এই সবগুলো ধারণারই অস্তিত্ব শুধু মানুষের বানিয়ে তোলা কিছু গল্পে যেগুলো তারা বিশ্বাস করে এবং একে অপরের কাছে ছড়িয়ে দেয়। মানুষের এই সমষ্টিগত কল্পনার বাইরে সমগ্র মহাবিশ্বে কোনো ‘ঈশ্বর’ নেই, কোনো ‘রাষ্ট্র’ নেই, ‘টাকা’ বলে কিছু নেই, ‘মানবাধিকার’ নেই, ‘আইন’ নেই, নেই কোনো ‘ন্যায়বিচার’।
মানুষ এ কথাটা সহজেই বুঝতে পারে যে, ভূত-প্রেত কিংবা আত্মায় বিশ্বাস করার মধ্য দিয়ে প্রাচীন মানুষের মাঝে এক ধরনের সামাজিক বন্ধন, এক ধরনের সামাজিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল। এবং এই বিশ্বাসগুলোই তাদের দিয়েছিলো প্রতি পূর্ণিমার রাতে আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচার মতো রীতি বা আচার-অনুষ্ঠান। যেটা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বা বুঝতে চাই না সেটা হল, আধুনিক সামাজিক সংগঠনগুলোও ঠিক একই নিয়মে গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যের দুনিয়ার কথাই ধরা যাক। আধুনিককালের ব্যবসায়ী এবং আইনজীবীরা একেকজন শক্তিশালী জাদুকর। প্রাচীনকালের মানবগোষ্ঠীগুলোতে যে ধরনের জাদুকর থাকত তাদের সাথে এদের একটাই পার্থক্য। সেটা হলো, তারা আগের জাদুকরদের থেকে অনেক বেশী চমকপ্রদ গল্প বলতে পারে। এ ধরনের চমকপ্রদ গল্পের একটা চমৎকার উদাহরণ হতে পারে ‘পিউজো’ (Peugeot) কোম্পানির ইতিহাস।
প্যারিস থেকে সিডনি পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করা মোটরগাড়ি, ট্রাক এবং মোটরসাইকেলের গায়ে আধা-সিংহ আধা-মানুষের (Stadel lion-man) প্রতিকৃতি সম্বলিত একটা চিহ্ন প্রায়ই দেখা যায়। আধা-সিংহ আধা-মানুষের এই চিহ্নটা আসলে জার্মানির স্ট্যাডেল গুহায় পাওয়া যাওয়া অনেক প্রাচীন একটি মূর্তির প্রতিরূপ। এই চিহ্নটা পিউজো কোম্পানির তৈরি করা গাড়িগুলোর জন্য অপরিহার্য এক অলংকার। পিউজো ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন এবং বৃহদাকার গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে অন্যতম। পিউজো কোম্পানি ভ্যালেনটিগনি (Valentigney) নামের একটি গ্রামে পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে গাড়ি তৈরি করতে শুরু করে। এই গ্রামটি ছিলো স্ট্যাডেল গুহা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। বর্তমানে এই কোম্পানিতে প্রায় দুই লাখ লোক কাজ করে যাদের বেশিরভাগই একে অপরকে চেনে না। কিন্তু এই অচেনা লোকগুলো পরস্পরের সাথে এত নিঁখুতভাবে কাজের সমন্বয় করে যে ২০০৮ সালে পিউজো কোম্পানি প্রায় ১৫ লাখ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি তৈরি করে এবং সেখান থেকে তাদের মুনাফা আসে ৫৫০ কোটি ইউরো।
এখন, কোন অর্থে আমরা বলতে পারি যে, পিউজো (Peugeot SA) কোম্পানিটির অস্তিত্ব আছে? পিউজো কোম্পানির বানানো অনেক গাড়ি আছে, কিন্তু গাড়িগুলোকে কি একটি কোম্পানি বলা যায়? যদি পিউজো কোম্পানির বানানো সবগুলো গাড়ি ভেঙে ফেলা হয় এবং লোহালক্কড়ের দোকানে সেই ভাঙা টুকরো-টাকরা গুলো বেচেও দেওয়া হয়, তারপরও কিন্তু পিউজো কোম্পানিটি থেকে যাবে। এটা আরও নতুন নতুন গাড়ি তৈরি করবে এবং বার্ষিক আয় ব্যয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। কোম্পানিটির গাড়ি বানাবার কারখানা আছে, আছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং বিক্রি করার জন্য দোকান। কোম্পানিতে কাজ করে অনেক শ্রমিক, হিসাবরক্ষক এবং কর্মকর্তা কিন্তু, এ সবকিছুর সমষ্টিকেও কিন্তু পিউজো কোম্পানি বলা যাবে না। কারণ, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোম্পানির সকল কর্মচারী মারা যেতে পারে, কোম্পানিটির সকল কারখানা, যন্ত্রপাতি এবং দোকান গুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। এরপরও কোম্পানিটি টাকা ধার করতে পারবে, নতুন কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবে, নতুন করে কারখানা বানাতে পারবে এবং যন্ত্রপাতি কিনতে পারবে। সুতরাং এসবের সমষ্টিকেও পিউজো কোম্পানি বলা যাচ্ছে না। পিউজো কোম্পানিতে আছে অনেক ম্যানেজার এবং আছে অনেক শেয়ারমালিকও। কিন্তু তারাও কিন্তু কোম্পানির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য নয়। সবগুলো ম্যানেজারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও এবং কোম্পানির সবগুলো শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হলেও কোম্পানিটি বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে।

কিন্তু এতসব কথার মানে কিন্তু এই নয় যে, পিউজো কোম্পানি অমর বা কোনোকিছুতেই তার অস্তিত্ব বিলীন হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেই মুহূ্র্তে একজন বিচারক কোম্পানি ভেঙে দেবার ঘোষণা দেবেন, এর সকল কর্মচারী, কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষক, ম্যানেজার, শেয়ারমালিক সকলে অক্ষত থাকলেও সাথে সাথেই পিউজো কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এ থেকে বোঝা যায়, বাস্তব দুনিয়ার কোনো বস্তু বা ব্যক্তিই পিউজো কোম্পানির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য নয় এবং পিউজো কোম্পানি বাস্তব জগতের কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সমষ্টি নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে বাস্তব দুনিয়ায় আদৌ কি ‘পিউজো’ বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে?
পিউজো হল আমাদের সমষ্টিগত কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট একটি সত্তা। আইনজীবীরা একে বলেন ‘আইনসিদ্ধ গল্প’ (legal fiction)। আপনি আঙুল তুলে কখনোই একে দেখাতে পারবেন না, কারণ এর কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এটি একটি আইনসিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে সমাজে টিকে থাকে। আপনার আমার মতো এই অদৃশ্য, কল্পিত সত্ত্বাটিও নিজ দেশের প্রচলিত আইন কানুনের অধীন। এই কাল্পনিক সত্ত্বাটি আমাদের মানুষদের মতোই একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে, কিনতে পারে নিজের নামে জমি-জমা-সম্পত্তি। এবং মানুষের মতোই এই কোম্পানিতে যারা কাজ করে তারা কোম্পানিকে অভিযুক্ত এবং ধ্বংসও করতে পারে।