Site icon BnBoi.Com

দি মিরর মিস্ট্রি – আগাথা ক্রিস্টি

দি মিরর মিস্ট্রি - আগাথা ক্রিস্টি

দি মিরর মিস্ট্রি

১. মিসেস ভ্যান রাইডক

দি মিরর মিষ্ট্রি (মিস মার্পল ধারাবাহিক) – আগাথা ক্রিস্টি

০১.

মিসেস ভ্যান রাইডক আয়নার কাছ থেকে সরে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেন মারপলের কাছ থেকে তার পোষাকটা সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। মিস মারপল ভালো করে দেখে নিয়ে গাউনটির খুব প্রশংসা করলো। আবার মিসেস রাইডক লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার বয়স্কা পরিচারিকা স্টেফানিকে সেটি খুলে নেওয়ার জন্য আদেশ জানালেন।

স্বল্পবাসে আচ্ছাদিত মিসেস রাইডক আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। পরিমিত প্রসাধন ও পরিচর্যার জন্য তাঁর শরীরে এখনও লাবণ্যের রেশ মুছে যায়নি। সর্বাঙ্গে সযত্ন প্রয়াস সুস্পষ্ট।

রুথ ভ্যান রাইডক জেনকে কৌতুকের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, তারা যে সমবয়সী একথা কি প্রকাশ পায়?

মিস মারপলের বিস্মিত হয়ে তার মনের কথা জানালেন, তিনি কোনোমতেই তার বয়সকে এক মুহূর্তের জন্যও লুকিয়ে রাখতে পারেন না।

মিস মারপল মাথার কেশ শুভ্র। মুখের গোলাপি চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। চোখ দেখলেই তার মনের নির্মল ভাবের কথা কারুর অবিদিত থাকে না। মিসেস রাইডকের সঙ্গে এখানেই তার ব্যতিক্রম।

মিসেস রাইডক জেনের সঙ্গে একমত হলেন। সোফার ওপর সমস্ত দেহের ভার ছেড়ে বসে তিনি স্টেফানিকে বিদায় দিলেন। স্টেফানি পোষাকটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। স্টেফানি রাইডকের তিরিশ বছরের সঙ্গী। রাইডকের অতীতের চেহারা সম্বন্ধে সে-ই একমাত্র সাক্ষী। রাইডক জেনকে জানালেন যে তার সঙ্গে রাইডকের কিছু কথা আছে। জেন রাইডকের প্রতি মনোযোগ দিলেন। রাইডক জানালেন তিনি লুইজির সম্বন্ধে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

মিস মারপলের মন অতীতে পাড়ি দিল। ফ্লোরেন্সের বোর্ডিংবাড়ি। দুই মার্কিন প্রাণবন্ত মেয়ে। আকর্ষণীয় ব্যবহার। রুথ লম্বা আগ্রহী মেজাজী। ক্যারি লুইজি ছোট্টখাট্টো সাদাসিধে স্বপ্নালু। লুইজির সঙ্গে জেনের বহুদিন দেখা হয়নি। তাহলেও ক্রীসমাসের কার্ডের মধ্যে দিয়ে তাদের যোগাযোগ আছে।

তিনজনের জীবন তিন পথের পথিক হলেও প্রীতি বিনিময়ের মধ্যে দিয়েই পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ অবিছিন্ন রয়েছে। এদের মধ্যে রুথ ইওরোপে বেশি আসে। তাই মিস মারপলের সঙ্গে রুথের বেশি দেখা হয়। ক্যারি লুইজ ইংলণ্ডে থাকা সত্ত্বেও বিশ বছরের বেশি তার সঙ্গে দেখা হয়নি। হয়তো একজায়গায় থাকা হয় বলেই দেখা সাক্ষাতের আয়োজন কম হয়।

ক্যারি লুইজকে নিয়ে রুথের দুশ্চিন্তার কারণ মিস মারপল জানতে চাইল, কিন্তু কারণটা অজানা বলেই রুথ জানাল তার চিন্তা এত বেশি। তার স্বাস্থ্য বা সুখ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। সংসারের স্বরূপ লুইজের অজানা আর সেইখানেই রুথের যত চিন্তা। এদের মধ্যে লুইজি আদর্শবাদী সারাজীবন সেবা ও ধর্মের মধ্যেই জীবন নিয়োগ করবে এই ছিল জেনের চিন্তা। আর রুথ হলো শক্ত মনের মানুষ। সমাজের কাছ থেকে কিছু আশা করে না। তবে ক্যারি লুইজ সম্বন্ধে রুথের একটাই চিন্তা–কেবলই আদর্শবাদী লোকেদের বিয়ে করে, যারা রুথের মতে মাথা খারাপ লোকেদের দলে। উচ্চ ভাবনার কথায় লুইজের মন বিগলিত হবেই। যে কোনও বয়সের মানুষকেই সে সমস্ত বিচার বিবেচনা হারিয়ে নিজের করে নিতে পারত। তাদের মধ্যে গুলব্রাজেন একজন। যার খ্যাতি পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি তার সমস্ত ধনসম্পদ সকাজে দান করেছেন। ক্যারি বত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হয়।

অবিবাহিত মিস মারপল একমনে রুথের কথা শুনে যায়। রুথ বলে চলে, জনি বেষ্টারিককে ক্যারি যখন বিয়ে করেছিল তখন সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল। জনি ছিল অতি স্বার্থপর, বিলাসী ও অলস তবে স্বামী হিসেবে নিরাপদ। বিলাসবহুল জীবন ছাড়া সে আর কিছু চাইত না। জনির থিয়েটার নিয়ে মাথা ঘামানো বা সীন আঁকা এইসবেই লুইজির মন গলেছিল। মাঝখান থেকে শিল্পের দিকে জনিকে ঠেলতে গিয়ে লুইজি তাকে হারাল। একটা যুগোশ্লাভ মেয়ে জনিকে বশ করল। মজার কথা এই, যে লুইজি তার ক্ষমাসুন্দর মন নিয়ে সমস্ত ঘটনাটা খুব সহজভাবে নিল। জনির আগের পক্ষের দুই ছেলেকে নিজের কাছে এনে রাখল। জনির সঙ্গে মেয়েটার বিয়েতে কিছুই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো না। জানা যায় মেয়েটা নাকি জনিকে প্রচুর যন্ত্রণা দিয়ে গাড়িসুদ্ধ খাদে ফেলে দেয়।

মিসেস রাইডক আয়নায় একবার মুখটা দেখে নেয়। তারপর বলে চলে লুইজি আর এক পাগল লিউইসকে বিয়ে করে। সবার জীবনে উন্নতি ঘটানোই যার লক্ষ্য। তবে সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপকার করার পদ্ধতিও পাল্টায়। এখন শিশু অপরাধীদের নিয়ে সকলে ভাবতে বসেছে। এদের ব্যাপারে লিউইসের প্রচণ্ড উৎসাহ। লুইজির কাছে এর আবেদন অবর্ণনীয়। এসব ব্যাপার রুথের ভালো লাগে না। গুলব্রাজেন সম্পত্তির অছিদের পরামর্শমত লুইজির বাড়ির জমিতে একটা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। সেখানে এই অপরাধীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। এদের মাঝেই লিউইস আর লুইজ বাস করে।

মিসেস রাইডক অসহায় ভঙ্গীতে মিস মারপলের দিকে তাকালো। কিন্তু মিস মারপল বুঝে উঠতে পারে না ভয়ের কারণটা ঠিক কি। রুথ জানায় তার সাথেও কারণটা স্পষ্ট নয়। ওদের বাড়িতে সেদিন গিয়ে তার পরিবেশটা ভালো লাগেনি। অ্যামালগ্যায়েটেড সিরিয়ালন কোম্পানী ডোববার আগেই জুলিয়ানকে সব শেয়ার বেচে দেওয়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছিল। তার দৃঢ় বিশ্বাস কোনো গণ্ডগোল ক্রমশ দানা বাঁধছে। এদিকে লিউইস নিজের খেয়ালে মগ্ন, ক্যারি লুইজিও স্বপ্নের ঘোরে থাকতে ভালোবাসে, বাস্তবের সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ নেই। রুথ জেনকে তাড়াতাড়ি ওখানে গিয়ে গোলমালের সূত্রটা অনুসন্ধান করতে বলে।

জেন বিস্মিত হয়। কিন্তু রুথ বলে, জেনই একমাত্র পারবে। সামনে মিষ্টি ব্যবহার দেখিয়ে অন্তনিহিত সমস্ত ঘটনা জানবার মত ক্ষমতা সে রাখে। গ্রাম্য শান্তিময় পরিবেশের মধ্যে থাকলেও বাস্তবের সঙ্গে সে খুব ভালো করে পরিচিত। মানুষের মুখোশের আড়ালে মুখটা তার চোখে সহজেই ধরা পড়ে। সেইজন্যই রুথ জেনকে স্টোনিগেটসে গিয়ে খোঁজ খবর নিতে বলে। এর জন্য প্রাথমিক কাজটুকুও রুথ করে রেখেছে।

মিসেস ভ্যান রাইডক একটা সিগারেট ধরিয়ে তার বক্তব্য মারপলকে বলতে লাগলো।

রুথ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো, একথা অস্বীকার করা যায় না যে যুদ্ধের পর থেকে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের পক্ষে জীবন নির্বাহ করা কঠিন হয়েছে। জেনও তাদের মধ্যে একজন। জেন তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো, ভাইপো রেমণ্ড যদি তাকে সাহায্য না করতো তবে দিন চালানো সত্যি দুষ্কর হত।

রুথ জেনকে থামিয়ে বলে যে ক্যারি লুইজি তার ভাইপোর সম্বন্ধে জানে না। লুইজিকে সে বলেছে, জেন খুবই অর্থকষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছে। প্রখর আত্মসম্মানবোধের জন্য কারোর কাছে সাহয্যেও নেবে না। তাই যদি তাকে ডেকে কোনো বন্ধু একটু আরামে রাখার ব্যবস্থা করে– রুথ ভেবেছিল এইসব শুনলে হয়তো জেন রাগ করবে কিন্তু জেন অবাক হয়ে আনন্দের সঙ্গে বললো এইরকম বুদ্ধি করে রুথ এগিয়েছে যখন তখন নিশ্চয়ই লুইজি ফাঁদে পা দিয়েছে। রুথ বলে লুইজি জেনকে চিঠি লিখবে বলেছে।

জেন প্রয়োজনটা বুঝে যেতে রাজি হয়ে যায়! রুথ জানায় তার কিন্তু কোনো স্পষ্ট ধারণার ভিত নেই। মিস মারপলের মনে অনেক দিনের আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার রবিবার গীর্জার প্রার্থনা করতে গিয়ে গ্রেসের জন্য খুব চিন্তা হতে লাগল। ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ যেন ওত পেতে রয়েছে এমন মনে হতে লাগল। ঘটলও তাই। পরদিনই, গ্রেসের বাবার, নৌ-বিভাগের বড় কর্তা ছিলেন…. মাথায় কিছুটা গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল। হঠাৎই কয়লাভাঙ্গার হাতুরি দিয়ে লুইজিকে মারতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সে ধর্মবিরোধী মেয়ে, তার মেয়ে নয় এই যাচ্ছেতাই কথা বলতে বলতে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিলেন। অবশেষে ধরে বেঁধে তাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কয়েকমাস হাসপাতালে থেকে গ্রেস সুস্থ হয়ে বাড়ি এল।

রুথ তাকে বললো তাহলে সেদিন সে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আভাস পেয়েছিলো।

আসলে জেনের ধারণার পিছনে যুক্তি ছিল। গ্রেস নিয়ম কানুন জানা মেয়ে হয়েও সেদিন উল্টো টুপি পরে এসেছিল। তার এই অসচেতনতাই জেনকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে অন্যমনস্ক। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। গ্রেস সেইদিন তার বাবার আচরণের মধ্যে কিছু বিসদৃশ্য ব্যাপার লক্ষ্য করেও এটা তার মেজাজ বলে উপেক্ষা করেছিলো।

রাইডক বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকালো। সে ভেবেছিল সেন্ট মেরি মিড শান্ত সরল জায়গা। জেন তাকে বললো সব জায়গায় মানুষ সমান হয়। শহরে চট করে নজরে পড়ে না।

জেন স্টোনিগেটস্ যেতে রাজি হল। পরোক্ষভাবে রেমণ্ডের ওপর অবিচার করা হল ঐ কথা বলে তবে সে এখন মেক্সিকোয় গেছে ছমাসের জন্য। তার আগে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারমধ্যেই জেন গোলমালটা ধরে ফেলতে পারবে এই বিশ্বাসটুকু রাখে।

.

০২.

মিস মারপল খুব হিসেবী মহিলা। সেন্ট মেরি মিডে ফিরে যাবার আগে কিছু প্রয়োজনীয় কথা জেনে নিলেন।

ক্যারি লুইজির সঙ্গে চিঠি আর কার্ডের মধ্যে দিয়ে কুশল বিনিময় ছাড়া বিশদভাবে কোনো যোগাযোগ তাদের মধ্যে নেই। সেইজন্য রুথের কাছ থেকে সংক্ষেপে কিছু খবর সে সংগ্রহ করতে চায়। যেমন স্টোনিগেটসের বাড়িতে কোন কোন লোকের সঙ্গে তার দেখা হবে।

রুথ বলে, গুলব্রাজেনকে বিয়ে করে লুইজির কোনো সন্তান ছিল না। গুলব্ৰাণ্ডজেনের আগের পক্ষের তিনটি বড় ছেলে ছিল। পরে ওরা একটি মেয়েকে দত্তক নেয়, নাম পিপা। তখন তার দু বছর বয়স। ভারী মিষ্টি দেখতে তাকে। রুথ সঠিক জানে না কোথা থেকে তাকে আনা হয়েছিল তবে সম্ভবত কোনো শিশু প্রতিষ্ঠান থেকে হবে। এর মধ্যে লুইজি বুঝল সে সন্তানসম্ভবা। কিন্তু যতটা আনন্দ পাবার কথা ততটা সে পেল না। বারবার নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। মনে হলো পিম্পাকে সে এবার তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে। মিলড্রেড একেবারে সাধারণ চেহারা নিয়ে জন্মাল। নিজের সন্তান আর পালিত কন্যা দুজনকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে চাইলেও পিপাই যেন অনেকখানি অধিকার করে থাকত। এতে হয় তো মিলড্রেড মনক্ষুণ্ণ হত। কুড়ি বছর বয়সে সুন্দরী পিপ্পা একজন ইতালিয়ানকে বিয়ে করল। গুলব্রাজেনের বাহু টাকা পিপ্পা পাবে জেনেই মারচিজ তাকে বিয়ে করল। মিলড্রেড বিয়ে করল স্ট্রেট নামে এক পাদরীকে। লোকটি তার থেকে বয়সে কিছু বড় হলেও ভালো ছিল। তারা সুখেই থাকত।

স্বামীর মৃত্যুর পর মিলড্রেড স্টোনিগেটসে তার মার কাছে ফিরে এল। পিপপার বিবাহিত জীবন সম্বন্ধেও লুইজি বেশ খুশি হয়েছিল। গিদো ছিল স্বাস্থ্য সৌন্দর্যে ভরপুর প্রাণবন্ত ছেলে। বছর কয়েক বাদে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে পিপা মারা যায়। গিদো অত্যন্ত ভেঙে পড়ে। লুইজি অত্যন্ত আঘাত পায়। এরপর জনি রেস্টারিকের সঙ্গে লুইজির দেখা এবং বিয়ে হয়। গিদো আবার বিয়ে করে। তার বাচ্চা জিনা, ক্যারি লুইজি; জনি রেস্টারিক, জনির প্রথম স্ত্রী, দুই ছেলে অ্যালেক্সিস ও স্টিভেন সবাই এসে স্টোনিগেটেসে বাস করতে লাগল।

এর কদিন বাদে মিলড্রেডের বিয়ে হল। তারপর জনির সঙ্গে বিচ্ছেদ। তার ছেলেরা অবশ্য ছুটিতে স্টোনিগেটসে আসত। তারপর ১৯৩৮ সাল নাগাদ ক্যারি বিয়ে করল লিউইসকে। প্রকাণ্ড বড় এক চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট কোম্পানীর বড়কর্তা সে। তবে ঐ পরোপকারের বিদঘুঁটে নেশা তার। প্রথমে শিশু অপরাধীদের ধরে এনে পুষ্টির ব্যবস্থা করা তারপর তাদের পড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগা। লিউইস ভেবেছিল অপরাধীরা বুদ্ধিমান জীব। ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে তাদের দিয়ে অনেক ভালো কাজ করানো যায়। মিস মারপল রুথের এই কথায় সম্মতি জানায়। তবে তার মতে কথাটা একেবারে সত্যি হয় না সবসময়।

রুথ আবার মারপলের কাছে ভালোভাবে জেনে নিল, লুইজি ডাকলে সে তাহলে অবশ্যই যাচ্ছে তো। মারপল কথা দিল।

.

০৩.

মিস মারপল ট্রেন থেকে যে স্টেশনে নামল তার নাম মার্কেট কিম্বল। যাত্রীদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

বেশ হাওয়া বইছিল। পরিধানে সাধারণ পোশাক মারপলের। জিনিসপত্র সামলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এমন সময় একজন যুবক তার দিকে এগিয়ে এল।

নিজের পরিচয় জানিয়ে ছেলেটি বলল, যে সে স্টোনিগেটস থেকে মারপলকে নিতে এসেছে। ছেলেটি কেমন যেন মুখস্থের মত করে কথা বলল। কথাবার্তায় কৃত্রিমতার ছাপ।

মিস মারপলের চেহারার মধ্যে অসহায় বৃদ্ধার ছাপ। কথাবার্তায় স্যুটকেশটা নিতে বলাতে সে একটা কুলিকে ডেকে স্যুটকেশটা গাড়িতে তুলে দিতে বলল। কুলিটি খুব একটা গুরুত্ব না দেওয়ায় ছেলেটি তার ওপর একটু চটে গেল।

মিস মারপলকে নিয়ে যেতে যেতে আত্মপরিচয় দিয়ে ছেলেটি বলল, তার নাম এডগার লোমন। মিসেস সোরাকোল্ড তাকে পাঠিয়েছে। সে তার সহকারী।

তার কথাবার্তার মধ্যে আত্মতুষ্টির ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নিজের কথা বেশি করে বলতে ভালোবাসে। তবে তার কথা শুনে মিস মারপল বুঝতে পারল তার সুরটা খাঁটি নয়। কোথায় যেন বেসুরো বাজছে। মারপল একটু চিন্তিত হল। স্টেশনের বাইরে ফোর্ড গাড়ির দিকে এডগার এগিয়ে গিয়ে মারপলের কাছে জানতে চাইল কোন দিকে সে বসবে, সামনে না পিছনে।

উত্তর দেবার আগেই একটা ঘটনা ঘটল। ঝকঝকে একটা রোলস্-বেল্টলে গাড়ি গর্জন করে স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। অতুলনীয় সুন্দরী একটি মেয়ে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল। পরনে কর্ডবয় স্ন্যাস আর গলাখোলা পার্ট।

হৈ হৈ করে সে এডগারের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। মিস মারপলকে নিয়ে যেতে সে এসেছে। ঝকমকে হেসে বলল তার নাম জিনা। ক্যারি লুইজি তার দিদা। মারপলের জলের ব্যাগের খুব প্রশংসা করল। তারপর তার কোট ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করল।

জিনার হঠাৎ আগমনে এডগার বেশ বিরক্ত। কিন্তু, জিনা তার রাগকে গুরুত্ব না দিয়েই মারপলের বাক্সটাক্সগুলো সব নিয়ে আসতে বলল তাকে।

মিস মারপলকে গাড়িতে বসিয়ে জিনা দ্রুত ড্রাইভ করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল।

মিস মারপল এডগারের কথা তুলতেই জিনা হেসে তার মাতব্বরি হাবভাবের কথা সম্বন্ধে বলতে লাগল।

মিস মারপল এডগারের সম্পর্কে জানতে চাইল কিন্তু জিনার মতে ওর কোনও দায়িত্ব নেই, সে একটা আস্ত পাগল। জিনার হাসিতে ঠাট্টার সঙ্গে নিষ্ঠুরতার ছোঁয়াও প্রকাশ পেল।

এডগার সম্বন্ধে পাগল কথাটা শুনে মিস মারপল বিস্মিত হল। জিনা বলে চলল, স্টোনিগেটসে প্রায় সকলেই পাগল। সে তার দিদা লিউইস বা বেলভাবকে বাদ দিয়ে আর যারা আছে তারা সবাই অস্বাভাবিক। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে জিনার নিজেরও কখনো কখনো পাগল পাগল লাগে নিজেকে। মিলড্রেড মাসিমা পর্যন্ত বেড়াতে বেড়াতে আপন মনে বকবক করেন।

গাড়ি খালি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। মারপলের দিকে তাকিয়ে জিনা বলে তার ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে, যে দিদার সঙ্গে ইনি এক স্কুলে পড়েছেন। আসলে মারপল জিনার মনের অবস্থাটা অনুমান করতে পারে। অল্পবয়সীদের পক্ষে ভাবা খুব মুস্কিল হয় যে বৃদ্ধরাও একদিন জোয়ান ছিল। ইস্কুল আর পড়াশুনো নিয়ে নাজেহাল হত।

জিনা সেই সূদুর অতীতের ছবি কল্পনা করতে চাইল। মারপল বলল, তাকে সেই বহুদিন আগেকার মানুষ বলে ভাবা গেলেও দিদার সম্পর্কে ভাবাটি কঠিন।

জিনা তার সঙ্গে একমত হয়ে বলল, সত্যিই তার দিদার বয়স একটা সময়ের পর আর বাড়েনি।

মারপল বলল, তার দিদার সঙ্গে বহু দিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না। হয়ত পরিবর্তন হয়েছে অনেক।

জিনা তার শরীরের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে লাগল। কোমরে বাতের যন্ত্রণার জন্য তাকে এখন লাঠি ব্যবহার করতে হয়। চুলে পাক ধরেছে।

স্টোনিগেটস সম্বন্ধে জিনার মন বিরূপ। পুরনো আমলের সব ঘরবাড়ি। হৈ চৈ করে দিন কেটে যায় অবশ্য। সবাই এখানে কাজ পাগল। ডাক্তারেরা সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চা অপরাধীগুলো খুব ভালো। একজন জিনাকে শিখিয়েছে কিভাবে টুকরো তার দিয়ে তালা খোলা যায়। আর একজন, দেবদূতের মত চেহারা যার সে শিখিয়েছে কিভাবে মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতে হয়।

এইসব খবর মিস মারপল মন দিয়ে শুনে নিল।

জিনা এইসব দস্যিগুলোকে খুব পছন্দ করে। তবে লিউইস বা ডঃ ম্যাডরিক মনে করে সকলে অস্বাভাবিক। কোনো না কোনও কারণে ছেলেগুলো বিগড়ে গেছে। একথা জিনা বিশ্বাস করে না। অনেক গণ্ডগোলওয়ালা বাড়ির ছেলেরাও তো ভবিষ্যতে নামটাম করে।

এইসব সমস্যার কথা বলতে বলতে দুজনে চলতে লাগল।

লিউইস অবশ্য এসব নিয়ে বিশেষ ভাবে না। কেউ কেউ আছে যারা প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে মানুষের উন্নতি করবেই। যেমন লিউইস।

মিঃ লোমন স্টেশনের সেই ছেলেটা সত্যিই সেরোকোল্ডের সহকারী কিনা মারপল জিনার কাছ থেকে জানতে চাইল।

জিনা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললো এই বোকাটা নাকি হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াতো, বড় বড় কথা বলে নিজেকে জাহির করাই তার কাজ। একেবারে বাজে লোক। এমন ভাব দেখায় যেন বাড়িরই একজন। ওই হয়ত একদিন তাদের সবাইকে খুন করে বসে থাকবে। বলে জিনা জোরে হেসে উঠল। মিস মারপল কিন্তু গম্ভীর হয়ে গেল।

মস্ত ফটক পেরিয়ে গাড়ি ভেতরে ঢুকলো। গেটের বাইরে জোরালো পাহারা। রাস্তার আশেপাশে অযত্নের ছাপ। জিনা মারপলের মনের কথা বুঝেই বলল, যুদ্ধের সময় মালী পাওয়া যায় না বলে তারা রাখেনি। তাই সব খারাপ হয়ে গেছে।

একটু বাঁক নিয়েই ভিক্টোরিয় গথিক ধরনের বাড়ির সামনে জিনা গাড়িটা দাঁড় করাল।

মারপল নেমে বারান্দায় উঠল। তারপর জেন মারপল আর ক্যারি লুইজি দুজনে একেবারে মুখোমুখি। ক্যারি বিশেষ বদলায়নি। এখনো বিনা প্রসাধনে তারুণ্য ধরে রাখতে পেরেছে। হাতে লাঠি মাথায় রূপালী ছাপ থাকলেও চোখে স্বপ্ন, মুখে সরলতা কত বছর বাদে জেনের সঙ্গে তার দেখা! এতদিন লুইজি আসতে বলেনি বলে ভুল স্বীকার করলো। সত্যিই সে এর জন্য দুঃখিত। বারান্দার অন্য প্রান্ত থেকে জিনা চেঁচিয়ে তার দিদাকে ঘরে আসতে বললো, নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে।

ক্যারি লুইজি মিষ্টি হেসে বললো, এইভাবে তার স্বাস্থ্য নিয়ে এরা সব সময় হৈ হৈ করে। তারও যে বয়স হয়েছে একথা কিছুতেই ভুলতে দেবে না। তাও মন মানতে চায় না বয়স হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা আলোচনা করে এই দুই পুরোনো বন্ধু খুব হাসতে লাগল।

দুজনে পাশাপাশি দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার মুখে এক বয়স্কা মুখে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে। খাড়া নাক, ছোট চুল।

কড়া গলায় মহিলাটি লুইজিকে এতক্ষণ ঠান্ডায় থাকার জন্য খুব বকাঝকা করলো।

লুইজি জলিকে না বকতে অনুনয় করল তারপর মিস মারপলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

এর নাম মিস বেলভার। লুইজির পাহারাদার বন্ধু সব।

জুলিয়েট বেলভার ভারী গলায় বললো, তার সাধ্যে যতটুকু কুলোয় ততটুকুইসে করে। এখানে কোনো নিয়মের বালাই নেই।

বড় বড় আবলুশ কাঠের আসবাবপত্রে ঘরটি সাজানো। জানলায় ভারী পর্দা, রঙটা কিছুটা ফিকে। মস্ত বড় বিছানা। এরই পাশাপাশি অত্যন্ত আধুনিক স্নানঘর।

মিস বেলভার তার ভার গলায় জানালো জন রেস্টারিক বাড়িতে দশটা স্নানঘর তৈরি করে ছিল কারাকে বিয়ে করার পর। বেলভার মারপলের কাছে জানতে চাইল, সে তাকে চেনে কিনা। উত্তরে মারপল জানাল মিসেস সেরাকোন্ডের সঙ্গে চিঠিতেই তাদের যোগাযোগ বেশি ছিল।

হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে মিস মারপল বেলভারকে দেখতে পেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বিশাল হলঘর পেরিয়ে তারা যেখানে এসে পৌঁছল সেখানে প্রচুর বই। জানলার বাইরে একটি হ্রদও চোখে পড়ল।

জানলার কাছে লুইজি দাঁড়িয়ে ছিল।

জেন তাকে বিস্ময় ভরা গলায় বলল, এই এত বড় বাড়িতে তার তো রীতিমত ভয় করছে, যদি হারিয়ে যায়।

লুইজি জানাল এক মস্ত বড় লৌহ ব্যবসায়ী বাড়িটা তৈরি করেছিল। একটা বাড়িতেই চোদ্দটা বসবার ঘর। প্রত্যেকটাই বিশাল বড়। লুইজি এই বাড়ির কোনও পরিবর্তন করেনি। এরিকের সঙ্গে এখানে আসবার পর থেকে প্রায় সব একই আছে। যেটুকু বদলানো হয়েছে তা বাড়ির বড় অংশটা-বড় হলঘর আর উপরের ঘরগুলো ভালো বলে ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে।

গাছের ফাঁক দিয়ে লাল ইটের তৈরি মস্ত একটা দালান দিয়ে জিনাকে হেঁটে আসতে দেখে মারপল হেসে বললো, জিনাকে দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে।

লুইজি বললো, যুদ্ধ শুরু হবার আগে ওকে সে আমেরিকায় রুথের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। জিনার বিয়ের ব্যাপারে রুথ খুব মুষড়ে পড়েছিল। রুথ বলেছিল ছেলেটি জিনার উপযুক্ত পাত্র নয়। যাইহোক জিনা এই বাড়িতে চলে আসার পর লুইজির ভালোই লাগে। কারণ এত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা মেয়ে বাড়িতে থাকলে বাড়ির চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়।

জানলার বাইরে সুপুরুষ যুবকটির সঙ্গে জিনাকে দেখতে পেয়ে মারপলের খুব ভালো লাগল। মারপলের ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়ে লুইজি বললো, ও হচ্ছে স্টিভ, জন রেস্টারিকের ছোট ছেলে। ও এখানেই থাকে। নাটক, থিয়েটারের সব দেখাশোনা করে।

জেন কিন্তু এত দূর থেকেও ওদের দুজনের হাবভাবের মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষ্য করল। লুইজিকে তার আভাস দিতেই সে একেবারে উড়িয়ে দিল কথাটা। কিন্তু মারপলের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই, সে স্থির নিশ্চিত স্টিভেন জিনার প্রেমে পড়েছে। মারপলের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা সবসময় প্রশংসা পেয়ে এসেছে। সে জানে যা একবার তার চোখে ধরা পড়ে তা ভুল হয় না।

.

০৪.

মিসেস সেরাকোল্ডের স্বামী হাতে কয়েকটা চিঠি নিয়ে হলঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

লিউইস সেরাকোল্ড ব্যক্তিত্বময় ছোটখাটো মানুষ। রুথের মতে সে একটা ডাইনামো ছাড়া আর কিছু নয়।

লিউইস লুইজিকে কিছুটা বিমর্ষ ভাবে বললেন, ওরা যা ভেবেছিলেন কিন্তু তা হয়নি, আবার দুষ্টুমী শুরু করেছে। আবার চুরি করতে আরম্ভ করেছে।

লুইজি মারপলের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিল। অন্যমনস্ক ভাবে পরিচয়টুকু সেরে ফেলে তিনি আবার পুরনো কথায় ফিরে এলেন। একটু পরে আবার কি মনে হতে অতিথির প্রতি মনোযোগ দিলেন।

মারপল যে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন একথা জানিয়ে তিনি আনন্দ প্রকাশ করলেন। তাকে অনেক থাকতে অনুরোধ করলেন, তাতে লুইজির মন ভালো হবে জানালেন।

লিউইস হাতের অন্যান্য চিঠি নিয়ে লুইজির সঙ্গে আলোচনা করতে লাগলেন। মারপলের দিকে ফিরে বললেন, এইসব ছেলেরা টাকার গুরুত্ব কিছু জানে না। তাদের শেখাতে হবে টাকার প্রকৃত রহস্য, প্রয়োজনীয়তা।

এরপর চায়ের ডাক পড়ল। জেনের হাত ধরে লুইজি হলঘরের দিকে নিয়ে গেল। যেখানে পরিচয় হল লুইজির মেয়ে মিলড্রেডের সঙ্গে। মোটা চেহারার এই মিলড্রেডের, সাদামাটা পয়সাওয়ালা চেহারা।

লুইজি এরপর জিনার স্বামী ওয়ালিরসঙ্গে আলাপ করাল। অপ্রসন্ন মুখে সে কেক চিবোচ্ছে।

একটু বাদে জিনা আর স্টিভেন রেস্টারিক এল। লিউইসের পাশে এডগার লোমন এসে বসল। জিনা কথা বলতে গেলে এমন ভাব করল যেন শুনতেই পাচ্ছে না। মারপলের কাছে সবটা কেমন বিভ্রান্তিকর লাগল।

নৈশাহারের সময় আরও কয়েকজনের সঙ্গে মারপলের দেখা হল। অল্পবয়সী ডাক্তার ম্যাডরিক, দুজন শিক্ষক আর খুব শান্ত তিনটি ছাত্র। জিনা ফিসফিস করে বলল, এদের মধ্যে যার নীল চোখ সেই লাঠিমারায় ওস্তাদ।

খাবারদাবার পরিবেশনে অযত্নের ছাপ। খাওয়ার শেষে যে যার কাজে চলে গেল, লুইজি আর মারপল পুরনো দিনের গল্প করতে লাগলো। এরমধ্যে এডগার একটু অস্থিরতা নিয়ে স্টেশনের কথাটা তুলল। সে যে খুব আঘাত পেয়েছে তার কথাতেই তা স্পষ্ট। কিছুটা উত্তেজিত।

লুইজি তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলল, জিনা ওই রকমই মেয়ে। এডগার যে গিয়েছিল তার জন্য লুইজি কৃতজ্ঞ, জিনা অপমান করতে যায়নি। যদিও এডগারের ধারণা তাকে। অপমানের জন্যই জিনা স্টেশনে গিয়েছিল। এডগার রেগেমেগে চলে গেল। ওর এই ব্যবহারে মিলড্রেড খুব বিরক্ত হল।

রাত্রে ঘরে বসে মারপল স্টোনিগেটসের মানুষদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে ভাবতে লাগলো। এখনো সম্পূর্ণ রূপটা বুঝতে পারেনি। প্রত্যেকের মধ্যে ঘটনার সংঘাত সমস্যা রয়েছে। এ ওকে পছন্দ করে না ও তাকে পছন্দ করে না। চাপা অসন্তোষ।

পিপপার মৃত্যুর পর মিলড্রেড এই বাড়ির এক মেয়ে হল। লুইজি জিনাকে স্টোনিগেটস থেকে নিয়ে আসার পর মিলড্রেড আড়ালে পড়ে গেল। পাদরী স্ট্রেটের সঙ্গে বিয়ে হল মিলড্রেডের তাদের কোনো সন্তান হয়নি। এতদিন বাদে সে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে। সত্যই সে সুখী কিনা বোঝা যায় না। লিউইসের নিজের কাজ ছাড়া অন্য দিকে মন নেই। অজানা কোনো স্রোতের কেন্দ্র বিন্দুতে লুইজি অবস্থান করছে। মারপলের মনেও একটা আশঙ্কা তৈরি হতে শুরু করল।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে এডগারের মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তার কোথাও যেন কোনো গণ্ডগোল রয়েছে। কিছুতেই যেন সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না।

.

০৫.

পরদিন সকালে লুইজিকে না জানিয়ে মারপল বাগানের দিকে গেল। অবহেলার চিহ্ন সবজায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। শাকসজীর বাগানটাতেই একটু যা যত্ন করার ফলে অনেক সবজী হয়েছে। টেনিস খেলবার জায়গাটি বেশ পরিচ্ছন্ন। এমন সময় এডগার এসে মারপলকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হল। মারপল তাড়াতাড়ি তাকে ডাকল। বাগান পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি কোথায় আছে সে দিতে পারবে কিনা মারপল তার কাছে জানতে চাইল। এডগারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাকে মন দিয়ে মারপল লক্ষ্য করতে লাগল। সে এতই সাধারণ যে তাকে দ্বিতীয়বার মনে রাখবার প্রয়োজন হয় না।

মারপল তাকে জিজ্ঞেস করলো মিঃ সেরাকোল্ড তার ওপর নির্ভর করেন কিনা। হয়তো নিশ্চয় করেন।

এডগার অন্যমস্ক হয়ে বললো তার সত্যই সে ব্যাপারে জানা নেই।

এরপর মারপলের কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে এডগার তার জীবনের কিছু গোপন কথা বলল। মারপলকে কথা দিতে হল সে কাউকে বলবে না। মিঃ সেরাকোন্ডই একমাত্র জানেন। বলে একটু হেসে সে জানালো, তার বাবা উইনস্টন চার্চিল।

মারপলের কাছে ব্যাপারটা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে গেল। এডগার বলে চলল তার কথা। তার মা স্বাধীন ছিলেন না, স্বামী পাগলা গারদে থাকায় বিবাহবিচ্ছেদের উপায় ছিল না। তাই ওদের দোষ দেওয়াও যায় না। এডগারের জন্য যতটা করবার তিনি করেছেন। যদিও খুব গোপন। আর এইখানেই যত গোলমাল।

কিছু শত্রু জুটে গেছে যারা তার বাবার কাছ থেকে তাকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছে। তারা সবসময় তাকে নজরবন্দী করে রেখেছে। সে যা কিছু করে তাতেই তারা বাদ সাধে। লণ্ডনে ডাক্তারি পড়বার সময় ওর উত্তরপত্রের উত্তরগুলো তারা সব বদলে দেয় সে ফেল করে। নানাভাবে ওরা ওর জীবনটাকে গণ্ডগোলে ভরিয়ে তুলতে শুরু করে। এখানেও সে নিরাপদ নয়। সবাই ওকে অপছন্দ করে। মিঃ সেরাকোল্ড ছাড়া।

এসব খুব গোপনীয় কথা, বলতে বলতে এডগার উঠে পড়ে, চলে যায়।

মিস মারপলের মাথায় নানা চিন্তা ঘোরে। ওর জন্য কষ্ট হয়। হঠাৎ কে বলে ওঠে পাগল, একেবারে মাথা খারাপ।

ওয়াল্টার কখন এসে দাঁড়িয়েছে মারপল লক্ষ্য করেনি।

ওয়াল্টার বলে সে বিশ্বাস করে না, লর্ড মন্টগোমারি এডগারের বাবা।

মারপল তার সঙ্গে একমত হয়।

ওয়াল্টার জানায় তার কথার কিছু ঠিক নেই। জিনাকে নাকি বলেছে রাশিয়ার রাজ সিং হাসনের উত্তরাধিকারী নাকি ওই। তার মতে এ বাড়ির সকলের মাথা খারাপ।

মারপল তাকে জিজ্ঞেস করে স্টোনিগেটসে কি তার থাকতে ভালো লাগছে না।

ওয়াল্টার এই পরিবেশটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এত বড়লোক হয়েও এরা কেন। এভাবে জীবনযাপন করে তার মাথায় ঢোকে না। ভালো চাকর বাকর নেই, জিনিসপত্র ভাঙা ছেঁড়া ফাটা তাই দিয়েই দিন চলছে। চারদিকে অপরিষ্কার। কারুর যেন কোনও হুঁশ নেই। টাকা পয়সার অভাব না থাকা সত্ত্বেও তালি দেওয়া নোংরা জামাকাপড় পড়ে।

ওয়াল্টারের হাতেও একেবারে পয়সা ছিল না। পরিশ্রম করে নিজের চেষ্টায় সে উন্নতি করেছে। জিনা আর ও দুজনকে পরস্পর পছন্দ করে বিয়ে করেছে। নিজেদের নিয়ে মেতে ছিল। মাঝখান থেকে বাদ সাধল জিনার একজন অহঙ্কারী কাকীমা। জিনা তার দিদিমার কাছে কদিনের জন্য ইংল্যাণ্ডে এল। সঙ্গে ওয়াল্টারও।

কিন্তু এখানে আসবার পর তাদের জোর করা হল বরাবরের জন্য থেকে যাওয়ার। এখানে নাকি অনেক কাজ আছে কারবার। কাজ বলতে সেই বিরক্তিকর বাচ্চাদের লজেন্স খাওয়ানো আর খেলানো। ওয়াল্টার এই একঘেঁয়ে কাজে কোনো আনন্দ পায় না। জিনাও কেমন যেন এখানে এসে পাল্টে গেছে। দুজনের মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল তার মৃত্যু হয়েছে।

মিস মারপল ওর কথা বুঝলেন। মারপলের সঙ্গে ওয়াল্টার নিজের এক কাকীমার খুব মিল পেল। মনের মধ্যে অত কথা জমে ছিল, অনায়াসে বলে ফেলল। তারপর সুন্দর হেসে সে মারপলকে বললো, সে যেন কিছু মনে না করে তাকে এত কথা বলে ফেলল বলে। তাকে খুব ভলো লাগল মারপলের।

মিলড্রেড ওয়াল্টারকে পছন্দ করে না। তাকে এদিকে আসতে দেখে ওয়াল্টার উঠে পড়ল।

ওই লোকটা বড্ড বিরক্ত করে তাই না! বলতে বলতে হাঁপাতে হাঁপাতে স্ট্রেট এসে ঘরে ঢুকল। তারপর জিনার বিয়েটা যে কতখানি মর্মান্তিক সেকথা বলতে লাগল। আমেরিকায় পাঠানোর জন্যই জিনার এমন দুর্ঘটনা হল।

মারপল বলল, কিন্তু শত্রুদের ভয়েতেই তো এই কাজ করতে হয়েছিল। মিসেস স্ট্রেট কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ওসব বাজে ভয়ের মানেই হয় না। মায়ের জন্যই আজ এই অবস্থা। এইসব উদ্ভট আদর্শের মধ্যেই স্ট্রেটকে বাস করতে হয়।

মারপল চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল সে মনে করে, স্ট্রেটের ছোটবেলাটা বোধহয় খুব একটা সুখের হয়নি।

মিলড্রেড কৃতজ্ঞতা নিয়ে বলল, যাক একজন তাহলে বুঝেছে। তার পাশাপাশি সুন্দরী পিপাও বড় হয়ে উঠতে থাকায় তাকে যে খুব একটা ভালো থাকতে দেয়নি কেউ, এর জন্য ছেলেমেয়েরা যে কত কষ্ট সহ্য করে তা বলবার নয়। বোনের দিকেই সবার নজর ছিল। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না। অথচ পিপপার জন্মের কোনো ঠিকানা ছিল না। জিনাকে দেখলেই বোঝা যায় খারাপ রক্ত ওর মধ্যেও বয়ে চলেছে।

মারপল এই সময় জিনাকে যে তার পছন্দ হয়েছে সেকথা বুঝিয়ে দিল।

কিন্তু স্ট্রেট ভোলবার পাত্রী নয়। স্টিভেন রেস্টারিককে নিয়ে যা কাণ্ড করে চলেছে জিনা তাই নিয়ে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। এত টাকাকড়ি থাকা সত্ত্বেও বাড়ির এই দশা কেন সে বুঝতে পারে না। সব মিলিয়ে তার মনে খুব অসন্তোষ। মিলড্রেডের বাবা এই বাড়িতে বাস করে গেছে বলে তারও অধিকার আছে এখানে থাকবার।

বেলভারের সম্বন্ধে মারপল জানতে চাইল।

মিলড্রেড বলল, তার মাকে ও খুব ভালোবাসে। ও অনেকদিন হল এখানে রয়েছে। মায়ের বিপদের সময় পাশে থেকে বেলভার অনেক সাহায্য করেছে। ওকে ছাড়া মার চলে না।

এমন সময় লিউইস এসে ঘরে ঢুকলেন। মিলড্রেডকে লক্ষ্যই করলেন না।

তিনি এসে মারপলের কাছে দুঃখপ্রকাশ করলেন, প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখাতে না পারার জন্য। তাকে এখন লিভারপুল যেতে হবে। তবে ডঃ ম্যাডরিক একটু বাদে এসেই ঘোরাতে নিয়ে যাবে।

ইতিমধ্যে স্ট্রেট উঠে গেল, লিউইস খেয়ালও করলেন না।

মারপল এডগারের সম্বন্ধে লিউইসকে জিজ্ঞেস করল, তার স্বাভাবিকতা সম্বন্ধে জানতে চাইল। লিউইস বললেন, এডগার অবৈধ সন্তান। মা ভালো ঘরের মেয়ে, বাবা নাবিক, ছেলেবেলাটা তার ভালো কাটে না। নিজের সম্বন্ধে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প বানিয়ে লোককে বলে। ডঃ ম্যাডরিক ওকে দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। ওকে বোঝানো হচ্ছে জন্মটা বড় নয়, মানুষ নিজেকে কিভাবে গড়ে তুলছে সেটাই বড় কথা।

এডগার বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে কিনা মারপল জানতে চাইল। অর্থাৎ শত্রুরা ওকে নির্যাতন করে এসব কথা কি কোনও ইঙ্গিত বহন করছে!

লিউইস এই ব্যাপারটা খুব একটা ভয়ের বলে মনে করেন না।

মিঃ সেরাকোল্ড ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিদায় নিলেন।

মিস বেলভার ঘরে ঢুকে বললো, কবে হয়তো একদিন লোকটা কাজ করতে করতে মুখ থুবড়ে পড়বে। কাজ পাগল মানুষ। স্ত্রীর কথাও একটু ভাবে না।

দুজনে বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা তোরণের কাছে এসে দাঁড়াল। গুলব্রাজেন এটা তৈরি করেন।

ডঃ ম্যাডরিক এলেন। তাকেও মিস মারপলের প্রকৃতস্থ বলে মনে হল না।

মিস মারপলকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটু অসংলগ্ন ভাবেই বলে যেতে লাগলেন তাদের ভবিষ্যৎ উদ্যোগ, সেরাকোল্ড মানুষ হিসেবে কত মহৎ বর্তমান চিকিৎসা শাস্ত্রের সমস্যা ইত্যাদি। ছেলেদেরকে শাস্তি না দিয়ে তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করাই তার উদ্দেশ্য।

মারপল এডগার লোমনের কথা তুলল। তাকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে একথাও জানাল। ডঃ ম্যাডরিক হেসে বললেন মানুষ মাত্রেই কিছুটা অস্বাভাবিক।

.

০৬.

দিনান্তে কিছুটা ক্লান্তি এল মারপলের। একটা বাড়িকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু ঘটে চলেছে কিন্তু কোনো ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে না। লোমনের মধ্যে অসঙ্গতি আছে ঠিকই কিন্তু লুইজির সঙ্গে তার কি সম্পর্ক বুঝতে পারছে না সে।

হঠাৎ মারপলের মনে হল ক্যারি লুইজি নামটা রুথ আর সে ছাড়া কেউ ব্যবহার করে না। স্বামীর কাছে ক্যারলিন, বেলভারের কাছে কারা, রেস্টারিওর কাছে মা, ওয়ালির কাছে মিসেস সেরাকোল্ড আর জিনার কাছে দিদা।

এই বিভিন্ন নাম দেওয়ার অর্থ কি? হতে পারে মারপলের মাথায় ঘুরতে লাগল।

পরদিন সকালে লুইজি মারপলকে চিন্তিত মুখে থাকতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞেস করল।

মারপল সঙ্গে সঙ্গে বলল সে লুইজির কথাই ভাবছে। সে তার কাছ থেকে জানতে চাইল একটা সত্যি কথা–এখানে দুশ্চিন্তা করবার মত তার কিছু আছে কিনা।

লুইজি তার কথা শুনে বিস্মিত হল।

মারপল নানাভাবে কথাটা জানতে চাইল।

লুইজি অন্যমনস্ক হয়েই কিছুটা বলল, তার চিন্তা লিউইসকে নিয়ে সে বড্ড পরিশ্রম করে। স্টিভেনটার খেতে মনে থাকে না। জিনা বড় ছটফটে।

মারপল মিলড্রেডের কথা জানতে চাইল।

লুইজি জানাল, মিলড্রেড কখনোই হাসিখুশি থাকে না। পিপার একেবারে উল্টো স্বভাবের।

মারপল বলল, তার তো অসুখী হবার কারণ থাকতেও পারে।

লুইজি জবাব দিল, মেজাজ দেখানোর জন্য বেশির ভাগ মানুষেরই কারণের প্রয়োজন হয় না।

লুইজির সঙ্গে মারপল একমত হল। লুইজি জানাল বেলভারের জন্য কোনো বিষয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। তার হাতে সব ভার দিয়ে সে একেবারে নিশ্চিন্ত। বেলভার তার জন্য সব কিছু করতে পারে। সে চায় লুইজি সবসময় দামী পোষাক পরিচ্ছদে নিজেকে সাজিয়ে রাখুক। লিউইসের কাজের ব্যাপারে তার কোনও উৎসাহ নেই।

এমন সময় মিসেস বেলভার এসে একটা টেলিগ্রাম লুইজির হাতে দিল, ক্রিস্টিয়ান গুলব্রাজেন আজ বিকেলে এসে পৌঁছবেন খবর পাঠিয়েছেন।

লুইজি শুনে একটু অবাক হল। তারপর বেলভারকে সব ব্যবস্থা করতে বলল।

লুইজি ক্রিস্টিয়ান সম্বন্ধে বলল, সে ওদের সৎ ছেলে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান আছে ও। এইসময়ই লিউইস এখানে নেই, ক্রিস্টিয়ান খুব ব্যস্ত মানুষ বলে এক রাতের বেশি থাকতেও পারবে না।

বিকেলে ক্রিস্টিয়ান এসে পৌঁছল। স্বাস্থ্যবান মানুষ। ধীরস্থির যুক্তিসম্পন্ন কথা বলে। লুইজি আর মিলড্রেডের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। ক্রিস্টিয়ান আর মিলড্রেডের মধ্যে চেহারার খুব মিল।

জিনা এখানে এখনো রয়েছে দেখে ক্রিস্টিয়ান কৌতুক করল। ওয়ালি তার কথার ধরনে বিরক্ত হল।

মারপল ক্রিস্টিয়ানের উচ্ছলতার চিন্তামগ্ন মনটাকে লক্ষ্য করল। তার সঙ্গেও ক্রিস্টিয়ানের আলাপ হল।

লিউইস কবে ফিরবেন জেনে নিয়ে ক্রিস্টিয়ান লুইজিকে বলল যে, তাকে লিউইসের সঙ্গে দেখা করেই যেতে হবে।

সবাই ধরে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজের ব্যাপারেই ক্রিস্টিয়ান এখানে এসেছে। মিস মারপলের চোখে কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার নজরে পড়ল। সে লক্ষ্য করল ক্রিস্টিয়ান বারবার লুইজির দিকে তাকাচ্ছে, দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা।

চা-পানের শেষে মারপল লাইব্রেরীতে এসে বসল। তাকে অবাক করে দিয়ে ক্রিস্টিয়ান এসে তার কাছে বসল। তারপর মারপলের সম্বন্ধে একটু জেনে নিয়ে তাকে প্রশ্ন করল লুইজিকে সে কেমন ভালোবাসে।

মারপল তাকে সত্যিই ভালোবাসে জানার পর বলতে লাগল, সবাই লুইজিকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু সে জানে না পৃথিবীটা আসলে পাপে ভরা।

মারপল এসব শুনে বিস্মিত হল। ক্রিস্টিয়ান তাকে লুইজির শরীর সংক্রান্ত খবরগুলো বেশ সন্দেহের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ধারালো চোখে জেনে নিতে চাইল লুউজির সঙ্গে মিলড্রেড আর বেলভারের সম্পর্ক কেমন। জিনাকে নিয়েও সে কেমন যেন চিন্তিত। একমনে সে এমন কিছু অসংলগ্ন কথা বলে যেতে লাগল যা শুনে মারপলের মনে হল আসন্ন কোনো বিপদের গন্ধ সে যেন পেয়েছে তাই সে লুইজি সম্বন্ধে বেশ চিন্তিত।

এমন সময় মিস স্ট্রেট ঘরে এসে ক্রিস্টিয়ানকে এখানে থাকতে দেখে অবাক হল। ডঃ ম্যাডরিকের সঙ্গে কোনো দরকার আছে কিনা তিনি জানতে চেয়েছেন।

ক্রিস্টিয়ান জানালো যা কথা বলবার লিউইস আসবার পরই হবে। তারপর কি মনে হতে ক্রিস্টিয়ান ডঃ ম্যাডরিকের উদ্দেশে বেরিয়ে গেল।

ক্রিস্টিয়ানের হঠাৎ চলে যাওয়াতে মিলড্রেড অবাক হল। মারপলের সঙ্গে এতক্ষণ কি কথা বলছিল জানতে চাইল। মারপল বেশ সরলভাবে সব বলল, মিলড্রেড জানালো লুইজির শরীর ভালোই আছে তাকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণই নেই।

.

০৭.

পরদিন দুপুর অব্দি নির্বিঘ্নে কাটল। মারপল লক্ষ্য করল বিকেল বেলা বেলভারকে নিয়ে ক্রিস্টিয়ান বাগানের দিকে গেল। নিশ্চয়ই কোনো আলোচনা হবে। অথচ সেরাকোল্ডের সঙ্গে কাজের কথা বলতেই তো তার আসা।

বিকেল চারটে নাগাদ মারপল বাগানে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ চমকে দেখে একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে এডগার বেরিয়ে এলো।

আপন মনে সে বিড়বিড় করছে চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি।

মারপল অবাক হয়ে তার কাছে এই অবস্থার কারণ জানতে চাইল।

হাঁটতে হাঁটতে এডগার জানাল, সে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করেছে। তার গলা ধরে এল। যাকে সে বিশ্বাস করে এসেছে আজ সেই তার শত্রু। ওর পেছনে চর লাগিয়েছে। এর কারণ কি সে তাকে জিজ্ঞেস করবে।

মারপল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল এসব কথা সে কার সম্বন্ধে বলছে।

এডগার বলল যে তার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, বলতে বলতে পালিয়ে গেল। মারপল এসবের কোনো অর্থ বুঝতে পারল না।

সাড়ে ছটা নাগাদ লিউইস ফিরলেন তারপর ক্রিস্টিয়ানের সঙ্গে বারান্দায় পায়চারী করতে করতে কথা বলতে লাগলেন।

মিস মারপল দূরবীনে চোখ রাখলেন। দুটো চিন্তাচ্ছন্ন মুখচ্ছবি ভেসে উঠল।

ওদের টুকরো কথাবার্তা যেটুকু কানে এল তাতে মারপল বুঝতে পারলেন লুইজির কাছ থেকে ওরা কোনো ব্যাপার গোপন করতে চাইছে। রুথ যে ভুল বলেনি মারপল সেটা বুঝতে পারল। স্টোনিগেটসে যে বিপদ ঘনিয়ে উঠেছে তার ধাক্কা লুইজির গায়ে এবার লাগবে।

নৈশাহার তেমন জমল না। সবাই কেমন চুপচাপ। খাওয়া শেষ করেই ক্রিস্টিয়ান নিজের ঘরে চলে গেল।

অন্যেরাও যে যার কাজে ব্যস্ত হল। বই পড়বার জন্য ওয়ালার একটা টেবিল ল্যাম্পের বোতাম টিপতেই হলঘরের অর্ধেক আলো নিভে গেল।

সে বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে সারানোর ব্যবস্থা করতে গেল।

বেলভারের হঠাৎ মনে হল লুইজি ওষুধ খায়নি। সে তাড়াতাড়ি ওষুধটা নিয়ে এল।

হঠাই লিউইস বলে উঠলেন ওষুধটা আজ আর তাকে খেতে হবে না, ওটা তার পক্ষে উপকারী নাও হতে পারে। তিনি গ্লাসটা নিয়ে পাশে রেখে দিলেন। বেলভার বেশ বিরক্ত হল।

হঠাৎ সামনের দরজাটা খুলে এডগার এসে প্রবেশ করল। তারপর চাপা আক্রোশ নিয়ে লিউইসের দিকে এগিয়ে এল।

লিউইস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তার কি হয়েছে।

এডগার ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, সে তাকে এতদিন ঠকিয়েছে। তার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

লিউইস এডগারের হাত ধরে শান্ত হতে বললেন। তারপর তাকে অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন। সশব্দে দরজা বন্ধ হল। বেলভার আর মারপল দুজনেই বুঝতে পারল এডগার লিউইসকে তালাবন্দী করল।

মিস বেলভার, মিলড্রেড এডগারের এই পাগলামীতে অত্যন্ত বিরক্ত হল। লুইজির প্রশ্রয়কেই মিলড্রেড এর জন্য দায়ী করল।

লুইজি তার সম্বন্ধে বললো ও সত্যিই খুব ভালো ছেলে।

এডগার এতক্ষণ যা ব্যবহার করেছে তারপরেও লুইজির এই মন্তব্য শুনে মারপল অবাক হল।

জিনা বলল সে লক্ষ্য করেছে এডগারের পকেটে কিছু একটা নাড়াচাড়া করছিল।

ওদিকে লিউইস আর এডগারের চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছিল।

এডগার বলে যাচ্ছিল, সে জানে লিউইসই তার বাবা। তাকে বঞ্চিত করাই তার লক্ষ্য। তাকে সে ঘৃণা করে।

লিউইস ঠান্ডা গলায় কি যেন বলল। এডগারকে থামাতে গিয়ে উল্টো ফল হল, এডগার আরও বেশি চীৎকার করতে লাগল।

হঠাৎ সবার কানে এল লিউইস এডগারকে রিভলবার নামাতে বলছে।

জিনা ভয়ে চীৎকার করে উঠল।

লুইজি এরপরও বললো এটা এডগারের অভিনয় ছাড়া আর কিছু নয়। সে লিউইসকে ভালোবাসে।

এডগারের হাসির শব্দে মারপলের মনে হল সে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।

হঠাৎ বন্দুকের শব্দ। লুইজি বললো ওটা বাইরে থেকে এসেছে। ভয়ের কারণ নেই।

এডগার চীৎকার করে বললো সে লিউইসের এই নির্ভীক চোখ দুটোকে ভয় পায় না। সে তাকে আজ শেষ করবেই। বাবা হয়েও সে পরিচয় গোপন করেছে। আজ আর রেহাই নেই।

কিছু একটা করতে হবে বলতে বলতে মিস বেলভার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আবার গুলির শব্দ।

মিলড্রেড কেঁদে উঠল। ধপাস করে একটা শব্দ ভেসে এল।

রেস্টারিক দরজা খোলার জন্য চীৎকার করতে লাগল।

বেলভার একগোছা চাবি নিয়ে এল কোনটা দিয়ে তালা খোলা যায় দেখতে।

এমন সময় আলো জ্বলে উঠল। স্টিভেন তালা খুলতে চেষ্টা করল। ঘরে পাগলের কান্না।

ওয়ালটার এসব দেখে অবাক হল। মিলড্রেড তাকে জানালো ঐ পাগলটা মিঃ সেরাকোল্ডকে গুলি করেছে।

লুইজি তার এই কথা শুনে বিরক্ত হল। উঠে গিয়ে সে বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে এডগারকে ডাকতে লাগল। এমন সময় দরজা খুলে গেল।

লিউইস স্বয়ং দরজা খুললেন। তাকে একটুও বিচলিত দেখালো না। সবাইকে চিন্তিত দেখে তিনি কোনো গুরুত্ব না দিয়েই ডঃ ম্যাডরিকের খোঁজ করতে লাগলেন।

বেলভার পুলিসে খবর দিতে হবে কিনা জানতে চাওয়াতে, ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই বলে সেরাকোল্ড জানালেন।

সেইসময় এডগারকে দেখে মনে হল না ভয়ের কিছু আছে। সে বেশ অনুতাপের সুরেই ক্ষমা প্রার্থনা করল। তার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নেই বলেই জানাল। ওয়ালটার দেখে শুনে লিউইসকে বলল তিনি খুব অল্পের জন্যই বেঁচে গেছেন।

মিস মারপল এই সুযোগে এডগারকে জিজ্ঞেস করলো তার মাথায় কে ঢুকিয়েছে যে লিউইস তার বাবা।

এডগার একটু থতমত খেয়ে জানালো কেউ নয়।

ওয়ালটার তার বন্দুকটা দেখতে পেয়ে খুব চটে গেল।

সেরাকোল্ড বাধা দিয়ে ম্যাডরিককে বললেন এডগারকে পরীক্ষা করতে।

মিলড্রেড চীৎকার করে এডগারের ওপর তার রাগ প্রকাশ করছিল।

এডগার লিউইসের পা ধরে অনুরোধ করলে তাকে যেন পাগলা গারদে না পোরা হয়।

ডঃ ম্যাডরিক এডগারকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যেতে বললেন।

মিস বেলভার মুখচোখ কঠিন করে হলঘরে এসে ঢুকলো। তারপর জানালো সে পুলিসকে খবর দিয়েছে আসার জন্য।

শুনে লুইজি ধমকে উঠল।

এডগার আর্তনাদ করে উঠল। লিউইস বিরক্ত হল, তাকে বারণ করা সত্ত্বেও সে এই কাজ করেছে শুনে।

মিস বেলভার ঠান্ডা গলায় জবাব দিল পুলিস না ডেকে তার উপায় নেই। ক্রিস্টিয়ানকে কেউ গুলি করে মেরে রেখে গেছে।

.

০৮.

কথাটা বুঝতে সবাই খানিকটা সময় নিল।

লুইজি বিস্মিত হল। তাকে থামিয়ে লিউইস দরজার দিকে পা বাড়ালেন। ম্যাডরিক বেলভার সবাই সঙ্গে সঙ্গে গেল।

মারপল লুইজিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। সে যেন কিছুতেই কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। মুখচোখ বিহ্বল।

ওয়ালটার রিভলবার হাতে এডগারের দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো।

কিন্তু লুইজি তাকে মিথ্যে সন্দেহ করতে বারণ করল।

জিনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে।

আচমকা দরজা খুলে ঘরে যে প্রবেশ করল তাকে দেখে মিস মারপল চমকে উঠল। স্টিভেনের সঙ্গে চেহারার অসম্ভব মিল। ছেলেটির মুখে বুদ্ধি আর আত্মবিশ্বাস মাখা।

বোঝা গেল এর আসবার খবর সবার জানা। এতক্ষণ যা কাণ্ড ঘটেছে অ্যালেক্সকে মিলড্রেড এমনভাবে সেকথা বলতে শুরু করল মিস মারপলের সেটা ভালো লাগল না।

অ্যালেক্স প্রথমে এটা আত্মহত্যা বলে সন্দেহ প্রকাশ করল। মিস মারপলকে দেখে সে একটু অবাক হল।

এমন সময় বেলভার এসে জানালো সেরাকোল্ড সকলকে লাইব্রেরীতে বসতে অনুরোধ করছে। এতে পুলিসের পক্ষে সুবিধা হবে। সে লুইজিকে যেতে বারণ করল। লুইজি ক্রিস্টিয়ানকে একবার দেখতে চাইল। জলি বাধা দিলে সে শুনল না, মারপলকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে দরজার দিকে এগোল।

দুজনে বারান্দায় বেরিয়ে ওক সুইটের দিকে হাঁটতে লাগল। এখানেই ক্রিস্টিয়ানকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। লুইজি দরজার সামনে দাঁড়াল। ডেস্কে টাইপরাইটারের সামনে বসে। চেয়ারের ওপর হেলে পড়েছে শরীরটা। উঁচু হাতল আছে বলে পড়েনি।

লিউইস ক্যারির কাছে এগিয়ে এলেন। লুইজি এটাকে আত্মহত্যা নয় খুন বলেই মনে করলো। ক্রিস্টিয়ানকে দেখে লুইজির মুখে বেদনার ছায়া নামল। আত্মার শান্তি কামনা করল।

লিউইসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লুইজি বেরিয়ে এল। মারপল একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল।

.

০৯.

ইনসপেক্টর ক্যারি তার দলকে নিয়ে পৌঁছলেন, বেলভার অভ্যর্থনা জানালো। নিজের পরিচয় দিয়ে বেলভার তাদের নিয়ে গেল।

পুলিস তার কাজ শুরু করল, ছবি তোলা হল। তারপর সব পরীক্ষা করে অ্যামবুলেন্স আনিয়ে দেহটা পাঠিয়ে দেওয়া হল। ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।

ইনসপেক্টর সকলকে দেখে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, এই অবস্থায় তারা হয়তো সকলে খুব বিচলিত। আজ তাদের বেশিক্ষণ আটকাবেন না। মিঃ সেরাকোল্ডের কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু জেনে নিলেন।

মিস বেলভার এডগার আর সেরাকোল্ডের ঘটনার কথা জানিয়ে বললো, সেরাকোল্ডের কথা মত ডঃ ম্যাডরিককে ডাকার পর কিছু দরকার আছে কিনা জানার জন্য ক্রিস্টিয়ানের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে সে মরে পড়ে আছে।

ইনসপেক্টর বাড়িতে ঢোকা বেরোনোর ব্যবস্থা কিরকম সে সম্বন্ধে বিশদ জানলেন। এখানকার প্রতিষ্ঠানের কথা দরজায় পাহারা থাকে কিনা সে সম্বন্ধে জানলেন, ক্রিস্টিয়ানের আসার কারণ কি এবং যার সঙ্গে দরকার তার সঙ্গে কথা না বলে ঘর থেকে চলে গেছেন শুনে একটু অবাক হলেন।

ঘটনার সময়টা নটা বেজে তেইশ মিনিট নাগাদ হবে। গুলির আওয়াজটা এডগারদের ঘর থেকে হয়নি একথা মনে করলেও বাড়িরই অন্য কোনো অংশ থেকে হয়েছে একথা কেউ সেই সময় বিশ্বাস করতে পারেনি– বেলভার জানালো, বাড়িতে একটা খুন আর একটা খুনের চেষ্টা দুটো একই সঙ্গে হচ্ছে একথা কেউ ভাবতেই পারেনি।

ইনসপেক্টর প্রশ্ন করলেন ঘরের কোনো জিনিস তারপর সরানো হয়েছে কিনা।

বেলভার একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দিল। পরের বার সে টাইপরাইটারের ওপর কাগজটাকে দেখতে পায়নি।

ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন তারা আসবার আগে আর কে ঘরে ঢুকেছিল, উত্তরে বেলভার মিসেস সেরাকোল্ড ও মিস মারপলের নাম করলো।

মিস মারপলের সঙ্গে পরিচিত হবার পর ইনসপেক্টর বিনীত হয়ে সেদিনের সন্ধ্যার ঘটনার কথা জানতে চাইলেন। তারপর তারা একসঙ্গে মৃতদেহ দেখতে ঘরে ঢুকেছিলো সেকথা শুনলেন। ইনসপেক্টরের প্রশ্নের জবাবে মারপল জানাল সে টাইপরাইটারের ওপর কোনো কাগজ দেখতে পায়নি। এটা তাকে বিস্মিত করেছিল।

মারপলের সঙ্গে ক্রিস্টিয়ানের কি কথা হয়েছিল ক্যারি শুনলেন। ক্রিস্টিয়ানের সঙ্গে সেরাকোল্ডের কথাবার্তা হয়েছিল সে খবর মারপল ইনসপেক্টরকে দিলেন। জানলা দিয়ে তিনি পাখি দেখছিলেন। দু-একটা কথা কানে এসেছিল ইনসপেক্টর বরং সে সব কথা মিঃ সেরাকোল্ডকে জিজ্ঞাসা করলেই ভালো করবেন।

এছাড়া আর কিছু অদ্ভুত ঘটনা মারপলের চোখে পড়েছে কিনা ক্যারি জানতে চাইলে মারপল জবাব দিল, সন্ধ্যেবেলার সব ঘটনাই অদ্ভুত। মারপলের হঠাৎ মনে পড়ে যেতে সে বললো মিঃ সেরাকোল্ড আজ সন্ধ্যায় তার স্ত্রীকে ওষুধ খেতে দেননি।

বেলভার বিরক্ত হয়েছিল। মারপল চলে যাবার পর সার্জেন্ট লেক তার প্রশংসা না করে পারল না।

.

১০.

লিউইস সেরাকোল্ড ঘরে প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি তার ওপর পড়ল। ক্লান্ত ও বিষণ্ণ পায়ে তিনি এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলেন। লিউইসের নিকট আত্মীয় নয় গুলব্রাজেন। তাই তাঁর এতখানি বিষণ্ণতা ক্যারিকে একটু বিস্মিত করেছিল।

ইনসপেক্টর তাকে প্রশ্ন করলেন ক্রিস্টিয়ানের আসা সম্বন্ধে তিনি কি একেবারেই কিছু জানতেন না। ক্রিস্টিয়ানের আসবার কারণ জানতে চাইলেন।

একটু চুপ করে থেকে লিউইস বললেন, ক্রিস্টিয়ান বছরে দুবার মিটিং করতে আসত। মাত্র একমাস আগেই সে ঘুরে গেছে। তাই সে আসায় সবাই একটু অবাকই হয়েছিল।

লিউইস বললেন, তার কথাগুলো যদি তার স্ত্রীকে না বলা হয় তবে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন। ক্রিস্টিয়ান এসেছিল তাকে একটু জানাতে যে, কেউ তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে মারবার চেষ্টায় আছে।

শুনে ক্যারি অবাক হয়ে গেলেন।

ক্রিস্টিয়ান কথাটা বলবার পর তিনি লক্ষ্য করলেন, বাতের ব্যথা বলে স্ত্রী যা কষ্ট পাচ্ছিলেন তা আর্সেনিক বিষ খাবার ফলে হতে পারে।

এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করার সুযোগ পাননি তারা, ভেবেছিলেন নিশ্চিত হয়ে লুইজিকে জানাবেন।

ক্যারি জিজ্ঞাসা করলেন, ক্রিস্টিয়ান কাউকে সন্দেহ করেছিল কিনা।

লিউইস জানালেন, হয়তো করেছিলেন। নইলে খুন হবেন কেন। তবে কারোর নাম বলেনি। তবে তারা ঠিক করেছিলেন পরিবারের পুরনো বিচক্ষণ বন্ধু ক্রোমারের বিশপ ডঃ গ্যালব্রেথকে সব জানাবেন। ওনার কথামত কাজ হবে। তাই খাওয়া দাওয়ার শেষে ক্রিস্টিয়ান ডঃ গ্যালব্ৰেথকে একটা চিঠি লিখতে বসেছিলেন। সেই সময় কেউ তাকে গুলি করে মারে।

প্রমাণ হিসেবে লিউইস বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা চিঠিটা বের করে দেখালেন।

ক্যারি বেশ রাগত স্বরেই জানালেন যে তার এই কাজটা করা অন্যায় হয়েছে।

লিউইস জানালেন অকারণে তিনি একাজ করেননি। তিনি জানতেন তার স্ত্রী ঐ ঘরে যাবেন তাই তিনি সেটা সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি যাতে আঘাত না পান তার জন্য লিউইস সব করতে রাজী।

কোনো কথা না বলে ইনসপেক্টর চিঠিতে চোখ রাখলেন, সেখানে ডঃ গ্যালব্ৰেথকে পত্রপাঠ স্টোনিগেটসে চলে আসতে অনুরোধ করা হয়েছে। এখানে একটা বিপদ দেখা দিয়েছে। উনি লুইজির হিতাকাঙ্খী, এই ভালোমানুষ লুইজিকে অল্প অল্প করে বিষ খাওয়ানো হচ্ছে। প্রথম কখন সন্দেহ হয় সেকথা জানাতে গিয়েই চিঠিটা অসমাপ্ত হয়েছে। এর পরই তাকে গুলি করা হয়। লিউইসের মতে হত্যাকারী চিঠির তাৎপর্য জানত না বা সরাবার সময় পায়নি বলে সরায়নি।

গুলব্রাজেন লিউইসকে সেই সন্দেহ জনক ব্যক্তিটির নাম বলেছে কিনা ইনসপেক্টর জানতে চাইলেন। লিউইস একটু থেমে অস্বীকার করলেন তারপর হঠাৎই বলে উঠলেন যে ক্রিস্টিয়ান মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ ছিল।

ক্যারি জিজ্ঞেস করলেন তিনি কিভাবে বুঝলেন বিষটা মেশানো হচ্ছে। উত্তর লিউইস জানালো সবাই যা খায় উনিও তাই খান শুধু ওষুধটাই আলাদা।

ক্যারি ওষুধটা পরীক্ষা করতে চাইলেন। লিউইস বেশ চটজলদি সেটা আনবার জন্য উদ্যোগী হল। যা দেখে ক্যারি একটু অবাকই হলেন। যেন লিউইস আগে থেকেই জানেন ক্যারি তাকে কি বলবেন।

লিউইস লুইজির কাছ থেকে ব্যাপারটা কেন গোপন রাখতে চাইছেন সেকথা জানার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ইনসপেক্টর। তাকে তো বরং সজাগ করে দেওয়াই উচিত ছিল।

লিউইস জানালেন, লুইজি অন্য ধাতের মানুষ। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবেন না। কেউ তাকে মেরে ফেলতে পারে।

লিউইস এতদূর ভেবে ফেলেছেন দেখে ইনসপেক্টর বিস্মিত হলেন।

লিউইস সত্যকে অস্বীকার করতে চান না, তিনি বললেন এখানকার দুশো লোকের অতীত ভালো নয়, তা সত্ত্বেও তারা মতলব করে বিষ খাওয়াতে পারবে না, কোনোদিন। তাহলে বাড়ির লোকদের মধ্যেই কেউ হবে।

ধীর স্বরে ক্যারি বললেন, বাইরের লোকও তো কেউ কেউ আছেন।

লিউইস সে কথায় সম্মতি জানিয়ে বললেন, তাতে তাদের কি স্বার্থ থাকতে পারে?

ক্যারি লোমনের কথা তুললেন।

লিউইস বললেন, ও ক্যারিলিনের ভক্ত। ও কোনও ক্ষতি করতে পারে না। আর সন্ধ্যায় যা করেছে তা নিতান্তই অভিনয়।

ক্যারি জানতে চাইলেন, এই সাংঘাতিক অভিনয়ের জন্য ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হবে কিনা।

লিউইস জানালেন, তার প্রয়োজন নেই। নির্দ্বিধায় বলা যায় ও নিরপরাধী।

ক্যারি জানতে চাইলেন ক্রিস্টিয়ান ধনী ছিলেন কিনা। তাহলে ওর মৃত্যুতে নিকট আত্মীয়েরা লাভবান হবে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে এ বাড়ির কেউই হত্যাকারীর ভূমিকা নিয়েছে। লিউইস কাউকে সন্দেহ করেন কিনা তিনি জানতে চাইলেন।

লিউইস জানালেন সেকথা বলা খুব কঠিন। তা যে কেউ হতে পারে। ক্রিস্টিয়ান যাওয়ার পর কেবলমাত্র ওয়ালটার হাড় বেরিয়েছিল। তবে এডগার আর তিনি বেরিয়ে পরার পর আর কে কে বেরিয়েছিল তা তার অজানা।

ইনসপেক্টর সেদিনকার মত সবাইকে শুতে যেতে বলে বিদায় দিলেন।

মিঃ সেরাকোল্ড বেরিয়ে যেতে ক্যারি লেককে জিজ্ঞাসা করলেন তার কাকে খুনী মনে হয়।

লেক জবাব দেয় তার সন্দেহ সেরাকোল্ড জানেন কে খুনী। ক্যারি তার সঙ্গে একমত হন।

২. পুলিসের লোকেরা এসেছে

১১.

পরদিন সকালে খেতে বসে জিনা বললো, পুলিসের লোকেরা আবার এসেছে। ওয়ালি ওদের ধীরস্থির ভাব দেখে খুব অবাক হয়েছে।

ওর কথা শুনে মিস মারপল হাসল! অ্যালেক্স আর স্টিভেন নির্বিকার চিত্তে খাচ্ছিল। জিনা মারপলকে দেখাল ওদের ওই ভাবলেশহীনতা।

অ্যালেক্স জানান এইসব বলে তাদের ওপর জিনা অবিচার করছে। পুলিসরা তাকেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দেখছে। কারণ খুনের সময়ই সে এসেছে।

স্টিভেন হেসে বলল, অ্যালেক্স যদি ঝামেলায় পড়ে তবে সে খুব খুশি হবে। তাকে আর কেউ সন্দেহ করবে না। কারণ হল ছেড়ে সে একটুও নড়েনি।

জিনা হতাশ সুরে জানাল পুলিস নিশ্চয় ভাবছে না একাজটা তারাই কেউ করছে।

অ্যালেক্স মন্তব্য করল, কাজটা নিশ্চয় বাইরের কোনো আগন্তুক এসে করেনি।

মিস বেলভার এসে মারপলকে লাইব্রেরী ঘরে যেতে অনুরোধ করল।

পিস্তলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যে ঘরে খুন হয়েছে সেখানে আর বাইরে পিস্তল ছুঁড়ে তারা পরীক্ষা করছে কিসব।

কালো পোশাক পরে বিষঃ মুখে মিলড্রেড ঘরে এল। লাইব্রেরী ঘরে যাবার জন্য মিস মারপল উঠে পড়লেন।

লিউইস সেরাকোল্ড জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মারপল ঘরে ঢুকতে তিনি বললেন মারপলের নিশ্চয় খুব কষ্ট হচ্ছে তার ওপর দিয়েও তো ধকল যাচ্ছে।

মারপল একটু হাসল। লিউইস তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। একটু কুণ্ঠিত হয়েই তিনি যা বললেন মারপল তো তা শুনে চমকে উঠল। লুইজির কোনও শত্রু থাকতে পারে সে বিশ্বাস করে না। তাকে কেউ বিষ খাইয়ে মারবার চেষ্টা করবে একথা অবিশ্বাস্য। মিঃ ব্রাউণ্ডজেনের কথাকে এতটা বিশ্বাস করছেন কেন লিউইস।

লিউইস বললেন ক্রিস্টিয়ানের ধারণা ভুল নয় কারণ পুলিস ওষুধে বিষ পেয়েছে।

মারপল বলল, তাহলে বাতের ব্যথা, অসুস্থতা সব এই জন্যই হয়েছে। রুথ তা হলে ঠিকই তো বলেছে।

লিউইস হঠাৎ রুথের নাম শুনে অবাক হয়ে গেলেন।

মারপলের মুখ আরক্ত হল। সে আর গোপন না করে বলেই ফেলল, তার এখানে আসটা হঠাৎ বেড়াতে আসা নয়। মারপল সব ঘটনা খুলে বলল।

লিউইস একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি মারপলের কাছে পারমর্শ চাইলেন।

মারপল লুইজিকে জানাতে বারণ করল। ওর বিশ্বাস আর ভালোবাসায় আঘাত করলে ও বাঁচবে না।

লিউইস জানেন মারপল আর লুইজির সম্পর্ক একদিনের নয়। তাই তাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে।

মারপল একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল ক্যারির মৃত্যু হলে অর্থের দিক দিয়ে ক্যারি লাভবান হবে।

টাকা শব্দটা শুনেই লিউইস উত্তেজিত হল। এই জিনিসটা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ কিছু ভাবতে পারে না।

মারপল বুঝিয়ে বলল, এক্ষেত্রে এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা তো সম্ভব নয়। লুইজির মত অত ভালো মেয়ের ওপর কেউ রেগে থাকতে পারে না। একমাত্র লোভের বশেই মানুষ যা ইচ্ছে করতে পারে।

লিউইস জানালেন ইনসপেক্টরও এই কথা মনে করেন। ক্যারিলিনের সলিসিটার লণ্ডন থেকে আজ আসবে। গিলফয় কোম্পানীর সাহয্যেই সে তার উইল করেছে। যাইহোক আইনের কথা ছেড়ে লিউইস বলতে শুরু করলেন নানা প্রতিষ্ঠানে দান করে এরিক কিছু টাকা সমান ভাগ করে দেয় মিলড্রেড আর পিপপার মধ্যে। আর সব সম্পত্তি নিয়ে ট্রাস্ট ফাণ্ড করে। তা থেকে যা আয় হয় তা পাবে ক্যারিলিন। তার মৃত্যুর পর মিলড্রেড আর পিপা বা তার ছেলেমেয়েরা সমান ভাবে পাবে। ক্যারিলিনেরও নিজস্ব অনেক সম্পত্তি আছে। সে তার অর্ধেক লিউইসকে দিয়েছে। বাকি টাকাটা পাবে বেলভার তারপর যা থাকবে তার সমান ভাগ হবে অ্যালেক্স ও স্টিভেনের মধ্যে।

এত গণ্ডগোলের কথা শুনে মারপল অবাক হল। ক্যারির মৃত্যু তাহলে সত্যিই সবাই লাভবান হবে।

লিউইস বললেন, এটা ঠিক কথা হলেও এদের মধ্যে কেউ খুনের মতলব ভাঁজছে একথা ভাবাই যায় না।

বাড়ির সবাই ক্যারিলিনকে কত ভালোবাসে সেকথা লিউইস বললেন। একজনের কথা শুধু বাদ দিল, জিনার স্বামী। মারপল তার কথা মনে করিয়ে দিতেই লিউইস একটু গম্ভীর হলেন।

লিউইস তার সম্বন্ধে বললেন, ওর বয়স অল্প বলে কাজে এখনো মন বসাতে পারেনি। সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি। চিন্তাভাবনাও অপরিণত। আমেরিকায় মানুষের বিচার হয় তার সাংসারিক সাফল্য দিয়ে।

মারপল মন্তব্য করল, এদেশে আমরা জাগতিক ব্যর্থতাগুলোকেই বড় করে তুলি।

একথা শুনে লিউইসের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল।

মিস মারপল, একটু লজ্জা পেয়ে অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বললো, সে মনে করে সৎ পরিশ্রমী মানুষেরাই বিপথগামী ছেলেদের মঙ্গল করে। এদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা তার উদ্দেশ্য নয়। আসলে তার বক্তব্য এসব কিছু ওয়ালটার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়।

লিউইস তার কথা স্বীকার করলেন। তবে যুদ্ধে সে খুবই সাহস দেখিয়েছিল।

মারপল বলল, হত্যাকারীর পক্ষে সবচেয়ে প্রয়োজন হল সাহস ও অহঙ্কার।

লিউইস অবাক সুরে বললেন, সে কেন এই কাজ করবে সে বুঝতে পারছে না।

মারপল বলল, সে যদি চায় তাহলে করতেই পারে। এ জায়গাটা ওর পছন্দ নয়। এদিকে জিনা এ জায়গা ছেড়ে যেতে চাইছে না। টাকা হাতানোই যদি উদ্দেশ্য হয় তবে জিনা যত তাড়াতাড়ি টাকা পেয়ে যায় ততই তো ভালো। অন্য কারুর প্রতি জিনা প্রেমে পড়বার আগেই টাকা পাওয়া চাই।

একথা শুনে লিউইস বিস্মিত হলেন।

মারপল তাকে জানালেন, তিনি বোধহয় জানেন না অ্যালেক্স আর স্টিভেন দুজনেই জিনার প্রতি অনুরক্ত।

লিউইস কিছুতেই কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। স্টিভেন অত্যন্ত ভালো ছেলে, সবসময় নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তিনি ম্যাডরিককেও একথা বলছিলেন। ডঃ ম্যাডরিকের কথা উঠতেই তার মনে পড়ল তাকে বলতে হবে, ক্যারির সঙ্গে দেখা করে এডগার সম্বন্ধে একটা রিপোর্ট দিতে।

মিস মারপল লিউইসরা সেরাকোল্ড সম্বন্ধে কতটুকু জানেন জানতে চাইল। তিনি জানালেন তার বিষয়ে তিনি সব জানেন।

তার পক্ষে বিষ প্রয়োগ করা সম্ভব কিনা জানতে চাইল।

উত্তরে লিউইস বললেন, তাকে তিনি ঠিক এ কাজের জন্য সন্দেহ করতে পারছেন না। কারণ এতে তার কী লাভ থাকতে পারে।

মারপল বলল, লাভক্ষতির কথা নয় সে একটু অস্বাভাবিক বলেই তার কথাটা মনে এসেছে।

লিউইস একটু চিন্তা করে বললেন, সে বেশ সুস্থই হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ যে তার কী হল এটাই অদ্ভুত ব্যাপার।

মারপল একটু এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো, ঐ কারণটাই যদি একটু জানতে পারা যেত– এইসময় ক্যারি এসে ঘরে ঢুকলেন।

.

১২.

সেরাকোন্ড ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ক্যারি বললেন, লিউইস নিশ্চয়ই সাহয্য চাইতে এসেছিলেন। যাতে স্ত্রীর কোনো ক্ষতি না হয়। ইনসপেক্টর বললেন, উনি বোধহয় জানেন না এ ব্যাপারে আপনার যোগ্যতা কতখানি।

মারপল কিছু বুঝতে পারলেন না।

ক্যারি একটু হেসে বললেন, মিঃ সেরাকোল্ড হয়তো ভেবেছেন আপনি স্ত্রীর বহুদিনের পুরনো বন্ধু, চমৎকার মানুষ। কিন্তু ক্যারি জানেন অপরাধ ও অপরাধীদের সম্বন্ধে মারপলের কতখানি কৌতূহল। সুপারিন্টেন্টে ব্রেকার তাকে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মারপলের মতামত শোনবার জন্য ক্যারি আগ্রহী হলেন। মার্কিনীটার ওপর সন্দেহ আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন।

মারপল মন্তব্য করল, ও খুনী হলেই বোধহয় সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

ইনসপেক্টরের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল। এ ব্যাপারে তিনি নিরপেক্ষ নন। লোকটার আচরণ তার অদ্ভুত লাগে।

মারপল জানালেন, মিঃ সেরাকোল্ডকে তিনি সন্দেহ করতে পারছেন না। উনি সত্যই স্ত্রীকে ভালোবাসেন।

ক্যারি বললেন মিসেস সেরাকোল্ড প্রাপ্য টাকা এঁকে দিয়ে দিয়েছেন তাই তার টাকারও কোনও প্রয়োজন নেই। এছাড়া অন্য নারীর প্রতি সেরাল্ডে আসক্ত হতে পারে একথাও অভাবনীয়। তাই তাঁকে এব্যাপার থেকে বাদ দেওয়া হল।

ইনসপেক্টরের মতে যে বিষ দিয়েছে সেই খুনটা করছে। প্রথম সন্দেহটা ওয়ালটার হাডের ওপর পড়ে। ওই টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বালাবার চেষ্টা করে। ফলে ফিউজ হয়। সেই সুযোগে সে ঘর থেকে বেরয়। রান্নাঘরের কাছে ফিউজের বাক্স। সেখান থেকে যে কোনও দিকে যাওয়া যায়। গুলির আওয়াজ যখন হল তখনও সে হলঘরে অনুপস্থিত। সুতরাং সন্দেহজনক ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম ওরই নামই তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে।

মারপল দ্বিতীয় ব্যক্তিটির নাম জানতে চাইল।

ক্যারি অ্যালেক্স রেস্টারিকের কথা বলল।

এছাড়াও তিনি কাউকে সন্দেহ করেন কিনা ক্যারির কাছ থেকে জানতে চাইলেন অবশ্য তার যদি আপত্তি না থাকে।

ক্যারি বললেন, আপত্তির কোনও প্রশ্নই নেই, কারণ তিনি তো তার সাহায্য চাইতেই এসেছেন। তিনি জানতে চাইলেন এইসময় আর কেউ ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে কিনা।

মিঃ সেরাকোল্ডের ঘরের ব্যাপার স্যাপারেই তিনি নিমগ্ন ছিলেন। একটু ভয়ও পেয়েছিলেন সেই সময়। এর মধ্যে কেউ বেরিয়ে ফিরে আসতেই পারে কারণ ঘরটা অর্ধেক অন্ধকারে ঢাকা ছিল।

তবে লুইজিকে অতটা নিশ্চিন্ত দেখে মারপলের অদ্ভুত লেগেছিল।

সেই সময় ঘরে কে কোথায় কি করছিল যতটা সম্ভব মনে করে মারপল বলল।

ক্যারির মতে গুলির আওয়াজ শোনার সময়ের ওপর জোর দেওয়াটা ঠিক হবে না। শব্দটা ফাঁকাও হতে পারে।

মারপল জানাল এডগারকে কেউ ঐ সময়েই কায়দা করে হয়তো খেপিয়ে দিয়েছিল। কারণ ও হঠাৎ করেই ওরকম বিগড়ে গেছিল। ওর বাবা কে এই চিন্তায় সব সময় অস্থির থাকে। সেই সুযোগটা কেউ ওই সময়ে লাগাতে পারে। সে হয়ত ভেবেছিল এই গণ্ডগোলের মাঝখানে কাজ সেরে নিতে পারবে।

এডগারের হাতের রিভলবারটা ওয়ালটার হাডের। সবাই চাইছে ওকে দোষী করতে। যেহেতু ও বাইরের লোক। ক্যারি জানতে চাইলেন এসে মিসেস হাড়ও খুশি হবে কিনা।

মারপল কথাটার কোনও উত্তর দিল না। কারণ তার মনোভাব তার অজানা।

কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে। চাকর বাকরদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে গেছে। কাউকেই সন্দেহ করা যাচ্ছে না। ডঃ ম্যাডরিক একমাত্র এখন বাকি।

অতএব ডঃ ম্যাডরিকের ডাক পড়ল। তিনি গটগট করে ঘরে ঢুকলেন। কড়া পাহারাদার থাকায় কলেজ থেকে বেরনো বা ঢোকা কারুর পক্ষে সম্ভর নয়-এ কথায় সকলে একমত হলেন।

কাজেই ইনসপেক্টর ম্যাডরিকের কথায় এলেন। তখন তিনি কোথায় কি করেছিলেন। তার একটা হিসেব চাইলেন।

ডঃ ম্যাডরিক তার লিখিত বিবরণটা দেখালেন।

ক্যারি ম্যাডরিককে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কি সত্যিই লোমনকে মানসিক রোগী বলে মনে করেন।

উত্তরে তিনি এমন একটা হাসলেন যা দেখে ক্যারি খুব বিরক্ত হল।

ম্যাডরিকের মতে ওর সম্পূর্ণ চেতনা আছে।

ক্যারি বললেন, তাহলে সে নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে গুলি ছুঁড়েছে।

একথায় তিনি আপত্তি জানিয়ে বললেন, এটা সম্ভব নয় কারণ নোমন মিঃ সেরাকোল্ডকে খুবই ভালোবাসে।

ক্যারি মুচকি হেসে বললেন, ভালোবাসা প্রকাশের রীতিটা খুবই ভয়ঙ্কর। কারণ দুটো গুলিই মিঃ সেরাকোল্ডের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে।

ডঃ ম্যাডরিক বললেন, মানুষের ভালো মন্দ সব কাজের পিছনে কোনো না কোনো কারণ কাজ করে। এডগারের যদি ইচ্ছে থাকত মারবার তাহলে সে ঠিকই মারতে পারত। মিঃ সেরাকোল্ড এব্যাপারটা জানেন বলেই প্রাণের ভয় করেননি।

ক্যারি লোমনের সঙ্গে দেখা করবেন জানালেন। তারপর স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর কাছে আর্সেনিক আছে কিনা।

কথাটা শুনে ডাক্তার চমকে উঠলেন। বললেন তার কাছে মারফিয়া থাকে কিন্তু আর্সেনিক থাকে না।

ক্যারির প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল ডাক্তার গানটার এঁদের পারিবারিক চিকিৎসক। তিনি মিসেস সেরাকোল্ডের চিকিৎসা করেন না। মনোবিজ্ঞানী হিসেবেই তিনি কাজ করে থাকেন।

ক্যারি ম্যাডরিককে যাবার অনুমতি দিলেন।

এরপর ওয়ালটার হাড়ের ডাক পড়ল। সে বেশ সতর্ক ভঙ্গিতে কথা বললো।

স্টোনিগেটসে বিদ্যুতের তারগুলো বহু পুরনো দিনের। তাই বারবার লাইন খারাপ হয়ে যায়। কালকে সে ফিউজটা সারিয়েই ফিরে এসেছিল, দশ পনের মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। সে গুলির আওয়াজ শুনতে পায়নি। ফিরে এসে দেখে সেরাকোন্ডের অফিসের পাশে সবাই জটলা করেছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল তাকে গুলি করা হয়েছে কিন্তু পরে দেখা গেল তা নয়।

ক্যারি রিভলবারের প্রসঙ্গ তুলতেই হাড বলল সে দেখেই চিনতে পেরেছে ওটা তার রিভলবার। ওটা সে ঘরের ড্রয়ারে রাখে। এই খবর কে জানে আর কে জানে না সেকথা তার অজানা। হলে ফিরে এসে সে যারা আগে সেখানে ছিল তাদের সবাইকেই দেখে।

ইনসপেক্টর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মিঃ গুলব্রাজেন এবারে যে হঠাৎ এসে পড়েছিলেন তাতে কেউ বিচলিত হয়ে পড়ছিল কিনা।

একটু ভেবে ওয়ালটার জানালেন সে সম্বন্ধে তার কিছু মনে হয়নি। সে কেন এসেছিল সে ব্যাপারে ও কিছু জানে না। কে হত্যাকারী হতে পারে সে সম্বন্ধে ধারণা নেই তার।

ক্যারি এই ঘটনার পিছনে অ্যালেক্স রেস্টারিকের সম্ভাবনা কতখানি জানতে চাইলেন কারণ সে সেইসময় একা গাড়ি চালিয়ে এসেছে। থিয়েটারের কাজের জন্য তারও তো টাকার লোভ থাকতে পারে।

হাড নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারল না। এ ব্যাপারে জোর করে কিছু বলতেও চায় না সে।

.

১৩.

জোর গলায় হাত পা নেড়ে অ্যালেক্স কথা বলছিল।

রাগত স্বরেই সে জানাল একা গাড়ি চালিয়ে আসবার জন্যই তাকে সবাই সন্দেহ করছে, একথা সে বুঝতে পেরেছে। কাউকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সেই সময় চারিদিকে কুয়াশা। গাড়ির আলো তার ওপর দিয়ে পড়াতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। এইটা যদি নাটকের সিনারী তৈরি করার কাজে লাগায় তবে বেশ হবে। একটা রহস্যময় পরিবেশের কল্পনা করছিল। বেশ গা ছমছম বিপজ্জনক পরিবেশ।

মিঃ গুলব্রাজেনকে অ্যালেক্স চিনত কিনা ক্যারি জানতে চাইলেন।

অ্যালেক্স জানাল খুন করতে হলে যতখানি জানার প্রয়োজন হয় অতখানি নয়, তাছাড়া তার বড়লোকদের সঙ্গে মেশার বিশেষ ইচ্ছেও হয় না।

রেস্টারিক বিষ নিয়ে নাড়াচাড়া করে কিনা ক্যারি জানতে চাইলেন। সে জানালো এ ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই।

ক্যারি আর্সেনিকের কথা তুলতে সে বললো কুশীলবের মেজাজ দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে বটে আর্সেনিক মাখা খাবার খাওয়াতে।

এখানে আসা যাওয়া সম্বন্ধে ক্যারি জানতে চাইলে সে উত্তরে বললো তার কোনো ঠিক থাকে না। তবে শনিবারই আসার চেষ্টা করে। মিসেস সেরাকোল্ডের কাছে সে অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছে।

ক্যারি মন্তব্য করলেন, তার সঙ্গে সে হয়ত প্রচুর টাকাও পেয়েছে। এ কথায় অ্যালেক্স বিরক্ত হল। লুইজির উইলের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে সে ঠিকমত সহোয়যাগিতা করল না। তার মতে, তার সম্বন্ধে এত প্রশ্ন করবার কোনো মানে হয় না, কারণ তার তো কিছু ঘটেনি।

অ্যালেক্স চলে যাবার পর স্টিভেন রেস্টারিক এসে সেইদিন তখন কি করছিল সে কথা বলল। ঝগড়া শুনে সে অবিচলিতই ছিল। কারণ মাঝে মাঝেই সে ওরকম চেঁচামেচি করে। তাদের কাউকেই সে পছন্দ করে না। জিনা মেয়ে বলে তার ওপরেও খুব রাগ। সেও এডগারের সঙ্গে ইয়ার্কি করে। জিনার অবজ্ঞা এডগার একদম সহ্য করতে পারে না। আসলে সেও জিনাকে ভালোবাসে। সে বলল গোলমাল শুরু হতে তার পিয়ানো বাজানো থেমে যায়। তার মতে সেদিন এডগার নাটক ছাড়া আর কিছুই করছিল না। এই গণ্ডগোলের মধ্যে ওয়ালি আর বেলভার ছাড়া কেউ বের হয়নি। তবে ঝগড়ার দিকে সবার মন থাকায় কেউ অতটা ভালো লক্ষ্য করেনি। তবে মিসেস সেরাকোল্ড আর জিনা যে বাইরে যায়নি সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

স্টিভেনের কথা শুনেই ক্যারি বুঝছিলেন সে নিজেকে খুব চালাক মনে করে। তাকে এ ব্যাপারে সে সন্দেহ করে। তার নাম সে কিছুতেই মুখে আনল না। ভাবটা এমন, প্রমাণ না পেলে তো তারা বিশ্বাস করবে না বলে লাভ কি।

স্টিভেন চলে গেলে ক্যারির মাথায় একরাশ চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল।

এমন সময় জিনা তার সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আজ সে অন্যদের মতো কালো পোষাক পরেনি। এই রঙটা তার পছন্দও নয়, তাছাড়া গুলব্রাজেন তার নিকট আত্মীয়ও নয়। ছোট বেলায় তিনচারবার দেখেছে।

জিনা সেই সন্ধ্যার ঘটনা বলতে লাগল। ক্যারির মনে হল এর আগে এত নাটকীয়ভাবে আর কেউ বলেনি। সেই সময় কে কি করছিল সে সব কথা বেশ মজার ভঙ্গিতে বলে গেল। ওর ধারণা দুষ্টু ছেলেদের মধ্যে কেউ নয় পাগলদের মধ্যেই কেউ খুনী।

যখন ইনসপেক্টর বললেন ঐ কড়া পাহাড়া থেকে কেউ বেরোতে পারবে না জিনা বললো ওরা যদি ইচ্ছে করে তবে অবশ্যই বেরোতে পারবে। সে তাদের জানে ভালো করে।

জিনা চলে গেলে ক্যারির মাথায় দুটো কথা ঘুরতে লাগল। প্রথমত এর আগে কেউ বলেনি ওয়ালটার হলঘরে ফিরে আসবার পর গুলির শব্দ শোনা গেছে। দ্বিতীয়ত, মিস বেলভার চাবি আনবার জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তাও তিনি বললেন না।

.

১৪.

মিসেস স্ট্রেট সম্পূর্ণ কালো পোষাকআসাকে সজ্জিত হয়ে লাইব্রেরী ঘরে বসেছিল। এহেন পরিবেশে জিনা আবশ্যই বেমানান।

মিসেস স্ট্রেট ক্যারির ডাকের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েই এই অযথা সময় নষ্টের কথা ক্যারিকে জানালো।

ক্যারি তাকে বুঝিয়ে বললেন এইসব কাজে ছোটখাটো ব্যাপারগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করে বড় কাজে হাত দিলে সুবিধা হয়। এইজন্য তারা সবশেষে এমন মানুষদের সাহায্য চান যাদের ওপর নির্ভর করা যায়। অন্যরা এতক্ষণ যা বলে গেছে তার যথার্থতা বোঝবার জন্য।

একথা শুনে স্ট্রেটের মুখের কাঠিন্য সরে গেল।

ক্যারি বলতে লাগলেন, তিনি আশা করেন, স্ট্রেট যেহেতু এ বাড়ির মেয়ে তার ওপর অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ মহিলা সেই হেতু এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার নিশ্চয়ই সুচিন্তিত মতামত থাকবে।

ক্যারি কথা শেষ করতে না দিয়েই স্ট্রেট বলে উঠল, খুনী সম্বন্ধে তার কোনো সন্দেহই নেই। জিনার হতচ্ছাড়া মার্কিন স্বামীটাই এই কাজ করেছে। ওর সম্বন্ধে কেউ কোনো খোঁজ রাখে না।

ক্যারি এই সন্দেহের কারণ জানতে চাইলেন।

স্ট্রেট জবাব দিল, ক্রিস্টিয়ান নিশ্চয় ওর সম্বন্ধে কোনো গোপন তথ্য জানতে পেরেছিল, আর সেই জন্যই সে তাড়াতাড়ি এখানে ফিরে আসে। ভাব দেখিয়েছিল নিজের কাজ আছে। জিনাটা দুম করে ওই বোকাটাকে বিয়ে করে বসল। ওর সম্বন্ধে কোনো খোঁজই নিল না। নিজেকে বাঁচানোর জন্যই ও হয়তো ক্রিস্টিয়ানকে মেরেছে।

ক্যারি এখনো ওয়ালটারকে গ্রেপ্তার করেনি কেন ভেবে সে বিস্মিত হল।

ক্যারি বললেন বিনা প্রমাণে তো কাউকে ধরা যাবে না।

স্ট্রেট জানাল ওয়ালটার হয়তো কায়দা করে ফিউজ সারানোর নাম করে বেরিয়ে গিয়েছিল, গুলি করে আবার ফিরে এসেছে।

ক্যারি জিনার কথা বললো, স্ট্রেট বললো ওসব একদম মিথ্যে কথা। ও সব পারে।

স্ট্রেট দুজনকেই সন্দেহ করে কিনা ক্যারি জানতে চাইল।

ইতস্তত করে স্ট্রেট জানালো জিনাকে হয়তো আসল কথাটা জানাতে চায়নি বলেই ক্রিস্টিয়ানের মুখ বন্ধ করা হয়েছে।

ক্যারি জিনার রূপের প্রসংসা করলেন। স্ট্রেট তাকে বললো ইতালিতে অমন মেয়ে প্রচুর আছে। তাছাড়া রূপ নয়, টাকার জন্যই ওয়ালটার ওকে বিয়ে করেছে।

স্ট্রেটের আর্থিক অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করাতে সে ক্যারিকে বলল, তার স্বামী ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। তারও কোনও বাজে খরচ নেই। তাছাড়া তার মার কাছ থেকে সে সব টাকাটাই পাবে।

ক্যারি তার মায়ের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন।

জবাবে স্ট্রেট জানালো তার মায়ের শরীর বয়সের জন্য দুর্বল হয়েছে বা বাতে ধরেছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করবার কোনো মানে হয় না। মিঃ সেরাকোল্ড এসব নিয়ে চিন্তা করেন না। মিস বেলভারই বড় বেশি মাথা ঘামায় সব ব্যাপারে, যে ওই বাড়ির কত্রী।

ক্যারি চিন্তাচ্ছন্নভাবে বললেন, ঐ দুই রেস্টারিক ভাই এখানে কেন রয়েছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

এই বাড়িতে ওদের থাকা নিয়ে স্ট্রেট যে খুব অসন্তুষ্ট তা ওর কথাতেই প্রকাশ পেল। স্টিভেনকে সন্দেহ করবার কারণ নেই কেননা সে ওদের সঙ্গে একই ঘরে ছিল। স্ট্রেট তার কথায় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল হত্যাকারী ওয়ালটার হাড় ছাড়া আর কেউ নয়।

এরপর পালা এল এডগার লোমনের। তাকে দেখে বা তার আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেল না। তবে অতিমাত্রায় বিনয়ী।

এডগার মিঃ সেরাকোল্ডের মত লোকের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছে তার জন্য খুব দুঃখ প্রকাশ করল। সে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করল। ইনসপেক্টর যদি তাকে গ্রেপ্তার করেন তবে সে কিছু মনে করবে না।

ক্যারি বোঝালো প্রমাণ ছাড়া অভিযোগের প্রশ্নই ওঠে না। আর মিঃ সেরাকোল্ড বলেছেন বন্দুক ছোঁড়াটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয়।

এডগার লিউইসের মহানুভবতার প্রশংসা করে নিজের ছেলেবেলার দুঃখময় জীবনের কথা ক্যারিকে বিস্তারিত বলল। সে এও বলল, কোনোদিন কারুর প্রতি সে অন্যায় করেনি। কাউকে ঠকায়নি। কেবলমাত্র নিজেকে বড় করে দেখাতে চেয়েছে। এখানে সে যে লিউইসের সেক্রেটারী সেটা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই আড়ালে হাসে। তবে মিসেস সেরাকোল্ড ছাড়া। উনি সত্যিই ভালোমানুষ। এডগার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল তার বাবা নেই বলেই এই অবস্থা হয়েছে। এখন সে মিঃ সেরাকোল্ডকেই বাবা বলে মানে। তাতে আর কেউ তার পেছনে লাগতে সাহস করবে না।

ক্যারি যখন বললেন যে, সেই আবার অভিযোগ করেছে যে মিঃ সেরাকোল্ড তার শত্রু তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। তখন এডগার একটু ইতস্তত করতে লাগল।

রিভলবারটা সে ওয়ালটারের ঘর থেকে নিয়েছিল মনে করতে পারল না। এমন গলার এড়িয়ে যেতে ক্যারি ধীর গলায় আবার জিজ্ঞেস করল সেটা সে কোথা থেকে পেয়েছিল। এডগার একটু চুপ করে রইল।

ক্যারি তাকে জিজ্ঞেস করল তার কিছু মনে পড়ছে কিনা। সে জানাল তার কিছুমনে নেই। সবার ওপরে তার রাগ হচ্ছিল।

মিঃ সেরাকোল্ড তার বাবা একথা কে বুঝিয়েছে ক্যারি জানতে চাইলে, সে যেভাবে কেউ কথাটা বললো তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল সে মিথ্যে বলছে, তাকে জোর করে লাভ নেই ভেবে ক্যারি তাকে সাবধান করে দিয়ে বিদায় দিলেন।

ক্যারি বুঝলেন লোকটা একই সঙ্গে দাম্ভিক, মিথ্যাবাদী আবার সরলও। একে দিয়ে কোনো কাজ হাসিল করা সম্ভব। মিস মারপল ঠিকই ধরেছেন, ওর মাথায় কেউ দুর্বুদ্ধি যুগিয়েছে।

কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল, ইনসপেক্টর পিয়ানোর সামনে চেয়ারে। সার্জেন্ট লেক জানলার পাশে চেয়ারে।

ক্যারি লক্ষ্য করলেন, এখানে বসে স্টাডিরুমের দরজার দিকে লক্ষ্য রাখতে গেলে লেককে আর দেখা যাচ্ছে না।

লেক উঠে লাইব্রেরীতে গেল। ক্যারি মনে মনে একটা হিসেব তৈরি করছিলেন। তাতে দেখা গেল, লাইব্রেরী থেকে বারান্দায় বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে খুন করে আবার নিজের চেয়ারে এসে বসে পড়া মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। সকলের অবস্থিতির কথা ভেবে নিয়ে ক্যারি বুঝলেন জিনা হাডের পক্ষে খুন করাটা অসম্ভব নয়। টুল থেকে উঠে বাইরে বের হলে তা জিনার নজরে আসত। কিন্তু জিনা বলেছিল গোলমাল শুরু হবার সময়ে স্টিভেন পিয়ানোর সামনে ছিল। তারপর ঠিকঠিক বলা মুস্কিল। ক্যারি অনেক ভেবেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না।

পিয়ানোর পাশে রাখা স্বরলিপিগুলি ক্যারি নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন। তারপর মিউজিক টুলের ডালাটা খুলে ফেললেন। এটা সেটা নাড়তে নাড়তে হঠাৎ একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলেন। বিবর্ণ হয়ে আসা হলদেটে কাগজ পত্রের মধ্যে একটা পিস্তল। লেক উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল তবে নির্ঘাৎ স্টিভেন তাতে আর সন্দেহ নেই।

ক্যারি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তা কখনোই হতে পারে না, তিনি নিশ্চিত ভুল পথে চালিত করবার জন্যই কেউ একাজ করেছে।

.

১৫.

মিসেস সেরাকোল্ডের দরজায় এসে মারপল টোকা দিল।

লুইজির সাড়া পেয়ে মারপল ভেতরে প্রবেশ করল।

আয়নার সামনে বসে লুইজি চুল আঁচড়াচ্ছিল। জানালো, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে সে পুলিসের কাছে যাচ্ছে।

মারপল তার শরীরের খবর নিল। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করল কে খুনী হতে পারে বলে তার ধারণা।

লুইজি আসলে কিছুই ভেবে উঠতে পারেনি। এর আগেরবার যখন ক্রিস্টিয়ান এসেছিল তখন থেকেই ঝামেলার সূচনা সেইজন্যই ও এবার এখানে এসেছিল বলে লুইজির মনে হয়।

আগের বার রাত্রিতে কে কে ছিল জিজ্ঞেস করায় লুইজি বললো, এবারে যারা আছে তারা সবাই ছিল। অ্যালেক্স লণ্ডন থেকে এসেছিল। সেবার রুথ ছিল।

রুথের নাম শুনে মারপল অবাক হয়ে গেল। একটু যেন আলোও দেখতে পেল। সে বুঝতে পারল ক্রিস্টিয়ান আর রুথ দুজনেই গণ্ডগোলের আভাস পেয়েছিল। রুথ তার অস্বস্তির কারণটা ধরতে পারেনি। ক্রিস্টিয়ান জানতে পেরেছিল কেউ লুইজিকে বিষ খাইয়ে মারবার চক্রান্ত করছে।

লুইজি হঠাৎ জেনকে বললো সে বুঝতে পেরেছে তার কাছ থেকে সবাই কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে। লিউইসকেও খুব অন্যমনস্ক দেখালো।

মারপল বললো, সেটা হয়ত খুনের জন্য তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন।

লুইজি কি জানি চিন্তা করতে লাগল।

মারপল তার চিন্তার কারণ জানতে চাইল। লুইজি জানাল সে জিনার কথা ভাবছে। তার বিশ্বাস সে সত্যিই ওয়ালিকে ভালোবাসে। জিনা বয়সসুলভ চপলতা নিয়ে পুরুষদের আকর্ষণ করলেও তার আসল টান স্বামীর দিকেই। ওয়ালি ওর মত না হলেও ওদের বিয়ে হয়েছে। জিনার সুখটা খুব দরকার।

মারপল একমত হয়ে বলল, সবারই অধিকার আছে সুখী হবার।

লুইজি বললো, জিনার ব্যাপার অন্যরকম। ওর মা পিম্পাকে নিয়ে একটা পরীক্ষার চেষ্টা চলেছে আর তাতে সফল হতেই হবে। এর পরের কথা বলতে গিয়ে লুইজি হঠাৎ থেমে গেল। মারপল কৌতহলী হয়ে উঠল। বারবার কথাটা জানতে চাইল। কারণ জানাটা তার দরকার।

লুইজি বলে চলল, পিপপার মা ছিল ক্যাথারিন এলানওয়ার্থ।

মারপল বিস্মিত হল। যাকে ফঁসী দেওয়া হয়েছিল স্বামীকে বিষ খাওয়ানোর অপরাধে! পিপা তার মেয়ে।

এরিক আর লুইজি পিম্পাকে সবরকম ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষা দিয়ে বড় করে তুলেছিল।

এসব শুনে মিস মারপল স্তম্ভিত, লুইজি ইনসপেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে বসবার ঘরে চলে গেল।

ক্যারি ঘরে দাঁড়িয়ে সব জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিলেন, সব আসবাবপত্র পুরনো রঙ ওঠা।

মিসেস সেরাকোল্ড ঘরে এলো। পরনে কালো পোষাক। চেহারায় ভাঙন ধরেছে।

ক্যারি ধীরে ধীরে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। সেও আগ্রহ নিয়ে তার জবাব দিচ্ছিলেন। সেদিনের সন্ধ্যাবেলার ঘটনা সব বলল।

ক্যারি যখন শুনলেন যে লুইজি এতটুকু ভয় পায়নি, তিনি একটু বিচলিত হয়ে এই নিস্পৃহতার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তরে লুইজি বলল এডগারের সবটাই নাটক। গুলি হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে।

ইনসপেক্টর একথা বিশ্বাস করলেন না।

হঠাই মিসেস সেরাকোল্ড বললো, তাদের কাজকর্মে অনেকেরই ধারণা ভাল নয়। এডগ, লিউইসকে শ্রদ্ধা করে। ও পাগল নয়। তবে হঠাৎ উত্তেজিত হবার কারণটা লুইজি বুঝ পারেনি।

ক্যারি রিভলবারটা দেখালেন। লুইজি সেটা চিনতে পারল না।

ক্যারি জানালেন এটা পিয়ানোর টুলের মধ্যে পাওয়া গেছে। কয়েকদিনের ভেতরেই এটা কেউ ব্যবহার করেছে। ভালো করে পরীক্ষা এখনো না হলে ক্যারির দৃঢ় বিশ্বাস এরই একটা গুলি গুলব্রাজেনের প্রাণ নিয়েছে।

লুইজি অবাক হল। কাল রাতে স্টিভেন রেস্টারিক পিয়ানো বাজিয়েছে। ওর প্রতি ক্যারির সন্দেহের কথা জানাতে লুইজি অস্বীকার করল। তার মতে ও খুন করতেই পারে না।

ক্যারি লুইজি ঘর থেকে বেরোতেই জিনা তাকে জিজ্ঞাসা করল পুলিসের লোকগুলো তাকে খুব বিরক্ত করেছে কিনা।

লুইজি তাদের জানালো ইনসপেক্টর তার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেছে।

জিনা, জলি, লুইজি মারপল সবাই মিলে লাইব্রেরী ঘরে গেল।

সেখানে লুইজি তার চিঠিগুলো দেখল। ছেলেদের আত্মীয়দের কাছ থেকে চিঠিগুলো আসে। ডঃ ম্যাডরিক তার উত্তর দেন। আর ব্যক্তিগত চিঠিগুলোর উত্তর তিনি নিজেই দেন।

চিঠির শেষে একটা পার্সেল খোলা হতে দেখা গেল তাতে খুব সুন্দর একটা চকোলেটের বাক্স। তার ভেতর থেকে অ্যালেক্স রেস্টারিকের কার্ড বের হল।

নিজে আসা সত্ত্বেও কার্ড পাঠিয়েছে দেখে লুইজি অবাক হল।

মারপল তাড়াতাড়ি লুইজিকে সেই চকোলেট খেতে বারণ করল।

মিসেস সেরাকোল্ড অবাক।

মারপল জিনাকে বলল অ্যালেক্স কোথায় আছে দেখতে।

জিনা উঠে গেল।

অ্যালেক্স ঘরে ঢুকেই লুইজিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করল। মারপল বলল, লুইজি চকোলেট পেয়ে খুব খুশি হয়েছে।

চকোলেটের কথা শুনে অ্যালেক্স অবাক। সে তো পাঠায়নি।

মারপল বাক্সটা হাতে নিয়ে লিউইসের কাছে গিয়ে সব জানাতে তিনি গম্ভীর হলেন। ডঃ ম্যাডরিক সেগুলো পরীক্ষা করলেন।

লুইজির প্রিয় চকোলেটগুলোই পাঠানো হয়েছে যখন তখন ভেতরের কেউই একাজ করেছে। মিস মারপল আর ব্যাপারটা লুইজির কাছে গোপন রাখতে চাইল না।

.

১৬.

জিনা মন দিয়ে একটা সিনারী আঁকছিল। হঠাৎ শুনতে পেল কেউ বলছে, কোনো বদমাস লোক নাকি খাবারে বিষ মেশাবার তালে রয়েছে।

জিনা তাকিয়ে দেখল সেই তালা খোলায় চৌকশ ছেলেটা আর্নি। যার থিয়েটারে খুব উৎসাহ।

জিনা জিজ্ঞেস করল কার থেকে সে এসব কথা শুনেছে।

সে জানাল তারা সব খবর রাখে। মিসেস সেরাকোল্ডের কেউ ক্ষতি করবে না। তবে ওই বদমাইশ বেলভারটা–

এ ধরনের মন্তব্য শুনে জিনা তাকে এক ধমক দিল।

আর্নি তখন সেটা কি ধরনের বিষ ছিল সে সম্বন্ধে খোঁজ নিতে শুরু করল। চকোলেটের কথাও তার কানে গেছে।

হঠাই সে বলে উঠল সে জানে অপরাধী কে।

জিনা তার কথা শুনে বিরক্ত হল।

আর্নি একভাবে বলে যেতে লাগল, তালা খুলে মজা করবার জন্য প্রায়ই রাত্রে সে বাগানে বেরিয়ে যায়।

জিনা বিশ্বাস করল না।

আর্নি তখন বলল ঠিক আছে সে বরং পুলিশকেই সব বলে দেবে।

জিনার খুব কৌতূহল হল শোনাবার জন্য কিন্তু সে ততক্ষণে হাওয়া।

তারপরেই স্টিভেন এল। তারা কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে চলতে লাগল। চকোলেট আর কার্ড নিয়ে তারা প্রেরকের বোকামির কথা বলতে বলতে এগোতে লাগল।

জিনা চিন্তা করতে লাগল, তার দিদাকে কে বিষ খাওয়াতে পারে। সে ওয়ালিকে সন্দেহ করে না বলে স্টিভ ঠাট্টা করল তার স্বামীপ্রীতি দেখে। জিনা আর্নির কথাগুলো স্টিভেনকে বলল। সে কোনো গুরুত্বই দিল না।

সকালবেলা ঝকমকে রোদে দাঁড়িয়ে ক্যারি অ্যালেক্সকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোথায় গাড়ি থামিয়েছিল। অ্যালেক্স সঠিকভাবে বলতে পারল না।

ক্যারি তীক্ষ্ণ চোখে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর কনস্টেবল জজেটকে ডাক দিতেই সে দৌড়তে দৌড়তে মাঠ পেরিয়ে বাড়ির দিকে গেল তারপর রোয়াকের কাছে দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। একটু পরেই জানলার পর্দাটা জোরে নড়ে উঠল তারপর বাগানের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল।

ক্যারি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন মাত্র দুমিনিট বিয়াল্লিশ সেকেণ্ড লেগেছে।

অ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন তার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ তিনি এখনো করেননি, শুধু দেখছিলেন খুন করাটা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না।

অ্যালেক্স বলল, তাকে নিশ্চয়ই অপরাধী ভাবা হচ্ছে না কারণ সে নিশ্চয়ই বোকার মত বিষ মেশানো চকোলেটে নিজের নাম লেখা কার্ড পাঠাবে না।

ক্যারি বললেন যে ইচ্ছে করেই এই খটকা যাতে মনের মধ্যে তৈরি হয় তার ব্যবস্থা করেছে। অ্যালেক্স ব্যঙ্গ করে ক্যারির বুদ্ধির তারিফ করল।

জজেট ক্যারিকে বলল তার মতামত জানলার পর্দা নাড়াতে গিয়ে দেখে, ওপরের একটা হুক খোলা। অর্থাৎ ভেতরের আলো বাইরে দেখা যাবে।

অ্যালেক্স সেই আলো লক্ষ্য করেছিল কিনা জিজ্ঞেস করাতে সে বলল কুয়াশার জন্য কিছুই ভালো করে দেখা যায়নি। তাছাড়া সে দৃশ্যপট ভাবতেই ব্যস্ত ছিল।

মাঠের ওপর দিয়ে ক্যারি আর জজেট বাড়ির দিকে যেতে লাগলেন। অ্যালেক্স ভাবল নিশ্চয় পায়ের ছাপ খুঁজছে। তবে রাত্রির বৃষ্টিতে সব মুছে গিয়েছিল।

অ্যালেক্সকে দেখে জিনা দৌড়ে এল। তাদের মধ্যে নানা কথা হতে লাগল ভবিষ্যৎ নিয়ে। অ্যালেক্স তাকে বিয়ে করতে চায়। ওয়ালিকে ছেড়ে দিয়ে সে তার কাছে চলে আসতে বলে জিনাকে। অ্যালেক্সের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় তার মাথায়।

.

১৭.

লুইজি বিভ্রান্ত হয়ে বলে ওঠে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তাকে কেউ বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।

স্নেহের সুরে লিউইস জানাল এই দুঃখটা তিনি তাকে দিতে চাননি।

লুইজি জেনের দিকে ফিরে জানতে চায় এসব কথা সত্যি কিনা।

মারপল সায় দেয়। লুইজি পাগলের মত বলে যায় তার এতদিনের বিশ্বাস ভালোবাসা তাহলে সব মিথ্যে।

লিউইস জানালেন তিনিও একথা জানতে পারেননি।

লুইজি বারবার বলতে লাগল ক্রিস্টিয়ান এবার এসে ঐ জন্য তাকে বারবার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছিল। সে তো তাকে স্পষ্ট করে সব বলতে পারত। যা ঘটেছে সে সব অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় তার।

সকলে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। লুইজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সে এবার বুঝেছে কতখানি মনগড়া জগতে সে বাস করছে। বাস্তবের সংস্পর্শে সে আসেনি। তার এই মুহূর্তে কাউকে ভালো লাগল না। সে একা থাকতে চাইল। আত্ম বিশ্লেষণ করতে চাইল।

মিস মারপল হলঘরে চলে এল, অ্যালেক্স নাটকীয় ভঙ্গিতে তাকে অভ্যর্থনা জানাল।

লিউইস সেরাকোল্ড হল পেরিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

ইনসপেক্টরের সঙ্গে অ্যালেক্সের কি কথা হয়েছিল সব সে মারপলকে জানাল।

স্টিভেন রেস্টারিক ব্যস্ত হয়ে ঢুকল। অ্যালেক্সকে আর্নির কথা বলল। আনি জিনা যা দেখেছে বলেছে স্টিভেন সেকথা অ্যালক্সকে জানাল। অ্যালেক্স কৌতূহলী হল।

তারপর পরে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে স্টিভেন লাইব্রেরীর দিকে চলে গেল।

অ্যালেক্স মারপলের কথা ভুলেই গিয়েছিল। সে লাইব্রেরীতে চলে গেল। বন্ধ দরজার আড়াল থেকে কথা ভেসে এল। সে দিকে মারপল মন দিল না মনে হয়েছিল আর্নি বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। কুয়াশার রাতে বাগানে বেড়ানোটা বিশ্বাস করা শক্ত হল।

মারপল একমনে অ্যালেক্সের কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। জজেট হাঁপাচ্ছে-নিঃশ্বাস ফেলছে ঘনঘন অন্য কেউ..অন্য কেউ হঠাৎ মারপলের কি মনে হতে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

.

১৮.

আচমকা অন্ধকারের মধ্যে ওয়ালিকে দেখে জিনা চমকে উঠল। ওয়ালি তাকে খুঁজতে এসেছে। এখানে ছাড়া আর তো কোথাও তাকে পাওয়া যায় না।

জিনা বলল তাকে থিয়েটারের কাজ করতেই এখানে থাকতে হয়।

ওয়ালি জিনার কাছে জানতে চাইল এসব ঝামেলা শেষ হতে আর কতদিন লাগবে।

জিনা একটু ভেবে জানাল আর দিন পনের লাগবে।

শুনে ওয়ালি চিন্তিত হল। তারপর বলল তারপরেই আমেরিকা যাওয়া যাবে।

জিনা একথা শুনে যেতে রাজি হল না। থিয়েটার, দিদাকে ছেড়ে সে যেতে পারবে না।

ওয়ালি জানাল সে একা যাওয়ার কথা বলেছে।

জিনা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। তার মানে ওর যাওয়া না যাওয়াটা ওয়ালির কাছে বড় নয়। জিনা খুব রেগে যেতে ওয়ালি একটা বোঝাঁপড়া করতে চাইল তার সঙ্গে। সে জিনাকে বলল বিয়ের আগে পারিবারিক অবস্থার খবর সে রাখেনি। কিন্তু এখন দেখছে এসব কাণ্ড কারখানা সহ্য করা তার পক্ষে মুস্কিল। সে ফিরে যেতে চায়। জিনার কাছে কিছু আশা করে না। সে যদি মুক্তি পেয়ে অন্য কারোর সঙ্গে চায় থাকতে পারে। ওয়ালি চায় তার স্ত্রী তার সঙ্গে থাকবে সব সময়।

জিনা ওয়ালিকে স্বার্থপর বলল। সে এখানে থাকতে চায়। ওয়ালি জানাল তার এইসব খুনখারাপি জায়গার মধ্যে থাকতে ভালো লাগে না।

জিনা তাকে বলল, যেতে না দিলে সে এসময় যাবে কি করে। ইনসপেক্টর এমনিতেই ওয়ালিকে সন্দেহ করে। ওয়ালি বলল প্রমাণ ছাড়া তো আর ধরা যাবে না।

জিনা হঠাৎ কেঁদে ফেলল, ওয়ালির জন্য তার খুব ভয় লাগছে। ওয়ালি বলল, শুধু শুধু ভয় পেয়ে লাভ নেই। কারণ তাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই।

ওরা বাড়ির দিকে রওনা হল। জিনা ওয়ালিকে যখন জিজ্ঞেস করল যে সে কি চায় না যে জিনা তার সঙ্গে থাক সে তখন চুপ করে রইল।

জিনা রেগেমেগে ওয়ালির উদ্দেশে যা তা কথা বলে স্পষ্ট বলে দিল, সে তার সঙ্গে যাবে না। তাকে বিয়ে করাই ওর ভুল হয়েছিল। আমেরিকায় গিয়ে সে যে কোনো মেয়ের সঙ্গে থাকতে পারে। ওয়ালি রাজি হল।

.

১৯.

ইনসপেক্টর ক্যারি জজেটের সাহায্যে যেখানে তদন্ত চালাচ্ছিলেন, সেখানে মিস মারপল ওদের দুজনকে ঘরে ঢুকতে দেখল।

আচমকা বেলভার তাকে ঠান্ডা লেগে যাবে বলে ঘরে ঢুকতে বলল।

যেতে যেতে মিস মারপল যাদুর ভেলকির সাহয্যে মানুষকে কেমন বোকা বানানো হয় সে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল। কাটা মানুষও কেমন জোড়া হয়ে যায়।

বেলভার কিছু বুঝল না। ভাবল গণ্ডগোলের মধ্যে বেচারির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

হঠাৎ মারপল লুইজির খবর নিল। বেলভার জানাল সে মনে মনে খুব আঘাত পেয়েছে।

মারপল বলল, লুইজি এমন কিছু ব্যাপার বুঝতে পারে যা অন্যেরা বোঝে না।

বেলভার যখন বলল লুইজি বাস্তব জগতের বাইরের মানুষ, তখন মারপল কথাটা শুনে বিস্ময়ের ভান করল।

এইসময় এডগার লজ্জিত মুখে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল।

দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতর গেল।

.

২০.

লাইব্রেরী ঘরে চাপা উত্তেজনা, সবাই একসঙ্গে রয়েছে। লিউইস অন্যমনস্ক হয়ে পায়চারী করছেন।

বেলভার জানতে চাইল কি ব্যাপার। উত্তরে তিনি বললেন আর্নিকে পাওয়া যাচ্ছে না।

জিনা দৌড়ে লুইজির কাছে গেল। জিজ্ঞেস করল তার শরীর অসুস্থ লাগছে কিনা।

ক্যারি ফ্যাকাসে মুখে বলল, ছেলেটার জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে।

মারপল অস্ফুটে বলল, বোকা ছেলেটার এমন বিপদ ঘটল।

স্টিভেন আসতে লিউইস তাকে সব ঘটনা খুলে বললেন।

ডঃ ম্যাডরিক একটি সুদর্শন ছেলেকে নিয়ে ঢুকলেন, আর্থার জেসকিনসের সঙ্গেই আর্নির শেষ দেখা হয়।

লিউইস আর্থারকে আর্নির সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে জানলেন সে কিছু জানে না। এও বললো যে তালা খোলা নিয়ে সে কখনো সত্যি বলত না। কাল রাত্রে ও বিছানা ছেড়ে কোথাও যায়নি।

লিউইস আর্থারের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না।

দরজার কাছে হৈচৈ শোনা গেল। একজন মাস্টারমশাই ধপ করে চেয়ারে বসে বললেন যে তাদের পাওয়া গেছে।

মিলড্রেড জানতে চাইল কে তারা।

উত্তরে তিনি বললেন, স্টেজের ওপর ভারী লোহা পড়ে অ্যালেক্স আর আর্নি দুজনেরই মাথা একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। সবশেষ।

৩. গরম সুরুয়া

২১.

লুইজির জন্য মারপল গরম সুরুয়া নিয়ে এসে ডাকল। ক্যারি বিছানা থেকে উঠে মারপলের হাত থেকে বাটিটা নিল। মুখটা ম্লান। মারপল পাশে চেয়ারটা টেনে বসল।

লুইজি তিনটে মৃত্যু সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল। এদের জন্য তারা কত কি করতে চেয়েছে। বর্তমান জীবন ধারাটাই বদলে গেছে। সবকিছু জটিল হয়ে পড়েছে।

মারপল একটা নখ কাটার কাচি তুলে নিল। কাচিটা বেশ নতুন রকমের। একদিকে একটা বাড়তি আঙুল ঢোকানোর জায়গা।

লুইজি জানাল সকালে অ্যালেক্স ওটা দিয়ে গেছে। ডান হাতের নখ কাটবার সুবিধা হয় এতে।

মারপলের মাথায় একরাশ চিন্তা ঘুরতে লাগল।

লুইজি তাকে বললো, সে কতটা বুঝতে পারছে, ঘটনাটা কোন দিকে গড়াবে?

মারপল কিছু বলল না।

লুইজি তাকে শুধু বলল সে যেন যা করা উচিত তাই করে।

.

২২.

মিস মারপল ক্যারিকে তার সঙ্গে একবার হলঘরে যেতে বলল। একটা জিনিস দেখাবে।

হলঘরে এসে ক্যারিকে মারপল একজায়গায় দাঁড় করাল। এটাকে একটা অভিনয়মঞ্চ ভেবে সামনের দিকে তাকাতে বলল। ক্রিস্টিয়ান হত্যার রাতে যে যেভাবে ছিল সবটা ক্যারিকে কল্পনা করতে বলা হল।

ক্যারি বিস্মিত হলেন।

মারপল তার মনের অবস্থা বুঝল। তারপর সে জাদুর ভেলকির কথা বলতে লাগল। তরুণীকে করাত দিয়ে কাটার কথা ভাবতে ভাবতেই মারপল খুনের ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।

ক্যারি ভাবলেন মারপল পাগল হয়ে গেছে।

মারপল সেই রোমহর্ষক খেলা দেখানোর পদ্ধতি বর্ণনা করে যেতে লাগল। আমরা ভাবি দুটো মানুষ আসলে কিন্তু একটা মানুষ।

ইনসপেক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মারপল বলে চলল একটা মানুষ পার্ক থেকে ঢুকে বাড়ির বাইরে আবার বেরিয়ে যেতে দুমিনিট পয়তাল্লিশ সেকেণ্ড লাগে, এতে দুমিনিটেরও কম সময় লাগবে।

ক্যারি বুঝলেন না।

মারপল বুঝিয়ে দিল লিউইসের অফিসঘরে– স্টাডিরুমে দুজন নয় একজন লোক ছিল। ভেতর থেকে সেটা দেখা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে একজন জানলা খুলে রোয়াকে নামল। দৌড়ে গেল (অ্যালেক্স পদশব্দ শুনেছিল) ক্রিস্টিয়ানের ঘরে ঢুকে গুলি করল। দৌড়ে ফিরে এল। এদিকে ঘরের লোকটি একাই দুজনের গলায় কথা কাটাকাটি চালাল এতক্ষণ। ঐ দুএকমিনিট সময় বাদ দিলে অবশ্য ঘরে দুজনই ছিল।

ক্যারি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলেন। মানে এডগার খুন করেছে আর লুইজিকে বিষ দিয়েছে।

মারপল জানাল বিষ দেবার ব্যাপারটা একদম বাজে কথা। সবার দৃষ্টি ঐ দিকে যাবার জন্য ঘটনা ঐভাবে সাজানো হয়েছে। আর্সেনিকের প্রভাবের সঙ্গে বাতের মিল আছে বলে ঐ সুযোগটা নেওয়া হয়েছে। টনিকে আর্সেনিক বা টাইপরাইটারে চিঠিতে কয়েকটা লাইন জুড়ে দেওয়া ভেলকি ছাড়া কিছু নয়। ক্রিস্টিয়ান ট্রাস্টের ব্যাপারেই এসেছিল। গচ্ছিত টাকা এধার ওধার করেছে কেউ। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সন্দেহটা একজনের ওপরেই গিয়ে পড়ছে– লিউইস সেরাকোল্ড।

.

২৩.

মিসেস ড্যানি রাইডককে লেখা জিনা হেডের একটি চিঠির বক্তব্য হল, সে আগেই জানিয়েছে এডগার একেবারে বোকা লোক। ইনসপেক্টর কথার মারপ্যাঁচে যখন ওকে কাবু করতে লাগল তখন ভয় পেয়ে দৌড়তে দৌড়তে হ্রদে গিয়ে পড়ল। সেখানে একটা পচা নৌকা ছিল সেটাকে ধরল। লিউইস চীৎকার করল। তরপর দৌড়তে লাগল। এডগার সাঁতার জানে না। লিউইস জলে ঝাঁপ দিল তারপর দুজনেই শ্যাওলায় জড়িয়ে গেল। একটা পুলিস দড়ি দিয়ে ওদের টেনে আনল।

মিলড্রেড যখন বলল ওরা ডুবে যাবে এবার লুইজি তাতে শান্তস্বরে সায় দিল।

তারপর সব শেষ। অনেক চেষ্টা করা হল, বাঁচানো গেল না।

লুইজি মিলড্রেডকে নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতর চলে গেল। বোঝা গেল, মা আর মেয়ের মধ্যে টানের ব্যাপকতা।

চিঠির শেষে জিনা আর ওয়ালির আমেরিকায় ফেরার কথা বলা হয়েছে।

.

২৪.

মারপল কিভাবে আন্দাজ করেছিল সেকথা লুইজি তাকে জিজ্ঞেস করল। তাকে একটু রোগা আর দুর্বল লাগছে। সে দুঃখ পেয়েছে তবে খুব একটা ধাক্কা খায়নি।

মারপল বলল, সবাই বলে লুইজি বাস্তব পৃথিবীর বাইরের মানুষ। কিন্তু সে দেখল একমাত্র লুইজিই বোঝাতে পারে কোনটা সত্যি আর কোনটা চোখের ভুল। এডগার সত্যিই লিউইসকে আর জিনা সত্যিই তার স্বামীকে ভালোবাসত। পাগলামিতে এডগার নিখুঁত অভিনয় করেছে।

লিউইসের টাকাকড়ির ব্যাপারে খুব মাথা ছিল। কাজেই সব কর্তৃত্ব তার হাতে চলে গিয়েছিল আর তাতেই মুস্কিলটা বাঁধল।

লিউইস অঙ্কের যাদুকর ছিল। হাজার হাজার টাকা সন্দেহ না জাগিয়ে সরানোর উপায় বের করে ফেলেছিল। ছেলেদের সে শেখাতো। তারা শেখা বিদ্যা নিয়ে লিউইসের সিন্দুক ভরাত তার অসৎ পন্থা ক্রিস্টিয়ান ধরে ফেলেছিল। লুইজিকে নিয়েই একমাত্র চিন্তা ছিল।

ক্রিস্টিয়ান ধরে ফেলেছে বুঝে তৈরি হয়েই ছিল লিউইস। এডগার লোমনের ধরনে আর একজন আছে। তাকেই আনা হয়েছিল লোমনের নাম দিয়ে। সমস্ত ঘটনাটা লিউইস সাজায়। অ্যালেক্স বুঝেছিল বলেই লুইজির কাটা নখ সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ দীর্ঘদিন আর্সেনিক দিলে নখে তার ছাপ পড়বেই।

মারপল বলল সে চেহারার মিল দেখেই বুঝতে পেরেছিল এডগার লিউইসের ছেলে। লিউইসই তাকে জানিয়েছে একথাও বলল। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিল।

লুইজি তাদের দুজনের মধ্যেকার ভালোবাসা কত গভীর ছিল জানাল। তার মনে কোনো সন্দেহই হয়নি। সে জানে লিউইস তাকে বিষ দেবে না। তবে অ্যালেক্স আর আর্নির মৃত্যুর পর তার বিশ্বাস জন্মাল লিউইস ছাড়া আর কেউ একাজ করবে না। লুইজি খুব ভয় পেয়েছিল। এরপর না জানি কী ক্ষতি করে বসে এই ভেবে চিন্তা করত। সে বুঝতে পেরেছে ক্ষমতার সঙ্গে বিনয় ও নম্রতা থাকা চাই।

ডঃ গ্যালব্রেথ লুইজির বিনয়ের প্রশংসা করাতে সে সুন্দর দুটো নীল চোখ মেলে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চাইল। তার যে কোনও গুণই নেই। অন্যের মহত্ত্ব থাকলে সে চোখ মেলে দেখে।

মিস মারপলের মনে হল লুইজি ঠিক একইরকম রয়েছে।

জিনা মারপলকে বলল, তার মিলড্রেড মাসীর কাছেই দিদা ভালো থাকবে। মাসীও বেশ ভালো হয়ে গেছে।

মারপল তাতে সায় দিল। জিনা জানাল এবার সে স্টোনিগেটসের ইতালী, ছেলেমানুষী সমস্ত ভুলে খাঁটি আমেরিকান হয়ে যাবে।

মারপল বললো ওদের দেখে তারও সেই বহু পুরনো দিনের সমস্ত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা– সেই বন্ধুত্ব– কতশত অতীতের কাহিনী।

Exit mobile version