Site icon BnBoi.Com

দ্য সেভেনথ স্ক্রৌল – উইলবার স্মিথ

দ্য সেভেনথ স্ক্রৌল - উইলবার স্মিথ

দ্য সেভেনথ স্ক্রৌল

 ১. মরু থেকে চুপিসারে

দ্য সেভেন্‌থ স্ক্রৌল –উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

উৎসর্গ

সিলেটের রিয়াদ আহমেদ এবং তাঁর প্রিয় বন্ধবী নীলাঞ্জনাকে

অঘ্রানের এক রাতে তোমার কক্ষে সমস্ত আয়োজন সেরে রেখেছিলে, আমি জানতাম–আমি জানতাম–তুমি চেয়েছিলে এমনই; অথচ দেখো, আমি নিজেই কেমন হয়ে গেলাম জড়সড়ো। বহু কথা বলছিলে তুমি; অনেক উপলক্ষ্য আমার সামনে দিয়ে অতি দীর্ঘ নদীর মতন বয়ে গেল। আমি ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে তবু তাতে ভাসলাম না।

অক্লান্ত তুমি, অনেক বলে বলে শেষমেষ কী যেনো কী খুঁজে পেলে; জানতে চাইলে, সত্যি কী আমি মুটিয়ে গেছি? আমি তোমার অবয়বে এক মুহূর্তের সহস্রভাগের এক ভাগ সময় চোখ বুলিয়ে বলতে চাইলাম, বটে; ভুলে তা হয়ে গেল, না, যে! আমার সামনে অজস্র পাকা ধান; কী আশ্চর্য, ফসল তুলতে পারলাম না।

ভূমিকা

রিভার গড-এর বাংলা সংস্করণ প্রকাশের পর থেকে প্রচুর পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, যারা ই-মেইল, ফোন বা পত্রের মাধ্যমে নিজেদের উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়েছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ। যতোটা না লেখক বা অনুবাদক, তার চেয়ে বেশি পাঠক আমি। বিদেশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার স্বাদ নেওয়ার সময় বারবারই মনে হতো, প্রাচীন মিশরের পটভূমিতে যে প্রচুর সংখ্যক ঐতিহাসিক উপন্যাস আছে, তার একটা ঝলক বাংলায় আসা উচিত। ভয়ও ছিল, বিশাল কলেবর এবং কাহিনীর ধীরগতি হয়তো পাঠকের জন্য সুস্বাদু মনে হবে না। কিন্তু রিভার গড সেই ভয় দূর করেছে। আমি ভাগ্যবান–বাংলাদেশের পাঠক আমার রূপান্তর গ্রহণ করেছেন। উইলবার স্মিথের মিশরীয় পটভূমির উপন্যাসগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশ্বের বড় বড় সব কয়টি ভাষায় তা অনুবাদিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জননী, আমার বাংলায় তা কেন হবে না–এ রকমই একটা জেদ থেকে উইলবারের সাহিত্য-দূত মার্টিন পিক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কাকতালীয় ব্যাপার, মার্টিন সাহেব ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে ছিলেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পক্ষে কাজ করতেন এ ঢাকায়। তার উৎসাহ, উইলবারের সমর্থন আমার আগ্রহ আরো বাড়িয়েছে।

আগে যেমন বলেছি, অনুবাদ সময় সাপেক্ষ এবং অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পেশাগত ব্যস্ততা অনেক সময়েই বাধ সাধে এ কর্মে, তারই ফলে বই প্রকাশে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব। আগের মতোই বানানরীতি রইলো এখানেও, যদিও কাহিনীটি অনেকটাই ভিন্নতর।

যারা রিভার গড পড়ে জানতে চেয়েছেন টাইটার তারপর কী হলো, তাদেরকে কেবল এতোটুকু বলি, টাইটা কিন্তু এখনো বেঁচে আমি শুনেছি, এ মুহূর্তে বিশ্বের বেশ কয়টি দেশে তার নাম তালিকার এক নম্বরে আছে, গত আগস্ট মাস থেকেই।

কেমন লাগলো দ্য সেভেন্থ স্ক্রোল, জানার আগ্রহ রইলো।

ডা. মখদুম আহমেদ
ধানমন্ডী, ঢাকা
১৪ জুলাই, ২০০৮
.

মরু থেকে চুপিসারে চলে এলো গোধূলি, সারি সারি বালিয়াড়ি ঢাকা পড়ে গেল রক্ত-বেগুনি ছায়ায়। যেনো মোটা একটা মখমলের চাদরে চাপা পড়লো সমস্ত শব্দ, আর তাই কোমল প্রশান্তি আর মৌন নিস্তব্ধতার ভেতর বিষণ্ণ সন্ধ্যে ঘনালো।

বালিয়াড়ির চূড়ায়, যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে থেকে মরুদ্যান আর মরুদ্যানকে ঘিরে থাকা ছোট্ট গ্রামটা পরিষ্কার দেখা যায়। প্রতিটি বাড়ির সাদা ছাদগুলো সমতল। গায়ে গায়ে, প্রচুর খেজুর গাছ, মুসলমানদের মসজিদ আর কপটিক খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো শুধু ওগুলোর চেয়ে বেশি উঁচু। ধর্মীয় বিশ্বাসের দুই স্তম্ভ লেকের দু ধারে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।

হ্রদের পানি গাঢ় হচ্ছে, দ্রুত ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ, তুলে এক ঝাঁক হাঁস, নলখাগড়া ঢাকা পাড়ের কাছাকাছি নামতে ছলকে উঠে জল।

বড়ো বিপরীত একটা জোড়া ওরা। ভদ্রলোক লম্বা, একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে; অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো খেলা করছে রূপালি চুলে। তরুণী মেয়েটার বয়স কম, ত্রিশের কোঠায় হবে, ছিপছিপে, প্রাণচঞ্চল। ঘন, কোঁকড়া কালো চুলগুলো ঘাড়ের পেছনে এক করে বাঁধা।

চলো, ফিরে যাই, আলেয়া আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে, তরুণীর দিকে তাকিয়ে সস্নেহে হাসলেন ভদ্রলোক। তাঁর প্রথম স্ত্রী বিগত হওয়ার পর একে বিয়ে করেছেন তিনি। জীবনের সমস্ত সুখ, আনন্দ যেনো ফিরিয়ে এনেছে ও। নিজের জীবন, কাজ সবকিছু নিয়ে দারুণ সন্তুষ্ট একজন মানুষ অধ্যাপক ডুরেঈদ।

তাঁর কাছ থেকে হঠাৎ করেই সরে গেল তরুণী। চুলের ফিতে খুলে দিয়ে বালিয়াড়ির ঢাল ধরে ছুটলো, খিলখিল শব্দে হাসছে।

খানিক দূর নামার পরই তাল হারিয়ে ফেললো সে, পড়ে গেল ঢালু পথের উপর। ওর পড়নের লম্বা পোশাক উপরে উঠে যেতে দৃশ্যমান হলো একজোড়া সুগঠিত বাদামি ঊরু।

বালিয়াড়ির মাথা থেকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন ডুরেঈদ। মাঝে-মধ্যে। একেবারে শিশুদের মতো আচরণ করে মেয়েটি। অন্যান্য সময়ে শান্ত, সৌম্য একজন তরুণী সে। ডুরেঈদ এখনো নিশ্চিত নন, ওর কোন ধরনের আচরণ তিনি

বেশি ভালোবাসেন। গড়িয়ে একবারে বালিয়াড়ির নিচে গিয়ে থামলো মেয়েটা; এখনো হাসছে, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে লাগলো বালি।

এবারে তোমার পালা! চিৎকার করে ডুরেঈদের উদ্দেশ্যে বলল রোয়েন। বয়সের কারণে ডুরেঈদের শরীরে এখন আর সেই চঞ্চলতা নেই। ধীরে, বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি। এক হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন স্ত্রীকে। চুমো খাওয়ার ইচ্ছেটা দমন করলেন অতি কষ্টে। বাড়ির বাইরে, এমন কী প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশ করার আরবীয় রীতি নয় এটি।

অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক-ঠাক করে চুল বেঁধে নিল রোয়েন। নলখাগড়ার ঝোঁপ ঘেঁষে, সেচের খালগুলোর উপর স্থাপিত নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে হেঁটে চললো ওরা। ক্ষেতের কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে থাকা কৃষকের দল হাত উঁচিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। দারুণ সম্মান করে তারা অধ্যাপক ডুরেঈদকে।

আস্সালামু আলাইকুম, ডক্টর!

জ্ঞানী লোকদের সম্মান দিতে জানে এরা। বিগত বছরগুলোয় ডুরেঈদ এবং তাঁর পরিবারের সদয় আচরণের জন্য একটু বেশিই ভালোবাসে তাঁকে। গ্রামের বেশিরভাগ অধিবাসীই মুসলমান, কিন্তু তিনি খ্রিস্টান–এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশে।

ভিলায় পৌঁছতে, বৃদ্ধা পরিচারিকা আলেয়া, বকুনি লাগালো ডুরেঈদ আর রোয়েনকে। সবসময় দেরি করো তোমরা! কেননা বাপু, একটু নিয়ম করে চললে ক্ষতি কী শুনি? এখানে আমাদের একটা সম্মান আছে!

বুড়ি মা, ঠিকই বলেছো, বিনয়ের সাথে বললেন ডুরেঈদ, তোমাকে ছাড়া যে আমাদের কী করে চলতো! অনুচ্চ স্বরে গজগজ করতে করতে রোয়েনকে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিল বুড়ি।

চাতালে বসে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলো ওরা জলপাই, আঙুর, রুটি আর ছাগ দুধের তৈরি পনির দিয়ে। আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। মরুর নিস্তব্ধ আকাশে মিটমিট করছে তারার দল।

রোয়েন, প্রিয়তমা, টেবিলের ওপাশে বসা স্ত্রীর হাত ছুঁলেন ডুরেঈদ। চলো, কাজ শুরু করি। উঠে দাঁড়িয়ে, চাতালের উপরে নিজের স্টাডির উদ্দেশ্যে হেঁটে চললেন তিনি।

স্টাডিতে প্রবেশ করে, লম্বা স্টীল সেফের সামনে এসে দাঁড়ালো রোয়েন আল সিমা, হাতল ঘুরিয়ে কমবিনেশন লক খুলছে। গাদা গাদা প্রাচীন বই-পুস্তক আর রাশি রাশি গুটানো স্ক্রোল বা প্যাপিরাস রয়েছে স্টাডিতে, আরো রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি ও আর্টিফ্যাক্ট। এ সবই তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় ও সংগ্রহ। এতো কিছুর মাঝখানে স্টিলের সেফটা এ ঘরে মানায় নি।

ভারী স্টীলের দরজাটা খুলে যেতে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলে রোয়েন। প্রাচীন এসব পুরানিদর্শন দিনের মধ্যে যতোবারই দেখুক, সশ্রদ্ধ ভয় ও বিস্ময় মেশানো একটা অনুভূতি অবশ করে দেয় ওকে।

সপ্তম স্ক্রোল, ফিসফিস করে বলল রোয়েন, ওটা ছোঁয়ার মুহূর্তে শক্ত হয়ে উঠলো পেশী। গুটানো প্যাপিরাসে লেখা সপ্তম লিপি প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো, লিখে রেখে গেছে সময়কে জয় করে ইতিহাস ঠাই করে নেওয়া বিশাল এক প্রতিভা। সে বেঁচে ছিল কয়েক সহস্র বছর আগে, ধুলোয় মিশে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু তার সম্পর্কে সব কথা জানার পর রোয়েন তাকে নিজের স্বামীর মতোই শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। তার কথা চিরন্তন ও অবিনাশী, সেসব যেনো কবর থেকে স্পষ্ট উঠে আসে রোয়েনের কানে, ভেসে আসে স্বর্গীয় উদ্যান থেকে। খ্রিস্টপূর্ব আধ্যাত্মিক ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাস করতো সে, সেই মহান ত্রয়ী–ওসিরিস, আইসিস আর হোরাস-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিল। রোয়েন তার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পায়। সেও সাম্প্রতিক একটা ট্রিনিটি অর্থাৎ ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী, সেও পরম ঈশ্বর, ঈশ্বরপুত্র এবং পরমআত্মার প্রতি নিবেদিত প্রাণ।

স্ক্রোলটা লম্বা একটা টেবিল নিয়ে এলো রোয়েন, ওখানে আগেই কাজ শুরু করেছেন ডুরেঈদ। টেবিলের উপর তার সামনে ওটা রাখতে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় শ্রদ্ধা মেশানো বিস্ময় ও সমীহ ফুটে উঠতে দেখলো রোয়েন। ও জানে, দু জনেরই এ একই অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ডুরেঈদ চান স্ক্রোলটা সারাক্ষণ টেবিলেই থাকুক, এমন কী যখন ওটার কোনো প্রয়োজন নেই, তখনও। ক্রোলের ছবি আর মাইক্রোফিল্ম আছে, কাজ করতে কোনো অসুবিধে হয় না। তবু লেখাগুলো পরীক্ষা করার সময় প্রাচীন লেখকের অদৃশ্য উপস্থিতি যেনো তাঁর খুব দরকার।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন ডুরেঈদ। আমার চেয়ে তোমার চোখ ভালো, রোয়েন, বললেন তিনি। দেখো দেখি, এ ক্যারেক্টারটা থেকে কী বুঝলে?

কয়েক মুহূর্ত মাথা ঘামানোর পর, ডুরেঈদের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিল রোয়েন, ওটার ভেতর দিয়ে তাকালো আবার।

দেখে মনে হচ্ছে, আমাদেরকে ধোকায় ফেলার জন্য টাইটা নিজের তৈরি আরেকটা গুপ্তলিপি ব্যবহার করেছে এখানে, বলল ও। বলার সুরে প্রাচীন লেখকের প্রতি আদর ও ভালোবাসা ফুটল, তবে তারই সঙ্গে কৃত্রিম একটু ক্ষোভও প্রকাশ পেল; সব মিলিয়ে ভাবটা যেনো বন্ধুটি এখনো বেঁচে আছে এবং সকৌতুক চালাকি করছে ওদের সঙ্গে।

তাহলে, মাথা খাঁটিয়ে ধাঁধার জবাব বের করতে হয়, দুরেঈদের কণ্ঠে উৎসাহ। প্রাচীন এ খেলাটা তাঁর খুব পছন্দ না হলে সারাজীবন লেগে থাকতে পারতেন না।

কাজে মগ্ন হয়ে পড়ে ডুরেঈদ এবং রোয়েন। ঠাণ্ডা রাতের প্রহর কাটে নিঃশব্দে। এ সময়টাই কাজ করতে পারে ওরা। কখনো ওরা ইংরেজিতে কথা বলে, কখনো আরবিতে; দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষ। ফ্রেঞ্চ ওদের তৃতীয় ভাষা, তবে খুব কমই ব্যবহার করার দরকার পড়ে। দুজনেই ওরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করেছে, মাতৃভূমি এ মিশর থেকে অনেক দূরে। মাতৃভূমি এ মিশর, এটা ক্রীতদাস টাইটার প্রিয় একটা প্রকাশভঙ্গি, স্ক্রোলে বহুবার ব্যবহার করেছে সে, উচ্চারণ করতে রোয়েনেরও খুব ভালো লাগে।

প্রাচীন এ মিশরীয়র সঙ্গে কত দিক থেকেই না বিচিত্র আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করে রোয়েন। সন্দেহ নেই, টাইটার সরাসরি বংশধরও যেহেতু কপটিক খ্রিস্টান, কাজেই ওর রক্তধারা প্রাচীন সেই ফারাও আর পিরামিড যুগ থেকে প্রবাহিত। আরবরা তো মিশর জয় করেছে সম্প্রতি, চোদ্দশো বছরও হয় নি।

গ্রামের শেষ মাথায় নিজ পরিবারে ফিরে গেছেন বৃদ্ধা আলেয়া, রাত দশটার দিকে নিজেই দু কাপ কফি বানালো রোয়েন। কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় টুকটাক আলাপ হলো।

রোয়েনের কাছে, তার স্বামীর সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, তাই এমন কোনো আলোচ্য বিষয় নেই, যা নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ড থেকে আর্কিওলজিতে ডক্টরেট নিয়ে মিশরে ফেরার পর পরীক্ষা দিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যান্টিকুইটিজ-এ চাকরি পেয়েছে রোয়েন। ডুরেঈদ ওই বিভাগেরই পরিচালক।

ডুরেঈদ যখন মহৎ প্রাণের উপত্যকার কবর খনন করেন, রোয়েন তখন তার সহকারী হিসেবে ছিল। ওটা ছিল রানী লসট্রিস-এর সমাধি, খ্রিস্টের জন্মের সতেরো শ আশি বছর আগেকার।

সমাধির সমস্ত জিনিস প্রাচীনকালেই চুরি হয়ে গেছে, এটা দেখে হতাশ হন ডুরেঈদ। রোয়েনও খুব কাতর হয়ে পড়ে। থাকার মধ্যে আছে শুধু দেয়াল ও সিলিং ঢাকা দেয়ালচিত্র।

স্তম্ভের পেছনের দেয়ালে রোয়েনই তখন কাজ করছিল, যেখানে এককালে দাঁড়িয়ে ছিল ভাস্কর্যশিল্প–অলংকৃত ও শিলালিপিসমৃদ্ধ পাথুরে শবাধার; দেয়ালচিত্রের ছবি তুলছে ও। এ সময় একদিকের দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়লো, বেরিয়ে পড়লো দশটা কুলঙ্গি বা দেয়ালে তৈরি ছোট খোপ। দেখা গেল দশটা কুলঙ্গিতে দশটা তেল চকচকে স্বচ্ছ পাত্র রয়েছে। প্রতিটি পাত্রে পাওয়া গেল একটা করে প্যাপিরাস। ক্ষয় ক্ষতি কিছু হলেও, প্রায় চার হাজার বছর পর আশ্চর্য অটুট অবস্থায় আজো টিকে আছে।

কি আশ্চর্য ও বিস্ময়কর কাহিনীই না বলা হয়েছে ওগুলোয়। শক্তিশালী ও সুদক্ষ শত্ৰু-বাহিনী আক্রমণ করলো একটা জাতিকে এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত হলো ঘোড়া এবং ঘোড়ায় টানা রথ। এর আগে মিশরীয়রা ঘোড়া দেখে নি। হিকসস বাহিনীর দ্বারা পরাজিত ও বিধ্বস্ত নীলনদের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ পালাতে বাধ্য হলো। নেতৃত্ব দিল ওদের রাণী, রাণী লসট্রিস; বিশাল নদী অনুসরণ করে দক্ষিণ দিকে চলে এলো মিশরের অধিবাসীরা, চলে এলো প্রায় নদীর উৎসমুখে, ইথিওপিয় ভূখন্ডে, নির্দয় পাহাড়ি এলাকার গভীরে। এখানে, প্রবেশ নিষিদ্ধ পাহাড়শ্রেণির ভেতর, রাণী লসট্রিস ও তাঁর স্বামী মামোসের মমি করা দেহ সমাধির ভেতর সংরক্ষণ করলেন। ফারাও মামোস, যুদ্ধে হিকসস বাহিনীর হাতে নিহত হন।

বহু বছর পর রাণী লসট্রিস তাঁর প্রজাদের নিয়ে উত্তর অভিযানে বেরোন, আবার ফিরে আসেন মিশরে। এবার ওঁদের কাছে নিজস্ব ঘোড়া আর রথ আছে, দুর্গম আর নিষ্ঠুর আফ্রিকার প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে দক্ষ হয়েছে যোদ্ধারা, সুদীর্ঘ নদীর তীর ধরে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মতো ছুটে এসে হানাদার হিকসস বা রাখাল-রাজা বাহিনীকে প্রতিআক্রমণ করে বসলো মিশরীয় বাহিনী। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হার হলো হিকসসের, তার কবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো আপার ও লোয়ার ঈজিপ্ট।

এ গল্প রোয়েনের অস্তিত্বের অণু-পরমাণুতে শিহরণ জাগায়। প্যাপিরাসে বৃদ্ধ ক্রীতদাসের আঁকা চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফের অর্থ ধীরে ধীরে একটু একটু করে উদ্ধার করে ওরা, আর প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হতে থাকে ও।

কায়রোর মিউজিয়ামে, সারাদিন রুটিন কাজ করার পর এ ভিলায় রোজ রাতে স্ক্রোল নিয়ে বসে ওরা। দেখতে দেখতে কয়েক বছর কেটে গেছে, তবে নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের ফলও পেয়েছে, দশটা ফ্রোলের পাঠোদ্ধার করা গেছে, বাকি আছে শুধু সপ্তম স্ক্রোল। এটি আসলে হেঁয়ালিতে ভরা, লেখক গূঢ় রহস্যময় সাঙ্কেতিক ভাষায় এমন সব ঘটনার কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে গেছে যে এতো কাল পর কার সাধ্য অর্থ বের করে। নিজেদের কর্মজীবনে হাজার হাজার টেক্সট স্টাডি করেছে ওরা, কিন্তু সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা এমন সব সিম্বল বা প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করেছে যা আগে কখনো ওদের চোখে পড়ে নি। এখন ওরা দু জনেই জানে যে টাইটা চেয়েছিল তার প্রিয় রাণী ছাড়া আর কেউ যেনো এর অর্থ করতে না পারে। মনোহারিনী রাণীকে দেওয়া এগুলো ছিল তার শেষ উপহার, যে উপহার রাণী সঙ্গে করে কবরে নিয়ে যাবেন।

দু জনের এক করা মেধা, কল্পনাশক্তি আর শ্রম কয়েক বছর ধরে কাজে লাগিয়ে অবশেষে একটা উপসংহারে পৌঁছতে যাচ্ছে ওরা। অনুবাদে এখনো অনেক ফাঁক রয়ে যাচ্ছে, কিছু অংশের পাঠ সঠিক হলো কিনা সন্দেহ আছে, তবে পাণ্ডুলিপির মূল কাঠামোটা এমন ভঙ্গিতে সাজিয়েছে ওরা যে তা থেকে বক্তব্যের সারমর্মটুকু বের করে নেওয়া সম্ভব।

এ মুহূর্তে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মাথা নাড়ছেন ডুরেঈদ, যেমন আগেও বহুবার করেছেন তিনি। সত্যি আমি ভয় পাচ্ছি, বললেন। এটা বিশাল

একটা গুরু দায়িত্ব। বছরের পর বছর রাত জেগে যে জ্ঞান আমরা অর্জন করলাম, এটা নিয়ে কী করা হবে। এ যদি মন্দ কোনো লোকের হাতে পড়ে… কথা শেষ না করে চুমুক দিলেন আবার, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন কী আমরা যদি ভালো কোনো লোককেও দেখাই, প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো এ গল্প সে কী সত্যি বলে বিশ্বাস করবে?

কাউকে দেখাবার দরকার কি? রোয়েনের কথায় সামান্য হলেও ক্ষোভ বা ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। যা করার আমরা করলেই তো পারি। মাঝে মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডুরেঈদের বয়েস হয়েছে, কাজেই তিনি সতর্ক ও সাবধান। আর রোয়েনের আচরণে তারুণ্যের অস্থিরতা প্রকাশ পায়।

তুমি বুঝবে না, রোয়েন, বললেন তিনি। যখনই তিনি এ কথা বলেন, অস্বস্তি বোধ করে রোয়েন। আরব পুরোপুরি পুরুষদের জগৎ, মর্যাদার সমান ভাগ মেয়েদেরকে তারা এখনো দিতে শেখে নি। অথচ আরেক জগতের সঙ্গে পরিচয় আছে রোয়েনের, যেখানে মেয়েরা সমান মর্যাদা দাবি করে এবং পায়ও দান। হিসেবে নয়, অধিকার হিসেবে। দুই জগতের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে রোয়েন, পশ্চিমা জগৎ আর আরব জগৎ।

রোয়েনের মা ইংরেজ মহিলা, কায়রোর ব্রিটিশ দূতাবাসে কাজ করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ওর বাবা মিশরীয়, কর্নেল নাসেরের সরাসরি অধীনে একজন তরুণ অফিসার ছিলেন। পরস্পরকে ভালোবাসেন ওঁরা, তারপর বিয়ে করেন। যদিও ওদের দাম্পত্য জীবনটা সুখের হয় নি।

ওর মা চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে ইংল্যান্ডের ইয়র্কে, নিজের জন্মস্থানে। চেয়েছিলেন জন্মসূত্রে তাঁর সন্তানের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থাকা চাই। মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর মায়ের জেদে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয় রোয়েনকে। তবে প্রতিটি দীর্ঘ ছুটি কায়রোয় বাবা ও চাচার সঙ্গে কাটিয়েছে ও। ওর বাবার বিস্ময়কর পদোন্নতি হয়, শেষ দিকে তিনি মোবারক মন্ত্রীসভার সদস্য হতে পেরেছিলেন। বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসত রোয়েন, বোধহয় সেজন্যই বাবা ও আরব সমাজের প্রভাব বেশি পড়ে ওর উপর। বাল্য ও কৈশোর কাল বেশির ভাগটাই মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে কাটালেও মা বা পশ্চিমা সমাজের প্রভাব ওর উপর খুব কম।

কপটিক সমাজের ঐহিত্য হলো গুরুজনরা মেয়ের পাত্র ঠিক করবেন। মৃত্যুর আগে রোয়েনের বাবা তার জন্য পাত্র ঠিক করে দিয়েছিলেন। মনের গভীরে আপত্তি থাকলেও মৃত্যুপথযাত্রী বাবার শেষ ইচ্ছে রক্ষা করেছিল সে।

তবে ডুরেঈদের সঙ্গে ওর দাম্পত্য-জীবন সুখের হয় নি এ কথা বলা যাবে না। শুধু যদি ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা ওর না থাকতো, রোয়েন জানে, অত্যন্ত সুখের হতো ওর জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ডেভিড বলে এক তরুণের প্রেমে পড়েছিল সে।

ভালোই চলছিল রোয়েনের জীবন। হঠাৎ একদিন নিজের বাপ-মায়ের কথা মেনে তাদেরই নির্বাচিত এক সুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে বসে ডেভিড। ভেঙে যায় ওদের সম্পর্ক।

ডুরেঈদকে রোয়েন সম্মান করে, পছন্দও করে। শুধু কখনো কখনো গভীর রাতে ওর মনে হয়, সমর্থ কোনো তরুণ হয়তো আরো অনেক বেশি শারীরিক সুখ দিতে পারতো ওকে।

ডুরেঈদ আবার কথা বলছেন। মন্ত্রীর সঙ্গে আবার আমি কথা বলেছি, কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত নাহুত তাকে বুঝিয়েছে যে, আমি একটু পাগলাটে। বিষণ্ণ হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। নাহুত গাদ্দাবি তাঁর ডেপুটি, অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী তরুণ, মন্ত্রীসভায় ও প্রশাসনে তার আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা অনেক। মিনিস্টার আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফাণ্ড পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই আমাকে দেখতে হবে বাইরে থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় কিনা। সম্ভাব্য স্পনসর হিসেবে তালিকায় চারটি নাম রেখেছি। প্রথমেই বলা যেতে পারে গেটি মিউজিয়ামের কথা, কিন্তু বিশাল ও নিষ্পণ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে কখনোই আমার ভালো লাগে নি। একা একজন লোকের সাহায্য পেলে খুশি হই। সিদ্ধান্তে আসাটা তাহলে সহজ হয়। এসব কিছুই নতুন নয়:রোয়েনের কাছে, তবু এ দিয়েই শুনছে ও।

তারপর ধরো, হের ফন শিলার। তার টাকা আছে, এ বিষয়ে আগ্রহও আছে, কিন্তু তাঁকে আমি এতো ভালোভাবে চিনি না যে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি।

আর আমেরিকান ভদ্রলোক? তিনি তো বিখ্যাত একজন কালেক্টর।

পিটার ওয়ালশের সঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। নিজের ভাগ বাড়াবার দিকে এতো বেশি ঝোঁক তার, তাঁকে আমার রাক্ষস বলে মনে হয়। সত্যি ভয় পাই।

তাহলে বাকি থাকলো কে? তালিকার প্রথম নামটা?

ডুরেঈদ জবাব দিলেন না, কারণ উত্তরটা দু জনেরই জানা। ওঅর্ক টেবিলের দিকে তাকালেন তিনি, জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কত সাধারণ আর নগণ্য। পুরানো একটা প্যাপিরাস স্ক্রোল, কয়েকটা ফটোগ্রাফ আর নোট বুক, একটা কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। বিশ্বাস করা কঠিন মন্দ লোকের হাতে পড়লে এ সামান্য কয়টা জিনিস কী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

তারপর হেসে উঠলেন। আমি বোধহয় একটু বেশি ভয় পাচ্ছি। হয়তো রাত জেগে কাজ করার প্রতিক্রিয়া। চলো, কাজে ফিরে যাই আবার? আগে পাজি বুড়ো টাইটার পুরো বক্তব্য অনুবাদ করি, তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে, কী বলো?

সামনের স্তূপ থেকে উপরের ফটোটা হাতে নিলেন। স্ক্রোলের মাঝখানের অংশ দেখানো হয়েছে এতে। ভাগ্যই খারাপ, তা না হলে ঠিক এ জায়গার প্যাপিরাস ভেঙে খসে পড়বে কেন। চোখে চশমা পরলেন। পড়ছেন রোয়েনকে শোনাবার জন্য।

সিঁড়ে বেয়ে হাপির ঠিকানায় পৌঁছতে হলে অনেকগুলো ধাপ নামতে হবে। কঠিন পরিশ্রম আর অনেক চেষ্টার পর দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছলাম আমরা। তারপর আর এগুলাম না, কারণ এখানেই রাজকুমার একটা দৈববাণী পেল। স্বপ্নের ভেতর তার বাবা, মৃত দেবতা ফারাও, দেখা দিলেন তাকে এবং জানালেন, দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ জায়গাতেই আমি অনন্তকাল বিশ্রাম নিব।

চোখ থেকে চশমা খুলে রোয়েনের দিকে তাকালেন ডুরেঈদ। দ্বিতীয় ধাপ, বললেন তিনি।

অন্তত এ একবার স্পষ্ট একটা বর্ণনা দিয়েছে টাইটা। সে তার স্বভাবসুলভ হেঁয়ালি এখানে ব্যবহার করে নি।

এসো, স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফগুলো দেখি, বলল রোয়েন, গ্লসি শিটগুলো নিজের দিকে টেনে নিল। টেবিল ঘুরে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ডুরেঈদ। একটা গিরিখাদে ওরা বাধা পেল। খাদের ভেতর স্বাভাবিক বাধা কী হতে পারে? খানিক পরপর নদীর তলায় ঢাল থাকতে পারে, স্রোত ওখানে প্রবল হবে। কিংবা একটা জলপ্রপাত থাকতে পারে। ওটা যদি দ্বিতীয় জলপ্রপাত হয়, তাহলে এ জায়গায় ছিল ওরা- স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফের এক জায়গায় আঙুল ঠেকালো রোয়েন। ওখানে বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়েছে সরু একটা নদী।

হঠাৎ মনোযোগ ছুটে গেল রোয়েনের, মাথা তুললাম। শুনছ? গলার স্বর বদলে গেছে, তীক্ষ্ণ ও সতর্ক শোনাল।

কী? ডুরেঈদও মুখ তুললেন।

কুকুর, বলল রোয়েন।

ওই ব্যাটা দোআঁশলাটা, বললেন ডুরেঈদ, ঘেউ ঘেউ করে রাতটাকে ভৌতিক করে তোলে। ওটাকে আর না তাড়ালেই নয়।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার ঘরে বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল ওরা। পেছন দিকে পাম গাছের তলায় শেডের ভেতর জেনারেটরের নরম শব্দ থেমে গেছে। মরু রাতের স্বাভাবিক অংশ হয়ে ওঠায় শুধু থেমে গেলে ওটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ওরা।

চাতালের দরজা দিয়ে তারার অস্পষ্ট আলো ঢুকছে ভেতরে। উঠে গিয়ে দরজার পাশের একটা শেলফ থেকে তেল ভরা ল্যাম্পটা নামালেন ডুরেঈদ, জ্বলার পর চেহারায় কৃত্রিম বা সকৌতুক হতাশা ফুটিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালেন। যাই, দেখে আসে…

ডুরেঈদ, বাধা দিল রোয়েন, কুকুরটা!

কয়েক সেকেন্ড কান পেতে শোনার পর একটু উদ্বিগ্ন দেখালো ডুরেঈদকে। কুকুরটা একদম চুপ মেরে গেছে। ও কিছু না, বলে দরজার দিকে এগুলেন তিনি।

তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিল রোয়েন, ডুরেঈদ, সাবধান কিন্তু!

গুরুত্ব না দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন ডুরেঈদ, বেরিয়ে এলেন চাতালে।

বাইরে একটা ছায়া নড়তে দেখলো রোয়েন, ভাবল বাতাসে মাচার উপর কোনো লতা বা ডাল দোল খাচ্ছে। তারপর ওর খেয়াল হলো, রাতটা একদম স্থির, এতোটুকু বাতাস বইছে না। এ সময় লোকটাকে দেখতে পেল, ফ্ল্যাগস্টোনের উপর দিয়ে দ্রুত ও নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। মাছ ভর্তি পুকুরটা পাকা চাতালের মাঝখানে, ওটাকে ঘুরে এগুচ্ছেন ডুরেঈদ; লোকটা তার পেছন দিকে চলে আসছে।

ডুরেঈদ! রোয়েনের চিৎকার শুনে দ্রুত আধ পাক ঘুরলেন ডুরেঈদ, উঁচু করলেন ল্যাম্পটা।

কে তুমি? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এখানে কী চাও?

আগন্তুক নিঃশব্দে তাঁর কাছে চলে আসছে। গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা আলখেল্লা ফুলে উঠছে পায়ের চারপাশে, এক প্রস্থ কাপড়ে মাথাটা ঢাকা। ল্যাম্পের আলোয় ডুরেঈদ দেখলেন মাথার সাদা কাপড়ের একটা প্রান্ত মুখের উপর নামিয়ে এনে লোকটা তার চেহারা ঢেকে রেখেছে।

লোকটা রোয়েনের দিকে পেছন ফিরে রয়েছে, তার হাতের ছুরিটা তাই দেখতে পায় নি ও। তবে ডুরেঈদের পেট লক্ষ্য করে ছোরা মারার ভঙ্গিটা চিনতে পারল। ব্যথায় কাতরে উঠলেন ডুরেঈদ, কুঁজো হয়ে গেলেন। আততায়ী ছুরিটা বের করে নিয়ে আবার ঢোকালো, তবে এবার ল্যাম্প ফেলে দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললেন ডুরেঈদ।

খসে পড়া ল্যাম্পের শিখা দপদপ আওয়াজ করছে। আলো ও ছায়ার ভেতর ধস্তাধস্তি করছে দু জন। রোয়েন দেখতে পেল ডুরেঈদের সাদা শার্টের সামনের দিকটায় গাঢ় একটা দাগ ছড়িয়ে পড়ছে।

দৌড় দাও! চিৎকার করছেন ডুরেঈদ। যাও, রোয়েন, যাও! লোকজনকে ডাকো! ওকে আমি ধরে রাখতে পারছি না! রোয়েন জানে ডুরেঈদ নেহাতই শান্তশিষ্ট একজন ভদ্র মানুষ, জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে বইপত্র নিয়ে কাটিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে লোকটার সঙ্গে তিনি পারছেন না।

যাও, রোয়েন, যাও! প্লিজ, নিজেকে বাঁচাও! গলার আওয়াজই বলে দিল রোয়েনকে, ডুরেঈদ দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তবে এখনো তিনি আততায়ীর ছুরি ধরা হাতটা ছাড়েন নি।

আতঙ্কে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল রোয়েন, হঠাৎ সংবিৎ ফিরে ছুটলো দরজার দিকে। চাতালে বেরিয়ে এলো বিড়ালের মতো ক্ষিপ্র বেগে। আততায়ীকে ডুরেঈদ আটকে রেখেছেন, লোকটা যাতে রোয়েনের পথ আগলাতে না পারে।

নিচু পাঁচিল টপকে ঝোঁপের মাঝখানে নামলো রোয়েন, প্রায় সেঁধিয়ে গেল দ্বিতীয় লোকটার আলিঙ্গনের ভেতর। তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে মোচড় খেলো, ছিটকে সরে গিয়ে ছুটলো আবার লোকটার লম্বা করা হাতের আঙুল আঁচড় কাটলো ওর মুখে। নিজেকে প্রায় ছাড়িয়ে নিয়েছে রোয়েন, এ সময় আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আটকে গেল গলার কাছে ওর সুতি ব্লাউজে।

একবার লোকটার হাতে ছুরি দেখতে পেল রোয়েন, তারার আলো লেগে ঝিক করে উঠলো রূপালি একটা লম্বা আকৃতি। ওটা দেখামাত্র মৃত্যু ভয় নতুন শক্তি যোগাল ওকে। ফড় ফড় করে ছিঁড়ে গেল কামিজ, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটছে রোয়েন-তবে তারপরও একটু দেরি হয়ে গেছে ওর ছুরির ফলাটাকে পুরোপুরি এড়াতে পারলো না। বাহুর উপর দিকটা চিরে গেছে, বুঝতে পেরে বাঁচার আকুলতা আরো তীব্র হয়ে উঠলো, সমস্ত শক্তি এক করে লোকটাকে লাথি মারল রোয়েন। লাগলো শরীরের নিচের দিকে নরম কোথাও, তবে ঝাঁকি খেলো ওর গোড়ালি আর হাঁটু। লোকটা গুঁড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়ল মাটিতে।

পাম বীথির ভেতর দিয়ে ছুটছে রোয়েন। প্রথম দিকে খেয়াল থাকলো না কোনো দিকে যাচ্ছে বা কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ছুটছে যতক্ষণ শক্তিতে কুলায় দূরে সরে যাবার চেষ্টায়। তারপর ধীরে ধীরে আতঙ্কটা নিয়ন্ত্রণে আনল। ঝট করে পেছন দিকে তাকালো, কেউ ওর পিছু নেয় নি। লেকের কিনারায় পৌঁছে ছোটার গতি কমাল, বুঝতে পারছে তা না হলে হাঁপিয়ে যাবে। অনুভব করলো কাঁধের নিচে বাহু থেকে গরম রক্ত গড়াচ্ছে, হাত বেয়ে নেমে এসে আঙুলের ডগা থেকে ঝড়ে পড়ছে টপ টপ করে।

থামলো রোয়েন, বসে হেলান দিল একটা পাম গাছে। এক ফালি কামিজ ছিঁড়ে বাহুর ক্ষতটা বাঁধল, অক্ষত হাতটা এতো বেশি কাঁপছে যে কাজটা শেষ করতে অনেক সময় লাগলো। বাম হাত দাঁত দিয়ে ধরে গিট বাঁধল ব্যান্ডেজে, এখন আর আগের মতো রক্ত বের হচ্ছে না। কোনো দিকে যাবে বুঝতে পারছে না রোয়েন। এদিক ওদিক তাকাতে একটা জানালো দেখতে পেল, ভেতরে ল্যাম্প জ্বলছে। কাছাকাছি সেচ খালটার পাশে ওটা আলেয়ার ঘর, চিনতে পারলো ও। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকেই এগুলো।

একশো কদমও এগোয় নি, শুনতে পেল পাম বীথির ভেতর কে যেনো কাকে আরবিতে বলছে, ইউসুফ, মেয়েলোকটা তোমার এদিকে আসে নি তো?

সঙ্গে সঙ্গে রোয়েনের সামনের অন্ধকারে একটা টর্চ জ্বলে উঠলো, শোনা গেল আরেক লোকের গলা, না, এদিকে আসে নি।

ভাগ্যক্রমে সামনের লোকটার হাতে গিয়ে পড়ে নি রোয়েন। ঝপ করে বসে পড়লো, মরিয়া হয়ে চারদিকে তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজছে। ওর পেছনের পাম বীথির ভেতর থেকে আরেকটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে, ওর ফেলে আসা পথ ধরে। নিশ্চয়ই এ লোকটাকেই লাথি মেরেছিল, তবে এরই মধ্যে আঘাতটা সামলে নিয়েছে।

দু দিকে বাধা, কাজেই লেকের দিকে ফিরে এলো রোয়েন। রাস্তাটাও ওদিকেই। এতো রাতে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ঈশ্বর চাইলে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়েও যেতে পারে কাউকে। ছুটতে গিয়ে আছাড় খেলো রোয়েন, হাঁটুর চামড়া উঠে গেল, লাফ দিয়ে সোজা হয়ে আবার ছুটলো।

দ্বিতীয়বার আছাড় খাবার পর হাতে ঠেকল কমলালেবু সাইজের একটা পাথর। আবার ছোটার সময় মুঠোয় থাকলো ওটা, অস্ত্র হিসেবে খানিকটা অভয় দিচ্ছে ওকে।

বাহুর ক্ষমতা ব্যথা করছে। ডুরেঈদের কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে। তার আঘাত যে গুরুতর, ও জানে। বাঁচবে তো? যেভাবে হোক ডুরেঈদের কাছে সাহায্য নিয়ে ফিরতে হবে ওকে। ওর পেছনে পাম বীথির ভেতর টর্চ নিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে লোক দু জন। ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে তারা। খানিক পর পর পরস্পরের সাড়া নিচ্ছে।

একটা নালা থেকে অবশেষে রাস্তার উপর উঠে এলো রোয়েন। বোধ হয় স্বস্তি পাওয়াতেই পা দুটো কাঁপতে শুরু করলো, মনে হলো এ পা নিয়ে আর হাঁটতে পারবে না। তবু চেষ্টা করলো রোয়েন। গ্রামের দিকে ঘুরলো ও। হাঁটা শুরু করছে, তবে প্রথম বাঁকে এখনো পৌঁছায় নি। এ সময় গাছপালার আড়াল থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসতে দেখলো একজোড়া হেডলাইটকে। রাস্তার মাঝখান ধরে গাড়িটার দিকে ছুটল রোয়েন। বাঁচান! আরবিতে চিৎকার করছে। সাহায্য করুন, প্লিজ!

বাঁক ঘুরলো গাড়িটা। হেডলাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার আগে রোয়েন দেখলো গাঢ় রঙের ছোট একটা ফিয়াট ওটা। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে থামানোর জন্য হাত নাড়ছে ও, হেডলাইটের আলোয় রাস্তাটাকে মনে হচ্ছে

থিয়েটারের স্টেজ। সামনে থামলো ফিয়াট, ছুটে পাশে চলে এলো রোয়েন, দরজার হাতল ধরে টান দিল।

প্লিজ, বাঁচান! ওরা…

দরজা খুলে গেল, লাফ দিয়ে নিচে নেমে রোয়েনের আড়ষ্ট ডান হাতটা খপ করে ধরে ফেললো ড্রাইভার। হ্যাঁচকা টানে ব্যাক ডোরের দরজা খুলল সে। ইউসুফ! বশিত! পাম বীথির দিকে মুখ ঘুরিয়ে ডাক দিল। মেয়েটাকে পেয়েছি! ইউসুফ আর বশিত সাড়া দিচ্ছে, শুনতে পেল রোয়েন। দেখলো টর্চের আলো ঘুরে গিয়ে এদিকেই সরে আসছে দ্রুত।

ওর ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ওকে নত করার চেষ্টা করছে ড্রাইভার,গাড়ির ব্যাক সীটে ঢোকাতে চায়। হঠাৎ খেয়াল হলো রোয়েনের, বাম হাতের মুঠোয় পাথরটা এখনো আছে। একটু ঘুরলো ও, শক্ত করলো পেশী, মুঠোয় ধরা পাথরটা সজোরে ঠুকে দিল লোকটার মাথার পাশে। শেষ মুহূর্তে খুলি বাঁচাবার চেষ্টা করলো। সে ফলে পাথরটা গুঁড়িয়ে দিল তার কপালের হাড়। বিনা প্রতিবাদে রাস্তার উপর ঢলে পড়লো লোকটা, তারপর আর নড়ল না।

পাথরটা ফেলে দিয়ে আবার ছুটছে রোয়েন। হঠাৎ খেয়াল হলো, হেডলাইটের তৈরি আলোর পথ ধরে ছুটছে সে, তার প্রতিটি নড়াচড়া আলোকিত। পাম বীথি থেকে বেরিয়ে এসে ওর পিছু নিয়েছে অপর দু লোক, চিৎকার করে কী যেনো বলছে তারা। পেছন দিকে তাকাতে রোয়েন দেখলো, দ্রুত কাছে চলে আসছে খুনীরা। বুঝতে পারল, বাঁচার একমাত্র উপায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। ঘুরে রাস্তার কিনারায় চলে এলো, ঢাল বেয়ে তর তর করে নামছে। নামার গতি নিয়ন্ত্রণে থাকলো না, লেকের কোমর সমান পানিতে চলে এলো রোয়েন। আতঙ্ক ও অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারে নি রাস্তার পাকে লেকের কাছে চলে এসেছে। এখন আর ঢাল বেরিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় নেই। তবে মনে পড়লো, সামনে প্যাপিরাস আর নল খাগড়া আছে, লুকানোর জায়গা পাওয়া যেতে পারে।

লেকের গভীরে চলে এলো রোয়েন, পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে না। সাঁতরাচ্ছে ও। গলায় ওড়নাটা নেই, কোথায় খসে পড়েছে বলতে পারবে না। কামিজ আর সালোয়ার খুব বেশি ঢোলা হওয়ার সাঁতার কাটতে অসুবিধে হচ্ছে। পানির উপর থাকা নিরাপদ নয় মনে করে কিছুক্ষণ ডুব সাঁতার দিল। সন্দেহ নেই, ইতোমধ্যে রাস্তার কিনারায় পৌঁছে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে লোকগুলো।

মাথার উপর নল খাগড়া ঝোঁপ পেয়ে থামলো রোয়েন। আরো খানিকটা ভেতরে সরে এলো। পানির উপর শুধু নাকটা তুলে রেখেছে, মুখটা রাস্তার উল্টো দিকে ফেরানো। রোয়েন জানে ওর কালো চুলে টর্চের আলো প্রতিফলিত হবে না।

কান দুটো পানির নিচে থাকলেও রাস্তার উপর থেকে লোকগুলোর জোরালো গলা শুনতে পাচ্ছে রোয়েন। কিনারায় দাঁড়িয়ে নল খাগড়ার উপর টর্চের আলো ফেলছে, খুঁজছে ওকে। একবার টর্চের আলো ওর মাথার চারপাশে ঘোরাফেরা করলো, ডুব দেওয়ার জন্য বড় করে শ্বাস নিল রোয়েন। তবে না, আলোটা সরে গেল।

মাথা একটু তুললাম রোয়েন, কান দুটো পানির উপর উঠে এলো। লোকগুলো আরবিতে কথা বলছে। যে লোকটার নাম বশিত তার গলা চিনতে পারল। মনে হলো সে ওদের লীডার, কাকে কী করতে হবে বলে দিচ্ছে। ইউসুফ, যাও, বেশ্যাটাকে তুলে আনেনা।

ঢাল বেয়ে নেমে আসার আওয়াজ পেল রোয়েন। ছপ ছপ শব্দ তুলে পানিতে নামলো ইউসুফ। আরো সামনে, রাস্তা থেকে বলল বশিত। ওদিকে, নল খাগড়ার ভেতর, আমি যেখানে টর্চের আলো ফেলছি।

পানি ওদিকে অনেক গভীর। কেউ আমরা সাঁতার জানি না। তুমি না।

ওই তো, তোমার ঠিক সামনে। নল খাগড়ার ভেতর। আমি ওর মাথা দেখতে পাচ্ছি। বশিত উৎসাহ দিল তাকে। ধরা পড়ে গেছে, বুঝতে পেরে যতটা সম্ভব পানির নিচে মাথা নামালো রোয়েন।

চারদিকে প্রচুর পানি ছিটিয়ে ওর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ইউসুফ। অকস্মাৎ আল্লাহ রে, আল্লাহ বলে চিৎকার দিল সে, ঘুরে উঁচু পাড়ের দিকে পালাচ্ছে। কিছু না, নল খাগড়ার ভেতর থেকে এক ঝাঁক হাঁস ভয় পেয়ে সশব্দে ডানা মেলেছে আকাশে। রাস্তা থেকে বশিত হুমকি-ধামকি দিলেও কাজ হলো না, ইতোমধ্যে ঢালের উপর উঠে পড়েছে ইউসুফ, সে আর পানিতে নামতে রাজি নয়। ঢাল বেয়ে রাস্তায় উঠেছে সে, বলল, আসল গুরুত্ব স্কোলের, মেয়েটার তেমন গুরুত্ব নেই। স্ক্রোল ছাড়া টাকা পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।

রাস্তার কিনারা থেকে গাড়ি কাছে ফিরে গেল লোকগুলো। উঠে বসলো সবাই, গ্রামের দিকে চলে গেল গাড়ি। তারপরও ভয়ে পানি থেকে উঠছে না রোয়েন, ভাবছে অন্ধকার রাস্তায় ওরা কাউকে পাহারায় রেখে গেছে কিনা। খানিক পর ঠাণ্ডায় কাঁপুনি ধরে গেল, পানি থেকে না উঠলে মারা যেতে পারে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না, শরীরে শক্তি আছে বলেও মনে হলো না। মরি মরব, দিনের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত পানি ছেড়ে আমি উঠব না।

এবাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ কাটল। আগুনের আভায় আকাশটাকে রাঙা হয়ে উঠতে দেখলো রোয়েন। পাম গাছগুলোর ভেতর কমলা রঙের শিখাও মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কী ঘটছে বুঝতে পেরে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গেল রোয়েন। কীভাবে শক্তি ফিরে পেল বলতে পারবে না, লেকের পাড়ে উঠে এসে কাদায়

দাঁড়িয়ে থাকলো। ঠক ঠক করে কাঁপছে, ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, পানি গড়াচ্ছে চোখ দুটো থেকে।

ভিলায় আগুন দিয়েছে ওরা! বিড়বিড় করলো রোয়েন। ডুরেঈদ! ওহ্ গড, প্লিজ! নো, নো!

ঢাল বেয়ে উঠলো রোয়েন, জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে ছুটছে।

*

শেষ বাঁকটা ঘোরার আগেই হেডলাইট আর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল বশিত, ভিলার চালু ড্রাইভওয়ে ধরে গড়িয়ে এসে চাতালের নিচে থামলো ফিয়াট। পাথুরে ধাপ বেয়ে তিনজনই তারা চাতালে উঠে এলো। বশিত যেখানে ফেলে গেছে সেখানেই পুকুরের পাশে পড়ে রয়েছেন ডুরেঈদ। সেদিকে একবারও না তাকিয়ে পাশ কাটালো তারা, সরাসরি স্টাডিরূপে ঢুকলো। নাইলনের সস্তা টোট ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো বশিত। এরই মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি কাজ সারো।

দোষটা ইউসুফের, ফিয়াটের ড্রাইভার কথা বলছে, সে-ই তো মেয়েটাকে পালাতে দিল।

রাস্তায় তুমিও একটা সুযোগ পেয়েছিলে, খেঁকিয়ে উঠলো ইউসুফ। কিছু করতে পারো নি।

থামো! দু জনকেই ধমক দিল বশিত। টাকা পেতে চাইলে কোনো ভুল করা চলবে না। টর্চের আলোয় টেবিলে পড়ে থাকা স্ক্রোলটা দেখালো সে। এটাই সেটা। নিশ্চতভাবেই জানে, চিনতে পারার জন্য ক্রোলের ফটোগ্রাফ দেখানো হয়েছে তাকে। প্রতিটি জিনিস চেয়েছে ওরা–প্রতিটি ম্যাপ আর ফটো। কাগজপত্র, বই, কিছুই রেখে যাওয়া চলবে না। দ্রুত হাতে টেবিলের সমস্ত জিনিস টোট ব্যাগে ভরে ফেলা হলো। বশিত বলল, এবার ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হয়। নিয়ে এসো তাকে।

চাতালে বেরিয়ে এলো দু জন, ডুরেঈদের গোড়ালি ধরে টেনে নিয়ে এলো স্টাডিতে। আনার সময় তাঁর মাথা পাথুরে ধাপের উপর আর দোড়গোড়ায় ঘন বাড়ি খেলো, তার রক্ত মেঝেতে লাল ও ভেজা দাগ ফেলে দিল, টর্চের আলোয় চকচক করছে। . .

ল্যাম্পটা আনো! নির্দেশ দিল বশিত। ডুরেঈদের ফেলে দেওয়া ল্যাম্পটা কুড়িয়ে আনল একজন। অনেক আগেই নিভে গেছে সেটা। কানের কাছে তুলে নাড়লো বশিত। তেলে ভর্তি হয়ে আছে, বলল সে, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ছিপি খুলল। যাও, ব্যাগটা গাড়িতে রেখে এসো।

সবাই বেরিয়ে গেল স্টাডি থেকে। বশিত ল্যাম্পের প্যারাফিন ঢালল ইবনে আল-সিমার শার্ট আর ট্রাউজারে। কাজটা শেষ করে শেলফগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো সে, বাকি তেল দিয়ে বই আর পাণ্ডুলিপিগুলো ভেজাল। ল্যাম্প ফেলে দিয়ে আলখেল্লার ভেতর থেকে দিয়াশলাই বের করে জ্বালল। প্রথমে বুককেসে আগুন দিল সে। দপ করে জ্বলে উঠলো প্যারাফিন, স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরে গেল। ডুরেঈদের কাছে ফিরে এলো সে। দিয়াশলাইয়ের আরেকটা কাঠি জ্বেলে তাঁর প্যারাফিন আর রক্তে ভেজা কাপড়ে ফেললো।

ডুরেঈদের বুকের উপর নীল কয়েকটা শিখা নাচতে শুরু করলো। কাপড় পুড়ে যাচ্ছে, আগুন ধরছে মাংসে, সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ওগুলোর রঙ। এক সময় কমলা দেখালো, মাথা থেকে স্কুল বা ভুসা ভর্তি ধোঁয়া উঠছে।

ছুটে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ল বশিত। চলে গেল ওরা।

*

অসহ্য ব্যথা জাগিয়ে দিল ডুরেঈদকে। গভীর অতল জীবনের প্রান্তসীমা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য এরকম তীব্রতারই প্রয়োজন ছিল। গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর্যায়ে প্রথমেই তিনি নিজের মাংস পোড়ার গন্ধ পেলেন, তারপরই নিদারুণ যন্ত্রণা পুরো শক্তিতে আঘাত করলো তাকে। একটা ঝাঁকি খেয়ে কাঁপুনি শুরু হওয়ার পর তা আর থামছে না। চোখ মেলে নিজের দিকে তাকালেন তিনি।

কালো ছাই হয়ে যাচ্ছে কাপড়, কুঁকড়ে উঠছে। আর ব্যথা যে এতো তীব্র হতে পারে, তার কোনো ধারণা ছিল না। অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন, কামরার ভেতর তার চারপাশে আগুন জ্বলছে। ধোয়া আর উত্তাপের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার উপর দিয়ে, এ-সবের ভেতর দিয়ে দোড়গোড়ার আকৃতিটা কোনো রকমে দেখা গেল। যন্ত্রণার অবসান চাইছেন তিনি, মৃত্যু কামনা করছেন।

তারপর রোয়েনের কথা মনে পড়লো দগ্ধ, কালো ঠোঁট খুলে প্রিয়তমার নামটা উচ্চারণ করতে চাইছেন, কোনো আওয়াজ বের হলো না। শুধু রোয়েনের চিন্তা নড়াচড়ার শক্তি এনে দিল তাঁকে। কারণ, রোয়েনকে তিনি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। একটা গড়ান দিলেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে আগুনের আঁচ ঝলসে দিল পিঠ। গুঙিয়ে উঠে আবার গড়ালেন, দরজার দিকে একটু এগুলেন।

নড়তে প্রবল ইচ্ছাশক্তি লাগছে, প্রতিটি নড়াচড়া নতুন করে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা বয়ে আনছে। তবে গড়ান দিয়ে আবার যখন চিৎ হলেন, তাজা ও ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়ায় একটু আরাম বোধ হলো। বাড়তি শক্তিটুকু ধাপগুলোর উপর দিয়ে ঠাণ্ডা পাকা চাতালে নেমে আসতে সাহায্য করলো তাকে।

কাপড় আর শরীরে এখনো আগুন জ্বলছে। নিস্তেজ বাড়ি মেরে শিখাগুলো নেভাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাত দুটো, জ্বলন্ত, কালো থাবা হয়ে আছে। তারপর পোনা ছাড়া পুকুরটার কথা মনে পড়লো। শরীরটাকে ঠাণ্ডা পানিতে ফেলে দেওয়ার চিন্তা আরেকটু শক্তি এনে দিল মনে। ক্রল করে সেদিকে এগুলেন, শিরদাঁড়া ভাঙা সাপের মতো।

মাংস থেকে উকটগন্ধী ধোয়া উঠছে, গলায় বেঁধে যাওয়ায় কাশি শুরু হলো, তবু মরিয়া হয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছেন। পাথুরে মেঝের খাঁজে ফোস্কা ওঠা ত্বকের কিছুটা রয়ে গেল, শেষ একটা গড়ান দিয়ে পুকুরে পড়লেন তিনি। হিসস করে শব্দ হলো, বাষ্প উঠলো খানিকটা, ম্লান মেঘ মুহূর্তের জন্য অন্ধ করে দিল তাকে। জ্বলন্ত মাংসে ঠাণ্ডা পানির আলিঙ্গন অসহনীয় ব্যথায় জন্ম দিল, প্রায় অচেতন হয়ে পড়লেন ডুরেঈদ।

আবার যখন সচেতন হলেন, ভেজা মাথা তুলে দেখলেন শেষ প্রান্তের ধাপ বেয়ে চাতালে উঠে আসছে একটা ছায়ামূর্তি। কে চিনতে পারলেন না, তবে আসছে বাগানের দিক থেকে। তারপর জ্বলন্ত ভিলার আলো পড়লো ছায়ামূর্তির গায়ে, এবার রোয়েনকে চিনতে পারলেন তিনি। ভেজা চুল লেপ্টে আছে মুখে, ছেঁড়া ও কাদামাখা কাপড় থেকে লেকের পানি ঝরছে। ডান হাতের উপর দিকে ব্যান্ডেজ, এখনো সামান্য রক্ত চুয়াচ্ছে।

রোয়েন তাঁকে দেখতে পায় নি। চাতালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত স্টাডিরূপের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ডুরেঈদ কি ওই আগুনের ভেতর? প্রশ্নটা মনে জাগতেই সামনে বাড়লো রোয়েন, কিন্তু আগুনের আঁচ নিরেট পাঁচিলের মতো, ঠেকিয়ে দিল ওকে। সেই মুহূর্তে খসে পড়লো ছাদ, গর্জে উঠে আকাশের দিকে লাফ দিল শিখাগুলো। চারদিকে টুকরো টুকরো আগুন ছড়িয়ে পড়লো। পিছিয়ে এলো রোয়েন, হাত তুলে মুখ ঢাকল।

মুখ খুলে রোয়েনকে ডাকছেন ডুরেঈদ। কিন্তু ধোঁয়ায় পোড়া গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ঘুরে ছুটল রোয়েন, ধাপ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ডুরেঈদ বুঝতে পারলেন, লোকজনকে ডাকতে যাচ্ছে রোয়েন। ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শেষ একবার চেষ্টা করলেন তিনি। কাকের মতো কর্কশ কা-কা আওয়াজ বের হলো গলা থেকে।

বন করে ঘুরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন। চিৎকারটা শুরু হলো কয়েক সেকেন্ড পর। ডুরেঈদের ঘাড়ের উপর ওটা কোনো মানুষের মাথা নয়। খুলির চুল অদৃশ্য হয়েছে, পুড়ে ছাই হবার পর বেশিরভাগই খসে পড়েছে; সিদ্ধ মাংসের ফালি ঝুলছে গাল আর চিবুক থেকে। গোটা মুখ কালো, ভেতরে কাঁচা মাংস দেখা যাচ্ছে। পিছু হটছে রোয়েন। ডুরেঈদ যেনো কুৎসিত একটা প্রাণী।

রোয়েন, আওয়াজটা এতো কর্কশ, কোনো রকমে চেনা গেল। আবেদনের ভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন তিনি। থামল রোয়েন, আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে ছুটে এসে বাড়ানো হাতটা ধরল।

ওহ্, গড! ওহ্, গড! ফোঁপাচ্ছে রোয়েন। টেনে ডুরেঈদকে পুকুর থেকে তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাঁর হাতের চামড়া চলে এলো ওর মুঠোর ভেতর, সার্জিকাল রাবার গ্লাভের মতো। চামড়া ছাড়ানো নগ্ন ও রক্তাক্ত তালু বীভৎস দেখাচ্ছে।

পুকুরের কিনারায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে স্থির হলো রোয়েন, ডুরেঈদকে দুহাতের ভেতর তুলে নিতে চাইছে। ও জানে, ডুরেঈদের ভারী শরীরটা তুলতে পারবে না। সে চেষ্টা করলে আরো বেশি ব্যথাও পাবেন ডুরেঈদ। এখন শুধু জড়িয়ে ধরে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ও। সন্দেহ নেই মারা যাচ্ছেন উনি, এভাবে পুড়ে যাবার পর কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না।

লোকজন এখুনি ছুটে আসবে, আরবিতে ফিসফিস করছে রোয়েন। নিশ্চয়ই কেউ আগুন দেখেছে।

রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর মোচড় খাচ্ছেন ডুরেঈদ। মরণঘাতি জখমের ব্যথায় আর কথা বলার চেষ্টায়। স্ক্রোল? কোনো রকমে শুনতে পেল রোয়েন। জ্বলন্ত ভিলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ও।

নেই, বলল রোয়েন। সব শেষ। হয় পুড়ে গেছে, নয়তো চুরি হয়ে গেছে।

হাল… ছেড়ো… না, বললেন ডুরেঈদ, শব্দের চেয়ে ফপ ফপ আওয়াজের সঙ্গে বাতাসই বেশি বের হচ্ছে গলা থেকে। এতো পরিশ্রম… এতো সাধনা…

সব শেষ, আবার বলল রোয়েন। ওগুলো ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না…

না! অস্পষ্ট আওয়াজ, তবে প্রতিবাদের সুরটা তীব্র। আমার জন্য… আমার শেষ ইচ্ছে…।

এ-সব বোলো না, ডুরেঈদ! মিনতি করলো রোয়েন। তুমি ভালো… সুস্থ হয়ে উঠবে।

কথা দাও, বললেন ডুরেঈদ। কথা দাও আমাকে!

কোনো স্পনসর নেই। আমি একা। একা আমার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়।

নিকোলাস! বললেন ডুরেঈদ। ঝুঁকে তার আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ওর কানে অগ্নিদগ্ধ ঠোঁট ঠেকল। হারপার নিকোলাস! আবার বললেন তিনি।

কঠিন মানুষ… বুদ্ধিমান মানুষ..সাহসী… এতোক্ষণে তাঁর কথা ধরতে পারলো রোয়েন। হ্যাঁ, অবশ্যই, সম্ভাব্য স্পনসরদের তালিকায় হারপার নিকোলাসের নামটা সবার আগে আছে। রোয়েন জানে, ডুরেঈদ এ হারপার নিকোলাসকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। এ ভদ্রলোক যে তাঁর প্রথম পছন্দ, তা তিনি অনেকবার রোয়েনকে জানিয়েছেন।

কিন্তু কী বলব তাকে আমি? তিনি তো আমাকে চেনেনও না। কী করে তাঁকে বিশ্বাস করাবো? আসল স্ক্রোলই তো নেই!

ওর উপর আস্থা রাখবে। ফিসফিস করলেন ডুরেঈদ। ভালো মানুষ। আস্থা রাখবে… আবার ব্যাকুল আবেদন প্রকাশ পেল তাঁর কথায়, আমাকে কথা দাও!

হঠাৎ মনে পড়লো রোয়েনের। কায়রোয়, ওদের ফ্ল্যাটে, একটা নোটবুক আছে; আরো আছে টাইটা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ভর্তি হার্ড ড্রাইভ, ওর পি.সি.-তে।, সব শেষ হয়ে যায় নি। ঠিক আছে, রাজি হলো ও। কথা দিচ্ছি, ডুরেঈদ।

শরীরের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে মানবিক কোনো অনুভূতি প্রকাশ পাবার কথা নয়, তা সত্ত্বেও ফিসফিস করার সময় ডুরেঈদের গলায় ক্ষীণ সন্তুষ্টির আভাস থাকলো। মাই ফ্লাওয়ার… মাথাটা সামনের দিকে নত হলো, রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।

গ্রামের কৃষকরা রোয়েনকে ওই অবস্থাতেই দেখতে পেল, পুকুরের কিনারায় ডুরেঈদকে জড়িয়ে ধরে আছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। ইতোমধ্যে ভিলার আগুন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, আগুনের আভার চেয়ে ভোরের আলো এখন আরো বেশি উজ্জ্বল।

*

মিউজিয়াম আর অ্যান্টিকুইটিজ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সব স্টাফই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য মরুদ্যানে হাজির হলেন। এমন কি আতালান আবু সিন, সাংস্কৃতিক ও পর্যটন মন্ত্রীও কায়রো থেকে কালো এয়ার কন্ডিশনড মার্সিডিজ নিয়ে চলে এলেন। মন্ত্রী হওয়ার সূত্রে তিনিই ইবনে ডুরেঈদের বস্।

মুসলমান, তাই গির্জার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। নাহুত গাদ্দাবি তার মামার পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর মা মন্ত্রীর ছোট বোন। ডুরেঈদ প্রায়ই হাসিমুখে বলতেন, আর্কিওলজিতে ভাগ্নের সমস্ত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার অভাব এ আত্মীয়তার সম্পর্ক পুষিয়ে দিয়েছে। প্রশাসক হিসেবেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তবে সেসব প্রকাশের উচ্চারণ করতে সাহস পায় না কেউ।

গির্জার ভেতর ধূপের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রোয়েনের। কালো পোশাক পরা পুরোহিত বাইবেল পাঠ করছেন। ডান বাহুর ক্ষত শুকাতে শুরু করায় টান পড়ছে স্টিচে, নতুন করে শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। অলংকৃত, গিলটি করা বেদির সামনে লম্বা কালো কফিন যতবার দেখছে রোয়েন, ততবার চুলবিহীন খুলি ছাড়ানো ডুরেঈদের মাথাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। টলে উঠছে ও, তাল সামলাবার জন্য সীটের হাতল আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে।

অবশেষে গির্জার অনুষ্ঠান শেষ হলো। তবে রোয়েনের কাজ এখনো শেষ হয় নি। সেই একমাত্র নিকটাত্মীয়, কাজেই শব মিছিলের সামনে থাকতে হলো ওকে। তমাল বীথির ভেতর দিয়ে এগুলো মিছিল, শেষ মাথায় পারিবারিক গোরস্থানে ডুরেঈদের আত্মীয়-স্বজনরা অপেক্ষা করছে।

কায়রোয় ফিরে যাবার আগে আতালান আবু সিন রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে এলেন। দু একটা সান্ত্বনার কথাও শোনালেন তিনি। আইন-শৃঙ্খলার কী সাংঘাতিক অবনতি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। এ জঘন্য . অপরাধের জন্য দায়ী ক্রিমিনালদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। প্লিজ, যে কয় দিন ইচ্ছে ছুটি নিন আপনি।

আমি সোমবারে মিউজিয়ামে আসছি, জবাব দিল রোয়েন।

পকেট ডায়েরি বের করে পাতা ওল্টালেন মন্ত্রী, বললেন, তাহলে বিকেল চারটার সময় দেখা করবেন আমার সঙ্গে। বিদায় নিয়ে মার্সিডিজের দিকে এগুলেন তিনি।

এরপর হ্যান্ডশেক করতে এলেন নাহুত গাদ্দাবি। ফ্যাকাসে চামড়ায় অসংখ্য তিল আর চোখের নিচে কফি রঙের দাগ থাকলেও নাহুত যথেষ্ট লম্বা। মাথায় ঢেউ খেলানো চুল, দাঁতগুলো খুব সাদা। দামি স্যুট আর সেন্ট ব্যবহার করেন তিনি। তার বাড়ানো হাতটা দেখতে না পাবার ভান করলো রোয়েন। গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন নাহুত। ভালো মানুষরা তাড়াতাড়ি চলে যায়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। ডুরেঈদকে আমি শ্রদ্ধা করতাম।

মাথা ঝাঁকালো রোয়েন, মুখে কিছু বলল না, জানে ডাহা মিথ্যে কথা কলছেন নাহুত। ডুরেঈদ আর তাঁর ডেপুটির মধ্যে কোনোকালে সদ্ভাব ছিল না। টাইটার স্ক্রোল নিয়ে কতবার কাজ করতে চেয়েছেন নাহুত, কিন্তু দুরেঈদ অনুমতি দেন নি। বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতেন, নাহুত যাতে সপ্তম স্ক্রোল ছুঁতে না পারেন।

এ নিয়ে দু জনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হয়েছে কয়েকবার। তুমি বোধহয় ডিরেক্টর পদটার জন্য অ্যাপ্লাই করবে, তাই না, রোয়েন? ওই পদ পাবার যোগ্যতা তোমার আছে।

ধন্যবাদ, নাহুত, ইউ আর ভেরি কাউন্ড। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কিছু ভাবি নি আমি। তবে তুমিও বোধহয় অ্যাপ্লাই করছ, তাই না?

অবশ্যই, নিচু গলায় হেসে উঠে মাথা ঝাঁকালেন নাহুত। কে জানে, তুমি হয়তো আমার নাকের সামনে থেকে পদটা কেড়ে নেবে। তার হাসিতে সংশয় বা উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। আরব সমাজে রোয়েন একটা মেয়ে, তার উপর খ্রিস্টান, আর নাহুত মন্ত্রী মহোদয়ের ভাগ্নে। তিনি জানেন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণই তাঁর অনুকূলে। বন্ধুরাও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, আমরাও তাই করব, কী বলো? তুমি আর আমি, আমরা তো পরস্পরের বন্ধুই, তাই না?

হ্যাঁ, ভবিষ্যতে অনেক বন্ধু দরকার হবে আমার, বিড়বিড় করলো রোয়েন।

ডিপার্টমেন্টের কে তোমার বন্ধু নয়? সবাই তোমাকে পছন্দ করে, রোয়েন। নাহুতের অন্তত এ কথাটা সত্যি। তোমাকে আমি লিফট দিতে পারি? আমি জানি মামা আপত্তি করবেন না।

আজই আমি কায়রোয় ফিরছি না, নাহুত, তবু ধন্যবাদ। ডুরেঈদের ব্যক্তিগত কিছু বিষয় দেখাশোনা করতে হবে আমাকে। কথাটা সত্যি নয়। আজ সন্ধ্যের দিকে কায়রোয় ওদের ফ্ল্যাটে ফিরবে রোয়েন। তবে কারণটা নিজেও ভালো জানে না, নাহুতকে ওর প্ল্যান সম্পর্কে জানতে দিতে চাইছে না।

তাহলে সোমবার বিকেলে মিউজিয়ামে আবার দেখা হচ্ছে।

আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক বন্ধু আর গ্রামের কৃষকদের সময় দিতে হলো, সবাই তারা রোয়েনের সঙ্গে দেখা করে শোক প্রকাশ করলো। নিঃসঙ্গ আর অবশ লাগছে নিজেকে, এতো লোকের এতো শোক আর সান্ত্বনা অর্থহীন মনে হলো রোয়েনের। সন্ধ্যের খানিক আগে ডুরেঈদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, মনটা অশান্ত হয়ে আছে। ডান হাতটা সিঙে ঝুলছে, গাড়ি চালাতে তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।

কায়রোর কাছাকাছি এসে ট্রাফিক জামে পড়লো রোয়েন। গির্জা-অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। ডুরেঈদের রেনোয়া আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে রেখে এলিভেটরে চড়ে উঠে এলো টপ ফ্লোরে।

ফ্ল্যাটে ঢুকে দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়ালো রোয়েন। সিটিংরূপ তছনছ করা হয়েছে–এমন কি কাপের্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, দেয়াল থেকে নামানো হয়েছে সব কয়টা পেইন্টিং। যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ভাঙাচোরা ফার্নিচার আর ছড়ানো ছিটানো অর্নামেন্টের ভেতর দিয়ে হাঁটছে রোয়েন। প্যাসেজ ধরে এগোবার সময় বেডরুমের ভেতর তাকালো। বেডরুমটাও বাদ দেওয়া হয় নি। ওর আর ডুরেঈদের কাপড়-চোপড় মেঝেতে পড়ে আছে, কাবার্ডের দরজাগুলো খোলা। একটা কাবার্ডের দরজা কজাসহ খুলে ফেলা হয়েছে। বিছানাটা ওল্টানো, চাদর আর বালিশ মেঝেতে পড়ে আছে।

একই অবস্থা বাথরুমের। কসমেটিকস আর পারফিউমের বোতল সব কয়টা ভাঙা। তবে ভেতরে ঢুকলো না রোয়েন, জানে ঢুকলে কী দেখতে পাবে। প্যাসেজ ধরে বড় কামরাটার দিকে এগিয়ে গেল। ওটাই ওরা স্টাডি আর ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করে।

এখানেও সব ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়েছে, তবে প্রথমেই রোয়েনের চোখ পড়লো অ্যান্টিক দাবা সেটটার উপর। ডুরেঈদের দেওয়া উপহার, ওর খুব শখের জিনিস। জেট আর আইভরি দিয়ে তৈরি বোর্ডটা ভেঙে দু টুকরো করা হয়েছে, খুঁটিগুলো অকারণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে কামবার চারদিকে। ঝুঁকে সাদা কুইনটা তুলে নিল রোয়েন। মোচড় দিয়ে রানীর ঘাড় ভাঙা হয়েছে।

অক্ষত হাতে রানীকে নিয়ে রোয়েন যেনো ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। জানালোর নিচে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে চুরমার করা হয়েছে ওর পি.সি.। স্ক্রীন ফেটে চৌচির, মেইনফ্রেম চিড়ে-চ্যাপ্টা। দেখেই বোঝা যায়, হার্ড ড্রাইভে কোনো তথ্য নেই। এ কমপিউটার মেরামত করা সম্ভব নয়।

দেরাজগুলো খোলা, ভেতরের সব জিনিস মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে ফ্লপি ডিস্কগুলো কোথাও পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না কোনো নোটবুক বা ফটোগ্রাফ। সপ্তম স্ক্রোলের সঙ্গে ওর সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিন বছরের কঠিন পরিশ্রম আর সাধনা সব শেষ। এখন প্রমাণ করাই অসম্ভব যে ওগুলোর অস্তিত্ব ছিল।

ডেস্কের উপর বসে দু হাতে মুখ ঢাকল রোয়েন। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। রীতিমতো ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষের মধ্যে কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।

*

সোমবার সকালের মধ্যে নিজের জীবনে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলো রোয়েন। ফ্ল্যাটে এসে ওর জবানবন্দি নিয়ে গেছে পুলিশ। আবর্জনা ফেলে দিয়ে ঘরগুলো একাই যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে। সাদা রানীর বিচ্ছিন্ন মাথাটা খুঁজে পাবার পর আঠা দিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সবুজ রেনোয়ায় যখন চড়ল, ডান হাতের ক্ষতটায় প্রায় কোনো ব্যথাই নেই। মনটা খুশি, তা বলা যাবে না। তবে হতাশা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, নিশ্চিতভাবে জানে এখন কী করতে হবে ওকে।

মিউজিয়ামে পৌঁছে প্রথমেই দুরেঈদের অফিসে ঢুকলো রোয়েন। ওর আগেই ওখানে পৌঁছে গেছেন নাহুত গাদ্দাবি, দেখে বিব্রত ও অস্বস্তি বোধ করলো। দু জন সিকিউরিটি গার্ডকে কাজে লাগিয়েছেন নাহুত। তারা ডুরেঈদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ চেপে রেখে রোয়েন শান্ত সুরে বলল, তোমার উচিত ছিল এ কাজটা আমাকে করতে দেওয়া।

অমায়িক হেসে নাহুত বললেন, দুঃখিত, রোয়েন। ভাবলাম আমার সাহায্য পেলে তুমি খুশি হবে। মোটা টার্কিশ চুরুট কুঁকছেন। এ চুরুটের ধোঁয়া আর ঝাঁঝাল গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না রোয়েন।

ডুরেঈদের ডেস্কের পেছনে এসে দাঁড়ালো ও। একটা দেরাজ খুললো। ডুরেঈদের ডে বুকটা এখানে ছিল। এখন দেখছি নেই। তুমি দেখেছ?

না, ওই দেরাজে কিছুই পাওয়া যায় নি। গার্ড দু জনের দিকে তাকালেন নাহুত, যেনো সাক্ষী দিতে বলছেন। ঘাড় ও নাক চুলকে মাথা নাড়লো তারা। রোয়েন জানে, ডে বুকে গুরুত্বপূর্ণ খুব বেশি কিছু ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত তথ্য রেকর্ড ও জমা করার দায়িত্ব রোয়েনের উপর দিয়ে নিশ্চিত ছিলেন ডুরেঈদ। আর রোয়েন সেগুলো যত্নের সঙ্গে ওর পি.সি-তে তুলে রাখত।

ধন্যবাদ, নাহুত, বলল রোয়েন। বাকি যা করার আমি করছি। তোমাকে আর আটকে রাখতে চাই না।

কোনো সাহায্য দরকার হলে বলবে, রোয়েন, প্লিজ। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে সম্মান দেখিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নাহুত গাদ্দাবি।

ডুরেঈদের অফিস খালি করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বেশিরভাগ আগেই বাক্সে ভরা হয়েছিল, গার্ডদের বলতে তারা সেগুলো রোয়েনের অফিসের ভেতর দেয়াল ঘেঁষে রেখে এলো। লাঞ্চ আওয়ারে নিজের কাজ নিয়ে বসলো রোয়েন, শেষ করার পরও দেখা গেল মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে হাতে এক ঘণ্টা সময় আছে।

ডুরেঈদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা করতে হয়, দীর্ঘ একটা সময় মিউজিয়াম ছেড়ে দূরে থাকতে হবে রোয়েনকে। শ্রদ্ধেয় ফারাও আর পুরা নিদর্শনগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলো বিশাল বিল্ডিঙের পাবলিক সেকশনে চলে এলো রোয়েন।

সোমবার, কাজেই মিউজিয়ামের এগজিবিশন হলগুলো টুরিস্টে গিজগিজ করছে। তিনতলার কয়েকটা কামরায় রয়েছে তুতেনখামেন ট্রেজার, প্রচণ্ড ভিড়ে ওখানে দু মিনিটের বেশি টিকতে পাল না রোয়েন। অনেক ঠেলাঠেলি করে কোনো রকমে একবার ডিসপ্লে কেবিনেটের সামনে পৌঁছতে পারল, কেবিনেটের ভেতর শিশু ফারাও-এর সোনালি ডেথ-মাস্ক রয়েছে।

ওখান থেকে বেরিয়ে প্রাচীন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলো রোয়েন। তিন হাজার বছর পরও দ্বিতীয় রামেসিসের সরু মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, দেখে মনে হবে প্রশান্তচিত্তে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তার ত্বকে হালকা চকচকে একটা ভাব আছে, মার্বেলে যেমন দেখা যায়। তাঁর চুল সোনালি, তবে হেনা বা মেহেদি দিয়ে রাঙানো। একই জিনিস দিয়ে রঙ করা হাত লম্বা, সরু এবং সুগঠিত। তবে পরনে শুধু লিনেন-এর তৈরি একটা ফালি। কবর চোররা তাঁর মমির প্যাঁচও খুলে ফেলেছিল, লিনেন ব্যান্ডেজের তলা থেকে মন্ত্রপূত কবচ আর গুবরে পোকা আকৃতির মণি পাবার লোভে, কাজেই তার শরীর প্রায় নগ্নই বলা যায়। আঠারোশো একাশি সালে এলো বাহারির পাহাড় প্রাচীরের একটা গুহায় অন্যান্য রাজার মমির সঙ্গে যখন পাওয়া গেল তাঁকে, শুধু প্যাপিরাস পার্চমেন্টের একটু টুকরো সাঁটা ছিল বুকে, ওই টুকরোটা থেকেই তাঁর বংশধারা সম্পর্কে সব কথা জানা যায়।

বংশধারা উল্লেখ করার মধ্যে এক ধরনের গৌরব তো আছেই, আরো আছে। নীতিবোধ। প্রাচীন যে-কোন মমির সঙ্গে তথ্য ও বার্তা থাকে, সেগুলো কতটুকু সত্য বা অতিরঞ্জিত নয়, সেটাই হলো প্রশ্ন। এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছে ওরা ডুরেঈদ-রোয়েন–লেখক টাইটা সত্যি কথা লিখে গেছে কি? তার বর্ণনামতো সত্যিই কি বহুদূর নির্দয় আফ্রিকান পাহাড়ের গভীরে সমস্ত গুপ্তধন সহ আরেকজন মহান ফারাও নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছেন? চিন্তাটা উত্তেজিত ও রোমাঞ্চিত করে। রোয়েনকে, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।

তোমাকে কথা দিয়েছি, ডুরেঈদ, ফিসফিস করে আরবিতে বলল রোয়েন, তোমার আমার সুখস্মৃতির উদ্দেশ্যে কাজটা আমি করব।

হাত পনেরো মিনিট সময় থাকতে মিউজিয়ামের মূল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রোয়েন। এক পাশের একটা হলে ঢুকবে ও, টুরিস্ট বা গাইডরা ওদিকে খুব কমই যায়। গেলেও শুধু আমেনহোটেপ-এর মূর্তি দেখতে।

সরু কামরাটায় ঢুকে কাঁচ মোড়া ডিসপ্লে কেসের সামনে দাঁড়ালো রোয়েন, কেসটা মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা। ছোটখাট আর্টিফ্যাক্ট, যন্ত্রপাতি আর হাতিয়ার, কবচ, মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্রে ঠাসা ভেতরটা এগুলো মধ্যে আছে নিউ কিংডম-এর বিশতম রাজবংশের জিনিসপত্র, এক হাজার একশো খ্রিস্টপূর্ব আমলের। আর ওল্ড কিংডম-এর জিনিসগুলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরানো। এ-সব সংগ্রহের ক্যাটালগ নিখুঁত নয়, অনেক জিনিসের কোনো পরিচয়ই উল্লেখ করা হয় নি।

শেষের দিকে, নিচের শেলফে, সাজানো রয়েছে অলঙ্কার, আঙটি আর সীল। প্রতিটি সীলের পাশে মোমের উপর ওই সীলের একটা করে ছাপ। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে এ আর্টিফ্যাক্টগুলোর একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রোয়েন। ডিসপ্লের মাঝখানে নীল ল্যাপিস ল্যাজিউলাই দিয়ে তৈরি একটা খুদে সীল। প্রাচীনকালে ল্যাপিস মূল্যবান ও দুর্লভ ছিল, যেহেতু মিশরীয় সাম্রাজ্যে জিনিসটা পাওয়া যেত না। ওই সীল থেকে মোমের উপর যে ছাপ দেওয়া হয়েছে তাতে ডানা ভাঙা একটা শ্যেন বা বাজপাখি দেখা যাচ্ছে। বাজ পাখির নিচে লেখাটা পরিষ্কার পড়তে পারলো রোয়েন : টাইটা, মহারানীর লেখক।

রোয়েন জানে, এ সেই একই লোক, কারণ স্ক্রোলে নিজেই সই হিসেবে ডানাভাঙা শ্যেন পাখি ব্যবহার করেছে সে। রোয়েন ভাবছে এ ক্ষুদে আর্টিপ্যাক্ট কোত্থেকে এখানে এলো। সম্ভবত কোনো গ্রামবাসী বৃদ্ধ লেখক তথা ক্রীতদাসের হারানো সমাধি থেকে চুরি করেছে। তবে কে সে, কবে বা ঠিক কোত্থেকে পেল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই।

তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ, টাইটা? এ কি মাথা খাঁটিয়ে তৈরি করা একটা বিরাট ধাঁধা? তুমি কি তোমার সমাধি থেকে আমার উদ্দেশে হাসছ? আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ঠাণ্ডা কাঁচে কপাল ঠেকে গেল। তোমার সমাধি যেখানেই থাকুক, তুমি যেখানেই থাকো, আমার বন্ধু হবে? নাকি আমার প্রতিপক্ষ হওয়াই তোমার ইচ্ছে? দাঁড়িয়ে কামিজ থেকে ধুলো ঝাড়ল রোয়েন। ঠিক আছে, দেখা যাবে। তোমার সঙ্গে খেলব আমি, দেখবো কে কাকে হারাতে পারে।

*

গাঢ় রঙের চকচকে সিল্ক স্যুট পরে ডেস্কে বসে আছেন আতালান আবু সিন। তবে রোয়েন জানে আলখেল্লা পরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন মন্ত্রী মহোদয়, স্বস্তি পান গালিচার উপর কুশনে হেলান দিয়ে বসতে। ওর চোখের কৌতুক লক্ষ করে হাসলেন তিনি; বললেন, আজ দুপুরে কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে মিটিং ছিল।

রোয়েন তাকে পছন্দ করে। ওর সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করেন তিনি, মিউজিয়ামের চাকরিটাও তাঁর ব্যক্তিগত অনুমোদন ছাড়া পেত না ও। তাঁর পজিশনে অন্য যে কোনো লোক মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে রোয়েন আবেদন প্রত্যাখ্যান করত, বিশেষ করে স্ত্রীর আপত্তির মুখে।

ওর কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি হাতের ব্যান্ডেজটা দেখিয়ে রোয়েন বলল, দশ দিন পর স্টিচ খোলা হবে।

পরিবেশ একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে, তাই ভূমিকা না করে সরাসরি নিজের কথা বলে গেল রোয়েন। ডুরেঈদকে হারিয়ে আমি এখন বুঝতে পারছি না জীবনটা নিয়ে কী করব। তাই ভাবছি দূরে কোথাও একা থাকব কিছুদিন। আমাকে ছয় মাসের ছুটি দিতে হবে। ভাবছি ইংল্যান্ডে মায়ের কাছে চলে যাব।

মন্ত্রির উদ্বেগ অকৃত্রিম মনে হলো। রোয়েনকে তিনি অনুরোধ করলেন, তবে প্লিজ, আমাদেরকে ছেড়ে বেশিদিন থাকবেন না। আপনাদের গবেষণা অমূল্য অবদান রেখেছে। ডুরেঈদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে হলে আপনার সাহায্য ছাড়া চলবে না। মুখে যাই বলুন, রোয়েনের কথায় তিনি যে স্বস্তি পাচ্ছেন সেটা পুরোপুরি চাপা থাকলো না। তিনি আশা করেছিলেন আজই তাঁর সামনে ডিরেক্টরশিপের জন্য আবেদনপত্র জমা দেবে রোয়েন। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভাগ্নে নাহুত গাদ্দাবির সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর। রোয়েন আবেদনপত্র জমা দিলে সান্ত্বনাসূচক কিছু বাণী শুনিয়ে অবশ্যই সেটা বাতিল করা হতো। দু জনেই ওরা জানে ডিরেক্টরের পদটা নাহুত গাদ্দাবিই পেতে যাচ্ছেন।

বিদায় নেওয়ার সময় রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন আতালান, ডেস্কে ঘুরে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এলেন। এলিভেটরে চড়ে নিচে নামার সময় নিজেকে রোয়েনের বন্ধনহীন ও স্বাধীন লাগলো।

রেনোয়া নিয়ে গেট থেকে বেরুতেই কায়রো ট্রাফিক গ্রাস করলো ওকে। অলস পিঁপড়ের মতো এগুচ্ছে গাড়ি, আরোহী উপচে পড়া একটা বাস ওর সামনে, অবিরত নীল ধোয়া ছাড়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রেনোয়া। শহরের ট্রাফিক সমস্যার যেনো কোনো সমাধান নেই। রিয়ার-ভিউ মিররে চোখ রেখে পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। ওর ব্যাক বাম্পার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, ওটার পেছনে যানবাহনের ভিড় নিরেট ও সম্পূর্ণ অচল। শুধু মোটর সাইকেল আরোহীরা চলাচলের স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেরকম একজনকে আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসতে দেখলো রোয়েন। লাল তোবড়ানো একটা টু হানড্রেড সিসি হোন্ডা, গায়ে এতো ধুলো জমেছে যে রঙটা কোনো রকমে চেনা গেল। ব্যাকসীটে একজন আরোহী বসে আছে, ড্রাইভারের মতো তারও মুখের নিচের অংশ মাথায় জড়ানো কাপড় নামিয়ে আড়াল করা, ধোঁয়া আর ধুলো থেকে রক্ষা পাবার জন্য।

রঙ সাইড দিয়ে ছুটে আসছে মোটরসাইকেল, আসছে ট্যাক্সি আর ফুটপাথ ঘেঁষে পার্ক করা কারগুলোর সরু ফাঁক গলে, ফাঁকটার দু পাশে অতিরিক্ত এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। মোটর সাইকেল আরোহীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল একটা ইঙ্গিত করলো ট্যাক্সি ড্রাইভার, তারপর চিৎকার করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, তার এ পাগলামি আর বোকামির জন্য আল্লাহ তাকে অবশ্যই নরকে পাঠাবে।

রোয়েনের রেনোয়ার পাশে চলে এসে মুহূর্তের জন্য মন্থর হলো হোন্ডার গতি, ব্যাক সীটে বসা আরোহী একটু ঝুঁকে খোলা দরজা দিয়ে ওর পাশের প্যাসেঞ্জার সীটের উপর কী যেনো একটা ছুঁড়ে দিল। পরক্ষণে গতি এমন বাড়লো, মুহূর্তের জন্য রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়লো মোটরসাইকেলের সামনের চাকা। বাম দিকে সরু একটা গলি পেয়ে সঁাৎ করে ঢুকে পড়লো সেটায়, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হওয়ার আগে পেছনে বসা আরোহী ঘাড় ফিরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো একবার, আর ঠিক সেই সময় বাতাস লেগে সরে গেল তার মুখের কাপড় াৎ করে উঠলো রোয়েনের বুক। লোকটাকে চিনতে পেরেছে ও। মরুদ্যানে–একেই দেখেছিল, ফিয়াটের আলোয়। ইউসুফ!

ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পাশের সীটে পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালো রোয়েন। কালচে সবুজ রঙের জিনিসটা টিভির ওঅর মুভিতে অনেকবার দেখেছে ও রঙটা মিলিটারি গ্রীন। এটা যে একটা গ্রেনেড, বুঝতে পারলো রোয়েন। দেখলো, পিন খোলা। তারমানে এখুনি ওটা বিস্ফোরিত হবে।

কিছু চিন্তা না করেই দরজার হাতল ঘুরিয়ে লাফ দিল রোয়েন। খুলে হাঁ হয়ে গেল দরজা, রাস্তার উপর ছিটকে পড়লো ও। কাঁচে পা না থাকায় সচল হলো রেনোয়া সরাসরি ধাক্কা দিল স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বাসের পেছনে।

পেছনের ট্যাক্সিটা এগিয়ে এসেছিল, সেটা দুই চাকার আড়ালে রাস্তার উপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে রোয়েন, এ সময় বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। ড্রাইভারের দরজা দিয়ে কমলা শিখা আর সাদাটে ধোয়ার মেঘ বেরিয়ে এলো, সেই সঙ্গে প্রচুর আবর্জনা। পেছনের জানালো বিস্ফোরিত হলো বাইরের দিকে, হীরের কর্নার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের টুকরো। বিস্ফোরণের শব্দে রোয়েনের কানে তালা লেগে গেল, ব্যথাও করছে। বিকট আওয়াজটার পর নিথর নিস্তব্ধতা নেমে এলো, তারপরই শুরু হয়ে গেল কাতর গোঙানি আর চিৎকার-চেঁচামেচি। বসলো রোয়েন, আহত হাতটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। রেনোয়া ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে দেখা গেল ওর স্লিং ব্যাগটা রাস্তার উপর নাগালের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সেটা নিয়ে কোনো রকমে দাঁড়ালো। চারদিকে দিশেহারা মানুষ কে কী করবে বুঝতে পারছে না। বাসের ভেতর কয়েকজন আরোহী আহত হয়েছে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট্ট মেয়ের কপালে শ্যাপনেল লাগায় ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে, মেয়ের ক্ষতে রুমাল চেপে ধরেছে মা। রোয়েনের দিকে খেয়াল নেই কারো, তবে জানা কথা এখুনি পুলিশ চলে আসবে। ও জানে, ওকে পেলে জেরা করার জন্য আটকে রাখা হবে, হয়তো কয়েক দিনই। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আস্তে করে কেটে পড়লো ও, কয়েক পা এগিয়ে ঢুকে পড়লো সরু গলির ভেতর, যেটার ভেতর একটু আগে হোন্ডা মোটরবাইক অদৃশ্য হয়ে গেছে।

গলিটার শেষ মাথায় পাবলিক ল্যাভেটোরি, একটা কিউবিকলে ঢুকে বন্ধ দরজায় হেলান দিল রোয়েন, চোখ বন্ধ করে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। ডুরেঈদ ইবনে আল-সিমার বীভৎস হত্যাকাণ্ডের আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি ও, সে জন্যই নিজের নিরাপত্তার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে নি। আজ এইমাত্র ঘটনাটা ঘটার পর ওর মনে পড়ছে, সেদিন ওকেও খুন করতে চেয়েছিল তারা। অন্ধকারে শোনা একজন আততায়ীর গলা এখন ওর কানে বাজছে, মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।

ওর প্রাণের উপর দ্বিতীয় আঘাতটা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। সন্দেহ নেই, এরকম আঘাত একের পর এক আসতে থাকবে। ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, উপলব্ধি করলো রোয়েন। কী করা উচিত আধ ঘণ্টা ধরে ভাবল। তারপর ওয়াশবেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ-হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ালো, মেকআপ ঠিকঠাক করলো। রাস্তায় বেরিয়ে এসে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ালো কিছুক্ষণ, লক্ষ্য রাখছে কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। তারপর একটা ট্যাক্সি থামাল।

ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার মিশরীয় পাউন্ড তুললাম রোয়েন। টাকাটা অল্পই। তবে ইয়র্কের লয়েড ব্যাংকে আরো টাকা আছে ওর। তাছাড়াও আছে মাস্টারকার্ড। এরপর সেফ ডিপোজিট থেকে একটা প্যাকেট সংগ্রহ করলো, ওটায় ওর ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর লয়েড ব্যাংকের কাগজপত্র আছে।

কায়রোয় রোয়েনের পিতৃকুলের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, তারা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই আশ্রয় দিবে ওকে, কিন্তু নিজের বিপদের সঙ্গে তাদের কাউকে জড়াতে চাইছে না ও। ছোটখাট একটা টু-স্টার টুরিস্ট হোটেল খুঁজে নিল, নদীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে। এ ধরনের হোটেলে অনেক টুরিস্ট যাওয়া-আসা করে। হয় লুক্সর না হয় আসওয়ানের পথে চলছে যারা।

হোটেল রুমে নির্জনতা পেয়েই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশন-এ ফোন করলো রোয়েন। কাল সকাল দশটায় হিথরোর উদ্দেশে একটা প্লেন ছাড়বে। ওয়ান-ওয়ে ইকনমি সিট বুক করলো, ওদেরকে নিজের মাস্টারকার্ডের নাম্বার জানালো।

ইতোমধ্যে ছয়টা বেজে গেছে তবে ইংল্যান্ডে এখনো অফিস-আদালত খোলা। নোটবুক খুলে নম্বরটা দেখে নিল রোয়েন। লীডস ইউনিভার্সিটিতেই লেখাপড়া শেষ করেছে ও। তিনবার রিং হতে অপরপ্রান্তে সাড়া পাওয়া গেল। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট। প্রফেসর ডিক্সনের অফিস। মার্জিত মহিলা কণ্ঠ সাড়া দেয়।

মিস হিগিন্স বলছেন?

হ্যাঁ। আপনি কে?

রোয়েন। রোয়ে আল সিমা, আপনি যাকে রোয়েন সাঈদ বলে চিনতেন।

রোয়েন, সত্যি তুমি? কতকাল তোমার কোনো খবর নেই! আছো কেমন?

কিছু সময় আলাপের পর প্রফেসরকে লাইনে চাইলো রোয়েন। তিনি ধরলেন ফোন।

আমার ফেভারিট স্টুডেন্ট? শুনে হাসছে রোয়েন। অনেক আগেই অবসর নেওয়ার কথা প্রফেসরের, বয়েস সত্তরের উপর। এখনো তিনি শক্ত-সামর্থ, অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী, আর সব সুন্দরী ছাত্রীকে ফেভারিট বলে মনে করেন।

. ইন্টারন্যশনাল কল, প্রফেসর, মনে করিয়ে দিল রোয়েন। আমি শুধু জানতে চাই অফারটা এখনো বহাল আছে কিনা।

মাই গুডনেস, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করবে না।

পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। যদি দেখা হয় সব আপনাকে খুলে বলব।

অবশ্যই তোমার লেকচার আমরা শুনতে চাই। কবে নাগাদ আসতে পারবে?

কাল আমি ইংল্যান্ডে আসছি। ইয়র্কে, মায়ের কাছে থাকব। আপনি ফোন নম্বরটা লিখে রাখুন। তবে কয়েকদিনের মধ্যে আমিই আপনাকে কল করব।

ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে বিছানায় কাত হলো রোয়েন।

দু মাস আগে রানী লসট্রিস-এর সমাধি ও স্ক্রোল আবিষ্কার এবং খনন কাজ সম্পর্কে লেকচার দেওয়ার জন্য প্রফেসর ডিক্সন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওকে। গোটা বিষয়টা সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন একটা বই পড়ে, বিশেষ করে বইটার শেষে যোগ করা ফুটনোট পড়ে। বইটা প্রকাশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মহলে বিরাট আলোড়ন উঠেছিল। অ্যামেচার ও প্রফেশনাল, দু ধরনের ঈজিপ্টলজিস্টই খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। এমন কি টোকিও আর নাইরোবির মতো দূর দেশ থেকেও প্রচুর চিঠি আর ফোন আসে। সবারই একটা প্রশ্ন, উপন্যাসের কাহিনী সত্যের উপর ভিত্তি করে রচিত কিনা।

রোয়েন আসলে কোনো গল্প লেখককে ট্রান্সক্রিপসন দেখাতে একদমই রাজি হয় নি, বিশেষ করে ওগুলো তখনো সম্পূর্ণ না হওয়ায়। ওর মনে হয়েছিল, গোটা ব্যাপারটাকে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট হিসেবে গণ্য করা উচিত। প্যালিয়েন্টেলজিকে স্পিলবার্গ যেমন জুরাসিক পার্কের মাধ্যমে খেলা করে ফেলেছেন, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।

ওর আপত্তিতে এমন কি ডুরেঈদও কান দেন নি। কারণটা অবশ্যই টাকা। বড় কোনো কাজ তো দূরের কথা, টাকার অভাবে ওদের ডিপার্টমেন্ট ছোটখাট কোনো কাজেও হাত দিতে পারছিল না। বইটার নাম রিভার গড, লেখক উইলবার স্মিথ। আগেই কথা হয়ে যায়, রয়্যালটির অর্ধেক টাকা ডিপার্টমেন্ট পাবে। সেই টাকা দিয়ে এক বছর গবেষণা আর অনুসন্ধানের কাজ চালানো সম্ভব হয়েছে। তবু লেখকের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারে নি রোয়েন। তার কারণ, স্ক্রোলে যা লেখা আছে তার উপর রঙ চড়িয়েছেন তিনি, ঐতিহাসিক চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে দিয়ে এমন সব কথা বলিয়েছেন বা এমন সব কাজ করিয়েছেন, যা করা বা বলা হয়েছে কিনা প্রমাণ নেই। প্রাচীন লেখক টাইটাকে আধুনিক লেখক উইলবার স্মিথ চিত্রিত করেছেন মিথ্যে বড়াইকারী ও দাম্ভিক হিসেবে, বিশেষ করে এখানেই রোয়েনের আপত্তি।

পরে অবশ্য রোয়েনকে মেনে নিতে হয়েছে। একজন লেখক তার পাঠককে প্রাঞ্জল ভাষায় মুখরোচক গল্পের খোরাক পরিবেশন করবেন, এ তো জানা কথা। সন্দেহ নেই, সে কাজে উইলবার স্মিথ পুরোপুরি সফল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো রোয়েন। ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে, এ নিয়ে চিন্তা করলে শুধু শুধু মাথা ব্যথাই বাড়বে।

ওর বরং এখন জরুরি সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। লীডস-এ লেকচার দিতে হলে ওর স্লাইডগুলো লাগবে, কিন্তু সেগুলো মিউজিয়ামে ওর অফিসে আছে। কীভাবে ওগুলো ওখান থেকে বের করা যায় ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন, কাপড় না পাল্টেই।

*

শেষে সহজ সমাধানটাই বেছে নিল রোয়েন। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসে ফোন করে কী করতে হবে বলে দিল ও, ওই অফিসের একজন সেক্রেটারি স্লাইডগুলো নিয়ে হাজির হলো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেক ইন ডেস্কে। ওকে ওগুলো দেওয়ার সময় সে জানালো, আজ সকালে অফিস খোলার পর পুলিশ এসেছিল। কথা বলার জন্য আপনাকে খুঁজছিল তারা।

বোঝাই যায়, রেনোয়ার রেজিস্ট্রেশন চেক করেছে পুলিশ। ভাগ্য ভালো যে রোয়েনের কাছে ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। মিশরীয় পাসপোর্ট নিয়ে দেশত্যাগ করতে হলে সমস্যা এড়ানো যেত না। পাসপোর্ট কন্ট্রোল পয়েন্টে পুলিশ সম্ভবত রেসট্রিকশন অর্ডার দিয়ে রেখেছে। যা হোক, চেক পয়েন্টে কোনো অসুবিধে দেখা দিল না। ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে নিউজ-স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো রোয়েন।

স্থানীয় সবগুলো দৈনিকে ওর গাড়িতে বোমা ছুঁড়ে মারার ঘটনাটা ছাপা হয়েছে, সেই সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ইবনে ডুরেঈদের হত্যাকাণ্ড। রিপোর্টাররা বলতে চেয়েছে ঘটনা দুটোর মধ্যে যোগসূত্র আছে এবং কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে মৌলবাদী ধর্মীয় গ্রুপগুলোকে দায়ী বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। রোয়েন প্রতিটি দৈনিকেরই একটা করে কপি কিনল।

• প্লেন তখন আকাশে, নোটবুক বের করে ডুরেঈদ হাসলেন, হারপার নিকোলাস সম্পর্কে যা যা বলেছে সব লিখে রাখছে রোয়েন। লন্ডনে পৌঁছে এ ভদ্রলোককে খুঁজে বের করতে হবে, যদি তিনি ইংল্যান্ডে থাকেন।

ডুরেঈদের কাছে রোয়েন শুনেছে, ব্রিটিশ কলোনিয়াল চাকরিতে অবদানের জন্য নিকোলাসের বড়ো বাবাকে ব্যারোনেট উপাধিতে ভূষিত করেছিল রানী। তিন পুরুষ ধরেই নিকোলাসের পরিবার আফ্রিকার সঙ্গে গাঢ় হৃদ্যতা এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে, বিশেষত উত্তর আফ্রিকার ব্রিটিশ কলোনি ছিল যে দেশগুলোয়, সেগুলোর সাথে মিশর, সুদান, উগান্ডা এবং কেনিয়া।

রোয়েন জানে, স্যার নিকোলাস নিজেও আফ্রিকার উপকূলে ব্রিটিশ আর্মির হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরবি এবং সোয়াহিলি–দু ভাষাতেই সমান দক্ষ ভদ্রলোক, একজন সৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং প্রাণিবিজ্ঞানী। বাপ-দাদার মতো নিকোলাসও বহুবার উত্তর আফ্রিকার গহীন এলাকায় অভিযান চালিয়েছেন, সংগ্রহ করেছেন মূল্যবান নমুনা। বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়, এমন কি রয়াল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিতে লেকচার পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি।

নিঃসন্তান বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর পর পারিবারিক টাইটেল এবং কুয়েনটন পার্কের এস্টেটের মালিকানা বর্তায় নিকোলাসের উপর। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয় সে। যতোটা না এস্টেট দেখাশোনার জন্য, তার চেয়ে বেশি পারিবারিক মিউজিয়াম পরিচালনার কারণে। ১৮৮৫ সালে প্রথম ব্যারন চালু করেছিলেন ওটা। আফ্রিকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য দারুণ জনপ্রিয় এ যাদুঘর; এছাড়াও প্রাচীন মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানা আর্টিফ্যাক্টও রয়েছে এখানে।

ডুরেঈদের কথা অনুযায়ী, উদ্দাম, ক্ষেত্রবিশেষে আইনের ভয় না করা একটা সত্তা আছে নিকোলাসের। বোঝা যায়, যাদুঘরের সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে আইনকে কাঁচকলা দেখাতে পারেন তিনি।

গাদ্দাফির লিবিয়া থেকে দুপ্রাপ্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ পাচার করার সময় ডুরেঈদকে তার এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল নিকোলাস। শ্রেষ্ঠ নমুনাগুলো নিজের সংগ্রহে রেখে বাদকবাকিগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয় অভিযানের খরচা ওঠানোর জন্য।

তার আরো একটা অভিযান সম্পর্কে জানতেন দুরেঈদ। সেটাও বেআইনী কাজ। গোপনে ইরাকে ঢুকতে হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনেরে নাকের ডগা থেকে একজোড়া পাথুরে ব্যাসরিলীফ ফ্রীজ উদ্ধার করে আনেন তিনি। ফ্রীজ হলো স্তম্ভ বা কার্নিসের মধ্যবর্তী কারুকার্যময় অংশ। ডুরেঈদ জানিয়েছেন, জোড়ার একটা নাকি পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হয়েছে, এসবই কয়েক বছর আগের ঘটনা।

এখন কি নিকোলাস রাজি হবে ফারাও-এর সম্পদের অনুসন্ধানে অভিযানে যেতে? কোনো সন্দেহ নেই, ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হবে মিশরের সম্পদ পাচারের দায়ে।

ডুরেঈদ বার বার করে বলেছেন, নিকোলাসের প্রচুর প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীদের কারণেই এতো কিছু পারে সে।

সৎ ও পবিত্র থাকার একটা ঝোঁক আছে নিজের মধ্যে, রোয়েন জানে। কথাটা ভেবে আপন মনে হাসলো ও। হারপার নিকোলাস যদি ওকে সাহায্য করতে রাজি হন, সাংঘাতিক ঝুঁকি নিতে হবে তাঁকে। প্রশ্ন হলো, কোনো স্বার্থ ছাড়া কেন কেউ নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নেবে? তাছাড়া, যে কাজটায় তাঁর সাহায্য চাইতে যাচ্ছে, সেটাও কোনো অংশে কম বেআইনী নয়। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন।

এয়ার হোস্টেস ওর ঘুম ভাঙিয়ে সিট বেল্ট বাঁধার তাগিদ দিল। ওদের প্লেন হিথরোতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে।

*

বিমানবন্দর থেকে মা-কে ফোন করলো রোয়েন। মা, আমি রোয়েন! তুই কোথায়? চির আমুদে স্বরে জানতে চান রোয়েনের মা।

হিথরোতে। তোমার সাথে কিছুদিন থাকবো। কোনো সমস্যা নেই তো?

শোনো মেয়ের কথা! সমস্যা আবার কী? ভর্ৎসনার সুরে বলেন মহিলা।

কোন্ রেলে আসবি?

সাতটার সময়। কিংস ক্রস ট্রেনে।

ঠিক আছে। আমি স্টেশনে আসবো তোকে নিতে। কী ঘটেছে রে? ডুরেঈদের সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ঝাটি? আমি জানতাম–ওই লোকের বয়স তোর বাপের সমান!

বেশ কিছু সময় নীরব রইলো রোয়েন, এটা ঠিক ব্যাখ্যাদানের সময় নয়। দেখা হলে সব বলবো।

নভেম্বরের বিষণ্ণ শীতল সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিলেন জর্জিনা লুমলি, রোয়েনের মা। পায়ের কাছে সধৈর্য বসে পোষা কুকুর ম্যাজিক। ঠিক যেনো মানিকজোড়। ট্রায়াল কাপে হোক, কিংবা অন্য সময়ে, ম্যাজিক জর্জিনার সঙ্গে থাকবেই। রোয়েনের মনে অদ্ভুত এক শান্তি বোধ হয়, যেনো বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছে।

ওর গালে চুমু খেয়ে স্বাগত জানালেন জর্জিনা। কাদা মাখা ল্যান্ড-রোভারের দিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন মেয়েকে।

ম্যাজিকও লেজে নেড়ে স্বাগত জানালো রোয়েনকে।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবে গাড়ি চালানোর পর একটা সিগারেট ধরিয়ে জর্জিনা বললেন, ডুরেঈদের খবর বল।

কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েন। এ ক-দিনের সমস্ত কান্না যেনো পথ খুঁজে পেল, দুঃখ শোক উথলে বের হলো ওর ভেতর থেকে। ডুরেঈদের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের বর্ণনা দেওয়ার সময় জর্জিনা মেয়েকে এক হাতে সান্ত্বনা দিলেন।

জর্জিনার কটেজে যতক্ষণে ফিরলো ওরা, সমস্ত শোক ভুলে একটু হালকা হয়েছে রোয়েন। মায়ের তৈরি খাবার দিয়ে বেশ আয়েশ করে ডিনার করলো দু জন। কবে শেষ এমন খাবার খেয়েছে, রোয়েন ভুলেই গিয়েছিল।

এখন কী করবে? গ্লাসে পানীয় ঢেলে দিতে দিতে জানতে চাইলেন জর্জিনা।

সত্যি করে বললে–আমি জানি না, মনে মনে রোয়েন ভাবে, মিথ্যে কথা বলতে গেলে কেনো যেনো সবাই এ কথাটাই বলে! মিউজিয়াম থেকে ছয় মাসের ছুটি পেয়েছি, প্রফেসর ডিক্সন ইউনিভার্সিটিতে একটা লেকচারের জন্য আয়োজন করে রেখেছেন। মোটামুটি এ তো।

ঠিক আছে। যতোদিন ইচ্ছে থাক না তুমি। চিরন্তন মাতৃস্নেহ ঝরে পড়লো জর্জিনার কণ্ঠ থেকে।

ইয়র্কে, মায়ের গ্রামের বাড়িতে লেকচার তৈরি করার জন্য স্লাইড আর নোটগুলো সাজাতে কয়েকটা দিন ব্যয় করলো রোয়েন। রোজ বিকেলে পোষা কুকুর ম্যাজিককে নিয়ে গ্রামের পথে হাওয়া খেতে বেরোয় ও। মেয়ে অভয় দিলেও, একা ওকে কোথাও যেতে দেন না জর্জিনা, তিনিও সঙ্গে থাকেন।

কুয়েনটন পার্ক চেনো তুমি? বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে একদিন জানতে চাইলো রোয়েন, মায়ের কাছে।

বেশ ভালো চিনি, উৎসুক জর্জিনা বলেন। ম্যাজিক আর আমি বছরে কম করে হলেও পাঁচ কি ছয় সিজন যাই ওখানে। দারুণ জায়গা। অনেক বুনো হাঁসের দলের দেখা মেলে। শিকারের জন্য এর চেয়ে ভালো আর হয় না। ইংল্যান্ডের সেরা পেশাদার শুটাররা যান ওখানে, পাখি শিকারে।

নিকোলাস হারপার–ওটার মালিক, ওনার সাথে পরিচয় আছে তোমার?

এমনি দেখেছি আর কি। পরিচয় নেই। জর্জিনা উত্তরে বলেন। ওর বাপের সঙ্গে জানাশোনা ছিল বিয়ের আগে। ভালো নাচতো ব্যাটা। সবসময় যে ড্যান্স ফ্লোরে নাচত–তাও নয়!

রোয়েন স্তম্ভিত।

মা!

হুম। বেশ দুরন্ত ছিলাম কিন্তু!

তুমি আর ম্যাজিক আবার কুয়েনটন পার্কে যাবে কবে?

এই তো, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে।

আমি যেতে পারি?

নিশ্চই। একজন বিটার পেলে তো ওরা বর্তে যায়। লাঞ্চ, বিয়ারের বোতল সব ওরাই দেয়। হঠাৎ থেমে পরে মেয়ের চোখে তাকালেন জর্জিনা। কী ব্যাপার বল তো?

শুনেছি বিখ্যাত ঈজিপশিয়ান কালেকশন আছে ওদের। একটু দেখতে চাই।

পাবলিকের জন্য ভোলা নয়। নিকোলাস বেশ রুক্ষ মানুষ, সবসময় আড়ালে থাকতে চান। নিমন্ত্রীত অতিথি ছাড়া কারো প্রবেশাধিকার নেই যাদুঘরে।

তুমি পারবে নাকি, আমার জন্য একটা নিমন্ত্রণপত্র যোগাড় করে দিতে?

মাথা নাড়েন জর্জিনা।

আমি না। কিন্তু প্রফেসর ডিক্সনের সঙ্গে নিকোলাসের ভালো খাতির। ওকে বলে দেখতে পারি।

*

দশ দিন পর প্রফেসর ডিক্সনের সঙ্গে দেখা হলো রোয়েনের। মায়ের গাড়ি নিয়ে লীডস-এ গেল সে। কক্ষভর্তি বই, কাগজ আর আর্টিফ্যাক্ট আনমনা করে তুললাম রোয়েনকে। দুরেঈদের মৃত্যুর খবরে দারুণ অবাক হলেন ডিক্সন, অবশ্য খুব দ্রুতই বিষয়টা পরিবর্তন করে ফেললেন তিনি। লেকচারের জন্য ওর প্রস্তুতি নিয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন।

চলে আসার কিছুক্ষণ আগে কুয়েনটন পার্কের কথা বলল রোয়েন। সাথে সাথেই সাড়া দিলেন প্রফেসর।

তুমি এখনো ওখানে যাও নি? অবাক হলাম। দারুণ কালেকশন। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুয়েনটন পরিবারের সংগ্রহশালা সত্যি দেখার মতো। আগামি বৃহস্পতিবার এস্টেটে শিকারে যাচ্ছি আমি, তখন নিকোলাসের সঙ্গে কথা বলে দেখবো এখন। ও অবশ্য অনেকটা পাল্টে গেছে। বেচারার উপর দিয়ে বেশ ঝড়-ঝাপ্টা গিয়েছে। মোটর দুর্ঘটনায় স্ত্রী আর দুই মেয়ে হারিয়েছে গত বছর। নিকোলাস নিজেই চালাচ্ছিল তখন।

তো, তোমার লেকচারের অপেক্ষায় থাকলাম। মনে হয়, একশোরও বেশি শ্রোতা পাবে। ইয়র্ক শায়ার পোস্ট থেকে একজন রিপোর্টারও যোগাড় করেছি আমি। তোমার ইন্টারভিউ নিতে চায়। বলা যায়, আমাদের ডিপার্টমেন্টের জন্য সেরা পাবলিসিটি। দুই এক ঘণ্টা আগে এসো, ওদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে নিও। .

আপনার সাথে এর আগেই আমার দেখা হবে, স্যার। রোয়েন জানায় বৃদ্ধকে। মা আর ম্যাজিককে নিয়ে কুয়েনটন পার্কে যাচ্ছি আমরা বৃহস্পতিবারে। বিটারের চাকরি পেয়েছি ওইদিন!

ঠিক আছে। তোমাকে খুঁজবো। ভালো থেকো।

বিদায় নেয় রোয়েন।

*

দারুণ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল উত্তর থেকে। ঘন মেঘমালা, ধূসর, ভারী, যেনো পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে আছে। মায়ের দেওয়া জ্যাকেটের নিচে তিনপ্রস্থ কাপড় পরেছে রোয়েন। কিন্তু কাঁপুনি থামাতে পারছে না। এক সারিতে সমস্ত বিটারেরা এগুচ্ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। পা দুটো কবেই বরফ হয়ে গেছে! নীলের উপত্যকার আর্দ্র-বাতাস রোয়েনের রক্ত পাতলা করে দিয়েছে।

আজকের দিনের শেষ ড্রাইভের জন্য প্রধান বিটার, জর্জিনাকে লাইনের সামনের দিকে নিয়ে এসেছেন। ওদের কাজ হবে, গুলিবিদ্ধ পাখি বা বুনোহাঁসগুলোকে সংগ্রহ করা।

দিনের শেষভাগে সবচেয়ে উত্তেজনাকর হাই লার্চে চলছে অভিযান। পাহাড়ের গা থেকে পাখিগুলো তাড়িয়ে আনার জন্য প্রচুর বিটার চাই এখানে, বিশাল ভূখণ্ড ছড়িয়ে আছে চারপাশে। তাড়া খেয়ে পাখির দল এসে পরবে উপত্যকায় তৈরি থাকা শিকারীর বন্দুকের সামনে।

বুনোহাঁস আর পাখিদের প্রতি এ বড়ো অন্যায় ব্যবহার, রোয়েন ভাবে। জর্জিনা তাকে জানিয়েছেন, যতো উঁচু দিয়ে উড়ে যাবে ওরা, যতোই কঠিন হবে শিকার, ততো বেশি খুশি শিকারীরা।

জানিস, একদিনের শুটিং-এর জন্য কতো টাকা খরচ করে এরা? জর্জিনা বলেছিলেন। এক আজকের দিনেই ১৪ হাজার পাউন্ড আয় হবে এস্টেটের। এ সিজনে বিশদিন চলবে শিকার। এবার হিসেব করে দেখ, কতো টাকার মামলা! এস্টেটের সিংহভাগ অর্থই আসে শুটিং থেকে। শুধু শুধু অবসর সময় কাটানোর চেয়ে কুকুর নিয়ে দৌড়ে আমার মতো লোকাল মানুষ কিছু পয়সা রোজগার করছে খারাপ কী?

অবশ্য, বিটারের কাজে এখন আর কোনো আমোদ পাচ্ছে না রোয়েন। ঢালু পথে হাঁটা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, একবার তো পরেই গিয়েছিল। গায়ে-হাতে মাটি মাখামাখি, ক্লান্তিতে একেবারে নুয়ে গেছে সে। হাতের লাঠির উপর ভর দিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু তার মা মোটেও ক্লান্ত নয়, চোখ চকচক করছে তার।

এই শেষ ল্যাপ, রোয়েন। বললেন জর্জিনা।

নিজের দুরবস্থায় লজ্জা পেল রোয়েন। লাঠি ফেলে, এক লাফে একটা ডোবা অতিক্রম করতে চাইলো সে। হিসেবের গড়মিল, এক হাঁটু কাদাপানিতে মুখ থুবড়ে পড়লো।

হেসে ফেললেন জর্জিনা। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক হাতে টেনে তুললেন মেয়েকে। ধড়মড় উঠলো রোয়েন। ওদিকে প্রধান বিটার চিৎকার করছেন, বামে থেমে দাঁড়াও সবাই!

থমকে দাঁড়ালো লাইন। একজন বিটারে কাজ হলো ঝোঁপ-ঝাড়ে বসে থাকা বুনোহাঁস, পাখির দলকে ধীরে সুস্থে, একটি দুটির দলে করে উড়তে বাধ্য করা, এক ঝকে নয়। এতে করে প্রথম দুই ব্যারেল ফায়ার করার পর অপর বন্দুক তৈরি করে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পায় শিকারী। কতো চমৎকারভাবে অপেক্ষারত শিকারীর বন্দুকের সামনে পাখি পাঠাতে পারে–এরই ভিত্তিতে নির্ণীত হয় একজন কীপারের মূল্য।

বুক ভরে শ্বাস টেনে চারদিকে তাকায় রোয়েন। ঝোঁপের ফাঁক গলে উপত্যকা দেখতে পারছে সে। গত সপ্তাহের তুষারপাতে পাহাড়ের পাদদেশের কিছুটা ঘেঁসো জমিন সাদা হয়ে গেছে। ওখানে, নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষায় আছে শিকারীরা।

সবাই অধীর অপেক্ষায় আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে, কখন দেখা দেয়। বুনোহাঁস।

নিকোলাস কোনজন, মা? রোয়েন শুধোয় মা-কে। শিকারীদের শেষ সারির দিকে, দেখান জর্জিনা।

ও, লম্বা ভদ্রলোক?

খড়খড় করে ওঠে ওয়াকি টকি। কীপার সবাইকে নতুন নির্দেশ দিচ্ছেন। ধীরে বামে ঘোরো। আস্তে আস্তে ঝোপে বাড়ি দাও। বাধ্যগতের মতো হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকে বিটারেরা।

সামনে এগোন এবারে। এক ঝাঁক উড়ে গেলে থেমে দাঁড়াবেন।

ধীরে, নিরাসক্তভাবে বাতাসে ডানা মেলে বুনোহাঁসের দল।

জর্জিনা, ম্যাজিক–সবাই খুব খুশি। নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়েছে যেনো ম্যাজিক, এ কাজের জন্যই তো ওর জন্ম! তাড়া দেওয়া ওর ভারী পছন্দ।

ম্যাজিকের তাড়া খেয়ে উড়ে যায় একদল বুনোহাঁস। মেয়ে হাঁসটা সামনে, পুরুষটা পেছনে। দারুণ রাজকীয় অবয়ব তার। রক্তবর্ণ আর সবুজের মিশেল লেজটা সিনামন আর কালো রঙে সাজানো, ভীষণ লম্বা।

উড়ে যেতে যেতে ধূসর আকাশের গায়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে উঠে হাঁসটা। এমন। সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়ে রোয়েন।

দ্যাখ, দ্যাখ, কেমন সুন্দর উড়ে যায়! উত্তেজনায় খসখসে হয়ে গেছে জর্জিনার গলা। দিনের সেরা জোড়া! বাজি রাখলাম, কোনো বন্দুক ওদের নাগাল পাবে না!

ওই তো উড়ে যাচ্ছে ওরা, মুক্ত, স্বাধীন। এখনই চলে যাবে পাহাড় পেরিয়ে। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা গরম হাওয়া টেনে উপত্যকার দিকে নিয়ে যায় হাঁস। দম্পতিকে।

বিটারের সারি এ সময়ের অপেক্ষায় ছিল। এর জন্যই যতো কষ্ট। উড়ে গিয়ে বন্দুক ফাঁকি দিতে পারলে সবচেয়ে খুশি হয় বিটারেরা।

বাতাসে মুচড়ে উড়ছে এখনো জোড়া হাঁস। নিজে থেকেই থমকে দাঁড়িয়েছে তাড়ুয়ারা।

ওদিকে, উপত্যকার তলায় বসে থাকা শিকারীদের বন্দুকের নল ঊর্ধ্বমুখী হয়। সর্বোচ্চ গতিসীমায় পৌঁছে গেছে বুনোহাঁসের জোড়া, উত্তেজনায় অধীর শিকারীরা। ছো মারার ভঙ্গিতে এবারে নিচে নামতে শুরু করেছে।

যে কোনো বিচারেই সুকঠিন একটা টার্গেট ওরা। বারো বোর শর্টগানের আওতার শেষ সীমানায় ঝরে পড়তে থাকা বুনো হাঁসে লাগানো চাট্টিখানি কথা নয়। সবচেয়ে সেরা শর্ট হয়তো একটাকে পেতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে দুটো? মনে হয় না।

এক পাউন্ড বাজী ধরলাম! জর্জিনা বলে ওঠেন। দুটোই বেঁচে যাবে! কেউ অবশ্য তার সাথে বাজী লাগতে এলো না।

ধীরে, একপাশে ঠেলে দিচ্ছে বাতাস, পাখিজোড়াকে। দূরের কোণায় সরে যাচ্ছে ওরা। নড়ছে বন্দুকের নল, রোয়েন দেখতে পারছে ওর অবস্থান থেকে। এবারে, একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিকারীরা কিছুটা সহজ অবস্থানে চলে গেছে টার্গেট।

সারির সবচেয়ে শেষের শিকারী দাঁড়িয়ে আছে গতিপথে।

আপনার শর্ট, স্যার, কিছুটা পরিহাসের সুরে এক বন্দুকধারী বলল লম্বা শিকারীকে। নিজের অজান্তেই দম আটকে ফেললো রোয়েন। অবয়বে কী এক প্রতীক্ষা!

যেনো হাঁস জোড়ার আগমন সম্পর্কে সচেতন নয় নিকোলাস হারপার। শর্টগান হাতের ভাঁজে আটকে শিথিল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে, দীর্ঘ শরীর স্থির।

মাদী হসটা যখন তার অবস্থান থেকে ষাট ডিগ্রী মতো কোণে রয়েছে, প্রথমবারের মতো নড়ে উঠলো নিকোলাস। সহজাত ভঙ্গিতে শর্টগান ঘুরিয়ে বাতাসে বৃত্ত কাটলো, বৃত্ত পূর্ণ হওয়ার আগেই চিবুকে যখন ঠেকলো বন্দুকের বাট; গুলি করলো সে।

দূরত্বের কারণে শব্দটা দেরিতে পেল রোয়েন। বন্দুকের আঁকি, নলের সামনে থেকে ওড়া ম্লান নীল ধোয়া তার নজড়ে এলো আগে। অস্ত্র নামিয়ে রাখলো নিকোলাস। মাথা নিচু করে হঠাৎই ধরিত্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো মাদী হাঁসটা। কোনো পালক ছড়িয়ে পড়লো না বাতাসে, সরাসরি মাথায় লেগেছে গুলি। এ সময় আবারো গুলির শব্দ পেল রোয়েন।

ততক্ষণে সরাসরি নিকোলাসের মাথায় উপরে চলে এসেছে মদ্দাটা। এবারে, পিঠ সামান্য বাঁকিয়ে গুলি ছুঁড়লো সে, লম্বা শরীর বেঁকে গেছে। আবারো, গর্জে উঠলো বন্দুক।

একইসঙ্গে সন্তুষ্টি আর নিরাশা নিয়ে রোয়েন ভাবলো, মিস হয়েছে গুলিটা, নিজের মতো করে তখনো উড়ছে হাঁস। ওর অস্তিত্বের এক অংশ চাইছে হাঁসটা বেঁচে থাকুক, আবার আরেক অংশ চাইছে লম্বা লোকটা সফল হোক। আচমকা, পাখা ভাঁজ হয়ে এলো বুনোহাঁসের; রোয়েনের জানা নেই, ওর হৃদপিন্ডও ছিদ্র হয়ে গেছে।

মদ্দাটা মাটি ছুঁতে উল্লাসের ধ্বনি বের হলো তাড়য়াদের মুখ থেকে। এমনকি অন্য শিকারীরা সবাই সমস্বরে স্বীকার গেল দারুণ শর্ট, স্যার!

রোয়েন অবশ্য এ উল্লাসে যোগ দেয় নি, কিন্তু ওর শরীরের হিমঠাণ্ডা কেটে গেছে। একটু হলেও প্রভাবিত হয়েছে সে। ডুরেঈদের কথা ঠিক প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোক তার প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।

শেষ চলন শেষ হতে প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো চারদিক। ক্লান্ত বিটার আর কুকুরগুলোকে তুলে নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো জঙ্গলের পাশে। লম্বা বেঞ্চে বসলো সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে। সিগারেট ধরিয়ে সবার সাথে গল্পে মেতে উঠলেন জর্জিনা।

এমন কঠিন একটা দিন শেষ হতে মনের গভীর কোথাও আনন্দ বোধ করছে। রোয়েন। ক্লান্ত, শিথিল কিন্তু আশ্চর্যরকম তৃপ্ত ও। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও স্ক্রোল, ডুরেঈদের হত্যা আর অদেখা শত্রুদের নিয়ে ভাবে নি সে।

ঢাল বেয়ে পাহাড়ের নিচে নেমে এলো ট্রাক, এক পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল পেছনে আসা সবুজ রেঞ্জরোভারের। দুটো বাহন যখন পাশাপাশি, জানালো দিয়ে তাকিয়ে সরাসরি নিকোলাস কুয়েনটন হারপারের চোখে তাকালো রোয়েন। এস্টেটের গাড়ির চালকের আসনে বসে সে।

প্রথমবারের মতো কাছ থেকে লোকটাকে দেখছে রোয়েন। বয়সে তরুণ অবাক বিস্ময়ে সে ভাবে। ডুরেঈদের বয়সি কাউকে আশা করেছিল মনে মনে। সম্ভবত চল্লিশ পেরোয় নি বয়স। ট্যান করা চামড়া, বহু ঝড়-বঞা সহ্য করেছে বোঝা যায়। মোটা দ্রুর নিচে গভীর সবুজ অন্তর্ভেদি চোখ। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি, চওড়া মুখে তবু বিষাদের ছাপ। রোয়েনের মনে পড়লো, প্রফেসর ডিক্সন কি বলেছিলেন ওকে। তাহলে পৃথিবীতে একা আমি শোকসন্তপ্ত নই!

ওর চোখে চোখ রাখলো নিকোলাস। ভাব পাল্টে যাচ্ছে ভদ্রলোকের মুখের টের পায় রোয়েন। সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে কার না হয়! কিন্তু মনের গভীরে শান্তি বোধ করলো না রোয়েন। ডুরেঈদের নৃশংস মৃত্যু ওর স্মৃতিতে এখনো অম্লান। সেই সাথে ব্যথাতুর। চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো ও। পাশ কাটিয়ে চললো রেঞ্জ রোভার।

*

লীডস ইউনিভার্সিটিতে লেকচারটা ভালোই দিল রোয়েন। ওর বাচনভঙ্গি চমৎকার, নিজের সাবজেক্টের উপর ভালো দখল আছে। রানী লসট্রিসের সমাধি খোঁড়া ও স্ক্রোল আবিষ্কারের বর্ণনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো শ্রোতাদের। তাদের অনেকেই বইটা পড়েছে, ফলে স্বভাবতই প্রশ্নোত্তর পূর্বে জানতে চাওয়া হলো কাহিনীর কতটুকু সত্য। এ পর্যায়ে খুব সাবধানে কথা বলতে হলো রোয়েনকে, লেখকের নিন্দা করা থেকে সযত্নে বিরত থাকলো ও।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর জর্জিনা আর রোয়েনকে ডিনার খাওয়ালেন প্রফেসর ডিক্সন। ডিনার পরিবেশনের আগে ওয়াইন দিয়ে গেল ওয়েটার। রোয়েন খাবে না শুনে বিস্মিত হলেন প্রফেসর, তারপর ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, তুমি কী ধর্মান্তরিত হয়েছ? মানে মুসলমান হয়েছ?

হেসে ফেলে রোয়েন। বলল, আমি কপ্ট। তবে মদ না খাবার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। টেস্টটা আমার ভালো লাগে না।

আমার লাগে, বলে ওয়াইন ভর্তি গ্লাসটা ঠোঁটে তুললেন জর্জিনা।

হয়তো ওয়াইনের প্রভাবেই, নিজের জীবনের বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে বিস্তারিত বলে গেলেন ডিক্সন। কফির সময় রোয়েনের দিকে ফিরলেন তিনি।

ও, ভুলেই গেছি, হঠাৎ বললেন প্রফেসর। এই সপ্তাহের যে কোনো একদিন সন্ধ্যেয় কুয়েনটন পার্কে তোমার ভিজিট নিশ্চিত করেছি আমি। নিকোলাসের পি. এ, মিস স্ট্রিটকে ফোন করলে ও তোমার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবে।

*

কুয়েনটন পার্কে যাওয়ার পথটা রোয়েনের পরিচিত। কয়দিন আগে জর্জিনার সঙ্গে এসেছিল। কিন্তু এবারে ল্যান্ড রোভারে সে একা। বিশাল প্রধান ফটক কাস্ট আয়রনে তৈরি। তার একটু সামনে গেলে তিন চারটে রাস্তা চলে গেছে, প্রতিটির সামনে সাইনবোর্ড পথ নির্দেশ করছে।

যাদুঘরে যাওয়ার পথটা চলে গেছে হরিণ-পার্কের মাঝখান দিয়ে। নির্ভিক উৎসুক চোখে ইতিউতি ঘুরে ফিরছে হরিণের পাল। কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের ফাঁক গলে বিশাল বাড়িটা এক আধবার দেখতে পারছে রোয়েন। প্রফেসর ডিক্সনের দেওয়া গাইডবুক পড়ে সে জেনেছে, ১৬৯৩ সালে প্রখ্যাত স্থপতি স্যার ক্রিস্টোফার রেন এর নকশা করেছিলেন। ষাট বছর পর ব্রাউন সাহেব তৈরি করেছেন বাগানটা। অসাধারণ বললে আসলে কম বলা হবে, এমনই সৌন্দর্য এর।

কপার বিচ গাছের সারির মাঝে মূল বাড়ি থেকে আধ মাইল মতো দূরে যাদুঘরের অবস্থান। বোঝাই যায়, বহুবার মেরামত করা হয়েছে বাংলোটা। দরজার কাছেই অপেক্ষাই ছিলেন মিসেস স্ট্রিট, রোয়েনকে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে ডেকে নিলেন তিনি। ধূসর চুলের মধ্যবয়স্কা মহিলা। সোমবারে বিকেলে আপনার লেকচারে আমি ছিলাম। দারুণ হয়েছে! একটা গাইডবুক আছে মিউজিয়ামের, আমার মনে হয়, এর সংগ্রহে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। বিশ বছর হয়ে গেল এখানে চাকরি করছি। আজ একা আপনিই ভিজিটর। নিজের মতো করে ঘুরে দেখুন, পাঁচটার আগে এখান থেকে যাচ্ছি না আমি। গলিপথের শেষ মাথায় আমার অফিস, প্রয়োজন হলে ওখানে পাবেন আমাকে।

আফ্রিকান স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিসপ্লে দেখে প্রথমেই মুগ্ধ হলো রোয়েন। আলোচ্য মহাদেশের সমস্ত প্রাণীই আছে সেখানে। রূপালি-ধূসর পুরুষ গরিলা থেকে শুরু করে সব রকমের বানর, কলোবাস।

যদিও কিছু কিছু নমুনা প্রায় একশ বছরের পুরোনো, তথাপি অত্যন্ত ভালো অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, সুদক্ষ কর্মী দ্বারা পরিচালিত হয় এ যাদুঘর। বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এ জন্য রোয়েন ভাবে। মনের গভীরে স্বীকার যায়, পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড, ভালো কাজেই লেগেছে।

অ্যান্টিলোপের কক্ষে গিয়ে বিস্ময়াভূত রোয়েন তার চারপাশে তাকিয়ে দেখে সংরক্ষিত প্রাণীগুলো। একটা অভাবিত সুন্দর, অ্যাঙ্গোলান প্রজাতির দুর্লভ হরিণের স্টাফ দেখে দুঃখ বোধ হয় তার। এমন সুন্দর একটা প্রাণী মেরেছে হারপার পরিবার! ভাবা যায়! পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দেয়–শিকারীর সংগ্রহ না থাকলে আজ আর কেউ দেখতে পেতো না এ প্রজাতি।

পরবর্তী হলঘরে রয়েছে হাতির সংগ্রহ। বিশাল একজোড়া আইভরির সামনে দাঁড়িয়ে থমকে যায় রোয়েন–এতো বড়ো, বিশ্বাসই হতে চায় না কোনো জীবিত জন্তুর ওগুলো। এ যেনো ডায়ানার হেলেনিক মন্দিরের থামের মতো মোটা! থেমে পরে, ক্যাটালগ কার্ডটা পড়ে দেখে রোয়েন :

আফ্রিকার হাতির দাঁত, লক্সোডোনটা আফ্রিকানা। ১৮৯৯ সালে স্যার জোনাথন কুয়েনটন হারপার কর্তৃক মৃত। বামদিকের দাঁতের ওজন ২৮৯ পাউন্ড, ডানদিকের ৩০১ পাউন্ড। বড়ো দাঁতের দৈর্ঘ্য ১১ফুট ৪ ইঞ্চি। বেড় ৩২ ইঞ্চি। একজন ইউরোপীয় শিকারী কর্তৃক সংগৃহীত সবচেয়ে বড় আইভরি।

রোয়েনের দ্বিগুণ লম্বা ওগুলো। ওর কোমরের অর্ধেক মোটা। এরপর মিশরীয় সংগ্রহের কক্ষে ঢুকে চমৎকৃত হলো রোয়েন।

কক্ষের কেন্দ্রে ওর চোখ আটকে যায়। পনেরো ফুট উঁচু মূর্তি ওটা, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের। দেবতা ওসিরিসের মতো করে চিত্রায়িত–পালিশ করা লাল গ্রানাইট পাথরের। দেব সম্রাট তাঁর পেশীবহুল পায়ে দাঁড়িয়ে, আঁটো জামা আর স্যান্ডল পরনে। বাম হাতে যুদ্ধ-ধনুকের অবশিষ্টাংশ বহন করছেন তিনি, বাকি অংশ ভেঙে গেছে। এতো হাজার বছরে কেবল এ সামান্য ক্ষতি ছাড়া সম্পূর্ণ অক্ষত মূর্তিটা। ডান মুঠোয় রাজকীয় বর্ণমালায় লেখা একটা সীল ধারণ করে আছেন। ফারাও।

মস্তকে দীর্ঘ দ্বিমুকুট। মুখাবয়বে প্রশান্তির ছাপ।

দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারলো রোয়েন। কেননা, কায়রো যাদুঘরের গ্রান্ড হলে এর একটা জমজ রয়েছে। অফিসে যাওয়ার পথে প্রতিদিনই দেখতো সে।

নিজের ভেতরে উথলে ওঠা রাগের অস্তিত্ব টের পায় রোয়েন। মাতৃভূমি মিশরের অত্যন্ত মূল্যবান একটা সম্পদ ওটা। অথচ তার দেশ থেকে চুরি করে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। কারো অধিকার নেই, ওটা এখানে নিয়ে আসার। মহান নদী, নীলের তীরে এর আবাস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায় রোয়েন, মূর্তির নিচে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক পড়ে।

রাজকীয় অক্ষরে লেখা আছে সতর্কবাণী: আমি পবিত্র রামেসিস, দ্বিতীয়, দশ হাজার রথের প্রভু। হে মিশরের শত্রু–সাবধান! আমাকে চিনে রাখো!

রোয়েন নিজে জোরে পড়ে নি বার্তাটা, কিন্তু ওর পেছন থেকে নরম, ভারী কণ্ঠে কেউ একজন পাঠ করে বাক্যগুলো, চমকে দেয় তাকে। কাউকে আসতে শুনে নি রোয়েন, পাই করে ঘুরে দাঁড়ায় ও।

নীল কার্ডিগানের পকেটে হাত গোজা ভদ্রলোকের, এক কনুইয়ে একটা ফুটো। বহুল ব্যবহৃত ডেনিম জিন্স ওভারঅল পরনে, মনোগ্রাম করা ভেলভেট কার্পেট স্লিপার পায়ে।

দুঃখিত, আপনাকে চমকে দিতে চাই নি। আলস্যভরা মার্জিত হাসলো সে, চমৎকার সাদা দাঁতের সুন্দর হাসি। এরপরেই ওকে চিনতে পারলো।

আরে, আপনি! রোয়েন ভাবে, আমাকে চিনতে পেরেছেন ভদ্রলোক! এক মুহূর্তের জন্য দেখা হয়েছিল মাত্র! পরক্ষণেই, তার দৃষ্টির কিছু একটা বিরক্ত করলো তাকে। যা হোক, হাত মেলালো রোয়েন।

নিক কুয়েনটন হারপার, নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক। আপনি পার্সিভালো ডিক্সনের ছাত্রী, আমি জানি। আমার মনে হয়, গত বৃহস্পতিবারে শিকারে আপনাকে দেখেছি। সম্ভবত বিট করছিলেন সেদিন।

একটু সহজ হয় রোয়েন। হ্যাঁ। আমি রোয়েন আল সিমা। আমার ধারণা, আমার স্বামী ডুরেঈদ আল সিমা আপনার পরিচিত।

ডুরেঈদ! চিনবো না মানে! মরুতে বহু সময় কাটিয়েছি দু জন একসঙ্গে। দারুণ লোক। কোথায় উনি?

ও মারা গেছে।

এমন সাধাসিধা, হৃদয়হীনের মতো বলতে চায় নি রোয়েন, কিন্তু আর কোনো জবাব এলো না মাথায়।

ওহ! বলেন কি? জানতামই না! কেমন করে ঘটলো?

এইতো, সপ্তাহ তিনেক আগে। খুন।

ওহ, মাই গড! চোখে বেদনা ফুটে উঠলো নিকোলাসের। নিখাদ ভাবাবেগ। মাত্র চারমাস হলো কায়রোতে ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। কতো চমৎকার ছিলেন তখনো। কারা খুন করেছে, পাওয়া গেছে?

মাথা নেড়ে রুমের চারদিকে দৃষ্টি ফেরায় রোয়েন, ওর চোখের কান্না দেখতে দিতে চায় না।

আপনাদের সংগ্রহ অসাধারণ!

বিষয়ের এ হঠাৎ পরিবর্তন মেনে নেয় নিকোলাস। সব আমার দাদার কীর্তি। কায়রোতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে কাজ করতেন উনি।

বাধা দিয়ে রোয়েন বলে ওঠে, আমি জানি। সে সময় প্রথম আর্ল ছিলেন ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল অব ঈজিপ্ট। ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭। আমার দেশে একনায়কত্ব চালিয়েছেন বহুদিন।

নিকোলাসের চোখের দৃষ্টি সরু হয়। পার্সিভালো বলেছিল আপনি তার সেরা ছাত্রী। কিন্তু এটা বলেনি যে, আপনার জাতীয়তাবোধ এতো প্রখর। রামেসিসের হায়ারোগ্লিফিক অনুবাদ করার জন্য আমার সাহায্য দরকার নেই তবে।

আমার বাবা গামাল আবদেল নাসেরের বাহিনীতে ছিলেন, বিড়বিড় করে রোয়েন। রাজা ফারুকের পুতুল সরকার ভেঙে নাসেরই মিশরে ব্রিটিশ শাসনের যবনিকা টেনে দেন। সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করেন।

ওহ হো! নিকোলাস মুচকি হাসে। দুই মেরুর লোক তবে আমরা। তবে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। আশা করি, আমি আর আপনি শত্রু নই আর!

মোটেও না, ডুরেঈদ আপনার সম্পর্কে বেশ ভালো বলতো।

আমি তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। আবারো প্রসঙ্গ পাল্টায় নিক। রাজকীয় উশব তি, বা ছোট্ট পুতুল-এর সংগ্রহ নিয়ে আমরা বেশ গর্বিত। প্রাচীন সাম্রাজ্যের প্রত্যেক ফারাও-এর সমাধি থেকে শুরু করে টলেমি পর্যন্ত সবার আছে। চলুন আপনাকে দেখাই।

একটা দেয়াল জুড়ে সাজনো ডিসপ্লে কেস। শেলফের পর শেলফ জুড়ে শুধু পুতুল, সম্রাটের মৃত্যুর পর তার সমাধির মধ্যে একজন দাস বা ভৃত্য হিসেবে রাখা হতো ওগুলো।

চাবি দিয়ে একটা কেস খুলে সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটা বের করে নিকোলোস। এটা হলো মায়া-র উশ তি, তুতেনখামেন, আয়ে এবং হোরেমহেব-এর শাসনামলে ভৃত্য ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৩ সালে নিহত, আয়ে-এর সমাধি থেকে: সংগৃহীত।

পুতুলটা হাতে নিয়ে ওটার গায়ে অঙ্কিত হায়ারোগ্লিফিক পড়ে রোয়েন অনায়াসে। আমি মায়া-, দুই রাজ্যের কোষাধ্যক্ষ। পবিত্র ফারাও, আয়ে-এর হয়ে আমি জবাবদিহি করব। তিনি চিরজীবী হোন! ইচ্ছে করেই আরবিতে বলল রোয়েন। একটু পরীক্ষা করে দেখতে চায়। সাথে সাথেই সারলীল আরবিতে উত্তর দেয় নিকোলাস।

পার্সিভালো ডিক্সন দেখছি খাঁটি কথা বলেছেন। নির্ঘাত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী আপনি।

পালা করে আরবি এবং ইংরেজিতে কথা বলে চললো ওরা। নিজেদের পছন্দমতো বিষয় পেয়ে আড়ষ্টতা কাটলো অনেকটা। প্রতিটি কেসের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ করে দেখলো।

যেনো প্রাচীনকালে ফিরে গেছে দু জন। এমন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের সামনে বর্তমান সময় যেনো কোনো গুরুত্ব বহন করে না। ঘণ্টা, মিনিট কেটে যেতে থাকে। মিসেস স্ট্রিট এসে চমকে দিলেন ওদের। আমি চলে যাচ্ছি, স্যার নিকোলাস। আপনি তাহলে লক্ করে এলার্ম চালু করে দিয়েন। সিকিউরিটি গার্ডেরা ডিউটিতে চলে এসেছে।

কয়টা বাজে? বলে, নিজের কবজির রোলেক্সের দিকে তাকায় নিকোলাস। পাঁচটা চল্লিশ! আজব ব্যাপার! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, আপনি যান, মিসেস স্ট্রিট। এতো সময় দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

এলার্ম সেট করতে ভুলে যেয়েন না আবার, সতর্ক করে দিয়ে বলেন স্ট্রিট।

একদিনের জন্য অনেক আদেশ দিয়ে ফেলেছেন আমাকে। এখন যান তো! হেসে বলে নিকোলাস। এবারে রোয়েনের দিকে ফিরে বলে, ডুরেঈদের স্মৃতিবিজড়িত একটা জিনিস না দেখিয়ে আপনাকে ছাড়ছি না। সময় আছে তো?

রোয়েন মাথা নাড়ে। ওর হাত ধরতে এক হাত এগিয়েও কি মনে করে যেনো সরিয়ে নেয় নিক। আরব সমাজে ভদ্রমহিলাদের এমন কি ছোঁয়াও বারণ। একটু হলেও প্রভাবিত হয় রোয়েন।

ব্যক্তিগত নামাঙ্কিত একটা কক্ষে ওকে নিয়ে যায় নিকোলাস।

এটা হলো ইনার মিউজিয়াম। ব্যাখ্যাদানের ভঙ্গিতে বলে সে। বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আগে আমার স্ত্রী সব গোছাতো, কিন্তু থেমে যায় নিকোলাস। দেরাজের উপর একটা পারিবারিক ছবির দিকে তাকায় এক পলক। নিকোলাস আর গাঢ় রঙা চুলের এক মেয়ে বসে কোনো এক পিকনিক পার্টিতে। মাথার উপরে বিস্তৃত ওকের শাখা। মায়ের মতো দেখতে দুটো ফুটফুটে মেয়ে আছে কাছেই, একজন নিকের কোলে; বড়টা ঘোড়ার দড়ি ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে। আড়চোখে তাকিয়ে, নিকোলাসের চোখে সব হারানোর কষ্ট দেখতে পায় রোয়েন।

ভদ্রলোককে সামলে নিতে দিয়ে রুমের চারদারে চোখ বুলায় সে। বিশাল, আরামদায়ক কক্ষ–একজন পুরুষের, বোঝাই যায়। তবে তার দ্বৈত-চরিত্র যেনো প্রকাশ্য, বই-পত্রের পণ্ডিতির পাশাপাশি অভিযাত্রীর ছাপ বড়ো স্পষ্ট। বইয়ের সারির সঙ্গে রয়েছে ফিশিং রীল, শটগান, কার্টিজ, বাক্স, জ্যাকেট।

দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো চিনতে পারে রোয়েন। উনিশ শতকীয় শিল্পী ডেভিড রবার্টের আঁকা জলরঙ। আরো রয়েছে নেপোলিয়নের সঙ্গে মিশর ভ্রমণ করা শিল্পী ভিভান্ত ডেনন-এর প্রাচীন মিশরীয় স্থাপত্য চিত্র।

ফায়ারপ্লেসে কাঠখণ্ড ফেললো নিকোলাস। অর্ধেক দেয়াল ঢাকা পর্দার সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকে রোয়েনকে। একটানে পর্দা সরিয়ে ফেলে, সন্তুষ্টির সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগলো?

দেয়ালে কারুকার্জ করা বাস-রিলিফ ফ্রিজ দেখে তাক লেগে যায় রোয়েনের। কিন্তু নিজের অনুভূতি প্রকাশ পেতে দেয় না সে।

অ্যামোরাইট বংশধারায় ষষ্ঠ রাজা, হামুরাবি, খ্রিস্টপূর্ব ১৭৮০ সালের দিকের, নিপ্রাণ স্বরে বলে রোয়েন। প্রাচীন সম্রাটের নিখুঁতভাবে খোদাই করা মূর্তি পর্যবেক্ষণ করার ছল করে আবারো বলে, আসুর-এ, সম্ভবত তার প্রাসাদের স্থান, জিগুরাত থেকে আনা। দুটো থাকার কথা। কম করে হলেও পাঁচ মিলিয়ন ডলার করে এক একটি। সম্ভবত আধুনিক মেসোপটেমিয়ার শাসক, সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে দুজন নীতি বিবর্জিত লোক এগুলো চুরি করে এনেছিল। আমার জানা মতে, টেক্সাসের জনৈক পিটার ওয়ালশের কাছে এর বাকিটা আছে।

অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে নিকোলাস। এরপর অট্টহাস্যে ফেটে পরে। ধুত্তোর! ডুরেঈদকে বলেছিলাম গোপন রাখতে। ব্যাটা বলে দিয়েছে। সেই প্রথম নিকোলাসকে হাসতে শুনলো রোয়েন। প্রাণখোলা, অবিচলিত হাসি।

হ্যাঁ, দ্বিতীয়টির মালিক সম্বন্ধে আপনার কথা ঠিক, হাসতে হাসতেই বলে নিক। কিন্তু দামটা ভুল বলেছেন; পাঁচ নয়, ছয় মিলিয়ন।

ডুরেঈদ আমাকে আরো বলেছে, আপনি শাদ এবং দক্ষিণ লিবিয়ায়ও অভিযান চালিয়েছেন।

মন্তব্য করে রোয়েন। মাথা নেড়ে পরিহাস করে চলে নিক।

দেখা যাচ্ছে, আমার কোনো গোপনীয়তা আপনার কাছে গোপন নেই! বিপরীত দিকের দেয়ালে সাজানো একটা আর্মার-এর দিকে এগোয় সে। সম্ভবত সতেরোশো শতকের ফ্রেঞ্চ জিনিস। লিবিয়া থেকে আমি এবং ডুরেঈদ এ জিনিসটা নিয়ে আসি। অবশ্য কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির কাছ থেকে অনুমতি ছাড়াই! চমৎকার ব্রোঞ্জের বস্তুটি নামিয়ে রোয়েনের হাতে দেয় সে। একজন মা, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন–এমন ভাস্কর্যটি।

হানিবল, হামিলকার বারকার পুত্র। বলে চলে নিকোলাস। খ্রিস্টপূর্ব ২০৩ সালের। উত্তর আফ্রিকার ব্যাগ্রাদাস নদীর ধারের পুরোনো ক্যাম্পে পাওয়া গিয়েছিল। রোমান জেনারেল সিপিওর হাতে পরাজয়ের আগে সম্ভবত ওখান থেকেই ধরা খেয়েছিলেন হানিবল। দুশো ব্রোঞ্জের কাজ রয়েছে ওই সময়ের তার মধ্যে সেরা পঞ্চাশটি আমার অধিকারে।

বাকিগুলো বেচে দিয়েছেন? মূর্তিটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে রোয়েন শুধায়। এতো চমৎকার জিনিস ছাড়তে ও চাইলো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস। ছাড়তে হলো। কিন্তু কী করব, ওই অভিযানে কম টাকা খরচ হয় নি আমার। কিছু মাল বিক্রি করে খরচ উঠিয়েছি।

ডেস্কের কাছে গিয়ে একটা হুইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে আসে নিকোলাস।

ঢালবো আপনার জন্য?

মাথা নাড়ে রোয়েন।

ঠিক আছে। রমণীসুলভ ড্রিঙ্ক চলবে?

কোকাকোলা আছে? রোয়েন বলে।

আছে। ওটা আপনার জন্য আরো খারাপ। শুধু চিনি আর চিনি। বিষ একেবারে।

যা হোক, নিকের দেওয়া কোকের গ্লাস হাতে নেয় রোয়েন, বলে, ডুরেঈদ আমাকে সবই বলেছে। ডেস্কের বসে ভদ্রলোকের চোখে তাকায় এবারে। আসলে, ডুরেঈদের অনুরোধেই আমি আপনার কাছে এসেছি। বলতে পারেন, ওর ইচ্ছে এটা।

আহা! তবে দেখছি কোনো কিছুই দৈবাৎ নয়! মনে হচ্ছে কোনো গভীর ষড়যন্ত্রে আমি তুচ্ছ এক ঘুটি মাত্র। ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে দিকে ইঙ্গিত করে নিকোলাস।

বসুন। তারপর বলুন!

গভীর অন্তর্ভেদি সবুজ চোখে রোয়েনের দিকে চেয়ে থাকে সে। মনে মনে প্রমাদ গোণে রোয়েন–এ লোকের কাছে মিথ্যে বলে পার পাওয়া সহজ নয়।

বড় করে শ্বাস নিল সে, তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চয়ই প্রাচীন এক মিশরীয় রাণী, রাণী লসট্রিস-এর নাম শুনেছেন। আমি সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ডের কথা বলছি, হিকসস ইনভেশন-এর সময় বেঁচেছিলেন।

হেসে ফেললো নিকোলাস। ও, আপনি ওই বইটার কথা বলছেন, রিভার গড। সোফা ছেড়ে লম্বা একটা শেলফের সামনে চলে এলো ও। বইটা হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলো, ডেস্কে রাখলো ওটা। বহুবার উল্টানো হয়েছে পৃষ্ঠাগুলো বোঝাই যায়।

পড়েছেন বইটা? রোয়েন জানতে চায়।

হ্যাঁ। উইলবার স্মিথের সমস্ত লেখাই আমি পড়েছি। দারুণ লাগে। এখানে, কুয়েনটন পার্কে বার দুয়েক শিকার করেছেন উনি।

তারমানে উপন্যাসে দুর্দান্ত ভায়োলেন্স আর যৌনতা পছন্দ করেন আপনি কোনো সন্দেহ নেই। চেহারা বিকৃত করে বলল রোয়েন। এ বইটার সম্পর্কে কী ভেবেছেন?

স্বীকার করছি, লেখক আমাকে বোকা বানিয়েছেন। পড়ার সময় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল নিশ্চয়ই সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছে। হেসে উঠলো নিকোলাস। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। পড়া শেষ করি, তারপর ডুরেঈদকে ফোনও করেছিলাম। বইটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টে শেষ দিকে চলে এলো ও। লেখকের নোট সত্যি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। শেষ বাক্যটা তো আমি ভুলতেই পারি না। পড়ি, কেমন?

নীলনদের উৎসমুখের কাছাকাছি আবিসিনিয়ান পাহাড়ে কোথাও ফারাও মামোস-এর অনাবিষ্কৃত ও সুরক্ষিত সমাধির ভেতর ট্যানাস-এর মমি আছে। ..

চোখে প্রশ্ন, নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন।

বইটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলো নিকোলাস। পড়া শেষ হতে ভাবলাম, সত্যি হলে কি ভালোই না হত। আসলে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলেই নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, জানেন না, ফারাও মামোসের সমাধি খুঁজে বেরুতে পারলে কি যে খুশি হতাম! ডুরেঈদকে ফোন করি। কিন্তু তিনি যখন বললেন, এ-সব স্রেফ ভিত্তিহীন অনুমান, মনটা খারাপ হয়ে যায়।

না, ভিত্তিহীন অনুমান নয়, প্রতিবাদ করলো রোয়েন, তারপর নিজেই দ্রুত সংশোধনী আনল, মানে, অন্তত সবটুকু নয়।

কিন্তু ডুরেঈদ তো মিথ্যে কথা বলার মানুষ ছিলেন না!

ডুরেঈদ মিথ্যে কথা বলেন নি, সত্যি কথাটা বলার জন্য একটু সময় নিচ্ছিলেন। পুরো কাহিনীটা আপনাকে বলার প্রস্তুতি ছিল না তার। স্বভাবতই আপনি অনেক প্রশ্ন করতেন, কিন্তু উত্তরগুলো তার জানা ছিল না। তৈরি হওয়ার পর আপনার কাছেই আসার কথা ছিল। স্পনসরদের একটা তালিকা তৈরি করি আমরা, তাতে আপনার নামটাই ছিল সবার উপরে।

সব প্রশ্নের উত্তর জুরেঈদের জানা ছিল না, তারমানে কি আপনার জানা আছে?

স্ক্রোল আবিষ্কার মিথ্যে নয়। ওগুলোর নয়টা আছে কায়রো মিউজিয়ামের ভন্টে। রানী লসট্রিসের সমাধি থেকে আমিই ওগুলো আবিষ্কার করি। লেদার স্লিং ব্যাগ থেকে একগাদা কালার ফটোগ্রাফ বের করলো রোয়েন, একটা বেছে ধরিয়ে দিল নিকোলাসের হাতে। সমাধির পেছনের দেয়ালের ছবি। কুলঙ্গিতে রাখা চকচকে জারগুলো অস্পষ্ট হলেও দেখতে পাবেন। ছবিটা তোলা হয় আমরা ওগুলো নামানোর আগে।

ভালো ছবি, কিন্তু এটা যে-কোন জায়গায় তোলা হতে পারে।

মন্তব্যটা কানে না তুলে নিকোলাসের হাতে আরেকটা ফটো ধরিয়ে দিল রোয়েন। এটায় দশটা স্ক্রোলই দেখতে পাচ্ছেন, মিউজিয়াম ওআর্করূপে, যেখানে বসে কাজ করতেন ডুরেঈদ। বেঞ্চের পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকদের আপনি চিনতে পারছেন?

ডুরেঈদ আর উইলবার স্মিথ। নিকোলাসের চেহারায় একাধারে সন্দেহ ও কৌতুক ফুটে উঠলো। ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন বলুন তো!

এই যে, লেখক বড় ধরনের পোয়েটিক লাইসেন্স নিলেও, তিনি তাঁর বইতে যা লিখেছেন তা সত্যের উপর ভিত্তি করে লেখা। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব সপ্তম স্কোলের, ডুরেঈদের খুনীরা যেটা চুরি করে নিয়ে গেছে।

কেন ওটা বাকিগুলোর চেয়ে আলাদা? খানিক পর জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

এ জন্য যে ওটায় ফারাও মামোসকে কবর দেওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এবং, আমাদের বিশ্বাস, দিক নির্দেশনাও আছে, সেটা ধরে সমাধির সাইট খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

বিশ্বাস করেন, নিশ্চিতভাবে জানেন না?

সপ্তম স্ক্রোলের বেশিরভাগটাই এক ধরনের সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা। আমি আর ডুরেঈদ যখন কোড ভাঙার কাজটা শেষ করে এনেছি, ঠিক তখনই… ডুরেঈদকে ওরা খুন করলো।

এতো দামী জিনিস, নিশ্চয়ই আরো কপি আছে?

মাথা নাড়লো রোয়েন। সমস্ত মাইক্রোফিল্ম, আমাদের সব নোট, অরিজিনাল স্লোলের সঙ্গে চুরি হয়ে গেছে। ডুরেঈদকে যারাই খুন করে থাকুক, তারা কায়রোয় আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার পিসি ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই পিসিতে আমাদের গবেষণার সমস্ত তথ্য জমা ছিল।

আগুনে কয়লার টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে ডেস্কে ফিরে এলো নিকোলাস। তার মানে আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এমন কিছু নেই যা দেখে বোঝা যায় কথাগুলো সত্যি?

না, নেই, বলল রোয়েন। তবে এখানে সবই টুকে রাখা আছে। লম্বা আঙুল দিয়ে নিজের কপালে টোকা দিল সে। আমার স্মরণশক্তি খুবই ভালো।

রোয়েন থামতে নিকোলাস জানতে চাইলো, এবার বলুন, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?

আমি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি ফারাও মামোসের সমাধিটা আপনি খুঁজে বের করুন!

আচমকা হাবভাব পাল্টে গেছে নিকোলাসের। দুষ্ট্র স্কুলবয়ের মতো হাসে সে। এরচেয়ে বেশি কিছু আমি আর চাই না।

সেক্ষেত্রে, আপনাকে আমার সঙ্গে এক ধরনের এগ্রিমেন্টে আসতে হবে। রোয়েন বলে তাকে। ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে বসে সে। প্রথমে, আমি বলবো, আমার কি চাই, এরপর আপনার পালা।

কয়েকটা বিষয়ে একমত হলো নিকোলাস, কিছু বিষয়ে তর্ক করলো। এভাবে সময় গড়ালো, তারপর দেখা গেল রাত বাজে একটা। ক্লান্তির কাছে রোয়েনই হার মানল প্রথম, বলল, আমি আর মাথা ঘামাতে পারছি না। ভাবছি আবার কাল সকালে শুরু করলে কেমন হয়?

নিকোলাস বলে, তাই হোক। আপনি এখানে ঘুমোতে পারেন। সাতাশটা বেডরুম আছে আমাদের।

না, ঠিক আছে। দাঁড়িয়ে পরে বলে রোয়েন। আমি বাড়ি ফিরবো।

রাস্তায় দারুণ ঠাণ্ডা, সতর্ক করে দিয়ে নিকোলাস বলে। কিন্তু রোয়েনের চোখমুখ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঠিক আছে, আমি জোর করছি না। কাল তাহলে আসুন একবার। দশটার সময় আমার ল-ইয়ারদের সাথে মিটিং আছে, দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যাবে। এখানে লাঞ্চ করতে পারি আমরা, তখন না হয় কথা বলা যাবে? বিকেলে যদিও শুটিং করার কথা আমার ভাবছি, বাদ দিব। যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে তাহলে।

*

পরদিন কুয়েনটন পার্কের লাইব্রেরিতে ল ইয়ারদের সাথে বৈঠকে বসলো নিকোলাস। কাঠ-কোট্টা, নীরস আলাপ। এ বছরটা বলতে গেলে একেবারে যাচ্ছেতাই যাচ্ছে তার। বছর শুরুর কথা নিক মনে করতে না চাইলেও ওর স্মৃতিতে তা চির অম্লান থাকবে। নিশুতি রাতে, তুষারপাতের মধ্যে সে নিজেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল; যার ফলে ঝরে গেছে তাজা কটি প্রাণ।

ওটা থেকে সামলে উঠতে না উঠতেই পরবর্তী আঘাত। লয়েডস্ ব্যাঙ্কের ইনসুরেন্স সিন্ডিকেট থেকে ফোন পেল সে। অর্ধ-শতাব্দী থেকেই ওই সিন্ডিকেট থেকে বেশ বড় অঙ্কের একটা সাহায্য পেয়ে আসছিল হারপার পরিবার। পঞ্চাশ বছরেও যা হয় নি, এবারে ঠিক তাই ঘটলো। বিরাট অর্থক্ষতির সম্মুখীন হলো সিন্ডিকেট। ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং! নিকোলাসের নিজের শেয়ার ছিল আড়াই মিলিয়ন। আট মাসের মধ্যে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে হবে তাকে।

প্রায় একই সঙ্গে কুয়েনটন পার্কের সুগার বিট ফসলে লাগলো মড়ক। এক হাজার একর ভূমির ফসল নষ্ট হয়ে গেল।

অন্তত আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড আমাদের প্রয়োজন এ মুহূর্তে, একজন ল ইয়ার বললেন। ওটা কোনো সমস্যা নয়–যাদুঘরে অনেক মূল্যবান সংগ্রহ আছে। কিছু জিনিস বিক্রি করলে ভালো আয় হতে পারে।

রামেসিস মূর্তি, কিংবা ব্রোঞ্জ বা হামুরাবি ফ্রিজ বিক্রির চিন্তায় আঁতকে উঠলো নিকোলাস। ও জানে, এর ফলে হয়তো দেনা মেটাতে পারবে সে, কিন্তু প্রাণের সমান প্রিয় সংগ্রহ হারিয়ে বেচে থাকতে হয়তো পারবে না।

কক্ষনো না, আচমকা বলে উঠে সে। ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকায় আইনবিদরা।

আর কী উপায় আছে, আসুন ভেবে দেখি। একগুয়ের মতো বলে নিকোলাস। ডেইরি ফার্ম তো আছে।

ওতে করে কেবল দশ লাখ পাওয়া যাবে, তাও যদি ভাগ্য ভালো হয়।

রেসের ঘোড়াগুলো বেচলে কেমন হয়? এবারে একাউন্টেন্ট বলে ওঠে।

মাত্র ছয়টা ঘোড়া আছে ট্রেনিং-এ। আরো দুইশো গ্রান্ড হলো। এর পরেও দুই লাখ বিশ হাজার পাউন্ড বাকি থাকে।

ইয়ট আছে, তরুণতম আইনবিদ বলে।

ওটার বয়স আমার চেয়ে বেশি, মাথা নাড়ে নিকোলাস। বাপের জিনিস। ওটা কি করে বিক্রি করি? কোনো দাম পাবো না। এর চেয়ে আমার শটগান বেচলে ভালো পাবো!

দু জন আইনবিদ একটা তালিকায় চোখ বুলায়। পাওয়া গেছে! এক জোড়া সাইডলক ইজেক্টর! চল্লিশ হাজার পাওয়া যাবেই।

তালিকায় আর কী কী রেখেছেন? শুষ্ক কণ্ঠে বলে নিক। আমার পুরোনো আন্ডারপ্যান্ট আর মোজা?

ওর মন্তব্য উপেক্ষা করে অন্যরা। লন্ডনে একটা বাড়ি আছে। দেড় মিয়িয়ন পাওয়া যাবে।

এই বাজারে নয়, নিকোলাস ফোড়ন কাটে। এক মিলিয়ন হতে পারে। কাগজে নোট নেয় ল ইয়ার। সম্পূর্ণ এস্টেট যেনো বেচতে না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য আছে বটে।

কোনো রকমের সিন্ধান্ত ছাড়াই শেষ হলো সভা। দারুণ ক্লান্ত, অসহায় বোধ করছে নিকোলাস।

ল ইয়ারদের বিদায় দিয়ে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে গিয়ে গোসল সেরে নতুন জামা পরে নেয় সে। কোনো কারণ ছাড়াই, কেনো যেনো শেভ করে একটু পরিপাটি হয়।

রেঞ্জ রোভার চালিয়ে মিউজিয়ামে পৌঁছে। ঝিরঝিরে তুষার পরছে।

মিসেস স্ট্রিটের অফিসে ওর অপেক্ষায় বসেছিল রোয়েন। দরজায় দাঁড়িয়ে তার হাসির শব্দ শুনতে পেল নিকোলাস–মিসেস স্ট্রিটের সাথে ভালোই জমেছে মেয়েটার!

মেইন হাউজ থেকে গরম খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে কুক। এমন বাজে আবহাওয়ায় এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। বাইরে ঝড়ো হাওয়া, আগুনের পাশে বসে খেয়ে নিল ওরা।

খেতে খেতেই ডুরেঈদের মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে চাইলো নিকোলাস। সবই বলল রোয়েন, নিজের ক্ষতের কথাও বাদ দিল না। কায়রোর রাস্তায় ওর উপর দ্বিতীয়বার হামলার কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনলো নিকোলাস।

কাউকে সন্দেহ হয়? রোয়েনের বলা শেষ হতে বলল সে। এমন কেউ–যার কাজ হতে পারে এটা?

মাথা নাড়ে রোয়েন।

না, এমন কোনো পূর্বাভাস তো পাই নি। সে বলে।

আপন চিন্তায় ডুবে থেকে খাবার শেষ করে দু জন। কফির সময়ে এসে নিক বলে, ঠিক আছে, আমাদের এগ্রিমেন্ট নিয়ে তবে আলাপ করি, আসুন।

আবারো, এক ঘণ্টা ধরে তর্কে মেতে উঠলো দু জন।

লুটের মাল বা উদ্ধার করা আর্টিফ্যাক্ট আপনি কতটুকু পাবেন, নির্ধারণ করা সত্যি কঠিন, যতক্ষণ না আমি জানছি উদ্ধার করার পেছনে আপনার অবদান কতটুকু হবে, কফির কাপ দুটো আবার ভরার সময় বলল নিকোলাস। ভুলে যাবেন না, অভিযানের সমস্ত খরচ আমি দিচ্ছি, প্ল্যানটাও আমার তৈরি।

আপনি ধরে নিন আমার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা না হলে লুটের মাল বা উদ্ধার করা আর্টিফ্যাক্ট বলে কিছু থাকবে না। শুধু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, এগ্রিমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত আর একটি কথাও আপনাকে আমি বলছি না।

একটু যেনো কর্কশ লাগছে আপনাকে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

রোয়েনের ঠোঁটে দুষ্ট হাসি ফুটল।

আপনি যদি আমার শর্তে রাজি না হন, স্পনসরদের তালিকায় আরো তিনজনের নাম আছে, হুমকি দিল রোয়েন। অগত্যা তাদেরকেই আমার বিশ্বাস করতে হবে।

ধরা যাক, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম, কিন্তু সমান ভাগ কীভাবে সম্ভব?

আর্কিওলজিকাল আর্টিফ্যাক্টস থেকে প্রথমে আমি বেছে নিব, বলল রোয়েন।

পরের বার বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন আপনি। এভাবে চলতে থাকবে।

প্রথমে আমি বাছার সুযোগ নিলে অসুবিধে কী? একদিকের ভুরু উঁচু করে জানতে চাইলো নিকোলাস।

আসুন তাহলে টস করি, বুদ্ধি দিল রোয়েন, সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে এক পাউন্ডের একটা কয়েন বের করলো নিকোলাস।

কল! আঙুলের টোকায় কয়েনটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল নিকোলাস।

রোয়েন চিৎকার দিল, হেডস!

ধ্যেত! কয়েকটা আলগোছে পকেটে ভরল নিকোলাস।

ঠিক আছে,–আপনিই আগে বেছে নেবেন–আদৌ যদি আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায়। আপনার জিনিস নিয়ে আপনি যা খুশি করুন, আমার কিছু বলার থাকবে না। ইচ্ছে করলে সব আপনি কায়রো মিউজিয়ামকে দান করতে পারেন। তো, ডিল? নিচু টেবিলের উপর ডান হাতটা চিৎ করে রাখলো ও।

ডিল! নিকোলাসের হাতের উপর হাত রাখলো রোয়েন। পার্টনার।

এবার শুরু করুন। কোনো কিছু গোপন করা যাবে না। যা জানেন সব বলে ফেলুন।

বইটা আনুন, বলল রোয়েন। রিভার গড নিয়ে ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো, টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছে রোয়েন। বইয়ের যে অংশটুকু ডুরেঈদ সম্পাদনা করেছিলেন, প্রথমে সেটার উপর চোখ বুলানো যাক। পাতা ওল্টাচ্ছে রোয়েন। এখান থেকে। এখান থেকে দুরেঈদের অস্পষ্টকরণ শুরু হয়েছে।

যা বলার সরল ভাষায় বলুন, বলল নিকোলাস। এরই মধ্যে আমি আপনার হেঁয়ালিকরণের শিকার।

রোয়েন হাসলো না। এ পর্যন্ত গল্পটা আপনি জানেন। হিকসস বাহিনীর কাছে উন্নতমানের চ্যারিয়াট বা রথ থাকায় রানী লসট্রিস হেরে গেলেন, তিনি তাঁর লোকজনসহ ঈজিপ্ট থেকে বিতাড়িত হলেন। নীল নদ ধরে দক্ষিণে গেলেন ওঁরা, পৌঁছলেন সাদা ও নীল নদের সঙ্গমে। অন্য ভাষায়, আজকের দিনের খার্তুমে। এ সবই স্ক্রোলে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলে যায়।

মনে পড়ছে। বলে যান।

ওঁদের রণতরীতে রানী লসট্রিসের স্বামী অষ্টম ফারাও মামোসের মমি করা লাশ ছিল। বারো বছর আগে, হিকসস বাহিনীর একটা তীর ফুসফুসে নিয়ে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায়, স্বামীকে লসট্রিস কথা দিয়েছিলেন তাঁর সমাধির জন্য তিনি একটা সুরক্ষিত জায়গা খুঁজে বের করবেন, সেখানে সমাধির ভেতর লাশের সঙ্গে তাঁর বিপুল ধন-সম্পদও থাকবে। খার্তুমে পৌঁছে রানী লসট্রিস সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বামীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের সময় হয়েছে। তিনি তাঁর চৌদ্দ বছরের ছেলে প্রিন্স মেমননকে সমাধির স্থান খুঁজে বের করতে পাঠালেন, সঙ্গে থাকলো এক স্কোয়াড্রন চ্যারিয়ট। মেমননের সঙ্গে তার পরামর্শদাতা ছিল, অক্লান্ত অপুরুষ ইতিহাস লেখক টাইটা।

হ্যাঁ, এ অংশটুকু আমার মনে আছে। মেমনন আর টাইটা বন্দি শিলুক ক্রীতদাসদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের পরামর্শেই নদীর বাম বাহু ধরে এগোয়–এ বাহুটাকেই আমরা নীল নদ বলে জানি।

মাথা ঝাঁকিয়ে আবার শুরু করলো রোয়েন, পুবদিকে চলে এলো ওরা এবং বাধা পেল ভীতিকর পাহাড়ে, এতো উঁচু যে নীল দুর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত বইতে যা পড়েছেন স্ক্রোলের সঙ্গে মেলে, কিন্তু এখানে এসে, খোলা বইয়ের পাতায় টোকা দিল, ডুরেঈদের হেঁয়ালিপনা শুরু হলো। তিনি যে ফুটহিল বা পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে দাঁড়ানো পাহাড়ের বর্ণনা দিয়েছেন…।

বাধা দিল নিকোলাস, পড়ার সময়ই ভেবেছি, বর্ণনায় ভুল আছে। ইথিওপিয়ান হাইল্যান্ডের যে জায়গা থেকে নীল নদ বেরিয়েছে সেখানে কোনো ফুটহিল বা ফুটহিলস নেই। অসংখ্য পর্বতের একটা স্তূপ হিসেবে কল্পনা করতে হবে জায়গাটাকে, শুধু পশ্চিমে খাড়া ও বন্ধুর উতরাই বা ঢাল আছে। বর্ণনাটা যে-ই দিক, নীল নদের কোর্স তার জানা নেই।

যেন মনে হচ্ছে আপনি জানেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, শুনে হেসে উঠলো নিকোলাস।

কম বয়সে বোকার মতো সাহস করে মানুষ, আমিও এক আধবার করেছিলাম, বলল নিকোলাস। সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য লেক টানা থেকে ভাটির দিকে সুদানের রোজিরেস ড্যাম পর্যন্ত বোট নিয়ে গিয়েছিলাম অ্যাবে গিরিখাদের তলা দিয়ে। অ্যাবে হলো নীল নদের ইথিওপিয়ান নাম।

কিন্তু কেন আপনি…

আগে কেউ যেতে পারে নি, তাই। মেজর চেসম্যান, ব্রিটিশ কনসাল, ১৯৩২ সালে চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় মারাই পড়েছিলেন। ভেবেছিলাম অভিযানটা সফল হলে একটা বই লিখব, তা থেকে এতো বেশি রয়্যালটি পাব যে সারাজীবন আর কাজ করতে হবে না, মনের ফুর্তিতে দুনিয়াটা চষে বেড়াব। অ্যাবে নদীর পুরোটা কোর্স আমি স্টাডি করেছি, শুধু ম্যাপ দেখে নয়। একটা সেসনা ১৮০ ভাড়া করি, খাদের উপর দিয়ে উড়ে যাই, লেক টানা থেকে ড্যাম পর্যন্ত ৫০০ মাইল। আমার তখন ২১ বছর বয়স, সাংঘাতিক ডানপিটে।

কী ঘটেছিল? রোয়েন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ডুরেঈদ এ সম্পর্কে কিছু বলে যায় নি, তবে রোয়েন জানে ঠিক এ ধরনের একটা অ্যাডভেঞ্চারেই ওদেরকে বেরুতে হবে।

স্যান্ডহার্সট কলেজ পড়ি তখন। ক্রিসমাসের ছুটিতে এ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই, বলল নিকোলাস। সব মিলিয়ে আটজন ছিলাম আমরা। গিরিখাদের নিচের পানিকে এক কথায় হিংস্র বলব। মাত্র দু দিন টিকেছিলাম। দুনিয়ার বুকে নরকতুল্য যে কয়টা জায়গা আছে, ওই গিরিখাদ তার মধ্যে একটা। অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ গভীর ও এবড়োখেবড়ো ওটা। পাঁচশো মাইলের মধ্যে বিশ মাইল পেরুতে না পেরুতেই ভেঙে চুরমার করে দেয় আমাদের সব কয়টা কাইয়্যাক। সমস্ত ইকুইপমেন্ট ছেড়ে আসতে বাধ্য হই আমরা, সভ্য জগতে আবার ফেরার জন্য খাদের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে হয়েছিল।

চেহারা ম্লান হয়ে গেল, বিষণ্ণ সুরে বলল আবার, দুই বন্ধুকে হারাই আমরা। ববি পামার নদীতে ডুবে যায়, টিম মার্শাল পাহাড় থেকে পড়ে যায়। এমন কি আমরা ওদের লাশও খুঁজে পাই নি।

নীল নদের ওই খাদে আর কেউ নেভিগেট করতে পেরেছে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, দুঃখজনক স্মৃতি থেকে নিকোলাসের মনটা ফেরাতে চাইছে।

হ্যাঁ। আরো কয়েক বছর পর ফিরে যাই আমি। দ্বিতীয়বার লীডার হিসেবে নয়, অফিশিয়াল ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সেস এক্সপিডিশন-এর জুনিয়র মেম্বার হিসেবে। নদীটাকে বশ মানাতে আর্মি, নেভী আর এয়ারফোর্সের সাহায্য নিতে হয়েছিল।

রোয়েনের এ মুহূর্তের অনুভূতি সশ্রদ্ধ বিস্ময়। নিকোলাস আক্ষরিক অর্থেই অ্যাবেতে নৌকো বেয়েছে। এ যেনো নিয়তিই ওর কাছে টেনে এনেছে নিকোলাসকে। ডুরেঈদ ঠিক কথাই বলে গেছেন। এ কাজের জন্য সব দিক থেকে উপযুক্ত লোক নিকোলাস ছাড়া আর বোধহয় নেই কেউ। তাহলে গিরিখাদটার স্বভাব-চরিত্র ভালোই জানেন আপনি। ভেরি গুড। এবার আপনাকে আমি সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা যা বলে গেছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেব। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, স্ক্রোলের এ অংশের কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে ফাঁকগুলো পূরণ করতে হয়েছে। অনুমানের উপর নির্ভর করে। আপনাকে বলতে হবে, আপনার জানার সঙ্গে বর্ণনাটুকু মেলে কিনা।

দেখা যাক।

বন্ধুর উতরাই বা ঢাল সম্পর্কে আপনি যে বর্ণনা দিচ্ছেন, টাইটার বর্ণনার সঙ্গে সেটা মেলে–খাড়া একটা পাঁচিল, ওই পাঁচিল থেকেই বেরিয়ে এসেছে নদীটা। ওরা ওদের চ্যারিয়ট ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, ক্যানিয়নের খাড়া ও এবড়োথেবড়ো এলাকায় ওগুলো চলছিল না। ভারবাহী ঘোড়া নিয়ে হাঁটা শুরু করে ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে খাদটা এতো গভীর আর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কয়েকটা ঘোড়া নিচে পড়ে যায়। ওই সময় প্রাচীন একটা পথ অনুসরণ করছিল ওরা, পাহাড়ী ছাগলের আসা-যাওয়ায় তৈরি। ঘোড়াগুলো নদীতে পড়ে গেলেও, প্রিন্স মেমননের নির্দেশে সামনে এগুতে থাকে ওরা।

জায়গাটা আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি। সত্যি ভীতিকর।

এরপর টাইটা কয়েকটা বাধার কথা লিখেছে, তার ভাষায় সেগুলো ধাপ।

আমি ও ডুরেঈদ সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি ওগুলো আসলে কী। তবে সবচেয়ে

গ্রহণযোগ্য অনুমান, ওগুলো আসলে জলপ্রপাত।

অ্যাবে গিরিখাদে জলপ্রপাতের কোনো অভাব নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল নিকোলাস।

এ অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। টাইটা বলছে, খাদের ভেতর দিয়ে বিশ দিন এগোবার পর তারা দ্বিতীয় ধাপ-এর সামনে পড়লো। এখানেই প্রিন্স মেমনন তার মৃত বাবার মেসেজ পায়, স্বপ্নের ভেতর–মামোস তার ছেলেকে জানান, এ জায়গাতেই তাকে সমাহিত করা হোক। টাইটা বলছে, এরপর তারা আর এগোয় নি। আমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারি কিসে তারা বাধা পেয়েছিল, তাহলে খাদের কতটা ভেতরে তারা ঢুকতে পেরেছিল তার একটা নিখুঁত হিসেবে বেরিয়ে আসবে।

ম্যাপ আর পাহাড়ের স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ দরকার, বলল নিকোলাস। আরো দরকার আমার এক্সপিডিশন নোট ও ডায়েরি। রেফারেন্স লাইব্রেরি আপ-টু-ডেট করে রাখে ও, স্যাটেলাইট ফটো পেতে অসুবিধে হবে না।

আমার দাদার বাপ, তিনিও ইথিওপিয়ায় শিকার করতে গিয়েছিলেন গত শতকে ১৮৯০-এর দিকে ডেবরা মারকোস-এ নীল নদ পেরিয়েছিলেন তিনি। হয়তো তার নোটও আমাদের কাজে লাগবে। চেয়ার ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙলো নিকোলাস।

কার পার্কে রাখা পুরোনো সবুজ ল্যান্ড রোভার পর্যন্ত রোয়েনের সাথে হেঁটে গেল। গাড়িতে চড়ে ইঞ্জিন চালু করলো রোয়েন, জানালো দিয়ে নিক বলল, আমার মনে হয়, আপনি এখানে, হলে থাকলে ভালো করতেন। এখান থেকে ব্রান্ডসবারী পর্যন্ত কম করে হলে তিনঘণ্টা লাগে যেতে আসতে। আফ্রিকা যাওয়ার আগে প্রচুর কাজ আমাদের।

আপনার সঙ্গে এখানে থাকছি, লোকে কী বলবে?

লোকে কী ভাবলো না ভাবলো–ওটা কোনোদিনও পাত্তা দিই নি আমি, বলল নিক। কাল কখন দেখা হচ্ছে?

ইয়র্কে একজন ডাক্তার দেখাতে হবে আমাকে। হাতের সেলাই কাটার সময় হয়ে এসেছে। এগারোটার আগে আসতে পারবো বলে মনে হয় না। জানালা দিয়ে হাত নেড়ে, গাড়ি ছেড়ে দিল রোয়েন।

বাতাসে এলোমেলো অবাধ্য চুল ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখের উপর। গাঢ় চুলের নারী বরাবরই নিকোলাসকে আকৃষ্ট করে। ওর স্ত্রী, রোসেলিনেরও ওই পুবদেশীয় ধাঁচ ছিল চেহারায়। তুলনা চলে আসায় মনে মনে অপরাধী বোধ হতে লাগলো নিকোলাসের। কিন্তু রোয়েনকে ভুলে থাকা বেশ কঠিন।

রোসেলিনের মৃত্যুর পর এ. প্রথম কোনো নারী ওকে নাড়া দিতে পেরেছে। মেয়েটার মিশ্র রক্ত ওর মনে দোলা দিয়েছে। কিছুটা রক্ষণশীল, আবার একই সঙ্গে আধুনিকাও, চমৎকার রসবোধসম্পন্না নারী রোয়েন। এমন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছে, যা নিকোলাসের কাছে আরাধ্য। সাধারণত পুবের মেয়েরা এমন হয় না, নিজেদের নিয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট হয় তারা। কিন্তু এ ললনা ভিন্ন ধাতের, বুঝতে বাকি নেই নিকোলাসের।

২. ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট

ফোনে আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে, পরিচিত ডাক্তারের কাছে রোয়েনকে নিয়ে যাচ্ছেন জর্জিনা, ওর হাতের সেলাই কাটতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরেই নিজেদের কটেজ থেকে বেরিয়ে পড়লো মা ও মেয়ে, সঙ্গে কুকুরটাও রয়েছে।

গ্রামের রাস্তায় বাঁক ঘোরার সময় রোয়েন বিরাট একটা ট্রাক দেখতে পেল, পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে ওটাকে নিয়ে আর কিছু ভাবল না। গ্রাম ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসার পর কুয়াশা দেখতে পেল ওরা, কোথাও কোথাও বেশ গাঢ়, ত্রিশ গজের বেশি দৃষ্টি চলে। জর্জিনা জোরে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত, কুয়াশা থাকলেও গ্রাহ্য করছেন না। ল্যান্ড রোভার ফুল স্পীডে ছুটছে। তবে পুরানো হওয়ায় গাড়িটা সম্ভবত ঘণ্টায় ষাট মাইলের বেশি ছুটতে পারে না, আন্দাজ করলো রোয়েন।

পেছনের রাস্তা চেক করার জন্য ঘাড় ফেরাল ও দেখতে পেল সেই ট্রাকটা ওদের পেছনে রয়েছে। নিচের দিকে কুয়াশা জমে থাকায় ট্রাকের শুধু ক্যাব দেখা যাচ্ছে। রোয়েন তাকিয়ে রয়েছে, হঠাৎ পুরো ট্রাকটাই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল। ঘাড় সোজা করে মায়ের সাথে কথা বললো রোয়েন।

তুমি কী সত্যি একটা লেবার গভর্নমেন্ট চাও? মাথা নাড়লো ও।

আমি চাই থেচার ফিরে আসুক।

সীটে একটু সরে বসে পেছনের জানালো দিয়ে আবার তাকালো রোয়েন। ট্রাকটা এখনো ওদের পেছনে কুয়াশার মধ্যে ভেসে রয়েছে। আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি চলে আসায় এখন ল্যান্ড রোভারের নীলচে ধোয়াও খেতে হচ্ছে ড্রাইভারকে। হঠাৎ সেটার গতি আরো বাড়লো। মামি, ট্রাকটা বোধহয় তোমাকে পাশ কাটাতে চাইছে, মৃদু গলায় বলল ও।

ওদের রিয়্যার বাম্পার থেকে ট্রাকের প্রকাণ্ড বনেট মাত্র বিশ ফুট দূরে। ট্রাকের রেডিয়েটর ক্রোম লোগগা দিয়ে সাজানো, ক্যাপিটাল লেটারে পাশাপাশি তিনটে শব্দ–এমএএন। লোগোটা ল্যান্ড রোভারের ক্যাব-এর চেয়ে বেশি লম্বা, কাজেই রোয়েন যেখানে বসে আছে সেখান থেকে ড্রাইভারের চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

সবাই আমাকে পাশ কাটাতে চায়, অভিযোগ করলেন জর্জিনা। সংক্ষেপে এটাই আমার জীবনকাহিনী। জেদের বশে সরু রাস্তার মাঝখানটা দখল করে রাখলেন তিনি।

আবার পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। একটু একটু করে আরো কাছে চলে আসছে ট্রাক। পেছনের জানালো পুরোপুরি ঢেকে দিল ওটা। ক্লাচ ছেড়ে দিয়ে দৈত্যাকৃতি ইঞ্জিনের আবর্তন বাড়াল ড্রাইভার, ভীতিকর গর্জন শোনা গেল। পথ ছাড়লে ভালো করবে, মাকে বলল রোয়েন। লোকটা মনে হচ্ছে রেগে গেছে।

অপেক্ষা করুক, ঠোঁটের এক কোণ থেকে কথা বলছেন জর্জিনা, আরেক কোণে সিগারেট ঝুলছে। ধৈর্য একটা সদগুণ। তাছাড়া, এখানে ওকে পথ ছাড়া সম্ভব নয়। সামনে সরু একটা পাথুরে ব্রিজ আছে। এদিকের রাস্তা-ঘাট খুব ভালো চিনি আমি।

ট্রাক ড্রাইভার এতো কাছে থেকে ইলেকট্রিক হর্ন বাজাল, কানে তালা লেগে গেল রোয়েনের। পেছনের সিটে লাফালাফি আর চিৎকার শুরু করলো ম্যাজিক।

স্টুপিড বাস্টার্ড! তিক্ত গলায় গাল দিলেন জর্জিনা। উলুকটা ভেবেছে কি? রোয়েন, ওর নাম্বার প্লেট লিখে রাখো। ইয়র্ক পুলিশকে রিপোর্ট করব আমি।

প্লেটে কাদা, পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে কন্টিনেন্টাল : রেজিস্ট্রেশন। সম্ভবত জার্মান।

যেন জর্জিনার প্রতিবাদ শুনতে পেয়েই ট্রাকের গতি সামান্য কমাল ড্রাইভার, ধীরে ধীরে দুই গাড়ির মাঝখানের দূরত্ব বিশ গজে দাঁড়ালো। ঘাড় ফিরিয়ে এখনো পেছন দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন।

হুঁ-হুঁ, হুন ব্যাটা ভদ্রতা শিখছে, সন্তুষ্টচিত্তে বললেন জর্জিনা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সামনে তাকালেন তিনি। ওই দেখা যায় ব্রিজ…

এই প্রথম ট্রাকের দেখতে পাচ্ছে রোয়েন। ড্রাইভার এমন একটা হেলমেট পরে আছে, চোখ আর নাকের ফুটো ছাড়া মুখের সবটুকুই নীল উলে ঢাকা। হেলমেটটা তার চেহারায় অশুভ আর শয়তানি একটা ভাব এনে দিয়েছে। সাবধান! সর্বনাশ! অকস্মাৎ চিৎকার শুরু করলো রোয়েন। ট্রাক সোজা আমাদের উপর উঠে আসছে! ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো, ওদেরকে যেনো ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরের গর্জন গ্রাস করে ফেলেছে। চকচকে ইস্পাত ছাড়া এক মুহূর্ত কিছুই দেখতে পেল না রোয়েন। তারপরই ট্রাকেই সামনের অংশ ল্যান্ড রোভারের পেছনটা চুরমার করে দিল।

ধাক্কা খেয়ে সিটের পিঠে রোয়েনের অর্ধেক শরীর উঠে এলো। কোনো রকমে তাল সামলে সোজা হলো ও, দেখলো ট্রাকটা ওদেরকে শিয়ালের চোয়ালে আটকানো পাখির মতো তুলে নিয়েছে। চকচকে ক্রোম রেডিয়েটর স্টীল বুল বার দিয়ে সুরক্ষিত, বারগুলো প্রায় তুলে নিয়েছে ল্যান্ড রোভারকে, ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে।

হুইলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন জর্জিনা, নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।পারছি না! ব্রিজ… সরে যেতে চেষ্টা করো…

সেফটি বেল্টের কুইক রিলিজ বাকলে টান দিয়ে ডোর হ্যাঁন্ডেলের দিকে হাত বাড়াল রোয়েন। ব্রিজের পাথুরে পাঁচিল তীর বেগে ছুটে আসছে ওদের দিকে। রাস্তার উপর আড়াআড়ি হয়ে যাচ্ছে ল্যান্ড রোভার, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

রোয়েনের হাতের ধাক্কায় কিছুটা খুলে গেল দরজা, কিন্তু পুরোটা খুলল না, কারণ ব্রিজ শুরু হওয়ার আগে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দু সারি স্তম্ভের মাঝখানে পৌঁছে গেছে ল্যান্ড রোভার।

গাড়ি চ্যাপ্টা হতে শুরু করায় মা ও মেয়ে একযোগে চিৎকার দিচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে দু জনেই ছিটকে পড়লো সামনের দিকে। পাথুরের স্তম্ভে বাড়ি খেয়ে চুরমার হয়ে গেল উইন্ডস্ক্রীন, ল্যান্ড রোভারের বডি এমব্যাঙ্কমেন্ট ধরে নেমে যাবার সময় ডিগবাজি খেতে শুরু করলো।

একটা গড়ান দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে বাইরে পড়লো রোয়েন। ঢালের মধ্যে পড়ায় শরীরটা স্থির থাকলো না, তা থাকলে হাড়গোড় সব গুঁড়ো হয়ে যেত। পড়ার পর গড়াতে শুরু করলো, কিনারা থেকে খসে পড়লো ব্রিজের নিচে ঠাণ্ডা হিম স্রোতের মধ্যে।

পানির নিচে মাথাটা ডুবে যাবার আগে উপরে আকাশ আর ব্রিজ দেখতে পেল রোয়েন। গর্জন তুলে বিদায় নেয়ার আগে ট্রাকটাকেও দেখতে পেল। একজোড়া বিশাল কার্গো ট্রেলার টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওটা। ট্রেলার দুটোর লম্বা বডিওঅর্ক ব্রিজের গার্ড রেলকে ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে আছে।

দুটো ট্রেলারই গাঢ় সবুজ নাইলন তারপুলিন দিয়ে মোড়া। কাছাকাছি ট্রেলারের এক পাশে কোম্পানির লাল ট্রেডমার্ক দেখতে পেল রোয়েন, কিন্তু নামটা পড়ার সময় পাওয়া গেল না, তবে আগেই পানির নিচে তলিয়ে গেলও।

আবার যখন পানির উপর মাথা তুললাম, দেখলো ভাটির দিকে খানিকটা সরে এসেছে। তীরে উঠে এসে কাদার মধ্যে শুয়ে কাশছে রোয়েন। কাশির সঙ্গে প্রচুর পানি বেরিয়ে এলো, হালকা লাগলো শরীরটা। কোথায় আঘাত লেগেছে পরীক্ষা করছে, এ সময় উল্টে পড়া ল্যান্ড রোভারের দিক থেকে জর্জিনার যন্ত্রণাকাতর চিৎকার ভেসে এলো।

কাদা, তারপর ঘাসের উপর দিয়ে ছুটল রোয়েন। এমবেঙ্কমেন্টের গোড়ায় চিৎ হয়ে রয়েছে ল্যান্ড রোভার। বডিটা শুধু তোবড়ায় নি, ভেঙে বা ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ফ্রন্ট হুইল এখনো ঘুরছে। মামি! মামি, তুমি কোথায়? ফুঁপিয়ে উঠলো রোয়েন। আহত পশুর মতো জর্জিনার গোঙানি থামছে না। তোবড়ানো বডি ধরে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে রোয়েন, গোঙানির উৎসেব দিকে এগুচ্ছে, জানে না কী দেখতে হবে।

জর্জিনা ভিজে মাটিতে বসে আছেন, ল্যান্ড রোভারের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে। পা দুটো সরাসরি সামনের দিকে সোজা করা। তবে তার বাম পা হাঁটুর কাছাকাছি মোচড় খেয়ে আছে, ফলে জুতো পরা গোড়ালি বাঁকা হয়ে কাদার দিকটা নির্দেশ করছে। সন্দেহ নেই ওই পা-টা হাঁটু বা হাঁটুর খুব কাছাকাছি ভেঙে গেছে।

গোঙানোর বা বিলাপ করার সেটা কারণ নয়। জর্জিনা বসে আছেন ম্যাজিককে কোলে নিয়ে। শোকে আকুল ভঙ্গিতে কুকুরটার উপর ঝুঁকে রয়েছেন তিনি, লাশের গায়ে হাত বুলাচ্ছেন আর দোল খাচ্ছেন, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আহাজারি। কুকুরটার বুক ইস্পাত আর মাটির মাঝখানে পড়ে গুঁড়িয়ে গেছে। মুখের কোণ থেকে বেরিয়ে এসেছে জিভের ডগা, গোলাপি ওই ডগা থেকে এখনো ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। নিজের স্কার্ফ দিয়ে তা মুছে ফেলছেন জর্জিনা।

পাশে বসে মায়ের কাঁধ দুটো একহাতে জড়িয়ে ধরল রোয়েন। মাকে আগে কখনো কাঁদতে দেখে নি ও। আদরের হাত বুলিয়ে জননীকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে, কিন্তু জর্জিনার বিলাপধ্বনি থামছে না।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারবে না রোয়েন। তবে এক সময় বাঁকা হয়ে থাকা মায়ের অবশ পা দেখে আঁতকে উঠলো, সেই সঙ্গে ভাবল কাজটা শেষ করার জন্য ট্রাক ড্রাইভার আবার ফিরে আসতে পারে। ক্রল করে ঢালের মাথায়, সেখান থেকে রাস্তার মাঝখানে চলে এলো রোয়েন, ব্রিজে উঠে আসা প্রথম গাড়িটাকে থামাবে।

*

এগারোটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, দু ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে উদ্বিগ্ন নিকোলাস ইয়র্ক পুলিশকে ফোন করলো। ভাগ্য ভালো যে ল্যান্ড রোভারের লাইসেন্স প্লেটটা গত রোববারে লক্ষ্য করেছিল। পুলিশ স্টেশনের মহিলা কনস্টেবল কমপিউটর চেক করে জানালো, দুঃখিত, স্যার। ল্যান্ড রোভারটা আজ সকালে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জার ইয়র্ক হসপিটালে…

হাসপাতালে পৌঁছতে চল্লিশ মিনিট লাগলো। রোয়েনকে পাওয়া গেল মেয়েদের সার্জিকাল ওয়ার্ডে, মায়ের বেডের পাশে বসে আছে। অ্যানেসথেটিকের প্রভাব এখনো কাটে নি, জর্জিনা সচেতন নন। নিকোলাসকে দেখে মুখ তুলে তাকালো রোয়েন। আপনি সুস্থ তো? কী ঘটল?

মা… মায়ের পা ভেঙে গেছে। সার্জেনকে বাধ্য হয়ে উরুতে একটা পিন আটকাতে হয়েছে।

আপনি কেমন আছেন?

এখানে সেখানে কেটে-ছিড়ে গেছে। সিরিয়াস কিছু না।

কীভাবে ঘটল?

একটা ট্রাক… ঠেলে রাস্তা থেকে ফেলে দিল আমাদেরকে। পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করলো রোয়েন।

পরিষ্কার মেরে ফেলার চেষ্টা, বলল নিকোলাস। বিচলিত হওয়া ওর স্বভাব নয়, চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠলো পুলিশকে জানিয়েছেন?

আরো সকালে পুলিশকে রিপোর্ট করা হয়েছিল ট্রাকটা চুরি গেছে–ঘটনাটা ঘটার অনেক আগে। লিটেল শেফ কাফের সামনে থেমেছিল ড্রাইভার, তখন। লোকটা জার্মান, ইংরেজি জানে না।

এবার নিয়ে ওরা তিনবার আপনাকে খুন করার চেষ্টা করলো, বলল নিকোলাস। কাজেই আপনার নিরাপত্তার দিকটা এখন আমাকে দেখতে হবে।

হাসপাতালের ওয়েটিং রুপে এসে কাউন্টির চীফ কনস্টেবলকে ফোন করলো নিকোলাস। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গেও ওর পরিচয় আছে।

ওয়ার্ডে ফিরে এসে দেখলো জর্জিনার জ্ঞান ফিরেছে। এখনো একটু আচ্ছন্ন বোধ করছেন তিনি, তবে কোনো রকম কষ্ট পাচ্ছেন না। নিকোলাস যেমন আয়োজন করেছে, চাকা লাগানো বেডে শুইয়ে জর্জিনাকে প্রাইভেট ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হলো। কয়েক মিনিট পর অর্থোপেডিক সার্জেন ঢুকলেন কেবিনে।

হ্যালো, নিকোলাস, এখানে তুমি কী করছ? সার্জেন বললেন। রোয়েন অবাক হয়ে ভাবছে, কত মানুষই না চেনে ওকে। জর্জিনার দিকে ফিরলেন সার্জেন, বললেন, কেমন লাগছে এখন? কিছু না, সত্যি ভাঙেনি–শুধু ফেটে গেছে। আবার আমরা জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি, তবে আমাদের সঙ্গে অন্তত দশ দিন থাকতে হবে আপনাকে।

আপনার আপত্তি আমি গ্রাহ্য করছি না, জর্জিনা ঘুমিয়ে পড়ার পর রোয়েনকে নিকোলাস নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছে, হল-এ আমার হাউজ কিপার একটা কামরা রেডি রেখেছে আপনার জন্য। পরেরবার কে, কখন আপনাকে ধরে মেরে ফেলবে, ঠিক আছে?

তর্ক করার মতো অবস্থায় নেই তখন রোয়েন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রেঞ্জ রোভারে উঠে বসে সে। প্রথমে তার হাতের সেলাই কেটে, কুয়েনটন পার্কের উদ্দেশ্যে চললো নিকোলাস। পৌঁছানোর সাথে সাথে রোয়েনকে বেডরুমে পাঠিয়ে দিল সে।

কুক আপনার ডিনার পাঠিয়ে দেবে। ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধটা খেয়ে নিয়েন। মায়ের কটেজের চাবিটা দিলে মিসেস স্ট্রিট আপনার কাপড়-চোপড় নিয়ে আসতে পারতো। এর মধ্যে, টুথব্রাশ আর নাইটগাউন যোগাড় করে রেখেছে। হাউজকিপার। আগামি সকালের আগে আর কোনো কথা নয়।

অনেক দিন পর নিজেকে নিরাপদ লাগলো রোয়েনের। ঘুমের ওষুধটা টয়লেটে ফ্লাশ করে ফেলে দিল সে।

বালিশের উপর যে নাইটড্রেসটা রাখা, লম্বা একটা লেস দেওয়া সিল্কের পোশাক ওটা। সম্ভবত, ওগুলো নিকোলাসের স্ত্রীর ছিল, চিন্তাটা ওর মনে মিশ্র একটা অনুভূতি এনে দিল।

অপরিচিত আরামদায়ক পরিবেশে কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল রোয়েন।

*

সকাল হতে, একজন পরিচারিকা এসে দি টাইমস পত্রিকা আর এক কাপ আর্ল গ্রে টি দিয়ে গেল রোয়েনকে। কিছু সময় পর ওর হোল্ডঅলটা নিয়ে ফিরে এলো সে।

ডাইনিং রুমে আটটা ত্রিশের দিকে স্যার নিকোলাস আপনার সঙ্গে নাস্তা সারবেন। জানিয়ে গেল মেইড।

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো রোয়েন, সুযোগ পেয়ে ছয় ফুট লম্বা আয়নায় নিজের নগ্ন শরীরটা পরীক্ষা করে নিল। বাহুর ক্ষতটা এখনো ভেজা ভেজা, পুরোপুরি শুকায় নি, ঊরু আর পাঁজরের এক পাশে গাঢ় দাগ ফুটে আছে, কার অ্যাক্সিডেন্টের অবদান। হাঁটুর নিচেও এক ইঞ্চি লম্বা একটা সরু দাগ, চামড়া উঠে গেছে। কাপড়-চোপড় পাল্টে ডাইনিং রুমে আসার পথে খেয়াল করলো, একটু খোঁড়াচ্ছে।

ডাইনিং রুমের দোরগোড়ায় এসে রোয়েন দেখলো নিকোলাস পত্রিকা পড়ছে। হাতছানি দিয়ে ওকে ডেকে টেবিলের নাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। চেয়ারে বসে, ডিম পোঁচে চামচের ঘা দিয়ে শুরু করলো রোয়েন।

ভালো ঘুম হলো? উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে চলে নিকোলাস, পুলিশকে ফোন করেছিলাম। ওরা এমএএন ট্রাকটা খুঁজে পেয়েছে, হারোগেটের কাছে। পরিত্যক্ত ওটা। যদিও তদন্ত চলছে, তবে পুলিশ খুব একটা আশাবাদী নয়। ঘাগু লোকের পাল্লায় পড়েছি আমরা।

হাসপাতালে একবার ফোন করা দরকার।

মুখ তুললাম নিকোলাস। করা হয়েছে। দু বার। জর্জিনা ভালো আছেন। তাকে জানিয়েছি, এ সন্ধ্যায় ওকে দেখতে যাবেন আপনি।

সন্ধ্যা, এতো দেরি কেনো?

তার আগে পর্যন্ত আপনাকে আমি ব্যস্ত রাখতে চাই। আপনার কথায় এতোগুলো টাকা আর সময় খরচ করব, জানতে হবে না কিসের পেছনে ছুটছি? একটু থেমে কাজের কথা শুরু করলো নিকোলাস। মরুভূমিতে আপনাদের ভিলায় প্রথম হামলাটা হলো। আততায়ীরা জানত কী চায় তারা, জানত কোথায় খুঁজতে হবে। বেশ। এবার দ্বিতীয় হামলার প্রসঙ্গে আসি। কায়রোয় আপনার গাড়ির ভেতর হ্যান্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলো। সেদিন বিকেলে আপনি মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন, এ খবর কে জানত? মন্ত্রী ভদ্রলোক ছাড়া?

মুখভর্তি খাবার নিয়ে কিছু সময় ভাবলো রোয়েন।

ঠিক মনে নেই। সম্ভবত ডুরেঈদের সেক্রেটারিকে বলেছিলাম, আর হয়তো বলেছিলাম রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টদের একজনকে।

ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়লো নিকোলাস। তারমানে তো মিউজিয়ামের অর্ধেক স্টাফই আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানত। ঠিক আছে, এবার বলুন কে জানত আপনি মিশর ত্যাগ করছেন? কাকে বলেছেন ইংল্যান্ডে এসে আপনি আপনার মায়ের কটেজে উঠবেন?

অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একজন ক্লার্ক আমার স্লাইডগুলো এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়।

তাকে আপনি জানিয়েছিলেন কোন ফ্লাইট ধরবেন?

কেন জানাব।

কাউকেই জানান নি?

না… হ্যাঁ, ইন্টারভিউয়ের সময় শুধু মিনিস্টারকে বলেছিলাম, ছুটি চাওয়ার সময়। কিন্তু তিনি… না, অসম্ভব! প্রতিবাদ করলেও রোয়েনের চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো।

কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস। দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা, রোয়েন। আপনি আর ডুরেঈদ সপ্তম স্ক্রোলের উপর কাজ করছিলেন, এ বিষয়ে মিনিস্টার সবই জানতেন, তাই না?

বিশদ জানতেন না, তবে জানতেন আমরা কী নিয়ে ব্যস্ত।

ঠিক আছে, পরবর্তী প্রশ্ন–চা, না কফি? রোয়েনের কাপে কফি ঢাললো নিকোলাস, তারপর আবার শুরু করলো, আপনি বলেছেন সম্ভাব্য স্পনসরদের একটা তালিকা ছিল। সন্দেহভাজনদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য ওটা কাজে লাগতে পারে।

গেটি মিউজিয়াম, বলল রোয়েন, শুনে হাসলো নিকোলাস।

তালিকা থেকে বাদ দিন ওটা। কায়রোর রাস্তায় গ্রেনেড ফাটিয়ে বেড়ানো ওদের কাজ নয়। তালিকায় আর কে ছিল?

হের ফন শিলার।

হ্যামবুর্গ। হেভী ইন্ডাস্ট্রি। মেটাল ও অ্যালয় রিফাইনারি। বেস মিনারেল প্রোডাকশন। মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। তালিকার তৃতীয় লোকটা কে?

পিটার ওয়ালশ, বলল রোয়েন। টেক্সান।

আরেক বিলিওনেয়ার। ফোর্ট ওয়ার্থে বাস করেন। গোটা আমেরিকার জুড়ে ফাস্ট ফুডের ব্যবসায়, কারখানায় দশ হাজার লোক খাটে। মেইল অর্ডার রিটেইল। কালেক্টর হিসেবে রাক্ষস বলা হয় তাঁকে। আর্কিওলজিক্যাল এক্সপ্লোরেশনে অঢেল টাকা খাটান। যারা আর্টিফ্যাক্ট কালেক্টর তাদের উপর বিশেষ নজর রাখতে হয়। নিকোলাসকে। সব মিলিয়ে সংখ্যায় দুই ডজনের বেশি হবে না তারা। বিভিন্ন নিলাম অনুষ্ঠানে ঘুরে-ফিরে দেখা-সাক্ষাৎও হয়। দু জনেই এঁরা চোখ বোজা ডাকাত। পছন্দ হয়ে গেলে এঁরা তাঁদের সন্তানকেও খেয়ে ফেলতে পারেন। এঁদের পথে আপনি যদি বাধা হন, কী করবেন এঁরা? বইটা ছাপা হওয়ার পর দু জনের। কেউ ডুরেঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিনা জানেন?

জানি না, করতেও পারেন।

ধরে নিতে হবে ডুরেঈদ কী করছিলেন ওঁরা তা জানতেন। সন্দেহের তালিকায় দু জনই থাকছেন। এবার চলুন, মিউজিয়ামে যাই। দেখা যাক, মিসেস স্ট্রিট কী ব্যবস্থা করেছেন।

নিকোলাসের স্টাডিতে ঢুকে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেলো রোয়েন। সন্দেহ নেই এতো সব আয়োজন করতে হওয়ায় রাতে নিকোলাস ঘুমায় নি। কামরাটাকে মিলিটারি টাইপ হেডকোয়ার্টার বানিয়ে ফেলেছে ও। কামরার মাঝখানে বড় একটা ইজেল ও ব্ল্যাকবোর্ড দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে একটার উপর একটা পিন দিয়ে আটকানো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ। কাছাকাছি এসে সেগুলো দেখলো রোয়েন, তারপর অন্যান্য জিনিসের দিকে তাকালো।

প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নিল একটা লার্জ-স্কেল ম্যাপ, স্যাটেলাইট ফটোগুলোর মতো দক্ষিণ-পশ্চিম ইথিওপিয়ার একই এরিয়া কাভার করেছে। ম্যাপের পাশেই নাম-ঠিকানা, ইকুইপমেন্ট আর রসদের তালিকা–বোঝা গেল, এগুলো নিকোলাস ওর আগের আফ্রিকান অভিযানে ব্যবহার করেছে। দূরত্বের মাপজোক ও হিসাবসহ একটা শিটও দেখলো রোয়েন। অপর একটা শিটে ধারণা দেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য খরচের, ওটাকে বাজেট শিট বলা যেতে পারে। ব্ল্যাকবোর্ডের মাথার দিকে লেখা হয়েছে–ইথিওপিয়া জেনারেল ইনফরমেশন। নিচে গায়ে গায়ে সাঁটানো টাইপ করা পাঁচটা ফুলসক্যাপ শিট। পুরো শিডিউল পড়লো না। রোয়েন, তবে নিকোলাসের প্রস্তুতির বহর দেখে মুগ্ধ হলো।

হাতে স্টিক নিয়ে বোর্ডের পাশে দাঁড়ালো নিকোলাস, ইঙ্গিতে সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল রোয়েনকে। ক্লাসে শৃঙ্খলা থাকতে হবে। বোর্ডে পয়েন্টারের বাড়ি মারল। আপনার প্রথম কাজ আমাকে বিশ্বাস করানো কয়েক হাজার বছর আগে মুছে যাওয়া টাইটার পায়ের ছাপ আবার আমরা অনুসরণ করতে পারব। আসুন সবচেয়ে আগে অ্যাবে গিরিখাদের জিয়োগ্রাফিকাল দিকগুলো বিবেচনা করি।

পয়েন্টার দিকে স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফে নদী কোর্স ব্যাখ্যা করলো নিকোলাস। এই সেকশন ধরে নদীটা এগিয়েছে কালো আগ্নেয় শিলায় তৈরি মালভূমি ডুবিয়ে দিয়ে। পানি থেকে ওঠা পাহাড়-প্রাচীর কোথাও কোথাও একদম খাড়া, দুদিকে চারশো থেকে পাঁচশো ফুট উঁচু। আরো কঠিন সিস্ট শিলার স্তর যেখানে, প্রবাহে সেখানে সুবিধে করতে পারে নি। কাজেই নদীর চলার পথে বিশাল আকারে বেশ কিছু ধাপ তৈরি হয়েছে। টাইটার ধাপ যে আসলে জলপ্রপাত, আপনাদের এ ধারণা সম্ভবত সত্যি।

টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো নিকোলাস, কাগজের অনেকগুলো বান্ডিল পড়ে রয়েছে উপরে, সেগুলোর ভেতর থেকে একটা ফটোগ্রাফ তুলে নিল। ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সের এক্সপিডিশনের সময় এ ছবিটা তুলি আমি। খাদের ভেতর জলপ্রপাতগুলো কী রকম, সে সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবেন।

সাদা-কালো ছবি, দু পাশে আকাশে ছোঁয়া পাহাড়-প্রাচীর দেখা যাচ্ছে, নিচে অর্ধনগ্ন ক্ষুদে কিছু মূর্তি ও বোট, তাদের উপর আকাশ থেকে নেমে আসছে বিপুল জলরাশি। রোমহর্ষক একটা দৃশ্য। আমার কোনো আইডিয়া ছিল না! এরকম দেখতে! হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন।

জায়গাটা কি রকম দুর্গম আর নির্জন, ছবি দেখে আপনি ধারণা করতে পারবেন না, বলল নিকোলাস। একজন ফটোগ্রাফারের দৃষ্টিতে, ওখানে দাঁড়াবার এমন একটা জায়গা নেই যেখান থেকে খাদ বা জলপ্রপাতের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ক্যামেরায় বন্দি করা যায়। তবে এটুকু অন্তত বুঝতে পারবেন যে উজানের দিকে পায়ে হেঁটে আসা মিশরীয় একদল অভিযাত্রীকে কীভাবে থামিয়ে দেবে ওই জলপ্রপাত। সাধারণত জলপ্রপাতের পাশে কোনো না কোনো ধরনের পথ তৈরি হয়, হাতি বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী আসা-যাওয়া করায়। তবে, এ ধরনের জলপ্রপাতকে পাশ কাটানোর মতো কোনো পথ বা উপায় থাকে না।

মাথা ঝাঁকাল রোয়েন। আমরা তাহলে একমত হলাম একটা জলপ্রপাতই আরো সামনে এগুতে বাধা দেয় ওদেরকে পশ্চিম দিক থেকে যেতে দ্বিতীয় জলপ্রপাতটা।

স্যাটেলাইট ফটোয় নদীর কোর্স পয়েন্টার দিয়ে অনুসরণ করলো নিকোলাস, সেন্ট্রাল সুদানের গাঢ় গোঁজ আকৃতির রোজিরেস ড্রাম থেকে। সীমান্তের ইথিওপিয়ান দিকটায় বন্ধুর উতরাই বা ঢল আরো উঁচু হয়েছে, মূল গিরিখাদ শুরু হয়েছে ওখান থেকেই। ওদিকে কোনো রাস্তা বা শহর নেই, বহুদূর উজানের দিকে শুধু দুটো ব্রিজ আছে। পাঁচশো মাইলের মধ্যে কিছুই নেই, আছে নীল নদের খরস্রোত প্রবাহ আর ভয়ালদর্শন কালো ব্যাসল্ট শিলা। খাদের গভীরে প্রধান জলপ্রপাতগুলো স্যাটেলাইট ফটোয় চিহ্নিত করে রেখেছি আমি। পয়েন্টার তুলে সেগুলো দেখালো নিকোলাস, লাল মার্কার পেন দিয়ে তৈরি বৃত্তের ভেতর প্রতিটি।

রোয়েন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও দেখছে।

এখানে দ্বিতীয় জলপ্রপাত, সুদানিজ বর্ডার থেকে একশো বিশ মাইল উজানে। তবে আমাদেরকে আরো অনেক ফ্যাক্টর বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন, টাইটা ওদিকে গেছে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে, ইতোমধ্যে নদী তার কোর্স বদলে থাকতে পারে।

কিন্তু ক্যানিয়নটা চার হাজার ফুট গভীর, ওটার ভেতর থেকে নদী পালাবে কী করে? রোয়েনের প্রশ্নের মধ্যে প্রতিবাদের সুর।

নীল নদ যতই বেয়াড়া হোক।

ঠিক, কিন্তু নদীর তলা যে বদলেছে এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়। বন্যার মরশুমে প্রবাহের বিপুলতা ও শক্তি ব্যাখ্যা করা যায়, এমন ভাষার উপর আমার দখল নেই। সাইড ওয়ালের বিশ মিটার পর্যন্ত ফুলে ওঠে নদী, ছোটে ঘণ্টায় দশ নট গতিতে।

নদীর ওই ভরা মাসে আপনি দাঁড় টেনেছেন? রোয়েনের গলায় সন্দেহ।

আরে না, বন্যার মরশুমে না। ওই সময় কিছুই ওখানে টিকবে না।

ছবিটার দিকে এক মিনিট চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো ওরা, সমস্ত আক্রোশ নিয়ে ফুলে-ফেঁপে থাকা বিপুল জলরাশির আস্ফালন কল্পনা করতে গিয়ে আতঙ্ক অনুভব করছে।

তারপর নিকোলাসকে মনে করিয়ে দিল রোয়েন দ্বিতীয় জলপ্রপাত।

সেটা এখানে, উপনদীগুলোর একটা যেখানে অ্যাবের মূল প্রবাহে এসে মিলিত হয়েছে। ওটার নাম ডানডেরা নদী, বারোশো ফুট অলটিচ্যুড পর্যন্ত উঠে এসেছে, চোক রেঞ্জের সানসাই পাহাড় চূড়ার নিচে, গিরিখাদের একশো মাইল উত্তরে।

আপনার মনে আছে, ঠিক কোনো স্পটে ওটা অ্যাবের প্রবাহে মিলিত হয়েছে?

সে অনেক বছর আগে কথা। তাছাড়া, ওই খাদের তলায় প্রায় এক মাস ছিলাম তো, অসংখ্য দুঃস্বপ্নের মধ্যে নির্দিষ্ট একটাকে স্মরণ করা মুশকিল। মাইলের পর মাইল একঘেয়ে পাহাড়-প্রাচীর আর দেয়ালের বন-জঙ্গল স্মৃতিগুলোকে ঝাপসা করে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরম আর পোকা-মাকড়ের অত্যাচারে আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। বিরতিহীন বৈঠা চালাবার কথা মনে আছে, আর কানে এখনো লেগে আছে পানির অন্তহীন গর্জন। তবে অ্যাবে আর ডানডেরার মিলিত হওয়ার জায়গাটা দুটো কারণে মনে আছে আমার।

ইয়েস? ব্যগ্র ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝুঁকলো রোয়েন, কিন্তু নিকোলাস মাথা নাড়লো।

ওখানে আমরা একজনকে হারাই। দ্বিতীয় অভিযানের একমাত্র বলি। রশি ছিঁড়ে যায়, একশো ফুট নিচে পড়ে যায় বেচারা। পাথরের একটা স্তূপের উপর পিঠে দিয়ে পড়ে।

দুঃখিত। আর কী কারণ?

ওখানে কপটিক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের একটা মঠ আছে, পাথরের অবয়বে তৈরি, নদীর সারফেস থেকে চারশো ফুট উপরে।

গিরিখাদের ওই গভীরে? অবিশ্বাসে ভুরু কোঁচকাল রোয়েন। ওখানে তারা মঠ বানাতে গেল কেন?

ইথিওপিয়া সবচেয়ে পুরানো খ্রিস্টান দেশগুলোর মধ্যে একটা। দেশটায় নয় হাজারেরও বেশি চার্চ আর মঠ আছে। দুর্গম পাহাড়ে, পৌঁছনো যায় না এমন মাঠের সংখ্যা অনেক। ডানডেরা নদীর উপর এ মঠটা সেন্ট ফুমেনটিয়াস-এর সমাধি ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। তৃতীয় শতাব্দী তিনি ইথিওপিয়ায় খ্রিশ্চানিটির পত্তন করেছিলেন, বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টেনটিনোপোলের কাছ থেকে। কথিত আছে, লোহিত সাগরের তীরে এসে তার জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেলে আকসুম পৌঁছেন তিনি, ওখানেই ইজানা সাম্রাজ্য পাল্টে দেন।

আপনি ওই মঠে গেছেন?

অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত ছিলাম, যাই কি করে! মঠ বলতে নদী থেকে আমরা শুধু দেখতে পেয়েছি পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে পাথর কাটা গহ্বর, আলখেল্লা পরা সন্ন্যাসীরা সারি সারি গুহার মুখে বসে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমাদের আত্মহত্যা করার প্রচেষ্টা লক্ষ করছিলেন। আমাদের কেউ কেউ শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতও নাড়েন, কিন্তু পাল্টা সাড়া না পেয়ে অভিমান করেন।

কিন্তু নদীর যে ভয়ঙ্কর ছবি দিচ্ছেন, ওই স্পটে আমরা পৌঁছব কীভাবে?

এরই মধ্যে হতাশ? হাসলো নিকোলাস। দাঁড়ান, আগে ওখানকার মশককুলের সঙ্গে পরিচিত হোন। ওরা আপনাকে তুলে নেবে, উড়িয়ে নিয়ে যাবে নিজেদের আস্তানায়, তারপর সমস্ত রক্ত শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে।

ধ্যেত, সিরিয়াস হোন। সত্যি, ওখানে যাবে কীভাবে?

সন্ন্যাসীদের খাবার যোগান দেয় গ্রামবাসীরা, ওরা বাস করে গিরিখাদের উপর হাইল্যান্ডে। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে বুনো ছাগলের তৈরি ট্রাক আছে। ওদের কাছ থেকে জেনেছি, গিরিখাদের কিনারা থেকে ওই ট্র্যাক ধরে ওখানে নামতে তিন দিন লাগে।

পথ চিনে আপনি নামতে পারবেন?

না, তবে এ বিষয়ে মাথায় কয়েকটা আইডিয়া আছে, পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে প্রথম প্রশ্ন, চার হাজার বছর পর ওখানে পৌঁছে ঠিক কী পাবার আশা করব আমরা। নিকোলাসের চোখে প্রত্যাশা। এবার আপনার পালা। কনভিন্স মি। রূপোয় মাথা মোড়া পয়েন্টারটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো ও, ভাঁজ করা হাত বাঁধল বুকে।

প্রথমে আপনাকে বইটার কাছে ফিরে আসতে হবে, পয়েন্টার রেখে দিয়ে রিভার গড তুলে নিল রোয়েন। গল্পের ট্যানাস চরিত্রটির কথা আপনার মনে আছে?

রানী লসট্রিসের অধীনে মিশরীয় আর্মির কমান্ডার ছিলেন, টাইটেল ছিল মিশরের সাহসী সিংহ। হিকসস তাড়া করায় লসট্রিস বাহিনীকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে মিশর থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।

ট্যানাস সেই সঙ্গে রানীর গোপন প্রেমিকও ছিলেন। এবং, আপনি যদি টাইটার বক্তব্য বিশ্বাস করেন, রানীর বড় ছেলে প্রিন্স মেমননের পিতাও বটে।

আরকুন নামে এক ইথিওপিয়ান রাজাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মারা যান ট্যানাস, মমি করা তার লাশ রানীর কাছে ফিরিয়ে আনে টাইটা, গল্পের আরো খানিক অংশ স্মরণ করলো নিকোলাস।

এ থেকে আরেকটা সূত্রে চলে আসা যায়, ডুরেঈদ আর আমি বহু কষ্টে উদ্ধার করেছি।

সপ্তম স্ক্রোল থেকে? বুক থেকে হাত নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকলো নিকোলাস।

না কোনো স্ক্রোল থেকে নয়, রানী লসট্রিসের সমাধিতে পাওয়া দেয়াল লিপি থেকে। ব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করলো রোয়েন।

এটা সমাধিকক্ষে পাওয়া দেয়ালচিত্রের আংশিক ছবি, এনলার্জ করা। দেয়ালের ওই অংশ পরে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যায় চিরকালের জন্য। জারগুলো তখনই পাই আমরা। ডুরেঈদ ও আমার বিশ্বাস, টাইটা এ লিপি সম্মানজনক জায়গায় রেখেছিল এবং এটার বিশেষ তাৎপর্য আছে। সম্মানজনক জায়গা বলছি এ জন্য যে, স্ক্রোল যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তার ঠিক উপরেই ছিল এ লিপি।

ছবিটা নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস।

হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে নিকোলাস, রোয়েন বলে যাচ্ছে, বইটা থেকে আপনি জেনেছেন, হেঁয়ালি করতে ভালোবাসত টাইটা, শব্দ নিয়ে কৌতুক করতে বা খেলতে পছন্দ করত। বহু জায়গায় নিজের বুদ্ধির তারিফ করেছে সে। বলেছে, সেই শ্রেষ্ঠ বাও খেলোয়াড়।

চোখ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস সরিয়ে নিকোলাস বলল, হ্যাঁ। বাও সম্ভবত দাবারই প্রাচীন সংস্করণ। মিশর ও আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে পাওয়া কিছু বোর্ডও আমার মিউজিয়ামে আছে।

বাও খেলা হয় রঙিন পাথর দিয়ে, প্রতিটি পাথরের আলাদা পদমর্যাদা। সে যাই হোক, আমরা জানি ধাঁধা তৈরি করার নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে উত্তর-পুরুষকে জানাবার একটা ঝোঁক ছিল টাইটার মধ্যে। নিজেকে বুদ্ধিমান বলে দাবি করার ভঙ্গিটায় কিন্তু গর্বের ভাব নেই, বরং যেনো সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা। তার প্রমাণ, ফারাও-এর সমাধিতে ইচ্ছে করেই অনেক সূত্র রেখে গেছে সে। শুধু স্ক্রোলে নয়, মিউরালেও। টাইটা আমাদের বলছে, সে তার প্রিয় রানীর সমাধিতে দেয়ালচিত্রগুলো নিজের হাতে এঁকেছে বা রঙ চড়িয়েছে।

এটা ওই সূত্রগুলোর একটা বলে আপনার ধারণা? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ফটোটার উপর টোকা দিল নিকোলাস।

পড়ন না, বলল রোয়েন। আমি তো বলি ক্ল্যাসিকাল হায়ারোগ্লিফিকস–তার দুর্বোধ্য কোডের তুলনায় কঠিন নয়।

থেমে থেমে অনুবাদ করছে নিকোলাস, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন–নীল দাতা, যে নীল তাকে খুন করেছে–হাপির সঙ্গে হাতে হাত ধরে অনন্ত কাল পাহারা দিচ্ছেন পাথুরে শেষ ইচ্ছাপত্র, যে ইচ্ছাপত্রে আভাস দেওয়া হয়েছে রাজপুত্রের জনককে কোথায় রাখা হয়েছে, যিনি কিনা জনক নন, রক্ত এবং ছাই দাতা। মাথা নাড়লো নিকোলাস, না, কোনো অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বোধহয় অনুবাদে ভুল করছি।

হতাশ হবেন না। এ তো সবে টাইটার সংস্পর্শে এলেন। এটা নিয়ে আমরা কয়েক সপ্তা মাথা ঘামিয়েছি। ধাঁধাটা ধরতে হলে রিভার গডে ফিরে যেতে হবে। মানে ট্যানাস প্রিন্স মেমননের জনক নন, তবে রানীর প্রেমিক হিসেবে তার বায়োলজিক্যাল ফাদার। মৃত্যুশয্যায় তিনি মেমননকে নীল তলোয়ার উপহার দিয়েছিলেন, এ নীল তলোয়ারের আঘাতেই তিনি গুরুতর জখম হন, আরকাউনকে শায়েস্তা করতে গিয়ে, আরকাউনের দ্বারাই। বইটায় যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা আছে।

হ্যাঁ, বইটা পড়ার সময় আমি ভেবেছিলাম নীল তলোয়ারটা নিশ্চয়ই ওই ব্রোঞ্জ যুগে একটা বিস্ময়কর বস্তু ছিল। কাজেই রাজপুত্রকে দেওয়ার মতো একটা উপহার হতেই পারে। তাহলে, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন, আসলে ট্যানাস? বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো নিকোলাস। আপাতত আপনার করা অর্থ আমি মেনে নিলাম।

ধন্যবাদ। ফারাও মামোস নামেমাত্র মেমননের জনক ছিলেন, রক্তসম্পর্কিত বাবা নন। এখানেও আবার বলা হচ্ছে, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন। মামোস, প্রিন্সকে ঈজিপ্টের, দ্বৈত মুকুট দান করে যান, উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যে রক্ত ও ছাই।

এটুকু হজম করতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বাকিটুকু?

এবার আসুন, হাতে হাতে ধরে। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় এর অর্থ হতে পারে কাছাকাছি, অথবা দৃষ্টিসীমার ভেতর। হাপি হলেন নীল নদের উভলিঙ্গ দেবতা বা দেবী, তিনি কখন কি জেন্ডার গ্রহণ করবেন তার উপর নির্ভর করে। স্ক্রোলের সব জায়গায় নদীটার বিকল্প নাম হিসেবে হাপিকে ব্যবহার করেছে টাইটা।

তাহলে সপ্তম স্ক্রোল আর রাণীর সমাধিতে পাওয়া দেয়াললিপি এক করলে পুরো বক্তব্যটা কী দাঁড়াচ্ছে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

সংক্ষেপে এই–দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছাকাছি কোথাও অথবা দৃষ্টিসীমার ভেতর কোথাও ট্যানাসকে করব দেওয়া হয়েছে। তাঁর সমাধির বাইরে বা ভেতরে কোথাও একটা মনুমেন্ট অথবা লিপি আছে, যাতে মামোসের সমাধিতে যাওয়ার পথনির্দেশ পাওয়া যাবে।

দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো নিকোলাস। লাফ দিয়ে শূন্য থেকে অর্থ লুফে নিচ্ছি, ফলে আমি ক্লান্ত। আমার জন্য আর কী সূত্র রেখেছেন আপনি?

আর কোনো সূত্র নেই।

কী বলছেন! আর কোনো সূত্র নেই মানে? নিকোলাস হতভম্ব।

সত্যি নেই।

আসুন ধরা যাক, নদীটা চার হাজার বছর পরও আকৃতি ও নকশায় একই রকম আছে। আরো ধরা যাক, টাইটা আসলেও ডানডেরা নদীর দ্বিতীয় জলপ্রপাতের দিকটা নির্দেশ করছেন। ওখানে পৌঁছে তাহলে আমরা ঠিক কী খুঁজবে? যদি শিলালিপি থাকে, তা কি অটুট অবস্থায় পাব? নাকি স্রোত আর রোদ বৃষ্টির অত্যাচারে ক্ষয়ে গেছে সব?

রোয়েন বলল, হাওয়ার্ড কার্টারের কাছেও এরকম অস্পষ্ট ও দুর্বল একটা সূত্র ছিল। মাত্র এক টুকরো প্যাপাইরাস, তা-ও সেটার অথেনটিসিটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় নি। অথচ ওই সূত্রই আমাদেরকে তুতেনখামেনের সমাধিতে পৌঁছে দিয়েছে।

হাওয়ার্ড কার্টারকে শুধু ভ্যালি অভ দ্য কিংস সার্চ করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দশ বছর লেগে যায় তাঁর। আর আপনি আমাকে ইথিওপিয়া দিচ্ছেন, আকারে ফ্রান্সের দ্বিগুণ। কতদিন লাগবে আমাদের, ধারণা করতে পারেন?

ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লো রোয়েন। ক্ষমা করুন আমাকে। এখানে আর থাকার কোনো অর্থ হয় না, শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। বরঞ্চ, হাসপাতালে মায়ের কাছে যাই।

এখন তো ভিজিটিং আওয়ার নয়।

নিজের একটা রুম আছে ওনার, রোয়েন বলে।

চলুন, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি, ভদ্রতা করে নিকোলাস বলল।

কোনো প্রয়োজন নেই। ট্যাক্সি নিয়ে নিতে পারবো আমি। শীতল স্বরে বলে উঠলো রোয়েন।

এক ঘণ্টা লাগবে ট্যাক্সিতে করে যেতে। কাজেই, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, সবুজ রেঞ্জ রোভারে উঠলো রোয়েন।

পনেরো মিনিট কাটলো নিঃশব্দে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে নিকোলাস। শেষমেষ সে মুখ খুলে। মাপ চাইতে খুব একটা অভ্যস্ত

নই আমি। সত্যি দুঃখিত–যদি রুঢ় ব্যবহার করে থাকি। একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।

রোয়েনের নীরবতা না ভাঙতে, নিকোলাস ফের বলে, দেখুন, যদি কথাবার্তা বলেন, তবে তো চিঠি লিখে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। অ্যাবে গিরিপথে সেটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার হবে।

আমার তো মনে হলো–ওদিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আপনার নেই। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল রোয়েন।

আমি হলাম গে এক নাছোড়বান্দা, নিকোলাস হাসছে, রোয়েন না হেসে পারে না।

সত্যি, এ ব্যাপারে আমাকেও একমত হতে হচ্ছে। আপনি একজন বর্বর নাছোড়বান্দা।

কাজেই, এখনো আমরা পার্টনার আছি–তাই না? নিকোলাস বলে।

এই মুহূর্তে এক আপনি ছাড়া আর কোনো বর্বর নেই কাছেপিঠে। কাজেই আপনিই আমার পার্টনার!

হাসপাতালের প্রবেশপথে রোয়েনকে নামিয়ে দেয় নিকোলাস। তিনটার দিকে ওকে তুলে নেবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়র্কের শহরতলীর পথে রওনা হয় সে।

ইয়র্ক মিনিস্টারের কাছে সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় থেকেই একটা ফ্ল্যাট আছে তার। কেইম্যান আইল্যান্ড কোম্পানির নামে বরাদ্দ ওই অফিসে একটা আনলিস্টেড এবং নিরাপদ ফোন আছে। কেউই এ নম্বর ট্রেস করতে সক্ষম হবে না। রোসেলিনের সঙ্গে পরিচয়ের আগে এখানে অনেকটা সময় ব্যয় করতো সে। এখন অবশ্য কেবল গোপনীয় কাজের জন্য জায়গাটা ব্যবহার করে থাকে নিকোলাস। লিবিয়া এবং ইরাক অভিযানের সময়ও এখান থেকেই গোটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

বহুবছর ব্যবহার করা হয় নি। ভ্যাপসা একটা গন্ধ বাড়িতে। কেতলিতে পানি চড়িয়ে দুটো ফোন লাগালো নিকোলাস। একটা জার্সিতে অবস্থিত ব্যাঙ্কে, অপরটি কেইম্যান আইল্যান্ডে।

ওদের পরিবারে একটা কথা প্রচলিত ছিল–বুদ্ধিমান হঁদুরের অনেকগুলো পথ খোলা থাকে। এ ধরনের হঠাৎ প্রয়োজনের জন্য একটা টাকা সরিয়ে রেখেছিল নিকোলাস। এ মুহূর্তে অভিযান চালাতে হলে টাকা চাই।

একাউন্ট নং, পাসওয়ার্ড দিয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করলো সে। সত্যি, টাকা থাকলে সব কাজ কতোই না সহজ হয়ে যায়!

ঘড়ি দেখলো নিকোলাস। ফ্লোরিডাতে এখনো ভোররাত। কিন্তু দ্বিতীয়বার রিং হতেই ধরলো অ্যালিসন। সোনালি চুলো এক সেক্স বোম্ এ মেয়ে–পৃথিবীর দুর্গমতম জায়গায় সাফারি আয়োজন করে থাকে।

নিকোলাস, তুমি তো দেখছি আমাদের কথা একদম ভুলেই গেছ!

না, ঠিক ভুলি নি। একটু ব্যস্ত ছিলাম। কেমন করে মানুষকে বলবে সে, ওর স্ত্রী আর দুই মেয়ে মারা গেছে?

ইথিওপিয়ায়? জিজ্ঞেস করলো অ্যালিসন, গলার আওয়াজ একটু ম্লান শোনালো। কবে যেতে চাও?

এই ধরো আগামি সপ্তায়।

ঠাট্টা করছ নাকি? ওখানে আমরা মাত্র একজন হান্টার গাইডকে দিয়ে কাজ করাই, দু বছরের জন্য বুক হয়ে আছে সে।

আর কেউ নেই? বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ঢুকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাকে।

শিকার কী হবে, পর্বত নায়ালা? মেনেলিকের বুশবাক?

মিউজিয়ামের জন্য এটা হবে আমাদের কালেকটিং ট্রিপ, অ্যাবে নদীপথে, এর বেশি আর কিছু বলতে প্রস্তুত নয় নিকোলাস।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অ্যালিসন। আগেই বলে রাখছি, এতে আমাদের সায় নেই। এতো অল্প সময়ে নোটিশে মাত্র একজন গাইডকে তুমি পেতে পারো, তবে আমি জানি না নীল নদে তার কোনো ক্যাম্প আছে কিনা। লোকটা রাশিয়ান, তার বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগও শোনা গেছে। কেউ কেউ বলে সাবেক কেজিবি-র লোক, মেনজিসটুর পাণ্ডাদের একজন।

মেনজিসটুকে কালো স্টালিন বলা হয়, উৎখাত করার পর বুড়ো সম্রাট হাইলে সেলাসিকে হত্যা করেন। ষোলো বছর মার্কসিস্ট শাসনে ইথিওপিয়াকে নতজানু অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর স্পনসর ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ওখানে কমিউনিজমের পতন ঘটার পর মেনজিসটুকে উৎখাত করা হয়, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। আমার খুব ঠেকা, যে কোনো একজন গাইড হলেই চলে। কথা দিচ্ছি, পরে অভিযোগ করব না।

ঠিক আছে, তবে মনে থাকে যেন। নিকোলাসকে আদ্দিসআবাবার একটা ফোন নম্বর দিল অ্যালিসন।

আবার ডায়াল ঘোরাল নিকোলাস। আদ্দিসের লাইন পাওয়া এতো সহজ হবে ভাবে নি নিকোলাস, একবার ডায়াল করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ইথিওপিয়ান বাচনভঙ্গিতে মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ সাড়া দিল। নিকোলাস বোরিস ব্রুসিলভকে চাইতেই মেয়েটা ভাষা বদলে ইংরেজিতে কথা বলল।

বর্তমানে তিনি সাফারিতে আছেন, বলল সে। আমি তাঁর স্ত্রী, ওইজিরো টিসে। নিকোলাস জানে, ইথিওপিয়ার মেয়েরা স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না। ওইজিরো টিসে শব্দের অর্থ নারী সূর্য, চমৎকার নাম।

আপনি যদি সাফারি সম্পর্কে কিছু জানতে চান, আমি জবাব দিতে পারব। নারী সূর্য বলে ওঠে।

*

হাসপাতালের বাইরে থেকে রোয়েনকে রেঞ্জ রোভারে তুলে নিল। নিকোলাস। কেমন আছেন জর্জিনা? জানতে চাইলো ও।

পায়ের অবস্থা ভালো, কিন্তু ম্যাজিকের জন্য এখনো খুব কাতর।

ওরকম একটা ছানা কালই কিনে দিন। তারপর নিকোলাস জিজ্ঞেস করলো, আমরা যদি আফ্রিকায় যাই, মায়ের কাছ থেকে আপনি বিদায় নিতে পারবেন?

হেসে ফেললো রোয়েন। বলতে পারেন বিদায় আমি নিয়ে রেখেছি। চার্চ গ্রুপ থেকে একজন মহিলা থাকবেন ওর সঙ্গে, মাম্মির কোনো অসুবিধে হবে না। সীটে একটু ঘুরে বসে নিকোলাসের দিকে সরাসরি তাকালো রোয়েন। সারাদিন কোথায় ছিলেন? আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে।

আরবীয় কায়দায় শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো নিক। আল্লাহ আমাকে শয়তান ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করুন!

আরে, ধ্যাত! কী করেছেন, বলুন তো?

আগে মিউজিয়ামে ফিরি, তারপর।

যাদুঘরে ফিরে মিশরীয় সংগ্রহের হলঘর পেরিয়ে আফ্রিকার স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংগ্রহশালায় এসে ঢুকলো নিকোলাস। একটা অ্যান্টিলোপ হরিণের ডায়োরামার সামনে এসে থামালো রোয়েনকে। ছোট্ট এবং মাঝারি গড়নের প্রাণী এগুলো ইম্পালা, থম্পসন এবং গ্রান্টের গ্যাজেল, জেরেনুক প্রভৃতি।

কোণার দিকের ছোট্ট একটা প্রাণীর উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করে নিকোলাস। ম্যাডোকাওয়া হারপারি, এটাকে বলা হয় হারপারস ডিক-ডিক, ডোরাকাটা ডিক ডিক হিসেবেও পরিচিত।

প্রাণীটির তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, আকারে বড় একটা খরগোশের মতো। কাঁধ আর পিঠের ব্রাউন চামড়ার উপর চকলেট রঙের ডোরা, নাকটা এতো লম্বা যে শুড় বলে মনে হয়। নিকোলাসের চেহারায় গর্বের ভাব দেখে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকলো রোয়েন, শুধু বলল, এটার কি বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে?

তাৎপর্য নেই মানে? এ প্রজাতির এটাই সম্ভবত শেষ নমুনা। এতোই দুর্লভ, জুলজিস্টরা সন্দেহ করে এটা একটা কাল্পনিক প্রাণী, কোনো কালেই অস্তিত্ব ছিল না। ছবি দেখে তারা কি বলেছিল জানেন? সাধারণ একটা ডিক-ডিকের কাঠামোয় বেজির চামড়া পরানো হয়েছে। এর চেয়ে জঘন্য অভিযোগ কখনো শুনেছেন?

আমি হতভম্ব, এরকম অন্যায় কেউ করতে পারে! হেসে উঠলো রোয়েন।

ঠাট্টা নয়, বলল নিকোলাস। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে আবারো একটা ডিক-ডিক শিকারে আফ্রিকা যাচ্ছি আমরা।

ঠিক বুঝলাম না।

আসুন, আমার সঙ্গে, সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। নিজের স্টাডিতে রোয়েনকে নিয়ে চলে নিক। লাল চামড়ায় বাঁধানো একটা নোটবুক তুলে নেয়। অত্যন্ত পুরোনো নোট বুকটা–স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গেছে মলাট।

বুড়ো দাদা জোনাথন-এর শিকার বিষয়ক বর্ণনা। লেখার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ কালিতে আঁকা ছবিও রয়েছে। পাতার মাঝে পুরোনো ফুল, গাছের পাতা ইত্যাদি। শিরোনাম পড়লো নিকোলাস:

২ ফেব্রুয়ারি, ১৯০২। অ্যাবে নদীর ক্যাম্প থেকে। আজ সারাদিন বিশাল দুটো হাতিকে ধাওয়া করি, কিন্তু নাগালের মধ্যে পেলাম না। সাংঘাতিক গরম। হাল ছেড়ে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখি ছোট একটা হরিণ নদীর তীরে ঘাস খাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তুলে ফেলে দিলাম ওটাকে। তারপর কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখি, এটা আসলে জীনাস মাডুকা-র সদস্য। এ প্রজাতিটা আগে কখনো দেখি নি আমি। সাধারণ ডিক-ডিকের চেয়ে আকারে এটা বড়, গায়ে ডোরা আছে। এটা সম্ভবত নতুন একটা আবিষ্কার।

কাগজটা থেকে মুখ তুললাম নিকোলাস। অ্যাবে গিরিখাদে যেতে হলে আমাদের একটা অজুহাত দরকার ডিক-ডিক সেটা এনে দিচ্ছে।

হ্যাঁ, আমিও এ বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। ইথিওপিয়া সরকার অনুমতি দেবে তো?

আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে অবশ্য দেবে না, বলল নিকোলাস। সেজন্যই তো ডিক-ডিককে ব্যবহার করব আমরা। অনুমতি নিয়ে বহু সাফারি কোম্পানি ইথিওপিয়ায় অপারেশন। চালাচ্ছে। প্রয়োজনীয় পারমিট, সরকারের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট, যানবাহন, ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট, আইনগত পরামর্শ ইত্যাদি সবই তাদের আছে। এ অভিযানের প্ল্যান আয়োজন যদি আমরা করি, কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। সাফারি কোম্পানির সীল-ছাপ্পড় ছাড়া গেলে লোকাল জঙ্গী গ্রুপগুলোও হুমকি হয়ে দেখা দেবে।

তাহলে ডিক-ডিক শিকারী হিসেবে যাব আমরা, যাব একটা সাফারি কোম্পানির অধীনে?

একজন সাফারি অপারেটরের সঙ্গে আদ্দিসআবাবায় এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছি আমি, অন্তত প্রথম পর্যায়ে আমরা তার সাহায্য নেব, বলল নিকোলাস। প্রয়োজনীয় সূত্র হাতে এলে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে, তখন আমরা নিজেদের লোকজন আর ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করব। তৃতীয় পর্যায়টা হবে ইথিওপিয়া থেকে লুটের মাল বের করে আনা। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কাজটা সহজ হবে না।

সত্যিই তো, বের করব…

জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ এ মুহূর্তে জবাব দিতে পারব না।

কবে রওনা হচ্ছি আমরা?

তার আগে আরেকটা প্রসঙ্গ। টাইটার ধাঁধার যে অর্থ আপনারা বের করেছেন, ভিলা থেকে চুরি যাওয়া আপনার নোটে সেটা লেখা ছিল?

হ্যাঁ, ছিল। সব কিছুই হয় নোটে নয়তো মাইক্রোফিল্মে ছিল। দুঃখিত।

তার মানে আমরা যা জানি প্রতিপক্ষও তাই জানে।

হ্যাঁ।

তাহলে আমার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, বলল নিকোলাস। অ্যাবে গিরিখাদে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চাই আমি প্রতিপক্ষ পৌঁছবার আগেই। ওরা আপনার ধারণা ও উপসংহার চুরি করেছে প্রায় এক মাস হয়ে এলো। কে জানে, হয়তো এরই মধ্যে . রওনা হয়ে গেছে।

কবে? আবার জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

নাইরোবি হয়ে আদ্দিসআবাবায় যাচ্ছি, শনিবারে। প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ওখান থেকে এয়ার কেনিয়া ফ্লাইট ধরে আদ্দিসে যাবো আমরা, সোমবার দিনের মধ্য ভাগে নামবো সেখানে। আজ সন্ধ্যাতেই লন্ডনে গিয়ে রাতটা আমার ফ্ল্যাটে পার করে, কাল রওনা হবো। ইয়েলো ফিভার আর হেপাটাইটিস ইনজেকশন নেওয়া আছে?

আছে, কিন্তু নিজের মাল-সামান কিছুই তো কায়রো থেকে নিয়ে আসতে পারি নি।

ওটা লন্ডনে গিয়ে দেখা যাবে। কী কী দরকার, কিনে নিব। ইথিওপিয়ায়। ভয়াবহ গরম।

নিজের হাতের লিস্টিতে এক এক করে দাগ দিচ্ছে নিকোলাস।

এখন থেকেই ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধমূলক টেবলেট খেতে শুরু করব আমরা। এমন এক এলাকায় যাচ্ছি, যেখানে ক্লোরোকুইন রেজিস্টেন্ট ফ্যালসিপেরাম মশা আছে, কাজেই

তালিকায় দ্রুত চোখ বুলাচ্ছে নিকোলাস।

কায়রো থেকে সবেমাত্র এসেছেন, কাজেই আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ইথিওপিয়ার ভিসা লাগবে আমাদের, তবে জানাশোনা লোক আছে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাব।

হাতের কাজ শেষ হতেই রোয়েনকে তার জিনিসপত্র প্যাক করার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিল নিক।

যতক্ষণে কুয়েনটন পার্ক থেকে বের হচ্ছে ওরা, আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। ইয়র্ক হাসপাতালে কিছু সময় থেমে মা-কে বিদায় বলল রোয়েন। দেখা-সাক্ষাত শেষ করে আবারো সবুজ রেঞ্জ রোভারে চড়লো সে।

নিকোলাসের শরীরের পুরুষালি সৌরভ, আর তার উপস্থিতির নিরাপত্তার ভেতর গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন।

*

নিকোলাসের লন্ডনের বাড়িটা নাইটসব্রিজে। কুয়েনটন পার্কের মতো অভিজাত নয়, কিন্তু এখানে বরঞ্চ স্বস্তি অনুভব করলো রোয়েন। এ যেনো তার বাড়ির মতো হোক না, মাত্র দু দিনের জন্য থাকা। এ সময়টাতে খুব কমই নিকোলাসের দেখা পেল সে। শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি ব্যস্ততায় দম ফেলার ফুরসত নেই তার। হোয়াইট হলে, সরকারি ভবনে যেতে হলো কয়েকবার। পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসের উদ্দেশ্যে লেখা সরকারি কাগজ নিয়ে ফিরে এলো নিকোলাস।

ইংরেজরা আসলেই সুবিধা আদায় করে নিতে সবচেয়ে পটু মনে মনে রোয়েন ভাবে। নিকোলাসের ব্যস্ততার সময়টাতে তালিকা মিলিয়ে কিছু কেনাকাটা সেরে নিল ও। পথে প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কায় কাটালো, কখন কোন্ দিক থেকে কে আবার আক্রমণ করে বসে। কেউ অনুসরণ করছে কি না–তাও নিশ্চিত হয়ে নিল রোয়েন। নিজেকেই অবশ্য চোখ রাঙালো এমন ছেলেমানুষি ভয় করছে বলে।

প্রতি সন্ধ্যাতেই, নিকোলাসের আগমনের সময়টার জন্য উৎকণ্ঠা ভরে অপেক্ষায় থাকলো রোয়েন–যদিও নিজের কাছে স্বীকার গেল না, ভদ্রলোক কাছে থাকলে আলাদা একটা নিরাপত্তাবোধ ঘিরে রাখে তাকে।

*

শনিবার সকালে হিথরোর চার নম্বর টার্মিনালে পৌঁছে লাগেজগুলো পরীক্ষা করলো নিকোলাস। রোয়েনের কাঁধে একটা স্লিং ব্যাগ, আর নিয়েছে নরম একটা ক্যানভাস ব্যাগ। নিকোলাসের হান্টিং রাইফেলটা লেদারে মোড়া, আলাদা একটা প্যাকেটে রয়েছে একশো রাউন্ড অ্যামুনিশন। ওর সঙ্গে আর শুধু একটা লেদার ব্রীফকেস রযেছে। মাথায় পানামা হ্যাঁ, চেক-ইন কাউন্টারে থেমে বসে থাকা মেয়েটার উদ্দেশে মুচকি হাসলো।

প্লেন ছাড়ার পর দাবার খুঁটি সাজালো নিকোলাস, বোর্ডটা খোলা হয়েছে দুই সীটের মাঝখানের আর্ম-রেস্টে। কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা এয়ারপোর্টে যখন প্লেন নামছে, তৃতীয় গেমটা তখনো শেষ হয় নি। দু জনেই একটা করে জিতেছে, শেষটা অমীমাংসিত থেকে গেল। যদিও রোয়েন এগিয়ে ছিল শেষ খেলাটায়।

নাইরোবির নরফোক হোটেলে একজোড়া গার্ডেন বাংলো বুক করেছে নিকোলাস। রোয়েন বিছানায় উঠেছে দশ মিনিটও হয় নি, পাশের বাংলো থেকে নিকোলাসের ফোন পেল। আজ রাতে ব্রিটিশ হাই কমিশনে ডিনার খাচ্ছি আমরা। পুরানো বন্ধু। নরমাল ড্রেস পরলেই চলবে। আটটার দিকে বেরুতে পারবেন তো?

এ লোকের সঙ্গে সফরে বেরিয়ে আলস্যে ভেসে যাওয়ার কোনো উপায় নেই মনে মনে ভাবলো রোয়েন।

*

নাইরোবি থেকে আদ্দিসআবাবা অতটা দূরে নয়, তবে নিচের প্রকৃতি একের পর এমন সব বিচিত্র শোভা মেলে ধরছে যে এয়ার কেনিয়া ফ্লাইটের জানালার সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে থাকলো রোয়েন। মাউন্ট কেনিয়ার চূড়াটাকে অনেক বছর পর মেঘমুক্ত দেখলো নিকোলাস, তুষার মোড়া জোড়া শৃঙ্গ রোদ লেগে চকচক করছে। তারপর শুরু হলো মরুভূমি, মরুভূমি শেষ হতে ইথিওপিয়ান মালভূমি দেখা গেল। আফ্রিকায় ইথিওপিয়ার চেয়ে পুরানো সভ্যতা শুধু মিশর, রোয়েনকে বলল নিকোলাস। আমরা, পশ্চিমারা যখন নেংটি পরে ঘুরতাম, তখনো এরা ছিল অত্যন্ত সভ্য; এদের দেব-দেবীর বিপরীতে আমরা করতাম প্যান এবং ডায়ানার পুজো।

হ্যাঁ। চার হাজার বছর আগে টাইটা যখন এ পথ দিয়ে গেছে এ এলাকার লোকজন তখনো সভ্য ছিল। এদের খুব প্রশংসা করেছে স্লোলে, বলেছে, তার কালচারের মতোই এদের কালচার উন্নত। এটা একটা ব্যতিক্রমই বলব, কারণ অন্য প্রায় সব জাতিকে নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছে সে।

আকাশ থেকে আদ্দিস যে কোনো আফ্রিকার শহরের মতোই। নতুন এবং পুরোনোর মিশ্রণ; ঐতিহ্যবাহী এবং রূপময় স্থাপত্যরীতি–দুই-ই আছে এখানে। আছে ইটের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পাতায় ছাওয়া বাড়ি-ঘর।

জমিনের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার বলতে লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। জ্বালানি কাঠ যোগায় এ গাছ। দরিদ্রস্য দরিদ্য এ জনপদে এ কাঠই একমাত্র জ্বালানি। চিরকাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইথিওপিয়া। আগে হানাদার বর্বরেরা অত্যাচার করতো, এখন করে অপরিচিত রাজনৈতিক মতাদর্শ।

এতো উচ্চতার কারণে ইথিওপিয়ার বাতাস অত্যন্ত শীতল, মিঠে রাগলো রোয়েন এবং নিকোলাসের কাছে।

প্লেন থেকে নেমে টার্মিনাল বিল্ডিঙে চলে এলো ওরা।

স্যার… নিকোলাস! দু জনেই ওরা লম্বা এক তরুণীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, ওদের দিকে এস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে, হাঁটার ভঙ্গিতে নৃত্যশিল্পীর মনকাড়া সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একেই বোধহয় কলঙ্কবিহীন ত্বক বলে, গাঢ় মধুর মতো রঙ, লাবণ্যে ভরপুর। মেয়ে হাসতেও জানে, যেনো কতদিনের পরিচয়। ঐতিহ্যবাহী

পূর্ণদৈর্ঘ্য স্কার্ট পরে আছে, হাঁটার সময় ফুলে উঠছে।

আমার দেশ ইথিওপিয়ায় স্বাগতম, স্যার নিকোলাস। আমি ওইজিরো টিসে। কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো সে। আপনি নিশ্চয়ই ওইজিরো রোয়েন। রোয়েনের দিকে ডান হাত বাড়ালো সে। নিকোলাস লক্ষ করলো, প্রথম দর্শনেই মেয়ে দু জন পরস্পরকে পছন্দ করছে।

ওদের পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছিল টিসে, ফিরে এসে একটা খবর দিল। আপনারা ভিআইপি লাউঞ্জে বিশ্রাম নিন। ব্রিটিশ এমব্যাসির এক ভদ্রলোক ওখানে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। জানি না কীভাবে খবর পেল ওঁরা।

ভিআইপি লাউঞ্জে মাত্র একজন লোককে দেখা গেল, ট্রপিকাল স্যুট পরা ব্রিটিশ, ডোরাকাটা স্যান্ডহার্সট টাই পরনে। নিকোলাসকে দেখেই সোফা ছেড়ে এগিয়ে এলো সে। নিকি! কেমন আছো, বন্ধু? ভাবিনি এতো থাকতে এখানে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। প্রায় বারো বছর পর, তাই না?

হ্যালো, জিওফ্রে। জানতাম না এখানে চাকরি করছ তুমি।

মিলিটারি অ্যাটাশে। হিজ এক্সেলেন্সি নাইরোবি থেকে খবর পান তুমি আসছ। আমাকে জানালেন, কারণ উনি জানেন তুমি আমার পুরানো বন্ধু, স্যান্ডহার্সট কলেজের। আগ্রহ চেপে রাখতে পারছে না, বারবার রোয়েনের দিকে তাকাচ্ছে। খানিকটা হতাশ ভঙ্গি করে তার সঙ্গে রোয়েনের পরিচয় করিয়ে দিল নিকোলাস।

জিওফ্রে টেনেন্টে। আপনাকে একটু সাবধানে থাকার পরামর্শ দিব। বিষুব রেখার উত্তরে সবচেয়ে নামকরা প্লেবয়। ওর আধ মাইলের মধ্যে কোনো মেয়েই নিরাপদ নয়।

হয়েছে, এতোটা বাড়িয়ে বলতে হয় না! নিকোলাস তার যে পরিচয় দিল, তাতে জিওফ্রেকে গর্বিত ও তৃপ্ত মনে হলো। প্লিজ, এ লোক যা বলছে তার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না, ডক্টর আল সিমা। কুখ্যাত একজন নিন্দুক।

নিকোলাসকে টেনে একপাশে সরিয়ে আনল জিওফ্রে। রাজধানীর বাইরে দেশের অবস্থা সম্পর্কে ভীতিকর একটা ধারণা দিল সে।

হিজ এক্সিলেন্সি একটু উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে গোজাম-এর ওদিকে শয়তানদের বসবাস। উনি চান না আর রোয়েনকে নিয়ে ওদিকে যাও তুমি। আমি অবশ্য বলেছি, নিজেকে তুমি রক্ষা করতে জানো।

খুব অল্প সময়ের ভেতর কাজ সেরে ফিরে এলো ওইজিরো টিসে। আপনাদের লাগেজ, ফায়ার আর্মস আর অ্যামুনিশনের কাস্টমস ক্লিয়ার্যান্স পাওয়া গেছে। এটা আপনাদের সাময়িক পারমিট, ইথিওপিয়ায় যতোক্ষণ থাকবেন সঙ্গে রাখতে হবে। পাসপোর্টগুলোও রাখুন, ভিসায় সীল মারা হয়েছে। এক ঘণ্টা পর লেক টানা ফ্লাইট, কাজেই হাতে কিছুটা সময় আছে।

যদি কখনো চাকরি পেতে অসুবিধে হয়, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, মেয়েটার দক্ষতার প্রশংসা করলো নিকোলাস।

ওদের সঙ্গে ডিপারচার গেট পর্যন্ত হেঁটে এলো জিওফ্রে। বিপদ হলে আমরা আছি। জন্মেছি নেতৃত্বদানের জন্য!

জন্মেছি নেতৃত্বদানের জন্য–কথাটার মানে কী? অপেক্ষমাণ বিমানের পথে যেতে যেতে রোয়েন শুধায় নিকোলাসকে।

স্যান্ডহার্সট কলেজের আপ্তবাক্য। নিকোলাস ব্যাখ্যা করে বলে।

দারুণ, সত্যি, নিকি!

আমার কাছে নিকোলাস নামটাই বেশি অভিজাত আর সুন্দর শোনায়!

তা ঠিক। তবে নিকি, বেশ সুইট লাগছে শুনতে!

*

টুইন অটার বিমান ওদেরকে সুউচ্চ গগনে তুলে আনলেও নিচের জমিন এতো কাছে যে গ্রাম আর খেতগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এর কারণ পাহাড়ি এলাকার উপর রয়েছে প্লেন। তারপর নিচে একটা মালভূমি দেখা গেল, হঠাৎ সেটার সামনে মুখ ব্যাদান করে থাকতে দেখা গেল বিশাল এক গিরিখাদকে, আকারে এতোই বড় যে কল্পনাকেও যেনো হার মানায়। অ্যাবে নদী! সিট থেকে। সামনের দিকে ঝুঁকতে হলো রোয়েনকে নিকোলাসের কাঁধে টোকা দেওয়ার জন্য।

খাদটার কিনারা বা ধার খাড়া ও স্পষ্টভাবে কাটা, আর তারপরই ত্রিশ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে নেমে গেছে ঢাল। মালভূমির ফাঁকা ও নিঃস্ব সমতল জমিন জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ঘন বন-জঙ্গলে আচ্ছাদিত খাদের পাঁচিলগুলোকে। এখানে সেখানে জঙ্গল ভেদ করে মাথাচাড়া দিয়ে আছে বাতিদানে সাজানো লম্বা মোমের মতো পাথরের বিশাল সব স্তম্ভ, একেকটা পাঁচ সাত তলা বাড়ির মতো বড়। কোথাও কোথাও ধসে পড়েছে পাঁচিল, সেখানে শুধু কোটি কোটি টন আলগা পাথর ছড়িয়ে আছে। পাঁচিলের গায়ে ব্লাফ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর বিস্তার ক্রমশ উপর দিকে, মাথার দিকে কোনটার চেহারা সূচের মতো, কোনোটা আবার প্রকৃতির তৈরি ভাস্কর্য শিল্প, ঠিক যেনো মানুষের আকৃতি।

ঢল নেমেছে তো নেমেছেই, যেনো কোনো শেষ নেই, তারপর দুই ঢাল যেখানে দৃষ্টিভ্রমের কারণে মিলিত হয়েছে বলে মনে হলো, এক মাইল বা আর বেশি গভীরে, সেখানে চিকচিক করতে দেখা গেল সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদীটাকে। কুপি বা চিমনি আকৃতির উপরের পাঁচিল দ্বিতীয় একটা কিনারা তৈরি করেছে নীল • নদের পানি থেকে পাঁচশো ফুট উপরে, এ অংশটাকে উপখাদ বলা যেতে পারে। উপখাদের পাঁচিলগুলো একদমই খাড়া, মাঝখানে লাল স্যান্ডস্টোনের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে নদী। কোনও কোথাও খাদটা চল্লিশ মাইল চওড়া, আবার কোথাও মাত্র দশ। তবে পুরো দৈর্ঘ্য জুড়েই ভীতিকর গাম্ভীর্য আর অশেষ নির্জনতা বাসা বেঁধে আছে। মানুষের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না।

ওখানেই আপনারা নামতে যাচ্ছেন, ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো কণ্ঠস্বর, ফিসফিস করলো ওইজিরো টিসে। নিকোলাস রোয়েন কথা বলছে না। এ ধরনের আদিম, রোমহর্ষক ও রহস্যময় প্রকৃতির মুখোমুখি হলে সব ভাষাই হারিয়ে যায়।

প্রায় স্বস্তির সঙ্গে দেখলো, ওদের নাগাল পাওয়ার জন্য উঠে আসছে উত্তরের পাঁচিল, দীর্ঘ নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো চোক রেঞ্জের সারি উঁচু পাহাড়, ওদের খুদে ও ভঙ্গুর বিমানের চেয়ে অনেক ওপরে।

বাঁক ঘুরে সেই পবর্তশ্রেণীর ভেতর ডাইভ দিল বিমান। স্টারবোর্ড উইংটিপের দিকে হাত তুললাম টিসে।

লেক টানা, বলল সে। চওড়া পাত্রে ঢালা পারদের মতো টলটল করছে লেকের পানি। টানা লেক লম্বায় পঞ্চাশ মাইল, এখানে সেখানে মাথা তুলেছে কয়েকটা দ্বীপ, প্রতিটিতে একটা করে মঠ বা প্রাচীন চার্চ আছে। ল্যান্ড করার জন্য লেকের উপর দিয়ে শেষবার ওড়ার সময় প্যাপারাসের তৈরি খুদে বোটে সাদা আলখেল্লা পরা পাদ্রীদের দেখতে পেল ওরা, এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাচ্ছে।

লেকের পাশে মেঠো স্ট্রিপে ল্যান্ড করলো অটার, পেছনে ধুলোর মেঘ উঠলো। তাল পাতার গায়ে রঙিন নকশা করা কয়েকটা ঘর, এটাই এখানকার টার্মিনাল বিল্ডিং। রোদ এতো উজ্জ্বল যে খাকি জ্যাকেটের পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে পরতে হলো নিকোলাসকে। প্লেন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ও। সাদা ও নোংরা টার্মিনাল ভবনের গায়ে বুলেটের গর্ত দেখা গেল, রানওয়ের কিনারায় ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে একটা রাশিয়ান টি-তারটিফাইভ ব্যাটল ট্যাংকের পোড়া খোল। নিকোলাসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অন্যান্য আরোহীরা বেরিয়ে এলো, বিল্ডিঙের পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়ায় তাদের অস্থির আত্মীয় স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে একটাই মাত্র গাড়ি, বালি রঙের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার। ড্রাইভারের দরজায় বড় বড় হরফে লেখা ওয়াইল্ড চেস্ সাফারি।

মেয়ে দু জনকে নিয়ে নিচে নামলো নিকোলাস। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। তার পরনে রঙচটা বুশ সুট। লম্বা সে, রোগা না হলেও গায়ে চর্বি নেই, হাঁটার সময় সামান্য ঝাঁকি খায় শরীর।

নিকোলাস আন্দাজ করলো চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস হবে। কটা রঙের চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখ নিপ্রভ ও নীলচে। মুখে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন আছে, নাক ছুঁয়ে দেওয়ায় সেটা বিকৃত দেখাচ্ছে।

টিসে প্রথমে তার সঙ্গে রোয়েনের পরিচয় করিয়ে দিল।

রোয়েন করমর্দন না করায় ভুরু কুঁচকে বাউ করলো লোকটা। এরপর টিসে নিকোলাসের পরিচয় দিল। ইনি আমার স্বামী, অল্টো বোরিস। বোরিস, ইনি অল্টো নিকোলাস।

আমার ইংলিশ ভালো নয়, বলল বোরিস।ফ্রেঞ্চ খানিকটা ভালো।

কোনো অসুবিধে নেই, ফ্রেঞ্চ ভাষায় জবাব দিল নিকোলাস। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। হাত বাড়ালো ও।

হ্যান্ডশেকের অজুহাতে নিকোলাসের হাতটা মুচড়ে দিতে চেষ্টা করলো বোরিস। সতর্ক ছিল নিকোলাস, এ ধরনের আধ-বুড়ো শয়তানদের চেনা আছে, মুঠোয় এতোটা জোর ছিল যে সুবিধে করতে পারলো না বোরিস। নিকোলাসের ঠোঁটে অলস হাসি। প্রথমে ঢিল দিতে হলো বোরিসকে, ক্ষীণ হলেও শ্রদ্ধার ভাব ফুটল নীলচে চোখে।

আপনি তাহলে ডিক-ডিকের খোঁজে এসেছেন? প্রশ্ন তো নয়, প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো লোকটা। অথচ লোকের আমার কাছে আসে বড় হাতি শিকার করার জন্য।

হয় পর্বত নায়ালা।

বড় হাতিকে ভয় পাই, হাসলো নিকোলাস।

ডিক-ডিক আমার জন্য মানিয়ে যায়।

খাদে আগে কখনো নেমেছেন?

স্যার নিকোলাস ১৯৭৬ সালে নদী এক্সপিডিশনের জন্য ওখানে নেমেছিলেন। জবাব দিল রোয়েন, দু জনের মাঝখানে নীরব উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে ও।

স্ত্রীর দিকে ফিরল বোরিস। আমার অর্ডার মতো সমস্ত রসদ আনা হয়েছে?

হ্যাঁ, কেমন যেনো ভয়ে ভয়ে জবাব দিল টিসে। প্লেনে আছে সব।

টয়োটার সামনের সিটে বসলো পুরুষরা, অসংখ্য প্যাকেট আর রসদ নিয়ে মেয়েরা বসলো পেছনে। ঘুরে ফিরে সব কিছু তাহলে দেখার ইচ্ছে নেই আপনাদের? নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো বোরিস, গলার আওয়াজ হুমকির মতো শোনালো।

মানে?

লেকের আউটলেট, পাওয়ার স্টেশন, খাদের উপর পর্তুগাল ব্রিজ, নীল নদের উৎসমুখ দেখার জিনিস অনেকই আছে। দেখতে চাইলে সন্ধ্যের আগে ক্যাম্পে ফেরা সম্ভব নয়।

ধন্যবাদ, বলল নিকোলাস। তবে এ সব আগেই দেখা আছে আমার।

সারি সারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। এলাকাটার নাম গোজাম, রাস্তার ধারে প্রচুর লোকজন দেখা গেল। সবাই খুব লম্বা, ছাগল বা ভেড়া চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষ ও নারী সবাই প্যান্ট পরা, তবে মেয়েদের ব্লাউজের উপর উলেন শাল আছে। ইথিওপিয়ার সব এলাকার মতো গোজামের লোকজনও দেখতে খুব সুন্দর। মেয়েরা কালো হলে কী হবে, রূপ যৌবন যেনো উথলে পড়ছে। পুরুষরা বেশিরভাগই সশস্ত্র। একে ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল তো আছেই, আরো আছে দু ধারি তলোয়ার।

গ্রামের কুঁড়েগুলো গোল দেয়ালের তুকুল-ইউক্যালিপটাস অথবা সাইসল। গাছের নিচে।

চোক রেঞ্জের চূড়ায় লালচে-বেগুনি মেঘের তুমুল আলোড়ন শুরু হলো। চাদির তৈরি সিকির মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, কিছুক্ষণ ঝরেই থেমে গেল। তাতেই কাদায় থকথকে হয়ে উঠলো রাস্তা।

খানিক পর শুরু হলো পাথুরে খানা-খন্দ। এমনকি ফোর-হুইল ড্রাইভ টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পক্ষেও এ সব বাধা পেরিয়ে এগোনো সম্ভব নয়। ঘুরপথ ধরতে হলো, মাঝে মধ্যে গাড়ি এগুচ্ছে হাঁটা গতিতে, তা সত্ত্বেও অনবরত ঝকি খাচ্ছে। আরোহীরা।

কালাদের জানোয়ার বললেই হয়, বোরিসের গলায় ঘৃণা। রাস্তা মেরামত করার কথা চিন্তাও করে না। কেউ কিছু বলছে না, তবে রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে মেয়ে দুটোকে দেখলো নিকোলাস। দুজনেই নির্লিপ্ত।

সামনে আরো খারাপ রাস্তা পড়লো। ভারী যানবাহন চলাচল করায় চাকার ঘর্ষণে দীর্ঘ নালা তৈরি হয়েছে।

মিলিটারি ট্রাফিক? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

কিছু কিছু, জবাব দিল বোরিস। এদিকে শুফতাদের তৎপরতা খুব বেশি। শুফতা হলো ডাকাত সরদার আর দলত্যাগী সমর নায়ক। প্রসপেক্টিং কোম্পানির ট্রাকও আসা-যাওয়া করে। বড় একটা মাইনিং কোম্পানি গোজামে কনসেশন পেয়েছে, ড্রিলিং করার জন্য পৌঁছে গেছে তারা।

আমরা কিন্তু এখনো কোনো সিভিলিয়ান ভেহিকল দেখি নি, বলল রোয়েন। এমন কী পাবলিক বাসও না।

ব্যাখ্যা দিল টিসে, এক সময় ইথিওপিয়াকে আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি বলা হত, কিন্তু মেনজিসটু ক্ষমতায় এসে ইকোনমির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। খাদ্য এখানে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোটর কিনবে এমন সঙ্গতি হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনের আছে। ছেলেমেয়েদের কী খাওয়াবে, এ চিন্তাতেই পাগল হয়ে আছে সবাই।

আদ্দিস ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে ডিগ্রি নিয়েছে টিসে, কর্কশ হাসির সঙ্গে বলল বোরিস। সব কিছু জানে সে, একটু বেশিই জানে! স্ত্রীর প্রতি এটা তার ধমকও বলা যায়, বিদ্রূপও বলা যায়। টিসে আর কোনো কথা বলল না।

বিকেলের দিকে ম্লান সূর্য উঠলো। ফাঁকা একটা এলাকার মাঝখানে গাড়ি থামাল বোরিস। আঙুল মটকাবার বিরতি। পানি ছাড়ার সময়।

মেয়ে দু জন ট্রাক থেকে নেমে বোল্ডারের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এলো কাপড় পাল্টে। ঢোলা প্যান্টের উপর ব্লাউজ পরেছে, ব্লাউজের উপর উলের চাদর। এগুলো টিসে আমাকে ধার দিয়েছেন, নিকোলাসকে বলল রোয়েন।

কাজের জন্য এগুলোই ভালো, মন্তব্য করলো নিকোলাস।

ট্রাক যখন আরেকটা পাথুরে উপত্যকায় নেমে যাচ্ছে, দিগন্তে নেমে আসছে সূর্যও। পাশেই একটা নদী, পাড় হয়ে গেছে। নদীর উপর একটা চার্চ, নল খাগড়া আর পাতায় ছাওয়া ছাদের উপর কাঠের কপটিক ক্রস বসানো হয়েছে, দেয়ালগুলো সাদা। গ্রামটা দাঁড়িয়ে আছে চার্চকে ঘিরে।

ডেবরা মারিয়াম, বলল বোরিস। ভার্জিন মেরীর পাহাড়। আর নদীর নাম ডানডেরা। বড় একটা ট্রাকে আমার লোকজনকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ক্যাম্প রেডি করে অপেক্ষা করছে তারা। আজ রাতে এখানেই আমরা ঘুমাব, কাল ভাটি ধরে এগোব, যতক্ষণ না খাদের কিনারায় পৌঁছাই।

গ্রামের ঠিক সামনে ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় তাবুটা আপনাদের, নিকোলাসকে জানালো বোরিস।

ওটা রোয়েনের জন্য, বলল নিকোলাস। আমার নিজের একটা আলাদা তাঁবু দরকার।

ডিক-ডিক শিকার করতে এসে আলাদা তাঁবু? বোরিসের চোখে নগ্ন বিস্ময়। আপনি আমাকে তাজ্জব করলেন, স্যার! চেঁচামেচি করে লোকজনকে ডাকলো সে, আরেকটা তাঁবু টাঙাবার নির্দেশ দিল। দ্বিতীয়টার পাশেই টাঙানো হলো সেটা। রাতে আপনার সাহস বাড়তে পারে। চাই না বেশি দূর হাঁটতে হোক আপনাকে।

বু গাম গাছের নিচু ডালে একটা ড্রাম ঝোলানো হয়েছে, ড্রামের নিচে শুকনো পাতার তৈরি অসংখ্য ফুটোয়লা দেয়াল, উপরে ছাদ নেই–এটাই ওদের বাথরুম বা শাওয়ার। প্রথমে ব্যবহার করলো রোয়েন, বেরিয়ে এলো তাজা চেহারা নিয়ে, মাথায় ভিজে তোয়ালে জড়ানো, মুখে হাসি। আপনার পালা, নিকোলাস! নিকোলাসের তাঁবুকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সময় হাঁক ছাড়লো। পানি খুব গরম!

নিকোলাসের শাওয়ার সেরে কাপড় বদলাতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সোজা হেঁটে এসে ডাইনিং তাঁবুতে ঢুকলো, আগেই এখানে জড়ো হয়েছে সবাই। আগুনের চারপাশে ফেলা হয়েছে ক্যাম্পচেয়ারে, একটাতে বসলো নিকোলাস। মেয়ে দুটো বসেছে উল্টো দিকে, কথা বলছে নিচু গলায়। হাতে গ্লাস নিয়ে নিচু টেবিলে পা তুলে দিয়েছে বোরিস। নিকোলাস বসতেই ইঙ্গিতে ভদকার বোতলটা দেখালো। বাস্কেটে বরফ আছে।

কথা না বলে মাথা নাড়লো নিকোলাস। গলাটা অবশ্য শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, মনে মনে ভাবল বিয়ার পেলে মন্দ হতো না।

গোপন একটা কথা বলি, নিকোলাসকে বলল বোরিস। আজকাল ডোরা কাটা ডিক-ডিক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আদৌ কোনো কালে ছিল কিনা তা-ও আমার সন্দেহ আছে। আপনি টাকা আর সময় অপচয় করতে এসেছেন।

অসুবিধে কী, বলল নিকোলাস। ওগুলো তো আমারই।

কোন্ এক বুড়ো ভাম কবে কী মেরেছিল–এসবের কোনো বিশ্বাস আছে? দশ দিন আগে তিনটে হাতির ছাপ দেখেছি, মদ্দা হাতি, বলল বোরিস। একেকটা দাঁত একশো পাউন্ডের কম নয়।

কথা কাটাকাটি চলছে, বোরিসের ভদকার বোতল নীল নদ থেকে বন্যা নেমে যাবার মতো দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। টিসে যখন বলল ডিনার রেডি, বোতলটা সঙ্গে নিয়ে চেয়ার ছাড়লো সে। টেবিলের দিকে এগুবার সময় টলতে দেখা গেল তাকে। খেতে বসে টিসেকে কথায় কথায় ধমক দেওয়া ছাড়া আর কোনো অবদান রাখলো না।

ভেড়ার মাংস সিদ্ধ হয় নি কেন? কুকের উপর চোখ রাখো নি কেন? ওরা তো কুত্তার বাচ্চা, তুমি জানো।

আপনার মাংস কি সিদ্ধ হয় নি, স্যার নিকোলাস? স্বামীর দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো টিসে। বললে কুককে দিয়ে সিদ্ধ করে আনাই।

একদম নিখুঁত রান্না হয়েছে, আশ্বস্ত করলো নিকোলাস। তুলোর মতো নরম মাংস আমি পছন্দ করি না।

ডিনারের শেষ দিকে দেখা গেল বোরিসের বোতল খালি হয়ে গেছে। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে তার চেহারা, মনে হলো ফুলেছেও। টেবিল থেকে উঠে কারো সঙ্গে কথা বলল না, নিজের তাঁবুর দিকে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি আমি। এ শুধু সন্ধ্যের দিকে ঘটে। দিনের বেলা একদম শান্ত ভদ্রলোক। ভদকা ওদের রাশিয়ান ঐতিহ্য। উজ্জ্বল হাসি দিল টিসে, শুধু চোখ দুটোয় বিষাদের ছায়া লেগে থাকলো। নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে উঠতে চার্চ পর্যন্ত হেঁটে আসার প্রস্তাব দিল সে। ওরা রাজি হতে একজন চাকরকে ডেকে লণ্ঠন আনালো।

হাতে লণ্ঠন নিয়ে আগে আগে চললো চাকর ছেলেটা। গোলাকার ভবনের সামনে প্রাচীন এক পুরোহিত অভ্যর্থনা জানালেন দলটাকে। অসাধারণ একটা ক্রুশ হাতে ওদের হাসিমুখে স্বাগত জানালেন তিনি।

হাঁটুগেড়ে বসে আশীর্বাদ চাইলো রোয়েন আর টিসে। হাতের ক্রুশ ওদের কপালে চুঁইয়ে অ্যামহারিক ভাষায় কিছু বলল পাদ্রী। এরপর হাতছানি দিয়ে ভেতরে ডেকে নিল ওদের।

মৌলিক রঙে আঁকা অসাধারণ দেয়ালচিত্রে ভরপুর প্রার্থনালয়। লণ্ঠনের আলোয় মণিমুক্তোর মতো জ্বললো। বাইজেন্টাইন প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট চিত্রগুলোতে দেবতার চোখ বিশাল, মাথায় সোনালি মুকুট। বেদীর উপরে ভার্জিন মেরী শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, নিচে বসে ফেরেশতারা এবং তিন ম্যাজাই। পোলারয়েড ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম নিকোলাস।

ছবি তোলা শেষ হতে, এক জায়গায় বসে প্রার্থনারত টিসে এবং রোয়েনের দিকে দেখলো সে।

এমন বিশ্বাস আমার যদি থাকতো! অনেকবারের মতো নিকোলাস ভাবে। কঠিন সময়ে এর থেকে সহায়তা পাওয়া যায়। রোসেলিন আর মেয়েদের জন্য এমন প্রার্থনা যদি করতে পারতাম কখনো। চার্চে থাকা বেশ কঠিন হয়ে উঠলো তার জন্য। বেরিয়ে এসে রাতের তারাভরা আকাশ দেখতে থাকে নিকোলাস।

ধীরে, এ খারাপ ভাবটা চলে যায় ওর। সত্যি, আফ্রিকার তুলনা হয় না।

মেয়ে দু জনের প্রার্থনা শেষ হতে পুরোহিতকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু টাকা এবং পোলারয়েডে তোলা তার একটা ছবি দিল নিকোলাস। দারুণ খুশি বুড়ো ভদ্রলোক।

ফেরার পথে নিঃশব্দে পাহাড়ের ঢাল ধরে নেমে চললো ওরা।

*

নিকি! নিকোলাস! উঠুন, প্লিজ! ধাক্কা দিয়ে নিকোলাসের ঘুম ভাঙালো রোয়েন। উঠে বসে টর্চ জ্বাললো ও, দেখলো ঢোলা প্যান্ট আর ব্লাউজের উপর উলের ওড়না পরেছে রোয়েন।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, তবে রোয়েন জবাব দেওয়ার আগেই বোরিসের কর্কশ গর্জন আর খিস্তি শুনতে পেল, রাতের নিস্তব্ধতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার তাঁবু থেকে ভেসে আসছে। আরো একটা রোমহর্ষক শব্দ পেল নিকোলাস, শক্ত মুঠো দিয়ে মাংস ও হাড়ে আঘাত করলেই শুধু এ ধরনের আওয়াজ হতে পারে।

মেয়েটাকে মারছে, রাগে কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। যেভাবে পারেন থামান আপনি।

প্রতিটি আঘাতের পর ব্যথায় চিৎকার করছে টিসে, তারপর ফোঁপাচ্ছে। ইতস্ত ত করছে নিকোলাস। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় শুধু একজন বোকা নাক গলায়, এবং সাধারণত পুরস্কার হিসেবে তার কপালে জোটে অকস্মাৎ ঐকমত্যে পৌঁছনো স্বামী স্ত্রীর কঠোর নিন্দা।

কিছু একটা করুন, নিকোলাস! প্লিজ!!

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কট থেকে নামলো নিকোলাস। শুধু শর্টস পরে রয়েছে ও। জুতো খোঁজার ঝামেলায় গেল না, বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। রোয়েন ওর পিছু পিছু আসছে, ওর পা-ও খালি।

ওদের তাঁবুর ভেতর লণ্ঠন জ্বলছে এখনো, ক্যানভাসের দেয়ালে বড় আকৃতির ছাড়া নড়াচড়া করছে। নিকোলাস দেখলো বোরিস তার স্ত্রীর চুল ধরে হিড়হিড় করে মেঝের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, গর্জন করছে রুশ ভাষায়।

বোরিস! মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তিনবার চিৎকার করতে হলো নিকোলাসকে। টিসেকে ছেড়ে দিয়ে তাঁবুর ফ্ল্যাপ তুললাম বোরিস। শুধু আন্ডারপ্যান্ট পরে আছে সে। শরীরে কিলবিল করছে পেশী, তবে বুকটা চ্যাপ্টা ও লোহার মতো শক্ত মনে হলো, কোঁকড়ানো সোনালি চুলে ঢাকা। তার পেছনে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে টিসে, উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফোঁপাচ্ছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মেয়েটা, তার শরীরের সমতল অংশগুলো সাপের চামড়ার মতো মসৃণ।

রাত দুপুরে এ-সব কী? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, অনেক কষ্টে রাগ চেপে রাখছে। শান্ত সরল একটা মেয়ের এ অপমান সহ্য করার মতো নয়।

কালো বেশ্যাটাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছি, খেঁকিয়ে উঠলো বোরিস। আপনার কোনো ব্যাপার নয়, মিস্টার। তবে আপনিও যদি ঝাল মাংসের খানিকটা ভাগ চান, সেটা আলাদা কথা। হেসে উঠলো সে, আওয়াজটা শুনে গা ঘিন ঘিন করে উঠলো নিকোলাসের।

আপনি সুস্থ, ওইজিরো টিসে? আমাদের সাহায্য দরকার থাকলে বলুন। কথাগুলো বলার সময় বোরিসের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস, নগ্ন শরীরটার দিকে তাকিয়ে টিসেকে আরো অপমান করতে ইচ্ছুক নয়।

কোনো রকমে উঠে বসলো টিসে, ভাঁজ করা হাঁটু তুললাম বুকের সামনে, নগ্নতা ঢাকার জন্য সে দুটোকে হাত দিয়ে আলিঙ্গন করলো। আমি ভালো আছি, স্যার নিকোলাস। ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে আপনারা চলে যান, প্লিজ। তার নাক থেকে গড়ানো রক্ত ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে, লাল হয়ে উঠছে সাদা দাঁতগুলো।

আমার স্ত্রী তোমাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলছে, ইউ ইংলিশ বাস্টার্ড! ভাগো, যাও! তা না হলে এমন শিক্ষা দিব…। টলতে টলতে এগিয়ে এলো। বোরিস, ঘুসি তুললাম নিকোলাসের বুক লক্ষ্য করে।

সাবলীল অনায়াস ভঙ্গিতে সরে গেল নিকোলাস, বোরিসকে ঠেলে দিল যেদিকে তার এগোবার ঝোঁক। ভারসাম্য হারিয়ে তাঁবুর সামনে খোলা জায়গায় আছাড় খেলো সে, পড়ার সময় একটা ক্যাম্প চেয়ারকেও সঙ্গে নিল।

প্লিজ, এসব করবেন না! এখনো ফোপাচ্ছে টিসে।

ও রেগে গেলে মানুষ থাকে না। আপনার সঙ্গে যদি পেরে না ওঠে, দেখবেন কারো না কারো ক্ষতি করবে।

রোয়েন, টিসেকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে যান, নরম সুরে নির্দেশ দিল নিকোলাস। ছুটে তাঁবুতে ঢুকলো রোয়েন, কট থেকে চাদর তুলে এনে জড়িয়ে দিল টিসের গায়ে, তারপর তাকে দাঁড় করালো।

টিসেকে নিয়ে নিজের তাঁবুর দিকে এগুচ্ছে রোয়েন, এ সময় উঠে দাঁড়ালো বোরিস। হুঙ্কার ছাড়লো সে, উল্টে পড়া ক্যাম্প চেয়ার হাতে নিল। মাটিতে আছাড় মেরে চেয়ারের একটা পা ভাঙল সে, সেটা নিয়ে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে।

খেলতে চাও, তাই না, ব্যাটা ইংরেজ? এসো তাহলে, হয়ে যাক! ধেয়ে এলো নিকোলাসের দিকে, নিনজা ব্যাটনের মতো হাতের কাঠ ঘোরাল। বাতাসে শিস কেটে নিকোলাসের মাথার দিকে ছুটে এলো পায়াটা।

ঝট করে মাথা নিচু করলো নিকোলাস, লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পায়াটা এরপর ওর বুক বরাবর নামিয়ে আনল বোরিস। লাগলে পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে যেত, তবে শেষ মুহূর্তে মোচড় খেয়ে সরে গেল নিকোলাস।

একটা বৃত্ত ধরে ঘুরছে ওরা, তারপর আবার হামলা করলো বোরিস। ভদকা খাওয়ায় তার রিফ্লেক্স ভোতা হয়ে গেছে, তা না হলে এরকম শক্ত ও অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষের সঙ্গে লাগতে যাবার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করত নিকোলাস। বোরিসের পায়াটা আরেকবার বাতাসে শিস কেটে ছুটে এলো ওর মাথার দিকে, এবারও ঝট করে নিচু হয়ে আঘাতটা এড়ালো সে। তারপর সোজা হলো, কষে একটা ঘুষি মারল বোরিসের তলপেটে। হুসস করে বাতাস বেরিয়ে এলো, ফুসফুস খালি হয়ে গেল বোরিসের। হাত থেকে ছিটকে পড়লো, কুঁজো হলো শরীরটা, তারপর পড়ে গেল মাটিতে। হেঁটে এসে তার সামনে দাঁড়ালো নিকোলাস। তোমাকে প্রথম ও শেষবার সাবধান করে দিচ্ছি, বোরিস ব্রুসিলভ। মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া চলবে না।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রোয়েনের উদ্দেশ্যে নিক বলল, মেয়েটাকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে রাখুন। আঙুল দিয়ে কপালের উপরে এসে পড়া ভেজা চুলগুলো সরায়। আর, কোনো সমস্যা না থাকলে একটু ঘুমোই, কেমন?

*

ভোর রাতের দিকে বৃষ্টি শুরু হলো বেশ। ক্যানভাসের তাঁবুতে যেনো বাদ্য বাজালো ঝরঝর জলরাশি। হঠাৎ হঠাৎ নীলচে বৈদ্যুতিক শিখায় কেমন অপার্থিব রকম আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিক। অবশ্য, সকালের নাস্তার সময় হতে দেখা গেল, মেঘ কেটে গেছে, উজ্জ্বল রোদে ঝকমক করছে চরাচর। মৃদুমন্দ বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ।

নাস্তার টেবিলে পরম বন্ধুর মতো নিকোলাসকে অভ্যর্থনা জানালো বোরিস। গুড মর্নিং, স্যার নিকোলাস! কাল রাতে খুব মজা করলাম আমরা, কী বলেন? মনে পড়লে এখনো আমার হাসি পাচ্ছে। সাম গুড জোকস! আর এক দিন ভদকা খেয়ে ওই খেলাটা আমরা আবার খেলবো, কেমন? এ যে, নারী সূর্য, তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ডকে নাস্তা খেতে দাও! কাল রাতে ওরকম খেলাধুলোর পর ওঁর খুব খিদে পেয়েছে।

টিসে নির্লিপ্ত ও বিষণ্ণ, চাকরদের নাস্তা পরিবেশন তদারক করছে। একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে, নিচের ঠোঁট কাটা। নিকোলাসের দিকে সে একবারও তাকাচ্ছে না।

আমরা আগে রওনা হব, কফি খাবার সময় ব্যাখ্যা করলো বোরিস। ক্যাম্প তুলে বড় ট্রাকে চড়ে পিছু নেবে চাকররা। ভাগ্য ভালো হলে আজ রাতে খাদের কিনারায় ক্যাম্প ফেলতে পারব। নামতে শুরু করব কাল।

ট্রাকে ওঠার সময় বোরিসের কান বাঁচিয়ে দু একটা কথা বলল টিসে। ধন্যবাদ, অল্টো নিকোলাস। তবে কাজটা আপনি ভালো করেন নি। আপনি ওকে চেনেন না। আপনাকে এখন থেকে সাবধান থাকতে হবে। ও ভোলে না, ক্ষমাও করে না।

ডেবরা মারিয়াম গ্রাম থেকে একটা শাখা পথ ধরে এগুলো ওরা, ডানডেরা নদীর পাশ দিয়ে এগিয়ে ছ। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার অবস্থা খুবই করুণ, ট্রাক ঠেলার জন্য বারবাৰ কাদায় নামতে হলো নিকোলাসকে। বড় ট্রাকটা এক সময় ধরে ফেললো ওদেরকে। বোরিস সারাক্ষণ গজগজ করছে। আমার কথা শুনলে এ ভোগান্তির মধ্যে প্যতে হতো না। রাস্তা নেই, শিকারো নেই, তবু যাব!

বিকেলে লাঞ্চ খাবার জন্য নদীর ধারে থামলো ওরা। হাত-পা থেকে কাদা ধোয়ার জন্য পানিতে নামলো নিকোলাস, পিছু নিয়ে রোয়েনও নেমে এলো। নদীর পানি হলুদ হয়ে আছে, বৃষ্টি হওয়ায় ভরাট হয়ে গেছে। ডোরা কাটা ডিক-ডিকের গল্প বোরিস বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না, নিকোলাসকে সাবধান করে দিল রোয়েন।

টিসে বলছেন, আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে তার। বুক আর বাহু ধোয়ার সময় নিকোলাসের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো ও। যেখানে রোদের ছোঁয়া পরেনি–ত্বক অত্যন্ত সাদা এবং মসৃণ। বুকের গাঢ় লোমগুলো কোঁকড়া। অসাধারণ শরীর।

লাগেজ হাতড়াতে পারে, বলল নিকোলাস। আপনার লাগেজে কোনো কাগজ-পত্র বা নোট নেই তো?

শুধু স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ আছে আর নোটবুকে যা আছে তার সবই শর্টহ্যান্ড–বোরিস বুঝবে না।

টিসের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধান।

তিনি খুব সরল। কারো ক্ষতি করবেন না।

বোরিস তাঁর স্বামী, ভুলে যাবেন না। অনুভূতি যা-ই বলুক, দু জনের কাউকেই বিশ্বাস করার দরকার নেই। শার্টটা ধুয়ে নিল নিকোলাস, ভিজেই পরল। চলুন।

ট্রাকের কাছে ফিরে ওরা দেখলো, সাউথ আফ্রিকান হোয়াইট ওয়াইনের বোতল খুলছে বোরিস। নিকোলাসকে একটা টাম্বলার ভরে দিল সে। টিসে ওদেরকে ঠাণ্ডা চিকেন রোস্ট আর হাতে তৈরি ইনজেরা রুটি পরিবেশন করলো। খাওয়া শেষ হতে নিকোলাসের পাশে ঘাসের উপর শুয়ে দাড়িওলা এক শকুনের দূর নীলিমায় ভেসে যাওয়া দেখলো রোয়েন। যাবার সময় হতে রোয়েনের হাত ধরে দাঁড় করালো নিকোলাস। শারীরিক সংস্পর্শ দুর্লভ একটা মুহূর্ত, নিকোলাসের আঙুলগুলো প্রয়োজনের চেয়ে এক কি দু সেকেন্ড দেরি করে ছাড়লো রোয়েন।

রাস্তার অবস্থা ভালো হওয়া তো দূরে কথা, আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। অতি কষ্টে একটা চড়াই পেরিয়ে এসে উতরাই ধরে নামতে শুরু করলো ট্রাক। অর্ধেক দূরত্ব নামার পর চুলের কাঁটার মতো বাঁক পড়লো। বাঁকটা ঘুরতেই দেখা গেল বিশাল একটা ট্রাক, প্রায় ট্রাক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছে বটে এ পথে প্রচুর ভারী যানবাহন চলাচল করে, তবে এ প্রথম একটাকে দেখলো ওরা। খুব সাবধানে ও কৌশলে ট্রাক আর উঁচু পাড়ের মধ্যবর্তী সরু ফাঁক গলে সামনে বাড়লো বোরিস।

পেছনের সীটে বসেছে রোয়েন, জানালো দিয়ে প্রকাণ্ড ডিজেল ট্রাকটা দেখতে পেল। সবুজের উপর লাল রঙে লেখা হয়েছে কোম্পানির নাম, লোগোটাও একই রঙের। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো ওর। মনে হলো, এ লোগো কিছুদিন আগে দেখেছে। অথচ মনে করতে পারছে না ঠিক কবে বা কোথায়।

বাকি পথ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকলো রোয়েন। বারবার শুধু মনে হচ্ছে ডানাওয়ালা ঘোড়ার লোগো আগেও কোথাও দেখেছে। লাল লোগগার উপর কোম্পানির নাম লেখা পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন।

দিনের শেষে ট্র্যাকের পাশে একটা সাইনপোস্ট দেখলো ওরা। পোস্টের পায়াগুলো কংক্রিটে গাঁথা, লেখাগুলো প্রফেশনাল কারো হাতের কাজ। বোর্ডের মাথায় একটা তীরচিহ্ন আঁকা, নির্দেশ করছে বুলডোজার দিয়ে সমান করা নতুন একটা রাস্তা, বাঁক ঘুরে ডান দিকে চলে গেছে। তার নিচের লেখাগুলো পড়লো রোয়েন–

পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন
বেস ক্যাম্প–ওয়ান কিলোমিটার
প্রাইভেট রোড
অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।

লাল ঘোড়া পেছনের পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আছে, ডানা দুটো দু দিকে মেলা।

ঝট করে মনে পড়ে গেল রোয়েনের! একই ট্রাক! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেও, মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। আতঙ্কের একটা ধাক্কা খেয়েছে বুকে। এ ট্রাকটাই ইয়র্কে ওর মায়ের ল্যান্ড রোভারকে ব্রিজ থেকে ঠেলে নিচে ফেলে দিয়েছিল। অসম্ভব, একই কোম্পানির ট্রাক ইথিওপিয়ার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চলে আসাটা কাকতালীয় কোনো ঘটনা হতে পারে না!

আরো কয়েক মাইল এগিয়ে খাদের খাড়া কিনারায় এসে থামলো ওরা।

আজ এ পর্যন্তই, বোরিস ঘোষণা করে। আগামীকাল পায়ে হেঁটে খাদে নামবো আমরা। ক্যাম্প ফেলল।

নিচে নেমে নিকোলাসের হাত ধরে টান দিল রোয়েন। কথা আছে, ফিসফিস করলো ও। নদীর ধারে চলে এলো দু জন।

পা ঝুলিয়ে একটা পাথরের উপর পাশাপাশি বসলো ওরা। পাশের ফুলে ওঠা নদী আভাস দিচ্ছে ওদের সামনে কী অপেক্ষা করছে। ঠাণ্ডা পাহাড়ি জলরাশি অসংখ্য পাথরের মাঝখান দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে। ওদের নিচে পাহাড়-প্রাচীর পাথরের খাড়া দেয়াল, প্রায় এক হাজার ফুট গভীর। ওরা এতো উপরে রয়েছে যে সন্ধ্যের আলোয়-ছায়া আর জলপ্রপাত থেকে ছড়িয়ে পড়া জলকণার ভেতর নিচের অন্ধকারো রহস্যময় লাগছে। নিচে তাকাতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো রোয়েনের, নিজের অজান্তেই নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরল। ধরার পর বুঝতে পারলো কী করছে, তাড়াতাড়ি আবার ছেড়ে দিল।

কিনারা থেকে হঠাৎ লাফ দিয়েছে ডানডেরা নদীর ঘোলাটে পানি। আশ্চর্যের ব্যাপার, পড়ার পথে চকচক করছে সূর্যালোকে। রঙধনুর সাত রঙ অবয়বে। নিচের কালচে পাথরে আছড়ে পড়ছে সশব্দে–অতল খাদে উড়ছে সাদাটে মেঘ।

নিকোলাস, আপনার মনে আছে, ইয়র্কে একটা ট্রাক মামির ল্যান্ড রোভারকে ব্রিজ থেকে ফেলে দিয়েছিল?

কেন মনে থাকবে না! রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস। আপনাকে আপসেট লাগছে। কী ব্যাপার?

ট্রাকটার গায়ে কোম্পানির নাম আর লোগো ছিল। নামটা আমি পড়তে পারি নি, তবে লোগোটা লক্ষ করেছিলাম। আজ বিকেলে ঠিক ওই একই ধরনের একটা ট্রাককে আমরা পাশ কাটিয়ে এসেছি। লোগা লাল আর সবুজের একটা ঘোড়া। কোম্পানির নাম পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন।

আপনার ভুল হয় নি?

না!

একই কোম্পানির ট্রাক ইয়র্কশায়ার আর গোজামে? মেনে নেওয়া যায়?

কোম্পানি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে যে তাদের ট্রাক চুরি গেছে। এটা হয়তো তাদের সাজানো ব্যাপার, চুরি যাবার ঘটনা ঘটেনি, মিছিমিছি রিপোর্ট করেছে।

অসম্ভব নয়।

ডুরেঈদকে খুন করার পরও আমার উপর দু বার হামলা করেছে ওরা, বলল রোয়েন। বোঝাই যায়, বড় ধরনের আয়োজন করার ক্ষমতা রাখে তারা। মিশর আর ইংল্যান্ডে যারা আয়োজন করতে পারে, তাদের পক্ষে ইথিওপিয়ায়ও সেটা করা সম্ভব। সবচেয়ে বড়ো কথা, সপ্তম স্ক্রোল তাদের দখল রয়েছে, সেসব দেখে তারা জেনেছে অ্যাবে নদীই তাদের গন্তব্য।

হঠাৎ পাথর থেকে নেমে পড়লো নিকোলাস। আসুন।

কোথায়? রোয়েন হতভম্ব।

পেগাসাস বেস ক্যাম্পে। চলুন সাইট ফোরম্যানের সঙ্গে কথা বলি।

ওদেরকে টয়োটায় উঠতে দেখে বাধা দেওয়ার জন্য ছুটে এলো বোরিস।

আমার অনুমতি না নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

চারদিকটা দেখতে, বলে ক্লাচ ছেড়ে দিল নিকোলাস। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।

কী বলে… না! আমার ট্রাক! ধরার জন্য ছুটছে বোরিস, কিন্তু টয়োটার গতি বেড়ে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়লো সে।

বিল করবেন। রিয়ার-ভিউ মিরবে তাকিয়ে হাসলো নিকোলাস।

সাইনপোস্ট দেখে বাঁক ঘুরলো ওরা, সাইড ট্র্যাক ধরে একটা রিজ পেরুল। চূড়ায় উঠে ব্রেক করলো ও, সামনের দৃশ্যটার উপর চোখ বুলাচ্ছে।

দশ একরের মতো জায়গা পরিষ্কার ও সমতল করা হয়েছে। জায়গাটা কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ঢোকার একটা মাত্র গেট। সবুজ ও লাল রঙ করা তিনটে প্রকাণ্ড ডিজেল ট্রাক বেড়ার ভেতর পার্ক করা রয়েছে। ছোট আরো কয়েকটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে, আর রয়েছে একটা লম্বা মোবাইল ড্রিলিং রিগ। উঠানের আরেক অংশ দখল করে রেখেছে প্রসপ্রেক্টিং ইকুইপমেন্ট। একদিকে স্তূপ করা হয়েছে ড্রিলিং রড আর ইস্পাতের কোর বক্স, স্পেয়ার পাটস ভর্তি কাঠের বাক্স, ডিজেল ভর্তি চুয়াল্লিশ গ্যালনের কয়েকটা ড্রাম। এতো সব জিনিস, অথচ তারপরও উঠানে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে, এর কারণ প্রতিটি জিনিস সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। গেটের ঠিক ভেতরে দশবারোটা ঘর, করোগেটেড শিট দিয়ে তৈরি। বড় একটা আউটফিট, বলল নিকোলাস। নিজেদের কাজ বোঝে ওরা। চলুন দেখা যাক চার্জে কে আছে।

গেটে দু জন গার্ড, ইথিওপিয়ান আর্মির ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরা। অচেনা ল্যান্ড ক্রুজার দেখে বিস্মিত হয়েছে তারা। নিকোলাস হর্ন বাজাতে একজন এগিয়ে এলো, সন্দেহে কুঁচকে আছে ভুরু, হাতে বাগিয়ে ধরা এ কে ফরটিসেভেন রাইফেল।

এখানকার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাই, আরবিতে বলল নিকোলাস, বলার সরে কর্কশ কর্তৃত্ব থাকলো, সেন্ট্রিদের অনিশ্চিয়তা ও অস্বস্তির মধ্যে ফেলাটাই উদ্দেশ্য।

অপেক্ষা করতে বলে সঙ্গীর কাছে ফিরে পরামর্শ করলো সেন্ট্রি, তারপর টু ওয়ে রেডিওর হ্যান্ডসেট তুলে মাইক্রোফোনে কথা বলল। কথা বলার পর পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে, কাছাকাছি একটা ঘরের দরজা খুলে একজন শ্বেতাঙ্গ বেরিয়ে এলো।

তার পরনে খাকি কভারাল, মাথায় নরম বুশ ক্যাপ। চোখ দুটো আয়না লাগানো সানগ্লাসে ঢাকা। শক্ত লেদারের মতো গায়ের চামড়া, আকারে প্রকাণ্ড না হলেও শক্ত-সমর্থ, আস্তিন গুটানো হাতে পেশী ফুলে আছে। গার্ডের সঙ্গে দু একটা কথা বলে টয়োটার দিকে এগিয়ে এলো সে।

কী চাই? কেন আসা হয়েছে? কথার সুরে টেক্সাসের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট, না ধরানো চুরুটটা দু সারি দাঁতের মাঝখানে আটকে রেখেছে।

আমি হারপার নিকোলাস। ট্রাক থেকে নেমে এগিয়ে এলো ও, হাত বাড়াল। হাউ ডু ইউ ডু?

আমেরিকান লোকটা ইতস্তত করলো, তারপর এমন ভঙ্গিতে হাতটা ধরল তাকে যেনো একটা ইলেকট্রিক ঈল মোচড়াতে দেওয়া হয়েছে।হেল, বলল সে।

জ্যাক হেলম্। অ্যাবিলিন, টেক্সাস থেকে। আমিই এখানকার ফোরম্যান। লোকটার হাতে সব কয়টা শিরা ফুলে আছে, শুকনো কয়েকটা ক্ষতচিহ্নও লক্ষ করলো নিকোলাস। নখের ভেতর গ্রিজ, কালো হয়ে আছে।

বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। দেখুন না, হঠাৎ ট্রাকটা বেঁকে বসেছে। ভাবলাম এখানে যদি কোনো মেকানিক পাই, দেখাব। হাসলো নিকোলাস, তবে বিনিময়ে লোকটা কোনো রকম উৎসাহ দেখালো না।

উটকো ঝামেলায় জড়ানো কোম্পানির পলিসি নয়। মাথা নাড়লো লোকটা।

টাকা লাগলে দিতে রাজি আছি…।

একবার তো বললাম, না! দাঁত থেকে চুরুট নামিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছে হেলম্।

আপনাদের কোম্পানি পেগাসাস। বলতে পারেন হেড অফিস কোথায়? ম্যানেজিং ডিরেক্টরের নাম কী?

আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। ঘুরে দাঁড়াতে গেল হেলম্।

শিকার করতে এসেছি, কয়েক সপ্তা এদিকে গুলি ছুঁড়ব। আমি চাই না ভুল করে আপনার কর্মচারীদের কারো গায়ে লাগুক। একটা ধারণা দিতে পারেন, কোনোদিকে আপনারা কাজ করবেন?

এখানে আমি একটা প্রসপেক্টিং আউটফিট চালাচ্ছি, মিস্টার। গতিবিধি সম্পর্কে খবর ফাঁস করতে পারি না। যান! ঘুরে সোজা নিজের অফিস-ঘরে চলে গেল হেলম্।

ছাদে স্যাটেলাইট ডিক্স, মন্তব্য করলো নিকোলাস। ভাবছি এ মুহূর্তে কার সঙ্গে কথা বলছে হেলম্।

টেক্সাসে কারো সঙ্গে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

নাও হতে পারে, বলল নিকোলাস। পেগাসাস নামকরা মাল্টিন্যাশনাল। হেলম্ টেক্সান, তার মানে এ নয় যে তার বসও তাই হবে। ইউ টার্ন নিল টয়োটা। পেগাসাসের কুৎসিত কেউ যদি এ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত থাকে, আমার নামটা তার চেনা চেনা লাগবে। আমরা আমাদের হাজিরা নোটিশ দিয়েছি, দেখা যাক কী জবাব পাওয়া যায়।

*

ডানডেরা নদী ও জলপ্রপাতের কাছে ফিরে এসে ওরা দেখলো ইতোমধ্যে ক্যাম্প ফেলা হয়েছে, ওদের জন্য চা বানাতে বসে গেছে শেফ। সন্ধ্যের মধ্যে পুরো আধ বোতল ভদকা শেষ না করা পর্যন্ত মুখ হাঁড়ি করে থাকলো বোরিস। তারপর সে জানালো, ঘোড়া আর গাধার বাচ্চা এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা। এখানকার মানুষগুলোও তাই, খচ্চর; সময়ের কোনো মূল্য দেয় না। ওরা না পৌঁছলে খাদে আমরা নামতে পারব না।

এতে করে, অন্তত আমার রাইফেল নিয়ে বেরুনোর সুযোগ পাওয়া গেল, নিকোলাস বলে। আফ্রিকায় ধৈর্য ধারণের জন্য কেউ পয়সা দেয় না অবশ্য।

সকালে নাস্তা খাবার পরও যখন খচ্চরগুলো পৌঁছল না, নিজের রাইফেলটা হাতে নিল নিকোলাস। ওর কাছ থেকে সেটা চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করলো বোরিস। মনে হচ্ছে পুরানো একটা রাইফেল? জিজ্ঞেস করলো সে।

১৯২৬ সালে তৈরি। আমার দাদা নিজ হাতে বানিয়েছিলেন।

তখনকার লোকজন জানত কীভাবে রাইফেল বানাতে হয়? প্রশংসা করলো বোরিস। শর্ট মাউজার ওবানডর্ফ ডাবল স্কয়্যারব্রিজ অ্যাকশন বিউটিফুল! তবে নতুন করে ব্যারেল লাগানো হয়েছে, ঠিক বলি নি?

অরিজিন্যাল ব্যারেল কেটে ফেলে দিয়েছি, বলল নিকোলাস। নতুনটা লাগানোয় এখন আমি একশো কদম দূর থেকে একটা মশার ডানা উড়িয়ে দিতে পারি।

ক্যালিবার সেভেন ইন্টু ফিফটিসেভেন, ঠিক?

টুসেভেনটিফাইভ রিগবি, তার ভুলটা ধরিয়ে দিল নিকোলাস।

একই কার্টিজ, আপনারা কায়দা করে অন্য নাম দিয়েছেন। হাসছে বোরিস। একশো পঞ্চাশ গ্রেন বুলেট প্রতি সেকেন্ডে দু হাজার আটশো ফুট গতি পাবে। সত্যি খুব ভালো রাইফেল, সেরাগুলোর মধ্যে একটা।

ধন্যবাদ, বলল নিকোলাস। আপনার প্রশংসার আমি মূল্য দিই।

ইংরেজ মানুষদের রসবোধ!

টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য ক্যাম্প ত্যাগ করলো নিকোলাস, ওর সঙ্গে রোয়েনও এলো। নদীর তীরে এসে দুটো ক্যানভাস ব্যাগের সাদা বালি ভরল ওরা। এটা পাথরের উপর ব্যাগ দুটো রাখা হলো, রাইফেলের রেস্ট হিসেবে কাজ করবে। ব্যাক-স্টপ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে খোলা হিলসাইড। দুশো গজ এগুলো নিকোলাস, ওখানে একটা কার্ডবোট কার্টুন সেট করলো, তার উপর টেপ দিয়ে আটকাল একটা বিসলে-টাইপ টার্গেট। পাথরটার পেছনে ফিরে এলো আবার, এখানে রোয়েন আর রাইফেলটা অপেক্ষা করছে।

গুলির প্রথম আওয়াজটাই ঘাবড়ে দিল রোয়েনকে। রাইফেলটা দেখতে এতো নিরীহ, তা থেকে এরকম বিকট আওয়াজ বেরুতে পারে, ভাবা যায় না। মনে হলো রোয়েনের কানে যেনো ভোঁ বাজছে। টার্গেটের তিনি ইঞ্চি ডানে আর দু ইঞ্চি নিচে লেগেছে বুলেট। কী ভয়ানক জিনিস! আপনি নিরীহ প্রাণীগুলোকে এ ভয়ঙ্কর বন্দুক দিয়ে মারবেন? রোয়েনের কথায় প্রতিবাদ ও আপত্তির সুর।

বন্দুক নয়, রাইফেল। নিকোলাস ঠিক করে দেয়। কম পাওয়ারের একটা রাইফেল দিয়ে যদি মারি; অথবা লাঠি দিয়ে তাতে কী আপনি সন্তুষ্ট হবেন?

টেলিস্কোপে সাইট অ্যাডজাস্ট করলো নিকোলাস। পরবর্তী শট বুলসআইনের মাত্র এক ইঞ্চি উপরে লাগলো।

একজন খাঁটি শিকারী যতো দ্রুত এবং পরিষ্কারভাবে শিকার মারতে মারবেন ততো নিপুণ তার দক্ষতা।

বন্দুকই হোক বা রাইফেল–কেমন করে স্রষ্টার সৃষ্টি আপনারা মারতে পারেন? রোয়েন বলে।

ওটা আপনাকে বুঝিয়ে বলা শক্ত, আবারো, গুলী করে নিকোলাস। এবারে, টার্গেটে লেগেছে।

এ হলো পুরুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। আর, শিকার কেন উচিত নয়? ঈশ্বর তো ওগুলো আমাদেরকে দান করেছেন। আপনি তো বিশ্বাসী। উদ্ধৃতি শোনান আমাকে–অ্যাক্টস টেন ভার্সেস টুয়েলভ অ্যান্ড থারটিন।

দুঃখিত, মাথা নাড়লো রোয়েন। আপনি শোনান।

শুনুন–…জগতের সমস্ত চতুষ্পদী প্রাণী, বন্য প্রাণী, হামা-দিয়ে চলা জীব, আকাশের যতো খেচর, অনুরোধ রক্ষা করছে নিকোলাস, তোমার প্রতি নির্দেশ, পিটার; জাগো এবং মারো। খাবার গ্রহণ করো।

আপনার উকিল হওয়া উচিত ছিল। কৃত্রিম হতাশায় গুঙিয়ে মতো উঠলো রোয়েন।

অথবা পুরোহিত! এগিয়ে গিয়ে টার্গেট নিয়ে আসে নিকোলাস। আদর করে হাত বোলায় রাইফেলে।

আধ ঘণ্টা পর কেসে ভরা রাইফেল নিয়ে ক্যাম্পে ফিরছে ওরা, কাছাকাছি এসে। দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। মেহমান! বলে চোখে বাইনোকুলার তুললাম। বাহ্, নোটিশে তাহলে কাজ হয়েছে! ওখানে পেগাসাসের একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে, রোয়েন। চলুন দেখা যাক কী ঘটছে।

ক্যাম্পের আরো কাছাকাছি এসে ওরা দেখলো দশ কি বারোজন ইউনিফর্ম পরা সৈনিক লাল-সবুজ পেগাসাস ট্রাকের পাশে জড়ো হয়েছে, সবাই ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। ডাইনিং তাঁবুর ফ্ল্যাপ তোলা, ভেতরে ক্যাম্প চেয়ার পেতে বসে রয়েছে জ্যাক হেলম, একজন ইথিওপিয়ান আর্মি অফিসার ও বোরিস। গভীর আলোচনায় মগ্ন।

নিকোলাস ভেতরে ঢুকতেই চশমা পরা ইথিওপিয়ান আর্মি অফিসারের সঙ্গে পরিচয় করিতে দিল বোরিস। ইনি কর্নেল টুমা নগু, সাউদার্ন গোজাম এলাকার মিলিটারি কমান্ডার।

কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

কর্নেল কঠিন সুরে বলল, আপনার পাসপোর্ট আর ফায়ার আর্মসের লাইসেন্স দেখান। তার চেহারা থমথম করছে। পাশে বসা জ্যাক হেলমের চোখে নগ্ন উল্লাস, নিভে যাওয়া চুরুট চিবাচ্ছে।

নিজের তাঁবু থেকে কাগজপত্র নিয়ে এলো নিকোলাস। টেবিলের উপর সেগুলো মেলে ধরে বলল, আমি জানি, ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারির দেওয়া আমার পরিচয় পত্রটাও দেখতে চাইবেন আপনি। আর এটা হলো আদ্দিসআবাবা থেকে দেওয়া ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডরের প্রশংসাপত্র। আর এ যে, এটা দেখছেন, লন্ডনে ইথিওপিয়ার অ্যামব্যাসাডর ভদ্রলোক দিয়েছেন। আরেকটা, এটাই শেষ দিয়েছেন আপনাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জেনারেল সাইয়ি আব্রাহা।

অলঙ্কৃত অফিশিয়াল লেটারহেড আর সরকারি সীল ছাপ্পড়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে কর্নেল নগু। সোনালি ফ্রেমের চশমার ভেতর তার চোখ দুটোয় প্রায় বিহ্বল দৃষ্টি। স্যার! লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লো সে, কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে স্যালুট করলো। আপনি আগে বলেন নি কেন? জেনারেল আব্রাহার বন্ধু আপনি? জানতাম না, আমি জানতাম না! কেউ আমাকে বলে নি। বিরক্ত করার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত, স্যার!

আবার স্যালুট করলো সে, বিব্রত বোধ করায় আনাড়ি ও আড়ষ্ট লাগছে তাকে। আমি শুধু আপনাকে বলতে এসেছিলাম যে পেগাসাস কোম্পানি এলাকায় ড্রিলিং ও ব্লাস্টিং অপারেশন চালাচ্ছে। বিপদ ঘটতে পারে। প্লিজ সাবধান থাকবেন। তাছাড়া, এলাকায় অসংখ্য ডাকাত আর শুফতা আছে, সেদিক থেকেও সাবধান থাকতে হবে আপনাকে। উত্তেজনায় হাঁপিয়ে গেছে সে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, পেগাসাস কোম্পানিয় এমপ্লয়ীদের জন্য এসকর্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি এখানে আমরা। যে কোনো রকম বিপদে আমাকে শুধু একটা খবর দিলেই হবে, আপনার সাহায্যে হাজির হয়ে যাব আমরা।

ধন্যবাদ, কর্নেল।

আপনাকে আর বিরক্ত করব না, স্যার। তৃতীয়বার স্যালুট করে পেগাসাস ট্রাকের দিকে পিছু হটছে কর্নেল, টেক্সান ফোরম্যানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। জ্যাক হেলম্ এ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি, কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েই চলে যাচ্ছে সে। ট্রাক চলতে শুরু করার পর ক্যাব জানালো থেকে চতুর্থ ও শেষ স্যালুটটা করলো কর্নেল নগু।

স্যালুটের উত্তরে অলসভঙ্গিতে একবার হাত নাড়লো নিকোলাস, রোয়েনকে বলল, সব মিলিয়ে বোঝা গেল, মি. পেগাসাস চান না এদিকে আমরা থাকি। সন্দেহ করছি শিগগির আবার তিনি সার্ভিস দিতে আসবেন।

ডাইনিং টেবিলের কাছে ফিরে এসে বোরিসকে নিকোলাস বলল, এখন শুধু আপনার খচ্চরগুলো এলেই হয়।

গ্রামে লোক পাঠিয়েছি। এসে পড়বে।

*

খচ্চরগুলো পৌঁছল পরদিন সকালে। ছয়টা শক্ত-সমর্থ জানোয়ার, প্রতিটির সঙ্গে খাকি শর্টস আর সাদা হাফশার্ট পরা একজন করে চালক। সকাল দশটার মধ্যে ওগুলোর পিঠে মালপত্র চাপিয়ে খাদে নামার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললো ওরা। পথের শেষ মাথায় থামলো বোরিস, গলা লম্বা করে ঢালের দিকে তাকালো। তার মতো লোককেও অন্তত এ একবার খাদের সীমাহীন পতন ও দূরতিগম্য বিভীষিকা সন্ত্রস্ত ও নার্ভাস করে তুললাম।

আপনারা ভিন্ন এক জগতের ভিন্ন এক সময়ের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছেন, প্রায় দার্শনিক ভঙ্গিতে বলল সে। ওরা বলে, ট্রেইলটা দু হাজার বছরের পুরানো, যিশুর বয়েসি। ডেবরা মারিয়াম গির্জার কালো পুরোহিত গল্প শোনায়, যিশু ক্রুশবিদ্ধ হবার পর ইসরায়েল থেকে পালাবার সময় ভার্জিন মেরী এ পথ ধরেই গিয়েছিলেন। মাথা নাড়লো সে। তবে কথা হলো, এখানকার লোকেরা সত্যি-মিথ্যে সবই বিশ্বাস করে। ট্রেইলে পা ফেললো সে।

পাহাড়-প্রাচীরকে জড়িয়ে আছে ওটা, নেমে গেছে এমন তির্যক ভঙ্গিতে, আর পাথরের ধাপগুলো পরস্পরের কাছ থেকে এতো দূরে, যে প্রতিটি পদক্ষেপে হাঁটু ও পেটের শিরা, পেশী ও চামড়ায় প্রবল চাপ পড়ে, ঝাঁকি খায় শিরদাঁড়া। ট্রেইলের পতন আরো বেশি খাড়া ও কর্কশ যেখানে, পাথর ধরে ঝুলে পড়তে হলো ওদেরকে, কিংবা ক্রল করে এগুতে হলো।

দেখে মনে হলো অসম্ভব ব্যাপার, ভারী বোঝা নিয়ে খচ্চরগুলো ওদেরকে অনুসরণ করতে পারবে না। ওগুলো যে কিরকম সাহসী, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। পাথরের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে লাফ দিল, পড়ার পর সামনেই দুই পা ভাঁজ হয়ে গেল, পেশী শক্ত করে তৈরি হলো পরবর্তী ধাপে লাফ দেওয়ার জন্য। ট্রেইলটা এতো সরু যে পেটমোটা বোঝা একদিকের পাথরের পাচিলে ঘষা খাচ্ছে, অপরদিকের সীমাহীন অধোগতি ফাঁক লোভীর মতো হাঁ করে আছে।

ট্রেইল যখন বেঁকে গেছে, খচ্চরগুলো লাফ দিয়ে বাক নিতে পারছে না বা একবারের চেষ্টায় এগুতে পারছে না। পিছিয়ে এসে ট্রেইলটা স্পর্শ দিয়ে অনুভব করতে হচ্ছে, পাঁচিলে গা ঘসে থেমে থেমে প্রতি বার একটু একটু করে এগুচ্ছে, ঘন ঘন দেখে নিচ্ছে খাদের কিনারা, আতঙ্কে ঘুরে গিয়ে বেরিয়ে আসছে চোখের সাদা অংশ। কর্কশ হুঙ্কার ছেড়ে, ওগুলোর গায়ে চাবুক মারছে চালকরা।

কোথাও কোথাও ট্রেইলটা পাহাড়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কয়েকবার ভেতরে ঢোকা অসম্ভব মনে হলো, সরু প্রবেশমুখের দু পাশে সূচের মতো ধারালো হয়ে আছে পাথর। কোথাও আবার মুখটা এততাই সরু যে বোঝাসহ খচ্চর ভেতরে ঢুকতে পারবে না। অগত্যা পিঠ থেকে সব নামাতে হলো, খানিক দূর এগিয়ে তুলতে হবে আবার।

দেখুন! অবাক বিস্ময়ে চিৎকার দিল রোয়েন, হাত তুলে ফাঁকা দিকটা দেখালো। যাদের গভীরতা থেকে বিশাল ডানা মেলে উঠে এলো কালো একটা শকুন, ভেসে গেল প্রায় ওদের দুই হাত দূর দিয়ে, লালচে নগ্ন মাথা ঘুরিয়ে কালো চোখে তাকালো ওদের দিকে।

পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে জড়িয়ে থাকা ট্র্যাক ধরে সারাদিন এগুলো ওরা, বিকেল শেষ হয়ে আসছে অথচ এখনো অর্ধেক দূরত্বও পেরোয় নি। আরো একবার পুরোপুরি উল্টোদিকে ঘুরে গেল ট্রেইল, সামনে থেকে ভেসে এলো জলপ্রপাতের গর্জন। প্রকাণ্ড একটা ঝুল-পাথরের দিকে এগুচ্ছে ওরা, আওয়াজটা সেই সঙ্গে বাড়ছে। কোণ ঘুরে ওটাকে পেরিয়ে আসতেই বিপুল জলরাশির পতন পুরোপুরি দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এলো।

প্রবল বর্ষণে ঝড়ের মতো গতি পেয়ে গেছে বাতাস, মনে হলো ওদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, পাহাড়-প্রাচীরের গর্তের কিনারা আঁকড়ে ধরে কোনো রকমে ঝুলে থাকতে হলো। ওদের চারদিকে রাশি রাশি জলকণা বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে উঁচু করা মুখ, কিন্তু ইথিওপিয়ান গাইড থামার সুযোগ না দিয়ে সোজা এগিয়ে নিয়ে চলল। এক সময় মনে হলো বর্ষণের তোড়ে উপত্যকায় ভেসে যাবে ওরা, এখনো কয়েকশো ফুট নিচে সেটা।

তারপর, যেনো মন্ত্রবলে, ভাগ হয়ে গেল বিপুল জলরাশি, স্বচ্ছ নিবিড় পতনশীল পর্দার পেছনে পা ফেলে ঢুকে পড়লো শ্যাওলা ঢাকা ও ভেজা চকচকে পাথরের গভীর ফোকরে হাজার বছর ধরে পানির তোড়ে পাহাড়-প্রাচীর ক্ষয়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে। গাঢ় ছায়াময় এ জায়গায় আলো আসছে শুধু জলপ্রপাত ভেদ করে, তার রঙ সবুজাভ, ফলে গা ছমছমে রহস্যময় একটা আবহ তৈরি হয়েছে, ওরা যেনো সাগরের তলায় একটা গুহার ভেতর রয়েছে।

আজ রাতে এখানে আমরা ঘুমাব, জানালো বোরিস, ওদের বিস্ময় উপভোগ করছে সে। গুহার পেছনে জ্বালানি কাঠের বান্ডিলগুলো ইঙ্গিতে দেখালো, পাশেই পাথরের তৈরি ফায়ারপ্লেস, উপরের দেয়াল ধোয়া লেগে কালো হয়ে আছে। খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে মঠ সন্ন্যাসীদের জন্য খাবার নিয়ে যায় গ্রামবাসীরা, এ জায়গা তারা কয়েকশো বছর ধরে ব্যবহার করছে।

গুহার আরো ভেতরে চলে আসায় জলপ্রপাতের শব্দ ক্রমশ ভোঁতা হয়ে এলো, পায়ের নিচে এখন শুকনো পাথর। চাকররা আগুন জ্বালার পর রোমান্টিক যদি না-ও হয়, আরামদায়ক আশ্রয় হয়ে উঠলো জায়গাটা। এক কোণে স্লিপিং ব্যাগের ভাঁজ খুলল নিকোলাস, স্বভাতই ওর পাশে রোয়েনও। দু জনেই খুব ক্লান্ত, স্লিপিং ব্যাগের ভেতর লম্বা হয়ে পেশীতে ঢিল দেওয়ার চেষ্টা করলো, গুহার ছাদে লাল-গোলাপি প্রতিফলন দেখছে।

ভাবুন একবার! ফিসফিস করলো রোয়েন। কাল আমরা স্বয়ং টাইটার পায়ের ছাপে পা ফেলব।

ভার্জিন মেরীর কথা না হয় বাদই দিলাম। হাসলো নিকোলাস।

আপনি অসহ্যরকম বিশ্বনিন্দুক, দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোয়েন। আমার আরো ধারণা, আপনার নাক ডাকে।

আজ রাতেই সেই ফয়সালা হয়ে যাবে! কিন্তু পথের ক্লান্তিজনিত কারণে আগেই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন, নাক-ডাকার শব্দ শোনা হলো না। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস হালকা, প্রবাহমান পানির শব্দ ছাপিয়ে সামান্যই শোনা যায়। কতোকাল আগে একজন রূপসী নারীকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল নিকোলাস! রোয়েন ঘুমিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহ হওয়ার পর ঝুঁকে পরে ওর গাল ছুঁলো সে।

শুভরাত্রী, ছোট্ট সোনা, ফিসফিস স্বরে বলল নিক। খুব ধকল গেল আজ। নিজের ছোট্ট মেযেটাকে এমন বলেই ঘুম পাড়াতো ও।

*

ভোর হওয়ার আগেই নড়াচড়া শুরু করলো খচ্চর চালকরা। পায়ের সামনেটা দেখা যায়, এরকম আলো ফুটতেই আবার ওরা রওয়ানা হলো। পাহাড়-প্রাচীরের উপরের অংশে সকালের প্রথম রোদ লাগলো যখন, তখনও ওরা উপত্যকার মেঝে থেকে এতো উঁচুতে রয়েছে যে নিচের গোটা এলাকার উপর চোখ বুলানো সম্ভব হলো।

রোয়েনকে কাছে টেনে নিল নিকোলাস, বাকি ক্যারাভানকে থাকতে দিল ওদের সামনে। বসার একটা জায়গা খুঁজে নিচে প্যাচানো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ খুলল ও। নিচের দৃশ্য থেকে প্রধান প্রধান চূড়া আর বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করলো ওরা, ফলে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল কোথায় ওরা রয়েছে। এখান থেকে অ্যাবে নদী আমরা দেখতে পাব না, বলল নিকোলাস। সেটা এখনো উপ-খাদের গভীরে লুকিয়ে আছে। দেখতে পাব সম্ভবত সরাসির ওটার উপরে পৌঁছবার পর।

যেখানে আছি বলে হিসাব করলাম তাতে যদি ভুল না হয়, একজোড়া হাঁসুলিবাঁক ঘোরার পরই নদীটা দেখতে পাবার কথা–সম্ভবত ওই খাড়া পাঁচিলটার ওদিকেই বাক দুটো পাওয়া যাবে।

বোধহয়, সায় দিল নিকোলাস। আর ডানডেরা নদী অ্যাবের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ওদিকের ওই পাঁচিলগুলোর নিচে। বুড়ো আঙুলের গিঁট ব্যবহার করলো আনুমানিক দূরত্ব মাপার জন্য। এখান থেকে প্রায় পনেরো মাইল।

দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছরের মধ্যে কয়েকবারই গতিপথ বদল করেছে ডানডেরা। আমি অন্তত দুটো নালার আভাস পাচ্ছি, দেখতে প্রাচীন রিভার বেডের মতো। হাত তুলে দেখালো রোয়েন। ওখানে, আর ওদিকে। এখন অবশ্য জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। নিচে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দম আটকাল ও। কি বিশাল এলাকা! আর কি জটিল! এ দুর্গম পাথরের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সমাধির প্রবেশপথ কীভাবে খুঁজে পাব আমরা?

সমাধি? কোন সমাধির কথা বলা হচ্ছে? পেছন থেকে সাগ্রহে জানতে চাইলো বোরিস। ওদের খোঁজে ট্রেইল ধরে পিছিয়ে এসেছে সে। তার পায়ের আওয়াজ ওরা শুনতে পায়নি। কি, চুপ হয়ে গেলেন কেন? কার সমাধি খুঁজছেন আপনারা?

কার আবার, নিরুদ্বিগ্ন নিকোলাসের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলো, সেন্ট ফুমেনটিয়াসের সমাধি।

মঠটা না সেন্টের নামে উৎসর্গিত? ফটোগ্রাফ পেঁচিয়ে রাখার সময় বোরিসের দিকে ফিরে রোয়েনও হাসলো।

হ্যাঁ। হতাশ দেখালো বোরিসকে, যেনো আরো ইন্টারেস্টিং কিছু শুনবে বলে আশা করেছিল। হ্যাঁ, সেন্ট ফুমেনটিয়াস। তবে ওরা আপনাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। সন্ন্যাসীরা ছাড়া ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই কারো। ক্যাপ নামিয়ে মাথা চুলকাল সে, তার চুল তারের মতো, সুখের ঘষায় প্রায় ধাতব শব্দ উঠছে। এ সপ্তায় তিমকাত উৎসব হবে। আনন্দ-উত্তেজনার বন্যা বয়ে যাবে ওখানে। বাইরে থেকে দেখে মজা পেতে হবে, ভেতরে ঢুকতে পারবেন না।

চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকালো সে। চলুন যাওয়া যাক। দেখে মনে হচ্ছে কাছে, কিন্তু অ্যাবেতে পৌঁছতে আরো দুদিন লেগে যাবে আমাদের। নিচে আরো কঠিন পথ, এমন কি ডিক-ডিক শিকারীর জন্যও। নিজের কৌতুকে হেসে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো সে, ট্রেইল ধরে এগুলো।

পাহাড়-প্রাচীরের যতই নিচে নামছে ওরা ট্রেইল ততই মসৃণ হয়ে উঠছে, ধাপগুলো আগের চেয়ে অগভীর, পরস্পরের সঙ্গে দূরত্বও বাড়ছে। সহজে এগোেননা যাচ্ছে, তাই গতিও বেড়ে গেল। তবে বাতাসের মান ও স্বাদ বদলে গেছে। পাহাড়ী ঠান্ডা বাতাস উধাও হয়েছে, তার বদলে স্থান দখল করেছে শক্তিহীন নিস্তেজ বাতাস, তাতে সীমা না মানা জঙ্গলের স্বাদ ও গন্ধ লেগে আছে।

গরম! বলে উলেন শালটা গা থেকে খুলে ফেললো রোয়েন।

দশ ডিগ্রী বেশি, আন্দাজ করলো নিকোলাস। পুরানো আর্মি জার্সিটা মাথা গলিয়ে খুলে আনল, এলোমেলো হয়ে থাকলো এক রাশ কালো চুল নিচে আরো গরম লাগবে। অ্যাবেতে পৌঁছবার আগে আরো তিন হাজার ফুট নামতে হবে।

এরপর বেশ খানিকদূর ডানডেরা নদী ঘেঁষে এগিয়েছে ট্রেইল। মাঝে মধ্যে দেখা গেল নদীটা থেকে কয়েক শ ফুট উপরে রয়েছে ওরা, আবার খানিক পরই নেমে আসতে হলো কোমর সমান পানিতে, তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ভয়ে খচ্চরের পিঠে চাপানো বোঝা আঁকড়ে ধরে আছে।

তারপর ডানডেরা নদী খাদ এতো গভীর আর খাড়া হয়ে উঠলো যে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, পাহাড়-প্রাচীর সটান দাঁড়িয়ে আছে পানির উপর। কাজেই নদী ছেড়ে আঁকাবাঁকা ট্র্যাক ধরল ওরা, ভাঙাচোরা পাহাড় আর লাল পাথুরের ব্লাফের মাঝখান দিয়ে এগিয়েছে।

ভাটির দিকে এক কি দু মাইল এগোবার পর আবার ওরা অন্য এক মেজাজের ডানডোরার সঙ্গে মিলিত হলো, নদী এখানে ঘন ও নিবিড় বনভূমির ভেতর দিয়ে কলকল শব্দে ছুটে চলেছে। লতানো গাছের ডগা পানি ছুঁয়ে আছে, ওদের মাথায় গাছের শ্যাওলা লেগে গেল। ওদেরকে দেখে ডালে ডালে খুব লাফালাফি আর চেঁচামেচি করছে কয়েক ঝক বাঁদর। একবার নিচের ঝোঁপ ভেঙেচুরে ছুটল বড় আকৃতির একটা জানোয়ার। ঝট করে বোরিসের দিকে তাকালো নিকোলাস।

মাথা নাড়লো রুশ গাইড, হাসছে। না, ডিক-ডিক নয়। কুডু।

সারাটা দিন আঁকাবাঁকা ট্রেইল ধরে এগুলো ওরা, শেষ বিকেলে ক্যাম্প ফেললো নদীর খানিকটা উপরে, ফাঁকা একটা জায়গায়। এখানে আগেও অনেকবার ক্যাম্প ফেলা হয়েছে, লক্ষণ দেখে বোঝা গেল। ট্রেইল যেনো এখানে দুই সময়শাসিত পর্যায়ে বিরক্ত–জলপ্রপাতের মাথা থেকে মঠে নামতে ট্যুরিস্টদের পুরো তিন দিন লাগে, সবাই তারা এ একই জায়গায় ক্যাম্প ফেলে।

দুঃখিত, এখানে কোনো শাওয়ার নেই, মক্কেলদের জানালো বোরিস। হাত মুখ ধুতে চাইলে উজানের দিকে প্রথম বাঁক ঘুরলে নিরাপদ একটা পুল আছে।

রোয়েনের চোখে আবেদন, নিকোলাস, ঘামে একদম ভিজে গেছি। এমন কোথাও পাহারা দেবেন, ডাকলে যাতে শুনতে পান?

বাঁকটার ঠিক নিচেই শ্যাওলা ঢাকা তীরে শুয়ে থাকলো নিকোলাস; কাছাকাছি, তবে দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে ভেসে আসা রোয়েনের পানি ছিটানো আর মৃদু হাসির শব্দ শুনছে। একবার মাথা ঘোরাবার পর উপলব্ধি করলো স্রোত নিশ্চয়ই রোয়েনকে ভাটির দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। কারণ, গাছপালার ফাঁকে এক পলকের জন্য নগ্ন পিঠ দেখা গেল, তারপর নিতম্বের ভাঁজ–মাখনের মতো, ভেজা ও চকচকে। অপরাধবোধ জাগায় তাড়াতাড়ি চোখ ফেরালো নিকোলাস।

খানিক পর ভাটির দিকে থেকে তীর ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেল রোয়েনকে, কোমল সুরে গুন গুন করছে, চুলের পানি মুছছে তোয়ালে দিয়ে। আপনার পালা, নিকোলাস। যান আমি পাহারায় থাকি?

আমি এখন বড় হয়েছি। মাথা নাড়লো নিকোলাস, তবে রোয়েন পাশ কাটানোর সময় তার চোখে রক্তিম লজ্জা আর সেই সঙ্গে কৌতুকের ক্ষীণ ঝিলিক দেখতে পেল। হঠাৎ নিকোলাস ভাবল, রোয়েন কি জানে স্রোতের টানে কতটা ভাটির দিকে চলে এসেছিল সে, তার কতটুকু দেখে ফেলেছে ও? চিন্তাটা রোমাঞ্চিত করে তুললাম ওকে।

গোসল করার জন্য উজানে চলে এলো নিকোলাস। কাপড় খোলার সময় উপলব্ধি করলো রোয়েন ওকে কতটা উত্তেজিত করে তুলেছে। একটু যেনো অপরাধবোধের খোঁচা লাগলো–রোসেলিনের পর আর কোনো নারী ওকে জাগিয়ে তুলে নি এমন করে।

ঠাণ্ডা পানি উপকারে আসবে, বিড়বিড় করলো ও, তারপর ডাইভ দিল নদীতে।

*

সন্ধ্যার পরপরই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে আছে ওরা হঠাৎ মুখ তুলে কান পাতলো নিকোলাস। কিসের একটা আওয়াজ হচ্ছে না?

ঠিক ধরেছেন, হেসে উঠে বলল টিসে। আপনি গান শুনতে পাচ্ছেন। আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে মঠের পুরোহিতরা আসছেন।

ঠিক তখনই আগুনের লাল শিখা দেখতে পেল ওরা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে উঠে আসছে মশালমিছিল, গাছপালার ভেতর দিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসায় মিটমিট করছে আলোগুলো। খচ্চর চালক আর চাকর-বাকরেরা ভিড় করে সামনে বাড়লো, ছন্দোবদ্ধ গানের সঙ্গে তালি দিচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে সম্মানিয় মঠ প্রতিনিধিদের।

ভারি ও গভীর পুরুষকণ্ঠ ক্রমশ চড়ছে, তারপর আবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অস্পষ্ট ফিসফিসানি, তবে বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই আবার চড়ছে, এভাবে বারবার। গানের কথাগুলো বোঝা গেল না, তবে সম্মিলিত কণ্ঠের প্রলম্বিত সুর হৃদয়কে দোলা দিয়ে যায়, আপনা থেকে ভক্তির একটা ভাব চলে আসে মনে। নিকোলাসের শরীর শিরশির করে উঠলো, হিম রোমাঞ্চ নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে।

তারপর দেখা গেল পুরোহিতদের সাদা আলখেল্লা, মশালের আলোয় দেওয়ালি পোকার মতো লাগছে, উঠে আসছে ট্রেইল ধরে। ক্যাম্পের সামনে খোলা জায়গায় সাধুদের দেখামাত্র ক্যাম্প সার্ভেন্টরা জমিনে হাঁটু গাড়ল। সামনের সারিতে রয়েছে অধস্তন তরুণ উপাসকরা, খালি পায়ে, খালি মাথায়। তাদের পিছু নিয়ে এলেন। সন্ন্যাসীরা, পরনে দীর্ঘ আলখেল্লা ও লম্বা পাগড়ি। কয়েক সারিতে এলেন তারা, তবে দু পাশে সরে গিয়ে পেছনটা ফাঁক করে দিলেন। সন্ন্যাসীরা আসলে এ মুহূর্তে মর্যাদাপূর্ণ প্রহরীর ভূমিকা পালন করছেন, তাঁদের ঠিক পেছনেই রয়েছেন নকশাদার আলখেল্লা ও অলঙ্কার পরিহিত যাজক বা পুরোহিতরা।

তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে ভারী কপটিক ক্রস, বসানো হয়েছে। রূপোয় মোড়া একটা দণ্ডের মাথায়। পুরোহিতদের সারিটাও দু পাশে সরে গেল আবেগমথিত সুরে এখনো তারা গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করছেন, সরে গিয়ে চাঁদোয়া ঢাকা.পালকিটাকে সামনে এগোবার পথ করে দিলেন। চারজন তরুণ উপাসক বয়ে নিয়ে এলো সেটা; নামিয়ে রাখলো ক্যাম্পের ঠিক মাঝখানে। মশাল ও ক্যাম্প লণ্ঠনের আলোয় লাল আর হলুদ সিল্ক পর্দা ঝলমল করছে।

মোহন্তকে অভ্যর্থনা জানাতে সামনে এগুতে হবে, ফিসফিস করলো বোরিস। তাঁর নাম জালি হোরা। পালকির কাছাকাছি চলে এসেছ ওরা নাটকীয় ভঙ্গিতে। পর্দা সরিয়ে দীর্ঘকার এক ব্যক্তি মাটিতে পা রাখলেন।

রোয়েন ও টিসে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে জমিনে হাঁটু গাড়ল, হাতজোড়া করলো বুকে। তবে নিকোলাস ও বোরিস নড়ল না। নিকোলাস বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মোহন্ত বা প্রধান পুরোহিতের দিকে।

জালি হোরা কঙ্কাল বললেই হয়। তার আলখেল্লা ঢোলা হলেও তেমন লম্বা নয়, হাঁটুর নিচে পা, পাগড়ির মতো সুরু ও কালো, মোচড় খাওয়া পেশি ফুলে আছে, হাড়ের উপর ফুটে আছে আকা-বাঁকা শিরা। আলখেল্লাটা সবুজ ও সোনালি, তার উপর সোনার তৈরি সুতো দিয়ে নকশা করা হয়েছে, চকচক করছে আগুনের আভায়। মাথায় লম্বা হ্যাঁ, চূড়াটা সমতল, গায়ে এমব্রয়ডারি করা নক্ষত্র ও ক্রস চিহ্ন।

মোহন্তের মুখ গাছের শুকনো শিকড়ের সমষ্টি বলে মনে হবে, অসংখ্য ভাঁজ আর বালরেখা কলের ছাপ ফেলেছে। কুঞ্চিত ও ফাটা ঠোঁটের ভেতর এখনো কয়েকটা দাঁত অবশিষ্ট আছে, প্রত্যেকটি ভাঙাচোরা ও হলুদ। রূপালি-সাদা দাড়ি, চোয়ালে যেনো সাগর তীরের ফেনা জমে আছে। একটা চোখ পিকাল অপথ্যালমিয়ায় আক্রান্ত, অস্বচ্ছ নীল, সম্ভবত কিছুই দেখতে পান না; তবে অপর চোখ শিকারী চিতার মতোই তীক্ষ্ণ ও চকচকে।

চড়া, কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বললেন তিনি। আশীর্বাদ দিই; বাছাদের মঙ্গল হোক! কনুই দিয়ে নিকোলাসকে পুঁতো মারল বোরিস, দু জনেই ওরা সামান্য মাথা নত করলো। প্রধান পুরোহিত সুর করে গান করছেন বা মন্ত্র আওড়াচ্ছেন, তিনি থামলেই কোরাস ধরছে সমবেত পুরোহিতরা।

আশীর্বাদ পর্ব শেষ হতে এক একে চারদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাতাসে ক্রসচিহ্ন আঁকলেন মোহন্ত, এ সময় চারজন কিশোর চারটে রূপোর ধূপদানি ঘোরাতে শুরু করলো দ্রুতবেগে, সবগুলো থেকে ধূপ-ধুনার ধোঁয়া বের হচ্ছে।

এরপর মেয়ে দু জন মোহন্তের সামনে এসে হাঁটু গাড়ল। ওদের দিকে ঝুঁকলেন তিনি, রূপোর ক্রস দিয়ে হালকা ভাবে প্রত্যেকের গাল স্পর্শ করলেন সুর করে আওড়ালেন বিশেষ আশীর্বাদ।

ফিসফিস করলো বোরিস, লোকে বলে এঁর বয়েস একশো দশ বা তারও বেশি।

সাদা আলখেল্লা পরা দু জন তরুণ উপাসক আফ্রিকান কালো আবলুস কাঠের তৈরি একটা টুল বয়ে নিয়ে এলো, ডিজাইনটা এতো সুন্দর যে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস। ধারণা করলো, সম্ভবত কয়েক শতাব্দী ধরে মঠপ্রধানরা ওটা ব্যবহার করছেন। উপাসক দু জন জালি হোরার কনুই ধরল, ধীরে ধীরে যত্নের সঙ্গে বসিয়ে দিল তাঁকে টুলের উপর। এরপর পুরোহিতবৃন্দ ও সাধু সন্ন্যাসীরা ঘিরে বসলো তাকে, তাদের কালো মুখ তার দিকে উঁচু হয়ে আছে।

তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে টিসে, স্বামীর কথা ইথিওপিয়ার অফিশিয়াল ভাষা অ্যামহারিক-এ অনুবাদ করছে। আপনাকে আবার অভ্যর্থনা জানাবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি, হোলি ফাদার।

বৃদ্ধ প্রধান পুরোহিত মাথা ঝাঁকালেন। বোরিস আবার বলল, আমি বিশিষ্ট এক ভদ্রলোককে সেন্ট ফুমেনটিয়াস ভিজিট করাবার জন্য নিয়ে এসেছি। উনি আপনাকে, সন্তুষ্ট করবেন।

এ কি! প্রতিবাদ করলো নিকোলাস, কিন্তু দেখা গেল সাধু-সন্ন্যাসী আর পুরোহিতবৃন্দ প্রত্যাশায় চকচকে চোখ নিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অগত্যা বাধ্য হয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করতে হলো, এখন কী করতে হবে আমাকে?

বুঝতে পারছেন না, এতোটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কেন এসেছেন উনি? শয়তানি হাসি ফুটল বোরিসের ঠোঁটে, সে-ও ফিসফিস করছে উপহার চান! টাকা!

মারিয়া থেরেসা ডলার? জানতে চাইলো নিকোলাস, ইথিওপিয়ার এ মুদ্রা কয়েক শতাব্দী ধরে চলছে।

তা না হলেও ক্ষতি নেই। সময় বদলেছে, জালি হোরাকে এখন মার্কিন ডলার বা ব্রিটিশ পাউন্ড দিয়েও সন্তুষ্ট করা যায়।

কত?

আপনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তাঁর উপত্যকায় শিকার করবেন। কমপক্ষে পাঁচশো ডলার।

ব্যাগ আছে খচ্চরের পিঠে, উঠে গিয়ে সেখান থেকে টাকা নিয়ে আসতে হলো নিকোলাসকে। ইতোমধ্যে হাত পেতেছেন পুরোহিতপ্রধান, তাতে নোটগুলো ধরিয়ে দিল ও।

হাসলেন মোহন্ত, ভাঙা ও হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়লো। তারপর তিনি কথা বললেন। অনুবাদ করলো টিসে, সেন্ট ফুমেনটিয়াস ও তিমকাত উৎসবে স্বাগতম। অ্যাবের তীরে আপনার শিকার অভিযান সফর হোক।

সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য খসে পড়লো। নড়েচড়ে বসলো সবাই, হাসাহাসি শুরু করলো। মোহন্ত বোরিসের দিকে তাকালেন, দৃষ্টিতে প্রত্যাশা। তাঁর কথা ভাষান্তর করলো টিসে, প্রধান পুরোহিত বলছেন, এতোটা পথ আসতে তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে।

বুড়ো শয়তান ব্র্যান্ডি খেতে চাইছেন! হাসছে বোরিস হাঁক ছেড়ে ক্যাম্পবাটলারকে ডাকলো। একটু পরই ব্র্যান্ডির একটা বোতল মোহন্তের সামনে ক্যাম্প টেবিলে রাখা হলো, তার পাশেই থাকলো বোরিসের ভদকা। পরস্পরের স্বাস্থ্যপান করলো তারা। ব্র্যান্ডিতে কিছু মেশালেন না মোহন্ত, ঢোক গেলার পর সুস্থ চোখটা থেকে পানি বেরিয়ে এলো। বোতলটা অর্ধেক খালি করার পর খসখসে গলায় একটা প্রশ্ন করলেন, রোয়েনের দিকে তাকিয়ে।

টিসে বলল, ওইজিরো রোয়েন, উনি আপনাকে জিজ্ঞেস করছেন, ও আমার কন্যা, কে তুমি, কোত্থেকে এলে? মানবজাতির ত্রাণকর্তা যিশুর পথে কে তোমাকে নিয়ে এলো?

আমি একজন মিশরীয়, প্রাচীন ধর্মে বিশ্বাসী, জবাব দিল রোয়েন।

মাথা ঝাঁকাল মোহন্ত, পুরোহিতরাও সবাই প্রশংসাসূচক হাসি দিল। খ্রিস্টধর্মে সবাই আমরা ভাই-বোন, মিশরীয় ও ইথিওপিয়ানরা, মোহন্ত ওকে বললেন। এমন কি কপটিক শব্দটাও গ্রিক ভাষায় মিশরী। ষোলোশো বছরেরও বেশি দিন ধরে কায়রোর প্রধান গির্জার পুরোহিত ইথিওপিয়ার বিশপকে নিয়োগ দান করেছেন। ১৯৬০ ষালে সম্রাট হাইলে সেলাসি নিয়মটা বাতিল করেন। তবু আমরা সবাই যিশুর সত্যিকার পথ অনুসরণ করব। আপনাকে স্বাগতম, প্রিয় কন্যা।

ব্র্যান্ডির বোতল দ্রুত খালি হয়ে গেল। ইঙ্গিতে সেটা বোরিসকে দেখালেন মোহন্ত। বোরিস ইংরেজিতে বলল, শালার ব্যাটা এতো জায়গা পাচ্ছে কোথায় যে শুধু ঢেলেই চলেছে?

তার এ কথাও অনুবাদ করতে যাচ্ছিল টিসে, হঠাৎ খেয়াল হতে মাথাটা নিচু করে নিল সে। তারপর নিকোলাসের দিকে মুখ তুলে বলল, মোহন্ত জানতে চাইছেন, উপত্যকায় কি শিকার করতে চাইছেন আপনি?

নিজেকে শক্ত করলো নিকোলাস, তারপর জবাব দিল সাবধানে। অবিশ্বাসে দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন প্রধান যাজক, খলখল করে হেসে উঠলেন তিনি। দেখাদেখি বাকি সবাইও হাসতে শুরু করলো। ডিক-ডিক? আপনি ডিক-ডিক শিকার করতে এসেছেন? কিন্তু তাহলে মাংস পাবেন কোত্থেকে?

পাহাড় চূড়ায় দাঁড়ানো ডোরাকাটা ডিক-ডিকের একটা ফটো নিয়ে এসে তাঁর সামনে শ্যাম্প টেবিলের উপর রাখলো নিকোলাস। এটা সাধারণ কোনো ডিক-ডিক নয়। এটা একটা পবিত্র ডিক-ডিক। ইঙ্গিতে টিসেকে অনুবাদ করতে বলল ও। গল্পটা বলছি আমি।

ভালো একটা গল্প শোনার আশায় চুপ হয়ে গেল সবাই, এমন কি মোহস্তের হাতের গ্লাসও মাঝপথে থেমে গেছে। ওটা তিনি দ্বিতীয় বোতল থেকে ভরেছেন।

জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট খাদ্যের অভাবে মরুভূমিতে মারা যাচ্ছেন, শুরু করলো নিকোলাস। ত্রিশটা দিন ও ত্রিশটা রাত পেরিয়ে গেছে, এককণা খাবারও জোটেনি তাঁর। সেইন্টের নাম শুনে বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকল কয়েকজন পুরোহিত। শেষে প্রভু তার ভৃত্যের প্রতি সদয় হলেন, ছোট একটা হরিণ আটকে দিলেন অ্যাকেইশা গাছের ডালে ও কাটায়। তারপর সেইন্টকে তিনি বললেন, তোমার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছি, কাজেই তুমি মরবে না। এ মাংস নিয়ে খাও তুমি। জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট যখন ছোট্ট প্রাণীটিকে স্পর্শ করলেন, ওটার পিঠে তার আঙুলের ছাপ পড়ে গেল চিরকালের জন্য।

সবাই চুপ। এতোই প্রভাবিত হয়েছে যে চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছে।

ফটোটা আরেকবার প্রধান পুরোহিতকে দেখালো নিকোলাস। দেখুন, সেইন্টের আঙুলের ছাপ আছে।

ফটোটা সশ্রদ্ধভঙ্গিতে হাতে নিলেন জালি হোরা, ভালো চোখটার সামনে তুললেন। বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বিস্মিত গলায় বললেন, কথাটা সত্যি! সেইন্টের আঙুলের ছাপ পরিষ্কারই চেনা যায় ফটোটা তিনি পুরোহিতদের দেখার জন্য নিলেন। প্রত্যেকে দেখলেন, এবং প্রধান পুরোহিতের মন্তব্য পুনরাবৃত্তি করলেন।

আপনারা কেউ এ প্রাণীটিকে দেখেছেন কখনো? উত্তরে এক এক করে সবাই মাথা নাড়লেন। পুরোহিতদের দেখা শেষ, এখন সেটা তরুণ উপাসকরা দেখছে।

হঠাৎ তাদের একজন তড়াক করে সোজা হলো, ফটো হাতে লাফাচ্ছে আর উত্তেজনায় চিৎকার করছে। আমি দেখেছি, দেখেছি আমি! যিশুর ফিরে, পবিত্র এ প্রাণীরূপে দেখা দিয়েছে আমাকে! খুবই কম বয়েস তার, কিশোরই বলতে হবে।

বাকি সবাই নিন্দা করছে তার, কেউ বিশ্বাস করতে রাজি নয়।

মাথামোটা ছেলে, মাঝে মধ্যে শয়তান ভর করে, অভিমান সুরে বললেন জালি হোরা, দুঃখে কাতর দেখালো তাকে। ওর কথায় গুরুত্ব দেবেন না। বেচারা তামের!

ইতোমধ্যে তামেরের হাত থেকে ফটোটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উপাসকদের হাতে হাতে ঘুরছে সেটা, আর ফিরে পাবার জন্য ছুটাছুটি করছে সে। সবাই তার সঙ্গে কৌতুক করছে। কিন্তু তামের সাংঘাতিক উত্তেজিত, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। বাধা দেওয়ার জন্য এগুলো নিকোলাস, দুর্বলচিত্তের এক কিশোরকে নিয়ে এ খেলাটা নিষ্ঠুর মনে হলো ওর। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কিশোরের মনে কি ঘটল কে জানে, সটান পড়ে গেল সে জমিনের উপর, যেনো কেউ তার মাথায় মুগুরের বাড়ি মেরেছে। পিড়ানো ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেল, হাত-পা মোচড় ও ঝাঁকি খাচ্ছে, চোখের মণি উল্টে গিয়ে অদৃশ্য হলো খুলির ভেতর, শুধু সাদা অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামছে সাদা ফেনা।

তার কাছাকাছি নিকোলাস পৌঁছবার আগেই চারজন উপাসক চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল তাকে। রাতের অন্ধকারে তাদের হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল। বাকি সবার আচরণ দেখে মনে হলো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি। জালি হোরা ইঙ্গিতে একজন তরুণকে আবার গ্লাসটা ভরে দিতে বললেন।

বেশ দেরী করে বিদায় নিলেন জালি হোরা, কয়েকজনের সহায়তায়। অর্ধ সমাপ্ত ব্রান্ডির বোতলটা এক হাতে আঁকড়ে ধরে রাখলেন।

আপনার ওপর সে খুশি হয়েছে, ইংরেজ, বোরিস বলল। জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট এর গল্পটাতো বটেই, আপনার ডলার তার আরো বেশি পছন্দ!

 ৩. পরদিন সকালে আবার

পরদিন সকালে আবার যখন রওনা হলো ওরা, ট্রেইলটা বেশ কিছুদূর নদীর পাড় ঘেঁষে থাকলো। মাইলখানেক পর স্রোতের গতি খুব বেড়ে গেল, তারপর উঁচু ও লাল পাহাড়-প্রাচীরের মধ্যবর্তী সরু ফাঁকের ভেতর ঢুকে পড়লো, সেখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছে অর্থাৎ এখানে আরেকটা জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে।

বহুল ব্যবহৃত ট্রেইল ছেড়ে জলপ্রপাতের কিনারায় এসে দাঁড়ালো নিকোলাস। দুশো ফুট গভীরে পাথরের একটা ফাটলে তাকালো ও, আক্রোশে সংকুচিত ভয়াল প্রবাহকে কোনো রকমে গলে বেরিয়ে যেতে দেয়ার মতো চওড়া। ফাঁকটার ওপারে একটা পাথর ছুঁড়ে দিতে পারে নিকোলাস। নিচের ওই গহ্বরে কোনো পথ বা পা ফেলার জায়গা নেই। ফিরে এসে ক্যারাভ্যানের সঙ্গে যোগ দিল ও, ঘুরপথ ধরে নদীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওরা, ঢুকে পড়েছে আরেকটা গভীর জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকায়।

এটা বোধহয় এক সময় ডানডেরা নদীর কোর্স ছিল, ফাটলটার ভেতর নতুন পথ তৈরির আগে। পথের দু পাশে উঁচু জমিনের দিকে হাত তুললাম রোয়েন, তারপর ইঙ্গিতে ট্রেইলের উপর ছড়িয়ে থাকা মসৃণ বোল্ডারগুলো দেখালো।

নদীর গতি পথ বারবার বদলে যাওয়ায় গোটা এলাকায় ক্ষয় আর কাটাছেঁড়ার প্রচুর নমুনা দেখতে পাবেন। নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন, লাইমস্টোনের পাঁচিলগুলোয় গুহা আর ঝরনা গিজগিজ করছে।

ট্রেইল এখন দ্রুত নীল নদের দিকে নামছে, শেষ কয়েক মাইলে প্রায় পনেরোশো ফুট নিচে চলে এসেছে ওরা। উপত্যকার সাইডগুলো গাছপালায় ঢাকা, বহু জায়গায় দেখা গেল লাইমস্টোনের গা থেকে খুদে ঝরনার পানি অলসভঙ্গিতে পুরানো নদীর তলায় পড়ছে।

নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে গরমও বাড়ছে। আজ শার্ট পরেছে রোয়েন, ঘামে ওর শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানটা ভিজে গেছে।

এ জায়গায় দেখা গেল ঘন জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে স্বচ্ছ পানি নেমে আসছে, স্রোতটা চওড়া হয়ে রীতিমত ছোট একটা নদী হয়ে উঠেছে। তারপর উপত্যকার একটা কোণ ঘুরলো ওরা দেখতে পেল ওদের সঙ্গে এখানে স্রোতটাও মিলিত হয়েছে ডানডেরা নদীর মূল প্রবাহে। খাদের পেছন দিকে তাকিয়ে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে একটা অকৃত্রিম সরু খিলান দেখতে পেল ওরা, ফাটলের ভেতর দিয়ে ওই খিলান হয়ে বেরিয়ে এসেছে নদী। ফাটল ও খিলানের চারধারে পাথরের রঙ অদ্ভুত লালচে-গোলাপি, পালিশ করা মসৃণ, ভজের উপর ভাঁজ খেয়ে আছে, ফলে রঙ ও আকৃতিতে মানুষের জোড়া ঠোঁটের মতো দেখতে হয়েছে।

যেন কোনো দৈত্যের মুখ থেকে নর্দমা বেরিয়েছে, ফিসফিস করলো রোয়েন, তাকিয়ে আছে খিলান, ফাটল আর অদ্ভুত দর্শন পাথরের দিকে। ভাবছি টাইটা আর প্রিন্স মেমননের নেতৃত্বে প্রাচীন মিশরীয়রা এখানে যদি এসে থাকে, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাদের। প্রকৃতির এ অদ্ভুত খেয়াল নিশ্চয়ই তাদেরকে খুব নাড়া দিয়েছিল।

নীরবে রোয়েনের মুখ পরীক্ষা করে নিকোলাস। পবিত্র দৃষ্টিতে, বড়ো বড়ো গাঢ় চোখে তাকিয়ে মেয়েটা। হঠাৎ করেই কুয়েনটন পার্কে রাখা একটা পোর্টেটের কথা মনে পড়ে যায় নিকোলাসের। ভ্যালি অব দ্য কিংস থেকে উদ্ধার করা একজন রামেসিস আমলের রাজকুমারীর অবয়ব সেটা।

তাদের রক্ত আপনার শিরাতেও বইছে, বলল নিকোলাস। অবশ্যই তারাও আপনার মতো মুগ্ধ হয়েছিল।

নিকোলাসের হাত ধরল রোয়েন। আপনি আমাকে ভরসা দিন, নিকোলাস। বলুন এখানে আমার উপস্থিতি স্বপ্নের ভেতর ঘটছে না। বলুন আমরা যা খুঁজতে এসেছি তা অবশ্যই পাব। আমাকে নিশ্চয়তা দিন, হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ডুরেঈদের আত্মাকে শান্তি দিতে পারব আমরা।

নিকোলাসের দিকে মুখ তুলে রেখেছে রোয়েন, উদ্ভাসিত মুখে চকচক করছে শিশির কণার মতো ঘাম। ওকে আলিঙ্গন করার প্রবল একটা ঝোঁক চাপল, ইচ্ছে হলো ভেজা ও ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ায় চুমো খায়। তার বদলে ঘুরে দাঁড়ালো নিকোলাস, ট্রেইল ধরে নেমে যাচ্ছে।

নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই নিকোলাসের, রোয়েনের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। খানিক পর পেছনে শব্দ হলো, পিছু নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে রোয়েন। নিঃশব্দে নিচে নামছে ওরা, অন্যমনস্ক থাকায় ওদের সামনে হঠাৎ উন্মোচিত প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না নিকোলাস।

ওরা দাঁড়িয়ে আছে উপখাদের অনেক উপরে, একটা কার্নিসে। ওদের নিচে লাল পাথর ভর্তি বিশাল এক কড়াই, পাঁচশো ফুট গভীর। কিংবদন্তীর অ্যাবের মূল্য প্রবাহ সবুজ খরস্রোত, লাফ দিয়ে পড়ছে ছায়াময় অতল গহ্বরে। সেটা এতো গভীর যে সূর্যের আলো নাগালো পায় না। ওদের পাশ থেকে ডানডেরা নদীর বিক্ষিপ্ত পানিও একই ভঙ্গিতে লাফ দিয়েছে, পানির পতনটা বকের সাদা পালকের মতো লাগছে দেখতে, খাদের ভেতরকার বাতাসে মোচড় খাচ্ছে ও ফুলছে। অতল গহ্বরে মিলিত হচ্ছে দুই প্রবাহ; বিপুল জলরাশি টগবগ করে ফুটছে, বিশাল ঢেউগুলো চুরমার হয়ে ফেনা তৈরি করছে, অবশেষে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পেয়ে সেদিকে ছুটে চলেছে অনিয়ন্ত্রিত প্রচণ্ড শক্তিতে।

বোট নিয়ে আপনি ওখানে গিয়েছিলেন? নিকোলাসের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোয়েন।

কম বয়েসে কত রকম বোকামি করে মানুষ, ক্ষীণ বিষণ্ণ হাসি নিকোলাসের ঠোঁটে, পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় হাতের রোম দাঁড়িয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। এক সময় মৃদু গলায় রোয়েন বলল, উজানের দিকে আসার সময় টাইটা আর মেমনন কী ধরনের বাধার সামনে পড়েছিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। নিজের চারদিকে তাকালো ও। তারপর খাদের নিচের অংশটা দেখালো, পশ্চিম দিকটা। ওদের পক্ষে অবশ্যই উপখাদ ধরে আসা সম্ভব ছিল না। পাহাড়-প্রাচীরের চূড়াগুলো যে রেখা তৈরি করেছে, নিশ্চয়ই সেই রেখা ধরে আসে তারা সরাসরি এখান পর্যন্ত, যেখানে এ মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। চিন্তাটা ওর গলায় উত্তেজনার ভাব এনে দিল।

জোর করে কিছুই বলা যায় না। তারা হয়তো নদীর ওপারে পৌঁছেছিল।

নিকোলাস ঠাট্টা করে বললেও রোয়েনের চেহারা ঝুলে পড়লো। এটা তো ভাবি নি। হ্যাঁ, তা সম্ভব বৈকি। নিকোলাস, এপারে যদি কোনো সূত্র না পাই ওপারে আমরা পৌঁছব কীভাবে?

যখনকার সমস্যা তখন দেখা যাবে।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ওরা। যে কাজ নিয়ে এখানে আসা হয়েছে তার ব্যাপকতা ও বিশালত্ব কল্পনা করছে দু জনেই, উপলব্ধি করছে অনিশ্চয়তার মাত্রা। খানিক পর রোয়েনই আবার নিস্তব্ধতা ভাঙল, নিকোলাস, মঠটা কোথায়? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

সরাসরি আমাদের পায়ের নিচে যে, দেখবেন কীভাবে।

ওখানে আমরা ক্যাম্প ফেলব?

সন্দেহ আছে। চলুন দেখি বোরিসকে ধরি, দেখি সে কী ভাবছে।

খাড়াইয়ের কিনারা ধরে ট্রেইল অনুসরণ করলো ওরা, খচ্চরগুলোকে ধরে ফেললো যেখানে দু ভাগ হয়ে ট্রাক। একটা পথ নদীর উল্টোদিক ধরে জঙ্গল ঢাকা নিচু জমিনে নেমে গেছে, অপরটা আগের মতোই কিনারার পাথরে ঝুলে আছে। ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল বোরিস, হাত তুলে নিচু জমিনে নেমে যাওয়া ট্র্যাকটা দেখালো সে। ওদিকে জঙ্গলের ভেতর ভালো একটা ক্যাম্পসাইট আছে। শেষবার শিকার করতে এসে ওখানে ছিলাম আমরা।

জঙ্গলে ঢুকে ফাঁকা একটা জায়গা পাওয়া গেল। কয়েকটা বুনো ডুমুর গাছ। থাকায় ছায়ার অভাব নেই। এক কোণের ছোট্ট একটা ঝরনা রয়েছে নির্মল পানি। বোঝা হালকা করার জন্য তাঁবুগুলো খাদে বয়ে আনে নি বোরিস। খচ্চরের পিঠ থেকে মালপত্র নামানো শেষ হতেই নিজের লোকদের তিনটা ছোট কুঁড়েঘর বানাবার হুকুম দিল সে। ঝরনার কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে একটা ল্যাট্রিনও তৈরি করা হবে।

এ সব কাজ যখন চলছে, রোয়েন আর টিসেকে ডেকে নিল নিকোলাস, তিনজন রওনা হয়ে গেল মঠ দেখার জন্য। দুই ট্রাকের মুখে এসে দাঁড়ালো ওরা, তারপর টিসের নেতৃত্বে পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ঘেঁষা ট্রেইল ধরে এগুলো। খানিক পরই চওড়া এক প্রস্থ পাথুরে সিঁড়ি পাওয়া গেল, পাহাড়-প্রাচীরের মুখ বেয়ে নিচে নেমে গেছে।

সাদা আলখেল্লা পরা একদল সন্ন্যাসী ধাপ বেয়ে উঠে আসছিল, অল্প কিছুক্ষণ থেমে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলো টিসে। তারা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে উঠে যেতে সে বলল, তিমকাত উৎসবের আগের রাতটাকে কাটেরা বলা হয়। কাল উৎসব তো, আজ তাই সবাই খুব ব্যস্ত। তিমকাত খুব বড় ধর্মীয় উৎসব।

কিন্তু মিশরের চার্চ ক্যালেন্ডারে তো এ ধরনের কোনো উৎসবের উল্লেখ নেই, বলল রোয়েন।

এটা আসলে ইথিওপিয়ান ইপিফানি, যিশুর ব্যাপ্টিজম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়, ব্যাখ্যা করলো টিসে। উৎসব চলার সময় নদীতে গিয়ে কিছু ধর্মীয় আচার অনুশীলন করা হবে, সমস্ত পাপ ধুয়ে-মুছে পবিত্রকরণের পর ব্যাপ্টিজমে দীক্ষা দেওয়া হবে তরুণ উপাসকদের, ঠিক যেভাবে ব্যাপ্টিস্টের হাতে দীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং যিশু।

খাড়া পাহাড় প্রাচীরের অবয়ব বেয়ে নেমে গেছে সিঁড়ির ধাপ, আবার ওরা সেটা ধরে নামতে শুরু করলো। শত শত বছর ধরে নগ্ন পা ফেলায় প্রতিটি ধাপ মসৃণ ডিশ-এ পরিণত হয়েছে। ওদের কয়েকশো ফুট নিচে নীল নদ হিসহিস আওয়াজ তুলে টগবগ করে ফুটছে, চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিপুল জলকণা।

হঠাৎ করেই চওড়া একটা চাতালে বেরিয়ে এলো ওরা, কঠিন পাথর কেটে মানুষই এটা তৈরি করেছে। মাথার উপর লাল পাথর ঝুলে আছে, তোরণশোভিত উদ্যানের উপর ছাদ হিসেবে কাজ করছে; খিলান আকৃতির পাথরের তোরণগুলো প্রাচীন মিস্ত্রীরা ছাদের অবলম্বন হিসেবে তৈরি করেছিল। ঢাকা ও লম্বা চাতালের ভেতর দিকের দেয়ালে অসংখ্য প্রবেশপথ, সামনের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড় প্রাচীরের গা কেটে অসংখ্য হল, সেল, চেম্বার, চার্চ ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। নির্জনতা প্রিয় সন্ন্যাসীরা এখানে বসবাস করছেন হাজার বছরেরও বেশি দিন ধরে।

চাতালের দৈর্ঘ্য জুড়ে দলে দলে ভাগ হয়ে বসে আছেন সন্ন্যাসীরা একদিকে কিছু সন্ন্যাসী যাজকের ধর্মশাস্ত্র পাঠ শুনছেন।

এদের মধ্যে বেশিরভাগই নিরক্ষর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিসে বলে। এমন কী বাইবেল পর্যন্ত পড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়!

এই হলো চার্চ অব কনস্ট্যানটিন, বাইজেন্টিয়াম সময়ের, নিকোলাস হাত উঁচু করে দেখায়। বাগানের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আরেক দল সন্ন্যাসীকে দেখা গেল, সুর করে ধর্মীয় সঙ্গীত গাইছেন, অ্যামহ্যারিক ভাষায় লেখা। নানা গন্ধে ভারি হয়ে আছে বাতাস। জ্বালানি কাঠ আর ধূপের ধোঁয়া তো আছেই, আরো আছে ঘাম গরম নিঃশ্বাস, শোক, অসুস্থতার গন্ধ। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে বসে রয়েছে তীর্থে আসার সাধারণ মানুষ। দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা, অনেককেই অসুস্থ আত্মীয়-স্বজনকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। সেইন্টের কাছে অনেক কিছু চাওয়ার আছে তাদের। কেউ তার ভোগান্তির অবসান চায়, কেউ ফিরে পেতে চায় সুস্থতা, আবার কেউ এসেছে পাপের শাস্তি মওকুফ করার আবেদন নিয়ে।

মায়ের কোলে অনেক অন্ধ ছেলেকে দেখা গেল। হাড় থেকে মাংস খসে পড়ছে এমন রোগীর সংখ্যাও কম নয়। তাদের আহাজারি ও গোঙানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সন্ন্যাসীদের সুর করে গাওয়া প্রার্থনা সঙ্গীত আরো মিশছে প্রকাণ্ড কড়াইয়ের নিচ থেকে ভেসে আসা নীলনদের ফোঁসফোসানি।

এক সময় ওরা সেন্ট ফুমেনটিয়াস ক্যাথেড্রালের প্রবেশমুখে এসে পৌঁছালো। মাছের হাঁ করা মুখের মতো গোল একটা ফাঁক, তবে দরজার চারদিকের গায়ে চওড়া বর্ডারের উপর আঁকা হয়েছে নক্ষত্র, ক্রসচিহ্ন ও সেইন্টদের মাথা।

প্রবেশপথে সবুজ ভেলভেটের আলখেল্লা পরা একজন যাজক পাহারায় দাঁড়িয়ে আছেন। টিসে তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন তিনি। চওড়া হলেও, দরজাটা নিচু, ঢোকার সময় মাথা নিচু করতে হলো নিকোলাসকে। ভেতরে ঢোকার পর মাথা উঁচু করে চারদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল।

বিশাল গুহার ভেতর ছাদ এতো উপরে যে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। পাথুরে দেয়াল। দেয়ালচিত্রে ঢাকা, ডানাবিশিষ্ট পরী আর দেব-দেবীদের ছবি আঁকা হয়েছে, মোমবাতি আর ল্যাম্পের কাঁপা কাঁপা আলো পড়ায় যেনো মনে হলো নড়াচড়া করছে। ছবিগুলো আংশিক ঢাকা পড়েছে পাঁচিলের উপর কারুকাজ করা লম্বা ব্যানার বা পর্দা ঝুলে থাকায়, কিনারার ঝালর জট পাকিয়ে গেছে, ছিঁড়েও গেছে কোথাও কোথাও। এরকম একটা ব্যানারে সেইন্ট মাইকেলকে দেখা যাচ্ছে, সাদা একটা ঘোড়া ছোটাচ্ছেন তিনি। আরেকটায় দেখা গেল ক্রস-এর পাদদেশে হাঁটু গেড়ে রয়েছেন ভার্জিন, তার উপরে যিশুর স্নান শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে, পাঁজরে গাঁধা রোমান বর্শা।

গির্জার এটা বাইরের অংশ।.দূর প্রান্তের দেয়ালে মিডল চেম্বারে ঢোকার দরজা। দরজা আসলে একজোড়া খোলাই রয়েছে। পাথরের মেঝে ধরে হেঁটে এলো ওরা তিনজন, হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত তীর্থযাত্রীদের পাশ কাটিয়ে। সবাই তারা হয় গান গাইছে, নয়তো কান্নাকাটি করছে, অনেককেই দেখা গেল যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। ধূপ-ধুনোর নীলচে ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হয়ে আছে জায়গাটা।

তিনটি ধাপ পেরিয়ে ভেতরের দরজাগুলোর সামনে পৌঁছতে হয়, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আলখেল্লা পরা দু জন দীর্ঘদেহী যাজক, মাথায় লম্বা হেট, হেঁটের মাথা সমতল। তাঁদের একজন রাগের সঙ্গে কী যেনো বললেন টিসেকে।

ওরা এমন কি কিড়ি বা মিডল চেম্বারেও ঢুকতে দেবেন না, জানালো টিসে। ওই চেম্বারের সামনে মাকডাস–হোলি অব হোলিস।

উঁকি দিয়ে প্রহরী যাজকদের পেছনে তাকালো ওরা, মিডল চেম্বারের ভেতর দিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ পবিত্র স্থানটার দরজাই শুধু দেখা গেল।

মাকডাসে শুধু ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা ঢুকতে পারেন কারণ, ওখানে ট্যাবট আছে, আর আছে সেইন্টের সমাধিতে ঢোকার দরজা।

মন খারাপ করে, গুহা থেকে বেরিয়ে চাতাল ধরে নেমে এলো ওরা।

*

তারা ভরা আকাশের নিচে বসে রাতের খাবার খেলো দলটা। বাতাসে এখনো দম আটকানো গরম। নাগালের ঠিক বাইরে মেঘের মতো ঝুলে আছে ঝক ঝক মশা। কাপড়ের বাইরে চামড়ায় রিপেলন্ট মেখেছে ওরা, তা না হলে রক্ষা ছিল না।

এবার বলুন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যেখানে আসতে চেয়েছিলেন সেখানে আপনাকে আমি পৌঁছে দিয়েছি। অত দূর থেকে যে প্রাণীর সন্ধানে এলেন, বলুন সেটা কোথায় খুঁজবেন।

ভোরে ট্র্যাকারদের ভাটির দিকে পাঠাবেন, জবাব দিল নিকোলাস। সব ডিক-ডিকের পায়ের ছাপ একই রকম বলে আমার ধারণা। ছাপ চোখে পড়লে কাছাকাছি লুকিয়ে থাকতে হবে। ডিক-ডিক নিজেদের এলাকা ছেড়ে কোথাও যায় না। অপেক্ষা করলে দেখতে পাবে। আর দেখতে পেলে আমাকে খবর দেবে।

মায়ের কাছে মাসির গপ্পো–আমাকে শেখায়, কী করতে হবে! একটা গ্লাসে ভদকা ঢেলে নেয় বোরিস।

ঠিক আছে, ট্র্যাকারদের পাঠালাম। কিন্তু আপনি কী করবেন? মেয়েদের নিয়ে ক্যাম্পে থাকবেন? তির্যক দৃষ্টি হেনে হাসলো বোরিস। মেয়েরা আপনার সেবা-যত্ন করলে আমার কোনো আপত্তি নেই।

চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়ালো টিসে, রান্নাবান্নার তদারক করার কথা বলে কিচেনের দিকে চলে গেল। বোরিসের ইঙ্গিতটা গায়ে মাখল না নিকোলাস। বলল, ডানডেরার পাশে ঝোঁপের ভেতর কাজ করব আমরা। ওদিকে ডিক-ডিক থাকতে পারে। আপনার লোকদের নদীর ওদিকে যেতে নিষেধ করে দেবেন। আমি চাই না শিকারের সময় কেউ ডিসটার্ব করুক।

পরদিন ভোরের আলো ভালো করে ফোঁটার আগেই ক্যাম্প ত্যাগ করলো ওরা, সঙ্গে রাইফেল ও হালকা খাবার নিয়েছে। ডানডেরার পাশে এসে ঝোঁপের ভেতর দিয়ে হাঁটছে নিকোলাস, পেছনে রোয়েন। কয়েক পা এগিয়ে একবার করে থামলো, কান পেতে শুনছে। ডালে ডালে প্রচুর পাখি; ঝোঁপের ভেতর খুদে প্রাণীদের সংখ্যাও কম নয়। ইথিওপিয়ানরা শিকারে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, বলল নিকোলাস। আর খাদের ভেতর সন্ন্যাসীরাও বোধহয় অভ্যস্ত নয়, বলল নিকোলাস। তারাও বোধহয় ওয়াইল্ডলাইফকে বিরক্ত করে না। হাত তুলে হরিণের পায়ের ছাপ দেখালো। এগুলো বুশবাকের ছাপ। ট্রফি হিসেবে সাংঘাতিক লোভনীয়।

আপনি কি সত্যি সত্যি ডোরাকাটা ডিক-ডিক পাবেন বলে আশা করেন?

আরে না। নিকোলাস হাসে। মনে হয়, বুড়ো দাদা ডিক-ডিকের গপ্পোটা বানিয়ে বলেছিল। আমরা, হারপার পরিবার মাঝে মধ্যে সত্যের অপলাপ করি বৈকি।

উঁচু গাছের ডালে একটা সানবার্ডকে বসে থাকতে দেখলো ওরা, পালকগুলো পান্না বসানো টায়রার মতো ঝলমল করছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনটা দেখে নিল নিকোলাস, তারপর পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়িতে বসে রোয়েনকেও বসতে ইঙ্গিত করলো। ডিক-ডিক খোঁজার অজুহাতে সবার চোখের আড়ালে এভাবেই পালিয়ে আসতে হবে। এখন বলুন, আসলে ঠিক কী খুঁজব আমরা।

একটা সমাধির অবশিষ্ট, কিংবা কোনো গোরস্থানের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে ফারাও মামোসের সমাধি তৈরি করার সময় শ্রমিকরা বসবাস করত।

ইট বা পাথরের যে কোনো কাজ, সায় দিল নিকোলাস। বিশেষ করে স্তম্ভ বা মনুমেন্ট।

টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট। মাথা ঝাঁকালো রোয়েন। গায়ে হায়ারোগ্লিফিকস খোদাই করা থাকবে। হয়তো রোদ-বৃষ্টিতে ম্লান হয়ে গেছে, খসে পড়েছে, কিংবা ঢাকা পড়েছে ঝোঁপের ভেতর আমি জানি না।

এখানে আমরা বসে আছি কেন? চলুন মাছ ধরি।

বেলা এগারোটার দিকে নদী তীরে একটা ডিক-ডিকের ছাপ দেখলো নিকোলাস। বড় একটা গাছের বেরিয়ে থাকা শিকড়ের তলায় লুকাল ওরা, নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পর খুদে প্রাণীগুলোর একটাকে দুএক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেল। ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল সেটা, গাছের গুঁড়ির মতো গুঁড়টা নাড়ছে, মানবশিশুর টলমল করা পায়ের মতো খুব ফেলছে জমিনে, নিচু একটা ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ল, ব্যস্তভাবে চিবাল। তবে গায়ের ইউনিফর্মটা ধূসর, কোনো রকম দাগ নেই।

ওটা অদৃশ্য হতে উঠে দাঁড়ালো নিকোলাস। বিস্ময়কর কিছু নয়, বিড়বিড় করলো। চলুন অন্যদিকে যাই।

দুপুরের খানিক পর এমন একটা জায়গায় পৌঁছল ওরা, পাহাড় প্রাচীরের রঙ যেখানে গোলাপি-লালচে মাংসের মতো। এরকম একজোড়া প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে গহ্বরের ভেতর বেরিয়ে এসেছে নদী। জায়গাটা যতদূর সম্ভব পরীক্ষা করলো ওরা, তারপর বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। পাথর এখানে সোজা নেমে এসেছে পানিতে, পানির কিনারায় এমন একটা গর্ত নেই যেখানে পা রাখা যায়।

ভাটির দিকে ফিরে এলো ওরা, আদ্যিকালের একটা ঝুলন্ত ব্রিজ ধরে নদী পেরুল। শুকনো লতানো গাছ আর শণ দিয়ে ব্রিজটা সম্ভবত সন্ন্যাসীরাই বানিয়েছেন। এপারে এসেও আরেকবার গহ্বরের ভেতর দিয়ে এগোবার চেষ্টা করলো ওরা। লালচে-গোলাপি পাঁচিল পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে এড়িয়ে এগুতে চেষ্টা করায় দেখা গেল স্রোত এতো জোরালো যে নিকোলাসকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হলো ওকে।

আমরা যখন এগুতে পারছি না, ধরে নিতে হবে টাইটাও পারে নি।

ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে ফিরে এসে একটা ছায়া খুঁজে নিল ওরা, ওখানে বসে লাঞ্চ খেলো। গরমে সেদ্ধ হবার অবস্থা। নদীর পানিতে রুমাল ভিজিয়ে মুখ মুছলো রোয়েন। চিৎ হয়ে শুয়ে লালচে-গোলাপি প্রাচীর দেখছে নিকোলাস, চোখে আঁটা বাইনোকুলার। মসৃণ চকচকে সারফেসে কোনো ফাটল আছে কিনা খুঁজছে। চোখ থেকে বাইনোকুলার না নামিয়েই কথা বলছে ও। রিভার গড পড়ে জানা যায়, মিশরের সাহসী সিংহ অর্থাৎ ট্যানাস আর ফারাও-এর লাশ অদলবদল করার জন্য লোকজনের সাহায্য নিতে হয়েছিল টাইটাকে। বাইনোকুলার সরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো। ব্যাপারটা আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। কারণ ওই যুগে মানুষ এ ধরনের কাজ করতে ভয় পেত। ভাবছি, স্ক্রোলের অনুবাদে কোনো ভুল হয় নি তো? টাইটা কি সত্যি লাশ বদলাবদলি করেছিল?

হেসে উঠে নিকোলাসের দিকে কাত হলো রোয়েন। আপনার প্রিয় লেখক উইলবার স্মিথ এখানে কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। গল্পের এ অংশটুকু তিনি একটা মাত্র বাক্যের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন। বাক্যটি হলো, আমার কাছে সে ছিল যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে মহান নেতা। আবার চিৎ হলো রোয়েন। সেজন্যই বইটার এতো সমালোচনা করি। আমি যতটুকু জানি বা বিশ্বাস করি, ট্যানাস তাঁর নিজের সমাধিতে আছেন, তেমনি ফারাও-ও আছেন নিজের সমাধিতে।

দুত্তোর! হতাশ গলায় নিকোলাস বলে। ওই রোমান্টিক অংশটা সত্যি আমার খুব প্রিয় ছিল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, চলুন, উপত্যকার বাকি অংশেও একটু খুঁজে দেখতে চাই। গতকাল বেশ চমৎকার একটা জায়গা দেখলাম।

শেষ বিকেলের দিকে ক্যাম্পে ফিরল ওরা। কিচেন থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালো টিসে। হাঁপাচ্ছে সে। কখন ফিরবেন তার অপেক্ষায় ছিলাম। জালি হোরা তিমকাতে উৎসবে দাওয়াত দিয়েছেন আমাদের। ওইজিরো রোয়েন তাঁর প্রধান অতিথি। গরম পানি রাখা আছে, এখুনি গোসল করে তৈরি হয়ে নিন। তা না হলে মঠে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।

*

ভোজের কক্ষে ওদেরকে নিয়ে যাবার জন্য প্রধান পুরোহিত একদল তরুণ উপাসককে পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা এলো গোধূলি পার করে, প্রত্যেকের হাতে একটা করে জ্বলন্ত মশাল। তাদের মধ্যে তামেরও আছে, প্রথমে চিনতে পারলো রোয়েন। তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিতে লজ্জায় জড়সড় ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো সে, নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে আনা বুনো ফুলের একটা গোছা বাড়িয়ে ধরল রোয়েনের দিকে। প্রস্তুত ছিল না রোয়েন, কিছু না ভেবেই আরবিতে ধন্যবাদ দিল তাকে।

শুকরান!

তাফাদ্দালি!

রোয়েনকে অবাক করে দিয়ে তামেরও পাল্টা ধন্যবাদ জানালো ওই আরবিতেই।

তুমি এতো ভালো আরবি বলো কী করে? রোয়েন জানতে চায়। আমার মা লোহিত সাগরের ওদিক থেকে এসেছে। আরবি আমার মায়ের ভাষা।

মঠের উদ্দেশে ওরা যখন রওনা হলো, ভক্ত কুকুরছানার মতো রোয়েনের পিছু নিল তামের।

পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে আরেকবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো ওরা, বেরিয়ে এলো জ্বলন্ত মশাল ঘেরা চাতালে। গাছপালায় ছাওয়া সরু উদ্যান-পথ লোকজনে ঠাসা, ভিড় সরিয়ে ওদের জন্য পথ তৈরি করলো তরুণ উপাসকরা। তীর্থযাত্রীরা কি ভাবল কে জানে, অ্যামহ্যারিক ভাষায় স্বাগত জানালো ওদেরকে, হাত লম্বা করে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

নিচু প্রবেশপথ পেরিয়ে গির্জার বাইরের অংশে পৌঁছল ওরা। আজো মনে হলো মশাল আর ল্যাম্পের অনিশ্চিত আলোয় দেয়ালচিত্রের চরিত্রগুলো নাচছে। মেঝেতে নলখাগড়া দিয়ে তৈরি কার্পেট ফেলা হয়েছে, পায়ের উপর পা তুলে তাতে বসে আছেন সন্ন্যাসীরা, মনে হলো সবাই তারা এখানে উপস্থিত। গলা চড়িয়ে তারাও ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। বসা সন্ন্যাসীদের প্রত্যেকের পাশে একটা করে বোতল, তাতে মধু মিশিয়ে তৈরি করা স্থানীয় মদ তেজ। হাসিখুশি সন্ন্যাসীদের চকচকে চেহারা দেখে বোঝা যায়, এরই মধ্যে ভালো সার্ভিস দিয়েছে বোতলগুলো।

নিকোলাসের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করলো টিসে, আমি চেখে দেখবো, তারপর আপনি খাবেন। স্থান বিশেষে এ মদের রঙ, স্বাদ ও শক্তি বদলে যায়। বড় গামলা বা পিপে থেকে পরিবেশন করা হচ্ছে, একেকটার ধরন একেকরকম। নিজের বোতল থেকে সরাসরি পান করলো সে। এটা ভালোই। বেশি না খেলে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।

ওদের চারপাশে বসা সন্ন্যাসীরা পান করা জন্য সাধাসাধি করছে, বাধ্য হয়েই নিজের বোতলটা ধরতে হলো নিকোলাসকে। হালকা ও মিষ্টি একটা স্বাদ পেল ও, মধুর পরিমাণ খুব বেশি বলেই হয়তো মদ বলে মনে হলো না। ভালোই তো!

কিন্তু সাবধান, বলল টিসে। তেজের পর নিশ্চয়ই ওরা আপনাকে কাটিকালা সাধবে। কাটিকালা চোলাই করা কড়া মদ, খেলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না, ওটা আপনার ঘাড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলবে।

সন্ন্যাসীরা এবার রোয়েনের যত্ন-আত্তির দিকে নজর দিয়েছেন। ও যে কপটিক খ্রিস্টান, এটা তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। সন্দেহ নেই, ওর রূপ-যৌবনও পবিত্র ও

সংযমী চিরকুমারদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়েছে কিছুটা।

রোয়েনের কানে কানে নিকোলাস বলল, বোতলটা ঠোঁটে তুলে ভান করুন খাচ্ছেন। তা না হলে ওঁরা আপনাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না।

রোয়েন বোতলটা মুখের সামনে তুলতেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন সন্ন্যাসীরা। বোতল নামিয়ে নিকোলাসকে রোয়েন বলল, স্বাদটা তো দারুণ। মদ কোথায়, এতো মধু।

মদ না খাবার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেললেন? হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

মাত্র এক ফোঁটা, স্বীকার করলো রোয়েন। তাছাড়া কে বলল আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম খাব না?

অতিথিদের সামনে গরম পানি ভর্তি একটা করে পাত্র রাখা হলো, হাত ধোয়ার জন্য। ভোজন পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। হঠাৎ ড্রামের শব্দ শোনা গেল, তারপর ভেসে এলো নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। কিড্ডির খোলা দরজা ভরাট করে তুললো বাদ্যযন্ত্রীদের একটা দল। চেম্বারের একদিকের দেয়াল ঘেঁষে আসন গ্রহণ করলো তারা।

অবশেষে প্রাচীন প্রধান পুরোহিত জালি হোরা ধাপের মাথায় উদয় হলেন। রক্তলাল সাটিনের লম্বা আলখেল্লা পরে আছেন, দুই কাঁধে সোনালি সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারির কাজ করা। মাথায় পরেছেন প্রকাণ্ড এক মুকুট। সোনার মতো চকচক করলেও নিকোলাস জানে ওটা আসলে পালিশ করা পিতল, আর বহুরঙা পাথরগুলো কাঁচ।

হাতের দণ্ড উঁচু করলেন প্রধান যাজক, সেটার মাথায় রুপোর কাজ করা ক্রস। সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে বিশাল গুহার ভেতর অটুট নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

দীর্ঘ সময় নিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন জালি হোরা। প্রার্থনা শেষ হতে দু জন তরুণ উপাসক ধাপের নিচে নামতে সাহায্য করলো তাঁকে। বয়োবৃদ্ধ পুরোহিতরা হৃৎপিণ্ড আকৃতির একটা বৃত্ত রচনা করে বসেছেন, সেই বৃত্তের মাথায় তিনি তাঁর প্রাচীন জিম্মেরা চৌকিতে বসলেন। এরপর চাতাল থেকে মিছিল নিয়ে ভেতরে ঢুকলো তরুণ উপাসকরা, প্রত্যেকের মাথায় নলখাগড়ার তৈরি ঝুড়ি, আকারে গরুর গাড়ির চাকার মতো। অতিথিদের প্রতিটি বৃত্তের সামনে একটা করে নামিয়ে রাখা হলো।

প্রধান যাজকের সঙ্কেত পেয়ে সব কয়টা ঝুড়ির ঢাকনি একযোগে ভোলা হলো। আনন্দে হৈ-চৈ করে উঠলেন সন্ন্যাসীরা। প্রতিটি ঝুড়িতে একটা করে পিতলের গামলা রয়েছে, হাতে বেলা গোল ময়দার ইনজেরা রুটি, গভীর গামলার কিনারা পর্যন্ত ভরাট হয়ে আছে। আরো একদল উপাসক ঢুকলো, ভারি পিতলের গামলা বয়ে আনতে বারোটা বাজছে তাদের, টলমল করছে পা। মরিচ আর এলাচের গন্ধে ভারী হয়ে উঠলো বাতাস। এ গামলাগুলো থেকে ধোয়া উঠছে, ভেতরে রান্না করা খাসীর মাংস।

পুরোহিত আর সন্ন্যাসীরা রুটি ও মাংসের উপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, দেখে মনে হলো হিংস্র কোনো প্রাণী শত্রু নিধনে মেতে উঠেছে। আহার পর্ব মাত্র শুরু হয়েছে, উপাসকরা পরিবেশন করলো ড্রাম ভর্তি তেজ। খাবে কি, হাঁ করে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। পুরোহিত ও সন্ন্যাসীরা মুখ খোলার পর তা আর বন্ধ করছে না, এক হাতে যতটুকু ধরে ভেতরে ভরছে মাংস আর রুটি, না চিবিয়ে ঢক ঢক করে তেজ ঢেলে নামিয়ে দিচ্ছে গলা দিয়ে, এভাবে বিরতিহীন চালিয়ে যাচ্ছে। মাংসের গামলা খালি হয়ে আসায় নিকোলাস ভাবল এবার বোধহয় নোংরা দৃশ্যটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, তরুণ উপাসকরা এরপর নিয়ে এলো আস্ত মুরগির রোস্ট।

নিকোলাস নির্দেশে কিছুই না খেয়ে রোয়েন ভান করছিল প্রচুর খাচ্ছে, হঠাৎ ম্লান গলায় বলল, আমার অসুস্থ লাগছে।

চোখ বন্ধ করে ইংল্যান্ডের কথা ভাবুন, পরামর্শ দিল নিকোলাস। এ উৎসবের আপনিই স্টার। ওরা আপনাকে পালাতে দেবে না।

তারপর শুরু হলো চিৎকার, কাটিকালা! কাটিকালা! পুরোহিত বা সন্ন্যাসী, কেউ থামছেন না। উপাসকরা ছুটে বেরিয়ে গেল চাতালে, খানিক পর ফিরে এলো ডজন ডজন বোতল আর চায়ের কাপ নিয়ে। স্থানীয় লোকজনকে অবজ্ঞা যতোই করুক, খাওয়া-দাওয়া শুরু হওয়ার পর দেখা গেল খাদ্যগ্রহণের প্রতিযোগিতায় পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের সঙ্গে জোর পাল্লা দিচ্ছে বোরিস। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতায় সে-ই জিতছে বলে মনে হলো। ওরা দেখলো তরুণ উপাসকরা তার পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিচ্ছে। কাটিকালা আসার পর দেখা গেল, চোখের পলক না ফেলে বোতলের পর বোতল খালি করে ফেলছে বোরিস।

তারপর এক সময় প্রধান পুরোহিতের চোখে নিকোলাস আর রোয়েনের ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে গেল। তেজ আর কাটিকালা খেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তিনি, দাঁড়াবার পর টলছেন, এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে আসছেন সরাসরি রোয়েনের দিকে, হাতে মাংস ভরা বিশাল এক রুটি টকটকে লাল ঝোল ঝরছে তা থেকে।

তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ভয়ে কুঁকড়ে গেল রোয়েন। উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিকোলাসের বাহু খামছে ধরল রোয়েন। না! প্লিজ, না। বাঁচান আমাকে, নিকোলাস। আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, প্লিজ…

প্রধান অতিথি হওয়ার মাসুল দিতে হবে না? হাসলো নিকোলাস।

নাটকীয় আবহ তৈরি হলো। হঠাৎ করে ব্যান্ড পার্টির সদস্যরা একযোগে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করায়। পবিত্র উপহার হাতে নিয়ে রোয়েনের সামনে হাজির হলেন মোহন্ত। উপস্থিত পুরোহিত আর সন্ন্যাসীরা রুদ্ধদ্বাসে অপেক্ষা করছেন। নিয়তির অমোঘ বিধান কী করে এড়ায় রোয়েন, অগত্যা চোখ বুজে হাঁ করতে হলো ওকে।

উৎসাহদায়ক গর্জন, করতালি ও বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত ঐকতানের মধ্যে প্রাণপণে চিবিয়ে যাচ্ছে রোয়েন। ওর মুখ গোলাপি হয়ে উঠলো, চোখ বেয়ে দর দর করে পানি ঝরছে। এক পর্যায়ে নিকোলাসের মনে হলো পরাজয় মেনে নিয়ে সবটুকু উগরে দেবে ও। তবে না, ধীরে ধীরে, সাহসের সঙ্গে, প্রতিবার একটু একটু করে, গিলে ফেললো মুখের খাবার। তারপর নেতিয়ে পড়লো।

দর্শকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো, তাদের উল্লাসধ্বনিতে কান পাতা দায়। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ওর সামনে নিচু হলেন মোহন্ত, হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ঝুঁকলেন, আলিঙ্গন করলেন ওকে। তারপর আলিঙ্গন ঢিলে না করেই রোয়েনের পাশে নিজের জন্য জায়গা করে নিলেন তিনি। খেয়াল নেই, মাথার মুকুট পাশে গড়াচ্ছে।

মনে হচ্ছে আপনি ওঁর হৃদয় জয় করেছেন, শুকনো গলায় বলল নিকোলাস। আমার ভয় করছে, দৌড়ে না পালিয়ে যে কোনো মুহূর্তে উনি আপনার কোলে চড়ে বসতে পারেন।

দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো রোয়েনের। খপ করে কাটিকালার একটা বোতল তুলে নিয়ে মোহন্তের ঠোঁটে ঠেকালো। পান করুন! চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন জালি হোরা, তবে ওর হাত থেকে পান করার জন্য ওকে তাঁর ছেড়ে দিতে হলো। বোতল থেকে সরাসরি খানিকটা কাটিকালা পান করে ইঙ্গিত করলেন জালি হোরা, অর্থাৎ তিনি রোয়েনের হাত থেকে রুটি মাংস খেতে চাইছেন।

রোয়েন ইতস্তত করছে দেখে নিকোলাস বলল, বুড়োকে খুশি রাখতে পারলে ভবিষ্যতে কিছু সুবিধে পাওয়া যেতে পারে।

রুটি আর মাংস হাতে নিয়ে তাঁকে খাওয়াতে যাবে রোয়েন, হঠাৎ এমন চমকে উঠল যে হাতের রুটির-মাংস জালি হোরার কোলের উপর পড়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে রোয়েন, যেনো প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত; তাকিয়ে আছে পাশে পড়ে থাকা মুকুটটার দিকে।

কী হলো? দ্রুত জানতে চাইলো নিকোলাস, তবে গলাটা চড়তে দেয় নি। হাত বাড়িয়ে রোয়েনের বাহু ধরে ফেললো। উপস্থিত কেউই ওর চমকে ওঠা লক্ষ্য করে নি। অপর হাতে বোতল ছেড়ে দিয়ে রোয়েনও নিকোলাসের বাহু খামচে ধরল, ওর আঙুলের শক্তি অনুভব করে বিস্মিত হলো নিকোলাস। শার্ট ভেদ করে ওর নখ চামড়া ছিঁড়ে ফেলছে। মুকুটটা দেখুন! ফিসফিস করলো রোয়েন, হাঁপাতে শুরু করেছে। পাথরটা। নীল পাথরটা!

কাচ ও স্ফটিকের পাথরগুলো সস্তাদরের, তবে ওগুলোর সঙ্গে মুকুটে অল্পদামী কিছু পাথরও আছে। একটা পাথর নীল, আকারে সিলভার ডলারের মতো, আসলে নীল সিরামিকের তৈরি সীল, পুরোপুরি গোল, তাপ দিয়ে কঠিন করা হয়েছে। চাকতির মাঝখানে একটা মিশরীয় রথ খোদাই করা ঘোড়া টানা রথ, সামরিক শকট। রথের উপর খোদাই করা হয়েছে ডানা ভাঙা বাজপাখি। চাকতির বৃত্তাকার কিনারা জুড়ে হায়ারোগ্লিফিক্স-এ লেখা হয়েছে দুটো বাক্য, পড়তে মাত্র কয়েক মুহূর্ত লাগলো নিকোলাসের,

আমি দশ হাজার রথের নেতৃত্ব দিই।
আমি টাইটা, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক।

এখান থেকে এ মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচে রোয়েন। খাবার, তেজ আর ঘামের গন্ধে বমি পাচ্ছে ওর। ইতোমধ্যেই অনেক সন্ন্যাসী ঢলে পরেছে নিজ নিজ স্থানে।

কিন্তু এখনো মোহন্তের মূল আকর্ষণ ওর ওপর। অ্যামহারিক ভাষায় অনর্গল বলে যাচ্ছে, রোয়েনের খোলা হাতে চাপড় দিচ্ছে থেকে থেকে। এখন আর তার বক্তব্য অনুবাদ করে শোনাচ্ছে না টিসে। সাহায্যের আশায় নিকোলাসের উদ্দেশ্যে তাকালো রোয়েন; কিন্তু সেও মনে হচ্ছে ধ্যানমগ্ন। সম্ভবত, মুকুটটার কথাই ভাবছে।

চোখ ইশারায় বার্তা বিনিময় হলো, কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা চলবে না। ব্যাপারটা নিয়ে এখুনি আলোচনা করা দরকার, কিন্তু এখান থেকে পালাবে কীভাবে? এ সময় ওদেরকে সাহায্য করলো বোরিস, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো মাতালটা, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়লো। টলতে টলতে এগিয়ে এলো টিসে, সে-ও মাতাল হতে চলেছে, নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো, অল্টো নিকোলাস, এখন আমি কী করব?

কথা না বলে দাঁড়ালো নিকোলাস, এগিয়ে এসে বোরিসকে কাঁধে তুলে নিল। পালাবার এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ! বলল ও, যদিও পুরোহিত বা সন্ন্যাসীদের মধ্যে সাড়া দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। চাতালে বেরিয়ে এলো নিকোলাস, ওর পিছু নিয়ে মেয়ে দু জনও। কোথাও না থেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ওরা।

আমার ধারণা ছিল না অল্টো নিকোলাসের শরীরে এতো শক্তি! হাঁপাচ্ছে টিসে, কারণ ধাপগুলো খুব উঁচু আর সিঁড়িটাও খুব লম্বা।

আমারও তো ধারণা ছিল না, বলল রোয়েন, নিজেও বলতে পারবে না কথার সুরে কী কারণে গর্ব প্রকাশ পেল। ছেলেমানুষি কোরো না, নিজেকে চোখ রাঙাল, তোমার কেউ হয় না ও!

কুঁড়েঘরে ঢুকে বোরিসকে তার বিছানায় ছুঁড়ে দিল নিকোলাস, হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে, ঘামছে দরদর করে। তার কাছে টিসেকে রেখে রোয়েনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলও।

আপনি দেখেছেন…? উত্তেজিত গলায় শুরু করলো রোয়েন, তবে ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দিল নিকোলাস। রোয়েনের ঘরে চলে এলো ওরা। দেখেছেন আপনি? আবার জানতে চাইলো রোয়েন। পড়তে পেরেছেন?

আমি দশ হাজার রথের নেতৃত্ব দিই, বলল নিকোলাস।

আমি টাইটা, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক, বাকিটুকু পূরণ করলো রোয়েন। সে এখানে এসেছিল! ওহ্ নিকোলাস! টাইটা এখানে এসেছিল। এ প্রমাণটাই খুঁজছিলাম আমরা। এখন আমরা জানি অযথা সময় নষ্ট করছি না! নিজের বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। আপনার কী ধারণা, প্রধান পুরোহিত সীলটা পরীক্ষা করতে দেবেন?

মাথা নাড়লো নিকোলাস। মনে হয় না। মুকুটটা মঠের মূল্যবান ধর্মীয় সম্পদ। আপনাকে তার খুব ভালো লাগলেও, দেখতে দেবেন বলে মনে হয় না। তবে, বেশি আগ্রহ দেখানো চলবে না। ওটার তাৎপর্য সম্পর্কে জালি হোরার কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া, আমরা চাই না বোরিস কিছু টের পাক।

ঠিক বলছেন। সরে গিয়ে বিছানায় নিজের পাশে জায়গা করলো রোয়েন। বসুন এখানে।

বসলো নিকোলাস।

রোয়েন জানতে চাইলো, বলুন, সীলটা কোত্থেকে এল? কে পেয়েছিল? কবে, কোথায়?

ধীরে, সুন্দরী, ধীরে। একের ভেতর চারটে প্রশ্ন, কোনটারই উত্তর আমার জানা নেই।

কল্পনা করুন! তাগাদা দিল রোয়েন। আঁচ করুন। আইডিয়ান দিন।

বেশ, রাজি হলো নিকোলাস। সীলটা তৈরি করা হয়েছে হঙকঙে। ওখানে ছোট্ট একটা কারখানা আছে, হাজারে হাজারে তৈরি করা হয়। মিশরে বেড়াতে গিয়ে জালি হোরা একটা কিনে এনেছেন?

নিকোলাসের বাহুতে চিমটি কাটল রোয়েন, জোরে। সিরিয়াস হোন? চোখ রাঙিয়ে নির্দেশ দিল।

আমার চেয়ে ভালো আইডিয়া থাকলে শোনান, বাহুটা অপর হাতে ডলছে নিকোলাস।

বেশ, আমি বলি। ফারাও-এর সমাধি নির্মাণের কাজ চলছে, এ-সময় সীলটা এখানে খাদের ভেতর পড়ে যায় টাইটার হাত থেকে। তিন হাজার বছর পর বুড়ো এক সন্ন্যাসী, মঠে যারা প্রথম বসবাস করতে আসে তাদের একজন, এটা কুড়িয়ে পান। না, হায়ারোগ্লিফিক্স পড়তে পারেন নি। সীলটা তিনি তখনকার প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যান, প্রধান পুরোহিত ওটাকে সেন্ট ফুমেনটিয়াস-এর একটা অলঙ্কার বলে ঘোষণা করেন, এবং সেট করেন মুকুটে।

তারপর সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগলো-আইডিয়াটা মন্দ নয়, বলল নিকোলাস।

আপনি কোনো ফুটো দেখতে পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, উত্তরে মাথা নাড়লো নিকোলাস। তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে টাইটা সত্যিসত্যি এখানে ছিল এবং তাতে প্রমাণ হয় আমাদের থিওরি মিথ্যে নয়?

প্রমাণ খুব কঠিন শব্দ। আসুন বলি, সব মিলিয়ে ওদিকটাই নির্দেশ করছে।

বিছানার উপর শরীরটা মুচড়ে পুরোপুরি নিকোলাসের দিকে ফিরলো রোয়েন। ওহ্, নিকোলাস, উত্তেজনায় কাঁপছি আমি! যিশুর কিরে, আজ রাতে আমি এক মিনিটও ঘুমাতে পারব না। এই, আমরা আবার সার্চ শুরু করব কখন?

রোয়েনের চোখ জোড়া উত্তেজনায় চকচক করছে, রক্তিম মুখে গোলাপি আভা। ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট দুটো, ভেতরে লালচে জিভের ডগা দেখতে পাচ্ছে। নিকোলাস। এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না ও। ধীরে ধীরে রোয়েনের দিকে ঝুঁকলো, ইচ্ছে করেই, এড়িয়ে যেতে চাইলে যাতে সুযোগ পায় রোয়েন। নড়লো না রোয়েন, কিন্তু কিন্তু ধীরে ধীরে কোমল আভায় বদলে গেল। যেনো নিকোলাসের চোখের তারায় কিছু একটা খুঁজে দেখতে চাইছে। এক ইঞ্চি মতো দূরে ওদের ঠোঁট, আর এগুলো না নিকোলাস। ঠোঁট দুটো এক হলো রোয়েনের অভিপ্রায়ে। প্রথমটায় নরম, ধীরে; কেবল আলতো শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, এরপর ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠলো ওদের অধীর কামনা। যেনো টসটসে পাকা ফলের মতো, উন্মত্তের ভঙ্গিতে পরস্পরের মুখের স্বাদ নিল ওরা। এরপর আচমকা, যেনো জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রোয়েন। দ্বিধাগ্রস্থ চোখে চেয়ে রইলো পরস্পরের চোখে।

না, নিজেকে সরিয়ে দিল রোয়েন। প্লিজ, না। আমি…আমি এখনো তৈরি নই!

সোজা হয়ে বসলো নিকোলাস, রোয়েনের একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের তালুর উপর রাখলো। তারপর ওর হাতে ঠোঁট ছোঁয়াল, মাত্র একবার। কাল সকালে দেখা হবে, বলে হাতটা ছেড়ে দিল ও, দাঁড়িয়ে পড়লো। খুব ভোরে, কেমন? তৈরি থাকবেন। মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ও।

*

পরদিন ভোরে কাপড় পরার সময় পাশের ঘরে রোয়েনের নড়াচড়ার আওয়াজ পেল নিকোলাস। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু শিস দিতে বেরিয়ে এলো রোয়েন, তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল, রওনা হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছে।

বোরিস এখনো জাগে নি, ওদেরকে নাস্তা পরিবেশনের সময় জানালো টিসে।

অবাক কাণ্ডই বলব আমি। নিজের প্লেটে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। কাল রাতের ঘটনা মনে থাকায় ওর মতো রোয়েনও আড়ষ্ট হয়ে আছে। তবে রাইফেল আর প্যাক-কাঁধে ঝুলিয়ে উপত্যকা ধরে রওনা হতে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো ওরা, চোখে মুখে উত্তেজনা ও প্রত্যাশা ফুটে উঠলো।

ঘণ্টাখানেক হলো হাঁটছে, এ সময় ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকালো নিকোলাস, তারপর রোয়েনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে সাবধান করে দিল, পেছনে ফেউ লেগেছে।

কজি চেপে ধরে স্যান্ডস্টোনের বড় একটা বোল্ডারের আড়ালে রোয়েনকে টেনে নিয়ে এলো নিকোলাস। আড়ালে পৌঁছে শুয়ে পড়লো ওরা। লাফ দেয়ার ভঙ্গি নিল নিকোলাস, ডাইভ দিয়ে পড়লো নোংরা জোব্বা পরা রোগা-পাতলা একটা মূর্তির উপর। উপত্যকা ধরে ওদের পিছু পিছু উঠে এসেছে সে। চিৎকার দিয়ে জমিনে হাঁটু গাড়ল মূর্তিটা, ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করলো।

নিকোলাস তাকে হঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করালো। তামের! পিছু নিয়েছ কেন? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? আরবিতে জানতে চাইলো ও।

চোখ ঘুরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো তামের। না, মাফ চাই! দয়া করুন, মারবেন না! আমি কোনো ক্ষতি করতে চাই নি।

ছেড়ে দিন ওকে, নিকোলাস। তা না হলে আবার খিচুনি শুরু হবে।

নিকোলাস ছেড়ে দিতেই ছুটে এসে রোয়েনের পেছনে লুকাল তামের, ভয়ে ওর : একটা হাত আঁকড়ে ধরল, উঁকি দিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে নিকোলাসের দিকে।

মারব না, সত্যি কথা বললে মারব না, তাকে অভয় দিল নিকোলাস। কিন্তু সত্যি কথা না বললে গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে গাছে ঝোলার। কে তোমাকে পাঠিয়েছে?

আমি নিজে থেকে এসেছি। কেউ আমাকে পাঠায় নি, কাঁপতে কাঁপতে বলল তামের। ওই জায়গাটা দেখাব আপনাদের, যেখানে পবিত্র ডিক-ডিক আমাকে দেখা দিয়েছিল। ওটার চামড়ায় ব্যাপ্টিস্টের আঙুলের ছাপ ছিল।

হেসে ফেললো নিকোলাসও। ও সত্যি কথা বলছে কিনা সন্দেহ আছে আমার। আমি যতটুকু বুঝি, ডোরাকাটা ডিক-ডিকের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তামেরের দিকে তাকালো ও। যদি বুঝি যে মিথ্যে বলছ, সত্যি সত্যি তোমাকে গাছে ঝোলানো হবে, মনে থাকে যেন।

আমি মিথ্যে কথা বলছি না, বলে ফোঁপাতে শুরু করলো কিশোর ছেলেটা।

নাক গলাল রোয়েন। কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন ওকে! ও আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তামেরের মাথায় আদর করে হাত বুলালো।

ঠিক আছে, তোমাকে একটা সুযোগ দেওয়া হলো, বলল নিকোলাস। নিয়ে চলো আমাদের, দেখি কোথায় দেখেছিলে পবিত্র ডিক-ডিক।

আবার রওনা হলো ওরা। তামের হাঁটছে না, বলা চলে রোয়েনের পাশে নাচছে, হাতটাও সে ছাড়তে রাজি না। একশো গজও পেরোয় নি, চেহারা থেকে ভয়-ডর সব উধাও হয়ে গেল, আহ্লাদে আটখানা অবস্থা। চোখে-মুখে লাজুক ভাব নিয়ে খিকখিক করে হাসছে।

এক ঘণ্টা ওদেরকে পথ দেখালো তামের, ডানডেরা নদী থেকে দূরে সরিয়ে আনল। উপত্যকার অনেক উপর, উঁচু জমিতে উঠে আসার পর লাইমস্টোনের রিজ দেখতে পেল ওরা, হুকের মতো কাটা নিয়ে ঘন ঝোঁপগুলো গোটা এলাকাটাকে দুর্গম করে রেখেছে। ঝোঁপগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো, দেখে মনে হচ্ছে। এগোবার কোনো পথ নেই। তবে আঁকাবাঁকা একটা সরু পথ ঠিকই খুঁজে বের করলো তামের, এতো কম চওড়া যে দুপাশের কাঁটাঝোঁপ এড়াতে ধীর পায়ে সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো তামের, রোয়েনের কব্জিতে টান দিয়ে ওকেও নিজের পাশে দাঁড় করালো। হাত দিয়ে নিচের দিকটা দেখালো সে, প্রায় নিজের পায়ের আঙুলগুলো।

নদী! বলল তামের, গলায় উল্লাস। তার পাশে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস, অবাক হয়ে শিস দিল মৃদু। বিশাল এক বৃত্ত তৈরি করে তামের ওদেরকে পশ্চিমে নিয়ে এসেছে, তারপর ফিরিয়ে এনেছে ডানডেরা নদীর এমন একটা পয়েন্টে যেখানে প্রবাহটা এখনো বয়ে চলেছে গভীর নালার তলায়।

এ মুহূর্তে সেই গহ্বরের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। একবার তাকিয়েই নিকোলাস লক্ষ্য করলো, পাথুরে নালার মাথার দিকটা একশো ফুটের কম চওড়া হলেও, রিম-এর নিচে গহ্বরটা প্রসারিত হয়েছে। বহু নিচের পানির সারফেস থেকে উঠে আসা পাথরের পাঁচিল মাটির তৈরি তেজ বোতলের মতো ক্রমশ ফুলে উঠেছে। আবার ওটা সরু হয়েছে মাথা কাছাকাছি যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে। ওখানে দেখেছি, গহ্বরের অপরদিকটা দেখালো তামের। ওখানে কাটাঝোঁপের ভেতর থেকে একটা ঝরনার বেরিয়ে এসেছে। ধনুকের মতো বাঁকা পাথুরে পাঁচিলে ঝুলে আছে সবুজ শ্যাওলার জাল, তা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরে পড়ছে দুশো ফুট নিচের নদীতে।

ওপারে যদি দেখে থাকো, আমাদেরকে এপারে আনলে কেন?

চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে তামের। এদিকে আসাটা সহজ। ওপারের জঙ্গলে কোনো পথ নেই। ঝোঁপের কাঁটা লাগবে মেমসাহেবকে।

তামেরের কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল রোয়েন। গহ্বরের ঠোঁটে ঝুলে থাকা একটা গাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত হলো। ইতোমধ্যে দুপুর পেরিয়ে গেছে, গরমে ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে শরীর। রোয়েনকে নিকোলাস ইংরেজিতে বলল, মুকুটে টাইটার সিরামিক সম্পর্কে তামের কিছু জানলেও জানতে পারে, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।

প্রথমে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ জুড়ল রোয়েন, মাঝে মধ্যে তামেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ওটা কী, প্রধান পুরোহিতের মুকুটে নীল পাথরটা?

সেইন্টের পাথর ওটা, সেন্টফুমেনটিয়াসের প্রধান পুরোহিত বলেন, যিশুর মতোই পুরানো ওটা।

কোত্থেকে এলো ওটা, জানো তুমি?

মাথা নাড়লো তামের। বোধহয় আকাশ থেকে পড়েছে। তারপর হয়তো সেন্ট ফুমেনটিয়াস মারা যাবার সময় প্রধান পুরোহিতকে দিয়ে যান। কিংবা তার কফিনে ছিল, কবরে ঢোকানোর আগে বের করে নেওয়া হয়।

হ্যাঁ, হয়তো। তামের, তুমি সেন্ট ফুমেনটিয়াসের কবর দেখেছ?

ভয়ে ভয়ে চারদিকে চোখ বুলাল তামের, যেনো কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। শুধু অধিকারী পুরোহিতদের মাকডাসে ঢোকার অনুমতি আছে, মাথা নিচু করে বিড়বিড় করলো সে।

তুমি দেখেছ, নরম সুরে অভিযোগ করলো রোয়েন, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। তামেরের সন্ত্রস্ত ভাব লক্ষ্য করে উৎসাহ বোধ করছে ও। আমাকে বলতে পারো, আমি কাউকে বলব না।

মাত্র একবার, স্বীকার করলো তামের। আমার বয়সী কয়েকটা ছেলে টাবট পাথরটা ছোঁয়ার জন্য জোর করে পাঠায় আমাকে। না গেলে ওরা আমাকে মারধর করত। প্রিস্টের সহকারী সব ছেলেকেই পাঠায় ওরা। ঘটনাটার কথা মনে পড়ে

যাওয়ায় তার চেহারা শুকিয়ে গেল। সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। কেউ ছিল না, আমি একা। তখন মাঝরাত, পুরোহিতরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চারদিক অন্ধকার। মাকডাসে তো সেইন্টের আত্মা ঘুরে বেড়ায়, তাই না? ওরা আমাকে বলে দিয়েছিল, আমি যদি অযোগ্য বা অপবিত্র হই তাহলে সেইন্ট আমার মাথায় বাজ ফেলবেন।

সেইন্টের কবর পর্যন্ত গেলে তুমি? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। সমাধির ভেতরে ঢুকলে?

মাথা নাড়লো তামের। ঢোকার মুখে বার আছে। সেইন্টের জন্মদিনে শুধু প্রধান পুরোহিত ওখানে ঢুকতে পারেন।

তুমি তাহলে বারের ভেতর দিয়ে তাকালে?

হ্যাঁ, কিন্তু ভেতরটা অন্ধকার। সেইন্টের কফিন অবশ্য দেখা যাচ্ছিল। কাঠের কফিন, গায়ে পেইন্টিং আছে–সেইন্টের মুখ।

তিনি কি কালো?

না, ফর্সা। লাল দাড়ি আছে। পেইন্টিংটা খুব পুরানো। ঝাপসা হয়ে গেছে। কফিনের কাঠ পচে গেছে, গুঁড়ো হয়ে ঝড়ে পড়ছে।

সমাধির মেঝেতে শোয়ানো কফিনটা?

না। পাথরে একটা শেলফে খাড়া করা।

আর কিছু মনে করতে পারো তুমি? তামের মাথা নাড়তে রোয়েন অন্য প্রশ্ন করলো তাকে, কফিনটা কি মাকডাসের পেছনের দেয়ালে?

হ্যাঁ। বেদি আর টাবট পাথরের পেছনে।

বেদিটা কী দিয়ে তৈরি? পাথর দিয়ে?

কাঠের বেদি। মোমবাতি আছে, বড় একটা ক্রস আছে, কয়েকটা মুকুটও আছে। আর আছে পানপাত্র।

বেদির গায়ে কি ছবি আঁকা আছে?

না, খোদাই করা ছবি আছে। মুখগুলো কেমন যেনো, কাপড়-চোপড়ও অন্য রকম। ঘোড়া আছে।

টাবট সম্পর্কে বলুন, নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। আমাদের চার্চে টাবট স্টোন বলে কিছু নেই।

আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ কী। ইহুদিদের তাবেরনাক জাতীয় কিছু নাকি ওটা? আপনি জানার কথা।

ওর উদ্দেশ্যে ফিরলো রোয়েন। হ্যাঁ, অন্তত, মিশরীয় গির্জায় ব্যাপারটা তাই। এমব্রয়ডারি করা স্বর্ণের কাপড়ে মুড়ে একটা মণিমুক্তা খচিত বাক্সে রাখা হয়। বলা যেতে পারে, একটা গির্জার প্রাণ হলো তা।

রোয়েনের প্রশ্ন শুনে টাবট সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলো না তামের, শুধু জানালো, পাথরটা কাপড়ে মোড়া। সবাই বলে, শুধু সেইন্টের জন্মদিনে প্রধান পুরোহিত ওটা খোলেন।

নিকোলাস ও রোয়েন দৃষ্টি বিনিময় করলো, তারপর নিকোলাস বলল, চিন্তা করে বের করুন আমরা কীভাবে দেখতে পারি।

সেইন্টের জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আপনাকে হতে হবে ভারপ্রাপ্ত পুরোহিত… হঠাৎ সচকিত দেখালো রোয়েনকে, ফিসফিস করে জানতে চাইলো, আপনি কি… না, তা আপনি ভাবতে পারেন না।

আরে না, তা কি আমি ভাবতে পারি!

মাকডাসে আপনি ধরা পড়লে ওরা আপনাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।

উত্তরটা হলো, ধরা না পড়া।

আপনি গেলে আমিও যাব। কীভাবে ম্যানেজ করবেন?

ধীরে। নিকোলাস ঠোঁটে অলস হাসি। মাত্র দশ সেকেন্ড হলো আইডিয়াটা মাথায় এসেছে। প্ল্যান করার জন্য অন্তত দশটা মিনিট সময় দিন।

দু জনেই ওরা গহ্বরের ওপারে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো। নিস্তব্ধতা ভাঙল রোয়েন, কাপড়ে মোড়া একটা পাথর। টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট?

জোরে বলবেন না, শয়তান শুনছে।

হঠাৎ চিৎকার দিল তামের। ওই দেখুন! ওদিকে তাকান! রোয়েনের হাত ধরে ঝকালো সে। বলেছি না! অপর হাতে নদীর ওপারটা দেখাচ্ছে। কাটাঝোঁপের কিনারায়! দেখতে পাচ্ছেন না?

কী? কী দেখবো?

ডোরাকাটা ডিক-ডিক। জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের ডিক-ডিক। গায়ে পবিত্র ছাপ…

ওপারের ঝোঁপের গায়ে নরম, খয়েরি একটা অস্পষ্ট প্রলেপ দেখতে পেল রোয়েন। কি জানি। এতো দূর থেকে…।

প্যাক হাতড়ে বাইনোকুলার বের করলো নিকোলাস। কিছুক্ষণ দেখার পর হেসে উঠলো। মাই গড! বুড়ো দাদার রেপুটেশন এতোদিনে নিরাপদ হলো! এ তো সত্যি সত্যি ডোরাকাটা ডিক-ডিক! বাইনোকুলারটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিল।

আগের দিন সাধারণ যে ডিক-ডিকটা ওরা দেখেছিল, আকারে এটা তার অর্ধেক হবে। গায়ের রঙও ধূসর নয়, উজ্জ্বল লালচে খয়েরি। তবে প্রথমেই চোখে লাগে কাঁধে ও পেছন দিকের গাঢ় চকলেট রঙের ডোরাগুলো পাঁচটা দাগ, পরস্পরের সঙ্গে সমান দূরত্বে, দেখে সত্যি সত্যি মনে হবে পাঁচ আঙুলের ছাপ।

ডিক-ডিকের অর্ধেক গায়ে ছায়া পড়েছে, বাতাস শোঁকার সময় নাক কোঁচকাচ্ছে। মাথা উঁচু করে আছে, সন্দিহান ও সতর্ক। ম্যাডোকোয়া হারপারি কোনো সন্দেহ নেই, ফিসফিস করে রোয়েনের কানে কানে বলল কী। দুঃখিত, গ্রান্ড পা- তোমাকে জোচ্চোর ভাবার জন্য!

রাইফেলটা হাতে নিল সে, বোল্ট টেনে চেম্বারে একটা রাউন্ড ঢোকালো। রোয়েন জানতে চাইলো, গুলি করবেন নাকি?

এখুনি না। ছোট টার্গেট, তিনশো গজ দূরে। মাথা নাড়লো নিকোলাস। আরো কাছে আসার অপেক্ষায় থাকব।

কেমন করে পারবেন এটা করতে? এতো সুন্দর একটা প্রাণী?

সুন্দর বা কুৎসিত- কী আসে যায়? এখানে আসার পেছনে ডিক-ডিক শিকার একটা কারণ!

কথা না বলে চোখে আবার বাইনোকুলার তুললো রোয়েন। পালিয়ে যা, পালিয়ে যা, মনে মনে বলছে। কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে. গহ্বরের দিকে এগিয়ে আসছে ডিক-ডিক।

দুশো গজ, বিড়বিড় করলো নিকোলাস, শুয়ে পড়েছে ও, টেলিস্কোপ সাইটে চোখ। এ সময় হঠাৎ উত্তেজনায় টান টান হলো খুদে হরিণ, ফেলে আসার পথ ধরে ছুটলো, অদৃশ্য হয়ে গেল কাঁটা ঝোঁপের ভেতর।

ভয় পেল কেন? বলার পর মুখের ভাব বদলে গেল নিকোলাসের বাতাসে কিসের যেনো একটা গুঞ্জন, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। হেলিকপ্টার! রোয়েনের হাত থেকে বাইনোকুলার নিয়ে আকাশের দিকে তাক করলো। আকাশে মেঘ নেই, একটু পরই যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখা গেল। কাঠামোটা চিনতে পারলো নিকোলাস।

বেল জেট রেঞ্জার। এদিকেই আসছে। আসুন, লুকিয়ে পড়ি।

কাটাঝোঁপের ভেতর গা ঢাকা দিল ওরা। হেলিকপ্টারটাকে এখনো বাইনোকুলার ধরে রেখেছে নিকোলাস। সম্ভবত ইথিওপিয়ান এয়ার ফোর্স অ্যান্টি শুফতা টহলে বেরিয়েছে। না, দেখে তো সামরিক বলে মনে হচ্ছে না। সবুজ আর লাল ফিউজিলাজ, লাল ঘোড়া। লাল ঘোড়া তো পেগাসাস এক্সপ্লোরেশনের লোগো।

কাছাকাছি চলে আসায় রোয়েন এখন খালি চোখেই লোগোটা দেখতে পাচ্ছে। ওদের সামনে আধ মাইল দূরে রয়েছে কপ্টার, উড়ে যাচ্ছে নীল নদের দিকে।

জ্যাক হেলম্ ভালো একটা বাহন পেয়েছে, বলল নিকোলাস। যখন খুশি আমাদের উপর নজর রাখতে পারবে।

কপ্টারটা উপখাদের কুঁজ পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, সম্ভবত মঠের দিকে যাচ্ছে।

বসের নির্দেশে ওরা সম্ভবত আমাদের ক্যাম্প খুঁজছে, আন্দাজ করলো নিকোলাস। চলুন, ফিরি। না, সবুর! ইঞ্জিনের আওয়াজ আবার বাড়তে শুরু করেছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁকে আবার কপ্টারটাকে দেখা গেল, ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। নদীটাকে অনুসরণ করছে ওরা, বলল নিকোলাস। কিছু খুঁজছে। বলে মনে হয়।

আমাদের?

এ সময় ওদেরকে চমকে দিয়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটলো তামের। বাঁচাও! তার স্বরে চিৎকার করছে। কে কোথায় আছ বাঁচাও আমাকে! শয়তান তাড়া করেছে! যিশু তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বাঁচাও! ফাঁকা জায়গায় বেরিয়েও থামছে না, ছুটছে এখনো।

পাইলট তাকে দেখে ফেলেছে, কপ্টার ঘুরে গেছে ওদের দিকে। খুব নিচু দিয়ে এলো ওটা, গহ্বরের ঠোঁটের কাছে স্থির হলো শূন্যে। ফরওয়ার্ড কেবিনের উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর দুটো মাথা দেখতে পাচ্ছে ওরা। আরো নিচে নামছে পাইলট। নদীর উপর ঝুলে থাকলো। ঝোঁপের ভেতর কুঁকড়ে আছে ওরা, নিকোলাসকে দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে রোয়েন। কানে ভারী রেডিও এয়ারফোন আর গাঢ় চশমা থাকলেও জ্যাক হেলকে চিনতে পারলো ওরা। পাইলট কালো। দু জনেই গলা লম্বা করে নিচে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরা পড়ে যাওয়ায় এখন আর লুকিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। হাত-পা ছড়িয়ে পেছনের গাছে হেলান দিল নিকোলাস, হ্যাঁটা মাথার পেছনে ঠেলে দিয়ে হাত নাড়লো হেলমের উদ্দেশে।

ফোরম্যান সাড়া দিল না। নিকোলাসের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দিয়াশলাই জ্বাললো, ঠোঁটে ঝোলা আধ পোড়া চুরুটে ধরালো আগুনটা। কাঠিটা ফেলে দিয়ে এক মুখ ধোয়া ছাড়লো নিকোলাসকে দিকে, তারপর কী যেনো বলল পাইলটকে। উপরে উঠলো কপ্টার, বাঁক ঘুরে উত্তর দিকে চলে গেল।

শুধু আমাদেরকে নয়, আমাদের ক্যাম্পটাও দেখে গেল ওরা, বলল রোয়েন।

চলুন, ফিরি, বলল নিকোলাস। কাল আবার আসা যাবে।

ওদেরকে আমার ভয়ই লাগছে, বলল রোয়েন, তবে নিকোলাস চুপ করে আছে দেখে প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলো, তামেরের আবার খিঁচুনি শুরু হয় নি তো?

পথের ধারেই পাওয়া গেল তাকে। কাঁপছে সে এখনো, কাঁদছে, তবে খিচুনি ওঠে নি। রোয়েন গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে শান্ত হলো সে। ওদের পেছন পেছন অনেক দূর এলো, তারপর কখন এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল মঠের দিকে।

*

সন্ধ্যের আগে আরেকবার মঠ দেখতে এলো ওরা। পাথুরে ক্যাথেড্রালের প্রবেশমুখে থামলো, তারপর আউটার চেম্বারে ঢুকে তরুণ উপাসকদের ভিড়ে মিশে গেল।

খোলা দরজা দিয়ে মিডল চেম্বারের ভেতর তাকিয়ে ফিসফিস করলো রোয়েন, তামেরের কথা থেকে বোঝা যায়, ডিউটিতে থাকা পুরোহিত কখন ঘুমিয়ে পড়বে তার অপেক্ষায় থাকে শিক্ষানবিস তরুণরা।

কিন্তু ভেতরের সম্পর্কে আমাদের তো তেমন করে কিছু জানা নেই, নিকোলাস বলে।

দেখা গেল পুরোহিতরা বিনা বাধায় ভেতরে আসা-যাওয়া করছেন, কারো অনুমতির জন্য কোথাও থামছেন না। তবে দরজায় পাহারায় দাঁড়ানো পুরোহিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় নাম ধরে সম্বোধন করছেন সবাই। পরস্পরকে সবাই তারা চেনেন। নিকোলাস বলল, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, তারপর ধরা পড়ে গেলাম। পবিত্র এলাকায় অনুপ্রবেশের সাজাটা যেনো কী?

নীলনদের বুভুক্ষু কুমীরের খোরাক বানানো হয় না তো? হেসে উঠলো রোয়েন। তবে আমাকে না নিয়ে ওখানে আপনি ঢুকছেন না।

এ নিয়ে এখুনি তর্ক করতে রাজি নয় নিকোলাস। খোলা দরজা দিয়ে যতটুকু পারা যায় দেখে নিতে চাইছে ও। আউটার চেম্বারের চেয়ে মিডল চেম্বারটা আকারে ছোট বলে মনে হলো। ভেতরে ছায়ার ভেতর দেয়ালচিত্র দেখা যাচ্ছে। মুখোমুখি দেয়ালে আরেকটা দরজা। তামেরের বর্ণনা অনুসারে ওটা মাকডাসে ঢোকার পথ। পাঁকটা বন্ধ করা হয়েছে গ্রিলের গেট বসিয়ে। গেটের ফ্রেমটা গাঢ় রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি, তবে বারগুলো লোহার।

দরজার দু পাশে পাথুরের সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত এমব্রয়ডারি করা পর্দা ঝুলছে, তাতে সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের জীবন কাহিনী থেকে নেওয়া দৃশ্য ফুটে উঠেছে। একটা দৃশ্যে নতমস্তকে সমবেত শিষ্যদের ধর্মীয় বাণী শোনাচ্ছেন তিনি, এক হাতে বাইবেল, অপর হাতটা আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে উপরে তোলা। আরেকটা পর্দায় ফুটে উঠেছে একজন সম্রাটকে ব্যাপ্টিজমে দীক্ষিত করার দৃশ্য। জালি হোরার মতোই মাথায় উঁচু আর সোনালি মুকুট পরে আছেন সম্রাট, সেন্টের মাথার চারপাশে একটা বলয়। সম্রাটের মুখ কালো, তবে সেইন্টের মুখ সাদা।

ইতিহাস কি এখানে বিশুদ্ধ? বিড়বিড় করে নিজেকেই প্রশ্নটা করলো নিকোলাস।

কী ভেবে হাসছেন আপনি? জানতে চাইলো রোয়েন। ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় পেয়ে গেছেন?

না, ভাবছি ডিনারের কথা। চলুন, ফিরি।

ডিনারে বসে দেখা গেল বোরিস ঢক ঢক করে শুধু মদই খাচ্ছে। সারাদিন কে কী করলো বা দেখলো আলোচনা হচ্ছে। দুপুরে তারই শিকার করা কবুতরের রোস্ট খাচ্ছে সবাই মজা করে।

তো, ইংরেজ সাহেব, কেমন শিকার করলেন আজ? ভয়ঙ্কর ডিক ডিক আবার আপনাকে আক্রমণ করে বসে নি? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল বোরিস।

আপনার ট্র্যাকারদের কী খবর? কোনো চিহ্ন মিললো? নিকোলাস শুধায়।

পায় নি আবার! কুড়ু, বুশবাক, বাফেলো- কি নেই এখানে? এমনকি, ডিক ডিক পর্যন্ত পেয়েছে ওরা, কিন্তু আফসোস, ডোরাকাটা নয়!

মুখ খুলতে যাচ্ছিল রোয়েন, চোখ ইশারায় নিষেধ করলো নিকোলাস, নিচু গলায় আরবিতে বলল, জানলে কাল ওরা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইবে।

মিস্টার নিকোলাস, স্যার, মা জননী কি আমাকে ভদ্রতা বলে কিছু শেখান নি? সবাই না বুঝলে, সে ভাষায় কথা বলতে নেই। নিন, খানিকটা ভদকা খান।

আমার ভাগটুকুও আপনি খেয়ে ফেলুন, বলল নিকোলাস।

ডিনারের সময় প্রায় কোনো কথাই বলছে না টিসে। করুণ আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। রোয়েন লক্ষ্য করলো, স্বামীর দিকে ভুলেও সে তাকাচ্ছে না। ডিনার শেষ হতে নিকোলাস আর রোয়েন উঠে পড়লো, আগুনের ধারে স্ত্রীকে বসিয়ে রাখলো বোরিস।

নিজেদের কুঁড়ের দিকে যাবার সময় নিকোলাস বলল, যেভাবে গিলছে বোরিস, আজ রাতেও না বউকে ধরে পেটায়।

আজ সারাদিন টিসের উপর অত্যাচার করেছে লোকটা, বলল রোয়েন। আমাকে টিসে বললেন, আদ্দিসআবাবায় ফিরেই স্বামীকে ছেড়ে দেবেন।

এরকম একটা জানোয়ারের সঙ্গে বিয়ে হলো কী করে? দেখতে তো খুবই সুন্দর, ভালো একজনকে বেছে নিতে পারলেন না?

সব মেয়ে সমান নয়, জবাব দিল রোয়েন। কিছু মেয়ে জানোয়ার দেখলে আকৃষ্ট হয়। বিপদের মধ্যে রোমাঞ্চ থাকে, সেটাই বোধহয় কারণ। সে যাই হোক, টিসে জানতে চাইছেন কাল আমাদের সঙ্গে বেরুতে পারবেন কিনা। স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বেচারি।

অন্তত ওঁকে রেহাই দেওয়ার জন্য সঙ্গে নেওয়া দরকার, রাজি হলো নিকোলাস।

পরদিন ভোর হওয়ার আগেই রওনা হলো ওরা। রিগবি হাতে নিকোলাস সামনে থাকলো, পেছনে মেয়ে দু জন কথা বলতে বলতে আসছে। ডোরাকাটা ডিক-ডিক সম্পর্কে জানানো হলো টিসেকে, ওদের প্ল্যানটাও ব্যাখ্যা করা হলো। আগের দিন তামের যে পথ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই পথটাই অনুসরণ করছে ওরা।

সূর্য বেশ অনেকটা উপরে উঠে আসার পর ফাটলটার ঠোঁটে, কাটা-ঝোঁপের নিচে পৌঁছলো ওরা। ওত পেতে বসে থাকা ছাড়া আজ কোনো কাজ নেই ওদের। খানিক পর রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, বেচারি ডিক-ডিককে যদি গুলি করতে পারেন, ওপার থেকে সেটাকে আনবেন কীভাবে?

ক্যাম্প ছাড়ার আগেই ব্যবস্থা করেছি, বলল নিকোলাস। হেড ট্র্যাকারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। গুলির শব্দ হলে রশি নিয়ে হাজির হবে সে, ওপারে পৌঁছতে সাহায্য করবে আমাকে।

ওদের নিচে ফাটলটার দিকে তাকালো টিসে।

এর উপর দিয়ে ওপারে যেতে কোনোদিনই রাজি হব না আমি।

টিসে আর রোয়েন নিকোলাসের কাছাকাছি শুয়ে পড়লো। নিচু গলায় গল্প করছে হাতে রিগবি নিয়ে অপেক্ষা করছে নিকোলাস, কাটা গাছে হেলান দিয়ে। দুপুর পেরিয়ে গেল। ডিক-ডিকের দেখা নেই।

গরমে সিদ্ধ হচ্ছে মেয়েরা আগেই মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের। ঝিমুনি এসে যাচ্ছে।

আরো প্রায় আধঘণ্টা পর কী একটা শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল নিকোলাসের। ওর পেছনের কাটাঝোঁপ থেকে আওয়াজটা এসেছে বলে মনে হলো। খুবই অস্পষ্ট, তবে পরিচিত। এমন একটা শব্দ, এক নিমেষে পুরোপুরি স্রোত নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে। একে-ফরটিসেভেনের সেফটি ক্যাচ সামনে টেলে ফায়ার পজিশনে আনা হয়েছে।

এক ঝটকায় কোল থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে দু বার গড়ান দিল নিকোলাস, শরীর মুচড়ে পাশে শুয়ে থাকা মেয়ে দুটোকে আড়াল দেওয়ার চেষ্টা একই সঙ্গে রিগবিটা কাঁধে তুলে ফেলেছে, তাক করেছে পেছনের ঝোঁপ।

মাথা তুলবেন না, হিসহিস করলো নিকোলাস। নিচে রাখুন মাথা! ট্রিগারে আঙুল,পাল্টা গুলি করার জন্য প্রস্তত। টার্গেট দেখতে পেয়েই ব্যারেল ঘোরালো সেদিকে।

বিশ কদম দূরে এক লোক গুঁড়ি মেরে বসে আছে, হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল সরাসরি নিকোলাসের মুখে তাক করা। চকচকে কালো লোকটা, ভেঁড়া-ফাঁড়া ক্যামোফ্লেজ ফেটিগ পরে আছে, মাথার নরম ক্যাপটাও তাই। ওয়েবিং বেল্টে একটা বুশনসাইফ, গ্রেনেড, পানির বোতল ও গেরিলাযোদ্ধার অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে। প্রফেশনাল শুফতা, চিন্তা করছে নিকোলাস, ঝুঁকি নেওয়া যায় না। একই সঙ্গে উপলব্ধি করলো, ইচ্ছে থাকলে এতোক্ষণে মেরে ফেলতে পারতো ওকে।

রিগবি তাক করলো নিকোলাস অ্যাসল্ট রাইফেল মাজলের এক ইঞ্চি উপরে, ওটার পেছনে গেরিলার রক্তলাল ডান চোখে।

অচল বা চালমাত অবস্থা; চোখ সরু করে জানান দিল লোকটা। তারপর আরবিতে নির্দেশ দিল, সলিম, মেয়ে দুটোকে কাভার দাও লোকটা নড়লে গুলি করবে ওদের।

খসখস আওয়াজ শুনে একপাশে তাকালো নিকোলাস। ঝোঁপের আড়াল থেকে আরেকজন গেরিলা বেরিয়ে এলো। একই ড্রেস, তবে কোমরের কাছে ধরে আছে রাশিয়ান আরপিডি লাইট মেশিন গান। সাবধানে এগিয়ে এসে পয়েন্ট-ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মেয়েদের উপর মেশিন গান তাক করলো সে।

ওদের চারপাশের ঝোঁপ থেকে আরো আওয়াজ আসছে। দু জন নয়, গেরিলাদের গোটা একটা গ্রুপ, বুঝতে পারলো নিকোলাস। জানে, মাত্র একটা গুলি করার সুযোগ পাবে ও। ফলাফল যা-ই হোক, রোয়েন আর টিসে ততক্ষণে লাশে পরিণত হবে।

মাজলটা ধীরে ধীরে নিচু করলো নিকোলাস। তারপর মাটিতে রাইফেল নামিয়ে মাথার উপর হাত তুললো। ওরা যা বলে শুনুন।

সোজা হলো গেরিলা লীডার, নিজের লোকদের সঙ্গে দ্রুত কথা বলছে। ওর রাইফেল আর প্যাক নিয়ে নাও।

আমরা ব্রিটিশ নাগরিক, বলল নিকোলাস সাধারণ ট্যুরিস্ট। যোদ্ধা বা সরকারি লোক নেই।

কথা নয়, একদম চুপ! কঠিন সুরে খেঁকিয়ে উঠলো লিডার। আরবি ভাষা শুনে চমকে গেছে। আড়াল থেকে গেরিলারা বেরিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে পাঁচজনকে দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তবে অনেকেই হয়তো সামনে বেরোয় নি নড়াচড়ার ধরনই বলে দেয় প্রফেশনাল, গুলি পথে বাধা হচ্ছে না, সুযোগ দিচ্ছে না পালানোর ঝটপট সার্চ করা হলো ওদেরকে, তারপর ধমক দিয়ে পথে এনে তোলা হলো।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জানতে চাইলো নিকোলাস।

কোন প্রশ্ন নয়! ওর শোল্ডার রেডের মাঝখানে একে-ফরটিসেভেনের বাঁট দিয়ে আঘাত করলো একজন গেরিলা। পড়েই যাচ্ছিল, কোনোরকমে তাল সামলালো।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে ওদেরকে। সূর্যের অবস্থান লক্ষ করছে নিকোলাস, সুযোগ পেলেই দেখে নিচ্ছে পাহাড়-প্রাচীরের চূড়াগুলো। পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা, নীলনদের কোর্স ধরে সুদান সীমান্তের দিকে। শেষ বিকেলের দিকে আন্দাজ করলো দশ মাইল পেরিয়েছে। ইতোমধ্যে উপত্যকার একটা পাশে পৌঁছেছে ওরা, ডালটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। আরো মাইলখানেক এগোবারপর গেরিলাদের ক্যাম্পটা দেখা গেল। কয়েকটা মাত্র একচালা, সেন্ট্রিরা লাইট মেশিন গান নিয়ে সর্তক হয়ে আছে।

ক্যাম্পের মাঝখানের একটা একচালার সামনে দাঁড় করানো হলো ওদেরকে। ভেতরে নিচু ক্যাম্প টেবিলের উপর ঝুঁকে ম্যাপ দেখছে তিনজন অফিসারদের মধ্যে কমান্ডারকে আলাদাভাবে চেনা গেল। গেরিলা গ্রুপের লীডার তার কাছে গিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কিছু বলল, ইঙ্গিতে বন্দিদের দেখালো।

সোজা হলো কমান্ডার, বেরিয়ে এলো রোদে। লোকটা বেশি লম্বা নয়, তবে চেহারায় এতো বেশি গাম্ভীর্য ও কর্তৃত্ব যে সেটা প্রথমে চোখে পড়ে না। কাঁধ দুটো চওড়া, কাঠামোটা চৌকো ও নিরেট। মুখে কোঁকড়ানো কালো দাড়ি, অল্প দুয়েকটা শাদা। চেহারায় মার্জিত একটা ভাব স্পষ্ট, সুদর্শনও বলতে হবে। চোখ দুটো চঞ্চল ও বুদ্ধিদীপ্ত, দৃষ্টি নিক্ষেপে ক্ষিপ্রতা লক্ষ্য করার মতো। আমার লোক বলছে তুমি নাকি আরবি জানো, নিকোলাসকে বলল সে।

তোমার চেয়ে ভালো জানি, মেক নিমুর, জবাব দিল নিকোলাস। তা, এ তোমার শেষ পরিণতি? একদল ডাকাতের সর্দার? কিডন্যাপারদের লীডার?

এক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে থাকলো মেক নিমুর। নিকোলাস? ওহ্ গড! তোমাকে আমি চিনতে পারি নি? তোমাকে? হাসছে সে। দুই হাত মেলে দিল, ভঁজে আটকে বুকে টেনে নিল নিকোলাসকে। নিকোলাস! নিকোলাস! দু গালে দু বার চুমো খেলো, তারপর বাহু সমান দূরে ঠেলে দিয়ে মেয়ে দূটোর দিকে তাকালো। এ ব্যাটা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল ওদেরকে। দু জনেই ওরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এদিকে গেরিলা দল ততক্ষণে হাওয়া।

লজ্জা দিচ্ছ, মেক।

নিকোলাসকে আবার চুমো খেলো মেক নিমুর। তাও একবার নয়, দু বার।

না একবারই, প্রতিবাদ করলো নিকোলাস। দ্বিতীয়বার ভুলে। ওদের গুলিতে তোমাকে মরতে দেওয়া উচিত ছিল আমার।

গলা ছেড়ে হেসে উঠলো গেরিলা কমান্ডার মেক। প্রায় পনেরো বছর আগের কথা, তাই না? তুমি কী এখনো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে আছো? এতোদিনে নিশ্চয়ই জেনারেল হয়ে গেছ!

থাকলে হতাম, কিন্তু থাকি নি।

মেয়ে দুটোর মধ্যে কে জানে কেন টিসেকে মনে ধরেছে মেকের, অন্তত ঘন ঘন তার দিকেই তাকাচ্ছে সে। তোমাকে আমি চিনি। কয়েক বছর আগে আদ্দিসে দেখেছি। তখন কিশোরী ছিলে। তোমার বাবা অল্টো জিমেন, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। মেনজিসটু তাকে খুন করে।

আমিও আপনাকে চিনি, বলল টিসে। আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস, মেনজিসটুর বদলে আপনারই ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত ছিল। সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো সে।

সোজা হয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। কারো সামনে মাথা নিচু করো না। নিকোলাসের দিকে তাকালো কমান্ডার মেক। আমার লোকেরা একটু বেশ উৎসাহী, খারাপ ব্যবহার করায় দুঃখিত। তবে আমরা খবর পেয়েছি যে মঠে কিছু লোকজন। এসেছে, প্রশ্ন করছে নানা রকম। এসো, নিকোলাস, ভেতরে এসো।

ক্যাম্প ফায়ার থেকে কেটলিতে কফি বানিয়ে আনা হলো, মগে ভরে ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। পুরানো দিনের কথা স্মরণ করলো নিকোলাস ও মেক। ফকল্যান্ড যুদ্ধের আগে মেনজিস্টুর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে ওরা দু জন।

কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ, মেক, নিকোলাস বলে, হারজিত হয়ে গেছে। এখন কেন বনে-জঙ্গলে দলবল নিয়ে ঘুরে ফিরছো? কেন আদ্দিসে গিয়ে আরাম-আয়েশে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছ না, অন্যদের মতো?

এখনো আদ্দিসে মেনজিন্টুর মতো শত্রু আছে আমার। শত্রুমুক্ত ইথিওপিয়া না হলে কেমন করে লড়াই ছেড়ে দিই? মেক নিমুর জানায়।

এরপর ইথিওপিয়ার রাজনীতি নিয়ে গভীর আলাপে মগ্ন হয়ে যায় নিকোলাস ও মেক। কী নিয়ে কথা বলছে তারা, আলোচ্য চরিত্রই বা কারা কিছুই বুঝতে পারলো না রোয়েন। তবে, বিভিন্ন বিষয়ে নিকোলাসের প্রজ্ঞা দেখে অবাক হলো সে। এমন কী মেক নিমুর পর্যন্ত নিকোলাসের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ চাইছে!

তার মানে, এখন ইথিওপিয়ার সীমান্তের বাইরে, সেই সুদান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তোমার যুদ্ধ? নিকোলাস শুধালো নিমুরকে।

সুদানে তো বিশ বছর ধরেই আগুন জ্বলছে, একমত হয়ে বলে মেক। উত্তরের মুসলমানদের সঙ্গে দক্ষিণের খ্রিস্টানদের লড়াই চলছে ওখানে।

আমি সেটা জানি, মেক। কিন্তু তা হলো সুদানে- তোমার যুদ্ধ নয় ওটা!

অবশ্যই এটা আমার যুদ্ধ। মেক একরোখা স্বরে বলে। আমি সৈনিক এবং খ্রিস্টান।

চোখে সম্মতি নিয়ে সায় দেয় টিসে। গোগ্রাসে মেক নিমুরের কথা গিলছে সে।

অল্টো মেক যিশুর পথের সৈনিক। সাধারণ লোকের অধিকারের জন্য কাজ করছে সে। অভিভুত স্বরে নিকোলাসকে বলল টিসে।

হুম। লড়াই ওর রক্তে। নিকোলাস হাসে।

তো, নিকি, এখানে কী করছো তুমি? যদি সৈনিক না হয়, যদি লড়াই ভালো না-ই বাসো, তবে কী করছো এ জঙ্গলে? মেকের কণ্ঠে কৌতূহল।

এসেছি অ্যাবে গিরিখাদে, নিকোলাসের জবাব। ডিক-ডিক শিকার করব?

কী বললে? ডিক-ডিক? মেকের চোখে অবিশ্বাস। তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠলো। তুমি? ডিক-ডিক শিকার করবে? তুমি? নাহ্, বিশ্বাস করলাম না। তোমার অন্য কোনো মতলব আছে।

প্রশ্ন হলো, প্রয়োজনে তোমার সাহায্য পাব কিনা।

চাইলেই পাবে। দু দু বার জান বাঁচিয়েছ।

একবার, শুধরে দিল নিকোলাস।

এমন কি একবারও যথেষ্ট।

*

কাল সকালে সেন্ট ফুমেনটিয়াস মঠে ওদেরকে পৌঁছে দিবে মেক। তিমকাত উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য গেরিলাদের নিয়ে তারও সেখানে যাবার কথা। প্রধান পুরোহিত জালি হোরা তার বন্ধু। নিকোলাস আন্দাজ করলো, মঠটা আসলে মেকের ডীপ কাভার বেস। সম্ভবত সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে প্রতিপক্ষ বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তথ্যও পায় সে।

একটা একচালার অর্ধেকটা চট দিয়ে ঘিরে ছেড়ে দেওয়া হলো নিকোলাস আর রোয়েনকে, বিছানা তৈরি হলো শুকনো ঘাস বিছিয়ে। মশা তাড়াবার জন্য ধূপ জ্বালা হলো। রোয়েন আর নিকোলাস কাছাকাছি শুয়েছে, রোয়েনের শরীর চাদরে ঢাকা। ঘরের দরজা খোলা, বাইরে ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল মেক আর টিসেকে।

সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় রোয়েন বলল, ইথিওপিয়ার মেয়েরা মনে হচ্ছে। আরবের মতো নয়। আরবের কোনো মেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত একা বসে থাকবে না। বিশেষ করে সে যদি বিবাহিতা হয়।

যা-ই বলেন, ওদের দুজনকে একসঙ্গে মানিয়েছে বেশ। নিকোলাস নিজের মত দেয়। ওদের জন্য আমার শুভকামনা রইলো!

এরপর রোয়েনের দিকে ফিরে ও জানতে চাইলো, আপনি কেমন, রোয়েন? একজন আড়ম্বরপূর্ণ, লাজুক আরব মেয়ে নাকি প্রগতিশীল পশ্চিমা নারী?

এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সময় মনে হয় এখনো আসে নি; অথবা হয়তো অনেক দেরী হয়ে গেছে! বলেই, পাশ ফিরে নিকোলাসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল রোয়েন।

আহ্! শুভরাত, ওইজিরো রোয়েন।

শুভরাত, অল্টো নিকোলাস, মুখ না ঘুরিয়েই বলল রোয়েন, যেনো ওর ঠোঁটে জেগে ওঠা হাসিটা নিক দেখতে না পায়।

*

পরদিন ভোর হওয়ার আগেই রওনা হয়ে গেল গেরিলারা। মার্চ শুরু হলো পুরোপুরি সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে, মূল দলের সামনে ও দু পাশে থাকলো স্কাউটরা। নিকোলাসকে মেক জানালো, গিরিপথের এদিকে খুব কমই আসে আর্মি, তবু তারা সারাক্ষণ সতর্ক থাকে।

চলার পথে টিসের উচ্ছ্বাস আর আবেগ হলো দেখার মতো। তার মুগ্ধ দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও মেকের উপর থেকে নড়ছে না। রোয়েনের কানে কানে বলল, পারলে একমাত্র উনিই আমাদের দেশটাকে এক করতে পারবেন, হাজার বছরেও যে কাজ কেউ পারে নি। ওকে দেখে আমি যেনো আমার কৈশোর ফিরে পেয়েছি। আনন্দ আর আশা জা ছে বুকে।

মঠের কাছাকাছি পৌঁছতে সারাটা সকাল লেগে গেল। ডানডেরা নদীকে দেখামাত্র গেরিলাদের নিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লো মেক মঠে পাঠানো হলো মাত্র চারজন স্কাউকে। এক ঘণ্টা পর মাথায় বড় আকারের বান্ডিল নিয়ে একদল তরুণ উপাসক এলো মঠ থেকে। মেককে সমীহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালো তারা, বান্ডিলগুলো রেখে আবার নেমে গেল সরু পথ ধরে গিরিখাদে।

বান্ডিল থেকে বেরুল শিক্ষানবিস সন্ন্যাসীদের উপযোগী ঢোলা আলখেল্লা। গেরিলাদের মধ্যে শুধু যারা খ্রিস্টান, তারা পারবে। দেখা গেল আলখেল্লার ভেতর শুধু সাইডআর্মস ভরলো গেরিলারা। বাকি সব অস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাহাড় প্রাচীরের গুহায় রেখে যাওয়া হচ্ছে, পাহারায় থাকবে কয়েকজন সেন্ট্রি।

সন্ন্যাসী সেজে রওনা হয়ে গেল গেরিলারা, মঠ আর মাত্র কয়েক মাইল দূরে। পথ থেকেই বিদায় নিল নিকোলাস, মেয়ে দু জনকে নিয়ে ফিরে এলো ক্যাম্পে।

রাগে ও হতাশায় ফাঁকা জায়গাটায় পায়চারি করছিল বোরিস। তুমি একটা খারাপ মেয়েমানুষ! টিসেকে দেখেই মারমুখো হয়ে ছুটে এলো সে। সারারাত দেহদান করে এলে!

কাল সন্ধ্যায় আমরা পথ হারিয়ে ফেলি, বলল নিকোলাস, গেরিলাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বোরিসকে বলার জন্য এ মিথ্যে গল্পটা ওকে শিখিয়ে দিয়েছে মেক। আজ সকালে একদল সন্ন্যাসী আমাদের দেখতে পেয়ে ফিরিয়ে আনে।

হারিয়ে তো যাবেনই, মিস্টার! খেঁকিয়ে উঠলো বোরিস। গাইড হিসেবে আমাকে ভাড়া করেছেন, অথচ আমাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা উঠলে আপনার অ্যালার্জি হয়! খারাপ মেয়েমানুষ, তোমার সঙ্গে আমার পরে বোঝাঁপড়া হবে। যাও, কী খাওয়া হবে দেখো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছতলায় দুপুরের খাবার পরিবেশন করলো টিসে। ওরা খাচ্ছে, রোয়েনের হাতে টোকা দিয়ে নিকোলাস বলল, আপনার সেই ভক্ত হাজির!

চুপিচুপি কখন এসেছে, কেউ দেখে নি তামেরকে। একটা কুঁড়ের পাশে গুঁড়ি মেরে বসে আছে। রোয়েন তার দিকে তাকাতেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল মুখ, বোকার সলজ্জ হাসি হাসছে।

আপনার সঙ্গে বিকেলে আমি বের হচ্ছি না, বোরিসের কান বাঁচিয়ে নিকোলাসকে বলল রোয়েন। আশঙ্কা করছি টিসে উপর আবার আজ অত্যাচার হবে। আপনি তামেরকে নিয়ে যান।

রওনা হওয়ার সময় রোয়েনের খোঁজে চারদিকে তাকালো তামের, কিন্তু রোয়েন তার কুঁড়ে থেকে বেরুল না। অগত্যা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিকোলাসের পিছু নিল সে। তুমি আমাকে নদীর ওপারে নিয়ে যাবে, বলল নিকোলাস। যেখানে পবিত্র প্রাণীটা থাকে।

উত্তেজনার নতুন খোরাক পেয়ে নিকোলাসের সামনে চলে এলো তামের, ফুর্তিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।

ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে এসে আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে এক ঘণ্টা এগুলো ওরা। ক্ষয়ের কারণে এবড়ো থেবড়ো হয়ে থাকা পাথরেরমাঝখানে হারিয়ে গেছে পথটা, চেনাই মুশকিল। কোনো দিকে খেয়াল নেই, লাফিয়ে একের পর এক কাঁটাঝোঁপের ভেতর ঢুকে পড়ছে তামের। এ পাথুরে জমিন আর কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে আরো প্রায় দুঘণ্টা এগুলো ওরা। এ পথে রোয়েনকে কেন আনতে চায় নি তামের, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নিকোলাস। নগ্ন হাত দুটো কাঁটায় চিরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, ট্রাউজারের পায়া ছিঁড়ে গেছে অন্তত দশ জায়গায়। তবে পথটা চিনে রাখছে ও, পরে খুঁজে নিতে পারবে।

অবশেষে আরেকটা রিজের মাথায় চড়ে থামলো তামের, হাত তুলে ওপারটা দেখালো। ওদের নিচে ফাঁক বা গহ্বরের পাঁচিল দেখতে পেল নিকোলাস। সেই ফাঁকা জায়গাটাও চোখে পড়লো, ডোরাকাটা খুদে ডিক-ডিক যেখানে বেরিয়ে আসে। ডানডেরা নদীর ওপারে কাঁটাগাছটাও চিনতে পারল, ওটার আড়ালে বসে থাকার সময় মেকের গেরিলারা বন্দি করেছিল ওদের।

তামেরকে বোতল থেকে পানি খেতে দিল নিকোলাস, তারপর নিজে খেলো। ঢাল বেয়ে নামার আগে রিগবি রাইফেলটা চেক করলো, লেন্স থেকে ধুলো মুছলো। চেম্বারে এক রাউন্ড গুলি ভরে সেট করলো সেফটিক্যাচ। আমার পেছনে থাকবে, নির্দেশ দিল ছেলেটাকে।

ঢাল বেয়ে নামছে নিকোলাস, কয়েক কদম পরপর সামনের ও দু পাশের কাঁটা ঝোঁপ পরীক্ষা করার জন্য থামছে। এভাবে ঝরনারটার মাথায় পৌঁছে গেল ওরা। এদিকের জমিন নরম ও ভেজা ভেজা। পশু-পাখিরা এখানে পানি খেয়েছে। কুডু আর বুশবাক-এর পায়ের ছাপ চিনতে পারলো নিকোলাস। তবে ওগুলোর মাঝখানে খুদে হৃৎপিণ্ড আকৃতির ছাপও আছে।

ঝোঁপ লক্ষ্য করে নিঃশব্দ পায়ে এগুলো নিকোলাস। ভেতরে ঢুকতেই বিষ্ঠার একটা তূপ দেখতে পেল, ডিক-ডিক তার নিজস্ব এলাকার সীমানা চিহ্নিতকরণের জন্য বাউন্ডারি পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করে। খুদে বুলেট আকৃতির বিষ্ঠা, ডিক-ডিক এদিকে এলেই স্যুপটা আকারে আরেকটু বড় হয়।

শিকারের খোঁজে মগ্ন হয়ে পড়লো নিকোলাস, মনোযোগের মাত্রা দেখলে মনে হবে মানুষখেকো সিংহের পিছু নিয়েছে। প্রতিবার কয়েক ইঞ্চি এগুচ্ছে, পা ফেলার আগে দেখে নিচ্ছে সামনে শুকনো পাতা বা ডাল আছে কিনা, চোখের চঞ্চল দৃষ্টি দ্রুত বেগে আশপাশের ঝোঁপের ভেতর ঘোরাফেরা করছে।

একটা কান সামান্য একটু নাড়তে ধরা পড়ে গেল ডিক-ডিক। শরীরের অর্ধেকে ছায়া পড়েছে, গায়ের লালচে রঙ পেছনের শুকনো ডালের সঙ্গে মিশে এক হয়ে আছে, এমন স্থির যেনো মেহগনি খোদাই করে বানানো একটা মূর্তি। ওই একবার শুধু কান নড়ে ওঠায় ধরা পড়লো অস্তিত্ব। তারপর অবশ্য নাকটাও একটু কোঁচকাল, যেনো অস্বস্তিবোধ করছে। সম্ভবত বিপদ সম্পর্কে সচেতন, তবে জানে না। কোনোদিক থেকে আসবে।

ধীরে ধীরে রাইফেলটা কাঁধে তুললো নিকোলাস। লেসের ভেতর দিয়ে দুই শিং-এর মাঝখানের প্রতিটি রোম দেখতে পাচ্ছে। গলা আর মাথার মাঝখানে ক্রস হেয়ার সেট করলো, চামড়াটার ক্ষতি করতে চায় না।

ওই তো, ওই তো! নিকোলাসের কনুইয়ের কাছ থেকে তার স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল তামের! সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্টকে অভিনন্দন, পবিত্র প্রাণী দেখা দিয়েছে!

বাদামী ধোঁয়ার মতো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ডিক-ডিক, লেন্স থেকে চোখ সরাবার পর নিকোলাস শুধু ঝোঁপের দু একটা ডাল সামান্য নড়তে দেখলো। কাঁধ থেকে রাইফেলটা ধীরে ধীরে নামিয়ে তামেরের দিকে তাকালো ও। এটা কি করলে তুমি?

ধমক খেয়ে মাথা নিচু করলো তামের।

এরপর একাই এগুলো নিকোলাস, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলো। ক্যাম্পে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল ওদের। ক্যাম্পফায়ারের কাছে থামতেই ছুটে এলো রোয়েন। কী ঘটল? ডিক-ডিককে দেখা গেছে?

আপনার ভক্তকে জিজ্ঞেস করুন। ওই ভাগিয়ে দিয়েছে।

তামেরের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর শুরু করলো রোয়েন।

তোমাকে নিয়ে সত্যি আমি গর্বিত, তামের। শুনে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করলো ছেলেটা, কুকুরছানার মতো লাফাতে লাফাতে মঠের পথ ধরল।

নিকোলাসের জন্য কফি নিয়ে এলো রোয়েন, আগুনের সামনে ওর পাশে বসলো। বার দুয়েক তাকিয়েই কিছু একটা সন্দেহ হলো নিকোলাসের, জিজ্ঞেস করলো, কিছু একটা হয়েছে। কী?

আগুনের ওদিকে বসে রয়েছে বোরিস, চট করে তাকে একবারের দেখে নিল রোয়েন, তারপর নিকোলাসের আরো কাছে সরে এসে গলা খাদে নামাল, মেকের সঙ্গে দেখা করার জন্য টিসেকে নিয়ে মঠে গিয়েছিলাম। টিসে অনুরোধ করাতেই যেতে হয়েছিল। কী বলছি বুঝতে পারছেন তো? টিসে একা গেলে বোরিস সন্দেহ করবে, তাই।

বুঝব না কেন।

ওদের দু জনকে নিরিবিলিতে কথা বলার সুযোগ করে দিই, বলল রোয়েন। তবে তার আগে ওদের সঙ্গে তিমকাত উৎসব সম্পর্কে আলাপ হয় আমার। উৎসবের পঞ্চম দিনে প্রধান পুরোহিত টাবট নিয়ে অ্যাবেতে নামেন। মেক আমাকে বললেন, পাহাড়-প্রাচীরের গা বেয়ে পানির কিনারা পর্যন্ত নামার একটা পথ আছে।

হ্যাঁ, জানি আমরা।

যেটা আপনি জানেন না-নদীতে নামার মিছিলে সবাই থাকে। সবাই মানে, সব্বাই। প্রধান পুরোহিত, সব কয় জন পুরোহিত, শিক্ষানবিস উপাসকরা, প্রতিটি সত্যিকার বিশ্বাসী, এমন কি মেক আর তার লোকজনও। শুধু যে নদীতে নামে তাই নয়, রাতটা ওরা ওখানে কাটায়। সারাটা দিন ও রাত মঠ একদম খালি পড়ে থাকে।

হাসি ফুটল নিকোলাসের মুখে। ইন্টারেস্টিং তো!

ভুলবেন না, আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, হিসহিস করে বলল রোয়েন। ভুলেও আমাকে ফেলে যাবার কথা ভাববেন না!

*

সেদিনের রাতের খাবারের পর রোয়েনের তাঁবুতে গেল নিকোলাস। ওখানে ছাড়া আর কোথাও একা কথা বলার উপায় নেই। এবারে, অবশ্য রোয়েনের বিছানায় বসার মতো বোকামি করলো না সে। রোয়েন বসলো একপ্রান্তে, নিকোলাস একটা মোড়ায় ওর দিকে মুখ করে।

যে কোনো রকম পরিকল্পনা করার আগে একটা বিষয়ে বলে নিতে চাই। আপনি জানেন, ধরা পরলে কী ঘটবে?

মানে সন্ন্যাসীরা যদি হাত নাতে ধরে ফেলে? রোয়েন জানতে চায়।

সবচেয়ে কম কিছু করলেও এ উপত্যকা থেকে আমাদের বের করে দেবে ওরা। প্রধান পুরোহিতের দারুণ ক্ষমতা। আর খারাপ কিছু হলে ধরে পেটাবে আর কি। নিকোলাস বলে চলে, তাদের ধর্মে এটা সবচেয়ে পবিত্র স্থান; ব্যাপারটা হালকা করে দেখবেন না। বিপদের পরিমাণ কম নয়। এমনও হতে পারে ছুরি খেলাম, না হয় খাবারে বিষ দিয়ে মারলো।

আমরা টিসেকেও হারাবো। সে তো ধার্মিক মেয়ে, রোয়েন বলে।

আর মেক নিমুর তো খেপে যাবেই। মনে হয় না এর পরে আমাদের বন্ধুত্ব আর টিকে থাকবে।

চুপচাপ বসে রইলো ওরা দু জন। শেষমেষ নিকোলাস নীরবতা ভাঙে।

তো, বুঝলেন তো কি অবস্থা। আপনি একনিষ্ঠ খ্রিস্টান- আপনাদের গির্জাতেই তো আমরা চুরি করে ঢুকছি। এ বিষয়ে কী বলেন?

আমি ভেবেছি এ নিয়ে, রোয়েন স্বীকার করে। তবে এটা ঠিক আমার চার্চ নয়। কপটিক খ্রিস্টানদের।

মানে শুধু বিভেদ।

মিশরীয় কোনো চার্চে এমনকি সবচেয়ে পবিত্র স্থানেও কারোর ঢুকতে বাধা নেই। কাজেই, প্রধান পুরোহিতের নিষেধাজ্ঞা আমি কেয়ার করি না। একজন একনিষ্ঠ খ্রিস্টান হিসেবে গির্জার যে কোথাও যাবার অধিকার আমার আছে বৈকি।

মৃদু শিষ দিয়ে ওঠে নিকোলাস। আপনিই না বলেছিলেন, আমার ল ইয়ার হওয়া উচিত!

দেখুন, এসব নিয়ে তামাশা করবেন না। একটাই কথা- ওখানে আমাকে যেতেই হবে। এমনকি, টিসে, মেক কিংবা পুরোহিত রুষ্ট হোক- কিছু যায় আসে না।

এমনও হতে পারে, আপনার হয়ে আমি করলাম কাজটা। নিকোলাস পরামর্শ দেয়। আমি হলাম গিয়ে পাপী বান্দা। কাজেই আমার পরিত্রাণের কোনো ব্যাপার তো নেই।

না, সজোরে মাথা নাড়ে রোয়েন। কোনো ধরনের খোদাই করা বাণী থাকতে পারে- আমাকে তা দেখতেই হবে! আপনি ভালো হায়ারোগ্লিফিক পারেন না। আপনি অ্যামেচার, আমি প্রফেশন্যাল। আমাকে ওখানে থাকতেই হবে।

ঠিক আছে। তাহলে আপনি যাবেন। আত্মসমর্পণের সুরে বলে নিকোলাস। এবারে পরিকল্পনার পালা। কিছু জিনিস লাগবে আমাদের ফ্ল্যাশলাইট, ছুরি, পোলারয়েড ক্যামেরা, বাড়তি ফিল্ম

আর্ট পেপার, আর নরম পেন্সিল- ছাপ নেওয়ার জন্য, রোয়েন যোগ করে।

ওহ্ হো! ওগুলো তো আনি নি!

দেখলেন তো- আপনি অ্যামেচার!

গভীর রাত পর্যন্ত আলাপ করে চললো ওরা। শেষমেষ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিক।

অনেক রাত হয়েছে। ঘুম আসছে আমার। শুভরাত্রি।

এখনো দু দিন বাকি উৎসবের। এ সময়ে কী করার প্ল্যান আপনার?

আগামীকাল আবারো সেই অ্যান্টিলোপ ডিক-ডিকের পেছনে ছুটছি আমি, নিক বলে।

আমিও আসছি আপনার সাথে, দৃঢ়তা নিয়ে বলে রোয়েন, এ বিষয়ে আর আপত্তির কোনো সুযোগ নেই।

শুধু যদি তামেরকে রেখে আসেন, তবেই, বলে, তবু ছেড়ে বেরিয়ে এলো নিকোলাস।

*

ঘন কাঁটাঝোঁপের গাঢ় ছায়া থেকে খুদে হরিণটা বেরিয়ে আসতেই সকালের নরম রোদ লেগে রোমগুলো মসৃণ সিল্কের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সরু ফাঁকা জায়গাটা ধরে দ্বিধাহীন হেঁটে আসছে।

রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে তৈরি নিকোলাস। রিগবিতে মেটাল জ্যাকেট বুলেট ভরেছে, লাগলে ক্ষতটা চওড়া হবে না, বের হওয়ার সময় বড় গর্ত তৈরি করবে না।

ফাঁকা জায়গাটার পাশের কয়েকটা ঝোঁপের দিকে এগিয়ে এলো ডোরাকাটা ডিক-ডিক। নিচু একটা ঝোঁপের উপরের কুচি পাতা ছিঁড়ছে দাঁত দিয়ে। নিস্তব্ধ সকালে বিকট আওয়াজ করলো রাইফেল। ঝোঁপ থেকে শূন্যে লাফ দিল খুদে হরিণ, মাটিতে পড়ার আগেই ছোটার ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে পা ছুঁড়ছে। সলিড বুলেট এতো জোরে আঘাত করে নি যে ছিটকে পড়ে যাবে ডিক-ডিক। হৃৎপিণ্ডে বুলেট নিয়ে ছুটলো ওটা। মারা গেছে এরই মধ্যে, ছুটছে রিফ্লেক্সের বশে, রক্তস্রোতে অবশিষ্ট অক্সিজেনের জোরে।

সর্বনাশ! না, ওদিকে না! লাফ দিল নিকোলাস। খুদে প্রাণীটি সোজা খাদের কিনারা লক্ষ্য করে ছুটছে। অন্ধের মতো শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, পতনের সময় ডিগবাজি খেলো, অদৃশ্য হয়ে গেল ওদের দৃষ্টিপথ থেকে, নেমে যাচ্ছে প্রায় দুশো ফুট গভীর ডানডেরা নদীর গহ্বরে। ছুটে এসে কিনারায় দাঁড়ালো নিকোলাস, পিছু নিয়ে এলো রোয়েনও।

হাত দিয়ে রোয়েনই দেখালো, ওই যে, ওই যে, দেখতে পাচ্ছি।

ডিক-ডিক সরাসরি ওদের নিচে পড়ে রয়েছে। করুণ চোখে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস। তবে এক সেকেন্ড পরই ওর চেহারায় জেদ ফুটে উঠলো। মারতে যখন পেরেছি, তুলে আনতেও পারব। চলুন, আপাতত আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাই।

*

বিকেলে আবার ফিরে এলো ওরা, সঙ্গে বোরিস, দু জন ট্র্যাকার ও দু জন স্কিনার। সঙ্গে করে ওরা নাইলনের চারটে কয়েল নিয়ে এলো। প্রথমইে খাদের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে ডিক-ডিককে দেখে নিল নিকোলাস, ভয় হচ্ছিল স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেল কিনা। তারপর কয়েলের রশি ফাঁকা জায়গাটায় লম্বা করে ফেলে সাজাবার কাজে সাহায্য করলো ট্র্যাকারদের। দুটো কয়েলের রশি জোড়া লাগিয়ে গিটটা খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করলো নিকোলাস। খাদের নিচে রশি ফেলা হলো, প্রান্তটা পানির সারফেস ছুঁতে তুলে আনা হলো আবার।

একশো আশি ফুট, মাপ শেষ করে বলল ও। ত্রিশ ফ্যাদম। বোরিসের দিকে তাকালো। রশি বেয়ে এতোটা উপরে ওঠা সম্ভব নয়, আপনারা আমাকে টেনে তুলবেন।

মোটা একটা কাঁটাগাছে বাঁধা হয়েছে রশিটা। পরনে শুধু শার্ট আর খাকি শর্টস। খাদের ঠোঁটে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে হেলান দিল নিকোলাস, রশিটা কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলে আছে, লেহের অংশটুকু ফিরিয়ে আনা হয়েছে দু পায়ের মাঝখানে। পেছন ফিরে গহ্বরে লাফ দিল, পতন নিয়ন্ত্রণ করছে কাঁধের উপর দিয়ে রশি ছেড়ে, ব্রেক করার প্রয়োজন হলে উরুতে পেঁচিয়ে নিচ্ছে। পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে নিকোলাস, দু পায়ের সাহায্যে পাথুরে পাঁচিল থেকে দূরে রাখছে। নিজেকে। দ্রুত নেমে এলো নিচে, পা দুটো ডুবে গেল তীব্র স্রোতে, রশির মাথার লাটিমের মতো ঘুরছে শরীরটা। যে পাথরটার উপর পড়ে আছে ডিক-ডিক, সেটার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে রয়েছে ও কাজেই পানিতে নামতে বাধ্য হলো। রশির শেষ প্রান্ত দাঁত দিয়ে ধরে থাকলো, দূরত্বটুকু পেরিয়ে এলো সতরে।

খুদে পাথুরে দ্বীপটায় উঠে এসে খানিক দম নিল নিকোলাস। তারপর ডিক ডিকের চার পা এক করে বাঁধলো। পিছিয়ে এসে মুখ তুলে তাকালো উপরে। গহ্বরের মাথা থেকে উঁকি দিয়ে ওকে দেখছে বোরিস। টানুন! চিৎকার করলো নিকোলাস, রশিটা তিনবার ঝাঁকালো। টান টান হলো নাইলন, ঝাঁকি খেয়ে দ্বীপটা থেকে শূন্যে উঠে পড়লো ডিক-ডিক, গহ্বরের পাঁচিল ঘেঁষে দ্রুত উঠে যাচ্ছে ওপরে। তিন ভাগের দুই ভাগ উঠে গেছে, এ সময় কোথাও আটকাল রশিটা, তবে একটু পর নিজেই মুক্ত হলো, সাপের মতো এঁকেবেঁকে খাদের কিনারায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

বেশ খানিক পর নিচে নেমে এলো রশিটা, বুদ্ধি করে বড় তরমুজ আকৃতির একটা পাথর বেঁধে দিয়েছে বোরিস। খাদের কিনারা থেকে নিচে তাকিয়ে রশির নামাটা দেখছে সে, ইঙ্গিতে নির্দেশ দিচ্ছে নিজের লোকজনকে। রশিটা ধরে একটা লুপ তৈরি করলো নিকোলাস, বগলের তলায় ঢুকিয়ে নিল সেটা, মুখ তুলে ইঙ্গিত দিল বোরিসকে। টান টান হলো রশি, পাথরের উপর থেকে শূন্যে উঠে পড়লো ওর পা। ঝাঁকি খেতে খেতে উঠে যাচ্ছে উপরে। খাদের কিনারা থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে পৌচেছে, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল রশি। পাথরের গায়ে অসহায়ভাবে ঝুলছে ও। কি ঘটেছে? বোরিসকে জিজ্ঞেস করলো।

শালার রশি কোথাও আটকে গেছে, পাল্টা চিকা রকরলো বোরিস। কোথায় আটকেছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন?

নিকোলাসের দৃষ্টি রশি অনুসরণ করলো। সরু ও লম্বা একটা ঠাটলে ঢুকেছে রশিটা, সম্ভবত ডিক-ডিককে তোলার সময়ও এটাতেই আটকে ছিল। তবে ডিক ডিকের তুলনায় নিকোলাসের ওজন বহুগুণ বেশি, ফলে ফানেলের ভেতর রশিটা অনেক বেশি সেঁধিয়ে গেছে। শূন্যে ঝুলে রয়েছে ও, প্রায় একশো ফুট নিচে নদী আর পাথরের দ্বীপ।

দোল খান, ঝাঁকি দিন, উপর থেকে চিৎকার করলো বোরিস।

সে চেষ্টাই করছে নিকোলাস। গহ্বরের গায়ে পায়ের ধাক্কা দিয়ে রশিটাকে যতটা সম্ভব নাড়াচাড়া করছে, পাক খেয়ে মোচড়াচ্ছে। এক সময় ঘাম ছুটে গেল, বগলের তলায় রশির ঘষা লাগায় জ্বালা করছে চামড়া। লাভ হচ্ছে না, বোরিসকে জানালো।টেনেই তুলতে হবে। জোর লাগান, যতটা পারা যায়।

কয়েক সেকেন্ড পর ঠাটলটার উপরের রশি লোহার মতো শক্ত ও টান টান হলো, পাঁচজন লোক যত জোরে পারা যায় টানছে। ফাটলের নিচের রশি এক চুল নড়ছে না। বজ্র আটুনি একেই বলে, বের করে আনা সম্ভব নয়। নিচে তাকিয়ে চিন্তা করছে নিকোলাস। একটা মানুষের পতনের গতি ঘণ্টায় একশো পঞ্চাশ মাইল। এ গতিতে পানিতে নামা আর নিরেট কংক্রিটে নামা একই কথা।

আবার উপরে তাকালো নিকোলাস। লোকগুলো এখনো সর্বশক্তি দিয়ে রশি টানছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফাটলার ধারালো কিনারা রশির একটা রোয়া কেটে দিল, রশির গা থেকে লম্বা সবুজ পোকার মতো আলগা হয়ে আসছে। আঁতকে উঠে চিৎকার দিল নিকোলাস, থামুন, টানবেন না! কিন্তু বোরিসকে দেখা যাচ্ছে না, ট্র্যাকারদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে নিজেও রশি টানছে সে।

দ্বিতীয় রোয়াও ছিঁড়ে গেল। এখন মাত্র একটা রোয়ায় ঝুলছে নিকোলাস। ওটাও যে কোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে, বুঝতে পারলো ও। রুশ কুত্তা, কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস-থাম, শালা! টানবি না! থাম! কিন্তু ওর গলা বোরিসের কানে পৌঁছায় নি। শ্যাম্পেনের ছিপি খোলার মতো পপ করে একটা শব্দ হলো, রশির তৃতীয় ও শেষ ব্লোয়াটা ছিঁড়ে গেল।

খসে পড়ছে নিকোলাস। পাথুরে দ্বীপটার কথা ভাবছে। ওটার উপর পড়বে নাকি? শরীরের একটা হাড়ও তাহলে আস্ত থাকবে না। আর যদি পানিতে পড়ে, নির্ঘাত পাঁজর আর শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে।

পানিতে পা দিয়ে পড়লো নিকোলাস, তার আগে বুক ভরে বাতাস নিয়ে ফেলেছে। আঘাতটা প্রচণ্ড, শরীরের প্রতিটি হাড় যেনো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খেলো। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেলো, বন্ধ চোখের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো উজ্জ্বল আলো। নদী ওকে ঢেকে ফেলেছে। তলিয়ে গেল গভীরে। গতিটা এখনো এতো বেশি, তলায় পৌঁছে যে ধাক্কাটা খেলো, মনে হলো পা ও কোমর ভেঙে শরীরের বাকি অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

তলায় বাড়ি খেয়ে উপরে উঠছে নিকোলাস, উপলব্ধি করলো পা ও কোমর অটুটই আছে। ইতোমধ্যে ফুসফুস খালি হয়ে গেছে, বাতাসের অভাবে ছটফট করছে ও। পানির উপর মাথা তুললো কাশতে কাশতে।

প্রবল স্রোতের মধ্যে গা এলিয়ে দিল নিকোলাস, মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ থেকে পানির সরালো। গহ্বরের পাঁচিল দুটো দ্রুতবেগে পিছিয়ে যাচ্ছে, আন্দাজ করলো দশ নট গতিতে ভেসে যাচ্ছে ও। এ গতিতে কোনো পাথরে বাড়ি খেলে হাড়গোড়

ভাঙার কোনো কারণ নেই। কথাটা যখন ভাবছে, আরেকটা পাথুরে দ্বীপ পাশ কাটালো ওকে, হাত বাড়ালে ছুঁতে পারতো। চিৎ হলো নিকোলাস, পা দুটো মেলে দিল সামনে। পাথর দেখলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে।

মনে মনে একটা হিসাব পাবার চেষ্টা করছে নিকোলাস, গহ্বরের সরু ও লালচে পাথরের খিলান হয়ে নিচে লাফ দিয়েছে নদী, সে জায়গা থেকে ঠিক কতটা দূরে রয়েছে ও। তিন কি চার মাইল তো হবেই, আন্দাজ করলো। আর নদী ওখানে প্রায় এক হাজার ফুট লাফ দিয়েছে। সামনে নদীর তলায় ঢাল ও উতরাইও না থেকে পারে না, ফলে তীব্র জলাবর্ত আর আলোড়নের মধ্যে পড়তে হবে ওকে একটু পরেই।

উপরে তাকালো নিকোলাস। দু দিকের পাঁচিল পরস্পরের দিকে কাত হয়ে পড়েছে। ফলে কোথাও কোথাও সরাসরি ওর মাথার উপর প্রায় এক হয়ে গেছে। শুধু এক ফালি সরু নীল আকাশ দেখা যায়, গহ্বরের ভেতরটা প্রায়-অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। ভাগ্য ভালো যে এটা বর্ষার মরশুম নয়। ওর মাথা থেকে পনেরো কি বিশ ফুট ওপরে। পাথরের গায়ে গতবারের বন্যা তার চিহ্ন রেখে গেছে।

কিছুক্ষণ পর ক্যানিয়নে নদীর কলকল ছলছল ছাড়াও নতুন একটা আওয়াজ শুনতে পেল নিকোলাস। ভোতা, গুরুগম্ভীর একটা শব্দ, যতই এগুচ্ছে, ততই বাড়ছে। গহ্বরের পাঁচিল পরস্পরের দিকে সরে এসেছে, সেই সঙ্গে নদীর স্রোতও এখন সংকীর্ণ একটা পথ দিয়ে ছুটছে, ফলে স্বভাবতই গতিও অনেক বেড়ে গেল। পানির আওয়াজ দ্রুত বজ্রপাত বা কামান দাগার বৈশিষ্ট্য অর্জন করছে, সমস্ত শব্দ পতিধ্বনিত হচ্ছে ক্যানিয়নের ভেতর। উপুড় হলো নিকোলাস, সবটুকু শক্তি কাজে লাগিয়ে স্রোতের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে কাছাকাছি পাথুরে পাঁচিলে পৌঁছল। কিন্তু লাভ হলো না, হাত দিয়ে ধরা যায় এমন কিছু নেই, পাথরের গা পিচ্ছিল ও মসৃণ করে রেখেছৈ নদী। স্রোতের দুর্বার টানে ভেসে চলেছে নিকোলাস, তাকিয়ে দেখলো চারপাশের পানি নিরেট কাঁচের মতো সমতল ও মসৃণ। নদী যেনো জানে সামনে কি অপেক্ষা করছে, এ তারই প্রস্তুতি।

পাঁচিলের কাছ থেকে সরে এলো নিকোলাস, আবার ভাটির দিকে পা করলো। অকস্মাৎ ওর নিচে বাতাস ভরা একটা জগৎ উন্মোচিত হলো, শরীরটা নিক্ষিপ্ত হলো শূন্যে। ওর চারপাশের বাতাস সাদা ফেনাময় পানিতে ভরে উঠলো। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, বিপুল জলরাশির অবিরাম পতন ঝরা একটা পাতার মতো কোথায় কে জানে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।

পতনটা মনে হলো অনন্তকাল ধরে চলছে। তারপর এক সময় আরেকবার পানিতে পড়লো নিকোলাস, ডুবে গেল সারফেস থেকে অনেক গভীরে। ওঠার সময় পানির সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হলো, বাতাসে চোখ খোলার পর দেখলো জলপ্রপাতের নিচে একটা ঘূর্ণির গভীর গর্তের ভেতর রয়েছে ও। ঘূর্ণির ভেতর পনি ঘুরছে, এটা একটা গতি, আরেকটা গতি স্রোতের টানে ঘূর্ণির ছুটে চলা।

ঘুরপাক খাচ্ছে নিকোলাস। ওপরে তাকাবার সুযোগ হলে এ প্রথম জলপ্রপাতের সাদা পানি দেখতে পেল, মেলে দেওয়া বিশাল চাদরের মতো লাগলো দেখতে। আর সামনে তাকাতে দেখতে পেল সরু একটা নির্গমণ পথ, বেসিন থেকে ওই পথ দিয়েই উন্মত্ত নদী ভাটির দিকে ছুটে চলেছে। স্রোতের টানে যতই সামনে এগুচ্ছে, ঘূর্ণিটার গভীরতা ততই কমে আসছে। আপাতত নিরাপদ মনে হলো নিজেকে ওর। ঘূর্ণি নিস্তেজ হয়ে আসায় বেসিনের কিনারায় সরে এলো, পাঁচিলের ফাটলে বেড়ে ওঠা ঝোঁপের ডাল ধরে বিশ্রাম নিচ্ছে। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো নিকোলাস। পাঁচিল বেয়ে পাহাড়ের মাথায় ওঠার কোনো উপায় নেই। বাঁচার চেষ্টা করতে হবে নদীর গতিপথ ধরে ভাটির দিকে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে। পাহাড়ী নদীর তলায় চড়াই-উত্রাই থাকাটা স্বাভাবিক, ফলে স্রোতের গতি বেড়ে যেতে পারে, কোথাও হয়তো পানিতে তুমুল আলোড়ন উঠবে। আরো জলপ্রপাত থাকাও বিচিত্র নয়।

পাহাড় বেয়ে ওঠার কি কোনো উপায়ই নেই? পাঁচিল ধরে আরেকবার নিকোলাসের দৃষ্টি উপরে উঠে গেল। অনেক উপরে একটা পাথর ঝুলে আছে, দেখতে ক্যাথেড্রা-এর উঁচু ছাদের মতো। পাঁচিলের গায়ে চোখ বুলাচ্ছে, কিছু একটা ধরা পড়লো চোখে। ছকে বাঁধা ও সাজানো মনে হলো, প্রাকৃতিক হতে পারে না।

দু সারি গাঢ় দাগ, পাথুরে পাঁচিল ধরে পানির সারফেস থেকে উপর দিকে উঠে গেছে, একেবারে সেই দুশো ফুট উপরের কিনারা পর্যন্ত। ঝোঁপের ডালপালা ছেড়ে দিয়ে সাবধানে ও ধীরগতিতে পানি কেটে এগুলো নিকোলাস, পৌঁছল যেখানে দাগগুলো পানির নাগাল পেয়েছে। কাছে এসে বুঝতে পারল, এগুলো দাগ নয়, পাথর কেটে তৈরি করা প্রতিটি চার বর্গইঞ্চি কুলুঙ্গি বা ফোকর। সারি দুটোর মাঝখানে বারো ফুটের মতো ব্যবধান, তবে প্রতি সারির কুলুঙ্গি অপর সারির কুলুঙ্গির সঙ্গে একই সরল রেখার উপর তৈরি। একটার ভেতর হাত গলালো নিকোলাস, কনুই পর্যন্ত ঢোকানো যায়। ওয়াটার মার্কের নিচের ফোকরগুলো ক্ষয়ে গেছে, ফলে হাতের ছোঁয়ায় মসৃণ লাগলো কিনারাগুলো। তবে পাঁচিলের উপর দিকে, ওয়াটার মার্ক ছাড়িয়ে, আকৃতিগুলো স্পষ্ট, পুরোপুরি চৌকো আর ধারালো।

একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করলো মাথায়। কতদিনের পুরনো ওগুলো? পাথর কাটার জন্য এখানে কাউকে নামতে হয়েছে, কীভাবে নামলো? এতো কষ্ট করে এগুলো তৈরি করার কারণই বা কী? নিচে এখানে কী আছে?

তারপর হঠাৎ নিকোলাসের চোখে আরো একটা জিনিস ধরা পড়লো। পাথরে বৃত্তাকার একটা খাঁজ, দুই সারি কুলুঙ্গির ঠিক মাঝখানে, বর্ষা বা বন্যার পর থেকে যাওয়া জলচিহ্নের অনেকটা ওপরে। নিচে থেকে সম্পূর্ণ গোল দেখাচ্ছে, প্রাকৃতিক নয় এমন আরো একটা আকৃতি।

সাঁতার দিয়ে বার কয়েক জায়গা বদল করলো নিকোলাস, বিভিন্ন কোণ থেকে জিনিসটাকে দেখছে। পাথর খোদাই করে তৈরি বলে মনে হলো, তবে আলো খুব কম থাকায় মানুষের হাতের কাজ কিনা নিশ্চিত হতে পারলো না। ডিজাইনটার মধ্যে ছবি বা সংকেত যদি থাকেও, এখান থেকে দেখার উপায় নেই। কুলুঙ্গিতে পা রেখে খানিকটা ওঠার চেষ্টা করলো নিকোলাস, কিন্তু পারলো না। একটার সঙ্গে আরেকটার দূরত্ব এতো বেশি যে একটয় পা রাখার পর হাত দিয়ে দ্বিতীয়টার নাগাল পাওয়া কঠিন। চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিবার নদীতে পড়ে গেল ও।

নদীর পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা, নিকোলাসের দাঁত পরস্পরের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে। তীব্র স্রোতের টানে সরু নির্গমন পথের দিকে এগুচ্ছে, ওই পথ ধরে জননী নীলনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সমস্ত ব্যাকুলতা নিয়ে ছুটে চলেছে ডানডেরা।

নদীর তলা এখানে সাংঘাতিক ঢালু, পানির গতি ক্রমশ বাড়ছে। একের পর এক তীব্র আলোড়নের মধ্যে পড়লো নিকোলাস, নদী যেনো এখানে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচে নেমেছে। তারপর এক সময় খানিকটা শান্ত হলো পানি, চিৎ সাঁতার দিচ্ছে নিকোলাস। বিশ্রাম নেওয়ার এ সুযোগ ছাড়া যায় না, তাকিয়ে আছে উপরে।

উপরে আলো খুব কম। কারণ, মাথার উপর পাথরের পাঁচিল প্রায় এক হয়ে মিশে আছে। বাতাসে ভ্যাপসা গন্ধ, ডানা ঝাঁপটাচ্ছে অসংখ্য বাদুড়। তবে চারদিকটা ভালো করে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না, সামনে থেকে আবার নদীর গর্জন ভেসে আসছে। ঢাল বেয়ে নিচের দিকে ছুটে চলেছে ডানডেরা, খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিকোলাসকে। খানিক পর দিশেহারা করে তুললো ওকে, কত দূর বয়ে নিয়ে এলো হিসাব নেই, হিসাব নেই সব মিলিয়ে মোট কয়টা জলপ্রপাত পার হলো।

অকস্মাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল চারদিক। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসায় মনে হলো কেউ যেনো সরাসরি ওর চোখে সার্চলাইট তাক করেছে। রোদ লাগায় চোখ কোঁচকাল নিকোলাস, তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো ফ্যাকাসে লাল পাথরের খিলানের নিচ দিয়ে ভেসে এসেছে ও। পাহাড়ের এ অংশটুকু ওর চেনা, রোয়েনের সঙ্গে দেখে গেছে। ওর সামনে রয়েছে রশি দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত ব্রিজ। ক্লান্ত শরীরটা কোনো রকমে ছোট্ট সৈকতের সাদা বালির দিকে তাকালো। ক্রল করে এগুবে, সে শক্তিও অবশিষ্ট নেই। বমি করলো নিকোলাস, শরীরের অর্ধেকটা এখনো নদীতে।

অন্তত বেঁচে আছি, বলে জ্ঞান হারালো নিক।

*

কাঁধে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙল নিকোলাসের। সুন্দরী মেম সাহেব আপনার নাম ধরে ছুটোছুটি করছেন আর কাঁদছেন! জেগে উঠুন, সাহেব, উঠুন! চোখ মেলে তাকালো নিকোলাস, তামেরকে দেখে বালির উপর উঠে বসলো। একই সঙ্গে কেউ হাসতে ও কাঁদতে পারে, তামেরকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না ও। বেঁচে আছে মনে পড়ে যাওয়ায় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলো, দ্রুত পরীক্ষা করে দেখে নিল হাড়গোড় সব ঠিক আছে কিনা। সন্তুষ্ট হয়ে চোখ তুললো, দেখলো পাহাড়ের ঠোঁটের কাছে মোটাসোটা আর লাল দেখাচ্ছে সূর্যটাকে। তার মানে সময়টা শেষ বিকেল।

উঁচু পাড় বেয়ে ওঠার পর সরু পথ পাওয়া গেল, ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে পৌঁছল ওরা। ছুটে আসছিল রোয়েন, উল্লাসে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিকোলাসকে। বেঁচে আছেন! আপনি বেঁচে আছেন! হাসছে বটে, তবে চোখে জল।

আমাকে চেনেন না? দশ ফুট লম্বা, বুলেটপ্রুফ। তবে সত্যি কথা বলতে কী, বেঁচে আছি শুধু আপনার এ আলিঙ্গনের লোভে।

তাড়াতাড়ি নিকোলাসকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল রোয়েন। অন্য কোনো অর্থ করবেন না আবার!

রোয়েনের কাছ থেকে জানা গেল, ভাটির দিকে নিকোলাসের লাশ খুঁজছে বোরিস আর তার ট্র্যাকারেরা। আর নিকোলাসের ডিক-ডিকটাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে স্কিনাররা।

ছাল ছাড়াবার সময় ওখানে আমার থাকা দরকার! বলল নিকোলাস, তামেরের কাঁধে হাত রেখে ছুটলো। দেখা যাক সময়মতো পৌঁছতে পারি কি না!

*

সন্ধ্যার অন্ধকারে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। দু জন স্কিনার, কিফ আর সালিন, খেতে বসেছে। ওদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নিল নিকোলাস, তারপর গোসল সেরে কাপড়চোপড় পাল্টাল, ক্যানভাস রোল থেকে ছুরি বের করে চলে এলো স্কিনিং শেডে। ইতোমধ্যে ওখানে একটা গ্যাস লণ্ঠন জ্বালা হয়েছে। স্কিনাররা দাঁড়িয়ে থাকলো, নিকোলাস নিজেই ডিক ডিকের ছাল ছাড়াচ্ছে।

ভাবছি বাঁচলেন কীভাবে! দরজায় উদয় হলো বোরিস। নিকোলাস জবাব দিল না, একমনে কাজ করছে। এ আপনার ডোরাকাটা ডিক-ডিক? হঁদুর বললেই হয়! তবু নিকোলাস তাকাচ্ছে না। ইঁদুর শিকার শেষ হলো, এবার আমরা তাহলে আদ্দিস আবাবায় ফিরে যেতে পারি, কী বলেন? জানতে চাইলো সে।

নিকোলাস তাকে মনে করিয়ে দিল, এটা ওর সাফারি, আর চুক্তি করা হয়েছে তিন সপ্তাহের জন্য। ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ ছেড়ে দরজার সামনে থেকে সরে গেল বোরিস।

কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে নিকোলাস, দরজায় আরেকজনকে দেখা গেল। পরে আছে. পুরোহিতদের ঢোলা আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি, কথা বলা আগে তাকে . নিকোলাস চিনতে পারলো না। মঠে ওরা বলাবলি করছে, তুমি নাকি মনের গেছ, দোস্ত। যদিও বিশ্বাস করি নি, তবু নিশ্চিত হতে এলাম, বলে হাসলো কমান্ডার মেক।

মুখ তুলে হাসলো নিকোলাস। ভেতরে এসো।

ভেতরে ঢুকে নিকোলাসের পাশে বেঞ্চের উপর বসে পড়লো মেক। বোরিস সিলভকে কতদিন থেকে চেনো তুমি?

প্লেন থেকে নামার পর, জবাব দিল নিকোলাস। এক বন্ধু ওর নাম সুপারিশ করে।

তোমার বন্ধু ভুল করেছে, বলল মেক। তোমাকে আমার সাবধান করা উচিত, দোস্ত। কেন সাবধান করা উচিত ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করলো সে। বছর দশেক আগে মেনজিসটুর গুণ্ডাপাণ্ডারা তাকে বন্দি করে আদ্দিসের কাছাকাছি কার্ল মার্ক্স কারাগারে রেখেছিল। ওখানে ইন্টারোগেটরদের একজন ছিল বোরিস। তখন কেজিবি-তে ছিল সে। কথা আদায় করার জন্য বন্দি বা বন্দিনীর পায়ুপথে প্রেশার হোস ঢুকিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিত। বন্দিরা ফুলতে থাকত, যতক্ষণ না তাদের নাড়িভূড়ি বিস্ফোরিত হয়। মেক পালিয়ে আসায় সে-যাত্ৰা বোরিসের হাত থেকে বেঁচে যায়। মেনজিসটু ক্ষমতা হারাবার পর কেজিবি থেকে অবসর নেয় বোরিস, সাফারি গাইড হিসেবে কাজ শুরু করে।

প্রসঙ্গ বদলে মেক জানালো, দিনকাল খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিনা নোটিশে এ এলাকা ছাড়তে হতে পারে তাকে। আদ্দিসে এক ভদ্রলোক আছেন, নাম কর্নেল মরিয়ম কাদের, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন, তাঁকে নিকোলাস মেসেজ দিলে মেক পেয়ে যাবে। কোডনেম সোয়লো বললে মেককে চিনবেন তিনি।

বিদায়ের সময় আগের প্রসঙ্গে আবার ফিরে এলো মেক। তোমাকে জানিয়ে রাখি, বোরিসকে আমার খুন করতে হতে পারে।

বেশ কিছুসময় কেউ কোনো কথা বলল না। এরপর মেক নিমুর বলে, জীবন খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আজকাল, নিকোলাস। কখন যে কোথায় চলে যেতে হয়। কাজেই, আগে ভাগে বিদায় বলে নিচ্ছি। আদ্দিসে একজন লোক আছে আমার কখনো কিছু দরকার হলে তার কাছে খবর পাঠিও। কর্নেল মরিয়াম কাদের তার নাম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছেন। আমার জানের দোস্ত। আমার কোড হলো সোয়ালো। ওটা উচ্চারণ করলে ও তোমাকে চিনে নেবে।

এরপর আলিঙ্গন করে বিদায় নিল মেক নিমুর।

*

পরদিন সকালে ব্যথায় আড়ষ্ট শরীর নিয়ে স্কিনিং শেডে চলে এলো নিকোলাস। ছাড়ানো চামড়াটা পরীক্ষা করলো, নতুন করে লবণ মাখালো, তারপর কিফ আর সালিনকে নির্দেশ দিল ডিক-ডিকের খুলি পিঁপড়ের ঢিবিতে পুঁতে ফেলতে হবে, পিঁপড়েগুলো যাতে অবশিষ্ট মাংস খেয়ে ওটাকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে।

ওখান থেকে ডাইনিং কুঁড়েতে চলে এলো নিকোলাস, ব্রেকফাস্ট সেরে রোয়েনকে নিয়ে বের হল মাছ ধরতে। ঝুলন্ত ব্রিজের কাছাকাছি ছিপ ফেললো ওরা। ব্রিজের উপর ফেকাসে লাল পাথরের খিলানটার দিকে হাত তুলে রোয়েনকে বলল, আপনাকে আসলে বোরিসের সামনে থেকে সরিয়ে আনার জন্য মাছ ধরতে। চেয়েছি। কাল ওদিকে কী দেখে এসেছি শুনুন।

নিকোলাসের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো রোয়েন। ও থামতে জানতে চাইলো, ফোকরগুলো কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

কি হতে পারে বুঝতে পারছি না। তবে বহু বছরের পুরানো ওগুলো।

রাজমিস্ত্রীদের জন্য মাচা বা ভারা তৈরি করতে হলে এ ধরনের ফোকর দরকার হতে পারে, বলল রোয়েন।

আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়! ব্যঙ্গ নয়, নিকোলাসের চোখে প্রশংসা।

দু একটা আইডিয়া আপনিও দিন।

ধর্মীয় কোনো প্রতীক? কোনো সংকেত? রোয়েনের চেহারায় সন্দেহ দেখতে পেয়ে আবার বলল নিকোলাস, মানলাম, গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।

একটা ঘাস ছিঁড়ে ডগাটা দাঁত দিয়ে কামড়ালো রোয়েন। ধরুন ফোকরগুলো কাটা হয় মাচা তৈরির জন্য। নদীর পাশে, পাহাড়ের গায়ে, মাচা কেন দরকার হবে?

মাছ ধরার জন্য।

কিন্তু এ নদীতে মাছ খুব বেশি নেই, বলল রোয়েন। আর কিছু দেখেছেন?

দু সারি কুলুঙ্গির মাঝখানে গোল একটা আকৃতি। পাথর খোদাই করে তৈরি।

শিরদাঁড়া খাড়া করলো রোয়েন। লিপি, নাকি নকশা?

মাথা নাড়লো নিকোলাস। আলো কম, অত উঁচুতে পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না, বলল ও। কাল তিমকাত উৎসব, মাগডাস-এ ঢোকার একমাত্র সুযোগ। এ কাজটা শেষ করার পর খাদে নেমে আরেকবার দেখতে হবে এগুলো।

সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, নিকোলাস, বলল রোয়েন।

আমিও তাই বলি.. ফিসফিস করে বলে নিকোলাস। কথাটার উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে ধুপধাপ পা ফেলে ওর পাশ থেকে উঠে চলে গেল রোয়েন। রাগ করেছে ভীষণ।

*

ওদের জন্য দু জন তরুণ উপাসককে এসকর্ট হিসেবে পাঠিয়েছেন বিশপ, ভিড় সরিয়ে পথ তৈরি করবে তারা। কিন্তু দেখা গেল সিঁড়ির গোড়ায়। পৌঁছবার আগেই এসকর্ট দু জন সচল জনারণ্যে হারিয়ে গেল। কাছাকাছি থাকুন, বলে ইমার একটা বাহু খামচে ধরল নিকোলাস, কাঁধ দিয়ে ভিড় তো নয় যেনো পাহাড় ঠেলছে।

দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে চাতাল দাঁড়িয়ে থাকা অনেকগুলো পাথুরে স্তম্ভের একটার গায়ে পিঠ ঠেকাতে পারলো ওরা। এখান থেকে ক্যাথেড্রালে ঢোকার পথটা পরিষ্কারই দেখা যায়। রোয়েন যথেষ্ট লম্বা নয়, সামনে জনসমুদ্র থাকায় প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তাই ওকে সিঁড়ির নিচের ছোট একটা স্তম্ভের মাথায় তুলে দিল নিকোলাস। অবলম্বন হিসেবে নিকোলাসের একটা কাঁধ আঁকড়ে ধরল রোয়েন, কারণ ওর পেছনেই গভীর খাদ, নিচে বয়ে চলেছে নীলনদ।

উপাসকরা একঘেয়ে সুরে ভক্তিগীত গাইছে। বাদ্যযন্ত্রীদের বারোটা দল ড্রাম সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। প্রতিটি ব্যান্ডকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ভক্তরা, তাদের পরনে বিচিত্র বাহারি আলখেল্লা, মাথার উপর বহুরঙা ছাতা।

প্রচণ্ড গরম আর উৎকট দুর্গন্ধের মতোই জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিপুল উত্তেজনা আর প্রত্যাশা। গান ও বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে উন্মাদনা ক্রমশ বাড়ছে; হাজার হাজার উপাসক, ভক্ত পূজারি, যেনো একটিমাত্র জ্যান্ত প্রাণীতে পরিণত হয়ে বিশেষ একটা ছন্দে দোল খাচ্ছে।

হঠাৎ করে ক্যাথড্রালের ভেতর থেকে পিতলের অনেকগুলো ঘণ্টা একযোগে। বাজতে শুরু করলো, পরমুহূর্তে সেই কান ঝালাপালা করা আওয়াজের সঙ্গে যোগ দিল কয়েক শো হর্ন আর ট্রামপিট বা ভেরী। সিঁড়ির মাথায় গোত্রপ্রধানদের দেহরক্ষীরাও বসে থাকলো না, অটোমেটিক রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলিবর্ষণ শুরু করলো বিরতিহীন। মহিলারা শুরু করলো উলুধ্বনি, সে আওয়াজ যেমন রোমহর্ষক তেমনি রক্ত পানি করা। ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো পুরুষদের চেহারা। মেঝেতে হাঁটু গাড়ল তারা, আকুল আবেদন জানাবার ভঙ্গিতে মাথার উপর দু হাত তুলে ঈশ্বরের কৃপা ভিক্ষে চাইছে। মহিলারা তাদের শিশুসন্তানকে মাথার উপর তুলে ধরল, কৃঞ্চবর্ণ গাল বেয়ে অনর্গল নেমে আসছে চোখের পানি।

ভূগর্ভস্থ চার্চ থেকে গেট হয়ে বেরিয়ে এলো পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের একটা বিশাল মিছিল। প্রথমে এলো সাদা আলখেল্লা পরা ভক্তরা, তাদের পিছু নিয়ে এলো তরুণ উপাসকদের দল, আজ নদীর কিনারায় তারা ব্যাপ্টাইজড হবে। তামেরকে চিনতে পারলো রোয়েন, আশপাশের কিশোরদের চেয়ে যথেষ্ট লম্বা সে, চোখাচোখি হতে লজ্জা পেয়ে হাসলো।

ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কড়াই আকৃতির জায়গাটা ছায়ার ভেতর অস্পষ্ট দেখাচ্ছে, মাথার উপর ঝুলে আছে দু একটা রূপালি তারা নিয়ে রক্তবর্ণ শামিয়ানার মতো সরু আকাশ।

তরল লাভা স্রোতের মতো মশার মিছিল কুণ্ডলি ছড়াতে শুরু করলো পাহাড় প্রাচীরের গা থেকে, পুরোহিতরা সুর করে গান করছেন, ড্রামের গুরুগম্ভীর আওয়াজ পাহাড়ে লেগে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ব্যাপ্টিজম প্রার্থীদের পিছু নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা, তাঁদের আলখেল্লায় পিতলের তৈরি রূপালি ক্রস সঁটা, মাথায় জড়ানো সিল্ক পট্টি, অনেকেই ব্যানার বহন করছেন। তাঁদের পেছনে দু জন পুরোহিতকে দেখা গেল, ট্যাবট বহন করছেন। পুরোহিত দু জন অস্বাভাবিক লম্বা, মাথায় রত্নখচিত পাগড়ি, পরনে বহুরঙা আলখেল্লা। আর্ক অভ ট্যাবারন্যাকল বা চন্দ্রাতাপ আবৃত আসন লাল কাপড়ে মোড়া, সেটা জমিনে লুটিয়ে পড়েছে। কাপড়ে মোড়ার কারণ অপবিত্র বা পাপীরা যাতে চামড়ায় চোখে ওটাকে সরাসরি দেখার সুযোগ না পায়।

মিছিলের শেষ দিকে যোগ দিলেন জালি হোরা। আজ তিনি নীল পাথর লাগানো মুকুটটা পরেন নি। পরেছেন ইপিফানি ক্রাউন। চকচকে ধাতু-খণ্ড আর বহুমূল্য পাথর দিয়ে সাজানো। মুকুটটা এতো ভারী, প্রধান পুরোহিতের প্রাচীন ঘাড় ওটার ভারে নুয়ে পড়েছে। দু জন তরুণ ভক্ত তার কনুই ধরে গাইড করছে। অনিশ্চিত পা ফেC সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। এ সিঁড়িপথই নীল নদীর দিকে নেমে গেছে।

মিছিল এগুচ্ছে, সেই সঙ্গে সিঁড়ির মাথায় বসে থাকা লোকজন সোজা হলো নিচে নামার জন্য। চাতাল খালি হয়ে আসছে দেখে রোয়েনকে স্তম্ভের উপর থেকে নামিয়ে মিছিলে যোগ দিল নিকোলাস, জায়গাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবার আগেই গির্জার ভেতর ঢুকে পড়তে হবে ওদেরকে। জনস্রোত সামনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তারই মধ্যে একপাশে সরে আসছে ওরা, উদ্দেশ্য গির্জার প্রবেশমুখে পৌঁছনো। সামনে বোরিস আর টিসেকে দেখতে পেল ওরা, তবে তারা ওদেরকে দেখতে পায় নি।

গির্জার আউটার চেম্বারে ঢোকার গেটে এসে মাথা নিচু করলো নিকোলাস, ভেতরে ঢুকে আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেল না। ভেতরের গেটগুলোয় কোনো প্রহরী নেই দেখে সাইড ওয়াল ঘেঁষে এগুলো ও, এক হাতে রোয়েনের কব্জি ধরে আছে, অপর হাতে ব্যাগটা। সামনেই ঝুলছে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা পর্দা। ভারী পর্দা তুলে ভেতরে গা ঢাকা দিল ওরা।

পর্দার কাঁপন তখনো পুরোপুরি থামেনি, সবেমাত্র দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে ওরা, কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো কানে। পর্দা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকালো নিকোলাস। সাদা আলখেল্লা পরা চারজন পুরোহিত গির্জার ভেতর দিক থেকে এগিয়ে আসছেন, আউটার চেম্বার পার হয়ে গেটের সামনে থামলেন, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিলেন মেইন গেট।

আজ রাতে আর ওই গেট খোলা হবে না, ফিসফিস করলো নিকোলাস। ভেতরে আটকা পড়েছি আমরা।

কেউ আমাদেরকে বিরক্ত করবে না, জবাব দিল রোয়েন। চলুন, এখুনি কাজ শুরু করি।

পা টিপে টিপে পর্দার আড়াল থেকে বেরুল ওরা, আউটার চেম্বার পার হয়ে একটা দরজার দিকে এগুলো। রোয়েনকে নিয়ে মিডল চেম্বারে পা রাখলো নিকোলাস।

প্রথম চেম্বারের তুলনায় আকারে ছোট আর নিচু এটা। দেয়ালচিত্রগুলোয় সম্ভবত নিয়মিত রঙের প্রলেপ লাগানো হয়। মেঝে খালি, শুধু বাঁশ দিয়ে পিরামিড আকৃতির একটা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তাতে দাঁড়িয়ে আছে পিতলের তৈরি প্রদীপ, প্রতিটি প্রদীপে তেলের উপর ভাসছে সলতে। আলোর অন্য কোনো উৎস চোখে পড়লো না। সিলিং আর চেম্বারের কুলুঙ্গিগুলোয় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে।

মেঝে পেরিয়ে আরেকটা দরজার দিকে এগুলো নিকোলাস, মাকডাসে ঢুকতে হলে এ তালামারা দরজা পেরুতে হবে ওদেরকে। টর্চ বের করে দরজাটা পরীক্ষা করলো ও। দুটো কবটেই সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের প্রতিকৃতি খোদাই করা হয়েছে, মাথার চারধারে আলোর একটা বৃত্ত, ডান হাত আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে উপরে ভোলা।

তালাটা কয়েকশো বছরের পুরানো, ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে খুলতে বিশ সেকেন্ডের বেশি লাগলো না। তালা খোলার পর একটা কবাটে কাঁধ ঠেকিয়ে চাপ দিল নিকোলাস। কজায় তেল দেওয়া হয় না, কাঁচকাঁচ করে প্রতিবা। জানালো। ভেতরে ঢোকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ফাঁক হলো কবাট, ভেতরে ঢোকার পর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল।

মাকডাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বোবা বিস্ময়ে চারদিকে তাকালো ওরা। হোলি অব হোলিজ খুব ছোট একটা চেম্বার, এতো ছোট হবে বলে ওরা ধারণা করে নি। দশ-বারো কদম ফেললে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পৌঁছনো যায়। গম্বুজ আকৃতির ছাদ এতো নিচু পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে হাত উঁচু করলে ছোঁয়া যাবে।

মেঝ থেকে ছাদ পর্যন্ত সারি সারি শেলফ, ভক্তদের দেওয়া উপহারসামগ্রী সাজানো রয়েছে-ট্রিনিটি ও ভার্জিন আইকন, বাইজেনটাইন স্টাইলে গড়া, অলংকৃত রূপোয় মোড়া। সেইন্ট আর সম্রাটদের খুদে মূর্তিও আছে। আর আছে পালিশ করা মেটাল দিয়ে তৈরি পাত্র, গহনার বাক্স, মেডেল, মালা, শাখা-প্রশাখাসহ মোমদানি– প্রতিটিতে মোমবাতি জ্বলছে।

মেঝের মাঝখানে সিডারউডের অলটার, প্যানেলে বিশ্ব সৃষ্টির ছবি খোদাই করা-স্বর্গ থেকে আদমের পতন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত সবই দেখানো হয়েছে। সিল্কে মোড়া অলটার, ক্রসটা রূপোর তৈরি। প্রধান পুরোহিতের মুকুট মোমবাতির আলোয় চকচক করছে, টাইটার নীল সিরামিক সীল মুকুটটার ঠিক কপালের মাঝখানে।

নিঃশব্দে এগিয়ে এসে বেদীর সামনে হাঁটু গাড়ল রোয়েন। প্রার্থনার বসে মাথা নত করলো ও। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো নিকোলাস, মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না।

রোয়েনের প্রার্থনা শেষ হতে ওর পাশে চলে এলো নিকোলাস। ট্যাবট পাথর। ইঙ্গিতে বেদীর সামনেটা দেখালো। একসঙ্গে সেদিকে এগোলে ওরা। মাকডাসের পেছনে কাপড় মোড়া একটা কাঠামো দেখা যাচ্ছে। রূপো আর সোনার তৈরি সুতোয় এমব্রয়ডারি করায় কাপড়টা ভারী বলে মনে হলো। কাঠামোটা মানুষের মতোই লম্বা। ওটাকে ঘিরে ঘুরছে দু জন ছুঁতে ভয় পাচ্ছে-যদি প্রত্যাশা পূরণ না হয়! উত্তেজনা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য উপাসনালয়ের পেছন দিকের দেয়ালে তাকালো নিকোলাস, ওদিকে বার লাগানো একটা গেট রয়েছে। সেইন্ট ফ্রমেনটিয়াসের সমাধি। বলে গ্রিলের দিকে এগুলো। ওর পাশে চলে এলো রোয়েন। কাঠের গায়ে চৌকো ফোকর, সেগুলোর একটা দিয়ে ভেতরে তাকালো। ভেতরটা অন্ধকার। ফোকরের ভেতর টর্চ ঢুকিয়ে বোতামে চাপ দিল নিকোলাস।

টর্চের আলোয় রঙধনুর সব কয়টা রঙ ওদের চোখ যেনো ধাধিয়ে দিল। আলোটা চোখে সয়ে আসতে চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন, ওহ, সুইট হেভেন! এমন কাঁপুনি শুরু হলো, যেনো প্রবল জ্বরে ভুগছে ও। মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে যাওয়ায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা।

সেলের মতো দেখতে সমাধি কক্ষে পেছনের দেয়ালে, একটা পাথুরে শেলফের উপর, সেট করা হয়েছে কফিনটা। কফিনের গায়ে একটা মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা, ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটার আদলে। ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে, অনেক জায়গাতেই রঙ নেই, তা সত্ত্বেও মানুষটার স্নান চেহারা, লালচে দাড়ি ইত্যাদি আলাদাভাবে চেনা যায়।

রোয়েনের বিস্ময় বোধ করার এটাই একমাত্র কারণ নয়। কফিন শেলফটার উপরে এবং দুপাশে তাকিয়ে আছে ও। ওখানে যেনো বিভিন্ন রঙের দাঙ্গা বেধে গেছে, দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে সূক্ষ্ম ও দৃষ্টিনন্দন পেইন্টিং সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়। ভাবতে আশ্বর্য লাগে, এতো কালো পরও পেইন্টিংগুলো অক্ষত ও অম্লান রয়েছে কীভাবে।

ওগুলোর উপর টর্চের আলো ঘোরাল নিকোলাস, যেনো পড়ে যাবার ভয়ে নিকোলাসের একটা বাহু আঁকড়ে ধরে থাকলো রোয়েন। ওর আঙুল নিকোলাসের মাংসে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, অথচ নিকোলাস কোনো ব্যথা অনুভব করছে না।

বড় বড় যুদ্ধের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, নীলনদের পানিতে যুদ্ধজাহাজগুলো পরস্পরের মুখোমুখি। আছে শিকারের দৃশ্য, সিন্ধুঘোটক আর বিশাল সব হাতিকে ধাওয়া করছে শিকারীরা, লম্বা গজদন্ত রোদ লেগে চকচক করছে। কোথাও রক্তপিপাসু পদাতিক বাহিনী উন্মত্ত আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষ বাহিনীর উপর। শত শত রথ নিয়ে বীর যোদ্ধারা ছুটে চলেছে রণক্ষেত্র অভিমুখে, গিরিখাদের তলায় ধুলো উড়ছে, ঘোড়সওয়ারদের অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।

প্রতিটি দেয়ালচিত্রের নিচের দিকে দীর্ঘদেহী এক যোদ্ধার মূর্তি দেখা যাচ্ছে। একটা দৃশ্যে সে তার ধনুক পুরোপুরি টেনে ধরেছে, আরেকটায় ব্রোঞ্জের তৈরি তলোয়ার ঘোরাচ্ছে। শত্রুরা মাথা নোয়াচ্ছে তার সামনে, সে তাদেরকে পায়ের নিচে পিষছে, কিংবা অনেকগুলো মাথা একহাতে ধরে অট্টহাসি হাসছে।

টর্চের আলো সেন্ট্রাল প্যানেলের উপর স্থির করলো নিকোলাস। কফিনের উপর দেয়ালটা কাভার করছে এ প্যানেল। এখানে দেবতুল্য সেই মূর্তি রথের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে ধনুক, অপর হাতে বল্লম। মাথায় পাগড়ি বা হেলমেট নেই, চুলগুলো তার পেছনে পতাকার মতো উড়ছে-সিংহের সোনালি কেশর যেন। চেহারায় আভিজাত্য ও গর্ব, দৃষ্টিতে অদম্য স্পর্ধা।

তার নিচে ধ্রুপদী মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা কয়েকটা লাইন। গলা খাদে নামিয়ে অনুবাদ করলো রোয়েন :

মিশরের সাহসী সিংহ
এক হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত
প্রশংসার স্বর্ণশেকলে ভূষিত
ফারাও-এর চিরকালীন বান্ধব
সমস্ত দেবতার সৈনিক
আপনি চিরজীবী হোন!

প্রবল আবেগে ফুঁপিয়ে উঠলো রোয়েন তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এই শিল্পীকে আমি চিনি। তার শিল্পকর্ম নিয়ে পাঁচ বছর গবেষণা করেছি। আমি যিশুর কসম খেয়ে বলতে পারি, এ দেয়ালচিত্র চার হাজার বছর আগে ক্রীতদাস টাইটার আঁকা। আর এ সমাধির ডিজাইনও তারই করা। হাত তুলে কফিন রাখা শেলফের খানিক উপরে আথরে খোদাই করা নামটা দেখালো। না, এটা কোনো খ্রিস্টান সেইন্টের কফিন নয়। কয়েক শো বছর আগে কোনো একজন প্রাচীন পুরোহিত হঠাৎ এটা দেখতে পান, নিজ ধর্মের নামে দখল করে নেন। কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস ফেললল ও। ওদিকে তাকান! ওটা ট্যানাস-এর সীল-লর্ড হেরাব, সমগ্র মিশরীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি, রানী লসট্রিস-এর প্রেমিক, প্রিন্স মেমনন এর প্রকৃত পিতা, যিনি পরে ফারাও টামোস হয়েছিলেন।

অনেকক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভাঙল নিকোলাস, সবই তাহলে সত্যি। সপ্তম স্ক্রোলের সমস্ত রহস্যই দেখা যাচ্ছে এখানে। এখন শুধু চাবিটা পেলেই হয়।

হ্যাঁ, চাবি-টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট! ধীরে ধীরে ঘুরলো রোয়েন, চেহারায় শ্রদ্ধা আর ভয় ফুটে রয়েছে, এগুচ্ছে ট্যাবট স্টোনটার দিকে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো ও। নিকোলাস, আমার ভয় করছে। যা ভেবেছি ওটা হয়তো তা নয়। প্লিজ, আপনি দেখুন।

লম্বা কাঠামোটার সামনে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস, কাপড়টা সরিয়ে নিল। ফ্যাকাসে লাল একটা এ্যানিট পিলার দেখতে পাচ্ছে ওরা, গায়ে বহুরঙা চিত্রবিচিত্র দৃশ্য খোদাই করা। পিলারটা প্রায় ছয়ফুট লম্বা, গোড়ার দিকে এক বর্গফুটের মতো হবে। ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়ায় চ্যাপ্টা বা সমতল চূড়ার কাছে আধ বর্গমিটার। দাঁড়িয়েছে। এ্যানিট প্রথমে পালিশ করা হয়েছে, খোদাই করা হয়েছে পরে। এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা পাথরটা ছুঁলো রোয়েন, হায়ারোগ্লিফিক্সের উপর হাত বুলাচ্ছে।

আমাদেরকে লেখা টাইটার চিঠি, ফিসফিস করলো ও। খোদাই করা লিপির ভিড় থেকে একটা প্রতীকচিহ্ন খুঁজে নিল-ডানাভাঙা একটা বাজপাখি। ওটা স্পর্শ করার সময় আঙুলগুলো কাঁপতে শুরু করলো। লেখা হয়েছে প্রায় চার হাজার বছর আগে। প্রতীক্ষায় আছে, এতো বছর পর আমরা পড়ব, অর্থ উদ্ধার করব। দেখুন কীভাবে সে সই করেছে। এ্যানিট পিলারটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে রোয়েন, পালা করে চার। দিকেই পরীক্ষা করছে হেসে উঠে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কখনো বা ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ছে, তারপর আবার হাসছে, যেনো একটা প্রেমপত্র পড়ছে ও।

পড়ে শোনান আমাকে, বলল নিকোলাস। ক্যারেক্টরগুলো বুঝতে পারি, তবে সেন্স বা মিনিং সহজে ধরতে পারি না। আপনি ব্যাখ্যা করুন।

নিখাদ টাইটা! হেসে উঠলো রোয়েন, উত্তেজনায় লালচে হয়ে উঠেছে চেহারা। বরাবরের মতো অস্পষ্ট ভাষায়, ধাঁধার সাহায্যে মেসেজ দিয়েছে এখানেও। এ সম্ভবত তার নিজস্ব কোনো কোড। একটা হায়ারোগ্লিফিক্স লাইনে আঙুল দিয়ে। প্রকাণ্ড ডানা মেলে শকুনরা উঠলো সূর্যকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। ডেকে উঠে লেজের দিকে ঘুরে গেল শেয়ালরা। নদী বয়ে চলল জমিনের দিকে। পবিত্র স্থানের অমর্যাদাকারীরা সাবধান! সমস্ত দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে তোমাদের উপর!

অর্থহীন প্রলাপ নয় তো? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

না, অর্থহীন নয়! টাইটা কখনো অর্থহীন কথা বলে না। নিজেকে সে দুর্লভ প্রতিভা বলে দাবি করে, কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি একটু হয়তো ছিটগ্রস্ত। তাকে বুঝতে হলে তার চিন্তাধারা বুঝতে হবে। সে আমাদের জন্য কিছু ধাঁধা রেখে গেছে, অর্থ বের করতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। সেজন্যই আমরা ক্যামেরা নিয়ে এসেছি। ছবি তোলার পর ওই পাথর থেকে ছাপ নিব আমরা। পরে যাতে স্টাডি করা যায়।

ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করলো নিকোলাস। প্রথমে দুই রোল কালার ফটো তুলি, তারপর পোলারয়েড ব্যবহার করব-কালার ফটোগুলো ডেভেলপ করতে সময় লাগবে, তার আগেই যাতে কাজ শুরু করতে পারি। একে একে পিলারটার চারদিকেরই ফটো তুললো ও। ছবি তোলা শেষ হতে গ্রিল গেটের সামনে এসে তালাটা পরীক্ষা করলো। এ তালাটা একটু জটিল, খুলতে হলে তালার ক্ষতি হতে পারে। তার মানে পুরোহিতরা জানবেন এখানে কেউ ঢুকছিল।

তাহলে ভেতরে ঢোকার দরকার নেই, বলল রোয়েন। গ্রিলের এদিক থেকেই ছবি তুলুন।

গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ক্যামেরা ঢোকালো নিকোলাস, বেশ কয়েকটা ফটো তুললো। এবার পোলায়েড। ক্যামেরা বদল করে আরেক দফা ছবি তোলা হলো। নিকোলাস প্রতিটি প্লেট এক্সপোজ করার পর রোয়েনকে দিল ডেভেলপমেন্ট চেক করার জন্য।

প্রায় দু ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর ফটো তোলার পর্ব শেষ হলো। ক্যামেরা রেখে দিয়ে আর্ট পেপারের একটা রোল বের করলো নিকোলাস। পিলারের গায়ে সাঁটা হলো কাগজটা, তারপর টেপ দিয়ে আটকানো হলো। দু জন দুদিক থেকে কাজ শুরু করলো-নিকোলাস উপর থেকে, রোয়েন নিচ থেকে। দু জনের হাতে একটা করে কালো আর্ট ক্রেয়ন, খোদাই করা প্রতিটি হরফ ওই পেন্সিল দিয়ে ঘষে ফাঁকা কাগজে হুবহু তুলে নিল ওরা। টাইটা এখন যেখানেই থাকুক, আমি জানি আমাদের কাজ দেখে খিকখিক করে হাসছে সে, বলল রোয়েন। ভাবছে, যতই চালাক হও তোমরা, আমার হেঁয়ালি ধরতে পারা এতো সহজ কাজ নয়!

ডিজাইনের আউটলাইন কাগজে তোলা পরিশ্রমসাপেক্ষ ও একঘেঁয়ে কাজ, তবু সময় যে কীভাবে বয়ে গেল দু জনের কেউই টের পেল না। কাজ শেষ হতে রোয়েন জানতে চাইলো, কয়টা বাজে বলুন তো?

ভোর চারটে। আসুন, জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলি।

আর একটা কাজ বাকি আছে, বলে আর্ট পেপারের একটা কোণ ছিঁড়ে বেদির দিকে এগুলো রোয়েন, ওখানে প্রধান পুরোহিতের মুকুটটা পড়ে রয়েছে। মুকুটটার মাঝখানে নীল, সিরামিক সীলটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো ও, তারপর আর্ট পেপারে ডানা ভাঙা বাজপাখির একটা ছাপ নিল। ইতোমধ্যে পিলারটাকে কাপড়ে মুড়ে দিয়েছে নিকোলাস, নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।

মিডল চেম্বারে ফিরে এসে তালটা আবার লাগিয়ে দিল নিকোলাস। রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, মেইন দরজা দিয়ে বের হবে কীভাবে?

খানিক চিন্তা করে নিকোলাস বলল, মিডল চেম্বার থেকে বের হওয়ার আরো রাস্তা থাকতে বাধ্য। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো ও। পুরোহিতরা মেইন গেট খুব কমই ব্যবহার করেন। এখান থেকে ওদের কোয়ার্টারে যাবার কোনো না কোনো পথ নিশ্চই আছে…. হঠাৎ থেমে হাত তুলে দেখালো রোয়েনকে। ….ওদিকে তাকান! দেয়াল ঘেঁষে একটা মসৃণ লম্বা দাগ দেখা গেল মেঝেতে, শত শত বছর ধরে আশা-যাওয়া করায় মেঝে ওখানে ক্ষয়েও গেছে। পর্দার দিকে তাকান, ওদিকে, হাত দিয়ে ধরায় কেমন কালচে হয়ে গেছে। দ্রুত এগিয়ে এসে পর্দাটা সরাতেই গোপন একটা দরজা দেখা গেল। যা ভেবেছি! পিছু নিন।

পাথুরে একটা টানেল ধরে এগুলো ওরা। ডান দিকে বাঁক নেওয়ার পর সামনে ম্লান আলোয় আভাষ পাওয়া গেল। টর্চ নিভিয়ে ফেললো নিকোলাস।

বাসি খাবার আর ঘামের গন্ধ ঢুকলো নাকে। সন্ন্যাসীদের একটা পাথুরে সেলকে পাশ কাটালো ওরা, দরজা নেই। টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল ভেতরটা ফাঁকা। কোনো ফার্নিচার নেই, দেয়ালে শুধু একটা কাঠের ক্রস, তার নিচে চাকা লাগানো বিছানা। এরকম আরো দশ-বারোটা সেলকে পাশ কাটালো ওরা, একই রকম দেখতে। পরবর্তী বাঁক ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। মুখে সামান্য বাতাস লাগছে। কেউ কোথাও নেই দেখে আবার এগুলো ওরা। কিছু দূর যাবার পর পেছন থেকে নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরল রোয়েন।

কী? জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নিকোলাস, রোয়েন ওর কাঁধে চাপ দেওয়ার চুপ করে গেল। তারপর শুনতে পেল আওয়াজটা। মানুষের গলা, গোলক ধাঁধার ভেতর অস্পষ্টভাবে প্রতিধ্বনি তুলছে।– তারপরই ভেসে এর বুকের রক্ত ছলকান একটা আর্তচিৎকার, যেনো তীব্র ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে কেউ। সাবধানে এগুলো ওরা, কাও চোখে ধরা পড়তে চায় না। তবে আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে।

এতোক্ষণে ওরা আলো দেখতে পাচ্ছে। গলিপথের একধারে একটা সেল থেকে বের হচ্ছে আলোটা। আরো একটা রক্ত হিম করা আর্তচিৎকার শোনা গেল, এটা একটা নারীকণ্ঠ। চিৎকারটা প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসছে, গলিপথে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ওদেরকে।

কী ঘটছে বলুন তো? নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফিসফিস করলো রোয়েন।

জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লো নিকোলাস, রোয়েনের হাত ধরে আবার এগুলো। আলোকিত সেলের দরজাটাকে পাশ কাটাতে হবে ওদের। উল্টো দিকের দেয়ালে পিঠ ঘষে একটু একটু করে এগুচ্ছে নিকোলাস। ওর পাশেই রয়েছে রোয়েন, ওর একটা বাহু ধরে আছে।

সেলের ভেতর তাকালো ওরা, নারীকণ্ঠের চিৎকারটা আবার শুনতে পেল। তবে এবার চিৎকারের সঙ্গে মিশে আছে একটা পুরুষকণ্ঠ।

দৃশ্যটা ওদের চেখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। চাকা লাগানো বিছানার উপর সম্পূর্ণ নগ্ন ওরা, ঘামে চকচকে দুটো শরীর এক হয়ে আছে। শক্তিশালী শরীরে আদিম কোনো পুরুষের মতোই নারীর অভ্যন্তরে নিজেকে প্রবেশ করিয়ে ভালোবাসছে একটা জোড়া।

কেঁপে কেঁপে উঠে শিকার করে উঠলো মেয়েটা। চরম পুলকে শিউড়ে উঠছে বারবার।

প্যাসেজ থেকে ফাঁকা চাতালে বেরিয়ে এলো ওরা, থামলো সিঁড়ির গোড়ায়, নীলনদের গন্ধ মেখে উঠে আসা তাজা বাতাসে ভরে নিল নিজেদের ফুসফুস।

টিসে ওর কাছে চলে গেছে, নরম সুরে ফিসফিস করলো রোয়েন। অন্তত আজ রাতের জন্য তো বটেই, মন্তব্য করলো নিকোলাস।

না, প্রতিবাদ করলো রোয়েন। শুধু আজ রাতের জন্য নয়, চিরকালের জন্য। আপনি ওর মুখ দেখেন নি? টিসে এখন মেকের মেয়ে মানুষ।

৪. নিকোলাসের ঘুম ভাঙল

বিকেলে নিকোলাসের ঘুম ভাঙল বোরিসের চেঁচামেচিতে। আমার বউ! আমার বউ! আপনি জানেন কোথায় গেছে আমার বউ? কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না!

হাত দিয়ে চোখ রগড়ে বিছানার উপর উঠে বসলো নিকোলাস। তোমার বউ কোথায় আছে তার আমি কি জানি।

শালী আমার কালা কুত্তাটার সঙ্গে পালিয়েছে! হুংকার ছাড়লো বোরিস। আপনি সব জানেন! বলুন কোথায় গেছে ওরা, তা, না হলে খুনোখুনি কাণ্ড ঘটে যাবে!

মুখ সামলে কথা বলুন, সাবধান করে দিল নিকোলাস।

বউ তো নয়, বেশ্যা! মেক নিমুরকে ভালো খদ্দের ভেবে তার সঙ্গে পালিয়েছে! কিন্তু আমার নামও বোরিস ব্রুসিলভ। আমি ইন্টেলিজেন্স চীফ ছিলাম…. কি বলে ফেলছে বুঝতে পেরে থেমে গেল বোরিস।…শালীর পেটে গুলি করব আমি, বেশ্যা মাগীটা তাকে মরতে দেখবে। ছুটে নিকোলাসের কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে গেল সে। গায়ে শার্ট চড়িয়ে তার পিছু নিল নিকোলাস।

নিজের কুঁড়েতে ফিরে একটা ব্যাগে কয়েকটা জিনিস ভরেছে বোরিস। এ মুহূর্তে হান্টিং রাইফেলে কাট্রিজ ঢোকাচ্ছে।

গেছে যাকগে, দরজা থেকে বলল নিকোলাস। ওদের পিছু নিলে আপনার বিপদ হতে পারে। মেকের সঙ্গে পঞ্চাশ জন গেরিলা আছে। আপনার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, বোঝা উচিত জোর করে কোনো মেয়েকে ধরে রাখা যায় না।

কে ধরে রাখতে চায়? বেশ্যাটাকে আমি খুন করতে চাই! চাবির গোছাটা নিকোলাসের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল বোরিস। সাফারি শেষ হয়ে গেছে, মিস্টার। ল্যান্ড ক্রুজারের চাবি রইল, নিজের চেষ্টায় আদ্দিস আবাবায় ফিরে যাবেন। বড় ট্রাকটা আমার জন্য রেখে যাবেন। আদ্দিসে পৌঁছে আমার ট্র্যাকারকে ল্যান্ড ক্রুজারের চাবি বুঝিয়ে দেবেন। সাফারি বাতিল করায় আপনি কিছু টাকা ফেরত পাবেন, সেটা পরে আমি পাঠিয়ে দেব।

নিকোলাসের কোনো যুক্তিই মানলো না, কাঁধে ব্যাগ আর হাতে রাইফেল নিয়ে। ক্যাম্প ত্যাগ করলো বোরিস। নিজের কুঁড়েতে ফিরে আসছে নিকোলাস, দেখলো দরজা দিয়ে মাথা বের করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রোয়েন। সবই শুনলাম, বলল সে। টিসেকে পেলে সত্যি মেরে ফেলবে। আমাদের কি কিছুই করার নেই?

না, নেই। আমাদের কোনো সাহায্য ওদের লাগবেও না। যান, আবার শুয়ে পড়ুন।

কাল রাতের পোলারয়েড ছবিগুলো দেখছিলাম। টাইটা আমাদেরকে অঢেল দান করে গেছে। আসুন না, দেখবেন।

ভেতরে ঢুকে নিকোলাস দেখলো পোলারয়েড আর আর্ট পেপারে তোলা ছাপগুলো ক্যাম্প টেবিলে বিছিয়ে রেখেছে রোয়েন।

আপনি যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, আমি কিছু কিছু কাজ করেছি। চারটে পোলারয়েড পাশাপাশি রাখলো রোয়েন, ওগুলোর উপর টেনে আনল বড় আকারের ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা। ভাঁজ করা পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে জিনিসটা, প্রফেশনাল ল্যান্ড সার্ভেয়ারস মডেল। ওটার নিচে ফটোগ্রাফের প্রতিটি সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ধরা পড়বে। টাইটা পাথরের প্রতিটি দিকের নাম রেখেছে-বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীত। এর মানে কী?

পৃষ্ঠা সংখ্যা?

ঠিক আমি যা ভেবেছি, বলল রোয়েন। মিশরীয়রা বিশ্বাস করে বসন্ত হলো সমস্ত নতুন জীবনের সূচনা। প্যানেলগুলো কী নিয়মে পড়তে হবে সে-কথাই এখানে বলে দিচ্ছে টাইটা। এটা বসন্ত, একটা ফটোগ্রাফ দেখালো ও।

মৃতের পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে এখানে, বলল রোয়েন। পড়ছি, অনাদি অনন্ত ও অন্ধকার সমুদ্রের উপর মৃদুমন্দ প্রথম বায়ু আমি। আমি প্রথম সূর্যোদয়। আলোর প্রথম আভাস। ভোরের বাতাসে উড়ছি সাদা একটা পালক। আমি রা। সমস্ত বস্তুর শুরু আমি। বেঁচে থাকব চিরকাল। আমার ক্ষয় বা বিনাশ নেই। গ্লাস থেকে চোখ তুলে নিকোলাসের দিকে তাকালো রোয়েন। আপাতত এ-সব থাক, পরে ফিরে আসা যাবে। পরের অংশটুকু পড়া দরকার…এটা পড়ার সময় আমি আপনার দিকে তাকাবো না। টাইটা মাঝে মধ্যে বাজে ভাষা ব্যবহার করে। এ শুরু করছি :

দেবীর কন্যা তার মায়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সিংহীর মতো সগর্জনে মিলিত হবার জন্য ছুটছে সে। পাহাড় থেকে লাফ দিল, দাঁতগুলো সাদা। সমস্ত বিশ্বের বেশ্যা সে। তার জননেন্দ্রিয় থেকে বিপুল স্রোত বেরিয়ে আসে। তার জননেন্দ্রিয় একদল কর্মীকে গ্রাস করেছে। তার শারীরিক ক্ষুধা পাথরমিস্ত্রী আর রাজমিস্ত্রীদের খেয়ে ফেলেছে। তার জননেন্দ্রিয় একটা অক্টোপাস, গিলে ফেলেছে একজন রাজাকে।

ওরে ব্বাপ! নিকোলাস মুচকি হাসে। দারুণ জিনিস। একি আপনি কি লজ্জা পেলেন নাকি? ওটা কি আমি লালিমা দেখছি আপনার গালে? হতেই পারে না!

আপনার স্কটিশ উচ্চারণের মতোই ভুয়া, ঠাণ্ডা স্বরে বলে রোয়েন। এখনো চোখ তুলে দেখছে না নিকি কে।

কি বুঝলেন?

মাথা নাড়লো নিকোলাস।

চলুন আপনাকে একটা জিনিস দেখিয়ে আনি।

এক ঘণ্টা পর ঝুলন্ত ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল ওদেরকে, ডানডেরা নদীর তীব্র স্রোতের অনেক উপরে এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে ব্রিজটা।

নীল নদের দেবী হলো হাপি। তাহলে এ নদী তার কন্যা, মায়ের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছুটে চলেছে, লাফ দিচ্ছে পাহাড় থেকে, গর্জন করছে। সিংহীর মতো, ফেনায় সাদা দেখাচ্ছে তার দাঁত? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

শয়তানি হাসিতে নিকোলাসের মুখ ভরে উঠলো। জানি, এরপর কী বলবেন। এ খাজের দিকে তাকিয়ে ওটাই প্রথম আমার মনে এসেছিল! আপনি বলেছিলেন, এ হলো এক সর্বগ্রাসী মুখগহ্বর- আমার কাছে অবশ্য অন্য কিছুর মতো মনে হচ্ছে!

আমি কেবল এইটাই বলতে পারি- আপনার নিশ্চই অসাধারণ কিছু নারী বন্ধু ছিল! রোয়েন বলে ফেলে মুখ ফসকে। এ হে! টাইটার খপ্পরে পরে আমিও আজে বাজে বকছি।

নদীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো নিকোলাস, একদল কর্মীকে গ্রাস করেছে। পাথরমিস্ত্রী আর রাজমিস্ত্রীদের খেয়ে ফেলেছে।

ফারাও মামোস একজন গড বা দেবতা। নদী একজন গডকে গিলে ফেলেছে…পাথুরে খিলানসহ। নিকোলাসের মতোই উত্তেজিত রোয়েন। খাদের ভেতর পাঁচিলে আপনি ওই কুলুঙ্গিগুলো দেখেছেন বলেই সম্পর্কটা ধরতে পেরেছি আমি। নিকোলাস, ওখানে আবার আমাদের যাওয়া দরকার। খোদাই করা ডিজাইনটা দেখতে হবে।

সেজন্য প্রস্তুতি দরকার, বলল নিকোলাস। রশি কাটতে হবে, একটা পুলি সিস্টেম দরকার হবে। সবার সাহায্যে লাগবে।

আপনি প্রস্তুতি নিন, সেই ফাঁকে পাথরটার অনুবাদ শেষ করি আমি… হঠাৎ থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালো রোয়েন। শুনুন!

কান পাতলো নিকোলাস, নদীর কলকল ছলছল ছাপিয়ে জেগে উঠলো রোরের আওয়াজ।

পেগাসাস দেখছি পিছু ছাড়ে নি! আসুন! রোয়েনের হাত ধরে ছুটলো ও, ব্রিজ থেকে নেমে সৈকতে চলে এলো। ব্রিজের নিচে সাদা বালিতে বসে থাকলো ওরা, বোল্ডারের আড়াল থাকায় আশা করছে হেলিকপ্টার থেকে ওদেরকে দেখা যাবে না।

লালচে পাহাড় প্রাচীরের ওদিকটায় চক্কর দিল জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। ওদেরকে পাইলট দেখতে পায় নি, ঘুরে গিয়ে খাদের এদিক থেকে ওদিক টহল দিতে শুরু করলো। তারপর হঠাৎ ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল, কপ্টারের গতি কমে আসছে। পাহাড়ে কোথাও নামছে, ব্রিজের তলা থেকে ক্রল করে বের হবার সময় বলল নিকোলাস। ওদের এ উঁকি-ঝুঁকি মারা আমার ভালো ঠেকছে না।

খুব একটা চিন্তার কিছু আছে বলে মনে করি না, বলল রোয়েন। ডুরেঈদের খুনীদের সঙ্গে পেগাসাসের যদি কোনো সম্পর্ক থাকে, তার ব্যবস্থা পরে এক সময় করা যাবে। প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেটা আগের মতোই প্রবল রোয়েনের, তবে হাতের জরুরি কাজগুলো প্রথমে সারতে চাইছে। ওদের চেয়ে এগিয়ে আছি আমরা, তাই না? মঠ বা শিলালিপির তাৎপর্য সম্পর্কে ওদের এখনো কোনো ধারণা নেই।

চলুন ক্যাম্পে ফিরি, বলল নিকোলাস। আমি চাই না খাদের কাছাকাছি ওরা আমাদেরকে আবার ঘুরঘুর করতে দেখে ফেলে।

*

গ্যানট্রি বা মোবাইল একটা ক্রেন তৈরি করলো নিকোলাস, ওকে সাহায্য করলো ট্র্যাকার আর স্কিনাররা। ব্লক আর ট্যাকল নেই, তার বদলে ব্যবহার করা হলো কাঠের পোল। স্লিং শীট তৈরির জন্য কুকিং হাট থেকে কেটে আনল এক টুকরো ক্যানভাস, সেটার চার কোণে চারটি ফুটো করে রশি বাঁধা হলো। প্রস্তুতি শেষ করতে বিকেল হয়ে গেল, রোয়েন ছাড়া বাকি সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিকোলাস।

গ্যানট্রি আর রশির কুণ্ডলী নিয়ে সেই স্পটে পৌঁছল ওরা, পাহাড়ের কিনারা থেকে যেখানে নিচে লাফ দিয়েছিল ডিক-ডিক। ওখান থেকে রওনা হলো ভাটির দিকে, পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ধরে এগুচ্ছে। এদিকে ঝোঁপ খুব ঘন, ম্যাটিট দিয়ে কাটার জন্য মাঝে মধ্যে থামতে হলো। জলপ্রপাতের আওয়াজ পথ দেখালো নিকোলাসকে। ভাটির দিকে যতই এগুলো, ততই বাড়ছে শব্দটা। তারপর একসময় পানির গর্জনে পায়ের নিচে কাঁপতে শুরু করলো পাথর। খানিক পর কিনারায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে ঝুঁকল নিকোলাস, জলোচ্ছ্বাসের সাদা ফেনা দেখে কিফকে বলল, এই জায়গাই। তারপর ব্যাখ্যা করলো ঠিক কী চাইছে ও।

গ্যানট্রি ঠিক কোথায় সেট করা দরকার জানার জন্য ক্যানভাস স্লিং সিটে বসলো নিকোলাস, কিফ বাহিনীকে বলল, কিনারা থেকে বিশ ফুট নিচে নামাও আমাকে। ও জানে, বিশ ফুট নিচ থেকে শুরু হয়েছে ঝুল-পাথর। ওই পয়েন্ট পর্যন্ত নাইলন রশি পাথরে ঘষা খাবে না, তবে ফুলে থাকা পাহাড়-প্রাচীরের গা চারদিকে অনেকটাই দেখতে পাওয়া যাবে।

দেড়শো ফুট নিচে নদীর পাথুরে গহ্বর, পেছন ফিরে শূন্যে ঝুলছে নিকোলাস, পাথরের গায়ে দুই সারি কুলুঙ্গি প্রায় পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছে। তবে পাঁচিলের গায়ে খোদাই করা ডিজাইন ফুলে থাকা পাথরের আড়ালে থেকে গেল। কিফকে সংকেত দিতে স্লিং সিট ওরে তুলে নিল ওরা।

গ্যানট্রি আরো নিচের দিকে সেট করতে হবে। জিনিসপত্র তুলে নিয়ে ঝোঁপ ভেঙে আবার এগুলো ওরা, পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ধরে। দাঁড়াও! হঠাৎ চিৎকার করলো নিকোলাস। ঝোঁপগুলো এদিকে খাটো কেন? পরীক্ষা করে দেখার পর ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। পাহাড়-প্রাচীরের এদিকের কিনারা ক্ষয়ে গেছে, ফলে পাথুরে জমিন পেছনের চেয়ে অনেক বেশি ঢালু। নিকোলাস ধারণা করলো, সম্ভবত এ জায়গা থেকে প্রাচীন মাচা নিচে নামানো হয়েছিল। আর সামনে এগোবার দরকার নেই। এখানেই গ্যানট্রি সেট করব আমরা।

ঝোঁপ-ঝাড় কেটে জায়গাটা পরিষ্কার করতে হলো। গ্যানট্রি সেট করার পর হাতে আর সময় থাকলো না, সন্ধ্যে হয়ে আসছে।

আজকের মতো থাক। এখন চললো, কাল সকালে ফিরে আসব, বলল নিকোলাস।

*

পরদিন সকালে আবার সেট করা গ্যানট্রির কাছে পৌঁছল ওরা। চালু জমিন একটা প্লাটফর্মে এসে শেষ হয়েছে, নিরেট পাথুরে প্লাটফর্মের কিনারায় খাদের ঠোঁট। ঘুরে ফিরে দেখে রোয়েন মন্তব্য করলো, নিশ্চয় করে বলা কঠিন, তবে বোধহয় আপার ধারণাই ঠিক-মানুষের তৈরি হতে পারে।

স্লিং সিটে বসে সংকেত দিল নিকোলাস, কিফ বাহিনী ওকে খাদে নামাতে শুরু করলো। ওর পরনে শর্টস আর টেনিস শূ, গায়ে টিশার্ট। স্লিং সিটে ঝুলছে নিকোলাস, খাদের খাড়া গা থেকে যথেষ্ট দূরে। নামার শুরুতেই দেখতে পেল, কুলুঙ্গি সারি সঙ্গে একই লাইনে রয়েছে ও। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে তৈরি বৃত্তাকার ডিজাইনটা ওর সামনে অর্থাৎ একই লেভেলে চলে এলো, তবে ওর কাছ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে ওটা, তার উপর শ্যাওলা পড়ে পাথরের রঙ বদলে গেছে, ফলে ঠিক বোঝা গেল না ডিজাইনটা কৃত্রিম কিনা। কিফ বাহিনী রশি ছাড়ছে, ডিজাইনটাকে উপরে রেখে নিচে নামছে স্লিং সিট।

পানির সারফেসে পৌঁছল স্লিং সীট, নদীতে নেমে পড়লো নিকোলাস। এরপর রোয়েন নামবে।

ডিজাইনটার সঙ্গে একই লেভেলে পৌঁছে রোয়েন সংকেত দিল, স্থির হয়ে গেল স্লিং সীট। বুকে ঝুলে থাকা বাইনোকুলারটা চোখে তুললো ও। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরই বাইনোকুলার ছেড়ে নিল, গলা চিরে বেরিয়ে এলো তীক্ষ্ণ উল্লাসধ্বনি। একশো ফুট নিচ থেকে চিৎকারটা স্পষ্ট শুনতে পেল নিকোলাস। উত্তেজনায় পা ছুঁড়ছে রোয়েন, নিকোলাসের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে।

হেসে উঠলো নিকোলাস, হাতছানি দিয়ে ওকে নিচে নেমে আসতে বলল। সংকেত পেয়ে আবার রশি ছাড়তে শুরু করলো খালিদ বাহিনী।

কী দেখলেন? মানুষের তৈরি? লিপি? পড়তে পেরেছেন? রোয়েন পানির কাছাকাছি নেমে আসতে রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলো নিকোলাস।

আপনি ঠিক ধরেছেন! উল্লাসে অধীর রোয়েন। আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর-হা, হা হা, হ্যাঁ! টাইটা এখানেও তার সই রেখে গেছে, ডানা ভাঙা বাজপাখি!।

অসাধারণ!

টাইটা যে এখানে এসেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল নিকোলাস। কুলুঙ্গিগুলো তৈরি করার জন্যে একটা মাচায় দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে। আমাদের প্রথম অনুমানই ঠিক। আপনি যে ফোকরে হাত রেখেছেন, ওটা খাদে নামার জন্য তার মইয়েরই একটা অংশ।

বুঝলাম, কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। এখানে নামার কি দরকার ছিল তার? খোঁড়াখুঁড়ি বা নির্মাণ কাজের কোনো চিহ্নই তো দেখছি না।

এক সেকেন্ড চিন্তা করে রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, পানির নিচে ফোকরগুলো আছে কিনা দেখেছেন?

না। সারফেসের নিচে পাথর কাটা সম্ভব নাকি।

তবু দেখুন।

ফোকরটা থেকে হাত না সরিয়েই পা ও শরীর পানির ভেতর ডোবাল নিকোলাস। পানির নিচে অদৃশ্য হলো মাথা, পা দিয়ে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে ফোকর খুঁজছে। অকস্মাৎ ঝাঁকি খেয়ে পানির উপর মাথা তুললো, চেহারা দেখে মনে হলো ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে।

সত্যি আছে! পানির নিচে আরেকটা ফোকর আছে!

একটা? আমি তো বলি, অনেকগুলো! তারপর বিনয়ে বিগলিত হওয়ার ভান করলো রোয়েন। প্লিজ, একবার ডাইভ দিয়ে দেখুন না!

বড় করে শ্বাস টেনে বাতাসে বুক ভরে নিল নিকোলাস, তারপর ডুব দিল পানিতে। সারফেসের নিচে প্রথম ফোকরটা হাত দিয়ে ছুঁলো, তারপর নেমে এলো আরো নিচে। দ্বিতীয়টা পাওয়া গেল ছফুট দূরে, বাকিগুলোর মতোই। এভাবে যতো নামছে নিকোলাস ততোই একের পর এক ফোকর পাচ্ছে। চারটে ফোকর, তার মানে সারফেস থেকে চব্বিশ ফুট নেমে এসেছেও। ভোঁ-ভোঁ করছে কান দুটো।

আরো নামছে নিকোলাস। পঞ্চশ ফোকরকে পাশ কাটালো। ফুসফুসের বাতাসে চাপ বাড়ছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে, যদিও. পানি এখানে গাঢ় আর ঘোলা। সরাসরি সামনে পাহাড় প্রাচীরের গা-ই শুধু দেখতে পাচ্ছে। ছনম্বর ফোকরটা চোখে পড়তে ধরে ফেললো কিনারা। ইতস্তত করতে নিকোলাস।

সারফেস থেকে ছত্রিশ ফুট নেমেছে অথচ এখনো নদীর তলায় পৌঁছতে পারে নি। সিদ্ধান্ত নিল, আরো ছ ফুট নামবে, তারপর উঠে যাবে উপরে। বাতাসের অভাবে ব্যথা শুরু হয়েছে বুকে।

নামছে, সাত নম্বর ফোকরটা চোখে পড়লো। ভাবল, আশ্চর্য নদীর একেবারে তলা পর্যন্ত আছে এগুলো, কাজটা টাইটা করলো কীভাবে! ওদের তো ডাইভিং ইকুইপমেন্ট ছিল না! শেষ ফোকরটা ধরে চিন্তা করছে নিকোলাস, আরো নিচে নামার ঝুঁকি নিবে কিনা। ফিজিক্যাল লিমিটের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, শরীরের পেশী কাঁপতে শুরু করেছে। ঠিক আছে, আর মাত্র একটা!

বিপদ সংকেত পেতে শুরু করেছে নিকোলাস। মাথার ভেতরটা হালকা লাগছে। পানির চাপে কুঁচকে যাচ্ছে, ভজ খাচ্ছে চামড়া। এ সময় আঙুল ঠেকল আট নম্বর ফোকর। আর নয়, এবার ওপরে উঠতেই হয়। হঠাৎ নদীর তলায় পা লাগলো। পানিতে পা ছুঁড়ে ওপরে উঠতে চাইছিল, কিছু একটা ধরে ফেললো ওগুলোকে, সজোরে টেনে নিল পাথুরে পাঁচিলের দিকে। ছ্যাঁৎ করে উঠলো বুক। অক্টোপাস! টাইটার অক্টোপাস। একজন রাজাকে গিলে ফেলেছে! আতঙ্কে এ সব চিন্তা করছে নিকোলাস। পা ছুঁড়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। যেনো কোনো জলদানব টেনে রেখেছে পা দুটোকে। নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় লাগলো, শরীরটা সেঁটে আছে পাঁচিলের গায়ে। তারপর ভাবল, অক্সিজেনের অভাবে হ্যাঁলুসিনেশনের শিকার হয়ে পড়েছে ও। আসলে কি ঘটেছে আন্দাজ করতে পারলো এতোক্ষণে।

অক্টোপাস নয়, ওয়াটার প্রেশার। পাথরের গায়ে সরু একটা ফাটল আছে, আন্ডারওয়াটার টানেলের মুখ। শ্যাফটের ভেতর তীব্র বেগে পানি ঢুকছে, সেই স্রোতে আটকা পড়েছে ওর পা, তবে শরীরের উপরের অংশে এখনও ওই স্রোতের কোনো প্রভাব পড়ে নি। নিকোলাস টের পাচ্ছে ফাটলটার নির্দিষ্ট একটা আকৃতি আছে, রাজমিস্ত্রির তৈরি চৌকো লিনটেল-এর মতো। এ লিনটেলই ওকে ভেতরে টেনে নিতে চাইছে। হাত দুটো উপরের পাঁচিলে মেলে সমস্ত শক্তি দিয়ে টানটা থেকে পা দুটোকে মুক্ত করতে চাইছে নিকোলাস, কিন্তু আঙুলগুলো ধরার মতো কিছু পাচ্ছে না, মসৃণ আর শ্যাওলায় মোড়া পিচ্ছিল পাথরে হড়কে যাচ্ছে হাত। বাঁকা হয়ে উপড়ে আসছে নখগুলো।

তারপর হঠাৎ সিঙ্কহোলের উপর শেষ ফোকরটার নাগাল পেয়ে গেল নিকোলাস। দু হাত ফোকরের কিনারা ধরে প্রাণপণে চেষ্টা করলো পা দুটোকে

ফাটল থেকে বের করে আনতে। রিজার্ভ শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে, দুই হাতের পেশী কাঁপছে থরথর করে, মাংসের নিচে থেকে ফুলে উঠলো ঘাড়ের রগগুলো, মনে হলো মাথাটা বিস্ফোরিত হবে। একেবারে লাভ হলো না তা নয়, সিঙ্কহোলের ভেতর শরীরের ঢুকে যাওয়াটা বন্ধ হয়েছে।

ফুসফুসের সব বাতাস খরচ হয়ে গেছে। বড়জোর আর একবার চেষ্টা করতে পারবে নিকোলাস। গাঢ় মেঘের মতো আকৃতি দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে, নেতিয়ে পড়ে বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছেটা অদম্য হয়ে উঠলো। কোত্থেকে এতো শক্তি পেল বলতে পারবে না, পা দুটোকে টানছে তো টানছেই। মাথার ভেতরটা অন্ধকার ছিল, হঠাৎ বিভিন্ন রঙের বিস্ফোরণ ঘটল সেখানে, চোখ দুটোকে ধাধিয়ে দিল। তবু ঢিল দেয়নি নিকোলাস, টেনে যাচ্ছে। অনুভব করলো পা দুটো বেরিয়ে আসছে সিঙ্কহোল থেকে স্রোতের টান দুর্বল হয়ে পড়েছে। শক্তির উৎস জানা নেই, নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করার জন্য আরো জোর খাটালো।

হঠাৎ করেই ছাড়া পেল নিকোলাস, সারফেসের দিকে উঠে আসছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, আবার অন্ধকার হয়ে গেল মাথার ভেতরটা, কানে গর্জন করছে জলপ্রপাতের মতো বিকট শব্দ। নিঃশেষ হয়ে গেছে ও। জানে না কোথায় রয়েছে, সারফেসে পৌঁছতে হলে আর কতটুকু উঠতে হবে। একবার মনে হলো উঠছে না, ডুবে যাচ্ছে। শেষ হয়ে গেছে ও।

পানির উপর ওঠার পরও বুঝতে পারে নি যে উঠেছে। এতো শক্তি নেই যে পানি থেকে মুখ তুলে শ্বাস নেবে। পানিতে মুখ দিয়ে যেনো একটা লাশ ভাসছে। তারপর অনুভব করলো মাথার চুল ধরে টান দিল রোয়েন, ঠাণ্ডা তাজা বাতাসের স্পর্শ পেল মুখে।

নিকোলাস! শ্বাস নিন! চিৎকার করছে রোয়েন। শ্বস নিন, নিকোলাস, শ্বাস নিন!

মুখ খুলে পানি ছাড়লো নিকোলাস, তারপর বিষম খেলো।

আপনি বেঁচে আছেন! ওহ, থ্যাঙ্ক গড! এতো দেরি করছেন দেখে ভাবলাম আপনি ডুবে গেছেন। কেঁদে ফেললো রোয়েন। আর একটু থাকলেই ঠিক ঠিক মরে যেতেন।

খাদ থেকে প্রথমে নিকোলাসকে তোলা হলো, তারপর রোয়েনকে।

*

নিকোলাসের নির্দেশে গ্যানট্রি খুটে ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে রাখা হলো, হেলিকপ্টার থেকে জ্যাক হেলম্ যাতে দেখতে না পায়। কাঁটাঝোঁপের ছায়ায় শুয়ে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল নিকোলাস, প্রতিটি মুহূর্ত ওর সেবায় ব্যস্ত থাকলো রোয়েন। মাথার ব্যথাটা কোনমতে কমছে না, নিঃশ্বাস ফেলার সময় বুকে ব্যথা অনুভব করছে ও। এক সময় ওকে ধরে দাঁড় করালো রোয়েন। ক্যাম্পে ফেরার সময়। আড়ষ্ট একজন বুড়োর মতো লাগলো নিকোলাসকে, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যথা। ক্যাম্পে ফিরে ওকে ওর কুঁড়েতে শুইয়ে দিল রোয়েন, মশারি টাঙাল, আগুনের মতো গরম এক মগ চায়ের সঙ্গে দুটো অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট খাওয়াল।

আরো এক মগ চা চাইলো নিকোলাস। সেটা খালি হতে রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, এখন একটু ভালো লাগছে?

বোধহয় বাঁচব, বলে হাসলো নিকোলাস।

মুখের রঙ ফিরে এসেছে, বলল রোয়েন, চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন না!

আপনার মনোযোগ কাড়ার আর কোনো উপায় ছিল? এখন যখন জানেন যে বাঁচবেন, বলে ফেলুন কী ঘটেছিল?

সিঙ্কহোলটার বর্ণনা দিল নিকোলাস। ও থামতে রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর বলল, সারফেস থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে ফোকর তৈরি করেছে টাইটা? মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। কীভাবে, নিকোলাস?

চার হাজার বছর আগে ওয়াটারলেভেল আরো হয়তো নিচে ছিল। হয়তো খরায় শুকিয়ে গিয়েছিল নদীর তলা।

কিন্তু তাহলে মাচা দরকার হবে কেন? তাছাড়া, শুকনো নদী খাদের অন্য যে . কোনো জায়গার মতোই, তাই না? না, দুর্গম বলেই এ স্পটটা বেছে নিয়েছিল। টাইটা। অন্তত একটা অন্যতম কারণ।

আপনার সঙ্গে আমি একমত।

তাহলে সারফেসের নিচে ফোকরগুলো টাইটা তৈরি করলো কীভাবে? হাসলো রোয়েন। জানি একই প্রশ্ন অযথা রিপিট করছি। ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গ আপাতত থাক। এবার সিঙ্কহোলটার কথা বলুন। সাইজটা কী?

মাথা নাড়লো নিকোলাস। অন্ধকারে মাপার সুযোগ হয় নি। দুই কি তিন ফুট হবে।

দু সারি ফোকরের ঠিক মাঝখানে ফাটলটা?

না, একটু একপাশে। তবে নদীর একেবারে তলায়। চৌকো বলে মনে হয়েছে, তবে তা নাও হতে পারে। জান বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলাম, অতশত খেয়াল করি নি।

মানুষের তৈরি? বিড়বিড় করলো রোয়েন, দরজার দিকে এগুলো। নোট আর ফটোগ্রাফগুলো নিয়ে আসি।

ফিরে এসে বিছানার পাশে মেঝেতে সুখাসনে বসলো রোয়েন, কাগজপত্র ছড়িয়ে রাখলো নিজের সামনে। মশারি থেকে মাথা বের করে ওর দিকে তাকালো নিকোলাস।

শিলালিপির বসন্ত পর্বের বাকি অংশটুকু ডিসাইফার করেছি আমি। নোটবুকটা খুলে নিজের হাতের লেখাটুকু দেখালো রোয়েন। এগুলো প্রাথমিক নোট, এখানে সেখানে কিছু প্রশ্ন চিহ্ন আছে। কোথাও অনুবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি নি, কোথাও হয়তো টাইটা নতুন সংকেত ব্যবহার করেছে। এগুলো নিয়ে পরে মাথা ঘামাব। সবুজ কালিতে লেখা এগুলো উদ্ধৃতি, মৃতের পুস্তক থেকে নেওয়া। খানিকটা পড়ি। বিশ্বকে আঁকা হয়েছে বৃত্তাকারে, সূর্য দেবতার চাকতি, আমন রা। মানুষের জীবন একটা বৃত্ত, শুরু জরায়ুতে, শেষ সমাধিতে। রথের চাকার বেড় তার নিচে হত্যা করে একটা সরীসৃপকে।

হলুদ কালিতে এ যে, লেখাগুলো দেখছেন, এগুলো মৃতের পুস্তক বা অন্য কোনো উৎস থেকে এসেছে বলে মনে হয় নি আমার। এগুলো টাইটারই লেখা বলে আমার ধারণা। বিশেষ করে এ প্যারাগ্রাফটার উপর আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। পড়ছি-দেবীর কন্যা গর্ভবতী হলো। সে গর্ভবতী হলো এমন একজনের দ্বারা যার কোনো শুক্র নেই। সে তার যমজ বোনকেও নিজের ভেতর ধারণ করছে। তার নিজের জরায়ুতে চিরকালের জন্য কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে ণটা। তার যমজ কোনোদিনই জন্ম নেবে না। আর আলো কোনোদিনই তার দেখা হবে না। চিরকাল অন্ধকাররেই কাটাতে হবে তাকে। বোনের জরায়ুতে বোন, তার বর তাকে চিরকালীন বৈবাহিক সূত্রে বাঁধতে চাইলো। জন্ম না হওয়া যমজ বোন হলো দেবতার কনে, যিনি কিনা একজন মানুষ। ওদের নিয়তি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওরা অনন্তকাল বাঁচবে। ওদের বিনাশ নেই।

নোট বুক থেকে মুখ তুললো রোয়েন। আমরা আগেই একমত হয়েছি, দেবীর কন্যা মানে হলো ডানডেরা নদী। গড বা দেবতা এক সময় মানুষ ছিলেন, তার মানে পরে তিনি ফারাও হন। দেবতা হিসেবে বরণ করে একমাত্র মামোসকেই মিশরের সিংহাসনে তোলা হয়। তার আগে তিনি একজন মানুষ ছিলেন।

মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। শুক্ৰহীন ব্যক্তি টাইটা নিজেই, বোঝা যায়। সে যে খোঁজা পুরুষ, এ-কথা বারবার বলেছে। তবে রহস্যময় যমজ বোন সম্পর্কে কী ভাবছেন আপনি?

নদীর যমজ স্বভাবতই একটা শাখা হবে, কিংবা স্রোতের আরেকটা ধারা, তাই না?

আপনি বলতে চাইছেন সিঙ্কহোল ডানডেরার যমজ বোন। খাদের তলায় ওটা কোনোদিনই রা-র আলো দেখবে না। টাইটা, যার শুক্র নেই, পিতৃত্ব দাবি করছে, তার মানে বলতে চাইছে সে-ই আসলে আর্কিটেক্ট।

ঠিক তাই। আর নদীর যমজ বোনের সঙ্গে ফারাও মামোসের বিয়ে দিয়েছে, যে বিয়ে অনন্তকাল স্থায়ী হবে। সব মিলিয়ে দেখার পর আমি উপসংহারে পৌঁছেছি, ওই সিঙ্কহোলের ভেতরটা দেখার সুযোগ না পেলে ফারাও মামোসের সমাধির লোকেশন কোনোদিনই আমারা খুঁজে পাব না।

কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব বলে আপনার ধারণা?

কাঁধ ঝাঁকালো রোয়েন। আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, নিকোলাস। কীভাবে কী করবেন, আপনার উপর ছেড়ে দিলাম। আমি শুধু জানি, টাইটা ওই সিঙ্কহোলে কাজ করেছে। সে পারলে, চার হাজার বছর পর আজ আপনারও পারা উচিত।

কিন্তু টাইটার সঙ্গে কি আমার তুলনা চলে? টাইটা ছিল একটা প্রতিভা। আমি পণ্ডিত, এ-কথা বারবার বলছে সে। আর আমি? আমি তো সামান্য একজন….

আপনি যা-ই হোন, আমি জানি আমাকে আপনি হতাশ করবেন না! মুচকি হেসে বলল রোয়েন।

*

বোরিস আর টিসে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবার পর গোপনীয়তা বজায়। রাখার আর কোনো প্রয়োজন থাকলো না, এখন আর রোয়েনের কুঁড়েতে চুপিচুপি ঢুকে ফিসফিস করে কথা বলতে হয় না নিকোলাসকে। যে কুঁড়েতে বসে খাওয়াদাওয়া সারত ওরা সেটাকে বানানো হলো ওদের নতুন হেডকোয়ার্টার। ক্যাম্প স্টাফকে দিয়ে বড় একটা টেবিল তৈরি করালো নিকোলাস, তাতে জড়ো করা হলো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফসহ অন্যান্য জিনিসপত্র, ইতোমধ্যে ওরা যা সংগ্রহ করতে পেরেছে। কিচেন থেকে নিয়মিত চা যোগান দিয়ে গেল শেফ, কাগজপত্রের উপর হুমড়ি খেয়ে ঘন্টর পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিল ওরা।

একটা ব্যাপারে একমত হলো দুজনেই, সিঙ্কহোলটা মানুষের অর্থাৎ টাইটার তৈরি কিনা বুঝতে হলে উপযুক্ত ইকুইপমেন্ট নিয়ে আবার নামতে হবে ওখানে। তার মানে স্কুবা দরকার হবে। রোয়েন জানালো, ডুরেঈদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে লোহিত সাগরে অ্যাকুয়াল্যাঙ ব্যবহার করেছে সে, তবে তাকে এক্সপার্ট বলা যাবে না।

শুধু ইকুইপমেন্টই নয়, এক্সপার্টদের সাহায্যও দরকার হবে। অপারেশনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য এ সব নিয়ে ওদেরকে এলাকায় আবার ফিরে আসতে হবে যথাসম্ভব দ্রুত, বর্ষা মরশুম শুরু হয়ে যাবার আগেই।

ঠিক হলো সিঙ্ক-হোলটা সম্পর্কে আরো খানিক পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার পর রওনা হবে ওরা, ফিরে এসে যাতে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করা যায়।

সিঙ্ক-হোল প্রসঙ্গে নিজের ধারণার কথা বলল নারা, যা ঢোকে তা বেরিয়েও আসে, যেমন উপরে কিছু উঠলে সেটা নেমে আসতেও বাধ্য। ফাটলটার ভেতর এতো জোনে পানি ঢুকছে, নিশ্চয়ই কোথাও দিয়ে বের হচ্ছেও সেই পানি, তাই না?

বলে যান।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার। নদীর তলা থেকে ওই সিঙ্কহোলে ঢাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পানির প্রেশার ওখানে ভয়ঙ্কর। তবে আমরা যদি আউটলেটটা খুঁজে পাই, সেদিক থেকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

একটা সম্ভাবনা বটে। চেহারা দেখে মনে হলো নিকোলাসের বক্তব্য প্রভাবিত করেছে রোয়েনকে। একটা স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ টেনে নিল ও। মঠটা চিহ্নিত করে ফটোগ্রাফের উপর একটা বৃত্ত এঁকেছে নিকোলাস। গহ্বরের ভেতর নদীর কোর্সও চিহ্নিত করেছে, যদিও খাদটা এতো সরু আর ঘন ঝোপে এমনভাবে ঢাকা যে ছোট স্কেলের ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় না, হাই-পাওয়ারড ম্যাগনিফাইং লেন্স ব্যবহার করা সত্ত্বেও। এই পয়েন্টে নদীটা গহ্বরে ঢুকছে, আঙুল দিয়ে দেখালো রোয়েন। আর এটা হলো সাইড ভ্যালি, যেটা বেয়ে ট্রেইল ঘুরপথে এগিয়েছে। ঠিক আছে?

তা আছে, বলল নিকোলাস, কিন্তু আপনি আসলে বলতে চাইছেন কী?

এখানে আসার পথে আমরা মন্তব্য করেছিলাম এ উপত্যকা সম্ভবত এক সময় ডানডেরা নদীর আদি কোর্স ছিল, পরে নদীটা গহ্বরের ভেতর আলাদা একটা তলা তৈরি করে নেয়।

হ্যাঁ, মনে আছে।

এ পয়েন্টের জমিন নীলদের দিকে খুব বেশি ঢালু, তাই না? এবার বলুন, আপনার কী মনে আছে, শুকনো উপত্যকা বেয়ে নামার সময় আরেকটা ছোট প্রবাহ দেখেছিলাম আমরা? মনে হয়েছিল প্রবাহটা উপত্যকার পূর্বদিকের কোথাও থেকে বেরিয়েছে?

কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি, বলল নিকোলাস। আপনার ধারণা সিঙ্ক হোল দিয়ে ঢুকে ওই পথে বেরিয়েছে স্রোতটা। দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে অসুবিধে কী?

ক্যামেরা ব্যাগ আর হালকা ডে-প্যাক নেওয়ার জন্য নিজের কুঁড়েতে চলে গেল নিকোলাস, ফিরে এসে দেখলো রোয়েন যাবার জন্য তৈরি হয়েছে, তবে ইতোমধ্যে ওর একজন সঙ্গী জুটেছে।

পথে ওদের সামনে থাকলো তামের, এগুচ্ছে নাচতে নাচতে, সরু কাঠির মতো পায়ের চারপাশে আলখেল্লার জুল ফুলে ফুলে উঠছে। নৃত্যের সঙ্গে গীতও গাইছে। ছেলেটা। অ্যামহারিক ভাষায় তার তেমন দখল নেই, তবে যিশু আর সেইন্টদের নিয়ে যত গান আছে তার প্রায় সবই মুখস্থ। কয়েক মিনিট পরপর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে সে, দেখে নিচ্ছে রোয়েন ঠিকমতো আসছে কিনা। আগুনের মতো গরম রোদের ভেতর উপত্যকার ঢাল বেয়ে ওঠা অত্যন্ত ক্লান্তিকর, ওরা দু জন ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠলো। কিন্তু তামেরকে যেনো পরিশ্রম বা রোদ স্পর্শই করছে না, আগের মতোই হাসি-খুশি আর অক্লান্ত লাগছে তাকে।

ঝরনার বা প্রবাহটা উপত্যকার যেখানে বেরিয়েছে সেখানে পৌঁছে কয়েকটা অ্যাকেইশা গাছের ছায়ার বসে পড়লো ওরা। বিশ্রাম নেয়ার সময় চোখে বাইনোকুলার তুলে উপত্যকার পাশটা পরীক্ষা করছে নিকোলাস। ঘন ঝোপে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, খানিক পর মন্তব্য করলো। দুঃখিত, পায়ে হেঁটেই উৎসের সন্ধান করতে হবে।

আবার হাঁটা শুরু হলো। উপত্যকার পাশ বেয়ে উঠে যাচ্ছে, মাথার উপর সূর্য। জলপ্রবাহের কিনারা ধরে হাঁটছে ওরা। কয়েক জায়গায় জমা হয়েছে ঝরনার পানি, সেখান থেকে খুদে জলপ্রপাত লাফ দিয়েছে নিচের দিকে। ঘন ঝোঁপ, শিকড় যেখানে পানির নাগাল রয়েছে সেখানে ওগুলো তাজা আর গাঢ় সবুজ। পানির উপর কালো আর হলুদ প্রজাপতি মেঘের মতো উড়ছে। সবুজ শ্যাওলা মোড়া পাথরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে সাদা-কালো একটা খঞ্জনা। ঢালের অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে ছোট একটা জলাশয়ের পাশে বিশ্রাম নিতে বসলো ওরা। বিরক্ত করছে দেখে হ্যাট দিয়ে একটা ফড়িংকে বাড়ি মারল নিকোলাস, ছিটকে সেটা ঝরনার পানিতে পড়লো। দুর্বল ভঙ্গিতে পা ছুঁড়ছে ওটা, স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে নিচের দিকে, এ সময় পানির ভেতর থেকে গাঢ় একটা ছায়া মাথাচাড়া দিল। আলোড়ন উঠলো পানিতে, আয়নার মতো রূপালি পেট ঝিক করে উঠলো, অদৃশ্য হয়ে গেল ফড়িংটা।

মাছ! কম করেও দশ পাউন্ড! ইস, রডটা আনি নি!

ঝরনার পাশে নিকোলাসের কাছাকাছি বসে আছে তামের। হঠাৎ একটা হাত তুলে লম্বা করলো সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসলো তার আঙুলে। হলুদ আর কালো ভেলভেটের মতো ডানা বারবার মেলছে আর গুটাচ্ছে। নিকোলাস আর রোয়েন তাকিয়ে আছে অবাক চোখে, কারণ ওদের মনে হলো তামের ডাক দেয়াতেই তার আঙুলে এসে বসেছে ওটা। খিকখিক করে হেসে উঠে হাতটা আমার দিকে সরিয়ে আনল তামের। দেখাদেখি রোয়েনও ওর হাত তুলে লম্বা করলো। এবং কি আশ্চর্য, প্রজাপতিটা উড়ে চলে এলো ওর আঙুলে।

খিলখিল করে হেসে উঠলো রোয়েন। ধন্যবাদ, তামের, এতো সুন্দর একটা উপহার দেয়ার জন্য, হাসি থামতে বলল ও। হালকা একটু ফুঁ দিয়ে প্রজাপতিটাকে উড়িয়ে দিল, নিকোলাসের দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলল, বুনো পশু-পাখিদের সঙ্গে ওর খুব ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করেছেন? ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

সন্ন্যাসী আর পুরোহিতরা বিনা বাধায় ওকে ঘুরে বেড়াতে দেয়, পশু-পাখিরা সম্ভবত জেনে ফেলেছে ওর দ্বারা তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।

যেনো ওদের কথা বুঝতে পেরেই হেসে উঠে আবার হাতটা লম্বা করলো তামের। এবারও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রজাপতি এসে বসলো তার আঙুলে।

আরো পঞ্চাশ ফুট উপরে ওঠার পর ঝরনার উৎসটা দখেতে পেল ওরা। লাল স্যান্ডস্টোনের নিচু একটা পাঁচিল দেখা গেল, পাঁচিলের গায়ে একটা গুহামুখ, সেটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ঝরনার পানি। গুহামুখে ঘন ঝোঁপ, ভেতরটা দেখা যায় না। হাঁটু গেড়ে ঝোঁপ সরাল নিকোলাস, নিচু ফাঁকের ভেতর তাকাতে চেষ্টা করলো। তেমন কিছু দেখার নেই। ভেতরটা অন্ধকার, বলল ও। তবে অনেক লম্বা গুহাটা।

ওটার তুলনায় আপনি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছেন, বলল রোয়েন। আমাকে ঢুকতে দিন।

ভেতরে কেউটে থাকতে পারে, সাবধান করলো নিকোলাস। প্রচুর ব্যাঙ দেখতে পাচ্ছি।

জুতো খুলে ঝরনার পানিতে নেমে পড়লো রোয়েন, নিকোলাসের কথা যেনো শুনতে পায় নি। স্রোত ঠেলে এগুতে কষ্ট হচ্ছে ওর, তবে ডুবেছে মাত্র উরুর অর্ধেকটা। গুহাটা নিচু, ভতরে ঢোকার সময় ঝুঁকে শরীরটাকে প্রায় অর্ধেক করে নিতে হলো। ভেতরে ঢোকার পর বলল, সামনের দিকে আরো নিচু হয়ে এসেছে ছাদ।

বি কেয়ারফুল, ডিয়ার গার্ল। কোনো ঝুঁকি নেবেন না।

আমি আপনার ডিয়ার নই। আমি গার্লও নই।

তাহলে ইয়ং লেডি বলি?

না, কেন! আমার নাম রোয়েন। কিছুক্ষণ আর কোনো কথা হলো না। তারপর গুহার ভেতর থেকে রোয়েন বলল, আর এগুতে পারছি না। সরু হয়ে গুহাটা একটা শ্যাফটে নেমেছে বলে মনে হচ্ছে।

শ্যাফট?

মানে প্রায় চৌকো একটা গর্ত আর কী।

কৃত্রিম? মানুষের তৈরি?

বলা সম্ভব নয়। তীরবেগে পানি বের হচ্ছে। পাথরে কোনো টুলসের দাগ দেখছি না। খোঁড়াখুঁড়ির কোনো চিহ্নও নেই। প্রচুর শ্যাওলা।

পানি তোড় না থাকলে ওই শ্যাফট গলে কোনো মানুষ ঢুকতে পারবে?

বামুন হলে পারবে।

কিংবা কোনো বাচ্চা ছেলে?

হ্যাঁ, বাচ্চা ছেলে হলে পারবে। কিন্তু ওখানে কে একটা বাচ্চাকে নামাবে?

টাইটার যুগে শিশুশ্রম ব্যবহার করা হতো, বলল নিকোলাস। টাইটাও হয়তো ব্যবহার করেছে।

গুহা থেকে টানেলটা পরীক্ষা করার কোনো উপায় নেই? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

অসম্ভব, জোর দিয়ে বলল রোয়েন। পানির বেগ ওখানে প্রবল। শ্যাফটের ভেতর হাত গলাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার শক্তিতে কুলোয় নি।

ব্যাগ হাতড়ে কালো একটা অ্যানাডাইজড ইন্সটুমেন্ট বের করলো নিকোলাস। অ্যানারয়েড ব্যারোমিটার। প্রত্যেক নেভিগেটরের কাছে একটা থাকা উচিত। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে রিডিং নোট করলো ও।

খুলে বলুন।

আমি জানতে চাই সিঙ্কহোলের মুখ যে লেভেলে রয়েছে, এ ঝরনার তার চেয়ে নিচে কিনা। তা যদি না হয়, সম্ভাবনার তালিকা থেকে এটাকে আমরা বাদ দিতে পারি।

এখন তাহলে আমরা সিঙ্ক-হোলের লেভেল মাপতে যাব, টাইটার হ্রদে?

হ্যাঁ।

*

ওরা কোথায় যাচ্ছে জানার পর নতুন একটা পথ দেখালো তামের, ঝরনার উৎস থেকে টাইটার হ্রদের উপর পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় পৌঁছতে দু ঘণ্টার বেশি লাগলো না। বিশ্রাম নেওয়ার সময় রোয়েন মন্তব্য করলো, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তো, গেম ট্রেইলের সবগুলো ওর চেনা। গাইড হিসেবে দারুণ।

বোরিসের চেয়ে ভালো, বলল নিকোলাস। ব্যারোমিটার বের করে আরেকটা রিডিং নিল ও।

চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব খুশি।

খুশি হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে, বলল নিকোলাস। নদীর সারফেস থেকে খাদের এ পাঁচিলের মাথা একশো আশি ফুট। সারফেস থেকে সিঙ্ক-হোল আরো পঞ্চাশ ফুট। হিসাবে বলছে, রিজের উল্টোদিকে আপনার ঝরনার উৎস সিঙ্ক হোলের চেয়ে একশো ফুটেরও বেশি নিচে।

অর্থাৎ?

অর্থাৎ প্রচুর সম্ভাবনা আছে স্রোতটা এক ও অভিন্ন হবার। ইনফ্লো এখানে, টাইটার হ্রদের তলায়; আর আউটফ্লো গুহার ভেতর।

কিন্তু কাজটা করলো কীভাবে টাইটা? হতভম্ব দেখালো রোয়েনকে। কীভাবে নামলো হ্রদের তলায়?

কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস। এ-সব কাজ করার নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে। পানির তলায় বহুকাল আগে থেকে কাজ করছে মানুষ। পানির নিচে ব্রিজের পিলার তৈরি করে না? কিংবা বাঁধের ভিত? ভেবে দেখুন না, পানির প্রবাহ মাপার জন্য টাইটা নীলনদের লেভেলের নিচে শ্যাফট তৈরি করে নি? সে তার হাইড্রোগ্রাফ-এর বর্ণনা দিয়েছে রিভার গড-এ, মনে পড়ে? প্রতিষ্ঠিত টেকনিক হলো একটা কফার ড্যাম তৈরি করা… হঠাৎ থেকে গেল ও। আরে, একটা ড্যাম! টাইটা, বুড়ো ভাম, নদীতে বাঁধ দেয় নি তো?

কিন্তু তা কি সম্ভব?

আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, টাইটার পক্ষে সবই সম্ভব। তার হাতে লোকাল ছিল প্রচুর। আসওয়ানের কাছে নীলনদে সে যদি হাইড্রোগ্রাফ তৈরি করতে পারে, তার মানে ধরে নিতে হবে হাইড্রোডাইনামিক্স প্রিন্সিপাল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল তার। হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব।

আমরা প্রমাণ করব কীভাবে?

ডানডেরা নদীকে বাধা বিশাল একটা কাজ। কিছু না কিছু প্রমাণ আজও রয়ে গেছে, থাকতে বাধ্য।

সেই বাঁধ টাইটা কোথায় তৈরি করতে পারে? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রোয়েন। আপনি হলে কোনো জায়গাটা বেছে নিতেন?

একটা জায়গার কথা বলতে পারি আমি, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল নিকোলাস। ট্রেইল যেখানে নদীর কিনারা ছেড়ে ঘুরপথে উপত্যকা ধরে নেমেছে, আর নদীটা যেখানে গহ্বরে পড়েছে। দু জনেই ওরা একযোগে মাথা ঘুরিয়ে উজানের দিকে তাকালো।

তাহলে আমরা অপেক্ষা করছি কেন? লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো রোয়েন। চলুন দেখে আসি।

উত্তেজনাটা সংক্রামক, হাসির ফোয়ারা ছেড়ে নাচতে নাচতে কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে ট্রেইল ধরল তামের, তারপর উপত্যকা বেয়ে উঠে এলো ট্রেইল যেখানে নদীর পাশে ফিরে এসেছে। আবার যখন জলপ্রপাতের ওপরে এসে দাঁড়ালো ওরা, সূর্য তখন অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ডানডেরা এখানে লাফ দিয়ে পড়েছে গহ্বরের মুখে, তারপর সর্বশেষ দৌড় শুরু করেছে নীলনদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। টাইটা যদি এখানে বাঁধ দিয়ে থাকে- খাদের মুখের দিকটায় হাত তুললাম নিকোলাস,–সাইড ভ্যালির দিকে নদীর দিক বদল সম্ভব।

আমারও মনে হচ্ছে সম্ভব। হেসে উঠলো রোয়েন। কিছু না বুঝে ওদের সঙ্গে তামেরও হাসছে।

হাত তুলে চোখে ছায়া ফেললো নিকোলাস, মুখ তুলে জলপ্রপাতের দু দিকে ব্লাফ দুটো দিকে তাকালো। ব্লাফ দুটো লাইমস্টোনের তোরণ বা গেট তৈরি করেছে, মাঝখানে গর্জন করছে নদী ঠোঁট থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ার সময়। ওদিকটায় উঠতে চাই আমি, এলাকার লেআউট বুঝতে হবে। আপনি উঠবেন?

বাধা দিতে দেখতে পারেন, চ্যালেঞ্জ করলো রোয়েন, ওঠার সময় সে-ই পথ দেখালো। কঠিন চড়াই, কোথাও কোথাও হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে হলো। অনেক জায়গায় আলগা বা ঝুরঝুরে হয়ে আছে লাইমস্টোন, বিপদ ঘটার সমূহ আশঙ্কা। তোরণটার পুব শাখার চূড়ায় উঠতে ঘেমে গোসল হয়ে গেল ওরা। তবে এতো কষ্টের পুরস্কারও জুটল। নিচের দুর্গম এলাকা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়েছে ওদের সামনে।

সরাসরি উত্তরে লম্বা সরু শৈলশিরা ও মালভূমি খাড়া পাচিলের মতো মাথাচাড়া দিয়ে আছে, যেনো সছিদ্র দুর্গ-প্রাকার, অসংখ্য ভাঁজ আর খাজ বিশিষ্ট। আরো দূরে ও উপর দিকে অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণী, পর্বতমালার চূড়া, কাছাকাছি উজ্জ্বল নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে স্নান নীল পাখির পালকের মতো।

প্রকৃতির বিধ্বস্ত রূপ, নিজের চারপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করলো রোয়েন। টাইটা এ জায়গা কেন বেছে নিয়েছিল, বোঝা যায়। অনুপ্রবেশ এখানে প্রায় অসম্ভব।

ছবিটা এখন পরিষ্কার, বলল নিকোলাস, হাত লম্বা করে নিচের উপত্যকাটা দেখালো। উপত্যকার বিভক্তিরেখা স্পষ্ট। জমিনের স্বাভাবিক পতনও দেখতে পাচ্ছি। ওদিকে, খাদের ওপার থেকে আমাদের নিচের পয়েন্ট পর্যন্ত সবচেয়ে সরু। সরু গলা বলতে পারি, নদী সংকুচিত হয়ে ওটা দিয়ে বেরিয়েছে-বাঁধ তৈরির জন্য আদর্শ সাইট। শরীরটা মুচড়ে বাম দিকটা দেখালো রোয়েনকে। নদীর পানি উপত্যকায় ছড়িয়ে দেওয়া কঠিন কাজ ছিল না। গহ্বরের ভেতর নদী শুকিয়ে যাবার পরও সে ওখানে কী করেছে আমরা জানি না। তারপর বাঁধের দেয়াল ভেঙে ফেলে সে, সেটা আরো সহজ কাজ ছিল। ভেঙে ফেলার পর নদী আবার তার স্বাভাবিক কোর্স ফিরে পায়।

ওদের দু জনের মুখভাব গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করছে তামের, যে যখন কথা বলে তখন তার দিকে তাকায়। কিছুই বুঝছে না, তবু রোয়েনের প্রতিটি হাবভাব ও আচরণ তার উপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। রোয়েন মাথা ঝাঁকালে সে-ও আঁকায়। রোয়েন ভুরু কোঁচকালে সে-ও তাই করে। আর রোয়েন যখন হাসে, খিকখিক করে সে-ও হেসে ওঠে।

নদীটা ছোট নয়, বলল রোয়েন।

নিশ্চয়ই মাটি দিয়ে বাঁধটা বানায় নি?

মাথা নাড়ল নিকোলাস। মাটি দিয়ে এ নদীকে বশ মানানো সম্ভব নয়। রক স্ল্যাব বা পাথরের ফলক দিয়ে সম্ভব। পরে বাঁধটা ভেঙে ফেললেও কিছু কিছু আলামত থাকার কথা।

তাহলে খোঁজ শুরু করতে হয়, বলল রোয়েন। প্রথমে খাদের সরু গলায়। তারপর ভাটির দিকে এগিয়ে যাব।

ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলো ওরা। রোয়েনের জন্য সহজ পথ অনুসরণ করছে তামের। রোয়েনের হাতছানি দিচ্ছে সে। উপত্যকার গলায় বেরিয়ে এলো ওরা, দাঁড়ালো নদীর পাথুরে পাড়ে, নিজেদের চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে।

বাঁধের পাঁচিল কত উঁচু ছিল? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

খুব বেশি উঁচু হওয়ার কথা না। পাঁচিলের পাশ ধরে খানিকটা ওপরে উঠলো নিকোলাস, ওখানে উবু হয়ে বসে সামনে-পেছনে মাথা ঘোরাল, প্রথমে দেখে নিল উপত্যকার নিচের দিকের দৈর্ঘ্য,. তারপর দেখলো গহ্বরের মুখে পতনশীল জলপ্রপাতের ঠোঁট। তিনবার স্থান বদল করলো নিকোলাস, প্রতিবার ঢালের আরেকটু উপর উঠে গেল। যত উঠলো ততই খাড়া হচ্ছে ঢাল। শেষে দেখা গেল ঢালের গায়ে অনেক কষ্টে ঝুলে আছে ও, তবে চেহারা দেখে মনে হলো সন্তুষ্ট। ওখান থেকেই চিৎকার করলো রোয়েনের উদ্দেশে, আমার ধারণা এ পর্যন্ত উঁচু ছিল বাঁধটা। ধরুন, পনেরো ফুট।

রোয়েন এখনো নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, ওখান থেকে এবার উল্টোদিকের পাড়ে তাকালো, পাড় থেকে খাড়া উঠে যাওয়া হলে একশো ফুট, গলা চড়িয়ে বলল।

কঠিন কাজ, তবে অসম্ভব নয়, বলল নিকোলাস।

কাজের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। বাধের পাঁচিল পাহাড়ের গায়ে ঠেকাতে হয়েছিল টাইটাকে।

একই লেভেলে থেকে জায়গা বদল করলো নিকোলাস। এক সময় সরাসরি জলপ্রপাতের উপর চলে এলো, তারপর আর সামনে এগোবার উপায় দেখছে না। নিচে, রোয়েন আর তামেরের পাশে নেমে এসে বলল, প্রায় চার হাজার বছর আগের ঘটনা। কোনো চিহ্ন না থাকাই স্বাভাবিক। রক ব্লক বা পাথরের ফলক পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বাঁধ ভেঙে ফেলার পর তীব্র স্রোতে ভেসে গেলেও কত দূর আর যাবে।

উপত্যকা বেয়ে নামতে শুরু করলো ওরা। খানিক দূর নামার পর একটা পাথরের খণ্ড দেখতে পেল রোয়েন, আশপাশের অন্যান্য পাথরের সঙ্গে যেনো বেমানান। পুরানো আমলের কেবিন ট্রাংকের মতো আকার। শ্যাওলা আর লতাপাতায় অর্ধেকটাই ঢাকা, তবে বেরিয়ে থাকা অংশে ডান দিকে মোচড় খাওয়া একটা কোণ স্পষ্ট। নিকোলাসকে ডেকে দেখালো ও।

স্ল্যাবটার গায়ে হাত বুলালো নিকোলাস। সম্ভব। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাটালির দাগ পেতে হবে, রাজমিস্ত্রী যেখানে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করেছিল। আপনি জানেন, প্রথমে পাথরের গায়ে বাটালি দিয়ে গর্ত করা হতো, তারপর গজাল ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হতো, যতক্ষণ না ফেটে যায়।

আরো আধ কিলোমিটার পর্যন্ত উপত্যকার মেঝে সার্চ করলো ওরা। বন্যায় সময়ও এতো দূরে কোনো ব্লক ভেসে আসবে না, বলল নিকোলাস। চলুন, দেখি জলপ্রপাত হয়ে গহ্বরের মুখে কিছু পড়েছে কিনা।

ডানডেরার পাড়ে ফিরে এলো ওরা, ঢাল বেয়ে নামলো জলপ্রপাত পর্যন্ত। উঁকি দিয়ে তাকালো নিকোলাস।

ভাটির চেয়ে এদিকটায় গভীরতা কম, বলল নিকোলাস। আমার ধারণা একশো ফুটও হবে না।

ভাবছেন আপনি ওখানে নামতে পারবেন? রোয়েনের চোখে সন্দেহ। নিচ থেকে বিস্ফোরিত হয়ে উঠে আসছে বাষ্পকণা ঘন মেঘের মতো, চোখ-মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। পানির বিরতিহীন পতন বজ্রপাতের মতো আওয়াজ করছে, কথা বলার সময় চিৎকার করছে ওরা।

রশি, টেনে তোলার লোক থাকলে ভেবে দেখা যেত। কিনারায় শক্ত হয়ে বসলো নিকোলাস, চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে নিচের গামলার দিকে তাকালো। আলগা পাথরের ছোটবড় অনেক প রয়েছে ওখানে-ছোট আকৃতির গোল পাথর, কয়েকটা বেশ বড়। কিছু পাথর কোণ বিশিষ্ট, কল্পনার সাহায্য নিলে কিছু পাথরকে চৌকো বলেও মনে হবে। তবে ওগুলোর সারফেস পানির তোড়ে মসৃণ হয়ে আছে, ভেজা ও চকচকে। বেশিরভাগই আংশিক জলমগ্ন, সচল জলকণায় ঢাকা।

ওগুলো সে পেল কোত্থেকে? হঠাৎ জানতে চাইলো রোয়েন।

কে কি পেল? নিকোলাস বিস্মিত।

আপনি বুঝতে পারছেন না? ভুল দিক থেকে শুরু করেছি। আমরা জানার চেষ্টা করছি ব্লকগুলোর কি গতি হয়েছে। তার বদলে আমাদের খোঁজ করা উচিত নয়, ব্লকগুলো টাইটা পেল কোত্থেকে?

তাই তো! শেষটা জানার চেষ্টা করছি আমরা, শুরুটা নয়। বাঁধের ভাঙা পাঁচিল নয়, আমাদের খোঁজা উচিত পাথরের খনি।

কোত্থেকে শুরু করা যায়? রোয়েনের ব্যাকুল প্রশ্ন।

রোয়েনের প্রশ্ন বুঝতে পারুক বা না পারুক, খিক খিক করে হেসে উঠলো তামের। দু জনেই ওরা একযোগে তার দিক তাকালো। তারপর হাতছানি দিয়ে তামেরকে ডাকলো রোয়েন। পাশে বসিয়ে আরবিতে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করে বলল তাকে। শোনার পর চোখ বড় বড় করলো তামের, তারপর উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো, জেসাস স্টোন! জেসাস স্টোন! আসুন আমার সঙ্গে, আপনাদের দেখাই! দাঁড়ালো রোয়েন, তামের তাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপত্যকার ঢাল বেয়ে।

তামের ছুটছে, তার সঙ্গে রোয়েনকেও ছুটতে হচ্ছে। আনন্দে অ্যামহারিক গীত গাইছে ছেলেটা। ওদের পিছু নিয়ে আস্তে ধীরে হাঁটছে নিকোলাস। উপত্যকার আধ মাইল নিচে মিলিত হলো ওদের সঙ্গে।

এখানে নিকোলাস তামেরকে দেখলে হাঁচু গেড়ে বসে পাথুরে পাঁচিলে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। প্রার্থনা করছে সে, চোখ দুটো বন্ধ। তার পাশে রোয়েনও বসে আছে।

খানিক পর লাফ দিয়ে সোজা হলো তামের, ধুলোর উড়িয়ে নাচল কিছুক্ষণ।

প্রার্থনা শেষ, এবার আমরা জেসাস স্টোনের কাছে যেতে পারি। রোয়েনের হাত ধরল আবার, পাথরে পাঁচিল ঘেঁষে এগুলো। নিকোলাসের সামনে থেকে ওরা দু জন যেনো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল, যাকে বলে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস।

রোয়েন! ডাকলো ও।কোথায় আপনি? কী ব্যাপার?

এদিকে, নিকোলাস! এদিকে আসুন!

সাবধানে পা ফেলে পাথরের পাঁচিলের সামনে চলে এলো নিকোলাস। ওহ, গড! এ তো আমি এক বছর চেষ্টা করলেও খুঁজে পেতাম না!

পাহাড়-প্রাচীরের গা ভাঁজ খোঁজে, ভেতর দিকে ঢুকে গেছে, তৈরি করেছে গোপন একটা প্রবেশপথ। খাড়া দুই পাশ বেয়ে ওপরে উঠে গেল নিকোলাসের দৃষ্টি, ফাঁকটায় ঢুকে পড়েছে। ত্রিশ কদম পার হতে খোলা একটা অ্যামফিথিয়েটারে ঢুকলো, কম করেও একশো গজ লম্বা হবে, আকাশের দিকটা উন্মুক্ত। দেয়ালগুলো নিরেট পাথর, এক পলক তাকিয়েই নিকোলাস বুঝতে পারলো উপত্যকার মেঝেতে রোয়েনের পাওয়া পাথরটার মতো স্ফটিকতুল্য শিলা বা অভ্র এগুলো।

লক্ষণ দেখে বোঝা গেল গামলা থেকে পাথর কেটে ফাঁকা করা হয়েছে জায়গাটা, সারি সারি স্তর কাটার দাগ পাচিলের মাথা পর্যন্ত লম্বা। কাটার পর সব ব্লক সরানো হয়নি, অ্যাম্পিথিয়েটারের মেঝেতে স্থপ করা রয়েছে। আবিষ্কারটা হতভম্ব করে তুলেছে নিকোলাসকে, নড়তে বা কথা বলতে পারছে না। একেবারে নিখুঁত চারকোনা পাথরও পড়ে আছে মেঝেতে, প্রয়োজন না পড়ায় বের করা হয় নি। রোয়েনকে নিয়ে সেটার সামনে দাঁড়িয়েছে তামের।

রোয়েনের হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে তামের। জেসাস স্টোন। জেসাস আমাকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসেন। প্রথম যেদিন এলাম, দেখি এ পাথরে উপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। লম্বা সাদা দাড়ি ছিল, চোখ দুটো মায়া ভরা, দয়ালু, কিন্তু বিষণ্ণ। গান শুরু করে বুকে ক্রস চিহ্ন আঁকল সে, গানের তালে তালে দুলছে।

এগিয়ে এসে নিকোলাস দেখলো পাথরটার উপর শুকনো ফুল, মাটির পাত্র, তেজ ফ্লাস্ক ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। তার মানে নিয়মিতই এখানে আসে তামের, জেসাস স্টোন তার ব্যক্তিগত বেদি, যিশুকে খুশি করার জন্য নৈবেদ্য দিয়ে যায়।

প্রাচীন বেদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করছে রোয়েন, দেখা দেখি তামেরও। প্রার্থনা শেষ হতে নিকোলাসের পাশে চলে এলো রোয়েন, দু জন ঘুরেফিরে দেখছে পাথরখনির মেঝেটা। এতো নিচু গলায় কথা বলছে ওরা, জায়গাটা যেনো পবিত্র কোনো ধর্মীয় স্থান।

ঘুরেফিরে দেখার পর পাথরখনির প্রবেশমুখে থামলো ওরা, ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে, দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। একটা সাইজ করা চৌকো পাথরের উপর বসলো ওরা, তামের বসলো ওদের পায়ের কাছে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে; মুখ তুলে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নিকি তামেরের দিকে তাকালো। তামের, তোমার উপর আমরা খুব খুশি।

তুমি খুব ভালো ছেলে।

ওর প্রশংসা পরে করলেও চলবে, বলল রোয়েন। চলুন, ফিরে যাই।

ফেরাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, বলল নিকোলাস। আজ চাঁদ উঠবে না, অন্ধকারে পা ভাঙব।

এখানে ঘুমানোর প্ল্যান করছেন? রোয়েন অবাক।

অসুবিধে কি? বললেই আগুন জালতে পারি। সঙ্গে সারভাইভাল রেশন আছে। আর আপনার সঙ্গে তো প্রহরী আছেই, কাজেই আপনার সম্ভ্রম হুমকির সম্মুখীন হবে। না।

সত্যিই তো, অসুবিধে কী!

আগুন জ্বালার জন্য শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করতে যাবে নিকোলাস, হঠাৎ স্থির হয়ে কান পাতলো। শব্দটা রোয়েনও শুনতে পাচ্ছে। আবার সেই পেগাসাস হেলিকপ্টার, বলল নিকোলাস। এই অসময়ে কি খুঁজছে ওরা?

মাথার উপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওরা, এক হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে গেল কপ্টারটা, লাল আর সবুজ নেভিগেশন্যাল আলো মিটমিট করতে দেখা গেল। মঠের দিকে যাচ্ছে ওটা।

*

প্রস্তরখনির মুখের কাছে একটা আগুন প্রস্তুত করলো নিকোলাস। সবার মধ্যে খাবার বিলি-বণ্টন করে দিল। দারুণ তৃপ্তি নিয়ে খেলো রোয়েন।

প্ৰস্তুরখনির দেয়ালে আগুনের কারণে ওদের ভূতুড়ে ছায়া পড়েছে। আচমকা একটা নাইটজার ডেকে উঠতে ভয় পেয়ে নিকোলাসের একটু কাছে এসে বসলো রোয়েন।

কী জানি, টাইটা হয়তো এখন আমাদের নিয়ে তামাশা করছে, সে বলে, মনে হয়, এতোক্ষণে তার তো ভয় পাওয়ার কথা। প্রথম অংশের ধাঁধারা সমাধান আমরা করেই ফেলেছি।

পরের ধাপটাই যে কঠিন। ওই হ্রদের নিচে নেমে দেখতে হবে। কি মনে হয়, কি পাবো ওকানে? নিকোলাস জানতে চায়।

কী জানি, অস্বস্তিভরে বলল রোয়েন। কিছু অনুমান করতে ভয় হয়।

আমি মোটেও ভয় পাই না। ঠিক আছে, আপনার হয়ে আমি বলে দেই? রোয়েন হেসে সায় দিতে ও বলে চলে, ওখানে আমরা ফারাও মামোস-এর সমাধির প্রবেশ পথ খুঁজে পাবো। একদম আসল সমাধি! গোজামিল নয়!

কিন্তু অতো নিচে নামবেন কেমন করে? অ্যাকুয়ালাঙ তো নেই।

এখনো জানি না, নিকি স্বীকার যায়। তবে হয়তো পুরোদস্তুর ডুবুরির পোশাকে নামতে হবে।

নিস্তদ্ধতা জেঁকে বসে। অবশেষ নীরবতা ভেঙে একহাত দিয়ে রোয়েনের কাঁধে জড়িয়ে ধরে নিকি। চিয়ার আপ। একটা ব্যাপার পরিষ্কার–যদি আমরা না পাই, তবে আর কেউ মামোসের সমাধি খুঁজে পাবে না।

যদি সত্যিই হ্রদের নিচে সমাধির প্রবেশপথ থেকে থাকে, তবে সপ্তম ফ্রোলের অনেক কথাই ভুয়া। মানে যে তথ্য আমরা টাইটা, ডুরেঈদ এবং সবশেষে উইলবার স্মিথের মাধ্যমে পেয়েছি।

আরো কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎই উল্লসিত হয়ে উঠে রোয়েন।

ওহ নিকি! কী অসাধারণ একটা খেলায় আমরা নেমেছি। কিন্তু সত্যি পিরবো তো? সত্যি কোনো উপায় কি আছে?

দেখা যাক।

কখন দেখা যাবে?

সময় হলে। এখনো জানি না, তবে প্রচুর প্ল্যানিং আর পরিশ্রম পড়বে কাজটা শেষ করতে হলে।

তো, আপনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এ ব্যাপারে? রোয়েন জানতে চায়।

মুচকি হাসে নিকোলাস। সত্যি বলছি–জীবনেও ভাবি নি টাইটা এ পর্যন্ত নিয়ে আসবে আমাদের। আবার এমনও ভাবছি না, স্রেফ দরজা ভেঙে লুট করে আনবো মামোসের সম্পদ। হাওয়ার্ড কার্টার কতো কষ্ট করে তুতেনখামেনের সমাধি পেয়েছেন, জানেন না? তবে, সত্যি, রোমাঞ্চ পেয়ে বসেছে আমাকে। আমি এর শেষ দেখবো!

একসময় নিকোলাসের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন। ও ঘুমিয়েছে, নিশ্চিত হওয়ার পরই একটা চুমো খেলো নিকোলাস, ফর্সা কপালটায়।

আপনমনেই হাসলো একটু মেয়েটা।

*

ঘুমটা কোনো ভাঙল বুঝতে পারেনি নিকোলাস। কোথায় রয়েছে মনে পরল, দেখলো পাথরখনির ভেতর ওর কাছাকাছি শুকনো ঘাসের উপর শুয়ে রয়েছে রোয়েন। আকাশে চাঁদ নেই, তবে তারাগুলো যেনো মাটির কাছাকাছি নেমে এসেছে, একেকটা পাকা আঙুরের মতো বড়। আগুনটা নিভে এসেছে, ওধারে শুয়ে নাক ডাকছে তামের। ব্লাডার খালি করার জন্য উঠতে হলো নিকোলাসকে।

আগুনটাকে পাশ কাটিয়ে ফিরে আসছে, যে শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে সেটা আবার ভেসে এলো দূর থেকে অস্পষ্ট, পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে আসছে, ফলে বোঝা যায় না উৎসটা ঠিক কোনো দিকে। এ আওয়াজ আগেও অনেকবার শুনেছে ও। অটোমেটিক গানফায়ারের শব্দ, সম্ভবত একে-ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে বের হচ্ছে। বিরতিহীন নয়, প্রতিবার তিন রাউন্ড করে। প্রফেশনালের কাজ।

ভোরের দিকে রোয়েনের ঘুম ভাঙালো নিকোলাস। অবশিষ্ট রেশন থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে গোলাগুলির কথাটা জানালো ওকে। বোরিস হতে পারে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।সে হয়তো মেক নিমুর আর টিসেকে ধরে ফেলেছে।

মনে হয় না। বোরিস কয়েকদিন আগে রওনা হয়েছে, তার গুলির আওয়াজ এতো দূর পৌঁছবে না।

তাহলে?

কী জানি। আমার ভালো ঠেকছে না রোয়েন। কেয়ারিটা আরেকবার দেখে ক্যাম্পে ফিরে যাই চলুন।

আলো জোরালো হতে পাথরখনির কয়েকটা ছবি তুললাম নিকোলাস। কয়েকটা ব্লকের ছবি তোলার সময় ওগুলোর পাশে পোজ নিল রোয়েন, মেরিলিন মনরোর ভঙ্গিতে একটা হাত মাথার পেছনে রেখে।

উপত্যকার ঢাল বেয়ে ফেরার পথে সন্তুষ্ট দেখালো ওদেরকে, প্রাচীন পাথরখনি আবিষ্কার ওদের অভিযানকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর কীভাবে কী করা হবে, সে আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়লো ওরা। গহবরের নিচের অংশ ফ্যাকাসে লাল পাহাড় প্রাচীনের কাছে যখন পৌঁছল, বেলা তখন প্রায় এগারোটা। মঠ থেকে ট্রেইল ধরে উঠে আসা একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হলো ওখানে।

রোয়েনের নির্দেশে ব্যাপার কি জানার জন্য সন্ন্যাসীদের দিকে ছুটলো তামের। তামেরকে দেখে কেঁদে ফেললো সন্ন্যাসীরা, চিৎকার করে দুঃখজনক কোনো ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে। একটু পরই ছুটে ফিরে এলো তামের।

আপনাদের ক্যাম্পে লোকজন নেই। একদল শয়তান এসেছিল। চাকরবাকরদের অনেকেই নেই–খুন হয়ে গেছে।

খপ করে রোয়েনের কব্জি চেপে দরল নিকোলাস। আসুন! ছুটলো ও, দেখি কি হয়েছে!

*

শেষ এক মাইল ছুটে ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা, কিচেন শেডের সামনে কিছু একটাকে ঘিরে আরো একদল সন্ন্যাসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। ভিড় ঠেলে সামনে চলে এলো নিকোলাস, পেটে শূন্য একটা অনুভূতি, আতংকে মুখের ঘাম ঠাণ্ডা লাগছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ভন ভন করছে নীল মাছি, মাঝখানে পড়ে আছে রক্তে ভাসমান কুক সহ আরো তিনজন ক্যাম্প সার্ভেন্টের লাশ। প্রথমে তাদের হাতগুলো পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে, হাঁটু গাড়তে বাধ্য করা হয়েছে মাটিতে, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে মাথার পেছনে।

রোয়েনকে এগিয়ে আসতে দেখে বাধা দিল নিকোলাস, তাকাবেন না!

ওর কথায় কান না দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো রোয়েন।ওহ, গড! দু হাতে মুখ ঢাকল।

এগিয়ে এসে লাশগুলো দেখলো নিকোলাস। কিফ, সালিন আর আলিকে দেখছি না। কোথায় ওরা? আলি, কোথায় তুমি?

ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো আলি। এখানে, ইফেন্দি! গলাটা কেঁপে গেল তার, মুখ ঝুলে পড়েছে। তার শার্টের সামনে শুকনো রক্ত দেখা গেল।

কি হয়েছে বলো! আলিকে ধরে সোজা করলো নিকোলাস।

ওরা ছিল শুফতা, ডাকাত, খুনী! ওরা ছিল হায়েনা, শিয়াল সাপ! রাতের অন্ধকারে হঠাৎ আসে, এসেই গুলি ছোঁড়ে কুঁড়ে লক্ষ্য করে। কতজন ছিল বলতে পারব না, কেন এভাবে খুন করলো তাও বলতে পারব না! ফোঁপাতে লাগলো আলি।

খানিক পর জানা গেল রোয়েনের ঘর তছনছ করা হয়েছে। ক্যানভাস ফোল্ডারের প্রচুর ফটোগ্রাফ আর কাগজপত্র ছিল, খালি করে নিয়ে গেছে সব। ওদের হেডকোয়ার্টারও তছনছ করা হয়েছে। স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ আর ম্যাপ, পাথর ফলকের রাবিং, পোলারয়েড-কিছুই নেই।

নিজের কুঁড়ে থেকে ছুটে রোয়েনের কুঁড়েতে চলে এলো নিকোলাস। একই অবস্থা আমার ঘরেরও। সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গেছে, রাইফেলটাও। পাসপোর্ট আর ট্রাভেলার্স চেক ডে-প্যাকে ছিল বলে রক্ষা পেয়েছে!

নিঃশব্দে কাঁদছে রোয়েন। আমাদের গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গেছে ওরা, এমনকি পোলারয়েডগুলোও বাদ দেয়নি। ওহ, নিকোলাস, মিশরে আমাদের মরুভূমির বাসাতে যা ঘটেছিল, এখানে আবার ঠিক তাই ঘটলো। ওদের হাত থেকে এখানেও আমরা নিরাপদ নই। কাল রাতে আমরা ক্যাম্পে থাকলে কি ঘটত? ছুটে এসে নিকোলাসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওই রোদের মধ্যে আমরাও মরে পড়ে থাকতাম!

ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতদের সঙ্গে কথা হয়েছে নিকোলাসের। ওঁদের ধারণা, আক্রমণটা ওকে আর রোয়েনকে খুন করার জন্যই করা হয়। বলছেন, এখান থেকে এখুনি ওদের চলে যাওয়া উচিত, কারণ আবার হামলা হতে পারে।

কিফ, সালিন আর আলিকে রওনা হবার প্রস্তুতি নিতে বলেছে নিকোলাস। ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা কথা দিয়েছেন, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কর্তৃপক্ষকে ঘটনার কথা জানাবেন তাঁরা।

একঘণ্টার মধ্যে রওনা হবার জন্য তৈরি হয়ে গেল ওরা। সমস্ত ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট আর বোরিসের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র প্রধান পুরোহিত জালি হোরার দায়িত্বে রেখে যাওয়া হচ্ছে। খচ্চরগুলোর পিঠে হালকা বোঝা চাপানো হলো।

প্রধান পুরোহিত এসকর্ট হিসেবে একদল সন্ন্যাসীকে পাঠালেন, ওদেরকে পাহাড় চূড়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন। স্কিনিং শেডে ডোরাকাটা ডিক-ডিকের ছাল আর খুলিটা পেল নিকোলাস, গুটিয়ে একটা বাণ্ডিল রবানাল, স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে দিল একটা খচ্চরের বোঝার উপর।

এসকর্ট পার্টির সঙ্গে তামেরও রয়েছে। সারাক্ষণ রোয়েনের কাছাকাছি থাকলো সে। ট্রেইল ধরে রওনা হলো ওরা, প্রথম এক মাইল ওদের সঙ্গে আসছেন সন্ন্যাসীদের বড় একটা মিছিল।

দুপুর পার হয়ে গেল টাইটার ড্যাম সাইটে পৌঁছতে। নদীর পানিতে মাথা ধোয়ার কয়েক মিনিট এখানে থামলো ওরা। জলপ্রপাতের উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলো, দু জনের মনই বিষণ্ণ ও কাতর হয়ে আছে।

কবে নাগাদ আবার ফিরব আমরা? ফিসফিস করে জানতে চাইলো রোয়েন।

বর্ষা শুরু হতে আর দেরি নেই, বলল নিকোলাস। হায়েনারাও গন্ধ পেয়ে কাছে চলে আসছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, রোয়েন।

গহ্বরের ভেতর তাকিয়ে বিড়বিড় করলো রোয়েন, এখনো তুমি জেতেনি, টাইটা। খেলায় আবার আমরা ফিরে আসব।

সন্ধে হয়ে এলেও নদীর পাশে স্থায়ী ক্যাম্পসাইটে থামলো না ওরা, অন্ধকারে পথ চলা অসম্ভব না হওয়া পর্যন্ত কয়েক মাইল এগুলো। তাঁবু ফেলে আরাম করার কথা ভাবল না কেই, সন্ন্যাসীদের দেওয়া রুটি আর ছাগলের দুধ খেয়ে পাথুরে জমিনের উপর বেডরোল খুলে শোয়ে পড়লো। ক্লান্ত শরীর, সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেল।

*

পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগে খচ্চরের পিঠে মালপত্র তোলা হলো, কড়া কফি খেয়ে ট্রেইল ধরলো ওরা। সদ্য ওঠা সূর্য ঢালের খাড়া পাঁচিল আলোকিত করে তোলায় এতো কাছে মনে হলো যেনো ছোঁয়া যাবে। রোয়েনের পাশে চলে এসে নিকোলাস বলল, এভাবে হাঁটলে আশা করা যায় বিকেলের দিকে ঢালের গোড়ায় পৌঁছে যাব। জলপ্রপাতের পেছনের গুহায় রাত কাটানো সম্ভব হতে পারে।

তারমানে কাল কোনো এক সময় ট্রাকের কাছে পৌঁছব, বলল রোয়েন। নিকোলাস, অনেকক্ষণ ধরে একটা কথা ভাবছি আমি। ধরুন, আমাদের পোলারয়েড আর রাবিংগুলো পেগাসাসের কারো হাতে পড়েছে, যে ওগুলোর অর্থ করতে পারবে। আমরা কতদূর এগিয়েছি এটা বোঝার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হবে?

ও-সব কথা পরে ভাবা যাবে, রোয়েন, জবাব দিল নিকোলাস। সঙ্গে রিগবি রাইফেলটা পর্যন্ত নেই, কাজেই খুব অসহায় বোধ করছি। আগে প্রাণে বাঁচি, তারপর অন্য কিছু।

কিফ, খচ্চরচালক, আর সন্ন্যাসীরাও তাই ভাবছে, কারণ দেখা গেল তাদের হাঁটার গতি মুহূর্তের জন্যও মন্থর হচ্ছে না। দুপুরের দিকে অল্প সময়ের জন্য থামার নির্দেশ দিল নিকোলাস, নিজেরা কফি খাবে, খচ্চরগুলোকে পানি খাওয়াবে। কিফ আগুন জ্বালছে। বাইনোকুলার নিয়ে পাথুরে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলো নিকোলাস। খুব বেশি দূর ওঠেনি, ঘাড় ফেরাতে দেখতে পেল পিছু নিয়ে উঠে

আসছে রোয়েনও। কাছে এসে বলল, দেখতে এলাম কী করছেন আপনি।

সামান্য রেকি। সামনে স্কাউট রাখা দরকার ছিল, এভাবে অন্ধের মতো ট্রেইল ধরে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। যত দূর মনে পড়ে, ঠিক সামনেই পড়বে অত্যন্ত কঠিন পথ। খোদা জানে কিসের মধ্যে গিয়ে পড়ব।

আরো ওপরে উঠলো ওরা, তবে চূড়ায় ওঠা সম্ভব হলো না বিশাল এক পাহাড় প্রাচীর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকায়। বাধাটার ঠিক নিচে ভালো একটা জায়গা বেছে নিয়ে উপত্যকার দুটো ঢালই বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস। এ এলাকার কথা মনে আছে ওর। খাড়া ঢাল ওয়াল-এর গোড়ায় পৌঁছতে যাচ্ছে ওরা, জমিন এ দিকে অসম্ভব এবড়োখেবড়ো আর রুক্ষ-কঠিন, খোলা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, অনুভবে ডাঙার অস্তিত্ব টের পেয়ে তীরে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আগে সাজ সাজ রব তুলে ফুলে-ফেঁপে ওঠা। ট্রেইল খুব কাছ থেকে অনুসরণ করেছে নদীটাকে। নদীর পাড় বলতে সরু আল, তার উপর ঝুলে আছে পাহাড়-প্রাচীন-রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-বরফ নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে অদ্ভুত, ভীতিকর আকৃতি দিয়েছে, ডিজনির কার্টুনে দেখা দুষ্ট ডাইনীর সচ্ছিদ্র দুর্গ যেন। এক জায়গায় ট্রেইলের উপর জ্বলে আছে লাল স্যান্ডস্টোনের বিশাল এক পাথুরে অবলম্বন, বাধ্য হয়ে ওঠাকে ঘুরে এগুতে হয়েছে নদীকে, ওখানে ট্রেইল এত সরু হয়ে গেছে যে বোঝা সহ একটা খচ্চর যেতে চাইলে পাড় থেকে নদীতে পড়ে যাবার ভয় আছে।

চোখে লেন্স লাগিয়ে উপত্যকার তলাটা সাবধানে দেখে নিল নিকোলাস। বেমানান সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না, কাজেই মাথা তুলে নিজেদের উপর দিকে পাহাড়-প্রাচীরে দৃষ্টি বুলাল।

এ সময় নিচের উপত্যকা থেকে আলির চিৎকার ভেসে এলো। জলদি, ইফেন্দি! খচ্চরগুলো রওনা হবার জন্য রেডি হয়েছে।

তাহ ঝাঁকিয়ে তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলল নিকোলাস, তারপর আবার বাইনোকুলার তুলে সামনের জমিনের উপর দৃষ্টি বুলালো। ঝিক করে চোখে লাগলো উজ্জ্বল একটা আলো। ভুরু কুঁচকে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে সমস্ত মনোযোগ এক করলো নিকোলাস।

কী ব্যাপার? দূত জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। কী দেখলেন?

নিশ্চিত নই। বোধহয় কিছু না, চোখ থেকে বাইনোকুলার না নামিয়ে জবাব দিল নিকোলাস। পালিশ করা কোনো ধাতব বস্তুর সারফেসে, অন্য একজোড়া

বাইনোকুলারের লেন্সে, কিংবা একটা রাইফেলের ব্যারেলে রোদ লেগে থাকতে পারে।

জলদি, স্যার! খচ্চরচালকরা অপেক্ষা করতে রাজি নয়! আবার আলির চিৎকার ভেসে এলো।

দাঁড়ালো নিকোলাস।

কিছু না, চলুন। রোয়েনের হাত ধরে নামতে সাহায্য করছে নিকোলাস। হঠাৎ ঢালের উপর দিক থেকে ভেসে পাথর নড়াচড়ার আওয়াজ। রোয়েনকে ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটে আঙুল রাখলো ও। অপেক্ষা করছে ওরা, স্কাইলাইনের উপর চোখ।

অকস্মাৎ বাঁকা একজোড়া শিং মাথাচাড়া দিল চূড়ার কিনারায়, ওগুলোর নিচে বুড়ো এক পুরুষ হরিণের মাথা। আড়ষ্ট হয়ে আছে কান দুটো, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন। পাহাড়-প্রচীরের কিনারায় থামলো ওটা, ঠিক ওরা যেখানে গুঁড়ি মেরে বসে আছে তার সরাসরি ওপরে, যদিও ওদেরকে দেখতে পায়নি এখনো। হরিণটা ঘাড় ফেরালো, ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকের চোখটা রোদ লাগায় ঝিক করে উঠলো। দাঁড়ানোর সতর্ক ভঙ্গি, আড়ষ্ট কান আর পেছন ফিরে তাকানোই বলে দেয় কোনো কারণে ভয় পেয়েছে।

তারপর হঠাৎ যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেল হরিণটার শরীরে। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল রিজের পেছনে, দূরে মিলিয়ে গেল ছুটে পালানোর শব্দ।

কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে ওটা, ঢালের নিচে তাকিয়ে বলল নিকোলাস। খচ্চর আর সন্ন্যাসীদের কাফেলা এরই মধ্যে রওনা হয়ে গেছে, নদীর উঁচু পাড়ের ট্রেইল ধরে এগুচ্ছে।

আমাদের এখন তাহলে কী করা উচিত? জানতে চাইলো রোয়েন।

সামনের পথ রেকি করা দরকার, কিন্তু সেজন্য যে সময় দরকার তা নেই।

কাফেলা দ্রুত এগুচ্ছে, এখুনি ঢাল বেয়ে নিচে না নামলে পেছনে পড়ে থাকবে ওরা। বিপদের নিরেট কোনো প্রমাণ এখনো পায়নি নিকোলাস, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করাও চলে না। আসুন! রোয়েনের হাত ধরলো ও, ছুটে নেমে আসছে ঢাল বেয়ে।

কাফেলার পেছনে চলে এলো ওরা, নিকোলাস এখনো ওদের মাথার উপর স্কাইলাইন গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করছে। পাহাড়-প্রাচীর কাত হয়ে ঝুলে আছে ওদের উপর, ঢেকে ফেলেছে অর্ধেক আকাশ। ওদের বাম দিকে নদী নিজের শব্দ দিয়ে অন্য সব শব্দ মুছে ফেলছে।

পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে একটা পাতা ঝরে পড়তে দেখছে নিকোলাস। গরম বাতাসে শুকনো পাতাটা ডিগবাজি খেতে খেতে নেমে আসছে। এতো ছোট, কোনো বিপদসংকেত হতে পারে না, তবু অলস কৌতূহলবশত ওটার পতন লক্ষ্য করছে ও। বাদামী পাতাটা অবশেষে ওর মুখ স্পর্শ করলো। হাত তুলে ধরলো নিকোলাস, দু আঙুলের মাঝখানে নিয়ে ঘষা দিল, জানে গুঁড়িয়ে যাবে।

কিন্তু মসৃণ আর নরম লাগলো জিনিসটা। হাত খুলল নিকোলাস, ভালো করে দেখলো। পাতা নয়, ভেঁড়া এক টুকরো গ্রিজড পেপার। মাথার ভেতর সতর্ক সংকেত বেজে উঠলো। সেমটেক্স আর প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের যুগে সামরিক কাজে ব্লাস্টিং জেলিগনাইট আজকাল খুব কমই ব্যবহার করা হয়, তবে মাইনিং ইন্ড্রাস্ট্রি আর মিনারেল এক্সপ্লোরেশনে এখনো জিনিসটার চাহিদা ব্যাপক। সাধারণত নাইট্রোজেলাটিন স্টিক বাদামি রঙের গ্রিজড পেপারে মোড়া থাকে, স্টিকের মাথায় ডিটোনেটর সেট করার আগে এক্সপ্লোসিভ এক্সপোজ করার সময় কাগুঁজে মোড়কটার একটা প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়।

নিকোলাসের মাথার ভেতর ঝড় বইছে। ওরা এপথে আসবে এটা জানার পর কেউ যদি পাহাড়-প্রাচীরে জেলিগনাইট বসিয়ে থাকে, তাহলে আলোর যে প্রতিফলন দেখা গেছে সেটা বিস্ফোরকগুলোর মাঝখানে পড়ে থাকা কপার ওয়ায়্যারিং-এর কয়েল থেকে সৃষ্টি হতে পারে। সেক্ষেত্রে অপারেটর লোকটা এ মুহূর্তে পেছনের পাহাড়ে কোথাও শুয়ে আছে। বুড়ো হরিণ সম্ভবত তাকে লুকিয়ে তাকতে দেখে ভয় পেয়েছিল।

কিফ! নিকোলাসের গলার শিরা ফুলে উঠলো। থামাও ওদের। ফিরিয়ে আনো! কাফেলার মাথায় পৌঁছনোর জন্য ছুটলো ও, এ বলছে এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওদের পেছনে পাহাড়ে সত্যি যদি কেউ থাকে, নিকোলাসের প্রতিটি নড়াচড়া পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। কাফেলার মাথায় পৌঁছে খচ্চরগুলোকে সরু ট্রেইলে ঘোরানো, তারপর নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে আনা, সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ছোটার গতি কমিয়ে আনলো নিকোলাস, তবে এখনো চিৎকার করে ফিরে আসতে বলছে ওদেরকে, সেই সঙ্গে হাতছানি দিয়ে ডাকছে রোয়েনকে।

ছুটে আসছে রোয়েন, ধৈর্য হারিয়ে নিকোলাসও খানিকটা পিছিয়ে এলো। কী ব্যাপার, নিকোলাস? রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলো রোয়েন।

ট্রাক থেকে সরে যেতে হবে। পরে ব্যাখ্যা করব।

রোয়েনের হাত ধরে ফেলে আসা পথ ধরে ছুটলো নিকোলাস, আবার আলির নাম ধরে ডাকলো।

পঞ্চাশ গজও কভার করতে পারে নি, পাহাড়-প্রাচীনের মুখ বিস্ফোরিত হলো। বাতাসের তীব্র আলোড়ন ধাক্কা, মারন, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার অবস্থা হলো ওদের। কান ও মাথার ভেতর ব্যথা করে উঠলো। তারপর বিস্ফোরণের মুল শক্তি ঝাঁকি দিয়ে গেল ওদেরকে-একটামাত্র বিস্ফোরণ নয়, একের পর এক অনেকগুলো, যেনো মাথার উপর বিরতিহীন বজ্রপাত হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে উঠলো ওরা, পরস্পরের সঙ্গে জড়িতে গেল। রোয়েনকে আঁকড়ে ধরে পেছন দিকে তাকালো নিকোলাস, দেখলো পাহাড়-প্রাচীরের চূড়ায় পর পর কয়েকটা বিস্ফোরণ ঘটলো। লম্বা, নৃত্যরত পাথর আর ধূলোর ঝরনার একের পর এক উথলে উঠছে।

আতংকে দিশেহারা, তবু জেলিগনাইট সাজানোর দক্ষতা লক্ষ্য করে নিকোলাসের মনে সমীহ জাগলো। এ একজন মাস্টার বম্বারের কাজ। পাথরখণ্ডের ধস এক সময় থামলো, এখন শুধু স্বচ্ছ নীল আকাশের গায়ে মিহি ধুলো দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য মনে হলো ধ্বংসযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু তারপরই পাহাড়-প্রাচীরের কাঠামো বদলে যেতে শুরু করলো।

প্রথমে ধীরে ধীরে পাথরের পাঁচিল বাইরের দিকে কাত হলো। পাহাড়ের গায়ে বিশাল ফাটল সৃষ্টি হতে দেখলো নিকোলাস, যেনো রাক্ষসের প্রকাণ্ড মুখ শুলে যাচ্ছে। পাথরের বিরাট পাত ধসে পড়ছে, স্লো মোশনে নেমে আসছে ওদের উপর। ভেঙে পড়ার আওয়াজ শোনে মনে হলো একই সঙ্গে হুংকার ছাড়ছে আর গোঙাচ্ছে শত শত টন পাথর, গোটা পাহাড়-প্রাচীর অনেক নিচের নদীতে পড়ে যাচ্ছে।

দৃশ্যটা সম্মোহিত করে ফেলেছে নিকোলাসকে, মনে হলো বিস্ফোরণের ফলে ব্রেন অবশ হয়ে গেছে। চিন্তা শক্তি ফিরে পেতে কিংবা তৎপর হতে সময় লাগলো, নিজের উপর জোর খাটাতে হলো। ও দেখলো, বেশিরভাগ বিস্ফোরণ ঘটেছে ট্রেইলের সামনের দিকে, কাফেলার মাথার কাছে। ওদিকে তামের ছিল, আলির পাশে। এক্সপ্লোসিড ট্র্যাপের ভেতরে ওরা দু জনও ঢুকবে, এ আশায় পাহাড় প্রাচীরের মাথায় অপেক্ষা করছিল বহুবার। কিন্তু রোয়েনকে নিয়ে নিকোলাস যখন উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করলো, বিস্ফোরণ ঘটাতে বাধ্য হয়েছে সে।

অসহায় দাঁড়িয়ে থেকে পতনশীল পাথরের বিশাল স্রোতটাকে নেমে আসতে দেখছে নিকোলাস ওর সামনে ট্রেইলের উপর, গ্রাস করছে লোকজন আর খচ্চরগুলোকে, কিনারা থেকে বিরতিহীন জলপ্রপাতের মতো লাফ দিয়ে পড়ছে নদীর তলায় পাথর ধসের কান ফাটানো গর্জনের ভেতর থেকেও লোকজনের আর্তনাদ ভেসে আসছে।

ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ, এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। ব্যাখ্যা করার সময় নেই, যে কোনো মুহূর্তে টন টন পাথরের নিচে ওরাও চাপা পড়ে যাবে। ঝট করে রোয়েনকে দু হাতে ধরে বুকে তুলে নিল নিকোলাস, লাফ দিয়ে পাড় টপকে নদীর দিকে পড়লো। পাড়ের ঢালে দু জন একসঙ্গে পড়লো ওরা, বারবার গড়িয়ে নেমে এলো ত্রিশ ফুট। এখানে বড় একটা পাথর পড়ে আছে, আকারে একটা বাড়ির মতো হবে। ওই পাথরে লেগে স্থির হলো শরীর দুটো।

ধীরে ধীরে সোজা হলো নিকোলাস, রোয়েনের হাত ধরে দাঁড় করালো, তারপর ওকে নিয়ে লে এলো পাথরটার উল্টোদিকে। এদিকে, জমিন ঘেঁষে, ভেতর দিকে একটা ভাঁজ খেয়েছে পাথর, সেই ভাঁজের ভেতর ঢুকে পড়লো ওরা।

যতোটা সম্ভব পিছিয়ে এসে পাথুরে খোলের ভেতর শুয়ে থাকলো দু জন। ধ্বংসযজ্ঞ আরো বিস্তৃত হয়েছে, এতোক্ষণে ওদের উপর নামতে শুরু করলো ধসটা। বিশার রাবার বলের মতো লাফ দিতে দিতে প্রকাণ্ড টুকরোগুলো ছুটে আসছে, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে গতি, তারপর ওদের শেলটারের সামনের দিকটায় লেগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। গড়িসে এসে একটা করে টুকরো ভাঙে, অমনি প্রচণ্ড আঁকি খেয়ে কাঁপতে শুরু করে ওদের শেলটার। ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরিত পাথরের ছোট টুকরোগুলো মিসাইলে পরিণত হলো, বাতাসে শিস খেটে নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীতে বড় বড় ঢেউ জাগলো, আছড়ে পড়ে ভাঙার সময় দুই তীরে ফেনা জমে উঠলো।

ওদের শেলটারের উপর ইতোমধ্যে কয়েকশো টন পাথর ধসে পড়েছে, তবে এ সবে মাত্র শুরু। এক সময় মনে হলো পাহাড়ের অর্ধেকটাই নেমে আসছে ওদের উপর। ধুলো এখন ঘন মেঘের মতো, দু হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, খকখক করে কাশছে দুজনেই। বিশাল বাড়ির মতো শেলটার পাথর ধসে চাপা পড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে রোয়েনের উপর ওঠে এলো নিকোলাস, নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে ফেললো ওকে। ছোট্ট একটা পাথর টোকা দিল ওর মাথার পাশে, তাতেই চোখে অন্ধকার দেখলো নিকোলাস। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করলো ও, অনুভব করলো কানের পেছন গরম একটা স্রোত, জ্যান্ত প্রাণীর মতো চিবুকে নেমে আসছে ওটা।

তারপর ধীরে ধীরে মাটি ও পাথর ধস বন্ধ হলো। এখন আর ওদের শেলটার ঘন ঘন আঁকি খাচ্ছে না। মিহি ধুলো হালকা হয়ে যাচ্ছে। নিস্তেজ হয়ে পড়ছে পাথরের গর্জন।

সাবধানে চোখের পাতা থেকে ধুলো পরিষ্কার করলো নিকোলাস। ওর নিচে নড়ে উঠলো রোয়েন। হামাগুড়ি দিয়ে সরে এলো নিকোলাস, রোয়েন যাতে বসতে পারে। বসার পর দু জন দু জনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। শাদা ধুলো মুখোশ পরিয়ে রেখেছে ওদেরকে। মাথার চুলকে মনে হচ্ছে উইগ। আপনার মুখে রক্ত, আতংকে কর্কশ শোনালো রোয়েনের গলা।

খুলির চামড়া সামান্য একটু কেটে গেছে, বলল নিকোলাস। আপনার খবর কী?

আমার হাঁটু মজকেছে। সিরিয়াস বলে মনে হয় না, অল্প অল্প ব্যথা করছে।

তাহলে বলতে হবে অদ্ভুত ভাগ্য আমাদের, বলল নিকোলাস। এ ঘটনার কারুরই বাঁচার ছিল না।

রোয়েন হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরুতে যাচ্ছে দেখে হাত ধরে বাধা দিল নিকোলাস। না! গোটা ঢার আলগা হয়ে আছে। পুরোপুরি স্থির হতে আরো সময় লাগবে। তাছাড়া….

তাছাড়া কি?

ওদেরকে জানতে দেওয়া চলবে না আমরা বেঁচে আছি, বলল নিকোলাস।

জানলেই শেষ করার জন্য ছুটে আসবে।

নিকোলাসের কথা শেষ হওয়া মাত্র কপ্টার ইঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে এলো, কাছাকাছি কোথাও থেকে টেক-অপ করছে। রোয়েনকে ধরে আবার শুইয়ে দিল নিকোলাস, নিজেও ওর পাশে শুয়ে পড়লো।

মাথার উপর এসে চক্কর নিচ্ছে কপ্টারটা। বোধহয় জীবিত কাউকে খুঁজছে, ভাবল নিকোলাস। রোরের আওয়াজ দূরে সয়ে যাচ্ছে, পাথরের ভাঁজ থেকে মাথা বের করে বাইরে উঁকি দিল নিকোলাস। আধ মাইল উজানের দিকে যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখা গেল, পেগাসাসের জেট রেঞ্জারই বটে। দূরে সরে যাচ্ছে, ফলে উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর ককপিটটা পরিষ্কার দেখা গেল না। তবে ঠিক সেই সময় কপ্টারের গতি কমে এলো, দিক বদলে উত্তর দিকে যাচ্ছে এখন, এবার প্যাসেঞ্জারদের দেখার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। পাইলটের পাশেই বসে রয়েছে জ্যাক হেলম্, আর কর্নেল নগু বসেছেন ঠিক ওদের পেছনে। সবাই ওরা তাকিয়ে আছে নিচের নদী ও উপত্যকায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিজের আড়ালে হারিয়ে গেল কপ্টারটা।

আর কোনো সন্দেহ নেই, বলল নিকোলাস। পেগাসাসের মালিক যে-ই হোক, আপনার ডুরেঈদকে খুন করা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত খারাপ যা কিছু ঘটেছে তার জন্য সে-ই দায়ী। হেলম্ আর কর্ণেল নগু তার বেতনভুক্ত চাকর মাত্র।

কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? রোয়েন মানতে পারছে না। কর্নেল ন ইথিওপিয়ান আর্মির একজন অফিসার।

এটা আফ্রিকা, রোয়েন, সম্ভাব্য সব কিছু বিক্রি হয়, বলল নিকোলাস। শুনুন, এ সব বিষয়ে পরে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে। এখন আমাদের প্রথম কাজ এ খাদ থেকে বেরিয়ে সভ্য জগতে ফিরে যাওয়া। হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের ভাজ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো ও, ধীরে ধীরে দাঁড়ালো।

ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে গেল নিকোলাসের দৃষ্টি। ওদের ওপরে ট্রেইলটা পাথর ধসে চাপা পড়ে গেছে। ওর পাশে বেরিয়ে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো রোয়েন, গুঙিয়ে উঠে পড়ে যাবার উপক্রম করলো, নিকোলাস ধরে না ফেললে যেতে পড়ে। হাঁটু! শরীরের ভর ভালো অর্থাৎ ডান পায়ে চাপালো রোয়েন, সাহস করে হাসলো।

ঠিক হয়ে যাবে।

ট্রেইল ধরে যাওয়া সম্ভব নয়, বলে রোয়েনকে নিয়ে নদীতে নেমে এলো নিকোলাস, নামার সময় আবার পাথর ধস শুরু হয় কিনা ভেবে ভয়ে ভয়ে থাকলো।

কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে নিকোলাসের খুলির ক্ষতটা ধুয়ে দিল রোয়েন, নিকোলাসের ডে-প্যাক হাতড়ে অ্যান্টিসেপটিক মলমের একটা টিউব বের করলো। মলম লাগাবার পর নিকোলাসের গলা থেকে ব্যানড্যানা খুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

প্রথম কাজ তামেরকে খুঁজে বের করা, নিকোলাসকে মনে করিয়ে দিল।

নদীর পাড় ঘেঁষে পানি কেটে এগুলো ওরা। নদীর তলা আলগা পাথরে ভর্তি, খুব সাবধানে এগুতে হচ্ছে। প্যাকটা পানির উপর তুলে রেখেছে নিকোলাস। আলগা পাথরের ভেতর দিয়ে ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠা অত্যন্ত কঠিন মনে হলো। খানিক দূর ওঠার পরই দু জন সন্ন্যাসীর থেতলানো লাশ দেখতে পেল ওরা, পাথরের নিচে অর্ধেক চাপা পড়ে আছে। একটা খচ্চরের শুধু একটা পা বেরিয়ে আছে বাইরে। পিঠের বোঝা খুলে গেছে, জিনিসপত্র ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। দেখতে পেয়ে ডিক-ডিকের গুটানো ছালটা তুলে নিল নিকোলাস, আটকে রাখলো ওর ব্যাগের সঙ্গে।

শেষবার যেখানে তামের আর কিফকে দেখা গেছে সেদিকে ওঠছে ওরা। কিন্তু এক ঘণ্টা সার্চ করার পরও দু জনের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদের উপর ঢালটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে ঝোঁপ আর গাছপালা। হাঁটুর জখম নিয়ে যতটা সম্ভম ওপরে উঠলো রোয়েন, হাত দিয়ে মুখের সামনে চোঙ তৈরি করে ডাকছে, তামের! তামের! তামের! ওর চিৎকার উপত্যকার পাঁচিলে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসছে।

নিকোলাস বলতে চাইলো, ডেকে কোনো লাভ নেই, সে বেঁচে থাকলে তোর কিন্তু বলল না।

ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে আছে রোয়েনের, তবু হাল ছাড়তে রাজি নয়। তামের! সাড়া দাও! তামের, কোথায় তুমি?

রোয়েন কেঁদে ফেলবে, এ বয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে না নিকোলাস।

আর ঠিক তখন আরো ওপরের ঢাল থেকে অস্পষ্ট একটা কাতর শব্দ ভেসে এলো। গুঙিয়ে উঠে ডার আঁচড়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে রোয়েন। বাধা না দিয়ে পিছু নিল নিকোলাস। খানিক দূর ওঠেই কেঁদে ফেললো রোয়েন। প্যাক ফেলে ওর পাশে চলে এলো নিকোলাস। ইতোমধ্যে ঢালের উপর হাঁটুগেড়েছে রোয়েন।

পাথর ধসের নিচে চাপা পড়েছে তামেরের শরীর। ছেঁড়া-ফাড়া মুখটা প্রায় চেনাই যায় না, চামড়ার অর্ধেকটাই নেই। মাথাটা কোলে তুলে নিল রোয়েন, শার্টের আস্তিন দিয়ে নাকের ফুটো থেকে ধুলো বের করছে, আরো যাতে ভালো ভাবে শ্বাস নিতে পারে। তামেরের মুখের কোণ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। আবার যখন কাতর আওয়াজ করলো, গলগল করে বেরিয়ে এলো। সেটা মুছতে গিয়ে সারা মুখে লেপ্টে দিল রোয়েন।

তামেরের শরীরের নিচের অংশ পাথরে চাপা পড়েছে। পাথর সরাতে চেষ্টা করলো নিকোলাস, তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলো কাজটা সম্ভব নয়। বড় একটা খণ্ডের নিচে রয়েছে তামের, আকারে সেটা বিলিয়ার্ড বোর্ডের দ্বিগুণ হবে। কত টন ওজন হবে পাথরটার আন্দাজ করা কঠিন, বিশ থেকে পঁচিশ টরে কম হবে না। সন্দেহ নেই, শিরদাঁড়া আর পেলভিস চুরমার হয়ে গেছে। সাহায্য ছাড়া একজনের পক্ষে এ পাথর সরানোর প্রশ্নই ওঠে না। সম্ভব যদি হতো, পাথরটার নড়াচড়া চিড়ে চ্যাপ্টা শরীরটাকে আরো শুধু কষ্টই দিত।

অদ্ভুত এক অভিমান নিয়ে নিকোলাসের দিকে তাকালো রোয়েন। কিছু একটা করুন! প্লিজ, কিছু একটা করুন!

নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো নিকোলাস। নিঃশব্দে মাথা নাড়লো ও। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো বোয়েন, চোখের জল বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়ছে তামেরের কপালে।

ও এভাবে মারা যাবে আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো? নিকোলাসের দিকে করুণ চোখে তাকালো রোয়েন। এ সময় চোখ মেলে ওর দিকে তাকালো তামের।

ছাল ছাড়ানো রক্ত ভেজা মুখ, অথচ হাসছে তামের। কুৎসিত বীভৎস চেহারা ওই হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। আম্মি! ফিসফিস করলো সে। আপনি আমার মা। মা ছাড়া এতো আদর কে করে! আম্মি, তোমাকে আমি ভালোবাসি!

কথাগুলো আড়ষ্ট, শেষ হতেই শরীরে একটা খিচুনি উঠলো। ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল চেহারা, ককিয়ে উঠলো একবার, তারপর স্থির হয়ে গেল। আড়ষ্ট ভাবটুকু দূর হলো কাঁধ থেকে, মাথাটা কাত হয়ে গেল একদিকে।

কাঁদছে রোয়েন, মাথাটা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। তারপর ওর কাঁধ ছুঁয়ে নিকোলাস বলল, ও মারা গেছে, রোয়েন।

মাথা ঝাঁকালো রোয়েন। জানি। শুধু আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য বেঁচে ছিল ও।

তামেরের মাথাটা রোয়েনের কোল থেকে তুললাম নিকোলাস, সরে এসে ধীরে ধীরে দাঁড়ালো রোয়েন। তামেরের মাথা নামিয়ে রেখে তার হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করে দিল নিকোলাস। তারপর আলগা পাথর দিয়ে ঢেকে দিল লাশটা।

এবার আমাদের যেতে হয়, তামের।

তামেরের কবরে একটা চুমো খেলো রোয়েন। তারপর নিকোলাসের কাঁধে ভর দিয়ে নেমে এলো নদীতে।

পানি কেটে উজানের দিকে রওনা হলো ওরা। পাথর ধস নদীর অর্ধেকটাই ভরাট করে ফেলেছে, ফলে অবশিষ্ট ফাঁক গলে পানি খুব দ্রুত ছুটে চলেছে। দুর্গত এলাকা, ছাড়িয়ে এসে নদীর পাড়ে উঠলো ওরা, তারপর খাড়া ঢাল বেয়ে, পৌঁছল ট্রেইলে। এখানে সামান্য বিশ্রাম নিল, তাকালো পেছন দিকে। পাথর ধসের নিচে লালচে-খয়েরি দেখাচ্ছে নদীর পানি। মঠের সন্ন্যাসীরা বিস্ফোরণের আওয়াজ যদি না-ও শোনে থাকে, ঘোলা পানি দেখে চিন্তায় পড়ে যাবে, কী ঘটেছে দেখার জন্য এদিকে আসবে। লাশগুলো তুলে নিয়ে যাবে মর্যাদার সঙ্গে কবর দেয়ার জন্য। চিন্তাটা খানিকটা হলেও সান্ত্বনা এনে দিল নিকোলাসের মনে। রোয়েনকে নিয়ে আবার রওনা হলো ও। এ ট্রেইল ধরে দু দিনের কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে ওদেরকে।

রোয়েন এখন খুব বেশি খোঁড়াচ্ছে। কিন্তু নিকোলাস সাহায্য করতে গেলে ঝাঁপটা দিয়ে সরিয়ে দিল ওর হাত। কিছু না, শুধু একটু আড়ষ্ট লাগছে। হাঁটুটা পরীক্ষা করতেও দিল না, জেদ করে নিকোলাসের সামনে থাকলো।

রাতটা ওরা ঢালের নিচে কাটালো। সামনেই খাড়া পাচিল বেয়ে ওঠে গেছে। পথটা। পথ থেকে রোয়েনকে বেশ খানিকটা সরিয়ে আনলো নিকোলাস, থামলো গাছপালায় ঢাকা একটা নালায়। ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর আগুন জ্বাললো, জানে বাইরে থেকে দেখা যাবে না। এবার হাঁটুটা নিকোলাসকে দেখতে দিল রোয়েন। চামড়া ওঠা জায়গাটা ফুলে আছে, ছুঁতে খুব গরমও লাগলো। মাথা নাড়লো নিকোলাস।

এ পা নিয়ে আপনার হাঁটা ঠিক হচ্ছে না।

আর কোনো উপায় আছে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। জবাব না দিয়ে বোতলের পানি দিয়ে নিজের ব্যানড্যানাটা ভেজাল ও, তারপর শক্ত করে বেঁধে দিল পায়ে। দুটো পেইনকিলার ট্যাবলেট খেতে দিল।

সারভাইভালো রেশন সামান্যই অবশিষ্ট আছে, আধপেটা খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। আগুনের ধারে বসে ফিসফাস করছে দু জন। চূড়ায় ওঠার পর কী ঘটবে? জানতে চাইলো রোয়েন। যেখানে রেখে এসেছি সেখানে কী ট্রাকগুলো পাব? পাহারাদাররা আছে, নাকি কেটে পড়েছে? আর যদি পেগাসাসের লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? তাহলে কী হবে?

আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তরই আমার জানা নেই, স্বীকার করলো নিকোলাস।

আদ্দিস আবাবায় পৌঁছে এ ম্যাসাকারের ঘটনা পুলিশকে আমি জানাব, বলল রোয়েন। আমি চাই জ্যাক হেলম্ আর তার লোকজন উপযুক্ত শান্তি পাক।

সেটা বোধহয় উচিত হবে না, বলল নিকোলাস। কারণ আবার আমরা ইথিওপিয়ায় ফিরে আসতে চাই। এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশি হৈ-চৈ করলে গোটা উপত্যকায় ট্রপস আর পুলিশ গিজগিজ করবে। টাইটার ধাঁধার সমাধান পাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মামোসের সমাধির কথাও ভুলে যেতে হবে।

ও, হ্যাঁ, এদিকটা আমি ভাবিনি।

তাছাড়া, অভিযোগ করে লাভ হবে কিনা ভেবে দেখুন। কর্নেল নগু, হেলমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পেগাসাস যদি একজন আর্মি কর্নেলকে পকেটে ভরতে পারে, পুলিস অফিসারদের পকেটে ভরা তো আরো সহজ। ওদের হাত কতটা লম্বা কে জানে। হয়তো দেখা যাবে আর্মি চীফকে কিনে রেখেছে। কিংবা কেবিনেট মেম্বারদেরও।

এ-ও আমি ভাবিনি, স্বীকার করলো রোয়েন।

এখন থেকে ঠিক আফ্রিকানদের মতো করে ভাবতে হবে। টাইটার স্ক্রোল থেকে শেখার কিছু আছে বৈকি। তার মতোই আমাদের হতে হবে চতুর, ধূর্ত। এর ওর নামে অভিযোগ না করে, যদি কোনোমতে এবার বের হয়ে যেতে পারি ইথিওপিয়া থেকে, সবাই ভাববে আমরা পাথর ধ্বসে মারা গেছি। এতে করে গিরিখাদে ফিরে আসা সহজ হবে।

বেশ কিছুক্ষণ আগুনের শিখার দিকে চেয়ে রইলো রোয়েন। নিশ্চুপ। শেষমেষ বলল, আপনি বলেছিলেন এরচেয়ে ভালো প্রতিশোধও নাকি আছে?

ওদের নাকের ডগা থেকে ফারাও মামোসের সমস্ত গুপ্তধন সরিয়ে নেব আমরা।

সেই নিশৃংস, লম্বা দিনে প্রথমবারের মতো হাসলো রোয়েন, এ কথায়। ঠিক। সব জিনিস আমরা নিয়ে গেলে পেগাসাসের মালিকের উচিত সাজা হবে!

*

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙার পর বসতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠলো রোয়েন।

ব্যান্ড্যানা খুলে হাঁটুটা আবার দেখলো নিকোলাস। ফোলাটা আরো বেড়েছে, আকারে প্রায় দ্বিগুণ দেখাচ্ছে হাঁটু। আবার ওটা বাঁধল ও, শেষ দুটো ট্যাবলেট খাইয়ে দিল। নিকোলাসকে ধরে দাঁড়াতে পারলো রোয়েন, খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢালের নিচে এস দাঁড়ালো। পাহাড়-প্রাচীর বেয়ে উঠে যাওয়া পথটার দিকে দু জনই ওরা তাকিয়ে থাকলো। আসার পথে কী রকম কষ্ট হয়েছে মনে পড়ে যাচ্ছে। চূড়া থেকে নিচে নামতে পুরো একটা দিন লেগেছিল ওদের।

শুরু হলো ওঠা। প্রতি পদক্ষেপের পর আরো যেনো খাড়া হয়ে ওঠছে পথটা। রোয়েন কোনো আওয়াজ করছে না, তবে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছে চেহারা, দরদর করে ঘামছে। দুপুর হয়ে গেল, এখনো ওরা জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছতে পারে নি। তবু বিশ্রাম নেয়ার জন্য রোয়েনকে থামতে বলল নিকোলাস। খাবার কিছু নেই, বোতল থেকে ঢক ঢক করে শুধু পানি খেলো রোয়েন। নিকোলাসও খেলো, মাত্র এক ঢোক।

কিন্তু রওনা হবার সময় দাঁড়াতে গিয়ে পারলো না রোয়েন। ওহ! অসহায়ভাবে তাকার নিকোলাসের দিকে। দাঁড়াব কি, পা তো নাড়তেই পারছি না!

কিছু আসে যায় না, হেসে উঠে বলল নিকোলাস। বাম-ব্যাগ থেকে অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস চাড়া সব বের করে ফেললো ও, তারপর সেটা কোমরে জড়িয়ে নিল। লাফ দিন, ওঠে পড়ন ঘোড়ার পিঠে।

নিকোলাসের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন। কী বলছেন? তারপর চোখ তুলে ট্রেইলের দিকে তাকালো, খাড়া একটা মইয়ের মতো ওঠে গেছে। মাথা নাড়লো ও। অসম্ভব!

এ স্টেশন থেকে এটাই একমাত্র ট্রেন ছাড়ছে, বলে রোয়েনের সামনে পেছন ফিরে বসলো নিকোলাস। খানিক ইতস্তত করার পর ক্রল করে ওর পিঠে ওঠে পড়লো রোয়েন।

কিছু দূর ওঠতেই হাঁপিয়ে গেল নিকোলাস, রসালাপ থেমে গেছে। ঘামে ওর শার্ট ভিজে গেল, সেই ঘাম রোয়েনের শার্ট ভিজিয়ে দিয়ে চামড়ায় পৌঁছে গেল। উষ্ণ ভেজা ভেজা ভাবটুকু অন্য সময় হলে হয়তো অশ্লীল লাগত, এখন লাগলো না। পুরুষ-পুরুষ গন্ধটাও খারাপ লাগছে না ওর, বরং আরাম আর স্বস্তিদায়ক বলে মনে হচ্ছে।

প্রতি আধ ঘণ্টা পরপর রোয়েনকে নামিয়ে নামিয়ে বিশ্রাম নিল নিকোলাস, চোখ বন্ধ করে পড়ে তাকালো যতোক্ষণ না আবার নিয়মিত হয় শ্বাস-প্রশ্বাস। বিশ্রাম বলতে ওইটুকু, দম ফিরে পাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার পিঠে বোঝ তুলে নিয়ে খাড়া ট্রেইল ধরে ওঠা। এভাবে সারাটা দিন পেরিয়ে গেল। তারপর একটা বাঁক ঘুরতেই ট্রেইলের সামনে ঝুলে থাকতে দেখা গেল জলপ্রপাতটাকে, লেস লাগানো পর্দার মতো। হোঁচট খেতে খেতে বিপুল জলরাশির পেছনে চলে এলো নিকোলাস, গুহার ভেতর ঢুকে রোয়েনকে মেঝেতে নামালো, তাক হয়ে ঢলে পড়লো একপাশে, লাশের মতো স্থির হয়ে গেল।

আবার যখন চোখ মেললো নিকোলাস ততক্ষণে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সন্ন্যাসীদের রেখে যাওয়া স্তূপ থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করেছে। রোয়েন, ছোট একটা আগুন ধরিয়েছে। নিকোলাস ওঠে বসতে যাচ্ছে দেখে ঝুঁকলো ও, নিকোলাসের মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বলল, ওহ নিকোলাস, আজ আপনি আমার জন্য যা করলেন, আমি এর প্রতিদান দিব কীভাবে?

কৌতুক করে কিছু বলতে গিয়েও বলল না নিকোলাস, আসলে শক্তিতে কুলালো না। রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর চুপচাপ শুয়ে থাকলো, ভয় লাগছে, এ আরামটুকুর মেয়াদ হঠাৎ না শেষ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে নিকোলাসের মাথাটা নামিয়ে দিল রোয়েন, একটু সরে বসলো। গৃহকর্তাকে স্যামন বা শ্যাম্পেন দিয়ে খুশি করতে পারছি না, বলল ও। নির্ভেজাল ও পুষ্টিকর পাহাড়ী জল পেলে চলবে কি?

শুধু পানি খেয়ে রাত কাটাব? মাথা নাড়লো নিকোলাস। বাম-ব্যাগ থেকে টর্চ বের করলো, গুহার মেঝে থেকে খুঁজে নিল মুঠো আকৃতির একটা পাথর। টর্চের আলো উপর দিকে তাক করতেই অসংখ পায়রার ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ উঠলো। কার্নিসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে ওগুলো। লক্ষ্যস্থির করে পাথরটা ছুঁড়লো নিকোলাস। এক ঢিলে তিন-চারটে পায়রা জখম হলো, তাড়াতাড়ি ছুরি বের করে সব কয়টাকে জবাই করলো ও। রোয়েনের দিকে তকিয়ে হাসলো। রোস্ট খেতে কেমন লাগবে গৃহকত্রীর?

পায়রাগুলোকে আগুনে সেদ্ধ করার সময় রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, আমাদের চুরি যাওয়া কাগজপত্র যে পেগাসাসের হাতে পড়েছে তাতে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই, তাই না?

নেই, বলল নিকোলাস। জলপ্রপাতের উপর ওদের বেস ক্যাম্পে অ্যান্টেনা দেখেছি, মনে আছে? আমাদের ফটো আর কাগজপত্র টেলিফ্যাক্স করে জ্যাক তার বসের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

তার মানে পেগাসাসের মালিক ট্যানাস-এর সমাধিতে পাওয়া ফলক সম্পর্কে সবই জানে এখন। আর সপ্তম স্ক্রোল তো আগেই পেয়েছে। লোকটা যদি নিজে ঈজিপ্টোলজিস্ট না-ও হয়, তেমন একজনকে ভাড়া করতে পারে।

আমার ধারণা লোকটা হায়ারোগ্লিফিক্স নিজেই পড়তে পারে। আমার আরো ধারণা, নোকটা নিশ্চয়ই একজন কালেক্টর হবে। এদের টাইপ আমার জানা আছে। অবসেশনে ভোগে, ম্যানিয়াক হয়ে ওঠে।

হ্যাঁ। এদের আমি চিনি। একজন তো আমার নিকটেই বসে এখন!

নাহ্! নিকোলাস হাসে। এদের তুলনায় আমি কিছুই না। জানি, বাকি দু জনের নাম ডুরেঈদের তালিকায় ছিল।

পিটার ওয়ালশ আর হের ফন শিলার।

দু জনই খুনী কালেক্টর, বলল নিকোলাস। ফারাও মামোসের ট্রেজার পাবার চেষ্টায় মানুষ খুন করতে ওদের বাধবে না।

রোয়েন বলল, কিন্তু আমি ওঁদের সম্পর্কে যত দূর জানি, দু জনেই বিলিওনেয়ার।

টাকার সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক নেই, বলল নিকোলাস। এই গুপ্তধন ওরা কেউ পেলে ছোট্ট একটা আইটেমও কখনো বিক্রি করবে না। ভল্টে লুকিয়ে রাখবে, দেখতে দেবে না কাউকে। একা একা উপভোগ করবে ব্যাপারটা। অনেকটা স্বমেহনের মতো ব্যাপার।

কি ধরনের শব্দ চয়ন! রোয়েন প্রতিবাদ জানায়।

বিশ্বাস করুন। ব্যাপারটা যৌন উত্তেজনার সাথে সম্পর্কিত। অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের অনুরূপ।

যে কোনো মিশরীয় পুরাকীর্তি আমি পছন্দ করি, কিন্তু ওরকম কোনো আকাক্ষা কল্পনাও করতে পারি না।

বুঝতে হবে–এরা কোনো সাধারণ লোক নয়। সম্পদের জোড়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে এরা। যা ইচ্ছে, তাই পেতে পারে। এতেই তারা একটা অপার্থিব আনন্দ পায়।

এই পেগাসাসের পেছনে যে-ই থাকুক, সে তো তবে পাগল, মন্তব্য করলো রোয়েন।

পাগলের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক, বলল নিকোলাস। আমরা বিশাল ধনী একটা অসুস্থ ম্যানিয়াকের পাল্লায় পড়েছি।

*

পায়রার মাংস দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলো ওরা। তারপর কিছু না বলে গুহার পেছন দিকে চলে গেল রোয়েন, দেখেও না দেখার ভান করলো নিকোলাস। খানিক পর রোয়েন ফিরে আসতে কিছু না বলে নিকোলাসও গেল, রোয়েন ভান করলো লক্ষ্য করছে না। আরো খানিক পর পালা করে কাপড় চোপড় খুলে জলপ্রপাতের পানিতে গোসল করে এলো দু জন।

গুহাটা থেকে বের হওয়ার আগে পরস্পরের ক্ষত পরীক্ষা করলো ওরা। নিকোলাসের খুলির জখম দ্রুত সেরে উঠছে, কিন্তু রোয়েনের হাঁটুর অবস্থা কালকের মতোই খারাপ। ব্যানড্যানাটা আবার বেঁধে দেওয়া ছাড়া করার মতো কিছু নেই নিকোলাসের।

বাম-ব্যাগ আর ডিক-ডিকের ছাল এখানে ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে, নিকোলাসকে। শরীরের সঞ্চিত শক্তি খরচ হতে শুরু করেছে, অতিরিক্ত এক পাউন্ড বোঝাও কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে, চূড়ায় পৌঁছুনোর আগে ট্রেইলের উপরই ঢলে পড়তে পারে শরীর। ডে-প্যাকে ক্যামেরাসহ তিন রোল ডেভলপ না করা ফিল্ম ছিল, প্রতিটি প্লাস্টিক ক্যাপসুলে ভরা। ডে-প্যাকে ছিল বলেই প্রক্সির খুনীদের হাতে পড়েনি ওগুলো। ট্যানাস সমাধির ফলকে পাওয়া হায়ারোগ্লিফিক্স-এর একমাত্র রেকর্ড এগুলো, হারাবার ঝুঁকি নিকোলাস নিতে পারে না। কাজেই খাকি শার্টের বুক-পকেটে ভরে বোতাম লাগিয়ে দিল। ব্যাগ আর ছাল গুহার পেছন দিকের একটা ফাটলে গুঁজে রাখলো, পরে সুযোগ মতো নিয়ে যাবে।

প্রস্তুতি নেয়ার পর শুরু হলো ওদের সবচেয়ে কঠিন যাত্রা। ট্রেইলের এ শেষ অংশটুকু অসম্ভব দুর্গম। প্রথম দিকে নিকোলাসের কাঁধে হাত রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো রোয়েন। কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টা পরই পরাজয় স্বীকার করলো, বলল, আর পারছি না।

কে বলেছে পারতে হবে? রোয়েনের সামনে পেছন ফিরে বসে পড়লো নিকোলাস।

আবার রওনা হবার পর দেখা গেল বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘন ঘন থামছে নিকোলাস। ট্রেইল যেখানে ভালো, নিকোলাসের পিঠ থেকে নেমে এক পায়ে হাঁটলো রোয়েন, নিকোলাস এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলো ওকে। তারপর এক সময় ঢলে পড়লো রোয়েন, ওকে আরার নিজের পিঠে তুলে নিতে হলো নিকোলাসের।

যাত্রাটা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে। দু জনেই সময়ের হিসাব ভুলে গেল। অসহ্য যন্ত্রণার ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। এক সময় দেখা গেল ট্রেইলের উপর পাশাপাশি পড়ে আছে ওরা, অসুস্থ, বমি করছে, ক্ষুদা-পিপাসায় কাতর, ব্যথায় গোঙাচ্ছে।

নিকোলাস, আপনি যান…আমাকে রেখে আপনি উঠে যান।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো নিকোলাস।

পালগ নাকি! চোখ রাঙালো ও।

চূড়া আর বেশি দূরে নয়, জিদ ধরলো রোয়েন। বোরিসের লোকজনকে ডেকে আনবেন, ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।

ওরা ওখানে না-ও থাকতে পারে। প্রক্সির লোকজন আপনাকে পেয়ে যেতে পারে। টলতে টলতে সোজা হলো নিকোলাস। উঠুন! ধমক দিল ও। হাত ধরে সাহায্য করলে দাঁড়াতে।

নিকোলাস পা ফেলছে, রোয়েন গুনছে। নিকোলাসেরই নির্দেশ। একশো পর্যন্ত গোনা শেষ হলেই থেমে বিশ্রাম নিচ্ছে ও। দম ফিরে পেলেই আবার শুরু করছে যাত্রা। নিকোলাসের গলাটা দু হাতে জড়িয়ে রেখেছে রোয়েন, গুনছে ওর কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে। গোটা বিশ্ব যেনো কুঁকড়ে ওদের সামনে সরু ট্রেইলে পরিণত হয়েছে। ট্রেইলের একপাশে যে পাহাড়-প্রাচীর মাথাচাড়া দিয়েছে বা অন্য পাশে রয়েছে গভীর খাদ, সে-সম্পর্কে দু জনের কেউই সচেতন নয়। নিকোলাস হোঁচট খেলে বা ঝাঁকি দিয়ে পিঠের বোঝাটা অ্যাডজাস্ট করতে হাঁটুর ব্যথা ইলেকট্রিক শকের মতো রোয়েনের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করতে ও নিকোলাসকে বুঝতে দিতে চায় না, চোখ বুজে গুনছে।

এরপর বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে নিকোলাস, জানে শুয়ে পড়লে আর উঠে বসতে পারবে না। তারপর বিশ্রাম নেওয়ার সময় রোয়েনকে পিঠ থেকে নামালো না। কারণ আবার পিঠে তোলা বড় বেশি কষ্টকর।

প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, নিকোলাসের কানে ফিসফিস করলো রোয়েন। আজ রাতের মতো এখানেই থামুন। আপনি নিজেকে খুন করে ফেলছেন।

আর একশো কদম, অস্ফুটে বলল নিকোলাস।

না, নিকোলাস। নামিয়ে দিন আমাকে।

জবাবে পাথুরে পাঁচিল থেকে কাঁধ সরিয়ে টলমল করতে করতে সোজা হলো_ নিকোলাস, ট্রেইল বেয়ে ওপরে উঠছে। কাউন্ট! নির্দেশ দিল।

ফিফটি-ওয়ান, ফিফটি-টু, নির্দেশ পালন করলো রোয়েন। হঠাৎ করে পায়ের তলায় বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটলো, ফলে পড়ে যাবার অবস্থা হলো নিকোলাসের। মাতালের মতো বিক্ষিপ্ত পা ধাপে তুলতে চেয়েছিল, কিন্তু আর কোনো ধাপ ওখানে নেই, পথটা অকস্মাৎ সমান হয়ে গেছে।

কোন রকমে ভারসাম্য রক্ষা করলো নিকোলাস। খাদের কিনারায় টলমল করছে শরীরটা, গোধূলির আবছা অন্ধকার সামনে, কি দেখছে ভালো করে বুঝতে পারছে না। অন্ধকারে আলো আছে, তবে ধারণা করলো চোখে ভুল দেখছে ও। তারপর কানে এলো লোকজনের আওয়াজ। মাথাটা ঝাঁকালো নিকোলাস, বাস্তবে ফিরে আসতে চাইছে।

ওহ, ডিয়ার গড! নিকোলাস, ওহ নিকোলাস! আপনি পেরেছেন! আমরা চুড়ায়! ওই তো আমাদের ভেহিকেল! আপনি জিতেছেন, নিকোলাস!

কথা বলতে চাইছে নিকোলাস, কিন্তু গলা শুকিয়ে যাওয়ায় কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আলোটার দিকে এগুচ্ছে ও, ওর পিঠ থেকে চিৎকার জুড়ে দিল রোয়েন।

এদিক আসুন, প্লিজ! প্লিজ আমাদেরকে সাহায্য করুন! প্রথমে ইংরেজিতে, তারপর আরবিতে। প্লিজ সাহায্য করুন!

আঁতকে ওঠার আওয়াজ হলো, তারপরই শোনা গেল লোকজনের ছুটোছুটির শব্দ। ধীরে ধীরে নিচু হলো নিকোলাস, নরম ঘাসে রোয়েনকে শুইয়ে দিল। গাঢ় ছায়ামূর্তিরা ঘিরে ধরল ওদেরকে। তারপর টর্চের আলো পড়লো নিকোলাসের মুখে, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলে উঠলো পুরানো বন্ধু জিওফ্রে টেনেন্ট। হ্যালো, নিকোলাস? নাইস সারপ্রাইজ। আদ্দিস আবাবা থেকে আমি তোমার লাশের খোঁজে এসেছি। শুনলাম তুমি নাকি মারা গেছ, হাহ?

হ্যালো, জিওফ্রে! এতো কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ, দোস্ত।

দুটো ক্যাম্প চেয়ার আনতে বলল জিওফ্রে, যত্ন করে তাতে বসানো হলো নিকোলাস আর রোয়েনকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে দু জনের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো ধূমায়িত কফির মগ। খানিক পর নিকোলাস বলল, কোত্থেকে কী শুনেছ বলো আমাকে, জিওফ্রে। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।

প্ৰথম খবর পাই সুদান সীমান্তের কাছে নদী থেকে তোমার গাইড বোরিসের লাশ পাওয়া গেছে, বুলেটে ঝাঁঝরা।

রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস, ভুরু কুঁচকে সাবধান করে দিল। তার সম্পর্কে শেষ খবর জানি আমরা, একা একটা স্কাউটিং এক্সপিডিশনে বের হলো। চার রাত আগে আমাদের ক্যাম্প হামলা করে শুফতারা, সে-ও হয়তো তাদের সামনে পড়ে যায়।

হ্যাঁ, তোমাদের উপর হামলার খবরও পেয়েছি আমরা। কর্ণেল নগু রেডিও মেসেজ পাঠিয়েছিলেন আদ্দিসে।

লোকজনের ভিড়ে কর্নেল নও রয়েছেন, ভিড় ঠেলে এগিয়ে না আসা পর্যন্ত তাঁকে ওরা দেখতে পেল না। ক্যাম্প লণ্ঠনের আলোয় এসে দাঁড়ালেন তিনি, তাঁর দিকে চোখ পড়তে শিউরে উঠে আড়ষ্ট হয়ে গেল রোয়েন। ও কিছু বলে ফেলবে, এ ভয়ে ওর হাতটা ধরে জোরে চাপ দিল নিকোলাস।

আপনাকে দেখে বড়ই আনন্দ বোধ করছি, মি. নিকোলাস, কর্নেল নুগু শাদা দাঁত বের করে অমায়িক হাসলেন। আমাদের সবাইকে আপনি ভয়ানক দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন!

সেজন্য ক্ষমা চাই, বিনয়ের অবতার সাজলো নিকোলাসও।

প্লিজ, স্যার, বললেন কর্নেল, ভুল বুঝবেন না। পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন-এর তরফ থেকে আমরা একটা রিপোর্ট পাই, তাতে বলা হয়েছে একটা ব্লাস্টিং অ্যাক্সিডেন্টের মধ্যে ড়ে যান আপনারা। এক্সপ্লোরেশন কোম্পানির জ্যাক হেলম্ যখন আপনাদেরকে সাবধান করে বলেন যে খাদের ভেতর তারা পাথর বসাচ্ছে, আমি তখন ওখানে উপস্থিত ছিলাম।

কিন্তু আপনি… রেগে গিয়ে ফোঁস করে ফণা তুললাম রোয়েন, তবে নিকোলাস আবার ওর হাতে জোরে চাপ দিতে থেমে গেল।

আপনি যেমন বলছেন, যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আমাদের অবহেলাই সম্ভবত দায়ী, বলল নিকোলাস। তবে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় নি, ক্ষতি যা হবার ক্যাম্প স্টাফ আর সন্ন্যাসীদের হয়েছে। ওরা বেশ কয়েকজন আমাদের সঙ্গে ছিল, সবাই মারা গেছে। আদ্দিসে পৌঁছে কর্তৃপক্ষের কাছে ফুল স্টেটমেন্ট দেব আমি।

আশা করি আপনি কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনছেন না?

কারো বিরুদ্ধেই আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, কর্নেল নগু, বলল নিকোলাস। আপনার বিরুদ্ধে তো নয়ই। খাদের ভেতর শুফতারা আছে, এ কথা বলে আপনি আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া, আপনি যেখানে উপস্থিত ছিলেন না, এ সব ঠেকাতেন কীভাবে?

অসংখ্য ধন্যবাদ, মি. নিকোলাস। কর্নেলকে সন্তুষ্ট দেখালো। এবার বলুন, স্যার, আপনাদের জন্য কি করতে পারি আমি?

মনে মনে গাল দিল নিকোলাস। তারপর জোর করে হাসলো ও। দেখুন আপনি আমার এ উপকারটা করতে পারেন কিনা। ডানডেরা জলপ্রপাতের নিচের গুহায় আমি আমার ব্যাগ আর হান্টিং ট্রফি ফেলে এসেছি। ব্যাগটায় আমাদের পাসপোর্ট আর ট্যাভেলার্স চেক আছে। একজন লোককে পাঠিয়ে ওগুলো আনিয়ে দিতে পারলে সত্যি কৃতজ্ঞ বোধ করব। হবু আততায়ীকে দিয়ে এতো নগণ্য একটা কাজ করাচ্ছে ভেবে হাসি পেল নিকোলাসের।

কর্নেল নগু আপাতত সরে গেলেন। জিওফ্রেকে নিকোলাস জিজ্ঞেস করলো, এখানে তুমি পৌঁছতে কীভাবে?

হালকা প্লেন নিয়ে ডেবরা মারিয়ামে আসি। ওখানে একটা ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং ফিল্ড আছে। কর্নেল গু দেখা করেন, আর্মি জীপে চড়িয়ে এখানে নিয়ে আসেন আমাদেরকে। পাইলট আর প্লেন ডেবরা মারিয়ামে অপেক্ষা করছে।

ক্যাম্পের একজন সার্ভেন্ট এসে খবর দিল, নিকোলাস আর রোয়েনের গোসলের জন্য গরম পানি দেওয়া হয়েছে।

সত্যি বলছি তোমাদের দু জনকে জীবিত দেখে ভারী আনন্দ হচ্ছে, বলে রোয়েনের কাঁধ চাপড়ে দিল জিওফ্রে।

*

পরদিন সকালে ডেবরা মারিয়াম থেকে প্লেনে চড়ে আদ্দিস আবাবায় ফিরছে ওরা। পাইলটের সঙ্গে সামনে বসেছে জিওফ্রে, রোয়েনকে নিয়ে নিকোলাস পেছনে। কাল রাতে নিভৃতে আলাপ করার সুযোগ হয় নি, প্লেনে বসে সেটা সেরে নিচ্ছে ওরা দু জন। ডিক-ডিকের ছালটা রয়েছে নিকোলাসের সিটের নিচে। কাল রাতেই একজন লোককে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল নগু, আজ সকালে ব্যাগ আর ছাল ফিরে পেয়েছে ও।

হোয়াইট হলো থেকে সেই থেকে একের পর এক ফ্যাক্স আসছে। এখন যখন ওদের খোঁজ পাওয়া গেছে, ইথিওপিয়ার পুলিস কমিশনার বলেছেন তিনি নিজে নিকোলাস ও রোয়েনের সঙ্গে কথা বলবেন। প্লেনে বসে ওরা দু জন সিদ্ধান্ত নিল, বোরিসের মৃত্যুর সঙ্গে মেক নিমুরকে কোণাখানে। জড়ানো চলবে না। আরো সিদ্ধান্ত হলো, পেগাসাসকে তো বটেই, ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষকেও কোনোভাবে সতর্ক করা হবে না। ওদের প্রতিদ্বন্দ্বি পেগাসাস, এটা ওরা জানে বলে স্বীকার করলে প্রতিপক্ষ ভয়ংকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। আর ইথিওপিয়া কর্তৃপক্ষ যদি বুঝতে পারে মামোসের গুপ্তধন পাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, ওদের ভিসা বাতিল হয়ে যাবে, এমনকি ওদেরকে ইথিওপিয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করাও হতে পারে। অজ্ঞতার ভান করে নিরীহ ভালো মানুষ সাজাই সব দিক থেকে ভালো।

নিকোলাস আর রোয়েনের ব্যাপারে লন্ডন এতো বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যে, ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর ওদেরকে নিজের বাড়িতে অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন জিওফ্রের মাধ্যমে। তিনতলায় পাশাপাশি দুটো বেডরুম ছেড়ে দেওয়া হলো ওদেরকে।

হিজ এক্সিলেন্সির বাড়িতে তোমাদের কোনো অসুবিধে হবে না, জানালো জিওফ্রে।

*

ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের বাড়িটা নির্মিত হয়েছিল পুরোনো সম্রাট হাইলে সেলাসির আমলে, ১৯৩০ সালে মুসোলিনি ইথিওপিয়া অধিগ্রহণের আগে। শহরতলীতে চমৎকার কলোনিয়াল ঘরানার স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। বড়ো বারান্দা, লন। এতো বছরেও ম্যানশনের কোনো ক্ষতি হয় নি।

পাশের কামরার সংলগ্ন বাথরুম থেকে রোয়েনের শাওয়ার সারার আওয়াজ শুনলো নিকোলাস নিজের বাথটাবে আধ শোয়া অবস্থায়। খানিক পর বেডরুম থেকে ডাক্তারের গলা ভেসে এলো, রোয়েনের হাঁটু প্রসঙ্গে কথা বলছেন।

রাষ্ট্রদূত স্যার অলিভার ওদের অপেক্ষাতেই বারান্দায় বসে ছিলেন। লাল-মুখো, সাদা চুলো মানুষ একজন। জিওফ্রে দ্রুত এগিয়ে এসে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল, সঙ্গে ওর পত্নী সিলভিয়া টেনেন্ট। এছাড়াও, আরো জনা বারো অতিথি রয়েছে ডিনারে।

অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে ইথিওপিয়ার পুলিশ কমিশনার জেনারেল ওবেঈদকে।

অ্যামব্যাসাডর নিজে নিকোলাস ও রোয়েনের সঙ্গে জেনারেলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। জেনারেল ওবেঈদ দীর্ঘদেহী মানুষ, ব্লু মেস ইউনিফর্ম তাঁকে মানিয়েছেও খুব। হ্যান্ডশেক করার সময় রোয়েনের হাতের উপর কপালটা প্রায় ঠেকিয়ে ফেললেন ভদ্রলোক। খুবই রসিক আর হাসিখুশি মানুষ তিনি।

মনে করিয়ে দেয়ার সুরে বললেন, কাল আপনাদের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। স্রেফ একটা রুটিন ইন্টারভিউ, আপনাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।

হ্যাঁ, অবশ্যই, বলল নিকোলাস। কখন যেতে বলেন, জেনারেল?

সকাল এগারোটার দিকে আমার ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে।

খাবারের এক পর্যায়ে এসে রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী বললেন, তুমি জানো, স্যার নিকোলাস, কুয়েনটন পার্কের মালিক। এরপর নিকোলাসের দিকে ফিরে যোগ করলো, আমার স্বামী আবার ভালো শুটার।

কুয়েনটন পার্ক, না? আরে, পত্রিকায় পড়েছি তো। ব্রিটেনের সেরা কিছু পাখি আছে ওখানে।

একটু পর জিওফ্রে ফিসফিস করে বলল, তুমি ভালোই ওর এ জয় করেছ, নিকি!

ডিনার শেষ হবার পর যে যার নিজের কামরায় ফিরে এলো ওরা। কাপড় ছাড়তে যাচ্ছে রোয়েন, নক হলো দরজায়। কবাট সামান্য একটু ফাঁক করে বাইরে

তাকালো ও, দেখলো হাতে একটা কাগজ নিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছে না।

এখানে এসেই লন্ডনে একটা ফ্যাক্স পাঠিয়ে ছিলাম, তার উত্তর এসে গেছে-ঘরে ঢুকে দেখি মেঝেতে পড়ে রয়েছে। ভদ্রবেশে আছেন তো?

এক মিনিট, বলে দরজা বন্ধ করে দিল রোয়েন, খানিক পর আবার খুলল। আসুন।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো নিকোলাস। পেগাসাসের মালিককে এখন আমরা চিনি, রোয়েন।

কে, বলুন! দুই হাত মুঠো করলো রোয়েন।

একটা চেয়ার টেনে এনে নিকোলাস বলল, বসুন।

রোয়েন বসার পর ফ্যাক্স পেপারের ভাঁজ খুলে চোখ বুলালো আরেকবার। পেগাসাসের পঁয়ষট্টি ভাগ শেয়ারের মালিক ভলহালা মাইনিং কোম্পানি, বাকি পঁয়ত্রিশ পার্সেন্টের মালিক অস্ট্রিয়ার অ্যানাকোন্ডা মেটালস। পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি স্টক এক্সচেঞ্জে রেজিস্ট্রি করা, শেয়ার ক্যাপিটাল বত্রিশ মিলিয়ন…

এতো ডিটেলস কে শুনতে চায়! আপনি আমাকে লোকটার নাম বলুন।

ভলহালা আর অ্যানাকেন্ডা, দুটোরই আবার মালিক এইচ এম আই-হ্যামবুর্গ ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ। এইচএমআই-এর সমস্ত শেয়ারের মালিক হের ফন শিলার ফ্যামিলি ট্রাস্ট। দু জন মাত্র ট্রাস্টি হের ফন শিলার আর তাঁর স্ত্রী ইনজেমার।

হের ফন শিলার! বিড়বিড় করলো রোয়েন, এখনো নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে। সম্ভাব্য স্পনসর হিসেবে ডুরেঈদ তালিকায় তার নাম রেখেছিল। উইলবার স্মিথের বইটা নিশ্চয়ই তিনি পড়েছেন। আমি জানি, জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ওটা। আপনার মতো তিনিও সম্ভবত ডুরেঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

আমারও তাই ধারণা, বলল নিকোলাস। কায়রো মিউজিয়ামের ভেতর আপনারা ডুরেঈদ কি করছিলেন, এটা জেনে নেওয়া কঠিন কোনো ব্যাপার ছিল না। বাকিটা তো সবাই আমরা জানি।

কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তিনি পেগাসাসকে ইথিওপিয়ায় নিয়ে গেলেন কীভাবে?

জিওফ্রে আমাকে জানিয়েছে, ওখানে তারা একটা কনসেশন পায় পাঁচ বছর আগে। স্ক্রোল হাতে পাবার অনেক আগে থেকে ওখানে রয়েছেন হের ফন শিলার। শুধু বেস ক্যাম্পটা অ্যাবি খাদে সরিয়ে আনতে হয়েছে ওদেরকে। খোঁজ নিলে জানা যাবে জ্যাক হেলম্ ফন শিলারের একজন ম্যাসলম্যান। কর্নেল নগুও ওদের পকেটে।

সব কিছু মিলে যাচ্ছে, বলল রোয়েন। বসকে হেলই ওখানে আমাদের পৌঁছানোর খবর দেয়। ফন শিলারের নির্দেশেই, শুফতাদের দিয়ে আমাদের ক্যাম্পে হামলা করা হয়।

যাক, এখন অন্তত আমরা জানি কার সঙ্গে লড়ছি।

মাথা নাড়লো রোয়েন। এই কাজে হের ফন শিলারকে কেউ সাহায্য করছে। কায়রোর কোনো লোক।

নিকোলাস জানতে চাইলো, আপনার মিনিস্টারের নামটা যেনো কী?

আরে না! সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো রোয়েন। আতালান আবু সিন হতে পারেন না! আমি তাকে সারাজীবন ধরে চিনি। অত্যন্ত সৎ মানুষ। সতোর টাওয়ার বলব আমি।

মোটা টাকা ঘুষ পেলে এ রকম বহু টাওয়ারকে কাত হয়ে যেতে দেখেছি আমি, নরম সুরে বলল নিকোলাস, শুনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন।

*

পরদিন সকালে পুলিশ কমিশনারের গাড়ি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে এলো ওদেরকে। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালেন জেনারেল ওবেঈদ। বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন তিনি, ইন্সপেক্টর গালা সব লিখে নিলেন। বোরিস ব্রুসিলভ যে কেজিবির অফিসার ছিল, ওরা সেটা জানে কিনা জিজ্ঞেস করা হলো। ইন্টারভিউ শেষ হতে একটা বিবৃতি টাইপ করা হলো, পড়ে দেখার পর সেটায় সই করলো। নিকোলাস। বিদায় দেয়ার সময় জেনারেল বললেন, যে কোনো ধরনের সাহায্য দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন, স্যার নিকোলাস। এরপর রোয়েনের দিকে তাকালেন তিনি। আমি আশা করব আবার আপনি ইথিওপিয়ায় বেড়াতে আসবেন।

আসব না মানে! কিছুদিনের মধ্যেই আবার আমাদেরকে দেখতে পাবেন আপনি! হাসছে রোয়েন।

বাইরে বেরিয়ে এসে নিকোলাসকে বলল ও, সত্যি, এরকম ভালো মানুষ আজকাল দেখা যায় না।

আমারও তাই ধারণা, বলল নিকোলাস।

*

পরদিন সকালে ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে দু জনেই ওরা একটা করে এনভেলাপ পেল, ডাইনিং টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে। ওয়েটারকে কফি দিতে বলে নিজের এনভেলাপটা খুলল নিকোলাস। পড়ার পর অবাক হয়ে তাকালো রোয়েনের দিকে, বলল, জেনারেল ওবেঈদ আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন! আপনাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে দুপুরের আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হাজির হবে। মানে? প্লিজ বা থ্যাঙ্ক ইউ গেল কোথায়?

আমাকেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বলল রোয়েন। আমিও জানতে চাই, এর মানে কি?

ওখানে না গেল জানা যাবে না।

আজ সকালে কিন্তু ওদের কপালে উষ্ণ অভ্যর্থনা জুটলো না। গার্ড ওদেরকে জেনারেল চার্জ অফিসে পাঠিয়ে দিল। ওখানে ডেস্ক অফিসারের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ভুল বোঝাবুঝির ঝামেলা শুরু হলো। লোকটা ইংরেজি প্রায় জানে না বললেই হয়। অবশেষে টেলিফোনে ফিসফিস করে কার সঙ্গে যেনো কথা বলল সে, কথা শেষ করে দেয়াল ঘেঁষে ফেলা কাঠের বেঞ্চ দেখিয়ে বসতে বলল ওদেরকে।

চল্লিশ মিনিট গরমে সেদ্ধ হলো ওরা। চোর-বদমাশদের ধরে এনে জেরা করা হচ্ছে, এটা ছাড়া উপভোগ করার মতো আর কিছু নেই এখানে। অবশেষে ইন্সপেক্টর গালাকে পার্টিশনের দরজায় দেখা গেল। কালকের মতো হাসলেন না, মুখ হাঁড়ি করে আছেন, হাতছানি দিয়ে ডাকলেন ওদেরকে। এগিয়ে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিল নিকোলাস, ইন্সপেক্টর দেখতে না পাবার ভান করে ওদেরকে পথ দেখিয়ে পেছন দিকের একটা কামরায় নিয়ে এলেন। বসার কোনো অনুরোধ এলো না, নিকোলাসকে বলা হলো, আপনার দখলে একটা আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, সেটা হারিয়ে ফেলার জন্য আপনিই দায়ী।

হ্যাঁ, আমি আমার স্টেটমেন্টে বলেছি….

ওকে বাধা দিয়ে ইন্সপেক্টর গালা বললেন, অবহেলা করে আগ্নেয়াস্ত্র হারানো অত্যন্ত সিরিয়াস অফেন্স।

আমার তরফ থেকে কোনো অবহেলা হয় নি, অস্বীকার করলো নিকোলাস।

অস্ত্রটার উপর আপনি নজর রাখার ব্যবস্থা করেন নি। স্টীল সেফে ভরে রাখার কোনো চেষ্টা করেন নি।

অ্যাবি খাদে স্টীল সেফ, ইন্সপেক্টর?

অবহেলা, বললেন ইন্সপেক্টর। অপরাধতুল্য অবহেলা। আমরা জানব কীভাবে অস্ত্রটা সরকারবিরোধী দুস্কৃতকারীদের হাতে পড়ে নি?

আপনি বলতে চাইছেন অজ্ঞাত পরিচয় কোনো ব্যক্তি একটা রিগবি দিয়ে সরকারকে উৎখাত করতে পারে?

নিকোলাসের বিদ্রূপ গ্রাহ্য না করে দেরাজ খুলে দুই প্রস্থ ডকুমেন্ট বের করলেন সালাম। এগুলো আপনাদের বহিষ্কার আদেশ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ইথিওপিয়া ছেড়ে যেতে হবে।

আরে, ডক্টর আল সিমা তো জীবনেও কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বহন করেন নি। তো, তাকে নিষিদ্ধ করার কি মানে?

অনেক তর্ক-বিতর্ক করেও কোনো লাভ হলো না। অবশেষে নিকোলাস বলল, জেনারেল ওবেঈদর সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি।

তিনি উত্তর সীমান্তে গেছেন, কয়েক সপ্তাহ পর ফিরবেন। প্লিজ, ডকুমেন্টে সই করুন।

সই করা শেষ হতে ওরা যখন রোলস রয়েসে উঠছে, তখন রোয়েন বলল, কি ঘটলো এটা?

খুব সহজ। পেগাসাস কেবল নগুকেই হাত করে নি, রাতে তাদের মালিক জেনারেল ওবেঈদের সাথেও কথা বলেছে। হের ফন শিলার সাহেব।

এর মানে বুঝছেন তো, নিকি? আমরা আর ইথিওপিয়ায় ফিরতে পারবো না। মামোসের সম্পদ চিরকাল অধরা থেকে যাবে।

যেবার ডুরেঈদ আর আমি লিবিয়া আর ইরাকে ঢুকেছিলাম, সাদ্দাম হোসেন বা গাদ্দাফি কেউ আমাদের স্বাগত জানায় নি–যতদূর মনে পরে।

মনে হচ্ছে, আইন ভাঙার সম্ভাবনায় একেবারে খুশি আপনি!

ইথিওপিয়ার আইনের থোরাই পরোয়া করি আমি।

কিন্তু ধরা পরলে ওই ইথিওপিয়ার জেলেই ওরা পুরবে আপনাকে, অন্তত ওই ব্যাপারটা মাথায় নিন!

হেসে নিকোলাস বলে, আপনিও মাথায় রাখুন। কেননা, ধরা পরলে আপনারও একই হাল হবে।

*

পরদিন ওদেরকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়ার সময় জিওফ্রে বারবার একই কথা বলছে, হিজ এক্সিলেন্সি সাংঘাতিক রেগে গেছেন। আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ তো জানিয়েছেনই, আরো যা যা করার সবই তিনি করবেন….

এটা নিয়ে এতো হৈ-চৈ করার দরকার কি, বলল নিকোলাস। দু জনের কেউই আমরা এখানে আর ফিরে আসতে ইচ্ছুক নই। কাজেই বলা চলে না যে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়েছে।

কিন্তু তোমরা দুজনেই ব্রিটিশ নাগরিক….

সবই ঠিক, তবু এতো গুরুত্ব না দিলেও চলে।

কেনিয়া এয়ারওয়েজের টিকেট আগেই বুক করা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ে প্লেনে চড়ে বসলো ওরা। বিদায়ের সময় জিওফ্রেকে খুব বিষণ্ণ দেখালো। ছুটিছাটায়। লন্ডনে গেলে আমার খোঁজ করো, উৎসাহ দিয়ে হাসলো নিকোলাস।

প্লেন গড়াতে শুরু করেছে, এয়ারপোর্ট বিল্ডিংকে পাশ কাটিয়ে এলো। হঠাৎ নিকোলাসের পাশের সিটে আড়ষ্ট হয়ে গেল রোয়েন। দেখুন! জানালো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পেগাসাস!

এয়ারপোট বিল্ডিঙের দূর প্রান্তে একটা একজিকিউটিভ জেট এইমাত্র স্থির হলো। প্লেনটা সবুজ রঙ করা। ওরা তাকিয়ে আছে, জেটের দরজা খুলে গেল। অভ্যর্থনা জানাবার জন্য ছোট্ট একটা ভিড় তৈরি হয়েছে টারমাকে।

জেটের দরজায় প্রথমে উদয় হলেন ছোটখাট একজন মানুষ, পরনে ক্রীম ট্রপিক্যাল স্যুট, মাথায় সাদা পানামা হ্যাট। আকার-আকৃতি যা-ই হোক, ভদ্রলোকের হাবভাবে আত্মবিশ্বাস আর কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। মাথা উঁচু করে রাখার ভঙ্গিটা দম্ভ হতে পারে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকানোর ধরনটা ক্ষমতার গর্ব হওয়া বিচিত্র নয়। তার চোয়াল কঠিন, যেনো সারাক্ষণ ছেদ ধরে আছেন।

দেখামাত্র চিনতে পারলো নিকোলাস। সোথবি ও ক্রিস্টি সহ নামকরা দু একটা অকশন ফ্লোরে বেশ কয়েকবারই হের ফন শিলারকে দেখেছে।

হের ফন শিলার, বিড়বিড় করলো।

আমার চোখে লাগছে ফণা তোলা গোক্ষরা!

সিঁড়ি বেয়ে জেট থেকে তরতর করে নেমে আসছেন হের ফন শিলার।

দেখে বিশ্বাস হয়, ভদ্রলোকের বয়স সত্তর? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। চুল আর ভুরু রঙ করেছেন, তা না হলে এতো কালো দেখাত না।

সর্বনাশ, এ আমি কাকে দেখছি! হঠাৎ আঁতকে উঠলো রোয়েন।

ছোট্ট ভিড়টা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন ব্লু ইউনিফর্ম পরা জেনারেল ওবেঈদ। হের ফন শিলারকে স্যালুট করলেন তিনি।

কি, বলি নি? ফন শিলারের পকেটে আরো কে কে আছে কে বলবে!

দেখুন, দেখুন! আবার একবার আঁতকে উঠলো রোয়েন, তাকিয়ে আছে জেটের দরজায়। এবার যে আরোহীটিকে ওখানে দেখা গেল তার বয়েস বেশি নয়। সুদর্শন তরুণ, মাথায় ঢেউ খেলানো কালো চুল, মাথায় হ্যাট নেই। ওহ গড, নাহুত গাদ্দাবি!

নাহুত গাদ্দাবি…কে?

মিউজিয়ামে জুরেঈদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। ডুরেঈদের জায়গায় ওই এখন চাকরি করছে।

টারমাক ধরে গড়াচ্ছিল ওদের প্লেন, হঠাৎ সেটার গতি বেড়ে গেল। পেগাসাসের জেট দৃষ্টিপথ থেকে সরে গেল। যে যার চেয়ারে হেলান দিল ওরা, বলা উচিত নেতিয়ে পড়লো।

আর কোনো সংশয় নেই। প্রতিপক্ষ কারা, পরিষ্কার হয়ে গেছে।

মাথা ঝাঁকালো রোয়েন।

হের ফন শিলার পাপেট পাপেট-মাস্টার। আর নাহুত তার শিকারী কুকুর। সন্দেহ নেই নাহুতই কায়রোয় খুনীদেরকে ভাড়া করেছিল আমাদেরকে মেরে ফেলার জন্য। ওহ, নিকোলাস, দুরেঈদকে কবর দেয়ার সময় নাহুত কি বলেছিল তা যদি আপনি শুনতেন। ডুরেঈদকে নাকি, পরম বন্ধু মনে করত সে, শ্রদ্ধা করত…।

জেনারেল ওবেঈদ ইথিপিয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফন শিলার বিদেশি বিনিয়োগকারী–দেশের উন্নয়নের পেছনে অবদান রাখছেন–এমন ধারণা দিয়েছে হয়তো।

স্বামীর হত্যাকারীদের আসল চেহারা দেখার পর রোয়েনের শোক যেনো উথলে উঠলো। ভিতরে ভিতরে এ আঘাত তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিকোলাস ভালো ভাবেই জানে, এ আগুন নেভানোর সাধ্য তার নেই, কেবল মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দিতে পারে সে। নরম স্বরে টাইটার ধাঁধার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে রোয়েনকে সান্ত্বনা দিতে চাইলো ও।

নাইরোবি পৌঁছে প্লেন বদল করলো ওরা, হিথরোতে পৌঁছল পরদিন সকালে। ইতোমধ্যে ওরা দু জন আলোচনা করে একটা প্ল্যান তৈরি করেছে, অ্যাবি গিরিখাদে ফিরে গিয়ে গহ্বরের ভেতর টাইটার পুল কীভাবে খুঁজে দেখা হবে। অনেকটা সামলে নিয়েছে রোয়েন নিজেকে, ততক্ষণে। তবে নিকোলোস জানে, কেবল উপরে উপরেই ভেতরে জ্বলছে মেয়েটা।

৫. সকালে হিথরোতে

এতো সকালে হিথরোতে নামলো ওরা, ইমিগ্রেশনে কোনো ভিড় নেই। আর যেহেতু সাথে কোনো লাগেজও নেই, কাজেই ঝামেলা আরো কম।

নাইলন ব্যাগে ডিক ডিকের চামড়া ভরে সেটা বগলের নিচে নিয়ে নিল নিকোলাস। এরপর এক হাত ধরে রোয়েনকে নিয়ে রওনা হলো।

ট্যাক্সির সারিতেও কোনো জ্যাম নেই। সোমবার সকাল আটটা ত্রিশ তখন। নাইটসব্রিজে নিকোলোসের বাড়িতে পৌঁছল ওরা।

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো রোয়েন, ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস কিনে আনলো নিকোলাস। দু জন মিলে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে খেলো।

অ্যাবি গিরিখাতে যেতে হলে আপনার তো এক্সপার্ট সাহায্য প্রয়োজন হবে। রুটিতে মাখন লাগাতে লাগতে মন্তব্য করলো রোয়েন।

একজনের কথা ইতোমধ্যেই চিন্তা করে রেখেছি আমি। আগেও কাজ করেছি ওর সাথে, নিকোলাস বলে। এক্স-রয়াল ইঞ্জিনিয়ার। ডাইভিং এবং আন্ডার ওয়াটার কন্ট্রাকশন বিশেষজ্ঞ। ডেভনে একটা কটেজে থাকে। রিটায়ার্ড। নির্ঘাত এখন পরে পরে বোক্ব হচ্ছে। আমি ডাকলেই ছুটে আসবে।

খাওয়া শেষ হতে নিকোলাস.বলল, আমি এটো প্লেট ধুয়ে নিব। ফিল্মগুলো ডেভলপ করিয়ে আনুন আপনি, আমার রেইনকোটটা ধার হিসেবে নিয়ে যান। এদিকে আমি জরুরি কয়েকটা ফোন সারি।

রোয়েন বেরিয়ে যেতে কুয়েনটন পার্কে মিসেস স্ট্রিটকে ফোন করলো নিকোলাস।

আপনার ডেস্কে দুই ফুট লম্বা কাগজপত্র জমে গেছে।

খুব আনন্দের খবর।

বেশিরভাগই বিল। লয়েড ব্যাঙ্ক এবং ল-ইয়ারেরা ফোন করে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে।

এই ভালো। আমি ইয়র্কে থাকলে ওরা আমাকে খুঁজে পাবে না। নোটবুক আর পেন্সিল নাও। তারপর শোনো কী কী করতে হবে তোমাকে।

দশ মিনিট ডিকটেশন দিল ও।

শেষমেষ বলল, ইয়র্কে ফোন করে বাড়তি রুমটা তৈরি রাখতে বলো। ডক্টর আল সিমা আর আমি অনির্দিষ্ট সময় থাকবো ওখানে।

এরপর এক্স-রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড্যানিয়েল ওয়েবকে ফোন করলো নিকোলাস, ডেভনে। উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে তৈরি একটা জাগুয়ার আছে তার, শখ বলতে সেটা খুলে আবার জোড়া লাগানো আর মাছ ধরা। দু বার রিঙ হতে রিসিভার তুললাম, ভেসে এলো ড্যানিয়েলের গলা, কে হে?

নিকোলাস, বলল ও। স্যাপার, একটা কাজ আছে। কথা বলবে? কোনো ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দিল ও।

ঠাট্টা কোরো না তো, বলল ড্যানিয়েল। তুমি ডাকলে কবে যাই নি? তবে বিস্তারিত সব জানতে হবে। কোথায় দেখা করব?

কাল আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। স্লাইড রুলটা নিয়ে আসতে ভুলো না। নিকোলাস জানে ড্যানিয়েল পকেট কমপিউটর ব্যবহার করে না।

এরপর আদ্দিস আবাবায় ফোন করে জিওফ্রে টেনেন্টকে চাইলো নিকোলাস। জিওফ্রে লাইন আসতেই বলল, মিস রোয়েন তোমাকে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানিয়েছেন।

বিশ্বাস করতে পারলে খুশি হতাম, জবাব দিল জিওফ্রে। তোমরা তাহলে ভালোয় ভালোয় পৌঁছে, কেমন?

হ্যাঁ, কোনো অসুবিধে হয় নি, বলল নিকোলাস। আমার একটা উপকার করতে হয়, জিওফ্রে। কর্নেল মারিয়াম কিদেন, ইথিওপিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। তুমি তাকে চেনো?

সজ্জন ব্যক্তি,বলল জিওফ্রে। খুব ভালো করে চিনি। শনিবারে তাঁর সঙ্গে টেনিস খেলেছি। কেন, কী দরকার তাঁকে তোমার?

আমি একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি। তাঁকে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবে। বলবে, ইমার্জেন্সি। প্লিজ, জিওফ্রে।

এরপর, আফ্রিকা এয়ার সার্ভিসে ফোন করে জেনি বাদেনহোর্সকে চাইলো। কিন্তু সে নেই। শেষমেষ একটা মেসেজ দিয়ে রাখলো ও জেনি, নিকোলাস কুয়েনটন হারপার বলছি। তোমার সেই পুরনো হারকিউলিস বিমানটা এখনো ওড়ে তো? কাজে ঝুঁকি আছে, তবে টাকা আছে। আমার ইউ কে ফ্ল্যাটে ফোন করো। ধন্যবাদ।

রিসিভার নামিয়ে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠলো।

দরজা খুলে দিতে ভেতরে ঢুকলো রোয়েন, কোটের পকেট থেকে হলুদ একটা প্যাকেট বের করে দেখালো নিকোলাসকে। আপনি সত্যি মাস্টার ফটোগ্রাফার। সবগুলো ছবি নিখুঁত হয়েছে। ফলকের প্রতিটি ক্যারেক্টর খালি চোখে পড়তে পারছি আমি। টাইটার সঙ্গে খেলাটায় আবার আমরা ফিরে এসেছি।

ডেস্কের উপর গ্লসি ফটোগ্রাফগুলো সাজালো ওরা, মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আপনি দেখছি ডুপ্লিকেটও করিয়েছেন গুড। নেগেটিভগুলো আমার ব্যাংকের সেফ ডিপোজিটে চলে যাবে। দ্বিতীয়বার ওগুলো হারাবার ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না।

নিকোলাসের বড় সাইজের ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে প্রতিটি প্রিন্ট এক এক করে স্টাডি করলো রোয়েন, ফলকের চারটে সাইডেরই একটা করে সবচেয়ে পরিষ্কার প্রিন্ট আলাদা করলো। এগুলো ব্যবহার করব আমরা। রাবিংগুলো না থাকায় খুব একটা অসুবিধে হবে না। তারপর হায়ারোগ্লিফিক্স-এর একটা অংশ পড়তে শুরু করলো, গোক্ষুর কুণ্ডলী ছাড়িয়ে মণি পরানো ফণা তুললাম। প্রভাতের তারাগুলো তাঁর চোখে ঝিলিক মারলো। তার কালো আর পিচ্ছিল জিভ তিনবার চুমো খেলো বাতাসকে। উত্তেজনায় গরম আর লালচে হয়ে উঠলো ওর চেহারা। এখানে টাইটা কি বলছে বুঝতে পারছি না। উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে উঠলো ও।

ও-সব এখন রেখে দিন, একটু কঠিন সুরে বলল নিকোলাস। আপনাকে আমি চিনি, একবার শুরু করলে সারাদিন আর উঠবেন না। ইয়র্কে যেতে হলে এখনো রেঞ্জ রোভারে বহু রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, এদিকে আবহাওয়ার খবর বলছে বাইরে তুষারপাত হবে। অন্তত অ্যাবি গিরিখাতের চেয়ে ভিন্ন কিছু তো উপভোগ করা যাবে!

হঠাৎ কী যেনো মনে পড়ায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো রোয়েন। হ্যাঁ। মাঝেমধ্যে আমি একটু বেশি বেশিই করে ফেলি। দাঁড়িয়ে পড়লো রোয়েন, যাওয়ার আগে কি দেশে একটা ফোন করতে পারি?

অবাক হলো নিকোলাস। দেশে মানে কায়রোতে?

হ্যাঁ–মানে–ডুরেঈদের পরিবার তো ওখানে–

আরে, এটা আবার বলতে হয় নাকি! ফোন আছে ওখানে, যতো খুশি করুন। নিচে, কিচেনে আছি আমি। রওনা হওয়ার আগে এক চাপ চা না খেলেই নয়।

আধা ঘণ্টা পরে চেহারায় একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে নিচে নেমে এলো রোয়েন। সরাসরি নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় লাগছে। কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়!

বলুন, নিকোলাস বলে।

দেশে যেতে হবে আমাকে কায়রোতে। অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকালো। নিকোলাস। অল্প কিছুদিনের জন্য, দ্রুত বলে চলে নিকোলাস। ডুরেঈদের ভাইয়ের সাথে কথা বললাম মাত্র। কিছু কাজ পরে আছে ওখানে।

কিন্তু একা একা আপনার ওখানে যাওয়াটা আমার মনঃপুত হচ্ছে না, মাথা নাড়ে নিকোলাস। অন্তত গতবার যা হলো, তারপর?

আপনার কথা সত্য হলে–নাহুত গাদ্দাবি যদি বেঈমান হয়, তবে তো আর কোনো চিন্তা নেই। সে এখন ইথিওপিয়ায়।

তারপরেও, ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না। টাইটার খেলায় আপনি হলেন আমার চাবিকাঠি।

অনেক ধন্যবাদ। গলার সুরে ব্যঙ্গ ফুটিয়ে তুললাম রোয়েন। কেবল এ জন্যই আমার জন্য চিন্তা করেন?

না, সত্যি করে বললে, আপনার সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

আরে, আপনি টের পাওয়ার আগেই আমি চলে আসবো। মাত্র কয়দিনের ব্যাপার। আর তাছাড়া, ব্যস্ত থাকার বহু উপায় আপনার হাতের নাগালে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস বলে, আপনাকে ঠেকানো আমার সাধ্য নয়। কখন রওনা হচ্ছেন

আজই সন্ধের ফ্লাইটে।

একটু যেনো তাড়াহুড়ো করে ফেললেন। আজই মাত্র এলাম। চলুন, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি এয়ারপোর্টে।

মাথা নাড়ে রোয়েন। না, নিকি। আমি ট্রেনে যেতে পারবো। হিথরো আপনার বিপরীত দিকে।

তবুও আমি যাবো! নিকোলাস নাছোরবান্দা।

বিকেলে রোয়েনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়ার সময় নিকোলাস বলল, কর্নেল মারিয়াম কিদেনের মাধ্যমে আমার বন্ধু মেক নিমুরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। আমার প্ল্যানে মূল চাবিই হলো মেক। তার সাহায্য ছাড়া টাইটার সঙ্গে খেলাটায় আমরা অংশগ্রহণই করতে পারব না।

এয়ারপোর্ট বিল্ডিঙে অদৃশ্য হওয়ার আগে রোয়েন বলল, আমি কায়রো পৌঁছে জানাবো। আপনিও তাই, নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে ফোন করবেন।

রোয়েন চলে যেতেই অদ্ভুত একটা দুঃখবোধ ঘিরে ধরলো নিকোলাসকে। যেনো কি একটা হারিয়েছে সে। পরক্ষণেই, মনের গহীন কোণে বেজে উঠলো সতর্কঘণ্টি। খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রোয়েন মিশরে পৌঁছলেই ব্যাপারটা শুরু হবে। কিন্তু কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না নিকোলাস, ব্যাপারটা কি হতে পারে।

ওহ্। দয়া করে ওর কোনো ক্ষতি করো না। নিজের অজান্তেই জোরে জোরে বলল নিক, কার উদ্দেশ্যে এটা অবশ্য বোঝা গেল না। একবার মনে হলো, জোর করে রোয়েনকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু কোন অধিকারে?

পছন্দ হলো না ব্যাপারটা, বিড় বিড় করে নিজের মনেই বলল নিকোলাস।

*

কর্মচারীরা সবাই জানে ভদ্রলোক তাদের কাছ থেকে ঠিক কি আশা করেন। প্রতিটি জিনিস যেমনটি চান তেমনটিই পেলেন তিনি। কোয়ানসেট হাট এর চারদিকে সপ্রশংস দৃষ্টি বুলালেন হের ফন শিলার। বস-এর আগমন উপলক্ষ্যে বেসটাকে ভালোভাবেই সাজিয়েছে হেলম্।

লম্বা পোর্টেবল বিল্ডিঙের অর্ধেকটাই দখল করে রেখেছে তাঁর নিজের প্রাইভেট কোয়ার্টার। ভেতরে জীবাণুনাশক স্প্রে আর এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করা হয়েছে। কাবার্ডে ঝুলছে তার কাপড় চোপড়, কসমেটিক্স আর মেডিসিন সাজানো হয়েছে : বাথরুম কেবিনেটে। প্রাইভেট কিচেনে সব রকম ইকুইপমেন্ট রাখা হয়েছে, তার প্রিয় ডিশ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণেরও কোনো অভাব নেই। সঙ্গে করে নিজের চাইনিজ শেফকেও তিনি নিয়ে এসেছেন।

হের ফন শিলার নিরামিষভোজী, অধূমপায়ী ও টিটোটেলার। চা, মদ আর মাংস তিনি বিশ বছর আগে পরিত্যাগ করেছেন। তখন তিনি মোটা ছিলেন, চোখের নিচে কালচে পোটলা ঝুলত। এখন তিনি একহারা, চামড়ায় যথেষ্ট লাবণ্য ফিরে পেয়েছেন। শক্তির বিচারে এখনো তাকে তরুণই বলা যায়, অথচ বয়েস হয়েছে সত্তর।

সেই যৌবন কাল থেকেই শারীরিক চাহিদাকে দমিয়ে রেখে মনের চাহিদাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। মানুষ বা জীবিত কোনো প্রাণীর চেয়ে জড়পর্দাথকেই বেশি মূল্য দিয়েছেন। যে রাজমিস্ত্রী হাজার বছর আগে মারা গেছে, তার হাতে খোদাই করা একটা পাথর যে কোনো সুন্দরীর নরম দেহের চেয়ে বেশি উত্তেজিত করে তাঁকে। তিনি শৃংখলা পছন্দ করেন, কর্তৃত্ব ফলাতে ভালোবাসেন।

তাঁর বিশাল সংগ্রহে অমূল্য সব প্রাচীন বস্তু রয়েছে, সবই অন্য লোকদের আবিষ্কার করা। জীবনে এ একবার সুযোগ পেয়েছেন তিনি নিজে কিছু আবিষ্কার করার, একজন ফারাও-এর সমাধি ভেঙে ভেতরে ঢুকবেন, চার হাজার বছরের মধ্যে তিনিই হবেন প্রথম মানুষ যিনি নিজের চোখে দেখবেন কি আছে সেখানে। এ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছেন হের ফন শিলার, পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। এরইমধ্যে কিছু মানুষ মারা গেছে, আরো কিছু মারা গেলে তার কিছু আসে যায় না। কোনো মূল্যই তাঁর কাছে বেশি নয়।

প্রমাণ সাইজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলেন হের ফন শিলার। ঘন, কর্কশ, কালো চুলে আঙুল চালালেন। অবশ্যই কলপ লাগানো, শরীর বা চেহারার এতোটুকু যত্ন তাঁকে নিতেই হয়। কাঠের মেঘে ধরে এগিয়ে এসে কনফারেন্স রুমের দরজা খুললেন তিনি।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই। টেবিলের মাথার দিকে এগিয়ে এলেন হের ফন শিলার, দাঁড়ালেন কার্পেট মোড়া নিচু ও ছোট একটা মঞ্চের উপর। এ মঞ্চটা সঙ্গে নিয়ে বেড়ান তিনি। মাত্র নয় ইঞ্চি উঁচু ওটা। পুরুষ ও মহিলাদের দিকে এ উঁচু মঞ্চ থেকে তাকান তিনি। বেশ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন, সবাইকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। সবার চেয়ে উঁচু হয়ে থাকে তাঁর মাথা।

প্রথমে তিনি জ্যাক হেলমের দিকে তাকালেন। টেক্সান হেলম্ এক যুগ ধরে তাঁর কাজ করছে। অত্যন্ত বিশ্বস্ত, গায়ে গণ্ডারের মতো শক্তি, মনটাও ইস্পাতের মতো কঠিন। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই যে কোনো আদেশ পালন করা তার প্রধান গুণ। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো কাজ দিয়েই পাঠানো হোক তাকে, সম্ভাব্য কম ঝামেলার মধ্যে কাজ সেরে নিরাপদে ফিরে আসবে।

এরপর হের ফন শিলার সুন্দরী মহিলার দিকে তাকালেন। উতে কেম্পার তার প্রাইভেট সেক্রেটারি। মনিবের সমস্ত ব্যক্তিগত দিকগুলো দেখেন তিনি। ওঁর অনুমতি ছাড়া ফন শিলারের সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারে না। কেম্পার ফন শিলারের কমিউনিকেশন এক্সপাটও বটে। হাট-এর একদিকের দলে থরে থরে সাজানো ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্টগুলোর নিয়ন্ত্রণ ওঁর হাতে। বয়েস প্রায় চল্লিশ হলেও দেখে আরো কম মনে হয়। দেখতে খুবই সুন্দর।

ফন শিলারের স্ত্রী, ইনজেমার, আজ বিশ বছর হলো প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। সেই থেকে খালি জায়গাটা পূরণ করছেন কেম্পার।

টেবিলের উপর নিজের সামনে রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে বসেছেন কেম্পার তাঁকে ছাড়িয়ে ফন শিলারের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো আরো দু জন কর্মচারীর উপর।

আদ্দিস আবাবা থেকে জেট রেজ্ঞার হেলিকপ্টার চড়ে নাইল গিরিখাদের চূড়ায় নিজেদের বেস ক্যাম্পে আজ সকালে পৌঁছেছেন হের ফন শিলার, হেলিকপ্টার থেকে নামার সময় আজই প্রথম কর্নেল নগুকে দেখেছেন। কর্নেল সম্পর্কে খুব কমই জানেন তিনি, তবে, হেলমের নির্বাচন মন্দ হবে না বলে ধরে নিয়েছিলেন। কর্নেলের কাজ সম্পর্কে হেলম্ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও, তিনি নিজে ঠিক তৃপ্ত হতে পারেন নি। এরই মধ্যে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন কর্নেল নগু। হারপার নিকোলাস আর ঈজিপশিয়ান মেয়েটাকে মুঠোয় পেয়েও বেরিয়ে যেতে দিয়েছেন। আফ্রিকায় বহু বছর ধরে অপারেশন চালাচ্ছেন ফন শিলার, কালো মানুষদের উপর তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ জন্মায় নি। কর্নেল নগু তাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তবে আপাতত তার সার্ভিস দরকার হবে। হাজার হোক দক্ষিণ গোজামের মিলিটারি কমান্ডার কর্নেল। চিন্তার তেমন কিছু নেই, কাজ পুরালে উটকো ঝামেলা সরিয়ে ফেলা যাবে। হেলই সে-ব্যবস্থা করবে। কীভাবে কী করা হলো বিশদ জানতে চাইবেন না ফন শিলার।

টেবিলে দাঁড়ানো শেষ লোকটার দিকে তাকালেন তিনি। এ আর এক লোক, আপাতত যাকে তাঁর খুব দরকার। নাহুত গাদ্দাবিই প্রথম তাঁকে সপ্তম স্ক্রোল সম্পর্কে সচেতন করেন। যতটুকু তিনি শুনেছেন, ওই স্ক্রোলের সূত্র ধরে একজন ইংরেজ লেখক একটা উপন্যাস লিখেছেন। না, উপন্যাসটি তিনি পড়েননি। এ সব ছাইপাঁশ কখনোই তাঁর পড়তে ইচ্ছে করে না। কথাটা সত্যি, নাহুত সচেতন না করলে একজন ফারাও-এর গুপ্তধন উদ্ধারের এ সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত থেকে যেতেন।

আদি স্ক্রোলটা অনুবাদ করেন দুরেঈদ আল সিমা, কাজটা শেষ হওয়া মাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করে নাহুত। ইতিহাসে রেকর্ড করা হয় নি এমন একজন ফারাও আর তাঁর সমাধির অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা। সেই থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন তাঁরা। ডুরেঈদ আর তার স্ক্রোলের সূত্র ধরে তদন্ত চালাচ্ছিলেন, তাদের তদন্তের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে জানার পর নাহুতকে তিনি ওদের ব্যবস্থা করতে বলেন, বলেন স্ক্রোলটা তার চাই।

স্ক্রোলটা এখন তার কালেকশনের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে, অন্যান্য অমূল্য সম্পদের সঙ্গে ইস্পাত আর কংক্রিটের ভল্টে রেখে দিয়েছেন যত্ন করে। স্কলস পাহাড়ের নিচে তার নিজের একটা নিভৃত দুর্গ আছে, ভল্টা সেখানে।

তবে নাহুত তার উপকার যেমন করেছেন, অপকারও কম করেন নি। ডুরেঈদ আর তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলার দায়িত্বটা তাঁকে দেওয়া উচিত হয় নি। উচিত ছিল প্রফেশনাল কাউকে পাঠানো। কিন্তু নাহুত জেদ ধরে বলেছিলেন কাজটা তিনি নিখুঁতভাবে সারতে পারবেন। এর জন্য মোটা টাকা নেন তিনি, অথচ গোটা ব্যাপারটা লেজেগোবরে করে ছাড়েন। কাজেই, সময় হলে, নাহুতকেও সরিয়ে ফেলা হবে। তবে এ মুহূর্তে ওকে তাঁর দরকার।

সন্দেহ নেই ঈজিপ্টোলজি আর হায়ারোগ্লিফিক্স-এর নাহুত একজন এক্সপার্ট। হবে না, সারাজীবন এসব নিয়েই তো পড়ে আছেন। তিনি নিজেও কিছু কিছু বোঝেন বৈকি, তবে উৎসাহী অ্যামেচার ছাড়া আর কিছু বলা যায় না তাকে। স্ক্রোল ছাড়াও নতুন যেসব উপকরণ পাওয়া গেছে, সবই গড় গড় করে পড়তে পারেন নাহুত, যেনো বন্ধুকে লেখা চিঠির মতোই সহজপাঠ্য। ওর সাহায্য নিয়ে ফারাও মামোস-এর সমাধি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

বসুন সবাই, বসুন, প্লিজ, বললেন হের ফন শিলার। আসুন শুরু করি আমরা।

সবাই বসার পরও খুদে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকলেন ফন শিলার। সবার চেয়ে উঁচু হয়ে থাকতে ভালোবাসেন তিনি। একটা কথা পরিষ্কার বলে দিতে চাই। এ কামরা থেকে কোনো পর, ডকুমেন্ট, নোট ইত্যাদি বাইরে বের হতে পারবে না। এখানকার সব কিছুই অত্যন্ত কনফিডেনশিয়াল এবং আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ফ্রয়লিন কেম্পার আপনাদেরকে একটা করে ডকুমেন্ট ফোল্ডার দেবেন, মিটিং শেষে ওগুলো আবার তার কাছে ফিরে যাবে। আমার ইচ্ছা আর নির্দেশের এদিক ওদিক হলে তার পরিণতি ভালো হবে না।

সবাইকে একটা করে ফোল্ডার বিলি করলেন প্রাইভেট সেক্রেটারি উতে কেম্পার। টেবিল থেকে ডোশিয়ে তুলে খুললেন ফন শিলার। আপনদের ফোল্ডারে হারপার নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে সংগ্রহ করা পোলারয়েড ফটোগ্রাফির কপি আছে। প্লিজ, ওগুলো দেখুন।

সবাই যে যার ফোল্ডার খুলল।

স্টাডি করার পর ড. নাহুত বলছেন ফটোগ্রাফে যে ফলকটা দেখা যাচ্ছে সেটা জেনুইন, প্রাচীন ঈজিপশিয়ান আর্টিফ্যাক্ট, প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া চলে যে সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড সতেরোশো নব্বই বি.সি.-র। আপনি নতুন আর কিছু বলতে চান, ড. নাহুত?

ধন্যবাদ, হের ফন শিলার, বলে হাসলেন নাহুত, নার্ভাস দেখাচ্ছে তাকে। জার্মান ধনকুবেরের আচরণে ঠাণ্ডা এমন কিছু আছে যা তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। ডুরেঈদ আর রোয়েনকে খুন করার নির্দেশ দেয়ার সময় ভদ্রলোকের মধ্যে এক বিন্দু উত্তেজনা বা আবেগ দেখেন নি তিনি। জানেন, তাঁকে খুন করার জন্য অন্য কাউকে নির্দেশ দেয়ার সময়ও একদম নির্লিপ্ত দেখাবে ফন শিলারকে। কোনো সন্দেহ নেই, স্বেচ্ছায় বাঘের পিঠে চড়ে বসেছেন তিনি। আমি আমার আগের কথাই রিপিট করতে চাই। এ প্রিন্টের ফলকটা জেনুইন বলেই মনে হচ্ছে। তবে নিশ্চিত হবার জন্য ফলকটা আমাকে দেখতে হবে।

সেটা যাতে আপনি দেখার সুযোগ পান তার ব্যবস্থা করার জন্যই এখানে আমরা মিলিত হয়েছি, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ফন শিলার। এখন আপনার মতামত দিন, প্লিজ। ফলকটা যদি জেনুইন হয়, কোথায় পাওয়া যাবে? মানে, কোথায় আমরা খুঁজব?

শুধু ফলকটার কথা ভাবলে চলবে না, বললেন নাহুত। কর্নেল নও যে পোলারয়েড সংগ্রহ করেছেন সেগুলোও বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। নিজের ফোল্ডার থেকে একটা ফটোগ্রাফ বেছে নিলেন তিনি। এই যেমন এটা। তার দেখাদেখি বাকি সবাই যে যার ফোল্ডার থেকে নির্দিষ্ট ওই ফটোগ্রাফটা হাতে নিল।

ফলকটার পেছনে তাকালে দেখতে পাবেন ছায়ার ভেতর একটা গুহার দেয়াল রয়েছে, আবার বলল নাহুত, ফন শিলার উৎসাহ দিয়ে হাসলেন। আরো রয়েছে বার লাগানো একটা দরজা বা প্রবেশ পথ। হতেরটা রেখে দিয়ে আরেকটা ফটো তুললেন। এবার এটা দেখুন। অন্য এক সাবজেক্টের ছবি। দেয়ালচিত্র বলল আমি, প্লাস্টার করা দেয়ালে বা কোনো গুহার মসৃণ পাথরের উপর আঁকা হয়েছে। সম্ভবত গ্রিল বা বার লাগানো দরজার ভেতর ক্যামেরা গলিয়ে এ দেয়ালচিত্রের ছবি তোলা হয়েছে। দেয়ালচিত্রে ঈজিপিশিয়ান স্টাইলের ছাপ ও প্রভাব স্পষ্ট। আপার ঈজিপ্টের কুইন লসট্রিসের সমাধিতে এ ধরনের দেয়ালচিত্র আছে, ওখান থেকে আদি টাইটা স্ক্রোল উদ্ধার করা হয়। কাজেই আমার ধারণা, ওই একই গুহা বা সমাধি থেকে এসেছে এ ফলক আর দেয়ালচিত্রের ছবি।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ালো, ছবিগুলো হারপার নিকোলাস কোত্থেকে তুলেছেন। কর্নেল নগু, এলাকটা আপনি চেনেন। মোনা যাক এ ব্যাপারে আপনার কি বলার আছে।

অনেক আলোচনার ও তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্তে আসা হলো, ছবিগুলো তোলা হয়েছে একটা কপটিক খ্রিস্টান গির্জার ভেতর থেকে। নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন কর্নেল নগু, একটা ফটোয় লাল কালির বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পসাইট থেকে মাত্র এক মাইল দূরে জায়গাটা। বৃত্তের ভেতর ওটা সেন্ট ফুমেনটিয়াসের মঠ।

ওই মঠ সার্চ করা হোক, নির্দেশ দিলেন ফন শিলার কর্নেল নগু, ওখানে আপনার লোকজন ঢুকতে পারবে?

কেন পারবে না, হের ফন শিলার? মঠের একজন সন্ন্যাসী আমার নিজের লোক। তাছাড়া, গোজাম এলাকায় এখনো মার্শল ল বলবৎ রয়েছে, কিন্তু আমি ওখানকার কমান্ডার। বিদ্রোহী বা চোর ডাকাতদের ধরার জন্য যে কোনো জায়গা আমি সার্চ করতে পারি।

ভেরি গুড, বললেন ফন শিলার। ওই ফলকটা আমি চাই। আপনি জেনে রাখুন–গুণী লোকদের পুরস্কার দিই আমি। যে কোনো সময় মি. হেলম্ কে ফোন করে খবর দিতে পারেন আপনি। আর, আমি চাই ড. নাহুত আপনার সাথে গিয়ে এলাকটা সার্চ করে দেখুক। যে কোনো রকম চিহ্ন-প্রমাণ যেনো না হারায়।

কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে তাঁকে স্যালুট করলেন কর্নেল নগু। এরপর দ্রুত বেরিয়ে গেলেন কক্ষ ছেড়ে।

*

এর সৈন্যদের মধ্যে থেকে বিশজনকে বাছাই করলেন তিনি, জানেন ধর্ম বা নৈতিকতার প্রতি তাদের কোনো মোহ নেই। ভোর হওয়ার দু ঘণ্টা আগে নিরাপদ পেগাসাস কমপাউন্ডে প্যারেড করালের তাদের, তারপর ফ্লাডলাইটের নিচে দাঁড় করিয়ে ব্রিফ করলেন। কাছেই জেট রেঞ্জার তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে, কন্ট্রোলে বসে আছে পাইলট। অস্ত্রশস্ত্র সহ এতোগুলো লোককে একবারে বহন করা সম্ভব হবে না, কাজেই ঠিক হয়েছে চারবারে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথম ফ্লাইটে নগু থাকলেন, সঙ্গে কারিফ ফারকী। মঠ থেকে তিন মাইল দূরে কপ্টার ওদেরকে নামিয়ে দিল, ডানডেরা নদীর কিনারা ঘেঁষে ফাঁকা একটা জায়গায়। এ একই জায়গায় মিলিত হয়েছিল তারা নিকোলাসের ক্যাম্পে হামলা চালাবার আগে।

ভোরের প্রথম আলোয় মঠে পৌঁছনোর প্ল্যান করেছেন কর্নেল। কনটিনজেন্ট নিয়ে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন, রাবার সোল লাগানো প্যারাট্রুপার বুট থেকে প্রায় কোনো শব্দই হচ্ছে না।

পাথুরে চাতাল বা চাতাল ফাঁকা পড়ে আছে। আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাথেড্রাল থেকে পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত প্রার্থনাসঙ্গীতের একটানা ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ ভেসে আসছে। মাঝে মধ্যে বিরতি নিচ্ছেন তাঁরা, তখন শুধু প্রধান পুরোহিতের গলা শোনা গেল। দরজাগুলোর সামনে সৈনিকদের নিয়ে থামলেন কর্নেল। কাউকে কোনো নির্দেশ দেয়ার প্রয়োজন নেই, সবাই জানে কার কি কাজ। সবার উপর একবার চোখ বুলালেন তিনি, তারপর লেফটেন্যান্টের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকালেন।

গির্জার আউটার চেম্বার খালি। সন্ন্যাসীরা জমায়েত হয়েছেন মিডল চেম্বার কিচ্চিতে। ভেতরে ঢুকে আউটার চেম্বারের ঢোকার দরজা খোলা দেখা গেল। ভেতরে ঢুকলেন তিনি, তার লোকজন দু সারিতে ভাগ হয়ে সাড়ি ওয়াল ঘেঁষে পজিশন নিল, হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল কক ও লক করা, ডগায় আটকানো বেয়নেট হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত ভক্তদের কাডার দিচ্ছে।

ব্যাপারটা নিঃশব্দে ও দ্রুত ঘটে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সন্ন্যাসীরা টের পেলেন যে তাদের পবিত্র স্থানে বৈরী একদল লোক ঢুকে পড়েছে। ঢাক-ঢোল পেটানোর আওয়াজ থেমে গেল, থেমে গেল প্রার্থনাসঙ্গীত, গাঢ় মুখগুলো পেছন ফিরে সশস্ত্র লোকজনকে দেখছে। একা শুধু প্রধান পুরোহিত ওলি জারকস সচেতন নন, চোখ বুজে নিবিষ্টচিত্তে প্রার্থনা করছেন এখনো।

নিস্তব্ধতার ভেতর এগুলেন কর্নেল নগু, হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সন্ন্যাসীদের লাথি মেরে পথ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। ওদি জারকাসের হাড়সর্বস্ব কাঁধ ধরে একটা ঝুঁকি দিলেন, তারপর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন মেঝেতে। প্রধান পুরোহিতের মাথা থেকে খসে পড়লো মুকুটটা।

সন্ন্যাসীদের দিকে ফিরে অ্যামহ্যারিক ভাষায় কর্নেল বললেন, চোর-ডাকাত আর গুণ্ডাবদমাশদের খোঁজে গোটা মঠ সার্চ করা হবে। আমার লোকজনকে কর্তব্য পালনে বাধা দিলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।

ক্রল করে তাঁর দিকে ঘুরলেন জালি হোরা, এমব্রয়ডারি করা পর্দা ধরে অনেক কষ্টে সোজা হলেন। স্পষ্ট ও কঠিন সুরে বললেন, এটা আমাদের পবিত্র স্থান। এখানে আমরা পরম পিতা, সন্তান ও পবিত্র আত্মার আরোধনা করি।

চুপ ব্যাটা! গর্জে উঠলেন কর্নেল নগু, হোলস্টার থেকে টেকারেভ পিস্তল বের করে তাক করলেন প্রধান পুরোহিতের বুকে।

হুমকিটা গ্রাহ্য না করে জালি হোরা বললেন, এখানে কোনো শুফতা নেই। আমরা সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যিশু ও পরম পিতার নামে বলছি, আপনারা চলে যান, আমাদেরকে নির্বিঘ্নে….

পিস্তলটা উল্টো করে জালি হোরার চোয়ালে প্রচণ্ড বাড়ি মারলেন কর্নেল, গালটা তরমুজের মতো ফেটে গিয়ে লাল হয়ে উঠলো। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলেন প্রধান পুরোহিত, পর্দা ধরে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গোঙাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে সন্ন্যাসীরাও।

হেসে উঠে জালি হোরার পায়ে ল্যাং মারলেন কর্নেল। মেঝেতে একটা রক্তাক্ত স্কুপে পরিণত হলেন প্রধান পুরোহিত। বুড়ো বেবুন, কোথায় তোর গড? যত জোরে পারিস ডাক, কোনো সাড়া পাবি না। হেসে উঠলেন নগু, পিস্তল নেড়ে লেফটেন্যান্টকে সংকেত দিলেন।

মিডল চেম্বরে ছয়জনকে পাহারায় রেখে মাকডাস-এর দিকে এগুলেন কর্নেল। দরজায় তালা দেওয়া দেখে লেফটেন্যান্ট সবাইকে পিছিয়ে যেতে বলে হাতের একে-ফরটিসেভেন তুলে গুলি করলো। বন্ধ জায়গার ভেতর এক পশলা গুলি বিকট আওয়াজ করলো, সেটা থামার পর শোনা গেল সন্ন্যাসীরা একযোগে বিলাপ শুরু করেছে।

কাঁধের ধাক্কায় বিশাল দরজা পুরোপুরি খুলে ফেলা হলো। ভেতরে কয়েকটা মাত্র কুপি জ্বলছে। হঠাৎ এমন কি নাস্তিকরাও এ পবিত্রতম স্থানে ঢুকতে ইতস্তত করছে। বুঝতে পেরে হাঁক ছাড়লেন কর্নেল, নাহুত! এদিকে আসুন! হের ফন শিলার আপনাকেই জিনিসটা খুঁজে বের করতে বলেছেন।

একটা ঢোক গিলে মাকডাস-এ ঢুকলেন নাহুত, টর্চ হাতে তার পেছনেই থাকলেন নও। টর্চের আলো উপহার সামগ্রী ভরা শেলফ, রঙিন কাঁচ আর মূল্যবান পাথর, তামা আর রুপো, সোনা আর দেয়ালচিত্রের উপর নাচানাচি করছে। আলোটা থামলো উঁচু সিডার কাঠের বেদির উপর, উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো এপিফানি মুকুট, পানপাত্র আর রুপালি কপটিক ক্রস।

বেদির সামনে! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো নাহুত। গ্রিল লাগানো দরজা। এখান থেকেই পোলারয়েড ছবি তোলা হয়েছে! গ্রিল ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। আলো, আলো!

কাপড় মোড়া ট্যাবট পাথরটাকে পাশ কাটিয়ে তাঁর দিকে ছুটে এলেন কর্নেল, গ্রিলের ভেতর টর্চের আলো ফেললেন।

এতোক্ষণ চিৎকার করছিলেন নাহুত, এখন গলা থেকে আওয়াজ বের হতে চাইছে না, আবেগে ফিসফিস করছেন, এগুলো প্রাচীন দেয়ালচিত্র। কোনো সন্দেহ নেই, ক্রীতদাস টাইটার কাজ! কর্নেলের দিকে তাকালেন তিনি। দরজাটা ভাঙতে বলুন!

কিন্তু প্রাচীন হলেও কাঠামোটা এখনো সাংঘাতিক মজবুত, সবাই মিলে চেষ্টা করেও নড়ানো গেল না। কর্নেলের নির্দেশে কয়েকজন ট্রুপারকে নিয়ে একজন জুনিয়ার অফিসার ছুটলো সন্ন্যাসীদের কোয়ার্টার সার্চ করতে, গ্রিলের গেট ভাঙার জন্য যন্ত্রপাতি দরকার।

ওরা চলে যেতে গ্রিল গেটের দিকে পেছন ফিরলেন কর্নেল। ফলকটার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, বলে মাকডাস-এর চারদিকে টর্চের আলো ফেললেন। কাপড় মোড়া ট্যাবট পাথরে স্থির হলো আলো। বোধহয় এটাই! রূপো আর সোনার তৈরি সুতোয় এমব্রয়ডারি করা কাপড়টা ভারী বলে মনে হলো। সেটা ধরে টান দিলেন নগু।

টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট, খোদাই করা ফলক বা পিলার, উন্মোচিত হলো। ফটোতে এ পাথরটাই দেখেছি আমরা! বিড়বিড় করলেন তিনি। হের ফন শিলার এটাই চেয়েছেন। আমরা সবাই রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেলাম!

এগিয়ে এসে ফলকটার সামনে হাঁটু গাড়লেন নাহুত, আলিঙ্গন করলেন পাথরটাকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন।

এই সময় মাকডাসে ফিরে এলো জনিয়ার অফিসার। কোথাও থেকে মরচে ধরা একটা কোদাল পেয়েছে সে, কাঠের হাতল সহ।

গ্রিল গেট ভাঙার পর সমাধির ভেতর প্রথমে ঢুকলেন নাহুত। ধুলোর ভেতর দিয়ে ছুটে এসে প্রাচীন কাঠের কফিনের সামনে হাঁটুগেড়ে বসলেন। তার পেছনে এসে টর্চের আলো ফেললেন কর্নেল কফিনের উপর।

কফিনের ভেতর যে মানুষটা শুয়ে আছেন তার ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকা হয়েছে-শুধু কফিনে পাশগুলোয় নয়, ঢাকনির উপরও। দেয়ালচিত্র আর কফিনের ছবি যে একই শিল্পীর আঁকা, সেটা স্পষ্ট।

সমাধির উপর দেয়াললিপির দিকে মুখ তুললেন নাহুত। তারপর আবার কফিনের দিকে তাকালেন। সোনালি চুলের বীরযোদ্ধার ছবির নিচে লেখাগুলো পড়লেন তিনি। ট্যানাস, লর্ড হেরাব। ভাবাবেগে কেঁপে গেল তাঁর গলা, সশব্দে ঢোক গিললেন। সপ্তম স্ক্রোলের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। ফলক আর কফিন পেয়ে গেছি আমরা। এগুলো মহামুল্যবান ট্রেজার। হের ফন শিলার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবেন।

যদি আপনার কথা সত্যি হয়, বললেন নগু। মনে রাখবেন, তা না হলে কিন্তু গর্দান হারাতে হবে। হের ফন শিলার অত্যন্ত ডেঞ্জারাস মানুষ।

ফলক আর কফিনটা মঠের বাইরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন, কর্নেল, অভয় দিয়ে হাসলেন নাহুত। এগুলো কপ্টারে তুলে পেগাসাস ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারলে বস্তা বস্তা টাকা পাবেন আপনি।

কয়েকজন লোককে লাগিয়ে দেওয়া হলো, ফলকের চারপাশ থেকে চৌকো পাথরের ভিত ভাঙার কাজ শুরু হলো। ভিত থেকে ফলকটা মুক্ত করার পর নাহুত আন্দাজ করলেন, কম করেও আধ টন ওজন হবে। সন্ন্যাসীদের করুণ আবেদনে কান না দিয়ে মিডল চেম্বার থেকে উলেন পর্দা ছিঁড়ে নিয়ে এলেন তিনি, সেই পর্দা দিয়ে কফিন আর ফলক মোড়া হলো। দশজন স্বাস্থ্যবান ট্রুপার ফলকটা বহন করবে। কফিন নিয়ে রওনা হবে তিনজন। বাকি সাতজন এসকর্ট হিসেবে থাকবে।

ফলক আর কফিন নিয়ে মিছিলটা রওনা হলো। পথ তৈরি করার জন্য বসে থাকা সন্ন্যাসী আর পুরোহিতদের লাথি মারছে ট্রুপাররা। তারপর হঠাৎ প্রায় একযোগে কপাল ও বুক চাপড়ে হায় হায় করে উঠলেন সন্ন্যাসী ও ভক্তবৃন্দ। ট্রপাররা রাইফেলের গুতো মারছে তাদেরকে, কারো কারো বাহু আর পাঁজরে। বেয়নেটের ডগাও ঢুকে গেল। চিৎকার, কান্না, প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়ছে। উপাসকরা কেউ কেউ লাফ দিয়ে সোজা হলেন, সন্ন্যাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পরস্পরকে উৎসাহ দিচ্ছেন। দেখতে দেখতে ধর্মীয় একটা উন্মাদনা দানা বেঁধে উঠলো। সবার চোখে মুখে আক্রোশ আর হিংস্রতা ফুটে উঠেছে, যেনো পবিত্র পলক আর মহামান্য সেইন্টের কফিন রক্ষা করার জন্য জান দিতেও পিছপা হবেন না তারা।

উত্তেজনা ও হৈ-চৈ তুঙ্গে উঠলো, এ সময় সরু কাঠির মতো কাঠামো নিয়ে। সোজা হলেন প্রধান পুরোহিত জালি হোরা। তাঁর দাড়ি আর আলখেল্লায় রক্ত লেগে রয়েছে, চোখ দেখে মনে হবে বদ্ধ উন্মাদ, লালচে আর নিষ্পলক। থেতলানো ঠোঁট আর চামড়া তোলা গাল থেকে অদম্য একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো, তীরবেগে ছুটলেন তিনি। রঙ করা কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে, ছুটে আসছেন কর্নেল নগুকে লক্ষ্য করে।

কর্নেল নগু গর্জে উঠলেন, আরে, পাগলটা করে কি! হাতে ধরা রাইফেলের বেয়নেট সামনে তাক করলেন। এটা কি দেখতে পাচ্ছ, হাঁদারাম?

কিন্তু জাগতিক কোনো বাধা গ্রাহ্য করার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন জালি হোরা। তিনি থামলেন না, সরাসরি ছুটে এলেন বেয়নেটের তীক্ষ্ণ ডগা লক্ষ্য করে। আলখেল্লা ভেদ করে ঘ্যাঁচ করে শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল ধারাল ফলাটা, পিঠ দিয়ে বের হলো শিরদাঁড়ার পাশে। বিদ্ধ হবার পর মোচড় খাচ্ছে শরীরটা, কাতর আওয়াজ বেরিয়ে আসছে গলা থেকে।

টান দিয়ে বেয়নেটটা বের করতে চাইছেন কর্নেল, কিন্তু পারছেন না। যতই জোর খাটাচ্ছেন ততই দোমড়ানো-মোচড়ানো পুতুলের মতো নাচানাচি করছেন জালি হোরা, হাত ছুঁড়ছেন চারদিকে, পা ছুঁড়ছেন বাতাসে। বেয়নেট মুক্ত করার একটাই উপায় আছে এখন। রেট-অব-ফায়ার-সিরেক্টর ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেল শটে নিয়ে এলেন কর্নেল, একটা মাত্র গুলি করলেন।

বেয়নেট মুক্ত হলো, মেঝেতে চলে পড়লেন জালি হোরা। পরমুহূর্তে সন্ন্যাসী আর পুরোহিতরা আক্ষরিক অর্থেই যেনো উন্মাদ হয়ে গেল। একযোগে ছুটে এলেন তারা, সশস্ত্র ট্রুপারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কেউ কেউ কালি হাতে আঁকড়ে ধরলেন বেয়নেট।

যেখানে বহু লোক ধস্তাধস্তি করছে সেখানে গুলি করা সম্ভব নয়। কাজেই প্রথমে বেয়নেট চার্জ শুরু হলো। নিরস্ত্র প্রতিপক্ষ বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। গুরুত্বর জখম নিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে অনেকে, কেউ কেউ ভিড় ঠেলে সামনে এগুতে পারছে না, বাকি সবাই দলবদ্ধভাবে হামলা করার জন্য অপেক্ষা করছে। এ সুযোগে ট্রপাররা কোমরের কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলো। আঠাশ রাউন্ডের ম্যাগাজিন, একটা শেষ হলে আরেকটা লোট করা হচ্ছে।

পিলার বা ফলকটা মেঝেতে পড়ে রয়েছে, সেটার পেছনে লুকিয়ে আছেন নাহুত। চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছেন, ভাবছেন এ সব আমার না দেখাই ভালো, শুধু শুধু রাতের ঘুম নষ্ট হবে।

সীজ ফায়ার! এক সময় নির্দেশ দিলেন কর্নেল নগু। প্রতিপক্ষের একজনও বেঁচে নেই। কার্গো তোলো। ফরওয়ার্ড মার্চ! রক্তাক্ত মেঝে আর লাশের মাঝখান দিয়ে পথ করে নিয়ে আবার এগুলো ট্রুপাররা।

আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে নাহুত। মাথার উপরের হেলিকপ্টারের শব্দ এ জন্যই পেল না।

*

ইথিওপিয়ায়, নিজ বাসভবন কোয়েনসেন হাট-এর সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হের ফন শিলার। এক পা পেছনে উতে কেম্পার। জেট রেঞ্জারের পাইলট আগেই ফোন করে জানিয়েছে গুপ্তধনের আগমনের কথা। কাজেই সবাই তৈরি, কি আছে দেখার জন্য।

একরাশ ধূলো উড়িয়ে নিচে নামলো কপ্টার। থামবার সাথে সাথেই হেলম্ লোক লাগিয়ে দিল, নাইলনের দড়ি আলগা করে বাক্স খুললো ওরা। ভিতরে নিয়ে যেতে লাগলো ওগুলো।

কনফারেন্স রুমের মাঝখানের লম্বা টেবিলটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করা হয়েছে। প্রথমে, অতি সতর্কতার সাথে রাখা হলো থামগুলো, এরপর লর্ড ট্যানাস, মিশরের সাহসী সিংহের কফিন।

হাতের ইশারায় নিজের লোকদের চলে যেতে বলে, ফন শিলারের দিকে চাইলো হেলম্। একপাশে উতেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি।

খুলবো? শিলারের মুখ দেখতে দেখতে নরম স্বরে জানতে চায় হেলম্।

সাবধানে, কর্কশস্বরে বললেন শিলার। কোনোক্ষতি যেনো না হয়।

কপালে একস্তর ঘাম জমা হয়েছে। পাশে দাঁড়ানো উতের দিকে কোনো মনোযোগ নেই শিলারের, একদৃষ্টে দেখছেন সব ট্রেজার। একটা ছুরি দিয়ে সমস্ত দড়িদড়া কেটে ফেলতে লাগলো হেলম্। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বাড়ছে ফন শিলারের। যেনো ফুসফুসের রোগী–ঘরঘর করছে বুকের ভেতর।

হ্যাঁ, ফিসফিস করে বললেন তিনি। ওমন করে, আস্তে আস্তে।

তাঁর মুখ পরখ করলো উতে কেম্পার। সবসময় নতুন কোনো সংগ্রহ এলে এমনটিই করতে দেখছে সে শিলারকে। মনে হয় যেনো, হার্টের রোগী–এখনি মারা যাবেন।

থামের উপরে প্রান্তের কাপড়টা সরিয়ে দিল হেলম্। ধূলো উড়ে এসে পড়লো শিলারের ঘামচর্চিত কপালে। খাকি বুশ জ্যাকেটের সামনেটা ভিজে গেল ধূলোমিশ্রিত ঘর্মস্রোতে। খোদাই করা হায়াগ্লিফিকে চোখ পরতে নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠে শিলার। ওদিকে উতে নিজের ভিতরেই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা টের পাচ্ছে। এমন আবেগঘন সময়ে কী করে শিলার জানা আছে তার।

এ দিকে দেখুন–হের ফন শিলার, নাহুত বলে। ডানা ভাঙা বাজপাখির একটা প্রতাঁকের উপর হাত বোলায় সে। এটা হলো দাস টাইটার স্বাক্ষর।

আসল? চরম অসুস্থ মানুষের গলায় বললেন শিলার।

একদম আসল। আমার জীবনের কসম! নাহুত বলে।

চোখ দুটো দারুণ জ্যোতিতে চকচক করছে জার্মান ধনকুবেরের।

এই থামটা আজ থেকে চার হাজার বছর আগে খোদাই করা হয়েছিল, নাহুত বলে চলে। এই হলো লিপিকারের স্বাক্ষর। দ্রুত অনুবাদ করে যেতে থাকে সে, শিয়াল-মাথা দেবতা আনুবিস তাঁর থাবায় রক্ত আর মাংসপিন্ড ধরে আছেন, ধরে আছেন হাড়, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড। বাও খেলার ঘুটির মতো সেগুলোকে নাড়াতে পারেন তিনি, আর আমার প্রতঙ্গ তাকে সহায়তা দেয়, আর আমার মাথা লম্বা খেলার ষড়

থামো! শিলার নির্দেশ দিলেন। এর জন্য পরেও সময় পাবে। এখন যাও এখান থেকে! আমাকে একা থাকতে দাও!।

অবাক হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় নাহুত। এমন সময়ে কেউ মানা করতে পারে? হেলম্ ওকে ডেকে নিতে দুইজনে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে।

হেলম! পেছন থেকে ডাকে শিলার। নিশ্চিত করো, যেনো কেউ বিরক্ত না করে।

নিশ্চই, হের শিলার। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে উতের দিকে তাকালো হেলম্।

ও থাকবে! শিলার বলেন।

লোক দু জন চলে যেতে উতে এগিয়ে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে এলো। এরপর, দরজায় পিঠ রেখে তাকালো জার্মান ধনকুবেরের চোখে।

তার উন্নত বুকজোড়া সামনে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে; দৃঢ় বৃন্তদুটো বড়ো বিন্দুর মতো। পাতলা সুতির ব্লাউজের নিচে থেকে পরিষ্কার দেখা যায়।

কসটিউম? জানতে চাইলো উতে। ওটা চাই আপনার? তার নিজের কণ্ঠস্বরও কষ্টার্জিত। এ খেলাটা সেও কম পছন্দ করে না।

হ্যাঁ, কসটিউম চাই। ফিসফিসায় শিলার।

ব্যক্তিগত দরজা গলে উতে অদৃশ্য হয়ে যেতেই নিজের কাপড় খুলতে শুরু করলো সে। পুরোপুরি নগ্ন হয়ে উতে যে দিক দিয়ে আসবে, সেদিকে ফিরে দাঁড়ালো।

হঠাৎ, দোরগোড়ায় উদয় হলো উতে। ওর রূপান্তরে শ্বাস আটকে ফেললো শিলার। বেণী করা চুলের মিশরীয় পরচুলা পরেছে উতে, তার উপর ফনা তোলা কোব্রার ইউরিয়াস মুকুট। বহু পুরনো জিনিস ওটা–পাঁচ মিলিয়ন ডয়েস মার্ক দিয়ে কিনেছে ফন শিলার।

আমি প্রাচীন মিশরের রানী, লসট্রিসের পুনর্জন্ম, নীচুস্বরে বলে চলে উতে।

আমার আত্মা অমর। আর দেহ অবিনশ্বর। রানির কবর থেকে উদ্ধার করা স্বর্ণের স্যান্ডেল উতের পায়ে। ব্রেসলেট, আংটি, কানের দুল–সবই রানি লসট্রিসের সমাধি থেকে পাওয়া। ভক পাওয়া।

হ্যাঁ, তুমি-তাই–শিলারের স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

আমি চিরকাল বাঁচবো, এমন কোনো শক্তি নেই, আমাকে বিনাশ করে।

চিরকাল–শিলার কাঁপছে আবেগে।

কোমড়ের উপরে পুরোপুরি নগ্ন উতে। সাদা, বিশাল স্তন একেবারে দুধ সাদা। দুই হাত দিয়ে ও দুটোকে মুঠোর ভেতর ধরলো সে।

চার হাজার বছর ধরে এ সম্পদ তোমার অপেক্ষায় আছে, আহ্বান জানায় উতে। নাও ওদের!

স্বর্ণের স্যান্ডল থেকে সুন্দর পা জোড়া ছাড়িয়ে আনে লসট্রিস। হলুদ স্কার্টের সামনের অংশ দুই ভাগ করা ফাঁক করে ধরে নিজের শরীরের চুম্বক অংশ দেখায়। প্রতিভাবান অভিনেত্রী উতে, তার প্রতিটি ভঙ্গি হিসেবি।

এ হলো অমরত্বের শপথ, মধু-রঙা যৌনাঙ্গের চুলের উপর একটা হাত রাখে। উতে। নাও আমাকে!

চোখ পিটপিট করে ঘাম সরায় শিলার, মৃদু শব্দে গুঙিয়ে উঠে।

ধীরে, কোমর নাচায় উতে; খুব ধীরে, যেনো প্যাঁচ খুলতে থাকা কোব্রা। ঊরুজোড়া ফাঁক করে দাঁড়ায়। দুই আঙুলে ছড়িয়ে দেয় যোনির ঠোঁট।

এ হলো অমরত্বের প্রবেশদ্বার! ঢোকো এখানে!

জোরে গুঙিয়ে উঠেন শিলার। বহুবার অভিনীত এ নাটক কখনোই তাকে হতাশ করে না। ঘোরের মধ্যে যেনো উতের দিকে এগিয়ে যায় সে। পাতলা, কাঠখোট্টা; হাজার বছরের পুরনো শুকনো মমির মতো তার দেহ। বুকের চুল রুপালী, কোমড়ের চামড়া আলগা হয়ে ঝুলে গেছে, কিন্তু যৌনাঙ্গের এবং মাথার চুল কুচকুচে কালো ফন শিলারের। বিশাল পুরুষাঙ্গ তার দেহের সাথে মেলে না। ধীরে উতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে ক্রমশ ফুলে প্রবল হয়ে উঠলো তা–অগ্রভাগের চামড়া সরে গিয়ে পথ করে দিল গোলাপি ডগাটার।

তাড়াতাড়ি, শিলার আবেদন জানালেন, ওই পাথরটার উপরে!

তার দিকে পেছন ফিরে প্রাচীন পাথরটার উপর উবু হয়ে বসলো উতে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে শিলারকে, পেছন থেকে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে সে, অসট্রিচ পাখির ডিমের মতো গোলাকার দু অংশের মাঝখান দিয়ে।

*

সারারাত ধরে কাজ করলো হেলম্ আর তার লোকজন। পেগাসাস ওয়ার্কশপে বসে সমস্ত মালামাল কাঠের বাক্সে ভরে রাখলো। সকালে ট্রাকে তুলে আদ্দিস আবাবায় পাঠানো হলো সেগুলো। তার পরামর্শে নাহুত ট্রাকের পেছনে রইলো। হের ফন শিলার রাজধানীর এয়ারপোর্টে পৌঁছল কোম্পানির হেলিকপ্টারে চড়ে, সঙ্গে রয়েছেন উতে কেম্পার। ওঁরা পৌঁছবার কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজির হলেন পুলিশ কমিশনার জেনারেল ওবেঈদ। হের ফন শিলারকে বিদায় জানাতে এসেছেন তিনি।

ত্রিশ ঘণ্টার কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে পেগাসাস ট্রাকও সময়মতোই পৌঁছল। কাঠের বাক্সগুলো যখন ফন শিলারের প্রাইভেট জেটে তোলা হচ্ছে, জেনারেল ওবেঈদ তখন ডিউটিরত কাস্টমস অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। জিওলজিক্যাল স্যামপল হিসেবে ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে,তাতে সই করে নিঃশব্দে বিদায় নিলেন অফিসার।

একুশশো ঘণ্টায় ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো জেট প্লেনটা। সিনিয়র। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন অফিসার যারা অপেক্ষা করছেন তারা সবাই হের শিলারের পুরানো বন্ধু, খবর পাওয়া মাত্র এয়ারপোর্টে চলে আসেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে জেটে বসে হুইস্কি খেলেন তারা, প্রত্যেককে একটা করে মোটাতাজা এনভেলাপ দেওয়া হলো।

বাকি রাতটুকু পাহাড়ী পথ ধরে ছুটলো ট্রাক। তেরপল দিলে ঢাকা ট্রাকটাকে অনুসরণ করছে হের শিলারের শোফার, কার্গো ট্রাক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না। ভোর পাঁচটার দিকে লোহার গেট দিয়ে দুর্গের ভেতর ঢুকলো গাড়ি। দুৰ্গটা আকারে বিশাল, পরিবেশেটাও ভৌতিক। বাটলার থেকে শুরু করে বিশাল, পরিবেশটাও ভৌতিক। বাটলার থেকে শুরু করে কর্মচারীরা সবাই মনিবের জন্য অপেক্ষা করছিল। শিলারের কালেকশন দেখাশোনা করেন হের রিপার, তিনিও স্টাফসহ উপস্থিত। বাক্স দুটো ফর্কলিফটে তোলা হলো, ভল্টে নিয়ে যাওয়া হবে।

কাঠের বাক্স খোলা হচ্ছে, দুর্গের উত্তর টাওয়ারে চলে এলেন ফন শিলার। গোসল সেরে ব্রেকফাস্ট করলেন, পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলো চাইনিজ শেফ। নাস্তা শেস করে স্ত্রীর বেডরুমে চলে এলেন তিনি। আগের চেয়ে রোগা আর নিপ্রভ লাগলো ভদ্রমহিলাকে। সব চুলই একদম সাদা হয়ে গেছে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে মোমের তৈরি। নার্সকে বিদায় করে দিয়ে স্ত্রীর কপালে চুমো খেলেন ফন শিলার। ক্যান্সার রোগ ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছে মহিলাকে, তবু ফন শিলারকে তিনি এক জোড়া পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছেন, এ কথাটা মনে রেখে এখনো স্ত্রীকে ভালোবাসেন ফন শিলার।

স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটিয়ে নিজের বেডরুমে চলে এলেন তিনি, ঘুমালেন চার ঘণ্টা। যতই ক্লান্ত হোন, এর বেশি ঘুম তার দরকার হয় না। দুপুর পর্যন্ত ব্যবসার কাগজপত্র দেখলেন তিনি। তারপর তত্ত্বাবধায়ক রিপার ইন্টারকমে জানালেন, তাঁরা সবাই তার জন্যে ভল্টে অপেক্ষা করছেন।

প্রাইভেট সেক্রেটারি কেম্পারকে সঙ্গে নিয়ে এলিভেটরে চড়লেন ফন শিলার। এলিভেটরে দরজা খোলার পর দেখা গেল হের রিপার ও নাহুত অপেক্ষা করছেন। একবার চোখ বুলাতেই ফন শিলার বুঝতে পারলেন দু জনেই উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছেন। এক্স-রে শেষ হয়েছে? আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজ ধরে ভল্টের দিকে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

জ্বী, হের ফন শিলার! হের রিপার জবাব দিলেন। বয়েসে তিনি প্রৌঢ়, আর্কিওলজি নিয়ে অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করেছেন, মুখে ফ্রেঞ্জকাট দাড়ি। টেকনিশিয়ানরা দারুণ কাজ দেখিয়েছেন। প্লেটগুলো ভারি চমৎকার হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকে নিয়মিত চাঁদা দেন ফন শিলার, কাজেই তাঁর যে কোনো অনুরোধ রাজকীয় আদেশ বলে গণ্য করা হয়। ক্লিনিকের ডিরেক্টর তাঁর সবচেয়ে আধুনিক পোর্টেবল এক্স-রে ইকুইপমেন্টসহ দু জন টেকনিশিয়ানকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে একজন সিনিয়ন রেডিওলজিস্ট। লর্ড হারাব-এর ছবি ভোলা হয়েছে। প্লেটগুলো স্টাডি করে রিপোর্ট তৈরি করেছেন রেডিওলজিস্ট।

স্টীল ভল্টের তালায় প্লাস্টিক পাস কার্ড ঢোকালেন হের রিপার, হিস হিস শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। সবার আগে ভেতরে ঢুকলেন ফন শিলার। ভেতরে ঢুকে ভল্টের চারদিকে চোখ বুলালেন তিনি। বরাবরের মতো উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে এলো তার।

ভল্টের দেয়াল দুই মিটার পুরু, ইস্পাত আর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। ভল্টটা অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে সুরক্ষিত। আরো ভেতরে চলে এলেন ফন শিলার, থামলেন মেইন ডিসপ্লে রুমে। ইউরোপের বিখ্যাত ডিজাইনার এ কামরার প্ল্যান ও ডিজাইন তৈরি করেছেন। প্রধান রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে নীল। কালেকশনে প্রতিটি আইটেম আলাদা কেসে রাখা হয়েছে।

মিডনাইট-ব্লু ভেলভেট কুশনে রাকা হয়েছে স্বর্ণালংকার আর মূল্যবান রত্ন, কামরার ভেতর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ওগুলো নেই। সুকৌশলে লুকানো স্পটলাইটের আলো এসে পড়েছে আইভরি আর অবসিডিয়ান-এর উপর। প্রাচীন দেব-দেবীর অসংখ্য মূর্তি শোভা পাচ্ছে উঁচু মঞ্চের উপর-তথ, আনুবিস, হাপি আর সেথ আছেন, আছেন ওসিরিস, আইসিস আর হোরাস।

কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট। পাশে দাঁড়িয়ে ওটার মসৃণ গায়ে হাত বুলালেন ফন শিলার, তারপর পাশের কামরায় চলে এলেন।

এখানে কাঠের জোড়া সেতুর উপর রাখা হয়েছে ট্যানাস, লড হেরাব-এর কফিন। সাদা কোট পরা একজন রেডিওলজিস্ট আলোকিত ডিসপ্লে বোর্ডে সামনে ঝুঁকে রয়েছেন, বোর্ডে আটকানো রয়েছে কয়েকটা এক্স-রে প্লেট। পাশে এসে সেগুলোর দিকে তাকালেন ফন শিলার। কাঠের কফিনে আউটলাইনের ভেতর কোঁকড়ানো মানুষের আকৃতি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, হাত দুটো বুকের উপর ভাজ করা। এই বডি সম্পর্কে আমাকে আপনার কি বলার আছে? মহিলা রেডিওলজিস্টের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ফন শিলার।

পুরুষ, বললেন মহিলা। মধ্যবয়স্ক, মৃত্যুর সময় বয়েস ছিল পঞ্চাশের উপর, তবে ষাটের নিচে। ছোটখাট আকৃতি। উপস্থিত সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। পাঁচটা দাঁত নেই….

একটানা পাঁচ মিনিট লাশের বর্ণনা দিলেন রেডিওলজিস্ট, তারপর বললেন, মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ বুক ভেদ করা জখম। জখমের জন্য দায়ী হতে পারে বল্লম বা বর্শা। অস্ত্রটা কোনাকুনি ঢোকে, বাম ফুসফুস ফুটো করে ফেলে।

আর কিছু?

হের ফন শিলার, রেডিওলজিস্ট এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বললেন, আপনার আরো অনেক মমি পরীক্ষা করেছি আমি। কিন্তু এরকম আগে কখনো দেখিনি। পেটের ভিসেরা বের করার জন্য যেভাবে পেট কাটা হয়েছে, বোঝাই যায় অত্যন্ত দক্ষ কোনো ফিজিশিয়ানের কাজ।

ধন্যবাদ, বললেন ফন শিলার, তাকালেন নাহুতের দিকে। এ পর্যায়ে কোনো মন্তব্য?

ট্যানাস, লর্ড হেরাব-এর যে বর্ণনা সপ্তম স্ক্রোলে দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে এ সব মেলে না।

কোথায় মেলে না?

ট্যানাস ছিলেন দীর্ঘদেহী। বয়েস আরো কম। কফিনের ঢাকনিতে তার ছবি দেখুন, হের ফন শিলার।

বলে যান।

এক্স-রে প্লেটের ডিসপ্লের সামনে এসে দাঁড়ালেন নাহুত, হাত তুলে গাঢ় ও নিরেট কয়েকটা দাগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। জুয়েলারি, বললেন তিনি।

কবচ। বাজুবন্ধ। বুকের আচ্ছাদন বা বর্ম। কিছু নেকলেস। আঙটি আর কানে রিঙ। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো মুকুটটা, মুকুটে বসানো গোক্ষুর সাপের ফণা। ওটা শুধু রাজপরিবারের সদস্যরা পরেন।

এ সব কিসের ইঙ্গিত দেয়? ফন শিলারকে হতভম্ব দেখালো।

এটা সাধারণ কোনো মানুষের বডি নয়, কিংবা শুধু অভিজাত কারো বডিও নয়। অলংকারের পরিমাণ খুব বেশি। আমার বিশ্বাস এটা আসলে একটা রাজকীয় মমি।

অসম্ভব, ধমক দিলেন ফন শিলার। কফিনে কি লেখা রয়েছে পড়ন। পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে এটা মিশরীয় একজন সেনাপতির মমি।

ক্ষমা করবেন, হের ফন শিলার, সবিনয়ে বললেন নাহুত। সম্ভাব্য ব্যাখ্যা একটা নিশ্চয়ই আছে। রিভার গড বইটায় আভাস দেওয়া হয়েছে টাইটা নাকি দুটো মমি অদলবদল করে-একটা ছিল ফারাও মামোসের মমি, অপরটা ছিল তার সুহৃদ ট্যানাসের।

অদলবদল করার কী কারণ ছিল? শিলারের চেহারায় অবিশ্বাস।

কুসংস্কার বা আধ্যাত্মিক কারণ থাকতে পারে, জাগতিক কোনো কারণ যদি না ও থাকে। টাইটা চেয়েছিল তার প্রিয় বন্ধু ট্যানাস ফারাও-এর গুপ্তধন মৃত্যুর পরও পাহারা দিবে এবং ব্যবহার করবে। বন্ধুর প্রতি এটা ছিল তার শেষ উপহার।

এ সব আপনি বিশ্বাস করেন?

অন্তত অবিশ্বাস করি না। এ ধারণার পক্ষে আরো যুক্তি আছে, হের ফন শিলার। এক্স-রে থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মমির তুলনায় কফিনা আকারে অনেক বেশি বড়। আমার ধারণা, আরো দীর্ঘ কোনো মানুষের জন্য কফিনটা তৈরি করা হয়েছিল। জ্বী, হের ফন শিলার, প্রচুর সম্ভাবনা আছে যে এটা একটা রাজবংশীয় মমি।

শিলারের চেহারা পশুর মতো দেখাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কথা বললেন

কর্কশ সুরে, হোয়াট! কোনো রাজার মমি?

সম্ভবত, তাই।

হ্যাঁ। কফিনের ডালায় ছবিতে স্বর্ণের ইউরিয়াস মুকুট দেখা যাচ্ছে!

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কফিনটার পাশে দাঁড়ালেন শিলার। খুলুন এটা। ফারাও মামোসের মমিটা আমাকে দেখান।

*

কাজটা অত্যন্ত কঠিন। প্রথমে নাহুতকে নিশ্চিত হতে হবে রঙের নিচে কোথায় রয়েছে ঢাকনির জয়েন্ট। সেটা জানার পরই কেবল বার্নিশ আর আঠা তোলার কাজে হাত দেওয়া যাবে। কাজগুলো শেষ করতে প্রায় সারাটা দিন লাগিয়ে দিলেন তিনি।

ঢাকনি মুক্ত হওয়ার পরও সেটা তোলা হলো না। হের ফন শিলার দুই ছেলের সঙ্গে মিটিংয়ে রয়েছেন, তাঁকে খবর পাঠানো হলো। জরুরি আলোচনা বাদ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভল্টে চলে এলেন তিনি, কুদে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কফিনের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, তুলুন এবার ঢাকনি।

ঢাকনি তোলা হলো। ভেতরে তাকালেন হের ফন শিলার। তার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠলো। ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গিতে একটা লাশকে শুয়ে থাকতে দেখবেন বলে আশা করেছিলেন, তার বদলে কফিনের ভেতরটা এলোমেলো ও আলগা লিনের ব্যান্ডেজে ভর্তি দেখতে পাচ্ছেন। এ সব কি…. মনে হলো রেগে উঠবেন, ঝুঁকে বিবর্ণ ব্যান্ডেজ ধরতে গেলেন।

না! ছোঁবেন না! বাধা দিলেন নাহুত। চিৎকার করা হয়ে গেছে, বুজতে পেরে আড়ষ্টবোধ করলেন তিনি। মাফ করবেন, হের ফন শিলার। ব্যাপারটা সত্যি বিস্ময়কর। লাশ অদলবদল হবার সম্ভাবনাটা আরো বেড়ে গেল। আপনার অনুমতি পেলে ব্যান্ডেজ খোলার আগে আরো স্টাডি করতে চাই, হের ফন শিলার।

মঞ্চ থেকে নেমে পড়লেন হের ফন শিলার। গাঢ় নীল ডাবলব্রেস্টেড জ্যাকেটের ব্রেস্ট পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন মুখের। ঠিক আছে। কিন্তু এ কি সম্ভব? সত্যি এটা ফারাও মামোসের মমি হতে পারে? আবার মুখ মুছলেন তিনি। আলগা বাধনগুলো ভোলা হোক।

তার আগে, হের ফন শিলার, ফটো তোলা দরকার।

হ্যাঁ, অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন ফন শিলার। আমরা আর্কিওলকিস্ট, বিজ্ঞানী, সাধারণ লুটেরা নই। তুলুন ছবি।

আলগা বাধনও খুব সাবধানে, একটু একটু করে তুলতে হচ্ছে। এতো বেশি সময় লাগছে যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার অবস্থা হলো শিলারের। পুরানো আলগা কাপড়ের শেষটুকু মমির গা থেকে সরিয়ে নিলেন নাহুত, সময় তখন রাত একটা। আলগা কাপড়ের পর নিখুঁতভাবে কয়েক স্তরে বাধা হয়েছে ব্যান্ডেজ, তবে সেগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারছে চকচকে সোনা।

রাজকীয় কফিনে, কফিনের ভেতর আরো কয়েকটা কফিন থাকার কথা। এখানে সে সব দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না মুখোশগুলোও। ওগুলো নিশ্চয়ই ফারাও-এর নিজস্ব কফিনে রয়ে গেছে। সেই কফিনে অবশ্যই ট্যানাসের মমি শুয়ে আছে, আবিষ্কারের অপেক্ষায়। এখানে আমরা শুধু রাজবংশীয় মমির ইনার ড্রেসিং দেখতে পাচ্ছি।

লম্বা ফরসেপ দিয়ে ব্যান্ডেজের ওপরের স্তরটা ছাড়ালেন নাহুত। ইতোমধ্যে আবার মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন হের ফন শিলার, ঝুঁকে কপিরে ভেতর তাকিয়ে আছেন।

এটা মামোস রাজপরিবারের বক্ষাবরণ বা বুকের বর্ম, রুদ্ধশ্বাসে ফিসফিস করলেন নাহুত। স্পট লাইটের নিচে অলংকারটা ঝলমল করছে। বর্মটা সোনার তৈরি, বহুমুল্য রত্নখচিত, গোটা কুব জুড়ে আছে। মাঝখানে একটা শকুনের আকৃতি, সোনার উপর, বিশাল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে, বাঁকা নখে ধরে আছে রাজপরিবারের প্রতীক চিহ্ন, সোনার তৈরি সর্পিল অলংকরণ।

আর কোনো সন্দেহ নেই, হের ফন শিলারও ফিসফিস করলেন। ঐ প্রতীক চিহ্নই লাশের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে।

এরপর ওরা রাজার হাত মুক্ত করলেন, বক্ষাবরণের উপর ভাঁজ করা ছিল। আঙুলগুলো লম্বা, প্রতিটি আঙুলে একের পর এক আঙুটি পরানো, হাতের মুঠোয় রাজদণ্ড। রাজার প্রতীক চিহ্ন। এটাই আসল প্রমাণ। কথা বলার সময় হাঁপাচ্ছেন নাহুত। উনি অষ্টম মামোস, প্রাচীন মিশরের আপার ও লোয়ার কিংডমের শাসনকর্তা। রাজার মাথার দিকে এগুলেন তিনি, এখনো সেটা ব্যানডেজে মোড়া।

না, মাথা খুলবেন সবশেষে, বাধা দিলেন ফন শিলার। ফারাও-এর মুখ দেখার জন্য এখনো আমি প্রস্তুত নই।

কাজেই রাজার শরীরের নিচের দিকটায় কাজ শুরু করলেন নাহুত আর হের রিপার। ব্যান্ডেজের প্রতিটি স্তরের নিচ থেকে বের হলো মন্ত্রঃপূত কবচ, সবই সোনার তৈরি, বহুমূল্য রত্নখচিত। আকাশ, জমি আর পানিতে এমন কোনো প্রাণী নেই যার নকশা খোদাই করা হয় নি কবচগুলোয়, সবই রঙিন। প্রতিটি কবচের ফটো তোলা হলো, তারপর কফিন থেকে তুলে রাখা হলো রুপোর ট্রেতে।

অনেক রাত হয়েছে, হের ফন শিলার, এ সময় বললেন নাহুত। আপনি যদি বিশ্রাম নিতে চান….

না!

এরপর রাজার আঙুল থেকে আঙটিগুলো ভোলা হলো এক এক করে। সবশেষে নাহুত আর হের রিপার এসে দাঁড়ালেন মাথার দু পাশে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে ফারাও-এর মুখ আর মাথা, প্রায় চার হাজার বছর পর এ প্রথম। চুল খুব পাতলা, হেনা দিয়ে রাঙানো। চামড়ায় সুগন্ধী লাক্ষার প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল, পালিশ করা অম্বরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। নাকটা বড়, টিকালো। ঠোঁট জোড়া পেছন দিকে সামান্য ঢুকে আছে, যেনো স্বপ্নের ভেতর হাসছেন। চোখের পাতায় রেজিন বা লাক্ষার প্রলেপ থাকায় অশ্রুতে ভেজা মনে হলো, পাতাগুলো আধবোজা। ফারাও তার কপালে রাজকীয় মুকুট পরে আছেন। গোক্ষুরের মাথার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এখনো নিখুঁত ও স্পষ্ট। লম্বা জিভ মাঝখানে চেরা। চোখগুলো চকচকে নীল কাঁচ। ফণার পেছনে রাজপরিবারের প্রতীক চিহ্ন।

ওই মুকুট আমার চাই, আবেগে কেঁপে গেল শিলারের কণ্ঠস্বর। তুলুন ওটা, আমার হাতে দিন।

কিন্তু তুলতে গেলে মমির ক্ষতি হতে পারে…

নাহুতকে ধমক দিলেন ফন শিলার। আবার তর্ক করেন!

এখুনি তুলছি, হের ফন শিলার, তাড়াতাড়ি বললেন নাহুত। তবে সময় লাগবে। হের ফন শিলার যদি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন, তোলার পর আমরা খবর পাঠাব…।

রেজিন মোড়া কপালের চামড়ার সঙ্গে সোনার বৃত্তটা শক্তভাবে আটকে আছে। কপাল থেকে ওটাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কফিন থেকে গোটা মমিটা তুলতে হলো প্রথমে। তোলার পর স্টেইনরেস স্টীলের স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো। বিশেষভাবে তৈরি সলভেন্টের সাহায্যে নরম করা হলো রেজিন। কাজটা শেষ করতে প্রচুর সময় লাগলো।

মুকুটটা আলাদ করে রাখা হলো নীল ভেলভেট কুশনে। ভল্টের সমস্ত আলো নিস্তেজ করে দিয়ে একটা মাত্র স্পট লাইটের আলো সরাসরি ফেলা হলো ওটার উপর। তারপর নাহুত আর হের রিপার উপরতলায় গেল ফন শিলারকে খবর দিতে।

মুকুট দেখার জন্য ভল্টে যখন আবার নামলেন ফন শিলার, সঙ্গে ওদের কাউকে রাখলেন না, ওদের বদলে পাশে থাকলেন প্রাইভেট সেক্রেটারি উতে কেম্পার। ভারী ভল্টের দরজা আটকে দিলেন জার্মান ধনকুবের।

মুকুটটা দেখামাত্র হাঁপাতে শুরু করলেন তিনি, হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস টানতে লাগলেন। এতো জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন উতের কোমড়, ব্যাথায় ঝাঁকিয়ে উঠলো মহিলা। কিন্তু এ ব্যাথাই যেনো জাগিয়ে তুললাম উতেকে। ফন শিলার সমস্ত কাপড় খুলে ফেললেন তার দেহ থেকে। সোনালী মুকুটটা পড়িয়ে দিলেন উতের মাথায়, এরপর নগ্ন শরীরে শুইয়ে দিলেন খোলা কফিনের ভেতর।

আমি জীবনের চাবিকাঠি, প্রাচীন কফিনের মধ্য থেকে ফিসফিস করে বলে উঠলো উতে। আমার মুখ অমরত্মের ছোঁয়ায় চিরউজ্জ্বল।

নগ্ন শিলার দাঁড়িয়ে রইলেন কফিনের সামনে। তার পুরুষাঙ্গ ফুলে-ফেঁপে বিশাল আকার নিল, দপ দপ করে কাঁপছে ওটা–যেনো নিজস্ব কোনো জীবন আছে তার।

নিজের শরীরে ধীরে হাত বোলাচ্ছে উতে, আঙ্গুলগুলো যখন যোনর স্পর্শকাতর অঙ্গ ছুঁলো, কেঁপে উঠে সে বলল, আপনি চিরজীবী হোন!

ফারাও মামোসের মুকুটের প্রভাব হলো অবিশ্বাস্য। আগে কোনোদিনও গুগোল্ড ফন শিলারের এমন হয় নি। উতের কথা শেষ হতে না হতেই তার পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ নিজে থেকেই উগড়ে দিল রুপালি বীজের ধারা–আঠালো তরল লেপ্টে গেল উতের সাদাটে, নরম পেটে।

ওদিকে, ভোলা কফিনে উতে কেম্পার চরম পুলকে কেঁপে কেঁপে উঠছে; পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে অসহ্য সুখে, যেনো খিচুনি ধরেছে তার।

*

রোয়েনের মনে হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ নয়, বহু বছর ধরে মিশরের বাইরে ছিল সে। শহরতলীর জ্যাম, লোকের ভিড়, বাজারের মশলা আর ধূলোর মিলিত গন্ধ, মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি–সবকিছু কতকাল ধরে যেনো শোনে নি।

প্রথম দিনে অন্ধকার থাকতেই নিজের গির্জার ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পরলো রোয়েন। নীল নদের তীর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চললো। হাঁটুটা এখনো উঠলো, লাঠি ব্যবহার করতে হচ্ছে হাঁটার জন্য। দূরের পানিতে ফেলুচ্চার তেকোণা পাল দেখে কেমন আনমনা হয়ে গেল রোয়েন। মৃদুমন্দ বাতাসে কাঁপছে নীলের জল।

ইথিওপিয়ায় যে নীল নদ দেখে এসেছে ও, তার থেকে এটা কত আলাদা। এ। যে অ্যাবি নয়–সত্যিকারের নীল নদ। অনেক চওড়া, ধীর, বাতাসে সোঁদা একটা গন্ধ–রোয়েনের অত্যন্ত প্রিয়। এটা তার নদী, তার স্বদেশ। যা করতে এখানে সে এসেছে, মনে মনে তার সপক্ষে জোর পেল রোয়েন। সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝরে গেল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হাঁটতে লাগলো ও।

ডুরেঈদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য তারা নিশ্চই খুব চিন্তায় আছে। প্রথমে ডুরেঈদের ভাই কিছুটা শীতল আচরণ করছিল ওর সাথে; পরে তার স্ত্রী যখন রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো, আর বাচ্চারে এসে জড়ো হলো তার পাশে, একটু সহজ হয়ে উঠলেন ভাইজান। বাচ্চাগুলো সবাই রোয়েনকে আম্মা বলে ডাকে। শেষমেষ, ভাইজান নিজেই ওকে মরুদ্যানে পৌঁছে দেওয়ার কথা জানালেন। কিন্তু রোয়েন বিনীত কণ্ঠে জানালো, সমাধিতে ও একা যেতে যায়। অতুক্তি না করে নিজের প্রিয় সিত্রো : গাড়িটা ধার দিতে রাজি হলেন তিনি।

ডুরেঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মরুর বাতাসে চুলগুলো সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেল রোয়েন। এ মরু দুরেঈদের জীবনভর প্রিয় ছিল। ভালোই হলো–আর কখনোই মরু থেকে দূরে থাকতে হবে না তাকে। খুব সাধাসিধে কবরের ফলকে শুধু নাম আর তারিখ লেখা। একটু নিচু হয়ে কবরের উপর থেকে শুকনো ফুল আর পাতা সরিয়ে পরিষ্কার করে দিল রোয়েন।

অনেকক্ষণ ডুরেঈদের পাশে বসে রইলো ও। কত উপভোগ্য সময়ই পার করেছে সে, এ জ্ঞানতাপসের সঙ্গে। তার নরম মনোভাব, প্রজ্ঞা, ভালোবাসা সবকিছু ভিড় করে আসছে রোয়েনের মনে। রোয়েন জানে, ডুরেঈদের মতো করে তাঁকে সে কখনোই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারে নি, কিন্তু এতে ডুরেঈদের মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না।

ও নিশ্চই বুঝেছে–কেননা আমি আজ এখানে এসেছি–রোয়েন ভাবে। বিদায় বলতে এসেছে রোয়েন। ওর জন্য তার শোক আর ভালোবাসা থাকবে, তবু তাকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন থেমে থাকে না। ডুরেঈদ, আমাকে বিদায় বলো! বহুক্ষণ পর, দৃঢ়পায়ে সমাধি ছেড়ে বেরিয়ে আসে রোয়েন, একবারো পেছনে ফিরে তাকিয়ে।

ঘুরপথে গিয়ে আগুনে পোড়া ভিলার রাস্তা এড়িয়ে গেল ও। কায়রোতে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন মুখে ওর অপেক্ষায় বসে ডুরেঈদের পরিবার। রাতে ভালো খাবারের আয়োজন আছে আজ রোয়েনের সম্মানে।

*

মূলত, মন্ত্রী আতালান আবু সিন-এর সঙ্গে দেখা করতেই কায়রো এসেছে রোয়েন, কিন্তু তিনি অফিসের কাজে প্যারিসে আছেন। তিন দিন ধরে অপেক্ষা করতে হলো তাকে। রোয়েন জানে, নাহুত গাদ্দাবি কায়রোতে নেই, তাই ওর মনে তেমন কোনো ভীতিরও উদয় হলো না। মনের সুখে প্রচুর সময়ে মিউজিয়ামে কাটালো ও। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে এখানে, তাদের সাথে আলাপ গল্পে অনেকটা সময় কাটলো।

বাকি সময় মিউজিয়ামের রিডিং রুমে বসে টাইটার স্ক্রোলের মাইক্রোফিল্মে চোখ বোলালো সে। বার বার করে পড়ে নিশ্চিত হতে চাইলো, কোনোকিছু বাদ পরেছে কি না। একটা অংশ ভালোমতো পড়ে বিষদ নোট নিল রোয়েন। এখন যখন ফারাও মামোসের সমাধি আবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারছে সে।

একটা অংশে লিপিকার টাইটা ফারাও-এর সমাধি পরিদর্শনের বর্ণনা দিয়েছে। এ অংশটা বেশ আকর্ষণ করলো রোয়েকে। বিশেষত, ফারাও-এর মৃত্যু-মুখোশের তাকে যেনো জাদু করলো। টাইটা লিখেছে, আমি নিশ্চিত, হাজার বছরেও কোনো স্বর্ণকার এমন একটি জিনিস তৈরি করে নি কখনো। অনাগত দিনগুলোর মানুষজন একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখবে এ সৃষ্টি।

একজন কপটিক খ্রিস্টান হিসেবে সরাসরি এ প্রাচীন লিপিকারের উত্তরসূরী রোয়েন। আবেগে কেঁপে উঠে সে।

কিন্তু আতালান আবু সিনের জন্য অপেক্ষার দিনগুলোতে নিকোলাস কুয়েনটন হারপারের কথা বারবারই মনে হলো তার। তার অনেক বিষয়েই বেশ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রোয়েন। অনেকগুলো কঠিন সিন্ধান্ত নিতে হবে তাকে, খুব দ্রুত।

অবশেষে, আতালান আবু সিনের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রহর চলে এলো। চুড়ান্ত সময়টাতে বিদ্রোহ করতে চাইলো রোয়েনের মন, ইচ্ছে হলো, না যায়, কিন্তু নিশিথে পাওয়া মানুষের মতোই বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে চললো ও।

এক ঘণ্টা দেরি করে মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসে পৌঁছলো রোয়েন। বেশ চনমনে মুডে আছেন আতালান। সাদা দিশদাশা আর পাগড়ী মাথায়। আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত মেলালেন রোয়েনের সাথে। লন্ডনে হলে হয়তো গালে চুমো খেতেন!

গত কয়েকদিন মিউজিয়ামে পড়ে কাটিয়েছি আমি, অনেক পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। শুনে অবাক হলাম–নাহুত নাকি ইস্তফা দিয়েছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আতালান। আমার ভাইপোটা আসলে মোটেও ধীরস্থির নয়। সে নাকি জার্মানিতে কি একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। আমি অবশ্য জোর করেছিলাম, কিন্তু–

তাহলে পরিচালক পদে কাকে নিয়োগ দিচ্ছেন এখন? এমন নিষ্পাপ কণ্ঠে জানতে চাইলো রোয়েন, যেনো কিছু সন্দেহ না হয়।

এখনো কোনো এপয়েন্টমেন্ট দিই নি, স্বীকার করলেন আতালান। নাহুত ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে ভালো কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। হতে পারে, হয়তো আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দিব। কিন্তু বিদেশী কেউ ওই পদ পেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।

সম্মানীত মন্ত্রী–আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে রাজি হলেন আতালান।

ব্যক্তিগত সেক্রেটারিকে ইশারায় বিদায় করে দিলেন তিনি।

বলুন, মাই লেডি, কি ব্যাপারে কথা বলতে চান?

এর এক ঘণ্টা পর রোয়েন বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। ওকে বিগলিত ভঙ্গিতে এগিয়ে দিলেন মন্ত্রী মহোদয়।

বিদায়ের ক্ষণে নিচু গলায় বললেন, আবার আমাদের দেখা হবে, খুব শীঘ্রই ইনশাল্লাহ!

*

হিথরো বিমান বন্দরে ইজিপশিয়ান বিমান থেকে নামলো রোয়েন। দারুণ ঠান্ডা এখানে অন্তত পনেরো ডিগ্রি কম মিশরের চেয়ে। বিষণ্ণ, কুয়াশাঘেসা সন্ধ্যায় ইয়র্কের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়লো ও। ট্রেন ইয়র্কে পৌঁছতে স্টেশন থেকে নিকোলাসের নাম্বারে ফোন করলো।

আরে, আপনি আমাকে বললেই তো এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিতাম, ভর্ৎসনার সুরে বলল নিকোলাস।

আবার নিকিকে দেখে নিজের আনন্দে অবাক হয়ে গেল রোয়েন নিজেই। রেঞ্জ রোভার থেকে নেমে, লম্বা পায়ে এগিয়ে আসছে সে। এ ক-দিনে চুল কাটে নি নিকোলাস–এলোমেলো হয়ে আছে বড়ো বড়ো চুল।

আপনার হাঁটুর খবর কি? প্রথমেই জানতে চাইলো নিকোলাস। এখনো কি পিঠে তুলে নেয়ার প্রয়োজন আছে?

প্রায় সেরে গেছে হাসতে হাসতে জবাব দিল রোয়েন। লাঠিটা এবার ফেলে দিলেই পারি। ইচ্ছে হলো, দুই হাতে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে–এতো আনন্দ হচ্ছে। বদলে, শান্ত ভাবে ঠান্ডায় লালচে হয়ে আসা গালটা বাড়িয়ে ধরে রোয়েন। চুমো খেলো নিকি। পুরুষ পুরুষ গন্ধ–সম্ভবত আফটার শেভের রোয়েনের সমগ্র অস্তিত্বে ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো।

আপনাকে দেখে দারুণ তপ্ত মনে হচ্ছে। কায়রো সফর কেমন হলো?

কায়রো সবসময়ই আমার কাছে টনিকের মতো। অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হলো। রোয়েন বলে।

বাসায় তো কোনো খাবার নেই। থেমে, সামনে কোনো পাবে খেয়ে নেবেন?

আগে মাকে দেখতে চাই। অনেক দিন দেখি না। কেমন আছেন, কে জানে।

গত পরশু গিয়েছিলাম দেখতে। ভালোই আছেন। নিকোলাস বলে। নতুন কুকুর ছানাটা বেশ মনে ধরেছে। নাম কি রেখেছে শুনবেন–টাইটা!

সত্যি, আপনি খুব দয়ালু মানুষ।

ভালোলাগে ওনাকে। চলুন, এক বোতল লাফ্রোয়েগ কিনে তাকে দেখে আসি।

মধ্যরাত হয়ে গেল জর্জিনার কটেজ ছেড়ে বের হতে। দারুণ খাওয়া-দাওয়ার পর, ওদেরকে দরজায় বিদায় জানালেন তিনি। বুকে ধরে আছেন নতুন কুকুরছানা টাইটা-কে।

আপনি আমার মা-কে খারাপ করে দিচ্ছেন! অনুযোগের সুরে রোয়েন বলে।

কে-কাকে খারাপ করছে? নিকোলাস জানতে চায়।

আমাকে উনার সাথে থাকতে দেওয়া উচিত ছিল।

এখন তো টাইটা আছে তার সাথে। আর, আপনাকে আমার এখন হাতের কাছে রাখা দরকার। মিশরে যখন ছিলেন, কাজ অনেক এগিয়ে রেখেছি।

ইয়র্ক মিনিস্টারের পেছনের ফ্ল্যাটে কুয়েনটন পার্কের হাউজকিপার কামরা প্রস্তুত করে রেখেছিল।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে রোয়েনের ব্যাগ নিয়ে করিডর ধরে এগুচ্ছে নিকোলাস, পাশের একটা কামরা থেকে নাক ডাকার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো রোয়েন। কে ওখানে?

স্যাপার ওয়েব, বলল নিকোলাস। দলের নতুন সদস্য। আমাদের নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ার। কাল আপনার সঙ্গে পরিচয় হবে। দাঁড়িয়ে পড়েছে নিকোলাস, ওর পেছনে এসে দাঁড়াতে হলো রোয়েনকেও।

আপনি কি কুয়েনটন পার্কে থাকছেন, না এখানে?

আরে না! কুয়েনটন পার্কে আমি আছি জানলে ব্যাঙ্কের লোকেদের আসার. ধুম পরে যাবে। ওদের সাথে এখন দেখা করতে চাচ্ছি না। আপনার উপরের তলার বেডরুমে আছি। কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন।

নিকোলাস চলে যেতে ছোট্ট রুমটার চারপাশে চোখ বোলালো রোয়েন। বেশ বড়ো একটা বেড, সঙ্গে ছোট্ট এটাচ বাথরুম। বিছানায় শুয়ে তার মনে হলো, নিকোলাস বলেছে প্রয়োজন হলে ডাকতে!

প্রলোভন দেখিও না! ফিসফিসালো রোয়েন, ছাতের দিকে তাকিয়ে।

অ্যাবি গিরিখাদে ফিরে গেল ও। নিকোলাসের মেদহীন একহারা কাঠামো, ঘামে ভেজা, খাড়া ট্রেইল ধরে উঠে যাচ্ছে, পিঠে ঝুলে রয়েছে ও।

রোয়েনের অস্তিত্ব তারস্বরে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে সর্বগ্রাসী এক ক্ষুধার কথা।

যথেষ্ট হয়েছে আজে-বাজে চিন্তা! নিজেকেই বকুনি দিল ও, বাথরুমে ঢুকলা শাওয়ার নিতে।

*

পরদিন সকালে দরজায় নিকোলাসের ধাক্কায় ঘুম ভাঙলো রোয়েনের।

ব্রেকফাস্ট খেতে বসে তার সঙ্গে ড্যানিয়েলের পরিচয় করিয়ে দিল ও। ড্যানিয়েলের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো, দারুণ স্বাস্থ্যবান।

হ্যালো, আমি রোয়েন আল সিমা, রোয়েন বলে।

ওহ হো, আমারই পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, ডিম পোঁচে ঘা দিয়ে নিকোলাস বলে উঠে। এ হলো ড্যানি ড্যানিয়েল ওয়েব, বন্ধুরা ডাকে স্যাপার।

রোয়েনকে সে বলল, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিস আল সিমা।

মাথা নাড়লো রোয়েন। না, আমাকে শুধু রোয়েন বলে ডাকবেন, প্লিজ। :

ব্রেকফাস্টে বসে ইথিওপিয়া বা টাইটা প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হলো না, ড্যানিয়েল আর নিকোলাস নিজেদের অতীত স্মরণ করে খানিকক্ষণ হাসাহাসি করলো। তারপর হাতে কফির কাপ নিয়ে দাঁড়ালো নিকোলাস, আসুন, রোয়েনকে বলল। আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।

ওর পিছু নিয়ে সিটিংরুমের সামনে এসে দাঁড়ালো রোয়েন আর ড্যানিয়েল। কামরাটার দরজা খুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে কুর্নিশ করলো নিকোলাস, বলল, দয়া করে ভেতরে ঢুকুন!

সেন্ট্রাল টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে জলজ্যান্ত ডোরাকাটা ডিক-ডিক, শিং সহ। আফ্রিকা থেকে আনা ছালটা কিছু দিয়ে ভরা হয়েছে, জায়গামতো বসানো হয়েছে শিং দুটো-ব্যস, তৈরি হয়ে গেছে নিখুঁত মডেল। রোয়েনের মনে হলো, এখুনি ওটা লাফ দেবে। ওহ, নিকোলাস, কি সুন্দর! ডিক-ডিককে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে ও।

মডেলটা সব কথা মনে করিয়ে দিল রোয়েনকে। গিরিখাদের ঝোঁপের ভেতর প্রচণ্ড গরম, খাদ থেকে নিচে পড়ে যাবার ভয়, ডানডেরা নদী, টাইটার পুল, পেগাসাসের হেলিকপ্টার, মঠ, সন্ন্যাসী, তামেরের মর্মান্তিক মৃত্যু, সব যেনো একসঙ্গে ভিড় করে এলো মনের কানাচে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা গ্রাস করলো ওকে। সেটা বুঝতে পেরে ওর একটা হাত ধরে টান দিল নিকোলাস, ফিরিয়ে আনলো ডাইনিং রুমে।

ডানডেরা নদীর গহ্বরে কীভাবে নামব, আসুন আলোচনা করি, বলল নিকোলাস। আপনি ছিলেন না, ড্যানিয়েল আর আমি একটা প্ল্যান তৈরি করেছি। আপনার মনে আছে তো, টাইটার পুলে ডুব দেয়ার জন্য স্কুবা ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলাম আমরা? কী কী সমস্যা আছে তা-ও বলেছিলাম।

হ্যাঁ, মনে আছে, বলল রোয়েন। আপনি বলেছিলেন অ্যান্ডারওয়াটার ফাটলের কাছে প্রেশার খুব বেশি, কাজেই অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।

হ্যাঁ। সেই অন্য পদ্ধতির কথা আমাকে জানিয়েছেন ড্যানিয়েল। বলা যায়, সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেছে।

ড্যানিয়েলের দিকে তাকালো রোয়েন। ড্যানিয়েল একবার কেশে গলা পরিষ্কার করলো, তারপর বলল, একটু আভাস দিই। মাঝে মধ্যে পুরানো পদ্ধতিই সবচেয়ে ভালো কাজ দেয়।

ওকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হচ্ছে, বুঝতে পেরে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিল রোয়েন। আপনার যদি এতোই বুদ্ধি, তাহলে বিখ্যাত নন কেন? প্রশ্নটা করার পর হঠাৎ ভুরু কোঁচাকাল। পুরানো পদ্ধতি? তার মানে টাইটা যেভাবে কাজটা করেছিল? ডাইভিং ইকুইপমেন্ট ছাড়া যেভাবে সে হ্রদের তলায় পৌঁছেছিল?

কী সাংঘাতিক! উনি তো ধরে ফেলেছেন! নিকোলাস, কে কাকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে? অসহায় দেখালো ড্যানিয়েলকে।

একবার তালি মারলো রোয়েন। বাধ! বলল ও। চার হাজার বছর আগে টাইটা যেখানে বাঁধ দিয়েছিল আপনারাও সেখানে আবার বাঁধ দিতে চাইছেন!

টেবিল ছেড়ে দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালো ড্যানিয়েল, দেয়াল ঘেঁষে খাড়া করা পর্দা ঢাকা একটা বোর্ড রয়েছে ওখানে। পর্দাটা সরালো সে উন্মোচিত হলো পিন দিয়ে আটকানো এনলার্জ করা ফটোগুলো। ডানডেরা নদীর যেখানে টাইটা বাঁধ। তৈরি করেছিল বলে ধারণা করে ওরা, নিকোলাসের তোলা সেই জায়গার ফটো রয়েছে এখানে। আর রয়েছে তামেরের দেখানো প্রাচীন পাথরখনির ফটো।

ওগুলোর উপর মার্কার পেন দিয়ে রেখা টানা হয়েছে, দূরত্বের হিসাব রেখাও হয়েছে।

নিকোলাস আমাকে এ পয়েন্টে রিভার বেড-এর ডাইমেনশন-এর হিসাব দিয়েছে, আগের প্রবাহ ফিরে পেতে হলে কতটা উঁচু করতে হবে পাঁচিল, তারও আনুমানিক একটা হিসাব আমরা বের করেছি। সঙ্গে খুব কম ইকুইপমেন্ট থাকবে, তবু কাজটা করা সম্ভব বলে মনে করি আমি।

প্রাচীন মিশরীয়রা যদি করতে পারে, আপার জন্য কাজটা পানির মতো সহজ হবার কথা, ড্যানিয়েল, মন্তব্য করলো রোয়েন।

ধন্যবাদ, রোয়েন, আড়ষ্ট হেসে বলল স্যাপার ওয়েব। তবে কাজটা সহজ নয় মোটেই। বোর্ডে আটকনো ড্রইংগুলোর দিকে তাকালো সে। বাঁধ তৈরি করার অনেক পদ্ধতি আছে, তবে আজকাল যে পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় তাতে হাতের কাছে রিউনফোর্সড কংক্রিট আর হেভি আর্থ-মুভিং ইকুইপমেন্ট দরকার। এসব আধুনিক সুবিধে আমরা পাব বলে মনে হয় না।

টাইটা তো বুলডোজারের সাহায্য ছাড়াই কাজটা করেছিল।

কিন্তু তার ছিল বিপুল লোকবল।

লোকবল কমবেশি আমরাও যোগাড় করতে পারব।

নিকোলাস বলল, বর্ষা শুরুর আগে আমাদের হাতে সময় মাত্র দু মাস। ভাবছি মঠ সন্ন্যাসীদের সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা।

তোমরা আমাকে শ্রমিক এনে দেবে, আমি তোমাদেরকে বাঁধ তৈরি করে দেব, প্রতিশ্রুতি দিল ড্যানিয়েল। আগে যেমন বলেছি, পুরানো পদ্ধতিই ভালো। প্রাচীন মিশরীয়রা মুল বাঁধের ভিত তৈরির জন্য যে কফার ড্যাম আর গ্যাবিয়ন সিস্টেম ব্যবহার করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সরি বাধা দিল রোয়েন। গ্যাবিয়ন? ইঞ্জিনিয়ারিঙে আমার কোনো ডিগ্রী নেই।

সরি বলা উচিত আমার, আড়ষ্ট হেসে বলল ড্যানিয়েল। আমার ড্রইংগুলো দেখুন, প্লিজ। বোর্ডের দিকে ফিরলো সে। এই টাইটা ভদ্রলোক সম্ভবত বাঁশ বা বেত দিয়ে বিশাল আকারের ঝুড়ি তৈরি করে সেগুলোয় পাথর ভরেছিলেন। এগুলোকে গ্যাবিয়ন বলে। বোর্ডের আঁকা নকশা দেখালো সে। তারা গ্যাবিয়নগুলোর মাঝখানে বৃত্তাকার পাঁচিল তোলার জন্য কাঠ ব্যবহার করেন। সেগুলোও তিনি পাথর আর মাটি দিয়ে ভরাট করেন।

মোটামুটি একটা ধারণা পাচ্ছি, বলল রোয়েন। তবে এতো সব খুঁটিনাটি আমার না জানলেও চলে।

তা ঠিক, বলল ড্যানিয়েল। নিকোলাস আমাকে জানিয়েছে, কাঠের কোনো অভাব হবে না। তবে বাঁশ বা বেতের বদলে ব্যবহার করব তারের জাল, গ্যাবিয়ন তৈরির কাজে।

তারের জাল? রোয়েন অবাক। অ্যাবি উপত্যকায় আপনি তারের জাল পাবেন কোত্থেকে?

কাছাকাছি একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে তৈরি হচ্ছে ওগুলো, বলল ড্যানিয়েল। অন্যান্য ইকুপিমেন্টেরও অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

পাথরখনির কথাটাও বলো, উৎসাহ যোগালো নিকোলাস।

মাথা ঝাঁকালো ড্যানিয়েল। পাথরখনির ফটো দেখেছি আমি। দেড়শোর বেশি গ্র্যান্টি ব্লক সাইজ করা আছে। তারের জাল আর টিম্বার কফার ওয়াল-এর সঙ্গে যদি এ ব্লকগুলো ব্যবহার করি, মুল বাঁধের ভিত খুব শক্ত হবে।

একেকটা ব্লক কত টন ওজন, আন্দাজ করতে পারেন? আনবেন কীভাবে? প্রশ্ন করার পর হাত তুললাম রোয়েন। থাক, বলতে হবে না। আপনি সম্ভব বললে আমি মেনে নিব।

সম্ভব, আশ্বস্ত করলো ড্যানিয়েল।

টাইটা যখন আনতে পেরেছে, আমরাও পারব, বলল নিকোলাস। তার পদ্ধতিই ব্যবহার করব আমরা। আপনার এতে খুশি হওয়ার কথা। হাজার হোক,

সে আপনার আত্মীয়।

ঠাট্টা নয়, আত্মীয়ই তো।

সমস্ত ইকুইপমেন্ট কাল থেকে লোড করার কাজ শুরু হবে, বলল নিকোলাস। আপনাকে বলা হয় নি, আমরা মাল্টায় যাচ্ছি।

মাল্টায় কেন?

কেননা, মাল্টায় জেনি বাদেনহোর্সট-এর হোম বেস।

জেনি কি?

জেনি বাদেনহোর্সট, আফ্রিকা এয়ার-এর মালিক।

কিছুই তো বুঝছি না, কে এ?

আফ্রিকা এয়ার হলো একটা এয়ার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি, জেনি আর ওর ছেলে ফ্রেড মিলে চালায়। রদ্দি কিছু হারকিউলিস বিমান আছে ওদের। মাল্টা হলো বেস। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট দেশ–কোনো আফ্রিকান পলিটিক্স নেই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার যে কোথাও যেতে হলে এটাই হলো ভালো পথ। মূলত বিভিন্ন মুসলিম দেশে ড্রাগস চোরাচালানে ব্যবহৃত হয় জেনির বিমান, তাকে তাই মধ্যপ্রাচ্যের এলো ক্যাপোনো বলতে পারেন। তিব্বতে আমি আর ডুরেঈদ এ জেনির বিমানেই গিয়েছিলাম। এবারে, ও আমাদের অ্যাবেতে নিয়ে যাবে।

ইথিওপিয়া থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে আমাদের, বলল রোয়েন।

ফিরবো কীভাবে?

খিড়কি দরজা দিয়ে। নিঃশব্দে হাসলো নিকোলাস। গেট কীপার হিসেবে থাকবে পুরানো দোস্ত মেক।

মেকের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করেছেন?

টিসের মাধ্যমে। মনে হলো, টিসেই এখন মেকের প্রাইভেট সেক্রেটারি। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে মেক, কারণ বিশাল পরিধি জুড়ে টিসের যোগাযোগ, মেকের দূত হিসেবে আফ্রিকার যে কোন শহরে যেতে পারবে ও, যেসব জায়গায় যাওয়া মেকের জন্য নিরাপদ নয়।

দেখা যাচ্ছে অনেক কাজই সেরে ফেলেছেন আপনি, বলল রোয়েন। মেক কি টাইটার ব্যাপারটা জানেন?

বিশদ জানে না। মাথা নাড়লো নিকোলাস। তবে সন্দেহ করেছে। কিছু আসে যায় না, আমি, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি।

ওদিকের আর সব খবর কী?

ফোনে কথা বলার সময় টিসেকে খুব উত্তেজিত মনে হলো, বলল নিকোলাস। পরিষ্কার কিছু বলতে পারলো না, তবে শুনেছে সেইন্ট ফুমেনটিয়াস মঠে নাকি হামলা করা হয়েছে। জালি হোরা সহ চল্লিশ জনের মতো সন্ন্যাসী হতাহত হয়েছেন। চার্চে যেসব পবিত্র পুরানিদর্শন ছিল সবই নাকি লুঠ হয়ে গেছে।

ওহ, ডিয়ার গড, ননা! স্তম্ভিত দেখালো রোয়েনকে।এ কীভাবে সম্ভব! কারা করলো?

ডুরেঈদকে যারা খুন করেছে, বলল নিকোলাস। আর আপনাকে খুন করা জন্য তিনবার চেষ্টা করেছে।

পেগাসাস।

হ্যাঁ, বলল নিকোলাস।হের ফন শিলার।

এর জন্য আমরাই দায়ী। ফিসফিস করে রোয়েন বলে। আমরাই তো ওদের পথ দেখিয়ে ওই পবিত্র স্থানে নিয়ে গেছি। নির্ঘাত আমাদের ক্যাম্প থেকে চুরি যাওয়া পোলারয়েড ছবি দেখে ওরা ট্যানাসের কফিনের সন্ধান পেয়েছে।

ওহ হো, রোয়েন। ফন শিলারের পাগলামীর জন্য নিজেদের দায়ি করার কোনো মানে হয় না। তীক্ষ্ণ স্বরে নিকোলাস বলল।

আমরাই তো এসব শুরু করেছি। রোয়েন তবু শান্ত হয় না।

মোটেও না। আমরা কাউকে মারি নি। আর ফন শিলার পুরো মাকডাস খালি করে ফেলেছে।

নিকি, আমার যে কি খারাপ লাগছে।

তার মানে কি ধরে নেবো পুরো অভিযান আপনি বাতিল করতে চান? কাটা কাটা স্বরে বলল এবারে নিকোলাস।

কিছু সময় নিয়ে ভেবে, মাথা নাড়লো রোয়েন।

না। এমনও হতে পারে, ফিরে গিয়ে টাইটার পুলের তলায় পাওয়া ধন সম্পদের মাধ্যমে কিছুটা হলেও সন্ন্যাসীদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারবো আমরা।

তাই আশা করি, স্বস্তির ভঙ্গিতে সায় দেয় নিকোলাস। আমিও তাই চাই।

*

দৈত্যাকার হারকিউলিস সি-এমকে ওয়ান চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট টারবো প্রপ প্লেন, গায়ের রঙ ধূসর খয়েরি, ফিউজিলাজের আইডেনটিফিকেশন লেটারিং ঝাপসা হয়ে গেছে। প্লেনের কোথাও আফ্রিকান স্কাই লেখা নেই। জেনি বাদেনহোর্সটের হাতে পড়ার আগে চল্লিশ বছরে পাঁচ লাখ ঘণ্টা উড়েছে ওটা।

মাল্টার ভ্যালেটা এয়ারফিল্ডের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে রোয়েন। উড়বে তো? জিজ্ঞেস করলো ও।

জেনি ইচ্ছে করেই ওটার চেহারা এরকম করুণ করে রেখেছেন, ওকে আশ্বস্ত করলো নিকোলাস।

পাইলট হিসেবে কেমন ওঁরা?

দু জনেই, মানে বাপ ও ব্যাটা, ফাস্ট-রেট অ্যারো ইঞ্জিনিয়ার। বিগ ডলির ইঞ্জিন চকচকে রেখেছে এখনো।

বিগ ডলি কী জিনিস?

ডলি পারটনের বড়ো ভক্ত আমাদের জেনি।

হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে এলেন জেনি বাদেনহোর্সট, হাতছানি দিয়ে ডাকলেন ওদের। তাঁর পিছু নিয়ে বিশাল হ্যাঁঙ্গারে ঢুকলো ওরা, থামলো ছোট একটা অফিসের সামনে, দরজায় লেখা রয়েছে আফ্রিকান স্কাই। ভেতরে সুন্দরী একটা মেয়ে বসে রয়েছে।

জেনি বাদেনহোর্সটের নতুন সেক্রেটারি, ফিসফিস করলো নিকোলাস।

ম্যাচিউর আর রক্ত-রঙা চুলের না হলে ওর আবার মনে ধরে না!

ম্যারা ওদেরকে কফি পরিবেশন করলো। জেনি বাদেনহোর্সটের সঙ্গে ফ্লাইট প্ল্যান নিয়ে কথা হলো নিকোলাসের।

জ্ঞাতি ভাই গাদ্দাফীর সঙ্গে এ মুহূর্তে আমার একটু এ কষাকষি চলছে, তাই তাঁর রাজ্য এড়িয়ে প্লেন চালাতে হবে আমাকে। মিশরের উপর দিয়ে যাব, তবে ল্যান্ড করব না। হাত তুলে ডেস্কে ছড়ানো ম্যাপগুলো দেখালেন তিনি। সুদানে আবার গৃহযুদ্ধ চলছে, তবে উত্তর দিকটায় রাডার ব্যবস্থা আধুনিক নয়, তাই ব্ল্যাঙ্ক স্পট থেকে উড়ে যাওয়া কঠিন হবে না। সামরিক স্থাপনাগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকব আমরা। ল্যান্ড করবো সীমান্তের বেশ খানিক এ দিকে।

ফ্লাইং টাইম সম্পর্কে একটা ধারণা দিন, বলল নিকোলাস।

পনেরো ঘণ্টা।

রিফুয়েলিং?

দরকার হবে না। এক্সটা ট্যাংক আছে। একাত্তর হাজার কিলো ফুয়েল নিচ্ছি। হ্যাঁঙ্গারের গেট দিয়ে বড় একটা ট্রাক ঢুকলো। ফ্রেড আর ড্যানিয়েল ফিরে এসেছে।

ট্রাকটা থামলো হ্যাঁঙ্গারের শেষ মাথায়, ওখানে ইকুইপমেন্ট ও স্টোর তূপ হয়ে রয়েছে, ললাড করার জন্য তৈরি। ট্রাক থেকে নেমে এলো ফ্রেড, নিকোলাস ও রোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। ছেলেটা বাপেরই তরুণ সংস্করণ।

এটাই শেষ ট্রাক, ট্রাকের সামনের দিকটা ঘুরে এগিয়ে এলো ড্যানিয়েল। আর কোনো কার্গো নেই। ইচ্ছে করলে এখুনি আমরা প্লেনে ওগুলো তুলে ফেলতে পারি। আমার ফ্রন্ট-এন্ড লোডিং ট্রাক্টর একদম শেষে তুলবো।

ভোর চারটের সময় রওনা হতে চাই আমরা, বলল নিকোলাস। সব কার্গো একসঙ্গে নেওয়া যাচ্ছে না, হারকিউলিসকে আরো একবার কার্গো নিয়ে যেতে হবে।

জেনি বললেন, নো প্রবলেম।

টাইটা, আসছি আমরা! রোয়েনের ফিসফিসানি একা শুধু নিকোলাস শুনতে পেল।

এমন চোরের মতো ঢোকায় একটা সুবিধা হবে–পেগাসাসের টের পেতে সময় লাগবে, নিকোলাস মন্তব্য করলো।

আপনার কথা যেনো সত্যি হয়, হাতের আঙুলগুলো এক করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল রোয়েন। পেগাসাস ধারে কাছে না থাকলে টাইটার ধাঁধা নিয়ে পূর্ণমনোনিবেশ করা সম্ভব হবে।

*

ওরা আবার ইথিওপিয়ায় ফিরে যাচ্ছে, গম্ভীর সুরে বললেন হের ফন শিলার। আচ্ছা! আপনি ঠিক জানেন, হের ফন শিলার?

নাহুতের দিকে কটমট করে তাকালেন ফন শিলার। এ মিশরীয় আর্কিওলজি এক্সপার্ট তাঁর বিরক্তি উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছেন। ভদ্রলোককে চাকরি দেওয়ায় নিজের উপর এখন তিনি অসন্তুষ্ট। নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা ঝাড়লেও, মঠ থেকে উদ্ধার করে আনা ফলকটার খোদাই অনুবাদ করতে মোটেও সফল হননি নাহুত। কেন দেরি হচ্ছে জিজ্ঞেস করায় একের পর এক খোঁড়া অজুহাত খাড়া করছেন। আপনি কি ভাবেন, প্রতিপক্ষ কি করছে না করছে আমি তার খবর রাখব না? জেনারেল ওবেঈদ ওদের উপর নজর রাখছেন, তাঁর কাছ থেকে সব খবর পাচ্ছি আমি। ইংল্যান্ড থেকে ডক্টর রোয়েন মিশরে গিয়েছিলেন…

সেক্ষেত্রে, হের ফন শিলার, তার ব্যবস্থা করেন নি কেন?

আপনি গাধা নাকি? রেগে গেলেন ফন শিলার। ব্যবস্থা করি নি, কারণ আমার ধারণা আপনি নন, ডক্টর রোয়েনই আমাকে ফারাও-এর সমাধিতে নিয়ে যাবে।

কিন্তু স্যার, আমি তো…

এখন পর্যন্ত কিছুই আপনি করেন নি, নাহুত। ফলকটা এখনো দুর্বোধ্য…

কাজটা খুব কঠিন, হের ফন শিলার।

কঠিন বলেই তো মোটা টাকা বেতন দিয়ে আনা হয়েছে আপনাকে। ওই ফলকে সত্যি যদি মামোসের সমাধিতে পৌঁছানোর সূত্র থাকে, তাহলে লেখক টাইটা সেটাকে জটিল করেই তো রাখবে।

আমাকে যদি আরো খানিক সময় দেওয়া হয়…

কি বলছি শুনতে পাচ্ছেন না? হারপার নিকোলাস অ্যাবে গিরিখাদে ফিরে যাচ্ছেন। মাল্টা থেকে একটা চার্টার করা প্লেন নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন তাঁরা, সঙ্গে সমস্ত ইকুইপমেন্ট আছে, ট্র্যাক্টের সহ। আমার কাছে এর অর্থ হলো, তারা সমাধিটা খুঁজে পেয়েছেন, ফিরে যাচ্ছেন মাটি খুঁড়ে বের করতে।

ওরা মঠে পৌঁছাক না, খতম করা কোনো ব্যাপার না, বললেন নাহুত, যেনো নিজেই আশ্বস্ত হতে চাইছেন। কর্নেল নগুকে বললেই তিনি ব্যবস্থা করবেন।

আপনি একটা উজবুক। গর্জে উঠলেন ফন শিলার। যারা আমাকে মামোসের সমাধি পাইয়ে দেবেন, আমি তাদেরকে মেরে ফেলবো? নাহুতের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। আপনাকে আমি ইথিওপিয়ায় ফেরত পাঠাচ্ছি। ওখানে কোনো কাজে এলেও আসতে পারেন।

নাহুত চুপ করে থাকলেন।

বেস ক্যাম্পে গিয়ে হেলমের অধীনে কাজ করবেন আপনি, বললেন ফন শিলার। সে আপনাকে অর্ডার করবে, আপনি তার অর্ডার মতো কাজ করবেন। হারপার নিকোলাস আল রোয়েনের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিতে যাবে না।

ওখানে তাহলে আমার কাজটা কি হবে?

অ্যাকশন নেবেন না, তবে ওদের উপর নজর রাখবেন। কিন্তু সাবধান, নজর রাখতে গিয়ে ওদেরকে আবার সতর্ক করে দেবেন না যেন। কর্নেল নগুর একজন স্পাই আছে, ওদের গতিবিধি সম্পর্কে সে কর্নেলকে রিপোর্ট করবে, আপনি কর্নেলের কাছ থেকে সে সব জেনে নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন, বুঝতে চেষ্টা করবেন হারপার নিকোলাস ঠিক কী অর্জন করতে চাইছেন।

আর আপনি? ইথিওপিয়ায় আসছেন না?

এতো প্রশ্ন করেন কেন? সময় হলেই ঠিকই আমি ওখানে পৌঁছে যাব।

ফলকটার কি হবে?

আপনি ওটার ফটো তুলে নিয়ে যান। স্যাটেলাইটে রিপোর্ট পাঠাবেন।

আমাকে কখন আপনি পাঠাতে চান?

যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। সম্ভব হলে এক্ষুনি। আমার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলুন, যান।

সেইদিনে প্রথমবারের মতো সুখী দেখালো নাহুতকে।

*

পনেরো ঘণ্টার ফ্লাইট শেষ হয়ে এলো। পূর্ব দিগন্তে ইথিওপিয়ান পাহাড়-শ্রেণীর নীলচে আভাস ফুটে উঠলো গাঢ় নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে, হাত তুলে নিকোলাস না দেখানো পর্যন্ত রোয়েনের চোখে ধরা পড়লো না। প্রায় পৌঁছে গেছি, বলল ও। চলুন, ফ্লাইট ডেকে যাই।

উইন্ডশীল্ডের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে সামনে কোথাও ল্যান্ডমার্ক দেখলো না ওরা, যতদূর দৃষ্টি যায় ধু-ধু বৃক্ষহীন প্রান্তরই শুধু চোখে পড়ে।

আমার হিসেবে দশ মিনিটে পৌঁছে যাব আমরা, বললেন জেনি। কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছেন? উত্তরে কেউ কিছু বলল না।

পাঁচ মিনিট।

ওদিকে! জেনি বাদেনহোর্সটের কাঁধের উপর দিয়ে হাত লম্বা করে দেখালো নিকোলাস। ওটাই নীলনদের কোর্স। বহু দূর সামনে ঘন কাঁটাঝোঁপ গাঢ় একটা রেখা তৈরি করেছে। সুগার মিলের চিমনিটাও দেখা যাচ্ছে। মেক বলেছে মিল থেকে তিন মাইল দূরে এয়ারস্ট্রিপটা।

কিন্তু চার্টে নেই, বললেন জেনি। কোঅর্ডিনেটস-এর পৌঁছতে আর এক মিনিট। স্টপওয়াচে ধীরে ধীরে পার হলো সময়টা।

এখনো কিছু দেখছি না, কো-পাইলটের সিট থেকে বলল ফ্রেড। তার কথা শেষ হওয়া মাত্র হারকিউলিসের নাকের সামনে দিয়ে একটা ফ্লেয়ার উঠে গেল আকাশের আরো ওপরে। ককপিটে উপস্থিত সবাই স্বস্তির হাসি হাসলো।

জেনি বাদেনহোর্সটের পিঠ চাপড়ে দিল নিকোলাস। ধন্যবাদ।

কয়েকশো ফুট ওপরে উঠলো প্লেন, ওয়ান-এইটি টার্ন নিয়ে ফিরে আসছে। প্রান্তরে এখন দুটো সিগন্যাল ফ্লেয়ার জ্বলছে-একটা কালো ধোয়া ছাড়ছে, অপরটা সাদা। মাইলখানেক দূরে থাকতে ঝোপে ঢাকা ও পরিত্যক্ত ল্যান্ডিং স্ট্রিপের অস্পষ্ট রেখা ধরা পড়লো চোখে। বিশ বছর আগে রোজিরেস এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করেছিল একটা বেসরকারি কোম্পানি। নীলনদ থেকে পানি নিয়ে আখ চাষ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু বরাবরের মতো আফ্রিকান খরা জিতে যায়, পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় নেয় কোম্পানি। সেই থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এয়ারস্ট্রিপটা। মেক নিমুর রদেভো হিসেবে এ জায়গাটা বেছে নিয়েছে।

কাউকেই তো দেখছি না, বললেন জেনি। আমাকে এখন কি করতে বলেন?

আরেকটা ফ্লেয়ার থাকার কথা… ওই তো! রানওয়ের শেষ প্রান্ত থেকে আকাশে উঠলো আরেকটা ফ্লেয়ার। হাসছে নিকোলাস। কাঁটাঝোঁপের আশপাশে এ প্রথম মানুষের নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে গা ঢাকা দিয়েছিল ওরা।

মেক, সন্দেহ নাই। আপনি ল্যান্ড করতে পারেন।

*

ওদের সামনে রানওয়েতে এখন ক্যামোফ্লেজ ফেটিগ পরা সচল মূর্তি দেখা যাচ্ছে।

প্লেন থামার পর লোডিং র‍্যাম্প নিচু করা হলো, সেটা বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে এলো মেক। নিকোলাস! আলিঙ্গন করলো নিকোলাসকে, সশব্দে চুমো খেলো দু গালে, আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে চেহারা। আমার কথাই ঠিক! শুধুই ডিক ডিক শিকার নয়, অন্য কোনো রহস্য আছে! কি?

পুরানো বন্ধুকে মিথ্যে বলি কীভাবে! কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস।

তাহলে কি ধরে নিতে পারি দু জন মিলে খুব মজা করা যাবে? জীবন এখানে বড়ই একঘেয়ে।

কথা দিচ্ছি।

একহারা দেহ সৌষ্ঠব, একটা নারীমূর্তি উঠে এলো র‍্যাম্প বেয়ে। মেয়েটার পরনে জলপাইস সবুজ ফেটিগ। কথা না বলা পর্যন্ত টিসেকে নিকোলাস চিনতেই পারলো না। ক্যানভাস প্যারা বুট আর কাপড়ের তৈরি ক্যাপ পরে আছে, দেখে মনে হবে একটা ছেলে।

নিকোলাস! রোয়েন! ওয়েলকাম চিৎকার জুড়ে দিল টিসে, হাঁপাচ্ছে। রোয়েন আর টিসে জোড়া লেগে গেল।

আরে, এরা তো দেখছি খোশগল্পে মগ্ন হয়ে পড়লো! জেনি হাসছে। আমাকে আজ রাতেই মাল্টা ফিরতে হবে। সন্ধের আগেই টেক-অফ করতে চাই।

মেকের নেতৃত্বে দ্রুত মাল খালাস করার কাজ শুরু হলো। তার লোকজন প্লেনে ঢুকে রোলারে চড়ালো ভারী বাক্সগুলো। ড্যানিয়েল অবশ্য নিজের ফ্রন্ট-এন্ড লোডার স্টার্ট দিল, বাছাই করা কিছু কার্গো নামিয়ে এনে জড়ো করলো কাঁটাঝোঁপের আড়ালে। সূর্য পাটে বসেছে, এ সময় খালি হয়ে গেল প্লেন।

ককপিটে বসে শেষ একবার আলোচনা করলো নিকোলাস ও জেনি।

আজ থেকে চারদিন পর, একমত হলেন জেনি, হ্যান্ডশেক করলেন নিকোলাসের সঙ্গে।

ভদ্রলোকেকে যেতে দাও, নিকোলাস, নিচে থেকে হাঁক ছাড়লো মেক। ভোরের আগে সীমান্ত পার হতে হবে আমাদের।

প্লেন ফিরে যাবার পর টিসেকে নিয়ে একটা ঝোঁপের সামনে বসলো রোয়েন। আবার দেখা হওয়ায় দু জনেই খুব খুশি।

তোমাদের মালপত্র পাহারা দেওয়ার জন্য পুরো একটা কমব্যাট প্লাটুন রেখে যাচ্ছি এখানে, নিকোলাসকে বলল মেক। সীমান্ত পর্যন্ত খুব ছোট একটা দল যাব আমরা। আপাতত এদিকে শত্রুপক্ষের তৎপরতা খুবই কম, কাজেই কোনো বিপদ হবারই কথা।

ইথিওপিয়ান বর্ডার কত দূরে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হবে, বলল মেক। চাঁদ ওঠার আগেই সীমান্ত পার হতে চাই। আমার দলের বাকি লোকজন অ্যাবে গিরিখাদের মুখে অপেক্ষা করছে। কাল ভোরে ওদের সঙ্গে মিলিত হব।

প্লাটুন কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একপাশে সরে গেল মেক, রোজিরেসে রেখে যাওয়া অবশিষ্ট কার্গো তার অধীনেই পাহারা বেদে গেরিলানা। তারপর ছজন লোককে ডাকলো সে, বর্ডার পার হবার সময় এসকর্ট হিসেবে থাকবে ওরা।

হঠাৎ গলা চড়িয়ে নিকোলাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মেক। ওটা উনি কোনো, বুদ্ধিতে প্লেনে করে এনেছেন, নিকোলাস? থিয়ডালাইট-এর মোটাতাজা পায়াগুলোর দিকে বিরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। বিশাল এক বাক্স খুলে প্লেন থেকে ওটা বের করে এনেছে ড্যানি স্যাপার।

ড্যানিয়েল আরবি জানে না, কাজেই অনুবাদকের ভূমিকা নিতে হলো নিকোলাসকে। ড্যানিয়েল বলছে ওটার ডেলিকেট ইট্রুমেন্ট। প্লেন থেকে ড্রপ করার ঝুঁকি নিতে রাজি হয় নি। বলছে, এটার কোনো ক্ষতি হলেও যে কাজের জন্য তাকে আনা হয়েছে সে-কাজ করতে পারবে না।

কে ওটা বহন করবে? জিজ্ঞেস করলো মেক। আমার লোকদের বললে বিদ্রোহ করবে তারা।

বুনো ভাঁড়টাকে বলো আমি নিজে এটা বহন করবো, বলল ড্যানিয়েল। তার বাঁদরগুলো এটা ছুঁলে তাদের হাত আমি ভেঙে দিব। বোঝাটা হ্যাঁচকা টানে নিজের কাঁধে তুলে নিল সে।

হারকিউলিস ফিরে যাবার আধঘণ্টা পর অন্ধকার ও নিস্তব্ধ প্রান্তর ধরে রওনা হলো ওরা, অ্যাডভান্স পাগৰ্ড পাঁচ মিনিট আগে রওনা হয়েছে। পুব দিকে যাচ্ছে ওরা। লম্বা পা পেলে দ্রুত হাটছে মেক। রোয়েন ভাবলো, নিকোলাস আর মেকের চোখ শিকারি বিড়ালের মতো সতর্ক, ওদের দুজনের ঠিক পেছনেই রয়েছে ও। অন্ধকারে কীভাবে দেখতে পাচ্ছে কে জানে, মাঝে মধ্যেই ফিসফিস করে সাবধান করে দিচ্ছে ওকে কখনো মেক, কখনো নিকোলাস-সাবধান করায় গর্ত বা পাথরের স্তূপগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারছে রোয়েন। তারপরও যখন হোঁচট খেল, সব সময় মনে হলো ওর পাশেই আছে নিকোলাস, শক্ত হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো প্রতিবার।

নিস্তব্ধতার ভেতর শৃংখলা বজায় রেখে এগুচ্ছে দলটা। প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ মিনিট করে বিশ্রাম। বিশ্রামের সময় একসঙ্গে বসছে নিকোলাস আর মেক, ওদের দু একটা কথা রোয়েনের কানে ভেসে আসছে। অ্যাবে গিরিখাদে ওদের ফিরে আসার কারণটা মেককে ব্যাখ্যা করে নিকোলাস। মামোস আর টাইটা শব্দ দুটো কয়েকবার উচ্চারণ করলো নিকোলাস। মেকের ভরাট কণ্ঠস্বর থেকে প্রশ্নবোধক আওয়াজ বের হচ্ছে। বিশ্রাম শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা।

এক পর্যায়ে সময়ের আর কোনো হিসাব থাকলো না রোয়েনের। শরীর ও এ দুটোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপ পরিশ্রম সাপেক্ষ ও কষ্টকর মনে হলো। ক্ষতটা প্রায় সেরে গেলেও, আবার ব্যথা শুরু হলো হাঁটুতে। মাঝে মধ্যে অনুভব করলো নিকোলাস ওর বাহু ধরেছে, খানা-খন্দটুকু পার করে দিচ্ছে। আবার কখনো বা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো গোটা দল, সামনে থেকে নিচু গলার সতর্ক সংকেত ভেসে এসেছে। অন্ধকারে চুপচাপ অপেক্ষা। সবাই উত্তেজিত ও নার্ভাস। তারপর আরো একটা সংকেত এলো। আবার শুরু হলো কষ্টকর পদযাত্রা। একবার নদীর গন্ধ পেল রোয়েন, ভাবল নীলনদের কাছাকাছি কোথাও রয়েছে ওরা। কেউ কোনো কথা বলে নি, তবু পুরুষদের আড়ষ্ট ভাব লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো সামনে কিছু একটা আছে। গেরিলারা কাঁধ থেকে অস্ত্র নামিয়ে বাগিয়ে ধরলো।

সামনে বর্ডার, রোয়েনের মুখের কাছাকাছি নিঃশ্বাস ফেললো নিকোলাস। উত্তেজনাটা সংক্রামক। ক্লান্তিক কথা ভুলে গেল রোয়েন। পালস রেট বেড়ে গেছে।

এক ঘণ্টা পার হলো। তবু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলো না ওরা। আরো এক ঘণ্টা পর সামনে থেকে কারো হাসির অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো। অল ক্লিয়ার, রোয়েনকে বলল নিকোলাস। ইথিওপিয়ায় ঢুকে পড়েছি আমরা। আপনার খবর কি, রোয়েন?

ভালো আছি।

ক্লান্ত আমিও। চাঁদের আলোয় হাসলো নিকোলাস। খানিক পরই ক্যাম্প ফেলা হবে।

সন্দেহ হলো মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছে নিকোলাস। পথ যেনো ফুরোবার নয়, কাজেই হাঁটারও কোনো বিরাম নেই। এক সময় কান্না পেল রোয়েনের। তারপর হঠাৎ নদীর আওয়াজ ভেসে এলো কানে। ইতোমধ্যে ভোর হয়ে এসেছে। সামনে যারা অপেক্ষা করছিল, তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল মেককে। হাত ধরে পথ থেকে রোয়েনকে সরিয়ে আনলো নিকোলাস, এক জায়গায় বসিয়ে নিজের হাতে খুলে দিল পায়ের বুট।

সত্যি আপনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে গর্ব করা চলে, রোয়েনের মোজা খোলার সময় বলল নিকোলাস, পায়ের ফোস্কাগুলো পরীক্ষা করলো। হাঁটুর ব্যান্ডেজটাও খুললো। সামান্য ফুলে আছে। নরম ছোঁয়ায় ডলে দিল নিকোলাস। পেইনকিলার দিচ্ছি, আরাম পাবেন। ব্যাগ থেকে ট্যাবলেট বের করলো ও। তারপর প্যাড লাগানো নিজের জ্যাকেটটা মাটিতে বিছালো। দুঃখিত, স্লিপিং ব্যাগ পেছনে ফেলে আসা হয়েছে। এয়ার ড্রপের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ট্যাবলেট আর পানির বোতলটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিল। সবশেষে ইমার্জেন্সী রেশনের প্যাকটা খুললো।

মুখে খানিকটা শুকনো মাংস নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন। হাতে গরম এক মগ চা নিয়ে নিকোলাস যখন ওর ঘুম ভাঙালো, তখন বিকেল যাই যাই করছে। ওঁর পাশে বসে নিকোলাসও চুমুক দিচ্ছে নিজের মগে। শুনে খুশি হবেন, মেক এখন সব কথাই জানে। আমাদেরকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে সে।

কতটুকু কী বললেন?

আগ্রহী করে তোলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। ঠোঁট টিপে হাসলো নিকোলাস। সব কথা একসঙ্গে বলা ঠিক না, প্রতিবার একটু একটু করে বলতে হয়। আমরা কি খুঁচছি, জানে। আরো জানে নদীতে একটা বাঁধ দিতে যাচ্ছি।

বাধ তৈরির জন্য লোকবল দরকার, তার কী ব্যবস্থা?

সেন্ট ফুমেনটিয়াসের সন্ন্যাসীরা তার কথা শুনবেন। ওঁরা তাকে বীরপুরুষ বা হিরো বলে মনে করেন।

বিনিময়ে নিশ্চয়ই কিছু দেয়ার কথা বলেছেন। কি?

এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয় নি। আমি বলেছি, কি পাব জানা নেই। হেসে উঠে বলল, আমাকে ও বিশ্বাস করে।

উনি খুব চালাক, তাই না?

চালাক শব্দটা যদি নিন্দার অর্থে ব্যবহার করেন, আমি একমত হব না, বিড়বিড় করলো নিকোলাস। আমি জানি সময় হলে স্পষ্ট করেই বলবে সাহায্যের বিনিময়ে কী সে চায়। হঠাৎ মুখ তুলে তাকালো ও। তোমার কথাই হচ্ছিল, মেক।

এগিয়ে এসে নিকোলাসের পাশে উবু হয়ে বসলো মেক। আমাকে নিয়ে কি ষড়যন্ত্র করছিলে তোমরা?

রোয়েন বলছেন, তোমার মধ্যে দয়া-মায়া বলে কিছু নেই, সারারাত তাকে হটিয়েছ।

নিকোলাস আসলে আপনাকে পঙ্গু বানাচ্ছে। দেখলাম তো, আপনাকে নিয়ে কী রকম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার কথা হলো, ওদের সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করতে হবে। মেয়েরা সেটা উপভোগ করে। তারপরই সিরিয়াস হয়ে উঠলো মেক। সত্যি দুঃখিত, রোয়েন। সীমান্ত মানেই হাজার রকম বিপদ। হোম গ্রাউন্ডে চলে এসেছি, এখন আর আমাকে আপনার অতোটা দানব বলে মনে হবে না।

রোয়েন বলল, ধ্যাত, আমরা তো আসলে আপনার প্রশংসা করছিলাম। সত্যি কৃতজ্ঞ বোধ করছি, মেক।

নিকোলাস আমার পুরানো বন্ধু না!

প্রসঙ্গ বদলে রোয়েন বলল, মঠে কি ঘটেছে টিসের কাছে খানিকটা শুনলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

রাগে দু হাত দিয়ে ধরে নিজের দাড়ি টানছে মেক। ওখানে যা ঘটেছে তার জন্য নগু আর তার টুপাররা দায়ি। ওরা পশুও অধম। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় আমরা কাদের বিরুদ্ধে লড়ছি। মেনজিসটুর নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলাম, তার জায়গায় নতুন একটা আতংখ ছড়িয়ে পড়লো।

ওখানে ঠিক কি ঘটেছে মেক?

ধীরে ধীরে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিল মেক, বলল কী কী লুঠ হয়েছে। ঘুমা যে দায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ন্যাসী যারা পালাতে পেরেছেন তারা সবাই তাকে চেনেন।

রাগে দাঁড়িয়ে পড়লো মেক। থরথর করে কাঁপছে সে। যে কোনো গোজামবাসীর কাছে ওই মঠ প্রাণের চেয়েও প্রিয়। আমি নিজে ধর্মকর্ম করি না, কিন্তু যারা করেন তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আছে। জালি হোরাকে আমি গুরুজন বলে মানতাম। প্রধান পুরোহিতকে খুন করে আমাকে খেপিয়ে তুলেছে ওরা। এর ফল ওদেরকে ভোগ করতে হবে। মাথায় ক্যাপ পরল সে। চলুন এবার রওনা হতে হয়। সামনের পথ অত্যন্ত দুর্গম।

*

সীমান্তে অনেকটা পেছনে ফেলে আসায় এখন দিনের বেলাও হাঁটা নিরাপদ। দ্বিতীয় দিনের পদযাত্রা ওদেরকে গিরিখাদের গভীরে পৌঁছে দিল। বড় পাহাড়ের সামনে যে ছোট পাহাড় থাকে, এখানে তেমন কিছু নেই–এ যেনো অকস্মাৎ মাথাচাড়া দেওয়া একটা বিশাল দুর্গে ঢুকে পড়া। দু দিকে পাহাড়ের স্তূপ বা গুচ্ছের পাঁচিল প্রায় চার হাজার ফুট ওপরের আকাশ ছুঁয়েছে, মাঝখানের গভীরতায় সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে নদীটা, দৈর্ঘ্যের যত দূর দেখা যায় আলোচন আর উচ্ছ্বাস, দ্রুতগতি স্রোত আর ঘূর্ণি সমস্ত পানিকে সাদা করে রেখেছে। দুপুরে নদীর ধারে ঝোঁপ আর গাছপালার নিচে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামার। অনুমতি দিল মেক। ওদের নিচে সৈকত, প্রকাণ্ড সব বোল্ডারের ছাড়াছড়ি। ওগুলো নিশ্চয়ই পাহাড়-প্রাচীরের গা বেয়ে গড়িয়ে নেমেছে।

সামান্য ব্যবধানে বসে আছে ওরা পাঁচজন। থিয়ডালাইট নিয়ে মেকের সঙ্গে ড্যানিয়েলের এ কষাকষি এখনো থামেনি। ড্যানিয়েল বেশি কথা না বলে নির্লিপ্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারী ইট্রুমেন্টার কাছাকাছি বসে আছে সে। মেক আর টিসে একদমই চুপচাপ। তবে হঠাৎ টিসে হাত লম্বা করে মেকের বাহু স্পর্শ করলো। ওদেরকে আমি জানাতে চাই, বলল সে।

উত্তর দেয়ার আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলো মেক, তারপর মাথা আঁকালো। অসুবিধে কি, বলল সে, কাঁধ ঝাঁকালো।

আমি চাই ওরা জানুক, আবার বলল টিসে। বোরিসকে ওরা চিনতেন। কাজেই বুঝবেন।

তুমি চাও আমি বলি? নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো মেক, টিসের একটা হাত ধরল।

হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকালো টিসে। তুমি বললেই ভালো হয়।

কিছুক্ষণ কথা বলল না মেক, নিজের চিন্তা-ভাবনা গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর যখন শুরু করলো, নিকোলাস রোয়েনের দিকে তাকালো না, তাকিয়ে থাকলো টিসের দিকে। এই মেয়েটার উপর প্রথম যখন আমার চোখ পড়লো, উপলব্ধি করলাম ওর আর আমার নিয়তি এক সুতোয় বাঁধা।

মেকের আরো গা ঘেঁষে বসলো টিসে।

টিসে আর আমি তিমকাত উৎসবের রাতে শপথ নিই এবং ঈশ্বরের ক্ষমা প্রার্থনা করি, তারপর আমি ওকে আমার মেয়েমানুষ হিসেবে গ্রহণ করি।

মেকের পেশীবহুল কাঁধে হাত রাখলো টিসে।

রাশিয়ান লোকটা আমাদের পিছু নিল। সে এখানটায় আমাদেরকে ধরে ফেলে, ঠিক এখন যেখানে বসে আছি। আমি তাকে আলোচনায় বসে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে বললাম। কিন্তু সে রাজি হলো না। তখন আমি বললাম, টিসে যদি স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়, আমি বাধা দিব না। সে বলল, টিসেকে চায় না, চায় ওর লাশ। তারপরই গুলি করলো সে, প্রথমে আমাকে লক্ষ্য করে, তারপর টিসেকে। কিন্তু সে জানত না, আড়াল থেকে তার উপর আমার লোকজন নজর রাখছিল।

ঘটনাটা স্মরণ করে শিউরে উঠলো টিসে।

বোরিস নিজের বোকামিতে মারা গেছে। তার লাশটা আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিই।

বোরিস যে মারা গেছে আমরা তা জানি, এ প্রথম কথা বলল রোয়েন। তারপর প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্য জিজ্ঞেস করলো, মঠে পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে আমাদের?

এখুনি রওনা হলে সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাব, বলল মেক।

*

মাই মেতাম্মা, সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের নব নির্বাচিত প্রধান পুরোহিত, মঠের চাতালে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর মাথায় রুপালি চুল, জালি হোরার চেয়ে বয়েস কিছু কম হবে, একহারা ও লম্বা। আজ তিনি বিশিষ্ট অতিথি অ্যাল্যান মেকের সম্মানে নীল মুকুটটা পরেছেন।

অতিথিদের জন্য আলাদা সেল বরাদ্দ করা হয়েছে, গোসলের পর সেখানে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল ওরা। তারপর সন্ন্যাসীরা এসে নিয়ে গেলেন ওদেরকে। খানাপিনার বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। তেজ-এর পাত্র তৃতীয়বার ভরার পর প্রধান পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের মন-মেজাজ হালকা ও নরম হয়ে উঠলো, লক্ষ্য করে মাই মেতাম্মার কানে ফিসফিস করলো মেক।

সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের ইতিহাস নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে-ঝড়-বিক্ষুব্ধ সাগর থেকে কীভাবে ঈশ্বর তাঁকে আমাদের তীরে তুলে দিলেন, তিনি যাতে আমাদের সত্যিকার ঈমানদার হতে সাহায্য করতে পারেন?

প্রধান পুরোহিতের চোখ পানিতে ভরে উঠলো। তার পবিত্র শরীর, এখানে সমাধিস্থ করা হয়, আমাদের মাকডাসে। বর্বররা এলো, আমাদের ধর্মীয় ঐশ্বর্য লুঠ করে নিয়ে গেল। আমরা পিতৃহীন বালকে পরিণত হয়েছি। এখন আর পূণ্য অর্জনের জন্য ইথিওপিয়ার প্রতিটি প্রান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা এখানে আসবে না। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। এ মঠ ধ্বংস হয়ে যাবে। সন্ন্যাসীরা চলে যাবে ঝরে পড়া পাতার মতো।

সেইন্ট ফুমেনটিয়াস যখন ইথিওপিয়ায় আসেন, একা আসেন নি। বাইজানটিয়াম চার্চ থেকে তার সঙ্গে আরো একজন খ্রিস্টান এসেছিলেন, নরম সুরে তাকে মনে করিয়ে দিল মেক।

সেইন্ট অ্যান্টোনিয়া, তেজ পাত্র থেকে আরো এক ঢোক পান করলেন প্রধান। পুরোহিত।

সেইন্ট অ্যান্টোনিয়া, সায় দিল মেক। সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের আগেই তিনি মারা যান। তবে তিনি তার ভাইয়ের চেয়ে কম পবিত্র ছিলেন না।

অবশ্যই তিনি অতি পবিত্র এবং মহান সেইন্ট ছিলেন, আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা তার প্রাপ্য, বলে আরো এক ঢোক তেজ পান করলেন মাই মেতাম্মা।

ঈশ্বরের চাল বড়ই রহস্যময়, নয় কি? সবিস্ময়ে মাথা নাড়লো মেক।

তার পথ অত্যন্ত গভীর, আমাদের বুঝতে চাওয়ার বা প্রশ্ন তোলার কোনো অধিকার নেই।

তবে তিনি করুণাময় এবং বিশ্বাসীদের পুরস্কৃত করেন। তিনি পরম করুণাময়, ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন প্রধান পুরোহিত।

আপনারা, আপনাদের মঠ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বলল মেক। সেইন্ট ফুমেনটিয়াসকে লুঠ করে নিয়ে গেছে ওরা-হায়, তা আর কোনোদিন উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিন্তু ঈশ্বর যদি আরেকজনকে পাঠান, তাহলে কেমন হয়? তিনি যদি আপনাদেরকে সেইন্ট অ্যান্টোনিয়ার শরীর পাঠিয়ে দেন, তখন আপনারা কী করবেন?–ভেজা চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, মনে হলো প্রধান পুরোহিত একটা হিসাব মেলাবার চেষ্টা করছেন। সেটা হবে সত্যিকার একটা মিরাকল।

বৃদ্ধ প্রধান পুরোহিতের কাঁধে একটা হাত রেখে নরম সুরে ফিসফিস করলো মেক, কান্না থামিয়ে গভীর মনোযোগর সঙ্গে তার কথা শুনছেন মাই মেতাম্মা।

*

শ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে, পরদিন সকালে উপত্যকার ঢাল বেয়ে ওঠার সময় নিকোলাসকে বলল মেক। মাই মেতাম্মা কথা দিয়েছেন দুদিনের মধ্যে একশো লোক যোগাড় করে দেবেন। আরো পাঁচশো দেবেন আগামী সপ্তাহ। দূর দূরান্তের খ্রিস্টান গ্রামগুলোর খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন উনি, বাঁধ তৈরির কাজে সাহায্য করলে নরকের আজাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, কারণ এ বাঁধ তৈরির মাধ্যমে উদ্ধার হবে সেইন্ট অ্যান্টোনিয়ার পবিত্র দেহাবশেষ।

দুই মেয়েই ঢালের উপর দাঁড়িয়ে পড়লো।

বেচারা বুড়ো মানুষটাকে এসব বলে লোভ দেখিয়েছ তুমি? জিজ্ঞেস করলো টিসে।

সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের বদলে অন্য একজন সেইন্টের দেহ। আমরা যদি সমাধিটা খুঁজে পাই, মঠের পাওনা হবে মামোসের মমি।

কাজটা অত্যন্ত নিচ হয়েছে, বিস্ফোরিত হলো রোয়েন। সাহায্য পাবার বিনিময়ে আপনি তাকে চিট করবেন?

কেন, চিট করা হবে কেন?

অভিযোগ শুনে রেগে গেল মেক। কোনো প্রমাণ নেই যে ওটা আসলেই সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের লাশ ছিল। অথচ তারপরও কয়েকশো বছর ধরে এলাকার খ্রিস্টানদের ঐক্যবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্য পূরণ করছিল, গোটা ইথিওপিয়ার তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করছিল, উৎসাহ দিচ্ছিল ভক্তবৃন্দকে সন্ন্যাসী হতে। এখন সেটা লুঠ হয়ে যাওয়ায় মঠের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

তাই আপনি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেবেন? রোয়েন এখনো রেগে আছে।

ওঁরা যেটা হারিয়েছেন সেটার চেয়ে কোনো অংশে মামোসের লাশ কম অথেনটিক নয়। প্রাচীন খ্রিশ্চানের লাশের বদলে প্রাচীন মিশরীয়র লাশ হলে কী আসে যায়, যদি সবগুলো উদ্দেশ্য সেটা পূরণ করতে পারে এবং আরো পাঁচশো বছর টিতে থাকতে পারে মঠটা? নিকোলাসের দিকে ফিরলো মেক। তুমি কি বলো, নিকোলাস?

ধর্মীয় ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না, বলল নিকোলাস। তবে মনে হচ্ছে মেকের কথায় খানিকটা বোধহয় যুক্তি আছে।

খ্রিশ্চানিটি সম্পর্কে আপনি আবার কবে থেকে এক্সপার্ট হলেন? আপনি তো, আমি যতদূর জানি, অজ্ঞেয়বাদী।

সত্যিই তো, ওসব সম্বন্ধে আমি আর কী জানি। আপনি বরঞ্চ মেকের সঙ্গে আলাপ করুন, বলে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাতজোড়া করে উঠে দাঁড়ালো নিকোলাস। আমি বরং স্যাপার ওয়েবের সঙ্গে বাঁধটা নিয়ে আলোচনা করি। হন হন করে এগিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের পাশে চলে এলো, লাইনের একেবারে মাথায়।

পেছন থেকে মাঝে মধ্যেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। নিকোলাসের কানে। আপনমনে হাসলো ও। মেককে ওর চেনা আছে, নতুন করে চেনা হচ্ছে রোয়েনকে। ওদের মধ্যে কে জেতে দেখার খুব আগ্রহ জাগলো।

*

মাঝ দুপুরে গহ্বরের মাথায় পৌঁছল ওরা। ক্যাম্প ফেলার জন্য জায়গা খুঁজছে মেক, মারটনকে নিয়ে নদীর সরু গলায় চলে এলো নিকোলাস, ঠিক নদী যেখানে জলপ্রপাতে পরিণত হয়ে নিচে লাফ দিয়েছে, তার ওপরে। থিয়ডালাইট সেট করার পর হাত ইশারায় নিকোলাসকে লেভেলিং স্টাফ নিয়ে পাহাড়-প্রাচীরে ওঠা নামা করতে বলল ড্যানিয়েল, সারাক্ষণ থিয়ডালাইটের লেন্সে চোখ। ওঠা নামা করার সময় লেভেলিং স্টাফটা খাড়া রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে নিকোলাস।

ঠিক আছে, হাঁক ছাড়লো ড্যানিয়েল, বিশটা শট নেয়ার পর। এবার তুমি নদীর ওপারে চলে যাও।

কী বলে! কীভাবে যাব? সাঁতরে, নাকি উড়ে?

উজানের দিকে তিন মাইল হাঁটতে হলো নিকোলাসকে, ট্রেইরটা যেখানে অগভীর ডানডেরা নদীর উপর দিয়ে ওপারে পৌঁছেছে। ওপারে পৌঁছে কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে হলো ওকে, থামলো অপর পাড়ে বসে যেখানে ড্যানিয়েল সিগারেট ফুকছে। ফুসফুসে ক্যান্সার বাধিয়ো না, কেমন? পানির এদিক থেকে চিৎকার করে বলল নিকোলাস।

প্রয়োজনীয় শট নিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফেরার জন্য আবার নদীর অগভীর অংশটুকু পার হতে হলো নিকোলাসকে। শেষ এক মাইল প্রায় গাঢ় অন্ধকারে হাঁটতে হলো ওকে, তবে পথ দেখালো ক্যাম্পসাইটের কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট আলো। ক্যাম্পে পৌঁছে লেভেলিং স্টাফটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এতো খাটালে, ফলটা ফেলে দিল?

স্লাইড রুল থেকে চোখ তুললাম না ড্যানিয়েল। লণ্ঠনের আলোয় ড্রইংগুলো স্টাডি করছে সে, কিছু রদবদলও করছে। তোমার আনুমানিক হিসাব প্রায় নির্ভুলই বলতে হবে, এক সময় মুখ তুলে বলল সে। জলপ্রপাতের উপর ক্রিটিক্যাল পয়েন্টে নদীটা একচল্লিশ গজ চওড়া, যেখানে আমি স্ট্রাকচারটা খাড়া করতে চাই।

আমি শুধু জানতে চাই ওখানে একটা বাঁধ তৈরি করা সম্ভব কিনা।

নাকের পাশে আঙুল ঘষলো ড্যানিয়েল, হাসছে। তুমি আমাকে আমার লাল ফ্রন্ট-এন্ডার এনে দাও, আমি নীলনদকেও বাঁধতে পারব।

*

রাত একটু বেশি হতে আগুনের ধারে বসে সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া সারলো। ক্যাম্পফায়ারের দিক থেকে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন, চোখাচোখি হতে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। কয়েক সেকেন্ড পর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাম্প এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, একবার পেছন ফিরে দেখে নিল নিকোলাস ওকে অনুসরণ করছে কিনা। পাশে চলে এসে টর্চ জালল নিকোলাস, দু জন ফিরে এলো আবার ড্যাম সাইটে, বসলো একটা বোন্ডারের উপর।

টর্চ নিভিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকলো ওরা, চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে তারার আলোয় এখন অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। নিস্তব্ধতা ভাঙলো রোয়েন, খুব নিচু গলায় কথা বলছে, গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে, জানেন। ভেবেছিলাম আর বোধহয় কোনোদিন এখানে আমাদের ফিরে আসা হবে না।

মেক আর প্রধান পুরোহিত সাহায্য না করলে ব্যাপারটা সম্ভব হত না।

মেক আর আপনিই জিতলেন, ক্ষীণ হাসির শব্দ রোয়েনের গলায়। হ্যাঁ, সন্ন্যাসীদের সাহায্য আমাদের দরকার। স্বীকার করছি, মেকের সঙ্গে তর্কে পারা সম্ভব নয়।

তার মানে পুরস্কার হিসেবে ওদেরকে মামোসের মমি দিতে আপনার কোনো আপত্তি নেই?

যে মমিই পাই, আদৌ যদি পাই, বলল রোয়েন। আমরা যতো দূর জানি, আসল মামোসের মমিটা চুরি করে নিয়ে গেছেন কর্নেল নগু।

খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রোয়েনের কাঁধটা এক হাতে জড়িয়ে ধরলো নিকোলাস। কিন্তু রোয়েন ব্যাপারটাকে ঠিক সহজভাবে নিল না। আড়ষ্ট হয়ে গেল শরীর। তবে কিছু বলল না, হাতটাও সরিয়ে দিল না, খানিক পর বরং একটু পর ঢিল পড়লো পেশীতে।

ওহ, নিকোলাস, আমার যেমন ভয় লাগছে তেমনি উত্তেজিত হয়ে আছি। ভয় লাগছে এ ভেবে যে আমাদের আশা হয়তো পূরণ হবে না। আর উত্তেজিত হয়ে আছি এ আশায় যে টাইটার সঙ্গে খেলাটায় আমরাই জিতব। মুখ ফেরালে ওর নিঃশ্বাস অনুভব করলো নিকোলাস নিজের ঠোঁটে।

রোয়েনকে চুমো খেলো ও, আলতোভাবে, ফুলের স্পর্শের মতো আলতো। এরপর, ধীরে ঠোঁট সরিয়ে পরখ করে দেখলো মেয়েটার মুখ। সরে যাবার কোনো চেষ্টা নেই রোয়েনের অবয়বে, বরঞ্চ একটু এগিয়ে পাল্টা চুমো খেলো ও, নিকিকে। প্রথম চুমোটা হলো স্নেহ-পরবশ–বোনসুলভ, রোয়েনের দু ঠোঁটের পাঁচিল শক্ত করে সেঁটে আছে পরস্পর। এক হাত উপরে নিয়ে এসে তার মাথার পেছনের চুলে ধরলো নিকি, ধরে রাখলো রোয়েনের মুখ, ওর সামনে। প্রবল, সর্বগ্রাসী চুমো খেলো এবারে–রোয়েনের বদ্ধ ঠোঁটের উপর চেপে বসলো ওর ঠোঁট জোড়া।

ধীরে, সুস্বাদু কোনো চকোলেটের মতোই রোয়েনের ঠোঁটজোড়ার বাঁধন আলগা করে ক্রমশই ভেতরে ঢুকে পড়ছে নিকোলাস, জিভ দিয়ে পরখ করছে যেনো মিষ্টি স্বাদ। নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠলো মেয়েটা, ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো নিকোলাসকে। দু হাতে আঁকড়ে ধরে রইলো নিকির শরীর, দারুণ সাড়া দিচ্ছে ওর চুমোর। দুটো জিভ এখন পরস্পরের সান্নিধ্যে।

জোড়া দেহের মাঝখানে চোরের মতো উঠে এলো নিকোলাসের এক হাত; ধীরে ধীরে খুলে ফেলছে রোয়েনের শার্টের সামনের বোতামগুলো একদম কোমড়ের বেল্ট পর্যন্ত। ওর আলিঙ্গনে একটু সরে বসে কাজটা সহজ করে দিল রোয়েন। পাতলা, সুতির শার্টের নিচে তার উদ্ধত বুকজোড়া একেবারে নগ্ন বিষয়টা অদ্ভুত সুখ এনে দিল নিকোলাসকে। এক হাতে ও দুটোর একটাকে ধরলো ও, ছোট্ট, কিন্তু দৃঢ়, ওর মুঠো পুরোটা ভরলো কেবল। দুই আঙুলে অনুভব করে দেখলো সে বৃন্তটা; পাকা ছোট্ট স্ট্রবেরির মতো দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটা।

চুমো ভেঙে, মুখটা রোয়েনের নরম বুকে ডুবিয়ে দিল নিকোলাস। নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠে ওকে যেনো স্বাগত জানাচ্ছে মেয়েটা। একটা বৃন্তে নিকোলাসের ঠোঁটের স্পর্শে পরম সুখে শ্বাস আটকে আসতে চাইলো রোয়েনের, ওর আঙুলের লম্বা নখগুলো ডেবে গেছে দয়িতের পিঠের গভীরে। পুরুষসঙ্গীর দৃঢ় আলিঙ্গনের ভেতর নিজে থেকে আগুপিছু দুলছে রোয়েন; কিন্তু একটু পরই, ঠোঁট সরিয়ে নিল সে। নিকোলাস ভাবলো, ও হয়তো আমাকে প্রত্যাখ্যান করছে। পরমুহূর্তেই নিকোলাসের চুল খামচে ধরে আরেকটা বুক বাড়িয়ে ধরলো সে, ওর ঠোঁটের সামনে। এবারেও, নিকোলাসের তৃষ্ণার্ত টানার সময় কেঁপে কেঁপে উঠলো তার শরীর।

ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে উঠছে রোয়েনের নড়াচড়াগুলো। আর অপেক্ষা করতে পারছে না নিকোলাস–এক হাত রোয়েনের খাকি স্কার্টের নিচে দিয়ে নরম পাপড়ির উপর রাখল ও। হঠাৎই, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো রোয়েন। দ্রুত হাতে স্কার্ট সমান করে, লাগিয়ে ফেললো শার্টের বোতাম।

আমি আমি খুব দুঃখিত, নিকি! আমি সত্যি চাই অনেক বেশি করে চাই-কিন্তু বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বুকের আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। কিন্তু এখন না! এখনই না! দুটা দুনিয়ার মধ্যে পরে গেছি আমি, নিকি! আমায় ক্ষমা করো! একটা অংশ তোমাকে চায় ওহ, খুব করে চায় কিন্তু আমার অন্য অংশটা যে বাধা দেয়!

উঠে দাঁড়িয়ে, কেতাদুরস্ত চুমো খেল নিকোলাস। তাড়াহুঁড়োর কিছু নেই, হুঁ? সবুরে যেনো কী ফলে? এখন চলুন, আপনাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাই!

*

পরদিন ভোরে আলো ভালো করে ফোঁটার আগেই মাই মেতাম্মার প্রতিশ্রুতি অনুসারে সন্ন্যাসীদের প্রথম দলটা উপত্যকা বেয়ে উঠে এলো। এক লাইনের একটা মিছিল, সন্ন্যাসীরা সবাই তরুণ, সবার পরনে সাদা আলখেল্লা, সুর করে গান করতে করতে আসছে।

কী সর্বনাশ! অকারণে হাসি পাচ্ছে নিকোলাসের। আবার না ক্রুসেড বেঁধে যায়।

ডাকাডাকি করে টিসেকে খুঁজলো নিকোলাস, সে কাছে আসার পর বলল, অনুবাদক হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হলো তোমাকে। ড্যানিয়েল অ্যামহ্যারিক বা আরবীর একটা বর্ণও জানে না, কাজেই ওর কাছাকাছি থাকতে হবে তোমাকে।

ঠিক আছে, নিকি।

দিনের আলো আরো উজ্জ্বল হতে মেককে নিয়ে ড্রপ সাইট দেখতে বের হলো নিকোলাস। দুপুরের দিকে সিদ্ধান্তে এলো, উপত্যকাটাই ব্যবহার করতে হবে। ওদেরকে ঘিরে পাথুরে যে রিজগুলো দাঁড়িয়ে আছে তার তুলনায় উপত্যকার মেঝেই বেশি সমতল, বাধা-বিঘ্নও কম। তাছাড়া, প্লেন থেকে জিনিসগুলো ফেলা দরকার বাঁধ এলাকার যতোটা সম্ভম কাছাকাছি।

পরদিন সকালে নির্বাচিত সাইটে দাঁড়িয়ে মেককে নিকোলাস বলল, টাইম একটা মেজর ফ্যাক্টর। প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে বর্ষা।

আকাশের দিকে তাকালো মেক। সন্ন্যাসীদের ধরলে ওরা দেরিতে বর্ষা শুরু করার জন্য প্রার্থনায় বসবে।

ড্রপ শুরু করার আগে প্লেন নিয়ে পাঁচ মাইল সোজা এগিয়ে আসার মতো উন্মুক্ত আকাশ পাবেন জেনি। ফ্লেয়ার আর মার্কার গতকালই কিছু কিছু বসানো হয়েছে, আজ সেগুলো চেক করলো ওরা। উপত্যকার মাথায় রয়েছে ড্যানিয়েল, আকাশের গায়ে তার নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে স্মোক ফ্লেয়ার সেট করছে সে। ঘাড় ফিরিয়ে উল্টো দিকে তাকালো নিকোলাস, উপত্যকার দূর প্রান্তে একটা পাথরের উপর বসে রয়েছে ড্যানিয়েল। মেকের লোকজন এখনো মার্কার বসানোর কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারে নি, তবে জানিয়েছে আর বেশি সময় নিবে না।

সব কিছু সুষ্ঠুভাবেই ঘটলো। ঘড়ির কাঁটা ধরে উড়ে এলো জেনি বাদেনহোর্সটের প্রকাণ্ড হারকিউলিস। মোট ছয় বার উপত্যকার উপর দিয়ে উড়ে গেলেন তিনি, প্রতিবার চারটে করে ভারী ও চৌকো বাক্স ফেললেন নিচে। বাতাসে ভর করে প্যারাস্যুটগুলো উপত্যকার নানাদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আগেই নির্দেশ দেওয়া আছে, দল বেঁধে ছুটলো তরুণ সন্ন্যাসীরা, বাক্সগুলো ধরা ধরি করে তুলে আনবে। নিকোলাস, মেক আর মানটিন আলোচনা করে আগেই ঠিক করে রেখেছে ক্যাম্পের কোথায় কী রাখা হবে। প্রতিটি বাক্সে নম্বর দেওয়া আছে, নম্বর দেখে বোঝা যাবে কোনটায় কী আছে। এক নম্বর বাক্সে আছে শুকনো খাবার, ওদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট, মশারিসহ; মেককে খুশি করার জন্যে কয়েক বোতল হুইস্কিও আনা হয়েছে। এ বাক্সটার দায়িত্বে নিকোলাস নিজে থাকলো।

নির্মাণ সামগ্রী আর হেভি ইকুইপমেন্টের দায়িত্ব থাকলো ড্যানিয়েলের উপর। তার নির্দেশ অনুবাদ করছে টিসে, সন্ন্যাসীরা বাক্সটা বয়ে নিচে যাচ্ছে প্রাচীন পাথরখনিতে।

রাত হয়ে গেল, অথচ অর্ধেক বাক্সও উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি, যেখানে পড়েছে সেখানেই পড়ে থাকলো। সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করলো মেক, কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে।

পরদিন আবার হারকিউলিস নিয়ে ফিরে এলেন জেনি। এবার তিনি রোজিরেস থেকে কার্গো তুলে এনেছেন। সব বাক্স উপত্যকা থেকে তুলে আনতে আরো দুটো দিন লেগে গেল। প্রায় সবই জমা করা হলো প্রাচীন পাথরখনিতে, বাক্স খোলর পর জিনিসগুলো এমনভাবে সাজানো হলো যাতে যেটা যখন দরকার চাইলেই পাওয়া যাবে।

এ কয় দিন কাজ করার সময় সন্ন্যাসীদের উপর নজর ছিল নিকোলাসের, কয়েকজনের পরিচয় আলাদাভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। এদের মধ্যে কারো কারো রয়েছে নেতৃত্ব দেয়ার গুণ। দু একজন আরবি ও অল্পস্বল্প ইংরেজি জানে। তাদের মধ্যে একজন হানশিত শেরিফ। নিকোলাস তাকে সহকারি হিসেবে বেছে নিল, দোভাষীর কাজও চালানো যাবে।

ক্যাম্প গুছিয়ে নেয়ার পর কাজ ভাগাভাগির পালা। রোয়েন আর টিসের কাছ থেকে নিকোলাসকে দূরে সরিয়ে এনে মেক বলল, এখন থেকে আমার কাজ হবে সাইটের সিকিউরিটি রক্ষা করা। তৃতীয়বার হামলা করতে পারে নগু, কাজেই প্রস্তুত থাকা দরকার। তোমরা যে খাদে ফিরে এসেছ, এ খবর পেতে দেরি হবে না তার।

শাবলের চেয়ে একে-ফরটিসেভেনই মানাবে তোমার হাতে, সায় দিল নিকোলাস। তবে টিসেকে এখানে রেখে যাও। ওকে আমার দরকার।

তা থাকুক, তবে আশা করব ওর উপর নজর রাখবে তুমি। রাতে এসে একবার করে দেখে যাব আমি।

নিজের লোকজনকে ডিফেন্সিভ পজিশনে পাঠিয়ে দিল মেক। ট্রেইলের অনেক দূর পর্যন্ত থাকলো তারা, ক্যাম্পের চারধারেও পজিশন নিল। কাজ থেকে মুখ তুলে তাকালে নিকোলাস তাদের দু একজনকে উঁচু জমিনের মাথায় নড়তে চড়তে দেখতে পায়।

সেই থেকে রোজ রাতে ক্যাম্পে এসে টিসের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে মেক। কোনো কোনো গভীর রাতে টিসের তাঁবু থেকে তার ভরাট গলার উল্লাসধ্বনি ভেসে আসে, তার সঙ্গে মিশে থাকে টিসের জলতরঙ্গ হাসি। তখন রোয়েনের কথা মনে পড়ে যায় নিকোলাসের। পাশের তাঁবুতেই রয়েছে মেয়েটা, অথচ কত দূরে।

৬. পঞ্চম দিনে তিনশো শ্রমিক

পঞ্চম দিনে তিনশো শ্রমিক পাঠালেন মাই মেতাম্মা। এরা কেউই সন্ন্যাসী নয়, পাহাড়ী গ্রামগুলোর তরুণ অধিবাসী। সবাইকে নিয়ে দল গঠন করা হলো, প্রতি দলে থাকলো ত্রিশজন শ্রমিক। দলের নেতা নির্বাচন করা হলো একজন সন্ন্যাসীকে। বাঘ, সিংহ, মৌমাছি-এভাবে রাখা হলো দলের নাম। স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এসেছে সবাই, একঘেয়ে লাগলেই পালাবে। তাই পারিশ্রমিক দেয়ার কথা ঘোষণা করলো নিকোলাস, কাজের বিনিময়ে সবাইকে রূপালি ডলার, অর্থাৎ মারিয়া থেরেসা দেওয়া হবে। একটা লোহার সিন্দুকে ভরে এ ডলার প্রচুর পরিমাণে নিয়েও এসেছে নিকোলাস।

ফ্রন্ট-এন্ডারের উঁচু সিটে বসে কলকাঠি নাড়লো ড্যানিয়েল, ট্র্যাক্টরের হাইড্রলিক বাহু তুলে নিল তারের জাল দিয়ে তৈরি প্রথম গ্যাবিয়ন। বোল্ডর ভর্তি পার্সেল, ওজন হবে কয়েক টন। সবাই যে যার কাজ ফেলে ডানডেরা নদীর কিনারায় জুড়ো হয়েছে দেখার জন্য। হলুদ ট্রাক্টর নিয়ে খাড়া পাড় বেয়ে সাবধানে নেমে যাচ্ছে ড্যানিয়েল, বিস্ময়সূচক গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। গ্যাবিয়ন শূন্যে ঝুলছে, নদীতে নেমে এলে ট্র্যাক্টর। বাধা পেয়ে খেপে উঠলো নদীর স্রোত, পেছনের চাকার চারপাশে ফণা তুলছে! কিছুই গ্রাহ্য করছে না ড্যানিয়েল, নদীর আরো গভীরে নেমে যাচ্ছে সে।

মেশিনার পেট ডুবে গেল পানিতে। সন্ন্যাসীরা গান ধরল, বাকি সবাই তালি দিচ্ছে। মেশিন লক করে ব্রেক কষলো ড্যানিয়েল, ভারী গ্যাবিয়ন নিচে নামিয়ে এনে খালাস করলো পানিতে, তারপর পিছিয়ে আনছে ট্র্যাক্টর। গ্যাবিয়ন সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গেছে, তবে ছোট একটা ঘূর্ণি ওটার অবস্থান চিহ্নিত করছে। নদীর কিনারায় আরেকটা গ্যাবিয়ন তৈরি রাখা হয়েছে, হাইড্রলিক বাহু তুলে নিল সেটাকে।

চিৎকার করে শ্রমিদের কাজে ফিরতে বলল নিকোলাস। উপত্যকা ধরে এক লাইনে উঠতে শুরু করলো তারা। নিকোলাসের নির্দেশে কাজের সময় তারা শুধু ল্যাঙট বা নেংটি পরে আছ। প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘামছে সবাই, কয়লার মতো কালো চামড়া চকচক করছে।

পাথরখনি থেকে পাথর বয়ে আসতে হচ্ছে নদীর কিনারায়, ওখানে তারের জালে ভরা হচ্ছে গ্যাবিয়ন।

*

যতোই কিনা ডলারের লোভ বা মারের ভয় দেখাও, সন্ন্যাসীরা কেউ রোববারে কাজ করবে না। রোববারে সারাদিন ঘুমোবে তারা। এর প্রস্তুতি হিসেবে প্রতি শনিবারে আগে ভাগেই কাজকর্ম শেষ করে ফেলে।

তো, শনিবার রাতে যখন সব কয়টা ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছে, নিকোলাসের চোখে কোনো ক্লান্তি নেই। কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না সে। শেষমেষ, একা একাই বাধের এলাকাটা দেখে এলো সে। ফিরে এসে দেখে, পুরোদস্তুর কাপড়-চোপড় পরে বসে আছে রোয়েন–তারও ঘুম আসে না।

কফি? আগুনের ধার থেকে নিকোলাসের জন্য কাপে কফি ঢাললো ও।

গতরাতে আমারও ঘুম হয় নি, স্বীকার গেল রোয়েন। একদম বাজে একটা স্বপন দেখেছি। একবার দেখলাম, মামোসের সমাধিতে গোলকধাঁধার মধ্যে হারিয়ে গেছি। সমাধি প্রকোষ্ঠ খুঁজছি-, একের পর এক দরজা খুলছি কিন্তু প্রতিটি কক্ষেই মানুষজন। একটা কক্ষে কাজ করছিল ডুরেঈদ–আমি দেখলাম–ও আমার উদ্দেশ্যে বলছে, চার ষাঁড়ের চাল মনে আছে তো? শুরু থেকে ওই নিয়মে খেলবে! এতো জীবন্ত, এতো সত্যি! আমি খুব চাইছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথেই বুঝলাম, ওকে আর কোনোদিনও

দেখতে পাবো না! ক্যাম্পফায়ারের আলোয় মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে। রোয়েনের চোখের পানি।

এমন বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতা থেকে ওর এ সরিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে নিকোলাস বলল, অন্যান্য কক্ষে কাদের দেখলেন?

পরের রুমে ছিলেন নাহুত গাদ্দাবি। খুশির হাসি হেসে, তিনি বললেন, শিয়াল ধাওয়া করছে সূর্যকে! সাথে সাথে, তার চেহারা পাল্টে হয়ে গেল শিয়াল দেবতা আনুবিস–সমাধি দেব। এমন ডাকাডাকি শুরু করলো, ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম আমি।

নীরবে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে ওরা। শেষমেষ, রোয়েন বলে উঠলো, জানি, এ সবই উঠলোতু–অর্থহীন। কিন্তু পরের রুমে ফন শিলার ছিলেন। তিনি আকাশে উড়ে, ডানা ঝাঁপটে বললেন, পাখা মেলেছে শকুন, আর পতন ঘটছে অতিকায় পাথরের। ঘৃণায় ইচ্ছে হলো তাকে আঘাত করি, কিন্তু তা করার আগেই পালিয়ে গেল যে!

এরপর আপনি জেগে গেলেন? নিকোলাস বলে।

না। আরো একটা কক্ষ দেখেছি স্বপ্নে।

এবারে কে ছিল? চোখ নামিয়ে নিল রোয়েন, মৃদুস্বরে বলল, আপনি ছিলেন।

আমি? বলেন কি?

কিন্তু আপনি কিছু বলেন নি। বলে, লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো রোয়েন। দারুণ মজা পেল নিকোলাস।

কী করলাম আমি তখন?

কিছু না। মানে আপনাকে তা বলতে পারবো না। রোয়েনের চোখের সামনে এখনো ভাসছে দৃশ্যগুলো একেবারে জীবন্ত। নিকোলাসের সুঠাম-নগ্ন শরীরের সৌন্দর্য, গন্ধ–সব এসে যেনো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো ওকে।

আরে, বলুনই না! কি করছিলাম? নিকোলাস শুনেই ছাড়বে!

না! দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে চট করে উঠে দাঁড়ায় রোয়েন, লজ্জায় মুখ লাল। এ প্রথম স্বপ্নে কাউকে ওমন করে দেখলো ও। অনুভব করলো চরম পুলক। ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে রোয়েন আবিষ্কার করেছে, ওর পাজামার নিচটা ভিজে গেছে।

আমাদের সামনে পুরো এক দিনের কাজ! এ কথাটাই মাথায় এলো মেয়েটার।

হ্যাঁ। এখান থেকে বের হবার উপায় খুঁজে পেতে হবে আমাদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস বলে।

*

প্রথম কয়েকদিন কাজের কোনো অগ্রগতি খালি চোখে ধরা পড়লো না। জালে আটকানো যতো বোল্ডারই ফেলা হলো সব বেমালুম হজম করে ফেলছে ডানডেরা। তারপর অবশ্য ধীরে ধীরে উঁচু হতে শুরু করলো বাঁধ। অমনি কাজের উৎসাহ বেড়ে গেল সবার। আরো দু দিন পর নদীর এদিক থেকে পানিতে বোল্ডার ফেলা অসম্ভব মনে হলো, এবার কাজ শুরু করতে হবে নদীর উপর থেকে।

শ্রমিকদের ঘন ঘন আসা-যাওয়ায় ডানডেরার অগভীর পয়েন্ট পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল। ট্যাক্টরটাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওপারে, একশো লোক রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে গেছে। ওখান থেকে ড্যাম সাইটে আসার জন্য আরো একটা পথ তৈরি করতে হলো। তারপর থেকে প্রতিদিন কয়েক মিটার করে লম্বা হচ্ছে বাঁধটা, মাঝখানের ফাঁক ক্রমশ সরু হয়ে আসছে।

ওদিকে বাফেলল আর হাতি–শ্রমিকদের দুটো দল, ড্যাম সাইট থেকে দুশো : মিটার দূরে কঠিন পরিশ্রম করছে। জঙ্গল থেকে কেটে আনা গাছের কাণ্ড দিয়ে খেলনা তৈরি করছে তারা। গাছের কাণ্ড পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে হেভি পিভিসি দিয়ে মোড়া হচ্ছে, ওয়াটারপ্রুফ করার জন্য। কাঠামোটার উপর চাপানো হচ্ছে একই আকৃতির আরো একটা কাঠামো। দৈত্যকার একটা স্যান্ডউইচ তৈরি হলো, বাঁধা হলো মোটা তার দিয়ে। সবশেষে জোড়া লাগানো কাঠামোর একপ্রান্তে বোল্ডার ভরে ব্যালাস্ট তৈরি করা হলো। ভেলার একটা দিক ভারী করতে চেয়েছে ড্যানিয়েল, ওটা যাতে পানিতে প্রায় খাড়াভাবে ভেসে থাকে-একটা প্রান্ত নদীর তলায় আঁচড় কাটবে, অপরপ্রান্তটা ভেসে থাকবে সারফেসের উপর। এ ভেলা বাঁধের দুই বাহুর মাঝখানের ফাঁকে আলম্ব বা ঠেকনা হিসেবে কাজ করবে।

হাতি, মোষ আর গণ্ডার, এ তিনটে দল উপত্যকার মাথায় মাটি খুঁড়ে একটা খাল তৈরি করছে; নদী দিক বদলে ওই খালে ঢুকবে।

পনেরো দিনের দিন তৈরি হয়ে গেল বাঁধ। সেদিনই নতুন কাটা খাল বেয়ে ছুটলো ডানডেরা, কিছুদূর গিয়ে ছড়িয়ে পড়লো গোটা উপত্যকায়।

খালের পাড় ধরে রোয়েনকে নিয়ে হাঁটছে নিকোলাস, লম্বা উপত্যকার পুরোটা দৈর্ঘ্য পেরিয়ে এলো ওরা। অবশেষে সেই প্রবাহটার কাছে পৌঁছল দু জন, যে ঝরনার মেরের সঙ্গে এসেছিল ওরা-তামের হাত লম্বা করায় আঙুলে এসে বসেছিল রঙিন প্রজাপতি। পাড়ে এসে দাঁড়ালো ওরা, তারপর কথা না বলে পরস্পরের দিকে তাকালো। প্রবাহটা নেই, শুকিয়ে গেছে।

ঘুরে গিয়ে খালি ঝরনার তলা অনুসরণ করলো ওরা, ঢাল বেয়ে উঠছে। খানিক দূর ওঠার পর একটা কার্নিসে পৌঁছল, প্রজাপতি ঝরনার এখান থেকেই নির্গত হতো। গুহাটা এখনো গাঢ় সবুজ লতা গুল্মে ভরে আছে, তবে এখন দেখতে হয়েছে কঙ্কালের খুলির অক্ষিগোলকের মতো, অন্ধকার ও খালি।

ঝরনা শুকিয়ে গেছে! ফিসফিস করলো রোয়েন, নিকোলাসের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বাধ তৈরি হওয়ার ফলে পানির সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় টাইটার পুল থেকেই এখানে পানি আসছিল!

আসুন, উত্তেজনায় রোয়েনের একটা হাত চেপে ধরলো নিকোলাস। এখানে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

কোথায়? রোয়েন অবাক। নিকোলাসের আরো কাছে সরে এলো ও।

কোথায় আবার, টাইটার পুলে। ফিসফিস করলো নিকোলাস।

*

টাইটার পুলে প্রথমে নামলো নিকোলাস। পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে নিচে নামার জন্য এবার চওড়া কপিকল ব্যবহার করা হচ্ছে, দোলনার মতো দেখতে রশির শেষ প্রান্তে কাঠের চেয়ার সহ। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে ফুলে থাকা ঝুল পাথরটাকে এড়াবার সময় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দুলতে শুরু করলো চেয়ার, পাঁচিল আর চেয়ারের মাঝখানে আটকা পড়লো ওর ডান হাতটা। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো নিকোলাস, হাতটা ছাড়িয়ে আনার পর দেখলো একটা আঙুলের গিটের চামড়া উঠে গেছে, টপ টপ করে রক্ত ঝরছে ক্ষতটা থেকে। জখমটা তেমন গুরুতর নয়, মুখের ভেতর পুরে চুষে পরিষ্কার করে নিল। তারপরও অবশ্য রক্ত বের হচ্ছে, তবে এ মুহূর্তে আর কিছু করার নেই ওর।

জুল-পাথরটাকে ছাড়িয়ে এসেছে কপিকল, ওর নিচে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো অতল গহ্বর, প্রায় অন্ধকার গা ছমছম করা পরিবেশ। পাথর পাঁচিলের গায়ে খোদাই করা নকশাটার উপর চোখ আটকে গেল, খাড়া দুই সারি কুলুঙ্গির মাঝখানে। কী খুঁজতে হবে জানে বলেই এবার পঙ্গু বাজপাখিটার আউটলাইন চিনতে পারলো ও। প্রায় এক মাস আগে গিরিখাদ ছেড়ে চলে যাবার পর মনে প্রায়ই একটা সংশয় জাগত যে ব্যাপারটা বোধহয় তাদের কল্পনা, পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে টাইটা নিজের কোনো প্রতীক চিহ্ন খোদাই করে নি, আবার ফিরে এলে দেখতে পাবে পাচিলটা মসৃণ ও নিষ্কলঙ্ক। কিন্তু না, ব্যাপারটা কল্পনা নয়। প্রতীক চিহ্ন একটা সত্যি আছে, সেই সঙ্গে আছে প্রতিশ্রুতি।

পায়ের নিচে গিরিখাদের তলায় তাকালো নিকোলাস, পুরের উপর জলপ্রপাতের ধারা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। উজানে তৈরি বাঁধের ভেতর দিয়ে জোয়ানো পানি এখনো নেমে আসছে, তবে খুব বেশি নয়। ওর নিচে হ্রদের লেভেল নাটকীয়ভাবে কমে গেছে, পাথর পাঁচিলের গায়ে পানির ভেজা ধাপ দেখে বোঝা গেল। এখন আরো পঞ্চাশ ফুট পাঁচিল পানির উপর রয়েছে। আরো আট জোড়া কুলুঙ্গি দেখা যচ্ছে পানির উপর। আগে যেখানে ওগুলোর কাছে যাবার জন্য সাঁতরাতে হয়েছে। নিকোলাসকে, এখন সেখানে প্রায় কোনো পানিই নেই।

তবে পুলটা পুরোপুরি পানি শূন্য হয়ে পড়ে নি। মাঝখানটায় এখনো কালো পানি জমে আছে, চারপাশে সরু কার্নিস। ওই কার্নিসেই নামলো নিকোলাস। বিচিত্র অভিজ্ঞতাই বলতে হবে। এখানে যখন শেষবার এসেছিল, পানির নিচের ফাটলটা ওকে টেনে নিতে চেয়েছিল ভেতরে, প্রাণ বাঁচাবার জন্য মরণপণ যুদ্ধ করতে হয়েছিল ওকে।

মুখ তুলে তাকালো নিকোলাস, গহ্বরের ওপরের স্তরে, রোদ যেখানে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। ও যেনো একটা মাইনশ্যাফটের তলায় রয়েছে। তলপেটের ভেতরটা খালি খালি লাগলো, স্যাঁতসেঁতে বাতাসে কেঁপে উঠলো শরীর। কপিকলের রশিতে ঝাঁকি দিল ও, উপর থেকে সেটা টেনে নিল ওরা। পিচ্ছিল পাথুরে কার্নিস ধরে পাহাড়-প্রাচীনের দিকে এগুলো নিকোলাস, ওখানে কুলুঙ্গির সারিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পাঁচিলের গায়ে ফাটলটার আকৃতি এখন পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস। ওই ফাটলই ওকে নিজের শ্যাওলা ভরা গলায় টেনে নিতে চেয়েছিল। পাচিলের গোড়ায় পানি জমে গেছে, গভীরতাও একটু বেশি, ফলে ফাটলট। প্রায় পুরোপুরি ডুবে আছে এখনো। সারফেসের উপর দেখা যাচ্ছে শুধু নেমে আসা কুলুঙ্গি সারির নিচে খিলান আকৃতির ফাটলটার ওপরের অংশ। বাকিটা পানির নিচে।

ক্যার্নিস ধরে পাঁচিল ঘেঁষে এগুচ্ছে নিকোলাস, ক্রমশ সরু হয়ে আসছে কার্নিস। পাঁচিল পিছ ঘষে এগুতে হচ্ছে ওকে, পায়ের গোড়ালি পানি ছুঁয়ে থাকছে। তারপর আর পানিতে না নেমে এগুবার উপায় থাকলো না। অথচ এখানে পানির গভীরতা সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা নেই।

তবু পা শুকনো রাখার জন্যে সরু কার্নিসে উবু হয়ে বসলো নিকোলাস, একটা হাত পাঁচিলে রেখে ঝুঁকলো, অপর হাতটা দিয়ে ভোবা ফাটলটার নাগাল পেতে চাইছে।

গর্তটার ঠোঁট মসৃণ। কিনারাগুলো এতো বেশি সরল আর ফাটলটা এতো বেশি চৌকো, ধরেই নিতে হয় মানুষের তৈরি। শার্টের আস্তিন গুটাবার সময় নিকোলাস লক্ষ্য করলো, ওর আহত আঙুলটা থেকে এখনো রক্ত গড়াচ্ছে। তবে গ্রাহ্য না করে হাতটা ডুবিয়ে দিল পানির তলায়। নিচের দিকটা হাতড়াচ্ছে, ফাঁকটার সিল বা গোবরাট খুঁজছে। আঙুলের ডগায় কর্কশ পলস্তারা করা একটা ব্লক ঠেকলো। আরো ঝুঁকলো নিকোলাস, পানির নিচে বাইসেপের অর্ধেকটা ডুবে গেল।

অকস্মাৎ জ্যান্ত একটা প্রাণী, ক্ষিপ্র ও ভারী, ঠিক ওর চোখের সামনে পানির ভেতর পাক খেল, আঁতকে উঠে ঝট করে হাতটা পানি থেকে তুলে নিল নিকোলাস। প্রাণীটা ওর হাতের পিছু নিয়ে সারফেস পর্যন্ত উঠে এলো, ওর নগ্ন মাংসে লম্বা সূচের মতো দাঁত বসাতে চেষ্টা করলো। পলকের জন্য কুৎসিত ও ভীতিকর ব্যারাকুড়ার মতো মাথাটা দেখতে পেল ও, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো আঙুলের ক্ষত থেকে বের হওয়া রক্তের গন্ধই ওটাকে আকৃষ্ট করেছে।

লাফ দিয়ে সোজা হলো নিকোলাস, সরু কার্নিসে টলমল করছে অক্ষত হাতে অপর হাতের বাহু খামচে ধরেছে। প্রাণীটার শুধু সামনের একটা দাঁত স্পর্শ করেছে ওকে, অথচ তাতেই ডান হাতের উল্টোপিঠের চামড়া যেনো ধারালো ক্ষুর দিয়ে চিরে দেওয়া হয়েছে। ওর পায়ের সামনে পানির উপর ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে।

চোখের পলকে কালো পানি যেনো জ্যান্ত হয়ে উঠলো, জলজ প্রাণীর আকৃতি তীব্র উন্মাদনায় মোচড় খাওয়ায় আলোড়িত পানিতে ফেনা তৈরি হলো। পাঁচিল পিঠ সাঁটিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। আকৃতিগুলো অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে ও, মোচড়ানো ও আঁকাবাঁকা ফিতের মতো, কোনো কোনটা ওর কব্জির মতো চওড়া, কালো আর চকচকে।

ঈল, বুঝতে পারলো নিকোলাস। ওর জানা আছে ট্রপিক্যাল ঈল এরকম দৈত্যাকারই হয়। বদ্ধ জলে আটকা পড়েছে ওগুলো, ছোট্ট জায়গায় সংখ্যায় খুব বেশি হওয়ায় সমস্ত মাছ ইতোমধ্যে সাবাড় করে ফেলেছে, ফলে খিদের জ্বালায় একেকটা রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। শেষবার এখানে সাঁতার কাটার সময় ওর শরীর থেকে রক্ত ঝরেনি, সেজন্য ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা জানালো নিকোলাস।

গলা থেকে সূতি রুমালটা খুলে হাতের ক্ষতটা বাধলো। পাহাড়-প্রাচীরের ফাটলটা পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, ঈলগুলো মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে ওগুলোয় কী ব্যবস্থা করে যায় চিন্তা করে কেরেছে নিকোলাস।

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো হ্রদের পানি। চেয়ার সহ কপিকলটা নেমে আসছে আবার। ফাটলের ভেতর কোনও টানেল পেলেন? চেয়ার তেকে জানতে চাইলো। রোয়েন। তারপর নিকোলাসের হাতে বাধা রুমালটা দেখে আঁতকে উঠলো। আরে রক্ত কেন? কীভাবে কাটলো?

রক্ত একটু বেশি বের হচ্ছে, তবে ক্ষতটা গভীর নয়, বলল নিকোলাস। কীভাবে হলো? রক্তে ভেজা রুমালের একটা কোণ ছিঁড়ে পানিতে ফেললো ও। দেখুন।

লম্বা আকৃতিগুলো পানিতে আলোড়ন তুলতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন। একটা ঈল পানির উপর মাথা তুলে শরীরের অর্ধেকটা আছড়ালো সরু কার্নিসে, তারপর কয়েকটা মোচড় খেয়ে আবার অদৃশ্য হলো পানির নিচে। কি… কি ওগুলো?

বিশ্বস্ত দারোয়ান রেখে গেছে টাইটা, বলল নিকোলাস। আমরা যাতে পানির নিচে ফাটলটায় ঢুকতে না পারি।

*

বাঁশ দিয়ে নিকোলাস ও ড্যানিয়েল যে ভারাগুলো বানিয়েছে সেগুলো ঝুলে আছে প্রায় চার হাজার বছর আগে পাথর কেটে তৈরি করা কুলুঙ্গিতে গাঁথা অবস্থায়। টাইটা প্রতিটি কাঠামো জোড়া লাগিয়েছিল সম্ভবত গাছের বাকল দিয়ে তৈরি রশি দিয়ে, তবে ড্যানিয়েল ব্যবহার করছে হেভী-গজ গ্যালভানাইজ ওয়ায়্যার, ফলে অনেক লোকের ভার সহ্য করার মতো পোক্ত হয়েছে। বাঘ নামে শ্রমিকদের গ্রুপটা একটা চেইন তৈরি করলো, সমস্ত জিনিসপত্র আর ইকুইপমেন্ট হাতে হাতে নামতে শুরু করলো এক ভারা থেকে আরেক ভারায়।

খাদের নিচে প্রথমে নামানো হলো পোর্টেবল হোল্ডা ইএমফাইভ হানড্রেড জেনারেটর। পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ায় ফ্লাডলাইট সাজানো হয়েছে আগেই, কানেকশন দেয়ার পর জেনারেটর চালু করতেই উজ্জ্বল আলো বহুদূরে তাড়িয়ে নিয়ে গেল ছায়াগুলোকে। ভারার উপর থেকে শ্রমিকদের হাততালি আর হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। ফুয়েল বাঁচানোর জন্য একটু পরই অবশ্য বন্ধ করে দেওয়া হলো জেনারেটর।

জলমগ্ন ফাটলটার চারধারে গ্যাবিয়ন অর্থাৎ তারের জানে আটকানো বোল্ডার ফেলা হলো, এরপর বালতি করে শুরু হবে পানি সেচা। তার আগে সবাইকে ভারার উপর আশ্রয় নিতে বলল নিকোলাস, হ্রদের কিনারায় একা থেকে গেল ও সঙ্গে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড ভরা একটা ব্যাগ। গ্রেনেডগুলো গেরিলা লীডার মেক মেক নিমুরের কাছ থেকে দান হিসেবে পেয়েছেও।

পিন খোলার সাত সেকেন্ড পর বিস্ফোরিত হলো ওগুলো হ্রদের মাঝখানে একের পর এক অনেকগুলো ছুঁড়ে দিল নিকোলাস। একটা করে ছেড়ে, কার্নিস ধরে যতটা সম্ভব দূরে সরে আসে, কানে হাত। শেষ গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হওয়ার পর হ্রদের কিনারায় ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো অসংখ্য ঈল মারা গেছে, তবে আহত হয়ে মোচড় খাচ্ছে তারচেয়েও বেশি, বিস্ফোরণের ধাক্কায় হ্রদের পানি থেকে ডাঙায় উঠে এসেছে। ভারা থেকে নেমে এসে শ্রমিকরা মরা ও আধমরা ঈলগুলো তুলে যত্ন করে সাজিয়ে রাখছে দেখে নিকোলাস একজন সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা এগুলো খান?

পেটে হাত বুলিয়ে সন্ন্যাসী একগাল হাসলেন, ভারি স্বাদ!

একটা বাঁশ দিয়ে হ্রদের গভীরতা মাপল নিকোলাস, প্রায় সাত ফুট। গ্যাবিয়ন ফেলে পুলটাকে অর্ধচন্দ্র আকৃতিতে ঘিরে ফেলা হয়েছে, বালতি দিয়ে বাঘেরা পানি সেচতে শুরু করলো। পানির লেভেল নিচে নামছে, সেই সঙ্গে পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ার পালটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।

একটু পরই বোঝা গেল ফাটলটা প্রায় চৌকোই, তিন মিটারের মতো চওড়া, দুমিটারের মতো উঁচু। পাশ আর ছাদ পানির তোড়ে ক্ষয়ে গেছে, তবে পানির লেভেল আরো নিচে নামতে সুগঠিত পাথুরে ব্লক-এর অবশিষ্ট দেখতে পেল ওরা, ওগুলো সম্ভবত ফাটলটা বন্ধ করে রেখেছিল। চার প্রস্থ ব্লক এখনো অক্ষত রয়েছে, প্রাচীন রাজমিস্ত্রী ফাটলটার গোড়ায় যেখানে বসিয়েছিল, বাকিগুলো কয়েক হাজার বছরের বন্যায় ভেঙে গেছে, ঢুকে পড়েছে পেছনের টানেলে। ফলে আংশিক বন্ধ হয়ে আছে টানেলটা।

পুলে নামলো নিকোলাস। পানি এখনো হাঁটু সমান। ফাটলটার সামনে হেঁটে এসে খালি হাতে পাথুরে আবর্জনা সরাচ্ছে। রোয়েনও ধৈর্য ধরতে পারলো না, পুলে নেমে নিকোলাসের পাশে চলে এলো। টানেল বলেই তো মনে হচ্ছে! উত্তেজনায় ফিসফিস করলো ও। নাকি শ্যাফট? কিন্তু বাধাটা কেন? টাইটার ইচ্ছাকৃত নয় তো?

বলা কঠিন। নদীর মূল স্রোত থেকে প্রচুর আবর্জনা ঢুকেছে ভেতর। খানিকটা হতাশ দেখার নিকোলাসকে। আর্কিওলজির নিয়ম ধরে পথটা পরিষ্কার করতে হলে কয়েক সপ্তা লেগে যাবে। ও সব এখানে আমাদের পোষাবে না। আলো আর লোকবল যখন আছে রাতদিন হাত লাগিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে কাজটা।

*

ওরা ডানডেরা নদীতে বাঁধ দিয়েছেন, হের ফন শিলারকে বললেন নাহুত গাদ্দাবি। হারপার নিকোলাসের ক্যাম্পে আমাদের স্পাই আছে, সেই রিপোর্ট পাঠিয়েছে। খাদের ভেতর তিনশো লোককে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, ইকুইপমেন্ট আর সাপ্লাইয়ের পরিমাণও বিপুল। এমন কী একটা ট্র্যাক্টরও নিয়ে গেছেন।

ভুরু কুঁচকে জ্যাক হেলমের দিকে তাকালেন হের ফন শিলার, হেলম্ মাথা আঁকালো। গম্ভীর দেখালো জার্মান বিলিওনিয়ারকে। জরুরি স্যাটেলাইট মেসেজ পেয়ে আদ্দিস আবাবার চলে আসেন তিনি, ওখান থেকে জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টারে চড়ে পৌঁছেছেন অ্যাবে গিরিখাদের উপর পেগাসাস বেস ক্যাম্পে, ঢালের চূড়ায়।

ডানডেরা নদীকে বাঁধ দিয়ে বাঁধা চাট্টিখানি কথা নয়, জানেন তিনি। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা আবিষ্কার না করলে এতো বড় একা কাজে হাত দেবে না তার প্রতিপক্ষ হারপার নিকোলাস, এ ও তাঁর কাছে পরিষ্কার। ঠিক কোথায় বাঁধটা দেওয়া হয়েছে দেখতে চাইলেন তিনি। স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফের উপর একটা ক্রশ চিহ্ন আঁকলো হেলম। তাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন বাধ দিল ওরা? কারণটা ব্যাখ্যা করো, হেলম্।

প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে অনুমান পাল্টা অনুমান করার পর সবাই একমত হলো, পানির নিচে কিছু একটার নাগাল পেতে চেয়েছে নিকোলাস। তারপর প্রশ্ন উঠলো, বাঁধ এলাকার নিচে কী আছে? হেলম্ জানালো, বাঁধটার ঠিক নিচে নদী ঢুকে পড়েছে। সরু ও গভীর একটা নালার ভেতর। নালাটা আট মাইল লম্বা, শেষ মাথার ওপরে রয়েছে মঠটা। ওই নালার উপর দিয়ে হেলিকপ্টার নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, তবু কয়েকবার গেছে হেলম। একবার তারা নিকোলাস আর ওঁর বান্ধবীকে নালার উপর উঁচু জমিনে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছে। কি করছিল ওরা? না, কিছু করছিল না, নালার উপর পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় বসে ছিল শুধু। হেলিকপ্টারটা ওরা দেখতে পায়? হ্যাঁ, অবশ্যই, দেখতে পেয়ে নিকোলাস হাতও নাড়ে। হের ফন শিলার বললেন, তোমাদের আওয়াজ পেয়ে বসে পড়েছিল ওরা, তার আগে নিশ্চয়ই। ওখানে কিছু করছিল। তারপর সিদ্ধান্তে আসলেন, নিকোলাস বিশ্বাস করে ড্যামের নিচে খাদের ভেতর সমাধিটা আছে। হেলমকে জিজ্ঞেস করলেন, স্পাই লোকটা কখন আর কীভাবে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে?

হেলম্ ব্যাখ্যা করলো। ঢালের কয়েকটা গ্রাম থেকে কিছু কিছু সাপ্লাই গ্রহণ করছে নিকোলাস, খচ্চরের পিঠে মালপত্র চাপিয়ে ওদের ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করছে কয়েকজন মহিলা। স্পাই লোকটা ওই মহিলাদের হাতে রিপোর্ট পাঠায়।

পরশুর মধ্যে রিপোর্ট করো আমাকে, বাঁধের নিচে কী করছে নিকোলাস, নির্দেশ দিলেন হের ফন শিলার। কনফারেন্স টেবিলের উল্টোদিকে বসা কর্নেল টুমা নগুর দিকে তাকালেন। এলাকায় কতজন লোককে আপনি ডিউটিতে রাখছেন?

তিনটে পুরো কোম্পানি, সব মিলিয়ে তিনশোর বেশি লোক, জবাব দিলেন কর্নেল নগু। সবাই অভিজ্ঞ যোদ্ধা।

কোথায় তারা? ম্যাপে আমাকে দেখান।

তাঁর পাশে চলে এলেন কর্নেল। একটা কোম্পানি এখানে। দ্বিতীয়টা ডেবরা মারিয়াম গ্রামে। তৃতীয়টা ঢালের নিচে, নিকোলাসের ক্যাম্পে হামলা চালাবার জন্য তৈরি হয়ে আছে।

আমার ধারণা হামলাটা এখুনি চালানো দরকার, নাহুত গাদ্দাবি বললেন।

শত্রুকে সময় দিতে নেই।

চুপ করুন! ধমক দিলেন হের ফন শিলার। আমি আপনার মতামত চেয়েছি? ম্যাপটা কিছুক্ষণ দেখার পর কর্নেলকে তিনি প্রশ্ন করলেন, গেরিলা কমান্ডারের সঙ্গে কতজন রয়েছে, জানেন? কী যেনো নাম তার, নিকোলাসকে সাহায্য করছে?

মেক নিমুর। এককোরো কম, সম্ভবত পঞ্চাশজন, বাধ আর ক্যাম্প পাহারা দিচ্ছে।

দু আঙুলের মাঝখানে ধরে কানের লতি মোচড়াচ্ছেন হের ফন শিলার। গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটলো।

দ্বিতীয়বার যে পথে ইথিওপিয়ায় ঢুকেছে নিকোলাস, বেরিয়েও যাবে সেইপথে, গেরিলা কমান্ডারের সাহায্য নিয়ে, বললেন তিনি। ঢোকার সময় বৈধ পথ ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না, বেরিয়ে যাবার সময় আরো সম্ভব হবে না। কাজেই আমি চাই ওই পথে ডেবরা মারিয়াম কোম্পানিটাকে মোতায়েন করুন আপনি, কর্নেল নগু। নদীটার দুই দিকেই পাহারায় থাকুক তারা, মঠের নিচে। নিকোলাস যেনো উদ্ধার করা ট্রেজার নিয়ে সুদান সীমান্তে পৌঁছতে না পারে।

ইয়েস, গুড আইডিয়া! কর্নেলকে উল্লাসিত দেখালো।

আপনার বাকি লোককে ঢালের নিচে জড়ো করুন। গেরিলাদের চোখে ধরা পড়া চলবে না, তবে বাঁধ দখল করার জন্য তৈরি হয়ে থাকতে হবে। আমি নির্দেশ দিলেই যাতে হামলা শুরু করতে পারে।

হামলাটা কখন শুরু করব আমরা?

নিকোলাসের উপর কড়া নজর রাখা হবে, বললেন হের ফন শিলার। আর্টিফ্যাক্ট সরাতে শুরু করলে আমরা জানতে পারব। অনেকগুলোই এতো বড় হবে যে লুকানো সম্ভব নয়। তখনই হামলা করব আমরা। ওরা চুরি করছে, আমরা ওদের উপর বাটপারি করব।

*

টানেলের মুখ পরিষ্কারের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। শিফটিং পদ্ধতিতে কাজ চলছে, নতুন শিফট শুরু হওয়ার আগে ড্যানিয়েলের স্টীল টেপ নিয়ে টানেলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে নিকোলাস। শেষবার মাপার পর বলল, একশো বিশ ফুট পরিষ্কার করা হয়েছে। সাবাশ, হানশিত শেরিফকে বলল ও। হানশিত শেরিফ স্বেচ্ছাসেবী সন্ন্যাসীদের ফোরম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।

টানেলের মেঝে এখনো তির্ষক একটা পথ ধরে নিচের দিকে চালু হয়ে আছে। ফ্লাডলাইটের আলোয় টানেলের প্রবেশ মুখটা এখন পরিষ্কারই চৌকো দেখাচ্ছে। টানেলটা যে একজন ইঞ্জিনিয়ারের নকশা ধরে তৈরি করা হয়েছে, এখন আর হাতে কোনো সন্দেহ নেই। পায়ের কাছে পানি কাদায় পড়ে থাকা একটা জিনিস দেখতে পেয়ে কুঁকলো নিকোলাস, দু আঙুলে ধরে ফ্লাডলাইটের আলোয় পরীক্ষা করলো।

টানেল থেকে বেরিয়ে এলো নিকোলাস হাসতে হাসতে। পুলটাকে ঘিরে থাকা নিচু পাঁচিলের উপর বসে রয়েছে রোয়েন, জিনিসটা ওকে দেখালো। ছো দিয়ে নিকোলাসের হাত থেকে নিয়ে নিল রোয়েন, চিৎকার করে উঠলো, ওহ, সুইট মেরি! নিকোলাস, এ আপনি কোথায় পেলেন?

কাদায় পড়েছিল, বলল নিকোলাস। চার হাজার বছর ধরে। জিনিসটা চিনতে পারছেন কী? মদের পাত্র ছিল এক কালে, তারই ভাঙা একটা টুকরো। সম্ভবত টাইটার কোনো শ্রমিকের হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়।

মৃৎপাত্রের টুকরোটা হাত দিয়ে ঘষে চুমো খেলো রোয়েন। আমরা যে ঠিক পথ ধরে এগুচ্ছি, এটা তার আরেকটা প্রমাণ।

পরবর্তী শিফটের কাজ দু ঘণ্টা চলার পরই শেষ বাধাটা অপসারিত হলো, হৈ চৈ শুনে টানেলের ভেতরে ঢুকে নিকোলাস দেখলো বড় একটা বোল্ডার এক পাশে সরিয়ে আনার পর সামনে একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। পাঁচিলের এ জানালার ভেতর টর্চের আলো ফেললো ও। খালি ও কালো শূন্যতা ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। পিছিয়ে এসে হানশিত শেরিফের পিঠ চাপড়ে দিল ও। প্রত্যেকের জন্য এক ডলার করে বোনাস। তবে কাজ চালিয়ে যাও, সমস্ত আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে হবে। আবর্জনা সরাতে আরো দু শিফট লাগলো। ফাঁকটা বড় হওয়ার পর দেখা গেল সামনে একটা গুহা রয়েছে।

গুহা মানে বিরাট একটা গর্ত। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দশ ফুট নিচে পানি দেখা যাচ্ছে, চারপাশে গোলাকার ও খাড়া পাচিল। টর্চের আলোয় দেখা গেল ছাদে কয়েকটা ফাটল তৈরি হয়েছে, সম্ভত কোনো এক কালে পাথর ধসে পড়েছিল। গুহা বা গর্তের ওপারে কালো ছায়া ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, দূরত্ব হবে একশো ফুট বা আর কিছু বেশি।

পানিতে না নেমে এ বাধা পেরুনো সম্ভব নয়। ত্রিশ ফুট লম্বা একটা বাঁশ এনে গভীরতা মাপার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু থই পাওয়া গেল না। এর মানে? নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, বিহ্বল দেখাচ্ছে ওকে।

আমার ধারণা, এটা একটা ন্যাচারাল ফল্ট, বলল নিকোলাস। পানিকে পথ দেখিয়ে পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেছে, সারফেসে আবার বেরিয়েছে সেই প্রজাপতি ফোয়ারায়। নদী আসলে নিজেই নিজের পথ খুঁড়ে নিয়েছে।

পানি তাহলে জমে আছে কেন?

শ্যাফটে একটা বাঁক থাকায়, সম্ভবত, বলে নিচের পানিতে টর্চের আলো ফেললো নিকোলাস। আলোয় আকৃষ্ট হয়ে সারফেসের দিকে উঠে এলো একটা ঈল, দেখে আঁতকে উঠলো রোয়েন।

গুহাটার ওপারে আরেক বার টর্চের আলো ফেললো নিকোলাস। গর্তটা যদি পাথর ধসে তৈরি হয়ে থাকে, টাইটার টানেল তাহলে তো গুহার ওপারেও থাকার কথা। আছেও, যদিও ওর চোখে নয়, ধরা পড়লো রোয়েনের চোখে। ওটা কি, চৌকো ফাঁকটা?

মুচকি হেসে নিকোলাস বলল, ওটাই আমি খুঁজছিলাম। এ টানেলেরই অংশ ওটা।

আমরা ওপারে যাব কীভাবে? রোয়েন উদ্বিগ্ন।

আশপাশে প্রচু বেওবাব গাছ আছে, ওগুলোর শুকনো কাঠ খুব হালকা, বলল নিকোলাস। ভাসমান একটা ব্রিজ বানাতে কতক্ষণই বা লাগবে।

*

জুলুরা বলে–এনকুলু-কুলু তাঁদের মহান দেবতা, বেওব্যাব গাছকে উল্টো করে মাটিতে গেঁথেছেন, শ্বাস্তি হিসেবে। নিকোলাস জানালো রোয়েনকে।

কেনো? বেওব্যাব গাছের এমন শাস্তি কোনো? কী এমন করেছিল এ গাছ? রোয়েন জানতে চায়।

নিজেকে জঙ্গলের সবচেয়ে উঁচু আর মোটা গাছ বলে বেশ গর্ব ছিল তার। তাই এনকুলু-কুলু এ শাস্তি দিলেন।

সেই বেওব্যাব গাছের কাণ্ড পাশাপাশি পানিতে ফেলে তার দিয়ে বাঁধা হয়েছে, ভাসমান সেতু পেরিয়ে সিঙ্কহোল-এর ওপারে প্রথমে পৌঁছাল নিকোলাস, তারপর ওর পিছু নিয়ে রোয়েন। টানেলের দ্বিতীয় অংশের মুখে দাঁড়ালো দু জন, ভেতরে টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে দুই অংশের পার্থক্যটা ধরা পড়লো চোখে। মুল স্রোতটা নিশ্চয়ই সিঙ্কহোল দিয়ে বেরিয়ে যেত। টানেলের দ্বিতীয় অংশের মাপ প্রথমটার মতোই-তিন মিটার চওড়া, দুই মিটার উঁচু। তবে চৌকো আকৃতি আরো বেশি স্পষ্ট। পাঁচিল আর ছাদ কর্কশ হলেও, এগুলোকে আকৃতি দেয়ার জন্য, যে টুলস ব্যবহার করা হয়েছে তার চিহ্ন পরিষ্কার চোখে পড়লো। পায়ের নিচে টানেলের মেঝে চ্যাপ্টা পাথর ফেলে তৈরি করা হয়েছে, পলেস্তারার কাজ এখনো সবটুকু ক্ষয়ে যায় নি। টানেলের পুরোটা দৈর্ঘ্য জলমগ্ন ছিল, পানি সরে যাবার পরও পিচ্ছিল হয়ে আছে শ্যাওলায়। ভেতরের বাতাসে পচা একটা গন্ধ ভেসে আছে। ড্যানিয়েল তার টেনে নিয়ে এসে আলো জ্বালার ব্যবস্থা করলো। ওরা দেখলো, দ্বিতীয় অংশের শ্যাফট ক্রমশ উপর দিয়ে উঠে গেছে।

টাইটা প্রথমে টানেলটাকে নিচে নামিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিল, পরে আবার ওপরে তুলেছে, মন্তব্য করলো রোয়েন, হাসছে। নিকোলাসের পাশে রয়েছে ও, দু জনেই শ্যাফট ধরে সাবধানে এগুচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপ গুনছে নিকোলাস।

একশো দশ কদম হাঁটার পর দাঁড়িয়ে পড়লো ওরা। সামনের টানেল ভিজে নয়, মেঝে ও পাঁচিল শুকনো খটখটে। আরো পঞ্চাশ পা এগুলো ওরা, পাঁচিলের দাগ দেখে বোঝা গেল বন্যায় সময়ও এ লেভেলে পানি উঠত না। এদিকের মেঝে ও পাঁচিল চার হাজার বছর আগে মিশরীয় ক্রীতদাসরা যেভাবে তৈরি করে রেখে গেছে এখনো ঠিক তেমনি আছে। ব্রোঞ্জের তৈরি বাটালির দাগগুলো এতো তাজা, মনে হচ্ছে মাত্র কয় দিন আগে কাজ শেষ করে ফিরে গেছে তারা। আরো দশ গজ এগুবার পর একটা পাথুরে ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা। মেঝে এখানে সমতল। টানেল এখানে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে, একশো আশি ডিগ্রী কোণ ঘুরে।

পানির লেভেল এখান পর্যন্ত কোনদিনই উঠবে না, এ কথা টাইটা জানলে কীভাবে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। তখনকার দিনে নিখুঁত মাপজোকের জন্যে কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না, অথচ হিসেবে তার এতোটুকু ভুল হয় নি।

কেন স্ক্রোলে তো সে বারবার বলেছে, আমি একটা জিনিয়াস। তার দাবি স্বীকার করে নিতে হয়, বলল রোয়েন।

পাশাপাশি একশো আশি ডিগ্রী বাকটা ঘুরলো ওরা। হাতের ইলেকট্রিক ল্যাম্পটা উঁচু করে ধরে আছে নিকোলাস, পেছনে কেবল ঝুলছে। সামনের দিকটা আলোকিত হয়ে উঠতে বিস্ময়সূচক একটা আওয়াজ করলো রোয়েন, নিকোলাসের খালি হাতটা খামচে ধরল। দাঁড়িয়ে পড়লো দু জনেই, অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

টানেলের নিচের যে অংশটা ওরা পেরিয়ে এসেছে সেটা তৈরি করার সময় তেমন একটা যত্ন নেওয়া হয় নি, দেয়াল আর মেঝে এবড়োখেবড়ো ছিল, ছাদে ছিল ফাটল। তার মানে টাইটা জানত নিচের লেভেলটা পানিতে ডুবে থাকবে, তাই সৌন্দর্য বাড়ানোর কোনো চেষ্টা করে নি।

এখন ওদের সামনে থেকে ওপরে উঠে গেছে একটা চওড়া সিঁড়ি। একটু তির্যক ভঙ্গিতে উঠেছে, ফলে সিঁড়ির মাথাটা দেখা যাচ্ছে না। প্রতিটি ধাপ টানেলের পুরো প্রস্থের সমান লম্বা, পুরো এক হাত চওড়া। চকচকে, মসৃণ পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ধাপগুলো, এতো নিখুঁত কাজ যে জয়েন্টগুলো চোখে পড়ে না। নিচের অংশের টানেলের চেয়ে এ দিকের টানেলের ছাদ তিনগুণ বেশি উঁচু, সারি সারি গম্বুজের মতো দেখতে, প্রতিটি গম্বুজের মাপ সমান। দেয়াল আর ছাদের গম্বুজে আবরণ হিসেবে বসানো হয়েছে নীল এ্যানিট ব্লক। তবে কোথাও কোনো অলঙ্করণ চোখে পড়লো না।

নিকোলাসের হাতে মৃদু চাপ দিল রোয়েন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো ওরা। ধামগুলো মিহি ধুলোয় ঢাকা, নরম আর ট্যালকম পাউডারের মতো সাদা। কিছু দূর ওঠার পর সিঁড়ির মাথাটা দৃষ্টিপথে চলে এলো। নিকোলাসের হাতের তালুতে নখ ঢুকিয়ে দিল রোয়েন। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে আরেকটা ল্যান্ডিঙে, ল্যান্ডিঙের ওপারে চারকোনা একট দরজা দেখা যাচ্ছে। ল্যান্ডিং পেরিয়ে দরজাটার সামনে দাঁড়ালো ওরা। বিরল এক শুভ মুহূর্ত উপস্থিত ওরা যেনো নিঃশব্দে অনন্ত কাল ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে আছে। পৃথিবীর আর কোনো মানুষের সাথে এ মুহূর্ত ভাগাভাগি করতে কোনোদিনও চাইতো না নিকোলাস, চোখ তুলে রোয়েনের মুখে তাকিয়ে দেখলো একই অনুভূতি।

নদীর সাদা মাটি দিয়ে প্লাস্টার করা দরজা, দেখে মনে হলো আইভরি দিয়ে মোড়া। কোথাও কোনো দাগ নেই, যেনো ত্রুটি হীন কোনো কুমারীর ত্বক। সাদা প্লাস্টারের মাঝখানে এমবস করা একজোড়া সীল রয়েছে। ওপরের সীলটার আকৃতি চৌকো একটা গিট, মুড়ে রেখেছে শিং-ওয়ালা গুবরে পোকা। বৃত্তাকার শিং অনন্ত কাল বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এটা রাজকীয় একটা প্রতীক চিহ্ন। লেখাগুলো, হায়ারোগ্লিফিকস, পড়লো রোয়েন, তবে নিঃশব্দে।

সর্বশক্তিমান। ঐশ্বরিক ও স্বর্গীয়। মিশরীয় নিম্ন ও উচ্চ রাজ্যের শাসনকর্ম। দেবতা হোরাস-এর ঘনিষ্ঠ। ওসিরিস আর আইসিসি-এর প্রিয়পাত্র। মামোস, তিনি যেনো চিরজীবী হন!

রাজকীয় বর্ণমালার নিচে ছোট আরেকটা ডিজাইন রয়েছে, বাজপাখির আকৃতি, ভাঙা ডানা সেঁটে আছে বুকে, আর লেখাগুলো-আমি, ক্রীতদাস টাইটা, আপনার নির্দেশ পালন করেছি, স্বর্গীয় ফারাও। পঙ্গু বাজপাখির নিচে আর মাত্র একটা লাইন দেখা গেল, তার অর্থ করলে দাঁড়ায়-আগন্তুক! দেবতারা দেখছেন! রাজার চিরকালীন বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালে চড়া মাশুল দিতে হবে।

*

দরজার সীল ভাঙা বিশাল একটা কাজ এবং সময় সাপেক্ষ, অথচ বর্ষা শুরু হওয়ার আগে হাতে অল্প যে সময় আছে তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। দরজা ভেঙে সমাধির ভেতর ঢোকার প্রস্তুতি নিতে মূল্যবান একটা দিন বেরিয়ে গেল। স্বভাবতই সমাধি এলাকার নিরাপত্তা বিধান নিকোলাসের প্রথম উদ্বেগ। সিঙ্ক-হোলের উপর ভাসমান সেতুর মুখে মেককে সশস্ত্র প্রহরার ব্যবস্থা করতে বলল ও, এ সীমা রেখার সামনে বাড়া নিষিদ্ধ করা হলো। সেতু পেরুতে পারবে সব মিলিয়ে মাত্র নয়জন-নিকোলাস, রোয়েন, ড্যানিয়েল, মেক, টিসে আর চারজন সন্ন্যাসী।

লোহার টানেল পরিষ্কার করার কাজে হানশিত শেরিফ বারবার নিজের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে, ফলে আগেই তাকে প্রধান সহকারি হিসেবে বেছে নিয়েছে নিকোলাস। সিদ্ধান্ত হলো, এখন থেকে যা কিছু আবিষ্কার করা হবে প্রতিটির রেকর্ড রাখা চাই। তেপায়া ও স্পেয়ার ক্যামেরা ইকুইপমেন্ট নিয়ে হাজির হলো হানশিত, অ্যাপ্রোচ টানেল আর সীল করা দরজার ফটো তুললাম নিকোলাস। ফটো তোলার কাজ শেষ হতে দরজা ভাঙার টুলস নিয়ে আসার জন্য হানশিতকে অনুমতি দিল ও।

সিঙ্কহোল পর্যন্ত সরিয়ে আনা হয়েছে জেনারেটর, ফ্লাডলাইট জ্বেলে সিঁড়ির উপরের ল্যান্ডিং আর দরজাটা আলোচিত করার ব্যবস্থা হলো। টৌকো আকৃতির প্লাস্টার যে টুকু কাটা হবে তা চিহ্নিত করে নিয়েছে নিকোলাস, তা আগে টাইটার সতর্কবাণীর অনুবাদ শুনিয়ে দিয়েছে ড্যানিয়েল, মেক আর টিসেকে। কেউই ওরা ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নেয় নি।

দরজার গা থেকে দুটো সালই অক্ষত অবস্থায় তুলে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রথমে প্রোব হিসেবে বড় সূচ ব্যবহার করা হলো। প্লাস্টারের নিচে কী আছে সেটা জানাই উদ্দেশ্য। একটু পরই জানা গেল প্লাসাটারের নিচে রয়েছে নল খাগড়ার ছিলকা দিয়ে নিখুঁতভাবে বোনা কয়েকটা স্তর। রোয়েন বলল, ওই বুননই প্লাস্টারকে খসে পড়তে দেয় নি। লম্বা সূচটা গায়ের জোরে আরো ভেতরে ঢোকালো নিকোলাস, এক পর্যায়ে ওটা আর ঠেকল না কোথাও, অপর দিকে বেরিয়ে গেছে ডগা। দরজার কবাট ছয় ইঞ্চি চওড়া, জানালো নিকোলাস। চার কোণে চারটে খুদে ফুটো তৈরি করা হলো। সরে এসে হানশিতকে জায়গা ছেড়ে দিল ও, তুরপুন দিয়ে ফুটোগুলোকে বড় করার কাজে হাত দিল সে।

গর্তগুলো বড় হওয়ার পর হানশিতকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে তাকালো নিকোলাস। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখার নেই। তবে প্রাচীন বদ্ধ বাতাস লাগলো মুখে। গন্ধটা শুকনো, উগ্র। আলোটা দাও! ড্যানিয়েলকে বলল ও। ড্যানি স্যাপার ওর হাতে ল্যাম্পটা ধরিয়ে দিল।

কী দেখছেন? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। বলুন আমাকে! রঙ! ফিসফিস করলো নিকোলাস। চোখ ধাঁধানো বিচিত্র সব রঙের বাহার! সরে এসে কোমর ধরে রোয়েনকে উঁচু করলো ও। ফাঁকাটায় চোখ রাখলো রোয়েন।

কী সুন্দর! চেঁচিয়ে উঠলো সে। কী সুন্দর!

*

হেভী-ডিউটি ইলেকট্রিক ব্লোয়ার ফ্যান চালু করলো ড্যানি স্যাপার, শ্যাফটের বাতাস চারদিকে ছড়িয়ে দেবে। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার সময় রোয়েন ছাড়া আর কাউকে থাকতে দেবে না নিকোলাস, সবাইকে পাঠিয়ে দিল ভাসমান সেতুর কাছে। ওর হাতে একটা চেইন-স রয়েছে দু জনেই মাস্ক আর গগলস পরে নিল।

তুরপুন দিয়ে বড় করা ফুটো থেকে হেন-শ কাজ শুরু করলো, প্লাস্টার ও নিচের ছিলকার বুনন নরম কেকের মতো কেটে ফেলছে। চৌকো ফাঁকটা তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। জোড়া সীলসহ প্লাস্টারের চারকোনা টুকরোটা সাবধানে কবাট থেকে আলাদা করে নিল ওরা। এবার ফাঁকের ভেতর ফ্লাডলাইটের আলো ফেললো নিকোলাস। ভেতরে এখন ধুলোর মেঘ তৈরি হয়েছে, কিছুই দেখা গেল না। হ্যাঁচ গলে ভেতরে ঢুকলো নিকোলাস, তারপর রোয়েনকে ঢুকতে সাহায্য করলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো দু জন, ব্লোয়ার ফ্যান ধুরোর মেঘ সরিয়ে দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল ধুলো, তারপর প্রথমেই ওদের চোখ পড়লো পায়ের নিচে মেছের উপর। মেঝে এখানে পাথরের ফলক দিয়ে তৈরি নয়, হলুদ আকিক পাথরের টানলো দিয়ে মোড়া, পালিশ করা চকচকে, আর এমন কৌশলে জোড়া লাগানো যে জয়েন্টগুলো দেখা যায় না। স্বচ্ছ ও অবিচ্ছিন্ন কাঁচের একটা চাদর বলে মনে হয়, স্লান দেখাচ্ছে শুধু যেখানে মিহি ধুলো জমেছে। ওদের পা লেগে ধুলো খোনে সরে গেছে, ফ্লাডলাইটের আলো পড়ায় ঝলমল করছে আকীক। ওদেরকে ঘিরে থাকা ধুলো আরো পাতলা হয়ে এলো, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে ফুটছে বিচিত্র বর্ণ আর আকৃতি। মাস্ক খুলে আকিক মেঝেতে ফেলে দিল রোয়েন। নিকোলাসও তাই করলো। প্রাচীন, অস্বাস্থ্যকর বাতাসে নিশ্বাস নিল ওরা। বাতাস এখানে কয়েক হাজার বছর আটকে আছে। ছাতা ধরা গন্ধ, লিনের ব্যান্ডেজ আর সুবাসিত লাশের ঘ্রাণ পেল ওরা।

ধুলো পুরোপুরি সরে যেতে লম্বা ও সোজা একটা প্যাসেজওয়ে দেখতে পেল ওরা, শেষ প্রান্তটা ছায়া আর অন্ধকারে লুকিয়ে আছে। হ্যাঁচ দিয়ে গলিয়ে স্ট্যাডসহ ফ্লাডলাইটটা ভেতরে নিয়ে এলো নিকোলাস। প্যাসেজটার পুরো দৈর্ঘ্য এবার আলোচিত হয়ে উলঠ।

পাশাপাশি এগুচ্ছে ওরা, প্রাচীন দেবতাদের ছায়া ও মূর্তি চারদিকে থেকে ঝুঁকে রয়েছে ওদের উপর। দেয়াল থেকে চোখ রাঙাচ্ছেন তারা, বিশাল চোখে আক্রোশ ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সিলিং থেকে। রোয়েনকে নিয়ে ধীরে পায়ে এগুচ্ছে নিকোলাস। আকিক টাইলের উপর ধুলো জমে থাকায় পা ফেলায় কোনো শব্দ হচ্ছে না। বাতাসে ভেসে থাকা ধুলো আলোকিত জালের মতো লাগছে, পরিবেশে এনে দিয়েছে অলৌকিক স্বপ্নরাজ্যের ভাব। প্রতি ইঞ্চি দেয়ালে আর ছাদে লিপি বা নকশা দেখা যাচ্ছে সবই দীর্ঘ উদ্ধৃতি, বুক অব ব্রিদিংস, বুক অব দা পাইলনস ও বুক অব উইজডম থেকে নেয়া। অন্যান্য হায়ারোগ্লিফিক্স ফুটিয়ে তুলেছে মর্ত্যলোকে ফারাও মামোসের অস্তিত্বের ইতিহাস, সদগুণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, যে কারণে দেবতাদের ভালোবাসা পেয়েছিলেন তিনি।

আরো খানিক সামনে লম্বা ফিউনারাল গ্যালারি দেখতে পেল ওরা, আটটা শ্রাইন-এর পথমটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। শ্রাইন হলো লাশের দেহাবশেষ বা জীবিতকালে তার ব্যবহার করা জিনিসপত্র স্মৃতি হিসেবে রাখার বাক্স। প্রথমটা ওসিরিস-এর শ্রাইন। বৃত্তকার একটা চেম্বার, দেয়ালে ঈশ্বরের প্রশংসা লিপিবদ্ধ করা, কুলুঙ্গিতে ওসিরিস-এর খুদে মূর্তি, চোখগুলো আকীক মনি আর স্ফটিক পাথর দিয়ে তৈরি, এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন যে চোখাচোখি হতেই শিউরে উঠলো রোয়েন। হাত বাড়িয়ে দেবতার গোড়ালি ছুঁলো নিকোলাস, একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো, সোনা।

তারপর মুখ তুলে তাকালো টাওয়ারের মতো উঁচু দেয়ালচিত্রের দিকে, শ্রাইনের চারদিকে ছড়িয়ে আছে, উঠে গেছে গম্বুজ-আকৃতির ছাদে। পাতাল রাজ্যের অধিপতি পিতা ওসিরিস-এর আরেকটা দৈত্যাকার ফিগার, মুখটা সবুজ, নকল দাড়ি, বাহু জোড়া বুকে ভাঁজ করা, হাতে বাঁকা লাঠি, মাথায় লম্বা হেড-ড্রেস বা মুকুট, মুকুটের কপালে ফণা তোলা গোক্ষুর। সচল ধুলোর মধ্যে দেবতাকে জ্যান্ত মনে হলো, ওদের চোখের সামনে যেনো নড়াচড়া করছেন।

প্রথম শ্ৰাইনের সামনে বেশিক্ষণ থামলো না ওরা। গ্যালারিটা তীরের মতো লম্বা হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তী শ্রাইন দেবীর প্রতি উৎসর্গিত। কুলুঙ্গিতে বসে আছেন আইসিস, বসে আছেন সিংহাসনে, এ সিংহাসনই তার প্রতীক চিহ্ন। শিশু হোরাস স্তন পান করছেন। দেবীর চোখ আইভরি আর নীল ল্যাপিস ল্যাজুলি।

কুলুঙ্গির চারপাশ দখল করে আছে দেয়ালচিত্র, শিল্পীর আঁকা তাঁরই ছবি। এখানে জননী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে তাঁকে, সুর্মা টানা কালো রাতের মতো চোখ, মাথায় সান ডিস্ক আর পবিত্র গরুর শিং। তার চারপাশের দেয়াল হায়ারোগ্লিফিক্স সঙ্কেত, এতো উজ্জ্বল যে জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে। একশো নাম তাঁর, কখনো অ্যাসট তিনি, কখনো নেট বা বাস্ট। পটাহ, সেকের, রেনাট নামেও ডাকা হয় তাঁকে। প্রতিটি নাম এককটা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।

পরবর্তী শ্রাইনে রয়েছে হোরাস-এর মূর্তি, এ-ও সোনার তৈরি, মাথাটা বাজপখির। ডান হাতে ধনুক, বাঁ হাতে ইংরেজি হরফটি আকৃতির ক্রস। জীবন মৃত্যুর দেবতা তিনি। তাঁর চোখ লাল রত্ন। মূর্তির চারপাশে তারই বিভিন্ন বয়েসের দেয়ালচিত্র। শিশু হোরাস আইসিস-এর স্তন পান করছেন। তরুণ হোরাস ঋজু ও গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর, বাজপাখির মুখ নিয়ে অন্য এক রূপে হোরাস, শরীরটা কখনো সিংহের, আবার কখনো বীরযোদ্ধার, মাথার মুকুট। তাঁর নিচে হায়ারোগ্লিফিক্স-মহান দেবতা এবং স্বর্গের প্রভু, বহু গুণের অধিকারী, সমস্ত দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিধর, যে শক্তি তার স্বর্গীয় পিতা ওসিরিস-এর শত্রুকে পরাভূত করেছিল।

চার নম্বর শ্রাইনে দাঁড়িয়ে আছেন সেথ, শয়তান, ধ্বংস আর যুদ্ধের দেবতা। তারও শরীর সোনার তৈরি, তবে মাথাটা কালো হায়েনার।

পঞ্চম শ্রাইনে রয়েছেন লাশ আর কবরের দেবতা, আনুবিস, মাথাটা শিয়ালের। লাশের দেখাশোনা করেন তিনি, বিশাল দাঁড়িপাল্লায় হৃৎপিণ্ড ওজন করার সময় নিক্তির কাটা পরীক্ষা করেন। পাল্লা দুটো যদি সমান সমান হয়, মৃত ব্যক্তির গুরুত্ব ও মূল্য আছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়, কিন্তু যদি একদিকের পাল্লা তার বিরুদ্ধে এক চুলও নিচে নেমে থাকে, আবিস তার হৃদয় দৈত্যাকার কুমীরকে খেতে দেন।

তারপর তথ-এর শ্রাইন। ইনি ভাষা বা লিখন-এর দেবতা, মাথাটা পবিত্র সারস জাতীয় পাখির, হাতে কলম। সপ্তম শ্রাইনে চার পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন পবিত্র গাভী হ্যাঁথোর, গায়ের রঙ সাদা ও কালো, মুখটা মানুষের মতো, তবে কান দুটো ট্রাম্পেট আকৃতির। অষ্টম শ্রাইন আকারে সবচেয়ে বড়, তিনি সমস্ত সৃষ্টির জনক আমন রা। তিনি সূর্য; প্রকাণ্ড সোনার বৃত্ত, সোনালি রশ্মি ছড়াচ্ছেন।

এখানে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে তাকালো নিকোলাস। আটটা পবিত্র শ্রাইন ট্রেজার হিসেবে এতো গুরুত্বপূর্ণ, এরকম মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন এর আগে আবিষ্কার হয়েছে কিনা সন্দেহ। টাকার অঙ্কে এগুলোর কি দাম হতে পারে ভাবতে গিয়ে চিন্তাশক্তি লোপ পাবার অবস্থা হলো ওর। ওজন দরে সোনা বিক্রি করলে কী দাম পাওয়া যাবে সেটা বের করা সহজ কাজ, কিন্তু প্রাচীন এ শিল্পকর্মের মূল্য তার চেয়ে শত বা সহস্র গুণ বেশি হবে। তাছাড়া, সবে মাত্র শুরু ট্রেজারের কয়েকটা মাত্র নমুনা দেখতে পেয়েছে ওরা। না জানি সামনে আর কত কি আছে।

চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে গলিপথের শেষ মাথায় বিশাল চেম্বারের দিকে ঘুরলো নিকোলাস।

সমাধি, ফিসফিস করলো রোয়েন।

ওরা সামনে বাড়ছে, সেই সঙ্গে পিছিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার। এখন ওরা সমাধির ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। ওটার দেয়ালও চিত্ৰশোভিত, প্রতিটি বিচিত্র বর্ণ থেকে যেনো আগুনের মতো আভা ফুটে বের হচ্ছে। দীর্ঘ এক মানুষের ছবি দেয়াল ধরে সিলিং পর্যন্ত পৌঁছেছে। ওটা দেবী নাট-এর নমণীয়, সর্পিল দেহ, সূর্যের জন্ম দিচ্ছেন। তার ভোলা জরায়ু থেকে সোনালি কিরণ বের হচ্ছে, ফারাও-এর অলকৃত পাথুরে শবাধারকে আলোকিত করছে, মৃত রাজাকে দান করছে নতুন জীবন।

চেম্বারের ঠিক মাঝখানে রাখা হয়েছে রাজকীয় শবাধার, বিশাল এক কফিন, প্রকাণ্ড এক নিরেট গ্র্যানিট থেকে কেটে বের করা। এতো বড় আর অসম্ভব ভারী কফিনটা জলমগ্ন টানেল দিয়ে বয়ে আনতে কতজন ক্রীতদাস লেগেছে, ভাবতে গিয়ে তাজ্জব বনে গেল নিকোলাস।

তারপর কফিনের ভেতর তাকালো ও আর তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে গেল। শবাধারটা খালি। প্রকাণ্ড গ্র্যানিট ঢাকনি তুলে ফেলা হয়েছে, তুলে এমনভাবে এক পাশে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে যে পুরোটা প্রস্থ জুড়ে ফাটল ধরেছে ওটায়, এ মুহূর্তে দু ভাগ হয়ে পড়ে রয়েছে কফিনের পাশের মেঝেতে।

ধীর পায়ে সামনে বাড়লো ওরা, হতাশার তিক্ত স্বাদের সঙ্গে ধুলো মিশছে জিভে। একেবারে কাছে এসে কফিনের ভেতর চারটে জার-এর ভাঙা টুকরো দেখলো ওরা। পাত্রগুলো তৈলস্ফটিক দিয়ে তৈরি, রাজার নাড়িভূঁড়ি, লিভার ও শরীরের অন্যান্য ভেতরকার অঙ্গ রাখার জন্য। ভাঙা ঢাকনিতে দেবতা আর অবাস্তব প্রাণীদের মাথা অলঙ্করণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

ফাঁকা! ফিসফিস করলো রোয়েন। রাজার লাশ গায়েব হয়ে গেছে।

*

দেয়ালচিত্রের ফটো তুলতে কয়েকটা দিন ব্যয় হলো। দেবতা ও দেবীদের মূর্তিও বাক্স বন্দি করা হলো এ সময়। কাজের ফাঁকে খালি শবাধার নিয়ে আলোচনা করলো নিকোলাস ও রোয়েন। রোয়েন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, সমাধির গেটের সীল তো ভাঙা হয় নি।

ওটার একটা ব্যাখ্যা আছে, নিকোলাস তাকে বলল, সম্ভবত টাইটা নিজেই সমাধি থেকে রাজার শরীর আর ট্রেজার সরিয়ে রেখেছিল। সপ্তম স্ক্রোলের বহু জায়গায় এমন বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয়ে দারুণ হতাশ ছিল সে। বলেছিল, তার চেয়ে দেশ ও জাতীর কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারতো এ সম্পদ।

মানতে পারলাম না, রোয়েন জেদ ধরে। এতো কষ্ট করে, নদীর উপর বাঁধ দিয়ে পুলে নামার রাস্তা বন্ধ করলো, এমন জটিল ফাঁদের মধ্যে সমাধি মুখ বানালো, আর এরপর সে কিনা রাজার সমাধি নষ্ট করে ফেলবে? হতেই পারে না। টাইটা অন্তত বিচক্ষণ ব্যক্তি, নিজের মতো করে মিশরে দেব-দেবীদের আরাধনা করতে সে। ওমন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সে কিছুতেই সরিয়ে রাখবে না। এ সমাধির কিছু একটা ব্যাপার আমার এখনো বোধগম্য নয়, কেমন যেনো অদ্ভুত–ফারাও-এর দেহ নেই, দেয়ালচিত্রগুলোও কেমন যেনো।

ফারাও-এর বডির কথা না হয় মানলাম, কিন্তু ছবিগুলোকে কেনো অদ্ভুত বলছেন? নিকোলাস জানতে চায়।

ঠিক আছে, দেখাচ্ছি, এক হাত দিয়ে আইসিস-এর ছবিটা ইঙ্গিত করলো রোয়েন। সুন্দর আঁকা–সন্দেহ নেই, দারুণ কোনো শিল্পীর কাজ। কিন্তু ওগুলোর মধ্যে যত্নের ছাপ কম। কেমন যেনো কাঠখোট্টা আঁকা–জীবন্ত নয়, কখনোই মনে হয় না, একজন জিনিসের সৃষ্টি। রাণী লসট্রিসের সমাধির যেখানে আমরা অ্যালাবাস্টারের জারে স্ক্রোলগুলো খুঁজে পেয়েছিলাম সেগুলোর তুলনায় এরা কিছুই না।

চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে দেয়ালচিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করছে নিকোলাস। মনে হয়, ঠিক বলেছেন। এমনকি, মঠে ট্যানাসের সমাধির আঁকাও এরচেয়ে অনেক অভিজাত।

ঠিক তাই! খুশি মনে বলে রোয়েন। ওগুলো টাইটার নিজের হাতের পেইন্টিং। কিন্তু এগুলো তার নয়–কোনো একজন নকলবাজের।

চিত্রের কোন বার্তা আপনার কাছে অপছন্দনীয় লাগছে?

এমন কোনো মিশরীয় সমাধির কথা শুনেছেন, যেখানে মৃতের পুস্তক থেকে কোনো উদ্ধৃতি নেই? যেখানে স্বর্গের সাতটি প্রবেশদ্বার মৃতব্যক্তি কেমন করে পার হবেন–তার কোনো বর্ণনা নেই?

এখান থেকে আপনি জেনি বাদেনহোর্সটের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কীভাবে?

মাথা নিচু করে ভাবছে নিকোলাস। কিছু না বলে রোয়েনের কাছ থেকে সরে এলো ও। মেয়েটার কথা নিয়ে একান্তে ভাবা প্রয়োজন। সমস্ত ট্রেজার প্যাকিং করা তদারকি করার ফাঁকে ফাঁকে ওটা নিয়েই ভাবতে চাইছে সে।

ছয়টা পবিত্র মূর্তি বড়ো বড়ো বাক্সে এঁটে গেল, কিন্তু দেবী হ্যাঁথোর এবং দেবতা সেথ-এর মাথাটা বিশেষ বড়ো হয়ে গেছে বাক্সের জন্য। নিকোলাসের ধারণা, এ দুই অংশ আলাদা ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। সেথ-এর মাথা আলাদা করা সম্ভব। ধীরে ধীরে কাঠের পেরেক খুলে অংশে অংশে আলাদা করা হলো বিশাল মূর্তিদ্বয়।

নিকোলাসের পর্যবেক্ষণের সমানে হানশিত সুসম্পন্ন করলো প্যাকিং। সব কিছু গোছানো শেষ হতে রোয়েনের কাছে ফিরে নিকি দেখলো, শূন্য শবাধারের কাছে বসে দেয়াল লিখন পড়ছে মিশরীয় সুন্দরী।

আপনি ঠিক বলেছেন, সায় দিয়ে বলল নিকোলাস। এখানে মৃতের পুস্তক থেকে কোনোই উদ্ধৃতি নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত। কিন্তু কী করার আছে আমাদের? এ রহস্য, রহস্যই থাকবে।

নিকি, ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। আমার পুরো সত্তা বলছে–আমরা কিছু একটা মিস করছি।

আমি বেচারা মাথামোটা, একজন সুন্দরী-বিদূষী নারীর ইন্সটিঙ্কট নিয়ে কেনো প্রশ্ন তুলবো?

জ্বালাবেন না। এখন বলুন, এ সমাধির হায়ারোগ্লিফিকস্ নিয়ে কতোটা সময় কাজ করতে পারবো আমি?

খুব বেশি হলে দুই সপ্তাহ। জেনির সাথে রেডিও যোগাযোগ করতে হবে আমাকে। ও আমাদের রোসেইরেস এয়ারস্ট্রিপ থেকে তুলে নেওয়ার কথা। এর কোনো অন্যথা করা যাবে না।

আরে, আগে কেননা যোগাযোগ করেন নি? রোয়েন বলল অবাক হয়ে। এখন কি করে যোগাযোগ করবেন?

ডেবরা মারিয়ামে একটা পাবলিক টেলিফোন আছে, পোস্ট অফিসে, হেসে বলল নিকোলাস।

টিসে তো গোজামের যে কোনো জায়গায় অনায়েসে ঘোরাফেরা করতে পারে। একদল সন্ন্যাসী থাকবে এসকর্ট হিসেবে, এসকাপমেন্টে উঠে ব্রিটিস এমব্যাসির জিওফ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবে টিসে, জিওফ্রে মেসেজটা পৌঁছে দিবে জেনির কাছে।

কবে যাবে টিসে?

মেক বলেছে, কাল। মাল্টা থেকে প্লেন নিয়ে রওনা হবার জন্য জেনিকে সময় দেওয়া দরকার, কিন্তু প্লেন পৌঁছতে দেরি হলো, কিংবা প্লেন পৌঁছল, আমরা পৌঁছতে দেরি করলাম-এরকম হলে বিপদ ঘটতে পারে। সঠিক টাইমিং হতেই হবে।

*

পয়লা এপ্রিল ভোরবেলা, টিসেকে মেসেজটা দিল নিকোলাস। জেনিকে তুমি বলবে, এপ্রিল ফুলস ডে-র ভোরবেলা ওঁকে পৌঁছতে হবে রদেভোয়। তারিখটা মনে রাখতে সুবিধে হবে।

সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তখুনি রওনা হয়ে গেল টিসে। বেশ খানিক দূর চলে গেছে সে, হঠাৎ রোয়েন বলল, ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে! ছুটলো ও। এই টিসে! টিসে, দাঁড়াও!।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের ঘনঘটা দেখে গম্ভীর হয়ে উঠলো নিকোলাস।

দাঁড়িয়ে পড়েছে টিসে, হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে পৌঁছল রোয়েন। ওরা দু জন কথা বলছে, আবার ঢালের উপর আকাশের দিকে তাকালো নিকোলাস, ভাবছে সময়ের আগেই না বর্ষা শুরু হয়ে যায়। তারপর আবার যখন ওদের দিকে তাকালো, দেখলো টিসের হাতে কী যেনো একটা গুঁজে দিল রোয়েন। শার্টের পকেটে সেটা খুঁজে মাথা ঝাঁকালো টিসে, তারপর আবার সন্ন্যাসীদের পিছু নিয়ে রওনা হয়ে গেল। রোয়েন ফিরে আসতে নিকোলাস জানতে চাইলো, কী ব্যাপার, রোয়েন?

মেয়েদের অনেক গোপন ব্যাপার থাকে, জবাব দিল রোয়েন। সব কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না। তারপর হেসে উঠে বলল, জিওফ্রের মাধ্যমে মামিকে একটা মেসেজ পাঠাতে বললাম টিসেকে, জানাতে চাই আমি ভালো আছি।

উত্তরটা নিকোলাসকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। মায়ের ফোন নম্বর টিসেকে দেওয়ার জন্য আগেই একটা কাগজে লিখে রেখেছিল রোয়েন? তাহলে সবার সামনে কেন টিসেকে দিল না? ঠিক আছে, সিদ্ধান্ত নিল নিকোলাস, টিসে ফিরে এলে আসল ব্যাপার জেনে নিবে ও।

টানেলের ভেতর সিঁড়িটার গোড়ায় ওয়ার্কশপ তৈরি করেছে ওরা। হানশিত শেরিফ একটা টেবিল বানিয়ে দিয়েছে, তাতে রোয়েনের ড্রইং, বই, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি ছড়ানো। ড্যানিয়েল একটা ফ্লাডলাইটেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাশের দেয়ালে আটটা ক্রেটে রয়েছে দেব-দেবীদের মূর্তি। সিঙ্ক-হোলের উপর ভাসমান সেতুতে কমান্ডার মেকের সশস্ত্র গেরিলারা চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে। টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে রোয়েনকে-ফটোগ্রাফ পরীক্ষা, দেয়ালচিত্রের মাপজোক, শিলালিপির অনুবাদ, কাজের কোনো শেষ নেই। কোনো কোন দিন একটানা পনেরো ঘণ্টাও কাজ করে। এক পর্যায়ে রেগে যায় নিকোলাস, হুকুমের সুরে ঘুমাতে যেতে বলে।

আজও ঠিক তাই ঘটলো। ধমক খেয়ে টানেল থেকে বেরিয়ে চওড়া কার্নিসে চলে এলো রোয়েন, এখানেই ওদের ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। মশারি আগেই টাঙানো হয়েছে, ভেতরে ঢুকে শ্লীপিং ব্যাগে আশ্রয় নিল। একটু দূরে নিকোলাসও শুলো।

মাত্র তিন ঘণ্টা পর সকাল হয়ে গেল। ঘুম ভাঙার পর রোয়েনকে ওর মশারির ভেতর দেখতে পেল না নিকোলাস। মাখন, ইনজেরা রুটি আর সেদ্ধ ডিম খেল। হাতে দুকাপ কফি নিয়ে টানেলে ঢুকলো, সেতু পেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় উঠে এলো। গ্যালারিতে পৌঁছে দেখলো ওসিরিস-এর খালি শ্রাইনের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে কী যেনো দেখছে রোয়েন। বাম হাতের গরম কাপটা ওর বাহুতে ঠেকাতে চমকে উঠলো ও। রেগে গিয়ে বলল, আমাকে আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।

কী দেখছেন? জানতে চাইলো নিকোলাস, রোয়েনের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিল কাপটা। কী আবিষ্কার করলেন?

বলতে হলে দেখাতে হবে, জবাব দিল রোয়েন। আসুন আমার সঙ্গে। নিকোলাসকে নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায়, নিজের ওয়ার্কশপে নেমে এলো ও। কয়েকদিন ধরে আমি শুধু ট্যানাস-এর সমাধিতে পাওয়া ফলকের এক পাশের লিপি অনুবাদ করেছি। সবই মুল বই থেকে নিয়ে খোদাই করা, একটা লাইনও টাইটার নয়। সব আমি নোটবুকে লিখে রেখেছি। নোটবুকটা নিকোলাসকে দেখালো ও তারপর একপাশে সরিয়ে রাখলো। দ্বিতীয় নোটবুকটা হাতে নিল। এটায় আছে ফলকের চতুর্থ পাশের লিপির নকল। এগুলোর অর্থ আমি জানি না। শুধু সংখ্যার লম্বা তালিকা। সম্ভবত কোনো ধরনের কোড বা সঙ্কেত। তবে এ ব্যাপারে আমার একটা আইডিয়া আছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

এবার এটা দেখুন, বলে তৃতীয় একটা নোটবুক হাতে নিল রোয়েন। এখানে রয়েছে ফলকের তৃতীয় দিকটায় যে লিপি পাওয়া গেছে তার অনুবাদ। এগুলো উদ্ধৃতি হতে পারে না, কারণ প্রাচীন কোনো ক্লাসিক্যাল বইতে এ সব আমি পাই নি। এগুলোর বেশিরভাগই, আমার ধারণা টাইটার লেখা। সে যদি আরো কোনো সূত্র রেখে গিয়ে থাকে, এ লিপির মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

দুষ্ট ক্ষীণ হাসি ফুটলো নিকোলাসের ঠোঁটে। এটা সেই অংশ না, দেবীর লালচে আর ব্যক্তিগত অঙ্গের বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে?

নোটবুক থেকে মুখ তুলতে পারলো না রোয়েন। আপনি দেখছি ভোলার বান্দা নন। সামান্য একটু লালচে হলো ওর চেহারা। ফলকের তৃতীয় দিকের মাথায় কী লেখা ছিল দেখুন। টাইটা এ দিকটার নামকরণ করেছে, শরৎ। সবচেয়ে আগে এটাই আমার চোখে পড়েছিল।

সামনের দিকে ঝুঁকে হায়ারোগ্লিফিক্স পড়লো নিকোলাস, পড়ছি-ষড় চতুষ্টয়ের নিয়ম মেনে নিয়ে মহান দেবতা ওসিরিস প্রথম চাল দিলেন। হ্যাঁ, এ অংশটুকু আগেও পড়েছি আমি। টাইটা বাও খেলার কথা বলছে এখানে, খেলাটা সে সাংঘাতিক ভালোবাসত।

হ্যাঁ, বলল রোয়েন। এবার বলুন, আমি যে স্বপ্নটার কথা বলেছিলাম, তা কি আপনার মনে আছে? যে স্বপ্নে ডুরেঈদকে সমাধির একটা চেম্বারে দেখি আমি?

দুঃখিত, বলল নিকোলাস। মনে করিয়ে দিলে খুশি হই।

সেই স্বপ্নে ডুরেঈদ আমাকে বলেন, ষড় চারটের আচরণ বিধি মনে রাখবে-শুরু করবে প্রথম থেকে।

খেলাটা সম্পর্কে আমি বিশেষজ্ঞ নই। স্বপ্নে তিনি আপনাকে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?

খেলাটার নিয়ম বা কৌশল এতো হাজার বছর পর হারিয়ে গেছে। তবে আপনি জানেন, এগারো আর সতেরোতম সাম্রাজ্যের সমাধির ভেতর পাওয়া জিনিসপত্রের সঙ্গে বাও বোর্ডও ছিল, তা থেকে ধরে নেওয়া চলে যে দাবা খেলারই অনুন্নত সংস্করণ ছিল সেটা। নোটবুকের খালি একটা পৃষ্ঠায় স্কেচ আঁকলো রোয়েন। কাঠের বেৰ্ডি, মেলা হত দাবার বোর্ডের মতো করে, খুঁটি হিসেবে থাকত আট সারি চওড়া কাপ, আট সারি গভীর কাপ। ওগুলো ছিল রঙিন পাথর, প্রত্যেকের আচরণ নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা। বিশদ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, তবে প্রথমেই চারটে ষাঁড়ের চাল দেওয়া টাইটার মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়দেরই শোভা পায়। এ চালের অর্থ হলো, কিছু খুঁটি বিসর্জন দিয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রথম সারির কাপগুলোকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে বোর্ডের মাঝখানটায় প্রভাব বিস্তার করা যায়।

বলে যান, শুনছি।

ছকের প্রথম সারির কাপ, ইঙ্গিতে স্কেচটা দেখালো রোয়েন। ডুরেঈদ বলেছেন, প্রথম থেকে শুরু করবে। আর টাইটা বলেছে, মহান ওসিরিস প্রথম চাল দিলেন।

ঠিক বুঝলাম না।

আসুন আমার সঙ্গে, বলে নোটবুক হাতে সাদা প্লাস্টার করা দরজার হ্যাঁচ দিয়ে ভেতরে ঢুকলো রোয়েন, দাঁড়ালো ওসিরিস-এর শ্রাইন-এর কাছে। প্রথম চাল। শুরু। গ্যালারির দিকে মুখ করলো ও। এটা প্রথম শ্রাইন। সব মিলিয়ে কয়টা শ্রাইন?

আটটা।

বাহ্, হারপার নিকোলাস দেখছি শুনতেও জানেন!

আটটা উপর-নিচে, আটটা আড়াআড়ি… থেমে গেল নিকোলাস, রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন

জবাব না দিয়ে নোটবুকটা খুলল রোয়েন। এখানে যে সংখ্যা আর সঙ্কেত রয়েছে, অর্থবহ ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়। একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো রকম সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। শুধু একটা ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি, তালিকায় এমন কোনো সংখ্যা নেই যেটা আট-এর চেয়ে বড়।

কী যেনো বুঝেও বুঝতে পারছি না।

আজ থেকে চার হাজার বছর আগে কেউ যদি দাবার চাল ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করত, সে কী এভাবে সংখ্যা সাজিয়ে রাখত না?

আপনি বলতে চাইছেন, টাইটা আমাদের সঙ্গে বাও খেলা খেলছে।

হ্যাঁ, আর প্রথম শ্রাইনটাই টাইটার প্রথম চাল।

কিন্তু খেলার নিয়ম যেখানে জানি না, টাইটার সঙ্গে এ খেলা আমরা খেলব কীভাবে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

*

হের ফন শিলার ডেকে পাঠিয়েছেন, গর্বিত ভঙ্গিতে কনফারেন্স রুমে ডুকলেন কর্নেল টুমা নগু। পিছু নিয়ে ঢুকলেন নাহুত গাদ্দাবিও, তিনিও নিজের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য চেহারায় ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। উতে কেম্পারের সঙ্গে কথা বলছিলেন ফন শিলার, ওদেরকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন, এগিয়ে এলেন দ্রুত। নাহুতকে যেনো দেখতেই পান নি, কর্নেলকে প্রশ্ন করলেন, কাল আমাকে রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। খাদ থেকে আপনার ইনফরমার কোনো মেসেজ পাঠায় নি?

এক নিমেষে চুপসে গেলেন কর্নেল নগু। জার্মান বিলিওয়ানিয়ারকে খুব ভয় পান তিনি। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত, হের ফন শিলার। নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে মেয়েগুলো ফিরতে দেরি করে ফেলেছে।

বুঝলাম, কিন্তু খবর পেতে দেরি হলে আমার তো চলবে না, কর্কশ সুরে বললেন ফন শিলার। রিপোর্ট দিন।

নিকোলাস বাঁধের কাজ শেষ করেছেন সাতদিন আগে। ভাটির দিকে সরে গেছেন তিনি, ঝুলন্ত মাচা বানিয়ে নালায় নেমেছেন। আমার ইনফরমার জানিয়েছে, খালি হ্রদের তলায় একটা ফাঁক পরিষ্কার করছে ওরা।

একটা ফাঁক? কী ধরনের ফাঁক? অসুস্থ দেখালো হের ফন শিলারকে।

গর্ত বা ফাটল হবে…।

ব্যাখ্যা করুন, বর্ণনা দিন। ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করছেন ফন শিলার।

যে মেয়ে মেসেজটা নিয়ে এসেছে তার মাথায় খুব একটা বুদ্ধি নেই, হের:ফন শিলার, বললেন নগু। পানি সরে যাবার পর হ্রদের তলায় নাকি একটা ফাঁক বা গর্ত দেখা গেছে। আবর্জনায় ভরা ছিল।

ওটা একটা টানেল! হিসহিস করে উঠলেন ফন শিলার। সমাধির ভেতর ঢোকার পথ পেয়ে গেছেন ওঁরা। আর কী দেখেছে সে?

মেয়েটা বলছে, ফাঁকটার ভেতর একটা গুহা আছে। পাথরের কুলুঙ্গি আর দেয়ালচিত্র আছে…

ওহ, গড! দেয়ালচিত্র মানে কি? খ্রিস্টান সেইন্টদের ছবি?

নাহুত বললেন, তা সম্ভব নয়, হের ফন শিলার। আমি আপনাকে বলছি, হারপার নিকোলাস ফারাও মামোসের সমাধি আবিষ্কার করেছেন।

আপনি চুপ থাকুন। হুংকার ছাড়লেন ফন শিলার। কর্নেলের দিকে ফিরলেন তিনি। মেয়েটা কী বলেছে সব আমাকে জানান।

দেয়ালচিত্র আর মূর্তির কথাই শুধু বলেছে, হের ফন শিলার। দুঃখিত।

বাক্সে ভরেছেন, বললেন নগু।

নিকোলাস কি শ্রাইনে কোনো মমি পাননি?

আমি জানি না, হের ফন শিলার। মেয়েটা আর কিছু বলতে পারে নি।

কোথায় সে? আমার কাছে আনুন তাকে। আমি নিজে তাকে জেরা করতে চাই।

কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্রাম্য এক তরুণীকে কনফারেন্স রুমে নিয়ে আসা হলো। তার মুখে লাল আর কালো কালি দিয়ে ডোরা কাটা দাগ, পরনে ঢোলা আলখেল্লা, কোলে দুধের বাচ্চা। আলখেল্লা সরিয়ে স্তনের বোঁটাটা বাচ্চার মুখে পুরে দিল সে। শিশু ও মা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিলারের দিকে।

ওকে জিজ্ঞেস করুন কুলুঙ্গি বা শ্রাইনে কোনো কফিন ছিল কিনা।

এক মিনিট মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেন কর্নেল। তারপর ফন শিলারকে। জানালেন, বোকা মেয়েলোক। বলছে, লাশ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তবে মূর্তিগুলো বাক্সে ভরা হয়েছে। ওগুলো পাহারা দিচ্ছে একদল সৈনিক।

সৈনিক? সৈনিক মানে?

ও আসলে মেক মেক নিমুরের গেরিলাদের কথা বলতে চাইছে, ব্যাখ্যা করলেন নগু। কমান্ডার মেক এখনো নিকোলাসের সঙ্গে আছেন।

মোট কটা বাক্স? কটা মূর্তি? জানতে চাইলেন ফন শিলার।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটিকে। তারপর ফন শিলারকে বলরেন, পাঁচটার কম নয়, দশটার বেশি নয়। ও ঠিক জানে না।

একেকটা কত বড়?

কর্নেলের প্রশ্ন শুনে একটা হাত পুরোপুরি লম্বা করে দেখালো মেয়েটি।

ফন শিলার বললেন, সংখ্যায় এতো কম? আকারে এতো ছোট? জানালার সামনে এসে বাইরে তাকালেন তিনি। মেয়েটা যদি মিথ্যে কথা না বলে, নিকোলাস এখনো মামোসের ট্রেজার আবিষ্কার করতে পারেন নি। আরো অনেক বেশি থাকার কথা। :

মেয়েটির সঙ্গে এখনো কথা বলছেন কর্নেল নগু। শিলারের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ও বলছে, টিসে নামে একটা মেয়ে নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে ডেবরা মারিয়ামে গেছে, সঙ্গে আছে সন্ন্যাসীদের একট দল। মেয়েটিকে আমি চিনি, হের ফন শিলার। এক রাশিয়ান শিকারীকে বিয়ে করেছিল, এখন অবশ্য মেকের মনোরঞ্জন করছে।

ছুটে মেয়েটির সামনে ফিরে এলেন ফন শিলার। টিসে? ডেবরা মারিয়াম? কেন, ডেবরা মারিয়ামে কী করছে সে?

প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়লো মেয়েটি। তারপর অ্যামহ্যারিক ভাষায় কিছু বলল। কর্নেল জানালেন, ও বলছে, কী করছে তা ও জানে না, তবে এখনো সে ডেবরা মারিয়ামে আছে।

মেঝেতে দুধ ফেলছে। ভাগান ওকে, তাড়ান! ঘৃণায় মুখ কোচকালের ফন শিলার। মেয়েটা চলে যেতে কর্নেলকে তিনি বললেন, এই টিসে সম্পর্কে আর কি জানেন বলুন আমাকে।

আদ্দিস আবাবার অভিজাত পরিবারের মেয়ে সে, বললেন নগু। ওদের পরিবারের সঙ্গে সম্রাট হাইলি সেলাসির রক্তের সম্পর্ক আছে বলে শোনা যায়। রাস টাফারি মাকোনেন গোত্রের।

সে যদি গেরিলা কমান্ডার মেকের মেয়েমানুষ হয়, আর যদি নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে এসে থাকে, আমরা তার কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারি, বললেন ফন শিলার। কাজেই তাকে আমি চাই।

প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে, কিডন্যাপ করে আনলে, সমস্যা হতে পারে, চিন্তিত দেখালো কর্নেলকে। তবে আমি তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে গ্রেফতার করে আনতে পারি। আর সে যদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে, তাকে আদ্দিস আবাবায় ফিরে যেতে দেওয়া যাবে না। ওদের পরিবার আমাদের জন্য বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।

আপনার পরামর্শ কী? জানতে চাইলেন ফন শিলার।

জেরা করার পর ছোট একটা অ্যাক্সিডেন্ট।

যা ভালো বোঝেন করবেন, বললেন ফন শিলার। তবে কোনো কাজেই আমি খুঁত দেখতে চাই না। বলে, নাহুতের চোখে তাকালেন তিনি, ভয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো নাহুত।

*

ওসিরিস-এর শ্রাইন আরো একটা দিন পরীক্ষা করলো ওরা। এখন এমন কী চোখ বুজেও শ্রাইনের উপর দেয়ালচিত্রগুলো পরিষ্কার দেখতে পায় ওরা। এরপর ট্যানাস-এর সমাধিতে পাওয়া ফলকের লিপিগুলো মুখস্থ করে ফেললো, রোয়েনের নোটবুকে লেখা অনুবাদ পড়ে। একজন পড়ে, অপরজন দেয়ালচিত্রের দিকে তাকিয়ে মিল বা তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা করে।

আমার প্রেম উত্তপ্ত মরুভূমিতে পাত্র ভর্তি ঠাণ্ডা পানি। আমার প্রেম বাতাসে পতপত করা পতাকা। আমার প্রেম সদ্যোজাত শিশুর প্রথম ক্রন্দন।

দেয়াল থেকে চোখ নামিয়ে হাসলো রোয়েন। টাইটা মাঝে মধ্যে খুব রোমান্টিক হয়ে পড়ে।

কাজে এ লাগান। এখানে আমরা কাব্যচর্চা করতে আসি নি।

নীরস, বিড়বিড় করলো রোয়েন, তবে আবার চোখ তুললাম দেয়ালে।

এখানে দেখুন–নিকোলাস পড়ে, বহু সম্পর্কের মাঝে জড়িয়ে আমরা মিছে বলি, এ সম্পর্ক হতে পারে শিশুর সঙ্গে মায়ের, প্রেমিক আর প্রেমিকার, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের, নারীর সঙ্গে পুরুষের।

এই নিয়ে আজ সকালে তিনবার এ লাইনটা পড়লেন। কী এমন আছে এতে? রোয়েন ঝঝিয়ে উঠে। একটু লাল হয়ে গেছে ওর গাল।

দুঃখিত। ভেবেছিলাম, এটাও আপনার কাছে রোমান্টিক লাগবে! বিড়বিড় করে নিকোলাস। আচ্ছা, এটা পড়ি—

আমি ভুগেছি আবার ভালোবাসাও পেয়েছি। ঝড়-ঝাঁপটা আমাকে টলাতে পারে নি। তীর আমার মাংসভেদ করে গেছে, কিন্তু কোনো ক্ষতি করতে পারে নি। সামনে পড়ে থাকা সরল অথচ ভুল পথ আমি এগিয়ে গেছি। আমি গোপন সিঁড়ি ধরেছি, পৌঁছে গেছি দেবতাদের আসন পর্যন্ত।

লম্বা গ্যালারি ধরে সামনে তাকালো রোয়েন। এই কথাগুলোর মধ্যে কিছু থাকতে পারে। সামনে পড়ে থাকা সরল অথচ ভুল পথ… গোপন সিঁড়ি? কাল থেকে চুল সরালো ও। নাহ, নিকোলাস, আমার আর ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না। কোত্থেকে শুরু করব তাই তো বুঝতে পারছি না।

ধৈৰ্য্য হারালে চলবে কেন, বলল নিকোলাস, হাসলো। আসুন, আপনার বন্ধুর মতো প্রথম থেকে শুরু করি। পড়ছি আবার, কেমন? প্ৰকাণ্ড ডানায় ভর দিয়ে শকুন আকাশে উড়লো সূর্যকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য–

নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে হাসতে যাবে রোয়েন, হঠাৎ সামনের দেয়ালে চোখ পড়তে স্থির হয়ে গেল। শকুন! বলে হাত তুলে নিকোলাসের পেছনের দেয়ালটা দেখালো। ঘুরে সেদিকে তাকালো নিকোলাস।

ওদিকে একটা শকুন রয়েছে, ছবিটা এতো সুন্দর যে কোনো তুলনা হয় না। সুতীক্ষ দৃষ্টি থেকে যেনো আগুন ঝরছে, হলুদ ঠোঁট বাঁকা ও চুঁচালো। ডানাগুলো পুরোপুরি মেলা, প্রতিটি পালকের কিনারা বহুমূল্য পাথরের আকৃতিতে রঙ করা। প্রায় নিকোলাসের মতোই লম্বা পাখিটা, তবে মেলে দেওয়া ডানা অর্ধেক দেয়াল দখল করে রেখেছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সরাসরি মাথার উপর সিলিংয়ে তাকালো রোয়েন, তারপর নিকোলাসের বাহু ছুঁয়ে ওকেও তাকাবার তাগিদ দিল।

সূর্য, ফিসফিস করলো রোয়েন। আমন রা-র সোনালি সুর্য-চাকতি আঁকা হয়েছে। গম্বুজ আকৃতির ছাদের সবচেয়ে উঁচু অংশে। সূর্যের আভা যেনো ছায়াগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে। রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সম্ভাব্য সবগুলো দিকে, তবে এটা রশ্মি দেয়ালের মোচড় খাওয়া অংশ অনুসরণ করে নেমে এসে আলোকিত করে রেখেছে শকুনটাকে। সূর্যকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আকাশে উড়লো শকুন, আবার বলল রোয়েন। টাইটা কি আক্ষরিক অর্থেই বলেছে কথাটা?

সামনে এগিয়ে এসে দেয়ালচিত্রটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করলো নিকোলাস, হাত বুলাল ডানা, পেট আর বাঁকা ঠোঁটের উপর। পেইন্টের নিচে প্লাস্টার করা দেয়াল মসৃণ। হাতে কিছুই ঠেকে না।

মাথাটা, নিকোলাস! মাথাটা দেখুন! লাফ দিয়ে শকুনের মাথা ছুঁতে চাইলে রোয়েন, কিন্তু নাগাল পেল না। আপনি চেষ্টা করুন।

এবার নিকোলাসও শকুনের মাথার একপাশে সূক্ষ্ম একটা ছায়া দেখতে পেল, যেখানে ফ্লাডলাইটের আলো ক্ষীন বাধা পেয়েছে। হাত তুলে স্পর্শ করার পর বুঝতে পারলো দেয়ালের যে অংশে মাথাটা আঁকা হয়েছে সেটা দেয়ালের অন্যান্য অংশের চেয়ে চুল পরিমাণ ফুলে আছে। উঠলো একটু ভাব থাকলেও, কোনো জয়েন্ট আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, রোয়েনকে বলল ও। একদম মসৃণ, একটা দেয়ালেরই অংশ মনে হচ্ছে।

চাপ দিন। চাপ দিন! শকুনের মাথাটা সূর্যের দিকে ঠেলুন! তাগাদা দিল রোয়েন।

মাথায় তালু ঠেকিয়ে তাই করলো নিকোলাস। কই, কিছুই তো ঘটছে না।

চার হাজার বছর ধরে এঁটে বসে আছে, জোর খাটান!

জোর খাটালো নিকোলাস। হতাশ দেখালো ওকে। এ নিরেট দেয়াল, নড়বে না।

আমাকে তুলুন। আমাকে দেখতে দিন। রোয়েনের কথামতো ওর কোমরে দুহাত রেখে ওপরে তুললাম নিকোলাস। আঙুলের ডগা দিয়ে পরীক্ষা করছে। রোয়েন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, নিকোলাস! কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছেন আপনি। মাথার চারপাশের আউটলাইনের রঙে ফাটল ধরেছে। আঙুলে অনুভব করছি। আরো ওপরে তুলুন আমাকে।

রোয়েনকে আরো একটু ওপরে তুললাম নিকোলাস।

হ্যাঁ, কোনোই সন্দেহ নেই! উল্লাসে কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। কিছু একটা নড়ে গেছে। মাথার উপর দেয়ালে সরু চুলের মতো খাড়া ফাটলও দেখতে পাচ্ছি। আপনি নিজেই দেখুন।

খালি অ্যামুনিশনের একটা ক্রেট এনে শকুনটার নিচে রাখলো নিকোলাস, সেটার উপর উঠে দাঁড়াতে শকুন আর ওর চোখ একই লেভেল থাকলো। চেহারা বদলে গেল ওর। পকেট নাইফ বের করে মাথাটার আউটলাইনের মেঝেতে। মনে হচ্ছে মাথাটা আলাদা একটা অংশ, স্বীকার করতে হলো ওকে। ওটার উপর খাড়া একটা চিড়-ও এখন দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তাতে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে এদিক ওদিক চাপ দিতে তিন ফুট প্লাষ্টার খসে পড়লো। টাইলের মেঝেতে পড়া মাত্র মিহি ধুলোয় পরিণত হলো সেটা। দেয়ালে একটা ফাটল তৈরি হয়েছে। একটা খাজ বলে মনে হচ্ছে। পুরোটা পরিষ্কার করলে বোঝা যাবে আসলে কী।

নিচে আরো প্লাস্টার খসে পড়লো। হাঁচি দিচ্ছে রোয়েন। কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ছে না।

হ্যাঁ, খাড়া একটা খুঁজই বটে, উপর দিকে উঠে গেছে, বলল নিকোলাস। এরপর শকুনের মাথার আউটলাইন থেকে প্লাস্টার খসাতে শুরু করলো। মাথাটা এখন মুক্ত, কাজটা শেষ করে বলল। দেখে মনে হচ্ছে খাজ ধরে উপর দিকে ওঠানো যাবে এটাকে। চাপ দিয়ে দেখবো?

একশো বার! হাজার বার! রুদ্ধশ্বাসে বলল রোয়েন।

শকুনের মাথার নিচে দুই হাতের তালু ঠেকিয়ে চাপ দিল নিকোলাস। চোখ-মুখ কুঁচকে উঠলো ওর। সেই সঙ্গে রোয়েনেরও, যেনো নিকোলাসের সঙ্গে সে-ও চাপ দিচ্ছে।

নরম একটা ঘষা খাওয়ার আওয়াজ হলো, মৃদু ঝাঁকি খেতে খেতে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে মাথাটা। খাঁজের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ওরা। লাফ দিয়ে বাক্স থেকে নেমে পড়লো নিকোলাস।

দু জনেই ওরা বিচ্ছিন্ন মাথাটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকলো। দীর্ঘ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর ফিসফিস করলো রোয়েন, কই, কিছুই তো ঘটছে না!

ফলকের বাকি লেখা কী বলে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

তাই তো! দেয়ালের চারদিকে চোখ বুলাল রোয়েন, তারপর মুখস্থ বলে গেল, আরো লেখা আছে-শিয়াল ডেকে উঠে লেজের দিকে ঘুরে গেল। খুদে আনুবিস-এর ছবির দিকে কাঁপা একটা হাত তুললাম ও, কবরস্থানের দেবতা আনুবিস-এর মাথাটা শিয়ালের। শকুনের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে তাঁর ছবিটা, ওসিরিস-এর প্রকান্ড ছবির নিচে। সেদিকে ছুটলো রোয়েন, শিয়ালের মাথায় তালু রেখে চাপ দিল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

সরুন, আমি দেখছি, বলে ছুরির ফলা দিয়ে শিয়ালের মাথার চারপাশ থেকে প্লাস্টার খসাল নিকোলাস। তারপর নতুন করে চাপ দিল। শুধু মাথা নয়, গোটা ছবিটা ঘুরে যেতে শুরু করলো, যতক্ষণ না কালো হলুদ টানলোসের দিকে ফিরলো।

দু জনেই পিছিয়ে এসে তাকিয়ে থাকলো, প্রত্যাশায় চকচক করছে দু জোড়া চোখ। কিন্তু এবারও কিছু ঘটল না।

ফলকে আরো একটা কথা লেখা আছে, বিড়বিড় করলো রোয়েন। মনে পড়ে? নদী জমিনের দিকে গড়ায়। পবিত্র স্থানের অমর্যাদাকারীরা সাবধান, তোমাদের উপর সমস্ত দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে।

নদী? আমি তো দেয়ালে কোনো নদী দেখছি না।

দেয়ালে তন্নতন্ন করে খুঁজছে রোয়েন। পেয়েছি! হাপি! উত্তেজনায় সরু ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো কণ্ঠস্বর। নীলনদের দেবতা! নদী।

মহান দেবতা ওসিরিস-এর মাথার সঙ্গে একই সমতলে রয়েছেন নদীর দেবী। হাপি উভলিঙ্গ, বুকে স্তন আছে, উঠলো পেটের নিচে পুরুষের জননেন্দ্রিয়। মাথাটা জলহস্তীর, হাঁ করা, চোয়ালের ভেতর বিশাল গহ্বর দেখা যাচ্ছে।

কয়েকটা অ্যামুনিশন ক্রেটের উপর দাঁড়িয়ে হাত লম্বা করলো নিকোলাস, ছুঁতে পারলো হাপিকে। পরীক্ষা করার পর বলল, এটাও আলাদা করা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

নদী জমিনের দিকে গড়ায়, নিকোলাস। তার মানে নিচের দিকে নামবে ওটা। টানুন।

আগে কিনারাগুলো পরিষ্কার করতে দিন। কাজটা শেষ করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। ছুরিটা পকেটে রেখে দিয়ে নিকোলাস বলল, এবার কিছু একটা ঘটবে বলে মনে হচ্ছে। তৈরি থাকুন। আমার জন্য একটু দোয়াও করতে পারেন।

দেবতার ছবিতে দু হাতের তালু রেখে নিচের দিকে চাপ দিল নিকোলাস, ধীরে ধীরে শক্তি বাড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুই নড়লো না। কাজ হচ্ছে না।

দাঁড়ান, আমি আসছি! বাক্সের উপর উঠে নিকোলাসের পেছনে দাঁড়ালো রোয়েন, ওর দুই কাঁধের উপর দিয়ে সামান্য বাড়ালো হাত দুটো, দেবতার ছবির উপর তালু।

দু জন মিলে চাপ দিচ্ছে। আরে, নড়ছে দেখছি! হঠাৎ করে হাপির ছবি আলগা হয়ে গেল, ছুটে গেল ওদের হাত থেকে, তীক্ষ্ণ ঘষা খাওয়ার শব্দের সঙ্গে খাজ ধরে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নেমে এলো।

ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় বাক্স সহ নিচে পড়ে গেল ওরা, নিকোলাসের পিঠে বসে আছে রোয়েন। এক মুহূর্ত পর দু জনেই লাভ দিয়ে সোজা হলো।

কী ঘটলো? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, তারপরই ঝট করে ছাদের দিকে তাকালো। উপর থেকে গুরুগম্ভীর একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। কী ঘটছে বলুন তো? ওর গলায় আতঙ্ক। দু জনেই মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভুল, নাকি সত্যিসত্যি গোটা ছাদ নড়ছে?

শব্দটা ভৌতিক লাগছে না? ফিসফিস করলো নিকোলাস। যেনো ছাদের কোথাও বিশাল কোনো প্রাণী নড়াচড়া করছে?

আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। মেঘ ডাকার মতো গড়গড় করছে গোটা ছাদ। পাহাড় ধসের সাথে অনেকটা মেলে। তারপর কামান দাগার মতো বিকট শব্দ হতে লাগলো।

উঁচু সিলিঙে একটা ফাটল ধরল, গ্যালারির পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে। আঁকাবাঁকা ফাটলটা থেকে ধুলোর মেঘ নেমে আসছে। তারপর, ধীরগতি দুঃস্বপ্নের মতো, ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সরাসরি তার উপরের ছাদটা ধসে পড়তে শুরু করলো।

টাইটার সতর্কবাণী! চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন। দেবতাদের অভিশাপ! স্তম্ভিত বিস্ময়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও, নড়ার শক্তি নেই।

খপ করে ওর একটা হাত ধরে টান দিল নিকোলাস। ছুটুন! বাঁচতে চাইলে ছুটুন! রোয়েনকে নিয়ে খিচে দৌড় দিল ও।

গ্যালারি ধরে ছুটছে ওরা সীল করা প্রবেশপথের ফাঁকটার দিকে। পাথর আর প্লাস্টারের টুকরো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে গলিপথে, ধুলোয় চারদিক অন্ধকার। ওদের পেছনে অবিরত বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে, ধসে পড়ছে গোটা ছাদ। ওরা ছুটছে, ওদেরকে অনুসরণ করছে নিয়ন্ত্রণহীন পাথর ধস। পেছন দিকে তাকানোর সময় বা সাহস কোনোটাই ওদের নেই, তবে পতনের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছে ফাঁকটা গলে বাইরে বের হওয়ার সময় ওরা পাবে না।

প্লাস্টারের একটা টুকরো রোয়েনের কাঁধে ঘষা খেয়ে বেরিয়ে গেল। হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল ওর, নিকোলাস ধরে না ফেললে পড়ে যেত। না পড়লেও, আতঙ্কে হাঁটতে পারছে না। নিকোলাস ওকে টেনে নিয়ে আসছে। ধুলোয় সামনেটা দেখা যাচ্ছে না, প্রবেশপথের ফাঁকটা কত দূরে বোঝা যাচ্ছে না। প্রায় পৌঁছে গেছি, মিথ্যে আশ্বাস দিল নিকোলাস। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই প্লাস্টারের একটা টুকরো ফ্লাডলাইটে আঘাত করলো। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল গ্যালারি।

নিকোলাস এখন পুরোপুরি অন্ধ, বাঁচার আকুতি প্রথমেই ওকে দিশা খুঁজে পাবার তাগাদা দিল। কিন্তু চারদিকেই ধসে পড়ছে ছাদ, প্রতি মুহূর্তে পতনের মাত্রা আরো বাড়ছে। বুঝতে পারল, যে কোনো মুহূর্তে গোটা ছাদ নেমে আসবে ওদের উপর। কোথাও না থেমে ছুটছে ও, ভারী বোঝার মতো টেনে আনছে রোয়েনকে। কিছুই না দেখে দেয়ালের শেষ মাথায় পৌঁছল, ধাক্কা খেয়ে সব বাতাস বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। ধুলোর মেঘের ভেতর প্লাস্টার করা দরজার গায়ে চৌকো ফাঁকটা অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে, সিঁড়ির মাথা থেকে আসা ল্যাম্পের আলোয় শুধু আভাসটুকু পাওয়া যায়। হ্যাঁচকা টানে রোয়েনকে বুকে তুলে নিল নিকোলাস, তারপর ফাঁকের ভেতর ছুঁড়ে দিল। ওপারে পড়লো রোয়েন, কাতর শব্দ ভেসে এলো এপারে। আবর্জনার আরেকটা টুকরো লাগলো নিকোলাসের মাথার পেছনে, ব্যথায় জ্ঞান হারাবার অবস্থা হলো। হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেছে, দাঁড়াতে চেষ্টা করেও পারছে না। শুনতে পেল রোয়েন ওর নাম ধরে চেঁচাচ্ছে।

হামা দিয়ে এগুলো নিকোলাস। হাত তুলে ফাঁকটার নাগল পেতে চাইছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে একটা হাত ওর কব্জি চেপে ধরল। আর ঠিক এক সেকেন্ড পরই গ্যালারির সম্পূর্ণ ছাদ ধসে পড়লো নিচে।

ল্যাম্পলাইটের আলোয় নিকোলাসের হাত ধরে পথ দেখালো রোয়েন। কোথায় লেগেছে? হাঁপাচ্ছে ও। কপালের উপর চুলের ভেতর থেকে রক্তের একটা ধারা গালে নেমে আসছে। ধুলো মাথা মুখে লাল নদীর মতো লাগছে দেখতে।

তাড়াতাড়ি পা চালান, বলল নিকোলাস। খকখক করে কাশছে ও। গোটা টানে নল ধসে পড়তে পারে। পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে ছুটলো ওরা। তারপর ধুলোর ভেতর সামনে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল। ড্যানিয়েল।

আপনারা বেঁচে আছেন! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। কী ঘটছে ওদিকে?

নিকোলাস আর রোয়েন থামলো না। পালিয়ে এসো! কর্কশ সুরে বলল নিকোলাস। দ্রুত টানেল থেকে উঠে এলো নিকোলাস, রোয়েন আর ড্যানি স্যাপার।

ভাসমান সেতুর উপর উঠে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামলো ওরা।

*

সন্ন্যাসীদের বাইরে রেখে পোস্ট অফিসে ঢুকলো টিসে। বহুসময় বসে থাকার পর আদ্দিস আবাবার লাইন পাওয়া গেল, ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে ভেসে এলো জিওফ্রে টেনেন্টের কণ্ঠস্বর। হ্যালো?

নিজের পরিচয় দিল টিসে।

আমি আপনার কলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, বলল জিওফ্রে। আপনারা সবাই কেমন আছেন, টিসে?

নিকোলাসের মেসেজটা মুখস্ত বলে গেল টিসে।

আমার বন্ধুকে বলবেন ওর কথামতো সব করা হবে, বলে যোগাযোগ কেটে দিল জিওফ্রে।

এবার আমি, পোস্ট মাস্টারকে বলল টিসে, আদ্দিস আবাবায় আরেকটা ফোন করতে চাই-মিশরীয় দূতাবাসে।

দ্বিতীয় কলের লাইন পেতে একটু দেরি হলো। বিকেল পাঁচটার সময় মিশরীয় দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাশের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো টিসের। ভদ্রলোককে আগে থেকেই চেনে সে, কূটনীতিকদের কয়েকটা পার্টিতে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, মিটিংয়ে যেতে হবে। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি, ওইজিরো টিসে?।

এই ভদ্রলোকের মাধ্যমে কায়রোর যাঁকে মেসেজটা দিতে হবে তাঁর নাম ঠিকানা ও পদমর্যাদা একটা কাগজে লিখে দিয়েছে রোয়েন। নামটা শুনে কালচারাল অ্যাটাশে ভদ্রলোক টিসেকে খুশি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নাম ও পদমর্যাদা ভুল শুনেছেন কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দু বার রিপিট করতে বললেন। সবশেষে লিখে নেওয়া মেসেজটা পড়ে শোনালেন টিসেকে। ঠিক আছে তো?

রাত হতে আর বেশি দেরি নেই, কাজেই আজ আর খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামা সম্ভব নয়। কোথায় রাত কাটানো যায় ভাবছে টিসে, এ সময় গ্রামের সর্দার তার কিশোরী মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন। রাতটা তাঁর বাড়িতে মেহমান হিসেবে কাটাবার অনুরোধ করেছেন তিনি। স্বস্তিবোধ করলো টিসে, কিশোরীর সঙ্গে সর্দারের বাড়িতে চলে এলো। অভিজাত পরিবারের মেয়ে সে, তার সম্মানে রাতে বড়সড় একটা ভোজ দিলেন সর্দার। গ্রামে তার বাড়িটাই সবচেয়ে বড়। সন্ন্যাসীদের থাকার ব্যবস্থা হলো বাড়ির উঠানে, তাঁবুর ভেতর। বাড়ির পেছনের একটা গেস্টরুম খুলে দেওয়া হলো টিসেকে। ভোজন পর্ব শেষ হতে রাত গম্ভীর হয়ে গেল। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো টিসে।

ওর ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে, কেনো জানে না, টিসের মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সেই মেনজিস্টুর দিনগুলোর মতো, তড়িঘড়ি বাইরে তাকিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলো সে। অন্ধকারে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ট্রাকের আওয়াজ। ক্রমশই কাছে চলে আসছে। মাথায় উলের কাপড় দিয়ে ঢেকে যতোক্ষণে পোশাক পরে ফেললো ও, বাইরের দরজায় তখন তুমুল কড়াঘাত।

দরজা খুলুন! বজ্রকণ্ঠে আদেশ এলো। আমরা সরকারের গোয়েন্দা।

পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলো টিসে। ও জানে, তাঁরই খোঁজে এসেছে এরা। কিন্তু কোথায় দৌড়াবে সে অন্ধকারে? কিছুই চেনে না টিসে, এ এলাকার। হঠাৎ করে মনে পড়লো, নদী রয়েছে কাছে ধারে। অন্তত নদীর পাড় পর্যন্ত তো পালিয়ে যেতে পারবে। ছুটলো টিসে। ঠিক এ সময়েই টর্চের উজ্জ্বল রশ্মি আবিষ্কার করে ফেললো ওকে।

ওই তো মেয়েটা! কে যেনো বলল কর্কশ কন্ঠে। টর্চের আলোয় রোয়েনের শাম্মা পতপত করে উড়ছে, প্রাণপণে ছুটছে সে।

গুলি কোরো না! নির্দেশ এলো। একে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে!

ক্ষীপ্র গ্যাজেলের গতি টিসের পায়ে, দৌড়ে ওকে ধরা কারো কম্ম নয়। কিন্তু হলো না। কিছু না বুঝেই অন্ধকারে সামনের কাঁটাতারের বেড়ায় আছড়ে পড়লো

সে। জামায় কাঁটা আটকে, পরে রইলো ওখানেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেনে হিঁচড়ে ওকে ছাড়িয়ে আনলো সৈনিকের দল।

এগিয়ে এসে টিসের চুলের গোছা ধরে টান দিল একজন, ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো টিসে। লোকটা চড় মারতে যাবে, হাঁপাতে হাঁপাতে সৈনিকদের ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন একজন অফিসার। ভীষণ মোটা।

কী করছ! কাকে মারছ? লোকটাকে চোখ রাঙালেন তিনি। ওঁনাকে তোমরা ক্রিমিন্যাল ভেবেছ নাকি? রাজধানীর অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের মেয়ে উনি।

টিসের দিকে ফিরে ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, ডিস্ট্রিক্ট কমান্ডার কর্নেল নগুর নির্দেশে আপনাকে একবার আমাদের আর্মি হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে, মিস টিসে।

কেন, কী করেছি আমি? ঢোক গিলে জানতে চাইলো টিসে।

গোজামে শুফতা–দুস্কৃতকারীদের তৎপরতা সম্পর্কে কর্নেল আপনাকে প্রশ্ন করতে চান।

তর্ক করে বা বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই, অফিসারের সঙ্গে বেরিয়ে এসে একটা সামরিক ট্রাকে চড়লো টিসে। ট্রাকের সামনে অফিসারের সঙ্গে বসেছে ও, ড্রাইভার একজন সৈনিক। কিছুক্ষণ কোনো কথা হলো না। তারপর অফিসার বললেন, ড্রাইভার ইংরেজি বোঝে না। আপনাকে বলতে চাই, আপনার বাবা, অল্টো জিম্যানকে আমি চিনতাম। তাঁর প্রতি আমি ঋণী ও কৃতজ্ঞ। আজ রাতে যা ঘটছে তার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত, কিন্তু একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে কতোটুকুই বা আমার ক্ষমতা। উপর থেকে নির্দেশ এলে আমাকে তা মেনে চলতে হয়।

আমি কোনো অভিযোগ করছি না, বলল টিসে।

আমার নাম হাম্মেদ। যদি সম্ভব হয়, আপনাকে আমি সাহায্য করব–অল্টো জিম্যানের খাতিরে, কথা দিলেন লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ।

ধন্যবাদ, এখন বন্ধুর বড়ো প্রয়োজন আমার।

*

ধুলো সরার জন্য সময় দিতে হলো। তারপরও বেশ কিছুক্ষণ গ্যালারি থেকে আলগা পাথর খসে পড়ার আওয়াজ ভেসে এলো ওদের কানে। সিঙ্কহোলের উপর ভাসমান সেতুর উপর রয়েছে ওরা, ইতোমধ্যে রোয়েনের মাথায় অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে নিকোলাস। দু জনের কারো আঘাতই তেমন গুরুতর নয়।

দু ঘণ্টা পর টানেলে ঢোকার জন্য তৈরি হলো নিকোলাস। ড্যানিয়েল আর রোয়েনকে সেতুর উপর থাকতে বলল ও, রওনা হলো একাই, সঙ্গে নিয়েছে লম্বা একটা বাঁশ আর জেনারেটরের সঙ্গে সংযুক্ত হ্যান্ড ল্যাম্প।

খুব সাবধানে এগুচ্ছে নিকোলাস, এগুবার আগে বাঁশ দিয়ে টানেলের ছাদ খোঁচা মারছে। ল্যান্ডিঙে পৌঁছেই দেখতে পেল সমাধির প্রবেশপথটাকে সীল করে রেখেছিল যে প্লাস্টার করা দরজা, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অ্যামুনিশন ক্রেটগুলো, আটটাই, ছিটকে পড়েছে এদিক সেদিক, কোনো কোনোটা আবর্জনায় ডুবে আছে। মূর্তিগুলোর কথা ভেবে মাথাটা ঘুরে উঠলো নিকোলাসের। একেকটা অক্ষত মূর্তির জন্য বিলিওনিয়ার কালেক্টররা বস্তা বস্তা ডলার দিতেও দ্বিধা করবেন না, জানে ও। এতো কষ্টকর আর ঝুঁকিবহুল অভিযান থেকে এ আটটা মূর্তিই হয়তো সর্বমোট প্রাপ্তি ওদের, তা ও যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, দুঃখের কোনো সীমা থাকবে না।

আবর্জনা থেকে বাক্সগুলো উদ্ধার করলো নিকোলাস। প্রত্যেকটা খুলে ভেতরে তাকালো, পরীক্ষা করলো মূর্তিগুলো। নেহাতই ওদের ভাগ্য বলতে হবে, সবগুলোই অক্ষত আছে। আর কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয় ও, প্রতিবার একটা করে বয়ে নিয়ে এলো সেতু পর্যন্ত।

সমাধির বাইরের ল্যান্ডিঙে ফিরে এসেছে নিকোলাস, ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো। রোয়েন। কোনো যুক্তিই মানল না, নিকোলাসের সঙ্গে সে-ও টানেলে ঢুকলো।

গ্যালারিতে ঢোকার মুখে স্থির হয়ে গেল রোয়েন। শোকে কাতর, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। এ আমি বিশ্বাস করি না! ধরা গলায় বলল ও। টাইটা নিশ্চয়ই চায় নি এতো সুন্দর শিল্পকর্ম এ ভাবে ধ্বংস হয়ে যাক।

মানে? কী বলতে চান?

পরে ব্যাখ্যা করব, কারণ নিজেই এখনো বুঝতে পারছি না, বলল রোয়েন। শুধু জানি, টাইটাকে আমি যতটুকু চিনেছি, তার মধ্যে ধ্বংস করার প্রবণতা একেবারেই ছিল না। আপনি লোকজন ডেকে গ্যালারিটা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুন।

স্যাপারকে ডেকে নিয়ে এলো নিকোলাস। গ্যালারির অবস্থা দেখে হাঁ হয়ে গেল সে। কী করতে হবে শোনার পর বলল, সবচেয়ে বড় সমস্যা ধুলো। আবর্জনায় হাত দিলেই মেঘের মতো উড়তে শুরু করবে।

কাজেই পানি দরকার, বলল নিকোলাস। টানেল থেকে সিঙ্কহোল পর্যন্ত দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে দাও লোকজনকে। একটা চেইন পানির বালতি আনবে, আরেকটা আবর্জনা সরাবে।

ঈশ্বরই জানে কয় দিন লাগবে? হতাশ দেখার ড্যানিয়েলকে, তবে হানশিতকে ডেকে এসে কাজটা বুঝিয়ে দিল সে।

সন্ন্যাসী বা গ্রামবাসী যুবকদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই, কারণ এখনো তারা বিশ্বাস করে এটা একটা ধর্মীয় কাজ, অংশগ্রহণ করতে পারায় নরকের আজাব থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে। হানশিত শেরিফের নেতৃত্বে বাঘেরা কাজ শুরু করে দিল।

ভাঙা পাথর আর আবর্জনা বলে নিয়ে ফেলা হচ্ছে সিঙ্কহোলে। ওটা এতো গভীর, পানির লেভেল উঁচু হলো না, সব গ্রাস করে নিচ্ছে। অল্প জায়গার ভেতর একশোর উপর লোক কাজ করছে, পরিবেশটা গুমোট হয়ে উঠলো। তাজা বাতাসের জন্য টাইটার পুলে বেরিয়ে এলো নিকোলাস। পুলটাকে ঘিরে থাকা পাঁচিলে এসে দাঁড়াতেই, দেখলো ওর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছে মেক।

নিকোলাস, জিজ্ঞেস করলো সে, ডেবরা মারিয়াম থেকে এখনো ফেরেনি টিসে? কালই না ওর ফিরে আসার কথা ছিল?

ওকে তো দেখিনি আমি। ভাবছিলাম ও বোধহয় তোমার সঙ্গে আছে।

ওর খোঁজে লোক পাঠাবো, তাই ফিরেছে কিনা নিশ্চিত হতে এলাম, বলল মেক, চেহারায় শুধু উদ্বেগ নয়, অপরাধী অপরাধী ভাবও ফুটে আছে। ডেবরা মারিয়ামে টিসেকে পাঠানোর প্রস্তাবটা তারই ছিল।

নিকোলাসেরও খারাপ লাগছে। দুঃখিত, মেক। ওকে ঢালের উপর পাঠানোটা বিপজ্জনক হতে পারে বলে আমিও ভাবিনি।

গোজামের সবাই ওকে চেনে, বলল মেক।

বিপদ হওয়ার তো কথা নয়। তবু, খোঁজ নিচ্ছি আমি। চলে গেল সে।

পরবর্তী কয়েকটা দিল টিসেকে নিয়ে দুচিন্তায় থাকতে হলো ওদেরকে। এদিকে গ্যালারি পরিষ্কার করার কাজও খুব ঢিমে তালে এগুচ্ছে। গ্যালারির মুখে নিকোলাসের সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে রোয়েন। দেয়ালচিত্রের প্রতিটি ভাঙা টুকরো দেখা মাত্র কান্না পাচ্ছে ওর, কাতর হয়ে পড়ছে শোকে। ছবির কোনো অক্ষত অংশ দেখতে পেলেই নিজের দখলে রেখে দিচ্ছে। এক টুকরো প্লাস্টারে আইসস-এর মাথাটা অক্ষত অবস্থায় পেল। আরেকটায় পেল তথ এর পুরো ছবি।

লম্বা গ্যালারির ভেতর সময়ের কোনো হিসাব পাওয়া সম্ভব নয়, এখানে রাত ও দিন সমান। একেবারে ক্লান্ত ও বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত টানেল ছেড়ে বেরোয় না ওরা। তারপর যখন বেরোয়, টাইটার হ্রদের উপর সরু আকাশে তারার মেলা দেখে সময় কাটায়, ক্লান্তি সত্ত্বেও চোখে ঘুম আসে না।

হ্রদের পাশে ক্যাম্পে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবার পর টানেলে ঢুকতে যাচ্ছে ওরা, ভাসমান সেতু পেরুচ্ছে, এ সময় গ্যালারির দিক থেকে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার ভেসে এলো। তারপর শোনা গেল বহু লোকের হৈ-চৈ। হানশিত শেরিফ কিছু একটা পেয়েছে, বলল রোয়েন।ধ্যেত, ওখানে আমাদের থাক, উচিত ছিল- দৌড় নিল ও, পিছু নিয়ে নিকোলাসও।

গ্যালারির সামনে ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা, দেখলো অর্ধনগ্ন শ্রমিকরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে সবাই একসঙ্গে কথা বলছে, ইঙ্গিতে ও হাত নেড়ে পরস্পরকে কী যেনো বোঝাবার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে সামনে এগুলো নিকোলাস ও রোয়েন, দেখতে পেল যেখানে ওসিরিস-এর শ্রাইন ছিল সেই পর্যন্ত গ্যালারিটা পরিষ্কার করা হয়ে গেছে। ওদের উপর ছাদ ভাঙাচোরা আর এবড়োখেবড়ো, নিচে টানলোসের বিধ্বস্ত মেঝেতে পড়ে রয়েছে বিশাল আকারের একটা পাথুরে ঢাকা। এটা টাইটার মেকানিজম বা তার অবশিষ্ট, প্রাচীন ক্রীতদাস ছাদে ফিট করেছিল। ওরা, নিকোলাস ও রোয়েন, ডিভাইসটা কাজ করায় ছাদটা ধসে পড়ে। বিশাল চাকাটাই মেকানিজমের মুল অংশ, দেখতে অনেকটা মিল হুইলের মতো, ওজন হবে কয়েক টন। জিনিসটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস।

রিভার গড পড়ার সময় নিশ্চয়ই আপনি খেয়াল করেছেন চাকার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল টাইটার, রোয়েনকে বলল ও। রথের চাকা, পানি তোলার চাকা, আর একটা নিশ্চয়ই ব্যালেন্স হুইল-বুবি ট্র্যাপের জন্য। আমরা লিভার নাড়তেই গোঁজ সরে যায়। ওই গোঁজই চাকাটাকে জায়গা মতো আটকে রেখেছিল। চাকা যে-ই ঘুরতে শুরু করলো, গ্যালারির উপর সিলিঙে সাজিয়ে রাখা প্রকাণ্ড পাথরগুলো খসে পড়লো ছাদে, ভেঙে পড়লো ছাদ।

এখন নয়, নিকোলাস! ধৈর্য হারিয়ে বলল রোয়েন। পরে আপনার লেকচার শোনা যাবে। টাইটার ডেথ-ট্র্যাপ হানশিতকে উত্তেজিত করে নি। সে অন্য কিছু আবিষ্কার করেছে। আসুন।

ভিড় ঠেলে আরো সামনে এগুলো ওরা, দাঁড়ালো দীর্ঘদেহী হানশিতের মুখোমুখি। কী ঘটেছে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। কী পেয়েছ তুমি?

পাল্টা চিৎকার করলো হানশিত, এ দিকে, ইফেন্দি! জলদি আসুন!

আরো কিছুটা এগিয়ে পাথর ধরেস বন্ধ গ্যালারির সামনে থামলো। ওই দেখুন! হাত তুললাম হানশিত।

ভাঙা শ্রাইনের ভেতর একটা হাঁটু গাড়লো নিকোলাস। ফাটল ধরা পাথুরে দেয়ালে এখনো রঙ করা প্লাস্টারের টুকরো দেখা যাচ্ছে। ধসে পড়া দেয়ালের মুখ থেকে বড় একটা টুকরো সরালো হানশিত, তারপর সদ্য তৈরি ফাঁকটার দিকে আঙুল তাক করলো। চোখের পলকে পালস রেট বেড়ে গেল নিকোলাসের। গ্যালারির এক পাশে একটা পথ দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত আরেকটা টানেলের মুখ। মহান দেবতার প্লাস্টার মোড়া ছবির পেছনে লুকিয়ে ছিল। নিকোলাস তাকিযে আছে, বাহুতে রোয়েনের স্পর্শ আর মুখের পাশে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলো।

এটাই, নিকোলাস! এ টানেলটাই! ফারাও মামোসের আসল সমাধিতে ঢোকার পথ। এ গ্যালারি, যেকানে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি, এটা স্রেফ একটা ধাপ্পা। আসল সমাধি আছে দ্বিতীয় টানেলের ভেতর।

হানশিত! আবেগে রুদ্ধ গলায় নির্দেশ দিল নিকোলাস, তোমার লোকদের বলো পথটা পরিষ্কার করুক।

সঙ্গে সঙ্গে পাথর আর আবর্জনা সরাবার কাজ শুরু হয়ে গেল। ফাঁকটার ভেতর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো একটা দরজা। এটাও চৌকো, তিন মিটার চওড়া, দুই মিটার লম্বা। লিনটেল আর চৌকাঠের বাজু নিখুঁতভাবে কাটা, পালিশ করা পাথর। দরজাটা ভেঙে পড়েছে, ভেতরে সউঠে গেছে পাথুরে সিঁড়ির ধাপ।

তার টেনে নতুন দরজার মুখে আরোর ব্যবস্থা করা হলো। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পাও রাখলো নিকোলাস, দেখলো ওর পাশে পাও রাখলো রোয়েন।

আমিও আপনার সঙ্গে যাব, জেদের সুরে বলল ও।

এখানে কোনো ফাঁদ থাকতে পারে, সাবধান করলো নিকোলাস। হয়তো প্রথম বাকেই টাইটা আপনার জন্য ওত পেতে আছে।

এসব বলে কোনো কাজ হবে না, আমি যাবই।

ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ওরা, প্রতি ধাপে থেমে দেয়াল আর সামনের দিকটা পরীক্ষা করে নিচ্ছে। বিশ ধাপ ওঠার পর আরেকটা ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা, . দুদিকে দুটো দরজা দেখা যাচ্ছে। তবে সিঁড়িটা সোজা আরো উপরে উঠে গেছে।

কোনদিকে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

চলুন উপরে উঠি, বলল রোয়েন। পাশের প্রকোষ্ঠে দুটোয় পরে ঘুরে আসব।

সাবধানে আবার উপরে উঠতে শুরু করলো ওরা। আরো বিশ ধাপ পার হওয়ার পর হুবহু একই রকম আরেকটা ল্যান্ডিং দেখা গেল, দুদিকে দুটো দরজা। সিঁড়িটা এরপরও ওপরে উঠে গেছে।

নিকোলাসকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে রোয়েন বলল, উপরেই উঠব।

আরো বিশ ধাপের মাথায় আরেকটা ল্যান্ডিং, এটাও দুদিকে একটা করে দরজা। সিঁড়িটাও উঠে গেছে নাক বরাবর।

ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। অভিযোগের সুরে বলল নিকোলাস।

কনুই দিয়ে ওর পিঠে খোঁচা মারল রোয়েন। কোন বাধা না পাওয়া পর্যন্ত ওঠা উচিত, বলল ও। আবার উঠতে শুরু করে একই ধরনের আরো দুটো ল্যান্ডিং পেল ওরা।

অবশেষে! শেষ ল্যান্ডিঙে উঠে এসে বিস্ময় প্রকাশ করলো নিকোলাস। আশা করেছিল এটারও দুদিকে দরজা দেখতে পাবে, পেলও দেখতে, কিন্তু সামনে আর কোনো ধাপ নেই, তার বদলে নিরেট দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এবার কি করবেন?

সব মিলিয়ে কয়টা ল্যান্ডিং? জানতে চাইলো রোয়েন।

আটটা, বলল নিকোলাস।

আটটা, পুনরাবৃত্তি করলো রোয়েন। সংখ্যাটা খুব পরিচিত লাগছে না?

ল্যাম্প লাইটের আলোয় রোয়েনের মুখটা ভালো করে দেখলো নিকোলাস।

আপনি বলতে চাইছেন….।

বলতে চাইছি গ্যালারিতে আটটা শ্রাইন রয়েছে বা ছিল, এখানে রয়েছে আটটা ল্যান্ডিং, বাও বোর্ডেও আটটা খুঁটি থাকে।

টপ ল্যান্ডিঙে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা, চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।

অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙল নিকোলাস, ঠিক আছে, এবার বুলুন কোনদিকে যাবেন।

একটায় গেলেই হয়, বলল রোয়েন। ডানদিকে চলুন।

ডান দিকের দরজা দিয়ে একটা গলিপথে ঢুকলো ওরা। খানিক দূর যাবার পর একটা টি-জাংশনে পৌঁছল-সামনে নিরেট দেয়াল, দুদিকে দুটো দরজা। আবার ডান দিকের গলিপথে ঢুকি আসুন, বলল রোয়েন। তাই ঢুকলো নিকোলাস। কিন্তু কানিক দূর যাবার পর আরেকটা টি-জাংশন পড়লো সামনে।

রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস। কি ঘটছে বুঝতে পারছেন তো? জিজ্ঞেস করলো। টাইটার আরেকটা চালাকি। সে আমদেরকে একটা গোলকধাঁধায় নিয়ে এসেছে। সঙ্গে লম্বা তার না থাকলে এতোক্ষণে হারিয়ে যেতাম।

ফেলে আসা পথের দিকে তাকালো রোয়েন, তারপর দৃষ্টি ফেললো ডান ও বাম দিকের গলিপথে। শিউরে উঠে নিকোলাসের বাহু খামচে ধরল ও। আমার ভয় করছে! চলুন ফিরে যাই। কেন যেনো মনে হচ্ছে বিপদের মধ্যে আছি আমরা। এভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে চলে আসা উচিত হয় নি।

বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে প্যাসেজ ধরে ফেরার পথে ইলেকট্রিক তাঁর গুটিয়ে নিচ্ছে নিকোলাস, ইচ্ছে হচ্ছে বিপদ এগাবার জন্য দৌড় দেয়। নিকোলাসের গায়ে প্রায় সেঁটে আছে রোয়েন। দুজনেরই মনে হচ্ছে অন্ধকার থেকে কে যেনো লক্ষ রাখছে ওদের উপর, পিছু নিয়েছে, অপেক্ষা করছে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।

*

আর্মি হেডকোয়ার্টারে নয়, টিসেকে নিয়ে আসা হলো ঢালের নিচে ফরেন প্রসপেক্টিং কোম্পানি পেগাসাসের বেস ক্যাম্পে। টিসে অভিযোগ করায় লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না, বললেন, আমি শুধু কর্নেল নগুর নির্দেশ পালন করছি।

বিশাল কনফারেন্স রুমে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কর্নেল নগু। ইউনিফর্ম পরে আছেন, চোখে মেটাল-ফ্রেমের চশমা, তবে মাথায় কিছু নেই। টেবিলের এক ধারে জ্যাক রাফেরও বসে আছে, হাত দুটো বুকে ভাঁজ করা। একটা চুরুট নিচ্ছে সে, আগুনটা নিভে গেছে।

লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ, অ্যামহারিক ভাষায় বললেন কর্নেল নগু। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। প্রয়োজন হলে আপনাকে ডাকা হবে।

লেফটেন্যান্ট চলে যাবার পর টিসে বলল, আমাকে অ্যারেস্ট করা হলো কেন, কর্নেল নগু?

দুজনের কেউই জবাব দিল না, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকর টিসের দিকে।

আমি কি এখন চলে যেতে পারি? আবার জিজ্ঞেস করলো টিসে।

এবার কথা বললেন কর্নেল, কুখ্যাত একদল টেরোরিস্টের সঙ্গে মেলামেশা করছেন আপনি। এর মানে হলো, ওদের মতো আপনিও একজন শুফতা।

এ আপনার মিথ্যে অভিযোগ।

অ্যাবে উপত্যকার একটা মিনারেল কনসেশনে অনধিকার প্রবেশ করেছেন আপনি, বলল হেলম্। কুখ্যাত টেরোরিস্টদের নিয়ে এ কোম্পানির নিজস্ব এলাকায় মাইনিং অপারেশন শুরু করেছেন।

কোথাও কোনো মাইনিং অপারেশন শুরু হয়নি, প্রতিবাদ করলো টিসে।

আমাদের কাছে আরো তথ্য আছে। আপারা ডানডেরা নদীতে একটা বাঁধ দিয়েছেন।

তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তাহলে আপনি অস্বীকার করছেন না যে একটা বাঁধ তৈরি করা হয়েছে?

বললামই তো, এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, বলল টিসে। আমি কোনো টেরোরিস্ট গ্রুপের মেম্বার নই। কোনো মাইনিং অপারেশনেও অংশ নিই নি।

নোটবুকে কী যেনো লিখলেন কর্নেল। চেয়ার ছেড়ে জানালোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো হেলম্। ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা দীর্ঘতর হচ্ছে আবার গুপ মেরে গেছে ওরা।

টিসে বলল ছয়-সাত ঘণ্টা একটানা ট্রাকে ছিলাম। আমি ক্লান্ত। আমাকে টয়লেটে যেতে হবে।

টয়লেটের কাজ আপনি এখানেই সারতে পারেন। আমি বা মি. হেল খারাপ বোধ করব না। হাসলেন কর্নেল, তবে নোটবুক থেকে চোখ তুললেন না।

ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালো টিসে। জানালোর কাছ থেকে সরে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল হেলম্। টিসে ভাবল, এদেরকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে ভয় পেয়েছে। খুবই ক্লান্ত সে, তলপেট ব্যথা করছে, তবু চেহারায় মর্যাদার ভাব ফুটিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

মুখ তুলে ভুরু কোঁচকালেন কর্নেল। টিসের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ তিনি আশা করেন নি। শুফতা ডাকাত মেক মেক নিমুরের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা

আপনি অস্বীকার করতে পারে না। হঠাৎ অভিযোগ করলেন তিনি।

মেক নিমুর ডাকাত নন, বলল টিসে। তিনি সত্যিকার দেশপ্রেমিক এবং গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী একজন শ্রদ্ধের নেতা।

আপনি তার উপপত্নী। বেশ্যাও বলা চলে।

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল টিসে।

হঠাৎ গর্জে উঠলেন কর্নেল নগু, মেক নিমুর কোথায়? তার সঙ্গে ডাকাতরা মোট কয়জন? টিসের দৃঢ় মনোভাব অস্থির করে তুলেছে তাঁকে।

টিসে জবাব দিল না।

কথা বলুন! মুখ খুলুন! গর্জে উঠলেন কর্নেল। তা না হলে আপনাকে টরচার করা হবে।

মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলো টিসে।

দ্রুত পায়ে হেঁটে কর্নেলের পেছনে চলে এলো হেলম, পেছনের একটা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল কনফারেন্স রুম থেকে। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। খানিক পর আবার ফিরে এলো, কর্নেলের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মাথা ঝাঁকালো।

সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছাড়লেন কর্নেল নগু। তারপর দু জনই টিসের সামনে চলে এলো।

ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলা যায় ততই ভাল, বলল হেলম্। আমাকেও ব্রেকফাস্টে বসতে হবে, আপনাকেও টয়লেটে যেতে হবে। কর্নেল সরকারী কর্মচারী, তাকে অনেক নিয়ন-কানুন মেনে চলতে হয়। আমার ও-সব বালাই নেই। উনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন, আমিও সেগুলো করব। তবে এবার আপনাকে উত্তর দিতে হবে। কথা শেষ করে চুরুটে আগুন ধরালো সে। এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, মেক নিমুর কোথায়?

কাঁধ ঝাঁকালো টিসে, ঘাড় ফিরিয়ে আবার জানালার বাইরে তাকালো।

আগে থেকে কিছু বুঝতে না দিয়ে দুশ করে টিসের মুখে ঘুসি মারল হেলম্। একটা মেয়েকে এভাবে কেউ ঘুসি মারতে পারে, ভাবা যায় না। ছিটকে চেয়ার সহ মেঝেতে পড়ে গেল টিসে। এগিয়ে এসে তার পেটে সবুট লাথি মারল হেলম্। বেশ্যা মাগী, কথা বলিস না কেন?

এরপর এগিয়ে এলেন কর্নেল নগু। টিসের বুকের মাঝখানে একটা পা রাখলেন তিনি, তারপর ঝুঁকে চুলের গোছা ধরে টান দিলেন। নতুন করে শুরু করা যাক। মেক নিমুর এখন কোথায়?

ঘুসি আর লাথি খেয়ে জ্ঞান হারাবার অবস্থা হয়েছে টিসের। এবার তার উপর ঝুঁকলো হেলম্, ট্রাউজারের বেল্টটা খুলে নিল। এখনো সময় আছে, কথা না বললে ন্যাংটো করে চুরুটের ছ্যাকা দেওয়া হবে গায়ে। কোথায় সে? কি করছে মেক নিমুর? তোর সঙ্গী-সাথীরা ডানডেরা নদীতে বাঁধ দিয়েছে কেন?

মুখের ভেতর থুথু জমিয়ে হেলমের চোখে ছুঁড়ে দিল টিসে। ছিটকে দূরে সরে গেল হেলম্, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।

ধরে রাখুন শালীকে! কর্নেলকে বলল সে। টিসের বুক থেকে পা নামিয়ে বসে পড়লেন কর্নেল, তারপর শক্ত করে হাত দুটো ধরলেন।

পা ছুঁড়ছে টিসে, কিন্তু দু জন শক্তসমর্থ পুরুষের সঙ্গে সে পারবে কেন। তার ট্রাউজার খুলে ফেললো হেলম্। তারপর শার্টটাও ছিঁড়ে ফেললো। কোথায় সে? কি করছে মেক? জিজ্ঞেস করলো হেলম্, টিসের স্তনের বোঁটার কাছে জ্বলন্ত চুরুট সরিয়ে আনল।

মরিয়া হয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করলো টিসে, কিন্তু কর্নেল তার হাত দুটো পিছমোড়া করে ধরে রেখেছেন। আর্তনাদ করে উঠলো টিসে, রুটের লালচে ডগা তার স্তনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

*

শীতকাল, বলল রোয়েন, ট্যানাসের সমাধিতে পাওয়া ফলকের চতুর্থ দিকটার এনলার্জ করা ফটোগ্যাফ ফ্লাডলাইটের আলোয় মেলে ধরল। এদিকটাতেই টাইটার নোটেশন রয়েছে, যেটাকে আমি বাও বোর্ড বলে মনে নিয়েছি। সংখ্যা ও সঙ্কেত সবগুলো আমি বুঝি না, তবে বাদ দেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, প্রথম সঙ্কেতটা চারটে দিকের একটাকে চিহ্নিত করে। এ চারটে দিককে বোর্ডের একেকটা দুর্গ হিসেবে বর্ণনা করেছে সে। নোটবুকের পাতাগুলো দেখালো নিকোলাসকে, ওগুলোয় হিসাব করেছে ও।

এদিকে দেখুন, উত্তর দুর্গে বসে আছে বেবুন, দক্ষিণ দুর্গে মৌমাছি, পশ্চিমে পাখি আর পূর্বে কাঁকড়া বিছে। ফলকের ফটোগ্রাফেও চিহ্নগুলো রয়েছে, আঙুল দিয়ে দেখালো নিকোলাসকে। তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফিগার, এগুলো

সংখ্যা-আমার ধারণা, এগুলো ফাইল আর কাপ-এর প্রতিনিধিত্ব করে। এগুলোর সাহায্যে আমরা তার কাল্পনিক লাল পথরের চাল অনুসরণ করতে পারব। লাল হলো বোর্ডের হাইয়েস্ট-র্যাংকিং কালার।

প্রতি সেট নোটেশনের মাঝখানে স্তবকগুলো কি? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।যেমন এখানে লেখা রয়েছে উত্তুরে বাতাস আর ঝড় সম্পর্কে।

আমি জানি না, স্মোকস্ক্রীন হতে পারে। কোনো কাজই সে আমাদের জন্য সহজ করে রাখেনি। ওগুলোর কোনো তাৎপর্য থাকতেও পারে, তবে সেটা ধরা পড়বে আমরা যখন আমাদের পথর দিয়ে চাল দিতে দিতে খেলাটায় অনেক দূর এগিয়ে যাব। রোয়েন এবার মুখ তুলে পাথুরে সিঁড়ির দিকে তাকালো, যে সিঁড়ি টাইটার গোলকধাঁধার দিকে উঠে গেছে।

এবার দেখতে হবে আমার থিওরির সঙ্গে টাইটার আর্কিটেকচারের কঠিন পাথর আর দেয়াল মেলে কিনা। প্রশ্ন হলো, আমরা শুরু করব কোত্থেকে?

প্রথম থেকে, বলল নিকোলাস। দেবতা প্রথম চাল দিলেন। টাইটা তো তাই জানিয়েছে। আমরা যদি ওসিরিস-এর শ্রাইন থেকে শুরু করি, সিঁড়ির গোড়া থেকে, তাহলে আমরা হয়তো তার কাল্পনিক বাও বোর্ডের অ্যালাইনমেন্ট পেয়ে যাব।

আমারও তাই ধারণা, বলল রোয়েন। আসুন ধরে নিই এটা টাইটার বোর্ডের উত্তর দুর্গ। এখান থেকে আমরা ষাঁড় চতুষ্টয়ের ধ্রুপদী নিয়ম আবিষ্কার করব।

কঠিন ও একঘেয়ে কাজ, এগুলো শম্বুকগতিতে। প্যাসেজ আর টানেলের ভেতর বারবার ঢুকে প্রাচীন লেখকের এ মস্তিষ্কের তার আর চিন্তাধারা চার হাজার বছর পর আঁচ করতে চাওয়া। গোলকধাঁধায় এখন ওরা ঢুকছে চক নিয়ে, প্রতিটি টানেলের শাখা ও মোড়ের দেয়াল চিহ্নিত করছে নিকোলাস, লিখে রাখছে শীতকাল শিরোনামে নিকোলাসমে ফলকের দিকটায় পাওয়া নোটেশন।

ওরা বুঝতে পারলো ওদের প্রথম ধারণাটা সঠিক হয়েছে, ওসিরিস-এর শ্রাইন হলো বোর্ডের উত্তর দুর্গ। কাজেই খুশি হয়ে উঠলো মন, জানে এটাকে সূত্র ধরে খেলার চাল আবিষ্কার করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু আবার হতাশ হতে হলো যখন বুঝল প্রচলিত বোর্ডের সহজ দুই ডাইমেনশন-এর কথা ভাবে নি টাইটা। সমীকরণে তৃতীয় একটা ডাইমেনশন যোগ করেছে সে।

ওসিরিস-এর শ্রাইন থেকে উঠে যাওয়া সিঁড়িটাই আটটা ল্যান্ডিঙের মাঝখানে একমাত্র লিঙ্ক নয়। সিঁড়ি থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি প্যাসেজ অতি সূক্ষভাবে হয়ে উপরে উঠে গেছে, নয়তো নিচে নেমেছে। এ-ধরনের একটা টানেল অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক মোচড় আর বাঁক ঘুরতে হলো ওদেরকে, অথচ টেরই পেল না যে ওদের লেভেল বদলে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ ওরা সেন্ট্রাল ল্যান্ডিঙে বেরিয়ে এলো, তবে যেটা ধরে ঢুকেছিল তারচেয়ে এক ল্যান্ডিং উপরে।

ওখানে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওরা। নিস্তব্ধতা ভাঙল রোয়েন। একবারও মনে হয় নি যে ওপরে উঠছি। আমাদের ধারণার চেয়ে গোটা ব্যাপারটা আরো অনেক বেশি জটিল, নিকোলাস।

ভীতিকর, মন্তব্য করলো নিকোলাস।

তবে কিছু প্রতাঁকের অর্থ এখন আমার কাছে পরিষ্কার, বলল রোয়েন। ওগুলো লেভেল-এর প্রতিনিধিত্ব করে। গোটা ছকটা আবার নতুন করে সাজাতে হবে।

থ্রী-ডাইমেনশনাল বাও, ধাঁধা মেলনোর নিয়মে খেলতে হবে, বলল নিকোলাস। আমাদের আসলে একটা কমপিউটর দরকার। বুড়ো ক্রীতদাস সত্যিই জিনিয়াস ছিল। জানা সত্ত্বেও বোঝার উপায় নেই যে টানেলের মেঝে উপরে উঠেছে। নাকি নিচে নেমেছে, অথচ তার কাছে একটা স্লাইড কল পর্যন্ত ছিল না। এ গোলকধাঁধা আশ্চর্য এক ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়।

তার প্রশংসা পরে করলেও চলবে, বলল রোয়েন। এখন আসুন সংখ্যাগুলো নতুন করে সাজাই।

তার আগে এ সেন্ট্রাল ল্যান্ডিঙে আলো আর ডেস্ক নিয়ে আসি, বলল নিকোলাস। বোর্ডের মাঝখান থেকে কাজ শুরু করা উচিত বলে মনে করি। চাক্ষুষ বা আন্দাজ করা সহজ হতে পারে।

*

কামরার ভেতর শুধু নরম একটা গোঙানির শব্দ হচ্ছে। নিজের রক্ত আর প্রস্রাবের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। কর্নেল ন কনফারেন্স টেবিলে বসে একটা চুরুট ধরালেন। হাত সামান্য একটু কাঁপল, দেখে মনে হলো অসুস্থ। তিনি একজন সৈনিক, মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে অভ্যস্ত, তিনি নিজেও একজন নিষ্ঠুর মানুষ। মেনজিস্টুর সময়ে নির্যাতন সয়েছেন। কিন্তু আজ যা চাক্ষুষ করলেন, তাঁর বুকটা রীতিমত কেঁপে গেছে। এখন তিনি জানেন হের ফন শিলার কেন এতো ভরসা করেন হেলমের উপর। লোকটা আসলে মানুষ নয়, জানোয়ার।

কামরার আরেক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছোট একটা বেসিনে হাত ধুচ্ছে হেলম্। সময় নিয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত দুটো মুছলো সে, কাপড়ে লাগা রক্তের দাগও মুছলো তারপর হেঁটে এসে দাঁড়ালো টিসের সামনে। আর বোধহয় কিছু বলার নেই ওর, শান্ত সুরে বলল সে। কিছু গোপন করেছে বলে মনে হয় না।

টিসের দিকে তাকালেন কর্নেল। গোটা বুক আর মুখ জুড়ে পোড়া দাগগুলো দগদগে ঘায়ের মতো লাগছে। উপুড় করলে নিতম্বেও এ দাগ দেখা যাবে। চোখ বুজে পড়ে রয়েছে টিসে, চোখের পাপড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত মুখ খোলেনি মেয়েটা। শুধু হেলম্ যখন তার চোখের পাতায় জ্বলন্ত চুরুট ছোঁয়াল, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি, গড়গড় করে সব বলে ফেলেছে।

খানিকটা স্বস্তিবোধ করছেন কর্নেল নগু। হেলম্ তাঁকে টিসের চোখের পাতা খুলে রাখতে বলেছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন হয় নি।

ওর উপর নজর রাখুন, নির্দেশের সুরে বলল হেল, শার্টের গুটানো আস্তিন কব্জিতে নামাল। কর্নেলকে পাশ কাটিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সে। দরজাটা খোলা রেখে গেল, ফলে জার্মান ভাষার দুএকটা শব্দ শুনতে পেলেন কর্নেল। এখন তিনি জানেন পাশের ঘরেই রয়েছেন হের ফন শিলার। হেলমের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন ভদ্রলোক, সেজন্যই কনফারেন্স রুমে ঢোকেন নি।

ফিরে এসে কর্নেলের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকালো হেলম্।ওকে আর দরকার নেই আমাদের। কি করতে হবে আপনি জানেন।

নার্ভাস ভঙ্গিতে চেয়ার ছাড়লেন কর্নেল, হোলস্টারে হাত রাখলেন। এখানে? এখুনি?

বোকার মতো কথা বলবেন না, ধমক দিল হেলম্। অন্য কোথাও পাঠান। দূরে কোথাও। তারপর কাউকে ডেকে জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলুন। আবার পাশের ঘরে চলে গেল সে।

দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করলেন কর্নেল, লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ!

দু জন মিলে টিসেকে কাপড় পরাল ওরা। তার ট্রাউজার আর শার্টও অনেক জায়গায় পুড়ে গেছে। কাপড় পরাবার সময় আহমেদ টিসের দিকে না তাকাবার চেষ্টা করলেন। ট্রাকে একটা চাদর আছে, নিয়ে আসি, বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ফিরে এলেন একটু পরই। টিসের ট্রাউজার আর শার্টের উপর চাদরটা জড়িয়ে দেওয়া হলো, তারপর দু জন মিলে দাঁড়াতে সাহায্য করলো তাকে। কর্নেল কনফারেন্স রুম থেকে বেরুলেন না, হাম্মেদ একাই টিসেকে নিয়ে ট্রাকের দিকে এগুলেন। প্যাসেঞ্জার সীটে বসানো হলো টিসেকে। দুহাতে পোড়া মুখটা ঢেকে রেখেছে সে।

মাথা ঝাঁকিয়ে হাম্মেদ আবার ডাকলেন কর্নেল। শান্ত সুরে নির্দেশ দিলেন তিনি। নির্দেশ শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন হাম্মেদ। এক পর্যায়ে প্রতিবাদ করতে গেলেন তিনি, খেঁকিয়ে উঠে তাকে থামিয়ে দিলেন কর্নেল। তারপর বললেন, মনে রাখবেন, জায়গাটা কোনো গ্রামের কাছাকাছি হওয়া চলবে না। নিশ্চিত হয়ে নেবেন, কোনো সাক্ষী যেনো না থাকে। কাজ শেষ করেই রিপোর্ট করবেন আমাকে।

স্যালুট করে ট্রাকে ফিরে এলেন লেফটেন্যান্ট, ক্যাবে টিসের পাশে উঠে বসলেন। নির্দেশ পেয়ে ট্রাক ছেড়ে দিল ড্রাইভার।

ব্যথায় দিশেহারা বোধ করছে টিসে, সময় সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। উঁচু পথ ধরে ছুটছে ট্রাক, প্রায় অচেতন টিসের মাথা ঘন ঘন আঁকি খাচ্ছে। মুখটা এতো ফুলে আছে, চোখ খুলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। খোলার পর মনে হলো অন্ধ হয়ে গেছে সে। তারপর বুঝতে পারলনা, সূর্য ডুবে গেছে, দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে। চারদিক। তারমানে হেলম্ তাকে প্রায় সারাটা দিন কনফারেন্স রুমে আটকে রেখেছিল।

চোখ খুলে উইন্ডস্ক্রীনে তাকিয়ে আছে টিসে, হেডলাইটের আলোয় সামনের পথটা চিনতে পারলো না। আমাকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বিড়বিড় করলো সে। এটা তো গ্রামে ফেরার পথ নয়।

নিজের সীটে লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ যেনো আরো কুঁজো হয়ে গেলেন, কোনো কথা বললেন না। ব্যথায় আর ক্লান্তিতে টিসেও আর কোনো প্রশ্ন করলো না। চোখ বুজে সীটের উপর নেতিয়ে পড়লো সে।

হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো ট্রাক, ঝাঁকি খেয়ে ঘুম ভাঙল টিসের। কর্কশ কয়েক জোড়া হাত ক্যাব থেকে নামিয়ে হেডলাইটের আলোয় দাঁড় করালো তাকে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাত দুটো পিছনে আনা হলো, বাঁধা হলো চামড়ার বেল দিয়ে। আপনারা আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন, ফুঁপিয়ে উঠলো বেচারি।

বাঁধা কব্জি ধরে টান দিল একজন সৈনিক, রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো টিসেকে। আরো দু জন সৈনিক পিছু নিল ওদের, হাতে কোদাল। রাস্তা থেকে একশো মিটার দূরে ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর থামলো ওরা। একটা গাছের গোড়ায় বসানো হলো তাকে, তার ফাঁক দিয়ে গায়ে চাঁদের আলো পড়ছে। ওই আলোতেই টিসে দেখতে পেল তার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। কবর খুঁড়ছে দু জন লোক, অপর লোকটা তার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে নাগালের ঠিক বাইরে।

প্লিজ, ফিসফিস করলো টিসে। আমাকে মারবেন না!

কথার জবাব না দিয়ে সৈনিক এক পা এগুলো, সবুট লাথি মাল টিসের পাঁজরে। একদম চুপ!

ব্যথার চেয়ে মৃত্যু ভয় বেশি কাহিল করে ফেললো টিসেকে।

কবর খোঁড়া হয়ে গেল। গর্ত থেকে উঠে এলো সৈনিক দু জন। ট্রাক থেকে নেমে এলেন লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ, হাতে একটা টর্চ। টর্চের আলোয় গভীরতা দেখলেন তিনি। গুড। যথেষ্ট গম্ভীর হয়েছে। টর্চটা নিভিয়ে দিলেন। তোমরা সবাই ট্রাকের কাছে চলে যাও। কর্নেল বলে দিয়েছেন, কোনো সাক্ষী থাকা চলবে না। গুলির আওয়াজ হলে ফিরে আসবে, কবরে মাটি ফেলতে সাহায্য করবে আমাকে।

সৈনিকরা ফিরে গেল।

এগিয়ে এসে টিসেকে ধরে দাঁড় করালেন হাম্মেদ, টেনে আনলেন কবরের কাছে। আপনার চাদরটা দিন আমাকে, বলে নিজেই টিসের গা থেকে খুলে নিলেন সেটা। তারপর লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন কবরের ভেতর। টিসে শুনতে পেল হাত . দিয়ে কবরের তলার মাটি নাড়াচাড় করছেন লেফটেন্যান্ট। তারপর তার নিচু গলা শুনতে পেল, কবরের ভেতর কিছু একটা দেখাতে হবে ওদেরকে। দেখে যাতে মনে হয় লাশ….

চামড়ার বেল্টটা কব্জি থেকে খুলে ফেলে দিলেন কবরের ভেতর। দিশেহারা টিসে ফিসফিস করে জানতে চাইলো, কি করছেন আপনি? কবরের ভেতর তাকিয়ে দেখলো চাদরের উপর এমন ভাবে মাটি ফেলা হয়েছে, দেখে মনে হবে ভেতরে একটা লাশ আছে।

প্লিজ, কথা বলবেন না! চাপা গলায় সতর্ক করে দিলেন হাম্মেদ। টিসেকে নিয়ে চলে এলেন ঘন একটা ঝোঁপের ভেতর, বসিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে শুয়ে পড়ন। পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত নড়বেন না বা কথা বলবেন না।

কবরের কাছে ফিরে এসে পিস্তলের ফাঁকা দুটো আওয়াজ করলেন আহমেদ। তারপর তার চিৎকার শুনতে পেল টিসে, চলে এসো তোমরা, কাজটা শেষ করি।

সৈনিকরা কবরের কাছে ফিরে এলো। ঝোঁপের ভেতর থেকে মাটিতে কোদালের কোপ মারার আওয়াজ পেল টিসে, গর্তটা ভরা হচ্ছে। একজন সৈনিক বলল, লেফটেন্যান্ট, আপনার টর্চটা জ্বালছেন না কেন? কবরের ভেতরটা তো দেখতে পাচ্ছি না।

মাটি ভরার জন্য আলো লাগবে কেন? ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন হাম্মেদ। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো। আলগা মাটি সমান করে দেবে, আমি চাই না এখানে এসে কেউ হোঁচট খাক।

কিছুক্ষণ পর মাটি ভরার কাজ শেষ হলো, ট্রাক নিয়ে ফিরে গেল সৈনিকরা। স্বস্তি, ব্যথা ও ক্লান্তিতে ঝোঁপের ভেতর শুয়ে কাঁদছে টিসে। আরো কিছুক্ষণ পর হামাগুড়ি দিয়ে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো সে, একটা গাছ ধরে দাঁড়ালো, টলছে।

এতোক্ষণে অপরাধবোধটা গ্রাস করলো তাকে। ভাবল, মেকের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, শত্রুপক্ষকে বলে দিয়েছি সব কথা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে গিয়ে তাকে আমার সাবধান করা উচিত।

টলতে টলতে রাস্তার দিকে এগুলো টিসে।

*

টাইটার কোড ভাঙা গেছে কিনা বোঝার একমাত্র উপায় হলো তার তৈরি তালিকায় পাওয়া চাল অনুসারের খেলাটা চালিয়ে যাওয়া। জটিল ছকে তৈরি টানেলের শাখা-প্রশাখার ভেতর দিয়ে সাবধানে এগুলো ওরা, টাইটার চাল ধরে এগুচ্ছে, সেগুলো সাদা চক দিয়ে এঁকে রাখছে দেয়ালের গায়ে।

ফলকের শীতকাল শিরোনামে আঠারোটা চাল রয়েছে। রোয়েন যেটাকে প্রথম চাল ধরে নিয়েছে সেখান থেকে বারোটা চাল পর্যন্ত এগোনো সম্ভব হলো। কিন্তু তারপর সামনে পড়লো নিরেট দেয়াল, পরবর্তী চালে পা ফেলার কোনো সুযোগ নেই।

ধ্যেত, এতো পরিশ্রম সব বৃথা গেল, দেয়ালটায় লাথি মেরে বলল নিকোলাস।

দুঃখিত, চোখ থেকে চুল সরাল রোয়েন। আমারই কোথাও ভুল হয়েছে। দ্বিতীয় কলামের ফিগার উল্টো করে ধরে এগুতে হবে।

তার মানে নতুন করে শুরু করো আবার।

হ্যাঁ, প্রথম থেকে।

খেলাটা যদি ঠিকমতো খেলতেও পারি, জানব কীভাবে খেলতে পেরেছি? জানতে চাইলো নিকোলাস।

সূত্র অনুসরণ করে আমরা যদি একটা উইনিং কম্বিনেশনে পৌঁছতে পারি, সেটা : হবে চালমাত, ঠিক আঠারো চালের মাথায়। এরপর আর যুক্তিসঙ্গত কোনো চাল থাকবে না, তখন ধরে নিতে হবে খেলাটা আমরা শেষ করতে পেরেছি।

ওই পজিশনে পৌঁছে কী পাব আমরা?

ওখানে পৌঁছনোর পর বলতে পারব। মিষ্টি করে হাসলো রোয়েন। হাসিখুশি থাকুন, নিকোলাস। কষ্টের মাত্র শুরু হয়েছে।

টাইটার নোটেশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির সংখ্যাগুলোর মূল্যমান নতুন করে নির্ধারণ করলো রোয়েন, প্রথমগুলোকে ধরল কাপ মূল্যমানে, দ্বিতীযগুলোকে ফাইল মূল্যমানে। কিন্তু এভাবে মাত্র পাঁচটা চল এগোলো গেল, তারপর আর সামনে বাড়ার পথ নেই।

তৃতীয় সারির প্রতীকগুলোকে আমরা লেভেল পরিবর্তনের চিহ্ন হিসেবে ধরেছি, হয়তো এখানে ভুল হচ্ছে বলল নিকোলাস। আসুন আবার শুরু করি, এবার ওগুলোকে দ্বিতীয় মূল্যমান দিই।

তাতে প্রচুর সময় লাগবে, প্রতিবাদ করলো রোয়েন। তারচেয়ে আসুন, নোটেশনের মাঝখানে টাইটা যেসব উক্তি করেছে সেগুলো আরেকবার পড়ি। দেখা যাক কোনো সূত্র বেরোয় কিনা।

বেশ।

প্রথম কোটেশন, হায়ারোগ্লিফিক্সে আঙুল রাখলো রোয়েন। পড়ছি-নাম থাকলে জিনিসটাকে চেনা যায়। নামবিহীন জিনিস শুধু অনুভব করা যায়। পেছনে জোয়ার আর মুখে বাতাস নিয়ে জলপথে ভ্রমণ করেছি আমি। হে, ভালোবাসা আমার, তোমার স্বাদ আমার ঠোঁটে মিষ্টি-মধুর।

ব্যস?

হ্যাঁ, তারপর পরবর্তী নোটেশন। কাঁকড়া বিছে, দুই আর তিন সংখ্যা, তারপর আবার….

জলপথে ভ্রমণ আর ভালোবাসা আমার মানে কী? এভাবে ফলকের ধাঁধা নিয়ে গবেষণা চলল। রাতদিনের হিসাব ভুলে গেল ওরা, ঘুম আর খিদে গ্রাহ্যের মধ্যে আনলো না। তারপর একদিন বাস্তব জগতে ফিরে এলো সিঁড়ির গোড়া থেকে ড্যানিয়েলের আওয়াজ ভেসে আসায়। ডেস্ক ছেড়ে দাঁড়ালো নিকোলাস, আড়মোড়া ভেঙে হাতঘড়ি দেখলো আটটা বাজে। কিন্তু রাত নাকি দিন জানি না। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখতে পেল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ড্যানিয়েল, তার কাপড়চোপড় ভেজা। তোমার এ অবস্থা কেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। সিঙ্কহোলে পড়ে গিয়েছিলে?

হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছলো ড্যানিয়েল। কেউ তোমাকে বলে নি? বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে।

রোয়েন আর নিকোলাস পরস্পরের দিকে আতঙ্ক ভরা দৃষ্টিতে তাকালো।

এতো তাড়াতাড়ি? ফিসফিস করলো রোয়েন। আমাদের হিসেবে তো বর্ষা শুরু হতে আরো এক সপ্তাহ দেরি আছে।

কাঁধ ঝাঁকালো ড্যানিয়েল। ঋতুর পরিবর্তন হয় না?

অকাল বর্ষণ নয় তো? জানতে চাইলো নিকোলাস। নদীর কি অবস্থা? লেভেল উঠতে শুরু করেছে?

সে কথা বলার জন্যই তো এলাম। বাঁধের উপর উঠতে যাচ্ছি আমি বাঘ গ্রুপটাকে নিয়ে। ওটার উপর নজর রাখা দরকার। যদি দেখি বাঁধ ভেঙে পড়তে যাচ্ছে, একজন নিকোলাসেরকে পাঠাব। তখন কোনো তর্ক বা সময় নষ্ট করো না, সেই মুহূর্তে বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। আমার লোক পাঠানোর মানে হবে যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে বাঁধ।

হানশিত শেরিফকে সঙ্গে নিয়ো না, নির্দেশ দিল নিকোলাস। ওকে এখানে আমার দরকার।

টানেল থেকে বেশিরভাগ শ্রমিককে নিয়ে চলে গেল ড্যানিয়েল। নিকোলাস ও রোয়েন পরস্পরের দিকে তাকালো, দু জনেই গম্ভীর।

আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে, অথচ টাইটার ধাঁধার সমাধান করতে পারছি না, বলল নিকোলাস। একটা ব্যাপার নিশ্চিত জানবেন, নদীর লেভেল বাড়তে শুরু করলে…

কথাটা রোয়েন শেষ করতে দিল না। নদী! চেঁচিয়ে উঠলো। সাগর নয়। অনুবাদে ভুল করেছি আমি। শব্দটার অনুবাদ করেছি-জোয়ার। ধরে নিয়েছিলাম টাইটা সাগরের কথা বলতে চাইছে। কিন্তু আসলে হবে স্রোত বা প্রবাহ। মিশরীয়রা দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না।

দু জনেই ওরা ডেস্কে পড়ে থাকা নোটবুকের কাছে ছুটে এলো। পড়ছি আবার–পেছনে স্রোত আর মুখে বাতাস নিয়ে জলপথে ভ্রমণ করেছি…। মুখ তুলে রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস।

নীলনদে, জলপথে মানে নীলনদে, বলল রোয়েন। জোরালো বাতাস সব সময় উত্তরদিক থেকে আসছে, আর স্রোত সব সময় দক্ষিণ দিক থেকে বয়। টাইটা উত্তর দিকে মুখ করেছিল। উত্তর দুর্গ।

কিন্তু আমরা ধরে নিয়েছিলাম উত্তরের প্রতীক বেবুন, ওকে মনে করিয়ে দিল নিকোলাস।

না! আমার ভুল হয়েছে। অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে রোয়েনের চেহারা। শুনুন–হে, ভালোবাসা আমার, তোমার স্বাদ আমার ঠোঁটে মিষ্টি-মধুর। মধু! মৌমাছি! উত্তর আর দক্ষিণের প্রতীক চিহ্ন আমি উল্টোপাল্টা করে ফেলেছিলাম।

আর পুব ও পশ্চিম? ওখানে কী পাচ্ছি আমরা? নতুন উদ্যমে অনুবাদে মনোযোগ দিল নিকোলাস। পড়ছি–আমার পাপ গোলাপের মতোই টকটকে লাল। ওগুলো আমাকে বেঁধে রেখেছে ব্রোঞ্জের মতো শেকল দিয়ে। ওগুলো আমার হৃদয়ে জ্বালাময়ি খোঁচা দেয়, এবং আমি চোখ ফেরাই সন্ধ্যা তারার দিকে।

এখানে কী ভুল করলাম বুঝতে পারছি না…

খোঁচা শব্দটা ভুল অনুবাদ, বলল নিকোলাস। হওয়া উচিত বিদ্ধ করে বা কামড় দেয়। কাঁকড়া বিছে কামড় দেয়। কাঁকড়া বিছে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যা তারার দিকে। সন্ধ্যা তারা সব সময় পশ্চিমে দেখা যায়। কাঁকড়া বিছে হলো পশ্চিম দুর্গ, পুবদিকের দুর্গ নয়।

বোর্ডটাকে উল্টো করে দেখতে হবে! উত্তেজনায় লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লো রোয়েন। চলুন নতুন নিয়মে খেলি।

লেভেল সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসি নি আমরা, প্রতিবাদ করলো নিকোলাস। সিস্ট্রাম কী আপার লেভেল, নাকি তিন তলোয়ার?

উপায় যখন পেয়েছি, এটা ধরেই এগুতে হবে আমাদের। সিস্ট্রামকে আপার লেভেল ধরে খেলব আমরা, তাতে কাজ না হলে আরেক ভাবে চেষ্টা করা যাবে।

কাজটা আগের চেয়ে সহজ লাগলো। বহুবার আসা-যাওয়া করায় পরিচিত হয়ে উঠেছে, এখন আর আগের মতো গা ছমছমও করে না। টানেলের প্রতিটি কোণে, মোচড়ে, বাঁকে আর টি-জাংশনে নিকোলাসের হাতের চক দিয়ে লেখা চিহ্ন রয়েছে। জটিল বাক আর মোচড় ঘুরে দ্রুত এগুতে পারছে ওরা। প্রতিটি নোটেশন অনুসরণ করে এগুতে পারছে দেখে উৎসাহ আর উত্তেজনা বেড়ে গেল, সামনে কোনো বাধা পাচ্ছে না।

আঠারোতম চাল, কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। এটা যদি আমাদেরকে ভোলা ফাইলগুলোর একটায় নিয়ে যেতে পারে, যেটা প্রতিপক্ষের দক্ষিণ দুর্গের জন্য হুমকি, তাহলে সেটা হবে চেক কু। বড় করে শ্বাস টানলো ও। পাখি। তিন আর পাঁচ নম্বর। সঙ্গে লোয়ার লেভেলের প্রতীক তিন তলোয়ার।

শুনে শুনে পা ফেলে পাঁচটা জাংশন পেরিয়ে এলো ওরা, নেমে এলো গোলকধাঁধার সবেচেয়ে নিচের লেভেলে, প্রতিটি মোড়ের পাথরের ব্লকে চক দিয়ে আঁকা চিহ্নগুলো পড়ে নিজেদের পজিশন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে।

এটাই! রোয়েনকে বলল নিকোলাস, দাঁড়িয়ে পড়লো দু জনে, নিজেদের চারদিকে তাকালো।

অসাধারণ কিছুই এখানে নেই, রোয়েনের গলায় হতাশার সুর। এর আগে অন্তত পঞ্চাশবার এখান দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি আমরা। এটাও আর সব বাঁকের মতো।

টাইটা চেয়েছেও তাই, আমরা যাতে পার্থক্যই বুঝতে না পারি।

এখন তাহলে কী করব আমরা? এ প্রথম দিশেহারা দেখালো নিমাকে।

ফলকের শেষ লেখাটা পড়ন তো।

হাতের নোটবুক খুলল রোয়েন। পড়েছি-মিশরের এ পবিত্র আর কালো মাটিতে ফসলের কোনো কমতি নেই। আমি আমার গাধার পাঁজরে চাবুক মারলাম, রাঙলের কাঠের ফলা নতুন জমিন গুঁড়ো করল। আমি বীজ বপন করলাম, ঘরে তুললাম আঙুর আর শস্যদানা। সময় মতো আমি মদ্য পান করলাম আর রুটি খেলাম। মরশুমের ছন্দ মেনে চলি আমি, জমিনের যত্ন নিই।

মুখ তুলে নিকোলাসের দিকে তাকালো রোয়েন। মরশুমের ছন্দ? টাইটা কি ফলকের চারটে মুখের কথা বলছে? জমিন? প্রশ্ন করে পায়ের সামনে পাথরের দিকে তাকালো। জমিন কি পায়ের নিচে নয়, নিকোলাস?

পাথরের ফলকে পা ঠুকলো নিকোলাস, কিন্তু আওয়াজটা হলো তো আর নিরেট। জানার একটাই উপায় আছে। তারপর গলা চড়িয়ে হাঁক ছাড়লো, হানশিত! এদিকে এসো!

 ৭. বৃষ্টির মধ্যে

বৃষ্টির মধ্যে হলুদ ফ্রন্ট এন্ড লোডার-এর উঁচু সিটে বসে বাগ গ্রুপটাকে গালিগালাজ করছে ড্যানিয়েল, আবার হাসছে ও, কারণ জানে তার গালাগালির একটা শব্দও ওরা বুঝতে পারছে না। ইতোমধ্যে বৃষ্টির মাত্রা কমে গেছে, তবে পাহাড় চূড়ার মাথায় বিশাল এলাকা জুড়ে কালো আর ভারী হয়ে আছে মেঘ। সত্যিকার অর্থে বর্ষা মরশুম শুরু হয় নি; প্রবল বাতাস বইছে, মেঘগুলো সরে গেলেও যেতে পারে।

তবে নদী উপরে উঠছে। বাতাস থেমে গেলে তুমুল বৃষ্টি শুরু হবে। তখনকার বিপদের কথা ভেবেই বাঁধের উপর গ্যাবিয়ন ফেলে আরো উঁচু করা হচ্ছে ওটা। জালে পাথর ভরা হচ্ছে, বাঘের বাচ্চারা সেগুলো বয়ে এনে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখছে, ড্যানিয়েল সেগুলো তার ট্রাক্টরের ক্রেনে তুলে নিয়ে বাঁধের মাথায় নামাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, নদীর পানিকে কোনোভাবেই বাঁধের মাথায় উঠতে দেওয়া যাবে না। তা যদি একবার উঠতে পারে, এ বাঁধ খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে, কারো সাধ্য নেই ঠেকিয়ে রাখে। আর বৃষ্টি যদি একবার শুরু হয়, নদীকে বশে রাখাও সম্ভব হবে না।

ড্যানিয়েল জানে বিপদ ঘটতে শুরু করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলবে না, কারণ তখন নিকোলাসকে খবর পাঠিয়েও কোনো লাভ নেই। বাঁধ ভাঙা পানির সঙ্গে দৌড়ে নিকোলাসের কাছে আগে পৌঁছতে পারবে না। ব্যাপারটা এখন সূক্ষ্ম বিবেচনার। ওর খুব সতর্ক এ। বলছে, নিকোলাসকে সাবধান করার এখনই সময়। টানেল থেকে এখুনি ওদের বেরিয়ে আসা উচিত।

তবে এও ড্যানিয়েল. জানে যে টানেলের ভেতর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে ওরা, সময়ের আগে টানেল থেকে ডেকে নিলে ক্ষতি তো হবেই, তার উপর রেগেও যাবে নিকোলাস।

ড্যানিয়েল সিদ্ধান্ত নিল, নদীর উপর নজর রেখে আরো এক ঘণ্টা অপেক্ষা করবে সে। নদীর কিনারা ঘরে ট্রাক্টর নিয়ে এগুলো, আরেকটা গ্যাবিয়ন নামাবে বাঁধের মাথায়।

*

হানশিত শেরিফ আর তার কয়েকজন লোকের সঙ্গে নিকোলাসও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। গোলকধাঁধার এটা সবচেয়ে নিচের লেভেল, মেঝে থেকে একটা একটা করে তুলে ফেলা হচ্ছে স্ল্যাব বা ফলক। ওগুলোর মাঝখানের জয়েন্ট এতো আঁটসাঁট যে এমন কী ক্রোবার দিয়ে আলাদা করতেও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ওরা। সময় বাঁচানোর জন্য নিজেদের তৈরি স্লেজ-হ্যামার দিয়ে ফলকগুলো ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হলো নিকোলাসকে।

শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও, সবারই চোখে-মুখে ভয়ে ছাপ লেগে আছে, কারণ তারা জানে গিরিখাদের মাথায় নদীর লেভেল উপরে উঠতে শুরু করেছে। নিকোলাসের জন্য খারাপ খবর হলো, হানশিত শেরিফের ষোলোজন শ্রমিক। ডিউটিতে আসে নি। সন্দেহ নেই, পালিয়েছে তারা।

টানেলের বাঁক থেকে ফলক ভাঙতে শুরু করেছে ওরা। ভাঙা হচ্ছে বাঁকের দু দিকের মেঝেই। একটা করে ফলক ভাঙা হয়, নিচে কোনো দরজা বা ধাপ দেখার আশায় দম ধরে রাখে নিকোলাস। কিন্তু হতাশ হতে হয়, নিচে নিরেট পাথর ছাড়া আর কিছু নেই।

কাজ থামিয়ে পানি খেতে এসে রোয়েনকে বলল ও, আশা করার মতো কিছু দেখছি না।

রোয়েন উত্তরে কিছু বলার আগেই হানশিতের চিৎকার ভেসে এলো, এফেন্দি, দেখে যান!

হাত থেকে পানির ফ্লাস্কটা ফেলে দিয়ে ছুটলো রোয়েন, খেয়ালই করলো না যে ওটা ভেঙে গিয়ে ওর পা ভিজিয়ে দিল। হানশিতের পাশে এসে দাঁড়ালো সে। হ্যাঁমার উপর তুলে আরেকটা আঘাত করার জন্য তৈরি হানশিত। কী… কী… থেমে গেল রোয়েন, ইতোমধ্যে ওর পাশে চলে এসেছে নিকোলাসও। দুজনেই দেখলাম সদ্য ভাঙা একটা ফলকের নিচে সাধারণ কোনো পাথর নয়, ড্রেস করা আরেকটা ফলক রয়েছে।

তারপর দেখা গেল সাজানো ফলকের আরো একটা স্তর রয়েছে মেঝের নিচে, টানেলের এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলকগুলো চারপাশের পাথরের সঙ্গে জোড়া লাগানো, জয়েন্টগুলো এতো সরু যে প্রায় চোখেই পড়ে না। কিনারাগুলো মসৃণ ও সমান, কোনো রকম খোদাই বা চিহ্ন নেই। কী ব্যাপার, নিকোলাস? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

বোঝাই যাচ্ছে, আরেকটা স্তর, নিচে হয়তো কোনো ফাঁক আছে। না তোলা পর্যন্ত বোঝা যাবে না।

দ্বিতীয় স্তরের ফলক এতো চওড়া আর শক্ত যে ওদের হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা সম্ভব হলো না। অগত্যা বাধ্য হয়ে প্রথম ফলকের চারধারে জয়েন্ট বরাবর গভীর খাল কেটে আলাদা করতে হলো প্রথমে, তারপর তুলে ফেলা হলো। ভিত থেকে একটা প্রান্ত তুলতে পাঁচজন লোককে হাত লাগাতে হলো।

ফলকটার নিচে একটা ফাঁক আছে। হাঁটু গেড়ে উঁকি দিল রোয়েন। খোলা শ্যাফটের মতো।

একটা ফলক তোলার পর বাকিগুলো তোলার কাজ সহজ হয়ে গেল। অবশেষে চৌকো ফাঁকটার সবটুকু উন্মোচিত হলো। অন্ধকার শ্যাফটের ভেতর ল্যাম্পের আলো ফেললো নিকোলাস। ভেতরের ফাঁক টানেলের এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত, নিচের প্রথম ধাপে পা রাখার পর সোজা হয়ে দাঁড়াতে নিকোলাসের কোনো অসুবিধে হলো না, বাকি ধাপগুলো, পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী বাঁক নিয়ে নেমে গেছে। আরেকটা সিঁড়ি, বলল ও। বোধহয় এটাই সেটা। ভুল পথ দেখাতে দেখাতে এমন কী টাইটাও এততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা।

শ্রমিকরা সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, তবে জানে বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত সিলভার ডলার পাবে তারা।

আমরা কী এক্ষুনি নিচে নামছি? জানতে চাইলো রোয়েন। জানি ফাঁদ থাকতে পারে, সাবধান হওয়া দরকার; কিন্তু সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে।

ফাঁদ থাকুক আর নাই থাকুক, আজ আমাদের ঝুঁকি নেওয়ার দিন, বলল নিকোলাস।

পাশাপাশি নামছে ওরা। প্রতিবার সাবধানে একটা করে পা ফেলছে। হাতের ল্যাম্প মাথার উপর উঁচু করে ধরেছে নিকোলাস। রোয়েন বলল, নিচে একটা চেম্বার দেখা যাচ্ছে।

মনে হচ্ছে স্টোররুম, ফিসফিস করলো নিকোলাস। দেয়াল ঘেঁষে সাজানো কি ওগুলো? সংখ্যায় কয়েকশো হবে। কফিন, পাথুরে শবাধার? গাঢ় আকৃতিগুলো প্রায় মানুষেরই আদল, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একের পর এক অনেকগুলো সারি। চেম্বারটা চৌকো।

না, বলল রোয়েন। একদিকে ওগুলো শস্য রাখার বাস্কেট, আমি চিনতে পারছি। আরেকদিকে দুই হাতলঅলা জার, মদ রাখার জন্য। সম্ভত মৃত লোককে দান করা হয়েছে।

এটা যদি সমাধি সম্পদের স্টোররুম হয়ে থাকে, উত্তেজনায় আঁটসাঁট গলায় বলল নিকোলাস, ধরে নিতে হয় সমাধির খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা।

হ্যাঁ! চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন। দেখুন-স্টোররুমের শেষ মাথায় একটা দরজা। ওদিকে আলো ফেলুন!

প্রকোষ্ঠের এক প্রান্তে ফাঁকটা দেখা গেল, যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওদের। শেষ ধাপ কয়টা ছুটে পার হলো ওরা। কিন্তু স্টোররুমের লেভেল ফ্লোরে পৌঁছতেই অদৃশ্য একটা বাধা থামিয়ে দিল ওদেরকে। ছিটকে পেছন দিকে পড়লো দু জনেই।

ঈশ্বর! নিজের গলা খামছে ধরেছে নিকোলাস, কর্কশ শোনালো আওয়াজটা। পিছিয়ে আসুন! পিছিয়ে আসুন!

হাঁটুগেড়ে প্রায় ঢলে পড়ার অবস্থা হলো রোয়েনের, বাতাসের অভাবে সে-ও ভুগছে। নিকোলাস! চিৎকার দিতে চাইছে, কিন্তু সমস্ত বাতাস আটকে গেছে ফুসফুসে। বুকে প্রচণ্ড একটা চাপ অনুভব করছে ও। নিকোলাস! আমাকে বাঁচান! দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার অবস্থা হয়েছে ওর, ডাঙার তোলা মাছের মতো খাবি খাচ্ছে।

রোয়েনের উপর ঝুঁকলো নিকোলাস, দু হাতে ধরে তুলতে চেষ্টা করলো। পারছে না, সাংঘাতিক কাহিল লাগছে নিজেকে। পা দুটো হাঁটুর কাছে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে, নিজের ওজনই বইতে পারছে না। ও জানে, দম আটকে মারা যাচ্ছে ওরা। চার মিনিট, ভাবল ও। চার মিনিটের মধ্যে তাজা বাতাস না পেলে মৃত্যু ঘটবে মস্তিস্কের।

রোয়েনের পেছনে দাঁড়ালো নিকোলাস, ওর বগলের তলা দিয়ে গলিতে হাত দুটো এক করর, তারপর আবার ওকে তুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ওর সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। পেছন দিকে ঢলে পড়ছে ও, ধাপের উপর। সমস্ত মনোবল এক করে নিজেকে স্থির রাখতে চাইছে। আবার রোয়েনকে তুলতে চেষ্টা করলো। কীভাবে পারলো বলতে পারবে না, শুধু খেয়াল করলো ধাপ বেয়ে পিছু হটছে ও, বুকের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে রোয়েন। প্রতিটি পা ফেলতে অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি লাগছে। আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে রোয়েন, নিকোলাসের বৃত্তাকার বাহুবন্ধনে ঝুলছে, অসাড় পা দুটো পাথুরে ধাপের উপর ঘষা খাচ্ছে।

চিৎকার করতে চাইছে নিকোলাস, হানশিতকে বলতে চাইছে সাহায্য করো। কিন্তু গলা থেকে কোনো আওয়াজই বের করতে পারলো না। আরো পাঁচ ধাপ উঠে এলো। বুঝতে পারছে, রোয়েনের ভার বহন করা ওর পক্ষে আর সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে এ ও জানে, ওকে যদি এখানে ফেলে গেল নিকোলাস। ধাপের উপর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, বুকের উপর রোয়েন। শ্বাস নিতে দাও, ঈশ্বর শ্বাস নিতে দাও! গলায় আওয়াজ নেই, শুধু ঠোঁট দুটো নড়ছে। প্লিজ, গড়…..

যেনো ওর প্রার্থনা শুনেই ছুটে এলো তাজা বাতাস, নাক-মুখ গলে ফুসফুসে পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা মুক্তি ফিরে এলো। রোয়েনকে আবার জড়িয়ে ধরল নিকোলাস, নিধে হলো টলতে টলতে। এবার সিঁড়ির মাথার দিকে মুখ করে উঠছে নিকোলাস, ফাঁকটার মাথায় পৌঁছে গেল, হানশিত শেরিফের পায়ের কাছে।

কী ব্যাপার, এফেন্দি? কী হয়েছে আপনাদের? উদ্বিগ্ন হানশিত জানতে চাইলো।

টানেলের মেঝেতে রোয়েনকে শুইয়ে দিল নিকোলাস, জবাব দেওয়ার শক্তি নেই। রোয়েনের গালে চাপড় মারলো ও। কথা বলুন, রোয়েন! কথা বলুন!

রোয়েন সাড়া দিচ্ছে না। কাজেই ওর উপর ঝুঁকলো নিকোলাস, মুখটা নিজের মুখ দিয়ে চেপে ধরল, ফুঁ দিল ভেতরে। চোখের কোণ দিয়ে দেখলো, রোয়েনের বুক ফুলছে।

মাথা তুললাম নিকোলাস, তিন পর্যন্ত শুনলো। প্লিজ, ডালিং, প্লিজ! শ্বাস নিন! মড়ার মতো চেহারায় কোনো রঙ ফুটছে না। আবার ঝুঁকলো ও, মুখে মুখ চেপে ফুঁ দিল। রোয়েনের ফুসফুস ভরে গেল আবার, এবার নিকোলাসের নিচে নড়ে উঠলো ও। গুড গার্ল! লক্ষ্মী মেয়ে!

তৃতীয় বার ফুঁ দেওয়ার পর নিকোলাসকে ঠেলে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিল রোয়েন, আড়ষ্টভঙ্গিতে উঠে বসলো, বোকার মতো তাকালো চারদিকে। নিকোলাসের উপর চোখ পড়তে অবাক হয়ে জানতে চাইলো, নিকোলাস, কি ঘটেছে?

ঠিক জানি না। তবে দু জনেই মারা যাচ্ছিলাম। এখন কেমন লাগছে আপনার?

মনে হচ্ছিল অদৃশ্য একটা হাত আমার গলা চেপে ধরেছে। শ্বাস নিতে পারছিলাম না, তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

গলিপথের লোয়ার লেভেলে কোনো ধরনের গ্যাস আছে। আপনি অজ্ঞান ছিলেন মিনিট দুয়েক।

কপালে হাত দিল রোয়েন। ব্যথা করছে। শুনতে পাচ্ছিলাম আপনি আমার নাম ধরে ডাকছেন। আপনি আমাকে ডালিং বলেছেন… নাকি ভুল শুনলাম?

সামান্য স্লিপ অভ টাং, হাত ধরে রোয়েনকে দাঁড় করালো নিকোলাস। তারপরও টলছে ও, হেলাল দিল নিকোলাসের গায়ে।

ধন্যবাদ, নিকোলাস। ঋণের বোঝা শুধু বাড়ছেই। জানি না কোনোদিন শোধ করতে পারব কিনা।

একটা না একটা উপায় দু জনে মিলে বের করেই ফেলবো। স্মিত হাসি লেগে রয়েছে নিকোলাসের ঠোঁটে।

হঠাৎ রোয়েন খেয়াল করলো, চারপাশের লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নিকোলাসের গা থেকেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও। কী ধরনের গ্যাস, নিকোলাস? গ্যাস ওখানে এলোই বা কোত্থেকে? আপনার কি ধারণা, এটাও টাইটার আরেকটা চালাকি?

সম্ভবত কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেনও হতে পারে। মিথেনও তো বাতাসের চেয়ে ভারী, তাই না?

এলো কোত্থেকে?

পচা লাশ থেকে তৈরি হতে পারে, বলল নিকোলাস। তবে ওই বাস্কেট আর। জারগুলোকে সন্দেহ হচ্ছে আমার। ওগুলোর ভেতরে কী আছে জানার পর বুঝতে পারব। কেমন লাগছে এখন? মাথার ব্যথাটা কমেছে?

আমি ভালো আছি। এখন আমরা কী করব, নিকোলাস?

চেম্বার থেকে গ্যাস পরিষ্কার করতে হবে, বলল নিকোলাস। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

শ্যাফটের গ্যাস লেভেল পরীক্ষা করার জন্য মোমবাতি ব্যবহার করলো নিকোলাস। ডান হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামছে। নামার সময় হাতের বাতিটা মেঝের দিকে নিচু করলো, প্রতিবার এক ধাপ করে নামছে। ভালোই জ্বলছে বাতি, নাচানাচি করছে শিখাটা। তারপর চেম্বারের মেঝে থেকে ছয়টা ধাপ ওপরে থাকতে, শিখাটা হলুদ হয়ে গেল, নিভে গেল দপ করে। দেয়ালে চক দিয়ে দাগ কাটলো নিকোলাস।

না, মিথেন নয়, বলল ও। কার্বন ডাইঅক্সাইডই।

শ্যাফটের মাথা থেকে রোয়েন বলল, মিথেন হলে বুঝি বিস্ফোরণ ঘটত? হেসে উঠলো ও।

হানশিত, ব্লোয়ার ফ্যানটা নিয়ে এসো, বলল নিকোলাস।

হাতে ফ্যানটা নিয়ে দম আটকালো নিকোলাস, নিচের ধাপটায় নেমে এসে চেম্বারের মেঝেতে রাখলো ওটা। ফ্যান চালু করেই ছুটে ফিরে এলো দেয়ালে দাগ কাটা জায়গাটার ওপরে। রোয়েনের প্রশ্নের উত্তরে জানালো, পনেরো মিনিট পর পর টেস্ট করতে হবে।

গ্যাস সরাতে এক ঘণ্টা লেগে গেল। চেম্বারে নেমে এখন ওরা শ্বাস নিতে পারছে। নিকোলাসের নির্দেশে কিছু জ্বালানি কাঠ নিয়ে এলো হানশিত, চেম্বারের মাঝখানে আগুন জ্বালা হলো। আঁচ পেয়ে বাতাস আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এরপর নাকে নিয়ে বাস্কেটগুলো পরীক্ষা করলো নিকোলাস।

ব্যাটা অতি চালাক! বলল নিকোলাস। নানা জিনিস মিশিয়ে সার তৈরি করে রেখে গেছে।

চেম্বারের আরেক দিকে চলে এলো ওরা, মাটির একটা জার কাত করে খানিকটা পাউডার ঢাললো মেঝেতে। আঙুলে নিয়ে ঘষা দিল নিকোলাস, তারপর শুকলো। লাইমস্টোনের গুঁড়ো। অনেক আগে শুকিয়ে যাওয়ায় গন্ধ হারিয়ে ফেলেছে, তবে টাইটা সম্ভবত কোনো ধরনের অ্যাসিডে ভিজিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত ভিনিগার, আবার প্রস্রাবও হতে পারে। এ থেকেই কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়েছে।

তার মানে এটাও তাহলে একটা ফাঁদ ছিল, বলল রোয়েন।

এতো হাজার বছর আগেও টাইটা পচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানত। ওই মিশ্রণ থেকে কী ধরনের গ্যাস তৈরি হবে জানা ছিল তার। ব্যাটাকে বিরাট কেমিস্ট বলতে আমার আপত্তি নেই।

আর বাতাস যেহেতু এখানে স্থির, এ-ও জানত যে চেম্বারের মেঝেতে ভেসে থাকবে গ্যাস, উপরে উঠবে না। আমি ধরে নিচ্ছি এ শ্যাফটের ডিজাইন করা হয়েছে একটা ইউ-ট্র্যাপ-এর আদলে। বাজি ধরে বলতে পারি, ওই প্যাসেজও ক্রমশ উপর দিকে উঠে গেছে… হাত তুলে আরেক প্রান্তের দরজা বা ফাঁকাটা নিকোলাসকে দেখালো রোয়েন। প্রথম ধাপটা এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি আমি।

*

নদীর কিনারায় পাথরের উঁচু স্তূপ তৈরি করেছে ড্যানিয়েল, লেভেল মনিটর করার জন্য। ওগুলোর উপর কড়া নজর আছে তাঁর।

বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর ছয়ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। পাহাড় চূড়ায় মেঘ সরে গেছে, তবে উত্তর দিগন্তে নতুন করে জমা হচ্ছে আবার। ওদিকে, হাইল্যান্ডে, যে কোনো মুহূর্তে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হবে। তা যদি হয়, ড্যানিয়েল ভাবছে, এখানে অ্যাবে গিরিখাদে বন্যার পানি পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে।

ট্র্যাক্টের থেকে নেমে নদীর পাড় ধরে নিচে নামলো সে, স্টোন মার্কার পরীক্ষা করবে। গত এক ঘণ্টায় পানির লেভেল এক ফুটের মতো নেমেছে। তবে নিজেকে খুশি হতে নিষেধ করলো সে-কারণ, নদীর লেভেল এক ফুট উঁচু হতে মাত্র পনেরো মিনিট লেগেছিল। চূড়ান্ত বর্ষণ আসন্ন। অমোঘ নিয়তির মতো, এড়াবার উপায় নেই। নদী ফুলে-ফেঁপে উঠবে। বিস্ফোরিত হবে বাঁধ। ভাটির দিকে ফিরে বাঁধটা দেখলো সে। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে।

চরম মুহূর্তটা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য যতোটুকু তার পক্ষে সম্ভব, করেছে ড্যানিয়েল। বাঁধের পাঁচিল প্রায় চার ফুট উঁচু করেছে সে। পাঁচিলের পেছনে আরেক প্রস্থ অবলম্বন তৈরি করেছে, বাধটাকে আরো খানিক পোক্ত করার জন্য। আর কিছু করার নেই তার। এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা।

পাড় বেয়ে উঠে এসে হলুদ ট্রাক্টরের গায়ে হেলান দিল ড্যানিয়েল, শ্রমিকদের দিকে তাকালো। রণক্লান্ত সৈনিকদের মতো লাগছে ওদেরকে। নদীকে ঠেকিয়ে রাখতে আজ দুদিন ধরে খাটছে ওরা, প্রত্যেকেই ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। ওদেরকে আবার কাজ করতে বলাটা হবে অমানবিক। এরপর নদী হামলা করলে পরাজয় মেনে নিতে হবে।

কয়েকজন শ্রমিক আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে বসে উজানের দিকে তাকালো। বাতাসে অস্পষ্টভাবে ভেসে এলো তাদের গলা। কিছু একটা কৌতূহলী ও উত্তেজিত করে তুলেছে তাদেরকে। ট্র্যাক্টরের উপর উঠে কপালে হাত রেখে রোদ ঠেকালো ড্যানিয়েল। ঢালের দিক থেকে ট্রেইল ধরে এগিয়ে আসছে পরিচিত একজন মানুষ। ক্যামো ফেটিগ পরা, হাঁটার ভঙ্গিতে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। মেক নিমুর। তার সঙ্গে দু জন কোম্পানি কমান্ডারও রয়েছে।

কাছাকাছি এসে মেক জানতে চাইলো, ড্যানিয়েল, তোমার বাঁধের খবর কী? পাহাড়ে বৃষ্টি শুরু হতে যাচ্ছে। নদীটাকে বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখকে পারবে বলে তো মনে হয় না।

ট্র্যাক্টর থেকে লাফ দিয়ে নেমে মেকের সঙ্গে করমর্দন করলো ড্যানিয়েল। তুমি যেমন নিকোলাসের বন্ধু, আমিও তেমনি। বন্ধুর জন্য যতোটুকু পারা যায় করছি। তবে তোমার কথাই ঠিক, ডানডেরাকে বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।

আমি শুধু নদীকে নিয়ে চিন্তিত নই, বলল মেক। খবর পেয়েছি সরকারি বাহিনী হামলা করার জন্য পজিশনে চলে আসছে। আমার কাছে তথ্য আছে, ডেবরা মালিয়াম থেকে পুরো একটা ব্যাটালিয়ন রওনা হয়েছে। আরেকটা ফোর্স আসছে সেন্ট ফুমেনটিয়াস মঠের নিচে থেকে উঠে আসছে অ্যাবে নদী ধরে।

সাঁড়াশি আক্রমণ, তাই না?

আমরা সংখ্যায় কম, বলল মেক। আক্রমণ শুরু হলে কতোক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব জানি না। আমার লোকেরা গেরিলা, সেটপিস ব্যাটলে অভ্যস্ত নয়। আমাদের কৌশল হলো হিট অ্যান্ড রান। আমি তোমাকে বলতে এসেছি, নোটিশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পালাবার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

আমার জন্য তোমাকে বেশি চিন্তা করতে হবে না, ছুটে পালাতে ওস্তাদ আমি। নিকোলাস আর মিস রোয়েনকে নিয়ে চিন্তা করো, টানেলের ভেতর না আটকা পড়ে।

ওদের কাছেই যাচ্ছি, বলল মেক। একটা ফল-ব্যাক পজিশনের ব্যবস্থা করতে চাই। যুদ্ধ শুরুর পর আমরা যদি পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, আবার আমাদের দেখা হবে মঠে লুকানো বোটের কাছে।

ঠিক আছে, মেক-হঠাৎ থেমে গেল ড্যানিয়েল, চারজনই ওরা মুখ তুলে ট্রেইলের দিকে তাকালো। পাড়ের কাছে লোকজনকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। কী ব্যাপার?

আমার একটার পেট্রল ফিরে আসছে। চোখ সরু করলো মেক।

নিশ্চয়ই নতুন কিছু ঘটেছে। তারপরই তার চেহারা বদলে গেল। গেরিলারা একটা স্ট্রেচার বয়ে আনছে। স্ট্রেচারে কাত হয়ে রয়েছে ছোট ও হালকা একটা দেহ।

মেককে ছুটে আসতে দেখে স্ট্রেচারের উপর উঠে বসলো টিসে। স্ট্রেচারটা মাটিতে নামিয়ে রাখলো গেরিলারা। সেটার পাশে হাঁটুগেড়ে বসলো মেক, দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল টিসেকে। কথা না বলে পরস্পরকে অনেকক্ষণ ধরে থাকলো ওরা। তারপর টিসের মুখটা দু হাতের তালুতে ভরে ক্ষতগুলো খুঁটিয়ে দেখলো মেক। গোটা মুখ ফুলে উঠেছে, এরই মধ্যে পুঁজ জমেছে কয়েকটা ক্ষতের মুখে। চোখের পাতায় ফোস্কা পড়েছে।

কে করলো? কার কাজ? নরম সুরে জানতে চাইলো সে।

পোড়া ঠোঁট নাড়লো টিসে, আবেগে আর অভিমানে আহত পশুর মতো দুর্বোধ্য আওয়াজ বের হলো শুধু। তারপর বলতে পারল, ওরা আমাকে সব কথা….

না, কথা বলো না,, বাধা দিল মেক, দেখলো টিসের নিচের ঠোঁট ফেটে গিয়ে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে। তোমার দোষ নেই।

বাধা দিয়ো না, আমাকে বলতে হবে, ফিসফিস করলো টিসে। ওরা আমাকে কথা বলতে বাধ্য করেছে। তোমার গেরিলাদের সংখ্যা, এখানে নিকোলাসের সঙ্গে তুমি কী করছ, সব কথা বলে ফেলেছি। দুঃখিত, মেক। আমি তোমার সঙ্গে বেঈমানী করেছি…।

কে দায়ী? কে তোমার এ অবস্থা করলো?

কর্নেল নগু আর পেগাসাসের আমেরিকান লোকটা, হেলম্।

আলতো আলিঙ্গনে আবার টিসেকে জড়ালো মেক, তবে তার চোখ দুটো থেকে আগুন ঝরছে।

*

টানেলের লোয়ার চেম্বার পুরোপুরি গ্রাসমুক্ত হয়েছে। মেঝের মাঝখানে এখনো জ্বলছে আগুনটা, উত্তপ্ত বাতাস সিঁড়ি হয়ে উপরের টানেলে বেরিয়ে গেছে, অক্সিজেন-সমৃদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে মিশে গ্যাস তার ক্ষতি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে রোয়েন, নিকোলাসের পিছু নিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠছেও।

চল্লিশটা ধাপ বেয়ে চেম্বারটায় নেমেছিল ওরা, হুবহু একই রকম আরেক প্রস্থ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ওদের মাথা চল্লিশতম ধাপের সঙ্গে একই লেভেলে আসার পর হাতের ল্যাম্পটা উঁচু করে সামনে কী আছে দেখার চেষ্টা করলো নিকোলাস। সুবিশাল এক তোরণের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো আলো, রঙিন সব বিচিত্র আকৃতি আর নকশায় ধাধিয়ে গেল ওদের চোখ, যেনো বৃষ্টির পর মরুভূমির একটা মাঠে অপরূপ সব ফুল ফুটেছে। গম্বুজ আকৃতির জায়গাটার চারদিকের দেয়ালে বিচিত্র সব পেইন্টিং, এতো সুন্দর আর নিখুঁত যে দম বন্ধ হয়ে এলো।

টাইটা! ভাঙা ও কাঁপা আওয়াজ বের হলো রোয়েনের গলা থেকে। এগুলো তার আঁকা। টাইটার বৈশিষ্ট্যই আলাদা, চিনতে আমি ভুল করি না। তার কাজ যেখানেই দেখি, চিনতে পারব।

উপরের ধাপটায় দাঁড়িয়ে সবিস্ময় তিনদিকে তাকাচ্ছে ওরা। এগুলোর তুলনায় লম্বা গ্যালারির দেয়ালচিত্র ম্লান তো বটেই, অনুকরণ দোষেও দূষিত। এগুলো মহান এক শিল্পীর কাজ, কালজয়ী প্রতিভার, যার শিল্পকর্ম চার হাজার বছর পরও মানুষকে মুগ্ধ বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিতে পারে।

ওরা খুব ধীর পায়ে সামনে এগুলো, প্রায় একটা ঘোরের মধ্যে। তোরণ পেরিয়ে আসার পর দেখলো দু দিকের দেয়াল ঘেঁষে সারির সারি ক্ষুদে চেম্বার রয়েছে, প্রাচ্যের বাজারগুলোয় যেমন ছোট দোকান-ঘর দেখা যায়। প্রতিটি দোকানের প্রবেশমুখে পাহারা দিচ্ছে লম্বা স্তম্ভ, উঁচু হয়ে ছাদ ছুঁয়েছে। প্রতিটি স্তম্ভ দেবতাদের একেকটা মূর্তি। মূর্তিগুলোই আসলে গম্বুজ আকৃতির সিলিংটাকে মাথায় করে রেখেছে।

প্রথম দুটো দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস, চাপ দিল রোয়েনের বাহুতে। ফিসফিস করে বলল, ফারাও-এর ট্রেজার চেম্বার। চেম্বার বা দোকানগুলো মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত অদ্ভুত সুন্দর সব জিনিসে ঠাসা।

এগুলো ফার্নিচার স্টোর, বিড়বিড় করলো রোয়েন। চেয়ার, টুল, খাট আর ডিভানের আকৃতি স্পষ্ট চিনতে পারছে ও। কাছের স্টলের সামনে চলে এলো, হাত বাড়িয়ে রাজকীয় একটা সিংহাসন ছুঁলো। একেকটা বাহু পরস্পরকে পেঁচিয়ে থাকা একজোড়া করে সরীসৃপ, ব্রোঞ্জ আর ল্যাপিস ল্যাজুলাই দিয়ে তৈরি। পায়াগুলো সোনা দিয়ে তৈরি সিংহের থাবা। সীট আর পিঠে শিকার ধাওয়া করার দৃশ্য আঁকা হয়েছে। পিঠের মাথায় সোনার তৈরি একজোড়া ডানা।

সিংহাসনের পেছনে সাজানো রয়েছে অসংখ্য ফার্নিচার। জালি দিয়ে ঢাকা একটা ডিভান চিনতে পারলো ওরা, জালিটা আবলুস কাঠ আর আইভরি দিয়ে তৈরি। তবে ডজন ডজন আরো বহু জিনিস রয়েছে, বেশিরভাগই বিভিন্ন অংশ খুলে আলাদা করা, ফলে কোনটা যে কী চেনা গেল না। প্রতিটি অংশ দামি মেটাল আর রঙিন রত্নখচিত, তাকালেই দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছে। তোরণের দু পাশে সারি সারি ছোট আকৃতির কুলুঙ্গি দেখা গেল, সেগুলো আশ্চর্য সুন্দর কালেকশনে ভরা। প্রতি জোড়া কুলুঙ্গির মাঝখানে মৃতের পুস্তক থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি লেখা হয়েছে, লেখা হয়েছে। তোরণসমূহ পেরিয়ে ফারাও-এর ভ্রমণ কাহিনীর বিবরণ, ট্রেইলে কতো রকমের বিপদ ওত পেতে ছিল, দৈত্য আর দানবরা কীভাবে তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

লম্বা গ্যালারির নকল সমাধিতে এ পেইন্টিং ছিল না, নিকোলাসকে বলল রোয়েন। একবার শুধু রাজার মুখে দিকে তাকান। বুঝতে পারবেন উনি সত্যিকার একজন বাস্তব চরিত্র ছিলেন।

ওদের পাশের দেয়ালচিত্রে দেখা যাচ্ছে মহান দেবতা ওসিরিস ফারাও-এর হাত ধরে পথ দেখাচ্ছেন, কাছে সরে আসা দানবদের কবল থেকে রক্ষা করছেন তাঁকে।

ফিগারগুলো দেখুন, সায় দিয়ে বলল নিকোলাস আড়ই কাটের পুতুলের মতো নয়, সব সময় ডান পা বাড়িয়ে রেখেছে। এগুলো বাস্তবে দেখা পুরুষ ও নারী। প্রতিটি ফিগার অ্যানাটমিক্যালি কারেক্ট। শিল্পী হিউম্যান বডি স্টাডি করেছেন, শারীরিক কাঠামো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল তার।

পাশের দেয়ালের খুপরির সামনে থামলো ওরা। ভেতরে অস্ত্র আর যুদ্ধের সরঞ্জাম দেখা গেল। রথের প্যানেলগুলো সোনার তৈরি পাতা দিয়ে ঢাকা, ফলে চোখ ধাধিয়ে গেল। সাইড প্যানেলে, প্রতিটি লম্বা চাকার পেছনে, সাজানো রয়েছে তীর আর বর্শা। রথের পাশে রয়েছে স্তূপ করা ছোরা আর আইভরির হাতলসহ তলোয়ার, ফলাগুলো চকচকে ব্রোঞ্জ। র‍্যাকে রাখা হয়েছে বলুম। ঢালগুলো ব্রোঞ্জের তৈরি, ঢালের গায়ে যুদ্ধবিজয়ের দৃশ্য, সঙ্গে স্বর্গীয় মামোসের প্রতিকৃতি আঁকা। কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি হেলমেট আর ব্রেস্টপ্লেট দেখলো ওরা।

পাশাপাশি পাঁচটা ক্ষুদে চেম্বারে রয়েছে পাঁচটা যুদ্ধক্ষেত্রের মডেল। প্রতিটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে শত শত সৈন্য রথ নিয়ে আক্রমণের জন্য তৈরি। সৈনিক, ঘোড়া, রথ, অস্ত্র সবই স্বর্ণের। প্রতিটি মূর্তি বা আকৃতির গায়ে ফারাও-এর নাম খোদাই করা। এ পাঁচটা দোকান বা স্টোর দেখে এতোই বিহ্বল হয়ে পড়লো রোয়েন, নিকোলাসের গায়ে হেলান দিতে বাধ্য হলো, মনে হলো অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটা স্টোরে সৈন্য সংখ্যা গুনতে শুরু করলো নিকোলাস, কিছুক্ষণ পর হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, এভাবে সম্ভব নয়, বের করে গুনতে হবে-পরে।

কত ভরি ওজন একজন সৈনিকের? বিড়বিড় করে জানতে চাইলো রোয়েন।

একটা মূর্তি হাতে নিয়ে ওজন পরীক্ষা করলো নিকোলাস। পনেরো থেকে বিশ ভরির কম নয়, বলল ও।

কয়েক হাজার সৈন্য, তাই না? আবার ফিসফিস করলো রোয়েন।

সৈন্য, সেবিকা, ঘোড়া, রথ, অস্ত্র, ঢাল, পানপাত্র-সব মিলিয়ে আনুমানিক ত্রিশ হাজার পিস।

দাম….না, থাক! হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো রোয়েন।

সোনার দাম এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়, বলল নিকোলাস। প্রত্ন নিদর্শন হিসেবে মূল্য ধরতে হবে। প্রতিটি মূর্তিকে খোদাই করা রয়েছে ফারাও-এর নাম ও সীল। একটা মূর্তির জন্য একজন কালেক্টর দশ লাখ ডলার দিতেও হয়তো আপত্তি করবেন না।

নিকোলাসের দিকে অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকালো রোয়েন। যাহ্! এতো?

এতোই। কিংবা আরো বেশি। এগুলো আমরা, যুদ্ধ ক্ষেত্রের এ মডেল পাঁচটা, লম্বা ক্রেটে ভবে। আমার ধারণা দুটো ক্ৰেটেই সবগুলোর জায়গা হয়ে যাবে।

চারদিকে চোখ বুলাচ্ছেল রোয়েন, হঠাৎ নিকোলাসের হাত ধরে ঝাঁকালো। নিকোলাস, স্টোরের সারি একটা নয়! দেখুন, প্রথম সারর পেছনে আরো এক সারি স্টোর রয়েছে।

একজোড়া স্টোরের মাঝখানে সরু প্যাসেজ দেখা গেল, তার ভেতর দিয়ে পেছনের সারির স্টোরগুলোর সামনে চলে এলো ওরা। তারপর দেখা গেল, দুই সারি নয়, আসলে তিন সারি স্টোর রয়েছে। প্রতিজোড়া স্টোরের মাঝখানের দেয়ালে চোখ জুড়ানো সব ছবি আঁকা, সবগুলোতেই রাজার জীবনকাহিনীর দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কোনো ছবিতে কন্যাদের সঙ্গে খেলছেন বা কৌতুক করছেন, কোনো ছবিতে পুত্রসন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। মন্ত্রী পরিষদের সঙ্গে মিটিং করছেন বা উপপত্নীদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। ভোজনের দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, পুরোহিতদের সঙ্গে বসে আছেন রাজা। প্রতিটি মানুষকে আঁকা হয়েছে চোখে দেখে, প্রতিটি চরিত্রই বাস্তব থেকে নেওয়া।

বিশাল কামরাটার সেন্ট্রাল প্যানেলগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। একটা প্যানেলের দিকে হাত তুলে রোয়েন বলল, এটা নিশ্চয়ই টাইটার আত্মপ্রতিকৃতি। ওটা একজন খোঁজা ব্যক্তির প্রতিকৃতি।

নিজের চেহারা আঁকতে গিয়ে টাইটা কী পোয়েটিক লাইসেন্স নিয়েছে? নাকি সত্যিসত্যি এতো সুদর্শন ছিল সে? ক্রীতদাসের চেহারায় এতোটা আভিজাত্য থাকতে পারে?

সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কাড়ে টাইটার বৃদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া। সেই চোখে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি। শিল্পীর হাত এতো ভালো, ওরা যে তীব্র দৃষ্টিতে তাকে দেখছে, সে-ও ওদেরকে একই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে। ক্ষীণ, স্মিত হাসি লেগে রয়েছে টাইটার মুখে। পেইন্টিংটা বার্নিশ করা, ফলে সুরক্ষিত রয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে গতকাল আঁকা হয়েছে ছবিটা। টাইটার ঠোঁট একটু ভেজা ভেজা, চোখ দুটোয় চকচকে ভাব।

গায়ের রঙ ফর্সা,  মন্তব্য করলো নিকোলাস। চোখ নীল। তবে লাল চুল রঙ–করা হয়েছে হেনা দিয়ে।

কে জানে কোথায় টাইটার জন্ম। স্ট্রোলের কোথাও এ সম্পর্কে কিছু বলেনি টাইটা। গ্রিস বা ইটালি হতে পারে না। জলদস্যু হতে পারে? জার্মান বা ভাইকিং? আসলে টাইটার রুটস কোনো দিনই জানা যাবে না, সে নিজেও সম্ভবত জানত না।

পাশের প্যানেলের দেখা যাচ্ছে তাকে, বলল নিকোলাস।

এ প্যানেলে রাজা ও রানীর সামনে নতজানু হয়ে প্রণাম করছে টাইটা, রাজা ও রানী পাশাপাশি দুটো সিংহাসনে বসে আছেন। হিচককের মতো, বলল রোয়েন। নিজের সৃষ্টির মধ্যে উপস্থিত থাকতে ভালোবাসত টাইটা।

আরো এক সারি স্টোরের সামনে দিয়ে হেঁটে এলো ওরা। এগুলোয় ঠাসা রয়েছে তৈজসপত্র বাসনকোসন, জার, গামলা, পানপাত্র, হাতা-চামচ। বেশিরভাগ সোনা বা রুপার তৈরি। পালিশ করা ব্রোঞ্জ আয়না দেখা গেল। মূল্যবান সিল্ক আর লিনেন-এর রোল রয়েছে, অনেক কাল আগেই পচে গিয়ে নরম ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়েছে। তারপর, দু সারি স্টোরের মাঝখানের দেয়ালে দেখা গেল হিকসস-এর সঙ্গে যুদ্ধের দৃশ্য, যে যুদ্ধে ফারাও আহত হয়েছিলেন। হিকসসের নিক্ষিপ্ত তীর রাজার বুকে বিঁধে আছে, হাতে সার্জিকাল ইন্সট্রুমেন্ট, রাজার বুকের গভীর থেকে তীরটা বের করে আনছে।

এরপর ওরা সারি সারি কুলুঙ্গির সামনে এসে দাঁড়ালো, ভেতরে কয়েক শো সিডার কাঠের বাক্স বা চেস্ট। বাক্সগুলোর গায়ে রাজার প্রতীক চিহ্ন আঁকা, আর ছবিগুলোতে দেখা যায় রাজা টয়লেটে রয়েছেন, সুর্মা লাগাচ্ছেন চোখে, লাল রঙ দিয়ে রঙিন করছেন চেহারা, নাপিতরা তাঁর দাড়ি কামাচ্ছে, চাকর-বাকরা পরাচ্ছে রাজকীয় পোশাক।

কিছু বাক্সে রাজকীয় প্রসাধনী আছে, বলে উঠলো রোয়েন। বাকিগুলোতে ফারাও-এর কাপড়চোপড়।

পাশের দেয়ালের দৃশ্যগুলোয় দেখা যাচ্ছে রাজা বিয়ে করছেন। কুমারী লসট্রিস, রানী হতে যাচ্ছেন। টাইটা ছিল রানী লসট্রিসের ক্রীতদাস। সে তার কত্রীর অবয়ব আঁকার সময় সমস্ত মেধা ঢেলে দিয়েছে। রানীর চেহারার খুঁটিনাটি সূক্ষ্ম সব বৈশিষ্ট্য এতো নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে, নিষ্পলক তাকিয়ে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। কোনো সন্দেহ নেই শিল্পী এখানে অতিরঞ্জনের স্বাধীনতা নিয়েছে। নগ্ন স্তন জোড়ার উপর সযত্নে টানা ব্রা শুধু নিখুঁত আকৃতি দেওয়ার কাজ করে নি, যৌন বিশুদ্ধতা ফুটিয়ে তোলারও চেষ্টা করেছে।

টাইটা কতোই না ভালোবাসত রানীকে, বলল রোয়েন, বলার সুরে ক্ষীণ ঈর্ষার ছোঁয়া থেকে গেল। প্রতিটি রেখায় তার প্রমাণ পাবেন আপনি।

মৃদু হেসে, এক হাতে রোয়েনের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো নিকোলাস।

পরবর্তী সারির কুলুঙ্গিতে আরো কয়েকশো কাঠের বাক্স রয়েছে, ঢাকনির উপর : রাজার ক্ষুদে প্রতিকৃতি, সমস্ত অলঙ্কার পরে আছেন। তাঁর আঙুল আর গোড়ালিতে আঙটি ও ঘুঙুর, বুক সোনার মেডেলে মোড়া, বাহু আর কব্জিতে বালা পরানো। একটা প্রতিকৃতিতে দেখা গেল রাজা একত্রিত দুই মিশরীয় রাজ্যের জোড়া মুকুট পরে আছেন। একটা লাল অপরটা সাদা-মুকুটের কপালে শকুন আর গোক্ষুরের মাথা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের মুকুট ব্যবহার করতেন তিনি। সব মিলিয়ে বারোটা মুকুট দেখলো ওরা।

ঢাকনিতে যা দেখছি, বাক্সের ভেতরও কী তাই আছে? ফিসফিস করে জানতে চাইলো রোয়েন।

এমন কী নিকোলাসও চিন্তা করতে গিয়ে একটা ঢোক গিলল। রোয়েনের প্রশ্নের উত্তর যদি ইতিবাচক হয়, এ বিপুল ঐশ্বর্য কল্পনা করা সত্যি কঠিন। কোনো বাক্স না খুলেই ইতোমধ্যে ওরা যা দেখেছে, তার মূল্য বুঝতে হলে কমপিউটার নিয়ে বসতে হবে। পরিমাণে এতো বিপুল প্রত্ন সম্পদ এর আগে কোথাও পাওয়া যায় নি।

আপনার মনে আছে, স্ক্রোলে কী লিখেছিল টাইটা?

এতো বেশি গুপ্তধন কোনো কালে কোথাও এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দেখে মনে হচ্ছে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া হয় নি। ফারাও মামোসের ট্রেজার পুরোটাই আছে এখানে।

পেছনের অর্থাৎ তৃতীয় সারির স্টোরগুলোয় রয়েছে চীনামাটি আর কাঠের মূর্তি–উশব তি। এমন কোনো পেশা বা ব্যবসার লোক নেই যাদের মূর্তি এখানে পাওয়া যাবে না। পুরোহিত, লিপিকার, আইনবিশারদ, চিকিৎসক, কৃষক, মালী, রুটি আর মদ তৈরির কারিগর, নর্তকী, নাবিক, রজকিনী, সৈনিক, সাধারণ শ্রমিক, খোঁজা প্রহরী, রাজমিস্ত্রী, বাজনদার, মুসাফির, ভবঘুরে-সমাজের সর্ব স্তরের সবাই আছে, এমন কী বেশ্যাও। প্রত্যেকের হাতে নিজ নিজ পেশার যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম। এরা সবাই পরলোকে রাজার সঙ্গী হবে, সেবা করবে ফারাও-এর।

তোরণশোভিত বিশাল কামরার শেষ মাথায় এসে পৌঁছল ওরা। সামনে এককালে ছিল কয়েক সারিতে টাঙানো সাদা লিনেন। ওগুলোর রঙ এখন আর সাদা নেই, পর্দাও আর পর্দা নেই। সব পচে গিয়ে রিবনের মতো লম্বা হয়ে ঝুলে আছে, দেখে মনে হচ্ছে নোংরা মাকড়সার জাল অথচ তারপরও পর্দায় লাগানো রত্নগুলো রিবনের সঙ্গে ঝুলছে, জেলের জালে ধরা পড়া চকচকে মাছের মতো। জালের ভেতর আরো একটা দরজা দেখতে পেল ওরা।

ওটা নিশ্চয়ই মূল সমাধিতে ঢোকার পথ, ফিসফিস করলো রোয়েন। রাজা আর আমাদের মাঝখানে এখন শুধু পচা খানিকটা জাল ছাড়া আর কিছু নেই।

কিন্তু দু জনই ওরা পা বাড়াতে দ্বিধায় ভুগছে। সামনে কোনো বিপদ নেই তো? টাইটার তৈরি সবগুলো ফাঁদ কী ওরা পেরিয়ে এসেছে?

*

গেরিলাদের মধ্যে কোনো ডাক্তার নেই, কমান্ডার মেকই আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা করে, তার হাতের কাছে সব সময় একটা মেডিকেল কিটও থাকে। পাথরখনির কাছাকাছি একটা কুঁড়েতে টিসেকে বয়ে নিয়ে এলো গেরিলারা, কুঁড়েটা ঘাসের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ছেঁড়া ট্রাইজার আর শার্ট খুলে টিসের ক্ষতগুলো ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে ধুলো মেক, তারপর ফিল্ড ড্রেসিং দিয়ে প্রায় সবগুলো ঢেকে দিল। তারপর উপুড় করা হলো টিসেকে, অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য। ব্যথা পেয়ে উফ করে উঠলো টিসে। মেক নরম সুরে বলল, আমার হাত ডাক্তারদের মতো ভালো নয়।

তবু আমার ভাগ্য যে তোমার হাতেই চিকিৎসা পাচ্ছি, বলল টিসে। জানো, মৃত্যু ভয়ের চেয়ে বেশি ভুগেছি তোমাকে আর দেখতে পাব না ভেবে।

নিজের প্যাক থেকে সোয়েটশার্ট আর ফেটিগ বের করে টিসেকে পরিয়ে দিল মেক, কয়েক সাইজ বড় হয়েছে গায়ে। কালচে, ফোস্কা পড়া ঠোঁট নেড়ে টিসে বিড়বিড় করলো, কুৎসিত লাগছে আমাকে, তাই না?

সাবধানে তার গালে আঙুল বুলাল মেক। আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তুমি, চিরকাল তাই থাকবে।

ঠিক সেই মুহূর্তগুলির আওয়াজ শুনলো ওরা। অনেক দূর থেকে ভেসে এলো, বয়ে নিয়ে এলো উত্তরে বৃষ্টি ভেজা বাতাস। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো মেক। শুরু হয়েছে। কর্নেল নৃগু হামলা করেছেন।

আমার দোষ। আমিই তাঁকে… .

না, দৃঢ় সুরে বলল মেক। তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি কথা না বললে ওরা তোমাকে মেরেই ফেলত। আর হামলা ওরা এমনিতেও করত। ওয়েবিং বেল্ট তুলে কোমরে জড়ালো সে। এবার দূর থেকে ভেসে এলো মর্টার শেলের আওয়াজ। আমাকে এবার যেতে হবে, টিসে।

জানি। আমার জন্য চিন্তা করো না।

তোমার চিন্তাই যুদ্ধ করতে উৎসাহ যোগাবে আমাকে। আমার লোকজন মঠে নামিয়ে নিয়ে যাবে তোমাকে। এক পর্যায়ে সবাই ওখানে জড়ো হব আমরা। যা-ই ঘটুক, ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে তুমি। কর্নেল নগুকে বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তাঁর শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে আমাদের।

তোমাকে ভালোবাসি, ফিসফিস করলো টিসে। তোমার জন্য চিরকাল অপেক্ষা করব।

দরজার কাছে মাথা নিচু করে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে গেল মেক।

*

পর্দার ফ্রেমে হাত ছোঁয়াতেই জালের মতো রিবনগুলো টাইলের মেঝেতে খসে পড়লো। জালে আটকানো রত্নগুলো মেঝেতে পড়ে জলতরঙ্গের মতো আওয়াজ তুললাম। জালের গায়ে ভেতরে ঢোকার জন্য যথেষ্ট বড় একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। রোয়েনের হাত ধরে পা বাড়ালো নিকোলাস, থামলো ইনার ডোরওয়ের সামনে। দরজা বা ফাঁকটার এক পাশে পাহারায় রয়েছে মহান দেবতা ওসিরিস-এর বিশাল এক মূর্তি, হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করা, এক হাতে বাঁকা লাঠি। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর স্ত্রী আইসিস, মাথায় লুনার ক্রাউন আর শিং। তাঁদের উদাস চোখের দৃষ্টি অনন্ত-অসীমের দিকে প্রসারিত, চেহারায় প্রশান্তির ভাব। বারো ফুট উঁচু জোড়া মূর্তির মাঝখান দিয়ে এগুলো রোয়েন ও নিকোলাস এবং অবশেষে ফারাও মামোসের আসল সমাধিতে পৌঁছে গেল।

ছাদটা গম্বুজ আকৃতির, গম্বুজ আর দেয়ালে আঁকা চিত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে-ফরমাল ও ক্ল্যাসিকাল। রঙ এখানে আরো গাঢ়, প্যাটার্নগুলো জটিল। যতটা আশা করেছিল ওরা তার চেয়ে আকারে ছোট চেম্বারটা। স্বর্গীয় ফারাও মামোসের বিশাল এ্যানিট কফিনেরই শুধু জায়গা হয়েছে।

কফিনটা বুক সমান উঁচু। সাইড প্যানেগুলো ভিত বা বেদীর সঙ্গে গাঁথা মনে হলো; ফারাও ও অন্যান্য দেবতাদের ছবি খোদাই করা। ঢাকনিতে একা শুধু রাজার চেহারা খোদাই করা হয়েছে, পুরো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জুড়ে। দেখেই ওরা বুঝতে পারল, ঢাকনিটা এখনো আদি অবস্থানে রয়েছে, পুরোহিতের মাটির সীল পুরোপুরি অক্ষত। এ সমাধিতে কখনো কারো অনুপ্রবেশ ঘটে নি। ফারাও মামোসের মমি চার হাজার বছর ধরে নির্বিঘ্নে শুয়ে আছে এখানে।

তবে ওদেরকে বিস্মিত করলো অন্য দুটো জিনিস। কফিনের উপর পড়ে রয়েছে অদ্ভুত সুন্দর একটা ধনুক। লম্বায় প্রায় নিকোলাসের সমান, স্টক-এর পুরোটা দৈর্ঘ্য ইলেকট্রাম কয়েল দিয়ে জড়ানো-সোনা ও রুপার এ মিশ্রণ পদ্ধতি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

আরেকটা জিনিস, যা কখনই কোনো রাজকীয় সমাধিতে থাকার কথা নয়, দাঁড়িয়ে আছে কফিনের গোড়ার কাছে। পুতুল আকৃতির মানুষের একটা মূর্তি। এক পলক তাকিয়েই জিনিসটার উন্নত মান ও পরিচয় বুঝতে পারলো ওরা, খানিক আগে সমাধির বাইরে এ মূর্তির আঁকা মুখ দেখেছে ওরা তোরণশোভিত কামরাটায়।

টাইটার কথাগুলো, স্ক্রোলে ওরা পড়েছে, মনে হলো সমাধির ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এ মুহূর্তে, জোনাকির মতো জ্বল জ্বল করছে কফিনের উপর

শেষবারের মতো যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম পাথুরে শবাধারের কাছে, সমস্ত শ্রমিকদের দূরে সরিয়ে দিলাম আমি। আমার পরে আর কারো পা পড়বে না এ সমাধিতে। একা হতে কাপড়ের পুঁটুলিটা খুললাম। সেই লম্বা ধনুক-লানাটা বেরুলো ওটা থেকে। আমার মিসট্রেসের নামে ওটার নাম দিয়েছিল ট্যানাস। কেবলমাত্র ওরই জন্য আমি তৈরি করেছিলাম ধনুকটা। আমাদের দু জনের পক্ষ থেকে শেষ এ উপহার ট্যাসের জন্য। সীল করা পাথরের কফিনের ডালার উপরে ওটা রেখে দিলাম।

আরো একটা জিনিস ছিল পুঁটুলিতে। আমার নিজহস্তে খোদাই করা একটা উশব তি পুতুল। শবাধারের পায়ের কাছে রাখলাম ওটা। ওটা খোদাই করার সময় তামার আয়না রেখেছিলাম সামনে–যাতে করে নিজের অবয়ব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। পুতুলটা ছিল একটা ছোটো টাইটা।

পুতুলের নিচের অংশে কাঠ খোদাই করে লিখেছিলাম —

কফিনের গোড়ায় হাঁটুগেড়ে বসলো রোয়েন, ছোট্ট পতুলটা হাতে নিল। গোড়ায় খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক্স দেখছে। ওর পাশে হাঁটুগেড়ে নিকোলাস বলল, পড়ুন তো দেখি।

নরম সুরে শুরু করলো রোয়েন, ঠিক আছে। আমি টাইটা। আমি একজন চিকিৎসক এবং কবি। আমি একজন স্থপতি এবং দার্শনিক। আমি তোমার বন্ধু। তোমার পক্ষ থেকে আমি জবাবদিহি করব।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সবই সত্যি, ফিসফিস করলো নিকোলাস।

ঠিক যেখান থেকে তুলেছে সেখানেই মূর্তিটা নামিয়ে রাখলো রোয়েন। তারপর মুখ তুলে নিকোলাসের দিকে তাকালো।

এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমি চাই এ মুহূর্ত যেনো শেষ না হয়।

কখনোই শেষ হবে না, প্রিয়। তোমার আর আমার কেবল শুরু। নিকোলাস বলল ওকে।

*

ওদেরকে আসতে দেখছে মেক। পাহাড়ের নিচের ঢালের কিনারা ঘেঁষে এগুচ্ছে দলটা। ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে আসছে, বুশ-ফাইটারের তীক্ষ্ণ সৃষ্টি ছাড়া দেখতে পাবার কথা নয়। প্রতিপক্ষ দলের শক্তি-সামর্থ্য উপলব্ধি করে হতাশ হলো মেক। ওরা ক্র্যাক ট্রপস, দীর্ঘ বহু বছর যুদ্ধ করে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। অত্যাচারী মেনজিসটুর বিরুদ্ধে লড়ার সময় এরাও তার দলে ছিল, ওদের অনেককেই সে ট্রেনিং দিয়েছে। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় এখন ওরা তার সঙ্গে লড়তে আসছে। গোটা আফ্রিকা মহাদেশে এটাই হচ্ছে নিষ্ঠুর বাস্তবতা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংগ্রামে পুষ্টি যোগায় প্রাচীন উপদলীয় কোন্দল, বর্তমান কালের রাজনীতিকদের লোভ আর দূনীতি।

তবে ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করার সময় এটা নয়। নিচের রণক্ষেত্রে কি কৌশল কাজে লাগবে সেটাই এখন তাকে খুঁজে বের করতে হবে। ওরা যারা আসছে তারা অবশ্যই দক্ষ নৈতিক। খুব আর লোককেই দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগই গা ঢাকা দিয়ে আছে। কোম্পানি স্ট্রেংথ, ভাবল সে, তারপর নিজের ছোট্ট ফোর্সের দিকে তাকালো। পাথরের ভঁজে লুকিয়ে আছে চৌদ্দজন গেরিলা। চমকে দেয়ার সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর যতটা সম্ভব জোরালো আঘাত হেনে পিছু হটতে হবে ওদেরকে, কর্নেল নগুর মর্টার শেল ওদের শুয়ে থাকা জায়গায় ছুটে আসার আগেই।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মেক ভাবল কর্নেল নগু বিমান হামলাও শুরু করবেন কিনা। আদ্দিসের এয়ার-বেস থেকে রুশ টুপোলেভ বহুবার এখানে আসতে সময় নেবে পঁয়ত্রিশ মিনিট। নাপামের গন্ধটা কল্পনা করলো সে, মনের চোখ দিয়ে দেখতে পেল আগুনের ঢেউ ওদের দিকে দ্রুত গড়িয়ে আসছে। তবে না, বিমান হামলার ঝুঁকি কর্নেল নগু বা তার পে-মাস্টার জার্মান হের ফন শিলার নেবেন না। গিরিখাদে নিকোলাস যা আবিষ্কার করেছে সেসব দখল করাই ওঁদের উদ্দেশ্য, ধ্বংস করা নয়। লুটের মাল আদ্দিসের কাউকে ভাগ দিতেও ওঁরা রাজি হবেন না। অ্যাবে গিরিখাদে এটা তাদের ব্যক্তিগত অভিযান, সরকারকে জানাবার মতো বোকামি তারা করবে না।

ঢালের গা বেয়ে আবার নিচে নেমে গেল মেকের দৃষ্টি। শত্রুপক্ষ পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে ডানডেরা নদীর দিকে এগুচ্ছে, উদ্দেশ্য নদীর পাশে ট্রেইলে অবস্থান গ্রহণ। খানিক পরই ওপরে, এ দিকটার একটা পেট্রল পাঠাবে ওরা, নিজেদের একটা পাশ সুরক্ষিত করার জন্য, তারপরই সরাসরি ওপরে উঠবে। হ্যাঁ, ওই তো ওদেরকে দেখা যাচ্ছে। আট-না, দশজন লোক মুল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সরাসরি তার নিচে থেকে উঠে আসছে উপর দিকে।

মেক সিদ্ধান্ত নিল, ওদেরকে যতোটা সম্ভব কাছাকাছি পৌঁছতে দেবে সে। সব কয়টাকে সাবাড় করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু সেটা বেশি আশা করা হয়ে যায়। চার-পাঁচজনকে গায়েল করতে পারলেই খুশি সে, বাকিগুলো ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে পড়ে তারস্বরে চিৎকার করুক। যুদ্ধে আহত লোকদের চিৎকার দারুণ উপকারী, সঙ্গী যোদ্ধারা মাথা নিচু করে রাখে, গুলি করার জন্য মাথা তুলতে ভয় পায়।

পাথর ঝড়ানো ঢালে চোখ বুলাল মেক। আরপিডি লাইট মেশিন গান প্রতিপক্ষের অ্যাডভান্ড গ্রুপের দিকে তাক করা হয়েছে। সালিম, তার মেশিন গানার, একজন ওস্তাদ। বলা যায় না, সে পাঁচ-সাতজনকেও ফেলে দিতে পারে। তারপর মেক দেখলো, তার ঠিক নিচেই রিজে একটা ফাঁক রয়েছে। খোলা রিজ পার হওয়ার ঝুঁকি ওরা নেবে না, ভাবল সে। ওপরে উঠবে ওই ফাঁক গলে, একজন একজন করে। তার আগে ফাঁকটার কাছাকাছি জড়ো হবে ওরা। তখনই সুযোগ পাবে তার গেরিলারা।

আবার আরপিডি-র দিকে তাকালো মেক। সালিম তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অপেক্ষা করছে সঙ্কেত পাওয়ার। ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেল মেকের দৃষ্টি। যা ভেবেছে, লাইনটা এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। বাম দিকের দীর্ঘদেহী লোকটা এরই মধ্যে পরিজশন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। তার দু পাশের দু জন লোক তির্যক এগোচ্ছে ফাঁকটার দিকে।

ঝোঁপ-ঝাড়ের সঙ্গে কর্নেল নগুর সৈনিকদের ক্যামোফ্রেজ হুবহু মিলে গেছে, তাদের অস্ত্র ক্যামোফ্লেজ নেটিঙে ঢাকা, রোদ যাতে প্রতিফলিত না হয়। ঝোঁপের ভেতর প্রায় অদৃশ্যই তারা, শুধু নড়াচড়া আর গায়ের রঙ ধরা পড়েছে চোখে। তারা এখন এতো কাছে, মাঝে মধ্যে দু একজনের চোখের মণি দেখতে পাচ্ছে মেক। কিন্তু এখনো তাদের মেশিন গানারকে সে দেখতে পাচ্ছে না।

প্রথম এক পশলা গুলিতেই প্রতিপক্ষের মেশিন গান স্তব্ধ করে দিতে হবে। আরে, ওই তো! ডান দিকের লাইনে দেখা যাচ্ছে গানারকে। লোকটা খাটো আর শক্ত-সমর্থ, কাঁধ দুটো ভারী, হাতগুলো লম্বা, লাইট মেশিন গানটাকে অনায়াসে বহন করছে নিতম্বের কাছে। অস্ত্রটা চিনতে পারলো মেক, রাশিয়ায় তৈরি ৭.৬২ আরপিডি। অ্যামুনিশন বেল্ট কাঁধ থেকে ঝুলছে, পিতলের কার্ট্রিজ চকচক করায় ধরা পড়ে গেল লোকটা।

নিচের নামছে মেক, বেসের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বোল্ডার আড়াল দিচ্ছে তাকে। নিচের একেএম-এর রেট-অব-ফায়ার সিলেক্টর র‍্যাপিড-এর ঠেলে দিল সে, মুখের একটা পাখ ঠেকালো কাঠের স্টকে। জিনিসটা অ্যাসল্ট রাইফেল, তবে কারিগরি ফলিয়ে নিখুঁত করা হয়েছে।

মেক যেখানে শুয়ে আছে যেখান থেকে আরপিডি বহনকারী প্রতিপক্ষ লোকটা আর মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে, উঠে আসছে ঢাল বেয়ে। ডান দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল সে, আরো তিনজন লোক ফাঁকটা লক্ষ্য করে উঠছে-মাত্র এক পশলা গুলি করেই ওদের ব্যবস্থা করতে পারবে সালিম। এরপর আরপিডি মেশিন গানারের পেটে লক্ষ্যস্থির করলো সে, ট্রিগার টানলো তিনবার।

তিনটে বিস্ফোরণ তালা লাগিয়ে দিল কানে, তবে মেক দেখতে পেল বুলেটগুলো টার্গেট মিস করেনি, পেট থেকে গলা পর্যন্ত তিনটে গর্ত তৈরি করেছে। নিচেরটা লেগেছে নাভির কাছে, ওপরেরটা গলায়।

মেকের চারদিক থেকে গেরিলারা গুলি করছে। যে ভাবছে, কে জানে প্রথম দফায় কজনকে ফেলতে পারলে সালিম। না, দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শত্রুপক্ষের সবাই ঝোঁপের নিচে। পাল্টা গুলিও হয়েছে, নীল ধোয়া দেখা যাচ্ছে ঝোঁপের মাথায়। কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেল, তারপর শোনা গেল বিকট চিৎকার, আমাকে লেগেছে! আল্লাহর দোহাই, আমাকে বাঁচাও! তার চিৎকার পাহাড়ে লেগে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মেক তার একে এম-এ নতুন ক্লিপ পরালো।

গা, আরো, গান গা! বিড়বিড় করলো সে।

*

নিকোলাস আর রোয়েন তো হাত লাগালোই, কফিন থেকে ঢাকনিটা তুলতে হানশিত শেরিফের আরো আটজন লোকের সাহায্য নিতে হলো। তোলার পর সবার হাত-পায়ের পেশী থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো, খুব সাবধানে তারা সেটাকে সমাধির দেয়াল ঘেঁষে নামিয়ে রাখলো। এরপর কফিনের পাশে এসে ভেতরে তাকালো নিকোলাস ও রোয়েন।

পাথরের তৈরি কফিনের ভেতর আরো একটা কফিন রয়েছে, এটা কাঠের। এটার ঢাকনিতেও খোদাই করা হয়েছে ফারাও-এর আকৃতি। এখানে দেখানো হয়েছে তার লাশের ছবি, হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করা, এক হাতে বাঁকা লাঠি। চেহারায় ফুটে আছে সুখময় প্রশান্তি।

দ্বিতীয় কফিনটা বের করলো ওরা, পাথুরে ঢাকনির চেয়ে এটার ওজন কম। সাবধানে গোল্ডেন সীল আর শুকনো রেজিনের শক্ত স্তরে ফাটল ধরালো নিকোলাস, তা না হলে ঢাকনিটা আলগা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় ঢাকনি সরাবার পর দেখা গেল ভেতরে আরো একটা কফিন। সেটা খোলার পর আরো একটা। এভাবে সব মিলিয়ে সাতটা কফিন পাওয়া গেল, একটার চেয়ে অপরটা আকারে একটু ছোট, তবে অলঙ্করণের মাত্রা ক্রমশ বাড়লো। সপ্তম কফিনটা পূর্ণ দৈর্ঘ্য একজন মানুষের চেয়ে আকারে সামান্য বড়, এটা তৈরি করা হয়েছে সোনা দিয়ে। পালিশ করা সোনায় ল্যাম্পের আলো পড়তে মনে হলো এক হাজার আয়না ঝলমল করে উঠলো, সমাধির প্রতিটি কোণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সোনালি আভায়।

অবশেষে সপ্তম কফিন খোলার পর দেখা গেল ভেতরে ফুল রয়েছে। কুঁড়ি আর পাপড়িগুলো শুকিয়ে গেছে, অদৃশ্য হয়েছে রঙও। সুগন্ধও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, রয়েছে শুধু পচা একটা ঝাঁঝ। পাপড়িগুলোর এমন অবস্থা, ছুঁতে না ছুঁতেই খুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে। ফুলের নিচে রয়েছে মিহি লিনেন। এক সময় নিশ্চয়ই বকের পালকের মতো সাদা ছিল, এখন খয়েরি দেখাচ্ছে-পচা ফুলের রস ঝরে পড়ায়। নরম ভাজের ভেতর সোনার চকচকে ভাব দেখতে পেল ওরা।

কফিনের দু পাশে দাঁড়িয়ে নিকোলাস ও রোয়েন লিনেনের জাল ছাড়ালো। ওদের আঙুলের চাপে টিস্যু পেপারের মতো ছিঁড়ে গেল ওগুলো। দু জনেই নিজের অজান্তে বিস্ময়সূচক আওয়াজ করলো ফারাও-এর ডেথ-মাস্ক উন্মোচিত হয়ে পড়ায়। মানুষের মাথার চেয়ে সামান্য একটু বড় ওটা আকারে, তবে সংশ্লিষ্ট মানুষটির হুবহু প্রতিচ্ছবি বলতে হবে মুখোশটিকে। শিল্পীর কাজ এতো নিখুঁত, চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো এতোকাল পরও অটুট রয়েছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো ওরা, স্ফটিকের চোখ দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন ফারাও-ও, সেই চোখে বিষণ্ণ দৃষ্টি, মনে হলো যেনো অভিযোগও আছে। :

মমির মাথা থেকে মুখোশটা তুলতে সাহস সঞ্চয়ের জন্য সময় নিতে হলো ওদেরকে। তারপর যখন তুললাম, আরো প্রমাণ পেল যে প্রাচীন কালে রাজা ও তাঁর জেনারেল ট্যানাস-এর দেহ অদলবদল করা হয়েছে। ওদের চোখের সামনে যে মমিটা পড়ে রয়েছে সেটা পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে কফিনের তুলনায় বেশ বড়। আংশিক আচ্ছাদন মুক্ত অবস্থায় রাখা, অনেকটা গুঁজে ভরা হয়েছে।

রাজকীয় মমির সঙ্গে কয়েকশো তাবিজ আর মন্ত্রঃপূত কবচ থাকবে, আবরণের নিচে, ফিসফিস করে জানালো রোয়েন। এটা বিখ্যাত বা অভিজাত কোনো ব্যক্তির মমি, কোনোমতেই একজন রাজার হতে পারে না।

লাশের মাথা থেকে ব্যান্ডেজের ভেতরে স্তর খুব সাবধানে খুলল নিকোলাস, ফলে মোটা দাড়ির কুণ্ডলি পাকানো জট বেরিয়ে পড়লো। তোরণের ভেতর কামরাটায় ফারাও মামোসের যে প্রতিকৃতি আমরা দেখেছি, তাতে তাঁর দাড়ি ছিল হেনায় রাঙানো, বিড়বিড় করলো ও।

এটা দেখুন। এখানে মমির দাড়ি শুকনো ঘাসের মতো, সোনালি আর রুপার মতো। আর কোনো সন্দেহ নেই, আবার বলল ও। এটা ট্যানাস-এর মমি। ট্যানাস টাইটার বন্ধু ছিলেন, আর রানীর ছিলেন প্রেমিক।

রোয়েনের চোখে জল। হ্যাঁ, বলল ও। লসট্রিসের পুত্রসন্তানের আসল বাবা তিনিই, পরে যিনি ফারাও টামোস হয়েছিলেন, হয়েছিলেন বহু রাজার পূর্ব-পুরুষ। কাজেই ইনিই সেই ব্যক্তি, যার রক্ত প্রাচীন মিশরের ইতিহাস জুড়ে বইছে।

সেই অর্থে যে কোনো ফারাও-এর মতোই মহান ছিলেন তিনি, শান্ত সুরে বলল নিকোলাস।

*

কথাটা প্রথমে খেয়াল হলো রোয়েনের। নদী! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, গলায় ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ ধার। নদী ফুলে উঠলে সব আবার হারিয়ে যাবে!

তবে সবই যে আমরা উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারব, তা ভাববেন না। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না এক জায়গায় এতো সম্পদ থাকতে পারে। এ দিকে আমাদের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, রোয়েন।

তাহলে? চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে রোয়েন।

সবচেয়ে সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো ক্রেটে ভরব আমরা, বলল নিকোলাস। আল্লাই জানে সে-সময়ও পাব কিনা।

কাজেই চরম ব্যস্ততার সঙ্গে কাজ শুরু করলো ওরা। পাঁচটা রণক্ষেত্রের সমস্ত স্বর্ণমূর্তি প্রথমে বাক্স বন্দি করা হলো। পাঁচটা লম্বা বাক্স লাগলো ওগুলোর জন্য।

মূর্তি, দেয়ালচিত্র, ফার্নিচার আর অস্ত্রগুলো নেওয়ার কথা ভাবতেই পারা গেল না। পড়ে থাকবে তৈজসপত্র, কাপড়-চোপড় আর কসমেটিক্সও। সোনার তৈরি বিশাল একটা রথও চার হাজার বছর ধরে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই রেখে যাবে ওরা।

ট্যানাসের মাথা থেকে সোনার ডেথ-মাস্ক তুলে নিল ওরা, তবে মমিটা কফিনের ভেতর থেকে গেল। তারপর নতুন প্রধান পুরোহিত মাই মেতাম্মাকে খবর পাঠালো নিকোলাস। তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল প্রাচীন সেইন্টের মরদেহ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে, সেটা গ্রহণ করার জন্য বিশজন সন্ন্যাসীকে নিয়ে চলে এলেন তিনি। ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে ট্যানাস-এর কফিন বয়ে নিয়ে গেলেন তারা, মঠের মাকডাস-এর স্থাপন করা হবে।

ইতোমধ্যে পাঁচটা রণক্ষেত্রের সমস্ত মূর্তি বাক্সে ভরার কাজ শেষ হয়েছে। তবে এগুলোর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে ডেথমাস্ক। একটা ক্রেটের ভেতর অনায়াসে ভরা গেল ওটাকে, পাশে শোয়ানো হলো টাইটার ক্ষুদে মূর্তিটাকে। ক্রেটে ফোম ভরা হয়েছে, ঢাকনির উপর ওয়াটারপ্রুফ ওয়াক্স ক্রেয়ন দিয়ে লেখা হলো-মাস্ক ও টাইটার কাঠের মূর্তি।

বেশিরভাগ গুপ্তধনই ফেলে যেতে হবে, কারণ হাতে সময় নেই। গায়ে ছবি আঁকা কাঠের টেস্টগুলো আর্টিফ্যাক্টস হিসেবে অমূল্য, ভেতরের জিনিসপত্র ছাড়াই। কিন্তু অসংখ্য চেস্টের মধ্যে থেকে কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা নেবে ওরা? শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, চেস্টের ঢাকনি ও গায়ে আঁকা ছবি দেখে বাছাই করা হবে। তার আগে কয়েকটা ঢাকনি খুলে দেখে নিতে হলো ছবির সঙ্গে ভেতরের জিনিসপত্র মেলে কি না। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ফারাও তার ব্লু যুদ্ধ মুকুট পরে আছেন, সেই মুকুট ভেতরেও পাওয়া গেল। শুধু যে বু ক্রাউন তাই নয়, লাল আর শাদা মুকুট জোড়াও অন্য একটা চেস্টে পেল ওরা। সবগুলোই অক্ষত ও অটুট অবস্থায় রয়েছে।

এরপর শুধু ছোটখাট আর্টিফ্যাক্ট ভরা হলো অ্যামুনিশন ক্রেটে। আকারে যেগুলো বড়, যতোই ঐতিহাসিক মূল্য থাকুক, বাদ দিতে হলো। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, রাজকীয় অলঙ্কার আর মূল্যবান পাথর ভরা চেস্টগুলো ক্রেটের ভেতর জায়গা করে নিতে পারছে, ফলে শুধু পাথর আর অলঙ্কারই নয়, চেস্টগুলোও অবিশ্বাস্য দামে বিক্রি করা যাবে। তারপর বড় আইটেমগুলো, তিনটি মুকুট আর রত্নখচিত কয়েকটা রক্ষাবরণ সহ, সদ্য তৈরি বড় কয়েকটা বাক্সে ভরা হলো।

প্রতিটি অ্যামুনিশন ক্রেট ভরা হয়ে গেছে, তারপরও মাত্র পাঁচ শতাংশ প্রত্ন সম্পদ নিতে পারছে ওরা। ক্রেটগুলো বয়ে আনা হলো সীল করা ডোরওয়ের বাইরে। লম্বা গ্যালারির আটটা মূর্তিও নিচ্ছে ওরা। ওগুলো বাক্সে ভরার কাজ শেষ হয়েছে, এ সময় সিঁড়ি বেয়ে প্রায় উড়ে আসতে দেখা গেল ড্যানিয়েলকে।

তুমি কি মরতে চাও, নিকোলাস? আর এক মিনিট সময়ও পাচ্ছ না। নদী ফুঁসছে, ফর গডস সেক! বাধটা যে কোনো মুহূর্তে চুরমার হয়ে যাবে।

তোরণের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ড্যানিয়েল, স্তম্ভিত বিস্ময়ে চারদিকে তাকালো। তবে বিস্ময়ের ঘোরটা কয়েক মুহূর্তে পরই সামলে নিল সে।

মিনিট, নিকোলাস, ঘণ্টা নয়! যিশুর কিরে, বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তাছাড়া, গিরিখাদের মাথায় যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে কমান্ডার মেক। টাইটার পুল থেকে তুমি গুলির আওয়াজও শুনতে পাবে। মিস রোয়েনকে নিয়ে এখুনি আমার সঙ্গে বের হতে হবে তোমার।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলল নিকোলাস।

ওদিকের সিঁড়ির নিচে, চেম্বারে, ক্রেটগুলো দেখেছ তো? মাথা ঝাঁকালো ড্যানিয়েল। গুড। ওগুলো মঠে নামিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো। তুমিই কাজটা সুপারভাইজ করবে, ঠিক আছে? বাকি সবাইকে নিয়ে ট্রেইলে তোমাকে আমরা অনুসরণ করব।

নিকোলাস দোহাই লাগে, সময় নষ্ট করো না। বিপদ এলে বলতে পারবে না আমি তোমাকে সাবধান করি নি।

তুমি যাও, আমরা আসছি, বলল নিকোলাস। বোটগুলো কোথায় আছে, জানো তো? মঠে পৌঁছেই ওগুলোয় বাতাস ভরার ব্যবস্থা করবে।

ড্যানিয়েল চলে যেতেই ছুটে তোরণের ভেতর ঢুকলো নিকোলাস, রোয়েন যেখানে এখনো ট্রেজার ভরছে ক্রেটে। যথেষ্ট হয়েছে, এবার চলুন!

কিন্তু নিকোলাস, এ সব আমরা ফেলে যেতে পারি না…

বেরোন, এক্ষুনি বেরোন! কঠিন সুরে ধমক দিল নিকোলাস। বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে! কী বলছি, শুনতে পাচ্ছেন, বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে!

আমি কি শুধু…

না, আর কিছুই নিতে পারবেন না। উঠুন! ঝুঁকে রোয়েনের বাহু ধরে টান দিল নিকোলাস।

ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রোয়েন, ওর হাতে চেস্ট থেকে তোলা এক গাদা সোনার অলঙ্কার। এগুলো ফেলে যাই কী করে! ওগুলো ট্রাউজারের পকেটে ভরতে শুরু করলো।

ঝুঁকলো নিকোলাস, দু হাতে ধরে রোয়েনকে তুলে নিল বুকে, তারপর তোরণ পেরিয়ে এসে ছুটলো।

চেম্বারের দূর প্রান্তের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে হানশিত শেরিফের কয়েকজন লোক, প্রত্যেকের মাথায় একটা করে ক্রেট। এখানে পৌঁছে রোয়েনকে নামালো নিকোলাস, বলল, কোনো রকম পাগলামি করবেন না।

মাথা নাড়লো রোয়েন, মনে হলো কেঁদে ফেলবে। সিঁড়ি বেয়ে নিকোলাসের আগে ছুটলো সে। মাথায় বোঝা থাকলেও, পোটাররা শৃঙ্খলা বজায় রেখে দ্রুতই এগুচ্ছে। তাদের দীর্ঘ এক লাইনের মিছিলের সঙ্গে মিশে গেল নিকোলাস ও রোয়েন, আঁকাবাঁকা গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। প্রতিটি বাঁকে চক দিয়ে আঁকা চিহ্ন থাকার পথ চিনতে কোনো অসুবিধে হলো না। অবশেষে বিধ্বস্ত লম্বা গ্যালারিতে পৌঁছল ওরা। সীর করা ডোরওয়েটা ভেঙে গেছে, ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ড্যানিয়েল। ওদেরকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।

তোমাকে না মঠে গিয়ে বোটগুলো রেডি করতে বললাম? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

আমার একটা দায়িত্ব বোধ আছে, গম্ভীর সুরে বলল ড্যানিয়েল। তোমাদের নিয়ে যাই কীভাবে?

কথা না বলে তার কাঁধে হালকা একটা ঘুসি মারলো নিকোলাস, তারপর ছুটে অ্যাপ্রোচ টানেল পার হলো, উঠে এলো সিঙ্কহোল-এর উপর ভাসমান সেতুতে। ঘাড় ফিরিয়ে ড্যানিয়েলের দিকে তাকালো ও, হাঁপাচ্ছে, চিৎকার করে জানতে চাইলো, মেক কোথায়? টিসেকে তুমি দেখছ?

টিসে ফিরে এসেছেন, তবে তাঁর অবস্থা খুবই করুণ।

কেন, কী হয়েছে তার? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।কোথায় সে?

ফন শিলারের গরিলাটা ধরেছিল তাকে, মারধর করেছে। মেকের লোকজন মঠে নিয়ে গেছে তাকে। কথা হয়েছে বোটের কাছে অপেক্ষা করবে।

গুড। আর মেক?

কর্নেল নগুর আক্রমণ ঠেকাবার চেষ্টা করছে। সেই সকাল থেকে রাইফেল, গ্রেনেড আর মর্টারের আওয়াজ পাচ্ছি। মেকও পিছু হটে মঠে পৌঁছবে, বোটের কাছে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য।

টানেলের শেষ কয়েক গজ পানির উপর দিয়ে ছুটলো ওরা। বাইরে বেরিয়ে এসে ক্রল করে টাইটার পুলকে ঘিরে থাকা নিচু পাঁচিলে উঠে পড়লো। ওখান থেকে চলে এলো পাহাড়ের গোড়ায় সরু কার্নিসে। মুখ তুলে নিকোলাস দেখলো হানশিত শেরিফের লোকজন দোলনার মতো দেখতে চওড়া কপিকলে তুলে পাহাড় প্রাচীরের চূড়ায় ক্রেটগুলো ওঠাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা শব্দ ঢুকলো কানে, সঙ্গে সঙ্গে চিনতেও পারল। গান ফায়ার! রোয়েনকে বলল ও।মেক লড়ছে এখনো, তবে পিছু হটে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।

ঝুলন্ত মাচায় উঠে পড়লো ওরা। পাহাড় প্রাচীরের চূড়ায় পৌঁছে চারদিকে তাকালো। মাথার উপর সূর্য, তেতে আগুন হয়ে আছে। সব কয়টা ক্রেট নিয়ে পোটাররা উপরে উঠেছে কিনা চেক করলো নিকোলাস। ঝোঁপ-ঝাড় ঢাকা ট্রেইল ধরে রওনা হয়ে গেল তারা, কলামের মাথায় থাকলো ড্যানিয়েল, গোড়ায় নিকোলাস ও রোয়েন। যুদ্ধের আওয়াজ এতো কাছে চলে এসেছে,ভয়ে কাপ ধরে যাচ্ছে বুকে। মনে হলো গিরিখাদের ভেতর মাত্র আধ মাইল দূরে লড়াই করছে ওরা। অটোমেটিক রাইফেলের আওয়াজ পোর্টারদের ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল,ঝোঁপ ঝাড়ের জঙ্গল পার হয়ে মেইন ট্রেইলে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে চাইছে ওরা, কর্নেল নগুর সৈনিকরা পথটা দখল করে নেওয়ার আগেই।

পথের জাংশনে পৌঁছবার আগেই স্ট্রেচার সহ একদল গেরিলাকে দেখতে পেল ওরা। তারাও মঠের দিকে যাচ্ছে। কাছাকাছি এসে নিকোলাস দেখলো স্ট্রেচারে শুয়ে রয়েছে টিসে। তার মুখে ব্যান্ডেজ আর করুণ চেহারা দেখে মোচড় দিয়ে উঠলো বুকটা। টিসে! কে আপনার এ অবস্থা করলো?

অভিমানী শিশুর দৃষ্টিতে নিকোলাসের দিকে তাকালো টিসে। থেমে থেমে, ফোঁপাতে দু একটা মাত্র শব্দ বলতে পারল।

হেলম! চাপা গলায় গর্জে উঠলো নিকোলাস। বেজন্মাটাকে ধরতে পারলে হয়? ওর পাশে এসে দাঁড়ালো রোয়েন, টিসেকে দেখে বিকৃত হয়ে উঠলো ওর চেহারা।

নিকোলাসকে ঠেলে সরিয়ে দিল রোয়েন, বলল, আপনি অন্য দিকে যান, আমি ওর পাশে থাকি।

নিকোলাস এক পাশে সরে এসে স্ট্রেচার বহনকারীদের একজনকে জিজ্ঞেস করলো, মিযরা, কি ঘটছে ও দিকে?

গিরিখাদের পুব দিকে থেকে একটা ফোর্স নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন কর্নেল নগু, বলল মিযরা। পাশ দিয়ে এগিয়ে এসেছে ওরা, তাই আমরা পিছু হটছি। এ যুদ্ধে আমরা অভ্যস্ত নই।

জানি, মন্তব্য করলো নিকোলাস। গেরিলারা সব সময় জায়গা বদল করবে। মেক কোথায়?

গহ্বরের পুব পাড় ধরে পিছু হটছেন তিনি, মিযরা যখন উত্তর দিচ্ছে, ওদের পেছন থেকে গোলাগুলির নতুন আরেক দফা আওয়াজ ভেসে এলো। ওই ওখানে উনি! মাথা ঝাঁকালো মিযরা। কর্নেল ন তাকে তাড়া করছেন।

তোমাকে সে কি নির্দেশ দিয়েছে?

ওইজিরো টিসেকে নিয়ে নৌকায় চড়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে।

ঠিক আছে। আমরাও তোমার সাথে যাবো।

*

অ্যাবে গিরিখাদের মাথায় জমাট বাঁধছে ঘন কালো মেঘ। পেগাসাস কোম্পানির জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার সারি সারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে উড়ছে। হেলম্ জানে মেক নিমুরের কাছে আরপিডি, রকেট-লঞ্চার আছে, গিরিখাদের ভেতর পাহাড়-শ্রেণীর আড়াল না নিয়ে উপায় নেই তাদের। ডান দিকের সিটে বসেছে যেনো পাইলটের পাশে। পেছনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসেছেন হের ফন শিলার আর : নাহুত গাদ্দাবি, দু জনেই পেছন দিকে ছুটস্ত উপত্যকার দিকে তাকিয়ে আছেন।

কয়েক মিনিট পরপর জ্যান্ত হয়ে উঠেছে রেডিও, কর্নেল নগুর লোকজন মর্টার সাপোর্ট চাইছে কিংবা লক্ষ্য অর্জনের রিপোর্ট দিচ্ছে।

ওরা কী গহ্বরের সেই জায়গায় পৌঁছেছে, জানতে চাইলেন ফন শিলার, হারপার নিকোলাস যেখানে কাজ করছে?

উত্তর পেতে আরো খানিকটা সময় লাগলো। রেডিও থেকে সরাসরি কর্নেল গুমার আওয়াজ ভেসে এলো। আমরা সফল হয়েছি, হের ফন শিলার। সমস্ত পজিশন দখল করে নিয়েছি। কপিকলে চড়ছে আমার লোকজন, গহ্বরের নিচে নামতে যাচ্ছে ওরা।

ফন শিলার পাইলটকে প্রশ্ন করলেন, ওখানে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?

মিনিট পাঁচেক, স্যার।

পৌঁছবার পর জায়গাটাকে ঘিরে চক্কর মারবেন, সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ড করবেন না।

আকাশে থেমে দাঁড়ালো কপ্টার।

কি হলো? শিলার জানতে চান। কি দেখছো?

বাঁধ, জ্যাক হেল বলে। কুয়েনটন-হারপারের বাঁধ দেখছি। প্রচুর কাজ করেছে ব্যাটা।

বৃষ্টিস্নাত আলোয় বাঁধে আটকে পড়া নীলের জল গাঢ় আর কাদাটে দেখাচ্ছে। লম্বা উপত্যাকায় চারপাশে ফুঁসছে পানি।

পরিত্যক্ত! হেল বলে চলে, ওরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।

নদীর তীরে হলুদ মতো ওটা কী? ফন শিলারের জিজ্ঞাসা।

ওটা দিয়ে মাটি সরায়। ওই যে, আমার ইনফরমার বলেছিল।

এখানে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। চলো নিচে গিয়ে দেখি! তর সইছে না ফন শিলারের।

পাইলটের কাঁধে হাত রেখে নির্দেশ দেয় হেলম্।

*

ট্রেইলের জাংশনে অপেক্ষা করছিল ড্যানিয়েল। নদী এখানে নতুন পথ ধরে সগর্জনে উপত্যকা বেয়ে নেমে যাচ্ছে, নামার পথে আদি ট্রেইলের কিছুটা অংশ ডুবিয়ে দিয়েছে। মাথায় ক্রেট নিয়ে পোর্টাররা উঠে যাচ্ছে উঁচু জমিনে।

হানশিত কোথায়? ড্যানিয়েলকে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। পোটারদের দীর্ঘ লাইনে তরুণ হানশিত শেরিফকে দেখে নিও।

আমিতো জানতাম সে তোমার সঙ্গে আছে, জবাব দিল ড্যানিয়েল।

ফেলে আসা পথের দিকে তাকালো নিকোলাস, ঝোঁপ-ঝাড়ে ঢাকা ট্রেইলে আর কেউ নেই। কে এখন খুঁজতে যায়! মঠে তাকে একাই ফিরতে হবে। ও থামতেই দূর থেকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ ভেসে এলো। পেগাসাসের কপ্টার, ভাবল নিকোলাস। আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে সরাসরি টাইটার হ্রদের দিকে যাচ্ছেন ফন শিলার। তার মানে ওরা কোথায় কাজ করছিল, জার্মান ধনকুবের আগে থেকেই তা জানে।

আওয়াজটার দিকে মুখ তুলে রয়েছে রোয়েনও, আশা ঘন কালো মেঘের গায়ে কোথাও হেলিকপ্টারটাকে দেখতে পাবে। শুয়োরের দলটা আমাদের সমাধিতে ঢুকলে পবিত্র একটা জায়গায় মর্যাদা নষ্ট হবে, বলল ও, গলায় রাগ।

হঠাৎ এগিয়ে এসে স্ট্রেচারের পাশে দাঁড়ানো রোয়েনের একটা হাত চেপে ধরল নিকোলাস। ঠিক বলেছেন আপনি! টিসেকে নিয়ে মঠে চলে যান আপনি। আমি একটু পরে আসছি। রোয়েন প্রতিবাদ করার আগেই ছুটে ড্যানিয়েলের সামনে চলে এলো ও।

ড্যানিয়েল, মেয়ে দুটোর দায়িত্ব তোমার উপর থাকলো।

নিকোলাসের পেছনে চলে এলো রোয়েন। কী করতে চাইছেন, বলবেন। আমাকে?

ছোট্ট একটা কাজ আছে। খুব বেশি দেরি করব না।

নিশ্চয়ই আপনি ওখানে আবার ফিরে যেতে চাইছেন না?

আতঙ্কিত দেখালো রোয়েনকে। ধরতে পারলে ওরা আপনাকে স্রেফ খুন করবে…

চিন্তা করবেন না, বলে হেসে উঠলো নিকোলাস, তারপর রোয়েন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর ঠোঁটে পূর্ণ চুমো খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, ফিরতি পথে ছুটছে। টিসের দিকে খেয়াল রাখবেন।

নিকি! পেছন থেকে বৃথায় ডাকলো রোয়েন।

*

বাঁধের উপর দিয়ে উড়ে এলো জেট রেঞ্জার। বাঁধ পিছিয়ে পড়তে গিরিখাদের আরো গভীরে নামলো কপ্টার। দু পাশে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়-প্রাচীন, মাঝখানে সরু ফাঁক, তার ভেতর দিয়ে ছুটছে ওরা। গহ্বরটা প্রায় শুকনো এখন, জমে থাকা পানি স্থির। ওই তো! ওই তো ওরা! সরাসরি সামনে হাত তুলল হেলম্। ওদিকে একদল লোককে দেখা যাচ্ছে, গহ্বরের কিনারায়। কর্নেল নগুকে আমি চিনতে পারছি। তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের স্পাই, হানশিত শেরিফ।

ইঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠলো তার গলা, পাইলটকে বলল, তুমি ল্যান্ড করতে পারো। ওই দেখো, কর্নেল নগু হাত নাড়ছেন।

হেলিকপ্টারের স্কিড জমিন স্পর্শ করতেই হানশিতকে নিয়ে ছুটে এলেন কর্নেল। নগু। ফন শিলারকে নিচে নামতে সাহায্য করলো ওরা, ঘুরন্ত রোটরের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে আনল। আমার লোকেরা জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। ডাকাতদের ধাওয়া করেছিলাম, উপত্যকার দিতে সরে যেতে বাধ্য করেছি। তারপর হানশিত শেরিফের পরিচয় দিলেন নণ্ড। হানশিত হারপার নিকোলাসের সঙ্গে সমাধির ভেতর ছিল, টানেলের প্রতিটি ইঞ্চি চেনে।

ইংরেজি বোঝে? জানতে চাইলেন ফন শিলার।

এক-আধটু।

গুড! গুড! হানশিতের দিকে তাকালেন ফন শিলার।

ওহে, সন্ন্যাসী, পথ দেখাও আমাকে। আসুন, নাহুত, আপনিও আমার সঙ্গে আসুন। প্রচুর বেতন দেওয়া হয়েছে আপনাকে, এবার কিছু কাজ দেখান।

পথ দেখিয়ে ওদেরকে পাহাড়-প্রাচীরের কিনারায়, কফিকলের কাছে নিয়ে এলো হানশিত। কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে গহ্বরের নিচে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন ফন শিলার। কপিকলের বাঁশের কাঠামো ভঙ্গুর আর নড়বড়ে মনে হলো। পেছন থেকে হানশিত বলল, সমাধিতে নামার এটাই একমাত্র পথ।

চোখ বুজে রশির দোলনায় বসলেন ফন শিলার। একে একে নিচে নামলো ওরা। টানেলটা কোথায়? চারদিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন ফন শিলার।

হাত তুলে পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ার ফাঁকটা দেখালো হানশিত। টাইটার পুলকে ঘিরে থাকা নিচু পাঁচিলের উপর দিয়ে সরু কার্নিসে চলে এলো সবাই। হেলম্ আর কর্নেলের দিকে তাকালেন ফন শিলার। হেলমকে নিয়ে আপনি এখানে পাহারায় থাকুন, কর্নেল, বললেন তিনি। হানশিত আর নাহুতকে নিয়ে ভেতরে ঢুকছি আমি। হেলমের দিকে তাকালেন। দরকার হলে তোমাদেরকে আমি ডেকে পাঠাব।

আমি আপনার সঙ্গে থাকতে পারলে খুশি হতাম, বলল হেলম্। আপনার নিরাপত্তার দিকটা….

ভুরু কুঁচকে ফন শিলার বললেন, যা বলছি শোনো। টানেলের মুখে ঢুকে পড়লেন তিনি। নাহুত আর হানশিত তাকে অনুসরণ করলো। এতো আলো। আসছে কোত্থেকে? জানতে চাইলেন ফন শিলার।

হানশিত বলল, একটা মেশিন আছে। তারপর ওরা শুনতে পেল সামনে থেকে জেনারেটরের অস্পষ্ট যান্ত্রিক গুঞ্জন ভেসে আসছে। সিঙ্কহোলের উপর ভাসমান সেতুতে না পৌঁছনো পর্যন্ত ওদের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না।

এখানে পানি কেন? বিড়বিড় করলেন নাহুত। মিশরীয় অন্য কোনো প্রাচীন সমাধিতে পৌঁছতে হলে এ রকম পানি পেরুতে হয়েছে বলে তো শুনিনি।

আপনি বেশি কথা বলেন, ধমক দিলেন ফন শিলার। আগে দেখতে দিন এ লোক আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যায়।

সেতু পার হওয়ার সময় হানশিতের কাঁধে ভর দিয়ে থাকলেন তিনি। এখান থেকে টানেল ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। হাই-ওয়াটার মার্ক ছাড়িয়ে এলো ওরা। টানেলের দেয়ালের দিকে পালিশ করা পাথর, লক্ষ্য করে ফারুকরি মন্তব্য করলেন, নাহ, আমারই ভুল হয়েছিল। টানেলের এ দিকে তো দেখছি মিশরীয় প্রভাব স্পষ্ট।

বিধ্বস্ত গ্যালারির বাইরে ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা। এখানে জেনারেটর রয়েছে। ইতোমধ্যে হাঁপিয়ে গেছেন ফন শিলার ও নাহুত, দু জনেই ঘামছেন–যতোটা না ক্লান্তিতে, তারচেয়ে বেশি উত্তেজনায়।

যতো দেখছি ততোই আশা জাগছে বুকে, বললেন নাহুত। এটা কোনো রাজকীয় সমাধি হওয়া বিচিত্র নয়।

এক পাশের দেয়াল ঘেঁষে স্তূপ করা রয়েছে প্লাস্টার সীল, হাত তুলে সেগুলো নাহুতকে দেখালেন ফন শিলার। ওগুলোর সামনে হাঁটু গাড়লেন নাহুত, মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন।

ফারাও মামোসের সীল, উত্তেজনায় কেঁপে গেল তাঁর গলা। সঙ্গে লিপিকার টাইটার সই। চকচকে চোখ তুলে শিলারের দিকে তাকালেন। এখন আর কোনো সন্দেহ-ই নেই। আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম সমাধিতে নিয়ে আসব, এনেছিও।

কয়েক মুহূর্ত কথা বললেন না ফন শিলার। তারপরই যেনো বিস্ফোরিত হলেন। কিন্তু কি লাভ হলো? সবই তো ভেঙে নষ্ট করা হয়েছে।

না! না! ব্যাকুল সুরে আশ্বস্ত করলো হানশিত। এ দিকে আসুন। সামনে আরো একটা টানেল আছে।

আবর্জনার ভেতর দিয়ে পথ করে এগুলো ওরা, হানশিত ব্যাখ্যা করছে গ্যালারির ছাদ কীভাবে ধসে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর আসল প্রবেশপথটা সেই আবিষ্কার করেছিল, এ কথা জানাতেও ভুলল না। সবশেষে বলল, সামনে রাশি রাশি গুপ্তধন পড়ে আছে, দেখে আপনাদের মাথা ঘুরে যাবে।–ঠিক আছে, বললেন ফন শিলার। সরাসরি সমাধিতে নিয়ে চলো আমাকে। আমার হাতে সময় খুব কম।

গোলকধাঁধা অর্থাৎ বাওবোর্ডের জটিল ছক ধরে পথ দেখালো হানশিত, লুকানো সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে তুলে আনল, তারপর ক্রমশ নিচু টানেল ধরে এগুলো।

অবশেষে তোরণশোভিত কামরার সামনে এসে থামলো ওরা। কামরার ভেতর দেয়ালচিত্র দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন নাহুত। এতো সুন্দর দেয়ালচিত্র জীবনে কখনো দেখিনি আমি।

এ রকম কিছু আমিও আশা করি নি, ফিসফিস করলেন ফন শিলার। আমি মুগ্ধ, আমি ধন্য!

কামরার প্রতিটি দিক অমুল্য ট্রেজারে ভর্তি, বলল হানশিত। ওখানে এমন সব জিনিস আছে, স্বপ্নেও আপনারা দেখেন নি। হারপার নিকোলাস খুব অল্পই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পেরেছেন, ছোট কয়েকটা বাক্সে ভরে। আর্টিফ্যাক্টের পাহাড় ফেলে রেখে গেছেন তিনি।

কফিনটা…কফিনটা কোথায়? রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলেন ফন শিলার। মমি! মমি!

ওটা ছিল সোনালি একটা কফিনে। হারপার নিকোলাস সেটা প্রধান পুরোহিতকে দান করেছেন। সন্ন্যাসীরা ওটা মঠে দিয়ে গেছে।

কর্নেল নগুকে দিয়ে ওটা আনিয়ে নেব আমরা, বললেন নাহুত। আপনি চিন্তা করবেন না, হের ফন শিলার।

তোরণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন ওঁরা, তারপর ছুটলেন। প্রথম সারির একটা স্টোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন ফন শিলার, শিশুর মতো অবিরাম হাসছেন।

অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! একই কথা বারবার বলছেন। কাঠের একটা চেস্ট স্তূপ থেকে নামালেন তিনি, কাঁপা হাতে খুলে ফেললেন ঢাকনি। ভেতরের জিনিসগুলো দেখে বোবা হয়ে গেলেন। চেস্টের উপর ঝুঁকে নরম সুরে কাঁদছেন।

*

ড্যানিয়েলের হলুদ ফ্রন্ট-এন্ড ট্র্যাক্টরের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে নিকোলাস। হাইড্রলিক কন্ট্রোল অপারেট করছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে, ক্রেনটাকে খাড়া করলো যতটুকু পারা যায়। নদী আক্ষরিক অর্থেই ফুঁসছে, বাঁধের মাথা ছুঁতে আর বেশি সময় নেবে না। বাঁধ ভাঙবেই, তবে সময়টা আরো খানিক এগিয়ে আনতে চেষ্টা করছে ও। ক্রেনের যান্ত্রিক হাত কাজ শুরু করলো, বাঁধের মাথা থেকে জালে আটকানো পাথর একটা একটা করে তুলে ফেলে দিচ্ছে পানিতে।

ওদিকে, উন্মাদের মতো আচরণ করছেন ফন শিলার। চেস্ট খুলে রাজকীয় অলঙ্কার শূন্যে ছুঁড়ছেন, চড়িয়ে দিচ্ছেন চারদিকে, ছুটে এসে এমন জায়গায় দাঁড়াচ্ছেন, ওগুলো যাতে তাঁর মুখ আর মাথায় পড়ে। সেই সঙ্গে অট্টহাসি হাসছেন, পাক খাচ্ছেন লাটিমের মতো, আবার কখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন। নাহুতও আবেগে আপ্লুত, তবে তিনি শিলারের আচরণ হাঁ করে গিলছেন।

খানিক পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ফন শিলার ফিসফিস করলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্কিওলজিকাল ডিসকভারি। এখনো তিনি কাঁপছেন, রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।

আমাদের সামনে কয়েক বছরের কাজ, ভাবাবেগের লাগাম টেনে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন নাহুত। এ অবিশ্বাস্য কালেকশনের ক্যাটালগ তৈরি করতে হবে, তারপর মূল্যায়নের পালা। আবিষ্কারক হিসেবে আপনার নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একেই বলে মিশরীয় অমরত্ব, আপনার নাম কেউ কোনোদিন ভুলবে না, হের ফন শিলার।

নিষ্পলক দৃষ্টিতে নাহুতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ফন শিলার। এ চিন্তাটা আগে তাঁর মাথায় ঢোকে নি। অমরত্ব লাভের এ সুবর্ণসুযোগ কেন তিনি হাতছাড়া করবেন? প্রথমে ভেবেছিলেন মামোসের ট্রেজার সবই একা দখল করবেন তিনি, কাউকে কোনো ভাগ দেবেন না। নাহুতের কথা শুনে এখন ভাবছেন, ফারাওদের মতো অমর হতে বাধা কোথায়? মমোসের ট্রেজার সাধারণ লোকের দ্রষ্টব্য বস্তুতে পরিণত হোক, এটা তিনি চান না, অন্তত তাঁর মৃত্যুর আগে নয়। না! নাহুতের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন তিনি। এই গুপ্তধন আমার, একা শুধু আমার! আমি মারা গেলে সব আমার সঙ্গে যাবে। আমি একটা উইল তৈরি করব। আমি মারা যাবার পর কী করতে হবে আমার ছেলেরা তা জানবে। আমার সমাধিতে থাকবে সব। ওটা হবে আধুনিক কালে ফারাও ফন শিলারের রাজকীয় সমাধি।

মানুষটা যে সত্যিকার অর্থে পাগল, আজই প্রথম উপলব্ধি করছেন নাহুত। তবে তিনি জানেন যে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। যা করার পরে মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হবে। এ বিপুল প্রত্ন নিদর্শন আরেকটা সমাধিতে হারিয়ে যাবে, তা তিনি হতে দেবেন না। মাথা নত করে আনুগত্য প্রণাম করলেন তিনি, আপনি যা বলেন, হের, ফন শিলার। তবে এ মুহূর্তে আমাদের প্রথম চিন্তা, নিরাপদে সব বাইরে বের করে নিয়ে যাওয়া। হেলম্ আমাদেরকে নদীর কথা বলে সাবধান করে দিয়েছেন। তাকে আর কর্নেলকে এখানে ডাকা দরকার, সমাধি খালি করতে হবে। প্যাক করে ওখান থেকে পাঠিয়ে দেব জার্মানিতে।

হ্যাঁ, ঠিক আছে। হেলম আর কর্নেলকে ডেকে পাঠান। রাজি হলেন ফন শিলার।

হানশিত, কোথায় তুমি? চিৎকার করলেন নাহুত।

খালি কফিনের সামনে হাঁটুগেড়ে প্রার্থনা করছে তরুণ সন্ন্যাসী। উঠে এসে নাহুতের সামনে দাঁড়ালো। যাও, ওদেরকে ডেকে আনো…., হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি, কান পাতলেন। ও কিসের শব্দ?

মাথা নাড়লো হানশিত, ছোটে আঙুল রেখে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিল। শুনুন! শুনুন!

হঠাৎ আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেল ফারুকরির চোখ। আওয়াজটা বহুদূর থেকে আসছে, খুবই নরম, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো।

কিসের শব্দ? জিজ্ঞেস করলেন ফন শিলার।

পানি! ফিসফিস করলেন নাহুত। ছুটন্ত পানির আওয়াজ!

নদী! কর্কশ শোনার হানশিতের গলা। টানেলের ঢুকে পড়ছে নদী! ঘুরলো সে, তারপর কামরা থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।

আমরা এখানে আটকা পড়ব! চেঁচিয়ে উঠে তার পিছু নিলেন নাহুত।

দাঁড়ান! অপেক্ষা করুন! গলা ফাটালেন ফন শিলারও, পিছু নিলেন ওদের। কিন্তু নাহুত ও হানশিত তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, স্বভাবতই পিছিয়ে পড়ছেন তিনি।

তবে নাহুতের চেয়ে দ্রুত ছুটছে হানশিত, গ্যাস্ট্র্যাপ-এর সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

হানশিত! ফিরে এসো! আমি তোমাকে হুকুম করছি! ছুটতে ছুটতে হাঁক ছাড়ছেন নাহুত, কিন্তু হানশিত থামলো না। টানেলের জটিল গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেল।

নাহুত, কোথায় আপনি? পাথুরে করিডরে শিলারের কাঁপা কাঁপা গলা প্রতিধ্বনি তুলছে। নাহুত শুনতে পেলেও সাড়া দিলেন না। ছুটছেন তিনি, তাঁর ধারণা হানশিতকে ঠিকমতোই অনুসরণ করছেন এখনো। খানিক পর মনে হলো সামনে থেকে হানশিতের পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে।

আরো তিনটে বাঁক ঘোরার পর নাহুত উপলব্ধি করলেন, গোলকধাঁধার ভেতর হারিয়ে গেছেন তিনি। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা মনে হলো বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়লেন, চিৎকার করে ডাকলেন, হানশিত! কোথায় তুমি?

উত্তরে পেছন থেকে শিলারের আতঙ্কিত গলা ভেসে এলো, নাহুত! নাহুত! এখানে আমাকে ফেলে যাবেন না! তার ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ ক্রমশ কাছে সরে আসছে।

শাট আপ ধমক দিলেন নাহুত। বোকার মতো চেঁচাবেন না! হাঁপাচ্ছেন তিনি, হানশিতের পায়ের আওয়াজ শোনার আশায় আবার কান পাতলেন। কিন্ত পানির কলকল ছলছল হাসি ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলেন না। আওয়াজটা মনে হলো তাঁর চারদিক থেকে ভেসে আসছে।

না! হানশিত, আমাকে ফেলে যেয়ো না! আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটলেন আবার, কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছেন নিজেও জানেন না।

*

আঁকাবাকা টানেলের প্রতিটি মোচড় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে হানশিত, মৃত্যুভয় তার পায়ে বিপুল গতি এনে দিয়েছে। কিন্তু মাঝখানের সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে হোঁচট খেলো সে, বাঁকা হয়ে গেল গোড়ালি, ধপাস করে পড়ে গেল সিঁড়ির ধাপে। গড়াতে গড়াতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল শরীরটা, লম্বা গ্যালারির নিচে এসে স্থির হলো।

অনেক কষ্টে, ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সোজা হলো সে। যদিও ছুটতে গিয়ে আবার পড়ে গেল, মচকানো গোড়ালি বিপদের সময় সাহায্য করতে রাজি নয়। যতোক্ষণ শ্বাস ততোক্ষণ আশ, ক্রল করে এগুল হানশিত। দরজা পেরিয়ে এসে ল্যান্ডিঙে পৌঁছল, জেনারেটরের পাশে। টানেল থেকে সচল পানির আওয়াজ ভেসে আসছে। আওয়াজটা এখন আর নরম নয়, চাপা গর্জনের মতো শোনাচ্ছে, জেনারেটরের যান্ত্রিক গুঞ্জন প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। ও যিশু, ও মেরী, আমাকে বাঁচাও গো! দেয়াল ধরে সোজা হলে আবার, এক পায়ে লাফাতে লাফাতে হাঁটছে। লোয়ার লেভেলে পৌঁছনোর আগে আরো দু বার হোঁচট খেয়ে পড়লো।

হাঁটুর উপর সোজা হয়ে সামনে তাকালো হানশিত। টানেলের ছাদে ইলেকট্রিক আলো সাজানো রয়েছে, তার আলোয় নিচের সিঙ্কহোলটা দেখতে পেল সে। দেখেও প্রথমে চিনতে পারলো না, কারণ আগের সেই চেহারা আর নেই। পানির লেভেল পালিশ করা মেঝের নিচে নয় এখন। পানিতে বিপুল একটা আলোড়ন উঠেছে। ভাসমান সেতু ভেঙে গেছে, এরইমধ্যে ডুবে গেছে অর্ধেকটা।

সিঙ্কহোলের ওপারের টানেলে, টাইটার পুল হয়ে, ঢুকে পড়েছে পাগলা নদী। সিঙ্কহোল ভরাট হয়ে গেছে, এপারের টানেলে উঠে আসছে পানি সগর্জনে। কিন্তু হানশিত জানে, বাইরে বের হওয়ার এটাই একমাত্র পথ।

এক পায়ে লাফ দিয়ে ভাসমান একটা পন্টুনে পড়লো হানশিত, কিন্তু সেটা এতো দ্রুত ঘুরপাক খাচ্ছে যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। হামাগুড়ি দিয়ে বসলো সে, ওই অবস্থায় এক পন্টুন থেকে আরেক পন্টুনে চলে যাচ্ছে। এভাবে সিঙ্ক হোলের ওপারে পৌঁছল, টানেলের দেয়াল ধরে সোজা হলো আবার, একটা গর্তের ভেতর হাত গলিয়ে ঝুলে থাকলো। কিন্তু নদীর পানি শ্যাফটের ভেতর এখন তুমুল বেগে ঢুকছে, হানশিতের শরীরের নিচের অংশ টানা স্রোতের মধ্যে পড়ে গেল। পানি ঠেলে সামনে এগুতে পারছে না সে, গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে হাতটা।

মাথার উপর টানেলের ছাদে এখনো ইলেকট্রিক বালব জ্বলছে, টানেলের শেষ মাথায় টাইটার পুলে বেরুনোর চৌকো ফাঁকটা অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে হানশিত। ওখানে একবার পৌঁছতে পারলে কপিকলে চড়ে পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় উঠে যাওয়া সম্ভব। শরীরের সব শক্তি এক করে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলো সে, এক গর্ত থেকে আরেক গর্তে হাত ঢোকাচ্ছে। আঙুলের নখ উপড়ে এলো, তবু এগুচ্ছে হানশিত।

অবশেষে দিনের আলো দেখতে পেল সে, টাইটার পুল থেকে ভেতরে ঢুকছে। আর মাত্র চল্লিশ ফুট এগুতে হবে। এভাবে এগুতে পারলে এ যাত্রা বেঁচে যাবে বলে মনে হলো। কিন্তু তারপরই নতুন একটা শব্দ ঢুকলো কানে। টানেলের বাইরে গহ্বরের ভেতর যেনো প্রলয়কাণ্ড শুরু হলো। কী ঘটছে বুঝতে পারলো হানশিত। বাধটা এবার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, বিপুল জলরাশি জলপ্রপাতের মতো থেমে আসছে টাইটার পুলে। টানেলের বিশাল ঢেউ গ্রাস করে ফেললো, টানেল ভরাট হয়ে উঠলো ছাদ পর্যন্ত।

বিপুল জলরাশির ধাক্কাটা পাথর ধসের মতো লাগলো হানশিতকে, খড়কুটোর মতো ভেসে গেল সে। সিঙ্কহোল নিজের গভীরে টেনে নিল তাকে, পানির প্রচণ্ড চাপ হাড়-গোড় সব গুঁড়ো করে দিচ্ছে। কানের কাছে একটা ড্রাম বিস্ফোরিত হলো, হাঁ করা মুখ দিয়ে ঢুকে ফুসফুস ভরাট করে তুললাম পানি। পানির নিচের গোপন শ্যাফট দিয়ে তীব্রবেগে ছুটলো তার লাশ, পাহাড়ের দূর প্রান্তে প্রজাপতি ফোয়ারায় বেরিয়ে যাবে।

কামানের বিস্ফোরিত গোলার মতো আওয়াজ তুলে বাধের চূড়া ভেঙে পড়লো। মুক্ত পানি উথলে উঠলো আকাশে, দেখতে পেয়েই লাফ দিয়ে ফ্রন্ট-এন্ডের সিট থেকে নিচে নামলো নিকোলাস, পাড় ধরে ছুটছে। কিন্তু মাত্র কয়েক পা এগুতে পারলো ও, আলোড়িত পানি নাগাল পেয়ে গেল ওর। খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ছে, গহ্বরের খোলা মুখ গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে।

*

তীব্র স্রোত ট্র্যাক্টরটাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জলপ্রপাতের মাথা থেকে খসে পড়লো ওটা, ওর নিচে শূন্যে ওটাকে এক পলকের জন্য দেখতে পেল নিকোলাস। খসে গহ্বরের নিচে পড়ছে, উপলব্ধি করলো ট্রাক্টরের সিটে থাকলে ওটার নিচে চাপা পড়ত ও। বিশাল মেশিনটা হ্রদের সারফেসে পড়লো, সাদা পানি ছিটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গভীরে।

একটু পর ঝুলে পড়লো নিকোলাস, নিচে পা দিয়ে। তীব্র স্রোত আবার ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পানির উপর মাথা তুললাম পঞ্চাশ গজ ভাটির দিকে। চোখ থেকে চুল সরিয়ে দ্রুত চারদিকে দৃষ্টি বুলাল ও।

ওর সামনে, নদীর মাঝখানে, পাথরের ছোট একটা দ্বীপ রয়েছে। অল্প একটু সাঁতরে ওটার উপর উঠলো, ওখান থেকে গহ্বরের দু পাশের খাড়া পাঁচিলগুলোর দিকে তাকালো। শেষবার যখন এখানে আটকা পড়েছিল, তখনকার কথা মনে পড়ে গেল ওর। বাঁধ ভেঙে দিয়ে ফারাও-এর সমাধি ডুবিয়ে দেওয়ার উল্লাস কর্পণের মতো উবে গেল।

ওই পিচ্ছিল পাঁচিল বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়, জানে নিকোলাস। ধরার মতো কোনো গর্ত নেই পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে। গোটা প্রাচীর জুড়েই ফুলে আছে পাঁচিলের গা, পার হওয়া অসম্ভব। সাঁতরে পেছন দিকে, জলপ্রপাতের গোড়ায় পৌঁছনোও সম্ভব নয়।

তারপর লক্ষ্য করলো, জলপ্রপাতের মাথা থেকে যতোটা আশা করেছিল ততো বেশি পানি নামছে না। তার মানে বাধটা পুরোপুরি এখনো ভেঙে পড়েনি, শুধু চূড়ার দিকটা ভেঙে গেছে। তবে চূড়া যখন ভাঙবে, এ নদীতে সাঁতার কাটা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই, যা করার এখুনি করা দরকার। বুট খুলে দ্বীপ থেকে ডাইভ দিয়ে নদীতে পড়লো নিকোলাস। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল, অবশিষ্ট বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।

দুনিয়া কাঁপানো গর্জন শুরু হলো, পানির নিরেট পাঁচিল জলপ্রপাতের মাথা থেকে লাফ দিচ্ছে নিচে। গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে সাঁতরাচ্ছে নিকোলাস, দ্রুতগতি বন্যার আগে থাকার ইচ্ছা। ধেয়ে আসা ঢেউ-এর গর্জন শুনে কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে তাকালো। গহ্বরটা ডুবিয়ে দিয়ে ছুটে আসছে পানির তোড়, পনেরো ফুট উঁচু, চুড়ার দিকটা সাপের মতো ফণা তুলে আছে। ওই চূড়ায় উঠতে হবে ওকে, তলিয়ে যাওয়া চলবে না, সিদ্ধান্ত নিল নিকোলাস। পানিতে থাবা মেরে ঢেউ এর ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা চালালো। অনুভব করলো স্রোতটা ওর নাগাল পেয়ে গেছে, তুলে নিচ্ছে মাথায়। চূড়ায় ওঠার পর পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা করলো নিকোলাস, হাত দুটো গুঁজে দিল নিজের পেছনে-ক্লাসিক বডিসাফার পজিশন, ঝুলে আছে ঢেউ-এর মুখে, মাথাটা সামান্য নত, শরীরের সামনের অর্ধেক অংশ পানির উপর তোলা, ভেসে থাকছে শুধু পা ছুঁড়ে। আতঙ্কিত কয়েকটা সেকেন্ড পেরিয়ে যাবার পর উপলব্ধি করলো, ঢেউ-এর মাথায় থাকতে পারছে ও, নিজের উপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ আছে; আতঙ্ক কমে এলো, রোমাঞ্চকর একটা শিহরণ বয়ে গেল শিরায় শিরায়।

বিশ নট! স্রোত আর নিজের গতি আন্দাজ করলো নিকোলাস, দু পাশের পাহাড়-প্রাচীর এতো দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে যে ঝাপসা লাগলো চোখে। ঢেউটার মাঝখানে থাকতে চেষ্টা করছে ও, পাঁচিলের কাছ থেকে দূরে। নিজেকে প্রায় কিছুই করতে হচ্ছে না, ঢেউই ওকে বয়ে নিয়ে চলেছে। তীব্র গতি আর বিপদের আশঙ্কা উপভোগ করছে নিকোলাস।

গহ্বরের গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় বোল্ডারগুলো ডুবে গেছে, ফলে ধাক্কা খাবার ভয়টা এখন আর নেই। প্রথম এক মাইল পেরিয়ে আসার পর ঢেউ তার আকৃতি বদলাল, কারণ গিরিখাদ এ দিকে চওড়া হয়ে গেছে। আরো খানিক পর দেখা গেল ঢেউটা ওকে মাথায় তুলে রাখতে পারছে না। দ্রুত চারদিকে চোখ বুলালো নিকোলাস। কাছেই বিশাল এক গাছের কাণ্ড ভাসছে, ছুটে চলেছে ঢেউয়ের সঙ্গে একই গতিতে। ভাঙা বাঁধের একটা অংশ এটা, কোনো একটা ফাঁকে খুঁজে রেখেছিল ড্যানিয়েল। কাণ্ড বা লগটা প্রায় ত্রিশ ফুট লম্বা, পিঠ দেখে মনে হচ্ছে তিমি বুঝি। কাঠুরেরা করাত দিয়ে কাটার সময় কাণ্ডের সব শাখা হেঁটে ফেলেনি, ফলে ওটার উপর ওঠার সময় ধরার জন্য শক্ত ডাল পেল নিকোলাস। পানিতে পা ঝুলিয়ে ভাটির দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলো, দম ও শক্তি ফিরে আসছে ধীরে ধীরে।

বাঁধ ভাঙা বন্যার আকৃতিতে এখন আর ঢেউ তেমন নেই, তারপরও গহ্বরের ভেতর দিয়ে প্রবল বেগে ছুটে চলেছে পানি। গতি প্রায় দশ নট, আন্দাজ করলো নিকোলাস। এ গতিতে টাইটার পুল আক্রান্ত হলে সমাধির ভেতর ফন শিলার আর তাঁর সঙ্গী সাথীদের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আগামি চার হাজার বছর ওখানে ওদেরকে থাকতে হবে। আপনমনে হাসলো নিকোলাস, যদিও পরক্ষণেই হাসিটা মুছে গেল। কারণ লম্বা লগটা একপাশে সরে যাচ্ছে, মনে হলো একদিকের পাহাড়-প্রাচীরে ধাক্কা খাবে।

গড়ান দিয়ে লগের আরেক দিকে চলে এলো নিকোলাস, পানিতে ঘন ঘন পা ছুঁড়ছে। বেঢপ ভেলা সাড়া দিল, তীব্র স্রোত থাকা সত্ত্বেও আবার সোজা হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে শিখছে নিকোলাস কীভাবে লগটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, সে সঙ্গে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওর মনে হলো এটায় চড়ে মঠ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। এমন কী এ গতিতে রোয়েন আর মারটিরে চেয়ে আগেও পৌঁছে যেতে পারে।

সামনে তাকিয়ে গহ্বরের এ অংশটুকু চিনতে পারলো নিকোলাস। টাইটার হ্রদের উপর এটা একটা মোচড় বা বাঁক। দু এক মিনিটের মধ্যে ওখানে পৌঁছে যাবে ও। ধারণা করলো, ঝুলন্ত দোলনা আর কপিকলটা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে।

ভারসাম্য ঠিক রেখে লগের মাঝখানে সোজা হওয়ার চেষ্টা করলো নিকোলাস, ঘন ঘন পাতা ফেলে চোখ থেকে পানি সরালো। টাইটার হ্রদের উপর জলপ্রপাতের মাথাটা দেখতে পেল, ওর দিকে ছুটে আসছে, নিচে খসে পড়ার জন্য শক্ত করলো নিজেকে।

ওর সামনে ছুটন্ত, দীর্ঘ, মসৃণ জলরাশি উন্মুক্ত হলো, পানির সঙ্গে শূন্যে লাফ দেওয়ার মুহূর্তে নিচের পাথুরে বেসিনটা এক পলকের জন্য দেখতে পেল নিকোলাস। ওর ধারণা ভুল, ঝুলন্ত মাচাগুলো বন্যার তোড়ে এখনো পুরোপুরি ভেসে যায় নি, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিচের অংশটা নেই, তবে ওপরের অংশ মাতালের মতো পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে দোল খাচ্ছে, ছুটন্ত পানি প্রায় ছুঁয়ে। অন্তত দু জন লোক ওই ভঙ্গুর কাঠামোয় আটকা পড়ে গেছে, নড়বড়ে কপিকলের একটা খুঁটি ধরে জ্বলে আছে কোনো রকমে।

পলকের জন্য তামাটে বেরেট-এর নিচে স্টীল-রিম চমশা ঝিক করে উঠতে দেখলো নিকোলাস, বুঝতে পারলো খুঁটির মাথার কাছে লোকটা কর্নেল নগু। নগু খুঁটিটার মাথা থেকে লাফ দিয়ে পাহাড়-প্রাচীরের চূড়ায় উঠলেন, অদৃশ্য হয়ে গেলেন নিকোলাসর দৃষ্টিসীমা থেকে। বিপুল জলরাশির সঙ্গে খসে পড়ছিল নিকোলাস, লগটা গোত্তা খাওয়ার ভঙ্গিতে নিচে নেমে ডুব দিল পানিতে। তারপর ওটার ডিগবাজি খাওয়া শুরু হলো, শক্ত ডাল ধরে মাঝখানে জ্বলে রয়েছে ও। মাত্র দু বার ডিগবাজি খেয়ে সোজা হয়ে গেল লগ। স্রোত আবার ওটাকে পেয়ে বসলো।

টাইটার পুল দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস। সমাধির প্রবেশপথ, টানেলের মুখটা, পুরোপুরি ডুবে গেছে-পানির সারফেস থেকে এখন সেটা অন্তত পঞ্চাশ ফুট নিচে। উল্লাস অনুভব করলো ও, এখন আর কারো পক্ষে সমাধির ভেতর ঢোকা সম্ভব নয়। ওর দৃষ্টি পাহাড়-প্রাচীরের গা বেয়ে ওপরে উঠলো। অবশিষ্ট মাচাগুলো ভেঙে পড়ছে, ফোকর থেকে বেরিয়ে আসছে বাঁশগুলো। অপর লোকটা এখনো খুঁটির উপর ঝুলছে, তবে এ খুঁটিটা পাহাড়-প্রাচীরের চূড়া পর্যন্ত পৌঁছায় নি। পানি থেকে বিশ ফুট উপরে রয়েছে সে, বাতাসে কাত হওয়া উঁচু বাঁশের আগায় বসা বিড়ালের মতো লাগছে তাকে। খুঁটির নিচের অংশ পানিতে ডোবা, স্রোত ওটাকে ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। চোখ ফিরিয়ে নেবে নিকোলাস, খুঁটির উপর থেকে ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো লোকটা।

হেলম্! জ্যাক হেলম্! লোকটাকে চিনতে পেরে নিকোলাসের শরীরে যেনো আগুন ধরে গেল। কিশোর উপাসক তামেরের কথা মনে পড়ে গেল পাথর ধসে চাপা পড়ে মারা গেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো টিসের ক্ষতবিক্ষত চেহারা। পানিতে পা ছুঁড়ে লগটাকে ঘোরাবার চেষ্টা করলো নিকোলাস, ওই খুঁটির নিচে পৌঁছতে চায়। লম্বা একটা বাঁশ দেখতে পেয়ে তুলে নিল হাতে। বাগিয়ে ধরল ওটা খোঁচা দিল খুঁটির গায়ে ঝুলে থাকা হেলমের নিতম্বে। পাকা আমের মতো খসে পড়লো হেলম, ঝপাৎ করে পানিতে পড়লো।

লগ সোজা করে নিল নিকোলাস, স্রোতের টানে আবার ওটা ছুটছে। হাতের বাঁশটা আবার বাগিয়ে ধরে চারদিকের পানিতে চোখ বুলাচ্ছে ও। ওর একেবারে কাছে পানি থেকে মাথা তুললাম হেলম্, তুলতেই খুলিল উপর বাঁশটা সবেগে নামিয়ে আনলো নিকোলাস।

খুলি নয়, বাঁশটা ফেটে গেল। আবার ডুব দিয়েছে হেলম্। নিকোলাসও বাঁশটা উল্টো করে নিয়ে অপেক্ষা করছে। দ্বিতীয়বারও কাছাকাছি মাথাচাড়া দিল আমেরিকান কসাই। আবার আঘাত করলো নিকোলাস। এবার কপালে লাগলো। খুলি ফাটার আওাজ পেল নিকোলাস। পানির নিচে তলিয়ে গেল হেলম, ঢিল পড়লো নিকোলাসের পেশীতে। কয়েক সেকেন্ড পর চোখের কোণ দিয়ে দেখলো লগের এক প্রান্তে একজোড়া হাত। ঝট করে সেদিকে তাকালো ও। মাথা আর কপাল থেকে হড়হড় করে রক্ত বের হচ্ছে, তারপরও লগে ওঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে হেলম্। এগিয়ে এসে তার হাতের উপর বাঁশ দিয়ে বাড়ি করছে হেলম। এগিয়ে এসে তার হাতের উপর বাঁশ দিয়ে বাড়ি মারলো নিকোলাস। একটা হাতের কব্জি গুঁড়ো হয়ে গেল। পরবর্তী বাড়িটা আবার পড়লো মাথায়। এবার হলুদ মগজ দেখতে পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল নিকোলাস।

পেছনে ফিরে বলল, শব্দ শুনে মনে হয় টুমা ন জিতে গেছে। ফন শিলার আর শয়তান মিশরীয়টার কী খবর, কে জানে।

সমাধিতে আর ঢোকা হচ্ছে না বাবাজিদের। অবশ্য, আবার বাধা দিলে আলাদা কথা। আচমকা চিন্তাটা এলো তার মাথায়। আরে, যখন নদী খুলে গেল, তখন আবার শিলার সমাধিতে ছিলেন না তো? মুচকে হেসে মাথা নাড়লো নিকোলাস।বেশি আশা করে ফেলছি। এতো ন্যায় বিচার নাও হতে পারে!

মঠের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে, ব্যথায় কাতড়ে উঠছে থেকে থেকে।

*

টানেলের একটা বাঁক ঘুরে ছুটে এলেন নাহুত গাদ্দাবি, ফন শিলারের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। বৃদ্ধ কোনো সাহায্যে আসবেন না, এ কথা জানা সত্ত্বেও তার উপস্থিতিতে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলেন তিনি। হানশিত না থাকায় টানেলের এ গোলকধাঁধা ভৌতিক একটা জায়গা হয়ে উঠেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও পরস্পরকে তাঁরা জড়িয়ে ধরে থাকলের জঙ্গলে পথ হারানো এক জোড়া বালকের মতো।

সামান্য কিছু অলঙ্কার এখনো ফেলে দেন নি ফন শিলার। মামোসের সোনার তৈরি বাঁকা লাঠিটা এখনো তার হাতে। স্যুটের পকেটগুলো ফুলে রয়েছে গহনায়। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধমকের সুরে জানতে চাইলেন, হানশিত কোথায়? আমাকে ফেলে আপনি ছুটছিলেন কেন? ইডিয়েট, বিপদটা বুঝতে পারছেন না? টানেল থেকে বের হবার উপায় কী?

আমি কী করে জানব… রেগেমেগে শুরু করলেও, ফন শিলারের পেছনের দেয়ালে চক মার্ক দেখে থেমকে গেলেন নাহুত। আগেও এগুলো লক্ষ্য করেছেন, তবে তাৎপর্যটুকু ধরতে পারেন নি। চিন্তা করবেন না, হারপার নিকোলাস আমাদের জন্য চিহ্ন রেখে গেছে। আসুন! টানেল ধরে দ্রুত পায়ে এগুলেন তিনি। প্রতিটি বাকে পৌঁছে চক মার্ক দেখে নিচ্ছেন।

এ ভাবে মাঝখানের সিঁড়িতে পৌঁছলেন ওঁরা, তবে হানশিত ওঁদেরকে ছেড়ে যাবার পর ইতোমধ্যে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে লম্বা গ্যালারিতে নেমে এলেন দু জন, নামার সময় শুনতে পেলেন নদীর হিসহিস আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে মনে হচ্ছে ঘুমন্ত একা ড্রাগন নিঃশ্বাস ফেলছে।

নাহুত ছুটলেন। হোঁটচ খেতে খেতে তার পিছু নিলেন ফন শিলার, প্রাচীন পা দুটো ভয়ে দুর্বল হয়ে গেছে।

দাঁড়ালো! প্লিজ, দাঁড়ান! সুরটা এখন আর ধমকের নয়, করুণা ভিক্ষার; কিন্তু শুনেও শুনছেন না নাহুত। প্লাস্টার-সীলড ডোরওয়ের কাছে পৌঁছে মাথা নিচু করলেন তিনি, দেখলেন ল্যান্ডিঙের উপর জেনারেটরটা এখনো চলছে, সারি সারি বালবও জ্বলছে ছাদের উপর।

ছুটে বাঁক ঘুরলেন নাহুত, তাঁর নিচে টানেলটা ডুবে গেছে বুঝতে পেরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সিঙ্কহোল বা ভাসমান সেতুর কোনো চিহ্নমাত্র নেই কোথাও, পন্টুনগুলো কম করেও পঞ্চাশ ফুট পানির নিচে ডুবে গেছে। ডানডেরা নদী, সহস্র বছরের প্রহরী, আবার তার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। গাঢ় ও দুর্ভেদ্য, সমাধির প্রবেশপথ সীল করে দিয়েছে, ঠিক যেভাবে চার হাজার বছর আগে দিয়েছিল। হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! আমাদের উপর রহম করো! ফিসফিস করছেন নাহুত।

বাঁক ঘুরে এগিয়ে এলেন ফন শিলার, নাহুতের পাশে দাঁড়ালেন। জলমগ্ন শ্যাফটের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছেন দু জনেই। তারপর পাশের দেয়ালে হেলান দিলেন ফন শিলার। আমরা আটকা পড়েছি, বিড়বিড় করলেন তিনি, শুনে দেয়ালে ঘষা খেয়ে বসে পড়লেন নাহুত। নাকি সুরে প্রার্থনা করছেন, অভিমানী শিশুর কান্নার মতো লাগলো শুনতে।

থামুন! হিসহিস করলেন ফন শিলার। প্রার্থনায় কোনো কাজ হবে না। বাঁকা লাঠিটা দিয়ে নাহুতের পিঠে সজোরে আঘাত করলেন। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলেন নাহুত, ক্রল করে পিছিয়ে যাচ্ছেন। বের হওয়ার কোনো না কোনো রাস্তা নিশ্চয়ই আছে, বললেন ফন শিলার। আসুন, খুঁজে বের করি। কোথাও বাঁক থাকলে নিশ্চয়ই ভেতরে বাতাস ঢুকছে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। ব্লোয়ার ফ্যানটা বন্ধ করুন, বাতাস নিজে থেকে নড়ে কিনা বুঝতে হবে।

শিলারের নির্দেশ পেয়ে ছুটলেন নাহুত, ফ্যানটা বন্ধ করলেন।

আপনার কাছে সিগারেট লাইটার আছে, বললেন ফন শিলার, তারপর নিকোলাসের ফেলে যাওয়া কাগজ আর ফটোগ্রাফগুলো দেখালেন। আগুন জ্বালুন। ধোয়া দেখে বুঝতে চেষ্টা করি বাতাস কোন দিকে বইছে।

পরবর্তী দু ঘণ্টা ধরে সমাধির সবগুলো লেভেলে ঘুরে বেড়ালেন ওঁরা, উঁচু করা হাতে ধরে আছেন জ্বলন্ত কাগজ, ধোয়ার গতিপথের উপর নজর রাখছেন। কিন্তু টানেলের কোথাও বাতাসের কোনো নড়াচড়া নেই। ক্লান্ত হয়ে আবার ওঁরা ফিরে এলেন জলমগ্ন শ্যাফটের কিনারায়।

শান্ত পানির ওপারে তাকিয়ে থেকে ফন শিলার বিড়বিড় করলেন, ওটাই একমাত্র পথ।

হানশিত হয়তো ওইপথেই বেরিয়ে গেছে, সায় দেয়ার সুরে বললেন নাহুত।

কিছুক্ষণ আর কোনো কথা হলো না। সমাধির ভেতর সময় বোঝা যাচ্ছে না। নদী নিজের লেভেলে স্থির হয়ে আছে, টানেলের ভেতর সারফেসে কোনো আলোড়ন নেই। মুদু সিঙ্কহোলের নিচে, স্রোত বইছে, তারই কোমল হিসহিস আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন নাহুত, জেরারেটরের ফুয়েল ফুরিয়ে আসছে।

খানিক পর অন্ধকার হয়ে যাবে টানেলগুলো।

আবার কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বললেন না। তারপর অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন ফন শিলার। আপনাকে সাঁতরাতে হবে। যেভাবেই হোক শ্যাফটের বাইরে বেরিয়ে লোকজনের সাহায্য চাইতে হবে। আমি আপনাকে অর্ডার করছি!

চোখে অবিশ্বাস, শিলারের দিতে তাকিয়ে থাকলেন নাহুত। দূরত্বটা আন্দাজ করতে পারছেন? টানেলের মুখ একশো গজ দূরে। একশো গজ যদি পার হতে পারি, বাইরে বেরিয়ে বাতাস পাব না-বন্যায় ভরাট হয়ে গেছে নদী।

লাফ দিয়ে সোজা হলেন ফন শিলার, হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে নাহুতের দিকে ঝুঁকলেন। হানশিত ওই পথে বেরিয়ে গেছে। আপনাকেও তাই করতে হবে। সাঁতার কেটে টানেল থেকে বেরিয়ে যাওয়া এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। কর্নেল নগু আর হেলকে নদীর পাশেই কোথাও পাবেন। হেলম্ জানে কী করতে হবে। আমাকে এখান থেকে বের করার ব্যবস্থা করবে সে।

আপনি একটা উন্মাদ! পিছু হটছেন নাহুত।

ফন শিলারও সামনে বাড়ছেন। আমি আপনাকে হুকুম করছি, নাহুত! আপনি আমার বেতন ভোগী কর্মচারী, ভুলে যাবেন না। আমি যা বলব আপনাকে তাই করতে হবে। আমি আপনার মনিব! নামুন, লাফ দিন পানিতে!

বুড়ো বলে কি! টানেলের মেঝেতে ঘষা খেয়ে এখনো পিছু হটছেন নাহুত।

সোনার বাঁকা লাঠিটা অত্যন্ত ভারী, সেটা দিয়ে নাহুতের কাঁধে বাড়ি মারলেন ফন শিলার। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন নাহুত। দ্বিতীয় বাড়িটা লাগলো তাঁর নাকে, নরম হাড় ভেঙে গেল, ফুটো দিয়ে হড়হড় করে রক্ত বের হচ্ছে। চিৎকার করছেন ফন শিলার। মেরে ফেলব। মেরে ফেলব। এখনো কথা শোন, তা না হলে মেরে ছাতু বানিয়ে ফেলব। আক্ষরিক অর্থে বানাচ্ছেনও তাই, একের পর এক আঘাত করে রক্তাক্ত করছেন নাহুতকে।

থাকুন! আহত ঘোড়ার মতো চিচি করছেন নাহুত। না, প্লিজ, থামুন! শুনব, যা বলেন শুনব! দয়া করে আর মারবেন না! মেঝেতে ঘষা থেকে থেকে শিলারের কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন, কোমর সমান পানিতে পৌঁছে থামলেন। আমাকে তৈরি হবার সময় দিন, হের ফন শিলার প্লিজ।

লাঠিটা আবার মাথার উপর তুলে এগিয়ে এলেন ফন শিলার। এক্ষুনি! আমার হুকুম, এক্ষুনি যান। আমি জানি চেষ্টা করলে টানেলের খোলা মুখ আপনি খুঁজে পাবেন। আমার ধারণা ওখানে কিছু বাতাস আটকা পড়েছে, শ্বাস নিতে পারবেন। তারপর বেরিয়ে যাবেন বাইরে। যান যান!

আঁজলা ভরা পানি তুলে মুখের রক্ত ধুলেন নাহুত। একটু সময় দিন, কাতর অনুনয় করলেন তিনি। জুতো আর কাপড়-চোপড় খুলতে হবে। আসলে সময়। নিতে চাইছেন তিনি।

কিন্তু পানি থেকে তাকে উঠতে দেবেন না ফন শিলার। যা করার ওখানে দাঁড়িয়েই করুন, নির্দেশ দিলেন, মারমুখো ভঙ্গিতে আবার লাঠিটা তুললেন মাথার উপর।

নাহুত বুঝতে পারলেন সোনার লাঠিটা মাথায় নেমে এলে খুলিটা গুঁড়ো হয়ে যাবে। পানির কিনারায় হাঁটু ডুবে গেছে তাঁর, এক পায়ে দাঁড়িয়ে অপর পায়ের জুতো খুলছেন। তারপর, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধীরে ধীরে শুধু আন্ডার প্যান্ড ছাড়া সমস্ত কাপড় গা থেকে খুলে ফেললেন। তার কাঁধের চামড়া থেঁতলে গেছে লাঠির আঘাতে, পিঠ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বুড়ো শয়তান বলে মনে মনে গাল দিচ্ছেন ফন শিলারকে। বুঝতে পারছেন, অন্তত নির্দেশ পালনের ভান না করে কোনো উপায় নেই। পানির নিচে ডুব দেবেন, টানেল ধরে কিছু দূর এগোবেন, পাশের দেয়াল ধরে অপেক্ষা করবেন কিছুক্ষণ, তারপর মাথা তুলে আবার ফিরে আসবেন।

গো! হুঙ্কার ছাড়ছেন ফন শিলার। আপনি আমার সঙ্গে চালাকি করছেন। সময় নষ্ট করে কোনোই লাভ নেই। ভুলেও ভাববেন না পানি থেকে আপনাকে আমি উঠতে দেব।

পানির আরো নিচে নেমে এলেন নাহুত, এবার তার বুক ডুবে গেল। বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন কয়েকবার। তারপর দম আটকে ডুব দিলেন সারফেসের নিচে। কূলের কিনারায় অপেক্ষা করছেন ফন শিলার, গাঢ় পানির নিচে নাহুতকে দেখতে পাচ্ছেন না। শুধু লক্ষ্য করলেন নাহুতের রক্ত সারফেসের রঙ বদলে দিচ্ছে।

এক মিনিট পার হলো। তারপর হঠাৎ পানির নিচে একটা তীব্র আলোড়ন উঠলো। গাঢ় সারফেসের উপর খাড়া হলো একটা ফর্সা বাহু, হাত ও আঙুল আবেদনের ভঙ্গিতে নড়ছে। তারপর আবার ধীরে ধীরে ডুবে গেল পানির নিচে।

গলা লম্বা করে সামনে এক পা বাড়লেন ফন শিলার। নাহুত! রাগে কাঁপছেন তিনি। আবার চালাকি শুরু করেছেন?

পানির নিচে আরেকটা জোরালো আলোড়ন উঠলো। সারফেসের নিচে আয়নার মতো কী যেনো ঝিক করে উঠলো।

নাহুত! গলা ফাটালেন ফন শিলার।

যেন তার ডাকে সাড়া দিয়েই পানির উপর মাথাচাড়া দিলেন নাহুত। তাঁর ত্বক মোমের মতো হলদেটে দেখাচ্ছে, সমস্ত রক্ত যেনো শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে, মুখটা চিৎকার করার ভঙ্গিতে পুরাপুরি খোলা, অথচ কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। তার চারপাশের পানি টগবগ করে ফুটছে, যেনো বড় আকৃতির মাছের একটা ঝাঁক পানির নিচে ভোজনে মত্ত। ফন শিলার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন, নাহুতের মাথার চারপাশ থেকে গাঢ় একটা ঢেউ জাগলো পানিতে, সেই সঙ্গে লাল গোলাপ পাপড়ির রঙ পেল সারফেস। প্রথম এক মুহূর্ত ফন শিলার বুঝতেই পারলেন না যে ওটা আসলে নাহুতের রক্ত।

তরপর তিনি দেখতে পেলেন সরীসৃপ আকৃতির লম্বাটে প্রাণীগুলো ছুটোছুটি করতে পানির তলায়, মোচড় খাচ্ছে, পেঁচিয়ে ধরছে নাহুতকে, কামড় দিয়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলছে তার মাংস। একটা হাতাবার উঁচু করলেন নাহুত, এবার সেটা শিলারের দিকে লম্বা করলেন, যেনো সাহায্যের আশায়। হাতটা অক্ষত নয়, কয়েক জায়গায় অর্ধচন্দ্র আকৃতির ক্ষত দেখা গেল-মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে।

আতঙ্কে চেঁচাচ্ছেন ফন শিলার, পুল থেকে পিছিয়ে আসছেন। নাহুতের চোখ দুটো বিশাল দেখাচ্ছে, দৃষ্টিতে অভিযোগ। শিলারের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, গলা থেকে উন্মত্ত যে চিৎকারটা বের হচ্ছে সেটাকে মানুষের বলে চেনার উপায় নেই।

বিশাল এক ট্রপিক্যাল ঈল সারফেসের নিচ থেকে মাথা তুললাম, হ্যাঁ করে আছে, ভাঙা কাঁচের মতো দাঁতগুলো চকচক করছে। খোলা চোয়ালে পুরে নিল নাহুতের গলা। কুৎসিত প্রাণীটাকে গলা থেকে ছাড়াবার কোনো চেষ্টাই করলেন না। নাহুত। প্রকান্ড ঈল মোচড় খাচ্ছে, ঘন ঘন কুণ্ডলী পাকাচ্ছে, দাঁত দিয়ে বিচ্ছিন্ন। করতে চাইছে গলার মাংস, আর নাহুতের চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তাকিয়ে আছেন শিলারের দিকে।

ধীরে ধীরে নাহুতের মাথা আবার পানির নিচে তলিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সারফেসের তলায় আলোড়িত হলো পানি, মাঝে মধ্যে দু একটা ঈলের চকচকে ও পিচ্ছিল গা ভেসে উঠলো পানির উপর। তারপর ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো পানি, এক সময় আয়নার মতো স্থির ও মসৃণ দেখালো আবার।

ঘুরে দৌড় দিলেন ফন শিলার। টানেল বেয়ে উঠে এলেন ল্যান্ডিঙে, ওখানে জেনারেটরটা এখনো সচল রয়েছে। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না তিনি, শুধু জানেন সিঙ্কহোলের কাছ থেকে যতোটা সম্ভব দূরে পালাতে হবে তাঁকে। সামনে খোলা কোনো প্যাসেজ পেলেই হলো, ছুটছেন সেটা ধরে। মাঝখানের সিঁড়িটার গোড়ায় পৌঁছে টানেলের এক কোণে ধাক্কা খেলেন, ছিটকে পড়লেন মেঝের উপর। কপালটা আলুর মতো ফুলে উঠলো।

কিছুক্ষণ পর সোজা হলেন তিনি, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন। দিশেহারা ও বিভ্রান্ত, কল্পনার চোখে অবাস্তব সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন। নিজেই বুঝতে পারছেন, পাগল হতে আর বেশি দেরি নেই তার। বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন, এক সময় আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি পেলেন না। তবু থামছেন না, হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছেন।

খাড়া শ্যাফট বেয়ে টাইটার গ্যাস ট্র্যাপে নামার সময় হড়কে গেল শরীরটা। ধাপ বেয়ে গড়িয়ে নিচে নামলেন। তারপর অনেক কষ্টে দাঁড়ালেন। টলতে টলতে কীভাবে তোরণটার কাছে পৌঁছলেন, নিজেও বলতে পারবেন না। তোরণ পেরিয়ে ফারাও মামাসের সমাধিতে ঢুকলেন তিনি।

তারপরই ম্লান হয়ে গেল বালবের আলো। হলুদ আভা ছড়াচ্ছে শুধু। আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললেন ফন শিলার। এরপর কী ঘটবে জানেন। খানিক পর ঘটলও তাই, নিভে গেল বালব, পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল সমাধি। আবার তিনি ছুটলেন, তবে কয়েক পা এগুবার পরই ধাক্কা খেলেন কিছু একটার সঙ্গে, ছিটকে পড়লেন।

খুলি ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। পড়ার পর আর নড়ছেন না তিনি। কতক্ষণ পর মৃত্যু আসবে? ভাবছেন তিনি। কয়েক দিন লাগতে পারে, এমন কী কয়েক সপ্তাহ লাগাও বিচিত্র নয়। কিসের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন বোঝার জন্য অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন। গাঢ় অন্ধকার, কাজেই হাত দিয়ে ছোঁয়ার পরও মামোসের পাথুরে শবাধারটা চিনতে পারলেন না। নিরাপদ মনে করে হোক বা অন্য কিছু ভেবে, কফিনটার ভেতর ঢুকলেন ফন শিলার। চুপচাপ শুয়ে থাকলেন তিনি, তাঁর চারদিকে একজন প্রাচীন সম্রাটের সমাধি সম্পদের স্তূপ। ধীর, অনিস্বীকার্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে ফন শিলারের জন্য।

 ৮. সেন্ট ফুমেনথিয়াসের মঠ

সেন্ট ফুমেনথিয়াসের মঠ খালি হয়ে গেছে। গিরিখাদের নিচে তুমুল : যুদ্ধের আওয়াজ শুনে সন্ন্যাসীরা নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়েছেন।

তোরণশোভিত খালি উদ্যান ধরে ছুটলো নিকোলাস, দম নেয়ার জন্য থামলো সিঁড়ির মাথায় এসে। এ সিঁড়ি নীলনদের লেভেল পর্যন্ত নেমে গেছে, ওখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে বোটগুলো। হাঁপাচ্ছে নিকোলাস, ওর নিচের গভীর বেসিনে চোখ বুলাচ্ছে, যেখানে সূর্যকিরণ প্রায় সময় পৌঁছতেই পারে না। জোড়া জলপ্রপাত থেকে ছড়িয়ে পড়া রূপোলি জলকনা সচল মেঘের মতো খাদের গভীরতা ঢেকে রেখেছে, জানার কোনো উপায় নেই রোয়েন আর ড্যানিয়েল ওর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছে কিনা, নাকি ট্রেইল ধরে মঠে পৌঁছুবার সময় তারা কোনো বিপদে পড়েছে।

তারপর হঠাৎ রোয়েনের গলা ভেসে এলো নিচে থেকে, ওর নাম ধরে ডাকছে। ঘন কুয়াশার মতো সচল জলকণার নিচ থেকে আসছে ডাকটা।

নিকোলাস, ওহ, নিকোলাস। তারপর সিঁড়ির ধাপে দেখা গেল ওকে, দ্রুত উঠে আসছে। থ্যাঙ্ক গড! ধরেই নিয়েছিলাম আপনাকে আর পাব না! ছুটে এসে নিকোলাসের গায়ে আছাড় খেলো ও। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ওরা, রোয়েন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বাকি সবাই কোথায়? খানিক পর নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

নিকোলাসের হাত ধরে সিঁড়ির ধাপে পা রাখলো রোয়েন। নিচে আসুন। সবাই ওরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ড্যানিয়েল আর মেক বোটে বাতাস ভরেছেন। ক্রেটগুলো তোলা হচ্ছে এখন।

টিসে?

ভালো আছে।

সিঁড়ির শেষ কটা ধাপ টপকে এলো ওরা। শেষবার যখন দেখেছিল নিকোলাস, তারচেয়ে দশ ফুট উঁচু হয়েছে এখানে নীলনদ। নদী এখন উন্মত্ত, গতিও তীব্র। সচল জলকণার ভেতর দিয়ে কোনোরকমে পাহাড়-প্রাচীরের গা দেখা যায়।

সাতটা রাবার বোট কিনারায় টেনে আনা হয়েছে। এরই মধ্যে চারটেতে বাতাস ভরা হয়েছে, কমপ্রেসড এয়ার সিলিন্ডারের সাহায্যে বাকিগুলোতেও বাতাস ভরার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাতাস ভরা চারটে বোটে ক্রেটগুলো তোলার পর এ মুহূর্তে সেগুলো নাইলন কার্গো নেট দিয়ে সুরক্ষিত করা হচ্ছে। এগিয়ে এসে মেকের কাঁধে হাত রাখলো নিকোলাস, বলল, ধন্যবাদ, বন্ধু। তোমার গেরিলারা বীরের মতো লড়েছে। তুমি আমার জন্য অপেক্ষাও করেছ। পাহাড়-প্রাচীরের সরু কার্নিসে শুয়ে-বসে থাকা গেরিলাদের দিকে তাকালো ও। কয়জনকে হারিয়েছ তুমি, মেক?

তিনজন মারা গেছে, ছয় জন আহত হয়েছে, বলল মেক। আরো বেশি ক্ষতি হতে পারত, কর্নেল ন যদি আরো জোরে ধাওয়া করতেন।

তবু এ-ও অপূরণীয় ক্ষতি, বলল নিকোলাস।

হ্যাঁ, কোনো মৃত্যুরই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়, সায় দিল মেক।

মেক, তোমার বাকি লোকজন কোথায়?

সীমান্তের দিকে রওনা হয়ে গেছে। শুধু বোটগুলো হ্যাঁন্ডেল করার জন্য কয়েকজনকে রেখে দিয়েছি। নিকোলাসের হাত ধরে কয়েক পা হেঁটে এলো মেক, গলা খাদে নামিয়ে বলল, বিপদ এখনো কাটে নি, নিকোলাস।

জানি, মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। কর্নেল নগু এখনো বেঁচে আছে।

শুধু তাই নয়, বলল মেক। অন্তত পুরো একটা কোম্পানি নিয়ে নদীর ভাটি পাহারা দিচ্ছে। আমার স্কাউটরা রিপোর্ট করেছে, দুই পাড়ের ট্রেইলের পজিশন নিয়ে আছে তারা।

আমাদের বোটের কথা কর্নেল জানে না, জানে কি? নিকোলাসের চোখে কঠিন দৃষ্টি।

জানার তো কথা নয়, বলল মেক। কিন্তু আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক কথাই তার জানার কথা ছিল না, অথচ জেনে ফেলেছে। আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে তার হয়তো কোনো ইনফর্মার ছিল। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলো সে, তারপর আবার বলল, কর্নেলের কাছে এখনো হেলিকপ্টার আছে, নিকোলাস। মেঘ কেটে গেলেই নদীতে আমাদেরকে দেখতে পাবে।

নদীই আমাদের একমাত্র এস্কেপ রুট। আশা করা যাক আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।

সবগুলো বেটে বাতাস ভরার কাজ শেষ হলো। একটা বোটে তোলা হলো টিসেকে, স্ট্রেচার সহ। তারপর ধরাধরি করে বোটের কাছে নিয়ে আসা হলো আহত দু জন গেরিলাকে, বাকি সবাই হাঁটতে পারছে। কাজটা শেষ হতে আবার নিকোলাসের কাছে ফিরে এলো মেক। তোমার রেডিও দেখছি ফিরে পেয়েছ, ক্যারিয়ার স্ট্র্যাপের সঙ্গে ফাইবার গ্লাস কেসটা নিকোলাসের কাঁধে ঝুলতে দেখে বলল সে।

এটা ছাড়া বিপদ এড়ানো যাবে না, জবাব দিল নিকোলাস। মেক, তুমি টিসেরবোটে থাকো। সামনের বোটে আমি রোয়েনকে নিয়ে থাকব।

আমাকে সামনে থাকতে দিলে ভালো হত, বলল মেক।

নদী সম্পর্কে কী জানো তুমি? নিকোলাস হাসছে না। এই নদী পথে একমাত্র আমিই আসা-যাওয়া করেছি।

সে তো বহু বছর আগের কথা, বলল মেক।

তখন আরো অনভিজ্ঞ ছিলাম। মেক, তর্ক করো না। আমার পেছনে থাকবে তুমি, তোমার পেছনে ড্যানিয়েল। তোমার গেরিলাদের মধ্যে আর কেউ আছে, এ নদী সম্পর্কে ধারণা রাখে?

আমার সব লোকই ধারণা রাখে, বলে নিজের লোকদের উদ্দেশে তাঁক-ডাক শুরু করলো মেক। চারজন গেরিলা ছুটে এসে বাকি চারটে বোটে উঠে পড়লো। সবাই যার যার বোটে চড়েছে কিনা দেখে নিয়ে, সবার শেষে নিজের বোটে উঠলো নিকোলাস। ওর নির্দেশ প্রত্যেকে বৈঠা হাতে নিল, টিসে আর আহত গেরিলা দু জন। বাদে।

মেক মিছে গর্ব করে নি, গেরিলারা সত্যি সত্যি দক্ষ হাতে বৈঠা চালাচ্ছে। দেখতে না দেখতে নীলনদের মূল স্রোতে গিয়ে পড়লো সাত বোটের ছোট্ট বহরটা।

প্রতিটি বোটে ষোলোজন লোকের জায়গা হবার কথা, সে তুলনায় লোক বা কার্গো কমই তোলা হয়েছে। কোনো বোটেই নয়জনের বেশি লোক নেই। তবে গুপ্তধন ভর্তি ক্রেটগুলো কম ভারী নয়।

সামনে বিপজ্জনক পানি, রোয়েনকে গম্ভীর সুরে বলল নিকোলাস। সেই সুদান সীমান্ত পর্যন্ত। বোটের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ও, হাতে হাল, সামনেটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। ওর পায়ের কাছে খুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে রোয়েন, ঝুলে আছে একটা সেফটি স্ট্র্যাপ ধরে।

জলপ্রপাতের নিচে জোরালো স্রোতটাকে আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে এলো ওরা, সরু একটা ফাঁক বরাবর বহরটাকে এক লাইন নিয়ে এলো, ওই পথে পশ্চিম দিকে ছুটছে নদী। আকাশের দিকে তাকালো ও, দেখলো পানি ভর্তি কালো মেঘ খুব নিচে নেমে এসেছে যেনো পাহাড়-প্রাচীনের চূড়াগুলোকে ছুঁয়ে দেবে।

ভাগ্য বোধহয় আমাদেরকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোয়েনকে বলল ও। এই আবহাওয়ায় হেলিকপ্টার নিয়ে বের হলেও ওরা আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।

হাতে বাধা রোলেক্সের দিকে তাকালো নিকোলাস, পানির ছিটা লেগে ঝাপসা হয়ে আছে কাঁচ। সন্ধ্যে হতে আরো দু ঘণ্টা। পেছন দিকে তাকালো ও। বাকি বোটগুলো ডুবুডুবু হয়ে অনুসরণ করছে ওদেরকে। বোটগুলো হলুদ রঙের, গিরিখাদের ঘাঢ় ছায়া আর কুয়াশার ভেতরও পরিষ্কার দেখা যায়। একটা হাত তুলে নাড়লো নিকোলাস, উত্তরে দ্বিতীয় বোট থেকে মেকও তাই করলো। দাড়ির ভেতর তার হাসি দেখতে পেল নিকোলাস।

নদী এরপর এঁকেবেঁকে, মোচড় খেয়ে এগিয়েছে। কোথাও কোথাও বোল্ডারের মাঝখান দিয়ে সরু পথ ধরে এগুতে হলো ওদেরকে। স্রোত এতো তীব্র, বৈঠা না চালালেও বোট ছুটছে। গিরিখাদের ভেতর বর্ষার পানি ঢোকায় নদীর উপর জেগে থাকা অনেক ক্ষুদে দ্বীপ বা বড় আকারের বোন্ডার ডুবে গেছে, তবে সারফেসের ঠিক নিচেই রয়েছে ওগুলো, বোঝা যাচ্ছে স্রোত বাধা পেয়ে ফেনা তৈরি হতে দেখে। বন্যার পানি দু দিকের পাড় ধরেই অনেক উপরে উঠে গেছে, উপ-খাদের প্রাচীর ছুঁই-ছুই করছে। একটা বোট যদি উল্টে যায়, বা বোট থেকে কেউ যদি পড়ে যায়, পিছিয়ে গিয়ে বোট বা আরোহীকে উদ্ধার করা অন্তত এ নদীতে সম্ভব নয়।

বোটের পেছনে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। মনে মনে শিউরে উঠলো, কারণ খানিক দূর থেকে শুরু হয়েছে নদীর উন্মত্ততা। ওর গোটা জগৎ উপ খাদের আকাশ ছোঁয়া প্রাচীরের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়লো। মুখে পানির ছিটা লাগছে, নাকি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, খেয়াল থাকলো না। নদীর নিচে প্রায় খাড়া ঢাল রয়েছে, ফলে তীব্র স্রোত বোটগুলোকে উল্টে দিতে চাইছে। ঢালের নিচে সমতল সারফেসে নামার সময় একটা বোট থেকে দু জন ছিটকে পড়লো। একজন লোককে দ্রুত ধরে ফেলায় বেঁচে গেল সে, কিন্তু চৌচির হয়ে গেল খুলি। ডুব দেওয়ার পর আর সে উঠলো না। কেউ কথা বলল না বা শোক প্রকাশ করলো না। সবাই যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।

নদীর গর্জনে কান পাতা দায়। সেই শব্দকে ছাপিয়ে উঠলো রোয়েনের চিৎকার, নিকোলাস, হেলিকপ্টার!

পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় নেমে আসা কালো মেঘের দিকে তাকালো নিকোলাস, দেখতে না পেলেও এঞ্জিলের আওয়াজ ঢুকলো কানে। মেঘের আড়ালে! পাল্টা চিৎকার করলো ও, হাতের উল্টোপিঠি দিয়ে পানির ছিটা আর বৃষ্টির ফোঁটা মুছলো চোখ থেকে। এই মেঘ-বৃষ্টির মধ্যে ওরা আমাদেরকে দেখতে পাবে না।

আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় ওদের উপর দ্রুত নেমে এলো আফ্রিকান রাত্রি। ঘনায়মান সন্ধ্যায় কোনো রকম সতর্ক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আরেকটা বিপদ লাফ দিয়ে পড়লো ওদের উপর। এক মুহূর্ত আগে নদীর মর্পণ বিস্তৃতি ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছিল বোট, পর মুহূর্তে ওদের সামনে উন্মুক্ত হলো পানি, নদী ওদেরকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। তারপর মনে হলো অনন্তকাল ধরে খসে পড়ছে ওরা, অথচ পতনটা ত্রিশ ফুটের বেশি নয়। জলপ্রপাতের নিচে পড়ে ডুবে গেল ওরা, বোট, কার্গো আর আরোহী জট পাকিয়ে একাকার। নদী এখানে স্রোতবিহীন, বিরাট একটা জায়গা জুড়ে ফুঁসছে, আবার বিপুল বেগে ধাবিত হওয়ার জন্য এক করছে যেনো সমস্ত শক্তি।

একটা বোট উল্টো হয়ে ভাসছে। বাকি বোটগুলোর আরোহিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে দ্রুত বৈঠা চালিয়ে ছুটে গেল সেদিকে। পানি থেকে তুলে নিল ডুবন্ত আরোহিদের, উদ্ধার করলো ভাসমান বৈঠা আর ইকুইপমেন্ট। সবার মিলিত চেষ্টায় বোটটাকেও সোজা করা সম্ভব হলো। ইতোমধ্যে গিরিখাদ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে।

ক্রেটগুলো গুনতে হয়, নির্দেশ দিল নিকোলাস। কয়টা হারালাম?

খানিকপর ড্যানিয়েলের চিৎকার শুনে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে হলো নিকোলাসের। সব মিলিয়ে তেরোটা ক্রেট! কোনো বাক্সই পানিতে পড়ে নি, কৃতিত্বটা আসলে কার্গো নেটের। তবে সবাই ওরা সাংঘাতিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ভেজা শরীরে কাঁপছে। এ অন্ধকারে এগোনোর চেস্টা আত্মহত্যা করতে চাওয়ার নামান্তর। কাছাকাছি বোটের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে মেকের চোখে তাকালো নিকোলাস।

মেক বলল, পাহাড়ের ওদিকটার একটা ভাজে পানি খানিকটা শান্ত। হ্রদের লেজের নিকটা হাত তুলে দেখালো সে। রাত কাটানোর জন্য কার্নিস পাওয়া যেতে পারে।

ঠিক ভাঁজ নয়, পাহাড়ের গায়ে সরু একটা ফাটল দেখলো ওরা। ফাটলটার মুখেই অ্যাবস্ট্রাক্ট শিল্পকর্মের মতো উদ্ভট আকৃতির একটা গাছ, বেশ অনেকগুলো শাখা, তবে একটাতেও কোনো পাতা নেই। ওটায় বোটের রশি বাঁধল ওরা। রশির দৈর্ঘ্য কমবেশি রাখা হলো, ফলে বোটগুলো পাশাপাশি বেসে থাকছে। গরম খাবার বা পানীয় কল্পনাও করা যায় না, বেয়নেটের ডগা দিয়ে টিনের কৌটা খুলে শুকনো কিছু খাবার মুখে দিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হলো।

নিজের বোট থেকে লাফ দিয়ে নিকোলাসের বোটে চলে এলো মেক, বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে কথা বলল কানে কানে। এই মাত্র রোল কল করলাম। জলপ্রপাত থেকে পড়ার সময় আরো একজনকে হারিয়েছি আমরা। এখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

লীডার হিসেবে আমি বোধহয় ভালো করছি না, বলল নিকোলাস। কাল সকাল থেকে তুমি সামনে থাকবে।

তুমি দায়ী নও। নিকোলাসের কাঁধে চাপ দিল মেক। এরচেয়ে ভাল করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। দায়ী আসলে শেষ ওয়াটারফলটা… থেমে গেল সে, দু জনই ওরা অন্ধকারে কান পেতে জলপ্রপাতের গর্জন শুনছে।

কতদূর এলাম আমরা? জানতে চাইলো নিকোলাস। আর কতদূর যেতে হবে?

বলা প্রায় অসম্ভব, তবে আমার ধারণা অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছি। কাল দুপুরের মধ্যে সীমান্তে পৌঁছে যাব।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মেক জিজ্ঞেস করলো, ক তারিখ আজ?

ভুলে গেছি। রোলেক্সটা চোখের সামনে তুলে আলোকিত ডায়ালে তাকালো নিকোলাস। গুড গড! আজ ত্রিশ তারিখ!

তোমার পিক-আপ এয়ারক্রাফট পরশু রোজিরেস এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছবে, মনে করিয়ে দিল মেক।

হ্যাঁ, পয়লা এপ্রিলে, বলল নিকোলাস। আমরা সময় মতো পৌঁছতে পারব তো?

উত্তরটা তোমার কাছ থেকে চাই আমি, বলল মেক, কিন্তু হাসছে না।

তোমার পাইলট কতটুকু বিশ্বস্ত? পৌঁছতে দেরি করার আশঙ্কা কতটুকু?

জেনি প্রফেশন্যাল, পৌঁছতে কখনোই দেরি করেন না, জোর দিয়ে বলল নিকোলাস। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো। খানিক পর জিজ্ঞেস করলো, রোজিরেস পৌঁছে তোমাকে যদি ট্রেজারের ভাগ দিয়ে দিই, ওগুলো নিয়ে কী করবে তুমি? একটা ক্রেটে জুতোর ডগা ঠেকালো নিকোলাস। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে?

তোমাদেরকে প্লেনে তুলে দেওয়ার পর কর্নেল নগুকে পেছনে ফেলার জন্য আরো কিছুদূর ছুটতে হবে আমাদের, কাজেই অতিরিক্ত বোঝা বইতে রাজি নই। আমার ভাগ তোমার সঙ্গে থাকবে। বিক্রিও করবে তুমি এখানে যুদ্ধ চালাবার জন্য নগদ টাকা দরকার আমার।

তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?

বিশ্বাস না করলে বন্ধু কিসের!

বন্ধুদের ঠকানো সবচেয়ে সহজ-ওরা বেঈমানী আশা করে না, বলল নিকোলাস, শুনে ওর কাঁধে হালকা ঘুসি মারলো মেক।

খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। কাল হয়তো বিকেল পর্যন্ত একটানা বৈঠা চালাতে হবে। বোটের উপর দাঁড়ালো মেক। লাফ দিয়ে পাশের বোটে চলে গেল। টিসেতার জন্য অপেক্ষা করছে ওখানে।

রোয়েনের দিকে ঝুঁকে হাত বাড়াল নিকোলাস। টেনে এনে ওর দুই হাঁটুর মাঝখানে বসাল, রোয়েন বাধা না দিয়ে হেলান দিল ওর বুকে, ভেজা কাপড়ে একটু একটু কাঁপছে। খানিক পর কাঁপুনিটা বন্ধ হয়ে গেল। রোয়েন ফিসফিস করে বলল, দেখা যাচ্ছে আপনি একটা হটওয়াটার বটল।

আমাকে খুব কাছে সবসময় থাকতে দেওয়ার এটা একটা মস্ত সুবিধে, নিঃশব্দে হাসছে নিকোলাস, রোয়েনের মাথায় আদর করে হাত বুলাচ্ছে। জবাবে রোয়েন আর কিছু বলল না, তবে নিতম্ব ঘষে আরো একটা কাছে সরে এলো। আরো খানিক পর ঢিল পড়লো ওর পেশীতে, ঘুমিয়ে পড়লো নিকোলাসের বুকে মাথা রেখে।

নিকোলাসও সাংঘাতিক ক্লান্ত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাল ধরে থাকার তালুতে ফোস্কা পড়ে গেছে, তবু রোয়েনের মতো এতো সহজে ঘুমিয়ে পড়তে পারলো না। রোজিরেস এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছতে পারার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, কাজেই নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে এগোনো আর কর্নেল নগুকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা উঁকি দিচ্ছে ওর মনে। নদী আর কর্নেল নগু পরিচিত শক্ত, কাজেই কীভাবে লড়তে হবে জানে। কিন্তু পরিচিত শক্র ছাড়াও অন্য অনেক কিছু বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে, অচিরেই সে সবের মুখোমুখি হতে হবে ওকে।

ওর বাহুবন্ধনে বিড়বিড় করে কী যেনো বলল রোয়েন, বুঝতে পারলো না নিকোলাস। স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা, ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। আদর করে আবার ওর মাথায় হাত বুলাল নিকোলাস, স্থির হয়ে গেল রোয়েন। কিন্তু খানিক পর আবার কথা বলল ও, এবার কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পেল নিকোলাস। সত্যি আমি দুঃখিত, নিকোলাস। আমাকে ঘৃণা করবেন না। কীভাবে আপনাকে আমি এ-সব… শেষ দিকে কথাগুলো জড়িয়ে গেল, কী বলতে চায় বোঝা গেল না।

নিকোলাসের স্নায়ু টানটান হয়ে উঠেছে, রোয়েনের কথাগুলো মনের সন্দেহ আর আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। বাকি রাতটুকু প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিল ও, ঘুম এলেও খানিক পরপর ভেঙে যাচ্ছে।

*

ভোরের আলো ফুটতে একটু ধাক্কা দিয়ে রোয়েনের ঘুম ভাঙালো নিকোলাস। গত রাতের বাড়তি খাবার থেকে ঠাণ্ডা কয়েক টুকরো মুখে পুড়লো।

আবার নদীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলো। মাথার উপর মেঘ এখনো নিচে নেমে আছে, কোথাও এতোটুকু ভাঙনও ধরে নি; খানিক পর পর এক পশলা করে বৃষ্টিও হচ্ছে। সারাটা সকাল ধরে বিরতিহীন টলো বোট, ধীরে ধীরে নদীর মেজাজ শান্ত হয়ে আসছে। স্রোত এখন আর আগের মতো তীব্র নয়, পাড়গুলো নয় দুর্গম বা খাড়া।

দুপুরের দিকেও মাথার উপর মেঘ জমাট বেঁধে থাকলো। নদীর এমন একটা বিস্তৃতিতে পৌঁছল ওরা, পানি এখানে প্রবাহিত হচ্ছে অসংখ্য ব্লাফ আর হেডল্যান্ডের ভেতর দিয়ে। ইতোমধ্যে নিরাপদ পথ চিনতে দক্ষ হয়ে, উঠেছে নিকোলাস, বোধহয় সেজন্যই কোনো রকম বিপদের মধ্যে না পড়ে বিস্তৃতিটুকু পার হয়ে এলো বোটগুলো। সম্ভবত সুদানের সমতল প্রান্তরে পৌঁছতে যাচ্ছি আমরা, নদী তাই চওড়া হয়ে যাচ্ছে, রোয়েনকে বলল নিকোলাস।

রোজারিস আর কত দূরে? জানতে চাইলো রোয়েন।

তা বলতে পারব না, তবে সীমান্তের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।

নদী শান্ত হওয়ায় নিকোলাস আর মেকের বোট এখন পাশাপাশি চলে এসেছে। একটা বাঁক ঘুরলো ওরা, সামনে আরো চওড়া দেখালো নদীকে, কোথাও কোনো আলোড়ন নেই।

একটু শান্ত হলো নিকোলাস। রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলল, আগামি রবিবারে উরচেস্টারের গ্রীলে লাঞ্চ করলে কেমন হয়? লন্ডনের সেরা।

একটু হাসার আগে রোয়েনের চোখে ছায়া খেলে গেল–লক্ষ্য করলো নিকি।

শুনতে তো ভালোই লাগছে। রোয়েন বলে।

লাঞ্চের পরে বাড়ি ফিরে টিভিতে প্রোগ্রাম দেখতে পারি। অথবা, আমাদের প্রিয় একটা খেলাও খেলতে পারি!

আপনি একটা বাজে লোক! হেসে ফেললো রোয়েন। তবে শুনতে কিন্তু ভালো লাগছে।

ঝুঁকে চুমো খেতে চাইলো নিকোলাস, রোয়েনের লাজনম্র চেহারাটা পরখ করতে চাইলো–কিন্তু পরবর্তী বাঁক গুরতেই নাক বরাবর সামনে নদীর মাঝখান থেকে উথলে উঠতে দেখলো একটা ফোয়ারাকে। সচল ফোয়ারা, ওদের দিকে ছুটে আসছে। পরমুহূর্তে অটোমেটিক ফায়ারের আওয়াজ ভেসে এলো, একটা রুশ আরপিডি থেকে আসছে।

লাফ দিয়ে রোয়েনের গায়ে পড়লো নিকোলাস, নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে ফেললো ওকে, শুনতে পেল পাশের বোট থেকে গেরিলাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করছে মেক। রিটার্ন ফায়ার! মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করো ওদের।

গেরিলারা বৈঠা ফেলে দিয়ে অস্ত্র তুলে নিল হাতে। নদীর পাড় সামান্য মোচড় খেয়েছে সেই মোচড়ের ভেতরের কোণ থেকে হামলা করা হয়েছে, গেরিলারা পাল্টা গুলি করছে সে দিকে।

শত্রুপক্ষ পাথর আর ঝোঁপের আড়ালে রয়েছে, গেরিলাদের সামনে নির্দিষ্ট কোনো টার্গেট নেই। তবে এ ধরনের অ্যামবুশে পড়লে বিরতিহীন পাল্টা গুলি করার কোনো বিকল্প নেই, আক্রমণকারীরা যাতে মাথা নিচু রাখতে বাধ্য হয়, যাতে লক্ষ্যস্থির করতে না পারে।

রোয়েনের মাথার কাছে বোটের নাইলন স্কিন ভেদ করলো একটা বুলেট, মেটাল অ্যামুনিশন ক্রেটে লাগলো। বৃষ্টির মতো বুলেট ছুটে আসছে, বোটগুলোর ফুটো হওয়া ঠেকানোর উপায় নাই। একজন গেরিলার মাথায় লাগলো একটা বুলেট, খুলির উপর একটা গভীর খাল কেটে বেরিয়ে গেল, ছিটকে পানিতে পড়ে গেল লোকটা। যতটা না ভয়ে, তার চেয়ে বীভৎস দৃশ্যটা অসুস্থ করে তুললাম রোয়েনকে। নিহত লোকটার রাইফেল ঘেঁ দিয়ে তুলে নিল নিকোলাস, পাড় লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে খালি করে ফেললো ম্যাগাজিন।

বোটগুলো এখনো স্রোতের সঙ্গে ভাটির দিকে ছুটছে, কেউ হাল ধরে না থাকায় অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। অ্যামবুশকে পাশ কাটিয়ে পরবর্তী বাঁক ঘুরতে এক মিনিটের বেশি লাগলো না। খালি রাইফেল ফেলে দিয়ে মেকের দিকে তাকালো নিকোলাস। রিপোর্ট করো, মেক।

আমার বোটে একজন মারা গেছে, বলল মেক।

প্রতিটি বোট থেকে রিপোর্ট চাইলো নিকোলাস। মারা গেছে ওই একজনহ, আহত হয়েছে তিনজন। তবে আহত কারো অবস্থা গুরুতর নয়। তিনটে বোট ফুটো হয়েছে, তবে প্রতিটি খোল আলাদা আলাদা ওয়াটারপ্রুফ কমপাটমেন্ট জোড়া লাগিয়ে তৈরি হওয়ায় এখনো ভেসে আছে পানির উপর।

বোট নিয়ে নিকোলাসের পাশে চলে এলো মেক। অথচ আমি ভাবছিলাম কর্নেল নগুকে ফাঁকি দিতে পেরেছি।

প্রথম হামলাটা হালকার উপর দিয়ে গেছে. বলল নিকোলাস। নদীতে ওরা আমাদেরকে আশা করে নি, ফলে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, কর্নেল গুকে আর চমকে দেওয়া যাবে না। বাজি ধরতে পারো, রেডিওতে কথা বলছে ওরা। নগু এখন জানে কোথায় রয়েছি আমরা, যাচ্ছিই বা কোনদিকে। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো মেক। মেঘ কেটে গেলে বিপদ হবে।

সুদান সীমান্ত আর কত দূরে?

আর বোধহয় দুঘণ্টার পথ।

বর্ডার ক্রসিঙে গার্ড থাকে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

না। দু দিকেই ফাঁকা ঝোঁপ।

ফাঁকা থাকলেই হয়, বিড়বিড় করলো নিকোলাস।

গোলাগুলি থেকে যাবার ত্রিশ মিনিট পর আবার ওরা হেলিকপ্টারের আওয়াজ পেল। মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে ভাটির দিকে। বিশ মিনিট পর আবার শোনা গেল রোরের আওয়াজ, তবে এবারও মেঘের আড়ালে থাকায় দেখা গেল ণা। উজানের দিক থেকে এলো, খানিক পর আবার ভাটির দিকে গেল। নগুর মতবলটা কী বলো তো? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মেক। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে নদীর উপর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মেঘের নিচে আমাদেরকে তো দেখতে পাচ্ছে না।

নিজের লোকজনকে ভাটির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বলল নিকোলাস। আমাদের সঙ্গে বোট আছে, কোনদিকে যাচ্ছি আন্দাজ করে নিয়েছে। হয়তো রোজারিস এয়ারস্ট্রিপ সম্পর্কেও তার জানা আছে। নদীর কাছাকাছি ওটাই একমাত্র পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ। পৌঁছে হয়তো দেখবো ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

নিজের বোট আরো কাছে সরিয়ে আনল মেক, তারপর বলল, আমার ভালো ঠেকছে না, নিকোলাস। সরাসরি ওদের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছি। কিছু একটা পরামর্শ দাও।

কিছুক্ষণ চিন্তা করলো নিকোলাস। তারপর জিজ্ঞেস করলো, নদীর এ অংশটা তুমি চিনতে পারছ না? এখনো বুঝতে পারছ না ঠিক কোথায় আমরা রয়েছি?

মাথা নাড়লো মেক। সীমান্ত পার হবার সময় নদীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকি আমরা। তবে পুরানো সুগার মিলটা চিনতে পারব, ওখানে পৌঁছবার পর। এয়ারস্ট্রিপ থেকে তিন মাইল উজানে ওটা।

পরিত্যক্ত?

হ্যাঁ, বলল মেক। বিশ বছর আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই খালি।

আকাশে মেঘ থাকায় এক ঘণ্টার মধ্যে সন্ধে হয়ে যাবে, বলল নিকোলাস। নদী শান্ত, কাজেই রাতেও আমরা বোট চালাতে পারি। গুমা হয়তো তা আশা করছে না। অন্ধকারে তাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হতে পারে।

এই তোমার পরামর্শ? মেকের গলায় ক্ষোভ। এ যেনো চোখ বুজে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়া।

আরো ভালো প্ল্যান পেতে হলে তথ্য দাও আমাকে, বলল নিকোলাস। জেনি কাল কখন পৌঁছবেন জানাও। এখন ঠিক কোথায় রয়েছি বলো।

মেক কথা বলল না।

ওদের মতো গেরিলারাও খুব টেনশনে ভুগছে। সন্ধ্যে হয়ে এলেও, হাতের অস্ত্র দুই পারের দিকে তাক করে রেখেছে তারা। আরো অনেকক্ষণ পর মেক বলল, আমরা সম্ভবত এক ঘণ্টা আগেই সীমান্ত পেরিয়ে এসেছি। সুগার মিলটা আর বেশি দূরে হতে পারে না।

অন্ধকারে ওটাকে তুমি খুঁজে পাবে কীভাবে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

নদীর পারে পাথরের তৈরি একটা জেটি আছে, বলল মেক। ওখান থেকে কার্গো বোটগুলো খার্তুমে চিনি নিয়ে যেত।

ঝপ করে রাত নেমে এসে অন্ধকারে ঢেকে দিল ওদের জগৎ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিকোলাস, পাড় থেকে এখন আর ওদেরকে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার আরো একটু গাঢ় হতে বোটগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে নাইলন রশি দিয়ে বেঁধে নিল ওরা, কোনটা যাতে আলাদা হয়ে না যায়। বৈঠা চালাতে নিষেধ করলো নিকোলাস, কোনো রকম শব্দ না করাই ভালো। স্রোতের টানে নিঃশব্দে ছুটে চলছে বোটগুলো। ডানদিকের তীর ঘেঁষে যাচ্ছে ওরা, মাঝে-মধ্যেই নদীর তলায় ঘষা খেয়ে আটকে যাচ্ছে ওরা, মাঝে-মধ্যেই নদীর তলায় ঘষা খেয়ে আটকে যাচ্ছে বোট, তখন পানিতে নেমে ঠেলে গভীর জলে আনতে হচ্ছে।

অকস্মাৎ রোজিরেস-এর পাথুরে জেটি ওদের সামনে যেনো লাফ দিয়ে উদয় হলো, সময় মতো দেখতে না পাওয়ায় নিকোলাসের বোট ধাক্কা খেলো ওটার সঙ্গে। বোট থেকে কয়েকজন আরোহী ছিটকে পড়লেও, কেউ আহত হলো না। পানি এখানে কোমর সমান, বোট টেনে পাড়ে তুলতে কোনো অসুবিধে হলো না, বিশজন গেরিলাকে আখ খেতের ভেতর ছড়িয়ে দিল মেক, কর্নেল নগুর আকস্মিক হামলা যাতে ঠেকানো সহজ হয়।

রোয়েনকে, বোট থেকে নামতে সাহায্য করলো নিকোলাস, তারপর টিসেকে–নিতে এলো। হেসে উঠে নিকোলাসের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলো টিসে, জানালো নিজেই নামতে পারবে। দীর্ঘ বিশ্রামে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। তবে নিকোলাসকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না।

টিসে তীরে নামতেই নিকি তাকে জিজ্ঞেস করলো, একটা কথা, টিসে। জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি। ডেবরা মারিয়াম থেকে রোয়েন আপনাকে যে মেসেজটা পাঠাতে বলেছিলেন, সেটার কি হলো?

ও, হ্যাঁ, বলল টিসে। মিশরীয় দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাশে মুসাদকে মেসেজটা আমি জানিয়ে দিয়েছি। ফিরে এসে আপনার বান্ধবীকে বলেওছি কথাটা, উনি আপনাকে বলেন নি?

ওঁর হয়তো মনে নেই, বলে এড়িয়ে যাবার চেস্টা করলো নিকোলাস। তাছাড়া, ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু, ধন্যবাদ, টিসে।

অ্যামুনিশন ক্রেটগুলো বোট থেকে দ্রুত নামানো হলো। খালি বোট পানি থেকে তুলে লুকিয়ে রাখা হলো আখ খেতের ভেতর। অন্ধকারে কাজ চলছে, আলো জ্বালতে নিষেধ করে দিয়েছে নিকোলাস। গেরিলাদের মধ্যে ক্রেটগুলো ভাগ করে দেওয়া হলো। নিজের কাঁধে ড্যানিয়েলও একটা বাক্স তুললাম। নিকোলাসের এক কাঁধে রেডিও, অপর কাঁধে ইমার্জেন্সি প্যাক জ্বলছে, মাথায় নিয়েছে একা কেট, ফারাও-এর সোনার ডেথ-মাস্ক আর টাইটার উশব তি আছে ওটায়।

প্রথমেই স্কাউটদের ছোট একটা দলকে এয়ারস্ট্রিপে পাঠিয়ে দিল মেক, ওরা যাতে অ্যামবুশের মধ্যে না পড়ে। তারপর আগাচায় ঢাকা ট্রেইল ধরে এক লাইনে রওনা হলো মূল দল। এক মাইলও এগুনি, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিল কাস্তে আকৃতির চাঁদ। তারপর একটা দুটো করে তারাও দেখা গেল। রাতের কালো আকাশের গায়ে সুগার মিলের চিমনিটা চিনতে পারলো ওরা।

কোনো অঘটন ছাড়াই রাত তিনটের দিকে এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছল ওরা। ইতোমধ্যে চাঁদ ডুবে গেছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর অ্যামুনিশন ক্রেটগুলো সাজিয়ে রাখা হলো, পাহারায় থাকলে কয়েকজন গেরিলা। রোয়েন আর টিসে আহত গেরিলাদের দেখাশোনা করছে।

মেকের মেডিকেল কিটটা সাংঘাতিক কাজে লাগলো। ছোট্ট একটা আগুন জ্বালা হয়েছে, পর্দার ভেতর, তারই আভায় আহতদের সেবা করছে ওরা। এক পাশে সরে এসে রেডিওর এরিয়াল লম্বা করলো নিকোলাস, রেডিও নাইরোবি ধরে চাকা-চাকার গান শুনলো কিছুক্ষণ। আগেও শুনেছে, মেয়েটার গলা ওর ভালোই লাগে। তবে একটু পরই রেডিও বন্ধ করে দিল, ব্যাটারি অপচয় করতে চায় না। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজল নিকোলাস, ভোর হওয়ার আগে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়। কিন্তু ঘুম এলো না-বেঈমানীর আভাস পেয়ে বড় বেশি রেগে আছে ও।

*

বিগ ডলি! সাড়া দাও, বিগ ডলি! আমি ফারাও তোমাকে ডাকছি। আমার কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ? সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগে রেডিওর সাহায্যে ডাকাডাকি শুরু করছে নিকোলাস।

তারপর মেককে বলল, জেনিকে আমি চিনি, সময়ের হিসেব করেই রওনা হবেন, যাতে খুব ভোরে ল্যান্ড করতে পারেন এখানে।

যদি আদৌ রওনা হন আর কি, মেকের গলায় সংশয়।

জেনি? ওঁকে তুমি চেনো না, তাই এ-কথা বলছ। জেনি কখনোই হতাশ করেন নি আমাকে। মাইক্রোফোনের বোতামে চাপ দিয়ে আবার ডাকলো নিকোলাস, বিগ ডলি! বিগ ডলি। সাড়া দাও!

হঠাৎ দাঁড়াতে শুরু করলো রোয়েন, বলল, ইঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। শুনুন!

নিকোলাস ও মেক ঝেপের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে উত্তর আকাশের দিকে তাকালো।

ওটা হারকিউলিস নয়, হঠাৎ বলল নিকোলাস, বিস্মিত দেখালো ওকে। ঘুরে দক্ষিণে তাকালো, নদীর দিকে। তাছাড়া, শব্দটা আসছে উল্টোদিক থেকে।

ঠিক, সায় দিল মেক।

সিঙ্গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ। রোরের শব্দও পাচ্ছি। আমি।

পেগাসাস হেলিকপ্টার! বলল নিকোলাস। হামলা করতে আসছে।

তবে না, আওয়াজটা ক্রমশ দূরে মিলিয়ে গেল। ঢিল পড়লো নিকোলাসের পেশীতে। ওরা আমাদের দেখতে পায় নি। বোটগুলো লুকিয়ে রাখার লাভ হয়েছে।

ঝোঁপের আগালে ফিরে এলো ওরা। রেডিওটা আমার অন করলো নিকোলাস। কিন্তু জেনি বাদেনহোর্সটের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ মিনিট পর জেট রেঞ্জারের ফিরে আসার আওয়াজ পেল ওরা। খানিকক্ষণ কান পেতে সোনার পর নিকোলাস বলল, ফিরে যাচ্ছে আবার। কিন্তু দশ মিনিট পর আবার ভেসে এলো রোরের শব্দ।

নগু কিছু একটা করছে ওদিকে, বলল মেক, চেহারায় অস্বস্তি।

কি? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

হয়তো বোটগুলো দেখতে পেয়েছে, বলল মেক। হামলা করার আগে আরো লোকজন এনে জড়ো করছে। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে কান পাতলো সে। খানিক পর ফিরে এলো নিকোলাসের পাশে। নিকোলাস রেডিওতে কথা বলছে।

তুমি ডাকতে থাকো। আমি যাই, গেরিলাদের সাবধান করে দিই।

পরবর্তী তিন ঘণ্টা নীলনদের উপর দিয়ে বারবার আসা-যাওয়া করলো পেগাসাসের জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। তবে নতুন কিছু ঘটছে না। রোনের আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ওরা, শব্দটা হলে রেডিও থেকে এক-আধবার শুধু মুখ তুলছে নিকোলাস। তারপর হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠলো রেডিও, জেনি বাদেনহোর্সটের গলা ভেসে এলো। ফারাও! বিগ ডলি বলছি। আমার কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ?

সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল নিকোলাস, আমি ফারাও। মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনাও, বিগ ডলি।

পৌঁছতে আরো এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট লাগবে, জেনি বাদেনহোর্সটেরই গলা, কোনো সন্দেহ নেই।

মাইক্রোফোন রেখে দিয়ে রোয়েন আর টিসের দিকে তাকালো নিকোলাস। জেনি রওয়া হয়ে গেয়েছেন, ওঁ….

মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল, নদীর দিক থেকে ভেসে এলো একে ফরটিসেভেনের বিরতিহীন গর্জন। কয়েক সেকেন্ড পর দুটো গ্রেনেডও বিস্ফোরিত হলো। গুঙিয়ে উঠলো নিকোলাস, সর্বনাশ! নগু হামলা করেছে।

কোনো চিন্তা করবেন না, জবাব দিল জেনি। আপনি মুকুট পরে থাকুন, মনিব আমার। আমি ঠিকই পৌঁছব, আগুন থেকে তুলেও নিব আপনাদের।

পরবর্তী আধ ঘণ্টা নদীর কিনারা বরাবর গোলাগুলির আওয়াজ ক্রমশ বাড়লো, একে-ফরটিসেভেনের শব্দ মুহূর্তের জন্যও থামছে না। ধীরে ধীরে কাছে সরে আসছে যুদ্ধটা। পরিষ্কার বোঝা গেল, ছড়িয়ে থাকা গেরিলারা পিছু হটছে। বিশ মিনিট পরপর ব্রেনের আওয়াজও পেল ওরা, প্রতিবার আরো সৈন্য এনে নিজের শক্তি বাড়িয়ে নিচ্ছে কর্নেল নগু।

এয়ারস্ট্রিপের কাছাকাছি ঝোঁপের ভেতর সুস্থ ও সমর্থ পুরুষ বলতে শুধু নিকোলাস আর ড্যানিয়েল, বাকি সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছে। ক্রেটগুলো গুরুত্ব অনুসারে নতুন করে সাজালো ওরা দু জন, প্লেন ল্যান্ড করলে তাড়াহুড়ো করে লোড করা হবে। যুদ্ধক্ষেত্রের চারটা মডেল প্রথমে ভোলা হবে প্লেনে। তারপর ডেথ-মাস্ক আর টাইটার পুতুল আছে যে ক্রেটে, সেটা। তৃতীয় দফায় তোলা হবে তিনটি মুকুট-লাল, সাদা আর নীল ক্রাউন। এ তিনটের দাম সম্ভবত বাকি সমস্ত ট্রেজারের চেয়েও বেশি। কাজটা শেষ করে আহত গেরিলাদের সঙ্গে কথা বলল নিকোলাস, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ দিল, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো আত্মত্যাগের জন্য। ওদেরকে প্লেনে ওঠার প্রস্তাব দিল নিকোলাস, এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়।

আহতদের মধ্যে থেকে সাতজন ওর প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলো, কমান্ডার মেককে ছেড়ে কোথাও তারা যাবে না। বাকি সবাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলো, বিশেষ করে টিসের যুক্তি এড়াতে না পেরে। যারা প্লেনে উঠবে তাদেরকে এয়রস্ট্রিপের আরো কাছাকাছি তুলে আনা হলো। ক্রেটগুলো আগেই সরিয়ে আনা হয়েছে।

আপনি কী করবেন? টিসেকে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। আপনিও কি আমাদের সঙ্গে আসছেন? পুরোপুরি সুস্থ এখনো আপনাকে বলা যায় না।

হেসে উঠলো টিসে। যতোক্ষণ দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব, আপনারা আমাকে মেকের পাশেই দেখতে পাবেন।

আপনি কী জানেন, নিজের ভাগের শেয়ার মেক আমাকে নিয়ে যেতে বলেছে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। অতিরিক্ত বোঝা সঙ্গে নিতে রাজি নয়?

জানব না কেন। মেক আমার সঙ্গে আলোচনা করেছে। এখানে যুদ্ধ চালাতে হলে আমাদের টাকা দরকার।

নিজের অজান্তেই ঝট করে মাথাটা নিচু করে নিল টিসে, অকস্মাৎ একটা বিস্ফোরণ ঘটার পরপরই। ঝোঁপের কিনারা থেকে ধুলোর লম্বা একটা স্তম্ভ আকাশের দিকে খাড়া হলো। বাতাসে শিস কেটে ওদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল শ্যাপনেল। সুইট মেরি! কী ওটা? আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে টিসের চেহারা।

দু ইঞ্চি মর্টার, বলল নিকোলাস। নড়েনি ও, আড়াল পাবারও চেষ্টা করে নি। যতো গর্জে ততো বর্ষে না।নগু শেষবার কপ্টারে করে ওগুলো এনেছে বলে মনে হয়।

হারকিউলিস এখানে পৌঁছচ্ছে কখন?

জেনিকে ডেকে জিজ্ঞেস করছি। রেডিওর উপর ঝুঁকলো নিকোলাস।

রোয়েন আর টিসে পরস্পরের হাত ধরে ফিসফিস শুরু করলো। টিসে বলল, আপনারা, ইংরেজরা সবাই এতো চালু নাকি?

আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি মূলত মিশরীয়। এবং আতঙ্কিতও বটে। সহজ হেসে টিসের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো রোয়েন। আমি তোমাকে মিস করব, হে নারী সূর্য!

হ্যাঁ। আশা করি, এর পরের বার ভালো পরিবেশে দেখা হবে।

তাই কামনা করি।

মাইক্রোফোনে কথা বলছে নিকোলাস, বিগ ডলি, দিস ইজ নিকোলাস। আপনার পজিশন জানান।

ফারাও, আমরা বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাব। আপনারা কী চিনে বাদাম ভাজছেন, নাকি আমি মর্টারের আওয়াজ শুনছি?

এতো যার রসবোধ, তার মঞ্চে থাকা উচিত ছিল, বলল নিকোলাস। শত্ররা এয়ারস্ট্রিপের দক্ষিণ প্রান্ত দখল করে নিয়েছে। আপনাকে উত্তর দিক থেকে আসতে হবে। বাতাস বইছে পশ্চিম দিক থেকে, গতি পাঁচ নট।

ধন্যবাদ, স্যার। প্যাসেঞ্জার আর কার্গো সম্পর্কে বলুন।

প্যাসেঞ্জার ছয় আর তিন নয়জন। ক্রেটের সংখ্যা বাহান্ন, প্রায় দেড় টন ওজন।

এতো কম লোক আর কার্গোর জন্য আসতে বলেছেন আমাকে? জেনি হেসে উঠলো।

বিগ ডলি, সাবধান। এলাকায় আরেকটা এয়ারক্রাফট আছে। জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। সবুজ আর লাল। মতিগতি সুবিধের নয়, তবে আন আর্মড।

রজার, ফারাও। শেষ একবার যোগাযোগ করব।

রেডিও ছেড়ে আহত গেরিলাদের কাছে চলে এলো নিকোলাস, এখানে রোয়েন আর টিসেও রয়েছে। প্লেন আসতে আর বেশি দেরি নেই, গোলাগুলির আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠলো ওর গলা। শুধু এক কাপ চা খাওয়ার সময় আছে।

বলতে হলো না, নিজেই চা বানাতে বসে গেল ড্যানিয়েল।

হাতে চায়ের কাপ, রোয়েন হঠাৎ বলল, আপনার হারকিউলিস পৌঁছে গেছে, ইঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছি আমি।

পাঁচ মিনিট পর ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, ফারাও, জবাব দিল জেনি।

লম্বা এয়ারস্ট্রিপের দিকে তাকালো নিকোলাস। মেকের গেরিলারা পিছু হটছে এখনো, কাঁটাঝেপের ভেতর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, পিছু হটার সময়ও অনবরত গুলি করছে তারা। কর্নেল নগু খুব জোরে তাড়া করেছে।

তাড়াতাড়ি, জেনি, তাড়াতাড়ি, বিড়বিড় করছে নিকোলাস। তবে রোয়েন আর টিসের দিকে ফেরার আগে চেহারায় হাসি ফুটিয়ে তুললাম। কাপে আস্তে ধীরে চুমুক দিন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই।

গোলাগুলির চেয়ে প্লেনের আওয়াজ বেড়ে গেছে। তারপর হঠাৎ ওটাকে দেখা গেল। এতো নিচু দিয়ে আসছে, মনে হলো কাঁটাগাছগুলোয় ঘষা খাবে। দুই ডানা এতো বড়, আগাছায় চাপা পড়ে সরু হয়ে থাকা এয়ারস্ট্রিপের দুই প্রান্ত ছুঁই ছুঁই করছে। জমিন স্পর্শ করলো প্লেন, ধুলোর মেঘ পাক খেতে শুরু করলো পেছনে, ইঞ্জিন রিভার্স করে দিল পাইলট।

ঝোঁপগুলোকে পাম কাটিয়ে এগুলো হারকিউলিস, ককপিট থেকে ওদেরকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো জেনি। স্পীড যথেষ্ট কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফুটব্রেক আর রাডার বার-এর উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। ঘুরে যাচ্ছে প্লেন, স্ট্রিপ ধরে ফিরে আসছে ওদের দিকে, কাছাকাছি আসার আগেই লোডিং র‍্যাম্প খুলে গেল।

খোলা হ্যাঁচওয়েতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্রেড, জেনি বাদেনহোর্সটের ছেলে। লাফ দিয়ে নিচে নামলো সে, আহত লোকগুলোকে স্ট্রেচারে তুলতে সাহায্য করলো নিকোলাস আর ড্যানিয়েলকে। র‍্যাম্প বেয়ে ওদেরকে তুলতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগলো। তার পরই শুরু হয়ে গেল অ্যামুনিশন ক্রেট লোড করার কাজ। ওদের সঙ্গে রোয়েনও হাত লাগালো কাজে, হালকা ক্রেটগুলো একাই বয়ে নিয়ে এলো। একটা ক্রেটও ফেলে যেতে রাজি নয় ও।

দাঁড়ানো হারকিউলিসের দেড়শো গজ দূরে বিস্ফোরিত হলো একটা মর্টার। দ্বিতীয় শেলটা পড়লো মাত্র একশো গজ দূরে।

ক্রেট কাঁধে ছুটছে নিকোলাস, চিৎকার করে বলল, রেঞ্জিং শট!

ওরা আমাদেরকে সাইটে পেয়ে গেছে, ফ্রেডও চেঁচাচ্ছে। এক্ষুনি কেটে পড়তে হয়। বাকি কার্গো তোলার সময় নেই। লেটস গো! গো….গো…গো….!

আর মাত্র চারটে ক্রেট ঝোঁপের ভেতর পড়ে রয়েছে। ফ্রেডের তাগাদায় কান না দিয়ে ড্যানিয়েল আর নিকোলাস র‍্যাম্প বেয়ে ছুটলো। ঝোঁপের ভেতর ঢুকে দুটো করে বাক্স মাথায় তুললাম ওরা, ছুটে ফিরে আসছে আবার। র‍্যাম্প ইতোমধ্যে উঠতে শুরু করেছে, প্লেলে ইঞ্জিন গর্জে উঠলো, গড়াতে শুরু করেছে চাকা। টেইলবোর্ডের উপর দিয়ে ক্রেইগুলো ছুঁড়ে দিল ওরা, তারপর লাফিয়ে ধরে ফেললো দরজার কিনারা। প্লেনের ভেতর ঢুকে ড্যানিয়েলকে টেনে নিল নিকোলাস।

আবার যখন পেছনে তাকালো ও, ঝোঁপের পাশে নিঃসঙ্গ আর একা লাগলো টিসেকে। মেককে আমার ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানাবেন! চিৎকার করে বলল ও।

টিসেও চিৎকার করলো, আমাদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে আপনি জানেন।

গুডবাই, টিসে, রোয়েনের চিৎকার ইঞ্জিনের গর্জনে চাপা পড়ে গেল, ধুলোর সচল মেঘে ঢাকাও পড়ে গেল টিসে। হিসহিস শব্দ তুলে পুরোপুরি উঠে এলো র‍্যাম্প।

রোয়েনের কাঁধে হাত রেখে বিশাল গুহার মতো কার্গো হোল্ড হয়ে ককপিটের কাছাকাছি একটা জাম্প সিটের পাশে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস। রোয়েনকে সিটে বসিয়ে দিয়ে বলল, স্ট্র্যাপ বাধুন। তারপর ছুটলো ককপিটের দিকে।

ভাব দেখে মনে হচ্ছিল আপনি বোধহয় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হেসে উঠে নিকোলাসকে বলল জেনি, কন্ট্রোল থেকে চোখ না তুলেই। শক্ত হোন! আকাশে ডানা মেলছি!

পাইলটের সিটের পেছনটা আঁকড়ে ধরল নিকোলাস, জেনি আর ফ্রেড কন্ট্রোল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। থ্রটল লিভার ঠেলে দিয়ে ফুল পাওয়ার দিল ওরা, প্লেনের গতি ক্রমশ বাড়ছে।

জেনি বাদেনহোর্সটের কাঁধের উপর দিয়ে সামনে তাকালো নিকোলাস, রানওয়ের শেষ মাথায় ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর ক্রামোফ্লেজ ড্রেস পরা অস্পষ্ট ছায়া। ছায়া আকৃতি দেখা যাচ্ছে। ওদিকেই ছুটছে প্লেন, ঝোঁপের ভেতর থেকে সৈনিকরা গুলি করছে এদিকে।

এসব ক্ষুদে বুলেটে আমার হারকিউলিসের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না, জেনি বলল। হারকিউলিস খুব শক্ত বুড়ি। তারপর প্লেনটাকে আকাশে তুলে ফেললো সে।

জমিনে ছড়িয়ে থাকা সরকারি সৈন্যদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে এলো প্লেন, আকাশের দিকে নাক উঁচু করে আরো ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড, ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড। বাপ-বেটা, জেনি ও ফ্রেডের উপর ভরসা রাখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তারপর মাত্র পাঁচ সেকেন্ড পর বেলুনের মতো চুপসে গেল জেনি, প্রায় কাতরে উঠে, বলল, ওই ফড়িং আবার কোত্থেকে এলো?

নীলনদের পাড় ঘেঁষা ঝোঁপ থেকে সরাসরি প্লেনের সামনে আকাশে উঠে আসছে পেগাসাস কোম্পানির জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। এমন তির্যক একটা কোণ ধরে ওপরে উঠছে ওটা, বোঝাই যায় যে দ্রুতগতি হারকিউলিস এখনো পাইলটের দৃষ্টি পথের বাইরে রয়েছে, তা না হলে প্লেনের পথ থেকে সরে যাবার চেষ্টা করত।

মাত্র পাঁচশো ফুট ওপরে উঠেছি আমরা, স্পীঢ় একশো দশ নট, ডান দিকের সিট থেকে চিৎকার করে বাপকে সাবধান করলো ফ্রেড। এই অবস্থায় দিক বদল সম্ভব নয়।

জেট রেঞ্জার এতো কাছে যে ফ্রন্ট সীটে বসা কর্নেল নগুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তার চশমায় লেগে প্রতিফলিত হচ্ছে রোদ। পাইলটের আগে সেই প্রথম হারকিউলিসকে দেখতে পেল। নিকোলাস তার চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠতে দেখলো। সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে কপ্টারটাকে ঘুড়ির মতো গোত্তা খাওয়াতে চেষ্টা করলো পাইলট, বিশাল হারকিউলিসের পথ থেকে সরে যাবার চেষ্টায়। সংঘর্ষ এড়ানো অসম্ভব বলে মনে হলো, তবে দক্ষতার সঙ্গেই কপ্টারটাকে পাক খাওয়াতে শুরু করলো সে, ডিগবাজি খাওয়ানোর ভঙ্গিতে হারকিউলিসের পেটের নিচে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওটা, প্লেনের আরোহীরা অনুভব করলো দুটো আকাশযানের ফিউজিলাজ পরস্পরকে আলতো চুমো খেলো।

ছোঁয়াটুকু যতই সামান্য হোক, কপ্টারের নাক জমিনের দিকে ঘুরে গেল, সেটা মাত্র চারশো ফুট নিচে। হারকিউলিস ফুল স্পীডে ছুটছে, ওপরে উঠছে ক্রমশ, কিন্তু হেলিকপ্টারের পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কপ্টার যখন জমিন থেকে দুশো ফুট ওপরে, হারকিউলিস টার্বোপ্রপ ইঞ্জিনগুলো, প্রতিটি চার হাজার নয়শো হর্সপাওয়ার, বাতাসে তীব্র আলোড়ন তুললাম, সেই আলোড়ন প্রচণ্ড পাথরধসের মতো আঘাত করলে, ওটাকে।

বাতাসে ভেসে থাকা ঝরা পাতার মতো লাগছে এখন। কপ্টারটাকে, ডিগবাজি খাচ্ছে বিরতিহীন। ইঞ্জিন ফুল পাওয়ারে চালু, জমিনের উপর পড়লো সেটা। ফিউজিলাজ অ্যালুমিনিয়াম ফুয়েলের মতো দুমড়ে মুচড়ে গেল, কর্নেল নগু মারা গেল এমন কী ফুলের ট্যাংক বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই। আগুনে বিশাল একটা কুণ্ডলি গ্রাস করলো জেট রেঞ্জারকে।

*

উত্তরের কোর্স ধরে ছুটছে হারকিউলিস। নিচে সুদান। দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেইন কেবিনে ফিরে এলো নিকোলাস।

আহতদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা যাক, ড্যানিয়েলকে বলল ও। স্যাপারের সঙ্গে রোয়েনও সেফটি বেল্ট খুলে হাত লাগালো বলল ও। ড্যানিয়েলের সঙ্গে রোয়েনও সেফটি বেল্ট খুলে হাত লাগালো কাজে। তাড়াহুড়োর মধ্যে স্ট্রেচারগুলো প্লেনের দরজার কাছাকাছি রাখা হয়েছিল, সেগুলো সরিয়ে আরো ভেতর দিকে আনা হলো। জেনি কিছু ওষুধ-পত্র নিয়ে এসেছে, সঙ্গে অল্প কিছু খাবারও, সে সব বিলি-বণ্টন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওরা। খানিক পর রোয়েন আর ড্যানিয়েলকে ওখানে রেখে ফ্লাইট-ডেকের পেছনে, গ্যালিতে চলে এলো নিকোলাস। ফ্রিজ খুলে টিনের কৌটা থেকে সুপ আর তাজা পাউরুটি বের করলো ও, চুলোয় আগেই চায়ের পানি চড়িয়েছে।

চায়ের পানি ফুটছে, নিজের ইমার্জেন্সি প্যাক থেকে একটা নাইলন ওয়ালেট বের করলো নিকোলাস, ভেতরে কিছু ওষুধপত্র আছে। একটা শিশি থেকে পাঁচটা ট্যাবলেট বের করলো, গুড়ো করে ফেলে দিল দুটো মগে। মগ দুটোর চা ঢেলে চিনি আর দুধ মেশালো, ভালো করে নাড়লো চামচ দিয়ে। আরব দেশের মেয়ে, গরম এক মগ চায়ের লোভ সামলতে পারবে না।

আহত গেরিলাদের খাওয়ানো হয়ে গেছে, গ্যালি থেকে ফিরে এসে ড্যানিয়েল আর রোয়েনকে মাখন লাগানো রুটি আর সুপ খেতে দিল নিকোলাস, সঙ্গে মগ ভর্তি চা। ওরা দু জন চা খাচ্ছে, ফ্লাইট ডেকে ফিরে এলো নিকোলাস, হেলাল দিল জেনি বাদেনহোর্সটের সিটের পিঠে। মিশরীয় সীমান্তে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে আপনার? জানতে চাইলো ও।

চার ঘণ্টা বিশ মিনিট, বলল জেনি।

মিশরীয় এয়ার স্পেস এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় আছে? আবার প্রশ্ন করলো নিকোলাস।

সিটে ঘুরে গিয়ে নিকোলাসের দিকে অবাক হয়ে তাকালো জেনি। লিবিয়ার উপর দিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তবে গাদ্দাফির এয়ারফোর্স বিনা নোটিশে গুলি করে ফেলে দিলে কিছু করার নেই। আরো সমস্যা আছে। ওদিকে গেলে সাত ঘণ্টা বেশি। থাকতে হবে আকাশে, ফুয়েলে কুলাবে না-সাহারার কোথাও ফোর্স ল্যান্ডিং করতে হবে। একটা ভুরু কপালে তুললাম সে। কী ব্যাপার, নিকোলাস, এ ধরনের প্রশ্ন করার অর্থ কি?

কোনো অর্থ নেই, হঠাৎ উঁকি দিল মনে, বলল নিকোলাস।

এ ধরনের প্রশ্ন আমাকে ঘাবড়ে দেয়, জোর করে হাসলো জেনি।

তার কাঁধ চাড়ে দিল নিকোলাস। ভুলে যান।

মেইন হোল্ডে ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো দুটো ফোল্ড-ডাউন বাঙ্কে বসে রয়েছে রোয়েন ও মাটিন। রোয়েনের খালি মগটা ওর পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। পাশে বসলো নিকোলাস; একটা হাত তুলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রোয়েন।

ভাগ্য ভালো যে আপনার মাথার ক্ষতটা প্রায় শুকিয়ে গেছে, ফিসফিস করে বলল নিকোলাসকে।

প্রথমে ঘুমিয়ে পড়লো ড্যানিয়েল। শুয়ে পড়লো সে, চোখ বুজল, খানিক পরই নাক ডাকতে শুরু করলো। কয়েক মিনিট পর নিকোলাসের গায়ে ঢলে পড়লো রোয়েন, সাবধানে ওর পা দুটো বাঙ্কের উপর তুলে ভালো করে শুইয়ে দিল নিকোলাস, একটা চাদর গলা পর্যন্ত টেনে দিল। তারপর ঝুঁকে আলতো একটা চুমো খেলো রোয়েনের কপালে। যাই তুমি করে থাকো, তোমাকে কীভাবে আমি ঘৃণা করতে পারি!

ল্যাবেটোরিতে ঢুকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল নিকোলাস। হাতে প্রচুর সময় আছে। অন্তত তিন-চার ঘণ্টার আগে রোয়েন আর ড্যানিয়েলের ঘুম ভাঙবে না। আর জেনি ও ফ্রেডকে ককপিটে ব্যস্ত থাকতে হবে সারাক্ষণ, প্লেনের কোথায় কী ঘটছে জানার সুযোগ হবে না ওদের।

কাজটা শেষ হতে হাতঘড়ি দেখলো নিকোলাস। দু ঘণ্টা লেগেছে। টয়লেট সিট বন্ধ করে হাত ধুলো ও। ক্ষুদে কেবিনে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দরজার তালা খুলল।

ফোল্ড ডাউন বাঙ্কে এখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে রোয়েন আর ড্যানিয়েল। মেইন হোল্ড থেকে আবার ফ্লাইট ডেকে চলে এলো নিকোলাস। কান থেকে এয়ারফোন খুলে ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো ফ্রেড। সামনে নীলনদ। এতো সময় ধরে টয়লেটে ছিলেন, আমি তো ভাবলাম আপনার কিছু অবশিষ্ট থাকে কি না!

তার বাপের সিটের উপর ঝুঁকে নিকোলাস জানতে চাইলো, ঠিক কোথায় রয়েছি আমরা?

উরুর ওর মেলা চার্টটায় মোটা তর্জনী রাখলো জেনি। এখানে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে মিশরীয় সীমান্তে পৌঁছে যাব।

জবাব না দিয়ে রেডিও সেট অন করলো জেনি। এবারে আমার কাজ দেখাবার পালা।

মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মাউথপিসে কথা বলছে, হ্যালো, আবু সিমবেল দিস ইজ জুলু হুইস্কি ইউনিফর্ম ফাইভ জিরো জিরো।

তৃতীয়বার ডাকার পর আবু সিমবেল কন্ট্রোল সাড়া দিল। রুটিন অনুসারে নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলো জেনি। পাঁচ মিনিট পর আবু সিমবেল কন্ট্রোল টাওয়ার উত্তরে গতি বজায় রাখার অনুমতি দিল তাকে।

আরো এক ঘণ্টা নির্বিঘ্নে উড়লো ওরা, তবে প্রতি মিনিটে স্নায়ুর উপর চাপ আরো বাড়ছে নিকোলাসের।

অকস্মাৎ, কোনো রকম আভাস না দিয়ে, একটা ফাইটার ইন্টারসেপটরের রূপালি ঝলক দেখা গেল সরাসরি সামনে। ওদের নিচ থেকে উঠে এলো সেটা, হারকিউলিসের বো-র সামনে। ওদের নিচ থেকে উঠে এলো সেটা, হারকিউলিসের বো-র সামনে। রাগে ও বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো জেনি, পর মুহূর্তে দেখলো রকেট বেগে আরো দুটো ফাইটার ওদের প্লেনের নিচ থেকে উঠে আসছে, এতো কাছে মনে হলো যে কোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ ঘটতে পারে।

সবাই ওরা ফাইটার প্লেনগুলোর টাইপ চিনতে পারল। মিগ টোয়েনটি ওয়ান, মিশরীয় এয়ারফোর্সের মুল শক্তি। ডানার নিচে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এয়ার-টু এয়ার মিসাইল, পড় থেকে ঝলছে। আনআইডেনটিফায়েড এয়ারক্রাফট! মাউথপিসে চিৎকার করছে জেনি। স্টেট ইওর কল সাইন!

ইতোমধ্যে দুটো ফাইটার হারকিউলিসের দু পাশে চলে এসেছে, অপরটা উঠে এসেছে ওদের মাথার উপর আকাশে।

জবাব এলো, জেড-ডব্লিউ-ইউ ফাইভ হানড্রেড, মিশরীয় বিমান বাহিনীর রেড লিডার। ইউ উইল কনফার্ম টু মাই অর্ডারস।

ঘাড় ফিরিয়ে নিকির দিকে তাকালো জেনি। কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। কী ব্যাপার?

ঠিক কী ঘটছে আমিও বুঝতে পারছি না।

রেড লীডার যা বলছে শোনো, ড্যাড, বাপকে পরামর্শ দিল ফ্রেড। তা না হলে মিসাইল ছুঁড়ে উড়িয়ে দেবে আমাদের।

অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো জেনি, তারপর মাইক্রোফোনে বলল, দিস ইজ জেডডব্লিউইউ ফাইভহানড্রেড। আমরা সহযোগিতা করব। প্লিজ আপনাদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করুন।

আপনার নতুন হেডিং জিরো ফাইভ থ্রী। নির্দেশ এখুনি পালন করুন।

প্লেনটাকে পুব দিকে ঘুরিয়ে নিল জেনি, তারপর চার্টের দিকে তাকালো। আসওয়ান! সবিস্ময়ে বলল। ওরা আমাদেরকে আসওয়ানে পাঠাচ্ছে! তাহলে তো এখুনি আসওয়ানকে জানাতে হয় যে আমাদের সঙ্গে আহত লোকজন আছে।

মেইন হোল্ডে ফিরে এসে রোয়েনের ঘুম ভাঙালো নিকোলাস, লক্ষ্য করলো ল্যাভেটোরির দিকে যাবার সময় সামান্য একটু টলছে। তবে দশ মিনিট পর যখন ফিরে এলো, পুরোপুরি তাজা ও সচেতন দেখালো ওকে, মুখ ধুয়ে চুল আঁচড়েছে।

*

ওদের সামনে এখন আবার নীলনদকে দেখা যাচ্ছে, দুই পাড়েই ছড়িয়ে পড়েছে আসওান শহর। আসওয়ানের কন্ট্রোল টাওয়ার নির্দেশ দিতে ল্যান্ড করার জন্য রানওয়ে বরাবর সোজা হলো হারকিউলিস। মরুভূমি থেকে ওদেরকে পথ দেখিয়ে এদিকে এনেছে মিশরীয় এয়ারফোর্সের ফাইটারগুলো, এখন আর ওগুলোকে দেখা যাচ্ছে না, তবে টাওয়ারের সঙ্গে তাদের রেড লীডারের কথাবার্তা শোনা গেল। বন্দি হারকিউলিসকে আসওয়ান টাওয়ারের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে তিন ফাইটারের বহরটা।

পেরিমিটার বেড়া পেরিয়ে এসেরানওয়েতে ল্যান্ড করলো হারকিউলিস। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে নির্দেশ এলো, ডান দিকে ঘুরে যান। মেইন রানওয়ে থেকে বাঁক ঘুরতেই সামনে ছোট একটা ভেহিকেল দেখা গেল, ছাদের সাইনবোর্ডে লেখা, ইংরেজি ও আরবিতে, আমাকে অনুসরণ করুন।

ভেহিকেলটা ওদেরকে পথ দেখিয়ে একটা হ্যাঁঙ্গারের সামনে নিয়ে এলো। প্লেন স্থির হতেই হ্যাঁঙ্গারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো পাঁচটনী পাঁচটা ট্রাক, দ্রুত এগিয়ে এসে ঘিরে ফেললো হারকিউলিসকে সাদা কাপড় পরা সশস্ত্র কিছু লোক লাফ দিয়ে নিচে না এলো, হাতের অটোমেটিক রাইফেল প্লেনের দিকে তাক করা।

টাওয়ারের নির্দেশ পেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করলো জেনি। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না, বলে নিকোলাসের দিকে তাকালো সে। আপনি পারছেন, নিকি?

কথা না বলে মাথা নাড়লো নিকোলাস, খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে আবার নির্দেশ এলো। টেইল র‍্যাম্প নামাতে বলছে।

ককপিটে ওরা কেউ কথা বলছে না, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, চেহারায় বিস্ময় ও উদ্বেগ।

হঠাৎ পেরিমিটার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সাদা একটা ক্যাডিলাক, সরাসরি ছুটে এসে হারকিউলিসের কার্গো র‍্যাম্পের সামনে ব্রেক কষল। লাফ দিয়ে নিচে নেমে দরজা খুলল শোফার, শেষ বিকেলে রোদে বেরিয়ে এলেন বিশাল বপু আরোহী। চেহারায় বলে দেয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিজাত মানুষ, ধীর-স্থির ও দৃঢ়চেতা। হালকা রঙের ট্রপিক্যাল স্যুট পরে আছেন, জুতো জোড়া সাদা, মাথায় পানামা হা, চোখে গাঢ় চশমা। র‍্যাম্প বেয়ে প্লেনে চড়ছেন তিনি, সঙ্গে দু জন পুরুষ সেক্রেটারি।

প্লেনের ভেতর ওরা পাঁচজন অপেক্ষা করছে।

কর্তা ব্যক্তি চোখ থেকে গাঢ় চশমা খুলে ব্রেস্ট পকেটে খুঁজলেন। রোয়েনকে চিনতে পেরে হ্যাট মাথা থেকে খুলে হাসলেন। ডক্টর আল সিমা–রোয়েন! আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন! কংগ্রাচুলেশন্স। রোয়েনের হাতটা ধরে ঝাঁকালেন, নিকোলাসের দিকে তাকাবার সময়ও সেটা ছাড়লেন না।

আপনি নিশ্চয়ই স্যার নিকোলাস কুয়েটন-হারপার। সত্যি কথা বলতে কি, আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। ডক্টর রোয়েন, আপনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন না?

কথা বলার সময় নিকোলাসের সরু চোখের দিকে তাকাতে পারলো না রোয়েন, উনি আমাদের মাননীয় সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী আতালান আবু সিন।

সত্যি কথা বলতে কী, নিকোলাসের গলায় ক্ষীণ ব্যঙ্গ, আমিও আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে অপ্রত্যাশিত উল্লাস অনুভব করছি, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়।

আমাদের প্রাচীন ও গৌরবময় অতীত ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া বিপুল প্রত্ন সম্পদ মিশরে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার ও মিশরীয় জনগণের তরফ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার নিকোলাস। সাজিয়ে রাখা অ্যামুনিশন ক্রেটগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালেন মন্ত্রী আতালান আবু সিন।

প্লিজ, এটাকে খুব বড় করে দেখবেন না, বলল নিকোলাস, তবে রোয়েনের উপর থেকে পলকের জন্যও সরাতে পারছে না। যদিও রোয়েন ওর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না।

কী যে বলেন, স্যার, মন্ত্রী অমায়িক হাসি হাসলেন।এই অভিযানে আপনার অনেক টাকা খরচ হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। কাজেই আমরা চাই না আপনি খালি পকেটে ফিরে যান। ড. রোয়েন আমাকে জানিয়েছেন, আপনার পকেট প্রায় আড়াই লাখ স্টার্লিং বেরিয়ে গেছে। কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করলেন তিনি, বাড়িয়ে দিলেন নিকোলাসের দিকে।

এতে মিশরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা চেক আছে, দু লাখ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের। চেকটা নিয়ে আপনি আমাদেরকে ঋণমুক্ত করুন, স্যার নিকোলাস, প্লিজ।

আপনি সত্যি খুব উদার মানুষ, মিনিস্টার, এনভেলাপটা পকেটে ভরার সময় বলল নিকোলাস, ভাব দেখে মনে হলো হাসি চেপে রেখেছে। এটাও বোধহয় ড. আল সিমার পরামর্শ?

অবশ্যই, সহাস্যে বললেন। আপনার সম্পর্কে ড. রোয়েনের খুব উঁচু ধারণা…

তাই কী? বিড়বিড় করলো নিকোলাস, এখনো রোয়েনের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

মন্ত্রীর হাতের ইশারায় একজন সেক্রেটারি এগিয়ে আসে। হাতের ট্রেতে লাল ভেলভেট কাপড়ের উপর শুয়ে আছে একটা রাজকীয় তারা–মাঝখানে সিংহের ছবি।

তারাটা হাতে তুলে নিকোলাসের দিকে এগুলেন আবু সিন। মিশরের সাহসী সিংহ, প্রথম ক্লাস মর্যাদা বলে নিকোলাসের গলায় লাল ফিতে জড়ানো মেডালটা পরিয়ে দিলেন। ওর নীলে কাদা-মাটি চৰ্চিত শার্টে ঝুলে রইলো ওটা।

আহত লোকজনকে একটা ট্রাকে তোলা যেতে পারে। পেছন ফিরে কাকে যেনো ইঙ্গিত দিলেন তিনি, প্লেনের ভেতর সশস্ত্র লোকজন ঢুকে পড়লো। তাদের মধ্যে পাঁচজন লোক পাহারায় থাকলো, বাকি দশ-বারোজন হাত লাগালো . ক্রেটগুলো নামানোর কাজে।

দশ মিনিটের মধ্যে খালি হয়ে গেল বিগ ডলি। বাহান্নটা ক্রেট চারটে চাচ চনী ট্রাকে তোলা হলো, ট্রাকগুলো ঢেকে দেওয়া হলো তারপুলিন দিয়ে। সময় নষ্ট না করে কনভয়টা রওনা হয়ে গেল তখুনি। বাকি একটা ট্রাকে আহত গেরিলাদের তোলা হয়েছে, তবে এখনো সেটা দাঁড়িয়ে আছে।

বিদায়, স্যার নিকোলাস, মিটিমিটি হেসে নিকোলাসের দিকে ডান হাতটা বাড়ালেন। আবু সিমবেল থেকে এদিকে সরিয়ে আনার জন্য সত্যি দুঃখিত। তবে কী জানেন, সব ভালো যার শেষ ভালো। আমি জানি, নিজের পথে রওনা হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন আপনি। কাজেই আপনাকে আর আটকে রাখব না। বিদায়ের আগে আপনার জন্য আর কিছু করতে পারি আমি? আপনাদের সঙ্গে যথেষ্ট ফুয়েল আছে তো?

জেনি বাদেনহোর্সটের দিকে তাকালো নিকোলাস, জেনি তিক্ত সুরে বলল, আছে।

নিকোলাসের দিকে ফিরে আতালান আবু সিন বললেন, লুক্সরের যাদুঘরে আপনার উদ্ধার করে আনা ফারাও মামোসের ট্রেজার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছি আমরা। খুব শীঘ্রই আমাদের প্রেসিডেন্ট মুবারক আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে। ডক্টর আল সিমা যে আমাদের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যান্টিকুইটিজ এর ডিরেক্টর হয়েছেন–এতো আশা করি আপনি জানেন। নতুন মিউজিয়ামের দায়িত্বে তিনিই থাকবেন। নিশ্চই আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন উনি।

ড্যানি স্যাপার আর দু জন পাইলটকে মাতা নুইয়ে সম্মান দেখালেন মন্ত্রী।

আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন, বলে র‍্যাম্প বেয়ে নামতে শুরু করলেন।

রোয়েন তাকে অনুসরণ করতে যাবে, পেছন থেকে নরম সুরে ডাক দিল নিকোলাস, রোয়েন।

পাথর হয়ে গেল রোয়েন। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধীরে ধীরে নিকোলাসের দিকে ঘুরলো, ওরা ল্যান্ড করার পর এ প্রথম ওর চোখের দিকে তাকালো।

এ আমার পাওনা ছিল না, বলল নিকোলাস, আর তারপরই আবেগের একটা ধাক্কা খেয়ে উপলব্ধি করলো নিঃশব্দে কাঁদছে রোয়েন। ওর ঠোঁট জোড়া, কাঁপছে, চোখের পানি গড়াচ্ছে গাল বেয়ে।

আমি দুঃখিত, নিকি ফিসফিস করে বলল রোয়েন। কিন্তু আপনার জানার কথা যে আমি চোর নই। মামোসের গুপ্তধন মিশরের প্রাপ্য, আমাদের নয়।

তাহলে আমাদের মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল, সেটা মিথ্যে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

না! বলল রোয়েন। আমি… ভাষা হারিয়ে ফেলে থরথর করে কেঁপে উঠলো রোয়েন, ঝট করে ঘুরে এস্তা হরিণীর মতো ছুটে নেমে গেল র‍্যাম্প বেয়ে। ওখানে, রোদের মধ্যে, ক্যাডিলাকের দরজা খুলে অপেক্ষা করছে শোফার। মন্ত্রী আগেই গাড়িতে উঠে পড়েছেন। বাকি ট্রাকটায়ও সশস্ত্র লোকগুলো উঠে পড়ছে।

এই ব্যাটা মিশরীয়রা এ পাল্টে ফেলার আগেই, চলুন ভাগি এখান থেকে! জেনি বলল।

দারুণ আইডিয়া, তিক্ত স্বরে বলল নিকোলাস।

*

আবার আকাশে ওঠার পর মেডিটারেনিয়ান কোর্স ধরে সেই উত্তর দিকেই রওনা হলো হারকিউলিস। নিকোলাস, ড্যানিয়েল, জেনি আর ফ্রেড-চারজনই ককপিটে রয়েছে। দীর্ঘ সবুজ সাপের মতো নীলনদ ওদের পাশাপাশি এঁকেবেঁকে পেছন দিকে ছুটছে।

দীর্ঘ যাত্রা পথে খুব কম কথা বলছে ওরা। তিক্ত প্রসঙ্গটা একবার শুধু জেনি তুললাম। এ যাত্রা ফি ছাড়াই কাজ করতে হলো, কী বলেন?

আমি ঠিক টাকার লোভে আসিনি, মন্ত্রব্য করলো ড্যানিয়েল। তবে পারিশ্রমিক পেলে ভালো লাগত। বাচ্চাকাচ্চাদের নতুন জুতো দরকার।

কেউ চা খাবে নাকি? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, ওদের কথা যেনো শুনতে পায় নি।

মন্দ হয় না, বলল জেনি। আপনি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন পাওনা ষাট হাজার ডলার এক কাপ চা খাইয়ে পরিশোধ করবেন, আমার বলার কিছু নেই।

গ্যালিতে চলে এলো নিকোলাস, সবার জন্য চা বানালো। ককপিটে ফিরে এসে পরিবেশনও করলো নিজ হাতে। সবাই আশা করছে কিছু না কিছু বলবে ও। কিন্তু মিশরীয় সীমান্ত পার না হওয়া পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে রাখলো নিকোলাস

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ খুলল, ঋণশোধ করি নি, এমন রেকর্ড কি আমার আছে? নেই। যার যা পাপ্য সবাই তা পাবে, বোনাসসহ।

সবাই ওরা কঠিন দৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নিকোলাসের দিকে। সবার মনের সন্দেহ প্রকাশ পেল জেনি বাদেনহোর্সটের একটা মাত্র শব্দে। কীভাবে?

আমাকে একটু সাহায্য করো, স্যাপার, বলল নিকোলাস, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে কন্ট্রোল ফ্রেডের হতে দিয়ে ওদেরকে অনুসরণ করলো জেনি। মেইন ডেকে বেরিয়ে এসে ল্যাভেটোরতে ঢুকলো ওরা। জেনি আর স্যাপার দোরগোড়া থেকে দেখছে, পকেট থেকে একটা টুল বের করে কেমিকেল টয়লেটের ঢাকনি খুলে ফেললো নিকোলাস। স্কুগুলো খুলছে নিকোলাস, পেছনে নিঃশব্দে হাসছে জেনি। স্কুগুলো গোপন প্যানেলটাকে জায়গা মতো বসিয়ে রেখেছে। হারকিইলস স্মাগলারদের প্লেন, কাজেই করিগরি ফলিয়ে ভেতর দিতে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। জেনি আলফ্রেড শুধু পরিশ্রম করে নি, বাপ-বেটাকে অনেক মাথা খাঁটিয়ে পরিবর্তনগুলো গোপন রাখারও ব্যবস্তা করতে হয়েছে। এ রকম গোপন হোল্ড শুধু ল্যাভেটোরিতেই নয়, ইঞ্জিন হাইজিং আর ফিউজিলাজের অন্যান্য অংশেও আছে।

প্যানেল খোলা হতে ভেতরে হাত গলিয়ে একটা জিনিস বের করলো নিকোলাস। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠলো জেনি। গড! কি ওটা?

প্রাচীন মিশরের নীল যুদ্ধ মুকুট, বলল নিকোলাস। মুকুটটা ড্যানিয়েলের হাতে তুলে দিল ও। বাঙ্কের উপর রাখো, তবে খুব সাবধানে।

কমপার্টমেন্টের ভেতর আবার হাত গলালো নিকোলাস, আরেকটা, মুকুট বের করে আনলো। আর এটা হলো নেমেস ক্রাউন। জেনি বাদেনহোর্সটের হাতে ধরিয়ে দিল।

আর এটা কী? এটা হলো একত্রিত দুই রাজ্যের লার আর সাদা ক্রাউন। আর এটা? ফারাও মামোসের ডেথ-মাস্ক। এটা? এটাই কিন্তু শেষ নয়-লিপিকা টাইটার উশব তি।

কিন্তু, হতভম্ব দেখাচ্ছে ড্যানিয়েলকে, মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক, আসওয়ানে ওরা যে ক্রেটগুলো নামিয়ে নিয়ে গেল, ড. রোয়েন গোনেন নি?

গুনেছেন কিনা জানি না, বলল নিকোলাস। তবে গুনলেও বাহান্নটা ক্রেট হত।

তাহলে তো অন্তত তিনটে লম্বা ক্রেট হালকা হয়ে গেছে, মাথায় করে নিয়ে যাবার সময় টের পায় নি ওরা যে ওগুলো খালি?

টয়লেটের জন্য এক গ্যালনের প্রচুর কেমিকেল বোতল ছিল এখানে, আরো ছিল বিশ-পঁচিশটা স্পেয়ার অক্সিজেন সিলিন্ডার, বলল নিকোলাস। ওজন ঠিক রাখার জন্য ওগুলো ক্রেটে ভরে দিয়েছি।

ড্যানিয়েলের হাসি দেখে কে! তবে তার প্রশ্ন শেষ হয় নি এখনো। আপনি জানলেন কীভাবে ড. রোয়েন আমাদেরকে ধোঁকা দেবেন?

আমার জানা উচিত যে ও চোর নয়, ওর ওই কথাটা মিথ্যে ছিল না। রোয়েন সত্যি সৎ একটা মেয়ে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত, সর্ব অর্থে। আমি বলতে চাইছি, আমাদের ঠিক বিপরীত চরিত্র।

খোঁচা মেরে বলা হলেও প্রশংসা করার জন্য ধন্যবাদ, মি. নিকোলাস, শুকনো গলায় বলল জেনি। কিন্তু আপনাকে সন্দিহান করে তোলার জন্য নিশ্চয়ই আরো কারণ ছিল।

হ্যাঁ, অবশ্যই ছিল, তার দিকে ঘুরলো নিকোলাস। প্রথম সন্দেহ জাগে আমরা যখন ইথিওপিয়া থেকে ফিরে আসি, এসেই মিশনে যাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন রোয়েন। বুঝতে পারি কিছু একটা করছেন। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হই রোয়েন যখন টিসের মাধ্যমে আদিসের মিশরীয় দূতাবাসে একটা মেসেজ পাঠালেন। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমাদের রিটার্ন ফ্লাইট সম্পর্কে মিশরের কাউকে সতর্ক করে দিয়েছেন উনি।

আরে, একটা জঘন্য মেয়ে!

সাবধান! হুঙ্কার দিয়ে উঠলো নিকোলাস। সে অত্যন্ত সভ্রান্ত একজন মেয়ে। সৎ, দেশপ্রেমিক, তরুণী। মনের মধ্যে তার এতোটুকু কলুষতা নেই

আচ্ছা, আচ্ছা! ড্যানি স্যাপারকে চোখ মারলো জেনি। ভুল হয়েছে। মাপ চাই!

*

প্রাচীন মিশরের মাত্র দুটো মুকুট রাখা হয়েছে পালিশ করা ওয়ালনাট কনফারেন্স টেবিলে। কনফারেন্স রুমটা জুরিখের একটা ফাইভ স্টার হোটেলের দশতলায়। সবগুলো জানালোর পর্দা টেনে দিয়েছে নিকোলাস, সিলিঙে লুকানো উৎস থেকে আলো পড়ছে মুকুট জোড়ার উপর। হোটেলটার একটা স্যুইট ভাড়া নিয়েছে নিকোলাস, সেই সঙ্গে প্রাইভেট কনফারেন্স রুমটাও।

আমন্ত্রীত অতিথির জন্য একা অপেক্ষা করার সময় চারদিকে তাকিয়ে প্রস্তুতিতে কোনো খুঁত আছে কিনা দেখে নিল নিকোলাস, তারপর আয়নার সামনে হেঁটে এসে স্যান্ডহার্সট টাইয়ের নটটা অ্যাডজাস্ট করলো। চিবুকের কাটাটা শুকিয়ে গেছে। ওর পরনের ডোরাকাটা স্যুটটা সেভাইল রো থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করা।

কোমল শব্দে ইন্টারকম বেজে উঠলো। হ্যান্ডসেট তুললাম নিকোলাস।

পিটার ওয়ালশ, আপনার অতিথি, নিচের লবিতে পৌঁছেছেন, স্যার নিকোলাস।

প্লিজ, ভদ্রলোককে ওপরে পাঠিয়ে দিন, বলল নিকোলাস।

কলিংবেল বাজতেই কনফারেন্স রুমের দরজা খুলে দিল ও। দরজার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন পিটার ওয়ালশ। স্যার নিকোলাস, বললেন তিনি, আশা করি আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন না। আপনার মেসেজ পেয়ে ব্যক্তিগত প্লেন নিয়ে সেই ফোর্ট ও অর্থ থেকে ছুটে আসতে হয়েছে আমাকে। নিকোলাস তাঁকে টেলিফোন করেছিল ত্রিশ ঘন্টা আগে। এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবার অর্থ হলো, ফোন পেয়েই প্লেনে চড়ে বসেন ভদ্রলোক।

ভেতরে আসুন, মি, ওয়ালশ, সহাস্যে বলল নিকোলাস। বলুন কী খাবেন।

এসব প্যাচাল বাদ দিন তো, ভেতরে ঢুকে বললেন ওয়ালশ। আগে বলুন কী দেখাতে চান। তাঁর পিছু দিয়ে আরো দুই জ্বলোক ভেতরে ঢুকলেন, দু জনকেই চেনে নিকোলাস।

দরজা বন্ধ করে কনফারেন্স টেবিলের দিকে তাকালো নিকোলাস। আসুন আমার সঙ্গে।

ধনকুবের পিটার ওয়ালশের বয়স সত্তর হলেও, দেখে মনে হয় পঞ্চাশ। পাকানো, তেল চকচকে খুঁটির মতো কাঠামো। ফর্বস ম্যাগাজিন-এর ধনকুবেরদের তালিকায় সাত নম্বরে আছেন তিনি, বলা হয়েছে এক দশমিক সাত বিলিয়ন নগদ মার্কিন ডলারের মালিক ভদ্রলোক।

অ্যান্টিকুয়ারিয়ান জগত্তা খুব ছোটই বলতে হবে, এ জগতে অল্প কিছু লোক চলাফেরা করেন, কাজেই তাদের প্রায় সবাইকেই চেনে নিকোলাস। ওয়ালশের একজন সঙ্গী ডালাস ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, প্রাচীন ইতিহাস পড়ান। ওই ভার্সিটিতে নিয়মিত চাঁদা দেন ওয়ালশ। অপর ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে নাম করা ও শ্রদ্ধেয় আন্টিকস ডিলার।

ওয়ালশ অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন, ফলে পেছনের ওঁরা দু জন তার সঙ্গে ধাক্কা খেলেন, যদিও ওয়ালশ তা খেয়ালই করলেন না।

এ আমি কী দেখছি? বিড়বিড় করলেন তিনি, তারপর নিকোলাসের দিকে চট করে একবার তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললেন, এগুলো কি নকল?

প্রথমে কিছু না বলে হাসলো নিকোলাস। তারপর বলল, পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

কনফারেন্স টেবিলের দিকে পা টিপে টিপে এগুলেন ওয়ালশ, যেনো ভয় পাচ্ছেন দ্রুত হাঁটলে চোখের সামনে থেকে মুকুট দুটো গায়েব হয়ে যাবে। এগুলো একদম নতুন, ফিসফিস করলেন তিনি। তা না হলে অন্তত অস্তিত্ব সম্পর্কে খবর পেতাম।

বলতে পারেন সদ্য মাটির নিচে থেকে তোলা হয়েছে, বলল নিকোলাস। আপনিই প্রথম দেখছেন।

মামোস! নেমেস মুকুটের খোদাই করা লিপির উপর চোখ বুলালেন ওয়ালশ। গুজবটা তাহলে মিথ্যে নয়! আপনি নতুন একটা সমাধি খুলেছেন।

প্রায় চার হাজার বছরে পুরানো একটা সমাধিকে আপনি যদি নতুন বলেন, আমার আপত্তি নেই।

ওয়ালশ আর তাঁর উপদেষ্টারা টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়ালেন। কারো মুখে কথা নেই, সবার চোখ চকচক করছে।

শুধু আমরা নিজেরা এখানে থাকব। কিছুক্ষণ, বললেন ওয়ালশ, নিকোলাসকে সরে যেতে বলছেন। কথা বলার সময় হলে আপনাকে ডাকব আমি। প্লিজ!

এক ঘণ্টা পর আবার কনফারেন্স রুমে ফিরে এলো নিকোলাস। তিন ভদ্রলোক টেবিলের তিন দিকে এমন ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেনো মুকুট দুটোর অবিচ্ছেদ্য অংশ পরিণত হয়েছেন তাঁরা। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন ওয়ালশ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কনফারেন্স রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তারা।

দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালশ কর্কশ সুরে জানতে চাইলেন, কত?

পনেরো মিলিয়ন মার্কিন ডলার, জবাব দিল নিকোলাস।

তার মানে প্রতিটি সাড়ে সাত মিলিয়ন।

না, প্রতিটি পনেরো মিলিয়ন। দুটো ত্রিশ মিলিয়ন।

ওয়ালশ এমনভাবে দুলে উঠলেন, মনে হলো চেয়ার থেকে সরে যাবেন। আপনি পাগল, না অন্য কিছু?

আসুন পার্থক্য কমিয়ে আনি, বললেন ওয়ালশ। সাড়ে বাইশ মিলিয়ন।

মাথা নাড়লো নিকোলাস। এক দর।

এ আপনার সাংঘাতিক অন্যায়, হারপার! আপনি ডাকাতি করতে চাইছেন।

উত্তর না দিয়ে হাতঘড়ি দেখলো নিকোলাস। তারপর ছোট্ট করে বলল, দুঃখিত।

চেয়ার ছাড়লেন ওয়ালশ। দুঃখিত আমিও। ঠিক আছে, আমি তাহলে গেলাম। পরে হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে, নতুন কিছু পেলে আমাকে খবর পাঠাবেন।

পেছনে হাত বেঁধে দরজার দিকে এগুলেন তিনি। দরজাটা খুলছেন, পেছন থেকে ডাকলো নিকোলাস, মি. ওয়ালশ!

ব্যঙ্গভঙ্গিতে ওর দিকে ঘুরলেন ওয়ালশ। ইয়েস?

পরের বার আপনি আমাকে শুধু নিকোলাস বলে ডাকবেন, আর আমি আপনাকে শুধু পিটার বলে, ঠিক আছে? আমরা তো পুরানো বন্ধুই, তাই না?

শুধু এটুকুই বলার আছে আপনার?

হ্যাঁ! আর কি? নিকোলাসকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।

আপনি আমাকে টরচার করছেন, অভিযোগ করলেন ওয়ালশ, ফিরে এলেন টেবিলের কাছে। চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়লেন। আপনি নরকে পচবেন।

নিকোলাস কথা বলছে না।

ঠিক আছে, টাকাটা আপনি কীভাবে চান?

দুটো ব্যাংক ড্রাফটে, প্রতিটি পনেরো মিলিয়ন ডলার।

ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়ালেন ওয়ালশ, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মসিউ মন্টিফ্লেরিকে ডাকুন।

*

কুয়েনটন পার্কে, নিজের স্টাডিরুমের ডেস্কে বসে সামনের দেয়াল ঢাকা প্যানেলিং-এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে নিকোলাস। ডেস্কের তলায় হাত গলিয়ে ইলেট্রনিক কন্ট্রোল-এর গোপন বোতামে চাপ দিল, প্যানেলের একটা অংশ নিঃশব্দে সরে গেল একপাশে বেরিয়ে পড়লো ডিসপ্লে কেবিনেটের আর্মারড প্লেট গ্লাস। একই সঙ্গে আপনা থেকে জ্বলে উঠলো সিলিঙের স্পটলাইট, চোখ ধাঁধানো রশ্মিগুলো পড়লো কেবিনেটে রাখা জিনিসগুলোর উপর। ফারাও মামোসের মৃত্যু মুখোশ আর দ্বৈত মুকুটের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো কী যেনো নেই ওখানে। তারপর ডেস্ক থেকে টাইটার উশব তি তুলে নিল ও, মুখের সামনে ধরে এমন সুরে কথা বলল, যেনো নিজের সঙ্গেই আলাপ করছে। নিঃসঙ্গতা কী জিনিস, তুমি তা ভালোই বোঝে, তাই না? এ ও বোঝ যে কাউকে ভালোবেসে না পাওয়াটা কী যন্ত্রণাময় একটা অভিজ্ঞতা!

স্ট্রাচুটা রেখে দিয়ে ফোনের দিকে হাত বাড়ালো নিকোলাস। আন্তর্জাতিক একটা নাম্বারে ফোন করে তিন বার রিঙ হতে আরবি কণ্ঠস্বর উত্তর দিল।

মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালকের অফিস। আপনার জন্য কী করতে পারি?

ডক্টর আল সিমা আছেন? আরবিতেই জানতে চাইলো নিকোলাস।

একটু ধরুন। আমি ওনাকে লাইনে দিচ্ছি।

ডক্টর আল সিমা বলছি। রোয়েনের গলা শুনে নিকোলাসের শিরদাঁড়া বেয়ে রোমাঞ্চকর একা শিহরণ নেমে এলো।

রোয়েন?

আপনি! ফিসফিস করে বলল রোয়েন। জীবনেও ভাবিনি আবার কথা হবে!

ডিরেক্টর হয়েছেন, কংগ্রাচুলেট করার জন্য ফোন করলাম।

আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন, বলল রোয়েন।

তিনটা ক্রেট কম পেয়েছি। আমরা।

জ্ঞানী এক লোক যেমন বলেছিল, বন্ধুদের ঠকানো সবচেয়ে সহজ-ওরা বেঈমানী আশা করে না। আপনিও করেন নি, আমিও না। কথাটার সত্যতা আপনার অন্তত বোঝা উচিত, রোয়েন।

তিন সেকেন্ড চুপ করে থাকলো রোয়েন। আপনি ওগুলো বিক্রি করেছেন, শুনেছি আমি। মুকুটগুলোর জন্য পিটার ওয়ালশ বিশ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন।

ত্রিশ মিলিয়ন, শুধরে নিল নিকোলাস। তবে শুধু নীল আর নেমেস মুকুটের বিনিময়ে। এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে লাল আর সাদা ক্রাউন সহ ডেথ-মাস্ক কেবিনেটে সাজানো রয়েছে।

এখন তবে লয়েডস্ ব্যাঙ্কে সমস্ত দেনা শোধ করতে পারবেন। আপনি উঠে দাঁড়িয়েছেন আবার।

আরে, মজার ব্যাপার। লয়েডস্ সিন্ডিকেট ভালো খবর দিয়েছে। এখনো একেবারে শেষ হই নি বলা যায়।

আমার মা যেমন বলে–বিড়ালের অনেক জীবন।

অর্ধেক অবশ্য টিসে আর মেক নিমুরের ভাগে গেছে।

অন্তত, একটা ভালো কাজে গেছে। দাঁত দাঁত ঘষলো রোয়েন। কণ্ঠস্বরে আক্রমণাত্মক ভাব। এসব জানাতে আপনি ফোন করেছেন?

না। আরো একটা মজার খবর আছে। আপনার প্রিয় লেখক, উইলবার স্মিথ সমাধি আবিষ্কারের কাহিনী নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে সম্মত হয়েছেন। তিনি ওটার নাম দিয়েছেন দ্য সেভেন্থ স্ক্রোল। আগামী বছরের শুরুর দিকে প্রকাশ পাচ্ছে। বইটা। তাঁর অটোগ্রাফ সহ একটা কপি আমি পাঠিয়ে দিব আপনার কাছে।

আশা করি, এবার অন্তত ভদ্রলোক সব সত্যি কথা লিখেছেন, শুষ্ক স্বরে রোয়েন বলে।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকলো। এরপর রোয়েন বলল, আমার সামনে পর্বতসমান কাজ। যদি আর কিছু বলার না থাকে, মানে

বলার আছে যে!।

বলুন?

আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।

রোয়েনের দম আটকানোর আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পেল নিকোলাস।

খুব নরম সুরে, বেশ খানিকটা পরে ও প্রশ্ন করলো, এরকম একটা অসম্ভব কথা কেন আপনি ভাবছেন?

কারণ আমি উপলব্ধি করেছি আপনাকে আমি ভালোবাসি, জবাব দিল নিকোলাস।

আবার নীরবতা। কিছুসময় পর রোয়েন বলল, ঠিক আছে।

ঠিক আছে মানে কী?

ঠিক আছে, মানে আমি রাজি। এ বিয়েতে আমার মতো আছে।

এ রকম একটা অসম্ভব কথা কেন আপনি ভাবছেন? এবারে, নিকির পালা।

কারণ, আমি উপলব্ধি করেছি। সবকিছুর পরেও, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আজ বিকেলে, ৫:৩০ মিনিটে হিথরো থেকে মিশরের উদ্দেশ্যে একটা বিমান ছেড়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো গাড়ি চালালে হয়তো প্লেনটা ধরতে পারবো আমি। কিন্তু কায়রো পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

যতে দেরিই হোক আমি এয়ারপোর্টে আসবো।

তবে, আর দেরি নয়। আমি আসছি! তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দরজার উদ্দেশ্যে ছুটলো নিকোলাস। হঠাৎ কী মনে হতে থমকে দাঁড়ালো সে, দ্রুত ফিরে এসে ডেস্ক থেকে তুলে নিল টাইটার উশ তি।

এসো, ব্যাটা বুড়ো বর্বর, দরাজ হাসি হেসে বলল নিকি। বাড়ি ফিরে যাচ্ছ তুমি–বিয়ের উপহার হিসেবে!

*

শেষ কথা

রক্ত-বেগুনি সন্ধ্যার আলোয় গলিপথ ধরে হেঁটে ফিরছিল ওরা। ওদের নিচে চির-প্রবাহমান নীল নদ তার শান্ত, সবুজ জলরাশি নিয়ে বয়ে চলেছে, ধারণ করে রেখেছে কতো না পুরাতন গোপন কানাকানি। লুক্সরে, রামেসিস-এর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে নদী তীরে একদিন যেখানে ফারাও মামোসের রাজকীয় জলযান নোঙর ফেলেছিল, পাটাতনে বসে ছিল গর্বিত ক্রীতদাস টাইটা আর তার ভালোবাসা, কত্রী লসট্রিস; সেখানটায় এসে একটু থেমে দাঁড়ালো কপোত কপোতি। নদীর ওপারে সন্ধ্যার ছায়া নেমে গেছে, দূর-দূরান্তের পাহাড়শ্রেণী ধারণ করে আছে বিগত জীবনের যতো স্মৃতি।

মামোসের সমাধি মন্দিরের গলিপথগুলো কবেই ঢাকা পরে গেছে তাঁর পরে জন্মানো ফারাওদের নিজস্ব স্থাপনার কারণে। কোনো মানুষ আজো পারে নি তার সমাধি মন্দির আবিষ্কার করতে, যে সমাধিতে কখনো শোয়া হয় নি মামোসের। ডুরেঈদ ইবনে আল সিমা যে প্রস্তরখন্ডের আড়ালে পরে থাকা সুড়ঙপথে খুঁজে পেয়েছিলেন বিস্মৃত রানি লসট্রিসের সমাধি এবং সেই সঙ্গে টাইটার লেখা স্ক্রোল, ধারণা করা হয়, তারই সন্নিকটে কোথায়ও অনাবিষ্কৃত রয়েছে ফারাও মামোসের সমাধির গুপ্তপ্রবেশ পথ।

ঘনায়মান সাঁঝের আলোয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওরা চারজন। নিজেদের মধ্যকার অটুট বন্ধুত্ত ওরা পবিত্র নিস্তব্ধতার মধ্যেই যেনো উপভোগ করতে চায়। একটা দ্রুতগতির নৌকা পার হয়ে যায় ওদের। নদীর উজান থেকে এসেছে ওটা, অনেক ট্যুরিস্টে বোঝাই, দশ দিনের জলপথ ভ্রমনে এতোটুকু ক্লান্ত নয়, উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত দিয়ে দেখাচ্ছে রামেসিসের সমাধি মন্দিরের থাম আর মূর্তি। সন্ধ্যার পবিত্রতা যেনো তাদেরও ছুঁয়ে গেছে, ফিসফিস করে কথা বলছে তারা।

টিসের হাতে হাত ধরে আছে রোয়েন। একসঙ্গে হাঁটছে দুই বান্ধবী। ওদের হালকা-পাতলা গড়ন, মধু-রঙা ত্বক আর মিষ্টি হাসির রিনিঝিনি শব্দ সাহারা মরু থেকে আসা তপ্ত বাতাসেও শান্তির পরশ বুলায়। নিকোলাস এবং মেক নিমুর আসছে ওদের পেছন পেছন। কোমল চোখে দেখছে নিজেদের জীবনসঙ্গিনীকে।

তো, তুমি তাহলে এখন আদ্দিসের বড়ো হর্তাকর্তা, মেক নিমুর। শেষমেষ যোদ্ধা থেকে রাজনীতিবিদ। বিশ্বাসই হয় না।

সবকিছুরই একটা সময় আছে। যুদ্ধ বলো বা শান্তি, এক মুহূর্তের জন্য সিরিয়াস হয়ে উঠে মেক। নিকি হাসে।

ওহ হো, রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে তোমার কথাবার্তার ধরনও পাল্টে গেছে দেখছি, হালকা করে মেকের হাতে ঘুসি মারে নিকোলাস। এক ধাক্কায় শক্তিশালী শুফতা দস্যু থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী!

নীল মুকটের বিক্রির টাকা কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মেক স্বীকার করে। তবে ওরা জানতো, আমি ছ তা ইথিওপিয়ায় কোনো গণতান্ত্রীক ইলেকশন কেউ মেনে নেবে না। শেষ মেষ তো আমিই জিতলাম।

একটাই দুঃখ, সমস্ত টাকা তুমি ওদের দিয়ে দিলে। পনেরো মিলিয়ন পাউন্ড। অনেক টাকা! নি োলাস বলল।

সরাসরি তো আর দিই নি, মেক সংশোধন করে বলে, রাজস্ব খাতে দিয়েছি। এখন নজরদারী করছি, কী করা হয় ওই টাকা দিয়ে।

যাই বলো, পনেরো মিলিয়ন বহু টাকা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে নিকোলাস।

এমন অতি উদারতা ঠিক হজম হচ্ছে না। কিন্তু সামনের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে যাকে রানিং মেট করেছে, তার সম্পর্কে প্রশংসা না করে উপায় নেই!

ওরা দু জনেই টিসের ছোট্ট গোল নিতম্ব আর পিঠে ছড়িয়ে থাকা কোঁকড়া কালো চুলে চোখ বোলায়। স্কার্টের নিচে থেকে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে একজোড়া সুগঠিত বাদামি পা।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে তোমাকে ঠিক মানায় না, কিন্তু টিসে অবশ্য সংস্কৃতি এবং পর্যটন মন্ত্রী হিসেবে দারুণ উতরে যাবে।

আগামি আগস্টে আমরা যখন ইলেকশন জিতবো, ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওকে আরো ভালো মানাবে।

এই সময়ে ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকালো রোয়েন।

রাস্তার ওপারে যাই এসো, কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে কখন যে ওরা লুক্সরের জাদুঘরের নতুন অংশের কাছে চলে এসেছে, টেরই পায় নি নিকোলাস। রাস্তা পার হয়ে মিউজিয়ামের প্রবেশ পথে যার যার স্বামীর হাত ধরলো ওরা।

চওড়া বুলেভার্দ অতিক্রমের সময় ঘোড়ায় টানা ছোট্ট রথের পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলো ওরা, মুখ নামিয়ে রোয়েনের গালে ঠোঁট বুলালো নিকোলাস। তুমি সত্যি খুব সুস্বাদু–লেডি কুয়েনটন-হারপার।

আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন, স্যার নিকি! খিলখিল হাসিতে ফেটে পরে

রোয়েন বলে। জানেনই তো, ও রকম করে আমাকে কেউ ডাকে না।

যাদুঘরের প্রবেশমুখে এসে থমকে দাঁড়ায় ওরা দু জনা। কারনাকের মতোই লম্বা, হাইপোস্টাইল থাম তৈরি করা হয়েছে এখানে। তবে আকৃতিতে ছোট্ট। হলুদ স্যান্ডস্টোনে তৈরি দেয়াল, ভবনের সারিগুলো পরিষ্কার এবং সাধারণ। খুবই আকর্ষণীয়।

মিউজিয়ামের প্রবেশপথে ওদের আমন্ত্রণ জানায় রোয়েন। এখনো পাবলিকের জন্য খোলা হয় নি যাদুঘরটা। সোমবারে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী প্রেসিডেন্ট মুবারক আসছেন। ইথিওপিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে থাকছে টিসে এবং মেক। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরী দু জন রোয়েনকে সালাম দিয়ে গেট খুলে দিল।

যাদুঘরের ভেতরটা মৌন আর শীতল। এয়ার কন্ডিশনিং করা হয়েছে এমনভাবে, যেনো প্রাচীন সম্পদের কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। মামোসের দারুণ ট্রেজারের চমৎকার প্রদর্শনী করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং সৌন্দর্যের উপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে সব সম্পদ; রাজকীয় নীল আলোয় যেনো জ্বলছে ওগুলো।

চার সদস্য শান্ত এবং সমাহিত ভঙ্গিতে সমস্ত ট্রেজার পেরিয়ে হেঁটে চলে, নরমস্বরে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয় রোয়েন। অবাক বিস্ময় ওদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চূড়ান্ত প্রকোষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে এখন সবাই, এখানেই রয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান সংগ্রহ।

মামোসের সম্পদের বেশির ভাগটাই এখনো ডানডেরা নদীর নিচের সমাধিতে আটকে রয়েছে–ভেবে দেখুন, ফিসফিসায় টিসে। আরেকবার ওই অভিযান শুরু করতে ইচ্ছে করছে আমার।

আরে, বলতে ভুলে গেছি। মেক হাসে। স্মিথসোনিয়ান কোম্পানি বিরাট একটা অঙ্ক ঘোষণা করেছে, এ প্রজেক্টে ডানডেরা নদী থেকে আবার সমাধি সম্পদ উত্তোলনের কাজ হবে। মিশর আর ইথিওপিয়া–দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে।

দারুণ খবর! খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে রোয়েন। এই সমাধি নিজেই পৃথিবী শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হয়ে উঠবে, ইথিওপিয়া বহু টাকা কামাবে ট্যুরিজম থেকে।

এতো দ্রুত নয়, মেক নিমুর বাধা দেয়। একটা শর্ত আছে তাদের।

মুখ মলিন হয়ে যায় রোয়েনের। কি শর্ত?

তাদের দাবি–আপনি, রোয়েন, প্রজেক্টের পরিচালক হবেন।

খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো রোয়েন। এরপর, কপট ভাগম্ভিরতার সাথে বলল, আমারও একটা শর্ত আছে।

সেটা আবার কী? মেক জানতে চায়।

আমি নিজে প্রজেক্টের জন্য সহকারী নির্বাচিত করব।

হাসিতে ফেটে পরে মেক নিমুর। আমরা সবাই জানি, কে সেটা। নিকোলাসের পিঠে চাপড়ে দেয় সে। শুধু লক্ষ্য রেখো, সমস্ত আর্টিফ্যাক্ট যেনো ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারো!

নিকির কোমর ধরে কাছে টানে রোয়েন। ও বদলে গেছে একেবারে। এবারে তার প্রমাণ দিব। স্বামীর কোমর ধরে রেখে সবাইকে শেষ প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেল রোয়েন।

প্রবেশমুখে এসে থমকে দাঁড়ায় মেক এবং টিসে। কক্ষের মধ্যখানে আর্মারড কাঁচে মোরা ডিসপ্লে কেস দেখতে থাকে। লাল-সাদা উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যের মুকুট আর ফারাও মামোসের মৃত্যু-মুখোশ বসে আছে তীব্র স্পটলাইটের নিচে।

মেক নিমুর সবার আগে এ শক থেকে মুক্তি পায়। ডিসপ্লে কেসের সামনের প্যানেলে এসে প্লেটটা ভালো করে পড়ে সে–স্যার নিকোলাস এবং লেডি কুয়েনটন-হারপারের উপহার।

অবাক বিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিকোলাসকে দেখে সে। আর তুমি কিনা আমাকে তিরষ্কার করছিলে নীল মুকুটের টাকা সমস্তটা দিয়ে দেওয়ায়। নিজেই দেখছি লুটের শেয়ার দিয়ে দিয়েছ!

কাজটা কঠিন হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বীকার করে নিকোলাস। কিন্তু অত্যন্ত নাজুক একটা আলটিমেটাম দিয়েছিল একজন–সে এ মুহূর্তে আমার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে!

খুব বেশি দুঃখ করো না, খোকা, হাসতে হাসতে বলল রোয়েন। নেমেস মুকুট পিটার ওয়ালশের কাছে বেঁচে ইতোমধ্যে সুইটজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রেখেছে ও। বলেও ওটা আদায় করতে পারি নি।

দ্যাখো, আমার ব্যক্তিজীবনের এতো কিছু প্রকাশ করে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, নিকোলাস বলে ঘার গোঁজ করে। অনেক আগেই সূর্য অস্ত গেছে, এখন পানাহারের সময়। মনে হয়, হোটেলের বারে ভালো কিছু পানীয় দেখেছি আসার সময়। চলো গিয়ে দেখি, ঠিক দেখলাম কি না।

রোয়েনের হাত ধরে হেঁটে চলে নিকোলাস। মেক আর টিসে ওদের পিছু পিছু হেঁটে আসে, নিকোলাসের অস্বস্তিতে যার-পর-নাই আনন্দিত দু জনেই।

Exit mobile version