Site icon BnBoi.Com

মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর – আগাথা ক্রিস্টি

দ্য মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর - আগাথা ক্রিস্টি

মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর

 ০১. মেজর বারবি

০১.

মেজর বারবি তার পুরোনো গরম আর ভারী ওভারকোটখানা গায়ে চাপালেন। পায়ে পরলেন গামবুট, হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে দরজা খুলে এক ঝলক উঁকি মারলেন বাইরের দিকে।

বাইরে নিকষ কালো আঁধার, লণ্ঠনের ম্লান আলোয় মেজর বারনাবি দেখতে পেলেন সামনে আর আশেপাশে শুধু সাদা তুষারের স্তর পড়ে আছে। যতদূর নজর গেল শুধু তুষার ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ল না।

গত চারদিন ধরে গোটা ইংল্যান্ডে একটানা তুষারপাত হয়েছে, যার ফলে ডার্টমুর অঞ্চলের এই ছোট্ট সিটাফোর্ড গ্রামের মাটির ওপর তিন চার ফিট তুষারের আস্তরণ জমে রয়েছে।

লণ্ঠনের আলোয় বাইরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলেন মেজর বারনাবি, তারপর লণ্ঠন হাতে নিয়ে বাংলো থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। অল্প কিছুক্ষণ বাদে কাছেই একটা গলিতে এসে ঢুকলেন, সামনেই একটা পুরোনো আমলের বাড়ির সদর দরজার পাল্লায় জোরে কয়েকবার টোকা দিলেন মেজর বারনাবি।

চার পাঁচ সেকেন্ড কাটতে না কাটতেই দরজাটা গেল খুলে, অল্প বয়সি এক পরিচারিকা মেজরকে অভ্যর্থনা করে ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। ড্রইংরুমের ভেতরের বৈদ্যুতিক আলোর সাথে ফায়ারপ্লেসের চুল্লিতে গনগন করে জ্বলছে কাঠের গুঁড়ি। মেজর ফায়ারপ্লেসের সামনে এসে গনগনে আগুনে নিজের হাতদুটো মেলে ধরলেন কিছুক্ষণ, তারপর গলায় আঁটা পুরু পশমী স্কার্ফটা খুলে উল্টোদিকের কৌচে বসলেন আয়েস করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা ঠেলে ড্রইংরুমে ঢুকলেন দুইজন সমবয়সি মহিলা, মেজরকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তারা।

যাক, আপনি এসেছেন দেখে খুব ভালো লাগল মেজর বারনাবি। মহিলাদের মধ্যে যিনি প্রবীন তিনিই মন্তব্য করলেন, ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল মিঃ বারনাবি, যেদিকে তাকাই শুধু তুষার আর তুষার।

আমারও একই অবস্থা, মিসেস উইলেট, মেজর উঠে এসে তাদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে বললেন।

মিঃ গারফিল্ড আসছেন, মিসেস উইলেট বললেন, মিঃ ডিউকও আসছেন শুনেছি। আর মিঃ রাইক্রফটেরও আসার কথা আছে, কিন্তু যা বিশ্রী আবহাওয়া, শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছোতে পারবেন কিনা জানি না। তাছাড়া ওনার বয়স তো অনেক হয়েছে। ভায়োলেট, মিসেস উইলেট তার সঙ্গী যুবতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আগুনে আর একটু কাঠ দাও।

থাক, ওটা আমিই দিচ্ছি।বলেই মেজর এগিয়ে এসে পাশে রাখা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে আগুনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে থাকলেন।

আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে রয়্যাল নেভীর ক্যাপ্টেন জোসেফ ট্রেভিলিয়ান চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ডার্টমুরের গ্রামাঞ্চলে কিছু জমি কিনে গড়ে তুলেছিলেন সিটাফোর্ড–হাউস। মোট দুটি বাংলো নিয়ে গড়া এই প্রাসাদের একাংশ তিনি হস্তান্তর করেছিলেন তাঁর : পুরোনো পুরোনো বন্ধু ফোর বারনাবিকে। বাকি অংশটুকু তিনি একাই ভোগ করতেন। গোটা বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র বসিয়েছিলেন, জলের পাম্পও বসিয়েছিলেন জল সরবরাহের জন্য।

অনেক টাকা খরচ করে সাধের বাড়িটি তৈরি করার পরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের টাকার লোভ গিয়েছিল বেড়ে। বাড়ি করার পরে সেখানে ভাড়াটে বসানোর কোনো ইচ্ছে গোড়ায় তার না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মিসেস উইলেট নামে আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন এক ইংরেজ বিধবাকে শেষ পর্যন্ত তিনি বাড়িটি ভাড়া দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল একটাই–ট্রেভিলিয়ান নিজে বাড়িতে থাকবেন না। তার অনুপস্থিতিতে গোটা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার ভার তাদেরকেই নিতে হবে। মিসেস উইলেটও এই শর্তে রাজি হয়েছিলেন। একমাত্র অবিবাহিত যুবতী কন্যা ভায়োলেটকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল থেকে এসে বাসা বেঁধেছিলেন ইংল্যান্ডের এই পাড়াগাঁয়ে।

সেই থেকে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বাড়ির বাইরে। এক্সহ্যাম্পটনে একটি পুরানো বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন তিনি। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সিটাফোর্ডে এসে পুরনো বন্ধু মেজর বারনাবির সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে যান তিনি। আবার মেজর বারনাবিও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ক্যাপ্টেন ট্রাভেলিয়ানের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতেন। এই ভাবে প্রায় কয়েক বছর যাবৎ দুজনে দুজনের পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। না, মেয়েদের সম্পর্কে প্রৌঢ় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান এখন আর আদৌ আগ্রহী নন, যদিও যৌবনে তিনি যুবতী মেয়েদের নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। সিটাফোর্ড হাউসে ট্রেভিলিয়ান তার বন্ধু বারনাবির কাছে আসেন শুধু বন্ধুত্বের খাতিরেই, মিসেস উইলেট বা তার যুবতী মেয়ে ভায়োলেটের আকর্ষণে নয়।

মেজর, মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট হঠাৎ বলে উঠল, ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার উত্তর খোঁজা আপনার নেশা, তাই না?

-হ্যাঁ, তা বলতে পারো, মেজর বারনাবি বললেন, এই তো গত মাসে এক ক্রসওয়ার্ড ধাঁধা প্রতিযোগিতায় জিতে আমি তিনটে মোটা বই পেয়েছি।

-বাঃ চমৎকার! ভায়োলেট মন্তব্য করল, বইগুলো কি ধরনের?

তা ঠিক জানি না, বারনাবি বললেন, এখনও পাতা উল্টে দেখিনি, তবে মনে হচ্ছে ভীষণ বাজে আর বদখত বিষয় নিয়ে লেখা হবে।

–মেজর, ভায়োলেট আবার আপনার বন্ধুকে দেখতে এক্সহ্যাম্পটনে কিভাবে যান? আপনার তো গাড়ি নেই?

–কেন হেঁটে! মেজর বললেন।

হেঁটে! ভায়োলেট বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করল, হেঁটে ছয় ছয় মোট বারো মাইল পথ আসা-যাওয়া করেন আপনি?

–তাতে কি হয়েছে? বারনাবি বললেন, হাঁটার মতো সোজা ব্যায়াম খুব কমই আছে, যত বেশি হাঁটা যায় শরীর তত সুস্থ থাকে।

-ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মুখ থেকে শুনেছি যে আপনারা দুজনেই খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন।

কথাটা ভুল বলেননি উনি, মেজর বারনাবি বললেন, আমরা গরমের সময় দুজনে আল্পস পাহাড়ের চূড়ায় উঠতাম, শীতে স্কি করতাম। কিন্তু এখন দুজনেই বুড়ো হয়েছি তাই হাঁটা ছাড়া আর কোনো ব্যায়াম বা খেলাধূলা করা সম্ভব নয়।

কথা শেষ করে মেজর বারনাবি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকেও প্রচুর তুষারপাত হবে বলে মনে হচ্ছে।

কি মজা; আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন ভায়োলেট, আসলে আমি তো দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এতদিন থেকেছি, তাই তুষারপাত আমার কাছে খুব রোমান্টিক ব্যাপার!

বোকার মতো কথা বলো না ভায়োলেট, মিসেস উইলেট ধমকের সুরে বললেন, ঠাণ্ডায় পাইপের ভেতরের জল জমে যখন বরফ হয়ে যাবে তখন আর ব্যাপারটা রোমান্টিক থাকবে না।

পরমুহূর্তেই দরজা ঠেলে পরিচারিকা ভেতরে ঢুকে মিসেস উইলেটের কাছে এসে বলল, ম্যাডাম, মিঃ রাইক্রফট আর মিঃ গারফিল্ড দুজনেই এসেছেন। পরিচারিকার কথা শেষ হতে না হতেই দুজনেই ড্রইংরুমে এসে ঢুকলেন একজন মাঝবয়সি অন্যজন যুবক। ড্রইংরুমে ঢুকেই দুজনে সোজা ফায়ারপ্লেসের গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন নিজেদের শরীর চাঙ্গা করে নিতে।

যুবক মিঃ গারফিল্ড বললেন, পথে আসার সময় মিঃ রাইক্রফটকে দেখলাম পথের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন। দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম, ভাবলাম প্রচণ্ড তুষারপাতে পথে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তুষার চাপা পড়ে মারা যাবেন নির্ঘাত, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।’ কথাটা বলতে বলতেই তিনি এগিয়ে এসে ভায়োলেটের সঙ্গে করমর্দন করলেন।

যুবক মিঃ গারফিল্ডকে ভায়োলেটের সমবয়সি বলা চলে, তাকে দেখে একটু বেশি পুলকিতই হয়ে উঠল ভায়োলেট।

-আচ্ছা, আমরা কি কোথাও তুষারের ওপর একটু স্কেটিং করতে পারি না? গারিফল্ড জানতে চাইল।

স্কেটিং দিয়ে কী হবে? ভায়োলেট উত্তর দিল, তার চাইতে বরং চলুন রাস্তার জমে থাকা তুষার সাফ করি, তাতে অনেক মজা আছে।

সে তো আজ সকাল থেকেই করছি। গারফিল্ড বলল, এই দেখোনা আমার দুহাতে ফোস্কা পড়ে গেছে। বলেই নিজের দুহাত ভায়ালোটের দিকে বাড়িয়ে দিল।

মিঃ ডিউক এসেছেন। ড্রইংরুমের দরজা খুলে পরিচারিকা ভেতরে ঢুকে ঘোষণা করল।

স্টিফোর্ড হাউসের ছটা বাংলোর মধ্যে সবশেষ যেটা খালি পড়েছিল গত সেপ্টেম্বর মাসে সেটা কিনেছেন মিঃ ডিউক। দশাসই চেহারার মানুষ মিঃ ডিউক খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ দিনরাত শুধু নিজের বাগান নিয়ে পড়ে থাকেন তিনি। পরিচারিকা ঘর থেকে যেতে না যেতেই মিঃ ডিউক ভেতরে ঢুকে মেজর বারনাবির উদ্দেশ্যে বলেলন

মেজর, আজকের এই বিশ্রী আবহাওয়ায় আপনি কি পায়ে হেঁটে এক্সহ্যাম্পটনে বন্ধুর বাড়িতে যাবেন?

-না, মেজর জবাব দিলেন।

–বন্ধু ট্রেভিলিয়ান আমার জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবেন।

–সত্যিই ভারি বিশ্রী আবহাওয়া, তাই না মিঃ ডিউক।

মিসেস উইলেট বলে উঠলেন, প্রত্যেক বছর তুষারপাতের সময় ঘরে বন্দি হয়ে থাকা যে কি জঘন্য ব্যাপার, বলে বোঝানো যাবে না।

মিঃ ডিউক আর মেজর দুজনেই আড়চোখে তাকালেন তার দিকে কিন্তু মুখে কেউই কোনো মন্তব্য করলেন না।

খানিক পরে পরিচারিকা ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে ড্রইংরুমে এসে হাজির হল।

.

০২.

চা-এর পর্ব শেষ হলে মিসেস উইলেট ব্রিজ খেলার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু ছোকরা গারফিল্ড তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, তার চাইতে আসুন একটু প্রেতচর্চা করা যাক।

-প্রেতচর্চা! মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট চমকে উঠে বলল, সে আবার কি?

হ্যাঁ, গারিফ বলল, আজকের এই আবহাওয়া প্রেতলোকের বাসিন্দাদের আবাহন করার পক্ষে সবদিক থেকে উপযুক্ত। এখানে আসবার আগে মিঃ রাইক্রফটের সঙ্গে এই বিষয়েই আলোচনা করেছিলাম আমি।

ও ঠিকই বলেছে। গারফিল্ডের কথায় সায় দিয়ে মিঃ রাইক্রফট বললেন, আমি নিজে অতিলৌকিক গবেষণা পর্ষদের সদস্য। আমারও মনে হয় প্রেতচর্চা করার পক্ষে আজকের সন্ধ্যেটা আদর্শ। তবে আমরা যা করতে চাইছি তা কিন্তু নিছক আমোদ বা সময় কাটাবার জন্য তা আপনারা সবাই মনে রাখবেন।

তাহলে এবার ঘরের আলো নিভিয়ে দিচ্ছি, ভায়োলেট বলে উঠল একটা জুৎসই টেবিলও তো দরকার। না স্যার ওটা নয়, ওটা বড্ড ভারী।

ভায়োলেট নিজেই পাশের ঘর থেকে একটা ছোট গোল টেবিল নিয়ে এল। ফায়ারপ্লেসের সামনে সেই টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসল সবাই। এরপরে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল ভায়োলেট। মিসেস উইলেট আর ভায়োলেটের মাঝখানে বসলেন মেজর বারনাবি, ভায়োলেটের মুখোমুখি বসল গারফিল্ড। নিজের মনে একবার হাসলেন। বারবি, যৌবনে এই ধরনের প্রেতচর্চা করে তিনিও একসময় অবসর কাটিয়েছেন। এক সুন্দরী সুকেশী বান্ধবীর কথা তার মনে পড়ল, আজ যে আর বেঁচে নেই। প্রেতচর্চার সময় সবার চোখ এড়িয়ে টেবিলের নীচে তারা দুজনে পরস্পরের হাত ধরতেন। একমনে সেই পরলোকগত বান্ধবীর আত্মাকে ডাকতে লাগলেন মেজর বারনাবি।

প্রেত আবাহনের এই আমোদে যাঁরা অংশ নিয়েছেন তারা কেউই চুপ করে নেই, থেকে থেকেই নানারকম মন্তব্য করতে লাগলেন তাঁরা–না, ওদের আসতে বড্ড সময় লাগে দেখছি।

একমনে ডেকে নাও, নয়তো, কেউ সাড়া দেবে না। আঃ, চুপকরুন, গোলমাল করবেন না দয়া করে।

কয়েক সেকেন্ডের ভেতর সবাই চুপ করলেন, ড্রইংরুমের মেঝেতে সূঁচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। হঠাৎ টেবিলটা কেঁপে উঠল।

প্রশ্ন করুন,মিঃ রাইক্রফট গারফিল্ডের উদ্দেশ্যে বলেন, রনি, তুমিই প্রশ্ন করো।

–ইয়ে, কি প্রশ্ন করব বলুন তো?

প্রশ্ন কর কোনো আত্মা এসেছে কিনা, বলল ভায়োলেট।

–ইয়ে। এখানে কোনও আত্মা এসেছেন কি? রনি গারফিল্ড জানতে চাইলে, উত্তরে–টেবিলটা আবার কেঁপে উঠল।

–তার মানে হা, ভায়োলেট বলল, একজন আত্মা ঠিকই এসেছেন।

–আপনি কে? নাম বলুন দয়া করে। কোনো উত্তর নেই।

ওকে নিজের পরিচয় দিতে বলো, মিঃ রাইক্রফট বলে উঠলেন।

–ইয়ে, আপনি নিজের পরিচয় দিন, গারফিল্ড বলল।

সঙ্গে সঙ্গে টেবিলটা কাঁপতে লাগল, কখনো ধীরে, কখনো জোরে।

–সংখ্যা অনুযায়ী ইংরেজি বর্ণমালার হিসাবে সবাই জানলেন উপস্থিত আত্মার নাম ইভা।

–আপনি কি এখানে কাউকে কিছু বলতে চান?’ গারফিল্ড আবার প্রশ্ন করল।

–টেবিল কেঁপে উঠে জানাল যে তার অনুমান ঠিক।

–আপনি কি মিসেস উইলেট বা তার মেয়েকে কিছু বলতে চান?’ গারফিল্ড প্রশ্ন করলেন।

-না।

–মিঃ রাইক্রফট?

–না।

–মিঃ ডিউক?

–না।

–তাহলে কি আমায় কিছু জানাতে চান?

-হ্যাঁ। এইটুকু জানিয়েই টেবিল বারে বারে আবার কাঁপতে লাগল যেমন কেঁপে উঠছিল নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে।

–মিঃ রাইক্রফট এবং উপস্থিত সবাই দেখতে পেলেন কাগজের বুকে একটি নাম ফুটে উঠেছে ডায়না।

–ডায়না কে রনি? মিঃ রাইক্রফট বললেন, ওই নামে তুমি কাউকে চেনো?

–কই না।

-রনির উত্তর শুনে মেজর বারনাবি হেসে আড়চোখে তাকালেন মিসেস উইলেটের দিকে, তিনি কি যেন ভাবলেন নিজের মনে।

এবার ভায়োলেট আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করল। আত্মা জানাল যে শিগগিরই, সে ইটালি যাবে, লিওনার্ড নামে এক ব্যক্তি তার সঙ্গী হবে। শুনে সবাই হেসে উঠলেন।

–অ্যাই ভায়োলেট, রনি গারফিল্ড বলে উঠল, তুমি কিন্তু জোরে টেবিলটা ঠেলছ।

–মোটেও না,ভায়োলেট প্রতিবাদ করল, আসলে তুমি নিজেই ঠেলে আমার নামে দোষ দিচ্ছ।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পরে টেবিলের কাঁপুনি থেমে গেল, গারফিল্ড জানতে চাইল, ইভার আত্মা কি এখনও এখানে আছেন?

উত্তরে টেবিল জোরে কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে অন্য কোনো আত্মা এসেছেন,রণি জানতে চাইল, এখানে কি নতুন কোনো আত্মা এসেছেন?

-হ্যাঁ।

–আপনি কি কোনো খবর এনেছেন?

–হ্যাঁ।

–আমার জন্য?

–না।

–ভায়োলেট বা তার মায়ের জন্য?

–না।

–তবে কি মেজর বারনাবির জন্য?

–হ্যাঁ।

–বর্ণমালা অনুযায়ী খবরটা জানান।

–টেবিলের কাঁপুনি অনুযায়ী গারফিল্ড ইংরাজি বর্ণমালার এক একটি অক্ষর লিখতে লাগল, কাঁপুনি শেষ হতে দেখা গেল শব্দটি ট্রেভিলিয়ান।

এ তো আমাদের সবারই চেনা নাম, মিসেস উইলেট বললেন, এখানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাম লেখা হয়েছে।

-ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান? গারফিল্ড প্রশ্ন করল, ওঁর কি হয়েছে?

–আবার শুরু হল টেবিলের কাপুনি। যে দুটি শব্দ কাগজের বুকে ফুটে উঠল তিনি মারা গেছেন।

–কে মারা গেছেন? গারফিল্ড আবার প্রশ্ন করল, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান?

–হ্যাঁ।

–কিভাবে মারা গেছেন?

আমি আর পারছি না, আমায় আপনারা মাফ করুন। মিসেস উইলেট চাপা গলায় কেঁদে নিজের হাত দুটো তুলে নিলেন টেবিলের ওপর থেকে, এসব আমার আর ভালো লাগছে না। মিসেস উইলেটের কথায় সায় দিয়ে বাকি সকলেও হাত তুলে নিলেন টেবিল থেকে।

আলো জ্বালিয়ে দিন। নির্দেশ দিলেন মিঃ রাইক্রফট। মেজর বারনাবি কৌচ ছেড়ে উঠে ঘরের সবকটা আলো জ্বালিয়ে দিলেন। একটু আগে পাওয়া দুঃসংবাদ ঘরের ভেতরে যে বিষণ্ণ পরিবেশ তৈরি করেছিল, হঠাৎ আলোর ঝলকে তা কিছুক্ষণের জন্য কেটে গেল বলেই মনে হল। সবাই সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন, কেউই বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না।

ধ্যাৎ, এসব রসিকতা। ঘরের ভেতরের থমথমে ভাবটা কাটাবার জন্য রনি গারফিল্ড মন্তব্য করলেন।

এই জাতীয় রসিকতা প্রেতলোকের বাসিন্দাদের মোটেই করা উচিত নয়। মন্তব্য করলেন মিসেস উইলেট।

মানুষের মৃত্যু নিয়ে এ ধরনের রসিকতা করার অর্থই বা কি? প্রশ্ন করল ভায়োলেট।

আগেই বলে রাখি আমি কিন্তু হাত দিয়ে টেবিল ঠেলিনি, বলে উঠল রনি গারফিল্ড।

আমিও ঠেলিনি, একই সুরে বলে উঠলেন মিঃ রাইক্রফট।

আমিও ঠেলিনি,তাদের সঙ্গে একই সুরে গলা মেলালেন মিঃ ডিউক। মেজর বারনাবি কোনো মন্তব্য না করে উঠে পড়লেন, ঘরের জানালার ভেজানো কাঁচের শার্সির সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

ঢের হয়েছে, এবার বরং একটু ককটেলের ব্যবস্থা করা যাক, পরিবেশটা হাল্কা করতে বলে উঠলেন মিসেস উইলেট। তার ইঙ্গিতে রনি ঘণ্টা বাজাতেই পরিচারিকা এসে ঢুকল ভেতরে। মিসেস উইলেট তাকে ককটেলের আয়োজন করতে বললেন।

ককটেলের ব্যবস্থা হল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। ককটেল তৈরি করে প্রথম গ্লাসটি রনি তুলে দিল মেজর বারনাবির হাতে। গ্লাসের পানীয় পুরো শেষ করে মেজর বারনাবি মিসেস উইলেটকে বললেন, মিসেস উইলেট, আপনাকে এবং বাকি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি, শুভরাত্রি।

সেকি! মিসেস উইলেট অবাক হয়ে বলে উঠলেন, এই দুর্যোগের রাতে আপনি এখান থেকে বেরাবেন কি করে? আজকের রাতটা কি এখানে থেকে যেতে পারবেন না?

ধারেকাছে একটা টেলিফোনও নেই মিসেস উইলেট, বারনাবি বললেন, থাকলে আপনার ইচ্ছেমতো আজ বাড়ি না ফিরলেও পারতাম।

–টেলিফোন? কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে মেজর বারনাবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস উইলেট।

হ্যাঁ, বারনাবি বললেন, সত্যি বলতে কি, জো ট্রেভিলিয়ান সম্পর্কে আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আপনারা হয়তো এটাকে সুসংস্কার বলতে পারেন, কিন্তু তাহলেও আমি নিজে নিশ্চিত হতে চাই। আজ সন্ধ্যের ব্যাপারটাকে আমি পুরো রসিকতা বলে মেনে নিতে পারছি না।

আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি মেজর, মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু এই মিটাফোর্ড গ্রামে কোথাও টেলিফোন পাবেন না আপনি।

অতএব আমায় যেতেই হবে।

-তা তো বুঝলাম, মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু আপনি যাবেন কি ভাবে? রাস্তায় যে পরিমাণ তুষার জমেছে তাতে স্থানীয় কোনো ড্রাইভারই গাড়ি বের করতে রাজি হবে না।

গাড়ির দরকার নেই, মেজর বারনাবি বললেন, আমি হেঁটে যেতে পারব।

হেঁটে! এই দুর্যোগে? আপনার মাথা কি খারাপ হয়েছে, মেজর তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানালেন। মিসেস উইলেট, উপস্থিত সবাই তাকে একযোগে সমর্থন করলেন। কিন্তু মেজর বারনাবি ভয়ানক একগুয়ে ধাঁচের লোক, এঁরা কেউই তাকে রুখতে পারলেন না। সবার প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় টুপি পরলেন তিনি, তারপর বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।

কাজটা ভাল করেলন না উনি, জানালা দিয়ে আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে মিঃ রাইক্রফট মন্তব্য করলেন, একটু আগে মেজর বারনাবি নিজেই বলেছিলেন যে আরও তুষার পড়বে।

ঠিকই বলছেন আপনি, সায় দিয়ে বললেন মিঃ ডিউক, আমাদের মধ্যে কারও ওঁর সঙ্গী হওয়া উচিত ছিল।

ঈশ্বরের নামে শপথ করছি যে আর কোনোদিন সময় কাটানোর জন্য এই প্রেতচর্চার খেলা আর খেলব না, মিসেস উইলেট কঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, বেচারা মেজর বারনাবি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়িতে পৌঁছোনোর আগেই উনি মাঝপথে নির্ঘাৎ তুষার চাপা পড়ে মারা যাবেন, নয়তো ঠাণ্ডা লাগিয়ে জ্বর বা নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসবেন। ছিঃ! বুড়ো বয়সে এমন জেদ কখনো দেখাতে হয়? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন।

সে তো একশোবার, উপস্থিত সবাই সায় দিলেন তার কথায়। কিন্তু সায় দেওয়া সত্ত্বেও মনের দিক থেকে কেউই তেমন জোর পেলেন না। সবারই মনে হতে লাগল যদি…… ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সত্যিই কিছু ঘটে থাকে, তাহলে?

.

০৩.

হাঁটতে হাঁটতে মেজর বারনাবি যখন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়িতে এসে পৌঁছোলেন তখন রাত প্রায় আটটা।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তার নাম হ্যাজেলমুর। পথশ্রমে। ক্লান্ত মেজর বারনাবি সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন, কলিংবেলের বোতাম টিপে স্যুটে জমে থাকা অসংখ্য তুষারকণা দুহাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললেন তিনি। কয়েক মিনিট কেটে গেল, ভেতর থেকে কারো সাড়াশব্দ পেলেন না মেজর, আবার কলিংবেল টিপলেন তিনি।

কিন্তু এবারেও অবস্থা একইরকম রইল। ভেতর থেকে কেউ সদর দরজা খুলল না। তৃতীয়বার আরেকবার কলিংবেল টিপলেন বারনাবি। কিন্তু এবারেও কোনো কাজ হল না, দরজা আগের মতোই বন্ধ রইল। দরজার গায়ে কড়া লাগনো ছিল তাই ধরে খুব জোরে নাড়লেন মেজর বারনাবি, কিন্তু এবারেও কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলল না।

ট্রেভিলিয়ানের কি হল? এক অজানা আশঙ্কায় মেজর বারনাবির মনটা ছেয়ে গেল, ওর অসুখবিসুখ করেনি তো? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলেন মেজর বারনাবি! তারপর পেছন ফিরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন রাস্তায়। হ্যাজেলমুর বাড়িটি থেকে মাত্র একশো গজ দূরে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি, সেখানে এসে হাজির হলেন তিনি। কনস্টেবল গ্রেভস তার পরিচিত, তাকে সব খুলে বললেন বারনাবি।

আপনি পর-পর তিনবার কলিংবেল টিপলেন, জোড়ে কড়া নাড়লেন, তবু দরজা খুলল না? কনস্টেবল গ্রেভস ভুরু কুঁচকে বললেন, এ ত ভারি অদ্ভুত ব্যাপার।

শুধু অদ্ভুত নয়, মিঃ বারনাবি বললেন, সেই সঙ্গে ভাবনার ব্যাপার।

এই বিশ্রী আবহাওয়ায় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই বাড়ি ছেড়ে বেরোননি, কনস্টেবল গ্রেভস মন্তব্য করলেন।

এই কথাটাই আমি বলতে চাইছি, মেজর বারনাবি অনুনয়ের সুরে বললেন, এবার আপনি কিছু করুন।

করতে তো পারি, কনস্টেবল গ্রেভস বললেন। কিন্তু ধরুন, আপনার বন্ধু যদি তাতে কিছু মনে করেন, যদি উনি ব্যাপারটা অন্যভাবে নেন? তার চাইতে আমি দেখি টেলিফোনে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কিনা।

কনস্টেবল গ্রেভস একবার নয় পরপর কয়েকবার টেলিফোনে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। ওপাশ থেকে কেউ রিসিভার তুলল না।

মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কনস্টেবল গ্রেভস বললেন, আমি ডঃ ওয়ারেনকে সঙ্গে নিয়ে এখনই ওঁর কাছে যাব।

ডঃ ওয়ারেন ফাড়ির পাশেই থাকেন। কনস্টেবল গ্রেভসের মুখ থেকে সব শোনার পর তাকে বেশ বিরক্তই দেখাল। তবু কর্তব্যের তাগিদে গরম ওভারকোট আর ভারী গামবুট পড়ে তিনি তখনই বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে। তুষারপাত তখনও চলছে।

মেজর বারনাবি আর ডঃ ওয়ারেনকে সঙ্গে নিয়ে কনস্টেবল গ্রেভস এসে হাজির হলেন হ্যাজেলমুরে, কলিংবেল টিপে আর কড়া নেড়েও কোনো ফল হল না।

বাড়ির পেছনদিকে একবার চলুন, ডঃ ওয়ারেন প্রস্তাব দিলেন, দেখা যাক ওদিক দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায় কিনা।

বাড়ির পেছন দিকে এসে পৌঁছোনোর পর হঠাৎ তাদের নজরে পড়ল ট্রেভিলিয়ানের স্টাডির একটা জানালা খোলা। সেই ভোলা জানালা দিয়ে প্রথমে মেজর বারনাবি, তারপর কনস্টেবল গ্রেভস আর সবশেষে ডঃ ওয়ারেন ভেতরে ঢুকলেন। স্টাডির ভেতরে চরম বিশৃঙ্খলার চেহারা লক্ষ্য করলেন তারা। বই, খাতা, কাগজপত্র, দলিল সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন বিশালদেহী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, তার হাতদুটো দুপাশে ছড়ানো, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের দেহের পাশে গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা ধাতব টিউব পড়ে আছে। ডঃ ওয়ারেন হাঁটু গেড়ে বসে তার নাড়ী আর হৃৎপিন্ডের গতি পরীক্ষা করলেন, কয়েক সেকেন্ড বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

উনি কি মারা গেছেন? মেজর বারনাবি প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, ঘাড় নেড়ে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন ডঃ ওয়ারেন, কনস্টেবল গ্রেভসের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আপনি বলুন আমি কি করব? আপনার ওপরওয়ালা ইন্সপেক্টর সাহেব যতক্ষণ না এসে পৌঁছোচ্ছেন ততক্ষণ এই লাশ পরীক্ষা করাও আমার পক্ষে উচিত হবে না। তবে মৃত্যুর কারণ কি তা বলছি, খুলির গোড়ার হাড় ভেঙ্গে যাবার ফলে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু হয়েছে, আর মনে হচ্ছে ওই জিনিসটা দিয়েই ওঁর মাথায় আততায়ী জোরে আঘাত হেনেছে, বলে ডঃ ওয়ারেন মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা সবুজ রংয়ের ধাতব টিউবটা ইশারায় দেখালেন।

আততায়ী! ভীতি মেশানো সুরে কনস্টেবল গ্রেভস বলে উঠলেন, তার মানে ডাক্তার, আপনি বলছেন এটা খুন? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করা হয়েছে?

ডঃ ওয়ারেন কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবে শুধু ঘাড় নাড়লেন।

ডাক্তার, মেজর বারবি ডঃ ওয়ারেনকে প্রশ্ন করলেন, কতক্ষণ আগে ওঁর মৃত্যু ঘটেছে তা বলতে পারেন?

তা কম করে দু-তিন ঘণ্টা তো বটেই, ডঃ ওয়ারেন জবাব দিলেন, আমার হিসাবে তাই দাঁড়াচ্ছে।

প্রায় দু-তিন ঘণ্টা? হায় ঈশ্বর! আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন মেজর বারনাবি, তারপর তার বন্ধুর মৃতদেহের পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন, নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে সময় দাঁড়াচ্ছে বিকেল প্রায় পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। হা ঈশ্বর। তাহলে আজ বিকেলে ওখানে প্রেতচক্রে যা ঘটেছিল সে সবই সত্যি।

.

০৪.

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্টাডিটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মুখ তুলে একবার আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব অর্পন করেছেন তার ওপর, সেই দায়িত্ব পালন করতে ন্যারাকট ছুটে এসেছেন সুদূর এক্সটার থেকে, তাকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তদন্তের কাজে সাহায্য করবেন সার্জেন্ট পোলক।

স্টাডির খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। বাইরে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু চোখে পড়ে ধপধপে সাদা ঘন তুষারের স্তর, তার ওপর ঝলসাচ্ছে শীতের সূর্যকিরণ। জানালা থেকে প্রায় একশো গজ দূরে একটা ছোট কাঠের বেড়া দেখা যাচ্ছে, তার কিছুটা দূরেই পাহাড়ে ওঠার খাড়া চড়াই পথ শুরু হয়েছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ এখনও পড়ে আছে স্টাডিতে। নৌবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেবার পরেও ট্রেভিলিয়ান নাবিকদের ধাঁচের মতো চাপদাড়ি রাখতেন, লম্বাটে মুখে চিবুকের কাছে দাড়িটা ছুঁচলো হয়ে গেছে। ট্রেভিলিয়ানের বয়স হয়েছিল। প্রায় ষাট, কিন্তু দেখলে মনে হত তিনি সবে পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজে এখনও খেলাধুলা করেন। ট্রেভিলিয়ানের চড়া কাধ, পেশীবহুল অথচ মেদহীন শরীর দেখে তিনি বুঝতে পারলেন তিনিও খেলাধুলার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।

ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত ঠেকছে, বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তাকালেন সার্জেন্ট পোলকের দিকে, এই খুন সম্পর্কে আপনার ধারণা কি বলুন, শুনি।

ইয়ে–বারকয়েক মাথা চুলকালেন সার্জেন্ট পোলক, তারপর বেশ হুঁশিয়ার ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন, ইয়ে স্যার, আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যখন ওপর তলায় ছিলেন ঠিক সেই সময় আততায়ী বাইরের থেকে জানালা খুলে ভেতরে ঢোকে, তারপর ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করতে থাকে। ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে ও নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিল যে বাড়িতে কেউ নেই।

হুম, নাক দিয়ে শব্দ করে গম্ভীরগলায় ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরটা কোথায়?

আজ্ঞে ওপরতলায়, স্যার বিনীত ভঙ্গিতে সার্জেন্ট পোলক জানালেন, এই ঘরের ঠিক ওপরে।

এখন রোজই বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ সন্ধ্যে হচ্ছে, ন্যারাকট আবার বললেন, আমার ধারণা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যদি সত্যিই সেইসময় ওপরে থাকতেন, তাহলে ওই ঘরের আলো নিশ্চয়ই জ্বলত, আর জানালার কাছে আসবার সময় বাইরে থেকে তা আততায়ীর চোখে ঠিকই পড়ত।

আজ্ঞে আপনি বলতে চাইছেন যে সে অপেক্ষা করত, তাই না?

যে বাড়ির কোনো ঘরে আলো জ্বলে সেখানে বাইরে থেকে কোনো আততায়ী জানালা দিয়ে চুরি করতে বা খুন করতে ভেতরে ঢোকে না। যাক, তারপর কি ঘটেছিল বলে আপনি মনে করেন?

স্যার, সার্জেন্ট পোলক উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগলেন, আমার মনে হয় এবার কোনো আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পেয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ব্যাপারটা কি দেখতে নীচে নেমেছিলেন। আততায়ী ওঁর পায়ের আওয়াজ শুনেই ওঁর মাথায় জোরে আঘাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে ব্যাটা দরজার আড়ালে গিয়ে লুকোয়, ক্যাপ্টেন, ভেতরে ঢুকতেই ওই ভারি টিউবটা দিয়ে তার মাথায় জোরে আঘাত হানে পেছন থেকে।

হুম, নাক দিয়ে আবার আওয়াজ করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মানছি আপনার বক্তব্যে যুক্তি আছে। সেক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাহলে পোলক, আপনার যুক্তিটা আমার খুব যুৎসই বলে মনে হচ্ছে না। এ আমার ভাল লাগছে না।

লাগছে না, স্যার?

না, আর তার কারণ একটাই–সন্ধ্যে পাঁচটায় শুধু চুরি করার মতলবে একজন অপরাধী জানালা দিয়ে কারো বাড়িতে ঢুকবে এ আমি বিশ্বাস করি না।

কেন স্যার? সার্জেন্ট পোলক নিজের জেদ বজায় রাখতে বলে উঠলেন, এমন পরিস্থিতিকে সে এক দারুণ সুযোগ বলে ভাবতে পারে।

সুযোগের কথা হচ্ছে না, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, বাইরে থেকে দেখে চুরি বলে মনে হলেও আসল ব্যাপারটা তা নয় সেকি আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না?

আচ্ছা, আপনিই বলুন, জানালা দিয়ে চোরের কোন ঘরটিতে ঢোকা উচিত ছিল? রান্নাঘরে, তাই না? যেখানে দামি বাসনপত্র থাকে।

এদিকে থেকে আমি আপনার সঙ্গে পুরোপুরি একমত, সার্জেন্ট পোলক মন্তব্য করলেন।

জানালার দিকে একবার তাকান, সার্জেন্ট ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, ভেতর থেকে তাতে ছিটকিনি আঁটা ছিল না, বাইরে থেকে সহজেই একটানে পাল্লা খুলে ফেলা হয়েছিল। লক্ষ্য করেছেন।

দুপা এগিয়ে এসে সার্জেন্ট পোলক জানালা পরীক্ষা করে বললেন, তারপর বিস্ময়সূচক ধ্বনি উচ্চারণ করে বললেন, কি আশ্চর্য! জানালার পাল্লা দুটো আলতো করে ভেজিয়ে রাখা হয়েছিল, ছিটকিনি আঁটা হয়নি। বোঝাই যায় যে চুরি করার উদ্দেশ্যেই অপরাধী জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল এটা আমরা ধরে নিই তাই সে চেয়েছিল। এইভাবে সে আমাদের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছে, আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করেছে।

যাক, ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢুকেছে তাহলে। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, পোলক।

তাহলে স্যার, সার্জেন্ট পোলক গম্ভীর গলায় বললেন, আমদের এটাই ধরে নিতে হচ্ছে যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে কেউ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করেছে।

ঠিক ধরেছেন, এজন্য আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, এবং খুন যে করছে সে যে ট্রেভিলিয়ানের বিশেষ পরিচিত ছিল সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আততায়ী জানালা দিয়েই এ ঘরে ঢুকেছিল আপনার এই যুক্তিও অকাট্য, এবং জেনে রাখুন বাইরের গলানো তুষার পায়ে মাড়িয়ে সে এঘরে ঢুকেছিল যার ফলে ঘরের মেঝেতে ভেজা জুতোর ছাপও পড়েছিল। তবে শুধু এই ঘরেই, এ ছাড়া বাড়ির অন্য কোনো ঘরের মেঝেতে সেই ছাপ পড়েনি অন্তত। কনস্টেবল গ্রেভস বা ডঃ ওয়ারেন কারো চোখেই তা পড়েনি শুধু এই ঘরের মেঝের ওপর সেই গলানো তুষারসমেত ভেজা চামড়ার জুতোর দাগ তাদের চোখে পড়েছিল। এতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল তা হচ্ছে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের চোখের সামনেই আততায়ী এই ঘরের জানালা খুলে ভেতরে ঢুকেছিল। আর সেক্ষেত্রে আপনি জানতে বাধ্য যে আততায়ী এমন কেউ ছিল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বিশেষ পরিচিত। আচ্ছা সার্জেন্ট, আপনি তো এই এলাকারই লোক, বলুন তো যে ধারেকাছে এমন কেউ আছে কিনা যার সঙ্গে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শত্রুতা গড়ে উঠেছিল।

না স্যার, সার্জেন্ট পোলক জবাব দিলেন, শুধু ধারেকাছে নয়, দুনিয়ায় ওঁর কোনো শত্রু ছিল বলে আমার মনে হয় না। ভদ্রলোক এমনিতে ছিলেন খুবই ফুর্তিবাজ, এছাড়া চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে হঠাৎ প্রচুর টাকা রোজগারের নেশা পেয়ে বসেছিল। কিন্তু এজন্য প্রতিবেশীদের কারো সঙ্গে ওঁর কোনোরকম শত্রুতা গড়ে উঠেছিল বলে কখনো শুনিনি।

সে তো এখনকার ব্যাপার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, কিন্তু নৌবাহিনীতে চাকরি করার সময় কেউ ওঁর শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিনা তা আমাদের এখনও জানা নেই। সার্জেন্ট, আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে এখানে যদি আপনি কারো শক্ত হন তাহলে অন্য সেখানেই যান না কেন যেখানেও নতুন করে আবার কারো শক্ত হয়ে উঠবেন, আর ট্রেভিলিয়ানের খুনের প্রসঙ্গে সেই সম্ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছি না। এবার তাহলে পরবর্তী যুক্তিতে আসা যাক, কি বলেন? আপনি নিজেও একজন পুলিশ অফিসার আর তাই আপনার এটা অজানা নয় যে সাধারণত লাভের উদ্দেশ্যেই একজন অপরাধী ব্যক্তিগত খুনের মতো একটি অপরাধ সংঘটিত করে থাকে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই বেশ পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন তাই না?

তা বলতে পারেন স্যার, সার্জেন্ট পোলক বললেন, কিন্তু অন্যদিকে তিনি ছিলেন ভয়ানক কৃপণ, চাদা বা দানধ্যানের ব্যাপারে একটা আধলাও পারতপক্ষে ওঁর হাত দিয়ে গলতো না।

–হুম, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, খুনটা যখন হয় সেইসময় আর কোনো লোক বাড়িতে ছিল না?

আজ্ঞে না, সার্জেন্ট পোলক বললেন, গত পাঁচ ছয় বছর ধরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছাড়া মাত্র একটি লোককেই আমি এ বাড়িতে দেখেছি তার নাম ইভানস, সে রোজ দু বেলা ওঁর রান্না করে দিত, আবার কাজ শেষ করে বাড়িতে চলে যেত। ইভানস নিজেও নৌবাহিনীতে চাকরি করত, অবসর নেবার পরে ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনির কাজ করত। এখানে মোড়ের মাথায় ফোর স্ট্রীট নামে একটা গলি আছে–দেখেছেন নিশ্চয়ই। ইভানস সেখানেই তার বউকে নিয়ে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। এই তো সবে মাসখানেক হল ইভানস বিয়ে করেছে, কিন্তু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ব্যাপারটায় বেশ রেগে গিয়েছিলেন। ইভানস বিয়ে করুক এটা ওঁর ইচ্ছে ছিল না। এ বাড়িতে কোনো মহিলা নেই, তার কারণ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিজে প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী ছিলেন। যা ইভানসকে আমি নিয়ে এসেছি, আপনি নিজেও ওকে একবার জেরা করুন। ইভানস বলছে রান্নাবান্না আর ঘরের কাজকর্ম সকাল সকাল সারা হয়েছিল বলে গতকাল দুপুর ঠিক আড়াইটে নাগাদ ও ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বাড়ি চলে যায়।

হ্যাঁ, ইভানসের সঙ্গে আমার দেখা করা খুবই দরকার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, ও নিশ্চয়ই অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের সরবরাহ করতে পারবে।

আপনার কি ধারণা–কথাটা শেষ না করে মাঝপথে থেমে গেলেন সার্জেন্ট পোলক।

আমার ধারণা এই যে খুনের রহস্যের সাথে ছোটখাটো এমন একটা ঘটনা জড়িয়ে আছে যা সাধারণ চোখে বাইরে থেকে ধরা পড়ে না।

একটু উদাহরণ যদি দেন, স্যার?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন, হাসিমুখে শুধু বললেন, এই ইভানস কোথায়? ওকে কোথায় রেখেছেন?

ও খাবার ঘরে অপেক্ষা করছে স্যার।

লোকটা কেমন?

নৌবাহিনীর নোক, অত্যন্ত বদখত টাইপ,সার্জেন্ট পোলক সংক্ষেপে মন্তব্য করলেন।

মদ খায়?

না স্যার।

ও হালে বিয়ে করেছে বললেন না?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট গলা নামিয়ে বললেন, ইভানসের বউ-এর ওপর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কোনোরকম দুর্বলতা ছিল না তো?

না স্যার, সার্জেন্ট পোলক মৃদু হাসলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের ওইরকম কোনো দুর্নাম ছিল না। তাছাড়া আগেই বলেছি যে উনি মেয়েদের খুব ঘেন্না করতেন।

আর এই ইভানস নিশ্চয়ই ছিল ওঁর বিশ্বস্ত ও অনুগত ভৃত্য?

আমরা সবাই তো তাই জানি স্যার। সার্জেন্ট পোলক মুচকি হেসে বললেন, এক্সহ্যাম্পটন জায়গাটা খুব ছোট তা তো নিজের চোখেই দেখছেন। এখানে যা কিছু ঘটুক না কেন, কিছুই চাপা থাকে না।

বেশ, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, তাহলে এ ঘরে আর দেখার কিছু নেই। এবার আমরা ইভানসকে কিছু প্রশ্ন করে তারপর এ বাড়ির বাকি ঘরগুলো আমি পরীক্ষা করব। তারপর আমি থ্রি ক্রাউনসে একবার যাব, মেজর বারনাবির সঙ্গেও দেখা করব। খুনের সময় সম্পর্কে উনি একটা মন্তব্য করেছিলেন আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট, মনে পড়ে? হয়তো অজানা কিছু তথ্য ওঁর কাছেও আছে নয়তো খুন কখন হয়েছে তা এত নিখুঁতভাবে উনি বলেন কি করে?

তাহলে এটা আদৌ চুরির প্রচেষ্টা নয়। সার্জেন্ট পোলক দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, আসলে অপরাধী গোটা ব্যাপারটাকে ওইরকম চেহারা দিতে চেয়েছিল।

এটা আমার কাছে তেমন অস্বাভাবিক নয়, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, এই পরিস্থিতিতে ওইটাই স্বাভাবিক। আসলে জানালাটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

জানালাটা? সার্জেন্ট পোলক বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন স্যার?

গতকাল রাতে আবহাওয়া যেমন বিশ্রী স্যাঁতসেঁতে ছিল তাতে খুনী জানালা দিয়ে এঘরে ঢুকতে গেল কেন? বিশেষতঃ যেখানে আমার ধারণা গৃহস্বামী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের যে ছিল বিশেষ পরিচিত? এক্ষেত্রে সে তো সহজেই সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারত, নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল।

হয়তো তাই, সায় দিয়ে সার্জেন্ট পোলক বললেন, সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলে রাস্তা থেকে পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভয়েই হয়তো খুনী জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল।

আপনার যুক্তিটা আদৌ জোরালো নয়, পোলক। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, গতকালের বিশ্রী আবহাওয়ায় রাস্তায় কজন লোক বেরিয়েছিল যারা ওকে সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখতে? তা নয়, অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে এর পেছনে যা যথাসময় জানা যাবে।

০৫. ট্রেভিলিয়ানের ঠিকে রাঁধুনি

০৫.

ট্রেভিলিয়ানের ঠিকে রাঁধুনি ইভানস খাবার ঘরে একটি চেয়ারে বসেছিল, সার্জেন্ট পোলককে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট যেখানে আসতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।

ইভানস বেঁটেখাটো স্বাস্থ্যবান চেহারার লোক, তার হাত দুখানা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ লম্বা, দুহাতের মুঠো অর্ধেক বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যেস আছে তার। ইভানসের দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার কামানো, তার গোলাকার মুখে ক্ষুদে দুটি চোখের চাউনি খুব সতর্ক আর তীব্র, হঠাৎ দেখলে বুলডগের কথা মনে পড়ে। ইভানস যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও ধূর্ত প্রকৃতির লোক তা একনজর তাকে দেখেই বুঝতে পারলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

তোমার পুরো নাম কি?

হাত নেড়ে ইসারায় তাকে বসতে বলে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

আজ্ঞে রবার্ট হেনরী ইভানস।

ভাল, খুব ভাল। এবার বলো তো বাপু, ওই খুনের ঘটনা সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো?

আজ্ঞে আমি কিছুই জানি না স্যার, ইভানস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কাপ্তেন আর আমি আগে বহু জাহাজে একই সঙ্গে কাজ করেছি, উনি ছিলেন জাহাজের কম্যান্ডার, আর আমি ছিলাম ওঁর জাহাজের রান্নাঘরের হেড বাবুর্চি। আমার হাতে তৈরি রান্না কাপ্তেনের খুব প্রিয় ছিল। ওঁর মৃত্যুতে তাই আমার বুকের পাঁজরগুলো ভেঙ্গে গেছে। হতে পারেন উনি ছিলেন বড় অফিসার আর আমি এক খুদে খালাসী, তাহলেও একসঙ্গে অনেকগুলো বছর আমরা কাটিয়েছি তো, গত বিশ্বযুদ্ধেও লড়েছি।

ইভানস তার মনের যে ভাব প্রকাশ করতে চাইছে তার পুরোটাই যে ছলনা নয় সে সম্পর্কে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিঃসন্দেহ হলেন।

গতকাল শেষবার কখন তুমি ওঁকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলে?

তখন বেলা প্রায় দুটো হবে স্যার,ইভানস বলল, কাপ্তেনের লাঞ্চ খাওয়া শেষ হলে আমি তার এঁটো বাসনপত্র সরিয়ে নিয়েছিলাম টেবিল থেকে। কাপ্তেন নিজেই বললেন যে বিকেলে আমার আসবার দরকার নেই।

পরশুদিন বিকেলে তুমি এ বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলে? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন।

আজ্ঞে না স্যার, ইভানস বলল, যেভাবে একটানা তুষার পড়েছিল তাতে বিকেলে আর বাড়ি থেকে আমি বেরোতে পারিনি। কাপ্তেন অবশ্য এজন্য আমাকে কিছু বলেননি, এদিক থেকে উনি ছিলেন খুব ভালো মনিব, খুব বিবেচক। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ভালোভাবে কাজ করছি, চুরিচামারি করছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত উনি আমায় ঘাঁটাবেন না এই ধাঁচের মনিব ছিলেন উনি। বহুদিন ধরে তো দেখছি, কাপ্তেন বরাবর এইরকমই ছিলেন।

গতকাল দুপুরে উনি তোমায় ঠিক কি বলেছিলেন তা মনে আছে?

আছে হুজুর,ইভানস রুমালে চোখ মুছে বলল, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কাপ্তেন, তারপর নিজের মনে বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে আজ বারনাবি আসতে পারবে না, এই বিশ্রী দিনে আসবেই বা কি করে। কাপ্তেনের পুরোনো বন্ধু মেজর বারনাবি প্রত্যেক শুক্রবার এখানে আসতেন আবার প্রত্যেক মঙ্গলবার কাপ্তেন যেতেন ওঁর কাছে। দুই বন্ধু দাবা খেলতেন, আর ছিলেন ক্রসওয়ার্ড পাজলের ভক্ত। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কাপ্তেন হঠাৎ বলে উঠলেন, ইভানস তুমি বাড়ি যেতে পারো, আজ বিকেলে আর আসবার দরকার নেই। আবার কাল সকালে এসো।

মেজর বারনাবি ছাড়া তোমার মনিব আর কারো কথা বলেছিলেন কি যার এখানে আসবার কথা ছিল?

না স্যার, তেমন কিছু তো গতকাল ওঁকে বলতে শুনিনি।

ওঁর কথাবার্তায় বা আচরণে এমন কিছু দেখেছিলেন যা তোমার চোখে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল?

না স্যার।

আচ্ছা ইভানস, তুমি হালে বিয়ে করেছ তাই না?

হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, মিসেস বেলিংয়ের মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি।

কিন্তু শুনলাম তোমার এই বিয়ের ব্যাপারে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নাকি খুশি হয়নি, কথাটা সত্যি?

ঠিকই শুনেছেন স্যার। ইভানস ধীরে ধীরে বলল, আমার স্ত্রী রেবেকার রান্নার হাত খুব ভালো আর তাই আমি একসময় স্থির করেছিলাম যে তাকেও এখানে ঠিকে কাজে লাগিয়ে দেব। এ বাড়িতে আর কেউ তো নেই, কাপ্তেনকে বিপদে আপদে দেখাশোনা করার কেউ নেই, রেবেকা থাকলে এই অভাব মিটতো। কিন্তু কাপ্তেন আমার সে প্রস্তাবে একবারও রাজি হননি, বারবার আমায় বলতেন যে বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কোন মেয়েকে তিনি কাজে বহাল করবেন না। এরপর কাপ্তেন মিসেস উইলেটকে ওঁর সিটাফোর্ড হাউস বাড়িটা ভাড়া দিলেন আর নিজের থাকার জন্য এই হ্যাজেলমুর বাড়িটা ভাড়া নিলেন। সেই থেকে আমি কাপ্তেনের দুবেলা রান্নাবান্না আর ঘরদোর দেখাশোনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করুন স্যার, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে শীতের শেষে মিসেস উইলেট আবার ফিরে যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকায় আর তখন কাপ্তেনও ভাড়া বাড়ি ছেড়ে ফিরে যাবেন ওঁর নিজের বাড়িতে। তখন রেবেকাকেও আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারতাম। একরকম ঠিক করেই রেখেছিলাম যে রেবেকা সারাদিন রান্নাঘরেই ব্যস্ত থাকবে, আমি অন্যান্য কাজকর্ম করব, রেবেকার মুখ যাতে কাপ্তেন সারা দিনে একবারও দেখতে না পান সে ব্যবস্থা আমি করব। কিন্তু সবই পোড়াকপাল, মাঝখান থেকে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান মেয়েদের ওপর এমন হাড়ে হাড়ে চটেছিলেন কেন তা বলতে পারো?

হাড়ে হাড়ে চটা নয় স্যার, ইভানস মুচকি হেসে বলল, আসলে উনি ছিলেন খুব লাজুক স্বভাবের লোক তাই মেয়েদের সঙ্গে নিজে থেকে মেলামেশা করতে পারতেন না। এমন ধাঁচের পুরুষ আকছার দেখা যায়, সাধারণত অল্পবয়সে মেয়েদের হাতে কোনো কারণে নাকাল হলে এরা সবাই মেয়েদের ওপর এমনি রেগে যায়।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বিয়ে করেছিলেন?

না, স্যার, উনি ছিলেন চিরকুমার।

ওঁর আত্মীয়রা কোথায় আছেন জানো?

স্যার, যতদুর জানি এক্সেটারে কাপ্তেনের এক বোন থাকেন,ইভানস বলল, তাছাড়া ওঁর মুখ থেকেই এক ভাইপো না ভাইঝির কথাও শুনেছিলাম।

এঁরা কেউ ওঁর সঙ্গে কখনো দেখা করতে আসতেন না?

না স্যার, ইভানস বলল, যতদূর জানি ওঁর এক বোন এক্সেটারে থাকেন। তার সঙ্গে ওঁর ঝগড়াঝাটি হয়েছিল।

ভদ্রমহিলার পদবী কি জানো?

গার্ডনার, স্যার, নাম কি তা বলতে পারব না।

ওঁর ঠিকানা দিতে পারবে?

না স্যার, ওঁর ঠিকানা তো আমার জানা নেই।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বৈষয়িক দলিলপত্র যে আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। যাক, ইভানস, এবার বলো তো, গতকাল বিকেল চারটের পর থেকে তুমি কি করছিলে?

আমি বাড়িতে ছিলাম স্যার।

তোমার বাড়ি কোথায়?

এই তো মোড়ের মাথায় স্যার, ৮৫ নম্বর, ফোর স্ট্রীট।

বিকেলবেলা একবারও বাড়ি থেকে বেরোওনি তুমি?

না স্যার, ইভানস মুখ নামিয়ে বলল, তাছাড়া যেভাবে তুষার পড়ছিল তাতে বাইরে বেরোবোই বা কি করে?

সে তো বটেই। আচ্ছা ইভানস, তুমি যা বলছ তা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তা প্রমাণ করতে পারো?

আপনার কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যার।

আমি বলতে চাইছি ওই সময় কেউ তোমায় বাড়িতে থাকতে দেখেছিল? এমন লোক কেউ আছে?

আছে স্যার, ইভানস বলল, আমার স্ত্রী নিজে চোখে দেখেছে আমি বাড়ি ছেড়ে এক পাও বেরোইনি।

তাহলে তুমি আর তোমার স্ত্রী, দুজনেই গতকাল বিকেলে তোমাদের বাড়িতে ছিলে?

হ্যাঁ, স্যার।

মনে হচ্ছে তুমি সত্যি কথাই বলছ। যাক, তোমায় আর কোনো প্রশ্ন আপাতত করব না আমি।

স্যার, ইভানস বলল, যদি অনুমতি দেন তাহলে এবার আমি ঘরদোর সব সাফ করে ফেলতে পারি।

তা তো হবার নয় ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমাদের তদন্তের কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে ততদিন যেখানে যা কিছু যে অবস্থায় আছে ঠিক সেই অবস্থায় রাখতে হবে, কিছু সরানো বা এদিক ওদিক করা চলবে না।

ঠিক আছে স্যার,ইভানস ঘাড় নেড়ে বলল, আপনি যখন বলছেন তখন তাই হবে।

আমি চারপাশে সবকিছু একবার ভাল করে দেখে নিই ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি বরং অপেক্ষা করো, দরকার হলে তোমায় পরেও কিছু প্রশ্ন হয়তো করতে হতে পারে।

তাই হবে স্যার।

ইভানসের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার টেবিলের দিকে তাকালেন। রাতের খাবার টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে রেখেছে ইভানস মোষের সেদ্ধ করা জিভ, চাটনি, পনীর, বিস্কুট, এছাড়া টেবিলের পাশেই গ্যাস উনুনের ওপর রাখা ডেকচিতে টগবগ করে ফুটছে স্যুপ। সাইডবোর্ডে সাজানো রয়েছে সোডার বোতল, গ্লাস আর দু বোতল বিয়ার। একপাশে ছোট একটি মীট সেফের ওপর থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এক প্রস্থ রূপোর কাপ-ডিস, তাদের পাশে শোভা পাচ্ছে তিনটে উপন্যাস, একদম আনকোরা।

উপন্যাস তিনটে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, তাদের নাম–প্রেম যেখানে শেষ কথা, লিংকটের ফুর্তিবাজেরা, প্রেমের বন্দী।

ক্যাপ্টেন নারীবিদ্বেষী হলেও বাছাই করার ব্যাপারে খুব রসিক পুরুষ ছিলেন দেখছি, চাপা গলায় মন্তব্য করলেন তিনি।

চাপাগলায় মন্তব্য করলেও ইভানসের কান এড়াল না, সে বলল, ভুল করলেন স্যার, পড়ার জন্য নয়, ক্যাপ্টেন ওই তিনটে বই একটা নামকরণ প্রতিযোগিতায় জিতে পুরষ্কার পেয়েছিলেন। এই বই তিনটি কোনোদিন ওঁকে পড়তে দেখিনি, পাতাও উল্টে দেখেননি।

খাবার ঘরখানা আকারে মাঝারি, এককোণে একটি আলমারি, তার সামনে এসে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। সার্জেন্ট পোলক এতক্ষণ তার পাশেই ছিলেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি, এবার ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের অনুমতি নিয়ে তিনি আবার ফিরে গেলেন স্টাডিতে যেখানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছিলেন।

আলমারির সামনে এসে দাঁড়াতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট দেখতে পেলেন এক জোড়া স্কি, মাছ ধরার ছিপ, গলফ খেলার সরঞ্জাম, আর শিকার করার কিছু অত্যাবশ্যক সাজসরঞ্জাম ভেতরে শোভা পাচ্ছে। হাতির কেটে নেয়া পদ্মের পাতার মতো কান, জলহস্তীর চোয়াল, আর একটা চিতাবাঘের চামড়াও তার চোখে পড়ল। শুধু নারী বিদ্বেষী নয়, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে সর্বার্থে একজন খাঁটি পুরুষ ছিলেন এইসব দেখে সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হচ্ছিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

আচ্ছা ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, সিটাফোর্ড হাউস তো মাস কয়েকের জন্য মিসেস উইলেটকে ভাড়া দিয়েছিলেন কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, তাই না?

হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, আপনি ঠিকই শুনেছেন?

তাহলে খামোকা এসব জিনিস উনি এতদূরে এই ভাড়াবাড়িতে বয়ে আনলেন কেন? সিটাফোর্ড হাউসেই তো রেখে দিতে পারতেন?

সেটা আপনি বোঝেন, আমিও বুঝব, কিন্তু ক্যাপ্টেনকে বোঝাবে কে? ইভানসকে কিছুটা বিরক্তি মেশানোর গলায় বলল, ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এসব জিনিস এতদূর বয়ে নিয়ে আসা কি কম ঝক্কি? ক্যাপ্টেনকে বহুবার বলেছি কিন্তু উনি কিছুতেই বুঝবেন না, বারবার বলতেন, ইভানস, যাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি সে মেয়েমানুষ, আর আমার এইসব সাধের জিনিসের মর্ম বোঝ কোনো মেয়েমানুষের কর্ম নয়, আলমারির কাঁচ ভেঙ্গে চুরে সবকিছু ছড়িয়ে তছনছ করবে। তাই ওগুলো এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। আলমারির ভেতরে যা কিছু দেখছেন ক্যাপ্টেন ওগুলোকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো ভালোবাসতেন।

আচ্ছা ইভানস,ইচ্ছে করেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রসঙ্গ পাল্টালেন, সিটাফোর্ড হাউস ট্রেভিলিয়ান যাকে ভাড়া দিয়েছিলেন, সেই মিসেস উইলেটের সঙ্গে ওঁর কি আগেই পরিচয় ছিল?

না স্যার,ইভানস বলল, উইলিয়ামসনস নামে একটা বড় কোম্পানি আছে যারা জমি আর বাড়ির দালালী করে, মিসেস উইলেট ওদের মাধ্যমেই এসেছিলেন।

বাড়িটা ভাড়া নেবার আগে ওঁদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি?

তা হয়েছিল বৈকি, মিসেস উইলেট বাড়ি দেখতে এলেন তখন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ওঁর পরিচয় হল।

আজ্ঞে ঠিক তাই।

ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মিসেস উইলেটের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল কি?

হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, ভদ্রমহিলা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলেন।

আর তোমার মনিব?

স্যার, আমার মনিব ছিলেন এক পোড়খাওয়া জাহাজী,ইভানস মুখ টিপে হাসল, ওঁর মতো লোককে পটানো মিসেস উইলেটের কম্মো ছিল না। কিন্তু তাই বলে আমার মনিব কোনোদিন মিসেস উইলেটের সঙ্গে অভদ্রতা বা খারাপ ব্যবহার করেননি, তবে মিসেস উইলেট যখনই ওঁকে খাবার নেমতন্ন করতো ক্যাপ্টেন কোনো না কোনো ছুতোয় ঠিক তা এড়িয়ে যেতেন।

কেন, কোন উদ্দেশ্যে মিসেস উইলেট প্রায়ই কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খাবার নেমতন্ন করতেন? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ভদ্রমহিলা কি কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অংশটা পাকাপাকিভাবে দখল করতে চেয়েছিলেন যার পরিণতিতে শেষপর্যন্ত খুন হতে হল তাকে? হয়তো ভদ্রমহিলা ধরে নিয়েছিলেন খুব ঘনিষ্ট হবার পরে তিনি বাড়ির একটা অংশ নিজে কিনে নেবেন আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তারপর বাকি জীবনটুকু তার বন্ধু মেজর বারনাবির বাড়িতে তারই সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ন্যারাকটের মনে পড়ল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ভয়ানক বৈষয়িক লোক ছিলেন, প্রাণ গেলেও সিটাফোর্ড হাউসের তাঁর অংশটুকু তিনি কাউকে বিক্রি করবেন না, আর একজন মহিলাকে তো নয়ই।

মিসেস উইলেট মানুষ হিসাবে চমৎকার স্যার। ইভানস বলল, লোককে খাওয়াতে খুব ভালবাসেন। রোজ ওঁর বাড়িতে আত্মীয় বন্ধু কেউ না কেউ নিমন্ত্রিত হন।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বুঝলেন তিনি যা জানতে চাইছেন সে সম্পর্কে ইভানস এর চাইতে বেশি আলোকপাত করতে পারবে না। অগত্যা মিসেস উইলেটের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

ইভানসকে পাঠিয়ে স্টাডি থেকে সার্জেন্ট পোলককে ডাকিয়ে আনলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন দুজনে।

কিরকম মনে হল স্যার? ইভানস সম্পর্কে ইশারায় মন্তব্য করলেন সার্জেন্ট পোলক, ওর বক্তব্যের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পেলেন কি?

না, ওসব কিছু নেই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট উত্তর দিলেন, ইভানস আমার প্রশ্নের উত্তরে যা কিছু বলেছে তার মধ্যে মিথ্যে বা সন্দেহজনক কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে ভবিষ্যতে ওর চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটবে কিনা তা কে বলতে পারে? অবশ্য একথা মানতেই হবে যে ইভানস খুব বুদ্ধিমান লোক, খুব হুঁশিয়ার হয়ে তবেই সে আমার এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।

সার্জেন্ট পোলককে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার বাকি ঘরগুলো খানাতল্লাসি শুরু করলেন। গোটা বাড়িতে শোবার ঘর মোট তিনটে, এছাড়া আছে বাথরুম আর রান্নাঘর। দুটি শোবার ঘর একদম ফাঁকা। ভেতরে আসবাব দূরে থাক একটুকরো কাগজও পড়ে নেই। চারদিকে একপলক চোখ বুলিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এ বিষয়ে নিশ্চিত হলেন যে গত কয়েক সপ্তাহ কেউই ওই দুটো ঘরের একটিতেও থাকেনি। এরপর তারা দুজনে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নিজের ঘরটিতে। এ ঘরটি দিব্যি ছিমছাম ও ঝকঝকে, তকতকে, সবকটি আসবাবই যথেষ্ট রুচিসম্মতভাবে সাজানো। আসবাবগুলোর দেরাজ আর আলমারি খুলে ভেতরে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন তারা দুজনে, কিন্তু কোনোরকম বিশৃঙ্খলা তাদের চোখে পড়ল না। প্রত্যেকটি জিনিস যথাস্থানে রয়েছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে খুব পরিপাটি স্বভাবের লোক ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

ট্রেভিলিয়ানের নিজের শোবার ঘর খানাতল্লাসি সেরে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট পোলককে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন লাগোয়া বাথরুমে, কিন্তু সেখানেও সন্দেহজনক কোনো কিছু তাদের চোখে পড়ল না।

ওপরে তো কিছুই পাওয়া গেল না স্যার, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সার্জেন্ট পোলক মন্তব্য করলেন।

তাই তো দেখছি, সার্জেন্ট, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, কিন্তু স্টাডিতে যেসব কাগজপত্র আছে সেগুলো এখনও আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনি। আমি চাই এই কাজটা আপনি নিজে করুন তাছাড়া ইভানসকে এখনকার মতো আমি ছেড়ে দিচ্ছি, ও বাড়ি চলে যাক। পরে দরকার মতো আমি নিজে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করব ওর সঙ্গে।

তাই হবে স্যার। সার্জেন্ট পোলক গোড়ালি ঠুকে অভিবাদনের ভঙ্গিতে সায় দিল।

লাশ এবার সরানোর ব্যবস্থা করুন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আচ্ছা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের লাশ যিনি প্রথম পরীক্ষা করেছিলেন সেই ডঃ ওয়ারেন তো কাছেই থাকেন, তাই না পোলক?

হ্যাঁ স্যার।

ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, থ্রি ক্রাউনসের এপাশেই তো থাকেন উনি কেমন?

হ্যাঁ স্যার, পোলক ঘাড় নেড়ে হাসলেন।

তাহলে আমি আগে থ্রি ক্রাউনসের দিকেই যাব। নিন আপনি এখোন, সার্জেন্ট।

সার্জেন্ট পোলক দুটি আঙুল কপালের একপ্রান্তে ঠেকিয়ে আলতোভাবে স্যালুট করলেন তার ওপরওয়ালাকে। তারপর খাবার ঘরে ঢুকলেন তিনি। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন সেই বাড়ি থেকে, থ্রি ক্রাউনসের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি।

.

০৬.

থ্রি ক্রাউনস সরাইখানার মালিক মিসেস বেলিং ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে খাতির করে বসালেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের প্রসঙ্গ উঠতেই গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন তিনি, খুনীর আর দোষ কি, বাড়িতে ওঁর দেখাশোনা করার মতো দ্বিতীয় কেউ ছিল না, একটা কুকুর পর্যন্ত নয়। অথচ আপনিই দেখুন এখান থেকে এই বাড়ি কত কাছে। তাছাড়া এটা গন্ডগ্রাম হলেও আমার এই সরাইয়ের নাম অনেকেই জানে, বিশেষতঃ যাদের প্রায়ই ঘোরাঘুরি করতে হয়। খদ্দের তো এখানে কতই আসে, রাতও কাটায়, কিন্তু তাদের মনে কি অভিসন্ধি চাপা আছে তা কি জানা সম্ভব? আমি তো সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি কখন কি হয় এই ভেবে?

আচ্ছা মিসেস বেলিং, ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন, গতকাল রাতে আপনার এখানে কে কে ছিল বলতে পারেন?

হ্যাঁ, পারব না কেন, মিসেস বেলিং একটু ভেবে নিয়ে বললেন, মোট তিনজন গতকাল রাতে এখানে ছিলেন তাদের দুজনেই সেলসম্যান। তৃতীয়জন এসে পৌঁছেছিলেন শেষ ট্রেনে, বয়স নিতান্তই কম। ওর নামটা মনে করতে পারছি না। ওহো, আরও একজন ছিল বটে। সে এসেছিল লন্ডন থেকে, ওর নামটাও রেজিস্টারে লেখা আছে। আজ সকালবেলাই সে চলে গেছে, বলেছিল ছটা দশের ট্রেন ধরে এক্সেটারে যাবে। এই লোকটিকে আমার একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল।

কি কাজে এখানে এসেছে তা ও বলেছিল?

আজ্ঞে না, আমি বারবার জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু এ বিষয়ে ও একবারও মুখ খোলনি।

ছেলেটাকে দেখতে কেমন ছিল? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন।

দেখতে বেশ সুন্দর আর স্বাস্থ্যবান, মিসেস বেলিং বললেন, তবে চোখের চাউনি দেখলে মনে হয় যে মারাত্মক কোনো দুশ্চিন্তা সবসময় ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ছেলেটা এসে হাজির হল ঠিক লাঞ্চের সময়, খেয়েদেয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ একবার বাইরে বেরোলো, যখন ফিরে এল তখন ছটা ছাব্বিশ।

লাঞ্চের পরে ও কোথায় গিয়েছিল তা বলতে পারেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

না স্যার, দুঃখিত, মিসেস বেলিং জবাব দিলেন, ও ভীষণ চাপা, মুখচোরা স্বভাবের ছেলে। নিজে থেকে কোনো কথাই বলে না। কথা শেষ করে মিসেস বেলিং রেজিস্ট্রারের পাতা খুলে এগিয়ে দিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের দিকে।

জেমস পিয়ার্সন, লন্ডন, রেজিস্টারে নাম ঠিকানা দেখে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, শুধু এইটুকু দেখে কিছুই বোঝা যায় না, তবু জেমস পিয়ার্সন সম্পর্কে আমাদের খোঁজখবর নিতে হবে। ভালো কথা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বন্ধু মেজর বারনাবিকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?

এখানে পাবেন, মিসেস বেলিং জানালেন, ডাইনিং হলে উনি অনেকক্ষণ হল ব্রেকফাস্ট খেতে ঢুকেছেন, এই তো একটু আগে আমি ওঁকে কফি দিয়ে এলাম।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ডাইনিং হলে ঢুকে দেখলেন ভেতের কেউ নেই, শুধু এককোণে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক খবর কাগজ পড়তে পড়তে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি বসলেন, কোনো ভূমিকা না করে নিজের পরিচয়পত্রখানা তুলে ধরলেন তার সামনে, বললেন, আপনিই মেজর বারনাবি?

হ্যাঁ, প্রৌঢ় ভদ্রলোক কফির পেয়ালায় আরেকবার চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি হলেন গিয়ে–ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। এখানে কেন এসেছেন তা বুঝতে পেরেছি।

আপনার ঘনিষ্ট বন্ধু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্তের দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছে মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আশা করব এ কাজে আপনি আমায় প্রয়োজনীয় সহয়তা করবেন।

বলুন কি জানতে চান, কফির খালি পেয়ালা পাশে সরিয়ে রেখে মেজর বারনাবি বললেন, আমি যতদূর সম্ভব আপনাকে সহায়তা করব।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কি কোনো শত্রু ছিল?

আমি যতদূর জানি দুনিয়ায় ওঁর কোনো শত্রু ছিল না? বারনাবি জবাব দিলেন।

ওঁর রান্নার লোক ইভানসকে কি আপনার বিশ্বাসী বলে মনে হয়?

নিশ্চয়ই, বারনাবি জোর গলায় বললেন, আমি জানি ট্রেভিলিয়ান ওকে খুব বিশ্বাস করতেন।

ইভানস হালে বিয়ে করায় ট্রেভিলিয়ান কি ওর ওপর খুব রেগে গিয়েছিলেন?

রেগে যাননি, বারনাবি মুচকি হেসে বললেন, তবে ভেতরে ভেতরে ওর ওপর কিছু বিরক্ত হয়েছিলেন যদিও এ ব্যাপারে ইভানসকে কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলেননি তিনি। আসলে ট্রেভিলিয়ান নিজে ব্যাচেলার ছিলেন তাই।

আচ্ছা, আপনি তো ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কোনো উইল করেছিলেন কিনা বলতে পারেন? উনি ব্যাচেলার ছিলেন তাই জানতে চাইছি যে উইল তৈরি না করলে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অবর্তমানে ওঁর সম্পত্তির মালিক কে হবে?

ট্রেভিলিয়ান উইল করে গিয়েছেন, মেজর বারনাবি বললেন, সেই উইলের এক্সিকিউটর উনি আমাকেই করেছেন।

টাকাকড়ি কি অবস্থায় উনি রেখে গেছেন তা বলতে পারেন?

দুঃখিত, ইন্সপেক্টর তা আমি বলতে পারব না।

ট্রেভিলিয়ানের অবস্থা নিশ্চয়ই খুব স্বচ্ছল ছিল?

শুধু স্বচ্ছল নয়,বারনাবি বললেন, উনি ছিলেন রীতিমতো ধনী, ওঁর মতো ধনী লোক এ তল্লাটে আর একজনও নেই।

ওঁর জীবিত আত্মীয়রা কে কোথায় আছেন তা বলতে পারেন?

আত্মীয়? ভুরু কুঁচকে কি ভেবে নিয়ে মেজর বারনাবি জানালেন, যতদূর জানি এক বোন আর কয়েকটি ভাইপো আর ভাইজি আছে। তবে তাদের কাউকেই আমি কখনো দেখিনি। আত্মীয়দের সঙ্গে ট্রেভিলিয়ানের কোনো ঝগড়াঝাটি বা মনোমালিন্য হয়েছে বলেও কখনো শুনিনি।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওর উইল কোথায় রেখেছেন জানেন?

ওয়ালটার্স অ্যান্ড কার্বউডের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন, মেজর বারনাবি বললেন, ওরা এই এক্সহাম্পটনের বহুদিনের পুরোনো সলিসিটর। উইলটা ওরাই তৈরি করেছিল, ওদেরই জিম্মায় তা রয়েছে।

তাহলে মেজর বারনাবি, আমি এক্ষুনি একবার ওয়ালটার্স অ্যান্ড কার্বউডে যাব, আপনাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।

তার মানে? মেজর বারনাবি বলে উঠলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্তের সঙ্গে ওঁর উইলের কি সম্পর্ক?

মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট শান্তভাবে বললেন, আপনি আপনার বন্ধুর খুনের মামলাটাকে যতটা সাধারণ ভাবছেন বাস্তবে তা কিন্তু ততটা সাধারণ নয়। ভালো কথা, আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করব। মেজর বারনাবি, আমি জানতে পেরেছি ডঃ ওয়ারেনকে প্রশ্ন করেছিলেন বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিট নাগাদ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু ঘটেছিল কিনা?

যদি প্রশ্নটা করেই থাকি, মেজর বারবি কিছুটা রাগতসুরে বললেন, তাতে এমন কি অন্যায় হয়েছে?

ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন উঠছে না মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমার ধারণা কোনো কারণে নিশ্চয়ই মৃত্যুর এই সঠিক সময়টা আপনার মাথায় গেঁথে গিয়েছে।

পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট বলে এমন কি অন্যায় করেছি তাই তো বুঝতে পারছি না, বারনাবি আবার একইরকম রাগতসুরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ইচ্ছে করলে আমি দুটো বেজে পঁচিশ অথবা চারটে বেজে কুড়ি মিনিটও বলতে পারতাম, তাতে কিছুই আসে যায় না।

সে তো বটেই, বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট থেমে গেলেন, এই মুহূর্তে তিনি মেজর বারনাবিকে আর চটাতে চাইলেন না।

যাকগে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আরেকটা ব্যাপার আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে।

কোন ব্যাপার বলুন তো?

এই সিটাফোর্ড হাউস ভাড়া দেবার ব্যাপার কি? জানি না আপনার নিজের অভিমত কি, কিন্তু আমার কাছে এটা সত্যিই অদ্ভুত।

এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একমত, মেজর বারনাবি বললেন, শুধু আমি নই, সবাই এই একই কথা বলবে এবং সেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডের এই গন্ডগ্রামে বাড়ি ভাড়া নেওয়া আমার মনে হয় ভদ্রমহিলার নিজের মাথার ঠিক নেই।

ভদ্রমহিলা আপনার পরিচিত?

নিশ্চয়ই, আমি তো ওঁর বাড়িতেই ছিলাম যখন

যখন কি? প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

ও কিছু নয়, বাদ দিন,বলে এমনভাবে হাত নাড়লেন বারনাবি যেন এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলতে চান না তিনি।

তীক্ষ্ণ চোখে মেজর বারনাবির চোখের দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। বারনাবি যে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কিছু যে তার কাছে গোপন করতে চাইছেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এও বুঝতে পারলেন যে এক তীব্র দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বারনাবির মনে, যার আভাস তিনি তখনও পর্যন্ত দেননি।

আপনি নিজ মুখে এক্ষুনি বললেন, যে আপনি সিটাফোর্ড হাউসে ছিলেন, গলা সামান্য চড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ভদ্রমহিলা ওখানে কতদিন আছেন?

তা মাস কয়েক তো বটেই।

ভদ্রমহিলা বিধবা, একটি মাত্র মেয়ে ওঁর সঙ্গে থাকে, তাই না?

ঠিক বুলেছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

তা এত জায়গা থাকতে হঠাৎ এই গণ্ডগ্রামে উনি থাকতে এলেন কেন সেকথা ভদ্রমহিলা বলেছেন?

বলেছিলেন, মেজর রুমালে নাক মুছে বললেন, আসলে ভদ্রমহিলা বড্ড বেশি কথা বলেন–শহরের কোলাহলের বাইরে বহুদূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে থাকতে চান, এসব উনি বলেছিলেন, কিন্তু

আবার কথা শেষ না করে মঝপথে থেমে গেলেন মেজর বারনাবি।

কিন্তু এই কারণকে আপনার স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি তাই না মেজর? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

ঠিক তাই, মেজর বারনাবি মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ভদ্রমহিলা সুন্দরী, কথা বলে বোঝা যায় বিদূষী, রুচিশীলা ও ফ্যাশান সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। ওঁর মেয়েটিও শিক্ষিতা, সুন্দরী ও স্মার্ট। ওঁদের এই গণ্ডগ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকাটা খুবই বেমানান।

মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন। আপনার কি ধারণা ওরা মা আর মেয়ে কারো কাছ থেকে পালানোর জন্যই এই গণ্ডগ্রামে এসে উঠেছে? ওরা কি এখানে লুকিয়ে আছে?

না, কখনোই তা আমার মনে হয় না, বারবি জবাব দিলেন, এই সিটাফোর্ড খুব ছোট জায়গা, এখানে কোনো কিছুই গোপন থাকে না। ওরা খুব মিশুকে আর অতিথিবৎসল। কেউ না কেউ রোজই বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়। আচার-আচরণেও খুব বনেদী।

আপনার কি মনে হয় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে ভদ্রমহিলার আগে পরিচয় হয়েছিল?

না, তা হতে পারে না।

এত নিশ্চিভাবে কি করে বলছেন?

আচ্ছা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে পুরানো পরিচয়টাকে কোনোভাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পানা ওদের ছিল কি না একথা একবারও কি আপনার মনে হয় নি?

দেখুন, একটু ভেবে নিয়ে মেজর বারনাবি বললেন, সত্যি বলতে কি এভাবে ব্যাপারটা আদৌ আমি ভাবিনি, তবে আমার মনে হয় এই জাতীয় কোনো পরিকল্পনা ওদের ছিল না। জীবনের বহুসময় বিদেশে কলোনীতে কাটানো আর পাঁচজন ইংরেজের সঙ্গে ওদের কোনো তফাৎ নেই।

বেশ, তাই মেনে নিচ্ছি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসছি। মেজর, বাড়ি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিজে বানিয়েছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ,

আগে কখনো বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয়নি, এটাও ঠিক?

নিশ্চয়ই।

তাহলে এই বাড়িতে এমন কিছু অবশ্যই নেই যার আকর্ষণে মিসেস উইলেট সেটা ভাড়া নিয়েছেন।

এটা একটা ধাঁধা, যদিও এর সঙ্গে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান হ্যাজেলমুর নামে যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন সেটা কার সম্পত্তি?

হ্যাজেলমুরের মালিক এক মাঝবয়সি অবিবাহিতা মহিলা, নাম মিস গারপেন্ট। প্রত্যেক বছর শীতের সময় উনি চেল্টেনহ্যাম বেড়াতে যান, সেখানে একটা বোর্ডিংয়ে ওঠেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

মেজর বারনাবির উত্তরে এমনকিছুই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট খুঁজে পেলেন না যা তদন্তের কাজে কোনোভাবে তাকে পথ দেখাতে পারে। বিরক্তিসূচক ভাবে ঘাড় নেড়ে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন।

এই বাড়ির এজেন্ট তো উইলিয়ামসনস?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওদের অফিসটা তো শুনেছি এক্সহ্যাম্পটনেই, তাই না?

ওয়াল্টার্স অ্যান্ড বার্কউডের পাশের কামরায়।

বাঃ! হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, তাহলে মেজর আসুন না। এক্ষুনি একবার ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক, অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, মেজর বারনাবি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, উকিলরা কি চীজ, তা নিশ্চয়ই জানেন। বেলা দশটার আগে মিঃ বার্কউডকে ওঁর অফিসে পাবেন না।

.

০৭.

মেজর বারনাবিকে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রথমে এলেন এস্টেট এজেন্ট মেসার্স উইলিয়ামসনের অফিসে। এরা বাড়ি আর জমির দালালী করে, এদের মাধ্যমেই মিসেস উইলেট সিটাফোর্ড হাউস ভাড়া নিয়েছিলেন। জনৈক অল্পবয়সি কর্মচারী তাদের অভ্যর্থনা জানাল, মেজর বারনাবি তার সঙ্গে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তিনি যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্তে এসেছেন তাও জানালেন।

কি ভয়ানক নৃশংস কান্ড। অল্পবয়সি কর্মচারীটি নিজের থেকেই হঠাৎ মন্তব্য করল, এই খুনের কথা বলছিলাম। এমন কান্ড এর আগে কখনো এক্সহ্যাম্পটনে ঘটেছে বলে শুনিনি।

বেশি কথা বা বাজে কথা একদম বলবেন না। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তার পেশাদারী কড়া মেজাজে চাপা ধমক দিলেন, যে প্রশ্ন করব ঠিক তার জবাবটুকু বাস, তার বেশি কিছু নয়। এই সিটাফোর্ড হাউস তাহলে আপনাদের মাধ্যমেই ভাড়া দেওয়া হয়েছিল তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ, পুরোনো একটা খাতা খুলে তাতে চোখ বুলিয়ে কর্মচারীটি জবাব দিল, লন্ডনে বালটিন হোটেল থেকে উনি আমাদের বাড়ি ভাড়া চেয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন।

চিঠিতে কি উনি সিটাফোর্ড হাউসের নাম উল্লেখ করেছিলেন?

না, তা করেননি, শুধু লিখেছিলেন যে শীতের সময়টা কাটানোর জন্য ওঁর একটা বাড়ি খুব দরকার, আর সে বাড়িটা ডার্টমুর অঞ্চলে হলেই ভালো হয়। উনি এও উল্লেখ করেছিলেন যে ওঁর কম করে আটটা ঘর দরকার।

সিটাফোর্ড হাউসের নাম কি আপনাদের খাতায় ছিল?

আজ্ঞে না। তা ছিল না, তবে ভদ্রমহিলা ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন এই বাড়িতে সেসব তেমনটিই ছিল। উনি মোটা টাকা ভাড়া দিতে রাজি হয়ে গেলেন।

মিসেস উইলেট কি বাড়িটা নিজে দেখতে এসেছিলেন?

আজ্ঞে না স্যার, খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে বাড়িটা নিজে চোখে একবারও না দেখেই মিসেস উইলেট তা ভাড়া নিতে রাজি হয়েছিলেন। চুক্তিনামায় সই করার বেশ কিছুদিন বাদে উনি গাড়ি চালিয়ে এসে হাজির হলেন সিটাফোর্ডে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন, তারপর সেদিনই বাড়িতে ঢুকলেন। পরে আমাদের জানিয়েছিলেন যে বাড়িটা ওঁর খুব পছন্দ হয়েছে।

নিজে চোখে না দেখে শুধু দালালের মুখ থেকে শুনেই ভদ্রমহিলা বাড়িটা নিতে রাজি হলেন, বাড়িতে ঢোকার পরে জানালেন এটা তার খুব পছন্দসই হয়েছে, এসব দেখে আপনার মনে কি ধারণা হয়েছিল খুলে বলবেন?

দেখুন, আমি যে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছি, কর্মচারীটি মুচকি হেসে জবাব দিল, সেখানে এই শিক্ষাই পেয়েছি যে কোনো কিছু দেখেই অবাক হতে নেই।

আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মেজর বারনাবিকে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার পাশের কামরায় এসে ঢুকলেন। ওয়াল্টার্স অ্যান্ড বার্কউড সলিসিটার্স প্রতিষ্ঠানের অফিসটি এখানে। কার্ড পাঠাতেই মিঃ বার্কউড তাদের নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন।

মিঃ বাকউড বয়সে প্রবীন, সুন্দর সুপুরুষ এই পোঢ় এক্সহ্যাম্পটনের পুরানো বাসিন্দা, তার আগে তার বাবা আর ঠাকুরদাও এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন। মেজর বারনাবি পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে করমর্দন করলেন।

আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাব আশা করেই এতদূর এসেছি,ইন্সপেক্টর ন্যারাকট উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বললেন।

আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব সহায়তা করব, মিঃ বার্কউড গম্ভীর গলায় বললেন, বলুন কি জানতে চান।

আমি যতদূর শুনেছি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তার শেষ উইল আপনাকে দিয়েই করিয়েছিলেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, সেটা একবার দেখাতে পারেন?

আপনি ঠিকই শুনেছেন, ইন্সপেক্টর, মিঃ বার্কউড বললেন, আমি এক্ষুনি উইলটা নিয়ে আনার ব্যবস্থা করছি। কথা শেষ করে মিঃ বার্কউড টেলিফোনে তাঁর জনৈক সহযোগীকে নিহত ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের উইলটা নিয়ে আমার নির্দেশ দিলেন। মিনিট পাঁচেক বাদে একজন ছোকরা কামরা থেকে একটি মুখ বন্ধ খাম এনে রাখল তার সামনে। কেরানীটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে মিঃ বাকউড খামের মুখ খুলে ফেললেন, ভেতর থেকে টাইপ করা একটি দলিল বের করে পড়তে শুরু করলেন তিনি।

১। ……আমি জোসেফ অর্থার ট্রেভিলিয়ান, ঠিকানা সিটাফোর্ড হাউস, থানা সিটাফোর্ড, জেলা ডিভনসায়ার, আজ ঊনিশশো ছাব্বিশ সালের তেরোই অগাস্ট তারিখে আমার শেষ উইল লিখছি। সিটাফোর্ড হাউসের এক নম্বর বাংলোর বাসিন্দা মেজর জন এডওয়ার্ড বারনাবি এবং এক্সহ্যাম্পটনের সলিসিটর মিঃ বার্কউডকে আমি এই উইলের এক্সিকিউটার আর ট্রাস্টি হিসাবে নিয়োগ করছি।

২। আমার বহুদিনের পুরোনো ও বিশ্বস্ত পরিচারক রবার্ট হেনরি ইভানসকে আমি একশো পাউন্ড দিয়ে গেলাম যা সবরকম করের আওতা থেকে মুক্ত। তবে আমার মৃত্যু পর্যন্ত যদি ইভানস আমার অধীনে কাজে বহাল থাকে এবং অন্যকোথাও যাবার আগাম নোটিশ না দেয় শুধু সেক্ষেত্রেই ওই টাকা তার প্রাপ্য হবে।

৩। জীবিত অবস্থায় খেলাধুলায় জয়ী হয়ে যেসব পুরস্কার আমি অর্জন করেছি সেসবই বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে আমি দিয়ে গেলাম আমার বন্ধু মেজর এডওয়ার্ড বারনাবিকে, আমি এ পর্যন্ত যেসব জন্তু শিকার করেছি তাদের মাথা এবং দেহের অন্যান্য অংশের মালিকানাও তারই ওপর বর্তাবে।

৪। আমার যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রী করে তা নগদ টাকায় পরিণত করার অধিকার বর্তাবে এই উইলের দুই এক্সিকিউটর ও ট্রাস্টির ওপরে। আমার মৃত্যুর পরে সরকার যেসব কর ধার্য করবেন সেই টাকা থেকে তারা তা মেটাবেন এবং এই টাকা তারা বিভিন্ন ধরনের লগ্নী ও লাভজনক ব্যবসায় খাটাতে পারবেন।

৫। আমার যাবতীয় বিষয় সম্পত্তির মোট চারভাগের একভাগ পাবেন আমার ভগিনী জেনিফার গার্ডনার। ওই টাকা জেনিফার নিজেই ইচ্ছা ও প্রয়োজন মত খরচ করতে পারবে।

৬। আমার অপর ভগিনী মেরী পিয়ার্সন কিছুদিন আগে মারা গেছেন, তাঁর তিনটি সন্তানের প্রত্যেকেই আমার যাবতীয় সম্পত্তির মোট চারভাগের একভাগ সমানভাবে পাবে। উইলের নীচে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্বাক্ষর আর দুজন সাক্ষীর স্বাক্ষর, দুজন কর্মচারী এই উইলের সাক্ষী ছিলেন। এ দুটো স্বাক্ষর ওঁদেরই।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বোন মেরী পিয়ার্সন মারা গেছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন, ওঁর সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন, মিঃ বার্কউড?

তেমন বিশেষ কিছুই, নয়, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মিঃ বার্কউড জবাব দিলেন, মেরি খুব বেশিদিন হয়নি মারা গেছে। ওর স্বামী ছিলেন শেয়ারের দালাল, তিনি আগেই মারা গেছেন। আমি যতদূর জানি, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান সিটাফোর্ড সম্পত্তি কেনার পর মেরী একবারও তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি।

আচ্ছা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মোট পরিমান কত হবে বলতে পারেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

তা আশি নব্বই হাজার পাউন্ড তো বটেই, মিঃ বাকউড জবাব দিলেন, তার বেশি ছাড়া কম হবে না।

আগেই বলেছিলাম আপনাকে যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছিলেন ধনী লোক। বারনাবি এতক্ষণ বাদে মন্তব্য করলেন, প্রচুর টাকার মালিক ছিলেন উনি।

আচ্ছা, মিঃ বার্কউড, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট চেয়ার ছেড়ে উঠতে বললেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বোনেদের ঠিকানা আপনার কাছে আছে?

মেরী পিয়ার্সনের ঠিকানা আমার জানা নেই, মিঃ বার্কউড জবাব দিলেন, তবে জেনিফারের ঠিকানা দিতে পারি আপনাকে। লিখে নিন–মিসেস জেনিফার গার্ডনার, দ্য লরেন্স, ওয়াল্ডক রোড, এক্সেটার।

আরেকটা প্রশ্ন, ঠিকানা লিখতে লিখতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, মিসেস পিয়ার্সনের মোট কটি সন্তান?

যতদূর শুনেছিলাম তিনজন, মিঃ বার্কউড জবাব দিলেন, দুই মেয়ে আর এক ছেলে অথবা দুই ছেলে আর এক মেয়ে ঠিক মনে পড়ছে না।

আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ মিঃ বার্কউড বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তার কামরা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মেজর বারনাবিও এলেন তার পিছন পিছন। বাইরে বেরিয়ে আসার পরে কেউ কারো সঙ্গে একটি কথাও বললেন না, রাস্তা পেরিয়ে মোড়ের কাছে আসতেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেজর বারনাবিকে প্রশ্ন করলেন, এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ঠিক বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিটে মারা যান বলে আপনি একটা ভবিষ্যবাণী না এই ধরনের কিছু যেন বলেছিলেন শুনেছিলাম। ব্যাপারটা আসলে কি ঘটেছিল বলুন তো?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের প্রশ্ন শুনে মেজর বারনাবির মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠল, সেকথা তো আগেই আপনাকে বলেছি।

খোলাখুলিভাবে কিছুই বলেননি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, আপনি যা বলেছেন আইনের পরিভাষায় তাকে বলে সত্যগোপন করা যা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। আপনি যে খুনের নির্দিষ্ট সময়টি ডঃ ওয়ারেনকে সঠিকভাবে জানিয়েছিলেন নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল। আমার মনে হয় সেই উদ্দেশ্যটা আমার জানতে আর বাকি নেই।

যদি জানেনই তাহলে আবার আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন? বিরক্ত সুরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন মেজর বারনাবি।

আমার মনে হয় ওইদিন বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে কারো দেখা করার কথা ছিল, তাই না মেজর বারনাবি?

আজ্ঞে না, একইরকম বিরক্তিভরা গলায় মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, তেমন কিছুই ঘটেনি।

আপনাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি মেজর বারনাবি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট গম্ভীর গলায় বললেন, যা জবাব দেবেন ভেবেচিন্তে দেবেন। আচ্ছা, জেমস পিয়ার্সনের খোঁজখবর আপনি রাখেন?

জেমস পিয়ার্সন? অবাক হয়ে মেজর বারনাবি প্রশ্ন করনেল, কে সে? আপনি যার কথা বলছেন সে কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের ভাগ্নেদের একজন?

আমার তো তাই মনে হচ্ছে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জবাব দিলেন, তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জেমস, তাই না?

এ সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই, মেজর বারনাবি রাগত গলায় বললেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর কটি ভাগ্নে ছিল তা জানি, কিন্তু তাদের কার কি নাম সে আমার জানা নেই।

আমি যার কথা বলছি সেই জেমস পিয়ার্সন গতকাল রাতে থ্রি ক্রাউন্স সরাইখানায় ছিল। আশা করি আপনি সেখানে তাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন?

ভুল করছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, একইরকম বিরক্তি আর রাগতসুরে মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, আমি কাউকে চিনতে পারিনি, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের ভাগ্নেদের কাউকে জীবনে দেখিনি।

কিন্তু এইটুকু নিশ্চয়ই জানেন যে, গতকাল বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে ওঁর কোনো এক ভাগ্নের দেখা করার কথা ছিল?

না, আমি এই সবের কিছুই জানি না। গর্জে উঠলেন ফের বারনাবি।

তাহলে এই বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটের ব্যপারটা কি তাই খুলে বলুন।

বেশ, তাই বলছি, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, গোটা ব্যাপারটা এক ধরনের ছেলেমানুষি ছাড়া কিছুই নয়। অনেকেই এসব বিশ্বাস করেন না। শুনুন ইন্সপেক্টর, সামাজিকতা রক্ষা করতে এক একসময় মহিলাদের মন যে রক্ষা করতে হয় তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়, আর সেইভাবেই টেবিলটার্নিং নামে প্রেতচর্চার এক অনুষ্ঠানে আমি ওই দিন জড়িয়ে পড়েছিলাম। বলে মেজর বারনাবি সেদিন বিকেলে মিসেস উইলেটের বাড়িতে যা ঘটেছিল সংক্ষেপে তার বর্ণনা দিলেন।

আপনি বলতে চান মেজর বারনাবি, যে ওই প্রেতচর্চার অনুষ্ঠানে টেবিলের পায়ার ওঠানামার ঠক ঠক শব্দ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যুর খবর আমাদের জানিয়েছিল?

আমি নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও ব্যাপারটা ঠিক তেমনই ঘটেছিল।কপালের ঘাম রুমালে মুছে মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, ওই ঘটনার পরেই আমি অস্থির হয়ে পড়ি আর তাই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কেমন আছেন তা দেখার জন্য সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়ি।

মেজর বারনাবি মুখে অবিশ্বাসের কথা বললেও সেদিনের ওই ঘটনা যে তাকে খুব প্রভাবিত করেছিল সে সম্পর্কে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের মনে কোনো সন্দেহই রইল না। কিন্তু ভূতপ্রেত নিয়ে এই খেলার সঙ্গত কোনও ব্যাখ্যাই তিনি সেই মুহূর্তে খুঁজে পেলেন না।

নিশ্চয়ই এই প্রেতচর্চার পেছনে অন্য কোনো গভীর রহস্য আছে। এই রহস্যঘন খুনের মামলার তদন্তের দায়িত্ব আগে কখনো তাঁর হাতে আসেনি।

মেজর বারনাবি প্রেতের দ্বারা প্রভাবিত হোন বা নাই হোন তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তাঁর কাজ হল ট্রেভিলিয়ানের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা যার সঙ্গে ভূতপ্রেতের কোনো সম্পর্ক নেই।

.

০৮.

মেজর বারনাবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, দেখলেন এক্ষুনি তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে পৌঁছতে পারলে এক্সেটারে যাবার ট্রেনটা ধরতে পারবেন তিনি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বোনকে জেরা করার এই সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করতে চাইলেন না তিনি। মেজর বারনাবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুতপায়ে স্টেশনের দিকে এগোলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। অন্যদিকে মেজর বারনাবি নিজে এগোলেন থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ের দিকে। সরাইয়ে সবে ঢুকেছেন মেজর বারনাবি এমন সময় সুন্দর সুপুরুষ চেহারার এক অচেনা তরুণ তার সামনে এসে দাঁড়াল।

আপনি তো মেজর বারনাবি? অচেনা তরুণটি জানতে চাইল।

হ্যাঁ।

এক নম্বর সিটাফোর্ড কটেজ তো আপনারই ঠিকানা?

হ্যাঁ, কিন্তু আপনার

আমি ডেইলি অয়্যার খবরের কাগজের রিপোর্টার, আমি

তার কথা শেষ হবার আগেই রাগে বোমার মতো ফেটে পড়লেন মেজর বারনাবি।

আর একটি কথাও নয়, আপনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন তা জানতে আমার বাকি নেই। তবে এটাও জেনে রাখবেন, যতই প্রশ্ন করুন না কেন, আমার পেট থেকে একটি কথাও বের করতে পারবেন না। যদি কিছু জানবার থাকে তো সোজা পুলিশের কাছে চলে যান, আমায় খামোক বিরক্ত করতে এসেছেন কেন শুনি? যিনি খুন হয়েছেন আপনার এহেন আচরণে তার আত্মা অবশ্যই শান্তি পাচ্ছেন না!

ভুল করছেন, অল্পবয়সি রিপোর্টারটি এতটুকু দমে না গিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, কোনো খুনের ব্যাপারে খবর যোগাড় করতে নয়, এই খামটা আপনার হাতে তুলে দেবার জন্যই আমি এতদূরে ছুটে এসেছি। কথা শেষ করে সে কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা মুখ বন্ধ খাম বের করে তুলে দিলেন মেজর বারনাবির হাতে।

এই খামের ভেতরে কি আছে? মেজর বারনাবি প্রশ্ন করলেন।

আমাদের ফুটবল প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত একটি ধাঁধার সঠিক উত্তর আপনি পাঠিয়েছিলেন, রিপোর্টার ছোকরাটি জবাব দিল, সেই বাবদ আপনি পাঁচ হাজার পাউন্ড জিতেছেন, খামের ভেতরে সেই অঙ্কের চেক আছে। পুরস্কার পাবার জন্য আমি আপনাকে আমার নিজের তরফ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

ব্যাপারটা যে এরকম দাঁড়াবে তা মেজর বারনাবি স্বপ্নেও ভাবেননি। পাঁচ হাজার পাউন্ড তার কাছে অনেক টাকা, এত টাকা এক থোক হাতে পাবার কথা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। আর একটি কথাও জোগাল না তার মুখে, ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলেন।

পুরস্কার পাবার খবর জানিয়ে আমরা গতকাল সকালেই তো আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, রিপোর্টারটি বলল, পাননি চিঠি?

কি করে পাব বলুন? মেজর বারনাবি বললেন, সিটাফোর্ড এলাকাটার যে পুরো দশ ফিট তুষারের নীচে চাপা পড়ে আছে সে খোঁজ তো আপনাদের জানা নেই। কদিন ধরে তাই চিঠিপত্রও ঠিকমতো বিলি হচ্ছে না।

কিন্তু আজ সকালের কাগজে তো আপনার নাম ছাপা হয়েছে, সেটাও কি আপনার চোখে পড়েনি?

এই দেখুন, এখনও পর্যন্ত নিজের পরিচয়টাই আপনাকে দেওয়া হয়নি, রিপোর্টারটি বিনীতসুরে বলল, আমার নাম চার্লস এন্ডারবি, গতকাল রাতেই এখানে এসে পৌঁছেছি, তারপর আজ রওনা হয়েছিলাম সিটাফোর্ডের দিকে। আমরা আমাদের প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের প্রাপ্য চেক সবসময় নিজেরা গিয়ে হাতে হাতে দিয়ে আসি, এটাই আমাদের কাগজের রেওয়াজ, সেইসঙ্গে বিজয়ীর একটি সাক্ষাঙ্কারও প্রকাশ করি। হয়তো আপনার খোঁজ পেতাম না কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই থ্রি ক্রাউনসের মালিক, ওয়েটার, রাঁধুনি থেকে শুরু করে নিয়মিত খদ্দের সবাই দেখলাম আপনাকে চেনে।

কিছু মনে করবেন না। চেকসমেত খামটা সাবধানে পকেটে পুরে মেজর বারনাবি নরম সুরে বললেন, গোড়ায় আপনাকে অনেক কুকথা অকথা শুনিয়েছি। আমরা হলাম গিয়ে পুরোনো জমানার মিলিটারি অফিসার। যখন তখন মাথা গরম হয়ে ওঠে। যাকগে, আমার জন্য এত কষ্ট করেছেন আপনি, শুধু মুখে আপনাকে ছাড়ছি না। কি খাবেন বলুন।

শুধু একটা বিয়ার, এন্ডারবি মুচকি হেসে বলল।

দুটো বিয়ার অর্ডার দিয়ে সাংবাদিক ছোরার মুখোমুখি বসলেন মেজর বারনাবি, হঠাৎ বিষণ্ণ সুরে বললেন, তাছাড়া যিনি খুন হয়েছেন তিনি ছিলেন আমার বহুদিনের পুরানো বন্ধু, তাঁর বিয়োগ ব্যথা আমি বহু চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।

হ্যাঁ, এন্ডারবি সায় দিয়ে বলল, পথে আসতে যাকে দেখলাম, তারই মুখে শুনলাম এই খুনের প্রসঙ্গ। সবারই মুখে এককথা। সবদিক থেকেই এই খুনকে রীতিমতো রহস্যজনক বলা চলে। আচ্ছা ওঁর কি কোনো শত্রু ছিল?

না, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন।

ডাকাতি করতে এসে কেউ ওঁকে খুন করেছেন পুলিশ তা জানাতে নারাজ, এন্ডারবি বলল।

একথা আপনি জানলেন কি করে?

এন্ডারবি এ প্রশ্নের উত্তর দিল না, খবরের সূত্র ফাঁস করতে চায় না সে।

আপনি যে টাকাটা পেয়েছেন তার একটা রসিদ আমায় দিন, এন্ডারবি বলল।

এক্ষুনি দিচ্ছি, বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মেজর বারনাবি, পকেট থেকে খামটা বের করে খুলে দেখলেন ভেতরে সত্যিই পাঁচ হাজার পাউন্ডের চেক আছে কিনা। সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এক চিলতে কাগজে সই করে দিলেন তিনি।

ধন্যবাদ, রসিদটা পকেটে রেখে এন্ডারবি বলল, এবার আর কয়েকটা কাজ আমার করার আছে। এক, আপনার বাড়ির একটি ফটো তুলতে হবে, আপনি নিজে হাতে আপনার পোষা শুয়োরের বাচ্চা, বেড়াল নয়তো কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন, বাগানে ফুল গাছের গোড়ায় সার দিচ্ছেন এমন কিছু ফটোও তুলব। দুই, আপনার একটি ছোট সাক্ষাৎকার আমায় নিতে হবে। তেমন কিছু নয়, পাঁচহাজার পাউন্ড কিভাবে আপনি খরচ করতে চান এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আপনাকে। বেশ মুখরোচক ভাবে সাক্ষাৎকার লিখতে হবে আমায়।

বুঝেছি, ব্যাজার মুখে মেজর বারনাবি জানালেন, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই বিশ্রী আবহাওয়ায় সিটাফোর্ডে যাওয়া তো একরকম অসম্ভব ব্যাপার, গত তিনদিন ধরে একটি গাড়িও পথে বেরোয়নি, তুষারপাত বন্ধ হলেও পথঘাট সাফ হতে হতে আরও দিন তিনেক লেগে যাবে।

কি আর করব, আজ তাহলে উঠি,বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এন্ডারবি, করমর্দন শেষে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে দরজার দিকে।

বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় পোস্ট অফিসে এসে হাজির হল এন্ডারবি, সেখান থেকে অফিসে টেলিগ্রাম করল। তাতে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রহস্যময় খুনের ঘটনা উল্লেখ করল সবিস্তারে আর এও জানাল যে এই খুন সংক্রান্ত বিশদ রিপোটিং সে এখান থেকে পাঠতে পারবে।

অফিসে টেলিগ্রাম করেই কাজের পরবর্তী ধারা সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এন্ডারবি। নিহত ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনি ও আংশিক সময়ের পরিচারক ইভানসের ঠিকানা ইতিমধ্যেই যোগাড় করেছিল এন্ডারবি। পোস্ট অফিসে থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা ইভানস-এর পাড়ায় এসে সে হাজির হল।

ইভানস তার নগণ্য পেশার কারণে এতদিন পাড়ার লোকের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি বটে কিন্তু মনিব খুন হবার ফলে রাতারাতি সে বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফোর স্ট্রীটের এক বাসিন্দাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই সে এন্ডারবিকে এনে হাজির করল ইভানসের বাড়ির দোরগোড়ায়।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে খবরের কাগজের এক রিপোর্টার নিজে এসে হাজির হয়েছে তার কাছে এটা ইভানসের কাছে স্বপ্নেরও অতীত, এন্ডারবি মেজর বারনাবির নাম করতে সে তাকে খাতির করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসল। তার নববিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল। ইভানসের বউ-এর বয়স খুবই কম, আর চেহারায় চটক আছে। তার মেদহীন সরু কোমর, একমাথা কালো কোঁকড়ানো চুল আর রক্তাভ দুটি গালের দিকে তাকিয়ে এন্ডারবি মুগ্ধ না হয়ে পারল না, মনে মনে পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে ইভানসের রুচির তারিফ করল সে।

বুঝতেই পারছ, কেন তোমার কাছে এসেছি, এন্ডারবি হেসে বলল, তোমার মনিবের খুনের ব্যাপারে কিছু খবর আমার চাই। আশাকরি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে তোমার আপত্তি নেই?

আজ্ঞে না, ইভানস বিস্ময়ে বিগলিত হয়ে বলল, বলুন কি জানতে চান, আমি সাধ্যমতো উত্তর দেব।

তোমার মনিব ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে কে খুন করেছে বলে তোমার মনে হয়?

স্যার,ইভানস গলা নামিয়ে বলল, আমার ধারণা এটা নির্ঘাৎ কোনো গুন্ডা বদমাসের কাজ। নিশ্চয়ই ব্যাটা আকণ্ঠ মদ খেয়ে কোন গতিকে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছিল, ক্যাপ্টেন তাকে দেখতে পেয়ে ঘাড় ধরে বের করে দিতে চান, সেই, ফাঁকে ব্যাটা তাকে খুন করে।

ভুল করছ ইভানস, এন্ডারবি একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোমার এই ধারণার সঙ্গে পুলিশ একমত নয়।

আজ্ঞে? পুলিশের মতে খুনটা পূর্বপরিকল্পিত, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করবে বলেই সেদিন আততায়ী তার বাড়িতে ঢুকেছিল। আর আততায়ী নিছক মাতাল গুন্ডা বদমাইস নয় বলেই পুলিশের ধারণা।

এসব কথা আপনাকে কে বলল, স্যার? ভীতু গলায় ইভানস প্রশ্ন করল।

উত্তর না দিয়ে এন্ডারবি নিজেকে সামলে নিল। এসব খবর কিছুক্ষণ আগে থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে বসে মদ খেতে খেতে সেখানকার এক ওয়েটারের মুখে শুনেছে সে, যার বোনের জামাই খোদ কনস্টেবল গ্রেভস নিজে যাকে সঙ্গে নিয়ে মেজর বারনাবি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুন হবার পরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

খবর পেয়েছি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে, ভারিক্কি চালে বলল এন্ডারবি, যাতে পুলিশ সন্দেহ করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে আততায়ী জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল যা দেখে সবাই ধরে নেবে চুরি বা ডাকাতি করার মতলবে এক বা একাধিক লোক হ্যাজেলমুরে হানা দিয়েছিল, তাদের বাধা দিতে গিয়েই খুন হয়েছেন তোমার মনিব ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান। আততায়ী এইভাবেই সাজাতে চেয়েছে ব্যাপারটাকে।

সত্যিই, এমন নৃশংস কাজ কে করতে পারে? পরোক্ষে এন্ডারবির দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল ইভানসের যুবতী স্ত্রী।

আঃ রেবেকা,ইভানস চাপা ধমকের সুরে বলে ওঠে, সব ব্যাপারে কথা বলা তোমার সাজে না, এ সবের মাঝে তুমি মাথা গলাবে না। বউকে শাসন করেই গলা নামিয়ে এন্ডারবিকে প্রশ্ন করল ইভানস, স্যার আপনি সত্যিই পুলিশের গোয়েন্দা নন তো? বিশ্বাস করুন স্যার, আমি নেহাৎ ছাপোষা লোক, শুধু পেটের দায়েই এতদিন ক্যাপ্টেন-এর কাছে চাকরি করেছি। ওঁর খুনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তুমি মিছেই ভয় পাচ্ছ ইভানস, আশ্বাসের সুরে এন্ডারবি জানাল, আমি সত্যিই একজন রিপোর্টার, এই দেখো আমার পরিচয়পত্র, বলে পকেট থেকে আইডেন্টি কার্ড বের করে ইভানসের চোখের সামনে সে মেলে ধরল।

তোমার মনিবের খুনের ব্যাপারে খবর নেওয়া ছাড়া আরও একটা কারণে আমায় আসতে হয়েছে। মেজর বারনাবি আমাদের খবরের কাগজে একটা ফুটবল খেলার ধাঁধায় সঠিক উত্তর পাঠিয়ে পাঁচ হাজার পাউন্ড জিতেছেন, আমি ওই টাকার চেক তাকে দিতে এসেছিলাম।

কি বললেন আপনি, ইভানসের গলায় চাপা উত্তেজনা ফুটে বেরোল, এসব ধাঁধা তাহলে জোচ্চুরি নয়, সঠিক উত্তর পাঠালে লোকেরা তাহলে সত্যিই টাকা পায়?

পায় যে তা তো দেখতেই পাচ্ছ? এন্ডারবি বলল, মেজর বারনাবিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে আমার কথা সত্যি কিনা।

কিন্তু আমার মনিব ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে বলতেন এসব পুরোপুরি জোচ্চুরি, পুরস্কারের টাকা সবসময় ওরা আগে থেকে নিজেরাই হজম করে ফেলে, নয়তো এমন কাউকে কখনো পুরস্কার দেয় যে ওদের পেটোয়া লোক।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, যে একবার ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার সঠিক উত্তর পাঠিয়ে তিনটে উপন্যাস পুরস্কার পেয়েছিলেন আর খুন হবার আগের দিন পর্যন্ত সে উপন্যাস তিনটের একটিও তিনি যে খুলে দেখেননি সেকথাও এই প্রসঙ্গে জানাল ইভানস।

ইভানসকে মোচড় দিয়ে অনেক কিছু জেনে নিল এন্ডারবি, এই বিশ্বস্ত পুরোনো ভৃত্যকে নিয়ে একটি সরেস ফিচার লেখার পরিকল্পনা অনেকক্ষণ থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। ইভানসের রূপসী যুবতী বউ রেবেকার চোখেমুখে সবসময় এক অজানা ভীতি থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে কেন তাও এন্ডারবির চোখ এড়াল না। কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামাল না সে।

নিজের সাধ্যমতো আতিথেয়তার ত্রুটি করল না ইভানস, তার বউ-এর দেওয়া পানীয়ের গেলাসে শেষে চুমুক দিয়ে একসময় উঠে পড়ল এন্ডারবি, ব্যস্ত গলায় বলল, এবার তাহলে আমায় রওনা হতে হবে, সহযোগিতার জন্য তোমাদের দুজনকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে তোমার মনিব যখন আমাদের কাগজের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধায় জিতেছিলেন বলছ, তখন এটা জেনে রেখো যে তার খুনীকে ধরতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবরকম চেষ্টা করব।

দয়া করে তাই করুন স্যার,ইভানস হাত কচলে বলল, আপনারা খবরের কাগজের রিপোর্টাররা অনেক অসাধ্য সমাধান করতে পারেন।

ইভানসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিক এন্ডারবি ফিরে এল থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে।

মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ট্রেনে চেপে এক্সহ্যাম্পটন থেকে এক্সেটারে পৌঁছে গেলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। ট্রেন থেকে নেমে লরেনস নামে বাড়িটির কলিংবেলের ঘন্টা যখন তিনি বাজাচ্ছেন তখন দুপুর বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।

লরেনস বাড়িটা শুধু যে পুরোনো তাই নয়, এখন সবদিক থেকেই তার জীর্ণদশা চলছে। বাড়ির বাইরের দেওয়ালের রং আর পলেস্তারা কবে উঠে গিয়ে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে, বাড়ির চারপাশের বাগানের জায়গায় জায়গায় জমেছে আগাছা আর শ্যাওলা।

এদের আর্থিক অবস্থা যে ভাল নয় তা তো এই বাড়ির হাল দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নিজের মনে মন্তব্য করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

.

০৯.

দরজা খোলার আওয়াজ শুনে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মুখ তুলে তাকালেন, দেখলেন এক যুবতী খোলা দরজার পাল্লা দুহাতে ধরে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। যুবতী যে এই বাড়ির পরিচারিকা তার চেহারা আর পোষাক দেখেই সে সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

গুড আফটারনুন,ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমি ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। কিছুদিন আগে এক্সহ্যাম্পটনে মিসেস গার্ডনারের ভাই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন নিশ্চয়ই শুনেছেন, সেই খুনের তদন্তের ব্যাপারে ওঁকে কিছু প্রশ্ন করব, বলে এসেছি। মিসেস গার্ডনার ওঁর ভাইয়ের খুনের খবর শুনেছেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, মহিলা ঘাড় নেড়ে চাপা গলায় জবাব দিলেন, ওঁর উকিল মিঃ বাকউড টেলিগ্রাম করে খবরটা জানিয়েছেন।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট কোনো মন্তব্য করলেন না। সেই মহিলা অর্থাৎ মিসেস গার্ডনারের পরিচারিকা এবার তাকে নিয়ে এলেন ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমে দেয়ালের চেহারাও বাড়ির বাইরের মতোই জীর্ণ ও করুণ। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট একটা কৌচে গা এলিয়ে বসলেন।

তোমার মনিব অর্থাৎ মিসেস গার্ডনার নিশ্চয়ই এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি, পরিচারিকার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

যতটা ভাবছেন ততটা নয়, পরিচারিকা জবাব দিল, কারণ উনি ওঁর ভাইকে খুব বেশি দেখেননি, তেমন ঘনিষ্ঠতাও ওঁদের মধ্যে কখনো চোখে পড়েনি।

তোমার নাম কি? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

আজ্ঞে আমার নাম বিয়াত্রিস স্যার।

আচ্ছা, বিয়াত্রিস, জেরা করার ভঙ্গিতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, মিঃ বাকউড তোমার মনিব মিসেস গার্ডনারকে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তাতে কি ওঁর ভাইয়ের খুন হবার উল্লেখ ছিল?

কি বললেন আপনি? দুচোখ বড় বড় করে বিয়াত্রিস তার দিকে তাকাল, ভীতি মেশানো গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল, ওঁর ভাই তাহলে খুন হয়েছেন?

হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ঘাড় নেড়ে বললেন, তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে পাছে তোমার মনিব আঘাত পান সেই ভয়ে মিঃ বার্কউড গোড়াতেই ব্যাপারটা ইচ্ছে করে জানাননি তাকে। কিন্তু এভাবে কি আর এতবড় খবর চেপে রাখা যায়? আজ বিকেলের সব কটা সান্ধ্য দৈনিকেই দেখবে এই খুনের খবর ঠিক ছেপে বেরোবে।

ওঁর ভাই যে খুন হয়েছেন তা আমি এই প্রথম আপনার মুখ থেকে শুনলাম। খুন সে তো এক বীভৎস ব্যাপার, তাই না? তা আততায়ী কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মাথায় আঘাত করেছিল, না কি ওঁকে গুলি ছুঁড়ে খুন করেছিল?

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কি ভাবে খুন হয়েছেন তা সংক্ষেপে বিয়াত্রিসকে বলে তার কৌতূহল চরিতার্থ করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। তারপর বললেন, আমি শুনলাম গতকাল বিকেলে তোমার মনিবের এক্সহ্যাম্পটনে যাবার কথা ছিল, কিন্তু হয়তো আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত ওঁর সেখানে যাওয়া হয়নি।

দুঃখিত, বিয়াত্রিস বলল, তেমন কিছু তো শুনিনি, আমার মনে হচ্ছে আপনি ভুল খবর শুনেছেন। আমার মনিব মিসেস গার্ডনার কিছু কেনাকাটা করতে বিকেলে একবার বেরিয়েছিলেন ঠিকই, তারপর উনি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।

উনি কটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিলেন?

তা তখন সন্ধ্যে ছটা হবে।

আচ্ছা, মিসেস গার্ডনার কি বিধবা?

আজ্ঞে না,বিয়াত্রিস চাপা হেসে বলল, ওঁর স্বামী জীবিত।

তিনি কি কোনো কাজকর্ম করেন?

আজ্ঞে না, তিনি পঙ্গু, সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। বেচারা হাঁটাচলা করতে পারেন না তাই একজন নার্স দিনরাত ওঁর সেবা করে।

খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আচ্ছা বিয়াত্রিস, এবার তাহলে তুমি ভেতরে গিয়ে তোমার মনিব মিসেস গার্ডনারকে একবার এখানে পাঠিয়ে দাও। ওঁকে বলল যে মিঃ বার্কউডের তরফ থেকে আমি এসেছি।

বিয়াত্রিস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর তার মিনিটখানেক বাদেই এক মাঝবয়সি মহিলা ড্রইংরুমে ঢুকলেন। মিসেস গার্ডনার দেখতে লম্বা, মুখের গড়নটাও তার কিছুটা অস্বাভাবিক –কপালের দুই ভুরু বরাবর মুখখানা চওড়া আকার নিয়েছে, কানের পাশে রগে বেশ কিছুটা চুলে রূপোলি আভা ধরেছে।

আপনি মিঃ বার্কউডের তরফ থেকে এসেছেন?

মিঃ বার্কউডের কাছ থেকে আপনার নামটুকু শুধু জানতে পেরেছি তবে আমি তার পেশার সঙ্গে যুক্ত নই,ইন্সপেক্টর ন্যারাকট কৌচ ছেড়ে শিষ্টাচার দেখাতে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন, আমি ডিভিশন্যাল ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, গতকাল বিকেলে আপনার ভাই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন তা নিশ্চয়ই জানেন, ওই খুনের তদন্তের দায়িত্ব এখন আমিই পেয়েছি।

তীক্ষ্ণ দুটি চোখের চাউনিতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলেন মিসেস গার্ডমার, তারপর মন্তব্য করলেন, আপনি তাহলে পুলিশ অফিসার? বলছেন আমার ভাই খুন হয়েছে? কি আশ্চর্য। জো ছিল এক শান্ত নির্বিরোধী মানুষ, ওকে খুন করে কে লাভবান হল?

সেটা খুঁজে বের করাই তো আমার কর্তব্য, মিসেস গার্ডনার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আর এই তদন্তের ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর নেবার জন্যই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।

বেশ, মিসেস গার্ডনার বললেন, আমি যতদূর সম্ভব আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে তা এখনই বলতে পারছি না। গত দশ বছর আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ খুব কমই হয়েছিল। এই সময়ের ভেতরে ওর সঙ্গে যদি কারো বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গড়ে ওঠে তবে সেসব আমার কিছুই জানা নেই।

মাফ করবেন মিসেস গার্ডনার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন আপনার সঙ্গে কি আপনার এই ভাইয়ের কোনো ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?

ঝগড়াঝাটি বলতে যা বোঝায় জোর সঙ্গে আমার তা হয়নি, মিসেস গার্ডনার এতক্ষণ পরে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের মুখোমুখি একটি কোচে বসে বলতে লাগলেন, তবে অনেক সময় ও আমাকে ঠিক বুঝতে চাইতো না। এসব পারিবারিক খুঁটিনাটি ব্যাপার অনেক জটিল, সব আপনাকে বলত পারব না, শুধু এটুকু বলছি যে আমার ভাই জো আমার বিয়েতে বাধা দিয়েছিল। আমাদের এক নিঃসন্তান পিসিমা মারা যাবার আগে তার যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিল আমার ভাই জোকে, অল্প বয়সে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছিল সে। আমার আর আমার ছোট বোনের স্বামী দুজনেই গরিব ঘরের ছেলে। আমার স্বামী গত বিশ্বযুদ্ধে অনেকের মতোই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, বিদেশে লড়াই করতে গিয়ে কামানের গোলার আঘাতে তিনি আহত হন। দেশে ফেরার পরে উপযুক্ত চিকিৎসা করালে উনি আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করার ক্ষমতা ফিরে পেতেন কিন্তু সেই চিকিৎসা ছিল খরচ সাপেক্ষ। আমি এই চিকিৎসার খরচের টাকাটা জোয়ের কাছে ধার হিসাবে চেয়েছিলাম কিন্তু ও কিছুতেই টাকাটা আমায় দিতে চাইল না। তারপর থেকেই আমাদের দুজনের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল। চিঠিপত্র লেখাও একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

অদ্ভুত শক্ত চরিত্রের মহিলা, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজের মনে বলে উঠলেন, তার চেয়েও আশ্চর্যকর তার ভাই। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কিভাবে খুন হয়েছেন সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন একবারের জন্যও তিনি করলেন না, কোনো কৌতূহলও প্রকাশ করলেন না।

এক্সহ্যাম্পটনের ঘটনাটা কি ঘটেছিল তা কি আপনি জানতে চান না? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন মিসেস গার্ডনারের দিকে।

জানার সত্যিই তেমন প্রয়োজন আছে কি? ভুরু কুঁচকে মিসেস গার্ডনার উত্তর দিলেন, আমার ভাই খুন হয়েছে সে খবর তো আপনিই নিজের মুখেই দিলেন, আশাকরি তাকে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি।

তা হয়নি ঠিকই।

তাহলে আর এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত কিছু জানার আগ্রহ আমার নেই।

অস্বাভাবিক চরিত্র, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আবার নিজের মনে বলে উঠলেন, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না।

ইয়ে আমি আপনার আত্মীয়দের সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন।

করুন।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যুর পরে এখন আপনার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে আর কে কে বেঁচে আছেন?

আমার ছোট বোন মেরী পিয়ার্সনের দুই ছেলে জেমস, ব্রায়ান আর মেয়ে সিলভিয়া।

এদের সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আমি কিছু জানতে চাই, আপনি পর পর বলে যান। বেশ, বলছি। মেরীর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে জেমস সবার বড়, ওর বয়স আঠাশ, একটা বীমা কোম্পানিতে ভাল চাকরি করছে।

জেমস কি বিবাহিত?

না, তবে একটি মেয়েকে ও বহুদিন ধরে ভালবাসে। মেয়েটি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী শুনেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি।

জেমসের বর্তমান ঠিকানা কি?

২১, ক্রসওয়েল স্ট্রীট, লন্ডন, এস ডব্লিউ-৩।

তারপর? বলে যান, মিসেস গার্ডনারের বক্তব্য লিখে নিতে নিতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, জেমসের বোন সিলভিয়া আসছে তারপর, ওর সম্পর্কে যা জানেন, বলুন।

সিলভিয়ার বিয়ে হয়েছে মার্টিন ডেরিংয়ের সঙ্গে। মার্টিনের নাম আশা করি শুনেছেন, ও লেখক, ওর লেখা কতগুলো বই বাজারে প্রচুর কাটছে।

ঠিকানা?

দ্য লুক, সারে রোড ইমুলডন।

তারপর?

সবার ছোট হল ব্রায়ান, সে কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় গেছে। কাজেই তার ঠিকানা এই মুহূর্তে আপনাকে দিতে পারছি না। ওটা ওর ভাই বা বোনের কাছ থেকে পেয়ে যাবেন।

ধন্যবাদ, মিসেস গার্ডনার। এবার নিয়মমাফিক একটি মামুলি প্রশ্ন আপনাকে করছি। গতকাল বিকেলটা আপনি কিভাবে কাটিয়েছিলেন?

গতকাল বিকেলে আমি কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম, কেনাকাটা সেরে একটা সিনেমায় গিয়েছিলাম। ছবিটা দেখতে দেখতে মাথা ভীষণ ধরেছিল যে কারণে বাড়ি ফেরার পরে ডিনারের কিছু আগে পর্যন্ত চুপ করে শুয়েছিলাম।

আপনাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ, মিসেস গার্ডনার।

আর কিছু জানতে চান?

না, আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন করার নেই, আমি এবার আপনার ছোট বোনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। ভাল কথা, মিঃ বার্কউডের কাছ থেকে জানতে পারবেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার আগে যে উইল করেছিলেন তাতে তার সম্পত্তির কিছু অংশ আপনাকে আর আপনার বোন মেরীর ছেলেমেয়েদের দিয়ে গেছেন।

বাঃ, মন্তব্য করলেন মিসেস গার্ডনার, এ তো রীতিমতো সুসংবাদ। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট লক্ষ্য করলেন সম্পত্তির অংশ পাবার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে মিসেস গার্ডনারের বিপদমলিন কঠিন মুখখানা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুটি গালে ফুটে উঠল রক্তিমাভা।

ঠিক তখনই ওপরের একটি ঘর থেকে ভেসে এল পুরুষের কাতরকণ্ঠ।

জেনিফার! জেনিফার! তুমি কোথায় চলে গেলে? এখানে একটিবার এসো না!

মাপ করবেন। মিসেস গার্ডনার কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার স্বামীর হয়তো কোনো কিছুর দরকার হয়েছে, তাই আমায় ডাকছেন।

মিসেস গার্ডনার ড্রইংরুম ছেড়ে বেরোতে যাবেন কিন্তু তার আগেই আবার ওপর থেকে সেই গলা ভেসে এলঃ

কি হল জেনিফার! কোথায় গেলে তুমি?

আসছি বাপু! বলতে বলতে মিসেস গার্ডনার ড্রইংরুমের দরজা খুলে এগোলেন, একটু ধৈৰ্য্য ধরুন আসছি।

মিসেস গার্ডনারের পেছন পেছন ইন্সপেক্টর ন্যারাকটও বেরিয়ে এলেন ড্রইংরুম থেকে। সামনে বিশাল হলঘর, তারপর দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে এক স্বাস্থ্যবতী যুবতী নেমে আসতেই মিসেস গার্ডনার তার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। যিনি নেমে এলেন তার পরনে নার্সের ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম, তাকে দেখেই ইন্সপেক্টর ন্যরাকট ইচ্ছে করে তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, হেসে বললেন, মাপ করবেন, আমি একজন পুলিশ অফিসার, মিসেস গার্ডনারের ভাইয়ের খুনের তদন্তে এসেছি, আপনাকে দু একটা প্রশ্ন করতে পারি?

নার্স যুবতীটি বেশ ছটফটে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট পথ আটকে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার পাশ কাটিয়ে দ্রুতপায়ে এসে ঢুকলেন ড্রইংরুমে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকটও এলেন তার পেছন পেছন।

খুনের খবর শুনে আমার পেশেন্ট অর্থাৎ ক্যাপ্টেন গার্ডনার আচমকা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। নার্স বললেন, আসলে এই গোলমাল পাকিয়েছে ওই হতচ্ছাড়ী বিয়াত্রিস। কিছুক্ষণ আগে ওই ওপরে গিয়ে চেঁচিয়ে ক্যাপ্টেন গার্ডনারকে বলছিল যে ওঁর শ্যালক ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করা হয়েছে। বিয়াত্রিসের ঘটে এতটুকু বুদ্ধি নেই।

আচ্ছা, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, আপনার পেশেন্ট ক্যাপ্টেন গার্ডনারের অসুখটা কি খুব জটিল

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, নার্স গম্ভীর গলায় বললেন, বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝ যায় না বটে কিন্তু গোলার আঘাতে ওঁর মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্র এমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে উনি দেহের কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর নাড়াতে পারেন না, উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি তাই ভবিষ্যতে সুস্থ হয়ে উঠবেন সে সম্ভাবনাও নেই।

আচ্ছা, গতকাল বিকেলে ক্যাপ্টেন গার্ডনার কি কোনও মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন অথবা উত্তেজিত হয়েছিলেন?

কই, নার্স অবাক সুরে বলল, তেমন কিছু ঘটেছে বলে তো শুনিনি।

গতকাল পুরো বিকেলটাই কি আপনি ওঁর কাছে ছিলেন?

না, নার্স একটু ভেবে নিয়ে বলল, ক্যাপ্টেন গার্ডনারের দুটো বই পাল্টে আনার জন্য একবার লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম। এ কাজটা সাধারণতঃ ওঁর স্ত্রী নিজেই করেন কিন্তু গতকাল ওঁর স্ত্রী আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাই ক্যাপ্টেন আমাকেই লাইব্রেরীতে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। ফেরার সময় ওঁর অনুরোধমতো মিসেস গার্ডনারের জন্য কয়েকটা ছোট উপহারও কিনেছিলাম। কাপ্টেন বলে দিয়েছিলেন ফেরার পথে আমি যেন রেস্তোরাঁয় বিকেলের চা, জলখাবার খেয়ে নিই আর সেই খরচও উনি বেরোবার সময় আমায় দিয়েছিলেন। আমি গতকাল বিকেলে যখন বেরোই তখন চারটে বেজে গেছে, সন্ধ্যে ছটার পর বাড়ি ফিরেছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম আমি যতক্ষণ বাইরে ছিলাম সেই সময়টা ক্যাপ্টেন গার্ডনার দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে এসে মিসেস গার্ডনারকে দেখতে পেয়েছিলেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, উনি আমার আসার আগেই ফিরে এসেছিলেন, নার্স বলল, শুনলাম মাথা ধরেছে বলে উনি শুয়ে আছেন।

মিসেস গার্ডনার ওঁর স্বামী ক্যাপ্টেন গার্ডনারকে খুব ভালবাসেন। তাই না?

স্বামী স্ত্রীর পরস্পরকে ভালবাসা এমন কিছু নতুন নয়। নার্স বলল, তেমন ভালবাসা অনেক দেখেছি। কিন্তু মিসেস গার্ডনারের বাপার পুরো আলাদা। উনি ওঁর স্বামীকে এককথায় পুজো করেন, ওঁর জন্য এমন কোনও কাজ নেই যা উনি করতে পারেন না। স্বামীকে এমনভাবে ভালবাসতে আমি আগে কখনও কোনও স্ত্রীকে দেখিনি। এই ভালবাসার তুলনা হয় না। এই তো গতমাসে

মাপ করবেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, এবার আমায় রওনা দিতে হবে নয়তো ট্রেন ধরতে পারব না।

১০. ট্রেন পাছে ফস্কে যায়

১০.

ট্রেন পাছে ফস্কে যায় এই ভেবে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট একরকম দৌড়েই বেরিয়ে এলেন মিসেস গার্ডনারের বাড়ি থেকে, যাবার আগে ভদ্রতার খাতিরে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেবার সময়টুকু পর্যন্ত পেলেন না তিনি। ঈশ্বর সহায় ছিলেন তাই সময়মতো স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনটা পেয়ে গেলেন তিনি।

নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে প্রথমেই গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তরে এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, যেখানে ওপরওয়ালা পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে দেখা করে প্রাথমিক তদন্তের ফলাফল জানালেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও নিলেন তার কাছ থেকে। কিছুক্ষণ বাদে ওপরওয়ালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার স্টেশনে এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, দুপুর পৌনে দুটোর ট্রেন ধরে সোজা এসে পৌঁছোলন লন্ডনে।

লন্ডন স্টেশন থেকে ক্রমওয়েল স্ট্রীট খুব বেশিদুরে নয়, যেখানে পৌঁছে একুশ নম্বর বাড়িটি খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হল না তাকে। মিসেস গার্ডনারের বড় বোনপো জেমস পিয়ার্সনের খোঁজ নিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, বাড়ির পরিচারিকা উত্তরে জানাল যে জেমস সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ অফিস থেকে ফিরবে।

জেমসের অফিসে না গিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার চলে এলেন উইম্বলডনে তার বোন সিলভিয়ার বাড়িতে। সিলভিয়ার বাড়িটা নতুন, বেশ ছিমছাম আর সাজানো গোছানো। কলিংবেল টিপতেই অল্পবয়সী এক পরিচারিকা দরজা খুলে এসে দাঁড়াল, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, তার হাতে ভিজিটিং কার্ড তুলে দিয়ে বললেন যে গৃহকর্ত্রী মিসেস সিলভিয়া ডেরিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান।

পরিচারিকাটি ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে নিয়ে গিয়ে একতলার ড্রইংরুমে বসাল, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিলভিয়া ডেরিং ওপর পর থেকে নেমে এল, মুখোমুখি একটা সোফায় বসে নিজে থেকেই বলে উঠল।

আপনি নিশ্চয়ই জোসেফ মামার খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছেন। সত্যিই এ অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। বললে বিশ্বাস করবেন না, মামা খুন হবার পর আমি নিজেও সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন কি হয় ভেবে। দিনকাল যা পড়েছে, কখন জানালা ভেঙ্গে চোর ডাকাত বাড়িতে ঢুকবে তা কে বলতে পারে। এই তো দেখুন না গত হপ্তায় বাড়ির সবকটা জানালা আর দরজায় মজবুত কবজা আর ছিটকিনি লাগিয়েছি, অনেকগুলো টাকা তাতে খরচ হয়েছে।

সিলভিয়া ডেরিংয়ের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি নয়, কিন্তু তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, যে কারণে প্রথমে দেখলে যে কেউ ধরে নেবে তার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে বহু আগেই। সিলভিয়ার গড়ন বেঁটেখাটো, দেহের চামড়ায় রক্তাল্পতার ছাপ ফুটে উঠেছে। গলার সুরে কথা বলার ঢংয়ে সবসময় প্যানপ্যানে নাকি কান্নার ভাব। এই ধাঁচের মেয়েরা সবসময় নিজের কথা বলে, অন্যের অভাব অভিযোগ শোনার কোনো আগ্রহই এদের মধ্যে দেখা যায় না। ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে সিলভিয়া আপনমনে বলে চলে।

আপনাকে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারলে আমি সত্যিই খুশি হতাম, কিন্তু মুশকিল হল জোসেফ মামার সঙ্গে আমার খুব মেলামেশা কোনদিনই ছিল না। আসলে উনি লোক খুব সুবিধার ছিলেন না, অন্যের নিন্দা আর সমালোচনা সবসময়েই ওঁর মুখে লেগেই থাকতো। এছাড়া সত্যিই, শিল্প, সঙ্গীত, চারুকলা, এইসব সূক্ষ্ম বিষয়ের ধারে কাছে উনি কখনও হাঁটেননি জীবনে। টাকা ছাড়া জীবনে মামা আর কিছুই চিনতেন না, কিন্তু টাকাই জীবনে তো সব নয়।

খবরটা আপনি খুব তাড়াতাড়িই পেয়েছেন দেখছি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন।

হ্যাঁ সিলভিয়া ঘাড় নেড়ে বলল।

মামার সঙ্গে আপনার বহুদিন দেখা হয়নি, তাই না, মিসেস ডেরিং? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

ঠিক ধরেছেন, সিলভিয়া জবাব দিলেন। বিয়ের পরে এ পর্যন্ত মামার সঙ্গে মাত্র দুবার আমার দেখা হয়েছে। শেষ যেবার গিয়েছিলাম ওঁর কাছে সেবার মার্টিন অর্থাৎ আমার স্বামীর সঙ্গে মামা খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। আমার স্বামীর সঙ্গে মামা সেবার যে ব্যবহার করেছিলেন এককথায় অসভ্যতা ছাড়া তাকে আর কিছু বলা চলে না।

অর্থাৎ তোমার স্বামী তোমার মামার কাছে যেবার কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন আর তিনি যে ধার দেননি তাই তোমার এতো রাগ, মনে মনে সিলভিয়ার উদ্দেশ্যে মন্তব্যটা করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

এবার নিয়মমাফিক একটা প্রশ্ন আপনাকে করছি, মিসেস ডেরিং, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, গতকাল বিকেলে আপনি কোথায় ছিলেন, কিভাবে সময় কাটিয়েছেন এসব জানা একান্ত দরকার।

আমার গতিবিধির সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে চান, এই তো? হেসে সিলভিয়া জবাব দিল গতকাল প্রায় পুরো বিকেলটাই আমি ব্রীজ খেলে সময় কাটিয়েছি। পরে আমার এক বান্ধবী এসেছিল। তার সঙ্গেই গল্প করে সন্ধ্যেটুকু কাটিয়েছি, আমার স্বামী বাড়িতে ছিলেন না।

আপনার পরের ভাই ব্রায়ান তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, তাই না মিসেস ডেরিং?

হ্যাঁ,

ওর ঠিকানাটা আমায় যদি দেন–

দেখুন, পুরো ঠিকানাটা এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই, তবে ও যে জায়গায় থাকে তার নাম নিউ সাউথ ওয়েলস, শুধু এইটুকু মনে আছে।

ধন্যবাদ, মিসেস ডেরিং তদন্তের কাজে সহযোগিতা করার জন্য পুলিশের তরফ থেকে আপনাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছি, গুডনাইট।

উইম্বলডন থেকে আবার যখন ক্রমওয়েল স্ট্রীটে এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তখন সন্ধ্যে সাতটা, সিলভিয়ার বড় ভাই জেমস তার অল্প কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফিরেছে। জেমস পিয়ার্সন একাধারে সুদর্শন ও সুস্থাস্থ্যের অধিকারী, শুধু দোষের মধ্যে তার একটি চোখ ট্যারা। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট লক্ষ্য করলেন তার দুচোখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। দুচোখের নীচে কালি পড়েছে তাও তার নজর এড়াল না।

আমি ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আপনার খুনের তদন্তের দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার কি কিছু বক্তব্য আছে?

ইন্সপেক্টর ন্যরাকটের কথা শুনে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জেমস, ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনি কি আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন?

ভুল করছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট হেসে বললেন, আমি শুধু জানতে চাই গতকাল বিকেলে আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন। আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছে।

উত্তর না দিলে তো সেটা আমার পক্ষে যাবে না, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, জেমস পিয়ার্সন বলল, বুঝতে পেরেছি, আমি যে গতকাল ওখানে গিয়েছিলাম সেটা আপনি খুঁজে বের করেছেন।

আপনি নিজেই হোটেলের রেজিস্ট্রারে আপনার নাম মোটা মোটা হরফে সই করেছেন, মিঃ পিয়ার্সন।

নিশ্চয়ই, এটা অস্বীকার করার মতো ব্যাপার নয়, জেমস বলল, হ্যাঁ, আমি ওখানে গিয়েছিলাম, আর যাবই না কেন?

সে তো বটেই, কিন্তু কেন গিয়েছিলেন জানতে পারি?

আমি আমার মামাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

আপনি যে ওঁকে দেখতে যাচ্ছেন তা আগে থেকে ঠিক ছিল?

তার মানে? জেমস চাপা উত্তেজিত সুরে প্রশ্ন করল, আপনি কি বলতে চাইছেন?

আপনি যে ওখানে যাচ্ছেন তা কি আপনার মামা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান আগে থেকে জানতে পেরেছিলেন?

না, জানতেন না, হঠাৎ মামাকে দেখার ইচ্ছে হল তাই চলে গেলাম।

বাঃ চমৎকার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মুচকি হেসে বললেন, তা ওখানে পৌঁছোনোর পরে কি হল, মামার সঙ্গে আপনার আদৌ দেখা হয়েছিল কি?

হ্যাঁ, কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে জেমস পিয়ার্সন জবাব দিল, হ্যাঁ, মামার সঙ্গে গতকাল আমার ঠিকই দেখা হয়েছিল। শুনুন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে আমি জানতে চেয়েছিলাম। কিভাবে কোন পথে গেলে তাড়াতাড়ি সিটাফোর্ডে পৌঁছোতে পারব। স্টেশনের কর্মচারীরা বলল যে প্রচণ্ড তুষারপাত হবার দরুন পথঘাট সব বন্ধ তাই গাড়িঘোড়াও চলছে না, অতএব সিটাফোর্ডে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ মামার সঙ্গে দেখা করাটা ছিল খুবই জরুরী।

জরুরী? হঠাৎ প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

হ্যাঁ, মামার নাম শোনার পরে স্টেশনের এক পোর্টার জানাল যে সে তাকে ভালভাবেই চেনে এবং তিনি যেখানে থাকেন সে জায়গাটার আসল নাম হল এক্সহ্যাম্পটন। ওই পোর্টারই আমায় বলে দিল হাঁটাপথে কিভাবে এগোলে আমি অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে পৌঁছোতে পারব।

তখন কটা বেজেছিল মনে আছে?

তা দুপুর একটা তো বটেই, জেমস পিয়ার্সন বলতে লাগল, এরপর আমি থ্রি ক্রাউনস নামে একটা সরাইয়ে উঠলাম, সেখানে লাঞ্চ খেয়ে মামার কাছে যাব বলে রওনা হলাম।

কটা নাগাদ। মনে আছে?

দুঃখিত, তা ঠিক মনে করতে পারছি না।

তিনটে? চারটে? সাড়ে চারটে?

ওই ওইরকমই হবে, আমতা আমতা করে জেমস জবাব দিল, তবে তার পরে নয়।

সরাইয়ের মালিক মিসেস বেলিং জানিয়েছেন, আপনি সাড়ে চারটে নাগাদ রওনা হয়েছিলেন। যাক, তারপর কি হল?

তুষার ঢাকা পথ মাড়িয়ে একসময় মামা হ্যাজেলমুর নামে যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন সেখানে পৌঁছোলাম, ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা সেরে আবার সরাইয়ে ফিরে এলাম।

বেশ, এবার বলুন তো মিঃ পিয়ার্সন, মামার বাড়িতে পৌঁছোনোর পরে আপনি ভেতরে ঢুকলেন কিভাবে?

কেন? আমি নিচে কলিংবেল বাজালাম, তার কিছুক্ষণ পরে মামা নিজেই সদর দরজা খুলে দিলেন।

আপনাকে ওই সময়ে দেখে তিনি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিলেন, তাই না?

ঠিক ধরেছেন, মামা আমায় দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন।

তা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে অর্থাৎ আপনার মামার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে কতটা সময় সেখানে কাটিয়েছিলেন মিঃ পিয়ার্সন?

তা পনেরো কুড়ি মিনিট তো বটেই, জেমস আবার আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আমি চলে আসার সময় মামা দিব্যি সুস্থ্য শরীরে জীবিত ছিলেন, এ আমি শপথ করে বলছি।

আপনি যখন ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন তখন কটা বেজেছিল।

দুঃখিত, দুচোখ নামিয়ে জেমস জবাব দিল, তা আমার ঠিক মনে নেই।

সত্য গোপন করা যে গুরুতর অপরাধ তা নিশ্চয়ই জানেন মিঃ পিয়ার্সন? পুলিশী ধাঁচে কড়া গলায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, কটা নাগাদ আপনি আপনার মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তা আপনার ঠিকই মনে আছে। ভাল চান তো সময়টা বলে ফেলুন।

তখন বিকেল সওয়া পাঁচটা বেজেছিল,ভীত গলায় জবাব দিল জেমস।

আবার মিথ্যে বললেন, একইরকম কড়া গলায় বললেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আপনি বিকেল পৌনে ছটা নাগাদ থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে ফিরে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে ওখানে পৌঁছোতে যে কোন সুস্থদেহী মানুষের সাত, বড়জোর আট মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তার মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে মামার কাছ থেকে আপনি যখন বিদায় নিয়েছিলেন তখন ঘড়িতে পাঁচটা সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ বেজেছিল।

সোজাপথে তো সরাইয়ে ফিরে যাই নি, জেমস বলল, আমি একটু ঘুরপথে বেড়াতে বেড়াতে ফিরে এসেছিলাম, শহরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে।

ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষারপাতের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর সাধ আপনার হল কি করে? যাক, মামার সঙ্গে কথাবার্তা কি হয়েছিল তাই বলুন।

তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়নি। জেমস বলল, মামা কেমন আছেন, ওঁর দিন কেমন কাটছে এইসব খোঁজখবর নিলাম, উনিও জানতে চাইলেন আমরা কে কেমন আছি, এইসব।

তোমার মতো পাকা মিথ্যেবাদী গোয়েন্দার জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি, মনে মনে তার উদ্দেশ্যে বললেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মুখে বললেন, তা জেমস, এবার আমার একটা সিধে সরল প্রশ্নের জবাব দিন। মামা খুন হয়েছেন জেনেও থানায় গিয়ে খোঁজখবর না নিয়ে আপনি গতকাল এক্সহ্যাম্পটন ছেড়ে লন্ডনে ফিরে এলেন কেন? কতবড় অন্যায় আপনি করেছেন তা বুঝতে পারছেন?

হয়তো অন্যায় করেছি। মুখ তুলে জেমস অকপটে জানাল, কিন্তু বিশ্বাস করুন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আমি আসলে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম আমি দেখা করে চলে আসার কিছুক্ষণ বাদেই মামা খুন হন। এবার আপনিই বলুন, আমার পক্ষে ভয় পেয়ে এইভাবে চলে আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক ছিল? খবর পেয়েই আমি জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিই। তারপর স্টেশনে পৌঁছে পরের ট্রেন ধরে ফিরে আসি লন্ডনে। আমি যা করেছি তা পুরোপুরি বোকামি কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে আর কিই বা করণীয় ছিল বলতে পারেন?

এইটুকুই আপনার বক্তব্য হিসাবে ধরে নিতে পারি তাহলে?

হাঁ, অবশ্যই।

তাহলে, মিঃ পিয়ার্সন, আপনাকে এখনই একবার আমার সঙ্গে স্থানীয় থানায় আসতে হবে, যেখানে আপনার এই বক্তব্য স্বীকারোক্তি আকারে আমি লিখে নেব, তারপর তাতে আপনাকে দিয়ে সই করিয়ে নেব।

ব্যাস, শুধু ওইটুকু?

না, আরও আছে, গম্ভীর গলায় ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, তারপরেই আপনি ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন তা ভাবনে না। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে থানার হাজতে আটকে রাখব।

হা ঈশ্বর! জেমস পিয়ার্সন বিলাপ করে উঠল, আমায় এই বিপদ থেকে রক্ষা করার মতো কেউ কি এখানে নেই?

ঠিক সেইমুহূর্তে ড্রইংরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল এক যুবতী। শুধু অপরূপ সুন্দরী বললে সেই যুবতীর রূপ বর্ণনা করা যায় না। তার চোখেমুখে জড়িয়ে রয়েছে এমনই এক অপার করুণার উৎস যা বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রথম দর্শনে যে কেউ তাকে এক মহীয়সী পরিত্রাতা বলে মনে করতে পারে।

কি ব্যাপার জিম? যুবতী জেমসকে প্রশ্ন করল, তোমায় এতো নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন, কি হয়েছে?

সব শেষ হয়ে গেছে, এমিলি, জেমস ভাঙ্গা গলায় জানাল, ইনি গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, উনি সন্দেহ করছেন যে মামাকে আমিই খুন করেছি, তাই এখন আমায় গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যেতে চাইছেন, বলছেন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত থানার হাজতে আমায় আটকে রাখবেন।

হাতে পায়েই শুধু বড় হয়েছে। শাসন করার সুরে এমিলি বলতে লাগল, অথচ ঘটে একছিটে বুদ্ধি যদি তোমার থাকতো জিম। উকিল সঙ্গে না থাকলে যে পুলিশ অফিসারদের প্রশ্নের জবাব দিতে নেই এই কথাটা আর কবে তুমি শিখবে, বলতে পারো? নিশ্চয়ই বোকার মতো এমন কিছু বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে যার জন্য উনি তোমায় থানায় নিয়ে যেতে চাইছেন। তুমি একটি আস্ত গদর্ভ। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আপনি ওকে গ্রেপ্তার করছেন কেন জানতে পারি?

সংক্ষেপে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বুঝিয়ে দিলেন যে মামার সঙ্গে দেখা করে সরাইয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরে জেমস খবর পায় যে তিনি খুন হয়েছেন, তারপর পুলিশের সঙ্গে দেখা না করে ফিরে আসে লন্ডনে। জেমস বলছে যে ঘাবড়ে গিয়েই সে পালিয়ে এসেছে, কিন্তু আইনের চোখে তার এই আচরণ সন্দেহজনক, তাই তাকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কোনও পথ এই মুহূর্তে তার সামনে খোলা নেই।

বিশ্বাস করো এমিলি, আর্তনাদ করে উঠল জেমস পিয়ার্সন। এই জঘন্য আর নৃশংস কাজ আমি করিনি, বিশ্বাস করো।

নিশ্চয়ই ডার্লিং, এমিলি সায় দিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করছি যে এ খুন তুমি করোনি। আসলে মামাকে খুন করার হিম্মতই তোমার নেই।

হা ঈশ্বর। দুনিয়ায় বন্ধু বলতে আর কেউ আমার রইল না, যে আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারে! জেমস আবার বিলাপ করতে লাগল।

কে বলল নেই? এমিলি দুহাতে জেমসের গলা জড়িয়ে ধরে ফেলল, এই তো আমি আছি। ঘাবড়াও মাৎ, জেমস। আমার বাঁ হাতের এই অনামিকার দিকে একবার তাকাও

এই যে হীরের আংটিটা জ্বলজ্বল করছে তা তোমারই দেওয়া উপহার জিম। আমি তোমার বিশ্বস্ত প্রণয়নী। এতটুকু না ঘাবড়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে যাও, উনি যা বলেন তাই করো। বাকি সব কিছু আমার ওপর ছেড়ে দাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এও জেনে রেখো, তুমি যে একাধারে আস্ত গর্ধভ ও ভীতুর ডিম তা জানতে ওঁর বাকি নেই।

আপনার নামটা কি? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এমিলিকে প্রশ্ন করলেন।

এমিলি ট্রেফুসিস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

গুড ইভিনিং, মিস ট্রেফুসিস। বলেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জেমসকে নিয়ে দরজার দিকে এগোলেন।

অ রিবোয়ার ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, নিখুঁত ফরাসীতে পাল্টা বিদায় জানাল এমিলি। জেমসের মুখে আর কথা যোগালো না, পাশ থেকে টুপিটা তুলে মাথায় চাপিয়ে সে এমন ভয়ে ভয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের পেছন পেছন যেতে লাগল যেন তাকে ফাঁসী দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। থানায় যাবার আগে প্রেমিকার কাছ থেকে বিদায় নেবার কথাও ভয়ের চোটে ভুলে গেল জেমস পিয়ার্সন।

.

১১.

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহক্রমে পুলিশ তার এক ভাগ্নেকে গ্রেপ্তার করেছে এই খবর সোমবারের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল গোটা এক্সহ্যাম্পটনে। গোড়ায় স্থানীয় খবরের কাগজগুলোয় যে ঘটনাটি পেছনের পাতায় মাত্র তিন চার লাইনে ছেপে প্রকাশ করেছিল, জেমস পিয়ার্সন গ্রেপ্তার হবার পরে তারাই নেমে পড়ল সত্য উদ্ঘাটনে, প্রথম পাতায় তারাই এই খবরকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে শুরু করল। কে কত জোরালো সত্য কাহিনী লিখতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হল ওইসব কাগজের স্থানীয় রিপোর্টারদের মধ্যে। তবে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের রহস্য উদঘাটনের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো যেহেতু চার্লস এন্ডারবিই সবার আগে যোগাড় করেছিল তাই অন্য কোনও খবরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার তার চাইতে ভাল কভারেজ দিতে পারছিল না।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাড়ীনক্ষত্র সবকিছুরই হদিশ যে মেজর বারনাবি রাখেন এটা সে জানতে পেরেছে আর বারনাবির ফটো ভোলা আর সাক্ষাৎকার নেবার ছুতোয় সে জোঁকের মতো সেঁটে আছে সবসময় তার সঙ্গে সঙ্গে।

দুপুরবেলা নিজের পয়সা খরচ করে মেজর বারনাবিকে লাঞ্চ খাওয়াল এন্ডারবি আর কিছুক্ষণ বাদেই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। মেজর বারনাবি লাঞ্চ খেয়ে বিদায় নেবার পরে থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে ঢোকবার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়েছিল এন্ডারবি, আশে পাশে জমে থাকা তুষার গলতে শুরু করেছে তার ওপর ঠিকরে এসে পড়েছে সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ, দুচোখ মেলে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল সে, এমন সময় এক অচেনা নারীকণ্ঠ তার কানে এল, মাপ করবেন–বলতে পারেন এই এক্সহ্যাম্পটনে দেখার মতো কি কি আছে?

মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই এন্ডারবির চক্ষুস্থির। আঁটো ট্রাউজার্স আর জ্যাকেট চাপানো কাঁধে ঝোলাব্যাগ এমন এক রূপসী-যুবতীর সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় হল যার রূপের বর্ণনা তার মতো ঝানু রিপোর্টারের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়। মনে মনে আক্ষেপ করল এন্ডারবি, এই সুন্দরী যদি আমার প্রেমিকা হতো। মুখে বলল, একটা পুরোনো আমলের দূর্গ আছে, এন্ডারবি বলল, যদিও তাকে তেমন কোনও দ্রষ্টব্য কোনমতেই বলা যায় না। আপনি চাইলে আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে যেতে পারি।

আপনাকে গাইড হিসাবে পেলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব, যুবতী বলল, আপনিই তো সাংবাদিক মিঃ এন্ডারবি, তাই না?

হ্যাঁ, অবাক হয়ে এন্ডারবি প্রশ্ন করল, কিন্তু আমার পরিচয় আপনি জানলেন কি করে?

এই সরাইয়ের মালিক মিসেস বেলিং বলেছেন, যুবতী বলল, আমার নাম এমিলি ট্রেফুসিস। মিঃ এন্ডারবি আপনার সাহায্য আমার খুব দরকার।

এন্ডারবি পুলকিত হয়ে বলল, নিশ্চয়ই করব, কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো?

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহক্রমে পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে সেই জেমস পিয়ার্সন আমার প্রণয়ী, ওর সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।

ওঃ, চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এন্ডারবি বলল, তাহলে এই ব্যাপার

আজ্ঞে হ্যাঁ, এমিলি বলল, কিন্তু জিম যে এই খুন করেনি সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, আর তা প্রমাণ করব বলেই আমি এখানে ছুটে এসেছি, কিন্তু পুরুষ মানুষ পাশে না থাকলে কি এভোবড় কঠিন কাজ সফল করা সম্ভব? পুরুষ মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি সবই ভাল, মেয়েদের দিয়ে অতো ভালভাবে হয় না।

হ্যাঁ আমতা আমতা করে এন্ডারবি সাহস দিয়ে বলল, এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

জানেন, আজ সকাল থেকে আরও কত বড় বড় রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বললাম, সাহয্য চাইলাম কিন্তু দেখলাম তাদের কারোর ঘটেই সেই বস্তুটি নেই যার নাম উপস্থিত বুদ্ধি, সবাই কেমন যেন বোকা বোকা মুখ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে আর মাঝে মাঝে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এঁদের মধ্যে শুধু আপনাকেই বুদ্ধিমান বলে মনে হল, তাই

ভুল করছেন ম্যাডাম, আপনি আমার সম্পর্কে খামোকা বাড়িয়ে বলছেন, আমি নিজেকে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না।

আমার একটা প্রস্তাব আছে, এমিলি বলল, আপনি আর আমি দুজনে মিলে একসঙ্গে যদি অংশীদারের মতো এই খুনের তদন্তটা বেসরকারী পর্যায়ে করতে পারি তাহলে আপনি আর আমি দুজনেরই লাভবান হবার সম্ভাবনা।

কিভাবে, এন্ডারবি প্রশ্ন করল। আমি যাকে পুলিশের খপ্পর থেকে বাঁচাতে চাইছি সেই জেমস পিয়ার্সন নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়ে বেকসুর খালাস পাবে আর এই রহস্যের তদন্ত করতে গিয়ে যে গোপন খবর আমাদের হাতে আসবে সে সবই আপনি স্কুপ হিসাবে যোগান দিতে পারবেন আপনার কাগজে। বুঝতে পারছেন না, আমি এ ব্যাপারে পুরোপুরি আপনার ওপরেই নির্ভর করতে চাইছি।

মুখে একসঙ্গে কাজ করার লোভ দেখালেও আসলে এমিলি চাইছিল এন্ডারবি তার অধীনে থেকে এক ধরনের বেসরকারী গোয়েন্দার কাজ করুক। এন্ডারবি যে তার রূপে মজেছে এটা বুঝতে তার বেগ পেতে হয়নি তাই এমিলি প্রস্তাব দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার তোষামোদও করছিল। এমিলির ভাগ্য ভাল। এন্ডারবি সহজেই তার টোপটা গিলে ফেলল।

সত্যিই আপনার জবাব নেই। দেঁতো হাসি হেসে এন্ডারবি বলল, যেদিক থেকেই দেখা যাক না কেন আপনার তুলনা হয় না। বেশ, এমিলি তোমার প্রস্তাবে আমি রাজী, এখন থেকে সর্বান্তকরণে আমি তোমার সঙ্গে সহযোগিতা করব।

এবার তাহলে বাজে কথা বাদ দিয়ে বলো তো কোন দিক থেকে এগোবো? এমিলি জানতে চাইল।

আমি আজ বিকেলে সিটাফোর্ড যাচ্ছি, এন্ডারবি জানাল, তুমিও আমার সঙ্গে চলো না।

সেখানে কি আছে শুনি।

আছেন একজন,এন্ডারবি বলল, তার নাম মেজর বারনাবি, ক্যাপটেন ট্রেভিলিয়নের বহুদিনের পুরোনো বন্ধু। উনি ভীষণ সেকেলে রুচির লোক, খবরের কাগজের রিপোর্টার দেখলেই চটে যান। অথচ এই লোকই হালে আমাদের কাগজের একটা ফুটবলের খাবার সঠিক উত্তর পাঠিয়ে নগদ পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরষ্কার পেয়েছেন।

তাহলে আমি যাচ্ছি, এমিলি বলল, আমি কোথাও গেলে কখনও খালি হাতে ফিরে আসি না, কিছু না কিছু একটা ঠিকই জোগাড় করি।

থ্রি ক্রাউনস সরাইখানা থেকে বেরিয়ে পথ দেখিয়ে এমিলিকে পুরোনো দুর্গের কাছে নিয়ে এল এন্ডারবি, কিন্তু এমিলি দুর্গের ভেতরে ঢোকার কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর খুনের তদন্ত সম্পর্কে আলোচনায় মেতে উঠল তার সঙ্গে।

আসুন, খাঁটি গোয়েন্দার চোখ দিয়ে আমরা গোটা পরিস্থিতিটা বিচার করে দেখি, বলেই পকেট থেকে নোটবই আর পেনসিল বের করল এমিলি। তার পাতায় পাতায় লেখা নামগুলোয় চোখ বুলিয়ে সে বলতে লাগল :

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু হলে যারা লাভবান হবে তাদের মধ্যে আছেন–(১) আমার ভদ্রলোক, (২) ওর বোন সিলভিয়া আর ওদের মাসী জেনিফার গার্ডনার যাঁর স্বামী যুদ্ধ থেকে পঙ্গু হয়ে ফিরেছেন। সিলভিয়াকে নির্দোষ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, জীবনে একটা মাছিও মারে নি সে। কিন্তু তার লেখক স্বামীটি খুব সুবিধার লোক নন, মদ আর মেয়েমানুষ সংক্রান্ত যতরকম নোংরামি আছে তার কোনটিতেই তার অরুচি নেই। টাকার পিছনে ও দিনরাত পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। সিলভিয়া ওর মামার টাকাটা পেলে মার্টিন ঠিক সেটা হাতিয়ে নেবে, তারপর ওকে কিছু না জানিয়ে সরে যাবে ওর জীবন থেকে।

ভদ্রলোক তো খুবই রূপবান, এন্ডারবি বলল, মেয়েরা তো ওকে পুজো করে শুনেছি।

ভুল শুনেছেন, এমিলি বলল, যাদের স্বামী থেকেও নেই, সেইসব সোসাইটি লেডীরা মার্টিনের পেছন পেছন কুকুরের মত ঘুরে বেড়ান, তার সঙ্গে দুরাত কাটাতে পেলে ধন্য হয়ে যান। কিন্তু যাঁরা খাঁটি মানুষ তারা ওকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে।

হ্যাঁ, সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসাবে মার্টিনের নামও লেখা যায়, এন্ডারবি নোট নিতে নিতে বলল, লেখকের ছদ্মবেশে এক শয়তান হলেও হতে পারে। আচ্ছা, তুমি কি মনে করো ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর আসল খুনী এই অপরাধের যাবতীয় দায় জেমসের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে?

তুমি আর আমি দুজনে মিলে যদি আসল খুনীকে খুঁজে বের করতে পারি তাহলে চারিদিকে দারুণ হৈ-চৈ পড়ে যাবে,এন্ডারবি বলল, আমি তখন হয়ে যাব ডেইলি অয়্যার কাগজের অপরাধ বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এমিলি এসব ব্যাপার তো শুধু গল্প উপন্যাসেই ঘটে বলে জানি।

বোকার মতো কথা বোলো না। এমিলি চাপা ধমকের সুরে বলল, আমি যখন তোমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছি তখন এসব আমার বেলাতেও ঘটবে জেনে রেখো।

আচ্ছা, এন্ডারবি বলল, তোমার জেনিফার মাসীকে কি সন্দেহের আওতায় রাখা যায়?

জনিফার মাসী লোক হিসাবে খুবই ভাল কিন্তু তাহলেও তদন্তের স্বার্থে ওঁকেও সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন এক্সেটারে যা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এমনও হতে পারে যে জেনিফার মাসী ওঁর ভাইয়ের সঙ্গেও কোনও কারণে দেখা করতে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান হয়তো সেইসময় ওঁর ভগ্নীপতি অর্থাৎ জেনিফার মাসীর স্বামী ক্যাপ্টেন গার্ডনার সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেছিলেন যা শুনেই মাসী রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, হাতের কাছে ওই মোটা নলটা দেখতে পেয়ে তাই দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিলেন তার ভাইয়ের মাথায়।

বাঃ, চমৎকার অনুমান। এন্ডারবি তারিফ করার সুরে বলে উঠল, আর কাকে সন্দেহ করছো?

আমি কাউকেই বাদ দিচ্ছি না, এমিলি বলল, এমন কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনি কাম চাকর ইভানসকেও নয়। ইভানসের কাজকর্মে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান অবশ্যই চিরদিনই খুশি ছিলেন, উইলে তাকে বিশ্বস্ত বলে উল্লেখও করেছেন এবং তাকেও একশো পাউন্ড দেবার কথা উইলে লিখেছেন তিনি। থ্রি ক্রাউনস সরাইখানার মালিক মিসেস বিলিংয়ের বোনটিকে ইভানস হালে বিয়ে করেছে। মিসেস বিলিংয়ের পেট খুব আলগা, আমি দেখব ওঁর কাছ থেকে কিছু খবর বের করা যায় কিনা। যে পুলিশ কর্মচারীটি প্রথম ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল সেই কনস্টেবল গ্রেভসের ঘোট শ্যালিকাও ওই সরাইয়ে চাকরী করে, আমি ওকেও হাত করব দেখে নিয়ে। পুলিশ এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে কখন কোন পথে এগোচ্ছে সে সবই আমি ওর কাছ থেকে জানতে পারব। তবে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যাঁকে বাড়িভাড়া দিয়েছিলেন সেই মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেটকে আমার খুব অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে।

কেন? এন্ডারবি প্রশ্ন করল।

শীতকালের মাঝামাঝি নাগাদ বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, এমিলি বলল, এটা প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হল ওঁদের প্রেতচর্চার ব্যাপারটা, আচ্ছা তোমার নিজের কি এই ব্যাপারটাকে খুব জটিল ও রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে না?

সে তো হচ্ছেই, এন্ডারবি সায় দিয়ে বলে, তবে এ সম্পর্কে কাগজে কিছু লেখার আগে নিয়মিত প্রেতচর্চা করেন এমন কিছু বিশিষ্ট লোকের সঙ্গে আলোচনা করব, তাদের মতামত নেব।

আরে, তেমন লোক তো আমাদের হাতের কাছেই আছেন।

কে বল তো?

কেন? এন্ডারবি বলল, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, যিনি শার্লক হোমসের মতো এক গল্পের গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করে প্রচুর নাম যশ অর্জন করেছেন।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সঙ্গে প্রেত-চর্চার কি সম্পর্ক? এমিলি প্রশ্ন করল।

উনি নিজেই এক রহস্যময় মানুষ। এন্ডারবি বলল, গোয়েন্দা গল্প আর ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন, এখন বুড়োবয়সে ভূতপ্রেত আছে কি নেই তাই নিয়ে পড়াশোনা করছেন। বই পত্র পড়ছেন, পোভড়া বাড়িতে অর দুর্গে রাত কাটাচ্ছেন, যাকে বলে প্রেততাত্ত্বিক, গবেষণা। তবে এ সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

ভূতপ্রেতে আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই, এমিলি বলল, আর অলৌকিক ব্যাপার বলে কিছু আছে একটা আমি বিশ্বাস করি না। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন এই খবর সে এসে জানিয়ে গেল কিন্তু কে তার খুনী সে কথা চেপে গেল কেন? আসলে এসবের কোনও ভিত্তি নেই।

আমি একটা গাড়ি ভাড়া করেছি, এন্ডারবি বলল, আধঘণ্টার ভেতর আমরা দুজন তাতে চেপে পৌঁছে যাব সিটাফোর্ডে।

নাঃ, এবার দেখছি আমাকেই বলতে হচ্ছে চার্লস, তোমার জবাব নেই, এন্ডারবির ভাব আর ভঙ্গি অনুকরণ করে মন্তব্য করল এমিলি, যা দেখে এন্ডারবি না হেসে পারল না।

এবার তাহলে চলো, সরাইখানায় ফিরে যাই, এমিলি বলল, জামাকাপড় গুছিয়ে মিসেস বেলিংয়ের পেট থেকে দেখি কোনও খবর বের করতে পারি কিনা। পুলিশ জিমকে ধরে নিয়ে গেছে বলে আমার মন যে ভেঙ্গে গেছে তা বোঝাতে আমায় এবার নাকে কান্না কাঁদতে হবে।

.

১২.

থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে ফিরেই এমিলি দেখল বেলিং হলঘরের মাঝখানে এসে, দাঁড়িয়েছেন।

মিসেস বেলিং, এমিলি বলল, আজ বিকেলেই আমি রওনা হচ্ছি

আজ বিকেলেই? মিসেস বেলিং প্রশ্ন করলেন, তাহলে চারটে দশের ট্রেন ধরে এক্সেটারে যাচ্ছেন?

না, এমিলি জবাব দিল, আমি সিটাফোর্ড যাব। ভালকথা ওখানে আপনার চেনাশোনা এমন কেউ আছেন কি যাঁর কাছে ওঠা যায়?

সত্যি? মিসেস বেলিং প্রশ্ন করলেন, ইয়ে যদি কাউকে না বলেন তাহলে একটা খবর আপনাকে দেব মিস এমিলি।

আপনি নির্ভয়ে আমার কাছে মুখ খুলতে পারেন, এমিলি বলল, আমি ভুলেও কাউকে কিছু জানাব না।

মিঃ পিয়ার্সনকে চেনেন তো? মিসেস বেলিং গলা নামিয়ে বলে উঠলেন, পুলিশ ওঁকে গ্রেপ্তার করেছে।

সে কি? দুঃসংবাদ শুনে এমিলির বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, কবে গ্রেপ্তার হলেন?

এই তো আজই, মিসেস বেলিং জবাব দিলেন, মাত্র আধঘন্টা আগে।

আমার পক্ষে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, মিসেস বেলিং,বলতে গিয়ে এমিলির গলা ধরে এল, দুচোখের কোন বেয়ে জল গড়াতে লাগল, আপনি হয়তো জানেন না যে আমরা দুজনেই পরস্পরকে ভালবাসি, শীগগিরই আমরা বিয়ে করব বলেও স্থির করেছিলাম কিন্তু তার আগেই এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটল! হা ঈশ্বর! বিশ্বাস করুন মিসেস বেলিং এই জঘন্য অপরাধ ও করেনি, পুলিশ মিছিমিছি ওকে গ্রেপ্তার করেছে। এইটুকু বলে মিসেস বেলিংয়ের বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ঘটনা যখন ঘটেছে তখন শুধু কান্নাকাটি করে কোনও লাভ নেই বাছা,মিসেস বেলিং রুমালে এমিলির চোখের জল মোছাতে মোছাতে সহানুভূতির সুরে বললেন, তার চেয়ে এখন নিজেকে শক্ত করো। যে ভাবেই হোক, জিমকে বাঁচাতেই হবে।

তাহলে তো তোমায় সিটাফোর্ড-এ যেতে হবে, মিসেস বেলিং বললেন, ওখানে ভদ্রভাবে থাকার মতো জায়গা একটাই আছে তাহলে সিটাফোর্ড হাউস। ওই বাড়ির পাঁচ নম্বর মহলে থাকেন মিসেস কার্টিস, গরমের সময় উনি ঘরভাড়া দেন। কিন্তু অতদূর যাবে কিভাবে? গাড়িভাড়া করেছো?

না, এমিলি বলল, আমি মিঃ এন্ডারবির গাড়িতে চেপে যাব।

আর মিঃ এন্ডারবি নিজে কোথায় থাকবেন?

কেন, এমিলি জবাব দিল, মিঃ এন্ডারবি সম্পর্কে আমার খুড়তুতো ভাই, আমরা দুজনে মিসেস কার্টিসের মহলের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকব।

তাহলে তো খুবই ভাল হয়, মিসেস বেলিং বললেন, তাহলে আর দেরী না করে চোখেমুখে জল দিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয় নাও, আর হ্যাঁ, শোন বাছা, আমি নিজেও এখানে চোখ কান সবসময় খোলা রাখব, তেমন কোনও খবর পেলেই তোমায় জানাব, পুলিশ কিছু টের পাবার আগেই।

সত্যি ম্যাডাম, এতক্ষণ বাদে এমিলি খুশিভরা গলায় মন্তব্য করল, আপনার দয়ার তুলনা হয় না।

চা খেয়ে থাকা খাওয়ার বিল মিটিয়ে এমিলি বেরিয়ে এল থ্রি ক্রাউনস সরাই থেকে। মিঃ এন্ডারবি তার পুরনো ফোর্ড গাড়ি নিয়ে তৈরি হয়েছিল, এমিলিকে দেখতে পেয়েই সে পেছনের দরজা খুলে দিল।

একটা কথা, এমিলি বলল, আপনাকে কিন্তু আমি আমার খুড়তুতো ভাই বলে পরিচয় দিয়েছি তা ভুলে যাবেন না। এটা গ্রামাঞ্চল কিনা, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা অনেকেই এখানে ভাল চোখে দেখে না।

বাঃ চমৎকার! এন্ডারবি মন্তব্য করল, তাহলে আমি তোমাকে এমিলি বলে ডাকব, কেমন?

একশোবার, এমিলি ঘাড় নেড়ে মুচকি হাসল। আর তোমায় ডাকব চার্লস বলে।

এমিলির কথা শেষ হতেই এন্ডারবি গাড়িতে স্টার্ট দিল।

.

১৩.

সিটাফোর্ড পৌঁছে সিটাফোর্ড হাউস খুঁজে বের করতে এমিলির আর চার্লসের অসুবিধে হল না, যথাসময়ে মিসেস কার্টিসের কাছে তাদের দুজনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। মিসেস কার্টিস এমিলি আর চার্লসের আতিথ্যের ত্রুটি করল না, গোড়াতেই নিজের হাতে চা তৈরি করে খাওয়ালেন তাদের, আর সেই ফাঁকে তাঁর মুখ থেকে সিটাফোর্ড হাউসের বাসিন্দাদের নাম, ধাম, পেশা সবকিছুই কৌশলে জেনে নিল এমিলি। চা পর্ব শেষ হলে চার্লস এমিলিকে সঙ্গে নিয়ে মেজর বারনাবির কটেজের দিকে রওনা দিল। ঘটনাচক্রে তখনই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এসে হাজির হলেন সিটাফোর্ড হাউসে, সোজা মিসেস উইলেটের সঙ্গে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলেন তিনি, কথা প্রসঙ্গে জানালেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের ব্যাপারে তিনি তাদের কিছু প্রশ্ন করবেন। মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেটও সেইসময় বসেছিলেন তার মায়ের গা ঘেঁষে।

আপনি কি জানতে চান বলুন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মিসেস উইলেট বললেন, আমি যতদূর সম্ভব সঠিক উত্তর দিয়ে সাহায্য করব আপনাকে। হয়তো এই বাড়িতে এমন কোনও সূত্র থাকতে পারে যা এই খুনের তদন্তে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু তেমন কিছু আদৌ আছে কিনা সে বিষয়ে আমার খুব সন্দেহ আছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তাঁর ব্যক্তিগত যা কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র ছিল সব এ বাড়ি থেকে অনেক আগেই সরিয়ে ফেলেছিলেন, এমনকি ওঁর মাছ ধরার ছিপখানা পর্যন্ত। হয়তো উনি ধরেই নিয়েছিলেন যে ভাড়াটে হিসাবে ওঁর এইসব সৌখীন জিনিসের কোনরকম যত্ন আমি করব না তাই।

তার মানে ওঁর সঙ্গে আপনার আগে থাকতে পরিচয় হয়নি?ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

না, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আমি এই বাড়ি ভাড়া নেবার পরে কতবার চিঠি লিখে ওঁকে আসবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি, এমন কি ডিনারের নেমন্তন্ন পর্যন্ত করেছি, কিন্তু উনি একবারও আসেন নি। আসলে উনি যে ভীষণ লাজুক আর মুখ চোরা লোক ছিলেন তাতে আমার এতটুকু সন্দেহ নেই। অথচ দুঃখের ব্যাপার হল অনেকেই এই স্বভাবের জন্য ওঁকে নারীবিদ্বেষী বলতো।

দেখুন ম্যাডাম, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমি যতদূর জেনেছি ক্যাপ্টেন ট্টেভিলিয়ানের মৃতদেহ সবার আগে আবিষ্কার করেন ওঁর পুরোনো বন্ধু মেজর বারনাবি আর এও জেনেছি যে তার আগে এখানে প্রেতচর্চার অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছিলেন।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভায়োলেটের গলার ভেতর থেকে ক্ষীণ আর্তনাদের মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এল।

বেচারী ভায়োলেট! মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিসেস উইলেট মন্তব্য করলেন এই ঘটনা ঘটবার ফলে ও মানসিক দিক থেকে ভয়ানক ভেঙ্গে পড়েছে। অবশ্য শুধু ও একা নয়, আমাদের সবারই একই অবস্থা। আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই, কিন্তু তাহলেও ব্যাপারটা অলৌকিকভাবে আমার চোখের সামনে ঘটেছিল।

সত্যি বলছেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

নিশ্চয়ই। মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, যদিও গোড়ায় আমরা ব্যপারটাকে নিছক মজা বলেই ধরে নিয়েছিলাম। রোনাল্ড গারফিল্ড নামে এক তরুণ সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা গোড়ায় তাকেও সন্দেহ করেছিলাম, ভেবেছিলাম এটি ওঁরই কাজ।

তাহলে গোড়ায় যা নিছক মজা বলে মনে হয়েছিল তাই এখন আপনার কাছে এক অলৌকিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই না?ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, সাধারণ ভাবে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না?

ঠিক ধরেছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, আমি এখন নিশ্চিত যে যেদিন আমাদের এই প্রেতচক্রের অনুষ্ঠানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন বলে যে খবর আমরা পেয়েছিলাম তা নিশ্চয়ই কোনও অশরীরী প্রেতাত্মা আমাদের জানিয়েছিল।

তাই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন, আচ্ছা দক্ষিণ আফ্রিকার কোন অংশে আপনারা থাকতেন?

আমরা কেপ টাউনে থাকতাম, ইন্সপেক্টর, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, আমার মেয়ে আগে কখনও ইংল্যান্ডে আসেনি, তাই এখানে এসে তুষারপাত দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেছে।

তা অন্যান্য জায়গা থাকতে আপনি বেছে বেছে এই এলাকায় এলেন কেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

আমরা ডিভনশায়ার বিশেষতঃ ডার্টমুর সম্পর্কে প্রচুর বই পড়েছি, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, জাহাজেও এই জায়গার ওপর গাদা গাদা বই পড়েছি আর তার ফলেই আগ্রহ বেড়েছে।

কিন্তু তাই বলে এক্সহ্যাম্পটনে? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আবার প্রশ্ন করলেন, এতো একেবারে অজপাড়াগাঁ, অনেকেই এর নাম শোনে নি।

আগেই তো আপনাকে বললাম ইন্সপেক্টর যে এই এলাকা সম্পর্কে প্রচুর বইপত্র আমরা পড়েছি। তাছাড়া এখানে আসার পথে জাহাজে একজন যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, এক্সহ্যাম্পটন সম্পর্কে তার মুখেও অনেক প্রশংসা শুনেছি।

তরুণ যুবক? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন, তা ছেলেটির নাম কি বলুন তো?

ভুরু কুঁচকে মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, কি যেন ওর নাম, বুলেস না স্মাইথ, তা ঠিক মনে পড়ছে না।

তারপরেই আপনার এই জায়গাটা ভাল লেগে গেল আর আপনি বাড়ির দালালদের ধরে ধরে চিঠি লিখতে লাগলেন যাতে এখানে আপনার পছন্দমত একটা বাড়ি তারা যোগাড় করে দেন, তাই না?

হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর, মিসেস উইলেট ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, আপনি যা বললেন ঘটনাটা ঠিক তাই ঘটেছিল।

ভদ্রমহিলা নিজেকে খুব চালাক ভাবেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজের মনেই মন্তব্য করলেন, আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন ভায়োলেটের দুচোখ আগুনের মতো জ্বলছে। গোটা বাড়িখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তল্লাসী করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, কিন্তু এমন কিছুই তার হাতে এল না যা তদন্তের কাজে সাহায্য করতে পারে। তল্লাসী সেরে ফিরে এসে আবার মিসেস উইলেটের মুখোমুখি কৌচে বসলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আর তখনই ভায়োলেটের দুচোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি।

এ কিরকম ব্যাপার? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের সঙ্গে সত্যিই, যদি ওদের কোনও সম্পর্ক না থাকে তাহলে ভায়োলেট মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে কেন? পেট থেকে কথা বের করার উদ্দেশ্যে একটা তীর ছুঁড়ে দিলেন তিনি ভায়োলেটের দিকে।

আচ্ছা ভায়োলেট, তুমি তো পিয়ার্সনকে ভালভাবেই চেনো, নাই না?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ভায়োলেটের দুচোখ হঠাৎ কপালে উঠল। দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে কৌচ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝের কার্পেটের ওপর।

বেচারী ভায়োলেট! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস উইলেট মন্তব্য করলেন, ওর দেহ মন দুদিক থেকেই বড্ড দুর্বল। প্রথমে এই প্রেতচক্র, তারপরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রহস্যময় মৃত্যু, এসব ঘটনা ওর স্নায়ুর ওপর প্রভাব ফেলেছে, তাই মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, ইন্সপেক্টর।

ধন্যবাদ ম্যাডাম, কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জবাব দিলেন, আমার যেটুকু জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। আজকের মতো আমি বিদায় নিচ্ছি।

কথা শেষ করে তিনি আর একটি মুহূর্ত দাঁড়ালেন না, সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন নিচে।

.

১৪.

দেখুন না মেজর বারনাবি, এমিলির গলায় অসহায় ভাব ফুটে বেরোল, জিম পিয়ার্সনের সঙ্গে আমার বিয়ের সব ঠিকঠাক, এদিকে মাঝখান থেকে পুলিশ খামোকা ওকে খুনী সন্দেহে গ্রেপ্তার করল। এখন আমি কি করি বলুন তো?

সত্যিই তো, মেজর বারনাবি সায় দিয়ে বললেন, এতো রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। বিশ্বাস করো এমিলি, তোমায় সমবেদনা জানাবার ভাষা এই মুহূর্তে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। বলতে বাধা নেই, আমি একেবারের জন্যও জিম পিয়ার্সনকে সন্দেহজনক বলে মনে করছি না।

পুলিশ না মানলেও আপনি যে জিমকে নির্দোষ হিসাবে মনে করেন তাতেই আমি কৃতজ্ঞ বোধ করছি মেজর। এমিলি মন্তব্য করল, আচ্ছা আপনার কি ধারণা জানতে পারি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনী কে হতে পারে?

দেখুন ম্যাডাম, মেজর বারনাবি বললেন, আমার ধারণা বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢুকে ওঁকে খুন করেছে কিন্তু পুলিশ তা মানতে রাজী নয়। তবে যে যাই বলুক না কেন এটা ঠিক যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কোনও শত্রু ছিল না।

আচ্ছা, উনি যাদের বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন সেই মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে মানুষ হিসাবে কেমন? এমিলি প্রশ্ন করল।

ওঁরা তো খুব ভাল লোক বলেই শুনেছি, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, যেমন দয়ালু তেমনি পরোপকারী।

তবু এতো জায়গা থাকতে ওঁরা হঠাৎ সিটাফোর্ডের মতো এক অজ পাড়াগেঁয়ে এসে হাজির হলেন কেন?

দেখুন ম্যাডাম, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি একবারের জন্যও মাথা ঘামাইনি, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন।

ধন্যবাদ মেজর, এন্ডারবি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আজকের মতো আমরা বিদায় নিচ্ছি, কিন্তু আগামীকাল সকালে আমি ক্যামেরা নিয়ে আবার এসে হাজির হব, আপনার একটা ফটো তুলব, তাছাড়া এক সাক্ষাৎকারও নেব।

বেশ তো, নেবেন। বলে মেজর বারনাবি হাত তুলে তাদের দুজনকেই বিদায় জানালেন।

ফিরে এসে মুখোমুখি বসল এমিলি আর এন্ডারবি, মাথার টুপিটা খুলে খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এমিলি বলল, চার্লস, মিসেস উইলেট যে প্রেতচর্চার অনুষ্ঠান করেছিলেন তার নাম টেবল টার্নিং। প্রেতচর্চা বলে উল্লেখ করা হলেও এটা আসলে এক ধরনের খেলা যেখানে মানসিক চিন্তাতরঙ্গ হাতের সূক্ষ্ম পেশীগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে আর তারই ফলে টেবলের পায়া ওঠানামা করে, এর মধ্যে ভূতপ্রেতের কোনও ব্যাপার নেই।

হ্যাঁ, এন্ডারবি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলে, ছাত্রজীবনে হোস্টেলে থাকতে এই খেলা আমিও বহুবার খেলেছি। ব্যাপারটা যে পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক সেদিক থেকে আমি নিজেও তোমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত।

এখন দেখতে হবে সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, এমিলি বলল, আর সবাইকে বাদ দিলেও মেজর বারনাবি আর মিঃ রাইক্রফটের নাম কেন কে জানে বারবার আমার মনে ওঠাপড়া করছে। ওঁদের দুজনের মধ্যে একজন যদি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করে থাকেন তবে তা মোটেই অস্বাভাবিক হবে না। এছাড়া ছিলেন, মিঃ ডিউক যার সম্পর্কে এখনও আমরা কিছুই জানি না। এছাড়া মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেট দুজনেই আমার কাছে রহস্যময় চরিত্র।

কিন্তু ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার পেছনে তাদের কি স্বার্থ থাকতে পারে? এমিলি প্রশ্ন করল।

বাইরে থেকে দেখলে কোনও স্বার্থ নেই বলেই মনে হয় বটে। এন্ডারবি উত্তর দিল, কিন্তু আমার ধারণা কোথাও নিশ্চয়ই কোনও একটা যোগসূত্র রয়েছে। সেটা কি তাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

এমিলি কিছু মন্তব্য করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কাছে কোথায় গম্ভীর এক ঘন্টাধ্বনী হল, সেই আওয়াজ অনেকক্ষণ পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হল।

আওয়াজটা শুনলে? বলতে বলতে মিসেস কার্টিস একতলা থেকে দ্রুতপায়ে ওপরে

ঠে এলেন।, এমিলি বলল,লরে প্রিন্সট

শুনলাম, এমিলি বলল, কিন্তু ওটা কিসের ঘণ্টা ম্যাডাম?

এখান থেকে বারো মাইল দূরে প্রিন্সটাউনে জেলের পাগলাঘন্টার আওয়াজ এটা। মিসেস কার্টিস বললেন, এর অর্থ হল জেলখানা থেকে একটু আগে কোনও কয়েদী পালিয়েছে। এইটুকু বলে মিসেস কার্টিস আর দাঁড়ালেন না, আগের মতোই দ্রুতপায়ে আবার নিচে নেমে গেলেন তিনি।

ইস, এন্ডারবি বলল, সময়মতো সবকিছু ঘটে না, এটাই দুঃখের ব্যাপার। গত শুক্রবার দিন যদি এই কয়েদীটা পালাতো তাহলেই সহজেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনীকে ধরতে পুলিশের নিশ্চয়ই এতটুকু অসুবিধা হতো না।

হয়তো তাই, সায় দিয়ে বলল এমিলি।

তা না করে ব্যাটা তিনদিন পরে পালাল, এন্ডারবি বলল, যখন সবকিছু পুরো জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এমিলি এবারে আর কোনও মন্তব্য করল না।

১৫. সিটাফোর্ড হাউসের সামনে

১৫.

পরদিন সকালবেলায় সিটাফোর্ড হাউসের সামনে পায়চারী করছিল এমিলি, সেখানেই মিঃ রাইক্রফটের সঙ্গে তার আলাপ হল। কথাপ্রসঙ্গে মিঃ রাইক্রফট জানালেন যে পক্ষীতত্ব আর অপরাধতত্ত্ব এই দুটি বিষয়ে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বড় ভাগ্নে জিম পিয়ার্সনকে পুলিশ ওঁর খুনী সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছে, মিঃ রাইক্রফট বলেন, আমার ধারণা ও পুরোপুরি নির্দোষ।

কিন্তু পিয়ার্সনের গতিবিধি বা কার্যকলাপ সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? এমিলি প্রশ্ন করল।

এককথায় বলতে গেলে কিছুই জানি না, মিঃ রাইক্রফট উত্তর দিলেন, তবে আপনার মতো সুন্দরী যুবতীর যিনি প্রণয়ী তিনি কি আর সত্যিই হত্যাকারী মানসিকতাসম্পন্ন লোক হবেন? সেদিন ঘটনা যা ঘটেছিল আমার মতে তা এরকম : জিমের হয়তো হঠাৎ কিছু বেশি টাকার দরকার পড়েছিল আর মামার কাছে এসে সে ওই টাকাটা চেয়েছিল। কিন্তু জিমের মামা অর্থাৎ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওই টাকা তাকে দিতে রাজী হননি। টাকাটা না পেয়ে জিম নিশ্চয়ই খুব রেগে যায় আর তখনই হাতের কাছে পড়ে থাকা ধাতুর হাতলটা তুলে নিয়ে সে তার মামার মাথায় আঘাত করে সাজোরে। এক আঘাতেই নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান মারা গিয়েছিলেন। সেদিন থেকে এটাই বলা যায় যে মামাকে খুন করার কোনও পরিকল্পনা সেদিন জিমের ছিল না। আবার এমনও হতে পারে যে জিম আদৌ রাগের মাথায় সেদিন তার মামাকে খুন করেনি, টাকা না পেয়ে শুধু ঝগড়াঝাটি করে সে ওইদিন বেরিয়ে এসেছিল তাঁর বাড়ি থেকে। তারপর অন্য কোনও পেশাদার খুনী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ভেতরে কোনও গতিকে ঢুকে পড়েছিল যার হাতে তিনি খুন হন। এই দ্বিতীয় ধারণাটির ওপরেই আমি জোর দিচ্ছি। তাহলে এটাও ধরে নিতে হয় যে মামা ভাগ্নের মধ্যে টাকাকড়ি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে তা আড়ালে দাঁড়িয়ে আসল অপরাধী শুনে ফেলেছিল। এও হতে পারে যে সেই অপরাধী বহুদিন ধরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার সুযোগ খুঁজছিল, ওইদিন মামা ভাগ্নের ওই ঝগড়া, সে সুযোগ এনে তুলে দিয়েছিল তার হাতে।

আপনার এই ধারণা যদি সত্যি হয়, বলে কথা শেষ না করে মাঝপথে থেমে গেল এমিলি।

-হ্যাঁ, আমার এই ধারণা সত্যি হলে এটাই প্রতিপন্ন হবে যে আসল অপরাধী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুবই ঘনিষ্ট ছিল এবং এটাও ধরে নিতে হবে যে সে এই এক্সহ্যাম্পটনের বাসিন্দা। এই প্রসঙ্গে যার নাম আমার মনে আসছে সে হল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনি ইভানস। হয়তো ঘটনার সময় ইভানস বাড়ির ভেতরেই ছিল আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে তার বড় ভাগ্নে জিমের ঝগড়াও সে শুনতে পেয়েছিল। এখন দেখতে হবে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান মারা গেলে ইভানসের কোনওভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা আছে কিনা?

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ইভানসের নামে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল, এমিলি মন্তব্য করল।

পর্যাপ্ত মোটিভ খাড়া করার পরে এই যুক্তি যথেষ্ট নয়, মিঃ রাইক্রফট বললেন, আমাদের জানতে হবে মাঝখানে ইভানসের হঠাৎ বেশি টাকার দরকার পড়েছিল কিনা। এছাড়া মিসেস ইভানসকেও বাদ দিলে চলবে না। এমনও হতে পারে যে তার নিজেরই হঠাৎ টাকার দরকার পড়েছিল আর স্ত্রীকে খুশি করতে গিয়েই ইভানস এই কান্ডটি ঘটিয়েছে। এটা গ্রাম দেশ মিস ট্রেফুসিস, এখানে বিচিত্ররূপিনী নারী অনেক দেখতে পাবেন আপনি। কিন্তু জানবেন, মিসেস ইভানসকে কিছুতেই সন্দেহের আওতার বাইরে রাখা যাবে না।

আচ্ছা মিঃ রাইক্রফট, এমিলি প্রশ্ন করল, প্রেতচর্চার নামে আপনারা সেদিন যে টেবলটার্নিং-এর খেলায় মেতেছিলেন সে সম্পর্কে আপনার নিজের কি অভিমত?

মিস ট্রেফুসিস, মিঃ রাইক্রফট জবাব দিলেন, আমি অলৌকিকে বিশ্বাসী তা জেনে রাখবেন। সেদিনের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ আমি পরামনোবিদ্যা গবেষণা সমিতিতে লিখে পাঠিয়েছি। সত্যিই কি অদ্ভুত ঘটনা, পাঁচজন লোক বসে প্রেতচর্চা করছে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুন হবার ঘটনা যারা কেউ জানে না, কিন্তু সে খবর অলৌকিক ভাবে তাদের কাছে পৌঁছে গেল এক প্ৰেতলোক-এর এক অজানা বাসিন্দার মাধ্যমে।

মিঃ গারফিল্ড লোকটি কেমন? এমিলি প্রশ্ন করল।

ভাল ছেলে, মিঃ রাইক্রফট বললেন, কিন্তু তার মধ্যে কোনরকম কৈফিয়ৎ আমার চোখে পড়েনি।

মিসেস উইলেট আর তার মেয়েকে আপনার কিরকম মনে হয়?

ওঁরা দুজনেই খুব মিশুকে, মিঃ রাইক্রফট বললেন, যদিও কিছুটা সেকেলের ধাঁচে। ওঁদের হাতে পয়সাকড়ি আছে বিস্তর তেমনি ওঁরা খুবই অতিথিপরায়ণ।

এতো জায়গা থাকতে শীতকালে ওঁরা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এখানে এসে হাজির। হলেন কেন?

আপনার প্রশ্নটা অসঙ্গত নয়, মিস ট্রেফুসিস, মিঃ রাইক্রফট বললেন, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রচণ্ড গরম ওঁদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল তাই শীতের সময় তুষারপাতের মধ্যে কাটানোর লোভে ওঁরা মা মেয়ে এসে হাজির হয়েছেন এখানে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে চালুপথ বেয়ে নেমে এল। সামনে একসারি সুদৃশ্য ছোট কটেজ, তার একটির দিকে ইশারা করে এমিলি প্রশ্ন করল, এখানে কে থাকেন?

ক্যাপ্টেন উইয়াট, মিঃ রাইক্রফট বললেন, ভদ্রলোক গত যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছেন। হাঁটাচলা করতে পারেন না।

উনি কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বন্ধু ছিলেন? এমিলি জানতে চাইল।

বন্ধু নয়, মিঃ রাইক্রফট বললেন, পরিচিত ছিলেন বলা যায়, দুজনের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না, উইয়াট মোটেই মিশুকে নন তবু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান এদিকে এলে ওঁর সঙ্গে দেখা করতেন।

আরও কিছুক্ষণ যাবার পর মিঃ রাইক্রফট এমিলিকে তার নিজের কটেজে নিয়ে এলেন। বসার ঘরের সবকটি আলমারী বইয়ে ঠাসা, তাদের মধ্যে পক্ষীতত্ত্বের চাইতে আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের বই-ই সংখ্যায় বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিচার ও তদন্ত কাহিনীর কয়েকটি সংকলন তার চোখে পড়ল।

বাঃ বেশ সুন্দর তো আপনার কটেজটা, এমিলি মন্তব্য করল, কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে তাই এবার আমায় ফিরতে হবে।

.

১৬.

ব্রেকফাস্ট খাবার অল্প কিছুক্ষণ বাদেই রণি গারফিল্ড এসে হাজির হল মিসেস কার্টিসের বাড়িতে, এমিলির সঙ্গে একরকম যেতেই আলাপ করল সে। রণি গারফিল্ড এমিলিকে নিয়ে এল তার মাসী মিস পার্সিহাউসের কাছে যার নাম এমিলি এর আগেই শুনেছিল মিসেস কার্টিসের কাছে।

তাহলে তুমিই সেই মেয়ে যার সঙ্গে কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর বড় ভাগ্নে জিমের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে? কোনও ভূমিকা না করেই মিস পার্সিহাউস এমিলির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তোমার কথা মিসেস কার্টিস আগেই আমায় বলে রেখেছেন। জিম যে পুরো নির্দোষ তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই জেনো। আর এটাও জেনো যে পুলিশ ওকে ঠিকই ছেড়ে দেবে। যা তুমি নিজে এই খুনের তদন্ত করবে শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি, আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করব তোমায়। বল, কি করতে পারি তোমার জন্য?

রণি গারফিল্ড কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে মিস পার্সিহাউস বলে উঠলেন, উঁহু, গুরুজনদের কথার মাঝখানে একদম কথা বলবে না বাছা, আর কোনদিন যেন এটা তোমায় করতে না দেখি। তাছাড়া তুমি পুরুষ মানুষ, আমাদের মেয়েদের কথার মধ্যে থাকা তো তোমার কোনও দরকার নেই। বাগানের শেষে দুটো চেয়ার আর একটা বেঞ্চ পড়ে আছ, তুমি বরং ওগুলো রং করে ফ্যালো, রংয়ের টিন আর বুরুশ ওখানেই পাবে।

তাই যাচ্ছি মাসী, বলে বাধ্য ছেলের মতো রণি গারফিল্ড দ্রুতপায়ে এগোলো বাগানের দিকে। তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল এমিলি তারপর মুখ তুলে বলল, ম্যাডাম আমি পরপর কয়েকজন স্থানীয় লোকের নাম বলে যাচ্ছি, আপনি দয়া করে আমায় বলুন এরা কে কেমন লোক। প্রথম লোকটি হলেন মেজর বারনাবি।

গোড়াতেই এই হতচ্ছাড়ার নাম করলে? মিস পার্সিহাউস জবাব দিলেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের লোক, স্কুলের গন্ডী পেরোনোর পরেই রোজগারের দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঢুকে গিয়েছিল মিলিটারীতে। গত মহাযুদ্ধে বিদেশে গিয়েছিল, লড়াই করে অনেক মেডেলও পেয়েছিল, কিন্তু হলে কি হবে, অবসর নেবার পরে স্বভাবটা ভয়ানক হিংসুটে আর কুচুটে হয়ে পড়েছে। সবসময় শুধু নিজের কথাই ভাবছে, কারও ভাল দুচোখে সইতে পারে না। যেমন খিটখিটে ওঁর স্বভাব তেমনি নিচু ওঁর মন, যেখানে স্বার্থের গন্ধ নেই সেখানে ওঁকে কখনও দেখতে পাবে না।

মিঃ রাইক্রফট?

উনি হলেন সেই ধাঁচের লোক যাঁরা চান লোকে সবসময় তাদের মাথায় তুলে নাচানাচি করুক। দুনিয়ার এমন কোনও গোয়েন্দা গল্পের বই নেই যা তুমি ওঁর কাছে পাবে না, আর সেগুলো দিনরাত পড়ে ওঁর ধারণা হয়েছে গোয়েন্দাগিরির সবটুকু ওঁর জানা হয়ে গেছে। ওঁকে খুব বেশি পাত্তা দিয়ো না।

মিঃ ডিউক?

উনি খুব সাধারণ আর সাদাসিধে ধাঁচের লোক যার মধ্যে কোনরকম বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু তাহলেও আমার অনেক সময় মনে হয় ওঁর মধ্যে অদ্ভুত কোনও সত্ত্বা লুকিয়ে আছে। অথচ সেটা কি তা আজ পর্যন্ত আমার জানা হয়ে ওঠেনি।

মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেট?

ভাল লোকের নাম করেছ, মিস পার্সিহাউস পাশের টেবলে রাখা একটা খাম তুলে নিলেন, তার ভেতর থেকে একটা লেবেল টেনে বের করে বললেন, এ হল এমনই একটা লেবেল যা ট্রেনে, জাহাজে বা প্লেনে চড়ে বেড়ানোর সময় যাত্রীরা তাদের মালপত্রে এঁটে রাখে, এতে তাদের নামধাম, গন্তব্যস্থল, সবকিছু লেখা থাকে। মিসেস উইলেট আর ওঁর মেয়ে এখানে এসে পৌঁছোনোর পরে গাড়িতে চেপে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই গিয়েছিলেন আর ঠিক তখনই ওঁর কোনও বাক্সের গায়ে সেঁটে থাকা এই লেবেলটা খসে বাতাসে উড়ে এসে পড়েছিল আমার বাড়ির সামনে। রণি ওটা কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। রণির মুখ থেকে শুনেছিলাম ওঁরা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন যে ওঁরা দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেন। সে সময়কার গরম সইতে না পেরে শীতকালটা ইংল্যান্ডের অজ পাড়াগাঁয়ে তুষারপাতের মধ্যে কাটাবেন বলে এসেছেন। অথচ মজার ব্যাপার হল এই লেবেলের গায়ে যে হোটেলের নাম ঠিকানা লেখা আছে সেটা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অবস্থিত। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে একটাই, তা হল–দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, ওঁরা আসলে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। প্রশ্ন হল, অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন অথচ তা চেপে গিয়ে বারবার ওঁরা কেন বলছেন যে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছেন?

ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময় তাতে সন্দেহ নেই, এমিলি বলল, তাছাড়া শুধু গরমের হাত থেকে বাঁচতে শীতকালটা ইংল্যান্ডের এক অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বাড়ি ভাড়া নেয়, এটাও আমার চোখে ঠিক স্বাভাবিক ঠেকছে না।

আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত,মিস পার্সিহাউস বললেন, তুমি কি ওঁদের সঙ্গে দেখা করেছো?

না, এমিলি বলল, তবে ভাবছি আজ একবার যাব, মুশকিল হচ্ছে কেন এসেছি তা কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না।

আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ এটা কোনও সমস্যাই হবে না। বলেই মিস পার্সিহাউস গল্প চড়িয়ে তার বোনপো রণিকে ডাকলেন।

কি ব্যাপার মাসী, সবুজ রং মাখা বুরুশ হাতে নিয়ই রণি বাগান থেকে দৌড়ে এল, এত হাঁকডাক করছ কেন, কি হয়েছে?

শোন বাছা, মিস পার্সিহাউস রণির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, গতকাল বিকেলে উইলেটদের বাড়িতে চা খেতে গিয়েছিলে মনে পড়ছে?

পড়ছে মাসী, রণি ঘাড় নেড়ে জবাব দিল। কিন্তু কেন বলতো?

চায়ের সঙ্গে কি খাবার ওখানে খেয়েছিলে তা মনে আছে?

আছে মাসী, রণি বলল, একটা নতুন ধরনের কেক মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট আমায় খাইয়েছিল, নাম বলেছিল কফি কেক। বলেছিল ও নিজের হাতে ওই কেক বাড়িতে তৈরি করেছে।

বাঃ, মিসেস পার্সিহাউস এমিলির দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন, এই তো খুব ভালো অজুহাত পাওয়া গেছে, আর তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই। একটুকরো কাগজে তিনি মিসেস উইলেটের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখলেন যা তার দূর সম্পর্কের বোনঝি এমিলিকে পাঠাচ্ছেন, মিসেস উইলেট যেন কফি কেক তৈরী করার পদ্ধতি লিখে তার হাতে দেন। চিঠির নিচে নিজের নাম সই করলেন তিনি ক্যারোলিন পার্সিহাউস হিসাবে। চিঠিখানা খামে পুরে এমিলির হাতে দিলেন তিনি তারপর বললেন, কই, আমার বোনগো রণির সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তো করলে না বাছা। অথচ এই ঘটনার দিন কিন্তু উইলেট ওখানে উপস্থিত ছিল। শোনো এমিলি, আমার রণি এমনিতে ছেলে হিসাবে খুবই ভাল কিন্তু মানসিক দিক থেকে ও ভয়ানক দুর্বল। দুঃখের সঙ্গে বলছি টাকার জন্য এমন কোনও কাজ নেই যা করতে ওর বাধে। এতোবড় হয়েছে অথচ বুদ্ধি শুদ্ধি এখনও হয়নি।

এমিলি কোনও মন্তব্য না করে চুপ করে রইল। মিস পার্সিহাউস বলতে লাগলেন, আরও একজন বাকি আছেন তিনি হলেন ক্যাপ্টেন উইলেট। বেচারা যুদ্ধে গিয়ে পঙ্গু হয়েছেন, এখন ও দিনরাত বাড়িতে বসে থাকেন আর আফিমের নেশা করেন। ওইরকম একটি মস্তিষ্ক আর বদমেজাজী হাড়হাভাতে লোক তুমি ইংল্যান্ডে আর দুটি পাবে না। বলো, আর কি জানতে চাও?

আর কিছু আপাততঃ আমার জানা নেই, ম্যাডাম, এমিলি বলল, যেটুকু বলেছেন তা এখনকার মতো যথেষ্ট।

.

১৭.

মিস পার্সিহাউসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিটাফোর্ড হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এমিলি, এমন সময় পেছন থেকে হেঁড়েগলায় কে যেন বলে উঠল দাঁড়ান তো। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল এমিলি, পেছন ফিরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল মাঝবয়সী একটি লোক কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটির গায়ের রং গাড় তামাটে। মাথার চুল ধপধপে সাদা। লোকটির একটি পা নেই আর দৈহিক ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি কাঠের ক্রাচে ভর দিয়ে আছেন তিনি।

এই লোকটিই যে ক্যাপ্টেন উইয়াট সে সম্পকের এমিলির মনে কোনো সন্দেহই রইল না।

মাপ করবেন, মাঝবয়সী সেই অচেনা লোকটি বললেন, এপথে কিছুক্ষণ আগে একটা মাদী বুল টেরিয়ারকে যেতে দেখেছেন?

না এমিলি বলল, পথের মাঝখানে কোনও কুকুর, বেড়াল আমার চোখে পড়েনি, একটু থেকে এমিলি জানতে চাইল, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই বহুদিনের পরিচয় ছিল? এমিলি বেশ বুঝতে পারল যে এই মুহূর্তে গোটা সিটাফোর্ড গ্রামে এক দর্শনীয় মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এই ক্যাপ্টেন উইয়াট নিজেও যেচে তার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিলেন, কুকুরের প্রসঙ্গটা একটা ছুতো মাত্র।

তেমন ঘনিষ্ঠতা আমাদের মধ্যে ছিল না, ক্যাপ্টেন উইয়াট বললেন, এই কটেজটা উনি আমায় বিক্রী করেছিলেন। আমি নিজে ভীষণ খিটখিটে মেজাজের লোক, ওঁকে কখনোই বরদাস্ত করেতে পারতাম না। এসব গ্রাম্য জায়গায় একা সময় কাটানো অভ্যেস করতে হয়, কিন্তু কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তা জেনেও যখন তখন এসে হাজির হতেন, আমি পছন্দ করছি না বুঝেও বসে থাকতেন আর নিজের মনে এন্তার বকবক করতেন। কথা শেষ করে কটেজের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় হাক দিলেন ক্যাপ্টেন উইয়াট, আবদুল!

সঙ্গে সঙ্গে কটেজের ভেতর থেকে একজন কালো চামড়ার লোক বেরিয়ে এল, তার গায়ের রং আর মাথার পাগড়ী দেখে এমিলি বুঝতে পারল যে লোকটি জাতে ভারতীয়।

আমি মিলিটারীতে থাকার সময় শেষ লড়াই লড়েছিলাম ইন্ডিয়ায়। কাপ্টেন উইয়াট আবদুলকে দেখিয়ে বললেন, ওই খানেই বর্মার যুদ্ধে আমার বাঁ পা বাদ যায়। আবদুল সেখানে আমার আদালী ছিল। খুব বিশ্বস্ত লোক, যুদ্ধ শেষ হবার পরেও ও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি। এসব জায়গায় এইরকম চাকরবাকরই আমার পছন্দ। ছিঃ ছিঃ আপনাকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। দয়া করে আমার কটেজে একবার আসুন, আমার সঙ্গে এককাপ চা অন্ততঃ খান।

ধন্যবাদ, এমিলি মুচকি হাসল, আজ আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না, আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

এখনকার দিনের হালচালই অন্যরকম।ক্যাপ্টেন উইয়াট নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বললেন, এই ট্রেন ধরা, এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখা, সব যেন অত্যন্ত যাচ্ছেতাই।

এমিলি কোনও মন্তব্য করল না, হাত নেড়ে সংক্ষেপে বিদায় জানিয়ে সে আবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

একসময় হাঁটতে হাঁটতে সিটাফোর্ড হাউসের সামনে এসে পৌঁছল এমিলি। কলিংবেলের দড়ি ধরে টানার মিনিটখানেকের ভেতর একজন যুবতী পরিচারিকা দরজা খুলে দাঁড়াল তার সামনে। এমিলি কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সেই পরিচারিকা চটপটে ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলে উঠল, মাফ করবেন, মিসেস উইলেট মানসিক দিক থেকে ভয়ানক ক্লান্ত, আজ ওঁর পক্ষে কোনও খবরের কাগজের রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হবে না।

এমিলি বুঝতে পারল মেয়েটি তাকে রিপোর্টার ঠাউরেছে। অন্যদিকে খবরের কাগজের রিপোর্টারেরা যে ইতিমধ্যেই এ বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেছে সে বিষয়েও নিঃসন্দেহ হল সে।

তুমি ভুল করছ, গলা সামান্য চড়িয়ে এমিলি বলল। আমি রিপোর্টার নই, মিস ক্যারোলিন পার্সিহাউস আমায় পাঠিয়েছেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে।

ওঃ তাই নাকি! রণির মাসীর নাম শুনে পরিচারিকার হাবভাব পাল্টে গেল, সম্ভ্রম মেশানো গলায় সে বলল, তা কি দরকার আপনি বলুন তো।

আবার ভুল করলে! এমিলি কাষ্ট হেসে বলল, যার সঙ্গে আমি দেখা করতে এসেছি দরকারটা তাকেই বলব। তুমি ভেতরে গিয়ে ওঁকে শুধু খবরটা দাও, তাহলেই হবে।

এমিলির আচরণে পরিচারিকাটি বেশ দমে গেল, আর কথা না বাড়িয়ে সে তাকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। মিস উইলেটের ড্রইংরুমটি আকারে বেশ বড়, তাকে হলঘর অনায়াসে বলা চলে। চারপাশে বিলাসের প্রচুর উপকরণ ছড়ানো, ঘরের এককোণে ফায়ার প্লেসে কাঠের বড় বড় টুকরো জ্বলছে। একটা অস্বাভাবিক জিনিস এমিলির চোখে পড়ল তাহল ঘরের চারটে দেয়ালের কোনটিতে একটিও ফোটো ঝুলছে না।

গুড মর্নিং, এক সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী যুবতী এগিয়ে এসে এমিলির সঙ্গে করমর্দন করল, আমি মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট। মার শরীরটা খুব ভাল নেই তাই এখনও বিছানা থেকে ওঠেন নি। আমি কি আপনাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি?

এমিলি এবার মিস পার্সিহাউসের লেখা চিঠিখানা তুলে দিল ভায়োলেটের হাতে। চিঠি পড়ে ভায়োলেট বলল, মিস পার্সিহাউস কফি কেক তৈরি করার পদ্ধতি জানতে চেয়েছেন, এতো খুব ভাল কথা, আপনি দয়া করে একটু বসুন, আমি রাঁধুনীর কাছ থেকে ওটা এখুনি লিখে নিয়ে আসছি। ইয়ে, আপনি কি মিস পার্সিহাউসের বাড়িতেই উঠেছেন?

না, এমিলি গম্ভীরগলায় জবাব দিল, আমি মিসেস কার্টিসের বাড়িতে উঠেছি।

তাই বলুন, ভায়োলেট মুখ টিপে হাসল, তাছাড়া মিস পার্সিহাউসের বাড়িটাও খুব ছোট, বাড়িতে যে একখানা ঘর ছিল সেটা দখল করে বসে আছে ওঁর বোনপো রণি। তবে মিস পার্সিহাউস খুব চমৎকার মহিলা, ওঁর তুলনা হয় না।

সায় দিয়ে এমিলি বলল, এ সম্পর্কে আমি আপনার সঙ্গে একমত। আচ্ছা এ বাড়ির মালিক তো ছিলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তাই না, যিনি সেদিন খুন হলেন?

ঠিক ধরেছেন,বলতে গিয়ে ভায়োলেটের গলা হঠাৎ ধরে এল, কি ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো। কোথা থেকে কি যে ঘটে গেল এখনও বুঝতেই পারছি না।

শুনলাম আপনারা নাকি প্রেতচর্চার আসর বসিয়েছিলেন, এমিলি বলল, আর তখনই নাকি অলৌকিকভাবে জানতে পারেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন। ব্যাপারটা কি সত্যি?

ওফ! সেই সন্ধ্যের কথা জীবনের শেষ দিনটুকু পর্যন্ত আমার স্মৃতিতে বয়ে বেড়াতে হবে। ভায়োলেট আক্ষেপের সুরে বলল, আমরা খেলাচ্ছলে যা করছিলাম তা যে এমন ভয়ঙ্কর আর ভয়ানক রূপ নেবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি।

সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যে কজন পুরুষ মানুষ উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে মেজর বারনাবি ছিলেন পয়লা নম্বরের নাস্তিক। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাম অলৌকিকভাবে প্রকাশ পাবার পরে উনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে, ফিরে আসার পরে ওঁর মুখ থেকেই সেই ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংবাদ জানতে পারি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন শুনে মিঃ রাইক্রফটের তো প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা, অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সামলে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। আর রণি? মনে হচ্ছিল যেন ভূত দেখেছে। আমার মা নিজেও এ ব্যাপারটায় খুব বিচলিত হয়েছিল, এমন ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি, এখনও পারেন না, আর সত্যি বলতে কি আমি নিজেও এখনও পারছি না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছি, হে ঈশ্বর, একি হল? এও কি সম্ভব?

এমিলি কিছু বলতে যাবার আগেই যুবতী পরিচারিকাটি রূপোর ট্রেতে একটি ভাজ করা কাগজ এনে রাখল তার সামনে। কাগজটা তুলে নিল এমিলি, ভাঁজ খুলে দেখল কফি কেক তৈরি করার পদ্ধতি তাতে সবিস্তারে লেখা হয়েছে। কাগজখানা ভাঁজ করে হাতব্যাগের। ভেতরে রেখে দিল সে। ভায়োলেটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এমিলি সদর দরজার দিকে সবে পা বাড়িয়েছে এমন সময় ভেতরের একটি ঘর থেকে নারী কণ্ঠে অসহ্য কাতরানির আওয়াজ ভেসে এল তার কানে।

হা ইশ্বর! নারী কণ্ঠে সেই কাতরানি স্পষ্ট শুনতে পেল এমিলি, আমি যে আর সইতে পারছি না। এই দুর্ভাগ্যের অবসান কি আর ঘটবে না? কেন তুমি তবে আমায় বাঁচিয়ে রেখেছো প্রভু?

এ যন্ত্রণার আওয়াজ যে মিসেস উইলেটের গলা থেকে ভেসে আসছে, সে বিষয়ে এমিলির কোনও সন্দেহ রইল না।

.

১৮.

দুপুর আড়াইটে নাগাদ এমিলি দেখা করল ডঃ ওয়ারেনের সঙ্গে।

দেখুন মিস ট্রেফুসিস, ডঃ ওয়ারেন বললেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ যখন আমি প্রথম দেখি তখন ঠিক আটটা। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে তারও দু ঘন্টা আগে ওঁর মৃত্যু ঘটেছিল। আমার ধারণা উনি যখন খুন হন তখন ঠিক বিকেল চারটে বেজেছিল

ডঃ ওয়ারেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে এমিলি এরপর বিকেল তিনটে দশের ট্রেন ধরে এক্সেটারে এল। স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে উঠেছিলেন মিঃ ডেকার্স, মিঃ ডেকার্স জিমের পক্ষের উকিল। তার সঙ্গে দেখা করল এমিলি।

মিঃ ডেকার্স এমিলিকে ছোটবেলা থেকে চিনতেন, তাকে পাশে বসিয়ে তিনি বললেন, এমিলি তোমার কাছে গোপন করে কোনও লাভ নেই, কিন্তু পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে এমন কিছু তথ্য হাতে পেয়েছে যেগুলো জিম পিয়ার্সনের বিপক্ষে যাবে।

সেগুলো আপনি অনায়াসে আমায় জানাতে পারেন,কথাগুলো বলতে গিয়ে এমিলির গলা একটুকু কাপল না, আমি এখন সবকিছুর জন্য তৈরি আছি।

তাহলে শোনো, মিঃ ডেকার্স বলতে লাগলেন, জিমের যে হঠাৎ প্রচুর টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল তা প্রমাণিত হয়েছে। বিবিন্ন কোম্পানীর শেয়ার কেনার নেশা ছিল ওর, যে কারণে প্রায়ই ওকে নিজের অফিস থেকে টাকা ধার করতে হত। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার কিছুদিন আগে একটা নামী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার জলের দরে বিক্রী হবার খবর পায় জিম, আর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার কিছু শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেই সময় শেয়ার কেনার মত টাকা তার হাতে ছিল না। এদিকে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে টাকা ব্যাপারটাই বানচাল হয়ে যাবে। তাই উপায় না দেখে জিম পিয়ার্সন শেষকালে গিয়ে হাত পেতেছিল তার মামা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর কাছে শেয়ার কেনার টাকা ধার চেয়ে। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, ট্রেভিলিয়ান সেদিন ওকে অতগুলো টাকা ধার দিতে রাজী হন নি।

এমিলি কোনও মন্তব্য না করে চুপ করে শুনে যেতে লাগল, মিঃ ডেকার্স বলতে লাগলেন, এখন ব্যাপার হল পুলিশ গোটা ব্যাপারটাকে খুনের একটা বড় মোটিভ হিসাবে দাঁড় করাতে চাইছে। কোর্টে মামলা উঠলে সরকারী উকিল এটাই প্রমাণ করতে চাইবেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান টাকা ধার দেবেন না জেনে জিম তখনই ওকে খুন করে। ওঁর অ্যাটর্নি মিঃ বার্কউডের অফিসে গিয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের উইলে ওঁর নামে যে টাকা গচ্ছিত ছিল সেটা যোগাড় করে নেয়। পুলিশ যাতে খুনী হিসাবে তাকে সন্দেহ করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই জিম এটা করেছিল।

কিন্তু মিঃ ডেকার্স, এমিলি বাধা দিয়ে বলে উঠল, সেক্ষেত্রে এটা কি প্রমাণ করা যায় যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান উইলে তার নামে কত টাকা গচ্ছিত রেখেছেন তা জিম আগে থাকতে জানতে পারে নি?

না বাছা, মিঃ ডেকার্সের মুখে করুণ হাসি ফুটে উঠল, তা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। সিলভিয়া, জিম আর ব্রায়ান ওরা তিনজনেই তাদের মামার উইলের কথা জানত আর তা নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে নানারকম আলোচনা আর ঠাট্টা রসিকতা করত। জিম নিজে অস্বীকার করলেও ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত চাপা থাকবে না।

আচ্ছা মিঃ ডেকার্স, এমিলি প্রশ্ন করল, আপনি নিজে কি সত্যিই জিমকে অপরাধী বলে মনে করেন। দয়া করে আমার কাছে কিছু লুকোবেন না।

না বাছা, মিঃ ডেকার্স কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, আমার মতে জিম খুবই সাদাসিধে ধাঁচের ছেলে। তবে একই সঙ্গে এও বলব যে ওর মধ্যে সতোর খুব অভাব। তা হলেও মানুষ খুন করার মত ক্ষমতা যে ওর নেই সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তবে জিমের বিরুদ্ধে সব প্রমাণই অত্যন্ত জোরালো যা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি তাই চাইছ মিঃ লরিমার ওর হয়ে এই মামলা লড়ুন, সবাই বলে উনি অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারেন।

মিঃ ডেকার্সের সামনেই একটুকরো কাগজে জিমের উদ্দেশ্যেই চিঠি লিখল এমিলি। তাতে উল্লেখ করল,

প্রিয়তম জিম,
……..বিশ্বাস কর, সবকিছু ঠিক সময় মিটে যাবে, কাজেই মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করে মন খারাপ কোর না। আরেকটা অনুরোধ, ভুলেও যেন কখনও সত্য গোপন কোর না, প্রকৃত পক্ষে যা ঘটেছে তাই বলবে। মিঃ ডেকার্স এ ব্যাপারে তোমায় সবদিক থেকে সাহায্য করবেন। বুঝলে? ইডিয়ট কোথাকার।
–তোমার এমিলি।

চিঠিখানা মিঃ ডেকার্সের হাতে তুলে দিল এমিলি, বলল যাতে তিনি সেটা জেল হাজতে জিমের হাতে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। মিঃ ডেকার্স কথা দিলেন চিঠিটা জিমের হাতে পৌঁছে দেবেন বলে।

মিঃ ডেকার্সের কাছে বিদায় নিয়ে থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে এল এমিলি। জানতে পারল যে মিসেস গার্ডনার বাইরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে।

আপনি কি নার্স ডেভিসের সঙ্গে দেখা করবেন? একজন পরিচারিকা এমিলিকে প্রশ্ন করল।

নিশ্চয়ই, এমিলি জবাব দিল, তার কিছুক্ষণ বাদেই নার্স ডেভিস এসে হাজির হলেন সেখানে। সংক্ষেপে নিজের পরিচয় ওকে দিল এমিলি, সেই সঙ্গে শোনাল তার দুর্ভাগ্যের বিবরণ।

হ্যাঁ, আজকের সকালের কাগজেই আমরা খবরটা পড়েছি। নার্স ডেভিস বললেন, কি ভয়ংকর ব্যাপার দেখুন তো! সত্যি, আপনার সহ্যশক্তির তারিফ করেত হয় মিস ট্রেফুসিস।

কোথায়, এমিলি কোথায়? বলতে বলতে দশাসই বপু অথচ সুশ্রী দেখতে এক মহিলা এসে হাজির হলেন সেখানে।

এই যে মাসী, তুমি এসে গেছে, এমিলি হাসিমুখে এগিয়ে এসে মহিলাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, আমি কতক্ষণ ধরে তোমার আশায় বসে আছি।

বস এমিলি, শ্রীমতী গার্ডনার হেসে বললেন, চা খাও, আমি এক্ষুনি একবার ওপর থেকে ঘুরে আসছি।

এমিলিকে পরিচারিকা এক কাপ চা এনে দিল। ওপরে কাজ সেরে শ্রীমতী গার্ডনার ফিরে এলেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। এমিলিকে বললেন, এত ঘাবড়াবার কিছু নেই বাছা, পুলিশ যথাসময় আসল খুনীকে গ্রেপ্তার করবে তা জেনে রেখো। তুমি শুধু দুশ্চিন্তা করে নিজের চেহারা নষ্ট করো না। তাছাড়া ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান লোকটি ছিলেন ভয়ানক নিষ্ঠুর ধাঁচের, আমরা কি সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি তা ওঁর অজানা ছিল না। সময়মত কিছু টাকা যদি উনি ধার দিতেন তাহলে তোমার রবার্ট মেশোর চিকিৎসা আর একটু ভালভাবে করতে পারতাম। কাজেই সত্যি বলতে কি, উনি খুন হওয়ায় আমি নিজে অন্ততঃ তেমন দুঃখ পাইনি।

এমিলির শরীর ও মন দুদিক থেকেই খুব ক্লান্তি বোধ করছিল, কখন যে তার দুচোখের কোল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করছে তা সে নিজে টেরই পায় নি।

কেঁদো না বাছা, এমিলির মাসী গার্ডনার রুমাল দিয়ে তার দুচোখ আর গাল মুছিয়ে দিয়ে স্নেহভরা গলায় বললেন, বুঝতে পারছি এতো ধকল তুমি সইতে পারছে না, তবু উপায় কি বলো। জিম পিয়ার্সন যতদিন না বেকসুর খালাস পাচ্ছে ততদিন এই চাপ তোমায় সইতেই হবে।

.

১৯.

কিন্তু মিস ট্রেফুসিস অ্যাটর্নি মিঃ বার্কউড প্রশ্ন করলেন, আপনি হ্যাজেলমুরে গিয়ে নিজে ব্যক্তিগতভাবে খানাতল্লাসী চালিয়ে কি খুঁজে পাবেন বলে আশা করছেন? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নিজের ব্যবহার্য যা কিছু জিনিস পত্র ওখানে ছিল পুলিশ তদন্তের গোড়াতেই সরিয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারছি আপনি যেকোন ভাবে মিঃ পিয়ার্সনের নির্দোষিতা প্রতিপন্ন করতে ব্যর্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু এইভাবে কতদূর এগোতে পারবেন?

আমি পুলিশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি না, মিঃ বার্কউড, এমিলি বলল, তাদের তদন্তের কাজে বাধাও দিচ্ছি না। আমি নিজে একবার হ্যাজেলমুরে গিয়ে সেখানকার পরিবেশটা নিজে চোখে দেখতে চাইছি। দয়া করে হ্যাজেলমুরে ঢোকার চাবিটা আমায় দিন আপনি।

চাইছেন যখন তখন নিন, মিঃ বার্কউড তার টেবলের ড্রয়ার খুলে একটা মাঝারী আকারের চাবি বের করে তুলে দিলেন এমিলির হাতে, আপনার হাতে চাবিটা দিলে কোনও ক্ষতি হবে না বলে মনে করি।

চাবিটা নিয়ে মিঃ বার্কউডকে ধন্যবাদ দিল এমিলি, তারপর ফিরে এল বাড়িতে। সেদিন সকালবেলাতেই মিসেস বেলিংয়ের লেখা একটা চিটি এসে পৌঁছেছিল এমিলির হাতে যার বয়ান এরকম?

প্রিয় মিস ট্রেফুসিস,
সাধারণভাবে ধরে নিয়েছিলাম যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যুর পরে তার বাড়ি থেকে কিছুই সরানো হয়নি এবং পুলিশও তাই অনুমান করেছিল। কিন্তু ইভানসের মুখ থেকে জানতে পারলাম সে তার প্রভুর অর্থাৎ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের একজোড়া বুট খুঁজে পাচ্ছে না। প্রসঙ্গতঃ জানাচ্ছি যে এটা সাধারণ বুট জুতো নয়, এ হল সেই ধাঁচের একজোড়া বুট, যা লোকে প্রচণ্ড তুষারপাতের সময় পায়ে গলিয়ে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোয়। বেঁচে থাকতে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওই বুট জোড়ায় নিয়মিত তেল মাখাতেন সেকথা ইভানস নিজে আমাকে জানিয়েছে। হয়তো এটা আদৌ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়, তবু যেহেতু আপনি নিজে ও খুনের তদন্ত নিয়ে মাথা ঘামচ্ছেন তাই এ খবর আপনাকে জানান আমার কর্তব্য বলে মনে করছি। ঈশ্বরের কাছে আপনার সাফল্য কামনা করছি।
ইতি–মিসেস বেলিং।

এমিলির হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে চার্লস নিজেও তাতে চোখ বোলালো, পুরোটা পড়ে নিয়ে সে বলল, ধ্যাৎ, এটা আদৌ কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

অত শীগগির মন্তব্য করো না চার্লস, এমিলি বলল, এত জিনিস থাকতে ওই একজোড়া বুটই বা হারিয়ে গেল কেন সেটা ভেবে দেখছো না?

হয়তো ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ঘটনার দিন নিজেই ওই বুটজোড়া কোনও ভিখিরি বা ভবঘুরেকে দয়া পরবশ হয়ে দান করেছিলেন, চার্লস বলল, আর সেই ফাঁকে সে ব্যাটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে তাকে খুন করেছিল।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছিলেন এক পয়লা নম্বরের কৃপণ লোক। এমিলি বলল, জীবনে ওঁর হাত দিয়ে কখনও একটা শিলিং কেউ গলতে দেখেনি। কাজেই এহেন লোক দয়াপরবশ হয়ে কোনও ভিখিরি বা ভবঘুরেকে একজোড়া বুট দান করেছেন এই সিদ্ধান্ত আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, চার্লস, তুমি কিছু মনে করো না।

চার্লস এমিলির মন্তব্যের কোনও প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইল। এমিলি কথা না বাড়িয়ে তখনই এসে হাজির হল এক্সহাম্পটনে। থ্রি ক্রাউনস সরাইখানায় পৌঁছে মিসেস বেলিংয়ের সঙ্গে দেখা করল সে। মিসেস বেলিং তার লেখা চিঠিখানা এমিলির হাতে পৌঁছেছে জেনে খুশি হলেন, তাকে তখনই নিয়ে এলেন তিনি ইভানসের বাড়িতে। ইভানস কাজে বেরিয়েছিল। কিন্তু এমিলি এতটুকু নিরাশ হল না, ইভানসের স্ত্রীর মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করল সে।

তোমার স্বামী মিসেস বেলিংকে বলেছে যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার পরে ওঁর একজোড়া বুট সে খুঁজে পাচ্ছে না, এমিলি বলল, অথচ পুলিশ ওই বাড়ি থেকে জিনিসপত্র কিছুই সরায় নি।

হ্যাঁ, ইভানসের বৌ সায় দিয়ে বলল, খবরটা আমিও জেনেছি, সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। খুব লো দেখতে একজোড়া বুট, শীতের সময় ক্যাপ্টেন ও-দুটো পায়ে গলিয়ে বেরোতেন। তার আগে দু জোড়া গরম পশমী মোজা পায়ে গলাতেন তিনি।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার আগে যে নিজে ওই বুটজোড়া মেরামত করতে দেননি সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত? এমিলি গলা সামান্য চড়িয়ে প্রশ্ন করল।

নিশ্চয়ই, ইভানসের বৌ জবাব দিল, মেরামত করতে দিলে আর কেউ না থোক তা ইভানসের অজানা থাকতো না। আমার মনে হচ্ছে এটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার, ক্যাপ্টেনের খুনের সঙ্গে এই বুট জোড়া খোয়া যাবার কোনও সম্পর্ক নেই।

আমারও তাই ধারণা, এমিলি তার মনোভাব ইচ্ছে করেই ফাঁস করল না ইভানসের বৌয়ের কাছে।

জানেন মিস ট্রেফুসিস,ইভানসের বৌ মুচকি হেসে বলল, ক্যাপ্টেনের খুনের তদন্ত যে পুলিশ অফিসার করছেন তিনি আজ সকালে আবার এসেছিলেন।

তা উনি গেলেন কোন দিকে?

শুনলাম উনি মিঃ ডিউকের বাড়িতে গেছেন।

মিঃ ডিউক। নামটা শুনে ভেতরে ভেতরে খুব অস্বস্তি আর বিরক্তি বোধ করল এমিলি। এখনও পর্যন্ত এই লোকটি সম্পর্কে কোনও ধারণা গড়ে তুলতে পারেনি সে।

ধন্যবাদ, এমিলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখনি একবার সিটাফোর্ডে যাব, ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে আমার একবার দেখা করতে হবে। কিন্তু তার আগে একবার হ্যাজেলমুরটা ঘুরে যাব ভাবছি।

একা আর পুরোপুরি নিরস্ত্র অবস্থায় এমিলি এসে হাজির হল হ্যাজেলমুরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরে। ঢুকে দেখতে পেল মিঃ বার্কউড ঠিকই বলেছিলেন, ভেতরে বেশির ভাগ জিনিসই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কম্বলগুলো ভাজ করে থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা, সবকটা টেবলের ড্রয়ার ফাঁকা, আলমারীর ভেতরে টাঙ্গানো হ্যাঁঙ্গারগুলোতে জামা-প্যান্ট দূরে থাক একটা গেঞ্জীও ঝুলতে দেখল না এমিলি! জুতো রাখার শেলফটাও একদম ফাঁকা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একতলায় বসার ঘরে নেমে এল এমিলি। এখানেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ পড়েছিল, খোলা জানালা দিয়ে তুষার মেশানো ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক হু হু করে ঢুকছিল ঘরের ভেতরে।

সেদিনের ঘটনাটা দেখবার চেষ্টা করল এমিলি। কে খুন করেছিল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে, এবং কেন, এই প্রশ্ন আবার উঁকি দিল তার মনের কোণে। সবারই অনুমান বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিটের সময় তিনি খুন হয়েছিলেন, সেকি সত্যি, নাকি তার প্রণয়ী জিমই খুন করেছিল তার মামাকে উত্তেজনার বশে, যে কথা বারবার সে চেপে গেছে পুলিশের কাছে? মামাকে খুন করে জিম কি সত্যিই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছিল, তারপর জানালার ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল ঘরের ভেতরে মেঝের ওপর পড়ে থাকা তার মামার মৃতদেহের দিকে তারপর প্রচণ্ড ভয় পেয়ে একসময় ছুটে পালিয়েছিল সেখান থেকে। এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে এমিলিকে?

অন্যদিকে মিঃ রাইক্রফটের ধারণা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ভেতরে খুনী আগেই ঢুকে বসেছিল, মামার সঙ্গে জিমের ঝগড়া আড়াল থেকে শুনতে পেয়েছিল সে, আর জিমের অজান্তেই সে-ই খুন করেছিল। যদি এ সিদ্ধান্ত সত্যি হয় তাহলে কে সে লোক? যদি এই সিদ্ধান্ত আদৌ সত্যি হয় তাহলে তার সঙ্গে কি বুটজোড়া খোয়া যাবার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে? বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এমিলি একবার খাবার ঘরে উঁকি দিল একজোড়া ট্রাঙ্ক দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এককোণে। তখনই এমিলির চোখে পড়ল একটা কৌচের ওপরে পড়ে আছে তিনটে আনকোরা ইংরেজী উপন্যাস।

এই বইগুলো ট্রেভিলিয়ান খবরের কাগজের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার উত্তর নির্ভুলভাবে পাঠিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন কিন্তু বেঁচে থাকতে একদিনের জন্যও বইগুলো খুলে দেখেন নি তিনি।

কোথায় গেল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সেই বুটজোড়া, কোথায় যেতে পারে? মাথার ভেতর তোলপাড় করা এই তিনটি প্রশ্ন নিয়ে এমিলি আবার এসে হাজির হল ওপরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরে। শোবার ঘরের ভেতরটা একরকম ফাঁকাই বলা চলে তবু যদি কোথাও কোনও সূত্র পাওয়া যায় সেই আশায়। মেঝের কার্পেট টেবলের ফাঁকা ড্রয়ার কিছুই ঘাঁটতে বাদ রাখল না সে। সবশেষে আস্তিন গুটিয়ে দুটো হাত গুঁজে দিল সেই ঘরের কোণে ফায়ারপ্লেসের চিমনির ভেতরে। হঠাৎই বাইরে থেকে সেখানে কি যেন তার চোখে পড়েছিল।

হাতড়াতে হাতড়াতে কি যেন একটা শক্ত জিনিস এমিলির হাতে ঠেকল, সঙ্গে সঙ্গে একটানে সেটা টেনে বের করে আনল সে।–এই তো, পুরোনো খবরের কাগজের একটা মোড়ক। মোড়টা খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজোড়া পুরু চামড়ার। বুটজুতো।

একি! ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর সেই পুরনো বুটজোড়া? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করল এমিলি, কিন্তু কেন? এই বুটজোড়া পুরোনো খবরের কাগজে মুড়ে এই ফায়ারপ্লেসের চিমনির ভেতরে রাখল কে? কি তার উদ্দেশ্য?

অনেকক্ষণ সেই জুতোজাড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল এমিলি, তারপর জুতোজাড়া হাতে নিয়ে আবার চলে এল নীচে। খাবার ঘরের পাশেই এককোণায় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের যাবতীয় খেলাধুলো, শিকার আর মাছ ধরার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা, সেগুলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল এমিলি, তারপর হঠাৎ নিজের মনে বলে উঠল, ওঃ, তাহলে এই হল ব্যাপার। কথাটা বলেই এমিলি সামনের একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়ল।

হা, নিজের মনে বলে উঠল এমিলি।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে কে খুন করেছে তা এবার আমি বের করে ফেলেছি, কিন্তু কেন সে এই কাজ করেছে তা জানি না। তবু আমার সময় নষ্ট করলে চলবে না।

একলাফে দৌড়েই হ্যাজেলমুর থেকে বেরিয়ে এল এমিলি, ট্যাক্সি ভাড়া করে তখনই এসে হাজির হল মিঃ ডিউকের বাড়িতে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সদর দরজার কড়া খুব জোরে জোরে নাড়ল এমিলি। সদর দরজার পাল্লা খুলে গেল মিনিট খানেক বাদে। একটি অপরিচিত পুরুষের মুখ দেখে এমিলি ধরে নিল ইনি মিঃ ডিউক ছাড়া অন্য কেউ নন।

আপনি মিঃ ডিউক? এমিলি প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ।

আমি এমিলি ট্রেফুসিস, একবার ভেতরে আসতে পারি? আমার বিশেষ দরকার।

কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে মিঃ ডিউক একপাশে সরে দাঁড়ালেন।

আমি ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে দেখা করতে চাই, এমিলি বলল, উনি ভেতরে আছেন?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট? মিঃ ডিউক বিস্ময় মেশানো গলায় বললেন, হ্যাঁ, উনি আছেন, কিন্তু আপনি কেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান জানতে পারি?

এই কারণে, সেই বুটজোড়া সামনে নামিয়ে রেখে এমিলি জবাব দিল।

এই বুটজোড়া সম্পর্কে ওঁর সঙ্গে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

 ২০. ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন

২০.

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার ঠিক এক সপ্তাহ বাদে আরেক শুক্রবার সন্ধ্যের কিছু পরের ঘটনা। সিটাফোর্ড হাউসে মিসেস উইলেটের বসার ঘরে এসে জড়ো হয়েছেন মিঃ রাইক্রফট, মেজর বারনাবি, রণি গারফিল্ড, ব্রায়ান পিয়ার্সন আর এমিলি, এছাড়া মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেটও উপস্থিত আছেন সেখানে।

আজ এই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ, মিসেস উইলেট মন্তব্য করলেন।

তার মানে?

আগে স্থির ছিল যে আমরা পুরো শীতকালটাই এই সিটাফোর্ডে কাটাব, মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু হঠাৎ কিছু পারিবারিক সমস্যা দেখা দিয়েছে যে কারণে শীতকাল শেষ হবার আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে।

আপাততঃ লন্ডনে, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, আশা করছি সেখান থেকে আমরা বিদেশে রিভিয়েরার দিকে রওনা হতে পারব।

সত্যি বলছি, মিঃ রাইক্রফট মন্তব্য করলেন, আপনি চলে গেলে আমাদের খুব লোকসান হবে।

না, না, লোকসান হবে কেন, মিসেস উইলেট বললেন, আসুন আজ শেষবারের মতো একসঙ্গে চা পান করা যাক।

তুমি কি করবে? মেজর বারবি আড়চোখে ব্রায়ান পিয়ার্সনের দিকে তাকালেন, তুমি এখান থেকে কেটে পড়বে ঠিক করেছে?

আপাতত লন্ডনে যাচ্ছি, ব্রায়ান জবাব দিল, তবে আমার ভাই জিম যতক্ষণ খালাস না পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঝামেলার হাত থেকে পুরোপুরি রেহাই মিলছে না।

ব্রায়ানের কথা শেষ হতেই বাইরে থেকে দরজায় করাঘাতের শব্দ হল। ব্রায়ান উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল, সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকল চার্লস এন্ডারবি।

আসুন সাংবাদিক প্রবর, মিসেস উইলেট অভ্যর্থনার সুরে বললেন, আমাদের সঙ্গে এককাপ চা খান।

ধন্যবাদ। একটি কৌচে বসে চার্লস এন্ডারবি বলল, সবাই হাজির আছেন দেখছি, খুব ভাল সময়েই এসেছি।

হ্যাঁ, মিসেস উইলেট বললেন, আসুন, শেষবারের মতো সবাই মিলে এক হাত ব্রীজ খেলা যাক। এক মিনিট, ম্যাডাম, মিঃ রাইক্রফট বাধা দিয়ে বললেন, মিসেস উইলেট, আপনি খুব ভালভাবেই জানেন আমি নিজে অলৌকিক ও পরলোক তত্ত্বে বিশ্বাসী, এ বিষয়ে আমি প্রচুর পড়াশোনা করেছি। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে আপনার এই বসার ঘরে আমরা এক আপাত-ব্যাখ্যাহীন অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।

কথা শেষ করে মিঃ রাইক্রফট একটু তাকালেন আর মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেটের গলা থেকে চাপা গোঙানীর মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল।

সেদিনের ঘটনা আমার মনে করিয়ে দেবার জন্য আপনি যে কষ্ট অনুভব করেছেন তা বুঝতে পারছি, মিস উইলেট, মিঃ রাইক্রফট ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে বললেন, পুলিশ অবশ্য সন্দেহক্রমে একজনকে গ্রেপ্তারও করেছে, অবশ্যই সেই ধৃত ব্যক্তি অর্থাৎ জিম পিয়ার্সন সত্যিই আসল অপরাধী কিনা সে বিষয়েও আমাদের অনেকেরই মনে সন্দেহ আছে। আমার একটি প্রস্তাব আছে তা হল, গত শুক্রবারের মতো আসুন, আজ আবার আমরা প্রেতচর্চার এক অনুষ্ঠান বসাই।

না, প্রতিবাদের সুরে চেঁচিয়ে ওঠে ভায়োলেট, কখনও নয়।

না, আপনি দেখছি অত্যন্ত নির্মম, রণি গারফিল্ড মন্তব্য করল, মিঃ রাইক্রফট, আপনি সত্যিই মানুষ না প্রেত সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ জাগছে।

মিসেস উইলেট, মিঃ রাইক্রফট বললেন, আমার এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার নিজের কি অভিমত?

আমার এই প্রস্তাব খুব ভাল লাগছে না,মিসেস উইলেট বললেন, গত সপ্তাহের ওই ঘটনা আমার মেয়ের মাথায় যে প্রভাব ফেলেছে তা এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি নি। এরই মধ্যে আবার?

আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন তো? চার্লস এন্ডারবি মিঃ রাইক্রফটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি এটাই বলতে চান যে আজকের প্রেতচক্রের অনুষ্ঠানে যেসব প্রেতাত্মা আসবে তারা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের আসল খুনীর নাম আমাদের দেবে?

চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি, মিঃ রাইক্রফট কৌতূহলী সুরে বললেন, হয়ছে। অপরাধীদের মুখ থেকেই আমরা আসল অপরাধীর নাম জানতে পারব। দোহাই মিস উইলেট, আপনি আর আপত্তি করবেন না।

কিন্তু বিশ্বাস করুন, ভায়োলেট মিনতি করে বলল, মেজর, আপনি তো ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, মিঃ রাইক্রফটের এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার নিজের কি অভিমত?

আমি এর মধ্যে আপত্তির কিছুই দেখছি না, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, মিঃ রাইক্রফট যখন বলছেন তখন একবার না হয় দেখাই যাক।

মেজর বারনাবির কথা শেষ হতেই রণি গারফিল্ড পাশের ঘর থেকে ছোট চৌপায়া টেবলটা নিয়ে এল, যার সাহায্যে এক সপ্তাহ আগেও প্রেত আবাহন করা হয়েছিল।

সেদিন মিঃ ডিউক এখানে ছিলেন,মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু আজ তিনি নেই।

তা নেই ঠিকই, মিঃ রাইক্রফট বললেন, তার জায়গায় মিঃ এন্ডারবি আছেন।

মাপ করবেন, চালর্স এন্ডারবি প্রতিবাদের সুরে বলল, আমি একজন সাংবাদিক, অলৌকিক ব্যাপারে আর ভূতপ্রেত নিয়ে খেলায় আমার আদৌ বিশ্বাস নেই। আমি বড়জোর প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে এখানে উপস্থিত থাকব আর যা কিছু ঘটবে সব লিখে নেব শর্টহ্যান্ডে।

যিনি এক সপ্তাহ আগে শুক্রবার দিন যেখানে বসেছিলেন আজও তিনি সেখানে বসলেন। চালর্স এন্ডারবি কৌচ ছেড়ে উঠে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল, ফায়ারপ্লেসের আগুনের মৃদু আভায় উপস্থিত সবার ছায়া ঠিকরে পড়েছে ঘরের দেয়ালে যার ফলে কাউকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।

তাহলে এবার শুরু করা যাক, মিঃ রাইক্রফট বললেন, এখন ঘড়িতে সময় বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। গত শুক্রবার দিন ঠিক এই সময় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছিলেন।

তার কথা শেষ হবার আগেই ভায়োলেটের চাপা গলার আর্তনাদ শোনা গেল, সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। ব্রায়ান পিয়ার্সন উঠে ঘরের আলো জ্বালাল, তারপর এগিয়ে এসে সদর দরজা খুলে দিল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল তিনজন লোক, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, এমিলি ট্রেফুসিস, আর মিঃ ডিউক। ওঁদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখে সবাই বেশ বিচলিত হল।

পায়ে পায়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, পকেট থেকে রিভলভার বের করে উপস্থিত এক ব্যক্তির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, মেজর জন বারবি গত শুক্রবার দিন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার অভিযোগে আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করলাম। আপনাকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি যে এখন থেকে আপনি যা কিছু বলবেন তা বিচারের সময় আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে। আপনাকে এবার আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

.

২১.

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের কথায় ঘরের ভেতর যেন ভূমিকম্প হল, এই অভাবিত পরিণামের জন্য উপস্থিত কেউই মানসিক দিক থেকে তৈরি ছিলেন না। সবাই তাই বিস্মিত অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়েই রইল। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আর দাঁড়ালেন না, তিনি গাড়ি নিয়েই এসেছিলেন, আসামী মেজর বারনাবির হাতে হাতকড়া পরিয়ে তখনই গাড়িতে নিয়ে তুললেন তিনি। একটু পরেই তার গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ শুনতে পেলেন সবাই।

কিছুই বুঝতে পারলাম না ছাই, চার্লস এন্ডারবি মন্তব্য করল, আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, সাংবাদিক হিসাবে আমি একটা গাধাকে এখনও ছাপিয়ে উঠতে পারি নি। যাক এমিলি, ব্যাপারটা কি খুলে বলবে কি? দোহাই তোমায়, একটু ঝেড়ে কাশশা। রাতের আগেই খবরটা লিখে সিটি অফিসে টেলিগ্রাফ করতে হবে।

ব্যাপারটা এই যে, মেজর বারনাবিই তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করেছিলেন, এমিলি মন্তব্য করুল।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তো মেজর বারনাবিকে গ্রেপ্তার করলেন দেখলাম, চালর্স বলল, মনে হচ্ছে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ভুল করেন নি। তবু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওঁর বন্ধু মেজর বারনাবির হাতে কিভাবে খুন হলেন সেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। এতবড় একটা ঘটনা সবার চোখের আড়ালে ঘটল কি করে? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যদি সত্যিই বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে খুন হয়ে থাকেন।

ভুল, এমিলি বাধা দিয়ে বলল, উনি ঠিক সন্ধ্যে পৌনে ছটা নাগাদ খুন হয়েছিলেন। সব খুলে না বললে তোমরা বুঝতে পারবে না। জেনে রাখো, এই সমস্যার সমাধানের মূলে আছে স্কি।

স্কি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল সবাই।

হ্যাঁ, ঘাড় নেড়ে এমিলি জবাব দিল, মেজর বারনাবি আগে থাকতেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন আর তার গোটা ব্যাপারটাতে অলৌকিকের ছোঁয়া দেবার উদ্দেশ্যে যেদিনের প্রেতচর্চার অনুষ্ঠানে কৌশলে টেবলের পায়া মেঝেতে ঠুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যেন জনৈক অশরীরী প্রেতাত্মা এসে জানিয়ে গেল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন। মেজর বারনাবির পরিকল্পনা ছিল খুবই নির্ভুল, এখানে বসেই সেদিন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একটু পরেই প্রচণ্ড তুষারপাত আবার নতুন করে শুরু হবে, আর তার ফলে পথের ওপর জুতোর যাবতীয় ছাপ আর অন্যান্য দাগ সবই যাবে মুছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন এমন একটা ধারণা তার আচরণে কথাবার্তায় সেদিন সবার মনে গেঁথে গেল, তার পর তিনিই আবার রওনা হলেন এক্সহাম্পটনের দিকে, যাবার আগে সবাইকে জানিয়ে গেলেন প্রেতাত্মার জবানী শুনে তিনি ভয়ানক বিচলিত হয়েছেন, তাই তার অন্তরঙ্গ বন্ধু সত্যিই কেমন আছেন তা নিজের চোখে যাচাই করে দেখতে যাচ্ছেন তিনি। এরপরে মেজর বারনাবি সোজা তার নিজের বাড়িতে গেলেন, বাগানের ভেতর একটি ছাউনীতে মাঝধরার ছিপ আর জালের সঙ্গে একজোড়া স্কিও রাখা ছিল, সেই স্কি পায়ে গলিয়ে তিনি রওনা হলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির দিকে। মেজর বারনাবি একজন তুখোড় স্কি দৌড়বাজ, তাই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই।

হ্যাজেলমুরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়িতে পৌঁছে মেজর বারনাবি পেছন দিক দিয়ে এসে হাজির হলেন বসার ঘরের জানালার সামনে। সেখানে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বসার ঘরেই আছেন, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জানালার কঁচের শার্সিতে টোকা দিলেন তিনি। মেজর বারনাবি নিশ্চয়ই সেই জানালা দিয়ে এর আগেও ওই বাড়িতে ঢুকেছেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান সেদিনও জানালা খুলে দিলেন আর মেজর বারনাবি সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লেন তার বাড়ির ভেতরে। দুজনের মধ্যে এরপর কি কথাবার্তা হয়েছিল তা এখন বলতে পারব না কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে কথাবার্তার ফাঁকে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান পেছনে ফিরেছিলেন আর সেই সুযোগে হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা ধাতুর হাতল তুলে নিয়ে মেজর বারনাবি পেছন থেকে সাজোরে আঘাত হানেন তার মাথায়। সে আঘাত কতটা প্রচণ্ড ছিল আশাকরি বুঝতে পারছেন সবাই, কারণ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান এক আঘাতেই মারা যান।

আততায়ী মেজর বারনাবির হাতে প্রচুর সময় ছিল, নিজের পা থেকে স্কি দুটো খুলে তিনি এরপর খাবার ঘরের আলমারীর ভেতর রাখা অন্যান্য জিনিসপত্রের ফাঁকে খুঁজে রাখেন। এরপর আমার ধারণা তিনি বসার ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্রের দেরাজ খুলে ভেতরের সবকিছু তছনছ করেন, লণ্ডভণ্ড করেন ঘরের বাকি সবকিছু। এগুলো করার পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল একটিই, তাহল, যাতে পুলিশ এবং বাইরের লোক প্রথম দর্শনে এটাই ধরে নেয় যে কোনও চোরাচোড় কোনমতে জানালা খুলে ভেতরে ঢুকেছে যাকে বাধা দিতে গিয়ে খুন হয়েছেন গৃহস্বামী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান। এসব কাজকর্ম সারতে সারতে মেজর বারনাবির রাত অনেকটা বেজে গিয়েছিল। এরপর বাইরে বেরিয়ে ঘুরপথে চড়াই বেয়ে তিনি ফিরে যান, তাঁকে দেখে তিনি এটাই ধরে নেয় যে অনেকখানি পথ হেঁটে তাকে ফিরতে হয়েছে। স্কি সম্পর্কে কারও মনে সন্দেহ না জাগা পর্যন্ত মেজর বারনাবি ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাপদ।

আপনি যা বলছেন তা তো রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার, মিস ট্রেফুসিস, মিঃ রাইক্রফট বললেন, মেজর বারনাবি আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান দুজনেই ছিলেন পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু।

জানি, এমিলি সায় দিয়ে বলল, আমার নিজেরও গোড়ায় সেই ধারণা ছিল। অনেক মাথা খাঁটিয়েও সমস্যার সমাধান খুঁজে পাইনি। শেষকালে তাই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আর মিঃ ডিউকের শরণ নিতে হয়েছিল। কথা শেষ করে এমিলি তাকাল মিঃ ডিউকের দিকে, প্রশ্ন করল মিঃ ডিউক?

বেশ তো, মুখ টিপে হাসলেন মিঃ ডিউক, ইচ্ছে হলে বলুন, মিস ট্রেফুসিস।

চার্লস, মিঃ এন্ডারবির দিকে তাকিয়ে এমিলি বলতে লাগল, তোমার মনে পড়ে ইভানস তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছিল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান প্রায়ই বিভিন্ন ফুটবল বিষয়ক ক্রসওয়ার্ড পাজলের সমাধান তার নামে পাঠিয়ে দিতেন খবরের কাগজের অফিসে। তিনি ওই পাজলের একটি সমাধান পাঠান তার তাতে হ্যাজেলমুরের বদলে সিটাফোর্ড হাউসের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করেন।

শুক্রবার সকালবেলা খবরের কাগজের অফিস থেকে পাঠানো একটি চিঠি পড়ে মেজর বারনাবি জানতে পারেন যে ফুটবল বিষয়ক একটি ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করে পাঁচহাজার পাউন্ড পুরস্কার পেয়েছেন তার বন্ধু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান। অবশ্য জবানবন্দীতে মেজর ওই চিঠি পাবার কথা অস্বীকার করেছেন এবং এও বলেছেন যে আবহাওয়া খারাপ হবার দরুন শুক্রবার দিন সকালবেলা কোনও চিঠিপত্রই আসে নি। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে আমি জেনেছি এটা নির্জলা মিথ্যে, শুক্রবার দিন সকালে অন্যান্য দিনের মতো ডাক ঠিকই বিলি হয়েছিল স্থানীয় ডাকঘর থেকে। মেজর বারনাবির যেকোন কারণেই তোক খুব টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল, ওই চিঠি পড়ে তিনি তখনই স্থির করলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করে পুরো টাকাটা নিজে হাতিয়ে নেবেন।

অভাবনীয়, মিঃ রাইক্রফট প্রশংসার সুরে মন্তব্য করলেন, এত স্বপ্নেও ভাবা যায় না। কিন্তু এইভাবে অনুসন্ধান করতে কে শেখাল আপনাকে। কে আপনাকে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল?

উত্তর দিতে গিয়ে এমিলি মিসেস বেলিং-এর লেখা সেই চিঠির উল্লেখ করল আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ফায়ারপ্লেসের টিমনির ভেতর থেকে কিভাবে তার হারানো বুটজোড়া উদ্ধার করেছিল তাও জানাল।

এক নজর তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওটা স্কি করার বুট, এমিলি আবার বলতে শুরু করল, আর তখনই পরপর কতগুলো সম্ভাবনা ফিল্মের মতো ফুটে উঠল মনের কোণে। দেরী না করে তখনই ছুটে গেলাম নিচে। একটা স্কি আরেকটার চাইতে আকারে ছোট ছিল যা দেখে মনে ধারণা হয়েছিল যে নিশ্চয়ই ওখানে দুজোড়া স্কি আছে। হারানো বুটজোড়া লম্বা স্কি দুটোর সঙ্গে চমৎকারভাবে খাপ খেয়েছিল, ছোট দুটোর সঙ্গে মোটেই খাপ খায়নি।

কিন্তু মেজর বারনাবি বুটজোড়া লুকোতে গেলেন কেন? মিঃ রাইক্রফট জানতে চাইলেন।

আমার মনে হয় পুলিশ সব জানতে পারবে এই ভয় পেয়েই উনি কাজটা করেছিলেন, এমিলি জবাব দিল, হয়তো স্কি দেখলেই ওরা প্রয়োজনীয় সূত্র পেয়ে যাবে এমনটাই উনি ধরে নিয়েছিলেন। তাই ওই বুটজোড়া খবরের কাগজে মুড়ে মেজর বারনাবি ফায়ারপ্লেসের চিমনির ভেতরে গুঁজে রাখেন, আর ওইখানেই উনি সব চাইতে বড় ভুল করে বসলেন। মনিবের বুটজোড়া খোয়া গেছে তা ইভানসের চোখ এড়াল না আর যথাসময়ে সে আমার কানেও পৌঁছে দিল।

মেজর বারবি কি জেনেশুনে ইচ্ছে করে খুনের দায় জিম পিয়ার্সনের ওপর চাপাতে চেয়েছিলেন? ব্রায়ান পিয়ার্সন গম্ভীর গলায় জানতে চাইল।

না, তা নয়, এমিলি জবাব দিল, আসলে জিম একটা বোকা হাঁদা, নিজের নির্বুদ্ধিতার ফলেই ওর এই হাল হয়েছে।

জিমকে নিয়ে তখন আর চিন্তার কোনও কারণ নেই, এমিলি, বলতে বলতে চার্লস এন্ডারবি উঠে দাঁড়াল, ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে কেউ ঠেকাতে পারবে না তা তো বুঝতেই পারছে। যা এবার আমি তাহলে টেলিগ্রাফ অফিসে চললাম, মেজর বারনাবির গ্রেপ্তারের এই খবরটা আজ রাতের মধ্যেই আমার অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। আপনারা আমায় মাফ করবেন, আমায় এক্ষুনি বেরোতে হবে। কথা শেষ করেই ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল চার্লস এন্ডারবি।

আসল অপরাধী ধরা পড়ল বটে কিন্তু সবদিক পুরোপুরি লক্ষ্য হল না, ভায়োলেট এমিলিকে বাইরে নিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, হতভাগা বাপটার কথা ভেবে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

কার কথা বলছ? এমিলি অবাক হয়ে জানতে চাইল, তোমার বাবা?

ঠিক তাই, ভায়োলেটের ঠোঁটে করুণ হাসি ফুটে উঠল, কদিন আগে প্রিন্সটাউন জেলখানা থেকে যে কয়েদিটি পালিয়েছিল সেই হতভাগ্য আমার বাবা। তোমার প্রণয়ী জিমের মেজ ভাই ব্রায়ানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া থেকে জাহাজে আসার পথে আলাপ হয়েছিল, তখনই আমরা দুজনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। ব্রায়নই পরিকল্পনা করেছিল যে বাবা জেল ভেঙ্গে পালিয়ে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে তারপর সে তার বাবা এখানে আমাদের দুজন পুরুষ ভৃত্য হিসাবে বাস করবে, যাদের দেখে কারও মনে কোনওরকম সন্দেহ জাগবে না। ব্রায়ানের পরিকল্পনা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তারপর ব্রায়নই এই বাড়ির খোঁজ আমাদের দিয়েছিল, ও নিজেই উদ্যোগী হয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ওই অংশটা আমরা যাতে ভাড়ায় থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

তা তোমার বাবা এখন কোথায়? এমিলি জানতে চাইল, পুলিশ কি তাকে গ্রেপ্তার করে আবার জেলে পাঠিয়েছে?

না, আবার করুণ হাসি হাসল ভায়োলেট, প্রচণ্ড তুষারপাতে ঠাণ্ডা লেগে বাবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, এখন আর তার বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। জেলে যাবার বছর পনেরো আগে ঘোড়ার পায়ের লাথিতে মাথায় চোট পেয়েছিলেন বাবা, তারপর থেকে মাথার অসুখে ভুগছেন তিনি, ব্রায়ান বলেছিল ভালবাবে চিকিৎসা করলে হয়তো তার এই রোগ সেরে যেতেও পারে আর তাই সে তার জেল ভেঙ্গে পালানো পরিকল্পনা করেছিল।

আমায় দেখতে যতই ভাল হোক না কেন, আসলে আমার বাবা যে একজন কয়েদী, যে জেল ভেঙ্গে পালিয়েছে এই ব্যাপারটা আমার গায়ে চেপে বসেছে তা নিশ্চয়ই জানবে। এমিলি এইসব জানবার পরে কোনও ভদ্রবংশীয় যুবক আমায় গ্রহণ করবে না। সেদিন থেকে ব্রায়ান সত্যিই মহান, তাকে জীবনে কখনও ভুলতে পারব না।

.

২২.

বেচারী ভায়োলেট, এমিলি সহানুভূতির সুরে বলল, তোমার কথা ভেবে সত্যিই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।মন্তব্য করে এমিলি আর দাঁড়াল না, উপস্থিত সবার কাছে তখনকার মত বিদায় নিয়ে সিটাফোর্ড হাউস থেকে বেরিয়ে এল সে, হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছল মিস পার্সিহাউসের বাড়িতে।

কেমন? তখনই বলেছিলাম না যে মেজর বারনাবি অত্যন্ত নীচ, স্বার্থপর আর হিংসুটে লোক? বারনাবির গ্রেপ্তারের বিবরণ এমিলির মুখ থেকে শুনে মিস পার্সিহাউস বলে উঠলেন, এমন একটা জঘন্য স্বভাবের লোকের সঙ্গে গত কুড়ি বছর ধরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কি করে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন সেটাই ভাবার বিষয়। স্কি চড়া, ঘোড়ায় চড়া, পাহাড়ে ওঠা, রাইফেল শুটিং আর ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার সমাধান করা, এ সবের কোনটিতেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাগাল কোনদিন পায়নি বারনাবি। তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছিলেন ধনী লোক, সেই তুলনায় মেজর বারনাবি ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত, এক কথায় গরীব মানুষ। যাক এবার বলো তুমি কি করবে।

আমি এবার লন্ডনে যাব, এমিলি বলল, সেখানে জিম যে বীমা কোম্পানীতে চাকরী করছে সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করব যাতে সামান্য কিছু টাকা না বলে ধার নেবার অপরাধে ওঁরা যেন জিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করেন।

হুম, কোনও মন্তব্য না করে গম্ভীর শব্দটি উচ্চারণ করলেন রণি গারফিল্ডের মাসী মিস পার্সিহাউস।

জিমের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আশাকরি, এমিলি বলল, মনে হয় ভবিষ্যতে এমন ভুল আর কখনও করবে না সে।

তা না হয় হল, মিস পার্সিহাউস বললেন, তারপরেও তোমার করণীয় একটা কাজ আছে তা নিশ্চয়ই মনে আছে?

কোন কাজ বলুন তো,এমিলি অবাক হয়ে বলল, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না?

বটে! রাগত সুরে রণির মাসী বলে উঠলেন, আবার ন্যাকামি হচ্ছে? জিম আর চার্লস এন্ডারবি, এদের দুজনের মধ্যে জীবনসঙ্গী হিসাবে কাকে বেছে নেবে জানতে চাইছি।

কেন এ প্রশ্ন করছ মাসী। এমিলি এবার সত্যিই ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলে উঠল, আমার বর যে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে তা তো তোমার জানা আছে।

মিস পার্সিহাউস কোনও মন্তব্য না করে শুধু মুখ টিপে হাসলেন। এমিলি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল আর সঙ্গে সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চার্লস এন্ডারবির সঙ্গে।

এমিলি! এন্ডারবি এমিলির দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, সত্যিই গো সোনামণি, তোমার তুলনা নেই। আমি এবার তোমায় চুমু না খেয়ে ছাড়ছি না, বলে সে পথের মঝখানে সত্যিই এমিলিকে জড়িয়ে ধরে পরপর কয়েকবার চুমু খেল।

আঃ চার্লস, এমিলি মৃদু গলায় ধমকে উঠল, রাস্তার মধ্যে কি অসভ্যতা করছে।

সে না হয় ছেড়ে দিচ্ছি, এন্ডারবি এমিলির হাত ছেড়ে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল, পিয়ার্সনের নির্দোষিতা প্রমাণ হয়েছে, পুলিশ তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে।

তুমি কি বলতে চাইছো বল তো চার্লস, এমিলি বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

এমিলি, এন্ডারবি গদ গদ গলায় বলে উঠল, বিশ্বাস করো, আমি তোমায় কতটা ভালবাসি তা তুমি কোনদিন টেরও পাবে না। তুমি নিজেও যে আমায় একই রকম ভালবাসো তাও জানতে আমার বাকি নেই। তা এইভাবে আর কতদিন চলবে বলো? সবকিছু যখন ভালোয় ভালোয় মিটে গেল তখন এসো এবার আমরা দুজনে বিয়ে করে ঘর সংসার বাঁধি। তা কিরকম বিয়ে তোমার পছন্দ তা বলো, গীর্জায় নিয়ে নাকি রেজিস্ট্রি করে, কিভাবে তুমি বিয়ে করতে চাও?

ওঃ, তুমি বিয়ের কথা বলছ, এমিলি বলল, তাহলে আর আমার করার মতো কিছু নেই।

সেকি কিন্তু –এমিলি–

না, তুমি যা চাইছো, তা কখনোই হতে পারে না, কঠিন গলায় বলে উঠল এমিলি।

কিন্তু এমিলি–

শোন চার্লস, একইরকম দৃঢ় গলায় বলল এমিলি, আমি জিমকে ভালবেসে এসেছি, এতো কাণ্ডের পরে এখনও মনপ্রাণ দিয়ে শুধু ওকেই ভালোবাসি, ওর জায়গায় আর কাউকে আমি বসাতে পারব না, ওর বদলে আর কাউকে আমি কখনো কোনও মতে বিয়ে করতে পারব না।

সত্যিই পারবে না? অবাক চোখ এমিলির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল চার্লস এন্ডারবি, তুমি এতো নিষ্ঠুর? এত নির্মম?

তোমার মন যা চায় তাই বলে আশা মিটিয়ে আমায় গাল দিতে পারো চার্লস, এমিলি বলল, কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত থেকে আমায় একচুলও নড়াতে পারবে না। আচ্ছা, তুমিই বা আমাকে পাবার জন্য এত পাগল হয়েছে কেন বলো তো? তুমি একজন তরুণ সাংবাদিক, দ্য ডেইলি অয়্যার কাগজের জন্য এক দারুণ এক্সকুসিভ স্কুপ জোগাড় করেছে। কে জানে এই স্কুপই হয়তো তোমার উন্নতির দুয়ার খুলে দেবে। তুমি হলে সেই জাতের পুরুষ যে নিজের ভাগ্য নিজের হাতে গড়ে। এককথায় খাঁটি শক্তিশালি পুরুষ মানুষ যারা তাদের কাছে আমার মতো এক সাধারণ নারীর কোনও মূল্যই নেই। তুচ্ছ কারণে নাকি কান্না কাদা আর সবসময় তার মতো আঁকড়ে ধরে থাকা, এছাড়া আমি তোমার আর কিই বা করেত পারি? এমনও হতে পারে যে আজ তুচ্ছ আর অলীক চোখের নেশায় তুমি আমায় স্ত্রী হিসাবে পেতে চাইছো তা চিরস্থায়ী হবে না, হয়তো ভবিষ্যতে আমিই হয়ে দাঁড়াব তোমার জীবনের পাপগ্রহ যখন প্রতি মুহূর্তে প্রতি পদে তুমি আমার মৃত্যু কামনা করবে? আমি তো তোমার জীবন বিষিয়েও দিতে পারি? না চার্লস, তুমি শক্তসমর্থ মানুষ, যথার্থ অর্থে পুরুষ, জীবনের চলার পথে তোমার নারী না হলেও চলবে, অন্ততঃ আমার মতো নারীর কোনও প্রয়োজনই তোমার হবে না…..

দোহাই তোমার এমিলি, চার্লস এন্ডারবি করুণ চোখে তার দিকে তাকাল, অনর্থক ওসব নিয়ে শীতকালের এই সুন্দর সন্ধ্যাটা নষ্ট করে দিয়ো না। তোমার মুখে রাজনৈতিক নেতাদের মতো এতো বকবকানি শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগছে না। তুমি যে আঘাত দিলে তাতে আমার বুক ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে গেছে। তবু বিশ্বাস করবে কিনা জানি না তবু বলছি ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আর মিঃ ডিউককে সঙ্গে নিয়ে যখন তুমি মিসেস উইলেটের বসার ঘরে ঢুকলে তখন তোমায় কি সুন্দর দেখাচ্ছিল তা ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। তোমায় ঠিক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না, বিজয়ী সিংহীর মতো মনে হচ্ছিল যে এইমাত্র শিকার সেরে বিজয়ীর মত এসে দাঁড়াল।

চার্লসের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ভারী বুটের আওয়াজ তুলে সেখানে এসে দাঁড়ালেন মিঃ ডিউক।

এই যে মিঃ ডিউক, এমিলি মুচকি হেসে বলল, ভালই হয়েছে আপনি এসেছেন। চার্লস, ইনি হলেন মিঃ ডিউক, একসময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চীফ ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ ছিলেন।

কী আশ্চর্য! অবাক সুরে চার্লস বলে উঠল, আপনি সেই চীফ ইন্সপেক্টর ডিউক? আমি তো নিজের কান আর চোখকে বিশ্বাস করতেই পারছি না।

একসময় আপনি তো আমাদের কাছে স্বপ্নের মানুষ ছিলেন মশাই, গল্পের গোয়েন্দাদের মতো আমরা শ্রদ্ধা করতাম আপনাকে। যাক, আপনার সঙ্গে পরিচয় হতে আমি নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি দ্য ডেইলি অয়্যার পত্রিকার একজন সাংবাদিক, আমার পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে অনুরোধ করছি সাত আটশো শব্দের মধ্যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর খুনের মামলাটা সহজ ভাষায় সত্য কাহিনীর ঢংয়ে লিখে দিন না, আমরা ওটা রবিবারের পাতায় ছাপাব। আমাদের পাঠকেরা এই ধরনের সত্যকাহিনী খুব আগ্রহ সহকারে পড়েন। আপনি লেখাটা অফিসে সরাসরি আমার নামে পাঠিয়ে দেবেন, আমার হাতে এলেই আমি পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকা চেক কেটে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব, তাও এক হাজার পাউন্ডের কম কিছুতেই হবে না জানবেন।

নিশ্চয়ই লিখব, মিঃ ডিউক হেসে বললেন, তবে আমি তো লেখক নই, কাজেই সোজা ভাষায় যা লেখার লিখে দেব, আপনারা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে ছাপিয়ে দেবেন।

মিঃ ডিউককে চার্লস এন্ডারবির সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে এমিলি দৌড়ে গিয়ে ঢুকল মিসেস কার্টিসের বাড়িতে। মিসেস কার্টিস বিছানায় বসেছিলেন, এমিলিকে দেখে তড়াক করে উঠে বসে বললেন, তাহলে মিস ট্রেফুসিস, এখানকার পাট তুলে দিয়ে আপনি তাহলে চললেন?

ঠিক বলেছেন, এমিলি বলল, এখন আমি লন্ডনে যাব, আর আমার সঙ্গে উনিও যাবেন।

এবার তাহলে বলে ফেলুন তো মিস ট্রেফুসিস, মিসেস কার্টিস অন্তরঙ্গ হবার সুরে বললেন, দুজনের মধ্যে কার সঙ্গে ঝুলে পড়বেন বলে ঠিক করলেন?

এ আর মুখ ফুটে বলার কি আছে, এমিলি মুখ টিপে হাসল, ঝুলে তো একজনের সঙ্গেই পড়ব বলে স্থির করে রেখেছি, যাকে বেকসুর খালাস করে আনব বলে আমার এখানে আসা। সে কে তা তো জানেনই ম্যাডাম, তার নাম জিম পিয়ার্সন।

সে কি বাছা! মিসেস কার্টিস বিস্ময়ে দুচোখ কপালে তুলে বললেন, তুমি কথাটা সত্যিই মন থেকে বলছ তো? মিঃ এন্ডারবি এই তদন্তের কাজে তোমায় এত সাহায্য করলেন, অথচ

মিসেস কার্টিস, বাচ্ছা ছেলেমেয়েদের বোঝনোর মতো করে এমিলি বলল, আমি নই, আসলে ভুল করেছেন আপনি নিজে। মিঃ এন্ডারবি একজন প্রতিভাসম্পন্ন সাংবাদিক, তার সামনে বিশাল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। পায়ের নিচে পড়ে আছে গোটা দুনিয়া। বিয়ে করে ঘর বাঁধার জন্য ওঁর জন্ম হয়নি। কিন্তু আমি যাকে এতদিন ভালবেসে এসেছি আর আজ যদি তাকে বিয়ে না করি, তাহলে জানবেন ওঁর অবস্থা সত্যিই খুব অসহায় হয়ে দাঁড়াবে।

জানতাম বাচ্ছা, মিসেস কাটিস বললেন, এর চাইতে কোনও জোরালো অজুহাত তোলা মুখে জোগাবে না। কথা শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মিসেস কার্টিস নেমে এলেন একতলায়, সেখানে তার স্বামী মিঃ কার্টিস একটা কৌচে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন সামনের দিকে।

এই যে আমার উনি, ইশারায় স্বামীকে দেখিয়ে মিসেস কার্টিস মন্তব্য করলেন, আমার বড় জ্যাঠাইমার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। হতচ্ছাড়া জর্জ প্লাংকেটকে বিয়ে করলেন আর ঠিক তারপরেই ওঁর সরাইখানা দেনার দায়ে বাঁধা পড়ল। অবশ্য তার দুবছরের মধ্যেই বড় জ্যাঠাইমা দেনা পুরো মিটিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর তো সেই কারবারের দারুণ রমরমা।

হুম, মিঃ কার্টিস আপন মনেই মন্তব্য করলেন।

জর্জ প্ল্যাংকেট লোকটি দেখতে ছিল খুবই সুন্দর, মিসেস কার্টিস মন্তব্য করলেন।

যাকে এককথায় বলে রমনীমোহন পুরুষ। কত নারী যে ওঁর জীবনে এসেছে তার লেখাজোখা নেই। অথচ মজার ব্যাপার হল বড় জ্যাঠাইমাকে বিয়ে করার পর বাকি জীবনে উনি অন্য কোনও নারীর দিকে মুখ তুলে তাকান নি।

হুম,! তৃতীয়বার মিঃ কার্টিস আবার সেই একরকম গম্ভীর শব্দ উচ্চারণ করলেন।

Exit mobile version