Site icon BnBoi.Com

এ পকেট ফুল অফ রাই – আগাথা ক্রিস্টি

এ পকেট ফুল অফ রাই - আগাথা ক্রিস্টি

এ পকেট ফুল অফ রাই

১.১ কনসোলিডেটেড ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট অফিসে

 পকেট ফুল অফ রাই (১৯৫৩) / আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

প্রথম পর্ব

০১.

কনসোলিডেটেড ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট অফিসে এই সময় চা তৈরির পালা এক এক জনের। আজ নতুন টাইপিস্ট মিস সোমার্স চা তৈরি করে সকলকে দিল।

অফিসের কর্তা মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি মিস গ্রসভেনর। তিনিই বিশেষ চা’টা তৈরি করে মিঃ ফর্টেস্কুর কামরায় ঢুকলেন।

স্বর্ণকেশ এই সুন্দরী মহিলার চলা বলা সমস্ত কিছুই আকর্ষণীয়। বেশবাস ও প্রসাধনে সে নিজেকে আরও মোহনীয় করে তুলবার চেষ্টা করে।

অফিসে এ নিয়ে অনেকেই কানাঘুষা করে। তবে তা ঠিক নয়। মিঃ ফর্টেঙ্কু সম্প্রতি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীটিও যথেষ্ট সুন্দরী। কাজেই অফিসের কোন সুন্দরীর দিকে তার নজর পড়বার কথা নয়।

রাজহংসীর ভঙ্গিতে চায়ের ট্রে হাতে মিস গ্রসভেনর কামরায় ঢুকে কর্তার টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। মিষ্টি স্বরে বললেন, আপনার চা মিঃ ফর্টেস্কু।

বেলা এগারোটা দশ মিনিট। খানিকক্ষণ আগে চা দেওয়া হয়েছে।

সহসা মিস গ্রসভেনরের টেবিলের কলিংবেল তীব্রস্বরে বেজে উঠল।

জরুরী ডাকের ইঙ্গিত পেয়ে চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন মিস গ্রসভেনর। ধীর ছন্দে মিঃ ফর্টেস্কুর কামরার সামনে এসে তিনি টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

মুহূর্তে যেন এক তীব্র ধাক্কা খেলেন তিনি। যে দৃশ্য চোখের সামনে দেখলেন তা তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল।

মিঃ ফর্টেস্কু ডেস্কের পেছনে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। শরীর জুড়ে ভয় জাগানো আক্ষেপ।

–ওহ্ মিঃ ফর্টেস্কু..আপনি কি অসুস্থ

কোনরকমে বলবার চেষ্টা করলেন মিস গ্রসভেনর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন কিন্তু তাঁর পৌঁছবার আগেই মিঃ ফর্টেস্কুর দেহ যন্ত্রণায় প্রায় ধনুকের মতো বেঁকে গেল।

–ওই চা–কি দিয়েছ–একজন ডাক্তার

যন্ত্রণাকাতর শব্দ কয়টি অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলেন তিনি।

মিস গ্রসভেনর সন্ত্রস্ত কপোতর মতো ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে টাইপিস্টদের ঘরে ঢুকলেন। চিৎকার করে বললেন, মিঃ ফর্টেঙ্কু বোধহয় মরতে চলেছেন…অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন…এখুনি একজন ডাক্তার ডাকতে হবে…তার অবস্থা সংকটজনক।

মুহূর্তে সমস্ত অফিসে তোলপাড় শুরু হল।

ষোল বছরের পুরনো কর্মী, অফিসের প্রধান টাইপিস্ট মিস গ্রিফিথ অফিসের ছোকরা বয়কে একজন ডাক্তার ডেকে আনতে পাঠিয়ে দিলেন।

অপর একজন, মিঃ ফর্টেস্কুর ব্যক্তিগত ঠিকানা লেখা বই খুঁজতে শুরু করলেন। তাতে খুঁজে পাওয়া গেল হার্লে স্ট্রীটের স্যর এডউইন স্যাণ্ডেম্যালের ঠিকানা।

মিস গ্রসভেনর ততক্ষণে একটা চেয়ারে এলিয়ে পড়েছেন। কাতর স্বরে বলছেন, রোজকার মতোই চা বানিয়েছিলাম…ওতে তো কোন গোলমাল থাকতে পারে না–

মিস গ্রিফিথ ডাক্তারকে টেলিফোন করছিলেন। রিসিভার হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একথা বলছ কেন?

–মিঃ ফর্টেঙ্কু বললেন,…চায়ের মধ্যে ছিল….

কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসের ছোকরা বয়ের চেষ্টায় আর মিস গ্রিফিথের টেলিফোনে দুজন ডাক্তার আর দুটো আলাদা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল অফিসের সামনে।

মিঃ ফর্টেস্কুকে সেন্ট জিউড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

ডঃ আইজ্যাক্স বেথনাল গ্রিন আর হার্লে স্ট্রীটের স্যর এডুইন স্যাণ্ডেম্যাল মিঃ ফর্টেস্কুর আকস্মিক অসুস্থতাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে মনে করেননি।

ইনসপেক্টর নীল ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিয়মমাফিক তদন্তের কাজ শুরু করেছিলেন।

তিনি মিস গ্রসভেনরের কাছ থেকে সকালে মিঃ ফর্টেস্কুর চা পর্বের সমস্ত বর্ণনা শুনে নিয়েছেন।

আনুপূর্বিক ঘটনার বর্ণনা মিস গ্রিফিথের কাছ থেকেও শুনেছেন আলাদা ভাবে।

অফিসের কাপ ডিস, চায়ের পাত্র ইত্যাদি সরঞ্জাম সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের জন্য যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ইনসপেক্টর জানতে পারলেন এসব বাসনপত্র কেবল মিস আইরিন গ্রসভেনরই হাতে নিয়েছিলেন। কেবল কেটলিটা সকলের চায়ের জন্যই ব্যবহার করা হয়েছিল।

মিস গ্রসভেনরের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হলে সেন্ট জিউস হাসপাতাল থেকে ফোন এল। ধরলেন ইনসপেক্টর নীল।

ওপাশ থেকে আবেগবর্জিত গলায় শোনা গেল, পাঁচ মিনিট আগে মিঃ ফর্টেস্কু মারা গেছেন।

ইনসপেক্টর নীল নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে ব্লটিং কাগজে লিখে রাখলেন বারোটা তেতাল্লিশ।

সেন্ট জিউস হাসপাতালের ডঃ বার্নসডর্ফ বছর খানেক আগে একটি বিষপ্রয়োগের ঘটনায় ইনসপেক্টর নীলের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

ডঃ বার্নসডর্ফ স্বয়ং ইনসপেক্টর নীলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললেন।

–হ্যাল্লো নীল, বুড়ো শকুন, বিষের লাশ নিয়ে পড়েছ আবার?

–হ্যাল্লো ডাক্তার, আমাদের রোমী মারা গেছে শুনলাম।

–হ্যাঁ। আমাদের কিছুই করার ছিল না।

–মৃত্যুর কারণ জানা গেছে?

–ময়না তদন্তের আগে কিছু বলা ঠিক হবে না। এটুকু বলতে পারি, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়–কথাটা অবশ্য ব্যক্তিগত।

–নিশ্চয়ই…নিশ্চয়ই…তাহলে বলছেন বিষপ্রয়োগের ঘটনা?

–অবশ্যই। বেসরকারীভাবে আর একটা কথা জানাচ্ছি, ভায়া, বিষটা ছিল ট্যাকসিন –

ট্যাকসিন–সে আবার কি রকম বিষ…কোন দিন তো নাম শুনিনি–

-খুবই স্বাভাবিক। খুব কম লোকেই নামটা জানে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই এরকম একটা কেস আমার হাতে আসে। একটা বাচ্চা খেলার সময় ইউ গাছের ফল খেয়ে বিভ্রাট বাঁধিয়েছিল…একই কেস

–ইউ গাছের ফল?

-ফল বা পাতা। সমান বিষাক্ত। এর উপক্ষার হল ট্যাক্সিন। এসব কাজে ট্যাক্সিন একেবারে মোক্ষম। অবশ্য আমারও ভুল হতে পারে…তবে তোমাকে ব্যক্তিগত ভাবে জানালাম। কাজটা খুবই আগ্রহ জাগাবার মতো–ভদ্রলোকের জন্য দুঃখ হয়।

–মারা যাবার আগে তিনি কিছু বলেছিলেন?

–তোমার লোক পাশেই ছিল, লিখে নিয়েছে। তার কাছ থেকে জানতে পারবে সব কিছু। অফিসে চায়ের মধ্যে কিছু দেওয়া হয়েছিল এরকম কথা তিনি বলেছিলেন–অবশ্য এটা ঠিক নয় একেবারে।

–ঠিক নয় বলছ কেন?

–কারণ হল, এই বিষটা দ্রুত কাজ করতে পারে না। আমার বিশ্বাস, বিষের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তিনি চা পান করার পরেই।

–হ্যাঁ, অফিসের লোকরা এরকমই জানিয়েছে।

–সায়ানাইড আর মাত্র কয়েক ধরনের বিষই আছে যা দ্রুত কাজ করে।

–এক্ষেত্রে সায়ানাইড জাতীয় কিছু নয় বলছ?

-না, ভায়া, ওরকম বিষের কোন সম্ভাবনাই নেই। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছবার আগেই তিনি মারা যান। বেসরকারী ভাবেই তোমাকে বলছি, আমি বাজি রেখে বলতে পারি বিষটা ছিল ট্যাকসিন।

–এই বিষের প্রতিক্রিয়া হতে কত সময় লাগে?

–ধর, এক থেকে তিন ঘণ্টা। সময়টা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। মৃতব্যক্তির প্রাতরাশটা ভালই করা ছিল মনে হয়। তাই বিষের ক্রিয়া একটু সময় নিয়ে হয়েছে।

–প্রাতরাশ? চিন্তিত ভাবে বললেন ইনসপেক্টর নীল।

–তোমার শিকার সফল হোক ভায়া…তাহলে রাখছি।

–ধন্যবাদ ডাক্তার। ফোনটা দয়া করে একটু সার্জেন্টকে দিন। তার সঙ্গে কথা বলব।

একটু পরেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে সার্জেন্ট হে’র গলা ভেসে এল।

-বলুন স্যর

–নীল বলছি। আমাকে শোনাবার মতো কিছু কি আছে–মৃত ব্যক্তি কি বলেছিলেন?

-উনি বলেছিলেন চায়ে কিছু ছিল–অফিসে খেয়েছিলেন। তবে মেডিক্যাল অফিসার অন্য কথা বলেছেন।

-হ্যাঁ, সেকথা শুনেছি। আর কিছু?

–একটা অদ্ভুত ব্যাপার স্যর। উনি সে স্যুট পরেছিলেন তার পকেট পরীক্ষা করে আমি রুমাল, চাবি, পকেটব্যাগ, খুচরো টাকা–সাধারণত যা থাকে তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত জিনিস পেয়েছি।

–কি জিনিস?

–তার জ্যাকেটের ডানদিকের পকেটে কিছু শস্যের দানা ছিল।

–শস্যদানা? কি শস্য? প্রাতরাশের কোন খাবার কি? বার্লি, গম বা ভুট্টার দানা—

ওটা রাই বলেই মনে হল স্যর, বেশ কিছুটা পরিমাণেই ছিল–

–আশ্চর্য ব্যাপার…ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু হবে সম্ভবত–কোন নমুনা—

আমারও তাই ধারণা–তবে জানানো উচিত মনে হল–তাই –

ঠিক কাজই করেছ।

চিন্তিত ভাবে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ইনসপেক্টর নীল। অফিসেই বিষপ্রয়োগ হয়েছে–এরকম সন্দেহটা মাথা জুড়ে ছিল। সন্দেহ থেকে এবারে নিশ্চিত অবস্থায় এলেন।

রেক্স ফর্টেস্কুকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে লক্ষণ প্রকাশ হবার অন্তত এক থেকে তিন ঘন্টা আগে।

সুতরাং একটা দিকে নিশ্চিত হওয়া গেল যে অফিসের কর্মচারীরা এ ব্যাপারে নির্দোষ।

মিঃ ফর্টেস্কুর খাস কামরায় বসে এতক্ষণ কাজ করছিলেন ইনসপেক্টর নীল। তার সঙ্গে একজন অধস্তন পুলিস কর্মচারীও ছিল।

এবার সেখান থেকে উঠে তিনি অফিসের বাইরের ঘরে এলেন। সেখানে টাইপিস্টরা টাইপরাইটারে কাজ করছিলেন। কিন্তু তাদের কাজে কোন গতি ছিল না।

মিস গ্রিফিথকে ডেকে হাসপাতাল থেকে পাওয়া দুঃসংবাদটা জানালেন নীল।

–মিঃ ফর্টেস্কু বারোটা তেতাল্লিশে মারা গেছেন।

মিস গ্রিফিথ আশ্চর্য হলেন না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন মনে হয় তিনি অসুস্থ ছিলেন।

কোন রকম ভূমিকা না করে নীল এরপর সরাসরি মিস গ্রিফিথকে বললেন, মিঃ ফর্টেস্কুর পরিবারের কিছু খবরাখবর আমার জানা দরকার। আপনি নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করবেন?

নিশ্চয়ই ইনসপেক্টর।

এরপর এসম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে যা জানা গেল তা এরকম।

মিঃ ফর্টেস্কু সপরিবারে বেডন হীথ অঞ্চলে অভিজাত পাড়ায় নিজস্ব বাড়িতে বাস করেন। লণ্ডন থেকে এই অঞ্চলের দূরত্ব মাত্র কুড়ি মাইল। ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা খুবই ভাল।

বছর দুয়েক আগে মিঃ ফর্টেঙ্কু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। প্রথম মিসেস ফর্টেষ্ণু বহুদিন আগে মারা যান। দ্বিতীয়া স্বামীর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।

প্রথম পক্ষের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা হল পার্সিভাল ও ল্যান্সলট। মেয়ে ইলেইন।

মেয়ে বাড়িতেই থাকে। বড় ছেলেও। তিনি ব্যবসার একজন অংশীদার। সম্প্রতি ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে ইংলণ্ডের উত্তরাঞ্চলে গেছেন। আগামীকাল তার ফিরে আসার কথা।

মিঃ ফর্টেস্কুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর মিঃ পার্সিভালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে, হোটেলে পাওয়া যায়নি। তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের হোটেল ছেড়ে আজ সকালেই অন্যত্র চলে গেছেন।

মিঃ ফর্টেস্কুর দ্বিতীয় ছেলে মিঃ ল্যান্সলট, বাবার সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি বিদেশে থাকেন।

দুই ছেলেই বিবাহিত। মিঃ পার্সিভাল বছর তিন আগে বিয়ে করেছেন। তিনি ইউটি লজেই আলাদা ফ্ল্যাটে থাকেন। তবে শিগগিরই বেডন হীথেই নিজেদের বাড়িতে উঠে যাবেন।

আজ সকালে বেডন হীথেও টেলিফোন করা হয়েছিল। মিসেস ফর্টেস্কুকে পাওয়া যায়নি, তিনি গলফ খেলতে গেছেন।

মিসেস পার্সিভালকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। তিনি সারাদিনের জন্য লণ্ডনে গেছেন।

ছোট ছেলে মিঃ ল্যান্সলট বছর খানেক হল বিয়ে করেছেন। তিনি বিয়ে করেছেন লর্ড ফ্রেডরিক অ্যানটিসের বিধবাকে। তাদের বিয়ের ছবি কাগজে ছাপা হয়েছিল।

প্রয়াত লর্ড ফ্রেডরিক অ্যানটিসের নামটি ইনসপেক্টর নীলের জানা। খেলাধুলার জগতে খুব দুর্নাম ছিল ভদ্রলোকের। একটা ঘোড়া দৌড়াবার আগে তিনি নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

তার স্ত্রীর সম্পর্কেও একটি ঘটনা নীলের জানা। তিনি এর আগে বিয়ে করেছিলেন এক বৈমানিককে। ব্রিটেনের যুদ্ধে তিনি মারা যান।

এরপর নীল ফোন করলেন বেডন হীথে ইউট্টি লজে। কিন্তু এব্যাপারে কথা বলার মতো সেই সময় বাড়িতে ফর্টেন্ধু পরিবারের কেউই উপস্থিত ছিলেন না।

বাড়ির হাউসকিপার মিস ডাভের সঙ্গেই অগত্যা কথা বললেন নীল। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি জানালেন মিঃ ফর্টেস্কুকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তার মৃত্যু হয়েছে।

এধরনের আকস্মিক মৃত্যুতে নিয়মমাফিক কিছু তদন্ত পুলিসকে করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি সেকাজেই বাড়িতে আসছেন।

.

–মিস গ্রিফিথ, এবারে আর কিছু, যা আপনি জানেন, আমাকে জানালে খুশি হব। আচ্ছা মিঃ পার্সিলের সঙ্গে তার বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল? প্রশ্ন করলেন নীল।

ইদানীং তাদের বনিবনা হচ্ছিল না। মিঃ পার্সিভাল তার বাবার অনেক কথাই মেনে নিতে পারছিলেন না। এই নিয়েই কথা কাটাকাটি হতো।

পিতা পুত্রের এসব ঝগড়াঝাটি আপনারাও শুনেছিলেন?

-হ্যাঁ, শুনেছিলাম। মিঃ ফর্টেস্কু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ল্যান্সকে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন। সে ভাল ঘরে বিয়ে করেছেন, তার বুদ্ধিও বড় ছেলের চেয়ে অনেক বেশি চোখা।

এরপর অফিসের অন্য কর্মী মিস গ্রসভেনরের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলেন নীল।

মিস গ্রিফিথ বিদায় নিলে ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ওয়েট তার ঊধ্বর্তন অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ ফর্টেস্কু যে ধরনের ব্যবসা করতেন, তাতে বাজারে তার অনেক শত্রু থাকা অসম্ভব নয়।

–হ্যাঁ, শক্ত নিশ্চয়ই ছিল, বললেন নীল, তবে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল বাড়িতে, অফিসে নয়। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে আমি একটা পরিচিত নক্সা দেখতে পাচ্ছি, ওয়েট। দেখ, ভদ্রলোকের দুই ছেলে, বড়টি ভাল। ছোট ল্যান্স বদ। এদিকে স্ত্রীর বয়স স্বামীর চেয়ে ঢের কম। স্ত্রীটির আবার গলফের মাঠে যাতায়াত আছে। খুবই পরিচিত একটা ছক।

এই সময় মিস গ্রসভেনর ঘরে প্রবেশ করলেন। ইনসপেক্টর তাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

পরে সরাসরিই প্রশ্ন করলেন, মৃত মিঃ ফর্টেস্কু সম্পর্কে আপনাকে দু-একটি প্রশ্ন করতে চাই। ইদানীং তার মধ্যে কোন পরিবর্তন কি আপনি লক্ষ্য করেছিলেন?

পরিবর্তন, মিস গ্রসভেনর বললেন, ঠিক পরিবর্তন কিনা বলতে পারব না, তবে হঠাৎ করেই কেমন রেগে উঠতেন। বিশেষ করে মিঃ পার্সিভাল সম্পর্কে।

–আর একটা প্রশ্ন কেবল আপনাকে করছি মিস গ্রসভেনর। মিঃ ফর্টেস্কুর কি পকেটে শস্যের দানা নিয়ে ঘোরার অভ্যাস ছিল?

-শস্যের দানা? পকেটে? অত্যন্ত বিস্মিত হলেন মিস গ্রসভেনর, এরকম কেন হবে… না না…

ধরুন বার্লি, রাই বা এই জাতীয় কিছু ব্যবসাসংক্রান্ত লেনদেন বা নমুনা হিসেবে

-ওহ না। এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য তিনি প্রতীক্ষা করছিলেন। আর আসার কথা ছিল এট্ৰিকাস বিল্ডিং সোসাইটির প্রেসিডেন্টের

মিস গ্রসভেনরের কাছ থেকে আর কিছু জানার ছিল না। ইনসপেক্টর নীলের সামনে ব্যাখ্যাহীন প্রশ্ন হয়ে রয়ে গেল এক পকেট রাই।

.

ইউট্টি লজের সামনে গাড়ি থেকে যখন নামলেন ইনসপেক্টর নীল আর ডিটেকটিভ কনস্টেবল ওয়েট–মিস ডাভ জানালা দিয়ে দুজনকে আগেই দেখতে পেলেন।

ইউট্রি লজ নামের বিশাল বাড়িটা লাল ইটের তৈরি। অনেকটা লম্বাটে ধরনের। মাঝে মাঝে টালিবসানো ত্রিকোণ আর শার্সিলাগানো জানালা।

সামনে বিস্তীর্ণ বাগান। সেখানে চোখে পড়ে গোলাপ ফুলের গাছের সঙ্গে নানা জাতের লতা। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ইউ গাছের ঝোপ।

বাড়ির ডানপাশে বিশাল এক ইউ গাছ খোলা আকাশে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে বেড়ে উঠেছে। তার তলায় অজস্র সেই বিষফল।

যে কেউ এসব ফল দিয়ে ইচ্ছে মতো ট্যাকসিন তৈরি করে নিতে পারে–চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবলেন নীল।

অস্বস্তিকর ভাবনাটা মাথায় নিয়েই সদর দরজার ঘণ্টা বাজালেন তিনি। দরজা খুলে তাকে অভ্যর্থনা করল মধ্যবয়স্ক একজন লোক।

নিজের আর সঙ্গীর পরিচয় দিয়ে নীল জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস ফর্টেস্কু ফিরেছেন?

-না, স্যর।

–মিঃ পার্সিভাল বা মিস ফর্টেস্কু?

–না, স্যর।

–তাহলে আমি মিস ডাভের সঙ্গেই কথা বলতে চাই।

–ওই যে উনি আসছেন। একপাশে সরে গিয়ে বলল লোকটি।

এইসময় সিঁড়ি দিয়ে কৃশ চেহারার একজন মহিলাকে নিচে নেমে আসতে দেখা গেল। তার পরণে হালকা রঙের পোশাক। নিখুঁত ভাবে চুল বাঁধা। ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট রহস্যময় হাসির রেখা।

মিস ডাভ নিজের পরিচয় দিয়ে পুলিস অফিসার দুজনকে অভ্যর্থনা জানালেন।

ইনসপেক্টর নীল বললেন, যতদূর জানা গেছে সকালে প্রাতরাশের সঙ্গেই মিঃ ফর্টেঙ্কু এমন কিছু গ্রহণ করেছিলেন, যা তার আকস্মিক মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সার্জেন্ট হে যাতে রান্নাঘরে গিয়ে যেসব খাবার দেওয়া হয় সেগুলো পরীক্ষা করতে পারেন আপনি দয়া করে তার ব্যবস্থা করে দিন।

-ওহ, নিশ্চয়ই, বললেন মিস ডাভ। পরে পাশে দাঁড়ানো বাটলারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ক্রাম্প, তুমি সার্জেন্ট হে-কে রান্নাঘরে নিয়ে যাও। তিনি যা যা দেখতে চান দেখিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর।

দুজনে বিদায় নিলে মিস ডাভ ইনসপেক্টরকে একটা ছোট ঘরে নিয়ে এলেন। দুজনে মুখোমুখি একটা টেবিলে বসলেন।

–এই মুহূর্তে বাড়িতে পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের কথা। তবে মিসেস ফর্টেস্কু যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারেন। মিসেস পার্সিভালও তাই। আমি অবশ্য মিঃ পার্সিভালের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে চলেছি।

–ধন্যবাদ মিস ডাভ। বললেন নীল।

-প্রাতরাশের কিছু খাবার পেয়ে মিঃ ফর্টে অসুস্থ হয়েছেন আপনি বলছেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব?

–বাড়ি থেকে বেরনোর আগে প্রাতরাশে তিনি কি শস্যদানার মতো কিছু খেয়েছিলেন?

–না, ওসব কিছু তার পছন্দ নয়।

–সকালে তিনি কোনরকম ওষুধ খেতেন? হজমের ওষুধ বা টনিক জাতীয় কিছু?

–না, এ ধরনের কিছু খেতেন না।

–প্রাতরাশে কে কে উপস্থিত ছিলেন?

মিসেস ফর্টেস্কু, মিস ফর্টেস্কু, মিসেস ভাল ফর্টেস্কু। মিঃ পার্সিভাল বাইরে ছিলেন।

কথাটা শুনে একটু চিন্তিত হলেন ইনসপেক্টর নীল। স্ত্রী, আর পুত্রবধূ মাত্র দুজন ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির সঙ্গে প্রাতরাশ করেছিলেন। এদের মধ্যে যে কোন একজনের পক্ষে কফিতে ট্যাকসিন মিশিয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কফির সঙ্গে ট্যাকসিনের কটুস্বাদ ধরা পড়বার কথা নয়।

মিস ডাভ নিবিষ্ট চোখে নীলকে দেখছিলেন। তার চোখে চোখ পড়তেই মিস ডাভ বলে উঠলেন, কোন বিষক্রিয়ার ঘটনায় কখনো জড়িয়ে থাকিনি।

-কাজটা কে করতে পারে আপনার কোন ধারণা আছে মিস ডাভ?

প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন নীল।

-কোন ধারণা নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন মিস ডাভ, তবে কি জানেন, সত্যি কথা বলতে তিনি এমন বিরক্তিকর মানুষ ছিলেন যে, বাড়ির কোন মানুষ তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না।

ব্যাপারটা আরো গভীরের মিস ডাভ। এই বাড়ির সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে নিশ্চয় আপনার আপত্তি নেই?

নির্লিপ্ত মুখে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করলেন মিস ডাভ।

–আমার বক্তব্য যদি আদালতে বলা না হয় তাহলে ব্যক্তিগত ভাবে যা জানি বলতে পারি।

–তাহলে নিশ্চিন্তে বলুন আপনি। আমার কাজে সাহায্য হবে।

একটু ঝুঁকে বসলেন মিস ডাভ। একমুহূর্ত চুপ করে কি ভাবলেন। পরে বলতে শুরু করলেন।

-দেখুন ইনসপেক্টর, আমাকে যাতে আপনি ভুল না বোঝেন তাই শুরুতেই একটা কথা বলে নেই। আমার মনিবের প্রতি বিদ্বেষ বা আনুগত্য কোনটাই নেই। আমি টাকার জন্য কাজ করি। প্রয়োজনে আমি সব কাজ যেমন করতে পারি তেমনি, টাকা খরচ করে পাকা লোকদেরই কাজে লাগাই।

এই বাড়িতে টাকা খরচ করতে কেউ কার্পণ্য করে না। তাই মিসেস ক্রাম্পের মত পাকা রাঁধুনি রয়েছে এখানে। আর বাটলার ক্রাম্পও তার কাজ ঠিকঠাকই করে।

বাড়ির লোকদের সম্পর্কে আমার ধারণার কথাই নিশ্চয় আপনি জানতে চেয়েছেন; তাই না ইনসপেক্টর।

-যদি কিছু মনে না করেন। বললেন নীল।

–আমাদের মনিব প্রয়াত মিঃ ফর্টেস্কুর প্রশংসা করা সম্ভব নয়। কেননা, প্রায়ই তিনি তার চতুর শঠতার বিষয় বাড়িতে গল্প করতেন। তাছাড়া এমন কটুভাষী ছিলেন যে…তাছাড়া বাড়ির সকলেই বলতে গেলে সমান বিরক্তিকর।

মিসেস ফর্টেস্কু–অ্যাডেল, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, বয়সে তিনি স্বামীর চেয়ে প্রায় ত্রিশ বছরের ছোট। দেখতে সুন্দরী…যৌনআবেদনময়ী, তবু যে তিনি মিঃ ফর্টেস্কুকে বিয়ে করেছিলেন, তা কেবল টাকার লোভে। অসম্ভব টাকার নেশা তার।

এই বিয়েতে মিঃ ফর্টেস্কুর দুই ছেলেমেয়ে পার্সিভাল ও ইলেইন মোটেও খুশি হতে পারেনি। তাদের অশোভন ব্যবহার মিসেস বুদ্ধিমতীর মতই অগ্রাহ্য করেন।

প্রথমে মিঃ পার্সিভালের কথাই শোনা যাক।

–পার্সিভালের কথা? ওর স্ত্রী তাকে ভ্যাল বলে ডাকে। নিজেও ওই নাম পছন্দ করেন। পিতার মতই শঠ আর ধূর্ত। সবসময় নিজের কাজ হাসিল করার মতলবে থাকেন। তবে বাবার

মত খরচে নয়, বরং খুব বিপরীত।

পার্সিভালের স্ত্রী বিয়ের আগে হাসপাতালের নার্স ছিল। খুব ভীরু প্রকৃতির আর খানিকটা বোকাটে। তাদের প্রেমের বিয়েতে মিঃ ফর্টেঙ্কু খুশি হতে পারেননি। বাপ ছেলে পরস্পরকে ঘৃণার চোখেই দেখতেন বলতে পারেন।

মিসেস ভ্যালও শ্বশুরকে অপছন্দ করত।

-মেয়ে ইলেইন কিরকম?

মেয়েটি অতটা খারাপ নয়। তার জন্য আমার দুঃখ হয়। খেলাধূলায় ভাল, পড়াশোনাতেও। এক হতাশ তরুণ স্কুলমাস্টারের সঙ্গে তার একবার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাপ টের পেয়ে সম্পর্কের ইতি ঘটান। মেয়েটি দেখতে তেমন ভাল নয়। তারও লক্ষ্য বাপের টাকার দিকে।

–অন্য ছেলেটি–মিঃ ল্যান্সলট?

–শুনেছি খুবই সুপুরুষ তবে বদ চরিত্রের। তাকে কখনো দেখিনি আমি। অতীতে একটা চেক জাল করার ঘটনা ঘটিয়েছিল। সে এখন বিদেশে–পূর্ব আফ্রিকায়।

-বাবার সঙ্গে কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল?

-তা ঠিক হয়নি। তবে বহু বছর তার সঙ্গে তিনি কোন যোগাযোগ করেননি। ল্যান্সের নাম একেবারেই শুনতে পারতেন না। তবে টাকাকড়ি থেকে বঞ্চিত করতে পারেননি। কারণ আগেই তাকে কোম্পানির জুনিয়র অংশীদার করে নিয়েছিলেন।

তবে যতদূর মনে হয় ল্যান্স হয়তো আবার ফিরে আসবে।

–এরকম কোন আভাস কি পাওয়া গেছে?

–কিছুদিন আগে সম্ভবত পার্সিভাল গোপনে কিছু একটা করে ফেলেছিলেন। সেটা বাপ জানতে পেরে প্রচণ্ড রেগে যান। সেইসময় ছোট ছেলেকে আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। তারপর থেকে পার্সিভালও কেমন ভীত হয়ে থাকতেন সব সময়।

-বাড়ির চাকরবাকরদের মধ্যে ক্রাম্পের কথা তো বলেছেন। অন্য চাকরবাকররা কিরকম?

-এবাড়িতে পার্লারমেড মানে ওয়েস্ট্রেস হিসেবে আছে গ্ল্যাডিস মার্টিন। সে ঘর গুছানোর কাজকর্মের সঙ্গে ক্রাম্পকেও সাহায্য করে। মেয়েটি ভাল। তবে বড্ড বেশি সরল।

এলেন কার্টিস হল হাউসমেড। কাজের মানুষ, তবে ভয়ানক বদমেজাজী।

এছাড়া বাইরের কিছু বুড়ি আসে বাড়িতে কাজের জন্য। বাড়িতে আর একজন আছেন–তিনি মিস র‍্যামসবটম।

–তিনি কে? নীল জানতে চান।

–মিঃ ফর্টেস্কুর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর দিদি। সেই স্ত্রী বয়সে মিঃ ফর্টেস্কুর চেয়ে বড় ছিলেন। দিদিটি তার চেয়েও বড়। এখন প্রায় সত্তরের মতো বয়স।

তিনতলায় একখানা ঘরেই তিনি থাকেন। খুব একটা নিচে নামেন না। রান্নাবান্না, অন্যান্য কাজ নিজেই করে নেন। একজন কাজের মেয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।

এই বৃদ্ধা কোনদিন তার ভাগ্নীপতিকে সহ্য করতে পারেননি। বোন বেঁচে থাকতে এখানে এসেছিলেন, তার মৃত্যুর পরেও থেকে যান। মিস ফর্টেস্কু ও ছেলেরা তাকে ডাকে এফি মাসি বলে।

বাড়ির লোকজন বলতে এই সব?

–হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, এরাই সব।

–এবারে আপনার কথা কিছু বলুন মিস ডাভ।

–আমি..আমি একজন অনাথা। সেন্ট অ্যালফ্রেড সেক্রেটারিয়েল কলেজে সেক্রেটারি কোর্স পাস করেছি। কিছুদিন এক অফিসে কাজও করেছি। এখানে আসার আগে মোট তিন জায়গায় আমি কাজ করেছি। কিন্তু এক দেড় বছরের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠতে থাকি। তাই, একটু বেশি স্বাধীনতা নিয়ে থাকব বলে এই ইউট্টি লজে চলে এসেছি। এখানে আছি একবছরের কিছু বেশি।

কথা বলতে বলতে মিস ডাভ সম্বন্ধে একটা ছবি মনে মনে এঁকে নিয়েছিলেন নীল। তার কথা শেষ হতেই বললেন, এবারে আমি ওই পার্লারমেড গ্ল্যাডিস আর পরিচারিকা এলেনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আর একটা কথা মিস ডাভ, মিঃ ফর্টেঙ্কু কি কোন কারণে পকেটে শস্যের দানা রাখতে পারেন?

–শস্যদানা? আমার কোন ধারণা নেই ইনসপেক্টর। অবাক হয়ে বললেন মিস ডাভ।

–তার পোশাক কে দেখাশোনা করতেন?

–ক্রাম্প।

–আর একটা কথা–মিসেস ফর্টেস্কু কি স্বামীর সঙ্গে একই ঘরে থাকেন?

–হ্যাঁ। মনে হয় তাঁর আসার সময় হয়েছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন মিস

–তিনি তো বললেন গলফ খেলতে গেছেন। কাছাকাছি তত তিনটে গলফের মাঠ রয়েছে। তবুও এখনও পর্যন্ত তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না দেখে আশ্চর্য হচ্ছি।

-এটা আশ্চর্যের কিছু নয় ইনসপেক্টর। গলফ ক্লাব নিয়েই অবশ্য বেরিয়ে গেছেন গাড়ি নিয়ে, তবে গলফ আদৌ নাও খেলতে পারেন।

নীল তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন মিস ডাভের দিকে। একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে খেলেন জানেন?

–সম্ভবত তার সঙ্গী মিঃ ডিকিয়াল ডুবরে। আমি গ্লাডিসকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটা কথা ইনসপেক্টর, আপনাকে যেসব কথা বললাম, তা নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি না করার জন্যই আপনাকে পরামর্শ দেব।

মিস ডাভ বিদায় নিলেন। তিনি যে কথাগুলো তাকে বললেন, তার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে নীলের অসুবিধা হল না। ইউট্টি লজের অভ্যন্তরীণ ছবিটা বেশ পরিষ্কার হয়েই উঠেছে তার কাছে। যদিও কথাগুলো বিদ্বেষমূলকভাবে বললেন কিনা মিস ডাভ, তা তার কাছে স্পষ্ট নয়।

এই বাড়ির যা হালচাল, তাতে মিঃ ফর্টেস্কুকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষপ্রয়োগের মোটিভের কোন অভাব নেই।

নিজের ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন ইনসপেক্টর নীল। ঘরে প্রবেশ করল ভয়ে জড়োসড়ো একটি মেয়ে–গ্ল্যাডিস মার্টিন।

ঘরে ঢুকেই সে বলতে শুরু করল, আমি কিছু করিনি–আমি এসবের কিছুই জানি না।

মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানা সম্ভব হল না।

নতুন কথা যা সে জানালো তা হল সে আগে বিভিন্ন কাফেতে কাজ করেছে। সবে দুমাস হয়েছে এসেছে ইউট্টি লজে।

জিজ্ঞাসাবাদের শেষ দিকে নীল জিজ্ঞেস করলেন, আজকে মিঃ ফর্টেঙ্কু যে স্যুট পরেছিলেন, সেটা কে ব্রাশ করেছিল, বলতে পার?

–ওনার তো অনেক স্যুট আছে, আজ কোনটা পরেছিলেন বলতে পারব না।

–তার পকেটে কোনদিন শস্যের দানা দেখেছ?

–শস্যের দানা? শস্যের দানা কি? অবাক হল গ্ল্যাডিস।

–রাই দানা। কালো রঙের রুটি হয়, জানো তো–এই দানা তোমার মনিবের স্যুটের পকেটে পাওয়া গেছে।

-রাই দানা-

-হ্যাঁ, ওগুলো কি করে পকেটে এলো তুমি কিছু বলতে পার?

–আমি ওসব দেখিনি, কিছু বলতে পারব না।

গ্ল্যাডিসকে বিদায় দিয়ে ইনসপেক্টর রান্নাঘরে এলেন। বিশাল চেহারার লাল মুখ এক স্ত্রীলোক রান্নার কাজ করছিল।

রাঁধুনী মিসেস ক্রাম্পের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে কোনরকমে পালিয়ে বাঁচলেন নীল। পুলিস দেখে এতটুকু টসকায়নি সে। এবাড়িতে যে কখনো বাজে বাজে খাবার দেওয়া হয়েছে, এমন কথা সে কারোর মুখে শুনতে রাজি নয়।

ইনসপেক্টর নীলের অবস্থা দেখে সার্জেন্ট হে দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন।

নীল হলঘরে ফিরে এলেন। মেরী ডাভ তখন টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরে রেখে একটা কাগজে কিছু লিখে নিচ্ছিলেন।

রিসিভার নামিয়ে রেখে মিস ডাভ নীলকে বললেন, একটা টেলিগ্রাম। এই যে—

কাগজটা এগিয়ে দিলেন তিনি। নীল দেখলেন প্যারী থেকে এসেছে বার্তাটা।

ফর্টেস্কু ইউট্টি লজ বেডন হীথ, সারে, দেরিতে তোমার চিঠি পেয়েছি। আগামীকাল চা পানের সময় উপস্থিত হব। রোস্টকরা ভীল নৈশভোজে আশা করছি। ল্যান্স।

কাগজটা টেবিলে রেখে ভ্রু কুঁচকে নীল বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিতাড়িত ছেলেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।

.

০২.

মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণু যখন তাঁর জীবনের শেষ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন খাস কামরায় বসে, সেই সময় তাঁর ছোট ছেলে ল্যান্স ফর্টেস্কু আর তার স্ত্রী সাঁজ এলিজে হোটেলের বাগানে গাছের নিচে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। আসলে স্বামীর কাছ থেকে মিসেস ল্যান্স অর্থনৈতিক জগতের শঠতার গল্পই শুনছিলেন।

যে শ্বশুরকে তিনি কখনো চোখে দেখেননি, তার সম্পর্কে তার ধারণা তিনি সবসময়ে কৌশলে আইন বাঁচিয়ে চলা মানুষ। সতোর অভাব ছিল না তার মধ্যে।

মিসেস ল্যান্স সুন্দরী না হলেও স্বাস্থ্যবতী ও দীর্ঘাঙ্গী হওয়ায় তাকে অসুন্দর দেখায় না। মাথায় একরাশ বাদামী চুল, চলার গতিও ছন্দময়। মনটাও উদার, ব্যক্তিত্বময়।

বাবাকে পছন্দ করি না এটা ঠিক, কিন্তু তার ডাকে আবার ফিরে না গিয়েও পারছি না। একবার যখন বুড়ো মত বদলেছে, তখন সুযোগটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না, বুঝলে প্যাট।

একটু থেমে ল্যান্স আবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবার চিঠিটা পেয়ে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, পার্সি তাকে চূড়ান্ত হতাশ করেছে। এটা চিরকালই মহাধূর্ত–নিজের মতলব ছাড়া কিছু বোঝে না

প্যাট্রিসিয়া বললেন, তোমার ভাইকে মনে হয় না আমার পছন্দ হবে।

-না, না প্যাট, তুমি তোমার মতো থাকবে। আমার কথায় প্রভাবিত হয়ো না। পার্সির সঙ্গে আমি মানিয়ে চলতে পারতাম না, তোমাকে আমি সেকথাই বলতে চাইছি। হাতখরচের টাকা আমি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উড়িয়ে দিতাম কিন্তু ও সব জমিয়ে রাখতো। আমি ভাল মন্দ সবার সঙ্গেই মিশতে অভ্যস্ত ছিলাম। পার্সি বেছে বেছে বন্ধুত্ব করতো। আমি বুঝতে পারতাম ও মনে মনে আমাকে ঘৃণা করে। তবে কারণটা জানতাম না।

–আমি জানি কেন। বলল প্যাট্রিসিয়া।

-তুমি বুদ্ধিমতী, হয়তো বুঝতে পার। ওকে ওই চেকের ঘটনাটা কিন্তু পার্সিভালই ঘটিয়েছিল। আমি যে চেক জাল করিনি একথা অবশ্য বিশ্বাস করবে না।

ইতিমধ্যেই অবশ্য আমি কোম্পানির একজন অংশীদার হয়েছিলাম। ঘোড়ার পেছনে লাগাবার জন্য যে টাকাটা দেরাজ থেকে নিয়েছিলাম, সত্যিকথা বলতে সেটা আমারই ছিল। তবু ভেবেছিলাম, টাকাটা ফেরত দিতে পারব। তবে চেকের ব্যাপারটা পার্সিই করেছিল, আর শাস্তি পেয়ে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল আমাকে।

তুমি বলতে চাও, কোম্পানি থেকে তোমাকে হঠাবার জন্য সে একাজটা করেছিল? বলল প্যাট্রিসিয়া।

–হতেও পারে। তবে ওসব আমি কিছু আর মনে রাখতে চাই না। এখন ভাবছি, এতদিন পরে আমাকে দেখে ও কি ভাববে।

-কিন্তু তোমার বাবা তার ওপরে এমন খেপে গেলেন কেন?

–সেটা জানতেই ইচ্ছে হচ্ছে। যেভাবে বুড়ো আমাকে চিঠি লিখেছে তাতে মনে হয়েছে গুরুতর কোন অপরাধই হবে

-তোমার বাবার প্রথম চিঠি কবে পেয়েছিলে?

-তা মাস চার-পাঁচ হবে। ওই চিঠি পেয়েই আশ্বস্ত হয়েছিলাম। লিখেছিলেন, পার্সি খুবই অসন্তোষজনক হয়ে উঠেছে। আরও লিখেছিলেন, অর্থকরী দিক থেকে তোমার সুব্যবস্থা করব, তোমার স্ত্রীকেও সাদরে গ্রহণ করব। বুঝলে প্রিয়া, অভিজাত ঘরে বিয়ে করায় বুড়ো খুবই খুশি হয়েছিল।

–অভিজাতদের ওই আবর্জনা কেউ পছন্দ করে? হেসে বললেন প্যাট্রিসিয়া।

–অভিজাতরা আবর্জনা কিনা বলতে পারব না, তবে তোমাকে যে বিয়ে করেছি, তার আহ্বান হয়তো এজন্যেই। পার্সিভালের স্ত্রী কেমন হয়েছে দেখা যাক।

-তোমার বোনের কথা তো বললে না।

চিন্তিত ভাবে বলল প্যাট্রিসিয়া। যে পরিবারের বউ তিনি হয়েছেন, সেখানকার মেয়েদের কথাই হয়তো তার মাথায় ঘুরছিল।

-ইলেইনের কথা বলছ, বলল ল্যান্স, ও খুবই ভাল মেয়ে। আমি যখন বাড়ি ছেড়ে আসি তখন ও খুবই ছোট ছিল।

–তোমাকে ও কোন চিঠি লিখেছিল? বলল প্যাট।

–কি করে লিখবে? কোন ঠিকানা তো দিয়ে আসিনি। আমাদের পরিবারের পারস্পরিক হৃদ্যতাও তেমন ছিল না কোন দিন।

প্যাট বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল ল্যান্সের দিকে। তা লক্ষ করে ল্যান্স বললেন, এসব জেনে আর কি হবে, আমরা তো ওদের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি না। নিজেদের অন্য আলাদা একটা বাড়ি কোথাও নিয়ে নেব, সেখানেই আমরা থাকব।

–তোমার মায়ের কথা বিশেষ ভাবতে চাও না, তাই না? প্যাট জানতে চাইল।

–আমাদের মা ছিলেন বৃদ্ধ। ইলেইনের যখন জন্ম হয় তখন তার বয়স পঞ্চাশ। ছেলেবেলায় মনে পড়ে তিনি আমাকে নাইট আর রানির গল্প শোনাতেন। আমার সেসব একদম ভাল লাগত না।

–তুমি কাউকেই তেমন ভালবাসতে না।

–আমি তোমাকে ভালবাসি, প্যাট। বলে তিনি স্ত্রীর হাত নিজের মুঠোয় নিলেন।

.

০৩.

বড় হলঘরে ইনসপেক্টর নীল যখন টেলিগ্রামের কাগজটা টেবিলে রাখছেন ঠিক সেই সময়েই বাইরে একটা গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ শোনা গেল।

কিছুক্ষণ পরেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন যে মহিলা তার মোহিনী মূর্তি যে কোন পুরুষের কাছেই আকর্ষণীয়। ইনিই অসামান্য সুন্দরী মিসেস ফর্টেস্কু। তার পেছনের গলফ ক্লাব হাতে পুরুষটিকে দেখে নীল অনুমান করলেন, যেমন শুনেছেন, মিঃ ভিভিয়ানই হওয়া সম্ভব।

বয়স্ক ধনী মানুষের যুবতী স্ত্রীদের যেসব পুরুষমানুষ বন্ধুত্বের জন্য বেছে নেয় তাদের চরিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রয়েছে ইনসপেক্টর নীলের।

বাড়িতে পুলিস অফিসারের উপস্থিতি এবং তার মুখে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অ্যাডেল ফর্টেস্কু একটু টলে গেলেন। একটা আরাম কেদারায় তার শরীর এলিয়ে পড়ল, দু হাতে চোখ চেপে ধরলেন তিনি।

ক্রাম্প দৌড়ে গিয়ে একগ্লাস ব্র্যাণ্ডি নিয়ে এসে এগিয়ে দিল। একচুমুক খেয়ে তিনি তা। সরিয়ে দিলেন।

-বেচারি রেক্স। কোনরকমে উচ্চারণ করলেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু।

একজন ডিটেকটিভ ইনসপেক্টরের উপস্থিতিতে মিঃ ডুবয় স্বভাবতই ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অপ্রস্তুত স্বরে কোনরকমে দুঃখপ্রকাশ করে বিশেষ কাজের অজুহাত দেখিয়ে কোনরকমে গা বাঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করতে বিলম্ব করলেন না।

নীল সবই বুঝলেন। তিনি অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে দুঃখের সঙ্গে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর কারণ জানালেন।

–আপনি বলছেন তাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল? এ আমি কখনো বিশ্বাস করি না—

নিশ্চয় খাদ্যে বিষক্রিয়া..কিন্তু সকালেই তো আমরা একই খাবার খেয়েছি–

বাড়ির সকলেই কি খেয়েছিল? নীল প্রশ্ন করলেন।

-না…তা অবশ্য বলতে পারব না।

–আপনার এখানে দেখছি প্রচুর ইউগাছ রয়েছে। এই গাছের পাতা বা ফল কোন ভাবে খাবারে মিশে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

–ইউফল? এগুলো কি বিষ?

–এসব খেয়ে বাচ্চারা প্রায়শই বিপদ ঘটায় মাদাম।

–আর সহ্য হচ্ছে না ইনসপেক্টর, দু হাতে মাথা টিপে ধরলেন মিসেস ফর্টেস্কু, আমি কিছু পারব না, সব ব্যবস্থা করবেন মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কু।

–আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি মাদাম, তিনি তো এখন উত্তর ইংলণ্ডে কোথাও রয়েছেন।

–ওহ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম।

–এই অবস্থায় আপনাকে আর বিরক্ত করব না। কেবল একটা কথা, আপনার স্বামীর পকেটে কিছু শস্যদানা পাওয়া যায়, এর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন?

-না, আমার কোন ধারণা নেই। মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ফর্টেস্কু।

চোখে রুমাল চাপা দিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে চললেন। নীলের মনে হল এ কান্না অভিনয় নয়।

চোখে রুমাল চেপে রেখেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা অতিক্রম করে চলে গেলেন।

ইনসপেক্টর নীলের চোখ এড়িয়ে গেল, রুমালের ফাঁকে মিসেস ফর্টেস্কুর ঠোঁটে ঠোঁটে জেগে উঠেছিল সূক্ষ্ম একটা হাসি।

.

ইতিমধ্যে সার্জেন্ট হে রান্নাঘর থেকে মারমালেড, হ্যাম, চায়ের নমুনা, কপি, চিনি ইত্যাদি যা প্রয়োজনীয় মনে করেছেন কিছুটা করে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়েছেন।

তার অভিযানের সংবাদ জানিয়ে সার্জেন্ট হে নীলকে বললেন, কিন্তু স্যর, ইউ ফল বা পাতা কোথাও চোখে পড়েনি। আর তার পকেটের শস্যদানার কথাও কেউ কিছু বলতে পারল না।

ঠিক সেই সময়েই টেলিফোন বেজে উঠল। নীল ধরলেন। সদর দপ্তর থেকে জানানো হলো মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে, তিনি লণ্ডনে ফিরে আসছেন।

রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতেই বাড়ির সদরের সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেলেন নীল।

একটু পরেই নানা প্যাকেট হাতে এক মহিলা এসে ঘরে ঢুকলেন। ক্রাম্প প্যাকেটগুলো হাতে নিল। নীলের দিকে ফিরে বলল, ইনি মিসেস পার্সিভাল, স্যর।

গোলগাল চেহারার মহিলা, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। অসন্তোষ মাখানো মুখভাব। নীলের মনে হল মহিলা অত্যন্ত ক্লান্ত।

মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর আকস্মিক মৃত্যুর খবর তাকেও জানানো হলো।

–সত্যিই অদ্ভুত খবর, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন মিসেস পার্সিভাল, নিজের অর্ধেক বয়সের মেয়েকে বিয়ে করে মারাত্মক ভুল করেছিলেন–এবারে যা হবার তাই হলো…

নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাকে দেখতে লাগলেন। তার মনে হলো, ব্যাপারটা মহিলার খারাপ লাগেনি।

-মৃত্যুর কারণ নিশ্চয় আপনারা জেনেছেন, না হলে এখানে আসতেন না।

–হ্যাঁ, খাদ্যে বিষক্রিয়া। প্রাতরাশে তিনি এমন কিছু খেয়েছিলেন, যার প্রতিক্রিয়াতেই…

–প্রাতরাশ। কিন্তু..বুঝতে পারছি না ও কিভাবে বিষটা—

এই সময় পাশ থেকে কে বলে উঠল, আপনার চা লাইব্রেরীতে দিয়েছি মিসেস ভ্যাল।

–ওহ, চা, ধন্যবাদ মিস ডাভ, যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, চা বড্ড দরকার—

বলতে বলতে বিদায় নিলেন মিসেস ভ্যাল।

–মিস ডাভ, হাউসমেড এলেনকে একবার দরকার।

–আসুন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। দুজনে ওপরে উঠে এলেন। এলেনকে মোটেই বিমর্ষ বা ভীত মনে হল না।

এলেনের কথায় বিষের ঝাঁঝ মেশানো ছিল। সে গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে একপ্রস্থ বিষ উদগার করল।

এখানে সবাই জানে…ওদের সর্বত্রই দেখা যায়…টেনিস বা গলফ ওসব সবই ধাপ্পা…আমি নিজের চোখে অনেক কিছু দেখেছি। লাইব্রেরীর দরজা খোলা ছিল…দুজনে…উনি আর ওই লোকটা…আমাদের মনিব সবই টের পেয়েছিলেন…নজর রাখার জন্য একজনকে লাগিয়েও ছিলেন…শেষ পর্যন্ত মনিব মরলেন…জানতাম….

নীল আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে কখনো ইউফল দেখেছ?

–ইউ…ওগুলো তো বিষাক্ত। ওই ফল ওরা দিয়েছিল নাকি স্যর?

–আমরা এখনো ঠিক জানি না, কি দেওয়া হয়েছিল। একটু চিন্তা করল এলেন। পরে বলল, আমি অবশ্য ওঁকে কখনো ইউফল ঘাঁটতে দেখিনি..না…কখনো দেখিনি।

তার কাছ থেকেও মিঃ ফর্টেস্কুর পকেটে শস্যদানা থাকার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন না নীল।

এলেনকে বিদায় দিয়ে নীল এলেন তিন তলার ছোট্ট ঘরে মিস র‍্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করতে।

ঘরে ঢোকার মুখেই নীল জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন নিচে সার্জেন্ট হে ইউ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। লোকটাকে বাগানের মালী বলেই তার মনে হল।

মালপত্রে ঠাসা ছোট্ট ঘরটা। গ্যাসের আগুনের পাশে এক বৃদ্ধা টেবিলে বসে পেসেন্স খেলছেন। পরণে হালকা বেগুনী রঙের পোশাক। মাথায় এলোমেলো পাকাচুল।

মুখ না তুলেই তিনি বললেন, আসুন, ইচ্ছে হয় বসতে পারেন।

কিন্তু বসার প্রতিটি চেয়ারই নানা ধর্মীয় পত্রপত্রিকায় বোঝাই। ওসব সরিয়ে কোন রকমে একটা চেয়ারে নীল জায়গা করে নিলেন।

–বলুন, কি ব্যাপার। মুখ তুললেন মিস র‍্যামসবটম।

নীল যথারীতি দুঃখপ্রকাশ করে মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুসংবাদ জানালেন।

–অহঙ্কার আর পাপের পরিণতি। কোনরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মন্তব্য করলেন মিস র‍্যামসবটম।

-আশাকরি ভগ্নীপতির মৃত্যুতে আঘাত পাননি আপনি। বললেন নীল।

-ঠিকই বলেছেন আপনি। দুঃখ না হওয়াই স্বাভাবিক। রেক্স ফটেন্ডু চিরকালই পাপী মানুষ ছিলেন। তাকে আমি পছন্দ করতে পারিনি।

-তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।

বৃদ্ধা একথার কোন উত্তর না দিয়ে তাস হাতে তুলতে লাগলেন।

নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলেন। কিন্তু হতাশ হলেন।

–আমি কি বলব আশা করেছিলেন?

এটুকু বলতে পারি, আমি তাকে বিষ খাওয়াইনি।

–কাজটা কে করে থাকতে পারে এরকম কোন ধারণা আপনার আছে?

–প্রশ্নটা অসঙ্গত। আমার মৃত বোনের দুই ছেলে এবাড়িতে রয়েছে। র‍্যামসবটমের রক্ত যাদের শরীরে রয়েছে তারা খুনের মতো কোন জঘন্য কাজ করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

–আমি সেকথা বলতে চাইনি মাদাম।

–রেক্স খুবই অসৎপ্রকৃতির মানুষ ছিল। বহু লোকই আছে যারা তাকে খুন করতে চেয়েছে।

–বিশেষ কারো কথা কি আপনি ভাবছেন?

মিস র‍্যামসবটম এবার তাস ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শান্ত ধীর কণ্ঠে বললেন, আমার মতামত যদি জানতে চান তাহলে বলব, বাড়ির চাকরবাকরদের মধ্যেই কেউ একাজ করেছে। ওই বাটলারকে আমার সুবিধার লোক মনে হয় না। আর পার্লারমেইড মেয়েটাও যেন অন্যরকম। আচ্ছা…শুভসন্ধ্যা।

কিছুই বার করা গেল না বৃদ্ধার মুখ থেকে। অগত্যা নীল চুপচাপ নিচে নেমে এলেন।

হলঘরে ঢুকতেই দীর্ঘাঙ্গী গাঢ় বর্ণের এক তরুণীর মুখোমুখি হলেন নীল।

–আমি এই মাত্র ফিরেছি ইনসপেক্টর ওরা বলছে…বাবা নাকি মারা গেছে?

–খুবই দুঃখের হলেও কথাটা ঠিক। বললেন নীল। মেয়েটি একটা চেয়ারের পিঠ চেপে ধরল। চোখ বুজে ধীরে ধীরে বসে পড়ল।

–ওহ,…না-না।

দু গাল বেয়ে চোখের জল নেমে এলো মেয়েটির।

-বাবাকে পছন্দ করতাম একথা বলতে পারব না। তবু…তবু…আমি মেনে নিতে পারব না…কখনও না…

দরদর ধারায় অশ্রু নামতে লাগল। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করতে লাগল সে।

ইনসপেক্টর নীল বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ইলেইন ফর্টেস্কুর দিকে। তার মনে হল ইউট্রি লজে এই প্রথম মৃতমানুষটির জন্য একজন সত্যিকার শোকপ্রকাশ করল।

.

০৪.

ইনসপেক্টর নীলের কাছ থেকে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ শোনার পর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বললেন, কমবয়সী সুন্দরী স্ত্রী–তাকেই তো আমার সন্দেহ হচ্ছে।

–এরকম ক্ষেত্রে এটাই সাধারণত দেখা যায়। বললেন নীল।

–কিন্তু মোটিভ তো খুঁজে বার করা দরকার।

–তাও আছে স্যর…মিঃ ডুবয় অবশ্যই।

–সে এর মধ্যে ছিল বলে তোমার মনে হয়?

–তা অবশ্য মনে হয় না স্যর। লোকটা খুবই সাবধানী–গা বাঁচাতে চায়। তবে মতলবটা মনে হয় মহিলার মাথাতেই ছিল।

-যাইহোক, আমাদের উচিত হবে ভোলা মনে কাজ করা। আর যে দুজনের সুযোগ থাকা সম্ভব, তাদের অবস্থা কিরকম বুঝছ?

–মিঃ ফর্টেস্কুর মেয়ে আর পুত্রবধূ! মেয়েটি একজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবার আপত্তি ছিল। লোকটার টাকার দিকেই নিশ্চয় চোখ রেখেছিল। এটাই তার মোটিভ হতে পারে।

তবে পুত্রবধূ–মিসেস পার্সিলের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। এই তিনজনের যেকোন একজনের পক্ষেই বিষপ্রয়োগ সম্ভব বলে মনে হয়। অন্য কারও পক্ষে কতটা সম্ভাবনা ছিল তা অনুসন্ধান সাপেক্ষ।

প্রাতরাশ গুছিয়ে ছিল পার্লারমেইড, বাটলার আর রাঁধুনি। নিয়েও গিয়েছিল এরাই। মিঃ ফর্টেস্কুর খাবারেই যে কেবল ট্যাকসিন মেশানো থাকতে পারে এটা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। অবশ্য যদি বিষটা ট্যাকসিনই হয়ে থাকে।

–প্রাথমিক রিপোর্টে ট্যাকসিন বলেই উল্লেখ করা হয়েছে দেখলাম।

–তাহলে নিশ্চিত হওয়া গেল। আমরা এবারে এগিয়ে যেতে পারব। নীল বললেন।

–চাকরবাকরদের মধ্যে কিছু পাওয়া যায়নি বলছ?

–না স্যর। ওদের ব্যবহারে কোনরকম অস্বাভাবিকতা নেই। –আর কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?

-না স্যর, তেমন কেউ নেই। তবে এবারে সাক্ষ্যপ্রমাণ কিছু পাওয়া যেতে পারে–ট্যাকসিন যখন তৈরি বা জোগাড় হয়েছে, তার কিছু প্রমাণও থাকবার কথা।

বেশ তুমি তোমার মতোই এগিয়ে যাও। ওহো, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কু এখানেই আছেন। তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য অপেক্ষা করছেন।

অন্য ছেলের সঙ্গেও প্যারিতে আমরা যোগযোগ স্থাপন করেছি। সে আজই রওনা হচ্ছে–তুমি তার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা করতে পার।

–হ্যাঁ, স্যর, আমিও ওরকম ভেবে রেখেছি। তাহলে আমি স্যর পার্সিভাল ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিই।

-হ্যাঁ তাই কর।

.

বছর ত্রিশের যুবা পার্সিভাল ফর্টেস্কু। মাথায় হালকা রঙের চুল। পোশাকপরিচ্ছদে নিখুঁত।

ইনসপেক্টর নীলের মুখ থেকে বাবার মৃত্যুর বিবরণ শোনার পর পার্সিভাল স্বাভাবিক ভাবেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

-বলছেন ট্যাকসিন বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল…কিন্তু ওরকম কোন বিষের কথা তো শুনিনি।

–কমই শোনা যায় এ বিষের কথা। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া আচমকা হয়–আর তা মারাত্মক।

–আপনি বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই বাবাকে কেউ বিষ খাইয়েছিল? খুবই ভয়ানক কথা।

–আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে।

এব্যাপারে, কারো সন্দেহ করার মতো আপনার কোন ধারণা

–আমাদের তদন্ত এখনো চলছে, স্যর। আমাদের কাজের পক্ষে সুবিধা হবে যদি আপনি আপনার বাবার সম্পত্তি বিলিব্যবস্থার ব্যাপারে আমাদের কিছু ধারণা দেন। আপনি আপনার বাবার সলিসিটরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন।

সলিসিটর হলেন বিলিংসবি, হর্সথর্প ও ওয়াল্টার্স। বেডফোর্ড স্কোয়ারে ওদের অফিস। উইলের ব্যাপারে আমি মোটামুটি আপনাকে জানাতে পারব।

–এটা যদিও আমাদের রুটিন মাফিক কাজ, তবে আমাদের কাজে সুবিধা হবে।

–দুবছর আগে বিয়ের পরে একটা নতুন উইল করেন বাবা। তাতে তিনি তার স্ত্রীকে ১,০০,০০০ পাউণ্ড সরাসরি দিয়েছিলেন, আর ৫০,০০০ পাউণ্ড দিয়েছেন আমার বোন ইলেইনকে। বাকি অংশের অধিকার দিয়েছেন আমাকে। অবশ্য আমি প্রতিষ্ঠানের একজন অংশীদারও।

–আপনার ভাই ল্যান্সলট ফর্টেস্কু, তিনি তাহলে কি পাচ্ছেন? জানতে চাইলেন নীল।

-বাবা তাকে কিছু দিয়ে যাননি। ওদের দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন আগের এক মনোমালিন্যের জেরই এটা বলতে পারেন।

-তাহলে দেখা যাচ্ছে, উইল অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে আপনারা তিনজনই লাভবান হচ্ছেন–মিসেস ফর্টেস্কু, আপনি আর মিস ইলেইন?

–আমার ক্ষেত্রে কতটা কি থাকবে বলতে পারি না। কেননা, অর্থকরী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাবা ইদানীং কিছু ভুল করে ফেলেছিলেন। তাছাড়া মৃত্যুকর ইত্যাদিও আমাকে দিতে হবে।

ইনসপেক্টর নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললেন মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুর দিকে।

সম্প্রতি ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আপনি আর আপনার বাবা একমত হতে পারেননি, তাই না স্যর?

–আমার মতামত তাকে জানিয়েছিলাম কেবল

–ওই নিয়ে আপনাদের মধ্যে বচসাও হয়েছিল?

–না, ইনসপেক্টর কোন বচসা হয়নি।

–যাক, কিছু এসে যায় না। তবে আপনার বাবা আর ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতোই বিরূপ ছিল, এটা নিশ্চয়ই ঠিক?

-হ্যাঁ, কথাটা ঠিক।

–যদি তাই হয় তাহলে এটা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা।

মেরী ডাভের দেয়া টেলিগ্রামের বয়ান লেখা কাগজটা নীল এবারে এগিয়ে দিলেন।

পার্সিভাল পড়লেন। তার মুখভাব বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল। তিনি বেশ রাগতভাবেই বললেন, ব্যাপারটা কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

–এটা যে সত্যি তার প্রমাণ আপনার ভাই আজই প্যারি থেকে আসছেন। আপনার বাবা আপনাকে এসম্পর্কে কি কিছু জানিয়েছিলেন?

–কখনোই না। আমার কাঁধে সমস্ত কাজের দায়িত্ব চাপানো আর এভাবে ল্যান্সকে ডেকে পাঠানো–এ সম্পূর্ণ অসঙ্গত।

–আপনার বাবা কেন এরকম একটা কাজ করলেন এসম্পর্কে নিশ্চয় আপনার কোন ধারণা নেই?

–অবশ্যই নেই। এ তার নিছক পাগলামি ছাড়া আর কি। ইদানীংকালে তার এমন অনেক অদ্ভুত কাজেরই কোন কারণ খুঁজে পেতাম না। যে করেই হোক এটা বন্ধ করতে হবে

পর মুহূর্তেই তিনি বলে উঠলেন, কিছু মনে করবেন না ইনসপেক্টর, মনেই ছিল না যে বাবা মারা গেছেন।

ইনসপেক্টর নীল সহানুভূতির সঙ্গে মাথা নাড়লেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন পার্সিভাল নিজে থেকে আর কি বলেন শুনবার জন্য।

–ইনসপেক্টর…আমি ভাবতে পারছি না এরকম একটা ঘটনা ঘটবে।

বলতে বলতে মিঃ পার্সিভাল দরজার দিকে এগোলেন।

–কোন প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকতে পারেন। অফিসের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় ইউট্রি লজেই ফিরব।

–আমি সেখানে একজনকে রেখে এসেছি স্যর। আশাকরি আবার দেখা হবে।

পার্সিভাল ফর্টেস্কু বেরিয়ে গেলেন।

–কিরকম বুঝলেন স্যর?

–সার্জেন্ট হে জানতে চাইলেন।

–এখনো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একদল বিরক্তিকর মানুষ–খুবই অদ্ভুত।

.

০৫.

ল্যান্স ফটেন্ডু আর তার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া আকাশ পথে বাড়ির পথে। হিথরো বিমান বন্দরের দিকে উড়ে চলেছে তাদের আকাশযান।

লে বুর্জে ছেড়ে আসার পাঁচ মিনিট পরে ডেইলি স্মেলের পৃষ্ঠায় বাবার মৃত্যুর খবরটা দেখতে পেলেন ল্যান্স।

–তিনি মারা গেছেন! বাবা

অস্ফুটে কথাকটা উচ্চারণ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন ল্যান্স।

-তোমার বাবা মারা গেছেন

–হ্যাঁ, প্রিয় প্যাট। অফিসেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেন্ট জিউস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানেই তিনি মারা যান।

উঃ অদ্ভুত ঘটনা, সত্যিই আমি দুঃখিত। ঠিক তুমি যখন বাড়ি ফিরতে চলেছ–কি হয়েছিল, স্ট্রোক?

–তাই মনে হয় আমার। বুড়ো মানুষটাকে যে আমি পছন্দ করতাম তা বলব না, কিন্তু এখন তো তিনি নেই…ভাল হতে গিয়েও আমার ভাগ্যটা আবার খারাপ হয়ে গেল, প্যাট।

–হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। ঘটনাটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

প্লেন থেকে নামার কিছুক্ষণ আগে একজন অফিসার উঠে এলেন। ঘোষণা করলেন, মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেঙ্কু প্লেনে আছেন?

ল্যান্সলট সাড়া দিলেন।

দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।

অন্য যাত্রীরা প্লেন থেকে নামার আগেই ল্যান্সলট আর প্যাট অফিসারটির সঙ্গে নেমে এলেন।

আশপাশে যাত্রীরা সন্দেহ আর কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

–এমন একটা উদ্ভট কাণ্ড আমি একেবারে মেনে নিতে পারছি না ইনসপেক্টর। অসম্ভব। ইনসপেক্টর নীলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ল্যান্সলট। পরে আবার বললেন, ট্যাকসিন ইউফল, আমাদের পরিবারে এসব বিষ প্রয়োগ হবে–নাঃ নাঃ–

-তাহলে বলছেন আপনার কোন ধারণা নেই, কে আপনার বাবাকে বিষপ্রয়োগ করতে পারে?

-না, ইনসপেক্টর, না। ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকেই তার ওপরে চটা ছিল…যথেষ্ট শই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিষ খাইয়ে হত্যা করবে…না…আমি বাইরেই থাকতাম…বাড়িতে কি চলছে, আমার জানার কথা নয়

ইনসপেক্টর নীল বললেন, আপনার ভাইয়ের কাছে শুনেছি, অনেক বছর আগে আপনার সঙ্গে মিঃ ফর্টেস্কুর মনোমালিন্য ঘটেছিল এবং তা বজায় ছিল। এই অবস্থায় আপনার বাড়ি ফিরে আসার ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন?

–তাহলে আপনাকে খুলেই বলি ইনসপেক্টর। মাস দুয়েক আগে, আমার বিয়ের ঠিক পরেই, বাবার একটা চিঠি আমি পাই। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, অতীতকে নতুন করে আর ভাবতে চান না তিনি। আমি ইচ্ছে করলে বাড়ি ফিরে এসে ব্যবসাতে যোগ দিতে পারি।

তার এই প্রস্তাবের পরে আমি ইংলন্ডে ফিরে আসা স্থির করে ফেলি।

মাস তিনেক আগে, গত অগাস্টে, ইউট্টি লজে এসে বাবার সঙ্গে আমি দেখা করি। সেই সময়ে তিনি চমৎকার একটা প্রস্তাব আমাকে দেন।

–আমি তাকে জানাই স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ইংলণ্ডে ফিরে আসার দিন জানিয়ে দেব।

তারপর আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যাই এবং প্যাটকে সব কথা বলি। আমাদের দুজনের কাছেই বাবার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তারপরই আমরা ওখানকার কাজ কারবার গুটিয়ে ইংলণ্ডে চলে এলাম।

–আপনি ইংলণ্ডে ফিরে এসেছেন, এই খবরে আপনার ভাই আশ্চর্য হয়েছেন।

তির্যক দৃষ্টিতে নীল তাকালেন ল্যান্সলটের দিকে। তার দিকে চোখ তুলে হাসলেন ল্যান্স।

-আশ্চর্য হবারই কথা পার্সির। ও ছুটি কাটাতে নরওয়েতে গিয়েছিল, বাবা সেই সময়টাই বেছে নিয়েছিলেন। সব কিছু পার্সির অজান্তে করাই তার ইচ্ছে ছিল বলে আমি মনে করি।

পার্সি নিজেকে ভ্যাল বলতেই পছন্দ করে। তার সঙ্গে বাবার দারুণ বচসা হয়। সে বাবাকে কোন ঝামেলায় জড়াতে চেয়েছিল বলেই আমার ধারণা। ঠিক কি নিয়ে গণ্ডগোলটা তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। তবে এটা বুঝেছিলাম, তিনি তার ওপরে প্রচণ্ড চটে গিয়েছিলেন। আমার ধারণা, বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারলে পার্সিকে রুখে দিতে পারবেন।

আপনি কতদূর কি জেনেছেন, আমি জানি না ইনসপেক্টর। আমাদের পরিবারের সকলেই জানে বাবা পার্সির স্ত্রীকে বিশেষ সুনজরে দেখতেন না। যদিও আমার বিয়েতে মনে মনে খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার সেটাও একটা কারণ বলে আমি মনে করি।

–গত অগাস্টে আপনি ইউট্রি লজে এসেছিলেন বললেন, ওই সময়ে কতদিন ছিলেন?

–ঘন্টা দুয়েকের বেশি নয়। চাকরবাকররাও সম্ভবত একথা জানতে পারেনি। তিনি জানিয়েছিলেন, তার প্রস্তাবটা নিয়ে প্যাটের সঙ্গে আলোচনা করে আমার সিদ্ধান্তের কথা তাকে যেন লিখে জানিয়ে দিই। আমি তার কথামতোই কাজ করি। আমি এখানে আসার আনুমানিক দিন ও সময় লিখে জানিয়ে দিই। গতকালই একটা টেলিগ্রাম করেছি।

-হ্যাঁ, সেটা আমি দেখেছি, মাথা নেড়ে সায় দিলেন নীল, সেটা দেখে আপনার ভাই খুবই আশ্চর্য হয়ে যান।

-তা হওয়াই স্বাভাবিক। দীর্ঘশ্বাস মোচন করে পার্সিভাল বললেন, এবারেও ভাগ্য পার্সিকে জিতিয়ে দিল–আমার আসতে দেরি হয়ে যায়।

–গত অগাস্টে পরিবারের কারোর সঙ্গেই কি আপনার দেখা হয়নি?

–হয়েছিল। আমার সম্মা চায়ে উপস্থিত ছিলেন।

–আপনার সঙ্গে কি তার আগেই পরিচয় হয়েছিল?

-না। হেসে উঠে বললেন ল্যান্সলট, বুড়োর চেয়ে অন্তত ত্রিশ বছরের ছোট আমার সৎমা।

–প্রশ্নটার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন মিঃ ল্যান্সলট, আপনার বাবার দ্বিতীয়বার বিয়েতে আপনি বা আপনার ভাই কি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন?

–অসন্তুষ্ট কিনা ঠিক জানি না, তবে আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে যাই, পার্সিও তাই। আমাদের যখন দশ বারো বছর বয়স, সেই সময় আমাদের মা মারা যান। এতদিন পরে কেন বাবা বিয়ে করলেন, কেন আগে করেননি–এসব ভেবে আমরা খুবই অবাক হয়েছিলাম।

-বয়সের এরকম ব্যবধানে কাউকে বিয়ে করায় বেশ ঝুঁকি থেকে যায়, এটা অবশ্য ঠিকই। বললেন নীল।

–কথাটা নিশ্চয় আপনি পার্সির মুখ থেকে শুনে থাকবেন। কাউকে এরকম দোষারোপ করতে অভ্যস্ত। আমার সম্মাই বাবাকে বিষ খাইয়েছেন, আপনিও কি এরকম ভাবছেন নাকি, ইনসপেক্টর?

–এরকম কোন সিদ্ধান্তে আসার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি মিঃ ল্যান্সলট। আর একটা কথা, এখন আপনার পরিকল্পনা কি, জানতে পারি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভাবলেন ল্যান্সলট। পরে বললেন, নতুন করে ভাববার দরকার হয়ে পড়েছে। বাড়ির সবাই কি ইউট্রি লজেই রয়েছে?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমার সেখানেই এখন যাওয়া ভাল। আর তুমি, স্ত্রীর দিকে তাকালেন ল্যান্সলট, বরং সাময়িক ভাবে একটা হোটেলেই যাও প্যাট।

–আমি তোমার সঙ্গেই থাকতে চাই ল্যান্স।

–অবুঝ হয়ো না প্যাট, ইউট্রি লজে আমার অভ্যর্থনাটা কেমন হবে আমি কিছুই জানি না। বাবার মৃত্যুর পরে পার্সি বা অ্যাডেল যে কেউ একজনের দখলে এসেছে বাড়িটা–এই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে অবস্থাটা বুঝে আসতে দাও। প্যাট, বিষপ্রয়োগের ঘটনা পর্যন্ত ওই বাড়িতে ঘটছে–কোন রকম ঝুঁকি আমি নিতে চাই না।

 ১.২ অ্যাডেল ফর্টেস্কুর চিঠি

০৬.

অ্যাডেল ফর্টেস্কুর চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না মিঃ ডুবয়। দেশলাই ধরিয়ে টুকরোগুলো ছাই করে ফেললেন।

চিঠিটা পাবার পর খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। মেয়েরা এরকম বোকামির কাজই বরাবর করে থাকে। এটা তার অতীতের অভিজ্ঞতা। তাই এবারে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে চাইছেন।

বাড়িতে জানিয়ে রেখেছেন, মিসেস ফর্টেষ্ণু টেলিফোন করলে উনি বাইরে গেছেন যেন জানিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে তিনবার টেলিফোন করেছেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু। তারপর এই চিঠি। চিঠির ব্যাপারটাও বন্ধ করা দরকার। এটা খুবই ঝুঁকির কাজ।

মিসেস ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথা বলার জন্য উঠে গিয়ে টেলিফোন তুললেন মিঃ ডুবয়।

ওপাশ থেকে অ্যাডেলের গলাই শুনতে পেলেন তিনি।

–ভিভিয়ান, শেষ পর্যন্ত এলে?

–হ্যাঁ, অ্যাডেল। কথা বলা দরকার। কাছে ধারে কেউ নেই তো?

–না, আমি লাইব্রেরী থেকে বলছি।

–অ্যাডেল, আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে।

–নিশ্চয়, প্রিয় ভিভিয়ান।

–উঁহু, টেলিফোনে আর প্রিয় বলবে না–এটা নিরাপদ নয়। মনে রেখো তোমরা–এবং আমিও এখন পুলিসের নজরে রয়েছি।

-হ্যাঁ, তা জানি। কিন্তু তুমি একটু বেশি ভয় পাচ্ছ ভিভিয়ান।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ…সাবধান হতে চাই। শোন এখন আমাকে চিঠি টেলিফোন সব বন্ধ রাখো।

–কিন্তু ভিভিয়ান…

–আমাদের সতর্ক থাকতে হবে অ্যাডেল। এটা কেবল সাময়িক ব্যবস্থা

–ঠিক আছে, ওহ

–আর শোন, অ্যাডেল, আমার লেখা চিঠিগুলো—হ্যাঁ

, বলেছি তো পুড়িয়ে ফেলব।

–শিগগিরই কাজটা করবে। ঠিক আছে, খেয়াল রেখো চিঠি লিখবে না…টেলিফোন করবে ….যথাসময়েই আমার কাছ থেকে খবর পাবে।

রিসিভার নামিয়ে রেখেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না মিঃ ডুবয়। অ্যাডেলকে লেখা তার চিঠিগুলোর জন্য খুবই দুর্ভাবনা হচ্ছে।

সব মেয়ের চরিত্রই একরকম। ব্যক্তিগত চিঠি তারা সহজে নষ্ট করতে চায় না। অথচ নিজেরা চিঠি লিখতে পারলেই বেশি খুশি হয়।

তাঁর লেখা চিঠিগুলোতে কি লিখেছিলেন এই মুহূর্তে ঠিক ঠিক মনে করতে পারছিলেন না তিনি। তবে পুলিশের পক্ষে অসম্ভব নয়, কোন শব্দের কদৰ্থ বার করা। নিরীহ বয়ানের চিঠিও তারা ভয়াবহ করে তুলতে পারে।

ক্রমেই অস্বস্তি বেড়ে চলল। অ্যাডেল যদি চিঠিগুলি পুড়িয়ে না থাকে? যদি সেগুলো পুলিসের হাতে গিয়ে পড়ে? নাঃ অসম্ভব!

মিঃ ডুবয় অস্থির ভাবে উঠে দাঁড়ালেন। ভাবতে চেষ্টা করলেন, অ্যাডেল চিঠিগুলো কোথায় রাখতে পারে?…ওপরের বসার ঘরের ডেস্ক…সেকেলে এই ডেস্কে গোপন ড্রয়ার আছে বলেছিল অ্যাডেল। গোপন ড্রয়ার…পুলিসের চোখ এড়াবার জন্য নিশ্চয় তার মধ্যেই গোপন চিঠিগুলো রাখবে সে…নিশ্চয় তাই।

বিষ কোথা থেকে এলো পুলিস তাই খোঁজ করছে। প্রতিটি ঘর নিশ্চয় এখনো দেখেনি। এখনো সময় আছে…হা…দেরি হবার আগেই কাজটা করে ফেলতে হবে…

পরিকল্পনা ছকতে গিয়ে মনে মনে বাড়ির গঠনটা ভাবতে চেষ্টা করলেন ডুবয়।

বেলা শেষ হয়ে আসছে। একটু পরেই অন্ধকার থেমে আসবে…সেই সুযোগেই সকলের অগোচরে কাজটা হাসিল করতে হবে।

এই সময় চায়ের জন্য সকলেই নিচে থাকবে। হয় লাইব্রেরীতে বা বসার ঘরে। চাকরবাকররাও নিজেদের ঘরে চা পানে ব্যস্ত থাকবে।

এটাই মোক্ষম সুযোগ। দোতলায় কেউ থাকবে না..ইউ ঝোপের মধ্য দিয়ে গেলে সকলের চোখের আড়ালে থাকা যাবে।…বারান্দার শেষে একটা দরজা…ওতে তালা থাকে না…স্বচ্ছন্দে দোতলায় উঠে যাওয়া যাবে।

পরিকল্পনা সতর্কভাবে মনে মনে যাচাই করে নিলেন মিঃ ডুবয়। মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক হলে এসব কিছুই দরকার হত না। কিন্তু এখন বাড়ির চারপাশে বিপদ…তার থেকে নিজেকে দূরে রাখাই নিরাপদ।

.

সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখেই বড় জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়ল মেরী ডাভের। আবছা অন্ধকার নেমেছে বাগানে। কে একজন যেন হঠাৎ ইউ ঝোপের পাশ দিয়ে মিলিয়ে গেল। মূর্তিটিকে পুরুষ বলে চিনতে পারলেন।

চকিতে মিস ডাভের মনে হলো, তবে কি মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেঙ্কু ফিরে এলেন? হয়তো গেটের কাছে গাড়ি রেখে বাগানে ঢুকেছেন। বাড়ি থেকে কেমন অভ্যর্থনা পাবেন সেটাই হয়তো দেখবার ইচ্ছা।

মিস ডাভের ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। তিনি দ্রুতপায়ে নিচে নেমে এলেন।

গ্ল্যাডিস টেলিফোনের কাছে দাঁড়িয়েছিল। মিস ডাভকে দেখে সে কেমন ঘাবড়ে গেল।

–এই মাত্র টেলিফোনের শব্দ শুনলাম গ্ল্যাডিস, কে করল?

–ভুল নম্বর ছিল মিস, লোকটা লন্ড্রী খোঁজ করছিল। তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগল গ্ল্যাডিস, তার আগে মিঃ ডুবয় ফোন করেছিলেন। মাদামের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।

-বুঝেছি। চায়ের সময় হয়ে গেছে অনেকক্ষণ…।

বলতে বলতে মেরী হলঘরে ঢুকলেন। সেখান থেকে লাইব্রেরীতে এলেন। অ্যাডেল ফর্টেস্কু একটা সোফায় চুল্লীর পাশে বসে আছেন।

মেরীর সাড়া পেয়ে অ্যাডেল বললেন, চা কোথায়?

এখনই আসছে।

চারটেয় চায়ের সময়। এখন সময় পাঁচটা বাজতে কুড়ি। গ্ল্যাডিস তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের সরঞ্জাম গুছাতে শুরু করল।

মিসেস ক্রাম্প একটা গামলায় প্যাস্ট্রি মেশাচ্ছিল। বিরক্তমুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল মেয়ে, চা কখন নিয়ে যাবে, লাইব্রেরী থেকে ঘন্টা কতক্ষণ ধরে বেজে যাচ্ছে

–এখুনি যাচ্ছি–মিসেস ক্রাম্প।

রান্নাঘরে কেতলিতে চায়ের জল চাপিয়ে পাশের ভাঁড়ার ঘরে ঢুকল গ্ল্যাডিস। কেক, বিস্কুট, প্যাস্ট্রি আর মধু ট্রেতে নিয়ে নিল।

হুড়োহুড়ি করে না মেপেই আন্দাজ মতো কিছু চায়ের পাতা নিয়ে রুপোর পটে ঢেলে দিল। তারপর রান্নাঘরে ফিরে এসে পটে গরম জল ঢেলে নিয়ে লাইব্রেরী ঘরের দিকে ছুটল।

সোফার পাশে টেবিলে চায়ের পট নামিয়ে রেখে, ফের রান্নাঘর থেকে খাবারের ট্রে নিয়ে এল।

মেরী ডাভ যখন লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেই সময় ঘরে ঢুকল ইলেইন ফর্টেস্কু। চুল্লীর পাশে বসে হাত সেঁকতে লাগলেন।

হলঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিলেন মেরী ডাভ। এই সময় তার মনে হল কেউ ওপরে হাঁটছে। বোধহয় জেনিফার ফর্টেস্কু। কেউ অবশ্য নিচে এল না।

মেরী ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেলেন।

.

বাড়ির একপাশে একটা আলাদা সুইটে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন পার্সিভাল ফর্টেস্কু। মেরী এসে বসার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

–চা দেওয়া হয়েছে ।

জেনিফার ফর্টেব্দুর পরণে বাইরে যাওয়ার পোশাক দেখে আশ্চর্য হলেন মেরী। তিনি উটের লোমের কোটটা খুলবার চেষ্টা করছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে মেরী ফের বললেন, আপনি বাইরে গিয়েছিলেন জানতাম না।

-একটু বাগানে গিয়েছিলাম কিন্তু থাকতে পারলাম না, বড্ড ঠাণ্ডা, মিস ডাভ। আগুনের কাছে যেতে হবে।

কোটটা গা থেকে খুলে রেখে জেনিফার মিস ডাভের পেছনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আগে আগে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন।

মেরী হলঘরে এলে, সেই সময়েই সদরে ঘণ্টা বেজে উঠল। এই শব্দটার জন্যই যেন তিনি উৎসুক হয়েছিলেন। ভাবলেন, নিশ্চয় গৃহত্যাগী ছেলেকে দেখতে পাবেন।

দরজা খুলতেই চোখে পড়ল, মুখে স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক।

–মিঃ ল্যান্স ফর্টেস্কু?

–বিলক্ষণ।

মেরী পাশে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, আপনি একা? মালপত্র

হাতের জিপ লাগানো ব্যাগটা দেখিয়ে বললেন ল্যান্স এই আমার সব, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছি।

-আপনার স্ত্রী আসেননি?

–তিনি আপাতত আসছেন না।

বুঝেছি। আসুন আমার সঙ্গে। সকলেই লাইব্রেরী ঘরে আছেন।

সুদর্শন ল্যান্সকে কাছে থেকে দেখলেন মেরী। তারপর তাকে লাইব্রেরীতে পৌঁছে দিলেন।

.

ইলেইন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন ল্যান্সকে। অনেকদিন পরে গৃহত্যাগী ভাইকে দেখে তিনি যেন স্কুলের মেয়ের মতো হয়ে গেলেন।

ল্যান্স অবাক হল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।

–উনি জেনিফার?

জেনিফার ফর্টেস্কু তাকালেন। তার চোখে আগ্রহের দৃষ্টি। বললেন, ভ্যাল, শহরে কাজে আটকে গেছে। সবই তো ওকে একা সামাল দিতে হচ্ছে। কী যে যাচ্ছে আমাদের ওপর দিয়ে।

সোফায় বসে অ্যাডেল, হাতে একটা কেক, তাকিয়ে দেখছিলেন ল্যান্সকে।

-অ্যাডেলকে তুমি চেনো নিশ্চয়ই, তাই না? বললেন জেনিফার।

–হ্যাঁ…চিনি বইকি। মৃদু হেসে বললেন ল্যান্স, এগিয়ে এসে অ্যাডেলের হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন।

–আমার পাশে সোফায় বসে ল্যান্স। বললেন অ্যাডেল। তারপর এক কাপ চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন।

-তুমি আসাতে খুশি হয়েছি। বাড়িতে আর একজন পুরুষের উপস্থিতির অভাব আমরা বোধ করছিলাম। বাড়িতে পুলিস এসেছিল, জান নিশ্চয়ই। ওরা ভাবছে–

গলা ভারী হয় এলো অ্যাডেলের, মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলেন, বড় ভয়ঙ্কর…

-আমি সবই জানি, সহানুভূতির স্বরে বললেন ল্যান্স, আমার সঙ্গে ওরা লণ্ডন এয়ারপোর্টে দেখা করেছিল।

পুলিস তোমাকে কি বলেছে?

–যা ঘটেছে, সবই বলেছে।

–তাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে, নিশ্চয় এরকম বলেছে? আমাদের মধ্যেই যে কেউ বিষপ্রয়োগ করেছে, একথাই ওরা ভাবছে।

ল্যান্স শুষ্ক হাসি হাসল। তার চোখে শীতল দৃষ্টি।

যাই ভেবে থাকুক, সবই প্রমাণ করার বিষয়। ওরা ওদের কাজ করুক। এনিয়ে আমাদের ভাববার কিছু নেই।…অনেক দিন পরে মনে হচ্ছে সত্যিকার চা মুখে তুললাম–চমৎকার চা।

-তোমার স্ত্রী? তাকে আনলে ভালো হতো।

–প্যাট…প্যাট লণ্ডনেই আছে…অবস্থা বুঝে পরে…আঃ কেক দেখে লোভ হচ্ছে… ল্যান্স একখণ্ড কেক কেটে মুখে তুলল।

–আমাদের এফি মাসি? এখনো বেঁচে আছেন তো? বললেন ল্যান্স।

–ও হ্যাঁ, তিনি ভালই আছেন। তিনি নিচে আসতে চান না বড় একটা…কেমন যেন হয়ে পড়েছেন।

-তার সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। আচ্ছা, আমাকে যিনি ঢুকতে দিলেন সেই গম্ভীরমুখ মহিলাটি কে?

নিশ্চয় মেরী ডাভ হবে। আমাদের বাটলার-ক্রাম্প তো আজ ছুটি নিয়েছে। মেরী আমাদের বাড়ি দেখাশোনা করে। খুবই কাজের মেয়ে।

-ওহ, তাই বুঝি। আমারও মনে হল খুব বুদ্ধিমতী।

–তাহলে অচল পেনির মতো তুই আবার ফিরে এলি? মিস র‍্যামসবটম বললেন ল্যান্সকে।

–হ্যাঁ, এলাম এফি মাসি। ল্যান্স হাসল।

সময়টা ভালই বেছে নিয়েছিস। বাড়িতে পুলিস, গতকাল তোর বাবা খুন হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে দেখছি, ওরা সব জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোর বউকে এনেছিস?

–প্যাটকে আপাতত লণ্ডনেই রেখে এসেছি।

–বুদ্ধির কাজ করেছিস। এখানে কখন কি ঘটে কেউ বলতে পারে না।

–এসব যা শুনছি, তোমার কোন ধারণা আছে এফি মাসি?

–ঠিক এরকম প্রশ্নই একজন ইনসপেক্টর কাল এখানে এসে আমাকে করেছিল। লোকটার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে মনে হল।

এদিকে কি চলছিল, আমি তো জানি না কিছুই। বাবাকে এই বাড়িতেই বিষপ্রয়োগ করা হয়, পুলিস একথা কেন বলছে?

–পাপের রাজত্ব, বুঝলি।

একটু থেমে মিস র‍্যামসবটম আকাশের দিকে তাকালেন।

–ব্যাভিচার আর খুন–দুটো এক ব্যাপার নয়। ওর কথা আমি ভাবতে চাই না ল্যান্স।

–অ্যাডেল, বলছ?

সতর্ক কণ্ঠে জানতে চাইলেন ল্যান্সলট ফর্টেস্কু।

–আমার মুখ বন্ধ।

–তুমি আমাকে খুলে বলো তো এফি মাসি। অ্যাডেলের একজন ছেলে বন্ধু আছে, তাই না? তারা দুজনে যোগসাজসে বাবাকে চায়ের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিল, তুমি কি তাই বলতে চাইছ?

–ওসব নিয়ে ঠাট্টা তামাশার ইচ্ছে নেই আমার। তবে মনে হয় ওই মেয়েটা কিছু জানে।

কোন মেয়েটা। ল্যান্স উৎকণ্ঠ হল।

-ওই যে মেয়েটা, ওরা বলছে ছুটি নিয়েছে…আমার চা এনে দেবার কথা ছিল তার। সে যদি ছুটির নাম করে পুলিসের কাছে যায়, আমি অবাক হব না। তোকে দরজা খুলে দিয়েছে কে?

চুপচাপ শান্ত চেহারার একজন। ওরা বলল নাম মেরী ডাব। সেই পুলিসের কাছে গেছে বলছ?

–সে যাবে না। আমি বলছি পার্লারমেইডের কথা। ও কথায় কথায় একবার আমাকে বলে ফেলেছিল, কাউকে সে ঝামেলায় ফেলতে চায় না। আমি তাকে পুলিসের কাছে যেতে বলেছিলাম। সে আজেবাজে বকতে বকতে জানালো, পুলিস তার কথা বিশ্বাস করবে না। পরে ফের বলল, ও কিছুই জানে না। মেয়েটা কেবলই উল্টোপাল্টা বকছে। মনে হয় ভয় পেয়েছে। নিশ্চয় কিছু ও দেখেছিল বা শুনেছিল, কিন্তু গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারছে না।

-তোমার ধারণা ও পুলিসের কাছে যেতে পারে? সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ল্যান্সলট, বলছ–ও কিছু দেখে থাকতে পারে? কিন্তু…।

–জানিস, পার্সিভলের বউ একজন নার্স।

প্রসঙ্গ পাল্টে একেবারে অন্য প্রসঙ্গ তুললেন হঠাৎ মিস র‍্যামসবটম। ল্যান্সলট বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।

-হাসপাতালের নার্সরা ওষুধ নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত। বললেন, র‍্যামসবটম।

–ওই যে কি নাম ট্যাকসিন…ওটা কি ওযুধে ব্যবহার করা হয়?

মনে হয় ওই জিনিসটা পাওয়া যায় ইউগাছের ফল থেকে। বাচ্চারা ওগুলো খেয়ে অনেক সময় বিপদ ঘটায়।

ল্যান্সের ভুরু উঠে গেল। তীব্র দৃষ্টিতে সে তাকাল এফি মাসির দিকে।

-সত্যি কথা, আমি স্নেহবৎসল। সকলেই তা জানে। কিন্তু তাই বলে আমি বদ কাজ বরদাস্ত করতে পারব না।

.

মেরী ডাভ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মিসেস ক্রাম্পের অভিযোগ শুনছিলেন। প্যাস্ট্রি বেলতে বেলতে বেচারীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল।

–একবার আপনি ভাবুন মিস, বাড়ির কর্তা মারা গেছেন, বহুদিন পরে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন মিস্টার ল্যান্স…তার ওপরে তার সঙ্গে রয়েছে স্ত্রী…অভিজাত ঘরের মেয়ে… নৈশভোজের ব্যবস্থাটা তো আমি নমঃ নমঃ করে অন্যদিনের মতো সারতে পারি না। অত করে বোঝালাম যে আজ ছুটি নেবার দরকার নেই… কে শোনে কার কথা–আমাকে শুনিয়ে গেল, আজ আমার ছুটি…আমি সে ছুটি নিচ্ছি। তা চুলোয় যাক ক্রাম্প…তার তো আর আমার মতো নিজের কাজ নিয়ে গর্ব নেই।…তা এদিকে দেখুন, গ্ল্যাডিসকে বললাম, রাত্তিরে আমার কাজে একটু হাত লাগিও মেয়ে…বলল, ঠিক আছে, আমি আছি। তারপর সেই যে বেরুলো আর দেখা নেই। আজ রাত্তিরে একা আমি কি করে সামাল দেব…তবু ভাগ্য ভাল মিঃ ল্যান্স তার স্ত্রীকে সঙ্গে আনেননি।

-ঠিক আছে, মিসেস ক্রাম্প, আমি আছি। আর মেনুটা একটু সাধারণ করে নিলেই হবে। সান্ত্বনার সুরে বললেন মিস মেরী ডাভ।

–আপনি নিজে টেবিলে থাকবেন বলছেন, মিস?

–গ্ল্যাডিস সময় মতো ফিরে যদি না আসে–

মেরী ডাভকে বাধা দিয়ে মিসেস ক্রাম্প বলে উঠলেন, ও ফিরে আসবে না, আমি জানি। ও গেছে তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। ছোকরার নাম অ্যালবার্ট। সামনের বসন্তে ওরা বিয়ে করবে বলেছে ও আমাকে।

-চিন্তার কি আছে আমিই চালিয়ে নেব-ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।

মেরী ডাভ ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। ঘরে এখনো আলো জ্বালানো হয়নি। অ্যাডেল ফর্টেস্কু তখনো চায়ের ট্রের পেছনে সোফায় বসেছিলেন।

–একি আলো জ্বালানো হয়নি। আলোটা দেব, মিসেস ফর্টেস্কু?

বলতে বলতে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিলেন মেরী ডাভ। পর্দা টেনে দিতে গিয়ে তার চোখ পড়ল অ্যাডেলের মুখের দিকে, থমকে গেলেন তিনি

কুশনের ওপরে কাৎ হয়ে এলিয়ে পড়েছে দেহটা…পাশেই পড়ে রয়েছে আধখাওয়া একটুকরো কেক আর মধু…কাপের চা-ও সম্পূর্ণ খাওয়া হয়নি।…আচমকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু।

.

–সম্ভবত পটাসিয়াম সায়ানাইড, ইনসপেক্টর, চায়ের সঙ্গে ছিল। ডাক্তার বললেন।

–সায়ানাইড? অধৈর্যভাবে বলে উঠলেন নীল। অথচ ওঁকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল।

–হুম তাহলে তো এবারে আপনাকে ছক পাল্টে নিতে হবে।

–হুম।

রেক্স ফর্টেস্কুর কফিতে প্রয়োগ করা হয়েছিল ট্যাকসিন। আর সায়ানাইড দেওয়া হল অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে চায়ের সঙ্গে।…এবারে একেবারে চোখের ওপরে। ব্যাপারটা যে একান্তভাবেই পারিবারিক তা বুঝতে কষ্ট হল না ইনসপেক্টর নীলের।

ওরা চারজন একসঙ্গে লাইব্রেরীতে বসে বিকেলের চা পান করছিলেন। অ্যাডেল ফর্টে, জেনিফার ফর্টেস্কু, মিস ইলেইন ফর্টেস্কু আর বাইরে থেকে নতুন আসা ল্যান্সলট ফর্টেস্কু।

মিস র‍্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ল্যান্স, জেনিফার নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে চিঠি লিখতে বসেছিলেন। সকলের শেষে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে ছিলেন ইলেইন।

ইলেইন জানিয়েছে, যাবার সময়ও অ্যাডেলকে সুস্থ অবস্থায় দেখে গেছেন। শেষ এককাপ চা ঢেলে নিচ্ছিলেন।

ওই শেষকাপই তাঁর জীবনের শেষ চা হল।

এরপর মেরী ডাভ ঘরে ঢুকেছিলেন সম্ভবত কুড়ি মিনিট পরে। তিনিই আবিষ্কার করেন মৃতদেহ।

অজানা ওই বিশ মিনিটের মধ্যেই ঘটে গেছে যা কিছু। মাত্র বিশ মিনিট।

দ্রুত সিদ্ধান্ত স্থির করে নিলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

চুপসে যাওয়া বেলুনের মত বিশাল বপু নিয়ে একটা টেবিলের পাশে বসেছিলেন মিসেস ক্রাম্প।

–সেই মেয়েটি এখনো ফিরে আসেনি? জানতে চাইলেন নীল।

–কে গ্ল্যাডিস? না, আসেনি। এগারোটার আগে ও আসছে না—

চা সেই করে দিয়ে গিয়েছিল বলছেন?

-হ্যাঁ। আমি ওটা ছুঁইনি পর্যন্ত–শপথ করে বলছি। তাছাড়া গ্ল্যাডিস এরকম কাজ করতে পারে আমি তা বিশ্বাস করি না স্যর। মেয়েটা বোকা–তবে ভালো মেয়ে

নীলেরও অবশ্য তাই ধারণা। কেন না চায়ের পটে সায়ানাইড পাওয়া যায়নি।

–ওর কি আজ ছুটি ছিল?

–না, স্যর, আগামীকাল ওর ছুটির দিন।

–ক্রাম্প-সেও কি

মিসেস ক্রাম্প এবার উদ্ধত ভঙ্গীতে ঘাড় ঘোরালেন।

–এসব নোংরামোর মধ্যে ক্রাম্প নেই, তার ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করবেন না স্যর। সে বেরিয়েছে তিনটের সময়–মিঃ পার্সিলের মতোই সে এসবের বাইরে–

আশ্চর্য সমাপতন এই যে সবেমাত্র লণ্ডন থেকে ফিরে এসেই ল্যান্সলট ফর্টেঙ্কু বাড়ির দ্বিতীয় বিয়োগান্ত ঘটনার কথাটা শুনতে পান।

নীল বললেন, আমি সেকথা ভাবছি না মিসেস ক্রাম্প। গ্ল্যাডিসের কথা সে কিছু জানে কিনা তাই আমি জানতে চাইছিলাম।

–আমি ভাল করেই জানি। ভাল জামাকাপড় পরে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই কোন মতলবে বেরিয়ে থাকবে। একবার ফিরে আসুক

নীল রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় অ্যাডেল ফর্টের ঘরে গেলেন।

নিখুঁত সাজানো গোছানো বিলাসবহুল ঘর। একদিকে একটা দরজা; পাশে স্নানঘর। দরজায় পোর্সেলিনের আয়না বসানো। স্নানঘরে একটু দূরে একটা দরজা, ড্রেসিংরুমে যাওয়া যায় সেই দরজা দিয়ে।

নীল চারপাশটা দেখে শয়নঘরের দরজা দিয়ে বসার ঘরে এলেন।

গোলাপী কার্পেটে সাজানো এঘরটা। এঘরে দেখার কিছু ছিল না। কেননা, আগেরদিনই খুঁটিয়ে দেখে গেছেন। ছোট চমৎকার ডেস্কটা তার নজরে পড়েছিল।

সহসা নীলের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। গোলাপী কার্পেটের ওপরে পড়েছিল ছোট একটুকরো মাটি।

এগিয়ে গিয়ে টুকরোটা তুলে নিলেন। মাটি তখনো ভিজে।

সতর্ক চোখে চারপাশ দেখলেন নীল–না, কোন পায়ের ছাপ নেই কোথাও। কেবল এই একটুকরো ভিজা মাটি।

এবারে এলেন গ্ল্যাডিস মার্টিনের শোবার ঘরে। সে অনুপস্থিত। এগারোটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। ক্রাম্প ফিরে এসেছে আধাঘন্টা আগে। কিন্তু গ্ল্যাডিসের পাত্তা নেই।

অগোছালো ঘরে গ্ল্যাডিসের স্বভাবের পরিচয় খুঁজছিলেন। বিছানা যে কখনো সাফ করা হয় না, তা বোঝা যাচ্ছিল। জানলাগুলোও বন্ধ।

গ্ল্যাডিসের ব্যক্তিগত কিছু জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার মধ্যে ছিল সস্তাদরের কিছু গয়না।

আলমারীর দেরাজে চোখে পড়ল কয়েকটা ছবির পোস্টকার্ড; খবরের কাগজের কাটা টুকরো। সেলাইয়ের নকসা, আর সাজসজ্জার, পোশাকের ফ্যাসনের কথা ছিল টুকরোগুলোতে।

ছবির পোস্টকার্ডগুলো নানা জায়গায়। তিনখানা পোস্টকার্ড বেছে নিলেন নীল। এগুলোতে বার্ট নামে কেউ সই করেছিল। মিসেস ক্রাম্প যে তরুণের কথা বলেছেন, সম্ভবত এই সে।

প্রথম পোস্টকার্ডে লেখা, বুকভরা ভালবাসা জানাচ্ছি, তোমারই বার্ট।

দ্বিতীয় পোস্টকার্ডে–এখানে অনেক সুন্দরী মেয়ে তবে তোমার পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। সেদিনের কথাটা ভুলে যেও না। শিগগিরই দেখা হবে। দারুণ সুখের দিন আসছে আমাদের। ভালবাসা নিও। বার্ট।

তৃতীয় পোস্টকার্ডটা, তাতে কেবল লেখা, ভুলে যেও না, তোমার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। ভালবাসা রইল। বার্ট।

লেখা দেখে বোঝা যায় অনভ্যস্ত হাতে অশিক্ষিত কারও লেখা।

খবরের কাগজের কাটা টুকরোগুলোর নানা জিনিসপত্রের খবরগুলো আগ্রহের সঙ্গে পড়লেন নীল।

পোশাক, রূপচর্চা, রুপোলী পর্দার বিভিন্ন তারকার কথা ছড়িয়ে আছে এগুলোতে। একজায়গায় পাওয়া গেল উড়ন্ত পিরিচ সম্পর্কে কিছু লেখা।

আর একটা অংশে রয়েছে আমেরিকার ডাক্তারদের আবিষ্কার করা ওষুধের কথা, রুশডাক্তারদের আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা।

হতাশ হলেন নীল। এসব জিনিসের মধ্যে গ্ল্যাডিসের হঠাৎ অদৃশ্য হবার কোন সূত্র পাওয়া গেল না। রেক্স ফর্টেস্কুর মৃত্যুর বিষয়ে কোন কিছু গ্ল্যাডিস দেখে থাকবে, এরকম বলা হচ্ছে। কিন্তু সন্দেহ করবার মতো তেমন কোন সূত্রও পাওয়া গেল না কোথাও।

চায়ের ট্রেটা বিকেলে সে লাইব্রেরী থেকে এনে হলঘরে ফেলে গিয়েছিল। রান্নাঘরে ফিরে যায়নি।

গ্ল্যাডিসের এরকম ব্যবহার করার কোন কারণ আন্দাজ করা যায়নি। আচমকাই সে গা-ঢাকা দিয়েছিল। ঘরে এসবের কোন সূত্রই কোথাও পেলেন না নীল।

হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন নীল। তারপর ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

শেষ ধাপে নামতেই সার্জেন্ট হে উত্তেজিত ভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হলেন।

–স্যর, ওকে খুঁজে পেয়েছি স্যর—

কাকে খুঁজে পেয়েছ? সচকিত হলেন নীল।

–স্যর সেই হাউসমেইড…এলেনই ওকে দেখতে পেয়েছে। খিড়কির দরজার পিছনে তার জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া ছিল। সেগুলো তুলে আনা হয়নি, তাই একটা টর্চ নিয়ে এলেন গিয়েছিল সেখানে। মেয়েটার লাশের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল–কেউ তাকে গলা টিপে মেরে রেখে গিয়েছিল। একটা মোজা জড়ানো ছিল মেয়েটার গলায়। আমার মনে হয়, স্যর, অনেকক্ষণ আগে মারা গেছে। তাছাড়া স্যর, অত্যন্ত কদর্য তামাশা করেছে। খুনী–মেয়েটার নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকে রেখেছে

.

০৭.

ভোরের ট্রেনেই মেরী মিড ছেড়ে রওনা হয়েছিলেন মিস মারপল। তারপর জংশনে ট্রেন বদল করে চক্ররেল ধরে লণ্ডন হয়ে বেডন হীথ স্টেশনে পৌঁছালেন।

ট্রেনে আসতে আসতেই সকালের সংস্করণের তিনটি দৈনিক পড়া শেষ করেছেন। খবরটা সব কাগজেই প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। ইউট্রি লজের তিনটি বিয়োগান্ত ঘটনার বিবরণ।

বেডন হীথ স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে ইউট্রি লজে পৌঁছে সদর দরজায় বেল বাজালেন বৃদ্ধা মহিলাটি।

সাবেকী ধরনের টুইডের কোট আর স্কার্ট তার পরণে, একটা স্কার্ফ আর মাথায় ফেল্টের পালক বসানো টুপি। তার সঙ্গে মালপত্র বলতে একটা ভাল জাতের সুটকেস আর একটা হাতব্যাগ।

-বলুন মাদাম। বাটলার ক্রাম্প দরজা খুলে দাঁড়াল।

–গ্ল্যাডিস মার্টিন নামে যে মেয়েটি মারা গেছে, আমি এসেছি তার সম্পর্কে কথা বলতে।

–ওহো, মাদাম–এই যে

ঠিক সেই মুহূর্তে লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মিসেস ল্যান্স ফর্টেস্কু-কথা শেষ না করে তার দিকে তাকাল ক্রাম্প।

-উনি গ্ল্যাডিসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন মাদাম। বলল ক্রাম্প।

দয়া করে আসুন আমার সঙ্গে মাদাম।

প্যাট মিস মারপলকে সঙ্গে করে লাইব্রেরীতে এসে বসলেন।

–আপনি কি বিশেষ কারু সঙ্গে কথা বলবেন বলে এসেছেন? বললেন প্যাট, আমি আর আমার স্বামী কয়েকদিন হল আফ্রিকা থেকে এসেছি–এব্যাপারে কিছুই প্রায় জানি না

মিস মারপল প্যাট্রিসিয়া ফর্টেস্কুকে লক্ষ্য করছিলেন। তার গাম্ভীর্য আর সরলতায় তিনি মুগ্ধ হলেন। মুখভাবে কেমন অসুখী ভাব।

হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে মিস মারপল বললেন, ওই গ্ল্যাডিস নামের মেয়েটি খুন হওয়ার খবরটা খবরের কাগজে পড়লাম। মেয়েটিকে আমি ভালভাবেই জানি। বলতে গেলে তাকে আমিই বাড়ির কাজকর্ম শিখিয়েছি। তাই দুঃসংবাদটা পড়ে ছুটে না এসে পারলাম না–যদি কিছু করার থাকে।

-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। ওর সম্পর্কে এখানে কেউই বিশেষ কিছু জানে না। আপনি আসাতে ভালই হয়েছে।

–মেয়েটি ছিল অনাথ–একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে। সতেরো বছর বয়সে আমার কাছে এসেছিল। সেন্ট মেরী মিডে অনাথ মেয়েদের শিক্ষাদানের একটা ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে। আমার কাছেই ঘরের কাজকর্ম শিখেছে ও। পরে অবশ্য কাফেতে কাজ নিয়ে চলে আসে।

–আমি মেয়েটিকে কখনো দেখিনি। দেখতে কেমন ছিল বলতে পারব না।

–ওহ একেবারেই দেখতে ভাল ছিল না। বুদ্ধিও একটু ভেঁতা। আর খানিকটা পুরুষঘেঁষাও ছিল। তবে পুরুষরা বিশেষ পাত্তা দিত না ওকে–অন্য মেয়েরাও তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতো।

-আহা বেচারি। প্যাট সহানুভূতি প্রকাশ করল।

–সত্যিই দুর্ভাগ্য মেয়েটির। হয়তো একটু বেশি স্বাধীনতা ভোগ করবে বলে কাফেতে কাজ নিয়েছিল। কিন্তু রেস্তোরাঁর জীবনে সুখকর কিছু ঘটেনি সম্ভবত তাই বাড়ির কাজ বেছে নেয়। এ বাড়িতে ও কতদিন ছিল?

–শুনেছি, মাস দুয়েক এখানে কাজ করেছিল। আর এর মধ্যেই কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল ওর জীবনে। আমার মনে হয় ও কোন কিছু শুনে বা দেখে থাকতে পারে…তারই জের–

–আমাকে সবচেয়ে আঘাত করেছে ওই নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকানো ব্যাপারটা। বড় নিষ্ঠুর কাজ। মনুষ্যত্বের অপমান।

-আপনার কথা বুঝতে পারছি মাদাম। প্যাট বললেন, আপনি বরং ইনসপেক্টর নীলের সঙ্গে কথা বলুন। তিনি এই তদন্তের দায়িত্বে আছেন। তিনি খুবই মানবিক।

.

এক বাড়িতে পরপর তিনটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা…সারা দেশের খবরের কাগজগুলো পুলিসের কাজের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। ফলে খুবই অস্বস্তি দেখা দিয়েছিল পুলিস মহলে।

অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিস কমিশনার অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, প্রথমে স্বামী তারপরে স্ত্রী–দুজনকে পর পর খুন করা কোন বাইরের লোকের কাজ নয়, নীল। আমার মনে হয়, উন্মাদের মত এই খুন যে করেছে, সে বাড়িরই কেউ। মিঃ ফর্টেস্কুর কফিতে ট্যাকসিন মিশিয়ে দিয়েছে কোন সুযোগে। তারপর সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়েছে মিসেস অ্যাডেল ফর্টেস্কুর চায়ের কাপে।

পরিবারের বিশ্বাসভাজন এমন কারোর পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব। তুমি কি ভেবেছ–নীল, বাড়ির লোকেদের মধ্যে কে হতে পারে?

-একটা ব্যাপার, স্যর, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দুটি ঘটনাতেই পার্সিভাল ফর্টেস্কুর নাম অনুপস্থিতের তালিকায় রয়েছে।

হ্যাঁ, তুমি কি বলতে চাইছ, চিন্তিতভাবে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বললেন, সে নিজেকে সরিয়ে রেখে কৌশলে কাজ সমাধা করেছে? কিন্তু কিভাবে তার পক্ষে এটা সম্ভব?

–লোকটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্যর।

-বাড়ির মেয়েদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করছ না তুমি? অথচ সমস্ত ব্যাপারটা পর্যালোচনা করলে, বোঝা যায় এই কাজে মেয়েদের হাত রয়েছে।

ইলেইন ফর্টেঙ্কু আর পার্সিভালের স্ত্রী, এরা দুজনেই প্রাতরাশের সময় উপস্থিত ছিলেন। আবার দেখ, বিকেলে চা পানের সময়েও তারা। এদের দুজনের যে কেউ একজনের পক্ষেই কাজটা করা সম্ভব। ওদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করোনি?

ইনসপেক্টর নীল কোন জবাব দিলেন না। তিনি তখন ভাবছিলেন মিস মেরী ডাভের কথা। তাকে অতিমাত্রায় স্বাভাবিক দেখা গেছে বরাবর।

আর কেমন একটা হালকা খুশির ছোঁয়া রয়েছে কথায় ও কাজে। গোটা ব্যাপারটাই নীলের চিন্তা তাই মিস ডাভের দিকে প্রবাহিত করতে চাইছিল।

আর ওই গ্ল্যাডিস মার্টিন–তার সম্পর্কে নিজেকেই দায়ী ভাবতে চাইছিলেন তিনি।

তার মধ্যে পুলিস সম্পর্কে স্বাভাবিক ভীতি লক্ষ্য করেছিলেন তিনি। এখন তার মনে হচ্ছে ওটা ছিল তার চাপা অপরাধবোধ।

গ্ল্যাডিস নিশ্চয় কিছু দেখেছিল বা শুনেছিল। হয়তো সামান্য কিছু–কিন্তু তার সন্দেহ জেগে উঠেছিল। কিন্তু তা নিয়ে সে মুখ খুলতে চায়নি। এখন আর কিছুই জানা যাবে না তার কাছ থেকে।

.

ইউট্রি লজে প্রথম সাক্ষাতেই বেশ উদারতার সঙ্গে মিস মারপলকে গ্রহণ করলেন মিস ডাভ। বৃদ্ধাকে সৎ আর কর্তব্যনিষ্ঠ বলেই তার মনে হল।

–মেয়েটির সম্পর্কে এখানে কেউই বিশেষ কিছু জানত না। আপনি এখানে আসায় আমাদের কাজের অনেক সুবিধা হল।

-কর্তব্যবোধেই আমাকে আসতে হল ইনসপেক্টর। মেয়েটি আমার বাড়িতেই একসময়ে ছিল। বড্ড বোকা মেয়ে তাই তার জন্য দুঃখবোধ না করে পারছি না।

–গ্ল্যাডিসের জীবনে কি কোন পুরুষের ব্যাপার ছিল?

–আহা বেচারি, একজন পুরুষবন্ধু পাওয়ার জন্য ও বড় ব্যাকুল ছিল। সেজন্যেই সে, আমার ধারণা, রেস্তোরাঁর কাজে চলে এসেছিল। যাই হোক, মনে হয় শেষ পর্যন্ত একজন তরুণকে সে জোগাড় করেছিল।

-আমারও তাই মনে হয়। সম্ভবত তরুণটির নাম অ্যালবার্ট ইভান্স। কোন হলিডে হোমে ওদের পরিচয় হয়েছিল–গ্ল্যাডিস রাঁধুনীকে বলেছিল ছেলেটি নাকি একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার।

-না, এমনটি সম্ভব নয়, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মিস মারপল, ছেলেটি নিশ্চয় ওকে এরকমই বুঝিয়েছিল। সহজেই ও সবকিছু বিশ্বাস করে বসত। আপনি কি ছেলেটিকে এব্যাপারে জড়িত বলে মনে করছেন?

না, ওরকম কিছু মনে হয়নি আমার। যতদূর জেনেছি, ছেলেটি এখানে কখনো আসেনি। সে নানান সামুদ্রিক বন্দর থেকে মাঝেসাঝে একখানা ছবির কার্ড পাঠাতো। মনে হয় কোন জাহাজের নিম্নতম ইঞ্জিনিয়ার গোছের ছিল সে।

–অসুখী মেয়েটির জীবনে এই ছেদ বড় মর্মান্তিক ইনসপেক্টর–আমি ভুলতে পারছি না ওর নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকানো ছিল নিদারুণ নিষ্ঠুরতার কাজ

একটু থেমে আবার বললেন মিস মারপল, যাইহোক, ইনসপেক্টর, আমি আমার সামান্য মেয়েলি শক্তি দিয়ে যদি এই ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে চাই আপনার আপত্তি আছে? এমন নৃশংস একটি খুনের পর আসামী যেন কিছুতেই শাস্তি এড়াতে না পারে।

–আপনার সহযোগিতা আমার কাম্য মিস মারপল।

–এখানে স্টেশনের কাছে একটা গলফ হোটেল রয়েছে দেখলাম, আর মনে হয়, বিদেশী মিশন সম্বন্ধে আগ্রহী একজন বৃদ্ধাও আছেন এই বাড়িতে–মিস র‍্যামসবটম তার নাম।

-হ্যাঁ, সঠিক ক্ষেত্রই বেছে নিয়েছেন আপনি, সচকিত হয়ে বললেন নীল, ওই বৃদ্ধা মহিলার কাছে আমি গিয়েছিলাম–কিন্তু কোন কথা বার করতে পারিনি।

কাজের ক্ষেত্রে আপনার উদারতার পরিচয় পেয়ে আমি খুশি ইনসপেক্টর। খবরের কাগজ পড়ে সঠিক ঘটনা জানা যায় না আজকাল। বড় বেশি ফেনানো-ফাপানো থাকে। মূল বিষয়গুলো যদি জানা যেত

–এখানে যা ঘটেছিল তা এরকম–মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণু তাঁর নিজের অফিসে ট্যাকসিন নামের বিষের ক্রিয়ায় মারা যান। ইউগাছের ফল বা পাতা থেকে বিষ পাওয়া যায় জানেন নিশ্চয়ই।

-হ্যাঁ–খুবই সহজলভ্য। মিসেস ফর্টেস্কুর ঘটনা

-হ্যাঁ, তিনি পরিবারের অনেকের সঙ্গে লাইব্রেরীতে চা পান করছিলেন। তার সৎ মেয়ে মিস ইলেইন সবার শেষে লাইব্রেরী ছেড়ে বেরিয়ে যান। তিনি বলেছেন, মিসেস ফর্টে আর এক কাপ চা পট থেকে ঢালছেন, দেখে গেছেন তিনি।

এর পর প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে বাড়ির হাউসকীপার মিস ডাভ চায়ের ট্রে আনার জন্য লাইব্রেরীতে ঢোকেন। তিনিই মৃত অবস্থায় সোফায় বসে থাকা মিসেস ফর্টেস্কুকে আবিষ্কার করেন। তখনো তার পাশে ছিল অর্ধেকপূর্ণ চায়ের কাপ। চায়ের ওই তলানিতেই পটাসিয়াম সায়ানাইড পাওয়া যায়।

–বিষক্রিয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হয়। ওই মারাত্মক বিষ লোকে বোলতার চাক ভাঙার কাজে ব্যবহার করে।

–ঠিকই বলেছেন। এখানে এক প্যাকেট পাওয়া গেছে বাগানে মালীর ঘরের শেডের মধ্যে ।

-মিসেস ফর্টেস্কু চা ছাড়া আর কিছু খাচ্ছিলেন?

–হ্যাঁ, সঙ্গে চকোলেট কেক, সুইস রোল ইত্যাদি ছিল।

জ্যাম আর মধুও ছিল সম্ভবত? বললেন মিস মারপল।

–হ্যাঁ, মধু ছিল। পটাসিয়াম সায়ানাইড ছিল চায়ে।

–হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। এবারে তৃতীয় মৃত্যুটার সম্পর্কে বলুন, ইনসপেক্টর।

–এই ঘটনাটিও খুব পরিষ্কার। গ্লাডিস লাইব্রেরীতে চায়ের ট্রে নিয়ে আসে। খাবারের ট্রে সে হলঘরে ফেলে রেখেই চলে যায়। তারপর থেকে মেয়েটিকে আর কেউ দেখেনি।

সারাদিন মেয়েটি একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই রাঁধুনী মিসেস ক্রাম্প অনুমান করেন, সে তার কোন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যাটা কাটাতে গেছে। তার এমন মনে করার কারণ হল মিসেস ক্রাম্প দেখেছিলেন, গ্ল্যাডিস সুন্দর একজোড়া নাইলন মোজা আর সবচেয়ে দামী জুতো পরেছিল।

অবশ্য মিসেস ক্রাম্পের অনুমান ঠিক হয়নি। মেয়েটির হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, বাইরে জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া ছিল, তুলে আনা হয়নি। সে খাবারের ট্রে হলঘরে ফেলে রেখে ছুটে যায় দেয়ালের কাছে–অর্ধেক জামাকাপড়ও তুলেছিল–ঠিক সেই সময়েই কেউ লুকিয়ে তার গলায় মোজা জড়িয়ে টানে। গ্ল্যাডিসের ঘটনা এই।

-বাইরে থেকে কেউ এসেছিল মনে হয়?

–অসম্ভব কিছু নয়, ভেতরের কেউ হতে পারে। পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই হোক, ওকে পাওয়ার জন্যই অলক্ষিতে অপেক্ষা করছিল।

যখন আমরা মেয়েটিকে জেরা করি, খুবই নার্ভাস মনে হয়েছিল তাকে। তার মধ্যে কোন গোপন উদ্বেগ বা অপরাধবোধ ছিল–আমরা সেটা ধরতে পারিনি।

–পুলিসের জেরায় বেশির ভাগ মানুষই ভীত বিব্রত হয়ে পড়ে–স্বাভাবিক ভাবেই।

–এক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মিস মারপল। আমার ধারণা গ্ল্যাডিস এমন কাউকে কিছু একটা করতে দেখেছিল, যার গুরুত্ব সে বুঝতে পারেনি। তেমন মনে হলে সে অবশ্যই জানাত আমাদের। আমার মনে হয়, সেই অজ্ঞাত আততায়ী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেয়েটিকে বিপজ্জনক মনে করেছিল।

-কিন্তু কেবল এই কারণে তাকে খুন করে নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকে দিয়েছিল? সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন মিস মারপল।

-ওটা একটা হীন বীরত্ব দেখানো ছাড়া কি হতে পারে?

–না, ইনসপেক্টর–এটাকে অকারণ মনে করতে পারছি না। এর মধ্যে একটা ছক ধরা পড়ছে।

–ছক? অবাক হলেন ইনসপেক্টর। তিনি ইঙ্গিতটা ধরতে পারছিলেন না।

–হ্যাঁ, ঘটনাটাকে আমার একটা নির্দিষ্ট ছকের পরম্পরা বলেই মনে হয়।

–ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিস মারপল।

–দৃশ্যপটটা কল্পনায় আনার চেষ্টা করুন। মিঃ ফর্টেস্কু–কোথায় খুন হলেন? না, তার অফিসে। তারপরেই মিসেস ফর্টেস্কু–লাইব্রেরীতে বসে চা পানরত অবস্থায়। চায়ের সঙ্গে খাবার ছিল কেক আর মধু।

এরপর হতভাগ্য গ্ল্যাডিস, তাকে পাওয়া গেল নাকে কাপড়ের ক্লিপ লাগানো অবস্থায়।

পর পর ঘটনাগুলো খুবই অর্থবহ মনে হচ্ছে আমার কাছে। নির্দিষ্ট একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। আমি।

–কিন্তু, আমি তো

বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন ইনসপেক্টর নীল।

–ছেলেবেলায় মাদার গুজ ছড়াটা নিশ্চয় পড়া ছিল আপনার ইনসপেক্টর নীল? ছড়ার কথাগুলো মনে করলে একটা পরিচিত চিত্র পাবেন আপনি।

–আপনি খুলে বলুন দয়া করে, মিস মারপল।

–আপনি আশ্চর্য মানুষ–চমৎকার সরলতা। আমি আপনাকে মনে করাবার চেষ্টা করছি। ব্ল্যাকবার্ডস বা কালো পাখির কথা।

নিদারুণ এক হেঁয়ালির গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। বৃদ্ধা মহিলাটির মাথায় গোলমাল আছে এমন কথা ভাবা ঠিক হবে কিনা কেবল এই কথাই তিনি ভাবতে লাগলেন।

–ব্ল্যাকবার্ডস-ব্ল্যাকবার্ডস

অনেক পরে বিহ্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন নীল।

–হ্যাঁ, মিস মারপল বললেন, ছড়ার কথাগুলো ছিল…

গান তোক ছয় পেনি একমুঠো রাই
কালোপাখি চার ও কুড়ি ভাজা হল পাই
খোলা হলো পাই যেই গায় গান পাখি
রাজার জবর খানা কেউ বলে নাকি?
মোহর গোণেন রাজা রাজকোষে বসি
মধু খান মহারানি দিনভর খুশি।
তার দাসী শাড়ি মেলে বাগানের ফাঁকে
উড়ে এসে পাখি এক ঠোকরালো নাকে।

–যাব্বাবা। ইনসপেক্টর নীল যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

–অবাক হবার কিছু নেই মনে হয়; বললেন মিস মারপল। মিলটা বড় অদ্ভুত। দেখুন, রাই পাওয়া গেল মিঃ ফর্টের পকেটে। নানান কাগজে অবশ্য নানান ধরনের শস্যদানার কথা। বলেছে। তবে ছিল ভুট্টার দানাটানা নয়, রাই, তাই না?

হ্যাঁ, মাদাম।

–তাহলে মিলিয়ে নিন, তাঁর নামের প্রথম শব্দটা হল রেক্স–মানে হল, রাজা। তিনি তার কর্মক্ষেত্রে খাসকামরায় ছিলেন–বলা চলে কোষাগারে ছিলেন।

ওদিকে মিসেস ফর্টেন্ডু অর্থাৎ রানি লাইব্রেরীতে কেক মধু খাচ্ছিলেন। খুনীকে তাই পার্লারমেইড গ্ল্যাডিসের নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকাতেই হল।

–আপনার ওই উদ্ভট ছড়ার সঙ্গে যখন এভাবে মিলে যাচ্ছে তাহলে তো মানতে হয় সব কিছুই অর্থহীন–অকারণ–

-ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে ওই কালোপাখি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।

আমার বিশ্বাস কালোপাখির একটা যোগাযোগ এর মধ্যে কোথাও না কোথাও ঠিক পাওয়া যাবে। কাজেই ব্ল্যাকবার্ডস বা কালোপাখির কথাটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।

স্যর, স্যর ।

ঠিক সেই মুহূর্তে সার্জেন্ট হে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। কিছু বলার জন্যই সে এসেছিল। কিন্তু মিস মারপলকে লক্ষ করে থেমে গেল।

–আমি মনে রাখব মিস মারপল, অবস্থাটা সামাল দিতে চেষ্টা করলেন নীল আপনি যখন এভাবে বলছেন। আপনিও ওই মেয়েটির বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে থাকুন।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে মিস মারপল ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

-বুঝলে কালোপাখি—ব্ল্যাকবার্ডস

সার্জেন্ট হে-র দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে আওড়ালেন নীল।

–আঁ স্যর—

না..কিছু না..কি বলতে চাইছিলে তুমি?

রুমালে জড়ানো হাতের জিনিসটা এগিয়ে ধরে হে বলল, এই জিনিসটা স্যর…ঝোপের মধ্যে পড়েছিল। মনে হল পেছনের জানালা দিয়ে কেউ ছুঁড়ে ফেলেছিল।

রুমাল থেকে বের করে টেবিলের ওপরে জিনিসটা রাখতেই নীল চমকে উঠলেন। একটা মারমালেডের কৌটো-সামান্য একটু-মাত্ৰ ওপর থেকে খরচ করা হয়েছে।

কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে নীল কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে রইলেন। তাঁর মন সেই মুহূর্তে একটা দৃশ্য কল্পনা করবার চেষ্টা করছিল।

নতুন এক কৌটো মারমালেড–ওপর থেকে খানিকটা তুলে নেওয়া…মারমালেডে ট্যাকসিন মিশিয়ে সকলের অজ্ঞাতেই আসল কাজটা তাহলে সেরে রাখা হয়েছিল…পরে কৌটোর ঢাকনা বন্ধ করে–

–স্যর, সার্জেন্ট হে বলল, সেদিন প্রাতরাশে মিঃ ফর্টেঙ্কু শুধু মারমালেড নিয়েছিলেন, অন্যরা নিয়েছিলেন জ্যাম আর মধু

সম্বিত ফিরে পেলেন নীল। বললেন, ব্যাপারটা দেখছি খুবই সহজ হয়েছিল–কফির কাপে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার চাইতে এই কাজটা অনেক কম ঝুঁকির ছিল। মিঃ ফর্টেস্তু নিজের হাতেই কৌটো খুলে ওপর থেকে এক চামচ মারমালেড তুলে টোস্টের ওপর লাগিয়ে নিয়েছিলেন। বিষপ্রয়োগের খুবই নির্ভুল উপায়

–হ্যাঁ স্যর।

সার্জেন্ট হে-ও কল্পনায় দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছিল। উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল ইনসপেক্টর নীলের দিকে।

তার মানে, কোন অদৃশ্য হাত কৌটো খুলে সমান মাপে খানিকটা মারমালেড সরিয়ে নিয়ে আবার ঢাকনা এঁটে যথাস্থানে সেটা রেখে দিয়েছিল। তারপর…তারপর আগের মারমালেডের কৌটোটা, যেটায় ট্যাকসিন মেশানো ছিল সেটা জানালা গলিয়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। হা…কিন্তু ওই অদৃশ্য হাতের মালিকটি কে হতে পারে…বুঝেছ হে, এই কৌটোর মধ্যে ট্যাকসিন পাওয়া গেলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

-ঠিক স্যর। আঙুলের ছাপও পাওয়া সম্ভব।

-না হে, সেই অদৃশ্য হাত এমন অসতর্ক কাজটা নিশ্চয়ই করবে না। এতে যদি আঙুলের ছাপ থেকে থাকে…সে হয়তো মিঃ ফর্টেস্কু…কিংবা ক্রাম্প বা গ্ল্যাডিসের। যাই হোক, পরীক্ষার পরেই সব পরিষ্কার বোঝা যাবে।

আচ্ছা, এ বাড়িতে মারমালেড কিভাবে আনা হয়, কোথায় রাখা হয় এসব খবর নিয়েছ?

–হ্যাঁ স্যর। জ্যাম আর মারমালেড ছখানা করে কৌটো একসঙ্গে আনা হয়। পুরনো কৌটো শেষ হয়ে এলে নতুন কৌটো রান্নাঘরে পাঠানো হয়।

-তাহলে ঠিকই অনুমান করেছি, বললেন নীল, বাড়ির কোন লোক অথবা এখানে যাতায়াত আছে এমন কেউই কারচুপির কাজটা করে রেখেছিল। তারপর প্রাতরাশের টেবিলে ঠিক হিসেব মতোই….

নীল সহসা নিজের কথায় নিজেই সজাগ হয়ে উঠলেন। তিনি ভাবলেন, মারমালেডে বিষ মেশানোর কাজটা যদি আগেই হয়ে থাকে তাহলে একটা বিষয় একদিক থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, ওই দিন প্রাতরাশের টেবিলে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা কেউই দায়ী নন।

একটা গুরুত্বপূর্ণ নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত যেন পেলেন নীল। সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করার কথা তার মনে হল।

মিস মারপলের ছেলেভুলানো ছড়ার সেই ব্ল্যাকবার্ডস-এর কথাটাও এই সঙ্গে মনে পড়ে গেল তার। ছড়ার কথার সঙ্গে ঘটনার পরম্পরা অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছে–কাজেই উপেক্ষা করা যায় না সেই পাই আর ব্ল্যাকবার্ডস।

-ও. কে, হে, তুমি তোমার কাজে যাও।

.

দোতলার একটা শোবার ঘরে এলেন বিছানা গোছাচ্ছিল। মিস মেরী ডাভ তদারক করছিলেন। ইনসপেক্টর তার খোঁজে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

এলেন বিছানায় নতুন চাদর পাতছিল। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নীল জানতে চাইলেন, কোন অতিথি আসছেন মনে হচ্ছে?

মেরী স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, মিঃ জেরাল্ড রাইটের আসবার কথা ছিল। কিন্তু তার আসা নাকচ হয়ে গেছে

–জেরাল্ড রাইট? উনি কে?

সামান্য হাসলেন মেরী। কিন্তু সংযতকণ্ঠে বললেন, মিস ইলেইন ফর্টেস্কুর একজন বন্ধু।

-এখানে তার কখন আসার কথা ছিল?

–আমি শুনেছি তিনি গলফ হোটেলে উঠেছিলেন-মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুর পরের দিন। মিস ইলেইন তার জন্য ঘরটা তৈরি রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু পর পর মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ায় মিঃ রাইট হোটেলেই থেকে যাওয়া স্থির করেন।

–গলফ হোটেলে বললেন?

–হ্যাঁ।

চাদর আর তোয়ালে গুছিয়ে নিয়ে এলেন ঘর ছেড়ে চলে গেল। মেরী ডাভ ইনসপেক্টরকে বললেন, আপনি কি কোন কারণে আমাকে খুঁজছিলেন?

-হ্যাঁ। আসলে সময়ের ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে নিতে চাইছিলাম আপনার কাছ থেকে।

-হ্যাঁ, বলুন, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন মেরী ডাভ।

–আমার জানার বিষয় সময় আর স্থান নিয়ে। চা পানের আগে আপনি শেষবার গ্ল্যাডিসকে দেখেছিলেন হলঘরে, তাই না?

-হ্যাঁ, আমি ওকে চা আনার কথা বলেছিলাম।

–তখন সময় পাঁচটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি

–হ্যাঁ, তাই হবে।

–আপনি কোথা থেকে আসছিলেন?

–ওপর থেকে নিচে একটা টেলিফোনের আওয়াজ শুনেছিলাম

–টেলিফোন ধরেছিল কি গ্ল্যাডিস?

–হ্যাঁ। রঙ নাম্বার ছিল। কে লন্ড্রীর খোঁজ করছিল।

–সেই শেষবার আপনি তাকে দেখেছিলেন?

–এর মিনিট দশ-পনেরো পরেই ও চায়ের ট্রে লাইব্রেরীতে নিয়ে এসেছিল।

–মিস ফর্টেঙ্কু কি সেই সময়েই ঢোকেন?

–দু-তিন মিনিট পরেই। আমি তখন মিসেস পার্সিভালকে চায়ের কথা জানাতে যাই।

–আপনি বলেছিলেন, ওপরে কারও পায়ের শব্দ শুনেছিলেন

-হ্যাঁ। মনে হয়েছিল মিসেস পার্সিভাল আসছেন–কিন্তু কেউ নিচে নেমে না আসায় আমি উঠে যাই।

-মিসেস পার্সিভাল কোথায় ছিলেন?

তিনি তাঁর শোবার ঘরে ছিলেন। সবে এসেছিলেন, বাগানে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলেন।

-হাঁটতে বেরিয়েছিলেন? তখন সময় কত?

সময়…মনে হয় পাঁচটা।

–মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেস্কু কখন আসেন?

মিসেস পার্সিভালকে চা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে নিচে নেমে আসি। তার কয়েক মিনিট পরেই। আমার ধারণা হয়েছিল, তিনি আগেই এসেছিলেন কিন্তু

–তিনি আগে এসেছিলেন এরকম ধারণা হয়েছিল কেন আপনার?

-কারণ…টেলিফোনের শব্দ পেয়ে নিচে নামার সময় সিঁড়ির জানালা দিয়ে তাকে যেন চোখ পড়ল।

–বাগানে তাকে দেখেছেন বলে মনে হয়েছে?

–হ্যাঁ। ইউ ঝোপের আড়ালে কাউকে যেন একঝলক চোখে পড়ল–তাই মনে হয়েছিল তিনিই হবেন।

বাগানে কাউকে দেখেছেন, এবিষয়ে আপনি নিশ্চিত মিস ডাভ? চিন্তিতভাবে বললেন, নীল।

আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ইনসপেক্টর। এই কারণেই দরজায় বেল বাজাতে তাকে দেখে অবাক হয়ে যাই।

ইনসপেক্টর নীল ধীর সংযতকণ্ঠে বললেন, না মিস ডাভ, বাগানে আপনি কোনমতেই মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেস্কুকে দেখে থাকতে পারেন না। তার ট্রেন বেডন হীথ স্টেশনে পৌচেছিল চারটে সাঁইত্রিশ মিনিটে–নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট দেরিতে। ট্রেনে খুবই ভিড় ছিল। সেসব সামলে ট্যাক্সি ধরা-কয়েক মিনিট অন্তত দেরি হয়ে থাকে, স্টেশন থেকে বেরুতে বেরুতে পৌনে পাঁচটা হয়ে যাবার কথা।

ট্যাক্সি খুব তাড়াতাড়িও যদি এসে থাকে–তিনি যখন ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছেন, তখন সম্ভবতঃ পাঁচটা কি পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। না…আপনি যাকে বাগানে দেখেন তিনি মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেন্ধু হতে পারেন না।

–তবে আমি যে কাউকে দেখেছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মাথা ঝাঁকালেন ইনসপেক্টর নীল। ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, আপনি দেখেছিলেন কাউকে। তবে আবছা অন্ধকারে লোকটাকে নিশ্চয় স্পষ্টভাবে দেখতে পাননি?

–মুখ দেখতে পাইনি। আবছাভাবে দেখলেও মনে আছে বেশ লম্বা আর ছিপছিপে চেহারার মানুষ…আমরা সকলে তো ল্যান্সলট ফর্টেস্কুর অপেক্ষাই করছিলাম, তাই মনে হয়, উনিই হবেন।

–লোকটা কোনদিকে যাচ্ছিল বলে মনে হল?

–ইউগাছের ঝোপের পেছন দিয়ে বাড়ির পুবদিকে।

–ওই দিকে তো একটা দরজা আছে–সেটা তালাবন্ধ থাকে?

রাত্রে সব দরজা বন্ধ করার পরে তালা লাগানো হয়।

–তা হলে তো ওই পাশ-দরজা দিয়ে যে কেউ বাড়ির ভেতরে অজান্তে ঢুকে যেতে পারে!

–তা অসম্ভব নয়। তাহলে ওই লোকটাই কি গা-ঢাকা দিয়ে ওপরে গিয়েছিল তারই পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম বলে আপনার মনে হচ্ছে?

–এরকম হতে পারে।

–কিন্তু লোকটা তাহলে কে?

–আমিও তাই ভাবছি–

আর একটা কথা মিস ডাভ, ব্ল্যাকবার্ডস বিষয়ে আপনি কিছু জানেন?

আচমকাই প্রশ্নটা করে ফেললেন নীল। কিন্তু মেরী ডাভ কথাটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না। তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

–ব্ল্যাকবার্ডস মানে কালোপাখি সম্পর্কে জানতে চাইছি।

ক্রমশ মুখভাব পরিবর্তিত হল মিস ডাভের। তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, ওহ, আপনি গত গ্রীষ্মের সেই অদ্ভুত ঘটনার বিষয়ে বলছেন? কিন্তু…

ইনসপেক্টর নীল বাধা দিয়ে বললেন, ভাসাভাসা কিছু কানে এসেছে, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বলতে পারবেন।

ব্যাপারটা, আমার মনে হয়, কেউ তামাশা করতেই করেছিল। চারটে মরা কালোপাখি মিঃ ফর্টেস্কুর লাইব্রেরী ঘরের টেবিলে কেউ রেখে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম মালীর ছেলেরই কাণ্ড। জানালা তো খোলা ছিল।

ছেলেটা অবশ্য পরে বলেছিল সে একাজ করেনি। কালোরঙের পাখিগুলোকে মালী ফলের গাছের ডালে গুলি করে মেরেছিল।

-তারপর কেউ ওগুলো মিঃ ফর্টেস্কুর টেবিলে রেখে দিয়েছিল?

–হ্যাঁ।

–মিঃ ফর্টেঙ্কু ব্যাপারটা কিভাবে নিয়েছিলেন। তিনি বিরক্ত হন?

–বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক।

–বুঝেছি।

–আচ্ছা, ধন্যবাদ মিস ডাভ। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।

মেরী ডাভ একটু ইতস্তত করলেন। তারপর ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। নীলের মনে হল, হয়তো তার কিছু জানার উদ্দেশ্য ছিল।

ওই কালো পাখির ব্যাপারটা মিস মারপল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ইনসপেক্টর নীলের মাথায়। তিনি আশ্চর্য হলেন জেনে যে কালোপাখির একটা যোগাযোগ এসবের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ঘটনার স্রোতের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক এখনো তিনি জানেন না। আর সংখ্যাটা চার আর কুড়ি নয়। প্রতীক হিসেবেই যেন কালোপাখির উপস্থিতি রয়েছে বাস্তবে।

ঘটনাটা যদিও আগের–গত গ্রীষ্মকালের। তবু নীলের মনে হলো খুনীর অপরাধের সঙ্গে এর যোগসূত্রের সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখতে হবে।

.

০৮.

মিস মেরী ডাভের পর নীল মিস ইলেইন ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথা বলতে এলেন।

–আমি দুঃখিত মিস ফর্টেস্কু, আর একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে আপনাকে। আসলে ব্যাপারটা আমরা পরিষ্কার করে নিতে চাইছি–আপনিই সম্ভবত শেষ জন যিনি মিসেস ফর্টেস্কুকে জীবিত অবস্থায় দেখেছেন? সময়টা সম্ভবত পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিট

-মনে হয়। সারাক্ষণ তো আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সংযতকণ্ঠে বললেন ইলেইন ফর্টেস্কু।

-তা ঠিকই বলেছেন। তবে অন্যরা চলে যাওয়ার পর আপনিই মিসেস ফর্টেন্ধুর সঙ্গে থেকে যান?

-হ্যাঁ।

–আপনাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল জানতে পারি?

–আমরা কি নিয়ে কথা বলেছিলাম, তা কিছু এসে যায় না, ইনসপেক্টর।

–সম্ভবত না, তবে শুনলে সেসময়ে মিসেস ফর্টেস্কুর মানসিকতা কি রকম ছিল তা আন্দাজ করা যাবে।

–মানসিকতা–আপনার কি ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন?

–সবরকম সম্ভাবনার কথাই আমাদের খতিয়ে দেখতে হয় মিস ফর্টেস্কু। আশাকরি আপনি আমার বক্তব্য বুঝতে পারছেন।

ইলেইন ফর্টেঙ্কু একটু ইতস্তত করলেন। পরে বললেন, আলোচনা হয়েছিল আমার বিষয়েই

-আপনার বিষয়ে বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

–আমরা একজন বন্ধু…তার কথাই অ্যাডেলকে বলছিলাম আমি। জানতে চাইছিলাম, আমার এক বন্ধুকে বাড়িতে থাকার জন্য আসতে বলতে তার কোন আপত্তি আছে কিনা?

-আপনার এই বন্ধুটি কে?

–তার নাম জেরাল্ড রাইট। একজন স্কুলশিক্ষক। উনি গলফ হোটেলে উঠেছেন।

–আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিশ্চয়ই?

–আমরা বিয়ের কথা ভাবছি।

–কথাটা বলতে গিয়ে মিস ফর্টেস্কুর মুখে লালের আভা পড়ল। নীল তা লক্ষ্য করলেন।

-খুব আনন্দের কথা। আমার অভিনন্দন রইল। মিঃ রাইট গলফ হোটেলে কতদিন উঠেছেন?

-বাবা মারা যাওয়ার পর আমি তাকে তার পাঠিয়েছিলাম।

–তারপরেই উনি চলে আসেন?

–তার এবাড়িতে থাকার কথায় মিসেস ফর্টেস্কু কি বলেছিলেন?

–তিনি কোন আপত্তি করেননি। মনে হয়, ভাল মনেই নিয়েছিলেন।

–শুনেছি আপনার বাবা মিঃ রাইট সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন।

-বাবা খুবই অন্যায় ব্যবহার করেছিলেন। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিস ফর্টেস্কুর কণ্ঠস্বর, জেরাল্ড খুবই বুদ্ধিমান আর প্রগতিশীল ধ্যানধারণার মানুষ। বাবার ব্যবহারে জেরাল্ড খুবই আঘাত পেয়েছিল। তখনই সে চলে যায় আর বহুদিন ওর খবরাখবর পাইনি।

-বোঝা গেল।

মোটা অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় জেরাল্ট রাইটের পুনরায় আবির্ভাব হয়েছে, এরকম ভাবনাই ইনসপেক্টর নীলের মাথায় খেলে গেল।

–আপনার আর মিসেস ফর্টেস্কুর মধ্যে আর কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল?

–সেরকম কিছু নয়।

–আপনারা যখন কথা বলেন, তখন সময় পাঁচটা বেজে পঁচিশ। আর মিসেস ফর্টেস্কুকে মৃত অবস্থায় দেখা যায় ছটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে। মাঝখানের সময় আধঘণ্টা–ওই সময়ের মধ্যে আপনি কি আর ঘরে ঢুকেছিলেন?

না।

–ঘর থেকে বেরিয়ে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

–একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।

–গলফ হোটেলের দিকে কি?

–হ্যাঁ। কিন্তু জেরাল্ড সেখানে ছিল না।

–ঠিক আছে, আপাতত এটুকুই। ধন্যবাদ। মিস ইলেইন ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার মুখে নীল বলে উঠলেন, একটা কথা, আপনি কি কালোপাখি বিষয়ে কিছু জানেন?

-ওহ, কালোপাখি-বুঝেছি, পাইয়ের মধ্যে যেগুলো ছিল, তার কথা বলছেন?

নীলের মনে পড়ল, ব্ল্যাকবার্ডস তো পাইয়ের মধ্যেই থাকার কথা।

–পাই-হ্যাঁ, কবে এ ব্যাপার হয়েছিল?

–সে তো তিন চার মাস আগের কথা–কয়েকটা বাবার টেবিলের ওপরেও ছিল?

–আপনার বাবা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েছিলেন। কিন্তু কে এগুলো রেখেছিল আমরা জানতে পারিনি।

–আর একটা কথা। আপনার সৎমা কি কোন উইল করেছিলেন?

ইলেইন একমুহূর্ত চুপ করে থাকল। পরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কোন ধারণা নেই ইনসপেক্টর। আজকাল তো অনেকেই করে শুনেছি।

–আপনি কোন উইল করেছেন?

-না-না–আমি করিনি। উইল করবার মতো কিছু তো ছিল না এতদিন। এখন অবশ্য

–হ্যাঁ, আপনি এখন পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ডের মালিক–দায়িত্ব বড় কম নয়।

ইলেইন ফর্টেস্কু চলে গেলেন। কিন্তু নতুন ভাবনা আলোড়ন তুলল নীলের মনে। মেরী ডাভের কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

বাগানে একজনকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল–চারটে পঁয়ত্রিশের সময়। মেরী ডাভ মিথ্যা কথা বলে তাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে–এমন মনে হল না নীলের।

নতুন একটা সম্ভাবনার পথ দেখতে পেলেন নীল। ওই সময়ে বাগানে নিশ্চয়ই কেউ একজন ছিল–তাকে দেখে ল্যান্সলট ফর্টেন্ধু হতে পারেন–মনে হয়েছিল মেরী ডাভের। তার মনে অজ্ঞাত পরিচয় লোকটির চেহারা আর শরীরের গড়নের সঙ্গে ল্যান্সলট ফর্টেস্কুর চেহারার মিল ছিল।

ইউ ঝোপের আড়ালে এমন একজন গা ঢাকা দিয়েছিল ব্যাপারটা একেবারে নতুন কিছু।

আর একটা বিষয়-এর সঙ্গেই যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলেন নীল। মেরী ডাভ ওপরে কার পদশব্দ শুনেছে। তার মানে, কেউ ওপরে ছিল বোঝা যাচ্ছে–অথচ তাকে কেউ দেখতে পায়নি।

নীল একটুকরো ভেজা মাটি অ্যাডেল ফর্টেস্কুর ঘরে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। এই দুই বিষয়ে সম্পর্ক না থেকে পারে না–নীল ভাবলেন।

একটা সাবেকী আমলের চমৎকার ডেস্ক রাখা আছে সেই ঘরে। তার মধ্যে গোপন দেরাজ ছিল। তাতে তিনখানা চিঠি পাওয়া গেছে। অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে ভিভিয়ানের লেখা।

এরকম উদ্ভ্রান্ত প্রেমের চিঠিচাপাটি নীলের সারা কর্মজীবনে আরো অনেক হাতে পড়েছে। প্যাঁচপ্যাঁচে আবেগের বোকামি ভরা সব প্রেমপত্র।

তবে অ্যাডেল ফর্টেস্কুর লুকনো ডেস্কে যে তিনখানা চিঠি পাওয়া গিয়েছিল–সেগুলোর লেখা ছিল সতর্কতায় ভরা। নিষ্কাম প্রেমের চিঠি বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। যদিও নীল জানেন, এগুলা মোটেই তা ছিল না।

চিঠিগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পেরে নীল সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটারের অফিসে।

এই চিঠিগুলো থেকে একটা যোগসাজসের ইঙ্গিত স্পষ্টতই পাওয়া যায়ভিভিয়ান ডুবয় আর অ্যাডেল ফর্টেস্কুর।

মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুকে বিষপ্রয়োগের ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন তার স্ত্রীই নিজে থেকে অথবা ভিভিয়ান ডুবয়ের যোগসাজসে।

যদিও চিঠিগুলোতে খুনের কোনরকম ইঙ্গিত ছিল না। তা অবশ্য থাকবার কথাও নয়-নীল বুঝতে পেরেছেন ভিভিয়ান অতিশয় সাবধানী মানুষ।

আর তার পক্ষে যা সম্ভব, নীল আন্দাজ করতে পারলেন, ভিভিয়ান নিশ্চয় চিঠিগুলো নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে।

অ্যাডেল নিশ্চয়ই তাকে জানিয়েছিলেন তার কথামতোই তিনি কাজ করেছেন। যদিও তা করেননি।

ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে একের পর এক ঘটনায় প্রবেশ করে চলল নীলের সন্ধানী মন।

অ্যাডেল ফর্টেষ্ণু তার স্বামীকে বিষপ্রয়োগ করেছেন এই সন্দেহ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেল তার মৃত্যুতে। তার পরও একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটল ইউট্রি লজে।

এভাবেই এক নতুন সম্ভাবনার মুখোমুখি হয়ে পড়লেন ইনসপেক্টর নীল।

ভিভিয়ান ডুবয়কে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু। কিন্তু ভিভিয়ান অ্যাডেলকে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তার একলক্ষ পাউণ্ড। স্বামীর মৃত্যুর পর যা অ্যাডেলের হাতে আসতো।

ভিভিয়ান মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়ে থাকবেন। হৃদপিণ্ডের গোলযোগ জাতীয় কিছু। যদিও পরে প্রমাণিত হয়েছে মিঃ ফর্টেস্কুকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।

ইনসপেক্টর নীল ঘটনাটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। যদি এমন ঘটেই থাকে, মিঃ ফর্টেষ্ণুর মৃত্যুর জন্য অ্যাডেল ফর্টেষ্ণু আর ভিভিয়ান ডুবয়ই দোষী, তাহলে তাদের পরিকল্পনা কি রকম হতে পারে?

ভিভিয়ান ডুবয় নিশ্চয় ভয় কাটিয়ে উঠতে পারতেন না–অ্যাডেলের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত প্রকাশ পেতে।

উল্টোপাল্টা কিছু বলা বা করে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল। ঘন ঘন ডুবয়কে টেলিফোনও করে ফেলতে পারতেন। হয়তো তার ঘাবড়ে যাওয়ার কথাবার্তা ইউট্টি লজের কেউ শুনে ফেলতেও পারতো।

অতিশয় সতর্ক আর সাবধানী ডুবয় নিশ্চিত এসব আশঙ্কা করতেন। তিনি নিশ্চয় চুপচাপ থাকতেন না। সেক্ষেত্রে ডুবয় কি করতেন?

নীল ভাবলেন…এ প্রশ্নের উত্তর অনেক কিছুই হওয়া সম্ভব। যাই হোক না কেন…তিনি স্থির করলেন একবার গলফ হোটেলে খোঁজ নেওয়া দরকার…ডুবয় ওইদিন বিকেল চারটে থেকে ছটার মধ্যে হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছিলেন কিনা।

ভিভিয়ান ডুবয়ের চেহারাটা মনে করবার চেষ্টা করলেন নীল। ল্যান্স ফর্টেস্কুর মতোই দীর্ঘকায় তিনি। আবছা অন্ধকারে বাগানে গাছের আড়ালে তাকে ল্যান্স ফর্টেস্কু বলে ভয় ভুল হওয়া অসম্ভব নয়।

বাড়ির পাশ-দরজা দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। সহজেই তা করে থাকতে পারেন।

নিজের নিরাপত্তার তাগিদেই একাজটা তাকে করতে হতো। ওপরে গিয়ে চিঠিগুলোর খোঁজ করতেন অবশ্যই।

কিন্তু যখন দেখতেন, সেগুলো বেপাত্তা, তখন নিশ্চয় মরিয়া হয়ে উঠলেন। আশপাশে কেউ নেই দেখে এরপর লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে যেতে পারতেন।

সেখানে তখন অ্যাডেল ফর্টেন্ধু একা বসে আছেন-চা-পর্ব শেষ।–এমনটা কি নিতান্তই অসম্ভব?

মেরী ডাভ আর ইলেইন ফর্টেস্কুকে জেরা করা হয়েছে। এবারে একবার মিসেস পার্সিভালের সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার খোঁজে গিয়ে দোতলার বসার ঘরেই দেখা পেয়ে গেলেন নীল।

-মাপ করবেন মিসেস পার্সিভাল, কয়েকটা প্রশ্ন করব বলে এলাম।

নিশ্চয়ই, আসুন।

–দুজনেই পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসলেন। এবারে মহিলাকে কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ হল।

নীলের মনে হল, খুবই সাধারণ এক মহিলা। মনের অসুখী-ভাবটা মুখ দেখে আঁচ করা যায়। হাসপাতালের একজন নার্স অর্থবান মানুষকে বিয়ে করেও মানসিক শান্তি পাননি।

–অনেক জটিল বিষয় পরিষ্কার করবার জন্য আমাদের বারবার নানা প্রশ্ন করতে হয়। ব্যাপারটা ক্লান্তিকর মনে হতে পারে–আসলে সময়ের বিষয়েই কয়েকটা কথা জানতে হবে।

সেদিন বিকেলের চা-পর্বে শুনেছি, একটু দেরিতেই আপনি যোগ দিয়েছিলেন। মিস ডাভ ওপরে এসে আপনাকে ডেকেছিলেন।

-হ্যাঁ, তাই। আমি চিঠি লিখছিলাম,–ও এসে জানায় চা দেওয়া হয়েছে।

–ওহ্, আমি ভেবেছিলাম আপনি একটু হাওয়ায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন।

–মেরী ডাভ বলেছেন? ঠিক তাই…চিঠি লিখতে লিখতে মাথাটা একটু ধরেছিল, তাই বাগানে খোলা হাওয়ায় একটু পায়চারি করব বলে বেরিয়েছিলাম।

-ওখানে কারও সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

-কার সঙ্গে দেখা হবে? আশ্চর্য হলেন মিসেস পার্সিভাল, আপনার একথা বলার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম না।

-আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হল, বাগানে আপনার সঙ্গে কারোর দেখা হয়েছিল কিনা। অথবা হাঁটবার সময় আপনাকে কেউ দেখেছিল কিনা?

-না, এসব কিছুই হয়নি। তবে একটু দূরে মালীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।

–এরপর আপনি ঘরে ফিরে আসেন–আর মিস ডাভ এসে বলেন চা দেওয়া হয়েছে?

-হ্যাঁ। এত দেরি হয়েছিল বুঝতে পারিনি। আমি নিচে নেমে যাই।

–লাইব্রেরী ঘরে কারা ছিলেন?

–অ্যাডেল আর ইলেইন। দু-এক মিনিট পরে আমার দেওর ল্যান্সও আসে।

–তারপর সকলে একসঙ্গে বসে চা পান করেন?

–হ্যাঁ।

–তারপর?

-ল্যান্স ওপরে এফি মাসির সঙ্গে দেখা করতে চলে যায়, আমিও অর্ধেক লেখা চিঠিটা শেষ করার জন্য ঘরে চলে আসি। ওরা দুজন ঘরে রইল।

-হ্যাঁ, মিস ইলেইন আরও পাঁচ-দশ মিনিটের মতো ছিলেন মিসেস ফর্টেন্ধুর সঙ্গে। আপনার স্বামী এখনো ফেরেননি?

-ওহ, না। শহরে কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে সাধারণত সাতটা হয়ে যায়।

–আপনার স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মিসেস ফর্টেস্কু কোন উইল করেছিলেন কিনা। উনি জানিয়েছেন, সম্ভবত করেননি। এবিষয়ে আপনি কিছু জানেন?

নীল লক্ষ্য করলেন, জেনিফার ফর্টেঙ্কু বেশ আগ্রহের সঙ্গে তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

-হ্যাঁ, অ্যাডেল একটা উইল করেছিল, ও নিজেই আমাকে একথা বলেছিল।

–এটা কতদিন আগের কথা?

-বেশি দিন আগের নয়–একমাস মতো হবে হয়তো। ভ্যাল কথাটা জানতো না। ঘটনাচক্রে আমিই জেনে ফেলি।

–খুবই আগ্রহ জাগানো ব্যাপার। বললেন নীল।

–সেদিন দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম ফেরার পথে চোখে পড়ল অ্যাডেল এক সলিসিটারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। হাইস্ট্রিটের অ্যানসেল ওয়ারেলের অফিস।

-তারপর?

–অ্যাডেলকে জিজ্ঞেস করি, ও সলিসিটরের অফিসে এসেছিল কেন? ও আমাকে বলে, কথাটা কাউকে যেন প্রকাশ না করি তখন, আমাকেই কেবল জানাচ্ছে–ও একটা উইল তৈরি করেছে।

ও বলে, প্রত্যেকেরই উইল করা উচিত। তবে লণ্ডনে পারিবারিক সলিসিটর বিলিংলের অফিসে ইচ্ছে করেই যায়নি। বুড়ো তাহলে বাড়ির সবাইকে কথাটা জানিয়ে দেবে। ও বলেছিল, আমি আমার নিজের পথেই চলতে চাই। আমি অ্যাডেলকে বলেছিলাম, কাউকে কিছু জানাব না। বলিওনি কাউকে।

–আপনার এই মনোভাব প্রশংসার যোগ্য মিসেস পার্সিভাল।

–ধন্যবাদ, যথেষ্ট সাহায্য পেলাম আপনার কাছ থেকে।

–সব ব্যাপারটাই বড় ভয়ানক ইনসপেক্টর–বড় ভয়ানক। আচ্ছা, সকালে যে বৃদ্ধা মহিলা এসেছেন, উনি কে বলতে পারেন?

–ওঁর নাম মিস মারপল। গ্ল্যাডিস মার্টিন ওঁর কাছে কিছুদিন ছিল। তার সম্পর্কেই খোঁজখবর করতে এসেছেন তিনি।

-তাই। আশ্চর্য ঘটনা।

–আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব মিসেস পার্সিভাল। ব্ল্যাকবার্ডস বা কালো পাখি বিষয়ে আপনি কিছু জানেন?

নীল আশ্চর্য হলেন দেখে, কথাটা শোনামাত্র জেনিফার ফর্টেস্কু যেন কেঁপে উঠলেন। তার হাতব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেল। সেটা তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ব্ল্যাকবার্ডস? কালো পাখি? কি রকম কালোপাখি?

–শুধুই কালোপাখি–জ্যান্ত বা মরাও হতে পারে—

আপনি কি বলছেন কিছু বুঝতে পারছি না। তীব্র স্বরে বলে উঠলেন জেনিফার।

–ওহ, তাহলে বলছেন, কালোপাখির বিষয়ে আপনি কিছু জানেন না?

–আপনি কি গত গ্রীষ্মকালে পাইয়ের মধ্যে যেগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার কথা বলছেন? সে তো এক হাস্যকর ঘটনা।

কয়েকটা লাইব্রেরীর টেবিলের ওপরেও ছিল

–হ্যাঁ। একটা বিশ্রী তামাশার ব্যাপার। এজন্য মিঃ ফর্টেষ্ণু খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন।

–শুধুই বিরক্ত হয়েছিলেন বলছেন? আর কিছু না?

-না, মানে, বুঝতে পারছি আপনি কি বলতে চাইছেন। উনি জানতে চেয়েছিলেন, কে এরকম কাজটা করেছিল–কাছাকাছি এরকম কাউকে দেখা গিয়েছিল কি না।

-অচেনা কেউ–একথা উনি বলেছিলেন?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, একথাই তিনি বলেছিলেন। সতর্ক দৃষ্টিতে জেনিফার তাকালেন নীলের দিকে।

–অচেনা কেউ..নীল বললেন চিন্তিত ভাবে, তাকে কি ভয় পেয়েছেন মনে হয়েছিল? মানে অচেনা কারো সম্পর্কে…

অত ভাল মনে নেই, তবে তেমনই মনে হয়েছিল। ওরকম বিশ্রী তামাশা ক্রাম্পই মনে হয় পানাসক্ত অবস্থায় করে থাকবে, ও অনেকটা অন্যরকম। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে মিঃ ফর্টেস্কুর ওপরে ওর কোন রকম রাগ ছিল কিনা। আপনার কি মনে হয় ইনসপেক্টর?

–সবই সম্ভব মনে হয়।

এরপর ওখান থেকে বিদায় নিলেন নীল।

.

লাইব্রেরীতে এসে নীল দেখতে পেলেন ল্যান্সলট স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে দাবা খেলছেন।

খেলায় বাধা দেয়ার জন্য যথারীতি দুঃখ প্রকাশের পর নীল বললেন, মিঃ ল্যান্সলট, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম। আপনি কি ব্ল্যাকবার্ডস মানে কালোপাখি সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?

–ব্ল্যাকবার্ডস? ল্যান্স যেন একটু মজাই পেলেন, কি ধরনের কালো পাখি? যারা দাসব্যবসা করে তাদেরও তো ব্ল্যাকবার্ডস বলা হয়।

ইনসপেক্টর সহজ কণ্ঠে হেসে উঠলেন। বললেন, সত্যিকথা বলতে আমি নিজেই ব্যাপারটা জানি না। ব্ল্যাকবার্ডস সম্বন্ধে কথাটা উঠেছে বলেই জানতে চাইলাম।

ল্যান্স সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করবার চেষ্টা করলেন ইনসপেক্টর নীলকে।

–ওহ, তাহলে নিশ্চয় ব্ল্যাকবার্ডস খনি সম্বন্ধে নয়?

–ব্ল্যাকবার্ডস খনি? যেন জোর একটা ধাক্কা খেলেন নীল, ব্যাপারটা কি?

–ওই ব্যাপারটা আমি নিজেও ভাল করে জানি না ইনসপেক্টর। ছেলেবেলায় শোনা। যতদূর মনে পড়ে, এটা বাবার জীবনের একটা অসাধু লেনদেনের ঘটনা। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলেরই কোন খনি হবে এটা। এফি মাসি সম্ভবত একবার বাবাকে এনিয়ে খুব কথা শুনিয়েছিলেন।

–এফি মাসি মানে মিস র‍্যামসবটন?

–হ্যাঁ।

–তাহলে তো ওঁর কাছে জিজ্ঞেস করলে পরিষ্কারভাবে জানতে পারব। কিন্তু ওই জাঁদরেল মহিলার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমি কেমন দুর্বল হয়ে পড়ি।

–উনি ওরকমই বরাবর। তবে ইনসপেক্টর, ঠিকভাবে চলতে পারলে ওঁর কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য আপনি পাবেন। বয়স হলেও ওঁর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অতীতের কোন কিছুই ভোলেন নি।

একটু থামলেন ল্যান্সলট। তারপর আবার বললেন, এবারে এখানে আসার পরেই ওঁর সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন লাইব্রেরীতে চা পানের একটু পরেই। এফি মাসির ধারণা গ্ল্যাডিস এমন কিছু জানত যা সে পুলিসকে জানায়নি। অবশ্য, আমরা জানতাম না যে ইতিমধ্যে সে মারা গেছে।

উনি ঠিকই বলেছিলেন, আমরাও এখন বুঝতে পারছি, বললেন নীল, তবে এখন তো সে বেচারী সব কিছুর বাইরে

-এফি মাসি নাকি ওকে পুলিসের কাছে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মেয়েটা অবশ্য সে-কথা শোনেনি।

ল্যান্সলট ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথা শেষ করে নীল এক দুঃসাহসিক কাজই করলেন। তিনি মিস র‍্যামসবটমের ঘরে উপস্থিত হলেন।

মিস মারপল তখন সেই ঘরে বেশ জাঁকিয়ে বসে গল্প করছিলেন। ওঁদের গল্পের বিষয় ছিল বিদেশী মিশন।

ইনসপেক্টর নীল ঘরে ঢুকতেই মিস মারপল উঠবার উপক্রম করলেন, নীল তাকে বাধা দিলেন।

-আপনি বসুন মাদাম। আপনার সামনে কথা বলতে কোন আপত্তি নেই।

–আমিও মিস মারপলকে এবাড়িতে এসে থাকতে বলেছি। ওই গলফ হোটেলে থাকা মানে মিছেমিছি কতগুলো টাকার শ্রাদ্ধ। আমার পাশের ঘরটাই খালি পড়ে আছে। আপনার কি কোন আপত্তি আছে ইনসপেক্টর?

–আমার দিক থেকে আপত্তির কিছু নেই মাদাম। বললেন নীল।

–অশেষ ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞস্বরে বললেন মিস মারপল, তাহলে হোটেলে একটা টেলিফোন করে আসি বুকিং বাতিল করতে হবে।

মিস মারপল চলে গেলেন। মিস র‍্যামসবটম নীলকে উদ্দেশ করে বললেন, এবারে আপনার কথা শোনা যাক।

–ব্ল্যাকবার্ডস খনি সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু শুনব বলে এসেছিলাম।

–তাহলে সন্ধানটা পেয়ে গেছেন, সহসা অট্টহাস্য করে উঠলেন মিস র‍্যামসবটন, তবে খুব বেশ কিছু বলতে পারব বলে মনে হয় না।

-কতদিন আগেকার ব্যাপার এটা মাদাম? জানতে চাইলেন নীল।

–তা প্রায় বছর পঁচিশ তো হবে। পূর্ব আফ্রিকার কোনও অঞ্চলে হবে-খনিটা লিজ নেবার কথা হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে ম্যাকেঞ্জি নামে এক ভদ্রলোককে নিয়ে আমার ভগ্নীপতি সেখানে যান।

কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না, ম্যাকেঞ্জি সেখানেই জ্বর হয়ে মারা যান। রেক্স বাড়ি ফিরে সকলকে জানিয়েছিল খবরটা ছিল ভুয়ো। আমার জানার মধ্যে এটুকুই ইনসপেক্টর।

-কিন্তু মাদাম, আমি শুনেছি, এর চেয়েও বেশি কিছু আপনি জানেন। বললেন নীল।

–সেসব শোনা কথা। আপনি আইনের মানুষশোনা কথা আইনে গ্রাহ্য নয় বলেই তো শুনেছি।

-কিন্তু মাদাম আমরা এখনো আদালতে যাইনি।

–বেশ। তাহলে যেটুকু যা শুনেছি আপনাকে শোনাতে পারি।

একটু থামলেন মিস র‍্যামসবটম। এরপর বললেন, সেই সময়ে ম্যাকেঞ্জি পরিবার বলেছিল, রেক্স ম্যাকেঞ্জিকে ঠকিয়েছিল। আমার ভগ্নীপতিকে জানতাম বলে আমি তাদের কথাটা অবিশ্বাস করতে পারিনি।

লোকটা তো ছিল ধূর্তের শিরোমণি। বিবেক বলে কিছু ছিল না তার। যেখানেই যা করত, আইনের দিক থেকে কোন ট্র্যাক রাখতো না। তাই ওরা কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি।

মিসেস ম্যাকেঞ্জি স্বভাবতই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তিনি এখানে এসে রেক্সকে হুমকি দিয়ে যান প্রতিশোধ নেবেন বলে। তিনি বলেন রেক্সই ম্যাকেঞ্জিকে খুন করেছে।

এ ঘটনার পরে শুনেছি ভদ্রমহিলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। মানসিক রোগের হাসপাতালেও কিছুদিন ছিলেন।

–মিসেস ম্যাকেঞ্জি কি একাই এসেছিলেন এখানে? বললেন নীল।

–সঙ্গে ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে এসেছিলেন। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা বাচ্চাদের দেখিয়ে তিনি চিৎকার করে বলেন, এদের দিয়েই প্রতিশোধ নেওয়াবেন। খুবই বোকার মতো কাজটা করেছিলেন, সন্দেহ নেই।

এর বেশি আর কিছু জানা নেই আমার ইনসপেক্টর। তবে কি জানেন, ওই ব্ল্যাকবার্ডস খনির মতো অনেক জোছুরি কাজই রেক্স সারাজীবন ধরে করে গেছে। তা হঠাৎ ব্ল্যাকবার্ডের ওপর আপনার নজর পড়ল কেন? ম্যাকেঞ্জির খোঁজ পেয়েছেন নাকি?

-ওই পরিবারের কি হয়, কিছু জানেন মাদাম?

-না ইনসপেক্টর কিছু আর কানে আসেনি। ঈশ্বরের বিচার সময় সাপেক্ষ বটে, তবে তা কেউ এড়াতে পারে না। রেক্স তার উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছে আমি মনে করি। আপনাকে আর কিছু বলার নেই আমার–আপনি এবারে আসুন।

অনেক ধন্যবাদ মাদাম।

বলে নীল উঠে দাঁড়ালেন।

–মিস মারপলকে একটু পাঠিয়ে দেবেন। দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান কিভাবে চালাতে হয় এবিষয়ে মহিলার অগাধ জ্ঞান।

ইনসপেক্টর নীল ঘর ছেড়ে নিচে এসে প্রথমে টেলিফোন করলেন অ্যানসেল ও ওয়ারেলে। পরে গলফ হোটেলে। পরে সার্জেন্ট হেকে ডেকে বললেন, তিনি কিছু সময়ের জন্য বাইরে যাচ্ছেন।

জরুরী কোন দরকার পড়লে গলফ হোটেলেই আমাকে পাবে। আর শোন, ব্ল্যাকবার্ডস সম্পর্কে কিছু জানতে পারো কিনা দেখো।

-ঠিক আছে স্যর।

.

সলিসিটর অ্যানসেলের সঙ্গে কথা বলে নীলের মনে হলো তিনি পুলিসকে সাহায্য করতে আগ্রহী।

নীল তার কাছ থেকে জানতে পারলেন, সপ্তাহ পাঁচ আগে অ্যাডেল ফর্টেস্কুর জন্য একটা উইল তিনি করে দিয়েছেন। ভদ্রমহিলা নিজেই অফিসে এসেছিলেন।

মিঃ অ্যানসেল আরও জানালেন ইতিপূর্বে তিনি ফর্টেন্ধু পরিবারের কারও জন্য কোন আইন সংক্রান্ত কাজকর্ম করেননি।

মিসেস ফর্টেস্কুর উইলের বিষয়টাও জানা গেল। তিনি তার মৃত্যুর পর সমস্ত কিছুই দিয়ে গেছেন মিঃ ভিভিয়ান ডুবয়কে।

খবরটাতে অভিনবত্ব ছিল, তবে ইনসপেক্টর নীলের কাছে একেবারে অভাবিত ছিল না। তবু তিনি একটু চিন্তিতই হলেন।

সব শেষে মিঃ অ্যানসেল বললেন, তবে, আমি যতদূর জানি, মিসেস ফর্টেঙ্কু বিশেষ কিছু রেখে যেতে পারেননি।

নীল জানেন, মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর মৃত্যুর পর অ্যাডেল ফর্টেস্কুর অবস্থাটা অনেক বদলে গিয়েছিল। স্বামীর উইল অনুযায়ী তিনি একলক্ষ পাউণ্ডের মালিক হয়েছিলেন। মৃত্যুকর ইত্যাদি বাদ দিয়ে যে অর্থ থাকবে তা আসবে ভিভিয়ান ডুবয়ের হাতে।

সলিসিটর অফিস থেকে বেরিয়ে নীল এলেন গলফ হোটেলে। নীলের টেলিফোন পাবার পর তিনি অপেক্ষা করেছিলেন।

ডুবয় বললেন, জরুরী কাজে হোটেল ছেড়ে চলে যাওয়ার মুখেই আপনার টেলিফোন পাই ইনসপেক্টর। এভাবে আটকে থাকায় খুবই অসুবিধায় পড়তে হবে।

–আমাদের হাত পা বাঁধা, বুঝতেই পারছেন। বুঝতে পারছি মিসেস ফটেন্ধুর মৃত্যুতে আপনি খুবই আঘাত পেয়েছেন। আপনাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, তাই না?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, আমরা প্রায়ই একসঙ্গে গলফ খেলতাম। চমৎকার মহিলা।

–আচ্ছা মিঃ ডুবয়, তার মৃত্যুর দিন বিকেলে আপনি তাকে টেলিফোন করেছিলেন?

–ঠিক মনে পড়ছে না। টেলিফোন কি করেছিলাম?

–যতদূর জেনেছি-চারটে নাগাদ আপনি টেলিফোন করেছিলেন।

–ও হ্যাঁ হ্যাঁ-মনে পড়েছে। ওর কুশলবার্তা জানতে চেয়েছিলাম। নিতান্ত মামুলী কথাবার্তা।

-এরপর একটু ঘুরে আসার জন্য আপনি হোটেলে ছেড়ে বেরিয়েছিলেন।

–মানে..হ্যাঁ…ইয়ে..ঠিক বেড়ানো নয়…দু-এক কোর্স গলফ খেলেছিলাম।

-মনে হচ্ছে ঠিক তা আপনি করেননি মিঃ ডুবয়। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি এখানকার পোর্টার আপনাকে ইউট্রিলজের দিকে যেতে দেখেছিল।

তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন নীল। তার চোখে চোখ পড়তেই মাথা নত করলেন মিঃ ডুবয়।

-ইয়ে…মানে..আমার ঠিক মনে পড়ছে না ইনসপেক্টর।

ইতস্তত করে বললেন মিঃ ডুবয়।

–আপনি সম্ভবত মিসেস ফর্টেস্কুর সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলেন?

কখনোই নয়। আমি এই বাড়ির কাছেই যাইনি।

–তবে কোথায় গিয়েছিলেন জানতে পারি কি?

–হাঁটতে হাঁটতে আমি থ্রি পিজিয়ন পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তারপর আবার ফিরে আসি।

–আপনি নিশ্চিত যে ইউট্রিলজে যাননি?

–আমি নিশ্চিত ইনসপেক্টর।

নীল এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনি বুদ্ধিমান, মিঃ ডুবয়। আসল সত্যটা আমাদের কাছে খুলে বললেই ভালো করবেন। খুব সামান্য কারণেই হয়তো আপনাকে ইউট্রিলজে যেতে হয়েছিল।

-না, না, ইনসপেক্টর, ওইদিন আমি মিসেস ফর্টেস্কুর কাছে আদৌ যাইনি।

–তাহলে মিঃ ডুবয়, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন ইনসপেক্টর নীল, এ বিষয়ে একটা লিখিত বক্তব্য আপনার কাছ থেকে নেওয়ার দরকার হবে। অবশ্য সেই সময় একজন উকিল সঙ্গে রাখার অধিকার আপনার আছে।

মিঃ ডুবয় যেন একটা ঝাঁকুনি খেলেন একথায়। তাঁর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল।

-আপনি…আপনি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন

–একেবারেই না মিঃ ডুবয়। আপনার যে কিছু আইনগত অধিকার আছে আমি সেকথাই বলতে চেয়েছি।

আপনাকে আমি আবারো বলছি, আমি ওদের কোন কিছুর মধ্যেই থাকিনি।

থাকেননি। তাহলে স্বীকার করুন, ওইদিন বিকেল চারটের সময় আপনি ইউট্রিলজে গিয়েছিলেন। বাড়ির জানালার দিকে একজন আপনাকে বাগানে দেখেছিল।

–ঢোকেননি? তাহলে আমিই বলছি শুনুন। বাগানের পাশ দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে আপনি দোতলায় ওঠেন। তারপর মিসেস ফর্টেস্কুর বসার ঘরে ঢুকে তাঁর ডেস্কে; বলছেন কিছু খোঁজেননি?

-তাহলে সেগুলো আপনার হাতেই পড়েছে? রুক্ষস্বরে বলে উঠলেন মিঃ ডুবয়, ও আমাকে বলেছিল ওগুলো পুড়িয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ইনসপেক্টর, ওই চিঠিগুলো থেকে আপনি যে কি অর্থ করেছেন তা বুঝতে পারছি। তবে তা একেবারেই সত্যি নয়।

-আপনি মিসেস ফর্টেস্কুর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, নিশ্চয় তা অসত্য নয়?

–তা অস্বীকার করি কি করে, আমার লেখা চিঠি যখন আপনি পেয়েছেন। তবে একটা অনুরোধ আপনাকে করব, ওগুলো থেকে কোন ভয়ানক ধারণা আপনি করবেন না। আমি বা অ্যাডেল কখনো মিঃ ফর্টেস্কুকে খুন করতে চাইনি। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আমার মানসিকতা তেমন নয়।

–মিসেস ফর্টেঙ্কু হয়তো এরকম মানুষই ছিলেন।

–একথা ঠিক নয়। সেও কি খুন হয়নি?

–সেকথা অবশ্য ঠিক। বললেন নীল।

–আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন একই লোক ওদের দুজনকে খুন করেছে।

–অসম্ভব নয়। তবে অন্য সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। মিঃ ডুবয়, এমন তো হতে পারে, মিসেস ফর্টেস্কুই তার স্বামীকে হত্যা করেন। কিন্তু এই কাজের জন্য তিনি বিশেষ একজনের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। সেই লোক তাকে এই কাজে সহায়তা হয়তো করেনি, তবে প্ররোচনা জুগিয়েছিল। এবং এর জন্যেই সেই লোকের কাছে মিসেস ফর্টেঙ্কু বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন।

-না, না, ইনসপেক্টর, এভাবে আমার বিরুদ্ধে আপনি অভিযোগ আনতে পারেন না।

-মিসেস ফর্টেস্কু একটা উইল করেছিলেন। তিনি মৃত্যুর পরে তার সমস্ত কিছু, মায় টাকাকড়ি, আপনাকে দিয়ে গেছেন।

–আমি এসবের এক কপর্দকও চাই না।

–আপনি অবশ্য যা পাবেন তা খুবই সামান্য। কিছু অলঙ্কার আর লোমের পোশাক। নগদ অর্থ খুবই কম। মিঃ ডুবয় যেন বোকা হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। পরে বললেন, কিন্তু ওর স্বামী-আমি ভেবেছিলাম

–তাহলে আপনি ভেবেছিলেন, কঠিন স্বরে বলে উঠলেন নীল, কিন্তু রেক্স ফর্টেস্কুর উইলের বিষয়বস্তু আপনি জানতেন না—

.

এরপর ইনসপেক্টর নীল গলফ হোটেলেই সাক্ষাৎ করলেন মিঃ জেরাল্ড রাইটের সঙ্গে। তাকে দেখে নীলের মনে হল, চেহারার দিক থেকে দুজনের মিল অনেক।

জেরাল্ড রাইটের ছিপছিপে গড়ন। কিন্তু ভাবভঙ্গী বুদ্ধিজীবীসুলভ।

–ইউট্রিলজে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর আপনি দিতে পারবেন আশা করছি মিঃ জেরাল্ড। বললেন নীল।

-খবরের কাগজ থেকেই যা জানার জেনেছি; মিষ্টি হেসে বললেন জেরাল্ড। আজকাল তো দেখছি নৃশংস সব খুনখারাবির খবরই কাগজগুলোর উপজিব্য হয়ে উঠেছে। যাই হোক, ইনসপেক্টর, ইউট্রিলজের ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। মিঃ রেক্স ফর্টেঙ্কু যখন মারা যান, আমি তখন আইল অব ম্যান-এ ছিলাম।

-হ্যাঁ। মিস ফর্টেস্কুর একটা টেলিগ্রাম পেয়ে আপনি সঙ্গে সঙ্গেই এসে পড়েন, নয় কি?

–আমাদের পুলিস দেখছি খুবই করিতকর্মা–সবই জানে। ইলেইনের তার পেয়ে আমি চলে আসি।

–আপনারা শিগগির বিয়ে করছেন বলে শুনেছি। বললেন নীল।

–আপনি ঠিকই শুনেছেন ইনসপেক্টর।

–ও বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই, ওটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাদের পরিচয় সম্ভবত খুব অল্পদিনের–ছয় কি সাত মাস

–একদম ঠিক।

–মিঃ ফর্টেস্কু আপনাদের বিয়েতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর অমতে বিয়ে হলে তিনি মিস ফর্টেস্কুকে কোন টাকাকড়ি দেবেন না, একথাও তিনি আপনাকে জানিয়েছিলেন। এরপর আপনি বাগদান ভেঙ্গে দিয়ে চলে যান–

-আপনার সব কথাই ঠিক ইনসপেক্টর। আসল কথা হল রাজনৈতিক মতবাদ সহ্য করতে পারেননি মিঃ ফর্টেস্কু।

তিনি ছিলেন অতি জঘন্য ধরনের পুঁজিবাদী মানুষ। আমি কেবল টাকার জন্য আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ বিসর্জন দিতে চাইনি।

তবে এখন আপনি উপস্থিত হয়েছেন এমন একজন মেয়েকে বিয়ে করতে যিনি সম্প্রতি ৫০,০০০ পাউণ্ডের মালিক হচ্ছেন।

জেরাল্ড রাইট মিষ্টি হাসলেন। বললেন, না, ইনসপেক্টর এখন তাকে বিয়ে করতে একদম আপত্তি নেই। সমাজের সকলের উন্নতির জন্য এ টাকাটা ব্যয় করা হবে। ওসব আলোচনা থাক ইনসপেক্টর-আপনি যা জানতে এসেছেন সেই কথাই বলুন।

-হ্যাঁ, মিঃ রাইট সেই প্রশ্নই আপনাকে করছি। গত ৫ই নভেম্বর বিকেলে সায়ানাইডের বিষক্রিয়ায় মিসেস ফর্টেঙ্কু মারা যান–এ খবর নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। ওই দিন বিকেলে আপনি ইউট্রিলজের কাছাকাছি ছিলেন বলেই জানতে চাইছি, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা সম্ভব এমন কিছু কি আপনার চোখে পড়েছিল–

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ইনসপেক্টর ওই দিন বিকেলে আমি ইউট্রিলজের কাছাকাছি ছিলাম। এমন ধারণা আপনার জন্মাল কি করে?

–মিঃ রাইট, ওই দিন বিকেলে সাড়ে চারটের সময় আপনি হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছিলেন এবং ইউট্রিলজের দিকে হাঁটছিলেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মনে করা যেতে পারে আপনি সেখানে গিয়েছিলেন।

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, সেরকম ভেবেই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হল কাজটা ঠিক হবে না। তাছাড়া সন্ধ্যা ছটায় মিস ইলেইনের আমার হোটেলে আসার কথা ছিল। তাই আমি কিছুক্ষণ বেড়িয়ে একটা গলির মধ্য দিয়ে হোটেলে ফিরে আসি ছটার মধ্যেই। ইলেইন অবশ্য আসেনি। ওই পরিস্থিতিতে অবশ্য সম্ভবও ছিল না।

–আপনি যখন হাঁটছিলেন, তখন আপনাকে কেউ দেখেছিল?

–তা তো খেয়াল করিনি। সরু গলিটার ভেতর দিয়ে কয়েকখানা গাড়ি অবশ্য পাশ দিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে চেনাজানা কেউ ছিল কিনা খেয়াল করিনি।

-বেশ। এই হোটেলেই আছেন মিঃ ভিভিয়ান ডুবয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?

-ডুবয়? আলাপ নেই। মনে হয় লম্বা চেহারা, গাঢ় রঙ, আর সোয়েডের জুতো পছন্দ তিনিই হবেন।

-হ্যাঁ। ওই দিন বিকেলে উনি ইউট্রিলজের দিকে গিয়েছিলেন। রাস্তায় তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?

-না, তাঁকে দেখেছি বলে মনে হয় না। ওই কর্দমাক্ত গলি দিয়ে কে হাঁটতে যাবে—

বুঝতে পারলাম। বললেন নীল।

ইউট্রিলজে ফিরে আসতেই সার্জেন্ট হে এসে উৎসাহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালো ইনসপেক্টর নীলকে।

–আপনার সেই কালোপাখি আবিষ্কার করেছি স্যার।

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ, স্যর, ওগুলো পাইয়ের মধ্যে ছিল। নৈশভোজের জন্য রবিবারে ঠাণ্ডা পাই রাখা ছিল। কেউ অজান্তে ভাড়ার ঘরে ঢুকে পাত্রের ঢাকনা খুলে শূকরের মাংস বের করে নিয়ে ছিল। আর তার মধ্যে রেখে দিয়েছিল কয়েকটা পচা কালো পাখি। পাখিগুলো মালির চালাঘরে ছিল। এ কিরকম ঠাট্টা বুঝতে পারছি না স্যর।

ইনসপেক্টর নীল অন্যমনস্কভাবে বলে উঠলেন, হা, রাজার এমন খানা অদ্ভুতই বটে-সার্জেন্ট হে কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। নীল বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।

.

০৯.

–তুমিই তাহলে ল্যান্সের স্ত্রী?

পেসেন্স খেলায় নিমগ্ন মিস র‍্যামসবটম মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন।

–হ্যাঁ। প্যাট উত্তর দিল।

মিস র‍্যামসবটম তার সঙ্গে আলাপ করতে চান জেনে প্যাট তার ঘরে এসেছিলেন।

-তোমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই দেখছি। বোসো আরাম করে। ল্যান্সের সঙ্গে কোথায় আলাপ হয়?

-কেনিয়াতেই পরিচয় হয়েছিল।

–শুনেছি, তোমার আগেও বিয়ে হয়েছিল?

–হ্যাঁ, দুবার।

–ওহ, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়?

-না। প্যাট মাথা নত করলেন, আমার প্রথম স্বামী ফাইটার প্লেনের পাইলট ছিলেন। তিনি যুদ্ধে মারা যান।

–আর দ্বিতীয় স্বামী? তিনি শুনলাম গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, তাই কি?

–হ্যাঁ।

–তোমার কোন দোষ ছিল?

–না, আমার কোন দোষ ছিল না। রেস খেলতেন।

–হুঁ। বাজিধরা, তাস খেলা এসব শয়তানের কাজ। এই বাড়িটাও শয়তানের আখড়া হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরই তাদের শাস্তি দিয়েছেন।

প্যাট অপ্রতিভ অবস্থায় বসে রইলেন। কথা শুনে ল্যান্সের এফি মাসিকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।

–এ বাড়ির সম্পর্কে কিছু জান তুমি? মিস র‍্যামসবটম জানতে চান।

–বিয়ের আগে সবাই যেমন শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে জানে আমিও সেটুকুই জেনেছি।

-হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই বলেছ। তোমাকে একটা কথা বলছি, আমার বোন ছিল বোকার হদ্দ, আর ভগ্নীপতি এক শয়তান, পার্সিভাল ছিঁচকে। তোমার স্বামী ল্যান্স, সে এই পরিবারের সব চেয়ে মন্দ ছেলে।

–আমার মনে হয় আপনার একথা ঠিক নয়। প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন প্যাট।

–যাই মনে কর বাপু, একটা কথা মনে রেখো, পার্সিভালকে কখনো বোকা ভেবে নিও না। ও বোকার ভান করে থাকে কিন্তু মহা ধুরন্ধর।

আর একটা কথা, ল্যান্সের কাজকর্মও আমি ভাল মনে করি না। কিন্তু আবার ওকে কেন যেন পছন্দ না করেও পারি না। ওটা চিরকালই কেমন বেপরোয়া গোছের। তোমাকে ওর ওপর নজর রাখতে হবে যেন বাড়াবাড়ি না করে।

ওকেও বলো, পার্সিভালকে যেন সমঝে চলে। ওকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। এবাড়ির সবাই জঘন্য মিথ্যাবাদী।

কথা শেষ করে খুশি খুশি মুখে প্যাটের দিকে তাকালেন বৃদ্ধা।

.

ইনসপেক্টর নীল স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন।

ওপাশ থেকে অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার বললেন, মনে হয় সে মারা গিয়ে থাকবে। তবু বেসরকারী স্যানাটোরিয়ামগুলোয় খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তুমি খবর পেয়ে যাবে। তোমার ওই কালোপাখির থিওরিটা অভাবিত।

-তবুও ওটাকে অবহেলা করা ঠিক হবে না মনে হচ্ছে স্যার। সব কিছুই কেমন মিলে যাচ্ছে।

–তাই দেখছি–রাই…কালো পাখি…লোকটির নাম–রেক্স

–আমি স্যর ডুবয় আর রাইটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি আপাতত। এদের কাউকেই হয়তো গ্ল্যাডিস নামের মেয়েটি দরজার পাশে দেখে থাকবে। ওরা ওখানে কি করছে দেখার জন্যই হয়তো হলঘরে ট্রে নামিয়ে রেখে দেখতে গিয়েছিল। মেয়েটাকে ওখানেই কেউ শ্বাসরুদ্ধ করে মারে। পরে দেহটা বাগানে যেখানে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যায় আর নাকে ক্লিপ এঁটে দেয়।

জঘন্য কাজ। একেবারেই উম্মাদের মতো–

-নাকে ক্লিপ লাগানোর ব্যাপারটা ওই বৃদ্ধা মহিলা মিস মারপলকে খুব নাড়া দেয়। খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা। উনি ওই বাড়িতেই আপাতত থাকছেন বৃদ্ধা মিস র‍্যামসবটমেরও তাই ইচ্ছা।

–তোমার বর্তমান কর্মসূচী কি নীল?

-লণ্ডনের সলিসিটরের সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব। রেক্স ফর্টেস্কুর ব্যাপারে আরো কিছু জানা দরকার। তাছাড়া, পুরনো সেই ব্ল্যাকবার্ড সম্পর্কেও খোঁজখবর করতে চাই।

.

বিলিংসলে, হর্সথর্প ও ওয়াল্টার্স প্রতিষ্ঠানের মিঃ বিলিংসলেকে যে ইউট্রিলজের তিনটি মৃত্যুর ঘটনা যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে, দ্বিতীয়বারের সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ইনসপেক্টর নীল। পুলিসকে সাহায্য করার জন্যই তিনি উদগ্রীব ছিলেন।

-এমন অস্বাভাবিক কাণ্ড আমার সারা কর্মজীবনে আর দেখিনি। এব্যাপারে সবরকম সাহায্যই আপনি আমার কাছ থেকে আশা করতে পারেন। বললেন মিঃ বিলিংসলে।

-আপনিই বলতে পারবেন মিঃ ফর্টেষ্ণুর প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থাটা কেমন। তাছাড়া মানুষটির সম্পর্কেও।

-কাজকর্মের সূত্রে মিঃ ফর্টেস্কুর সঙ্গে আমার সোল বছরের পরিচয়। তবে অন্য সলিসিটরের সঙ্গেও তার কাজকর্ম হত। আপনাকে তো উইলের বিষয়ে আগেই বলেছি। বর্তমানে মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুই তার সম্পত্তির অবশিষ্ট অংশের উত্তরাধিকারী।

মিঃ বিলিংসলে, আমি এখন মিসেস ফর্টেস্কুর উইলের সম্পর্কেই আগ্রহী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তো একলক্ষ পাউণ্ডের উত্তরাধিকারী হন, তাই না?

-হ্যাঁ। কিন্তু..আপনাকে বিশ্বাস করে বলা যায়, অত টাকা এই মুহূর্তে দেওয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অসম্ভব হত।

–তাহলে প্রতিষ্ঠান কি লাভজনক ছিল না?

–গত দেড় বছর থেকেই অবস্থা টলমল।

–এমন অবস্থা হল–বিশেষ কোন কারণ নিশ্চয় থাকবার কথা।

–আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন ইনসপেক্টর। আমার ধারণা মিঃ রেক্স নিজেই দায়ী প্রতিষ্ঠানের এ অবস্থার জন্য।

একটু থামলেন মিঃ বিলিংসলে। পরে বললেন, গত একবছর খুবই বেপরোয়া ভাবে কাজ করেছেন মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু। কারুর পরামর্শে কান দেন নি। ভাল স্টক বিক্রি করে ফাটকা শেয়ারে একেবারে পাগলের মতো লগ্নী করছিলেন। তবু নিজের কাজের বড়াই করে বড় বড় কথা বলতেন।

মিঃ পার্সিভাল তার বাবাকে বোঝনোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রেক্স ফর্টেস্কু কোন কথা শোনেন নি।

মিঃ পার্সিভাল আমার কাছেও এসেছিলেন তার বাবার ওপর আমার প্রভাব খাটানোর অনুরোধ নিয়ে। আমি যথাসাধ্য করেছিলাম। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল রেক্স ফর্টেস্কু একেবারে পাগলের মতো ব্যবহার করছিলেন।

ইনসপেক্টর নীল মাথা ঝাঁকালেন। তাঁর মনে হল, পিতা পুত্রের মনোমালিন্যের ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে।

-তবে আপনি মিসেস ফর্টেস্কুর উইলের বিষয়ে যা জানতে চাইছেন, আমি তার কিছুই বলতে পারব না। তার কোন উইল আমি করিনি।

–আমি সেটা জানি মিঃ বিলিংসলে। আমি কেবল জানতে চাইছিলাম, স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি একলক্ষ পাউণ্ড পাচ্ছেন কিনা?

–না…তা পাচ্ছেন বলা যাবে না। বাধা দিয়ে বললেন মিঃ বিলিংসলে।

–তাহলে কি তিনি খোরপোষ বাবদ সারা জীবন টাকাটা পেতেন?

–না, তাও নয়। তার একলক্ষ পাউণ্ড সম্পর্কে উইলে একটা শর্ত ছিল।

–শর্ত? বিস্মিত হলেন নীল।

-হ্যাঁ। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাস জীবিত থাকলে তবেই সরাসরি মিঃ ফর্টেস্কুর স্ত্রী টাকাটা পেতেন। এরকম শর্ত আজকাল বেশ চালু হয়েছে, আকাশপথে ভ্রমণের অনিশ্চয়তার জন্য।

–তাহলে দেখা যাচ্ছে, মিসেস ফর্টেস্কু একলক্ষ পাউণ্ড রেখে যাননি? একলক্ষ পাউণ্ড তাহলে কে পাচ্ছেন?

-প্রতিষ্ঠানেই থাকছে। সেই হিসেবে বলা যায়, সম্পত্তির অবশিষ্ট অংশের উত্তরাধিকারী মিঃ পার্সিভালই টাকাটার মালিক হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থায় টাকাটা তার খুবই প্রয়োজন।

.

ইনসপেক্টর নীলের প্রশ্নের উত্তরে তার ডাক্তার বন্ধু বললেন, তোমাদের পুলিসদের মাথায় কি ঘোরে বলো তো। অদ্ভুত সব কথা জানার জন্য হন্যে হয়ে পড়।

ধানাইপানাই বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলোতো।

–তাই বলছি। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। ব্যাপারটা যতদূর মনে হয় বুদ্ধিভ্রষ্টতা। ওই অবস্থায় মানুষ বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, সবসময় একটা হামবড়া ভাব, কথায় কথায় বিরক্তি আর রাগারাগি। কোন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এই রোগে ভুগলে লালবাতি জ্বলতে দেরি হয় না।

মিঃ ফর্টেস্কুর ব্যাপারটা তার পরিবারের লোকেরা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁকে ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তার মৃত্যুটা তোমার বন্ধুদের ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে।

-ওরা কেউ আমার বন্ধু নয়, বব, বললেন নীল, ওরা একদল বিরক্তিকর মানুষ।

.

১০.

ইউট্রিলজের ড্রইংরুমে পরিবারের সকলেই সেদিন জমায়েত হয়েছেন। পার্সিভাল ফর্টেস্কু সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে চলেছেন, এ একেবারে অসহনীয় অবস্থা। পুলিসের পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনো পর্যন্ত চলছে, খুশিমত তারা বাড়িতে যাওয়া আসা করছে। এসবের মধ্যে কোন পরিকল্পনা করা বা ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। বাড়ি ছেড়ে যে কেউ নড়বে, তারও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

তবুও মনে হয় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারি। ইলেইন, তোর কথা শোনা যাক। সেই জেরাল্ড রাইট না কি যেন নাম–তাকেই নাকি বিয়ে করছিস? তোরা কবে বিয়ে করছিস?

–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ইলেইন বলল।

–মাস ছয়েক অন্তত সময় নিচ্ছিস?

–না, অত দেরি করতে যাব কেন? মাসখানেকের মধ্যেই

–বিয়ের পর কোন পরিকল্পনা আছে তোদের?

–পরিকল্পনা মানে ভাবছি একটা স্কুল খুলব।

–কথাটা শুনতে ভাল–কিন্তু আজকালকার দিনে বড় ঝুঁকির ব্যাপার। আমার মনে হয় ভাল করে ভাবনা চিন্তা করে একাজে হাত দেওয়া উচিত।

-বাধা তো থাকবেই। জেরাল্ড বলে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতি সঠিক শিক্ষার ওপরেই নির্ভর করে।

তোর টাকাটার ব্যাপারে মিঃ বিলিংসলে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, ভবিষ্যতে তোর ছেলেমেয়েদের জন্যই টাকাটা কোন ট্রাস্টের হাতে রাখা ভাল। একটা নিরাপত্তা থাকে।

–আমার ইচ্ছা অন্যরকম, ইলেইন বললেন, স্কুলটা চালু করার জন্য টাকার দরকার। কর্নওয়ালে একটা বাড়িও দেখা হচ্ছে। ওটা হলে কিছু বাড়তি ঘর তৈরি করে নিতে হবে।

–ইলেইন…তাহলে তুই ব্যবসা থেকে টাকাটা তুলে নিবি বলছিস? কাজটা মনে হয় ঠিক হবে না।

ব্যবসার অবস্থার কথা তো তুমিই বলেছিলে–বাবা মারা যাওয়ার আগে। তাই টাকা তুলে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলেই মনে করি।

–ইলেইন, ওরকম বলতে হয়। আমার পরামর্শ যদি শুনিস, আমি বলব এভাবে সবটাকা তুলে নিয়ে স্কুলের আসবাব কিনে খরচ করাটা ঠিক কাজ হবে না। যদি স্কুল না চলে, তুই একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবি।

ইলেইন জোর দিয়ে বলল, স্কুল ঠিক চলবে।

-আমি তোর পক্ষে ইলেইন, চেয়ারে ঘুরে বসে বললেন ল্যান্সলট, কাজে না নামলে আগাম কিছু বোঝা যায় না। তোরা নেমে পড় ইলেইন। তোর টাকা যদি নষ্টও হয়, সান্ত্বনা থাকবে যা করতে চেয়েছিস তা করেছিস।

-তুই তোর উপযুক্ত কথাই বলেছিস, বললেন পার্সিভাল, তোর পরিকল্পনাটা এবার শোনা যাক ল্যান্স। তুই নিশ্চয়ই আবার কেনিয়া পাড়ি জমাবার কথা ভবাছিস? নাকি একটা আশ্চর্য কাজ করার জন্য এভারেস্টের চুড়ায় উঠবি?

এরকম ভাবছ কেন? ল্যান্স বলল।

–ইংলণ্ডের ঘরোয়া জীবনে তো কোনদিন সুস্থির হতে চাসনি না, তাই বলছি।

-বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবর্তনও আসে। এবারে আমি ভেবেছি পাকা ব্যবসাদার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করব।

তার মানে তুই…

–হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করব। তুমি তো সিনিয়র পার্টনার। তবে সামান্য জুনিয়র পার্টনার হিসেবে আমার যে অংশ ও অধিকার আছে, তাই কাজে লাগাব, ভাই পার্সি।

–সবই ঠিক আছে, পার্সি বলল তবে মুশকিল হল, তুই দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠবি। সত্যিই কি তুই ঠিক করেছিস ব্যবসাতে ঢুকবি?

-হ্যাঁ, তাই করছি। বলতে পারি পিঠেতে ভাগ বসাচ্ছি।

ব্যবসার অবস্থাটা মোটেই সুবিধার নয়। বড় জোর আমরা ইলেইনের টাকাটা দিতে পারব–যদি ও সেরকম চাপ দেয়। তাই ভাবছি–

–তাহলে কি বললাম ইলেইন, ল্যান্স বলল, সময় মতো টাকাটা তুলে নেওয়াই ভাল।

জেনিফার আর প্যাট, একটু দূরে জানালার পাশে বসে ওদের তিন ভাই বোনকে লক্ষ্য করে চলেছেন।

–এই যদি তোর মনের ইচ্ছা হয়ে থাকে, পার্সিভাল বললেন, তাহলেও বলব, আনন্দ পাবি না, দেখে নিস।

–আমার তা মনে হয় না ভাই পার্সি। প্রতিদিন শহরে অফিস করতে যাওয়া…কর্মচারীদের মধ্যে, বিশেষ করে স্বর্ণকেশী সেক্রেটারী মিস গ্রসভেনরের সান্নিধ্য…ইয়েস স্যার…হাঁ স্যর…শোনা…চমৎকার একটা পরিবর্তন ভাল না লেগে পারে?

–বোকার স্বর্গে বাস করা একেই বলে। ঈষৎ উত্তপ্ত কণ্ঠে বললেন পার্সিভাল, ব্যবসায় যে ঝামেলা পাকিয়ে উঠেছে সেই সম্বন্ধে কোন ধারণাই তোর নেই।

নেই তা জানি। তুমি তো রয়েছে–আমাকে তৈরি করে নেবে।

–দেখ, গত এক দেড় বছর বাবা নিজের মতো করে এমন সব অযৌক্তিক ঝুঁকি নিয়েছেন যে প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ভিত একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বোকার মত ভাল স্টক সব হাত ছাড়া করে ফাটকা খেলেছেন।

-তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, তার চায়ে যে ট্যাকসিন ছিল তা পরিবারের পক্ষে অশুভ হয়নি।

–কথাটা শুনতে খারাপ হলেও বাস্তব তাই। এখন যদি অন্তত কিছুদিন সাবধানে চলা যায় তাহলে অনেকটা সামলে ওঠা যাবে।

–কেবল সতর্কতায় কাজ হয় না, ঝুঁকিও নিতে হয়।

–তুই যাই বলিস, আমি যা বুঝি তা হল সতর্কতা আর মিতব্যয়িতা। বললেন পার্সিভাল।

–আমি ঝুঁকি নিতেই পছন্দ করি।

-দেখ ল্যান্স, ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন পার্সিভাল, আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি দুরকম, এই অবস্থায় একসঙ্গে চলতে পারব বলে মনে হয় না। হলেই বা মন্দ কি। বললেন লান্স।

–আমার মনে হয় অংশীদারী ব্যাপারটা বাতিল করে দেওয়াই ভাল হবে।

তার মানে আমার অংশটা তুমি কিনে নিতে চাইছ?

–অগত্যা। দৃষ্টিভঙ্গি যখন দুজনের দুরকম

-তাহলে আমার অংশের টাকা তোমাকে মেটাতে হবে। কিন্তু এই তো বলছিলে ইলেইনের টাকাটাই বড় জোর দেওয়া সম্ভব হবে। বাড়তি চাপ তাহলে মেটাবে কিভাবে?

-মানে…ইয়ে…আমি নগদ টাকার কথা বলছি না। স্থাবর সম্পত্তি আর বাড়িখানা আমরা ভাগ করে নিতে পারি।

–কথাটা নেহাৎ মন্দ বলনি। আমাকে ফাটকার অংশ দিয়ে নিজে নিরাপদ সম্পদ ভোগ করতে চাইছ। তবে কি জান…এক্ষেত্রে প্যাটের কথাটাও আমাকে ভেবে দেখতে হবে।

একটু থেমে আবার ল্যান্স বললেন, আমাকে তুমি একেবারেই বোকা ঠাউরে নিয়েছ, পার্সি। ভুয়ো হীরের খনি…ভুয়ো তেলের খনির ইজারা…এগুলোকে তুমি খুবই লাভজনক ভাবতে বলছ আমাকে

–এগুলোর সবই ফাটকাবাজি নয় ল্যান্স। কোন কোনটা খুবই লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।

–তুমি বাবার সেই পুরনো দিনের ব্ল্যাকবার্ড মাইনের মতো বাবার ফাটকা খেলার হালের মালগুলো আমাকে গছাতে চাইছ। হ্যাঁ, ভাল কথা পার্সি, ইনসপেক্টর কি তোমার কাছে ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা জানতে চেয়েছিলেন?

পার্সির ভ্রূ কুঞ্চিত হল। তিনি কি ভাবলেন।

–হ্যাঁ, জানতে চেয়েছিলেন। আমি বিশেষ কিছুই বলতে পারিনি। তখনতো তুই আর আমি দুজনেই ছেলেমানুষ ছিলাম। আমার যেটুকু মনে আছে, বাবা ওখান থেকে ফিরে এসে বললেন, সব ব্যাপারটাই বাজে।

–ওটা মনে হয়–সোনার খনি ছিল, তাই না? বলল ল্যান্স।

–মনে হয় তাই। বাবা নিশ্চিত ছিলেন ওখানে কোন সোনা ছিল না।

–ম্যাকেঞ্জি নামে একজন লোক মনে হয় বাবাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল।

–হ্যাঁ। ম্যাকেঞ্জি সেখানে মারা গিয়েছিলেন।

–আমার যেন ভাসা ভাসা মনে পড়ছে–ম্যাকেঞ্জি মারা যাবার পরে খুব একটা ঝামেলা : হয়েছিল…মনে হয় মিসেস ম্যাকেঞ্জি এখানে এসেছিলেন। বাবাকে দোষ দিয়ে অভিশাপও দিয়েছিলেন। আমার মনে আছে তিনি বলেছিলেন বাবাই তার স্বামীকে খুন করেছেন।

–এরকম কিছু হয়েছিল কিনা আমার ঠিক মনে পড়ে না।

–ওই ব্ল্যাকবার্ড খনিটা কোথায়? পশ্চিম আফ্রিকাতে কি?

–সম্ভবত তাই।

–অফিসে গেলে, ওই ইজারার ব্যাপারটা একবার দেখব।

–বাবাকে তো জানিস, পার্সি বললেন, তার ভুল হবার কথা নয়।

–মিসেস ম্যাকেঞ্জি আর যে দুটো বাচ্চাকে তিনি এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের কি হল কে জানে। ছেলেমেয়ে দুটোর এতদিনে তো বেশ বড় হবার কথা।

.

পাইউড প্রাইভেট স্যানাটোরিয়াম।

ইনসপেক্টর নীল ভিজিটার্স রুমে একজন বয়স্কা মহিলার মুখোমুখি বসে কথা বলছেন। ইনি হলেন হেলেন ম্যাকাঞ্জি। বয়স ষাট পার হয়েছে। মুখভাবে দুর্বলতার চিহ্ন। চোখে শূন্য দৃষ্টি। তার কোলের ওপর একখানা বই।

স্যানাটোরিয়ামের অধিকর্তা ডাঃ ক্রসবি রোগিনী সম্পর্কে জানিয়েছেন, তাকে পুরোপুরি মানসিক রোগগ্রস্ত বলা চলে না। বেশির ভাগ সময়েই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেন।

মিসেস ম্যাকেঞ্জির সামনে বসে ডঃ ক্রসবির কথাটাই স্মরণ করবার চেষ্টা করলেন নীল।

মাদাম, আমি এক মিঃ ফর্টেস্কুর সম্পর্কে কিছু কথা আপনাকে বলতে এসেছিলাম। ভদ্রলোকের পুরো নাম মিঃ রেক্স ফর্টেঙ্কু। আপনি নামটা শুনেছেন বলেই আমার ধারণা।

মিসেস ম্যাকেঞ্জি বইয়ের ওপরে চোখ ধরে রেখেই বললেন, না, ওই নাম কখনোই শুনিনি।

–আমার ধারণা, বেশ কয়েক বছর আগে তাকে আপনি চিনতেন।

–সে তো গতকালের কথা।

ডঃ ক্রসবির কথা ইনসপেক্টর নীলের মনে পড়ল। তিনি হতাশ না হয়ে বললেন, আপনি বেশ কয়েক বছর আগে ইউট্টি লজে তার বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

–হ্যাঁ, খুব সাজানো গোছানো বাড়ি।

-মিঃ ফর্টেস্কু পশ্চিম আফ্রিকায় একটা খনির ব্যাপারে আপনার স্বামীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেটা হল ব্ল্যাকবার্ড খনি।

-বইটা পড়ে শেষ করতে হবে–বেশি সময় নেই।

–নিশ্চয়ই মাদাম; নীল বললেন, মিঃ ম্যাকেঞ্জি আর মিঃ ফর্টেঙ্কু একসঙ্গে আফ্রিকা গিয়েছিলেন খনিটা দেখবেন বলে।

–আমার স্বামীই খনিটা আবিষ্কার করেছিলেন, বললেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি, আর তার দাবী জানিয়েছিলেন। খনি চালু করবার মতো টাকা তার ছিল না, তাই মিঃ ফর্টেস্কুর কাছে গিয়েছিলেন। অতসব আগে জানতে পারলে আমি তাকে কিছুতেই যেতে দিতাম না।

–হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। মিঃ ম্যাকেঞ্জি আফ্রিকায় গিয়ে জ্বর হয়ে মারা যান। নীল বললেন।

–ওহঃ, বইটা আমাকে পড়তে হবে। বইয়ের ওপর থেকে চোখ না তুলেই বললেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি।

–আপনার কি মনে হয় ওই ব্ল্যাকবার্ড খনির ব্যাপারে মিঃ ফর্টেস্কু আপনার স্বামীকে ঠকিয়েছিলেন?

–আপনি বড় বোকা।

–মানে বলছি… অনেক দিন আগের ঘটনা তো…এতদিনে সব মিটে গেছে…

–মিটে গেছে, কে বলেছে?

–তাহলে মেটেনি? নীল বললেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল—

ওসব বাজে কথা। সে জ্বর হয়ে মরেছে।

–আমি মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর কথা বলছি। বললেন নীল।

এবারে হালকা নীলাভ চোখ তুলে মিসেস ম্যাকেঞ্জি নীলের দিকে তাকালেন।

–আমিও তাই বলছি। সে নিজের বিছানায় শুয়ে মরেছে।

–উনি মারা যান সেন্ট জিউডস হাসপাতালে।

–কিন্তু আমার স্বামী কোথায় মারা যান কেউই তা জানে না। কোথায় তাকে কবর দেওয়া হয় তাও কেউ জানে না। রেক্স ফর্টেঙ্কু যা বলেছে সকলে তাই জানে। অথচ লোকটা জঘন্য মিথ্যাবাদী।

-আপনার কি মনে হয় মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু আপনার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী?

আজ সকালে তো ডিম খেয়েছিলাম, বলে উঠলেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি, তবু মনে হয় এই তো মাত্র ত্রিশ বছর আগের ঘটনা।

নীল একটু থমকে গেলেন। বুঝতে পারলেন, এভাবে চললে আসল কথায় পৌঁছনো যাবে না। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন।

–এক মাস আগে, চাপ দিয়ে বলতে লাগলেন নীল, কে যেন মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর টেবিলের ওপরে কয়েকটা মরা কালো পাখি রেখে দিয়েছিল।

–দারুণ ব্যাপার দেখছি।

–আপনার কোন ধারণা আছে মাদাম, এরকম কাজটা কে করে থাকতে পারে?

-ধারণা দিয়ে কি কাজ। আসল কথাটাই হল, আমি ওদের এই কাজ করার জন্যই মানুষ করে তুলেছিলাম, বুঝলেন?

–আপনার ছেলেমেয়েদের কথা বলছেন?

–হ্যাঁ। ডোনাল্ড আর রুবিওদের যখন মাত্র নয় আর সাত বছর বয়স তখন ওরা ওদের বাবাকে হারায়। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাতে আমি ওদের শপথ করিয়েছি।

ইনসপেক্টর নীল এবারে নড়েচড়ে বসলেন।

–আপনি ওদের কি শপথ করিয়েছিলেন?

–তারা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে–তাকে খুন করবে।

–ওহ, কাজটা ওরা করতে পেরেছিল?

–জেরাল্ড ডেনমার্ক গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ওরা তার করে জানিয়েছিল জেরাল্ড যুদ্ধে মারা গেছে।

-খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আপনার মেয়ের কি হয়?

–কোন মেয়ে তো আমার নেই।

–আপনার মেয়ে রুবির কথা বলছি।

–ওহ রুবি? তাকে আমি বাতিল করে দিয়েছি। সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি। কথাটা আপনি জানেন।

-আপনার মেয়ে এখন কোথায়, মাদাম?

–আমার কোন মেয়ে নেই, আপনাকে তো আগেই বলেছি। রুবি ম্যাকেঞ্জি বলে আর কেউ নেই।

–আপনি বলছেন সে মারা গেছে?

–মারা গেলে বরং ভালই হত, আচমকা হেসে উঠলেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি, নাঃ বড্ড সময় নষ্ট হচ্ছে আপনার সঙ্গে কথা বলে। বইটা আমাকে পড়তে হবে।

আবার থমকে গেলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি আরও কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিসেস ম্যাকেঞ্জি কোন উত্তর করলেন না। তিনি পুনঃ পুনঃ বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন।

বাধ্য হয়েই উঠে পড়লেন নীল। সুপারের ঘরে এলেন।

-ওর সঙ্গে দেখা করবার জন্য কেউ আসেন?

–আমি দায়িত্ব নিয়ে আসার পরে কেউ আসেন নি। শুনেছি, আমার আগে যিনি ছিলেন, তার সময়ে মহিলার মেয়ে দেখা করতে আসতেন। কিন্তু মেয়েকে দেখলেই তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। বারবার এমন হওয়ায় তাকে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়।

–ওঁর মেয়ে রুবি ম্যাকেঞ্জি এখন কোথায় থাকতে পারেন, আপনার কোন ধারণা আছে?

–না, একেবারেই না।

এখন সবকিছু সলিসিটারের মাধ্যমেই হয়। আপনি তার সঙ্গে দেখা করলে হয়তো কিছু জানতে পারেন।

ইনসপেক্টর নীল আগেই সলিসিটরের সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেনি।

বেশ কয়েক বছর আগেই মিসেস ম্যাকেঞ্জির জন্য একটা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল। তারপর থেকে তারা আর মিস ম্যাকেঞ্জিকে দেখেননি। এখন ট্রাস্টই তার ব্যাপারটা দেখেন।

রুবি ম্যাকেঞ্জির চেহারার সঠিক বর্ণনাও কারোর কাছ থেকে জানা সম্ভব হয়নি। একজন মেট্রন জানালেন, ছোটখাট, ছিপছিপে চেহারা। অন্য একজন বলেন, চেহারা ভারিক্কী–গোলগাল। একরকম হতাশ হয়েই নীল দপ্তরে ফিরে এলেন।

১.৩ ইউট্রি লজের বাগানে

১১.

ল্যান্সলট তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ইউট্রি লজের বাগানে বেড়াচ্ছিলেন।

–এই ইউগাছগুলো বড় ভয়ঙ্কর। এসব গাছ বাগানে রাখা সত্যিই রুচিহীনতার পরিচয়। আমি হলে হলিহক্স লাগাতাম।

কথাটা শুনে ল্যান্স চঞ্চল চোখে ইউগাছের দিকে তাকায়।

-যারা বিষ খাওয়ায় তারা বড় ভয়ানক। এসব লোকের মন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। বললেন প্যাট।

–আমি ঠিক ওরকম ভাবি না, ল্যান্স বললেন, এসব খুবই ঠাণ্ডা মাথার কাজ।

–তিন তিনটে খুন…এমন কাজ উন্মাদ ছাড়া কে করবে?

–আমারও তাই মনে হয় প্যাট। হঠাৎ তীব্রস্বরে বলে উঠে ল্যান্স, তুমি এখান থেকে চলে যাও–অন্য যে কোন জায়গায় চলে যাও, তোমাকে নিয়ে আমার প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা

প্যাট চলতে চলতে শান্ত গলায় বললেন, তুমি বুঝতে পেরেছ, তাই না–এই কাজটা কে করেছে

-না, আমার জানা নেই।

-বুঝতে পারছি, সে কারণেই তুমি আমার জন্য ভয় পাচ্ছ। কথাটা আমাকে জানাবে ভেবেছিলাম।

–আমি সত্যিই কিছু জানি না প্যাট..তবু মনে হয় তুমি এখানে না থাকলেই নিশ্চিন্ত থাকব।

–প্রিয় ল্যান্স, ভালমন্দ যাই ঘটুক, আমি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছি না। আমি এ-ও জানি খারাপটাই ঘটবে।

–তার মানে? তুমি একথা বলছ কেন প্যাট?

–আমার অভিশপ্ত ভাগ্যের কথাই বলছি ল্যান্স, দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্যাট, আমি যার সঙ্গেই থাকি তার ক্ষতি ছাড়া ভাল হয় না।

–প্রিয় প্যাট, তুমি আমার কোন দুর্ভাগ্য বয়ে আনননি। তোমাকে বিয়ে করার পরেই তো বাবা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

কিন্তু কি হল এতে? এখানে এসে চরম দুর্বিপাকের মধ্যে পড়লে। এ আমার ভাগ্যেরই অভিশাপ।

–এ সব তোমার মনের বিকার প্যাট।

–ওকথা বলো না ল্যান্স। আমি সত্যিই অভিশপ্ত।

–না, প্যাট, না। আমার সৌভাগ্য যে তোমাকে বিয়ে করতে পেরেছি। সে কারণেই দুর্ভাবনা তোমাকে নিয়ে। যদি এখানে সত্যিই কোন উন্মাদ থেকে থাকে, আমি চাই না তুমি বিষ মেশানো কিছু পান কর কিংবা গুলির শিকার হও।

একটু থেমে ল্যান্সলট আবার বলতে লাগল, আমি না থাকলে, ওই বৃদ্ধা মহিলা…কি যেন নাম…হ্যাঁ, মিস মারপল…তার কাছাকাছি থেকো। আমি জানি এফি মাসী তাকে কেন এখানে থাকতে বলেছেন।

-ল্যান্স, আমাদের এখানে কতদিন থাকতে হবে?

–এখনো ঠিক জানি না।

–এ বাড়ি এখন তোমার ভাইয়ের। আমার মনে হয় না আমাদের এখানে থাকা তিনি পছন্দ করছেন।

-ও যাই ভাবুক, আপাতত তাকে মেনে নিয়েই আমাদের এখানে থাকতে হবে।

–আমরা কি তাহলে আর পূর্ব আফ্রিকায় ফিরে যাব না?

–তুমি তাই চাও, বুঝতে পারি। আমারও তাই ইচ্ছা, এদেশ একদম ভাল লাগে না আমার।

ল্যান্সের চোখে হঠাৎ শয়তানী ঝিলিক খেলে গেল। একটু ঝুঁকে বলল, আমাদের মতলবের কথা কাউকে বোলো না প্যাট। পার্সিকে আর একটু কড়কে দেওয়া আমার ইচ্ছে।

–কিন্তু তুমি সাবধানে থেকো ল্যান্স। আমার বড় ভয় হয়।

-হ্যাঁ, ভেবো না, প্যাট, আমি সাবধানেই থাকব। পার্সিকে এত সহজে সব কিছু হাতিয়ে নিতে দেয়া যায় না।

.

ড্রইংরুমের সোফায় বসে মিস মারপল মশগুল হয়ে মিসেস পার্সির সঙ্গে গল্প জমিয়েছিলেন। তাঁর উল্টো দিকে আরাম কেদারায় বসে অনর্গল বকবক করে চলেছেন মিসেস পার্সিভাল।

মিস মারপল বুঝতে পারছিলেন, মনের মতো শ্রোতা পেয়ে মনের যত জমানো ক্ষোভ উজাড় করে দিতে চাইছেন মহিলা।

জীবনে অনেক কিছুই ঘটে, কত ভাল কত মন্দ। মাঝে মাঝে মনের কথা কাউকে বলতে না পারলে শান্তি পাওয়া যায় না। অফিসের কাজে সারাটাদিনই আমার স্বামীকে শহরে কাটাতে হয়। বাড়ি যখন ফেরেন, তখন এত ক্লান্ত থাকেন যে কথা বলার আর উৎসাহ তার থাকে না। সারাদিন নিঃসঙ্গই থাকতে হয় আমাকে।

খাওয়া দাওয়া আর আরাম করা–এর মধ্যে আনন্দ কোথায় বলুন। সামাজিক মেলামেশার কোন সুযোগ নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু থামলেন মিসেস পার্সিভাল। পরে বললেন, মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলতে নেই জানি, তবু না বলে পারছি না আমার শ্বশুর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে মোটেই বুদ্ধির পরিচয় দেননি।

আমার শ্বাশুড়ির বয়স ছিল আমারই সমান। ছিলেনও বড় বেশি পুরুষ ঘেঁষা। দুহাতে টাকা খরচ করতেন। শ্বশুর এত হিসেবি মানুষ ছিলেন, কিন্তু স্ত্রীকে বাধা দিতেন না।

এসব দেখে পার্সি বিরক্ত হত। এত অমিতব্যয়িতা একদম পছন্দ নয় ওর। শেষ দিকে শ্বশুর ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। ঝুঁকির কাজে যেন ইচ্ছে করেই জলের মতো টাকা খরচ করতেন।

–হ্যাঁ বুঝতে পারি, আপনার স্বামীর চিন্তায় পড়াই স্বাভাবিক।

গতবছর খুবই দুর্ভোগ গেছে পার্সির। সব দিক সামাল দিতে গিয়ে নিজেও কেমন বদলে গিয়েছিল। প্রায় সময়ই গুম হয়ে থাকতো–ডাকলে সাড়া দিত না।

আমার ননদ ইলেইন, বড় অদ্ভুত মেয়ে। মিশুকে কিন্তু বড় সহানুভূতিহীন।

পরিবারের লোকজনের কথা এভাবে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত কারো কাছে বলছি ভেবে নিশ্চয়ই আপনি অবাক হচ্ছেন। কিন্তু জানেন, প্রচণ্ড মানসিক উদ্বেগে আমি যেন কেমন হয়ে গেছি। কারো সঙ্গে কথা বললে যেন একটু স্বস্তি পাই। আপনাকে দেখে বড় স্নেহপ্রবণ মনে হয়েছে।

–আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।

চোখের কোণে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, কথাটা খারাপ শোনাবে হয়তো, মনে হয় আপনার সদ্য প্রয়াত শ্বশুর খুব ভাল মানুষ ছিলেন না।

-না তা কখনওই ছিলেন না। বললেন জেনিফার, আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি, অনেকেরই সর্বনাশের কারণ হয়েছেন। সন্দেহ হচ্ছে, সেই কারণেই কেউ প্রতিহিংসা নিল কিনা।

প্রশ্নটা করা হয়তো উচিত হচ্ছে না, একটু ইতস্তত করে বললেন মিস মারপল, কে এমন কাজ করতে পারে আন্দাজ করতে পারেন?

কে হতে পারে?

–ওহ, ওই লোকটা আমার বিশ্বাস, ওই ক্রাম্প। খুবই দুর্বিনীত স্বভাব। লোকটাকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার।

–লোকটার উদ্দেশ্য কি থাকতে পারে বলে মনে করেন? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-লোকটা যে রকম বদ, আর এত বেশি মদ খেতো যে কোন দুষ্কর্মের জন্য তার কোন মোটিভ দরকার হয় না। আমার ধারণা মিঃ ফর্টেন্ধু তাকে কখনো বকাঝকা করেছিলেন। তবে কি জানেন, প্রথমে ভেবেছিলাম অ্যাডেলই আমার শ্বশুরকে বিষ খাইয়েছিল। কিন্তু পরে অবাক হয়ে যাই দেখে সেও বিষ খেয়ে মারা গেল।

আপনাকেই বলছি বিশ্বাস করে, অ্যাডেল হয়তো ক্রাম্পকে দোষারোপ করেছিল। আর তাতে ক্ষেপে গিয়ে সে স্যাণ্ডউইচে কিছু মিশিয়ে দেয়। খুব সম্ভব গ্ল্যাডিসের সেটা চোখে পড়ে গিয়েছিল, ক্রাম্প তাই তাকেও খুন করে বসে।

বাড়িটা বড় ভয়ঙ্কর লাগছে আমার; পুলিসরা যদি বাধানিষেধ না রাখতো আমি অন্য কোথাও চলে যেতাম। জানি না, কোন দিন হয়তো পালিয়েই চলে যাব।

–না, এরকম কাজ ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বললেন মিস মারপল। পুলিস ঠিক আপনাকে খুঁজে বার করবে।

–জানি। তবু আমার কেবলই মনে হয় এ বাড়িতে থাকা বড় বিপজ্জনক।

–আপনার পক্ষে বিপজ্জনক মনে করছেন?

–ইয়ে..মানে…হ্যাঁ—তাই।

–তার মানে আপনি কিছু একটা জানেন?

-ওহ, না, চমকে উঠলেন জেনিফার, আমি কিছু জানি না…কি আবার জানব…আমি কেবল…কেমন নার্ভাস হয়ে পড়েছি… ওই ক্রাম্প লোকটা… কথা বলতে বলতে জেনিফার ফর্টেঙ্কু বারবার হাত মুঠো করতে চাইছেন, মিসেস মারপল লক্ষ্য করলেন। তার বুঝতে অসুবিধা হল না, বিশেষ কোন কারণেই জেনিফার অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও মনের ভাব তিনি গোপন করতে পারছেন না।

.

১২.

বাইরে অন্ধকার নামছে। লাইব্রেরীতে জানালার সামনে বসে উল বুনছেন মিস মারপল। প্যাট ফর্টেস্কু ঘরে ঢুকলেন।

বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। আপনাকে দেখে চলে এলাম। চুল্লীর সামনে বসে আপনি সেলাই করছেন দেখে ইংলণ্ডের ঘরোয়া আরামের জীবন বলেই মনে হচ্ছে।

-হ্যাঁ, ইংলণ্ডের মতই। বললেন মিস মারপল। তবে ইউট্টি লজের মতো আর কটা বাড়ি আছে।

–এ বাড়ির কথা আর না বলাই ভাল। টাকাকড়ি কেউ কম খরচ করে না। কিন্তু মনে হয় কোনদিন এ বাড়িতে সুখ ছিল।

–কথাটা আমারো সত্য বলেই মনে হয়।

তবে অ্যাডেল মনে হয় সুখী ছিল, প্যাট বলল, আমি অবশ্য তাকে দেখিনি। জেনিফার যে অসুখী তা বুঝতে পারি। ইলেই তো তার সেই মনের মানুষটিকে নিয়েই ডুবে আছে। ওহ আর মন ধরে রাখতে পারছি না এখানে।

কথা বলতে বলতে মিস মারপলের দিকে তাকাল। পরে বলল, ল্যান্স আমায় কি বলেছে, জানেন? আমি যেন আপনার কাছাকাছি থাকি। তাহলেই নিরাপদে থাকব। তার ধারণা এ বাড়িতে কোন উন্মাদ রয়েছে। কখন কি করে বসবে কেউ বলতে পারে না।

–আপনার অবস্থা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। বললেন মিস মারপল।

–আপনার স্বামী ফাইটার পাইলট ছিলেন, তাই না?

-হ্যাঁ। চুল্লীর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন প্যাট, আমার বিয়ের মাত্র একমাস পরেই সেই সাংঘাতিক ঘটনাটা ঘটেছিল। পৃথিবীটাকে বড় নিষ্ঠুর মনে হয়, জানেন? আমারও তখন মরার ইচ্ছা হয়েছিল। বড় ভাল ছিল ডন। খুবই হাসিখুশি। দেশের জন্য শেষ পর্যন্ত বীরের মতো প্রাণ দিল।

–আপনার দ্বিতীয় স্বামী?

–ওঃ সে বড় বেদনাদায়ক। বড় সুখী ছিলাম আমরা। কিন্তু বিয়ের দুবছরের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলাম ফ্রেডি সহজ পথে চলে না। তাকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা ছিল না আমার।

না, কেউ কাউকে বদলাতে পারে না। বললেন মিস মারপল।

–সবই বুঝতে পারতাম, দেখতে পেতাম। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। এরপর ফ্রেডি নিজেই একদিন বেসামাল হয়ে গেল। নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করল।

চেনাজানা লোকের কাছে যাতে মুখ দেখাতে না হয়, সেই জন্য আমি ইংলণ্ড ছেড়ে কেনিয়ায় চলে যাই। সেখানেই ল্যান্সের সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

আচমকা মিস মারপলের দিকে মুখ ফেরালেন প্যাট। বললেন, আচ্ছা মিস মারপল, পার্সিভালকে আপনার কি রকম মনে হয়?

ভদ্রলোককে তেমন ভাবে দেখার সুযোগ হয়নি, মনে হয় আমার এখানে থাকাটা তিনি পছন্দ করছেন না।

প্যাট হেসে উঠল। তারপর সামান্য ঝুঁকে বলল, ও বড় নীচ। বিশেষ করে টাকাকড়ির ব্যাপারে। ও নাকি বরাবরই এরকম, ল্যান্স বলে। জেনিফারও একই কথাবলে। সংসার খরচের ব্যাপার নিয়ে মিস ডাভের সঙ্গে তো নিত্য খিটিমিটি লেগে আছে। অথচ মিস ডাভ কত কাজের। আপনারও তাই মনে হয় না।

–হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা।

–আর ওই মিস র‍্যামসবটম। উনি আমাকে বড্ড ভয় ধরিয়ে দেন।

–ভয় ধরিয়ে দেন? কেন?

-কেমন ক্ষ্যাপাটে মনে হয় তাকে। ঘরে বসে সব সময় কেবল মানুষের পাপ নিয়ে ভাবেন। কোনদিন কি করে বসেন

–আপনার সত্যিই এরকম মনে হয়?

-ল্যান্স বলে এ বাড়িতে কোন উম্মাদ আছে। পরিবারেরই কেউ। আমিও তাই ভাবি। বাইরের কেউ কি এভাবে খুন করতে পারে? জানেন, আমার সবসময় ভয় হয়। আবার না কিছু ঘটে–

-না সে ভয় আর নেই বলেই আমার মনে হয়। বললেন মিস মারপল।

নিশ্চিতভাবে কিছু কি বলা যায়?

–মৃত্যুভয় অন্তত এবাড়িতে নেই আমার বিশ্বাস, খুনী লোকটির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে।

–কোন পুরুষ খুনী?

প্যাট চোখ বড় করলেন। যেন অদ্ভুত কিছু শুনছেন।

–পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই হোক, তার আর খুনের উদ্দেশ্য নেই।

–কোন উদ্দেশ্যের কথা বলছেন আপনি?

মিস মারপল মাথা ঝাঁকালেন। ধীরে ধীরে বললেন, সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।

.

১৩.

কনসোলিডেটেড ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টের অফিসে অন্যান্য দিনের মতো যথারীতি কাজ চলছে।

মিস সোমার্স সবার টেবিলে চা দিয়ে গেছেন। এমনি সময় ল্যান্স ফর্টেস্কু অফিসে ঢুকলেন। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চারপাশে তাকিয়ে জরিপ করে নিলেন। দেখলেন সবই প্রায় আগের মতোই রয়েছে।

টাইপিস্টদের ঘরে কর্মব্যস্ততার খটাখট শব্দ উঠছে। অনেক দিন পরে ল্যান্সকে দেখে পুরনো কর্মীদের অনেকেই উদগ্রীব হয়ে তাকাতে চাইছিল।

মিস গ্রিফিথ এগিয়ে এসে ল্যান্সের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।

–আমার ভাই অফিসে আছেন? জানতে চাইলেন ল্যান্স।

–বোধহয় ভেতরের দিকের অফিসে আছেন। সহজভঙ্গিতে বললেন মিস গ্রিফিথ।

ল্যান্স ভেতরের অফিসের সামনে এসে দেখলেন মাঝ বয়সী এক মহিলা ডেস্কে বসে আছেন।

মিস গ্রসভেনর খুব রূপসচেতন তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু সামনের মহিলাকে দেখে তা মনে হল না।

ল্যান্স নিজের পরিচয় দিলেন। জানতে পারলেন, ইনি মিসেস হার্ডক্যাসল। মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুর পার্সোনাল সেক্রেটারি। আগেকার রূপসী সেক্রেটারী মিস গ্রসভেনর গত সপ্তাহে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন।

ল্যান্স একটু গম্ভীর হলেন। বুঝতে পারলেন না পার্সিভাল তার সেক্রেটারি পরিবর্তন করল নিরাপদ থাকার জন্য না খরচ কমাবার জন্য।

ল্যান্স এগিয়ে গিয়ে তার বাবার ব্যক্তিগত কামরার দরজা খুলে ধরলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, পার্সিভাল কামরায় নেই। ডেস্কের পেছনে তার বদলে বসে আছেন ইনসপেক্টর নীল। একরাশ কাগজ ঘাঁটাঘাটি করছেন। শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন তিনি।

–সুপ্রভাত মিঃ ফর্টেস্কু। আপনি নিশ্চয়ই কাজকর্ম বুঝে নিতে এসেছেন?

–পার্সি তাহলে আপনাকে বলেছে আমি অফিসে ফিরে আসছি?

–হ্যাঁ বলেছেন।

–পার্সি নিশ্চয়ই খুশি হতে পারেনি। ও ভাবছে আমি ওর পিঠেয় ভাগ বসাতে চাইছি। ভয়ও পাচ্ছে, পাছে ব্যবসার টাকা নষ্ট করব বলে।

তবে কি জানেন ইনসপেক্টর, আমি মুক্ত বাতাসের মানুষ অফিসের ধরাবাঁধা জীবন আমার সইবে না। দম বন্ধ হয়ে যাবে। তবে কথাটা দয়া করে পার্সিকে জানাবেন না। ওকে নিয়ে একটু মজা করতে হবে। পুরনো পাওনা মেটাতে হবে।

–আপনার পুরনো পাওনা? কথাটা কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে? নীল বললেন।

–সে পুরনো কাহিনী

–হ্যাঁ, চেক নিয়ে কিছু একটা ঘটেছিল শুনেছি। আপনি কি এর কথাই বলছেন?

–আপনি অনেক কিছুই জানেন ইনসপেক্টর। আমার বাবা আমাকে এই নিয়ে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

নীল এবারে অন্যভাবে কথা শুরু করলেন। আমার মনে হয়, আপনার ভাই আপনার বাবার ছায়াতেই ছিলেন।

-বাইরে থেকে তাই মনে হয়। কিন্তু আমি জানি পার্সি বরাবর নিজের পথেই চলেছে। কেউ সেটা বুঝতে পারেনি।

নীল ডেস্কের কাগজপত্র হাতড়ে একটা চিঠি বার করে এগিয়ে ধরলেন।

-এই চিঠিটা আপনিই লিখেছিলেন, তাই না মিঃ ফর্টেস্কু?

ল্যান্স চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলেন। পরে ফেরত দিলেন।

প্রিয় বাবা,
প্যাটের সঙ্গে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তোমার প্রস্তাবে রাজি হতে আমার আর কোন আপত্তি নেই। এখানে সব গুছিয়ে নিতে নিতে একটু সময় লাগবে। আগামী অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ বা নভেম্বরের গোড়ার দিকে রওনা হতে পারব। সময়টা চিঠিতে জানাব। আশাকরি আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালই হবে। সাধ্যমত আমি সেরকম চেষ্টাই করব। শরীরের দিকে লক্ষ্য রেখো। —
তোমার ল্যান্স

–গত গ্রীষ্মে কেনিয়ায় পৌঁছে লিখেছিলাম। বাবা এটা রেখে দিয়েছিলেন বুঝি? কিন্তু অফিসের কাগজপত্রে কেন?

-না, মিঃ ফর্টেষ্ণু। এটা ইউট্টি লজের কাগজপত্রে পাওয়া গেছে। চিঠিটা আপনি কোন ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেন?

ল্যান্স একটু ভাবতে চেষ্টা করলেন। পরে বললেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে, তিনমাস আগের কথা ততা–চিঠিটা অফিসেই পাঠাই। কিন্তু ইনসপেক্টর, একথা জানতে চাইছেন কেন?

–দেখলাম যে আপনার বাবা এটা এখানে ব্যক্তিগত ফাইলে রাখেন নি। ইউট্রি লজে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সেটা ডেস্কের মধ্যে পেয়েছি। ভাবছি, তিনি এরকম করলেন কেন?

-মনে হয় পার্সির চোখের আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন। হেসে বললেন ল্যান্স।

–তাহলে আপনার বাবার ব্যক্তিগত কাগজপত্র দেখার সুযোগ আপনার ভাইয়ের ছিল, বলছেন?

-না, ঠিক তা বলছি না, ইতস্তত করলেন ল্যান্স, তবে পার্সি বরাবর এ ধরনের কাজ করে এসেছে।

-বুঝতে পারলাম। বললেন নীল।

ঠিক এই সময়েই পার্সিভাল ফর্টেস্কু দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন। ল্যান্সকে দেখে তিনি অবাক হলেন।

–হ্যাল্লো, তুই এসে গেছিস?

–হ্যাঁ, কাজের জন্য তৈরি হয়েই এসেছি। আমার করার কি কাজ আছে দাও।

পার্সিভাল তিক্ত হাসলেন। বললেন, আপাতত কোন কাজ তো দেখছি না। তবে মনে হয় আগে আমাদের ঠিক করে নেওয়া দরকার, ব্যবসার কোন দিকটা দেখা তোর পক্ষে সম্ভব। একটা অফিস কামরাও তোর জন্য ঠিক করতে হবে।

-ভালকথা, মৃদু হাসলেন ল্যান্স, রূপসী মিস গ্রসভেনরকে সরালে কেন? বড় বেশি জেনে ফেলেছিল বলে?

–কি সব আজেবাজে কথা বলছিস, ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন পার্সিভাল। মিস গ্রসভেনরের কাজের ওপর আর আস্থা রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। মিসেস হার্ডক্যাসল খুবই কাজের : তাছাড়া মাইনেও কম।

-মাইনে কম? কিন্তু ওই অজুহাতে, মনে হয়, অফিস কর্মচারীদের বাছাই করে সরিয়ে দেওয়া ঠিক কাজ নয়। তাছাড়া আমাদের এই দুঃসময়ে অফিস কর্মচারীরা যেভাবে সবদিক সামলেছে, তাতে তাদের সকলের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়াই উচিত বলে মনে করি আমি।

–আমি এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। অযথা খরচ করার মতলব সবসময় তোর মাথায় ঘোরে। ব্যবসার যা বর্তমান অবস্থা, এখন খরচ না কমালে সামাল দেওয়া যাবে না।

ইনসপেক্টর নীল সামান্য কাশলেন। তারপর বললেন, মাপ করবেন মিঃ ফর্টেস্কু, এই ব্যাপারেই আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

-হ্যাঁ, বলুন ইনসপেক্টর। বললেন পার্সিভাল।

–যা দেখছি, গত একবছর ধরে আপনার বাবার কাজকর্ম প্রতিষ্ঠানের খুবই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছিল।

–হ্যাঁ। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

–আপনি বারবার ডাক্তার দেখাবার কথা বলেও তাকে রাজি করাতে পারেননি তাই না?

–ঠিক তাই, ইনসপেক্টর। আমার বাবা ব্যবসার প্রচণ্ড ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছিলেন।

-খুবই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা। বললেন নীল। তবে ব্যবসার দিকে থেকে তার মৃত্যু। মঙ্গলজনক হয়েছে বলতে হবে।

পার্সিভাল বললেন, হ্যাঁ, তা হয়েছে, বলা চলে।

–আর একটা কথা মিঃ ফর্টেস্কু, আপনি বলেছিলেন যে আপনার ভাই ইংলণ্ড ছেড়ে যাওয়ার পর তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি–

–অবশ্যই তাই।

–কিন্তু, গত বসন্তকালে আপনি আপনার ভাইকে বাবার কাজকর্ম সম্পর্কে আপনার দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছিলেন। আপনি চাইছিলেন, আপনার ভাই যেন আপনার সঙ্গে যোগ দিয়ে বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাই নয় মিঃ ফর্টেস্কু?

–একরকম–হ্যাঁ, মনে হয় তাই। ভীতস্বরে বললেন। পার্সিভাল।

নীল এবার ল্যান্সের দিকে তাকালেন।

আপনি চিঠি পেয়েছিলেন।

ল্যান্স মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

–কি উত্তর দিয়েছিলেন আপনি?

–আমি পার্সিকে লিখেছিলাম, ওসব ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আর বুড়োকে নিজের পথে চলতে দেওয়াই ভাল। কেন না, উনি কি করছেন, ভালই জানেন।

ইনসপেক্টর নীল পার্সিভালের দিকে তাকালেন।

–আপার ভাইয়ের কাছ থেকে ওরকম উত্তর পেয়েছিলেন?

–মনে হয় মোটামুটি তাই ছিল।

-ইনসপেক্টর নীল, একটা ধারণা আপনার পরিষ্কার হওয়া দরকার। ল্যান্স বললেন, সম্ভবত এরকম একটা কারণেই বাবার কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। তারপরই নিজের চোখে সবকিছু দেখার জন্য আমি আসি। বাবার সঙ্গে সামান্যই কথা হয়েছিল আমার। আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। নিজের সবকিছু সামলাবার মতো ক্ষমতা তার ছিল। যাই হোক, কেনিয়ায় ফিরে গিয়ে প্যান্টের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক করি বাড়ি ফিরে আসব আর সব যাতে ঠিক ভাবে চলে দেখব।

কথা শেষ করে ল্যান্স চকিতে পার্সিলের দিকে তাকালেন।

–তোর কথাটা আপত্তিকর। বললেন পার্সিভাল, তুই ইঙ্গিত করতে চাইছিস, আমিই বাবাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলাম।

কিন্তু প্রকৃত সত্য তা নয়-তার স্বাস্থ্যের অবস্থাই আমার দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। আর ভাবনা হয়েছিল

পার্সিভালকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ল্যান্স বলে উঠলেন, তুমি তোমার পকেটের কথাটাই ভেবেছিলে। ঠিক আছে–

বলে উঠে দাঁড়ালেন ল্যান্স। তার মুখের ভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।

–এখানে থাকতে চাই বলে তোমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। তুমি একা সব লুটেপুটে খাবে তা আর হতে দেব না ভেবেছিলাম। কিন্তু…যাইহোক তোমার সঙ্গে একজায়গায় কাজ করা আমার পোষাবে না। তুমি চিরকালই নোংরা, ধূর্ত। মিথ্যা ছাড়া কিছু বোঝ না।

আর একটা কথাও বলব, অবশ্য প্রমাণ করতে পারব না। তবু বলছি, অতীতে যে চেক জাল করার ঘটনা নিয়ে আমাকে বাড়িছাড়া হতে হয়েছিল, আমার বিশ্বাস সেই জঘন্য কাজটা তুমিই করেছিলে।

তোমার মতো এমন নীচমনা জঘন্য প্রবৃত্তির মানুষকে আমি সহ্য করতে পারি না।

তুমি তোমার সাম্রাজ্য নিয়ে থাক। আমি, যেমন বলেছি, আমার ভাগের যা কিছু নিয়ে প্যাটের সঙ্গে অন্য কোন দেশে চলে যাবো। এদেশে আর নয়।

তোমার ইচ্ছে হলে সিকিউরিটিগুলো বাঁটোয়ারা করতে পার। যেগুলোতে ঝুঁকি নেই এমন সব কিছুই তুমি রাখতে পার, আমি কোন প্রতিবাদ করব না। বাবার যেসব ঝুঁকির লগ্নী ছিল, আমি মনে করি, তার শতকরা দু-তিন ভাগই আমার ভাগ্য ফিরিয়ে দিতে পারে। বাবার বুদ্ধির ওপর আমি আস্থাহীন নই।

ল্যান্সের রুদ্রমূর্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মনে হচ্ছিল বুঝি তিনি এখুনি পার্সিভালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। পার্সিভাল দ্রুত নীলের পেছনে কয়েক পা সরে দাঁড়ালেন।

না, পার্সি তোমার গায়ে হাত দেব না। ল্যান্স বললেন, তুমি যা চাইছিলে, তাই হলো, আমি এখান থেকে চলে যাব। তোমার খুশি হওয়া উচিত।

দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ল্যান্স বললেন, আর একটা কথা বলে যাই, ওই ব্ল্যাকবার্ড খনির ব্যাপারটাও ইচ্ছে হলে আমাকে দিতে পার। এসব খুনখারাবির পেছনে কোন ম্যাকেঞ্জি থাকলে তাদের আমি আফ্রিকায় নিয়ে যাব।

এতবছর বাদে কেউ প্রতিশোধ নিতে এসেছে, এসব আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু সম্ভবত ইনসপেক্টর নীলও ওটাকেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন,

–এ একেবারেই অসম্ভব। বললেন পার্সিভাল।

–অসম্ভব হলে উনি কালোপাখি আর বাবার পকেটের রাই নিয়ে এত খোঁজখবর করছেন কেন? কি বলেন ইনসপেক্টর?

–গত গ্রীষ্মের সেই ব্ল্যাকবার্ড বা কালোপাখির ব্যাপারটাই উনি বলছেন মিঃ ফর্টেস্কু। এ বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নিতে হয়েছে।

-ওসব বাজে ব্যাপার। ম্যাকেঞ্জিদের কথা অনেককাল সবাই ভুলে গেছে। -কিন্তু আমি শপথ করেই বলতে পারি, একজন ম্যাকেঞ্জি আমাদের মধ্যে রয়েছে। ইনসপেক্টরও মনে হয় এরকম সন্দেহই করছেন।

২. ইনসপেক্টর নীল সার্জেন্ট

দ্বিতীয় পর্ব

ইউট্টি লজে পৌঁছেই ইনসপেক্টর নীল সার্জেন্ট হেঁকে বললেন, মিস মারপলকে বল, আমি এখনই তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

একটু পরেই মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন।

–বেশিক্ষণ বসতে হয়নি তো ইনসপেক্টর। আমি মিসেস ক্রাম্পের সঙ্গে রান্নাঘরে কথা । বলছিলাম। আপনাদের পক্ষে কাজ করা সহজ, সরাসরি আসল বক্তব্যে পৌঁছতে পারেন। আমি কথায় কথায় কাজ উদ্ধার করতে পছন্দ করি।

–আপনি নিশ্চয় গ্ল্যাডিস মার্টিনকে নিয়েই কথা বলছিলেন?

-হ্যাঁ। দেখলাম মিসেস ক্রাম্প মেয়েটার সম্পর্কে অনেক কথাই জানে। মানে আমি বলছি গ্ল্যাডিসের নানা ভাবনাচিন্তার কথা।

–ওতে কোন সাহায্য হয়েছে? নীল বললেন।

–হ্যাঁ। অনেক কাজ হয়েছে।

–শুনুন মিস মারপল, আপনাকে একটা জরুরী কথা বলব বলে খোঁজ করছিলাম।

–বলুন ইনসপেক্টর।

–স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনার বেশ খ্যাতি আছে–

-ওসব নিশ্চয় স্যর হেনরি ক্লিদারিং-এর কাজ। আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু উনি। বললেন মিস মারপল।

–যাই হোক, দেখুন আপনার আর আমার দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ আলাদা। আমার মত হলো আসল ঘটনাটাকে বাস্তব দৃষ্টিতে দেখা।

–আপনার কথাটা একটু পরিষ্কার করে বলুন। বললেন মিস মারপল।

–মিঃ ফর্টেস্কুর খুনের পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে অনেকেই লাভবান হচ্ছে, বিশেষ করে একজনের কথাই বলব।

দ্বিতীয় যে খুনটা হল, দেখা যাচ্ছে তাতেও একই লোক লাভবান হচ্ছে। তৃতীয় খুনটাকে বলতে পারেন নিরাপত্তার জন্য খুন।

কিন্তু ইনসপেক্টর, আপনি কোন খুনকে তৃতীয় বলছেন? তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন মিস মারপল।

-আপনার ইঙ্গিত ঠিক। আমি সেই ছড়ার কথাই ভাবছিলাম। রাজা তার কোষাগারে রানী তার পার্লারে আর পরিচারিকা কাপড় শুকোতে দিচ্ছে–পরপর।

-হ্যাঁ, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। গ্ল্যাডিস মিসেস ফর্টেস্কুর আগেই খুন হয়েছেন।

ঘটনা এরকমই। যদিও গ্ল্যাডিসের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক রাতে। তার মৃত্যুর সঠিক সময় জানা সম্ভব হয়নি। অবশ্য আমার ধারণা সে বিকেল পাঁচটা নাগাদ খুন হয়েছে।

তা না হলে দ্বিতীয় ট্রেটা সে নিশ্চয়ই ড্রইংরুমে নিতে যেত।

–হ্যাঁ, এতে কোন ভুল নেই। বললেন ইনসপেক্টর নীল, প্রথমে সে চায়ের ট্রেটা নিয়ে যায়। দ্বিতীয়বারে খাবারের ট্রেটা নিয়ে হলঘরে আসতেই কিছু একটা ঘটে যায়। হয় সে কিছু দেখে থাকবে নয়তো শুনে থাকতে পারে।

এমন হওয়াও অসম্ভব নয়, সেই সময়েই মিসেস ফর্টেস্কুর ঘর ছেড়ে নেমে আসছিলেন। অথবা মিসেস ইলেইনের ছেলে বন্ধু জেরাল্ট রাইটও হতে পারে।

যেই হোক, গ্ল্যাডিসকে ইশারায় বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তাকে মরতে হয় শেষ পর্যন্ত।

-আপনার অনুমান যথার্থ ইনসপেক্টর। গ্ল্যাডিস বাগানে কাপড় তুলতে গিয়েছিল, আমি তা মনে করি না। ওরকম সন্ধ্যার সময়ে কেউ কাপড় শুকোতে দিতে যায় না। গোটা বাপারটাই একটা ধোঁকা। আসলে ওই ছড়ার সঙ্গে সঙ্গতি রাখারই অপচেষ্টা বলতে পারেন। তারপর ওই নাকে ক্লিপ আটকে দেয়া–সবই।

–পাগলামি ছাড়া কিছু নয় ওসব। আর এখানেই আপনার সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। আপনার ওই ছেলেভুলানো ছড়ার ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না।

-কিন্তু ওটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ঘটনাগুলো, মিলে যাচ্ছে।

–তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু ছড়ায় রয়েছে, পরিচারিকা তৃতীয় খুন। বাস্তবে আমরা দেখছি খুন হচ্ছেন রানী অর্থাৎ অ্যাডেল ফর্টেস্কু। তার আগেই অর্থাৎ পাঁচটা পঁচিশ থেকে ছটার মধ্যে, আমার বিশ্বাস গ্ল্যাডিস তার আগেই মারা গিয়েছিল। ছড়ার কথার সঙ্গে সংগতি তো রইল না মিস মারপল?

–আমার মনে হচ্ছে আপনি অসংগতিটা আরোপ করবার চেষ্টা করছেন। বললেন মিস মারপল।

ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়ালেন। মিস মারপলের কথাটা কানে তুললেন না। ঘর ছেড়ে যাবার আগে স্বগতোক্তির মতো বললেন, একজনই মাত্র হতে পারে।

.

মেরী ডাভ ছোট্ট একটা ঘরে থাকেন। নিজের ঘরে বসে তিনি পরিবারের হিসেবের খাতায় চোখ বোলাচ্ছিলেন।

এমনি সময় দরজায় টোকা দিয়ে ইনসপেক্টর নীল ঘরে ঢুকলেন।

চোখ তুলে নিস্পৃহ চোখে তাকালেন মিস ডাভ।

–সামনের চেয়ারটায় বসুন ইনসপেক্টর। এই মাসের হিসেবটা একটু দেখে নিচ্ছি।

ধন্যবাদ জানিয়ে চেয়ারে বসলেন নীল। তিনি মিস ডাভের ভাবভঙ্গির সঙ্গে মনে মনে মানসিক হাসপাতালে দেখা মিসেস ম্যাকেঞ্জির ভাবভঙ্গির মিল খুঁজবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হতাশ হলেন।

একটু পরেই হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখলেন মিস ডাভ।

-এবারে বলুন, ইনসপেক্টর।

-এই তদন্তে একটা ব্যাপারের ব্যাখ্যা কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। মিঃ ফর্টেস্কুর পকেটে কিছু রাই পাওয়া গিয়েছিল, তার কথাই বলছি আমি যদি

ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত, বললেন মিস ডাভ, কিন্তু এর কোন ব্যাখ্যা আমারও জানা নেই।

–আরো একটা ব্যাপার। গত গ্রীষ্মে মিঃ ফর্টেস্কুর টেবিলের ওপরে চারটে কালোপাখি পাওয়া গিয়েছিল। আর পাইয়ের পাত্রেও মাংসের বদলে পাওয়া গিয়েছিল কালোপাখি।

–হ্যাঁ, আমি জানি।

–দুটো ঘটনার সময়েই আপনি এখানে ছিলেন?

–হ্যাঁ, ছিলাম। খুবই বিশ্রী কাজ ছিল এগুলো। তবে উদ্দেশ্যহীন কাজ বলেই ভেবেছিলাম।

-উদ্দেশ্যহীন হয়তো বলা যাবে না। বললেন নীল, ব্ল্যাকবার্ড খনির বিষয়ে আপনার কিছু জানা আছে মিস ডাভ?

-ওরকম নামের কোন খনির কথা শুনেছি বলে মনে হয় না।

–আপনি মেরী ডাভ। তার চোখে ভয়ের আভাস দেখতে পেলেন নীল।

–এ কিরকম অদ্ভুত প্রশ্ন, ইনসপেক্টর? আপনি কি আমার আসল নামে সন্দেহ করছেন?

–ঠিক তাই। আমি বলতে চাইছি, আপনার নাম রুবি ম্যাকেঞ্জি।

মেরী ডাভ কোন প্রতিবাদ করলেন না। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

নীল লক্ষ করলেন, মেরী ডাভের দৃষ্টি ভাবলেশহীন।

-তাহলে, আমি কি বলব আশা করছেন?

দয়া করে বলুন, আপনার নাম কি রুবি ম্যাকেঞ্জি?

–আমার নাম মেরী ডাভ।

–এর সত্যতা প্রমাণ করতে পারবেন?

–কি দেখতে চান আপনি? আমার জন্মের প্রমাণপত্র?

-সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। কেন না আপনার কাছে কোন মেরী ডাভের বার্থ সার্টিফিকেট থাকতে পারে। আপনার কোন বান্ধবী হয়তো, এখন মৃত।

–তাহলে তো অনেক সম্ভাবনাই এরকম আপনি পেতে পারেন। ওহ, খুবই দেখছি আতান্তরে পড়ে গেছেন আপনি ইনসপেক্টর।

–পাইউড স্যানাটোরিয়ামের নাম শুনেছেন? আপনাকে সম্ভবত সেখানে সনাক্ত করা যেতে পারে, বললেন, নীল।

–ওই স্যানাটোরিয়ামটা কোথায় আছে?

–সেকথা আপার অজানা নয় নিশ্চয়ই, মিস ডাভ।

–ওই নাম জীবনে এই প্রথম আপনার মুখ থেকে শুনতে পেলাম। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

–তাহলে আপনি রুবি ম্যাকেঞ্জি নন, একথা অস্বীকার করছেন?

–কি বলব ইনসপেক্টর। আমি মেরী ডাভ নই কোন রুবি ম্যাকেঞ্জি একথা যদি আপনি জেনে থাকেন তাহলে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনারই।

ইনসপেক্টর নীলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন মেরী ডাভ।

–আমি রুবি ম্যাকেঞ্জি কিনা, ইনসপেক্টর, আপনি নিশ্চয়ই প্রমাণ করবার চেষ্টা করতে পারেন।

ইনসপেক্টর নীল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতেই সার্জেন্ট হে এগিয়ে এলো তার দিকে।

–স্যর, মিস মারপল আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।

–পরে দেখা যাবে। ব্যস্তভাবে বললেন নীল, সব কাজ ফেলে রেখে তুমি আগে মেরী ডাভ তার সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, যাচাই করে দেখো। তার আগের চাকরি ইত্যাদি সবকিছু খুব জরুরী।

–ঠিক আছে স্যর। এখুনি করছি।

নীল লাইব্রেরী ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

হাতের ব্যস্ত সেলাইয়ের কাঁটার দিকে তাকিয়ে মিস মারপল লাইব্রেরীতে বসে মিসেস পার্সিলের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছিলেন।

দরজার সামনে পৌঁছে নীল শুনতে পেলেন, মিস মারপল বলছেন, আমার মনে হয়েছিল, নার্সিং-এর কাজটা আপনি খুবই পছন্দ করেন। ওটা সত্যিই মহৎ কাজ।

নীল নিঃশব্দে আড়াল নিলেন। কিন্তু তাঁর মনে হল, মিস মারপলের চোখকে তিনি ফাঁকি দিতে পারেন নি।

ঘরের ভেতরে তখন মিস মারপল বলছেন, আপনাদের আলাপ পরিচয়ও বোধ হয় এই সেবার কাজের মাধ্যমেই হয়েছিল?

-হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেভাবেই শুরু হয়েছিল। আমি এখানে পার্সিভালের সেবার জন্য এসেছিলাম।

–চাকরবাকরদের কথায় অবশ্য কান দেওয়া ঠিক নয়। শুনেছি, আপনার আগে একজন নার্স ছিলেন, তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অযত্ন করার জন্য, তাই কি?

অযত্ন ঠিক নয়। বললেন জেনিফার, ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার বদলি হিসেবে আমি এসেছিলাম।

তখনই আপনাদের রোমান্স শুরু হয়? দারুণ ব্যাপার।

-হ্যাঁ। কিন্তু কি জানেন, মাঝে মাঝে কেমন মনে হয়, আবার যদি ওয়ার্ডে ফিরে যেতে পারতাম।

-হ্যাঁ আপনার মন আমি বুঝতে পারি। কাজটা খুবই প্রিয় ছিল আপনার।

–আগে অতটা মনে হত না। কিন্তু… এমন একঘেয়ে জীবন… কোন কিছু করার নেই…ভ্যালও তার ব্যবসা নিয়েই ডুবে থাকে–

–পুরুষরা আজকাল এরকমই হয়েছে। বললেন মিস মারপল।

–কিন্তু ওরা বোঝে না যে এতে স্ত্রীর জীবন কতটা শূন্য একঘেয়ে হয়ে যায়। হয়তো এটা আমার কাজেরই সাজা। তখন মনে হয়, কাজটা করা আমার উচিত হয়নি।

-কোন কাজটার কথা আপনি বলছেন?

–ভ্যালকে বিয়ে করার কথা বলছি।…না মিস মারপল, একটু ইতস্তত করলেন জেনিফার, এসব কথা নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না।

মাথা নাড়লেন মিস মারপল। প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যই যেন তিনি এরপর প্যারীতে নতুন চালু হওয়া মেয়েদের পোশাকের প্রসঙ্গ তুললেন।

.

স্টাডিরুমে মিস মারপল আর ইনসপেক্টর নীল কথা বলছেন।

-আমার যেটুকু যাচাই করার বাকি ছিল তা সম্পূর্ণ হয়েছে ইনসপেক্টর। এখন আমি নিশ্চিত। বললেন মিস মারপল।

-কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন? মিষ্টি হেসে বললেন নীল।

–আমি নিশ্চিত জেনেছি, কে মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুকে খুন করেছে। আপনার কাছ থেকে মারমালেডের ব্যাপারটা শোনার পরেই সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। কে, কিভাবে খুনটা করেছে, কোন কিছুই আর আমার কাছে অস্পষ্ট থাকে না।

ইনসপেক্টর নীল কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তার মনোভাব বুঝতে পেরে মিস মারপল বললেন, আমার অসুবিধা হল, মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে বোঝাতে পারি না।

–আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি না মিস মারপল। বললেন নীল।

–তাহলে সব খুলেই বলছি। অবশ্য আপনার সময় থাকলে।

একটু থামলেন মিস মারপল। একটু নড়েচড়ে বসলেন, পরে বলতে শুরু করলেন।

–আমি বাড়ির সকলের সঙ্গেই কথা বলেছি। একদিকে ওই বৃদ্ধা মিস র‍্যামসবটম থেকে ক্রাম্প ও মিসেস ক্রাম্পকেউই বাদ যায়নি। ক্রাম্পকে আমার মিথ্যাবাদী বলেই মনে হল। সে যাই হোক–এখন সেই টেলিফোনের ব্যাপার থেকে নাইলনের মোজা কোন বিষয়ই আমার অজানা নেই।

নীল মিস মারপলের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকালেন। তার মনে হল, বৃদ্ধা হয়তো নতুন অজানা কোন তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সেই কথার অবতারণা করার জন্যই হয়তো নানা গোলমেলে প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন।

তবু তিনি অধৈর্য হলেন না। তিনি মিস মারপলের সব কথা শুনবার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিলেন।

সব কথাই বলুন আপনি। বললেন নীল, তবে আসল কথাটা দিয়েই শুরু করুন।

–সেই করছি। বললেন মিস মারপল। আসল কথাটা হল গ্ল্যাডিসকে নিয়ে। আপনি তো জানেন, আমি এখানে এসেছিলাম গ্ল্যাডিসের জন্যই। আপনিই দয়া করে তার জিনিসপত্র দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাতেই আমি ওই টেলিফোনের কথা, নাইলনের মোজা ইত্যাদির বিষয় জানতে পারি। আর এই সূত্রেই মিঃ ফর্টেস্কু আর ট্যাকসিনের বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

মারমালেডে কে ট্যাকসিন মিশিয়েছিল এবিষয়ে আপনি কি কোন থিয়োরীর কথা বলছেন?

-না ইনসপেক্টর, এটা কোন থিয়োরী নয়। আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি ওসব।

একটু থেমে মিস মারপল ফের বললেন, কাজটা করেছিল গ্ল্যাডিসই।

কিছুই যেন বোধগম্য হচ্ছে না এভাবে তাকিয়েছিলেন নীল। তার চোখ পিটপিট করছিল।

–আপনি তাহলে বলছেন, গ্ল্যাডিসই মিঃ ফর্টেস্কুকে মারার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে মারমালেডে বিষ মিশিয়েছিল? বললেন নীল, এ অসম্ভব মিস মারপল। আপনার একথা মেনে নিতে পারছি না, আমি দুঃখিত।

-না, ইনসপেক্টর, মারমালেডে বিষটা মিশিয়েছিল গ্ল্যাডিসই, কিন্তু মিঃ ফর্টেস্কুকে মারা তার উদ্দেশ্য ছিল না। আপনিই বলেছিলেন, জেরার সময় সে খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। উল্টোপাল্টা কথা বলেছিল। ওকে অপরাধী বলেই আপনার মনে হয়েছিল।

-হ্যাঁ, তবে খুনের অপরাধ নয়। বললেন নীল।

-সেকথা ঠিক আসলে কাউকে খুন করা ওর উদ্দেশ্য ছিল না। তবে বিষটা ও মিশিয়েছিল। আমার সন্দেহ, সে জানত না ওই জিনিসটা বিষ।

–বিষটাকে তাহলে কী মনে করেছিল গ্ল্যাডিস। অবিশ্বাসের সুর প্রকাশ পেল নীলের কথায়।

হ্যাঁ, ইনসপেক্টর ওই জিনিসটাকে সে বিষ বলে জানত না। ও জানত ওটা সত্য উদ্রেকের ওষুধ।

মেয়েদের একটা বিচিত্র অভ্যাস হল তারা কাগজ থেকে নানা টুকরো খবর কেটে রেখে দেয়। বিশেষ করে প্রিয় পুরুষকে বশীভূত করার কোন জিনিস বা পদ্ধতির প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ যুগ যুগ ধরে একই রকম।

ডাইনীতন্ত্র, কবচ মাদুলি ইত্যাদি তাদের সহজে আকৃষ্ট করে। আজকাল তো বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান বলেও চালানোর চেষ্টা দেখা যায়।

এটা সত্যি যে মন্ত্রবলে কিছু করা কিংবা যাদুলাঠির কথা কেউ বিশ্বাস করবে না–যাদুলাঠির ছোঁয়ায় কাউকে ব্যাঙ করে দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু কাগজে যদি ছাপা হয়, বিশেষ কোন ইনজেকশন শরীরে নিলে, আপনার মধ্যে ব্যাঙের হাবভাব ফুটে উঠবে, তাহলে কেউ অবিশ্বাস করবে না।

সত্য উদ্রেককারী এমনি কোন ওষুধের কথা যদি কাগজে ছাপা হয় আর গ্ল্যাডিসের মতো মেয়েদের চোখে যদি তা পড়ে, তারা সহজেই বিশ্বাস করে নেবে।

–এরকম কোন ওষুধের কথা তাকে কি কেউ বলেছিল?

–হ্যাঁ। অ্যালবার্ট ইভান্স। মিস মারপল বললেন, নামটা অবশ্য ভুয়ো। তবে ওই নামেই সে একটা হলিডে ক্যাম্পে গত গ্রীষ্মকালে গ্ল্যাডিসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল এবং উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই তার খুব প্রশংসা করে আর ভালবাসার অভিনয় করে।

আমার বিশ্বাস সেই সময়েই সে তার ওপরে খুব অবিচার হয়েছে এমন কোন ঘটনার কথা গ্ল্যাডিসকে জানায়। সেই সূত্রেই রেক্স ফর্টেস্কুর প্রসঙ্গ উঠেছিল। সম্ভবত অ্যালবার্ট জানিয়েছিল এমন কিছু ওষুধের কথা যা প্রয়োগ করলে রেক্স ফর্টেস্তু নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করবে আর ক্ষতিপূরণ করবে।

এসব অবশ্য আমার জানার কথা নয় ইনসপেক্টর নীল, তবে এরকম যে হয়েছিল তাতে আমি নিশ্চিত।

অ্যালবার্ট ইভান্স ভালবাসার অভিনয় করে সহজেই গ্ল্যাডিসের মন জয় করতে সক্ষম হয়। মেয়েটা পুরুষের ভালবাসা লাভের জন্য বড়ই লালায়িত ছিল।

যাইহোক, অ্যালবার্টই উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গ্ল্যাডিসকে এখানে কাজ করতে পাঠায়। সহজে আজকাল কাজের লোক মেলে না। তাই কাজটা পেতে তার দেরি হয়নি।

এরপর অ্যালবার্ট আর গ্ল্যাডিস সাক্ষাতের জন্য একটা দিন স্থির করে। আপনি গ্ল্যাডিসের ঘরে কয়েকটা ছবির পোস্টকার্ড পেয়েছিলেন, নিশ্চয় আপনার মনে আছে। তার একটাতে লেখা ছিল। আমাদের দেখা করার তারিখ মনে রেখো।

একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ওরা দুজনে কাজে নেমেছিল। তাই পরস্পরের সাক্ষাতের ওই দিনটা দুজনের কাছেই একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল।

অ্যালবার্ট সেই সত্য উদ্রেককারী বিশেষ ওষুধটা গ্ল্যাডিসকে দিয়েছিল? ওই বিশেষ দিনেই সেটা মারমালেডে মিশিয়ে দেবার কথা ছিল যাতে ওই দিনই মিঃ ফর্টেঙ্কু প্রাতরাশে সেটা খেতে পারেন। অ্যালবার্ট এই কথাও বলেছিল গ্ল্যাডিস যেন কিছু রাই মিঃ ফর্টেস্কুর পকেটে রেখে দেয়।

অ্যালবার্ট কিভাবে কি বুঝিয়েছিল গ্ল্যাডিসকে আমি সেসব জানি না। তবে, গ্ল্যাডিসকে আমি যতটা জানি, সহজেই সে সবকিছু বিশ্বাস করে নিয়েছিল। ওর মত একটি অবাঞ্ছিত মেয়েকে সুপুরুষ কোন তরুণ যা বলবে তাই বিশ্বাস করে নেওয়া তার পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব ছিল না।

ইনসপেক্টর হাঁ করে যেন গিলছিলেন মিস মারপলের কথাগুলো। তিনি সম্মোহিতের মতোই বলে উঠলেন, তারপর? বলতে থাকুন।

–ব্যাপারটা ছিল এই রকম, ওইদিন অ্যালবার্ট মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর সঙ্গে অফিসে দেখা করতে যাবে। ইতিমধ্যে প্রাতরাশের সঙ্গে খাওয়া সত্য উদ্রেকের ওষুধ কাজ করতে শুরু করবে আর মিঃ ফর্টেষ্ণু সব স্বীকার করবেন।

মিস মারপল কথা শেষ করলেন দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে। পরে বললেন, ইনসপেক্টর নীল, একবার উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণুর মৃত্যুর খবর পাবার পর গ্ল্যাডিসের মনোভাব কি রকম হওয়া সম্ভব।

–কিন্তু মিস মারপল, ঘটনা যদি এরকমই হতো, তাহলে আমার জেরার মুখে গ্ল্যাডিস কথাটা প্রকাশ না করে পারত না।

-তাহলে আপনি মনে করবার চেষ্টা করুন, তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন মিস মারপল, আপনি যখন তাকে জেরা শুরু করেন, তখন প্রথমেই সে আপনাকে কি বলেছিল?

–সে বলেছিল, আমি এ কাজ করিনি। নীল বললেন।

-ঠিক তাই, গর্বিত স্বরে বললেন মিস মারপল, আপনার জানার কথা নয় ইনসপেক্টর, ঠিক ওরকম কথাই ও বলতে অভ্যস্ত ছিল। কোন গহনা কিংবা বাসন ভেঙ্গে ফেললেও, গ্ল্যাডিস সব সময় বলত, আমি একাজ করিনি মিস মারপল। কি করে হল ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমার বিশ্বাস ওর মতো মেয়েরা এরকম বলতেই অভ্যস্ত। কোন দোষ ঘটে গেলে, ওদের সবার আগে চিন্তা হয় কি করে দায় এড়িয়ে যাওয়া যায়। এটাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

কোন দুর্বল মনের তরুণী যখন কাউকে খুন করতে না চাইলেও তার খুনের কারণ হয়ে পড়ে তখন সে কথাটা স্বীকার করে নেবে, এরকমটা নিশ্চয়ই আপনি ভাববেন না। এরকম হলে তা খুবই অস্বাভাবিক বলতে হবে।

ইনসপেক্টর নীলের মনে পড়ল গ্ল্যাডিসের কথাগুলো। মেয়েটা খুবই নার্ভাস ছিল। অস্থিরভাবে বারবারই এককথা উচ্চারণ করছিল, আর এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছিল। এসবের যে কোন গূঢ় কারণ থাকতে পারে তা তার তখন মনে হয়নি। এখন নিজের ভুলটা বুঝতে পারছিলেন।

–সবকিছু অস্বীকার করবে স্বভাবতঃই এই সিদ্ধান্ত করে নিয়েছিল গ্ল্যাডিস। তারপর কি করে কি হলো এসব হয়তো ভেবে দেখার চেষ্টা করেছিল। ভেবেছিল হয়তো অ্যালবার্ট জানত না ওষুধটা কতটা কড়া। কিংবা নিজে বেশি মাত্রায় দিয়ে ফেলেছে এরকমও ভেবে থাকতে পারে।

অ্যালবার্ট যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তা অনুমান করেছিল গ্ল্যাডিস। সে তা করেও ছিল অবশ্য। আমার ধারণা অ্যালবার্ট টেলিফোন করেছিল তাকে।

সেদিন বাড়িতে অনেক টেলিফোন এসেছিল। যখনই মিসেস ক্রাম্প বা ক্রাম্প রিসিভার তুলেছে অমনি লাইন কেটে যায়।

এরকমই হয়তো অ্যালবার্ট করতো, যতক্ষণ না গ্ল্যাডিস ফোন ধরত। অ্যালবার্ট তাকে ওইদিন গ্ল্যাডিসকে তার সঙ্গে দেখা করার কথাই বলতো।

আমার এই অনুমানের একটা সমর্থন পাওয়া যায় মিসেস ক্রাম্পের কথায়। তিনি বলেছেন, ওইদিন ও সবচেয়ে ভাল নাইলনের মোজা আর জুতো পরেছিল। সে কারো সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল।

গ্ল্যাডিস জানত অ্যালবার্ট ইউট্রিলজেই আসছিল। এই কারণেই খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল গ্ল্যাডিস। অন্যদিনের চাইতে অনেক দেরিতে চা এনেছিল।

আমার ধারণা দ্বিতীয় ট্রেটা নিয়ে ও যখন হলঘরে যায় তখনই পাশের দরজা দিয়ে অ্যালবার্টকে দেখতে পায়।

অ্যালবার্ট হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছিল। ট্রে নামিয়ে রেখে গ্ল্যাডিস তার সঙ্গে দেখা করতে চলে যায়।

এরপরই ওকে গলা টিপে হত্যা করে? বললেন নীল।

–অ্যালবার্ট কোন ঝুঁকি রাখতে চায়নি। সে এক মিনিটের মধ্যেই কাজ সেরেছিল। বোকা মেয়েটাকে শয়তান খুনীর হাতে মরতে হল। সে ওর নাকে একটা ক্লিপ এঁটে দেয়। এই কাজটা খুনী করেছিল ছড়ার কথার সঙ্গে ব্যাপারটাকে খাপ খাওয়ানোর জন্য। সবই ছিল যথারীতি-রাই, কাতলোপাখি, কোষাগার, রুটি আর মধু। আর পাখির নাক ঠোকরানোর ব্যাপারটাকে বোঝাতে চেয়েছিল ক্লিপ আটকে।

-তার মানে বলতে চাইছেন, নিজেকে উম্মাদ প্রতিপন্ন করে শাস্তি এড়াবার ফন্দি এঁটেছিল খুনী? বললেন নীল।

শাস্তি সে এড়াতে পারবে না ইনসপেক্টর। কারণ হল, সে মোটেও উম্মাদ নয়, সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ।

নীল এবারে নড়েচড়ে বসলেন। পরে বলতে লাগলেন।

-আপনি যা পেশ করলেন, এটাকে একটা থিওরীই বলা চলে মিস মারপল। হয়তো আপনি বলবেন, থিওরী নয় আপনি এসব জানেন। আপনি বলতে চাইছেন, অ্যালবার্ট নামে একটা লোক উদ্দেশ্য মূলক ভাবে খুনগুলো করে। নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে হলিডে হোমে গ্ল্যাডিসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল।

সেই পুরনো ব্ল্যাকবার্ড খনির ব্যাপারে প্রতিশোধ নেবার জন্যই অ্যালবার্ট ইভান্স এই সব করেছিল, এই যদি আপনার বলার উদ্দেশ্য হয় তাহলে মেনে নিতে হয় মিসেস ম্যাকেঞ্জির ছেলে ডন ম্যাকেঞ্জি যুদ্ধে মারা যায়নি।

জীবিত থেকে সেই এই সমস্ত করেছে।

ইনসপেক্টর নীল অবাক হয়ে দেখলেন, মিস মারপল তার কথা অস্বীকার করে সজোরে মাথা ঝাঁকালেন।

-না, ইনসপেক্টর না, ওরকম কিছুই আমি বলছি না। কালোপাখির ব্যাপারটা কেউ একজন জানতো, যেগুলো লাইব্রেরীতে আর পাইয়ের মধ্যে রাখা হয়েছিল। সেই এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়েছিল।

কালোপাখিগুলো যে রেখেছিল সে নিশ্চয় ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা জানত। প্রতিশোধ নেবার কথাটাও তার মাথায় ছিল।

তবে মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুকে খুন করা তার ইচ্ছা ছিল না। সে চেয়েছিল ভয় ধরিয়ে দিয়ে মিঃ ফর্টেস্কুকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়ে প্রতিশোধ নিতে।

মিসেস ম্যাকেঞ্জি আপনাকে বলেছিলেন বাচ্চাদের তিনি প্রতিশোধ নেবার জন্য তৈরি করে তুলেছিলেন। কিন্তু ইনসপেক্টর, আমি বিশ্বাস করি না একাজ করা সম্ভব। বাচ্চাদের এভাবে তৈরি করা যায় না।

কেন না, অপরিণত বুদ্ধি হলেও বাচ্চাদের একধরনের বুদ্ধিবিবেচনা থাকে। তারা বড়জোর এটুকু করতে পারে, বাবার মৃত্যুর যে কারণ হয়েছে, যাতে সে মানসিক কষ্ট পায়। এই ক্ষেত্রে এরকমই কিছু হয়েছিল আর খুনী সেটা কাজে লাগায়। তাই বলছি কালোপাখির ব্যাপারটা পুরোপুরি ধাপ্পা।

–তাহলে একজন খুনীকে আলাদাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। বললেন নীল, আপনি এবারে খুনীর সম্পর্কে বলুন, লোকটি কে?

-খুনী। মৃদু হাসলেন মিস মারপল, খুনী সম্পর্কে আমার বিবরণ শুনলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন লোকটি কে। অন্তত খুনগুলো করার মতো মানসিক গঠন কার থাকতে পারে তা আপনি বুঝতে পারবেন।

লোকটি মোটেই উম্মাদ নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ, আর দারুণ বুদ্ধিমান। তবে একেবারেই বিবেকহীন। আরো বলি, সে এই খুনগুলো করেছে, স্রেফ টাকার জন্য।

পার্সিভাল ফর্টেস্কুর কথা বলছেন? মনের সায় পাচ্ছিলেন না, তবুও নামটা উচ্চারণ করলেন নীল।

–ওহ, না ইনসপেক্টর, পার্সিভাল নয়। সে হলো ল্যান্সলট ফর্টে।

–এ একেবারেই অসম্ভব।

মিস মারপলের দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন নীল।

মিস মারপল যে রকম মানুষের চরিত্র এঁকেছেন, তাতে নীল অবাক হননি। খুনীর সাদৃশ্য ল্যান্সের সঙ্গে প্রায় হুবহু এক। কিন্তু সুযোগ আর সম্ভাবনার কথা ভেবেই তিনি কথাটা বলেছেন।

মিস মারপল বুঝতে পারলেন, ইনসপেক্টর নীলের মাথায় ব্যাপারটা ঢোকাতে হলে তাকে ধাপে ধাপে পরিষ্কার করে সব বোঝাতে হবে। তিনি তাই ধীর শান্ত স্বরে তার ব্যাখ্যা শুরু করলেন।

-ল্যান্স বরাবরই ছিল নির্দয় প্রকৃতির। অতি বদ তার চরিত্র। অথচ সুপুরুষ চেহারার জন্য সে ছিল আকর্ষণীয়, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে।

ল্যান্সের মানসিক গঠন এমনই ছিল যে সে চিরদিন ঝুঁকি নেবার জন্যই তৈরি ছিল। সে নানা ঝুঁকি নিয়েছে আর বাহ্যিক আকর্ষণের জন্যই লোকে তার কথা বিশ্বাস করেছে।

গত গ্রীষ্মকালে সে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তবে সে যে তার বাবার চিঠি পেয়ে দেখা করতে এসেছিল, অথবা তিনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। এমন কোন প্রমাণও নিশ্চয়ই আপনি পাননি।

-না, মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু ল্যান্সকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ পাইনি। বললেন নীল, একটা চিঠি আমি পেয়েছি ল্যান্সের লেখা।

তবে সেটা একটা কারচুপিও হতে পারে। এখানে এসে পৌঁছনোর পর বাবার কাগজপত্রের মধ্যে ওটা গুঁজে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না।

–চমৎকার। তীক্ষ্ণবুদ্ধির কাজ। বললেন মিস মারপল, যাইহোক, বাবার সঙ্গে একটা মিটমাট কবে নেবার জন্যই সম্ভবত সে এখানে এসেছিল। কিন্তু তার বাবা রাজি হননি।

ল্যান্সের অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করুন। সে বিয়ে করেছিল। আর তার সৎ উপার্জনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বেঁচে ছিল কোন রকমে।

কিন্তু তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। প্যাট মেয়েটি সত্যিই ভাল। তাকে ভালবাসতো ল্যান্স। সেজন্যই সে চাইছিল একটা সম্মানজনক জীবন।

ল্যান্স যখন ইউট্রিলজে আসে তখনই সম্ভবত কালো পাখির ব্যাপারটা শুনেছিল। অ্যাডেল অথবা তার বাবা বলে থাকবে।

তখনই তার মনে পড়ে যায় ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা। সে ধরে নেয় ম্যাকেঞ্জিদের মেয়ে নিশ্চয়ই ছদ্মপরিচয়ে ওদের বাড়িতে আছে।

ব্যাপারটাকে মাথায় রেখে সে খুনের পরিকল্পনা নেয় যাতে ম্যাকেঞ্জিদের মেয়ের কাঁধেই দোষটা চাপানো যায়।

ল্যান্স বাবার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিল, কিছু আদায় করা সম্ভব হবে না। তাই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুনের পরিকল্পনা নিতে হয়।

মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর শরীর যে ভাল যাচ্ছে না তা ল্যান্স জানতো। তাই সে দেরি করার পক্ষপাতি ছিল না। কেননা ইতিমধ্যে তিনি মারা গেলে তার ভবিষ্যৎ একেবারেই তলিয়ে যাবে।

-হ্যাঁ, ল্যান্স তার বাবার শরীরের অবস্থার কথা জানতো। বললেন নীল।

–আমার ব্যাখ্যা তো তাহলে মিলেই গেল। বললেন মিস মারপল। যাই হোক, দৈবাৎই বলতে হবে কালোপাখির ছড়ার দিকে ল্যান্সের আগ্রহ জেগেছিল। তার বাবার নাম রেক্স ফর্টেস্কু। রেক্স শব্দটা আর পাই ও ডেস্কের ওপরে কালোপাখির উপস্থিতিই সম্ভবত তার এই আগ্রহ জাগার মূলে কাজ করেছিল।

আসলে তার পরিকল্পনাটাকে যতটা সম্ভব জটিল করে তুলতে চেয়েছিল সে। তার প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ব্ল্যাকবার্ড মাইনের ঘটনাটাকে অর্থাৎ মিসেস ম্যাকেঞ্জির প্রতিশোধ নেবার হুমকির সঙ্গে ঘটনাটাকে জড়ানো।

ছড়ার সঙ্গে সংগতি রেখেই তাই সে অ্যাডেলকে খুন করে। যাতে ব্যবসা থেকে এক লক্ষ পাউণ্ড বেরিয়ে যায়।

কিন্তু ছড়ার সঙ্গে মেলাবার জন্য আর একটা চরিত্রও দরকার হয়ে পড়েছিল। একজন পরিচারিকা যে বাগানে কাপড় মেলতে ব্যস্ত থাকবে। একটা ধাঁধার মতো করেই ছকটাকে সে তৈরি করেছিল। তার নিরীহ সহযোগীর মুখ বন্ধ করে দেবার মত চমৎকার অ্যালিবাইও সে ছকে রেখেছিল।

বিকেলে চা পর্বের আগেই সে বাড়িতে হাজির হয়। সেই সময়েই গ্ল্যাডিস দ্বিতীয় ট্রে নিয়ে হলঘরে ঢুকেছিল।

বাগানের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে সে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় আর হাতছানি দিয়ে গ্ল্যাডিসকে ডাকে।

গ্ল্যাডিস এগিয়ে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে শ্বাসরোধ করে। তারপর দেহটা বাগানের পেছনে যেখানে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয় সেখানে বয়ে নিয়ে যায়। এই কাজে সে তিন থেকে চার মিনিটের বেশি সময় ব্যয় করেনি।

এরপর আর কোন বাধা থাকে না। সে সদর দরজায় এসে ঘণ্টা বাজায়। বাড়িতে ঢোকার পর সে সকলের সঙ্গে চায়ে যোগ দেয়। চা পানের পর মিস র‍্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ওপরে চলে যায়।

ল্যান্স যখন নেমে আসে, অ্যাডেল তখনো ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছিলেন। সে তার পাশে বসে কথা বলতে থাকে এবং সুযোগ মতো চায়ে সায়ানাইড মিশিয়ে দেয়।

আমার ধারণা চিনি নেবার অছিলাতেই সাদা গুঁড়োর সায়ানাইড সে অ্যাডেলের কাপেই ফেলে দেয়। হেসে বলে, যাঃ ভুল করে তোমার কাপে আরো চিনি দিয়ে ফেললাম।

অ্যাডেল নিশ্চয়ই বলে, এজন্য সে কিছু মনে করেনি। এই চিনি মেশানোর ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হলেও খুব ঝুঁকির সন্দেহ নেই। দুঃসাহসী ল্যান্স ঝুঁকির কাজই বরাবর করেছে।

–আপনার ব্যাখ্যা অসম্ভব নয় মিস মারপল, বললেন নীল, বাস্তবে এরকমটা সম্ভবপর। কিন্তু, একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। তিন তিনটে খুনের ঘটনা ঘটিয়ে সে কি পেতে চেয়েছিল।

নিজের প্রাপ্য যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য ব্যবসায় বিপর্যয় ঠেকাবার প্রয়োজন ছিল, তার জন্য রেক্স ফর্টেস্কুর মৃত্যু না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাকি দুটি মৃত্যু থেকে তো তার প্রাপ্য কিছু বেশি হবার ব্যাপার ছিল না।

–আপনার সঙ্গে আমি একমত ইনসপেক্টর, বললেন মিস মারপল, আর ঠিক এই কারণেই ব্ল্যাকবার্ড খনির দিকে চোখ ফেলতে হয়। আমার ধারণা, ওই খনির ব্যাপারটা সত্যিই ভুয়ো ছিল না। ল্যান্স সেটা জানতো।

ইনসপেক্টর নীল, স্মৃতি হাতড়ে নানা টুকরো কথা মনে আনবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আজ লণ্ডনের অফিসে পার্সিভালকে বলা ল্যান্সের কথাগুলো তার মনে পড়ল। ঝুঁকির লগ্নীর সঙ্গে অলাভজনক সোনার খনি ব্ল্যাকবার্ড নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল সে।

খনিটার ব্যাপারে এমন ভুল করা মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর পক্ষে কতটা সম্ভব তা ভাববার চেষ্টা করলেন নীল।

যদি ধরে নেওয়া যায় খনিটা অলাভজনকই ছিল, কিন্তু বর্তমানে এর উন্নতি ঘটেছে।

তাহলে খনিটা কোথায়? ল্যান্স বলেছে পশ্চিম আফ্রিকায়। অথচ মিস র‍্যামসবটমই সম্ভবত বলেছিলেন সেটা পূর্ব আফ্রিকাতে।

ল্যান্সের তাহলে এরকম ভুল বলার উদ্দেশ্য কি হতে পারে? তবে এমনও হতে পারে বৃদ্ধা র‍্যামসবটমের স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। আবার নাও হতে পারে।

ল্যান্স এসেছে পূর্ব আফ্রিকা থেকে। আর যদি খনিটা পূর্ব আফ্রিকাতেই হয়ে থাকে, তাহলে খনি সম্পর্কে নতুন খবর শোনা তার পক্ষে সম্ভব।

নানা কথা চিন্তা করতে করতে আচমকা নীলের মনে পড়ে গেল–আজই ট্রেনে বেডন হীথ ফেরার সময় খবরের কাগজে একটা সংবাদ তার নজরে পড়েছে। টাইম পত্রিকায় খবরের হেডিংটা ছিল এরকম : টাঙ্গানাইকায় ইউরেনিয়ামের স্তর আবিষ্কার।

নীল ভাবলেন, যদি ওই ইউরেনিয়াম ব্ল্যাকবার্ড খনির এলাকায় হয়ে থাকে, তাহলে সমস্ত ব্যাখ্যাই সুন্দরভাবে মিলে যায়।

ওই খনির ভেতরে ইউরেনিয়ামের স্তর রয়েছে ল্যান্স হয়তো সেখানে এই খবর শুনেছিল। আর এই কারণেই সে এতকালের অলাভজনক ঝুঁকিকর খনি নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ল্যান্স জেনে গিয়েছিল ওখানে ইউরেনিয়ামের স্তরে তার জন্য বিশাল সৌভাগ্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু…

নীল মিস মারপলের দিকে তাকালেন। বললেন, কিন্তু এসব কি করে প্রমাণ করা যাবে বলে ভাবছেন আপনি?

-আপনি নিশ্চিত প্রমাণ করতে পারবেন আমার বিশ্বাস। গোড়া থেকেই লক্ষ করেছি, আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। খুনী কে যখন আপনি জানতে পেরেছেন, দরকারী সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতেও আপনার অসুবিধা হবে না।

যেমন ধরুণ, ওই হলিডে ক্যাম্পের ঘটনা। সেখানে তার ছবি দেখে সকলেই তাকে সনাক্ত করতে পারবে। অ্যালবার্ট ইভান্স নামে একসপ্তাহ সেখানে কাটিয়েছিল সে। কিন্তু ওই নাম নেবার কি দরকার হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। বলতে পারেন, এখানেও সে একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছিল।

ইনসপেক্টর নীল মাথা ঝাঁকালেন। পরে বললেন, কিন্তু মিস মারপল, এসব কিছুই তো কল্পনা নির্ভর।

-হলেও আমি নিশ্চিত এরকম চরিত্র আপনি আগেও দেখেছেন।

–হ্যাঁ। দেখেছি। মৃদু হাসলেন নীল।

-বেচারী প্যাটকে দেখেই ল্যান্সের দিকে নজর পড়েছিল আমার। বড় দুর্ভাগা মেয়ে–সবসময় বদ লোককেই ও বিয়ে করেছে।

-কিন্তু রুবি ম্যাকেঞ্জির ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার নয় এখনো।

–কারণ আপনি বরাবর ভুল মানুষকেই ভেবেছেন। মিসেস পার্সির সঙ্গে গিয়ে কথা বলুন, তাহলেই আপনার ধন্দ ঘুচবে।

.

ইনসপেক্টর নীল জেনিফার ফর্টেস্কুর ঘরে এলেন।

মিসেস ফর্টেস্কু, বিয়ের আগে আপনার নাম কি ছিল, জানতে পারি?

–ওহ।

প্রশ্ন শুনে বেশ চমকে গেলেন জেনিফার। তার চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল।

–সত্য কথাটা ভোলাখুলি বলাই ভাল মাদাম। আমার মনে হয় বিয়ের আগে আপনার নাম ছিল রুবি ম্যাকেঞ্জি; তাই না?

–আমি–মানে–এতে ক্ষতি কি হল?

–না, ক্ষতি বা দোষের কিছু নয়। বললেন নীল, কদিন আগে পাইউড স্যানেটোরিয়ামে আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

-মায়ের সঙ্গে এখন আর দেখা করতে যাই না। মা আমার ওপর রাগ করে আছেন। নিশ্চয়ই জানেন, মা বাবাকে খুব ভালবাসতেন।

–আর তাই তিনি আপনাকে স্বামীর হত্যার প্রতিশোধ নেবার মতো করে তৈরি করেছিলেন?

–হ্যাঁ, বললেন জেনিফার ফর্টেস্কু, ছেলেবেলা থেকেই তিনি বাইবেল স্পর্শ করিয়ে আমাদের শপথ করাতেন–যেন আমরা ভুলে না যাই তাকে একদিন খুন করতে হবে। বড় হয়ে যখন হাসপাতালের কাজ করতে যাই, তখন বুঝতে পেরেছিলাম, মার মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না।

–তার পরেও, আপনার মনে প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা ছিল?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, সেটা ছিল। আমি জানতাম মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণু বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন। তিনি গুলি করে বা ছুরি মেরে বাবাকে হত্যা করেননি। কিন্তু তার জন্যই বাবাকে মরতে হয়েছিল। দুটো ব্যাপারই এক, তাই নয়?

-হ্যাঁ, নৈতিক দিক থেকে এক।

–আমি তাই ঠিক করেছিলাম, তাকে কিছু শিক্ষা দেব। বললেন জেনিফার, সেই উদ্দেশ্যেই আমি এখানে তার ছেলের দেখাশোনার কাজটা নিয়েছিলাম। আমার আসার আগে আমার এক বান্ধবীই কাজটা করছিল। কিন্তু ইনসপেক্টর, সত্য কথা বলতে ঠিক কি ভাবে কি করব তা আমি কিছুই জানতাম না।

মিঃ ফর্টেস্কুকে খুন করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কেবল এটুকুই মাথায় ছিল তাঁর ছেলের সেবাযত্নে ত্রুটি রাখব, তাইতেই সে মারা যাবে। কিন্তু আমি তা পারি নি। কোন নার্সই সম্ভবত এমন কাজ করতে পারে না।

আমি রীতিমত পরিশ্রম করে ভ্যালকে সুস্থ করে তুলি। এর মধ্য দিয়েই সে আমাকে ভাল বাসতে শুরু করে। পরে বিয়ের কথা বলে।

আমি তখন ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করি। ভ্যালকে বিয়ে করেই আমি প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবি।

অর্থাৎ ভ্যালকে বিয়ে করে তার বাবার সব টাকাকড়ির মালিক হব আমি। এভাবেই বাবাকে ঠকিয়ে তিনি যে টাকা আত্মসাৎ করেন তা আমার হাতে আসবে। এই কাজটা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গতই মনে হয়েছিল।

হ্যাঁ, আপনার মনোভাব অযৌক্তিক ছিল না। বললেন নীল, আপনিই মনে হয় পাইয়ের মধ্যে আর টেবিলে কালোপাখি রেখেছিলেন?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর নীল, বললেন জেনিফার, কাজটা খুবই বোকার মতো হয়ে গিয়েছিল। তবে যেভাবে মিঃ রেক্স ফর্টেঙ্কু অহঙ্কার করে তার কীর্তিকাহিনী শোনাতেন, কি ভাবে আইন মেনেই মানুষকে একের পর এক বোকা বানিয়ে ঠকিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছিল তাকে বেশ ভয় দেখিয়ে দিতে হবে।

আর সেই কালোপাখির ঘটনার পরে তিনি বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন। মানসিকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

একটু থামলেন জেনিফার। শান্ত চোখে তাকালেন নীলের দিকে।

–এটুকুই কেবল, ইনসপেক্টর, এর বেশি আমি কিছুই করিনি। কাউকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, নিশ্চয়ই আপনি তা বুঝতে পারবেন।

-তা হয়তো পারি, হাসলেন নীল, তবে একটা কথা, আপনি কি ইদানীং মিস ডাভকে কোন টাকা দিয়েছিলেন।

জেনিফার রীতিমত চমকে উঠলেন। ভীত স্বরে বলে উঠলেন, আপনি কি করে জানলেন একথা?

–আমাকে অনেক কিছুই জানতে হয় মাদাম। বললেন নীল।

–আপনি তাকে রুবি ম্যাকেঞ্জি বলে ভাবছেন, একদিন সে এসে আমাকে একথা জানায়। সে বলে, ওকে যদি পাঁচশো পাউণ্ড দিই তাহলে সে আপনার কাছে রুবি ম্যাকেঞ্জি হয়েই থাকবে। আরও বলে, আমিই রুবি ম্যাকেঞ্জি একথা আপনি জানতে পারলে মিঃ ফর্টেঙ্কু ও তাঁর স্ত্রীকে খুনের অপরাধে আমাকেই অভিযুক্ত করা হবে।

ভ্যালকে এসবকথা জানাতে পারিনি, আমার কথাটাও জানত না। তাই অনেক কষ্ট করে আমাকে টাকাটা জোগাড় করতে হয়েছিল।

আমার বিয়ের বাগদানের হীরের আংটি আর মিঃ ফর্টেল্ক দিয়েছিলেন একটা নেকলেস–এই দুটো জিনিস বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।

–দুঃখ করবেন না মাদাম, সহানুভূতির সঙ্গে বললেন নীল, টাকাটা মনে হয় আদায় করে দিতে কষ্ট হবে না।

.

পরদিন মিস মেরী ডাভের সঙ্গে দেখা করলেন ইনসপেক্টর নীল।

–মিস ডাভ, আবার একবার আপনার কাছে আসতে হল।

একই রকম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নীলের দিকে তাকালেন তিনি।

-বলুন, ইনসপেক্টর।

-ভাবছি, মিসেস পার্সিভালের নামে আপনি পাঁচশো পাউণ্ডের একটা চেক লিখে দেবেন কিনা?

মুহূর্তে মেরী ডাভের মুখের চেহারা পাল্টে গেল। নীলের মনে হল, তার মুখের সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিয়েছে।

–ওই বোকা স্ত্রীলোকটা দেখছি সবই আপনাকে বলে দিয়েছে।

ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন মেরী ডাভ।

-হ্যাঁ, তা বলেছেন। আপনার জানা নেই বোধহয় মিস ডাভ, ব্ল্যাকমেল গুরুতর অপরাধ।

–এটা ব্ল্যাকমেল নয় ইনসপেক্টর। তার কিছু কাজ আমি করে দিয়েছিলাম। ওটা তারই পারিশ্রমিক।

–সেরকমই না হয় আমি ভাবব, আপনি চেকটা দিয়ে দিলেন।

মেরী ডাভ আর কথা বাড়ালেন না। চেকবইটা এনে নীরবে মাথা গুঁজে একটা চেক লিখলেন।

–মনে হয় আপনি অন্য কাজ খুঁজছেন?

–হ্যাঁ। এই কাজটা ঠিক মনঃপুত হয়নি।

–তাই দেখছি। বললেন নীল। সব কিছুই আপনাকে বেশ অসুবিধায় ফেলে দিয়েছে।

আমাদেরও হয়তো যে কোন মুহূর্তে আপনার অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হতে পারে।

–কিছুই পাবেন না ইনসপেক্টর, আমার অতীত সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ।

আবার শান্ত নির্লিপ্তভাব ফিরে এলো ডাভের কণ্ঠে।

–তেমন হলে তো সত্যিই সুখের ব্যাপার। তবে একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত যে গত তিন বছর যে সব জায়গায় আপনি কাজ করেছেন আপনি কাজ ছেড়ে চলে আসার তিন মাসের মধ্যেই সেখানে ডাকাতি হয়। এটাকে আশ্চর্য সমাপতনই বলা যায়, কি বলেন?

–এরকম তো ঘটতেই পারে ইনসপেক্টর।

-তা পারে অবশ্যই, বললেন নীল, তবে প্রতিক্ষেত্রেই এরকম হওয়াটা কি ঠিক মিস ডাভ? আমার মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও আমাদের আবার দেখা হয়ে যেতে পারে।

–কিছু মনে করবেন না ইনসপেক্টর, আমাদের দেখা না হয় সেটাই আশা করি।

.

-ওর বউটার জন্যই দুঃখ হয়। বললেন মিস র‍্যামসবটম। ছেলেটা সব সময়ই অন্যরকম ছিল। অবাক হয়ে ভেবেছি আমার বোন এলভিরার ছেলে কেন এরকম হল। অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম কিন্তু স্নেহের বশে কিছু বলতে পারতাম না।

কিন্তু খারাপ কাজ সবসময়ই খারাপ। সেজন্য শাস্তি হওয়া উচিত। এটাই চিরন্তন রীতি। আপনার মাধ্যমেই এখানে হয়তো সেকাজটা হবার ছিল। আমি অখুশি নই মিস মারপল। আশাকরি পুলিস ইনসপেক্টরকে সব জানিয়ে দিয়েছেন?

–হ্যাঁ। তিনি নিজেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। বললেন মিস মারপল।

–তিনি এসব কিছু প্রমাণ করতে পারবেন?

–আমি নিশ্চিত তিনি পারবেন? একটু সময় হয়তো লাগতে পারে।

সুটকেস গোছগাছ করে মিস মারপল আগেই ক্রাম্পের হাতে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মিস র‍্যামসবটমকে তার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এবারে তিনি নিচে নেমে এলেন।

প্যাট ফর্টেস্কু তাকে বিদায় জানাবার জন্য হলঘরে অপেক্ষা করছিলেন।

–আপনি আমাদের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। আপনার অভাব বেশ বোধ করব।

–কাজের জন্য এসেছিলাম, সেটা শেষ হল, এবারে তো যেতেই হবে। দুঃখ রইল কাজটা তেমন সুখকর হল না। তবে মন্দ কাজের জয় তো হয় না।

প্যাট কথাটা বুঝতে না পেরে বিস্মিতভাবে তাকালেন।

–আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

-তা আমি জানি। একদিন হয়তো পারবেন। তবে যাবার আগে একটা পরামর্শ দিয়ে যাই, যদি কোথাও কোন গোলমাল হয়, আপনি বিপর্যস্ত বোধ করেন, তাহলে আপনার ছেলেবেলার সেই আয়ারল্যাণ্ডেই ফিরে যাবেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেদনাকাতর চোখে প্যাটের দিকে তাকালেন মিস মারপল।

–এখানে আর আমাদের থাকবার ইচ্ছা নেই, বলল প্যাট, ল্যান্স বলেছে, সব মিটে গেলে পূর্ব আফ্রিকাতেই আমরা চলে যাব। সেখানেই আনন্দে থাকব।

–ঈশ্বর আপনাকে আশীর্বাদ করুন। ভাল মন্দ মিশিয়েই জীবন, মানুষকে সব কিছুই সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।

প্যাটের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মিস মারপল। বাইরে তার জন্য ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল।

.

সেদিনই সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরলেন মিস মারপল।

ঘরের কাজ করে দেয় যে মেয়েটি, বিটি, মিস মারপলের নামে আসা চিঠিপত্র তার টেবিলে গুছিয়ে রেখেছিল। কুশল বার্তা নেবার পর চিঠিগুলো নিয়ে বসলেন তিনি।

একটা চিঠির ওপরে আঁকাবাঁকা অক্ষরে ছেলেমানুষী লেখার ঠিকানা দেখে সেটা তুলে নিলেন তিনি। খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে আনলেন।

.

প্রিম মাদাম,

কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না, তাই আপনাকে লিখছি। আমাকে মাপ করবেন।

ওরা বলেছে খুন–কিন্তু শপথ করে বলছি আমি এমন খারাপ কাজ করিনি। কখনো করতে পারি না। আর আমি জানি, একাজ অ্যালবার্টও করেনি। আমি জানি।

গত গ্রীষ্মকালে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। আমরা বিয়ে করব ঠিক ছিল, কিন্তু সব গোলমাল করে দিচ্ছিলেন যিনি মারা গেলেন, সেই মিঃ ফর্টেষ্ণু। তিনি অ্যালবার্টের সব পাওনা মেটাননি; ওকে ঠকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি সবই অস্বীকার করছিলেন।

অ্যালবার্ট গরীব, তার কথায় কেউ কান দিচ্ছিল না। লোকেরা বড়লোক মিঃ ফর্টেস্কুর কথাই বিশ্বাস করেছে।

অ্যালবার্টের এক বন্ধু একজায়গায় কাজ করত, সেখানে নতুন একরকম ওষুধ তৈরি হয়। খবরের কাগজেও ওষুধটার কথা বেরিয়েছে, নিশ্চয় আপনি পড়েছেন। ওটা সত্যের ওষুধ, খেলে ইচ্ছে না থাকলেও মানুষ সত্যকথা বলে ফেলে।

মিঃ ফর্টেস্কুর অফিসে অ্যালবার্ট দেখা করতে যাচ্ছিল ৫ই নভেম্বর। আমাকে বলেছিল ওষুধটা মিঃ ফর্টেস্কুর খাবারে মিশিয়ে দিতে। তাহলে ওষুধটা ঠিক সময়ে কাজ করবে আর মিঃ ফর্টেঙ্কু সব স্বীকার করে অ্যালবার্টের পাওনা মিটিয়ে দেবেন।

মাদাম, আমি খুশি হয়ে ওষুধটা তার মারমালেডে মিশিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেই তিনি মারা যান। আমার মনে হয় ওষুধটা খুবই কড়া ছিল, অ্যালবার্ট নিশ্চয়ই এটা জানত না। জানা থাকলে একাজ ও আমাকে করতে বলতো না। অ্যালবার্ট জানত না, ওর দোষ নেই।

মাদাম, পুলিসকে আমি বলতে পারিনি। আমার ভয় হয়েছিল, তারা অ্যালবার্টকেই দোষী করত। কিন্তু আমি জানি সে একাজ করেনি। এখন সারা বাড়িতে পুলিস, আমি কি করব বুঝতে পারছি না। কি বলা উচিত তা-ও বুঝতে পারছি না। ওদের দেখলেই আমার বড় ভয় করে, কেমন সব প্রশ্ন করে ওরা। মাদাম, অ্যালবার্টের কাছ থেকে খবর পাইনি। আপনাকে কি করে বলব বুঝতে পারছি না, তবু আপনি যদি একবার আসতেন, আমার বিশ্বাস, ওরা আপনার কথা ঠিক শুনবে। আমি আর অ্যালবার্ট কোন দোষ করিনি। আপনি নিশ্চয় সাহায্য করবেন। আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। —স্নেহের
গ্ল্যাডিস মার্টিন

পুনঃ-আমার আর অ্যালবার্টের একটা ছবি পাঠালাম। হলিডে ক্যাম্পে একজন তুলেছিল, সেই আমাকে দেয়। অ্যালবার্ট ছবি ভোলা পছন্দ করে না, তাই ওকে ছবিটার কথা বলিনি। দেখলেই বুঝবেন ও কি চমৎকার ছেলে।

চিঠি পড়া শেষ করে ছবিটা তুলে নিলেন মিস মারপল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট চেপে ধরলেন।

ছবিতে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। মিস মারপলের চোখ যে ছবিটার ওপর নিবদ্ধ হল, তার মুখে হাসি, সে মুখ ল্যান্স ফর্টেস্কুর।

হৃদয়হীন এক খুনীর ছবির দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে বুকে চাপ সৃষ্টি হলেও দেখা গেল বেদনার অশ্রু ভরে তুলেছে মিস মারপলের দুই চোখ।

Exit mobile version