- বইয়ের নামঃ দ্য মুভিং ফিংগার
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
দ্য মুভিং ফিংগার
১-৫. লিমন্টকের শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ
দ্য মুভিং ফিংগার / আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
০১.
লিমন্টকের শান্ত গ্রামীণ পরিবেশেই শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ি পছন্দ হল আমাদের।
বাড়িটার নাম লিটল ফার্জ। যোয়ানা খুব খুশি বাড়ি দেখে। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম।
লিমন্টকের আধমাইল বাইরে জলাভূমির দিকে যাওয়া রাস্তার ওপরেই। সুন্দর সাদা রঙের বাড়ি। সামনে ভিক্টোরীয় যুগের হালকা সবুজ রঙ করা বারান্দা। মিস বার্টন নামে এক অবিবাহিত মহিলা বাড়িটার বর্তমান মালিক।
এরকম একটা অজানা অচেনা পরিবেশে আসার উৎসাহ দিয়েছিলেন আমার ডাক্তার মার্কাস কেন্ট।
তিনি বলেছিলেন, আপনার স্নায়ু আর পেশী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে নিশ্চিত, তবে একটু সময় লাগবে। খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্য ব্যস্ত হবেন না। দীর্ঘদিন ওষুধের ওপর রয়েছেন, স্বাভাবিক ভাবেই স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই শরীরের সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুকেও সেরে ওঠার সময় দিতে হবে। বোনকে নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যান।
একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার চেষ্টা করুন। আপনাকে চিকিৎসক হিসেবে এটাই আমার পরামর্শ।
বিমান ভেঙ্গে পড়ে জবরদস্ত জখম হয়েছিলাম। নার্সিংহোমে টানা পাঁচ মাস চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে। এখন ডাক্তার কেন্টের পরামর্শ মতো লিমন্টকের ভাড়া বাড়িতে নতুন আস্তানা হল আমার আর যোয়ানার।
বয়সে আমি যোয়ানার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।
লিটল ফার্জ ভাড়া নেওয়া হল ছমাসের জন্য। চুক্তিতে আরও তিন মাসের সংস্থান রাখা হয়েছে।
এমিলি বার্টন ছোটখাট চেহারার চমৎকার মহিলা। বাড়িটা ভাড়া দেবার ইচ্ছা ছিল না। আমাদের সঙ্গে কথা বলে তার ভাল লেগেছিল, তাছাড়া আমার অবস্থার কথাও শুনেছিলেন, তাই খুশি হয়েই বাড়িটা আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন।
এমিলি বার্টন জানিয়েছিলেন, তার পনেরো বছরের পার্লারমেইড ফ্লোরেন্স সম্প্রতি বিয়ে করেছে। ওদের হাই স্ট্রীটে একখানা চমৎকার বাড়ি আছে। সেখানে একেবারে ওপরের তলাতেই তিনি থাকবেন।
ওখানে আমাদের নতুন পরিচারিকার সন্ধান করতে হয়নি। এমিলি বার্টনের পরিচারিকা পারট্রিজ আমাদের কাছেই কাজ করতে রাজি হয়ে গেল।
তাকে সাহায্য করবার জন্য একটা মেয়েও রইল-বিট্রিস নাম তার। রোজ সকালে এসে সে পারট্রিজকে সাহায্য করবে।
পারট্রিজ কেমন একটু রুক্ষ প্রকৃতির তবে তার রান্নার হাত প্রশংসনীয়। আমার শরীর সেরে ওঠার জন্য যে ভাল খাবারদাবার দরকার এবিষয়েও সে যথেষ্ট সচেতন ছিল।
আমার বোন যোয়ানা খুবই সুন্দরী আর হাসিখুশি মেয়ে। নাচগান, হৈ হুল্লোড় করেই থাকতে ভালবাসে। প্রেম করে বেড়ানো ওর একটা বাতিক। তবে পল নামে একটা প্রতিভাবান ছেলেকে ও সত্যিই ভালবেসেছিল। কিন্তু সে ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াতে পারেনি। খুবই আঘাত পেয়েছিল যোয়ানা। মনের মেরামতির জন্য তারও একটু নির্জনতার দরকার ছিল।
গ্রামের নতুন জীবনে একদিন একদিন করে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলাম। আমার সুন্দরী বোনের কাছেও গ্রামের জীবন বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছিল।
বেশ চটকদার পোশাক পরেই সে ঘোরাঘুরি করে বেড়ায়। লিমণ্টকের হাই স্ট্রিটে লোকেরা ওর দিকে কেমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বেশ রসিয়ে রসিয়ে সেই গল্প সে করে আমাকে।
এসব নিয়ে আমি অবশ্য তাকে পরিবেশের অনুকূল পোশাক ও মেকআপের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেই। আমার কথা শুনে যোয়ানা খুব মজা পায়, হেসে লুটিয়ে পড়ে।
লিমন্টকে এক সপ্তাহের জীবনেই আমরা মিস এমিলি বার্টন সহ নতুন কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম। এরা হলেন এখানকার একজন উকিলের স্ত্রী মিসেস সিমিংটন, ডাক্তারের বোন মিস গ্রিফিথ, ভাইকারের স্ত্রী মিসেস ভেন ক্যালথ্রপ আর প্রিয়রস এণ্ডের মিঃ পাই।
মেলামেশার নতুন সঙ্গীদের পেয়ে যোয়ানা মন্তব্য করল, এই বেশ হলো, বেশ একটা সুখী পরিবারের মত। জানিস জেরি, আমার মনে হচ্ছে জায়গাটা সত্যিই ভাল। এখানে খারাপ কিছু ঘটে বলে মনে হয় না।
আমিও কথাটা স্বীকার করলাম। লিমণ্টকের মতো জায়গায় খারাপ কিছু ঘটতে পারে ভাবা যায় না। আমরা শান্তিতেই থাকতে পারব।
আমাদের ধারণাটা যে কত হাস্যকর এক সপ্তাহ পরেই হাড়ে হাড়ে বুঝে গেলাম। প্রথম চিঠিটা পেয়েই আমাদের সেই বোবোদয় হল।
.
লিমণ্টক জায়গাটা একটু খোলামেলা। পরিচয় না দিলে আমার এই কাহিনী ঠিক বুঝতে পারা যাবে না।
এই অঞ্চলের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। নর্মান বিজয়ের সময় প্রধানত গির্জার জন্য লিমক বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। একটা বিখ্যাত প্রায়রি এখানে ছিল। কয়েকজন ক্ষমতাশালী প্রিয়রও ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা ভোগ করেছেন। ঈশ্বর সেবার উদ্দেশে ক্ষমতাবান লমবার্ড ও ব্যারনেরা অনেক জমিও দান করেন।
এসব কারণে লিমণ্টক কয়েক শতাব্দী ধরে বেশ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে।
অষ্টম হেনরীর আমলেই সমসাময়িক অনেক গির্জার মতো লিমন্টকের গির্জারও গুরুত্ব খর্ব করা হয়েছিল।
তখন থেকেই ক্ষমতা অর্থ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে এক দুর্গ এখানে প্রধান শক্তির কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ক্ষমতার সেই দুর্গও ভেঙ্গে পড়ে অষ্টাদশ শতকের আধুনিকতার ছোঁয়ায়। চূড়ান্ত অবহেলার কবলে পড়ে লিমণ্টক। রেলপথ, সড়কপথ-অগ্রগতির কোন স্পর্শই লিমণ্টকের ভাগ্যে জোটেনি। অতীতের সমস্ত গুরুত্ব হারিয়ে এক অবহেলিত জনপদ রূপেই থেকে যায়। বিস্তীর্ণ পতিত জমি, জলাভূমি আর কিছু চাষবাসের খেত খামার নিয়েই বেঁচে থাকে লিমণ্টক। পুরনো আমলের একটা গীর্জা, স্যাক্সন আমলের কিছু ধ্বংসাবশেষ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ আর একটা হাই স্ট্রিট–এসবের মধ্যেই কেবল অতীত গৌরবের কিছু পরিচয় এখানে ধরা রয়েছে।
হাই স্ট্রিটের দুপাশে সম্ভ্রান্ত কিছু বাড়িঘর এখনো রয়েছে। কিন্তু দোকান, ডাকঘর, ডাক্তারখানা, সলিসিটর অফিস, আর সাপ্তাহিক বাজার আর এসবের সঙ্গে রয়েছে একটা নতুন স্কুল আর পাঠশালা।
আমরা তো এখানে চিরকাল থাকার জন্য আসিনি, ডাক্তারের উপদেশে কিছুদিনের অবকাশ যাপনই হল উদ্দেশ্য।
তবু যাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল, সেই পাড়াপড়শীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আগ্রহ আমাদের কিছু কম ছিল না।
চিঠিটা এসেছিল প্রাতরাশের সময়। লণ্ডন ডাকঘরের কোন ছাপ ছিল না। বুঝতে পারলাম স্থানীয় চিঠি। টাইপ করে ঠিকানা লেখা।
খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে আনলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, কিছু ছাপা অক্ষর কাঁচি দিয়ে কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। বিষয়বস্তু পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
অত্যন্ত কদর্য ভাষায় কেউ লিখেছে, যোয়ানা আর আমি ভাই বোন নই।
–কার চিঠি? কে লিখেছে?
আমার মুখভাব দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল যোয়ানা।
এই জঘন্য চিঠিটা পড়ে ওর নরম মনে আঘাত লাগতে পারে, ঘটনার আকস্মিকতায় সেই কথাটা একদম মনে পড়ল না। স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিখানা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
–নোংরা–জঘন্য একটা চিঠি। কোন বেনামী চিঠি এমন হয় কখনো শুনিনি। বলল। যোয়ানা।
-আমিও এই প্রথম দেখছি। বললাম।
-আমার পোশাক নিয়ে তুই ঠিকই বলেছিস জেরি। যে লিখেছে চিঠিটা, সে ভেবে নিয়েছে আমি কারও বাতিল হওয়া প্রেমিকা।
–আমরা দু ভাইবোন দেখতেও একরকম নই, এটাও আর একটা কারণ হতে পারে। সেকারণেই ভাই বোন ভাবতে পারেনি।
কথা শেষ করে আমি চিঠিটা চুল্লীর আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
–একদম ঠিক করেছিস। যোয়ানা বলল, কিন্তু ভাবছি, চিঠিটা কে লিখতে পারে?
–সে রহস্য বোধহয় কোন দিনই জানা যাবে না।
–কোন উম্মাদ গোছের লোকই হবে।
প্রাতরাশ শেষ করে যোয়ানা বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বিশ্রী ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলাম।
যোয়ানার ঝলমলে পোশাক আর সৌন্দর্য কেউ একজন নিশ্চয় ভাল মনে মেনে নিতে পারেনি সেই জন্যই আমাদের আঘাত দিতে চেয়েছে। কেননা এর মধ্যে মজা করার কিছু নেই।
নানান ভাবনা মাথায় ঘুরছে বলে বিশ্রী চিঠিটার কথা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছিলাম না।
একটু পরেই ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ এলেন। এখানে আসার পর প্রতি সপ্তাহে একবার আমাকে। পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাঁকেই অনুরোধ করেছিলাম।
মানুষটাকে আমার বেশ ভালই লাগে। একটু ঝাঁকুনি দিয়ে কথা বলেন, একটু লাজুক ভঙ্গী।
আমাকে রুটিন মাফিক পরীক্ষা শেষ করে গ্রিফিথ বললেন, ভালই উন্নতি করছেন। কিন্তু মুখভাব এমন বিরস কেন?
অশ্লীল বেনামী চিঠিটার কথা জানালাম তাঁকে। বললাম, চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে খুব মুষড়ে পড়েছি।
-আপনিও এরকম চিঠি পেয়েছেন?
বেশ উত্তেজিত স্বরে বললেন গ্রিফিথ।
–এখানে এরকমই চলছে নাকি। আগ্রহের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম।
–হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। আপনার বোন ভেঙ্গে পড়েনি তো?
–যোয়ানা খুবই আধুনিকা আর খুবই মনের জোর। ও বেশ মজাই পেয়েছে।
–সে রকম ভাবে নেওয়াই ভাল। খুবই জঘন্য কাজ।
–কিন্তু এসব কাণ্ড কে করতে পারে, আপনার কোন ধারণা আছে?
–না, সবই দুর্বোধ্য। তবে এসব বেনামী চিঠির ব্যাপারে দুরকম কারণ থাকে। কারো যদি বিশেষ কারো প্রতি রাগ বা বিদ্বেষ থাকে সে ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ঘৃণ্য পথ বেছে নিতে পারে।
কোন চাকর, ঈর্ষাপরায়ণ স্ত্রীলোক–এরাই এসব করে থাকে। তবে এদের খুঁজে বার করা খুব কঠিন কাজ নয়।
কিন্তু বিশেষ কাউকে না লিখে যখন ইচ্ছেমতো যাকে তাকে বেনামী চিঠি লেখা হতে থাকে, সেটাই হয় মারাত্মক। মানসিক বিকারগ্রস্ত, হতাশ লোকেরাই তেমন নোংরা কাজ করে থাকে। এদের খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়। তবে কখনো সন্ধান পাওয়া গেলে দেখা যায়, যাদের কথা ভাবা যায় না। তেমনি কেউ একজন সে।
গতবছর গ্রামের অন্যদিকে এরকম একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছে। খুবই রুচিসম্পন্না এক মহিলা, খুবই শান্ত ভদ্র, বেশ কয়েক ওখানে আছেন, এমন বিশ্রী চিঠি লিখেছিলেন।
গ্রামের উত্তর দিকেও এরকম একটা কাণ্ড ঘটেছিল। অবশ্য সেটা ছিল ব্যক্তিগত আক্রোশের কাজ।
–এসব তাহলে অনেকদিন থেকেই চলছে? জানতে চাইলাম আমি।
–ওহ, হ্যাঁ। বিশেষ করে স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক নিযে। ডাক্তার হেসে বললেন, সলিসিটর সিমিংটনকে অভিযোগ করা হয়েছিল তার লেডি টাইপিস্ট মিস গিনচের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে। বেচারি মিস গিনচ সোজা পুলিসের কাছে গিয়েছিল।
আমাকে অভিযোগ করা হয়েছে, আমি নাকি আমার মহিলা রোগীদের সঙ্গে অনৈতিক ব্যবহার করে চলেছি।
এসমস্ত কিছুই অবাস্তব আর পাগলামো ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এটাও ঠিক মন বড় বিষিয়ে তোলে। বড় ভয় পাই আমি এসবে।
–সত্যিই তাই। বললাম আমি।
-যতই বলি না কেন নোংরা ছেলেমানুষি, কোন এক সময় যে কোন একটা ঠিক সত্যি হয়ে উঠতে পারে।
অশিক্ষিত সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মানুষের মন এসবের প্রতিক্রিয়া সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এরফলে নানা ধরনের বিপদ ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়।
–আমার চিঠিটা যে লিখেছে, তাকে অশিক্ষিত বলেই তো ভাবছি।
–তাই হবে হয়তো।
এরপর ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ বিদায় নিলেন।
.
০২.
ব্যাপারটাকে আমি তাড়াতাড়ি ভুলে যাবারই চেষ্টা করতে লাগলাম। কেন না এরকম একটা বাজে ব্যাপারের কোন গুরুত্ব থাকতে পারে বলে আমার মনে হল না। হয়তো কোন ছিটগ্রস্ত স্ত্রীলোকের বিকারজনক কাজ।
কিন্তু আমার মোহভঙ্গ হল পরের সপ্তাহেই।
সেদিন পারট্রিজ গম্ভীর মুখে এসে আমাকে জানাল প্রতিদিনের কাজের মেয়েটি, বিট্রিজ আজ কাজে আসবে না।
–ওর হয়তো শরীর খারাপ হতে পারে। বললাম আমি।
–শরীর ঠিক আছে স্যর, ও খুবই ভেঙ্গে পড়েছে।
এরপরই মারাত্মক কথাটা শোনাল পারট্রিজ, আমাকে জড়িয়ে খুব খারাপ ইঙ্গিত করে একটা চিঠি তাকে লেখা হয়েছে।
শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। মেয়েটাকে আমি ভাল করে এখনো পর্যন্ত লক্ষই করিনি। শহরে হঠাৎ দেখলে চিনতেই পারব না। তাছাড়া আমি একজন লাঠিতে ভর দিয়ে চলা অসুস্থ মানুষ।
–এসব কি আজেবাজে কথা। খুবই বিরক্তির সঙ্গে বললাম আমি।
–বিট্রিসের মাকে আমি বলেছি সবই স্যর। এ বাড়িতে আমি যতক্ষণ আছি, এরকম কিছু ঘটবে না। তবে অন্য কোথাও কিছু হয়ে থাকলে আমি বলতে পারব না।
আমি জানি স্যর, বিট্রিসের এক বন্ধু আছে, সে গ্যারাজে কাজ করে। সেও এই রকম খারাপ একটা চিঠি পেয়েছে।
কেমন গোলমাল মনে হচ্ছে আমার স্যর, আমি বলি মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দেওয়াই ভাল। কিছু একটা আছে এর মধ্যে, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না।
.
সেদিন সকালে বেশ তেজী রোদ ছিল। বাতাসে কেমন বসন্তের আমেজ মাখানো। রাস্তায় একটু হাঁটবো বলে দুটো লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কিছু কাজও অবশ্য ছিল। সিমিংটনদের অফিসে যাব, কিছু শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করতে হবে। রুটিওয়ালা শক্ত রুটি দিয়েছিল, তাকেও কথাটা বলতে হবে। তাছাড়া ব্যাঙ্কেও যেতে হবে একবার।
যাতে দেরি না হয় মধ্যাহ্ন ভোজে যোয়ানা আমাকে পাহাড়ের কাছ থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসবে। তার সঙ্গে সেরকম কথা থাকল।
লিমন্টকের হাই স্ট্রীট এমন জায়গা যেখানে গেলে সকলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। খবরাখবর আদান-প্রদান হয়। আমিও আশা করলাম পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
শহরের পথে কিছুটা এগিয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে সামনে হাজির হল মেগান হান্টার। ও হল উকিল সিমিংটনের সৎ মেয়ে, মিসেস সিমিংটনের প্রথম বিয়ের সন্তান।
এখানে আসার পরে শুনেছি, ক্যাপ্টেন হান্টার মিসেস সিমিংটনের প্রতি খুবই খারাপ ব্যবহার করতেন। বিয়ের পর দুবছরও মহিলা তার সঙ্গে থাকতে পারেন নি। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। অনেক পরে তিনি এখানকার এক অবিবাহিত ভদ্রলোককে বিয়ে করেন। তিনিই রিচার্ড সিমিংটন।
এই বিয়েতে তাদের দুটি ছেলে হয়। তারা বাপমায়ের খুবই আদরের। মিসেস সিমিংটনকে সুন্দরী বলা চলে। তবে কেমন ফ্যাকাসে চেহারা। মেগানের সঙ্গে তার চেহারার মিল নেই একদম। ও বেশ লম্বা, মাথায় একরাশ বাদামী চুল, পাতলা সুশ্রী মুখ। সব সময় হাসিখুশি।
মেগানের বয়স প্রায় কুড়ি। কিন্তু দেখলে মনে হয় ষোল বছরের স্কুলের মেয়ে।
-ল্যাসার্সের খামারে গিয়েছিলাম হাঁসের ডিম যদি পাওয়া যায়। সাইকেল থেকে নেমে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল মেগান, দেখলাম আপনি একা চলেছেন
একটু থেমে মুখ ভরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে মেগান ফের বলল, আপনার বোন খুব সুন্দর, একদম আপনার মতো নয়।
-ভাইবোনেরা সব সময় একইরকম দেখতে হয় না। আমি বললাম।
–ঠিকই বলেছেন, আমিও ব্রায়ান বা কলিনের মতো নই। কেমন অদ্ভুত, তাই না?
আমি নিঃশব্দে হাসলাম। খানিকটা পাশাপাশি হেঁটে যাবার পর মেগান বলল, আপনি প্লেনে ওড়েন, তাই না।
-হ্যাঁ।
–তা করতে গিয়েই আহত হন?
–হ্যাঁ, প্লেন ভেঙ্গে পড়েছিল।
–হায় ভগবান। আমার ট্রেনে উঠতেই ভয় করে।
–সারাদিন তুমি কি কর মেগান? আমি জানতে চাইলাম।
-এখন আর কি করব, এক বছর আগে স্কুল ছেড়েছি। এখানে তেমন মেয়েও নেই যে তাদের সঙ্গে মিশব। এমনি ঘোরাঘুরি করেই কেটে যায় দিন। কথা বলতে বলতে আমরা হাই স্ট্রিটে এসে পড়েছিলাম। হঠাৎ মেগান তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ, মিস গ্রিফিথ এদিকে আসছেন।
-কেন, ওকে তুমি পছন্দ কর না?
–একদম না। দেখা হলেই ওর সেই বিচ্ছিরি গার্ল গাইডে যোগ দেবার কথা বলেন। ওই ব্যাপারটা আমার একদম অপছন্দ।
মেগানের কথা শেষ হতে না হতেই ডাক্তারের বোন মিস এমি গ্রিফিথ এসে পড়লেন।
মহিলার চেহারায় কিছুটা পুরুষালী ভাব থাকলেও সৌন্দর্যময়। কণ্ঠস্বর মিষ্টি ও জোরালো।
মেগান তার সঙ্গে দু-একটা মন রাখা কথা বলে সাইকেলটা রাস্তার ধারে রেখে ইন্টারন্যাশনাল স্টোর্সে ঢুকে পড়ল।
-অদ্ভুত কুঁড়ে মেয়ে, বললেন মিস গ্রিফিথ, কেবল ঘুরে ঘুরে কাটাবে। ওর মা মিসেস সিমিংটন, কিছু শেখানোর জন্য বলে বলে হার মেনেছেন। মেয়েটা ওর বাবার মতোই হয়েছে।
আমি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে কথা শোনার ফাঁকে তাকে লক্ষ্য করছিলাম। সব কথা কানেও যাচ্ছিল না।
হঠাৎ রাস্তার অন্য দিকে কাউকে দেখতে পেয়ে মিস গ্রিফিথ সেদিকে ছুটলেন। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মহিলার জোরালো ব্যক্তিত্ব কেমন অস্বস্তি ধরায়।
আমি প্রথমে ব্যাঙ্কের কাজটা মেটালাম। তারপর গেলাম উকিল সিমিংটনের অফিসে। একজন গ্রামীণ আইনজ্ঞের অফিস যেমন হওয়া উচিত অফিসটা তেমনি, বেশ সুন্দর। ঘরের চারপাশেই দলিলের বাক্স সাজানো। বাক্সের গায়ে নানা নামের লেবেন লাগানো।
রিচার্ড সিমিংটনের বাইরের চেহারাটা আপাত রুক্ষ মনে হলেও বেশ সদাশয় মানুষ।
আমার আনা কাগজপত্র দেখে অল্প সময়ের মধ্যেই কাজটা সেরে দিলেন। আমিও যাওয়ার জন্য উঠলাম।
–আপনার সৎ মেয়ে মেগানের সঙ্গে পথে আজ দেখা হল।
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কথাটা বললাম।
মিঃ সিমিংটন কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরে হেসে বললেন, ওহ, মেগানের কথা বলছেন? সবে স্কুল ছেড়ে এসেছে। ভাবছি কোন একটা কাজে লাগিয়ে দেব। অবশ্য বয়সও খুব বেশি নয়।
বাইরের অফিসে একমাথা কোকড়ানো চুল, মাঝবয়সী এক মহিলা দ্রুত টাইপ করে চলেছেন। তাকে দেখে ডাঃ গ্রিফিথের কথা আমার মনে পড়ল। ইনিই নিশ্চয় মিস গিনচ।
ওকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে কোন গোপন সম্পর্ক থাকা একেবারেই অসম্ভব।
এরপর রুটিওয়ালার দোকান হয়ে রাস্তার ধারে এসে যোয়ানা আর তার গাড়ির খোঁজে চারপাশে তাকালাম। যোয়ানকে কোথাও চোখে পড়ল না।
আচমকা সামনে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। মনে হল কোন ভাসমান দেবীমূর্তি রাস্তার পাশ দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টি যেন আটকে গেল। নিখুঁত গড়ন। এমন চমৎকার মানানসই চেহারা, চলার ভঙ্গী, কুঞ্চিত সোনালী কেশগুচ্ছ, কোন দেবীমূর্তি ছাড়া সম্ভব নয়।
আশ্চর্য মহিমান্বিত তরুণীকে দেখে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে আমার হাতের কিসমিসের রুটি রাস্তার ওপরে খসে পড়ে গেল। ওটা ধরতে গিয়ে, ভারসাম্য হারিয়ে লাঠি সমেত আমিও পড়ে গেলাম।
সেই দেবীমূর্তিই এগিয়ে এসে শক্ত দুই হাতে আমাকে টেনে তুলল। রুটি আর লাঠিও তুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
আমি অস্ফুটস্বরে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমার যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
-ধন্যবাদের কিছু হয়নি, ও কিছু না। নিতান্তই সাদামাটা কণ্ঠের কথা আমার কানে ভেসে এলো।
আমারও মোহভঙ্গ হল। বেশ স্বাস্থ্যবতী চটপটে একটি মেয়ে ছাড়া বেশি কিছু মনে হল না তাকে।
এমন বিসদৃশ সহাবস্থান যে সম্ভব আমার ধারণা ছিল না। ওই রূপের পাশাপাশি নিরুত্তাপ অতি সাধারণ কণ্ঠস্বর বড় বেশি বেমানান।
যোয়ানা কখন আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল বুঝতে পারিনি। ও জানতে চাইল কিছু ঘটেছে কিনা।
না কিছু না, ওর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, একটা বিচ্ছিরি রকমের ধাক্কা খেলাম। ও কে বলতে পারিস?
একটা গর্বিত হংসিনীর মতো অনেকটা সাঁতার কাটার ভঙ্গীতে এগিয়ে চলা মূর্তিটির দিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
-ওহ, ও হল সিমিংটনদের নার্সারী গভর্নের্স। ওকে দেখেই তোর এমন বেসামাল অবস্থা? দেখতে সুন্দর তবে বড়ই নিরুত্তাপ।
–হ্যাঁ, বললাম আমি। বাইরের সৌন্দর্যটা করুণভাবে অপচয়িত হয়েছে।
যোয়ানা গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিল। আমি উঠে বসলাম।
.
০৩.
প্রাচীন ভাঙ্গা গির্জার এলাকায় প্রিয়রস লজে বাস করেন মিঃ পাই। সেদিন বিকেলে আমরা তাঁর ওখানে গেলাম চা পান করতে।
ছোটখাট গোলগাল চেহারার মানুষ মিঃ পাই। নিজে যেমন ছিমছাম তেমনি বাড়ির প্রতিটি জিনিস সাজানো গোছানো আর বেশ ঝকঝকে। অনেক প্রাচীন জিনিস তিনি অতি যত্নের সঙ্গে মিউজিয়মের মতো সাজিয়ে রেখেছেন। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের সব দেখালেন।
একথা সেকথার পর একসময় মিঃ পাই বললেন, আপনারা বেশ সুন্দর বাড়িই পেয়েছেন। এমিলি বার্টনদের অনেকদিন থেকেই আমি জানি। আমি যখন এখানে আসি, তখন ওদের বৃদ্ধা মা বেঁচে ছিলেন। বিশাল চেহারা ছিল তার। পাঁচপাঁচটা মেয়েকে নিয়ে দারুণ দাপটে চলতেন। সবচেয়ে বড় মেয়েটির বয়সই ছিল তখন ষাটের কাছাকাছি। মায়ের সেবা করার জন্য তটস্থ থাকতো সকলে।
অদ্ভুত কি জানেন, বাড়িতে বাইরের লোকের আনাগোনা একদম পছন্দ করতেন না মহিলা। মেয়েদের বন্ধুদের কাউকে আনার উপায় ছিল না। এই করে মেয়েরা অবিবাহিতই থেকে গেল।
আমরা নিবিষ্টভাবে মিঃ পাইয়ের কথা শুনছিলাম। যোয়ানা বলল, এ যে একেবারে কোন উপন্যাসের কাহিনী বলে মনে হচ্ছে।
-হ্যাঁ, সেরকমই বলতে পারেন। ওদের বাড়িতে আছেন তো, ওই পরিবারের কথা আপনাদের জানা দরকার। প্রায় সাতানব্বই বছরে মারা যান মহিলা। মেয়েদের বিয়ে করার বয়সও পার হয়ে গেছিল ততদিনে। তাদের সহ্যশক্তিও বেশি ছিল না, একের পর এক মারা গেলেন। নানা অসুখে ভুগে। বেচারি ম্যাকেল দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, এমিলি সাধ্যমতো সেবা করেছেন তার। চমৎকার মহিলা। তবে অর্থকরী সমস্যায় পড়েছেন বলে বোধহয়।
–শুনেছিলাম, ভাড়া দেবার ইচ্ছে ছিল না–যোয়ানা বলল।
–তবুও, উনি নিজেই আমাকে বলেছেন ভাল ভাড়াটিয়া পেয়ে খুশি হয়েছেন।
–বাড়িটা খুবই নিরিবিলি। বললাম আমি।
–আপনার ওরকমই লাগছে? অবাক হবার মত কথাই বটে। বললেন মিঃ পাই।
–কিছু কি বলতে চাইছেন মিঃ পাই? যোয়ানা জানতে চাইল।
অন্য কিছু না। আমার ধারণা মানুষের চিন্তা আর ধারণা বাড়ির আবহাওয়ার মধ্যে উপলব্ধি করা যায়। অবশ্য এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আরও কিছু কথাবার্তার পর আমরা শুভরাত্রি জানিয়ে উঠে পড়লাম।
.
দুদিন পরে শনিবারের বিকেলে আমরা সিমিংটনদের বাড়িতে ব্রিজখেলার আসরে যোগ দিলাম।
সেখানে খেয়োলাড় হিসেবে পেয়েছিলাম আমরা দুজন, সিমিংটন দম্পতি, মিস গ্রিফিথ, মিঃ পাই, মিস বার্টন আর কর্নেল অ্যাপলটন।
কর্নেলের সঙ্গে সেদিনই পরিচিত হলাম। তিনি থাকেন সাতমাইল দূরের কুম্বত্রকার নামে এক গ্রামে। ভদ্রলোক ব্রিজ খেলতে খুবই ভালবাসেন। বয়স ষাটের কাছাকাছি। যোয়ানাকে দেখে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে খেলার ফাঁকে ফাঁকেই ওর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। আমার সুদর্শনা বোন যে তার মন হরণ করেছে, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।
সিমিংটনদের নার্সারী গভর্নেস সেই এলসি হল্যাণ্ডকে সেদিন কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। তবে তার রূপের সম্মোহন আগের মত প্রভাবিত করতে পারেনি। তার রূপ আর সুগঠিত দেহের অপচয় খুবই অসহনীয় ঠেকছিল।
মেয়েটির কথাই যে নিরুত্তাপ আর সাদামাটা তাই নয়, দাঁত প্রায় সমাধি প্রস্তরের মতো আর হাসলে মাড়ি বেরিয়ে পড়ে। এসব দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি।
আমরা যখন খেলতে বসেছি, তার কিছু পরেই বাচ্চাদের নিয়ে লঙব্যারেজে বেড়াতে চলে গেল। মিসেস সিমিংটনকে বলে গেল–অ্যাগনেসকে বলে গেছি, পাঁচটায় চা দিতে।
আমাদের সম্মানেই খেলার আয়োজন হয়েছিল। তাই আমি আর যোয়ানা বসেছিলাম, মিসেস সিমিংটন মিঃ পাইয়ের বিপক্ষে।
ঠিক পাঁচটাতেই ডাইনিংরুমে একটা বড় টেবিলে আমাদের চা পরিবেশন করা হয়েছিল। আমাদের চা পানের ফাঁকেই হাসিখুশি দুটি বাচ্চা লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকল। সিমিংটন দম্পতি বেশ আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচয় দিলেন।
একটু পরেই মেগান এসে ঘরে ঢুকল। ও আমাদের সঙ্গে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে করমর্দন করল। তাকে দেখে মিসেস সিমিংটন বলে উঠলেন, এই তো মেগান এসে গেছে। তোর চা বাচ্চারা আর মিস হল্যাণ্ড নিয়ে নিয়েছে।
-ঠিক আছে, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।
মেগান ঘর ছেড়ে চলে গেল। আজও চোখে পড়ল, সেদিনের মতোই অপরিচ্ছন্ন পোশাক মেগানের গায়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে কি জানি কেন মিসেস সিমিংটনের দিকে তাকিয়ে আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। মহিলাকে আমার খুবই নির্দয় আর স্বার্থপর বলে মনে হল।
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসে যোয়ানা একসময় বলল, মেয়েটার জন্য আমার খুবই দুঃখ হয়। বড় অবহেলিত।
-তুই লক্ষ্য করেছিস তাহলে?
-হ্যাঁ। ওর মা ওকে পছন্দ করে না, বোঝা গেল। ওকে যে পরিবার থেকে আলাদা ভাবা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা মেগানের বুঝতে না পারার কথা নয়। খুবই সবেদনশীল মেয়ে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে খুবই অসুখী–বাইরের হৈচৈ দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।
–ঠিকই বলেছিস, আমারও তাই মনে হয়। বললাম আমি।
পাহাড়ী পথে গাড়ি ছুটে চলেছে। যোয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, একটা ব্যাপার আমার খুব ভাল লাগল দেখে। জীবনীশক্তি ফিরে আসার লক্ষণ তোর মধ্যে ফুটে উঠেছে।
–বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছিস। বললাম আমি।
-নার্সিংহোমে থাকার সময় এক সুন্দরী নার্স তোর সেবা করত। তুই তার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখিসনি। কিন্তু আজ দেখলাম, যতবার গভর্নেস মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিস, ততবারই তার মুখে পুরুষসুলভ খুশির ভাব ফুটে উঠছিল। মেয়েটা দেখতে ভাল, সন্দেহ নেই। তবে তার মধ্যে যৌন আবেদন বলে কিছু নেই। খুবই অদ্ভুত।
–তুই নিজের কথা ভাব, যোয়ানা। বললাম আমি।
–কেন আমি আবার কি করলাম?
করিসনি। তবে যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, পলের কথা ভুলে গিয়ে তোকে ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথের দিকেই হাত বাড়াতে হবে। কর্নেল ভদ্রলোকের বয়সটা নেহাই বেশি, নইলে যেভাবে ক্ষুধার্ত ব্লাড হাউণ্ডের মতো তোর দিকে তাকাচ্ছিলেন
তাই করছিলেন বুঝি, হেসে উঠল যোয়ানা, এমিও তার দিকে বন্দুক তাগ করতে চাইবে আমার ধারণা।
ভুলে গেলে চলবে না যোয়ানা, আমরা এখানে এসেছি নিরিবিলিতে অবকাশ যাপন করতে। আমাদের তা বজায় রাখতে হবে।
.
নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ভোগ করার ভাগ্য নিয়ে আমরা যে লিমন্টকে আসিনি দিনে দিনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
সপ্তাহ খানেক পরে আমাদের ছাড়িয়ে দেওয়া কাজের মেয়েটি, বিট্রিসের মা মিসেস বেকার এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।
তাকে আমার চেনার কথা নয়। পারট্রিজই তাকে নিয়ে এল আমার কাছে।
ভদ্রমহিলা বেশি বিনয় প্রকাশ করতে গিয়ে তার বক্তব্য এমন গুলিয়ে ফেলছিলেন যে তার সারোদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল আমার পক্ষে।
যোয়ানা কি কাজে বাইরে গিয়েছিল। তাই আমাকেই সামাল দিতে হচ্ছিল ব্যাপারটা।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মোদ্দা কথাটা বোঝা গেল, মিসেস বেকার আমার পরামর্শ নিতে এসেছেন। তার ধারণা, আমরা লণ্ডনের শিক্ষিত ভদ্রমানুষ, তার মেয়ের ব্যাপারটা কি করা উচিত আমিই ভাল বলতে পারব।
সেই বেনামী চিঠি পাবার পর মেয়েকে তিনিই কাজটা ছাড়ার কথা বলেছিলেন তাই করেছিল সে। এখন আর এক মুশকিলে পড়েছে ব্রিট্রিস।
খামারে কাজ করে, জর্জ নামে একটি ছেলের সঙ্গে বিট্রিসের ভাব আছে। সেই ছেলেটিও ইতিমধ্যে একটি চিঠি পেয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে বিট্রিস নাকি কোন এক ফ্রেড লেডবেটারের ছেলে টমের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে।
চিঠি পাবার পর জর্জ ক্ষেপে আগুন হয়ে গেছে। সে বলেছে বিট্রিস অন্য ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা সে সহ্য করবে না।
বিট্রিস বারবার জর্জকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, চিঠির কথা একেবারে মিথ্যা। তাতে জর্জ আরও ক্ষেপে আগুন হয়েছে। এরপরই নিরুপায় হয়ে মিসেস বেকার আমার কাছে ছুটে এসেছেন।
আমি খুবই দুঃখিত হলাম ঘটনাটা শুনে। মিসেস বেকারকে পরামর্শ দিলাম পুলিসের কাছে। যেতে। পুলিস ছাড়া এসব নোংরা চিঠি লেখা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
–ও বাবা। পুলিসের কাছে যেতে পারব না স্যর। কোনদিন যাইনি আমরা কেউই। বললেন মিসেস বেকার।
পরে তিনি আবার বললেন, খুবই খারাপ ব্যাপার হচ্ছে স্যর এসব। ব্ল বোরের মিঃ আর মিসেস বিডলও এরকম চিঠি পেয়েছেন। খুবই সুখী মানুষ ছিলেন তারা। কিন্তু ওই চিঠি পাবার পর ভদ্রলোক কেমন যেন হয়ে গেছেন।
আমি এই সুযোগে জানতে চাইলাম, এসব ভয়ানক নোংরা চিঠি কে লিখছে এ বিষয়ে তার কোন ধারণা আছে কিনা।
-ধারণা বেশ ভালরকমেই আছে স্যর। বললেন, মিসেস বেকার, মিসেস ক্লিটের কাজ, আমরা সবাই তাই জানি।
সন্দেহ ভাজন মিসেস ক্লিটের পরিচয়ও তার কাছ থেকে জানা গেল। মহিলা একজন মালীর স্ত্রী। কারখানায় যাওয়ার রাস্তাতেই তার বাড়ি।
কি কারণে মিসেস ক্লিটকে সন্দেহ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্য কিছুই জানা গেল না মিসেস বেকারের কাছ থেকে।
তিনি শুধু বললেন, এসব করার মতোই লোক তিনি।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আর একবার পুলিসের কাছে যাবার পরামর্শ দিয়ে মিসেস বেকারকে বিদায় করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুবই ভাবনা দেখা দিল আমার। ক্লিট নামের স্ত্রীলোকটির বিষয়ে খবরাখবর নিতে হবে স্থির করলাম। গ্রামের সবাই যখন তাকে দায়ী ভাবছে, কথাটা কতটা সঠিক একবার অনুসন্ধান করা দরকার।
ডাঃ গ্রিফিথ ওই মিসেস ক্লিটকে অবশ্যই চিনতে পারবেন। ঠিক করলাম তার কাছেই জানতে চাইব। তেমন মনে করলে ব্যাপারটা পুলিসের গোচরে আনতে হবে।
আমি যখন ডাঃ গ্রিফিথের সার্জারিতে ঢুকলাম তখন তিনি শেষ রোগীটিকে দেখছেন।
কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি তাকে মিসেস বেকারের সঙ্গে আমার কথাবার্তার বিষয় সংক্ষেপে জানালাম। মিসেস ক্লিট সম্পর্কে গ্রামের সকলের ধারণার কথাও বললাম।
-ব্যাপারটা এত সহজ নয় মিঃ বারটন। ক্লিট নামের স্ত্রী লোকটি ওসব চিঠি চাপাটির পেছনে আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
আমাকে হতাশ করে বললেন গ্রিফিথ।
পরে তিনি জানালেন, মিসেস ক্লিট হলেন স্থানীয় ডাইনী। আজকালকার যুগেও কোন বিশেষ লোক বা বিশেষ পরিবার সম্পর্কে নানা কারণেই মানুষের মনে একটা অন্ধ কুসংস্কার গেঁথে যায়। লোকেরা এমন বিশেষ মানুষ বা পরিবারকে এড়িয়ে চলবারই চেষ্টা করে, তারা ভাবে এদের কোনভাবে অসন্তুষ্ট করলে নিজেদের ক্ষতি হবে।
মিসেস ক্লিট এক অদ্ভুত প্রকৃতির স্ত্রীলোক। গ্রামে কারোর কোন অমঙ্গল বা ক্ষতি হলে তিনি আগ বাড়িয়ে জাহির করেন, কবে তার গাছ থেকে আপেল ছিঁড়েছিল কিংবা তার বেড়ালের লেজ ধরে টেনেছিল, সেজন্যই এমনটি ঘটল। এমনি সব কারণেই সকলে তাকে খানিকটা বিদ্বেষের চোখে দেখে।
আর এসব চিঠির পেছনেও সে আছে, এমনটাও এই কারণ থেকেই সকলে ভাবছে। তবে ব্যাপারটা আমার মোটেও ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে এই চিঠির ঘটনা থেকে শিগগিরই কোন ক্ষতি হতে চলেছে।
.
বাড়ি ফিরে দেখলাম মেগান বারান্দায় বসে আছে। আমাকে দেখে বললো, হ্যাল্লো, আমি কি আজ মধ্যাহ্নভোজে আসতে পারি?
–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আমি বললাম।
আমি ওকে বসতে বলে ভেতরে গিয়ে পারট্রিজকে তিন জনের মতো খাবার তৈরি করতে বলে এলাম।
–সব ঠিক আছে তো? যদি কিছু তৈরি করতে অসুবিধা হয়, আমিও হাত লাগাতে পারি।
–কোন দরকার হবে না। তুমি শান্ত হয়ে বোস, আইরিশ স্টু বানানো হচ্ছে।
–আপনি খুব ভাল।
একটু থেমে পরক্ষণেই আবার বলল, আপনিও কি সকলের মতোই ভাবেন আমি অদ্ভুত রকমের একটা মেয়ে?
-কেন তা ভাবব কেন?
কারণ আমি যে তাই। তবে আমি বোকা নই। ওরা জানে না আমার ভেতরটাও ওদেরই মতো আর আমি ওদের মন থেকে ঘেন্না করি।
–ঘেন্না কর? কিন্তু কেন?
–আমার জায়গায় থাকলে আপনিও তাই করতেন। আপনি ঘেন্না না করে পারতেন না। মেগানের ভেতরের বঞ্চিত বিষণ্ণ সভা ধীরে ধীরে আমার কাছে প্রকাশিত হয়ে আমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে লাগল।
বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
–জানেন, আমাকে কেউ চায় না। আমি তা বেশ ভালই বুঝতে পারি। মা আমাকে মোটেই পছন্দ করে না। কেন তাও আমি জানি। আমাকে দেখে মার মনে পড়ে যায় বাবার কথা। আমি শুনেছি বাবা মার প্রতি খুব নিষ্ঠুর ব্যবহার করতেন। মুখে তিনি ওসব বলতে পারেন না, কিন্তু আমাকে এভাবে ভুগতে হয়। আমি বুঝতে পারি, মা কেবল চান তার বাচ্চাদের আর সৎ বাবাকে নিয়ে থাকতে।
–তুমি কোথাও গিয়ে নিজের মতো থাকলেই তো পার। বললাম আমি।
–তাহলে তো আমাকে রোজগারের জন্য কোন কাজ করতে হয়। কিন্তু কি করব?
–কেন, শর্টহ্যাণ্ড, টাইপ এমনি কিছু শিখে নিতে তো পার।
–ওসব আমার ভাল লাগে না। কিন্তু—
কিন্তু কি–
দুটি জলে ভরা চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল মেগান। ধীরে ধীরে বলল, আমি কেন সরে যাব? ওরা কেন আমাকে চাইবে না? আমি ওদের সঙ্গেই থাকব আর ওদের দুঃখ দিয়ে যাব।
একটু পরেই যোয়ানা ফিরল। গায়ের স্কার্ফ খুলে আমার পাশে বসতে বসতে বলল, গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আজ বেশ কয়েক মাইল হাঁটলাম। কি ব্যাপার, মেগানের মুখ অমন থমথমে কেন?
আমি মেগানকে বললাম, তুমি ভেতরে যাও, ওপরের বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নাও।
মেগান অতিবাধ্য বালিকার মতো উঠে ভেতরে চলে গেল।
-মেগান আজ আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে আসছে। বললাম আমি।
-তাই নাকি, খুব ভাল কথা। তাহলে আমিও ভেতরে যাই–হাতমুখ ধুয়ে আসি।
আমি একা বারান্দায় বসে বেচারী মেগানের কথাই ভাবতে লাগলাম।
.
০৪.
ভাইকার ডেন ক্যালথ্রপ আর মিসেস ক্যালথুপের কথা এতক্ষণ কিছু বলা হয়নি। অথচ তারা উভয়েই বিশিষ্ট ব্যক্তি।
ডেন ক্যালথ্রপ মানুষ হিসেবে চমৎকার, সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যেই প্রায় ডুবে থাকেন। গির্জার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান।
অন্যদিকে মিসেস ক্যালথ্রপও দৃঢ় চরিত্রের এক অসাধারণ মহিলা। তিনি সাধারণত অন্যের ব্যাপারে নাক গলান না। কিন্তু সব ব্যাপার জেনে নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। গ্রামের সকলেই তাকে কেমন যেন ভয় পায়।
মেগান যেদিন আমাদের এখানে মধ্যাহ্নভোজে আসে তার পরদিন মিসেস ক্যালগ্রুপের সঙ্গে হাই স্ট্রিটে আমার দেখা হয়।
–ওহ মিঃ বারটেন, আপনাকে একটা ব্যাপার জিজ্ঞাসা করবার ছিল। বেনামী-চিঠির কি এক গল্প চালু করেছেন শুনলাম।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি চালু করিনি কিছু, আগে থেকেই ব্যাপারটা ছিল।
-আগে থেকেই ছিল বলছেন? কিন্তু এখানে এসব করবার মতো কেউ আছে বলে তো জানি না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি। তারপর আকাশেৰ দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কি দেখতে দেখতে বললেন, হাস্যকর সব চিঠি–একেবারেই অবাস্তব।
আমি ইতস্তত করে বললাম, আপনিও কি–ইয়ে–মানে–এরকম চিঠি পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, তিনটে চিঠি পেয়েছি। হাস্যকর সব কথা লেখা ছিল–ক্যালের আর স্কুলের শিক্ষিকাকে নিয়ে কিন্তু আমি ভাল রকমই জানি ক্যালেরে ওরকম কাজ করা কোন কালেই সম্ভব নয়। তবে ওরা যা লিখছে–এসব যে গ্রামে কিছু হচ্ছে না তা নয়
-তার মানে আপনি বলছেন ওরা সত্য কথাগুলো জানে?
-হ্যাঁ। এখানে যে ব্যাভিচার বা লজ্জাজনক কিছু ঘটনা তা তো নয়। অনেক ব্যাপারই গোপনে ঘটে চলেছে। আপনার চিঠিতে কি লিখেছিল?
–লেখা ছিল আমি আর যোয়ানা ভাই বোন নই।
–কিন্তু ও তো আপনার বোন
–হ্যাঁ, যোয়ানা আমার বোন।
–তবে অন্য কিছু থাকা অসম্ভব নয়।
ঠিক এই সময়ে চোখে পড়ল এমি গ্রিফিত ইন্টারন্যাশনাল স্টোর্সে ঢুকছেন।
মিসেস ক্যালথ্রপও তাকে দেখলেন, অনুকম্পাসূচক মন্তব্য করলেন বেচারি। পরক্ষণে আমার দিকে ফিরে বললেন, কিন্তু এসব ব্যাপার মোটেই ভাল না। একেবারে অন্ধ ঘৃণা…জেনে রাখবেন এ হলো দারুণ ঘৃণার ব্যাপার।
মিসেস ক্যালথ্রপ সেদিন যে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তার প্রমাণ পেতে একদিনও দেরি হল না আমাদের।
বেদনাদায়ক ঘটনাটার কথা পারট্রিজই প্রথমে আমাদের জানাল।
সকালে চায়ের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে ও বলল, ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বিকেলে বেচারি মিসেস সিমিংটন মারা গেছেন?
মারা গেছেন? কি বলছ? যোয়ানা শঙ্কিত কণ্ঠে জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। মারা গেছেন। তবে আত্মহত্যা করেছেন। কথাটা সত্যিই, মিস।
–ওহ। যোয়ানা স্তম্ভিত হয়ে গেল, মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেছেন, এতো ভাবাই যায় না।
সেই বিচ্ছিরি চিঠি, পারট্রিজ বলল, কিন্তু যতই জঘন্য হোক এসব, এর জন্য একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করবে? সত্যি কিছু না থাকলে এমন হয় না মিস।
বেশ কিছুদিন আগে ওয়েন গ্রিফিথের বলা কথাটা আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, শিগগিরই এসব নিয়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। দেখছি তাই সত্যি হল।
–মেগান মেয়েটার এখন কি হবে? ওর জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে–একমাত্র অবলম্বন ছিল মা। যোয়ানা বলল।
অন্য বাচ্চাদের তাদের গভর্নেসই সামলে রাখতে পারবে। কিন্তু মেগানের পক্ষে মানিয়ে চলা এখন খুবই কষ্টকর হবে। বললাম আমি।
প্রাতরাশের পরে আমরা দু ভাইবোন মিলে মিঃ সিমিংটনের বাড়ি গেলাম। সেখানে ডাঃ গ্রিফিথের সঙ্গেও দেখা হল। মিঃ সিমিংটন একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন দেখলাম। মিস হল্যাণ্ড যথাসাধ্য করে বাচ্চাগুলোকে সামলাচ্ছেন।
জানা গেল, গতকাল বিকেলের ডাকে চিঠিটা এসেছিল। অভিযোগ ছিল, তাদের দ্বিতীয় ছেলেটি নাকি সিমিংটনের নয়।
এই চিঠি পেয়েই একেবারে ভেঙ্গে পড়েন মিসেস সিমিংটন। তিনি একটা কাগজে লিখে রেখে গেছেন, এভাবে আর চালাতে পারছি না।
–এসব বিষ মাখানো চিঠি–এবারে ঠিক লক্ষভেদ করেছে। বলল যোয়ানা।
গ্রিফিথ বললেন, উনি অবশ্য কিছুদিন থেকে ভুগছিলেন। আমিই চিকিৎসা করছিলাম। এটা অসম্ভব নয়, এমন একটা চিঠি পাবার পর মানসিক আঘাতটা সামলাতে পারেননি। নিজেকে শেষ করে দেবার পথই বেছে নেন। হয়তো ভেবেছিলেন, স্বামী তার কথা বিশ্বাস নাও করতে পারেন। যে কোন মহিলার পক্ষেই এই ধরনের অভিযোগ খুবই লজ্জার।
ডাঃ গ্রিফিথ বিদায় নিলে আমি আর যোয়ানা মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জবুথবু হয়ে একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। এলসি হল্যাণ্ড প্রায় জোর করে এক কাপ চা তার হাতে ধরিয়ে দিল।
-সকাল থেকে কিছু মুখে দেননি। এভাবে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এই চাটুকু খেয়ে নিন।
–আপনি খুবই দয়ালু মিস হল্যান্ড। আপনি যা করছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
বললেন মিঃ সিমিংটন।
ওসব কথা থাক। আমি আমার কর্তব্য করছি মাত্র। বাচ্চাদের জন্য ভাববেন না, আমি ওদের দেখে রাখছি। চাকর বাকরদের ব্যাপারটাও দেখছি। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। নিজেকে শক্ত করে তুলুন।
এলসি হল্যাণ্ডকে দেখে বেশ ভাল লাগল। খুবই বাস্তবমুখী আর দয়ালু।
মেগানকে পাওয়া গেল ওপরের বসার ঘরে। চোখমুখ দেখে বোঝা গেল, খুব কেঁদেছে। ওকে বললাম, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, আমাদের ওখানে কয়েকদিন থেকে আসবে চল।
মেগান খুশিই হল। ও তার কয়েকটা পোশাক আর টুকিটাকি জিনিস একটা সুটকেসে গুছিয়ে নিল।
যোয়ানা মিঃ সিমিংটন ও মিস হল্যাণ্ডকে কথাটা জানিয়েছিল। তারাও কেউ কোন আপত্তি করলেন না মেগানকে আমাদের বাড়িতে নিতে চাইছি বলে।
এরপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেগানকে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম।
.
০৫.
করোনারের তদন্তের অনুষ্ঠান হলো তিনদিন পরে।
মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর সময় সম্পর্কে জানানো হলো বিকেল তিনটে থেকে চারটের মধ্যে।
ঘটনার দিন তিনি বাড়িতে একাকী ছিলেন। মিঃ সিমিংটন অফিসেই ছিলেন, পরিচারিকা তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল বলে বাইরে গিয়েছিল।
এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল।
আর মেগান যেমন করে থাকে, সাইকেল নিয়ে বাইরে গিয়েছিল।
চিঠিটা এসেছিল সেদিন বিকেলের ডাকেই। মিসেস সিমিংটনই নিশ্চিত চিঠিটা বাক্স থেকে বের করেছিলেন। সেটা পড়ার পরই তার মানসিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
ঘাস আর বোলতার চাকের জন্য বাগানে সায়ানাইড রাখা ছিল। তাই তিনি জলে মিশিয়ে পান করে ফেলেন। তার আগে তিনি একটা কাগজে তাঁর অন্তিম বক্তব্য লিখে রেখে যান-এভাবে আর চলতে পারছি না।
করোনার ভদ্রলোক, খুবই ভদ্র আর বিবেচক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জানালেন, যারা এই ধরনের জঘন্য বেনামী চিঠি লিখে থাকে তাদের নৈতিক চেতনা বলে কিছু থাকে না, তাদের সব কথাই কদর্য মিথ্যায় পূর্ণ।
নৈতিক বিচারে এরা হত্যার অপরাধে অপরাধী। সকলেরই তাদের নিন্দা করা উচিত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, পুলিশ অবিলম্বেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার ও যথাযথ শান্তির ব্যবস্থা করবে। আইন অনুসারে, এই সব সামাজিক অপরাধীদের চরম শাস্তি হওয়া দরকার।
জরিরাও করোনারের বক্তব্য সমর্থন করে তাদের রায় জানালেন–সাময়িক ভাবে মানসিক বিভ্রান্তির পরিণতিতেই আত্মহত্যার-ঘটনা ঘটেছে।
তদন্তের পরদিন সকালে এমি গ্রিফিথ এলেন আমাদের বাড়িতে। আমি একাই ছিলাম। যোয়ানা আর মেগান বাইরে গিয়েছিল।
-সুপ্রভাত মিঃ বার্টন। এমি গ্রিফিথ বললেন, শুনলাম, মেগান হান্টার আপনাদের এখানে এসে আছে?
বললাম, হ্যাঁ, তাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি।
-খুবই ভাল কাজ করেছেন। আমি বলতে এসেছিলাম, ও ইচ্ছে করলে আমাদের কাছেও এসে থাকতে পারে। ওকে আমি কাজকর্মের মধ্যে আটকে রাখতে পারব।
–আপনার অনেক দয়া। ও আমাদের সঙ্গে বেশ ভালই আছে।
কথায় কথায় মিস এলসি তার নিজের বিষয় গার্ল গাইডের প্রসঙ্গে চলে এলেন। মেগান মেয়েটা চূড়ান্ত অলস হয়ে পড়ছে। এতদিনে ওর পক্ষে কোন কাজ নিয়ে থাকা উচিত ছিল। গাইডের কাজও মেয়েদের পক্ষে অনেক ভাল।
আমি হ্যাঁ হু করে কোন রকমে সায়কেটে যেতে লাগলাম।
একসময় মিস এমি গ্রিফিথ বললেন, মিসেস সিমিংটন সম্পর্কে ভাল ধারণা আমার কোন কালেই ছিলনা। আর আসল সত্যটা নিয়ে আমার একবারও সন্দেহ হয়নি।
–আসল সত্য মানে? আমি তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলাম।
–তদন্তের সময় যেসব কথা জানা গেল অর্থাৎ মিঃ সিমিংটন যা বললেন।
–কিন্তু তিনি তো বারবারই বলেছেন বেনামী চিঠির কোন কথাই সত্য নয়।
–তা অবশ্য বলেছিলেন। স্ত্রীর হয়ে সব ভদ্রলোককেই ওরকম বলতে হয়। মিঃ সিমিংটনকে আমি অনেক দিন ধরেই চিনি। অহঙ্কারী আর খুবই চাপা মানুষ। তার পক্ষে ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া অসম্ভব নয়।
–তাহলে তো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে মিসেস সিমিংটন কেন চিঠির বিষয় স্বামীকে জানাতে ভয় পেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ হওয়ায়, মিঃ সিমিংটন তার কোন কথা মেনে নেবে না।
মিস গ্রিফিথ মনে হলো আমার কথা শুনে চটে গেলেন। তিনি বললেন, তাহলে কি আপনি মনে করেন, একটা মিথ্যা অভিযোগের জন্য তিনি সায়ানাইড গিলে মরে গেলেন?
করোনারও তো তাই বললেন। চরম মানসিক আঘাতের ফলেই
-বাজে কথা রাখুন। কোন নির্দোষ মহিলা এরকম মিথ্যা ভরা বেনামী চিঠি পেলে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতো না। আমি হলে তো হেসেই উড়িয়ে দিতাম।
এবারে আমি হেসে বললাম, বুঝতে পেরেছি, আপনিও তাহলে একখানা বেনামী চিঠি পেয়েছিলেন?
এক মিনিট চুপ করে রইলেন এমি গ্রিফিথ। পরে ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে–হ্যাঁ, পেয়েছি। কোন উম্মাদেরই কাণ্ড হবে। দু-চার লাইন পড়ার পরেই বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিই।
–আপনার পুলিসকে ব্যাপারটা জানানো উচিত ছিল।
আমাদের কথাবার্তা খুবই একঘেয়ে হয়ে পড়েছিল। তাই ইচ্ছে করেই মেগানের প্রসঙ্গ তুললাম।
–ভালকথা, মেগানের নিজের খরচপত্র মেটানোর ব্যাপারে কি ব্যবস্থা আছে, আপনার কোন ধারণা আছে?
-বাইরের কারো সাহায্য ওর না হলেও চলবে। যতদূর জানি, ওর ঠাকুমা, মিঃ হান্টারের মা, মেগানকে কিছু মাসোহারা দিয়ে গেছেন। তাছাড়া মিঃ সিমিংটনও নিশ্চয় হাতখরচা বাবদ কিছু ব্যবস্থা করে থাকবেন। তবে ও যেরকম বেয়াড়া, ওর জীবনটা কাজে লাগাতে পারবে বলে সন্দেহ হয়।
আরও দু-চার কথা বলে মিস এমি গ্রিফিথ বিদায় নিলেন। মহিলার ওই পল্লবগ্রাহী স্বভাব আর মেগান সম্পর্কে হতাশার মনোভাব আমার খুবই খারাপ লাগল।
সেই দিনই একটু বেলায় মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে আমার দেখা হলো।
আমি নিজেই উপযাচক হয়ে মেগানের কথাটা পাড়লাম।
-ও আমাদের কাছে কদিন থাকুক। নিশ্চয়ই আপনার অসুবিধে হবে না। যোয়ানাও একজন সঙ্গী পেয়ে খুশি হয়েছে।
-মেগান, ও হ্যাঁ হ্যাঁ-আপনারা সত্যিই খুব ভাল।
মনে হল, মেগানের কথা যেন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, আমি বলতে মনে পড়ল। ভদ্রলোকের প্রতি মনটা আমার বিরূপ হয়ে পড়ল। স্ত্রীর প্রথম স্বামীর সন্তানকে তিনি যে ভাল চোখে দেখেন না, তা বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না আমার।
বললাম, ওর সম্পর্কে কি করবেন বলে ভাবছেন? মেগানকে নিয়ে?
ইয়ে…ও তো বাড়িতেই থাকবে…এ বাড়ি তো ওরও।
.
বিকেলে এলেন মিস এমিলি বার্টন। আমি তখন বাগানে ছিলাম। সেখানেই আমার সঙ্গে কথা বললেন।
দু-এক কথার পরেই বললেন, বেচারা মেয়েটা, মেগানের কথা বলছি, খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল।
–ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? আমি আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম। ব্যাপারটা সত্যি বলে মনে করেন?
–কখনোই না। একদম বাজে। মিসেস সিমিংটন এরকম একটা কাজ–না, না, অসম্ভব। তবে এটাকে ঈশ্বরের একটা বিচারই বলতে পারেন।
–ঈশ্বরের বিচার? আমি অবাক হলাম।
-হ্যা! এই যে সব নোংরা চিঠি–তার ফলে মানসিক যন্ত্রণা,-এ সব কিছুরই পেছনে একটা উদ্দেশ্য কাজ করেছে নিশ্চয়।
-কোন হীন উদ্দেশ্য যে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বললাম আমি।
–আপনি আমার কথা ঠিক ধরতে পারেননি মিঃ বার্টন, চিঠিগুলো যে লিখছে, সেই নীচমনা লোকের কথা আমি বলছি না, আমি বলছি, এরকম ঘটনা হয়তো ঈশ্বরের অভিপ্রেত–আমাদের দোষত্রুটির কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য।
–মানুষ নোংরা কাজ নিজের ইচ্ছেতেই করে মিস বার্টন, কিন্তু আশ্চর্য হল, তার এই কাজের দায়ভাগ ঈশ্বরের ওপরে চাপিয়ে দিতেই অভ্যন্ত। এভাবে আমরা নিজেরাই শাস্তির ব্যবস্থা করে রাখি–বুঝতে পারি না। এসবের মধ্যে ঈশ্বরকে টেনে আনার প্রয়োজন করে না।
–আমিও স্বীকার করি মিঃ বার্টন।
তারপর গলার স্বর খাটো করে এনে বললেন, সবাই বলছে, এসব কাজ করছে মিসেস ক্লিট। তবে আমি এসব বিশ্বাস করি না। আগে এখানে এসব কিছু ছিল না। সুন্দর সুখী একটা গ্রামীণ সমাজ ছিল। এখন এসব দেখে খুবই খারাপ লাগছে।
–আপনি–এধরনের কিছু পাননি?
ওহ না! রক্ষে করুন।
মুখচোখ লাল হয়ে উঠল তার। আমি দ্রুত ক্ষমা চাইলাম।
এরপর বাইরে থেকেই তিনি বিদায় নিলেন। তাকে বেশ চিন্তিতই মনে হল আমার।
বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। ড্রইংরুমে চুল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে যোয়ানা। চোখে পড়ল তার হাতে একখানা খোলা চিঠি।
-জেরি, এসেছিস, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল যোয়ানা, এই চিঠিটা বাক্সে পেলাম, কেউ হাতে করে ফেলে গিয়েছে।
-কি আছে, ওতে? তিক্ত স্বরে বললাম আমি।
–সেই একই নোংরা কথা।
কথা শেষ করে চিঠিখানা আগুনে ছুঁড়ে দিল ও। আমি চকিতে ঝাঁকুনি দিয়ে নুয়ে পড়ে সেটা টেনে নিয়ে এলাম–আগুনে ধরে উঠবার আগেই।
–বোকার মতো কাজ করছিস কেন? এটা আমাদের দরকার হবে। পুলিসকে দিতে হবে।
স্থানীয় থানার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ন্যাস পরদিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। খুবই যোগ্য অফিসার। সামরিক অফিসারের মতো দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা। চিন্তাশীল চোখ। প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে আমার ভাল লাগল।
প্রাথমিক সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর তিনি বললেন, সেই বেনামী চিঠির ব্যাপারে এসেছিলাম। শুনেছি, এরকম একটা চিঠি আপনিও পেয়েছেন।
-হ্যাঁ। এখানে আসার কিছু দিন পরেই।
–কি লেখা ছিল ওতে?
আমি সংক্ষেপে সেই চিঠির বিষয়বস্তুর কথা খুলে বললাম। ধৈর্য ধরে সবকথা শুনলেন ন্যাস।
–চিঠিটা কি আপনি
–দুঃখিত মিঃ ন্যাস, চিঠিটা সঙ্গে সঙ্গেই নষ্ট করে ফেলি। আসলে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তখন, ভেবেছি, কোন ঈর্ষাপরায়ণ লোক আমাদের এখানে আসা মেনে নিতে না পেরে লিখেছে।
-ওরকম চিঠি আমাদের হাতে পৌঁছন দরকার। বললেন ন্যাস।
–তবে আমার বোন গতকালই একটা চিঠি পেয়েছে। ও পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। আমি দিইনি।
-ধন্যবাদ, মিঃ বার্টন। খুবই বুদ্ধির কাজ হয়েছে এটা।
আমি ড্রয়ার খুলে চিঠিটা বার করে ন্যাসের হাতে দিলাম।
চিঠিটা পড়লেন ন্যাস। মাথা ঝাঁকালেন। তার কপালে বিরক্তির ছাপ পড়ল। চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে চালান করলেন।
–এটা কি আগের চিঠির মতোই আপনার মনে হচ্ছে–মানে খামের সঙ্গে আসল চিঠির তফাৎ।
-হ্যাঁ, এক রকমই তো মনে হচ্ছে আমার। বললাম আমি, খামের ওপরে নাম টাইপ করা আর ছাপা অক্ষর কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে চিঠিটা লেখা হয়েছে–একই রকমে।
–আমরা কয়েকজনকে নিয়ে একটা আলোচনা করতে চাই। কোন অসুবিধা না হলে, আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় আসতে অনুরোধ করব। এতে আমাদের হয়রানি কিছুটা কমবে মনে হয়।
–নিশ্চয়ই আসব, বললাম আমি, আমার অসুবিধার কিছু নেই।
এরপর পুলিসের গাড়িতেই আমরা থানায় রওনা হলাম।
আমি বললাম, এই বেনামী চিঠি-রহস্যের গোড়ায় পৌঁছতে পারবেন বলে আপনি মনে করছেন?
নিশ্চয়ই পারব, বললেন ন্যাস, কিছু সময় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। আসলে দরকার আমাদের কাজের ক্ষেত্রে গণ্ডী ছোট করে আনা।
তার মানে, কিছু বাদ দেবার কথা ভাবছেন?
-হ্যাঁ। তারপর পদ্ধতি মাফিক এগনো। যেমন ডাকবাক্সের ওপর নজর রাখা, হাতের ছাপের পরীক্ষা, টাইপরাইটারের খোঁজ নেওয়া–এইসব।
থানায় পৌঁছে দেখলাম মিঃ সিমিংটন আর ডাঃ গ্রিফিথ আগেই উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল সাধারণ পোশাক পরা ইন্সপেক্টর গ্রেভসকে।
শুনলাম ইনি লণ্ডন থেকে এসেছেন আমাদের এব্যাপারে সাহায্য করতে। বেনামী চিঠির ব্যাপারে ইনি একজন বিশেষজ্ঞ।
ব্লাড হাউণ্ডের মতো গলার স্বর গ্রেভসের। তিনি বললেন, এইসব চিঠির ভাষা, বক্তব্য, প্রায় একই ধারা মেনে চলতে দেখা যায়।
ন্যাস বললেন, বছর দুয়েক আগে একই ধরনের একটা কেস আমাদের হাতে এসেছিল। ইনসপেক্টর গ্রেভস তখন আমাদের সাহায্য করেছিলেন।
কিছু বেনামী চিঠি গ্রেভসের সামনে টেবিলে বিছিয়ে রাখা ছিল। তিনি সেগুলো পরীক্ষা করছিলেন বলে মনে হলো।
ন্যাস বলতে লাগলেন, চিঠিগুলো হাতে পাওয়ার ব্যাপারটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণত এসব পুড়িয়ে ফেলা হয়। অনেকে আবার স্বীকার করতেই চায় না যে কোন চিঠি তারা পেয়েছে। আসলে পুলিসের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার ভয়। এখানকার লোক দেখছি খুবই পিছিয়ে আছে।
-তবু, কাজ শুরু করার মতো কিছু চিঠি আমাদের হাতে এসেছে গ্রেভস বললেন।
আমার চিঠিখানা পকেট থেকে বার করে ন্যাস গ্রেভসকে দিলেন। তিনি সেটা দেখে, অন্য চিঠিগুলোর পাশে রেখে দিলেন।
–খুবই চমৎকার। তারিফ করার মতো করে তিনি বললেন, ভদ্রমহোদয়েরা, এই সুযোগে আপনাদের অনুরোধ করছি, এধরনের চিঠি পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নজরে আনবেন। কেউ পেয়েছে যদি শোনেন, তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদের পরামর্শ দেবেন।
আমি যে চিঠিগুলো হাতে পেয়েছি, তার মধ্যে একখানা রয়েছে–মিঃ সিমিংটন দুমাস আগে পেয়েছিলেন, একখানা পান ডাঃ গ্রিফিথ, একখানা মিস গিনচ, একটা পেয়েছেন মাংসওয়ালার স্ত্রী মিসেস মাজ, একটা পান মিসেস সিমিংটন। শেষ চিঠি যেটা এই মাত্র হাতে এলো সেটা পেয়েছেন মিস বার্টন। ওহহ, আর একটা রয়েছে, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পেয়েছিলেন।
গ্রেভস চিঠিগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলতে লাগলেন বিভিন্ন ধরনের চিঠি হলেও একটার সঙ্গে অন্যটার তফাৎ ধরা কষ্টকর। আগেও আমি এধরনের বহু চিঠি দেখেছি। কিন্তু এসবের মধ্যে কোন নতুনত্বের সন্ধান পাচ্ছি না। সবই কেমন একই ধারায় চলেছে।
–এই সব চিঠির লেখক সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পেরেছেন আপনারা? সিমিংটন বললেন।
গ্রেভস সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। পরে বলতে লাগলেন, কয়েকটা বিষয় আমি আপনাদের কাছে পরিষ্কার করে দিতে চাই।
যেমন ধরুন, এসব চিঠি লেখা হয়েছে কোন ছাপানো বইয়ের অক্ষর কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে।
বেশ পুরনো আমলের বই থেকেই অক্ষরগুলো নেওয়া হয়েছে, ১৮৩০ সালের ছাপা বই হলেও আশ্চর্য হব না।
হাতের লেখা আড়াল করার উদ্দেশ্যেই যে এটা করা হয়েছে, সহজেই বোঝা যায়। তবে আজকালকার যুগে বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় সবই ধরা পড়ে যায়।
খামের ওপরেও বিশেষ কোন লোকের হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। যেসব ছাপ পাওয়া গেছে তা হল, প্রাপক, আর ডাকঘরের কর্মী ও বাড়ির অন্যলোক দু-একজনের। বোঝা যায় লেখক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে ভুল করেনি–দস্তানা ব্যবহার করেছিল।
খামের ওপরে ঠিকানা লেখা হয়েছে উইণ্ডসর-৭ টাইপরাইটার মেসিনে। সেই মেসিনের টি আর এ ছোট অক্ষর দুটো ক্ষয়ে যাওয়া।
বেশিরভাগ চিঠিই হাতে করে চিঠির বাক্সে ফেলা হয়েছে। কিছু স্থানীয় ডাকে ফেলা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এসব চিঠির লেখক একজন স্ত্রীলোক–মধ্যবয়স্কা, সম্ভবত অবিবাহিতা।
-লিমন্টকের মতো জায়গায় টাইপরাইটার মেশিনটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে না বলে মনে হয়। বললাম আমি।
গ্রেভস দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের দিকে তাকালনে।
–টাইপরাইটারের ব্যাপারটা খুবই সহজ, বললেন ন্যাস, এটা মিঃ সিমিংটনের অফিসের একটা পুরনো মেসিন। তিনি এটা উইমেনস ইন্সটিউটে দান করেছিলেন। যে কেউই সেটা ব্যবহার করতে পারে।
গ্রেভস বললেন, খামের ওপরের নাম ঠিকানা থেকে এটা আন্দাজ করা যাচ্ছে, এক আঙুলে টাইপ করা হয়েছে।
–তাহলে কি অনভিজ্ঞ কেউ টাইপ করেছে? বললাম আমি।
–তা হয়তো নয়, গ্রেভস বললেন, বরং আমি বলব এমন কেউ টাইপ করেছে, যে জানাতে চায় না টাইপ করতে জানে। এ লাইনের অন্ধিসন্ধি তার জানা আছে।
আর একটা কথা, চিঠিগুলো লিখেছে একজন শিক্ষিতা স্ত্রীলোক। নিশ্চিতভাবেই কোন গ্রাম্য স্ত্রীলোক নয়। এখানে যারা আছে, তারা নেহাতই অশিক্ষিত–বানান করার বিদ্যাটাও অনেকের নেই।
কথাটা একটু অন্যরকম শোনাল আমার কানে। আমি তাই নানা কথা কল্পনা করতে লাগলাম।
সিমিংটন বললেন, তাহলে তো অনুসন্ধানের গণ্ডি অনেকটাই খাটো হয়ে গেল। যেরকম স্ত্রীলোকের কথা বললেন, ডজনখানেক মানুষই এখানে পাওয়া যেতে পারে।
–কথাটা ঠিকই বলেছেন। বললেন গ্রেভস।
–কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, সিমিংটন বললেন, আমার স্ত্রী যে ধরনের চিঠি পেয়েছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা। সম্পূর্ণ মিথ্যা। যা তার কাছে অত্যন্ত মানসিক আঘাতের কারণ হয়ে উঠেছিল।
আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন স্যর। এইসব চিঠিতে দেখা যাচ্ছে কেবল অন্ধ অভিযোগ–অন্তরঙ্গ কিছু জানার প্রতিফলন পাওয়া গেলে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা বলা যেত। যা পাওয়া যাচ্ছে তা হলো অবদমিত কাম আর ঈর্ষার প্রকাশ। এ থেকেই এসব চিঠির লেখক সম্পর্কে আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারছি।
সিমিংটন অনেকটা উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, আমার স্ত্রীকে খুন করা হয়েছে, তাকে প্রায় ছোরা মারা হয়েছে। চিঠি লিখে যে শয়তান এই জঘন্য কাজ করেছে, আপনারা তাকে ধরতে পারবেন আমি তাই আশা করছি। সে হয়তো ব্যাপারটা উপভোগই করছে-ওহ।
কথা শেষ করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন সিমিংটন।
–সে কি ভাবতে পারে গ্রিফিথ?
সিমিংটনের বলে যাওয়া শেষ কথাটাই আমি জানতে চাইলাম ডাক্তারের কাছে। কেন না, মনস্তত্ব ব্যাপারটা ওরই আওতায় পড়ে।
অনুতপ্ত হওয়া অসম্ভব নয়। নিজের ক্ষমতা দেখে আনন্দও হতে পারে। বিকৃত মনের উম্মাদনা কিছুটা শান্ত হতে পারে। বললেন গ্রিফিথ।
কিন্তু, আমার মনে হয় মিসেস সিমিংটনের মৃত্যু তাকে ভীতই করে থাকবে, সে আবার চেষ্টা করবে বলে মনে হয় না।
–মানুষ জলের জন্য বারবার কুয়োর কাছে যায়, বললেন, ন্যাস, আমাদের কাছে সেটা অত্যন্ত কাজের হবে। মনে রাখবেন সে আবার চেষ্টা করবে। বললেন ন্যাস।
তা যদি হয়, তাকে পাগলই বলব। বললাম আমি।
–একাজ সে না করে পারে না, গ্রেভস বললেন, একধরনের পাপবোধ তাকে দিয়ে এ কাজ করাবে।
–আমাদের আলোচনার শেষে একটা অনুরোধ আপনাদের করছি। দয়া করে চোখ-কান খোলা রাখবেন। বেনামী কোন চিঠি কেউ পেলে তা পুলিসকে জানাবার কথা বুঝিয়ে বলবেন।
এরপর গ্রিফিথের সঙ্গে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় চলতে চলতে বললাম, নিরিবিলি শান্ত সুন্দর জায়গা ভেবে স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে এলাম এখানে, এখন দেখছি ভুলই করেছিলাম চিনতে। এমন বিষাক্ত জায়গা–আপনার কি মনে হয় গ্রিফিথ, ওরা কি কিছু বুঝতে বা জানতে পেরেছে?
-পুলিসের কাজের পদ্ধতি যা তাতে কিছু নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। মনে হয় ওরা সরলভাবে সব বলছে, আসলে ওরা কোন কথাই জানায় না।
–এখানে এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত পাগল কেউ থাকলে আপনারই তো জানা উচিত। আমি বললাম।
মুখে কোন কথা বললেন না গ্রিফিথ। কেবল হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকালেন।
আমরা হাইস্ট্রিট ধরে হাঁটছিলাম। বললাম, যোয়ানকে নিয়ে এখান থেকে সরে পড়তে পারলেই হয়তো ভাল হত। কিন্তু আমি যাব না। শেষ দেখে যেতে চাই।
সামনেই আমার বাড়ির এজেন্টের অফিস। দ্বিতীয় দফায় টাকাটা জমা দেবার জন্য একবার যাওয়া দরকার। গ্রিফিথকে কথাটা জানিয়ে অফিসের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
একজন স্ত্রীলোক টাইপ করছিলেন। তিনি উঠে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মহিলার মাথার কোঁকড়ানো চুলের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আগে কোথায় যেন দেখেছি। একটু চিন্তা করতেই মনে পড়ে গেল আচমকা। মিঃ সিমিংটনের মহিলা কেরানী ছিলেন, মিসেস গিনচ। কথাটা তাকে বললামও।
–আপনাকে মনে হয় গলব্রেথ আর সিমিংটনের অফিসে দেখেছিলাম।
-হ্যাঁ। আগে ওখানে ছিলাম, বললেন মহিলা, টাকা কিছু কম হলেও এখানে চলে আসাই ভাল মনে হল। টাকাই তো সব নয়।
–নিঃসন্দেহে। বললাম আমি।
–মিঃ সিমিংটন আর আমাকে জড়িয়ে লেখা বিশ্রী একটা চিঠি আমি পাই। কী জঘন্য ভাষায় লেখা! আমি অবশ্য সেটা পুলিসের হাতে দিয়ে এসেছি। নিরূপায় হয়েই কাজটা আমাকে করতে হয়েছে।
–আপনি ঠিক কাজই করেছেন। বললাম।
–জানি লোকে এটা নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু এটা সত্যি বলেই জানবেন মিঃ বার্টন, সিমিংটন আর আমার মধ্যে খারাপ কিছু ছিল না।
অপ্রীতিকর হলেও কথাটা আমাকে এভাবে বলতে হচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবি মানুষের মন কত কদর্যতায় ভরা।
মিসেস গিনচের কথার সুরে অস্বস্তির ভাব থাকলেও আমার কেন যেন মনে হল, তিনি ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছেন। তার এই অস্বস্তির ভাবটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই যেন মনে হল।
৬.১ মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ
০৬.
বাড়ি ফিরে আসতেই যোয়ানা বলল, মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ এতক্ষণ বকবক করে গেলেন। মহিলাকে আমার পাগল বলেই মনে হয়, জানিস?
–কেন, কি বলে গেলেন তিনি? আমি জানতে চাইলাম।
–বলতে চাইলেন, মিসেস সিমিংটন স্বার্থপর আর বকাটে ধরনের মহিলা ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ভয় পাওয়ার মতো মোটেই ছিলেন না। তার ধারণা এখানে এমন কেউ একজন রয়েছে, যে ভয়ঙ্কর রকমের অসুখী। সেই এসব চিঠির মাধ্যমে মনের বিষ ছড়িয়ে চলেছে। আর সেই বিষেই ঘায়েল হয়েছেন মিসেস সিমিংটন।
যোয়ানা আমাদের জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হয় জেরি, সত্যিই কোন অসুখী ঈর্ষাকাতর লোক এসব চিঠি লিখছে?
–আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না যো। আমার শুধু দুঃখ হয়, যারা ওই শয়তানের শিকার হচ্ছে।
.
পরদিন সকালে প্রাতরাশ শেষ করার পর পরই এলেন এমি গ্রিফিথ। মেগান ড্রইংরুমে চলে গিয়েছিল।
রেডক্রশ থেকে মেইন রোডে একটা স্টল তৈরি হয়েছে। সেই খবর জানিয়ে এমি গ্রিফিথ বললেন, কিছু তরিতরকারী তুলে রাখতে, ওয়েন গ্রিফিথ ফেরার পথে নিয়ে যাবেন।
যোয়ানা বলল, সবজির ব্যাপারটা আমি একেবারেই কিছু বুঝি না। ঠিক আছে, যা পারি কিছু তুলে রাখব।
এমি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বেজে উঠল। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম।
-হ্যাল্লো, বলুন।
ওপাশ থেকে মেয়েলীকণ্ঠ ভেসে এল–এটা কি লিটল ফার্জ?
–হ্যাঁ, বলুন, কাকে চাই?
–ওহ, মিস পারট্রিজের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
–নিশ্চয়ই। কি নাম বলব? আমি বললাম।
দয়া করে বলুন, অ্যাগনেস ওডেল কথা বলতে চায়।
–বেশ, ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।
রিসিভার রেখে সিঁড়ির কাছে গিয়ে পারট্রিজকে ডেকে টেলিফোনের কথা বললাম।
–অ্যাগনেস ওডেল এসময় আবার কি চায়? বলতে বলতে পারট্রিজ এসে রিসিভার তুলে নিল। আমি ডাইনিংরুমে চলে এলাম। মেগান টেবিলে বসে মাংস খাচ্ছিল।
আমি একটা চেয়ারে বসে পাইপে তামাক ভরতে শুরু করলাম। একটু পরেই যোয়ানা ঢুকল ঘরে।
–কি জঘন্য সব সেকেলে রীতিনীতি। সেখানে মানুষের দাম এত কম ছিল ভাবা যায় না।–
-কেন কি হল? জানতে চাইলাম আমি।
-আগে নাকি এবাড়িতে ঝি চারকদের টেলিফোনে কথা বলা বা ছুটির দিনে কোন বন্ধুকে চা খেতে বলার নিয়ম ছিল না। চিন্তা কর একবার–ওরা কি মানুষ নয়?
ব্যাপারটা খুলে না বললে বুঝি কি করে? বিরক্তির সঙ্গে বললাম?
–পারট্রিজ ক্ষমা চাইছিল, অ্যাগনেস বলে কে একজন তাকে টেলিফোন করেছে বলে। আগে এসব নাকি এ বাড়িতে চলত না। অ্যাগনেস মেয়েটি আগে এ বাড়িতেই নাকি কাজ করত। বয়স ষোল-সতেরো হবে–একেবারেই বাচ্চা। নিজের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই বলে দরকার হলে পারট্রিজের কাছেই আসত। আজ বিকেলে সে আসতে চেয়েছে, সেকথাই টেলিফোনে জানিয়েছিল। তাকে আসার কথা বলবে কিনা, সেকথা জানতে চাইছিল পারট্রিজ।
–তা তুই কি বলেছিস?
–আমি বললাম, সে কাউকে চা খেতে আসতে বলবে এতে আমাদের আপত্তি করার কি আছে। মানুষ মানুষের সঙ্গে কি অমানবিক ব্যবহার করতো, চিন্তা করে দেখ একবার জেরি।
–ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বললাম আমি।
মেগানের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে এগিয়ে এসে বলল, আমি আজই বাড়ি চলে যাব ভাবছি।
-সেকি, কেন? আমি হতাশ স্বরে বলে উঠলাম।
-আপনাদের এখানে আমি খুব ভাল থাকলাম। আপনারা সত্যিই খুব ভাল। কিন্তু আমাকে এখন ফিরে যেতে হবে। ওটাই যে আমার বাড়ি।
–তা বলে আজই চলে যাবে? বলল যোয়ানা।
মেগানকে আমরা দুজনেই অনেক বোঝালাম তার মত বদল করার জন্য। কিন্তু ও একেবারে গোঁ ধরে রইল।
অগত্যা বোয়ানা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে গাড়ি করে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
যোয়ানা যখন ফিরে এলো আমি তখন বাগানে ঘাসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার কাছে এসে প্রশ্ন করল, সূর্যঘড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
.
মধ্যাহ্নভোজের কিছু আগেই ওয়েন গ্রিফিথ তাঁর গাড়ি নিয়ে এলেন। মালী কিছু সবজি তুলে রেখেছিল। গাড়িতে তুলে দিল।
আমি ওয়েন গ্রিফিথকে ভেতরে নিয়ে এসে কিছু পানীয় দিয়ে অভ্যর্থনা করলাম। মধ্যাহ্নভোজের জন্য অনুরোধ করলাম, কিন্তু রাজি হলেন না।
যোয়ানা হেসে বলল, মন বদলে ফেলুন ডঃ গ্রিফিথ। আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে থেকে যান।
–কিন্তু এমি যে অপেক্ষা করে থাকবে। কথা বলতে গিয়ে কেমন লাল হয়ে উঠলেন ওয়েন।
-আমি তাকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। বলে যোয়ানা ফোন করতে উঠে গেল।
ওয়েন গ্রিফিথ এরপর মধ্যাহ্নভোজে থেকে গেলেন। বেশ জমিয়েই আড্ডা দিলাম আমরা। সাহিত্য, নাটক, রাজনীতি কোন কিছুই আলোচনা করতে বাকি রাখলাম না।
কিন্তু লিমণ্টকের বেনামী চিঠি বা মিসেস সিমিংটনের আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে একবারও কথা বললাম না কেউ।
আমার মনে হলো আমাদের সঙ্গ বিশেষ করে যোয়ানার, বেশ উপভোগ করলেন ওয়েন। উৎফুল্ল মনেই বাড়ি ফিরে গেলেন।
.
ওইদিন বিকেলেই এমিলি বার্টনের বাড়িতে আমাদের চা পানের নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা পায়ে হেঁটে গেলেও একটু আগেই পৌঁছে গেলাম।
এমিলি বার্টনের বিশ্বস্ত পরিচারিকা ফ্লোরেন্স দরজা খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
মিস বার্টন বাইরে গিয়েছিলেন। কয়েক মিনিট পরেই তিনি দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন।
–সকালের কেকগুলো ভাল ছিল না, তাই কয়েকটা টাটকা কেক আনতে গিয়েছিলাম। বলে নিজের অনুপস্থিতির জন্য ক্ষমা চাইলেন তিনি।
–আমরা আগেই এসে পড়েছি মিস বার্টন। বলল যোয়ানা।
–আপনাদের পেয়ে কত যে আনন্দ হচ্ছে। মনের মতো কাউকে তো এখানে পাওয়া যায় না।
কথা বলতে বলতেই প্রায় হুটোপুটি করেই তিনি ছোট ছোট টেবিলের ব্যবস্থা করে ফেললেন আমাদের জন্য।
কয়েক মিনিট পরে ফ্লোরেন্স কয়েকটা ক্রাউন ডার্বি কাপ আর চায়ের পট নিয়ে হাজির হল।
চীনা চায়ের সঙ্গে স্যাণ্ডউইচ রুটি, মাখন আর ছোট আকারের কিছু কেকের আয়োজন ছিল। বেশ জমে গেল।
আমাদের কথাবার্তা স্বাভাবিক পথ ধরে চলছিল। এমিলি বার্টন ডাঃ গ্রিফিথের চিকিৎসার প্রশংসা করলেন।
সিমিংটন যে একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ তা-ও বারবার জানালেন। বললেন, তার চেষ্টাতেই এমিলি তার কিছু টাকা আয়কর দপ্তরের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পেরেছেন।
কথাপ্রসঙ্গে মিসেস সিমিংটনের কথা উঠে পড়ল। এমিলি বার্টন দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, বেচারি মারা যাওয়ায় বাচ্চারা অকালে মাতৃহারা হল। কী যে হয়ে গেল। আচমকা নিশ্চয় মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, নইলে বাচ্চাদের কথা তার মনে পড়ত।
–ওই বেনামী চিঠি তাকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিল। বলল যোয়ানা।
–কিন্তু ওসব বিষয় নিয়ে আমার আলোচনা করতে ভাল লাগে না। ভারি নোংরা বিষয়। এসব অগ্রাহ্য করাই উচিত আমার মনে হয়।
আমিও স্বীকার করলাম। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে এমি গ্রিফিথের কথা তুললাম। এমিলি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বললেন, উনি খুবই বাস্তবঘেঁষা আধুনিক মনের মানুষ। ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট স্বার্থ ত্যাগ করেছেন।
যোয়ানা আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছিল। আমি প্রসঙ্গ বদল করে মিঃ পাইয়ের কথায় এলাম।
এমিলি বার্টন এবারে অতটা উচ্ছ্বসিত হতে পারলেন না। বললেন, এমনিতে বেশ সদাশয় মানুষ। পয়সা আছে তবে অহঙ্কার নেই। মাঝে মাঝে তার কাছে অনেক অচেনা লোক আসে। বাইরে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, তাই অনেকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় আছে।
যোয়ানা বলল, ভ্রমণ মানুষের মনকে উদার করে। অচেনা মানুষের সঙ্গেও আলাপ পরিচয়ের সুযোগ পাওয়া যায়।
–বেড়াতে যাওয়ার কথা কাগজে পড়ি। কিন্তু যেতে ভরসা হয় না। মালপত্র সামলানো–বিদেশের বন্দরে মুদ্রা বিনিময়–এসব ভাবলেই আমার গায়ে জ্বর আসে।
এরপর একসময় মিসেস ডেন ক্যালগ্রুপের প্রসঙ্গ উঠল।
–ভদ্রমহিলাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, বললেন এমিলি, মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন
–কীসব কথা? জানতে চাইলাম আমি।
-আশা করা যায় না এমন সব কথা। তাছাড়া এমন ভাবে তাকান যে বড় অস্বস্তি হয়। ভাইকারের স্ত্রী হিসেবে অনেক বিষয়ে তার মানুষকে পরামর্শ দেওয়া উচিত, কিন্তু উনি কারো কোন ব্যাপারেই মাথা গলাতে চান না। লোকে কেমন যেন ভয় পায় ওকে।
–আশ্চর্য ব্যাপার। যোয়ানা বলে উঠল।
–অথচ উনি ভাল বংশের মেয়ে। খুবই প্রাচীন বংশ। ভদ্রমহিলার স্বামী খুবই বিদ্বান, আর অনুগতও।
এরপরেই মিস এমিলি আচমকা এখানকার স্কুলের শিক্ষিকার প্রসঙ্গে চলে এলেন।
–খুবই অপ্রিয় ধরনের এক তরুণী এই শিক্ষিকা। বললেন তিনি, অদ্ভুত রকমের লাল সে।
লক্ষ্য করলাম লাল কথটার ওপরে বেশ জোর দিলেন এমিলি বার্টন।
ফিরে আসার পথে যোয় না মন্তব্য করল, মহিলা খুবই ভাল।
.
রাতে নৈশ ভোজের সময় যোয়ানা পারট্রিজকে বলল, তোমাদের চায়ের আসর কেমন হল?
-ধন্যবাদ মিস, পারট্রিজ বলল, কিন্তু অ্যাগনেস আসেনি।
–সে কি! এলো না কেন? দুঃখপ্রকাশ করল যোয়ানা।
–কি জানি কি হল। ও নিজেই জানিয়েছিল, কিন্তু কথা ছিল, তাই আসতে চেয়েছিল। কেন এল না, কিছু জানালোও না। এই মেয়েগুলো যেন কেমন
–হয়তো শরীর খারাপ হয়েছিল। ফোন করে খবর তো নিতে পারতে। যোয়ানা বলল।
–ওহ, মিস, তা করেনি।
বেশ রাগতস্বরে বলে পারট্রিজ রান্নাঘরে চলে গেল।
–আসলে কি ব্যাপার হয়েছে আমি বলতে পারি, আমি বললাম যোয়ানাকে, ছেলেবন্ধুর সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে অ্যাগনেসের, তাই সে আসতে দেয়নি।
-তাই হবে হয়তো। হেসে বলল যোয়ানা।
একটু থেমে হঠাৎ বলে উঠল, আজ ঠিক এক সপ্তাহ হল, মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেছেন। পুলিস এতদিনে নিশ্চয় কোন সূত্র পেয়ে থাকবে।
অন্যমনস্কভাবে যোয়ানার কথায় সায় দিলাম। আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কেমন একটা সন্দেহের অনুভূতি যেন। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না অবচেতন মনে কি হচ্ছিল।
-কি ব্যাপার জেরি, চুপ করে আছিস কেন?
–আমার অন্যমনস্কতা যোয়ানা ঠিক লক্ষ্য করল। সপ্তাহ হয়ে গেল…মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেছেন…ওই দিন বিকেলে তিনি বাড়িতে একাই ছিলেন…বাড়ির কাজের লোকেরা সেদিন তাদের সাপ্তাহিক ছুটিতে ছিল..
আমি আচমকা বলে উঠলাম, আচ্ছা যো, পরিচারিকারা সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় তাই না?
–হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। বলল যোয়ানা।
সহসা আমি এগিয়ে গিয়ে ঘন্টা বাজালাম। শব্দ শুনে পারট্রিজ এসে দাঁড়াল।
–একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে পারট্রিজ। অ্যাগনেস উড কি এখনও কাজ করে?
–হ্যাঁ স্যর, সিমিংটনদের বাড়িতে কাজ করে।
আমার চিন্তাধারা কোন দিকে বইছিল আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। নিজের অজ্ঞাতেই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। দেখতে পেলাম রাত দশটা বাজে।
-এখন তাকে মনে হয় বাড়িতে পাওয়া যাবে।
–দশটার মধ্যে তো ফিরে আসা উচিত।
–আমি একবার টেলিফোন করে দেখি।
আমি হলঘরে এলাম। যোয়ানা আর পারট্রিজ আমাকে অনুসরণ করল।
–টেলিফোন করার কথা ভাবছিস কেন জেরি? যোয়ানা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
ততক্ষণে আমি রিসিভার তুলে নিয়েছি। বললাম, মেয়েটার আজ ছুটির দিন। ঠিকমতো বাড়ি ফিরল কিনা, নিশ্চিত হতে চাইছি।
টেলিফোনে ওপ্রান্ত থেকে সাড়া দিল এলসি হল্যাণ্ড। পরিচয় জানিয়ে বললাম, আপনাদের বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। আপনাদের কাজের লোক অ্যাগনেস ফিরেছে?
নার্সারি গভর্নের্সকে অনুরোধ করলাম মেয়েটার খোঁজ নেবার জন্য।
মিনিট দুই পরে ওপ্রান্ত থেকে মিঃ সিমিংটনের গলা শোনা গেল।
–হ্যাল্লো বার্টন, কি ব্যাপার?
–আপনার পরিচারিকা অ্যাগনেস ফিরেছে কিনা জানতে চাইছিলাম।
–মিস হল্যাণ্ড এই মাত্র খবর নিয়ে এলেন ও এখনো ফেরেনি। কোন দুর্ঘটনা বা ওরকম কিছু ভাবছেন নাকি?
-না, কোন দুর্ঘটনা নয়, তবে হলে অবাক হব না।
.
০৭.
সকালে ঘুম ভাঙ্গল সাতটায়। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। বেনামী চিঠিগুলো কে লিখেছে তা জানার একটা সূত্র যেন মনে পড়ে পড়েও পড়ছিল না।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি, হলঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি এসে রিসিভার তুলে নিলাম।
–হ্যাল্লো–
-ওহ্, তুমি উঠেছ, মেগানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কেমন ভয় মাখানো, কী সাংঘাতিক, শিগগির, এসো
–আসছি। এখনই আসছি।
সাংঘাতিক কিছু একটা যে ঘটেছে বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু কি ঘটতে পারে?
যোয়ানাকে ডেকে বললাম, আমি সিমিংটনদের ওখানে যাচ্ছি। মেগান ফোন করেছিল—
যোয়ানা বলল, কি হয়েছে ভাবছিস?
–মনে হয় পরিচারিকা অ্যাগনেসকে নিয়ে কিছু হয়েছে।
আধঘণ্টার মধ্যে দাড়ি কামিয়ে, স্নান করে পোশাক পরে গাড়ি বের করে সিমিংটনের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
মেগান আমার জন্যই হয়তো অধীর হয়ে পথের দিকে তাকিয়েছিল। গাড়ি থেকে নামতেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
-ওহ, জেরি তুমি এসেছে।
–শান্ত হও মেগান, আমি এসে গেছি। কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
–মেগান কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে।
–আমি ওকে খুঁজে পেয়েছি।
–অ্যাগনেসকে?
–সিঁড়ির নিচে। একটা দেয়াল আলমারি আছে ওখানে, তার মধ্যে মাছ ধরার ছিপ, গলফের ক্যাপ আর টুকিটাকি জিনিস থাকে।
–অ্যাগনেস কোথায় ছিল? আমি জানতে চাইলাম।
–ওই আলমারির মধ্যে দলা পাকিয়ে ছিল–ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা–মরে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
–তুমি আলমারিতে কি দেখতে গিয়েছিলে?
–কিছু না। তুমি কাল রাতে টেলিফোন করেছিলে–আমরা সবাই ভাবছিলাম অ্যাগনেস কোথায় গেল। রাতে ওর জন্য আমরা অনেকক্ষণ বসেছিলাম।
রাতে একদম ঘুম হয়নি আমার। খুব সকালে উঠে পড়েছিলাম। তখন আমাদের রাঁধুনী রোজ কেবল উঠেছিল। রাতে অ্যাগনেস ফিরে আসেনি বলে রোজ খুব রেগে গিয়েছিল। আমি রান্নাঘরে বসেই একটু দুধ আর রুটি খেয়েছিলাম। রোজ তখন এসে বলে, অ্যাগনেসের বাইরে যাওয়ার জামা জুতো সবকিছু ওর ঘরেই রয়েছে। আমার কেমন মনে হল, ও বাড়ির ভেতরেই কোথাও আছে–বাইরে যায়নি। তখন সব জায়গায় খুঁজতে শুরু করি। আর–ওই আলমারিটা খুলতেই–তার ভেতরে ওকে দেখতে পেলাম
–পুলিসে কেউ খবর দিয়েছে? বললাম আমি।
-হ্যাঁ। আমার সৎবাবা ফোন করেছিলেন। তারা এসে গেছে। ওদের দেখে আমার কেমন মনে হল। তখনই তোমাকে ফোন করলাম। তুমি কিছু মনে করোনি তো?
-না, মনে করব কেন। তুমি…ওকে খুঁজে পাওয়ার পর তোমাকে কেউ ব্রাণ্ডি বা কফি দেয়নি?
মেগান আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
ওইটুকু মেয়ে, অমন একটা মৃতদেহ আবিষ্কার করার পর তার স্নায়ুর অবস্থা কেমন হতে পারে, সিমিংটন পরিবারের কেউ একবার ভেবে দেখেনি।
পুলিসে খবর দিয়েই তারা কর্তব্য শেষ করেছে। মনে মনে সিমিংটনদের মুণ্ডুপাত না করে পারলাম না।
মেগানকে নিয়ে তখনই রান্নাঘরে গেলাম। মোটাসোটা গোলগাল চেহারার রোজ আগুনের পাশে বসে চা পান করছিল। আমাকে দেখেই সে কথা বলতে শুরু করল। রোজ খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল।
-রোজ, মেগান ওই মৃতদেহটা খুঁজে পেয়েছে। ওর মনে দারুণ চোট লেগেছে। কড়া করে এককাপ চা ওকে দাও।
পটেই চা ছিল। রোজ কাপে ঢেলে মেগানকে দিল। কয়েক ফোঁটা ব্রাণ্ডিও চায়ের কাপে ঢেলে দিল।
এরপর মেগানকে রোজের হেফাজতে রেখে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম।
মিস এলসি হল্যাণ্ডের সঙ্গেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল প্রথমে।
–ওহ, মিঃ বার্টন, কি ভয়ানক ব্যাপার। কে এরকম কাণ্ড করল?
–অ্যাগনেস তাহলে খুন হল? বললাম আমি।
-কেউ ওর মাথার পেছনে আঘাত করেছিল। ওহ কি ভয়ঙ্কর। তারপর দলা পাকিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখেছিল। বেচারা অ্যাগনেস-ও তো কারো ক্ষতি করেনি–এমন বীভৎসভাবে কে ওকে মারল?
এলসি হল্যাণ্ড তেমন ঘাবড়ায় নি। স্নায়ুর বেশ জোর আছে।
–মিঃ বার্টন, আমি বাচ্চাদের কাছে যাচ্ছি। মিঃ সিমিংটন বলেছেন ওদের আড়ালে রাখবার জন্য, ওদের মনে যাতে আঘাত লাগতে না পারে।
-মেগান শুনেছি মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছে। ওরও দেখাশোনা করা দরকার। রোজের কাছে বসিয়ে রেখে এসেছি ওকে–দেখবেন।
-ওহ্ নিশ্চয়ই। ওর কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। বেচারা মেয়েটার নিশ্চয়ই দারুণ লেগেছে। আমি এখনই গিয়ে দেখছি।
আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এলসি হল্যাণ্ড দ্রুত ওপরে চলে গেল।
ঠিক তখনই হলঘরে ঢুকলেন সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট ন্যাস। তার পেছনে সিমিংটন।
আমাকে দেখে ন্যাস খুশি হলেন। বললেন, এখুনি আপনাকে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।
আমি কেন এসেছি সেকথা উনি জানতে চাইলেন না।
সিমিংটনকে ন্যাস বললেন, সামনের ঘরটা একটু ব্যবহার করতে চাই মিঃ সিমিংটন।
–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বললেন সিমিংটন। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।
–আপনি কিছু এখনো মুখে দেননি মিঃ সিমিংটন। খালিপেটে খুনের মতো বিশ্রী ব্যাপারের মুখোমুখি হওয়া ঠিক নয়। আপনি, মিস হল্যাণ্ড আর মেগান সামান্য কফি মাংস খেয়ে নিন।
ন্যাস একজন পারিবারিক চিকিৎসকের মতোই কথাগুলো বললেন।
–ধন্যবাদ, সুপারিন্টেন্টে। আপনার কথাই মেনে নিচ্ছি। সামান্য হাসবার চেষ্টা করলেন সিমিংটন।
ন্যাস আমাকে নিয়ে ছোট ঘরটায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাড়ির সামনের দিকে একটা মাত্র জানালা এঘরে।
-কিভাবে আপনি খবরটা পেলেন মিঃ বার্টন? খুবই তাড়াতাড়ি এসে গেছেন। ন্যাস বললেন।
আমি তাকে মেগানোর টেলিফোনের কথা জানালাম।
–শুনলাম, গতকাল রাতে আপনি এখানে ফোন করেন? মেয়েটার ফেরার কথা জানতে চেয়েছিলেন?
আমি ন্যাসকে জানালাম অ্যাগনেস ফোন করেও পারট্রিজের কাছে যায়নি।
বুঝতে পেরেছি, চিন্তিতভাবে বললেন ন্যাস, সরাসরি খুন করা হয়েছে মেয়েটিকে। মনে হয় এমন কিছু ও জেনেছিল যা পারট্রিজকে জানাতে চেয়েছিল। কিছু কি জানিয়েছিল মনে। করেন?
-মনে হয় না, তাহলে পারট্রিজ জানাতে। আপনি ওকে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন।
–তাই করব। আগে এখানের কাজ শেষ করে নিই।
–সব জানতে পেরেছেন?
–মোটামুটি। ওদের আজ ছুটির দিন ছিল। দুই বোন এবাড়িতে কাজ করতো। ওদের একসঙ্গে ছুটির ব্যবস্থা মিসেস সিমিংটনই করেছিলেন।
-তারপর? জানতে চাইলাম আমি।
রাঁধুনী রোজ আসে মিটফোর্ড থেকে। ছুটির দিনে আড়াইঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। অ্যাগনেসকেই মধ্যাহ্নভোজের বাসনপত্র গুছিয়ে রাখতে হতো। গতকালও রাঁধুনী দুটো পঁচিশে বেরিয়ে যায়। সিমিংটন অফিসে বেরিয়ে যান দশ মিনিট পরেই। পৌনে তিনটে নাগাদ এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে যান। পাঁচ মিনিট পরেই মেগান হান্টার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। একমাত্র অ্যাগনেসেরই বাড়িতে থাকার কথা। সে সাধারণত তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে বেরিয়ে যায়।
-তাহলে বাড়ি কি খালি থাকে?
–ওসব নিয়ে এখানে তেমন কেউ ভাবে না। তিনটে বাজার দশ মিনিট আগে পর্যন্ত অ্যাগনেস বাড়িতে একাই ছিল। তার বাইরে বেরুবার কোন তোড়জোড় ছিল না। অ্যাপ্রন আর মাথায় টুপি অবস্থায়ই ওকে আবিষ্কার করি।
-কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন–ঠিক কখন সে মারা যায়?
–সরকারি ডাক্তারের বক্তব্য হল দুটো থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে।
–কিভাবে মারা হয়, আমি জানতে চাই।
-প্রথমে অজ্ঞান করে ফেলা হয়–মাথার পেছনে ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে। পরে ছুঁচলো কোন জিনিস দিয়ে মাথার নিচে গেঁথে দেওয়া হয়। ফলে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়।
-এতো রীতিমত ঠাণ্ডা মাথায় খুন।
–আমারও তাই মনে হয়।
–কিন্তু এমন নৃশংসভাবে খুন করার উদ্দেশ্য কি?
–সঠিক কারণ জানার উপায় নেই। তবে আন্দাজ করতে পারি।
–কিছু একটা জানতে পেরেছিল বলে মনে করেন?
–হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি।
–এখানে কাউকে কিছু আভাস দিয়েছিল?
-সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কাউকে কিছু জানায়নি। রাঁধুনী জানিয়েছে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন ভেঙ্গে পড়েছিল। সে নাকি বারবারই বলতো, কি করবে বুঝতে পারছে না।
একটু থেমে বিষণ্ণ হাসলেন ন্যাস। পরে আবার বললেন, মেয়েটি যদি আমাদের কাছে আসত তাহলে হয়তো আজ তাকে এভাবে মরতে হত না।
সবসময় এরকমই ঘটে। মানুষ পুলিসকে এড়িয়ে চলতে চায়।
তবে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারছি মিঃ বার্টন। সেদিন বিকেলে মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেন, সেদিন দুজন পরিচারিকারই ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। দুজনেরই সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। কিন্তু অ্যাগনেস বাড়ি ফিরে এসেছিল।
–কথাটা আপনি জেনেছেন?
-হ্যাঁ। ফ্রেড রেণ্ডেল নামে অ্যাগনেসের একজন ছেলেবন্ধু ছিল। সে মাছের দোকানে কাজ করে। বুধবারে দোকান বন্ধের পর সে অ্যাগনেসের সঙ্গে দেখা করত। পরে দুজনে একসঙ্গে বেড়াতে যেত।
ওই বুধবারে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। রেণ্ডাল একটা বেনামী চিঠি পেয়েছিল। তাতে জানানো হয়েছিল অ্যাগনেস অন্য কারও সঙ্গে মেলামেশা করছে। এই নিয়েই দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। তাই অ্যাগনেস রেগে গিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ও বলেছিল, ফ্রেড এসে ক্ষমা না চাইলে ও আর তার কাছে যাবে না।
-তারপর?
-এবাড়ির রান্নাঘরটা বাড়ির পেছন দিকে। বাড়িতে ঢুকতে হয় সামনের গেট দিয়ে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে পেছনে একটা দরজা আছে ঢোকার।
এবারে অন্য একটা বিষয় লক্ষ্য করুন। ওই দিন বিকেলে মিসেস সিমিংটনের কাছে যে চিঠিখানা এসেছিল, তার খামের ওপরে একটা ব্যবহার করা ডাকটিকিট লাগানো ছিল। ডাকঘরের সিলের বদলে ওরকমই দেখতে একটা কালির ছাপ ছিল। চিঠিটা যে ডাকে আসেনি এটাই তার প্রমাণ। চিঠিটা কেউ হাতে করে বাক্সে ফেলে গিয়েছিল বলেই আমার বিশ্বাস।
-হ্যাঁ, তাই তো প্রমাণ হয়। বললাম আমি।
-সাধারণত পৌনে চারটে নাগাদ বিকেলের চিঠি বিলি হয়। মেয়েটি রান্নাঘরের উল্টোদিকে ভাড়ার ঘরে ছিল। সেখান থেকেই জানালা দিয়ে সে একজনকে চিঠি ডাকবাক্সে ফেলে যেতে দেখে থাকবে।
–তারপর এই যুক্তি যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে, অ্যাগনেস জানতো, বেনামী চিঠির লেখক কে? কিন্তু তাহলে সে জানাল না কেন?
ন্যাস বললেন, হ্যাঁ, সে কোন আভাস কাউকে কেন দিল না, সেটাই প্রশ্ন। আমার ধারণা, এমন একজনকে সে চিঠিটা বাক্সে ফেলতে দেখেছিল, যাকে সে বেনামী চিঠির লেখক হিসেবে কল্পনাও করতে পারেনি। সেই লোকটি সব সন্দেহের বাইরে ছিল। বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। কথাটা কাউকে বলবে কিনা বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছিল পারট্রিজকেই জানাবে। তার পরামর্শ চাইবে।
–আপনার যুক্তি আমি স্বীকার করছি। বললাম আমি। এর পর ওই বেনামী চিঠির লেখক যেভাবেই হোক, ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। কিন্তু কিভাবে এই জানাটা সম্ভব হয়েছিল বলে আপনি মনে করেন, সুপারিন্টেন্টে?
–যেমন ধরুন টেলিফোনের কথাটা। আপনি যখন ফোন করেন, তখন কে শুনে থাকতে পারে বলে মনে করেন?
আমি একটু চিন্তা করলাম। পরে বললাম, টেলিফোন আমিই প্রথমে ধরি। তারপর সিঁড়ির কাছে গিয়ে পারট্রিজকে ডাকি।
–নিশ্চয় মেয়েটির নাম করে ডেকেছিলেন?
–হ্যাঁ। নাম ধরেই ডেকেছিলাম।
–আপনার কথা কেউ শুনেছিল?
–হ্যাঁ। আমার বোন আর মিস গ্রিফিথ শুনে থাকতে পারে।
–মিস গ্রিফিথ? উনি ওখানে তখন ছিলেন?
আমি তখন সব খুলে বললাম–রেডক্রশের স্টলের কথা–সবজি তুলে রাখার কথা–যোয়ানার সঙ্গে তার আলোচনার বিষয় সবকিছু।
–এরপর উনি কি গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন?
–বলেছিলেন মিঃ পাইয়ের কাছে যাবেন।
–তাহলে, এটা পরিষ্কার এই দুটি পথেই কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে গ্রামে এভাবেই সব কথা জানাজানি হয়ে থাকে।
কিন্তু কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সামান্য একটা অর্থহীন টেলিফোনের কথা–এটার মধ্যে প্রচার করবার কি থাকতে পারে যে মিস গ্রিফিথ বা মিঃ পাই তা প্রচার করতে পারেন? আমার অবিশ্বাসের কথা জানালাম ন্যাসকে।
তিনি মৃদু হেসে বললেন, শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটা সত্যিই মিঃ বার্টন যে এখানে যে কোন কিছুই খবর হয়ে উঠতে পারে। তারপর ওদিকের কথাটাও ভাবুন। মিস হল্যাণ্ড, রোজ-অ্যাগনেস কি বলেছিল তারাও শুনে থাকতে পারে।
তাছাড়া, অ্যাগনেস ওই দিন বিকেলে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল এই কথাটা তার কাছ থেকেও প্রচার হওয়া সম্ভব।
যাই হোক, এটা আশার কথা যে এভাবে গণ্ডীটা বেশ ছোট হয়ে এসেছে। এবার একটু ধৈর্য ধরে ঝাড়াই-বাছাই করে আমরা ঠিক অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারব।
-কাদের বাদ দেবার কথা ভাবছেন আপনি? জানতে চাইলাম আমি।
–যেমন ধরুন, স্কুলের শিক্ষিকারা। আর বিকেলে যেসকল মহিলা কেরানী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ হতে পারে, তা আমি ভাবি না।
আর একটা ব্যাপার মিঃ বার্টন, সময় নিয়ে দুটো সূত্র আমাদের সামনে রয়েছে যা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। গতকাল বিকেল আর একসপ্তাহ আগে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর দিন। গতকালের সময়টা ধরুন, সওয়া তিনটে, যখন রেণ্ডেলের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর অ্যাগনেস বাড়ি ফিরে আসে। আর একসপ্তাহ আগে চিঠিটা যখন আসে তার সময় চারটের মধ্যে।
গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে কি ভাবছেন? বললাম আমি।
-কি ভাবছি? ন্যাস একটু থামলেন, পরে বললেন, আমার মনে হয় কোন মহিলা সদর। দরজায় ঘণ্টা বাজায়। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গীই ছিল মহিলার। সে মিস হল্যাণ্ড বা মিস মেগানের খোঁজ করে। সে হাতে পার্শেল জাতীয় কিছুও নিয়ে আসতে পারে। সেই সময়েই কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে আগন্তুক ভারি কিছু দিয়ে অ্যাগনেসের মাথার পেছনে আঘাত করে। তারপর ওকে ঘাড়ের পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করে দলামোচা করে দেয়াল আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে।
-কিন্তু কোন স্ত্রীলোকের পক্ষে এই কাজটা বেশ শক্ত মনে হয় না কি? বললাম আমি।
ন্যাস তাকালেন আমার দিকে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
–দেখুন মিঃ বার্টন এসব বেনামী চিঠির পেছনে যে স্ত্রীলোকটি থাকতে পারে, সে মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ হতে পারে না। আর মানসিক ভারসাম্য যাদের থাকে না, তাদের দেহের শক্তি অন্যরকম হওয়াই সম্ভব। তাছাড়া অ্যাগনেসও তেমন একটা বড়সড় চেহারার ছিল না।
-অ্যাগনেসের দেহটা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। বললাম আমি।
-কাজটা পাকা বুদ্ধির বলতে হবে। দেহটা আবিষ্কারে দেরি হলে মৃত্যুর সময়ও সঠিক নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। ধরুন মিস হল্যাণ্ড যদি বাড়ি ফেরার পর মৃতদেহের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতেন কিংবা পড়ে আছে দেখতে পেতেন তাহলে ডাক্তার পরীক্ষা করে বলতে পারতেন দশ মিনিটের মধ্যে অ্যাগনেসের মৃত্যু হয়েছে কি না।
–অ্যাগনেসের মনে ওই মহিলা সম্পর্কে কোন সন্দেহ জেগেছিল বলে মনে করেন? চিন্তিতভাবে জানতে চাইলাম আমি।
অ্যাগনেসের মনে নির্দিষ্টভাবে কোন সন্দেহ জেগেছিল বলে মনে হয় না, বললেন ন্যাস, তবে অস্পষ্টভাবে কোন জিজ্ঞাসা জেগে থাকতে পারে।
খানিকটা কৌতূহলও হয়তো ছিল। ও ভাবতেই পারেনি, যে মহিলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে, সে তাকে খুন করতে পারে।
–আপনি এরকমই সন্দেহ করছেন? বললাম আমি।
–একটা ব্যাপার আমার বুঝতে ভুল হয়ে গিয়েছিল, বললেন ন্যাস, এসব বেনামী চিঠির লেখিকার মনে ভয়ের সঞ্চায় হয়েছিল।
হ্যাঁ, আমারও তাই সন্দেহ, ভয় থেকেই খুনটা করতে বাধ্য হয়েছিল সে। বিকৃত মানসিকতার মানুষের মনের ভয় বড় ভয়াবহ।
তবে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন–এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে এমন একজন লোক, সমাজে যে গণ্যমান্য বলে স্বীকৃত, বেশ সম্মানের অধিকারী। তার বিরুদ্ধেই লড়াইতে নামতে হয়েছে আমাদের।
কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলেন সুপারিন্টেন্টে ন্যাস। মুখ দেখে মনে হল, মনের তলায় কিছু হাতড়ে চলেছে।
-একবার রোজের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আপনিও সঙ্গে থাকলে খুশি হব।
আমি অবাক হলাম। বললাম, আসব বলছেন? অবশ্য বলতে বাধা নেই, এরকম একটা ইচ্ছা আমার মনে ছিল। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, ন্যাস কিভাবে নেবেন ভেবে।
একটু ইতস্তত করেই বললাম, বইতে দেখা যায়, গোয়েন্দারা যাকে সাহায্যের জন্য ডাকেন, সাধারণত তারাই অপরাধী প্রমাণিত হয়।
আপনার আহ্বানের পেছনেও কি–
উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন ন্যাস। পরে বললেন, আপনার কথা শুনে না হেসে পারছি না। মিঃ বার্টন। বেনামী চিঠির লেখক হিসেবে আপনাকে ভাবা চলে না। আপনার কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্যই পেতে পারি আমরা।
–শুনে খুশি হলাম। আপনি তা কিভাবে আসা করছেন জানতে পারি কি?
-আপনি এখানে সম্পূর্ণ নবাগত বলেই এখানকার লোকজন সম্পর্কে ভোলা মনে ধারণা করতে পারবেন। সকলের সঙ্গে সামাজিক ভাবে মেলামেশারও ভাল সুযোগ আপনার রয়েছে, যা থেকে অনেক কিছু জেনে যাবার সম্ভাবনা আপনার রয়েছে।
–অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন সমাজের উঁচু মহলের সম্ভাব্য খুনীকে সন্ধান করবার জন্য আমাকে একজন গুপ্তচরের ভূমিকা নিতে হবে। বললাম আমি।
–বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে, আপনি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না, মিঃ বার্টন?
একদম না। এখানকার নিরীহ মহিলাদের যে লোক মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইছে, আর হতভাগ্য পরিচারিকাদের পরিকল্পিতভাবে খুন করছে, সেই ভয়ঙ্কর চরিত্রের কোন অপরাধীকে শাস্তি দেবার কাজে সাহায্যে জন্য যে কোন কাজ করতেই আমি রাজি আছি।
একজন দায়িত্বশীল সামাজিক মানুষের মতোই বলেছেন আপনি স্যর। আপনাকে কেবল এটুকু মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা এমন একজন সাঙ্ঘাতিক চরিত্রের স্ত্রীলোকের সন্ধানে নেমেছি, যে সাপের মতোই ভয়ঙ্কর আর বিপজ্জনক।
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। মনে মনে আতঙ্কিত না হয়েও পারলাম না। বললাম, তবে নতুন কোন ঘটনা ঘটবার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে-যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের।
–বলেছেন ঠিক। তবে এটা জানবেন আমরা পুলিসরা বিভিন্ন দিকে কাজ করে চলেছি।
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ন্যাস জানালেন ইতিমধ্যে রোজ পুলিসকে দুবারে দুরকম কথা বলেছে। আরো একবার জেরা করার সময় সে যদি নতুন কোন কথা বলে তাহলে তা থেকে আসল সত্য প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে এই আশাতেই রোজের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কথাটা অযৌক্তিক মনে হল না আমার।
রান্নাঘরে এসে দেখলাম, রোজ প্রাতরাশের বাসনকোসন পরিষ্কার করছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।
তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম রোজ। আশা করি ঠিক ঠিক জবাব দেবে।
খানিকটা কড়া স্বরেই বললেন ন্যাস।
-আমি তো বলেছি স্যর, অ্যাগনেসকে খুবই ভয় পেয়েছে বলে মনে হয়েছিল আমার। কিছু একটা নিয়ে খুব ভাবছিল।
-কেন ও ভয় পেয়েছিল এ নিয়ে কিছু ও বলেনি তোমাকে? জানতে চাইলেন ন্যাস।
–না। আমি জানতে চাইলে ভয়ে কেঁপে উঠে বলেছিল, একথা বললে সে প্রাণে বাঁচবে না।
ন্যাস মাথা নাড়লেন চিন্তিতভাবে।
–গতকাল বিকেলে তুমি কি করেছিলে মনে করে নিশ্চয় বলতে পারবে?
-হ্যাঁ স্যর। এখান থেকে বেরিয়ে আড়াইটার বাস ধরে বাড়ি ফিরে গেছি। বিকেলটা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কাটিয়েছি। তারপর রাত ৮-৪০ মিঃ বাস ধরে নেদার মিডফোর্ড থেকে ফিরে আসি। তবে স্যর, একমুহুতের জন্যও মনে স্বস্তি ছিল না। খুবই খারাপ লাগছিল। ভাল করে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করতে পারিনি।
রোজকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আমরা এলসি হল্যাণ্ডের কাছে এলাম।
সে তখন বাচ্চাদের পড়ানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে ওদের লেখার কাজ দিয়ে উঠে এলো।
বাচ্চাদের পড়াশোনার বিঘ্ন যাতে না হয় সেজন্য আলাদা একটা ঘরে বসালো আমাদের।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ন্যাস বললেন, মিস হল্যাণ্ড, একটা কথা শুধু আমাকে বলুন। মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকে অ্যাগনেস কেন খুব মুষড়ে পড়েছিল, এ সম্পর্কে সে কি কিছুই জানায়নি?
-না স্যর, সে কিছুই জানায়নি। ও এমনিতে খুবই সরল প্রকৃতির মেয়ে ছিল। কথাও কম বলত।
-রোজের মতো ছিল না বলছেন। বললেন ন্যাস।
–হ্যাঁ। রোজ বড় বেশি বকে।
–গতকাল ঠিক কি ঘটেছিল যদি এবার দয়া করে বলেন
–যতটা মনে আছে বলছি শুনুন। গতকাল মধ্যাহ্নভোজ অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই হয়। তখন একটা বেজেছে। এরপর মিঃ সিমিংটন অফিসে ফিরে যান। অ্যাগনেস টেবিল গুছিয়ে রাখছিল। সেই সময় বাচ্চারা বাগানে খেলা করছিল। একটু পরে ওদের নিয়ে আমি বেড়াতে বেরোই।
ওদের কোথায় নিয়ে যান?
-মাঠের মধ্য দিয়ে কুম্বত্রকারে। ওরা ওখানে মাছ ধরতে চাইছিল। ছিপ নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে, ওগুলো নিয়ে যাবার জন্য আবার ফিরে আসতে হয়েছিল।
–তখন কটা বেজেছিল?
–কটা বেজেছে–মনে হয়–তিনটে বাজতে খুব বেশি বাকি ছিল না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বিশ মিনিট বাকি ছিল। মেগান তার সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল।
–আপনি ছিপের জন্য কখন বাড়ি ফিরে আসেন তাই জানতে চাইছিলাম।
–আপনি বাড়ি ফিরে এসে মেগান বা অ্যাগনেসকে দেখেছিলেন?
–মেগান ছিল না। অ্যাগনেসও বাড়ি চলে গিয়েছিল।
–তারপর আবার মাছ ধরতে চলে যান?
–হ্যাঁ। নদীর পাড় দিয়েই গিয়েছিলাম আমরা। তবে কিছুই ধরতে পারিনি। শূন্যহাতেই ফিরে এসেছিলাম আমরা।
বুধবারে আপনি চায়ের আসরে থাকেন?
-হ্যাঁ। মিঃ সিমিংটন ফিরে আসার পর আমি তাকে চা তৈরি করে দিয়েছিলাম। পরে বাচ্চাদের নিয়ে আমি পড়ার ঘরে যাই। মেগানও আমাদের সঙ্গে ছিল।
–আপনারা কটায় বাড়ি ফিরে এসেছিলেন?
-পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি ছিল। মিঃ সিমিংটন ফিরে এসেছিলেন পাঁচটার সময়। তিনি সকলের সঙ্গে বসে পড়ার ঘরেই চা পান করেন। বাচ্চারা তাতে খুব খুশি হয়েছিল। চা পর্বের পর বাচ্চাদের নিয়ে খানিকক্ষণ খেলাধূলা করি। বেচারি মেয়েটার কথা ভাবলে বড় কষ্ট হয়–সারাটা সময় ও দেয়াল আলমারিতেই পড়েছিল।
–ওই আলমারির কাছে সাধারণত কেউ যায়?
-না, ওদিকে কেউ যায় না। দরকারী কোন জিনিস তো ওটার মধ্যে থাকে না। ক্কচিৎ কখনো যাওয়া পড়ত ওদিকে।
–তা, বাড়ি ফিরে আসার পরে অস্বাভাবিক কিছু কি আপনার চোখে পড়েছিল?
–ওহ না, স্যর, কিছুই তেমন চোখে পড়েনি।
–আচ্ছা, আগের সপ্তাহে
–যেই সপ্তাহে মিসেস সিমিংটন
–হ্যাঁ।
–ওহ, সেসব কথা মনে পড়লে এখনও শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়।
–হ্যাঁ, সত্যিই ভয়ঙ্কর। সেদিন আপনারা সবাই বিকেলে বাইরে ছিলেন?
-হ্যাঁ। এ সময়টায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি সাধারণত বাইরেই থাকি। মনে আছে, সেদিন আমরা অনেক দূর–জলার দিকে গিয়েছিলাম।
আমরা ফিরে আসার সময় দেখতে পাই, রাস্তার অন্য ধার দিয়ে মিঃ সিমিংটন অফিস থেকে ফিরে আসছেন। ফিরে এসে চায়ের জল বসাই।
–আপনি মিসেস সিমিংটনের কাছে যাননি?
-না, যাইনি। ডাঃ গ্রিফিথ তাকে কিছু ওষুধ দিয়েছিলেন। সেটা খাওয়ার পরেই তার ঝিমুনি দেখা দিত। তাই ওই সময়টা তিনি বিছানাতেই থাকতেন।
বিকেলের ডাকে আসা চিঠি তাঁর কাছে কেউ নিয়ে যেত না?
–বিকেলের ডাক সাধারণত আমিই ফেরার পথে বাক্স থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখতাম। অনেক সময় মিসেস সিমিংটন বাক্স থেকে চিঠি বের করে নিতেন।
–সেদিন বিকেলে বিছানা থেকে না ওঠায় অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি?
-কিছুই না। এরকম কিছু তো কল্পনা করাও যায় না। আমি রান্নাঘরে কেতলিতে জল ফুটছে দেখে আসার পর চোখে পড়ল মিঃ সিমিংটন হলঘরে কোট খুলছেন।
শুনতে পেলাম তিনি মোনা মোনা বলে ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে তিনি দোতলায় উঠে মিসেস সিমিংটনের শোবার ঘরে যান। তারপরই তিনি অস্বাভাবিক কণ্ঠে আমাকে ডাকতে থাকেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাই।
তিনি বলেন, বাচ্চাদের যেন আমি সরিয়ে রাখি যাতে এ ঘরে না আসে। তারপরেই তিনি ডাঃ গ্রিফিথকে টেলিফোন করেন।
এরপর আর চায়ের কথা আমাদের কারু মনে ছিল না। সেই সাংঘাতিক ঘটনা, বাড়ির সমস্ত প্রাণচাঞ্চল্য যেন স্তব্ধ করে ফেলেছিল। উঃ, কী ভয়ংকর–দুপুরে খাওয়ার সময়ও মিসেস সিমিংটন এত হাসিখুশি ছিলেন।
ন্যাস এরপর প্রশ্নের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন, মিসেস সিমিংটন যে চিঠিটা পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আপনার ধারণা কিরকম মিস হল্যাণ্ড?
চকিতে মুখ তুলে তাকালেন মিস এলসি হল্যাণ্ড, দৃঢ়স্বরে বললেন, অত্যন্ত জঘন্য। আমি ওসব একদম বিশ্বাস করি না। মিসেস সিমিংটন, কখনও এমন নীতিহীন কাজ করতে পারেন না। এজন্যই তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন।
ন্যাস নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালেন। পরে বললেন, একটা কথা, মিস হল্যাণ্ড, আপনি কি এরকম চিঠি কখনো পেয়েছেন?
যেন চমকে উঠলেন এলসি। তার মুখ লাল হয়ে উঠলো।
-না-না, এরকম চিঠি আমি কখনও পাইনি।
–আপনি একটু ভেবে বলুন, মিস হল্যাণ্ড, বললেন ন্যাস, অবশ্য এটা ঠিক এরকম চিঠি পাওয়া খুবই মর্মান্তিক। লোকে তাই এরকম চিঠি পাওয়ার কথা চেপে যেতেই চায়। এসব চিঠিতে যা থাকে, আমরা জানি, সেসব মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। তাই বলছি, আপনার বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। ব্যাপারটা জানা আমাদের খুবই দরকার।
–কিন্তু সুপারিন্টেন্ডেন্ট, আমি সত্যিই পাইনি। আপনি বিশ্বাস করুন।
এলসি হল্যাণ্ডের মুখভাব কাঁদোকাঁদো হয়ে এলো। তিনি যে মিথ্যা বলছেন না, তা বিশ্বাসযোগ্যই মনে হলো।
এলসি হল্যাণ্ডকে বিদায় জানানো হলো। তিনি বাচ্চাদের কাছে চলে গেলেন। সুপারিন্টেন্টে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।
কয়েক মিনিট পরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, মনে হয় তিনি সত্য কথাই বলছেন, কোন চিঠি পাননি।
-আমারও তাই মনে হয়। বললাম আমি।
–কিন্তু, আশ্চর্য যা, তা হল, তিনি কোন চিঠি পেলেন না কেন? অথচ…অথচ মহিলা সুন্দরী।
-একটু বেশি রকম সুন্দরীই বলা চলে। আমি সায় দিলাম।
-সুন্দরী এবং তরুণী। বেনামী চিঠির লেখকদের চোখ এমন একজনকে এড়িয়ে গেল কেন? প্রশ্নটা ভেবে দেখার মতো, কি বলেন?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
–গ্রেভস বলেছিলেন, যারা চিঠি পায়নি তাদের কথাও তাকে জানাতে।
–আরও একজন এমন আছেন। মিস এমিলি বার্টনও কোন চিঠি পাননি।
–একথাটা আমার বিশ্বাস হয় না, বললেন ন্যাস; আমার ধারণা তিনি অবশ্যই চিঠি পেয়েছিলেন। একটা নয়, বেশ কয়েকটাও হতে পারে।
–আপনার এমন ধারণার কারণ কি?
-তার আগেকার পার্লারমেড ফ্লোরেন্স এলফোর্ডই আমাকে কথাটা বলেছে। ওই লেখকের ওপর খুবই রেগে আছে ফ্লোরেন্স।
–তাহলে এমিলি একেবারেই অস্বীকার করে গেলেন কেন কথাটা, বিশেষ করে পুলিস যখন তদন্তে নেমেছে?
-মিস বার্টন বরাবরই একটু অন্য ধরনের মহিলা। নোংরা অরুচিকর জিনিস এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত তিনি। তাই ওরকম জঘন্য ভাষার চিঠির কথা বলতে স্বভাবতই সঙ্কোচ বোধ করছেন তিনি।
–ওর চিঠিতে কি লেখা ছিল, তা কি জানতে পেরেছেন?
–এসব মারাত্মক কথা যে লিখতে পারে সে বদ্ধ উম্মাদ ছাড়া আর কি। আশ্চর্য হচ্ছি এই লোকটিকে আপনারা খুঁজে বের করতে পারছেন না?
এবারে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব অকে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন ন্যাস, এখানেই সে থামবে না, আরও চিঠি তাকে লিখতে হবে।
আমি ন্যাসের কথাটা মেনে নিতে পারলাম না। বললাম, যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, মনে হয় এইমুহূর্তে সে আর চিঠি লিখছে না।
লিখবে, না লিখে উপায় নেই তার। এ একধরনের রোগ। কেউ না কেউ চিঠি ঠিক পেতে থাকবে।
বাগানে মেগানের দেখা পেয়ে গেলাম। আগের মতোই আমাকে দেখে হাসিমুখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
-হাই, বার্টন
আমি মেগানকে বললাম, আমাদের ওখানে গিয়ে তো কদিন থেকে আসতে পার।
-তুমি বললে বলে আমার খুব ভাল লাগছে। কিন্তু এখন এখানেই থাকব ভাবছি। বাচ্চাগুলোকেও একটু দেখাশোনা করতে পারছি।
-ভাল কথা, যেভাবে ভাল থাকবে মনে করো তাই করবে।
–কিন্তু কিন্তু এরকম সাংঘাতিক কিছু ঘটলে তোমাকে ফোন করতে পারব তো?
–অবশ্যই। কিন্তু এরকম ভাবছ কেন তুমি?
–যা সব ঘটে চলেছে, কখন কি হয়
–যাই হোক, ওরকম ভয়াবহ কিছু আর আবিষ্কার করতে যেও না।
উঃ! বড় ভয়ানক সত্যি। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল।
মেগানের সঙ্গে কথা শেষ করে ন্যাসকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। যোয়ানাকে সব কথা শোনাতে বসলাম। সেই ফাঁকে ন্যাস গেলেন পারট্রিজের সঙ্গে কথা বলতে।
কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলেন ন্যাস। জানালেন, নতুন কিছু তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না।
–অ্যাগনেসের কথাটা ও কি কাউকে জানিয়েছিল? জানতে চাইল যোয়ানা।
–হ্যাঁ, বলেছিল, গম্ভীরভাবে বললেন ন্যাস, আপনাদের কাজের লোক মিসেস এমোরিকে। কোন সমস্যায় পড়ে তার পরামর্শ নিতে চায়–এই ভাবেই সে কথাটা জানিয়েছিল।
-তাহলে মিসেস এমোরির মুখ থেকেই কথাটা বাইরে ছড়িয়ে থাকতে পারে। বলল যোয়ানা।
–আমারও তাই ধারণা মিস বার্টন। বললেন ন্যাস।
–একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না, বললাম আমি, আমাকে আর আমার বোনকে নিয়ে ওই বেনামী চিঠি কেন লেখা হল? আমরা এখানে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। আমাদের ওপর কারোর তো রাগ থাকার কথা নয়।
-নবাগত তো কি, বললেন ন্যাস, বেনামী চিঠিলেখকের বিদ্বেষ যে কোন সুখী মানবিক মানুষের ওপরেই
-হ্যাঁ, মিসেস ডেন ক্যালQপও এরকমই বলতে চেয়েছিলেন। বলল যোয়ানা।
ন্যাস বললেন, মিস বার্টন, আমার একটা সন্দেহ, আপনার চিঠিটা আসলে মিস বার্টনকেই লেখা হয়েছিল। যদি চিঠির খামখানা ভাল করে লক্ষ্য করতেন, তাহলে ঠিক বুঝতে পারতেন।
–মিস বার্টনকে লেখা? এরকম কেন হতে যাবে? আশ্চর্য হল যোয়ানা।
–নামের ছোট্ট এ অক্ষরটা কৌশলে ইউ করে দেওয়া হয়েছিল, আমার সন্দেহ।
কথাটা শুনে আমিও ভাবিত হলাম। আগে এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি।
ন্যাস চলে যাবার পরে যোয়ানাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হারে, সত্যিই তোর মনে হয়, চিঠিটা মিস বার্টনকে লেখা হয়েছিল?
-না, না, কখনোই না। সুপারিন্টেন্টে বললেই তো হবে না। তাহলে ওরকম কথা লেখা থাকত না।
পরে যোয়ানা বলল, তুই একবার শহর থেকে ঘুরে আয়। সকলে কি বলাবলি করছে তা শোনা দরকার।
–পুলিসের ধারণা বেনামী চিঠির লেখক কোন স্ত্রীলোক। লোকেরাও হয়তো সেরকমই ধারণা করে নিয়ে থাকতে পারে। বললাম আমি।
–পুরুষ হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে বিশেষ ধরনের পুরুষদেরই এরকম মানসিকতা থাকে…অবদমিত কামোন্মাদনা। আমার একজনকে সন্দেহ হয়। বলল যোয়ানা।
–কার কথা বলছিস? জানতে চাইলাম আমি।
–মিঃ পাইকেই আমার সন্দেহ হয়। একাকীত্বের বিষণ্ণতায় মোড়া একজন অসুখী মানুষ। মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবি, এখানকার সব সুখী মানুষের প্রতিই তার ঘৃণা আর অবজ্ঞা রয়েছে। আর করেন কেমন বেয়ারা ধরনের সব কাজ-লোকে এ নিয়ে আড়ালে হাসিঠাট্টা করে।
-কিন্তু বেনামী চিঠি বিশেষজ্ঞ গ্রেভস বলেছেন, কোন মধ্যবয়স্কা অবিবাহিতা স্ত্রীলোক এসব বেনামী চিঠি লিখছে।
–মিঃ পাইও তাই, অবিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষ।
–কিন্তু যো, যতদূর দেখেছি, ওকে ঠিক মানাচ্ছে না।
–বাইরে থেকে এরকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। পয়সাওয়ালা ধনী মানুষ। কিন্তু টাকাই তো মানুষের পরিপূর্ণতার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
-উনি নিজেও কিন্তু ওরকম চিঠি পেয়েছেন।
প্রতিবাদ জানিয়ে যোয়ানা বলল, এসব কথা আমরা কেউই সঠিক জানি না। তার কাছে। শোনা, তার পক্ষে বানিয়ে বলা অসম্ভব কিছু না।
–আমাদের সুবিধে করে দেবার জন্য, বলছিস?
-হ্যাঁ। কোন রকম বাড়াবাড়ি করেন নি। বেশ বুদ্ধির সঙ্গেই কাজটা করেছেন, বলতে হবে।
–তাহলে তো বলতে হয়, উনি একজন পাকা অভিনেতা।
তাছাড়া আর কি। অভিনেতা না হলে এরকম কাজ করে চলা সম্ভব হয় কখনো?
যোয়ানার অভিনব আবিষ্কার আমার বিরক্তিরই সৃষ্টি করল। বললাম, এমন ভাব দেখাচ্ছিস, যেন তুই সব জেনে ফেলেছিস। বেনামী চিঠির লেখকের মানসিকতা বোঝা অত সহজ কাজ নয়, এটা মনে রাখিস।
তুই বলতে পারিস। কিন্তু, জেরি, আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। আমার কথাই ধর না, যদি আমি তরুণী আর মোটামুটি সুন্দরী হাসিখুশি সুখী মানুষ না হয়ে জেলে থাকতাম আর সকলকে জীবন উপভোগ করতে দেখতাম, তাহলে আমার মনে এমন এক শয়তানীর জম্ম হত, যে সকল সুখী মানুষকে আঘাত করতে চাইত, কষ্ট দিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে চাইত।
একটু থামল যোয়ানা। আমার দিকে তাকিয়ে পরে বলল, পুলিস যদি এমনি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটাকে দেখার চেষ্টা করত, তাহলে মনে হয়, রহস্য ভেদ করা তাদের পক্ষে সহজ হত, ওই লোকটা, তুই যদি তার মানসিকতা অনুভব করবার চেষ্টা করিস, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবি। এরপর এসব লোক কি করতে চাইবে তা অনুভব করাও তোর পক্ষে অসম্ভব হবে না।
অত সব ছাইপাঁশ ভাববার জন্য আমি এখানে এসেছিলাম, নাকি, বিরক্তির সঙ্গে বললাম আমি। ওসব অশ্লীল চিঠি আর খুনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে কোনদিনই স্বাস্থ্য উদ্ধার হবে না।
.
যোয়ানার কথামতো হাইস্ক্রীটে এসে দেখলাম, এখানে ওখানে লোকের জটলা। কি নিয়ে তারা আলোচনা করছে অনুমান করতে কষ্ট হল না।
প্রথমেই চোখ পড়ল গ্রিফিথের ওপর। কেমন রুগ্ন আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
–দেখে মনে হচ্ছে খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। বললাম আমি।
হতে পারে। বেশ ঝামেলার কিছু কেস নিয়ে পড়েছি। বললেন গ্রিফিথ।
–বেনামী চিঠির লেখকও এরমধ্যে রয়েছে?
–অস্বীকার করি কি করে? এধরনের মানসিক অত্যাচার
–লোকটা কে হতে পারে, আপনার কোন ধারণা আছে?
–একদম না। তবে ধারণা করতে পারলে বোধহয় বেঁচে যেতাম।
কথা বলার ফাঁকেই দেখতে পেলাম ডাক্তারের বোন এমি আসছে। তার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে গ্রিফিথকে বিদায় দিলাম।
-শুনলাম, আপনি বেশ তাড়াতাড়িই ওখানে হাজির হয়েছিলেন?
প্রায় চিৎকার করে বলতে বলতে এগিয়ে এলো এমি।
-আসলে গতকাল রাতে মেয়েটার আমাদের বাড়িতে চা খেতে আসার কথা ছিল। আসেনি বলে অস্বস্তি বোধ করেছিলাম।
বললাম আমি, মেগান যে আমাকে ফোন করেছিল সে কথাটা ইচ্ছে করেই চেপে গেলাম।
–এলো না বলে, আশ্চর্য বলতে হবে, আপনি সবচেয়ে খারাপটাই ভেবে নিতে পেরেছেন। আর আপনার ভাবনাটাই সত্যি হল শেষ পর্যন্ত।
আমি অর্থহীন ভঙ্গীতে হাসলাম। কোন জবাব দিলাম না।
–লিমণ্টকে খুনের ঘটনা এই প্রথম ঘটল। তাই উত্তেজনা সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিস এসব কি করে সামাল দেয় দেখা যাক।
-পুলিস সম্পর্কে আমি আশাবাদী, বললাম আমি, তাদের মধ্যে অনেক লক্ষ্য লোক রয়েছে।
-ওয়েলের কাছে শুনলাম, প্রথমে মাথায় মেরে ওকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়, পরে মাথার পেছনে ছোরা বিধিয়ে মারে। মেয়েটার ছেলেবন্ধুই একাজ করেছে বলে আমার ধারণা। আপনার কি মনে হয়?
–এরকমই সম্ভব বলছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
–অসম্ভব কেন? ওদের নাকি খুব ঝগড়া হয়েছিল। শুনলাম মেগান হান্টার নাকি প্রথমে মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিল। বেচারি নিশ্চয় খুব শক পেয়েছে।
সত্যিই মেয়েটা মনে বড় চোট পেয়েছে। বললাম আমি।
সেই মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। ব্যাপারটা যাচাই করে নিতে চাইলাম এই সুযোগে।
–একটা কথা, মিস গ্রিফিথ, মেগানকে বাড়ি ফিরে যাবার কথা গতকাল আপনিই কি বলেছিলেন?
–তেমন জোর দিয়ে কিছু বলিনি অবশ্য।
–তাই বলুন, আমি বললাম, আমিও তাই অনুমান করেছিলাম।
এমি গ্রিফিথ আমার চোখের দিকে তাকালেন। পরে সতর্কতার সঙ্গে বললেন, মেয়েটার তো বয়স অল্প, সব ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। তাই ওকে একটু সতর্ক করেই দিতে চেয়েছিলাম। কখন কি কথা ছাড়াবে–এখানে কেউ বলতে পারে না।
–কি কথা ছড়াবে?
আমি স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ না করে পারলাম না।
–লোকে কি বলে সে সম্পর্কে মনে হয় আপনার কোন ধারণা নেই। আমার কানে অনেক কথাই আসে, তাই আমি জানি।
লোকেরা খারাপটাই বলে–আর যে মেয়েকে কাজ করে তার জীবিকা অর্জন করতে হয়, সহজেই সে অন্যের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
–আপনি কি বলতে চাইছেন, ঠিক ধরতে পারছি না।
আমি সত্যিই ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আবার জীবিকার প্রশ্ন আসছে কি করে?
-আমি এলসি হল্যাণ্ডের কথা বলছি, বুঝতে পারছেন না, বললেন এমি, লোকে যাই বলুক, আমার ধারণা ও সত্যিকার ভাল মেয়ে। লোকের কথায় কান দিয়ে বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে জবাব না দিয়ে ও যথার্থ কর্তব্যই করেছে।
–লোকে কি বলছে?
এমির মুখে হাসি মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। খারাপ ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই আমার মনে হল।
লোকে বলাবলি করছে, ও দুই নম্বর মিসেস সিমিংটন হওয়ার চেষ্টা করছে। যে ভাবে সদ্য স্ত্রীহারা মানুষের সেবাযত্ন করে চলেছে
আমি বেশ ধাক্কা খেলাম। বললাম, এসব কী? মিসেস সিমিংটন মারা গেছেন সবে এক সপ্তাহ হল–
-আমিও তাই অসম্ভব বলেই ভাবছি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসলেন মিস গ্রিফিথ, মানুষের মন যে কি বস্তু তা তো জানেন। মেয়েটা তরুণী, তার ওপর বেশ সুন্দরী–লোকেরা যা চায় তার সবই রয়েছে। তবে যদি সত্যি সত্যি এমন কিছু ঘটনা থেকে থাকে, মেয়েটাকে আমি দোষ দিতে পারব না। সবমেয়েই ঘর আর বর চাইবে–এতে বিচিত্র কি?
আমার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। হাঁ করে তাকিয়ে মিস গ্রিফিথের কথা শুনে যেতে লাগলাম।
তবে এটা ঠিক, মিঃ সিমিংটন মেয়েটার মনের কথা কিছুই জানেন না। স্ত্রীর এমন মৃত্যুর পরে তার এখন দিশাহারা অবস্থা। মেয়েটা যেভাবে ভদ্রলোকের দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, তাতে তার নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কি?
–তাহলে বলছেন, এলসি হল্যাণ্ড মেয়েটার অবস্থা বুঝেই সুযোগটা নিয়েছে?
–ঠিক সেকথা বলছি না, ইতস্তত করে বললেন মিস গ্রিফিথ, মেয়েটার জন্য আমার দুঃখ হয়। আসলে লোকের এসব কুৎসিত কথা ভেবেই মেগানকে আমি বলেছিলাম, ওর বাড়িতে যাওয়া উচিত। মিঃ সিমিংটন আর ওই মেয়েটা শুধু এই দুজন বাড়িতে থাকা ভাল দেখায় না।
আসল রহস্যটা এতক্ষণে ঝরঝরে হল আমার কাছে। আমি নির্বিকার দৃষ্টি ফেললাম মুখরা স্ত্রীলোকটির মুখের ওপর।
–আমাদের এই ছোট্ট শহরের মানুষজন খুব সুবিধার নয় মিঃ বার্টন। এরা সবকিছুর মধ্যেই কু খুঁজে বেড়ায়।
কথা শেষ করে হেসে বিদায় নিলেন মিস গ্রিফিথ।
.
গীর্জার কাছে এসে মিঃ পাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। তিনি মিস এমিলি বার্টনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
-সুপ্রভাত মিঃ বাৰ্টন, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন মিঃ পাই, এমন একটা খবর যে আমাদের এই গ্রামে সৃষ্টি হবে, কল্পনা করতে পারিনি। এসব খবর রবিবারের খবরের কাগজে পেয়ে এসেছি এতকাল।
-সত্যিই বড় শোচনীয়। মিস বার্টন প্রতিধ্বনি তুললেন।
-আপনি এর মধ্যে নিশ্চয় উত্তেজনার খোরাকও পেয়েছেন মিস বার্টন, বলুন ঠিক বলছি কিনা। বেশ উপভোগ করছেন যে আপনার কথা শুনেই বুঝতে পারছি।
–মেয়েটা আমার কাছে কাজ করতে এসেছিল সরাসরি একটা অনাথ আশ্রম থেকে। সরল গ্রাম্য মেয়ে। তবে চমৎকার কাজের ছিল। পারট্রিজ ওকে খুব পছন্দ করত। বললেন মিস বার্টন।
গতকাল বিকেলে পারট্রিজের কাছে চা খেতে আসবে বলেও জানিয়েছিল, আমি বললাম। পরক্ষণে মিঃ পাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সম্ভবত কথাটা মিস গ্রিফিথ আপনাকে জানিয়ে থাকবে।
মিঃ পাইয়ের মনে যাতে সন্দেহ না হয় সেই উদ্দেশ্যেই আমি প্রসঙ্গক্রমে কথাটা উত্থাপন করলাম।
-হ্যাঁ, বলেছিলেন, বললেন মিঃ পাই, তার কথায় অবশ্য শ্লেষ ছিল। বলেছিলেন, আজকাল কাজের লোকেরাও বাড়িতে ফোন করে কথা বলে।
–কথাটা আমারও আশ্চর্য লাগছে, আমার বাড়িতে কাজ করা অ্যাগনেস একাজ কেন করল? পারট্রিজ নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিল।
–আপনার সেকেলে মনোভাব এখনো পাল্টায়নি মিস বার্টন, বললেন মিঃ পাই, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই সমাজে পরিবর্তনগুলো হয়। আজকাল বাড়ির কাজের লোকেরা একটু বেশি স্বাধীনতা পেয়ে থাকে, এ নিয়ে বকাঝকা করা চলে না।
আলোচনার মোড় ঘোরাবার উদ্দেশ্যে আমি বললাম, খুনের কথাটা খুব তাড়াতাড়িই দেখছি ছড়িয়ে পড়েছে।
-কেবল কি তাই–সঙ্গে গুজবও রয়েছে। বললেন মিঃ পাই, প্রথমে ছিল বেনামী চিঠি, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে খুন, লিমন্টকের মানুষ এরপর চনমনে না হয়ে পারে?
–এই দুটো ঘটনার মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে লোকেরা নিশ্চয় এরকম কিছু ভাবে না। বললেন এমিলি বার্টন।
–আপনি একেবারে খাপে খাপে মিলিয়ে দিয়েছেন, দারুণ, বলে উঠলেন মিঃ পাই, নিশ্চয় মেয়েটা কিছু জানত, তাই তাকে খুন করা হয়েছে। আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।
–সারাক্ষণই এসব শুনে চলেছি। আর ভাল লাগছে না।
বলে মিস এমিলি তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
আমি মিঃ পাইয়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, এসমস্ত ঘটনা মানে বেনামী চিঠি..খুন..এসব দেখেশুনে আপনার কি মনে হচ্ছে?
মাথা নিচু করে একমিনিট কি ভাবলেন মিঃ পাই। পরে গম্ভীরভাবে বললেন, দেখুন, পুলিস যা সাধারণত করে থাকে–হাতের ছাপ, হাতের লেখা এসব বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা–আমার ধারণা এভাবে বেশিদূর তারা এগুতে পারবে না। চরিত্র অনুধাবন করার পদ্ধতি অনুসরণ করাই এক্ষেত্রে সঠিক পথ। মানুষের কাজ, তাদের ভাবভঙ্গী, ভাবনাচিন্তার ধারা–এসব থেকেই প্রকৃত রহস্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এভাবে সম্ভব বলছেন? বললাম আমি।
–এ না হলে পুলিস কোনদিনই তার সন্ধান পাবে না।
–আপনি কার কথা বলতে চাইছেন? আমি অনুসন্ধিৎসু হলাম।
–ওসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না মিঃ বার্টন, আমি দুর্নাম রটনার অপবাদ নিতে পারি না। কথাটা বলে তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন মিঃ পাই।
.
আরও কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘোরাঘুরি করে বাড়ির পথ ধরলাম আমি।
গতকালকের খুন সম্পর্কে অনেককেই মন্তব্য করতে শোনা গেল, কোন জঘন্য ভবঘুরের কাজ বলে।
লিটলফার্জে পৌঁছে দেখলাম ড্রইংরুমে জানালার ধরে বসে যোয়ানা একটা ছবি দেখছে।
–কি দেখছিস অমন মনোযোগ দিয়ে কোন নতুন বন্ধুর ছবি মনে হচ্ছে।
ওর পাশে বসতে বসতে বললাম।
-কাছাকাছি পৌঁছেছিস, হেসে ছবিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, দেখতো চিনতে পারিস কিনা?
ছবিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। কিন্তু কিছু বোধগম্য হল না।
–কি এটা? জানতে চাইলাম আমি।
–মনে হয় প্লীহা বা ওই জাতীয় কিছুর ছবি। ডাঃ গ্রিফিথের মনে হয়েছে এটা দেখলে, আমি খুশি হব, তাই দিয়ে গেছেন।
আমি আগ্রহের সঙ্গে ফটোটার দিকে তাকালাম। কিন্তু মোটেই ভাল লাগল না। যোয়ানাকে সে কথা বললাম।
–জিনিসটা খুব খারাপ দেখতে। আমার সঙ্গেও গ্রিফিথের দেখা হয়েছিল হাইস্ক্রিটে। তোর কিরকম মনে হল ওকে?
–ওকে কেমন ক্লান্ত লাগছিল। মনে হল কোন বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে আছে।
-তোর কথাই হয়তো তার মন জুড়ে বসেছে। তাই অমন বিদঘুঁটে একটা প্লীহার ছবি তোকে দিয়ে গেছে।
বাজে বকিস না তো।
–বলে বিরক্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াল যোয়ানা। তারপর ঘর ছেড়ে ভেতরে চলে গেল।
প্লীহার ফটোটা রোদের তাতে পাকিয়ে যাচ্ছিল। আমি সেটা তুলে নিলাম। যোয়ানা বা আমার জিনিসটা পছন্দ না হলেও গ্রিফিথের কাজে লাগতে পারে। ওটাকে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক হবে না।
বইয়ের সেলফ থেকে একটা মোটা বই টেনে বার করলাম। ওর মধ্যে চাপে রেখে পাকিয়ে যাওয়া ছবিটা ঠিক করা যাবে।
কিন্তু বইটা হাতে নিতেই অদ্ভুতভাবে সেটা খুলে গেল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, বইয়ের মাঝখান থেকে বেশ কিছু পৃষ্ঠা নিখুঁতভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে।
হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বইটার দিকে। পরে গোড়ার পৃষ্ঠাটা খুলে দেখে নিলাম–বইটার ছাপা হওয়ার তারিখ লেখা হয়েছে ১৮৪০ খ্রিঃ।
চকিতে মাথায় খেলে গেল একটা কথা। এই বইয়ের কাটা পৃষ্ঠাগুলো থেকে অক্ষর কেটেই বেনামী চিঠিগুলো লেখা হয়েছিল।
কিন্তু কে এমন কাজ করতে পারে? কার পক্ষে এটা সম্ভব?
মিস এমিলি বার্টনের কথাই প্রথমে মনে পড়ল। পারট্রিজের হওয়াও অসম্ভব নয়। বাইরের কোন লোকও হতে পারে। হয়তো সে এমিলির জন্য অপেক্ষা করে কিছু সময় এঘরে ছিল।
কোন অতিথি যদি হয়ে থাকে, তবে কে সে? সমাজের অতি সম্মানিত একজন বলেছেন গ্রেভস। তাহলে কি মিঃ পাই? এমি গ্রিফিথ? না মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ?
৬.২ মধ্যাহ্নভোজের পরে
মধ্যাহ্নভোজের পরে যোয়ানাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এলাম। আমার অভাবিত আবিষ্কারটা ওকে দেখালাম। দুজনে মিলে ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। পরে বইখানা নিয়ে থানায় রওনা হলাম।
গ্রেভস থানায় ছিলেন না। ন্যাস ও অন্যান্যরা সকলেই আমার আবিষ্কার দেখে আনন্দ প্রকাশ করলেন।
ন্যাস বললেন, যদিও জানি এখন আর কিছু পাওয়া সম্ভব নয়, তবুও একবার বইখানা পরীক্ষা করে আমাদের দেখতে হবে যদি কোন হাতের ছাপ পাওয়া যায়।
আমি বললাম, পারট্রিজ রোজই বইগুলো ঝাড়পোঁছ করত। ওতে আমার হাতের ছাপ পাওয়াই সম্ভব।
একটু পরে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। ন্যাস আমার সঙ্গে এলেন।
পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি জানতে চাইলাম, আপনাদের কাজ কিরকম এগোচ্ছে?
কাজের সুবিধার জন্য অনেক ঝাড়াইবাছাই করে আমরা গণ্ডীটা ছোট করে এনেছি।
–খুব ভাল কাজ। তাহলে আপনাদের হিসাবে কারা রইল?
–প্রথম নামটি মিস গিনচ। গতকাল বিকেলে কুম্বত্রকার একটা বাড়িতে তার একজন লোকের সঙ্গে দেখা করবার কথা ছিল। সে-বাড়ির রাস্তা সিমিংটনের বাড়ি ছাড়িয়ে গেছে। যাওয়া আসার সময় দুবারই ওই পথে ভার যাবার কথা।
একসপ্তাহ আগে যেদিন মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেন, সেইদিন তিনি বিকেলে বেনামী চিঠিটা পেয়েছিলেন। মিস গিনচ সেই দিনই সিমিংটনের অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি খবর নিয়ে জেনেছি সেদিন মিস গিনচ তিনটে থেকে চারটের মধ্যে অফিস। থেকে বেরিয়ে ডাকঘরে গিয়েছিলেন কিছু ডাকটিকিট কিনবার জন্য। সাধারণত অফিসের বয়ই এসব কাজ করে দেয়। তবে সেদিন মিস গিনচ নিজেই গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাথা ভারি হয়ে আছে, কিছুক্ষণ খোলা হাওয়ায় হাঁটলে মাথাটা ছাড়তে পারে। তবে বেশিক্ষণ বাইরে ছিলেন না তিনি।
তবে ওই সময়টুকুই যথেষ্ট। বললাম আমি।
–হ্যাঁ। গ্রামের অন্য দিকে গিয়ে একটা চিঠি চিঠির বাক্সে ফেলে দিয়ে ফিরে আসার পথে সময়টা যথেষ্ট। তবে প্রশ্নটা হল, মিস গিনচকে সিমিংটনদের বাড়ির আশপাশে দেখেছে এমন একজনকেও খোঁজ করে পাইনি।
তারপর আর কার কার নাম আপনার তালিকায় আছে? জানতে চাইলাম আমি।
–আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কোন একজনকেও আমরা বাদ দিতে চাইনি–যার ক্ষেত্রে সামান্য সম্ভাবনার আভাসও রয়েছে। গতকাল গার্ল গাইডের একটা সভায় যোগ দিতে ব্রেনটনে গিয়েছিলেন মিস গ্রিফিথ। তিনি সেখানে বেশ দেরি করেই পৌঁছেছিলেন।
–আপনি কি ভাবছেন যে
-না, তার ব্যাপারে কিছুই ভাবছি না। কেন না কিছুই জানি ন। মিস গ্রিফিথকে ভাল স্বভাবের বিশিষ্ট মহিলা বলেই বরাবর জেনে এসেছি।
কিন্তু গত সপ্তাহের ব্যাপারটা তার ক্ষেত্রে কি খতিয়ে দেখেছেন? ওর পক্ষে কি চিঠি বাক্সে ফেলা সম্ভব ছিল?
–হ্যাঁ, তা সম্ভব ছিল। বললেন ন্যাস, ওই দিন বিকেলে তিনি শহরে কেনাকাটা করছিলেন। মিস এমিলি বার্টনের সম্পর্কেও একই রিপোর্ট। গতকাল প্রায় একই সময়ে তাঁকে বাজারে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে।
আগের সপ্তাহে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই রাস্তা ধরে সিমিংটনদের বাড়ি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
বুঝতে পারছি। খুব বিশ্রী একটা ব্যাপার নিয়ে পড়তে হয়েছে আপনাকে। অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় নিয়ে মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে।
–ঠিকই বলেছেন, বললেন ন্যাস, যাদের সঙ্গে প্রায় সময়ই মেলামেশা করতে হচ্ছে। তাদের মধ্যেই একজন অধম্মাদ অপরাধী এই ভাবনাটা খুবই পীড়াদায়ক। যাইহোক, এর পর রয়েছেন মিঃ পাই–
–তার কথাও আপনি ভেবেছেন? বললাম আমি।
-হ্যাঁ। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত চরিত্রের মনে হলেও খুব ভালো লোক তিনি নন। তার কোন অ্যালিবাই নেই। দুটো ঘটনার সময়েই তিনি বাগানে ছিলেন–একা।
-তাহলে দেখা যাচ্ছে কেবল মেয়েদেরই আপনি সন্দেহের তালিকায় রাখেননি?
–আমি বা গ্রেভস মনে করি চিঠিগুলোর পেছনে কোন পুরুষের হাত নেই। বরাবরই সেই কারণে আমরা মিঃ পাইকে বাদ দিয়েই ভেবেছি।
গতকালের ব্যাপারে আমরা প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই কথা বলেছি। আপনার এবং আপনার বোনের ব্যাপারটা ঠিক আছে। মিঃ সিমিংটন অফিসে ঢোকার পর আর বেরোননি। ডাঃ গ্রিফিথ রোগী দেখতে অন্যদিকে গিয়েছিলেন। আমি সেসব জায়গাতেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি। আমাদের কাজে যে কোন খুঁত ছিল না নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।
–আমি ধীরে ধীরে বললাম, আপনাদের সন্দেহভাজন মানুষদের মধ্যে চারজনকে পাওয়া যাচ্ছে–মিস গিনচ, মিঃ পাই, মিস গ্রিফিথ আর মিস এমিলি বার্টন–
–ভাইকারের স্ত্রীও রয়েছেন–এছাড়া আরও কয়েকজনের নাম বলা হয়নি
মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি?
–ভাইকারের স্ত্রী খানিকটা খ্যাপাটে ধরনের। তার পক্ষে এসব কাজ করা অসম্ভব নয়। গতকাল বিকেলে তিনি বাগানে ছিলেন।
ন্যাস আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে বাধা পড়ল। থানার ঘরে ঢুকলেন ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ।
-হ্যাল্লো ন্যাস, শুনলাম আমার খোঁজ করেছিলেন?
-ইনকোয়েস্টের দিন ঠিক হয়েছে শুক্রবার। আশা করি তার মধ্যেই আপনার কাজ হয়ে যাবে?
–হ্যাঁ। মোরেসবি আর আমি আজ রাতেই শবব্যবচ্ছেদের কাজটা করব।
–আর একটা ব্যাপার ডাঃ গ্রিফিথ, ন্যাস বললেন, মিসেস সিমিংটন আপনার দেওয়া কিছু ওষুধ খাচ্ছিলেন, পাউডার জাতীয় কিছু
-হ্যাঁ, তাতে কি?
–আপনি তাকে লিখে দিয়েছিলেন ওগুলো বেশিমাত্রায় খেলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
-হ্যাঁ, ঠিক। ওই ওষুধের মাত্রা যাতে তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার তাগিদে বাড়িয়ে না ফেলেন তার জন্যই ওই হুঁশিয়ারি জানানো হয়েছিল। আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন ফেনটিন বা অ্যাসপিরিন বেশিমাত্রায় পড়লে হার্টের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে। যাই হোক, মিসেস সিমিংটনের মৃত্যু যে সায়ানাইডে হয়েছিল এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
-ওহ হ্যাঁ, সেকথা আমি জানি–ব্যাপারটা যে কোন ঘুমের ওষুধ হতে পারে তা আমি ভাবছিলাম। আর বন্ধ নেই। ধন্যবাদ ডাঃ গ্রিফিথ।
গ্রিফিথ বিদায় নিলেন। আমিও প্রায় একই সময়ে থানা থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে বাড়ির দিকে চললাম।
বাড়িতে পৌঁছে যোয়ানাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। কেবল টেলিফোনের পাশে একটা কাগজে লেখা ছিল, ডাঃ গ্রিফিথ টেলিফোন করলে তাকে জানাতে হবে মঙ্গলবার যাওয়ার অসুবিধা আছে–বুধবার বা বৃহস্পতিবার হতে পারে।
ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম। আর তখনই খুব বিরক্তির সঙ্গে মনে পড়ল, গ্রিফিথ এসে পড়ায় আমার আর ন্যাসের আলোচনায় বাধা পড়েছিল।
বাকি দুজন সন্দেহভাজনের নাম শোনা হয়ে ওঠেনি। একা ঘরে বসে ভাববার চেষ্টা করতে লাগলাম বাকি দুজন কারা হতে পারে।
দুজনের একজন যে পারট্রিজই হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেওয়া বইটা এই বাড়িতেই পাওয়া গেছে। তাছাড়া, পরামর্শদাত্রী হিসেবে অ্যাগনেসকে মাথায় আঘাত করা তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাকে কোনভাবেই সে সন্দেহ করত না।
পারট্রিজ বাদে অন্যজন কে হতে পারে? তাকে হয়তো আমি চিনি না। এমন একজন হল মিসেস ক্লিট। গ্রামের লোকেরা তাকেই গোড়ায় সন্দেহ করত।
ধীরে ধীরে ব্যাপারটা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে লাগলাম। যে চারজন সন্দেহভাজনের নাম শুনলাম, এদের কারোর পক্ষেই একাজ করা সম্ভব না।
এমিলি বার্টন অতিশয় শান্ত আর দুর্বল। তাকে সন্দেহের আওতায় আনার একটাই মাত্র কারণ তার একাকীত্ব। ছোটবেলা থেকেই বাধানিষেধের মধ্যে থেকে, খারাপ সবকিছুতেই একটা ভীতি রয়েছে। এটাই কি তার অসুখী মনের ভাব সৃষ্টির কারণ? অবদমিত কিছু?
এমি গ্রিফিথের মধ্যে হাসিখুশি ভাব থাকলেও কিছুটা পুরুষালীও রয়েছে। তবে তার সফল জীবন-কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটে।
কিন্তু তবু জানি না কেন, আমার অবচেতন মনে একটা অস্বস্তি ঘোরাফেরা করতে লাগল। কিছু একটা যেন মনে পড়ে পড়েও পড়ছে না…ডাঃ গ্রিফিথ বলেছিলেন কিছু একটা…হ্যাঁ…মনে পড়েছে, তিনি বলেছিলেন, উত্তরে একজায়গায় প্র্যাকটিস করার সময়ে সেখানে লোকেরা খুব বেনামী চিঠি পেয়েছে।
এমি গ্রিফিথ এখানেও আছে, এখানেও সেই বেনামী চিঠি লোকেরা পেয়ে চলেছে। এটা কি নিছকই সমাপতন?
গ্রিফিথ অবশ্য বলেছিলেন, পুলিস শেষ পর্যন্ত একটা স্কুলের মেয়েকে ধরেছিল। সেই বেনামী চিঠি লিখত।
তবে ব্যাপারটা কি এমন হতে পারে না, পুলিস ভুল লোককে ধরেছিল? আসলে কাজটা ছিল এমি গ্রিফিথের। এখানে আসার পর সে আবার তার পুরনো খেলা শুরু করেছে। ব্যাপারটা ওয়েন গ্রিফিথ জানেন বলেই তাকে এমন চিন্তাগ্রস্ত আর ভেঙ্গে পড়ার মতো লাগছে। কিংবা তিনি হয়তো সন্দেহ করছেন বোনকে।
আর মিঃ পাই–লোকটির চরিত্র কল্পনা করলে তার পক্ষে একাজ অসম্ভব বলে মনে হয় না। কিন্তু…সেই কথাটা আবার মাথায় জেগে উঠল–আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না…ঠিক তাই…আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না…
হঠাৎ কেমন শীত করতে লাগল…অদ্ভুত একটা অনুভূতি…হঠাৎ দেখতে পেলাম আমি আর মেগান হাত ধরাধরি করে চলেছি…আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল সুন্দরী এলসি হল্যাণ্ড…তার গায়ে বিয়ের পোশাক..পথে চলতে চলতে শুনতে পেলাম লোকেরা বলাবলি করছে, ও ডাঃ গ্রিফিথকে বিয়ে করতে চলেছে…ওরা গোপনে অনেক দিন থেকে বাগদত্ত ছিল।
আমরা গির্জায় পৌঁছলাম…দেখতে পেলাম সেখানে ডেন ক্যালথ্রপ লাতিন ভাষায় মন্ত্রপাঠ করছেন।
আমচকা মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ লাফিয়ে উঠে বলতে লাগলেন, এটা বন্ধ করতেই হবে…এটা বন্ধ করতেই হবে।
কেমন একটা ধাক্কা খেলাম যেন। পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমি লিটল ফার্জের ড্রইংরুমে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।
চোখ মেলে দেখতে পেলাম মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ দরজা দিয়ে ঢুকছেন। আমি বিহ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সামনে এসে তিনি বললেন, মিঃ বার্টন, জেনে রাখুন এটা বন্ধ করতেই হবে। এইসব নোংরা চিঠি দেওয়া আর খুন। সহ্য করতে পারছি না–অ্যাগনেস উডের মতো বাচ্চা মেয়েটা চোখের সামনে খুন হচ্ছে।
ততক্ষণে আমি সজাগ হয়ে বসেছি। বললাম, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু কাজটা কিভাবে করবেন বলে ভাবছেন? আমরা এব্যাপারে কি করতে পারি?
–আমাদের এজায়গাটা বড্ড দূষিত হয়ে পড়েছে বুঝতে পারছি। আগে এমন ছিল না। অবিলম্বে সব রহস্যের সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
–পুলিস তো যথাসাধ্য করে চলেছে। বললাম আমি।
-তাই যদি তারা করতো তাহলে গতকাল অ্যাগনেস খুন হয় কি করে? এসব কাজ পুলিসকে দিয়ে হবে না, আমি ভাল রকম বুঝতে পারছি।
–কিন্তু যা করার তারাই তো করবে।
–না, একজন অভিজ্ঞ দক্ষ কাউকে চাই। জেনে রাখুন আমিই ব্যবস্থা করতে চলেছি।
–আপনি কি করে করবেন? বিরক্তির সঙ্গে বললাম আমি, এসব কাজের দায়িত্ব স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড নিতে পারে না যতক্ষণ না কাউন্টির চিফ কনস্টেবল অনুরোধ করছেন। ইতিমধ্যেই তারা গ্রেভসকে পাঠিয়েছে।
–আমি পুলিসের কারোর কথা বলছি না। কেবল বেনামী চিঠি আর খুনের বিষয়ে অভিজ্ঞ হলেই চলবে না, এমন একজন দরকার যিনি মানুষকে জানেন, বুঝতে পারেন। আমাদের এখন এমন একজনকে দরকার যিনি মানুষের মনের খারাপ দিকটার পরিচয় জানেন।
আমি কিছু বলার আগেই মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ বললেন, আমি নিজেই এব্যাপারে কিছু করতে চলেছি জানবেন।
কথা শেষ করেই তিনি দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
.
যথাসময়েই অ্যাগনেস উডলফের ইনকোয়েস্ট তদন্ত অনুষ্ঠিত হল। করোনার তার রায়ে জানালেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা খুন।
কদিন যেমন চারদিকেই উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, ইনকোয়েস্টের পর আবার দিনকতকের মধ্যেই সব কেমন শান্ত হয়ে পড়ল।
লিমন্টকের জীবনধারা একই খাতে বয়ে চলতে আরম্ভ করল।
তবে অ্যাগনেসের খুনের ঘটনা, এই জীবনস্রোতে একটা পরিবর্তনের সূচনা করল। সবার মনেই একটা ভয় আর চোখে সন্দেহের আভাস জেগে উঠল।
ইনকোয়েস্টের রায় যাই হোক না কেন, সকলেই জেনে গিয়েছিল, অজানা অচেনা কেউ অ্যাগনেসকে খুন করতে আসেনি। খুনী লুকিয়ে রয়েছে লিমন্টকের জনস্রোতেই। সে হয়তো অন্য সকলের সঙ্গেই হাইস্ক্রিটে, কেনাকাটা করে, নির্ভাবনায় হাঁটাচলা করে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে একটা নিরীহ কিশোরীকে মাথায় আঘাত করে তার ঘাড়ে বিধিয়ে দিয়েছিল ছুঁচলো কিছু।
সকলেই জানে, তার পরিচয় কেউ জানে না, অথচ সে মিশে আছে সকলের সঙ্গেই।
স্বীকার না করে পারছি না, এ নিয়ে অস্বস্তি আমার মনেও ছিল। ব্যাপারটাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার তাগিদ বোধ করছিলাম।
যোয়ানা আর আমার মধ্যে আলোচনা চলছিলই। তার মতে দোষী হল মিঃ পাই। আমার দৃষ্টি পড়ছিল মিস গিনচের দিকে।
যাই হোক, কিছুদিন বেশ নিরুপদ্রবে কাটল। আমাদের চেনাজানা কেউ বেনামী চিঠি পায়নি। ন্যাস বা পুলিস নতুন করে কোন ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করেছে কিনা, সেরকম কোন খবরই আমি পাইনি।
শুনেছি গ্রেভস ফিরে গেছেন। তদন্তের হয়তো ইতিই পড়ে থাকবে।
এমিলি বার্টন একদিন চা খেতে এসেছিলেন। মেগান মধ্যাহ্নভোজে এসেছিল। আমরা একদিন মিঃ পাইয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। গ্রিফিথ তার চিকিৎসার কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
একদিন আমরা গেলাম ভিকারেজে চা খেতে। সেদিন লিটলফার্জ থেকে যে মারমুখী ভাবটা নিয়ে ফিরেছিলেন, তারপর আর তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি।
কিন্তু দেখে ভাল লাগল, তার মধ্যে আগের সেই তীব্র ভাবটা আর নেই। সেটা হয়তো ছিল তার ক্ষণিক অতি উত্তেজনার ব্যাপার। আপাতত তিনি তাঁর বাগান পরিচর্যার কাজে মনোযোগ দিয়েছেন।
ভিকারেজের শান্ত সুখকর পরিবেশে এসে মনটা যেন অনেক হালকা হয়ে গেল।
একজন অতিথিকে দেখলাম ডেন ক্যালথুপের ড্রইংরুমে। বয়স্কা মহিলা, বেশ আলাপী আর অমায়িক। সারাক্ষণ পশম নিয়ে বুনে চলেছেন।
আমাদের কেক সহযোগে চা পানের অবসরে ভিকার এসে মিলিত হলেন। তিনি খুশি হয়ে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন।
এবাড়ির অতিথির নাম মিস মারপল। তিনি আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শুনে দেখলাম বেশ শিহরিত হলেন।
খুনের ঘটনাটাই প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের এসে পড়েছিল।
মিস মারপল মিসেস ডেন ক্যালথ্রপকে বললেন, এই খুনের ব্যাপারটা নিয়ে এই শহরের মানুষজন কি ভাবছে? তারা কি বলছে?
যোয়ানা বলে উঠল, মিসেস ক্লিটের কথাই আমার মনে হয়–
মিসেস ক্লিট কে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–যোয়ানা জানাল, তাকে গ্রামের সকলে ডাইনি বলেই জানে।
-ডাইনি না ছাই, বলে উঠলেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন।
লোকে তাহলে তাকে খুনের ব্যাপার সন্দেহ করছে না কেন? বললাম আমি, সবাই তো ধরে নিয়েছিল চিঠিগুলো তারই লেখা ছিল।
মেয়েটাকে, শুনেছি খুন করা হয়, বললেন মিস মারপল, এতেই মিসেস ক্লিটের ওপর থেকে সব সন্দেহ কেটে যাচ্ছে।
কারণ তিনি যদি মেয়েটির ক্ষতি করতেন তাহলে সে দিনে দিনে শুকিয়ে গিয়ে একদিন স্বাভাবিকভাবেই মারা যেত। ডাইনিদের ক্ষেত্রে এরকম হতেই শোনা যায়।
–এই সব পুরনো বিশ্বাস মানুষের মন থেকে হেঁটে ফেলার জন্য খ্রিস্টীয় মতবাদ যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে। বললেন ভিকার।
–কিন্তু এক্ষেত্রে কোন কুসংস্কার নয় অতি জঘন্য বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে আমাদের।
বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।
-যথার্থই অপ্রীতিকর ঘটনা এসব। বললাম আমি।
-খুবই ঠিক কথা বলেছেন আপনি মিঃ বার্টন, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মিস মারপল, কিছু যদি মনে করেন, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?
-স্বচ্ছন্দে।
–কথাটা হল, আপনি এখানে সম্পূর্ণ অচেনা, কিন্তু বুঝতে পারছি, জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। এই অপ্রীতিকর ঘটনার রহস্য আপনিই সমাধান করতে পারতেন বলে আমার ধারণা।
আমি স্মিত হেসে তাকালাম মিস মারপলের দিকে। আমার মনে হল, জীবন সম্পর্কে খুবই অভিজ্ঞ এই মহিলা।
–আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান তরুণ; তিনি বলতে লাগলেন, তবে আত্মবিশ্বাস তুলনায় যতটা থাকা দরকার ছিল তা নেই।
সম্পূ অপরিচিত একজন মহিলার মুখ থেকে আমার প্রশংসা শুনে যোয়ানা আমার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকাল।
মিস মারপলের দিকে ফিরে বলল, দয়া করে ওকে আর আকাশে তুলবেন না মিস মারপল, এমনিতেই মাটিতে পা পড়তে চায় না।
মিস মারপল তার হাতের পশমের কাটা বন্ধ রেখে বললেন, আসলে খুন করার ব্যাপারটা অনেকটা যাদুবিদ্যার কৌশলের মতো। কাজটা এমনভাবে করা হয়, যে নোক ভুল জায়গায় ভুল কিছু দেখতে থাকে। খুনীরা এভাবেই লোককে ভুল পথে চালিত করে।
একদম ঠিক কথা। আমাদের খুনীকেও প্রত্যেকেই এখনো পর্যন্ত ভুল জায়গাতেই খুঁজে বেড়িয়েছে। বললাম আমি।
–কারণ হল, বললেন, মিস মারপল, সকলে তাকে একজন উম্মাদ বলেই মনে করেছে। কিন্তু আমার ধারণা একজন অত্যন্ত সুস্থ মস্তিষ্কের কাউকেই খোঁজ করার কথা ছিল।
-ন্যাসও তাই বলেছিলেন। সমাজের অতিমান্য কারুর কথাই তিনি বলেছিলেন। বললাম আমি।
-হ্যাঁ। যথার্থই বলেছেন তিনি। বললেন মিস মারপল।
-ন্যাস আরও ভেবেছেন, বেনামী চিঠি আরও আসবে। আপনি কি এখনও বেনামী চিঠির লেখকের জন্য দুঃখিত মিসেস ক্যালথ্রপ?
-কেনই-বা নয়? বললেন তিনি।
অন্তত এই ঘটনায় আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। বললেন মিস মারপল।
–আপনি কোন চিঠি পেয়েছিলেন মিস বার্টন? প্রশ্ন করলেন মিস মারপল।
–পেয়েছি বইকি–জঘন্য সব কথা লেখা ছিল। বলল যোয়ানা।
বয়সে যারা তরুণ আর সুন্দর, আমার মনে হয় বেনামী চিঠির লেখকরা তাদেরই বেছে নেয়।
-এই কারণেই, আমি বললাম, এলসি হল্যাণ্ড কোন চিঠি না পাওয়ায় আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।
মিস এলসি হল্যাণ্ড, মানে, বললেন মিস মারপল, মিঃ সিমিংটনের সেই নার্সারী গভর্নেসের কথা বলছেন?
-হ্যাঁ।
–ও সত্যিকথা বলেছে আমার মনে হয় না। যোয়ানা বলল।
–ওর কথা আমি বিশ্বাস করি–মিথ্যা বলেনি। ন্যাসও তাই করেছেন। বললাম আমি।
–এ তো খুবই অদ্ভুত কাণ্ড দেখছি। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার বললেন মিস মারপল।
.
বাড়ি ফেরার পথে যোয়ানা বলল, তোর ওকথাটা ওখানে না বলাই ঠিক ছিল।
–কোন কথাটা? জানতে চাইলাম আমি।
–ন্যাস বলেছিলেন, আরো চিঠি আসতে পারে
––কেন উচিত হয়নি বলছিস?
–কারণ মিসেস ডেন ক্যালথ্রপই অপরাধী কিনা কেউ এখনো জানে না।
–একথাটা তুই বিশ্বাস করিস?
নিশ্চিত নই, তবে এটাও ঠিক, খুব অদ্ভুত ধরনের মহিলা তিনি।
দুদিন পরের কথা। এক বিকেলে হ্যাঁম্পটনে একটা নৈশ ভোজে গিয়েছিলাম। লিমণ্টকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল।
ফেরার পথে গাড়ির আলোকে গোলমাল দেখা দিল। গাড়ি থেকে নেমে একজায়গায় অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আলো।
পথ একদম জনশূন্য। এখানে সন্ধ্যার পরে বড় একটা কেউ পথে বের হয় না।
চলতে চলতে পথের ধারে চোখে পড়ল উইমেনস ইনসটিটিউটের বাড়িটা। তারার আলোয় ছায়ার মতো দেখতে পেলাম বাড়িটাকে।
হঠাৎ জানি না কেন, বাড়িটা একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল আমার। গাড়ি থেকে নামতেই মনে হল যেন গেটের কাছ থেকে ছায়ামূর্তি স্যাৎ করে সরে গেল।
অস্পষ্ট ভাবে হলেও একটা কেউ যে সরে গেল আড়ালে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আধখোলা গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যথাসম্ভব নিঃশব্দে আমি ভেতরে ঢুকলাম।
ছোট একটা পথ ধরে কয়েক পা এগিয়ে একটা দরজার সামনে পৌঁছলাম।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হল, কাছেই কোথায় একটা খসখস শব্দ হচ্ছে। মেয়েদের পোশাকে যেরকম শব্দ হয় শব্দটা অনেকটা সেরকম।
বাড়ির কোণের দিক থেকে শব্দটা পেয়েছিলাম। আমি দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালাম।
কিন্তু সেখানে কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল ন। শব্দটাও আর নেই। কোণের দিকে একটা খোলা জানালা চোখে পড়ল।
জানালা গলে কেউ ভেতরে ঢুকেছে কিনা দেখবার জন্য আমি গুটিগুটি পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
আমার পকেটে একটা টর্চ ছিল। এবার সেটা বার করে এনে সামনে আলো ফেললাম।
সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার থেকে তীব্র স্বরে কেউ বলে উঠল, আলো নিভিয়ে দিন।
চিনতে ভুল হল না, সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের গলা। আলো নিভিয়ে দিতে দিতেই টের পেলাম তিনি হাতধরে টেনে আমাকে বাড়ির একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।
এই ঘরে কোন জানালা ছিল না। বাইরে থেকে আমাদের উপস্থিতি কারো টের পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ন্যাস একটা সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন।
–ঠিক এই সময়েই আপনি এখানে উপস্থিত হলেন মিঃ বার্টন!
কেমন হতাশার স্বরে বললেন ন্যাস।
-খুবই দুঃখিত, আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম, গেটের কাছে কিছু একটা দেখেছি বলে সন্দেহ হল আমার,
–আপনি নিশ্চিত, কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?
–অস্পষ্টভাবে দেখা–কেউ মনে হল গেট দিয়ে ঢুকল। তার পরেই বাড়ির কোণের দিকে একটা মৃদু খসখস শব্দ মনে হল।
–আপনি ঠিকই দেখেছেন।
বাড়িটা ঘুরে এসেছিল কেউ একজন। জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তারপর আপনার আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত এগিয়ে যায়।
-ওঃ, খুবই দুঃখিত। কিন্তু সুপারিন্টেন্টে, ব্যাপারটা কি হতে পারে?
–সেই বেনামী চিঠির লেখক যে থেমে থাকবে না তা আমি জানতাম। আমার লক্ষ্যও ছিল সেটা–সে আবার আগের মতো চিঠি লিখুক।
বইয়ের ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলোর অক্ষর কেটে চিঠি লেখার কাজটা সহজেই হয়ে যাবে। কিন্তু খামের ব্যাপারটা ওভাবে করা সে পছন্দ করবে না। সে চাইবে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। তাই একই মেশিনে ঠিকানা টাইপ করতে সে চাইবে।
আমি জানতাম কোন এক সময়ে সেই অজ্ঞাত লোকটি এই ইনসটিটিউটে ঠিকানা টাইপ করতে ঠিক আসবে।
–মিস গিনচ বলে মনে করেন?
–অসম্ভব নয়। বললেন ন্যাস।
–তার মানে এখনো আপনি নিশ্চিত হতে পারেননি।
–হ্যাঁ। তবে যেই হোক, এই নোংরা খেলার কৌশলে রীতিমত অভিজ্ঞ বলতে পারি।
ন্যাসের কথা থেকে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, নানা ভাবেই তিনি তার কাজ করে চলেছেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি তারা যে চিটি লিখছে বা ডাকে দিচ্ছে তা সবই সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
কোন না কোন সময়ে অপরাধী একবার নিশ্চিত ভুল করবেই–যতই সে নিজের কাজ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হোক না কেন।
ন্যাস অনেকটাই এগিয়ে চলেছিলেন। আচমকা উপস্থিত হয়ে আমি বাধার সৃষ্টি করলাম।
আরো একবার আমি ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। ব্যাপারটা যে এরকম হয়ে উঠতে পারে আমার জানা ছিল না।
-ঠিক আছে যেতে দিন, হাল্কা গলায় বললেন ন্যাস, আবার পরে দেখা যাবে।
আমি বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
.
পরদিন সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের টেলিফোন পেয়ে চমকে উঠলাম।
–শেষ পর্যন্ত তাকে আমরা ধরেছি মিঃ বার্টন।
রিসিভারটা হাত থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কোন রকমে নিয়ে বললাম, ধরতে পেরেছেন
ন্যাস বললেন, টেলিফোনে সবকথা বলা ঠিক হবে না। আপনার আশপাশে নিশ্চয় কেউ ঘাপটি মেরে আছে। দয়া করে একবার থানায় চলে আসুন।
এখনই আসছি–
খুব তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে পৌঁছলাম। ভেতরের ঘরে বসেছিলেন ন্যাস আর সর্জেন্ট পার্কিনস।
ন্যাস হাসিমুখে বললেন, এতদিনে আমাদের দুর্ভোগের শেষ হল। অনেক হয়রানি হতে হয়েছে। নিন দেখুন
একটা চিঠি টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলেন। তুলে নিয়ে দেখলাম, চিঠিটা পুরোপুরি টাইপ করে লেখা। ভাষাও অনেকটা মোলায়েম।
চিঠিটা ছিল এরকম
মরা বউয়ের জায়গা নেবার চেষ্টা করে বিশেষ লাভ হবে না। তোমার অবস্থা দেখে শহরের সকলে হাসাহাসি করছে। দেরি হবার আগেই কোথাও পালাও-দূরে কোথাও, যত তাড়াতাড়ি পারো। নইলে তোমার অবস্থাও অন্য মেয়েটির মতো হবে।
চিঠি পড়া শেষ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ন্যাসের দিকে তাকালাম।
–মিস হল্যাণ্ড পেয়েছেন চিঠিটা, আজ সকালে।
উনি এত দিন কোন চিঠি পাননি কেন সেকথা ভেবে অবাক লাগছে। পার্কিনস বললেন।
-এটা কে লিখেছে?
জানতে চাইলাম আমি।
ন্যাসকে খুবই হতাশাগ্রস্ত আর ক্লান্ত লাগছিল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, খুবই দুঃখের ব্যাপার যে একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক ব্যাপারটাতে প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন, আমরা নিরূপায়।
–কে লিখেছে চিঠিঠা? আবার জানতে চাইলাম আমি।
–মিস এমি গ্রিফিথ।
.
সেদিন বিকেলেই পরোয়ানা নিয়ে ন্যাস আর পার্কিনস গ্রিফিথের বাড়ি গেলেন। ন্যাসের অনুরোধে আমাকেও সঙ্গে যেতে হল।
তার ধারণা, ডাক্তার প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। আঘাত সামলে নেওয়ার ব্যাপারে আমি তাকে সাহায্য করতে পারব।
আমিও অবশ্য আশান্বিত ছিলাম। কেননা ওয়েন আমাকে পছন্দ করেন।
সদরে ঘণ্টা বাজিয়ে আমরা মিস গ্রিফিথের খোঁজ করলাম। আমাদের ড্রইংরুমে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে তখন মিস এলসি হল্যাণ্ড, মেগান আর মিঃ সিমিংটন চা পান করছিলেন।
আপনার সঙ্গে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে চাই মিস গ্রিফিথ। এমির দিকে তাকিয়ে বললেন ন্যাস।
এমি চায়ের আসর থেকে উঠে আমাদের কাছে এলেন। মনে হল তার চোখে চকিতে ভয়ের ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। তিনি স্বাভাবিক উচ্ছল ভঙ্গীতেই কথা বলতে লাগলেন।
এমি ড্রইংরুম পার হয়ে একটা ছোট ঘরে আমাদের নিয়ে এলেন।
আমি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম, সিমিংটন ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালেন। ন্যাসের হাবভাবে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা ঘটেছে। আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পুলিসের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা একজন সলিসিটর হিসেবে তার না থাকবার কথা নয়। মনে হল তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠবার উদ্যোগ করছেন।
ন্যাস ততক্ষণে তার কর্তব্য শুরু করে দিয়েছেন। অত্যন্ত শান্ত ধীর ভঙ্গিতে মার্জিত স্বরে তিনি এমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মিস গ্রিফিথ, আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। অবশ্য আপনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আমার কাছে রয়েছে।
আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হল, না, না, মিস খুনের নয়, তবে বেনামী চিঠির। এখানে সেসব চিঠি লোকেরা পেয়ে চলেছে, সেগুলো লিখছেন আপনিই।
ন্যাসের কথা শুনে এমি উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন।
-ওসব জঘন্য চিঠি আমি লিখব, আপনি ভাবলেন কি করে? আপনার মাথা ঠিক আছে তো?
তারপর তীব্র শ্লেষের দৃষ্টি হেনে বললেন, না, না, ওসব চিঠি আমি লিখিনি।
ন্যাস এবারে এলসি হল্যাণ্ডকে লেখা চিঠিটা পকেট থেকে বের করে বললেন, এই চিঠিটা আপনি লেখেননি বলছেন?
চকিতের জন্য ইতস্তত করলেও এলসির কণ্ঠস্বরের বদল হল না। বললেন, না, এ চিঠি আমি কোনদিন লিখিনি।
-তাহলে একটু খুলেই বলা যাক মিস গ্রিফিথ, আপনার হয়তো মনে পড়তে পারে। গত পরশু রাত এগারোটার থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে উইমেনস ইনসটিটিউটে সেখানকার টাইপ মেশিনে আপনাকে এই চিঠি টাইপ করতে দেখা গেছে।
গতকাল এই চিঠি সহ অনেকগুলো চিটি নিয়ে আপনি ডাকঘরে ঢুকেছেন–
চিঠিগুলি ডাকে দেবার জন্যই গিয়েছিলাম। কিন্তু এ চিঠি আমি ডাকে দিই নি।
–তা ঠিক, আপনি ডাকে দেননি। কিন্তু চিঠিটা যাতে ডাকবাক্সে ফেলা হয় তার জন্য অত্যন্ত চতুর কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
ডাক টিকিটের জন্য অপেক্ষা করার সময় আপনি এই চিঠি সকলের অলক্ষ্যে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন, যাতে অন্য কারো চোখে পড়লে ডাকবাক্সে ফেলে দেয়। বস্তুত হয়েছিলও তাই।
এলসি কি বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন মিঃ সিমিংটন।
–এসব কি হচ্ছে? এমি, এমি, তোমার আইনের সাহায্য দরকার মনে করলে, আমি তৈরি আছি–
একথা শুনেই এমি দুহাতে মুখ ঢেকে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। দৃশ্যতই তিনি ভেঙ্গে পড়লেন।
–ডিক, তুমি চলে যাও দয়া করে চলে যাও
–প্রিয় এমি, আমার মনে হচ্ছে তোমার একজন সলিসিটর দরকার
–কিন্তু তুমি নয়। আমি সহ্য করতে পারব না–না–আমি চাই না
সিমিংটন তার আইনী বুদ্ধিতে মনে হয় ব্যাপারটা অনুমান করতে পারলেন। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, তবে আমি এক্সহ্যাম্পটনের মাইল্ডমে-কে ডাকছি–
এমি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সেই অবস্থাতেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
সিমিংটন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তেই ওয়েন গ্রিফিথ দরজার সামনে পৌঁছল, দুজনের প্রায় ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা।
–এসব কি ব্যাপার ন্যাস, আমার বোন—
হ্যাঁ, ডাঃ গ্রিফিথ, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু এছাড়া কোন উপায় ছিল না
–বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ন্যাস।
–আমার বোন এসব চিঠির জন্য দায়ী–আপনি তাই মনে করেন?
–সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ডাক্তার, বললেন ন্যাস, আমি খুবই দুঃখিত।
পরে এমির দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস গ্রিফিথ, প্রয়োজনে আপনি একজন সলিসিটরের পরামর্শ নিতে পারবেন–এবারে দয়া করে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে
–এমি
ওয়েন গ্রিফিথ বোনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন।
এমি একবারও ওয়েনের দিকে তাকালেন না। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
সকলে চলে গেলে ঘরে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ওয়েন। আমি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
-এমি এ সব করেছে, এ কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না
–কোথাও ভুলও হয়ে থাকতে পারে। আমি বলার চেষ্টা করলাম।
–তাহলে ও কথাটা এভাবে বলল কেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
থপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ওয়েন। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে একগ্লাস কড়া পানীয় জোগাড় করে আনালাম। একচুমুকে গ্লাসের পানীয়টুকু শেষ করে খানিকটা যেন চাঙা হলেন।
পরে বললেন, ব্যাপারটার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না মিঃ বাৰ্টন। এখন অনেকটা সামলে উঠতে পেরেছি।
আমার কিছু করণীয় থাকলে বলুন, গ্রিফিথ।
কারোরই আর কিছু করার নেই–কিছুই না—
এই সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল যোয়ানা। ওকে অতিশয় বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
ওয়েনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আমাকে বলল, তুই এবারে যেতে পারিস জেরি, এটা আমার কাজ।
আমি উঠে দাঁড়ালাম নীরবে। দরজার মুখে গিয়ে ফিরে তাকালাম একবার। দেখলাম, জেরি ওয়েনের সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছে।
.
সেদিন যোয়ানা যখন বাড়ি ফিরল, তাকে দেখে আমি খুশি হতে পারিনি। কেমন ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত লাগছিল ওকে।
ওর মনোভাবটা বুঝবার জন্য হাল্কা স্বরে বললাম, তাহলে তোর দেবদূতকে খুঁজে পেয়েছিস?
-না, জেরি, বেদনাভারাক্রান্ত কণ্ঠ ওয়েনের, ও জানিয়েছে আমাকে গ্রহণ করতে পারবে না। ও খুবই আত্মমর্যাদা সচেতন
আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বললাম, আমার মেয়েবন্ধুটিও আমাকে চায় না…
বলাবাহুল্য, ইতিমধ্যে ঘটনা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমার আর মেগানের সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল। তাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব করেছিলাম। সে প্রত্যুত্তরে গম্ভীরস্বরে আমাকে জানিয়েছিল, তোমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য আমি নই। তুমি আমাকে ভালবাস জানি, কিন্তু আমি ভালবাসার চেয়ে ঘেন্না করতেই শিখেছি।
এভাবেই সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু আমি নিরাশ না হয়ে তাকে জানিয়েছি আমি তার মুখ চেয়ে আশা করেই থাকব।
যোয়ানাকে আমাদের দুজনের সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে যথাসময়েই জানিয়েছিলাম।
এই মুহূর্তে দুজন সমব্যথী মানুষের নীরব হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
কয়েক মিনিট পরে যোয়ানা বলে উঠল, জেরি, এই মুহূর্তে বার্টন পরিবারের বলতে পারা যায় কোনই চাহিদা নেই।
আমি সজীব কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম, তাতে কিছু যায় আসে না যা, এখনো আমরা দুজনে দুজনের জন্য রয়েছি।
-হ্যাঁ, আপাতত এটাই আমাদের সান্ত্বনা। বলল যোয়ানা।
.
পরদিন ডাঃ গ্রিফিথ এলেন। যোয়ানা সম্পর্কে আবেগময় কণ্ঠে অনেক কথা বলতে লাগলেন।
–অতি চমৎকার মেয়ে যোয়ানা। ও যেভাবে নিজেকে আমার কাছে তুলে ধরেছে, তার তুলনা হয় না। কিন্তু, আমার দুর্ভাগ্য, আমি তাকে গ্রহণ করতে পারছি না।
ওয়েন আমাকে বোঝাতে চাইলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, এমিকে নিয়ে, এখবর জানাজানি হবার পর যেরকম নোংরা আলোচনা শুরু হবে, যোয়ানাকে তা স্পর্শ করে তিনি তা চান না।
যোয়ানা যে দুর্বল মনের মেয়ে নয়, বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াবার মতো দৃঢ়তা তার আছে, আমি ভাল করেই জানি। তাই গ্রিফিথের কথাগুলোকে আমার গালভরা বুলি বলেই মনে হল। আমি বিরক্তির সঙ্গেই বলেছিলাম যে, তিনি অনভিপ্রেতভাবেই বড় বেশি মহত্ত্ব দেখিয়ে ফেলছেন।
গ্রিফিথ চলে গেলে হাঁটতে হাঁটতে হাইস্ক্রিটের দিকে গেলাম। দেখলাম ওখানে সকলেই মুখরোচক আলোচনার খোরাক পেয়ে বেশ জমিয়ে তুলেছে।
ন্যাসের সঙ্গে দেখা হল। তিনি জানালেন এমিলি বার্টনের যে বইটা আমি আবিষ্কার করেছিলাম তার ছেঁড়া পাতাগুলো গ্রিফিথের বাড়ির সিঁড়ির নিচে দেয়াল আলমারিতে পাওয়া গেছে। দেয়াল-কাগজে সেগুলো মুড়ে রাখা ছিল। এটা পাওয়াতে তাদের মামলা সাজানোর কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।
আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, ওরকম একটা জায়গাতে মালপত্র গুঁজে রাখার ঝোঁক মহিলার বেশিই দেখা যাচ্ছে।
–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। অপরাধী মনস্তত্ত্ব ওরকমই দেখা যায়। আর একটা কথা, মৃত অ্যাগনেস উডের খুনের একটা সূত্রও পাওয়া গেছে।
আমি আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকালাম ন্যাসের দিকে।
-ডাক্তারের ডিসপেনসারী থেকে একটা ভারী নোড়া গোছের পাথরের টুকরো পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিত ওটা দিয়েই ওই মেয়েটার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, বললেন ন্যাস, তার মুখে সাফল্যের হাসি।
–ওরকম একটা অদ্ভুত জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া তো এক ঝক্কির কাজ। বললাম আমি।
–মিস গ্রিফিথের পক্ষে অসুবিধাজনক ছিল না। ঘটনার দিন বিকেলে তিনি গার্ল গাইডের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন।
সেদিন রেডক্রশের অফিসে কিছু সজী দেবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বেশ বড় একটা ঝুড়ি তার হাতে ছিল।
-বুঝলাম। কিন্তু সেই শিকটা বোধহয় খুঁজে পাওয়া যায়নি?
-না। কোনদিনই পাওয়া যাবে না। উম্মাদ হলেও সেই খুনে হাতের কাছে প্রমাণ রেখে যাওয়ার মতো মতিচ্ছন্ন নয়।
.
ভিকারেজে খবরটা যখন পৌঁছাল, শুনে মিস মারপল খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আগ্রহ নিয়েই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
মিস মারপল বেশ জোরের সঙ্গেই তার অবিশ্বাসের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন।
-না, মিঃ বার্টন, আমি নিশ্চিত, কথাটা সত্যি নয়, এ হতে পারে না।
-তা বলবার কোন উপায় নেই মিস মারপল, আমি বললাম, পুলিস ফাঁদ পেতে অপেক্ষায় ছিল। এমিকে তারা চিঠিটা টাইপ করতে দেখেছে।
–তা হতে পারে। কিন্তু
-ওখানেই শেষ নয়। পুরনো ছিঁড়ে নেয়া যে পৃষ্ঠাগুলো থেকে অক্ষর কেটে বেনামী চিঠিগুলো লেখা হয়, সেগুলোও তাঁর বাড়ি থেকে পুলিস উদ্ধার করেছে।
যেন আমার কথাগুলো বুঝতে পারলেন না, এমনি হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস মারপল। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এ খুবই খারাপ ব্যাপার মিঃ বার্টন–খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার
এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন মিস ডেন ক্যালথ্রপ।
-কি হয়েছে জেন? তোমার মুখ অমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেন? ব্যস্ত হয়ে বললেন ভিকারের স্ত্রী।
–ওহ, এখন তাহলে কি হবে? বিহ্বল স্বরে বললেন মিস মারপল।
–কি নিয়ে এত ভাবনায় পড়লে জেন?
–ওহ না…সব ঠিকমতো মনে আসে না…কোথাও কিছু একটা আছে…
মিস মারপল হঠাৎ এমন ভেঙে পড়লেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ তখনই তার বন্ধুকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে মিস মারপলের সঙ্গে আবার দেখা হল আমার। তাকে এমনভাবে দেখতে পাব আশাই করতে পারিনি।
গ্রামের শেষে মিসেস ক্লিটের বাড়ির কাছে একটা ছোট ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে মেগানের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
মেগানের সঙ্গে সারাদিনে একবারও আজ দেখা হয়নি। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য খুবই উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম।
এখন মেগানকে দেখতে পেয়ে আমি দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললাম।
কিন্তু কাছাকাছি হবার আগেই মেগান অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল, আর মিস মারপল এগিয়ে এসে আসার পথ আগলে দাঁড়ালেন।
–আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল মিঃ বার্টন। বললেন তিনি।
–মেগানের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে ছিল, ও চলে যাচ্ছে কেন? বললাম আমি।
–না, এখন মেগানকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। মেয়েটার সাহস নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপনি শান্ত হয়ে দাঁড়ান।
মিস মারপলের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে আমার কেমন ভয় জেগে উঠল। কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। মাথা নিচু করে মেগানকে অনুসরণ করা থেকে নিরস্ত হলাম।
.
বাড়িতে কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না। মেগানের সঙ্গে দেখা হলো অথচ কোন কথা বলতে পারলাম না। মিস মারপলই বা তার সঙ্গে অমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কি কথা। বলছিলেন?
তিনি আমার পথ আগলে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?
শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে ধরে রাখা সম্ভব হল না। রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
শহরের পথ পেরিয়ে সিমিংটনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম।
বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছিল। এখন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। ঝাপসা অন্ধকারে বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। গোটা বাড়িটা অন্ধকারের স্তূপের মতো মনে হচ্ছিল।
একদিকে বাড়ির জানালায় সামান্য আলোর রেখা চোখে পড়ল। মনে হলো ওটা বসার ঘরেরই আলো।
সদর দরজার দিকে যেতে গিয়েও পা টেনে নিলাম। আমি নিচু হয়ে প্রায় হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে একটা ছোট ঝোপ পার হয়ে জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। জানালার পর্দাটা ভাল করে টেনে দেয়া ছিল না। সেই ফাঁক দিয়ে আলো আসছিল। সেই ফাঁকে চোখ রেখে ভেতরের সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পেলাম।
সিমিংটন একটা বড় আরাম কেদারায় বসেছিলেন। পাশেই এলসি হল্যাণ্ড কিছু সেলাই করে চলেছে। মনে হয় বাচ্চাদের কিছু।
মাথা নিচু করে সেলাই করতে করতে এলসি হল্যাণ্ড বলছিলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ সিমিংটন, বাচ্চাদের স্কুল বোর্ডিং-এ যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু ওদের ছেড়ে যেতে আমার খুবই খারাপ লাগবে।
মিঃ সিমিংটন বললেন, ব্রায়ানের ব্যাপারে আপনার কথাই ঠিক। উনহে তে পরের টার্ম থেকেই ও শুরু করবে। আর কলিনের জন্য আরও একবছর অপেক্ষা করাই ভাল–ওর বয়স এখনও কম।
-হ্যাঁ, কলিন একেবারেই ছোট্ট।
সাধারণ একটা পারিবারিক চিত্র। কোন বৈচিত্র্য ছিল না এর কোথাও। জানালার পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে আমি ভাবতে লাগলাম, এখানে কেন এলাম?
সহসা সামনের দৃশ্যের পট পরিবর্তন হল। চমকে উঠলাম মেগানকে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে দেখে।
বেশ একটা উত্তেজনার ভাব তার চোখে মুখে। সিমিংটনের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে দেখলাম তার চোখ জ্বলছে, মুখের কোথাও শিশুসুলভ ভাব নেই। কিংবা ভয় বা সংশয়ের লেশ।
সিমিংটনকে মেগান কোন সম্বোধন করতে কখনো শুনিনি। এখনো কোন সম্বোধন না করেই সে বলে উঠল, আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
সিমিংটন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। মনে হলো তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
মেগান নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রইল সিমিংটনের দিকে। তার চোয়ালে দৃঢ়তাব্যঞ্জক ভাব ফুটে উঠেছে স্পষ্ট।
ওই অবস্থাতেই সে এলসি হল্যাণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার আপত্তি নেই তো এলসি?
–আপত্তি কেন থাকবে?
বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগলো। মেগান সরে গিয়ে ওকে যাবার পথ করে দিল। দরজার ওপাশে গিয়ে ঠোঁট চেপে এলসি একমুহূর্তের জন্য তাকাল ভেতরে। পরক্ষণে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
–এবারে বল মেগান, কি বলতে চাইছ। বিরক্তির সঙ্গে বললেন সিমিংটন।
একপা দু পা করে টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো মেগান। সটান সিমিংটনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কিছু টাকার দরকার।
–টাকা। বেশ কড়া স্বর বেরলো সিমিংটনের গলা থেকে, একথা তো কাল সকালেই বলা যেত। তোমার হাতখরচ কম পড়ছে মনে হয়?
–আমি বেশ কিছু টাকা চাই। দৃঢ় স্বরে বলল মেগান।
সিমিংটন এবারে নড়েচেড়ে বসলেন। তীক্ষ্ণস্বরে বললেন, তুমি তো আর কয়েক মাসের মধ্যেই সাবালিকা হবে। তখন তোমার দিদিমার রেখে যাওয়া সব টাকাই তুমি হাতে পেয়ে যাবে।
-জানি, আমি তোমার কাছ থেকেই টাকা চাই। মনে করতে পার এটা একটা ব্ল্যাকমেল। আমি যতদূর শুনেছি, আমার বাবাও এই ব্ল্যাকমেল করার জন্যহ জেলে গিয়েছিল। আমি তারই মেয়ে।
আমি তোমাকে টাকা দিতে বলেছি, কারণ, ওদিন আমার মার ঘরে তার ওষুধের পুরিয়ায় তোমাকে কিছু একটা মেশাতে দেখেছিলাম। টাকা না পেলে একথাটা সকলকে
কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে গেল মেগান।
কর্কশ শুষ্ককণ্ঠে বলে উঠলেন সিমিংটন, এসব তুমি কি বলছ, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
-আমি জানি, সব কথাই তুমি বুঝতে পেরেছ।
শয়তানের হাসি হাসলেন সিমিংটন। হাসতে হাসতেই লেখার টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন।
ড্রয়ার থেকে একটা চেক বই বার করে একটা চেক লিখে নিয়ে ফিরে এসে মেগানের দিকে এগিয়ে ধরলেন।
বললেন, তুমি এখন বড় হয়েছে, তোমার বিশেষ পছন্দের কিছু কেনার ইচ্ছে হতেই পারে, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু তার জন্য ওসব আবোলতাবোল কি বলতে শুরু করলে–কিছুই বুঝতে পারলাম না। যাক গে, এই নাও
চেকটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে মেগান বলল, ধন্যবাদ। এতেই আপাতত চলবে।
মেগান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সিমিংটন দরজার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত কি ভাবলেন। পরে চেয়ারে বসে পড়লেন।
সিমিংটনের মুখের ভাব দেখে আমার বুকের ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল। মনে হল মেগানের সমূহ বিপদ। আমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এসে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
সহসা সামনের দেয়ালের ধারের ঝোপটা যেন অন্ধকারে সচল হয়ে উঠল। সামনে পা বাড়াবার আগেই বুঝতে পারলাম ঝোপের আড়াল থেকে সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের দুটো হাত আমাকে জাপটে ধরল। কানের কাছে তার ফিসফিস কথা শুনতে পেলাম, উত্তেজিত হবেন না মিঃ বার্টন। সঙ্গে আসুন।
আমি স্তম্ভিত হবারও অবকাশ পেলাম না। হামাগুড়ি দিয়ে ন্যাসকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম।
ওই ভাবেই বাড়ির শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ন্যাস। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছলেন।
–মোক্ষম সময়েই এসে হাজির হয়েছেন। নিচু স্বরে বললেন ন্যাস।
মেগানের কথা ভেবে আমি খুবই অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, মেয়েটা একেবারে বাঘের মুখে পড়েছে–দেরি হলেই মরবে।
ন্যাসকে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললাম, মেয়েটার মুখ লক্ষ করেছিলেন? মেগান নির্ঘাৎ বিপদে পড়বে। ওকে এখুনি এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
–শান্ত হোন, মিঃ বার্টন, ন্যাস আমার হাত চেপে ধরে বললেন, এই সময় এমন অধীর হলে চলবে না। আমি যা বলব, তার বাইরে কিছু করতে যাবেন না, ঈশ্বরের দোহাই।
ন্যাস কি বলতে চাইছিলেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
কিন্তু এটা আর গোপন ছিল না যে কিছু একটা অনুমান করে তিনি এখানে ফাঁদ পেতে বসেছিলেন। দৈবাৎ এসে পড়ায় আমি দৃশ্যপটে চলে এলাম।
মেগান যে নিরাপদ নয় সেকথা আমার মতো তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। জেনেশুনে নিশ্চয় তাকে তিনি বিপদের মুখে ফেলে রাখবেন না। এই বিশ্বাস থেকেই শেষ পর্যন্ত আমাকে তাঁর কথা মেনে নিয়ে ধৈর্য ধরতে হল।
-বেশ, আপনার কথাই মেনে চলব, কথা দিলাম, বললাম আমি, তবে শেষ না দেখে এখান থেকে নড়ব না।
–বেশ এবারে শুনুন। বললেন ন্যাস।
তিনি জানালেন, পার্কিনস ইতিমধ্যেই বাড়িতে ঢোকার পেছনের দরজা খুলে রেখেছে, আমাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে।
রীতিমত দুঃসাহসিক একটা অভিযানের ইঙ্গিত। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওপরে যেতে না পারলে মেগানের কি হল তা জানার উপায় থাকবে না।
ন্যাসকে অনুসরণ করে এরপর পেছন দিকে এলাম। দরজা খোলাই পাওয়া গেল। পার্কিনস নিখুঁতভাবে কাজ সেরে রেখেছে।
দুজনে মিলে মন্থর পায়ে ওপরে উঠে গেলাম। ওখানে ভেলভেটের পর্দায় ঢাকা জানালার আড়ালে আত্মগোপন করলাম।
রাত দুটো পর্যন্ত ওখানেই কান পেতে বসে থাকতে হলে আমাদের।
একসময় একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। পর্দার আড়াল থেকে চোখে পড়ল সিমিংটন ঘর থেকে বেরিয়ে চাতাল পার হয়ে মেগানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
এক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
আমার অধীর হওয়ার কারণ ছিল না। ন্যাস আমাকে নিশ্চিন্ত করবার জন্য ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মেগান সম্পূর্ণ নিরাপদ। সার্জেন্ট পার্কিনস মেগানের ঘরে দরজার আড়ালে থেকে মেগানের ওপর নজর রাখছেন।
পার্কিনসের তৎপরতা ও কর্মকুশলতায় সন্দেহ ছিল না আমার। তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম, সিমিংটন ঘরে ঢুকলেও মেগান অরক্ষিত অবস্থায় নেই।
তবুও, সত্যিকথা বলতে, একটা বিষম উত্তেজনা আমাকে যেন ক্রমাগত সামনে ছুটে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে চলেছিল।
ওভাবে বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যদিও সদাসতর্ক ন্যাস শক্তহাতে আমার কব্জি চেপে ধরে রেখেছিল।
বুকের ভেতরে তোলপাড় চলেছিল। একটি মুহূর্তকে একঘণ্টা সময় বলে মনে হচ্ছিল। সিমিংটন এতক্ষণ ঘরের ভেতরে কি করছেন?
ন্যাসকে কিছু জিজ্ঞেস করবার উপায় ছিল না। তার অচঞ্চল চোখদুটি মেগানের দরজার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়েছিল।
সহসা চোখে পড়ল, সিমিংটন নিদ্রিত মেগানকে দুহাতের ওপর তুলে ধরে ধীরে ধীরে নিচে নেমে চলেছেন।
ন্যাস আমার হাত ছেড়ে দিল। কিছুটা দূরে থেকে সিমিংটনকে অনুসরণ করে চলল। আমিও চললাম তার পেছনে।
নিচে নেমে সিমিংটন মেগানকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে এনে মাথাটা গ্যাসের উনুনের ওপরে রাখলেন। ধীর হাতে গ্যাস চালু করে দিলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি ন্যাস ঘরের ভেতরে লাফিয়ে ঢুকলাম। সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিলেন ন্যাস।
চকিতে পেছনে ঘুরে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন সিমিংটন। পরক্ষণেই একেবারে ঝিমিয়ে পড়লেন।
–আপনার খেলা শেষ, সিমিংটন। মূর্তিমান শমনের মতো ন্যাস মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন।
আমি ছুটে গিয়ে মেগানকে কোলে তুলে কল ঘুরিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিলাম।
সিমিংটন বুঝতে পেরেছিলেন, বাধা দেবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না। খেলাটা নিখুঁত ভাবে শুরু করলেও শেষ করবার আর কোন সুযোগ নেই। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। এভাবে যে হেরে যেতে হবে নিশ্চয় কল্পনা করতে পারেন নি।
.
ওপরে অর্ধচেতন মেগানের বিছানায় বসে তাকে সুস্থ করে তুলবার চেষ্টা করছিলাম।
ন্যাস যে এতবড় একটা ঝুঁকি নেবে স্বপ্নেও ভাবিনি। তার এই দুঃসাহস কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম ন। রাগে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে উঠেছিল।
–এটা আপনারা খুবই অন্যায় কাজ হয়ে গেছে। এতবড় ঝুঁকি নেওয়া আপনার উচিত হয়নি।
–শান্ত হোন মিঃ বার্টন। মিস মেগান এখুনি ঠিক হয়ে যাবেন। বললেন ন্যাস।
-ও আদৌ সুস্থ হবে বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। অধৈর্যের সঙ্গে বলে উঠলাম আমি।
মিস মেগানের বিছানার পাশে যে দুধের গ্লাস ছিল তাতে বিষ রাখার মত বোকা সিমিংটন ছিলেন না। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ন্যাস, ঘুমের ওষুধই মেশানো ছিল দুধে। মেগানকে বিষ খাওয়ানোটা ওর পক্ষে বড় বেশি ঝুঁকির হয়ে যেত।
মিস গ্রিফিথের গ্রেপ্তারের পর সিমিংটন তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এর পর এখানে বিষপ্রয়োগ বা আঘাতজনিত কোন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটানো তার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে পড়ত।
মেগানের মৃত্যুটাকে তিনি আত্মহত্যার ঘটনা বলেই দেখাবার মতলব করেছিলেন।
মায়ের আত্মহত্যার শোক সইতে না পেরে একটি অসুখী মেয়ে গ্যাসের উনুনে মাথা রেখে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে–লোকে এটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নিত। বিশেষ করে মেগানকে অস্বাভাবিক মেয়ে বলেই যখন অনেকে মনে করত।
ন্যাসের কথায় যুক্তি থাকলেও মেগানের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।
–কিন্তু ওর জ্ঞান ফিরতে অনেক দেরি হচ্ছে।
মেগানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিতভাবে বললাম আমি।
–ডাঃ গ্রিফিথ তো ভাল করেই পরীক্ষা করে গেলেন। তবু চিন্তা করছেন কেন? হার্ট, নাড়ী সবই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থেকে নিজে থেকেই জেগে উঠবে।
একটু পরেই মেগান একটু নড়াচড়া করল। বিড়বিড় করে কি বলল বোঝা গেল না। সুপারিন্টেন্টে মিনিটখানেক অপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মেগান চোখ মেলে তাকাল।
-জেরি–
-এই তো আমি, মেগান।
–আমার অভিনয় ঠিক ঠিক হয়েছে তো?
–নিখুঁত ছিল। নকল ব্ল্যাকমেল বলে মনেই হয়নি। ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকাল মেগান।
কতটা কি হবে বুঝতে পারছিলাম না। তাই গত রাতে তোমাকে একটা চিঠি লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল বলে শেষ করতে পারিনি। টেবিলেই আছে চিঠিটা
আমি উঠে লেখার টেবিলের কাছে গিয়ে অসম্পূর্ণ চিঠিটা পেলাম।
ও লিখেছে প্রিয় জেরি,
তোমার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না। আমার মন-প্রাণ জুড়ে কেবলই তুমি। বুঝতে পারছি, সত্যিই তোমাকে ভালবাসি। তুমি ছাড়া আমি বাঁচার কথা ভাবতে পারছি না…।
.
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। হাওয়ায় কনকনে ভাব। জ্বলন্ত চুল্লীর তাপে ঘরের আবহাওয়া বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে।
ভিকারেজে আমরা সকলে উপস্থিত হয়েছি। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ সোফার কুশনগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, এই কারণেই একজন বিশেষজ্ঞকে ডেকে আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম আমি।
মনে পড়ল, হ্যাঁ, তিনি বলেছিলেন বটে–এসব এখনই বন্ধ করা দরকার…আমি এখনই তার ব্যবস্থা করতে চলেছি।…সেদিন খুবই বেপরোয়া আর উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম…ভদ্রমহিলা কি ব্যবস্থা নেন দেখা যাক।
এখন কথা শুনে বুঝতে পারলাম, সত্যিই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না মিসেস ডেন ক্যালপ।
কিন্তু কাকে ডেকেছিলেন তিনি, বিশেষজ্ঞ এমন কেউ? আর তিনি কতটা কিই বা করেছেন?
-সত্যিই ডেকেছিলেন কাউকে আপনি? জানতে চাইলাম আমি।
-হ্যাঁ। বললেন তিনি, মিস মারপলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ওই তো বসে রয়েছেন আমার সেই বিশেষজ্ঞ। জেন মারপল। ওই বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে বিশেষত্বহীন মনে হলেও এটা সত্যি জানবেন, মানুষের নানা দুরভিসন্ধির কথা তিনি জানেন।
মিস মারপল তার কুরুশের কাঁটা বুনে চলেছিলেন। ডেন ক্যালথ্রপের কথা শুনে তিনি সুতোর গুলি সরিয়ে রাখলেন।
–অতটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না মড, বললেন মিস মারপল।
–কথাটা কিছু মিথ্যে বলিনি। তুমি তাই।
সারা বছর গ্রামে পড়ে থাকি–মানুষের অনেক কাণ্ডকারখানাই চোখে পড়ে–এই যা।
–সত্যিকথা বলতে, প্রথম দিন আলাপ হবার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি একজন অসাধারণ মহিলা।
তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম যখন এখানকার খুনের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন।
আমার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন, এটাও সত্যিকথা। তিনি আমাকে আমার নিজের দিকে তাকিয়ে বিচার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
ডেন ক্যালথ্রপের কথায় স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সকলের আগ্রহ সৃষ্টি মিস মারপলের দিকে পড়ল। সকলের প্রত্যাশা অনুধাবন করতে পেরে তিনি বললেন,অপরাধগুলো সাধারণত খুব একটা জটিল থাকে না। একটু খোলা মন নিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়।
এখানের খুনের ব্যাপারটাও ছিল খুবই সরল। খুবই সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ–যদিও খুবই ভয়াবহ।
ভয়াবহ তো বটেই। আর খুবই রহস্যময়। বললাম আমি।
তবে ততটা অস্পষ্ট কিছু ছিল না। আপনি তা দেখতেও পেয়েছিলেন মিঃ বার্টন।
–মনে হয় না বিশেষ কিছু দেখতে পেয়েছি বলে।
–আপনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন। সমস্ত ব্যাপারটাই আপনি আমাকে ইঙ্গিতও করেছিলেন। ঘটনাগুলোর পারস্পরিক যোগসূত্র আপনার চোখ এড়াতে পারেনি। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকার জন্য আপনার অনুভূতির সঠিক তাৎপর্য ধরতে পারেননি।
আপনিই শুনিয়েছিলেন, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না–কিন্তু ভুল করে ধোয়ার জাল নিয়ে মেতে ওঠার জন্য সবকিছুই ভুল মনে হয়েছিল। এই ভুলটা সকলেই করেছিল। বেনামী চিঠির ব্যাপার নিয়েই মেতে উঠেছিল। অথচ মজার ব্যাপার হল, সত্যিই কোন বেনামী চিঠি ছিল না।
–কিন্তু, মিস, মারপল, ওরকম একটা চিঠি সত্যিই আমি পেয়েছিলাম। বললাম আমি।
–তা পেয়েছিলেন। কিন্তু সে চিঠিগুলো ধোঁয়া ছাড়া কিছুই ছিল না–আসল আগুনকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া।
প্রিয় মড ব্যাপারটা অনেকটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। যাই হোক, যদি ওই বেনামী চিঠির ব্যাপারটা বাদ দেওয়া যায় তাহলেই আসল ঘটনাটা আমাদের চোখে পড়ে যায়।
বেনামী চিঠির প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলেই আমরা একটা মারাত্মক ঘটনার মুখোমুখি এসে পড়ি-মিসেস সিমিংটনের আকস্মিক মৃত্যু–যেটাকে সুকৌশলে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এই মৃত্যুর ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, এর ফলে কার কি স্বার্থ চরিতার্থ হতে পারে? কার পক্ষে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুকামনা করা সম্ভব ছিল?
সবার আগে দৃষ্টি পড়ে তার স্বামীর ওপরেই। তার দিক থেকে কি ধরনের উদ্দেশ্য থাকা সম্ভব? দ্বিতীয় কোন নারীর আবির্ভাব? যার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা মিঃ সিমিংটনের বয়সী মানুষদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এখানে এসেই শুনেছিলাম, ওই বাড়িতে রূপবতী এক নার্সারী গভর্নেস আছেন। সরল সোজা ব্যাপারটা এখানেই যেন হাতছানি দিয়ে রহস্যের ইঙ্গিত করে।
মিঃ সিমিংটন ছাড়াছাড়া মানসিকতার এক আবেগবর্জিত মানুষ। এক স্নায়বিক বিকাগ্রস্ত স্ত্রীর সঙ্গে জড়িত ছিল তার জীবন। সেই অবস্থাতেই ওই সুন্দরী তরুণীর আবির্ভাব ঘটল।
ধোঁয়ার ব্যাপারটা–ওইসব বেনামী চিঠি–যদি সকলকে ভুল পথে চালিত না করত তাহলে অনিবার্যভাবে ঘটনার এই দিকে আলোকপাত ঘটত।
কিন্তু সুকৌশলে ওই বেনামী চিঠির ব্যাপারটাকেই এখানে কাজে লাগিয়ে সকলকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।
ওইরকম বয়সের কোন ভদ্রলোক যখন প্রেমে পড়েন, তখন তারা খুব বেপরোয়া হয়ে পড়েন। প্রায় সময়েই তাদের উম্মত্তের মতো ব্যবহার করতে দেখা যায়।
এদিকে মিঃ সিমিংটন, যতদূর জানতে পেরেছি, এমন চরিত্রের মানুষ ছিলেন যে মানবিক গুণাবলী বলতে তার কিছুই ছিল না। ফলে উম্মাদনা বোধ করবার মতো মনোবল একেবারেই ছিল না।
কি করে মেয়েটিকে বিয়ে করা যায় এই চিন্তাতেই একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে স্ত্রীর মৃত্যু ছাড়া তার ইচ্ছাপূরণের কোন উপায় ছিল না।
ভদ্রলোক সন্তানদের স্নেহ করেন। তাদের তাই ছাড়তে চাননি। সামাজিক সম্মান বজায় রাখার চিন্তাও মাথায় ছিল। এই সবকিছু বজায় রেখে সুন্দরী গভর্নের্সকে বিয়ে করতে হলে একটা খুনের ঘটনা ঘটানো ছাড়া উপায় ছিল না তার।
ব্যাপারটা যখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, যখন তিনি অত্যন্ত কৌশলী একটা ছক কষলেন।
তার অজানা ছিল না যে কারো স্ত্রী হঠাৎ মারা গেলে স্বামীর ওপরেই প্রথমে সকলের সন্দেহ পড়ে। সে মৃত্যু যদি বিষক্রিয়ায় হয় তাহলে নানারকম পরীক্ষার প্রশ্ন এসে পড়ে। সেক্ষেত্রে নিজেকে আড়ালে রাখা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই তিনি চাইলেন মৃত্যুর ঘটনাকে অন্যকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে সকলকে ভুলপথে চালিত করতে।
এই চিন্তা থেকেই একজন ভুয়ো বেনামী চিঠি লেখকের সৃষ্টি হল।
সাধারণত বেনামী চিঠির ব্যাপারে স্ত্রীলোকদেরই সন্দেহ করা হয়ে থাকে। বেনামী চিঠির লেখক স্ত্রীলোকই বেশি হয়। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রেও তাই হল। তারা ধরে নিল এসব চিঠি কোন স্ত্রীলোকই লিখছে।
সম্ভবত ডাঃ গ্রিফিথের কাছে বেনামী চিঠির গল্প মিঃ সিমিংটন শুনে থাকবেন। গ্রিফিথ উত্তরে থাকার সময়ে ওখানে সকলেই ওরকম চিঠি পেতে শুরু করেছিল। সেই গল্প শোনার পরই তিনি এমন কৌশলে চিঠিগুলো লিখলেন যাতে সকলেই ধরে নিতে বাধ্য হয়–সেগুলো কোন উম্মাদ স্ত্রীলোকই লিখেছে।
উড়ো চিঠির ব্যাপারে একসময়ে যে পুলিস তৎপর হয়ে উঠবে, এও তিনি জানতেন। হাতের লেখা, ডাকঘরের ছাপ, টাইপ মেসিন ইত্যাদি পরীক্ষার কৌশল তারা অবলম্বন করবে। তাই তাদের চোখে ধুলো দেবার ব্যাপারে নিখুঁত চাতুরির আশ্রয় নিলেন।
খুনের লক্ষ্যে তার প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন থেকেই। উইমেন ইনসটিটিউটে টাইপ মেশিনটা দিয়ে দেবার আগেই সম্ভবত সমস্ত খামে ঠিকানা টাইপ করে রেখেছিলেন। আর কাজটা নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ করার জন্য বহু আগেই কোন একসময় মিস এমিলির ঘরে অপেক্ষা করার ফাঁকে বেছে বেছে একটা ধর্মোপদেশের বই থেকে কতগুলো পাতা ছিঁড়ে রেখেছিলেন। এখানেও তিনি চাতুর্য অদ্ভুতভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি জানতেন ধর্মোপদেশের বই কেউ বড় একটা পড়ে না–কেটে নেওয়া পাতার খোঁজও তাই সহজে কেউ জানতে পারবে না।
বেনামী চিঠির ব্যাপারটা যখন বেশ ভাল রকমে জমে উঠল, সকলে তাই নিয়েই মেতে উঠল, সেই সুযোগে তিনি আসল ঘটনার দিকে হাত বাড়ালেন।
খুব সুবিধাজনক একটা সময় এজন্য বেছে নিলেন তিনি। সেদিন চাকরবাকরদের সাপ্তাহিক ছুটি, বিকেলে গভর্নের্স বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে গেছে, মেগানও তার সাইকেল নিয়ে বাড়ির বাইরে গেছে।
নিভৃতে একটা খুনের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার একেবারে প্রশস্ত সময়।
কিন্তু ভাগ্যেরই প্রহসন বলতে হবে তার ক্ষেত্রে, ঘটনাচক্রে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় অ্যাগনেস সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এরকম ব্যাপার যে ঘটতে পারে মিঃ সিমিংটন ভাবতে পারেননি।
–অ্যাগনেস তাহলে কিছু দেখেছিল, বলছেন? যোয়ানা জানতে চাইল।
–সঠিক বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা ও কিছু দেখেনি।
–হয়তো কিছু ধারণা হয়ে থাকতে পারে।
-না, তা নয়। আমার মনে হয় সে ছেলেবন্ধু আসতে পারে এই আশায় সারা বিকেল রান্নাঘরের জানালার ধারে বসেছিল। সত্যিকথা বলতে সেদিন বিকেলে বাড়িতে ডাকপিওন বা অন্য কেউই আসেনি।
–তাহলে মিসেস সিমিংটন কি কোন চিঠি পাননি?
-কখনই না। যাই হোক, রাতের জন্য কিছু পুরিয়া ওষুধ গ্রিফিথ মিসেস সিমিংটনকে দিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি সেটা খেতেন।
মিঃ সিমিংটন ওইদিন সবচেয়ে ওপরের পুরিয়ার মধ্যে সায়ানাইড রেখে দিয়েছিলেন।
তিনি জানতেন মধ্যাহ্নভোজের পরেই তার স্ত্রী সেটা খাবেন।
এরপর সিমিংটন অফিস থেকে ঠিক সেই সময়ে বাড়ি ফিরে এলেন, যখন এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এলো।
বাড়ি ফিরে তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন, এলসি তা শুনতে পেল, স্ত্রীর সাড়া না পেয়ে তার ঘরে ছুটে গিয়ে জলের গ্লাসে একফোঁটা সায়ানাইড ফেলে দেওয়া, বেনামী চিঠিটা দলা পাকিয়ে চুল্লীতে ফেলে দেওয়া আর এভাবে আর পারছি না লেখা কাগজের টুকরোটা স্ত্রী হাতের কাছে। রেখে দেওয়া–এই সব কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গেই শেষ করলেন তিনি।
–এক টুকরো কাগজ, আমার দিকে ফিরে বললেন মিস মারপল, এই কথাটাও আপনিই আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন মিঃ বার্টন। সাধারণত আত্মহত্যার কথা মানুষ এক টুকরো কাগজে লিখে রাখে না। তার জন্য তারা একখণ্ড কাগজ ব্যবহার করে। অনেক সময় খামও। তাই টুকরো কাগজের ব্যাপারটা আপনার খটকা লেগে ছিল।
–কিন্তু আপনার মতো করে তলিয়ে দেখতে পারিনি আমি।
–আসলে ব্যাপারটা একদম অন্যরকম ছিল। সিমিংটন হয়তো এই ধরনের কিছু কোথাও লিখে থাকবেন। সেটা চোখে পড়ায় লেখা সহ কাগজের টুকরো ছিঁড়ে নিয়েছিলেন মিঃ সিমিংটন। কার্যক্ষেত্রে সেই টুকরোটাই নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছিলেন।
একটু থেমে মিস মারপল আমার দিকে তাকালেন। পরে বললেন, আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন। তা হল–এলসি হল্যাণ্ড কোন বেনামী চিঠি পাননি।
–গতকাল রাতেই আমি ভাবছিলাম, ও নিজেই বেনামী চিঠিগুলো লিখেছিল, তাই নিজে কোন চিঠি পায়নি। আমি বললাম।
–ওহ্ না, বললেন মিস মারপল, বেনামী চিঠি যারা লেখে তারা নিজেদের নামেও লিখে থাকে। এটাই তাদের অপরাধের প্রকৃতি।
ব্যাপারটা আমি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। ওটা ছিল মিঃ সিমিংটনের দুর্বলতা। বলতে পারেন মনুষ্য চরিত্রের এক বিশেষ দুর্বলতা। ভালবাসার মেয়েকে তিনি ওরকম চিঠি দিতে চাননি।
এই একটা ব্যাপারই তার দিকে আমাকে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তুলেছিল। আর তিনি ধরাও পড়লেন।
-কিন্তু অ্যাগনেসকে খুন করার তো কোন প্রয়োজন ছিল না। যোয়ানা বলল।
–প্রয়োজন ছিল না ঠিকই। কিন্তু তার অপরাধী মন তাকে সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল, অ্যাগনেসের ব্যাপারে। তাই তাকে খুন করে সম্ভাব্য পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছিলেন। খুনীর অপরাধী মনোভাব এরকম বিকৃত হওয়া অসম্ভব নয়।
অ্যাগনেস পারট্রিজকে ফোন করছে এই ব্যাপারটা মিঃ সিমিংটন দেখতে পেয়েছিলেন আমি নিশ্চিত, তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, অ্যাগনেস বলছে, মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকে তার খুব চিন্তা হচ্ছে, সে কিছু বুঝতে পারছে না কি করবে।
মিঃ সিমিংটন ওই শুনেই ধরে নিয়েছিলেন অ্যাগনেস কিছু দেখেছে বা শুনেছে। এর পর তিনি আর ঝুঁকি নিতে চাননি।
–সবাই জানে ওই দিন সারা বিকেল তিনি অফিসেই ছিলেন। বললাম আমি।
ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম। আমার বিশ্বাস, অফিসে যাওয়ার আগেই তিনি মেয়েটিকে খুন করেন।
মিস হল্যাণ্ড সম্ভবত রান্নাঘরে বা ডাইনিংরুমে ছিলেন। মিঃ সিমিংটন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আভাস দিতে সদর দরজা খুলে আবার শব্দ করে বন্ধ করে দেন। তারপর ছোট্ট পোশাকের ঘরে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন।
এরপর অ্যাগনেস যখন বাড়িতে ছিল তিনি বেরিয়ে এসে সদর দরজায় ঘন্টা বাজান, আবার পোশাকের ঘরে লুকিয়ে পড়েন।
অ্যাগনেস কেউ এসেছে বুঝে সদর দরজা খুলতে এলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পোশাকের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পেছন থেকে ওর মাথায় আঘাত করেন। তারপর অচেতন দেহটা বয়ে নিয়ে সিঁড়ির তলায় দেয়াল আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখেন।
সেদিন সামান্য দেরিতে অফিসে পৌঁছলেও তাকে সন্দেহ করার কোন সুযোগ ছিল না। কেননা কেউই এব্যাপারে কোন পুরুষকে সন্দেহ করেনি।
–জঘন্য এক ভদ্রবেশি শয়তান। বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।
–তাহলে এমি গ্রিফিথকে নিয়ে টানা-হাচড়া কেন? সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের কাছে শুনলাম, পুলিস ডাঃ গ্রিফিথের ডিসপেনসারি থেকে হারানো নোড়া আর সেই শিকটাও পেয়েছে। ওগুলো নাকি রাখা ছিল সিমিংটনের অফিসের দলিলের একটা বাক্সের মধ্যে। বলল যোয়ানা।
–পাগল না হলে ওসব জিনিস এভাবে কেউ রেখে দেয়? বললাম আমি।
–কিন্তু ওই নোড়া দিয়ে সিমিংটন অ্যাগনেসকে মারেনি। বলল যোয়ানা, ওখানে একটা ডার্বিঘড়ি ছিল, তাতে চুল আর রক্ত লেগেছিল। এমি যেদিন গ্রেপ্তার হয়, সেই দিনই তিনি সেটা চুরি করেন। আর ওই ছেঁড়া বইয়ের পাতাগুলোও, সেদিনই তার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কথা হল, পুলিস যে এমিকে গ্রেপ্তার করল, তারা কি সত্যিই তাকে ওই চিঠিটা লিখতে দেখেছিল?
-এমি ওই চিঠি সত্যিই লিখেছিলেন। বললেন মিস মারপল।
হঠাৎ ওরকম চিঠি লিখতে গেলেন কেন?
-হঠাৎ কেন হবে, এমি বহুদিন থেকেই সিমিংটনের প্রেমে ডুবে ছিলেন।
–হায় কপাল। বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।
-দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খুবই নিবিড় ছিল। বললেন মিস মারপল, মিসেস সিমিংটন মারা যাবার পর তাই এমি খুবই আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন লোকমুখে এলসি হল্যাণ্ডকে নিয়ে সম্ভাবনাটার কথা ছড়িয়ে পড়ল, স্বাভাবিক ভাবেই এমির মন ভেঙ্গে পড়ল। সেই হতাশা থেকেই তিনি এলসিকে সরাবর জন্য একটা বেনামী চিঠি লেখার পরিকল্পনা নেন। যাতে ভয় পেয়ে এলসি এখান থেকে সরে পড়ে। নতুন আর একটা চিঠিকেও আগেকার বেনামী চিঠি লেখকের কীর্তি বলেই লোকে ধরে নেবে-নিশ্চয় এরকম ভেবে নিয়েছিলেন তিনি। তবুও যথেষ্ট সতর্ক হয়েই কাজটা করেছিলেন তিনি।
-তারপর? যোয়ানা জানতে চাইল।
-আমি নিশ্চিত যে, বললেন মিস মারপল, এলসি চিঠিটা যখন মিঃ সিমিংটনকে দেখিয়েছিলেন, তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন চিঠিটা কে লিখতে পারে। নিজেকে নিরাপদ করার একটা প্রশস্ত সুযোগও তিনি এই সঙ্গে পেয়ে গেলেন।
সিমিংটন জানতেন, পুলিস বেনামী চিঠির লেখককে ধরবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটা পুলিসের কাছে নিয়ে যান। তারা তাকে জানালেন, এমিকে ওই চিঠি লিখতে তারা দেখেছেন। এভাবেই দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল। সিমিংটন তার ঘটনার এক চমৎকার পরিসমাপ্তি টানার সুযোগ নিলেন।
এমি যেদিন গ্রেপ্তার হন, সেদিন তিনি পরিবারের সকলকে নিয়ে গ্রিফিথের ওখানে চা খেতে গেলেন। ওই সময়েই নিশ্চয় তিনি সঙ্গে করে ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো নিয়ে এসেছিলেন আর সুযোগ বুঝে সিঁড়ির তলার দেয়াল-আমলারিতে গুঁজে রাখলেন।
তার এই আচরণই অ্যাগনেসের মৃতদেহ রাখার ঘটনাটা মনে করিয়ে দেয়। এই কাজটা তার পক্ষে এমন কিছু কঠিনও ছিল না।
সম্পূর্ণ ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে মিস মারপলের প্রতি আমার কিছু ক্ষোভ জমে ছিল। সেকথাটা এবার উত্থাপন না করে পারলাম না।
-সবই বুঝলাম, মিস মারপল, আপনার একটা ব্যাপার আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে আছে। বেচারী মেগানকে আপনি এসবের মধ্যে টেনে এনেছেন দেখে আমি সত্যিই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম।
মিস মারপল আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চশমার আড়ালে তার চোখের কঠিন দৃষ্টি আমার চোখ এড়াল না।
–ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমাকে কিছু একটা করতেই হত, মিঃ বার্টন। সিমিংটন লোকটা এমনই ধূর্ত যে তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণই ছিল না। তাই সরাসরি তার মোকাবেলা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর এ কাজের জন্য এমন একজনের সাহায্যের দরকার ছিল, যার সাহস ও বুদ্ধি দুইই আছে। তাই মেগানকেই এ কাজের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছিল আমার।
কিন্তু, কাজটা খুবই ঝুঁকির হয়ে গিয়েছিল না কি? বললাম আমি।
–কথাটা ঠিকই বলেছেন। কাজটা নিঃসন্দেহ বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু একজন নিরপরাধ মানুষকে বাঁচাবার জন্য এই ঝুঁকিটুকু না নিয়ে পারিনি আমি। তবে মেগানের উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ছিল মিঃ বার্টন।
-হ্যাঁ, তা অবশ্য ছিল। বললাম, আমি, আপনি সত্যিই অসাধারণ মিস, মারপল, মিস ডেন ক্যালথ্রপকেও তাই অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।