবে না।

মনে মনে ভাবলাম, তার মানে এদের কাছ থেকে কোনোকিছু জানতে পারব না। তবে একথা মুখে প্রকাশ করলাম না।

গাট্টাগোট্টা চেহারার হাসিহাসি মুখে দাঁড়ানো একজনকে দেখিয়ে সে বললো, এ হল বেশাস, আপনার প্রধান পরিচারক। এ মিসরীয় ভাষা বুঝে তবে সেই একই কারণে কথা বলতে পারে না। আপনার যা প্রয়োজন তা একে বলতে পারেন।

তোরান ঘুরে ঘুরে আমার নতুন আবাসস্থলটি দেখাল। কামরাগুলো বেশ বড় তবে আড়ম্বরহীন। আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আগেই বন্দর থেকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এগুলো সব ধুয়ে পরিষ্কার করে সুন্দরভাবে থাকার জায়গায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শোবার কামরার পাশেই একটি গ্রন্থাগারে একশোর মতো বড় বড় লেখার কাগজের পাকানো ফালি এবং গ্রন্থ তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

তোরান বললো, এখানে মিনোয়ান সাম্রাজ্যের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবেন, এখানে আমারও বেশকিছু লেখা আছে। আশা করি এগুলো আপনার কাজে লাগবে। তারপর কামরার মাঝখানে লেখার টেবিল দেখিয়ে বললো, এখানে আপনার একান্ত ব্যবহারের জন্য কালি, তুলি আর উৎকৃষ্ট মানের সাদা প্যাপিরাস কাগজ পাবেন। আর আপনার লেখা কোনো পত্র পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পাঠাতে চাইলে আমি তার ব্যবস্থা করতে পারবো।

ভাবলেশহীন মুখে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আপনি সত্যি একজন হৃদয়বান লোক তোরান। তবে মনে মনে হেসে ভাবলাম, তা পাঠাবেন তবে তার আগে একটা অনুলিপি করে রাখবেন। আমি বুঝেছি যে তার বন্ধুত্ব আর দয়াশীলতারও একটা পরিসীমা আছে।

তারপর সে বলে চললো, ভঁড়ারে পঞ্চাশটি উৎকৃষ্টমানের মদের পিপা রাখা আছে। এগুলো খালি হলেই সাথে সাথে আবার ভরে দেওয়া হবে। রোজ সকালে বন্দর থেকে টাটকা মাছ-মাংস আসবে। আপনার দুজন পাঁচকই ভালো, আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমি নিজে ওদেরকে পছন্দ করেছি।

আস্তাবলে গিয়ে পৌঁছতেই প্রধান সহিস আমার সামনে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে প্রণত হল। তার পিঠে সদ্য চাবুকের দাগ দেখতে পেলাম।

বন্ধুত্বপূর্ণ কন্ঠে আমি তাকে বললাম, উঠে দাঁড়াও! এককালে আমিও ক্রীতদাস ছিলাম, তাই চাবুকের আঘাতের কথা আমার ভালো মনে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী? সে কোনমতে উত্তর দিল, ওয়াগা। লোকটি বেশ হাসিখুশি ধরনের, স্পষ্টতই ক্রিটবাসি নয়।

আমি তার নামটি উচ্চারণ করে বললাম, ঠিক আছে ওয়াগা। এবার তোমার ঘোড়াগুলো দেখাও। সে আমার আগে আগে আস্তাবলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলতে চলতে খালিপেটের গলা থেকে অর্থহীন তবে উৎসাহব্যঞ্জক শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলো।

আস্তাবলের পেছনে ছোট্ট চারণভূমিতে আটটি সুন্দর ঘোড়া দেখা গেল। ওয়াগা শিস দিয়ে ওদের ডাকতেই ঘোড়াগুলো সাথে সাথে তার কাছে ছুটে এলো। সে প্রত্যেকটি ঘোড়াকে তার কোমরে বেঁধে রাখা থলে থেকে এক টুকরা করে যবের পিঠা খাওয়াল। ঘোড়াগুলি যদি তাকে বিশ্বাস করে তাহলে আমিও এভাবে এগুলোকে খাওয়াব। ঘোড়া সাধারণত খুব ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারে।

খুব শিঘ্রই একদিন আমাকে ঘোড়ায় চড়ে দক্ষিণ উপকূলে ক্রিমাদ যেতে হবে। পথ দেখাবার জন্য আমার একজন পথপ্রদর্শক দরকার। তুমি কি রাস্তাটা চেনো? ওয়াগা সায় দিয়ে মাথা ঝুঁকালো। আমি তাকে বললাম, তাহলে তৈরি থেকো। আমি তোমাকে হঠাৎ যাবার কথা বলতে পারি আর খুব জোরে ছুটতে হবে। আমার কথা শুনে সে দাঁত করে করে হাসলো। মনে হল আমাদের দুজনের মধ্যে বনিবনা হয়ে গেছে।

.

পরদিন ভোরে সূর্য উঠার আগে ঘুম থেকে উঠে দ্রুত প্রাতরাশ সেরে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে নৌ-প্রশাসনের সদর দফতরে গেলাম। সেখানে নৌবাহিনীর উপ-প্রধান হেরাকল আর তার সহকারীদের সাথে সারাদিন আলোচনা আর তর্কবিতর্ক করে কাটালাম। তবে তেমন ফল হল না। ওরা আমাকে আটটি জরাজীর্ণ দুই স্তরের দাঁড়বিশিষ্ট জাহাজ দেবার প্রস্তাব করলো। এগুলো অনেক বছর বাণিজ্যপোত হিসেবে ব্যবহারের পর এখন প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ওরা চাচ্ছে এগুলো দিয়ে আমি হাইকসোদের মোকাবেলা করি। এতোদিনে আমি জেনেছি যে, মিনোয়ানরা গোমড়ামুখো এবং কঠিন প্রকৃতির লোক। বিদেশিদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখতে পেয়েছি রাষ্ট্রদূত তোরানকে, যে খুবই আমায়িক এবং পরোপকারী। তাকে অনায়াসে একজন জন্মগত মিসরী বলা যায়।

সন্ধ্যায় অত্যন্ত হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। পাঁচক যে ভেড়ার কাবাব রান্না করেছিল তা ছুঁয়েও দেখলাম না। তবে তোরান আমার ভাঁড়ারে যে সুস্বাদু মদ রেখেছিল তা পান করে শক্তি সঞ্চয় করলাম। তারপরদিন ভোরে আবার নৌ সদর দফতরে গেলাম।

আমার সমস্ত কলাকৌশল ব্যবহার করে আর তোরানের সহায়তায় অনেক দরকষাকষির পর শেষ পর্যন্ত দশম দিনে তিন ডেক বিশিষ্ট প্রায় নতুন ছয়টি রণতরীর ব্যবস্থা করলাম। এগুলো পানিতে ভাসাবার জন্য একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নৌবাহিনীর উপ-প্রধান কয়েকজন মিনোয়ান অভিজ্ঞ নৌ-কর্মকর্তা দিলেন। এছাড়া জাহাজ চালাতে উত্তর ইতালিয়ার আদিম গোত্রের শক্তিশালী ভাড়াটে নাবিক নেওয়া হল। এরা নিজেদেরকে ল্যাটিন কিংবা এটুস্কান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তোরান আমাকে আস্বস্ত করলো, এরা অত্যন্ত চমৎকার নাবিক এবং ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। এক একটি তিনডেকওয়ালা রণতরীতে একশো বিশজন করে এই আদিম গোত্রের লোকদের নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম যে, এবার হাইকসো নৌবহরের যে কোনো জাহাজের মোকাবেলা করতে পারবো।

নতুন জাহাজের ক্যাপ্টেনদের দ্বীপ ঘুরে অন্যপাশে ক্রিমাদ বন্দরে যেতে নির্দেশ দিলাম। সেখানে জারাস আর হুই আমার সুমেরিয় দুই ডেকওয়ালা রণতরীগুলো নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এখন থেকে এটিই আমার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূলঘাটি হবে। এখান থেকে মাত্র ছয়শো লিগ দক্ষিণে শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানতে পারবো। অনুকূল বাতাসে সমুদ্র পথে মাত্র পাঁচ দিনের পথ।

.

আমার সংগ্রহ করা নতুন তিন ডেকওয়ালা জাহাজগুলো সকালেই কুমুসস  থেকে যাত্রা শুরু করলো। আর এদিকে একইদিন ভোর হবার আগেই অন্ধকার থাকতেই আমি ওয়াগাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে জাহাজগুলো পৌঁছাবার আগেই ক্রিমাদ বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমার নির্দেশ মোতাবেক ওয়াগা দুটি ঘোড়ায় জিন পরিয়েছিল আর আরও চারটি ঘোড়া সাথে নিয়েছিল। পথে কোনো একটি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেই সাথে সাথে ঘোড়াটি বদলে নিতে পারবো।

তোরান আমাকে সতর্ক করে বলেছিল পথে পাহাড়ি জঙ্গলে দস্যু আর পলাতক আসামিরা লুকিয়ে থাকে। একথা ভেবে কোমরের খাপে একটা ছোট তরবারি আর ডান কাঁধে আমার লম্বা বাঁকা ধনুকটাও ঝুলিয়ে নিলাম।

ক্রীতদাস হিসেবে নিষেধাজ্ঞার কারণে ওয়াগা কোনো ধারালো অস্ত্র বহন করতে পারে না। তবে সে একটা গুলতি আর একটি থলে ভর্তি নদী থেকে আহরণ করা গোলাকার পাথর নিল। এই অস্ত্রটি দিয়ে তাকে আমি আকাশে অনেক উপরে উড়তে থাকা তিতির পাখি শিকার করতে দেখেছি। আরেকবার দেখেছি রান্নাঘরের পেছনের বাগানে ঘুরতে থাকা একটি হরিণকে এই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল।

ভোর হবার আগেই আমরা রওয়ানা দিলাম। একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার হিসেবে ওয়াগা আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল। সে রাস্তার প্রতেক্যটি বাঁক আর মোড় চিনতো। আমার ডান দিক দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সে পশুর মতো ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে আর হাতের ইশারায় আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।

প্রথমে ইডা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে তির্যকভাবে পার হলাম তারপর পূর্বদিকে সবচেয়ে উঁচু চূড়ার গিরিপথের দিকে চললাম। গ্রীষ্মের শেষেও এই জায়গাটি বরফাবৃত ছিল। এই উচ্চতার বড় বড় গাছগুলো কেটে কামারশালার হাপর আর কারখানার চুল্লির জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেখে আমার মন খারাপ হল। কাঠুরেরা একটি গাছও রাখেনি।

অবশেষে অনেক উঁচুতে আমরা আদিম অবস্থায় থাকা জঙ্গলে পৌঁছে বিশাল গাছগুলোর মধ্য দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলতে লাগলাম। গাছের উপরের শাখাগুলোর একটি আরেকটির সাথে জোড়া লেগে নিচে ছায়া দিচ্ছে। ঘন শৈবালের উপর দিয়ে চলার কারণে ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছিল। শুধু পাখির ডাক আর ছোট ছোট প্রাণীর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পাহাড়ের বরফ গলে যে ঝরণা বয়ে চলেছে, ঘোড়াগুলোকে সেই ঝরণার ঠাণ্ডা আর পরিষ্কার পানি পান করালাম।

জঙ্গলের মাঝে একটি খোলা জায়গায় পৌঁছে সূর্য দেবতা হেলিওসকে লক্ষ্য করার জন্য একটু থামলাম। পূর্ব দিগন্তের উপরে সূর্য দেবতা মাথা তুলেছেন।

এটি একটি পবিত্র স্থান। এখানেই সকল দেবতার পিতা ক্রোনাস আর তার পুত্র কন্যার জন্ম হয়। আমি তাদের উপস্থিতি অনুভব করলাম আর জঙ্গলের সুমিষ্ট বাতাসে আর দোঁ-আশ মাটিতে তাদের সুঘ্রাণ পেলাম। অমরাত্মাদের এতো কাছে আসতে পেরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। হয়তো আমার মাঝে এই অনুভূতি জেগে উঠার পেছনে কারণ হচ্ছে আমার শিরার মধ্যে একই সূত্রে জাত রক্ত প্রবাহিত হওয়া যা, ইনানা আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তারপর আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, ইনানা আমার একটি কল্পনা প্রসূত বিষয় মাত্র। আর আমি আমার নিজের অলস কুসংস্কারের একটি শিকার ছিলাম। তবে তার চেহারা বার বার আমার মনে ফিরে আসায় আমি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলাম।

ইনানার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতেই আমি তার হাসির প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম সে কাছেই রয়েছে আর এতে আমার অটল সিদ্ধান্ত ভেঙে পড়লো।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নিচে ক্রিটের দক্ষিণ উপকূলে পাহাড়ের ধারে ক্রিমাদ বন্দরের অবস্থান। দুপুর হতে আরও দুই ঘন্টা বাকি। আমরা বেশ ভালোই এগোচ্ছি।

মনে হল বিশ লিগ দূরত্ব থেকেই আমি বন্দরে নোঙর করা আমার সুমেরিয় জাহাজগুলোর মাস্তুলের ডগা দেখতে পাচ্ছি। ঘোড়ার পিঠে বসে পেছন ফিরে ফেলে আসা পথের দিকে তাকাতেই সেই আগ্নেয়গিরিটি দেখতে পেলাম যার মাঝে ক্রোনাস দেবতাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। উত্তর দিগন্তে এটা সোজা পানির উপরে উঠে গেছে। এর যমজ চূড়া থেকে বেয়ে পড়া ক্রিম রঙের ধূঁয়ার স্রোত-প্রবাহের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মৃদু হাসলাম। তার মানে দেবতার মেজাজ এখন শান্ত।

এই ফাঁকে ওয়াগা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে কাছের গাছটির পেছনে বসে পেচ্ছাব করতে লাগলো। এই আচরণ থেকে বুঝা যাচ্ছে ক্রীতদাস হওয়ার আগে সে একটি দ্র পরিবারের সন্তান ছিল। কেবলমাত্র নিম্ন শ্রেণীর এবং সাধারণ মানুষেরা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে।

তারপর ওয়াগা লাফ দিয়ে উঠে পোশক হাঁটুর নিচে নামিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে যেখানে সে বসে প্রস্রাব করছিল তার কাছেই মাটির দিকে দেখাল। আর সেই সাথে মুখ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শব্দ করতে লাগলো। কী হয়েছে জানার জন্য আমি ঘোড়া থেকে নেমে তার কাছে গেলাম।

গাছটির গোড়ায় নরম মাটি এমনভাবে এলোমেলো হয়ে রয়েছে যে, কিছুক্ষণ লাগলো বুঝতে যে, বিশাল কোনো পশুর দ্বিখণ্ডিত খুরের ছাপ সেখানে রয়েছে। খুরের ছাপটি নীল নদের তীরে আমার খামারে যে দুধেল গাই রয়েছে সেগুলোর তুলনায় অনেক গুণ বড়।

হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে খুরের ছাপটি মাপার চেষ্টা করলাম। আমার এক হাতে কুলোলো না। তারপর দুই হাত মেলে একটা খুরের ছাপ পুরোপুরি ঢাকতে পারলাম।

প্রচণ্ড বিস্ময়ে ওয়াগার দিকে তাকিয়ে বললাম, মালিন শেঠের দিব্যি। কোন দানব এই পায়ের ছাপ ফেলেছে? এর উত্তরে সে কী বললো তা আমি বুঝতে পারলাম না। বারবার মুখ দিয়ে একই শব্দ করতে লাগলো আর ভয়ে কাঁপতে লাগলো। তারপর একছুটে ঘোড়র কাছে গিয়ে কোনোমতে ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়ে আমাকেও ঘোড়ায় চড়তে ইশারা করলো। তারপর চারপাশের জঙ্গলের দিকে চকিত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। তার দেখাদেখি আমিও ঘোড়ার পিঠে চড়ে সামনের দিকে ঘোড়া এগিয়ে নিলাম।

এই বিশাল খুরের ছাপের কোনো একটি যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করছিলাম। এই আকারটি দেখে বাস্তবতার চেয়ে কাল্পনিক মনে হচ্ছিল, তারপর ব্যবিলনে রাজা নিমরদের প্রাসাদের দেয়ালে ঝুলানো বিশাল বিরল উরুস ষাড়ের মাথার খুলি আর শিংয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তবে ইউফ্রেটিস নদীর উত্তর-পুবে অনেক দূরে জাগরোস পর্বতের যে এলাকা থেকে সে এগুলো সংগ্রহ করেছিল, তা এই ক্ষুদ্র ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে অবস্থিত।

এই চমৎকার জঙ্গলে বিরল বন্য উরুস ষাঁড়ের বিচরণ বেশ অস্বাভাবিক, তবে সর্বাধিরাজ মিনোজ একে আশ্রয় দিয়ে থাকলে ভিন্ন কথা। সম্ভবত তিনি এই দানবীয় প্রাণীটিকে মিনোয়ান জাতির কুলমর্যাদাচিহ্ন এবং ক্রোনাস দেবতার পবিত্র প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। রূপার যে মুখোশটি মিনোজ পরে থাকেন তা থেকে এই সম্ভাবনার বিশ্বাস পাওয়া যায়। তবে এই বিষয়ে তোরানের সাথে আলোচনা করাটা ঠিক হবে না। সে ইতোমধ্যেই আমাকে মিনোয়ান শাসকের ব্যাপারে বেশি গভীরে নাক গলাতে নিষেধ করেছে।

আমি ওয়াগার দিকে তাকালাম। সে তখনও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। সে প্রচণ্ড ঘামছিল আর তার নিচের ঠোঁট থরথর করে কাঁপছিল। ঘোড়ার পিঠে বসে ছটফট করতে করতে পথের দুইদিকে ঝোঁপগুলোর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছিল। আমি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এই পর্বতে এখনও বন্য উরুস ষাঁড়ের বিচরণ থাকলেও সে খুবই বাড়াবাড়ি করছে।

যত বড়ই হোক না কেন উরুস হচ্ছে গরু আর গরু সাধারণত শান্ত প্রাণী হয়। তাকে কিছু বলতে যাবো এমন সময় সে চিৎকার করে উঠলো। তার গলা থেকে হঠাৎ এমন অদ্ভুত চিৎকারটি শুনে আমি চমকে উঠলাম।

তার ঘোড়াটি হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে আমার ঘোড়াটির গায়ে এসে এমনভাবে হেলে পড়লো যে সাথে সাথে সাবধান না হলে আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেতাম। কোনোমতে সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলাম। কিন্তু সে তখনও আতঙ্কিত হয়ে বিড়বিড় কিছু বলছিল আর যে পথের দিকে আমরা যাচ্ছিলাম তার উপরের কেঁপের দিকে দেখাল।

আমি তার দিকে চিৎকার করে বললাম, শান্ত হও বোকা! সাথে সাথে সামনের ঝোঁপের কাছে বিশাল কালো আকৃতিটির দিকে নজর পড়তেই আমি থেমে গেলাম। প্রথমে মনে করেছিলাম পর্বতের পাথুরে একটা অংশ। তারপর আকৃতিটি নড়াচড়া করতেই আকৃতিটি পরিষ্কার হয়ে চোখে ধরা পড়লো।

নিশ্চিতভাবে এটি একটি জীবন্ত প্রাণী।

ঘোড়ার পিঠে বসে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বিশাল প্রাণীটির চোখের দিকে তাকালাম। চোখগুলো বিরাট। আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ওয়াগার চিৎকার শুনে প্রাণীটি বিশাল ঘন্টার আকৃতির কানগুলো সামনের দিকে খাড়া করে রেখেছে। পিঠে উটের মতো কুঁজ। দুই শিংয়ের মাঝে ফাঁক আমার দুই হাত মেলে ধরলে তার সমান হবে। শিংগুলো হাতির দাঁতের মতো মোটা আর সুঁচোলো। থিবসে ফারাওয়ের প্রাসাদে আমি যে হাতির দাঁত দেখেছি সেগুলোর মত।

এটি কোনো জাবরকাটা শান্ত গরু নয়। অবাক বিস্ময়ে ওয়াগার মতো আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম।

প্রাণীটি মাথা নিচু করে ভয়ঙ্কর শিংদুটো আমাদের দিকে তাক করে ধরলো। সেই সাথে সামনের পা দিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করলো। তারপর একটি বিশাল তুষারধ্বসের মতো ঝোঁপঝাড় ভেঙে পর্বতের ঢাল বেয়ে নিচে আমাদের দিকে দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ রেখে এক লাফ দিল।

সঙ্কীর্ণ পথে আমি আটকে পড়েছিলাম। পেছনে ফেরার বা ঘোরার কোনো উপায় নেই। তরবারি কিংবা ধনুক বের করারও সময় পেলাম না।

ওয়াগার ঘোড়াটি আতঙ্কিত হয়ে পালাবার পথ খুঁজতে গিয়ে আরোহীসহ সরাসরি বঁড়টির হামলার মুখোমুখি পড়ে গেল। তবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও লোকটি অসম্ভব সাহসের কাজ করলো। তার পশমি আলখাল্লাটি গোল করে পাকানো অবস্থায় জিনের সামনে বাঁধা ছিল। সে এটা টেনে নিয়ে ছিঁড়ে একটা পতাকার মতো ছড়িয়ে দিল। তারপর একটা চাবুকের মতো বঁড়টির মাথার উপর ছুঁড়ে মারলো। আমি বুঝতে পারিনি তার উদ্দেশ্যে, তবে আলখাল্লাটি ষাঁড়ের শিংয়ের নিচে লেগে এর মাথার চতুর্দিকে পেঁচিয়ে বঁড়টির চোখ পুরোপুরি ঢেকে ফেললো।

ঘোড়া আর আরোহীকে চোখে না দেখলেও বঁড়টি বিশাল শিং দিয়ে ওদের দিকে তো মারলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটি শিংয়ের ডগা ওয়াগার ডান বগলের নিচে বুকে ঢুকে গেল। তার বুকের পাঁজর ভেদ করে শিংয়ের সুচালো ডগাটি উল্টোদিকে পিঠ দিয়ে বের হল।

ষাঁড়টি মাথা ঝাঁকাতেই ওয়াগার দেহ অনেক দূরে শূন্যে ছিটকে পড়লো। তারপর অন্ধ বঁড়টি আবার শিং দিয়ে গুতো মারলো আর এবার ঘোড়াটিকে আঘাত করতেই ঘোড়াটি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।

এবার বঁড়টি সম্পূর্ণ উন্মাদের মতো হয়ে গেল। শিংয়ে জড়ানো মাথা ঢাকা কাপড়টি সরাবার জন্য এদিক-ওদিক ঝোঁপঝাড়, গাছের কাণ্ডে গুতো মারতে লাগলো।

ওয়াগা আমাকে যে মূল্যবান সময়টুকু দিয়েছিল সেই সুযোগ আমি এক লাফে জিন থেকে মাটিতে নামলাম। ধনুকটি ইতোমধ্যেই হাতে নিয়ে এক টানে গুণ টেনে টান টান করে নিয়েছিলাম।

ভূণির তখনও ঘোড়ার জিনে আটকানো ছিল, তবে এ-ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমি সবসময় দুটো আলগা তীর কোমরবন্ধে গুঁজে রাখতাম। একটা তীর ধনুকে জুড়ে ধনুকের গুণ টেনে ধরলাম।

ষাঁড়টি সম্ভবত আমার নড়াচড়ার শব্দ কিংবা গন্ধে আমার উপস্থিতি টের পেয়েছিল। এবার সে তার বিশাল দেহটি ঘুরিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। তখনও এদিক সেদিক মাথা দোলাচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করলাম, তারপর নড়াচড়ার ফলে তার ডান কাঁধ আর বুকের সামনের অংশ আমার দিকে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো। এবার আমি তীর ছুঁড়লাম। এতো কাছের দূরত্বে তীরটা প্রচণ্ড গতিতে গিয়ে আঘাত করলো। তীরটি সম্পূর্ণ ষাঁড়ের বুকের ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু বাইরের দিকে সামান্য একটু ক্ষত রয়ে গেল যেখান থেকে উজ্জ্বল রক্ত ছলকে বের হল। আমার দ্বিতীয় তীরটি একই সারিতে এক আঙুল উপরে আঘাত করলো। ষাড়টি থমকে পিছিয়ে গেল তারপর এক চক্কর ঘুরে গিয়ে ঝোঁপের মাঝে অন্ধের মতো পড়ে গেল। শুনতে পেলাম পর্বতের খাড়া ঢালের গা ঘষটে নামছে। একমুহূর্ত পর নিচের দিকে পড়লো। বিশাল দেহটি ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল। তারপর ঝোঁপের মধ্যে পেছনের পা ছুঁড়ে ছটফট করতে লাগলো। অবশেষে বিকট একটি আর্তচিৎকার করে ছটফট করতে করতে মরে গেল। তার চিৎকারের শব্দ পর্বতের চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হল।

এক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপতে থাকা হাত স্থির করলাম। প্রথমে ওয়াগা যেখানে পড়েছিল সেখানে গেলাম। প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝা গেল তার মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম। ভোলা চোখদুটো স্থির হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, মুখ হা করা। আর কিছুই করার নেই, সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে।

তার ঘোড়াটাও মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। পশুটির গলায় আঘাত লেগেছে। এছাড়া সামনের পাও মারাত্মকভাবে জখম হয়ে ভেঙে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে তলোয়ার বের করলাম, তারপর পশুটির দুই কানের মাঝে মাথার খুলির উপর এক কোপ মারতেই পশুটি সাথে সাথে মারা গেল।

অন্য ঘোড়াগুলোর লাগামের দড়ি তখনও মৃত ঘোড়াটির জিনের সাথে বাঁধা ছিল। দড়ি খুলে ঘোড়াগুলোকে কাছেই একটা গাছের সাথে বাঁধলাম। তারপর আমার ঘোড়াটি আর এর সাথে বাঁধা অন্য ঘোড়াগুলোর খোঁজে চললাম। এগুলো বেশি দূর যায়নি। জঙ্গলের মধ্যেই ভোলা একটি জায়গায় ঘাস খাচ্ছিল। এদেরকে নিয়ে যেখানে অন্য ঘোড়াগুলো ছিল সেখানে এসে একই গাছের সাথে বাঁধলাম।

সবকিছু ঠিক করার পর ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যেখানে উরুস ষাঁড়টি পড়েছিল সেখানে গেলাম। মৃত পশুটির চতুর্দিক এক চক্কর ঘুরে দেখলাম, আবার অবাক হলাম এর বিশাল আকৃতি দেখে। এবার বুঝতে পারলাম ওয়াগা কেন এতো ভয় পেয়েছিল। আমার দেখা সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই আমাদেরকে আক্রমণ করেছিল।

বুঝলাম কেন রাজা নিমরদ এই পশু একশোটি শিকার করার জন্য গর্ব করতো আর কেন মিনোয়ানরা এটাকে তাদের জাতির কুলমর্যাদাচিহ্ন মনে করতো।

বিশাল প্রাণীটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় নিয়ে এর দিকে তাকালাম, আর একটু হলেই আমি মারা যেতাম। ওয়াগার রক্তমাখা আলখাল্লাটা এর শিং থেকে খুলে নিলাম। ভাঁজ করে বগলের নিচে রাখলাম। তারপর দাঁড়িয়ে হাত মুঠো করে ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষকে অভিবাদন করলাম। তারপর ঘুরে চললাম। আমার তীর মারার উপযুক্ত প্রতিপক্ষ বটে।

এরপর উপরে যেখানে সাহসী ওয়াগার মৃতদেহ পড়েছিল সেদিকে চললাম। মুখ থেকে রক্ত মুছে তারই আলখাল্লা দিয়ে তার শরীর পেচিয়ে দিলাম। তারপর দেহটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে জঙ্গলের একটা উঁচু গাছে উঠে দুই ডালের মাঝে গুঁজে রাখলাম। পরে সুযোগমতো তার সমাধির ব্যবস্থা করবো।

গাছে তার পাশে বসে তার নিজের দেবতার কাছে তাকে অর্পণ করে একবার সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা করলাম। তারপর গাছ থেকে নেমে এলাম।

.

মাটিতে পা ছুঁতেই মাটি এমন ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো যে আমি প্রায় টলে পড়ে যাচ্ছিলাম। নিজেকে খাড়া রাখতে গাছের কাণ্ড জাপটে ধরলাম। গাছটিও কাঁপছিল, এর শাখাপ্রশাখা দুলছিল। উপরের দিকে তাকাতেই উপর থেকে গাছের পাতা আর ছোট ছোট ডাল আমার উপর ঝরে পড়তে লাগলো। ভাবলাম ওয়াগার দেহটি হয়তো সরে গেছে তাই গাছের পাতা পড়ছে। কিন্তু আমি তো খুব ভালোভাবে লাশটি খুঁজে রেখেছিলাম।

আমার চারপাশে পুরো জঙ্গল ভয়ানকভাবে কাঁপছিল। এমনকি পর্বতও যেন নেচে উঠছে। প্রচণ্ড গর্জন শুনে ঘুরে ইডা পর্বতের চূড়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম চূড়া থেকে বিশাল একটি গ্রানাইট খণ্ড ভেঙে আলগা হয়ে নিচে উপত্যকার দিকে গড়িয়ে পড়লো।

ঘোড়াগুলো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। পেছনের পা ছুঁড়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দড়ির বাঁধন থেকে ছুটার চেষ্টা করতে লাগলো। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠা মাটির উপর দিয়ে টলমল পায়ে হেঁটে ওদের কাছে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। পাখি আর অন্যান্য পশুর মতো ঘোড়ার সাথেও আমি বিশেষ উপায়ে কথা বলে শান্ত করতে পারি। ওদেরকে শান্ত করে মাটিতে শুইয়ে দিলাম যাতে ওরা আহত না হয়।

তারপর ফিরে কুমুসস বন্দরের উপর দিয়ে উত্তর দিকে আর খোলা সাগর পেরিয়ে ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়ার দিকে তাকালাম।

দেবতা ক্রুদ্ধ হয়েছেন। জিউস যে শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছেন তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই করছেন। অনেক দূর থেকেও তার কান ফাটা গর্জন শোনা যাচ্ছে। পর্বতের অন্ধকার পাতালঘরের ছিদ্র দিয়ে ধূঁয়া, বাষ্প আর আগুনের বিরাট ঢেউ উঠে উত্তর দিগন্ত ঢেকে ফেলেছে। দেখলাম নগরীর দালানের সমান আকৃতির বড় বড় পাথর খণ্ড আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারছে।

আকষ্মিক এমন প্রলয়ঙ্কর ক্ষিপ্ততার সামনে আমার নিজেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হল। এমনকি সূর্য দেবতা হেলিওসেরও মুখ ঢাকা পড়েছে। পুরো পৃথিবীর উপর অন্ধকার হতাশা নেমে এসেছে। আতঙ্কে পৃথিবীও কাঁপছে আর গন্ধকের কটু গন্ধে বাতাস ভরে রয়েছে।

আমি ঘোড়াগুলোর কাছে বসে হাতের ভাঁজে মুখ ঢাকলাম। আমিও ভয় পেয়েছি। দেবতার রোষ থেকে রক্ষা পাবার কোন আশ্রয়স্থল এই পৃথিবীর কোথাও নেই।

দেবতার আত্মস্বরূপ সেই দানবীয় শিংওয়ালা প্রাণীটিকে আমি হত্যা করেছি। নিশ্চিত এরকম ধর্মদ্রোহীতাপূর্ণ অপরাধের কারণে ক্রোনাসের আক্রোশ আমার উপর এসে পড়েছে।

এরপর প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দেবতা তার তাণ্ডব চালিয়ে গেলেন, তারপর সূর্য মধ্যগগনে এসে পৌঁছতেই হঠাৎ এটা থেমে গেল যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল। গন্ধকের মেঘ উবে গেল, পর্বত স্থির হল আর পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এলো।

.

মাটি থেকে ঘোড়াগুলোকে উঠিয়ে আমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলাম, তারপর লাগামের দড়িতে বাঁধা অন্য ঘোড়াগুলো নিয়ে পর্বতের পথ বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।

তিনদিন আগে আমি জারাসকে আমার আসার কথা জানিয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম। ক্রিমাদ বন্দরে পৌঁছার অনেক আগে জারাস আর হুইকে দেখলাম পাহাড়ের পথ বেয়ে আমার দিকে আসছে। দূর থেকে দেখেই আমাকে চিনতে পেরে ওরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো, তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো। কাছে পৌঁছতেই লাফ দিয়ে মাটিতে নামলো। তারপর প্রায় টেনে আমাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে একজনের পর একজন বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি হোরাস আর হাথরের প্রতি আমার ভালোবাসার দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, যখন সে আমাকে তার কঠিন আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করলো তখন তার চোখে এক ফোঁটা পানি দেখা গিয়েছিল।

তারপর সে বললো, আমরা ভেবেছিলাম অবশেষে হয়তো আমরা তোমাকে হারালাম। তবে দেবতা ক্রোনাসও সেই কাজটি করতে পারেনি। যদিও আমার চোখ শুকনো ছিল, তবে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম যে, এমন ভাবপ্রবণ দৃশ্যটি দেখার মতো আর কেউ সেখানে ছিল না।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা হিসেবে আমি বললাম, মিনোয়ান যুদ্ধজাহাজগুলো কি ক্রিমাদ বন্দরে পৌঁছেছে?

জারাস মুখ থেকে সেঁতো হাসি মুছার চেষ্টা করে সাগরের দিকে দেখিয়ে বললো, না আসেনি। দেখতেই পাচ্ছেন ভূমিকম্পে সাগরের কি উথাল-পাথাল অবস্থা হয়েছে। নিশ্চয়ই ওরা পথ হারিয়েছে। মনে হয় ফিরে আসতে কয়েকদিন দেরি হবে।

তোমার জাহাজগুলো কীভাবে ঝড় সামলেছে? পাহাড়ের পথ বেয়ে নামতে নামতে আমরা কেবল নৌসংক্রান্ত আলোচনা করে চললাম। হুই যে হাতের ইশারা করে জারাসকে কিছু বলতে চাচ্ছে, তা দেখেও না দেখার ভাণ করলাম। যাইহোক ক্রিমাদ বন্দরের কাছাকাছি আসতেই সে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে বসলো, আমরা ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমাদের জন্য কোন বার্তা নিয়ে এসেছেন।

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, বার্তা? কার কাছ থেকে তোমরা বার্তা পাওয়ার আশা করেছিলে?

হয়তো প্রাসাদ থেকে?

আমি না জানার ভাণ করে বললাম, তোমরা রাজাধিরাজ মিনোজের কাছ থেকে বার্তা আশা করেছিলে? তাদের করুণ চাউনি উপেক্ষা করে আবার বললাম, না, কোনো বার্তা নেই। তবে তোমরা হয়তো শুনে থাকবে যে রাজকুমারী তেহুতি আর বেকাথা, দুজনেরই মিনোয়ান রাজার সাথে বিয়ে হয়েছে আর ওরা এখন রাজকীয় হেরেমের নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন। তোমরা দুজনেই প্রশংসনীয় দায়িত্ব পালন করেছ। প্রথম সুযোগেই আমি ফারাওকে একথা জানাবো। আমি জানি তিনি কৃতজ্ঞ হবেন। একটু থেমে আবার বলে চললাম, তোমরা হয়তো ভাবছো কেন আমি একা এসেছি। পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল আর একটা বন্যপশুর আক্রমণে আমার পরিচারকের মৃত্যু হয়েছে। তোমরা পাহাড়ে লোক পাঠিয়ে তার মরদেহটা খুঁজে যথাযথ সমাধির ব্যবস্থা করো।

আমি কথা বলেই চললাম, ওদেরকে রাজকুমারীদের নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না। আমি বলতে চাই নি যে মেয়েদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই আর ওরা হেরেমে কেমন আছে তাও আমি জানিনা।

বন্দরে পৌঁছে আমি অবাক হলাম দেখে দ্বীপের এপাশেও ক্রোনাস পর্বতের আগ্নেয়গিরির তাণ্ডবের প্রভাবে সাগরে বিক্ষুব্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় ঢেউ বন্দরের দেয়ালে আছড়ে পড়ছিল। তবে জারাস আর হুই তাদের জাহাজগুলো রক্ষার জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা নিয়েছিল। ওরা পাথরের জেটির সাথে দ্বিগুণ শক্তিতে জাহাজ বেঁধে রেখেছিল আর একটা জাহাজের সাথে আরেকটা জাহাজের সংঘর্ষ এড়াতে মাঝখানে পাকানো দড়িদড়ার গুচ্ছ ব্যবহার করেছিল।

কেবল একজন নাবিক জাহাজে রেখে বাকি সবাই তীরে বন্দর পরিচালকের অতিথি হিসেবে শূন্য গুদামে আশ্রয় নিয়েছিল। এর নাম পোইম্যান, অন্যান্য মিনোয়ানদের মতো সেও একজন বিষাদগ্রস্ত নিরাশাবাদি লোক।

রাতে সে আমাকে আমার কর্মকর্তাদেরসহ নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালো। তার এমন আতিথেয়তায় আমি অবাক হলাম। পরে জেনেছি সে মিনোয়ান গুপ্ত পুলিশের একজন কর্নেল। আর তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সকল মিসরীয়দের সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠাচ্ছে।

খাবারদাবার ছিল অতিরিক্ত লবণাক্ত আর পোড়া। মদও ছিল বিস্বাদ। সমস্ত কথাবার্তা কেবল ভূমিকম্প আর সাগরে যে ঝড় সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আমি আলোচনাটা অন্য দিকে ঘোরাতে চাচ্ছিলাম। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণ কী বলতে পারেন?

কারও কোনো সন্দেহ নেই যে দেবতার বিরুদ্ধে কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কারণে মানুষের উপর শাস্তিস্বরূপ এগুলো চাপানো হয়েছে।

আমি আবার বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, এমন কী গুরুতর সে অপরাধ যার জন্য এমন শাস্তির প্রয়োজন পড়লো? আর কী উপায়ে এই অপরাধের প্রতিকার হবে?

সবাই এবার কামরায় উপস্থিত রাজাধিরাজ মিনোজের একমাত্র জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি বন্দর-পরিচালকের দিকে তাকাল। সে একজন জ্ঞানী লোকের মতো ভাব আর কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠে বললো, দেবতার দৈব ইচ্ছার বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না। কেবল রাজাধিরাজ মিনোজ, প্রশংসিত হোক তার নাম চিরদিন- এ বিষয়ে এই জ্ঞান রাখেন। যাইহোক আমরা এটা জেনে খুশি হতে পারি যে, মহামান্য মিনোজ এই দৈব রোষের কারণটি খুঁজে বের করেছেন এবং তিনি এর সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন। তারপর সে ঘাড় বাঁকা করে ঘরের দেয়ালের বাইরে ঝড়ের শব্দ শোনার চেষ্টা বললো, ঐ যে শুনুন! ঝড়ের প্রকোপ কমে আসছে। দেবতার রোষ ইতোমধ্যেই প্রশমিত হয়ে আসছে। আগামীকাল এই সময়ের মধ্যেই সমুদ্র শান্ত হয়ে আসবে আর পর্বতও স্থির হয়ে যাবে।

আমি তবু নাছোড়বান্দার মতো বিষয়টির পেছনে লেগে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজাধিরাজ মিনোজ কী উপায়ে এতো সহজে দেবতাকে শান্ত করেন?

সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে একজন মুরব্বীর ভাব দেখিয়ে বললো, একমাত্র যে উপায়ে কোন দেবতাকে খুশি করা যায়। অর্থাৎ একটি বলি দিয়ে।

তোরান সাবধান বাণী উচ্চারণ না করলে হয়তো রাজাধিরাজ মিনোজের স্বভাবের বিষয়ে জানতে অনধিকার অনুপ্রবেশ করতাম। তবে আমি জিহ্বা সামলাম। বন্দর-পরিচালক অন্যদিকে ঘুরে তার সহকারীদের সাথে ঝড়ে তাদের কী কী ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো।

আমি বেশ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম এই কথাটি ভেবে যে, উরুস ষাড়কে আমি হত্যা করার পর ক্রোনাসের দৈব ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, দুটি ঘটনাই খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে আর এদুটোকে কেবল হঠাৎ যুগপৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা বলা যায় না।

আমি ভাবলাম শান্ত হওয়ার জন্য ক্রোনাস দেবতা রাজাধিরাজ মিনোজের কাছে কী বলি দাবী করেছিলেন?

.

পরদিন ভোরে ক্রিমাদ বন্দর রক্ষাকারী দেয়ালের গায়ে সাগরের ঢেউয়ের আছড়ে পড়া কমে এলো আর জারাস এবং হুইও হাইকেসোদের বিরুদ্ধে নৌ অভিযানের প্রস্তুতি নেবার কাজে ব্যস্ত হল।

চারদিন পর মিনোয়ান নৌবাহিনীর উপ-প্রধান হেরাকল যে ছয়টি তিনডেকওয়ালা যুদ্ধ জাহাজ আমার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন সেগুলো ক্রিমাদ পৌঁছালো। সাগরের ঢেউ তাদেরকে পুবদিকে অনেক দূরে প্রায় সাইপ্রাস পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। ওদের পানিও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল আর দাড়িরাও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

আমি ক্রিটের নাবিকদেরকে তিনদিনের পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে নিশ্চিত করলাম যেন ওরা ঠিকমতো খাবারদাবার, জলপাই তেল এবং যথেষ্ট পরিমাণে মদও পায়। এতে ওদের মাঝে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হল। বিশ্রাম শেষ হবার পর দুটি নৌবহরের মধ্যে যৌথ অনুশীলন শুরু করলাম।

ভাষাই আমাদের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, তবে আমি প্রতিটি জাহাজে দুইজন করে দোভাষি নিয়োগ দিলাম আর পতাকার ইঙ্গিত মিনোয়ান আর মিসরীয়দের একই অর্থ করা হল।

দুই নৌবহরেই সুশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ নাবিক ছিল আর এক সপ্তাহের মধ্যে ওরা জটিল কৌশলী অভিযান পরিচালনার কাজ শুরু করলো। মিনোয়ানরা শিঘ্রই সৈকতে রথ আর পদাতিক সেনা অবতরণ করা এবং আবার যুদ্ধাভিযানের পর সৈন্য, ঘোড়া এবং রথ কীভাবে উদ্ধার করতে হয় তা শিখলো।

যতই ওরা দক্ষ হতে শুরু করলো সেই সাথে মিসরীয় এবং মিনোয়ানদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাঁপড়া এবং সহযোদ্ধার মনোভাব গড়ে উঠলো। আমি জানি খুব শিঘ্রই এদেরকে হাইকসোদের বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠাবো। তবে আমার মূল চিন্তা হল সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় ওরা হাইকসোদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারবে।

উত্তম গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে প্রথম তীর ছোঁড়ার আগেই কিংবা খাপ থেকে তরকারি বের করার আগেই যুদ্ধ জয় করা যায়।

তারপর হঠাৎ একদিন একটি ছোট্ট এবং প্রায় পরিত্যক্ত একটি ধাউ ক্রিমাদ বন্দরের প্রবেশ মুখে এসে উপস্থিত হল। পালটি ঘেঁড়া আর ময়লা দাগে ভরা। আটজন মাল্লা প্রাণপণ চেষ্টায় পানি সেচে নৌকাটি পানিতে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। নাবিকদের চেহারা হতবিধ্বস্ত। জাহাজে কোনো পতাকা নেই আর এটা পানিতে বেশ নিচু হয়ে ভাসছিল, যেকোন মুহূর্তে ডুবে ডেতে পারে। কোনো জলদস্যু এই জাহাজের দিকে ফিরেও তাকাবে না, সম্ভবত সে কারণেই সাগরে ভেসে এতোদূর আসতে পেরেছে।

পাঁচটি ডিঙিতে সশস্ত্র লোকজন নিয়ে জারাসকে ধাউটিতে চড়ার নির্দেশ দিলাম। সে ধাউটিকে টেনে নিয়ে বন্দরে ঢুকলো। প্রবেশ পথ পার হতেই অচেনা ধাউটির পাল গুটিয়ে মিসরীয় পতাকা উড়াল। জারাস এটাকে জেটির সাথে বাঁধলো।

ধাউয়ের অধিনায়ক প্রভু তায়তার সাথে সাক্ষাত করতে চাওয়ায় তাকে আমাদের চারজন নাবিক চ্যাংদোলা করে তীরে নিয়ে এলো। আমি উপস্থিত হয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে তাকে বিশ ঘা চাবুক মারার নির্দেশ দিলাম, যাতে সে বুঝে এখানে কে হুকুম চালায়। হতভাগা লোকটি হাঁটু গেড়ে বসে জেটির পাথরে কপাল ঠেকিয়ে বাম হাতের আঙুল দিয়ে একটি শনাক্তকরণ সংকেত করলো। এটন আর আমি যখন ক্রীতদাস ছিলাম তখন আমরা এই সংকেতটি ব্যবহার করতাম।

এবার চাবুক মারার নির্দেশটি বাতিল করে তাকে আমার জাহাজের কেবিনে নিয়ে আসতে বললাম। কেবিনে ঢোকার পর প্রহরীদেরকে চলে যেতে বললাম, তারপর আমার পরিচারককে নির্দেশ দিলাম বন্দীটির হাতমুখ ধোয়ার জন্য গরম পানি আর নাবিকদের একটি পোশাক আনতে।

আমার পাঁচক টেবিলে আমাদের জন্য রান্না করা চিংড়ি আর টুনা মাছ ভাজি রাখলো, আর আমি এটুস্কান মদের একটি বোতলের কাঠের ছিপি খুললাম। তারপর বললাম, তোমার নাম কী বন্ধু?

সে দাঁত বের করে হেসে বললো, অন্য যেকোনো নামের মতো বন্ধুও একটি ভালো নাম। আমার মা যে নামটি রেখেছিলেন তার চেয়েও ভালো।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের পরস্পরের পরিচিতজনের খবর কী?

সে উত্তর দিল, মোটা লোক। তিনি শুভেচ্ছা আর কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। মাটিতে ফেলে রাখা পুরোনো জামার হাতায় সেলাই করে লুকিয়ে রাখা একগুচ্ছ পাকানো প্যাপিরাস কাগজ বের করে সে আমার হাতে দিল। পাকানো কাগজটি খুলতে খুলতে তাকে আমি খাবারগুলো খেতে ইশারা করলাম। সে টেবিলে গিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো।

কাগজটায় এক নজর দিয়েই আমি বুঝতে পারলাম এটা হাইকসো নৌবহরের বর্তমান সমর পরিকল্পনার একটি অংশ। এছাড়া এটন নীল নদের বদ্বীপে কয়েকটি সম্ভাব্য লক্ষবস্তু নির্দেশ করে দিয়েছে যা, তার বিবেচনায় আমার জন্য ভালো হবে।

এটন যখন এ-ধরনের কাগজ পাঠায় তখন আমি এর সত্যতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। কাগজটি আবার পাকিয়ে রাখলাম, পরে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

তুমি কি উপহারের কথা বলেছিলে, বন্ধু?

সে বেশ খুশি মনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি আপনার জন্য আটচল্লিশটা সংবাদবাহক পায়রা এনেছি। এগুলো আমার জাহাজের খাঁচায় রাখা আছে। এটনের চিঠিটা আবার খুলে আরেকবার পড়লাম।

আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, মোটা লোকটি এখানে লিখেছেন, তিনি আমার জন্য একশোটি পায়রা পাঠিয়েছেন। বাকিগুলোর কী হল?

আমাদের খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিল।

তার ধৃষ্টতা দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি আমার পাখিগুলো খেয়ে ফেলেছো? তারার চেঁচিয়ে জারাসকে ডাকলাম। সে আসতেই তাকে বললাম, এখুনি এই বদমাশের জাহাজে যাও। সেখানে আটচল্লিশটা কবুতর পাবে। এখুনি এখানে নিয়ে এসো। নইলে এগুলোও রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যাবে। জারাস কোনো প্রশ্ন না করে আমার নির্দেশ পালন করতে ছুটে গেল।

সে আমার দামি মদ আরেক গ্লাস খেয়ে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে বললো, চমৎকার মদ। আপনার রুচির প্রশংসা করতে হয়। আমাদের মোটা বন্ধু তার জন্য যথোপযুক্ত উপহার পাঠাতে আপনাকে অনুরোধ করেছেন।

আমি বিষয়টা নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলাম। আমি জানি কুনুসসে রাষ্ট্রদূত তোরানের একটি বড় কবুতরের খাঁচা আছে। কীভাবে এই আমার পাখি পাঠাবো বল। শেয়াল আর হায়েনারা যদি এগুলোও খেয়ে ফেলে?

আমার এই অপমানজনক উক্তি গায়ে না মেখে সে বললো, আপনার কোনো জাহাজে করে আমাকে সাগর পার করিয়ে নীলনদের বদ্বীপের কোনো নির্জন জায়গায় নামিয়ে দিন, আমি নিজ হাতে এগুলো তার কাছে পৌঁছে দেবো।

আমি বললাম, এর চেয়েও ভালো ব্যবস্থা করা যাবে, বন্ধু। এই মুহূর্তে কার্থেজের একটি বাণিজ্যপোত ক্রিমাদ বন্দরে অবস্থান করছে। এর ক্যাপ্টেন গতকাল আমার সাথে নৈশভোজ করেছে। চারদিন পর সে বদ্বীপে হাইকসোদের রোসেটা বন্দর হয়ে কার্থেজে ফিরে যাবে। তুমি নিশ্চয়ই জানো কার্থেজের সুলতান আর রাজা গোরাবের মধ্যে নিরপেক্ষ সম্পর্ক আছে। আমি তার জাহাজে করে তোমাকে রোসেটা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তুমি একশো কবুতর সাথে নিয়ে যাবে, এগুলো কুনুসসে ডিম ফুটে বের হয়েছে। ছেড়ে দিলেই এগুলো নিজের বাসায় ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হবে। আর এভাবেই সেই বিশালদেহি লোকটি আর আমি খুব শিঘ্রই পরস্পরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পারবো।

আমি জানি এই ব্যবস্থায় তিনি খুব খুশি হবেন। চাই কী আপনারা দুই এক দান বাও খেলাও পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে খেলতে পারবেন।

লোকটির এই ধরনের রসিকতায় আমার মনে হল সে সীমা লঙ্ঘন করছে। আর আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়টি তার জানাটা বেশ অনধিকার চর্চা মনে হচ্ছে। এই ধরনের অপরিচিত গুপ্তচরের সঙ্গ আমি খুব একটা পছন্দ করি না। তোরানের কবুতরগুলো এখানে আনার ব্যবস্থা করার জন্য জারাসকে কুমুসস পাঠালাম। আর ইতোমধ্যে আমার বন্ধু মিসর থেকে যে ভগ্নপ্রায় ধাউটি নিয়ে সাগর পার হয়ে এখানে পৌঁছেছিল, তা ক্রিট দ্বীপে অবস্থান করা কোনো হাইকসো গুপ্তচরের চোখে পড়ার আগেই গভীর সাগরে পাঠিয়ে ডুবিয়ে দিলাম। তার সাতজন মাল্লাকে আমার জাহাজের দাঁড় টানার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল।

চারদিন পর রোসেটা হয়ে কার্থেজগামি জাহাজটিতে একশো কুবরসহ বন্ধুকে তুলে দিলাম।

কাৰ্থেজিয় জাহাজটি দক্ষিণ দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই আমি এটনকে উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে একটি বার্তা লিখে তার পাঠানো কবুতরের পায়ে বেঁধে পাঠালাম। আর বন্ধুর হাতে রোসেটা পর্যন্ত জাহাজে তার জন্য যে উপহার পাঠিয়েছি সেকথাও জানালাম। সবশেষে বাও খেলার প্রথম চাল-পশ্চিম দুর্গ থেকে আমার সারস পাখি মুক্ত করে দিলাম। এই চালটি এটনকে সবসময় অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

.

পরদিন ভোরে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠতেই আমি জারাস আর হুইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইডা পর্বতের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে আবার কুনুসসের পথে রওয়ানা দিলাম। আমার নির্দেশ মোতাবেক হুই পথের বিভিন্ন জায়গায় নির্দিষ্ট দূরত্বে সরবরাহ চৌকির ব্যবস্থা করেছিল। প্রতি চৌকিতে নতুন ঘোড়াসহ সহিস আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। ব্যবস্থাটি বেশ চমৎকার ছিল।

ওর লোকেরা একটু পর পর সারা পথে গাছের গায়ে ব্রোঞ্জের গজাল মেরে দূরত্ব নির্দেশক রেখেছিল। এতে আমার নিজের অবস্থান সম্পর্কে কোনো সন্দেহ রইল না আর চলার গতিও কমাতে হয় নি। এক একটি চৌকির কাছাকাছি পৌঁছেই আমি শিঙ্গা ফুকে সহিসদের আমার আগমনের আগাম সংকেত দিতাম। তারপর সেখানে পৌঁছেই দেখতাম ওরা নতুন ঘোড়ায় জিন পরিয়ে অপেক্ষা করে রইছে। আমি একটু থেমে পানি মেশানো কয়েক ঢোক মদ খেয়েই নতুন ঘোড়ায় চড়ে সাথে সাথে রওয়ানা দিতাম। সহিস আমার হাতে মাংস আর পেঁয়াজের কাবাব খুঁজে দিতেই তা চিবোতে চিবোতে এগিয়ে চলতাম।

একটু পর যে ক্রীতদাসটি আমার জন্য জীবন দিয়েছিল, সদ্য খোঁড়া তার সমাধির কাছে এসে রাশ টেনে ধরলাম।

প্রার্থনা করে বললাম, শান্তিতে ঘুমাও ওয়াগা। আমি জানি আবার কোথাও আমাদের দেখা হবে। তখন আমি তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। তারপর হাত মুঠো করে তাকে অভিবাদন জানিয়ে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পাহাড়ের পেছন দিকের ঢাল বেয়ে কুনুসস বন্দরের দিকে ফিরে চললাম।

আমার রাষ্ট্রদূতের নতুন অট্টালিকার পেছনে আস্তাবলে পৌঁছে বিকেলের সূর্যের দিকে তাকিয়ে ক্রিমাদ থেকে এখানে পৌঁছার সময় মাপলাম।

সন্তুষ্ট হয়ে আপন মনে বললাম, দ্বীপটি পার হতে ছয় ঘন্টা লেগেছে। দীর্ঘ যাত্রার পর ক্লান্ত হলেও সোজা গ্রন্থাগারে গিয়ে লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সেখানে অনেক পাকানো প্যাপিরাস কাগজ আমার মনোযোগর জন্য রাখা হয়েছিল। বেশিরভাগই ছিল রাষ্ট্রদূত তোরানের কাছ থেকে আসা পত্র।

নৈশভোজ করার আগে একজন ক্রীতদাসের হাতে চিঠির উত্তরগুলো দিয়ে রাজপ্রাসাদের কাছে তোরানের বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য পাঠালাম। খাওয়াদাওয়ার পর শোবার কামরায় গেলাম।

সে রাতে আবার স্বপ্নে ইনানাকে দেখলাম। আমার শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথা ঢাকা ঘোমটা আর আলখাল্লা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে, তবে মুখ দেখা গেল না। আমি উঠে তার কাছে যেতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শীসার মতো ভারী হয়ে রয়েছে আর নড়াচড়াও করতে পারছি না। কথা বলার চেষ্টা করলাম, তবে জিহ্বা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। তবে এতে তেমন উদ্বিগ্ন হলাম না। বরং অনুভব করলাম আমার উপর সে তার করুণা ঢেলে দিয়েছে আর তার দৈব শক্তি আমাকে একটি ঢালের মতো ঢেকে রেখেছে। নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ভোরের আগেই তরতাজা হয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। তারপর গতরাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ভেবে যে এটা সত্যি ছিল না।

নগ্ন অবস্থায় কামরা থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে বুক ভরে সাগর থেকে ভেসে আসা তাজা বাতাস টেনে নিলাম।

সামনে ক্রোনাস পর্বতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেবতা আবার শান্তরূপ ধারণ করেছেন। একবার কালো ধূঁয়া বের হতেই মৃদু হাসলাম। তবে এখন এসব ভেবে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। কেননা আমি পরিকল্পনা করেছিলাম নীল নদীর বদ্বীপের উত্তর উপকূল জুড়ে হাইকসো অবস্থানে আগামী দশদিনের মধ্যে প্রথম হামলা চালাবো।

ঘুরে শোবার ঘরের দরজার কাছে পৌঁছতেই পায়ে নরম কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা লাগলো। জিনিসটা কী দেখার জন্য নিচের দিকে তাকালাম। তারপর ঝুঁকে জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে একটু কৌতূহল নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলাম।

অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম এটা একটা লিলি ফুল। তবে এরকম ফুল আমি কখনও দেখিনি। একটা বড় পানপাত্রের সমান আকার। পাপড়িগুলো সোনালি আর নিচের দিকে সিঁদুরে রঙের। পুংকেশরগুলো গজদন্তের মতো সাদা আর ডগাগুলো নীলকান্ত মণির মতো নীল।

ফুলটি এমন সুন্দর আর টাটকা যে বোঁটা থেকে তখনও স্বচ্ছ রস ঝরে পড়ছিল। দু আঙুলে ধরে ধীরে ধীরে ঘুরাতে ঘুরাতে এর সুগন্ধ পেলাম। গন্ধটা এতে পরিচিত যে এটা মনে হতেই আমার ঘাড়ের পেছনে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

এটি ছিল ইনানা দেবীর সুগন্ধ; ফুলের দেবী ইশতারের সুগন্ধ। যার প্রতীক হচ্ছে লিলি ফুল।

ফিসফিস করে বললাম, এটা স্বপ্ন নয়। সে সত্যিই এসেছেল।

ফুলটা ঠোঁটের কাছে তুলে নিয়ে চুমু খেলাম। সাথে সাথে অনুভব করলাম ফুলটি শুকিয়ে যাচ্ছে; পাপড়িগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে। রঙ ফ্যাকাশে হয়ে মলিন বাদামি হয়ে যাচ্ছে। তারপর পাপড়িগুলো গুঁড়িগুড়ি হয়ে ধূলোর মতো আমার আঙুলের ফাঁক গলে নিচের দিকে ভাসতে ভাসতে বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। ভোরের মৃদু বাতাসে উড়ে গেল।

মনে হল লিলি ফুলটির মধ্য দিয়ে দেবীর সত্তা আমার দেহে চলে এসে আমাকে নববলে বলিয়ান করে তুলেছে।

.

বারান্দায় চামড়ার বালতিতে পরিচারকেরা গরম পানি রেখে গিয়েছিল। সেই পানিতে স্নান সেরে নাবিকদের একটা নীল জামা পরে গ্রন্থাগারের দিকে চললাম।

গতরাতে দরজাটা একটু ফাঁক রেখে গিয়েছিলাম। দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই আতঙ্কে সেখানেই জমে গেলাম। আমার দিকে পেছন ফিরে আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা একটি নারী মূর্তি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ফিস ফিস করে বললাম, ইনানা! আর তখনই সে দ্রুত ঘুরে আমার পায়ের কাছে এসে নতজানু হয়ে বসে আমার হাতে চুমু খেল।

মাথা ঢাকা কাপড়টা ঠেলে ফেলে দিয়ে সে বলে উঠলো, প্রভু তায়তা! আপনাকে দেখে কি ভালো লাগছে। আপনার কথা খুব মনে পড়তো। আমরা সবাই আপনার অভাব অনুভব করেছি।

আমি বিস্ময়ে বলে উঠলাম, লক্সিয়াস, তুমি! আমি মনে করেছিলাম অন্য কেউ। কী করে আমাকে খুঁজে পেলে?

আমি আমার বন্ধু প্রভু তোরানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনিই জানালেন আপনি এখানে আছেন।

তাকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে কৌচের দিকে নিয়ে গেলাম। তাকে বসিয়ে লেখার টেবিলে পিতলের ঘন্টা বাজাতেই রান্নাঘর থেকে তিনজন ক্রীতদাস সিঁড়ি বেয়ে ছুটে এলো।

ওদেরকে নির্দেশ দিলাম, খাবার নিয়ে আস।

বড় থালায় ক্রীতদাসেরা সিদ্ধ ডিম, শুকনো মাছ, মাংসের বড়া আর শক্ত রুটি রেখে গেল। আমরা দুজনে মুখোমুখি বসে খেতে শুরু করলাম।

এখানে তোমার আসাটা নিরাপদ তো? আমি ভেবেছিলাম তেহুতি আর বেকাথার মতো তোমাকেও হেরেমে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

সে মাথা নেড়ে বললো, না! ঐ খাণ্ডারি মেয়েগুলো আমাকে নিচুজাতের ক্রীতদাসি মনে করে। ওরা আমাকে আমার ইচ্ছামতো ভিতরবাহির আসা যাওয়া করতে দেয়।

তাহলে ক্রীতদাসির জীবন তোমার জন্য ভালোই হয়েছে, লক্সিয়াস। তবে আগের চেয়ে দেখতে সুন্দর হয়েছে।

সে লজ্জা পেয়ে বললো, আপনি খুব মন জুগিয়ে কথা বলতে পারেন তায়তা।

আমার অন্য মেয়েদের কথা বল। ওরা কি তোমার মতো খুশি আছে?

ওরা দুজনেই ভীষণ একঘেয়েমিতে ভুগছে। আপনার কাছ থেকে একটি গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।

আমি একটু কৌশল করে বললাম, কেন, ওদের নতুন স্বামী কি ওদের সঙ্গ দেন না?

সে হেসে বললো, আপনি সেই টিনের মাথাওয়ালা বুড়ো সর্বাধিরাজ মিনোজের কথা বলছেন? আমরা তার এই নাম দিয়েছি, তবে সে যদি শুনতে পায় তবে নিশ্চয়ই আমাদের কল্লা কেটে নেবে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর তেহুতি কিংবা বেকাথা কেউ তাকে আর দেখেনি। হেরেমে আমাদের নতুন বন্ধুরাও কেউ তাকে বিয়ের পর একবারও দেখেনি। অনেকে বিশ বছরের বেশি সেখানে থাকার পরও তাকে কোনোদিন দেখেনি। আসলে কেউ তাকে সেই টিনের মাথা ছাড়া দেখেনি।

আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, বুঝলাম না। তার স্ত্রীদের কারও সাথে কি রাজার দৈহিক সম্পর্ক হয়নি? তুমি কি আমাকে একথা বলতে চাচ্ছো?

লক্সিয়াস বেশ কিছুদিন থেকেই রাষ্ট্রদূত তোরানের সাথে মেলামেশা করছে, কাজেই আমার কথার মানে বুঝতে তার খুব একটা অসুবিধা হল না। সে লজ্জিত হয়ে চোখ নামিয়ে বললো, কিছু দিন পর পর মিনোজ প্রহরীদের দিয়ে তার কয়েকজন স্ত্রীকে ডেকে পাঠান। তবে একবার হেরেম ছেড়ে যাওয়ার পর ওরা আর ফিরে আসে না।

আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয় ওদের?

প্রহরীরা বলে ওদেরকে দেবতার পছন্দের সারীতে উন্নিত করা হয়। তারপর ওদেরকে পর্বতের উচ্চ মন্দিরে পাঠান হয়।

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্সিয়াসকে আরও প্রশ্ন করলাম, তবে মনে হল সে এর বেশি কিছু জানে না। তাছাড়া উচ্চ মন্দিরের অবস্থান সম্পর্কেও তার খুব একটা আগ্রহ নেই। সে বারবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জারাস আর হুই কেমন আছে, কোথায় আছে এসব জানতে চাচ্ছিল। আমি জানি রাজকুমারীদের নির্দেশেই সে এই তথ্যগুলো জানতে চাচ্ছিল।

আর আমিও বারবার সর্বাধিরাজ মিনোজের অগণিত স্ত্রীদের দিকে আলাপ ঘুরিয়ে নিতে থাকলাম।

আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা হেরেমে যাওয়ার পর থেকে কতজন বধূ দেবতার প্রিয় হয়েছেন?

সে একমুহূর্ত ইতস্তত না করে উত্তর দিল, চল্লিশজন। আমি অবাক হয়ে গেলাম তার এই নিশ্চিত উত্তর আর সংখ্যাটি শুনে।

তার মানে তুমি আর রাজকুমারীরা হেরেমে যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন একজন করে স্ত্রীকে নেওয়া হত?

না না তায়তা। চল্লিশজন একইসময়ে হেরেম ছেড়ে যায়। ওরা চুলে ফুল খুঁজে নাচতে নাচতে আর গাইতে গাইতে চলে যায়।

এবার আমি একটু সরস মন্তব্য না করে পারলাম না, তাহলে সর্বাধিরাজ মিনোজ বেশ ব্যস্ত রাতই কাটিয়েছেন। তুমি নিশ্চিত যে এই চল্লিশজনের কেউ আর হেরেমে ফিরে আসেনি?

লক্সিয়াস চেহারা যতদূর সম্ভব নির্বিকার রাখার চেষ্টা করছিল, তবে তার চোখে হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল। সে বললো, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। রাজপ্রাসাদের আমাদের অংশে যা যা ঘটে তা সব আমরা জানি।

আমি তার উত্তরটা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলাম। আমার একধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা বিষয় আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।

তারপর আবার বললাম, চল্লিশজন স্ত্রী একসাথে গেল কিন্তু একজনও ফিরে এল না।

লক্সিয়াস মুখ ভার করে বললো, একথাটা একবার কিন্তু বলেছি তায়তা। তেহুতি জানতে চায় জারাস এখন কোথায় আছে। ক্রিমাদে আছে নাকি জাহাজে দায়িত্ব পালন করছে? সে তাকে একটি উপহার পাঠাতে চায়। আপনি কি সেটা নিয়ে যাবেন? আমি তার প্রশ্ন উপেক্ষা করলাম। এখন আমি তার কথার প্যাঁচে পড়তে চাই না।

এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বধূরা কখন হেরেম ছেড়ে গিয়েছিল?

লক্সিয়াস অধৈর্য হয়ে বললো, যেদিন ভূমিকম্প হয় সেদিন দুপুরবেলা ওরা হেরেম থেকে চলে যায়। একথা কি আগে বলিনি?

আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কথার মারপ্যাঁচের সাথে তাল মিলিয়ে মনে দ্রুত চিন্তা চলছিল। বললাম, তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো টিনের মাথা ওয়ালা ভূমিকম্পের মধ্যেই চল্লিশজন কুমারীর সাথে দুষ্টামি করতে চাচ্ছিল?

সে খিলখিল করে হেসে বললো, তাই তো মনে হচ্ছে। ইশ দেখতে পেলে কী মজা হত তাই না? তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমার এখুনি ফিরে যাওয়া উচিত, নয়তো ঐ উগ্রচণ্ডা প্রহরীরা আমাকে প্রাসাদে ঢুকতে দেবে না। মেয়েদেরকে কিছু বলবো?

ওদেরকে বল আমি পৃথিবীর আর সবকিছুর চেয়ে ওদেরকে ভালোবাসি।

সে মুখ ভার করে বললো, আর আমি?

বেশি লোভ করা না লক্সিয়াস। তুমিতো ইতোমধ্যেই একজন বুড়ো মানুষকে পেয়েছে, যে তোমাকে ভালোবাসে।

সে প্রতিবাদ করে বললো, তিনি এতো বুড়ো নন। তার বয়স খুব বেশি। আর তিনি অনেক ধনী। দেখবেন একদিন তিনি ঠিক আমাকে বিয়ে করবেন।

সে চলে যাবার পর আমি বারান্দায় বসে সে যা যা বলেছে সেগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম। খুব একটা মাথামুণ্ডু অর্থ খুঁজে পেলাম না, তবে মনে হচ্ছিল মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

আমার এখন ক্রিমাদে ফিরে গিয়ে জারাস আর হুইয়ের সাথে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে পরামর্শ করা দরকার। তবে তার আগে রাষ্ট্রদূত তোরানের কবুতরের খাঁচায় গিয়ে দেখতে হবে থিবসে এটনের কাছে আমাদের বন্ধু যে কবুতরগুলো নিয়ে গিয়েছিল, তার কোনো একটা ফিরতি ডাক নিয়ে এসেছে কিনা।

.

সেনাপতির কামরায় আমি যখন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল হেরাকল আর ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম, তখন কামরার বন্ধ দরজার বাইরে শোরগোল শোনা গেল।

হেরাকল বিরক্ত হয়ে যাড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো, কী ব্যাপার? আমি তো নির্দেশ দিয়েছিলাম এখানে কোনো ধরনের ব্যাঘাত করা যাবে না!

প্রহরীদলের অধিনায়ক পলিশকরা সেডার কাঠের দরজা খুলে ভেতরে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে ক্ষমা চেয়ে বললো, সম্মানিত মন্ত্রণাপরিষদ-সদস্য প্রভু তোরান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অবিলম্বে বার্তাটি যেন মিসরীয় প্রভু তায়তার হাতে পৌঁছান হয়।

হেরাকল আমার দিকে হতাশার চোখে তাকিয়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, আসতে দাও বুদ্ধ লোকটাকে। ওদের সকলকে আসতে দাও! আর সবাই যখন ইচ্ছা তখন আমার নির্দেশ অমান্য কর।

হেরাকলের রোষ থেকে লোকটিকে রক্ষা করতে আমি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মাননীয় এডমিরাল, আমি এ-বিষয়ের সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব নিচ্ছি। মিসরে আমার সূত্র থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা আসার কথা ছিল।

আমরা আপনার সুবিধামতো অপেক্ষা করবো, সম্মানিত তায়তা। একথা বলে হেরাকল গজগজ করতে করতে তার আসন থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে উপসাগরের ওপারে ক্রোনাস পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

জিনিসটা ছিল আমার কড়ে আঙুলের উপরের গাঁটের সমান প্রায় ওজনহীন একটি পাকানো হলুদ রেশমি কাপড়। ভাঁজ খোলার পর দেখলাম আমার পুরো হাতের সমান লম্বা আর এর উপর ঘনবিন্যস্ত সঙ্কেতলিপি লেখা রয়েছে, যার অর্থ কেবল এটন আর আমার জানা আছে। অন্যান্য যেকোনো লিখিত ভাষার তুলনায় এই সঙ্কেতলিপিতে অনেক সুবিধা রয়েছে। ঠাসাঠাসি করে বার্তা লেখা যায়, এতে লেখকের সুবিধা হয় আর সঠিক অর্থ বুঝাতে অনেক দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী ধরনের সুবিধা রয়েছে।

দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে এডমিরালের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাননীয় এডমিরাল, চমৎকার খবর এসেছে। আমাদের উভয়ের শত্রুর ঠিক বুকে আঘাত হানার সুযোগ এসেছে। নীল বদ্বীপের পশ্চিম প্রান্তের শূর সমভূমিতে হাইকসো রাজা গোরাব এক হাজার রথসহ একটি পদাতিক বাহিনী সাজিয়েছে।

জানালার দিক থেকে ফিরে উচ্ছ্বসিত হয়ে হেরাকল বললো, আমি ঐ এলাকাটা চিনি! জিন আর ধুয়ারা শহরের মাঝে মধ্যসাগরের তীর জুড়ে এর অবস্থান।

আমি একমত হয়ে বললাম, ঠিক বলেছেন! গত একবছর ধরে আমার ফারাও আর জেনারেল ক্র্যাটাস নীল নদের পশ্চিম তীরে তাদের আক্রমণভাগ সাজিয়েছেন। ওরা উত্তরদিকে মেয়েরিস হ্রদ পর্যন্ত এগিয়েছেন। জিন শহর থেকে দক্ষিণে এর দূরত্ব মাত্র আশি লিগ। তারপর চারকোণা হলুদ রেশমি কাপড়টা টেবিলে বিছিয়ে দিলাম। হেরাকল তার লোকজনসহ এর চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল। এটন একপাশে বার্তাটি লিখেছিল। আর অন্যপাশে উত্তর মিসরের একটি বিস্তৃত মানচিত্র এঁকেছিল। এতে হাইকসো আর মিসরীয় বাহিনীর অবস্থান তুলে ধরা হয়েছিল।

রেশমি মানচিত্রে হাত রেখে আমি বললাম, আমার সূত্র জানিয়েছে গোরাব একটি বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। মিসরের পূর্ব সীমান্ত থেকে নেমে এসে কুয়ামে আমাদের রক্ষাকূহ্যের উপর হামলা করার চেষ্টা করবে। এটি একটি চতুর পরিকল্পনা তবে, জিনে যে জায়গায় তার সেনাবাহিনীর সমাবেশ হবে তা সাগর থেকে আক্রমণের ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। মনে হচ্ছে এরকম একটা সুযোগের জন্য ক্রিমাদে অপেক্ষারত আমাদের সম্মিলিত নৌবহর সম্পর্কে গোরাব এখনও অবহিত নয়।

হেরাকল বললো, আপনি বলছেন গোরাব এক হাজার রথ সাজিয়েছে? তার মানে তার কাছে তিনহাজারেরও বেশি রথ রয়েছে। এই সংখ্যাটি খুব বেশি হয়ে যায়। গোরাব যদি আপনার পরিকল্পনা জানতে পারে, তাহলে আপনি আক্রমণ করার চেষ্টা করলেই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।

তার কথার উত্তরে আমি রেশমি কাপড়ের টুকরাটির উপর টোকা দিয়ে বললাম, এটা ঠিক যে গোরাব জিন নগরীতে এক হাজার রথের সমাবেশ ঘটিয়েছে। তবে আমার কাছে খবর আছে যে, মোয়েরিস হ্রদে ফারাও আর জেনারেল ক্রাটাসের মুখোমুখি অবস্থান করা মূলবাহিনী থেকে সে এখনও রথীসেনাদেরকে সরিয়ে এখানে আনেনি। তার মানে পাঁচশোরও কম রথীসেনা এই রথগুলোর পাহারায় রয়েছে। তারপর এটনের বার্তা থেকে পড়ে শোনালাম, পাঁচশো সেনা আর তার দ্বিগুণ ঘোড়া।

হেরাকল তার গোঁফ সমান করতে করতে চিন্তিতভাবে বললো, এটা প্রায় আপনার বাহিনীর সমান।

আমার নৌবহর সাগরে ভাসার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আর গোরাব তার বাকি সেনাদেরকে এখানে আসার আগেই এখন থেকে ছয়দিনের মধ্যে আমরা জিন নগরীতে পৌঁছাতে পারবো। ওরা বুঝে উঠার আগেই জাহাজের পেছন দিক থেকে রথগুলো সৈকতে নামিয়ে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে পারবো। অতর্কিত আক্রমণ করা মানে এক হাজার রথিসেনার সমান সুবিধা পাবো।

আমি আপনাকে একটা সরাসরি কথা বলতে চাই প্রভু তায়তা। এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। বিষয়টা খুব বেশি পরিপাটি আর একেবারে আকস্মিক মনে হচ্ছে। এখানে একটা ফাঁদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। যাইহোক সর্বাধিরাজ মিনোজ আপনার উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছেন। এই হঠকারী পরিকল্পনার জন্য আমার অনুমোদন নেবার প্রয়াজন নেই।

তাহলে আর কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই, মাননীয় এডমিরাল। আপনার পরামর্শ আর শুভেচ্ছার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন তাহলে আমি যেতে পারি।

আমি একাকী পাহাড়ের পথে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম। সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগে ক্রিমাদ পৌঁছলাম। আস্তাবলে জারাস আর হুইকে পেলাম। ওরা আমাকে অবাক হল, তবে আমি যা পরিকল্পনা করেছি তা শোনার পর খুশিতে ফেটে পড়লো।

হুইকে বললাম, আলো থাকতে থাকতেই ঘোড়াগুলো জাহাজে তুলে ফেল। আর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, তুমি যতজন লোক দরকার নাও আর রথের গাড়িগুলো জাহাজে তোলার পর ভালোভাবে রশি দিয়ে বেঁধে নিও। ওরা আমার নির্দেশমতো ওদের লোকজনদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিয়ে ছুটলো।

আমি কবুতরের খোপগুলোর কাছে গেলাম। এটন যে কবুতরগুলো পাঠিয়েছিল সেগুলোর এটা নতুন বাসা। দুটো মোটাসোটা শক্তিশালী গড়নের কবুতর বেছে নিলাম, তারপর দুটোর পায়ে একই ধরনের দুটো বার্তা বেঁধে দিলাম। তারপর একটার পর একটা কবুতরের মাথায় চুমু খেয়ে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিলাম। বন্দরের চারদিকে চারবার চক্কর দিয়ে সঠিক দিক ঠিক করার পর কবুতরগুলো দক্ষিণ-দক্ষিণ-পুবে উড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। রাতের বেলা ওড়াই ওদের জন্য মঙ্গলজনক। ঈগল আর বাজপাখি রাতের অন্ধকারে শিকার করে না। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি দুটো বার্তা এটনের জন্য পাঠিয়েছিলাম।

ছয়দিন পর আমাদের জন্য জিনের সৈকতে পথপ্রদর্শক রাখতে আমি তাকে অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা সৈকতে অবতরণ করার পর তার লোক আমাদেরকে পথ দেখিয়ে যেখানে রাজা গোরাব তার রথের সমাবেশ করেছে সেখানে নিয়ে যাবে।

মাঝরাতের ঘন্টাখানেক আগে আমাদের ছয়টি যুদ্ধজাহাজের নৌবহর বন্দর ত্যাগ করলো। গভীর সমুদ্রে ঢোকার সাথে সাথে আমরা দক্ষিণমুখি হয়ে মিসর আর জিন উপসাগরের দিকে চলতে শুরু করলাম।

ভোরের একটু আগে অন্ধকারে জলদস্যু সর্দার নাকাতির নেতৃত্বে বারোটি যুদ্ধ জাহাজ আমাদের নজর এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে উল্টোদিকে গেল। নাকাতি তার নিজের জাহাজ শান্তির কপোতে চড়ে দ্রুত ক্রিমাদের দিকে যাচ্ছিল। আমি যে খুশিমনে আমার ক্ষুদ্র নৌবহর নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিপদের মুখে চলেছি, সে সম্পর্কে আমাকে সাবধান করতে সে ক্রিমাদের দিকে দ্রুত ছুটছিল।

ভোরের কয়েকঘন্টা পর ক্রিমাদ বন্দরে পৌঁছে নাকাতি দেখলো আমরা কেউ সেখানে নেই। তবে আমি আহত আর অসুস্থ পাঁচজন সৈন্যকে বন্দরে রেখে গিয়েছিলাম। সিডন থেকে সুমেরিয়া জাহাজে আসার সময় আমি যখন নাকাতির শান্তির কপোত জাহাজটি কজা করে তাকে শিকলে বেঁধে বৈঠা বাওয়ার কাজে লাগিয়েছিলাম, তখন এই আহত লোকগুলো আমার সাথে ছিল। আবার যখন নাকাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে তার জাহাজ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তখনও এরা সেখানে উপস্থিত ছিল। কাজেই ওরা জানতো নাকাতি আমাদেরই একজন হয়েছে, তাই কোনো ইতস্তত না করে ওরা তাকে জানালো আমি কোথায়, কী উদ্দেশ্যে জিনের দিকে গিয়েছি।

বন্দরে আমার গুদাম থেকে পানি আর রসদ সংগ্রহ করে পরদিন ভোরের তিনঘন্টা পর নাকাতি আবার নৌবহর পানিতে ভাসালো। এবার সে আমাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে। তবে আমি তার আট ঘন্টা আগে বন্দর থেকে জাহাজ নিয়ে বের হয়েছি।

আমার অবশ্য জানার কথা নয় যে নাকাতি দ্রুত গতিতে আমাকে অনুসরণ করছে। বরং তাকে ছেড়ে দেবার পর থেকে তার কোনো খবর এযাবত আমি পাই নি। এখন ঐ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য অনুতাপ করছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করছিলাম যে, সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আবার জলদস্যুদের সর্দারের ভূমিকায় ফিরে গেছে। আর তার সাথে আমার দেখা হবে না।

পরে অবশ্য আমি জানতে পেরেছিলাম, নাকাতির সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছিল সে অনুযায়ীই সে কাজ করেছিল। এতোদিন যাবত সে সাগরের জলদস্যুদের মধ্য থেকে তার জাহাজের জন্য নাবিক সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিল।

আমার ধারণা ছিল সাগরের জলদস্যুরা বিশৃঙ্খল হয়; আধুনিক নৌবাহিনীর মতো ওদের মাঝে কোনো সংগঠন আর কাঠামোগত প্রক্রিয়া নেই। আমি এটা খেয়াল করিনি যে সাগরের জলদস্যুদের মাঝেও অনেক প্রশিক্ষিত এবং রণকুশল নাবিক রয়েছে। পরিস্থিতির কারণে ওরা দলত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ওদের একটি বিশাল আর সুসংগঠিত গোয়েন্দাবিভাগ রয়েছে যা, আমার পুরোনো বন্ধু এটনের গোয়েন্দা বিভাগের চেয়েও অনেক কর্মদক্ষ। এটনের লোকদের মাঝেও তার নিজের লোক ছিল, তবে মেমফিসে হাইকসো সদরদপ্তরেও সে গুপ্তচর নিযুক্ত করেছিল। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে আমার গোয়েন্দা বিভাগেও সে তোক ঢুকিয়েছে। এইসব সূত্র থেকেই সে এটন আর আমার মধ্যেকার বার্তা বিনিময়ের বিষয় জেনেছে। সে জানতো যে আমি জিনে হাইকসো রথের সমাবেশে হামলা করতে যাচ্ছি আর এও জানতে যে হাইকসোরাও আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন। তবে কী ঘটতে চলেছে তা জানাবার জন্য তার কাছে আমাকে পাঠাবার মতো কোনো বার্তাবাহক কবুতর ছিল না। তাই এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করার জন্য সে নিজেই চলে এসেছিল, তবে তার আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

.

ক্রিমাদ ছেড়ে আসার পর পঞ্চম দিনে সূর্য উঠার এক ঘন্টা আগে আমরা আফ্রিকার উপকূলে জাহাজ ভেড়ালাম। আমি ইচ্ছা করেই একটু পশ্চিম দিকে সরে জাহাজ চলার পথ বেছে নিয়েছিলাম। এমন কোনো নাবিক জীবিত নেই যে ডাঙা না দেখে পাঁচদিন জাহাজ চালিয়ে জিন উপসাগরের মতো একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে সঠিকভাবে পৌঁছতে পারে। উপসাগরের পূর্বদিকে জাহাজ ভেড়ানো আমার জন্য বিপজ্জনক ছিল। নীলনদের বদ্বীপের কাছে উপকূল জুড়ে ঘন জনবসতি রয়েছে। দিগন্তের উপরে পৌঁছার সাথে সাথে আমরা মানুষের চোখে ধরা পড়ে যেতাম। সোজা পথে জিন উপসাগরের দিকে যেতে না পারায় একটু পশ্চিম দিক ঘেঁসে যাওয়াটাই নিরাপদ ছিল। পশ্চিম উপকূলে ছিল সাহারা, এখানে বসবাস করতো খুবই কম সংখ্যক কিছু ভবঘুরে বেদুঈন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ডাঙা দেখার সাথে সাথে আমি আমার পথের নিশানা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম। কোনো ইতস্তত না করে আমি আমার নৌ-বহর ঘুরিয়ে পাল তুলে মরুভূমি ঘেঁসে চলার নির্দেশ দিলাম। তীরের সমান্তরাল হয়ে পাল তুলে তিন ঘন্টা ভেসে চলার পর বুঝা গেল আমার ইচ্ছাকৃত ভুলটি একটু বেশি হয়ে গেছে। প্রথমে এতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম, তবে পরবর্তীতে এটা সুফল বয়ে এনেছিল। এতে সময় অপচয়ের ফলে নাকাতির আমার সাথে দেখা হওয়ার যে বিলম্ব ঘটেছিল, তা পূরণ করার সুযোগ হয়।

অবশেষে আমরা জিন উপসাগরের মোহনায় এলাম। উত্তর দিক থেকে আসার পথে তীরভূমি ঢেকে রাখা সুস্পষ্ট অন্তরীপটি দেখেই এটা চিনতে পারলাম। নির্দেশ দিলাম বাতাসের গতিপথ আর পালের অবস্থান অনুযায়ী জাহাজের গতিপথ নির্ধারণ করে পর্যায়ক্রমে জাহাজ চালাতে। এভাবে চলে তারপর আমরা প্রবেশপথ দিয়ে উপসাগরে ঢুকলাম।

হাইকসোরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। অন্তরীপের মাঝখানে দিয়ে জীন উপসাগরে ঢুকতেই ওরা দলবেঁধে আমাদের দিকে তেড়ে এলো। ওরা নিশ্চয়ই উপসাগরের তীর আর নীল নদীর বদ্বীপের একশো লিগ এলাকা জুড়ে ভাসমান সবধরনের জলযান মোতায়েন করে রেখেছিল। চারকোণা পালের ছোট জাহাজ থেকে শুরু করে বিশাল তিনতলা জাহাজ নিয়ে ওরা আমাদের নৌবহরের উপর আক্রমণ করলো। কাছের জলযানগুলো পেছনের জাহাজকে ঢেকে রেখেছিল আর ছোটগুলো বড় জাহাজের আড়ালে ছিল। তবে দ্রুত একবার হিসাব করে আমি দেখলাম, আমাদের ছয়টি জাহাজের বিপরীতে ওদের প্রায় বিশটি জাহাজ ছিল।

সবকটি জাহাজের ডেকে অস্ত্রসজ্জিত লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। সূর্যের আলোয় তাদের শিরস্ত্রাণ, তরবারির ফলা আর বর্মগুলো ঝিকমিক করছে। আমাদের কাছাকাছি আসতেই তাদের রণহুঙ্কার আর যুদ্ধের আহ্বান পরিষ্কার বাতাসে ভেসে আসছে।

আমাদের পেছন দিকের উন্মুক্ত সাগর থেকে ভোরের বাতাস প্রবেশপথ দিয়ে উপসাগরে ঢুকে হাইকসোদের মুখোমুখি বয়ে যাচ্ছিল। এতে আমরা জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়ে পালাবার পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে হাইকসোদের জাহাজগুলো বাতাসের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। ওরা অবশ্য সঠিকভাবে জাহাজের দিক নির্দেশনা করতে পারছিল না, বৃথা সময় নষ্ট করছিল। আর এদিকে অনুকূল বাতাসে পাল ফুলে গিয়ে আমাদের ছয়টি জাহাজ দ্রুত গতিতে সামনের দিকে ধেয়ে চলছিল। দশবারো বার দাঁড় বাইতেই আমরা পুরোপুরি আক্রমণের গতি অর্জন করলাম।

আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে, শত্রুদের জাহাজের ডেকে লোকজন এতো ঘেঁসাঘেসি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, ওদের তীরন্দাজরা মানুষের শরীর আর বর্মের চাপে পড়ে ঠিকমতো ধনুকের ছিলা টানতে পারছিল না। এদিকে জারাস, হুই, আকেমি আর দিলবারসহ আমার অন্যান্য জাহাজের ক্যাপ্টেনরা, তাদের জাহাজগুলোতে কম লোক থাকার সুবিধাটি কাজে লাগাতে পারছিল। তবে উপসাগরের অন্তরীপ ঢোকার আগেই আমাদের তীরন্দাজরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ওরা ধনুকের গুণ টেনে তীর ধনুকের গায়ে ঠেকিয়ে রেখেছিল। শত্রু আর আমাদের অগ্রগামী জাহাজের মধ্যের দূরত্ব লম্বা পাল্লায় তীর ছোঁড়ার আওতায় আসতেই জারাস তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দিল। আমাদের মাথার উপর দিয়ে বয়ে আসা অনুকূল বাতাস আমাদেরকে সাহায্য করলো। এতে আমরা একশো গজের সুবিধা পেলাম। হাইকসোরা তাদের ধনুক উঁচু করার আগেই আমাদের তীরন্দাজরা দশবার তীর ছুঁড়তে পারলো।

পিঙ্গল বর্ণের তীরের মেঘে তাদের ডেক ছেয়ে গেল আর বিপুল সংখ্যায় মানুষ হতাহত হল। আহতদের আতকারের সাথে মিশে তীরের আঘাতের থাপ থাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

শত্রুর বিশাল তিনতলা জাহাজটি আমাদের বহরের যেকোনো জাহাজের প্রায় দেড়গুণ বড় ছিল। তবে এই ধরনের বিরূপ হাওয়ার পরিস্থিতিতে এর বিশাল আকার সুবিধার বদলে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবল বাতাসের সামনে এর খেসারত দিচ্ছে। এর বিশাল বিপজ্জনক ব্রোঞ্জের ডগাটি আর আমাদের দিকে মুখ করে নেই। বরং তিনতলা দাড়ির ডেকসহ এর কাঠামোর চওড়া দিকটি আমাদের দিকে উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে।

জারাসকে বললাম, এটা ঘুরতেই এর গায়ে গোত্তা মারো। সে এক লাফ দিয়ে আমার নির্দেশ পালন করতে গেল। ঢাকিরা দ্রুত লয়ে আক্রমণাত্মক গতিতে ঢাক পিটাতে লাগলো। দাঁড়ি বেঞ্চে বসা আমাদের দাড়িরা ছিল তরতাজা আর অধীর আগ্রহে এরকম আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগলো। হাওয়ার ধাক্কার সাথে বৈঠার গতি মিলে আমার নির্মম জাহাজটি সজোরে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি জারাসকে নানারকম নির্দেশ দিতে লাগলাম যাতে আমাদের জাহাজের মাথায় স্থাপিত ব্রোঞ্জের তীক্ষ্ণ ডগাটি শত্রুর তিনতলা জাহাজের সবচেয়ে দুর্বল দিকে মুখ করে থাকে।

আমাদের জাহাজ আর আমাদের লক্ষবস্তর মাঝখানে হাইকসোদের ছোট ছোট একতলা জলযানগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তিনতলা জাহাজটিকে তা দেওয়ার আগে জারাস চিৎকার করে বলে উঠলো, বৈঠা হাতে নাও! আমাদের দাঁড়িরা জোরে দাঁড় বেয়ে চললো আর প্রচণ্ড শব্দে আমাদের জাহাজের ঈগলের মতো বাঁকা এবং তীক্ষ্ণ ঠোঁট শত্রুর তিনতলা জাহাজটির গায়ে আঘাত হেনে এক পাশ দিয়ে অপর জাহাজটির উপরে চড়ে বসলো। মানুষের আর্তচিৎকারের সাথে কাঠের তক্তা আর ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া দাঁড়ের শব্দ মিশে গেল। জাহাজের দুটি মাস্তুলই ভেঙে ডেকের উপর পড়ে গেল। জাহাজটি একদিকে কাত হয়ে পড়লো। খোলা দাঁড়ের ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বেঞ্চে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসেরা সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ডুবে মরলো। আর উপরের ডেকের যোদ্ধারা জাহাজের কাঠামো উল্টে যেতেই সবাই পানিতে পড়ে গেল।

প্রচণ্ড সংঘর্ষের ধাক্কায় জারাস আর আমি আমাদের জাহাজের ডেকে পড়ে গেলাম। আমাদের জাহাজটি পানিতে থেমে পড়েছিল, আমরা উঠে দাঁড়াতেই চতুর্দিক থেকে ছোট ছোট হাইকসো জলযানগুলো আমাদেরকে ঘিরে জাহাজের পাশে দড়ি বাঁধা লোহার আঁকশি ছুঁড়ে মারতে লাগলো। এক পাল নেকড়ের মতো চিৎকার করতে করতে শত্রু সেনারা আমাদের জাহাজের ডেকে উঠে পড়লো। দুইপাশ দিয়ে এসে কুড়াল আর তরবারি হাতে ওরা আমাদেরকে ঘিরে ফেললো।

জারাস, আমি আর ডেকের অন্যান্য কর্মকর্তারা পরস্পরের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে একটি বৃত্ত রচনা করে দাঁড়ালাম। অসিচালনায় সবাই সুদক্ষ ছিল আর অনেকবার আমরা একসাথে লড়াই করেছিলাম। আমরা সহজেই হাইকসো আক্রমণকারীদের পরাস্ত করলাম। তবে ওদেরকে মেরে ফেলতেই আরও একদল হাইকসো শত্রু দুই পাশ দিয়ে উঠে এল।

আমার পায়ের নিচে ডেকের মেঝে রক্তে পিচ্ছিল হয়ে গেল আর কণুই পর্যন্ত আমার বাহু জমাট বাঁধা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। তারপরও অসভ্য হাইকসোরা আমাদেরকে আক্রমণ করতে এসে মারা যাচ্ছিল। আমার ডানপাশে জারাস ক্লান্তিহীনভাবে লড়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। হাত ভারি হয়ে আসছিল আর পাগুলো আর তাল সামলাতে পারছিল না।

একটা লোককে মেরে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে সামনে জাহাজের এক পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমার নৌবহরের অন্যান্য রণতরীর নাবিকরাও প্রচণ্ড লড়াই করছে। শত্রু জাহাজগুলো ওদেরকে ঘিরে ফেলেছে আর ওরা প্রাণ বাঁচাতে লড়ে যাচ্ছে। তারপর আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম আরও দশবারোটি শত্রু জাহাজ ভোলা সাগর থেকে উপসাগরে ঢুকছে। বড় বড় একতলা রণতরীগুলোর লোকেরা উল্লাসে চিৎকার করে দাঁড় বেয়ে আসছে। আমি জানি শুধু সংখ্যার কারণে এতোগুলো যুদ্ধ জাহাজের সাথে আমরা বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারবো না। একবার ভাবলাম কোনোভাবে লড়াই থামিয়ে খোলা সাগরের দিকে যেতে পারবো কি না। তবে বুঝতে পারলাম যে এই ভাবনা শুধু এক কাপুরুষ মনের শেষ ভাবনা নয়, এটি ছিল হতাশা থেকে এক অলীক কল্পনা। মনে হচ্ছে রক্তস্নান থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। আরও শত্রু জাহাজে উঠে আসতেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাতে লাগলাম। অবশেষে চরম ক্লান্তিতে নিঃশেষিত হয়ে আমার পা টলমল করতে লাগলো। জারাস আমার শরীরের সাথে তার ঢাল চেপে ধরে আমাকে খাড়া করে রাখতে চেষ্টা করলো। তবে এখন আমার তরবারি উঠাবার শক্তিও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যেসব শত্রু সেনাদেরকে হত্যা করেছি তাদের রক্তে আমার সারা মুখ, হাত রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে।

তারপর আরেকটি দাড়িওয়ালা শত্রুর মুখ আমার সামনে উদয় হতেই আমি আমার তরবারির ভেতা অংশ দিয়ে তাকে আঘাত করলাম। এততক্ষণ লড়াই করার পর তরবারির ধারালো অংশটি ভোতা হয়ে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। আমার আঘাতটি এতো দুর্বল ছিল যে নতুন শত্রু অবজ্ঞাভরে তার হাতের কব্জি ঘুরিয়ে এটা এক পাশে সরিয়ে দিল।

তারপর সে চিৎকার করে উঠলো, প্রভু তায়তা! আমি একটু থেমে হতভম্ভ হয়ে তার দিকে তাকালাম। তার দাড়ির কারণে প্রথমে আমি তাকে চিনতে পারিনি। তাছাড়া চোখে রক্তের ছিটা পড়ায় আমি ঝাপসা দেখছিলাম। তবে এখন বুঝলাম সে হাইকসো শত্রু নয়, তার চেহারা পরিচিত মনে হচ্ছে।

এবার তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম। সে বলে উঠলো, অস্ত্র থামান প্রভু তায়তা। আমি আপনার অধীনস্থ লোক।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, নাকাতি তুমি? আমি মনে করেছিলাম তুমি আর আসবে না।

সে দাঁত বের করে হেসে বললো, দেবতারা সবসময় আপনার প্রার্থনা পূর্ণ করেন না। তারপর সে হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে আমার পড়ে যাওয়া ঠেকাল। তবে আমি ঝটকা মেরে তার হাত সরিয়ে দিলাম। নতুন আশায় আমার মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার হয়েছে।

তুমি বেশ ভালো সময়েই এসেছো নাকাতি। যাইহোক তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি। হাত তুলে জাহাজের গলুইয়ের কাছে দেখালাম, হাইকসোরা লড়াই ছেড়ে পালাচ্ছে। জাহাজ তীরে ফেলে ওরা স্থলপথে পালাচ্ছে। ঐ ব্যাটাদের পাকড়াও কর। তারপর আমরা ওদের রথগুলো খুঁজে সেগুলো ধ্বংস করবো।

আমার কথা শুনে সে হেসে বললো, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, হাইকসো অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী তা থেকে মাত্র এক লিগ দূরত্বে আছে।

আমি বললাম, তুমি নিশ্চিত?

প্রভু এটনের মতো আমার অনেক সংবাদদাতা না থাকলেও তারা কোনো অংশে কম দক্ষ নয়। গোরাবের লোকেরা যে এখানে আপনার জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছিল আমার সংবাদদাতারা আমাকে সে খবর জানায়। আপনাকে সাবধান করার জন্য আমি সাথে সাথে ক্রিমাদের উদ্দেশ্যে জাহাজ নিয়ে ছুটি, কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখি আপনি আগেই চলে গেছেন। হোরাস আর আইসিসকে ধন্যবাদ যে সময়মতো এখানে পৌঁছে আপনাকে জীবিত পেয়েছি।

পোশাকের কিনারা দিয়ে মুখ থেকে ঘাম আর রক্ত মুছে আমি বললাম, সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তারপর নিচু হয়ে ডেক থেকে শত্রুর একটি তরবারি তুলে নিলাম। তারপর সোজা হয়ে জারাসের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম, আমাদেরকে তীরে নিয়ে চল। একটিও হাইকসো জানোয়ার যেন পালাতে না পারে!

বালুকাবেলার দিকে আমরা জাহাজ নিয়ে চললাম। আমার নির্দেশ মতো নাকাতি তার লোকজনদের নিয়ে পলাতক হাইকসোদের পেছনে ছুটলো। এদিকে জারাস আর হুই রথগুলো নামিয়ে ঘোড়াগুলোর লাগাম পড়াতে শুরু করলো।

এটন যে বেদুঈন পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছিল, ওরা সাগরতীরের বালিয়াড়িতে লুকিয়েছিল। এখন ওরা বের হয়ে এলো। অর্ধেক রথ নিয়ে হুই আর আমি বেদুঈনদের অনুসরণ করে হাইকসো অশ্বারোহী সেনাছাউনির দিকে চললাম।

জারাস নাকাতির সাথে যোগ দিল। বাকি রথে চড়ে ওরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালানো হাইকসোদের খুঁজতে বালিয়াড়ির দিকে ছুটলো।

রথের গুদামের হাইকসো প্রহরীরা লড়াই থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে সেখানে কি ওলোটপালট ঘটনা ঘটেছে তা কিছুই জানতো না। হুই আর আমি রথে চড়ে গুদামের সীমানা বেষ্টনির কাছে পৌঁছাবার পর আমি ওদের ভাষায় প্রহরীদের মূল ফটক খুলতে বললাম। ওরা আমাদেরকে দক্ষিণের মূল হাইকসো বাহিনী থেকে আসা নতুন সেনাদল মনে করে ফটক খুলে দিল।

ওরা যখন ভুলটি বুঝতে পারলো ততক্ষণে আমাদের লোকেরা ওদের মাঝে ঢুকে ওদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। ওদেরকে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসতে বাধ্য করে পিছমোড়া করে বাঁধলো।

রথের গুদামে সারিবদ্ধভাবে রাখা ৮৫০টি ঝকঝকে নতুন রথের গাড়ি পাওয়া গেল।

পরিষ্কার বুঝা গেল হাইকসো কারিগররা আমাদের মিসরীয় রথের গাড়ির নকশা নকল করেছিল। চিরাচরিত হাইকসো যন্ত্রের চেয়ে এগুলো অনেক উন্নত ধরনের। মূল কাঠামো মালাক্কা বেত আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো শক্ত পাইন কিংবা সিডার কাঠের চেয়ে অনেক হালকা আর নমনীয়। কঠিন নিচ্ছিদ্র না করে চাকাগুলোতে স্পোক বসিয়ে দ্রুতগামী এবং আরও টেকসই করা হয়েছে।

গাড়িগুলো বার্ণিশ করে গাদাগাদি করে রাখাছিল। সাথে আনা প্রদীপের তেল এগুলোর উপর ছিটিয়ে জ্বলন্ত মশাল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। গাড়িগুলো একটার সাথে আরেকটি লেগে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

হাইকসো রথগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার পর বেদুঈন পথপ্রদর্শক আমাদেরকে ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে নিয়ে গেল। সেখানে নল খাগড়ার ছাউনির আস্তাবলে প্রায় দুই হাজার ঘোড়া ছিল।

একটি বিষয়ে আমি হাইকসোদের প্রশংসা করবো, তা হল ঘোড়ার যত্ন নেওয়ার বিষয়ে। এই প্রাণীগুলোকে সযত্নে লালন-পালন করে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তারপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একেবারে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে আমি ঘোড়া বেশি পছন্দ করি। একটি ঘোড়ার উপর আস্থা রাখা যায়।

সৈকতের যেখানে জাহাজগুলো ছিল, ঘোড়াগুলোকে সেখানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কীভাবে এতগুলো ঘোড়ার ব্যাপারে বন্দোবস্ত করা যায়। দুই হাজার ঘোড়া বিশাল একটি সংখ্যা। নাকাতির বহরসহ সমস্ত জাহাজেও এতগুলো ঘোড়ার জায়গা করা সম্ভব নয়।

নাকাতির একজন কর্মকর্তা এই চমৎকার প্রাণীগুলোকে হত্যা করার পরামর্শ দেওয়ায় আমি বেশ বিরক্ত হলাম। আমি নাকাতির দিকে ফিরে বললাম, তোমার এই দলের মধ্যে পঞ্চাশ জনও কি নেই যারা ঘোড়াকে বুঝতে পারে আর ভালোবাসে?

আমার ক্ষিপ্তভাব টের পেয়ে সে বললো, অবশ্যই আছে প্রভু তায়তা।

ওদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো। পুরো ঘোড়ার পালটি ওদের মধ্যে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেবো। তারপর ওরা আলাদা আলাদা পথে ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে মিসরীয় এলাকায় নিয়ে যাবে। মেশিরে আমার এস্টেটে পৌঁছে দেবার পর প্রতিটি ঘোড়ার জন্য আমি একটি করে রূপার ডেবেন দেবো। এই কাজটি করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে আমি তার পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবো। এ ব্যাপারে আমি প্রতিজ্ঞা করতে রাজি আছি!

আধাঘন্টার মধ্যে নাকাতি স্বেচ্ছাসেবক দলের সমাবেশ করলো। ওরা যার যার পছন্দমতো ঘোড়ার পাল বেছে নিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গোধূলির আলোয় যাত্রা করলো।

ওদের মধ্যে কিছু লোক সাহারা হয়ে হাইকসো অবস্থান ঘুরে পশ্চিম দিক দিয়ে মিসরে পৌঁছাবার পথ বেছে নিল। অন্যান্যরা নীল নদীর বদ্বীপ পার হবার সিদ্ধান্ত নিল। সাঁতরে নদী পার হয়ে ওরা পূর্বদিকে সিনাই উপদ্বীপে পৌঁছাতে চেষ্টা করবে। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে লোহিত সাগরের উপকূল ধরে থিবসে পৌঁছতে পারবে।

ওদের চলে যাওয়া দেখে আমি হোরাস আর ইনানার উদ্দেশে ঐকান্তিক প্রার্থনা করলাম, যেন এই কঠিন যাত্রাপথে ওরা আমার ঘোড়াগুলোর উপর সদয় দৃষ্টি দেন।

.

এরপর বন্দীদের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম।

রথের গুদাম আর জিন উপসাগরের যুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়াসহ মোট ৭৯৩ জন হাইকসো সৈন্য আর নাবিককে বন্দী করা হয়েছিল। জারাস আর নাকাতি বন্দীদেরকে সৈকতে লম্বা সারিতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রেখেছিল। পুরো নগ্ন করে পিছমোড়াকরে দুইহাত বেঁধে রাখা হয়েছিল। হাল ছেড়ে দিয়ে গোমড়ামুখে ওরা হাঁড়িকাঠের নিচে ফাঁসির আসামির মতো জল্লাদের ডাকের জন্য অপেক্ষা করছিল।

নাকাতি আর আমার লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এই হতভাগাদের নিয়ে কী করা যায়? ওরা কেউ এদের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাল না। আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজগুলো দ্রুত মেরামত করা হয়েছিল। যেগুলো মেরামত করার উপায় ছিল না সেগুলো বালুকা বেলায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। লড়াই হয়েছে আর আমরা জয়ী হয়েছি। নতুন করে হাইকসো গোষ্ঠির লোকেরা প্রতিশোধ নেবার জন্য বালিয়াড়ির উপর দিয়ে আসার আগেই সবাই জাহাজে চড়ে গভীর সমুদ্রে চলে যেতে চাইছে।

হুই বললো, এদেরকে মেরে ফেললেই হয়।

জারাসও সায় দিয়ে বললো, আমারও তাই মত। ওদের সকলকে হত্যা করা হোক। সে জোরে জোরে হাইকসো ভাষায় কথগুলো বলছিল যাতে কাছের বন্দীরা তা শুনতে পায়।

নাকাতি তার মত দিয়ে বললো, এটা ভালো প্রস্তাব। ওদেরকে ছেড়ে দিলে ওরা কাল আবার আমাদের লোকদের হত্যা করবে আর মেয়েদেরকে ধর্ষণ করবে। সবাই চেঁচিয়ে একমত হল। তবে নাকাতি এক হাত তুলে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাকে বললো, তবে প্রভু তায়তা, আপনাকে আমি ভালো করেই জানি, আপনি কখনও আমাদের এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। যে লোক আত্মসমর্পণ করেছে তাকে আপনি কখনও ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে মারতে পারবেন না।

আমি কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বললাম, দুর্বল ও অসহায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাবার বিষয়ে তুমি আমার সম্পর্কে হয়তো একটু বেশি বলে ফেলেছ। আমি হয়তো তোমাকে অবাক করে দিতে পারি। তবে সে ঠিকই জানে আমার এই প্রতিবাদ সমাটেই আন্তরিক নয়। সে দাঁত বের করে হেসে বললো, তাহলে আমি একটা প্রস্তাব করছি। আমি আপনাকে দেখাচ্ছি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় যে, এই কুকুরগুলো আর কখনও ফারাও আর আমাদের মিসরের বিরুদ্ধে তীর ছুঁড়তে পারবে না কিংবা তরবারি উঠাতে পারবে না। তারপর আমরা তাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি যাতে আপনার বিবেকের কাছে আপনি পরিষ্কার থাকতে পারেন।

তার এই অন্তঃসারশূন্য বিতর্কে বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, কীভাবে সেটা করবে শুনি? কী কারণে ওদেরকে বিশ্বাস করতে বলছো?

হাঁটু গেড়ে বসা বন্দীদের পাহারায় তার যে লোকগুলো ছিল, তাদের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নেড়ে কিছু ইঙ্গিত করে সে আমাকে বললো, আমি আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছি, অনুগ্রহ করে এক মুহূর্ত এদিকে তাকান! ওরা একজন হাইকসো রথিসেনাকে টেনে নিয়ে এসে মুখ বালুর উপর রেখে উপুড় করে শোয়াল। বন্দীর দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। নাকাতি লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে তরবারি বের করলো।

সে লোকটিকে নির্দেশ দিল, তোমার বুড়ো আঙ্গুল তুলে ধর! বন্দীটি তার নির্দেশ পালন করলো। তরবারির দুই কোপে সে লোকটির বুড়ো আঙুল দ্বিতীয় গাঁট থেকে কেটে ফেললো। লোকটি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো। ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো আর কাটা বুড়ো আঙুলের অংশগুলো বালুতে পড়ে কাঁপতে লাগলো।

নাকাতি বললো, এবার আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই লোকটি আর কখনও মিসরের বিরুদ্ধে তীর কিংবা তরবারি কোনোটাই চালাতে পারবে না। আমরা সবাই অবাক বিস্ময়ে হা করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আমার লোকেরা উল্লাসে ফেটে পড়লো।

এরপর আমি কিছু বলার আগেই জারাস সামনে এগিয়ে গেল। সে এক পা দিয়ে নগ্ন আর আহত বন্দী লোকটিকে ঠেলে উল্টিয়ে চিৎ করে শোয়াল। তলোয়ার বের করে লোকটির পুরুষাঙ্গের নিচে তলোয়ারের ডগাটি ঢোকাল। তারপর সে বললো, এভাবে নিশ্চিত করা হল যেন, সে আর কখনও কোনো মিসরীয় নারী কিংবা সদ্যজাত শিশুকে ধর্ষণ করতে না পারে। এই কথা বলার সাথে সাথে তলোয়ারের ধারালো ফলার উপরের দিকে এক টানে সে লোকটির পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললো। তারপর তলোয়ারের ডগায় বিধিয়ে সাগরের ফেনায় ছুঁড়ে ফেললো।

আমার চতুর্দিকের লোকেরা আবার উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো। তবে আমি ওদের চেয়েও জোরে চিৎকার করে জারাসকে বললাম, এই নিষ্ঠুরতা এখনই থামাও জারাস। তোমার তলোয়ার খাপে ঢোকাও। তুমি তো হাইকসো পশুদের মতো একই পর্যায়ে নিচে নেমে পড়েছ!

জারাস ওর তলোয়ার খাপে ঢুকিয়ে ঘুরে আমার মুখোমুখি হল। চিবুক তুলে আমার মতোই একইভাবে হিংস্র ও রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রভু তায়তা। এদেরকে বন্দী করে আমাদের জাহাজে নেবার মতো জায়গা নেই। আর যদি অক্ষত অবস্থায় ওদেরকে মুক্তি দেন তাহলে আমাদের আর কত লোককে ওরা হত্যা করবে বলুন? আর কত নারী ও শিশু ওদের হাতে মারা পড়বে?

ধীরে ধীরে তার কঠিন যুক্তির সামনে আমার ক্রোধ কমে এলো। আমি। বুঝতে পারলাম খোঁজা করার সময় আমার উপর যখন ছুরি চালান হয় সেই ক্ষতের স্মৃতি আমার বিচার বিবেচনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি চাই না যে এ-ধরনের নৃশংসতা আর কোনো মানুষের সাথে হোক, তা সে যতই খারাপ হোক না কেন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম, তারপর কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে রাগটা দূর করার চেষ্টা করে বললাম, তুমি ঠিক কথাই বলেছো জারাস। আমি যাচ্ছি তুমি এসে আমার সাথে দেখা করো। বুড়ো আঙুল কাটো ঠিক আছে, তবে পুরুষাঙ্গটা বাদ দাও, ওটা ওদের দেবতা শেঠের জন্য রেখে দাও।

আমার কথা শুনে অন্যান্যরা একটু খোশ মেজাজে ফেরার চেষ্টা করে একটু অশ্লীল রসিকতা করতে লাগলো। আমিও ওদের কথা শুনে জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুরে জারাসের দিকে তাকাতেই আমার ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল।

জারাস অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। চারদিকে নীরবতা নেমে এল। শুধু শোঁ-শোঁ বাতাসের শব্দ আর আহত বন্দীটির ফোঁপানি শোনা যাচ্ছিল। এরপর জারাস শীতল আর পরিষ্কার কণ্ঠে বলতে শুরু করলো, হাইকমোরা যখন আমাদের গ্রামে হামলা চালায় তখন আমার দুই বোনের বয়স ছিল সাত আর আট বছর। বাবা তার সেনাদলের সাথে দূরে ছিলেন। হাইকমোরা প্রথমে আমার মা, তারপর পালাক্রমে দুই বোনকে ধর্ষণ করে। অর্ধেক দিন এভাবে ওদের উপর নির্যাতন চালায়। আমার তখন বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর, তবে আমি কোনক্রমে পালিয়ে মাঠে লুকালাম। সেখান থেকে সবকিছু দেখতে পেলাম। সবশেষে আমাদের কুটিরে আগুন লাগিয়ে আমার মা আর বোনদেরকে জীবন্ত অবস্থায় আগুনের মধ্যে ফেলে দেয়। আমি মাঠ থেকে ওদের আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। কথা শেষ করে সে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এখন আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

আমি তাকে কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে বললাম, ফারাও আর তোমার পরিবারের স্মৃতির প্রতি তোমার দায়িত্ব পালন কর।

জারাস উত্তর দিল, ধন্যবাদ প্রভু। তারপর খাপ থেকে তলোয়ার বের করে নাকাতির সাথে যোগ দিল।

অঙ্গচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে ওরা দুজনে ত্রিশজন লোক বেছে নিল, যারা খুব ভালোভাবে কুড়াল চালাতে পারে। প্রত্যেকের সাথে চারজন করে সহকারী দেওয়া হল, যারা বন্দীকে টেনে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখবে। প্রথম প্রথম বন্দীদের দুএকজন হাত মুঠো করে রেখেছিল। কিন্তু কুড়ালধারীরা সময়ের অপচয় না করে পুরো হাতটা কব্জি থেকে কোপ মেরে কেটে ফেললো। এরপর বন্দীরা সহযোগিতা করলো।

তারপর সহকারীরা ওদেরকে উল্টে চিৎ করে শুইয়ে দিল। তারপর ওদের পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে বালিয়াড়ির উপর ছেড়ে দেওয়া হল। ওরা গোঙাতে গোঙাতে কাটাস্থান চেপে ধরে রক্তপাত কমাবার চেষ্টা করতে লাগলো।

রক্তের গন্ধে গাংচিলের দল আকৃষ্ট হয়ে কাটা বুড়ো আঙুল আর যৌনাঙ্গের স্থূপের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

সমস্ত দৃশ্যটি দেখে আমি অসুস্থবোধ করে ঘুরে আমাদের জাহাজের দিকে চললাম। হাইকসো বন্দীদের আর্তচিৎকার আর কাকুতিমিনতি উপেক্ষা করার চেষ্টা করলাম। বরং রথের গাড়ি আর ঘোড়াগুলো জাহাজে উঠাবার কাজ তত্ত্বাবধান করতে লাগলাম।

রক্তপাতের কাজটি সমাপ্ত করার পর নাকাতি আমার কাছে বিদায় নিতে এল। তার সাথে আমার চুক্তি অনুযায়ী সে মধ্যসাগরের উপকূল জুড়ে হাইকসো বন্দর আর নগরগুলোতে লুটতরাজ চালিয়ে যাবে।

অবশেষে জারাস জাহাজের ডেকে উঠেই সাথে সাথে আমার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, প্রভু আমি আপনার কথা অমান্য করেছি। সমস্ত লোকের সামনে আমি আপনার নির্দেশ অমান্য করেছি। আপনি অবশ্যই আমাকে পদাবনতি দিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে খারিজ করতে পারেন।

আমি উত্তর দিলাম, তুমি যা ভালো মনে তা করেছে। আর কোনো মানুষ এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারে না। এখন যাও জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ক্রিমাদের পথে চল।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ধন্যবাদ তায়তা। আর কোনো দিন আপনার অবাধ্য হবে না।

.

সর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তেই আমি মাস্তুলের ডগায় উঠলাম, সেখান থেকে পেছনে সাগরের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম যে, পেছন থেকে কোন হাইকসো জাহাজ আমাদের পিছু নেই নি। সবকিছু পরিষ্কার। সাগরের গভীর নীলের উপরে মিসরের হালকা নীল উত্তর উপকূল দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার সাগরে সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করার সুবিধার্থে জাহাজগুলোর পেছনের গলুইয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে আগের মাঝি চেঁচিয়ে বললো, এই রশিতে তল পাওয়া যাচ্ছে না!

আমার গভীর সাগরে ক্রিটের দিকে চলেছি। আমি আমার পছন্দের জায়গা মাস্তুলের ডগায় অবস্থান নিয়েছি। জারাস পাহারাদারকে ছুটি দিল। দাঁড়িরা বৈঠা তুলে রেখে ডেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। পেছন দিক থেকে আসা বাতাসে পালগুলো ফুলে রয়েছে।

হঠাৎ আমার দেহ-মনে ভীষণ ক্লান্তি ভর করলো। কঠিন লড়াই আর তারপর জারাসের সাথে মুখোমুখি হওয়াটা আমাকে নিঃশেষিত করে দিয়েছে। একবার ভাবলাম নিচে নেমে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ি। তবে পেছন থেকে আমার প্রিয় মিসরের স্মৃতিসুরভিত উষ্ণ হাওয়া বয়ে আসছিল। মূল মাস্তুলের দোলানিতে আমার ঘুম পাচ্ছিল। জিন উপসাগরের যুদ্ধে শরীরের ক্ষতগুলোর কারণে ব্যথা অনুভব করছিলাম। মনে হল কেবিন অনেক দূরে। মাস্তুলে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কোমরের চারদিকে শক্ত করে মাস্তুলের সাথে দড়ি বাঁধলাম। তারপর চোখ বুজে চিবুক বুকে ঠেকালাম।

এরপর ঘুম ভাঙতেই দেখলাম চাঁদ আকাশের মাঝখানে আর সাগরের বুকে এর প্রতিচ্ছায়া ঢেউয়ের উপর একটি চকচকে রূপালি পথ তৈরি করে আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। আফ্রিকার গন্ধের বদলে এখন সাগরের লোনা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জাহাজের নিচে পানির শব্দ, মাস্তুলের গোড়ায় কাঁচকোচ আর বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

হঠাৎ সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে আমি আবার সতেজ আর সতর্ক হয়ে উঠলাম। মনে এমন আজব অনুভূতি হল যাতে আমি বুঝতে পারলাম দেবী ইনানা কাছেই এসেছেন। আগ্রহভরে তাকিয়ে দেখলাম তিনি চাঁদের প্রতিফলনে সৃষ্ট রূপালি পথ ধরে শূন্যে ভাসতে ভাসতে জাহাজের দিকে আসছেন। মুখের আবরণ নেই আর চাঁদের আলো তার মুখে খেলা করছে। তাকে দেখতে অপূর্ব লাগছিল।

জাহাজের কাছে এসে তিনি সাগরের বুক থেকে ডেকে উঠে আমার দিকে তাকালেন।

তার মুখের ভাব পরিবর্তিত হতেই আমারও মেজাজ বদলে গেল। হঠাৎ আমার মনে আতঙ্ক ভর করলো। আমি বুঝলাম তিনি আমার বিজয়ে অভিনন্দন জানাতে আসেন নি।

কথা না বললেও আমি আমার তার কণ্ঠস্বরের মসৃণ কোমল প্রতিধ্বনি আমার মস্তিষ্কে শুনতে পেলাম।

দেবতা রুষ্ট হয়েছেন। ক্রোনাস চরম বলি দাবি করছেন।

আমি বলতে চেষ্টা করলাম, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কথাগুলো গলায় আটকে গেল।

তিনি নিঃশব্দে বললেন, ওদের কাছে যাও। ওরা বিপদের মধ্যে রয়েছে। এবার বাতাসের শব্দের উপর দিয়ে সাবধান বাণীটি পরিষ্কার শুনতে পেলাম।

চেষ্টা করলাম তার কাছে যেতে, কিন্তু নড়াচড়া করতে পারলাম না। আমি চাচ্ছিলাম তিনি তার হেঁয়ালিমূলক বার্তাটি ব্যাখ্যা করুন, কিন্তু কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হল না।

তারপর গভীর ঘুমের ছায়া আমাকে আচ্ছন্ন করলো আর তিনিও চলে গেলেন। অন্ধকারে আমি চিৎকার করে বলতে চেষ্টা করলাম, ইনানা যেও না। আমার জন্য অপেক্ষা করো! তোমার কথা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু অন্ধকার আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।

পরের বার কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বুঝতে পারিনি, তবে চোখ মেলতেই দেখলাম ভোর হয়ে এসেছে।

নিচে তাকিয়ে দেখলাম ডেকে কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রথম দাঁড়িরা দাঁড়ি বেঞ্চে তাদের জায়গায় নামছে।

কোমরে বাঁধা রশিটা খুলে মাস্তুল থেকে নিচে উপরের ডেকে পা দিতেই জারাস হাসিমুখে আমার কাছে এসে বললো, প্রভু, আপনি আবার মাস্তুলে দড়ি বেঁধে ঘুমিয়েছেন, তাই না? কেবিনে আরাম পান না? তারপর আমার চেহারা দেখে তার মুখের হাসি মুছে গেল। সে বললো, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?

আমি নির্দেশ দিলাম, এখুনি সমস্ত রথের গাড়ি পানিতে ফেলে দাও। ঘোড়াগুলো অন্য জাহাজে নেবার ব্যবস্থা কর।

সে আড়ষ্ট হয়ে বললো, কেন তায়তা?

প্রশ্ন করো না। তোমার সাথে তর্ক করার সময় নেই আমার। অধৈৰ্য্য হয়ে তার কাঁধ ধরে জোরে কঁকি মেরে বললাম, প্রত্যেক জাহাজ থেকে একদল করে দাঁড়ি নাও। আমি প্রতি ঘন্টায় দাঁড়ি বদল করতে চাই।

প্রত্যেক ঘন্টায়?

আমি ক্রিমাদ পর্যন্ত সারা পথ আক্রমণের গতিতে যেতে চাই।

সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আক্রমণের গতি?

আমি তাকে ধমকে উঠলাম, একই কথা বার বার বলো না, জারাস। আমি পাঁচ দিনের মধ্যে কিংবা আরও আগে ক্রিমাদ গেঁছাতে চাই।

সে প্রতিবাদ করে বললো, আপনি আমার লোকদের মেরে ফেলবেন।

রাজকুমারীদের বদলে ওরা মরলে বরং ভালো।

সে আমার দিকে ভয়াকুল চোখে তাকিয়ে বললো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

দুই রাজকুমারী চরম বিপদে আছেন। হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে প্রত্যেকটি ঘন্টা আমরা হারাববা আর ওরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।

সে ঘুরে তার সহকারীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, সমস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনদের আসার বার্তা জানিয়ে পতাকা তোলো।

অন্যান্য জাহাজগুলো আমাদের জাহাজের দুইপাশে দুটি করে এসে ভিড়লো। ওরা প্রত্যেকে পাঁচদিনের পানি আর রসদসহ তাদের সেরা বিশজন দাঁড়িকে আমাদের জাহাজে তুলে দিল। এর বদলে আমরা আমাদের নাবিকদের মধ্য থেকে ক্রীতদাস আর দুর্বল লোকগুলোকে তাদের জাহাজে পাঠিয়ে দিলাম।

মাল তোলার কপিকলে তুলে সমস্ত ঘোড়া অন্যান্য জাহাজে তুলে দিলাম। একইভাবে রথের গাড়িগুলোও উপরে উঠিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম। জাহাজটিকে আমি যতদূর সম্ভব হালকা করতে চেয়েছিলাম। ক্রিটে পাঁচ দিনে পৌঁছানো কম কথা নয়।

হুই তার জাহাজ নিয়ে আমাদের জাহাজের কাছে ভিড়তেই জারাস তাকে একপাশে নিয়ে তার সাথে কথা বললো। কথা না শুনলেও ওদের ঠোঁটনড়া থেকে বুঝতে পারলাম। হুই ঘুরে দৃঢ়সংকল্পিত চেহারা নিয়ে আমার কাছে এল।

সে কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ভালো হয়েছে হুই। একজন ভালো লোকের হাতে তোমার জাহাজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে এখানে চলে এসো। তবে মনে রেখো তোমাকেও কিন্তু দাঁড় বাইতে হবে।

সমস্ত লোকজন জাহাজে উঠে আসার পর দাঁড়িদের প্রথম দলটি তাদের জায়গা নিতেই ঢাকিরা দ্রুত লয়ে ঢাক পেটাতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনিটে দশবার দাঁড় বাওয়ার গতি অর্জন করলো।

আমাদের জাহাজে যেন ডানা গজিয়েছে আর আমরা পানির উপর দিয়ে উড়ে চললাম। এক ঘন্টার মধ্যেই বহরের বাকি জাহাজগুলোকে দিগন্তের নিচে ফেলে এলাম।

দাঁড়িদের দল বদল করার পর প্রথম দলের ঘর্মাক্ত ক্লান্ত লোকগুলো হাঁপাতে লাগলো। পরবর্তী তিনদিন আর রাত আমরা একবারও গতি কমালাম না।

জারাস আর হুই নিয়মিত দাঁড় বাইল আর আমিও প্রতি বারো ঘন্টায় এক ঘন্টা করে দাঁড় বাইলাম। ইনানার সাবধান বাণীটি বার বার মনে পড়লো।

ওদের কাছে যাও। ওরা মারাত্মক বিপদের মুখে পড়েছে।

***

৮. চতুর্থদিন বিকেলবেলা

চতুর্থদিন বিকেলবেলা আমি মাত্র দাঁড় বাওয়া সেরে ঘামতে ঘামতে উপরে ডেকে গিয়ে জাহাজের সামনে সাগরের দিকে তাকালাম।

দ্বীপের তটরেখা না দেখা পর্যন্ত আমি হিসেব করে বুঝতে পারছিলাম আর কত দূর যেতে হবে। এমনকি নিশ্চিতও নই যে আমরা সঠিক পথে রয়েছি। পথ দেখাবার ভার আমি ইনানার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। যাইহোক সামনে সাগর এখনও শূন্য আর দিগন্ত রেখায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

বাতাস নেই। আকাশে মেঘও নেই। পরিবেশ থমথমে আর ভারী হয়ে রয়েছে। সামান্য কটু গন্ধকের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে, আমার গলা শুকিয়ে গেল। একবার কেশে জাহাজের পাশ দিয়ে পানিতে থুথু ফেললাম। জাহাজ ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু নড়ছে না।

জিন উপসাগর ছেড়ে আসার পর একবারও ভালো ঘুম হয়নি, তাই ভাবলাম নিচে কেবিনে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই। ঘুরতে যাবো এমন সময় সামনে দিগন্তে কিছু একটা আমার চোখে পড়লো। সরু কালো একটি রেখা। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম একঝাঁক পাখি আমাদের দিকে উড়ে আসছে। পাখি আমার খুব পছন্দ, তবে কাছে আসা পর্যন্ত এগুলো চিনতে পারলাম না। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম এগুলো সাধারণ কাক। ক্রিট দ্বীপের কাক সাধারণত একা কিংবা যুগলে থাকে। এছাড়া কাক সবসময় ডাঙার কাছে থাকে। এসব কারণেই দূর থেকে এদেরকে চিনতে পারিনি। কয়েকশো কাকের একটি ঝক। এরা সবচেয়ে কাছের ডাঙা থেকে কমপক্ষে একশো লিগ কিংবা তার চেয়েও বেশি দূরে রয়েছে। আমি ওদেরকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। কাকগুলো অনবরত একে অন্যের সাথে কা কা করছে যেন কোনো দুর্গত কিংবা সাবধান বার্তা দিচ্ছে।

এগুলো চলে যাবার পর আবার উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখলাম আরও পাখি উড়ে আসছে। এই আঁকে কাক ছাড়া অন্য পাখিও রয়েছে। সারস, বক, ছোট বাজপাখি, ঈগল আর অন্যান্য পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। এরপর এল ছোট ছোট রবিন, চড়ুই, ভরতপাখি, কবুতর আর কলিকার পাখি। আকাশ পাখিতে ভরে রয়েছে। সূর্য প্রায় ঢাকা পড়েছে। পাখির ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। একসাথে এতো পাখির চলে যাবার মধ্যে একটা মরিয়াভাব অনুভূত হচ্ছিল।

আকাশ থেকে একটা ছোট হলুদ ক্যানারি পাখি আমার কাঁধের উপর পড়লো। স্পষ্টতই এটি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমি পাখিটিকে হাতে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। এর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল।

আবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম আরও পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। হুই আর জারাস আমার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর দুজনেই মাথা পেছনে হেলিয়ে উপরে তাকিয়ে রইল।

হুই জিজ্ঞেস করলো, কী হচ্ছে তায়তা?

মনে হচ্ছে বিপুল সংখ্যায় পাখি দেশান্তরী হচ্ছে। তবে এর আগে এরকম কখনও দেখিনি।

হুই বললো, মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোনো কিছু থেকে ওরা পালাচ্ছে।

জারাস একমত হয়ে বললো, বন্য পশুপাখি বিপদ আসার আগেই টের পায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তাই না তায়তা? আমি তার প্রশ্ন উপেক্ষা করলাম, এজন্য নয় যে উত্তরটা আমি জানি না বরং সেই মুহূর্তে জাহাজের কাঠামোর সাথে ভারী কোনো দেহ ধাক্কা খাওয়ার কারণে পানি ছলকে উঠলো।

আমি এক পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সাগরের উপরিভাগ জ্যান্ত হয়ে ফুটছে। চকচকে দেহ নিয়ে বিশাল প্রাণী জাহাজের নিচে দেখা যাচ্ছে। পাখিরা যে পথে যাচ্ছিল একই পথে একঝাক টুনা মাছও যাচ্ছে। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম উত্তর দিগন্ত পর্যন্ত মাছের ঝাঁক ছড়িয়ে রয়েছে।

তাদের রূপালি দেহগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের সাথে অন্যান্য সাগরের প্রাণীও দেখা যাচ্ছে। ধারাল ডানাসহ চকচকে কালো শুশুকের দলও পানির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের সমান লম্বা তিমি পানির উপরে উঠে শ্বাস নেওয়ার সময় বাষ্পের মেঘ উপরে ছুঁড়ছে। বাঘের মতো ডোরাকাটা দেহবিশিষ্ট হাঙ্গরও ধারাল দাঁত বের করে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে।

মনে হল উত্তর দিগন্তের ওপারে ভয়ঙ্কর কোনো প্রলয়কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে, আর তাই সমস্ত প্রাণী ভয় পেয়ে পালাচ্ছে।

কয়েকঘন্টা পর উড়ন্ত আর সাঁতার কেটে চলা এই বিপুল প্রাণীর সংখ্যা কমতে কমতে একসময় আর দেখা গেল না।

.

রাত ঘনাতেই তারার আলোয় পথ দেখে চলতে লাগলাম। পরদিন ভোরে সূর্য উঠার পর দেখলাম আকাশ আর সাগরে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। সবকিছু নীরব নির্জন, থমথমে হয়ে রয়েছে।

কেবল দাঁড় বাওয়ার শব্দ, জাহাজের গায়ে পানির ছলকে ওঠার শব্দ আর দাঁড় বাওয়ার তালে তালে ঢাক পেটাবার ধুম ধুম শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। লোকজন কেউ কথা বলছে না কিংবা হাসছে না।

এমনকি আমার কাঁধের উপরের হলুদ ক্যানারি পাখিটিও নিশ্চুপ হয়ে একসময় দুপুরের দিকে টুপ করে ডেকে পড়ে গেল। আমি তুলে দেখলাম পাখিটা মরে গেছে। মরা পাখিটি সাগরের পানিতে পাখির দেবী আর্টেমিসের হাতে তুলে দিলাম। তারপর মাস্তুলের ডগায় আমার অবস্থানে উঠে পড়লাম।

দিগন্তের চারদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে দেখলাম সব শূন্য, কিছুই নেই। এক ঘন্টা বসে থাকলাম, তারপর আরও এক ঘন্টা বসে আশা নিয়ে দেখতে থাকলাম।

কড়া রোদে চোখ ব্যথা করছিল। আর কিছুক্ষণ পর চোখে ভূতুড়ে জাহাজ আর কাল্পনিক দ্বীপ দেখতে শুরু করলাম। চোখ বুজে চোখকে বিশ্রাম দিলাম।

যখন আবার চোখ মেলে তাকালাম, তখন অবাক হয়ে দেখলাম আমার মতিভ্রম আরও বেড়ে গেছে। আমাদের জাহাজের সামনে দিগন্তরেখা পর্বতমালার মতো আকাশের দিকে উঠছে। প্রতি মুহূর্তে এই সামুদ্রিক আল্পস পর্বতমালা উঁচু হয়ে আরও ভীতিকর হচ্ছে। চূড়ায় সদ্য পড়া তুষারের মতো সাদা ফেনা দেখা যাচ্ছে।

তারপর নিচে থেকে লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জারাস, হুই আর অন্যান্য কর্মকর্তারা দ্রুত জাহাজের সামনের গলুইয়ের দিকে ছুটছে। ওরা সেখানে সমবেত হয়ে সামনের দিকে আঙুল নির্দেশ করে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করছে। উপরের ডেকের দাঁড়িরা দাঁড় বাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে রয়েছে। জাহাজরে গতি ধীর হয়ে প্রায় থেমে এসেছে।

আমি দ্রুত মাস্তুল বেয়ে ডেকে নেমে সামনের দিকে ছুটে চললাম। লোকজনদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলাম যার যার অবস্থান নিয়ে জাহাজের দিক সঠিক পথে রাখতে।

সামনের দিক থেকে জারাস আর অন্যান্য কর্মকর্তারা আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকাল।

জারাস ছুটে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, এসব কী হচ্ছে? পৃথিবী কী উল্টে পড়ছে? তারপর কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বললো, সাগরতো ফুলে উঠে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে।

আমি কণ্ঠস্বর যতদূর সম্ভব শান্ত রেখে বললাম, এটা একটা ঢেউ।

সে প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে বললো, এটা খুব বড়। এতো দ্রুত আসছে যে এটাকে শুধু ঢেউ বলা যাবে না।

আমি নিশ্চিত হয়ে বললাম, এটা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। একই রকম জলোচ্ছ্বাস যা প্রাচীন কালের আটলান্টিস সাম্রাজ্যকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।

সকল দেবতার দিব্যি। এর হাত থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় নেই?

জারাসের মতো মানুষ এতো সহজে লড়াই ছাড়া হার মানার কথা নয়। তাকে ধমকে বলে উঠলাম, সমস্ত লোকজনকে সাবধান হতে বল। আর অতিরিক্ত দাঁড় হাতের কাছে রাখতে বল। ঐ জলোচ্ছ্বাস যখন আঘাত হানবে তখন বেশ ক্ষতি হবে। দাঁড়গুলো ভেঙে যাবে। আমাদেরকে গতিপথ ঠিক রেখে জাহাজ চালিয়ে যেতে হবে। এক পাশ থেকে আঘাত হানলে একটা কাঠের গুঁড়ির মতো উল্টে ফেলবে। কাজেই সমস্ত খোল কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে মজবুতভাবে সুরক্ষিত করো। পানিতে ভেসে থাকার জন্য দাঁড়ি বেঞ্চে কিছু একটা ব্যবস্থা নাও যাতে দাঁড়িরা ভেসে না যায়।

আমার নির্দেশ মোতাবেক জারাস হুইকে নিয়ে কাজে লেগে পড়েলা। আমি আর তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করলাম না। ওদেরকে ওদের মতো কাজ করতে দিয়ে জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের এদিকে আসা লক্ষ্য করতে লাগলাম।

যতই এটা কাছে আসছে ততই উঁচু হয়ে মনে হচ্ছে আরও দ্রুত গতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কাটি সামলাবার প্রস্তুতি নেবার মতো যথেষ্ট সময়ও হাতে নেই।

প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজের সামনের গলুই এতো দ্রুত উপরের দিকে উঠলো যে, তাল সামলাতে না পেরে আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম। আমার পেট ফুসফুঁসে চাপ দিতেই আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরও আমরা উপরের দিকে উঠতেই থাকলাম। জাহাজের পেছনের গলুই নিচু হতেই ডেক বাঁকা হয়ে প্রায় খাড়া হয়ে গেল। আমি দুই হাতে জাহাজের কিনারা ধরে রাখলাম। ডেকের উপরের যেসব আলগা জিনিসপত্র ছিল সেগুলো গড়িয়ে নিচের দিকে চলে গেল।

এমন লণ্ডভণ্ড বিশৃঙ্খল অবস্থা সত্ত্বেও জারাস আর হুই শক্ত হাতে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ সামলাতে চেষ্টা করছিল। ওরা লোকজনদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিল।

বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে মাঝিমাল্লারা দাঁড় বাইতে বাইতে চিৎকার করে দেবতা আর তাদের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছিল।

যতই আমরা উঁচু হলাম জাহাজ ততই খাড়া হতে হতে ডেক প্রায় খাড়া হয়ে গেল আর দাঁড়গুলো আকাশের দিকে মুখ করে থাকলো।

এক মুহূর্তের জন্য আমি বিশাল ঢেউয়ের চূড়ার উপর দিয়ে সামনে তাকালাম। দেখলাম আমরা এতো উঁচুতে উঠেছি যে আমি দূর দিগন্তে ক্রিটদ্বীপের দক্ষিণ তীর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর এর উপরে দ্বীপের অন্য পাশে ক্রোনাস পর্বতের চূড়ার ফাটল দিয়ে ধুয়ার স্তম্ভ সগর্জনে উপরের দিকে উঠছে। হলুদ গন্ধকের মেঘ পাক খেতে খেতে উঠে উত্তর দিকের পুরো আকাশ ঢেকে ফেলেছে। তারপর ঢেউয়ের সাদা চূড়া আমাদের জাহাজের উপর আছড়ে পড়ে সবুজ পানিতে আমাদেরকে ভাসিয়ে দিল।

জীবন রক্ষার জন্য যে রশি সবার কোমরে বেঁধে রাখা হয়েছিল, প্রচণ্ড চাপে তার একটা ছিঁড়ে যেতেই চারজন নাবিক সাগরে ভেসে গেল। তারপর আর ওদের দেখা গেল না। বাকিরা কোনোমতে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। আমার কোমরে জড়ানো মোটা শনের রশিটা শক্ত করে কোমরে চেপে বসে আমাকে কেটে প্রায় দুইভাগ করে ফেলছিল। ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। বুঝতে পারলাম আমরা ডুবে যাচ্ছি।

তারপর হঠাৎ জলোচ্ছাসের ঢেউয়ের পেছনের ঢাল দিয়ে জাহাজের সামনের গলুই ভেসে উঠলো। আমি আবার পরিষ্কার বাতাস বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। মনে হল যেন আমরা অনন্তকালের পর মুক্ত হয়েছি। শুধু কোমরে বেঁধে রাখা রশির কারণে আমরা জাহাজ থেকে ছিটকে পড়া থেকে বেঁচে গেলাম।

তারপর আবার আমাদের জাহাজ সাগরের বুকে ধপাস করে পড়লো। প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে কাঠের তক্তা, বাল্কহেড আর কাঠামোর অন্যান্য অংশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। দাঁড়গুলো শুকনো কাঠির মতো ছিঁড়ে গেল।

আমি ভেবেছিলাম আমরা আবার গভীর পানিতে ডুবে যাব। তবে আমাদের ছোট্ট জাহাজটি এবার কাঁপতে কাঁপতে মুক্ত হল। আবার আমরা ভেসে উঠলাম, পুরো ডেক পানিতে ভেসে গেছে। ডেকের উপর মানুষ আর যন্ত্রপাতি একে অপরের উপর স্থূপীকৃত হয়ে রয়েছে।

জারাস আর হুই চিৎকার করে লোকজনদের যার যার অবস্থানে যেতে নির্দেশ দিল। কয়েকজন নাবিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, কয়েকজনের হাতপা ভেঙে গিয়েছিল আর অন্যান্যদের পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এদেরকে একপাশে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। অতিরিক্ত ভালো দাঁড়গুলো নিচে দাঁড়ি বেঞ্চে ক্ষতিগ্রস্ত দাঁড়ের জায়গায় বাঁধা হল। দাড়ীরা ভাঙা দাঁড়ের গোড়ার অংশগুলো ছুঁড়ে ফেলে নূতন দাঁড় নিয়ে বাওয়া শুরু করলো।

তারপর আমরা পাগলের মত পানি সেচতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে জাহাজের উচ্চতা বেড়ে জাহাজ আবার পানির উপর হালকা হল। ঢাকিরা আবার ঢাক পেটাতে শুরু করলো। দাঁড়ীরা আবার তাদের আসনে বসে দাঁড় টানতে শুরু করলো। আমরা আবার ক্রিটের দিকে চললাম। এই নিচু অবস্থান থেকে এখন ক্রিটের তটরেখা আবার দিগন্তের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে এখন ক্রোনাস পর্বত থেকে নিঃসৃত আগ্নেয়গিরির ধূঁয়া আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।

দুপুরের একটু পর বাতাস জোরে বইতে শুরু করলো। নাবিকেরা মাস্তুল খাঁটিয়ে সমস্ত পাল খাটাল। এবার চলার গতি দ্বিগুণ হল। জলোচ্ছাসের পর পানিতে ভাঙা গাছের ডালপালা, আর সামনের দ্বীপ থেকে বিধ্বস্ত জাহাজ এবং দালানকোঠার ভাসমান ভাঙা টুকরা ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা এর মধ্য দিয়েই সাবধানে পথ করে নিয়ে এগিয়ে চললাম।

দুইঘন্টা পর আবার ক্রিট দ্বীপ নজরে এলো। এর উপরে আকাশ পর্যন্ত উঁচু আগ্নেয়গিরির ধুয়ার স্তম্ভের তুলনায় এটাকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন মনে হচ্ছিল। এখন উন্মাদ ক্রোনাস দেবতার গুড় গুড় গম্ভীর গর্জন আমাদের উপরও এসে পড়ছে। এতো দূর থেকেও গর্জন ঠিকই শোনা যাচ্ছিল। আর দেবতার তাণ্ডবের তালে তালে সাগরের পানিও নাচছিল।

দাঁড়ীরা ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দাঁড় টানছিল। অন্যান্য নাবিকরা ডেকে গা ঘেঁসাঘেসি করে বসে আহত আর মৃতপ্রায়দের সেবা করতে লাগলো। আতঙ্কে সবার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তারপরও আমি ক্রিটের দিকে ওদেরকে যেতে বাধ্য করছিলাম। যখন মনে হল ওরা বিদ্রোহ করে বসতে পারে, তখন জারাস আর হুই চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে রইল।

ডাঙার কাছাকাছি হতেই জলোচ্ছাসের তাণ্ডবলীলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ক্রিমাদ বন্দরের কাছে পৌঁছে চিনতেই পারছিলাম না। কেবল পেছনে ইডা পাহাড়ের চূড়া দেখে বুঝা গেল এটা ক্রিমাদ বন্দর।

প্রচণ্ড ঢেউ এসে সমস্ত দালানকোঠা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমনকি পোতাশয় রক্ষা করা বাঁধের ভারী পাথরখণ্ডগুলোও বাচ্চাদের খেলার ব্লকের মতো সাগরে ভেঙে পড়েছে।

পর্বতের পাদদেশ জুড়ে যেসব বন আর কৃষি ভূমি ছিল, সেগুলো সব রিক্ত হয়ে গেছে। বড় বড় গাছ, দালানের ধ্বংসাবশেষ আর বিশাল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ একসাথে মিশে জঞ্জালের মতো স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে।

সবচেয়ে খারাপ লাগলো, যখন দেখলাম আস্তাবলটা নেই। সহিস আর ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই ঢেউয়ের তোড়ে সাগরে ভেসে গেছে। রাজকুমারীরা দ্বীপের অন্যপাশে রয়েছে। ঘোড়া ছাড়া এই জট পাকানো জঙ্গলের ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ওদের কাছে পৌঁছাতে অনেকদিন লেগে যাবে।

বড় জোর এটুকু আশা করা যায়, দ্বীপের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত যে কয়েকটি রসদ সরবরাহ চৌকি করেছিলাম সেগুলো হয়তো অনেক উঁচুতে অবস্থানের কারণে জলোচ্ছাসের ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। হয়তো কয়েকটা ঘোড়াও বেঁচে থাকতে পারে।

ক্রিমাদ বন্দরের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটু দূরে গভীর সমুদ্রে আমরা জাহাজের নোঙর ফেললাম। তারপর জারাস আর হুইকে ডেকে বললাম, পর্বতের উপরে প্রতিটি রসদ সরবরাহ ঘাটির আস্তাবলে দশ থেকে বিশটা ঘোড়া থাকার কথা। যদি এখনও বেঁচে থাকে। তোমরা ত্রিশজন ভালো লোক। বেছে নিয়ে আমার সাথে তীরে চল। ওরা কেবল অস্ত্র নেবে কোনো বর্ম নয়। এতো ভার ঘোড়া নিতে পারবে না।

আমাদের দলটি তৈরি হওয়ার পর যে কয়েকটা ডিঙি প্রবল জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়েছিল সেগুলো পানিতে ভাসালাম। এতো লোকের ভারে ডিঙিগুলো বিপজ্জনকভাবে দুলে উঠলো।

ঢেউয়ের ধাক্কায় পানি ছলকে নৌকার গলুইয়ের দুই পাশ দিয়ে উঠতেই আমি নিরবে ইনানার প্রতি প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। দেবীকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, আমি কেবল তার নির্দেশ অনুসরণ করছি এবং তিনি নিশ্চয়ই তা শুনেছেন। পোতাশ্রয় রক্ষা বাঁধের কাছে পৌঁছার আগে কেবল তিনজন লোক নৌকা থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন কোনোমতে সাঁতার কেটে জাহাজে ফিরে যেতে পেরেছিল।

পাথরের গায়ে জোরে ধাক্কা লাগতেই ডিঙিগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তবে আমরা হাত ধরাধরি করে নিজেদের সামলে পোতাশ্রয় রক্ষা বাঁধে উঠলাম। আর কোনো ক্ষতি ছাড়াই শক্ত মাটিতে পা রাখলাম।

তারপর জারাস সমস্ত লোকজনকে দুই সারীতে বিভক্ত করার পর আমি ওদেরকে পানিতে ডুবে যাওয়া নগরীর ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাম। জঞ্জালের নিচে অর্ধেক দেহ মাটিচাপা পড়া ফুলে উঠা কয়েকটি লাশ ছাড়া শহর সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। এরপর আমরা পর্বতের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। এই স্থানটিও প্লাবিত হয়েছিল। আমি প্রথম সরবরাহ চৌকির দিকে যাওয়ার পথটি খুঁজতে শুরু করলাম। সমস্ত চিহ্ন ধুয়েমুছে গেছে। হয়তো কখনও তা খুঁজে পেতাম না যদি শিকারীর শিঙা ফুকার শব্দ না শুনতাম। সরবরাহ দলের তিনজন সদস্য উঁচু জায়গা থেকে আমাদেরকে দেখতে পেয়ে নিচে নেমে এলো।

ওরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, আমাদেরকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ভেবেছিল যে আমরা ওদের উদ্ধার করতে এসেছি। তবে বেশ হতাশ হল যখন বুঝতে পারলো আসলে তা নয় বিষয়টি। আমি সকলকে সরবরাহ চৌকির দিকে দৌড়ে উঠতে বললাম। পাগল ক্রোনাস দেবতার মেজাজের সাথে তাল রেখে পায়ের নিচে মাটি থরথর করে কেঁপে উঠছিল।

প্রথম চৌকিতে পৌঁছে ছয়জন লোক আর বিশটি ঘোড়া পেলাম। এরা কোনোভাবে তাণ্ডব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিল। নিচে মাটি কাঁপার কারণে ঘোড়াগুলো আতঙ্কে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। গন্ধক পোড়া গন্ধ শুঁকে ঘোড়াগুলোর নাসারন্ধ্র ফুলে উঠছিল। অনেক চেষ্টার পর ঘোড়াগুলোকে শান্ত করলাম।

কিছুক্ষণ থেমে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নিলাম। নিশ্চিন্ত হলাম দেখে যে আমার বাঁকা ধনুকটি মোমলাগান চামড়ার বাক্সে তখনও শুকনো রয়েছে। তবে ধনুকের অতিরিক্ত ছিলাগুলোর অবস্থা দেখে মনঃপুত হল না। কাজেই চৌকির অধিনায়কের কাছ থেকে তার আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু ধনুকের ছিলা নিলাম। তারপর ওদেরকে নির্দেশ দিলাম, কোনো কারণে আমরা যদি ফিরে আসতে বাধ্য হই তখন আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য ওরা যেন এখানেই অবস্থান করে।

তারপর আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে জারাস আর হুইকে ঘোড়ায় চড়তে নির্দেশ দিয়ে পথ দেখিয়ে আমাদের ছোট দলটিকে ইডা পর্বতের উপরের পথের দিকে এগিয়ে চললাম।

চূড়ায় পৌঁছাবার একটু আগে সামনের পথ থেকে ছুটে আসা একদল বন্য পশুর খুরের প্রচণ্ড বজ্রধ্বনির মতো শব্দ আর গর্জন শুনতে পেলাম। সাথে সাথে আমার দলের লোকদেরকে নিয়ে পথের পাশে ঘন গাছের মাঝে লুকালাম। একটু পরই একদল দানবাকৃতির পশু আমাদের পাশ কাটিয়ে নিচের দিকে গেল।

অবশ্য সাথে সাথে পশুগুলোকে চিনতে পারলাম। এগুলো ছিল একপাল বন্য উরুস ষাঁড়। রক্তের মতো জ্বলজ্বলে লাল চোখ নিয়ে এগুলো আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল। পিঠে কুজ। পিঠের চামড়া কালো আর গাঢ় বাদামি রংয়ের লম্বা দাগ। হা করা মুখ থেকে জিহ্বা বের হয়ে রয়েছে আর সেখান থেকে ফেনিল লালা ঝরছিল। পশুগুলো আতঙ্কিত হয়ে পর্বতের চূড়ার পাশের পথ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল।

ঠিক এসময়ে আরেকবার ভূকম্পনে আমাদের নিচে পর্বত আবার কেঁপে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম যেপথে বন্য ষাঁড়গুলো ছুটছিল সেদিকে পর্বতের চূড়ার কিনারায় একটি গভীর ফাটল দেখা দিয়েছে। পর্বতের ঢালটি এতো খাড়া ছিল আর পশুর পালটি এতো দ্রুত ছুটছিল যে তাল সামলাতে না পেরে পশুগুলো নিচের দিকে পতন সামলাতে পারলো না। সম্পূর্ণ পশুর পালটি চূড়ার উপর থেকে নিচে পড়ে গেল। পেছনেরগুলো সামনেরগুলোকে ঠেলতেই সমস্ত পশু শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কয়েকশো ফুট নিচে পাথরের উপর বিশাল দেহগুলো আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর সব নীরব হয়ে গেল, তারপর আবার নীরবতা ভঙ্গ হল আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ড গর্জনে।

আমরা আবার সবাই পথে নেমে শেষ খাড়া ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠলাম। এখানে একটু থামলাম। পেছন ফিরে বিধ্বস্ত ক্রিমাদ বন্দর থেকে একটু দূরে নোঙর করা আমাদের জাহাজের ক্ষুদ্র আকৃতিটি দেখলাম। তারপর আবার ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বসে সামনের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকালাম, যা ছিল এককালে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজধানী, কুমুসস।

বিশাল বন্দরটি আর নেই। বাতিঘরেরও চিহ্ন নেই। সম্ভবত বন্দরের অববাহিকায় ডুবে গেছে। বন্দরের দেয়ালগুলো ভিত্তিসহ পানিতে ভেসে গেছে। কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সাগরের পানি পাথরের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে, যেখানে একসময় এক বিশাল নগরী দাঁড়িয়েছিল।

সর্বাধিরাজ মিনোজ তার নৌবহরের যে দশ হাজার জাহাজের জন্য দম্ভ করতেন, সেগুলো সব জোয়ার রেখার উপর দিয়ে আছড়ে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পুরো উপসাগরের বুকে ভেসে থাকা একটি জাহাজেরও চিহ্ন নেই। বিধ্বস্ত জাহাজের ভাসমান জঞ্জালে পানি সয়লাব হয়ে রয়েছে। যে প্রাসাদে সর্বাধিরাজ মিনোজ আমার রাজকুমারীদের বিয়ে করেছিলেন সেটিও আর নেই। এছাড়া নৌসদর দপ্তর থেকে শুরু করে সৈকত জুড়ে যে সুরম্য অট্টালিকাগুলো ছিল সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝে জমজ আগ্নেয়গিরি প্রচণ্ড গর্জনের সাথে অগ্নিশিখা আর ধূঁয়া উদ্‌গিরণ করে আকাশ ঢেকে ফেললো।

আমি অবিশ্বাসের চোখে সামনের ধ্বংসলীলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিনোয়ান সাম্রাজ্যের চিহ্ন নেই। এর নিজের উন্মাদ দেবতা সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।

কিন্তু আমার মেয়েরা কোথায়? আমার বুকের ভেতরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হল। কেন তুমি আমাকে এখানে পাঠালে ইনানা? এটা কি শুধু আমার সাথে মজা করার জন্য আর আমাকে কষ্ট দেবার জন্য করেছ?

তারপর হঠাৎ চোখে পড়লো, যেখানে আমার ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক তার নিচে পাহাড়ের পাদদেশে মিসরীয় দুতাবাস ভবনটির দিকে। কিছুদিনের জন্য হলেও এটা আমার বাড়ি ছিল। ভবনটি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। এতো উঁচুতে জোয়ারের ঢেউ পৌঁছাতে পারেনি। দ্বীপের উত্তর ঢালে একমাত্র এই ভবনটি টিকে রয়েছে।

জারাস আর হুইকে চেঁচিয়ে ডাকলাম, আমার পেছন পেছন এসো। ঘোড়ার পাঁজরে পা দিয়ে তো দিতেই ঘোড়া সামনের দিকে চলতে শুরু করলো। পর্বতের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নামা শুরু করতেই আরেকবার ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়া থেকে প্রচণ্ড কম্পন শুরু হল। আমার ঘোড়াটি আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। আমি তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। তবে রেকাবের দুইপাশে ঝুলে থাকা লোক দুইজন ভারসাম্য হারিয়ে বিপজ্জনকভাবে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ঘোড়াটিকে শান্ত করা পর্যন্ত ওরা অতিকষ্টে নিজেরদেরকে ধরে রাখলো। তারপর আবার আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।

দূতাবাস প্রাঙ্গণ দেখে মনে হল জনশূন্য। দ্রুত মূল ফটকের সামনে পৌঁছেই লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলাম।

জারাস আর হুই, তোমরা দুজনে পেছনের আস্তাবলে গিয়ে খুঁজে দেখো কোনো ঘোড়া পাও কি না। মেয়েদেরকে খুঁজে পেলে ক্রিমাদ ফিরে যেতে আরও ঘোড়া প্রয়োজন হবে। কোনোমতেই হতাশার কাছে হার মানবো না। আমার রাজকুমারীরা জীবিত না থাকলে ইনানা কখনও আমাকে এখানে ডেকে আনতেন না।

দূতাবাসের দরজা হাট করে খোলা রয়েছে। আমি এক ছুটে ভেতরে ঢুকে জীবিত কেউ আছে কি না জানতে হাঁকডাক শুরু করলাম। তবে কেবল প্রতিধ্বনি আমাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। সমস্ত কামরা শূন্য তবে বেশির ভাগই লুট করা হয়েছে। জিনিসপত্র চারপাশে ছড়ানো ছিটানো। চাকরবাকর আর নগরী থেকে আসা আশ্রিতরা যা পেয়েছে লুট করে নিয়ে পালিয়েছে।

ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কোন দিকে ঘুরবো। হতাশাবোধ আমাকে প্রায় গ্রাস করার উপক্রম হয়েছে। মন শক্ত করে দেবীর কাছে জোরে জোরে প্রার্থনা করতে লাগলাম, ইনানা! ওরা কোথায়? এখন তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। মিনতি করছি আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চল।

সাথে সাথে আমার ডাকে সাড়া পাওয়া গেল। ভবনের উপরতলা থেকে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত্ব হল। প্রভু তায়তা তুমি? সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর সে চিৎকার করে বলে উঠলো, আমি মনে করেছিলাম লুটপাট করতে আরও লুটেরা দস্যুদল এসেছে। আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা মূর্তিটি সিঁড়ির শেষ ধাপগুলো ছুটে পার হয়ে আমার দুইহাতের মাঝে আঁপিয়ে পড়লো। আমি দুই হাতে তার মুখ ধরে উপরে তুললাম। তারপর এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, লক্সিয়াস, তুমি এখানে কী করছো বাছা! আমি তোমাকে অন্য কেউ মনে করেছিলাম।

আমার প্রভু তোরান আমাকে এখানে পাঠিয়ে বলেছেন আপনার জন্য অপেক্ষা করতে। আমরা জানতাম আপনি অবশ্যই আসবেন। আপনাকে পথ দেখিয়ে ক্রোনাস পর্বতে দেবতার প্রধান মন্দিরে নিয়ে যেতে বলেছেন। সে একনাগাড়ে এতোদ্রুত কথাগুলো বলে গেল যে, সে কী বলছিল তা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলাম। তারপর বললাম, শান্ত হও বাছা! আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারিছ না। লম্বা একটা শ্বাস নাও। তারপর ধীরে ধীরে খুলে বলল কী ঘটেছে।

সর্বাধিরাজ মিনোজের নির্দেশে পুরোহিতরা তেহুতি আর বেকাথাকে প্রধান মন্দিরে নিয়ে গেছে। সেখানে ওরা ক্রোনাস দেবতাকে শান্ত করার জন্য তাদেরকে বলি দেবে, যাতে দেবতা খুশি হয়ে অগ্নিবর্ষণ করে আর গন্ধক ছুঁড়ে মিনোয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংস না করেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে দ্রুত বলে চললো, ঐ পুরোহিতরা ইতোমধ্যে সর্বাধিরাজ মিনোজের চল্লিশজন কুমারীবধূকে বলি দিয়েছে। তবে ক্রোনাস তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার দুর্বার ক্রোধ প্রশমিত করা যাচ্ছে না। তিনি চরম বলি দাবী করছেন: মিসরীয় ফারাও রাজপরিবারের রাজকুমারীদের বলি চাচ্ছেন।

তোরান কোথায়?

এই ভয়ঙ্কর কাজটি করা থেকে সর্বাধিরাজ মিনোজকে বিরত করতে আর আপনি আসা পর্যন্ত অন্তত বলি বিলম্বিত করার জন্য তিনি প্রধান মন্দিরে গেছেন। তিনি বলেছেন একমাত্র আপনিই তেহুতি আর বেকাথাকে বাঁচাতে পারেন। যেভাবেই হোক তিনি জানতেন আপনি অবশ্যই আসবেন। একজন আলখাল্লাপরা নারী স্বপ্নে তাকে সাবধান করেছিলেন

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি মন্দিরে যাওয়ার পথ চেনো?

সে বললো, হ্যাঁ, চিনি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তোরান আমাকে বলেছেন কীভাবে গোপন দরজাটা খুঁজে বের করে গোলকধাঁধার পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

আমি তার হাত ধরে দূতাবাসের সামনের ফটকের দিকে ছুটে চললাম। জারাস আর হুই তাদের লোকজনদের নিয়ে সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। জারাস ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে আমার কাছে এসে বলতে শুরু করলো, আপনি ওদেরকে খুঁজে পেয়েছেন? তারপর আলখাল্লাপরা লক্সিয়াসকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, রাজকুমারীরা কোথায়?

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। যেতে যেতে সবকিছু খুলে বলবো। লক্সিয়াস জানে কোথায় ওদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবে।

দূতাবাসের আস্তাবলে হুই আরও ছয়টি ঘোড়া খুঁজে পেয়েছিল। সবাই ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে চললাম। আমি লক্সিয়াসকে আমার পেছনে বসালাম। সে দুই হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো। চাবুক মেরে ঘোড়া ছুটালাম।

লক্সিয়াস পর্বতের পাশ দিয়ে দ্বীপের পশ্চিম দিকে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। দুই লিগ দূরত্ব যাওয়ার পর পথের একটি দুইমুখি বাঁক পেলাম। রাস্তার মূল রাস্তাটি সোজা চলে গেছে। আর অন্য শাখাঁটি ইডা পর্বতের চূড়ার দিকে উঠে গেছে। এই পথের চিহ্ন হিসেবে একটি বিশাল সিডার গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর উপরের ডালপালাগুলো গর্জনরত আগ্নেয়গিরির মেঘের দিকে উঠে গেছে।

লক্সিয়াস আমার কাঁধের পেছন থেকে বলে উঠলো, প্রভু তোরান বলেছেন এই গাছটির বয়স তিনহাজার বছর। তারপর আঙুল তুলে সামনে সিডার গাছের কাঠে পেরেক দিয়ে লটকানো একটি বিশাল বন্য সঁড়ের মাথার খুলি দেখিয়ে বললো, আর ঐ যে ওটি হচ্ছে ক্রোনাস দেবতার প্রতিক। এর শিংগুলো আমার ক্রীতদাস ওয়াগাকে যে ষাঁড়টি হত্যা করেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ। বহুবছর ধরে রোদে পুড়ে রং জ্বলে চকচকে সাদা হয়ে গেছে।

এসব নিয়ে ভেবে আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে আমরা লক্সিয়াসের দেখানো পথে উপরের দিকে এগিয়ে চললাম। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথটি উপরে উঠে গেছে। সংকীর্ণ পথটি দিয়ে পাশাপাশি কেবল দুটি ঘোড়া চলতে পারবে। তারপর হঠাৎ পথটি একটি উঁচু কালো পাথরের চূড়ার সামনে শেষ হল। চূড়ার পাদদেশে একটি বিশাল পিতলের দরজা দেখা গেল। দরজাটির ঠিক মাঝখানে একই ধাতুর একটি গোলাকার তালার চাকা রয়েছে।

লক্সিয়াস আমার পেছনে জিনের উপর থেকে একটা বিড়ালের মতো লাফ দিয়ে মাটিতে নামলো। তারপর এক দৌড়ে তালার চাকার কাছে গিয়ে চাকাটি ঘুরাতে শুরু করলো। জোরে জোরে গুণে সে একবার বামদিকে আরেকবার ডান দিকে এভাবে কয়েকবার চাকাটি ঘুরালো।

তার পেছনে আমি ঘোড়া থেকে নেমে আমার ধনুকে একটা নতুন শুকনো ছিলা পরিয়ে ছিলাটা টেনে ধরলাম। তারপর তৃণির থেকে একজোড়া তীর নিয়ে কোমরবন্ধে গুজলাম, যাতে দরকার মতো সাথে সাথে তুলে নিতে পারি। তৃতীয় আরেকটি তীর ধনুকে লাগিয়ে বাম হাতে ধনুকের মাথা ধরলাম। ডান হাত দিয়ে খাপ থেকে তলোয়ার বের করলাম। জারাস, হুই আর অন্যরা আমাকে অনুসরণ করে অস্ত্রহাতে নিয়ে প্রস্তুত হল।

লক্সিয়াস শেষ একবার চাকাটা ঘুরাতেই যন্ত্রটি থেকে জোরে ক্লিক শব্দ শোনা গেল। ঢাকনিটা টেনে খুলতে লক্সিয়াসকে সাহায্য করতে আমি জারাসকে ইশারা করলাম। তারপর একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ধনুক উঁচু করে জারাসের কাঁধের উপর দিয়ে লক্ষ স্থির করলাম।

ভারী দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। এর পেছনেই সবুজ পোশাক পরা হেরেমের দুইজন উগ্রচণ্ডা রক্ষী দাঁড়িয়ে রয়েছে। উভয়েই খোলা তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দরজা খোলার সাথে সাথে ওরা সামনে এগিয়ে জারাস আর লক্সিয়াসকে আক্রমণ করলো।

জারাস তৈরি ছিল, সে একজনকে তার বালকসুলভ নগ্ন বুকে তলোয়ার বিধিয়ে হত্যা করলো। আমি অন্যজনকে তীর ছুঁড়ে মারলাম। এতো কাছের লক্ষ্যে তীরটি তার বুকে ঢুকে পাঁজর ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হল। দুই নারী যোদ্ধাই টু শব্দ না করে মাটিতে ঢলে পড়লো। আমরা মৃতদেহের উপর দিয়ে পার হলাম। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে আমি আর জারাস সুরঙের মধ্য দিয়ে ছুটলাম। দুইপাশের দেয়ালে ব্র্যাকেটে লাগানো ধূঁয়া উঠা মশালের আলোয় সুড়ঙটি মৃদু আলোকিত হয়ে রয়েছে।

লক্সিয়াস আমার পেছন থেকে বলে উঠলো, তোরান বলেছেন প্রত্যেকবার বামদিকে ঘুরবেন আর নয়তো আমরা এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবো।

আমি পর পর তিনবার বামদিকে মোড় ঘুরলাম। তারপর সুরঙের সামনে থেকে মন্ত্র পরার মৃদু শব্দ প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে ভেসে এলো। সামনে এগোতেই শব্দটি বাড়তে লাগলো। আরেকবার বামে মোড় ঘুরতেই সামনে মৃদু আলোর আভাস চোখে পড়লো।

লক্সিয়াস আর অন্যদেরকে সাবধান করে সেখানেই দাঁড়াতে বললাম। তারপর দুইপাশে জারাস আর হুইকে নিয়ে আমি সামনে এগোলাম। আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তারপর শেষ বাকটি ঘুরলাম।

সেখানে আরও দুইজন নারী যোদ্ধা আমাদের দিকে পেছন ফিরে সুরঙের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের সম্পূর্ণ মনোযোগ সামনের দিকে থাকায় ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পেল না। আমরা নিঃশব্দে ওদের পেছনে এগিয়ে গেলাম, জারাস আর হুই দুই হাত দিয়ে ওদের মুখ চেপে ধরলো, ওরা কোনো শব্দ করতে পারলো না। তারপর দ্রুত একবার তরবারি ঝলসে উঠতেই মেয়েগুলোর দেহ মাটিতে ঢলে পড়লো। ওদের শরীরের উপর দিয়ে সামনে এগোতেই আমরা একটা ব্যালকনিতে এসে পৌঁছলাম। জীবন্ত আগ্নেগিরির গা কেটে ব্যালকনিটি তৈরি কর হয়েছে।

আমাদের বিশ কিউবিট কিংবা তার চেয়েও বেশি নিচে মস্ত ফাঁক হয়ে থাকা একটি বিশাল গুহামুখের মতো খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। এর সামনের দেয়ালে দুই পাশে স্তম্ভ বসানো একটি প্রবেশ পথ দিয়ে দিনের আলো ঢুকে জায়গাটি আলোকিত হয়েছে। প্রবেশ পথটির মধ্য দিয়ে আমরা বিধ্বস্ত ক্রোনাস নগরী আর দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়া দেখতে পেলাম।

আমাদের ঠিক নিচে একটি প্রশস্ত অর্ধ-বৃত্তাকার মল্লভূমি দেখা যাচ্ছে। এর মেঝে সুক্ষ সাদা বালু দিয়ে ঢাকা, এর উপরে একটি সোনা আর রূপার একটি বেদি রয়েছে। বেদিতে একটি বন্য ষাঁড়ের সোনালি মূর্তি দাঁড় করানো রয়েছে। ষাঁড়ের মূর্তিটি ফুল আর সুগন্ধি ধুপের পাত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে।

মল্লভূমি আর বেদির চারপাশ ঘিরে কয়েক স্তরে গ্যালারির মতো ধাপে ধাপে পাথরের আসন পাতা রয়েছে।

নিচের দুই ধাপের আসনে সারিবদ্ধভাবে বসে রয়েছে কালো পোশাক আর উঁচু টুপিপরা মিনোয়ান অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। তাদের মুখে চক-খড়ি চূর্ণ মেখে সাদা করা হয়েছে আর চোখের চারদিকে প্রথাগতভাবে কালো সুরমা মাখা। ওরা সবাই কোনো নড়াচড়া না করে একদৃষ্টিতে নিচে রঙ্গালয়ের শূন্য মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেবল এক সুরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় গাওয়া শোকসঙ্গীত উচ্চারণ করার সময় তাদের মুখ নড়ছিল।

মাত্র কয়েকজনকে দেখে আমি অবাক হলাম। তেহুতি আর বেকাথার সাথে মিনোজের বিয়ের সময় বন্দরের রাজপ্রাসাদে ওরা কয়েকহাজার ছিল। আর আজ এখানে পঞ্চাশ জনেরও কম দেখা যাচ্ছে। অগ্নৎপাত আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মিনোয়ান সমাজের ফুলের ভয়াবহ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে।

স্তব গেয়ে চলা লোকগুলোর পেছনের সারির আসনগুলো শূন্য পড়ে রয়েছে। গ্যালারির কেন্দ্রস্থলে একটি উঁচু সোনার সিংহাসন রয়েছে। এটিও শূন্য।

সিংহাসনের ঠিক পেছনে ভূগর্ভস্থ মন্দিরে ঢোকার সুরঙ্গ পথের মুখ দেখা যাচ্ছে। গুহার মতো মুখটি দিয়ে কুনুসস উপসাগরের ওপারে দূরে ক্রোনাস পর্বতের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। জমজ আগ্নেয়গিরি ধুয়ার কুণ্ডলি উদ্‌গিরণ করে আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে সূর্যকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে।

আমরা যে ব্যালকনিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসেছিলাম সেটি নিচের মল্লভূমির মেঝে থেকে এতো উঁচুতে ছিল যে, আমাদের দিকে মুখ করে বসা দর্শকরা আমাদের দেখতে পাচ্ছিল না। এছাড়া গুহার ছাদ থেকে বালুময় মেঝের একটু উপর পর্যন্ত ঝুলানো একটি গাঢ় রঙের পর্দার আড়ালে আমরা আংশিক ঢাকা পড়েছিলাম। তারপরও আমি, জারাস আর হুইকে সাবধান করে বললাম একটু পিছিয়ে ছায়ার মাঝে গিয়ে ওদের অস্ত্রগুলো কিছু একটা দিয়ে ঢেকে রাখতে যাতে এর উপর দিনের আলো প্রতিফলিত হয়ে মন্দিরে আমাদের উপস্থিতি ফাঁস না হয়ে যায়।

আমার কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই এই রঙ্গমঞ্চের দুইদিকে দিয়ে রক্ত লাল আলখাল্লাপরা দুইসারি পুরোহিত ভেতরে ঢুকলো। ওরা সোনালি সিংহাসনের চারদিকে অবস্থান নিয়ে অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে গলা মিলিয়ে শোক সঙ্গীতে সামিল হল।

তারপর হঠাৎ সমস্ত শব্দ থেমে গেল। চতুর্দিকে গভীর নীরবতা নেমে এল। সমবেত উপাসকবৃন্দ এবার গোঙনির মতো শব্দ করে একটানা কিছু উচ্চারণ করে যেতে লাগলো আর সবাই একসাথে সকলে হাঁটু গেড়ে বসে মার্বেল পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকালো।

সর্বাধিরাজ মিনোজ এবার আসবেন মনে করে আমি সারাক্ষণ শূন্য সিংহাসনটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম মানুষকে ঠকানোর জন্য আরেকটি নাটকীয় কৌশল ব্যবহৃত হবে। তারপরও আমি অবাক হয়ে গেলাম।

এক মুহূর্ত সিংহাসনটি খালি ছিল আর তার পরের মুহূর্তেই দেখলাম মিনোয়ান নৃপতি সেখানে বসে রয়েছেন। আর দুর্বল কংকালসার দেহ নিয়ে তার মাও তার পাশে বসে রয়েছেন।

তার মা একজন বিধবার কালো বেশ পরে রয়েছেন। তবে মিনোজ অত্যন্ত উজ্জ্বল রাজভূষণ পরে রয়েছেন। মনে হচ্ছে তার উপস্থিতি দিয়ে গুহামুখে সমস্ত প্রজাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে। তার বর্ম আর দামি ধাতুর তৈরি বীভৎস ষাঁড়ের মুখোশ থেকে উজ্জ্বল আলোর চিকন ছটা ছায়ায় ছিটকে পড়ছে।

লুকোনো জায়গা থেকে বাদকদল রণসঙ্গীত বাজাতে শুরু করতেই পুরো গুহামুখ তুমুল কোলাহলপূর্ণ শব্দে ভরে গেল। আর সেই সাথে সমবেত উপাসকবৃন্দ আবেগে আত্মহারা হয়ে ব্যক্তি পূজার আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।

সর্বাধিরাজ মিনোজ এবার তার বর্ম পরা ডান হাতের মুঠো উঁচু করতেই আবার সম্পূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। এমনকি ব্যলকনিতে বসা আমরা তিনজনও সেই সাথে নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।

মিনোজ আবার আরেকটি ইঙ্গিত করতেই আবার সবাই সমস্বরে অন্যধরনের একটি আদিম পাশবিক ক্রদ্ধ শব্দ করতে শুরু করলো। তারপর গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পর্দাগুলো দুইদিকে সরিয়ে দেওয়া হল। রঙ্গস্থলের দুই পাশের পাথরের দেয়ালে দুটি বন্ধ দরজা দেখা গেল। সমবেত উপাসকরা আরও জোরে স্তব করতে লাগলো। এমনকি লাল পোশাকপরা পুরোহিতরাও তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে স্তব করতে লাগলো। শব্দটি এখন আর প্রার্থনা কিংবা পূজার স্তব রইল না। এটি এখন একটি প্রচণ্ড যৌন কামনা এবং ধর্ষকাম বিষয়ক আনন্দের কামোত্তেজনা জাগানো গর্জনে পরিণত হয়েছে।

পর্দা সরানো খোলা দরজা দিয়ে সবুজ পোশাক পরা একদল নারীযোদ্ধা ঢুকলো। ওরা মাথায় ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির উজ্জ্বল পালক উঁচু করে লাগানো টুপি পরে রয়েছে। হাতের উঁচু ঢালগুলো লবণ মাখানো কুমিরের চামড়ার তৈরি। ওরা চারপাশ থেকে গোল হয়ে ঘিরে ধরে কিছু একটা লুকিয়ে নিয়ে আসছিল। রঙ্গমঞ্চের ঠিক মাঝখানে এসে ওরা থামলো। তারপর পূর্বনির্ধারিত ইঙ্গিতে সরে দাঁড়াতেই আমার দুই রাজকুমারীকে মাঝখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেল।

তেহুতি আর বেকাথা হাত ধরাধরি করে হতবাক হয়ে মুখ উঁচু করে তাদের সামনে গ্যালারিতে বসা উপাসক আর পুরোহিতদের বিকট চিৎকার শুনছে। ওদের মাথায় সাদা গোলাপের মুকুট পরানো রয়েছে।

তবে মাথায় মুকুট ছাড়া পরনে আর কিছু নেই। দুজনেই পুরোপুরি নগ্ন। ওদেরকে দেখে খুব কমবয়সি, নাজুক প্রায় শিশুর মতো মনে হচ্ছিল। তেহুতি আর বেকাথাতে একা দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে নারী-দেহরক্ষী দলটি ঘুরে রঙ্গমঞ্চ থেকে বের হয়ে গেল।

সমবেত উপাসকদের একযোগে প্রচণ্ড চিৎকার করে মন্ত্র পড়ার শব্দে মেয়েদুটো অভিভুত হয়ে আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। সর্বাধিরাজ মিনোজ আবার উঠে দাঁড়াতেই চিৎকার থামিয়ে সবাই চুপ হলো। ধীরে ধীরে তিনি ঘুরতেই তার সোনালি মুখোশটি মন্দিরের পেছনের দেয়ালমুখি হল। দেয়ালের গায়ে দূরবর্তী ক্রোনাস পর্বতের ছবি আঁকা ছিল। এবার তিনি গলা চড়িয়ে তার দেবতাকে আবাহন করতে শুরু করলেন। তার শিরস্ত্রাণের মধ্য থেকে প্রতিধ্বনিতৃ হয়ে বের হয়ে আসা চিৎকার আর ষাঁড়ের মত গর্জনের একটি বর্ণও আমি বুঝতে পারলাম না।

তবে এবার কথাগুলোর অর্থ ঠিকই বুঝা গেল, যখন তিনি তার রত্নখচিত কোমরবন্ধ থেকে ব্রোঞ্জের বিশাল তলোয়ারটি বের করলেন। তলোয়ারটি আমার সমান লম্বা। তিনি ঘুরে নিচে বলির মেঝেতে দাঁড়ানো নগ্ন মেয়েদুটির দিকে তাকালেন।

যদিও মাথাটকা ধাতব মুখোশ আর পেছনে পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে কথাগুলো কিছুটা দুর্বোধ্য আর অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল, তারপরও এই প্রথমবার আমি তার উচ্চারিত কথাগুলোর অর্থ সঠিক ধরতে পারলাম।

হে প্রিয় ক্রোনাস! সকল দেবতার প্রথম দেবতা- ক্রোনাস! আমি আপনার পুত্র; আপনার ঔরসজাত; আপনার দেহ এবং রক্তের অংশ। হাজার বছর ধরে আমি আপনার উপাসনা করে আসছি। হাজার বছর ধরে আপনাকে ভালোবেসে আপনাকে মান্য করে এসেছি। এখন আবার দাঁড়িয়ে আপনার প্রতি আমার আনুগত্য এবং শপথ ঘোষণা করছি। আমি আপনার জন্য বলি এনেছি যা আপনার পবিত্র আত্মা ব্যকুলভাবে কামনা করছে। আপনার পানের জন্য কুমারী রাজকন্যার রক্ত আর খাওয়ার জন্য কুমারী রাজকন্যার মাংস এনেছি। আসুন আপনার পার্থিব রূপে এসে আপনার জন্য যে অর্ঘ্য এনেছি তা গ্রহণ করুন। মেরে ফেলুন! খেয়ে ফেলুন!

তারপর তিনি তলোয়ারটি তুলে তেহুতি আর বেকাথার সামনের বন্ধ দরজার উপর জোরে একটি খোঁচা মারলেন।

দরজাটির দুই দিকের পাল্লা খুলে গেল তবে ভেতরে অন্ধকার দেখা গেল। আমি তাকালাম তবে দরজার ওপাশে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর ভেতরে কিছু একটা নড়াচড়া করে উঠলো, যা এতো বিশাল আর ভয়ঙ্কর যে আমার কল্পনার বাইরে।

ভীত সন্ত্রস্ত বেকাথা হু হু করে কেঁদে উঠে তার বড় বোনের গা ঘেঁসে এলো। আতঙ্কে তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তেহুতি এক হাত দিয়ে তার বোনকে ধরলো। বেকাথাও দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই তোরণের দিক থেকে পিছিয়ে এলো।

পুরো মঞ্চ জুড়ে নিবিড় এবং স্পষ্ট বোধগম্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো; আর বাইরের জগতেও। আগ্নেয়গিরির মেঘের মত গুড়গুড় গর্জনও হঠাৎ থেমে গেল। নিচে পৃথিবী স্থির হয়ে রয়েছে। মনে হল বিশাল দেবতা ক্রোনাসও তার নিজের মন্দিরে যে নাটক ঘটতে যাচ্ছে তাতে সম্মোহিত হয়ে পড়েছেন।

নাকের ক্রদ্ধ ফেস-ফেঁসানি আর বালু ছড়ানো পথে ভারী খুরের ধপ ধপ শব্দে নীরবতা ভঙ্গ হল। একটি বন্য উরুস ষাঁড় তীব্র গতিতে খোলা দরজা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে ঢুকলো। সমবেত কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণের প্রচণ্ড কোলাহল হঠাৎ কানে যেতেই সে আচমকা মাঝ পথে থেমে পড়লো। তারপর সামনের পায়ের খুর দিয়ে বালু আঁচড়ে ধুলির মেঘ উড়াতে শুরু করলো।

এযাবত যত উরুস ষাড় আমি দেখেছি সেগুলোর গায়ে কালো আর গাঢ় বাদামি ডোরা কাটা ছিল। তবে এই ষাঁড়টির গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। চোখদুটো পালিশ করা রুবির মতো উজ্জ্বল। প্রচণ্ড ক্রোধে মাথাটি এদিকওদিক নাড়তেই মনে হল ষাঁড়টির দেহ আরও ফুলে আরও বড় হয়ে উঠছে। ক্রোধটি কোথায় ঝাড়বে সেই লক্ষ্য খুঁজছে।

বিশাল শিংগুলো হাতির দাঁতের মতো সাদা। কালো চকচকে ডগাগুলো বর্শার আগার মতো তীক্ষ্ণ। একজন মানুষ হাত মেলে ধরলে তার দ্বিগুণ হবে শিংদুটোর বিস্তার। . প্রাণীটি সামনে দাঁড়ানো নগ্ন মেয়েদুটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে একবার তাকালো, তারপর মাথা নিচু করলো। রাগে এর দুই কাঁধের মাঝখানের বিশাল কুজটি ফুলে উঠেছে। তারপর এটি খুর দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগলো।

জন্তুটির গায়ের রঙ ও আকৃতি আর সেই সাথে এর দেহ থেকে যে অশুভ আভা নিঃসৃত হচ্ছে তা থেকে হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, এটি কোনো বনজঙ্গল কিংবা পর্বতের প্রাণী নয়। এটি এমন একটি কিছু যাকে এর দানবীয় প্রভুর তরফ থেকে বলি গ্রহণ করার জন্য আগ্নেয়গিরির গভীর অগ্নিকুণ্ড থেকে পাঠানো হয়েছে।

শিকারের দিকে তাকিয়ে এটি দাঁত বের করে ক্রুদ্ধ গর্জন করলো। উপরের ঠোঁট পেছনের দিকে কুঁচকাতেই লম্বা তীক্ষ্ণদাঁত বের হয়ে পড়লো। এই দাঁত তৃণভোজীর নয় এটি মাংসাশী প্রাণীর দাঁত।

সর্বাধিরাজ মিনোজ এই প্রাণীটিকে প্ররোচিত করে বলতে লাগলেন, আমি আপনার পানের জন্য কুমারীর রাজরক্ত এনেছি। আপনার খাওয়ার জন্য কুমারী রাজকন্যার মাংস এনেছি। মেরে ফেলুন! খেয়ে ফেলুন!

আমাকে অসাড় করতে যাচ্ছিল যে আতঙ্কবোধ, তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। তারপর মিনোয়ানদের সমবেত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠের কানে তালা লাগানো শোরগোলের উপর দিয়ে গলা তুলে চিৎকার করে বললাম, জারাস, হুই! আমাদেরকে নিচে গিয়ে ওদেরকে বাঁচাতে হবে। পর্দা ব্যবহার করে নামতে চেষ্টা কর। তবে যেভাবেই হোক নেমে পড়।

ওরা দুজন প্রায় ধাক্কা দিয়ে দ্রুত আমাকে পাশ কাটাল। একজনের পর একজন ব্যালকনির রেলিং টপকালো, তারপর ঝুলন্ত পর্দাটি ধরে নিচে নামলো। নিচে মঞ্চে নামার সময় আঘাত এড়াতে ওরা পর্দা ধরে সরসর করে পিছলে নামলো। তবে দেখলাম তেহুতিকে বাঁচাতে ওরা অনেক দেরি করে ফেলেছে।

চকচকে সাদা বঁড়টি এখন তেহুতির দিকে এর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রিভূত করেছে। এবার প্রচণ্ড গর্জন করে সোজা তার দিকে তেড়ে গেল।

বেকাথা চিৎকার করে উঠলো। এই শব্দে নিশ্চিত দানবটির মেজাজ বিগড়ে গিয়ে চোখ আরও লাল হল। জারাস আর হুই তখন মাত্র মেঝেতে পা রেখেছে। আক্রমণের মাঝখানে হস্তক্ষেপ করার আগে মঞ্চের অর্ধেক জায়গা পার হতে হবে।

আমি ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে একটা তীর ছুঁড়লাম। তীরটা ঠিক বঁড়টির বিশাল কাঁধে আঘাত করলো যেখানে আমি লক্ষস্থির করেছিলাম। তবে কাঁধের হাড়ে লেগে তীরটা ছিটকে সরে গিয়ে দর্শকসারিতে বসা একজন মিনোয়ান অভিজাতের বুকে আঘাত করলো। লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

তীরের আঘাত বঁড়টির গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেনি। আর তীর ছুঁড়ার সাহস হল না, কেননা বেকাথা তখন তার বোনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সে সোজা ষাঁড়ের হামলার পথেই ছুটতে শুরু করেছে।

ষাঁড়টি তার দিকে ঘুরে দানবীয় মাথাটা নিচু করলো। লম্বা চকচকে একটা শিং দিয়ে বেকাথাকে গুতো মারতেই এটি তার বাহুর উপরে বিঁধলো। শিংয়ের তোয় বেকাথা ষাঁড়টির পিঠের উপর দিয়ে শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়লো। আমি দেখলাম তার বাহুর হাড় ভেঙে গিয়ে রক্ত ঝরছে। মনে হল মাটিতে নরম বালুর উপর পড়ায় সে বেশি আঘাত পায় নি। ষাঁড়টি আবার ঘুরে তাকে অনুসরণ করলো।

তেহুতি আমাদের সবার চেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল। সে একছুটে ষাঁড়টির আক্রমণের পথে গিয়ে জোরে চিৎকার করে দুই হাত তুলে ষাঁড়টির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো।

ষাঁড়টির দপদপ করে উঠা নাসারন্ধ্রের ছিদ্র থেকে বের হওয়া নিঃশ্বাসের গরম আর দুর্গন্ধময় বাষ্প গুহার স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল। তেতি এই বাস্পের নিচ দিয়ে ছুটতে ছুটতে মাথার গোলাপের মুকুটটি খুলে নিয়ে জন্তুটির মুখে ছুঁড়ে মেরে জম্ভটিকে পাশ কাটাল।

হতচকিত হয়ে বিশাল ষাঁড়টি একটু থামলো, এই ফাঁকে তেহুতি আবার এক চরকি মেরে ঘুরতেই জারাসকে দেখতে পেল। সে তখন মাত্র পর্দা বেয়ে রঙ্গমঞ্চের মেঝের কাছাকাছি নেমেছে।

সে চিৎকার করে উঠলো, জারাস! বঁড়টি এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর বেকাথাকে ছেড়ে ঘুরে তেহুতির দিকে তাড়া করতে ছুটলো। তেহুতি একটি হরিণীর মতো দ্রুতগামি হলেও ষাঁড়টি তার চেয়েও দ্রুতগামি ছিল। এটি প্রায় তার উপর এসে পড়তেই সে চোখের পলকে এক লাফ দিয়ে দিক বদল করলো। এতে বঁড়টি ঘুরে আবার তার পিছু নেওয়ার আগে সে একগজের মতো জায়গা পেল।

আমি দেখলাম এবার সে আমি যেখানে ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার নিচ দিয়ে যাবে। আমি কোমরবন্ধে গোঁজা তলোয়ারটি বের করে উঁচু করে ধরে নিচে মঞ্চের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। তলোয়ারটি সরাসরি নিচের দিকে পড়তেই এর ডগাটি বালুতে গেঁথে গেল। হাতলটি তেহুতির সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়ালো।

চিৎকার করে তেহুতিকে বললাম, তলোয়ারটি তুলে নাও!

আরেকবার তেহুতি একজন ক্রীড়াবিদের দ্রুতো আর শক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাল। ছুটন্ত অবস্থায় পাশ কাটাবার সময় সে তলোয়ারটি ঝট করে মাটি থেকে ডান হাতে তুলে নিল।

ষাঁড়টি আবার প্রায় তার উপর এসে পড়েছে। এটি মাথা ঘুরাতেই বামদিকের শিং বাতাসে হিশশ শব্দ করে তেহুতির কাঁধ ঘেসে গেল। তেহুতি মাথা নিচু করে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। বঁড়টি আবার তাকে পাশ কাটিয়ে গেল। তারপর ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার জন্য বঁড়টি ঝটকা মেরে মাথা উচুঁ করতেই তেহুতি এক হাত দিয়ে বঁড়টির কাছের শিংটি ধরে ফেললো।

তেহুতি এক হাত দিয়ে ধরে থাকা অবস্থায় বঁড়টি শিং উপরের দিকে তুলতেই সে বাধা দিল না। বরং সে ষাঁড়টির সাথে একই দিকে লাফ মারলো। ষাঁড়ের কুজওয়ালা পিঠের উপর দিয়ে শূন্যে ভেসে সে অন্যপাশে মাটিতে নামলো। মাটিতে নামার সময় সে তলোয়ারের ডগাটি ষাঁড়টির কাঁধের হাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় নিশানা করলো।

নরম এই স্থানটিতে কোনো হাড় নেই। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তেহুতি তলোয়ারটি পুরোপুরি ষাঁড়ের দুই কাঁধের মাঝখান দিয়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর তলোয়ারটি ভেতরে সেঁধানো অবস্থায় হাতলটি ছেড়ে দিল।

তারপর সে পিঠ বাঁকা করে আহত বঁড়টির পেছনে হালকা পায়ে এক লাফে নেমে দুই হাত উঁচু করে পেছন দিকে সরে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে দানবীয় জন্তুটির টলে পড়া লক্ষ্য করতে লাগলো। বঁড়টি সামনের দুই পা দুইদিকে ছড়িয়ে মাথা নিচু করে নাক মাটিতে ঠেকাল। মুখ হা করে প্রচণ্ড গর্জন করলো। এর গলা দিয়ে উজ্জ্বল রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হল।

তারপর টলতে টলতে পেছন দিকে হেলতেই পেছনের পাদুটো ভেঙে যেতেই পশুটি প্রচণ্ড শব্দে মঞ্চের মেঝেতে পড়ে গেল। শব্দটি শুনে মনে হল যেন কুঠার দিয়ে একটি সিডার গাছ কেটে মাটিতে ফেলা হয়েছে। একপাশে গড়িয়ে পড়ে এটি কিছুক্ষণ পর পর পেছনের পা দুটো ছুঁড়তে লাগলো। তারপর নিশ্চল হয়ে গেল।

পুরো গুহায় নীরবতা নেমে এলো। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম।

এরপর উপসাগরের ওপারে আগ্নেয়গিরিতে বিশাল দেবতা ক্রোনাস প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়লেন। দেবতা তার বলি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার আত্মস্বরূপ প্রাণীটিকে তার নিজ মন্দিরের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে।

আমি মন্দিরের রঙ্গমঞ্চ থেকে মুখ তুলে বাইরে কুমুসস উপসাগরে একটি আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলাম।

চরমতম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ক্রোনাস তার নিজের দুর্গ ধ্বংস করেছেন। মনে হল এটি বেশ ধীরে ধীরে ঘটছে। সম্পূর্ণ পর্বতটি বড় বড় কয়েক হাজার টুকরায় বিস্ফোরিত হল। এক একটি খণ্ড ক্রিট কিংবা তার চেয়েও বড়। সমুদ্রপৃষ্ঠের কয়েক হাজার ফুট নিচে আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থল থেকে প্রচণ্ড শক্তির বলে এগুলো অনেক উঁচুতে সজোরে নিক্ষিপ্ত হল। পাথরগুলো কেন্দ্রস্থলের গভীর চুল্লিতে উত্তপ্ত হয়ে একসময় গলে যায় এবং এমন উজ্জ্বল সাদা আলো নিয়ে জ্বলতে থাকে, যা সূর্যকে ম্লান করে দিয়ে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। তারপর পাথরগুলো সাগরে পড়তেই সাগরের পানি টগবগ করে ফুটতে থাকে।

ফুটন্ত পানি থেকে বাষ্প বিস্ফোরিত হয়ে পাক খেয়ে খেয়ে সাদা মেঘ হয়ে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে আকাশের দিকে উঠে যায়। এখন কিছুই আর নেই; সাগর, পৃথিবী আর আকাশ। শুধু ঘন বাস্পের দেয়াল রয়েছে।

মনে হল সমস্ত কিছু নিঃশব্দে ঘটেছে আর সারা পৃথিবী আর এর মাঝের সমস্ত জীবন্ত প্রাণী শ্বাস বন্ধ করে রেখেছে।

তারপর এই প্রলয় কাণ্ডের আওয়াজ শোনা গেল। উপসাগরের পানির উপর দিয়ে শব্দটি আসতে যা সময়টুকু লেগেছিল। অনেকটা পাথর পতনের মতো শব্দটি একটি কঠিন বস্তুর মতো ক্রিট দ্বীপের উপর আছড়ে পড়লো।

যদিও আমরা গুহার দেয়াল দিয়ে আংশিক ঢাকা ছিলাম, তারপরও প্রচণ্ড শব্দের ধাক্কায় আমরা মাটিতে পড়ে গেলাম। শব্দের চোটে কানে তালা লেগে যেতেই আমরা মাটিতে শুয়ে কানে হাত চাপা দিয়ে ফোঁপাতে লাগলাম।

প্রচণ্ড শব্দ আর কম্পনের কারণে গুহার ছাদ থেকে বড় বড় পাথরের চাঙর খসে পড়লো। পাথর চাপা পড়ে আমার চারদিকে মানুষ আর্তচিৎকার করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছিল। ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের ডেকের মত গুহার মেঝে দুলতে শুরু করলো।

সবার আগে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তবে জ্বলন্ত পর্বতের আলোয় আমার চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল আর মেঘের গুড়গুড় গর্জনের মতো শব্দে কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। কোনোমতে হাঁটু গেড়ে বসে গুহার চতুর্দিকে তাকালাম। তবে আমিই একমাত্র লোক নড়াচড়া করছিলাম না।

জারাস ষাঁড়ের মৃতদেহের কাছে পড়ে থাকা তেহুতির দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। সে তেহুতিকে তার কোলে তুলে নিল। আমি দেখলাম তেহুতিও বিমুঢ় আর হতভম্ব হয়ে রয়েছে।

হুই বেকাথার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হল সে তাকে ছুঁতে ভয় পাচ্ছিল। সে এমন একজন যোদ্ধা যে বহু যুদ্ধক্ষেত্রে ডিঙিয়ে এসেছে, অথচ তার ভালোবাসার নারীর রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। একটি শিশু যেমন তার প্রিয় পিতামাতার কাছে সান্ত্বনা খুঁজে, সেরকমভাবে বেকাথাও ভাঙা হাতটি অন্য হাতে ধরে হুইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এবার ওদের দিক থেকে ফিরে আমি সর্বাধিরাজ মিনোজের দিকে তাকালাম। তিনি গুহার খোলা মুখের কাছে দাঁড়িয়ে বাস্পের মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, যা সেই জায়গাটিকে নিশ্চিহ্ন করেছে যেখানে একসময় ক্রোনাস পর্বত অবস্থিত ছিল।

মিনোজ দুই হাতে তার মায়ের রোগা পলকা দেহটিকে ধরে দুই হাত মাথার উপরে উঁচু করে ধরে রেখেছে। তার মাথা চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে আর চোখগুলো কোটর থেকে বের হয়ে রয়েছে। গুহার ছাদ থেকে খসে পড়া পাথরের আঘাতে তিনি মারা গেছেন।

মিনোজ গর্জন করে উঠলো, কেন তুমি এটা আমার সাথে করলে? হে মহাপরাক্রমশালী ক্রোনাস, আমিতো তোমার সন্তান। আমার মা তোমার প্রেয়সী এবং স্ত্রী ছিলেন। তুমি কি আমার দেওয়া অর্ঘ্য গ্রহণ করে তাকে বাঁচাতে পারতে না?

আমি বুঝলাম সে এই পৃথিবীতে আরও অনিষ্টকর কাজ করার আগেই তাকে আমার মেরে ফেলতে হবে। এরপর সে আমাদের সকলকে-আমার রাজকুমারী, আমার বন্ধু আর আমার সহকর্মীসহ আমাকেও ধ্বংস করবে।

ধনুক তুলে একটা তীর ছুঁড়ে মারলাম। এটা তার পেছনের সোনারবর্মের ঠিক মাঝখানে আঘাত করলো। তার দেহ স্থির হয়ে গেল আর তীরের আঘাতে তার পিঠে যে গর্ত হয়েছিল সেখান থেকে কালো রক্ত ঝরতে লাগলো। রক্তের দুর্গন্ধে সমস্ত মন্দির ভরে গেল, যেন দশদিন রোদে ফেলে রাখার পর পচন ধরা লাশের দুর্গন্ধ।

তীরের আঘাতে মিনোজের দেহ গুহার দেয়ালের খোলা জায়গা দিয়ে নিচে পড়ে গেল। সে নিচে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মায়ের মৃতদেহটিও, কালো কাপড়ের পুতুলের মতো সে যেখানে পড়েছিল তার পাশে পড়লো।

আমি এক লাফে ব্যালকনির দেয়াল টপকে পর্দা বেয়ে মঞ্চের মেঝেতে নামলাম। তারপর যেখানে বেকাথা শুয়েছিল সেখানে ছুটে গেলাম। তলোয়ারের খাপসহ কোমরবন্ধ খুলে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হুইকে বললাম, তাকে শক্ত করে ধর। তার খুব যন্ত্রণা হবে।

তার বাহুর ভাঙা হাড়টি সোজা করতেই সে ফুঁপিয়ে উঠলো। হাড়টা সোজা রাখার জন্য তলোয়ারের খাপের সাথে হাতটা বেঁধে দিলাম। তারপর মদের বোতলটি আমার কোমরের থলে থেকে নিয়ে হুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, সে যতটুকু খেতে পারে ততটুকু তাকে খাওয়াও। এতে ভালো কাজ হবে।

যন্ত্রণার মধ্যেও মৃদু হেসে বেকাথা ফিসফিস করে বললো, হুই আমার মনের মানুষ। এখন সে যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো। তার ঘরই আমার ঘর। আর যে মদ আমি পান করছি তা তার সাথে ভাগাভাগি করে নেব। আমি তার জন্য গর্ববোধ করলাম।

মন্দিরের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখলাম হেরেম থেকে আসা রাজকীয় নারী দেহরক্ষীর দলটি পালিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ওদের সাথে মিলোয়ন অভিজাতরাও পালিয়েছে। তবে তোরানকে দেখলাম লক্সিয়াসের কাঁধে হাত রেখে জারাস আর তেতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধু, তুমি কি আমাদের সাথে আসবে?

তোরান একটু ভেবে উত্তর দিল, মিনোয়ান সাম্রাজ্য আজ এখানে ধ্বংস হয়েছে। আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পাঁচশো বছর আগে এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। তার চেহারা মলিন হল। তারপর এক মুহূর্ত পর বললো, আমি আমার স্বদেশ হারিয়েছি। তবে মিসর হাইকসোদের বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে মিত্র হারিয়েছে। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস বললো, তবে যাইহোক লক্সিয়াস আর আমি আপনার সাথে থিবসে গিয়ে সেটাকেই আমাদের নতুন দেশ বানাবো।

আমি ঘুরে জারাস আর তেহুতির দিকে তাকিয়ে বললাম, জারাস, তেহুতি, আমি তোমাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি। তবে অবাক হলাম না যখন তেহুতি দুজনের হয়ে উত্তর দিল।

সে কেবল বললো, তায়তা, আমি তোমাকে আর মিসরকে ভালোবাসি, তবে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি জারাসকে। যদি তোমার সাথে থিবসে ফিরে যাই, তবে আমার ভাই আবার আমাকে অন্য কোনো বর্বর দেশের পাগল রাজার সাথে বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। আমি যথাসাধ্য ফারাও আর আমার দেশের জন্য সেবা করার চেষ্টা করেছি। তবে এখন আমি মুক্ত হয়ে আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই। তারপর জারাসের এক হাত ধরে আবার বললো, আমরা হুই আর বেকাথার সাথে চলে যাবো। তারপর আইয়োনিয়ান সাগরের ওপারে উত্তরের দেশে নতুন ঘর বাঁধবো।

আমি বললাম, আমিও তোমাদের সাথে গেলে খুশি হতাম। তবে আমার দায়িত্ব রয়েছে থিবসে ফারাওয়ের সাথে। আমি তাকে জানাবো তুমি আর বেকাথা মরে গেছ, তাহলে তিনি আর কখনও তোমাদের খোঁজে কাউকে পাঠাবেন না।

সে বললো, ধন্যবাদ তায়তা। তারপর একটু ইতস্তত করে আবার বললো, হয়তো একদিন দেবতা প্রসন্ন হলে তুমি আবার আমাদেরকে খুঁজতে আসবে।

আমি একমত হয়ে বললাম, হয়তো আসবো।

সে কথা দিল, আমি আমার প্রথম ছেলে হলে তোমার নামে তার নামকরণ করবো। আমি ঘুরে চোখের পানি লুকালাম। তারপর শূন্য পাথরের বসার ধাপের উপর চড়ে গুহার দেয়ালের খোলা জায়গাটির কাছে এলাম। এখান দিয়েই আমার তীর মিনোজের দেহে আঘাত করেছিল।

খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে তিনশো ফুট নিচে তাকিয়ে দেখলাম পাথরের উপর রক্তের মাঝে মিনোজের দেহটি হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তার বুকের রূপার বর্মের উপর দিয়ে আমার তীরের ডগা বের হয়ে রয়েছে। মাথায় তখনও সেই শিরস্ত্রাণটি পরা রয়েছে। শিরস্ত্রাণের চোখের অন্ধকার গর্তের ভেতর দিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।

মৃদু কণ্ঠে প্রশ্নটি করলাম, তুমি কী? তুমি কী একজন মানুষ, দানব, শয়তান না দেবতা ছিলে? তারপর মাথা নেড়ে আবার বললাম, প্রার্থনা করছি এই প্রশ্নের উত্তর যেন কোনোদিন জানতে না পারি।

মিনোজের মা, পাসিফের মৃতদেহ আমার পায়ের কাছে পড়েছিল। আমি দেহটি তুলে নিচে ফেলে দিলাম। তারপর আবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটি দেহ একটি আরেকটির উপর বিশ্রিভাবে পড়ে রয়েছে।

তারপর ঘুরে আবার রঙ্গমঞ্চের দিকে গেলাম, যেখানে আমার মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই মন্দির থেকে বের হয়ে গোলক ধাঁধার মধ্য দিয়ে হেঁটে জঙ্গলের মাথায় আমাদের ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছলাম। তারপর ঘোড়ায় চড়ে শেষবারের মতো একটি পরিবারের মতো একসাথে চললাম। ইডা পর্বতের ঢালে পৌঁছে ঘোড়ার লাগাম টেনে থামিয়ে কুনুসস উপসাগরের দিকে ফিরে তাকালাম।

ক্রোনাস পর্বত আর নেই। সমুদ্রের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। কেবল টগবগ করে ফুটতে থাকা সাগরের ঘোলা পানি এর সমাধির চিহ্ন হয়ে রয়েছে।

তারপর সামনে তাকিয়ে দেখলাম, যেখানে একদা ক্রিমাদ বন্দরটি ছিল, সেখানে আমাদের ছয়টি জাহাজের নৌবহর অক্ষত দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে জাহাজগুলো তীর থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে সমুদ্রে নোঙর করা ছিল। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমার চতুর্দিকে সবাই খুশিতে আর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো। তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। ওরা জোড়ায় জোড়ায় ঘোড়া ছুটাচ্ছিল, লর্ড তোরান লক্সিয়াসের সাথে, হুই বেকাথাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তার জখমি হাতটি বাঁচিয়ে। আর এদের পেছনে জারাস আর তেহুতি পাশাপাশি ঘোড়া ছুটাচ্ছিল।

আমি একটু পিছিয়ে ওদেরকে যেতে দিলাম। তারপর ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম, এখান থেকেই ওদের আলাদা আলাদা পথ শুরু হয়ে সুখের পাহাড়ে গিয়ে শেষ হোক। কথাগুলো বললেও তাদের প্রতি আমার আনন্দ একটু দমে এলো যখন আমার নিজের বেদনা আর একাকীত্বের কথা মনে পড়লো। তারপর একটি কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, হয়তো তা কেবল গাছের উপরের সন্ধ্যার হাওয়ার শব্দও হতে পারে।

তুমি কখনও একা হবে না তায়তা। কেননা একটি মহৎ হৃদয় সবসময় চুম্বকের মতো অন্যের ভালোবাসা নিজের দিকে আকৃষ্ট করে।

আমি হতবাক হয়ে পাগলের মতো চারপাশে তাকালাম, মনে হল যেন আমি দেখছি জঙ্গলের দিক থেকে আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢেকে সে আমার। দিকে আসছে। তবে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসতেই আমার মনে হল হয়তো আমি ভুল দেখেছি।

Exit mobile version