Site icon BnBoi.Com

টেন ডলস – আগাথা ক্রিস্টি

টেন ডলস - আগাথা ক্রিস্টি

টেন ডলস

১. অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভ

টেন ডলস – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভ চলেছেন ট্রেনে। প্রচণ্ডগতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। তিনি ভাবছেন চিঠিটির কথা। একসময় পকেট থেকে সেটি বার করে পড়লেন।

প্রিয় লরেন্স,

অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে, যদি পান্না দ্বীপে আস। মনোরম পরিবেশ। ১২-৪০ মিঃ প্যাডিংটন… ওক ব্রিজে দেখা হবে।

প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে
কনসটান্স কালমিংটন।

অস্পষ্ট ছোট্ট চিঠি। তার মনে পড়ে সাত-আটবছর আগে পত্রলেখিকার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ইতালিতে। এতদিন পরে কি মনে করে চিঠি লিখছেন কে জানে?

পান্না দ্বীপটার কথা হালে খবরের কাগজে চোখে পড়েছে। এক ধনী ব্যক্তি দ্বীপটা প্রথমে কিনেছিলেন। সুন্দর একটা বাড়িও সেখানে তৈরি করেছেন।

পরে সেটা তিনি বেচে দেন এক চিত্রাভিনেত্রীর কাছে। অবশ্য অনেকের ধারণা নৌবাহিনীর কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে সরকার কিনেছে দ্বীপটা।

কেউ অবশ্য বলছেন মিঃ আওয়েন নামে এক ধনী ব্যক্তি বর্তমানে দ্বীপটার মালিক।

মিঃ ওয়ারগ্রেভ পলকের মধ্যে সবকিছু ভেবে নিলেন। পরে চিঠিটা পকেটে রেখে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলেন।

.

ভেরা ক্লেথর্ন, সেও চলেছে ট্রেনে, তৃতীয় শ্রেণীর একটা কামরায়। এই ভ্যাপসা গরমের সময় সমুদ্রতীরের মনোরম পরিবেশে আরামে থাকা যাবে এই ভেবেই সে আনন্দ পাচ্ছে। তার ওপর মনটা উল্লসিত নতুন একটা কাজ পেয়ে।

অবশ্য মাত্র একমাসের জন্য, প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ। স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে যায়, একটা মাস অন্তত নিরিবিলিতে থাকা যাবে। স্কুল থেকে একমাসের জন্য ছুটি নিয়ে নিয়েছে।

আবেদন করেছিল কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে। সঙ্গে সঙ্গেই যে নিয়োগপত্র পেয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি।

এ মাসের ৮ তারিখ থেকে কাজে যোগদানের কথা জানানো হয়েছে। নিয়োগকর্তা লিখেছেন–

… প্যাডিংটন থেকে ১২-৪০ মিঃ-এ ট্রেন। ওক ব্রিজ স্টেশনে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে। এই সঙ্গে পথখরচের টাকা পাঠানো হলো।

ধন্যবাদান্তে–
উনা নানসি আওয়েন

হঠাৎ, কি জানি কেন, হুগোর কথা ভেরার মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে সামনের লোকটির দিকে মনোযোগ দিয়ে তা ভুলে যাবার চেষ্টা করল।

সামনের সিটেই বসে আছে লম্বা-চওড়া লোকটি। গায়ের রং তামাটে। মুখে একটা, নিষ্ঠুরতার ছাপ। দেখেই মনে হয় গ্রীষ্মমণ্ডলে ঘোরা লোক।

ভেরার সামনে বসেছিল যে লোকটি তার নাম ফিলিপ লমবার্ড। ভেরার দিকে তারও চোখ পড়েছিল, সুন্দরী বলেই তার মনে হয়েছে। তবে মুখে মাস্টারনির ছাপ স্পষ্ট।

আসলে নতুন কাজটার কথাই সে তখন ভাবছে। এজেন্ট তাকে জানিয়েছে, ডেভনের পান্না দ্বীপে গিয়ে নিয়োগকর্তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।

সমুদ্রের ধারে মনোরম পরিবেশে কাজটা তার ভাল লাগবে বলেই সে মনে করছে।

প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। আর এক কামরায় বসে আছেন মিস এমিলি ব্রেনট। বয়স পঁয়ষট্টি। চিরকুমারী। সেকেলে চিন্তাভাবনার মানুষ। বাইবেল নিয়ে বসে থাকতেই ভালবাসেন।

একটা চমৎকার আমন্ত্রণ পেয়ে, তিনি পান্না দ্বীপে চলেছেন। তার পুরনো এক বান্ধবী লিখেছে–

…বেলহাভেনের এক অতিথি-নিবাসে আলাপ হয়েছিল, নিশ্চয় মনে আছে। আপাতত জানাচ্ছি, ডেভনের কাছে আমি নিজেই একটা অতিথি-নিবাস খুলছি। আপনার মত সুরুচিসম্পন্ন লোকেরা থেকে আনন্দ পাবেন।

চলে আসুন না আগস্ট মাসের ৮ তারিখে। খুব আনন্দ হবে।

শুভেচ্ছান্তে
ইতি
ইউ, এন, ও

বছর দুয়েক আগে মিস এমিলি বেলহাভেনে গিয়েছিলেন। মনে আছে, সেখানে মাঝবয়সী এক মহিলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। অবশ্য নাম বা পদবী এখন আর মনে পড়ছে না। তাতে কি, আমন্ত্রণটা আন্তরিক, কদিন শান্তিতে থাকা যাবে। চারপাশে আজকাল ছেলেছোকরাদের যা চলন-বলন হয়েছে, ঘেন্না ধরে যায়।

.

অন্য একটা ট্রেনে জানালার কাছে বসে আছেন জেনারেল ডগলাস। শাখা লাইনের ট্রেন-গতি মন্থর। পান্না দ্বীপে পৌঁছতে অনেক সময় লাগিয়ে দেবে।

কে এক আওয়েনের চিঠি পেয়েই তিনি চলেছেন সেখানে। লোকটিকে চিনতে না পারলেও চিঠিটা অগ্রাহ্য করতে পারেননি।

ভদ্রলোক লিখেছেন–

… পুরনো বন্ধুরাও অনেকেই আসছেন। আপনিও চলে আসুন না, বেশ ভাল লাগবে। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করা যাবে।

হারানো দিনের কথা জেনারেলের ভালই লাগে, এক রিচমণ্ড প্রসঙ্গ বাদে। প্রায় ত্রিশ বছর আগের এক বিষাক্ত অতীত সেটা। তা হোক–ওই প্রসঙ্গে না এলেই হল।

ট্রেনের গতিটা যদি বাড়ত। অধীর হয়ে পড়ছেন ক্রমেই জেনারেল।

.

ডাঃ আরমস্ট্রং চলেছেন সলসবেরি থেকে। মরিস গাড়িটা নিজেই চালাচ্ছেন। ধোপদুরস্ত পোশাক, সুন্দর চেহারা। সাফল্যের ঔজ্জ্বল্য মাখানো মুখে।

চিকিৎসক হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে খ্যাতিমান। জীবনে অবসর বলে কিছু নেই। এটাই খ্যাতির বিড়ম্বনা। তাই পান্না দ্বীপের ডাক পেয়ে খুশি হয়েছেন।

রুগী দেখাও হবে, সেই সঙ্গে নির্জন পরিবেশের সুখও উপভোগ করা যাবে।

চিঠি পাঠিয়েছেন মিঃ আওয়েন। তাঁর স্ত্রী নার্ভের অসুখে ভুগছেন। এ অবশ্য এমন কিছু রোগের পর্যায়ে পড়ে না।

ডাঃ আরমস্ট্রং-এর সাফল্যের ইতিহাস অবশ্য একেবারে কলঙ্কমুক্ত নয়। সেই অধ্যায় অবশ্য তাঁর চিকিৎসক জীবনের গোড়ার দিককার।

তারপর থেকে কোন দিন আর পানপাত্র স্পর্শ করেননি। আগের তুলনায় অনেক বেশি সতর্কও হয়ে গেছেন।

পান্না দ্বীপ আরও একশো মাইল। এই পথটা দ্রুত অতিক্রম করবার জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে চলেছেন অ্যান্টনি মাসটন।

সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য তরুণী মহলে খুবই জনপ্রিয় মার্সটন। এ বিষয়ে তিনি নিজেও যথেষ্ট সচেতন।

.

প্লাইমাউথ থেকে ট্রেনটা চলেছে মন্থরগতিতে। ব্লোর এই ট্রেনে চলেছে পান্না দ্বীপে। কামরায় দ্বিতীয় যাত্রী বলতে এক বৃদ্ধ নাবিক। জানালার ধারে বসে ঝিমোচ্ছে।

ব্লোর পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে নামগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল–

এমিলি ব্রেনট, ভেরা ক্লেথর্ন, ডাঃ আরমস্ট্রং, অ্যান্টনি মার্সটন, বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভ, ফিলিপ  লমবার্ড, জেনারেল ডগলাস, আর পরিচারক রজার্স ও তার স্ত্রী।

ব্লোর ভাবে, তালিকায় তার নামটাও থাকা উচিত ছিল। নিজেকে কি বলে পরিচয় দেবে সে? দলে একজন ফৌজি জেনারেল রয়েছে, নইলে স্বচ্ছন্দে সে রিটায়ার্ড ফৌজি অফিসার হতে পারত।

একটা পরিচয় অবশ্য নেওয়া যায়–দক্ষিণ আফ্রিকার একজন বিশিষ্ট নাগরিক। খাঁটি ইংরাজ ব্যবসায়ী।

সে আরও ভাবল, ভ্রমণকাহিনী যা পড়া আছে, তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলে নিজেকে জাহির করতে পারবে।

তালিকায় যাদের নাম দেখল, এরা নিশ্চিত কেউ তার ফাঁকিবাজি ধরতে পারবে না।

জানালার ধারের বুড়ো নাবিক হঠাৎ নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল–সমুদ্রের গতিক বড় সুবিধার মনে হচ্ছে না।

ব্লোর উপযাচক হয়েই বুড়োর কথার সমর্থন জানাল–তাই বুঝি?

বুড়ো খুক খুক করে কাশল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ঝড় আসছে–ঝড়–

–কিন্তু আবহাওয়া তো ভালোই দেখছি।

–না, না, গন্ধ পাচ্ছি। বড়–ঝড় ভয়ঙ্কর ঝড় আসছে।

ব্লোর কোন জবাব করল না এবারে।

.

০২.

ওক ব্রিজ স্টেশনের বাইরে চারজনের একটা দল জড়ো হয়েছে।

তাদের কারুর সঙ্গে পরিচয় নেই। প্রত্যেকের পেছনেই একটা করে সুটকেস নিয়ে কুলি দাঁড়িয়ে আছে।

দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। একজন চালক এগিয়ে এল। দলের মধ্যে মিঃ ওয়ারগ্রেভ বয়স্ক এবং সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ। তাকে উদ্দেশ্য করেই ট্যাক্সিচালক বলল, আপনারা পান্না দ্বীপে যাবেন তো, স্যার?

–হ্যাঁ।

–আপনাদের জন্য দুটো ট্যাক্সি রয়েছে। পাঁচমিনিট পরেই এক্সেটার থেকে ট্রেনে এক ভদ্রলোক আসছেন। তাকেও নিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মধ্যে একজন তার জন্য অপেক্ষা করে বাকি সকলে আমার সঙ্গে চলুন।

এই ব্যবস্থা মত ভেরা ক্ৰেথর্ন এবং ফিলিপ লমবার্ড রইল। অন্যরা সকলে একটা ট্যাক্সি চেপে। পান্না দ্বীপের দিকে রওনা হয়ে গেল।

ভেরা এবং লমবার্ড স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছে। পারস্পরিক পরিচয় বিনিময়ের পর কথায় কথায় তারা দুজনেই জানতে পারে নিমন্ত্রণকর্তা মিঃ আওয়েন কারুরই পরিচিত নন।

ব্লোর বলে, আমি মিসেস আওয়েনের সেক্রেটারির চাকরি নিয়ে একমাসের জন্য এখানে এসেছি। আওয়েনদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।

.

একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় স্টেশনে। বিরাট চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এলেন। নিখুঁত পোশাকের মানুষটির চালচলন ফৌজিদের মত। ইনিই হচ্ছেন জেনারেল ডগলাস।

ভেরা এবং  লমবার্ড এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করে। ভেরা বলে, আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। চলুন যাওয়া যাক।

তিনজনে ট্যাক্সিতে উঠে বসেন। তীব্রগতিতে ট্যাক্সি ধেয়ে চলে।

.

সমুদ্রতীরে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছয় ট্যাক্সিটা। একটা চায়ের দোকানে মাঝি-মাল্লারা বসে আড্ডা মারছে। সেখানেই বসেছিলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ এবং যে বোটে করে তারা যাবে তার চালক ডেভিসও ছিল তাদের সঙ্গে।

ভেরা ট্যাক্সি থেকে নামতেই ডেভিস এগিয়ে গিয়ে জানাল, আসুন, আমরা আপনাদের জন্যই প্রতীক্ষা করছি। আমাদের সকলের জন্য হয়তো মিঃ এবং মিসেস আওয়েন অধীর আগ্রহে রয়েছেন।

নির্জন জায়গাটা দেখে সকলের মনেই কেমন অদ্ভুত একটা শিহরণ জেগে ওঠে। কোথায় যাচ্ছেন, কার কাছে যাচ্ছেন কিছুই তাঁরা জানেন না, তবু অজ্ঞাত সেই আমন্ত্রণকারীর আকর্ষণ তারা কেউ অবহেলা করতে পারছেন না।

বোটচালক ডেভিস বোটে গিয়ে ওঠে। অন্যান্য সকলেও তাকে অনুসরণ করে।

ডেভিস বলে, মিঃ আওয়েন বলেছিলেন, আরও দুজনের আসার কথা আছে। তবে তাদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করবার প্রয়োজন নেই।

ঠিক সেই সময়েই প্রচণ্ডগতিতে ধেয়ে এসে একটা সুন্দর ট্যাক্সি সমুদ্রতীরে থামল। নেমে এলেন অপূর্ব সুন্দর একজন মানুষ। গ্রীক ভাস্কর্যেই কেবল তার তুলনা মেলে। ইনিই হলেন অ্যান্টনি মার্সটন।

ডেভিস সম্ভাষণ জানিয়ে আহ্বান জানায়। মিঃ মার্টন বোটে উঠতেই বোট ছেড়ে দিল।

.

সামনেই পান্না দ্বীপ। কিন্তু একটা ছোট্ট পাহাড় তাকে আড়াল করে রেখেছে বলে এখান থেকে দ্বীপটাকে দেখা যায় না।

বোটটা কিছুটা ঘুরে গিয়ে দুটো পাথরের মাঝখানে থামল।

একে একে সকলেই অবতরণ করলেন। জায়গাটা নির্জন ও সুন্দর। চারপাশে ফল, ফুলের গাছ, সুন্দর বাগান, তার মাঝখানে চমৎকার একটা বাড়ি। প্রাসাদোপম। সকলেরই পছন্দ হয় জায়গাটা।

একজন বয়স্ক পরিচারক এগিয়ে এসে বলে, দয়া করে আপনারা এদিকে আসুন।

সকলে পাশাপাশি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বিরাট হলঘর সামনে। উপযুক্ত টেবিল চেয়ারও রয়েছে। বড় টেবিলে অনেক পানীয় রয়েছে।

পরিচারকটি আবার বলে, আপনারা এখানে বিশ্রাম করুন। আমার নাম রজার্স। আমি এবং আমার স্ত্রী আপনাদের দেখাশোনা করব।

মিঃ আওয়েন দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি আজ আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। তবে আগামীকাল দুপুরের মধ্যে এসে যাবেন। আপনাদের সকলের জন্যই আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা আছে।

আপনারা বিশ্রাম করুন, আটটায় ডিনার।

এই বলে বিদায় নিয়ে রজার্স তার কাজে চলে গেল।

রজার্সের স্ত্রীর সঙ্গে ভেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। একটা ঘরের দরজা খুলে সে বলল, ম্যাডাম এটা আপনার ঘর।

চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরটা দেখে ভেরার খুব পছন্দ হল। সে খুশি হয়ে বলল, খুব সুন্দর ঘর।

–আপনার কিছু প্রয়োজন হলে দয়া করে বেল বাজাবেন।

ভেরা বলল, আচ্ছা শোন, আমি হলাম মিসেস আওয়েনের সেক্রেটারি। আমার কথা তোমাকে নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন তিনি?

–না ম্যাডাম; আমি কিছুই জানি না। আমরা কেবল একটা তালিকা পেয়েছি, তাতেই জানানো ছিল কে কোন ঘরে থাকবেন।

ভেরা কথাটা শুনে বিরক্ত হল। ভদ্রমহিলা তো অদ্ভুত! তাঁর নিজস্ব কর্মচারি হয়ে আসছে। সে, অথচ–

ভেরা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাজের লোক এখানে কজন আছ?

–আমরা দুজন। রান্নার কাজটা আমি দেখি, বাইরের অন্যসব কাজ আমার স্বামী দেখেন। আপনাদের কোনো অসুবিধাই হবে না।

–আমরা তো লোক কম নই, দশজন। তার ওপর মিঃ ও মিসেস আওয়েন আসবেন। এতজনের কাজ–

–অসুবিধে হবে না। ম্যাডাম, এবার আমি একটু কিচেনের দিকে যাচ্ছি।

রজার্সের স্ত্রী চলে গেল। মহিলার চোখমুখ ফ্যাকাসে। রক্তশূন্যতা বলেই মনে হল ভেরার। কিন্তু সমস্ত অবয়বে কেমন যেন একটা ভয়-ভয় ভাব। কিসের ভয়?

দিন শেষ হবার মুখে মুখে ডাঃ আরমস্ট্রং বোট থেকে পান্না দ্বীপে নামলেন। বোটচালকের নাম নরোকট।

অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। দ্বীপের চারদিক পরিষ্কার দেখা গেল না। ডাক্তার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। মনে বড় আরাম পেলেন।

ধীর পায়ে এগিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়ল তার। চিনতে পারলেন তাকে–বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ।

একবার তার এজলাসে ডাক্তারকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল। দক্ষ বিচারপতি। দোষীদের প্রতি নিষ্করুণ। সেই কারণে অনেকেই আড়ালে তাকে নিষ্ঠুর বলে।

এখানে যে তার দেখা পাবেন ডাক্তার আশা করতে পারেননি।

.

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভও ডাক্তারকে দেখে ভাবছিলেন, এই ভদ্রলোকই তো–হ্যাঁ, নামটা মনে পড়েছে, আরমস্ট্রং–একবার সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন।

মিঃ ওয়ারগ্রেভ একবার যাকে দেখেন, সহজে তাকে ভোলেন না। তিনি ডাক্তারকে বললেন, ওই হলঘরে গিয়ে বসুন।

ডাক্তার জানান, ভাবছি মিঃ ও মিসেস আওয়েনের সঙ্গে একবার দেখা করব।

–তা তো সম্ভব নয়!

–নয়?

–ওরা কেউ এখানে নেই। কোথায় যে এসেছি, কিছুই বুঝতে পারছি না।

ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর তিনি হলঘরের দিকে এগিয়ে যান।

.

অ্যান্টনি মার্সটন পথের ক্লান্তি দূর করল প্রাণভরে স্নান করে। নতুন পোশাক পরে বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে নিয়েছে।

নির্জন জায়গাটা তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। একটা যেন ছমছমে ভাব। তবে এ নিয়ে তার মনে ভয়টয়ের কোনো ব্যাপার নেই। ভয় কাকে বলে সে জানে না।

.

ব্লোর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় চিরুনি বোলায়, টাইয়ের নটটাও ঠিকঠাক করে নিতে ভোলে না।

মনে মনে ভাবছে, এতগুলো মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে, কেউ কাউকে চেনে না। আমন্ত্রণকারীও অনুপস্থিত। সবই যেন কেমন অদ্ভুত। কেউ বিশেষ কোন কথা বলছে না, কিন্তু পরস্পরের দিকে যেন কেমন করে তাকাচ্ছে।

ব্লোর-এর মনে পড়ল, ছোটবেলায় একবার এই দ্বীপে বেড়াতে এসেছিল। ভাগ্যের কি নির্বন্ধ, আবার এসেছে এখানে।

.

কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় ডিনারের ঘন্টা বাজল। ফিলিপ লমবার্ড ঘর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল।

মিস এমিলি বাইবেল খুলে বসেছিলেন। ডিনারের ঘন্টা শুনে বই বন্ধ করে রাখলেন। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগলেন।

.

০৩.

ডিনারে রজার্সের স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করলেন সকলে। রজার্স নিজেও চমৎকার পরিবেশন করল। অতিথিরা সকলেই খুশি।

এসে অবধি সকলের মধ্যেই যে একটা গুমোট ভাব ছিল সেটা এখন নেই। একে অন্যের সঙ্গে মন খুলে গল্পগুজব করছেন।

ডাক্তার ও মাসটন গল্প জুড়েছেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভের সঙ্গে। আদালতের নানা কাহিনী তিনি শোনাচ্ছেন।

ওদিকে ডগলাস ও মিস এমিলির মধ্যেও আলাপ যেন বেশ জমে উঠেছে।

ভেরা ক্লেথর্ন বরাবরই বড্ড কৌতূহলী। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প শুনছেন ডেভিসের কাছ থেকে। পাশে বসে শুনছেন লমবার্ডও। মাঝে মাঝে অন্যদের দিকেও তাকাচ্ছে।

–এগুলো কি?

মার্সটনের কথায় সকলেই তাকাল তার দিকে। সকলেরই চোখে পড়ল, ডাইনিং টেবিলের দক্ষিণ কোণে একটা টেবিলে কাচের স্ট্যান্ডে সাজান রয়েছে রঙীন দশটা পুতুল।

-বাঃ ভারি সুন্দর তো। ভেরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, এ যে অনেকগুলো। এক…দুই… তিন…বাব্বাঃ দশটা পুতুল। ছেলেবেলায় আমারও ছিল কতগুলো।

–সবারই থাকে। একজন বলল।

–এসব হল বড়লোকের বিচিত্র খেয়ালের নমুনা। বললেন ওয়ারগ্রেভ।

–ঠিকই বলেছেন। সমর্থন জানাল মিস এমিলি।

বাতাসের সঙ্গে সমুদ্রের গর্জন ঘরে ঢুকছে। কখনো বাড়ছে কখনো স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। ভেরা বলে, মনে হয়েছিল ঝড় উঠবে। তাহলে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। মিসেস আওয়েনরা আমাদের জন্য সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন।

–কে মিস আওয়েন? বলে ওঠেন মিস এমিলি, ওরকম কোনো নাম আমার মনেই পড়ছে না। অথচ–

এমন সময় রজার্স কফি নিয়ে ঘরে ঢুকল। আপাততঃ আওয়েন প্রসঙ্গ চাপা পড়ল। সকলে কফি নিয়ে বসলেন।

ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত নটা ঘোষণা হল। সকলেই চুপচাপ। কফি পান করছেন নিঃশব্দে। ডাঃ আরমস্ট্রং বারবার তাকাচ্ছে পুতুলগুলোর দিকে।

সহসা বাতাসের দাপাদাপি থেমে যায়। কেমন থমথমে হয়ে ওঠে ঘরের পরিবেশ। যেন এখুনি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। যেন তারই প্রতীক্ষা করছে সকলে।

তা কিন্তু ঘটলও। সহসা নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে একটা অজানা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শূন্যে ভেসে এল

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমোদয়গণ শুনুন। আপনাদের সকলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। একে একে বলে যাচ্ছি–

(১) এডওয়ার্ড জর্জ আরমস্ট্রং–আপনি ১৪ই মার্চ ১৯… লুইসা মেরি ক্লেসের মৃত্যু ঘটিয়েছেন।

(২)। এমিলি ক্যারোলাইন ব্রেনট–আপনি ৫ই নভেম্বর … বিয়াত্রিচে টেলর-এর মৃত্যুর জন্য দায়ী।

(৩) উইলিয়াম হেনরি ব্লোর–আপনি ১০ই অক্টোবর … জেমস স্টিফেন ল্যান্ডার-এর মৃত্যু ঘটিয়েছেন।

(৪) ভেরা এলিজাবেথ ক্লেথর্ন–আপনি ১১ই আগস্ট … সিসিল অগিলভি হ্যামিল্টনকে হত্যা করেছেন।

(৫) ফিলিপ  লমবার্ড–আপনি … ফেব্রুয়ারি, আফ্রিকায় একুশজন লোকের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

(৬) জন গর্ডন ডগলাস–৪ঠা জানুয়ারি …, আপনি আপনার স্ত্রীর প্রণয়ী রিচমণ্ডকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।

(৭) অ্যান্টনি জেমস মার্সটন–আপনি ১৩ই নভেম্বর … জন লুসি ও কোম্বের হত্যার জন্য দায়ী।

(৮) ও (৯) টমাস রজার্স ও এথেল রজার্স–তোমরা, ৬ই মে … জেনিফার ব্র্যাডির মৃত্যুর কারণ।

(১০) লরেন্স জন ওয়ারগ্রেভ–১০ই জুন, আপনি এডওয়ার্ড সেটনকে হত্যার অপরাধে অপরাধী।

অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ, আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনাদের কোন বক্তব্য আছে কি?

.

যেমন আচমকা কথাগুলো শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে রজার্স কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল। ঘরের বাইরে একটা আর্তনাদ আর কিছু পড়ে যাবার শব্দ শোনা গেল।

লমবার্ড দৌড়ে বাইরে এসে দেখল, রজার্সের স্ত্রী এথেল অচেতন হয়ে পড়ে আছে। লমবার্ড ও এমিলি দুজনে ধরাধরি করে তাকে সোফায় নিয়ে শুইয়ে দিল।

ডাঃ আরমস্ট্রং এগিয়ে এসে পরীক্ষা করলেন। বললেন, ভয় নেই, অজ্ঞান হয়ে গেছে, এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।

লমবার্ড ব্র্যান্ডি আনতে ছুটল। ভেরা চিন্তিতভাবে বলল, এভাবে কে কথা বলল?

ডগলাস বলল, নিশ্চয়ই মশকরা করেছে। কিন্তু বড্ড বিশ্রী। স্বর কাঁপছে তার।

ব্লোর কপালে ঘাম জমে উঠেছিল। রুমাল দিয়ে তা মুছল। তবে সে বিচলিত হয়নি। ওয়ারগ্রেভ এবং এমিলির মধ্যেই কেবল কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।

লমবার্ড সাহসের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দাটা খুঁজল, কিন্তু কাউকে কোথাও দেখতে পেল না।

একপাশে একটা ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। আর তখনই রহস্যটা ধরা পড়ে গেল।

–এই তো দেখছি। আনন্দে লাফিয়ে উঠে লমবার্ড ঘরে ঢুকে পড়ল। এমিলি ছাড়া সকলেই সেখানে ছুটে গেল।

ঘরে একটা টেবিল। তার ওপরে চোঙাওয়ালা একটা সেকেল গ্রামাফোন। তাতে একটা রেকর্ড চাপানো রয়েছে। চোঙার মুখ দেওয়ালের দিকে। তাই ঘরের দেওয়ালের ওপারেই বসার ঘর, বেশ কয়েকটা ফুটো রয়েছে দেওয়ালে।

পিনটা রেকর্ডের ওপর রেখে চালাতেই আবার আগের কথাগুলো বেজে উঠল।

–সর্বনাশ, বন্ধ করুন। ভেরা চেঁচিয়ে ওঠে।

লমবার্ড সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার হেসে বললেন, ঠাট্টা বটে তবে খুবই নিকৃষ্ট শ্ৰেণীর।

–কিন্তু চালালো কে?

সকলে আবার বসার ঘরে ফিরে গেল। রজার্স ইতিমধ্যে ব্র্যান্ডি নিয়ে এসেছে। তার স্ত্রীর সেবা করছেন এমিলি। সে এখন কথা বলতে পারছে। তার সারা মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

রজার্স বলে, এথেল, ভয় পাবার কিছু নেই। এটা খুবই বাজে একটা ব্যাপার।

–কিন্তু কী ভয়ঙ্কর সেই স্বর। কাঁপা গলায় বলে এমিলি।

ডাক্তার খানিকটা ব্র্যান্ডি এথেলের গলায় ঢেলে দেন। সে চাঙা হয়ে উঠতে থাকে।

–কী সাংঘাতিক সব মিথ্যা কথা। আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বলল রজার্স।

–কিন্তু রেকর্ডটা বাজাল কে?

রসার্জ কাঁপা কাঁপা স্বরে জানায়, মিঃ আওয়েনের নির্দেশেই এটা করা হয়েছে।

–কি নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি?

–বলেছেন, আপনারা সকলে যখন কফি পান করবেন, সেই সময় গ্রামাফোনে রেকর্ডটা চাপিয়ে চালিয়ে দিতে। কাজের ভার দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীকে।

মিঃ ওয়ারগ্রেভ রেকর্ডটা তুলে তার গায়ের লেখাটা পড়ে বললেন, একটা গানের রেকর্ড দেখছি। বেলা শেষের গান।

সকলে একই সঙ্গে কথাটার পুনরাবৃত্তি করে উঠল।

.

ডগলাস বলে উঠলেন, লোকটা দেখছি মোটেই সুবিধের নয়। তাকে একটা শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

–কিন্তু আওয়েন লোকটা কে? এমিলি তিক্ত স্বরে জানতে চাইলেন।

–ঠিক বলেছেন, লোকটার খবরাখবর জানা দরকার। রজার্স তুমি তোমার স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়ে এসো। তোমার সঙ্গে দরকারী কথা আছে। বললেন ওয়ারগ্রেভ।

ডাক্তার রজার্সকে সাহায্য করলেন। তাদের দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে এমিলি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ডাক্তার একটু পরেই ফিরে এসে জানালেন, এথেল ভাল আছে। তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে এলাম।

রজার্সও ঘরে ঢুকল প্রায় তার পেছন পেছন।

বয়স এবং পদমর্যাদায় মিঃ ওয়ারগ্রেভই ছিলেন প্রধান। আলোচনা সভার পরিচালনার দায়িত্ব তিনিই নিলেন।

সকলকে সম্বোধন করে বললেন, আওয়েন-রহস্যের একটা কিনারা হওয়া দরকার। আচ্ছা, রজার্স, এই লোকটি কে?

–পান্না দ্বীপের মালিক।

–তুমি নিশ্চই তাকে দেখেছ?

–না স্যার, মোটে এক সপ্তাহ হল আমি আর আমার স্ত্রী এসেছি। খবরের কাগজে বক্স নম্বর দেখে চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম। একটা চিঠির মাধ্যমে আমাদের চাকরি দেওয়া হয়েছিল।

সেই চিঠি অনুসারে আমরা এখানে এসে সব ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে নিয়েছিলাম।

তারপর আর একটা চিঠি এল, তাতে জানানো হল, অতিথিরা আসছেন, তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়।

গতকাল বিকেলে আর একটা চিঠিতে জানানো হল, ওঁরা আপাতত আসতে পারছেন না। আর ডিনার, কফি এবং রেকর্ড সম্পর্কেও তাতে নির্দেশ ছিল।

রজার্স পকেট থেকে একটা খাম বার করে মিঃ ওয়ারগ্রেভের দিকে বাড়িয়ে দিল।

একটা টাইপ করা চিঠি। তাতে ঠিকানা লেখা রয়েছে–বিৎস হোটেল।

আরও দু-একজন চিঠিটা দেখল। ওয়ারগ্রেভ বললেন, এখানে সকলেই আমরা আওয়েনের অতিথি। কিন্তু তিনি কে তা আমাদের ভালভাবে জানা দরকার। তাঁর সম্পর্কে কে কতটা জানেন তা জানা প্রয়োজন।

এমিলি বললেন, আমিই প্রথমে বলছি। গোড়া থেকেই ব্যাপারটা আমার খুব গোলমেলে ঠেকেছে। এক বান্ধবীর কাছ থেকে এখানে আসার আমন্ত্রণপত্র পাই। কিন্তু চিঠির তলায় নামটা ছিল অস্পষ্ট–ভালভাবে পড়া যাচ্ছিল না। তবে আওয়েন বলে কাউকে আমি চিনি না।

এরপর ভেরা জানাল, সে এখানে সেক্রেটারির নিয়োগপত্র পেয়ে এসেছে।

মার্সটন জানাল, বার্কলে বলে আমার এক বন্ধু থাকে নরওয়েতে। কিন্তু আশ্চর্য হল, তার চিঠিতে এখানকার চাকরির ব্যাপারটা জানতে পারি।

ডাক্তার বললেন, আওয়েন বলে কাউকে আমি চিনতাম না। তবে আমার পেশার ব্যাপারে কল পেয়েই এখানে এসেছি।

জেনারেল ডগলাস জানালেন, আওয়েনের একটা চিঠি আমি পাই। তাতে জানানো হয়েছিল, এখানে এলে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।

লমবার্ড বললেন, এরকম একটা চিঠি আমিও পেয়েছিলাম। জানানো হয়েছিল, আমার পুরনো বন্ধুরা আসছেন, আপনিও এলে আনন্দ হবে।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ চুপ করে সকলের কথা শুনলেন। পরে ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা অজ্ঞাত কণ্ঠস্বর আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা শুনিয়েছে। সেসব সত্যি কি মিথ্যা তা অবশ্য যাচাইয়ের প্রশ্ন।

তবে, একটা বিচিত্র ব্যাপার হল যে একমাত্র উইলিয়াম হেনরি ব্লোরের নামেই কোন অভিযোগ নেই। এই নামে আমাদের মধ্যে কেউ নেই–একজন আছেন মিঃ ডেভিস বলে। তার নামও এই অপরাধের তালিকায় নেই।

ব্লোর একথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, আমার নাম ডেভিস নয়—

তাহলে আপনি উইলিয়াম হেনির ব্লোর?—

হ্যাঁ।

লমবার্ড সঙ্গে সঙ্গে ব্লোরের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ম গলায় বলল, তুমি বলেছিলে, দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাটাল থেকে এসেছ। আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছি। আমার ধারণা, তুমি ন্যাটাল বা দক্ষিণ আফ্রিকায় জীবনে যাওনি।

সকলের দৃষ্টি ব্লোরের দিকে ঘুরল। ক্রুদ্ধ সে দৃষ্টি। মার্সটন তো ঘুসি বাগিয়েই এগিয়ে এল।

ব্লোর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আপনারা শুনুন, আমার পরিচয়পত্র সঙ্গেই রয়েছে। আমি আগে পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগে ছিলাম। এখন আমি প্রাইভেট গোয়েন্দা। এখানে সেই কাজ নিয়েই এসেছি।

–আপনাকে কে আসতে বলেছে?

–মিঃ আওয়েন। মনিঅর্ডারে মোটা টাকার পারিশ্রমিক পাঠিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন, আপনাদের ওপর নজর রাখার জন্য।

–নজর রাখতে? কিন্তু কেন?

–যাতে মিসেস আওয়েনের মূল্যবান গয়নাগাঁটি খোয়া না যায়। এখন বুঝতে পারছি, সবই ভাঁওতা, ও নামে এখানে কেউ নেই।

ভেরা বলল, যদি থাকেও, বদ্ধ পাগল ছাড়া কিছু নয়।

মিঃ ওয়ারগ্রেভ বললেন, তবে তাকে ভয় করবার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই আমার মনে হচ্ছে।

.

০৪.

হঠাৎ করে সকলেই কেমন নীরব হয়ে যায়। যেন হতাশায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে।

নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। বললেন, আমি কেন এখানে এসেছি এবারে বলি।

বলে পকেট থেকে একটা খাম বার করে তিনি টেবিলে রাখলেন। তার ভেতরের চিঠিটা বার করে সকলকে দেখিয়ে বললেন, কয়েকদিন আগে এটা পেয়েছি, লিখেছেন লেডি কনস্টান্স কালমিংটন।

তিনি আমার বিশেষ পরিচিত হলেও বেশ কয়েক বছর কোন যোগাযোগ নেই। এই চিঠিটা ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। আপনারাও এরকম চিঠি একটা করে পেয়েছেন। যে বা যারা এই চিঠি পাঠানোর পেছনে রয়েছে, বোঝা যাচ্ছে তারা আমাদের ব্যাপারে অনেক খবরাখবর জোগাড় করেছে।

তাই অপরাধগুলো একে একে আমাদের সবার ঘাড়ে চাপিয়েছে।

জেনারেল ডগলাস সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, এসবই মিথ্যা কথা।

–একটা বদমাশ লোকের কারসাজি এসব। ভেরা চিৎকার করে বলে।

পরপর সকলেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ওয়ারগ্রেভ হাত তুলে সকলকে থামতে অনুরোধ জানালেন। পরে বললেন, আমি আমার নিজের কথাই প্রথমে বলি শুনুন।

এই অজানা বন্ধুটি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে জনৈক এডওয়ার্ড সেটনের মৃত্যুর জন্য নাকি আমি দায়ী।

ঘটনাটা বললেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি দোষী কি নির্দোষ। ১৯… জুন মাসে আমার এজলাসে লোকটির বিচার হয়। বয়স্কা এক নারীকে হত্যা করেছিল সে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে সে জোরালো যুক্তি দিয়েছিল, জুরীরাও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।

কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তার চুলচেরা বিচার করে আমি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিই।

মিঃ ওয়ারগ্রেভ সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের বললেন, আমি বিচারকের আসনে বসে আইন রক্ষার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আমার বিবেকের কাছেও আমি পরিষ্কার। আপনারাই বলুন, আমার অপরাধটা কোথায়?

ডাঃ আরমস্ট্রং-এর মনে পড়ে যায় মামলাটার কথা।

এক অ্যাডভোকেট বন্ধুর কাছে তিনি শুনেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, আসামীর ওপর জজের নিশ্চয় কোন পোষা রাগ ছিল। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আইন ঘেঁটে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিল।

ডাক্তার বললেন, মামলার আগে থেকে আপনি কি সেটনকে চিনতেন?

কথাটা শুনে ওয়ারগ্রেভের মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে নিজেকে সংযত করলেন। বললেন, তার নাম পর্যন্ত আগে কখনো শুনিনি। পরিচয়ের প্রশ্নই আসে না।

ডাক্তার আরমস্ট্রং কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। মনে মনে বললেন, জজসাহেব, তুমি মিথ্যাবাদী।

.

বিচারপতির বক্তব্য শেষ হলে ভেরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার কথাটা বলছি শুনুন। একটা শিশু, তার ডাকনাম ছিল সিরিল। আমি তার গভর্নেস ছিলাম। আমি তাকে খুব ভালবাসতাম।

বলতে বলতে কান্নায় বুজে এলো তার গলা। পরে সামলে নিয়ে বলল, একদিন আমি তাকে সাঁতার শেখাচ্ছিলাম।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আমার জলে নামার আগেই দুষ্টুটা জলে নেমে পড়েছিল। খেয়াল হতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

তাকে টেনে তুললাম বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এই শিশুটির মৃত্যুর জন্য আমি তো দায়ী ছিলাম না।

ভেরা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিল। পরে বলল, তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। ওদের পরিবারের কারোরই কোনো অভিযোগ ছিল না আমার ওপরে, সকলেই আমাকে ভালবাসতো।

কিন্তু এখন এতদিন পরে আমাকে এই মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে। এসব কি? কার এই কারসাজি? উদ্দেশ্য কি?

বলতে বলতে ভেরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

জেনারেল ডগলাস ভেরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তুমি কেঁদো না। সবই মিথ্যে। আমরা সকলেই তা বুঝতে পারছি। কোন পাগলেরই কাণ্ড এসব।

এরপর ডগলাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকল্পিত দৃঢ় স্বরে বললেন, আর্থার রিচমণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আমার স্ত্রীর সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, তার কোন সত্যতা নেই। আমার স্ত্রী ছিলেন নির্মল চরিত্রের সাধ্বী মহিলা।

রিচমণ্ড ছিল আমার বাহিনীর এক নতুন অফিসার। যুদ্ধক্ষেত্রেই সৈনিকের মত মৃত্যুবরণ করেছিল সে। একজন সৈনিকের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা।

কথা শেষ করে জেনারেল বসে পড়লেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছেন।

এবারে  লমবার্ড বলতে শুরু করলেন। দুচোখে কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি বললেন, অদৃশ্য অভিযোগকারী কালামানুষগুলোর কথা বলল, তা সম্পূর্ণ সত্য। সকলে চমকে উঠে তাকাল লম্বার্ডের দিকে।

–হ্যাঁ, সম্পূর্ণ সত্যি, হাসল  লমবার্ড, বনের মধ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। খাবারও ফুরিয়ে গিয়েছিল।

দলে আমরা ইংরাজ ছিলাম তিনজন। সবাই চায় নিজের প্রাণ বাঁচাতে। আমরাও ওদের ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছিলাম।

–ছিঃ ছিঃ, দলের লোকদের ফেলে পালিয়ে এলে? এ তো কাপুরুষের কাজ। ধিক্কার জানালেন ডগলাস।

–হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি,  লমবার্ড বলল, খাঁটি ইংরাজের মত কাজটা হয়নি। আমাদের তখনকার মনের অবস্থা আশা করি আপনারা বিবেচনা করবেন। তাছাড়া, কুড়িটা জংলী মানুষের চেয়ে তিনজন শ্বেতাঙ্গের প্রাণের মূল্য অনেক বেশি।

.

–আমার নিজের কথা এবারে বলছি, অ্যান্টনি মার্টন বলতে শুরু করলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনানো হয়েছে, জন এবং লুসি কোম্বের হত্যার জন্য নাকি আমি দায়ী।

কিন্তু ঘটনাটা যে একটা দুর্ঘটনা ছিল, তা আপনারাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। কেম্বুিজের কাছে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, কাছের একটা বাড়ি থেকে দুটো বাচ্চা দৌড়ে আমার গাড়ির তলায় এসে পড়েছিল। এভাবেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল।

.

মিঃ ওয়ারগ্রেভ রজার্সের দিকে তাকালেন। বুঝতে পেরে সে বলল, মিস ব্র্যাডির মৃত্যুর সঙ্গে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে যা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

–বলে যাও।

সেই বৃদ্ধা ছিলেন চিরকুমারী। তাঁর শরীর ভাল ছিল না। আমরা দুজন দেখাশোনা করতাম। একদিন রাতে তার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। তার মধ্যেই পায়ে হেঁটে ডাক্তারের বাড়ি গেলাম। তিনিও এলেন, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মিস ব্র্যাডি হার্টফেল করে মারা যায়।

লমবার্ড মুখে কিছু বলল না কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রজার্সের দিকে।

.

লমবার্ড ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে নিজের কথা আপনি কিছু বলুন।

–আমার আর কি কথা!

–কেন, অভিযুক্তদের তালিকায় আপনার নামও তো ছিল।

–ল্যান্ডারের কথা বলছেন, সে-তো ছিল একটা ব্যাঙ্কলুটের আসামী।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, এই মামলাটা আমার এজলাসে ওঠেনি। তবে মামলার কথা আমার মনে আছে।

আপনার সাক্ষ্য বিবেচনা করেই ল্যান্ডারের শাস্তি হয়েছিল। পুলিসের পক্ষে আপনিই তো মকদ্দমাটা তদারক করেছিলেন, তাই না?

–হ্যাঁ। ব্লোর বলল, রাতের পাহারাদারকে কাবু করে সে তার কাজ হাসিল করেছিল। তার অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছিল। কারাবাসেই অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছিল।

–দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করার জন্য আপনি কোন পুরষ্কার পাননি?

–হ্যাঁ, আমার পদোন্নতি হয়েছিল। তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমি আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করেছিলাম। জানায় ব্লোর।

.

এরপরে ডাঃ আরমস্ট্রং তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন।

–সকলেই যখন বললেন, আমাকেও বলতে হল। কিন্তু কি বলব বলুন? ওই রোগীর নামও আমার মনে নেই আর। অনেকদিন আগের কথা। মনে হয় হাসপাতালের কোন অপারেশন কেস।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন কিছু মনে করবার চেষ্টা করলেন ডাক্তার। পরে বললেন, শেষ মুহূর্তে এসেছিল হাসপাতালে। হ্যাঁ, আমি মদ্যপান করেছিলাম, কিছুটা নেশাও হয়েছিল। সেই অবস্থাতেই তাকে অপারেশন করেছিলাম।

হ্যাঁ, বলতে পারেন সেই মহিলাকে আমিই মেরে ফেলেছি। সামান্য অপারেশন হলেও, হাত কাঁপছিল, গোলমাল করে ফেলেছিলাম। কিন্তু এক সিনিয়র সিস্টার ছাড়া আর কেউ জানত না সেই ঘটনা।

কিন্তু, এই রহস্য আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এতদিন পরে কে সেই কথা জানল?

-আমার কাছ থেকে কিছু শুনবার জন্য নিশ্চয় আপনারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন? বললেন এমিলি ব্রেনট, কিন্তু আমার কিছুই বলার নেই।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ প্রশ্ন করলেন, কিছুই নেই?

–না, কিছুই নেই। কেন না, চিরকাল আমি আমার বিবেকের নির্দেশেই চলে এসেছি, আজও সেভাবেই চলেছি।

–বেশ, তাহলে এখানেই আমার তদন্ত শেষ হল।

এই বলে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর রজার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা রজার্স আমরা কজন, তুমি আর তোমার স্ত্রী ছাড়া এই দ্বীপে আর কি কেউ আছে?

–না স্যার, আমি ভাল করেই জানি।

-দেখ, যে লোকের আমন্ত্রণে আমরা এখানে এসেছি সে মোটেই সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দ্বীপ থেকে আমাদের চলে যাওয়া উচিত। সম্ভব হলে আজ রাতেই–

–কিন্তু স্যার এখন তো বোট নেই।

–তাহলে তীরের সঙ্গে তোমরা যোগাযোগ রাখ কি করে?

–নারাকোট রোজ সকালে আসে, রুটি, দুধ আর চিঠিপত্র থাকলে দিয়ে যায়। কিছু ফরমাস থাকলে পরে তার ব্যবস্থা করে।

–তাহলে, কাল সকালেই আমরা দ্বীপ ছেড়ে চলে যাব, আপনারা কি বলেন?

সকলেই বিচারপতির প্রস্তাব একবাক্যে সমর্থন করল। একমাত্র মার্সটন বলল, আমি কিন্তু যাচ্ছি না, বিপদে আমি ভয় পাই না, এই রহস্যের শেষ দেখে আমি যেতে চাই।

কথা শেষ করে টেবিলের ওপর থেকে একটা জলের গ্লাস তুলে নিলেন। কিন্তু মুখে ঠেকাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেল। মুখটা কুঁচকে উঠল, চেয়ার থেকে টলে পড়ে গেলেন।

.

০৫.

এমন আকস্মিকভাবে ঘটনাটা ঘটল যে, বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সকলের কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল।

সবার আগে ছুটে গেলেন ডাক্তার। নাড়ী পরীক্ষা করলেন, গম্ভীর গলায় বললেন, আশ্চর্য, এর মধ্যেই মৃত্যু!

গ্রীক ভাস্কর্যের মত সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল যুবক মার্সটন। এমনভাবে তার মৃত্যু হবে, কেউ যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। এমন অসম্ভব ঘটনা কি করে সম্ভব হয়?

জেনারেল ডগলাস জানতে চাইলেন, বিষম লেগেই কি এমনটা হল?

–হ্যাঁ, শ্বাসরোধেরই ঘটনা। তবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

এই কথা বলে ডাক্তার গ্লাসটা তুলে নাকের কাছে ধরলেন। আঙুলের ডগা দিয়ে তলানি থেকে কি তুলে নিলেন, আলতো করে জিভে ঠেকালেন।

এবারে তিনি তাকালেন মার্সটনের মৃতদেহের দিকে। মুখটা সামান্য বিকৃত হয়ে গেছে। ঠোঁটদুটো নীল।

ডাক্তার উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।

–তবে? ভেরা অস্ফুটে উচ্চারণ করল।

–আমার বিশ্বাস পটাসিয়াম সায়ানাইড, তাই সঙ্গে সঙ্গে কাজ করেছে।

–তাহলে কি গ্লাসে ছিল? ওয়ারগ্রেভও বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

–হ্যাঁ!

–এমন বিষ কি নিজেই মিশিয়েছিল? লমবার্ড জানতে চান।

ব্লোর প্রতিবাদ করেন, অমন মানুষের আত্মহত্যা করা অসম্ভব। অসম্ভব।

–মনে হয় আত্মহত্যাই। চিন্তিতভাবে বললেন ডাক্তার।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্য সকলেই ডাক্তারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।

অন্য গ্লাসগুলোও পরীক্ষা করা হল। কিন্তু সন্দেহ করার মত কিছুই পাওয়া গেল না।

ব্লোর বলল, এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

–আমিও আপনার সঙ্গে একমত। চিন্তিতভাবে বললেন ডাক্তার।

.

মার্টনের মৃতদেহ ধরাধরি করে তার ঘরে রেখে এলেন ডাক্তার আর  লমবার্ড। সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে আসা হয়েছে।

একটা অদৃশ্য ঝড় যেন বয়ে গেল সকলের ওপর দিয়ে। অস্বাভাবিক থমথমে হয়ে গেল সমস্ত পরিবেশ।

রাত অনেক হয়েছিল। বারোটা। ওয়ারগ্রেভ বললেন, রাত অনেক হল, সবারই একটু ঘুম দরকার।

রজার্স বলল, আপনারা শুতে চলে যান। আমি খাবার ঘরটা পরিষ্কার করে এখুনি যাচ্ছি।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?-

-এখন ঘুমোচ্ছে।

–বেশ। ঘুমটা দরকার।

.

রাতের পোশাক পরে ওয়ারগ্রেভ শুতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। সহসা এডওয়ার্ড সেটনের কথা তার মনে পড়ল।

দুঁদে উকিল ম্যাথুস ওর হয়ে খুব জোরালো সওয়াল করেছিল। কিন্তু সরকার পক্ষের উকিল ছিল একেবারে অপদার্থ।

জেরার উত্তরে সেটনও শান্ত সংযতভাবে সুন্দর জবাব দিয়েছিল। জুরিরাও প্রভাবিত হয়েছিল। সকলেই ধরে নিয়েছিল সে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।

ওয়ারগ্রেভ ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখলেন। বাঁধানো দুপাটি দাঁত খুলে একটা গ্লাসে জলে ডুবিয়ে রাখলেন।

কিন্তু এত কিছুর পরেও সেটন মুক্তি পায়নি। তার রায়েই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল লোকটার।

ওয়ারগ্রেভ যেন আলো সহ্য করতে পারছিলেন না। দ্রুত হাতে আলোটা নিভিয়ে দিলেন।

রজার্স তার কাজ শেষ করে এনেছে। এমনি সময়ে হঠাৎ ঘটনাটা তার নজরে পড়ে গেল।

এ কী করে সম্ভব? হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। একটু আগেও দশটা পুতুল সে দেখেছে, কিন্তু এখন রয়েছে একটা কম–নটা পুতুল।

আর্থার রিচমণ্ডের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। তাই বিছানায় শুয়েও কেবলই এপাশ-ওপাশ করছেন জেনারেল ডগলাস।

তরুণ অফিসারটিকে তিনি পছন্দ করতেন। তাঁর স্ত্রী লেসলিও খুশি হয়েছিল তাকে দেখে। ফলে যাতায়াত বাড়ল।

গল্পগুজব, একসঙ্গে খেলা ঘোরা সবই হতে লাগল। এখন বুঝতে পারছেন, স্নেহের ভাবটাকে প্রশ্রয় দিয়ে সেদিন কী ভুলটাই করেছিলেন।

লেসলির বয়স ছিল উনত্রিশ আর রিচমণ্ডের আঠাশ। বয়সের পার্থক্যটা চিন্তা না করেই দুজেনর মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

লেসলি ছিল সুন্দরী। তিনি ভালবাসতেন তাঁকে। বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এমনভাবে যে আঘাত পাবেন বুঝতে পারেননি।

তিনি ছিলেন ফ্রান্সে–বাহিনীর সঙ্গে। রিচমণ্ডও সেখানে। মাঝে মাঝে সে দেশে–ইংলণ্ডে যেত। লেসলি ছিল সেখানেই। অবাধে মেলামেশার সুযোগ তারা পেয়েছে।

বিচিত্র উন্মাদনায় ডুবেছিল তারা। হঠাৎ লেসলির একটা চিঠি তার হাতে পড়ে যায়–রিচমণ্ডকে লেখা। কিছু আর জানতে বাকি থাকে না।

রিচমণ্ডের ঘন ঘন দেশে যাবার রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। উঃ কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন তিনি।

সেই সময় লড়াই শেষ হবার মুখে। ফ্রান্সে শত্রুপক্ষের কয়েকটা সুরক্ষিত ঘাঁটি তখনো থেকে গিয়েছিল। তারই একটায় আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন রিমণ্ডকে। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হয়।

লেসলিকে তিনি রিচমণ্ডের মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু লেসলিকে কিছুই জানতে দেননি।

চমৎকার অভিনয় করে গেছেন চার বছর। লেসলি তারপর মারা গেল নিউমোনিয়া জ্বরে। সে তো আজ ষোল বছর আগের ঘটনা।

কিন্তু এই ঘটনা তো কেউ জানতো না। অথচ এতদিন পরে জানা গেল কেউ একজন। রিচমণ্ডের কথা জেনে গেছে। কিন্তু কে সে?

সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। জেনারেল ডগলাসের মনে হল শব্দটা যেন ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।

.

ঘরের ছোট্ট আলোটা জ্বলছে, ভেরা শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুম আসছে না তার চোখে।

হুগোর কথা মনে পড়ছে তার। মার্সটনের মৃত্যু কী এক অজ্ঞাত কারণে আলোড়ন তুলেছে। মনে।

মিষ্টি চেহারার চঞ্চল ছোট্ট সিরিল। শ্রীমতি হ্যাঁমিলটন তার মা।

সেদিন সন্ধ্যায় সিরিলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল ভেরা। নিজের ঘরে যেতে গিয়ে পেছন থেকে হুগোর ডাক শুনতে পেল। বলল, চলো, দুজনে একটু বেড়িয়ে আসি।

করনওয়াল … পাহাড়ঘেরা অঞ্চল … নীল আকাশ … সামনে সমুদ্র … নরম হলুদ বালির বালিয়াড়ি–

ভেরা সম্মত হয়। নির্জন সমুদ্রতীরে এসে পাশাপাশি বসে দুজন।

হুগো জানায়, ভেরা আমি তোমায় ভালবাসি।

–আমি জানি।

–কিন্তু তুমি জান না, আমি খুব গরীব। তোমার আমার মাঝের ব্যবধান কোনোদিনই ঘুচবার নয়।

–গরীব তো কি এসে যায়–গরীব তো আমিও।

–সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাদার। আমিই সম্পত্তির মালিক হতে পারতাম—কিন্তু

কিন্তু কি?

–না, দাদার তো বয়স অনেক হয়েছে, সকলেই ধরে নিয়েছিল ছেলেপুলে কিছু আর হবে না। কিন্তু … তার পরেই এলো সিরিল। সে যদি মেয়ে হতো তাহলে … যাক …. সিরিলকে আমি ভালবাসি, ও বেঁচে থাকুক।

ভেরার বুঝতে কিছুই বাকি থাকল না। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সে জানতো, হুগো, তার ভাইপোকে অসম্ভব ভালোবাসে।

তারপরের দিনই তো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুষ্টুমি করে জলে নেমে আর ওঠেনি সিরিল।

ভেরা জানে, সেদিন সে তাকে স্বচ্ছন্দে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু তার যে কোথায় বাধা ছিল–সে সিরিলকে ইচ্ছে করেই বাঁচাবার চেষ্টা করেনি।

হা ঈশ্বর! ক্ষমা করো।

ভেরা জানে না ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেছেন কি না। কিন্তু হুগো ক্ষমা করেনি। ওই ঘটনার পর সে আর তার মুখদর্শন করেনি।

ভেরার বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। সে উঠে ঘুমের ওষুধ খেলো। তারপর দুহাতে মুখ গুঁজে বসে থাকে।

রাত এগিয়ে চলে ভোরের দিকে।

২. দরজায় ধাক্কার শব্দ

০৬.

দরজায় ধাক্কার শব্দে তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায়, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন ডাঃ আরমস্ট্রং।

দরজা খুলতেই দেখেন রজার্স দাঁড়িয়ে, তার চোখে জল, মুখ শুকনো।

–তোমার কি হয়েছে রজার্স?

–আমার স্ত্রী, গলা ধরে আসে রজার্সের, সে কোনো সাড়া দিচ্ছে না।

–চলো, দেখি ব্যাপারটা।

ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে রজার্সের ঘরে উপস্থিত হন ডাক্তার। বিছানায় বসে আস্তে করে রজার্সের স্ত্রীর হাতটা তুলে নিলেন।

বরফের মত শীতল হাত। চোখের পাতা তবু টেনে দেখলেন। তারপর গম্ভীর মুখে । অন্যদিকে তাকান।

রজার্স এগিয়ে আসে, কোন কথা বলতে পারে না, দুচোখে জল।

ডাক্তার মৃতদেহ আর একবার পরীক্ষা করলেন। তারপর বিছানা, পাশের টেবিল, ওয়াশস্ট্যান্ড সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলেন।

–স্যার, রজার্স ধীরে ধীরে ডাকে।

–বলো।

–ও কি হার্টফেল করেছে?

–তোমার স্ত্রীর কি কোন অসুখ ছিল?

–বাতে ভুগত মাঝে মাঝে।

–তার জন্য কি কোন ওষুধ খেতো?

–তেমন না। অনেক দিন কিছু খায়নি, কেবল

–কেবল কি?

–কেবল গতকাল রাতে আপনি যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন, সেটা খেয়েছিল।

প্রাতঃরাশের ঘন্টা তখনো বাজেনি। ডগলাস এবং ওয়ারগ্রেভ বারান্দায় পায়চারি করছেন। দেশের রাজনীতির পরিস্থিতি নিয়ে তারা গভীর আলোচনা করছেন।

এই বাড়ির পেছনেই একটা উঁচু টিলা। দ্বীপের মধ্যে সেটাই সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল ভেরা আর  লমবার্ড। সেখানে তারা দেখতে পায় ব্লোর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওদের দেখতে পেয়ে ব্লোর বলে, মোটরবোটের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না।

ভেরা বলে, একটু বেলা হলে হয়তো আসবে।

এমন সময় প্রাতঃরাশের ঘন্টা বেজে ওঠে। এরা সকলে ফেরার পথ ধরল।

চলতে চলতে ব্লোর বলল, কাল মার্সটন কেন আত্মহত্যা করল, কিছু বোঝা গেল না।

ভেরা বলল, আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে আপনার?

–এছাড়া আর কি? খুন হলে তার প্রমাণ কোথায়? মোটিভটা কি?

ওরা বাড়ির কাছে পৌঁছলে দেখতে পেল, এমিলি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। ওদের দেখতে পেয়ে জানতে চাইলেন, বোট আসছে?

ভেরা বলে, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

সকলে তখন খাওয়ার ঘরে উপস্থিত। রজার্স খাবার আনতে গেছে। ভেরা বলল, রজার্সকে যেন কেমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কাল তো বেশ হাসিখুশি ছিল।

ডাক্তার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এগিয়ে এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজ রজার্সের ত্রুটি মার্জনা করবেন। ওকে নিজের হাতেই সব করতে হচ্ছে আজ।

এমিলি জানতে চায়, কেন, কি হয়েছে তার?

ডাক্তার বললেন, আসুন, আগে খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। তারপর সকলে মিলে একটু আলোচনায় বসব।

.

প্রাতঃরাশের পাট চুকলে ডাক্তার রজার্সের স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদটা সকলকে জানালেন।

–আর্তনাদ শোনা গেল অনেকের কণ্ঠেই।

–চট করে বলা যাচ্ছে না।

–গতকাল সন্ধ্যাবেলা খুব মানসিক আঘাত পেয়েছিল। তাছাড়া শরীরও ছিল দুর্বল। হয়তো সহ্য করতে পারেনি। ভেরা বলল।

ডাক্তার বললেন, হার্টফেল কিনা, তা-ও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ওর স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো কথাই আমার জানা নেই।

এমিলি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন, তাহলে বিবেকের আঘাতই হবে। গতকাল সন্ধ্যায় ওর স্বামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তো সকলেই শুনেছেন।

ডাক্তার তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, সেই অভিযোগ শুনে কি–

–হ্যাঁ, পাপের ভয় ঢুকেছিল মনে। দেখেননি কেমন করে কাঁদছিল। ভয় না পেলে অজ্ঞান হবে কেন?

–ভয় পেয়েছিল, এটা সত্যি। তবে সেদিক থেকে চিন্তাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না কি?

–মোটেই না। ভগবানের অভিশাপ ঠেকানোর সাধ্য কারুর নেই। আমি অন্তত বিশ্বাস করি।

পাপীকে ঈশ্বর শাস্তি দেন না। পাপকে তিনি ঘৃণা করেন, ব্যঙ্গের সুরে বলেন ওয়ারগ্রেভ, পাপীকে শাস্তি দেয় সাধারণ মানুষ। তবে খুব সহজে তা সম্ভব হয় না।

ব্লোর প্রশ্ন করে, আচ্ছা, গতকাল রাতে শুতে যাবার আগে রজার্সের স্ত্রী কি কিছু খেয়েছিল? ডাক্তার বললেন, কিছু না।–যেমন ধরুন চা, জল বা ওই ধরণের কিছু?

–রজার্স আমাকে বলেছে, ওসব কিছুই তার স্ত্রী খায়নি।

–ওকথা বলা রজার্সের পক্ষে অসম্ভব নয়।

ঈঙ্গিতটা বুঝতে পেরে ডাক্তার ক্লোরের চোখের দিকে তাকান। ব্লোর পুনরায় বলে, কাল রাতের অভিযোগটা পাগলামো কি না এখনো প্রমাণ হয়নি। যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সেই বৃদ্ধা মহিলাটিকে স্বর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এতদিন বেশ নিশ্চিন্তেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কাল–

ভেরা বেশ জোর দিয়ে বলে, ওসব শোনার পর রজার্সের বউ কিন্তু মোটেও অস্বস্তি বোধ করেনি, আমি লক্ষ্য করেছি।

ব্লোর ভেরার দিকে তাকিয়ে বলল, গতকাল রাতে ওসব কথা শোনার পর রজার্সের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে যায়। রজার্সও দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তার আশঙ্কা ছিল পাছে না অজ্ঞান অবস্থায় তার স্ত্রী সত্যি কথাটা বলে বসে।

ব্লোর এক পলক সকলের মুখের দিকে তাকায়।–পরে এই পরিস্থিতিতে একেবারে নিষ্কন্টক হওয়ার জন্য স্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সেই কাজটাই সেরে নিয়েছে রজার্স।

ডাক্তার বললেন, কিন্তু ওর বিছানার পাশে তো কাপ-টাপ কিছু চোখে পড়ল না। তাছাড়া স্ত্রীকে কি এভাবে মেরে ফেলা সম্ভব?

–আপনি কি এর আগে শোনেননি স্বামী স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করেছে, অথবা অন্য উপায়ে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিয়েছে?

সকলেই চুপ করে এদের দুজনের কথা শুনছে। সকলের মনেই বিচিত্র একটা ভাব খেলা করছে।

এই সময়ে দরজা ঠেলে রজার্স ঘরে ঢুকল। ডাক্তার তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, মোটরবোট এসেছে?

ঘরের দেয়ালের ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে দশটা বাজল। রজার্স বলল, না স্যার। এত দেরি তো তার হয় না। অন্যদিন আটটার মধ্যেই চলে আসে।

ব্লোর আর  লমবার্ড বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

লমবার্ড বলল, সকলেই আমরা মোটর বোটের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি। অথচ–

–রজার্সের কথা মত সেটা আসবার সময় দুঘন্টা পার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা পূর্বপরিকল্পিত। মোটরবোট আসবে না।

লমবার্ড কি বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে কে হঠাৎ বলে উঠল, কোনোদিনই আর আসবে না।

ওদের চমকে দিয়ে ডগলাস এসে পাশে দাঁড়াল।–মজাটা ওখানেই। আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকব, দ্বীপ ছেড়ে কেউ যেতে পারব না। বুঝতে পারছ না এখনো–এই দ্বীপই আমাদের চিরশান্তিলাভের স্থান।

কথা শেষ করেই ডগলাস বারান্দা ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর সমুদ্রের দিকে।

ওদের দুজনের মনে হল জেনারেল যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আগের সেই ফৌজি মেজাজটা আর নেই।

ডঃ আরমস্ট্রং বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তার চোখে পড়ল বাঁ দিকে নিচু গলায় কথা বলছে ব্লোর আর  লমবার্ড। আর ডানদিকে অস্থিরভারে পায়চারি করছে ওয়ারগ্রেভ। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে।

ডাক্তার একমুহূর্ত দ্বিধা করে বিচারপতির দিকে এগিয়ে গেলেন।

এমনি সময় রজার্স ছুটে এল ডাক্তারের কাছে। বলল, স্যার, একটা কথা বলার ছিল।

রজার্সের মুখ ফ্যাকাশে। হাত দুটো কাঁপছে থরথর করে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কি হল রজার্স, এত ভয় পাচ্ছ কেন?

রজার্স ডাক্তারকে বসার ঘরে নিয়ে এল। তার চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ঘন ঘন সেঁক গিলছে। কোনরকমে হাত তুলে ইঙ্গিত করে বলল, স্যার, ওই পুতুলগুলো।

ডাক্তার তাকালেন সেদিকে,–হা, কি হয়েছে পুতুলগুলো?

–ওখানে দশটা পুতুল ছিল

–হ্যাঁ, সে তো আমরা সকলেই দেখেছি।

–কাল রাতে খাওয়ার পরে ঘর পরিষ্কার করতে এসে হঠাৎ চোখ পড়তে দেখি–দশটা নয়–নয়টা পুতুল রয়েছে।

–তারপর, কিছু হয়েছে?

–হ্যাঁ, সে তা আমরা সকলেই দেখেছি?

–হ্যাঁ, স্যার। এখন কটা আছে দেখুন–আটটা–

ডাক্তার পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আটটা–দুজন মারা গেছে, সঙ্গে সঙ্গে দুটো পুতুল কমে গেল–কিন্তু কে সরালো? আমাদের মধ্যে কি কেউ? নাকি সেই অদৃশ্য লোকটা?

.

০৭.

প্রাতরাশের পর এমিলি আর ভেরা বেড়াতে বেরুলো। তারা সেই টিলাটার ওপরে গিয়ে উঠল।

মৃদু বাতাসে সমুদ্রে ঢেউগুলো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোনদিকে একটাও জেলেডিঙি দেখা যাচ্ছে না। মোটরবোটের তো কোনো চিহ্নই নেই।

এমিলি বলল, বোট নিয়ে যদি লোকটা না আসে তাহলে কি হবে বলতো?

ভেরা খেলাধূলা করা মেয়ে। অত সহজে সে ভয় পায় না। তবু এখন সে বলল, এখানে একদম ভালো লাগছে না।

–এখানে কারুরই ভাল লাগবার কথা নয়, ভেরা।

টিলার ওপরে পাশাপাশি বসে আছে ওরা। দৃষ্টি সামনের সমুদ্রের দিকে। যদি মোটরবোটটা চোখে পড়ে।

ভেরা হঠাৎ বলল, প্রাতঃরাশের সময় যে আপনি বললেন, রজার্স আর তার স্ত্রী সেই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে মেরে ফেলেছে, একথা কি আপনি বিশ্বাস করেন?

সমুদ্রের দিকে চোখ রেখেই এমিলি ধীরে ধীরে জবাব দেয়, হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি। তা না হলে, কথাটা শুনেই রজার্স নার্ভাস হয়ে পড়বে কেন? তার স্ত্রীও অজ্ঞান হয়ে গেল। এ থেকেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যায়–ওরা এই মহাপাপ করেছে।

ভেরা বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, রজার্সের স্ত্রীর মুখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু অন্যদের সম্পর্কে কি বলবেন আপনি?

–তোমার কি মতামত?

–অভিযোগ তো সকলের নামেই একটা করে শোনা গেল। সকলেই সেটাকে উড়িয়ে : দিচ্ছে। কিন্তু আপনি কেবল রজার্সদের বেলায় বলছেন ওরা মহাপাপ করেছে।

এমিলি বললেন, তুমি কি বলতে চাইছ বুঝতে পেরেছি। কতগুলো অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেও কয়েকটি আবার নির্ভুল।

যেমন ধরো, লমবার্ডের ব্যাপারটা। বিপদেই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়। তার গায়ের রং কি, কোন দেশের লোক, এসব বিবেচনায় আসে না। অথচ কুড়িটা লোককে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে সে পালিয়ে এসেছিল।

আবার দেখ, মিঃ ওয়ারগ্রেভ, তিনি তাঁর পবিত্র কর্তব্য পালন করেছেন। সেটা অপরাধ হতে যাবে কেন?

ব্লোরের সম্পর্কেও একই কথা খাটে। তিনি এককালে পুলিসের অফিসার ছিলেন। আমার নিজের ব্যাপারও তাই।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি সংযতকণ্ঠে বললেন, সব কথা পুরুষদের সামনে বলা যায় না। তাই কাল আমি কিছু বলতে চাইনি। তোমাকে আজ বলছি শোন।

ভেরা বিস্মিত হয়ে এমিলির দিকে তাকায়। বলে, বলুন।

–আমার বাড়িতে একটি মেয়ে কাজ করত। তার নাম ছিল বিয়াত্রিচে স্টেলার। কাজকর্ম বেশ ভালোই করত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সাজপোশাক পরতে খুব ভালবাসতো।

পরে জানতে পেরেছিলাম, মেয়েটির স্বভাবচরিত্র ভালো নয়। বিয়ের আগেই সে একজনকে সব বিলিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি নাকি কোন বড় ঘরের।

ওই কাণ্ড ঘটার পর ছেলেটি মেয়েটিকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। পরে বড় ঘরেরই অপর একটি মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়াত্রিচে ততদিনে মা হতে বসেছে। জানতে পেরে সেই পাপিষ্ঠাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দিইনি–দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

পাপ কখনো কাউকে রেহাই দেয় না ভেরা। তাকেও দেয়নি। কদিন পরেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

হতভাগী, নিজের বুড়ো বাবামায়ের কথাও একবার ভাবল না।

ভেরা বলল, মেয়েটিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন কিংবা তার যে অমন শোচনীয় পরিণতি হল, এসবের জন্য আপনার কোন দুঃখ বা অনুশোচনা হয়নি? কখনো আপনার মনে হয়নি যে মেয়েটির মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী?

-ওসব কী বলছ? এমিলি স্পষ্ট জবাব দেন, আমার কেন অনুশোচনা বা দুঃখ হতে যাবে? আমি তো কোন অন্যায় করিনি। পাপকে কি ঘরে রেখে পুষবো?

একটু থেমে এমিলি ফের বলতে লাগলেন, সে তার পাপের ফল ভোগ করছে। আমি পাপকে প্রশ্রয় দিতে যাব কেন? এমন শিক্ষা কখনো পাইনি।

ভেরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে এমিলির মুখের দিকে তাকায়। তার মনে হয় সেই মুখ বড় নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর।

বারান্দায় বসে আছেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। খানিকটা দূরে নিচু গলায় কথা বলছেন লমবার্ড আর ব্লোর। ডাক্তার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

একবার বৃদ্ধ বিচারপতির দিকে তাকালেন। মনে মনে তিনি কি যাচাই করলেন। ভদ্রলোক অভিজ্ঞ বিচক্ষণ সন্দেহ নেই কিন্তু অশক্ত। তার চাই বলিষ্ঠ কর্মপটু লোক। মনে মনে আরো একবার হিসেব করলেন ডাক্তার। লমবার্ডদের দিকেই তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন, লমবার্ড, তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল।

–আমার সঙ্গে? অবাক হয়ে তাকায়  লমবার্ড।

–হ্যাঁ, একটু অন্য ব্যাপার

–বলুন কি বলবেন।

পরিস্থিতিটা তোমার জটিল মনে হচ্ছে কি না বলতো?

–খুবই জটিল এবং রহস্যময়।

–রজার্সদের সম্পর্কে ব্লোর যে কথাটা বলল, তোমার সত্যি বলে মনে হয়?

লমবার্ড বলে, আমার তো মনে হয়, ঠিকই বলেছে। ভদ্রমহিলাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।

ডাক্তার অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, তার চাইতেও সহজে ব্যাপার ঘটতে পারে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝতে পারছি তাই বলেছি তোমাকে–

কিভাবে বলতে চাইছেন আপনি?

–ওই ভদ্রমহিলার হার্টের অসুখ ছিল। অসুস্থ বোধ করলেই এক ধরণের ক্যাপসুল খেতেন। তাই সব সময় ওটা হাতের কাছে রাখতে হত।

লমবার্ড উত্তেজিতভাবে বলল, আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি। ভদ্রমহিলা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন সেই সময় সেই ক্যাপসুল না দিয়ে ডাক্তার আনতে ছুটেছিল রজার্স, তাই তো?

বলতে বলতে লমবার্ড চুপ করে গেল। একমিনিট কি চিন্তা করল। পরে বলল, এবারে আমার কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল।

–কি ব্যাপার?

–অনেক ঘটনাই আছে যার বিচার আইনের চোখ এড়িয়ে যায়। অপরাধী সাজা পায় না। রজার্সের অপরাধটি যেমন। অবশ্য এ তালিকায় স্বয়ং বিচারপতিও বাদ যাবেন না।

–তুমি বিশ্বাস করো ওকথা?

-হ্যাঁ, করি। ওয়ারগ্রেভ খুন করেছেন এডওয়ার্ড সেটনকে। অথচ তা করেছেন সম্পূর্ণভাবে আইনের আশ্রয় নিয়ে বিচারকের আসনে বসে।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের নিজের কথাও মনে পড়ে যায়। অপারেশন টেবিলে হত্যার কথা কারুর জানবার কথা নয়।

লমবার্ড বলে চলে, সেই কারণেই এই পান্না দ্বীপ, আওয়েন এসব কিছু আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমরা এমন এক জেলখানায় বন্দি, যেখান থেকে পালাবার পথ বন্ধ।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ঘুরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বলেন, রজার্সের মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু তলিয়ে চিন্তা করা দরকার। আমার ধারণা, তার মৃত্যুর পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। এক হল, সে গোপন কথা ফাঁস করে দিতে পারে এই আশঙ্কা, দ্বিতীয়, সে নার্ভাস হয়ে আত্মহত্যা করেছে।

–আত্মহত্যা? তা মনে করা যেতে পারে অবশ্য। আবার ওদিকে মার্সটনের ঘটনাও–কিন্তু মাত্র বারো ঘন্টার ব্যবধানে দু-দুটো আত্মহত্যার ঘটনা, কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? আমি–

-হ্যাঁ, বল, চুপ করলে কেন? ডাক্তার উৎসুক হলেন।

–আমার মনে হয় মার্সটনের মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। ডাক্তার চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে সায় দেন, কথাটা অযৌক্তিকও নয়। ওর গ্লাসেই কেবল সায়ানাইড গেল কি করে? আরও তো গ্লাস ছিল–

লমবার্ড হেসে বলল, হয় সে সায়ানাইড নিজে এনেছিল, নয়তো

নয়তো কি? ডাক্তার তাকান লমবার্ডের দিকে।

–বুঝতেই তো পারছেন ভাল করে। তবু আমার মুখে যখন শুনতে চাইছেন বলছি–মার্সটনকে হত্যা করা হয়েছে।

–তাহলে রজার্সের স্ত্রীর ব্যাপারটা কি বলবে, তুমি? ডাক্তার জানতে চান।

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে  লমবার্ড বলে, আসলে দুটো মৃত্যুর মধ্যে সূক্ষ্ম যোগসূত্র আছে বলে আমার ধারণা।

ডাক্তার বললেন, তোমার কথায়, একটা ব্যাপার আমার মনে পড়ে গেল।

এরপরে তিনি খাওয়ার ঘরের টেবিল থেকে দুটো পুতুল নিখোঁজ হওয়ার কথাটা জানালেন।

শুনে লমবার্ডের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কিছু সময় কি চিন্তা করল। তারপর বলল, আওয়েন লোকটা বিপজ্জনক। সবই তার কীর্তি। দুটো লোক মারা গেল আর অমনি দুটো পুতুল অদৃশ্য–ওই লোক ছাড়া এ কাণ্ড কে করবে।

ডাক্তার বললেন, কিন্তু রজার্স তো বলল এই দ্বীপে আমরা ছাড়া অন্য কোন লোক নেই।

লমবার্ড বলল, রজার্স হয় মিথ্যে বলছে, নয় সে ভুল করছে।

ডাক্তার বললেন, ভয় পেয়ে মিথ্যা বলা অসম্ভব নয়।

–এদিকে দেখুন, অন্যদিন মোটরবোট সকালেই আসে, আর আজ তার কোন পাত্তা নেই। সবই আওয়েনের ষড়যন্ত্র। তবে–

ডাক্তারের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এই কথা শুনে। কোনরকমে বললেন, তবে কি?

–দ্বীপটা ছোট আর জনমানবহীন। আওয়েনকে খুঁজে বার করা কষ্টকর ব্যাপার নয়। তাই করতে হবে আমাদের।

–কিন্তু লোকটা তো একটা খুনে। যদি–

–কোনো যদি নেই। ওটা একটা শেয়াল। একবার আমার সামনে পড়লেই সে বুঝতে পারবে।

এরপর সে বলে, চলুন ডাক্তার, একটা কাজ করা যাক। ব্লোর লোকটি ভালো, তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বীপটা খুঁজে দেখা যাক।

মেয়েদের এসব ব্যাপারে দরকার নেই। জেনারেল আর ওয়ারগ্রেভ তো ভয়েই জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে। কাজটা আমরা তিনজনেই করতে পারব।

.

০৮.

দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে। ব্লোর সহজেই রাজি হয়ে গেল। কেবল বলল, এই সময় একটা রিভলভার সঙ্গে থাকলে ভাল হতো।

লমবার্ড প্যান্টের পকেটের ওপর চাপ দিয়ে দেখিয়ে বলল, আমার কাছে একটা আছে।

ডাক্তার ও ব্লোর চমকে উঠে লম্বার্ডের দিকে তাকায়। একটা অশুভ ইঙ্গিত যেন ওরা দেখতে পায়।

ব্লোর বলল, সবসময়েই ওটা সঙ্গে থাকে নাকি?

–হ্যাঁ, অনেক গোলমেলে জায়গাতেই তো যেতে হয়।

ডাক্তার বললেন, ভালই হল। আওয়েনের কাছে কোন অস্ত্র থাকা অসম্ভব নয়। মোকাবিলা করা যাবে।

.

দ্বীপটা ছোট্ট । গাছপালা ঝোপঝাড় নেই বলে এখানে আড়াল-আবডালের কোন ব্যাপার নেই। একদিকে কেবল সেই ছোট্ট টিলা। তাতেও গুহাটুহা কিছু নেই। ওপরটা বেশ চওড়া আর সমতল।

ওদের তিনজনের দলটা দ্বীপটা খুঁজতে লেগে গেল। ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় এসে দেখল, জলের ধারে জেনারেল ডগলাস চুপচাপ বসে আছেন। তার দৃষ্টি দূর আকাশের শূন্যতায়।

সাড়া পেয়েও ডগলাস ওদের দিকে ফিরে তাকালেন না। নিজের চিন্তাতেই তন্ময় হয়ে আছেন।

ব্লোর গলাটা একটু ঝেড়ে আলাপের ভঙ্গিতে বলল, জায়গাটা সত্যি চমৎকার।

ডগলাস ভুরু কুঁচকে তাকায় এবারে। বলে, আমি একটু একলা থাকতে চাই–সময় ফুরিয়ে এসেছে–

ব্লোর লজ্জিতভাবে বলল, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। একটা লোককে আমরা তিনজন খুঁজে বেড়াচ্ছি। আপনার সঙ্গে দেখা হল বলে জানলাম।

–সময় নেই হে, তোমরা কিছুই বুঝতে পারছ না। ব্লোর আর তাকে ঘাঁটাল না। দলে ফিরে গেল।

বলল, লোকটার কথাবার্তা কেমন গোলমেলে হয়ে গেছে। আমাকে বলল, সময় ফুরিয়ে আসছে, একা থাকতে চায়।

ডাক্তার বিড়বিড় করে বললেন, তাই তো। ওরকম কথা বলছে, একটু ভেবে দেখা দরকার।

.

সারা দ্বীপ ঘুরে ঘুরে কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না। কোন লোক লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন জায়গাও কোথাও নজরে পড়ল না।

ক্লান্ত হয়ে ডেভনের দিকে তাকিয়েছিল লমবার্ড। বলল, ঝড় আসছে।

ব্লোর জলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এই পাড়টা অনেকটা উঁচু। আচ্ছা, এখানে আড়ালে কেউ লুকিয়ে নেই তো?

ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন, খাড়া পাড় নিচে নেমে গেছে। এখানে কারোর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়।

ব্লোর বলল, কিন্তু কোনো গর্ত তো থাকতে পারে।

লমবার্ড বলে, তবে কিনারের দিকে একটা নোক লুকিয়ে থাকতে পারে এমন জায়গা আছে। একটা দড়ি পেলে আমি নিচে নেমে যেতে পারতাম।

ব্লোর বলল, সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়া ভাল। আমি দেখছি, দড়ি জোগাড় করতে পারি কিনা।

ব্লোর চলে গেল।  লমবার্ড বলল, আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে, অন্ধকার হয়ে আসছে।

ডাক্তার চিন্তিতভাবে বললেন, ভাবছি, ডগলাসের মাথাটা বোধহয় খারাপই হয়ে গেল। মানসিক চাপ সইতে না পেরেই এমনটা হয়েছে।

.

সেই কথাবার্তার পর থেকে ভেরা এমিলিকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করছে। তাই সকালটা খুব অস্বস্তির মধ্যে কেটেছে তার।

খানিকটা করে দুরত্বে বারান্দায় তিনটে চেয়ারে বসে আছে ওয়ারগ্রেভ, এমিলি আর ভেরা।

ওয়ারগ্রেভের মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। নিজের চেয়ারে বসে একমনে উল বুনে চলেছেন এমিলি।

তার মুখটা করুণাহীন, নিষ্ঠুর মনে হওয়ায় চোখ ফিরিয়ে নিল ভেরা। সে আর বসে থাকতে পারল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলল।

.

হঠাৎ চমকে ওঠে ভেরা। জেনারেল ডগলাসের গলা। এমিলি এমিলি বলে কি যেন বলছেন। সে এগিয়ে যায়।

দেখে ডগলাস সমুদ্রের ধারে বসে আছেন। তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ওঃ তুমি এসেছে। আমি ভাবলাম লেসলি।

–লেসলি আপনার কে হয়?

–আমার? একদিন ওই আমার সব ছিল।

–আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই?

–হ্যাঁ। আমাকে ভালবাসতো প্রাণ দিয়ে। তাকে নিয়ে আমি শান্তিতে ছিলাম।

–তারপর?

-তারপর–দ্বিধাহীন কণ্ঠে ডগলাস বললেন, আজ আর তোমাকে লুকিয়ে লাভ নেই ভেরা, সবই স্বীকার করছি, রিচমণ্ডকে আমিই পাঠিয়েছিলাম মৃত্যুর মুখে। তাকে আমি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম, কাজেই সেদিক থেকে বিচার করলে তার মৃত্যুর কারণ আমিই। কিন্তু–..

কিন্তু কি?

–লেসলি এসব কিছুই জানত না। মনে যন্ত্রণা থাকলেও একদিনের জন্যও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। কিন্তু তবু লেসলি দিন দিন কেমন শুকিয়ে যেতে লাগল। আমার কাছ থেকে যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগল। তারপর একদিন সেই অবস্থাতেই আমাকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেল।

দুজন অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। পরে ডগলাসই প্রথম কথা বললেন, বসে আছি এখন তার অপেক্ষায়–

–কিসের?

–জীবনের শেষ ডাক, ভেরা!

ভেরা অস্থিরভাবে বলে ওঠে, না, না, ওসব কথা আপনি ভাববেন না।

–আমি ঠিকই ভাবছি ভেরা। আমি ভাল করেই বুঝতে পারছি, এই দ্বীপ থেকে কেউই কোনদিন বাইরে যেতে পারব না। এখানেই চিরবিদায় নিতে হবে। ওহো, ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বোঝা বড় ভয়ঙ্কর। এর থেকে নিষ্কৃতি চাই। লেসলি-লেসলি

বলতে বলতে ডগলাস আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভেরার কেমন ভয় করতে লাগল। সে কোন কথা না বলে পা টিপে টিপে সেখান থেকে সরে এলো।

.

কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্লোর দড়ি নিয়ে ফিরে এলো। এসে দেখে ডাক্তার পাহাড়ের নিচের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন। সে জিজ্ঞেস করল, লমবার্ড কোথায়?

–অ্যাঁ, লমবার্ড? আছে এদিকে কোথাও নিশ্চই। আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম ব্লোর।

–কি কথা?

–আমরা তো আওয়েনকে খুঁজছি, তাই না? কিন্তু ডগলাস লোকটিকে তোমার কেমন মনে হয়?

এমনিতে তো সন্দেহজনক কিছু মনে হয়নি। তবে তিনি যেন কি একটা আন্দাজ করছেন, সেটা জানা দরকার।

এমনি সময়  লমবার্ড এসে গেল। সে দড়িটা পরীক্ষা করে দেখে নিল। তারপর একটা প্রান্ত নিজের কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিল।

অন্য প্রান্ত ডাক্তার ও ব্লোরকে দিয়ে বলল, শক্ত করে ধরতে হবে। আমি যাচ্ছি। বলেই সে উঁচু পাড় বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল।

ব্লোর নিচু গলায় ডাক্তারকে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমার কেবলই একটা কথা মনে হচ্ছে–

–আমি লমবার্ডকে একদম বিশ্বাস করতে পারছি না।

–বুঝতে পারছি। কিন্তু মানুষটা একটু অন্যরকম তাই অমন মনে হচ্ছে। খুবই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ।

-হ্যাঁ, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, সেই কারণেই সবসময় সঙ্গে রিভলভার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

–ওটা একরকমের বাতিক।

–না, না, ডাক্তার। আপনি বা আমি তো এরকম করি না। বাতিক তো কতরকমেরই মানুষের হতে পারে। সব ছেড়েছুঁড়ে এরকম বাতিক হবে কেন? তাছাড়া–

–কি তাছাড়া?

–তাছাড়া, দেখুন, এখানে তো আমরা সকলেই বেড়াতে এসেছি। কিন্তু কেউ তো স্লিপিং, ব্যাগ, ছারপোকা মারার পাউডার, জলের বোতল, ফাস্ট-এড বক্স এসব সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি। অথচ আমি দেখেছি এই সমস্ত কিছুই ওর ব্যাগে রয়েছে।

ডাক্তার কোন কথা বলেন না, ব্লোরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ব্লোর ফের বলে, না, না, ডাক্তার, আমরা ছায়ার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কেউ কোথাও নেই। যদি থেকে থাকে, আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

.

প্রাসাদের মত বাড়িটাও তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা হল। কিন্তু কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না। একতলা দেখা হলে দোতলা দেখা হল।

ছাদের দক্ষিণ দিকে তেতলার ছাদে ওঠার সিঁড়ি। ব্লোর বলল, একবার ওপরটা দেখা দরকার।

ঠিক সেই সময়েই ওপাশের ঘরে থেকে একটা শব্দ পাওয়া গেল। রজার্সের স্ত্রীর মৃতদেহ ওখানে রয়েছে।

শব্দটা লক্ষ্য করে ব্লোর পা টিপে টিপে ঘরটার দিকে এগিয়ে চলল। অন্যরা তাকে অনুসরণ করে চলল।

দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ করে টান মেরে কপাট দুটো হাট করে খুলে ফেলল। সকলে অবাক হয়ে দেখল, কতগুলো জামাকাপড় হাতে করে রজার্স দাঁড়িয়ে আছে।

.

ব্লোর বলল, ওহে রজার্স, কিছু মনে করো না। কি রকম একটা শব্দ হল তাই–

রজার্স বলল, মনে করবার কিছু নেই। আমি আর এঘরে থাকতে পারছি না। তাই দু-চারটে জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছি, ভাবছি ওপাশের ছোট ঘরটায় থাকব।

–ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তাই ভালো।

ঘরের ভেতরে খাটের ওপরে রজার্সের স্ত্রীর মৃতদেহ সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। সেদিকে কেউই তাকিয়ে দেখল না।

ওখান থেকে সরে এসে তিনতলার ছাদটা দেখা হল। জলের ট্যাঙ্কের নিচে, ভেতরে কিছুই বাদ গেল না।

খোঁজার পালা শেষ হলে ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে সকলে একটা সত্য নতুন করে উপলব্ধি করল। দশজনের মধ্যে তারা আটজন জীবিত, দুজন মৃত।

এই কজন ছাড়া আর কোনো লোক বাড়িতে বা দ্বীপের কোথাও নেই।

.

০৯.

একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল তারা। নীরবতা ভঙ্গ করল  লমবার্ড। বলল, মনে হচ্ছে, আমরা সবাই ভুলই করেছি।

আমরা ছাড়া অন্য লোক এখানে নেই। যে দুটো মৃত্যু এখানে পর পর ঘটল, এগুলোর মধ্যে কোন রহস্য নেই।

ডাক্তার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, না, একথা আমি মেনে নিতে পারি না। একজন ডাক্তার হিসাবে আত্মহত্যার কেস আমি কিছু কম দেখিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মার্সটন আত্মহত্যা করার মত মানুষ ছিল না–অসম্ভব।

ব্লোর বলল, ওটা নিশ্চয়ই একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু রজার্সের স্ত্রীর ঘটনাটাকে কিছুতেই দুর্ঘটনা। বলা চলে না।

একটুক্ষণ থেমে পরে পুনরায় বলল, একটা কথা বলব ডাঃ আরমস্ট্রং?

স্বচ্ছন্দে।

–গতকাল রাতে রজার্সের স্ত্রীকে আপনি কিছু খেতে দিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, একটা ঘুমের ওষুধ।

–মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে যাওয়া কিন্তু অসম্ভব নয়।

ডাক্তার প্রতিবাদ করে বললেন, একথার কোন অর্থ হয় না। ডাক্তারদের এরকম ভুল হয় না, হলে চলে না।

ব্লোর বলল, কিন্তু গ্রামাফোনের কথাটা আমরা অবিশ্বাস করতে পারছি না। সেখানে আপনার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা হয়েছিল।

শেষ দিকে ব্লোরের কথার সুর এবং চোখের দৃষ্টির কোন পরিবর্তন ঘটেছিল কি?

লমবার্ড সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, এভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবার কোন মানে হয় না। বিপদ থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায় এখন আমাদের সেকথাই ভাবা উচিত। তা না করে তুমি এখন গ্রামাফোনের কথা তুলছ। তালিকায় তো তুমিও বাদ ছিলে না।

–ওসব ডাহা মিথ্যে। আমি গ্রাহ্য করছি না। কিন্তু ওসব বলে তুমি আমাকে চুপ করিয়ে দিতে পারবে না। তোমার সম্পর্কেও আমি জানতে চাই। ব্লোর বলল দৃঢ় স্বরে।

লমবার্ড বলল, আমার কথা বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবু বলছি, এখানে কোনরকম বিপদ হতে পারে এই কথা ভেবেই ওটা সঙ্গে এনেছি। তবে, সকলকে জানাবার জন্য আরো একটু বলা দরকার যে আমার এখানে আসাটা একটু অন্যরকম। অন্য সকলেই এসেছেন নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে।

মরিস নামে একটা লোক আমাকে বলেছিল, এখানে এলে আমি একটা কাজ পেতে পারি। কাজটা সাহসের। আমি রাজি হয়ে যেতে, সে আমাকে কিছু টাকাও দেয়।

লমবার্ড ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার সম্পর্কে কিছু বলার আছে?

ব্লোর হেসে বলে, না, নেই।

ডাক্তার জানতে চাইলেন, মরিস তোমায় আর কিছু বলেছিল?

–না, আর কিছু বলেনি। আমিও পীড়াপীড়ি করিনি। আমার টাকার দরকার ছিল, তাই কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।

ব্লোর বলল, গতকাল রাতে তাহলে একথাটা তুমি চেপে গেলে কেন?

–চেপে যেতে চাইনি। এরকম একটা পরিস্থিতির যে উদ্ভব হবে আমি তা ভাবতেই পারিনি।

ডাক্তার জানতে চাইলেন, কিন্তু এখন তুমি নিশ্চয়ই অন্যরকম ভাবছ?

লমবার্ডের মুখভাব কঠিন হয়ে ওঠে। সে বলে, এখন আমার অবস্থা আর সকলেরই মত–কুচক্রী আওয়েনের ফাঁদে পড়েছি।

একটু থেমে সে আবার বলে, দুজন লোক মারা গেল, অমনি দুটো পুতুলও উধাও হল, কেউ দেখতেই পেল না কখন এসব হল। সবই সেই শয়তান আওয়েনের কাজ।

কথা শেষ হবার পরক্ষণেই লাঞ্চের ঘন্টা বেজে উঠল। খাওয়ার ঘরে প্রথম ঢুকল  লমবার্ড। রজার্স অপেক্ষা করে ছিল।

লমবার্ড জিজ্ঞেস করল, রজার্স রান্নাবান্না করতে খুব অসুবিধা হয়েছে?

–না স্যর। তেমন কিছু হয়নি। টিনের খাবার তো প্রচুর ছিল। তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছি। নারাকোট তো আর এল না–ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না।

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

তারপর একে একে সকলেই এসে পৌঁছলেন। আবার টেবিলে বসার পর দেখা গেল জেনারেল তখনো অনুপস্থিত।

রজার্স জানতে চাইল, আপনারা শুরু করবেন না জেনারেলের জন্য অপেক্ষা করবেন?

ভেরা জানাল, তাঁকে তো সমুদ্রতীরে বসে থাকতে দেখে এলাম। কেমন অন্যমনস্ক। মনে হয় ঘন্টার শব্দ শুনতে পাননি।

রজার্স বলল, আমি তাহলে তাকে গিয়ে লাঞ্চের কথাটা জানিয়ে আসি।

ডাক্তার বললেন, তুমি সকলকে পরিবেশন কর, আমি তাকে নিয়ে আসছি।

সমুদ্রের গর্জন ক্রমশই বেড়ে উঠছিল। বাতাসও প্রবল হচ্ছে সেই সঙ্গে। আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত।

রজার্স সকলকে পরিবেশন করতে লাগল। মাংস দিতে দিতে সে বলল, কেউ যেন দৌড়ে আসছেন?

সমুদ্রের গর্জনের ভেতরেই পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া গেল।

ডাক্তার হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকলেন, জেনারেল—

জেনারেল কি? মারা গেছেন? ভেরা ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

–হ্যাঁ।

চমকে ওঠে সকলে। একে অপরের দিকে তাকাল। কিন্তু কারো মুখে কথা নেই।

সমুদ্রের দাপাদাপি আর বাতাসের হাহাকারের শব্দে ঘর ভরে ওঠে।

.

শেষ পর্যন্ত ঝড় শুরু হয়ে গেল।

সবাই মিলে ধরাধরি করে জেনারেলের দেহটা দোতলায় তুলে নিয়ে গেল।

খাবারের প্লেট কেউ স্পর্শও করেনি। ভেরা দরজায় এসে দাঁড়ায়।

রজার্স সবার আগে নেমে আসে নিচে। ভেরাকে বলে, দেখতে এলাম কটা পুতুল রয়েছে।

ভেরা তাকিয়ে দেখল। বলল, ওই দেখ সাতটা পুতুল।

–সাতটা!

.

জেনারেলের ঘরেই খাটের ওপরে শুইয়ে দেওয়া হল মৃতদেহ। সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। ডাক্তার শেষবারের মতো তাকে পরীক্ষা করলেন। তারপর নিচে নেমে এলেন।

ভেরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোলের ওপর উল আর কাটা পড়ে রয়েছে, এমিলি আর বুনছেন না।

ব্লোর হাঁটুর ওপরে কনুই আর মাথায় হাত রেখে বসে আছে।

অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন লমবার্ড। ঘরের এক কোণে বড় আরাম কেদারায় চোখ বুজে বসে রয়েছেন ওয়ারগ্রেভ।

ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করতে ওয়ারগ্রেভ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি বুঝলেন ডাক্তার?

গম্ভীর স্বরে ডাক্তার জবাব দিলেন, ভারি কিছু দিয়ে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তাতেই মৃত্যু ঘটেছে।

একটা চাপা ফিসফিসানি ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল।

–যে জিনিসটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটা কি আপনি দেখেছেন?

–না। তবে আমি নিঃসন্দেহ।

ওয়ারগ্রেভ এবারে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এক কঠিন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। আপনারা আজ যখন ব্যস্ত ছিলেন, আমি বারান্দায় চুপচাপ বসে ছিলাম। আপনারা যে সেই গুপ্তঘাতককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

লমবার্ড বলল, কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া গেল না।

ওয়ারগ্রেভ যেন সভাপতিত্ব করছেন, যেন সকলের নেতৃত্বের ভার নিজের হাতে নিয়েছেন, এমনি ভঙ্গি ও স্বরে বললেন, এখন নিশ্চয়ই আর কারো সন্দেহ নেই যে রজার্সের স্ত্রী এবং মাসটনের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। এখানে আমাদের নিমন্ত্রণ জানানো যে আওয়েনের ষড়যন্ত্র তাও এখন আর অপরিষ্কার নেই।

ব্লোর বলল, ওটা একটা পাগল কিন্তু বিপজ্জনক।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, পাগল হোক যাই হোক, তাকে নিয়ে আলোচনা করে আর লাভ নেই। এখন আমাদের উদ্ধারের পথ ভাবা দরকার।

ডাক্তার বললেন, কিন্তু এই দ্বীপে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আজ তন্নতন্ন করে খুঁজেছি আমরা। ….

ওয়ারগ্রেভ বললেন, নেই যে আজ সকালে আমিও বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, আমি চিন্তা করে দেখলাম, আওয়েন কতগুলো লোককে শাস্তি দেবার জন্য আঁটোসাঁটো পরিকল্পনা এঁটেছে। এই লোকগুলোর অপরাধ আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়েছে। তার এই পরিকল্পনা মতই মাসটন, রজার্সের স্ত্রী এবং ডগলাস প্রাণ হারিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দশটা পুতুলের তিনটে পুতুল উধাও হয়েছে।

এখন কথা হল, পরিকল্পনা কার্যকরী করবার জন্য আওয়েনকে এখানে থাকা প্রয়োজন–এবং সে যে আছে তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, একটি উপায়েই তার এখানে থাকা সম্ভব। আমার বিশ্বাস সে আমাদের মধ্যেই একজন।

–না, না-তা হতে পারে না। ভেরার গলা কান্নায় ভিজে এলো।

ওয়ারগ্রেভ ভেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেরা, এখন এমন একটা সময়, এড়িয়ে চলা বিপজ্জনক। অদৃশ্য আওয়েন যে আমাদের মধ্যেই একজন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আমরা দশজন ছিলাম, তার মধ্যে এখন রয়েছি সাতজন। এই সাতজনের মধ্যে যে কেউ হতে পারে।

একটু নেমে তিনি ফের বললেন, আশা করি সকলেই একমত হবেন।

ডাক্তার মৃদুস্বরে বললেন, আপনার কথা সত্যি ভাবতে বড় খারাপ লাগছে। তবু মনে হচ্ছে, আপনার ধারণাই ঠিক।

ব্লোর বলল, আমার দ্বিমত নেই। একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন বিচারপতি।

দেখা গেল একমাত্র ভেরা ছাড়া সকলেই সহমত পোষণ করছে। ভেরা দৃঢ়স্বরে বলল, আমি ওকথা বিশ্বাস করি না।

ব্লোর বলল, আমার একটা কথা, তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে, লমবার্ডের কাছে একটা রিভলভার আছে, গতকাল কিন্তু একথা সে স্বীকার করেনি। আজ নিজেই বলেছে।

লমবার্ড মৃদু হেসে বলল, আমি আগেই ব্যাপারটা ডাক্তার ও ব্লোরকে বুঝিয়ে বলেছি। তবু মনে হচ্ছে এখন সকলের কাছেই বুঝিয়ে বলা দরকার। বন্ধুবর ব্লোর, ব্যাপারটা নিয়ে খুবই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছেন–এটা দূর হওয়া দরকার।

এরপর  লমবার্ড তার বক্তব্য সকলকে শোনালো।

ব্লোর তবু বলল, এটা যে একটা বানানো গল্প নয়, তার কি প্রমাণ?

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, প্রমাণ আমাদের কারো কাছেই নেই। এক্ষেত্রে পরস্পরকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমরা এখন চরম সংকটের মুখে। এই অবস্থা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তবে একটা কথা সকলের মনে রাখতে হবে যে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়, এমন একজনও আমাদের মধ্যে নেই।

এমিলি মেঝের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। তিনি এবারে বললেন, কথাটা মিথ্যা নয় যে, আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে সন্দেহ করছি। আমাদের মধ্যেই এমন একজন নিশ্চয় আছে, যার কাঁধে শয়তান ভর করেছে।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, তাহলে দেখা গেল এ বিষয়ে আমরা সকলেই একমত যে আমরা সবাই পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখছি।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ এবারে বললেন, এবারে একথা ভাবতে হবে, আমাদের পক্ষে কার পক্ষে তিন তিনটে মানুষকে হত্যা করা সম্ভব হতে পারে।

ব্লোর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, তাহলে ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক। মার্সটনের ব্যাপারটা এখনো সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। কি হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।

তবে রজার্সের স্ত্রীর ব্যাপারে দুজনকে সন্দেহ করা যায়। এর মধ্যে একজন স্বয়ং রজার্স অপরজন ডাক্তার আরমস্ট্রং।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন, আমি একথার আপত্তি জানাচ্ছি।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, ডাক্তার আরমস্ট্রং, আপনার আপত্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তথ্যের মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রজার্সের স্ত্রীকে কিছু খাইয়ে দেওয়ার সুযোগ আপনার এবং রজার্সেরই সবচেয়ে বেশি ছিল।

অবশ্য এ ব্যাপারে অন্যদের ভূমিকাও বিচার্য। আমরা কেউই, মান, সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি, নির্বিশেষে, সন্দেহের বাইরে নই।

ভেরা বলল, রজার্সের স্ত্রীর ত্রিসীমানার মধ্যে আমি ছিলাম না।

এমিলি ডাক্তারকে বললেন, ডাক্তার, আপনার দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে রজার্সের স্ত্রী নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সময় কেউ ঘরে ঢুকে থাকলে তাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই দেখেছে, তাই না ডাক্তার?

ডাক্তার বললেন, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এক ওষুধ সবার ক্ষেত্রে একই রকম কাজ দেয় না। পরীক্ষা ছাড়া সঠিক বলা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ঘুমের ওষুধ কাজ করেছে অনেকটা সময় নিয়ে।

লমবার্ড চড়াসুরে বলল, আপনি তো এখন আপনার সুবিধামত কথাই বলবেন।

ডাক্তার কি জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, ওয়ারগ্রেভ তাকে বাধা দিয়ে বললেন, এভাবে পরস্পরকে হেনস্তা করে কোন লাভ নেই। আমাদের অন্য পথ ধরতে হবে।

.

এরপর ওয়ারগ্রেভ বললেন, আসুন, জেনারেল ডগলাসের মৃত্যু নিয়ে এবারে আলোচনা করা যাক। আমি অবশ্য এব্যাপারে কিছুই জানি না।

সকাল থেকে বারান্দায়ই বসেছিলাম। আমি সেই সময় সমুদ্রতীরেই গিয়ে থাকতে পারি, আমার ওপরে নজর রাখার মত কেউ ছিল না। তবে আমার এজাহার হিসাবে সকলকে জানাতে চাই, আমি সারাক্ষণ বারান্দায়ই ছিলাম।

ব্লোর বলল, আমি সকালটা ডাক্তার এবং লম্বার্ডের সঙ্গে কাটিয়েছি। তারাই এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন বলে আমি আশা করছি।

ডাক্তার বললেন, একথা ঠিকই। তবে একবার তুমি দড়ি আনতে বাড়ি গিয়েছিলে।

–সঙ্গে সঙ্গেই তো দড়ি নিয়ে ফিরে এলাম। খুঁজে নিতে যেটুকু সময় লেগেছিল।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, ব্লোর যখন দড়ি আনতে গেল তখন আপনি আর  লমবার্ড কি একসঙ্গেই ছিলেন?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তবে  লমবার্ড সামান্যক্ষণের জন্য যেন কোথায় গেছিল, আমি ওখানেই ছিলাম।

লমবার্ড জানাল, হ্যাঁ গিয়েছিলাম দেখতে যে দ্বীপটা থেকে বাইরে খবর পাঠাবার কোন উপায় করা যায় কিনা দেখতে। তবে সে তো দু-এক মিনিটের জন্য।

ডাক্তার বললেন, তা ঠিক, ওইটুকু সময়ের মধ্যে একটা মানুষকে খুন করা যায় না।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, ডাক্তার নিশ্চয়ই সেই সময় ঘড়ি দেখেননি?

–না।

এমিলি জানালেন, সবটাই আন্দাজ। এতে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। এবারে আপনার কথা বলুন।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, সকালে ভেরাকে নিয়ে একটু বেড়িয়েছি, তারপর বারান্দাতেই ছিলাম।

বারান্দায়? কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখতে পাইনি।

–আমি পুবদিকটায় ছিলাম, বেশ বাতাস আসছিল।

–লাঞ্চ পর্যন্ত আপনি ওখানেই ছিলেন?

-হ্যাঁ।

–ভেরা, তোমার কথা বল এবারে।

–আমি মিস এমিলিকে নিয়ে এদিক সেদিক খানিক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছি। সে সময় জেনারেলকে দেখেছিলাম। তাকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল।

ওয়ারগ্রেভ জিজ্ঞেস করলেন, অস্বাভাবিক কিরকম?

–তিনি বলেছিলেন, শেষ ডাকের অপেক্ষা করছেন। এই দ্বীপই আমাদের সকলের শেষ শান্তির জায়গা। শুনে আমার কেমন ভয় করছিল।

–এরপর তুমি কি করলে?

বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। লাঞ্চের সময় হয়নি বলে পেছনের বাগানে একটু ঘুরেছিলাম।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, রজার্সের সাক্ষ্যই বাকি রইল। তবে তা শুনে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না।

যথারীতি রজার্সেরও সাক্ষ্য নেওয়া হল। সে জানাল, সে সকাল থেকে রান্নার কাজেই ব্যস্ত ছিল। জেনারেলের ব্যাপারে কিছু জানে না। সবার শেষে বলল, তবে তখন আমি পুতুল আটটাই দেখেছিলাম।

লমবার্ড বলাল, মিঃ ওয়ারগ্রেভ এবারে আপনার শুনানি বলুন।

ওয়ারগ্রেভ এজলাসে রায় ঘোষণার মত করে বললেন, এতক্ষণ তিনজন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম।

কিন্তু কারোর ওপর সন্দেহ করা হয়নি। যদিও আমরা কেউই সন্দেহমুক্ত নই। শয়তান আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

আমার এটাই পরামর্শ, যেভাবেই হোক উপকূলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে। তবে অপরাধী এখন থেকে যথেষ্ট সাবধান হয়ে যাবে। কোন রকম ঝুঁকি নেওয়া কারোরই উচিত হবে না।

লমবার্ড বলল, তাহলে আলোচনা আজকের মত এখানেই শেষ হল।

.

১০.

নির্জন ঘরে লমবার্ড আর ভেরা কথা বলছে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। শার্সি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ভেরা এক সময় জিজ্ঞেস করল, বিচারপতি যা বললেন, তা আপনি বিশ্বাস করেন?

–ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

–আমি বিশ্বাস করি না ওসব কথা।

–সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে। একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। এর শেষ হলে বাঁচি।

-আমিও সেকথাই ভাবছি।

–তবে সতর্ক আমাদের সকলকেই থাকতে হবে; নইলেই বিপদ।

–ওকথা বললে তো আমাকেও ওদের দলে ফেলা হয়। কিন্তু আমি হত্যাকারী নই।

লমবার্ড মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভেরার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি মিস। আপনার সততা সম্পর্কে আমার কোন প্রশ্ন নেই।

–ধন্যবাদ। ভেরা নতমুখে বলল, তবে গ্রামাফোনে আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জানানো হয়েছে, আমার ধারণা, আপনি তা থেকে মুক্ত নন।

লমবার্ড স্মিত হেসে বলল, আপনার অনুমান যথার্থ। দেখুন, আমি বাস্তব মেনে চলা পছন্দ করি। প্রয়োজন হলে কাউকে হত্যা করতেও অরাজি হব না। তবে এরকম হত্যা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।

একটু থেমে লমবার্ড আবার বলল, আমাদের বাকি পাঁচজনের মধ্যে কাকে আপনার সন্দেহ হয়? আমি কিন্তু ওয়ারগ্রেভকে সন্দেহ করি।

–সে কী, কেন?

-বৃদ্ধ জীবনে অনেক কিছু দেখেছে। একদিন বিচারকের আসনে বসে বিচারও করেছে। সেই অভ্যাস এখনো হয়তো ছাড়তে পারেনি। এখন চাইছে স্বয়ং ভগবানের ভূমিকা নিতে।

ভেরা বলল, আশ্চর্য কিছু নয়। তবে আমার দৃষ্টি কিন্তু ডাক্তারের ওপর।

–কেন? ওঁকে আমার কখনোই সন্দেহজনক মনে হয়নি।

-দেখুন, প্রথম দুটো মৃত্যুর কারণ ছিল বিষ। ডাক্তারের পক্ষেই সেই বিষ সংগ্রহ করা সবচেয়ে সহজ। রজার্সের বউকে অবশ্য ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল।

-হ্যাঁ, মিথ্যে বলেননি। তবে জেনারেলের মৃত্যুর ব্যাপারে তাকে আপনি জড়াতে পারবেন না। কেন না উনি সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। আমি অবশ্য একটু সময়ের জন্য অন্যত্র গিয়েছিলাম। ওই সময়ে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।

তখন আপনাদের সঙ্গে থাকলেও পরে তো সুযোগ ছিল।

–কি রকম?

লাঞ্চের সময় অনুপস্থিত থাকায় ডাক্তারই তাকে ডাকতে গেছিলেন। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই।

–হ্যাঁ।

–তারপর দেখুন, মৃতদেহ পরীক্ষা করে তিনি বললেন এক ঘন্টা আগে মারা গেছে। ডাক্তারই এই কাজ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে?

–আপনার কথায় যুক্তি আছে স্বীকার করছি, তবে …

.

–আমাদের মধ্যে একজন অপরাধী, বিচারপতি বলেছেন, তাহলে সেই লোকটি কে? ব্লোরকে জিজ্ঞেস করল রজার্স।

-ওটা অনুমানের কথা।

–হ্যাঁ। নিশ্চিত হবার তো কোন উপায় নেই তবে অপরাধী যেই হোক, যেমন বুদ্ধিমান তেমনি নিষ্ঠুর। পর পর খুনগুলো ঠান্ডা মাথায় করে চলেছে।

-আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বড্ড ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে।

.

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি দূরে। চশমাটা বাঁ হাতে ধরা, নাড়াচাড়া করছেন।

ডাক্তার আরমস্ট্রং সেদিকে তাকিয়ে বললেন, যে ভাবেই হোক আমাদের এখান থেকে চলে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিচারপতি বললেন, আবহাওয়ার যা অবস্থা দেখছি, তাতে আগামী চব্বিশঘন্টার মধ্যে জলঝড় থামবে বলে মনে হচ্ছে না।

আকাশ পরিষ্কার না হলে, বোটের আসারও সম্ভাবনা নেই।

তার মধ্যে হয়তো আমরাও শেষ হয়ে যাব।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ জানালার কাছ থেকে সরে এসে বললেন, তা যাতে হতে না হয়, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।

ডাক্তার এবারে অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, আচ্ছা, কার দ্বারা এসব কাজ সম্ভব হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

–আদালতে যেমন কিছু প্রমাণ করবার জন্য তথ্যের প্রয়োজন হয়, এক্ষেত্রেও তাই। এখনো তেমন কিছু সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে এটা বুঝতে পারছি সব ঘটনার মূলে একজন রয়েছে।

ডাক্তার খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।

এমিলির মন অশান্ত হয়ে আছে। তিনি একটা বাইবেল পড়বার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু মন বসাতে পারছিলেন না।

শেষে বাইবেল রেখে ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটা বার করে আনলেন।

কলম তুলে নিয়ে ডায়েরীর পাতায় লিখতে শুরু করলেন–

জেনারেল ডগলাস মারা গেলেন। তাকেও হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে আজ লাঞ্চের পরে বিচারপতি চমৎকার বক্তৃতা দেন। তার ধারণা আমাদের মধ্যেই কেউ আত্মগোপন করে রয়েছে, যে একের পর এক এমন কাণ্ড করে চলেছে। আমি আগেই বলেছিলাম, কোন একজনের কাঁধে শয়তান ভর করেছে…

ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। এই পর্যন্ত লিখে এমিলি টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

একটু পরেই তন্দ্রা কেটে যায়। হাতে ধরা কলম তুলে আবার তিনি লিখতে শুরু করেন–

প্রত্যেকেই জানতে চাইছেন, কার পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভবপর। কিন্তু সঠিক উত্তর কারোরই জানা নেই। কিন্তু আমি জানি, একজনের ওপরে ভর করেছে বিয়াত্রিচে টেলার।

হঠাৎ তার খেয়াল হল। লেখার শেষ অংশটুকু পড়ে তিনি ভাবেন, এসব কি লিখেছি? ও নাম কেন লিখলাম? সঙ্গে সঙ্গে শেষের লাইন দুটো কেটে দিলেন ভালভাবে যাতে পড়তে পারা না যায়।

.

জোরালো হাওয়ার গর্জন ক্রমশ বেড়ে উঠছে। সঙ্গে সমুদ্রের ফোসানি। সকলেই ঘরের মধ্যে রয়েছে। শার্সিগুলো বন্ধ। ঘর জুড়ে মেঘলা দিনের আবছা অন্ধকার।

কেউ কোন কথা বলছেন না। মন সকলেরই বিক্ষিপ্ত যেন প্রত্যেকেই এক একজন আসামী।

রজার্স চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভেরা এমিলির দিকে তাকিয়ে বলল, চা টা আপনিই তৈরি করবেন।

এমিলি বললেন, আমার মন মেজাজ ভাল নেই, তুমিই কর।

ভেরা চা তৈরি করে পরিবেশন করল। ঘরের গুমোট ভাবটা খানিক হাল্কা হল।

একটু পরেই রজার্স ফের ঘরে ঢোকে। সে জানাল, ওপরের একটা স্নানের ঘরের পর্দা কে। খুলে নিয়েছে।

–কি রকম পর্দা ছিল? ব্লোর জানতে চায়।

–লাল সিল্কের।

–ও নিয়ে কেউ আর মানুষ খুন করতে পারবে না। যেতে দাও।

এমিলি বললেন, আমারও দুটো উলের গোলা খুঁজে পাচ্ছি না।

ভেরা বলল, কোথাও পড়ে গেছে হয়তো।

–তাই হবে।

রজার্স চলে গেল। সকলেই যার যার মত চা পান করতে লাগলেন। সকলের মনেই সন্দেহের মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

.

সবে ডিনার শেষ হয়েছে। রাত তখন নটা। সকলকেই শুতে যেতে হবে।

প্রথমে উঠে দাঁড়াল এমিলি এবং ভেরা।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, শুভরাত্রি জানাবার আগে সকলকেই আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, শুতে যাবার আগে দরজা ভাল করে বন্ধ করে দেবেন। সাবধানতা অবলম্বন করতে ভুলবেন না। কাল আবার সকলে এখানে মিলিত হব।

চারজন পরপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজা বন্ধ করবার শব্দও পাওয়া গেল।

রজার্সকে একাই সব কাজ করতে হচ্ছে তখন। সে খাওয়ার ঘর পরিষ্কার করে। তারপর আলো নিবিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে দেয়।

রজার্স তার নতুন ঘরে চলে আসে। দরজা বন্ধ করে ঘরটা একবার ভাল করে দেখে নেয়। আলমারি, খাটের তলা, কোন কিছু দেখতে বাকি রাখে না।

রজার্স শুয়ে পড়বার আগে ভাবল, আজ রাতে নিশ্চয় পুতুল কম হবে না। সংখ্যাটা একই থাকবে।

৩. লমবার্ড ঘড়িটা দেখল

১১.

লমবার্ড ঘড়িটা দেখল, সাড়ে নটা। ভাবল, নাঃ আর পড়ে থাকবো না। এবারে ওঠা দরকার।

সকালে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা তার বরাবরকার অভ্যাস। ঘুম ভাঙলেও বালিশে মুখ এঁজে পড়ে থাকে।

দরজা খুলে বাইরে আসে সে। দেখে ব্লোরের ঘর বন্ধ। এগিয়ে এসে টোকা দেয়।

একটু পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ব্লোর। তাকে দেখে লমবার্ডের মনে হয়, একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে।

ঘুমঘুম চোখে ব্লোর বলে, কি ব্যাপার?

–কটা বাজে খেয়াল আছে?

ব্লোর ঘড়ি দেখে। লজ্জিত ভাবে বলে, সর্বনাশ পৌনে দশটা। আসলে মনটা বড্ড অবসন্ন তো।

লমবার্ড বলে, তোমাকে কেউ ডেকেছিল? রজার্স চা দিয়ে গেছে?

-কই না তো? রজার্স কোথায়? যেন চমকে ওঠে ব্লোর।  লমবার্ড বলে, ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে আমারও এই কথাই মনে হচ্ছে।

দেখা গেল রজার্স নিরুদ্দেশ। সে তার ছোট্ট ঘরে বা রান্না ঘরে নেই। উনুনে আগুনও দেয়নি।

খবরটা অন্যদেরও দেওয়া হল। এমিলি ও ওয়ারগ্রেভ ছাড়া সকলেই রজার্সের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।

রজার্সের ঘরে দেখা গেল, বিছানা এলোমেলো। শোবার পোশাকটা ঘরের বাঁ পাশে পড়ে রয়েছে। দাড়িকাটার সরঞ্জাম টেবিলের একপাশে রয়েছে।

ব্রাশটা ভেজা, বোঝা গেল, দাড়ি কামিয়ে সে নিচে নেমেছে। সকলেই একে একে খাওয়ার ঘরে পা দিলেন।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, বাঃ রজার্স দেখছি বেশ পরিবাটি করে ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজিয়েছে।

ভেরা হঠাৎ বিচারপতির হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, দেখুন, পুতুল ছটা–

সকলেই সেদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে রইল।

.

রজার্সের মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেল খানিক পরেই। রান্নার কাঠ কাটতে গিয়েছিল রান্নাঘরের পেছনে। একটা কাটারি হাতেই ধরা ছিল। পাশেই কিছু কেটে রাখা কাঠ। হাত কয়েক দূরে দেয়ালে হেলান দেওয়া রয়েছে একটা রক্তমাখা কুঠার।

রজার্সের ঘাড়ে গভীর ক্ষতচিহ্ন।

.

১২.

এমিলি আর ভেরা মিলে সকালের খাওয়ার পাট কোন রকমে সমাধা করল। টিনের খাবার ছিল প্রচুর। তাই বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

রজার্সের ঘটনাটা নিয়ে আলোচনার পরে সকলে বসার ঘরে হাজির হয়েছেন। কেবল বাদ ছিলেন এমিলি।

তার শরীর গোলাচ্ছিল বলে খাবার ঘরের চেয়ারেই বসেছিলেন।

ডাক্তার ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমিলি খেতে চাননি।

এমিলির খুব ঘুম পাচ্ছিল। মৃদু গুঞ্জনের শব্দ তার কানে গেল। তাকিয়ে দেখেন জানালার কাছে একটা মৌমাছি উড়ছে।

হঠাৎ এমিলির মনে হল, কেউ যেন ঘরে প্রবেশ করল। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলেও পারলেন না।

কিন্তু কে এলো? তার মনে হল, বিয়াত্রিচে যেন। তার সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে তা থেকে।

মৌমাছির গুঞ্জন শব্দটা যেন কাছে এগিয়ে আসছে। হুল ফুটিয়ে দেবে না তো?

.

বসার ঘরে সকলে এমিলির জন্যই অপেক্ষা করছিল। ভেরা তাকে ডাকতে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল। ব্লোর তাকে বাধা দিয়ে বলল, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যিনি রয়েছেন তিনিই খাবার ঘরে বসে আছেন।

ডাক্তার বললেন, হঠাৎ একথা কেন বলছেন–

ব্লোর বলল, ওঁর বেশি বেশি ধর্মের ভাবটা আমার ভালো লাগে না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গ্রামাফোনের অভিযোগ শোনার পর আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব কথা খুলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনি কিছু বলেন নি।

ভেরা বলে, পরে উনি আমাকে সব কথা খুলে বলেছেন।

তাই বলে সে সকলকে বিয়াত্রিচে টেলরের কথা জানায়।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বলেন, সব শোনার পর আর ওঁকে দোষারোপ করা যায় না। আচ্ছা ভেরা, তোমার কি মনে হয়েছিল, বিয়াত্রিচের মৃত্যুর জন্য মিস এমিলির মনে দুঃখ বা অনুতাপ ছিল?

-না।

ব্লোর ওয়ারগ্রেভকে বলে, ওই মহিলা সম্পর্কে কোন ব্যবস্থা নেবেন না? অসুস্থ দেখাচ্ছিল–

-ডাক্তারই যা ভাল বুঝবেন করবেন। চলুন, বরং খাওয়ার ঘরেই যাওয়া যাক।

সকলে খাওয়ার ঘরে আসে।

এমিলি এখনো চেয়ারে বসে আছেন। কারোর পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পাননি।

ব্লোর এমিলির দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই থমকে দাঁড়ায়। এ কী দেখছে সে?

এমিলির মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। দেহ প্রাণহীন।

সবার আগে কথা বললেন ওয়ারগ্রেভ, ধরা গলায় বললেন, আমাদের সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে মিস এমিলি চলে গেলেন।

ডাক্তার এমিলির দেহ ভাল করে পরীক্ষা করে দেখছেন। বললেন, ঘাড়ের কাছে কিসের একটা দাগ দেখা যাচ্ছে।

ভেরা ঝুঁকে পড়ে দেখে বলে, মনে হচ্ছে কোন পোকার কামড়ের দাগ।

ডাক্তার বললেন, না, না, পোকার কামড় নয়। ওটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের দাগ।

ওয়ারগ্রেভ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কি বলছেন আপনি? ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে করে ওকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তাই। কোনরকমের সায়ানাইডই হওয়া সম্ভব। একই পটাসিয়াম মার্সটনকে দেওয়া হয়েছিল। ফলে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছে। আমাদের ডাক্তারি নাম অ্যাসফিকসিয়েশন।

হঠাৎ জানলার কাছে একটা গুঞ্জন শব্দ।

জানালার কাছে একটা মৌমাছি দেখা গেল।

ভেরা সেদিকে তাকিয়ে বলে, মৌমাছি এই কাণ্ড ঘটায়নিতো?

ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বললেন, মনে হচ্ছে ওটাকে হত্যাকারী কাজে লাগিয়েছে। সুচারু কাজ সন্দেহ নেই।

ভেরা হঠাৎ ডাক্তারকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা আপনি আসার সময় হাইপোডারমিকের সিরিঞ্জ সঙ্গে এনেছিলেন?

–হ্যাঁ। সব ডাক্তারের ব্যাগেই ওই সিরিঞ্জ থাকে।

সঙ্গে চারজোড়া চোখ ডাক্তারের দিকে ফেরে।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, কিছু যদি মনে করেন, দয়া করে আপনার সিরিঞ্জটা বার করে দেখাবেন? নিশ্চয়ই সেটা আপনার ব্যাগেই রয়েছে এখনো?

-আমার হাতব্যাগেই রয়েছে। সেটা আছে আমার ঘরে সুটকেসের ভেতরে।

–আপনার কথার সত্যতা আমরা যাচাই করতে চাইলে নিশ্চয় আপনার আপত্তি হবে না?

–কোন আপত্তি নেই। তাহলে চলুন—

ডাক্তারের পেছন পেছন মিছিল করে সকলে ওপর তলায় তার ঘরে গিয়ে ঢোকে। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কিন্তু সিরিঞ্জ কোথাও পাওয়া গেল না।

–নিশ্চই চুরি করেছে কেউ। আমি হলপ করে বলতে পারি। ডাক্তার কর্কশ গলায় বলেন।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, আমরা পাঁচজন এই ঘরেই রয়েছি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এর মধ্যেই একজন হত্যাকারী। নিরপরাধ চারজন এবারে তার লক্ষ্য।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আচ্ছা ডাক্তার, আপনার কাছে একটা ওষুধের বাক্স আছে?

-হ্যাঁ। এই তো। ডাক্তার বাক্সটা এগিয়ে ধরলেন।

-আমার হাতে কিছু ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুম না এলে খেতে হয়। তবে বেশি খেলে অনিবার্য মৃত্যু। লমবার্ড, তোমার কাছে তো একটা রিভলভার রয়েছে–

লমবার্ড জানায়, হ্যাঁ, আছে, তাতে কি?

-আমি বলতে চাইছি, ডাক্তারের ওষুধের বাক্স, আমার ঘুমের বড়ি এবং রিভলভার–এই ধরণের জিনিস যার কাছে যা আছে, সব একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে দেওয়া উচিত।

লমবার্ড বলে, কিন্তু রিভলভার হাতছাড়া করলেই তো বিপদে পড়ে যাব।

-লমবার্ড, তুমি শক্তিমান যুবক। কিন্তু ব্লোরও যুবক, গায়েও তার যথেষ্ট শক্তি। আমি ডাক্তার ও ভেরা ওকে সাহায্য করলে তুমি বাধা দিয়ে পারবে না, বুঝতেই পারছ।

লমবার্ড অগত্যা বলে, বেশ, কী করতে হবে বলুন?

–এই তো মাথায় বুদ্ধি ফিরেছে। তোমার রিভলভারটা কোথায়?

আমার ঘরে, খাটের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে।

–বেশ। চল আমরা সকলে যাচ্ছি।

লমবার্ড দ্বিমত করল না। সকলে মিলে তার ঘরে হাজির হল। কিন্তু বিস্ময় সেখানেও অপেক্ষা করছিল। দেখা গেল যথাস্থানে রিভলভার নেই।

.

–এ তো দেখছি ভেল্কি। লমবার্ড হতবাক হয়ে যায়।

ওয়ারগ্রেভ বলেন, ভেরা তুমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।

ভেরা বাইরে চলে গেলে লমবার্ডের শরীর তল্লাশি করা হলো। তারপর বাকি তিনজনও বাদ গেল না। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই কারোর কাছে পাওয়া গেল না।

এরপর ওয়ারগ্রেভ ভেরাকে ডাকলেন। সে এলে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না। এই সময়ে আমি নিরুপায়। তোমার কাছে সাঁতারের পোশাক আছে?

-হ্যাঁ। –

-তাহলে, এই পোশাক বদলে তা পরে এসো।

ভেরা চলে যায়। একটু পরেই সাঁতারের পোশাক পরে ফিরে আসে।

ওয়ারগ্রেভ তাকে বললেন, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমরা তোমার একটু পরীক্ষা করব।

ভেরার ঘরে কিছু পাওয়া গেল না। সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভেরাও পোশাক পাল্টে সকলের সঙ্গে এসে যোগ দিল।

আবার সকলে বসার ঘরে।

ওয়ারগ্রেভ সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে আমাদের কারোর কাছেই জীবন হানিকর কিছু নেই। এখন এই ওষুধগুলো নিচের খাবার ঘরে বাসন রাখার সিন্দুকে রেখে দিতে হবে।

লমবার্ড ব্যঙ্গের সুরে বলে, সিন্দুকের চাবিটা কি এরপর আপনার কাছে থাকবে?

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লমবার্ডের দিকে তাকালেন। তারপর শান্তভাবে বললেন, তাহলে, চলুন নিচে যাওয়া যাক।

নিচে গেরস্থালির চাবি একটা হুকে সাজানো আছে। ওয়ারগ্রেভ একটা রিং তুলে আনলেন। তাতে দুটো চাবি। ওটা সিন্দুকের চাবি।

খুলবার জন্য দুটোই ব্যবহার করতে হয়। ওয়ারগ্রেভ সিন্দুক খুলে ওষুধগুলো রেখে চাবি ঘুরিয়ে আবার বন্ধ করে দিলেন।

তারপর একটা করে চাবি লমবার্ড ও ব্লোরকে দিয়ে তিনি বললেন, তোমরা একে অপরের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিতে পারবে না, দুজনেই শক্তিমান।

সিন্দুক ভাঙা সহজ কাজ হবে না, তাতে শব্দও হবে প্রচণ্ড। কাজেই ওষুধগুলো নিয়ে আর ভয়ের কোন কারণ নেই।

একটু থেমে ওয়ারগ্রেভ আবার বললেন, কিন্তু লম্বার্ডের রিভলভারটা কোথায় গেল সেটাই ভাবছি। আচ্ছা, ওটা তুমি শেষ কখন দেখেছিলে লমবার্ড?

লমবার্ড বলল, কাল রাতে শোবার সময়।

ব্লোর বলল, রিভলভারটা পাওয়া না গেলেও অন্য একটা জিনিস কোথায় আছে আমি বলতে পারি। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

ব্লোরকে অনুসরণ করে সকলে খাওয়ার ঘরের পেছনে এলো। ব্লোর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল, জানলার নিচে ঘাসের ওপরে পড়ে রয়েছে সিরিঞ্জ ও একটা ভাঙ্গা পুতুল।

ব্লোর বলল, মিস এমিলিকে হত্যা করে হত্যাকারী ওগুলো ফেলে দিয়েছে।

ভেরা বলল, তাহলে খুঁজলে রিভলভারটাও পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। চলুন। দেখা যাক।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, চল তাহলে। তবে সবাই আমরা একসঙ্গে থাকব। এখন আলাদা ভাবে থাকা মানেই হত্যাকারীকে সুযোগ করে দেওয়া।

এরপর সকলে মিলে আঁতিপাতি করে খুঁজলেন, কিন্তু রিভলভার কোথাও পাওয়া গেল না।

.

১৩.

অবশিষ্ট পাঁচটা মানুষ। কিন্তু মানসিকভাবে কেউই স্বস্তিতে নেই। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করছে, কেন না, ওয়ারগ্রেভ বুঝিয়ে দিয়েছেন, খুনী তাদের মধ্যেই একজন। তবু বাঁচার চেষ্টায় তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত না থেকে পারছে না।

প্রকৃতিও আজ বড় অশান্ত। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। পাল্লা দিয়ে চলেছে ঝোড়ো হাওয়া।

থেকে থেকে দমকা হাওয়া বাড়িটার ওপর আছড়ে পড়ছে প্রচণ্ড আক্রোশে। যেন প্রাসাদোপম বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেবে।

ওরা পাঁচজন, বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ, ডাঃ আরমস্ট্রং, ব্লোর, লমবার্ড ও ভেরা ঘরে বসে আছে খানিক দূরে দূরে।

এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকে যেন একটা আলাদা দ্বীপ।

সকলেরই মনের মধ্যে একটা কথা কেবলই ঘুরে ফিরছে–খুনী আমাদের মধ্যেই একজন।

দূরেদূরে বসে আছে, কিন্তু তাদের চোরা দৃষ্টি পরস্পরকে তীক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছে। হাবভাব কতটা সন্দেহজনক তা জরীপ করবার চেষ্টা করে চলেছে।

সময় বয়ে চলে। হাওয়ার গজরানি আর শার্সির গায়ে বৃষ্টি আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া এঘরে অন্য কোন শব্দ নেই।

ভেরা বলল, চা করে নিয়ে আসা যাক।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, মন্দ হয় না। কিন্তু তুমি একা যেয়ো না, আমরাও সঙ্গে যাব। চা টা আমাদের সামনেই করো।

পারস্পরিক এই সন্দেহের খোলামেলা প্রকাশকে এখন আর কেউ অপমানজনক বলে মনে করছে না। তাই ভেরা বলল, বেশ চলুন।

.

সন্ধ্যাবেলা আলো জ্বালতে গিয়ে দেখা গেল, আলো জ্বলছে না। রজার্স মারা যাবার পর আর ইঞ্জিনটা চালানো হয়নি।

লমবার্ড ইঞ্জিনটা চালাবার কথা বললে, ওয়ারগ্রেভ বললেন, এখন আর ঝামেলা করে কাজ নেই। রান্নাঘরে অনেক মোমবাতি আছে, তাই জ্বালানো হোক।

তাই করা হলো।

.

মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। ভেরার মাথাটা ভারি ভারি বোধ হচ্ছিল। শরীরও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। স্নান করলে একটু স্বস্তিবোধ করবে ভেরার মনে হল।

সে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্লেটের ওপর বসিয়ে দোতলার ঘরে গেল। চারপাশে অন্ধকার। মোমবাতির সামান্য আলোয় অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে।

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ভেরার মনে পড়ে গেল হুগোর কথা। তার হাত কেঁপে উঠলো। প্লেটটা পড়ে গেল, বাতি নিভে গেল।

কিছু বুঝতে না পেরে তীব্র আতঙ্কে ভেরা আর্তনাদ করে উঠল। তার মনে হল একটা ঠান্ডা হাত তার কপালে, গলায় গালে ….

ভেরার চিৎকার শুনে সকলে ওপরে ছুটে আসে। একটা করে জ্বলন্ত মোমবাতি সবার হাতে।

ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করলেন ভেরাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানালেন, ভেরা বেঁচে আছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

ব্লোর নিচে গিয়ে একটু ব্র্যান্ডি নিয়ে আসে। ভেরাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই বাধা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল–না, না, আমি কিছু খাবো না।

সেই সন্দেহ। যদি পানীয়ের সঙ্গে কিছু মেশানো থাকে। ব্লোর অপমান বোধ করলেও হাত সরিয়ে আনল।

লমবার্ড বলল, একটা না-খোলা বোতল পাওয়া গেলে ভাল হতো, দেখছি–

বলে সে নিচে নেমে গেল। এত কাণ্ডের পরেও ভেরা যে বিচার শক্তি হারিয়ে ফেলেনি এতে সে খুশি।

ডাক্তার ভেরাকে সাবধানে তুলে ধরে কলের কাছে নিয়ে গেলেন। চোখে মুখে জল ছেটাল ভেরা। ওর সামনেই গ্লাস ধুয়ে জল দিলেন ডাক্তার। জলটুকু খেল সে। তারপর ডাক্তারের হাত ধরে ফিরে এসে খাটের ওপরে বসল।

ভেরা কেন ভয় পেয়েছিল তা জানা গেল। ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে একটা সামুদ্রিক লতা। কিন্তু ওটা আগে ওখানে ছিল না, সদ্য কেউ ঝুলিয়ে রেখে গেছে।

লমবার্ড একটা আনকোরা ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে এল।

তা থেকে খানিকটা পান করে ভেরা সুস্থ বোধ করতে লাগল।

লমবার্ড বলল, খুনীর একটা চেষ্টা ব্যর্থ হল। ভেবেছিল এই দফায় ভয় পাইয়ে কাজ হাসিল করবে। আপনার মনের জোর আছে বলতে হবে।

ব্লোর যে গ্লাসে করে ব্র্যান্ডি এনেছিল, ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে সেটা পরীক্ষা করছিলেন। ব্লোর বলল, আপনি আমায় সন্দেহ করছেন–

আবার অপ্রিয় প্রসঙ্গ উঠে পড়েছে। ভেরা সেটা চাপা দেবার জন্য বলল, আমাদের বিচারপতিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। তিনি কোথায়?

তখন সকলের খেয়াল হল। সত্যিই তো, তিনি নেই। ডাক্তার চিৎকার করে ডাকলেন–মিঃ ওয়ারগ্রেভ

কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আবার শুরু হল খোঁজার পালা। খাওয়ার ঘর, বসার ঘর, সিঁড়ি, বারান্দা সব খোঁজা হল।

শেষে তার ঘরে এসে সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ওয়ারগ্রেভ নিজের ঘরে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার মাথায় একটা পরচুলা, পরণে লাল সিল্কের গাউন।

ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন। ওয়ারগ্রেভ বেঁচে নেই জানালেন।

মাথার পরচুলাটা তুলে ফেলতেই দেখা গেল চকচকে টাকের মাঝখানে একটা লাল দাগ। ডাক্তার জানালেন, গুলির আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে।

ভেরা পরচুলাটা কুড়িয়ে নিল। সে চিনতে পারল। বললো, এটা দেখছি এমিলির হারিয়ে যাওয়া উলের গোলা দিয়ে তৈরি। আর গাউনটাও স্নানের ঘরের হারিয়ে যাওয়া পর্দার লাল সিল্কের কাপড়।

ব্লোর বলল, রিভলভারটা কেন সরানো হয়েছে, এবারে পরিষ্কার হল।

.

১৪.

ওরা এবারে চারজন–ডাক্তার, ভেরা, ব্লোর এবং লমবার্ড। সকলে নিচের বসার ঘরে নেমে এলো।

রাতে মুখে তো কিছু দিতে হবে। তার ব্যবস্থা কি হবে। টিনের খাবার ছিল প্রচুর। তাই দিয়ে কোন রকমে চালিয়ে দেওয়া হল। কেউই বিশেষ মুখে তুলতে পারল না।

ব্লোর বলল, এবারে কার পালা কে জানে?

ডাক্তার বললেন, আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।

লমবার্ড বলল, ছাড়ুন তো ওসব কথা। বিচারপতিও তো ও-কথা বারবার বলেছেন, তিনি নিজেই কি রেহাই পেলেন? যা হবার হবে–ও নিয়ে আর ভাববার দরকার নেই।

ডাক্তার বললেন, সত্যি, ঘটনাটা এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

লমবার্ড বলল, খুনীর কৌশলগুলো অতি চমৎকার। মিস ভেরার চিৎকার শুনে আমরা ওপরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, আর সেই সুযোগে সে কাজ হাসিল করে নিয়েছে।

ব্লোর বলল, কিন্তু গুলির শব্দ তো পাওয়া গেল না।

লমবার্ড বলল, পাব কি করে? একদিকে চিৎকার, দৌড়োদৌড়ি, তার মধ্যে সমুদ্রের গর্জন মিলেমিশে সব একাকার হয়ে গেছে।

তাছাড়া আমাদের মনযোগও ছিল অন্য দিকে।

তারপর আর বেশি রাত করল না তারা। দোতলায় যে যার ঘরে শুতে চলে গেল একটা করে মোমবাতি নিয়ে।

সিঁড়ি দিয়ে তাদের ওপরে ওঠার দৃশ্যটা ছিল বড়ই করুণ। চারজনই পাশাপাশি উঠছে। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ এমনই প্রবল যে কেউ কারো পেছনে যেতে রাজি নয়।

এভাবে ওপরে উঠে গিয়ে প্রায় একই সঙ্গে চার ঘরের চারটে দরজা বন্ধ করে তারা স্বস্তি বোধ করল।

.

লমবার্ড তার ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। খুঁটিয়ে দেখল নিজেকে। না, মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই। নিজের মনে হাসল সে। এরপর শোবার পোশাক পরে বিছানা নিল।

হাত ঘড়িটা টেবিলে রাখল খুলে। কি মনে হতে ড্রয়ারটা টান দিয়ে খোলে। সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব হয়ে গেল সে। ড্রয়ারের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া রিভলভারটা রয়েছে।

.

ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে রাত বারোটা বাজল।

পুলিস অফিসার ব্লোর বিছানায় ছটফট করছে। ঘুম আসছে না। অন্ধকারের মধ্যে তার মনে পড়ে–যারা তাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে তাদের কথা।

হঠাৎ ব্লোরের মনে পড়ে যায় তার স্ত্রীর কথা–ল্যাণ্ডরের। গ্রামাফোন রেকর্ডে তার কথা বলেছে। ওদের একটা দশবছরের মেয়ে ছিল। কী হল তাদের?

হঠাৎ ব্লোর চমকে ওঠে। ঘড়িতে একটার ঘন্টা পড়ল। পরক্ষণেই কার পায়ের শব্দ। বারান্দায় যেন কেউ হাঁটছে।

কান পেতে শুনল ব্লোর। হ্যাঁ, কোন ভুল নেই–কে হাঁটাচলা করছে।

ব্লোরের কপালে ঘাম জমতে থাকে। সে বিছানা ছেড়ে এসে দরজায় কান পাতে। না, এখন আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

দরজা খুলে বাইরে বেরুবে কিনা ভাবছে ব্লোর। হঠাৎ তার মনে হল কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।

শব্দটা তার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আবার চলতে থাকে–সিঁড়িতে নামার শব্দ পায়। আর কোন আওয়াজ হয় না।

ব্লোর তার সিদ্ধান্ত স্থির করে নেয়। সে চটিজোড়া খুলে নেয়। পায়ে কেবল মোজা।

লোহার ল্যাম্প স্টান্ডটা হাতিয়ার হিসাবে মুঠি চেপে তুলে নেয়। তারপর নিঃশব্দে বারান্দায় বেরিয়ে আসে।

এখন বাতাস ধীর। মেঘও কেটে গেছে। আকাশে চাঁদের হাল্কা আলো। সেই আলোতে ব্লোর দেখতে পায় একটা ছায়ামূর্তি যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

ব্লোর দৌড়োতে গিয়েও সামলে নেয়। না, হত্যাকারীর ফাঁদে ধরা দেবে না।

এবারে সে ডাক্তারের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দেয়। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায় না।

এরপর লম্বার্ডের দরজায় আঘাত করে। ভেতর থেকে সাড়া আসে, কে—

আমি ব্লোর।

–কি ব্যাপার বলো।

–ডাক্তার দেখছি তার ঘরে নেই।

–আসছি, অপেক্ষা করো।

এরপর ব্লোর ভেরার দরজায় মৃদু আঘাত করে। সাড়া পাওয়া গেল। পরিচয় জানিয়ে বলল, একমিনিট পরে আসছি।

লমবার্ড দরজা খুলে বারান্দায় বেরোয়। গায়ে রাতের পোশাক। হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। একটা হাত জ্যাকেটের পকেটে।

ব্লোর তাকে ডাক্তারের কথা বলে। দুজনে মিলে ডাক্তারের দরজায় আসে। টোকা দেয়, ডাকে। কোন সাড়া আসে না। এবারে দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে যায়। ঘরে কেউ নেই, ঘর ফাঁকা।

এবারে ওরা দুজন ভেরার দরজার সামনে আসে। ভেরা সাড়া দেয় কিন্তু দরজা খোলে না।

লমবার্ড বলে, আমিও ডাক্তারকে খুঁজতে যাচ্ছি। যদি ডাক্তার এসে ডাকে আপনি দরজা খুলবেন না। যদি আমি ও ব্লোর একসঙ্গে এসে ডাকি তাহলেই কেবল দরজা খুলবেন।

এরপরে সে ব্লোরকে বলে, চলো ডাক্তারের সন্ধান করা যাক।

ব্লোর বলে, কিন্তু একটা কথা ভাবছি–

–কি কথা?

–রিভলভারটা ডাক্তারের কাছে থাকা অসম্ভব নয়।

লমবার্ড বলে, না, ওটা আমার কাছে আছে। রাতে শুতে যাবার আগে ড্রয়ারেই পেয়েছি। অস্ত্রটা সে ব্লোরকে দেখায়।

ব্লোর কেমন থমকে যায়। কিন্তু মনে মনে বলে, না, ওই অস্ত্রকে আমি ভয় করি না। ভয় রহস্য আর গুপ্তঘাতককে।

.

ভেরার আর ঘুম আসে না। সে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকে। সে ভাবে তবে কি ডাক্তারই হত্যাকারী?  লমবার্ড আর ব্লোর তাকে খুঁজতে গেছে। এই অবস্থায় তিনি কোন ছলনা করে দরজা খোলাবার চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো বলবেন, ওরা দুজনেই মারা গেছে। কিংবা বাড়িতে আগুন লেগেছে?

ভেরা বিছানা থেকে নেমে দরজাটা একবার পরীক্ষা করল। তারপর জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া লাগে।

বুঝতে পারে, ভোর হতে বেশি দেরি নেই।

ভেরার দরজায় টোকা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে কথা ভেসে আসে আমি ব্লোর–আমি লমবার্ড।

দরজা খুলে ভেরা ওদের দুজনকে দেখতে পায়। পাজামা হাঁটু পর্যন্ত জলে ভেজা। দুজনকেই বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

ওরা হতাশভাবে জানায় ছোট্ট দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু ডাক্তারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

ভেরা বলল, তিনি হয়তো বাড়ির ভেতরেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন।

ব্লোর বলল, কোথাও দেখতে বাদ দেইনি আমরা।

লমবার্ড বলে, আরও একটা খবর আছে—

কি?

–পুতুল মাত্র তিনটা আছে–মানে আমরা তিনজনই মাত্র বেঁচে আছি।

ভেরার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। অস্ফুট আর্তনাদের শব্দ করে সে।

.

১৫.

আজ আকাশ নির্মেঘ নীল। ঝকঝকে রোদ। গত কদিনের আবহাওয়ার সঙ্গে আজ কোন মিলই নেই।

ওরা তিনজন–ভেরা,  লমবার্ড আর ব্লোর, সমুদ্রের ধারে বসে আছে। আজ, ওরা যেন খানিকটা হাল্কা, ভার মুক্ত বোধ করছে।

ডাক্তারের কথাই ভাবছিল তারা তিনজন।

লমবার্ড বলে, প্রতিমুহূর্তের মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে গেছেন ডাক্তার। এভাবে বেঁচে থাকা মৃত্যুরও বাড়া।

ভেরা বলে, কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন, এমন কোন প্রমাণ তো হাতে নেই।

–প্রমাণ সেই পুতুল। একটা উধাও।

–হ্যাঁ, অন্যদের ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছে। কিন্তু মৃতদেহটা উধাও হয়ে যাবে কেন?

–হয়তো হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল, ভাসতে ভাসতে দূরে চলে গেছে।

লমবার্ড কর্কশ গলায় বলল, কিন্তু তাকে হত্যা করল কে? তুমি না আমি? তুমি তো আমাকে ডাকলে–আমি তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। এর মধ্যে ডাক্তারকে হত্যা করার, সময় কখন পেলাম।

তাছাড়া সমুদ্রে ফেলে দিতে হলে তো কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য অনেক সময়ের দরকার।

ব্লোর বলে, ওসব হিসেব মিলবে না। আমি ভাবছি রিভলভারের কথা, ওটা সব সময় তোমার কাছেই ছিল।

–একদম বাজে কথা। আমাকে তো তোমরা তল্লাশি করেছিলে।

–তা করেছিলাম। তখন কোথাও হয়তো লুকিয়ে রেখেছিলে।

লমবার্ড উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, না, না–আমি বলছি কাল রাতে ওটা ড্রয়ারের মধ্যেই আবার পেয়েছি।

–তোমার কথাই যদি মেনে নিই তাহলে ওটা কে ফেরত দিল, কখন, কিভাবে ফেরত দিল, তা নিশ্চয় তুমি জান না।

–না।

–এখন ওটা তোমার কাছেই আছে তো?

–হ্যাঁ।

–তাহলে কি দাঁড়াল? আমার আর মিস ভেরার জীবন মরণ তোমার দয়ার ওপর নির্ভর করছে। তবে–

–বলো, তবে কি?

–ওষুধগুলো যেখানে আছে রিভলভারটাও যদি সেখানে রেখে দাও আর দুটো চাবি একটা করে আমাদের দুজনের কাছে থাকে–তবে তোমার কথা বিশ্বাস হতে পারে।

–অসম্ভব।

–অসম্ভব কেন? ব্লোর তীক্ষ্ম চোখে তাকায় লমবার্ডের দিকে।

–তোমার কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে আমিই তাহলে আওয়েন। যদি তাই হতাম তাহলে তো কাল রাতেই তোমাকে খতম করে দেবার সুযোগ ছিল।

এবারে ভেরা কথা বলে, মাথায় ঝুলছে মরণের খাঁড়া, আর আপনারা এখন ঝগড়া করছেন। ভাবুন কি করে আমরা বাঁচতে পারি।

ব্লোর আর  লমবার্ড কথা বন্ধ করে ভেরার দিকে তাকায়।

ভেরা আবার বলে, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, ডাক্তার মারা যাননি, কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন।

.

ব্লোর হাত ঘড়ি দেখে বলল, বেলা দুটো বাজে, লাঞ্চের কি হবে?

ভেরা বলে, আমি আর ওই বাড়িতে যাচ্ছি না।

–কিন্তু কিছু খাওয়া তো দরকার।

লমবার্ড বলে, আমার এখন খাবার ইচ্ছা নেই। আমি এখানেই থাকব আপাতত।

ব্লোর ভেরার দিকে তাকিয়ে বলল কিন্তু–

ভেরা বুঝতে পারল ব্লোর কি বলতে চাইছে। সে বলল, আপনার অনুপস্থিতিতে লমবার্ড আমাকে গুলি করে মারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

ব্লোর বলল, আমি তা বলতে চাইনি। কথা হয়েছিল, আমরা সব সময় একসঙ্গে থাকবো। আমি সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।

লমবার্ড বলল, বেশ চল আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।

-না, তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি। এই বলে ব্লোর বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

ভেরা ভয়ে ভয়ে বলল, উনি একটা ঝুঁকি নিলেন।

ঝুঁকির কিছু নেই। ডাক্তার ওর গায়ের জোরের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।

–কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

–একটু তলিয়ে ভাবুন। কাল রাতের কথা ভাবুন।

বলে  লমবার্ড একটু চুপ করে। তারপরে বলে, ব্লোর তার ঘরের সামনে প্রথম পায়ের শব্দ শুনেছে; তার পরে আমাকে ডেকেছে। আমার বিশ্বাস ডাক্তারকে হত্যা করার পরেই আমাকে, এসে ডেকেছে।

-তা কি করে সম্ভব?

–অতসব বলতে পারব না, আমার যা বিশ্বাস, সেই কথাই আমি বললাম। এটুকু জানি, ওর সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।

ভেরা এবারে ভয় পেয়ে যায়।–যদি তাই হয়, আমাদের কি হবে?

-কি আবার হবে।

লমবার্ড রিভলভারটা বার করে ভেরাকে দেখায়। বলে, এটা দিয়েই মোকাবিলা করব।

রিভলভার দেখে ভেরা আরও ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, লম্বার্ডের কাছে দয়ার পাত্র। যে কোন মুহূর্তে তাকে শেষ করে দিতে পারে।

সে সজাগ হয়, লমবার্ডের মনের কথা সে জানে না। কি উদ্দেশ্যে সে তার কাছে বসে আছে তা-ও সে বুঝতে পারছে না। ভেরা তো তাকে থাকবার জন্য অনুরোধ করেনি।

ভেরাকে চুপ করে থাকতে দেখে  লমবার্ড তার মনের কথা অনুমান করতে পারে। বলে, আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি হবে না, এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন।

ভেরা করুণ হেসে বলে, বিশ্বাস না করে উপায় কি। তবে ব্লোরকে আপনি ভুল বুঝেছেন। আমার ধারণা ও ডাক্তারকে খুন করেনি।

তারপর সম্পূর্ণ পাল্টে যায় ভেরার গলার স্বর। নিচুস্বরে বলে, আচ্ছা, আপনার এমন মনে হয়, সবসময় কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে?

-না, না, ওটা দুর্বল মনের চিন্তা।

ভেরা এবার চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। লমবার্ডের দিকে একটু এগিয়ে বসে। তারপর ফিসফিস করে বলে, এমন তো হতে পারে, এসব কিছুর পেছনে রয়েছে কোন মানুষের আত্মা। সে কারণই সবকিছু এমন নিখুঁত–

লমবার্ড বলে, ওসব আত্মা বা অলৌকিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।

–বিশ্বাস করেন না?

–না। কেন না, আমি ভাল করেই জানি, যা কিছু এখানে ঘটছে, সবের পেছনেই রয়েছে কোন মানুষ। আচ্ছা, এসব আত্মার ব্যাপার আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন?

–করি বইকি।

লমবার্ড এবারে মৃদু হাসল। বলল, সবই বিবেকের কাজ।

-মানে? যেন চমকে ওঠে ভেরা।

–না, বলছি বিবেকের কথা। আপনি তাহলে সেই শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন?

ভেরা অকস্মাৎ চিৎকার করে ওঠে, না-না–ও বিষয়ে আপনি কী জানেন?

–তা ঠিক কিছুই জানি না। তবু অনুমান করতে পারছি আপনার মত একটি মেয়ে, হৃদয়ঘটিতে কোন ব্যাপার না থাকলে তো এমন কাণ্ড করা সম্ভব নয়?

ভেরা হাঁপাতে লাগল। হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, হ্যাঁ ছিল।

লমবার্ডের মনে কি ঈর্ষার ছায়া পড়ল? তার মুখ বিবর্ণ দেখালো কেন?

ঠিক সেই সময় বাড়ির দিক থেকে একটা ভারি কিছু পড়ার শব্দ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে একটা আর্তনাদের শব্দ।

চকিতে দুজনে উঠে দাঁড়ালো, পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। লমবার্ড বলল, চলুন দেখা যাক–

ওদের জন্য এক মর্মান্তিক দৃশ্য অপেক্ষা করছিল। তবে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তাই আকস্মিকতার ধাক্কা ওরা নীরবেই সামলে নিতে পারল।

চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস করবার মত নয় এই দৃশ্য।

বারান্দার পূবদিকে ব্লোর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দু হাত দুদিকে ছড়ানো। মাথাটা একেবারে গেঁৎলে গেছে।

কাছেই পড়ে আছে একখণ্ড ভারি পাথর। পরিষ্কারই বোঝা গেল, ওই পাথর দিয়েই আঘাত করা হয়েছে।

কিন্তু এই কাজ কে করল? ভেরা আর লমবার্ড তো ছিল সমুদ্রতীরে।

কোন সন্দেহ নেই এ কাজ ডাক্তারের। এখনো জীবিত থেকে লোকটি নিষ্ঠুরভাবে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

লমবার্ড দাঁত দাঁত চেপে বলল, যে করেই হোক ডাক্তারকে এবার খুঁজে বার করব। আমি চললাম।

কাঁদো কাঁদো ভেরা এবারে অদ্ভুত সম্বোধন করে বসল, পাগলামো করো না, লমবার্ড। খুনীর লক্ষ্য এবার আমরা দুজন। আমরা তাকে খুঁজতে বেরব এটাই তার ফাঁদ–না না–তুমি যেতে পারবে না।

লমবার্ড থমকে দাঁড়াল। বলল, তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ। বেশ, চলো বাইরে যাই।

ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসল। এখন আর ওদের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। ভাগ্যই ওদের দুজনকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে।

লমবার্ড বলল, কাল আমরা এমন করে খুঁজলাম, ডাক্তার কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে বলো তো?

–কোথাও নিশ্চয় আছে। আর খুঁজতে গিয়ে কাজ নেই। মৃত্যু চারপাশেই ওত পেতে আছে।

লমবার্ড রিভলভারটা বার করে দেখাল। বলল, এটা এখনো আমার কাছে রয়েছে।

–অত বড়াই করো না  লমবার্ড। ব্লোরও কম হুঁশিয়ার ছিল না। তাই বলছি, আর খোঁজাখুঁজিতে গিয়ে কাজ নেই।

লমবার্ড ভেরার কথা অগ্রাহ্য করে না। সে তার পাশেই বসে থাকে।

ভেরা একসময় বলে, আজকের আবহাওয়া বড় চমৎকার। চাঁদের আলোয় সারারাত এখানেই কাটিয়ে দেব। তোমার ভাল লাগবে না?

লমবার্ড বলে, আপত্তি কি। চল, এখন একটু ঘুরে বেড়ানো যাক। অনেকক্ষণ একভাবে বসে আছি।

এরপর দুজনে একসঙ্গে হাত ধরে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক বেড়াল।

বিকেলের সোনালী রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে। আর কিছু সময় পরেই সূর্য অস্ত যাবে।

টিলার নিচের দিকে সমুদ্রের দিকটায় কি চোখে পড়ল লম্বার্ডের। সে সেদিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

ভেরা জিজ্ঞেস করল, কথা বলছো না কেন? কি দেখছ ওদিকে অমন করে?

লমবার্ড বলে, ওটা কি বল তো?

আঙুল তুলে দেখায় সে। ভেরা কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পরে বলে, মনে হচ্ছে সামুদ্রিক লতাজাতীয় কিছু জলে ভাসছে।

–চলো, কাছে গিয়ে দেখা যাক। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।

ভেরা লমবার্ডকে হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সেভাবেই বলল, যাবে তো চলো। আমার কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না।

–তবু, দেখতে ক্ষতি কি?

কাছে গিয়ে দেখা গেল, ভাসমান বস্তুটা লতা বা শ্যাওলা জাতীয় কিছু নয়। একটা জামা জলে ভাসছে।

আরও একটু কাছে গিয়ে ভাল করে লক্ষ্য করল ওরা। তখন বুঝতে পারল, শুধু পোশাক নয়, একটা মানুষের মৃতদেহ–জলে ভাসছে।

লমবার্ড বলল, জোয়ারের টানে এপাড়ে এসে ভিড়েছে। চিনতে অসুবিধা হল না। ডাক্তার আরমস্ট্রং-এর মৃতদেহ।

.

১৬.

লমবার্ড হেসে বলল, ব্যাপারটা মন্দ হল না, কি বলো ভেরা?

–কি ব্যাপার?

–এই যে তুমি আর আমি–এই দুজন ছাড়া দ্বীপে আর কেউ নেই।

ভেরার মুখ হঠাৎ কেমন কঠিন হয়ে উঠল। চোখের কোমল দৃষ্টি মুহূর্তে আগুন-ঝরা হয়ে উঠল। ও যেন আর মানবী নেই। এক কালনাগিনী।

লমবার্ড আবার বলে, কেবল তুমি আর আমি।

ভেরা অপাঙ্গে লম্বার্ডের দিকে তাকায়। নিজেকে ধিক্কার দেয় মনে মনে। এই লোকটাকে এত বিশ্বাস করছি কি করে? ওর মুখে ক্রমশই একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠছে। হাসছে, কিন্তু হাসিটা স্বাভাবিক নয়। কেমন পৈশাচিক ছাপ। তা না হলে ওই হাসি শুনে বুক কেঁপে উঠছে যেন?

ভেরার অন্তরাত্মা যেন বলে ওঠে, পালাও। পালাও—

মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পাল্টে নেয় ভেরা।

চোখের চাউনি স্বাভাবিক হল।

মুখে ফুটে উঠল অপূর্ব লাবণ্য।

বুকে জমে উঠল যেন একরাশ মধু।

কোমল মধুর স্বরে ভেরা এগিয়ে যায় লম্বার্ডের দিকে। মোহিনী দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকায়।

–শোন। স্বেচ্ছায় ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় ভেরা। নিজেকে ধরা দেয়।

যে নারী আপনা থেকে নিজেকে এগিয়ে দেয়, তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে কোন পুরুষ? লমবার্ড দুহাত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় ভেরাকে। বলে, ডাক্তারের জন্য তোমার দুঃখ হচ্ছে না?

ভেরা প্রণয়িনীর স্বরে জবাব দেয়, হলেই বা কি করা যাবে।

–চলো দুজনে মিলে ওর দেহটা বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাই।

–ওই মৃত্যুপুরীতে?

–হ্যাঁ, মৃত্যুপুরীতে।

–না, ওখানে না।

–তাহলে চলো, জল থেকে একটা পাথরের ওপরে তুলে রাখা যাক।

–তা করা যেতে পারে।

ওরা এগিয়ে যায় জলে ভাসমান মৃতদেহটার দিকে। কিন্তু জলে ভিজে যে মৃতদেহ এমন ভারী হয়ে যায় তা ওদের জানা ছিল না।

লমবার্ডই টেনে পাড়ের দিকে আনল। ভেরা প্রাণপণে তাকে সাহায্য করল।

শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে একটা চড়াই বেয়ে ডাক্তারের মৃতদেহ লমবার্ড টিলার পাথরের কাছে বয়ে নিয়ে এল।

ভেরা, পা পিছলে যাবার ভয়ে সারাক্ষণ লমবার্ডকে জড়িয়ে ধরে রইল।

পাথরটার ফাঁকে ফাঁকে ছোট গাছ। কিছু ফুলও ফুটেছে। সেখানেই ডাক্তারের দেহ শুইয়ে দেওয়া হল।

প্রকৃতির পেতে রাখা বিছানাতেই চিরনিদ্রায় শুয়ে রইলেন ডাক্তার।

লমবার্ড বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার চওড়া বুক জোরে জোরে ওঠানামা করছে। কপালে গলার তলায় ঘাম জমেছে।

শেষ বেলার রোদ পড়ে ঘামের বিন্দু চিকচিক করছে।

রুমাল দিয়ে মুখটা মোছা দরকার। লমবার্ড পকেটে হাত দিতে গিয়ে চমকে ওঠে।

রিভলভার তো পকেটে নেই। সর্বনাশ, পড়ে গেল নাকি জলে?

লমবার্ড ঘুরে দাঁড়ায়। অমনি চোখ পড়ে যায় অদূরে দাঁড়ানো ভেরার দিকে। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।

এতক্ষণের মোহিনী আবার কালনাগিনীতে রূপ পাল্টে ফেলেছে। তার বুক ওঠানামা করছে, নিঃশ্বাসে যেন বিষ ছড়াচ্ছে।

চোয়াল দৃঢ় হল লমবার্ডের। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, তোমার ছলাকলার অর্থ এতক্ষণে বোঝা গেল। সত্যিই তুমি অদ্ভুত।

ভেরা কোন জবাব দেয় না। নিশানা অনড়। দৃষ্টি স্থির–লমবার্ডের মুখে।

লমবার্ড গলার স্বর নরম করবার চেষ্টা করে, ভেরা রিভলভারটা ফিরিয়ে দাও।

–ফিরিয়ে দেব। নিষ্ঠুর হাসির উচ্ছ্বাস জাগে তার কণ্ঠে। কী ভয়ংকর সে হাসি।

লমবার্ড ফের বলে, পাগলামি করো না, ভেরা। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার।

ভেরা সেই নিষ্ঠুর হাসি হেসে উঠল ফের। তবে উচ্ছ্বাস কিছুটা স্তিমিত।

গলগল করে ঘাম ঝরছে লম্বার্ডের শরীর বেয়ে। ঠোঁটও শুকিয়ে উঠেছে।

লমবার্ড ভেবে পায় না, কি করে এই উন্মাদ মেয়েটাকে বোঝাবে সে নিরপরাধ? একমাত্র সেই পারে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে।

তবে বুঝতে পারে, মিনতি করে আর কাজ হবে না। এই মেয়ে তার কোন কথা বিশ্বাস করবে না। সে ভাবল, যদি শক্তি প্রয়োগ করে কিছু করা যায়। সে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে।

পলকের জন্য বুঝি অন্যমনস্ক হয়েছিল ভেরা। সঙ্গে সঙ্গে লমবার্ড ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

–দাও রিভলবারটা।

–না

–দ্রুত দুপা পিছিয়ে যায় ভেরা; ট্রিগার টিপে দেয়। একটুও কাঁপে না তার হাত।

অস্ফুট একটা আর্তনাদ।  লমবার্ড মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে।

.

ভেরা তখন নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন। আর ভয়ের কারণ নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। পৃথিবীটা যেন নতুন করে ভাল লাগছে।

ভেরা এখন একা। সারা দ্বীপে দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। আছে কেবল কটা মৃতদেহ।

কিন্তু, না সে আর ফিরে যাবে না। ভেরা এক পা দু পা করে এসে সমুদ্রের ধারে বসে পড়ল। আঃ। কী স্বস্তি।

.

কিছুক্ষণ পরেই সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার ক্রমশ ঘন হচ্ছে। উঠে দাঁড়ায় ভেরা।

একবার তাকায় বাড়িটার দিকে ফিরে। সে মন ঠিক করে নেয়। আর তো কোন ভয় নেই ওখানে। ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে সে পরম স্বস্তিতে গা হাত পা এলিয়ে দিতে পারে।

দরজা এঁটে দিলে, সে সম্পূর্ণ একা। ভয়টা কিসের। বরং এই খোলামেলা জায়গাতে থাকতেই গা ছমছম করবে।

এতক্ষণ পরে খিদে অনুভব হয় তার। বুঝতে পারে সে ক্লান্ত। অবসন্ন। খাদ্য না হলেও বিশ্রাম তার দরকার।

ভেরা দূর সমুদ্রের দিকে একবার ফিরে তাকায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। কাল না হোক পরশু বোট নিশ্চয় আসবে।

যেদিনই বোট আসুক, সে এখন একা, তার কোন ভয় নেই।

ধীর পায়ে সমুদ্রের কাছ থেকে সরে এসে ভেরা একতলার বারান্দায় উঠে আসে। খাবার ঘরে ঢোকে। তাকিয়ে দেখে তিনটে পুতুল রয়েছে।

ভেরা এগিয়ে যায় সেদিকে। তিনটে কেন থাকবে–থাকবার তো কথা একটা। সবাই তো মৃত, বেঁচে আছে কেবল সে একা।

ভেরা আপন মনে বলে উঠল, তোরা শেষের হিসেব মেলাতে পারিসনি। থাকবে ওখানে একটা।

হাত বাড়িয়ে দুটো পুতুল তুলে নেয় সে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে।

শেষ পুতুলটাকেও তুলে নেয় সে।

অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল ভেরা। পুতুলটাকে আদর করে গালে ছোঁয়াল, চুমু খেলো। তারপর বুকে চেপে ধরে গভীর নিঃশ্বাস নিল।

–চল আমার সঙ্গে।

ভেরা পুতুলটাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়। ঘর খোলে, আবছা আলো। কোণে কোণে অন্ধকার। কাকে দেখতে পাচ্ছে ভেরা? কে? হুগো? লমবার্ড?

ভেরা চেঁচিয়ে ওঠে, কে–কে

সামনেই একটা দড়ি ঝুলছে। তলায় ফাস। তার নিচে একটা চেয়ার।

কি মনে করে ভেরা এগিয়ে যায় চেয়ারটার দিকে। উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ফাঁসটা গলায় পরে নেয়।

অকস্মাৎ খিল খিল করে হেসে ওঠে সে। উন্মাদ হয়ে হাসতে থাকে। চেয়ারটা হঠাৎ পায়ের কাছ থেকে সরে যায়।

পুতুলটা হাতেই ধরা ছিল। সেটা ছিটকে মেঝেয় পড়ে ভেঙ্গে যায়। শেষ পুতুল ছিল ওটা।

.

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রধান কার্যালয়। কথা বলছেন দুজন। স্যার টমাস লেগ এবং ইনসপেক্টর মেন। টমাস হলেন সহকারী কমিশনার।

টমাস বললেন, একটা অবাস্তব ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। পরপর দশজন লোক মারা গেল একটা দ্বীপে, অথচ মৃতদেহ ছাড়া কোন জীবিত লোক সেখানে ছিল না। জবরদস্ত মাথাওয়ালা কোন মানুষের হাত ছিল এই কাণ্ডের পেছনে, তাতে সন্দেহ নেই।

মেন মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল, স্যার আমিও আপনার সঙ্গে একমত।

টমাস জানতে চান, ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে কোন সূত্র পাওয়া গেছে?

–না স্যার।

এরপর মেন কেন কিভাবে কাকে হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ দেন।

ওয়ারগ্রেভ এবং  লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গুলি লেগেছে একজনের মাথায়, অপরজনের বুকে।

বিষের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে দুজনকে। তারা হলেন মিস ব্রেনট এমিলি এবং মার্সটন।

রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিলেন মেন। পরে বললেন, বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে মারা গেছে রজার্সের স্ত্রী। তার স্বামীর মৃত্যু ঘটে কুঠারের আঘাতে।

বিবরণ শুনতে শুনতে স্যার টমাস নড়েচড়ে বসেন। বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে ওঠে তার।

মেন বলে চলেন, ডগলাসের মাথার খুলি ভেঙ্গে গেছে। কোন ধারালো জিনিস দিয়ে তাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়েছিল। ভেরা ক্লেথর্নকে মৃত অবস্থায় কঁসির রজ্জুতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

–আচ্ছা, ডেভনের সমুদ্রতীরের লোকেরা কি বলছে? টমাসের কপালে চিন্তার রেখা পড়ে।

–স্যার, ওরা কিছু জানে না। তাদের কাছ থেকে কেবল জানা গেছে, আওয়েন বলে এক ভদ্রলোক দ্বীপটার মালিক।

–তা, বেশ। দ্বীপটা কেনার পর সাজগোজের কাজ তো করতে হয়েছে? সেসব কে করেছিল?

–আকজাগ মরিস নামে একজন লোক।

এ সম্পর্কে তার কাছ থেকে কিছু জানা গেছে?

–উপায় ছিল না।

–মানে?

–সে মারা গেছে।

–তার সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল?

–হ্যাঁ স্যার। লোকটা চোরাই কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে কখনো ধরা যায়নি।

-এই মরিস লোকটা কেবল কি ওসবই করত?

–না স্যার। এমনিতে ঠিকাদারি কাজ করত। তবে ওটা ছিল তার বাইরেকার খোলস।

–মরিস শেষ কবে ডেভান গিয়েছিল?

–এই হত্যাকাণ্ডের আগেই গিয়েছিল। স্থানীয় লোকজনদের সে বুঝিয়ে এসেছিল, মিঃ আওয়েনের কিছু বন্ধু এখানে এসে কিছুদিন থাকবেন। মিঃ আওয়েনের সঙ্গে তারা বাজি ধরেছেন, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিছুদিন বাস করা চলে। কাজেই দু-চারদিনের মধ্যে ওই দ্বীপ থেকে কোন সংকেত এলেও কিছু করার দরকার নেই। তারপর ওদের ব্যবস্থা মিঃ আওয়েনই করবেন।

–এসব কথা ওরা বিশ্বাস করেছিল?

–কেউ কিছু সন্দেহ করেনি স্যার। ভেবেছে এসব বড়লোকদের খেয়াল। আওয়েনের আগে যিনি ওই দ্বীপটার মালিক ছিলেন তিনিও প্রায়ই ওখানে পার্টি দিতেন। এক্ষেত্রেও তাই তারা সন্দেহ করার মত কিছু পায়নি।

একটু থেমে মেন ফের বললেন, যে লোকটা ওদের বোটে করে পৌঁছে দিয়েছিল তার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল।

সে বলেছে, আগে যারা পার্টিতে আসত তারা ছিল পরস্পরের পরিচিত। কিন্তু এবারে যারা গিয়েছিল তারা একে অপরকে চিনত না। আর সকলেই অনেকটা শান্ত প্রকৃতির।

–ও কিছু করেছিল?

–দিন কয়েক পরে ওই দ্বীপ থেকে সাহায্য সংকেত পাওয়া যায়। তখন সে লোকজন জড়ো করে ওখানে উপস্থিত হয়। আর তার ফলেই আমরা এই লোমহর্ষক ঘটনাটি জানতে পারি।

–সাহায্য-সংকেত কবে পাওয়া গিয়েছিল?

–১৩ তারিখেই পেয়ে ছিল। কিন্তু সমুদ্র অশান্ত থাকায় সেদিন যেতে পারেনি। পরদিন সকালে আবার সংকেত পাওয়া যায়। সাহায্যকারীরা বিকেলে সেখানে গিয়েছিল।

-এই দলটা এখানে পৌঁছনোর আগেই হত্যাকারী সাঁতরে ডেভনে পৌঁছে পালিয়ে গেছে কিনা খবর নেওয়া হয়েছিল?

-সাঁতরে পালানো অসম্ভব ছিল স্যার। কেননা সমুদ্র ছিল অশান্ত।

টমাসের মুখ ক্রমশই গম্ভীর হয়ে পড়ছিল। খানিকক্ষণ তিনি চুপ করে থেকে কি ভাবলেন। পরে বললেন, ওই গ্রামাফোনের ব্যাপারে কিছু জানা সম্ভব হয়েছে?

-হ্যাঁ স্যার।

–ওটা কিভাবে করা হয়েছিল?

করিয়েছিল মরিস। সিনেমা-থিয়েটারের কাজ করে এমন একটা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে।

-ওই রেকর্ডে যে অপরাধগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল?

–হ্যাঁ স্যার। রজার্স দম্পতি মিসেস ব্র্যাডি নামে এক ভদ্রমহিলার বাড়ি কাজ করতো। ওদের অবহেলাতেই নাকি তিনি মারা যান।

–এরপর আছে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভের নাম।

-হ্যাঁ ওই নামটা আমি সেটন মামলায় শুনেছি। সে লোকটা দোষ করেছিল ঠিকই, তবে … যাক তারপর?

–ভেরা নামে একটি মেয়ে একবাড়িতে গভর্নেসের কাজ করতো। সেই বাড়ির ছোট্ট ছেলেটি সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। তাতে ভেরার কোন হাত ছিল না। মেয়েটি নিজের জীবন বিপন্ন করে তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। মেয়েটিকে ওই বাড়ির সকলেই ভালবাসতো।

-তারপর?

ডাঃ আরমস্ট্রং-এর কথা বলছি। তার চেম্বার ছিল হার্লে স্ট্রীটে। মাঝারি বয়েস। তবে পসার জমেছিল ভাল।

তারই চেম্বারে অপারেশন টেবিলে একটি মেয়ে মারা যায়। তাতে অবশ্য ডাক্তারের কোন হাত ছিল না। সার্জেনদের হাতে এমন দু-চারটে কেসতো ঘটেই।

এরপর স্যার মিস এমিলি ব্রেনটের কথা বলছি। তার বাড়িতে কাজ করত অবিবাহিতা একটি মেয়ে। বিয়াত্রিচে টেলর তার নাম।

বিয়ের আগেই মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। একথা জানতে পেরে গৃহকর্ত্রী তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। পরে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।

মেয়েটিকে এই অবস্থায় তাড়িয়ে দেওয়াটা অমানবিক কাজ হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আইনের চোখে মিস এমিলি কোন অপরাধ ওখানেই।

–যা দেখছি, তোমার ওই আওয়েন খুঁজে খুঁজে এমন কয়েকটি কেস বার করেছিল যারা আইনের চোখে অপরাধী হয়নি। মনে হচ্ছে, রহস্যের মূল সূত্রটা করেননি।

মেন আবার তার তালিকা থেকে বলতে শুরু করলেন, মাস্টান বলে যে ভদ্রলোক, তিনি জোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুটো বাচ্চাকে চাপা দিয়েছিলেন। সেজন্য অবশ্য তাকে অর্থদন্ড দিতে হয়েছিল।

এরপর হল জেনারেল ডগলাস। তার সার্ভিস রের্কড খুব ভাল। তার অধীনে কাজ করতে রিচমন্ড–সে একজন অফিসার। ফ্রান্সের যুদ্ধে সে মারা যায়। জেনারেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খুব ভাল। যুদ্ধক্ষেত্রে তো কমান্ডিং অফিসারদের ভুলে অনেক প্রাণহানী ঘটে থাকে। রিচমন্ডের মৃত্যুও ছিল এমন একটা ঘটনা।

-হ্যাঁ, খুবই সম্ভব।

–এরপরে হল ব্লোর, সে এককালে পুলিসে কাজ করত।

–হ্যাঁ ওকে আমি চিনতাম, টমাস বলেন, খুব একটা কাজের ছিল না। তবে কায়দাকানুন করে কয়েকটা প্রমোশন বাগিয়েছিল। একটা রিপোর্টে খুব গোলমাল করে ফেলেছিল–ল্যান্ডুর কেস। তার ওপরেই তদারকির দায়িত্ব ছিল।

অনেকের ধারণা তদন্তে ফাঁক রেখেছিল ইচ্ছে করেই। যোগ্যতাও তো তেমন ছিল না। বেশ, তারপর বলে দাও।

মেন বলতে শুরু করল, পরের নামটি হল, ফিলিপ লমবার্ড। ডাকাবুকো ধরনের লোক ছিল। অনেক দেশ ঘুরেও ছিল। তবে কোন বেআইনী কাজের রিপোের্ট নেই।

-আচ্ছা, সেই মরিস লোকটা তো মারা গেছে বললে, তাই না?

–হ্যাঁ, স্যার। গত ৮ই আগস্ট। বেশি মাত্রায় ওষুধ খেয়েছিল।

–সেটা কি আত্মহত্যা?

–সেটা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।

টমাস গভীর স্বরে বললেন,ব্যাপারটা তো খুব জটিল দেখতে পাচ্ছি। একজন দুজন নয়, দশ-দশটা লোক খুন হল, অথচ কে তাদের খুন করল, কেন করল, সেসব কিছুই জানা যাচ্ছে না-ভারী আশ্চর্য ব্যাপার।

–স্যার, একটা কথা বলতে চাই

–স্বচ্ছন্দে,

–কে এই হত্যাকান্ডের নায়ক তা জানা না গেলেও হত্যার কারণটা অনুমান করা যায়। গ্রামাফোন রেকর্ডের কথা, নিহত ব্যক্তিদের নামধাম ইত্যাদি পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে, কোন এক ব্যক্তির মাথায় ন্যায় বিচার সম্পর্কে বাতিক চেপেছিল। তার সঙ্গে মিশেছিল জিঘাংসা বৃত্তি। কিছু কিছু লোকের অপরাদের কথা সে জানত অথচ আইনের চোখে তারা অপরাধী প্রতিপন্ন হয়নি। সেই থেকেই সে ঠিক করে নিয়েছিল নিজেই ঈশ্বর সাজবে। এ একধরনের পাগলামোও বলা চলে।

খুঁজে খুঁজে এমনি দশজনের নাম সে সংগ্রহ করেছিল, আইন যাদের শাস্তি দিতে পারেননি তবে এই দশজন সত্যিকারের অপরাধী কিনা, তা বিচার সাপেক্ষ।

-এবার মনে হয় রহস্যের সূত্রটা পাওয়া যাচ্ছে । হুঁ, তারপর?

–আওয়েন স্থির করেছিল, এই দশজন লোককে প্রাণদন্ড দেবে। তারপর সুপরিকল্পিতভাবে ওদের পান্না দ্বীপে এনে একে একে হত্যা করে উধাও হয়ে যায়।

–কিন্তু আওয়েন পালালো কিভাবে?

–এই ক্ষেত্রে আমরা দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি।

–যেমন–

–হয় আওয়েন আদৌ দ্বীপে অনুপস্থিত ছিল, নয়তো নিহত দশজনের মধ্যে সে নিজেও একজন।

ওই দ্বীপে কি হয়েছিল, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে অনেকেরই টুকটাক লেখা বা ডায়েরি পাওয়া গেছে। ভেরা, এমিলি ওয়ারগ্রেভ এবং ব্লোর এর বিভিন্ন লেখার মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

সেই অনুযায়ী মৃত্যুগুলো পরপর এভাবে ঘটে–মার্সটন, রজার্সের স্ত্রী, জেনারেল ডগলাস রজার্স, এমিলি ব্রেনট এবং ওয়ারগ্রেভ।

মেন একটু থামল। মাথা নত করে কি ভাবল। পরক্ষণে বলল ভেরা তার ডায়েরিতে লিখেছে, ডাক্তারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লমবার্ড আর বোর সেই রাতে তাকে খুঁজতে বের হয়।

ব্লোরও তার নোটবইতে লিখেছে, ডাক্তার নিরুদ্দেশ। এরপর এসম্পর্কে কেউ আর কোন কথা লেখেননি।

এখন স্যার, ডাক্তার যে এই তিনজনকে হত্যা করে নিজে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে তা বলা যাবে না। কেন না, ডাক্তারকে জল থেকে তুলে আনা হয়েছে এবং টিলার ওপরে রাখা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কেউ তখনো বেঁচেছিল।

ব্লোর আর ভেরাকে হত্যা করার পর লমবার্ড আত্মহত্যা করেছে–এরকম ভাবাও সম্ভব হচ্ছে না কারণ তাহলে রিভলভারটা তার কাছে পাওয়া যেত। সেটা পাওয়া গেছে ওয়ারগ্রেভের ঘরে।

-আচ্ছা, সেটাতে কোন ছাপ পাওয়া গেছে?

হা স্যার, ভেরার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।

–গন্ডগোল তো মিটছে না দেখছি।

–গন্ডগোল আরও একক্ষেত্রেও পাওয়া যাচ্ছে। যদি ধরা যায় ভেরা লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করার পর ব্লোরকে পাথর ছুঁড়ে নিহত করেছে। কিন্তু তার পরই সূত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে।

ভেরার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে একটা চেয়ারে অথচ সে চেয়ারটা তার পায়ের নিচে ছিল না। চেয়ারটা পাওয়া গেছে ঘরের এক কোণে।

–এ কী করে সম্ভব?

–আমারও জিজ্ঞাসা সেটাই। যাই হোক, সবশেষে ব্লোরের কথা বলছি। যদি ধরে নিই সে  লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করে এবং পরে ভেরাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে নিজে আত্মহত্যা করেছে, তাহলে গোলমাল থাকছে।

–কি রকম?

–সে মারা গেছে একটা পাথরের আঘাতে, সেটা ছুঁড়ে মারা হয়েছিল পেছন দিক থেকে। তাহলে পাথরটা কে ছুঁড়ে মারল?

-হ্যাঁ, ঠিক কথা।

–সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এরকম, আওয়েন দশজনকে হত্যা করে নিজে ওই দ্বীপে ছিল। তারপর তার আর কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। ডেভনের লোকদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম, সাহায্য-সঙ্কেত পাবার পর থেকে উদ্ধারকারী দল পৌঁছবার আগে পর্যন্ত ওখান থেকে পালায়নি।

এই পরিস্থিতিতে পান্না দ্বীপের মৃত্যু-রহস্যের সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। এই ঘটনা রহস্যাবৃতই থেকে যাবে।

-আমিও ভেবে পাচ্ছি না, কে এই রহস্যের নায়ক?

.

গ্রন্থিমোচন

একটা মাছধরার জালে মাছের সঙ্গে একটা কাচের বোতল পাওয়া গিয়েছিল। বোতলের ছিপি খুলে তার মধ্যে একটা লেখা পাওয়া গিয়েছিল। জাহাজের মালিক সেই লেখা কাগজ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। নিচে সেই লেখাটা দেওয়া হল।

.

আমার এই স্বীকারোক্তি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছি। যদি এটা কারোর হাতে পড়ে ভাল নইলে হয়তো ঢেউয়ের ধাক্কায় পাথরে লেগে ভেঙ্গে সমুদ্রে ভেসে যাবে।

অবশ্য তাহলে মন্দ হয় না।

ছেলেবেলা থেকেই একটা নিষ্ঠুরতা আমার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অকারণে পোকামাকড়দের কষ্ট দিতে আমার ভাল লাগত।

বড় হয়ে এই ভাবটার প্রকাশভঙ্গী পাল্টে ছিল। তখন আমার মধ্যে সজাগ হয়েছে। ন্যায়বোধ। ভাল এবং মন্দকে বিচার করতে শিখেছি।

নিরপরাধ পেত সহানুভূতি। আর অপরাধীর প্রতি হতাম নির্দয়। ছেলেবেলার নিষ্ঠুরতা বা জিঘাংসা মিশে থাকত এই নির্দয়তার মধ্যে।

ভাগ্যক্রমে, ন্যায়নীতি এবং দণ্ডনীতি দুই সমানভাবে প্রয়োগ করবার অধিকার আমি পেয়ে গিয়েছিলাম, অর্থাৎ আমার হাতে ছিল বিচারের দণ্ড! আমার যাবতীয় কার্যকলাপ ছিল আইনের আঙিনাকে ঘিরে।

আইনশাস্ত্র সম্পর্কে আমার গভীর জ্ঞানের প্রশংসা সকলে করলেও, অনেকে নিষ্ঠুর জজ বলেও কটাক্ষ করত আমাকে। কথাটার মধ্যে অবশ্যই সভ্যতা ছিল। কোন নিরপরাধী আমার কাছে কখনো সাজা পায়নি।

তার বিরুদ্ধে যত প্রমাণই দাঁড় করানো হোক না কেন, আইনের সূক্ষ্মবিচারে তাকে আমি মুক্ত করে এনেছি।

আবার প্রকৃত অপরাধী, আমার হাতে কখনো রেহাই পায়নি। আমি তার উপযুক্ত দণ্ডবিধান করেছিনের মামলারভাবে বেকসুর খাল

সেটনের মামলাটার কথাই ধরা যাক। সে নিজে তার বক্তব্য সুন্দরভাবে পেশ করেছিল। তার কৌসুলীও সুন্দরভাবে কেস সাজিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে। সকলেরই ধারণা ছিল সেটন বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।

কিন্তু আইনের চুলচেরা বিচারে আমি তাকে চরম সাজা দিয়েছি। প্রথমে এই মামলা নিয়ে কিছু সমালোচনা হলেও পরে এই মামলা ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে উৎকৃষ্ট বিচারের নিদর্শন হিসেবে।

একসময় এজলাস থেকে অবসর নিলাম। এদিকে স্বাস্থ্যও ভাল যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছিলাম আমার সময় ফুরিয়ে আসছে।

একদিন এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, অনেক মানুষই এমন কিছু অপরাধ করে, আইন তাকে সেজন্য সাজা দিতে পারে না, তখনই তিনি রজার্স দম্পতির ঘটনাটা বললেন।

এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে তারা কাজ করতো। ওরা তার সেবা-যত্ন করত। সেই মহিলা। কৃতজ্ঞতার বশে ওদের নামে উইল করে গেছেন, রজার্স দম্পতি তা জানতে পেরেছিল।

স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারটা অনিশ্চিত। এতদিন তারা অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। সুযোগের অপেক্ষায় রইল।

ভদ্রমহিলা অসুস্থ হলে তাকে বিশেষ ধরনের একটা ওষুধ খাওয়াতে হতো। একবার অসুস্থতার সময়ে তারা তাকে তা খাওয়ালো না। ফলে তিনি মারা যান।

রজার্স দম্পতির অপরাধ কিন্তু লোকে বুঝতে পারল না। ওরা ব্যস্তভাবে ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটি করেছে, তাদের ব্যাকুলতা, কান্না ইত্যাদি দেখে কেউই তাদের সন্দেহ করতে পারল না।

এই ঘটনা শোনার পর আমার ভেতরের নীতিবোধ এবং জিঘাংসা প্রবৃত্তি একই সঙ্গে যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

ঠিক করলাম, আইন যাদের সাজা দিতে পারেনি, আমি এমন লোকদের খুঁজে বার করবো। নিজের হাতেই তাদের শাস্তিবিধান করব।

পদমর্যাদায় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠায় গণ্যমান্য এমন বহুলোকের সঙ্গেই আমার আলাপ-পরিচয় ছিল। তাদের কাছ থেকে গোটা দশেক ঘটনা আমি বার করে নিলাম।

কি করে এই ঘটনাগুলো সংগ্রহ করলাম তা বোঝাবার জন্য দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

একদিন এক প্রৌঢ়া নার্সের সঙ্গে মদ্যপানের অপকারিতা বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি এক ডাক্তারের কথা জানালেন।

এই ভদ্রলোক একদিন মদ্যপ অবস্থায় এক রোগীকে অপারেশন করেন। অপারেশনের ত্রুটির জন্য রুগীটি মারা যায়।

ভদ্রমহিলা অসতর্ক মুহূর্তে সেই ডাক্তারের পরিচয় প্রকাশ করে ফেলেন। সেই ডাক্তারই হলেন আরমস্ট্রং। তার চেম্বার হার্লে স্ট্রিটে।

একদিন এক ক্লাবে দুই ফৌজি অফিসারের সঙ্গে আলাপ হয়। তাদের কাছ থেকে জেনারেল ডগলাসের কাহিনী জানতে পারি।

এক প্রাক্তন সহকর্মী জানিয়েছিলেন ফিলিপ লমবার্ডের কাহিনী।

ব্রেনট এমিলি ছিলেন নীতিবাগিশ মহিলা। সেই জন্য অন্তঃসত্ত্বা বিয়াত্রিচে টেলারকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি।

আমাদের সমাজে এমন বহু ধনী ব্যক্তি রয়েছেন যারা অর্থের জোরে যা কিছু করে বেড়ান। আইন বা নীতির তোয়াক্কা করেন না।

এমনি একজন হলেন অ্যান্টনি মার্সটন। এদের কাছে সাধারণ মানুষের মূল্য কানাকড়িও নয়।

কাজে বা দায়িত্বে অবহেলাকে আমি গুরুতর অপরাধ মনে না করে পারি না। আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি না। ল্যাণ্ডর মামলা প্রসঙ্গে এমন একজনের নাম শুনেছিলাম, তিনি হলেন পুলিস ইনসপেক্টর ব্লোর।

একবার আমেরিকা যাবার পথে জাহাজে আলাপ হয়েছিল ভেরার প্রেমিক হুগোর সঙ্গে। সে একটু বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিল, সেই অবস্থায় ভেরার সবকথা আমাকে জানায়। ভেরাকে। সে আজো ভালবাসে। কিন্তু তার অপরাধকে কোনদিনই ক্ষমা করতে পারবে না।

আমার তালিকার দশম অপরাধী হল মরিস। সে নানাপ্রকার নিষিদ্ধ কাজ করত। চোরাইমালের কাজটাই প্রধান।

লোকের চোখে ফাঁকি দেবার জন্য ঠিকাদারির আড়াল নিয়েছিল। পুলিস সঠিক প্রমাণের অভাবে তাকে কোনদিন ধরতে পারেনি।

নামগুলো সংগ্রহ হবার পর, একটা পরিচ্ছন্ন পরিকল্পনা ছকে ফেললাম। সেই মত পান্না দ্বীপটা কিনে ফেললাম। তারপর মরিসকে দিয়ে সাজানো-গোছানোর কাজটাও করিয়ে নিলাম। এরপর হাত দিলাম আসল কাজে। অনেক ভেবেচিন্তে সুকৌশলে ওদের দশজনকে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করে ফেললাম। ওরা সকলে রাজি হবে কিনা, এব্যাপারে আশঙ্কা ছিল। তা দূর হল ওদের সায় পেয়ে।

প্রথম ধাপে সফল হওয়ায় বেশ স্বস্তিবোধ করলাম।

পান্না দ্বীপে একই দিনে অর্থাৎ ৮ই আগস্ট হাজির হবার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এই দলে আমিও ছিলাম।

হাতের কাছেই ছিল মরিস, আইনের চোখে ফাঁকি-দেওয়া অপরাধী। পান্না দ্বীপে যাবার আগে তার ব্যবস্থাটা করতে হল।

পান্না দ্বীপে যাবার আগের দিন মরিস আমার কাছে এসেছিল। আমি জানতাম সে প্রায়ই বদহজমে ভোগে।

তার অতিশয় কুশলকামী আমি, এমন ভান করতে হল আমাকে। জানালাম, আমি যে ওষুধ খেয়ে বদহজমের রোগমুক্ত হয়েছি, সেটা খেলে সে-ও উপকার পেতে পারে।

আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে ওষুধের নামটা লিখে দেবার জন্য অনুরোধ জানাল।

আমি আগেই তার জন্য একটা কড়া ঘুমের ক্যাপসুল কিনে এনে রেখেছিলাম। ড্রয়ার হাতড়ে সেটা বার করে তার হাতে দিয়ে ভাল মানুষের মত জানালাম, একটা আমার কাছে ছিল, এটা সে খেতে পারে।

রাতে শুতে যাবার আগে ক্যাপসুলটা খেতে হবে সে-কথাও মরিসকে জানিয়ে দিলাম।

আমি জানি সে আমার নির্দেশমতোই ক্যাপসুলটা খেয়েছিল এবং সে-রাতের ঘুমই তার শেষ ঘুম হয়েছিল।

পান্না দ্বীপে যাবার পর ঠিক করলাম যাদের অপরাধ গুরুতর, তাদেরই আগে সরিয়ে দিতে হবে। আর মৃত্যুর আগে যাতে ভয় ও মানসিক যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত হয়, সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

মার্সটন টাকার গরমে তার অপরাধের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করত। তাই প্রথমেই গেল সে।

এরপর গেল রজার্সের স্ত্রী। যদিও স্বামীর নির্দেশেই সে সবকিছু করতে বাধ্য হয়েছিল।

রজার্সের স্ত্রী ও মার্সটনের মৃত্যুযন্ত্রণা কম ছিল।

গ্রামোফোন রেকর্ড চলবার সময় সকলে যখন অন্যমনস্ক বিভ্রান্ত অবস্থায় ছিল, সেই সময় মার্সটনের পানপাত্রে সায়ানাইড মিশিয়ে দিলাম। চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হল।

গ্রামোফোনের অভিযোগ শুনে রজার্সের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য ব্র্যাণ্ডি নিয়ে আসে রজার্স। সকলের অলক্ষ্যে তাতে বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলাম।

তখনো পর্যন্ত মৃত্যুর ব্যাপারে কারো মনে তেমন বিভীষিকা জাগেনি। কাজেই কেউই কিছু সন্দেহ করতে পারল না।

জেনারেল ডগলাসের মৃত্যুটাও আকস্মিকভাবে ঘটিয়েছিলাম, তিনি বিশেষ কষ্ট পাননি। সমুদ্রতীরে আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিছুই টের পাননি। বারান্দা থেকে সতর্কভাবেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম, অন্যরা কেউ বুঝতেই পারেনি।

দ্রুতহাতে কাজটা শেষ করেই আবার বারান্দায় ফিরে এসেছিলাম।

১০ই আগস্ট সকালে অভ্যাসমত দাড়ি কামিয়ে রজার্স নিচে গিয়ে রান্নাঘরের কাজে হাত লাগায়। কাঠ দরকার হওয়ায় কাটারী দিয়ে কিছু কাঠ কাটল। সেই সময় নিঃশব্দে পেছন থেকে গিয়ে কুঠারের এক আঘাতে তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

সকলে যখন রজার্সের খোঁজে ছুটোছুটি করছে, আমি কঁক বুঝে লম্বার্ডের ঘরে গিয়ে তার রিভলবারটা নিয়ে এলাম। সেটা কোথায় রাখতো আমি জানতাম।

প্রাতরাশের টেবিলে এমিলির কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খুব সাবধানতার সঙ্গে একাজটা আমাকে করতে হয়েছিল।

কফি পান করেই তিনি আধা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সেই অবস্থায় তাকে একলা পেয়ে ইনজেকশন দিয়ে তার শরীরে কড়া সায়ানাইড সলিউশন ঢুকিয়ে দিলাম।

এই ঘটনাকে অন্যরূপ দেবার উদ্দেশ্যে আমাকে দুটো মৌমাছির সাহায্য নিতে হয়েছিল। এব্যবস্থা আমি আগেই করে রেখেছিলাম।

এতগুলো মৃত্যুর পর পরামর্শের ছলে সকলের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলাম। আমার আমন্ত্রিত অতিথিরা পরস্পরকে সন্দেহ করতে শুরু করল।

এই সূত্রেই ঘর তল্লাশী হল। রজার্সের রিভলভার পাওয়া গেল না। সেটা যাতে খুঁজে পাওয়া না যায় সেজন্য আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম নতুন বিস্কুটের টিনের মধ্যে। লেবেল লাগানো ছিল বলে কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায়নি।

এরপর এই হত্যা-নাটকের এক বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করলাম।

ডাক্তারের মনোভাব আমি জানতাম। পরপর কয়েকটা ঘটনায় তার ভূমিকা অনেকেরই সন্দেহ উদ্রেক করেছিল।

সেই অবস্থায় তাকে জানালাম হত্যাকারীকে ধরার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি, তার সাহায্য আমার দরকার।

ডাক্তার এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তখন তাকে জানালাম, পর পর মৃত্যুর ঘটনাতো ঘটেই চলেছে। এরপর আমি মারা গেছি এমন ভাবে পড়ে থাকব। কেউ সন্দেহ করবে না। আপনি আমাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করবেন। আপনি বললে আর কেউ সন্দেহ করবে না।

তিনি কিছুমাত্র সন্দেহ করলেন না। তাকে তখন পরিকল্পনাটা খুলে জানালাম।

পরিকল্পনা মত সেদিন সন্ধ্যায় আলো জ্বলল না। মোমবাতি জ্বালানো হল। ভেরাকে ওপরতলায় ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করে রাখা ছিল। সে চেঁচামেচি জুড়তেই সকলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আমি সেই সময় আমার ঘরে গিয়ে মরার ভান করে পড়ে রইলাম। যথারীতি ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করলেন।

সেই রাতেই দুটোর সময় চুপিচুপি ডেকে ডাক্তারকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেলাম। জরুরী পরামর্শ আছে বলে তাকে সমুদ্রের ধারে টিলার আড়ালে নিয়ে গেলাম।

সেখানে আলোচনার ফাঁকে সজোরে ধাক্কা মেরে ডাক্তারকে টিলার ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলাম।

বাড়িতে ফিরে এসে ফের ডাক্তারের ঘরে গেলাম। বেরুবার সময় একটু শব্দ করলাম ইচ্ছে করেই।

ব্লোর ভাবল, ডাক্তার বাইরে গেলেন। আমি সিঁড়ির তলায় লুকিয়ে পড়েছিলাম। ব্লোর আর  লমবার্ড যখন ডাক্তারকে খুঁজতে বাইরে গেল, আমি ফের আমার ঘরে গিয়ে মৃতের ভূমিকা গ্রহণ করি।

তার আগে অবশ্য লম্বার্ডের ঘরের ড্রয়ারে তার রিভলভারটা রেখে আসি।

এরপর বাকি রইল তিনজন। ভেরা,  লমবার্ড এবং ব্লোর। এদের তিনজনের মনেই ভয় আতঙ্ক, অবিশ্বাস।

ভেরা আর  লমবার্ড বাড়িতে যেতে চাইল না। ব্লোর একাই ফিরে গেল।

আমি পাথর নিয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কাছাকাছি আসতেই ছুঁড়ে মারলাম। বুড়ো বয়সেও নিশানা এতটুকু ফসকায়নি, আশ্চর্য। ব্লোর শেষ হয়ে গেল।

এরপর আমার চোখের সামনেই বুদ্ধিমতী ভেরা লমবার্ডকে গুলি করে মারল। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তীব্র হয়ে উঠেছিল।

এবারে ভেরা একা হয়ে গেল। সমস্ত দ্বীপে সে একা জীবিত মানুষ।

তার একমাত্র প্রতিবেশী কতগুলো মৃতদেহ। এই পরিস্থিতি এবং তার নিজের মনের পাপ-হুঁগোর প্রতি প্রতারণা, হুগোর ভাইপোর হত্যা এবং সর্বশেষ লমবার্ডকে হত্যা–সব মিলেমিশে তার মনের ওপর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল।

শেষ দৃশ্যটা পরিকল্পনা মত সাজিয়ে রেখেছিলাম। ভেরা প্রত্যাশিতভাবেই আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হল। আমি তার পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা নিয়ে দেয়ালের কাছে সরিয়ে রাখলাম।

.

আমার এই স্বীকারোক্তি কাচের বোতলে ভরে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। বোতলের মুখ ছিপি আটকে সীল করে দেব।

গতকালই ওরা তিনজন, লমবার্ড, ভেরা আর ব্লোর দ্বীপ থেকে সাহায্য সঙ্কেত পাঠিয়েছিল। উপকূল থেকে সাহায্যকারী দল চলে আসার আগেই আমাকে বাকি কাজটুকু শেষ করতে হবে।

আমার পঁসিনে চশমার কর্ডটা সাধারণ সুতো নয়। ইলাস্টিক। এই কর্ডটা যাতে বাইরে থাকে সেভাবে চশমাটা শক্ত খাপে ভরে রাখতে হবে।

আমার বিছানা থেকে দরজার দূরত্ব খুবই সামান্য। দরজার হাতলের সঙ্গে কার্ডটা অলতোভাবে লাগানো থাকবে।

আমি বিছানায় গিয়ে শোব। চশমার খাপটা রাখব আমার পায়ের তলায়। আর ইলাস্টিক কর্ডটার সঙ্গে রিভলবারটা বেঁধে নেবো।

রিভলভারে রয়েছে ভেরার হাতের ছাপ। রুমাল জড়িয়ে ওটা ধরব। তারপর মাথা লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দেব।

যে ঘটনাটা ঘটবে তা দাঁড়াবে এরকম–আমার হাত এলিয়ে পড়বে। সেই ঝাঁকুনিতে দরজার হাতল থেকে কর্ডটা খসে পড়বে, আর কর্ডের টানে রিভলভার ছিটকে দরজার কাছে গিয়ে পড়বে, রুমালটা খাটের কাছাকাছি পড়ে থাকব।

নিখুঁত শিল্পসম্মত একটা মৃত্যু। এটা যে একটা আত্মহত্যার ঘটনা তা কেউই বুঝতে পারবে না।

আমার মৃত্যুর যে বিবরণ ভেরা এবং আরো কজনের ডায়েরীতে লেখা আছে, তার সঙ্গে এই মৃত্যুর কোন অমিল থাকবে না।

পুলিস যথেষ্ট বিলম্বেই সজাগ হবার সুযোগ পাবে। কিন্তু তারা কি পান্না দ্বীপের হত্যা রহস্যের কোন কিনারা করতে পারবে?

তবে একটা সূত্র তাদের জন্য রয়েছে। যে দশজন লোক এই দ্বীপে এসেছিল, তাদের মধ্যে, একজন ছিল সম্পূর্ণ নিরপরাধ। আর সেই হল বাকি নজনের হত্যার নায়ক।

এই কথায় কোন মিথ্যা নেই। অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।

উদ্ধারকারী দল এবং পুলিস সহ কিছু কৌতূহলী মানুষজন যখন এই দ্বীপে আসবে তখন তারা পাবে দশটা মৃতদেহ আর দশটা ভাঙ্গা পুতুল।

আমার বিশ্বাস পুলিস এই রহস্যের কিনারা করতে ব্যর্থ হবে। পান্না দ্বীপের হত্যারহস্য রহস্যময় হয়েই থেকে যাবে।

–লরেন্স ওয়ারগ্রেভ

Exit mobile version