Site icon BnBoi.Com

কার্ডস অন দি টেবল – আগাথা ক্রিস্টি

কার্ডস অন দি টেবল - আগাথা ক্রিস্টি

কার্ডস অন দি টেবল

১. মিঃ শ্যাতানা

 

০১.

মিঃ শ্যাতানা আর্জেন্টিয়ান, পর্তুগীজ, গ্রীক না অন্য কোনো জাতির লোক সে সম্বন্ধে কারো কিছু জানা নেই। ভদ্রলোক পার্ক লেনের আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে বাস করেন।

মাঝে মাঝেই তিনি নানা রকমের পার্টি দেন। সেই পার্টিতে বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই স্থানলাভ করেন। পার্টির একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে।

মিঃ শ্যাতানা এমনই লোক যে তাকে দেখলেই সকলে কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন।

সকলের ধারণা ভদ্রলোকের দৃষ্টি প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করছে। মিঃ শ্যানার রসিকতার ধরনটাও কেমন অদ্ভুত।

সকলে তাকে এই কারণে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে।

আজকে যাকে কেন্দ্র করে কৌতুকপ্রবণতা গেজিয়ে উঠলো তিনি হচ্ছেন খর্বাকৃতি পোয়ারো।

মিঃ শ্যাতানা পোয়ারোকে তার ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি বললেন, আমার ফ্ল্যাটে একদিন চলে আসুন, অনেক আকর্ষণীয় জিনিষ দেখাতে পারবো। আমার সংগ্রহশালায় কেবলমাত্র পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্যগুলোই স্থান পেয়ে থাকে।

অপরাধ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্য বস্তু বলতে আপনি তাহলে কি মনে করেন?

আমি তাদেরই বলছি, যারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ খুনী!

হ্যাঁ যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেও নির্বিঘ্নে তাদের কাজ হাসিল করে গেছে। যাদের ইতিহাস কেবল সফলতায় ভরা, কোনো ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ পর্যন্ত এই সমস্ত অপকীর্তির বিন্দুবিসর্গও জানে না।

তিনি আরও উচ্ছ্বসিত ভাবে বললেন, জানেন মিঃ পোয়ারো, কেউ যদি কোনো কাজ নিখুঁত শিল্পসম্মত উপায়ে সমাধা করতে পারে তবে তাকে নিশ্চয় পুরস্কার দেওয়া উচিত। সব খুনীকেই হাতকড়া পরিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে হবে, দূরদর্শিতার অভাব থেকেই আপনার মনে এমন ধারণার উদ্ভব হয়েছে। আমার মতে সরকারের তরফ থেকে এইসব খুনীদের জন্যে বিশেষ ভাতার বন্দোবস্ত থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেক সভ্য নাগরিকের কর্তব্য এদের মহাসমারোহে সান্ধ্য ভোজে আপ্যায়িত করা। তাই আপনাকে শুক্রবার আঠারো তারিখে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বলছি।

মিঃ শ্যাতানা বিদায় নিয়ে এগোলেন। পোয়ারো অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

.

০২.

শুক্রবার মিঃ পোয়ারো মিঃ শ্যাতানার ফ্ল্যাটে গেলেন। উর্দিপরা খানসামা তাকে দরজা খুলে দিলেন।

পোয়ারোকে মহাসমারোহে ভেতরে নিয়ে গেলেন শ্যাতানা। আসুন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই…।

ইনি হচ্ছেন শ্রীমতি অলিভার, গোয়েন্দা ও রহস্য গল্পের লেখিকা। ভদ্রমহিলার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। খুনীদের মানসিক গতিপ্রকৃতি, অপরাধীর প্রবণতা, গভীর তত্ত্বের কিছু প্রবন্ধও হালকা সুরে পরিবেশন করেছেন।

ভদ্রমহিলা হাসিমুখে পোয়ারোকে সাদর অভিবাদন জানালেন।

ধীর গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শ্যাতানা, সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেলের সঙ্গে নিশ্চয় আপনার আলাপ আছে?

লম্বাচওড়া ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সুচতুর অফিসারদের মধ্যে সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেলই সর্বশ্রেষ্ঠ।

শ্যাতানা আবার মুখ খুললেন, ইনি হচ্ছেন ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ ধুরন্ধর কর্মচারী, কর্নেল রেস।

পোয়ারো চিন্তা করল যে মিঃ শ্যাতানার অতিথি নির্বাচনের ক্ষমতা আছে।

এরপর আরও অতিথি একে একে প্রবেশ করলেন–ডাঃ রবার্টস…ইনি একজন বিচক্ষণ ডাক্তার এবং তার রোগনির্ণয়ের মধ্যে যে কোনো ভুল থাকে না, রুগীর মনে এ বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতেও ভদ্রলোক যথেষ্ট পারদর্শী।

এবারে মিঃ শ্যাতানাকে খানসামা এসে জানাল মিসেস লরিমার কথা।

মিসেস লরিমার বয়স ষাটের কাছাকাছি, ভব্যসভ্য পোষাকআসাক, মাথার চুল ধূসর বর্ণের, গলার স্বরও বেশ তীক্ষ্ণ।

খানসামার কণ্ঠস্বর আবার ধ্বনিত হলো–মেজর ডেসপার্ড। দীর্ঘকায় স্বাস্থ্যবান পুরুষ হচ্ছেন ইনি। নানাধরনের শিকার সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা গল্প করতে লাগলেন দুজনে।

এবার প্রবেশ করলেন…মিস মেরিডিথ…, ইনি সেদিনের শেষ অতিথি। বয়স বাইশ তেইশের মধ্যে। সর্বাঙ্গে একটা বিষাদকোমল শ্ৰী আছে।

মিস মেরিডিথের সঙ্গে মিঃ পোয়ারোর আলাপ করিয়ে দিলেন মিঃ শ্যাতানা।

মিস মেরিডিথ বললেন, আমি আপনার বিষয়ে অনেক কথাই কাগজে পড়েছি। এ.বি.সি. মার্ডারের মতো রোমহর্ষক মামলার আসামীকে আপনিই তো পুলিসের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের বড় বড় কর্তারা এই রহস্যের কোনো হদিশ পাচ্ছিলেন না।

মিস মেরিডিথ এবার মিঃ শ্যাতানার সম্বন্ধে বলতে শুরু করলেন কিন্তু মাঝপথে থেমে গেলেন।

পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বাকিটা ব্যক্ত করলেন। ভদ্রলোক খুবই অপরাধপ্রবণ। তার চোখের দৃষ্টিও ক্রুর। তাকে দেখলে লোকের মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। কিন্তু ভদ্রলোকের ডিনারটা খুবই উপভোগ্য।

ইতিমধ্যে ডিনারের ডাক পড়লো। পোয়ারোর অনুমান সর্বৈব সত্য রাজকীয় আয়োজন খাদ্য তালিকায় ত্রুটিহীন পরিবেশন।

অতিথিরা সবাই খুব তৃপ্তি করে এবং রসিকতা করতে করতে এই ডিনারটি উপভোগ করলেন। ডিনার সারতে সারতে এক একজন নানাধরনের খুনের প্রক্রিয়া ব্যক্ত করতে লাগলেন।

মেজর ডেসপার্ড শুষ্ক স্বরে বললেন, বুনো জাতিরা স্বভাবতই প্রাচীন পন্থী। তারা তাদের পিতা-প্রপিতামহের বহু ব্যবহৃত পুরানো পন্থাই অনুসরণ করে চলে।

শ্ৰীমতী অলিভার বললেন, আমি ভেবেছিলাম ওরা শেকড়বাকড় নিয়ে নানাধরনের প্রক্রিয়া চালায় খুনের জন্য কিন্তু এখন দেখছি এটা সত্যি নয়।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল এ সম্বন্ধে তার বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি বললেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে তারা সাধারণতঃ সাবেকী আর্সেনিকই পছন্দ করে। এটা অনেক সহজলভ্য তবে মহিলাদের মধ্যে অনেক প্রথম শ্রেণীর অপরাধী আছে যারা সাংঘাতিক জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও খুব মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে।

মিঃ শ্যাতানা হেসে বললেন, বিষই হচ্ছে মহিলাদের প্রধান অস্ত্র।

খুনের ব্যাপারে ডাক্তারদের সুযোগসুবিধা প্রচুর। শ্যাতানার চিন্তার কালোছায়া এই উক্তির জন্য ডাক্তার রবার্টস রাগত স্বরে বললেন, আমি এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করছি তবে ভ্রমক্রমে আমরা কখনো কখনো রুগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াই সেটা নিছকই দুর্ঘটনা।

মিঃ শ্যাতানা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তবে আমি যদি কাউকে খুন করতে যাই তাহলে আমি সোজা রাস্তাই অবলম্বন করবো যেমন শিকার করতে গিয়ে ভুল করে অন্য কাউকে মেরে বসা; অথবা অন্যমনস্কভাবে কোনো অসুস্থ রোগীকে বিষাক্ত কোনো ওষুধ খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

সারা ঘর নীরব হয়ে গেল।

.

০৩.

সবাই খাওয়াদাওয়া সেরে ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। বেয়ারা কফি দিয়ে গেল। শ্যানা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা সবাই আসুন সবাই মিলে ব্রীজ খেলা যাক। ব্রীজের জন্য টেবিল পাতা হলো। পার্টনার নির্বাচন করা হল এবং পুরোদমে তাস খেলা শুরু হয়ে গেল।

মিঃ শ্যাতানার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি আজ মনে মনে ভাবলেন তার অতিথিরা তাকে অফুরন্ত আনন্দের ইন্ধন জোগাচ্ছে।

পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে কর্নেল বললেন, পাঁচটা ডায়মণ্ডের খেলা হলো, তার অর্থ গেম এবং রাবার, তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে, স্পেড লিড পড়লে কি হতো বলা যায় না!

কর্নেল রেস ঘড়িটার দিকে তাকালেন, রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট একটা রাবার হতে পারে।

ব্যাটেল রাজী হলেন না। আমার বেশি রাত জাগা সহ্য হবে না।

ক্ষুণ্ণ চিত্তে কর্নেল রেস হিসাব কষতে বসলেন। ফলাফলে মহিলারা হারলেন মোট তিন পাউণ্ড সাত শিলিং।

শ্ৰীমতী অলিভার হাসিমুখে সব হিসেব মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এবার সবাই বিদায় নেবার জন্য উঠে পড়লেন, সকলেই মিঃ শ্যাতানার ঘরে একে একে প্রবেশ করলেন। তিনি পাশের ঘরে চেয়ারে চোখ বুজে শুয়ে আগুন পোহাচ্ছেন।

কর্নেল রেস শ্যানার চেয়ারের দিকে এগোলেন, বললেন, এবার আমরা বিদায় নেবো মিঃ শ্যাতানা। কিন্তু কর্নেলের কথার কোনো উত্তর দিলেন না মিঃ শ্যাতানা।

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে নিদ্রামগ্ন শ্যানার হাত অল্প তুলে ধরলেন। তারপর ব্যাটেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি একটু দেখুন। মিঃ ব্যাটেল শ্যানার কোটের ফাঁকে উঁচু হয়ে থাকা শক্ত জিনিষটা স্পর্শ না করে যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে দেখে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, খুবই দুঃখের সঙ্গে আপনাদের জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে গৃহস্বামী শ্যাতানা মারা গেছেন।

সবাই অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠলেন, ভদ্রলোক যে প্রকৃতই মারা গেছেন সে বিষয়ে কি আপনি একেবারে নিশ্চিত। ডাক্তার রবার্টস প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।

ব্যাটেল তাকে বাধা দিলেন, এক মিনিট, ডাক্তার রবার্টস। ইতিমধ্যে কে কে ঘরে প্রবেশ করেছেন।

রবার্টস প্রথমটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। তার মানে?..আপনার কথার মর্মার্থ কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।…আমরা কেউই বাইরে…যাইনি। ভেতরেও কেউ ঢোকেনি।

ব্যাটেল সকলের দিকে তাকিয়ে মাপা তালে মাথা দুলিয়ে বললেন, বুকে ছুরি বসিয়ে ভদ্রলোককে খুন করা হয়েছে। ব্যাটেল লক্ষ্য করলেন প্রত্যেকেরই শরীর ঈষৎ কেঁপে উঠলো। চোখ মুখে আতঙ্ক ভয় ও উত্তেজনার শিহরণ। মেজর ডেসপার্ড অল্প ইতস্ততঃ করে উঠে দাঁড়ালেন। তার দাঁড়াবার ভঙ্গীতে সৈনিকের দৃঢ়তা। আমার মনে হয় আমরা সকলেই কোনো না কোনো সময় ব্রীজ টেবিল ছেড়ে দরজার কাছে গিয়েছিলাম।

ব্যাটেল তাই মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, এই বিষয়ে আলোচনা করবার জন্যে আপনাদের পাশের ঘরে যেতে অনুরোধ করছি।

চারজন ব্রীজ খেলোয়াড় ধীরে ধীরে পাশের ঘরের দিকে এগোলেন।

ব্যাটেল ফোন তুলে হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠালেন। স্থানীয় পুলিস বাহিনী এখনই এসে পড়বে। হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ, আমি যেন এই তদন্তের ভার গ্রহণ করি।

তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোক কতক্ষণ আগে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়।

পোয়ারো বললেন, আমার মনে হয় ঘণ্টাখানেক তো হবেই।

ব্যাটেল অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, হত্যাকারীর প্রকৃত উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?

ইতিমধ্যে পুলিস বাহিনী এসে পড়েছে। দরজা ঠেলে ডিভিশনাল সার্জন ঘরে প্রবেশ করলেন। ডান হাতে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ তার পেছনে পুলিস ইনসপেক্টর, সঙ্গে ক্যামেরাম্যান। সবার শেষে পুলিস কনস্টেবল। রুটিন বাঁধা পুলিসী কাজ শুরু হয়ে গেলো।

.

০৪.

ইতিমধ্যে পুরো এক ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে।

মৃতদেহ পরীক্ষা করবার পর বিভিন্ন ভাবে তার ফটো নেওয়া হয়েছে। একজন ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশারদও এসেছিলেন।

ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা ডিনার পার্টিতে মিঃ শ্যাতানা আপনাকে কি যেন বোঝাতে চেয়েছিলেন।

পোয়ারো উত্তর দিলেন, ভদ্রলোক ছিলেন অতিমাত্রায় দাম্ভিক। ভাবতেন শয়তানের শ্রেষ্ঠ অনুচর সেজে পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করে যাবেন। এই গর্বেই মারা পড়লেন।

ব্যাটেল মনে মনে বিড়বিড় করলেন, তাহলে মোট আটজন নিমন্ত্রিত–তার মধ্যে চারজনের ভূমিকা শুধু দর্শকের, বাকি চারজন হত্যাকারী।

দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন মিসেস অলিভার, অসম্ভব! এর মধ্যে কেউ খুনী হতে পারে না। এখানে সকলেই বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

ব্যাটেল ধীর ভাবে মাথা দোলালেন, এই বিষয়ে এখনই একেবারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। খুনীরাও অনেক সময় আপনার আমার মতো পোষাক পরে থাকে। বাইরে থেকে তাদের বোঝা যায় না। মিঃ শ্যাতানা হয়তো আজকের ভোজসভায় কতিপয় খুনীদের এক অভূতপূর্ব সম্মেলন ঘটাতে চেয়েছিলেন।

পোয়ারো মাথা নাড়লেন, ভদ্রলোকের একটা খ্যাতি ছিলো। ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতায় ভদ্রলোকদের আর বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা উচিত হবে না। এবার তাদের জবানবন্দি নেওয়া প্রয়োজন।

তাহলে আমরা না হয় বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি? কর্নেল রেস উঠে দাঁড়াবারা ভাব দেখালেন।

….ব্যাটেল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, না, না, আপনারা সকলেই থাকতে পারেন।

ব্যাটেল উঠে দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত কনস্টেবলকে ডাক দিলেন, পাশের ঘরে এণ্ডারসন ডিউটিতে আছে। ওকে গিয়ে বলবে অতিথিদের মধ্যে ডাক্তার রবার্টস যেন অনুগ্রহ করে একবার আমার সামনে হাজির হন।

ডাক্তার রবার্টস দ্রুতপায়ে ঘরে প্রবেশ করলেন, সত্যি সুপারিন্টেন্টে, কি সাংঘাতিক একটা ব্যাপারের মধ্যে আমরা জড়িয়ে পড়লাম, ছুরি মেরে কাউকে খুন করা…। না, এতোখানি দুঃসাহস আমার নেই। আর তাছাড়া ওনাকে ভালো করে আমি চিনি না পর্যন্ত সুতরাং ওনাকে খুন করবার পেছনে আমার বিন্দুবিসর্গ কারণ নেই।

ব্যাটেল নীরস ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন। আপনার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম, তবে আপনি জানেন আমাকে আইনমাফিক তদন্ত চালাতে হবে। ঘরের অপর অতিথিদের সম্বন্ধে কিছু জানেন?

না, দুঃখিত কিছু জানি না।

যাইহোক মিঃ ব্যাটেল সবাইকেই জেরা করলেন। জেরা করে জানতে পারলেন তিনজনই টেবিল ছেড়ে উঠেছিলেন কিন্তু মিঃ শ্যাতানার দিকে কেউই লক্ষ্য করেননি যে তিনি ঠিক তখন কি করছিলেন।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, আপনি নিশ্চয় খুঁজে বার করতে পারবেন যে কে খুনী। তবে আপনার তিনজনের মধ্যে কাকে খুনী বলে মনে হয়?–মিঃ ব্যাটেল ডাক্তার রবার্টসকে জিজ্ঞাসা করলেন।

ডাক্তার রবার্টস থতমত খেয়ে বললেন, আমার মনে হয় মেজর ডেসপার্ডই হত্যাকারী। ভদ্রলোকের নার্ভ খুবই শক্ত একমাত্র তিনিই এই ঝুঁকি নিতে পারেন।

এখানে মহিলাদের কোনও ভূমিকা নেই, কারণ এই খুনের পিছনে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন।

ব্যাটেল তাড়াতাড়ি বললেন, না, ওনাকে একটা লম্বা পাতলা ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ডাক্তার রবার্টস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠলেন, কি সাংঘাতিক ব্যাপার!

ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি বক্তব্য আছে তা প্রকাশ করুন।

পোয়ারো স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে হাত নাড়লেন এবং প্রশ্ন করলেন, আপনারা কটা রবার খেলেছিলেন?

রবার্টস চটপট জবাব দিলেন, তিনটে।

আমার আরও দুটি প্রশ্ন, এক হচ্ছে হারজিতের ভাগে কার কি রকম ভূমিকা এবং দুই ব্রীজ খেলোয়াড় হিসেবে এঁদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?

মিসেস লরিমা একজন দক্ষ খেলোয়াড়। মিস মেরিডিথ এমন কিছু ভালো নয়।

আর আপনি?

হা…আমি সাধারণত হাতের তাসের তুলনায় ডাকটা বেশি দিয়ে থাকি। এতে আমার লোকসানের থেকে লাভ হয় বেশি।

পোয়ারো বিজ্ঞের মত হাসলেন। চেয়ার ছেড়ে রবার্টস উঠে দাঁড়ালেন, তবে আজ চলি, শুভরাত্রি, বলে দ্রুত পায়ে ডাক্তার রবার্টস ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

.

০৫.

ব্যাটেল এবার মিসেস লরিমাকে জেরা শুরু করলেন। মিঃ শ্যাতানাকে আপনি নিশ্চয় খুব ভালো করে চিনতেন?

না। ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ভাবে কখনো মিশিনি।

তার সম্বন্ধে আপনার কি রকম ধারণা?

তাকে একজন প্রকৃত সৎ ব্যক্তি বলে মেনে নেওয়া কঠিন।

মাপ করবেন; একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হচ্ছি। মিঃ শ্যাতানার মৃত্যুতে আপনার কোনো স্বার্থসিদ্ধি ঘটবে না নিশ্চয়ই?

চিন্তিত চিত্তে মিসেস লরিমা বললেন, না সুপারিন্টেন্ডেন্ট, মিঃ শ্যাতানার মৃত্যুতে আমি কোনো লাভবান হবো না।

আপনার বাকি তিনজন সঙ্গী সম্বন্ধে কোনো কিছু বলতে পারেন?

ওদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু আমি জানি না।

আচ্ছা আপনি চেয়ার ছেড়ে ক বার উঠে গিয়েছিলেন?

একবার ডামি অবস্থায় আমি চেয়ার ছেড়ে ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়েছিলাম। মিঃ শ্যাতানা তখন জীবিত ছিলেন।

লরিমাকে ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন, এই তিনজনের মধ্যে কাকে আপনি খুনী বলে সন্দেহ করেন?

লরিমা বললেন, এ প্রশ্নটা আমার কাছে রীতিমতো অসঙ্গত বলে মনে হয়।

এর পর মিসেস লরিমাকে প্রশ্ন করলেন মিঃ পোয়ারো। আচ্ছা ম্যাডাম ব্রীজ খেলোয়াড় হিসেবে এঁদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা।

অসীম ধৈর্যসহকারে মিসেস লরিমা বললেন, মেজর ডেসপার্ড হিসেবী খেলোয়াড়।

ডাক্তার রবার্টসের হাতের খেলা খুবই ভালো, মিস মেরিডিথের খেলাও মন্দ নয়।

অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাডাম, আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।

মিসেস লরিমা চারজনের সঙ্গে করমর্দন করে শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলেন।

.

০৬.

পোয়ারোকে ব্যাটেল বললেন, ভদ্রমহিলা একটু প্রাচীন পন্থী, অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল। অবশ্য কিছুটা একগুঁয়েও।

পোয়ারো স্কোরের কাগজগুলো যত্ন করে টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন। এবং বললেন, আমরা এর ভেতর থেকে নিগূঢ় সত্যের ইঙ্গিত পেতে পারি। মিস মেরিডিথ অতিমাত্রায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, শ্বাসপ্রশ্বাসও কেমন এলোমেলো। চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া।

মিঃ ব্যাটেল ত্বরিৎ পায়ে উঠে গিয়ে মেরিডিথের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতে সাহায্য করলেন।

অযথা নার্ভাস হবেন না। আমি জানি এ ধরনের ঘটনাবলী স্নায়ুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

মিস মেরিডিথ বললেন, কি ভয়ঙ্কর একবার ভাবুন…আমাদেরই চারজনের মধ্যে একজন খুন করেছে।

আচ্ছা মিস মেরিডিথ মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

মিস মেরিডিথ উত্তর দিলেন, সত্যি বলতে কি ওনার সাথে আমার তেমন পরিচয়ই নেই, ভদ্রলোককে আমি একটু ভয় করেই চলতাম।

যাক এবার আসল কথায় আসা যাক, আপনি কি ব্রীজ খেলার সময় কখনো নিজের আসন ছেড়ে উঠেছিলেন?

হ্যাঁ, একবার বোধহয় উঠেছিলাম।

ঠিক আছে, এবার বলুন, অপর তিনজনের সম্বন্ধে কিছু জানেন কিনা।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মেজর ডেসপার্ড এ কাজ করেছেন বা দলের অন্যান্যরাও একাজ করতে পারে না।

মিঃ ব্যাটেল এবার বললেন, তাহলে আর মিছিমিছি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? এবার আপনি যেতে পারেন।

মিস মেরিডিথ বিদায় দিলেন। শ্রীমতী অলিভার লঘু অথচ গম্ভীর সুরে মন্তব্য করলে, আমার মনে হয় এই মেয়েটাই আসলে খুনী।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল কনস্টেবলকে আদেশ দিলেন মেজর ডেসপার্ডকে ডেকে দেবার জন্য।

.

০৭.

দ্রুত পায়ে মেজর ডেসপার্ড ঘরে প্রবেশ করলেন।

আপনাকে এতক্ষণ আটকে রাখবার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।

যাক, মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা কতটা ছিলো?

দেখুন ওনার সাথে মাত্র দুবার আমার দেখা হয়েছিলো।

এক মাস আগে বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়ে আলাপ হয়। আর একবার তিনি একটা ককটেল পার্টিতে আমাকে আহ্বান জানান।

ব্যাটেল আবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিঃ শ্যাতানাকে অপছন্দ করবার মতো আপনার কোনো কারণ আছে?

হা… অসংখ্য কারণ আছে। তবে হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিল না।

ব্যাটেল জিজ্ঞাসা করলেন, মিঃ শ্যানার অপকীর্তি সম্বন্ধে কি জানেন?

মেজর ডেসপার্ড অবহেলা ভরে বললেন, এর ওর গোপন ব্যাপারে নাক গলাননা পরলোকগত মিঃ শ্যাতানার একটা স্বভাব ছিলো। উনি কোনো নারীঘটিত ব্যাপারেও জড়িত থাকতে পারেন।

ওসব কথা থাক। এঁদের মধ্যে কাকে আপনি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন?

একাজ আমি করিনি আর মিস মেরিডিথ ও মিসেস লরিমার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভবই নয়।

ব্রীজ খেলার সময় আপনার এবং অন্য সকলের গতিবিধির কথা কিছু স্মরণ করতে পারেন?

দুবার মাত্র আমি আসন ছেড়ে উঠেছিলাম। প্রথমবার সাড়ে দশটার সময় আর তার আধঘন্টা পরে দ্বিতীয়বার উঠেছিলাম। মিসেস লরিমা একবার উঠেছিলেন এবং মিস মেরিডিথ একবার ঘরের চারধারে পায়চারী করেছিলেন। তবে ডাক্তার রবার্টস প্রায়ই তার চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলেন।

মিঃ ব্যাটেল আর একটা প্রশ্ন করলেন–ব্রীজ খেলোয়াড় হিসেবে এই তিনজনের সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

মিস মেরিডিথ ও মিসেস লরিমা সত্যিই ভালো খেলে। লরিমা তো একজন জাত খেলোয়াড়।

আপনি আর কোনো প্রশ্ন করবেন, ডেসপার্ড জিজ্ঞাসা করলেন।

না, আর কোনো প্রশ্ন নেই। আপনি আসতে পারেন, ব্যাটেল জানালেন।

ডেসপার্ড বিদায় নিলেন শুভরাত্রি জানিয়ে।

.

০৮.

সবাই নির্বাক। ব্যাটেলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রত্যেকের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে গেলো। শ্রীমতী অলিভার তার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করতে এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ওই মেয়েটা আর নয়তো ডাক্তার রবার্টস খুন করেছেন মিঃ শ্যাতানাকে। এই বিষয়ে তাদের কেউ কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহ দেখালেন না।

মিনিট দুয়েক সকলেই নির্বাক। ব্যাটেল এবার আলোচনায় মুখর হলেন। প্রথমে ডাক্তার রবার্টসের কথা স্মরণ করুন, ভদ্রলোককে সন্দেহ করবার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। বুকের ঠিক কোথায় আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে অভিলাষিত ফল পাওয়া যাবে এটা তিনি বেশ ভালোই জানেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ নেই। এবার আসছেন মেজর ডেসপার্ড। এনার মানসিক শক্তি খুবই সুদৃঢ়। ইনি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত। মহিলাদেরও সন্দেহ করবার মতো অবকাশ আছে। মিসেস লরিমার নার্ভ ভীষণ শক্ত তিনি একজন আদর্শবাদী মহিলা। তিনি কাউকে খুন করেছেন এটা কল্পনাতীত। সবশেষে মিস মেরিডিথ তার সম্বন্ধে কিছু আমাদের জানা নেই।

আলোচনা বেশ জমে উঠেছে হঠাৎ অতি উৎসাহের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন শ্রীমতী অলিভার, আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে, সেটা হচ্ছে আমরা সংখ্যায় চারজন সবাই গোয়েন্দা বিভাগের ক্রিয়া পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত সুতরাং আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের সন্দেহভাজন এক একজনের ওপর নজর রাখি আর তাছাড়া আমরা আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যাব।

ব্যাটেল এই প্রস্তাবে রাজী হলেন না। তিনি বললেন, পুরো তদন্তটা আমাকেই চালাতে হবে। এর মধ্যে আইনের প্রশ্ন জড়িত তাছাড়া ব্যক্তি নির্বাচনেও আমাদের মধ্যে মতান্তর দেখা দিতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে কে কার ওপর নজর রাখবে সেটাও একটা সুবিপুল সমস্যার ব্যাপার।

শ্ৰীমতী অলিভার হতাশ হলেন, কিন্তু প্ল্যানটা খুবই চমৎকার ছিলো। যাইহোক আমি যদি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালাই তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বাধা দেবেন না।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, না। তাতে আমার খুব বেশি আপত্তি থাকবে না। তবে এই সব খুনের মামলায় মাথা না গলানোই বুদ্ধিমানের কাজ।

কিন্তু আমি আমার তদন্তের ফলাফল সম্পূর্ণ গোপন রাখবো।

কর্নেল রেস এবার বলে উঠলেন, আমি ডেসপার্ডের ব্যাপারে যাবতীয় খোঁজখবর এনে দেবো। তবে দু-চারদিন সময় লাগবে।

অজস্র ধন্যবাদ, এতেই আমাদের অনেক উপকার হবে। কি ধরনের অনুমান করতে পারছেন।

হ্যাঁ, অনুমান করতে পারছি। যেমন ভদ্রলোক কোনো শিকার দুর্ঘটনা বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা ইত্যাদি।

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন।

কর্নেল রেস মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

এবার মিঃ ব্যাটেল হঠাৎ পোয়ারোকে বলে উঠলেন, আচ্ছা আপনি এই চারজনের মানসিক গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কি অভিমত পোষণ করেন?

পোয়ারো উত্তর দিলেন, এদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর প্রত্যেকের সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা জন্মেছে। এই হত্যার ব্যাপারে দুটি জিনিষ খুব স্পষ্ট। প্রথমত খুনীর মনের জোর অসাধারণ, দ্বিতীয় আত্মম্ভরিতাও তার বিপুল। এবার ডাক্তার রবার্টসের ব্রীজ খেলার কথা চিন্তা করুন। ভদ্রলোক ভাওতা দিতে ওস্তাদ। বিপদে পড়লে ঝক্কি সামলাতে পারবেন।

আবার এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সন্দেহের তালিকা থেকে মিস মেরিডিথকে বাদ দেওয়া যায় কারণ তিনি খুবই ভীত এবং নার্ভাস মহিলা। সুতরাং তার পক্ষে এই হত্যা ঘটানো অসম্ভব। এবার আসে মেজর ডেসপার্ড। চিন্তাশীল আত্মবিশ্বাসী মানুষ। অপরিহার্য মনে করলে যে কোনো রকমের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। সবশেষে মিসেস লরিমার বয়স ষাটের কাছাকাছি প্রখর বুদ্ধিমতী। স্বভাব বেশ শান্ত। তিনি যদি কোনো অপরাধ করেন তবে বেশ ভেবে চিন্তেই অগ্রসর হবেন। অঙ্কের মতো সবকিছু হিসেব করে চলেন। সেইজন্য আজকের খুনটা তার পক্ষে না করাই সম্ভব।

পোয়ারো খানিক দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, তাহলে দেখতে পাচ্ছেন আমাদের সামনে এখন মাত্র একটা পথই খোলা–তা হচ্ছে অতীত।

ব্যাটেল বিড় বিড় করে বললেন, পরিস্থিতিটা খুবই জটিল। আমরা অনেক সময় কোনো গণ্ডগোলের ব্যাপার আঁচ করতে পারি, বুঝতে পারি কেউ কোনো চালাকি খেলছে কিন্তু নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া খুব কষ্টকর হয়।

এই মামলাটা অনেকদিন গড়াবে। অনেক ঝামেলা দেখা দেবে, প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কিছুই প্রায় হাতের কাছে নেই। আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হচ্ছে চারজন খুনীর ইতিহাস সংগ্রহ করা। একজন দুজন হলে তবু না হয় চেষ্টা করে দেখা যেত। মানব প্রকৃতির মধ্যে মৌলিকত্বের একান্তই অভাব! দার্শনিক ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন পোয়ারো।

শ্ৰীমতী অলিভার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন। মহিলাদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। কেবল তারাই নিত্য নব উপায় উদ্ভাবন করতে পারে। এক মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে তার দুই চোখ নতুন ভাবনায় উদ্ভাসিত হলো। আচ্ছা যদি এই চারজনের মধ্যে কেউই মিঃ শ্যাতানাকে খুন না করে থাকে, হয়তো ভদ্রলোক প্ল্যান করে চারজন খুনীকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে তারপর মজা দেখাবার জন্য ঠান্ডা মাথায় আত্মহত্যা করে থাকেন!…

মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। আপনার কল্পনা শক্তির ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু মিঃ শ্যাতানা আত্মহত্যা করবার মতো মানুষ নন। জীবন তার কাছে পরম প্রিয়। বস্তু।

তবে ভদ্রলোক যে খুব ভালো লোক ছিলেন না, সে কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

পোয়ারো বললেন, সে যাইহোক এখন তিনি মৃত…নিহত সুতরাং খুনীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত, এখনও পর্যন্ত আমি সেই অভিমতই পোষণ করি।…আর সেই জন্যই বাঘের খাঁচার মধ্যেও আমি যেতে প্রস্তুত।

.

০৯.

ডাক্তার রবার্টস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার হাতের তালুতে এখনো কার্বলিক সাবানের গন্ধ ছড়িয়ে আছে।

আপনার তদন্ত কেমন এগুচ্ছে? খুনী ধরা পড়বে তো?

মিঃ ব্যাটেল উত্তর দিলেন, যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তবে কাগজে খবরটা প্রকাশ পায়নি এইটুকু বাঁচোয়া।

ইতিমধ্যে পোস্টমর্টেমের রিপোর্টও এসে পৌঁছেছে, সেই রিপোর্টটি ডাক্তার রবার্টসকে দেখতে দিলেন।

ভদ্রলোকের সলিসিটরের সঙ্গে উইল নিয়ে কথা হয়েছে। সিরিয়ায় তার এক আত্মীয়কে দানপত্র করে গেছেন।

ক্ষণিকের জন্য রবার্টসের মুখখানি কালো হয়ে গেল। মিঃ ব্যাটেল আরও বললেন, ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত কাগজপত্রও আমরা ঘেঁটে দেখেছি।

রবার্টস নিজেকে সংযত করে নিলেন। ব্যাটেলের দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করলেন, আমার কাগজপত্রও নিশ্চয় পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন না।

ব্যাটেল উত্তর দিলেন, সেইরকমই বাসনা আছে।

আমি আপনাকে বাধা দেবো না, ডাক্তার রবার্টস বললেন। আপনাদের কাজে সহায়তা করা প্রত্যেক সৎ নাগরিকের কর্তব্য।

অজস্র ধন্যবাদ, ব্যাটেল বললেন, আপনার কর্তব্যবোধকে সম্ভ্রম না জানিয়ে পারা যায় না। আরও একটি ব্যাপার…আপনাকে গোটা কয়েক প্রশ্ন করবো আশা করি উত্তর দেবেন।

বেশ! কি জানতে চান বলুন?

আপনার ব্যক্তিগত জীবন, আপনার জন্ম, আপনার বিবাহ…এই আর কি।

রবার্টস সোজা হয়ে বসলেন। ছোটবেলায় আমি স্নো ভিউ হোটেলে থেকে লেখাপড়া করতাম। বাবা ডাক্তার ছিলেন। পনের বছর বয়স যখন আমার তখন বাবা মারা যান, দুবছর বাদে মাও মারা যান। আমি তাদের একমাত্র সন্তান, এখনো অবিবাহিত। ডাক্তারীতে ভালোই পসার আমার রুগীরাও সকলে অবস্থাপন্ন ঘরের। এই হচ্ছে আমার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, আপনার পরিচিত চারজন লোকের নাম বলুন, যারা আপনার সম্বন্ধে খোঁজখবর দিতে পারবেন।

ডাক্তার রবার্টস সাবলীল ভঙ্গিমায় প্যাডের পাতায় চারজনের নাম লিখে ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। আপনি দরকার হলে সবকিছুই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি আমার সেক্রেটারীকে আপনাকে সাহায্য করবার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। আমি এখন রুগী দেখতে বাইরে বেরিয়ে যাব। ডাক্তার রবার্টস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে আমি চললাম। কথা বলতে বলতে ডাক্তার রবার্টস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল প্রথমে দেরাজ খুলে তন্নতন্ন করে সবকিছু গ্রীক্ষা করলেন। ব্যাঙ্কের পাসবইটা দেখলেন খুঁটিয়ে। বিষের আলমারিটা পরীক্ষা করে বিফল হলেন। চিঠিপত্রের ফাইলটা দেখলেন সবই ব্যক্তিগত চিঠি। হতাশভাবে ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। এবার ব্যাটেল ডাক্তার রবার্টসের সেক্রেটারীকে কিছু জেরা করবার জন্য ডাকলেন। তিনি বললেন, আচ্ছা শ্রীমতী বার্জেস, আপনি বোধহয় সমস্ত ঘটনাই শুনেছেন।

হ্যাঁ, ডাক্তার রবার্টস আমায় বলেছেন। সমস্ত পরিস্থিতিটা খুবই নোংরা এবং সাংঘাতিক। মিঃ ব্যাটেল মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ তা ঠিক কিন্তু আপনি একটু মনে করে বলুন যে শ্যাতানাকে কখনো দেখেছেন কিনা?

না, কখনো দেখিনি। ডাক্তার রবার্টসকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানোর সময় তার নামটা শুনেছি মাত্র।

শ্ৰীমতী বার্জেসকে বাগে আনা খুবই কষ্টকর, মিঃ ব্যাটেল তা বুঝতে পারলেন। তবু তিনি চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না এবং নতুন করে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তাহলে স্থির নিশ্চিত যে মিঃ শ্যাতানা ডাক্তার রবার্টসের কোনো পেশেন্ট ছিলেন না।

হ্যাঁ সেটা আমি জোরের সঙ্গেই বলতে পারি।

তবে আর কি করা যাবে। বিরস মুখে ব্যাটেল দরজার দিকে এগোলেন।

ডাক্তার রবার্টসকে বলবেন, আমি তার সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। আচ্ছা, নমস্কার শ্রীমতী বার্জেস।

.

১০.

ব্যাটেলের মুখে গভীর উদ্বেগ আর বিষাদের ছায়া।

পোয়ারা প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনার সকালের পরিশ্রমটা বৃথাই গেল মনে হয়?

ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, খুবই জটিল সমস্যা, তবে আমার বিশ্বাস ডাক্তার রবার্টস ভদ্রলোক সত্যই একজন খুনী। কিন্তু শ্যাতানাকে তিনি খুন করেছেন বলে মনে হয় না। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস।

তবে এটা তো আপনি বিশ্বাস করেন, তিনি আর কাউকে খুন করেছেন। একজন কেন, বহু লোককেই খুন করে থাকতে পারেন। তবে প্রমাণ পাওয়া শক্ত।

ভদ্রলোক অবিবাহিত তাঁর নামে কিছু স্ক্যাণ্ডাল রটেছিল। ভদ্রমহিলার নাম মিসেস ক্র্যাডাক। ভদ্রমহিলার স্বামীর অ্যানথ্রক্স রোগ হয়েছিল–বাজারে নিচুমানের একধরনের সেভিং ব্রাশ চালু ছিলো। তার মধ্যে কিছু ছিলো এই রোগের জীবাণুবাহী।

হত্যাকারীর পক্ষে এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ! পোয়ারো মন্তব্য করলেন।

ব্যাটেল কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করলেন, আপনি কোন পথ ধরে এগোবেন বলে ভাবছেন?

পোয়ারো উত্তর দিলেন, আমি সন্তর্পণেই অগ্রসর হবো। আমি কেবল তার সঙ্গে ব্রীজ খেলা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করবো।

পোয়ারো চোখ মিটমিট করে ফিরে তাকালেন, কেন? আপনার কাজের ধারা কি রকম, মিঃ ব্যাটেল?

খুবই সোজা একজন কর্তব্যপরায়ণ পুলিস অফিসার যে রকম নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে সত্য অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, সেই রকম। হাসিমুখে পোয়ারো পানীয়ের গ্লাস তুলে ধরলেন।

লাঞ্চের পর তারা দুজনে যে যার পথ ধরলেন। ব্যাটেল পরবর্তী কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে নির্দেশ দেবার জন্য স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে ফিরে গেলেন।

পোয়ারো এগোলেন ডাক্তার রবার্টসের চেম্বারের দিকে। পোয়ারোকে দেখে ডাক্তার রবার্টসের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠলো।

ঠাট্টার সুরে বললেন, একদিনে দুজন টিকটিকির শুভাগমন! রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে। সন্ধের মধ্যেই গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বেরিয়ে যাবে।

পোয়ারো মৃদু হাসলেন, না না, আমি আশ্বাস দিতে পারি আমার দৃষ্টি এখনো আপনাদের চারজনের প্রতিই নিবদ্ধ।

রবার্টস বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, বলুন কিভাবে আপনার কাজে লাগতে পারি?

পোয়ারো মিনিট খানেক কোনো কথা বললেন না। তারপর তার কোটের পকেট থেকে নিখুঁত ভাঁজ করা তিনটে ব্রীজ খেলার স্কোরশীট বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। শান্ত সুরে তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন, এই প্রথমটা হচ্ছে মিস মেরিডিথের হাতের লেখা। এখন আমার জিজ্ঞাস্য, এই স্কোরশীট দেখে কি স্মরণ করতে পারেন খেলাটা কিভাবে এগিয়েছিল?

এতদিন বাদে স্মরণ করা মুশকিল, আচ্ছা দাঁড়ান, দাঁড়ান ভাবতে দিন। হ্যাঁ মনে পড়েছে। স্পেডের খেলা ছিলো। ওঁরা একটা শর্ট দিলেন।

পরের তাসটা আমি আমার পার্টনার দুটো ডায়মণ্ডে খেলেছিলাম।

আচ্ছা কোনো উত্তেজনাপূর্ণ ডাক বা খেলার কথা আপনার মনে পড়ে না?

একটা গ্র্যাণ্ডস্লামের কথা মনে আছে। আমার হাতের খেলা। একবার তিনটে নো ট্রাম্প ডেকে বিশ্রীভাবে অনেকগুলো শর্ট দিলাম। প্রত্যেকটা রঙের ডিস্ট্রিবিউশন এত খারাপ ছিলো যে কল্পনা করা শক্ত। বলতে গেলে আমরা কোনো পিটই পাইনি, তবে এটা শেষদিকের তাস। তখন আমার পার্টনার ছিলেন মিসেস লরিমা।

মিঃ পোয়ারো এবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডাক্তার রবার্টস, সেদিনের খেলার মধ্যে কি এমন কোনো ভুলভ্রান্তি নজরে পড়েছে সাধারণ দৃষ্টিতে যা বিস্ময়কর?

ডাক্তার রবার্টস মিনিট দুয়েক চিন্তা করলেন তারপর মাথা নাড়লেন, না তেমন কিছুই আমার মনে পড়ছে না। ইতিপূর্বে নতুন কোনো বক্তব্য নেই তবে মিসেস লরিমা প্রকৃতই একজন জাত খেলোয়াড়। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁত খেলে। মেজর ডেসপার্ড ভালোই খেলেন, তবে বাইরে যেতে চান না। ঝুঁকি নেবার সাহস তার নেই।

বাকি মিস মেরিডিথ, তিনি মাঝে মধ্যে ভুল করে বসছিলেন। অন্যমনস্কতাই তার প্রধান কারণ।

সেইজন্য বিপরীত দিক দিয়ে প্রশ্নটা আমি আপনার কাছে রাখছি, সেদিন ডিনারের পর যে ঘরে বসে আপনারা তাস খেলেছিলেন তার একটা বিবরণ দিন।

রবার্টস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিবরণ দিতে শুরু করলেন : হাতির দাঁতের কাজ করা একটা বড় টেবিল ছিলো, চার-পাঁচটা বড় বড় চেয়ার। আটটা কি নটা পার্সিয়ান কম্বল। খুব সুন্দর চাইনিজ আলমারি। বারোটা চেয়ারের সেট। ছটা ভালো জাপানী ছবি। একটা বড় পিয়ানো, পাঁচ-ছটা নস্যির কৌটো, হাতির দাঁতের কাজ করা ছোট ছোট মূর্তি, প্রথম চার্লসের শীলমোহর খচিত কিছু মুদ্রা।…

চমৎকার চমৎকার। আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। আর কিছু ছিল কি?

হা, কিছু প্রাচ্যদেশীয় জিনিষপত্র সূক্ষ্ম রুপোর কাজ করা কতগুলো শিল্পবস্তু। কিছু অলঙ্কার। কতিপয় ছোট ছোট বস্তুর সমাবেশ। এবার ডাক্তার রবার্টস একটু থেমে মৃদু হেসে বললেন, আপনি যে জিনষটার কথা জানতে চান সেটা কি আমার তালিকার মধ্যে আছে?

পোয়ারো রহস্যময় হাসি হাসলেন, আমার ধারণা নির্ভুল হয়েছে; জানতাম আপনি সেটার কথা উল্লেখ করবেন না, তবে একটা কথা মনে রাখবেন, আজ আপনি আমাকে যা বললেন তা আমার পরবর্তী উদ্যোগে সহায়তা করবে।

দুজনে করমর্দন করলেন। পোয়ারো ডাক্তার রবার্টসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরলেন।

২. মিসেস লরিমার বাড়ি

১১.

পোয়ারো এবার মিসেস লরিমার বাড়িতে এলেন। সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। কলিংবেল টিপতেই এক বুড়ি দরজা খুলে দিল।

সে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চান?

মিসেস লরিমাকে।

তাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে বুড়ি ঝি মিসেস লরিমাকে ডাকতে গেল। পোয়ারো ঘরটির দিকে নজর বুলিয়ে নিল। প্রাচীন বনেদি ঢঙের আসবাবপত্র। চেয়ারগুলোয় দামী কুশন পাতা। দেওয়ালে টাঙানো পুরানো আমলের ফটোগ্রাফ, টেবিলের ওপর ফুলদানিতে গোলাপ শোভা পাচ্ছে।

মিসেস লরিমা ঘরে প্রবেশ করলেন। পোয়ারো মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমার বিশ্বস ম্যাডাম এই অযাচিত আগমনকে ক্ষমার চোখেই দেখবেন।

কিন্তু এই আগমনের সঙ্গে আপনার পেশার কি সম্পর্ক আছে?

পোয়ারো মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ আছে।

কিন্তু আমি আপনাকে দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না, আর তাছাড়া শখের গোয়েন্দার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই, মিসেস লরিমা বললেন।

মিঃ পোয়ারো উত্তর দিলেন, দশ মিনিটই যথেষ্ট।

যে ঘরে মিঃ শ্যাতানা নিহত হন, সে ঘরের একটা বর্ণনা আমায় দিতে পারেন?

গোটা কতক কাঁচের ফুলদানি ছিলো, আধুনিক ডিজাইনের দেখতে ও বেশ সুন্দর একগুচ্ছ ছোট ছোট রক্তিম টিউলিপ ফুল। ঘরটা এত বেশি জিনিষপত্রে ঠাসা যে প্রথম ঢুকে মনে হয়েছিল কোনো যাদুঘরে এসে পৌঁছেছি।

অল্প থামলেন লরিমা, আমি হয়তো আপনার কোনো কাজেই লাগতে পারলাম না। খুবই দুঃখিত, মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করিনি।

আর একটা প্রশ্ন বাকি আছে, পোয়ারো ব্রীজের স্কোরশীটগুলো বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

লরিমা কাগজগুলো নিয়ে দেখলেন, এটা হলো প্রথম রাবার তখন আমার পার্টনার ছিলেন মিস মেরিডিথ। অপরপক্ষে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। প্রথম ডিলে আমরা চারটে স্পেড ডেকেছিলাম। পরের তাসে দুটো ক্লাব ডাকা হয়েছিলো। তৃতীয় ডিলে খুব বেশি ডাকাডাকি চলে। আমার মনে আছে মিস মেরিডিথ পাস দিলে একটা হার্ট দিয়ে মেজর ডেসপার্ড ডাক শুরু করেন। আমি পাস দিলাম। ডাক্তার রবার্টস বীড দেন তিনটে ক্লাব। মিস মেরিডিথ মুখ খোলেন, তিনি ডাকেন স্পেড। মেজর ডেসপার্ড বলে চারটে ডায়মণ্ড। আমি ডবল দিই। ডাক্তার রবার্টস গোড়ার হার্ট রঙে ফিরে যান। কিন্তু চারটে হার্টসে একটা ডাউন দেন।

পোয়ারো সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন, কি অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি!

মিসেস লরিমা এবার উঠে দাঁড়ালেন, কিছু মনে করবেন না আমি এক্ষুনি বেরোব আর দেরি করা উচিত হবে না।

নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনাকে দেরি করিয়ে দেবার জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত।

পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন। এবং রাস্তায় পা দিলেন।

.

১২.

অনেক কষ্টে শ্ৰীমতী অলিভার গাড়ি থেকে রাস্তায় নামলেন। এত অপরিসর জায়গায় গাড়ি থেকে নামতে উঠতে খুবই কষ্টকর–এইসব ভাবতে ভাবতে বিরক্তিতে তার মন ভরে উঠল। তার হাতব্যাগের মধ্যে গুটিকতক ম্যাপ, গোটা তিনেক রহস্য উপন্যাস এবং কিছু আপেল। গাড়ি থেকে নেমে তিনি ধীরে ধীরে ওয়েনডন কুটিরের দিকে এগোলেন।

শ্ৰীমতী অলিভার অ্যানা মেরিডিথের বাড়িতে এলেন, ভালো আছেন তো, মিস মেরিডিথ? আমাকে চিনতে পারছেন নিশ্চয়?

নিশ্চয় পারছি! অ্যানা মেরিডিথ করমর্দনের জন্যে দ্রুত হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তার চোখের তারায় পলকের জন্যে একটা আতঙ্ক ফুটে উঠলো। যাইহোক সংযত হয়ে বলে উঠলেন, এই হচ্ছে আমার বন্ধু মিস দোয়স আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকি।

শ্ৰীমতী অলিভার মাথা নাড়লেন, তারপর মেরিডিথের দিকে ফিরে বললেন, আমার অনেক কথা আছে কোথাও বসতে পারলে ভালো হতো।

নিশ্চয় চলুন, ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি। শ্রীমতী অলিভার একটি সৌখিন চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এবার কোনো ভূমিকা না করে বললেন, গতদিনের সেই নৃশংস খুনটার সম্পর্কে আলোচনা করতেই আজ এখানে এসেছি। আমাদের এ ব্যাপারে কিছু করা উচিত। তিনি দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন, এই হত্যা ডাক্তার রবার্টসই করেছেন। এখন শুধু মাথা ঠান্ডা রেখে প্রমাণ খুঁজে বার করতে হবে।

কিন্তু সেটা কি উপায়ে? সংশয়ের সুরে মনের ভাব ব্যক্ত করলেন মেরিডিথ।

শ্ৰীমতী অলিভার বললেন, আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনাকে কেউ খুনী বলে সন্দেহ করুক।

মেরিডিথ শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না আপনি কেন আমার কাছে এসেছেন।

তার কারণ, আমার মতে অন্য দুজনের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু একজন সুন্দরী তরুণীর কথা সম্পূর্ণ আলাদা। তার নামে বাজে কথা রটলে অনেক খেসারত দিতে হবে। আর মেজর ডেসপার্ড তো পুরুষমানুষ আত্মরক্ষায় যথেষ্ট সক্ষম। যত চিন্তা কেবল আপনাকে নিয়ে।

আপনি সত্যিই ভারি দয়ালু!

ব্যাপারটা খুবই সঙ্কটময়। রোডা মন্তব্য করলেন।

নিশ্চয়ই সে কথা আর বলতে? শ্রীমতী অলিভার উত্তেজিত হয়ে বললেন। এইরকম প্রত্যক্ষ খুনের সংস্পর্শে ইতিপূর্বে আমি কোনোদিন আসিনি।

মিস কৌতূহলী হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, আচ্ছা, আপনি এই কর্তৃত্বে থাকলে কি করতেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রবার্টসকে গ্রেপ্তার করতাম।

তা ঠিক! আচ্ছা কেনই বা ডাক্তার রবার্টস মিঃ শ্যাতানাকে খুন করতে যাবেন? এ বিষয়ে আপনার কি ধারণা?

শ্ৰীমতী অলিভার বললেন, অসংখ্যা ধারণা আমার। যেমন শ্যাতানা হয়তো রবার্টসের কোনো না কোনো আত্মীয়াকে পথে বসিয়েছিলেন। রবার্টস তার প্রতিশোধ নিলেন। আবার এমনও হতে পারে মিঃ শ্যাতানা হয়তো ডাক্তার রবার্টসকে অনেক টাকা ধার দিয়েছিলেন। এখন সেটা পরিশোধ করে দিতে বলেছিলেন সেইজন্য ডাক্তার রবার্টস খুন করেছেন। অথবা রবার্টস হয়তো গোপনে দুটি বিয়ে করে থাকবেন। শ্যাতানা হয়তো সেটা জানতে পেরে গেছেন। এই কারণে আরও দৃঢ় বিশ্বাস ডাক্তার রবার্টসই মিঃ শ্যানার হত্যাকারী।

ডাক্তার রবার্টস কোনো পেশেন্টকে বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে মারতে কোনো অসুবিধাই ভোগ করবেন না।

ইতিমধ্যে অ্যানা কথার মাঝখানে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, মিঃ শ্যাতানা একবার কথা প্রসঙ্গে ল্যাবরেটরির বিষয়ে কি একটা মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এমন ধরনের অনেক বিষ আছে যা নাকি ডাক্তারী পরীক্ষাতেও ধরা পড়ে না।

বাইরের বাগানে কার পদশব্দ পাওয়া গেলো। শ্রীমতী অলিভার ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকালেন। দেখা গেলো মেজর ডেসপার্ড মন্থর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন।

.

১৩.

মেজর ডেসপার্ড একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, আসময়ে আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য আমি খুবই দুঃখিত, মিস মেরিডিথ। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।

না না, আপনার বিচলিত বোধ করবার কোনো কারণ নেই। অ্যানা বললেন, এই আমার বন্ধু রোডা।

রোডা করমর্দন করলেন ডেসপার্ডের সঙ্গে। আপনারা ভেতরে বসুন আমি চায়ের ব্যবস্থা করি। শ্রীমতী অলিভার মন্তব্য করলেন, কি আশ্চর্য যোগাযোগ, আবার আমাদের দেখা হয়ে গেল!

ডেসপার্ড ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। শ্ৰীমতী অলিভার রহস্যময় কণ্ঠে বললেন, আমার বিশ্বাস, ডাক্তার রবার্টসই খুন করেছেন।

তিনজনই চুপচাপ, ঘরের মধ্যে গুমোট আবহাওয়া। ইতিমধ্যে রোডা চা নিয়ে ঢুকলেন, আতিথেয়েতার জন্য ধন্যবাদ। আমার কার্ড রইল লণ্ডনে গেলে আমার সঙ্গে দেখা করবে, তখন সমাধানের পথ খোঁজা যাবে।

রোডা বললেন, চলুন গেট পর্যন্ত আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি।

অ্যানা হাত বাড়িয়ে অলিভারের সঙ্গে করমর্দন করলেন, শ্ৰীমতী অলিভার তার গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। রোডা হাসিমুখে হাত নেড়ে তাকে অভিবাদন জানালেন।

রোডা হাসিমুখে বললেন, ভদ্রমহিলা খুব মজার তাই না? আমার খুব ভালো লাগলো আলাপ করে। উনি খুব বুদ্ধিমতী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু উনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন?

অ্যানার কণ্ঠে চিন্তার সুর বাজে।

রোডা বিস্মিত দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালেন, কেন! উদ্দেশ্যের কথা তো স্পষ্ট ভাষাতেই ব্যক্ত করলেন।

ওদিকে মেজর ডেসপার্ড ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন। অহেতুক দেরির জন্য অ্যানা ক্ষমা চাইলেন।

মিস মেরিডিথ, এখন অত লৌকিকতার অবসর নেই। আমার আগমনের উদ্দেশ্যটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি, কথাটা বলা হয়তো অশোভন হবে, কিন্তু আমার মনে হলো পৃথিবীতে আপনাকে সাহায্য করবার কেউ নেই। যদিও আমি জানি মিস দোয়াস আপনার দুর্লভ বন্ধু। তবু পুলিসের চোখে মিস মেরিডিথ সন্দেহভাজন ব্যক্তি, যাই যদি আপত্তি না থাকে তবে আমার সলিসিটর মিঃ মেহনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।

অ্যানার চোখমুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো, সত্যিই এর কি কোনো প্রয়োজন আছে?

আমি বলব নিশ্চয় আছে, আইনের কত মারপ্যাঁচ আছে।

রোডা বললেন– এই নোংরা ঘটনাটা অ্যানাকে শেষ করে দেবে।

মেজর ডেসপার্ড ঘাড় সায় দিলেন, সত্যিই পাশবিক কাণ্ড! বিশেষ করে অল্পবয়সী তরুণীকে এর মধ্যে যদি টানা হয়।

রোডা আচমকা প্রশ্ন করলেন, আপনার কাকে সন্দেহ হয়? ডাক্তার রবার্টস না মিসেস লরিমা?

ডেসপার্ডের উত্তর, প্রমাণ না পেলে কোনো কিছুই বলা সম্ভব নয়।

রোডা সায় দিলো, আপনার কথা অস্বীকার করবো না। আচ্ছা সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল কিরকম লোক?

তিনি খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি, কর্মদক্ষতাও অসাধারণ। ডেসপার্ড এবার উঠে দাঁড়ালেন, এবার আমি বিদায় নেবো।

অ্যানাও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়ালেন।

এবার অ্যানা একা ডেসপার্ডকে এগিয়ে দিতে গেলেন, যখন ফিরে এলেন রোডা তখন খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

শ্ৰীমতী অলিভারকে আমার একদম পছন্দ হয় না, ওঁকে দেখার পরেই মনে কেমন খটকা লেগেছে। গোপন কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে উনি এখানে এসেছিলেন…?

মেয়েরা তো মেয়েদের সন্দেহ করবেই, এতো চিরকালের প্রথা! মেজর ডেসপার্ডও তো মাথায় কোনো মতলব নিয়ে এখানে আসতে পারেন?

নিশ্চয় না অ্যানা প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু রোডা দেখেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন।

.

১৪.

মিঃ ব্যাটেল মিস মেরিডিথের সঙ্গে দেখা করবার আগে তিনি এই অঞ্চলের আরো লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন। আর এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য অ্যানার সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করা।

মিঃ ব্যাটেলের পক্ষে এই কাজটা কষ্টসাধ্য নয়। তিনি প্রকৃত পরিচয় সর্বদা গোপন করে নানারকম খবর সংগ্রহ করেন। এই মুহূর্তে তিনি একজন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লোক বলে পরিচয় দিয়েছেন।

ওয়েনডন কুটিরের কথা বলছেন? হ্যাঁ ঠিকই, সার্জারি রোডের ওপর, গেলেই আপনার নজরে পড়বে। ওখানে দুজন তরুণী বাস করেন একজন মিস দোয়স অপরজন মিস মেরিডিথ। দুজনে খুব ভালো মেয়ে, কথা প্রসঙ্গে মিঃ ব্যাটেল অবশেষে মিসেস অসওয়েলের সন্ধান পেলেন, তিনি ঐ কুটিরে ঠিকের কাজ করেন। ওয়েনডনকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, মেয়ে দুটির স্বভাবচরিত্র খুব ভালো, সবসময় নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মেতে আছে।

মিঃ ব্যাটেল সম্ভাব্য সমস্ত স্থানেই ঘুরে বেড়ালেন। এদিক ওদিক থেকে খবর যা সংগ্রহ করলেন তাও খুব নিরাশ হবার মতো নয়। সমস্ত তিনি মনের মধ্যে গেঁথে রাখলেন। মাঝে মধ্যে দু-একটা রহস্যময় কথাও টুকে নিলেন তার ডায়েরীতে।

অবশেষে সন্ধ্যে আটটা নাগাদ কুটিরে হাজির হলেন। বেল টিপতেই একটি দীর্ঘাকৃতি মেয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। পরনে কমলা রঙের ফ্রক। তন্বী এবং সুন্দরী।

মিস মেরিডিথ কি এখানে থাকেন? প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল। তাকে বেশ গম্ভীর বলে মনে হলো।

হ্যাঁ…আপনি…?

দয়া করে তাকে গিয়ে বলুন, মিঃ ব্যাটেল একবার দেখা করতে চান।

আসুন, ভেতরে আসুন।

মিস দোয়সের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটেল ভিতরে প্রবেশ করলেন। মিঃ ব্যাটেল দেখা করতে এসেছেন, রোডা অ্যানাকে জানিয়ে দিলেন। অ্যানা এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।

তদন্তের কাজ কতদূর এগিয়েছে? তেমন আশাপ্রদ কিছু জানতে পারলেন?

খুব আশাপ্রদ বলা যায় না তবে এগোচ্ছে। আমরা ডাক্তার রবার্টসের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। মিসেস লরিমার সঙ্গেও কথাবার্তা হয়েছে, এখন শুধু আর মেজর ডেসপার্ড বাকি।

বলুন কি জানতে চান, অ্যানা মৃদু হেসে বললেন।

এই আপনার আত্মপরিচয় আর কি।

আমি নিজেকে ভদ্র সভ্য বলেই জানি। আমার জন্ম হয়েছিলো ভারতবর্ষের এক শহরে। কোয়েট্টায়। আমার বাবা মেজর মেরিডিথ। এগারো বছর বয়সে মা গত হলেন। বাবা যখন অবসর নিলেন আমার বয়স তখন পনেরো। আঠারো বছর বয়সে বাবা মারা যান। এরপর একটা চাকরি নিতে বাধ্য হলাম।

আচ্ছা মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে কিভাবে আপনার পরিচয় হলো?

অ্যানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলার মতো কিছু নেই, হোটেলের অন্যান্য ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যেভাবে আলাপ হয় সেই রকমই। মিঃ শ্যাতানাকে আমি একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু তিনি আমার প্রতি খুবই ভদ্র ব্যবহার করতেন। এই মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতাই আমার অস্বস্তির কারণ।

আচ্ছা এবার আমি উঠি, শুভরাত্রি বলে মিঃ ব্যাটেল বিদায় নিলেন।

চেয়ারে বসে অ্যানা অলসভাবে হাই তুললেন।

.

১৫.

মেজর ডেসপার্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালেন তারপর একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন।

জানলার ধারে একটা সীট দখল করলেন।

ডেসপার্ড বসে আছেন ইতিমধ্যে তিনি দেখলেন মঁসিয়ে পোয়ারে বসে আছেন। হাসিমুখে ডেসপার্ড ও মিঃ পোয়ারো কিছু কুশল বিনিময়ের পর আসল কথায় এলেন।

মেজর ডেসপার্ড বললেন, আপনার রেকর্ড তো মারাত্মক রকমের ভালো।

আচ্ছা মিঃ শ্যানার খুনের বিষয় কি তদন্ত করছেন?

না সরকারী ভাবে কেউ আমাকে নিয়োগ করেনি কিন্তু তবুও আমি নিজে থেকে কেসটা নিতে বাধ্য হয়েছি, কারণ হত্যাকারী আমার ক্ষমতাকে যে ব্যঙ্গ করে, এই ঘটনা তারই প্রকাশ।

কেবল আপনাকেই নয় গোটা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চোখের সামনে এই অপকীর্তি সাধিত হয়েছে।

ঠিক, আপনার মতো একজনকেই আমি খুঁজছিলাম, যার নজর তীক্ষ্ণ এবং স্মৃতিশক্তিও প্রখর। ডাক্তার রবার্টসকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম, কোনো ফল পাইনি। মিসেস লরিমাও আমায় হতাশ করেছেন। এবার আপনাকে চেষ্টা করে দেখি।

আচ্ছা মিঃ ডেসপার্ড, আমাকে সেই ঘরের একটা যথাযথ বিবরণ দিন, যে ঘরে মিঃ শ্যাতানা খুন হয়েছিলেন।

ডেসপার্ড হতাশভাবে বললেন, বিশেষ নজর দিয়ে দেখিনি…গোটাগতক ভালো জাতের কম্বল, কতগুলি মূর্তি, কিছু ছবি, একটি কৃষ্ণসার হরিণের মাথা ইত্যাদি।

মিঃ শ্যানার বনে জঙ্গলে গিয়ে শিকারের নেশা ছিল বলে আপনার নিশ্চয় মনে হয় না।

তিনি সেরকম পাত্রই নন, ঘরে বসে দাবা খেলা ছাড়া আর কিছুই খেলতেন না।

সেদিনের ব্রীজ খেলার কথা আপনার কিছু মনে আছে কি? মেজর ডেসপার্ড, ব্রীজ কি আপনি বেশি খেলেন?

না সেরকম কিছু মনে নেই আর ব্রীজ খেলা আমি ক্বচিৎ কদাচিৎ খেলি এই খেলায় যথেষ্ট বুদ্ধি দরকার।

পোয়ারো চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বললেন, মিঃ শ্যাতানা তাসে তেমন আসক্ত ছিলেন না। একটা খেলায় তার উৎসাহ ছিল সেটা লোককে ভয় দেখানো।

ডেসপার্ড ঈষৎ বিব্রত হয়ে পড়লো। তিনি বললেন, এক হিসেবে তাকে ব্ল্যাকমেলার বলাই যুক্তসঙ্গত। এইজন্যেই প্রতিফলে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।

মিঃ পোয়ারো বললেন, তিনি মেয়েদের মনের গতিপ্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতেন, তিনি তাদের গোপন কথা বার করার জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করতেন।

ডেসপার্ড অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, সত্যিই অবিশ্বাস্য। লোকটা ছিলো পর্বতপ্রমাণ নির্বোধ। কথা বলতে বলতে ডেসপার্ড উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, আচ্ছা আমার স্টপেজ এসে গেছে আবার দেখা হবে মিঃ পোয়ারো।

দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন ভদ্রলোক।

পোয়ারো জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন মেজর ডেসপার্ড লম্বা লম্বা পা ফেলে ফুটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

.

১৬.

সার্জেন্ট ওকোনার দেখতে শুনতে খুবই সুদর্শন। চওড়া, কাঁধ, দীর্ঘ দেহ, দুচোখে অকপট হাসির উচ্ছ্বাস। মেয়েরা তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যেত। তার ফলে সে সহজেই কাজ উদ্ধার করতে পারত।

মিঃ শ্যাতানার খুনের চারদিন পর তাকে এলিসা ব্যাটেলের পাশের চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেছে।

এইমাত্র রাস্তা দিয়ে এক ভদ্রলোক গেলেন তাকে দেখতেই আমার পুরানো মনিব মিঃ ক্র্যাডকের কথা মনে পড়ে গেলো।

এলিসা কৌতূহলী হয়ে বলল, আমিও এক ক্র্যাডক দম্পতির বাড়ি কাজ করেছি। তাহলে আমরা একই বাড়িতে কাজ করেছি, ভদ্রমহিলা খুবই ঝামেলা পাকাতেন। তার সঙ্গে ডাক্তার রবার্টসের নাম জড়িয়ে অনেক রসালো খবর রটেছিলো। ডাক্তার ভদ্রলোক অতিশয় ভদ্র তিনি মিসেস ক্র্যাডককে পেশেন্ট হিসাবেই দেখতেন। মিঃ ক্র্যাডক অ্যানথ্রক্স রোগে মারা গিয়েছিলেন। সে সময় মিসেস ক্র্যাডক খুবই স্বামীর সেবা করেছিলেন। ডাক্তার রবার্টস যখন মিঃ ক্র্যাডক বেঁচেছিলেন তখন ক্র্যাডক দম্পতির বাড়িতে আসাযাওয়া করতেন কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর আর আসেননি। মিসেস ক্র্যাডক হঠাৎ সমস্ত কিছু বিক্রী করে মিশরে চলে যান।

তা ঠিক, ওকোনার ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। ভদ্রমহিলা সেখানেই মারা যান।

.

১৭.

রোডা মনস্থির করল শ্ৰীমতী অলিভার তো তাকে দেখা করবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন, তবে কোনো সঙ্কোচ না করে শ্রীমতী অলিভারের বাড়ি যাওয়া যাক। এইসমস্ত চিন্তা করতে করতে রোডা রাস্তায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলেন। হাতে বাঁধা রিস্টওয়াচের দিকে নজর দিলেন, সাড়ে তিনটে বাজে, কারোর সঙ্গে দেখা করবার পক্ষে উত্তম সময়।

ফুট পেরিয়ে শ্রীমতী অলিভারের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন রোডা। হাত বাড়িয়ে কলিংবেলের বোতাম টিপলেন।

একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এসে দরজা খুলে দিলো।

মিসেস অলিভার কি বাড়িতে আছেন?

আসুন ভেতরে আসুন।

রোডা দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রৌঢ়া দাসীর পেছন পেছন সরু বারান্দা পেরিয়ে শ্ৰীমতী অলিভারের ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। তার মনে হলো বুঝি আফ্রিকার জঙ্গলে এসে পড়েছেন। সারা ঘর জুড়ে নানারকম পাখির মেলা। টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে শ্রীমতী অলিভার বসে আছেন। তার চুল উস্কোখুস্কো।

আরে রোডা যে। এসো এসো তোমাকে দেখে খুব খুশী হলাম।

আমি বোধহয় হঠাৎ এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম, রোডা বিব্রত কণ্ঠে বললেন।

আরে না না, তোমাকে অতো ব্যস্ত হতে হবে না। শ্রীমতী অলিভার সহজভাবে বললেন, আমি অবশ্য লেখার কাজে মগ্ন ছিলাম।

রোডা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, বসে বসে একটা উপন্যাস লিখে ফেলা নিশ্চয়ই চমৎকার ব্যাপার।

শ্ৰীমতী অলিভার ব্যাজার মুখে বললেন, না, ব্যাপারটা কিন্তু সহজ নয়। লেখবার আগে, অনেক ভাবতে হয় আর এই ভাবনাটা খুবই ক্লান্তিকর।

কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে তেমন কঠিন বলে মনে হয় না।

তোমার কাছে তা মনে না হবারই কথা, হাসিমুখে উত্তর দিলেন অলিভার; তোমার জন্য কফির বন্দোবস্ত করি।

দাসীকে ডেকে কফির অর্ডার দিলেন, তারপর ফিরে এসে মেরিডিথের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।

রোজা বললেন, মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে মেরিডিথ সলিসিটরের কাছে গেছে। অ্যানা খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছে এই ঘটনার দরুন। সে আরও একবার এইরূপ সাংঘাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলো। অ্যানা খুব স্পর্শকতার, কোনো কিছুর সম্মুখীন হতে ও খুব ভয় পায়।

শ্রীমতি অলিভার শান্ত ভাবে মাথা নাড়লেন এবং বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি সাহসী কিন্তু অ্যানার এই সাহসের একান্ত অভাব।

রোডা বিনীত কণ্ঠে বললেন, আপনাকে যা বললাম সেটা কিন্তু অ্যানার কাছে ফাঁস করে দেবেন না। এইসব বিষয়ে আলোচনা ও খুব অপছন্দ করে।

শ্ৰীমতী অলিভার নিশ্চিন্ত করলেন রোডাকে–তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি বলবো না তোমার বন্ধুকে।

টোস্ট আর কফি খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন রোভা, এমনভাবে আচমকা হানা দিয়ে হয়তো আপনার কাজের ক্ষতি করলাম আর বেশি বিরক্ত করব না।

শুভ রাত্রি…বলে রোডা বিদায় নিলেন।

.

১৮.

মিসেস লরিমা দরজা পেরিয়ে পা-বাড়ালেন রাস্তায়। তার সারা মুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তির ছাপ।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিপরীত দিকের ফুটপাতে অ্যানা মেরিডিথের ওপর তার দৃষ্টি পড়লো। মিসেস লরিমা সামান্য ইতস্ততঃ করলেন। তারপর রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন, কেমন আছেন, মিস মেরিডিথ?

অ্যানা চমকে ফিরে তাকালেন, ওঃ, আপনি! অনেকদিন বাদে আবার দেখা হলো।

মিস মেরিডিথের দৃষ্টি তখনো সেই ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে নিবদ্ধ।

মিসেস লরিমা প্রশ্ন করলেন, ওদিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছেন কেন?

অ্যানা ধরা পড়ে যাওয়ার কণ্ঠে বললেন, না, না, ও কিছু নয়। তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। তবে আমার বন্ধু রোডাকে এই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখলাম তাই ভাবছি ও কি মিসেস অলিভারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল?

মিসেস লরিমা বললেন, ওসব থাক চলুন আমরা একটু চা খাই সামনের ঐ দোকানে বসে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজন একটা রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকলেন।

মিসেস লরিমা মাথা নাড়লেন। মঁসিয়ে পোয়ারো ছাড়া আর কেউ যাননি, কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার প্রশ্ন করলেন অ্যানা, মিঃ ব্যাটেল তাহলে নিশ্চয় গিয়েছিলেন?

হা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন। অ্যানা প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোক কি বিষয়ে জানতে চাইলেন?

মিসেস লরিমা ইতস্ততঃ করে বললেন, নিয়ম মাফিক তদন্ত আর কি।

আচ্ছা মিসেস লরিমা, আপনার কি মনে হয় শেষপর্যন্ত প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়বে?

তিনি শান্ত সুরে বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না সমস্যাটি বড় জটিল। একই সুরে তিনি বললেন, জীবন বড় জটিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে দুটি জিনিষের একান্ত প্রয়োজন প্রথম হচ্ছে অফুরন্ত সাহস; দ্বিতীয়, অসীম সহ্য শক্তি, এবং শেষ লগ্ন সামনে এলে সকলেই ভাবে সত্যই এর কি কোনো প্রয়োজন ছিলো?

অমন ভাবে বলবেন না। ভীত কণ্ঠে বাধা দিলেন অ্যানা।

মিসেস লরিমা হেসে উঠলেন, জীবন সম্বন্ধে এ ধরনের অভিব্যক্তি হয়তো খুবই সাধারণ। তিনি বেয়ারাকে বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

উজ্জ্বল হাসি হেসে অ্যানা বললেন, ওই যে রাস্তার মোড়ে রোডা দাঁড়িয়ে আছে, আচ্ছা চলি নমস্কার। অ্যানা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রোডার দিকে।

রোডা তুই মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি?

রোডা উত্তর দিল, হা গিয়েছিলাম।

অ্যানা বিরক্তি চেপে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কেন?

রোডা উত্তর দিলেন, তিনি তো আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন, তাছাড়া ভদ্রমহিলার মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। এমন সুন্দর মহিলা আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। এই দেখ আমাকে তার একটা বইও উপহার দিলেন। রোডা হাসিমুখে বইটা বার করে অ্যানাকে দেখালেন। রোডা এবার অ্যানাকে অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তোর সলিসিটর ভদ্রলোককে কেমন দেখলি?

খুব কাঠখোট্টা গোছের, আইনের প্যাঁচ পয়জার সব একেবারে কণ্ঠস্থ।

আর মেজর ডেসপার্ডকে কেমন মনে হলো?

ভারী দয়ালু ভদ্রলোক, অ্যানা বলে উঠল।

তাহলে তিনি নিশ্চয় তোর প্রেমে পড়ছেন এতে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।

রোডার কথা শুনে অ্যানা মৃদু রাগত স্বরে রোডাকে বললে, আবোলতাবোল বকিস না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, সামনের ঐ বাসটা প্যাডিংটনে যাবে। চারটা পঞ্চাশে ছাড়বার কথা, চল আমরা এগিয়ে যাই।

.

১৯.

আমি সার্জেন্ট ওকোনার, ব্যাটেলের নির্দেশমতো আপনাকে ফোন করছি। সকাল এগারোটায় যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে তার সঙ্গে একবার দেখা করেন।

পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন।

ঠিক সাড়ে এগারেটায় ট্যাক্সি থেকে অবতরণ করলেন পোয়ারো। তারপর দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে রওনা হলেন। ব্যাটেলের বসবার ঘরে সবাই বসলেন। ব্যাটেল এসে প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর তিনজনে তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

ব্যাটেল বললেন, আমার মনে হয় এখন আমাদের মধ্যে একবার আলাপ আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু কর্নেল রেস এখনও এলেন না। বলতে বলতে দরজা ঠেলে কর্নেল রেস ঘরে ঢুকলেন।

আমি খুবই দুঃখিত; একটু দেরি করে ফেললাম। বলেই তিনি বলতে শুরু করলেন, মেজর ডেসপার্ডের বিষয়ে কিছু খবর সংগ্রহ করে এনেছি এই নিন। কর্নেল রেস কতকগুলি টাইপ করা কাগজ ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। শক্ত সমর্থ বলিষ্ঠ পুরুষ। সর্বদা সভ্য সমাজের আইনকানুন মেনে চলেন। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। দূরদৃষ্টি আছে এবং সবিশেষ নির্ভরযোগ্য।

এত প্রশংসাতেও ব্যাটেল তেমন বিচলিত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কোনো দুর্ঘটনা বা আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে কিনা? ব্যাটেল অধৈর্যভাবে মাথা নাড়লেন। মানুষ তার নিজের হাতে আইন তুলে নেবে এটা কখনোই সভ্য সমাজে চলতে দেওয়া যেতে পারে না।

কর্নেল রেস এবার উঠে দাঁড়ালেন, আপনাদের আলোচনায় বেশিক্ষণ যোগ দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। বিদায় জানিয়ে কর্নেল রেস চলে গেলেন। তিনি যে নথিপত্র রেখে গেছেন মিঃ ব্যাটেল তার মধ্যে চোখ ডোবালেন। আর মাঝে মাঝে নিজের প্যাডে পেন্সিল দিয়ে নোট করে নিলেন কিছু কিছু।

অলিভার এবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিঃ ব্যাটেল, আপনি এই খুনের তদন্তের ব্যাপারে কিভাবে এগোচ্ছেন।

ব্যাটেল ধীরে ধীরে শুরু করলেন, প্রথমে আমি এই কথাই বলবো যে মিঃ শ্যানার হত্যাকারী কে তা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার লোক সন্দেহভাজন চারজনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। এবার মিঃ ব্যাটেল পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলেন, এদের কারোর অতীত জীবন সম্বন্ধে কিছু জানতে পারলেন?

হা ডাক্তার রবার্টসের কোনো নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারো আকস্মিক মৃত্যু ঘটেনি। তবে অনেক তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে একটিমাত্র ঘটনার সন্ধান আমি পেয়েছি যার সঙ্গে বর্তমান মামলার কোনো যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। কয়েক বছর আগে ডাক্তার রবার্টস কোনো মহিলা পেশেন্টের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এবং এর জন্য সেই পরিবারে গণ্ডগোলের সূত্রপাত দেখা দেয়। ভদ্রমহিলার স্বামী অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে রবার্টসকে খুব শাসিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক এই ঘটনার অল্প কিছুদিন বাদেই অ্যানথ্রক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

সন্দেহজনক একটিমাত্র সূত্র যা আমি পেয়েছি; ছোট হলেও তা খুব মূল্যবান।

ব্যাটেল এবার অন্যদের সম্বন্ধে বলতে লাগলেন, বছর কুড়ি হলো মিসেস লরিমা বিধবা হয়েছেন। ভদ্রমহিলা অধিকাংশ সময় লণ্ডনে বাস করেন। কোনো রহস্যময় মৃত্যুর সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। তার মতো সম্ভ্রান্ত মহিলার যেভাবে থাকা উচিত তিনি তাই করেছেন। ব্যাটেল হতাশভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মিস মেরিডিথ তার পিতা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। মৃত্যুকালে মেয়ের জন্য কিছু রেখে যাননি ফলে তাকে নিজেই অন্নের সংস্থান করতে হয়।

প্রত্যেকেই মেয়েটির জন্য আন্তরিক দুঃখিত। মেজর ডেসপার্ডের কি খবর? তার সম্বন্ধে কতদূর কি জানতে পারলেন? প্রশ্ন করলেন শ্রীমতী অলিভার।

ব্যাটেল বললেন, আমার লোক তার উপর সবসময় নজর রেখে দিয়েছে। হ্যাঁ ভালো কথা ডেসপার্ড কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতে রাজী নন। ইতিমধ্যে সলিসিটরের পরামর্শ নিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি বিপদের আশঙ্কা করেন।

পোয়ারো মন্তব্য করলেন, যে কোনো অবস্থার জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত রাখেন।

সেইজন্যই তিনি কারো বুকে ছুরি বসাতে পারেন এটা ভাবা যায় না। মিঃ ব্যাটেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।

পোয়ারো মৃদু হেসে বললেন, আপনাদের একটা বিশেষ কথা জানাই। ডাক্তার রবার্টস এবং মিসেস লরিমার সঙ্গে আমি দেখা করেছি। মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে। বাকি কেবল মিস মেরিডিথ। এই তিনজনের সঙ্গে কথা বলে আমি এইটুকুই জেনেছি ডাক্তার রবার্টস চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেন।

মিসেস লরিমারের মানসিক একাগ্রতা মাত্রাতিরিক্ত বেশি।

পোয়ারো বললেন, এগুলি ক্ষুদ্র নগণ্য হলেও এগুলো তথ্য। হ্যাঁ, আমার তালিকায় সকলের শেষে মিস মেরিডিথের নাম।

মিঃ ব্যাটেল পোয়ারোকে একটি কাজের ভার দিলেন। কাজটা হচ্ছেঅধ্যাপক ল্যাক্সমোরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তিনি নিজে এই দায়িত্ব নিতে পারছেন না। কারণ আগামীকাল তাকে ডেভনশায়ার রওনা দিতে হবে। ব্যাটেল একটুকরো কাগজে একটা নাম ঠিকানা লিখে পোয়রোর হাতে দিলেন, এই হচ্ছে ল্যাক্সমোরের ঠিকানা। ভদ্রমহিলাকে একবার ভালো করে বাজিয়ে দেখুন। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের প্রকৃত মৃত্যুরহস্য আমি জানতে চাই।

পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু মঁসিয়ে ব্যাটেল, এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ কি কখনো কোনো বিষয়ে প্রকৃত সত্য অবগত করতে পেরেছে?

.

মিঃ পোয়ারো একদিন মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেলেন। পকেট থেকে কার্ড বার করে দাসীর হাতে দিলেন। এটা তোমার কত্রীর কাছে নিয়ে যাও।

কিছুক্ষণ বাদে দাসীটি হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসে পোয়ারোকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলো।

একজন সুন্দরী মহিলা আগুনের চুল্লীর কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি পোয়ারোর দিকে এগিয়ে এসে ধরা ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনিই মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো?

পোয়ারো মাথা নত করে অভিবাদন জানালেন।

আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন?

ম্যাডাম আমি মাঝে মধ্যে বেসরকারী ভাবে অনুসন্ধানের কাজ করে থাকি।

হ্যাঁ, বুঝেছি আপনি বলুন?

পোয়ারো বললেন, আমি অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুর বিষয়ে কিছু তদন্ত করতে চাই।

ভদ্রমহিলা এবার চমকে উঠলেন এবং রীতিমত ভয়ে বলে উঠলেন, কিন্তু কেন?

পোয়ারো উত্তর দিলেন–আপনার কীর্তিমান স্বামীর জীবনকাহিনী নিয়ে একটা বই লেখা হচ্ছে তাই লেখক সমস্ত তথ্য অবগত হতে চান।

ভদ্রমহিলা এবার দ্রুত বলে ফেললেন, আমার স্বামী কালাজ্বরে মারা যান। আমাজন নদীর ধারে তাকে কবর দেওয়া হয়।

পোয়ারো গম্ভীর স্বরে বললেন, কিন্তু আমি পরলোকগত শ্যাতানার কাছ থেকে অনেকরকম খবর সংগ্রহ করেছি। আপনার স্বামী যে কালাজ্বরে মারা যাননি তা মিঃ শ্যাতানা ভালোভাবেই জানতেন।

অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে ভদ্রমহিলা শুরু করলেন, হ্যাঁ আমার স্বামী বন্দুকের গুলিতে মারা যান।

আমার স্বামী ছিলেন উদ্ভিদবিদ। তিনি তখন লতা গুল্ম নিয়ে একটি বই লিখছিলেন। তাই মেজর ডেসপার্ডের সাথে পরিচয় হলে আমরা সদলবলে ঐ অঞ্চলে যাত্রা শুরু করলাম।

মিসেস ল্যাক্সমোর ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সত্যি কথা বলতে কি আমার স্বামী ছিলেন বয়সে আমার থেকে দ্বিগুণ বড়। আমার সাথে জন ডেসপার্ডের সম্পর্ক ছিল নীরব প্রেমের। আমরা ঠিক করে ছিলাম, বেদনায় হৃৎপিণ্ড পিষ্ট হয়ে গেলেও আমরা মুখ ফুটে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর কথাটাকে উচ্চারণ করবো না।

তারপর সেই নারকীয় রাত্রি। জন আর টিমোথি দুজনে ঝগড়া করছিল। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে এলাম…। দেখলাম সে তখন প্রচণ্ডভাবে জনকে শাসাচ্ছে অবশেষে জন গুলি চালালো। একটা গুলির আঘাতেই টিমোথি মারা গেল। সেদিনের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না।

সমস্তই জনকে বুঝিয়ে বললাম যে এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ কেউ না জানতে পারে; তাহলে লোকনিন্দা, পুলিসী ঝামেলা অনেক কিছু হতে পারে। সুতরাং টিমোথি তখন জ্বরে ভুগছিলো তাই সবাইকে বলা হলো যে টিমোথি জুরে মারা গেছে। আমাজনের তীরে ওকে কবর দেওয়া হলো। নীরব হয়ে গেলেন মিসেস ল্যাক্সমোর। চোখের কোণে মুক্তোর মতো দু ফোঁটা জল টলটল করছে।

পোয়ারো আবার কথা শুরু করলেন। আপনার ইতিহাস খুবই করুণ।

মিসেস ল্যাক্সমোর বললেন, মিঃ জন আত্মরক্ষার জন্যই এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সব দিক বিচার বিবেচনা করে আপনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন, টিমোথি যে জুরে মারা গেছে সেই কথাটাই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া সর্বতোভাবে শ্রেয়। মিসেস ল্যাক্সমোর এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

পোয়ারোও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বললেন, ম্যাডাম, এমন মহান আত্মোৎসর্গের কোনো প্রয়োজন দেখি না। এই করুণ ব্যাপারটা যাতে বরাবর গোপন থাকে সেটা আমি চেষ্টা করবো। বিদায় ম্যাডাম।

৩. ক্রম্পটন রোড

২১.

পোয়ারো এখন ক্রম্পটন রোড দিয়ে হাঁটছেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ঘড়ি বার করলেন। এখনও সময় আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে কোনো ক্ষতি হয় না।

পোয়ারো এদিকে গান গাইতে গাইতে দ্রুত এগিয়ে চললেন। হঠাৎ একটা স্টেশনারী দোকানে ঢুকলেন সিল্কের মোজা কিনতে। তরুণী সেলসলেডী বললেন, আসুন আসুন মোজা খুঁজছেন? এখানে ফরাসী দেশের তৈরি সিল্কের মোজা আছে।

পোয়ারো বললেন, এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু আমি আরো ভালো উৎকৃষ্ট জিনিষ চাইছি। এর সমস্তটাই ভালো সিল্কের তৈরি। ঠিক আছে আমাকে উনিশ জোড়া মোেজা ভিন্ন ভিন্ন রঙের দিন।

মিঃ পোয়ারো, সাড়ে সাঁইত্রিশ শিলিং একটা মোজার দাম সুতরাং উনিশ জোড়া মোজার দাম আপনি দেবেন আমাকে, তরুণী সেলসলেডী বললেন।

বাড়িতে পৌঁছবার পর সবে আধঘণ্টাও অতিবাহিত হয়নি। এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলো। অনতিবিলম্বে মেজর ডেসপার্ড এসে প্রবেশ করলেন। তার চোখেমুখে ক্রোধের স্পষ্ট ছায়া। ভদ্রলোক যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছেন।

কি উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি মিসেস ল্যাক্সমোরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? ঘরে পা দিতে না দিতেই ক্রুদ্ধ প্রশ্ন করলেন ডেসপার্ড।

পোয়ারো মৃদু হেসে বললেন-অধ্যাপক ল্যামোরের মৃত্যুরহস্যের প্রকৃত তথ্য আপনি আমার কাছেই পাবেন।

মেজর ডেসপার্ড কণ্ঠে কুদ্ধ ব্যঙ্গের ঝাঁঝ, প্রকৃত তথ্য আপনি আমার কাছেই পাবেন।

মেজর ডেসপার্ড অল্প থামলেন, তারপর আরম্ভ করলেন তার কাহিনী। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের অভিযানের ব্যবস্থা আমিই করি। কিন্তু সারা অভিযানটাই আমার কাছে বিরাট এক দুঃস্বপ্ন। মিসেস ল্যাক্সমোরের প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা ছিল না। কিন্তু ভদ্রমহিলা আমার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, এইসব কারণে আমার খুবই অস্বস্তি হতো।

যা হোক, প্রথম দু সপ্তাহ একরকম ভালোয় ভালোয় কেটে গেলো। তারপর আমরা তিনজনেই জুরে পড়লাম। এবং কিছুদিনের মধ্যে ভদ্রমহিলা এবং আমি সেরে উঠলাম কিন্তু অধ্যাপকের জ্বর বেড়েই চলল। এই জ্বরের ঘোরে টলতে টলতে একদিন অধ্যাপক নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে বেহুঁশ হয়ে এইসব করছেন অল্প সময়ের মধ্যে আমি বুঝতে পেরে ভদ্রলোকের চলার গতি রোধ করতে চাইলাম গুলি করে। ভদ্রমহিলা কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে বাধা দিলেন, দোহাই আপনার আমার স্বামীকে যেন গুলি করবেন না। তিনি এমনভাবে হাত টেনে ধরলেন যে নিশানা ভুল হয়ে গুলি সোজা পিঠে গিয়ে বিধলো।

ভদ্রলোক মারা গেলেন। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, ভদ্রমহিলা ভাবলেন আমি তার প্রেমে পড়ে মিঃ ল্যাক্সমোরকে খুন করেছি। শেষে তিনি আমাকে বললেন, লোক জানাজানির প্রয়োজন নেই, ভদ্রলোক জুরে মারা গেছে বলে প্রচার করলেই হবে। অবশেষে তাকে আমরা নদীর ধারে কবর দিলাম। তারপর থেকে অনেকবারই আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ঘটেছে কিন্তু আমি তাকে সভয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।

মেজর ডেসপার্ড শান্ত কণ্ঠে বললেন, এই হচ্ছে আমার কাহিনী।

পোয়ারো গভীর মনোযোগ সহকারে সমস্তটা শুনে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন, কাহিনীটা আপনার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক বিশেষ করে শ্যাতানার মত লোক যখন এর সন্ধান পেয়েছিলেন।

ডেসপার্ড অবহেলা ভরে মাথা নাড়লেন, আমি শ্যাতানাকে ভয় পাই না।

পোয়ারো কোনো জবাব দিলেন না। এবার উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের অভিপ্রায় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, তারপর বললেন, আপনার ঘটনাটা হয়তো এইরকমই ঘটেছিলো।

ডেসপার্ডের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অসংখ্য ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতায় দুহাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।

.

২২.

ইনসপেক্টর হার্পার সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেলকে বললেন, এই হচ্ছে স্যার প্রকৃত ঘটনা। এর মধ্যে কোনো ধোঁয়াটে ভাব নেই। সরকারি ডাক্তারও সন্তুষ্ট চিত্তে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কারও মনে কোনো অসন্তোষ ছিল না।

এই বোতল দুটো সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য খুলে বলুন। আমি সমস্তটা বিশদভাবে জানতে চাই।

একটা ছিল সিরাপের বোতল। তিনি সেটা পান করতেন। আর একটায় ছিল টুপির পালিশ জিনিষটা। খুবই বিষাক্ত। যে বোতলে টুপির পালিশ ছিল সেই বোতলটি একদিন হাত থেকে পড়ে চিড় খেয়ে যায়। তখন ভদ্রমহিলা তার দাসীদের বলেন একটা খালি সিরাপের বোতলে যেন ওই টুপির পালিশটি ঢেলে উঁচু তাকে রাখা হয়।

ঘটনার দিন রাত্রে ভদ্রমহিলা একটা পাত্রে বেশ কিছুটা সিরাপ ঢেলে পান করেন। কিন্তু সেটা সিরাপ নয়, টুপির পালিশ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে খবর পাঠানো হয়। কিন্তু ডাক্তার আসতে আসতে ভদ্রমহিলা মারা যান।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল আপন মনে চিন্তা করতে লাগলেন, ব্যাপারটা কতই সহজ, কত নিখুঁত, নিপুণ একটা খুন। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটাই তাকে জটিল ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

ব্যটেল তথ্যের জন্য আরো দু-চার জায়গায় ঘোরাফেরা করলেন কিন্তু কোনো প্রয়োজনীয় খবর সংগ্রহ করতে পারলেন না। যতখানি আশা নিয়ে ডেভনশায়ারে ছুটে গিয়েছিলেন ততখানি অবশ্য পূরণ হলো না। ব্যাটেল মনে মনে ভাবলেন মিসেস বেনসনের টাকা কড়ি, বিষয় সম্পত্তি কারা পেয়েছে? অ্যানা কি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্যেই ভদ্রমহিলাকে খুন করলেন। অ্যানা মেরিডিথ একসময় এখানে থাকতো সে কথাটাই বা গোপন করতে গেলো কেন? ব্যাটেলের সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হলো।

.

২৩.

সকালের ডাকেই পোয়ারোর আমন্ত্রণপত্র অ্যানার হাতে পৌঁছেছিলো, তার আসবার ইচ্ছা আদৌ ছিল না।

রোডাই একরকম জোর করে টেনে নিয়ে এলেন। রোডা অ্যানাকে বলল, সন্দেহভাজনদের মধ্যে তুইও একজন, অবশ্য বিচার করলে সন্দেহটা তোর ওপর সবচেয়ে কম।

অ্যানা ঠাট্টার সুরে বলল, রহস্য গোয়েন্দা উপন্যাসে দেখিস না, যার ওপর আদৌ কোনো সন্দেহ জাগে না সেই কিন্তু প্রকৃত অপরাধী।

তাহলেও সন্দেহভাজনদের মধ্যে তুইও একজন, রোডা তাকে ঠাট্টা করল।

অ্যানা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে এই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। পুলিসের কাছে আমি যে কোনো প্রশ্নের দিতে রাজী আছি। কিন্তু এরকুল পোয়ারো সে তো বাইরের লোক তবুও তাকে জবাবদিহি করতে যেতে হবে।

যাইহোক রোডা আর অ্যানা যখন পোয়ারোর বাড়িতে হাজির হলেন তখন বিকেল তিনটে। পোয়ারো তাদের ডেকে নিয়ে ঘরে বসালেন, সরবত দিলেন।

আপনারা আমার আমন্ত্রণ পাওয়া মাত্র হাজির হওয়াতে আমি খুব খুশী। যাইহোক এবার আসল কথায় আসা যাক।

শান্ত বিনয়ের ভঙ্গিতে কথা শুরু করলেন পোয়ারো। ম্যাডাম, আপনি একটু কষ্ট করে সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শ্যাতানার ড্রইংরুমটা স্মরণে আনার চেষ্টা করুন। সেখানে কি কি দেখেছেন, কোন কোন বস্তুর কথা সঠিক আপনার মনে পড়ছে, এই আর কি?

অ্যানা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ব্যাপারটা খুবই কঠিন। সবটা মনে করতে পারবো বলে মনে হয় না তবুও বলতে চেষ্টা করছি। দেওয়ালে মাঝে মাঝে কাজ করা ছিলো, মেঝের ওপর অনেক মূল্যবান কম্বল পাতা ছিলো, একপাশে একটা বড় আকারের পিয়ানো ছিলো। হতাশভাবে মাথা নাড়লেন অ্যানা, না, আপাতত আর কিছু মনে পড়ছে না।

পোয়ারো মৃদুস্বরে জানালেন, মিঃ শ্যাতানা একজন বিখ্যাত সংগ্রাহক ছিলেন, জীবনভোর নানা, দুষ্প্রাপ্য জিকির জানালেন, মিঃ শসপাতত আর কিছু মন্ন আকারের পিয়ানেওপর

হ্যাঁ, নিশ্চয়। ঘরটা তো হাজার রকমের জিনিষপত্রে ঠাসা।

তাহলে আপনি এমন কোনো বস্তুর নাম করতে পারছেন না যা বিশেষভাবে আপনার নজরে পড়েছিলো।

অ্যানা নিচু গলায় বললেন, আশঙ্কা হচ্ছে আমিও হয়তো আপনার অভীষ্ট বস্তুটিকে ঠিকমতো নজর দিয়ে দেখিনি।

মৃদু হাসলেন পোয়ারো। তাতে কিছু যায় আসে না। হ্যাঁ, ভালো কথা, মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে সম্প্রতি আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে?

অ্যানা বললেন, না, তবে ভদ্রলোক শীগগিরই একদিন এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। পোয়ারো হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন মিস দোয়স, আপনাকে একটা জিনিষ দেখিয়ে আনি।

রোডা কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, জিনিষটা কি?

পোয়ারো নিচু স্বরে বললেন, একটা ছোরা, এই ছোরাটার সাহায্যে বারোজন লোককে হত্যা করা হয়েছিল। আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক হোটেলের মালিক আমাকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে উপহার দিয়েছিলেন। আলমারী খুলে ছুরিটা দেখাতেই মিনিট তিনেক কেটে গেলো। তারপর রোডাকে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় পাশের ঘরে হাজির হলেন। এইবার রোডা ও অ্যানা বিদায় নেবার জন্য উঠে পড়ল।

পোয়ারো তাদের আর এক পাত্র সিরাপ পানের অনুরোধ জানালেন। তারা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন সে অনুরোধ পোয়ারো হাসিমুখে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

.

২৪.

ব্যাটেল বেশি ভনিতা না করে সরল ভাষায় তার ডেভনশায়ার অভিযানের আগাগোড়া ইতিবৃত্ত খুলে বললেন।

এদিকে… মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন, আজ বিকেলে আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা চালিয়েছি। মিস মেরিডিথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পুরানো প্রশ্নই জিজ্ঞেস করলাম, শ্যাতানার ড্রইংরুমে কি কি দেখেছিলেন।

মিস মেরিডিথ খুবই সন্দেহপ্রবণ। সেইজন্য পোয়ারোকে চমৎকার ফাঁদ পাততে হলো। মেরিডিথ গয়নার বাক্সের কথা বলতেই আমি তার কাছে ছুরিটার বিষয় জানতে চাইলাম। এর বিপরীত দিকের টেবিলেই যে ছুরিটা পড়েছিলো, সেটা তার দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো কিনা। সুকৌশলে আমার ফাঁদ এড়িয়ে গেলো মেরিডিথ। তবে তার কথাবার্তার মধ্যে একটা চারিত্রিক গড়নের আভাস পাওয়া যায়। যেমন সে গরীব কিন্তু সৌখিন সাজপোষাক করতে ভালোবাসে। ছোট ছোট সুন্দর বস্তুর ওপর দারুণ লোভ। মনের গড়নটা হত্যাকারীর নয়, বরঞ্চ চোরের সঙ্গেই বেশি খাপ খায়। মেরিডিথের চরিত্রে একটা দুর্বলতা আছে যে সে স্টেশনারী দোকান থেকে টুকিটাকি জিনিষপত্র চুরি করে।

যার জন্য মিসেস এল্ডনের ঘর থেকে এইভাবে জিনিষ সরানোর অভ্যাস তার ছিলো।

মিসেস এল্ডন ছিলেন অসাবধানী কিন্তু মিসেস বেনসন ছিলেন বিপরীত ধরনের মহিলা। তার সাবধানী চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয়। অ্যানা তাঁর কাছে ধরা পড়ে গেলো। তিনি তাকে চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করলেন। তখন এই হত্যার পেছনে একটা কার্যকারণ সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। তাহলে মনে হয় অ্যানা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলো তার ফলেই সে বোতল দুটো পালটে রেখে দেয়। নিঃসন্দেহে এটা একটা হত্যাকাণ্ড। তবে আদালতে প্রমাণ করা সাধ্যাতীত। এটাই হচ্ছে দুনম্বরের সফল হত্যা।

বর্তমানে আমাদের প্রধান বিবেচ্য, শ্যানার হত্যাকারী কে? এটাও কি অ্যানা মেরিডিথের কাজ?

ব্যাটেল মিনিট দুয়েক চুপ করে থেকে আবার মাথা নাড়তে শুরু করলেন। কিন্তু ঠিক খাপ খাচ্ছে না।

পোয়ারো সেকথায় সায় দিলেন, হ্যাঁ আমিও এবিষয়ে একমত। দুটো অপরাধের প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে মিঃ শ্যাতানাকে হত্যার ব্যাপারে মেয়েটার কোনো হাত নেই। ডাক্তার রবার্টস এবং মিস মেরিডিথ দুজনকেই আমাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

মেজর ডেসপার্ডের কি খবর? মিসেস ল্যাক্সমমারের সঙ্গে দেখা করে কিছু সুবিধে হলো?

পোয়ারো এবার মেজর ডেসপার্ডের কাহিনী শোনালেন।

ভদ্রলোকের কথা আপনার বিশ্বাস হয়?

হা হয়।

ব্যাটেল নিশ্বাস ফেললেন, আমারও তাই মনে হয় পরস্ত্রীর লোভে তার স্বামীকে খুন করবার মতো লোক তিনি নন। তাহলে অবশিষ্ট থাকেন, মিসেস লরিমা।

মিসেস লরিমা ফোন করেছিলেন। ভদ্রমহিলার ইচ্ছে আমি একবার গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।

দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকালেন। ব্যাটেলের চোখে সন্দেহের ঝিলিক। মনে হচ্ছে আপনি যেন এই ফোনটার অপেক্ষায় ছিলেন।

যাইহোক তাহলে আর দেরি করবেন না, উৎসাহ দিলেন ব্যাটেল; হয়তো শেষপর্যন্ত সত্যি কথাটাই উদ্ধার করে আনতে পারবেন।

কি জানি! উদাস কণ্ঠে বললেন পোয়ারো। তাই হয়তো হবে। আমি ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি।…

.

২৫.

হাসি-হাসি মুখেই পোয়ারোকে স্বাগত জানালেন মিসেস লরিমা। আপনি যে এত শীঘ্র দেখা দেবেন ভাবতে পারিনি।

মিসেস লরিমা ঘণ্টি টিপলেন। দাঁড়ান আগে চায়ের ব্যবস্থা করি।

দাসী এসে হাজির হলে চায়ের অর্ডার দিলেন মিসেস লরিমা। কিছুক্ষণ টুকটাক কথা হলো। ইতিমধ্যে দাসী চা নিয়ে হাজির; লরিমা চা ঢালতে ঢালতে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। প্রাত্যহিক খবরের কাগজগুলো তিনি বেশ মনোযোগ সহকারেই পড়েন বোঝা গেল।

কথা প্রসঙ্গে পোয়ারো মন্তব্য করলেন, শুনলাম দু-একদিন আগে আপনি নাকি মিস মেরিডিথের সঙ্গে বসে চা খেয়েছিলেন।

হা খেয়েছিলাম।

পোয়ারো মৃদু হাসলেন, এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সবার মধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। একমাত্র ডাক্তার রবার্টস ছাড়া।

কিছুদিন আগে ব্রীজ টেবিলে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। তাকে বেশ হাসিখুশী দেখলাম।

দু-এক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার প্রশ্ন করলেন, মিঃ ব্যাটেলের সাথে আপনার দেখা হয়েছে।

আজ বিকেলেই তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন। তাঁর কাজকর্ম কেমন চলছে?

পোয়ারোর স্বর গম্ভীর, ভদ্রলোক তেমন দ্রুত নন ধীরে সুস্থে অগ্রসর হওয়া তিনি পছন্দ করেন। তবে লক্ষ্যে ঠিক পৌঁছে যান।

হয়তো তাই হবে। তার ঠোঁটে বিদ্রুপের বাঁকা হাসি।আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ।

তাহলে ম্যাডাম, আমি একটু খুলে বলি, সেদিন রাত্রে মিঃ শ্যাতানার ঘরে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে যাঁর বুদ্ধি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ, যিনি সর্বাপেক্ষা যুক্তিপ্রবণ ও স্থির মস্তিষ্ক; তিনি হচ্ছেন ম্যাডাম আপনি।

যদি কেউ আমাকে বাজি ধরে কে এই খুন করেছে এই চারজনের মধ্যে তখন আমি আপনার ওপরেই বাজি ধরবো।

তার অর্থ, আমি হলাম সেই ধরনের মহিলা, যে নিখুঁত পরিকল্পনায় একজনকে খুন করতে পারে। অর্থাৎ মিঃ শ্যাতানাকে সফলতার সঙ্গে আমিই খুন করতে পারি।

পোয়ারো বললেন, শ্যাতানার হত্যার পেছনে এই ধরনের একটা মনোভাব সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো।

তাই বুঝি? মিসেস লরিমা মৃদু হাসলেন।

পোয়ারো আবার বললেন, তবে আপনার স্বভাব কিন্তু এ ধরনের ক্রাইমের উপযুক্ত নয়। আপনি যদি শ্যাতানাকে খুন করতেন সুচারু রূপে পরিকল্পিত হতো।

তাহলে এখন আপনি বলছেন এটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয় অতএব আমি তাকে খুন করিনি।

হ্যাঁ, ম্যাডাম ঠিক তাই। সবিনয়ে পোয়ারো মাথা নাড়লেন।

মিসেস লরিমা এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু আমিই শ্যাতানাকে খুন করেছি।

.

২৬.

সন্ধ্যার আঁধার ক্রমেই আরো ঘনিয়ে আসছে। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা।

অবশেষে পোয়ারো ধীরে ধীরে মুখ খুললেন, ম্যাডাম কেন আপনি শ্যাতানাকে খুন করেছেন? আপনার কোনো গোপন কথা তিনি কি জানতেন?

হ্যাঁ, সেই গোপন ঘটনা হলো অন্য কোনো মৃত্যু। তাই আমি আজ অকপটে সব প্রকাশ করছি। তাই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।

পোয়ারো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মিসেস লরিমা কথা শুরু করলেন, একাকীত্বের যন্ত্রণা যে কি ভীষণ আমার মত জীবনযাপন না করলে কেউ তা জানতে পারবে না। সর্বোপরি বিগত জীবনের মৃত্যুহীন স্মৃতি।

পোয়ারো ঈষৎ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, মিঃ শ্যাতানা সেদিন ডিনার টেবিলে যে উক্তি করেছিলেন সেটা কি আপনাকে উদ্দেশ্য করে?

হ্যাঁ, মিঃ শ্যাতানা সেদিন যে বলেছিলেন, মেয়েদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে বিষ, একথা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা।

এ ঘটনা তিনি জানতেন। কখন আপনি তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন?

সিদ্ধান্ত কখন মাথায় এল স্মরণ করা শক্ত, তবে ডিনারে বসবার আগে ছোরাটা আমার নজরে এল কিন্তু ডিনারের পর সবার অলক্ষ্যে ছোরাটা লুকিয়ে রাখলাম। তারপর ব্রীজের আসর বসলো। অবশেষে সুযোগ এসে উপস্থিত হলো। উঠে দাঁড়ালাম। তখন আমি ডামি, ইতস্তত পায়চারি করবার অছিলায় ফায়ারপ্লেসের কাছে হাজির হলাম। শ্যাতানা তখন চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। আমি অন্যদের দিকে তাকালাম, সকলেই তাস খেলায় ব্যস্ত সুতরাং এ সুযোগ হাতছাড়া হতে দিলাম না।

সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে ছুরি চালালাম। তারপর সন্দেহের হাত থেকে বাঁচবার একটা অজুহাত খুঁজে একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দিলাম।

তিনি কি সেসময় কোনো চিৎকার করে ওঠেননি?

না, কেবলমাত্র গলা দিয়ে মৃদু ঘড় বড় শব্দ বেরিয়ে এল।

তারপর আমি আবার ব্রীজের টেবিলে ফিরে গেলাম তখন সেখানে শেষ তাসটা খেলা হচ্ছে।

উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন পোয়ারো, চমৎকার, অভূতপূর্ব। এইরকম বিপজ্জনক ঝুঁকি আপনি নিলেন, এবং আশ্চর্যভাবে সাফল্য লাভ করলেন।

মিসেস লরিমার ঠোঁটে একধরনের বাঁকা হাসি বিচ্ছুরিত হলো। আপনি ঠিকই বলেছেন। আরও একটা কথা, আমি অসাধু প্রকৃতির মহিলা নই তাই আমার কৃতকর্মের ফলে কেবল মিঃ শ্যাতানাকেই জীবন থেকে বঞ্চিত করলাম তা নয়, অপর তিনজনের জীবনও দুর্বিপাকের মধ্যে টেনে আনলাম। তাই ঠিক করলাম আমার স্বীকারোক্তির ফলে তারা অন্তত রাহুমুক্ত হবে। ঘরের মধ্যে আবার থমথমে নীরবতা নেমে এলো।

পোয়ারো অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন, এই হত্যা যদি পূর্বপরিকল্পিত না হয় তাহলে এ খুন আপনার দ্বারা আদৌ সাধিত হয়নি।

মিসেস লরিমা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন, আপনি সত্যই বদ্ধ উন্মাদ। আমি যখন স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছি তখন কিভাবে এটা মিথ্যা হয় আর তাছাড়া আমার এতে স্বার্থই বা কি?

আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই ম্যাডাম, আপনি অপরাধের বোঝা নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে অল্পবয়সী মেয়েটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। সে আর কেউ নয়–তিনি হচ্ছেন অ্যানা মেরিডিথ।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন, মিসেস লরিমা শুষ্ককণ্ঠে বললেন, আমিও একজন নিরপরাধ মহিলা নই। অনেক বছর আগে আমি নিজে হাতে আমার স্বামীকে খুন করেছিলাম।

পোয়ারো নীরবতার মধ্য দিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর বললেন, খুনটা সর্বদাই খুনই, আপনার সাহস আছে, আপনার দৃষ্টিশক্তিও খুব স্বচ্ছ।

একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস লরিমা। পোয়ারোর দৃঢ়তায় প্রতিরোধ ক্ষমতার শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত তার দেহ থেকে অপহৃত হয়ে গেছে। তার কণ্ঠস্বর সরল শিশুর মত শোনালো।

.

২৭.

পোয়ারো আচমকা হেসে উঠলেন, হাসতে হাসতেই বললেন, এই হত্যার ব্যাপারে এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে গেছেন, যার চোখের সামনেই এই রহস্যময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

তখন বেশ রাত হয়েছে, অ্যানা মেরিডিথ ছিলো ডামি, ঘরের ভেতর ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তাসটা তেমন ঘোরপ্যাঁচের নয় তাই খেলার দিকে আমারও মন ছিলো না, খেলাটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমন সময় মিঃ শ্যানার দিকে আমার নজর গেলো। অ্যানা মেরিডিথ শ্যানার চেয়ারে ঝুঁকে পড়ে কি যেন করছে। তার হাতটা ভদ্রলোকের বুকের উপর ন্যস্ত। চোখেমুখে ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। চকিত দৃষ্টিতে সে একবার আমার দিকে ফিরে তাকালো। সবই বুঝতে পারলাম।

পোয়ারো গম্ভীর ভাবে বললেন, আপনি যে দেখে ফেলেছেন ও সেটা নিশ্চয়ই জানে না।

আহা বেচারী, সমবেদনায় আর্ত হয়ে উঠলেন মিসেস লরিমা। আগে আমি এত সংবেদনশীল ছিলাম না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে এসব অভ্যাস জন্ম নেয়।

পোয়ারো বললেন, সংবেদনশীল কথাটা বেশ শ্রুতিমধুর। উচ্চারণও বেশ গালভরা। তবে ম্যাডাম সেদিন অ্যানা মেরিডিথ কেন মিঃ শ্যাতানাকে খুন করেছিলো জানেন?

বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন মিসেস লরিমা, এসব কি সত্যি মিঃ পোয়ারো?

এর সত্যতা সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

মিসেস লরিমা কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ করে বলে উঠলেন, আমি কিন্তু আজকের এইসব কথাবার্তা একেবারে অস্বীকারও করতে পারি। মনে রাখবেন আপনার কোনো সাক্ষী নেই।

পোয়ারো সরল সুরে তাকে আশ্বস্ত করলেন, কোনো ভয় নেই ম্যাডাম। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। গভীর আন্তরিকতায় তিনি মিসেস লরিমার দুহাত চেপে ধরলেন। তারপর করমর্দন করে কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন, আপনার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি রইলো। আমি এখন বিদায় নিচ্ছি। বলে তিনি এগোতে লাগলেন। বেশ কিছুটা এগিয়ে আসবার পর একবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনদিকে তাকালেন। কেউ যেন মিসেস লরিমার বাড়ি প্রবেশ করলেন। তিনি একবার ভাবলেন ফিরে যাবেন কিন্তু তা না করে হেঁটে চললেন ধীরে ধীরে।

নিজের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলেন, মিঃ ব্যাটেল বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তার জন্য কোনো খবর রেখে যাননি।

তিনি রিসিভার তুলে ব্যাটেলকে ফোন করলেন, ব্যাটেল ভরাট কণ্ঠে বললেন, মিস মেরিডিথের সঙ্গে অনতিবিলম্বে একবার দেখা করা প্রয়োজন। এবং সেটা খুব জরুরী।

পোয়ারো চিন্তান্বিত চিত্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। অবশেষে ভয় ভাবনা দূরে ঠেলে ঘুম চোখে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন।

আগামী প্রভাত তার সামনে কি রূপে দেখা দেবে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা করে উঠতে পারলেন না।

.

২৮.

ব্যাটেল পোয়ারোকে ফোন করলেন। হ্যালো মিঃ পোয়ারো, মিসেস লরিমার কি খবর জানেন? তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

নানাকারণে ভদ্রমহিলা ইদানীং খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তার শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। তিনি ডাক্তারের চিকিৎসা মত ঘুমের বড়ি খেতেন কিন্তু গতরাত্রে একসঙ্গে অনেকগুলো বড়ি খাওয়ার ফলে তার মৃত্যু হয়। তিনি আত্মহত্যা করবার আগে তিনজনকে তিনটি চিঠি লিখে যান। ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেসপার্ড, আর মিস মেরিডিথ।

তিনি তাদের জানান তিনিই শ্যাতানার হত্যাকারী আর এর জন্য যে তাদের নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তার জন্য তিনি প্রত্যেকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

মিনিট দুয়েক পোয়ারো কোনো কথা বললেন না। রিসিভার ধরে বসে রইলেন।

তাহলে এই হলো মিসেস লরিমার অন্তিম সিদ্ধান্ত। সত্যিই অসাধারণ মহিলা। মিসেস লরিমার প্রতি শ্রদ্ধা আরো নিবিড় হলো।

ব্যাটেলের কণ্ঠস্বরে পোয়ারোর ধ্যানভঙ্গ হলো, গত সন্ধ্যায় কি বলেছিলেন? ভদ্রমহিলাকে সন্দেহ করছি বলে কি কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

পোয়ারো মৃদুকণ্ঠে বিড়বিড় করলেন। আমারই ধারণায় কোনো ভ্রান্তি ছিলো।

আপনি ভুল করেছিলেন, ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও প্রমাণ করবার ক্ষমতা আপনার ছিলো না।

ঠিক কি ঘটেছিলো পরিষ্কার করে খুলে বলুন তো?

সকাল আটটার ডাকে রবার্টস এই চিঠি পান। তিনি আর কালবিলম্ব না করে তাঁর নিজের গাড়িতে চড়ে মিসেস লরিমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েন। কিন্তু পরিচারিকার মুখে শোনেন ভদ্রমহিলা তখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। তিনি দ্রুতপায়ে ঘরে গিয়ে দেখেন সব শেষ।

ডিভিশনাল সার্জেনেরও তাই মত। ঘুমের ট্যাবলেটই তার মৃত্যুর কারণ।

ডেসপার্ড শহরের বাইরে গেছেন; আজ সকালের ডাক তার হাতে পৌঁছয়নি।

আর মিস মেরিডিথ? অল্প আগে তাকে ফোন করেছিলাম, তিনি খবরটা শুনে দুঃখপ্রকাশ করলেন বটে তবে তিনি যে স্বস্তিবোধ করছেন এটা তার গলার স্বরে টের পাওয়া যায়।

পোয়ারো যখন অকুস্থলে হাজির হলেন রবার্টস তখন প্রস্থানের উপক্রম করছেন।

কি জঘন্য কাণ্ড মিঃ পোয়ারো। শান্ত স্বভাবের সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা, তিনি যে এমন একটা কাজ করতে পারেন তা ভাবা যায় না।

তবে ঘটনাটা আপনাকে অনেকখানি হাল্কা করে দিয়েছে।

পোয়ারো মিসেস লরিমার দাসীকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন দাসী সবিস্তারে উত্তর দিল:

গতকাল আপনি বিদায় নেবার পর আর একজন অল্পবয়সী মহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মনে হয় সেই কারণে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

পোয়ারো দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কতক্ষণ ছিলেন মহিলা।

প্রায় ঘণ্টাখানেক।

বসবার ঘরের টেবিলের ওপর ডাকে পাঠাবার জন্য গোটাকতক চিঠি পড়ে ছিলো।

সেগুলি নিয়ে আমি ডাকে ফেলে দিয়ে আসি। মোট তিনটে চিঠি ছিলো।

পোয়ারো গম্ভীর ভাবে বলল, ঘুমের বড়ির শিশিটা কোথায় থাকতো?

তার শোবার ঘরের ছোট জাল আলমারিটার মধ্যে।

ভাগ্য আমাদের বিরুদ্ধে নইলে ঘণ্টাদুয়েক আগে টের পেলে ভদ্রমহিলাকে বাঁচানো যেত। ডিভিশনাল সার্জেন হতাশভাবে বললেন।

ভদ্রমহিলা কি মিঃ শ্যাতানাকে খুন করেছিলেন তা জানি না, হয়তো কোনো সঙ্গত কারণ ছিলো।

তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার উদ্যোগ করলেন, এক মিনিট, ডাক্তার-ব্যাটেল ডেকে উঠলেন।

পোয়ারো শয়নকক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন, আমি কি ভেতরে ঢুকে মৃতদেহটা দেখতে পারি।

অবশ্যই। ব্যাটেল সম্মতি জানালেন। আমাদের পরীক্ষা শেষ।

প্রাণহীন দেহটা বিছানার ওপর পড়ে আছে। মৃতদেহের বাঁ হাতের মাঝখানে একফোঁটা বিবর্ণ রক্তচিহ্ন। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো, তিনি দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করে নিচে নেমে এলেন। পোয়ারোকে রীতিমতো উত্তেজিত মনে হলো। তিনি ব্যাটেলের হাত ধরে বললেন, চলুন এক্ষুনি উইলিংফোর্ড যাবার ব্যবস্থা করুন। আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি মেরিডিথ তরুণী হলেও সাংঘাতিক এবং বিপজ্জনক। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার।

.

২৯.

রোডা অ্যানাকে ডাকলেন। অ্যানা চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসলেন, রোজা তাকে বলল, মিঃ ব্যাটেল এখানে আবার আসছেন।

তাকে বেনসনের ব্যাপারটা বলে দেওয়া ভালো, এটা লুকানোর কোনো দরকার নেই।

মেজর ডেসপার্ডও আসছেন বেশ মজাই হলো দেখছি। মেজর ডেসপার্ড এগারোটায় আসবেন বলে চিঠিতে জানিয়েছেন।

দশ মিনিট বাদেই মেজর ডেসপার্ড এসে পৌঁছোলেন। কিন্তু রোডা ও অ্যানা একটু বাইরে বেড়াতে গেছে শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন।

এদিকে অ্যানার দাসী সবে কাজে হাত লাগাতে যাবে এমন সময় আবার কলিংবেল বেজে উঠলো। দাসী দরজা খুলে দেখেন দুজন ভদ্রলোক মেরিডিথের খোঁজে এসেছেন কিন্তু মেরিডিথ নেই শুনে কোথায় গেছে খোঁজ করলেন। এবং দাসীর মুখে শুনে সেই দিকেই যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন।

পোয়ারো আর ব্যাটেল তখন বাঁ-হাতের পথ ধরে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। পোয়ারোকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে দ্রুত পায়ে হাঁটতে দেখে ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন, অতো তাড়া কিসের মঁসিয়ে পোয়ারো? মনে হচ্ছে আপনি যেন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন?

তা ঠিক, কেন জানি না, আমি নিজে খুব অস্বস্তি বোধ করছি।

ব্যাটেল বলল, কিসের আশঙ্কা করছেন? কিছু একটা নিশ্চয় আপনার মাথায় আছে? তা না হলে সকাল বেলা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এখানে চলে এলেন কেন? এবং আপনার কথাতেই আমি কনস্টেবল টার্নারকে নির্দেশ দিয়ে পাঠালাম, এ অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহ যেন কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে। মেয়েটা কিছু একটা করে বসতে পারে বলে আপনি সন্দেহ করছেন? তাছাড়া ভাবছি মেরিডিথ কি জানে যে তার বন্ধু মিসেস অলিভারের কাছে একটা গোপন তথ্য ফাস করে দিয়েছে?

পোয়ারো মাথা ঝাঁকালেন, সেই জন্যই বলছি, তাড়াতাড়ি চলুন। এক মুহূর্ত সময়ও এখন অনেক মূল্যবান।

দুজনে দ্রুত পায়ে হেঁটে চললেন। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে দুজনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, একটা ডিঙিতে রোজা আর অ্যানা নদীর মাঝবরাবর বসে আছেন। তারা হেসে হেসে গল্প করছে। তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ।

ঠিক সেই মুহূর্তে সকলের চোখের সামনে অভাবনীয় একটা ব্যাপার ঘটে গেল।

অ্যানা দুহাত বাড়িয়ে সজোরে ধাক্কা মারলেন রোডাকে। রোডা জামার প্রান্ত ধরে টাল সামলাবার চেষ্টা করছে। ঝকানিতে উল্টে গেলো ছোট ডিঙি নৌকাটা। দুজনেই পড়ে গেলো নদীতে।

দেখুন দেখুন! চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল। মিস মেরিডিথ ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে বন্ধুকে জলে ফেলে দিলো। এটা নিশ্চয় তার চতুর্থ হত্যাকাণ্ড।

তাঁরা দুজনেই দৌড়তে শুরু করলেন, মেজর ডেসপার্ড ছিলেন তাদের আগে।

তিনি জলে আঁপিয়ে পড়লেন। মেয়েদুটি এখন আর এক জায়গায় নেই। স্রোতের টানে পরস্পরের কাছ থেকে তফাতে চলে গেছেন।

মেজর ডেসপার্ড সাঁতরে রোডার দিকে এগিয়ে গেলেন।

ব্যাটেলও ইতিমধ্যে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ডেসপার্ড ততক্ষণে রোডাকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলেন, এবার অ্যানাকে খুঁজতে লাগলেন কিন্তু তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে অনেক পরে ব্যাটেল আর ডেসপার্ডের প্রচেষ্টায় অ্যানাকে খুঁজে পাওয়া গেল। তারা ধরাধরি করে তাকে তীরে নিয়ে এলেন।

পোয়ারোর সেবা শুশ্রূষায় জ্ঞান ফিরে এসেছে রোডার। তার পাশেই অ্যানাকে শোয়ানো হলো। ব্যাটেল যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাসচালু করবার চেষ্টা করলেন। তাকে সাহায্য করবার জন্য মিঃ পোয়ারো দাঁড়িয়ে রইলেন।

মেজর ডেসপার্ড জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কিছুটা সুস্থ আছেন তো?

রোডা স্বপ্নচ্ছন্ন কণ্ঠে উত্তর দিলেন, আপনি…আমায় বাঁচিয়েছেন! বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ডেসপার্ডের চোখের সামনে একটা অলৌকিক ছায়াছবি ভেসে উঠলো।

.

৩০.

পোয়ারোর কণ্ঠস্বর গম্ভীর। তারা তখন লণ্ডনের সীমান্ত দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন।

তিনি রোডাকে বললেন, অ্যানা তোমায় ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছে। এটা সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত।

রোডা উত্তর দিলেন, কিন্তু…কিন্তু কেন?

পোয়ারো মিনিট দুয়েক কোনো উত্তর দিলেন না। অ্যানাকে প্ররোচিত করার পেছনে মেজর ডেসপার্ডের মন্তব্যের উদ্দেশ্য আছে তা তিনি জানেন।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, আপনাকে প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে, মিস দোয়স। এবার যা বলবো তাতে আপনি নিদারুণ আঘাত পাবেন। আপনার বন্ধু একজন খুনী। তিনি যে মিসেস বেনসনের বাড়ি কাজ করতেন তাকে সুপরিকল্পিতভাবে মিস মেরিডিথই হত্যা করেছিলেন।

এসব আপনি কি বলছেন? অ্যানাই বোতল দুটি বদলে রেখেছিলো? এ হতে পারে!

তার পেছনেও যুক্তি ছিলো, মিঃ ব্যাটেল এবার উত্তর দিলেন।

সে যাইহোক, অ্যানার ধারণা একমাত্র আপনি আমাদের কাছে এ ঘটনার হদিশ দিতে পারেন। তাই আপনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো।

বন্ধু হিসেবে মিস মেরিডিথ যে খুব ভালো ছিলো না এতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। গাড়িটা একটা বাড়ির দোরগোড়ায় এসে থামলো।

এটা হচ্ছে পোয়ারোর বাড়ি। চলুন আমরা সকলে এখানে সমস্ত বিষয়টা আলোচনা করি।

পোয়ারো ড্রইংরুমে ঢুকতে না ঢুকতেই শ্রীমতি অলিভার তাদের স্বাগত জানালেন। ইতিপূর্বে ডাক্তার রবার্টসও সেখানে হাজির হয়েছেন।

আসুন আসুন, শ্রীমতী অলিভার এমন অমায়িক ভঙ্গিমায় সকলকে আহ্বান জানালেন যাতে মনে হয় এটা যেন তারই নিজের বাড়ি, পোয়ারোর নয়। আপনার টেলিফোন পাওয়া মাত্রই আমি রবার্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তারপর দুজনে একসঙ্গে এখানে হাজির হই।

পোয়ারো মৃদুস্বরে বললেন, এই রহস্যময় হত্যার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অবশেষে আমরা মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।

মিসেস অলিভারও আমাকে এই কথা জানালেন। সুন্দরী মেরিডিথই এই অপকীর্তির মূল সেটা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। তাকে তো খুনী বলে আমি কোনোদিন ভাবতেও পারিনি।

আজকের দিনটা আমার ডায়রীতে একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে, রবার্টস বললেন। প্রথমে মিসেস লরিমার পত্র। সেটি নিশ্চয় জাল চিঠি, তাই না?

নিঃসন্দেহে; তিনটে চিঠিই জাল।

মিস মেরিডিথ কি নিজের নামেও একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন?

সেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। নকলটাও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছিলো। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয় এই ভাওতায় ভুলতেন না। আমার অযাচিত কৌতূহল মাপ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো। মিসেস লরিমার মৃত্যুটা যে আত্মহত্যা নয় সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সে কথা আপনি প্রথম সন্দেহ করলেন কিভাবে? অ্যানা মেরিডিথ যে আগের দিন সন্ধ্যায় মিসেস লরিমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এ খবর বোধহয় তার কাছ থেকে প্রথম জানতে পারেন।

হ্যাঁ, অন্যান্য খবরের সঙ্গে এ তথ্যটাও সে সরবরাহ করেছিলো। তাছাড়া প্রকৃত অপরাধী কে সে সম্বন্ধেও আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম। অর্থাৎ মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারী কে তা আমি জানতাম এবং সে ব্যক্তি মিসেস লরিমা নন। তবে নিজস্ব পদ্ধতিতে বক্তব্য রাখাই আমার বরাবরের অভ্যাস, সেটা হচ্ছে এক এক করে বাছাই করা। মিসেস লরিমা শ্যানার হত্যাকারী নন। মেজর ডেসপার্ডও তাকে খুন করেননি। এবং শুনলে অবাক হবেন এই হত্যাকাণ্ডটার পেছনে মিস মেরিডিথেরও কোনো হাত ছিলো না।…

সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন তিনি। তাঁর মৃদু কোমল কণ্ঠস্বরে শিকারী বিড়ালের আমেজ।–তাহলে বুঝতেই পারছেন ডাক্তার রবার্টস, একমাত্র আপনিই অবশিষ্ট থাকেন। আপনিই মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করেছেন এবং মিসেস লরিমাকেও।

কম করেও মিনিট তিনেক কারো মুখে কোনো কথা ফুটলো না। একটা অস্বস্তিকর থমথমে নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করলেন ডাক্তার রবার্টস, বীভৎস ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আপনি কি পুরোদস্তুর পাগল, মঁসিয়ে পোয়ারো? বলা বাহুল্য, মিঃ শ্যাতানাকে আমি খুন করিনি। মিসেস লরিমাকে খুন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। মিঃ ব্যাটেল–তিনি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, আপনি এইসব আজগুবি প্রলাপ শোনাবার জন্যে আমাকে ডেকে এনেছেন।

স্থির হয়ে মিঃ পোয়ারোর সম্পূর্ণ বক্তব্যটা শুনলেই বোধহয় ভালো করবেন।

পোয়ারো বললেন, যদিও কিছুদিন আগেই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আপনিই মিঃ শ্যাতানাকে খুন করার ব্যাপারে এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে গেছে যে আদালতে দাঁড়িয়ে আপনার অপকীর্তির সাক্ষী দিতে পারবে।

রবার্টসের হাবভাব ক্রমশ স্থির শান্ত হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টিতে একটা উজ্জ্বল চকচকে আভা। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে পোয়ারোর কথার প্রতিবাদ জানালেন। আপনি আবোলতাবোল বকছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।

না, মোটেই আমি ভুল বকছি না। আজ ভোরে আপনি বাজে ভাওতা দিয়ে মিসেস লরিমার শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন, গত রাত্রে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে তিনি তখন গভীর নিদ্রায় অচেতন। আপনি প্রৌঢ়া দাসীকে ভাওতা দিলেন, বললেন মিসেস লরিমা খুব সম্ভবত মারা গেছেন। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবার জন্যে তাকে ব্র্যাণ্ডি আর গরম জল আনতে পাঠান। সেই সময় ঘরের মধ্যে তৃতীয় কোনো প্রাণী উপস্থিত ছিলো না। আর তারপর কি ঘটলো?…

আপনি হয়তো জানেন না ডাক্তার রবার্টস যে জানলায় জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করবার জন্য যে সমস্ত কোম্পানি আছে তাদের কেউ কেউ খুব ভোরেই কর্মচারীদের কাজে পাঠিয়ে দেয়। আপনি যখন মিসেস লরিমার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন সেই সময় একজন কর্মচারী মই নিয়ে হাজির হয়েছিলো, ঘটনাচক্রে মিসেস লরিমার ঘরের জানলাটাই সে প্রথম বেছে নেয়। তার ফলেই একটা দুর্লভ দৃশ্য তার চোখে পড়ে। তাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে তার নিজের মুখ থেকেই ঘটনাটা শোনা যাক।

পোয়ারো মৃদু পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন, তুমি ভেতরে এসো।

অনতিবিলম্বে দশাসই চেহারার শ্রমিকশ্রেণীর একজন লোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। তার মাথার চুল লাল, ডান হাতে ধরা একটা ক্যাম্বিসের টুপি। টুপির গায়ে গোল করে লেখা চেলসি উইণ্ডো অ্যাসোসিয়েশন। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঘরের মধ্যে যাঁরা বসে আছেন, তুমি তাদের কাউকে চিনতে পারছো?

লোকটি একবার সকলকে পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার রবার্টসের দিকে ইঙ্গিত করলো, এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছি।

শেষ কখন তুমি ভদ্রলোককে দেখেছো এবং উনি তখন কি করছিলেন?

আজ ভোরবেলার ঘটনা স্যার, তখন আটটাও বাজেনি। আমি চেইন লেনে এক ভদ্রমহিলার ঘরের জানলায় জমে থাকা বরফ সাফ করছিলাম। ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। তিনি ঘুমের ঘোরেই একবার চোখ মেলে তাকালেন। ভদ্রলোককেও আমি তখন তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমি তাকে একজন ডাক্তার বলেই মনে করি। তার হাতে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ছিলো। তিনি খুব দ্রুত ভদ্রমহিলার শরীরে ইনজেকশন ছুঁড়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। চোখ বুজে। আমি সেখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে নিঃশব্দে দ্বিতীয় জানলার দিকে এগোলাম..মনে হয়, আমি নিশ্চয় কোনো অন্যায় করিনি?

না না, অন্যায় নয়, পোয়ারো উৎসাহের সুরে বললেন, তুমি আমাদের মহা উপকার করেছ। অপূর্ব…অভূতপূর্ব! তারপর রবার্টসের দিকে ফিরে তাকালেন। তাহলে ডাক্তার রবার্টস…?

একটা..একটা অতি সাধারণ শক্তিবর্ধক ওষুধ… তোতলাতে শুরু করলেন রবার্টস। শুধু তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার জন্য সর্বশেষ প্রচেষ্টা।

পোয়ারো কথার মাঝখানে বাধা দিলেন। সাধারণ শক্তিবর্ধক।… এন মিথাইল সাইক্লো হেক্সানিল-মিথাইল-ম্যালোনিল ইউরিয়া। কেটে কেটে প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন তিনি। সাধারণ ভাষায় একে এভিপ্যান বলা হয়। ছোটখাটো অপারেশনের সময় সেই জায়গাটা অসাড় করে দেবার জন্য এর প্রয়োজন লাগে। শিরার মধ্যে বেশি পরিমাণ এভিপ্যান ইনজেক্ট করে দিলে সে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়তে বাধ্য। ভেরোম্যান বা ঐ জাতীয় ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের পর এই এভিপ্যানের প্রয়োগ খুব বিপজ্জনক। মিসেস লরিমার বাহুর ওপর আমি একটা ইনজেকশনের চিহ্ন লক্ষ্য করেছিলাম। পুলিশ সার্জেনকে ঘটনাটা জানাবার পর তারা ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেন এবং প্রধান পুলিস সার্জন স্যার চার্লস ইস্ফেরি-ই আমাকে এই তথ্য সরবরাহ করেছেন।

এতেই আপাতত আমাদের কাজ চলে যাবে বলে মনে হয়। ব্যাটেল মুখ খুললেন, শ্যাতানার হত্যার ব্যাপারে অতো মাথা ঘামাবার প্রয়োজন হবে না। অবশ্য দরকার পড়লে মিঃ ক্র্যাডককে হত্যার দায়েও আমরা আপনাকে অভিযুক্ত করতে পারি। খুব সম্ভবত তার স্ত্রীকেও আপনি হত্যা করেছেন।

মিঃ এবং মিসেস ক্র্যাডকের নাম শোনামাত্রই হতাশভাবে মুষড়ে পড়লেন ডাক্তার রবার্টস। তার মুখে আর কোনো প্রতিবাদের ভাষা জোগালো না। অবশ হয়ে হেলে পড়লেন চেয়ারের ওপর।

ঠিক আছে, আমি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। ক্লান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, আর কোনো বাধা দেবো না আমায় গ্রেপ্তার করুন। মনে হয় শয়তান শ্যাতনাই এ বিষয়ে আপনাদের কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আমারও সেই রকম সন্দেহ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম খুব সুন্দর ভাবে চিরকালের জন্য শ্যাতানার মুখ বন্ধ করতে পেরেছি। কিন্তু

না শ্যাতানা নয়, ধীর কণ্ঠে ব্যক্ত করলেন ব্যাটেল, সমস্ত কৃতিত্ব মঁসিয়ে পোয়ারোর।

তিনি দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ইউনিফর্ম পরা দুজন পুলিস ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। তিনি তাদের শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে ডাক্তার রবার্টসকে গ্রেপ্তার করবার আদেশ দিলেন।

রবার্টসকে নিয়ে কর্মচারী দুজন ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর শ্রীমতী অলিভার খুশি-খুশি চোখ তুলে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন। আমি তখনই বলেছিলাম এটা ওরই কীর্তি। তবে…তার কণ্ঠস্বরে কিছুটা সংশয়ের সুরও মিশেছিলো।

.

৩১.

পোয়ারো মৃদু হেসে বললেন, আপনারা জানেন বক্তৃতা দেবার সুযোগ পেলে আমি মনে মনে খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করি। আপনারা এই বৃদ্ধের বক্তৃতা শোনবার জন্য অনেকক্ষণ প্রতীক্ষা করে আছেন। এর জন্য আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

আমি সারা জীবন যতগুলো রহস্যময় মামলার সম্মুখীন হয়েছি তার মধ্যে এই মামলাটাই সবচেয়ে জটিল এবং অত্যাধিক চমকপ্রদ। কেন না এগিয়ে যাবার মতো সামান্যতম কোনো সূত্রের চিহ্ন এখানে নেই। চারজন মাত্র লোক এবং তাদের মধ্যেই একজন এই অপকীর্তির নায়ক। কিন্তু সে কোনজন? কি করে আমরা তাকে চিহ্নিত করতে পারি? বস্তুকেন্দ্রিক বিচারে বলতে হয় না, তা পারি না। ধরা ছোঁওয়া যায় এমন কোনো সূত্র নেই, না পাওয়া গেছে কোনো আঙুলের ছাপ, অভিযোগমূলক কোনো কাগজপত্র বা দলিলেরও হদিশ এখানে পাওয়া যায়নি। সন্দেহভাজন চারজন ব্যক্তিই কেবল আমাদের সামনে উপস্থিত আছেন।

আর বস্তুগত সূত্র বলতে একটিমাত্র যা পাওয়া যায়–সেটা হলো ব্রীজ খেলার চারটে স্কোরশীট। তাই এই মামলার একেবারে প্রথম থেকেই আমি স্কোরশীটগুলোর ওপর বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলাম। কারণ এর মধ্যেই ওদের মানসিক গতিপ্রকৃতির কিছুটা ইঙ্গিত নিহিত আছে, তাছাড়া একটা মহামূল্যবান সংবাদ এর মধ্যে থেকে খুঁজে পাই। দেখলাম তৃতীয় রাবারের স্কোরশীটে একদিকের কলমে ১৫০০০ সংখ্যাটি লেখা আছে। এই সংখ্যাটি দেখে সিদ্ধান্তে আসতে দেরী লাগে না যে খেলাটি ছিলো গ্র্যাণ্ডস্লামের। এখন সেদিন সন্ধ্যায় ব্রীজ টেবিলের সেই পরিবেশটার কথা চিন্তা করুন। সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যেই কোনো একজন মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করবার মতলব আঁটছে। তাকে অন্তত দুটো অতি মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। প্রথমত মারা যাবার আগে ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠতে পারেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তিনি যদি চেঁচিয়ে নাও ওঠেন, তাহলেও সেই চরম মুহূর্তে ঘরের অন্য কেউ তাকে দেখে ফেলতে পারেন।

চিন্তা করুন প্রথম ঝুঁকিটার সম্বন্ধে কিছু করার নেই এটাকে জুয়ার মতো ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়টা সম্বন্ধে সেকথা প্রযোজ্য নয়। চেষ্টা করলে এর কিছুটা প্রতিকার করা যেতে পারে। সাধারণ তাস পড়লে খেলোয়াড়রা তেমন মনোযোগ দিয়ে খেলেন না। তারা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখেন, নিজেদের মধ্যে সহজ হাল্কা সুরে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু কোনো জটিল তাস হলে তখন রীতিমত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সমস্ত মনটা তাসের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। এখন গ্র্যাণ্ডস্লামের খেলা খুব উত্তেজনাপূর্ণ এবং রাবার ব্রীজের প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ এই ডাকে ডবল দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তিনজন খেলোয়াড় গভীর মনোযোগ দিয়ে তাস খেলেছে। একজনের চিন্তা কিভাবে তেরোটা পিটই ঘরে তোলা যায়। বিরুদ্ধ পক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে কোনো সুযোগে একটা পিট অন্তত তাদের ছিনিয়ে নিতে হবে। তাদের তাস ফেলার মধ্যে যেন কোনো ভুল না হয়। পার্টনার কোন রঙটায় উৎসাহ দেখাচ্ছে, কোন রঙটায় দেখাচ্ছে না, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখতে হয় সবকিছুর।

ভেবে দেখলাম, সেই পরিবেশে কাউকে যদি খুন করতে হয় তবে ডামির পক্ষে হচ্ছে এই সুবৰ্ণসুযোগ। খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই বিশেষ ভীলটায় ডামি ছিলে ডাক্তার রবার্টস।

একথা মনে রেখেই মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নতুনভাবে মামলাটার দিকে অগ্রসর হলাম। সন্দেহভাজন চারজনের মানসিক গঠন বিচার-বিশ্লেষণ করে আমার মনে হলো এর মধ্যে একমাত্র মিসেস লরিমাই নিখুঁতভাবে কোনো হত্যার পরিকল্পনা করতে পারেন, এবং তাকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার ক্ষমতাও তার আছে। কোনো মুহূর্তের উত্তেজনায় তিনি কোনো খুন করে বসলেন একথা বিশ্বাস করতে আমি আদৌ প্রস্তুত নই। অপরপক্ষে মিঃ শ্যাতানা খুন হবার দিন মিসেস লরিমার কথাবার্তা আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। হয় তিনিই খুন করেছেন না হলে তিনি খুনীকে দেখেছেন। মেজর ডেসপার্ড, মিস মেরিডিথ, ডাক্তার রবার্টস এদের পক্ষে খুন করা সম্ভব। তবে প্রত্যেকের মানসিক গঠন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের।

তাই দ্বিতীয় পরীক্ষা হলো প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা দেখা করা এবং তারা মিঃ শ্যাতানার ঘরে কি কি জিনিষ দেখেছেন বিশেষ করে ছুরিটা কার নজরে পড়েছে। তাছাড়া ব্রীজ খেলার তাসের সম্বন্ধে বলা, কিন্তু ডাক্তার রবার্টসের কাছে তাস খেলার কোনো খবরই পেলাম না কারণ তার খেলায় মন ছিলো না।

তাসের ব্যাপারে মিসেস লরিমার স্মৃতিশক্তি কিন্তু আশ্চর্যভাবে তীক্ষ্ণ এবং তিনি যে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তাস খেলেন তাতে তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন অন্যকাউকে খুন করলেও ভদ্রমহিলা চোখ তুলে দেখবেন বলে মনে হয় না। তার কাছে আমি আর একটি মূল্যবান সংবাদ পাই। ডাক্তার রবার্টস গ্র্যাণ্ডস্লামের ডাক দিয়েছিলেন, বলাবাহুল্য খুবই অযৌক্তিক ভাবে। এবং তিনি তার পার্টনার মিসেস লরিমার রঙেই ডাক দেন। যার ফলে ভদ্রমহিলাকেই তাসটা খেলতে হয়।

তৃতীয় পরীক্ষা, ব্যাটেল এবং আমি দুজনে গভীর ভাবে আলোচনা করছিলাম, সেটা হচ্ছে ওই চারজনের কর্মজীবনের কৃত অপরাধ সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত হওয়া। কোন পরিস্থিতিতে তারা তাদের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিলেন বর্তমান ক্ষেত্রেও সেই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটেছে কিনা সেটা লক্ষ্য করাই হলো আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

তাদের পূর্বজীবনের ইতিহাস উদ্ধারের যা কিছু কৃতিত্ব তা সবই ব্যাটেল, কর্নেল রেস এবং শ্ৰীমতী অলিভারের প্রাপ্য, কিন্তু এর সাহায্যেও ব্যাটেল বর্তমান রহস্যের কোনো হদিশ খুঁজে পেলেন না। তার ধারণা পূর্ববর্তী খুনগুলোর বেলায় যে সমস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিলো তাদের কোনোটার সঙ্গেই বর্তমান খুনের কোনো সামঞ্জস্য নেই কিন্তু তা সত্য নয়। ডাক্তার রবার্টস আগে যে খুন করেছেন বলে আমরা জানি তার সঙ্গে বর্তমান খুনটার কোনো সাদৃশ্য নেই। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বুঝতে পারা যায় এদের মধ্যে চারিত্রিক মিল কত সুদৃঢ়।

রুগী পরীক্ষা করে দেখার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সব ডাক্তারদেরই বিধি আর সেই সুযোগে একজনের সেভিং ব্রাশে অ্যানথ্রক্স রোগের দূষিত জীবাণু মাখিয়ে রেখে আসা কত সহজ। মিসেস ক্র্যাডককে খুন করা হলো টাইফয়েড রোগের প্রতিষেধক ইনজেকশন দেবার আছিলায়। এবার শ্যাতানাকে খুনের কথাটা চিন্তা করুন। ডাক্তার রবার্টস উপলব্ধি করতে পারলেন তিনি বিপদের জালে জড়িয়ে পড়েছেন তাই শ্যাতানার মুখ বন্ধ করা দরকার সুতরাং খুন তাকে করতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মনস্থির করে ফেললেন তাকে একটা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিতে হবে। অবশ্য ব্রীজ টেবিলে ঝুঁকি নেবার অভ্যাস তার আছে।

যখন আমি মনে মনে প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছিলাম যে, ডাক্তার রবার্টসই প্রকৃত অপরাধী ঠিক সেই সময় মিসেস লরিমা আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে স্পষ্ট জানান এই খুনটা তিনিই করেছেন। কিন্তু এটা তিনি করেননি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম, কিন্তু এরপর তিনি যেটা বললেন সেটা আরও জটিল। তিনি বললেন তিনি নাকি অ্যানা মেরিডিথকে নিজে খুন করতে দেখেছেন।

পরের দিন সকালে বিছানায় শায়িত মিসেস লরিমার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আমি এই ঘটনার নিগূঢ় তাৎপর্য সর্বপ্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম। বাস্তবিক পক্ষে তিনি যা বলেছেন তাও যেমন সত্যি। আমার সিদ্ধান্ত ঠিক তেমনই অভ্রান্ত।

আসলে যা ঘটেছিলো তা এই। একবার ডামি থাকাকালীন মিস মেরিডিথ ঘুরতে ঘুরতে ফায়ারপ্লেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় মিঃ শ্যানার দিকে নজর পড়ে এবং ভদ্রলোক যে মারা গেছেন সে কথাটাও বুঝতে তার দেরি লাগে না। মেরিডিথ তখন শ্যানার আরো কাছে এগিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে তার হাত দুটোও মৃত শ্যানার কোটের বুকপকেটের কাছে উজ্জ্বল চকচকে বস্তুটার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বস্তুটি যে কি সেটা উপলব্ধি করতে পারে।

এই ঘটনায় হতচকিত হয়ে মেরিডিথ চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েছিলো, কোনো রকমে সেটা সামলে নেয়। কারণ কিছু আগে ডিনার টেবিলে ভদ্রলোক যে মন্তব্য করেছিলেন সেটা তার স্মরণ আছে। তিনি হয়তো কাগজপত্রেও এই ঘটনা সম্বন্ধে কিছু লিখে রেখে যেতে পারেন। তাতে প্রমাণিত হবে শ্যাতানাকে হত্যার পিছনে অ্যানা মেরিডিথেরও কোনো উদ্দেশ্য ছিলো।

সকলে মনে করবে যে নিজেই শ্যাতানাকে খুন করেছে। ভয়ে এবং আশঙ্কায় কাঁপতে কাঁপতে সে তখন আবার ব্রীজ টেবিলে ফিরে আসে।

সুতরাং মিসেস লরিমা সত্যিকথাই বলেছেন, কারণ খুনটা তিনি স্বচক্ষে ঘটতে দেখেছেন বলে বিশ্বাস করেন, আর আমার সিদ্ধান্তও অভ্রান্ত।

ডাক্তার রবার্টস যদি এই ঘটনার পর চুপচাপ বসে থাকতেন, তাহলে এই ব্যাপারে তাকে অভিযুক্ত করা যেতো কিনা সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। যদিও নিপুণ ভাওতা ও সুচতুর ফন্দি এঁটে আমরা তার মুখ থেকে প্রকৃত সত্য স্বীকার করিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম। আমি অন্তত এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতাম না তা ঠিক।

শ্যাতানাকে হত্যা করার পর ডাক্তার রবার্টস যে খুব অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন তাতে কোনো দ্বিমত নেই।

এই রহস্যের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পুলিস এই অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাবে। তার ফলে তারা হয়তো রবার্টসের পূর্বকৃত অপরাধের কোনো হদিশ খুঁজে বার করতে পারে। সেইজন্যে তিনি একটা চমৎকার মতলব আঁটলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মিসেস লরিমা ভেতরে ভেতরে অসুস্থ তাই তার পক্ষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া খুবই সাধারণ। সেই জন্য তিনি কোনো উপায়ে ভদ্রমহিলার হস্তাক্ষর যোগাড় করে সেই লেখার নকলে তিনটে চিঠি লিখলেন। তারপর ভোরবেলা সেই ছুতো করে মিসেস লরিমার বাড়ি ছুটে এলেন। রওনা হবার আগে নিজের পরিচারিকাকে ডেকে পুলিসের কাছে খবর পাঠিয়ে দিতেও ভুললেন না। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম মিসেস লরিমার হাতের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত কিনা তখন ভদ্রলোক খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন না তিনি পরিচিত নন।

উইলিংফোর্ড থেকে আমি শ্ৰীমতী অলিভারকে ফোন করলাম, তিনি অনেক কষ্টে নিজের কৌতূহল ও উত্তেজনা দমন করে ডাক্তার রবার্টসকে নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির হলেন। ডাক্তার রবার্টস যখন সব মিটে গেছে ভেবে স্বস্তিবোধ করলেন ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে চরম আঘাত এসে পড়লো। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। মিঃ পোয়ারো বিদ্যুৎগতিতে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার ফলে তিনি আর নতুন কোনো কৌশল প্রয়োগ করতে পারলেন না। অসহায়ভাবে ধরা দিতে বাধ্য হলেন।

সঙ্গে সঙ্গে এই রহস্যময় মামলার পরিসমাপ্তি ঘটলো।

কিছুক্ষণ সবাই নিস্তব্ধ হয়ে রইল, অবশেষে রোডা নীরবতা ভঙ্গ করলেন।

ভাগ্যিস জানলার ধারে দাঁড়িয়ে লোকটা সমস্ত দেখতে পেয়েছিলো তা না হলে ডাক্তার রবার্টস ধরাই পড়তেন না।

না, না সেটা কোনো ব্যাপার নয় ম্যাডাম, সমস্তটাই পোয়ারোর উর্বর মস্তিষ্কের কৃতিত্ব। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

এসো এসো বন্ধু লুকিয়ে থাকার আর দরকার নেই। উইণ্ডো ক্লীনার কে সবাই-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ইনি একজন সম্ভাবনাপূর্ণ নতুন অভিনেতা।

তাহলে সমস্ত ব্যাপারটা একটা ভাওতা! তাহলে রবার্টসকে সত্যিই কেউ দেখেনি!

আমি দেখেছিলাম, পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে গম্ভীর আত্মপ্রসাদের সুর। মনের চোখ দিয়ে অনেক কিছুই দেখা যায়।

ডেসপার্ড সকৌতুকে বললেন, এসো রোড, আমরা এনাকে খুন করে দেখি খুনীকে বৃদ্ধার প্রেতাত্মা ধরতে পারেন কিনা।

 

Exit mobile version