Site icon BnBoi.Com

এন অর এম – আগাথা ক্রিস্টি

এন অর এম - আগাথা ক্রিস্টি

এন অর এম

১. সুগঠিত জার্মান বাহিনী

এন অর এম (১৯৪১) / আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

১৯৪০ সাল। সুগঠিত জার্মান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ফ্রান্সের পতন যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে, নিচের ঘটনা সেই সময়ের!

টমি বেরেসফোর্ড ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের প্রাক্তন কর্মী। পত্নী টুপেনসকে নিয়ে তিনি অবসর জীবন যাপন করছে। তাদের দুই ছেলে ও মেয়ে বাইরে কর্মনিযুক্ত।

এমন একটা সময় ছিল যখন এই দম্পতি অনেক দুঃসাহসিক কর্ম করেছে, সত্য উদঘাটন করে অপরাধীকে শায়েস্তা করেছে, উত্তেজনা ও আনন্দে ভরা সেই দিনগুলো এখন কেবল স্মৃতিমাত্র।

অবসরের কর্মহীন অলস দিনগুলো তাই বড় একঘেয়ে ভাবেই অতিবাহিত হচ্ছে। তাই মাঝে মাঝে টমিকে আক্ষেপ করতে শোনা যায়, মিঃ কার্টারও আমাদের মনে রাখেননি, করার মত দু-একটা অন্তত কাজ তিনি দিতে পারতেন।

তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান মিঃ কার্টার (লর্ড এস্থাম্পটন) অবশ্য তার কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্কটল্যান্ডে থাকেন। মাছ শিকার করেই তার দিন কাটে।

সেদিন বেরেসফোর্ড দম্পতি ড্রইংরুমে বসে আছেন। এমন সময় লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

–আমি গ্রান্ট, লর্ড এস্থাম্পটনের বন্ধু। তারই পরামর্শে একটা কাজের সন্ধান নিয়ে মিঃ বেরেসফোর্ডের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

কাজের কথা শুনে টমি এবং টুপেনস দুজনেই সজাগ হল। করার মত কাজ নেই বলেই তো এতদিন তারা আক্ষেপ করছিল।

টমি উৎসাহিত হয়ে কাজটা সম্পর্কে জানতে চাইলে গ্রান্ট বললেন, নিছকই ফাইল ঘাঁটাঘাঁটির সামান্য একটা কাজ।

তাদের কথাবার্তার মাঝেই টেলিফোন বেজে উঠল, টুপেনস উঠে গিয়ে ধরল। ফিরে এসে জানাল, সে আলোচনায় থাকতে পারছে না বলে দুঃখিত। তার এক বন্ধু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এখুনি তাকে তার কাছে যেতে হবে।

টুপেনস চলে গেলে গ্রান্ট জানালেন, লর্ড এস্থাম্পটন নিজেই টমির জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করেছেন। কাজটা গোপনীয়–এমনকি স্ত্রীকেও জানানো চলবে না।

কেন না, তাকে নিয়োগ করা হবে একটি নিষিদ্ধ এলাকায়–যেখানে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সঙ্গত হবে না।

মিঃ গ্রান্ট বললেন, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অবিশ্বাস্যভাবে পালটে যাচ্ছে। যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা বীরের মতো লড়ছে, বোমারু ও যুদ্ধজাহাজগুলো সক্রিয় তবুও জার্মানদের সঙ্গে আমরা এঁটে উঠতে পারছি না।

পরিচালন ব্যবস্থায় রদবদল করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত মূল গলদ কোথায় আবিষ্কার করা হল। পঞ্চমবাহিনী অর্থাৎ গৃহশত্রুদের অব্যাহত সহযোগিতা পেয়ে চলেছে জার্মানরা–তার বলেই অপ্রতিহত হয়ে উঠছে জার্মানবাহিনী। আমাদের নিজেদের লোকই প্রতিপক্ষকে সমস্ত গোপন সংবাদ সরবরাহ করে চলেছে। এরা ছড়িয়ে রয়েছে সরকারী উচ্চমহলে, সামরিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে এমনকি আমাদের গোয়েন্দা দপ্তরেও। এদেরই সক্রিয়তায় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা।

টমি মনোযোগ দিয়ে সব শুনল। পরে বলল, আমি এখন একজন কর্মহীন শখের গোয়েন্দা মাত্র। নাৎসিপ্রেমী যেসব গৃহশত্রু দেশের সর্বনাশ করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমি কী করতে পারি? তাদের কাউকেই আমি চিনি না।

গ্রান্ট বললেন, পেশাদার গোয়েন্দাদের পক্ষে কাজটা করা কঠিন। এই কারণে একজন অভিজ্ঞ শখের গোয়েন্দার সন্ধানই আমরা করেছি। কাজটা আপনাকেই করতে হবে।

আমাদের গোয়েন্দা দপ্তরের সবচেয়ে কর্মতৎপর ও প্রাজ্ঞ কর্মীটিকে আমরা সম্প্রতি হারিয়েছি। গত মঙ্গলবারে সেন্টব্রিজ হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন–তিনি যে কাজ হাতে নিয়েছিলেন তা অসমাপ্ত রেখেই।

-আপনি কার কথা বলছেন? সাগ্রহে জানতে চাইল টমি।

–গোয়েন্দা ফারকুয়ার। তিনি অনেকটাই অগ্রসর হয়েছিলেন। যখন জাল গুটিয়ে আনার সময় হয়েছিল, তখনই একটা ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে যায়।

ঘটনাটা দুর্ঘটনা নয় বুঝতেই পারছেন। যাইহোক গোয়েন্দা ফারকুয়ার অসমাপ্ত কাজই আপনাকে সমাপ্ত করতে হবে।

টমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, বটে।

-মিঃ ফারকুয়ার ঠিক কতটা এগিয়েছিলেন আমরা কেউই জানি না। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সেই সময় তিনি কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ উচ্চারণ করেন, আমাদের সম্বল বলতে ওইটুকুই।

–শব্দগুলো কি শুনতে পারি?

–এন অর এম, সাংসুচি

–এর মধ্যে এমন কি রয়েছে যে

–মিঃ বেরেসফোর্ড, শব্দ কয়টি যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। এর অর এম শব্দ দুটি আগেও আমরা শুনেছি। এরা দু-জন ঝানু জার্মান গুপ্তচর। এদের কার্যকলাপ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। নিখুঁত চতুরতায় দেশে পঞ্চম বাহিনী গড়ে তোলে এরা, যার ফলে নাৎসিবাহিনীর সাফল্য অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আমরা জানতে পেরেছি, এন হলেন একজন পুরুষ এজেন্ট এবং এম মহিলা। দুজনই হিটলারের আস্থাভাজন।

–ফারকুয়ার এদের সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিলেন?

-হ্যাঁ, অন্তত একজনের নাগাল উনি পেয়েছিলেন অনুমান করা হচ্ছে। তার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল লিহাম্পটনে ফিরে যাবার একখানা রিটার্ন টিকিট যাতে পাওয়া গিয়েছে সাংসুচি শব্দের সঠিক পরিচয়। ফরাসি উচ্চারণে কথাটা সান্স সৌচি–সাংসুচি নয়।

–তা হওয়া সম্ভব, বলল টমি, তাহলে বলছেন, ওই জায়গায় গিয়ে আমাকে ঘাঁটি গাড়তে হবে।

-ঠিক তাই। আপনার বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তি প্রয়োগ করবেন, আমি নিশ্চিত, সঠিক লোকটিকে আপনি পাকড়াও করতে পারবেন।

-বেশ। লিহাম্পটন জায়গাটা সম্পর্কে কিছু বলুন।

–বিশেষত্ব কিছু নেই। কয়েকজন অকেজো বুড়োবুড়ি, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, দু-একজন বিদেশী কিংবা হয়তো ব্যবসায়ী–এরাই রয়েছে সেখানে।

-বলছেন এদের মধ্যেই মিশে আছেন এন অথবা এম?

–অথবা তাদের কোনো সহযোগী।

–চেষ্টা করে দেখা যাক তাহলে।

–ধন্যবাদ, আপনার সাফল্য কামনা করি।

.

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে টমি। স্ত্রীকে রেখে এই প্রথম বাইরে যেতে হচ্ছে তাকে। অথচ আসল কাজের কথাটা গোপন রাখতে হল।

টমিকে বিচলিত দেখে টুপেনস স্বামীকে প্রবোধ দিয়ে বলল, সে-ও এখানে একটা নার্সের কাজ জুটিয়ে নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেবে দিন।

সব গোছগাছ করে নিয়ে তিনদিন পর টমি এবারডিনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়ল। টুপেনস স্টেশনে এসে তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল।

স্কটল্যান্ডে ট্রেন বদল করে ম্যানচেস্টার, সেখানে থেকে তিনদিন পর লিহাম্পটনে পৌঁছানো গেল। একটা হোটেলে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে সান্স সৌচি ভিলা খুঁজে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না।

পাহাড়ের পাশেই ভিক্টোরিয় যুগের একটা ভিলা সান্স সৌচি। ওপর তলার যে কোনো জানালা থেকেই অদূরবর্তী তরঙ্গায়িত সমুদ্র চোখে পড়ে।

হলঘরে ঢুকেই একটা ধোঁয়াটে গন্ধ পেল টমি। সরাসরি অফিসঘরে ঢুকে ভিলার মালিক মিসেস পেরিনারের সঙ্গে দেখা করল।

মাঝবয়সি ভদ্রমহিলা। মুখে চড়া প্রসাধনের প্রলেপ। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। বেশবাসে। পরিপাটির অভাব চোখে লাগে।

টমি মিঃ মিয়াদো নামে নিজের পরিচয় দিল। যুদ্ধের সময় লন্ডনে থাকা নিরাপদ মনে না করায় এখানে সরে এসেছে। বন্ধুদের কাছে এখানকার ব্যবস্থাপনার প্রশংসা শুনেই এককথায় চলে এসেছে।

প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষ করে উপযুক্ত ভাড়ার বিনিময়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে নিল সে এবং পরদিন সকালেই হোটেল ছেড়ে সান্স সৌচিতে এসে উঠল।

মিসেস পেরিনা স্বাগত জানিয়ে হলঘরে নিয়ে গেল টমিকে। অন্যান্য বোর্ডাররা সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। একে একে সকলের সঙ্গেই তাকে পরিচয় করে দেওয়া হল। এরা হলেন, মিসেস ওরুরকি, মেজর ব্লেচলি, মিঃ কার্ল ভন দিনিম; মিস মিন্টন।

মাথায় পরিপাটি ঘন চুল, চুপচাপ বসে উল বুনছেন এক মহিলা। ইনি হলেন মিসেস ব্লেনকিনসপ। সব শেষে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার মুহূর্তে নিঃশব্দে মুখ তুলে নেন তিনি।

চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা দুলে উঠল টমির। প্রচণ্ড বিস্ময়ে হকচকিয়ে গেল। মিসেস ব্লেনকিনসপ–এ যে টুপেনস।

মুহূর্তে সমস্ত হলঘরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আবার তাকাল, নির্বিকার টুপেনস একাগ্র হয়ে আছে উলবোনা নিয়ে। চেনাজানার আভাসমাত্র তার চোখে নেই।

কিন্তু টুপেনস এখানে কেন? কীভাবে? টমির নিঃশ্বাস প্রশ্বাস মন্থর হয়ে গেল।

.

সন্ধ্যা পর্যন্ত একই জিজ্ঞাসা মাথায় নিয়ে ঘুরে ফিরে কোনোরকমে কাটিয়ে দিল টমি। মিসেস ব্লেনকিনসপকে যথাসাধ্য এড়িয়ে থাকবারই চেষ্টা করেছে। কিন্তু থেকেছে কাছাকাছিই।

ডিনারের সময় সান্স সৌচির আরও তিনজন বাসিন্দার সঙ্গে আলাপ হল। এরা হলেন মিঃ ও মিসেস ক্লে এবং মিসেস স্প্রট। এই যুবতী মায়ের সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট মেয়ে বেটি। অল্প অল্প কথা বলতে শিখেছে সবেমাত্র।

টমির পাশের আসনেই বসে ছিলেন মিসেস স্প্রট। টমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যুদ্ধের সোরগোল কমে এলো, সবাই দেখছি নিজের নিজের জায়গায় ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন!

টমি জবাব দেবার আগেই পাশ থেকে অপর এক মহিলা বলে উঠলেন, কমল কোথায়? দেশের পরিস্থিতি এখনও অস্বাভাবিক। হিটলার বলেছেন, ইংলন্ডের জন্য মজুত রেখেছেন ব্লিটসীগ মনে হয় মারাত্মক কোনো গ্যাস ওটা।

মেজর ব্লেচলি বলে উঠলেন, গ্যাস না হাতি। স্রেফ বোমা মেরেই উড়িয়ে দেবে ইংলন্ড। ফ্রান্সে যা করেছিল।

একপাশ থেকে টুপেনস বলে উঠল, আমার ছেলে ডগলাস তো বলে…

চমকে উঠল টমি। বেশ কৌতুক বোধ করল। নিজে ব্লেনকিনসপ সেজে আবার ডগলাসের নাম করা কেন?

.

ডিনারের পরে লাউঞ্জে জড়ো হয়েছে সকলে। যে যার মতো গল্প করে চলেছেন। মেয়েরা তাদের উল-কাটা নিয়ে ব্যস্ত।

মেজর তার সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বেশ রোমাঞ্চকর ভঙ্গিতে বর্ণনা করে চলেছেন। এমন সময় শ্রোতাদের মধ্য থেকে সুদর্শন যুবক ভন দিনিম উঠে দাঁড়ায়। সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

মেজর ঘাড় ঘুরিয়ে তার নিষ্ক্রমণ দেখলেন। তারপর টমিকে বললেন, এ হল জার্মান উদ্বাস্তু, বুঝলেন? যুদ্ধের একমাস আগে জার্মানি থেকে পালিয়ে এসেছে।

–উনি কি জার্মান?

–নির্ভেজাল জার্মান-ইহুদি নয়। ওর দুই ভাই হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর দিন গুণছে। এ কোনো রকমে পালিয়ে এসে বেঁচেছে।

-কী সর্বনাশ!

-তবে বলছি কী। অপরাধ হল ওর বাবা নাৎসি শাসনের সমালোচনা করেছিলেন।

টমি আলোচনার একটা সূত্র পেয়ে নড়েচড়ে বসেছিল। কিন্তু এই সময়ে মিঃ ক্লে এসে জুটে সব ভণ্ডুল করে দিলেন। তিনি শুরু করলেন নিজের শরীর স্বাস্থ্যের ফিরিস্তি।

.

খুব সকালে উঠেই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল টমি। ভিলার বাইরে পথ ধরে অনেকটা চলে গিয়েছিল। ফেরার পথে দেখা হয়েগেল মিসেস ব্লেনকিনসপের সঙ্গে।

এরকম একটি সুযোগের জন্যই মনে মনে তৈরি হয়েছিল হয়তো টমি। চকিতে দেখে নিল আশপাশে কেউ নেই। মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিয়ে কৌতুকভরা স্বরে বলে উঠল, সুপ্রভাত মাদাম…তুমিই তো!

-আমি এখন মিসেস ব্লেনকিনসপ মশাই। রসিকতা করল টুপেনস।

–কিন্তু এই চিড়িয়াখানায় এসে জুটলে কী করে?

-স্রেফ বুদ্ধির জোরে। তোমাকে আর তোমার সেই নাকউঁচু মিঃ গ্রান্টকে শিক্ষা দেবার জন্য।

–শিক্ষা বলতে শিক্ষা একেবারে আক্কেলগুড়ুম। কিন্তু রহস্যটা খোলসা কর।

–হিসেবটা এমন কিছু জটিল নয়। মিঃ গ্রান্টের মুখে মিঃ কার্টারের কথা শুনেই বুঝে নিয়েছিলাম কোনো গুরুতর কাজেই তোমার ডাক পড়বে। মিঃ গ্রান্ট উসখুস করছেন দেখে শেরীর বোতল আনবার অছিলায় বেরিয়ে গিয়ে বান্ধবী মরিনকে ফোন করলাম। বলে দিলাম, কিছুক্ষণ পরেই যেন আমাকে ফোন করে।

তার ফোন পেয়েই অসুস্থ বান্ধবীকে দেখতে যাবার নাম করে বেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে আড়ি পেতে ছিলাম।

তোমাদের সলাপরামর্শ সবই কানে গেল। তখনই ঠিক করলাম উন্নাসিক গ্রান্টকে শিক্ষা দিতে হবে। কেন না মিঃ কার্টার আমাদের দুজনকে আলাদা করে ভাবেননি কখনও।

-ঠিকই বলেছ, গম্ভীর স্বরে বলল টমি, তবে আশ্চর্য হচ্ছি, আমরা দুজনেই আবার অদ্ভুতভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলাম।

অতীতের সেই উজ্জ্বল দিনগুলি বুঝি আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তুমি হঠাৎ ব্লেনকিনসপ এই বিচ্ছিরি নামটা নিতে গেলে কেন?

–আমার কাপড় সামলে চলার সুবিধা হবে বলে ওই নামটাই খুঁজে নিতে হয়েছে।

–কাপড় সামলে মানে?

–তোমার মাথা মোটা হয়ে গেছে। আমার গায়ের নিকারের গলায় B অক্ষরটা এমব্রয়ডারি করা আছে। B অক্ষর দিয়ে বেরেসফোর্ড হতে পারে আবার ব্লেনকিনসপও হতে পারে। তাই আমার নাম হয়ে গেল প্যাট্রিসিয়া ব্লেনকিনসপ। কিন্তু তোমার মিয়াদো পদবীটাও হতকুচ্ছি।

-তোমার মত B অক্ষরের সমস্যা তো আমার ছিল না,তবে মিয়াদো অতি সজ্জন ব্যক্তি, অতীবও সম্মানের।

–তাহলে তুমি কি বিবাহিত না বিপত্নীক?

–বিপত্নীক, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল টমি, দশ বছর আগে আমার স্ত্রী সিঙ্গাপুরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

-আবার সিঙ্গাপুর কেন?

–কোনো কারণ নেই, মনে হল

–মন্দ নয়। তবে আমি বিধবা।

–তোমার স্বামী কোথায় মারা যান?

–তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। লিভারে পচন ধরেছিল, কোনো এক নার্সিংহোমে ছিল–

–আহা বেচারা! আর ডগলাস–তোমার ছেলে?

–সে নেভিতে। আমার কিন্তু আরো দুটি ছেলে আছে। এয়ারফোর্সে কাজ করছে রেমন্ড, আর শিশুপুত্র কাইলি দেশের বাড়িতে।

টমি এমনি হালকা রসিকতার ইতি টানল একসময়। সান্স সৌচি ক্রমেই এগিয়ে আসছিল। সে জানতে চাইল, আমার আগেই তো তুমি এই ভিলায় নাম লিখিয়েছ। জার্মান স্পাই বলে কাকে সন্দেহ করছ?

টুপেনসের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। বলল, সেভাবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে একটি সুদর্শন জার্মান যুবক এখানে আছে।

-হা, কার্ল ভন দিনিম। উদ্বাস্তু। পুলিশ নিশ্চয় তার কাগজপত্র খুঁটিয়েই পরীক্ষা করেছে। তোমার কি মনে হয়?

–আমি পুলিশের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারি না। অনেক সময় ওদের চোখও এড়িয়ে যায়। আমি ভোলা মন নিয়ে লক্ষ্য করে চলেছি।

–আচ্ছা, মিসেস পেরিনা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ?

–হ্যাঁ, তাকে আমার নজরে রাখার মত মনে হয়েছে।

–আমাদের কথা শেষ করা দরকার। আমাদের যোগাযোগের ব্যাপারটা কীরকম হবে? ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া ঠিক হবে না।

অবশ্যই। আমি স্থির করেছি, তোমাকে বানাব বিধবার সম্ভাব্য শিকার,-নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকব। ইতিমধ্যে আমি দু-জন স্বামীর সঙ্গে ঘর করেছি। তৃতীয়টির সন্ধানে রয়েছি–কাজেই লাউঞ্জে, কাফেতে তোমার সঙ্গে লেপ্টে থাকার চেষ্টা করব। তুমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও পৌরুষের খাতিরে পেরে উঠছ না। মনে হয় ব্যাপারটা সকলের কাছেই উপভোগ্য হয়ে উঠবে।

পরিকল্পনাটা জুতসই সন্দেহ নেই। ঠোঁটের কোণে হেসে টমি টুপেনসের দিকে তাকায়। পরক্ষণে আচমকা তার হাত টেনে ধরে।

–সামনে তাকিয়ে দেখ।

এক জোড়া যুবকযুবতী, অদূরে গাছগাছালির ছায়ায় ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পরস্পরের অনুরাগ বিনিময় করছে।

টুপেনস নিচুস্বরে বলল, যুবকটি কার্ল ভন দিনিম। কিন্তু মেয়েটিকে চিনতে পারছি না। তুমি সরে যাও।

টমি তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপরীত মুখে চলতে শুরু করল।

কিছুটা আসার পরেই মেজরের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ। দু-জনেই সমস্বরে সুপ্রভাত বিনিময় করে।

সূর্য উঠবার আগেই বেরিয়ে পড়া আমার অভ্যাস। বললেন মেজর।

–আজ্ঞে, আমারও তাই, বহুদিনের অভ্যাস। জবাব দেয় টমি।

মেজর কথা বলার সুযোগ পেলে সাতকাহন জুড়ে দেবেন। তাই টমি প্রথমেই ভিন্নপ্রসঙ্গে চলে আসে।

–কী যেন নাম, ওই মহিলাটি, হা, মিসেস ব্লেনকিনসপ, তার সঙ্গে দেখা হল। আপনি মহিলাকে জানেন?

–মিসেস ব্লেনকিনসপ। দেখতে মন্দ নয়। খুব কথা বলে। তবে বোকা নয়। আমি তাকে ঠিক জানি না। সবে এসেছেন এখানে। তা বলল কিছু?

-না, বিশেষ কিছু না। বলল টমি। মেজর অন্তরঙ্গ স্বরে বললেন, খুব সাবধান মশায়। পড়তি বয়সি মহিলা। আপনি হয়তো জানেন না, ও কিন্তু বিধবা।

-তাই নাকি? অবাক হওয়ার ভান করে টমি।

বেশ সরস হয়ে ওঠেন মেজর। টমির পিঠে থাবা বসিয়ে বলেন, আপনার যদিও বয়স ঢলে পড়েছে, তবু বিধবা বলে কথা। বুঝতেই তো পারেন ওরা কোনো শ্রেণির জীব। ইতিমধ্যেই মহিলা দু-জন স্বামীকে পার করেছে, তৃতীয় শিকারের সন্ধানে আছে বলেই সন্দেহ হয়। অতএব সাবধান–এ আমার উপদেশ।

কথা বলতে বলতে সান্স সৌচির গেটের কাছে পৌঁছে গেলেন তারা।

.

ওদিকে টুপেনস চলার গতি মন্থর করে। উৎকর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে আলাপরত কপোতক পোতিকে অতিক্রম করে যায়। যুবতীর চাপা স্বর তার কানে আসে…সাবধান থেকো কার্ল…কোনোরকম সন্দেহ…

আর শোনা গেল না। আরও কয়েক পা এগোল টুপেনস। তারপর আবার ঘুরল। যুবতীর গলার স্বর কানে এলো–নিজের অবস্থার কথা ভুলে যেয়ো না…জঘন্য ইংরেজরা–

কিছুদূর গিয়েই টুপেনস আবার ফিরল। যুবক-যুবতী এখন আর একসঙ্গে নেই। মেয়েটি দ্রুতপায়ে পথে নেমে পড়েছে।

যুবকটি অন্যমনস্কভাবে টুপেনসের দিকেই এগিয়ে আসছে।

দু-জনে চোখাচোখি হল। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল যুবকটি।

–সুপ্রভাত মিঃ কার্ল ভন দিনিম, প্রতিঅভিবাদন করল টুপেনস। ভারী মনোরম আজকের সকালটা।

-হ্যাঁ, চমৎকার আবহাওয়া। স্মিত হাসল দিনিম, ম্যাডাম, আপনি কি সান্স সৌচিতে ফিরছেন? তাহলে আপত্তি না থাকলে আমরা একসঙ্গেই যেতে পারি।

ওরা দু-জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। চলতে চলতে টুপেনস জিজ্ঞেস করল, প্রাতঃরাশ করেছেন, না বাকি আছে?

–ওই পাট চুকিয়েই বেরিয়েছি। এখন কাজে যাচ্ছি।

–কী কাজ? জানতে চাইল টুপেনস।

-কেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছি। কিছু একটা করে এই বিদেশে পেট চালাতে হবে তো। তাই যেটা জানি তাই নিয়েই লেগে পড়েছি।

–বিদেশে দুঃসময়ে বিদ্যেই পরম সহায়। আপনি ঠিকই করেছেন। বলল টুপেনস।

কথা বলতে বলতে দিনিমের মুখাভাবে একটা কাঠিন্য ফুটে ওঠে। তিনি বলতে থাকেন, দুই ভাই এখনও পচছে অত্যাচারী নাৎসীদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওইরকম একটি ক্যাম্পেই বাবা প্রাণ হারান।

সেই শোক সইতে না পেরে মাও আতঙ্কে আর ভয়ে অকালে মারা যান। একা আমিই কোনোক্রমে পালিয়ে এসে নড়েচড়ে বাঁচবার চেষ্টা করছি।

দিনিম কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। কথা শেষ হলে সশব্দে পা ফেলে নীরবে হাঁটল কিছুক্ষণ। টুপেনসের মনে তার কথাগুলোই গভীর বেদনা মথিত করে তুলছিল।

দু-জন পথচারী ওদের অতিক্রম করে চলেছে। হঠাৎ একজন তার সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওই শয়তানকে চিনে রাখ, একটা বজ্জাত জার্মান।

প্রবল ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত মন্তব্যগুলো উত্তপ্ত শলাকার মতো দিনিমের কানে প্রবেশ করল। মুহূর্তের মধ্যে তার শান্ত চেহারা ক্ষোভে উত্তেজনায় ভয়ানক হয়ে ওঠে। কপালের শিরা ফুলে ওঠে। সে উত্তেজিত ভাবে বলে ওঠে, শুনলেন তো এরকম মন্তব্যই পথেঘাটে আমাকে শুনতে হয়। আমি এখুনি ওদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারি।

মারমুখী জার্মান যুবককে শান্ত করতে টুপেনস বলে উঠল, মাথা গরম করবেন না, শান্ত হোন। এই সময়ে বিবেচনাশক্তি হারালেই বিপদ।

-কী বলতে চাইছেন আপনি। গনগনে স্বরে জিজ্ঞাসা করে দিনিম।

ধীর কণ্ঠে টুপেনস বলল, দুটো দিকই আপনার ভেবে দেখা উচিত। এই দেশ এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আপনি একজন জার্মান উদ্বাস্তু, স্থানীয় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাবে। তবু এটা তো সত্যিকথা আপনি বেঁচে আছেন, এবং স্বাধীন ভাবেই বেঁচে আছেন।

জার্মানদের মধ্যে যারা ভালো মন্দ চিনতে পারেন তেমন শিক্ষিত মানুষ পথেঘাটে সচরাচর ঘুরে বেড়ান না, এরা সব সাধারণ শ্রেণির মানুষ। সব জার্মানই এদের কাছে সমান। এদের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

টুপেনসের কথায় দিনিম সংযত হয়। ধীর পদক্ষেপে সে সান্স সৌচি পর্যন্ত টুপেনসকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেয়।

.

ডাইনিংরুমের দরজায় পৌঁছেই মিসেস পেরিনার গলা শুনতে পেল টুপেনস। তিনি তার মেয়ে শীলার গল্প শোনাচ্ছিলেন অতিথিদের।

-শীলার সঙ্গে আলাপ হলে আপনারা খুশি হবেন। কাল রাতে এসেছিল, আজই সকালে আবার ফিরে গেল।

টুপেনসকে দেখতে পেয়ে সুপ্রভাত জানিয়ে অভিবাদন করলেন। জানালেন, ডাইনিংরুমে তার ব্রেকফাস্ট দেওয়া আছে।

মিসেস স্প্রট, তার ছোট্ট মেয়ে এবং মিসেস ওরুরকি তখন ব্রেকফাস্ট সারছিলেন। টুপেনস সকলের সঙ্গে প্রাতঃকালীন অভিবাদন বিনিময় করল।

মিসেস স্প্রটের শিশুটি টুপেনসকে দেখতে পেয়েই আনন্দ করে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আধো-আধো স্বরে বলতে লাগল, গা-গা-ব (Ga-Ga-Bouch)।

মিসেস স্প্রট বললেন, সবে দু-বছর পার হল, ভালো করে কিছুই বলতে পারে না। বাব ওসবই আওড়াচ্ছে সারাক্ষণ।

বিপুল দেহী মিসেস ও রুরকি শিশুটির দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। তার বিকট আকৃতি দেখে শিশুটি ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে–Nazar

শিশুটির বিরাগ বুঝতে পেরে মিসেস ওরুরকি অপ্রতিভ হলেন। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

মিসেস স্প্রট বললেন, কোনো কিছুতেই ভয় পেলেই ও এমনি ভাষায় চিৎকার করে ওঠে।

মিসেস ওরুরকি বাচ্চাদের ভালোইবাসেন, কিন্তু তার অমন অদ্ভুত চেহারাই বাচ্চাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।

এইসময় টুপেনস দেখতে পেল, মেজর ব্লেচলি ও টমি ডাইনিংরুমে ঢুকছেন। উৎসাহিত হয়ে সে বলে ওঠে, আসুন আসুন মিঃ মিয়াদো। কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি–

টুপেনসের গায়ে-পড়া অতি-উৎসাহে থতমত খেল টমি। বলার চেষ্টা করল, ধন্যবাদ সত্যিই একটু দেরি হয়ে গেল।

মেজর ব্লেচলি ও টমি আসনগ্রহণ করলেন। ছোট্ট বেটি অমনি মায়ের কোলে হুটোপাটা করে হাত বাড়িয়ে দেয় মেজরের দিকে। মুখে আওয়াজ তোলে-পুচপুচ

মেজর হাসিমুখে শিশুর দিকে তাকান। আদুরে গলায় বলেন—আ–পুঁচকে মিস পিপ–সকালটা কেমন কাটল

ছোট্ট বেটি মজা পেয়ে লাফিয়ে উঠে খিলখিল শব্দে হেসে উঠল।

শিশুর হাসির শব্দটি হঠাৎ কেমন অর্থবহ বোধহয় টুপেনসের। দুর্বোধ্য একটা সন্দেহের দোলা লাগে মনে।

মেজর আর শিশুটির আন্তরিক সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতার ছায়া যেন দেখতে পায় সে। চমকিত হয়ে তাকায় ওদের দুজনের দিকে।

.

মিস মিল্টন সান্স সৌচির বাগানে চেয়ারে বসে আপন মনে উল বুনে চলেছেন। টুপেনস এগিয়ে এসে প্রাতঃকালীন অভিবাদন বিনিময় করে পাশের চেয়ারে বসল।

উলবোনা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে। কথায় কথায় মিস মিল্টন হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, আপনার এক ছেলে নেভিতে আছে বলেছিলেন, তাই না?

টুপেনস সাগ্রহে বলে উঠল, হা বড়টি। পরেরটি রয়েছে বিমানবাহিনীতে। কোলেরটিকে ফ্রান্সেই রেখে আসতে হয়েছে।

–আহা, তাহলে তো বড়ই কষ্টে দিন কাটছে আপনার।

–দেশের এই সঙ্কট সময়ে ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের কথা বড়ো করে দেখা উচিত নয় আমাদের। আমাদের এখন সাহসী হতে হবে, তাই নয়?

তবে জার্মানদের দাপট শীঘ্রই কমে আসবে। আমার ধারণা, মাস দুয়েকের মধ্যেই ওরা ঝিমিয়ে আসতে বাধ্য।

মিস মিল্টন উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, আমারও তাই ধারণা।

তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, আমি শুনেছি হিটলার এক মারাত্মক অসুখে ভুগছেন। অনেকেই অনুমান করেছেন, আগস্ট মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবেন।

টুপেনস বলল, জার্মানির ভেতরের অবস্থাও ভালো নয়। শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ। রসদেও টান পড়েছে।

-দুজনে বেশ জমে গেছেন মনে হচ্ছে।

মিঃ ও মিসেস ক্লে এসে উপস্থিত হলেন।

মিঃ ক্লে-এর কথার উত্তরে মিস মিল্টন বললেন, আমরা যুদ্ধের কথা বলছিলাম। এই শরতেই শেষ হয়ে যাবে, তাই নয়?

-বাজে কথা, বললেন মিঃ ক্লে, অত সহজ নয়। আরও দু-বছর এই রকমই চলবে।

চমকে ওঠার ভান করল টুপেনস। বলল, সর্বনাশ! আপনার কি ওরকমই মনে হচ্ছে মিঃ ক্লে?

নিজের আসনে নড়েচড়ে বসলেন মিঃ ক্লে। তিনি যে আগ্রহ সঞ্চার করতে পেরেছেন একথা ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদের সঙ্গে হাসলেন।

-আমার তাই ধারণা–যুদ্ধের এই ডামাডোল আরও বছর দুই চলবে নির্ঘাৎ।

টুপেনস ও মিস মিল্টন দু-জনেই প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করেন।

জার্মানিকে আমি ভালোভাবেই চিনি, বললেন মিঃ ক্লে, একসময়ে নিজের কাজে ওই দেশের কোথায় না গেছি। বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিক বাদ নেই কোথাও। ওদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ওই ব্লিটসীগ–ওতেই এরা আমাদের কাবু করার মতলব এঁটেছে। তার ওপর যদি রাশিয়া পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে তো আর কথাই নেই।

এইসময় ছোট্ট বেটিকে নিয়ে তার মা মিসেস স্প্রট এসে হাজির হলেন। শিশুটির হাতে ধরা একটা পুতুল। নিজের মনেই সে বকবক করে চলেছে।

ওদের দিকে তাকিয়ে সকলেই কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হলেন। বেটি মায়ের কোল থেকে নেমে ছোটাছুটি আরম্ভ করল।

টুপেনস প্রসঙ্গের খেই ধরিয়ে দিয়ে বলল, তারপর বলুন মিঃ ক্লে।

মিস মিল্টনও সাগ্রহে তাকাল মিঃ ক্লে-এর দিকে। টুপেনসকে আচমকা মিসেস ক্লে-এর দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, আপনারও কি একই অভিমত মিসেস ক্লে? আমাদের বিপন্নতা আর দীর্ঘস্থায়ী হবে?

আকস্মিক এই প্রশ্নে হকচকিয়ে যান মিসেস ক্লে। তিনি আমতা-আমতা করে বলেন, আমাকে বলছেন? আমি কি বলব? তবে দু-বছর চলবে বলে মনে হয় না।

-হ্যাঁ, সময়টা বড়ো বেশি। বলল টুপেনস।

-কিন্তু আলফ্রেড তো বলছে আরও দু-বছর চলবে। নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না আমি।

উপস্থিত সকলেই নীরব থেকে মিসেস ক্লে-এর মতামত শুনল। টুপেনস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে আশা করেছিল, এই আলোচনার সুযোগে তাদের মধ্যে সে একজনকে চিহ্নিত করতে পারবে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল টুপেনস। সম্বিৎ ফিরে পেল মিসেস পেরিনার আবির্ভাবে।

নিঃশব্দে তিনি পেছন থেকে আলোচনারত নারী-পুরুষদের মধ্যে এসে দাঁড়ান। তার মুখের দিকে তাকিয়ে টুপেনসের অনুভূতিগুলি সজাগ হয়ে উঠল। পলকের জন্য তার মনে একটা সন্দেহের ছায়াপাত হল। সে ভাবল, ওই মহিলা সম্পর্কে নজর খোলা রাখা দরকার।

.

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টমির সঙ্গে মেজর ব্লেচলি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। দুই বন্ধু তখন বেশির ভাগ সময়ই একসঙ্গে থাকেন।

গলফ খেলার মাঠের দিকে চলতে চলতে কার্ল দিনিম সম্পর্কে মেজর বলতে লাগলেন, ওই জার্মান ছোকরাকে কিন্তু আমি সন্দেহ না করে পারছি না, যাই বলুন। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার একমাস আগেই এখানে এসে গেড়ে বসেছে। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে-বুঝলেন কাজটা নির্ঘাত গুপ্তচরবৃত্তি।

টমি কৌতূহলী হয়ে বলল, কিন্তু এখানে তো কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই

–নেই তো কী, ঈষৎ উত্তেজনা মিশল মেজরের কণ্ঠস্বরে। এই সময়ে এমন নিরিবিলি জায়গায় থেকে কাজ করাই নিরাপদ। প্লাইমাউথ বা পোর্টসমাউথে থাকলে সদাসতর্ক পুলিশের নজরে পড়ে যাবার ষোলআনা সম্ভাবনা।

আমাদের ইংরাজ সরকারও হয়েছে তেমনি, আগ বাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। নাৎসীরা সব কমবয়সিই হয়-কার্ল ছোকরারও সেই বয়স। লক্ষ করে দেখবেন, তার চালচলনও সন্দেহজনক মনে হবে।

টমি মৃদু হাসল। বলল, অবস্থা যা দেখছি প্রেত-তাড়ানো ওঝা-বদ্যির দরকার এখন আমাদের দেশে।

-তারা কী করবে?

–কেন, টমি বলল, গন্ধ-শুঁকেই গুপ্তচর ধরে দেবে।

মেজর মাথা দোলালেন। বললেন, ঠিক বলেছেন গন্ধ শুঁকেই গুপ্তচর ধরা গেলে খুবই ভালো হত।

কথা বলতে বলতে দু-জনে ক্লাবের সামনে উপস্থিত হলেন। টমি এই ক্লাবের অস্থায়ী সদস্য।

ময়দানে নামার মুখে পাশ থেকে হ্যাল্লো সম্বোধন শুনে দু-জনেই ঘুরে তাকালেন। আর এক খেলোয়াড় এগিয়ে আসছেন।

মেজর উল্লাসে বলে ওঠেন, আরে এসো এসো হেডক। মিঃ বেরেসফোর্ড, ইনি হলেন আমার পুরোনো বন্ধু অ্যাডমিরাল হেডক। এখন অবশ্য স্থানীয় এ. আর. পি.দের কামাণ্ডার।

ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন কামাণ্ডার হেডক। বন্ধুর বন্ধু টমির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সোল্লাসে করমর্দন করলেন।

আমার বন্ধু ব্লেচলি আপনাকে পেয়ে বেশ আনন্দেই আছে দেখছি, হেসে বললেন হেডক, তবে ওর আসল আনন্দ কিসে জানেন, কিহে ব্লেচলি, তাহলে বলি, মেয়েরা বসে গালগল্প করবে, উল বুনবে, ব্লেচলি তাদের মধ্যে উপস্থিত থেকে উপভোগ করবে।

কথা শেষ করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সশব্দে হেসে উঠলেন তিনি।

মিঃ ব্লেচলিও পালটা আক্রমণ করলেন, তাহলে তো মিস পেরিনার কথা আমাকে বলতেই হয়।

–শীলা। সত্যিই চমৎকার মেয়ে। রূপও আছে যাই বলো।

–ইদানীং অবশ্য তাকে নিয়ে আমাকে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। বললেন ব্লেচলি।

সকলে ক্লাবঘরের বারান্দায় এসে বসলেন। মদ্যপানের ছোট্ট আসর বসল।

হেডক মিঃ ব্লেচলির দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার বলো, শীলা সম্পর্কে কী বলছিলে তুমি।

ব্লেচলি ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, সান্স সৌচির সেই জার্মান ছোকরা–তোমার শীলার সঙ্গে খুব ভাব জমেছে

-হুম, লক্ষ্য করেছ? আজকালকার মেয়েরা কী হয়েছে বলে তো, নীতিবোধ বলে কিছু নেই। শত্রুর সঙ্গে ঘর বাঁধতেও আটকাচ্ছে না। হামেশাই এরকম ঘটনা চোখে পড়ছে।

–ওই শীলা মেয়েটাও অঘটন ঘটালো বলে।

কথাপ্রসঙ্গে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির বিষয়ও বাদ থাকল না। কামাণ্ডার হেডক একসময় বললেন, এই লিহাম্পটনের অবস্থাও মোটে ভালো নয় হে। যে কোনো দিন জার্মান ছত্রীবাহিনী নেমে পড়তে পারে। ওপরমহলের ব্যবস্থাপনা যে কীরকম বুঝতে পারি না। কাছে ধারে একটা বিমানবিধ্বংসী কামান পর্যন্ত বসানো হয়নি।

হেডকের আলোচনা বিশেষ জমল না। কেন না, মেজর ও টমি উৎসাহ বোধ করলেন না। ওদের ওঠবার তাড়া ছিল।

বিদায় জানাবার আগে হেডক তাদের দুজনকে নিজের বাড়িতে একদিন মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানালেন।

.

মধ্যাহ্নভোজের কিছু পরেই টমি সান্স সৌচি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে লিহাম্পটনের এক প্রান্তে চলে এলো। দুটো পত্রিকা নিয়ে পুরোনো জেটির ধার ধরে হাঁটতে লাগল।

একটা মাছ শিকারের মঞ্চে ছিপ হাতে বসেছিলেন একজন বয়স্ক লোক। ফাতনার দিকে নিবদ্ধদৃষ্টি।

এই বৃদ্ধ আমাদের পরিচিত। ইনি হলেন ছদ্মবেশী মিঃ গ্রান্ট।

টমি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কিছু মিলল?

মাছ-শিকারি ফাতনা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই মাথা ঝাঁকান। মৃদুস্বরে জবাব দেন, ঠোকরাচ্ছে। কম।…মিঃ মিয়াদো, এগুলেন কদ্দূর?

–সবে হামাগুড়ি দিচ্ছি। বলল টমি।

–এগিয়ে চলুন। আসুন, আপনার অগ্রগতির রিপোর্টটা শোনা যাক।

টমি মিঃ গ্রান্টের পাশে আসন নেয়। মধ্যাহ্নের খাড়া রোদ মাথায় ঝরছে। ধীরে ধীরে বলতে থাকে, সান্স সৌচির বাসিন্দাদের একটা তালিকা তো আমি আগেই পেশ করেছি।

–হ্যাঁ, পেয়েছি। মিঃ গ্রান্ট মাথা ঝাঁকালেন।

-এখনও পর্যন্ত বলার মতো অগ্রগতি কিছু হয়নি। আপাতত মেজর ব্লেচলির সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। তবে নিতান্ত সাধারণ বলেই মনে হচ্ছে। নিজেই স্বীকার করেছেন। একসময় কোথায় না গেছেন।

সূত্রটা গুরুত্বপূর্ণ।

সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন মিঃ গ্রান্ট।

–জার্মান ছোকরা কার্ল ভন দিনিমের ওপরও নজর রাখছি।

–ছোকরা সম্পর্কে আমিও আগ্রহী। বললেন মিঃ গ্রান্ট।

–ভন দিনিম এন (N) বলে আপনার মনে হয়? জানতে চায় টমি।

–তা মনে হয় না। সান্স সৌচির বাসিন্দাদের মধ্যে সম্ভবত এম বা এন কেউই নেই। তাদের হয়ে হয়তো কাজ করে চলেছে ভন দিনিম। জার্মান উদ্বাস্তু পরিচয়টা খোলস হওয়া অসম্ভব নয়। লোকটির ওপর নজর রাখবেন।

–পুলিশি রেকর্ডে তার পূর্ব ইতিহাস তো রয়েছে

মাথা ঝাঁকালেন মিঃ গ্রান্ট। বললেন, সান্স সৌচিতে সে নিজের সম্পর্কে যা বলছে, পুলিশের নথিতে তার সমর্থন রয়েছে। নাৎসীদের সমালোচনা করায় তার বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছে, কথাটা ঠিক। তার বড়ো ভাই এখনও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।

মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে মা মারা গেছে। যুদ্ধ শুরু হবার একমাস আগে কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে এদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ভন দিনিম। শপথ করেছে, ইংলন্ডকে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।

রসায়ন নিয়ে গবেষণা করে ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছে। গ্যাস আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে তার আবিষ্কার যথেষ্ট কার্যকর।

–তাহলে তো দিনিম ইংলন্ডের বন্ধু, তাকে সন্দেহ করা বৃথা।

–ওই ভুলটি করবেন না, বললেন মিঃ গ্রান্ট, আপনি গোয়েন্দা, আবেগের প্রশ্রয় দেবেন না। জার্মান ভাইয়ের কাজ অতি নিখুঁত। ভন দিনিমের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে, ওই নামটা আদৌ তার নিজের নয়-নাম ভাঁড়িয়ে আছে।

তবে আমাদের শত্রুদের মধ্যে মারাত্মক হল সেই পঞ্চমবাহিনী মনে রাখবেন, যারা দেশের সন্তান হয়েও বিদেশী শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

এই ঘৃণ্য জীবগুলোর জন্যই আমাদের যাবতীয় প্রয়াস বৃথা হয়ে যাচ্ছে। মুশকিল হল এই ঘরশত্রুরা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে। শত্রুর জয় হলে এদেরও পদোন্নতি হবে।

টমি দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, ঘৃণ্য শয়তানের দল

–এই শয়তানদেরই কবজায় আনতে হবে আমাদের।

এক মুহূর্ত নীরব থাকলেন মিঃ গ্রান্ট। পরে বললেন, ওখানকার মহিলাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

–একজন মহিলাকেই আমার অন্যরকম মনে হয়েছে।

–মিসেস পেরিনার কথা বলছেন?

–হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে আপনার কিছু জানা আছে?

–সন্ধান নিতে হবে।

–আর একটা খবর আছে স্যার।

–বলুন।

–মিসেস ব্লেনকিনসপ নামে এক মহিলা সম্প্রতি এসে জুটেছেন।

বেশ তো, নজর রাখবেন।

–স্যার, ইনি আমার স্ত্রী।

বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে পড়ে মিঃ গ্রান্টের। প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠেন, কী বলছেন? স্ত্রীর কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখার কথা আপনাকে বলেছিলাম।

–আমি স্যার কিছুই ফাস করিনি। এর পর টমি টুপেনসের কায়দা-কৌশল সব খুলে জানাল। শুনে মিঃ গ্রান্ট প্রথমে গুম হয়ে রইলেন। পরে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বললেন, অদ্ভুত, সত্যিই অদ্ভুত। এমন মহিলা বুঝতে পারছি এজন্যেই এস্থাম্পটন এই মিশনে আপনার স্ত্রীকেও নিতে বলেছিলেন। আমিই রাজি হতে পারিনি।

এখন দেখছি বুদ্ধির দৌড়ে তিনি সকলকে টেক্কা দিতে পারেন। এস্থাম্পটন শুনলে নিঃসন্দেহে খুশি হবেন।

যাইহোক, ডিপার্টমেন্ট আপনাদের দুজনকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে–তাঁকে জানাবেন। আপনাদের যৌথ অভিযান সফল হোক।

.

ডিনার শুরু হতে তখনও কিছু সময় বাকি। টুপেনস লাউঞ্জে ঢুকে দেখতে পেলেন মিসেস ওরুরকি একাই বসে আছেন। জানালার বাইরে তাকিয়ে আপন মনে কী ভাবছেন।

টুপেনসকে দেখতে পেয়েই সোল্লাসে চিৎকার করে আহ্বান জানালেন।

বিশাল বপু ওরুরকিকে দেখলে কারোরই পছন্দ করবার কথা নয়। স্তূপীকৃত চর্বির মস্ত বাণ্ডিল যেন। বিশাল মাথা, গোল গোল পাকানো চোখ, গালে কুচিকুচি দাড়ি আর গোঁফের রেখা। তবু তার আহ্বান শুনে টুপেনসের মনে হল, তার প্রতি ভদ্রমহিলার কিছুটা টান আছে।

হাসিমুখে এগিয়ে এসে টুপেনস বলল, লিহাম্পটন জায়গাটার গুণ আছে বলতে হবে। মনের ভার সহজেই লাঘব করে দিতে পারে।

মিসেস ওরুরকি বললেন, অত ভাববেন না, আপনার ছেলেরা নিরাপদেই আপনার কাছে ফিরে আসবে। একজন তো বিমানবাহিনীতে আছে, তাই না?

টুপেনস মাথা ঝাঁকালো। মুখে দুশ্চিন্তার ভাব ফুটিয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

–এখন কি ফ্রান্সে আছে?

মিশরে আছে। চিঠিতে তো ওসব জানাতে পারে না–সংকেতে লেখা আমাকে বুঝে নিতে হয়।

–মা আর ছেলের ব্যাপার–আর এক ছেলে তো নৌবাহিনীতে?

নিজের ছেলে ডগলাসের কথা মনে পড়ে যায় টুপেনসের। নীরবে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। পরে বলে, তিনজনকেই ছেড়ে দূরে এসে আছি।

লন্ডনের বাড়িটা লিজ নেওয়া–ওটা নিয়েও ভাবনা হচ্ছে। ভাবছি লিজের মেয়াদ বাড়িয়ে আর কাজ নেই।

লন্ডনের কথা বলবেন না, বললেন মিসেস ওরুরকি, ওখানে আমাদের বহুকালের বাস, ছোটখাট একটা ব্যাবসাও আছে, কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের সর্বনাশ করেছে।

একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, অবশ্য এই পরিণতি নিয়ে কাউকেই দোষারোপ করার কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। এখানে তো দেখছি সবারই নানান অভিযোগ। মিসেস স্প্রট তো তার স্বামীর ওপরেই দেখছি যত ঝাল ঝাড়েন।

–ওর স্বামী কি সীমান্তের যুদ্ধে আছেন? জানতে চাইল টুপেনস।

–না যুদ্ধে যাননি। জীবনবীমা অফিসের সামান্য চাকুরে। বোমার ভয়ে বউ মেয়েকে এখানে রেখে গেছেন। সময় সুযোগ করে এসে এদের দেখে যান। বেচারির কি হয়রানি বলুন।

-হ্যাঁ, খরচের ব্যাপারটা তো কম নয়।

–তবু তো বলব, মিসেস পেরিনা কম খরচে যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত করেছেন। মহিলার তুলনা হয় না। কিন্তু কী জানেন, ওকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

-কেন? অবাক হয়ে তাকায় টুপেনস, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে। আপনার?

সবার ওপরেই চোখ রয়েছে আমার। ভাববেন না, আমি বকবক করছি। নজরে পড়ে তাই বলছি। কে কোথায় যান, কী করেন, দেখতে পাই সবই তাই বলছি, মিসেস পেরিনা এক বিচিত্র ধরনের মহিলা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

–আপনার এরকমই মনে হয়?

–আজকাল হচ্ছে। নিজেকে একটা রহস্যোর জালে জড়িয়ে রেখেছেন মহিলা। তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, আয়ারল্যান্ডের মেয়ে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বেমালুম বলে দিলেন, তিনি আইরিশ নন।

–সত্যিই কি উনি তাই?

–আমি আমার দেশের মেয়েদের চিনতে পারব না? উনি আয়ারল্যান্ডের কোন অঞ্চলের মেয়ে তা-ও আমি বলে দিতে পারি। অথচ উনি সকলকে বলে বেড়ান তিনি ইংরেজ। তার স্বামী ছিলেন স্প্যানিশ।

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন ওরুরকি। টুপেনস তাকিয়ে দেখল লাউঞ্জে প্রবেশ করছেন মিসেস স্প্রট আর তার পেছনে টমি।

টুপেনস মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠল। টমির দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে বলে উঠল, মিঃ মিয়াদো, আপনাকে দারুণ সতেজ লাগছে।

টমি হাসল। বলল, অনেক কসরত করে এলাম যে। গলফের মাঠ থেকে আসছি।

মিসেস ওরুরকি হঠাৎ টুপেনসের সোয়েটারের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েন। হাতে টেনে পরীক্ষা করে বলেন, এটা নিজের হাতে বোনা?

টুপেনস জবাব দেয়, আজ্ঞে হ্যাঁ।

–দারুণ বোনা হয়েছে। কিন্তু মিস মিল্টন বলছিলেন, আপনি নাকি উল বোনায় তেমন দক্ষ নন।

কথাটা শুনে কেমন চমকে উঠল টুপেনস। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল মিসেস ওরুরকির দিকে। পরে হেসে বলল, উল যথেষ্টই বুনেছি আমি। তবে মিস মিল্টন অন্য কারুকে স্বীকার করতে চান না

সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল টুপেনসের কথা শুনে।

.

ডাইনিং টেবিলে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা হয়। আজ আলোচনা চলছিল জার্মান গুপ্তচরদের নিয়ে। তারা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চতুর্দিকে।

কোনো এক গির্জার পাদ্রী শত্রুপক্ষের স্পাই। এক অস্ট্রিয়ান পাচিৎকার ঘরে ওয়ারলেসের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়েছে। এবার স্পাইদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘরশত্রু পঞ্চমবাহিনী এভাবেই আলোচনা এগিয়ে চলেছে।

টুপেনস চোখ কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে রয়েছে। যদি কোথাও গন্ধ পাওয়া যায়। তার মাথা জুড়ে রয়েছে এম ও এন।

মিসেস পেরিনার মেয়ে শীলা একপাশে চুপচাপ বসে রয়েছে। এককথায় তাকে সুন্দরী বলা চলে, মনে হল টুপেনসের। কিন্তু বিশেষ কথা বলছিল না সে।

মিসেস স্প্রট বলছিলেন, জার্মানরা বড় নৃশংস, গতযুদ্ধে তারা ক্যাভেল নামে একজন নার্সকে গুলি করে মেরেছিল। এমন অমানবিক কাজ ভাবা যায়?

শীলা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল, একজন গুপ্তচরকে হত্যা করা কিছু অমানবিক কাজ হতে পারে না। ক্যাভেল অনেক ইংরেজ বন্দিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

-না, না, উনি স্পাই ছিলেন না।

সমবেতভাবে প্রতিবাদ জানাল সকলে।

শীলা তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে বলল, স্পাই ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জার্মানরা কিছু অন্যায় কাজ করেনি।

তেজের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শীলা। তারপর সকলকে অবাক করে ড্রইংরুম ছেড়ে বাগানে চলে গেল।

কয়েকমুহূর্ত সকলেই নীরব হয়ে রইলেন। সামনের খাবারের প্লেটে মনোযোগী হয়ে ধীরে ধীরে আবার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

টমি এক ফাঁকে উঠে ধীরে ধীরে ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে বাগানে নেমে গেল।

শীলা বাগানের একদিকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। নিঃশব্দ পায়ে টমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রবল উত্তেজনায় শীলার হাত মুঠো করে পাকানো।

–বড় মনোরম রাত।

প্রথম কথা বলল টমি।

শীলা চকিতে টমিকে দেখে নিল। মৃদু স্বরে বলল, না, রাতের সেই সৌন্দর্য আর নেই।

টমি সংযত কণ্ঠে বলল, যুদ্ধের জন্য বলছেন?

-না, তা আমি বলিনি, তবে যুদ্ধকে আমি ঘৃণা করি।

–যুদ্ধ কেউ মেনে নিতে পারে না।

–কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। ক্ষিপ্ত দেশাত্মবোধ আমি বরদাস্ত করতে পারি না।

–দেশাত্মবোধ-কেন? বিস্মিত হয় টমি।

তীব্র দেশাত্মবোধ বড় মারাত্মক। কেবল দেশ দেশ করা–দেশকে সেবা করা। দেশের জন্য আত্মত্যাগ, দেশের সঙ্গে শত্রুতা করা–সব ভাঁওতা। একজনের দেশ বলতে এই যে বিশেষ কিছু একটা বোঝনো, এটাই অসহ্য, কেন এমন হবে?

-ঠিক বলেছেন, আমি তা মনে করি না। মৃদুস্বরে বলতে চাইল টমি।

-আমি কি বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী আপনারা, দেশের জন্য প্রাণত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত নন।

–কিন্তু দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগ করতে চাইবে প্রতিটি দেশপ্রেমী মানুষ।

–এ আমি বিশ্বাস করি না। আমি অনেক দেখেছি–অনেক আঘাত পেয়েই একথা বলছি। বলতে বলতে সহসা টমির দিকে ঘুরে দাঁড়ায় শীলা। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার বাবা প্যাট্রিক মেগুয়ির পরিণতির কথা আপনি জানেন?

-না।

–গতযুদ্ধের সময় তাকে বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ বাবার কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু একজন জাতীয়তাবাদী আইরিশ হিসেবে স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের কথা তিনি ভাবতেন, উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। এই অপরাধেই তাকে কয়েদ থাকতে হয়, পরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হয়।

তাহলে দেখুন, এক পক্ষের কাছে তিনি হলেন বিশ্বাসঘাতক, অপরপক্ষের কাছে তিনি দেশপ্রেমী শহীদ বলে বন্দিত।

কিন্তু আমি মনে করি, আমার বাবা ছিলেন একজন নিপাট মূর্খ। তার পরিণতি আমাদেরও স্পর্শ করেছে।

–খুবই স্বাভাবিক। বলল টমি।

-কিন্তু আমি সবকিছু মুছে ফেলতে চাই। আমার মাও তাই চায়। তিনি তার নাম বদলে ফেলেছেন। পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি সর্বত্র বলেন আমার বাবা ছিলেন একজন স্প্যানিয়ার্ড। আমরা কিছুদিন স্পেনে ছিলাম।

তারপর ইউরোপের নানা স্থান ঘুরে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে থিতু হয়েছি। একটা নিচু শ্রেণির ব্যবসা অবলম্বন করতে হয়েছে।

কথা শেষ করে নীরব হয়ে থাকে শীলা। পরে চকিতে মুখ তুলে বলে, আপনাকে কেন এতসব কথা বলে ফেললাম, জানি না। কিন্তু দেশাত্মবোধকে আমি ঘৃণা করি।

বলেই আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত সরে গিয়ে গাছপালার ছায়ায় মিলিয়ে গেল।

২. দুজনের দেখাসাক্ষাৎ

ওদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয় গোপনে, সকলের চোখের আড়ালে। নিজেদের মধ্যে মতামত বিনিময় করে তারা।

মিসেস পেরিনা, মিস মিল্টন, মিসেস ও রুরকি, মেজর ক্লে দম্পতি, কার্ল ভন দিনিম, শীলা, ও সকন্যা মিসেস স্প্রট–এদের সকলের সম্পর্কে নিজেদের ধারণার কথা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলে তাদের।

মেলামেশা, কথাবার্তা এসবের মধ্যে কী করে আসল মানুষ দুটিকে চিহ্নিত করা যায় এ নিয়ে দু-জনেরই নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে। সেই মতোই এগিয়ে চলতে থাকে টমি ও টুপেনস।

সান্স সৌচিতে ফেরার পথে টুপেনস ডাকঘরে ঢুকে কিছু ডাকটিকিট কিনল। তারপর একটা বুথ থেকে টেলিফোন সারল। ওখান থেকে বেরিয়ে কয়েকটা উলের গোলা কিনে পথে নামল।

টুপেনসের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির রেখা। বেলা শেষের মৃদুমন্দ হাওয়ার ছোঁয়া গাছের পাতায় পাতায়।

সান্স সৌচিতে নিজের ভূমিকার কথা ভেবে নিজেকেই বাহবা দেয় টুপেনস।

সকলেই জানে মিসেস ব্লেনকিনসপ তার প্রবাসী সন্তানদের জন্য উদ্বেগে আকুল হয়ে আছে। মনের ভার লাঘব করবার জন্য দুদিন অন্তর ছেলেদের নামে চিঠি পাঠায়। আর একাকিত্বের একঘেয়েমি কাটাবার সঙ্গী উল কাটা।

পাহাড়ি নির্জন পথ। পথের পাশের বাড়িগুলির দিকে তাকাতে তাকাতে সান্স সৌচির দিকে এগিয়ে চলতে থাকে টুপেনস। নামফলকগুলির ওপরও চোখ বোলায়।

স্মাগলার্স রেস্ট–বিচিত্র নামের বাড়িটি এখানেই আছে। কামাণ্ডার হেডকের আবাস। তার পাশাপাশি রয়েছে বেল ভিক্টা, শ্ৰেলি টাওয়ার, সী ভিউ, ক্যাসেল কার। এই সারির সব শেষের বাড়িটিই হল সান্স সৌচি।

কাছাকাছি এসে চলার গতি মন্থর করে টুপেনস। তার চোখে পড়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে এক মহিলা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সান্স সৌচির দিকে।

কৌতূহলী টুপেনস কাছাকাছি এসে পড়লে মহিলা চমকে মুখ ঘুরিয়ে তাকান।

দীর্ঘাঙ্গী, প্রশস্ত কাঁধ, মুখে মলিনতা থাকলেও বনেদিয়ানার ছাপ। কিন্তু বসনে দারিদ্র্যর চিহ্ন। বয়স চল্লিশের কোঠায়।

অপরিচিতা মহিলাকে চোখে পড়ামাত্র টুপেনসের মনে হল, এই মুখ তার চেনা, আগে কোথায় দেখেছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে স্মরণে আনতে পারল না।

টুপেনসই প্রথম কথা বলল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

মহিলা ইতস্তত করে বললেন, মাফ করবেন, এই বাড়িটা কি সান্স সৌচি?

কথায় বিদেশী টান কান এড়াল না টুপেনসের। মৃদু কণ্ঠে সে বলল, হ্যাঁ। কাকে খুঁজছেন আপনি?

-আপনি এই বাড়িতেই থাকেন?

–হ্যাঁ।

–আচ্ছা, বলতে পারেন, মিঃ রোসেনস্টাইন নামে কেউ থাকেন?

–মিঃ রোসেনস্টাইন, চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল টুপেনস, না, এই নামে তো কেউ এখানে নেই। আগে ছিলেন কিনা বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে বলতে পারি।

–তার আর দরকার হবে না, মাফ করবেন, আমারই ভুল হয়েছে।

বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না ভদ্রমহিলা। দ্রুত বিপরীত দিকে ফিরে চললেন।

অপরিচিতা মহিলার ব্যবহার টুপেনসের মনে সন্দেহ উসকে দেয়। সে রহস্যের আভাস পায়। কাকে খুঁজতে এসেছিলেন মহিলা? নাকি সবটাই ধোঁকা?

মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে নেয় টুপেনস। স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্রতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান মহিলাকে অনুসরণ করতে থাকে।

কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ায়। কাজটা কি সঙ্গত হচ্ছে? তার মনোভাব প্রকাশ হয়ে পড়ছে।

কারোর নজরে পড়ে গেলে সন্দেহ করতে পারে। তাহলে মিসেস ব্লেনকিনসপের ভূমিকাটা বিঘ্নিত হবে। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

আর এগলো না টুপেনস। দ্রুতপায়ে ফিরে এল সান্স সৌচিতে।

অবাক হলো টুপেনস, গোটা হলঘর ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। ওপর থেকে কেবল বেটির আধো আধো কথার স্বর ভেসে আসছে।

টুপেনস ভাবল, ওপরে যে যার ঘরে চলে গেছে না বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছে? একজনও কেন নিচে নেই?

নিস্তব্ধ হলঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল টুপেনস। নিঃঝুম বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বাইরে থেকে কী দেখবার চেষ্টা করছিলেন মহিলা? কাউকে খুঁজছিলেন নিশ্চয়? টুপেনস ভাবে, কী হতে পারে? কিছু কি ঘটতে চলেছে এই বাড়িতে?

ঠিক এই সময় চারপাশের নিথরতা যেন খানখান হয়ে যায়। টেলিফোন বাজছে।

এ বাড়ির টেলিফোনটা হলঘরে। একমাত্র এক্সটেনশন লাইন রয়েছে মিসেস পেরিনার কক্ষে।

এই মুহূর্তে আশপাশে কেউ নেই। টুপেনস কোনোরকম দ্বিধা না করে এগিয়ে গেল। সাবধানে রিসিভার তুলে আড়ি পাতল।

বোঝা গেল, এ বাড়ির এক্সটেনশনটি কেউ ব্যবহার করছে। পুরুষ কণ্ঠ শোনা যায়–সব কিছুই ঠিক ঠিক চলছে…সুযোগ বুঝে, মনে আছে তো, চার নম্বরে

এপাশ থেকে নারীকণ্ঠ কানে আসে–ঠিক আছে, চালিয়ে যাও…

এটা যান্ত্রিক শব্দ…রিসিভার নামিয়ে রাখার। ধীর পায়ে সরে আসে টুপেনস…তার মনে প্রচণ্ড আলোড়ন…সান্স সৌচির মহিলাদের মধ্যে কোনো একজন ধরেছিল টেলিফোন। কিন্তু কার কণ্ঠস্বর হতে পারে? কয়েকটি মাত্র শব্দ শোনা গেছে…এ থেকে তা বোঝার উপায় নেই।

টুপেনস পরক্ষণে ভাবে, মিথ্যাই উতলা হচ্ছে সে। কথাগুলোর মধ্যে আদৌ কোনো রহস্যই নেই। নিতান্তই সাধারণ ব্যক্তিগত আলোচনার খণ্ডাংশ…মূল্যহীন।

যা শুনবে মনে করে সে আড়ি পেতেছিল আসলে এসব কথা তা নয়।

তবে এটা বোঝা গেল, ফোনটা মিসেস পেরিনা ধরেননি। টুপেনস রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল মিসেস পেরিনা ঘরে ঢুকছে।

-মিসেস ব্লেনকিনসপ, আপনি কি ঘুরে এলেন না বেরচ্ছেন?

টুপেনস তার বৈকালিক ভ্রমণের কথা জানিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস পেরিনাও চললেন তার পেছনে।

সহসা অজানা এক আশঙ্কা ভর করল টুপেনসকে। তার মনে হল, মিসেস পেরিনার মুখে হিংস্র হাসি, তিনি যেন লোলুপ থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে।

সিঁড়ির বাঁকের মুখেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মিসেস ওরুরকির সঙ্গে। তার চোখেও যেন শিকারি বেড়ালের চাউনি।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল টুপেনস। সে তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় পরিবেশটাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করল। সত্যিই কি সে কোনো ফঁদে পড়েছে?

মিসেস ওরুরকি পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল টুপেনস। সে তার ভয় পাওয়ার কারণটা বুঝতে পারল। ফোনে আড়িপাতা সামাজিক অপরাধের মধ্যে গণ্য।

সেই কাজটা করেই মানসিক ভীতির শিকার হয়েছে সে।

তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোর্ডিংহাউসের নির্জন পরিবেশ।

নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ওপরে উঠতে লাগল সে।

টেলিফোনে শোনা সংক্ষিপ্ত কথাগুলো কানের উপর ভাসছে এখনও-সবকিছুই ঠিক ঠিক আছে। ব্যবস্থা অনুযায়ী চার নম্বরে…

শব্দগুলো যদি কোনো অর্থবহন করে থাকে তবে তা টুপেনসের কাছে একেবারেই অপরিচিত।

চার নম্বর…এর অর্থ কী? তারিখ না মাস…কি বোঝাতে পারে? ল্যাম্পপোস্ট বা চার নম্বর ব্রিজ-এরকম তাৎপর্য হওয়াও অসম্ভব নয়। টুপেনসের মনে পড়ল, ওই ব্রিজটা জার্মানরা একবার উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে এসে ঢুকল টুপেনস।

স্মাগলার্স রেস্ট-অদ্ভুত নাম। নামের মধ্যেই যেন অপরাধের গন্ধ লুকনো। এই বাড়িতেই কমাণ্ডার হেডকের বাস।

এটা অবশ্য ঠিক, ভৌগোলিক দিক থেকে বাড়িটির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হেডকের বাড়িতে মদের আসরে এসেছে টমি। ঘুরে ঘুরে বাড়িটা তাকে দেখালেন হেডক।

এই বাড়ির ইতিহাসটাও চমকপ্রদ। হান নামে এক জার্মান স্পাই বাড়িটার মালিক ছিল। বছর চারেক আগের কথা–হেডক সেই সময় লিহাম্পটনের একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।

হানের বাড়িতে তার বিদেশী বন্ধুদের ভিড় লেগে থাকত সারাক্ষণ। হেডকের সন্দেহ হয়। এরা সকলেই গুপ্তচর। যথারীতি তিনি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তার কথার গুরুত্ব দেয়নি।

পরে যখন তাদের টনক নড়ল, তখন আর করার কিছু ছিল না। পাখি পালিয়েছে। অনুসন্ধান করে ওই বাড়িতে পাওয়া গেল ট্রান্সমিটার আর সংযোগরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি।

হেডকের মুখে বাড়ির ইতিহাস শুনতে শুনতে টমি লক্ষ্য করল, এ বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের সমুদ্রে অনায়াসে সার্চ লাইটের সংকেত পাঠানো যায়। বাড়ির মুখ সমুদ্রের দিকে পেছন থেকে কেউই কিছু টের পাবে না।

জার্মানরা বেছে বেছে বেশ নিরাপদ একটি জায়গা বেছে নিয়েছিল।

লিহাম্পটনের নির্ভুল পরিচয় জানতে পেরেছিলেন প্রয়াত মিঃ ফারকুয়ার–ভাবল টমি। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি নির্দিষ্টভাবে এই বাড়ির নাম উল্লেখ না করে সান্স সৌচির কথা বললেন কেন?

…জার্মান গুপ্তচরদের এই ঘাঁটিটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন কমাণ্ডার হেডক। কিন্তু শত্রুপক্ষের অন্য কোনো আস্তানা কি আশপাশে নেই? হয়তো সান্স সৌচিই সেই ডেরা।

জার্মান স্পাইদের কার্যকলাপ ধরাপড়ার পরে চার বছর আগে ঠিক কাছাকাছি সময়েই লন্ডন থেকে এসে মিসেস পেরিনা বাড়িটি কিনে নেন। এই ঘটনা কি একেবারেই তাৎপর্যহীন?

লিহাম্পটন যথার্থই একটি অরক্ষিত এলাকা। এর পেছনে রয়েছে বিস্তৃত ঘাসের মাঠ। শত্রুসেনা অনায়াসে সেখানে ঘাঁটি গাড়তে পারে।

টমি সজাগ হয়ে ওঠে–মিসেস পেরিনা সম্পর্কে সে নতুন করে আগ্রহ বোধ করে।

.

বিদেশী পাতলা কাগজের চিঠিটা সকলকে শুনিয়েই পড়তে শুরু করেছে টুপেনস তথা মিসেস ব্লেনকিনসপ।

আসলে বিশেষ ব্যবস্থায় আসা এটা একটা নকল চিঠি। তার পেছনে রয়েছে বিচক্ষণ সরকারি গোয়েন্দা মিঃ গ্রান্টের পরিকল্পনা।

টুপেনসের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ হয়–সে মিঃ গ্রান্টকে মিঃ ফেরাডে নামে সম্বোধন করে থাকে।

সামরিক বিভাগ থেকে সেন্সরড হয়ে আসা চিঠিটা পড়তে থাকে টুপেনস—

প্রিয় মা,
মিশরে আমরা তাকে নিয়ে বেশ জমে গেছি। চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুই গোপনীয়–তিনি কিছুই বলতে চাইছেন না। দারুণ একটা পরিকল্পনা রয়েছে সামনে–চমকে দেবার মতো কিছু কাজ আমার জন্যও রাখা হয়েছে…জেনে ভালোই লাগছে… কোথায় চলেছি…

টুপেনসকে বাধা দিলেন মেজর ব্লেচলি। অসহিষ্ণু কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, আপনার ছেলের চিঠি হতে পারে, কিন্তু এসব কথা লিখে জানাবার তার কোনো অধিকার নেই।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে সকলেই সমবেত হয়েছেন। এই সুযোগটাই কাজে লাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে চিঠি পড়া আরম্ভ করেছিল টুপেনস।

বাধা পেয়ে বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণায় দেখা দিল তার। পলকে চারপাশটা দেখে নিয়ে বুঝতে পারল, সকলেরই মনোযোগ তার দিকে।

–আমাদের মা-ছেলের চিঠির মধ্যে একটা বিশেষ কৌশল থাকে, গম্ভীর স্বরে বলল টুপেনস, কিছু সংকেতের রহস্য কেবল আমরা দুজনই জানি।

আমি এখন নির্ভুল বলে দিতে পারি তারা কোথায় আছে..কী করতে চলেছে…কিন্তু এই চিঠি পড়ে সেসব বোঝার সাধ্য আর কারো নেই।

ব্লেচলি অপ্রস্তুত হেসে বললেন, আপনি যাই বলুন না কেন মিসেস ব্লেনকিনসপ–এভাবে চিঠি আদানপ্রদান সমর্থন করা যায় না। মিত্রপক্ষের গতিবিধি জানার জন্য জার্মানরা চারপাশে যেভাবে ওঁত পেতে রয়েছে–

-তা থাক না, চড়া গলায় বলল টুপেনস, আমি তো কাউকে কিছু বলি না। ভাববেন না আমি অসাবধানী।

-তাহলেও এটা ঠিক নয়। এসবের জন্য কোনোদিন দেখবেন আপনার ছেলেই বিপদে পড়ে গেছে।

-না, তা হবে না। আমি তার মা, আমার সন্তান কখন কোথায় আছে তা জানার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।

–হ্যাঁ, আপনার দাবি আমি সমর্থন করছি, বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন মিসেস ওরুরকি, আপনার কাছ থেকে খবর বার করে নেওয়া কারো সাধ্য হবে না তা আমরা জানি।

–কিন্তু ওই চিঠি তো বেহাত হতে পারে। ব্লেচলি বলার চেষ্টা করলেন।

–অসাবধানে চিঠি ফেলে রাখলে তো বেহাত হবে, বলল টুপেনস, এগুলো সব সময়েই তালাবন্ধ অবস্থায় রাখি।

মেজর ব্লেচলি তবুও গজগজ করতে থাকেন।

.

টুপেনসের কাজ চলছে চক্রবৎ। চিঠি পড়ছে, নিজে চিঠি লিখছে, তারপর সেগুলো গোয়েন্দা দপ্তরের সংগৃহীত বিদেশী খামে ভরে সান্স সৌচির ঠিকানায় পোস্ট করা–আবার চিঠি পড়া…

সেই চক্রবৎ নিয়মেই একটা চিঠি ডাকঘরে ফেলে দিয়ে হালকা মনে সান্স সৌচিতে ফিরছে টুপেনস।

গেটের কাছাকাছি এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অদূরে দাঁড়িয়ে মূর্তি-কার্ল ভন দিনিম আর সেই মধ্যবয়স্কা মহিলা

এক মিনিট দাঁড়িয়ে তাদের নিরীক্ষণ করল টুপেনস। দিনিম ঘাড় ঘোরালে…টুপেনসের ওপর দৃষ্টি পড়তেই দুই মূর্তি সরে দাঁড়াল।

অপরিচিত মহিলাটি ক্ষিপ্রগতিতে রাস্তায় নেমে অন্য পাড় ধরে টুপেনসকে অতিক্রম করে চলে গেল।

টুপেনস তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারল না।

দিনিম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মোলায়েম স্বরে বলল, সুপ্রভাত।

-ওই মাঝবয়সি মহিলাটিকে, আপনি যে কথা বলছিলেন? টুপেনস সরাসরি জানতে চাইল।

-উনি একজন পোলিশ মহিলা।

–আপনার বান্ধবী?

কঠিন স্বরে জবাব দিল দিনিম, না, না, বান্ধবী কেন, এর আগে তাকে কখনও দেখিনি।

–তাই বুঝি।

–ভদ্রমহিলা এ জায়গা সম্বন্ধে জানতে চাইছিলেন।

পথ ভুল করেছিলেন বোধ হয়? সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করল টুপেনস।

-না, উনি জানতে চাইছিলেন মিসেস গেটানির নামে কাউকে চিনি কিনা।

–ও। টুপেনস গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। কিন্তু চোখের কোণে দিনিমের মুখভাব দেখে নিল।

দু-জনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। টুপেনসের মাথায় ঘুরছে দুটি নাম–মিঃ রোসেনস্টাইন …মিসেস গেটানির…নামের রহস্যময়তা।

কিন্তু মহিলা কি দিনিমের কাছেই আসে? না অন্য কোনো উদ্দেশ্য?

টুপেনস ভাবতে থাকে, শীলাকে বলতে শুনেছিল–খুব সাবধানে থেকো। এরা দুজন নাৎসী এজেন্ট নয় তো? কিন্তু টমি বলেছিল শীলা জার্মান স্পাই নয়। সে তত ভুলও করতে পারে।

টুপেনস তার সামনে সন্দেহভাজন তিনজনকে দেখতে পাছে–কার্ল, শীলা আর মিসেস পেরিনা। এদের সম্পর্কে আরও বেশি সজাগ থাকবে সে।

.

সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়েছে অনেকক্ষণ। ইতিমধ্যেই অনেকে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছে। টুপেনসও তার ঘরের দরজা বন্ধ করে একটি বিশেষ পরীক্ষার কাজে রত হল।

ড্রয়ার টেনে ছোট্ট একটা জাপানি বাক্স বের করে আনল। বাক্সের গায়ে পলকা তালা ঝুলছে। তালা সরিয়ে বাক্স খুলতেই ভেতরে দেখা গেল একগুচ্ছ চিঠি বাণ্ডিল করা।

ওপরের চিঠিটা আজই সকালে এসেছে। টুপেনস সতর্কভাবে চিঠির ভাজ খুলল।

তার চোখের দৃষ্টি ঝলসে উঠল…ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। সকালে এই চিঠির ওপরেই চোখের ভুরু থেকে একটা চুল ছিঁড়ে আটকে রেখেছিল, সেই চুলটা এখন অদৃশ্য।

বাক্সটা হাতে করে হাত ধোবার বেসিনের কাছে এগিয়ে যায় টুপেনস। Grey powder রাখা আছে একটা বোতলে। সামান্য পরিমাণ পাউডার চিঠির ওপর ঢেলে দিল। কিছুটা ছড়িয়ে দিল জাপানি বাক্সটার ওপর।

বস্তুটার রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে টুপেনস আশ্বস্ত হল-চিঠি বা বাক্স কোথাও কোনো আঙুলের ছাপের চিহ্ন নেই। এই বাক্স থেকে যে চিঠিটা নাড়াচাড়া করেছে সে অতিশয় সাবধানী–হাতে গ্লাভস ব্যবহার করেছে।

টুপেনস ভাবনায় পড়ল লোকটি কে হতে পারে? মিসেস পেরিনা নয় তো? না কি শীলা? অন্য কেউও হতে পারে, যার সন্ধান এখনও সে জানে না। পুরুষ বা মহিলা যে কেউ একজন যে চিঠিগুলো নাড়াচাড়া করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

উদ্দেশ্য?

ব্রিটিশবাহিনীর গতিবিধির হদিস জানা।

.

দুপুরে নিজের বিছানায় শুয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে আছে টুপেনস। এমন সময় টলমল পায়ে ঘরে ঢুকল ছোট্ট বেটি। টুপেনসকে খুব পছন্দ মেয়েটির। তাকে দেখলেই তার উচ্ছ্বাস বেড়ে ওঠে।

ঘরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে বেটি–এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকে।

টুপেনস মাথা ঝুঁকিয়ে ছড়া কাটতে থাকে–

ওরে বোকা চললে কোথা
সর ওপাশে সর–
উঁচু নিচু ধাপ পেরিয়ে।
ঢুকলে রানির ঘর।

ছড়া শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল বেটি। টুপেনস তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আবোলতাবোল বকল। তারপর আবার নিজের চিন্তায় ডুবে গেল।

বোর্ডিং হাউসে অনেক মুখ। কিন্তু কোনো মুখ সনাক্ত করতে পারছে না সে। কে হতে পারে? যেই হোক, তাকে আবার ঘরের ভেতরে টেনে আনার ফঁদ পাততে হবে। কিছু বুঝতে দেওয়া চলবে না।

টুপেনসের চিন্তায় ছেদ পড়ল-মিসেস ম্প্রট হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন।

–বেটি এখানে–ওমা…দেখ কি শুরু করেছে–কখন বেরিয়ে এসেছে একদম টের পাইনি। মিসেস ব্লেনকিনসপ, দেখুন কি সর্বনাশ করেছে–ছিঃ ছিঃ…আমি ভীষণ দুঃখিত।

টুপেনস উঠে বসল। বেটির কীর্তি চোখে পড়ল তার। উল লেস সব এক জায়গায় করে একটা জলের পাত্রে ফেলে ঘোরাচ্ছে আর নিজের মনে হাসছে।

হেসে উঠল টুপেনস।

-দেখুন কেমন মজা করছে। আপনি ভাববেন না মিসেস ট–ওতে কিছু হবে না। চুপচাপ ছিল বলে আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম।

ওর চুপ করে থাকাটাই তো ভয়ের। কখন কি করে বসবে–আমি আজই আপনার জন্য কিছু উল কিনে আনব।

–আপনি ব্যস্ত হবেন না, মিসেস স্প্রট, ওগুলো শুকিয়ে নিলেই হবে।

বেটিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস স্প্রট।

.

-এর মধ্যেই আছে?

টুপেনসের বাড়িয়ে দেওয়া প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সতর্কস্বরে বলে উঠল টমি।

–হ্যাঁ, সাবধানে ধর। নিজের গায়ে ঢেলে দিয়ো না আবার।

প্যাকেটটা নাকের কাছে এগিয়ে নিয়ে চোখ কুঁচকে বলল টমি–ভয়ঙ্কর পচা গন্ধ-বস্তুটা কী?

–পচা হিং।

টুপেনসের কাছ থেকে টমি প্যাকেটটা নেবার পর সান্স সৌচিতে পর পর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল।

প্রথম ঘটনা মিঃ মিয়াদোর ঘর বদল।

বেচারা নিতান্তই শান্তশিষ্ট মানুষ। অকারণে অভিযোগ তোলার মতো স্বভাব নয় তার। কিন্তু তীব্র গন্ধে টিকতে না পেরে মিসেস পেরিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছেন।

মিঃ মিয়াদোর ঘরে উগ্র কটু গন্ধটা অস্বীকার করতে পারলেন না মিসেস পেরিনা। গ্যাসের লাইন লিক হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হল। কিন্তু কোনো গোলমাল ধরা পড়ল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করা হল, ঘরে কোথাও নেংটি ইঁদুর মরে পচে আছে।

টমি বলল, এই ঘরে রাত্রে শোওয়া অসম্ভব। বিকল্প একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।

মিসেস পেরিনা বললেন, একটা ঘর আছে বটে তবে সেটা এমন ভোলামেলা নয়। মিঃ মিয়াদো সম্মত হলে সেটা খুলে দিতে পারেন।

মিঃ মিয়াদো আপত্তি করলেন না। গন্ধের হাত থেকে মুক্তি পেতে উদগ্রীব তিনি। তার জন্য যে ঘরটি বন্দোবস্ত করা হল তার মুখোমুখিই রয়েছে মিসেস ব্লেনকিনসপের ঘর।

প্রথম ঘটনার সূত্রেই দ্বিতীয় ঘটনার উদ্ভব।

মিঃ মিয়াদো তার নতুন ঘরে আশ্রয় নেবার পরেই চোখ নাক ও গলার রোগে আক্রান্ত হলেন। চোখ নাক থেকে অনর্গল জল গড়াচ্ছে।

আকস্মিক আক্রমণটা অতি দ্রুত তীব্র হয়ে উঠল এবং মিঃ মিয়াদো রীতিমত শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। প্রাতঃরাশ সারবার জন্য নিচে যাবার ক্ষমতা রইল না তার।

সেদিন সকালেই মিসেস ব্লেনকিনসপ তার ছেলে ডগলাসের কাছ থেকে চিঠি পেলেন। রীতিমত হৈচৈ জুড়ে দিল টুপেনস–সবাই জেনে গেল সৈনিক ছেলের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পেয়েছেন মিসেস ব্লেনকিনসপ।

এবারে চিঠিটা সামরিক বিভাগের নজরে পড়েনি–সেন্সরড হয়নি–সেকারণেই চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ।

ডগলাসের এক বন্ধু ছুটিতে এসেছে, সেই চিঠিখানা হাতে করে নিয়ে এসেছে। এইবারেই প্রথম সরাসরি মাকে নিজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ডগলাস।

টুপেনস গলার স্বর চড়িয়ে ঘোষণা করল, এই চিঠিটা পড়েই বুঝতে পারছি, যা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে আমরা কত কম জানি।

প্রাতরাশের টেবিলে এইভাবে হৈচৈ বাঁধানোর পরে নিজের ঘরে এসে জাপানি বাক্সটার ভেতরে চিঠিটা রেখে দিল টুপেনস। তারপর চিঠির ভাঁজের ওপরে ছড়িয়ে দিল অদৃশ্য রাসায়নিক গুড়ো।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে টুপেনস শুনতে পেল মিঃ মিয়াদোর ঘর থেকে তার কাশি ও গোঙানি শোনা যাচ্ছে।

চকিতে তার মুখে হাসির রেখা খেলে যায়। কোনো দিকে নজর না দিয়ে সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।

সকলকে আগেই সে শুনিয়ে রেখেছে তার উকিলের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সে এ বেলা লন্ডন যাচ্ছে। সেই সুবাদে সান্স সৌচির বাসিন্দাদের অনেকেই কিছু কেনাকাটার দায়িত্ব দিয়েছে তাকে। অবশ্য টুপেনস গেয়ে রেখেছে, তার দরকারি কাজ সেরে সময় পেলেই ওসব করবে সে।

মিসেস স্প্রট বিদায় জানাল টুপেনসকে। ছোট্ট বেটির গাল টিপে আদর করল সে। বলল, ছোট্ট সোনা, তোমার জন্য লন্ডন থেকে রঙিন চকখড়ি নিয়ে আসব।

বাগান পার হয়ে রাস্তার দিকে যেতে গিয়ে আচমকা মোড় ঘুরে টুপেনস বাগানের কোণে চলে এলো। ওখানে কার্ল ভন দিনিম পাঁচিলে হেলান দিয়ে আপন মনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে মৃদু উত্তেজনার ছায়া।

টুপেনস কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, এখানে একা, কি ব্যাপার? কিছু ঘটেছে?

ক্ষোভে ফেটে পড়ল দিনিম, কী আবার, যা ঘটবার তাই ঘটছে।

টুপেনস তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তুলে ধরে।

-ওসব নিন্দা কটুক্তি আর সহ্য করতে পারছি না, বলল দিনিম, সব কিছুরই এবার একটা হেস্তনেস্ত করব।

হয়েছে কী বলবেন তো।

-এতগুলো মানুষের মধ্যে কেবল যা আপনিই আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করেন। আপনি হয়তো আমার মর্মর্যাতনা কিছুটা বুঝতে পারেন…দেশে আমার ঠাই হয়নি-নাৎসীদের অন্যায় নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশত্যাগী হতে হয়েছে। নাৎসী জার্মানিকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।

ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারব বলে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে জার্মান পরিচয়টাকেই সকলে বড়ো করে দেখছে।

–হ্যাঁ, আপনার অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারি। সহানুভূতির স্বরে বলল টুপেনস।

–সামান্য অসুবিধা আমি মানিয়ে নিতে জানি। কিন্তু ওখানেই তো শেষ হচ্ছে না। আমি একজন জার্মান–আপনার কাছে আমি স্বীকার করেছি। খবরের কাগজে যখন চোখে পড়ে জার্মান সৈন্যরা অকাতরে দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, একটার পর একটা জার্মান প্লেন গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, শহরের পর শহর বোমা বিধ্বস্ত হচ্ছে–মনের অবস্থা কেমন হয় বলুন। তার ওপর যখন ওই বুড়ো মেজর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জার্মান উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্যে গালাগালি ছুঁড়তে থাকেন আমি পাগল হয়ে যাই। বিশ্বাস করুন, আমি সইতে পারছি না–এসবের সমূহ অবসান আমি চাই।

দিনিমের উত্তেজিত মমর্যাতনাক্লিষ্ট রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। সে তার হাত চেপে ধরে বলে, আপনি শান্ত হোন। ধৈর্য ধরুন। এরকম মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন না। দোহাই।

-ইংরেজের জেলখানায় থাকলে তবুও অনেকটা স্বস্তি পাব আমি। পুলিশ আমাকে কয়েদ করলে খুশি হব।

–আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছেন, তার কথা ভাবুন–বাকি সব কিছু তার কাছে তুচ্ছ। আমি শুনেছি, বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার উপায় খোঁজার জন্য আপনি গবেষণা করছেন। এ তো কেবল ইংলন্ডের নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণকর এই কাজ।

টুপেনসের কথায় দিনিমের উত্তেজনা যেন অনেকটাই প্রশমিত হয়। তার চোখের তারা বাঁকা হয়ে ঘুরে যায়।

-হ্যাঁ, ইতিমধ্যেই অনেকটা সাফল্য অর্জন করেছি গবেষণায়। জিনিসটা প্রস্তুত করা এমন কিছু কঠিন হবে না, ব্যবহারও করা চলবে সহজে।

-তাহলে, ভাবুন তো একবার, কতবড় মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন আপনি। তাই বলি, শান্ত হোন। আমি নিজে জার্মান বিরোধী। তবু বলছি, এমন অনেক দয়ালু জার্মানকে আমি জানি, যাদের শ্রদ্ধা না করে আমি পারি না।

এখানে যেমন আমি রয়েছি, তেমনি মেজর ব্রেচলির মতো মানুষরাও রয়েছে। জার্মানিতেও তাই। এদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

কার্ল ভন দিনিম মাথা ঝুঁকিয়ে টুপেনসের হস্ত চুম্বন করে। বলে, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব…আপনার কথা বড়ো সুন্দর…আমি মনে অনেক জোর পেলাম।

টুপেনস বিদায় নিয়ে পথে এসে নামে। চলতে চলতে ভাবতে থাকে দিনিম এমন কর্তব্যপরায়ণ ও সৎ হওয়া সত্ত্বেও কেবল জার্মান পরিচয়ের জন্য কী নিদারুণ মর্ম নিপীড়ন সহ্য করছে। আরও দুর্ভাগ্য যে এখানে এই মানুষটাকেই সে সবচেয়ে পছন্দ করে।

.

কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও লন্ডনের একটা টিকিট না কেটে পারল না টুপেনস। লিহাম্পটনে থাকলে কখনও কারও চোখে পড়ে যেতে পারে।

সান্স সৌচির বাসিন্দাদের কে কখন কোথায় থাকে বলা যায় না। তাহলে তার গোটা পরিকল্পনাটাই ভণ্ডুল হবে।

টুপেনসের আশঙ্কাটা অচিরেই সত্য প্রমাণিত হল। শীলার সঙ্গে প্লাটফর্মে দেখা হয়ে গেল। একটা পার্শেলের খোঁজে নাকি বুকিং-এ এসেছিল, জানাল সে।

ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল টুপেনস। দেখতে পেল শীলা প্লাটফর্ম থেকে নেমে যাচ্ছে।

মেয়েটা এ সময় হঠাৎ করে স্টেশনে আসতে গেল কেন? সে কি তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে? না কি তাকে কেউ পাঠিয়েছিল, টুপেনস সত্যি সত্যি লন্ডনে যাচ্ছে কিনা দেখবার জন্য? এ-কাজ মিসেস পেরিনারই হওয়া সম্ভব।

.

সান্স সৌচির আওতার বাইরে নিরিবিলিতে দু-জনে পরদিন দেখা করল। টুপেনস বলল, আমার ঘরে কাকে ঢুকতে দেখেছিলে তুমি?

টমি হেসে উঠল। বলল, প্রথমে দেখলাম সেই ছোট্ট মেয়ে বেটিকে-হাতে একটা উলের গোলা।

তার পরে?

–কার্ল ভন দিনিম।

–সত্যি? চমকে উঠল টুপেনস, কখন ঢুকেছিল?

লাঞ্চের সময়। ডাইনিং রুম থেকে সবার আগে ওপরে উঠে আসে। দেখলাম চুপচাপ তোমার ঘরে ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট পনেরো ভেতরে ছিল।

টুপেনস চিন্তিতভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরল। যুবক দিনিম যে একজন দক্ষ অভিনেতা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ঘরে ঢোকার কোনো কারণ তো কার্লের নেই।

স্বদেশভূমি জার্মানির জন্যই দিনিমের এই গুপ্তচরবৃত্তি। নিঃসন্দেহে সে স্বদেশপ্রেমিক। সম্মানের যোগ্য। কিন্তু সে বিপজ্জনকও বটে। আর সেকারণেই তাকে ধ্বংস করা দরকার।

–খুবই দুঃখের ব্যাপার। চাপাস্বরে বলল টুপেনস। কিন্তু জার্মানিতে থাকলে আমরাও এ কাজই করতাম।

–যথার্থ বলেছ। স্বীকার করল টমি।

-যাইহোক, একটা দিকে পরিষ্কার হওয়া গেল, বলল টুপেনস, মিসেস পেরিনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিনিম আর শীলা কাজ করে চলেছে।

নেতৃত্বে রয়েছে মিসেস পেরিনা। আরও একজন আছে–এক অপরিচিতা বিদেশিনী মহিলা মাঝে মাঝে নিঃশব্দে এখানে আসে। তার সঙ্গে দিনিমকে কথা বলতে দেখেছি আমি।

-তাহলে এখন কি ভাবে এগুতে হবে বল।

-এখন আমাদের লক্ষ মিসেস পেরিনা। সুযোগ বুঝে তার ঘরে ঢুকতে হবে। নথিপত্র যদি কিছু পাওয়া যায়। তাছাড়া তার গতিবিধির ওপরেও কড়া নজর রাখা দরকার। আর যে মহিলার কথা বললাম, তিনি পোলিশ, তাকেও খুঁজে বার করতে হবে।

এই মিশনের সঙ্গে যোগাযোগটা সেই রাখছে মনে হচ্ছে। গোটা দলটাকেই তাহলে বাগে পাওয়া যাবে।

–ঠিক বলেছ। আবার কখন আসে নজর রাখতে হবে। গোপনে পেছন নিয়ে আস্তানাটা দেখে আসতে হবে।

জার্মান যুবক দিনিমের ঘরেও একবার হানা দেওয়া দরকার মনে হয়। বলল টুপেনস।

–তার ঘরে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ভালোভাবেই জানে যে কোনো মুহূর্তে পুলিশের নজর তার ওপরে পড়তে পারে। কাজেই হাতের কাছে কোনো প্রমাণ ফেলে রাখবে না। মিসেস পেরিনার ঘরে ঢোকাও কষ্টকর হবে।

-কেন?

–তারা মা মেয়ে খুবই সতর্ক। মিসেস পেরিনা যখন থাকেন না, তখন শীলা থাকে। তারপর বেটি তো সারাক্ষণই গোটা বারান্দায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার পেছনে থাকে মিসেস স্প্রট।

লাঞ্চের সময়েই সুযোগটা নিতে হবে। বলে টুপেনস।

–দিনিমের ঘরেও?

-হ্যাঁ। চুপি চুপি ওপরে উঠে আসব। পরে নেমে গিয়ে বলব, তীব্র মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে উঠে গিয়েছিলাম।

–তাহলে আর রোগ ধরে রাখি কেন? সারিয়ে তোলাই ভালো–কাজ তো মিটে গেল।

-হ্যাঁ, এবারে ভালো হয়ে যাও। আমি তো ওপরে গিয়ে এঘর ওঘরে অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট খুঁজে বেড়াব, ধরা পড়ে গেলে ওই কথাই বলব,-সেই সময় ওপরে কোনো ভদ্রলোকের উপস্থিতি সন্দেহজনক মনে হতে পারে।

-তোমার বুদ্ধির তুলনা হয় না। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল টমি।

.

যথাসময়ে টমি মিঃ গ্রান্টকে দিনিম সম্পর্কে তার নিশ্চিত ধারণার কথা জানিয়ে দিল। মিঃ অ্যালবার্টের নামেও একটা চিঠি ডাকে ছেড়ে দিল।

ফেরার পথে কমাণ্ডার হেডকের সঙ্গে দেখা হল। নিজের টুসিটার নিয়ে বেরিয়েছিলেন হেডক। টমিকে সাগ্রহে গাড়িতে তুলে নিলেন। তারপর দুজনে একসঙ্গে ফিরে এলেন স্মাগলার্স রেস্ট-এ।

দুপুর দুটো নাগাদ সান্স সৌচিতে পৌঁছল টুপেনস। বাগান পার হয়ে হলঘরে ঢুকল। শব্দ শুনে বুঝতে পারল, ডাইনিং রুমে সকলে ভোজনে ব্যস্ত।

জুতো খুলে হাতে নিল টুপেনস। তারপর নিঃশব্দে অথচ দ্রুত ওপরে উঠে এল। সরাসরি এসে ঢুকল নিজের ঘরে। জুতো রেখে নরম স্লিপার পায়ে গলালো।

ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে হাঁটতে লাগল…ওর মধ্যেই একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল মিসেস পেরিনার ঘরে।

.

বুকে হাত চেপে ধরল টুপেনস। ঘরে ঢুকে ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। মিসেস পেরিনা তো সাধারণ একজন মহিলা মাত্র নন…সেকারণেই এই শঙ্কা আর ভয়।

নিঃশব্দে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল টুপেনস।

ড্রয়ার টেনে পলকে সবকিছু দেখে নিল।

লেখার টেবিলে একটা ড্রয়ার টেনে খোলা গেল না। চাবি লাগানো।

আশান্বিত হয়ে উঠল টুপেনস। তাহলে এর মধ্যেই নিশ্চয় রয়েছে সব কিছু।

তালা বা বন্ধ ড্রয়ার খুলবার প্রয়োজনীয় কয়েকটা যন্ত্র সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল টুপেনস। সেগুলো এবারে কাজে লাগল।

সামান্য চেষ্টাতেই ড্রয়ারটা খুলে গেল।

ভেতরে পাওয়া গেল একটা ক্যাস বাক্স, কুড়ি ডলারের মতো খুচরো টাকা রয়েছে তাতে। সাগ্রহে একটা কাগজের বাণ্ডিল তুলে নিল হাতে। দ্রুত কাগজগুলোর ওপর চোখ বোলাতে লাগল। কিন্তু হতাশই হল।

কয়েকটা চিঠি, সান্স সৌচির মর্টগেজ ফর্ম, ইত্যাদি।

এর মধ্যে রহস্য কিছু পাওয়া গেল না। চিঠিগুলোও নির্দোষ।

সহসা ষষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ করে তুলল টুপেনসকে, এক ঝটকায় ড্রয়ারটা ঠেলে বন্ধ করে দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার সামনে মিসেস পেরিনা আবির্ভূত হলেন।

পলকের মধ্যে বেসিনের কাছে সরে গেল টুপেনস। তাকের শিশি-বোতল নাড়াচাড়া করতে লাগল।

ঘাড় ঘুরিয়ে মিসেস পেরিনাকে দেখে ক্লিষ্ট হেসে বলল, মিসেস পেরিনা, মাফ করবেন, একটা অ্যাসপিরিনের খোঁজে আপনার ঘরেই ঢুকে পড়েছি। অসহ্য যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আশাকরি কিছু মনে করবেন না। অ্যাসপিরিন তো সবসময়ই আপনার ঘরে থাকে জানি…

মিসেস পেরিনা ব্যস্তভাবে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলেন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, আপনি কষ্ট পাচ্ছেন আগে আমায় বলেননি কেন?

-বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম আপনারা সকলে খাবার টেবিলে বসে আছেন, তাই আর…

ক্ষিপ্র হাতে শিশি থেকে কতগুলি অ্যাসপিরিন বড়ি বার করে টুপেনসকে দিলেন মিসেস পেরিনা।

–যে কটা দরকার নিন।

টুপেনস তিনটা বড়ি তুলে নিল। তার আঙুল কাঁপছিল। মাথাযন্ত্রণার তীব্র কষ্টে এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

টুপেনসকে তার ঘরে পৌঁছে দিলেন মিসেস পেরিনা। চকিতে ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আপনার ঘরেই তো অ্যাসপিরিনের শিশি ছিল। আমি জানি।

-হ্যাঁ, আমার কাছে আছে, এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগল টুপেনস, কিন্তু কোথায় যে রেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।

–ঠিক আছে, এখন বিশ্রাম নিন। দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস পেরিনা। এতক্ষণে যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ পেল টুপেনস। টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

ভদ্রমহিলার ব্যবহারে তার মনোভাব কিছুই বোঝা গেল না। কিছু কি সন্দেহ করতে পেরেছেন? কিন্তু যখন দেখবেন লেখার টেবিলের ড্রয়ার খোলা, তখন তো তার মনে সন্দেহ উঁকি দেবে?

নাকি ভাববেন, নিজেই ড্রয়ার বন্ধ করতে ভুলে গেছেন। এমন ভুল তো সকলের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

টুপেনস মনে করার চেষ্টা করল, বাণ্ডিলের কাগজগুলো আগের মতো ঠিক ঠিক সাজিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা।

টুপেনস তার শোবার ঘরে চুপি চুপি উপস্থিত হয়েছে দেখে আর কি সন্দেহ করতে পারেন মিসেস পেরিনা? হয়তো ভাববেন মিসে ব্লেনকিনসপ বড় বেশি কৌতূহলী?

কিন্তু মিসেস পেরিনা যদি সত্যি সত্যি জার্মান গুপ্তচর হন? তাহলে এই ব্যাপারটাকে কখনওই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবেন না। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবেন।

কিন্তু তেমন হলে তো তার কথায় বা ব্যবহারে প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ত। তাকে দেখে যথেষ্টই স্বাভাবিক মনে হয়েছে।…

হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা কথা মাথায় খেলে গেল টুপেনসের। উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসল সে। তার নিজের অ্যাসপিরিনের শিশি এই ঘরে টেবিলের পেছনে রাখা হয়েছে। আইডিন, সোডার বোতল এসবও রয়েছে সেখানে।

মিসেস পেরিনা ওসবের হদিশ জানলেন কী করে? অ্যাসপিরিন সম্পর্কে তার শেষ তীক্ষ্ণ মন্তব্যটা তো নিরর্থক নয়। তাহলে…তাহলে…যে কাজটা এখন টুপেনস করতে চেয়েছে, অনেক আগেই তা সেরে নিয়েছেন ভদ্রমহিলা।

চুপি চুপি টুপেনসের ঘরে ঢুকে সবই হাতিয়ে দেখে নিয়েছেন।

.

বেটিকে দেখাশোনার দায়িত্ব টুপেনসের কাঁধে চাপিয়ে পরদিন সকালেই লন্ডন গেলেন মিসেস স্প্রট। তাই সারা সকালটা তাকে নিয়েই কাটল।

ইতিমধ্যেই বেটির আধোআধো কথা অনেকটাই সড়গড় হয়েছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে।

বেটিকে নিয়ে মিসেস স্প্রটের ঘরে ঢোকে টুপেনস। একটা একটা করে ছবির বই দেখায়। কিন্তু পুরোনো বই একদম পছন্দ করে না বেটি। নোংরা বই বলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

মিসেস ওরুরকি নিজের ঘর ছেড়ে একদম বেরোন না। লাঞ্চের পর বেটিকে ঘুম পাড়িয়ে উঠতেই মিসেস ওরুরকির ডাক পেল টুপেনস।

ভদ্রমহিলা তার ঘরে নাতি-নাতনি আত্মীয়-স্বজনের একরাশ ছবি টেবিলে ছড়িয়ে নিয়ে বসেছিলেন।

ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময়ের স্বরে টুপেনস একথা-সেকথায় কিছু সময় কাটাল। তারপরেই আচমকা একটা প্রশ্ন শুনে প্রবলভাবে চমকে উঠল।

–এবারে বলুন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, সান্স সৌচি সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

চোখ তুলে তাকাল টুপেনস। কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটার জবাব দেবে ভেবে পেল না।

মিসেস ওরুরকি নিজেই তাকে সঙ্কটমুক্ত করলেন। বলে উঠলেন, আমি জানতে চাইছি, এখানে খারাপ কিছু আপনার নজরে পড়েছে?

এবারে একটা সূত্র পেয়ে গেল জবাব দেবার। তাই টুপেনস বলল, খারাপ কিছু? তেমন কিছুর আভাস তো পাইনি।

–মিসেস পেরিনা সম্পর্কে নয়? ওর সম্পর্কে আপনার কৌতূহল আমি লক্ষ্য করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি তাকে সর্বদা অনুসরণ করেন।

সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল টুপেনসের। এমনভাবে ধরা পড়ে যাবে আগে ভাবতে পারেনি। কোনোরকমে সামলে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, উনি এক বিচিত্র মহিলা।

-বিচিত্র মোটেই নন, বললেন মিসেস ওরুরকি, আপাতদৃষ্টিতে নেহাত সাধারণ মহিলা বলেই মনে হবে। কিন্তু আমার ধারণা তিনি তা নন। আপনার ধারণা কী?

-আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন আমি ধরতে পারছি না। বলল টুপেনস।

-এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর করেছি–সবই রহস্যময় চরিত্র। মিয়াদোকে খেয়াল করেছেন কখনও।

সাদামাটা এক ইংরেজ ভদ্রলোক বলেই মনে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার কথায় অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ধরা পড়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয় না আপনার?

-ঠিকই বলেছেন, বলে উঠল টুপেনস, ভদ্রলোক এক অদ্ভুত মানুষ।

–অদ্ভুত একা তিনিই নন, সকলেই। টুপেনসের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসতে লাগলেন মিসেস ওরুকি।

একটা দুর্বোধ্য অসহায়তা ক্রমশ গ্রাস করছিল টুপেনসকে। মিসেস ওরুরকির মুখের দিকে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল।

ধীর পায়ে সে জানালার দিকে সরে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার।

জানালাপথে নিচের বাগানে তাকাল টুপেনস। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতার জল ঝরছে টুপটাপ শব্দে।

হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় টুপেনসের। একটা মুখ–সেই বিদেশিনী মহিলার, যে গতকাল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দিনিমের সঙ্গে কথা বলছিল।

…সহসা একদিকের ঝোপ সরিয়ে এই বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে।

টুপেনসের সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, সান্স সৌচির একটা জানালার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে কিছু দেখার প্রত্যাশা করছে। নিষ্পলক দুটি চোখে যেন আকুতি মাখানো, মনে হল টুপেনসের।

চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে মিসেস ওরুরকির দিকে তাকাল। অস্ফুট স্বরে কিছু বলবার চেষ্টা করল।

পরক্ষণেই ক্ষিপ্রবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বারান্দা পার হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে নিচে নেমে এলো।

ঝড়ের বেগে হলঘর পার হয়ে বৃষ্টিভেজা বাগানে নেমে থামল।

একমুহূর্তের বিরতি নিল। আবার ছুটল বাগানের সেই কোণের দিকে, যেখানে সেই বিদেশিনীকে কিছুক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।

কিন্তু কাউকে পেল না টুপেনস। কোথাও নেই সেই মহিলা। এপাশ-ওপাশ ঘুরে খুঁজল সে-কিন্তু আশ্চর্য, ভোজবাজির মতো যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই মূর্তি।

টুপেনস দৌড়ে বাগান পার হয়ে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত ছুটে গেল। কিন্তু জনহীন উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো মানুষের ছায়া পড়ল না।

কোথাও নেই সেই বিদেশিনী মূর্তি। কিন্তু টুপেনসের তো দেখায় কোনো ভুল ছিল না। কোনো মতেই না। স্পষ্ট দেখেছে সেই মুখ। কিন্তু পলকের মধ্যে এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে?

হতাশ বিভ্রান্ত টুপেনস সান্স সৌচির দিকে ফিরে চলল।

টুপেন্সের বুকে সন্দেহ আর ভয় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ঘুণাক্ষরেও যদি সে জানতে পেত, কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটতে চলেছে।

কিন্তু জানার উপায় ছিল না তার, কারুরই তা ছিল না।

সমস্যা পাকিয়ে উঠেছে বেটি, স্প্রটকে নিয়ে।

ক্লে দম্পতি অভিযোগ তুলেছেন তার বিরুদ্ধে।

আর তা নিয়ে আলোচনার জন্য সান্স সৌচির বাসিন্দারা মিলিত হয়েছেন মিসেস পেরিনার ঘরে।

মিঃ ক্লে অসুস্থ মানুষ।কিছুতেই ঘুম আসে না চোখে। কখনও সখনো যদি বা একটু ঝিমুনি আসে তা ভেঙ্গে যায় বেটির দাপাদাপিতে।

ছোট্ট বেটির বিরুদ্ধে মিঃ ক্লের এই অভিযোগের জবাবে মিসেস ব্লেনকিনসপ বললেন, ছোট্ট বেটির এখন তিন বছর বয়স পার হয়নি। ওরকম একটা শিশুর বিরুদ্ধে হইচই করে ঘুম নষ্ট করার অভিযোগ হাস্যকর বললেও কমই বলা হয়।

মিষ্টি মেয়েটা আছে বলে সান্স সৌচি আমাদের সকলের কাছেই আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

টুপেনসের ওই জবাবেই আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। সকলেই মূল বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যুদ্ধের বিষয় নিয়েই কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন।

সুযোগ পেয়ে মিঃ ক্লে নিজেও জার্মানদের বিরুদ্ধে অনর্গল বিষোগার করতে লাগলেন।

মিসেস পেরিনার ঘরে আলোচনা যখন জমে উঠেছে, ঠিক সেই সময় মিসেস ক্লে এসে ঘরে ঢুকলেন।

বেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। তারপর পরপর কয়েক কাপ কফি খেলেন আর তার লন্ডন ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা সকলকে শোনাতে লাগলেন।

এরপর সকলে উঠে হলঘরে গিয়ে বসলেন। বেটি নিজের মনে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। একসময় সে সকলের অলক্ষে বাগানে নেমে গেল।…

রাত সাতটার আগে বেটির কথা মনে পড়ে না মিসেস স্প্রটের। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

-সর্বনাশ, বেটির ঘুমোবার সময় হয়ে এল যে, বেটি–বেটি–

সকলেই দেখেছিলেন কিছুক্ষণ আগেও বেটি আশপাশে খেলা করছে। এখন কোথায় গেল? মিসেস স্প্রট গোটা হলঘর চক্কর দিতে দিতে বেটির নাম ধরে ডাকতে থাকেন। কিন্তু বেটির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

এবার সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেটির অনুসন্ধানে নেমে পড়েন।

সান্স সৌচির বিভিন্ন ঘর, রান্নাঘর, বাগান–কোথাও খোঁজা বাকি থাকে না।

–বেটি-ই-ই

অস্থির হয়ে চিৎকার করে ওঠেন মিসেস স্প্রট।

কে একজন বললেন, রাস্তার দিকে যায়নি তো?

অমনি টুপেনস আর মিসেস স্প্রট ছুটে পথে নেমে এলেন।

কিন্তু এখানেও নেই বেটি। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথের যতদূর দৃষ্টি যায়, কেউ নেই। কেবল দেখা গেল স্থানীয় একটি পরিচারিকা এগিয়ে আসছে।

মিসেস স্প্রট ও টুপেনসের জিজ্ঞাসার জবাবে মেয়েটি বলল, একটা বাচ্চা মেয়ে তো, আমি প্রায় আধঘণ্টা আগে তাকে দেখেছি। সবুজ ফ্রক পরা।

মিসেস স্প্রট সাগ্রহে জানতে চান, সে কোথায়–কোনদিকে গেছে?

মেয়েটি বলে, দেখলাম ঢালু পথ ধরে একজন মহিলার হাত ধরে হাঁটছে।

–মহিলা! মিসেস স্প্রট অস্থিরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, কেমন দেখতে তাকে?

মেয়েটি জানায়, পোশাক দেখে মনে হল বিদেশী। চেহারাও যেন কেমন।

টুপেনসের মনে পড়ল, সান্স সৌচির বাগানে সে এক মহিলাকে উঁকি মারতে দেখেছিল, তারপর তাকে আর কোথাও খুঁজে পায়নি।

কিন্তু বেটি তার সঙ্গে যাবে কেন?

মিসেস স্প্রট আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না।

-আমার বেটি। কি হবে–তাকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। সেই মেয়েমানুষটাকে কি জিপসিদের মতো দেখতে?

মেয়েটি জবাব দেবার আগেই টুপেনস বলে উঠল, তাকে জিপসিদের মতো দেখতে নয় মোটেই–সুন্দর দেখতে নীল চোখ, এক মাথা চুল।

মিসেস স্প্রট কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে টুপেনসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। টুপেনস বলতে থাকে, আজই দুপুরে তাকে আমি বাগানের ঝোপে দেখেছি। আড়াল থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। আগে একদিন দেখেছিলাম, কার্ল ভন দিনিমের সঙ্গে কথা বলতে। একই লোক সন্দেহ নেই।

পরিচারিকাটি বলে উঠল, আপনি যেরকম বললেন, তেমনি দেখতে তাকে। মাথাভর্তি চুল, নীল চোখ। অদ্ভুত রকম ভাষায় কথা বলছিল।

নিশ্চয় কোনো জার্মান মহিলা। ওহ–আমার বেটিকে নির্ঘাত সে খুন করবে।

–অতটুকু মেয়েকে কে খুন করবে? ধমকে ওঠে টুপেনস, আপনি শান্ত হোন। চলুন ঘরে যাওয়া যাক, পুলিশে খবর দিতে হবে এখুনি–আমরা বেটিকে ঠিক ফিরে পাব।

৩. ক্ষীণ সন্দেহ

টুপেনসের মনে ক্ষীণ সন্দেহ জেগেছিল, কার্ল ভন দিনিম বেটির অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেল ঘটনার কথা শুনে সকলের মতো সে-ও হতচকিত।

মেজর ব্লেচলি এগিয়ে এসে মিসেস স্প্রটকে বললেন, আপনি শান্ত হয়ে বসুন। এক চুমুক ব্রাণ্ডি খেয়ে চাঙা হয়ে নিন, আমি এখুনি থানার সঙ্গে যোগাযোগ করছি।

মিসেস স্প্রট তাকে বাধা দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি ঘর থেকে আসছি–

কথা শেষ না করেই তিনি একছুটে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলেন। মিনিট দুই পরেই আবার তাকে সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল। লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছেন।

মেজর ব্লেচলি থানায় ফোন করবেন বলে সবে রিসিভার তুলেছিলেন। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরলেন মিসেস স্প্রট।

মেজর ব্লেচলিকে হকচকিয়ে দিয়ে এক ঝটকায় রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ফোন করবেন না–মেজর, পুলিশকে জানাবেন না

বলতে বলতে থপ করে একটা কুশনের ওপরে বসে পড়লেন। জ্ঞান হারালেন মিসেস স্প্রট।

সকলেই অস্থির হয়ে ছুটে এলেন তার কাছে। মিনিট দুই অচৈতন্য থাকার পর সংজ্ঞা ফিরে পেলেন মিসেস স্প্রট। মিসেস ক্লে ধরাধরি করে তাকে সোজা করে বসিয়ে দেন।

মিসেস স্প্রটের চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। কাঁপা হাতে একখণ্ড কাগজ তিনি এগিয়ে ধরেন।

–বেটিকে খোঁজার সময় মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, তখন দেখার সময় পাইনি। আমার সন্দেহ হতে ছুটে গেলাম এখন। একখণ্ড পাথর মুড়ে কেউ আমার জানালা গলে ছুঁড়ে দিয়েছিল সম্ভবত, লেখাটা পড়ে দেখুন

সকলেই এগিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টমি মিসেস ক্লের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখের সামনেই মেলে ধরল।

বড় বড় অক্ষরে লেখা চিরকুট। লেখার ধাঁচে বিদেশী ছাপ স্পষ্ট।

আপনার শিশুটি আমাদের কাছে নিরাপদেই থাকবে। অযথা পুলিশের কাছে গিয়ে আপনার সন্তানের প্রাণ বিপন্ন করবেন না। গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। পরে আমাদের নির্দেশ পাবেন, সেই মতো কাজ করবেন। অন্যথা করলে শিশুটি খুন হবে। ধন্যবাদ

চিঠির নিচে কোনো স্বাক্ষর নেই। কেবল আড়াআড়ি দুটো হাড়ের ওপর মানুষের খুলির ছবি আঁকা।

–বেটি–আমার বেটি–

থেকে থেকে কঁকিয়ে উঠছেন মিসেস স্প্রট। নানাজনে নানারকম মন্তব্য করতে লাগলেন। পরামর্শের গুঞ্জনও শোনা যেতে লাগল। সহসা জোরালো গলায় বলে উঠলেন মেজর ব্লেচলি, চুপ করুন তো সকলে। ওসব ছেলেমানুষি হুমকিতে ভয় পেলে চলে না। আমরা এখুনি পুলিশে ফোন করব।

বলতে বলতে সশব্দে রিসিভার তুলে নিলেন মেজর।

ভীত বিহ্বল মিসেস স্প্রট দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আগের মতোই বাধা দিলেন মেজরকে।

-না, টেলিফোন করবেন না, ওরা আমার মেয়েকে খুন করবে।

–বোকার মতো কথা বলবেন না, ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন মেজর, ওদের সে সাহস হবে না।

-না, আপনাকে ফোন করতে দেব না। এবারে স্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেল মিসেস স্প্রটের, আমি ওর মা, পুলিশকে কিছু বলতে হয় আমি বলব।

মিসেস স্প্রটের বক্তব্য অপমানকর হলেও মেজর গায়ে মাখলেন না। মিসেস স্প্রটকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

আপনি আপনার সন্তানের জন্য বিচলিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, এখনই আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।

টমি পাশে দাঁড়িয়েছিল। মেজর তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মিঃ মিয়াদো আপনার মতামত কী?

টমি ঘাড় নেড়ে নীরবে মেজরকে সমর্থন জানাল।

মিঃ ক্লেও একই মতামত ব্যক্ত করলেন, ঘটনাটা পুলিশকে জানানোই কর্তব্য।

-কিন্তু না-পুলিশে জানাবেন না–ওরা বেটিকে মেরে ফেলবে।

কথা শেষ করে কাতর দৃষ্টি মেলে মিসেস ক্লে তাকালেন টুপেনসের দিকে।

পরে মেজরকে বললেন, আপনি কেবল পুরুষদেরই মতামত নিচ্ছেন, মেয়েদের কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না।

সকলের দৃষ্টি পড়ে টুপেনসের ওপরে। সে মিনমিনে গলায় বলে, মিসেস স্প্রট ঠিক কথাই বলছেন।

মুখে একথা বললেও টুপেনস বুঝতে পারছিল এই মুহূর্তে পুলিশে খবর দেওয়াই কর্তব্য।

ঘরের অন্যান্য মহিলারাও টুপেনসের বক্তব্য সমর্থন করলেন।

মিসেস পেরিনা এতক্ষণ ছিলেন না। সেই মুহূর্তে এসে সবকিছু শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মন্তব্য করলেন, পুলিশ কি করবে, সব কাজেই ওরা সমান অপদার্থ। পারেন তো নিজেরাই বাচ্চাটাকে খুঁজে বার করুন।

মিসেস পেরিনার ব্যক্তিত্বই শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হল। বেটিকে খুঁজতে বেরোনোই সাব্যস্ত হল।

পরামর্শ চলল। টমি ও মেজর ব্লেচলির পরামর্শে স্মাগলার্স রেস্ট-এ কমাণ্ডার হেডককে খবর পাঠানো হল।

হেডকের একটা গাড়ি আছে। তার ওপর তিনি অভিজ্ঞ বলশালী মানুষ। তার সাহায্য সবদিক থেকেই কাজে লাগবে।

মিসেস স্প্রট বললেন, উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে আমিও থাকব।

.

বেটিকে খুঁজতে বেরবার জন্য তৈরি হলেন হেডক, মেজর ব্লেচলি এবং টমি। মহিলাদের মধ্যে মিসেস স্প্রটকে নিয়ে দুজন। অপরজন হল টুপেনস।

উদ্ধারকারী দলের নেতা হলেন হেডক। তারই ছোটো সাদা রং-এর গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে উঠে পড়লেন সকলে। পেছনে রইলেন মহিলারা। দলের মধ্যে একমাত্র টুপেনসই সেই বিদেশিনী মহিলাকে চেনে।

গাড়িতে ওঠার পরে আচমকা একটা ছোটো পিস্তল টমির চোখের সামনে তুলে ধরল। চমকে উঠে বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল টুপেনস।

–মেজর ব্লেচলির পিস্তল, চাপা স্বরে বললেন মিসেস স্প্রট, দরকার লাগতে পারে ভেবে ওর ঘরে ঢুকে নিয়ে এলাম।

এমন একটা অপ্রত্যাশিত সংবাদে অতিমাত্রায় বিস্মিত হল টুপেনস। অন্যের পিস্তল হাতিয়ে নিয়ে এসেছেন মহিলা এ একেবারে অকল্পনীয় ব্যাপার।

উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ ধরে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে কমাণ্ডার হেডকের গাড়ি। সোজা স্টেশনে এসে থামল। নানান জনকে জিজ্ঞেস করা হল।

বেঁটে মতন একটি লোকের কাছে কার্যকরী সংবাদ পাওয়া গেল। লোকটি নিজে থেকেই এগিয়ে এসে জানাল, আপনার একটা বাচ্চা মেয়েকে খুঁজছেন তো? কিছুক্ষণ আগে আমি তাকে দেখেছি, এরনেস ক্লিক রোডে একজন বিদেশিনী মহিলার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। বাচ্চাটার গায়ে ছিল সবুজ ফ্রক।

একেবারে নির্ভুল হদিশ। হেডক গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।

-কী রোড বললেন–এরেনস ক্লিক? কোনো দিক দিয়ে গেলে সুবিধা হবে বলুন তো।

বেঁটে লোকটি বলল, রাস্তাটা শহরের বিপরীত দিকে। এসপ্লানেড ধরে পুরোনো শহর পার হয়ে যেতে হবে। পাহাড়ি পথ ধরে সোজা ওপরে

লোকটির কথা শেষ হবার আগেই গাড়ি চলতে শুরু করল।

ঝড়ের গতিতে ছুটে কিছুক্ষণে মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেল এরনেস ক্লিক রোডের খাড়াই পথের প্রান্তে।

খাড়াই এবং সংকীর্ণ পথ হেডকের গতি রোধ করতে পারল না। অবিশ্বাস্য দক্ষতায় তিনি গাড়িটাকে তুলে নিয়ে এলেন এই পথের মাথায়।

এর পরেই শুরু হয়েছে ঢালুপথ। তার শেষ হয়েছে হোয়াইট হেভেন বেতে।

জায়গাটা আগাছা আর ঘাসে ঢাকা হলেও এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। বড় বড় পাথরের চাই আশপাশে থাকলেও দৃষ্টি বাধা পায় না।

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন ব্লেচলি। চারপাশে দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি বললেন, এই বিস্তীর্ণ এলাকায় মেয়েমানুষটাকে খুঁজে বার করা কষ্টকর হবে।

হেডক বললেন, কোনো দিকেই তো কিছু নজরে আসছে না।

গাড়িতে ফিরে গিয়ে একটা দূরবিন নিয়ে এলেন তিনি। সেটা চোখে লাগিয়ে চারপাশ জরিপ করতে শুরু করলেন।

দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একজায়গায় এসে স্থির হয়ে গেলেন। দূরে দুটো চলমান বিন্দু লেন্সে ধরা পড়ল

-ওই তো–দেখতে পেয়েছি–পরিষ্কার দেখাচ্ছে।

প্রবল উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন হেডক। অন্য সকলেও ছুটে এলেন। এরপর দক্ষ হেডকের গাড়ির শব্দে নিঝুম পাহাড়ি পথ জেগে উঠতে লাগল।

ঝড়ের গতি গাড়ির চলমান চাকায়। বহু দূরে প্রায়-অদৃশ্য চলমান বিন্দু দুটো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল।

হ্যাঁ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এবারে…এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা–তার হাত ধরে ছোট্ট বেটি হাঁটছে, কখনও লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

অনিবার্য উত্তেজনায় সকলের হাত থেকে থেকে মুঠি পাকাচ্ছে–দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে।

উত্তেজনা চাপতে না পেরেই সম্ভবত মিসেস স্প্রট আচমকা চিৎকার করে ওঠেন।

সেই চিৎকারের শব্দ কানে যেতেই সামনের স্ত্রীলোকটি আকৃষ্ট হয়ে পেছনে ঘাড় ঘোরালো।

ধাবমান গাড়িটিকে দেখতে পেয়েই মুহূর্তের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর একঝটকায় বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করল।

মেয়েমানুষটি বুদ্ধিমতী। সোজা ছুটল না। গাড়ি যাতে তাকে অনুসরণ করতে না পারে সেজন্য এঁকেবেঁকে ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের কাঁধের কাছে চলে যায়।

উন্মাদের মতো গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিসেস স্প্রট সামনে ছুটতে লাগলেন। অন্য সকলে ছুটতে লাগলেন তার পেছনে।

বেটিকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিদেশিনী। দুর্বোধ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে সক্রোধে।

–হুঁশিয়ার, পেছন থেকে চিৎকার করে ওঠেন হেডক, বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে ওই মেয়েছেলেটা

সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভয়ে উদ্বেগে জড়সড়। কী জানি কী হয়। সত্যি যদি মেয়েছেলেটা ভয় পেয়ে বেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

হেডক পকেট থেকে পিস্তল বের করে চিৎকার করে উঠলেন, বাচ্চাটাকে নামিয়ে দাও, নইলে আমি গুলি করব।

বিদেশিনীর মুখে দুর্বোধ্য হাসির ঝিলিক খেলে গেল। সে আরও নিবিড়ভাবে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বেটিকে। গুলি করার সুযোগ সে রাখতে চায় না।

হেডক থমকে যান। স্তিমিত কণ্ঠে বলার চেষ্টা করেন, আমি কিন্তু গুলি চালাব…

ঠিক সেই মুহূর্তে গুলির শব্দ হল গুড়ুম

চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকান সকলে। দেখা গেল মিসেস স্প্রটের হাতে পিস্তল ধরা–

সামনের স্ত্রীলোকটি ততক্ষণে বেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেই পাহাড়ের ওপরে আছড়ে পড়ল। থর থর করে কাঁপছে তার শরীর। সকলে এগিয়ে যায় তার দিকে।

হাঁটু গেড়ে বসল টমি। তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে বিদেশিনী। একসময় মাথাটা হেলে পড়ল একপাশে। মাথায় রক্ত। বুলেট কপাল ভেদ করে গেছে।

পেছন থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে বেটিকে কোলে তুলে নিলেন মিসেস স্প্রট।

–আমার বেটি। ওঃ ভগবান, তোমার কোনো আঘাত লাগেনি।

মৃতার নিথর মুখের দিকে চোখ পড়তেই স্তিমিত হয়ে আসে তার কণ্ঠস্বর। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন, আমি–আমি খুন করেছি।

-এখন ওসব ভাববেন না। আপনি বেটিকে সামলান। বলল টুপেনস।

হেডক বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, তাজ্জব ব্যাপার, আমি সাহস পেতাম না। কিন্তু আনাড়ি হাতে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করলেন মিসেস স্প্রট। সত্যিই বিস্ময়কর

–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে বাচ্চাটার ক্ষতি হয়নি। বলল টুপেনস।

.

একজন অপরিচিতার মৃত্যুর ঘটনা হলেও, ঘটনাটা মৃত্যুর। হেডক পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। টানাপোড়েন বিশেষ হল না। কেবল সাক্ষী দিতে হয়েছে টমি ও টুপেনসকে।

যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও পুলিশি তৎপরতায় কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল, নিহত মহিলা একজন পোলিশ উদ্বাস্তু। নাম ভান্দা পলোনস্কা। পুনর্বাসন দপ্তরে কাজ করত সে। ধনী আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই তার।

মৃতদেহ সনাক্ত করেছেন মিসেস ক্যালফন্ট। তিনি জানালেন, মৃতার মাথায় কিছুদিন থেকেই গোলমাল দেখা দিয়েছিল। পোলান্ডে নির্মম অত্যাচারে চোখের সামনেই সন্তানকে মরতে দেখেছে। তাতেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। তবু তাকে এখানে একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল। গত সপ্তাহে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে হঠাৎ উদ্বাস্তু শিবির থেকে পালিয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারকে সে মন থেকে ঘৃণা করত।…

এই অনভিপ্রেত ঘটনায় মিসেস স্প্রটের স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল। তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তার চোখ বেয়ে দরদর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

–আমি একজনকে খুন করে ফেলেছি–কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না…এত বড়ো একটা অপরাধ আমি করে ফেললাম…বেটিকে ও পাহাড়ের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল…ওকে বাঁচাবার জন্যই…

অফিসার প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানেন?

–একদম না। খেলনা বন্দুক ছাড়া কখনও বড়ো কিছু হাতে নিইনি।

-বিস্ময়কর। নিতান্ত আনাড়ি হাতেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন আপনি। মৃতাকে চিনতেন আপনি?

-না, কোনোদিন দেখিনি আগে তাকে।

তার স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেল, পোলিশ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি একসময় কিছু উলের জামা বুনে পাঠিয়েছিলেন। ওসব জামা থেকেই সম্ভবত পলোনস্কা মিসেস স্প্রটের নতুন ঠিকানাটা উদ্ধার করে থাকবে।

যাইহোক, শেষ পর্যন্ত পুলিশি বিচারে রেহাই পেয়ে গেলেন মিসেস স্প্রট। তারপর এই নিস্তরঙ্গ ঘটনার স্মৃতি দুদিনেই সময়ের বুকে ঝাপসা হয়ে গেল।

.

ইঙ্গ-ফরাসি সম্মিলিত বাহিনী ডানক্রিক থেকে পালাতে শুরু করেছে। প্যারির পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। জার্মান বাহিনীর রণকৌশল ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মিত্রবাহিনীর সমস্ত প্রয়াস।

এমনি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে গোপনে নির্জনে মিলিত হয়েছে টমি ও টুপেনস।

যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিপর্যয়ের বিষয়ে চিন্তিতভাবেই।

টমি বলল, আমি নিঃসন্দেহ, এই বিপর্যয়ের পেছনে কাজ করেছে এক বিরাট অন্তর্দেশীয় চক্রান্ত।

–আমি তোমার সঙ্গে একমত, চিন্তিতভাবে বলল টুপেনস, কিন্তু সরকার কী করবে, উপযুক্ত প্রমাণ তো দরকার। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে চক্রান্ত দমন করতে গেলে তা হবে স্বেচ্ছাচারিতা।

-হ্যাঁ, চক্রের নায়ক-নায়িকাদের চিহ্নিত করাটাই হল আসল কাজ। এখানে তবু কিছুটা করতে পেরেছি।

–এখানে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল টুপেনস।

–কার্ল ভন দিনিম ও পলোনস্কার পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি।

–ওরা যৌথভাবে কাজ করছিল, আমার ধারণা।

–হ্যাঁ।

–কিন্তু, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। বেটিকে এভাবে অপহরণের চেষ্টা করল কেন?

টমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কাছেও ব্যাপারটা একটা ধাঁধা হয়ে আছে।

টুপেনস নিশ্চুপ থেকে কী চিন্তা করল। পরে বলল, আমার কী মনে হয় জান, মিসেস স্প্রট সম্ভবত নিজেও জানেন না যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ তার জ্ঞাত রয়েছে। কিংবা তিনি তেমন কিছু বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেটা উদ্ধার করার উদ্দেশ্যেই বেটিকে টোপ করতে চেয়েছিল এজেন্টরা।

–হ্যাঁ, এটা একটা কারণ হতে পারে, বলল টমি, এমন একটা হুঁশিয়ারি লেখা চিঠি তো তিনি পেয়েছিলেন।

টুপেনস চিন্তিতভাবে বলল, মিসেস স্প্রটকে সামনে রেখে একটা ভালো ফঁদ পাতা যেত যদি ভদ্রমহিলা একটু ধীরস্থির চিন্তাশীল হতেন। ওরকম অগভীর মনের মানুষকে নিয়ে কোনো গুরুতর কাজের পরিকল্পনা নেওয়া যায় না। কথা বা ব্যবহারের কোনো লাগাম থাকে না।

-তবে পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।

–হ্যাঁ।

–তারপর কী রকম দুম করে পিস্তল চালিয়ে বসলেন, বল, আমি হলে পারতাম না।

-একেবারেই আনাড়ি। আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে সামান্যমাত্ৰ ধারণা থাকলে কেউ ওইভাবে দুম করে ট্রিগার টিপতে পারে না।

খানিক বিরতি নিয়ে টুপেনস ফের বলল, ওই পোলিশ মহিলাকে প্রথম যেদিন দেখি, মুখটা কেমন চেনা মনে হয়েছিল। কিন্তু মনে করতে পারিনি।

–আগে কখনও দেখেছিলে মনে হচ্ছে?

–ঠিক বুঝতে পারছি না।

-একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ, মিসেস পেরিনার চেহারার সঙ্গে তার মেয়ে শীলার কিন্তু কোনো মিল নেই।

-ওভাবে খেয়াল করিনি। আচ্ছা, মিসেস স্প্রটের ঘরে পাথরে মুড়ে ওই চিরকুটটা কে ফেলতে পারে বলে তোমার মনে হয়?

বেটি চুরি যাবার পরে ঘরে গিয়ে উনি ওটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?

–আমার ধারণা মিসেস পেরিনাই কাজটা করেছেন।

–তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ওই জার্মান যুবক আর পোলনস্কার সঙ্গে মিসেস পেরিনারও যোগসাজস রয়েছে?

–আপাতত সেরকমই মনে হচ্ছে। মেজর যখন ব্যাপারটা পুলিশে জানাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখ, মিসেস পেরিনা ছুটে এসে কেমন গোটা ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করলেন। পুলিশের ধারে কাছেই ঘেঁষতে দেন না—

–তাহলে কি মিসেস পেরিনাই M?

–আমার বিশ্বাস। তুমি কী ভাবছ?

–আমি M নয় N-এর গন্ধ পাচ্ছি। এবং আমার নজর মেজর ব্লেচলির ওপর।

.

টুপেনস তীব্র চমকে মুখ তুলে তাকাল, উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে ঘরে ঢুকেছে শীলা। মুখ বিষণ্ণ। কিন্তু চোখ জ্বলছে।

-কী হয়েছে শীলা? উদ্বেগের স্বর ধ্বনিত হল টুপেনসের কণ্ঠে।

–এই মাত্র পুলিশ কার্লকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল।

–সে কী!

ঘটনাটা অজানা নয় টুপেনসের। খানিক আগেই জানালা পথে পুলিশের গাড়ি তার নজরে পড়েছে। তাছাড়া কারণটাও তার জানা। তবু উদ্বিগ্ন হবার ভান করল।

–আমি এখন কী করব? কার্লকে কি আমি আর দেখতে পাব না? আকুল স্বরে জানতে চাইল শীলা।

–অত ভাবছ কেন, শীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল টুপেনস, বুঝতেই তো পারছ, এখন যুদ্ধের সময়, আর কার্ল একজন বিদেশী, কিছু দিনের জন্য হয়তো তাকে আটকে রাখবে, এছাড়া কিছু নয়–

–কিন্তু পুলিশ যে ওর ঘর সার্চ করছে?

–তাতে কী, কিছু যদি পাওয়া না যায়—

কিছুই পাবে না তাঁরা। আপনার কি মনে হয়?

–আমি ঠিক জানি না, তুমি হয়তো জানতে পার।

–আমি! ক্ষুব্ধ দৃষ্টি টুপেনসের মুখের ওপর ফেলল শীলা।

আগের কথার জের টেনে টুপেনস ফের বলল, কিছু পাওয়া না গেলে ও নিরাপদই থাকবে।

-মা বললেন, মিথ্যা মামলা জুড়ে দিতে পারে পুলিশ।

-তোমার মা ভুল বলেছেন। এরকম কাজ তারা করবে না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার–তবে কি জান, জেনেশুনে তোমার অতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া ঠিক হয়নি।

–আপনি কার্লকে পছন্দ করেন না? আপনি কী ভাবছেন কাল

–অসম্ভব নয় শীলা। কার্ল তার জন্মভূমির হয়ে কাজ করতেই পারে

নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে প্রতিবাদ জানিয়ে শীলা বলে উঠল, না, কখনওই নয়, আমি কার্লকে জানি। ও তার বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়েই ডুবে ছিল। এই সুযোগ পাওয়ার জন্য ও ইংলন্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল।

এখানে উদ্বাস্তু হয়ে এলেও তার আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল প্রখর। নিজের দেশের প্রতিও মমত্ব ছিল। কিন্তু নাৎসীদের ঘৃণা করত মন থেকে। স্বপ্ন দেখত নাৎসীমুক্ত স্বাধীন জার্মানির।

-হ্যাঁ, ওরকমই বলত সে বলল টুপেনস।

–সে কারণেই কি আপনার ধারণা কার্ল একজন গুপ্তচর?

–সম্ভাবনার কথাই বলছি আমি।

উঠে দাঁড়াল শীলা। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি অন্যদের থেকে আলাদা, তাই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। আমি দুঃখিত।

শীলার কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে উঠল, কোনো রকমে বলল, আমি জানি কার্লকে ওরা আর বাইরে আসতে দেবে না, একদিন গুলি করে মারবে ঠিক।

.

–বেটিকে অপহরণ করার একটা কারণ আমি খুঁজে বের করেছি।

টমিকে বলল টুপেনস।

–শুনি তোমার যুক্তিটা কী? উদ্গ্রীব হল টমি।

-একদিন দুপুরে আমার ঘরে ঢুকেছিল বেটি, তোমাকে বলেছিলাম, নিশ্চয় মনে আছে, উল লেস জড়ো করে একগ্লাস জলে ফেলে ঘুটছিল…বাচ্চারা যা দেখে তাই অনুকরণ করবার চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই ও কোনো দিন কার্লকে ওভাবে রাসায়নিক তরলে কাগজ ফেলে অদৃশ্য লেখা উদ্ধার করতে দেখেছিল। বেটি তো ইদানীং কথা বলতেও শিখেছে। বাচ্চাটাকে তাই সে বিপজ্জনক ভেবেছিল আর তারই ইঙ্গিত পেয়ে পোলিশ মহিলাটি বেটিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল।

.

যুদ্ধের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। ফ্রান্সের ভাগ্যাকাশে চরম সংকট ঘনায়মান। ফরাসি উপকূলভূমি গেস্টাপোেদের অধিকারে চলে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা ইংলন্ড অভিমুখে অভিযান করতে পারে। চতুর্দিকে হতাশা আর আতঙ্ক।

কার্ল ভন দিনিমকে কবজা করা গেছে, টমি বলল, কিন্তু গুপ্তচক্রের আসল মাথাটিই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

–হ্যাঁ–মিসেস পেরিনা-সমস্ত কর্মকাণ্ডের নেত্রী। নাগাল ধরা সহজ হবে না। বলল টুপেনস।

–আর শীলা?

–না, না, ও এসবের মধ্যে নেই।

–তুমি নিশ্চিত?

–হ্যাঁ।

–তাহলে নিজে বেঁচে যাবে। প্রেমিককে হারিয়েছে, এবারে মাকে হারাবে। কষ্ট হয় দুর্ভাগা মেয়েটির জন্য। বলল টমি।

–আমাদের কী করার আছে বল।

–কিন্তু আমাদের ধারণা যদি ভুল হয়? অর্থাৎ M বা N যদি অন্য কেউ হয়?

–পরের কথা এখন ভেবে কী লাভ। আপাতত মিসেস পেরিনার ওপরে নজর রাখাই আমাদের কর্তব্য। পরে যদি ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়, তখন করণীয় ভাবা যাবে।

–আমাদের পুরোনো অনুগত কর্মী অ্যালবার্টকে তুমি এ-ব্যাপারে কাজে লাগাতে পার।

–তোমার বলার আগেই আমি তার কথা ভেবেছি। তাকে খবরও পাঠিয়েছি। কিন্তু তুমি কতদূর কী করলে?

–আমি…আপাতত গলফ ক্লাবে যাতায়াত করছি।

.

যৌবনে টমি ও টুপেনস যখন দুর্বার ছিল, যৌথভাবে বহু দুঃসাহসিক কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে, অ্যালবার্ট সহযোগী হিসেবে তাদের পাশে থেকেছে।

সেই হাসিখুশি বুদ্ধিমান যুবক এখন যৌবনোত্তীর্ণ। শরীরে মেদ জমেছে। দেখতে ভারিক্কি হলেও মনটি আগের মতোই সতেজ আছে।

এতদিন পরে আবার তাকে ডেকে এনে টমি ও টুপেনস একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে নিয়োগ করল…

.

গলফ মাঠে কমাণ্ডার হেডক আর টমি। একটা জোরালো শট হাঁকড়াবার পর টমি জিজ্ঞেস করল, ব্লেচলির সঙ্গে আপনার অনেক দিনের পরিচয়?

হেডকও কম যান না। অধিকতর জোরালো শটে বাজিমাত করলেন। মুখময় হাসি ছড়িয়ে বললেন, ব্লেচলির কথা বলছেন? গত শরতে এখানে এসেছে–তার সঙ্গে আমার জানাশোনা এই নমাস হল।

–উনি আপনার বন্ধুদের বন্ধু–এরকম বলেছিলেন।

মিথ্যা হলেও জোরের সঙ্গেই মন্তব্যটা উচ্চারণ করল টমি।

–এরকম বলেছিলাম? থমকে যান হেডক, না, না, তা কী করে হয়? এই গলফ ক্লাবেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়? কিন্তু ও-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

মানুষটাকে কেমন রহস্যময় মনে হয়, তাই না?

অবাক চোখে তাকান হেডক। তরল হেসে বলেন, ধ্যাৎ, কিসের রহস্য ওর মধ্যে?

স্টিক ঘুরিয়ে আর একটা সুন্দর শট নিল টমি। হেডক নিজের স্টিক বাগিয়ে ধরলেন।  বললেন, বুড়ো ব্লেচলি সোজাসাপ্টা সৈনিক মাত্র। তাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে কেন আপনার?

–আসলে এই এলাকায় হঠাৎই এসে উদয় হয়েছেন তোতার অতীত সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না।

খেলা চলল আরও কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত জিত হল কমাণ্ডারের। সাফল্যের আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে বললেন, ব্লেচলি আগে রাগবিশায়রে ছিল।

–আপনি ঠিক জানেন?

জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেলেন কমাণ্ডার। দ্বিধাজড়িত স্বরে বললেন, না–মানে ঠিক নিশ্চিত নই। তবে, ঠিকই, একটু কেমন যেন।

দুজনে হেঁটে এসে দুটো চেয়ার নিয়ে পাশাপাশি বসলেন।

–আমিও তাই বলতে চাইছি।

টমি তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে হেডককে।

–আপনার কথা শুনে মনে পড়ল, চোখ পিটপিট করে বলতে থাকেন হেডক, ব্লেচলিকে আগে থেকে চেনে এমন কাউকে এখানে নজরে পড়েনি। ওর সম্পর্কে কিছু কানে এসেছে নাকি?

-না, সেসব কিছু নয়।

–আমাকে গোপন করার কিছু নেই মিয়াদো। এখানে সকলেই আমার কাছে আসে, সবকথাই কানে আসে।

–সেটা জানি বলেই তো আপনার অভিমত জানতে চেয়েছি।

হেডক নড়েচড়ে বসলেন। তার চোখে পিটপিটানি ঘন হল।

–ব্লেচলি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? ওকে জার্মান বলে সন্দেহ করলে কিন্তু ডাহা ভুল হবে। আমার মতোই একজন খাঁটি ইংরেজ ব্লেচলি।

-না, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

জার্মানদের ও মন থেকে ঘৃণা করে। দেখেছেন তো কার্লকে দেখলেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠত…স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে কালের বিষয়ে আমি জেনেছি। সবাই জানত সে গ্যাস সম্পর্কে গবেষণা করছে, আসলে তার আসল মতলব ছিল এখানকার জলের ট্যাঙ্কটাকে বিষাক্ত করে তোলা।

টমি যেন স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কিছু। নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, না, ব্লেচলি সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।

–আমারও তাই অভিমত। বলেন হেডক।

আলোচনার এখানেই ইতি পড়ল। গলফ ময়দানে ততক্ষণে অনেক খেলোয়াড় জমায়েত হয়েছে। আর-এক প্রস্থ খেলার জন্য হেডক আর টমিও উঠে পড়ল।

স্টিক হাতে নিতে নিতে হেডক বললেন, একদিন আমার এখানে আসুন। ব্লেচলি সম্পর্কে একটা গুজব এখানে চালু আছে, আপনাকে শোনাব।

.

স্মাগলার্স রেস্ট-এ হেডকের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে পরিতৃপ্ত হল টমি। খাদ্য ও পরিবেশনের পরিপাটি, ঝকঝকে টেবিলপত্র বিশেষভাবে তাকে চমৎকৃত করল। হেডক ভাগ্যবান, তার পাঁচক-পরিবেশক কর্মচারীটি অতিশয় নিপুণ।

চেহারায় যেমন পরিপাটি, তেমনি চমক লাগানো আদবকায়দা। লন্ডনে প্রথম শ্রেণির রেস্তেরাঁর ওয়েটারও তার কাছে হার মানবে।

বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে টমি হেডকের কর্মচারীটির পঞ্চমুখে প্রশংসা করল।

এপেলডোরের সত্যিই তুলনা হয় না, সহাস্যে মন্তব্য করলেন হেডক, ভাগ্যে এরকম কাজের লোক পাওয়া যায়।

–সন্ধান পেলেন কোথায়? জানতে চাইল টমি।

বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। নামিদামি হোটেলে কাজ করে এসেছে।

এভাবে কথাবার্তা চলতে চলতেই অনিবার্যভাবে মেজর ব্লেচলির প্রসঙ্গ উঠল। কিন্তু দেখা গেল, হেডক আজ আর তেমন উৎসাহী নন। তিনি বরং মুখর হয়ে উঠলেন ইংলন্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে।

হেডক বললেন, আমি ভেবে পাই না লিহাম্পটনের মতো এমন একটি সমুদ্র-নিকটবর্তী স্থান কী করে এমন অরক্ষিত রাখা হয়।

জার্মান ডুবোজাহাজ যে কোনো সময় এখানে এসে হানা দিতে পারে। আকাশ থেকে ছত্রীবাহিনী নামিয়ে দিতেও কোনো বাধা নেই।

টমি হেডকের আক্ষেপ শুনে যেতে থাকে। আর এপেলডোরের নীরব আনাগোনা লক্ষ্য করতে থাকে।

এক সময় সে টেবিলে হুইস্কির বোতল সাজিয়ে দিয়ে যায়। তীক্ষ্ণ নজরে টমি তার মুখের দিকে তাকায়। মাথাভর্তি চুল, নীল চোখ। দেখলে ওয়েটার বলে মনে হয় না। চালচলনও অন্যরকম।

সন্দেহ দেখা দেয় টমির মনে। ছদ্মবেশে কেউ হেডককে প্রতারিত করছে না তো?

হেডক সমানে বকবক করে চলেছেন।

এদিকে জার্মানির গুপ্তচরবাহিনী কোথায় না ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের আশপাশেই তাদের নিঃশ্বাস টের পাওয়া যাচ্ছে। সব সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।…ধরা পড়েছে দু-একটা ক্কচিৎ কখনও।

প্রসঙ্গটাকে হাতছাড়া করল না টমি। হেডকের কথায় সুর মেলাল, আমাদের মাথামোটা পুলিশদেরও যা জিজ্ঞাসাবাদের বহর। কোনো স্পাইকে আটক করেই দুম করে জিজ্ঞেস করে বসে, তুমি কে হে? এম না এন?

টমির মুখ থেকে উচ্চারিত কথা যেন মুহূর্তে ঘরের ভেতরে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দেয়।

ওয়েটারের হাত থেকে সোডার বোতল ও খানিকটা মিষ্টি রস ছড়িয়ে পড়ে। লোকটি মাথা নিচু করে দুঃখ প্রকাশ করে, আমি দুঃখিত স্যার।

টমি লক্ষ করে লোকটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে।

হেডক হই-হই করে ধমকে ওঠেন। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। কপালে ঘামের রেখা। ফুটে ওঠে।

টমির জামায় হাতে মিষ্টি রস ছলকে পড়েছিল। হেডক বললেন, আসুন বাথরুমে হাতটা ধুয়ে ফেলবেন।

টমিকে বাথরুম অবধি পৌঁছে দিয়ে গজগজ করতে থাকেন, এমন অপদার্থ..লাফঝাঁপ ছাড়া কাজ করতে পারে না…

.

বাথরুমে ঢুকে হাত জামা পরিষ্কার করে নিতে থাকে টমি।

হেডক বাইরে দাঁড়ানো। তার তর্জনগর্জন এখনও শেষ হয়নি।

-বুঝলেন মিয়াদো, মেজাজ চড়ে গেলে আমার আর হুশ থাকে না। ভাগ্যে এপেলডোরের মতন কাজের নোক পেয়েছি।

সামান্য ভুলচুক সকলেরই হতে পারে…কিন্তু আমি একেবারে বরদাস্ত করতে পারি না। এপেলভোর অবশ্য আমার মেজাজ বুঝতে পারে…তাই রক্ষে।

বেসিনে হাত ধুয়ে বিপরীত দিকের ভোয়ালেতে হাত মুছবার জন্য এগুতে গিয়েই…একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল…খেয়াল করেনি টমি…বাথরুম পরিষ্কার করবার জন্য একখণ্ড সাবান আর একটা ভোয়ালে ফেলে রাখা ছিল…সেই সাবানের ওপরেই পা চাপিয়ে দিল।

মুহূর্ত মধ্যে যেন প্রলয় ঘটে গেল বাথরুমের ছোট্ট পরিসরে। পিছল মেঝেয় সাবানের টুকরোটি টমিকে যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল।

এক-পা শূন্যে আর এক-পা দিয়ে কোনো রকমে চলন্ত দেহের ভারসাম্য ঠেকিয়ে… বেসামাল অবস্থায় টমি গিয়ে ধাক্কা মারল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা ছোট্ট কেবিনে।

সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের ঢাকনা সরে গেল…অমনি এক ভোজবাজি।

টমির চোখ বিস্ফারিত হল। চোখের সামনে দেখতে পেল…ছোট্ট একটা কুঠুরি…আর তাতে রয়েছে ওয়ারলেসের যন্ত্রপাতি, ট্রান্সমিটার…

.

বাইরে হেডকের বকবকানি ততক্ষণে থেমে গেছে। টমির বিলম্ব হচ্ছে দেখে এগিয়ে এসে বাথরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়েছেন।

চোখের সামনে ছোট্ট দৃশ্যটাই টমির বোপোদয় ঘটিয়ে দিয়েছে। নিজের মনেই বলে উঠেছে, ছ্যা ছ্যা…কি আহম্মক আমি..লোকটাকে আমি এতদিন ইংরেজ ভেবে এসেছি..কখনও বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি।

অমন বিশাল চোয়াল…চড়া মেজাজ ধমকধামক সবেতেই জার্মান ছাপ স্পষ্ট। তার ওপরে অমন ফিটফাট চেহারার একজন অনুচর…ওয়েটারের ছদ্মবেশে…এই জন্যই M বা N নাম শুনেই অমন চমকে উঠেছিল দু-জনেই…

নেহাত দৈব বশেই রহস্যটা ধরা পড়ল। এর আগে দু-বার পাখি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে। নাৎসী এজেন্ট হানকে এখানে পাঠানো হয়েছিল প্রথমে। তারপর তাকে সরিয়ে মঞ্চে হাজির হয়েছে দেশপ্রেমিক কমাণ্ডার হেডক।

পুরো ভুয়ো নাম–জলজ্যান্ত N। নিশ্চিন্তে এমন একটা নিরাপদ স্থানে ডেরা বেঁধে এ দেশের ভাগ্য নিয়ে খেলা জুড়েছে। সান্স সৌচিকে বানিয়েছে দ্বিতীয় শিবির…সহযোগী অফিসাররা কিলবিল করছে সেখানে।…

সাবানে পা পিছলে ছোট্ট কেবিনে ধাক্কা খেয়ে মিনিটখানেকের মধ্যেই টমির মনে এতসব কথা বিজবিজ করে উঠল।

সোজা হয়ে সামলে দাঁড়াবার পরেই খেয়াল হল শত্রুর শিবিরে মাথা গলিয়ে দিয়েছে সে, সামলে চলতে না পারলে মহা বিপদ।

সে বুঝতে পারল…তাকে এখান থেকে নিরাপদে বাইরে বেরুতে হলে মোটা মাথার এক ইংরেজের অভিনয় বজায় রাখতে হবে। এছাড়া বাঁচার পথ নেই। সে যে কিছু দেখতে পেয়েছে তা বুঝতে দেওয়া চলবে না।

টমি মাথা তুলে দেখতে পেল বাথরুমের দরজার মাথায় যেন শূন্যে ঝুলছে হেডকের হিংস্র মুখ… নিষ্পলক চোখ জোড়া তার ওপরে নিবদ্ধ।

গোবেচরার মতো হেসে উঠল টমি। হেডক পালটা অট্টহাসি হেসে বলে উঠলেন, আরে আরে মিয়াদো, আপনি দেখছি বাথরুমে একেবারে ব্যালে নাচ জুড়েছেন। হায় হায়…চলে আসুন…অন্য ঘরে যাওয়া যাক।

টমি সামলেসুমলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। তার শরীরের সমস্ত পেশী টানটান হয়ে উঠেছে। ইন্দ্রিয়গ্রাম সজাগ। শত্ৰুপুরী থেকে যেভাবেই হোক তাকে নিরাপদে বাইরে যেতে হবে।

হেডক স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছেন। নিজের বসার ঘরে নিয়ে এলেন টমিকে। তারপর নিজের হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

শুনুন মিয়াদো, অন্তরঙ্গ সুরে বললেন হেডক, বসুন এখানে, আপনাকে নিভৃতে কয়েকটা কথা বলবার আছে।

টমির পাশে আসন নিয়ে ফের বলতে থাকেন, এসব কথা বাইরের কাউকে বলা চলে না…তবু…আপনাকে বিশ্বাস করি বলে বলছি…আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।

–অবশ্যই, টমি সতর্ক কণ্ঠে বলে, আপনি নির্ভয়ে বলুন।

-হ্যাঁ, বলছি। আমার আসল পরিচয় এখানে কেউই জানে না। আসলে আমি হচ্ছি সিক্রেট সার্ভিসের লোক। ডিপার্টমেন্টে আমার গোপন নাম M. I. 42B. x… এমন নাম আগে শুনেছেন?

–শুনিনি। এখন আগ্রহ হচ্ছে…

–বলছি শুনুন। কিন্তু হুঁশিয়ার…কেউ যেন ঘুণাক্ষরে টের না পায়। তাহলে গোটা পরিকল্পনাটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

বুঝতে পারছি। আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন…

এরপর হেডক ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানার বিবরণ শোনাতে লাগলেন। আর এক বোকা ইংরেজের ভূমিকা নিয়ে টমি শুনে যেতে লাগল মুখ হাঁ করে।

হাবভাবে এখন হেডক পুরোদস্তুর একজন ব্রিটিশ নাবিক…কিন্তু তার জোরালো চোয়াল, কপালের গড়ন, নাক, গলার স্বর সবেতেই জার্মানসুলভ ছাপ লক্ষ করতে লাগল টমি।

.

রোমাঞ্চকর সব তথ্যের বিবরণ শুনে হাঁপিয়ে উঠল টমি। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, আজ এখানেই থাক কমাণ্ডার, অনেক দেরি হয়ে গেল। কাল না হয় বাকিটা শোনা যাবে।

আর মনে মনে জপছে টমি, একবার এখান থেকে বেরুতে পারলে হয়।

টমি শুভরাত্রি জানিয়ে নিজেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো…হলঘরে এসে এপেলডোরের সঙ্গে চোখাচোখি হল। আগামী দিনের প্রাতঃরাশ গোছগাছ করছে ট্রের ওপর।

.

নিঃঝুম চারপাশ। স্মাগলার্স রেস্ট-এর আওতা ছেড়ে নিরাপদেই বেরিয়ে এলো টমি। রাস্তায় কাদের কথা বলার শব্দ কানে এলো।

মুখোমুখি হতে চিনতে পারল টমি। পথচারী দু-জনই পরিচিত। হেডকেরও আলাপ আছে এদের সঙ্গে। টমি কথা বলতে বলতে চলতে লাগল তাদের সঙ্গে।

মুক্তির নিঃশ্বাস যে কত আরামপ্রদ বুঝতে পারছে এতক্ষণে টমি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছেন হেডক। তার দরজা বন্ধ করার শব্দও কানে এসেছে। জার্মান স্পাইরা যে এত বোকা হয় জানা ছিল না টমির। স্রেফ বোকা বানিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে।

যুদ্ধ নিয়েই এখন আলোচনা সর্বত্র। ওরা তিনজনও জার্মানির ইংলন্ড আক্রমণের সম্ভাব্যতা নিয়ে মতামত বিনিময় করছে। ব্রিটিশ নৌবহর প্রস্তুত হয়েই রয়েছে…জার্মানরা চ্যানেল পার হবার সময়ই বুঝতে পারবে যুদ্ধ কাকে বলে। তবে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাশিয়ার ওপর।…

সান্স সৌচির বাগানের দরজার সামনে পৌঁছে গেল সে। গোটা পরিবেশটা যেন ঘুমে ঢলে পড়েছে।

সঙ্গীদের শুভরাত্রি জানিয়ে দরজা ঠেলে বাগানে ঢুকল টমি। মনে মুক্তির আনন্দ…অনাবিল স্ফূর্তি।

রডোডেনড্রন ঝোপটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে ঈষৎ মাথা হেঁট করল টমি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আচমকা ভারি কিছু একটা তার মাথার পেছন দিকে প্রচণ্ড আঘাত করল।

অস্ফুট আর্তনাদ করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল টমি। তারপরই টাল খেয়ে দেহটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল।

চোখের ওপর যেন কেউ এক বোতল কালি ঢেলে দিল। যন্ত্রণায় মুখ কুঞ্চিত হল।

সংজ্ঞা হারাল টমি।

.

সান্স সৌচির হলঘরে ব্রিজ খেলায় মজে গেছেন চার মহিলা। মিসেস স্প্রট, মিসেস ব্লেনকিনসপ, মিসেস ক্লে এবং মিস মিল্টন।

ইতিমধ্যে খেলা ছেড়ে মিসেস ম্প্রটকে কয়েক মিনিটের জন্য টেলিফোন ধরবার জন্য উঠতে হয়েছিল। ফিরে এসেছিলেন একরকম দৌড়ে। আসনে বসে ঘন ঘন শ্বাস টেনেছেন।

এর কিছুক্ষণ পরেই উসখুস করে উঠলেন মিসেস ক্লে।

–আমায় একটু উঠতে হবে ভাই। মিঃ ক্লে বাগানে পায়চারি করেছেন…ঠান্ডা লাগিয়ে বসবেন…একপলক দেখে আসি…কিছু মনে করবেন না…বাগান থেকে কেমন একটা বিশ্রী আওয়াজ পেলাম…কী করছেন কে জানে…।

বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

এই সময় মিস মিল্টন বলে উঠলেন, শীলাকে দেখতে পেলাম না এবেলা

মিসেস স্প্রট জবাব দিলেন, সিনেমায় গেছে।

–মিসেস পেরিনাও কি সঙ্গে গেছেন? জানতে চাইল টুপেনস।

–ঘরেই তো থাকবেন বলেছিলেন, বললেন মিস মিল্টন, কী সব হিসেবপত্র ঠিক করতে হবে। বেচারি…টাকার হিসেব-নিকেশ নিয়ে জীবনের আমোদআহ্লাদ খুইয়ে বসে আছেন…

সন্ধ্যার পর তো মনে হল একবার বেরিয়েছিলেন, বললেন মিসেস স্প্রট, আমি ফোন করতে গেলাম যখন, সেইমাত্র ফিরলেন।

মিস মিল্টন বলে উঠলেন, তাহলে গিয়েছিলেন কোথাও। সিনেমায় যাননি নিশ্চয়ই.. তাহলে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতেন না।

মিসেস স্প্রট বললেন, মাথায় তো টুপি চোখে পড়ল না। মাথার চুল সব কেমন এলোমেলো হয়ে ছিল। খুব হাঁপাচ্ছিলেন।

দেখে মনে হল কোথাও থেকে ছুটে আসছেন। আমাকে দেখেও কোনো কথা বললেন না, সরাসরি ওপরে উঠে গেলেন।

এই সময় মিসেস ক্লে ফিরে এলেন। নিজের আসনে বসতে বসতে বললেন, মিঃ ক্লে ঠিকই আছেন, বাগানে ঘুরে বেড়োচ্ছেন।

আবার তাস বাটা হল। আর ঠিক সেই সময়েই ঘরে এসে ঢুকলেন মিসেস পেরিনা।

–বেরিয়ে ফিরলেন? হাসিমুখে জানতে চাইলেন মিস মিল্টন।

–আমি বেড়োতে যাইনি তো? তীক্ষ্ণস্বরে বললেন মিস পেরিনা।

–না, মিসেস স্প্রট বলছিলেন কিনা, আপনি সন্ধ্যাবেলা বেরিয়েছিলেন—

ও, মিনিটখানেকের জন্য বেরিয়েছিলাম। আবহাওয়াটা কেমন দেখতে।

মেজাজ যে সরিফ নেই মিসেস পেরিনার রুক্ষস্বরের জবাব থেকেই পরিষ্কার বোঝা গেল।

–আজ আবহাওয়া চমৎকার, বললেন মিসেস ক্লে, মিঃ ক্লে আজ মনের আনন্দে গোটা বাগান ঘুরে বেড়োচ্ছন।

–এ সময়ে বাগানে এত ঘোরাঘুরি কেন, তীব্রস্বরে বললেন মিসেস পেরিনা, যুদ্ধের সময়, যে কোনো মুহূর্তে একটা বোঝা এসে পড়তে পারে। বলতে বলতে তিনি ক্ষিপ্রগতিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

আচমকা অমন বোমার কথা শুনে সকলেই হকচকিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার মেজাজ হঠাৎ এমন চড়ে গেল কেন কেউই বুঝতে পারলেন না।

–একেবারে মিলিটারি মেজাজ। বললেন মিসেস ক্লে।

নেশা করে এসেছেন নিশ্চয়। মন্তব্য করলেন মিসেস স্প্রট।

–ব্রিজ নিয়ে বসেছেন…ওঃ দারুণ!

মুখময় হাসি ছড়িয়ে আবির্ভূত হলেন মিসেস ওরুরকি।

–আপনার হাতে ওটা কী? সাগ্রহে জানতে চাইলেন মিসেস স্প্রট।

-ও এটা, হাতুড়ি, বাগানে পড়েছিল। কেউ নিশ্চয় ভুল করে ফেলে রেখে এসেছিল, তাই নিয়ে এলাম।

-বাগানে আবার হাতুড়ি ফেলে রেখে এলো কে? অবাক হলেন মিসেস স্প্রট।

–আমিও তাই ভাবছি। বললেন মিসেস ওরুরকি।

মেজর ব্লেচলি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। তিনিও একটু পরেই ফিরলেন। তার প্রায় পেছনেই ঘরে ঢুকলেন মিঃ ক্লে।

হলঘর আবার জমজমাট হয়ে উঠল।

.

খবরটা একসময় সকলেই জেনে গেল…সাল সৌচির অন্যতম বাসিন্দা মিঃ মিয়াদো সন্ধ্যা থেকেই রহস্যজনক ভাবে উধাও।

ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত টুপেনস। তবে টমির এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশান্বিত সে। টমি নিশ্চয় মিসেস পেরিনা কিংবা সমগোত্রের কাউকে অনুসরণ করতে গিয়ে মূল ঘাঁটির সন্ধান পেয়ে গেছে। কাজ সমাধা হলে যথাসময়ে ফিরে আসবে।

মিসেস পেরিনা যারপরনাই বিব্রত। দিন কয়েক আগেই ঘটে গেছে বেটিকে নিয়ে একটা দুঃখজনক ঘটনা।

সান্স সৌচির বাসিন্দাদের চাপে পড়ে পুলিশে ফোন করলেন মিসেস পেরিনা।

মেজর ব্লেচলি কৌতুকের হাসি মুখে মেখে ঘন ঘন আড়চোখে তাকাতে লাগলেন বিধবা মিসেস ব্লেনকিনসপের মুখের দিকে। মহিলার ভাবান্তরটা উপভোগ করতে উন্মুখ তিনি।

একটা অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সম্ভাবনার আশা দেখতে পেলেও টুপেনস কিন্তু নিশ্চেষ্ট থাকল না। তড়িঘড়ি দেখা করল মিঃ গ্রান্টের সঙ্গে।

টমির কোনো খবর রাখেন না মিঃ গ্রান্ট। বললেন, অস্থির হবেন না। পরবর্তী ঘটনার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।

তবে মিসেস পেরিনা যে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত নন সেই আভাস তিনি দিলেন। তবে এটা জানালেন যে, টুপেনস সেদিন দুপুরে টেলিফোনে আড়ি পেতে যে চতুর্থ কথাটি উদ্ধার করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ তিনি খবর পেয়েছেন, আগামী মাসের চার তারিখে যাতে ইংলন্ড আক্রমণ করা যায় সেভাবে নাৎসীরা প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এরপর অ্যালবার্টকেও টমির নিখোঁজ হবার সংবাদটা জানিয়ে দিল টুপেনস।

এই সময় অভাবিত ভাবেই এন্টনি মার্সর্ডন নামে এক তরুণের সঙ্গে তার আলাপ হয়ে গেল। ছেলেটি বেরেসফোর্ড দম্পতিকে চেনে বলে জানাল।

এক সময় টমির কাছ থেকে কিছু কাজও নাকি পেয়েছিল। টুপেনসের কাছেও করবার মতো কাজ চাইল সে।

টুপেনস তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে দিয়ে চারদিকে সতর্ক নজর রাখার কথা বলে দিল। আরও বলল, জরুরি কোনো সংবাদ থাকলে যেন সান্স সৌচির ঠিকানায় সংকেত-পূর্ণ চিঠি লিখে জানায়।

.

জ্ঞান ফিরলেও সঙ্গে সঙ্গেই চোখ খুলতে পারল না টমি। চোখের পাতা অসম্ভব ভারি হয়ে আছে। সমস্ত শরীরে অসহ্য ব্যথা।

নড়াচড়া করবার ক্ষমতাও নেই, হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঠোঁটের ওপর ব্যাণ্ডেজ সাঁটা–কোনো আওয়াজ বের করবার উপায় নেই।

একসময়-চোখ তুলে ঘন নিরেট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না টমি। বুঝতে পারল, পাথুরে মেঝেতে পড়ে আছে।

নিজের মনেই হাসল টমি। হাবাগোবার অভিনয় করেও পার পাওয়া গেল না। বিপদের গ্রাসে পড়ে গেছে। এখন ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি হাতড়ে বার করতে হবে।

শরীরে ব্যথা…পেটে খিদের মোচড়…হাত-পা বাঁধা…নিজের অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে

মনে পড়ে গেল ধুরন্ধর হেডক…বাথরুম…ওয়ারলেস..জার্মান ওয়েটার…তারপর সান্স সৌচির বাগানে মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত…

হ্যাঁ আঘাত, অসম্ভব নিরেট কিছুর আঘাত…কিন্তু এই আঘাত কার পক্ষে করা সম্ভব? হেডক তো স্মাগলার্স রেস্ট-এই রয়ে গেল…তার দরজা বন্ধ করার শব্দ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

সেই জার্মান পরিচারকটি কী? কিন্তু সে তো বাড়ির মধ্যেই ছিল। হলঘরে খাবারের ট্রে সাজাচ্ছিল।…কোনো সূত্রই উদ্ধার করতে সমর্থ হল না টমি।

অন্ধকারের বুক চিরে একফালি আলো চোখে পড়ল। ছোট্ট কোনো ঘুলঘুলিই হবে নিশ্চয়…ভাবল টমি।…ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে সে…কিন্তু ঘরটা কোথায়?

আচমকা এক ঝটকায় কপাট খুলে গেল। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল এপেলডোর। সেটা একপাশে বসিয়ে দিয়ে একে একে নিয়ে এলো জলের জাগ, গ্লাস আর চিজ সহ কিছু রুটি।

রুটিন কাজের মতো জিনিসগুলো যথাস্থানে রেখে টমির ঠোঁটের ব্যাণ্ডেজ খুলতে লাগল।

–মুখে টু শব্দ না করে খাবারটা খেয়ে নাও। চেল্লাবার চেষ্টা করলে আবার ব্যাণ্ডেজ সেঁটে দেব।

লোকটা খাবার তুলে তুলে টমিকে খাইয়ে দিল। যথারীতি নীরবে।

খাওয়া শেষ হলে টমি বলল, তোমাদের ব্যাপার স্যাপার কি বলো তো?

এপেলভোর নীরব।

-আমি হেডকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

লোকটা টমির মুখে আবার প্লাস্টার এঁটে দিল। তারপর উঠে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

কয়েক মিনিট পরেই হেডক উপস্থিত হল। পেছনে সহচর এপেলডোর।

টমির মুখ থেকে প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ খুলে নেওয়া হল। হাতপায়ের বাঁধনও আলগা হল। ধীরে ধীরে উঠে বসল টমি।

-চেঁচাবার চেষ্টা করলে খুলি উড়িয়ে দেব।

উদ্যত পিস্তল হাতে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল হেডক।

টমি কিন্তু সুর চড়িয়েই প্রথম কথাটা বলল, মতলবটা কী শুনি, আমাকে এভাবে অপহরণ করা হল কেন?

–অযথা বকবক করো না। আমার সঙ্গে চালাকি করে পার পাবে না, তোমার আসল পরিচয় আমি জানি…

টমি কিছু বলতে চায়। কিন্তু ধমকে তাকে থামিয়ে দেয় হেডক।

-একদম চুপ। তোমার মিথ্যের ঝুরি শোনার মতো সময় আমাদের নেই। তোমাকে নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই…এখান থেকে তুমি বাইরে বেরুতে পারছ না।

পুলিশ কিন্তু বসে থাকবে না–আমি যখন নিরুদ্দেশ

হিংস্র হয়ে ওঠে হেডকের মুখ। চোখ জ্বলে ওঠে।

–পুলিশ তো আজ বিকেলেই এসেছিল। অফিসার দু-জন আমার ঘনিষ্ঠ। তাদের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না যে তুমি এ বাড়িতেই অন্ধকুঠুরিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছ।

–পুলিশ আমাকে ঠিক এখান থেকে খুঁজে বার করবে।

-পুলিশ আর তোমার নাগাল পাচ্ছে না, আজ রাতের মধ্যেই হাপিস হয়ে যাচ্ছ তুমি। একটা ছোট্ট বোট এসে পৌঁছবার কথা আছে, তোমার প্রাণহীন দেহটা তার মধ্যে করেই সাগরে পাচার হয়ে যাবে। কাকপক্ষীতেও তোমার হদিশ পাবে না।

টমি বিলক্ষণ বুঝতে পারল দুর্ভেদ্য ফাঁদেই আটকা পড়েছে সে। নির্বিঘ্নেই এরা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু টুপেনস যদি নিরাপদ থাকে তাহলে এরা বেশিদূর এগুবার সুযোগ পাবে না।…কিন্তু তার কী হবে? গোয়েন্দা বিভাগ কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? টুপেনস নিশ্চয়ই এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে তার সন্ধানে।

সান্স সৌচি থেকে নিরাপদেই বেরিয়ে গিয়েছিল সে। দু-জন পরিচিত পথচারী তার সাক্ষী রয়েছে। এর পরও কি হেডক আর তার স্মাগলার্স রেস্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে না?

হেডক একসময় বিদায় নিল। তবে যাবার আগে ফের আগের মতোই টমিকে বেঁধে রেখে গেছে। বন্ধন দশায় না থাকলে ঘুলঘুলির ক্ষীণ আলোর উৎস লক্ষ্য করে চিৎকার করতে পারত টমি।

সে অনুমান করতে পেরেছিল রাস্তার ধারে কোনো চোর-কুঠুরিতেই তাকে আটকে রাখা হয়েছে। চিৎকার করতে পারলে বাইরে কারো না কারো কানে ঠিক পৌঁছত। কিন্তু মুখে প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ নিয়ে এখন নিরুপায় পড়ে থাকতে হবে তাকে।

কিন্তু নিশ্চেষ্ট থাকলে চলবে না। টমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল যদি দড়ি বা ব্যাণ্ডেজ আলগা করা যায়।

আধঘণ্টা ধরে হাঁচড়পাঁচড় করেও ব্যর্থ হল টমি। হাঁপিয়ে গেল সে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বাইরের অবস্থাটা ধারণায় আনবার চেষ্টা করতে লাগল।

এতক্ষণে বেলা পড়ে এসেছে সম্ভবত। হেডক হয়তো গলফ ময়দানে ভিড়েছে। হয়তো তার জন্য কাঁদুনি গাইছে সকলের কাছে। ছদ্ম উদ্বেগ মুখে মেখে প্রতারিত করছে সকলকে।

উৎকর্ণ হয়েছিল টমি। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছিল। সহসা তার কানে ধরা পড়ে কারো কণ্ঠস্বর। কে যেন এই ঘরের সংলগ্ন পথে গান গাইছে। ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে কণ্ঠস্বর। গান গাইতে গাইতে লোকটি পথ বেয়ে চলে যাচ্ছে।

বহুকালের পরিচিত গান-গলার স্বরও যেন চেনা মনে হল টমির।

তার মনে পড়ল ১৯১৪ সালে টুপেনসকে খুঁজে বার করার জন্য এই গান সে নিজেই গেয়েছিল। তার সেই অভিযান ব্যর্থ হয়নি।

কার পক্ষে এই ইঙ্গিতপূর্ণ গান গাওয়া সম্ভব হতে পারে?…একমাত্র অ্যালবার্টের পক্ষেই সম্ভব। এ কৌশল তাদের বহুচর্চিত।

টমি সজাগ হল। অ্যালবার্ট তাহলে হাতের নাগালেই তো রয়েছে।

কিন্তু আওয়াজ করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করবে সে পথ বন্ধ …কিন্তু অ্যালবার্টকে তার উপস্থিতি তো জানানো দরকার।

এক মুহূর্ত চিন্তা করল টমি। পরক্ষণেই প্রবল বেগে নাসিকা গর্জন আরম্ভ হল তার। মুখ বন্ধ হলেও নাসিকা সক্রিয় হতে তো বাধা নেই। অ্যালবার্ট নিশ্চয়ই এই সংকেতের অর্থ উদ্ধার করতে পারবে।

.

জার্মান এজেন্টদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিল অ্যালবার্ট। তাই টমির নিরুদ্দেশের সংবাদ পেয়েই সে তার পরিকল্পনা ছকে ফেলল।

জার্মান সিক্রেট সার্ভিসকে যে ভাবে তোক ঠেকাতে হবে। নাৎসীদের সাফল্য মানেই তো ফ্রান্সের বিপর্যয়।

টমি সম্পর্কে শেষ সংবাদ হল সে স্মাগলার্স রেস্ট-এ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিল। তারপর রাতে সান্স সৌচিতে ফিরেও এসেছিল।

অ্যালবার্ট প্রথমে সান্স সৌচির প্রবেশ পথ, বাগান পর্যবেক্ষণ করল। কিন্তু সন্দেহ করার মতো কিছু নজরে পড়ল না।

স্মাগলার্স রেস্টের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল সে। মস্ত বাড়িটা যেন ঝিম মেরে আছে। বাইরে থেকে ভেতরের ব্যাপার কিছু আঁচ করার উপায় নেই।

বাড়িটার পাশ ঘেঁসেই সরু পায়ে-চলা পথ। সেই পথেই পা ফেলল অ্যালবার্ট। আর শুরু করল চড়া সুরে সেই পরিচিত গান।

স্মাগলার্স রেস্টের সাদা দরজার কাছাকাছি এসে আবার খানিকটা পিছিয়ে যায় অ্যালবার্ট।

দরজা খুলে গেল। একটা গাড়ি বেরিয়ে এসে বড়ো রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল।

গাড়িতে বসা বিশালদেহী লোকটিকে চোখে পড়তেই অ্যালবার্ট মাথা নাড়ল। মনে মনে বলল, এই তাহলে কমাণ্ডার হেডেক। লোকটা গলফ খেলার সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে–তার মানে গলফ ময়দানে যাচ্ছে।

অ্যালবার্ট নিজের মনে গানের সুর ভাঁজছে। আড়চোখের দৃষ্টি বাড়ির দরজার দিকে।

একটা লোক বেরিয়ে এলো দরজা ঠেলে…পাহাড়ি পথ ধরে চলে গেল।

অ্যালবার্ট এবার দ্রুতপায়ে বাড়িটার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল–গলায় গানের সুর।

বাগানের একপাশে খোঁয়াড় মতো একটা ঘর। অ্যালবার্ট ঘুরতে ঘুরতে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।

সহসা গান থেমে গেল..সবিক্রমে যেন কারুর নাসিকা গর্জন করছে। কিন্তু এমনভাবে গর্জনধ্বনি ওঠানামা করছে কেন–কোনো জন্তু নয়তো? নাকি কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

সতর্ক নজরে চকিতে চারপাশটা দেখে নিল অ্যালবার্ট। ব্যাঙের মতো লাফিয়ে গিয়ে দাঁড়াল খোঁয়াড় ঘরে জানালার সামনে।

না; কোনো সন্দেহ নেই…তার সঙ্কেতপূর্ণ গানেরই প্রত্যুত্তর এটা…অ্যালবার্ট হাত বাড়িয়ে একটুকরো কাগজ ভেতরে ফেলে দিল।

৪. সাধারণ একটা পোস্টকার্ড

কালো কালিতে লেখা সাধারণ একটা পোস্টকার্ড। এটাই মিসেস ব্লেনকিনসপের পাওয়া সর্বশেষ চিঠি। ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে চিঠিটা মুখের সামনে তুলে ধরল।

প্রিয় প্যাট্রিসিয়া,
কাকিমার শরীরের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। ডাক্তাররা সর্বক্ষণ নজরে রেখেছেন। তবে আশা নেই। তাকে শেষ দেখা দেখতে হলে চলে এসো। ১০টা ২০মিঃ ট্রেন ধরে এরোতে আসবে। আমার এক বন্ধু তোমাকে আনতে গাড়ি নিয়ে যাবেন। কাকিমার অসুস্থতা উপলক্ষে অনেকখানি পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে আশা করে ভালো লাগছে।
ইতি
তোমার পেনিলোপ প্লেনি

টুপেনস তার অন্তর্বেদনা যথাসাধ্য মুখভাবে ধরে রাখবার চেষ্টা করে। তবে মনে মনে আশান্বিত হয় এন্টনি মার্সড়নের ইঙ্গিতপূর্ণ চিঠিটি পেয়ে।

অবশ্য খুব বেশি পরিচয় নেই তার এন্টনির সঙ্গে। তাই পুরোপুরি ভরসাও করতে পারছে না। ভাবল, দেখাই যাক না কী হয়–মিঃ গ্রান্ট তো রয়েইছেন পেছনে।

টেবিলে উপস্থিত অনেকেই সহানুভূতি জানালেন মিসেস ব্লেনকিনসপকে। এরোর উদ্দেশ্যে রওনা হবে বলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়াল টুপেনস। তারপর এলো মিসেস পেরিনার ঘরে।

সেখানে শীলা আর দিনিমের ব্যাপার নিয়ে মিসেস পেরিনার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলল টুপেনস।

মিসেস পেরিনার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে আসতে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল টুপেনস।

ছোট্ট বেটি টুকটুক করে ক্লে দম্পতির ফাঁকা ঘরে ঢুকছে। তার হাতে একখানা ছড়ার বই।

টুপেনস এগিয়ে এসে মজা করে দরজার আড়ালে দাঁড়াল। দেখল বেটি বইখানা এই ঘরের বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখছে আর আপন মনে বলছে–লুকিয়ে রাখি…লুকিয়ে রাখি।

ঘাড় ঘোরাতেই দরজায় দাঁড়ানো টুপেনসকে দেখতে পেল বেটি। অমনি খিল খিল হেসে উঠে ছুটে এলো তার কাছে।

টুপেনস ওকে হাত ধরে বাইরে আনল। জিজ্ঞেস করল ছড়া কেটে–ওরে বোকা চললে কোথা—

দুষ্টুমিভরা মুখে হেসে ওঠে বেটি, বলে লুকিয়ে রাখি–লুকিয়ে রাখি–ওই-

-ঠিক এই সময় মিসেস স্প্রট ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন, ছোঁ মেরে তুলে বেটিকে কোলে নিলেন।

বেটি তখনও বলছে–খোঁজ-খোঁজ-লুকিয়ে রাখি–

-না, এখন লুকোচুরি খেলতে হবে না–ঘরে চল।

.

বেটিকে নিয়ে মিসেস স্প্রট ঘরে ঢুকে গেলেন।

টুপেনস নিজের ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ায়। টুপিটা আগের জায়গায় নেই। কেউ ঢুকেছিল তার ঘরে। কে ঢুকল আবার?

কার্ল ভন দিনিম তো এখন হাজতে। মিসেস পেরিনা তার ঘরে। মিসেস ওরুরকিও সেখানে গল্পগুজব করছেন বসে। তাহলে এ কাজ করল কে?

আপন মনে হাসল টুপেনস। চলুক, চলতে থাকুক। মন্দ কী…

টুপেনস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা। এখনও যথেষ্ট সময় আছে।

পেনিলোপ প্লেনির চিঠিটা ড্রেসিং টেবিলের ওপরে চোখে পড়ার মতো করে ফেলে রাখল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ছোট্ট রেল স্টেশন এরো। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মার্সর্ডন তার জন্য নিকটবর্তী গ্রামে অপেক্ষা করে আছে। সরাসরি হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে বসল সে।

সুদর্শন এক যুবক বসেছিল চালকের সিটে। মাথা দুলিয়ে টুপেনসকে অভিবাদন জানাল।

গাড়ি স্টার্ট নিল।

.

ঘন গাছপালায় ঢাকা একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। এন্টনি মার্সডনকে এগিয়ে আসতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল টুপেনস।

–গতকালই আমরা মিঃ বেরেসফোর্ডের সন্ধান পেয়েছি, জানাল মাসর্ডন, তিনি ভালো আছেন। তবে শত্রু শিবিরে আরও ঘণ্টা বারো তাকে বন্দি অবস্থায় থাকতে হবে। একটা নির্দিষ্ট স্থানে গেস্টাপোদের একটা বোট আসবে, মিঃ বেরেসফোর্ডকে খুন করে নাকি ওই বোটেই পাচার করা হবে।

আমরা তার আগেই বোট সমেত সবকিছু দখল করে নেব। তাই শেষ মুহূর্তটি না আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

টুপেনস জিজ্ঞেস করল, পারবে তো?

–নিশ্চয়, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার কোনো বিপদ হবে না। জবাব দিল মার্সডন।

কাছেই স্তূপ করে রাখা ছিল একটা প্যারাস্যুট, কিছু জামাকাপড় আর এক খণ্ড ক্যানভাস। ওগুলোর দিকে আঙুল তুলে টুপেনস জিজ্ঞেস করল, এসব কী?

প্যারাসুট আর নার্সের পোশাক।

–এসব এখানে কেন?

–প্যারাসুট করে নেমে এসেছিল এক জার্মান নার্স। সে আপাতত আমাদের হাতে বন্দি। স্থানীয় এক চিকিৎসক ডাঃ বিনিয়নের চেম্বারে উপস্থিত হবার কথা ছিল তার।

–সাংঘাতিক ব্যাপার! তারপর?

–ডাঃ বিনিয়ন শত্রুপক্ষের লোক। আপনাকে নার্স সেজে তার চেম্বারে যেতে হবে।

–খাসা পরিকল্পনা। তাহলে মেকআপ

–সব বন্দোবস্ত আমরা করে রেখেছি–তবে খুবই ঝুঁকির কাজ।

–কিছু যায় আসে না, তোমরা প্রস্তুত থাকবে।

–আপনার নির্দেশ পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। বলল মার্সডন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখুঁত জার্মান নারীর ছদ্মবেশ নিয়ে নিল টুপেনস। এখন তার নাক সামান্য চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু। কিছু চুল কপালের ওপর আলগা হয়ে আছে।

মেকআপ শেষ করে নার্সের পোশাক পরে নিল টুপেনস। তারপর ঠিকানা নিয়ে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল। নির্জন রাস্তায় এভাবে পাঁচ মাইল পথ যেতে হবে তাকে।

১৪ নং এলসফা রোডে ডাঃ বিনিয়নের চেম্বার। বাড়ির সামনে পৌঁছে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল টুপেনস। তারপর কলিংবেল টিপল।

মধ্যবয়স্ক এক মহিলা দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখেই বোঝা যায় ইংরেজ নয়।

–ডাঃ বিনিয়ন? বলল টুপেনস।

–তুমি নার্স এন্টন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তাহলে অপারেশন থিয়েটারে চল।

মহিলা দরজা বন্ধ করে টুপেনসকে সঙ্গে করে দোতলায় উঠে এলো। ছোট্ট সার্জিকেল চেম্বার। স্ত্রীলোকটি টুপেনসকে বলল, এখানে বসো, ডাক্তার বিনিয়ন আসছেন।

টুপেনস অপেক্ষা করে থাকে। কাকে দেখতে পাবে বুঝতে পারছে না।

এক মিনিট পরেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়েই টুপেনসের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

কমাণ্ডার হেডক।

.

ছদ্মবেশী টুপেনসকে চিনতেও এক মুহূর্ত বিলম্ব হল না কমাণ্ডার হেডকের। কিন্তু অটল তার গাম্ভীর্য। জার্মান কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে ইংরাজিতে বললেন, তুমি তাহলে এসে গেছ?

-হ্যাঁ, স্যার, অকম্পিত কণ্ঠে বলল টুপেনস, আমি নার্স এন্টনি।

–নার্স, সকৌতুক হাসি ফুটল হেডকের ঠোঁটে, হ্যাঁ, এই পোশাকে নিখুঁত মানিয়েছে, তোমাকে। দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো।

টুপেনস সসম্ভ্রমে আসন নিল। অপেক্ষা করতে লাগল।

-তাহলে আমাদের এদিককার খবর তুমি জান সব…আঁ…আক্রমণের তারিখ কবে স্থির হয়েছে বলো তো?

–চার তারিখ।

সর্বসত্তায় কেঁপে উঠলেন হেডক। কপালের রেখায় দ্রুত ভাজ পড়ে।

–তাহলে দেখছি জেনে গেছ?

এক মুহূর্ত নীরব থেকে টুপেনস বলে, বলুন, আমাকে কী করতে হবে?

ভেতরের প্রচণ্ড উত্তেজনা চাপতে গিয়ে মুখ বিকৃত হয়ে উঠছিল হেডকের। কোনো রকমে বললেন, যথাসময়ে সবই জানতে পাবে। সান্স সৌচির নাম নিশ্চয় জানা আছে তোমার?

–ওই নাম আগে কখনও শুনিনি।

–শোননি বলছ?

–না। তীব্র স্বরে বলল টুপেনস।

হিংস্র হাসিতে মুখ বিকৃত হল হেডকের। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলেন, আশ্চর্য কাণ্ড, সান্স সৌচির নামই তুমি বলছ আগে শোননি। অথচ আমি জানি, গত একমাস ধরে ওখানেই তুমি আস্তানা গেড়ে আছ।

টুপেনসের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে।

বিদ্রুপের স্বরে হেডক বলে ওঠেন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, তাহলে ভালোই আছে বলা যায়, কী বলে?

সংযতকণ্ঠে জবাব দেয় টুপেনস, ডাঃ বিনিয়ন, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজই সকালে আমি এখানে প্যারাসুটে করে নেমেছি।

হা-হা অট্টহাসি হেসে উঠলেন হেডক।

–কত বোকা তোমরা ভেবে দেখ। ছেঁড়াফাটা একটা প্যারাস্যুট আর ক্যানভাসে কিছু জার্মান হরফ দেখেই ফাঁদে পা দিয়ে বসলে। হা-হা-শোন, আমি ডাঃ বিনিয়ন নই। বিনিয়ন হলেন আমার দাঁতের ডাক্তার। তার চেম্বারটি আমি কেবল মাঝে মাঝে নিজের কাজে ব্যবহার করে থাকি।

-তাই বুঝি! টুপেনসও সকৌতুকে মন্তব্য করে।

-হ্যাঁ, মিসেস ব্লেনকিনসপ। না, আমি তোমাকে আসল নাম মিসেস বেরেসফোর্ড বলেই বরং সম্বোধন করব।

এবারে আর চঞ্চল হল না টুপেনস। নিজেকে সে প্রস্তুত করে নিয়েছে। পরিণতি তার জানা। সে এখন মাকড়সার জালে বন্দি।

কোটের পকেট থেকে রিভলবার বার করে আনেন হেডক।

–কাজের কথা শোন। এখানে চেঁচামেচি জুড়বার চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। তোমাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না।

টুপেনস নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দেয়, আপনাকে জানিয়ে দিই, আমরা বন্ধুরা এ বাড়ির আশপাশেই ওঁত পেতে আছে।

আর এক দফা অট্টহাসি হেডকের। উল্লাসে ফেটে পড়ছেন যেন।

–তোমার পুরোনো দোস্ত মার্সড়নের ওপর দেখছি অগাধ আস্থা তোমার। আমি দুঃখিত মিসেস বেরোসফোর্ড, এন্টনি মার্সডন আমাদেরই লোক।

তোমাদের সিক্রেট সার্ভিসে ঢুকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে…তোমার এই সাহসিকতার প্রশংসা করলেও পরিণতির জন্য সত্যিই আমার আক্ষেপ হচ্ছে। যাইহোক, এবার বলো, সান্স সৌচি থেকে কতটা কী আবিষ্কার করলে?

টুপেনস নীরব। চোখে পলকহীন দৃষ্টি।

হেডক আবার বললেন, বুঝতে পারছি অনেক কিছুই জেনে গেছ। …বাকি অর্ধেকের খবর কী?

–একথার অর্থ?

-বুঝলে না, টমাস বেরেসফোর্ডের কথা জানতে চাইছি। সে-ও তো সান্স সৌচিতে ছিল। এখন অবশ্য আমার ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি যাচ্ছে।

-টমি–

-হ্যাঁ, টমি, উল্লাসে ফেটে পড়েন হেডক, সে এখন আমার থাবার মধ্যে। তবে তোমার ওপরেই নির্ভর করছে তার ভাগ্য। উলটো-পালটা কিছু বললেই টমির মাথা আঁঝরা হয়ে যাবে বুলেটে

চোখ নত করল টুপেনস। এক মিনিট নীরব রইল। পরে বলল, বলুন, কী জানতে চান?

–পথে এসো। আমাকে আগে বলল, এখানে তোমাদের নিয়োগ করেছে কে? তার সঙ্গে। তোমরা যোগাযোগ রাখ কীভাবে?

মৃদু হাসল টুপেনস। বলল, এসব কথার জবাব তো আমি মিথ্যাও বলতে পারি।

-তোমার প্রতিটি কথার সত্যতা আমি যাচাই করে দেখব।

এক মুহূর্ত নীরব থাকেন হেডক। তারপর চেয়ারটা টেনে টুপেনসের কাছাকাছি এনে বসলেন। তার মুখভাবের পরিবর্তন হল। নরম সুরে বলতে লাগলেন, তুমি কী ভাবছ আমি। জানি। শোন, সত্যিকথা বলতে, কর্মী হিসেবে তোমাকে ও তোমার স্বামীকে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাদের মতো সাহসী নরনারী যে কোনো রাষ্ট্রের সম্পদ। আগামী দিনে আমরা যে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলব, সেখানে তোমাদের খুবই প্রয়োজন।

যাইহোক, আমাদের নেতার আদৌ ইচ্ছে নেই এ দেশকে তার সাম্রাজ্যভুক্ত করা। তিনি চান, জার্মান শাসনের বাইরে থেকেই নিজের বলে বলীয়ান হয়ে উঠুক ব্রিটেন।

এই দেশেরই মহান সন্তানদের দ্বারা পরিচালিত হোক। দূর হোক সমস্ত দুর্নীতি, ঘুষ, নোংরামি ও মানসিক ব্যাধির।

দেশে দেশে এই পরিবর্তন আমরা আনতে চাই–গড়ে তুলতে চাই এক নতুন ইউরোপ। সেখানে বিরাজ করবে অবিচ্ছিন্ন শান্তি ও প্রগতি। মিসেস বেরেসফোর্ড, আমার অনুরোধ, তুমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের বিচার করে দেখো।

কমাণ্ডার হেডকের আবেগতপ্ত কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল টুপেনস। তার মনে হচ্ছিল, উষ্ণ আদর্শে উদ্বুদ্ধ যেন একজন খাঁটি ব্রিটিশ নাবিকের যাদুময় কথা শুনছে। মনে মনে হেডকের প্রশংসা করল সে।

একটা ফুরফুরে আবেগ যেন চঞ্চল হয়ে উঠল ভেতরে। কিছু না ভেবেই মনের খেয়ালে হালকা কণ্ঠে আবৃত্তি করে উঠল টুপেনস–

ওরে বোকা, চললে কোথা
সর, ওপাশে সর,
উঁচু নিচু ধাপ পেরিয়ে
ঢুকলে রানির ঘর।

শিশুপাঠ্য কৌতুক-ছড়ার এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যে হেডকের মধ্যে ঘটতে পারে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি টুপেনস।

সে হতভম্ব হয়ে দেখল, মুহূর্তের মধ্যে হেডকের কোমল মুখভাব পালটে গেল। চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন হেডক, দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলেন, বটে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।

গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন, অ্যান?

যে জার্মান মহিলা টুপেনসকে দরজা খুলে দিয়েছিল, ডাক শুনে সে ঘরে ঢুকল। হেডক তার হাতে পিস্তলটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি ভেতর থেকে আসছি–তুমি একটু নজর রাখো। দরকার মনে করলে গুলি করবে।

কথা শেষ করে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন হেডক।

টুপেনস নির্বিকার। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতে থাকে সামনের মহিলাটিকে।

–কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করো না, টুপেনসকে উদ্দেশ্য করে বলল জার্মান মহিলাটি, ইংরাজদের আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি।

গত যুদ্ধে আমার একমাত্র ছেলে ইংরেজদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। পুত্রশোকের আগুন আমার বুকে দিনরাত জ্বলছে।

সেই পোলিশ মহিলাটির কথা মনে পড়ে গেল টুপেনসের। আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে বেটিকে বুকের সঙ্গে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল।

গুলির মুখে প্রস্তুত তবু বেটিকে কোলছাড়া করবে না। এই অকৃত্রিম মাতৃস্নেহই সে দেখতে পাচ্ছে এখানেও।

চমকে ওঠে টুপেনস। অদ্ভুত এক আলো যেন সে দেখতে পায় চোখের সামনে। মাতৃস্নেহের সেই চিরন্তন আলোতে যেন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অভাবিতভাবে।

…মিসেস স্প্রট ইতস্তত করলেন না গুলি ছুঁড়তে আর বেটিকে আড়াল করে ধরে সেই গুলিতে প্রাণ দিলেন পোলিশ মহিলা। এ যেন রাজা সলেমানের সেই বিখ্যাত বিচার-কাহিনি। টুপেনসের মনে হল, সেই পোলিশ মহিলার মুখে সেদিন সে চিরন্তন মায়ের মুখের ছবিই দেখতে পেয়েছিল।

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন হেডক। উদ্ভ্রান্তের মতো গর্জন করে উঠলেন, কোথায় লুকিয়েছ সেটা, কোথায়, বলো।

টুপেনস হতবাক। কী লুকোবার কথা বলছেন হেডক সে বুঝতে পারছে না।

-তুমি এখন যাও।

অ্যানের হাত থেকে রিভলবারটা নিজের হাতে নিয়ে হুকুম করলেন হেডক।

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন হেডক। চেয়ারে বসে পড়লেন থপ করে।

–আমার হাত থেকে পার পাবে না তুমি, তোমার স্বামীও। আমি জানি কীভাবে কথা বার করতে হয়। বলো, কোথায় রেখেছ সেই বইটা?

চমকে ওঠে টুপেনস। হেডক তাহলে একটা বইয়ের সন্ধান করছেন। তাহলে একটা অস্ত্র পাওয়া গেল। খেলানো যাবে অন্তত কিছুক্ষণ।

টুপেনস ধীরে ধীরে বলল, সেটা যে আমি পেয়েছি জানলেন কী করে?

–আমাকে বোকা বানাবার বৃথা চেষ্টা করো না। ছড়াটা শিখলে কোত্থেকে?

-কিন্তু ভাবলেন কী করে সেটা আমি এখনও গোয়েন্দা দপ্তরে পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি?

-না তুমি পাঠাওনি। গতকাল থেকে যা যা ডাকঘরে দিয়েছ, সবই আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। আর বইটা তো পাওয়া যাচ্ছে না আজই। আমি বুঝতে পারছি, সকালে সান্স সৌচি থেকে বেরুবার আগে ওখানেই তুমি সেটা কোথাও লুকিয়ে রেখে এসেছ। আমাকে এত সহজে ফাঁকি দিতে পারবে না তুমি।

তিন মিনিট সময় আমি তোমাকে দিলাম। এর মধ্যে তোমাকে বলতে হবে বইটা কোথায় রেখেছ?

কথা শেষ করে হাতঘড়িটা খুলে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন হেডক।

-মিসেস বেরেসফোর্ড, মাত্র তিন মিনিট সময়

টুপেনসের মুখে অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির হাসির আভা। সমস্ত অঙ্কের হিসেব মিলে গেছে তার–মুহূর্তের ভাবনায় সকলের পরিচয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে তার কাছে।

এক দুই তিন চার করে মুহূর্ত গুণে চলেছেন হেডক। কিন্তু আট অবধি গুনে আর এগুতে পারলেন না।

একটা পিস্তলের শব্দের সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল হেডকের বিশাল দেহ। একরাশ বিস্ময় তার মৃত্যুকাতর দৃষ্টিতে।

হেডক নিজের হিসেবে এমনই তন্ময় হয়ে ছিলেন যে, পেছনের খোলা দরজা দিয়ে সাক্ষাৎ শমন এসে কখন এই ঘরে পা দিয়েছে, বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি।

বিভ্রান্ত টুপেনস চোখ তুলেই দেখতে পায় পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে মিঃ গ্রান্ট। পরক্ষণেই দু-জনে ঘর ছেড়ে লাফিয়ে বাইরে নেমে আসে। লাফিয়ে উঠে পড়ে অপেক্ষামান পুলিশের গাড়িতে।

এখুনি সান্স সৌচিতে পৌঁছতে হবে–একটা মুহূর্ত যেন নষ্ট না হয়। ওখানে একবার খবর পৌঁছে গেলে চক্রান্তের নায়িকাকে আর পাওয়া যাবে না। বলে উঠলেন গ্রান্ট।

মত্ত বেগে গাড়ি ছুটিয়েছেন মিঃ গ্রান্ট। একটা গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই একসময় টুপেনস প্রশ্ন করল, টমি কোথায়?

–মুক্ত। আধঘণ্টা আগে তাকে উদ্ধার করেছি।

উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে ঝড়ের গতিতে ছুটছে গাড়ি। ওই তো সান্স সৌচি দেখা যাচ্ছে বাগানের প্রবেশ পথ

গাড়ি থামতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল টুপেনস। তাকে অনুসরণ করলেন মিঃ গ্রান্ট।

হলঘরের দরজা যেমন থাকে বরাবর তেমনিই খোলা। ঘর জনশূন্য।

নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে থাকে টুপেনস। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে একপলক তাকাল নিজের ঘরের দিকে।

সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড। বিছানা বালিশ, ফালা ফালা কাগজপত্রে ছয়লাপ-ড্রয়ারগুলো খোলা। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ঘরের ভেতরে।

টুপেনস ঝট করে ক্লে দম্পতির খালি ঘরে ঢুকে পড়ল। একটানে বিছানার চাদর সরিয়ে ফেলতেই বাচ্চাদের পুরোনো ছড়ার বইটা বেরিয়ে পড়ল। ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিল টুপেনস। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিল মিঃ গ্রান্টের দিকে।

-এটাই খুঁজছিল হেডক-এরই মধ্যে সব আছে। অদৃশ্য কালিতে লেখা। সামান্য অসাবধানতার সুযোগে বাচ্চাটা খেলতে খেলতে বইটা ওখানে রেখে যায়–

হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ। ঝট করে ঘুরে তাকায় টুপেনস। দরজার সামনে দণ্ডায়মান মিসেস স্প্রট।

–কি ব্যাপার–আপনারা এখানে–

–মিঃ গ্রান্ট, টুপেনস আঙুল তুলে বলতে থাকে, ওই যে–আপনি যাকে খুঁজছিলেন বিখ্যাত নাৎসী-মহিলা স্পাই M–সান্স সৌচিতে ইনিই মিসেস স্প্রট।

.

টেবিল ঘিরে বসেছেন মিঃ গ্রান্ট, টমি এবং অ্যালবার্ট। সকলেরই সাগ্রহ দৃষ্টি টুপেনসের দিকে।

টুপেনস নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিয়েছে আগেই। সে-ও সবকিছু খুলে বলতে উৎসুক।

–নাও, এবার শুরু করো।

টমি অনুরোধ জানাল।

–তুমিই শুরু করো না, আমি পরে বলছি। বলল টুপেনস।

-আমার কথা তো যৎসামান্য। নেহাত দৈবক্রমেই বলা যায় আমি হেডকের ঘরের ট্রান্সমিটারের সন্ধান জেনে গিয়েছিলাম।

ওই সময় যেভাবে হেডক বাথরুমের দরজা ফাঁক করে তাকিয়ে ছিল, ভয় হয়েছিল, বুঝি এবারই আমাকে শেষ করে দেবে।

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, হেডক নিপুণ অভিনেতার মতো নিজেকে সংযত করে রাখল–আমাকে তার অভিসন্ধির আভাস মাত্র পেতে দেয়নি।

–ওই অভিনয় করেই তো সে সময়টা কাজে লাগিয়েছিল। একটু দেরি না করে সে ফোনে মিসেস টকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল।

আর মিসেস স্প্রটও সঙ্গে সঙ্গেই বাগানে ঢুকে তোমার অপেক্ষা করতে থাকে। তোমার মাথায় হাতুড়িটা ঠুকেছিল সেই।

ব্রিজ খেলার আসর ছেড়ে এসে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই সে কাজ হাসিল করেছিল। সে যখন ফিরে এলো, তাকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ ছিল না। তাকে কেবল ঘন ঘন শ্বাস নিতে দেখা গিয়েছিল।

–আমার বন্দিত্ব মোচনের কৃতিত্বটুকু অ্যালবার্টের প্রাপ্য। বলল টমি।

–হ্যাঁ, বললেন মিঃ গ্রান্ট, যথাসময়েই সে আমাকে খবরটা পৌঁছে দেয়।

আমরা যখন স্মাগলার্স রেস্টে পৌঁছই, তখন হেডক সেখানে ছিল না, কিছুক্ষণ আগেই গলফ ময়দানে বেরিয়ে গিয়েছিল। কটেজের দখল নিতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। পরে নৌকোটাও আমরা কবজা করে নিই।

-তোমার কথা এবারে বলো, টুপেনস। বলল টমি।

–আমার কথা বলতে হলে স্বীকার করতেই হয়, টুপেনস বলতে শুরু করে, আমার সামনে কোনো আলো ছিল না।

সকলকেই সন্দেহ করছি–সকলের চলন বলন অর্থপূর্ণ মনে হচ্ছে। তবে মিসেস স্প্রট ছিল বরাবরই আমার সন্দেহের বাইরে।

সেদিন দুপুরে আকস্মিকভাবেই টেলিফোনে আড়ি পাতার সুযোগ পেয়েছিলাম। ওই চতুর্থ, শব্দটা শুনেই খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

দুপুরে সান্স সৌচি ছিল একেবারে ফাঁকা। কেবল মিসেস ওরুরকি আর মিসেস স্প্রট এই দু-জনই উপস্থিত ছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার, মিসেস স্প্রটকে বাদ রেখে আমার সন্দেহ পড়ল মিসেস পেরিনা আর মিসেস ওরুরকির ওপর।

ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে সবকিছুর নায়িকা হচ্ছে মিসেস স্প্রট।

মহিলা এত সাদাসিদে থাকত যে সে এমন একটা চক্রান্তের মধ্যে থাকতে পারে সন্দেহ করবার কোনো অবকাশই ছিল না।

আমার চিন্তাধারা, কাজের অগ্রগতি সবই টমিকে জানিয়েছি। আমাদের আলোচনা থেকে মিসেস স্প্রট বরাবরই বাদ থেকেছে। টমি অপহৃত হবার আগে পর্যন্ত মিসেস স্প্রট সম্পর্কে আমার মন ছিল খোলা।

টমির অনুসন্ধানের ব্যাপারে অ্যালবার্টের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সেই সময়ই দারুণ চটপটে যুবক এন্টনি মার্সর্ডনের সঙ্গে আলাপ হল। সে জানায় একসময় টমির কিছু কাজও করে দিয়েছে।

অবশ্য মার্সডন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও আমি তাকে কখনওই পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি।

–কেন, বিশ্বাস করনি কেন? জানতে চাইল টমি।

–কারণ, মিঃ গ্রান্টের কাছে শুনেছিলাম, পঞ্চমবাহিনীর লোক সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের সার্ভিসেও যে তারা অনুপস্থিত নেই এ-বিষয়ে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

মার্সর্ডনকে আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করবার আগে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। ফল পেতেও দেরি হল না। সে একটা সঙ্কেতপূর্ণ চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিল। খবরটা যথাসময়েই আমি মিঃ গ্রান্টকে জানিয়ে দিলাম, তারপর মার্সডনের কৌশলে গিয়ে পড়লাম হেডকের আরেক আস্তানায়।

-কাজটা হয়েছিল দারুণ, হেসে বলে উঠলেন মিঃ গ্রান্ট, শত্রুরা ভাবতেই পারেনি আপনি যখন গ্রামের ভেতর দিয়ে পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে চলেছেন, তখন আমরাও আপনাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছি।

–তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, আপনি আসবেন। তাই ঝুঁকিটা নিতে ইতস্তত করিনি। যতক্ষণ পারা যায় আমি হেডকের সঙ্গে দরকষাকষি চালাতাম।

কিন্তু অদ্ভুত ঘটনাটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত রহস্যটাই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

–কী ঘটনা? উৎসুক হল টমি।

-বাচ্চাদের একটা ছড়া, বলল টুপেনস, ওরে বোকা চললে কোথা–কি জানি কেন মনে এলো, আমিও আবৃত্তি করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গেই দেখি ছিটকে লাফিয়ে উঠল হেডক। প্রবল ক্রোধে তার চেহারাটাই সম্পূর্ণ পালটে গেল।

অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা শিশু পাঠ্য ছড়া বলে তাকে উপহাস করেছি–এই ভেবে একটা লোক এতটা ক্রুদ্ধ কখনওই হতে পারে না। বিশেষ করে হেডক সেই সময় আবেগমথিত গলায় কথা বলে আমাকে ভজাবার চেষ্টা করছিল।

স্বভাবতই ছড়ার বইটার কথা আমার মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম, বইটার মধ্যেই এর রহস্য লুকিয়ে আছে।

এর পরের ব্যাপারটা পুরোপুরি হৃদয়বৃত্তি ঘটিত বলা যায়। হেডক অ্যানকে আমার প্রহরায় রেখে গিয়েছিল। তার মুখে আমি নিখাদ মাতৃত্বের ছায়া দেখতে পেলাম, যা দেখেছিলাম সেই পোলিশ স্ত্রীলোকটির মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল রাজা সলোমনের কথা বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না।

হঠাৎ এর মধ্যে আবার রাজা সলোমনকে টানলে কেন?

বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল টমি।

অনুকম্পার হাসি হাসল টুপেনস। একে একে অন্য দু-জনের মুখের ওপরেও তার দৃষ্টি ঘুরে গেল। সকলেই উগ্রীব নির্বাক।

টুপেনস বলল, কেন মনে পড়ল? মনে আছে সেই কাহিনি? একটি শিশুপুত্র নিয়ে দুই রমণী রাজার দরবারে উপস্থিত হয়েছিল। শিশুটির মাতৃত্বের দাবি জানিয়েছিল দু-জনেই।

রাজা সলোমন হুকুম করলেন, শিশুটিকে দুখণ্ড করে দু-জনকে দিয়ে দেওয়া হবে।

আসল মা আঁতকে উঠল। কিন্তু নকল মা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল।

আসল মা রাজাকে বলল, শিশুটিকে কেটো না। ওই রমণীকেই শিশুটি দিয়ে দাও।

এ হল সেই চিরন্তন মায়ের বুলি। সে কখনওই নিজের সন্তানের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না।

এবারে সেদিনের পাহাড়ের সেই ঘটনার কথা মনে করে রেখো।

হেডক গুলি ছুঁড়বার হুমকি দিতেই পোলিশ স্ত্রীলোকটি বেটিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরল–পাছে না তার গায়ে গুলি লাগে।

কিন্তু মিসেস স্প্রট একটুও ইতস্তত না করে ট্রিগার টিপে বসলেন। স্ত্রীলোকটি নিহত হল। কিন্তু ভেবে দেখো, ওই গুলিতে ছোট্ট বেটিও বিদ্ধ হতে পারত। মিসেস স্প্রটের মনে তেমন আশঙ্কা থাকলে কখনওই সে এভাবে গুলি করতে পারত না–আর তার শঙ্কিত না হওয়ার কারণ হল, সে শিশুটির গর্ভধারিণী নয়।

আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য হল, ওই শিশুটি মিসেস স্প্রটের মেয়ে নয়, তবুও কেন সে অমনভাবে গুলি করে পোলিশ রমণীটিকে হত্যা করল?

টুপেনস এক মুহূর্ত নীরব রইল। পরে ভারি গলায় বলল, কারণ ওই মহিলাই ছিল বেটির জন্মদায়িনী মা।

সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু মা কেবল তার সন্তান বেঁচে থাকবে, ভালো থাকবে এই আশায় তার সন্তানকে দত্তক দিয়েছিল। এমন ঘটনা-হৃদয় বিদীর্ণ করে।

–শিশুটিকে মিসেস স্প্রট দত্তক নিয়েছিল কেন? টমি জানতে চাইল।

–নিজের গুপ্তচরবৃত্তির কাজের সুবিধার জন্য–সান্স সৌচিতে নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য। এমনটা কখনওই সম্ভব নয় যে একজন প্রথম শ্রেণির গুপ্তচরও তার শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপজ্জনক খেলায় নামবে।

আমিও এই ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। শিশুটি সঙ্গে ছিল বলেই আমার সন্দেহের দৃষ্টি কখনও পড়েনি তার ওপরে।

কিন্তু দত্তক দিয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি বেটির জননী। যেভাবেই হোক সে মিসেস স্প্রটের ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল আর ঘুরে ঘুরে আসত যদি মেয়েটিকে একপলক দেখতে পায়।

এভাবেই একদিন সুযোগ পেয়ে সে বেটিকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। আমরা সকলেই শিশুটির কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লাম।

মিসেস স্প্রট কিন্তু সেই অবস্থাতেও পুলিশে খবর দেবার ব্যাপারে প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকে। এমনকি পুলিশে খবর দেবার পথ বন্ধ করার জন্য নিজের হাতে ভুয়ো হুঁশিয়ারিপত্র লিখে সকলকে ধোঁকা দেয়। পরে হেডককে খবর দেয় সাহায্যের জন্য।

পোলিশ মহিলাটিকে যে আবিষ্কার করা যাবে–এমনটা নিশ্চয় ভাবতে পারেনি তারা। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন আমরা সেই হতভাগিনীর নাগাল পেয়ে গেলাম–স্পট হুঁশিয়ার হয়ে গেল। সে আর ঝুঁকি নিতে চায়নি।

অব্যর্থ গুলিতে লক্ষ্যভেদ করে সে। এমন নির্ভুল লক্ষ্যভেদ কি কখনও এমন কারো দ্বারা সম্ভব–যে কোনো দিন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি।

অথচ আনাড়ি হাতে লক্ষ্যভেদ করেছে বলে আমরা বাহবা দিলাম মিসেস স্প্রটকে। সামান্য সহানুভূতিও পেল না হতভাগিনী। ভান্দা পলোনস্কা।

একটু থামল টুপেনস। পরে আবার বলতে শুরু করল, বেটির একটা ছেলেমানুষি খেলার মধ্যেও রহস্যের ইঙ্গিত ছিল। ব্যাপারটা আমাকে খুবই ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল।

উল লেস নিয়ে বেটি জলের গ্লাসে ঘোরাচ্ছিল। আসলে ওরকম একটা ব্যাপার বারবার তার চোখে পড়েছিল। তাই অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিল।

সে রাসায়নিকের সাহায্যে অদৃশ্য লেখা উদ্ধার করতে দেখেছিল মিসেস টকে-কার্ল ভন দিনিমকে কিন্তু নয়।

কার্ল এসবের সঙ্গে জড়িত নয় জেনে আমার আনন্দ হচ্ছে। ওকে আমি পছন্দ করি। বলল টমি।

টুপেনস আকুল স্বরে জানতে চাইল, দিনিমের কী খবর? তাকে নিশ্চয় গুলি করে মারা হয়নি?

মৃদু হেসে মিঃ গ্রান্ট জানালেন, না, সে নিরাপদেই আছে। আমার আশ্চর্য লাগছে, তার জন্য আপনারা এতটাই আগ্রহী ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।

টুপেনসের মুখে ভারমুক্ত উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল। বলল, শীলার কথা ভেবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। …নিজেদের বোকামির জন্য এখন লজ্জা হচ্ছে, মিসেস পেরিনাকেই আমরা চক্রের নায়িকা ভেবে নাকাল হয়েছি।

মিসেস ওরুরকি এবং নিরীহ ক্লে দম্পতিকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছি বোকার মতন।

টমি সশব্দে হেসে উঠল। বলল, আর মেজর ব্লেচলিকে তো আমি নজরের বাইরে যেতে দিতাম না।

–অথচ অতি সাদামাটা অস্থিরমতি এক মহিলার অভিনয় করে বেটির তথাকথিত মা আমাদের চোখের আড়ালে নিজের কাজ করে গেছে, ভাবা যায়? বলল টুপেনস।

–নিপুণ অভিনেত্রী বলতে হবে, বললেন গ্রান্ট, কিন্তু লজ্জা ও অনুতাপের ব্যাপার হল, এই ভয়ঙ্কর স্ত্রলোকটি জন্মসূত্রে ইংরেজ।

-একজন দেশপ্রেমী–সে যে জাতেরই হোক না কেন, সে শ্রদ্ধার পাত্র। এই মহিলা জার্মান হলে আমি তাকে সম্মান জানাতাম। কিন্তু এই দেশদ্রোহিণীর প্রাপ্য একমাত্র ঘৃণা।

-ভালো কথা, মিঃ গ্রান্টকে উদ্দেশ্য করে বলল টুপেনস, আপনি যা খুঁজছিলেন, সেটা পাওয়া গেছে?

–হ্যাঁ। বললেন মিঃ গ্রান্ট, সেই পুরোনো ছড়ার বইটাতেই ছিল।

–পুরোনো বই নোংরা বলে ধরতে চাইত না বেটি। মিসেস স্প্রট তাকে ওই ভাবে শিখিয়েছিল। ওই ভাবেই সে আসল জিনিস শিশুটির নাগালের বাইরে রাখতে চেয়েছে।

-বইটা সত্যিই সাংঘাতিক, বললেন মিঃ গ্রান্ট, আমাদের সামরিক পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা হুবহু ছক আঁকা রয়েছে ওই ছড়ার বইয়ের পাতায় পাতায়। সব অদৃশ্য কালিতে লেখা।

শুনে খুশি হবেন যে পঞ্চমবাহিনীর দায়িত্ব পালন করছিল যে-সব ব্যক্তি, তাদের প্রত্যেকের নাম আমরা উদ্ধার করেছি ওই বই থেকে। বহু জাঁদরেল ব্যক্তিও রয়েছে তাদের মধ্যে। এরা কাজ করে গেছে আমাদের সামরিক বিভাগ, গোয়েন্দা দপ্তর, ডাক বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে থেকে।

টুপেনস উজ্জ্বল চোখে তাকাল মিঃ গ্রান্টের দিকে। বলল, ওরা তাহলে আসবে

–হ্যাঁ, এবারে আসতে দিন, মৃদু হাসলেন মিঃ গ্রান্ট।

আসরে উপস্থিত হল টমি ও টুপেনসের দুই ছেলেমেয়ে ড্রেক ও ডেরক।

তাদের সঙ্গে এসেছে কাল ভন দিনিম ও শীলা পেরিনা।

কার্লকে কাছে পেয়ে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে শীলা, আমি জানতাম তুমি কোনো অন্যায় কাজ করতে পার না। কিন্তু ওরা কি তোমাকে এখনও নজরবন্দি করে রেখেছে?

কার্ল ভন দিনিম হেসে বলল, আমাকে কেন বন্দি থাকতে হবে?

একটু থেমে আবার বলল, শীলা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার কাছে আমার পরিচয় গোপন করেছিলাম। কার্ল ভন দিনিম আমার আসল নাম নয়-কাজের প্রয়োজনে ওই নামটা নিতে হয়েছিল।

টুপেনসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় দিনিম।

টুপেনস হেসে বলে, থামলে কেন, ওকে সবকথা এখন খুলে বল।

-কার্ল ভন দিনিম আমার এক বন্ধুর নাম, বলে দিনিম, বছর কয়েক আগে ইংলন্ডে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন আগে তার সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়েছিল জার্মানিতে। সেই সময় দেশের হয়ে কাজ করার জন্য আমাকে জার্মানিতেই থাকতে হয়েছিল।

তার মানে–তার মানে তুমিও ব্রিটিশ গোয়েন্দা।

বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলে শীলা।

-হ্যাঁ, শীলা, জন্মভূমির স্বার্থে। ওই সময় অনেক ঝড় গেছে আমার ওপর দিয়ে। দুবার আমাকে খুনের চেষ্টা হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।

তখন বুঝতে পারি, আমাদেরই গোয়েন্দা দপ্তরের কোনো কর্মী নাৎসীদের আমার আসল পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে।

কার্ল আর আমার চেহারার মধ্যে কিছুটা মিল ছিল। তার কারণও অবশ্য ছিল। আমার ঠাকুমা ছিলেন জার্মান। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ এই চেহারার সুবিধা বিবেচনা করেই আমাকে জার্মানিতে পাঠিয়েছিল।

কার্ল জার্মান হলেও নাত্সী ছিল না। বরং অত্যাচারী গেস্টাপোদের অন্তর থেকে ঘৃণা করত সে। নাৎসীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় কার্লের বাবাকে তারা খুন করেছিল, দুই ভাইকে কারাগারে পাঠিয়েছে। কার্লেরও অব্যাহতি পাবার কথা নয়। একই পরিবারের লোকের প্রতি তাদের ব্যবহারে ব্যতিক্রম ঘটবে কেন? দেশ ছেড়ে ইংলন্ডে পালিয়ে আসার কোনো সুযোগই কার্লের ছিল না।

কিন্তু কার্লের মুখ থেকেই একদিন শুনতে পেলাম, ইংলন্ডে পালিয়ে আসার ব্যাপারে নাৎসীরা কোনোরকম বাধার সৃষ্টিই করেনি। প্রয়োজনীয় সবরকম নথিপত্রই সে অনায়াসে হাতের কাছে পেয়ে গেছে।

সরলভাবেই এসব কথা আমার কাছে স্বীকার করেছিল কার্ল। তখনই আমার সন্দেহ হয়, নাৎসীদের এত সদয় হবার একটাই উদ্দেশ্য, তারা তাকে ইংলন্ডের মাটিতে ব্যবহার করতে চায়।

কালের প্রিয় বিষয় রসায়ন–সেই নিয়েই গবেষণায় ডুবে ছিল সে। ওই বিষয়ে আমারও যৎসামান্য দখল থাকায় বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়েছিল।

ওই সময়ে আমরা দুজনে একই বাড়িতে থাকতাম। সেখানেই একদিন ভোরে দেখতে পেলাম, নিজের বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে কাল। হাতে ধরা রিভলবার। অনুমান করলাম প্রচণ্ড মানসিক চাপ সইতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছে সে।

কার্লের লেখা একটা চিরকুট পড়েছিল পাশে। সেটা আমি গায়েব করলাম।

আমার তখন খুবই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। প্রাণ বাঁচাতে হলে আসু জার্মানি থেকে পালানো দরকার। ওই পরিস্থিতিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকেই সাজতে হবে কার্ল ভন দিনিম। এভাবে আত্মগোপন করার আর একটা উদ্দেশ্য আমার ছিল। কার্লকে ইংলন্ডে পাঠানো হচ্ছিল কেন, তা জানার সুযোগ পাব আমি।

কার্লের মৃতদেহে আমার নিজের পোশাক পরিয়ে দিয়ে আমি কার্ল সাজলাম। মাথার খুলি উড়ে যাওয়ায় কার্লের রক্তাপ্লুত মুখ সনাক্ত করার উপায় ছিল না। তাছাড়া বাড়ির মালকিনীও চোখে ভালো দেখতে পেত না। তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম।

কার্লের নথিপত্র যা ছিল সঙ্গে করে পাড়ি দিলাম ইংলন্ডে। কার্লকে যেতে বলা হয়েছিল লিহাম্পটনের সান্স সৌচিতে। তাই আমিও উপস্থিত হলাম সেখানে।

নির্ভেজাল কার্ল ভান দিনিম আমি। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে আমার কাজের বন্দোবস্ত করা  ছিল। যোগ দিলাম সেখানে।

ওখানে নিযুক্ত হবার পরে সন্দেহ হল, আমাকে নাৎসীদের জন্য নিশ্চয় কিছু করতে হবে। সতর্ক থাকলাম। পরে পরিষ্কার হয়ে গেল, আমার কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করা তাদের উদ্দেশ্য।

হলও তাই। সন্দেহবশত গ্রেপ্তার করা হল আমাকে। আমি অবশ্য নিজের আসল পরিচয় গোপনই রাখলাম।

ঠিক করেছিলাম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুখ খুলব না–দেখি ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। কিন্তু মাত্র দিন কয়েক আগে আমাদের বিভাগের একজন আমাকে চিনতে পারলেন।

শীলা অনুযোগের স্বরে বলল, আমাকে তো বলতে পারতে।

–আমি দুঃখিত শীলা।

ইতিমধ্যে নাচের আসরে যোগ দিয়েছিল ডেরক ও ড্রেক। গভীর অনুরাগে শীলার হাত জড়িয়ে ধরে কার্ল বলল, চলো শীলা, আমরাও নাচি

.

টমি ধীরে ধীরে টুপেনসের দিকে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, টুপেনস, শিশুটির কী হবে? সে কি আমাদের মধ্যে থাকবে?

টুপেনস আকুতি মাখা দৃষ্টি তুলে ধরে টমির দিকে। ধীরে ধীরে বলে, বেটি–তার কথা, তুমি মনে রেখেছ-তুমি বড়ো সহৃদয় টমি। আমি মা-বেটিরও মা

-তাই হবে টুপেনস-বেটিকে আমরা দত্তক নেব। ও আমাদেরই একজন হয়ে বড়ো হবে

-ও টমি।

গভীর আবেগে টমিকে জড়িয়ে ধরে টুপেনস।

Exit mobile version