Site icon BnBoi.Com

এম্পায়ার অভ্ দা মোগল দি রুলার অভ্ দা ওয়ার্ল্ড – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

এম্পায়ার অভ্ দা মোগল দি রুলার অভ্ দা ওয়ার্ল্ড

এম্পায়ার অভ্ দা মোগল দি রুলার অভ্ দা ওয়ার্ল্ড

১.১ পর্দার আড়াল থেকে

এম্পায়ার অভ দা মোগল – রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড
মূল : এ্যালেক্স রাদারফোর্ড
অনুবাদ : এহসান উল হক

প্রধান চরিত্রসমূহ

আকবরের পরিবার

হুমায়ূন, আকবরের পিতা এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট।

হামিদা, আকবরের মাতা।

গুলবদন, আকবরের ফুফু এবং হুমায়ূনের সৎবোন।

কামরান, আকবরের চাচা এবং হুমায়ুনের জ্যেষ্ঠ সৎভাই।

আসকারী, আকবরের চাচা এবং হুমায়ূনের মেজ সৎভাই।

হিন্দাল, আকবরের চাচা এবং হুমায়ুনের সর্বকনিষ্ঠ সৎভাই।

হীরা বাঈ, আকবরের প্রথম স্ত্রী, অম্বরের রাজকুমারী এবং সেলিমের মাতা।

সেলিম(জাহাঙ্গীর), আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

মুরাদ, আকবরের মেজ পুত্র।

দানিয়েল, আকবরের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র।

মান বাঈ, সেলিমের স্ত্রী, খোসরুর মাতা এবং অম্বরের রাজা ভগবান দাশের কন্যা।

যোধ বাঈ, সেলিমের স্ত্রী এবং খুররমের মাতা।

সাহেব জামাল, সেলিমের স্ত্রী এবং পারভেজের মাতা।

খোসরু, সেলিমের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

পারভেজ, সেলিমের মেজ পুত্র।

খুররম, সেলিমের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র।

আকবরের পরিষদবর্গ

বৈরাম খান, আকবরের অভিভাবক এবং প্রথম প্রধান সেনাপতি(খান-ই খান)।

আহমেদ খান, প্রথমিক পর্যায়ে আকবরের প্রধান তথ্য সংগ্রাহক এবং পরবর্তীতে প্রধান সেনাপতি।

মাহাম আঙ্গা, আকবরের দুধমা।

আদম খান, আকবরের দুধভাই।

জওহর, হুমায়ূনের পরিচারক এবং পরবর্তীতে আকবরের গৃহস্থালী রসদভাণ্ডারের প্রধান।

আবুল ফজল, আকবরের প্রধান ঘটনাপঞ্জিকার এবং উপদেষ্টা।

তারদি বেগ, দিল্লীর প্রশাসক।

মোহাম্মদ বেগ, আকবরের সেনাপতি।

আলী গুল, আকবরের তাজিক সেনাকর্তা।

আব্দুল রহমান, আকবরের আহমেদ খান পরবর্তী প্রধান সেনাপতি।

আজিজ কোকা, আকবরের একজন তরুণ সেনাপতি।

মোগল রাজসভার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

আতগা খান, আকবরের প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক।

মায়ালা, আকবরের একজন প্রিয় রক্ষিতা।

আনারকলি, আকবরের ইটালীয় রক্ষিতা।

শেখ আহমেদ, একজন গোড়া সুন্নি এবং ওলামা পরিষদের প্রধান।

শেখ মোবারক, উচ্চপদস্থ ওলামা এবং আবুল ফজলের বাবা।

ফাদার ফ্রান্সিসকো হেনরিকস, জেসুইট পুরোহিত।

ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেট, জেসুইট পুরোহিত।

জন নিউবেরি, ইংরেজ বণিক।

সুলায়মান বেগ, সেলিমের দুধভাই এবং বন্ধু।

জাহেদ বাট, সেলিমের দেহরক্ষীদের অধিনায়ক।

জোবায়দা, সেলিমের শৈশবের সেবিকা এবং হামিদার পরিচারিকা।

দিল্পী

হিমু, হিন্দু সেনাপতি যে আকবরের কাছ থেকে অল্প সময়ের জন্য দিল্লী ছিনিয়ে নেয়।

ফতেহপুর শিক্রি

শেখ সেলিম চিশতি, একজন সুফি সাধক।

তুহিন দাশ, আকবরের স্থপতি।

গুজরাট

ইব্রাহিম হোসেন, গুজরাটের রাজ পরিবারের একজন বিদ্রোহী সদস্য।

মির্জা মুকিম, গুজরাটের রাজ পরিবারের একজন বিদ্রোহী সদস্য।

ইত্তিমাদ খান, গুজরাটের রাজ পরিবারের একজন বিদ্রোহী সদস্য।

কাবুল

সাইফ খান, কবুলের প্রশাসক।

গিয়াস বেগ, কাবুলের কোষাধ্যক্ষ।

মেহেরুন্নেসা, গিয়াস বেগের কন্যা।

বাংলা

শের শাহ, বাংলা থেকে আগত শাসক যে হুমায়ূনের আমলে মোগলদের হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত করেছিলো।

ইসলাম শাহ, শের শাহ্ এর পুত্র।

শাহ দাউদ, আকবরের শাসনামলে বাংলার জায়গিরদার।

রাজস্থান

রানা উদয় সিং, মেওয়ার এর শাসক এবং বাবরের শত্রু রানা সাঙ্গার পুত্র।

রাজা রবি সিং, আকবরের একজন জায়গিরদার।

রাজা ভগবান দাশ, অম্বরের শাসক, হীরা বাঈ এর ভাই এবং মান বাঈ এর পিতা।

মান সিং, রাজা ভগবান দাশের পুত্র।

মোগলদের পূর্বপুরুষ

চেঙ্গিস খান

তৈমুর, পশ্চিমে পরিচিত তামুরলাইন হিসেবে যা তৈমুর-ই-ল্যাং(খোঁড়া তৈমুর) এর অপভ্রংশ।

উলাগ বেগ, তৈমুরের নাতি এবং বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ।

.

‘উদগিরণরত তীর এবং তলোয়ারের আঘাত
হাতির মজ্জা এবং বাঘের নাড়িভুড়ি বিদীর্ণ করে’
—-আবুল ফজলের আকবরনামা

*

প্রথম খণ্ড – পর্দার আড়াল থেকে

০১. অপ্রত্যাশিত বিপদ

উত্তর-পশ্চিম ভারত, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ

এ্যাকাসিয়ার জঙ্গলের প্রায় ত্রিশ ফুট গভীর থেকে নিচু কিন্তু গম্ভীর গর্জন। ভেসে এলো। গর্জন শোনা না গেলেও আকবর বুঝতে পারছিলেন সেখানে বাঘ থাকতে পারে। কারণ পশুটির গায়ের উগ্র গন্ধ ঐ স্থানের বাতাসে ভাসছিলো। খেদাড়েরা (শিকারকে তাড়ানোর জন্য নিযুক্ত লোক) তাদের দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছে। দিল্লী থেকে একশ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে যে পাহাড়ে আকবরের সৈন্যদল তাবু গেড়েছিলো সেখানে পুরো এলাকার উপর তখন চাঁদের রূপালী আলো ছড়িয়ে পড়ছে। তারা একটি ছোট বনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো যেখানে একটি বড় আকারের পুরুষ বাঘ দেখা গেছে। যে গ্রাম-প্রধান বাঘটির খবর আকবরের তাবুতে বয়ে এনেছিলো সে বলেছিলো সে শুনেছে, তরুণ মোগল সম্রাট শিকার করতে ভালোবাসেন এবং এটাও দাবি করে যে বাঘটি মানুষখেকো। বাঘটি পানি আনতে যাওয়া দুটি শিশু ও ক্ষেতে কর্মরত এক বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে গেছে।

গ্রাম-প্রধানটিকে আকবর উত্তমরূপে পুরস্কৃত করেছেন, সে চরম উত্তেজনা নিয়ে তাবুস্থল ত্যাগ করে। আকবরের অভিভাবক এবং প্রধান সেনাপতি খান-ই-খানান উপাধির অধিকারী বৈরাম খান এই যুক্তি দিয়ে আকবরকে বাঘ শিকার করা থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন যে, মোগল সাম্রাজ্যের শত্রুরা যখন অগ্রসরমান তখন এই শিকারের চিন্তা চরম বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আকবরের কাছে তখন অন্য কোনো বিষয় বাঘ শিকারের আকর্ষণ ও উত্তেজনার তুলনায় তুচ্ছ। কিছুতেই তাঁর মতো পরিবর্তন করা গেলো না। অবশেষে বৈরাম খান তাঁর শীর্ণ ও বহু ক্ষতচিহ্ন সমৃদ্ধ মুখে অনেক কষ্টে মৃদু হাসি টেনে শিকারে সম্মতি দিলেন।

খেদাড়েরা মোগলদের আদিনিবাস থেকে মধ্য-এশিয়ায় বয়ে আনা বহু পুরানো শিকারের কৌশল প্রয়োগ করছিলো। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্ধকার বনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো, আটশ জন লোকের তৈরি একমাইল প্রস্থের এক বিশাল বৃত্তের আকারে। সেই সাথে তারা পেতলের ঘন্টা এবং গলায় ঝোলানো সরু আকৃতির ঢোল পেটাচ্ছিলো। তারা বৃত্তটি ছোট করে আনতে শুরু করলো যার ফলে তাদের মানব-বেষ্ঠনী দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে বনের অন্যান্য জীবজন্তু যেমন-হরিণ, নীলগাই, বুনো-শূকর প্রভৃতি তাঁদের বৃত্তের কেন্দ্রে জড়ো হচ্ছিলো। একসময় বেড়ে উঠা আলোতে কয়েকজন খেদাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ দেখলো এবং আকবরকে খবর পাঠালো যিনি তাঁদের পিছু পিছু হাতির পিঠে চড়ে আসছিলেন।

আকবর যে বিশাল হাতিটির পিঠে মণি-মাণিক্য খচিত হাওদায় বসে ছিলেন সেই জানোয়ারটিও বুঝতে পারছিলো বাঘটি কাছেই রয়েছে। বিপদের আশংঙ্কায় জানোয়ারটি তার বিরাট মাথাটি দুপাশে দোলাচ্ছিলো এবং বারবার শুড় গুটাচ্ছিলো। পেছনে যে হাতিগুলি আকবরের দেহরক্ষী ও পরিচারকদের বহন করছিলো সেগুলির বিশাল পায়ের অস্থির পদক্ষেপও তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। আকবর তাঁর হাতির ঘাড়ের উপর কায়দা করে বসে থাকা শীর্ণ দেহের লাল পাগড়ী পরা লোকটিকে ফিসফিস করে বললেন, মাহুত, হাতিটাকে শান্ত কর। মাহুত তৎক্ষণাৎ তার হাতে থাকা লোহার ঈষৎ বাঁকা দন্ড দিয়ে হাতিটির বাম কানের পিছনে টোকা দিলো। উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতিটি তার পরিচিত সংকেত পেয়ে ধীরে শান্ত হয়ে এলো এবং স্থিরভাবে দাঁড়ালো। পেছনের হাতিগুলিও সামনেরটিকে অনুসরণ করে স্থির ও নিশ্চল হয়ে দাঁড়ালো এবং চারদিক ভীষণ নিস্তবদ্ধ হয়ে পড়লো।

চমৎকার, আকবর ভাবলেন। এই মুহূর্তে তিনি নিজের মধ্যে চরম উদ্দীপনা অনুভব করলেন। তাঁর শিরায় রক্ত ছলকে উঠলো এবং তিনি নিজ হৃৎপিণ্ডের ধু ধু শব্দ শুনতে পেলেন, তবে সেটা ভয়ে নয় উত্তেজনায়। যদিও তাঁর বয়স এখনো চৌদ্দ পূর্ণ হয়নি, ইতোমধ্যেই তিনি অনেকগুলি বাঘ মেরেছেন। বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির খেলা, অনিশ্চয়তা ও বিপদের আশঙ্কা সর্বদাই তার মাঝে শিহরণ জাগিয়েছে। তিনি জানেন বাঘটি যদি আচমকা বেরিয়ে আসে, একমুহূর্তে তিনি পিঠে থাকা তূণীর থেকে তীর নিয়ে তাঁর দ্বি-বক্র ধনুকের ছিলায় পরিয়ে ফেলতে পারবেন-বেশিরভাগ শিকারী এধরনের পরিস্থিতিতে এই অস্ত্রই ব্যবহার করে। কিন্তু আকবরের জানতে কৌতূহল হচ্ছিলো তাঁর গাদাবন্দুকের সামর্থ কতোটুকু, বিশেষ করে এই কুখ্যাত বড় আকারের বাঘটার বিরুদ্ধে। গাদাবন্দুক ব্যবহারে তার নৈপুণ্যের বিষয়ে তিনি গর্ব বোধ করেন এবং মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও লেখাপড়ার তুলনায় বন্দুক নিয়ে অনুশীলনেই অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। বন্দুক ছোঁড়ার নৈপুণ্যে যদি তিনি তার সৈন্যদলের যে কোনো সৈনিককে পরাজিত করতে পারেন তাহলে অশিক্ষিত হওয়া কি দোষের? বাঘটির গর্জন থেমে গেছে এবং জানোয়ারটি তার বাদামী চোখে তাকে লক্ষ করছে বলে আকবর অনুভব করতে পারলেন। খুব ধীরে তিনি তাঁর ম্যাচলক মাস্কেট (গাদাবন্দুক) এর কারুকার্য খচিত ইস্পাতের নলটি তার আসনের পার্শ্বে নিচু করে ধরলেন। বন্দুকে গুলি ও বারুদ আগেই ভরে রেখেছেন, এখন এর ছোট পলিতাটি (ফিউজ, যাতে আগুন ধরিয়ে এই বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে হয়। পরীক্ষা করলেন। তাঁর অনুচর তার পাশেই নিচু হয়ে পলিতায় অগ্নিসংযোগের জ্বলন্ত কাঠি ধরে রেখেছে।

সব ঠিক আছে নিশ্চিত হয়ে আকবর তার গাদাবন্দুকটি এ্যাকাসিয়ার জঙ্গলের সবচেয়ে ঘন ঝোঁপের দিকে তাক করলেন, তাঁর অনুমান বাঘটি ওখানেই লুকিয়ে আছে। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা বন্দুকের কাঠের বাটটি তার কাঁধে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলেন। অনুচরকে ফিসফিস করে বললেন, অগ্নিসংযোগের কাঠিটা দাও এবং খেদাড়েদের সংকেত দাও। সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতির পিছনে অর্ধবৃত্তাকারে জড়ো হয়ে থাকা খেদাড়েরা উচ্চশব্দে চিৎকার করতে লাগলো এবং তাঁদের ঘন্টা ও ঢোলের তীব্র শব্দ তুললো। কয়েক মুহূর্ত পর যেনো প্রত্যুত্তর দিতেই বিকট গর্জন করে বাঘটি জঙ্গলের অন্ধকার চিড়ে বেরিয়ে এলো। বন্দুকের পলিতায় আগুন দেয়ার সময় আকবর বাঘটির বড় বড় সাদা দাঁত আর শরীরের সোনালী-কালো একটি ঝলক দেখতে পেলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর হাতি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়েছে। বিস্ফোরণের তীব্র আলো ঝলসে উঠলো, সেইসাথে কানে তালা দেয়া গুড়ম শব্দ। বন্দুকের বিস্ফোরণের ধাক্কায় উল্টো ডিগবাজি খেয়ে আকবর তার আসনের একপাশে ছিটকে পড়লেন কিন্তু তার আগমুহূর্তে বাঘটিকেও ধরাশায়ী হতে দেখলেন দশগজ দূরে। ধোঁয়া সরে গেলে আকবর দেখলেন জানোয়ারটি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে এবং সেটির ডান চোখের উপরে সৃষ্ট অমসৃণ ফুটো থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।

আকবর বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি মাহুতের সাহায্য ছাড়াই হাতিটির হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে নামলেন, তার মুখে তখন আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। তিনি চমৎকার দক্ষতায় বাঘটিকে হত্যা করেছেন। যারা সন্দেহ করতে গাদাবন্দুক এধরনের শিকার করার জন্য অত্যন্ত ধীর গতি সম্পন্ন, তাঁদের ধারণাকে তিনি ভুল প্রমাণিত করলেন। একজন ভালো বন্দুকবাজের জন্য এই অস্ত্র যথেষ্ট দ্রুত কাজ করতে পারে। মৃত জানোয়ারটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য তিনি এগিয়ে গেলেন। বাঘটির গোলাপি জ্বিহা সেটার মুখের একপাশে শিথিলভাবে নেতিয়ে আছে, তার উপর সবুজ-কালো বর্ণের মাছির দল ভন ভন করা শুরু করেছে। কিন্তু বাঘটির পেটে দুধের বাঁট লক্ষ্য করে তিনি অবাক হলেন। যে বাঘটিকে তিনি শিকার করতে এসেছেন সেটাতো পুরুষ হওয়ার কথা! এই ভাবনাকে অনুসরণ করে তার মনে যে ভাবনাটি এলো তার প্রতিক্রিয়ায় তার কিশোর বয়সী ঘাড়ের পিছনের চুলগুলি প্রায় দাঁড়িয়ে গেলো। তিনি কম্পিত আঙ্গুলে একঝটকায় কাঁধ থেকে ধনুক টেনে নিলেন এবং পিঠের তূণ থেকে একটি তীর ছিলায় পরানোর সময়ই বিশাল আকারের দ্বিতীয় বাঘটি আচমকা জঙ্গল থেকে ছিটকে বেরিয়ে সোজা তার দিকে এগিয়ে এলো। কোনোক্রমে আকবর তার তীরটি ছুঁড়তে পারলেন এবং সেইমুহূর্তে সময় যেনো তার কাছে স্থির হয়ে গেলো। তার পেছন থেকে আসা সতর্কতাসূচক চিৎকার ও কোলাহলো যেনো অস্পষ্ট হয়ে এলো এবং তাঁর মনে হলো এখানে তিনি এবং বাঘটি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি তাঁর ছোঁড়া তীরটিকে খুব ধীরে বাতাস চিড়ে ছুটে যেতে দেখলেন। তার মনে হলো লাফ দিতে উদ্যত বাঘটি স্থির হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ সময় যেনো আবার সচল হয়ে উঠলো এবং বাঘটি প্রায় তার উপর এসে পড়লো। আকবর লাফিয়ে একপাশে সরে গেলেন, তার চোখ প্রায় বন্ধ এবং তার মনে হলো যেকোনো মুহূর্তে বাঘটির ধারালো নখ তার শরীরের মাংস চিরে ঢুকে যাবে এবং সেটার দুর্গন্ধযুক্ত মুখের ধারালো দাঁতগুলি তাঁর গলা কামড়ে ধরবে। পক্ষান্তরে ধুপ করে আছড়ে পড়ার শব্দে তিনি চোখ মেলে দেখলেন বাঘটি তার পাশে নিথর পড়ে আছে, তীরটি সেটার গলা এফোড় ওফোড় করে ঢুকে আছে। এক মুহূর্ত আকবর স্তব্ধ হয়ে রইলেন, অনুভব করলেন এটা এমন অভিজ্ঞতা যার সাক্ষাৎ তিনি আগে কখনোও পাননি-আতঙ্ক এবং সেইসঙ্গে ভাগ্যের সহায়তা। তখনো স্তম্ভিত, আকবর অগ্রসরমান ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেলেন এবং পিছন ফিরে দেখলেন। সরু ডালপালা ও ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একজন অশ্বারোহী তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই শিবির থেকে আগত দূত, সন্দেহ নেই বৈরাম খান তাকে পাঠিয়েছেন তাগাদা দেবার জন্য। পাঁচ মিনিট আগে হলে এধরনের উৎপাতে তিনি বিরক্ত হতেন তার শিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু এখন তিনি কৃতজ্ঞবোধ করলেন একটু আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার পরিণতি বিষয়ে তার চিন্তায় ছেদ টানার জন্য। খেদাড়েদের দল, রক্ষী এবং সেবকরা দুপাশে সরে দূতকে পথ করে দিলো। তার সবল উঁচু ঘোড়াটি ঘামে ভিজে গেছে এবং সে নিজে ধূলার আস্তরণে এমনভাবে আচ্ছাদিত হয়েছে যে তার পরনের উজ্জ্বল সবুজ রঙ্গের মোগলাই উৰ্দিটি প্রায় খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। আকবরকে কুর্ণিশ করে সে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো, সংক্ষিপ্ত অভিবাদন শেষে এক নিঃশ্বাসে বললো, সম্রাট, বৈরাম খান অনুরোধ করেছেন আপনি যেনো এক্ষুণি শিবিরে ফেরেন।

কেনো? বিদ্রোহী হিমুর সেনাবাহিনীর একটি অগ্রবর্তী সৈন্যদলের কাছে দিল্লীর পতন হয়েছে।

*

চার ঘন্টা পর, আকবর এবং তাঁর শিকারের সঙ্গীরা শিবিরের প্রথম নিরাপত্তা বেড়া অতিক্রম করলো। সূর্য তখন পরিচ্ছন্ন নীল আকাশে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। যদিও ছাতার ছায়ায় রয়েছেন, তারপরও আকবরের মাথা ব্যথা করছিলো। ঘামে তার পোষাক শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে, তবুও এইসব অসুবিধা তাঁকে খুব একটা কষ্ট দিচ্ছিলো না রাজধানী দিল্লীর পতনের ভয়াবহ সংবাদ তাকে যতোটা ভাবাচ্ছিলো। শাসনকার্য শুরুর আগেই কি তাঁর শাসন আমলের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে?

দশ মাসও পার হয়নি এক মোগল শিবিরে অস্থায়ীভাবে ইটের তৈরি সিংহাসনে তড়িঘড়ি করে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার পিতা সম্রাট হুমায়ূনের আকস্মিক মৃত্যুর শোক এখনো তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত। কিছুটা বিব্রত কিন্তু গর্বিত ভঙ্গীমায় তিনি বৈরাম খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য শিবিরের সম্মুখে টাঙ্গানো রেশমের চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়ালেন।

বর্তমানে যে দুঃসময় তারা অতিক্রম করছেন এর গুরুত্ব তাঁর মা হামিদা তাকে বুঝাতে পেরেছিলেন। পারসিক হওয়া সত্ত্বেও বৈরাম খান অন্য যে কোনো উপদেষ্টার চেয়ে তার নিরাপত্তা বিধানে অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। বৈরাম খান আঁচ করতে পেরেছিলেন আকবরের পিতার মৃত্যুর পর তার জন্য বিপদ সৃষ্টি হবে ভিতর থেকেই-উচ্চাকাক্ষী সেনাপতিরা ভাবছে এখন যখন হুমায়ূন মৃত এবং সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে গেছেন একটি মাত্র বালক পুত্রসন্তান, এটাই সিংহাসন দখলের উপযুক্ত সময় তাঁদের জন্য। তাদের অধিকাংশের মধ্যেই ভাবাবেগের অস্তিত্ব নেই। তাঁদের অনেকেই পুরানো মোগল গোত্র গুলির সদস্য যারা হিন্দুস্তানের শুষ্ক সমভূমিতে একটি নতুন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে আকবরের পিতামহ সম্রাট বাবরের সঙ্গী ছিলো। সিংহাসন অথবা খাঁটিয়া সর্বদা এই মনোভাব দ্বারাই তারা চালিত হয়েছে। যে কেউ নিজেকে যোগ্য এবং শক্তিশালী ভেবেছে সেই সিংহাসন অধিকারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। বিগত বছর গুলিতে অনেকেই এমন অনেকেই এমন প্রয়াস চালিয়েছে। এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে সন্দেহ নেই।

আকবর ভাবছেন যদি দিল্লীর পতনের দুঃসংবাদ সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তার মা এবং বৈরাম খান তার জন্য এতোদিন যা কিছু করেছেন সব ব্যর্থতায় পর্যবশিত হলো। মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহার করার জন্য তারা হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদটি প্রায় দুসপ্তাহ গোপন রেখেছিলেন। মৃত সম্রাটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রায় একই দৈহিক গড়নের একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে হুমায়ূনের ভূমিকায় নিয়োজিত করেছিলেন তাঁরা। রীতি অনুযায়ী সে প্রতিদিন ভোরে সম্রাটের রেশমের সবুজ পোষাক এবং রত্নখচিত পাগড়ি পড়ে দিল্লীর রাজপ্রাসাদ পুরানো-কেল্লার যমুনা তীরবর্তী বারান্দায় হাজিরা দিয়েছে প্রজাদের বোঝানোর জন্য যে সম্রাট এখনো জীবিত আছেন।

ইতোমধ্যে, মা হামিদা এবং ফুফু গুলবদন অনিচ্ছুক আকবরকে গোপনে দিল্লী ত্যাগ করতে রাজি করান। প্রদীপের কম্পিত আলোয় মায়ের উদ্বিগ্ন মুখটি এখনো তার চোখে ভাসছে যখন তিনি তাঁর শয়ন কক্ষে এসে তাকে ডেকে তুলেন এবং ফিসফিস করে বলেন, তাড়াতাড়ি করো, সঙ্গে কিছু নেবার দরকার নেই-জলদি! আচমকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে আকবর দেখেন মা তার গায়ে মস্তক আবরণ যুক্ত একটি কালো আলখাল্লা পড়িয়ে দিচ্ছেন, তিনি নিজেও অনুরূপ একটি আলখাল্লা পড়ে আছেন। তখনো ঘুমের রেশ কাটেনি, মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে প্রসাদের গুপ্ত সিঁড়ি পথে (যে সম্পর্কে আগে তিনি জানতেন না) তিনি তার মাকে অনুসরণ করে একটি অপরিচ্ছন্ন উঠানে উপস্থিত হোন। সেখানকার বাতাসে মানুষ অথবা পশুর প্রস্রাবের যে তীব্র গন্ধ ভাসছিলো-সেটা এখনো তার মনে আছে।

সেখানে একটি বড় টানা-গাড়ি অপেক্ষা করছিলো এবং আঁধারের ছায়ায় ফুফু গুলবদন এবং প্রায় বিশজন বৈরাম খানের অনুগত সৈন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। গাড়িতে উঠে পড় হামিদা ফিসফিস করে বলে ছিলেন।

কেনো, আমরা কোথায় যাচ্ছি? তিনি জিজ্ঞেস করেন।

এখানে থাকা তোমার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর কোনো প্রশ্ন করো না। যা বলছি করো।

আমি পালাতে চাই না। আমি কাপুরুষ নই। ইতোমধ্যেই রক্ত এবং যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে… তিনি প্রতিবাদ করেন।

গুলবদন এগিয়ে এসে তার বাহু আকড়ে ধরে বললেন, যখন তুমি শিশু ছিলে এবং তোমার জীবন বিপন্ন হয়েছিলো তখন তোমাকে বাঁচাতে আমি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছি। আমার উপর আস্থা রাখো এবং তোমার মা যা বলছে করো…।

তর্ক করা অব্যাহত রেখেই আকবর টানা-গাড়িতে চড়লেন, হামিদা ও গুলবদন তার পিছুপিছু গাড়িতে উঠে এলেন এবং তারা দ্রুত গাড়িটির পর্দা টেনে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা গাড়ি টানার হাতল কাঁধে তুলে নিয়ে রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে যাত্রা শুরু করলো। গুলবদন ও হামিদা চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন এবং তাঁদের দুশ্চিন্তার অংশবিশেষ অবশেষে আকবরের মাঝে সঞ্চারিত হলো, যদিও তিনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না এসব কি হচ্ছে। এক সময় তারা যখন রাজপ্রাসাদ থেকে অনেক দূরে শহরের শেষ সীমায় পৌঁছালেন তখন তার মা মুখ খুললেন। জানালেন সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের আগেই তাকে হত্যা করার এক গোপন ষড়যন্ত্রের কথা।

দিল্লীর সীমান্তে বৈরাম খানের অনুগত আরো সৈন্য তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলো এবং নিরাপত্তা প্রদান করে তাঁদের শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী একটি শিবিরে নিয়ে এলো। এক সপ্তাহ পর বৈরাম খান তার মূল সেনাবাহিনীসহ তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলেন এবং আকবরকে তার ইটের সিংহাসনে বসিয়ে দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিলেন। তারপর ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে উপযুক্ত নিরাপত্তা প্রদান করে বৈরাম খান আকবরকে দিল্লীতে ফিরিয়ে আনেন এবং শুক্রবারের জুম্মার নামাজের সময় তাঁর নামে খুদ্বা পাঠ করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে নতুন সম্রাট হিসেবে আকবরের পরিচিতি সমগ্র বিশ্বের কাছে ঘোষিত হয়। তখনো যাদের নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বোনার সময় ছিলো তাদের বিরুদ্ধে এটি ছিলো। কৌশলগত পদক্ষেপ। এই ঘোষণার পর সকল মোগল নেতারা আকবরের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলো।

এর ফলে আভ্যন্তরীণ শত্রুদের মোকাবেলা করা হলো, কিন্তু সাম্রাজ্যের দূরবর্তী রাজ্য গুলিতে আকবরের অভিষেক সংবাদের প্রভাব ততোটা জোড়াল ভাবে পড়লো না। পারতপক্ষে হিন্দুস্তানের উপর মোগলদের প্রভাব তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যেসব রাজা এবং জায়গিরদারগণ অল্প সময় আগে আকবরের পিতা হুমায়ুনের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেছিলো তারা স্বাধীন হতে চাচ্ছিলো এবং সাম্রাজ্যের বাইরের শত্রুরা সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছিলো। কিন্তু তাদের সবার উপরে সবচেয়ে বিপদজনক হুমকি স্বরূপ দেখা দিলো হিমু। আগে তাকে শত্রু হিসেবে ততোটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সে ছিলো ছোটখাট গড়নের মিষ্টভাষী একটি লোক। তবে তার চেহারাটি কুৎসিত এবং সে নিচু বংশোদ্ভূত এক অজ্ঞাত চরিত্র, যে বলতে গেলে প্রায় শূন্য থেকে একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠন করে ফেলতে সক্ষম হয় এবং মোগল শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। ইতোপূর্বে আকবর হিমুর ব্যাপারে বিন্দু মাত্র মাথা ঘামাননি কিন্তু এখন তিনি ভাবছেন বাস্তবে সে কেমন ধরনের মানুষ এবং কোনো মন্ত্রবলে সে তার যোদ্ধাদের দলে টানলো। তাঁর এ সাফল্যের পিছনে কি রয়েছে?

*

আকবরের শিবির হিসেবে গড়ে তোলা বিশাল তাবুশহরের প্রাণকেন্দ্রে তিনি প্রবেশ করছিলেন। বিশালদেহী হাতিটির পিঠে নিরাপদ উচ্চতায় অবস্থিত হাওদা (হাতির পিঠে নির্মিত আসন) থেকে তিনি সামনে তাকালেন, কেন্দ্রস্থলে তার নিজের তাবুটি দেখলেন-সেটি উজ্জ্বল রক্তিম বর্ণের যা সম্রাটের প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে-সেটির পাশে প্রায় একই দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণীয়তায় তৈরি বৈরাম খানের তাবুটি অবস্থিত। প্রধান সেনাপতি তাঁর জন্য তাবুর বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন, তাকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো আকবরের সেখানে পৌঁছানোর জন্য তিনি কতোটা অস্থির হয়ে ছিলেন।

আকবর হাতির পিঠ থেকে নামতে না নামতেই বৈরাম খান মুখ খুললেন। সম্রাট, আপনি খবরটা শুনেছেন-হিমুর সৈন্যরা দিল্লী দখল করে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই আপনার তাবুতে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কার্যক্রম শুরু করেছে এবং এখন আমাদের কি করণীয় সে সম্পর্কে বাকবিতণ্ডা চলছে। আকবর বৈরাম খানকে অনুসরণ করে তাবুতে ঢুকে দেখলেন অন্যান্য সেনাপতি এবং পরামর্শদাতারা তার বসার জন্য নির্ধারিত সবুজ মখমলে আচ্ছাদিত সোনার পাত মোড়া একটি টুলের চারপাশে পুরু লাল-নীল বর্ণের শতরঞ্জিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। আকবর আসন গ্রহণ করার পর সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন পুনরায় আসন গ্রহণ করার সময় তাঁদের নজর কতোটা সমীহের সঙ্গে তাঁর পাশে দাঁড়ানো বৈরাম খান কে প্রত্যক্ষ করলো। তারদি বেগকে তলব করো, সে তার বক্তব্য সম্রাটকে পুনরায় অবহিত করুক, বৈরাম খান আদেশ দিলেন। কয়েক মুহূর্ত পর দিল্লীর দায়িত্বে নিয়োজিত মোগল প্রশাসক সেখানে উপস্থিত হলো। আকবর তারদি বেগকে চিনতেন এবং পছন্দও করতেন। সে ছিলো উত্তর কবুলের পাহাড়ী এলাকায় জন্মলাভ করা এক অসীম আত্মবিশ্বাসী যোদ্ধা, পেশীবহুল বিশাল দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভরাট কণ্ঠের অধিকারী। তাঁর চোখজোড়া সর্বদা হাস্যকরভাবে মিটমিট করে কিন্তু এই মুহূর্তে সেগুলি রোদে-পোড়া, শুষ্ক এবং বিষণ্ণ রূপ ধারণ করেছে।

তারদি বেগ, ম্রাট এবং মন্ত্রীসভার সম্মুখে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করো। বৈরাম খানের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা শোনালো। বলো কীভাবে তুমি একজন যবক্ষার (নাইট্রিক এ্যাসিড) বিক্রেতা এবং তার অনুগত বিদ্রোহীদের কাছে সাম্রাজ্যের রাজধানীকে আত্মসমর্পণ করে পালিয়ে এলে।

তারা কোনো মামুলী বিদ্রোহী নয়, বরং অত্যন্ত শক্তিশালী, উত্তমভাবে অস্ত্রসজ্জিত এক সেনাবাহিনী। হিমু ছোট বংশোদ্ভূত হতে পারে কিন্তু যে কেউ তাকে ভাড়া করেছে তার জন্যই সে সফলভাবে যুদ্ধ জয় করেছে বহুবার। কিন্তু এখন সে আর ভাড়াটে সৈন্য নয়, সে এখন নিজের স্বার্থে লড়ছে। সম্রাটের পিতামহ যে পুরানো লোদী সাম্রাজ্যকে বিতাড়িত করেছিলেন হিমু তাদের অনুসারীদের আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, বহু সৎ এবং গর্বিত ব্যক্তিও তাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। আমাদের গুপ্তচরেরা খবর দিয়েছে একটি বিশাল অগ্রবর্তী বাহিনী পশ্চিমের সমভূমি থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আর হিমুর মূলবাহিনীর আরো বিশাল, তাঁদের রয়েছে তিনশত যুদ্ধ-হাতি এবং তাদের অবস্থান দিনের (প্রতিদিন তারা যততা দূর অগ্রসর হচ্ছে) হিসাবে বেশি দূরেও নয়। এই অবস্থায় রাজধানী ত্যাগ না করলে আমরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতাম।

বৈরাম খানের মুখ রাগে কঠিন হয়ে উঠলো। দিল্লী থেকে পালিয়ে এসে তুমি প্রতিটি বিদ্রোহী এবং গোত্রপতিদের কাছে এমন ইঙ্গিত পাঠিয়েছে যে তারা আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করবে না। আমি তোমার সঙ্গে বিশ হাজার সৈন্যের একটি দল রেখে এসেছিলাম….

সেটা যথেষ্ট ছিলো না।

তাহলে তোমার উচিত ছিলো আমাকে বার্তা পাঠানো এবং রাজধানী রক্ষা করা যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমি অতিরিক্ত সেনা পাঠাতাম।

তারদি বেগের চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো এবং তার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো কোমরবন্ধনীতে গুঁজে রাখা রত্নখচিত খাপ যুক্ত খঞ্জরটির (ড্যাগার বা ছোরা) হাতলের দিকে এগিয়ে গেলো। বৈরাম খান আপনি আমাকে বহু বছর ধরে চেনেন এবং আমরা পাশাপাশি যুদ্ধ করেছি ও রক্ত ঝরিয়েছি। আপনি কি আমার বিশ্বস্ততার প্রতি সন্দেহ পোষণ করছেন?

তোমার আচরণের জন্য ভবিষ্যতে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে, তারদি বেগ। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো তোমার হারানো রাজধানী কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়। আমাদের উচিত… একজন বাদামি দাড়ি বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তাবুতে ঢুকতে দেখে বৈরাম খান থেমে গেলেন। আহমেদ খান, তুমি নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছো দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। কি খবর এনেছে আমাদের বলো?

আকবর সর্বদাই আহমেদ খানের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন, সে তার পিতা হুমায়ূনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে অন্যতম ছিলো। হুমায়ূন তাকে আগ্রার প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু হিমুর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর বৈরাম খান তাকে ডেকে পাঠান এবং তার সাবেক পদ-প্রধানদূত ও গোপন তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তার ধূলিমলিন অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সদ্য শিবিরে পৌঁছেছে।

হিমু তার মূল সেনাবাহিনীর দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যদি তার বর্তমান গতি বজায় থাকে তাহলে সে আনুমানিক দুই সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীতে পৌঁছে যাবে। হিমুর দলের সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা একদল সৈন্যকে আমার সেনারা পাকড়াও করে, তাদের কাছ থেকেই এই তথ্য উদ্ধার করা গেছে। তারা আরো জানায় রাজধানীতে পৌঁছে হিমু নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছে। ইতোমধ্যে সে নিজে পাদশাহ উপাধি ধারণ করেছে এবং নিজ নামে মুদ্রা (টাকা) তৈরির আদেশ প্রদান করেছে। আরো জানা গেছে, এই মর্মে বক্তব্য প্রদান করছে যে হিন্দুস্তানে মোগলরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, সেই মোগলদের উত্তরসূরি এক বালক এখন শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং এই সাম্রাজ্যের শিকড় এতো নাজুক যে খুব সহজেই এর মূল উৎপাটন করা যাবে।

আহমেদ খানের বক্তব্যে মন্ত্রিসভার মধ্যে যেনো আচমকা প্রাণসঞ্চার হলো। আকবরের মনে হলো সকলে পরস্পরের দিকে ভীত দৃষ্টি বিনিময় করলো। আমাদের এখনই আঘাত করা প্রয়োজন-হিমু দিল্লীতে পৌঁছে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার আগেই, বৈরাম খান বললেন। তাড়াতাড়ি অগ্রসর হলে সে দিল্লীতে পৌঁছানোর আগেই আমরা তার নাগাল পাবো।

কিন্তু সেটা খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে, হেরাত থেকে আগত এক সেনাপতি আপত্তি জানালো। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আমাদের সবকিছু হারাতে হবে। আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে আমাদের আরো একটু সময় নেয়া উচিত…।

বাজে কথা। এমন শক্তিশালী অবস্থানে থেকে হিমু আলোচনার প্রস্তাবকে পাত্তা দিতে যাবে কেনো? বললেন মোহাম্মদ বেগ, তিনি বারাকসানি এলাকার একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। আমি বৈরাম খানের সঙ্গে একমত।

তোমরা সকলে ভুল করছো, মুখ খুললেন আলী গুল, যে একজন তাজাক। আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা রয়েছে-আমদের লাহোরে যাওয়া উচিত, সে স্থানটি এখনো মোগল নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সেখানে আমরা শক্তিসঞ্চয় করতে পারি। তারপর যখন আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী হবো, তখন শত্রুদের বিতাড়িত করতে পারবো।

কেউ তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না, আকবর ভাবলেন-যখন ক্রুদ্ধ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সভাসদরা তার চারপাশে শোরগোল তুললো। বৈরাম খান এসব বরদাশত করতে পারছিলেন না এবং একাগ্রভাবে আকবরের দিকে তাকিয়েছিলেন। আকবর বুঝতে পারছিলেন তিনি তার পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করছেন। তিনি এব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলেন যে বৈরাম খানের প্রস্তাবই সঠিক-আক্রমণ করাই সেই মুহূর্তে শত্রুদের প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায়। তাঁর পিতাও পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারকালে অনেক ক্ষেত্রে দেরির কারণে শত্রুরা শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। সেই মুহূর্তে আকবর মনস্থির করে ফেললেন। তাঁর বাবার মতো নিজেকে তিনি হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত হতে দিবেন না। হিন্দুস্তান শাসন করা মোগলদের নিয়তি, তারচেয়েও বড় সত্য এটা তার নিয়তি এবং তিনি এখানে টিকে থাকার চেষ্টাই অব্যাহত রাখবেন।

আকবর নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালেন, সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হলো। যথেষ্ট হয়েছে! এই সাম্রাজ্য ত্যাগ করে পালানোর চিন্তা করার স্পর্ধা তোমরা কোথায় পেলে? তিনি উচ্চস্বরে বললেন। তোমাদের কোনো অধিকার নেই অত্মসমর্পণ করার। এখানে আমিই ন্যায়সঙ্গত। শাসক এবং সম্রাট। আমার দায়িত্ব-আমাদের দায়িত্ব-নতুন ভূ-খন্ড জয় করা এবং যেসব ভূ-খন্ড আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের জন্য জয় করে গেছেন সেগুলিকে শত্রুর কাছে সমর্পণ করে পালিয়ে যাওয়া নয়। এখনই আমাদের উচিত হিমুকে আক্রমণ করা এবং হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া তরমুজের মতো তাকে ধ্বংস করা। আমি নিজে সৈন্যদের নেতৃত্ব দেবো।

আকবর বক্তব্য শেষ করে আসন গ্রহণ করার সময় এক মুহূর্ত বৈরাম খানকে লক্ষ্য করলেন, তিনি প্রায় দুর্বোধ্য মস্তক হেলানের মাধ্যমে আকবরের কঠোর বক্তব্যের প্রতি তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। অন্যান্য উপদেষ্টা এবং সেনাপতিরা তখন দাঁড়িয়ে আছেন এবং হঠাৎ তাদের সম্মিলিত কণ্ঠের উচ্চ শব্দে তাবু প্রকম্পিত হলো, সকলে একই বাক্য উচ্চারণ করছেন: মির্জা আকবর! মির্জা আকবর! তিনি প্রথমে আশ্বস্ত হলেন এবং তারপর গর্ববোধ করলেন। তারা কেবল তাঁকে তৈমুরের বংশধর একজন আমিরজাদা হিসেবেই মেনে নিলো না- বরং সম্রাট হিসেবে তাঁর প্রথম যুদ্ধাভিযানে তাঁকে অনুসরণ করার ইচ্ছাও প্রকাশ করলো। তিনি কিশোর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্যকে তারা গুরুত্ব প্রদান করেছে, ফলপ্রসূ নির্দেশনা দিতে পেরে তিনিও তৃপ্তিবোধ করছেন।

একঘন্টা পর আকবর মহিলাদের জন্য নির্ধারিত অন্দর মহলে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তাঁদের শয়ন এবং গোসলের তাবুগুলি সোনার পাতে মোড়া উঁচু কাঠের তৈরি ঝাঁঝরি দিয়ে সুরক্ষিত যেগুলি ষাঁড়ের চামড়ার ফিতা দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। একটিমাত্র প্রবেশ পথ উত্তম ভাবে সুরক্ষিত। তিনি যখন মায়ের তাবুতে প্রবেশ করলেন চন্দনের মিষ্টি গন্ধ তাঁর নাকে ভেসে এলো।

হামিদা রেশমের ফুল সজ্জিত একটি কোলবালিশে শুয়ে ছিলেন এবং তাঁর পরিচারিকা জয়নাব তার লম্বা কালো চুল আচড়ে দিচ্ছিলো। আরেক দিকে ফুফু গুলবদন একগ্রচিত্তে একটি বীণার তারে সুর মূর্ঘনায় মগ্ন ছিলেন। হামিদার বিপরীত দিকে আকবরের দুধমা মাহাম আঙ্গা একটি কামিজের উপর নশা সূচিকর্ম করছিলেন। মোগল রীতি অনুযায়ী রাজপুত্র এবং দুধমার সম্পর্ক আজীবন অবিচ্ছিন্ন থাকে। একইভাবে আকবরের তুলনায় কয়েক মাসের বড় মাহাম এর নিজ পুত্র আদম খান তার দুধ-ভাই এর মর্যাদা প্রাপ্ত এবং এই সম্পর্ক আপন ভাইয়ের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।

আকবরকে দেখে এই তিনজন মহিলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার মা হামিদার বয়স তখনো ত্রিশ পেরোয়নি এবং তাঁর শরীর হালকা-পাতলা। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আকবরকে জড়িয়ে ধরলেন। গুলবদন বীণা রেখে মৃদু হাসলেন। মাহাম আঙ্গাও তাঁকে উষ্ণ আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে এলেন।

আকবর তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী তিন মহিলাকে একত্রে দেখে খুশি হলেন যাদের তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন মনে করেন। আমি যুদ্ধ সংক্রান্ত সভা থেকে সরাসরি তোমাদের এখানে এসেছি। হিমুর অগ্রবর্তী সৈন্যরা দিল্লী দখল করে নিয়েছে কিন্তু তারা বেশিদিন দখলে থাকতে পারবে না। আগামীকাল আমার নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী হিমু ও তার মূল সৈন্যদল এর গতিরোধ করবে তারা দিল্লীতে পৌঁছানোর আগেই। আমরা হিমুকে পরাজিত করে আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করবো।

বাছা আমার, আবেগসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন হামিদা, আমি সর্বদাই জানতাম, এমনকি যখন তুমি আমার পেটে ছিলে, যে একদিন তুমি এক মহান যোদ্ধা এবং নেতা হবে। আমার সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হতে যাচ্ছে দেখে আমার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ। আমি তোমাকে কিছু জিনিস দিতে চাই। তিনি জয়নাবকে ফিসফিস করে কিছু বললেন, সে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলো। যখন ফিরে এলো দেখা গেলো তার হাতে সবুজ মখমলে জড়ানো কিছু রয়েছে যা সে হামিদার পায়ের কাছে শতরঞ্জির উপর রাখলো। হামিদা নিচু হয়ে মখমলের আচ্ছাদন সরিয়ে দিলেন, আকবর দেখলেন সেখানে তাঁর পিতার সোনালী বক্ষবর্ম (ব্রেস্টপ্লেট) এবং ঈগলাকৃতির হাতল বিশিষ্ট তলোয়ার-আলমগীর, যার খাপে নীলা পাথরের অলঙ্করণ রয়েছে।

বর্ম এবং তলোয়ার প্রত্যক্ষ করে আকবরের মনের পর্দায় এতেঠ স্পষ্টভাবে তাঁর পিতার অবয়ব ভেসে উঠলো যে তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন যাতে তার মা তার চোখের অশ্রু দেখতে না পান। হামিদা এবং মাহাম আঙ্গা তাঁর বক্ষে বর্ম পরিয়ে দিলেন। হুমায়ূন লম্বা এবং পেশীবহুল ছিলেন কিন্তু আকবরও ইতোমধ্যে সেই গড়ন লাভ করেছেন। বক্ষবর্মটি তাঁর শরীরে ভালোই মানিয়ে গেলো। এবারে হামিদা তাঁর দিকে আলমগীর এগিয়ে দিলেন। আকবর ধীরে তলোয়ারটি খাপমুক্ত করলেন এবং শূন্যে সেটা কয়েকবার চালালেন। সেটার ওজন এবং ভারসম্য তিনি সন্তুষ্টিবোধ করলেন।

তোমার প্রস্তুতির জন্য আমি এতোদিন অপেক্ষা করছিলাম, হামিদা বললেন, যেনো তিনি আকবরের মনের কথা বুঝতে পারছেন। এখন তুমি প্রস্তুত। আগামীকাল যখন তুমি রওনা হবে, আমি মাতাসুলভ দুশ্চিন্তা অনুভব করবো ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে একজন সম্রাজ্ঞীর গর্বও। আল্লাহ্ যেনো তোমার সহায় হোন আমার বাছা।

.

০২. একটি কাটা মাথা

মধ্যাহ্ন শেষে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে দিগন্ত ঝিকমিক করছিলো যখন দাঁড়িয়ে থাকা আকবর বিচলিত মনে এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিলেন। দিল্লীর উত্তর-পশ্চিম দিকের এক বৈচিত্রহীন ছোট ছোট পাহাড় বেষ্ঠিত এলাকার সমভূমিতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন তপ্ত বায়ুমণ্ডলের স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে প্রায় পঞ্চাশ জন সৈন্যের একদল অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। তাদের আগমন লক্ষ্য করতে করতে তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৈরাম খানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওদের সম্মুখে ওটা আহমেদ খান তাই না?

আমি নিশ্চিত নই। আপনার তরুণ চোখগুলি আমার থেকে ভালো, কিন্তু ওদের একজন যে পতাকাটি বহন করছে সেটা নিঃসন্দেহে আমাদেরই সবুজ রঙ চিহ্নিত মোগল পতাকা।

অল্পসময় পরেই বোঝা গেলো সেটা আহমেদ খানই, বৈরাম খানের পরামর্শে আকবর তাকে হিমুর অবস্থান ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে অধিক নিশ্চিত হওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে পাঠিয়েছিলেন তিন দিন আগে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সে তাঁদের কাছে পৌঁছালো এবং আকবরের সম্মুখে বিনীতভাবে অবনত হলো।

সোজা হউন, আহমেদ খান, কি সংবাদ এনেছেন বলুন?

কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা হিমু এবং তার মূল সেনাবহিনীকে খুঁজে পেয়েছি। তারা পানিপথে শিবির স্থাপন করেছে, এখান থেকে মাত্র বার মাইল উত্তর দিকে। পানিপথ নামটি আকবরের পরিচিত এবং এরসঙ্গে তার খানিকটা গৌরবও জড়িয়ে আছে। ত্রিশ বছর আগে তাঁর পিতামহ বাবর দিল্লীর লোদী বংশীয় সুলতান ইব্রাহিমকে এই পানিপথের যুদ্ধেই পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। এবার আকবরের পালা পানিপথের আরেকটি যুদ্ধে মোগল বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার। বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে বংশীয় ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য।

হিমুর বাহিনীতে কতোজন সৈন্য আছে আহমেদ খান? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

আমরা ধারণা করছি প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার, তাঁদের অর্ধেক অশ্বারোহী এবং উত্তম মানের। আর প্রায় পাঁচশত যুদ্ধ-হাতি রয়েছে।

আমরা যা ভেবেছিলাম সেটাই সত্যি হলো, আমাদের তুলনায় তার বিশ হাজার সৈন্য বেশি আছে। তাঁর কামান এবং বন্দুকের সংখ্যা কতো? আমরা যা ভেবে ছিলাম তার তুলনায় কম সংখ্যক কামান আছে ওদের, সর্বমোট ত্রিশটি হতে পারে, সেগুলির বেশিরভাগই ছোট আকারের। দূর থেকে যতোটা বুঝতে পেরেছি তার পদাতিক সৈন্যদের হাতে বন্দুকের পরিবর্তে তীর-ধনুক রয়েছে। তবে অল্পসংখ্যক বন্দুকধারী তার দলে রয়েছে।

বন্দুকের দিক থেকে আমরা ওদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, কি বলেন বৈরাম খান? আকবর তার প্রধান সেনাপতির দিকে ফিরলেন। পানিপথে যুদ্ধ না করার মতো আমাদের তেমন কোনো যুক্তি নেই, আছে কি? সেটি আমাদের সৈন্যদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনা একটি স্থান। সেখানে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমাদের যোদ্ধারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস পাবে, আমাদের সৈন্যসংখ্যা যদিও তুলনামূলকভাবে কম।

বৈরাম খান তাঁর অনুগ্রহভাজন তরুণ সম্রাটের উৎসাহ দেখে মৃদু হাসলেন। জ্বী সম্রাট, সেটি নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধ করার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান। আমরা এই বন্ধ্যা সমভূমির উপর দিয়ে গুপ্ত আক্রমণের আশঙ্কা ছাড়াই দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারবো।

আকবর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আহমেদ খান বলে উঠলেন, মহামান্য সম্রাট, আপনি পানিপথকে মোগলদের বিজয়ের জন্য সৌভাগ্যজনক বলছেন। সেটা সত্যি-কিন্তু হিমুর জন্য এর কোনো তাৎপর্য নেই। হিমুর শিবিরে ব্যবসা করেছে এমন একজন সওদাগরকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি এবং তার কাছে একটি গল্প শুনেছি। সে দাবি করেছে যে হিমুর একান্ত ব্যক্তিগত এক সেবকের কাছে সে এই গল্পটি শুনেছে। কিন্তু এই গল্পটি হিমুর দলের সকলেই জানে। কারণ পরবর্তীতে আমাদের হাতে বন্দী আরেকজন সৈনিক একই গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছে।

গল্পটি কি? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

সেটা হলো বেশ কিছু রাত আগে হিমুর হস্তিদলের একটি বিশাল হাতি বজ্রপাতের আঘাতে মারা যায়। আস্তাবলের অন্য হাতিগুলি সামান্য আহতও হয়নি। পরদিন সকালে হিমু যখন সংবাদটি জানলো তখন সে স্বীকার করলো যে, একই রাতে সে একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সে দেখেছে সে তার হাতির পিঠ থেকে একটি খরস্রোতা নদীতে পড়ে গিয়েছে। সে যখন ডুবে যাচ্ছিলো তখন একজন মোগল যোদ্ধা তাকে টেনে তীরে তুলে। তারপর তাকে শিকল দিয়ে বাঁধে এবং তার গলায় একটি দড়ি পেচিয়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। হিমু তার অনুসারীদের কাছে স্বপ্নটি ব্যাখ্যা করে এভাবে-সে বলে তার বংশে এমন ঐতিহ্য রয়েছে যে তারা স্বপ্নে যা দেখে তাদের বাস্তব জীবনে তার বিপরীত ঘটনা ঘটে। অতএব শীঘ্রই সে মোগলদের তাঁদের হাতির উপরের সুরক্ষিত আসন থেকে ভূমিতে ধরাশায়ী করবে এবং আমরা সকলে তার কাছে বন্দীত্ব বরণ করবো। যদিও পরবর্তীতে পরিষ্কার বোঝা গেছে সে ভীষণ চিন্তিত এবং সে তার হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি মুক্তহস্তে উৎসর্গ প্রদান করছে।

এটা নিঃসন্দেহে একটি দৈব সংকেত, আকবর ভাবলেন। এসময় বৈরাম খান বলে উঠলেন, এই গুজব যদি সত্যি নাও হয়, এর প্রচার হিমুর শিবিরের যোদ্ধাদের মনোবল কমিয়ে দেবে। এই জন্যই আমি মনে করি এখনই আমাদের পানিপথের দিকে অগ্রসর হওয়া।

*

দুইদিন পরের ঘটনা। ভোর হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রন্ধন কাজের জন্য জ্বালা আগুনের উজ্জ্বল কমলা রঙের শিখায় ভোরের ধূসর আধো-অন্ধকার অপসারিত হচ্ছিলো। আকবরের লোকেরা তড়িঘড়ি করে খাবার খেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। কিছুটা বিচলিত মনে আঙ্গুলের সাহায্যে তারা তাদের তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করছে এবং বারংবার ঘোড়ার পিঠে বাঁধা জিন যথেষ্ট শক্তভাবে এটে আছে কিনা দেখছে। সেইসঙ্গে বিড়বিড় করে আসন্ন যুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্য তাদের স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে। অন্যদিকে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছোট কামানগুলিকে চব্বিশটি ষাঁড়ের সঙ্গে জোতা হয়েছে যাতে সেগুলি সৈন্যদের সঙ্গে একই গতিতে অগ্রসর হতে পারে। অন্যদিকে হস্তী বাহিনীর মাহুতেরা হাতিগুলিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলো। সেগুলিকে ইস্পাতের বর্ম পড়ান হচ্ছিলো এবং তাঁদের দাঁতে বাঁকা খঞ্জর বাঁধা হচ্ছিলো। এই সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরেই তাদের পিঠে হাওদা বসান হবে যার উপর সৈন্যরা অবস্থান নেবে। হেকিমরা তাদের তাবুতে প্রয়োজনীয় মলম এবং ছোট ছোট শিশিতে ব্যাথা উপষমকারী ওপিয়াম ভরে সৈন্যদের জন্য প্রস্তুত রাখছিলো। সেই সঙ্গে মারাত্মক জখমের চিকিৎসার জন্য করাতো এবং ছ্যাকা দেয়ার দণ্ডও গুছাচ্ছিলো।

আকবরের ভালো ঘুম হয়নি। গৌরব ও বিজয়ের বিক্ষিপ্ত কল্পনা এবং দুঃশ্চিন্তা মিলেমিশে তাঁকে কেবলই সতর্ক করেছে বারবার, যেনো তাকে বলেছে- সাবধান! নিজের এবং তোমার পূর্বপুরুষের অমর্যাদা করোনা। শুধু শুধু শুয়ে না থেকে দুঘন্টা আগেই তিনি উঠে পড়েছেন। এখন তিনি পিতার বক্ষবর্ম এবং তলোয়ারে সুসজ্জিত। মাথায় পড়েছেন ঘাড়ের কাছে ধাতব পাত যুক্ত শিয়োস্ত্রাণ (হেলমেট)। তাঁর পাশে রয়েছেন বৈরাম খান এবং চওড়া কাঁধের অধিকারী তারদি বেগ, তারাও অস্ত্রে সজ্জিত এবং শিরোম্রাণ পরিহিত। আকবর অনেক কষ্টে বৈরাম খানকে রাজি করিয়েছেন তারদি বেগকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দিয়ে আরেকবার তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেয়ার জন্য।

দেড়ঘন্টা পর একটি অগ্রবর্তী দলকে অনুসরণ করে আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানকে পাশে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর অবস্থান প্রায় একমাইল চওড়া অগ্রসরমান বাহিনীর মাঝামাঝি স্থানে। তার ঘোড়াটিও যেনো তাদেরই মতো যুদ্ধ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। বৈরাম খান তাদের থেকে অল্প দূরে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন। তিনি আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী আশ্বারোহী বাহিনী এবং অগ্রবর্তী দলটি যেনো কোনোক্রমেই ষাঁড়-টানা গোলন্দাজ বাহিনী এবং হস্তী বাহিনীর কাছ থেকে বেশি দূরে সরে না যায়। আর পায়ে হেঁটে অগ্রসরমান তীরন্দাজ বাহিনীকেও তারা যেনো কাছাকাছি রাখে।

মোঘাচ্ছন্ন আকাশ নিয়ে ভোর হলো, নিচু মেঘগুলি বায়ুতাড়িত হয়ে ছুটে চলেছে। কিন্তু আকবর যখন উপরদিকে তাকালেন তখন মেঘগুলির মাঝে ফাঁক সৃষ্টি হয়ে সূর্য উঁকি দিলো, সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি তাঁর বর্মের উপর পড়ে ঝলসে উঠলো। নিজের ঊর্ধ্বমুখী মুখের উপর তিনি আচমকা উষ্ণতা অনুভব করলেন, তিনি বৈরাম খানকে লক্ষ্য করে বললেন, এটা আমাদের সৌভাগ্যসূচক আরেকটি দৈব সংকেত, তাই না? এই সংবাদটি আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিন। উদিত সূর্য আজ একমাত্র আমার উপরই আলো ছড়াচ্ছে। আর হিমু কালো মেঘ দ্বারা আচ্ছাদিত। জয় আমাদেরই হবে। পরবর্তীতে আরো বিজয় আমরা অর্জন করবো। আমাদের সাম্রাজ্য চন্দ্রগ্রহণের মতো অন্য সব রাজ্যকে আচ্ছাদিত করবে এবং তার চমৎকারিত্বে সকলের চোখ ঝলসে যাবে।

বৈরাম খান আকবরের বক্তব্যকে সমর্থন জানাতে যখন তার দিকে ফিরলেন, সেই মুহূর্তে আকবর তার বাবার তলোয়ারটি কোষমুক্ত করে মাথার উপর ঘুরালেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢুলিদের যুদ্ধ-ঢাকের আওয়াজ জোরাল হলো এবং শিঙ্গার আর্তনাদে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। জয় আমাদেরই হবে, আকবরের এই চিৎকার তার সমান্তরাল সকল যোদ্ধার মুখে উচ্চ স্বরে প্রতিধ্বনিত হলো।

কিন্তু সম্মুখ থেকে এর উত্তর ভেসে এলো, হিমুর যোদ্ধাদের সাহসী চিৎকার। হিমু, হিমু, হিমুপাদীশাহ! রেকাবে (ঘোড়ার পাদানী) ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আকবর দেখলেন তার সৈন্যদলের বাহিত সবুজ পতাকা ছাড়িয়ে প্রায় একমাইল দূরত্বে হিমুর হাতিগুলির বর্ম সূর্যের আলোয় ঝলসে উঠছে। তিনি হিমুর কৌশল বুঝতে পারলেন। হিমু তার যোদ্ধাদের আশেপাশের ছোট ছোট পাহাড় গুলিতে স্থাপন করেছে, বহু বছর আগে আকবরের পিতামহ বাবর একই কৌশলে তাঁর মহান বিজয় অর্জন করেছিলেন। আকবরের মতো হিমুও সম্মুখ আক্রমণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

আকবর বিস্ফোরণ উনুখ আগ্নেয়গিরির মতো উত্তেজনা অনুভব করলেন। তিনি তাঁর উঁচু কালো ঘোড়াটির পেটে লাথি মেরে সম্মুখে অবস্থিত যোদ্ধাদের মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে গেলেন, আদম খান এবং তার ঘাবড়ে যাওয়া দেহরক্ষীরা প্রাণপণে তাঁকে অনুসরণ করলো।

সম্রাট, আমাদের ডান-পার্শ্বস্থ যোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে, এক সেনাকর্তা আধঘন্টা পর আকবরের কাছে এগিয়ে এসে বললো। তার মুখমণ্ডল ধূলা আর ঘামে মাখামাখি হয়ে গেছে এবং তার শিরোস্ত্রাণটি খোয়া গেছে। তার সাদা ঘোড়াটি জোড়ালো শ্বাস ফেলছিলো এবং সেটার পশ্চাদদেশে(পাছা) তলোয়ারের আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। বৈরাম খান ইতোমধ্যে সম্মুখ সেনাদের অতিক্রম করা আকবরের উন্মত্ত গতি প্রতিরোধ করেছেন, এখন তিনি ও আদম খান তার পাশাপাশি আগাচ্ছেন। তারা তিনজন ছোট আকারের একডজন ব্রোঞ্জের কামানের বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করছে। কামানগুলি দাগার প্রস্তুতি চলছে। যেখানে সংঘর্ষ চলছে তার থেকে প্রায় একশ গজ পেছনে রয়েছেন তারা।

কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে আকবরের সম্মুখে বৈরাম খান সেনা কর্তাটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তারদি বেগের ভূমিকা কি আশাব্যঞ্জক?

অবশ্যই জনাব, কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে সে জবাব দিলো। যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে তার পতাকা এখনো সমুন্নত। তারদি বেগ হিমুর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ হাতিগুলির সামনে পড়ে গেছেন। সেগুলি তারদি বেগের যোদ্ধাদের প্রায় পিষ্ট করে ঢুকে গেছে। আমাদের বন্দুকধারীদের ছোঁড়া গুলি হাতিগুলির ইস্পাতের মস্তক-আবরণ ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। হাতিবাহিনীর আক্রমণকে অনুসরণ করে হিমুর পদাতিক সৈন্যরাও আক্রমণ করেছে। তাঁদের অনেকে পুরানো লোদী বংশীয় পতাকা বহন করছে। সর্বশেষ আমি দেখি তারদি বেগ প্রবল প্রতাপে শত্ৰু যোদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে গেছেন। কিন্তু ডান দিকে অবস্থিত আমাদের অশ্বারোহী সেনারা পিছু হটছে, কেউ কেউ তাদের সহযোদ্ধাদের ত্যাগ করে অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছে। যারা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে তাদেরকে ঘিরে ফেলে হত্যা করছে শত্রুরা।

উদ্বিগ্ন আকবর পুনরায় রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ডান-পার্শ্বস্থ সেনাদের দিকে তাকালেন। তার পদাতিক বাহিনী সত্যিই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছে। বৈরাম খান, আমাদের এক্ষুনি কিছু করা উচিত। আমি কি অতিরিক্ত সেনা নিয়ে ওদের সাহায্যে এগিয়ে যাবো?

না। এতে আরো বেশি প্রাণহানি হবে-আপনিও মারা যেতে পারেন কিন্তু তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না। হিমুর সেনাদের আমাদের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে আমরা এখনো অনেক শক্তিশালী। তারপর বাম দিক থেকে আমরা সেনা সমাগম বাড়াতে পারি।

এই কামান গুলির মাঝে আমরা কি যথেষ্ট শক্তিশালী? আকবর প্রশ্ন করলেন।

নিশ্চয়ই সম্রাট। আমি সেনাকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছি তারা যাতে পদাতিক তীরন্দাজদের কামানের বেষ্টনীর মধ্যে জড়ো করে। বৈরাম খান তার পার্শ্ববর্তী এক সেনা কর্তাকে হুকুম করলেন, মালবাহী গাড়িগুলিকে কামানগুলির ফাঁকে ফাঁকে জড়ো করে ফেলো সেগুলিকে আড়াল করার জন্য। অগ্রবর্তী সৈন্যদের আমাদের এখানে পিছিয়ে আসতে বলো এবং বাম দিকে যুদ্ধরত সৈনিকদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত রয়েছে তাদেরও আসতে বলো।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আকবর তখন মরিয়া হয়ে চিন্তা করছেন, তার মাথায় একটি চিন্তা এলো। বৈরাম খান, ডান পাশের যোদ্ধাদের মধ্যে যারা রক্ষা পেয়েছে তাদেরকেও আদেশ করা যায় আমাদের দিকে পালিয়ে আসতে-তারা যখন আতঙ্কিতভাবে পালানোর ভান করবে হিমু তাদেরকে অধিক উৎসাহে অনুসরণ করে আমাদের পাল্টা আক্রমণের আওতায় চলে আসতে পারে।

বৈরাম খান একটু ভেবে সম্মতি জানালেন। আপনি যুদ্ধ-শিক্ষা ভালোই আয়ত্ত করেছেন। হিমুর সেনাদের প্রচণ্ড শক্তিতে আক্রমণ করার জন্য এখনো আমাদের হাতে অব্যবহৃত অশ্বারোহী এবং হস্তীবাহিনী রয়েছে। আদম খান, একডজন সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যাও এবং ডান পাশের সেনাকর্তাদের মধ্যে যাকেই পাও বলে তারা যেনো আতঙ্কের ভান করে আমাদের দিকে পিছিয়ে আসে।

আদম খান একদল অশ্বারোহী নিয়ে ঘোড়া ছোটালো এবং বিশৃঙ্খল যুদ্ধ ক্ষেত্রের মাঝে হারিয়ে গেলো।

দশ মিনিট পরের ঘটনা। আকবর তখনো কামান ঘেরা বৃত্তের মাঝখানে তাঁর কালো ঘোড়াটির পিঠে বসে আছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তাঁর দলের কিছু অশ্বারোহী তাঁর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের শীর্ষে রয়েছে আদম খান। যেনো ভীষণ আতঙ্কিত, সে তার হাতে থাকা সবুজ রঙের মোগল পতাকাটি ছুঁড়ে ফেললো এবং ঘোড়ার ঘাড়ের কাছে উবু হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেটাকে ছোটাল। তাকে অনুসরণকারী অশ্বারোহীরাও তীব্র বেগে এগিয়ে আসছে। এসময় তিনি কয়েকটি বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং দেখলেন কয়েকজন অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো। কিন্তু আদম খানের কিছু হলো না দেখে তিনি আস্বস্ত হলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রের ধূলা এবং বন্দুকের ধোঁয়ার আস্তরণের উপর দিয়ে তিনি হিমুর কয়েকটি যুদ্ধ-হাতির হওদাকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তারা আকবরের আপাতদৃষ্টিতে পলায়নরত যযাদ্ধাদের বিপুল উৎসাহে তাড়া করে আসছে।

প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীকে গোলা ছুঁড়তে বলল, আকবল বৈরাম খানের হুকুম শুনতে পেলেন। বন্দুকধারীরা, শত্রু পক্ষের হাতিগুলির মাহুতদের লক্ষ্য করে গুলি চালাও। আর তীরন্দাজেরা, সকলে একত্রে তীর ছোঁড়ার জন্য আমার হুকুমের অপেক্ষায় থাকো।

শত্রুদের দিকে তাক করা প্রতিটি কামানে অগ্নিসংযোগ করা হলো। পরপর ছয়টি প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেলো, সেই শব্দে আকবর প্রায় কালা হয়ে গেলেন এবং বারুদের ঝাঝালো গন্ধে তার প্রায় দম আটকে এলো, ধোঁয়ার কারণে স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ধোয়া খানিকটা সরে গেলে তিনি দেখলেন, হিমুর পাঁচটি হাতিকে কামানের গোলা আঘাত করেছে। প্রথম হাতিটি করুণভাবে ড় তুলে আর্তনাদ করছে এবং তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। সেটার চতুর্থ পাটি হাঁটুর নিচে রক্তাক্ত একটি খুঁটিতে পরিণত হয়েছে। বাকি তিনটি হাতি মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে আছে। তাঁদের মধ্যে একটি হঠাৎ মৃত্যুযন্ত্রণায় সেটার পিঠে থাকা হাওদার সৈন্যসহ গড়ান দেয়ায় সেনারা সেটার দেহের নিচে পিষ্ট হয়ে গেলো।

পঞ্চম হাতিটির পেটে সৃষ্টি হওয়া গভীর ক্ষত দিয়ে সেটার নীলচে-ধূসর বর্ণের নাড়িভুড়ি প্রায় বেরিয়ে এসেছে। আকবর দেখলেন সেটার হাওদাটি প্রায় মাটি ছুঁয়েছে, একজন সৈন্য মাটিতে পড়ে গেলো, কিন্তু কিছু অক্ষত তীরন্দাজ তখনো সেটার মধ্যে রয়ে গেছে। হাতিটি পালাচ্ছে এবং সৈন্যসহ হাওদাটি সেটার পেছনে মাটিতে ছেচড়ে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হাতিটি আক্রমণ করতে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসতে থাকা অন্য হাতিগুলির সামনে পড়ে গেলো। একটি বিশাল হাতির সঙ্গে আহত হাতিটির প্রচন্ড সংঘর্ষ হলো এবং আহত হাতিটি সেটার দাঁতে আটকানো খঞ্জরের ফলায় বিদ্ধ হলো এবং তারা উভয়েই মাটিতে আছড়ে পড়লো। এগিয়ে আসা আরেকটি হাতি আহত হাতিটির ছেচড়ে নেয়া হওদার উপর হোঁচট খেয়ে ভূপাতিত হলো, ফলে সেটার হাওদায় থাকা সৈন্যরা ছাতু হয়ে গেলো। হিমুর হাতিগুলির আক্রমণের গতি শ্লথ হয়ে এলো, তারা তাদের ভূপাতিত স্বজাতীয়দের এড়িয়ে যেতে সচেষ্ট হলো।

তীর চালাও! যুদ্ধক্ষেত্রের গোলযোগ ছাড়িয়ে বৈরাম খানের আদেশ শোনা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে হিমুর বাহিনীর উপর বৃষ্টির মতো তীর বর্ষিত হতে লাগলো। আকবর দেখলেন হওদার উপর থেকে শত্রুবাহিনীর বহু সৈন্য হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে। একটি হাতি সেটার চোখের ঠিক নিচের অরক্ষিত অংশে তীর বিদ্ধ হয়ে সেটার পাশে থাকা আরেকটি হাতির দিকে হেলে পড়ে সেটার পথরোধ করে দিলো। তখনই দ্বিতীয়বার কামান দাগার ফলে চারদিক অবার ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হয়ে উঠলো এবং বিস্ফোরণের শব্দে আকবর কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ কালা হয়ে গেলেন। তিনি আদেশ দিতে থাকা বৈরাম খানের মুখ নড়তে দেখলেন কিন্তু কিছুই শুনতে পেলেন না। ধোঁয়া সরে গেলে তিনি বুঝতে পালেন বৈরাম খান কি আদেশ দিচ্ছিলেন। তার তীরন্দাজেরা শেষবারের মতো একযোগে তীর নিক্ষেপ করলো এবং আকবরের যুদ্ধহাতি ও আশ্বারোহী সৈন্যরা হিমুর বিশৃঙ্খল সেনাদের দিকে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করতে ছুটে গেলো। তাঁর হাতিগুলির পিঠে থাকা সবুজ পাগড়ি পড়া বন্দুকধারীরা গুলি ছুড়ছে। হিমুর হাতির পিঠে থাকা এক মাহুত গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সে মুচড়ে হামাগুড়ি দিয়ে আগানোর চেষ্টা করলো একবার, তারপর স্থির হয়ে গেলো।

আরেকদিকে আকবর দেখলেন একজন মোগল অশ্বারোহী কেবল একটি বর্শা নিয়ে অসীম সাহসে হিমুর একটি বিশাল যুদ্ধ-হাতিকে আক্রমণ করলো। একহাতে লাগাম ধরে থেকে অন্যহাতে সে বর্শাটি হাতিটির চোয়ালের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিলো। হাতিটির মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো এবং সেটি ঘুরে পেছন দিকে দৌড় দিলো।

আকবর এই মুহূর্তে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উত্তেজনায় ফেটে পড়ছেন এবং আদম খান এর বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে অতিক্রম করে যুদ্ধে নিজের ভূমিকা রাখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। তিনি তার অবস্থান থেকে অল্প দূরে আদম খানের রণনৈপুণ্য দেখতে পাচ্ছিলেন। বৈরাম খান, আমরা কি এখন লড়াইএ প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারি না?

না, আপনি আপনার ধৈর্য বজায় রাখুন। একজন ভালো সেনাপতি অথবা একজন কৌশলী সম্রাটকে বুঝতে হবে কোনো মুহূর্তটি তার আক্রমণ করার জন্য আদর্শ। এই মুহূর্তে পেছনে থেকে আমাদের আক্রমণের ফলাফল বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তলোয়ারের পাশাপাশি উত্তম বুদ্ধি এবং কৌশলও যুদ্ধ জয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেখুন হিমুর বাহিনী কেমন বিভ্রান্ত, তাদের আক্রমণ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

আমরা এই সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং হিমুর বাহিনীকে ধ্বংস করে পারি? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর মন আক্রমণে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া অন্যকোনো পরামর্শ মানতে চাইছে না।

এখন আমাদের বামপার্শ্বের সৈন্যদের সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিতে পারি, তারা যেনো শত্রুদের ঘিরে ফেলতে পারে। যেহেতু তারা এখনো যুদ্ধে পুরোপুরি অংশ নেয়ার সুযোগ পায়নি ফলে তারা অধিক সতেজ এবং উৎসাহী হয়ে আছে। এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলে ওদের সহায়তায় নিশ্চিতভাবেই আমরা বিজয়ী হবো যখন কিছু সময় আগে আমরা পরাজয়বরণ করতে যাচ্ছিলাম। যুদ্ধে এমনটাই ঘটে।

আকবরের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে বৈরাম খান হুকুম দিলেন। নির্দেশ পেয়ে তাঁদের অশ্বারোহী সেনারা হস্তীবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শত্রুদের ঘিরে ফেলতে এগিয়ে গেলো। ইতোমধ্যে হিমুর একদল অশ্বারোহী সেনা পালানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তাঁদের কেউ কেউ থেমে তাঁদের দলের মাটিতে পড়ে থাকা আহত যোদ্ধাদের তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে। আকবর দেখলেন হিমুর প্রায় বিশটি হাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাদলও পালায়ন শুরু করেছে। তাঁদের বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজেরা পেছন থেকে তখনো গুলি এবং তীর ছুড়ছে। কেউ কেউ অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করছে।

সেই সময় প্রায় আধ মাইল দূরে হিমুর সৈন্য দলের প্রায় একহাজার অশ্বারোহী সৈন্যকে কিছু ভূ-লুষ্ঠিত হাতিকে ঘিরে সাহসের সঙ্গে লড়াই করতে দেখা গেলো। হাতিগুলির মৃতদেহকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলো এবং মোগল বাহিনীকে পিছু হটানোর চেষ্টা করছিলো। আকবর অনুভব করলেন এখনো তার বিজয় অর্জিত হয়নি।

বৈরাম খান কিছু বলতে পারার আগেই আকবর তার ঘোড়ার পেটে লাথি মেরে সেই দিকে তীব্র বেগে ধাবিত হলেন। তিনি যখন সেই স্থানের কাছাকাছি পৌঁছালেন তার দেহরক্ষীরাও তাকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত হলো। হিমুর কিছু যোদ্ধা আকবরকে চিনতে পারলো। কমলা পাগড়িধারী এক সেনাকর্তার নেতৃত্বে তারা মৃত হাতিগুলির আড়াল থেকে বের হয়ে আকবরকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো।

আকবর দিক পরিবর্তন না করে তাদের দিকেই ঘোড়া ছোটালেন, তার রক্তে তখন লড়াই এর উন্মাদনা। মোগলদের ছোঁড়া গুলিতে শত্রু পক্ষের কয়েকজন ধরাশায়ী হলো কিন্তু সেনাকর্তাটি অক্ষত অবস্থায় এগিয়ে এলো। এই মুহূর্তে আকবর তার দেহরক্ষীদের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে চলে গেছেন। তিনি তার তলোয়ারটি সম্মুখে প্রসারিত করে সেনাকর্তাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। যোদ্ধাটি হঠাৎ একপাশে সরে গিয়ে আকবরকে লক্ষ্য করে তার তালোয়ার চালালো, আকবর তখন অনেকটা অরক্ষিত। তার তলোয়ারের ফলা আকবরের শিরোস্ত্রাণ (হেলমেট) ছুঁয়ে ঘুরে যাওয়ার সময় সেটায় যুক্ত ময়ূরের পলকটি দ্বিখণ্ডিত করলো। তারা উভয়ে তীক্ষ্ম বাঁক নিয়ে আবার পরস্পরের দিকে ছুটে এলো। এইবার যোদ্ধাটির চালানো তলোয়ার আকবরের বক্ষ-বর্মের উপর আচড় কেটে বেরিয়ে গেলো এবং এই আঘাতে তিনি একপাশে কাত হয়ে গেলেন। তার একটি রেকাব (পাদানী) ছুটে গেলো এবং কোনোক্রমে তিনি ঘোড়ার পিঠ আকড়ে থাকলেন। হিমুর সেনাকর্তাটি আবার আক্রমণ করার জন্য তার ঘোড়াটি ঘুরিয়ে নিলো। তার আঘাত ফলপ্রসূ হচ্ছে এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্রুত লড়াইটার ইতি টানার জন্য তড়িৎ বেগে সে আকবরের দিকে ছুটে এলো এবং তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করার জন্য গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো।

আকবর তার পরিকল্পনা অনুমান করতে পারলেন, তিনি শেষ মুহূর্তে একপাশে সরে গেলেন কিন্তু সেনাকর্তাটির তলোয়ারের অগ্রভাগ তার গলার কণ্ঠমণির (এ্যাডামস এ্যাপেল) ঠিক উপরে আঁচর কেটে ঘুরে গেলো। কিন্তু আকবর সেটা খেয়াল করলেন না। তিনি তাঁর তলোয়ারটি সেনাকর্তাটির ডান বগল বরাবর গভীরে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিলেন, আকবরের গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালানোর সময় শত্রুর ঐস্থানটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছিলো। যোদ্ধাটি তার ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে রইলো, তার বাহুসন্ধি থেকে পাথুরে মাটির উপর কালচে লাল রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিলো। দরদর করে ঘামতে থাকা আকবর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। নিজ প্রাণ রক্ষা করতে পেরে তিনি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করলেন এবং নিজের চারদিকে নজর বোলালেন। দেখলেন তাঁর দেহরক্ষীরা সেনাকর্তাটির অন্য সঙ্গীদের হত্যা করেছে। অল্প দূরে হিমুর কিছু সৈন্য তাঁদের ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, বাকিরা আত্মসমর্পণ করছে।

আকবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং কমলা পাগড়ী পড়া সেনাকর্তাটির দিকে ছুটে গেলেন। সে তখনো বেঁচে ছিলো। তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একহাতে তিনি তার মাথাটি তুললেন। তুমি খুব ভালো লড়েছ আকবর তাকে বললেন।

আমি আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আমি আপনার উপর আমার প্রভু হিমুর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, সেনাকর্তাটি উত্তর দিলো। সে খুব কষ্ট করে কথা বলছে।

হিমুর পক্ষ থেকে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে? তুমি কি বোঝাতে চাইছো?

আহত লোকটি ঘরঘর শব্দ করে শ্বাস নিলো এবং কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু প্রথমে তার মুখ দিয়ে কথা নয়, রক্ত বেরিয়ে এলো। অবশেষে সে বলতে পারল, আমরা আপনার ডান-পার্শ্বস্থ সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করার ঠিক পরপরই আপনার সেনাদের ছোঁড়া একটি তীর আমার প্রভুর চোখে ঢুকে তাকে আহত করে। তিনি এখান থেকে সামান্য দূরে আমার সমমর্যাদার কিছু ব্যক্তিগত রক্ষীর তত্ত্বাবধানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। লোকটির মুখে আবার রক্ত উঠে এলো এবং তার মাথাটি একদিকে নেতিয়ে পড়লো। স্পষ্ট বোঝা গেলো সে মারা গেছে। আকবর তাকে যত্নের সাথে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। ইতোমধ্যে তার রক্ষীরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাঁদের বললেন, এই লোকটির ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করো। যদিও প্রভু নির্বাচনে সে ভুল করেছে, সে একজন উত্তম যোদ্ধা ছিলো।

আকবর বুঝতে পারলেন তিনি বিজয়ী হয়েছেন, তার ধূলিমাখা মুখে চওড়া আকৃতির হাসি ফুটে উঠলো। তিনি তাঁর প্রথম পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। তার ভবিষ্যৎ-মহান সম্রাটের ভবিষ্যৎ-নিশ্চিতভাবেই উজ্জ্বল। তার পরবর্তী অভিযানগুলি হবে সাম্রাজ্য বিস্তারের লড়াই। আকবর বৈরাম খানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন কিন্তু কাছে আসার পর লক্ষ্য করলেন তার চেহারায় বিজয়ের উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত।

আকবর, কেনো আপনি লড়াই এ যোগ দিলেন যখন আমি আপনাকে পেছনে থেকে যুদ্ধে নির্দেশনা প্রদানের পরামর্শ দিলাম? বৈরাম খান কোনো আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন ছাড়াই শুষ্ক কণ্ঠে বললেন।

আকবরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, তিনি তীব্র ক্রোধ অনুভব করলেন। তিনি একজন সম্রাট। যদিও বৈরাম খান তার অভিভাবক এবং প্রধান সেনাপতি, কিন্তু তিনি তার সঙ্গে এভাবে কথা বলার স্পর্ধা কোথায় পেলেন? এভাবে তার বিজয়ের মুহূর্তটিকে মাটি করে দিলেন। এটাতো সম্রাট হিসেবে তার প্রথম যুদ্ধ! তার পিতামহ বাবর তাঁর মতো বয়সেই নিজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপর, তিনি উপলব্ধি করলেন বৈরাম খানের কাছে তিনি কতোটা ঋণী। তিনি তার ক্রোধ সংবরণ করে শান্ত গলায় বললেন, আপনি কি এমন একজন ব্যক্তিকে সম্রাট হিসেবে গ্রহণ করবেন, যে যুদ্ধ ক্ষেত্রের ভয়াবহতার মাঝে টগবগে রক্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে কাপুরুষের মতো শীতলতা অনুভব করবে?

এবার বৈরাম খানের মুখমণ্ডল থেকে কঠোরতা সরে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। না সম্রাট, অবশ্যই না।

ঐ সেনা কর্মকর্তাটি মৃত্যুর আগে আমাকে জানিয়েছে মৃত হাতিগুলির আড়ালে কোথাও আহত হিমু পড়ে আছে। চলুন আমরা অনুসন্ধান করে দেখি।

উন্মুক্ত তলোয়ারধারী দেহরক্ষীদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান নিয়ে আকবর এবং বৈরাম খান মাটিতে পড়ে থাকা মৃত হাতিগুলির দিকে হেঁটে গেলেন। কামানের গোলার আঘাতে যে হাতিগুলির নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছিলো সেগুলি থেকে তখন উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আকবর এবং বৈরাম খান একটি হাতিকে অতিক্রম করার সময় হঠাৎ সেটি যন্ত্রণায় মাথা ঘুরালো এবং ঔড় দিয়ে মাটিতে আঘাত করলো। নিজের অজান্তেই আকবর তলোয়ারের দিকে হাত বাড়ালেন কিন্তু দেখলেন ঘাড়ের উপর বিশাল ক্ষত নিয়ে প্রাণীটি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

হাতিটাকে তার মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রেহাই দাও, তিনি একজন দেহরক্ষীকে আদেশ দিলেন। এবং আহত অন্যান্য হাতিগুলির একই ব্যবস্থা করো। এই আদেশ প্রদানের সময় আকবর লক্ষ্য করলেন সামান্য দূরে বিধ্বস্ত একটি কারুকার্য খচিত হাওদার পাশে একজন তরুণ যোদ্ধা মাটিতে শুয়ে থাকা ছোটখাট আকৃতির একজন ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে আছে। মাটিতে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটির মিনা করা নক্শা শোভিত বর্ম দেখে বোঝা গেলো সে হিমু ছাড়া আর কেউ নয়। তরুণটি একটি রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে তার মুখের বাম পাশটা মুছে দিচ্ছে আর লোকটি তাকে চিৎকার করে বলছে, আমাকে এখানেই মরতে দাও। কিছুদিন পর কোনো মোগল কয়েদখানায় মৃত্যুবরণ করার চেয়ে এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করাই আমার জন্য সম্মানজনক হবে।

তরুণটিকে বন্দী করো, বৈরাম খান আদেশ দিলেন। সাথে সাথে দুজন লম্বা দেহের দেহরক্ষী তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলো এবং দুদিক থেকে তরুণটির বাহু জাপটে ধরে তাকে আহত লোকটার কাছ থেকে সরিয়ে আনলো। এইবার আকবর আহত লোকটিকে পরিষ্কার দেখতে পেলেন। যেখানে তার বাম চোখটি ছিলো সেখানে একটি তীরের অগ্রভাগ বিধে আছে এবং তীরটির বাকি অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তার মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে নিশ্চয়ই অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে, কিন্তু মনে হলো তার যন্ত্রণা উধাও হয়েছে যখন আকবর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি হিমু?

নিশ্চয়ই। আর কে হতে পারে?

তোমার ন্যায়সঙ্গত সম্রাটকে তোমার কি বলার আছে?

আমি বলতে চাই আমার কোনো ন্যায়সঙ্গত সম্রাট নেই এবং আমি তোমাকে ঘৃণা করি মোগল অনুপ্রবেশকারী। হিমু আকবরকে লক্ষ্য করে একপ্রস্থ রক্তাক্ত থুথু ছুঁড়ে দিলো কিন্তু তা আকবরের কাছে পৌঁছালো না।

এখনই তাকে হত্যা করুন, সম্রাট, বৈরাম খান বললেন।

আকবর তার তলোয়ার উঠালেন কিন্তু কোনো কারণে তিনি আহত লোকটাকে আঘাত করতে ইতস্তত করলেন। এটা ঠিক হবে না বৈরাম খান। আমার বাবা আমাকে সর্বদাই বলতেন হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার তুলনায় ক্ষমাই একজন সম্রাটের জন্য বেশি মর্যাদাকর…

একথা শুনে হিমু অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো এবং আকবরের দিকে এগিয়ে এলো। কিন্তু আকবরের দুজন রক্ষী সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে ফেললো। কিন্তু নিজের ক্ষুদ্র খ্যাতি ও মারাত্মক জখম যেনো তাকে হঠাৎ ভীষণ বল প্রদান করলো, হিমু প্রচণ্ডভাবে মোচড় খেয়ে এক মুহূর্তের জন্য রক্ষীদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো। টলমল পায়ে আকবরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে চিৎকার করে বললো, তোমরা আমাদের ভূ-খণ্ডকে কলুষিত কত ছো। তুমি স্বৈরাচারী তৈমুরের বংশধর, তুমি নিশ্চিতভাবে জানো না কে তোমার বাবা। আমি শুনেছি তোমার বাবা তোমার মাকে তার সেনাপতিদের ভোগে ব্যবহার করতে বেশ্যার মতো, যাতে তারা তার প্রতি অনুগত থাকে এবং তোমার মা- উট-মুখো বেশ্যা, সেটা উপভোগও…

হিমু আর কিছু বলতে পারলো না। তলোয়ারের এক কোপে আকবর তার ধড় থেকে মস্তক আলাদা করে দিলেন। ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ থরথর করে। কাঁপছে, তার মুখ হিমুর ছিটকে আসা উষ্ণ রক্তে রঞ্জিত। কয়েক মুহূর্ত তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না, কিন্তু তারপর তিনি তলোয়ার কোষবদ্ধ করে মুখের রক্ত মুছলেন এবং বৈরাম খানের দিকে ফিরলেন। শান্ত গলায় বললেন, আপনার কথাই ঠিক। অযোগ্য ব্যক্তিকে আমাদের ক্ষমা প্রদর্শন করা উচিত নয়। ঐ নোংরা প্রাণীটির দেহটাকে শিবিরে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করুন। আর ওর মাথাটা দিল্লীতে পাঠান, কোনো জনসমাবেশে সেটা ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিন। অন্যান্য প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহীদের জন্য সেটা একটা ভয়াবহ নিদর্শন হয়ে থাকুক।

আকবর বৈরাম খানকে নিয়ে শিবিরে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরলেন, এসময় আদম খান তাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। তার বাম হাতের আঙ্গুলে পট্টি বাঁধা। তুমি খুব ভালো লড়েছো দুধ-ভাই। আমি তোমার রণনৈপুণ্য দেখেছি।

শুনলাম তুমিও রক্তের স্বাদ লাভ করেছো, হিমুর দেহরক্ষী প্রধানকে হত্যা করে। কিন্তু একটি দুঃসংবাদ আছে। তারদি বেগ নিহত হয়েছেন।

কি?…কীভাবে উনি মারা গেলেন?

যখন তুমি আমাকে নির্দেশ দিলে তার সৈন্যদের অতঙ্কে পালানোর অভিনয় করিয়ে তোমার দিকে নিয়ে আসার তখন আমি এবং আমার সঙ্গীরা লড়াই করতে করতে তারদি বেগের অবস্থানে পৌঁছাই। আমরা দূর থেকে দেখতে পাই কয়েক জন ছাড়া তার অধিকাংশ দেহরক্ষীই মাটিতে লুটিয়ে আছে, আহত অথবা নিহত। সে নিজে ঘোড়া হারিয়ে ভূমিতে অবস্থান করছে এবং তাকে ঘিরে থাকা হিমুর যোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাণপণে লড়াই করছে। আমরা যখন তাকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যাই শুনতে পাই শত্রু যোদ্ধারা তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলছে। কিন্তু সে চিৎকার করে বললো, না! আমি একজন মর্যাদাবান মানুষ, আমার সাম্রাজের প্রতি বিশ্বস্ত। আমি দেখলাম শেষ বারের মতো তিনি তার শত্রুদের দিকে ছুটে গেলেন এবং একজন শত্রু একটি বর্শা তার পেটে ঢুকিয়ে দিলো। আরেকজন হিমুর যোদ্ধা তার মাথা টেনে ধরে পশুর মতো তাকে জবাই করলো।

তুমি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছ, তারদি বেগ, আমার ভাই, আমার তুগান। আজ রাতেই যেনো তোমার আত্মা জান্নাত লাভ করে এই কামনা করছি, বৈরাম খান বিড়বিড় করে বললেন। তোমাকে সন্দেহ করার জন্য আমি দুঃখিত।

দীর্ঘ বিরতির পর আকবর বৈরাম খানের সঙ্গে কথা বললেন। তারদি বেগকে শাস্তি বা মৃত্যুদন্ড প্রদান না করাটাই আমাদের জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত ছিলো, তাই না? হিমুকে ক্ষমা প্রদর্শন করা ভুল ছিলো কিন্তু তারদি বেগকে মার্জনা করে আমরা তাকে তার হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারের সুযোগ দিতে পেরেছি। আমার পিতা সঠিক ছিলেন, কি বলেন? ক্ষমা এবং নিষ্ঠুরতা উভয়ই একজন মহান শাসকের জন্য উপযুক্ত।

জ্বী সম্রাট, বৈরাম খান বললেন এবং আকবর দেখলেন তার প্রধান সেনাপতির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

.

০৩. বয়সের পূর্ণতা

লাহোরের দুর্গপ্রাসাদের মার্বেল পাথরের মঞ্চ থেকে আকবর নিচের দিকে তাকালেন। তিনি উঁচু পৃষ্ঠদেশ বিশিষ্ট সোনার সিংহাসনে বসে ছিলেন। বৈরাম খানের পরামর্শে হিমুর কোষাগারে সঞ্চিত স্বর্ণমুদ্রা গলিয়ে সিংহাসনটি নির্মাণ করা হয়েছে। গত ছয়মাস ধরে হিন্দুস্তানের যেখানেই। তিনি অবস্থান করেছেন সেখানেই সিংহাসনটি বয়ে নেয়া হয়েছে। প্রথম যুদ্ধ জয়ের পর প্রজাদের সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করার বুদ্ধিটি তার নিজেরই, কিন্তু বৈরাম খানের পরামর্শে এই মোগল শক্তি প্রদর্শনের উদ্যোগ আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে।

এই সফর আকবরের মনোবাসনা পূরণ করতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। প্রিয় কালো স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটির সোনা মোড়ান জিনে বসে লাগাম ধরে, পিতার ঝলমলে বক্ষ-বর্ম এবং তলোয়ার নিয়ে নিজ সাম্রাজ্য প্রদক্ষিণ করার সময় তাঁর নিজেকে ভীষণ শক্তিশালী এবং গর্বিত মনে হয়েছে। তাঁর পাশে ছিলেন বৈরাম খান এবং পেছন থেকে তাঁদের অনুসরণ করছিলো সেইসব সেনাপতি যারা হিমুর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তাদের মাঝে তাঁর দুধভাই আদম খানও ছিলো। এই দলের পিছনে রণ তূর্য এবং ঢাক বাজিয়ে এগিয়ে আসছিলো তার অশ্বারোহী সৈন্যরা। তাঁদের হাতে ছিলো সবুজ পতাকা এবং ইস্পাতের ফলা যুক্ত উঁচিয়ে ধরা বর্শা। অশ্বারোহী বাহিনীকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসছিলো তীরন্দাজ বাহিনী, বন্দুকধারী সৈন্য এবং গোলন্দাজ বাহিনী। তাঁদের কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে আর বাকিরা পায়ে হেঁটে।

তীরন্দাজ, বন্দুকধারী এবং অশ্বারোহীদের পেছনে এগিয়ে আসছিলো বড় বড় টানা গাড়ি। সেগুলিতে ঠাসা ছিলো হিমুর শিবির থেকে বাজেয়াপ্ত করা মুদ্রা, অলঙ্কারের সিন্দুক এবং রেশমী বস্ত্রের গাঁট- একদল বিশিষ্ট রক্ষী সেগুলির পাহারায় নিযুক্ত ছিলো। তাঁদের থেকে প্রায় পৌনে একমাইল পেছনে ছিলো আকবরের যুদ্ধ-হাতির দল, কারণ সেগুলি সম্মুখে থাকলে তাদের পদাঘাতে সৃষ্ট ধূলিমেঘ সম্রাটের গতিপথ আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। হাতিগুলি এখনো যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম পড়ে আছে, তাঁদের দাঁতে এখনো শোভা পাচ্ছে বাঁকা ফলা যুক্ত খঞ্জর, প্রদর্শনীর জন্য। হিমুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হাতিগুলি নিয়ে আকবরের হাতি সংখ্যা এখন ছয়শোর উপরে দাঁড়িয়েছে। তাদের পিছনে ছিলো কামান বহনকারী ষড়টানা গাড়ি। সর্বশেষে ছিলো তাবু, তৈজসপত্র, খাদ্য এবং জ্বালানী বহনকারী গাড়িবহর-রাজকীয় শিবির স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু তাতে মজুত ছিলো।

সর্বত্রই উৎসুক জনতা তাদের একনজর দেখার জন্য এমন ধাক্কাধাক্কি করছিলো যে রক্ষীরা তাঁদের ঠেকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলো। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও লোকজন ছুটে আসছিলো তাদের জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করার জন্য এবং সম্রাটকে তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করার জন্য। আকবরের ইচ্ছা ছিলো লাহোরে এসে এই মহড়ার সমাপ্তি টানা-অবশেষে তাই সেখানে পৌঁছে তিনি সন্তুষ্ট বোধ করলেন। লাহোর হলো সেই শহর যেখানে দুই বছর পূর্বে ১৫৫৬ সালের এক স্নিগ্ধ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর পিতা হুমায়ূন হিন্দুস্তান পুনরায় জয় করার অভিযানে যাওয়ার সময় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন। আকবর তাঁর সঙ্গেই ছিলেন এবং তখনকার সবকিছু তার স্পষ্ট মনে আছে।

নিজ পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আকবর পুনরায় একই সাজে লাহোরের প্রবেশপথ সাজানোর আদেশ দেন। এই মুহূর্তে উঁচু সিংহাসনে বসে নিচে সারিবদ্ধভাবে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা গোত্রপতি এবং রাজাদের দিকে তাকিয়ে তিনি গভীর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। হিমু তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তারা যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারেনি। প্রতিদিন তাদের প্রেরিত দূতেরা তাঁদের কাছ থেকে বাহারী প্রশংসা বাক্য এবং অপরিমিত উপহার বয়ে নিয়ে এসেছে- শিকারী কুকুর, রত্নহার পরিহিত ঘুঘু পাখি, রংধনু বর্ণিল পালক, পান্নাখচিত ছোরা, হাতির দাঁতে বাধাই করা গাদাবন্দুক, পদ্মরাগমণি খচিত বাতিদান, কাছিমের খোলে তৈরি বাক্সে ভরা সুগন্ধী প্রভৃতি। এমনকি একটি খুব বড় আকারের চুনি পাথরও তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছেন যেটা উপহারদাতার পরিবারের কাছে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ছিলো।

এই সব উপহার তিনি উদার চিত্তে গ্রহণ করেছেন কিন্তু ইতোমধ্যেই তিনি এমনটা বোঝার মতো যথেষ্ট বিচক্ষণতা অর্জন করেছেন যে, উপহার যতো বেশি মূল্যবান উপহার দাতার বিশ্বাসঘাতকতাও ততোই মারাত্মক। বৈরাম খানের সঙ্গে পরামর্শ করে আকবর এই সব আপাতদৃষ্টিতে অনুগত মিত্রদের লাহোরে তার সঙ্গে সাক্ষাত করার আদেশ দেন।

সকলে উঠে দাঁড়ান।

তারা সংখ্যায় প্রায় ষাট জনের মতো হবে, কেউ মসৃণ চকচকে চেহারার, কেউবা হৃষ্টপুষ্ট, রেশম এবং রূপার কারুকাজ করা জোব্বা বা আলখাল্লা পড়ে আছে, সেগুলির রং নীলার নীল থেকে শুরু করে জাফরানী হলুদ পর্যন্ত সকল বর্ণে বর্ণিল-কেউ কেউ পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি, তারা মোটা হাতে বোনা কাপড়ের আলখাল্লা ও পাজামা পড়ে রয়েছে, সকলে উঠে দাঁড়ালো। তাদের হাত করোজোড়বদ্ধ এবং মাথা নিচু।

আমার হুকুম পালন করার জন্য এবং আমার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অল্প সময় আগে আমার পিতা লাহোর অতিক্রম করার সময় আপনারা তাঁকে যে আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন সে ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আপনাদের অনেকের চেহারাও আমি চিনতে পারছি। আকবর তাদের সকলের উপর একবার দৃষ্টি বুলালেন। বৈরাম খান এখানে আকবরের কি করা উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আগেই বুঝিয়েছেন। আকবর জানতেন এই গোত্রপতিদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কমপক্ষে দশজন রয়েছে যারা তাঁর পিতার প্রতি অনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি তাদের মধ্যে দুইজন হিমুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। তারা হয়তো ভাবছে আকবর তাঁদের কর্মকান্ড সম্পর্কে কতোটা জানেন? কাছাকাছি অবস্থিত মুলতান থেকে আগত ঐ বসন্তের দাগ বিশিষ্ট ভুড়িওয়ালা গোত্রপতিটি, যে একটু আগে তাকে একটি বাদামী রঙের চমৎকার স্ট্যালিয়ন ঘোড়া উপহার দিয়েছে এবং এই মুহূর্তে তাঁর পায়ের নিচে থাকা শতরঞ্জির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে, সেকি জানে আকবরের কাছে তার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ রয়েছে? আহমেদ খানের লোকেরা তার একজন দূতকে আটক করে যে হিমুর কাছে তার পাঠানো একটি চিঠি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।

যাদের আনুগত্য প্রশ্নবিদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় এ বিষয়ে লাহোরে আসার পথে আকবর বৈরাম খান এবং তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বহু সময় ধরে আলোচনা করেছেন। কেউ বলেছে তার পিতামহ বাবরের সময় এসব ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমা প্রদর্শন করা হতো না। অপরাধীকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করা হতো অথবা তাদের হাত-পা ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে দুদিক থেকে টেনে দ্বিখণ্ডিত করা হতো। কিন্তু আকবর তারদি বেগের প্রতি তাঁর ক্ষমা প্রদর্শনের ফলাফল ভুলতে পারছিলেন না। এছাড়া তাঁর পিতা হুমায়ূন বলতেন, যে কোনো মানুষই প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে। কিন্তু কেবল একজন মহান ব্যক্তিই ক্ষমাশীল হতে পারে।

আকবর তাঁর পিতার অনেক বিচার কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন-এমনকি তার মা হামিদাও মনে করতেন যে তার পিতা কখনো কখনো অতিমাত্রায় দয়া প্রদর্শন করতেন। তবে আকবরের অনুভূতি বলে তাঁর পিতাই সর্বদা সঠিক ছিলেন। মোগলরা সর্বদাই নির্ভিক যোদ্ধা বলে বিবেচিত হবে এবং প্রয়োজনের সময় রক্ত ঝরাতে একটুও দ্বিধাগ্রস্থ হবে না। কিন্তু হিন্দুস্তানের মানুষের উপর শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে তাদের ভীতি প্রদর্শনের পাশাপাশি তাদের শ্রদ্ধাও অর্জন করতে হবে। অতিরিক্ত হত্যাকান্ড অতিমাত্রায় শত্রুতার জন্ম দেয়। বৈরাম খান গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার যুক্তি শ্রবণ করেছেন এবং শেষে একমতও হয়েছেন কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁকে সতর্কও করেছেন।

মনে রাখবেন, আপনার শত্রুদের চিনে রাখতে ভুল করবেন না এবং গুপ্তচরেরা যা বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আপনি ক্ষমা প্রদর্শনের পরেও যদি তারা বিশ্বাসঘাতকতা অব্যাহত রাখে তাহলে তাদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।

আকবর তাঁর মনকে আবার বর্তমানে ফিরিয়ে আনলেন। উপস্থিত কেউ সরাসরি তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলো না। তিনি অনুভব করলেন এই মুহূর্তে তাদেরকে সামান্য ভীতি প্রদর্শন করা প্রয়োজন। আমি জানি কেনো আপনারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা বুঝতে পেরেছেন যুদ্ধের হাওয়া আমার অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি ভাগ্যের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। আমার পূর্বপুরুষ তৈমুর হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন এবং এই ভূ-খণ্ডের উপর মোগলদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার পিতামহ বাবর এবং পিতা সেই অধিকার দৃঢ়ভাবে বজায় রেখেছিলেন এবং আমিও তার ব্যতিক্রম করবো না। যে কেউ আমার এই অধিকারের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করবে, তাকে ভয়ানক মূল্য দিতে হবে। যেমনটা হিমু দিয়েছে। আকবর একটু থামলেন তারপর দৃঢ়ভাবে পরিষ্কার কণ্ঠে আবার বলা শুরু করলেন, যদিও বহু প্রশংসা বাক্য এবং উপহার আপনাদের কাছ থেকে আমি লাভ করেছি, আমি জানি আপনাদের মধ্যে অনেকেই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। হয়তো এই মুহূর্তেও কারো কারো মনে ষড়যন্ত্র খেলা করছে। আপনারা সকলে আমার দিকে তাকান, যাতে আমি আপনাদের দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি।

ধীরে সকলে মাথা তুলে তাকালো, সকলের মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ, এমনকি যারা কোনো অপরাধ করেনি এবং সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলো তারাও আতঙ্কগ্রস্ত। আকবরের বয়স কম হলেও তিনি তার বাবার সংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করে শিখেছিলেন যে অধিকাংশ মানুষই ক্ষমতা লোভী। তার সম্মুখে বিব্রতভাবে দাঁড়ানো অনেকেই তখন দরদর করে ঘামছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো হিমুর বিদ্রোহের সময় মোগলদের উপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের কথা কল্পনাও করেনি।

আপনাদের মধ্যে অনেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমার রক্ষীরা আমার মুখ থেকে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণের অপেক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে যার সঙ্গে সঙ্গে তারা ন্যায়দণ্ড কার্যকর করবে। তিনি লক্ষ্য করলেন গোত্রপতিদের দৃষ্টি বেদির দুদিকে অবস্থানরত কালো পাগড়িধারী এবং সবুজ জোব্বা পড়া লোকগুলির দিকে নিবদ্ধ হলো। লাহোরে পৌঁছানোর পর থেকেই আমি ভাবছি এবিষয়ে আমার কি করা উচিত… আকবর থামলেন। বসন্তের দাগ বিশিষ্ট ভুড়িওয়ালা লোকটি তখন কাঁপতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি এখনো তরুণ, আমার শাসনকালও তরুণ। এই মুহূর্তে আমি আর রক্ত ঝরাতে চাই না, তাই আমি ক্ষমাশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনাদের অতীতের সকল অপরাধ আমি ভুলে যাবো এবং আশা করবো এখন থেকে আপনারা আমার প্রতি অবিচলভাবে বিশ্বস্ত থাকবেন। যদি তা পারেন তাহলে আমি আপনাদের প্রতি সদয় থাকব। আর যদি না পারেন তাহলে কোনো শক্তিই আপনাদের আর রক্ষা করতে পারবে না।

আকবর উঠে দাঁড়ালেন, উপস্থিত গোত্রপতি এবং নেতারা তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আবারও মাথানত করলো, তিনি তাদের মাঝে স্বস্তির ভাব প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি নিজের উপর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। তিনি স্পষ্টভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তার বক্তব্য শেষ করেছেন এবং তিনি নিজের প্রচণ্ড ক্ষমতাও উপলব্ধি করতে পারছেন। একটি মাত্র ইঙ্গিতে তিনি উপস্থিত যে কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করতে পারতেন। তিনি নিজে যেমন এটা জানতেন, তারাও সেটা জানতো। এই অনুভূতি তাঁকে পুলকিত করছিলো যে, যে কোনো মানুষের জীবনের গতি পরিবর্তনের ক্ষমতা তার রয়েছে। এজন্য তিনি ক্ষমাশীল হওয়ার প্রেরণাও অনুভব করলেন।

সেই দিন রাতে নিজ শয়নকক্ষে ফেরার সময়ও আকবর গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিলেন। তিনি দেখলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা তার শয়ন কক্ষের প্রবেশ দ্বারে তার একজন পরিচারকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট এই মহিলাটিকে আপনার হেরেমের তদারকে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং সে আপনাকে কিছু বলতে চায়, পরিচারকটি বললো।

বৃদ্ধাটির কুঁচকে যাওয়া মুখের দৃষ্টি এই বয়সেরও উজ্জ্বল এবং তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি আপনার পিতারও খেদমত করেছি সম্রাট এবং তাঁর রক্ষিতাদের দেখাশোনা করেছি যখন তিনি তরুণ যুবরাজ ছিলেন, বৃদ্ধাটি মুখ খুললো। তারপর সে একটু বিরতি নিলো, আকবর অনুভব করলেন বৃদ্ধাটি সাগ্রহে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

তুমি আমাকে কি বলতে চাও? রাতের আবহাওয়া আকবরের কাছে উষ্ণ ও ভারী বলে অনুভূত হচ্ছিলো এবং তিনি ক্লান্তি বোধ করছিলেন। কেনো যেনো তিনি পরিস্থিতি ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না এবং বৃদ্ধাটির অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সম্মুখে অস্বস্তি বোধ করছিলেন।

সম্রাট, বর্তমানে আপনার হেরেমে অনেক মেয়ে রয়েছে, আপনার আনুকূল্য লাভের আশায় বিভিন্ন গোত্রপতি এবং রাজারা তাদের পাঠিয়েছে। আপনার দৈহিক গড়ন বহু প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ঈর্ষার বিষয় এবং সকল তরুণী এর প্রশংসায় অজ্ঞান। তাই ভাবলাম আপনার মর্জি হলে কোনো তরুণীকে আপনার কাছে পাঠাই অথবা আপনি নিজেই কাউকে বেছে নিতে পারেন। আকরব সরাসরি বৃদ্ধার দিকে তাকালেন, লজ্জায় তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ইদানিং তার দুধভাই আদম খান প্রায়ই তাকে নিয়ে কৌতুক করতো এই জন্য যে-যদিও আকবরের বয়স সেসময় পনেরোর কাছাকাছি, তখনো তার কৌমার্য বজায় আছে। বহু তরুণী-এমনকি তার মায়ের সেবিকারা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্ট করেছে। প্রতিবার তিনি ভীষণ লজ্জাবোধ করেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি কি কারণে তার এমন অনুভূতি হয়েছে। সেটা কি এই জন্য যে, সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি নারী সংক্রান্ত বিষয়ে অনভিজ্ঞ? এবং সেটা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা? এমনকি একজন রক্ষিতার কাছেও? কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো। তিনি সম্রাট হিসেবে তার প্রথম যুদ্ধ লড়েছেন এবং পূর্ণাঙ্গ পুরুষে পরিণত হচ্ছেন। তার তখন সময় হয়েছে একজন পুরুষের সুখানুভূতির স্বাদ নেয়ার। আদম খানের কৌতুক থেকে সৃষ্ট কৌতূহল এবং নিজস্ব যৌন অনুভূতি তাঁকে উদ্দীপিত করে তুললো। হেরেম তদারককারিনী বৃদ্ধাটির দৃষ্টি তার উপর তখনো নিবদ্ধ এবং তিনি অনুভব করলেন সম্ভবত সেও জানে তিনি ইতোপূর্বে নারীসঙ্গ লাভ করেননি।

আমি একটি মেয়েকে আপনার জন্য পছন্দ করে দেবো, সম্রাট? সে জিজ্ঞেস করলো।

আকবর ইতস্তত করলেন, তার রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলো, এক মুহূর্তের জন্য। ঠিক আছে, ভাবছেন অত্যন্ত মেপে ও অভিজ্ঞভাবে তিনি কথা বলতে পারছেন।

আপনি নিজেই কি হেরেমে আসবেন জাঁহাপনা?

আকবরের মনে হলো তিনি সেখানে যাওয়ার সময় সকলের দৃষ্টি এবং কান তার গতিবিধির উপর নিবদ্ধ হবে। লাহোরের এই রাজপ্রাসাদের হেরেমে রাজপরিবারের সকল মহিলা অবস্থান করছিলো, তাদের মধ্যে তাঁর মা, ফুফু এবং দুধমাও আছেন। নিজের উপর তাদের অনুমান ও কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি যতোই স্নেহসিক্ত হোক না কেনো-সেটা কল্পনা করে আকবর আবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। এটাই তার জন্য উপযুক্ত সময়।

না, আমি হেরেমে যাবো না, মেয়েটিকে আমার শয়ন কক্ষে পাঠিয়ে দাও। দেয়ালে মশাল জ্বালা করিডোর দিয়ে মহিলাটি অন্দর মহলের দিকে চলে গেলো। সে একসময় হয়তো নিজেই খুব সুন্দরী ছিলো, হয়তো তার পিতার রক্ষিতাঁদের একজন। আকবর শুনেছেন মায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহের পূর্বে হুমায়ূন একজন মহা নারী-প্রেমিক ছিলেন এবং তাঁর বহু রক্ষিতা ছিলো।

পরিচারকদের বিদায় করে দিয়ে আকবর একা অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক অজানা উত্তেজনা এবং উৎকণ্ঠার মিশ্রণ তাকে নিষ্পেষণ করতে থাকলো। যতোই সময় গড়াচ্ছে ততোই তিনি অস্বস্তিতে আক্রান্ত হতে থাকলেন। তিনি ঠিক করলেন যে, হেরেমে খবর পাঠাবেন এই বলে যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু যেনো মুহূর্তে তিনি উঁচু দুভাগ বিশিষ্ট দরজার দিকে অগ্রসর হতে নিলেন, সেগুলি হঠাৎ খুলে গেলো এবং তার পরিচারক কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলো। সম্রাট, মেয়েটি এসেছে। হেরেম তত্ত্বাবধানকারিনী বৃদ্ধাটি বলেছে সে রাজা তাল্ক এর সাবেক রক্ষিতা। রাজা তার খুব কদর করতেন এবং তাকে পাঠিয়েছেন এই আশা করে যে আপনাকেও সে পরিতৃপ্ত করতে পারবে। ওর নাম মায়ালা। আমি কি তাকে ভিতরে পাঠাবো?

আকবর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। এক মুহূর্ত পর একটি লম্বা, ছিপছিপে আকৃতি মাথা ঢাকা ঢিলে পোষাকে আবৃত অবস্থায় কক্ষে প্রবেশ করলো। তার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। তার মাথার ঘোমটা এতো নিচু ছিলো যে তার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। এগিয়ে এসে সে কুর্ণিশ করলো। আকবর একটু ইতস্তত করে আলতোভাবে তার হাত ধরে তাকে সোজা করলেন। মেয়েটি তার সম্মুখে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তিনি তার নরম ও দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ পেলেন। তিনি যখন তার ঘোমটাটি পেছনে ঠেলে দিলেন তার লম্বা কালো চুল রেশমের মতো তার মসৃণ কাঁধে ছড়িয়ে পড়লো, আকবর জেসমিন ফুলের গন্ধ পেলেন। সে তখনো নতমুখ ছিলো, আকবর তার চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুললেন।

আবলুস কালো একজোড়া চোখ তার দিকে পাল্টা দৃষ্টি হানলো। তিনি তার লাল প্রলেপ যুক্ত পূর্ণঠোঁট দেখতে পেলেন-সেখানে মৃদু হাসি। কয়েক মুহূর্ত পর আকবরের আড়ষ্ঠতা বুঝতে পেরেই যেনো, সে মোলায়েম ভাবে আকবরের হাতটি নিজের বুকের কাছে পোষাকের ফিতার উপর পৌঁছে দিলো। তিনি ফিতা খুলে দিলেন, মেয়েটির পোষাক মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। সে সম্পূর্ণ নগ্ন, কেবল তার কোমরে একটি সোনার শিকলি জড়িয়ে আছে যার মাঝে ছোট ছোট চুনি পাথর বসান। তার ঠোঁট জোড়া ভীষণ আকর্ষণীয়, তার স্তনযুগল সুডৌল এবং উন্নত, স্তনের বোটাদ্বয় মেহেদি রাঙা।

আকবর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বাক্য হারিয়ে ফেলেছেন, মেয়েটি দুপা পিছিয়ে গেলো। তারপর আকবরের সম্মুখে ধীরে একপাক ঘুরলো। মনে হচ্ছে আপনার আমাকে পছন্দ হয়েছে জাহাপনা, সে ফিসফিস করে বললো। আকবর মাথা নাড়লেন। সে এবার তার দিকে এগিয়ে এলো এবং তিনি অনুভব করলেন সে খুব ধীরে দুষ্টুমিচ্ছলে তার পোষাক গুলি আলগা করে দিচ্ছে, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজেও নগ্ন হয়ে পড়লেন। আকবরের পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর একপলক প্রত্যক্ষ করে সে আবার হাসলো। আসুন সম্রাট আমার মাঝে পরিভ্রমণ করুন। আকবরকে তার পেলব আঙ্গুলে আকড়ে ধরে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। আকবর যখন তার পাশে শায়িত হলেন সে আকবরের হাতটি নিয়ে নিজের উরুসন্ধির মাঝে পৌঁছে দিলো। অনুভব করছেন সম্রাট, প্রেমের আদ্র মন্দির, যেখানে শীঘ্রই আপনি প্রবেশ করবেন। আপনাকে যা করতে হবে তা হলো….।

ছয় ঘন্টা পর, আকবর বিছানার উপর চিৎ হয়ে শায়িত, মেয়েটি তার পাশেই শুয়ে আছে, তাদের উভয়ের শরীরই ঘামে আবৃত। মেয়েটি তখন ঘুমাচ্ছে, তার হাত-পা ছড়িয়ে আছে, বক্ষ উঁচু-নিচু হচ্ছে এবং ঠোঁটজোড়া অর্ধউন্মুক্ত। তিনি তাকে দেখার জন্য মাথা ঘুরালেন, ভাবছেন কতো অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেলো। মেয়েটি তাঁকে সম্পূর্ণ অজানা এক অভিনব ইন্দ্রিয় সুখের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো যেখানে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারা ইতোমধ্যে তিনবার মিলিত হয়েছে। প্রথমে মৃদু অনুমান নির্ভর এবং তারপর আগ্রহী প্রবল ধাক্কা এবং হঠাৎ চরম পরিণতি। একসময় মেয়েটির নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি তার উপরে উঠলেন যা আরো অধিক সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন ও দীর্ঘস্থায়ী বলে সে তাকে বুঝিয়েছিলো। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর মতো মেয়েটিও প্রতিটি মুহূর্ত চরম সংবেদনশীতায় উপলব্ধি করছে এবং আনন্দ পাচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে তার মাঝে আবারো কামনা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। তিনি মেয়েটির নিতম্বে মৃদু ধাক্কা দিলেন। মায়ালা ঘুমাচ্ছন্ন গাঢ় চোখ মেলে তাকালো। মিষ্টি করে হাসল। কেউ আর কখনোও তার পৌরুষ নিয়ে ঠাট্টা বা সন্দেহ পোষণ করবে না, আকবর ভাবলেন-তাঁর তরুণ নিতম্ব তীব্র সুখে আন্দলিত হতে লাগলো যখন তিনি পুনরায় মেয়েটির উপর সওয়ার হলেন।

*

আগ্রার দূর্গ-প্রাচীরের নীচ দিয়ে সর্পিলভাবে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর উপর বাঁকা আকৃতির নতুন চাঁদ যে হালকা আলো ছড়াচ্ছিলো তা প্রতিফলিত হয়ে অস্পষ্ট মায়াবী দ্যুতির জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু আকবর নিরাপত্তা পাঁচিলের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাতের সেই মোহনীয় সৌন্দর্য খেয়াল করলেন না। হিমুকে পরাজিত করার পর বিজয়গৌরবের সঙ্গে তিনি হিন্দুস্তান পরিভ্রমণ করেছেন দুবছর আগে। এই বিশাল বালু-পাথর নির্মিত দূর্গে দশদিন আগে ১৫ই অক্টোবরে তিনি তাঁর সতেরো তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করেছেন। দিল্লীর পরিবর্তে সেখান থেকে উজানে একশ বিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই আগ্রাকে তিনি তার নতুন রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগ্রা তাঁর পিতামহ বাবর এর রাজধানী ছিলো। পিতা হুমায়ূন বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো একে তাঁর রাজধানী বানাতেন। আকবরের মা, ফুফু এবং দুধমা এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁর সকল সেনাপতি এবং উপদেষ্টারাও। একমাত্র বৈরাম খান এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন। তিনি যুক্তি দেখান যেকোনো বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কৌশলগত ভাবে দিল্লীই আদর্শ স্থান। সভাসদগণের সম্মুখে আকবরের সঙ্গে তর্ক এড়ানোর জন্য তিনি পরে আকবরের ব্যক্তিগত কক্ষে এসেছিলেন। কিন্তু আকবর তাঁর পরামর্শ কানে তোলেননি। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বৈরাম খান আকবরের সঙ্গে তাঁর সর্বপ্রথম সত্যিকার বিরোধ থেকে ফ্যাকাশে মুখে ধীর পদক্ষেপে ফিরে যান।

স্মৃতি রোমন্থনের সময় আকবর দ্রুকুটি করলেন। পরবর্তী মাস গুলিতে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যায়নি। তিনি অনুভব করছিলেন বৈরাম খানের আচরণ ক্রমশ বিরক্তিকর এবং অনধিকারচর্চামূলক হয়ে উঠছে। তার মনে হচ্ছিলো তিনি যতোই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন এবং শাসনকার্যে অধিক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইছেন, বৈরাম খান ততোই তাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছেন। বৈরাম খানের প্রতিটি বিরোধীতার সাথে তালমিলিয়ে শাসনকার্যে তাঁর নিজের স্বাধীন হস্তক্ষেপের আকাক্ষা বর্ধিত হচ্ছিলো।

সাম্রাজ্যের দুর্বল হয়ে পড়া সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় বৈরাম খানের ভূমিকা স্মরণ করে এখনো পর্যন্ত তিনি তাঁর এই ভাবনাগুলি কাউকে জানাননি। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করে তাঁর এই গোপন অনুভূতি প্রকাশ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তিনি অনুভব করছিলেন। হয়তো তার মায়ের বিচক্ষণ মন তাঁকে এ ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করতে সক্ষম হবে।

নিরাপত্তা পাঁচিল থেকে চক্রাকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে তিনি একটি ফুলবাগান শোভিত উঠান পেরিয়ে প্রধান হেরেমের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে সম্রাটের মায়ের উপযুক্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং বিলাসবহুল কক্ষে তাঁর মা হামিদা থাকেন। কক্ষটির বারান্দা যমুনা নদীর উপর প্রসারিত যেখানে তিনি নদীর টাটকা বাতাসে শ্বাস নিতে পারেন। হামিদা তাঁর শয়ন কক্ষে বসে তাঁর প্রিয় পারসিক কবিতার বই পাঠ করছিলেন। আকবরকে ঢুকতে দেখে তিনি বইটা রেখে দিলেন। কক্ষটির চারদিকের দেয়ালের ফোঁকরে একাধিক সুগন্ধি-তেলের প্রদীপ এবং মোমবাতি জ্বলছে।

কেমন আছো তুমি? মায়ের শরীরের চন্দনের উষ্ণ সুগন্ধ আকবরকে আবৃত করলো যখন তিনি তাকে আলিঙ্গন করলেন। উত্তর না পেয়ে হামিদা একটু পিছিয়ে গেলেন এবং ভালো করে পুত্রের মুখের দিকে তাকালেন।

কি হয়েছে? তোমাকে ভীষণ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

সত্যিই তাই মা।

বসো, আমাকে সবকথা খুলে বল।

আকবর তাঁর সমস্ত ক্ষোভ এবং নৈরাশ্যের কথা বলতে শুরু করলেন এবং হামিদা একান্তচিত্তে সেসব শুনতে লাগলেন। আকবরের বক্তব্য যখন শেষ হলো তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তার মাথা আবৃত করে থাকা পান্না শোভিত সোনার অলঙ্কারটির নিচে সুন্দর কপালটিতে কুঞ্চন দেখা গেলো। আকবরের পিতার তাকে দেয়া শেষ উপহার। অবশেষে বিষণ্ণ মুখে তিনি কথা বললেন।

যদিও তোমার কিছু অভিযোগ ন্যায়সঙ্গত তবুও তোমার পরিবারের প্রতি বৈরাম খান যে উপকার করেছেন সেসব তুমি ভুলতে পারো কি? হয়তো আমার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এক যুদ্ধে তোমার পিতা তাঁর প্রাণ বাঁচানোর পর তিনি আজীবন মোগলদের পক্ষে লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন। এমনকি যখন আমাদের ভাগ্যাকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিলো তখনো তিনি আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। সেসময় সহজেই তিনি পারস্যে তাঁর শাহ্ এর চাকরিতে ফিরে যেতে পারতেন। তোমার পিতার মৃত্যুর পর তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা এবং সাহসের দ্বারাই তুমি রক্ষা পেয়েছে এবং আমাদের সাম্রাজ্য অক্ষত আছে।

আমি তা জানি কিন্তু…।

হামিদা তাকে থামার জন্য হাত তুলে ইশারা করলেন। এটা স্বাভাবিক, যখন তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাঁর নির্দেশনা তোমার বিরক্তি উৎপাদন করছে এবং এটাও সত্য কখনো কখনো তিনি সহ্যের সীমা অতিক্রম করেন। কিন্তু এমন উপদেষ্টা যিনি প্রয়োজনের সময় সত্যি কথাটি বলতে দ্বিধা করেন না, তাদের তুলনায় উত্তম যারা তোমার প্রতিটি খেয়ালের প্রতি মধুমাখা সমর্থন প্রদান করে। তোমাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। যখন তোমার বয়স আঠারো হবে তখনোই তুমি সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়ার কথা চিন্তা করতে পারো কোনো অভিভাবকের সাহায্য ছাড়া। তার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করো, পর্যবেক্ষণ করো এবং শিখো। হিমুকে পরাজিত করার পর থেকেই কেবল তুমি প্রশাসনিক বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। তার আগে আমি এবং বৈরাম খান বহু চেষ্টা করেও তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি। যেসব সভায় তোমার উপস্থিত থাকা জরুরি ছিলো সেসব উপেক্ষা করে তুমি উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছো অথবা আদম খানের সঙ্গে বাজপাখি উড়িয়েছে। এখনো তুমি সাম্রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে তোমার প্রিয় নারীদের সঙ্গে সময় কাটাও। আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না। হেরেমের আনন্দ সত্যিই খুব মিষ্টি। একজন তরুণের কামনা বাসনা পরিতৃপ্ত করার প্রয়োজন থাকতেই পারে এবং এতো সংখ্যক সুন্দরী নারী যখন তোমার সকল বাসনা পূরণ করার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত-সেটা নিঃসন্দেহে তোমার জন্য তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু নিজেকেই জিজ্ঞাসা করো সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার জন্য তুমি সত্যিই প্রস্তুত কিনা অথবা এটা নিছক তোমার তরুণ হৃদয়ের উদ্ধত আচরণ এবং ধৈর্যের অভাব কিনা। আমি প্রস্তুত…।

আমার বক্তব্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করোনা। শোন। তোমার ধৈর্যহীনতা বলতে আমি এই অস্থিরতাকেই বুঝিয়েছি। তোমার মধ্যে মনোযোগের অভাব রয়েছে-সে কারণে তুমি এখনো পড়তে শিখোনি। তোমার লেখাপড়ার জন্য যতোজন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে সকলে ব্যর্থ হয়েছেন। বৈরাম খান নিজেও চেষ্টা করেছেন কিন্তু তুমি এড়িয়ে গেছে। তোমার পিতা এবং পিতামহ বিদ্বান ছিলেন এবং উত্তম যোদ্ধাও ছিলেন। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারা একজন ভালো শাসকের প্রধান গুণ, এমনকি তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।

এটা আমার প্রতি অন্যায় হচ্ছে। বলে উঠলেন আকবর। ভাবছেন কেনো তাঁর মা বিষয়বস্তু পরিবর্তন করলেন? তিনি বহুবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, যখনই তিনি বই এর পাতার দিকে তাকান, তাতে লেখা অক্ষরগুলি তার চোখের সামনে নড়াচড়া করে এমন তালগোল পাকিয়ে যায় যে তিনি সেগুলির অর্থ বুঝতে পারেন না। কিন্তু তার মা যিনি নিজেও একজন আদর্শ পাঠক- তিনি তার এই সমস্যার বিষয়টি কিছুতেই বুঝতে পারেন না। আকবর উঠে দাঁড়ালেন। হামিদার সঙ্গে তার আলোচনা তার অভিপ্রায় পূরণ করতে পারেনি। তাই দ্রুত এর সমাপ্তি টানাই মঙ্গল। তিনি মায়ের প্রশ্নাতীত সমর্থন আশা করেছিলেন, অথচ তার পরিবর্তে তিনি তাকে পাল্টা আক্রমণ করলেন। তোমার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ, তিনি আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন।

রাগ করোনা আকবর। আমি কেবল তোমার মঙ্গলের জন্যই এসব কথা বললোম। আমি তোমার জন্য গর্বিত এবং তুমি একদিন একজন মহান সম্রাট হবে। সব ধরনের অস্ত্রে তুমি পারদর্শী। তোমার চেয়ে দক্ষ কোনো ঘোড়সওয়ার, কুস্তিগির, তীরন্দাজ অথবা তলোয়ারবাজ নেই। তুমি নির্ভীক এবং উদার মনের অধিকারী। প্রজাদের ভালোবাসা অর্জনের যোগ্যতা তোমার আছে। কিন্তু তোমাকে ধৈর্যের শিক্ষা নিতে হবে এবং তোমার নিকটবর্তী সেই সব মানুষের সঙ্গে সতর্কভাবে বোঝাঁপড়া করতে হবে যারা তোমার ইচ্ছার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে মাথা নত করে না। আর সবকিছুর উপরে তোমাকে স্মরণ রাখতে হবে তোমার জীবনে আগত যাবতীয় মঙ্গলের জন্য তোমার কাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।

আকবর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন যখন তার মা এগিয়ে এসে তার কপাল চুম্বন করলেন। মা তাকে অমনোযোগী এবং অকৃজ্ঞ বলছেন এই বোধ তাঁর মাঝে হতাশা এবং ক্রোধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁকে চিন্তাহীন আরাম-সন্ধানী মনে করেন। তিনি কি সত্যিই এমন একজন তরুণ যে অসময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই? তার মেধা সম্পর্কেও মা কটাক্ষ করলেন। বৈরাম খানও তার প্রতি অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন। সজোরে দরজা খুলে বের হয়ে তিনি দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেলেন। মায়ের কথায় তাঁর অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয় কিন্তু তিনি কিছুতেই নিজের ভাবাবেগ সামলাতে পারছেন না। মা কেনো তাকে বুঝলেন না? তিনি তাকে সম্পূর্ণ অপদস্থ করেছেন।

তিনি তখনো গভীবভাবে চিন্তামগ্ন একটু পরে যখন তাঁর পরিচারক তার কক্ষে প্রবেশ করলো।

কি ব্যাপার?

মাহাম আঙ্গা আপনাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

তাঁর দুধমা আবার তাকে কি বলতে চায়? রুক্ষমুখে আকবর ভাবলেন মাহাম আঙ্গার কক্ষের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়। মা কি তাকে আকবরকে সংযমী এবং ধৈর্যশীল হওয়ার উপদেশ দিতে বলেছেন? যদি তাই হয় তাহলে তিনি বৈঠক সংক্ষিপ্ত করবেন-এই মুহূর্তে তিনি আর কোনো বক্তৃতা শুনতে প্রস্তুত নন। কিন্তু মাহাম আঙ্গা যখন আকবরকে সম্ভাষণ জানালেন তখন তার মুখে আকবরের প্রতি শুধুমাত্র ভালোবাসা এবং দুর্ভাবনার আভাস দেখা গেলো।

আমি লক্ষ করেছি ইদানিং তুমি ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকছে। আমার পরিচারিকা বলেছে কিছুক্ষণ আগে কুদ্ধভাবে তুমি তোমার মায়ের কক্ষ থেকে বের হয়ে এসেছে। আকবর, কি সমস্যা হয়েছে? তার স্বচ্ছ বাদামি চোখ আকবরের চোখের উপর নিবদ্ধ হলো এবং তাঁর কণ্ঠস্বর তেমনই কোমল আর মিষ্টি যেমনটা আকবর শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি সর্বদাই তাঁর কথা শ্রবণ করেছেন, তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। আকবর নতুন উদ্যমে তাঁর ক্ষোভের কাহিনী বর্ণনা করতে শুরু করলেন। মাহাম আঙ্গা গভীর মনোযোগে কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সম্পূর্ণটা শ্রবণ করলেন। আকবর যখন নিরব হলেন মাহাম আঙ্গা প্রশ্ন করলেন, তোমার মা এসব শুনে কি বললেন?

ধৈর্যধারণ করতে।

তিনি ঠিকই বলেছেন। তাড়াহুড়া করে কিছু করা বিচক্ষণতার লক্ষণ নয় এবং তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

তাঁর দুধমা তার মাকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন, আকবর ভাবলেন।

এই জন্যই আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। আমার নিজের মাঝেও দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি তুমি শাসন করার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছে, কিন্তু বৈরাম খান-একজন মহান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেটা স্বীকার করতে চাইছেন না। তিনি তার হাতে থাকা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইছেন না।

আমার পিতার মৃত্যুর পর শুধু নামে ছাড়া আর সবক্ষেত্রেই তিনি সম্রাটের ভূমিকা পালন করছেন… আকবর দ্রুত বলে যাচ্ছেন। এখন তিনি ভাবছেন তার ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বললে তিনি অসন্তুষ্ট হোন-যেমন আগ্রাকে রাজধানী করতে চাইলে তিনি এর বিরোধীতা করেন।

হয়তো সত্যিই তিনি নিজেকে সম্রাট ভাবছেন। আমি শুনেছি তিনি তাঁর অনুগামীদের মধ্য থেকে রাজপদের জন্য তোক নিয়োগ করেন তোমার অনুমতি ছাড়াই। আমি আরও জেনেছি, তার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলো, ইদানিং তিনি একজন সম্রাটের চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। আকবর, একটা বিষয় তোমার জানা দরকার, কিন্তু তোমাকে শপথ করতে হবে যে এই কথা আমি তোমাকে বলেছি সেটা তুমি কাউকে বলবে না।

নিশ্চয়ই বলবো না। বৈরাম খানের সম্রাটের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগের বিষয়টা বুঝিয়ে বলুন।

আমি জেনেছি রাজকীয় কোষাগার থেকে সম্পদ আত্মসাৎ করে তিনি নিজের ভাণ্ডার ভরছেন। বিশেষ করে তিনি একটি মহামূল্যবান ময়ূর আকৃতির রত্নখচিত হীরার হার আত্মসাৎ করেছেন যেটা হিমুর কোষাগারে ছিলো। পানি পথের বিজয়ের পর হিমুর উজির তার প্রভুর মালিকানাধীন মূল্যবান সম্পদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। সেই তালিকায় এই হারটির উল্লেখ ছিলো। কিন্তু তোমার সেনাকর্তাদের কেউ হারটি পায়নি। ফলে হিমুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত সম্পদের পাহারায় নিয়োজিত সৈন্যদের শাস্তি মূলক চাবুকপেটা করা হয় অবহেলার দোষারোপ করে।

আপনি নিশ্চিত যে বৈরাম খানই হারটি নিয়েছেন?

হ্যাঁ। প্রথমে আমি এই গল্প বিশ্বাস করিনি-কারণ রাজপ্রাসাদে কতোরকম ভিত্তিহীন গুজবই না প্রচলিত থাকে, বিশেষ করে হেরেমে গালগল্প ছাড়া আর তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু কিছু সপ্তাহ আগে তোমার দুধভাই আমাকে বলে সে এমন একটা গল্প জানে-যা শুনে আমি মজা পাবো। সে আমাকে একজন রক্ষিতার কথা বলে যে অল্প কিছুদিন আগে বৈরাম খানের হেরেমে ছিলো এবং নিজের চোখে হারটি দেখেছে। অবশ্যই সে সেটা পড়েছে। আমার ধারণা বৈরাম খান বিশেষ মুহূর্তে তাঁর প্রিয় নারীটির নগ্ন দেহে হারটি পড়া দেখতে ভালোবাসেন। আদম খান গল্পটির তাৎপর্য বুঝতে পারেনি- সে মনে করেছে বৈরাম খানের এই গোপন স্বভাবের কথা জানতে পেরে আমি হাসবো। আমিও তাকে কিছু বলিনি এবং সে ধারণা করতে পারেনি যে হারটির বর্ণনা শুনে আমি সেটাকে চিনতে পেরেছি।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না বৈরাম খান এধরনের কাজ করতে পারেন। হয়তো এটাকে তিনি চুরি মনে করছেন না। হয়তো তিনি ভাবছেন এটা তার ন্যায্য অধিকার। তিনি চার বছর ধরে তোমার অভিভাবকত্ব করছেন এবং ক্ষমতা মানুষের উপর বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে আকবর।

কিন্তু তিনি গোপনে হারটি নিলেন কেনো? নির্দোষ রক্ষীদের ভোগান্তিতে ফেললেন কেনো?

খুব ভালো প্রশ্ন করেছো আকবর।

আকবর এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। মাহাম আঙ্গার তাঁকে মিথ্যা কথা বলার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আকবর বৈরাম খানের ব্যাপারে দুর্ভাবনায় ছিলেন বলেই তিনি তাঁকে গল্পটা বললেন। এটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছিলো যে বৈরাম খান ক্ষমতার প্রতি এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত উপরি সুবিধাগুলির প্রতি ক্রমশঃ আসক্ত হয়ে পড়ছিলেন। আকবর মনস্থির করে ফেললেন। মাহাম আঙ্গা, আপনি আমাকে যা বললেন তার ফলে আমি এ ব্যাপারে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি যে বৈরাম খানের প্রভাব থেকে আমার নিজেকে মুক্ত করতে হবে।

সম্রাটের প্রতি এই ধরনের প্রতারণা যদি তোমার পিতামহের আমলে ঘটতো তাহলে দোষী ব্যক্তিকে এর জন্য জীবন দিতে হতো।

কি বললেন? আকবর বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। না, সে ধরনের কোনো চিন্তাই আমি করবো না। আমি আমার সবকিছুর জন্য বৈরাম খানের কাছে ঋণী এবং আমি এখনো আমার জীবন বাজি রেখে তাকে বিশ্বাস করি। যতোই দামি হোক না কেনো, ঐ হীরার হারটির জন্য আমি তার প্রতি মোটেই অসন্তুষ্ট নই। কিন্তু আমাকে তার নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাকে একাই সাম্রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নিতে হবে।

মনে হলো মাহাম আঙ্গা একমুহূর্ত কিছু ভাবলেন। তাহলে তাই হোক…তোমার পিতা যখন তোমার বিশ্বাসঘাতক চাচাঁদের প্রভাব থেকে নিজকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তখন তিনি তাদেরকে মক্কায় তীর্থ যাত্রায় পাঠিয়েছিলেন। বৈরাম খান এখন দিল্লীতে, সেখানে তিনি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন তাই না? তাঁর কাছে একটা চিঠি পাঠাও। বলো তোমার স্বার্থ রক্ষায় তার বিশ্বস্ত অবদানের জন্য তুমি তার প্রতি কতোটা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্যের সেবা করতে গিয়ে নিজে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন দেখে তুমি ভীষণ উদগ্রীব। বলল তোমার ইচ্ছা তিনি যাতে হজ্জ্ব পালন করেন, কারণ এর ফলে তার শরীর ও মন প্রশান্তি লাভ করবে। তাছাড়া তিনি যাতে এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করেন যাকে সুসংহত করার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন। তুমি সম্রাট। তোমার এই আদেশ সে পালন করতে বাধ্য।

আকবর একটি গাঢ় কমলা রঙের রেশমের কোলবালিশে হেলান দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। বৈরাম খানকে বিতাড়িত করার জন্য মাহাম আঙ্গার এই পরামর্শ নিঃসন্দেহে উত্তম। হজ্জ্ব পালন করতে তাঁর প্রায় একবছর লেগে যাবে। স্থল পথে গুজরাট গিয়ে সেখান থেকে জাহাজে চড়ে আরব দেশে পৌঁছাতে হবে। তারপর দীর্ঘ মরুপথ পারি দিয়ে তাকে মক্কায় পৌঁছাতে হবে। যখন তিনি ফিরে আসবেন তততদিনে নিশ্চয়ই আকবর সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারবেন। তখন তিনি তাঁর পরামর্শদাতা সাবেক অভিভাবককে কোনো সমৃদ্ধ রাজ্য নির্বাচন করে সেখানে আরামদায়ক অবসরে পাঠাতে পারবেন।

কিন্তু একই সময়ে আকবরের মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ তাঁকে বললো এই পরিকল্পনা খুবই অসম্মানজনক। তাঁর নিজের দিল্লীতে গিয়ে সামনাসামনি বৈরাম খানকে তাঁর অনুভূতির কথা বলাটাই যুক্তিসঙ্গত। তবে ইতোমধ্যে তিনি এধরনের চেষ্টা অনেকবারই করেছেন। সর্বদাই বৈরাম খান কথা ঘুরিয়ে ফেলেছেন এবং কৌশলে তাঁর ইচ্ছাকে দমন করেছেন। তার মোকাবেলা করার জন্য তিনি যদি মায়ের সমর্থন পেতেন তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটতো। কিন্তু হামিদা তার অনুভূতি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন….অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো…হয়তো এখন সময় হয়েছে মাকে এবং বৈরাম খানকে বোঝানোর, যে তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি নিজেই এখন চিন্তা করতে পারেন এবং কর্ম সম্পাদন করতে পারেন।

মাহাম আঙ্গা, আমার পত্র লেখকের ভূমিকাটি আপনিই পালন করুন এবং এতোক্ষণ যা বললেন তা লিখুন বৈরাম খানকে। সেই সঙ্গে এটাও যুক্ত করবেন যে আমি তাকে সর্বদাই সম্মান করবো…তিনি আমার কাছে একজন পিতার মতোন।

নিশ্চয়ই। আকবর দেখলেন মাহাম আঙ্গা একটি পিতল দিয়ে বাঁধানো নিচু গোলাপ কাঠের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে একটি কালির দোয়াত এবং ময়ূরের পালক রাখা ছিলো। তিনি টেবিলের সামনে হাঁটুমুড়ে বসলেন। একটি কাগজ টেনে নিয়ে মোমের কম্পিত আলোয় তিনি চিঠি লেখা শুরু করলেন যেটিকে আকবর নিজের মুক্তির সনদ বলে মনে করছেন। আকবর অনুভব করলেন সবকথা সঠিকভাবে লেখার ব্যাপারে তিনি তাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

১.২ উপহার হিসেবে প্রাপ্ত রক্ষিতা

০৪. উপহার হিসেবে প্রাপ্ত রক্ষিতা

বৈরাম খানের সাথে কীভাবে এতো অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করলে! হামিদা আকবরের কাঁধ আকড়ে ধরলেন। কে তোমাকে এই বুদ্ধি দিলো? কেউ না। আকবর এবিষয়ে মাহাম আঙ্গার ভূমিকা প্রকাশ করতে চাইলেন না। তিনি তাঁর ইচ্ছাকেই রূপ দিয়েছেন এবং আগে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা তার নিজেরই ছিলো। সেই মুহূর্তে আকবরের মনে হলো হামিদা তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেবেন। তিনি তাকে কখনোই এতো ক্রুদ্ধ হতে দেখেননি।

তিনি দিল্লী থেকে ফিরে আসলে তাঁকে কথাটা বলতে পারতে, তাঁর ফেরার সময়তো প্রায় হয়ে এসেছিলো। তারচেয়েও খারাপ যেটা হয়েছে, কথাটা আমাকে সরাসরি বলার মতো সাহস না পেয়ে তুমি শিকার করতে চলে গেলে এবং আমি সবকিছু জানতে পারলাম স্বয়ং বৈরাম খানের পাঠানো চিঠি থেকে!

মায়ের বক্তেব্যের সত্যতায় আকবরের মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠলো। চিঠিটিতে নিজের সীলমোহর প্রদান করে সেটা তাঁর দূতের হাতে দিল্লীতে রওনা করিয়ে দিয়েই তিনি চার দিনের জন্য বাঘ শিকারে চলে যান। তাঁর এই সিদ্ধান্ত যদি সৎ হতো তাহলে মায়ের মুখোমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ইতস্তত করতেননা অথবা শিকারের নামে বাস্তবতা এড়াতে চাইতেন না। তবুও শিকার থেকে ফিরেই তিনি মাকে বলতে চেয়েছেন…কি বলবেন তা মনে মনে চর্চাও করেছেন। আসলে আগ্রা থেকে দিল্লী যাতায়াত করতে একজন দূতের যতোটা সময় লাগে সে সম্পর্কে তার হিসাব ভুল ছিলো। তাই শিকার থেকে ফিরে দেখেন হামিদা তাঁর কক্ষেই তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

বৈরাম খান কি লিখেছেন?

লিখেছেন কোনো রকম পূর্ব সতর্কবাণী বা ব্যাখ্যা ছাড়াই তুমি তাঁকে হজ্জ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে এবং স্বয়ং আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে না পারার জন্য তিনি অনুতপ্ত। চিঠিটা পাওয়ার সাথে সাথে আমি তাঁকে অনুরোধ করে উত্তর পাঠাই তিনি যেনো রাজধানীতে চলে আসেন। আমার পত্রবাহক তার নাগাল পায় যখন তিনি দিল্লী থেকে কয়েক দিনের পথ দূরে। তিনি কি উত্তর দিয়েছেন শোন। আবেগ কম্পিত কণ্ঠে তিনি পড়তে শুরু করলেন: ফিরে আসতে বলে আপনি আমার প্রতি অসীম উদারতা প্রদর্শন করেছেন সম্রাজ্ঞী, কিন্তু তা সম্ভব নয়। আপনার পুত্র মহামান্য সম্রাট আমাকে হজ্জ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আপনার স্বামীর প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত ছিলাম যিনি যুদ্ধে আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন, আমি বর্তমান সম্রাটের প্রতিও অনুরূপ বিশ্বস্ত থাকতে চাই। আপনার পরিবারের উপর স্রষ্টার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এবং হিন্দুস্তানের বুকে তা আরো মহান হয়ে উঠুক এই কামনা করছি। বৈরাম খান একাধারে তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং উপদেষ্টা ছিলেন আকবর। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে তুমি তাকে অসম্মানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করলে?

আমি সর্বদাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আমি প্রস্তুত-এবং তুমিও তাই। তিনি ফিরে এসে আমার সাফল্য দেখতে পাবেন এবং আমি তাকে আমার সভায় কোনো সম্মানিত পদে নিযুক্ত করবো। আকবর দৃঢ়কণ্ঠে বললেন। কিন্তু বৈরাম খানকে তিনি যেভাবে চাকরিচ্যুত করেছেন সে ব্যাপারে তার মন এখন দ্বিধাবিভক্ত। তিনি কিছুতেই তার এই অনুভূতিকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। তিনি কি ভুল করেছেন? সম্ভবত জীবনে এই প্রথম তিনি তাঁর গ্রহণ করা কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজের মনের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হলেন। এখনো তার মা তাকে তিরস্কার করে চলেছেন।

তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। তুমি কীভাবে ভাবছো যে বৈরাম খানের মতো একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ তোমার হাতে আবারো নাজেহাল হওয়ার ঝুঁকি নেবেন? তিনি আর আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না এবং সেটা তোমার জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়।

তখনো হামিদা কথা বলে যাচ্ছেন, কিন্তু আকবর কল্পনায় মাহাম আঙ্গার মুখ দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত আস্থাভাজন এবং বৈরাম খানকে অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন…মা তার নেয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাকে দুর্বল করে ফেলছেন। মাকে এটা করতে দেয়া ঠিক হচ্ছেনা। বৈরাম খানকে আবার ফিরিয়ে আনলে শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়া তাঁর জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া গুরুজনদের উপদেশের প্রভাবে দ্বিধান্বিত হওয়া বা নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা একজন সম্রাটের জন্য মোটেই সমীচিন নয়।

আকবর অন্যদিকে তাকালেন। হামিদা একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন। তারপর ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, তুমি একটা নির্বোধ।

*

একমাস পরের ঘটনা। আকবর ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে মায়ালার আরো নিকটবর্তী হলেন, তার উষ্ণ নগ্ন শরীর তার দেহের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। তারা দীর্ঘসময় ধরে তেজস্বী রতিকর্ম সম্পাদন করেছেন, এখন তার অচেতন দেহকে সেই তৃপ্তিই যেনো আচ্ছাদিত করে রেখেছে।

জাঁহাপনা …জাহাপনা, উঠুন। কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে আকবর নিদ্রা আচ্ছন্ন চোখ মেলে হেরেম তদারককারিণীর কুঁচকান শুষ্ক মুখ দেখতে পেলেন।

কি হয়েছে? আকবরের হাত সহজাতভাবেই তার ছোরার খোঁজ করলো। সম্রাটকে হেরেমেও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

একজন দূত এসেছে, সে আহমেদ খানের লোক। সে বলছে সে যে সংবাদ এনেছে তা এই মুহূর্তে আপনার জানা প্রয়োজন।

ঠিক আছে। আকবর উঠলেন, তারপর তার শয়নকালীন ঢোলা জামা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চামড়ার চটি জোড়ায় পা গলালেন এবং বৃদ্ধাটিকে অনুসরণ করে হেরেমের দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। বাইরের প্রবেশ দ্বারের ভিতরে রক্ষীদের কাছ থেকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দূতটিকে তিনি চিনতে পারলেন। তাকে নোংরা এবং পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিলো কিন্তু আকবর বিচলিত হলেন তার মুখভাব দেখে।

কি ব্যাপার?

খারাপ খবর জাঁহাপনা। প্রায় চার সপ্তাহ আগে শিকার করতে বের হয়ে বৈরাম খান এবং তাঁর দশজন অনুচর আক্রান্ত হোন-তাঁর শিবির থেকে অল্প দূরে চম্বল নদীর তীরে।

বৈরাম খান কেমন আছেন? আকবরের মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছিলো। তিনি উত্তরটা অনুমান করতে পারছিলেন।

তিনি এবং তার শিকারের সঙ্গীরা সকলেই নিহত হয়েছেন জাঁহাপনা।

তুমি নিশ্চিত?

জ্বী। তাঁর শিবিরের রক্ষীরা নদীর পাশে নলখাগড়ার বোনে আধা লুকানো অবস্থায় তাদের মৃতদেহগুলি আবিষ্কার করে।

আমি নিজে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। কি ঘটেছিলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাকে জানতে হবে।

শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তারা এখন আগ্রার পথে রয়েছে জাহাপনা। তারা যে বার্তাবাহককে তাঁদের সম্মুখে প্রেরণ করেছিলো তার সঙ্গে আমার ধলপুরের অবকাশযাপন কেন্দ্রে দেখা হয়। আমার পরিচয় পেয়ে, যা ঘটেছে সবকিছু সে আমাকে বলে এবং আপনাকে দেয়ার জন্য এই চিঠিটা আমাকে দেয় যেটা বৈরাম খানের একজন কর্মকর্তা লিখেছে। দূতটি তার ধূলাময়লা যুক্ত সবুজ রঙের থলে থেকে একটি ভাজকরা কাগজ বের করলো।

আকবর যখন কাগজটির ভাঁজ খুললেন তখন ভেতরে থাকা রক্তের দাগযুক্ত আরেকটি ভাঁজ করা কাগজ মাটিতে পড়লো। আকবর সেটা তুললেন, তারপর প্রথম চিঠিটি দূতের হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে পড়ে শোনাও। দূতটি পড়া শুরু করলো, মাননীয় সম্রাট, অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি যে বৈরাম খানকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চম্বল নদীর তীরে তার এবং আমাদের অন্যান্য সাথীদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছি। সবাইকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে, অনেকে পিঠে তীরবিদ্ধ হয়েছে। তবে বৈরাম খানের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলা হয়েছে। আমরা মাথাটি খানিক দূরে পানির ধারে পাই। তাদের সকলের কাছ থেকে অলঙ্কার, অর্থ এবং অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছে। আক্রমণকারীরা কোনো দিকে গেছে জানার জন্য আমরা চিহ্ন ও আলামতো খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি। হয়তো তারা নৌকায় করে পালিয়েছে। আমি যে সংবাদ দিলাম তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ আরেকটি কাগজ পাঠাচ্ছি যেটা বৈরাম খানের দেহে পাওয়া গেছে।

আকবর ধীরে দ্বিতীয় চিঠিটা খুললেন। অন্য কারো তাকে এটা পড়ে শোনানোর দরকার ছিলো না। তিনি চিঠিটা চিনতে পেরেছেন-এটা তারই আদেশ যাতে মাহাম আঙ্গা বৈরাম খানের হজ্জ্বে যাওয়ার নির্দেশ লিখেছিলেন।

*

তিন ঘন্টা পর আকবর তার কক্ষের বারান্দা থেকে আগ্রার দূর্গের নিরাপত্তা প্রাচীরকে উষ্ণ করা সূর্যের প্রথম রশ্মি ছড়িয়ে পড়তে দেখলেন। দৃশ্যটি তার মাঝে কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করলো না। বরং তিনি এমনভাবে কাঁপছিলেন যেনো তার চারপাশের জগতটা বরফাবৃত। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বৈরাম খান মৃত। তিনি হত্যাকারীদের উপযুক্ত নৃশংস শাস্তি নিশ্চিত করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি নিজেও কি দোষী নন? তিনি যদি বৈরাম খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করতেন তাহলে হয়তো তিনি এখনো বেঁচে থাকতেন। আর তার মা কি বলবেন?

আকবর বৈরাম খানকে চাকরিচ্যুত করেছেন জেনে তিনি যতোটা রেগে গিয়েছিলেন তেমনটা আর কখনোও দেখা যায়নি। বৈরাম খানকে হত্যা করা হয়েছে এই ঘটনা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হবে? নিচের উঠানে পিতলের ঘন্টা বাজিয়ে রক্ষী তার পালা শেষ হওয়ার সংকেত দিলো। শীঘ্রই সূর্যটা দিগন্তের অনেক উপরে উঠে যাবে। হামিদা অন্য কারো কাছ থেকে খবরটা জানতে পারেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। যেমনটা বৈরাম খানের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার এখনি মায়ের কাছে যাওয়া উচিত। তিনি দ্রুত মুখে পানি ছিটিয়ে পরিচারকদের সাহায্য ছাড়াই পোষাক পড়ে নিলেন, তারপর হামিদার কক্ষের দিকে যাত্রা করলেন। যদিও তখন সবে মাত্র ভোর হয়েছে, হামিদা উঠে পড়েছেন। তার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আকবর বুঝতে পারলেন তিনি দেরি করে ফেলেছেন।

আমাকে ক্ষমা করো মা। তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমার বৈরাম খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত হয়নি। সেজন্য আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আকবর তার মায়ের রাগে ফেটে পড়ার অপেক্ষায় থাকলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চুপ রইলেন, তাঁর দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ।

বৈরাম খান আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো ছিলেন। অবশেষে তিনি বললেন। তার মৃত্যুতে আমার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি খুন হওয়ার জন্য আমি তোমাকে দায়ি করছি না এবং তোমারও উচিত নয় নিজেকে দোষী ভাবা। তুমি তার: প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলে কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষতি হোক সেটা তুমি চাওনি, আমি তা জানি। আকবর… তিনি সরাসরি তাকালেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যতোটা সম্ভব সবকিছু জানার চেষ্টা করো। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করো-তারা সাধারণ ডাকাত, ভাড়াটে খুনী যেনো হোক-তাদের রক্তের বিনিময়েই তাদের অপরাধের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করো।

আমি তা করবো মা, শপথ করে বলছি। আকবর ছেলেমানুষের মতো আশা করলেন হামিদা হয়তো তাকে আলিঙ্গন করবেন, কিন্তু তার হাতগুলি দুপাশে স্থবির হয়ে রইলো। আকবর বুঝতে পারলেন তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। আকবর তখনই তার কক্ষে ফিরলেন না। তিনি মুক্ত বাতাস এবং খোলা পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে দুর্গের নিরাপত্তা পাঁচিলের উপর উঠে গেলেন। সকালের সূর্যের আলো পড়ে যমুনার জল স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামি বর্ণ ধারণ করেছে কিন্তু আকবরের মনের দৃশ্যপটে তখন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ছবি ফুটে উঠেছে- তিনি বৈরাম খান এবং পিতার সঙ্গে বিজয়ীর বেশে দিল্লীতে প্রবেশ করছেন; পিতার সমাধির পাশে বৈরাম খান তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন; ইস্পাতের ধারালো ফলা ঝলসে উঠছে যখন বৈরাম খান তাঁকে চাতুর্যপূর্ণ পারসিক তলোয়ার চালনার কৌশল শিখাচ্ছেন, আকবরকে বার বার চেষ্টা করতে বলছেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারছেন; বৈরাম খানের নীলচে চোখে সন্তুষ্টির দৃষ্টি, যখন তিনি বন্দুক ছোঁড়া অনুশীলন করছেন।

কীভাবে তিনি তাদের মধ্যকার বিশ্বাসের বন্ধন উপেক্ষা করলেন এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন? তিনি মাহাম আঙ্গাকে বৈরাম খানের বিরুদ্ধে তাঁর উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন স্বার্থপরতা, ধৈর্যহীনতা এবং চিন্তাহীনতার বশবর্তী হয়ে কারণ তিনি শাসন ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য বৈরাম খানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিলেন। এটাই বাস্তবতা।

সূর্য তখন পশ্চিম থেকে ভেসে আসা মেঘ ছড়ানো ফ্যাকাশে নীল আকাশের অনেক উপরে উঠে গেছে যখন আকবর তার কক্ষে ফিরলেন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারলেন একটা জিনিস তার ঘরে কেউ রেখে গেছে যেটা তিনি কক্ষ ত্যাগ করার সময় ছিলো না। হাতির দাঁত আর ঝিনুকের সমন্বয়ে নির্মিত তাঁর অলঙ্কার রাখার বাক্সটির উপর একটি কাপড়ের ফালি জাতীয় বস্তু দেখা যাচ্ছে। বিশেষ সাবধানতায় সেটি একটি কাগজ চাপা দেবার হাতির দাঁতে তৈরি ভারবস্তু দিয়ে চাপা দেয়া রয়েছে। তিনি ফালিটি হাতে নিয়ে দেখলেন সেটা একটি ফ্যাকাশে সবুজ রঙের রেশমের কাপড়ের টুকরো যাতে কিছু লেখা রয়েছে। সেটার এখানে ওখানে কয়েকটি নীল কালির ছোপ ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হলো কোনো শিশু এটা করেছে। এবং আকবর সেটা ছুঁড়ে ফেলতে নিয়েও ফেললেন না, কারণ এক অজানা অনুভূতি তাকে বাধা দিলো। তিনি সেটা নিয়ে বারন্দায় গেলেন যেখানে উজ্জ্বল আলো রয়েছে। লেখক কাগজের পরিবর্তে কাপড়ের উপর কেনো লিখলো? সে কি তার হাতের লেখার পরিচিতি গোপন করতে চেয়েছে? যদিও তার দৃষ্টিতে সবই সমান, কারণ তিনি পড়তে পারেন না। যতোই মনোযোগ দিয়ে তিনি লেখাগুলি দেখলেন ততোই কালির আচড় গুলি তাঁর চোখের সামনে নাচতে লাগলো। আকবর তাঁর পরিচারককে ডাকলেন। এটাতে কি লেখা রয়েছে?

সেবকটি এক মুহূর্ত সেটা পড়ল তারপর মুখ তুলে তাকালো, তার চোখে বিস্ময়।

এটা একটা সাবধানবাণী জাহাপনা, এখানে লেখা আছে, যদিও একই স্তন থেকে নির্গত এক নদী দুধের বন্ধনে তোমরা আবদ্ধ, তোমার দুধ-ভাই তোমার বন্ধু নয়। আদম খানকে জিজ্ঞাসা করো বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সে কি জানে।

তুমি নিশ্চিত একথাই লেখা রয়েছে? সেবকটি মাথা নাড়লো। ওটা আমাকে দাও। আকবর রেশমের টুকরাটি তার জোব্বার ভিতরে ঢুকিয়ে রাখলেন। এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলোনা। এটা আদম খানের কোনো শত্রুর লেখা বিদ্বেষসূচক চিরকুট ছাড়া কিছু নয়।

জ্বী জাহাপনা।

আকবর বার্তাটি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। যেই বার্তাটি লিখে থাকুক প্রকাশ্যে আদম খানকে অভিযুক্ত করার সাহস তার নেই। কেনো? সে কি শাস্তির ভয় পাচ্ছে নাকি নিছক গোলযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে? ঢেলে দেয়া বিষকে আবার পাত্রে ফিরিয়ে নেয়া কঠিন কিছু ফোঁটা অজ্ঞাতই থেকে যায়। বিষয় যাই হোক না কেনো, এর প্রভাবে তার মনের শান্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যে তরুণটির সঙ্গে একত্রে বেড়ে উঠেছেন এবং যাকে তিনি নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছেন সেকি সত্যিই তার শত্রু হতে পারে? তাছাড়া আদম খানের মাতাই তাঁকে বৈরাম খানের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি মারাত্মক ভুল করেছেন যার ফলে তাঁর একজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে বিসর্জন দিতে হলো। এখন অধৈর্য হয়ে আরেকটি ভুল করা উচিত হবে না।

*

আকবর দেখ! আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে আমার বাজপাখিটাই শ্রেষ্ঠ, আদম খান চিৎকার করে উঠলো। তাদের মাথার অনেক উপরে পাখিটা ধাওয়া করতে থাকা একটি কবুতরের উপর তীর বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি জিতেছি!

কিছু সময় পরে আদম খানের প্রসারিত হাতের কনুই পর্যন্ত লম্বিত ধাতব আবরণ যুক্ত চামড়ার দস্তানার উপর বাজ পাখিটি উড়ে এসে বসলো। সেটার বাঁকা ঠোঁটে রক্ত লেগে আছে, পায়েও রক্ত। বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আদম খান পাখিটাকে মাটিতে গেঁথে রাখা একটি মাচার সাথে চামড়ার ফিতায় বেঁধে দিয়ে সেটার মাথায় ঠুলি পড়িয়ে দিলো। আমি স্বীকার করছি তোমার বাজপাখি তড়িৎ গতিতে শিকার করতে পারে, আকবর বললেন।

অমি তোমাকে বলেছিলাম তোমার নতুন তত্ত্বাবধানকারীটি তোমার পাখিগুলিকে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না। আমারটা যদি কয়েকদিনের জন্য তার হাতে পড়ে তাহলে সেটার অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। আদম খানের চওড়া চোয়াল বিশিষ্ট বলিষ্ঠ মুখে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি ফুটে রইলো।

তাই হয়তো। আকবর পাল্টা হাসলেন। আদম খান তার মনের কথা বুঝতে পারছে না ভেবে আকবর সন্তুষ্টি বোধ করলেন। তিনি এটাও ভেবে খুশি হলেন যে তাঁর আস্ফালনরত দুধভাই উচ্ছ্বাসে বিভোর থাকায় এ ব্যাপারে বিন্দু মাত্র চিন্তা করছে না যে আকবর হঠাৎ কেনো তার সঙ্গ কামনা করেছেন। হিমুকে পরাজিত করার পর হিন্দুস্তান পরিভ্রমণ শেষ হলে তাদের মধ্যে আর তেমন দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছিলো না। কিন্তু বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আদম খানের জড়িত থাকার বিষয়ে তার মনে সন্দেহ। দেখা দিলে তিনি আদম খানকে তাঁর সঙ্গে শিকার করা এবং বাজপাখি উড়ানোর আমন্ত্রণ জানান। পুরো সময়টা আপাতদৃষ্টিতে খেলার প্রতি মনোযোগী মনে হলেও আকবর সতর্কতার সঙ্গে তার দুধ-ভাইকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু আদম খান এমন কিছু বলেনি বা করেনি যার ফলে আকবরের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। সে তার চিরাচরিত অহঙ্কারী এবং উচ্ছ্বাসপ্রবণ আচরণই প্রদর্শন করছিলো।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আদম খান কার এতো ক্ষতি করেছে যার ফলে সে চিরকুট পাঠিয়ে তাকে আকবরের চোখে বৈরাম খানের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়? যদিও তিনি বিশাল অঙ্কের পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন তবুও গত তিন মাসে বৈরাম খানের হত্যাকারীদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

যতোই দুর্বল বা অস্পষ্ট হোক ষড়যন্ত্রের আভাস আকবর উপেক্ষা করতে পারছিলেন না, কিন্তু তাঁকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। হিন্দুস্তানের বিপুল বিস্তৃত ভূ-খণ্ডের নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত রাজ্য সমূহের মধ্যে তথ্য চলাচলে বহু সময় লেগে যাচ্ছিলো। হয়তো আহমেদ খান এবং তার গুপ্তচরেরা শীঘ্রই কোনো সূত্র পেয়ে যাবে। হত্যাকরীদের খুঁজে বের করে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম নেবেন না বলে মাকে কথা দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। মাকে রেশম কাপড়ে লেখা সতর্কবাণীটির কথা কি জানানো উচিত ছিলো? তিনি ভাবলেন। তিনি কয়েক বার তাঁকে জানাতে চেয়েছেন কিন্তু শেষপর্যন্ত বিরত হয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে এর ফলে তিনি আরো বিপর্যস্ত ও শঙ্কিত হবেন। তাছাড়া স্বভাবিক কারণেই এ বিষয়ে মাহাম আঙ্গাকেও তিনি কিছু বলতে পারেননি…

*

মন্ত্রীসভার বৈঠক ভীষণ দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর মনে হচ্ছিলো। আকবরের মাথা ব্যাথা করছিলো এবং তিনি অবকাশযাপনকেন্দ্র নির্মাণ বা রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাইছিলেন না। কিন্তু যখন তিনি সভাকক্ষ ত্যাগ করে হেরেমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন তাঁর মন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। কয়েকদিন আগে ঝিলাম নদী পরবর্তী পাহাড়ী রাজ্য থেকে তাঁর এক নতুন মিত্র তাঁর হেরেম খানার জন্য কয়েকজন রক্ষিতা পাঠিয়েছে। দলটি তিন রাত আগে আগ্রায় পৌঁছেছে এবং এখন নিজের চোখে মেয়েগুলিকে দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। মায়ালার সঙ্গে তার প্রথম সলজ্জ ও আবেগতাড়িত মিলনের ঘটনাটি যেনো অন্য এক জীবনের কাহিনী। মায়ালা এখনো তাঁর প্রিয় কিন্তু তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে এমন আরো নারীর সন্ধান তিনি পেয়েছেন। হেরেমে পৌঁছে তিনি দরবারের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন। সম্মুখের সতেজ আনন্দ উপভোগের চিন্তায় তার চলার গতি দ্রুত হলো।

বৃদ্ধা হেরেম তদারককারিণী আকবরের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তাঁকে পথ দেখিয়ে সে একটি কক্ষে নিয়ে এলো। কক্ষটি আকর্ষণীয় রেশম কাপড় এবং রঙ্গিন কাঁচের অলঙ্করণে সাজানো। এসব সাজসজ্জাও তাঁর নতুন মিত্র পাঠিয়েছে। মেয়েগুলিকে আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তাঁরা আপনার সেবা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জাঁহাপনা। আপনাকে শুধু কষ্ট করে আপনার পছন্দের মেয়েটিকে বেছে নিতে হবে। বৃদ্ধাটি তালি বাজানোর সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী গুপ্তকুঠরির দরজা খুলে গেলো। বুকে একইরকম আটসাট কাঁচুলি এবং কোমরে মুক্তার ঝালর বাঁধা ঢোলা সালোয়ার পরিহিত তিনজন তরুণী কক্ষে প্রবেশ করলো। তাঁদের কালো চুলে মেহেদীর দীপ্তি, রত্নখচিত ক্লিপ দিয়ে তা মাথার পিছনে বাঁধা। তাঁদের মধ্যে দুজন লম্বা গড়নের এবং আকর্ষণীয় চেহারা বিশিষ্ট। তৃতীয় জন একটু খাট তবে কমনীয় গড়নের অধিকারী, তার চেহারায় রয়েছে নিখুঁত চমৎকারিত্ব। কিন্তু তার সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি কিছু আকবরের দৃষ্টি কাড়লো। সে ভীষণ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং শিকারীর উপস্থিতি টের পাওয়া হরিণের মতো দ্রুত শ্বাস ফেলছিলো। তার অসহায়ত্ব আকবরকে নাড়া দিলো এবং তাঁকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই-একথা মেয়েটিকে বোঝানোর জন্য আকবর তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করলেন।

এই মেয়েটি। আকবর বলে উঠলেন।

ওর নাম শায়জাদা। আপনি উত্তম পছন্দ করেছেন জাঁহাপনা। হেরেম তত্ত্বাবধানকারিণী মন্তব্য করলো।

অন্য সকলে দয়া করে কক্ষ ত্যাগ করো, আকবর বললেন। তত্ত্বাবধানকারিণী যখন অন্য মেয়েগুলিকে নিয়ে চলে গেলো, আকবর দেখলেন শায়জাদার চোখে অশ্রু জ্বল জ্বল করছে। ভয় পেও না। তোমার যদি ইচ্ছা না থাকে, আমাকে বলো। আমি কোনো নারীর উপর বল প্রয়োগ করি না।

আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি না জাহাপনা। মেয়েটি মোগলদের পুরানো ভাষা তুর্কীতে কথা বললো এবং তার উচ্চারণ আকবরের কাছে অপরিচিত লাগলো।

তাহলে কি হয়েছে? আকবর তার কাছে গেলেন, তার মুখের কমনীয় ডিম্বাকৃতি এবং চোখের দুস্পাপ্য নীলচে দ্যুতি তাঁকে একমুহূর্তের জন্য বৈরাম খানের কথা মনে করিয়ে দিলো। তাকে এতো বেদনাদায়ক সুন্দরী দেখাচ্ছিলো যে আকবরের তাকে ছুতে ইচ্ছা করলো।

মেয়েটি একটু ইতস্তত করলো, তারপর কথা বলে উঠলো। আমি যখন জানতে পারি আমাকে আপনার দরবারে পাঠান হবে তখন আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করি এবং খুশি হই। আমার বড় দুই বোনও।

একটু আগে তোমার সঙ্গে যে দুটি মেয়ে ছিলো তারা?

না, তারা আমার বোন নয়।

তাহলে তোমার বোনেরা কোথায়?

মেয়েটির মুখ শক্ত হয়ে এলো। আমাদের দলটি যখন আগ্রা থেকে দুই দিনের পথ দূরে ছিলো, একদল মোগল সৈন্য আমাদের পথ আটকায়। তারা বলে তারা আপনার পাঠানো অগ্রবর্তী রক্ষী, তাঁদের আপনি পাঠিয়েছে আমাদেরু পরিদর্শন করার জন্য এবং সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে তখনই আপনার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি অধৈর্য হয়ে পড়েছেন বলে আমার দুই বোনকে তারা নিয়ে যায়। আমি আগ্রায় পৌঁছে আপনার হেরেম তত্ত্বাবধায়কের কাছে আমার বোনদের খোঁজ করি। কিন্তু তিনি বলেন তিনি অন্য কোনো মেয়ের খোঁজ জানেন না। দয়া করুন জাঁহাপনা, আমি আমার বোনদের জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি…

আমি কোনো অগ্রবর্তী রক্ষী পাঠাইনি। তাঁদের হুকুমকর্তা কে ছিলো?

আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার মনে হয় আমি শুনেছি একজন তাকে আদম খান নামে ডেকেছে।

আকবরের মাথাটি বিস্ময়ের ধাক্কায় পিছিয়ে গেলো। তুমি কি তাদের কারো মুখ দেখেছো?

তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, এবং তাঁদের চোখের নিচের অংশ কাপড়ে ঢাকা ছিলো।

মেয়েটির গাল বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে এবং সে তা মোছার কোনো চেষ্টাই করছে না। কিন্তু ক্রোধ উন্মত্ত আকবর তখন আর মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন না। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। তিনি বললেন। কয়েক মিনিট পরে আকবরকে লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁর দুধমার কক্ষের দিকে যেতে দেখা গেলো। ইশারায় মাহামের সেবিকাদের সরে যেতে বলে তিনি তীব্র ধাক্কায় দরজা খুলে তার কক্ষে প্রবেশ করলেন। মাহাম আঙ্গা একটি খাতায় কিছু লিখছিলেন। আকবরের অগ্নিমূর্তি দেখে তিনি দ্রুত সেটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

কি হয়েছে আকবর?

আপনার ছেলে কোথায়?

ওতো শিকারে গেছে। গত এক সপ্তাহ ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।

তাকে খুঁজে বের করুন-সে যেখানেই থাকুক-এবং তাকে বলবেন সে যেনো এই মুহূর্তে দরবারে ফিরে আসে?

নিশ্চয়ই বলবো। তোমার আদেশ তার জন্য শিরোধার্য। কিন্তু কেনো?

একটি মেয়ে, সে আমার হেরেমে নতুন এসেছে-আমার একজন নতুন মিত্র তাকে সম্মান এবং বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছো-মেয়েটি অভিযোগ করেছে আদম খান তার দুই বোনকে অপহরণ করেছে।

মাহাম আঙ্গার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার পুত্র যদি এই অপরাধ করেও থাকে তিনি সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

অভিযোগটি অত্যন্ত ভয়াবহ, এবার আকবর অপেক্ষাকৃত ভদ্র ভাবে বললো। আমার দুধভাই অভিযোগের জবাব দিক। সে যদি নিরপরাধ হয় তাহলে তার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

নিশ্চয়ই। মাহাম আঙ্গা আকবরের হাত ধরলেন। কিন্তু আকবর, হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। আমার ছেলে কখনোই…. তার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেলো।

আমি আশা করছি আপনার ধারণাই যেনো সঠিক হয়। প্র

কৃতপক্ষে আদম খান এবং তার শিকারের সঙ্গীরা আকবরের আদেশ পেয়ে আগ্রায় ফেরার তিন দিন আগেই আকবর নিখোঁজ মেয়ে দুটির ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানতে পেরেছিলেন। এক উট চালক তার পশুকে যমুনা নদীতে পানি খাওয়াতে নিয়ে গেলে সে মৃতদেহ গুলিকে দেখতে পায়। দেহগুলি নগ্ন ছিলো এবং গলা কাটা ছিলো।

*

কি হয়েছে আকবর? তুমি এতো রাতে আমাকে ডেকেছো কেনো? এখনো আমি আমার সফরের কারণে ক্লান্ত এবং অপরিচ্ছন্ন।

আদম খান তোমার মনে আছে কীভাবে আমরা কাবুলের দুর্গের সম্মুখের তৃণভূমিতে তীর বেগে আমাদের টাটুঘোড়া ছুটাতাম?

নিশ্চয়ই মনে আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তুমি…।

সেটা ছিলো এক চমৎকার সময়। আমরা পরস্পরের কাছ থেকে কদাচিৎ বিচ্ছিন্ন হতাম। আকবর আদম খানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।

সেটাই তো একজন দুধভাইয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত। আদম খান বললো।

সেটা তার চেয়েও বেশি। আমার নিজের কোনো ভাই বোন ছিলো না। তুমি না থাকলে আমি ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তাম। আর যখন আমার চাচারা আমাকে বাবা-মার কাছ থেকে অপহরণ করেছিলো, তখন তোমার মাই আমার একমাত্র রক্ষাকারিণী ছিলেন এবং তুমি নিজেও আমার সঙ্গে বন্দীত্ব বরণ করেছিলে। একই রকম কষ্ট ভোগ করেছে, একই বিপদ মোকাবেলা করেছো…এসব কারণেই আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করতে চাই তা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা আর অল্প বয়সী বালক নই এবং আমি এখন সম্রাট, তাই আমাকে প্রশ্নটা করতেই হবে।

তুমি কি বলতে চাও আকবর? আদম খানের হালকা বাদামি চোখ গুলি তার মায়ের মতোই-আকবরের মুখের উপর নিবদ্ধ হলো এবং সেগুলিতে তখন আর হালকা ভাব বজায় ছিলো না।

তিন দিন আগে এক বৃদ্ধ উট চালক যমুনা নদীতে ভেসে থাকা দুটি তরুণীর লাশ আবিষ্কার করে। সে মৃতদেহগুলিকে একটি লম্বা লাঠি দিয়ে টেনে পড়ে তোলে এবং কর্তৃপক্ষকে অবগত করে। মৃতদেহগুলি তখন বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো।

আকবর জোর করে মৃতদেহগুলি দেখেছিলেন, চামড়া সরে যাওয়া দেহগুলি মাটিতে মাখামাখি হয়েছিলো। ইতোমধ্যে সেগুলিতে মাছি ভন ভন করছিলো। তাঁদের চোখ গুলি খোলা ছিলো যা শায়জাদার চোখের তুলনায় অনেক বেশি ফ্যাকাশে নীল। কাটা গলা রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিলো। আকবরের মনে হচ্ছিলো যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি এতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেননি। আদম খান সামান্য মাথা নেড়ে বললো, শুনে আমার খারাপ লাগছে, কিন্তু এর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?

ধৈর্য ধরো। আমি আমার হেকিমকে দেহ দুটি পরীক্ষা করতে বলি। সে আমাকে বলে গলা গুলি দক্ষভাবে গভীর করে কাটা হয়েছে–সম্ভবত ধারালো ছোরার সাহায্যে এবং তারা মারা গেছে দুই-তিন দিনের বেশি হয়নি। হেকিম আরো বলেছে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। আদম খান, তুমি কি জানো এই তরুণী গুলি কারা ছিলো?

আমি কীভাবে জানবো?

আকবর তার দুধভাই এর রুষ্ট চেহারা পর্যবেক্ষণ করলেন। তুমি নিশ্চিত যে তুমি জানো না?

অবশ্যই। ওদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তুমি কি আমাকে দায়ি করছো?

না। আমি কেবল জানতে চেয়েছি ওদের তুমি চিনতে কি না।

কিন্তু কেনো? কেউ হয়তো ষড়যন্ত্র করে আমাকে এর সঙ্গে জড়িয়েছে।

মৃত মেয়ে গুলির বোন শায়জাদা বলেছে আগ্রায় আসার পথে তাদের কাফেলাকে একদল মোগল সৈন্য থামায়। তারা তার বোনদের তুলে নিয়ে যায়। শায়জাদা শুনেছে তাদের একজন তাদের হুকুমকর্তাকে আদম খান নামে ডেকেছে।

এটা মিথ্যা কথা! কেউ হয়তো তাকে ঘুষ দিয়েছে আমাকে লাঞ্ছিত করার জন্য।

তাহলে তুমি কি আমার কাছে শপথ করছো যে তুমি বা তোমার লোকেরা ওদের অপহরণ বা খুনের সঙ্গে জড়িত নয়?

আমি তোমার দুধভাই হিসেবে শপথ করে বলছি। আদম খানের শক্ত হাত আকবরের হাত আঁকড়ে ধরলো। আমি কখনোই আমাদের মাঝের বন্ধনকে অবমাননা করিনি।

আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।

শায়জাদা নামের মেয়েটি এখন কোথায়?

এখানে আমার হেরেমে। আমি তাকে তার বাড়িতে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলাম কিন্তু সে যেতে চায়নি। আমার ফুফু তার ঘটনা শুনে তার প্রতি সদয় হোন এবং নিজের কাছে রাখার প্রস্তাব করেন।

আদম খান কিছু বললো না কিন্তু আকবর লক্ষ্য করলেন তার বুক দ্রুত উঠানামা করছে। তোমার ওকে দোষী ভাবা ঠিক হবে না আদম খান। যখন সে তোমার নাম বলেছে তখন সে জানতো না তুমি কে এবং তার শোনায় ভুলও হতে পারে। এছাড়া তখন সে প্রচণ্ড ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলো। তবে আমি নিশ্চিত তাকে কেউ জোরপূর্বক বা ঘুষ দিয়ে অভিযোগের কথা বলায়নি। এখন এসো আমরা কোনো ভালো বিষয় নিয়ে কথা বলি। আমি একটি শংকর স্ট্যালিয়ন ঘোড়া দেখেছি যেটার ব্যাপারে তোমার মতামত প্রয়োজন…

সাধারণ বিষয়ের অবতাড়না করতে পেরে আকবর যেনো স্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর দুধ-ভাইকে প্রশ্ন করে তিনি বিব্রত বোধ করছেন, কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। আদম খান যেমন ক্ষুব্ধ ভাবে মরিয়া হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে সেটাও আকবরের জন্য স্বস্তিকর ছিলো। তবে আকবর অনুভব করছিলেন তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। আদম খানকে তার নির্দোষ হওয়া না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করার মাধ্যমে তাদের বাল্যকালের অন্তরঙ্গতার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম করার উপায়ও ছিলো না কারণ তিনি এখন সম্রাট।

.

০৫. দুধ এবং রক্ত

মে মাসের এক আর্দ্র দুপুর। আকবর শুয়ে আছেন মায়ালার আকর্ষণীয় কোমল পেটের উপর মাথা রেখে। তাঁর মাথার উপর ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে তৈরি টানা পাখা বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। এই মাত্র তারা অভিনব এক রতিকর্মের পালা উপভোগ করেছেন, যাতে শরীরের সব শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়েছে। আকবরের চিন্তায় তখন কেবল আনন্দময় উপাদান থাকার কথা। কিন্তু পক্ষান্তরে অস্বাভাবিক কিছু দৃশ্য তাঁর মনের প্রেক্ষাপট দখল করে রেখেছিলো। তিনি কষ্টে প্রকম্পিত হচ্ছিলেন এবং মৃদু আর্তনাদও করছিলেন। কপালে একটি হাতের স্পর্শ পেয়ে তিনি চমকে উঠে বসলেন। সেটা ছিলো মায়ালার হাত, সে আকবরকে আরাম দিতে চেষ্টা করছিলো। সেই দুই তরুণীর মৃতদেহ আবিষ্কারের পর থেকেই তাঁর এমন অনুভূতি হচ্ছে, যদিও তারপর আট সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন তিনি আরো বেশি চিন্তাক্লিষ্ট ও সতর্ক হয়ে উঠছিলেন এক অজানা হুমকির আশংঙ্কায়। এই বোধ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছিলো কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না আক্রমণটা কোনো দিক থেকে আসবে।

আকবর নিজের গরম হয়ে ওঠা কপালের উপর থেকে কালো চুলগুলি পেছনে ঠেলে দিলেন। তিনি তাঁর পিঠের উপর মায়ালার নগ্ন স্তনযুগলের স্পর্শ পেলেন, সে পেছন থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে। সে আকবরের কানে ফিসফিস করে কিছু বলছিলো-একটি নতুন রতিভঙ্গিমার কথা-সিংহের মিলন রীতি- হয়তো তাকে সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারবে। কিন্তু প্রস্তাবটি প্রলুব্ধকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি মায়ালার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তাঁর মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে সভা আহ্বান করেছেন আজই বিকালে এবং সভার আগে তাঁকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে।

বৈরাম খান নির্বাসিত এবং নিহত হওয়ার পর তাঁর প্রধানসেনাপতির পদটি শূন্য রয়েছে। এখন সময় হয়েছে এই পদে নতুন একজনকে নিয়োগ দেয়ার এবং একই সঙ্গে আরো কয়েকটি নিয়োগ দিতে হবে যাতে তিনি তাঁর গতানুগতিক কিছু দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন। তাছাড়া উজিরের পদটিও পূরণ করা দরকার-যদিও বৈরাম খান থাকতে এ পদে কাউকে নিয়োজিত করার প্রয়োজন ছিলো না। তবে উজির নিয়ে খুব একটা তাড়াহুড়া নেই। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ার আগে সভাসদদের সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একজন দুর্নীতিপরায়ণ এবং আত্মকেন্দ্রীক উজিরের চেয়ে কোনো উজির না থাকাই উত্তম। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে তার সেনাবাহিনীর জন্য একজন প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক (চিফ কোয়ার্টার মাস্টার) প্রয়োজন। বর্তমানে যে এই পদে কর্মরত সে অত্যন্ত অল্পবয়সে আকবরের পিতামহ বাবরের অধীনে চাকরিতে যোগ দেয়। সে এখন এতো বুড়ো হয়েছে যে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে সর্বদা আকবরকে বাবর বলে সম্বোধন করে এবং এই মর্মে বিড়বিড় করে যে তিনি অনেক বদলে গেছেন। প্রধান অশ্ব বিশেষজ্ঞের (মাস্টার অফ হর্স) পদটিও তিনি পুনঃপ্রচলন করতে চান, এর দায়িত্ব হবে বিপুল সংখ্যক ঘোড়া ক্রয় করা, তার পরিকল্পনাধীন বিজয় অভিযান পরিচালনার জন্য।

আকবর জানতেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে যোগ্য লোক নির্বাচন করতে হবে। ঐ সকল পদের অধিকারীদের বিশেষ সুবিধা এবং মর্যাদা রয়েছে, আরো রয়েছে নানা প্রকার প্রলোভন। তিনি যাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার ব্যাপারে আকবরের মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো না। হুমায়ূনের শাসন কালের প্রথম থেকেই মোগল পরিবারের প্রতি আহমেদ খান অকুণ্ঠ বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছে। এছাড়াও তিনি একজন বিচক্ষণ যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। তিনি ভয়াবহ সকল লড়াই এবং নির্বাসনের বছর গুলিতে আকবরের পিতার অধীনে কাজ করেছেন এবং হিন্দুস্তান পুনঃবিজয়ের সময় কাবুল থেকে হুমায়ূনের সঙ্গে এক কাতারে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন। পরবর্তীতে আকবরের পক্ষে হিমুর বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। আহমেদ খানকে প্রধান সেনাপতির পদে নির্বাচন করা হলে আকবরের অন্যান্য সেনাপতিরা হয়তো হতাশ হবে কিন্তু কেউই তার যোগ্যতাকে অস্বীকার করবে না।

কিন্তু প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক এর পদটি জটিলতা পূর্ণ। যে এ পদের জন্য নির্বাচিত হবে তার দায়িত্ব হবে মোগল সৈন্যদের জন্য সব ধরনের রসদ সরবরাহ করা-ঘোড়াকে খাওয়ানোর জন্য শস্য থেকে শুরু করে গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য বারুদ এবং কামানের গোলা পর্যন্ত সবকিছু। সে সময় গৃহস্থালীর রসদ সরবরাহ করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো হুমায়ূনের এক সময়কার পরিচারক জওহর। তার বহু বছরের বিশ্বস্ত সেবার প্রতিদান হিসেবে তাকে এ পদে নিয়োগ করা হয়। মা হামিদার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক এর পদটির জন্য আতগা খানের নাম সুপারিশ করেন। আতগা খান একজন সেনাকর্তা এবং সে কাবুলের লোক। হুমায়ূন যখন হিন্দুস্তানে হামিদাকে ডেকে পাঠান তখন আতগা খান তাঁকে নিরাপত্তা প্রদান করে দিল্লীতে নিয়ে আসে। সে একজন বুদ্ধিমান এবং মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং তার দুই কন্যা আমার সেবায় নিয়োজিত। সে দীর্ঘ যাত্রায় আমার নিরাপত্তা রক্ষা করেছে এবং আমি নিশ্চিত সে প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক হিসেবে তোমার স্বার্থ রক্ষা করবে, হামিদা পরামর্শ দেন। আকবর নিজেও আগা খানের ব্যাপারে গোপনে খোঁজখবর করে সিদ্ধান্ত নেন যে মায়ের উপদেশই তিনি বাস্তবায়ন করবেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন এতে হামিদা তার উপর সন্তুষ্ট হবেন।

অশ্ব বিশেষজ্ঞের পদটির ব্যাপারে আকবর কারো সঙ্গে আলোচনা করেননি এবং সিদ্ধান্ত নেন এ পদটিতে তিনি তার দুধভাই আদম খানকে নিয়োগ করবেন। আদম খান ঘোড়ার মান নির্ণয় সম্পর্কে অত্যন্ত বিজ্ঞ ছিলো। তাছাড়া এর ফলে সকলে বুঝতে পারবে তার উপর এখনো আকবর আস্থাশীল যদিও তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তখন সভায় অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আকবর তাঁর পরিচারকের কাছে জানতে পেরেছিলেন দুই তরুণী হত্যার বিষয়ে আদম খানকে তার জিজ্ঞাসাবাদের কথা কারো কাছে গোপন ছিলো না।

দুই ঘন্টা পর প্রথাগত শিঙ্গা ধ্বনির সাথে আকবর তাঁর দরবার কক্ষে প্রবেশ করলেন সিংহাসনের বাম পাশের উঁচু খিলান বিশিষ্ট দরজা দিয়ে-হিমুর ধনভাণ্ডারের সোনা গলিয়ে বানান সেই সিংহাসটিকে এখন এর স্থায়ী অবস্থানে বসানো হয়েছে। ইতোমধ্যে আকবর প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি সিংহাসনটিকে অলংকৃত করবেন ভবিষ্যতে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করা রত্ন দিয়ে। এটা হবে তার গৌরব এবং সাফল্যের প্রতীক। সিংহাসনের সবুজ মখমলের গদিতে আসন গ্রহণ করে আকবর ইশারায় তার সভাসদ এবং উপদেষ্টাদের বসতে বললেন।

বক্তব্য শুরু করার আগে আকবর তার পেছনে দেয়ালের উপরের দিকে অবস্থিত ছোট ছোট ফোকর বিশিষ্ট জাফরির দিকে তাকালেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন ঐ আড়ালের পেছনে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত আসনে হামিদা বসে আছেন তাঁর কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার জন্য। আমি আপনাদের আজকের সভায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি এই জন্য যে আমি কিছু পদে নিয়োগ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আহমেদ খান, আতগা খান এবং তুমি আমার দুধভাই আদম খান, এগিয়ে এসো। তারা তিনজন আকবরে সম্মুখে হাজির হওয়ার পর তিনি আবার শুরু করলেন, আহমেদ খান, প্রথমে আমার পিতার অধীনে এবং পরে আমার অধীনে আপনার বহু বছরের বিশ্বস্ত সেবা মূল্যায়ন করে আমি আপনাকে আমার প্রধান সেনাপতির পদে নিয়োগ দান করছি।

আহমেদ খানের লম্বা দাড়ি গুচ্ছের উপরে প্রসারিত হাসিতে তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। জাহাপনা আমি আমার সম্পূর্ণ সামর্থ প্রয়োগ করে অপনার সেবা করবো।

আমি জানি আপনি তা করবেন। শত্রুদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সম্রাটের চোখ এবং কান হিসেবে ভূমিকা পালন করার দায়িত্বও আপনার উপর অর্পিত হলো। আকবরের কাছ থেকে সংকেত পেয়ে তাঁর অনুচরেরা আহমেদ খানকে সম্মানের প্রতীক স্বরূপ সোনার কারুকার্যখচিত সবুজ রঙের রেশমি আলখাল্লা এবং রত্নখচিত খাপ বিশিষ্ট তলোয়ার প্রদান করতে এগিয়ে এলো।

এবার আকবর তার দুধভাই এর দিকে ফিরলেন। আদম খান, বাল্যকাল থেকেই তুমি আমার বন্ধু এবং সঙ্গী। আমি তোমাকে এমন একটি পদ প্রদান করতে চাই যার জন্য প্রয়োজনীয় মেধায় তুমি সমৃদ্ধ। আশা করি তুমি এ পদটির দায়িত্ব সম্মানের সঙ্গে পালন করবে। আদম খানের বাদামি চোখ গুলি জ্বল জ্বল করছিলো।

এগিয়ে এসো আমার দুধভাই, আমার নতুন অশ্ববিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি তোমাকে আলিঙ্গন করতে চাই। আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং যে মার্বেল পাথরের মঞ্চে তার সিংহাসন স্থাপিত ছিলো সেখান থেকে নেমে এলেন। তিনি আদম খানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেলেন। কিন্তু আকবর যদি তার কৃতজ্ঞতা আশা করে থাকেন তাহলে তাকে হতাশ হতে হলো।

আপনার অশ্ববিশেষজ্ঞ? কথাটি বলে আদম খান এক সেকেণ্ডের জন্য দেয়ালের উপরের জাফরির দিকে তাকালো। তার মা মাহাম আঙ্গা কি সেখানে রয়েছে?

হ্যাঁ আমার অশ্ববিশেষজ্ঞ, আকবর পুনরাবৃত্তি করলেন, তাঁর মুখের হাসি ধীরে অপসারিত হলো যখন তিনি আদম খানের বিভ্রান্ত ক্রুদ্ধ মুখভাব প্রত্যক্ষ করলেন। তাঁর দুধভাই কি আশা করছিলো?

আকবর তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন বুঝতে পেরে হঠাৎ আদম খান নিজেকে সংযত করলো। ধন্যবাদ জাঁহাপনা, সে আস্তে করে বললো। তার পদের জন্য নির্ধারিত ঐতিহ্যবাহী উপহার রত্নখচিত ঘোড়ার লাগাম এবং জিন গ্রহণ করলো আকবরের পরিচারকদের কাছ থেকে এবং তারপর মাথা নত রেখে পিছিয়ে গেলো।

আকবর তার সিংহাসনে ফিরে গেলেন। এবার তুমি আতগা খান। তোমার বহু সেবা মূল্যায়ন করে আমি তোমাকে আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষকের পদে নিযুক্ত করলাম।

আতগা খান, একজন লম্বা গড়নের চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট লোক। একটি চিকন সাদা ক্ষত তার বাম চোখের ভ্রু থেকে অক্ষিকোটরের নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত। বহু বছর আগে খাইবার গিরিপথের পাসাই উপজাতীয়দের এক গুপ্ত আক্রমণের স্মৃতিচিহ্ন। সে তার ডান হাতটি বুকের উপর রেখে ঝুঁকে কুর্ণিশ করলো। ধন্যবাদ জাঁহাপনা। আপনি আমাকে মহা সম্মানে ভূষিত করলেন। তাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কারুকাজ করা জোব্বা উপহার দেয়া হলো এবং জেড পাথরের সিলমোহর যা তার পরিচয়সূচক চিহ্ন বহন করে। এবারে আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং দরবার ত্যাগ করলেন।

সম্মুখে এবং পিছনে দেহরক্ষী নিয়ে আকবর যখন প্রায় তাঁর বিশ্রাম কক্ষের সামনে পৌঁছলেন ঠিক তখনই আদম খান পাশের একটি করিডোর দিয়ে তড়িৎ বেগে এগিয়ে এলো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে- সন্দেহ নেই আকবরের নাগাল পাওয়ার জন্য সে দরবার থেকে দৌড়ে এসেছে। সে কে চিনতে পারলেও আকবরের দেহরক্ষীরা আড়াআড়িভাবে বর্শা ধরে তার পথরোধ করলো। তাদের উপর হুকুম ছিলো অনুমতি ছাড়া কেউ যেনো সম্রাটের নিকটবর্তী হতে না পারে এবং একাজে অবহেলার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঠিক আছে, আসতে দাও। আকবর রক্ষীদের আদেশ দিলে তারা বর্শা সরিয়ে পথ করে দিলো। কি ব্যাপার আদম খান?

দরবারের সকলের সামনে তুমি আমাকে অপমান করেছে। সে এতো ক্রুদ্ধ ছিলো যে আকবর লক্ষ করলেন তার কপালের শিরা দপ দপ করে লাফাচ্ছে।

তোমাকে অপমান করেছি? সতর্ক হয়ে কথা বলো আদম খান, আকবর নিচু স্বরে বললেন কিন্তু আদম খান নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই করলো না।

তুমি সকলের সামনে আমাকে বোকা প্রতিপন্ন করেছো! এবার মনে হলো তার গলার স্বর আরো একধাপ উপরে উঠেছে। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কুস্তির কৌশলে মাটিতে শুইয়ে ফেলার তীব্র আকাক্ষা অনুভব করলেন আকবর, যেমনটা বাল্যকালে বহুবার করেছেন। আদম খান সর্বদাই রাগী ছিলো কিন্তু আকবর ছিলেন তার চেয়ে দক্ষ লড়িয়ে। কিন্তু অতীতে সেটা ছিলো শিশুসুলভ বৈরিতা এবং তাদের মাঝে তখন অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিলো। হয়তো এখন তাঁদের মধ্যে আর সেই বন্ধুত্ব বজায় নেই…তার উদ্ধত আচরণ প্রত্যক্ষ করে আকবর ভাবলেন তিনি সত্যিকার অর্থে তাকে কতোটা চিনেন। এতোদিন তাঁর মনে হয়েছে তিনি তাকে ভালোই চিনেন কিন্তু হঠাৎ আজ মনে হচ্ছে তিনি এ ব্যাপারে আর নিশ্চিত নন।

দেহরক্ষী এবং অনুচরদের কৌতূহলী দৃষ্টির ব্যাপারে সচেতন হয়ে তিনি খপ করে আদম খানের হাত ধরলেন। তুমি যাই আমাকে বলতে চাও তার জন্য উপযুক্ত জায়গা এটা নয়। আমার সঙ্গে এসো। তাকে নিয়ে আকবর নিজ কক্ষে প্রবেশ করলেন। যখন তাদের পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, তিনি আদম খানের হাত ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখী হলেন। তুমি কি নিজের অবস্থান ভুলে গেছো, তিনি বললেন ঠাণ্ডা গলায়।

না, বরং তুমিই ভুলে গেছো আমি কে।

একটু আগে আমি তোমাকে আমার প্রধান অশ্ববিশেষজ্ঞের পদে নির্বাচন করেছি। ভেবেছিলাম এই পদ লাভ করে তুমি আনন্দিত হবে।

তোমার আস্তাবল রক্ষক হয়ে আমি আনন্দিত হবো? এর থেকে উন্নত পদ আমার জন্য প্রযোজ্য। হিমুর সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে আমার প্রতি তোমার আচরণ বদলে গেছে…আমরা এমন সাথী ছিলাম যারা সবকিছু এক সাথে করতো কিন্তু তুমি আমাকে বর্জন করেছো। তুমি আর এখন আমাকে জিজ্ঞাসা করো না আমি কি ভাবি। আমার শিরায়ও রাজকীয় মোগল রক্ত প্রবাহিত। আমার পিতা তোমার বাবার ফুফাতভাই ছিলেন…

কোনো পদটি তুমি আশা করেছিলে? আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষকের পদটি, নাকি প্রধান সেনাপতির? আমি ঐ পদ গুলির জন্য এমন ব্যক্তি নির্বাচন করেছি যারা তাদের যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছে…এমন ব্যক্তি যাদের আমি বিশ্বাস করতে পারি।

তোমার দুধভাই ছাড়া আর কাকে তুমি বেশি বিশ্বাস করতে পারো?

সেটা দুধ-ভাই এর উপরই নির্ভর করে। কথাগুলি আকবরের মুখ থেকে সহজাতভাবে বের হয়ে এলো, তিনি নিজেকে দমাতে পারলেন না।

তুমি কি বোঝাতে চাইছো? যখন আকবর, আদম খানের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না সে বলে চললো, তুমি সেই অপহৃত রক্ষিতাঁদের ঘটনা বোঝাতে চাইছো তাই না? আমি তোমাকে বলেছি, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। সেটা একটা ষড়যন্ত্র ছিলো। কেউ ঐ ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো।

কেনো কেউ এমনটা করবে? তুমি এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নও যাকে কেউ ধ্বংস করতে চাইবে…বৈরাম খান আমাকে সতর্ক করেছিলেন যে তুমি নিজের সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করো।

হ্যাঁ সেই মহান বৈরাম খান। তার উপদেশ যদি এতোই মূল্যবান ছিলো তোমার কাছে তাহলে তুমি তাকে নির্বাসিত করেছিলে কেনো?

আমদ খানের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি সহ্য করা আকবরের পক্ষে আর সম্ভব হলো না। নিজের অজান্তেই তিনি তার মুখের উপর প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন এবং আদম খান মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়লো। আকবর দুপা পিছিয়ে এসে প্রস্তুত হয়ে রইলেন যদি তার দুধভাই আচমকা তাঁকে আক্রমণ করে এই কথা ভেবে। কিন্তু আদম খান তেমন কিছু করলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে রইলো এবং তার রক্তাক্ত নাক দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আকবরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

আকবর এখন নিজের ক্রোধ দমন করার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। তাঁর উচিত আদম খানের মাঝে বোধের উদয় ঘটানো। ভাই আমার, আমরা একত্রে অনেক কিছু করেছি এবং আমি তোমার মায়ের ঋণ কোনোদিন ভুলবো না। আমি ভেবেছিলাম অশ্ব বিশেষজ্ঞের পদটি তোমার পছন্দ হবে। আমি আমার সাম্রাজ্যের বৃদ্ধি ঘটাতে চাই। কিন্তু তা করতে হলে প্রথমে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে আমার সেনাবাহিনী এর জন্য প্রস্তুত। দ্রুতগতি সর্বদাই মোগলদের একটি প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমাদের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের জন্য, আমাদের অশ্বারোহী তিরন্দাজ এবং বন্দুকধারীদের জন্য শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী ঘোড়া প্রয়োজন। হিমুর বিরুদ্ধে অভিযানের পর আমাদের আস্তাবলে নতুন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তোমাকে সমগ্র সাম্রাজ্য ভ্রমণ করতে হবে প্রয়োজন হলে তুমি তুরস্ক, পারস্য আরব দেশে যাবে। কিন্তু তোমাকে জোগাড় করে আনতে হবে শ্রেষ্ঠ জানোয়ার গুলি।

আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে যা ঘটলো এসো আমরা তা ভুলে যাই। আকবর তার হালকা সবুজ জোব্বায় নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত উপেক্ষা করে তাকে আলিঙ্গন করলেন। কিন্তু আদম খানের আড়ষ্ট শরীর সাড়া দিলো না। আকবর তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলেন। আমি এ বিষয়ে মাহাম আঙ্গাকে কিছু বলবো না, এই ঘটনা শুনলে তিনি ভীষণ আহত হবেন।

কিন্তু আমি কি বলবো; এই, যে ঘোড়া থেকে পড়ে আমার নাক ভেঙ্গে গেছে? আদম খানের কন্ঠে এখনো বিদ্রুপের ছোঁয়া।

তোমার যা খুশি বলতে পারো। ঐখানে গামলায় পানি আছে, নিজেকে পরিষ্কার করে নাও। আকবর ভাবলেন এভাবে রাগে উন্মত্ত হওয়া তার ঠিক হয়নি। এটা কিছুতেই তাঁর উপযুক্ত আচরণ নয়। তিনি এখন আদম খানের সম্রাট, তার সমপর্যায়ের নন। তাদের উভয়েরই সেটা মনে রাখা উচিত ছিলো।

*

এবারের বর্ষাকালটা বেশ আগেই শুরু হয়েছে, ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে ঝরা অবিরাম বৃষ্টি নিচের সিক্ত জগতটাকে যেনো গ্রাস করতে চাইছে। যমুনার ফেঁপে ওঠা জল দুই সপ্তাহ আগে এর পাড় প্লাবিত করেছে এবং তখন থেকে অস্বাস্থ্যকর জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ এবং পলি দুর্গের ভিতর প্রবেশ করছে-ভেড়া এবং কুকুর গুলিকে ডুবিয়ে দিয়েছে, এমনকি একটি উটকেও। হিন্দুস্তানের এই ঋতুটিকে আকবর সবচেয়ে অপছন্দ করতেন, যখন সবকিছুই আর্দ্রতার আক্রমণে পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়। গ্রীষ্মের উষ্ণতার বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ গুলিতে এবং হেরেমে কয়েক ঘন্টার জন্য কর্পূরকাঠ জ্বালা হয়। যাতে মহামূল্য রেশম, কিংখাব এবং মখমল গুলি রক্ষা পায় পোকামাকড় এবং আর্দ্রতার আক্রমণ থেকে।

মায়ালার কক্ষে লাল চাদর ঢাকা বিছানায় নগ্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা আকবর কর্পূরের হালকা ঝাঁঝালো ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন। আকবরের শরীরকে আরাম দেয়ার জন্য এবং তার মাথা ব্যাথা দূর করার জন্য মায়ালা তাঁর পিঠ এবং কাঁধ মালিশ করে দিচ্ছিল খুবানির(বাদাম) তেল দিয়ে। প্রতি বর্ষাতেই তিনি এই মাথাব্যাথা দ্বারা আক্রান্ত হোন এবং সারাদিন অস্বস্তি বোধ করেন। তাঁর পিতারও একই সমস্যা ছিলো। তরুণ অবস্থায় এর জন্য হুমায়ুনের প্রিয় উপসম ছিলো মদের মধ্যে ওপিয়াম গুলে পান করা। কিন্তু তার এই আসক্তির জন্য তিনি প্রায় সিংহাসন হারাতে বসেছিলেন এবং আকবরকে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

মালিশ করে দেয়ার জন্য হুমায়ুনের যদি মায়ালার মতো কেউ থাকতো তাহলে হয়তো তাঁর ওপিয়ামের প্রয়োজন হতো না, আকবর ভাবলেন। তিনি তৃপ্তিতে ঘড় ঘড় শব্দ করছেন যখন মায়ালার নরম হাতের তালুগুলি দক্ষ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার পেশী সমূহের উপর কর্মরত। মায়ালা তাঁকে হাসাতেও পারে। একজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক হিসেবে সে আকবরের দরবারের সকল সদস্যের অনুকরণ করতে পারতো। গৃহস্থালীর রসদ সংরক্ষক জওহর থেকে শুরু করে প্রধান সেনাপতি আহমেদ খান পর্যন্ত সকলেই তার নির্দয় অনুকরণের শিকার হতেন।

আকবর তাঁর বলিষ্ঠ শরীরটি টানটান করলেন-যা দৃঢ় এবং প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য, তার অধীনস্থ যে কোনো সৈন্যের মতোই। মায়ালার দক্ষ মালিশের প্রভাবে তাঁর মাথাব্যাথা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। উপুর অবস্থায় হাতের উল্টোপিঠে মাথা রেখে তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঠিক তখনই উচ্চ স্বরে গোলযোগের শব্দ তার কানে এলো। ভীষণ ক্রুদ্ধ চিৎকার ছাপিয়ে একটি পরিচিত শব্দ ভেসে এলো ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষের শব্দ। কেউ লড়াই করছে। তিনি নারীকন্ঠের চিৎকার শুনলেন এবং তার পাশাপাশি তাঁর বহু পরিচিত গভীর একটি কণ্ঠস্বর চিৎকার করছে, আকবর! কাপুরুষ, সাহস থাকলে বের হয়ে এসে আমার মুখোমুখি হও…

আকবরের নিদ্রাচ্ছন্নতা উবে গেলো, তিনি ঝট করে উঠে পড়লেন, একটু থামলেন শুধু তাঁর ছোরাটা নেয়ার জন্য, তারপর নিজের নগ্নতার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মায়ালার কক্ষ থেকে খোলা উঠানে বেরিয়ে এলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে, সাধারণত উঠানের মধ্যবর্তী ঝর্নাটাকে ঘিরে মেয়েরা নাচে, গান গায় অথবা নিজেদের মধ্যে গল্প করে। কিন্তু এখন সেখানে একটি মাত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে-আদম খান, হেরেমের প্রবেশ দ্বারের একটু ভিতরে। তার একহাতে একটি তলোয়ার এবং আরেক হাতে একটি ছোরা। তার পেছনে দুজন হেরেমরক্ষীর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। আকবর আদম খানের দিকে তাকালেন।

তুমি এসব কি করেছো?

আদম খান দুলছিলো। আমি ঐ কুকুর আতগা খানকে খুন করেছি… তার কথা বলার ভঙ্গি প্রত্যক্ষ করে আকবর নিশ্চিত হলেন যা তিনি অনুমান করেছেন। সে আকণ্ঠ কড়া মদ পান করেছে।

কেনো? আতগা খান তো তোমার শত্রু ছিলেন না!

সে নিজেকে অনেক উৎকৃষ্ট ভাবতো, জমকালো জোব্বাটা পড়ে বসে ছিলো যেটা আমার হওয়ার কথা এবং অনুলেখক কে তার করণীয় বিষয়ের বর্ণনা দিচ্ছিলো। নির্বোধটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসেও ছিলো যখন আমি তার কক্ষে প্রবেশ করি। কিন্তু যখন আমি তলোয়ার দিয়ে তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করি তখন সে আর হাসছিলো না…বরং তার চেহারায় ছিলো বিস্ময়, যেমনটা এখন তোমার মুখে দেখা যাচ্ছে।

আকবর শুনলেন মায়ালা তার পেছনে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো কিন্তু তিনি আদম খানের উপর থেকে দৃষ্টি সরালেন না। মাথা না ঘুরিয়েই বললেন, ঘরের ভিতর যাও মায়ালা এবং আমি বের হতে না বলা পর্যন্ত সেখানেই থাকো। একটা কুকুর পাগল হয়ে গেছে।

প্রায় তখনই রক্ষীদের চিৎকার এবং হেরেমের দিকে ছুটে আসতে থাকা পদশব্দ শোনা গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদম খানের আচমকা আক্রমণে

পালিয়ে যাওয়া রক্ষীরা দলে ভারী হয়ে এসে হেরেমের সামনের উঠান ঘিরে ফেললো। তাঁদের মধ্যে বয়স্ক ভৃত্য রফিকও ছিলো। সে এক সময় হুমায়ূনের সেবা করেছে এবং এখন হামিদার সেবায় নিয়োজিত। বৃদ্ধটি কোথা থেকে যেনো জোগাড় করা একটি তলোয়ার ঝাঁকাচ্ছিলো। আকবর ইশারা করলেই রক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আদম খানকে কেটে ফেলবে। কিন্তু আকবর অন্য কারো হাতে তার দুধভাই এর মৃত্যু ঘটাতে চাইলেন না, যে এই পবিত্র বন্ধন ছিন্ন করেছে। এটা তাঁর দায়িত্ব। তিনি হাত নেড়ে রক্ষীদের পিছিয়ে যেতে বললেন।

একটু আগে তুমি আমাকে লড়াই এর আহ্বান জানাচ্ছিলে। তাই হবে। রফিক তোমার তলোয়ারটা আমাকে দাও। টলমল করতে থাকা আদম খানের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে রফিক পড়ো পড়ো অবস্থায় আকবরের কাছে গেলো। আকবর তার হাত থেকে তলোয়ারটা নিয়ে শূন্যে কয়েকবার চালালেন। সেটার পুরানো ধাচের বাটটি আকবরের কাছে কিছুটা অসুবিধা জনক লাগলো কিন্তু সেটার বাঁকা ফলাটি ছিলো ধারাল এবং চকচকে। তিনি রফিকের বাড়িয়ে দেয়া একটুকরো কাপড় তার নগ্ন কোমরে পেচিয়ে নিলেন।

ঠিক আছে আদম খান, আমাদের উভয়ের কাছেই এখন একটি করে ছোরা এবং তলোয়ার রয়েছে, কাজেই আমরা সমান সমান। দেখা যাক কি হয়, কি বলো?

আকবর আদম খানের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে স্থির হলেন, তাঁকে আক্রমণ করার জন্য আদম খানকে প্রলুব্ধ করতে চাইলেন। কিন্তু যদিও মদের প্রভাবে তার বুদ্ধি কিছুটা ভোতা হয়ে গিয়েছিলো, তখনো তার নিজের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ছিলো। সে শুরুতেই ভুল করতে প্রলুব্ধ হলো না। যখন তারা পরস্পর চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো তখন আকবর তার শিকারের কথা মনে করলেন- যখন তিনি অনুমান করার চেষ্টা করেন শিকারের প্রাণীটির পরবর্তী আচরণ কি হবে। হঠাৎ সুযোগ বুঝে তিনি ঝট করে সামনে বাড়লেন এবং আদম খানের তলোয়ারের বাটের উপরের অংশে যুক্ত আচ্ছাদনটিতে তলোয়ারের অগ্রভাগ ঢুকিয়ে দ্রুত মোচড় দিলেন। আদম খানের তলোয়ার তার হাত থেকে ছুটে পাথুরে মেঝেতে পড়লো। এটা একটা পারসিক কৌশল যা বৈরাম খান অনেক আগে আকবরকে শিখিয়েছিলেন। আকবর তাকে আঘাত করার আগেই আদম খান ঝট করে পিছিয়ে গেলো। তারপর তার ছোরাটা তুলে আকবরের দিকে সজোরে নিক্ষেপ করলো। আকবর একপাশে সরে গেলেন কিন্তু যথেষ্ট দ্রুততার সাথে নয়। ছোরাটির অগ্রভাগ তার চোখের নিচে আচড় কেটে গেলো। আকবরের গলা বেয়ে তখন উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তিনি তাঁর ছোরা এবং তলোয়ার ছুঁড়ে ফেললেন, তারপর তিনটি লম্বা লাফে এগিয়ে গিয়ে আদম খানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারা উভয়ে যখন মেঝের উপর আছড়ে পড়লো আকবর অনুভব করলেন আদম খান তার দেহের নিচ থেকে মুচড়ে বের হওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে। আকবর তার চুলের মুঠি ধরে সজোরে মাথাটা পাথুরে মেঝেতে ঠুকে দিলেন-একবার, দুবার, তিনবার। তারপর উঠে বসে ডান মুষ্ঠি দিয়ে তার মুখের উপর এতো জোরে ঘুষি বসালেন যে তার চোয়ালের হাড়ে মট করে শব্দ হলো। কুত্তার বাচ্চা…. তিনি চিৎকার করে উঠলেন।

আদম খানের মুখ দিয়ে তখন একটি যন্ত্রণাকাতর ঘড় ঘড় শব্দ বেরিয়ে আসছিলো। আকবর তাকে সজোরে টেনে দাঁড় করালেন, তাঁর মুখে তখন নিজের রক্তের লোনা স্বাদ। আদম খানের আহত অসাড় দেহটাকে উপর্যুপরি আঘাতের মাধ্যমে নিষ্প্রাণ করে ফেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করলেন আকবর। কিন্তু একজন সম্রাটের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বইরে চলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি আদম খানের শিথিল দেহটাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলেন এবং সেটা ভাঁজ হয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।

তোমাকে হত্যার নির্দেশ প্রদানের আগে তোমার কি কিছু বলার আছে?

আদম খান অনেক কষ্টে তার মাথা তুললো। তুমি হয়তো এখন আমাকে পরাজিত করতে পেরেছে কিন্তু আমি বহু মাস ধরে তোমাকে বোকা বানিয়ে আসছি। ঐ নির্বোধ কুকুরী গুলি, অবশ্যই আমি তাদের অপহরণ করেছিলাম- তুমিই কেনো সবসময় উত্তম জিনিসগুলি পাবে? আমি তাদের হত্যা করেছিলাম যাতে তারা ঘটনাটা কাউকে বলতে না পারে।

আর বৈরাম খান?

তুমি কি মনে করো? আদম খানের বিধ্বস্ত মুখে এই মুহূর্তেও যেনো বিদ্রূপপূর্ণ বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো।

এটাই ওর জীবনের শেষ হাসি, আকবর নিজের অজ্ঞতা এবং বোকামীর জন্য নিজের উপরই তীব্র ক্রোধ অনুভব করে ভাবলেন।

রক্ষী ওকে নিয়ে প্রাচীরের উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করো।

আকবরের সামনে দিয়ে দুজন রক্ষী আদম খানের পা টেনে উঠানের অপরপ্রান্তে ছেচড়ে নিয়ে গেলো, পাথরের মেঝেতে তার রক্তের লম্বা দাগ ফুটে উঠল। পাঁচিলের প্রান্তে পৌঁছে রক্ষীরা আদম খানের পা ছেড়ে দিয়ে তার বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে তাকে উপুর করলো, তারপর মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঠেলে বিশ ফুট নিচের চত্বরে ফেলে দিলো। রক্ষীরা ঝুঁকে নিচে পড়ে থাকা আদম খানকে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর আকবরের দিকে ফিরে বললো, জাঁহাপনা সে এখনো নড়ছে।

তাহলে ওর চুল ধরে টেনে আবার উপরে নিয়ে এসো এবং আবার নিচে নিক্ষেপ করো।

রক্ষীরা সিঁড়ি বেয়ে চত্বরে নেমে গেলো এবং কয়েক মিনিট পরে আবার আবির্ভূত হলো আদম খানের খিচতে থাকা শরীরটার চুল ধরে টেনে। এবার আকবরও রক্ষীদের অনুসরণ করে পাঁচিলের ধারে উপস্থিত হলেন এবং আদম খানের দ্বিতীয় পতন প্রত্যক্ষ করলেন। এ যাত্রায় আদম খানের মাথার খুলির সঙ্গে পাথরের সরাসরি সংঘর্ষে তা বাদামের মতো ফেঁটে গেলো এবং মাথার গোলাপি-ধূসর মগজ ছিটকে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আকাশ থেকে চিল নেমে এলো মৃতদেহটাকে ঠুকরে খাওয়ার জন্য। শীঘ্রই প্রায় একডজন চিল জুটে গেলো আকবরের বাল্যকালের সঙ্গীটির মৃতদেহ ভক্ষণ করার জন্য।

আকবর আর সেখানে দাঁড়ালেন না। সম্পূর্ণ ঘটনাটি তাঁর মনের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। তিনি এতো বোকামী করলেন কীভাবে? আবহাওয়া উষ্ণ হলেও তিনি ঠাণ্ডা অনুভব করলেন এবং কাঁপতে লাগলেন। একটা প্রশ্ন তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে প্রশ্নটি তিনি আদম খানকে করতে চেয়েও করেননি-হয়তো তিনি এর উত্তর কি হবে সে বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন। মাহাম আঙ্গা তার পুত্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কতটা জানেন? উঠানটিতে তখন ভিড় জমে গেছে। মেয়েরা তাদের ঘরং থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং হেরেম রক্ষীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অভাবিত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে। আমার জোব্বাটা এনে দাও, আকবর একজন পরিচারককে আদেশ দিলেন।

পনেরো মিনিট পর মনের মধ্যে একরাশ বিশৃঙ্খল ভাবনা নিয়ে আকবর। মাহাম আঙ্গার কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের তাঁর ঘর তল্লাশি করে ঘরের বাইরে পাহারায় থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আদম খানের অর্ধমাতাল অবস্থা বিবেচনা করে অনুমান করা যায় সে একাই নিজস্ব আবেগের তাড়নায় উন্মত্ত আচরণ করেছে, যদিও তার ক্ষোভ এবং ঈর্ষা দীর্ঘদিন ধরে তার মাঝে পুঞ্জিভূত ছিলো। তা সত্ত্বেও আর কোনো বিশ্বাসঘাতক নিজের ঘরের মাঝে ওৎ পেতে আছে কিনা সেটা অনুসন্ধান করে দেখার এখনই উপযুক্ত সময় আকবরের জন্য। মাহাম আঙ্গার কক্ষের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আকবরের দেহরক্ষীদের অধিনায়ক তাকে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো।

আমরা কক্ষটি তল্লাশি করেছি। এখানে প্রবেশ করা আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ জাহাপনা।

কি ঘটেছে সে সম্পর্কে দুধমাকে তোমরা কিছু বলেছে?

না জাহাপনা।

তিনি কি তার পুত্রের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন?

না জাহাপনা।

আকবরের প্রবেশের জন্য যখন রক্ষীরা কক্ষের দরজা খুলে দিলো তিনি অনুভব করলেন, যে কাজ তিনি করতে যাচ্ছেন তা যে কোনো যুদ্ধের চেয়েও অধিক তিক্ততাপূর্ণ। রক্ষীদের অধিনায়কের বক্তব্য অনুযায়ী তার সঙ্গে আদম খানের লড়াই অথবা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মাহাম আঙ্গা কিছুই জানেন না, যদিও একজন ক্ষিপ্রগতির পরিচারকের মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগার কথা বার্তাটি মাহাম আঙ্গার কাছে পৌঁছানোর জন্য। মাহাম আঙ্গা তার কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার চেহারা উদ্বিগ্ন।

আকবর, এসব কি হচ্ছে? হঠাৎ করে কেনো আমার সঙ্গে কয়েদির মতো আচরণ করা হচ্ছে? আকবরের মুখের উপর নিবদ্ধ তাঁর বাদামি চোখ গুলিতে নির্ভেজাল বিস্ময়। নিজেকে শক্ত করার জন্য আকবর কয়েক মুহূর্ত আগা খানের রক্তাক্ত মৃতদেহটির কথা ভাবলেন, যা তিনি কয়েক মিনিট আগে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখন তার দেহটি কর্পূর দিয়ে ধুয়ে সামাহিত করার প্রস্তুতি চলছে।

মাহাম আঙ্গা, সারা জীবন আমি আপনাকে আমার মায়ের মতো মনে করেছি। আমি যা বলতে যাচ্ছি তা বলা আমার জন্য মোটেই সহজ হবে, তাই আমি সরাসরি বলতে চাই। এক ঘন্টা আগে আপনার ছেলে আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক আতগা খানকে হত্যা করেছে এবং সে সশস্ত্র অবস্থায় বলপূর্বক হেরেমে ঢুকে পড়ে আমাকে হত্যা করার জন্য।

না! মাহাম আঙ্গা এমন কোমলভাবে শব্দটি উচ্চারণ করলেন যে তা প্রায় শুনাই গেলো না। নিজের অসার হয়ে আসা দেহের পতন ঠেকানোর জন্য তিনি অন্ধের মতো কিছু আকড়ে ধরতে চাইলেন অবলম্বন হিসেবে কিন্তু তার হাতে একটি মিষ্টির থালা ব্যতীত আর কিছু ঠেকলো না, থালাটি সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেলো।

এখানেই শেষ নয়। আদম খান আমাকে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের আহ্বান জানায় এবং আমি তাকে ন্যায্যভাবে লড়াই-এ পরাজিত করি। তারপর আমি আদেশ করি তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মৃত্যুদন্ড প্রদানের জন্য।

মাহাম আঙ্গা ধীরে তার মাথাটি দুপাশে নাড়ছিলেন এবং ফোঁপান ও বিলাপের মধ্যবর্তী একটি বেদনাদায়ক শব্দ করছিলেন। আমাকে বলল সে এখনো বেঁচে আছে, অবশেষে তিনি কান্না জড়িত স্বরে বলে উঠলেন।

আকবর তার কাছে এগিয়ে গেলেন। আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। আমার নির্দেশে তাকে মাথা নিচের দিকে দিয়ে প্রাচীরের উপর থেকে নিচে ফেলা হয়। আমার কাছে তার অপরাধের যে কেবল চাক্ষুশ প্রমাণ ছিলো তাই নয়, দম্ভের সঙ্গে সে তার অন্যান্য অপরাধের কথাও স্বীকার করেছে-আমাকে পাঠানো মেয়ে গুলিকে সে আক্রোশ এবং ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে অপহরণ ও হত্যা করে। তার চেয়েও জঘন্য বিষয় হলো সে বিদ্রূপ করে আমাকে বলে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড সেই পরিচালনা করেছে। এমন ঔদ্ধত্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি ছিলো…তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া ছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম?

না! এবার শব্দটি আর্তচিৎকারের মতো উচ্চারিত হলো। আমি তোমাকে আমার স্তনের দুধ পান করিয়েছি যখন তুমি শিশু ছিলে। আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে বাঁচিয়েছি যখন তোমার চাচা তোমাকে কামান দেগে মারতে চেয়েছিলো এবং কাবুলে তোমাকে বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা করেছি। আর সেই তুমিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করে-তোমার আপন দুধভাইকে! আমি আমার কোলে একটা বিষাক্ত সাপ পুশেছি, একটা শয়তানকে পুশেছি।

মাহাম আঙ্গা মেঝের উপর গড়িয়ে পড়লেন, প্রথমে বিকারগ্রস্তের মতো নখ দিয়ে শতরঞ্জিতে আচড় কাটলেন এবং তারপর আকবরের হাঁটুর নিচের মাংসে নখ বসিয়ে আঁচড় দিলেন। আকবরের পা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে শতরঞ্জির লাল রঙের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলো।

রক্ষী! আকবর নিজে তার গায়ে হাত দেয়ার কথা ভাবতে পারলেন না। তার সঙ্গে ভদ্র আচরণ করো। উনি শোকের আঘাতে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দুজন রক্ষী টেনে মাহাম আঙ্গাকে আকবরের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। এক মুহূর্ত পর তিনি মুক্ত হলেন কিন্তু পুনরায় আক্রমণের কোনো চেষ্ট করলেন না। শতরঞ্জির উপর বসে সামনে পিছনে দুলতে লাগলেন।

মাহাম আঙ্গা, আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আপনার ছেলে যা করেছে সে সম্পর্কে কি আপনি জানতেন, আমাকে হত্যার চেষ্টা সম্পর্কে? তিনি তার অবিন্যাস্ত চুলের মধ্য দিয়ে আকবরের দিকে তাকালেন। না।

আর আপনি যে বৈরাম খানকে তীর্থ যাত্রায় পাঠানোর বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে ছিলেন, সেটা কি এই জন্য যে আমার উপর তার প্রভাবের জন্য আপনি এবং আদম খান তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন? এবারে মাহাম আঙ্গা নীরব রইলেন। আপনাকে উত্তর দিতেই হবে এবং দিতে হবে সভাবে। এটাই সম্ভবত আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

আমি ভেবেছিলাম বৈরাম খান না থাকলে তুমি অন্যদের কাছ থেকে উপদেশ নেবে।

যেমন আপনার কাছ থেকে এবং আপনার ছেলের কাছ থেকে?

হ্যাঁ। আদম খান আমাকে জানায় সে তোমার অবহেলার শিকার এবং আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করি।

আর আপনি কি বৈরাম খানকে হত্যার বিষয়েও তার সঙ্গে একমত হোন, যাতে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আর ফিরে আসতে না পারে? মাহাম আঙ্গার প্রতি তার কোমল অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও আকবর আবারও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠছিলেন। এই জিজ্ঞাসাবাদ যতো তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততোই সকলের জন্য মঙ্গল।

আকবরের কণ্ঠস্বরে তিক্ততার আভাস পেয়ে তাঁর দুধমা কিছুটা শঙ্কিত হলেন। আমি কখনোও চাইনি বৈরাম খান নিহত হোক….এবং আমি নিশ্চিত তার হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার ছেলে দায়ি নয়, তোমাকে দম্ভ করে সে যাই বলে থাকুক না কেনো।

মায়ের ভালোবাসার মতো অন্ধ আর কিছুই নয়, আকবর ভাবলেন।

আমি সর্বদাই তোমাকে ভালোবেসেছি আকবর, মাহাম আঙ্গা নিপ্রভাবে বললেন, যেনো তিনি তার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন।

তা সত্যি, কিন্তু আপনি আপনার নিজের ছেলেকে তারচেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন। মাহাম আঙ্গা, আমি এখন যা করতে যাচ্ছি তা এই রকম। আগামীকাল আপনাকে দিল্লীর দূর্গে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে জীবনের বাকি দিন গুলি আপনি নির্বাসনে কাটাবেন। আপনার ছেলের জন্য একটি জাঁকজমকপূর্ণ সমাধি নির্মাণের জন্য আপনাকে আমি অর্থ প্রদান করবো। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের আর কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। আকবর যখন মাহাম আঙ্গার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছেন তিনি শুনতে পেলেন সে পুনরায় বিলাপ শুরু করেছে। তাঁর অসংলগ্ন হাহাকার তখন আর শোক বাক্যের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি তখন আকবরের উপর ঈশ্বরের অভিশাপ বর্ষিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছেন এবং নিজ মৃত পুত্রের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সেই সব যন্ত্রণাক্লিষ্ট শাপ শাপান্তের প্রতিধ্বনি পেছনে ফেলে আকবর ঘোর লাগা মানুষের মতো তার আপন মায়ের কক্ষের দিকে রওনা হলেন। গুলবদন হামিদার সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল ঘটনা সম্পর্কে তারা সবকিছু জানেন।

হামিদা আকবরকে বুকে জরিয়ে ধরে থাকলেন। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তুমি নিরাপদে আছো। ঐ অকৃতজ্ঞ শয়তানটা কি করার চেষ্টা করেছিলো আমি শুনেছি…।

পাচিলের উপর থেকে নিচে ফেলে তাকে আমি হত্যা করেছি। আর মাহাম আঙ্গাকে দিল্লীর দূর্গে নির্বাসনে পাঠাচ্ছি।

মাহামকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। তোমার দুধমা হিসেবে সে তার পবিত্র বন্ধনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হামিদা রুঢ় কণ্ঠে বললেন।

না। তার ছেলের মৃত্যুই তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি। তাছাড়া আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয় যে তিনি শৈশবে আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।

আমার মনে হয় মাহামকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তুমি সঠিক কাজ করেছে, গুলবদন কোমল স্বরে বললেন। যে আসল হুমকি ছিলো তার উপযুক্ত ব্যবস্থা তুমি করেছে এবং একজন মহিলার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা নিপ্রয়োজন। হিন্দুস্তানের এক পরাজিত শাসকের মা যখন তোমার পিতামহকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতে চেয়েছিলো, তিনি তাকে ক্ষমা করেছিলেন এবং সে জন্য অধিক শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। তিনি হামিদার দিকে ফিরলেন। আমি বুঝতে পারছি তোমার অনুভূতি কেমন, কিন্তু তুমি যখন তোমার ক্রোধ এবং আঘাতকে অতিক্রম করে যাবে তখন তুমি বুঝতে পারবে যে আমি ঠিক কথাই বলছি।

হয়তো, হামিদা আস্তে করে বললেন। কিন্তু গুলবদন, আমার মতো তুমিও জানো অতিরিক্ত ক্ষমা প্রদর্শনের পরিণতি কি। তোমার ভাই এবং আমার স্বামী বার বার তাদের ক্ষমা করেছেন যাদের তার হত্যা করা উচিত ছিলো এবং এর ফলে আমরা অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি।

হুমায়ূন তাই করেছেন যা তিনি সঠিক বলে বিশ্বাস করেছেন এবং সেজন্য নিশ্চিতভাবেই তিনি নিজেকে অধিক মহৎ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

মা এবং ফুফুর কথাবার্তা আকবর তেমন মনোযোগের সঙ্গে আর শুনছিলেন না। আদম খানের বিশ্বাসঘাতকতা তার প্রতি আকবরের ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারেনি। তিনি যদি তাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো তাকে গুরুতর অপরাধগুলি সংঘটন করা থেকে বিরত করতে পারতেন। আদম খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করার কোনো উপায় কি তার জানা ছিলো?

হঠাৎ আকবর অনুভব করলেন তার মা ও ফুফু কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার বোঝা উচিত ছিলো কি ঘটতে যাচ্ছে, তিনি বললেন। বৈরাম খানের ব্যাপারে মাহাম আঙ্গার পরামর্শ গ্রহণ করা আমার উচিত হয়নি বরং নিজের কাছেই প্রশ্ন করা উচিত ছিলো এতে তার কি লাভ ছিলো। শায়জাদা যখন তার বোনের অপহরণকারী হিসেবে আদম খানের নাম উল্লেখ করলো তখন আমার উচিত ছিলো আদম খানকে আরো কঠোরভাবে প্রশ্ন করা। এমনকি আমি এই মর্মে একটি সতর্কবাণী পেয়েছিলাম যে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে- কেউ একটি চিরকুট আমার কক্ষে রেখে গিয়েছিলো।

আমি জানি। আমার পরিচারকই তা করেছিলো। সে একটু আগে আমাকে এ কথা বলেছে। বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রফিক অনেক কিছু দেখতে ও শুনতে পায় যা অন্যরা বুঝতে পারে না। সে আড়িপেতে শুনে যে আদম খান বৈরাম খানের মৃত্যুর জন্য আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করছে এবং ধারণা করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। যদিও তার কাছে কোনো প্রমাণ ছিলো না তবুও সে তোমাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলো। নিজের জামার হাতা ছিঁড়ে সে চিরকুট বানায় কারণ কাগজ যোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না এবং সুযোগ বুঝে তোমার ঘরে রেখে আসে। আকবর, রফিক ভয় পাচ্ছে তার সন্দেহের কথা সাহস করে সরাসরি তোমাকে না বলায় তুমি হয়তো তাকে শাস্তি দেবে।

না। আমি তার কাছে দ্বিগুণ ঋণী। একটু আগে আমি যখন হেরেমে নিরস্ত্র ছিলাম তখন সে আমাকে একটি তলোয়ার দিয়েছিলো। তাকে জানিও আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তার বিশ্বস্ততার উপযুক্ত পুরষ্কার আমি তাকে দেবো। যে অঘটন ঘটে গেছে তার সকল দায় আমার। রফিকের সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমি আদম খানকে তেমন ভাবে চাপ দেইনি। আমি বোকার মতো কাজ করেছি। আমি আদম খান এবং মাহাম আঙ্গাকে ভালোবাসতাম এবং তারা সেই ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে আমার চারপাশের সকলের উদ্দেশ্যের বিষয়ে আমাকে সন্দেহ ও প্রশ্ন করতে হবে- এমনকি যারা আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী তাঁদের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য হবে। একজন সম্রাটের ভূমিকা অত্যন্ত নিঃসঙ্গ এই বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। একজন শাসকের কারো উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত নয়।

তুমি যদি এই দুঃখ জনক বাস্তবতা থেকে কিছু শিখে থাক তাহলে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে, হামিদা বললেন, তার চেহারা বিষণ্ণ। আজ থেকে বহু বছর পরে তুমি যখন আজকের দিনটির কথা মনে করবে তখন তুমি উপলব্ধি করবে এটা ছিলো সেই সময় যখন তুমি কৈশোরকে অতিক্রম করে বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষে এবং একজন ম্রাটে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে আমাদের মর্যাদা যাই হোক না কেনো, সকলের জীবনই বহু তিক্ত উপাদানে পূর্ণ। আজ তুমি এর কিছুটা স্বাদ পেয়েছে, দোয়া করি ভবিষ্যতে তুমি আরো বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

২.১ সূর্য, চাঁদ এবং আগুনের সন্তান

দ্বিতীয় খণ্ড – সূর্য, চাঁদ এবং আগুনের সন্তান

০৬. সম্রাটের বিজয় অভিযান

এই মাত্র সূর্য ডুবেছে, আকাশে তখন হালকা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে, যে অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হতে চলেছে তার উপযুক্ত পটভূমিকা যেনো প্রকৃতি স্বয়ং রচনা করেছে, আকবর ভাবলেন। আগ্রার দূর্গের সম্মুখবর্তী কুচকাওয়াজের মাঠ বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত পারসিক শতরঞ্জিতে ঢেকে ফেলা হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো একটি ফুল বাগান। মাঠের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে সোনার পাত মোড়া কাঠের রেলিং-এর পিছনে আকবরের সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ সভাসদগণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর সম্মুখে তৃতীয় দলটিতে উপস্থিত ছিলেন সেই সব শাসক যারা আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। মধ্যবর্তী স্থানে সবুজ রেশমের শামিয়ানার নিচে মার্বেল পাথরের মঞ্চের উপর একটি বিশাল সোনার দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হয়েছে। এর সোনার থালা দুটির এক একটি পাঁচ ফুট ব্যাপ্তি বিশিষ্ট এবং চারদিক হীরকাকার গোলাপ-সিলিকা এবং মুক্তা দ্বারা আবৃত। আট ফুট উঁচু ওক কাঠের কাঠামো থেকে মোটা শিকলে বাঁধা অবস্থায় পাল্লার থালাগুলি ঝুলছে।

দেহে সোনার কারুকাজখচিত সবুজ রঙের শক্ত আলখাল্লা, গলায় বাঁকা আকৃতির পান্না শোভিত মালা এবং মাথায় আলো বিচ্ছুরণকারী হীরকখচিত পাগড়ি পড়ে আকবর ঢাকের গম্ভীর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁড়িপাল্লাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। জ্বেলে রাখা মশালের আলোতে দাঁড়িপাল্লার পাশে রাখা অনেকগুলি ঢাকনা খোলা সিন্দুক থেকে রাশি রাশি মণিমাণিক্য জ্বল জ্বল করছে। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আকবর সন্তুষ্ট হলেন। এছাড়াও মঞ্চের উপর বহু সোনা ও রূপার তৈরি শিকল কুণ্ডলী করে রাখা হয়েছে-যেনো এক একটি সাপ। সেইসাথে সোনা-রূপার কারুকাজ করা অনেকগুলি থলে ইচ্ছাকৃত ভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় উপচে ভরা হয়েছে সম্রাটের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য। মণিমাণিক্যের পাশে পিতলের তালায় থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন সুস্বাদু মশলা। এর পাশে জেড পাথরের পাত্রে রয়েছে দুপ্রাপ্য সুগন্ধী। আরো সাজানো রয়েছে কারুকার্যখচিত সূক্ষ্ম রেশমী কাপড়ের গাঁট।

সেখানে আরেকটি জিনিস ছিলো-বিশটি বিশাল লৌহখন্ড। আকবর লক্ষ্য করলেন অনেকগুলি কৌতূহলী দৃষ্টি সেগুলি পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি যখন মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িপাল্লার দিকে এগিয়ে গেলেন ঢাকের ছন্দবদ্ধ দামামা থেমে গেলো এবং শিঙ্গার একক ধ্বনি চারদিক প্রকম্পিত করলো। শিঙ্গার সংকেত লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরিচারকগণ লৌহখণ্ড গুলি তুলে নিলো এবং দাঁড়িপাল্লার বিশাল একটি থালায় সেগুলি ভরতে লাগলো। লৌহখণ্ডের চাপে পাল্লার থালাটি মেঝে স্পর্শ করলো। আদম খানকে হত্যার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ের অধিকাংশ তিনি এই ভাবনায় ব্যয় করেছেন যে, কেনো তিনি আদম খানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি পূর্বেই অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং কীভাবে তিনি তার সভাসদগণের মধ্যে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের বিকাশ দমন করতে পারবেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন একটা কারণে তিনি আদম খানকে সন্দেহ করতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, সেটা হলো আদম খান ও মাহাম আঙ্গা বাল্যকাল থেকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত থাকার জন্য। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর কাছাকাছি এমন পর্যায়ে আর কেউ নেই। ভবিষ্যতে আর কাউকে তিনি এমন অবস্থানে আসতে দিবেন না এবং কাউকে এতোটা বিশ্বাসও করবেন না। তাকে তার নিজের অনুভূতির উপর নির্ভর করতে হবে। যদিও আদম খান ও মাহাম আঙ্গার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা আংশিকভাবে তাঁদের ষড়যন্ত্রের প্রতি তাঁর অন্ধত্বের কারণ কিন্তু তিনি নিজেও কম আত্মতুষ্ট ছিলেন না, নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদা নিয়ে তিনি এততাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি ভাবতে পারেননি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।

ভবিষ্যতে এ ধরনের গোলযোগ এড়ানোর জন্য একটি বুদ্ধি হঠাৎ করেই তার মাথায় আসে। একদিন তাঁর সেবক আকবরকে তাঁর পিতামহের স্মৃতি সম্বলিত বই পড়ে শোনাচ্ছিলো। বাবরের বিচক্ষণ মতামত গুলির মধ্যে দুটি বিষয় আকবরের মনোযোগ কাড়ে: যুদ্ধ এবং লুষ্ঠিত সম্পদ ব্যক্তিকে সৎ রাখে এবং তোমার অনুসারীদের প্রতি সদয় হও। তারা যদি অনুভব করে, যে অন্য কারো তুলনায় তোমার কাছ থেকেই তারা বেশি লাভবান হবে তাহলে তারা তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সফল হয়ে থাকেন তিনি হবেন বাবার এবং তাঁর কাছ থেকেই আকবরের শিক্ষা নেয়া উচিত। এ কারণেই তিনি সভাসদ, সেনাপতি এবং মিত্রদের আজ এখানে জমায়েত করেছেন তিনি তাদের বলবেন শীঘ্রই তিনি বিজয় অভিযান শুরু করতে চান যার ফলে রাজকীয় কোষাগারগুলি সোনা এবং রত্নে উপচে পড়বে এবং সেই অবশ্যম্ভাবী পুরষ্কারের সামান্য স্বাদ তিনি আজ তাদের প্রদান করতে চান। আকবর সংক্ষিপ্তভাবে হাসলেন তারপর হাত তুলে সবাইকে নীরব হতে বললেন।

পূর্বে আমার পিতা যেমনটা করেছেন অনুরূপভাবে হিন্দুস্তানের শাসকদের প্রথা অনুসারে আমি জনসম্মুখে মূল্যবান ধন-রত্নের সঙ্গে নিজেকে ওজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বছরে দুবার এই অনুষ্ঠান পালন করবো-একবার আমার চন্দ্র বছরের জন্মদিনে, যেটা আজকের দিন এবং আমার সৌর বছরের জন্মদিনে। ওজন করার পর ধন-সম্পদ গুলি আমন্ত্রিতদের মাঝে বিতরণ করা হবে। আজ এই কার্যক্রম আপনারা প্রত্যক্ষ করবেন। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ শুভেচ্ছা প্রদর্শনের জন্য আজকের এই প্রথম অনুষ্ঠানে আমি আপনাদেরকে আমার দেহের ওজনের তুলনায় বেশি ধন-সম্পদ প্রদান করবো। এই লৌহ খন্ডগুলির ওজন আমার ওজনের তুলনায় দ্বিগুণ। আকবর একমুহূর্ত সময় দিলেন তার কথাগুলি উপস্থিত সকলকে অনুধাবন করার জন্য। তারপর তিনি আসনসিঁড়ি হয়ে দাঁড়িপাল্লার খালি থালাটিতে বসলেন।

আকবরের পরিচারকগণ সঙ্গে সঙ্গে অপর থালাটি ভরা শুরু করলো এবং প্রথমে তারা সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান গুলি তুলতে লাগলো। দশ সিন্দুক রত্ন উঁচু করে থালাটিতে জড়ো করার পর আকবরের বসে থাকা থালাটি ধীরে মেঝে থেকে উপরে উঠতে লাগলো। চারদিকে ভীষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে এবং আকবর অনুভব করলেন সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ, এবং প্রত্যেকে মনেমনে হিসাব করছে তাদের ভাগে লুটের মালের কতোটা অংশ আসবে। মোগল বংশ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, তিনি চিন্তা করলেন, তখন রত্নগুলি সরিয়ে থালায় সোনা এবং রূপার শিকল ভরা হতে লাগলো এবং তারপর স্বর্ণমুদ্রার পোটলা। আগের সময়ে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত লুটের মাল পুরষ্কার হিসাবে প্রদান করা হতো, তখনো হয়তো শত্রুদের মৃতদেহ গুলিতে উষ্ণতা বজায় থাকতো। প্রত্যেক গোত্রপতি তার ভাগের লুষ্ঠিত সম্পদের উপর নিজের ঢাল রাখতে তারপর তা টেনে নিয়ে যেতো নিজের দলের লোকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেটা ছিলো এমন সময় যখন মোগলদের কোনো স্থায়ী আবাস ছিলো না। সেদিন এখন আর নেই। তিনি এখন হিন্দুস্তানের সম্রাট এবং তার উচিত অনুগামীদের অধিক পুরষ্কার প্রদান করা। সেটা কেবল যুদ্ধ অভিযানে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নয় বরং সফলভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্যেও।

ওজন পর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামূল্যবান উপহার সমূহ বিতরণ করার কাজ শুরু হলো। গৃহস্থালির রসদ সংরক্ষক জওহর এর সহায়তায় আকবর হিসাব করেছেন প্রত্যেকে কতোটা সম্পদ পাবে এবং সে আকবরের নির্দেশে তা খাতায় লিপিবদ্ধ করেছে। আকবর দেখতে লাগলেন জওহর একে একে সকলের নাম ধরে ডাকছে এবং তার সভাসদ, সেনাপতি এবং মিত্ররা তাদের জন্য নির্ধারিত অর্থ, রত্ন এবং রেশমীকাপড় নিতে এগিয়ে আসছে। তাদের সন্তানদের জন্যেও উপহার ছিলো: সোনালী পতায় পেচানো খুবানি (বাদাম), খেলনা মোগল সৈন্য-অশ্বারোহী, তীরন্দাজ এবং বন্দুকধারী এবং কানে রূপার দুল পড়া মেয়ে পুতুল, গলার হার, বালা ইত্যাদি। দূরবর্তী প্রদেশগুলির রাজ্যপালদের পাঠানোর জন্যেও আকবর কিছু ধন-রত্ন সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন। এছাড়া সম্রাজ্যের শহরগুলিতে অবস্থিত শস্যভাণ্ডার গুলিতে পাঠানোর জন্যেও তিনি শস্য, চাল এবং তেল সংরক্ষণ করতে বলেন যাতে সাধারণ প্রজারাও তাঁর উদারতার ভাগ পায়। সেই দিন রাতে বিশাল উঠানের গোলাপজল প্রবাহিত ঝর্নাকে ঘিরে জমে উঠে রাজকীয় ভোজ সভা। সেখানে মখমল ঢাকা বেদির উপর সোনার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আকবর আমন্ত্রিতদের সঙ্গে ভোজে অংশ নেন। তাঁর দক্ষ বাবুর্চিদের তৈরি উপাদেয় খাবারে টেবিল ভরপুর। আস্ত ভেড়ার ঝলসানো মাংস, শুকনো ফল ও বাদামের উপর সাজানো রান্না করা হাঁস এবং তিতির জাতীয় পাখির মাংস, জাফরান ও উপাদেয় মসলা যুক্ত মাখনের আখনি, দৈ এবং মসলায় পাকানো মুরগি প্রভৃতি। প্রাচুর্যের আরেক মাত্রা যোগ করার জন্য আকবর নির্দেশ দেন থালায় রাখা বিনিয়ানির ঢিবির চারদিকে রত্ন ছড়িয়ে রাখার জন্য। ঘি দিয়ে পাকানো বিরিয়ানিতে কিসমিস, আলুবোখারা, খোবানি, পেস্তাবাদাম প্রভৃতি যোগ করা হয়েছে। কাবুল থেকে বিশেষ ভাবে বরফসহ মোড়কে বেঁধে তাজা আঙ্গুর এবং তরমুজও আনা হয়েছে।

আকবর অপেক্ষা করলেন যততক্ষণ পর্যন্ত না বেশিরভাগ অতিথি মুখ মুছে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন সময় হয়েছে তাঁদের কাছে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলার। তাঁদের উজ্জ্বল পরিতৃপ্ত মুখগুলি যখন আকবরের দিকে ফিরলো তখন তিনি এমন আত্মবিশ্বাস অনুভব করলেন যে তারা যেকোনো স্থানে তাকে অনুসরণ করতে রাজি হবে।

এখন আমি আপনাদেরকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতে চাই। আমার পিতামহ বাবর হিন্দুস্তান জয় করার পর চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। অকালমৃত্যুর কারণে তিনি তাঁর রাজ্যের সীমা বাড়াতে পারেননি এবং একই কারণে আমার পিতাও একাজে অগ্রগতি সাধন করতে পারেননি। কিন্তু আমি তরুণ এবং আমার পূর্বপুরুষের যোদ্ধারক্ত আমার শিরায় সবলভাবে স্পন্দনরত। এর কাছ থেকে আমি নির্দেশনা পাই যে একটি টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই আমার নিয়তি। এমন একটি সাম্রাজ্য যাকে কেবল একটি যুদ্ধের সাহায্যে পরাজিত করা সম্ভব হবে না বরং অনাগত শতাব্দীগুলিতে বিস্ময়কর মর্যাদায় মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় রাজ্য জয় করা। আজ আমি আমাদের সাম্রাজ্যের কিছু ধন-সম্পদ আপনাদের প্রদান করেছি, কিন্তু আগামী বছর গুলিতে আমি আপনাদের যে সোনা ও মহিমা উপহার দেবো তার তুলনায় এই পরিমাণ খুবই সামান্য-আপনাদের সহায়তায় আমি যখন মোগল সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করবে তখন আপনারা সেটা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। আমার রাজত্ব বিস্তৃত হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, সাগর থেকে সাগরে। দক্ষিণ দিকে তা দাক্ষিণাত্যের বিশাল মালভূমি ছাড়িয়ে গোলকোন্দার হীরক খনি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং সেই উৎকৃষ্ট হীরা আমার সিংহাসনে এবং আপনাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাঁদের দেহে দীপ্তি ছড়াবে। এসব অলস দম্ভোক্তি নয়। এখানে আপনাদের সকলের সামনে আমি শপথ করছি নতুন ভূখণ্ড পরাভূত করার কেবল আমাদের সীমান্ত বর্তী ছোট ছোট গোত্র গুলি নয় যারা মনে করে আমাদের বিরোধীতা করে তারা পার পেয়ে যাবে, বরং সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাজ্য গুলিও। যদি তারা তাদের গর্বিত মস্তক মোগল আধিপত্যের কাছে নত করে তাহলে তারা আমাদের ক্ষমা, সম্মান এবং মহত্ত্বের অংশিদার হতে পারবে। কিন্তু যদি তারা প্রতিরোধ করে তাহলে আমার সেনাবাহিনী তাদের যোদ্ধাদের হাড় চূর্ণ করে ধূলায় মিশিয়ে দেবে এবং তাঁদের প্রাসাদ ও দূর্গকে ধ্বংসতূপে পরিণত করবে।

তাই আমি আহ্বান করছি, আপনারা সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন! প্রথমে যে আমাদের ক্ষমতার তেজ অনুভব করবে সে হলো মেওয়ার এর রানা উদয় সিং, রানা সাঙ্গার পুত্র। রানা সাঙ্গাকে আমার পিতামহ বাবর চল্লিশ বছর আগে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। মেওয়ার এর রানারা দাবি করে তারা রাজপুতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্য রাজপুত রাজারা বহু দিন আগে থেকেই আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে আসছে। কিন্তু উদয় সিং এখন আমাদের প্রতি প্রকাশ্যে বিদ্রোহী আচরণ প্রদর্শন করছে। তার যোদ্ধারা কয়েকদিন আগে মোগল বণিকদের গুজরাট উপকূলগামী একটি কাফেলায় আক্রমণ করে। আমি উদয় সিং এর কাছে এরজন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করলে সে আমাকে একটি অপমানজনক বার্তা পাঠায়: তুমি উত্তরের অসভ্য ঘোড়া চোরদের বংশধর। কিন্তু আমি ভগবান রামের উত্তরসূরি এবং সেই সূত্রে চন্দ্র, সূর্য এবং আগুনের সন্তান। কাজেই আমার উপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব নেই।

উদয় সিং টের পাবে তার উপর আমার কর্তৃত্ব আছে কি নেই। আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা আমাদের সামরিক প্রস্তুতি শেষ করে উদয় সিংকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য অভিযান চালাবো। কিন্তু আজ আপনারা উপভোগ করুন আপনাদের জন্য যে আমোদের ব্যবস্থা আমি করেছি! উপস্থিত সকলে আকবরের সমর্থনে উল্লাসধ্বনি করে উঠলো, আকবর তাঁর পান্নাখচিত পান পাত্রটি উঁচিয়ে ধরে বললেন, মোগলদের জয় হোক।

*

আট সপ্তাহ পরের ঘটনা। আকবর ও আহমেদ খান আগ্রার দূর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্যের তীব্র আলোর কারণে আকবরের চোখ গুলি কুচকে ছোট হয়ে আছে। তিনি সেখান থেকে যমুনা নদী পারের শুকনো মাটিতে প্রশিক্ষণরত একদল সৈন্যকে দেখছিলেন। সৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে একজনের পিছনে আরেকজন ঘোড়ার পিঠে বসে ছিলো। তাদের সামনে মাটিতে একসারিতে পাঁচ গজের ব্যবধানে বিশটি বর্শা গাঁথা ছিলো। এক একজন সৈনিক গেঁথে রাখা বর্শাগুলির মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আকাবাঁকা পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শেষ বর্শাটির কাছে পৌঁছে তারা নিজেদের ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো এবং সেখান থেকে প্রায় দশ গজ দূরে স্থাপিত একটি খড়ের মানবাকৃতিতে তাদের বর্শা ছুঁড়ে মারছিলো। প্রত্যেকে লক্ষভেদে সফল হচ্ছিলো।

চমৎকার, আকবর বলে উঠলেন। সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু করতে আর কতোদিন লাগতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আর এক মাস-এর আগেও হতে পারে। যদিও আমাদের গোলন্দাজদের নতুন নকশার বড় আকারের কামানে গোলার ভরার প্রশিক্ষণের জন্য আরো কিছু দিন সময় প্রয়োজন। এই নতুন ধরনের অধিক শক্ত নল বিশিষ্ট কামান গুলি তুর্কী কারিগরেরা আমাদের ঢালাই কারখানায় প্রস্তুত করেছে। এছাড়া লাহোরের দক্ষ বন্দুক কারিগরদের কাছে ফরমায়েশ করা অতিরিক্ত গাদাবন্দুক গুলিও, এসে পৌঁছায়নি। নিশানা দূরত্ব বাড়াতে এই নতুন বন্দুকগুলিতে বর্তমান বন্দুকের তুলনায় দ্বিগুণ বারুদ ভরা যাবে-একথা আমাকে জানানো হয়েছে এবং সেগুলি হাতে বিস্ফোরিত হওয়ার ভয়ও নেই। ওগুলি যখন আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে তখন আমাদের আশেপাশে হাজার মাইলের মধ্যে অমাদের মতো শক্তিশালী আর কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। এমনকি আমরা পারস্যের শাহ্দের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর বলে বিবেচিত হবে।

যমুনা পারে প্রশিক্ষণরত একজন সৈন্য যখন মাটিতে গেঁথে রাখা বর্শাগুলি তুলে নিল তখন সমগ্র দলটি নতুন করে সম্ভব হলো। এখন তারা সারিবদ্ধভাবে মাটিতে সাজানো মাটির পাত্র ছুটন্ত ঘোড়া থেকে বর্শায় গেঁথে তুলে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এবারে তাদের প্রচেষ্টা আগের মতো ভালো হলোনা। একজন ঘোড়সওয়ার লক্ষচ্যুত হয়ে তার বর্শাটি মাটিতে গেঁথে ফেলায় ডিগবাজী খেয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টে পড়লো এবং পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পেলো।

আকবর হাসলেন। তার নিজের দেহেও আঘাতের অনেক চিহ্ন আছে। তিনি এখন নিয়মিত প্রশিক্ষণ করছিলেন। গাদাবন্দুক, তলোয়ার এবং যুদ্ধকুঠার নিয়ে তিনি অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন যততক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলিকে তাঁর নিজের শরীরের অংশ মনে হচ্ছিলো। তিনি তাঁর সেনাকর্তাদের সঙ্গে কুস্তিও লড়ছিলেন। প্রথমে তারা আকবরকে সমীহ করার কারণে তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে ইতস্তত করছিলো। কিন্তু আকবরের দক্ষতা, গতি এবং কৌশলের চাপে পড়ে শীঘ্রই তারা সব ব্যবধান ভুলে গেলো।

দ্রুত গাঢ়লাল বর্ণ ধারণ করতে থাকা আকাশের দিকে একপলক তাকালেন আকবর। আর মাত্র আধ ঘন্টা পরেই চারদিক অন্ধকার হয়ে আসবে। আদম খান আমি নদী তীরের ঐ সৈন্যগুলির সঙ্গে পোলো খেলতে চাই। কিন্তু এখনতো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

একটু ধৈর্য্য ধরুন, তারপর বুঝতে পারবেন।

আধ ঘন্টা পর, সাধারণ জোব্বা এবং পাজামা পড়ে, একটি ছোট আকারের কিন্তু পেশীবহুল বাদামি রঙের ঘোড়ায় চড়ে আকবর দূর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি কুচকাওয়াজের মাঠ পার হয়ে নদী তীরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। পোলো খেলার সরঞ্জাম নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করছে পরিচারকরা। নদীর তীরে পৌঁছে আকবর ঘোড়ার পাঁজরে মৃদু গুতো দিয়ে সেটাকে অর্ধবল্পিত (দ্রুততম গতির তুলনায় কিছুটা কম গতি) গতিতে ছুটালেন এবং কিছুটা দূরে থাকা ঘোড়সওয়ারদের কাছে উপস্থিত হলেন। সম্রাটকে দেখে তারা ঘোড়া থেকে নেমে অভিবাদন জানানোর উদ্যোগ নিলো।

না। তোমরা জিনের উপরেই থাক। আমি একটা পরীক্ষা চালাতে চাই, আকবর বললেন।

আধারের কালচে নীল ছায়া যখন নদীটিকে ঢেকে দিলো তখন আকবর তাঁর পরিচারকদের আদেশ দিলেন তাঁর অভিনব পোলো খেলার আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য। তারা উপস্থিত লোকগুলির মাঝে পোলো খেলার লাঠি বিতরণ করলো, গোলের লাঠিগুলি গেড়ে তার পাশে মশাল পুতে দিলো এবং অবশেষে কয়লা জ্বালা পায়াওয়ালা ধাতব ঝুড়ির মধ্যে পোলো খেলার কাঠের বলটি রাখল। বলটি রাখার প্রায় সাথে সাথেই সেটা ধিকি ধিকি করে জ্বলতে লাগলো, কিন্তু চার পাঁচ মিনিট পরেও সম্পূর্ণরূপে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো না। আকবর হাসলেন। তাহলে তৈমুরের গল্পটি সত্যি! যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা প্রদানের পর বেশ কিছুদিন সন্ধ্যায় আকবর তাঁর কোর্চিকে(ব্যক্তিগত সেবক) তৈমুরের বীরত্বপূর্ণ অভিযানের লিখিত উপাখ্যান পড়ে শোনাতে বলেন। উদ্দেশ্য, যদি কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় তিনি তার মহান পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারেন। সেখানে উল্লেখ ছিলো তৈমুর দৈবক্রমে আবিষ্কার করেন যে, সোমরাজ গাছের শক্ত কাঠে আগুন দেয়া হলে তা ধিকি ধিকি করে কয়েক ঘন্টা ধরে জ্বলে। তখন তৈমুর তার যোদ্ধাদের আদেশ দেন সোমরাজ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি জ্বলন্ত বল নিয়ে সারারাত পোলো খেলার জন্য। এভাবে তিনি তাদেরকে যুদ্ধের জন্য সবল করে তুলতেন। এই কাহিনী শোনার পর থেকে নিজেই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য আকবর উদগ্রীব ছিলেন।

বলটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলো, আকবর আদেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন পরিচারক লম্বা সাঁড়াশি দিয়ে বলটি ঝুড়ি থেকে তুলে ছুঁড়ে দিলো। আগেই আকবর সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়েছেন এবং কাছে পৌঁছে তিনি জ্বলন্ত গোলকটিকে পোলোর ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করলেন। খেলা শুরু, তিনি চিৎকার করলেন। শীঘ্রই আধার ঘেরা নদীর তীরটিতে ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে হাস্যরত মানুষের উল্লসিত চিৎকার। খেলা চললো ততক্ষণ পর্যন্ত যখন চাঁদ আকাশের অনেক উপরে পৌঁছে যমুনার কাদাজলকে তরল রূপায় পরিণত করলো।

সেদিন রাতে যখন হেকিম আকবরের আড়ষ্ট পেশীগুলি গরম তেল দিয়ে মালিশ করছিলো তখন আকবর চিন্তা করছিলেন কেনো তৈমুর একবারও যুদ্ধে পরাজিত হননি। তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করতে পছন্দ করতেন- আঘাত এবং তারপর পলায়ন। এভাবেই তিনি সমগ্র এশিয়াতে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, কোনো বস্তুগত বা মানুষের বাধা তা যতোই শক্তিশালী হোক, তার অগ্রগতিকে প্রতিহত করতে পারেনি। বরফে জমাট বাধা হিন্দুকুশ পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে নামার সময় তিনি মানুষখেকো উপজাতিদের আক্রমণ এতো সহজে মোকাবেলা করেছেন যেনো তিনি তাঁর লোমশ পোষাকের গা থেকে মাছি তাড়িয়েছেন।

তৈমুরের যুদ্ধ কৌশলগুলি হয়তো রানা উদয় সিং এর মতো আধুনিক শক্রদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না যারা কামান দ্বারা সুসজ্জিত এবং মরুভূমিতে গড়ে তোলা উঁচু দেয়াল বিশিষ্ট দূর্গে অবস্থান করছে, আকবর ভাবলেন। কিন্তু তৈমুরের আত্মবিশ্বাস এবং লক্ষ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার চূড়ান্ত প্রত্যয় দুশ বছর আগে যেমন ছিলো, এখনো তেমনি ভাবে কার্যকরী। যোদ্ধা পূর্বপুরুষের সমকক্ষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এমন দুরন্ত শক্তিতে আকবরের রক্তের শিরায় চঞ্চলতা সৃষ্টি করছিলো যে তিনি হেকিমের মালিশরত হাতের নিচে স্থির থাকতে পারছিলেন না। কিন্তু সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যখন আগ্রা দূর্গের সিংহদ্বার থেকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এবং মোগল সৈন্যরা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রাজস্থানের ফ্যাকাশে কমলা বর্ণের মরুভূমি দিয়ে মেওয়ার এর দিকে যাত্রা করবে উদ্ধত রানাকে শায়েস্তা করার জন্য। আকবরের মা হামিদা তাঁর কাছে রাজস্থানের মরুভূমির এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন যে তিনি আগ্রায় বসেই সেখানকার শুষ্ক বালুময় বাতাস এবং সেখানে বিচরণকারী ময়ূরের কর্কশ ডাকের আবহ অনুভব করছেন। রাজস্থান সম্পর্কে হামিদার এই সুগভীর জ্ঞান অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি সেখানকার একটি ছোট মরুশহরে আকবরকে জন্ম দিয়েছেন যখন তিনি এবং হুমায়ুন রাজপুত রাজার ধাওয়ার মুখে আত্মগোপন করেছিলেন। ঐ রাজা শপথ নিয়েছিলো সে আকবরকে হামিদার গর্ভ থেকে জীবন্ত কেটে বের করে অজাত (এখনো যার জন্ম হয়নি) শিশুটিকে শের শাহ্ এর কাছে উপহার হিসেবে পাঠাবে। শের শাহ্ সেসময় হুমায়ূনকে সিংহাসন চ্যুত করেছিলো।

সেই রাজপুত রাজা এখন মৃত। কিন্তু উদয় সিংকে দমন করা এবং মেওয়ার এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা তখন সময়ের দাবি। আগ্রা থেকে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার একমাত্র পথে মেওয়ার এর অবস্থান হওয়ায় কৌশলগত ভাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কল্পনার চোখে আকবর দেখতে পেলেন তাঁর সৈন্যরা উদয় সিং এর রাজধানী চিত্তরগড় দূর্গের দরজা আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলছে, যেখানে তার পরিবার আটশ বছর ধরে বসবাস করছে। রাজপুতদের নেতা উদয় সিংকে পরাজিত করতে পারলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁকে সকলে ভয় পাবে এবং সম্মান করবে এবং আর কেউ তার বিরোধীতা করার সাহস পাবে না।

.

০৭. জাফরানী যোদ্ধা

ডিসেম্বরের এক মেঘশূন্য দিন। তখন ভোরবেলা, আকবর মেওয়ার এর রানার বিশাল দুর্গ-শহর চিত্তরগড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন-তার পাশে আহমেদ খান দাঁড়িয়ে আছেন। দুর্গের বালুপাথরের দেয়াল তিন মাইলের বেশি দীর্ঘ। রাজস্থানের শুষ্ক মালভূমি থেকে খাড়া পাঁচশ ফুট উপরে পাথুরে দেয়াল নিয়ে বর্ধিত হয়ে আছে দুর্গের কাঠামো। দুর্গপ্রাচীরের ভিতর রয়েছে মন্দির, রাজপ্রাসাদ, বাড়িঘর, বাজার এবং সেনা শিবির।

ইতোমধ্যে ছয় সপ্তাহ ধরে দুর্গশহরটিকে অবরোধ করে রাখার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় আকবর ভীষণ হতাশ হয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তিনি নিজেদের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। তারা চিত্তরগড়কে সম্পূর্ণরূপে ঘিরে ফেলেছেন, শহরগামী খাদ্যসরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে এবং রাজপুতদের পাঠানো অনুসন্ধানী দলের সদস্যদের হয় বন্দী করা হয়েছে নয়তো হত্যা করা হয়েছে। বন্দীদের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া গেছে। একটি দশ বছর বয়সি হাড্ডিসার বালক তার দুই বড়ভাই সহ ধরা পড়েছে। তারা মরিয়া হয়ে দূর্গের বাইরের দিকের দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছিলো খাদ্যের সন্ধানে। আকবরের সৈন্যরা বালকটিকে তার ভাইদের কাছ থেকে পৃথক করে ফেলে এবং সদ্য ঝলসানো ভেড়ার মাংসের লোভ দেখায়। অনেক মিষ্টি কথায় প্ররোচিত করার পর সে বলে, উদয় সিং নিজে প্রতিরোধকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করছে না। জয় মাল এবং পাট্টি নামের দুইজন সেনাপতিকে সে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করেছে। বালকটি আরো বলে, উদয় সিং আরাভাল্লি নামক পার্বত্য এলাকায় নিজের নামানুসারে উদয়পুর নামের একটি নতুন রাজধানী নির্মাণে ব্যস্ত আছে।

বালকটির ভাইয়েরা যখন জানতে পারলো সে তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে তখন তারা তাদের ছোটভাই এর প্রতি যে প্রতিক্রিয়া দেখালো তাতে রাজপুতদের নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। তারা বালকটিকে আক্রমণ করে তার গলাটিপে মারার চেষ্টা করে কিন্তু রক্ষীরা বাধা দেয়ায় ব্যর্থ হয়। কিন্তু পরের দিন তারা আবারও আক্রমণ করে যখন তাদের তিনজনকে অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে অবরোধ তৈরির জন্য পাথর ভাঙ্গার কাজে নিয়োগ করা হয়। এবারে সবচেয়ে বড় ভাইটি বালকটির মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করলো। যখন আক্রান্ত বালকটির কাছ থেকে তার ভাইকে সবলে টেনে সরানো হচ্ছিলো সে চিৎকার করে বলে, তুমি নাস্তিক আক্রমণকারীদের কাছে তথ্য ফাঁস করেছে। তুমি আর আমার ভাই নও। এমনকি তুমি এখন এক নজন রাজপুতও নও।

আকবর ঘটনাটি শুনে বালকটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, ভালো কাপড় পড়িয়ে শিবিরের রান্নাঘরে কাজে নিয়োজিত করার আদেশ দেন। এসম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, খাবারের প্রতি দুর্বলতার কারণে চিত্তরগড়ের আক্রমণকারীদের রান্নাঘরে কাজ করা তার উপযুক্ত নিয়তি। কিন্তু বালকটির কাছ থেকে চিত্তরগড়ে প্রবেশ করার কোনো গোপন পথ সম্পর্কিত তথ্য উঘাটন করা গেলো না। বয়স্ক বন্দীদের বলপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন করেও এ জাতীয় কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। হয়তো সেখানে প্রবেশের কোনো গোপন পথ আদতে নেই।

আকবর এবং তাঁর সেনাপতিরা দুর্গে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার শুরুর দিকের সাফল্যের আশা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন দুর্গ থেকে বর্ষণ করা কামানের গোলার বিপরীতে তার সৈন্যরা ঢেউ এর পরে ঢেউ এর মতো করে আক্রমণ চালাবে। উদ্দেশ্য মালভূমি থেকে শহরের প্রধান ফটক পর্যন্ত পাঁচশ গজ দীর্ঘ সর্পিলভাবে উপরের দিকে প্রসারিত পথটিকে আঘাত করা। প্রধান ফটকটি পাহাড়ের বর্ধিত অংশের শীর্ষে অবস্থিত। কিন্তু আকবরের আক্রমণকারী সৈন্যদের কেউ পথটির নিচ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছিলো না। যখনই তারা ঘোড়া ছুটিয়ে পথটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো-আকবর অসহায়ভাবে দেখছিলেন, কমলা রঙের পাগড়ি পরিহিত রাজপুতরা মোগলদের ছোঁড়া কামান এবং গাদা বন্দুকের তোপ উপেক্ষা করে চিত্তরগড়ের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের পেছন থেকে মোগল সৈন্যদের দিকে গাদাবন্দুকের গুলি এবং বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়ছিলো। এতে মোগল সৈন্য এবং তাঁদের ঘোড়াগুলি বিপুল সংখ্যায় মারা পড়ছিলো অথবা আহত হচ্ছিলো এবং অনেক আহত সৈন্য দুর্গের সামনের উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকছিলো। হতাশ আকবর দেখছিলেন তাঁর আরো সৈন্য মারা পড়ছে যখন তারা তাদের আহত সঙ্গীদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলো।

উদ্ধার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে এতো সৈন্যের মৃত্যু হলো যে আকবর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হলেন সেনা কর্তাদের আদেশ করতে যাতে তারা অন্ধকারের আড়াল ছাড়া উদ্ধার কার্য চালাতে না দেয়। রাজপুতরা এতো সফল ভাবে মোগল সৈন্যদের আহত বা হত্যা করছিলো যে মনে হচ্ছিলো চাঁদের আলোতেও তারা ভালো দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে।

পরবর্তী দিন গুলিতে মোগল সৈন্যদের আক্রমণ অব্যাহত থাকলো কিন্তু আহত সৈন্যদের সাহায্যের আবেদন, পানি খাওয়ার আকুতি এবং শেষ মুহূর্তে তাদের মা ও আল্লাহর কাছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের প্রার্থনা আকবর এবং তাঁর সেনাকর্তাদের ভীষণ কষ্ট দিতে লাগলো। আহত ঘোড়াগুলির যন্ত্রণাক্লিষ্ট হেষাধ্বনিও একই রকম কষ্টদায়ক মনে হচ্ছিলো। ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলিকে মাছির ঝাক ঘিরে ধরছিলো এবং সেগুলি থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। এই দুর্গন্ধ আকবরের শিবিরের চারপাশের বাতাস বিষাক্ত করে তুললো এবং তা থেকে খানিকটা রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি চন্দন কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাতে আদেশ দিলেন।

হার না মানার দৃঢ় সংকল্পে আকবর সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর শিবিরে ঘুরে ঘুরে টহল দিচ্ছিলেন সৈন্যদের উৎসাহ প্রদানের জন্য। তিনি রাতের বেলা পাথর এবং মাটি ছুঁড়ে ঢিবি বা অবরোধ তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন যাতে দিনের আক্রমণের সময় সেগুলির আড়াল পাওয়া যায়। যদিও সৈন্যরা আহত বা নিহত হয়ে দুর্গগামী ঢালু পথটির গোড়ায় পৌঁছাতে পেরেছিলো কিন্তু তারা আর অগ্রসর হতে পারছিলো না, বরং প্রতি আক্রমণের চাপে তারা বাধ্য হচ্ছিলো পিছিয়ে এসে ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিতে এবং সম্ভব হলে আহতদের সাথে করে নিয়ে আসতে।

একদল দক্ষ মোগল যোদ্ধা দুর্গগামী পথটিতে পুনরায় আঘাত হানার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। এবার আকবর এবং তাঁর সেনাপতিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আক্রমণের অগ্রভাগে হাতি ব্যবহার করবেন। সৈন্যরা হাতির পিঠের হাওদার উপর উঠতে লাগলো। সাফল্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য হাতিগুলিকে সাধারণের তুলনায় অধিক পুরু ইস্পাতের বর্ম পড়ানো হয়েছে। হাওদাতেও ভারী কাঠের আস্তরণ যোগ করা হয়েছে এতে অবস্থানকারী বন্দুকধারী ও তীরন্দাজদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য। হাওদাগুলি সৈন্য দ্বারা পূর্ণ হওয়ার পর হাতিগুলির কানের পিছনে ঘাড়ের উপর বসে থাকা মাহুতেরা বিশেষ কায়দায় টোকা মেরে তাঁদের দাঁড়ানোর সংকেত দিলো। পিঠে ও শরীরে অতিরিক্ত বোঝা নিয়ে অনেক ধীরে গদাইলস্করি চালে হাতি গুলি উঠে দাঁড়াতে লাগলো। হাতির পেছনে পদাতিক এবং অশ্বারোহী যোদ্ধারাও সঙবদ্ধ হচ্ছিলো।

আকবর তার উঁচুপাটাতনের উপর থেকে দেখতে পেলেন চিত্তরগড়ের প্রতিরোধকারীরা দুর্গের রক্ষাপাচিলের কাছে বিপুল সংখ্যায় সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। তারা আঁচ করতে পেরেছে তাদের উপর আরেকটি আক্রমণ শুরু হতে যাচ্ছে। মোগলরা বন্দুকের সীমানার বাইরে থাকলেও রাজপুতরা দুর্গ থেকে তাঁদের দিকে তীর বর্ষন করলো। অনেক তীর গতি হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো এবং হাতি বা সৈন্যদের বর্ম ভেদ করতে পারলো না, বাকিগুলি ঢাল দিয়ে প্রতিরোধ করা হলো। কিন্তু কিছু তীর ঘোড়াগুলিকে এবং অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধ বিশিষ্ট পদাতিক সৈন্যদের আহত করলো।

আহমেদ খান, আক্রমণে সফল হওয়ার জন্য আমাদের এখনই অগ্রসর হওয়া উচিত। হাতিগুলিকে সামনে আগানোর আদেশ দিন এবং তাদের রক্ষা করার জন্য কামান ও তীর ছুঁড়তে বলুন। আমি অশ্বারোহীদের প্রথম দলের সঙ্গে হাতিবাহিনীর পিছু পিছু অগ্রসর হবো।

আহমেদ খানের নির্দেশ পেয়ে অতিরিক্ত বোঝায় ভারাক্রান্ত হাতিগুলি ধীরে শুষ্ক পাথুরে মাটির উপর দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। এবারও প্রতিরোধকারীদের তীরের আক্রমণ তেমন সফল হলোনা। তীরগুলি হাতির ইস্পাতের বর্মে বাড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো কিম্বা কোনো ক্ষতি না করে হাওদার কাঠের আচ্ছাদনে বিধে থাকছিলো। কিন্তু মোগলরা যখন বন্দুকের গুলির আওতায় পৌঁছালো তখন একটি হাতি হঠাৎ থমকে গেলো, মনে হলো গুলি খেয়েছে। তারপর সেটি আবার তার সঙ্গীদের অনুসরণ করে শ্ৰান্তভাবে এগুতে শুরু করলো কিন্তু হাটার সময় পাথুরে মাটির উপর সৃষ্টি করলো রক্তের রেখা। মাঝে মধ্যে দুই এক জন সৈন্য আহত হয়ে হাওদার উপর থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তীব্র উত্তেজনা নিয়ে আকবর প্রত্যক্ষ করলেন হাতিবাহিনী পূর্বের যেকোনো আক্রমণের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর হতে পারছে। খুব শীঘ্রই তারা দূর্গগামী পথের পাদদেশে পৌঁছে যাবে। এখন সময় হয়েছে তাঁর নিজের অশ্ব বাহিনীকে প্রস্তুত করার।

সকলে আমাকে অনুসরণ করো। চিত্তরগড় আমাদের হবে, নিজের ঘোড়াটি দুলকি চালে ছুটিয়ে আকবর চিৎকার করে উঠলেন। হাতিগুলি যদি দুর্গগামী পথের কাছে পৌঁছাতে পারে তাহলে তিনি তার অশ্ববাহিনী নিয়ে পরবর্তী আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত থাকতে চান। এ সময় তিনি দেখলেন কিছু আগুন ভরা মাটির পাত্র চিত্তরগড়ের দুর্গপ্রাচীর থেকে হাতিগুলির দিকে ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেগুলি হাতিরগুলির উপর পড়লো না বরং কোনো ক্ষতি না করে ছড়িয়ে থাকা পাথরের উপর বিস্ফোরিত হলো। হঠাৎ দুর্গের ধাতু নির্মিত প্রধান ফটকের মাঝে সংযুক্ত ছোট দড়জা দিয়ে কমলা-পাগড়ি পড়া কিছু রাজপুত বেরিয়ে এলো। প্রথম লোকটি জ্বলন্ত কাঠি দিয়ে তার হাতে থাকা বড় একটি মাটির পাত্রে আগুন ধরাল। তারপর পাত্রটিতে বাধা দড়ি ধরে সেটা মাথার উপর ঘুরাতে ঘুরাতে ঢালু পথ বেয়ে হাতিগুলির দিকে ছুটে আসতে লাগলো। তাকে অনুসরন করে আসা অন্য রাজপুতদের হাতেও অনুরূপ আগুনের হাড়ি দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের সরোগোল তখন তুঙ্গে উঠেছে, আকবর দেখলেন হাওদার উপর থাকা সৈন্যরা বন্দুক এবং তীর ছোঁড়া শুরু করেছে। গুলি খেয়ে অনেক রাজপুত আগুনের পাত্রসহ ঢালু পথের উপর গড়িয়ে পড়ল কিন্তু বাকিদের দৌড় অব্যাহত থাকলো। বন্দুকের গুলিতে হাড়ি ফেটে তাদের একজনের গায়ে আগুন লেগে গেলো। একসময় অগ্রসরমান মানব মশালটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়ে লুটিয়ে পড়লো কিন্তু তার আগে হাত তুলে সাথীদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ প্রদান করলো। কিছু রাজপুত আক্রমণকারী, গুলি বা তীর বিদ্ধ হয়ে পথের পার্শ্বস্থ নিচু দেয়াল টপকে নিচের মাটিতে আছড়ে পড়লো। বাকিরা তাঁদের সঙ্গীদের মৃত্যুদৃশ্য উপেক্ষা করে এবং তাঁদের দিকে ধাবিত গুলি বা তীরের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে আসতে লাগলো।

রাজপুতরা দূর্গ থেকে বের হয়ে আসার এক দুই মিনিট পরের ঘটনা। তাদের সর্ব সম্মুখে থাকা লোকটি তার হাতের জ্বলন্ত পাত্রটি আকবরের প্রথম হাতিটির দিকে ছুঁড়ে মারলো, হাতিটি তখন দুর্গগামী ঢালু পথটির উপর সবেমাত্র সেটার সামনের একটি পা রেখেছে। লোকটি এক মুহূর্ত পর কপালে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো কিন্তু তার ছুঁড়ে দেয়া পাত্রটি প্রথম হাতিটির মাথায় বিস্ফোরিত হলো এবং আলকাতরার তরল আগুন সেটার বর্ম বেয়ে ছড়িয়ে পড়লো। আগুন সম্ভবত হাতিটির চোখ আক্রান্ত করলো অথবা বর্মের ভিতর ঢুকে গেলো কারণ, ব্যাথায় সেটি পাগলের মতো মাথা দুলিয়ে আর্তচিৎকার করতে লাগলো এবং হুড়মুড় করে ঘুরে পেছনের হাতিটিকে আঘাত করলো, একই সাথে পেছনের হাতিটির হাওদায় আগুন লাগিয়ে দিলো। ছুটে আসা রাজপুতদের মধ্যে যারা বেঁচে গিয়েছিলো তাঁদের ছোঁড়া পাত্রগুলিও তখন লক্ষ্যভেদ করলো।

আতঙ্কিত আকবর দেখলেন আগুন আক্রান্ত হাতিগুলির হাওদা থেকে তাঁর সৈন্যরা মাটিতে লাফিয়ে পড়ে পিছিয়ে আসতে লাগলো। কেউ কেউ মাটিতে গড়িয়ে গায়ের অগুন নেভানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। আরো হাতি ঘুরে যেতে শুরু করলো শরীরে জ্বলতে থাকা আগুন নিয়ে। আকবর দেখলেন একজন মাহুত তার হাতিটির মাথায় ইস্পাতের শলাকা গেথে দিলো। মাহুতরা আহত হাতিদের উন্মত্ততা রোধ করার জন্য এভাবে তাদের হত্যা করে। বিশাল হাতিটি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে রইলো। আরেকজন মাহুত মনে হলো ততোটা সাহসী নয়। সে তার হাতির ঘাড় থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে পালালো। চালক বিহীন হাতিটি হাওদায় জ্বলতে থাকা আগুন নিয়ে উন্মত্তের মতো মোগলদের তৈরি করা কৃত্রিম ঢিবির দিকে ছুটে এলো। একটি ঢিবির সাথে সংঘর্ষের পর সেটি গড়িয়ে পড়লো। পড়ার পর সেটার অরক্ষিত পেটটি আকবরের বন্দুকধারীদের নিশানার শিকার হলো। মৃত্যুবেদনায় সেটি জ্বলন্ত হাওদাসহ প্রচণ্ড শক্তিতে গড়ান মেরে তাতে আটকা পড়া সৈন্যদের পিষ্ট করে তাদেরও মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলো। মানুষ এবং পশুর মাংসপোড়া তীব্র গন্ধ তখন বারুদের গন্ধের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। আকবরের নাকে সেই গন্ধ পৌঁছালো এবং তিনি বুঝতে পারলেন এই আক্রমণটি পূর্বের সকল আক্রমণের মতোই ব্যর্থ হয়েছে। নিষ্ফল মৃত্যুর হাত থেকে সৈন্যদের বাঁচানোর জন্য তিনি হাত তুলে ইশারা করলেন পিছিয়ে আসার এবং নিজের ঘোড়াটিকেও ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি এই অচল অবস্থা কীভাবে অতিক্রম করবেন?

*

সেই সন্ধ্যায় আকবর তার যুদ্ধকালীন প্রিয়বেশ সোনার পাত মোড়া বক্ষ বর্মের কাঁধে ডুবন্ত সূর্যের প্রতিফলন নিয়ে গাঢ় লাল বর্ণের যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ তাবুতে প্রবেশ করলেন। তাঁর চেহারা বিষণ্ণ। তাবুটিতে যুদ্ধমন্ত্রণাসভা আহ্বান করা হয়েছে। কার্যকর হতে পারে এমন কোনো নতুন যুদ্ধ কৌশল আকবরের মাথায় খেলছে না। অর্ধবৃত্তাকারে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা আহমেদ খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের মাঝখানে তার জন্য নির্ধারিত ছোট আকারের সিংহাসনে তিনি আসন গ্রহণ করলেন। এই মুহূর্তে এদের সহযোগিতা এবং উপদেশ তিনি যতোটা প্রয়োজন মনে করছেন তেমনটি আর কখনোও করেননি। তাঁর এটাও মনে হচ্ছে যে এই দলটি খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন এদের মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদ বেগ, তিনি মোগল সেনাবাহিনীতে আহমেদ খানের চেয়েও পুরানো। যৌবনে তিনি পানি পথে বাবরের পক্ষে লড়েছে, পরে হুমায়ূনের পক্ষে। তারপর রয়েছে চৌকো কাধ বিশিষ্ট আলী গুল। সে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং তাজাকিস্তানের লোক। সে কেবল হুমায়ূনের শেষের দিকের কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বাকিরা আরো নতুন অনুগামী। যেমন বিশাল এবং শক্ত গড়নের অধিকারী রাজা রবি সিং, এই মুহূর্তে সে সশব্দে কাঠবাদাম চিবুচ্ছে। সে একজন রাজপুত এবং হিমুকে পরাজিত করার পর পর সে আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। আকবরের এই সেনাপতিদের পরিচয় বা বয়স যাই হোক না কেনো, তাঁদের প্রত্যেকের মুখে তখন লজ্জার ভাব বিরাজ করছিলো।

আজকের আক্রমণের সময় কতজন নিহত হয়েছে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

আহমেদ খান উত্তর দিলেন। আমরা আমাদের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধ হাতিগুলিকে হারিয়েছি এবং তিনশোর উপরে সৈন্য মারা গেছে। আরো অনেকে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে, তারা হয়তো বাঁচবে না।

অনেক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও এই আক্রমণের প্রয়োজন ছিলো, আকবর বললেন। আমাদের আরো অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে যেমনটা আমরা হাতির হাওদা গুলিকে তীর এবং গুলি রোধক করার ক্ষেত্রে করেছি। আমরা চিত্তরগড় দখল করার আগে রাজা উদয় সিং যাতে আরো সমন্বিত সেনাবাহিনী গঠন করতে না পারে বা অন্যান্য রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ না পায় সেই উপায় বের করতে হবে।

তার পক্ষে মিত্র যোগাড় করা সম্ভব হবে না, রবি সিং শান্ত স্বরে বললো।

সমগ্র রাজস্থানে একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মেওয়ার এর রানারা পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাব সম্পন্ন।

শুনে খুশি হলাম। কিন্তু কেউ কি বলতে পারেন, আগে কখনোও চিত্তরগড়কে দখল করা সম্ভব হয়েছিলো কিনা, বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া?

হ্যাঁ, মোহাম্মদ বেগ উত্তর দিলো, তার বন্ধুর ও ভাঙ্গা নাকটি চুলকাতে চুলকাতে। দুইশ বছরের বেশি সময় আগে আলাউদ্দিন খিলজি চিত্তরগড় জয় করেছিলো এবং ইদানিং কালে গুজরাটিরা।

আমরা তাঁদের যুদ্ধ কৌশল থেকে কিছু শিখতে পারি কি?

আলাউদ্দিন খিলজি কীভাবে চিত্তরগড় দখল করেছিলেন আমি তা জানি না, সে কাহিনী ইতিহাসের গর্ভে অনেক আগে হারিয়ে গেছে। আপনার পিতা চাম্পনির অবরোধ করার পর আমি গুজরাটে ছিলাম এবং তখন এক বুড়ো গুজরাটের কাছে আমি চিত্তরগড় দখলের কাহিনী শুনি। সে বলে, তারা ঢিবির অবরোধ সামনে এগিয়ে নিয়ে-এখন আমরা যেমন করছি, সেভাবেই প্রথমে সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি তারা করিডোরের মতো লম্বা আড়ালও তৈরি করেছিলো পশুর চামড়া মোটা ভাবে স্থাপন করে এবং সেটার সাহায্যে ঢালু দুর্গমুখী পথের বেশ খানিকটা অগ্রসরও হয়েছিলো। কিন্তু আমি জানতে পারি তাঁদের চূড়ান্ত জয় হয়েছিলো অবরুদ্ধ দুর্গবাসীদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণে। আমি করিডোর এর মতো ঢাকনার কথা আগেই হয়তো বলতাম কিন্তু আমার মনে হয়েছে সেটার সাহায্যে তীরের আক্রমণ ঠেকানো গেলেও কামান বা বন্দুকের গুলি ঠেকানো সম্ভব হবে না।

কিন্তু ঢাকনাটির পাশে পাথর ও মাটি লাগিয়ে এবং ছাদে পুরু তক্তা লাগিয়ে আমরা কি সেটার সহ্যক্ষমতা বাড়াতে পারতাম না? আহমেদ খান জিজ্ঞাসা করলো।

সেটা করতে অনেক সময় লাগবে এবং অনেক প্রাণহানিও ঘটবে, আলী গুল বলে উঠলো।

কিন্তু এ পর্যন্ত করা নিষ্ফল আক্রমণগুলিতেও আমাদের অনেক প্রাণহানি ঘটেছে, আকবর যুক্তি দিলেন। আমার পিতামহ বাবর একবার বলেছিলেন যে কোনো সম্রাটের যুদ্ধ জয় বা রাজ্যের প্রসার ঘটানোর জন্য জীবন উৎসর্গ করার প্রস্তুতি থাকতে হবে-বিশেষ করে তার নিজের, নিজ পরিবারের এবং নিকটবর্তী অনুগামীদের জীবন। একমাত্র বিজয় অর্জন করার পরেই সে যুদ্ধে নিহতদের পরিবারকে সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারে এবং সাধ্য মতো ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে পারে। করিডোরের মতো ঢাকনার বুদ্ধিটি আকর্ষণীয়। আপনারা সেটা তৈরির খসড়া পরিকল্পনা অঙ্কন করুন। যথেষ্ট পাথর এবং কাঠ জোগাড় করার জন্য লোক পাঠান। যারা করিডোরটি নির্মাণ করবে তাদের নিরাপত্তার জন্য গুজরাটিদের মতো মোটা চামড়ার আবরণ তৈরি করুন। এর সাহায্যে তীরের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া রাজপুতরা অনির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে অহেতুক কামান বা বন্দুক ছুড়বে না, তাঁদের বারুদের মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।

*

সদ্য তৈরি করা দুটি করিডোরের একটির প্রবেশ পথের সামনে ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন আকবর। তিনি বেশ আশান্বিত বোধ করছেন। যা অনুমান করেছিলেন তার তুলনায় কম সময়ে সেগুলি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত বন থেকে উত্তম মানের কাঠ যোগাড় করা গেছে। বন্দীদের পাথর জোগাড় করার কষ্টসাধ্য কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। আকবরের অনুমান অনুযায়ী চিত্তরগড়ের প্রতিরোধকারীরা কামান বা বন্দুক ছুঁড়ে তাদের বারুদের অপচয় করেনি। চামড়ার তৈরি পর্দা দিয়েও তীরের আক্রমণ অনেকটা প্রতিরোধ করা গেছে। তারপরও করিডোর তৈরির সময় প্রতিদিন প্রায় একশ মজুর নিহত হয়েছে। এই দরিদ্র লোক গুলিকে রৌপ্যমুদ্রার লোভ দেখিয়ে কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। আকবর তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জীবিত এবং মৃত মজুরদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার আদেশ দেন, যাতে যুদ্ধ জয়ের পর জীবিতদের এবং মৃতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা যায়।

যে করিডোরটির ভিতর আকবর প্রবেশ করছিলেন সেটা বিশাল আকারে তৈরি করা হয়েছে। মোহাম্মদ বেগকে এ কাজের তদারকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো। সে গর্বের সঙ্গে নিশ্চয়তা প্রদান করে বলেছে- এটি পাশাপাশি দশজন অশ্বারোহীর স্থান সংকুলানের মতো চওড়া এবং একদল ষাঁড় ছোট আকারের কামান সহ এর মধ্যে এটে যাবে। তাছাড়া সেটি একটি বড় আকারের যুদ্ধ হাতি হেঁটে যাওয়ার মতো উঁচু।

মোহাম্মদ বেগ, করিডোরটি এখন পর্যন্ত কতোদূর প্রসারিত হয়েছে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

এর শেষ মাথা দুর্গমুখী পথের গোড়া থেকে এখনো প্রায় একশ গজ দূরে আছে। তিনদিন আগে আমরা একটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এক রাজপুত যোদ্ধা করিডোরের ছাদের কয়েকটি তক্তায় আগুন ধরাতে সক্ষম হয়, কিন্তু আমাদের সাহসী মজুররা শিবিরের কুয়া থেকে বালতি করে পানি নিয়ে সেই আগুন নিভিয়ে ফেলে। ফলে করিডোরের সামনের অংশ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

এমন লোকদের নাম আমাকে জানাবেন যারা বুদ্ধির জন্য বিশেষ পুরষ্কারের দাবিদার।

জ্বী জাহাপনা।

এখন আমি নিজে ভিতরটা যাচাই করে দেখতে চাই। আকবর তার কালো ঘোড়াটির পাঁজরে আলতো গুতো মেরে করিডোরের প্রবেশ পথের ভিতর ঢুকে গেলেন, তাঁকে অনুসরণ করলেন মোহাম্মদ বেগ। পুরু কাঠের ছাদের জন্য ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা, কিন্তু ভেজা মাটি, ধোয়া, ঘাম, মানুষ এবং পশুর প্রস্রাব ও মলের সম্মিলিত গন্ধ আকবরের নাকে ধাক্কা দিলো। মাঝে মধ্যে দেয়ালে গোজা মশাল থেকে কিছুটা আলো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি মশালের সামনে একজন করে মজুর চামড়ার বালতিতে বালু এবং পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যাতে ছাদের রজন কাঠে আগুন লেগে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা নেভাতে পারে। এই সব মজুররা কেবল ছিন্ন পিরান এবং নেংটি পরে আছে। আকবর তাঁদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় তারা ঝুঁকে সম্মান জানালো। মাঝে মধ্যে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে তাঁদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বাক্য বিনিময় করছিলেন। তারা কোথা থেকে এসেছে কিম্বা তাঁদের পরিবারে কতোজন সদস্য আছে, এই জাতীয় প্রশ্ন করছিলেন তিনি। আবার এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তাদের একটি করে মুদ্রাও উপহার দিচ্ছিলেন। একজন কুচকে যাওয়া চামড়া বিশিষ্ট সাদা চুলের মশালধারী আকবরের পাশাপাশি হাটছিলো আর বর্ণনা করছিলো দিল্লীর কাছে গুরগাঁও নামের ছোট গ্রামে তার সর্দারীর গল্প। সেই মুহূর্তে একটি ভোতা শব্দের সঙ্গে করিডোরের দেয়াল কেঁপে উঠলো, ছোট ছোট বহু পাথর এবং বড় একটি দুটি দেয়াল থেকে খসে পড়লো। মশালধারীটি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়ল কিন্তু আকবরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোনো রকমে আবার হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালো। আকবর তখন তাঁর পিছিয়ে যেতে চাওয়া ঘোড়াটিকে শক্তভাবে টেনে ধরে রেখেছেন। মশালধারীটি লজ্জিত ভাবে বললো, আমি দুঃখিত জাঁহাপনা। আপনার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কামানের গোলার মোকাবেলা করার সাহস আমার নেই।

তুমি তোমার অবস্থানে স্থির থেকেই যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছো, আকবর বললেন। আর একটা কথা মনে রাখবে। কথাটি আমার বাবা যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন। তুমি যদি কোনো বিস্ফোরণ বা সংঘর্ষের শব্দ শুনতে পাও, বুঝে নেবে তুমি আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছ।

মশালধারীটি সংক্ষেপে হাসলো। আমি মনে রাখবো জাঁহাপনা। আকবর লোকটিকে কয়েকটি মুদ্রা দিলেন এবং সে হিন্দু কেতায় দুহাত মাথার উপর তুলে তাকে অভিবাদন জানালো। আকবর ঘোড়া চালিয়ে করিডোরের সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটু পরেই তিনি এর আকাবাকা বাঁক সত্ত্বেও শেষ মাথার হালকা আলো দেখতে পেলেন। মাঝে মাঝে উভয় পক্ষের বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো। একবার তিনি একটি মরণ চিৎকার শুনতে পেলেন, বুঝা গেলো আরেকজন মজুর নিহত হয়েছে।

শীঘ্রই আকবর করিডোরের শেষ মাথায় পৌঁছালেন। সেখানে পাথর এবং কাঠ জড়ো করে রাখা ছিলো অগ্রভাগ বর্ধিত করার জন্য। সুরঙ্গের একটু ভেতরে মজুররা শুকনো মাটিতে পানি মেশাচ্ছিলো দেয়ালকে সুসংহত করার সিমেন্ট হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আকবর এবং মোহাম্মদ বেগ ঘোড়া থেকে নামলেন। জাহাপনা আপনি এখানে এলে চিত্তরগড়ের প্রতিরক্ষা প্রাচীরটি ভালোভাবে দেখতে পাবেন, একজন সেনাকর্তা একটু দূরে খোলা জায়গায় অবস্থিত ঢিবির কাছ থেকে বললো।

সাবধান জাহাপনা। আপনি যদি তাঁদের দেখতে পান, তারাও আপনাকে দেখতে পাবে এবং আপনার সোনার বক্ষ-বর্ম দেখে আপনাকে চিনেও ফেলতে পারে, মোহাম্মদ বেগ বললো।

আমার সৈন্যরা প্রতিদিন এমন ঝুঁকি নিচ্ছে, কাজেই একই কাজে আমি পিছিয়ে যাওয়া উচিত নয়, আকবর বললেন। তিনি সেনাকর্তাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকে দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কিনারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, সেখানে নজরদারীর জন্য কোনো ধরনের মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। দুই এক মিনিট তাকিয়ে থাকার পর আকবর লক্ষ্য করলেন দুজন লোক প্রহরা মঞ্চে হাজির হয়ে সূক্ষ্মভাবে মোগলদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের একজন-লম্বা গড়নের এবং কালো দাড়ি বিশিষ্ট, সঙ্গীকে কিছু দেখাতে চাইছে। সূর্যের আলোয় তার আঙ্গুলের আংটির ঝলক এবং চালচলন প্রত্যক্ষ করে আকবর অনুমান করলেন নিশ্চয়ই সে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হবে। আকবর তাঁর সেনাকর্তাটিকে আদেশ করলেন, আমার জন্য দুটি গুলি ভরা বন্দুক আর বন্দুক রাখার তেপায়া এনে দাও, আমি ঐ ভদ্রলোক গুলিকে গুলি করে নিচে ফেলতে চাই।

তৎক্ষণাৎ করিডোরের মুখে অবস্থানকারী দুইজন বন্দুকধারী তাদের বন্দুক এবং তেপায়া আকবরকে দিয়ে দিলো। উপরের দিকে, ছয়ফুট লম্বা বন্দুক তাক করতে হলে আকবরকে মাটিতে অর্ধশায়িত হতে হবে। নিঃশব্দে এবং সতর্কভাবে অত্যন্ত দ্রুত আকবর আংটি পরিহিত লোকটির দিকে বন্দুক তাক করলেন। নিজেকে যতোটা সম্ভব স্থির করার জন্য দম আটকালেন, তারপর গুলি করলেন। বন্দুকের বারুদের তীব্র ধোয়ায় কাশতে কাশতে আকবর দেখলেন লোকটি মঞ্চ থেকে সামনের দিকে ঝুঁকলো এবং তাঁর থেকে কয়েক গজ দূরে ধুপ শব্দে আছড়ে পড়লো। দ্বিতীয় বন্দুকটি নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার আগেই তার সঙ্গীটি অদৃশ্য হলো।

মৃতদেহটা নিয়ে এসো, দেখা যাক আমরা কাকে মারতে পেরেছি। আকবর আদেশ দিলেন। দুইজন সৈন্য ভগ্ন দেহটিকে হেচড়ে তাদের কাছে নিয়ে এলো, আকবরের মনে হলো তাঁর গুলিটি লোকটির ডান কানের উপর আঘাত করেছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারলেন না, কারণ উপর থেকে পতনের ফলে তার মাথার পেছনের অংশের পুরোটাই রক্তাক্ত হয়ে আছে।

স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলো কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না, মোহাম্মদ বেগ বললেন।

আমিও চিনতে পারছি না, আকবর বললেন, কিন্তু রাজা রবি সিং একে চিনতে পারে যদিও এর চেহারা অক্ষত নেই, মেওয়ার এর বহু নেতা তার পরিচিত।

*

কয়েক মাস আগে কাদা এবং পাথর দিয়ে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা একটি ঢিবির উপর আকবর রাজা রবি সিংকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে চিত্তরগড়কে একটু ভালোভাবে দেখা যায়। রাজা রবি বলে উঠলো, জাহাপনা সেদিন আপনি আপনার দক্ষ লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে জয় মালকে হত্যা করার পর থেকে দুর্গের মধ্যে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। জয় মালের মৃতদেহ ফেরত দেয়ার সময় যদিও রাজপুতরা আপনার উত্থাপিত আত্মসমর্পণের শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছে তবুও পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে তারা তার মৃত্যুতে এবং করিডোরের অগ্রগতিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারা করিডোর এবং এর ভিতর দিয়ে টেনে নেয়া কামান ধ্বংসের জন্য আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু আমরা তাঁদের আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারছি। তাছাড়া ইদানিং আমরা তাঁদের যতো সংখ্যক অন্বেষণকারী দলকে পরাস্ত করেছি তার থেকে অনুমান করা যায় তাদের খাদ্যের মজুতও শেষ হয়ে এসেছে।

এরপর তারা কি করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না জাঁহাপনা। তারা দুইজন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এসময় হঠাৎ আকবর দেখলেন দুর্গের মধ্যে একই সঙ্গে কয়েক জায়গা থেকে কমলা বর্ণের আগুনের শিখা এবং কালো ধোয়া সর্পিল ভাবে আকাশে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তিনি সেখানে এধরনের আগুন পূর্বেও দেখেছেন, তবে তা নির্গত হয়েছে এক জায়গা থেকে। রাজা রবি সিং বলেছিলো সেগুলি যুদ্ধে নিহত গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চিতার আগুন। জয় মালের মৃতদেহ ফেরত দেয়ার পর যে আগুনটি জ্বালা হয়েছিলো সেটা ছিলো ভয়াবহ। কিন্তু এখন যে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে তার তুলনায় সেটি নিতান্তই তুচ্ছ।

ওখানে কি হচ্ছে রবি সিং?

দুর্গ রক্ষাকারীরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে যুদ্ধে জয়ী হওয়া আর তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যু নির্ধারণ করতে চায়। তারা জওহর সম্পাদন করছে। আপনি যে আগুন দেখতে পাচ্ছেন সেগুলি চিতার জন্য জ্বালা কাঠের স্থূপের আগুন। বিশেষ ভাবে তৈরি মঞ্চ থেকে রাজপুত মহিলা এবং তরুণীরা ঐ আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জীবন্ত পুড়ে মরার জন্য। মায়েরা তাদের শিশুদের বুকে চেপে ধরে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে। আকস্মিক যে কমলা এবং হলুদ বর্ণের আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ লোকেরা তখন চিতার মধ্যে বালতিতে করে তেল এবং ঘি ঢালছে, যাতে আগুনের তাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা কষ্ট কম পেয়ে দ্রুত মৃত্যুবরণ করে। তাদের স্ত্রী এবং সন্তানেরা আগেই নিহত হলে তারা আর কষ্ট পাবে না এবং শত্রুর হাতে পড়ে লাঞ্ছিতও হবে না এই ধারণা তাদের মনে সাহস যোগাবে। এই সাহসে বলিয়ান হয়ে আগামী কাল সকাল বেলা ঐ রাজপুত পুরুষ এবং তরুণরা তাঁদের জাফরানী যুদ্ধ পোষাক পরিধান করবে। তারপর নিজেদের ভ্রাতৃত্ববোধ কে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এবং আঘাতের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য সকলে ওপিয়াম মেশান পানি পান করবে। তারপর শেষবারের মতো আকস্মিক বেগে বীরত্বপূর্ণ আঘাত হেনে যতো বেশি সংখ্যক সম্ভব শত্রুকে হত্যা করে নিজেরা মৃত্যুবরণ করবে।

রাজা রবি সিং এর কন্ঠে একটি শান্তভাব এবং সম্মান সূচক প্রশংসার রেশ পাওয়া গেলো। বস্তুত রবি একজন রাজপুত, আকবর ভাবলেন। যদিও এমন আত্মবিসর্জনের ঘটনা আকবরের কাছে অপরিচিত এবং বিতৃষ্ণাজনক লাগছিলো তবুও তিনি ঐসব মহিলা ও তরুণীদের জন্য কিছুটা হলেও শ্রদ্ধা অনুভব করলেন। ওদের কষ্ট কমার জন্য ঐ আগুন সাদা হয়ে উঠুক, তিনি প্রার্থনা করলেন। তারপর রবিকে বললেন, আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ওদের মরণ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আরো বেশি সংখ্যক কামান করিডোরের ভিতর দিয়ে পাঠানোর নির্দেশ দিন এবং সেগুলিকে যতোটা সম্ভব আড়াল করে দুর্গমুখী পথের দিকে মুখ করে স্থাপন করতে বলুন। আর বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজেরা যেনো ভোরবেলায় সুরঙ্গ থেকে বেরিয়ে অবস্থান নেয়। যে মুহূর্তে দুর্গের প্রবেশ দ্বারের পিছনে তৎপরতা দেখা যাবে তখনই অশ্বারোহী এবং হস্তী বাহিনীকে করিডোরের সুরঙ্গে ঢোকার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলুন। কারণ হাতি এবং ঘোড়া সুরঙ্গের অন্ধকারে অবস্থান করতে থাকলে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

পরদিন ভোর বেলা চিত্তরগড়ের দুর্গগামী ঢালু পথের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া করিডোরের ঠিক বাইরে আকবর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ বেশ পরিধান করে আছেন এবং তাঁর সেনাপতিরা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। সোনার পাত মোড়া বক্ষ-বর্ম তাঁর শরীরে আট করে বাঁধা, মাথায় শিরোস্ত্রাণ এবং কোমরে ঝোলান রয়েছে পিতামহের তলোয়ার আলমগীর-এটি নতুন করে শান দিয়ে ধারালো করা হয়েছে। গতকাল রাতে মোগল সৈন্যরা যখন করিডোরের কাছে এবং ঢালের কাছাকাছি তাড়াহুড়া করে অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিলো তখন চিত্তরগড়ের প্রতিরোধকারীরা তাঁদের উপর বিক্ষিপ্তভাবে গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে কামান টানতে থাকা তিনটি ষাড় নিহত হয়। বাকি ষাঁড়গুলি ভয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লে কামানটি উল্টে পড়ে এবং কিছু তীরন্দাজ আহত হয়। কিন্তু বাকি কামানগুলি যথাযথ জায়গায় স্থাপন করার সময় রাজপুতরা চুপচাপ ছিলো, বোঝা যাচ্ছিলো পরের দিনের শেষ আক্রমণের জন্য তারা তাদের শক্তি এবং বারুদ মজুত রাখছিলো।

ভোর হওয়ার অনেক আগেই চিত্তরগড়ের পাহারা মিনারের ফাঁক দিয়ে যুদ্ধ ঢাকের উচ্চ শব্দ ভেসে আসতে থাকে। আকবর এতো প্রচণ্ড ঢাকের শব্দ আগে কখনোও শুনেননি। বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কিন্তু ঢাকের ছন্দ সম্মোহনের মতো অব্যাহত রয়েছে, তার সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে যুক্ত হচ্ছে শিঙ্গার আর্তনাদ। মাঝে মধ্যে একত্রে অনেক কণ্ঠের সম্মিলিত গর্জন ভেসে আসছিলো সব শব্দকে ছাপিয়ে। সেটা প্রতিরোধকারীদের হিন্দু দেবতার কাছে প্রার্থনার রব বলে রবি সিং ব্যাখ্যা করে।

তারা কখনো আক্রমণ করবে রবি সিং?

আর বেশি দেরি নেই। তারা ওপিয়ামের প্রভাবে এতোই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে নিজেদের আর বিরত রাখতে পারবে না।

পনেরো মিনিট পর ধীরে ধীরে বিশাল লোহার গজাল বসানো এবং ধাতব বেষ্টনী যুক্ত দুর্গ দ্বারটি উপরে উঠে যেতে লাগলো এবং এর পেছনের কাঠের দরজাটি খুলে যেতে লাগলো। কাঠের দ্বারে পর্যাপ্ত ফাঁক সৃষ্টি হতেই জাফরানী পোষাক পরিহিত এক যোদ্ধা একটি সাদা ঘোড়া নিয়ে বাকা তলোয়ার উঁচিয়ে ঢালু পথের উপর দিয়ে ছুটে এলো। তার পিছু পিছু অসংখ্য ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে এলো। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলো বয়স্ক এবং তরুণ পদাতিক যযাদ্ধারা। সকলে জাফরানী যুদ্ধ পোষাক পরিহিত এবং সকলের হাতে অস্ত্র ঝলকাচ্ছে। তারা যে রণহুঙ্কার দিচ্ছিলো আকবর তার অর্থ বুঝলেন না। রবি সিং এর অর্থ বুঝিয়ে দিলো, জীবন সস্তা কিন্তু সম্মান সস্তা নয়।

তোমরা সময় বুঝে আক্রমণ শুরু করো। আকবর গোলন্দাজ, বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজদের আদেশ দিলেন। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা একটি কালো ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা যোদ্ধাকে আঘাত করলো। সে যখন পড়ে গেলো তার উপর আরেকটি ঘোড়া হোঁচট খেলো এবং পিঠের সওয়ারীকে নিয়ে ঢালু পথটির নিচু পাঁচিল অতিক্রম করে প্রায় একশ ফুট নিচের মাটিতে আছড়ে পড়লো। কিছু যোদ্ধা বন্দুকের গুলি বা তীর বিদ্ধ হলো, কিন্তু বাকিরা নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে এলো হতাহতদের ঠেলে, ঢাল থেকে নিচে ছিটকে পড়া কিম্বা বহমান জাফরানী স্রোতের নিচে পদদলিত হওয়ার দিকে তাদের খেয়াল নেই। আকবরের প্রথম গোলন্দাজ যখন কামানের স্পর্শরন্ধ্রে সবেমাত্র অগ্নিসংযোগ করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই তার সামনে হাজির হলো সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়া নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধাটি। অগ্নিসংযোগের আগেই দুইজন গোলন্দাজকে তলোয়ার চালিয়ে কেটে ফেললো সে, তারপর দ্বিতীয় কামানটির গোলন্দাজের দিকে ধেয়ে গেলো। কিন্তু এই গোলন্দাজটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই কামানে অগ্নিসংযোগ করতে সক্ষম হলো। কামানের গোলাটি একদম কাছ থেকে প্রচণ্ড শক্তিতে নেতাটির পেটে আঘাত করলো এবং তার দেহের উপরের অংশ নিচের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়লো। আশ্চর্যজনকভাবে তার ঘোড়াটি অক্ষত রইলো এবং আকবরের সৈন্যদের অবস্থানের দিকে ছুটে গেলো। সেটার সাদা শরীর তখন কালচে রক্তে রঞ্জিত এবং সেটার রেকাবে তখনো সওয়ারীর পা আটকে আছে।

এই মুহূর্তে অন্যান্য রাজপুতরা ঢালু পথের নিচে পৌঁছে গেছে এবং মোগল সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য ছড়িয়ে পড়ছে। লড়াই এর আকাক্ষা তাঁদের মধ্যে এতো তীব্র যে, কোনো প্রকার সমর কৌশলের তোয়াক্কা না করে তারা যে দিকে নজর যায় আক্রমণ করতে লাগলো। তাদের এক একজনকে ঠেকাতে একধিক বন্দুকের গুলি বা তীর ছোঁড়ার প্রয়োজন হচ্ছিলো। যতো মারাত্মক ভাবেই জখম হোক না কেনো আকবরের সৈন্যদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাদের মাটিতে আছড়ে ফেলছিলো এবং সাথে থাকা ভারী দ্বিধার তলোয়ার বা খাঁজকাটা খঞ্জর দিয়ে কোপ মারছিলো। আকবর তাঁর একদল বন্দুকধারীকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বন্দুকে গুলি ভরার সময় নেয়ার জন্য তীরন্দাজদের কাছে পিছিয়ে আসার আদেশ দিলেন। দূর্গদ্বারের কাছ থেকে নীচ পর্যন্ত ঢালু পথটি তখন রক্ত এবং হতাহত যোদ্ধাদের দেহে ছয়লাব হয়ে গেছে।

সম্মুখ যুদ্ধে নিজের সৈন্যদের ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে দেখে আকবর স্বস্তি ও পুলক অনুভব করলেন। তাঁর সৈনিকরা রাজপুত যোদ্ধাদের ছোট ছোট দলকে ঘিরে ফেলছিলো। এখন চিত্তরগড়ের দুর্গদ্বার দিয়ে অনেক অল্প সংখ্যক যোদ্ধা বেরিয়ে আসছে। পথের নীচ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তারা গুলি বা তীর বিদ্ধ হয়ে হতাহত সাথীদের দেহের উপর লুটিয়ে পড়ছে। যদিওবা কেউ নিচে পৌঁছাচ্ছে সে আকবরের অশ্বারোহী বাহিনীর হাতে কচুকাটা হচ্ছে। রাজপুতদের ছোট ছোট প্রতিরোধগুলি আকবরের সৈন্যদের নিয়মতান্ত্রিক আক্রমণে বিধ্বস্ত হচ্ছিলো। আকবর অনুভব করলেন এই প্রথম বৈরাম খানের নির্দেশনা ছাড়া তাঁর বহুকক্ষিত বিজয় সন্দেহাতিতভাবে অর্জিত হতে যাচ্ছে। এটি সম্ভবত ভবিষ্যতে আরো অনেক বিজয়ের প্রথমটি। আপন অনুপ্রেরণার পাশাপাশি রাজপুতদের নগ্ন বীরত্ব তাঁকে অভিভূত করলো। এধরনের যোদ্ধারা শত্রুর চেয়ে মিত্র হিসেবেই বেশি কাম্য।

শীঘ্রই যুদ্ধক্ষেত্র স্থবির হয়ে পড়লো। আকবর রবি সিংকে কাছে ডাকলেন। এই সব বীর যোদ্ধাদের তাদের ধর্মমত অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করুন। যেহেতু জয় মালের মৃত্যুর পর উচ্চ পদস্থ সেনাকর্তারা অমার দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তাই তাঁদের কেউ এখনো বেঁচে থাকলে হত্যা করুন। মৃত্যুবরণ করা তাদের জন্য কঠিন হবে না কারণ বেঁচে থাকা তাঁদের জন্য নিজস্ব যুদ্ধনীতির লঙ্ঘন। তারপর দুর্গটি ধ্বংস করুন, যাতে দুর্গটিকে আর আমাদের বিরুদ্ধে কেউ ব্যবহার করতে না পারে এবং অন্যান্য রাজপুত নেতাদের জন্য এটা হবে একটি সতর্কবার্তা যারা আমার মিত্রতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখাতে চাইবে।

.

০৮. হীরা বাঈ

জাহাপনা, প্রভু রায় সূর্যন আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। রাহুম্ভর দূর্গশহরের সীমার ভিতর অবস্থিত নাগরিকদের প্রাণ রক্ষার বিনিময়ে তিনি আপনার জায়গিরদার হওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। লম্বা এবং তারের মতো পাকানো দেহের অধিকারী বয়স্ক রাজপুতটি মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার গর্বিতভাব স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছিলো। কথাগুলি বলতে তাকে নিজের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে।

আকবর বিজয়ীর হাসি গোপন করলেন। চিত্তরগড় বিজয়ের পর হত্যা করা যোদ্ধাদের কথা মাঝে মাঝে তার মনে এসেছে কিন্তু সে ব্যাপারে তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। চিত্তরগড় ধ্বংস করার আদেশ প্রদানের বিষয়েও তার মাঝে কোনো খেদ নেই-সে সময় রাজস্থানের বিস্তির্ণ মরুভূমি থেকে শহর ধ্বংসের লাল এবং কমলা রঙের আগুনের শিখা এবং সাথে ধূসর বোয়ার কুণ্ডলী কয়েক দিন পর্যন্ত দেখা গেছে। তাঁর নিষ্ঠুরতার প্রদর্শনী প্রত্যাশিত ফল প্রদান করেছে। আকবর রাহুম্ভর নামের আরেকটি রাজপুত দুর্গশহর অবরোধ করেছিলেন যেটা এর নিরেট ইটের দেয়াল এবং উঁচু মিনার বিশিষ্ট দুর্ভেদ্য গঠনের জন্য সমগ্র হিন্দুস্তানে সুপরিচিত ছিলো। কিন্তু হার মানতে সেটি এক সপ্তাহেরও কম সময় নিল। রায় সূর্যন যদি তার বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে সকল নেতৃস্থানীয় রাজপুত যুবরাজ তাঁর আধিপত্য মেনে নিয়েছে। অবশ্য মেওয়ারের রানা উদয় সিং ছাড়া। চিত্তরগড় এবং এর আশেপাশের এলাকা হারিয়ে সে যদিও আরাভাল্লির পার্বত্য এলাকায় আত্মগোপন করে আছে কিন্তু তারপরেও পরাজয় মেনে না নিয়ে আকবরের সেনাবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে এবং চিত্তরগড়ের পতনের পর এখনো এক বছর অতিক্রান্ত হয়নি। উত্তর ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজস্থানী যুবরাজগণ এবং তাদের জাফরানী যোদ্ধারা যদি পাশে থাকে তাহলে আকবরের কাছে কোনো কিছুই আর অজেয় থাকবে না।

তোমার প্রভুকে বলবে আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছি এবং রাহুম্ভরের সকল অধিবাসীকে পরিত্রাণ প্রদানের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আজ রাত পর্যন্ত সে সম্মানের সঙ্গে তার দুর্গে অবস্থান করতে পারে, কিন্তু আগামীকাল ভোরে যখন সূর্য দিগন্ত থেকে এক বর্শা উচ্চতায় অবস্থান করবে তখন আমি তাকে এবং তার সেনাপতিদের আমার শিবিরে অভ্যর্থনা জানাতে চাই এবং আমাদের মিত্রতার উৎসব উদযাপন করতে চাই।

ঐ দিন রাতে একজন অনুলেখককে আকবর তার তাবুতে ডাকলেন। কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তের শক্তিশালী আবেগ ঘন অনুভূতি তিনি নিজে লিখে রাখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখনো লিখতে জানেন না বলে তিনি সত্যিকার অনুতাপ বোধ করলেন। আগ্রায় ফিরে তিনি একজন বা একাধিক সভা ঘটনাপঞ্জি লেখক নিয়োগ করবেন। তারা তার এবং তাঁর পিতা ও পিতামহের রাজত্বকালের কৃতিত্বসমূহ লিপিবদ্ধ করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে একজন অনুলেখকই যথেষ্ট। আকবর অপেক্ষা করলেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না তরুণ অনুলেখকটি তার গলায় ঝুলানো কালির দোয়াতটির মুখ খুলে এবং লেখার পালকে ধার দিয়ে প্রস্তুত হলো। আকবর তলিপি প্রদান শুরু করলেন।

আমার শাসনকালের এই বছরটিতে যুদ্ধের আগুনের শিখা রাজস্থানের আকাশের বহু উচ্চে পৌঁছেছে। আমার সৈন্যদের দৃঢ়তা এবং শক্তি প্রত্যক্ষ করে শত্রুদের সাহস বালুতে শুষে যাওয়া বৃষ্টির মতো বিলুপ্ত হয়েছে। এখানে আমার বিজয় সম্পন্ন হয়েছে যা ভবিষ্যতের অনাগত গৌরব গুলির উপযুক্ত ভিত্তি প্রস্তর…

অনুলেখক চলে যাওয়ার অনেক পড়ে যখন সমগ্র শিবিরের কোলাহল থেমে গেছে, তখনো আকবরের ঘুম আসছিলো না। তাঁর শ্রুতলিখনের বাক্যগুলি হৃদয় থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে উত্থিত হয়েছে। তার ভবিষ্যতও গৌরবময় হবে বলে তিনি নিশ্চয়তা অনুভব করছিলেন। রচিত ঘটনাপঞ্জির মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তাঁর কীর্তি সম্পর্কে জানুক এটাই তার বাসনা। কিন্তু মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি মাত্র তীর বা বন্দুকের গুলি অথবা আততায়ীর ছোরার আঘাতে যে কোনো মুহূর্তে তিনি মৃত্যুবরণ করতে পারেন। তখন তাঁর সাম্রাজ্যের কি হবে? তাঁর কোনো বংশধর না থাকায় এই বিশাল মোগল সাম্রাজ্য তখন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। হিন্দুস্তানে মোগলদের অর্জনকে সম্মিলিতভাবে টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে গোত্রপতিরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হবে। তাহলে তাঁর পরাজয় ঘটবে, যেমন পরাজয় ঘটতে পারে উদাসীনতা বা আত্মতুষ্টির কারণে তিনি যদি তার সেনাবাহিনীকে পতনের দিকে ঠেলে দেন, তাহলে।

এমন কিছু ঘটতে দেয়া ঠিক হবে না। তিনি এখন বিশ বছরে পদার্পন করেছেন, এখন তাঁর দায়িত্ব সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও গন্তব্য নিশ্চিত করা। তাই এখন তাকে বিয়ে করতে হবে এবং সন্তান জন্ম দিতে হবে। তিনি বিয়ে করলে তার মা এবং ফুফু নিঃসন্দেহে খুশি হবেন। তারা বেশ কিছুদিন ধরে তাকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন, এমনকি সম্ভাব্য কনের ব্যাপারেও পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু রাজস্থান জয়ের পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকার কারণে আকবর এ বিষয়ে তেমন মনোযোগ দিতে পারেন নি এবং বাস্তবতা হলো বিয়ে করার জন্য তিনি তেমন আকাঙ্ক্ষাও অনুভব করেননি। কারণ হারেমে তিনি সীমাহীন যৌনতৃপ্তি লাভ করছিলেন। তাঁর পিতা মাতার মতো আন্তরিক সম্পর্ক তাঁর নিজের জীবনেও সৃষ্টি হোক এমন তাগিদ তিনি উপলব্ধি করছিলেন না। আদম খান এবং মাহাম আঙ্গার বিশ্বাসঘাতকতার পর ঘনিষ্ট কারো প্রতি নিজের বিশ্বাস অর্পণের বিষয়েও তিনি সন্দিহান রয়েছেন। কিন্তু এখন এখানে অস্থিরচিত্তে এবং একা বসে থেকে তার মনে হলো, বিয়ে করার সময় হয়েছে। এটা তাঁর নিজের জন্য না হলেও সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন। বিশেষভাবে যা কাম্য তা হলো স্বাস্থ্যবান ও সবল পুত্র সন্তান কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে তিনি মিত্ৰতাও তৈরি করতে পারেন। কোর্চির পড়ে শোনানো বাবরের দিনলিপির কিছু কথা আকবরের মনে পড়লো: আমি এমনভাবে আমার স্ত্রীদের নির্বাচন করেছি যাতে আমার গোত্রপতি এবং শাসকেরা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে।

বাইরে থেকে হঠাৎ ভেসে আসা তীক্ষ্ম চি চি শব্দে বোঝা গেলো পেঁচা বা অন্যকোন নিশাচর শিকারী ছোট কোনো জীবকে আক্রমণ করেছে। সেই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরে পরিতৃপ্ত আকবর দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গলেন। তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী নির্বাচনে ততোটাই সতর্কভাবে চিন্তা করবেন যতোটা তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে করে থাকেন। হামিদা এবং গুলবদন যে মেয়েগুলির কথা বলেছেন তাঁদের একজন পুরানো মোগল রাজবংশের মেয়ে-একজন তার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন এবং আরেকজন কাবুলের প্রশাসকের কন্যা-কিন্তু এই নারীগুলি সত্যিই কি হিন্দুস্তানের সম্রাটের জন্য উপযুক্ত? এদের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি হলে সেইসব নেতারা কি তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত হবেন যাদের তিনি মিত্র হিসেবে কামনা করেন?

*

আকবর যে উটটির পিঠে বসে ছিলেন সেটার পাঁজরের শেষাংশের মাংসল জায়গায় পায়ের গোড়ালি দাবিয়ে দিলেন। উটটি যমুনার চওড়া মেটে পারের উপর দিয়ে তীব্র বেগে সামনে ধাবিত হলো। উটের দৌড় প্রতিযোগীতা চলছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী সৈন্যদের বর্শার অগ্রভাগে অবস্থান করা জনতা উৎসাহ প্রদান করতে সম্মিলিত গর্জন তুললো। আকবর তার বাম পার্শ্বে অবস্থানকারী উজ্জল রঙের পোষাক পরিহিত রাজঅতিথিদের দিকে এক পলক তাকালেন-এদের মধ্যে লাল এবং কমলা পাগড়ি মাথায় রাজপুত রাজারা রয়েছেন যারা তার নতুন মিত্র-আগ্রার দুর্গপ্রাচীরের সম্মানিত স্থানে জড়ো হয়ে আছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রতিযোগীতায় জয় ছাড়া আর কোনো চিন্তা মাথায় আসা উচিত নয়। আকবরের বাম এবং ডান পা উটটির হাড় সর্বস্ব গলাকে পেচিয়ে একত্রিত হয়ে আছে। তার এক হাতে ধরা লাগামটি প্রাণীটির নাকে লাগানো পিতলের আংটার মধ্য দিয়ে টানা, আরেক হাতে একটি বাঁশের লাঠি। ঘোড়ার ছন্দবদ্ধ ও মসৃণ গতির তুলনায় উটের অসুবিধাজনক ভঙ্গির দৌড়ের বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।

তিনি নিজের উটটি ভালোই নির্বাচন করেছেন-পাকা শস্যের মতো রঙ বিশিষ্ট উটটি অল্প বয়সী পুরুষ, পিছনের পায়ের রান বলিষ্ঠ এবং দাঁতের বাড়ি খাওয়া শব্দ এবং থুতু ফেলার প্রবণতা দেখে এর সঞ্চিত শক্তির আভাস পাওয়া যায়। এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে আকবর বুঝতে পারলেন তিনি অন্য পাঁচজন প্রতিযোগীর তুলনায় এগিয়ে আছেন, কিন্তু দুই মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে এবং এসময়ের মধ্যে যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তার নিচে মাটিকে ঝাপসা দেখা যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ আরেকটি উট আঁকি দিয়ে তার পাশে হাজির হলো এবং সেটার চালকের উরু তার পায়ের সঙ্গে বাড়ি খেলো। সে রাজা অম্বর এর চৌদ্দ বছর বয়সী পুত্র মানসিং, তার কালো চুল মাথার পেছনে উড়ছে। রাজপুতরা খ্যাতিমান চালক কিন্তু মোগলরাও তাদের চাইতে কম দক্ষ নয়…হট! হট! আকবর তার লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করলেন কিন্তু তাকে লাঠিটি ব্যবহার করতে হলো না। তাঁর উটটি ঘাড় ফিরিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে নিজে থেকেই দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিলো।

কয়েক মুহূর্তের জন্য জানোয়ার দুটি সমপর্যায়ে রইলো, কিন্তু তারপর আকবর আবার এগিয়ে গেলেন। তাঁর চতুর্দিকে সবকিছু দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষ ও পশুর সম্মিলিত ঘামের গন্ধ নাকে আসছে। হট! হট! তিনি আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, এর ফলে তাঁর উত্তেজনা যেমন প্রশমিত হলো, একই সাথে উটটিকেও তাগাদা দেয়া হলো। তাঁর গলা ধূলায় পূর্ণ এবং মুখ থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু তাঁর একমাত্র মনোযোগ দুইশ গজ সামনে মাটিতে গাঁথা দৌড়ের শেষ সীমা নির্ধারণকারী দুটি বর্শার দিকে। ঘাড় ফিরিয়ে তিনি দেখলেন মানসিং এর কাছ থেকে তিনি প্রায় পাঁচ গজ সামনে এগিয়ে আছেন। তাঁর মনে হলো তিনি উড়ছেন এবং দ্রুতবেগে নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু হঠাৎ আকবরের উটটি হোঁচট খেলো, সেটির সামনের পা দুটি বেকায়দা ভাবে শুকনো কাঁটা ঝোঁপের মধ্যে জড়িয়ে গিয়ে, দৌড়ের শেষ সীমায় দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় আকবর ঝোঁপটি খেয়াল করেননি। উটটির সামনের পা দুটি যখন আটকে গেলো, তখন আকবর যতোটা সম্ভব পিছনে হেলে পড়লেন কুঁজের উপর- সেইসঙ্গে শক্তভাবে জানোয়ারটির পাজরের সঙ্গে বাম পা আটকে নিজের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলেন। একই সাথে আকবর লাগাম শিথিল করলেন উটটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সুযোগ দেয়ার জন্য যদিও তার সহজাত প্রবৃত্তি বলছিলো সেটা শক্তভাবে টেনে রাখার জন্য। কিন্তু উটটির মাথা তখন প্রায় মাটি ছুঁয়েছে এবং সেটি মাটিতে আছড়ে পরার উপক্রম করলো। লাগাম সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে আকবর সামনের দিকে ছিটকে গেলেন এবং প্রাণীটির ঘাড়ের পিছনের মাংসল অংশে দৃঢ়ভাবে এঁটে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করলেন সেটি কোনো পাশে পড়তে পারে, যাতে সেটার নিচে চাপা পড়তে না হয়। কিন্তু কোনোক্রমে উটটি আবার স্বাভাবিক হতে পারলো এবং ঝোঁপটিকে পেরিয়ে সামনে ধেয়ে গেলো। আকবর লাগাম আঁকড়ে ধরে সবলে নিজেকে সোজা করে ভারসাম্য রক্ষা করলেন। সম্পূর্ণ ঘটনাটির ব্যাপ্তি কয়েক মুহূর্ত কিন্তু তা মানসিংকে আকবরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ দিলো। তারা আবার সমপর্যায়ে এসে পড়লো। হট, আকবর চিৎকার করলেন, হট! এবং উটটি আবার তার চিৎকারে সাড়া দিলো, সেটির গলা প্রায় সমান্তরাল এবং প্রবলভাবে নাক দিয়ে শ্বাস টানছে। পাঁচ কদম পেরিয়ে আকবর বর্শা দুটির মাঝ দিয়ে অতিক্রম করে গেলেন, তিনি তখন মানসিং এর কাছ থেকে এক ফুট সামনে। আকবর দৌড়ের সীমা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত থাকা ঢুলিরা ঢোলের সম্মিলিত গর্জন তুলে তাঁর বিজয় ঘোষণা করলো। আকবর তার উত্তাপ ছড়াতে থাকা উটটির পিঠ থেকে লাফিয়ে নামলেন, বেঁচে যাওয়া এবং জয়ী হওয়ার জন্য প্রচণ্ড উল্লাস নিয়ে।

*

দুই ঘন্টা পরের ঘটনা। ঘনিয়ে আসতে থাকা আধারের পটভূমিতে ছায়ার আকারে বাদুরের দল তাদের নিশি অভিযানে যাত্রা করছে। আকবর আগ্রার দুর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, সদ্য গোসল করে সোনার কারুকাজখচিত জোব্বা আর পাজামা পড়েছেন। গলায় বক্র পান্না দিয়ে তৈরি সোনার মালা। উটের দৌড়ের প্রতিক্রিয়ায় তার শরীরের পেশীগুলি এখনো ব্যথা করছে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তাঁর রাজপুত অতিথিরা চারপশে জড়ো হয়ে আছেন উৎসবের পরবর্তী আয়োজন উপভোগ করার জন্য। রাজপুতদের অহমিকার কথা মনে রেখে আকবর এমন জমকালো উৎসবের আয়োজন করেছেন যে, তারা নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার আগেই তাদের প্রজারা জেনে যাবে মোগল সম্রাট তাদের শাসকদের কতোটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন।

আকবরের কাছ থেকে সংকেত পেয়ে আতশবাজী ছোঁড়া হলো, সেগুলি বন্দুকের চেয়েও উচ্চশব্দে সোনালী এবং সবুজ রঙ ধারণ করে আকাশে বিস্ফোরিত হলো এবং একে অনুসরণ করলো রূপালী এবং লাল আলোর ঝলকানি। এরপর বিস্ফোরিত হলো জাফরানী হলুদ, একে যে তীব্র শব্দ সঙ্গ দিলো-মনে হলো সেটা কোনো দানবাকৃতির ঈগলের চিৎকার। তারপর আকাশে সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো গাঢ় লাল এবং গোলাপি আভার বিচ্ছুরণ হলো। নিজের চারপাশে এবং যমুনার পারে জড়ো হওয়া জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজিত ধ্বনি আকবরের কানে এলো। কাশগড়ের জাদুকররা এই মনোমুগ্ধকর আতশবাজির প্রদর্শনীতে বিশেষ দক্ষ। আকবর তাঁদের আদেশ করেন তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য এবং তারা তাকে নিরাশ করেনি। হঠাৎ হুশ হুশ শব্দের সাথে আকাশে দেখা দিলো বিশালদেহী একটি বাঘ, সেটি এতো বড় হা করে আছে যেনো পুরো জগতটা গিলে ফেলবে। কয়েক মুহূর্ত সেটি আকাশে স্থির থাকলো-চমৎকারিত্বপূর্ণ এবং হিংস্র, তারপর কমলা এবং কালো ডোরা গুলি ছোট ছোট উজ্জ্বল তারার আকারে বিলীন হয়ে গেলো।

আমরা সবাই এখন বাঘের ছায়া দ্বারা আবৃত, অম্বরের রাজা ভগবান দাশ বললেন, তিনি বেটে আকারের পাকানো শরীরের অধিকারী একজন মানুষ বয়স ত্রিশের কোঠায়, নাকটি ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো তার পুত্র মানসিং এর মতোই, কপালে হিন্দুরীতির সিদুরের তিলক রয়েছে।

বাঘ হলো আমার রাজবংশের ঐতিহ্য, আপনি ঠিকই বলেছেন, আকবর উত্তর দিলেন, কিন্তু আমরা সকলেই কি জানোয়ারটির সাহস এবং শক্তিকে সমীহ করি না? আমাদের মাঝে এমন কেউ কি আছেন যিনি প্রাণীটির শক্তি এবং চাতুর্যপূর্ণ শিকারের কৌশলের বিপরীতে অসহায় বোধ করেননি? আমার আশা একদিন সমগ্র হিন্দুস্তানের মানুষ এই বাঘকে আলিঙ্গন করবে তাঁদের সম্মিলিত শক্তির প্রতীক হিসেবে।

হয়তো তাই হবে জাঁহাপনা, ভগবান দাশ আর একবার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে রহস্যময়ভাবে উত্তর দিলেন, সেখানে এখন কেবল রাতের তারারা ঝিকমিক করছে।

আমি প্রার্থনা করি তা হোক এবং আপনি ও আমি সত্যিকার সহযোদ্ধা হিসেবে বহুবার যুদ্ধ এবং বিজয় অভিযানের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটাই, আকবর নিজের মনোভাব বজায় রেখে বললেন এবং লক্ষ্য করলেন ভগবান দাশ তাঁর দিকে দ্রুত একপলক তাকালো। তিনি যেসব রাজপুত নেতাকে আগ্রায় তলব করেছেন তাঁদের মধ্যে বিকানার, জয়সলমীর এবং গোয়ালিয়র এর শাসকরা রয়েছেন। কিন্তু এদের মধ্যে ভগবান দাশ সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে অধিক চৌকশ এবং উচ্চাভিলাষী এবং মেওয়ারের রানা উদয় সিং এর সঙ্গে তার মিত্রতা নেই। উদয় সিং যদি পাহাড়ী অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে তার হারানো ভূ-খণ্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে তাহলে তার মোকাবেলা করার জন্য আকবরের ইচ্ছা ভগবান দাসের সেনাবাহিনী মোগলদের পাশে থাকুক। তার আজ রাতের পরিকল্পনা যদি সফল হয় তাহলে ভগবান দাশ নিশ্চিতভাবেই সমগ্র জীবনের জন্য তাঁর মিত্র হবেন। আকবর তাঁর হাতটি ভগবান দাশের কাঁধে রেখে বললেন, আসুন ভগবান দাশ, আমরা একসঙ্গে ভোজ সভায় অংশ নেই যেমনটি সত্যিকার মিত্রদের করা উচিত।

আকবর, ভগবান দাশ এবং অন্যান্যদের পথ দেখিয়ে একটি চারকোণা উঠানে নিয়ে এলেন। তিনটি আট ফুট উঁচু ঝাড়বাতিদান উঠানটি আলোকিত করে রেখেছে। বাতিদান গুলির প্রত্যেকটিতে এক ডজন করে বার ফুট লম্বা জেসমিন এর ঘ্রাণযুক্ত মোমবাতি স্থাপন করা। এছাড়াও সমগ্র উঠান জুড়ে রত্নখচিত সোনালী ছোট ছোট বাতিদানে ছোট আকারের মোমবাতি এবং সুগন্ধী তেলের প্রদীপ জ্বলছে। মেঝেতে রেশমের শতরঞ্জি বিছানো। তিন দিকে স্থাপিত খাবারের নিচু টেবিল গুলিকে ঘিরে কিংখাব মোড়া তাকিয়া রাখা হয়েছে বসার জন্য। চতুর্থ দিকে সোনালী নকশা বিশিষ্ট সবুজ মখমলের শামিয়ানার নিচে চওড়া মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। মঞ্চে রয়েছে একটি টেবিল, একটি সোনার ছোট সিংহাসন এবং সাথে সোনার পাত মোড়া একাধিক ডিভান।

আকবর এবং তাঁর প্রধান রাজপুত অতিথিরা মঞ্চে আসন গ্রহণ করার পর অতিথিদের সভাসদরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় আসন গ্রহণ করলেন। পরিচারকরা আকবরের রাজকীয় রান্নাঘরের সর্বোৎকৃষ্ট খাবার থালায় করে পরিবেশন করতে লাগলো। পাখি ও চতুষ্পদ জন্তুর ঝলসানো মাংস, মাখন এবং উপাদেয় মসলায় রান্না করা ঝোলযুক্ত খাবার; ঘি, শুকনো ফল এবং বাদাম দিয়ে রান্না করা বিরানী, টাটকা ভাজা রুটি-এর মধ্যে রাজপুত কেতায় ঘোল দিয়ে তৈরি করা বজরা এবং অন্যান্য শস্যের রুটিও রয়েছে। আরো রয়েছে আঙ্গুর, তরমুজ এবং বহু প্রকার মোগলাই মিষ্টান্ন। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আকবর সন্তুষ্টি বোধ করলেন। অতিথিদের মধ্যে সামান্য জড়তার ভাব বিরাজ করছিলো, কিন্তু তা খুবই স্বাভাবিক-কারণ মাত্র কয়েক মাস আগেই তিনি উপস্থিত বেশ কয়েকজন অতিথির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। আবার তাদের নিজদের কারো কারো মধ্যেও বৈরিতা রয়েছে। এই ভোজসভার উদ্দেশ্য হলো-যে রাজপুত যুবরাজেরা সর্বোচ্চ গর্বিতদের চেয়েও বেশি অহঙ্কারী, যারা দাবি করে তারা সূর্য এবং চন্দ্রের উত্তরসূরি-তাঁদের বুঝানো যে, এই প্রীতিকর মিত্রতা তাদের এবং আকবরের উভয়ের স্বার্থের জন্যই মঙ্গলকর।

ভোজন শেষে পরিচারকরা অতিথিদের হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করলো বেসন এবং সুগন্ধী পানি দিয়ে। অতিথিরা হাতের তেল-চর্বি পরিষ্কার করে মুখ ধুয়ে আরাম করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসলেন। এবারে আকবর উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ করলেন এবং নিজের বক্তব্য শুরু করলেন।

আমার বংশের লোকেরা হিন্দুস্তানকে ধ্বংস করে এর ধন-সম্পদ লুট করে নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য আসেননি। তারা এসেছিলেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য-যেমন করে কোনো বর তার বহু প্রতীক্ষিত স্ত্রীকে বরণ করার জন্য আসে। আমি কেনো বলছি যে হিন্দুস্তানের দাবিদার মোগলরা? কারণ প্রায় একশ ষাট বছরেরও বেশি সময় আগে আমার পূর্বপুরুষ তৈমুর হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন। যদিও তিনি এখানে স্থায়ী হননি, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে শাসক নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে এই ভূ-খণ্ড অবৈধ দখলকারীদের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে উত্তরে নিজেদের দ্বন্দ্ব মোকাবেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মোগলরা তখন এ বিষয়ে আর কিছুই করতে পারেনি। তারপর চল্লিশ বছর আগে আমার পিতামহ বাবর এখানে ফিরে আসেন এবং সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু আমি হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের প্রজা হিসেবে গণ্য করিনা অথবা তাদেরকে মোগল গোত্রগুলির তুলনায় নিকৃষ্টও মনে করি না। আমার চোখে সকল জাতি সমান। যদিও বিশ্বাসঘাতকরা কোনো প্রকার ক্ষমা লাভ করবে না, কিন্তু যারা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে তারা উত্তম রূপে পুরস্কৃত হবে। তাদেরকে আমার রাজ সভায় উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পদে অধিষ্ঠিত করা হবে, আমার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন পদ গুলিতে নিয়োগ দেয়া হবে বিশেষ করে আপনাদের, যারা আমার রাজপুত বন্ধুরা জন্মগতভাবে যুদ্ধে পারদর্শী। আপনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য আজ থেকে আমি ঘোষণা করছি আপনারা আমার ঘরের লোক বলে বিবেচিত হবেন। আমি আরো ঘোষণা করছি আজ থেকে আপনারা আপনাদের রাজ্যগুলি শাসন করবেন আমার নিযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে নয় বরং ওয়াতান হিসেবে নিজস্ব বংশধারার সদস্যরা যেভাবে রাজ্য শাসন করে।

আকবর আসন গ্রহণ করার সময় ভগবান দাশের দিকে এক পলক তাকালেন যিনি তার ডান পাশে বসে ছিলেন। আপনি আমাদের সম্মানিত করলেন জাহাপনা, রাজপুতটি বললেন।

এবং এখানে উপস্থিত হয়ে আপনি আমাকে সম্মানিত করেছেন, ভগবান দাশ, আমি আপনাকে আরো কিছু বলতে চাই। আমি বিয়ে করতে চাই। আপনার সবচেয়ে ছোট বোন হীরা বাঈ এর সৌন্দর্য এবং মর্যাদা সম্পর্কে আমি অবগত হয়েছি। তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে সমর্পণ করতে কি আপনি রাজি আছেন?

ভগবান দাশ যেনো বজ্রাহত হয়েছেন, উত্তর না দিয়ে তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, হীরা বাঈকে কেনো বিয়ে করতে চাইছেন জাহাপনা? হিন্দুস্তানের এতে নারীর পরিবর্তে আপনি আমার বোনকে কেনো নির্বাচন করলেন?

রাজপুতদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে। হিন্দুস্তানের সকল মানুষের মধ্যে আপনাদের সঙ্গেই মোগলদের সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্য রয়েছে-যারা যুদ্ধের শ্বেত উত্তাপে বলিষ্ঠ, গর্বিত এবং শক্তিশালী। আর সমস্ত রাজপুতদের মধ্যে আপনি ভগবান দাশ, সবচেয়ে অগ্রবর্তী। ইতোমধ্যে উটের দৌড়ের সময় আমি আপনার পুত্রের সাহস প্রত্যক্ষ করেছি। আমি নিশ্চিত আপনার বোন একজন উপযুক্ত সম্রাজ্ঞী বলে বিবেচিত হবে। আর খোলামেলা ভাবে বলছি- আমি আমার মিত্রদের আমার সঙ্গে কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাই। এবং এ ক্ষেত্রে বিবাহ বন্ধনের চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে?

তাহলে এটাই আপনার অভিপ্রায়-রক্তের বন্ধনে আমার বংশের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করা? ভগবান দাশ ধীরে ধীরে বললেন, যেনো তিনি আকবরের প্রস্তাবের গূঢ় অর্থ আত্মস্থ ও ওজন করার চেষ্টা করছেন।

হ্যাঁ।

এবং পরবর্তীতে আপনি আরো বিবাহ করবেন?

নিশ্চয়ই, আমার সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার জন্য তা প্রয়োজন হবে। কিন্তু আমি আপনার কাছে শপথ করছি, ভগবান দাশ, আমি সর্বদা আপনার বোনকে আমার প্রথম স্ত্রী হিসেবে এবং একজন রাজপুত রাজকন্যা হিসেবে উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করবো।

ভগবান দাশ কপালে কুঞ্চন নিয়ে বললেন, কিন্তু ইতোপূর্বে কোনো রাজপুত নারী তার নিজের সমাজের বাইরের কাউকে বিবাহ করেনি…এবং আপনার নিজের পরিবারও পূর্বপুরুষের রক্তের ধারা বিঘ্নিত করেনি।

আপনার কথা সত্যি। কিন্তু আমি হিন্দুস্তানে জন্মগ্রহণ করা প্রথম মোগল সম্রাট। হিন্দুস্তান একাধারে আমার দেশ ও জন্মভূমি। তাহলে কেনো আমি একজন হিন্দুস্তানী স্ত্রী গ্রহণ করবো না?

কিন্তু আমরা রাজপুতরা হিন্দু। আমার বোনের জন্য নিজের সমাজের বাইরে বিয়ে করার চেয়েও অধিক কঠিন নিজের ধর্মের বাইরে বিয়ে করা। সে আপনার মুসলিম ধর্মমত গ্রহণ করতে পারবে না।

আমি তাকে মুসলিম হতে বলবো না। আমি তার ধর্মকে শ্রদ্ধা করি যা আমার অন্যান্য বহু প্রজারও ধর্ম। আমি কখনোই আমার প্রজাদের ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিনি, তাহলে আমি হীরাবাঈ এর সেই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবো কেনো?

ভগবান দাশের ঈগল সদৃশ চেহারা বিষণ্ণই রয়ে গেলো, এবারে আকবর তার দিকে কিছুটা ঝুকলেন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যা একজন সম্রাটের জবান- আমি হীরা বাঈকে কখনোই তার ধর্ম পরিত্যাগের জন্য জোর করবো না এবং রাজকীয় হারেমের মধ্যে মন্দির বানিয়ে সে তার দেবতাদের পূজা করার অধিকার পাবে।

কিন্তু হয়তো আপনার নিজের পরিবার-আপনার সভাসদরা এবং আপনার মোল্লারা- এর প্রতিবাদ করবে?

সাদা পাগড়ি, কালো আলখাল্লা এবং লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট মোল্লাগণ যেখানে বসে ছিলো আকবর সেদিকে তাকালেন। তারা উপলব্ধি করবেন যে সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তিনি বললেন, তারপর কণ্ঠে ইস্পাত দৃঢ়তা নিয়ে যোগ করলেন: তারা এটাও বুঝতে পারবেন যে এটা আমার ইচ্ছা।

হয়তো বুঝবে, হয়তো নাও বুঝতে পারে…আর আমার বোন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট-কিছুটা একগুঁয়ে এবং জেদি প্রকৃতির মেয়ে, সে হয়তো এ প্রস্তাবে…

আপনার বোন একজন সম্রাজ্ঞী হবে এবং হয়তো পরবর্তী মোগল সম্রাটের জননীও- আর আপনি হবেন তার মামা। ভগবান দাশ, আপনি আপনার মতামত দিন। দয়া করে আমাকে নিরাশ করবেন না।

ভগবান দাশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, গলায় পড়া তিন প্যাঁচের মুক্তার মালায় তার আঙ্গুলগুলি খেলা করছে। অবশেষে তিনি হাসলেন। জাহাপনা, আপনার এই প্রস্তাব আমার পরিবারের জন্য সম্মানজনক। হীরা বাঈ আপনারই হবে। প্রার্থনা করি এই ঐক্যের প্রতি আমাদের সকল ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক।

*

কমলা এবং সোনালী সুতার কারুকাজ করা ঘন লাল রঙ্গের ঘোমটায় ঢাকা মেয়েটি একদম স্থির হয়ে বসে ছিলো। মাথায় পড়া মুকুটটি মুক্তা এবং সোনার সুতায় তৈরি করা ফুল পাতায় অলংকৃত। এটি আকবরের দেয়া বিয়ের উপহার। সাদা পোষাক পরিহিত হিন্দু পুরোহিত বিয়েতে তার ভূমিকাটুকু সম্পন্ন করেছেন এবং এখন আকবরের পক্ষে একজন মাওলানা মুসলিম রীতি অনুযায়ী কোরান থেকে আয়াত পাঠ করবেন। মাওলানা যখন সুললিত ছন্দে তেলাওয়াৎ করছেন আকবর লক্ষ্য করলেন মেয়েটির একটি সরু পেলব চরণ পোষাকের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেটি মেহেদীর জটিল নকশায় কারুকাজ করা।

আকবর নিজের হাতের দিকে তাকালেন, তাঁর হাত দুটিতেও মেহেদীর কারুকাজ-মা ও ফুফু সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে তাকে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছেন। তারা এখন উইলো গাছের শাখা দিয়ে তৈরি আড়ালের পেছন থেকে বিবাহ উৎসব প্রত্যক্ষ করছেন।

এক সময় তেলাওয়াৎ শেষ হলো, মাওলানা তার হাতির দাঁতের মলাট বিশিষ্ট কোরানটি বন্ধ করে সেটি পরিচারকের হাতে দিয়ে দিলেন। এর পর মাওলানা একটি গোলাপজলের জগ নিয়ে আকবরের বাড়িয়ে দেয়া হাত দুটিতে গোলাপজল ঢাললেন প্রতীকি পবিত্রতা আনয়নের জন্য। তারপর সলোমানি পাথরে (আকিক পাথর) তৈরি পাত্র থেকে আকবরের হাতে তরল পানীয় ঢাললেন এবং বললেন, বিবাহ বন্ধন নিশ্চিত করার জন্য পান করুন জাহাপনা।

আকবর সামান্য পান করলেন, তারপর হীরা বাঈ এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তাকে নিয়ে বিবাহ ভোজে যোগ দেয়ার জন্য। হিন্দু রীতি অনুযায়ী এই ভোজের আয়োজন করেছে কনে পক্ষ। আকবর ভগবান দাশকে আগ্রা দূর্গে উত্তম সাজ-সজ্জা বিশিষ্ট কয়েকটি কক্ষ প্রদান করেছেন তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং অন্যান্য সফরসঙ্গী ও কর্মচারী-ভৃত্যদের নিয়ে থাকার জন্য। আজকের দিন থেকে একমাস ব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠানের সূচনা হবে। উপহার প্রদান, শোভাযাত্রা, শিকার, হাতির লড়াই, যুদ্ধমহড়া প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই উৎসব মাস উদ্যাপিত হবে। কিন্তু ভোজসভা যতো অগ্রসর হচ্ছিলো ততোই আকবর আসন্ন রাত সম্পর্কে সামান্য অনিশ্চয়তা অনুভব করছিলেন। রক্ষিতাঁদের সঙ্গে আদান-প্রদানকৃত উপভোগের তৃপ্তি তার জন্য পরিচিত আনন্দপূর্ণ একটি বিষয় ছিলো। তাদের নরম পেলব হাত এবং সুগন্ধযুক্ত শরীর তাকে রাজকার্যের বোঝা থেকে সর্বদাই নিস্কৃতি দিয়ে এসেছে। কিন্তু একজন কুমারী রাজপুত রাজকন্যা শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে তার জন্য অভিনব অভিজ্ঞতা হবে।

পাশে বসে থাকা হীরা বাঈ এর দিকে আকবর এক পলক তাকালেন, এখনো ঝলমলে ঘোমটার আড়ালে তার মুখ ঢাকা। মেয়েটি কেমন হবে? এই প্রশ্ন শততম বারের মতো তাঁর মনে উদয় হলো। রাজপুত নারীরা তাঁদের চোখ ঝলসানো রূপের জন্য প্রসিদ্ধ, কিন্তু এই মেয়েটি যদি তেমন সুন্দর নাও হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই, আকবর নিজেকে বললেন। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এই বিবাহের মাধ্যমে তিনি অম্বর রাজ্যটিকে নিজের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। এ ধরনের আরো মিত্রতা ভবিষ্যতে সম্পাদিত হবে।

আকবর ভোজের পাশাপাশি আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিকে মনোযোগ প্রদানের চেষ্টা করলেন। কমলা রঙের পাগড়ি পড়া সুঠামদেহী উন্মুক্ত বক্ষের দুলিদের উদ্দাম ঢাকের তালে তালে এবং মোহনীয় বাঁশির সুরে ময়ূরনীল ঘাগড়া পরিহিত অম্বরের নর্তকীরা তাঁর সামনে ঘুরে ঘুরে নাচছে। রাজপুত গায়করা যুদ্ধক্ষেত্রের বিক্রম প্রকাশক কোনো গান গাইছে উচ্চ স্বরে, বাজিকররা আগুন জ্বলা দড়ির ফাঁসের মধ্যদিয়ে ডিগবাজি খেয়ে পার হচ্ছে, আয়নার কাঁচ বসান জোব্বা পরিহিত এক বৃদ্ধ তার পোষাকে মোমর আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে ঝুড়ির মধ্য থাকা একটি অজগর সাপকে প্রলুব্ধ করে খেলা দেখাচ্ছে।

অবশেষে এলো সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত যা আকবর নিজে পরিকল্পনা করেছেন। আকবরের প্রধান শিকারী উৎসব কক্ষে প্রবেশ করলো। তার পিছু পিছু এলো একটি বলিষ্ঠ দেহের অল্পবয়সী চিতাবাঘ। বাঘটির তামাটে গলায় চুনি ও হীরা খচিত গ্রীবাবন্ধনী সংযুক্ত। সেটার চোখের নিচের অশ্রুজলের দাগ পড়া অংশটি সোনা দিয়ে গিলটি করা, মনে হচ্ছে যেনো কোনো পৌরাণিক কল্পকাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা একটি জানোয়ার। আচমকা সেটার লেজের ঝাঁপটায় একটি পানপাত্র মাটিতে আছড়ে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে শিকারীটি বাঘটির গলার সঙ্গে যুক্ত চামড়ার রঙ্কুটি গুটিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করলো।

আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং ভগবান দাশকে লক্ষ্যকরে বললেন, এই বাঘটির নাম জালা, আমার প্রিয় শিকারী চিতাটির বাচ্চা। এই শুভ উৎসবে ওকে আমার পক্ষ থেকে আপনাকে উপহার হিসেবে প্রদান করতে চাই।

রাজার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আকবর জানতেন ভগবান দাশ তাঁর মতোই শিকার করতে পছন্দ করেন। এর থেকেও যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো চিতাবাঘ অত্যন্ত বিরল এবং মূল্যবান, সত্যিকার রাজকীয় প্রাণী। এটা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী উপহার। রাজা প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। রাজার উচ্ছ্বসিত মুখভাব এক নজর প্রত্যক্ষ করে আকবর আবার বললেন, আমার শিকারীরা ওর প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখবে এবং যখন তার প্রশিক্ষণ শেষ হবে আমি তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো। আকবর জালার কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তার নত মার্জিত মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। তোর বাবা যেমন আমার শিকারের সময় তড়িৎ এবং নির্ভীক আচরণ করে তেমনি তুইও তোর নতুন মনিবের জন্য করিস।

বিয়ের অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো চাঁদ তখন আকাশের অনেক উপরে, এর ঠাণ্ডা ফ্যাকাশে আলো যমুনার পানিকে তরল রূপায় পরিণত করেছে। যমুনার জল হীরা বাঈ এর জন্য নির্ধারিত হেরেম কক্ষের তিরিশ ফুট নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাজিয়েদের অনুসরণ করে আকবর হীরাবাঈকে নিয়ে কক্ষটিতে পৌঁছেছেন। আকবরের পরিচারকরা যখন তার পোষাক খুলে দিচ্ছিলো তখন তিনি কক্ষের এক প্রান্তে স্থাপিত সোনার কারুকাজ করা এবং ফুল ও তারা খচিত পর্দার দিকে তাকালেন-গুজরাটের বিখ্যাত তাঁতীরা দক্ষ হাতে সেটি তৈরি করেছে-ওটার আড়ালে নববধূর বিয়ের পোষাক খুলে সুগন্ধী তেল মেখে বাসর শয্যার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। যখন শেষ পরিচারকটি বিদায় নিল, আকবর তার সবুজ ঢিলা আলখাল্লাটি খুলে রেখে পর্দার কাছে উপস্থিত হলেন এবং পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। হীরাবাঈ তাঁর দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, স্বচ্ছ জাম রঙের মসলিন পোষাকের মধ্যদিয়ে তার ছিপছিপে শরীরের আবয়ব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। তার গাঢ় লাল মেহেদী দেয়া চুল উজ্জ্বল ঢেউ এর মতো নিতম্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আড়ষ্ট কাঁধ দুটি দেখে আকবর অনুমান করতে পারলেন সে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আছে।

হীরাবাঈ…ভয় পেও না। আমাকে ভয় করার মতো কিছু নেই। আকবর তার কাঁধে দুহাত রেখে আলতোভাবে নিজের দিকে ঘুরালেন। হয়তো তার চোখের অভিব্যক্তি-চিতার মতোই বুনো-আকবরকে সতর্ক করলো। হীরাবাঈ মুচড়ে আকবরের হাত থেকে মুক্ত হয়ে যখন ডান হাতটি উপরে তুললো, আকবর তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেমনটা করে থাকেন তেমনি তড়িৎ বেগে এগিয়ে গিয়ে তিনি বজ্রমুষ্ঠিতে তার কব্জি আকড়ে ধরলেন, ব্যথায় হীরাবাঈ চিৎকার করলো এবং একটি চওড়া ফলার ধারালো ছুরি তার হাত থেকে খসে পড়লো।

কেনো এমন করলে? আকবর চাপা স্বরে জানতে চাইলেন, এখনো তিনি শক্ত করে তার কব্জি ধরে আছেন। কেনো? আকবর আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এবার তার গলার স্বর খানিকটা উচ্চে উঠলো, হীরাবাঈ এর মুখ আকবরের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। কিন্তু হীরাবাঈ চুপ করে রইলো।

তার চোখ দুটি তার ভাইয়ের মতোই ঘন কালো রঙের, সেখানে এক রাশ ঘৃণা জমে আছে। অবশেষে সে কথা বলে উঠলো। কারণ আপনি আমার স্বজাতীয়দের শত্রু-চিত্তরগড়ের অগণিত বীর রাজপুতের হত্যাকারী এবং তাদের নারীদের, যারা আপনার সৈন্যদের লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার জন্য জওহর সম্পাদন (আগুনে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করা) করেছে। আমি নিজেও ওদের সঙ্গে মরতে পারলে ভালো হতো। আপনার কাছে নিজেকে সমর্পণের পরিবর্তে আমি খুশিমনে আগুনকে আলিঙ্গন করতে পারতাম।

আকবর হীরাবাঈকে ছেড়ে দিলেন, সে এলোমেলো ধাপে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে নিজের ভারসাম্য ঠিক করলো, তারপর নিজের কব্জি ডলতে লাগলো। আকবর তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন, যদিবা আর কোনো অস্ত্র তার কাছে থাকে, কিন্তু তার প্রায় নগ্ন শরীরে তেমন কিছু দেখা গেলো না। তোমার বড়ভাই স্বেচ্ছায় তোমাকে আমার কাছে সোপর্দ করেছেন। তিনি কি তোমার মনোভাব সম্পর্কে জানেন? একটি নতুন ভাবনা আকবরের মাথায় এলো। হয়তো তিনি জানতেন তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও। তিনিও কি তোমাকে এ বিষয়ে উস্কে দিয়েছেন?

এই প্রথমবারের মতো হীরাবাঈকে শঙ্কিত মনে হলো। না, তিনি কিছুই জানেন না। নিজ পরিবারের নারীদের তিনি খুব একটা সময় দেন না। এমনকি আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে এ খবরটিও আমি জানতে পেরেছি চিঠির মাধ্যমে।

আমার এখন উচিত রক্ষীদের তলব করা এবং সূর্যোদয়ের আগেই তোমার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা।

এখনই তা করুন।

তুমি কি সত্যিই মরতে চাও? সমগ্র জগত যখন জানবে তুমি কি করতে চেয়েছিলে, তখন তোমার বড়ভাইকে বাকি জীবনটা লজ্জা এবং অসম্মানের সঙ্গে কাটাতে হবে। এমন লোকের সঙ্গে কোনো রাজপুত নেতা সম্পর্ক রাখতে চাইবে যার বোন সকল সভ্য দায়িত্ববোধ এবং সম্মানকে বিসর্জন দিতে চেয়েছে। রাজপুতরা যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের বীরত্বের জন্য প্রসিদ্ধ, গোপন হত্যাকাণ্ড বা প্রতারণার জন্য নয়।

হীরাবাঈ ফুঁসে উঠলো। প্রথম বারের মতো আকবরের চোখে তার অপরূপ সৌন্দর্য ধরা পড়লো, ডিম্বাকৃতি মুখটির হাড়ের গঠন বিড়ালের মতোই সুন্দৰ প্ৰা পুলভিশ্বকৃতি মুশুনি কমনীয় এবং কোমল ত্বক একদম নতুন মধুর রঙের মতো। কিন্তু তার এই সৌন্দর্য তখন আকবরের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে তিনি তার দুই কাঁধ আকড়ে ধরলেন।

শোনো। একটি বোকা মেয়ের নির্বুদ্ধিতার জন্য আমি রাজপুত রাজ্যগুলির সঙ্গে আমার বহু প্রত্যাশিত মিত্রতা নষ্ট করবো না। চিত্তরগড়ের পতনের পর যে সব যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে, সম্মানজনক মৃত্যুই তাঁদের প্রত্যাশা ছিলো। রাজপুত যুদ্ধরীতি অনুযায়ী বেঁচে থাকা তাঁদের জন্য লজ্জাকর হতো। তোমার নিশ্চয়ই এটা অজানা নয়? সে কিছু বললো না, কিন্তু আকবর অনুভব করলেন হীরাবাঈ এর শরীর থেকে যুদ্ধংদেহী তেজ ক্রমশঃ অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। তিনি তার কাঁধে রাখা হাত দুটিও শিথিল করলেন। একটু আগে যা ঘটলো আমি সে সম্পর্কে কাউকে কিছু বলবো না এবং তুমি যদি তোমার পরিবারের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাও তাহলে তুমিও কিছু বলবে না। তুমি আমার স্ত্রী এবং একজন স্ত্রীর কর্তব্য তোমাকে পালন করতে হবে। তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো?

হীরা বাঈ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।

তাহলে আমার স্ত্রী হিসেবে এখন তুমি তোমার প্রথম দায়িত্ব পালন করো। আকবর বিছানার দিকে তাকালেন। হীরাবাঈ একটু সরে গেলো এবং কোমরে বাধা মুক্তার বন্ধনটির বাধন খুলতেই তার মসলিনের অন্তর্বাসটি মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। তার কমনীয় বাক বিশিষ্ট শরীরটি প্রলুব্ধকর দেখালো, কিন্তু আকবর যখন নিজের শরীরটি তার উপর স্থাপন করলেন তখন তাঁর মনে কামনার পরিবর্তে ক্রোধই বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে। আকবরের দেহ আন্দোলিত হতে লাগলো কিন্তু তার চোখ হীরাবাঈ এর মুখের উপর থেকে সরলো না। হীরাবাঈ এর চেহারায় ব্যথা বা অস্বস্তির কোনো অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো না যখন তার শরীরে আকবরের প্রবেশের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হলো। তৃপ্তিলাভের পরিবর্তে কাজটি সম্পন্ন করার জন্যই আকবর তখন উদ্গ্রীব। তার কুমারী স্ত্রীর সঙ্গে বাসর রাতটি এভাবে কাটবে বলে তিনি ভাবেননি। আদম খানের মতো তাঁর নবপরিণতা স্ত্রীও তার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। হীরাবাঈ, যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর মোকাবেলা করা যে কোনো শত্রুর মতোই বৈরী। কিন্তু আদম খানের মতো অন্য শক্ররাও তাঁদের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে যে আকবরের সঙ্গে বিরোধিতা তাঁদের অনুকূলে যায়নি। হীরাবাঈ হয়তো জীবন থাকতেই তা বুঝতে পারবে।

২.২ সেলিম

০৯. সেলিম

আমি দুঃখিত জাহাপনা, ওনার মাসিক রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়নি। খাজানসারা (হেরেম তদারককারি) ভীত দৃষ্টিতে আকবরের দিকে তাকালো যেনো হীরাবাঈ এর গর্ভধারণের ব্যর্থতার দোষটি কোনোভাবে তার উপরই বর্তেছে। রানীমা সর্বদাই বিষণ্ণ থাকেন, আপনাদের বিয়ের পর থেকেই যেমনটা রয়েছেন। তিনি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না। তিনি কদাচিৎ নিজের কক্ষ ছেড়ে হেরেমের বাগানে বেড়াতে যান। তিনি অম্বর থেকে সাথে করে আনা পরিচারিকাদের সঙ্গেই কেবল কথা বলেন এবং হেরেমের অন্য নারীদের থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের কোনো খেলা বা বিনোদনে যোগ দেন না। হয়তো তার কোনো অসুখ হয়েছে…আমি কি আরেকবার হেকিম কে খবর দেবো?

না। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক মাথা কাপড়ে ঢেকে (হেরেমের নারীদের যাতে দেখতে না পারেন) দুইজন খোঁজার তত্ত্বাবধানে হীরাবাঈকে পরীক্ষা করে গেছেন। আকবরও তখন কক্ষে ছিলেন। খোলের মধ্য থেকে উঁকি দেওয়া একটি কাছিমের মতো হাত বাড়িয়ে তিনি হীরাবাঈ এর পোষাকের নিচে শরীর হাতড়ে পরীক্ষা করেছেন। আমি কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না জাহাপনা, অবশেষে তিনি মন্তব্য করেন। ওনার জরায়ু পথ দৃঢ় এবং সুগঠিত।

আকবর বিষণ্ণ দৃষ্টিতে খাজানসারার দিকে তাকালেন। তিনি হীরাবাঈ এর কথা ভাবছেন। প্রতিবারই তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় তিনি কোনো প্রকার পরিবর্তন আশা করেছেন কিন্তু সে শিথিল হয়ে শুয়ে থেকেছে, কোনো প্রকার সাড়া দেয়নি। তিনি তার নিস্পৃহতায় যতোটা বিরক্ত হয়েছেন বাধা দান করলে হয়তো ততটা হতেন না। সে কি এখনো তাঁকে ছুরিকাঘাত করার স্বপ্ন দেখে? তিনি খাজানসারাকে সতর্ক করেছেন কোনো ধারাল বস্তু যেনো রানীর কক্ষে না থাকে। তত্ত্বাবধায়কটি কিছুটা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। হীরাবাঈ এর নিজের নিরাপত্তা এবং তার নিরাপত্তার জন্য এই আদেশ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ মাঝে মাঝে আকবরের আশঙ্কা হয়েছে সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতে পারে। তিনি তাকে একটি দ্বিতল কক্ষে স্থানান্তর করেছেন যার বারান্দা থেকে যমুনা দেখা গেলেও মার্বেল পাথরের আচ্ছাদনের কারণে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া অসম্ভব।

জাহাপনা?

আকবর ভুলে গিয়েছিলেন খাজানসারা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পারো। একমাস পরে আবার আমার সঙ্গে দেখা করবে-আল্লাহর ইচ্ছায় হয়তো তখন আমাকে দেয়ার জন্য তোমার কাছে কোনো ভালো সংবাদ থাকবে।

আকবর কিছুক্ষণ একা বসে থাকলেন। বাইরে পরিচ্ছন্ন মেঘহীন আকাশ। বর্ষাকাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তার উচিত বাজপাখি উড়াতে যাওয়া বা শিকার করতে যাওয়া। কিন্তু হীরাবাঈ সংক্রান্ত ভাবনা কেনো তাকে আচ্ছন্ন। করে রেখেছে? হয়তো সেটা ভালোবাসা নয়, হয়তো সেটা তার অহংকার… সকলেরই অনুমান করতে পারার কথা যে সম্রাট এবং রানীর মধ্যে কোনো প্রকার সমস্যা হয়েছে। একমাত্র রাতে হীরাবাঈ এর বিছানায় হানা দেয়া ছাড়া তারা একসঙ্গে আহার করেন না বা সময় কাটান না। তারপরও রাতের কাজ শেষে তিনি নিজের পৃথক কক্ষে ফিরে আসেন। আজ পর্যন্ত একদিন ভোরেও হীরাবাঈ এর বাহুতে তাঁর ঘুম ভাঙ্গেনি।

হয়তো মা তাকে এ বিষয়ে কোনো বিচক্ষণ উপদেশ বা সান্তনা দিতে পারবেন। এখনো পর্যন্ত মায়ের কাছে সবকিছু প্রকাশ করতে তিনি ইতস্তত বোধ করেছেন। প্রতি মাসেই তিনি আশা করেছেন হীরাবাঈ এর গর্ভধারণের সংবাদ পাবেন। কিন্তু সময় বয়ে যাচ্ছিলো এবং তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। বৃদ্ধ জওহর যে কথাটি তাকে বলেছে সেটা যদি সত্যি হয়-অধিক ক্ষতিকর কোনো পরিস্থিতি হয়তো দানা বেধে উঠছে। আকবরের একজন অমুসলিমকে বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হবে, ভগবান দাশের এই অনুমানটি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাওলানারা গোপনে এমন কথা বলাবলি করছিলো যে, আকবরের সন্তান না হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তি, কারণ তিনি একজন বিধর্মী হিন্দুকে বিয়ে করেছেন।

*

হামিদা পড়ছিলেন, কিন্তু আকবরকে দেখে তিনি তাঁর কবিতার বইটি নামিয়ে রাখলেন। কি হয়েছে? তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।

একটু আগে খাজানসারার সঙ্গে কথা হলো।

সে কি বললো?

হীরাবাঈ এখনো গর্ভধারণ করতে পারেনি।

তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তুমি মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ে করেছে।

আমি নিজেকে একথা বলেই সান্তনা দেই। কিন্তু আর কতো দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে?

তোমার বয়স এখনো কম। প্রয়োজনে আরো স্ত্রী গ্রহণ করবে। তোমার সন্তান নিশ্চয়ই হবে-এমনকি পুত্রও-তবে তারা হীরাবাঈ এর গর্ভে নাও হতে পারে।

বিষয়টি এখন আর আমার ধৈর্যহীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দুই সপ্তাহ আগে জওহর আমার কাছে এসেছিলো। তাকে আমার উজির বানানোর পর থেকে আরো বেশি তথ্য তার কাছে পৌঁছাচ্ছে।

রাজপ্রাসাদে প্রচলিত গুজবের কোনো গুরুত্ব নেই।

কিন্তু এটির আছে। কিছু উচ্চপদস্থ মাওলানা-মানে ওলামারা-দাবি করছেন যে হীরাবাঈ কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবে না। একজন বিধর্মীকে বিয়ে করে আমি ইসলামের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছি, তারজন্য এভাবে আল্লাহ্ আমার বিচার করছেন।

সাম্রাজ্য শাসন করো তুমি, ওলামারা নয়।

আমি তাদেরকে বা তাদের সংকীর্ণ কুসংস্কারকে ভয় করি না। তবে স্বীকার করছি প্রথমে আমার মনে হয়েছে তাঁদের কথায় হয়তো কিছুটা সত্য থাকতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি যতোই গভীর ভাবে চিন্তা করেছি ততই আমার মনে হয়েছে যে একজন ক্ষমাশীল করুণাময় আল্লাহ বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে তার সৃষ্ট মানুষকে কিছুতেই বর্জন করতে পারেন না। কিন্তু ওলামাদের বক্তব্য যতোই অসম্ভব হোক না কেনো হয়তো আমার প্রজাদের কেউ কেউ তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এর ফলে রাজ্যে ঘৃণা এবং বিভক্তি সৃষ্টি হতে পারে। ওলামারা ভালো করেই জানেন কেনো আমি একজন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছি-কেবল আমার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্যই নয় বরং এটাও প্রমাণ করার জন্য যে মোগল শাসন ধর্মনিরপেক্ষ।

তুমি বিচক্ষণ, হামিদা বললেন। তুমি সম্ভাব্য বিপদ আগেই অনুমান করতে পারো।

আমার পিতা আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছিলেন তার সম্ভইরা যে তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে সেটা তিনি অনেক দেরিতে বুঝতে পেরেছিলেন।

সেটা সত্যি। এর জন্য আমরা প্রায় জীবন হারাতে বসেছিলাম।

একই রকম ভুল আমি করতে চাই না, যদিও আমি যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তার প্রকৃতি ভিন্ন।

আমাকে হীরাবাঈ সম্পর্কে বলো। আমি জানি তুমি ওকে নিয়ে খুশি নও…আমাকে ক্ষমা করো বাবা, কিন্তু আমার এবং গুলবদনের কানে অনেক কথাই আসে। হীরাবাঈ কি তোমাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে?

সে আমাকে ঘৃণা করে।

কেনো?

চিত্তরগড়ের যোদ্ধাদের হত্যার জন্য সে আমাকে দোষারোপ করে এবং দূর্গশহর ধ্বংস করার জন্য…সে আমাকে তার স্বজাতীয়দের সর্বনাশের কারণ মনে করে।

সে এমন মনোভাব কীভাবে পোষণ করে যখন তারই ভাই তোমার মিত্র হতে পেরে এতো খুশি?

আকবর কাঁধ ঝাঁকালেন। আমার মনে হয় এর জন্য সে তার ভাইকেও অপছন্দ করে…কিন্তু সরাসরি আমাকে সে এ কথা বলেনি।

তুমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তুমি তাকে পুরোপুরি বুঝো? হয়তো আমাদের রাজপ্রাসাদ তার কাছে আপন মনে হয় না এবং রাজস্থানের জন্য তার মন কাঁদে। এক সময় হয়তো তার পরিবর্তন হবে।

আমি তাকে ভালোই বুঝতে পারি মা। বিয়ের রাতে সে আমাকে ছুরিকাঘাত করতে চেয়েছিলো। আকবর কথাটি বলতে চাননি কিন্তু নিজেকে বিরত করতে তিনি ব্যর্থ হলেন।

সে কি করেছে বললে? পুত্রবধূর প্রতি হামিদার সমস্ত সমবেদনা নিমিষেই উবে গেলো এবং তার চোখ দুটি রাগে ঝলসে উঠলো। এর জন্য তাকে তোমার মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো যেমন তোমার পিতার উচিত ছিলো প্রাথমিক বিদ্রোহের সময়ই তার ভাইদের হত্যার আদেশ দেয়া। তুমি একটু আগেই বললে তোমার পিতার ভুল গুলি থেকে তুমি শিক্ষা নিয়েছে, অথচ এখনো তুমি ঐ মেয়েটির সঙ্গে বিছানায় যাও যে তোমার মৃত্যু কামনা করে। আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি জানতাম তুমি বুঝবে না। তাই আমি এতোদিন তোমাকে কিছু বলিনি। আমি হীরাবাঈকে ত্যাগ করিনি কারণ তাকে আমি মিত্রতার প্রতীক মনে করি। এই বিবাহের ফলে রাজপুতরা খুশি হয়েছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে এই মিত্রতা কি বজায় থাকতো? আর নিজ দেবতাদের উপাসনা করার যে স্বাধীনতা হীরাবাঈ পেয়েছে তা আমার হিন্দু প্রজাদের জন্য একটি জীবন্ত প্রমাণ। এর ফলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে আমার কাছ থেকে তাদের ভয়ের কিছু নেই। বাইরের মানুষ আমাদের রাজপ্রাসাদের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা খুশি মনে দেখছে যে মোগল সম্রাট একজন হিন্দু স্ত্রী গ্রহণ করে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করছে।

হামিদা চুপ করে ছিলেন, তাঁর সুন্দর ভ্রু দুটি চিন্তায় কুচকে আছে। হয়তো তোমার ভাবনাই ঠিক, অবশেষে তিনি বললেন। আঘাত এবং মাতৃত্বসুলভ ক্রোধের কারণে আমি বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম। আমি হীরাবাঈ এর ঐ আচরণের কথা কাউকে বলবো না-এমনকি গুলবদনকেও না। তবে আমি আমার পরিচারিকাদের নির্দেশ দেবো তার উপর নজর রাখতে যাতে সে তার গর্ভধারণ প্রতিরোধের জন্য কিছু করতে না পারে। গর্ভধারণ প্রতিরোধের অনেক কৌশল প্রচলিত আছে। যেমন, তিক্ত ভেষজ ঔষধ সেবন, মিলনের আগে ভিনিগারে ভেজানো স্পঞ্জ যযানি পথের ভিতর ঢুকিয়ে রাখা, এমনকি মিলনের পরে ভেড়ার লোম পেচানো ছোট ডাল দিয়ে জরায়ু পরিষ্কার করার পদ্ধতিও রয়েছে। রাজপুত নারীদেরও নিজস্ব কৌশল থাকতে পারে।

ইতোমধ্যেই তার উপর নজর রাখা হয়েছে। খাজানসারা জালি পর্দার আড়াল থেকে মিলনের সময় আমাদের উপর নজর রাখে যদিবা হীরাবাঈ মিলনের আগে বা পরে অস্বাভাবিক কিছু করে তা আবিষ্কারের জন্য…আমার প্রতি তার ঘৃণার কারণে কি তার গর্ভধারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? সে প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী এবং মন শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যদিও বা সে সন্তান জন্ম দেয় তা কি মঙ্গল জনক হবে?

এসব বোকার মতো চিন্তা, আকবর। আর কেই বা বলতে পারে…হীরাবাঈ এর বয়স এখনো অনেক কম, সন্তানের মা হলে হয়তো তার মন পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

তার বয়স ততোটা কম নয় বাবাকে বিয়ে করার সময় তোমার বয়স যতোটা কম ছিলো।

আমি ভাগ্যবতী। তোমার বাবা আমাকে ভালোবেসে পছন্দ করেছিলেন এবং আমিও তাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আমি কেবল একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যা ছিলাম, হীরাবঈ এর মতো রাজকন্যা নয়। তোমার বাবা এবং আমার মধ্যকার সম্পর্ক অনেক বেশি সহজ ছিলো।

আকবর, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারবো। গুলবদন আমাকে শেখ সেলিম চিশতি নামের একজন সুফি সাধকের কথা বলেছে। সে তার সঙ্গে দেখা করেছে এবং বলেছে আমার পিতামহের মতো তিনিও ভবিষ্যৎ দেখতে পান। হয়তো তিনি তোমাকে এমন কিছু বলতে পারবেন যা শুনে তুমি শান্তি পাবে।

তিনি কোথায় থাকেন?

শিক্রিতে, এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

আমি জায়গাটা চিনি। আমি একবার শিকার করতে গিয়ে ঐ জায়গায় থেমেছিলাম পানি খাওয়ার জন্য।

*

আকবরের নেতৃত্বে ছোট আকারের একটি সৈন্যদল ধূলিময় পথের উপর দিয়ে শিক্রির মালভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তার দুটি প্রিয় শিকারী কুকুর পাশাপাশি দৌড়াচ্ছিলো এবং দুইজন শিকারের সহচর ও একজন কোৰ্চি ছাড়াও কিছু সংখ্যক দেহরক্ষী তাকে অনুসরণ করছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা একটি অল্প বয়সী হরিণকে তিনি হত্যা করেছেন এবং সেটা ইতোমধ্যে আগ্রার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে হরিণটিকে ঝুলিয়ে বেঁধে একজন শিকারের সহচর সেটা নিয়ে গেছে। তিনি যে অভিযানে বেরিয়েছেন সেটা শিকারের অভিযান, কোনো সাধুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় নয়-এমন ধারণা সৃষ্টি করাই যুক্তিসঙ্গত বলে আকবরের মনে হয়েছে।

দুপুরের রোদের উষ্ণ আবরণের মধ্য দিয়ে দূরে মালভূমির প্রান্তে মাটির ইটে তৈরি ঘরবাড়ির আবয়ব দেখা গেলো, সেটাই শিক্রি। রৌদ্রের তাপ কিছুটা কমে না আসা পর্যন্ত আমরা ওখানে বিশ্রাম করবো, তিনি কোৰ্চিকে বললেন। আমি একজন সুফি সাধকের গল্প শুনেছি যিনি ঐ গ্রামে থাকেন এবং আমার কৌতূহল হচ্ছে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তুমি ঘোড়া চালিয়ে ওখানে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো সম্রাটের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন কি না।

তরুন কোৰ্চিটি যখন ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলো আকবর মালভূমির খাড়া ঢাল বেয়ে ধীরে তাকে অনুসরণ করলেন। গ্রামে পৌঁছে একটি ঘন বিন্যস্ত আমগাছের পাশে তিনি ঘোড়া থেকে নামলেন। কয়েক মিনিট পর তিনি তার কোৰ্চিকে ফিরে আসতে দেখলেন।

জাহাপনা, শেখ সেলিম চিশতি হুজুর আপনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আমার সঙ্গে আসুন।

আকবর গ্রামের মধ্য দিয়ে তার কোচিঁকে অনুসরণ করে একটি নিচু একতালা বাড়ির সামনে উপস্থিত হলেন। বাড়িটিতে প্রবেশের দরজার দুইপাশে জানালা হিসেবে মাত্র দুটি ফোঁকর রয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি নিজেকে অন্ধকারের মধ্যে আবিষ্কার করলেন। তারপর যখন তাঁর চোখে আধার সয়ে এলো তখন তিনি সামনের মেঝেতে একজন মোটা কাপড়ের সাদা আলখাল্লা পরিহিত ব্যক্তিকে কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়তে দেখলেন।

মাফ করবেন জাহাপনা, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম যাতে তার নির্দেশনায় আমি আপনার উপকার করতে পারি। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধটি একটি মাটির মোমদানিতে মোম জ্বালালেন। মোমের হালকা আলোয় আকবর সুফিটির আখরোটের মতো কুঞ্চিত মুখ দেখতে পেলেন।

আপনি কীভাবে জানলেন আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি? আকবর তার আশেপাশে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞাসা করলেন। মেঝেতে পাতা একটি গাঢ় লাল রঙের জায়নামাজ, একটি অমসৃণ কাঠের তৈরি বাক্স এবং বিছানা হিসেবে ব্যবহৃত দড়ির চৌপায়া ছাড়া কক্ষটিতে আর কিছু নেই।

যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের সকলেই আমার কাছে ঐশ্বরিক সহযোগীতা কামনা করেন, যদিও তারা নিজেরা মনে করেন তারা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে আমার কাছে এসেছেন। মনে হচ্ছে আপনি অবাক হয়েছেন জাহাপনা। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলছি। আমার যে সামান্য ক্ষমতা রয়েছে তা অর্জনের জন্য আমি কখনোও প্রার্থনা করিনি, কিন্তু আল্লাহর ঐশ্বরিক কৃপায় কখনো কখনো আমি তার মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হই। এগিয়ে এসে আমার সামনে বসুন যাতে আমি আপনাকে ভালো করে দেখতে পারি।

আকবর সাধুর সামনে পাতা মাদুরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলেন। বেশ কিছু সময় সাধুটি কিছু বললেন না। কিন্তু তার পেচার মতো উজ্জ্বল চোখের তারা দুটি আকবরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো, যেনো আকবরের মনের ভিতরে কি আছে তাও তিনি জেনে যাবেন। একসময় তিনি সামান্য দুলতে লাগলেন, তাঁর লম্বা সরু হাত দুটি বুকের উপর ভাঁজ করা, তিনি নিচুস্বরে একটি প্রার্থনা বাক্য পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন, আমাকে জ্ঞান দাও, আমাকে পথ দেখাও। সাধুটি কখনো তাকে জিজ্ঞাসা করবেন তাঁর আগমনের কারণ? আকবর ভাবলেন। কিন্তু তিনি যখন অপেক্ষা করছিলেন, একটি প্রশান্তিময় অনুভূতি তাঁর মনে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এলো এবং তার দেহ ও মন চাপ ও দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হতে লাগলো। তার কামনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলিও ক্রমশ তার মধ্য থেকে অপসারিত হতে লাগলো যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি একটি শিশুর মতো দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে পড়লেন।

এখন আরম্ভ করার জন্য আমরা প্রস্তুত। সাধুটি হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে আকবরের কাঁধ স্পর্শ করলেন। আকবর চমকে চোখ খুললেন, ভাবছেন কতোক্ষণ ধরে তিনি এমন অর্ধ নিদ্রিত হয়ে ছিলেন যা আশ্চর্যজনক ভাবে অত্যন্ত আরামদায়ক ছিলো। আপনি আমার কাছে কি জানতে চান জাহাপনা?

জানতে চাই আমার স্ত্রী কোনো পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারবে কি না।

আর কিছু জানতে চান না? এটাতো খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন।

হয়তো ততটা সাধারণ নয়। আপনি কি জানেন আমার স্ত্রী একজন হিন্দু?

নিশ্চয়ই জানি জাহাপনা। সমস্ত হিন্দুস্তানের মানুষ তা জানে।

নিজে একজন মুসলমান হিসেবে আপনি কি মনে করেন আমার স্ত্রীর সন্তান না হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর বর্ষিত শাস্তি, যেহেতু আমি একজন বিধর্মীকে বিয়ে করেছি?

না। একজন সুফি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর একাধিক পথ রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজেদের নির্দিষ্ট পথটি খুঁজে বের করা।

আমাদের ধর্ম বিশ্বাস যেমনই হোক?

হ্যাঁ। আল্লাহ্ আমাদের সকলেরই স্রষ্টা।

সুফি ঠিক কথাই বলেছেন, আকবর ভাবলেন। তিনি বোকার মতো ওলামাদের কথার গুরুত্ব দিয়েছেন। হীরাবাঈ তাকে ঘৃণা করে বলে সন্তান ধারণ করছে না এমন ধারণাও তার বোকামী। তিনি কখনোও ভাবেননি তার অহংকার এবং মর্যাদাকে অতিক্রম করে একজন অপরিচিত মানুষের মুখ থেকে তিনি এই সত্য উদঘাটন করবেন।

আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবাসে না। যখনই আমি তার সঙ্গে মিলিত হতে যাই, আমি তার মাঝে আমার প্রতি ঘৃণা দেখতে পাই….আমি তার সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছি…কিন্তু…

সুফি হাত তুলে আকবরকে থামিয়ে দিলেন। আরো কাছে আসুন।

আকবর সামনের দিকে ঝুকলেন এবং সুফি তার মুখ ধরে নিজের কপালের সঙ্গে আলতো ভাবে তার কপাল স্পর্শ করালেন। আবারো ভালো লাগার একটি বিস্ময়কর অনুভূতি আকবরকে পাবিত করলো, তাঁর মনে হলো তিনি যেনো আলোর বন্যায় স্নানরত।

আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না জাঁহাপনা। আপনার স্ত্রী শীঘ্রই একটি পুত্র সন্তান ধারণ করবেন এবং আপনার আরো দুইজন সন্তান হবে। মোগল বংশের রক্তপ্রবাহ হিন্দুস্তানের বুকে বহু প্রজন্ম পর্যন্ত স্থায়ী হবে।

ধন্যবাদ শেখ সেলিম চিশতি, অসংখ্য ধন্যবাদ। আকবর তার মাথা নত করলেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে এসেছে, সবরকম আত্মসন্দেহ দূর হয়ে গেছে। তিনি অনুভব করলেন সবকিছুই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবে রূপ নেবে। নিজ সন্তানদের সহায়তায় তিনি একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করবেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তারা অগ্রসর হতে থাকবে…মোগল বংশ আরো ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে। আপনি যা বললেন সেসব যখন বাস্ত বায়িত হতে থাকবে তখন আমি শিক্রিকে একটি সমৃদ্ধ শহরে পরিণত করবো আপনার সম্মানে। এখানে নির্মিত রাজপ্রসাদ, ঝর্না, বাগান প্রভৃতি সমগ্র পৃথিবীর জন্য বিস্ময়ে পরিণত হবে এবং আমি আমার রাজপ্রাসাদ আগ্রা থেকে এখানে স্থানান্তরিত করবো।

আপনার স্ত্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা হবেন তাকে এখানে পাঠাবেন। এই গ্রামের বাইরে ছোট একটি আশ্রম আছে, সেখানে রানীমার যত্নের ব্যবস্থা করা যাবে। আর, হয়তো রাজপ্রাসাদের বাইরে এলে তার মনও অনেক শান্তি লাভ করবে এবং তখন তিনি আরো সহজে মাতৃত্বের প্রস্তুতি নিতে পারবেন।

সে কি এখানে তার ধর্মের চর্চা করতে পারবে?

নিশ্চয়ই পারবে। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি স্রষ্টাকে পাওয়ার একাধিক পথ রয়েছে।

তাহলে অবশ্যই আমি তাকে এখানে পাঠাবো। আকবর উঠে দাঁড়ালেন।

আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আপনি আমাকে স্বস্তি এবং আশা প্রদান করেছেন।

আমি নিজেও আনন্দিত। কিন্তু আরেকটি বিষয় আপনাকে আমার জানানো উচিত এবং সেটি আপনার পছন্দ নাও হতে পারে।

সেটা কি? আকবর অত্যন্ত নম্রভাবে সুফির কাঁধে তাঁর হাত রাখলেন।

যদিও আপনি তিন জন বলিষ্ঠ পুত্রসন্তান লাভ করবেন, কিন্তু মনে রাখবেন-ক্ষমতার লোভ এবং তা অধিকার করার আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে নিবিড় পারিবারিক বন্ধনকেও বিষাক্ত করে তুলতে পারে। সহজাত ভাবেই আপনার পুত্ররা আপনাকে ভালোবাসবে কিম্বা নিজেদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে এমনটা আশা করবেন না।

তার মানে? আপনি কি বুঝাতে চাইছেন আমার পিতা যেমন পারিবারিক বৈরিতার শিকার হয়েছিলেন তেমনি আমিও হবো?

এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই জাঁহাপনা। আমি প্রত্যক্ষ করেছি আপনি পুত্র সন্তান লাভ করবেন এবং আপনার সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হবে, কিন্তু এর বাইরে আমি কালো ছায়াও দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এখনো তা সম্পূর্ণ আকৃতি লাভ করেনি, এর মাঝে অবশ্যই কোনো সতর্কতা সংকেত নিহিত রয়েছে। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে জাহাপনা। আমার কথা গুলি মনে রাখবেন। আপনার পুত্ররা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাঁদের প্রতি নজর রাখবেন যাতে এই কালো ছায়া তাঁদের মাঝে ক্রিয়াশীল হওয়ার আগেই আপনি এর প্রভাব থেকে তাঁদের মুক্ত করতে পারেন।

সেদিন দিন শেষে আগ্রার পথে ফেরার সময় আকবর সুফির সতর্কবাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুরের সময় থেকে শুরু করে বহুবার মোগলরা বাইরের শত্রুর পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে কলহে জড়িয়ে পড়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পতিত হয়েছে। তিনি এ জাতীয় লক্ষণের দিকে সর্বদা নজর রাখবেন। কিন্তু সেসব অনেক দূরবর্তী ভবিষ্যতে অবস্থিত। এই মুহূর্তে তিনটি পুত্র সন্তান লাভের স্বপ্নে পাবিত আকবর অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে তাঁর ঘোড়া ছুটালেন।

*

ছয় সপ্তাহ পর আকবর খাজানসারার কাছে শুভ সংবাদটি পেলেন।

জাহাপনা, রানীমা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।

সন্তান কবে ভূমিষ্ঠ হবে?

হেকিম জানিয়েছেন অগাষ্ট মাসে।

আমি এখনই হেরেমে যাব। আকবর অনন্দ অশ্রু সংবরণ করতে করতে প্রায় দৌড়ে মহিলা মহলের দিকে অগ্রসর হলেন। হীরাবাঈ এর কক্ষে প্রবেশ করে তিনি আগরবাতির পরিচিত মিষ্টি ঘ্রাণ পেলেন। একটি হাসিহীন বহু বাহু বিশিষ্ট দেবী মূর্তির সামনে রাখা পিতলের পাত্রে হীরাবাঈ সর্বদাই এই আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখে। সে একটি বার্ণিশ করা নিচু রাজপুত-অসনে বসেছিলো এবং পরিচারিকা তার চুল আচড়ে দিচ্ছিলো। আকবরের মনে হলো তাঁর স্ত্রীর আড়ষ্ট এবং অনিশ্চিত চেহারা ইতোমধ্যে নরম হতে শুরু করেছে এবং ত্বকে নতুন করে উজ্জ্বলতা তৈরি হতে শুরু করেছে। কিন্তু তার স্বাভাবে কোনো কোমলতা যদি তিনি আশা করে থাকেন তাহলে তাকে হতাশ হতে হলো। সে যখন মুখ তুলে তাকালো আকবর লক্ষ করলেন তার মুখভাব আগের মতোই অনমনীয় এবং দূরবর্তী।

তুমি যেতে পারো, আকবর পরিচারিকাটিকে আদেশ দিলেন। সে চলে যেতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি তুমি মা হতে চলেছো?

হ্যাঁ। নিশ্চয়ই খাজানসারা আপনাকে এ কথা বলেছে।

আমি একজন সাধারণ স্বামীর মতো তোমার মুখ থেকেই সংবাদটি শুনতে চেয়েছিলাম। হীরাবাঈ-আমার ঔরসজাত সন্তান তোমার গর্ভে, হয়তো সে আগামী মোগল সম্রাট হবে। এই মুহূর্তে আমি কি এমন কিছুই করতে বা বলতে পারি না যাতে তুমি আমার প্রতি সদয় হতে পারো এবং নিজে খুশি হতে পারো?

একমাত্র অম্বরে আমাকে ফেরত পাঠালেই আমি খুশি হতে পারি, কিন্তু তা অসম্ভব।

শীঘ্রই তুমি একজন মা হবে। তোমার কাছে কি এর কোনো তাৎপর্য নেই? হীরাবাঈ ইতস্তত করলো। আমি সন্তানটিকে ভালোবাসবো কারণ তার শিরায় আমার স্বজাতীয়দের রক্তও প্রবাহিত হবে। কিন্তু আপনার প্রতি আমার যে ভালোবাসা নেই তার মিথ্যা অভিনয় আমি করতে পারবো না। আমি প্রার্থনা করি আপনি অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবেন।

আমাকে একটি সুস্থ্য পুত্র উপহার দাও, কথা দিচ্ছি তোমার সঙ্গে আর কোনো দিন আমি শোব না। হীরাবাঈ কিছু বললো না। আমি চাই আজ থেকে এক সপ্তাহ পর একটি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য তুমি প্রস্তুত

আপনি আমাকে কোথায় পাঠাতে চান? প্রথম বারের মতো হীরাবাঈ এর শিথিল আচরণের মধ্যে খানিকটা উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া গেলো।

ভয়ের কিছু নেই। তোমাকে আমি একটি শুভ আশীর্বাদপূর্ণ স্থানে পাঠাতে চাই-শিক্রিতে। আমি তোমাকে আগে কথাটি বলিনি কারণ আমি জানি তুমি আমার ধর্মকে অবিশ্বাস করো, কিন্তু শিক্রিতে একজন মুসলিম সুফি বাস করেন। তিনি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে তুমি আমার জন্য একটি সন্তান ধারণ করবে এবং আমাকে বলেছিলেন তোমাকে সেখানকার একটি আশ্রমে পাঠাতে যেখানে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত তোমার পর্যাপ্ত যত্ন নেয়া হবে। আমার শ্রেষ্ঠ হেকিমদের তোমার সঙ্গে পাঠাবো এবং তুমি যে কয়জন ইচ্ছা পরিচারিকা সাথে নিতে পারো। সেখানকার আবহাওয়া খুবই ভালো-আগ্রার তুলনায় ঠাণ্ডা ও স্বাস্থ্যকর। এই সব সুবিধা তোমার এবং তোমার গর্ভের সন্তানের উপকারে আসবে। এছাড়া তুমি সেখানে তোমার ধর্মও চর্চা করতে পারবে।

হীরাবাঈ তার কোলের উপর ভাজ করে রাখা হাতের দিকে তাকালো। আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু হবে।

আমি কি তোমার ভাইকে খবরটা জানাবো?

হীরাবাঈ মাথা নাড়লো। সে আরো কিছু বলতে পারে এমন আশা করে আকবর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন। আমি সন্তানটিকে ভালোবাসবো, সে বলেছে, কিন্তু বাস্তবে কি তা হবে? সে যদি বাবাকে ঘৃণা করে তাহলে সন্তানটির জন্য তার কতোটুকু ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে? সুফির সতর্কবাণী এক মুহূর্তের জন্য তার মনে এলো। তাঁর স্ত্রীর বৈরিতা কি সুফির প্রত্যক্ষ করা দূরবর্তী ছায়া গুলির একটি আরেকবার হীরাবাঈ এর আন্তরিকতাহীন চেহারা পর্যবেক্ষণ শেষে আকবর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অনুভব করলেন তার মাঝে আবার আনন্দ উচ্ছ্বাস ফিরে আসছে। তিনি প্রথম বাবা হতে চলেছেন…

*

যে পবিত্র মানুষটি তোমার জন্মের ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন তাঁর নাম অনুসারে আমি তোমার নাম সেলিম রাখলাম।

মোচড়াতে থাকা সদ্য জন্মলাভ করা শিশুটিকে কোলে নিয়ে আকবর বললেন। শিশুটি তার বাম হাতে ধরা। এবার ডান হাতে একটি পিরিচ ভর্তি ছোট ছোট স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে তিনি খুব যত্নের সঙ্গে শিশুটির মাথায় ঢাললেন। সেলিম তার ক্ষুদ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে এবং তার মুখ কুচকে গেলো কিন্তু সে কাঁদলো না। গর্বের হাসি দিয়ে আকবর সেলিমকে উঁচু করে ধরলেন যাতে সকলে তাকে দেখতে পায়। তারপর তিনি তার বয়স্ক উজির জওহর এর ধরে থাকা সবুজ মখমলের চওড়া গদিতে তাকে শুইয়ে দিলেন। এবার কালো পাগড়ি পরিহিত প্রধান ওলামা শেখ আহমেদ এর বক্তব্য প্রদানের পালা। একটি হিন্দু মায়ের গর্ভজাত সন্তানকে আশীর্বাদ করার ব্যাপারে তার মনোভাব কেমন হতে পারে? তার ঘন দাড়ি আচ্ছাদিত মুখ বৈশিষ্টহীন। তার মনের মধ্যে যাই থাকুক তা প্রকাশ পাচ্ছিলো না, যদিও তার অভিসন্ধিমূলক ফতোয়াকে ব্যর্থ করে দিয়ে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে।

সেলিমের জন্মের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ওলামা বয়ান শুরু করলেন: এই ভুবন আলো করা শিশুটির মঙ্গলময় আগমনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ওলামা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যাদের মহানুভব সম্রাট শিক্রিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেছেন। যুবরাজ সেলিম, আল্লাহ আপনাকে পথপ্রদর্শন করুন এবং এক সমুদ্র ঐশ্বরিক ঐশ্বর্য আপনার উপর বর্ষিত হোক এই কামনা করছি।

ঐদিন সন্ধ্যায় শিক্রির মালভূমিতে টাঙ্গানো বহু সংখ্যক শামিয়ানার নিচে সেলিমের জন্ম উপলক্ষে আয়োজিত ভোজসভা চলছিলো। মোগলদের আদি জন্মস্থান থেকে বয়ে আনা রীতিতে নাচ গানের অনুষ্ঠানও চলছিলো। রীতি অনুযায়ী আকবর, আহমেদ খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের হাতে ধরে চক্রাকারে নাচের ভঙ্গিতে কয়েক বার পাক খেলেন। এ সময়ে আকবরের মনে হলো তাঁর এখন আরেকটি জিনিস করা দরকার।

তখন রাত আরো গম্ভীর হয়েছে। আকবর ঘোড়ায় চড়লেন এবং অল্প কয়েকজন রক্ষী নিয়ে হীরাবাঈ যে আশ্রমে অবস্থান করছে সে দিকে রওনা হলেন।

সম্রাট এসেছেন! তার একজন রক্ষী চিৎকার করে জানান দিলো, যখন তারা আশ্রমের তোরণের সামনে উপস্থিত হলেন। অম্বর থেকে আগত কমলা পাগড়ি পরিহিত রাজপুত সৈন্যরা পাহারায় ছিলো। বর্তমান অবস্থায় তাদের রাজকন্যার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আকবর তাঁদের অনুমতি দিয়েছেন। সৈন্যরা সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের দলনেতা এগিয়ে এলো।

স্বাগতম জাহাপনা।

আকবর ঘোড়া থেকে নামলেন এবং নিজের কোর্চির দিকে লাগামটা ছুঁড়ে দিয়ে প্রবেশ পথ দিয়ে একটি স্বল্প আলোকিত উঠানের দিকে অগ্রসর হলেন। আবার কেউ চিৎকার করে ঘোষণা দিলো, সম্রাট এসেছেন! এবারে হীরাবাঈ এর একজন রাজপুত সেবিকা ছায়ার মধ্য থেকে প্রদীপ হাতে এগিয়ে এলো।

আমাকে আমার স্ত্রীর কাছে নিয়ে চলো।

হীরাবাঈ নীল রঙের তাকিয়ার ঠেস দিয়ে নিচু বিছানায় শুয়ে ছিলো। সেলিম তার বুকের দুধ পান করছিলো এবং আকবর হীরাবঈ এর চেহারায় এমন একটি তৃপ্তির ভাব লক্ষ্য করলেন যা তিনি আগে কখনোও প্রত্যক্ষ করেননি। সেটা এতোই অপ্রত্যাশিত যে তাকে তার কাছে অচেনা মনে হলো। কিন্তু যখন সে আকবরের দিকে তাকালো, তার চেহারা থেকে সেই পরিতৃপ্তির আভা অদৃশ্য হলো। আপনি কেনো এসেছেন? আপনারতো এখন ভোজ সভার অতিথিদের সঙ্গ দেয়ার কথা।

হঠাৎ আমার পুত্রের মুখ দেখতে ইচ্ছা হলো…এবং আমার স্ত্রীকে।

হীরাবাঈ কিছু বললো না, কিন্তু সেলিমকে স্তনের বোঁটা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পরিচারিকার কোলে দিলো। হঠাৎ দুধ পান করা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শিশুটি কাঁদতে লাগলো, কিন্তু হীরাবাঈ ইঙ্গিতে তাকে আকবরের কাছে নিয়ে যেতে বললেন।

হীরাবাঈ, আমি শেষ বারের মতো তোমার কাছে আবেদন করতে এসেছি। জীবনের বাকি সময়টা সেলিম আমাদের মাঝে রক্ত-মাংসের সংযোগ সূত্র হয়ে থাকবে। আমরা কি অতীতকে ভুলে তার জন্য আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারি না? আমি চাই আমার বাকি সন্তানদেরও তুমি ধারণ করো যাতে পরবর্তী জীবনে তারা পরস্পরকে সহযোগীতা করতে পারে আপন ভাই হিসেবে।

আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমাকে একা শান্তিতে থাকতে দিতে। আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন পুত্র সন্তান উপহার দিলে আপনি তা করবেন। আপনার বাকি সন্তানদের বাবা হওয়ার জন্য অন্য নারীদের গ্রহণ করুন।

সৎভাই থাকলে ভবিষ্যত সম্রাট হিসেবে সেলিমের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। সৎ ভাইরা তার প্রতি কম বিশ্বস্ত থাকবে। তুমি কি সেটা বিবেচনা করেছো? তোমার পুত্রের অবস্থান যথাসম্ভব শক্তিশালী করার জন্য তোমার কি কোনোই দায়বদ্ধতা নেই?

আমার পুত্রের শিরায় রাজপুত রক্ত প্রবাহিত। সে যে কোনো বিরোধীতা ধূলায় পদদলিত করবে। হীরাবাঈ চিবুক উঁচু করে বললো।

হীরাবাঈ এর এমন নিরুদ্বেগ একগুঁয়ে অহমিকা এবং দুনিয়া সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী আকবরকে ভীষণ হতাশ করলো। একবার তার মনে হলো ভবিষ্যত সম্পর্কে সুফির নেতিবাচক অনুমানের কথা হীরাবাঈকে জানাবেন। কিন্তু তিনি অনুভব করলেন সে তাতে মতো পরিবর্তন করবে না। তবে তাই হোক, কিন্তু তিনি এমন মেয়ের কাছে তাঁর পুত্রের লালন পালনের ভার অর্পণ করবেন না।

ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু তুমি যা করতে চাচ্ছ তার একটি মূল্য তোমাকে দিতে হবে। তোমার যখন ইচ্ছা হবে তুমি সেলিমকে দেখতে পারবে, কিন্তু তাকে আমি আমার মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখবো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোগল যুবরাজরা তাদের আপন মায়ের বদলে বয়োজ্যষ্ঠ রাজমাতাদের তত্ত্বাবধানে লালিত হয়। আমার মা ওর জন্য একজন দুধ-মা নিযুক্ত করবেন যা মোগল রীতিরই অংশ। আমার পুত্র রাজপুত নয় বরং মোগল রাজপুত্র হিসেবে মানুষ হবে।

হীরাবাঈ আকবরের দিকে তাকালো। কিন্তু তার মাঝে কষ্টবোধ বা প্রতিবাদের কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। সামান্য শক্ত হয়ে উঠা চোয়াল থেকেই তার একমাত্র প্রতিক্রিয়া বুঝা গেলো। আপনি সম্রাট। আপনার কথাই আইন। তার কণ্ঠস্বর কিছুটা উদ্ধত শোনালো। আকবর এসেছিলেন একটা শেষ চেষ্টা করতে যদিও তিনি আগেই অনুভব করেছিলেন হীরাবাঈ এর মনের বন্ধ দরজা কিছুতেই উন্মুক্ত করা সম্ভব নয়।

.

১০. জগতের একটি বিস্ময়

আপনি আমাকে ব্যাপক সম্মান প্রদান করলেন এবং আমার উপর অত্যন্ত বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করলেন জাহাপনা।

আমি জানি তুমি নিষ্ঠার সঙ্গে তোমার দায়িত্ব পালন করবে আবুল ফজল। আমি চাই আমার শাসন আমলের ঘটনাপঞ্জি পরবর্তী প্রজন্মগুলির জন্য অনুসরণীয় গ্রন্থ হয়ে থাকুক। এতে ভালো বা মন্দ সব ঘটনার সত্য বিবরণ তুমি লিপিবদ্ধ করবে। কখনোই আমার তোষামোদ করবে না।

আমি অকৃত্রিমতার ঘ্রাণযুক্ত কলম দিয়ে প্রতিটি শব্দ লিপিবদ্ধ করবো জাহাপনা।

আকবর তাঁর সদ্য নিয়োগকৃত প্রধান ঘটনাপঞ্জিলেখকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যদিও তাঁর অন্য একাধিক অনুলেখক ছিলো তবুও তিনি এমন একজন লেখকের প্রয়োজন অনুভব করছিলেন যে তাঁর প্রদান করা বক্তব্যের চেয়েও বেশি কিছু লিখতে পারবে-যে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর রাজত্ব কালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সমূহ লিপিবদ্ধ করবে যখন তিনি বেঁচে থাকবেন না তখনো। আবুল ফজল একজন বৃষস্কন্ধ এবং বক্র পা বিশিষ্ট লোক এবং বয়সে তার চেয়ে সামান্য ছোট। তার পিতা শেখ মোবারক যিনি একজন ধর্মতাত্ত্বিক পণ্ডিত, কয়েক বছর আগে পারস্য থেকে সপরিবারে মোগল রাজ দরবারে আগমন করেন। একজন উপদেষ্টা এবং রাজনীতিক বিশ্লেষক হিসেবে আবুল ফজলের দক্ষতা ইতোমধ্যেই আকবরের নজর কেড়েছে। কিন্তু তাঁর উজির জওহর এর সুপারিশে তিনি তাকে প্রধান ঘটনাপঞ্জিলেখকের পদে নিয়োগ করলেন। জওহর বলেছিলো যদিও আবুল ফজল একজন নিষ্ফল এবং নির্লজ্জ তোষামোদকারী তবুও তার মধ্যে চাতুর্য এবং বিশ্বস্ততা রয়েছে। ঘটনা সমূহের কেন্দ্রে অবস্থান করায় সে সেগুলিকে মহিমান্বিত করে তুলবে এবং তুলনামূলকভাবে সংযত এবং অবসরগামী লেখকদের চেয়ে কাজটি অধিক দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারবে। আবুল ফজলের পরিচ্ছন্নভাবে কামানেনা মুখের বিগলিত হাসি দেখে আকবর অনুমান করতে পারছিলেন এমন একটি আস্থানির্ভর কাজের দায়িত্ব পেয়ে সে কতোটা কৃতজ্ঞ বোধ করছে।

সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় আমি যে সংস্কার করতে যাচ্ছি তার বিবরণ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তোমাকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো আমার উত্তরসূরিদের নির্দেশনা প্রদান করা।

নিশ্চয়ই জাঁহাপনা। তড়িৎ বেগে হাত নেড়ে আবুল ফজল একজন পরিচারককে ইঙ্গিত করলো। পরিচারকটি একটি উঁত কাঠের তৈরি ছোট আকারের ঢালু লেখার টেবিল তার সামনে রাখলো এবং কাগজ, কলম ও কালি সরবরাহ করলো।

তাহলে শুরু করা যাক। আকবর উঠে তার কক্ষের মধ্যে পায়চারী শুরু করলেন। আমি ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথমত আমি আমার সকল কর্মকর্তাদের একটি মাত্র ক্রমবিভক্ত ধারায় সংগঠিত করতে চাই। তারা সেনাবাহিনীর সদস্য হোক বা না হোক প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্যের দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত থাকবে। তোমাকে বিস্মিত দেখাচ্ছে আবুল ফজল, কিন্তু এমন বিশাল এবং অসম সাম্রাজ্যের জন্য আমাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। এমনকি এদের মধ্যে রাজকীয় রন্ধনশালার প্রধানও অন্তর্ভূক্ত হবে-সে ছয়শো সৈন্যের দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত হবে। আমার উপদেষ্টা এবং ঘটনাপঞ্জিকার হিসেবে তুমি চার হাজার সৈন্যের দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত হবে।

আবুল ফজলের মুখে সন্তুষ্টির হাসি দেখা গেলো এবং সে আবার নুয়ে লিখতে শুরু করলো যখন আকবর বলা শুরু করলেন। দ্বিতীয়ত আমার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত কিছু ভূমি রাজ সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করা হবে এবং আমার কর্মকর্তাগণ সেগুলির উপযুক্ত কর সংগ্রহ করে সরাসরি আমার কোষাগারে পাঠাবে। বাকি ভূখণ্ড একাধিক জায়গিরে বিভক্ত করা হবে-এবং সেগুলি আমার সভাসদ এবং সেনাপতিদের অধীনে শাসনের জন্য প্রদান করা হবে। সেখানকার কর আদায়ের দায়িত্ব তাঁদের এবং করের একটা অংশ তারা সিংহাসনের পক্ষে লড়তে আগ্রহী একটি সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাখতে পারে। এর ফলে যখন আমার যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন হবে তখন খুব কম সময়ের মধ্যে আমি একটি বৃহৎ আকারের সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গঠন করতে পারবো।

জায়গিরের প্রশাসকরা কি তাদের সন্তানদের উক্ত জায়গির প্রদান করতে পারবে জাহাপনা?

না। তাদের মৃত্যু হলে জায়গির আমার তত্ত্বাবধানে ফেরত আসবে এবং আমার প্রমোদের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হবে। আকবর থামলেন। আমার অধীনস্থ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাম্রাজ্যের কর্মচারী(জায়গিরদার) হিসেবে নিযুক্ত হবে। গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের আমি জায়গির থেকে বিতাড়িত করবো এবং জায়গিরদারদের মৃত্যু হলে আমি সেই জায়গির বাজেয়াপ্ত করবো। এর ফলে আমার প্রশাসকরা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে এবং আমার বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করে বিদ্রোহ করতে পারবে না। আকবর থামলেন এবং কিছুক্ষণের জন্য কেবল আবুল ফজলের কলম চালানোর খস খস শব্দ শোনা গেলো। সব পরিস্কার ভাবে বুঝেছো? এতোক্ষণ যা বললোম তার সব কিছু ঠিক মতো লিখতে পেরেছো?

জ্বী জাহাপনা। আমি বিস্তারিত বিবরণ সহ সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছি। যারা এই বিবরণী পাঠ করবে তারা আপনার মহান বিচক্ষণতা, অতুলনীয় দূরদৃষ্টি এবং সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে অধ্যয়ন করে সীমাহীন উপকার লাভ করবে।

আবুল ফজল এতো বেশি বকর বকর করে কেন? আকবর ভাবলেন। বোধহয় সে মনে করে লাগাতার চাটুকারীতা তার অধিক আস্থাভাজন হওয়ার একমাত্র পথ। পারসিকরা কি এরকম আচরণই করে? কিন্তু বৈরাম খান তো এমন ছিলেন না। তাঁর সাবেক অভিভাবকের স্মৃতি এবং তার প্রতি তাঁর আচরণের বিষয়টি এখনো তার জন্য বেদনাময় এবং আকবর জোর করে তাঁর মন থেকে এই চিন্তা সরিয়ে দিতে চাইলেন।

চলো আমরা বাইরে যাই। বাকি কথা আমরা সেখানে যেয়ে আলাপ করবো। আকবর তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষ থেকে আবুল ফজলকে নিয়ে বাইরের উঠানে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাঁর তিন পুত্র খেলা করছিলো। পাঁচ বছরের সেলিম একটি খেলনা গাড়িতে বসে ছিলো এবং তার থেকে এগারো মাসের ছোট মুরাদ গাড়িটা টানছিলো। অন্য জন দানিয়াল, তার বয়স সাড়ে তিন বছর। একটি নিম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আকবর এবং আবুল ফজলের উপস্থিতি তারা টের পায়নি এবং খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। সেলিম দ্রুত বেড়ে উঠছিলো। তার দৈহিক গড়ন হীরাবাঈ এর মতো চিকন এবং ছিপছিপে। তার ঘন কালো চুল এবং লম্বা লম্বা চোখের পাপড়িও মায়ের মতোই। মুরাদ ওর কাছাকাছি লম্বা কিন্তু অধিক স্বাস্থ্যবান, অনেকটা আকবরের মতোই, কিন্তু জয়সলমিরের রাজপুত রাজকন্যা মায়ের মতো তামাটে চোখ তার। ছোট্ট দানিয়াল নাদুস নুদুস গড়নের, কিন্তু সে আকবর বা তার সুন্দরী পারসিক মায়ের চেহারা বা গড়ন পায়নি।

আকবর সন্তুষ্ট চিত্তে তাদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন যেমনটা তিনি সবসময় করে থাকেন। শেখ সেলিম চিশতি যেমন ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন তেমনটাই ঘটেছে, তিনি তিনটি বলিষ্ঠ পুত্র লাভ করেছেন। ওদেরকে দেখো আবুল ফজল, উত্তরসূরি হিসেবে ঐরকম তিনজন স্বাস্থ্যবান পুত্রের মতো সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের চেয়ে আমার সাম্রাজ্যের জন্য বেশি আর কি করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো? আল্লাহ্ আমার প্রতি অনেক সদয় হয়েছেন।

নিশ্চয়ই জাহাপনা। আল্লাহ্ তাঁর ঐশ্বরিক আলো আপনার উপর বর্ষণ করেছেন।

শিশুদের গাড়িটা উঠানের অন্য প্রান্তে পৌঁছে থেমে গেছে এবং মুরাদ সেটায় চড়ার চেষ্টা করছে, সন্দেহ নেই এবার তার পালা। সেই মুহূর্তে সুফির সতর্কবাণীর কথা মনে পড়তেই আকবরের পরিতৃপ্তভাব বাধাগ্রস্ত হলো। তাদেরকে একাগ্রচিত্তে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আকবর ভাবলেন তাঁকে তাদের শিক্ষার জন্য বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে এবং তাঁদের মধ্যে হিংসা বা বৈরিতার কোনো লক্ষণ দেখা যায় কি না সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু দেখা গেলো সেলিম হাসতে হাসতে মুরাদকে গাড়িতে বসার জায়গা ছেড়ে দিলো। তারা এখনো অনেক ছোট….তিনি বোকার মতো চিন্তা করছেন। তার ভাবনার অবকাশ সৃষ্ঠি হতে এখনো বহু বছর বাকি আছে- যদিওবা কোনো দুশ্চিন্তার অবকাশ সৃষ্টি হয়। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে যেতে নিলেন কিন্তু সেই সময় কোৰ্চি তাঁর দিকে এগিয়ে এলো।

জাহাপনা, শিক্রির নির্মাণ পরিকল্পনা আলোচনা করতে স্থপতিরা এসেছেন।

চমৎকার। আমি এখনই আসছি। তুমিও আমার সঙ্গে এসো আবুল ফজল। আমি চাই এই প্রকল্পের সবকিছু তুমি জানো। শেখ সেলিম চিশতিকে দেয়া ওয়াদা অনুযায়ী আমি শিক্রিতে একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করতে যাচ্ছি, এই সুফি সাধক আমার তিন পুত্রের জন্মের ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের প্রতি আপনার আগ্রহের কথা সর্বজনবিদিত জাহাপনা। দিল্লীতে আপনার পিতার সমাধিটি সারা হিন্দুস্থানের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্থাপনা।

এই প্রথম বারের মতো আবুল ফজল বাড়িয়ে বলছিলো না। আকবর ভাবলেন। বালুপাথর এবং মার্বেল পাথরে তৈরি হুমায়ূনের অষ্টভুজ সমাধিটি সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এর দ্বিতল গম্বুজ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ রুচিশীল বিন্যাস সমরকন্দে অবস্থিত তৈমুরের সমাধির কথা মনে করিয়ে দেয়, যার অঙ্কন চিত্র আকবর দেখেছেন।

তোমাকে এর বিস্তারিত বিবরণ ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে আবুল ফজল। শিক্রির গঠন শৈলী সবকিছু থেকে ভিন্ন মাত্রার হবে-এ পর্যন্ত আমার, আমার পিতার অথবা আমার পিতামহের দ্বারা হিন্দুস্তানে যা কিছু নির্মিত হয়েছে তার তুলনায়। আমি আমার হিন্দু প্রজাদের নির্মাণশৈলীতে শহরটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই জন্য আমি হিন্দু স্থপতিদের নির্বাচন করেছি। ইতোমধ্যে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমি বহু ঘন্টা ব্যয় করেছি। নির্দেশনা পাওয়ার জন্য তাঁদের কাছে প্রাচীন অনেক গ্রন্থ রয়েছে যাতে সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কীভাবে উত্তম ইট তৈরি করতে হয় তার থেকে শুরু করে স্থাপনার অবস্থান কেমন হলে এর অধিবাসীদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে, এর সবকিছু।

আকবরের সম্মেলন কক্ষে দুইজন স্থপতি অপেক্ষা করছিলো। তাঁদের একজন লম্বা এবং মধ্যবয়সী এবং অপরজন অনেক তরুণ এবং তার বগলে কিছু লম্বা আকারের পেচানো কাগজ দেখা যাচ্ছিলো। তারা আকবরকে কুর্ণিশ করলো। আকবর তাঁদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ তাকে সম্বোধন করলেন। স্বাগতম তুহিন দাশ, তোমার পরিকল্পনা জানার জন্য আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি। তোমার ছেলের হাতের ঐ কাগজগুলিতে কি রয়েছে?

এগুলিতে কিছু প্রাথমিক অঙ্কন চিত্র রয়েছে জাঁহাপনা।

ওগুলি খুলে ধরো, আমি দেখতে চাই।

নিশ্চয়ই। মোহন, জাঁহাপনা যা বললেন করো।

আকবর অপেক্ষা করতে লাগলেন যখন মোহন টেবিলের উপর একটা একটা করে নকশা গুলি মেলে ধরে সেগুলির চারকোণায় পাথর চাপা দিতে লাগলো। তার আঙ্গুলের অগ্রভাগগুলি কালি মাখা এবং সেগুলি সম্ভবত উত্তেজনায় সামান্য কাঁপছিলো। মোহনের কাগজগুলি মেলে রাখার কাজ শেষ হওয়ার আগেই আকবর সাগ্রহে তার উপর ঝুঁকে পড়লেন। কাগজগুলি চতুর্ভুজ দাগ বিশিষ্ট যার বিভিন্ন অংশে স্থাপনাগুলি চিহ্নিত করা আছে।

জাহাপনা আমরা এই অঙ্কনটা দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়। তুহিন দাশ সবচেয়ে বড় আকারের অঙ্কনটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এখানে আমি সমগ্র রাজপ্রাসাদের ভবনগুলির যৌগিক বিন্যাস অঙ্কন করেছি। আপনার নির্দেশ অনুযায়ী প্রধান শহরটিকে নিচে রেখে মালভূমির উপরে এর অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর তিন দিকে প্রাচীর থাকবে এবং উত্তর-পশ্চিম অংশে থাকবে বিশাল হ্রদ। এই হ্রদ শিক্রির নিরাপত্তাই শুধু রক্ষা করবে না বরং এর পানির চাহিদাও পূরণ করবে। আকবর সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন।

আমি প্রস্তাব করছি রাজপ্রাসাদ, মসজিদ এবং অন্য সকল ভবনগুলি অঙ্কিত ঢালের শীর্ষে অবস্থিত এই রেখা বরাবর নির্মাণ করা হোক যা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রসারিত। কিন্তু দয়া করে মনে রাখতে হবে জাহাপনা, যদিও আমরা আপনার ইচ্ছা বাস্তবায়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তবুও এই অঙ্কনগুলি আমাদের প্রাথমিক ধারণার বাস্তবায়ন মাত্র।

এই নকশাটি আমাকে আরেকটু বুঝাও। আকবর বললেন।

রাজপ্রাসাদটি ধারাবাহিক ভাবে সংযুক্ত একাধিক উঠানের সংযোগে গঠিত হবে। আজ আমরা প্রসাদের প্রধান ভবন গুলির অঙ্কিত নকশা নিয়ে এসেছি। এগুলি আপনার পছন্দ হলে আপনাকে আরো স্পষ্ট ধারণা দেয়ার জন্য আমরা এদের কাঠের তৈরি ক্ষুদ্র সংস্করণ বানিয়ে আনবো।

এই জায়গাটা কি? আকবর অঙ্কন চিত্রের একটি বিশাল দেয়াল ঘেরা অংশ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

এটা হেরেম সারা-আপনার নির্দেশ অনুযায়ী পাঁচশো নারী যাতে তাদের পরিচারিকাদের নিয়ে আরামে বসবাস করতে পারে তেমন বড় করে এর কাঠামো অঙ্কিত হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশেরই এই প্রাসাদে কক্ষ থাকবে, এর নাম পাঁচমহল। তুহিন দাশ একটি উঁচু পাঁচতলা ভবনের নকশা আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। আমি পারস্য ভ্রমণের সময় যে সব ভবন দেখেছি তার অনুকরণে এর নমুনা তৈরি করেছি। পারসিকরা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে ভবন গুলিতে ঠাণ্ডা বায়ু প্রবাহের জন্য জাফরি এবং সুরঙ্গের ব্যবস্থা রেখেছে এবং আমিও এই ভবনটিতে একই ব্যবস্থা রেখেছি। আমি এই প্রাসাদের সৌন্দর্যের দিকেও বিশেষ নজর দিয়েছি-এই দেখুন, প্রতিটি তলা কেমন সরু স্তম্ভের উপর ভর করে আছে। একদম উপরের তলায় অঙ্কিত হয়েছে হাওয়া মহল-এখানে গম্বুজ আকারের আচ্ছাদনের নিচে প্রচুর হাওয়া বাতাসের মধ্যে মহিলারা বসে সময় কাটাতে পারবে।

ভালো, আকবর বললেন। তাঁর স্ত্রী এবং রক্ষিতাঁদের উপযুক্ত বিলাসিতার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান রক্ষিতাদের মধ্যে এখনোও তিনি মায়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কামনার চেয়ে এতোদিনের ভালোবাসাই বোধহয় এর কারণ। যদিও অন্যরা আরো অধিক দৈহিক আকাক্ষা সৃষ্টি করতে পারছে। নবাগত একটি রুশ দেশীয় মেয়ে-যাকে এক ধনী মোগল সওদাগর উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে-মেয়েটি তার নীলা সদৃশ চোখ, ফ্যাকাশে চামড়া এবং সূর্যালোকের বর্ণে বর্ণিল চুল নিয়ে ইদানিং আকবরের অধিক মুনোযোগ কাড়ছিলো।

এই যে ভবনগুলির নকশা দেখছেন, এগুলি আপনার মাতা, ফুফু এবং প্রধান স্ত্রীদের জন্য নির্ধারণ করেছি জাঁহাপনা।

আকবর তুহিন দাশের অঙ্কিত কতিপয় অভিজাত প্রাসাদের নকশার উপর চোখ বুলালেন। রানী হীরাবাঈ এর জন্য তুমি কোনো প্রসাদটি প্রস্তাব করছো?

এটি জাহাপনা। দেখুন, এর ছাদের উপর একটি ছত্রী রয়েছে যেখানে তিনি চাঁদ দেখার জন্য যেতে পারবেন এবং পূজা অর্চনাও করতে পারবেন।

আকবর সতর্কতার সঙ্গে নকশাটি দেখলেন। যদিও তিনি কদাচিৎ হীরাবাঈ এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তবুও প্রথম স্ত্রী এবং বড় ছেলের মা হিসেবে তার উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানের দিকে তার মনোযোগ ছিলো।

চমৎকার! কিন্তু আমার প্রাসাদ কোনটি?

এই যে, হেরেমের পাশেই এর অবস্থান। এটি ছাদ বিশিষ্ট হাঁটাপথ এবং ভূগর্ভস্থ সুরঙ্গের মাধ্যমে হেরেমের সঙ্গে যুক্ত। আপনার প্রাসাদের সম্মুখের বিশাল উঠানটিতে থাকছে অনুপ তালাও বা অতুলনীয় জলকুণ্ড। এটি বার ফুট গভীর এবং হ্রদের সঙ্গে একাধিক জলনালী দ্বারা সংযুক্ত, ফলে সর্বদা আপনি জল প্রবাহের সতেজ কলধ্বনি শুনতে পাবেন।

সমগ্র শহরে সরবরাহ করার মতো যথেষ্ট পানি হ্রদটিতে থাকবে, এ বিষয়ে তুমি কি নিশ্চিত?

প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে আমাদের ইতিবাচক আশ্বাস প্রদান করেছে জাহাপনা।

এটা কি? আকবর তার প্রস্তাবিত প্রাসাদের একপাশে বেশ বড় জায়গা নিয়ে তৈরি একটি আয়তক্ষেত্রাকার আকৃতি সামান্য বিভ্রান্তি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

এটা আপনার ব্যক্তিগত চত্বর জাঁহাপনা, তবে এর মেঝে সাধারণ পাথরের বর্গাকার খণ্ড বিছিয়ে তৈরি না করে দাবার ছকের মতো করে তৈরি করার প্রস্তাব করছি আমি। আপনি এবং আপনার সভাসদগণ এখানে বিশাল আকৃতির ঘুটি বসিয়ে দাবা খেলতে পারবেন অথবা বিশ্রাম নিতে পারবেন। চমৎকার। তুমি ব্যাপক উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছো তুহিন দাশ। আর এটা কি?

আমি এর নাম দিয়েছি দেওয়ান-ই-খাস, আপনার ব্যক্তিগত সভার স্থান। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এটি দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন কিন্তু বাস্তবে এটি একটি কক্ষ। মোহন তোমার অঙ্কন করা অভ্যন্তরীণ নকশাটা দেখাও।

এখন মোহনকে খানিকটা আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। সে তার বাম কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি কাগজের পাতা বের করে টেবিলের উপর মেলে ধরলো। আকবর সেখানে অঙ্কিত একটি উঁচু ছাদ বিশিষ্ট কক্ষ দেখতে পেলেন যার ঠিক মধ্যখানে করুকার্যখচিত স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভটির নিম্নাংশ সরু কিন্তু সেটা উপর দিকে প্রসারিত হয়ে বৃত্তাকার ঝুলবারান্দার ভর কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে এবং ঝুলবারান্দার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কক্ষের চার দিকে প্রসারিত চারটি সেতু। সত্যিই আকর্ষণীয়, কিন্তু এটা কি ধরনের ঘর?

আমি ঠিক বুঝলাম না। অতো উঁচুতে অবস্থিত বরান্দা কি কাজে আসবে?

ঐ বারান্দায় সিংহাসনে বসে আপনি প্রজাদের বক্তব্য শ্রবণ করবেন জাহাপনা। আর আপনার সাম্রাজ্য যেহেতু পৃথিবীর একচতুর্থাংশ ভূখণ্ডে প্রসারিত তাই এই বাস্তবতার প্রতীক হিসেবে সেতু চারটি স্থাপন করা হয়েছে। যে কেউ আপনার কাছে বক্তব্য পেশ করতে চাইবে সে ঐ সেতুগুলির একটি দিয়ে আপনার কাছে অগ্রসর হবে। বাকি সভাসদরা নিচে অবস্থান করে সবকিছু দেখবে ও শুনবে।

আকবর একাগ্রচিত্তে নকশাটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি আশা করেছিলেন তুহিন দাশ সম্রাটের উপযুক্ত একটি সাধারণ সভা কক্ষের পরিকল্পনা করবে কিন্তু সে তার নিজের অবস্থানকে অতিক্রম করে গেছে। যতোই তিনি নকশাটি পাঠ করলেন এবং সেটার তাৎপর্য অনুধাবন করলেন ততোই বেশি তিনি সেটা পছন্দ করলেন।

তুমি এই ধারণা কোথায় পেলে? পারস্যের শাহ এর কি এমন কোনো স্থাপনা রয়েছে?

অন্য কোনো রাজা বা সম্রাটের এমন নকশার ভবন বা কক্ষ নেই জাহাপনা। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব পরিকল্পনা। আপনি কি এতে সন্তুষ্ট?

বোধহয় আমি সন্তুষ্ট…কিন্তু কেন্দ্রস্থলের এই স্তম্ভটি, মনে হয় এটি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হবে এবং সেটা চন্দন কাঠ?

না জাহাপনা। সেতুগুলির ভার সহ্য করার জন্য আমাদেরকে এটি বালুপাথর দিয়ে তৈরি করতে হবে।

অসম্ভব! এর নকশা অত্যন্ত জটিল।

আমার ভিন্ন মতের জন্য দুঃখিত জাঁহাপনা, কিন্তু আমি নিশ্চিত ভাবে জানি এই জটিল নকশা বালুপাথর দিয়েই তৈরি করা সম্ভব। হিন্দুস্তানের কারিগররা এতোই দক্ষ যে তারা বালুপাথরকে কাঠের মতোই কেটে বা খোদাই করে নকশা সৃষ্টি করতে পারবে-কোনো নকশাই তাঁদের জন্য কঠিন নয়।

তোমার কারিগররা যদি সত্যিই তা করতে পারে তাহলে সমগ্র রাজপ্রাসাদের প্রতিটি স্তম্ভ, ঝুলবারান্দা, জানালা এবং প্রবেশ পথ বালুপাথর (স্যাণ্ডস্টোন) দিয়ে তৈরি করা হোক। আমরা এমন একটি গোলাপ লাল শহর তৈরি করবো যা সমগ্র জগতের মাঝে একটি বিস্ময় হয়ে থাকবে… মনের দৃষ্টিতে ইতোমধ্যেই আকবর তার নতুন রাজধানী দেখতে পাচ্ছিলেন, একটি গহনার বাক্সের মতোই সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত, বালুপাথরের সুদৃঢ় গাঁথুনীতে বলিষ্ঠ। এটি কেবল শেখ সেলিম চিশতির উপযুক্ত শ্রদ্ধার্ঘই হবে না বরং মোগল শ্রেষ্ঠত্বের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেও অমর হয়ে থাকবে।

*

তুহিন দাশকে আকবর শিক্রির নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও নিযুক্ত করেছেন। সে জানিয়েছে ইতোমধ্যেই ত্রিশ হাজার নির্মাণ শ্রমিক সেখানে কাজ করছে এবং এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রতিদিন জ্বলন্ত সূর্যের নিচে অসংখ্য পুরুষ এবং কতিপয় নারীর লম্বা রেখা মালভূমি পর্যন্ত প্রসারিত বিশেষভাবে তৈরি মাটির রাস্তা দিয়ে প্রয়োজনীয় মালালাম চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন বর্জ ও পাথরকুচি ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে নেমে আসছে। দূর থেকে তাঁদের দেখতে অনেকটা পিঁপড়ের সারির মতো লাগে যারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অন্তহীন ধৈর্য এবং পরিশ্রমের সঙ্গে চলমান। তাঁদের পরিধানে অপ্রতুল পোষাক-পুরুষদের পরনে ময়লা ধূতি অথবা নেংটি এবং মহিলাদের পরনে সুতির শাড়ি। কোনো কোনো মহিলার পিঠে আবার তাঁদের দুগ্ধপোষ্য শিশু ঝুলিয়ে বাঁধা রয়েছে। মেটেবর্ণের বস্ত র আচ্ছাদনের নিচে পাতা মাদুরে রাতে তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা এবং সেখানেই তারা ঘুঁটে দিয়ে ডাল, সজি এবং হাতে বানানো চ্যাপ্টা গোলাকৃতির রুটি বানিয়ে আহার করে।

আকবর যখন ঘোড়ায় চড়ে নির্মাণ এলাকা পরিদর্শন করছিলেন তখন তাঁর মনে হলো এ যেনো তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি ভিন্ন ধরনের সেনাবাহিনীর যুদ্ধরত অবস্থা। তিনি তুহিন দাশকে নিয়ে প্রায়ই নির্মাণ কর্ম পরিদর্শনে আসেন। তুহিন দাশ সন্তুষ্টিপূর্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলো। দেখুন জাঁহাপনা ইতোমধ্যেই কতোটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ভূমি সমতল করা শেষ এখন তা ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তুত। শীঘ্রই আমরা প্রথমিক ভিত্তিপ্রস্তর গুলি খুড়তে পারবো।

আর বালুপাথর আহরণের কাজের অগ্রগতি কতোটা?

দুইহাজার অমসৃণ প্রস্তর খণ্ড ইতোমধ্যেই কাটা সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে সেগুলি বলদটানা গাড়িতে করে এখানে নিয়ে আসা শুরু হবে। তারপর এখানে কারিগররা সেগুলিকে আকৃতি প্রদানের কাজ শুরু করবে।

আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে যার ফলে কাজের গতি আরো দ্রুততর হবে। আমাদের হাতে সব নির্মিতব্য ভবনের বিস্তারিত নকশা রয়েছে। তাই পাথর সংগ্রহের স্থানেই প্রধান খণ্ডগুলি কেটে প্রতিটি ভবনের আকৃতি প্রদান করা যায়। তারপর সেগুলিকে শিক্রিতে এনে যথাস্থানে জুড়ে দিলেই হবে।

চমৎকার বুদ্ধি জাহাপনা। এর ফলে ভবনগুলি অল্প সময়ের মধ্যে সন্নিবেশিত করা সম্ভব হবে এবং নির্মাণ এলাকার হট্টগোল ও ভিড় হ্রাস পাবে।

আমি চাই সকল শ্রমিককে উত্তম পারিশ্রমিক দেয়া হোক। ঘোষণা দাও আমি তাদের দৈনিক মজুরী দ্বিগুণ করে দিচ্ছি এবং কাজ যদি ভালো গতিতে আগায় তাহলে সপ্তাহে একদিন রাজশস্যভাণ্ডার থেকে তাদের বিনামূল্যে শস্য সরবরাহ করা হবে। আমি চাই প্রতিদিন শ্রমিকরা চাঙ্গা ভাব নিয়ে কাজে যোগ দিক এবং আমি আরেকটি উত্তম উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই।

কীভাবে জাঁহাপনা?

আমাকে পাথর সংগ্রহের স্থানে নিয়ে চলল। আমার প্রজাদের সঙ্গে আমি পাথর কাটতে চাই এবং তাঁদের দেখাতে চাই যে তাঁদের সম্রাট কঠোর শারীরিক পরিশ্রমকে ভয় করেন না।

দুই ঘন্টা পরের ঘটনা। আকবরের নগ্ন গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। তিনি দৃঢ় মনোযোগের সঙ্গে পথরের উপর গাঁইতি চালাচ্ছিলেন। ঠিক লড়াই এর সময় তিনি যেমন করে যুদ্ধকুঠার বা বর্শা চালান তেমনি অব্যর্থ লক্ষে গাইতির চোখা অগ্রভাগ পাথরের সঠিক অবস্থানে আঘাত হানছিলো। সেটা ছিলো প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির কাজ। আগামীকাল তার শরীরের পেশীগুলি তেমনই আড়ষ্ট হয়ে পড়বে যেমনটা হয়ে থাকে যুদ্ধের কঠিন লাড়ই এর পর। কিন্তু কদাচিৎ তিনি এমন আনন্দবোধ করেন। নিয়তি তাঁর জন্য অনেক মহান কর্ম নির্ধারণ করে রেখেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে একজন সাধারণ মজুরের মতো কঠোর পরিশ্রম করতে তাঁর মোটেই খারাপ লাগছিলো না, যৌবনের শক্তিতে গৌরবান্বিত এবং ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা মুক্ত হয়ে।

২.৩ ধূসর সাগর

১১. ধূসর সাগর

জাঁহাপনা আপনি যখন গুজরাটের সমরাভিযান শেষ করে ফিরবেন ততোদিনে নতুন শহরের রক্ষাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, তুহিন দাশ আকবরকে বললো। আকবর, আবুল ফজল এবং তুহিন দাশকে নিয়ে ঘোড়ায় করে শিক্রির প্রতিরক্ষা প্রাচীর পরিদর্শন করছিলেন। বর্তমানে প্রাচীরটি ছয় ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছে।

তোমার কথা তোমাকে রক্ষা করতে হবে, আকবর উত্তর দিলেন। আমার যুদ্ধাভিযান বেশি দীর্ঘ হবে না। আহমেদ খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে নিয়ে আমার পিতা প্রায় চল্লিশ বছর আগে গুজরাট জয় করেছিলেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। শেরশাহ্ বলপূর্বক আমার পিতাকে গুজরাটের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করেছিলো। এইবার আমি গুজরাট জয় করার পর তা চিরকাল মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকবে।

ক্যাম্বে এবং সুরাত দিয়ে যে সব তীর্থযাত্রী আরবের উদ্দেশ্যে পবিত্র ধর্মযাত্রা করেন তারা যদি যাত্রা পথে নিরাপত্তা লাভ করেন, তাহলে তারা ব্যাপক ভাবে আপনার প্রশংসা করবেন জাহাপনা। গুজরাটের রাজ পরিবার গুলির অন্তঃকলহের ফলে সেখানে আইন-শৃক্ষলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তার কারণে ভ্রমণকারীদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে, আবুল ফজল সুললিত কণ্ঠে বলে উঠলো। গুজরাজ আবার মোগলদের নিয়ন্ত্রণে এলে এর বন্দরগুলি থেকে যে কর আদায় হবে, আমি নিশ্চিত তা আমাদের রাজস্ব আয়ের একটি বিরাট অংশ পূরণ করবে।

তুমি ঠিকই বলেছো আবুল ফজল। গুজরাজ এখনোও একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। আমার ইচ্ছা শিক্রির অলংকরণের জন্য সেখান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ যুদ্ধ লুষ্ঠিত মালামাল নিয়ে আসা।

কথা শেষ করে আকবর সেখানে তুহিন দাশ ও আবুল ফজলকে রেখে ঘোড়া ছুটিয়ে মালভূমি পেরিয়ে নিচের সমতল ভূমির দিকে রওনা হলেন। সেখানে তার সৈন্যরা শিবির স্থাপন করেছে। আকবর যখন সেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন তিনি অনুশীলনরত সৈন্যদের গাদাবন্দুকের গুলিবর্ষনের ধোয়া দেখতে পেলেন। আরেক দিকে গোলন্দাজবাহিনী নতুন তৈরি করা ব্রোঞ্জের কামানের ধ্বংস ক্ষমতা পরীক্ষা করছিলো। আকবরের নিজের কারখানায় কামানগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন আবিষ্কার থেকে বেশি সুবিধা লাভের জন্য তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে এমন বিশাল নলের কামান তৈরি করিয়েছেন যে আহমেদ খানের ধারণা সেটা স্থানান্তর করতে একহাজার ষাঁড় দরকার হবে। যদিও আকবর জানতেন আহমেদ খান বাড়িয়ে বলছেন তারপরও তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গুজরাট অভিযানে এই দানবাকৃতির অস্ত্রগুলি না নেয়ার। কারণ তাঁর ধারণা, অবরোধ সৃষ্টি করার বহু সময় পরেও দেখা যাবে ঐ অস্ত্র যথাস্থানে স্থাপন করে কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

আকবর দেখলেন আহমেদ খান এবং মোহাম্মদ বেগ একটি তাবুর পাশে দাঁড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে তর্ক করছে। আকবরকে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসতে দেখে উভয়ে কুর্ণিশ করলো।

আপনারা দুজন কি বিষয়ে তর্ক করছেন?

যুদ্ধ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ এবং শস্য সংগ্রহের সময় নিয়ে জাহাপনা, আহমেদ খান বললেন।

আমি এক মাস দেরি করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম জাঁহাপনা, মোহাম্মদ বেগ বললেন, এই সময়ের মধ্যে আমরা যাতে পর্যাপ্ত শস্য সংগ্রহ করতে পারি।

কিন্তু জাহাপনা, আমার বক্তব্য হলো-আমরা যদি কম মালামাল নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে পারি তাহলে আমাদের অপেক্ষাকৃত কম রসদ প্রয়োজন হবে। আবার অন্যদিকে গুজরাটের রাজপরিবারের ভিন্নমতাবলম্বী সদস্যরা বিশেষ করে মির্জা মুকিম এর উপর আমরা নির্ভর করতে পারি প্রয়োজনীয় রসদের জন্য।

আমি আপনার সঙ্গে একমত আহমেদ খান, আকবর বললেন। যুবরাজ মুকিম আমার হস্তক্ষেপ কামনা করে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তার জন্য আমাদের গুজরাট আক্রমণ অধিক বৈধতা লাভ করবে এবং তার কাছ থেকে আমি সৈন্য ও রসদ সহায়তা নেবো। সেক্ষেত্রে আমরা কবে রওনা হতে পারি?

এক সপ্তাহের মধ্যেই জাহাপনা, মোহাম্মদ বেগ বললেন।

ঠিক আছে, তাহলে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যেই রওনা হচ্ছি।

*

জাহাপনা, আপনি কি দিগন্তের ঐ ধূলার মেঘ দেখতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই বহু সংখ্যক মানুষ একসঙ্গে যাত্রা করেছে, আকবর এবং আহমেদ খান একদল অগ্রবর্তী সৈন্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তারা গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের কাছাকাছি অবস্থিত পাকতে থাকা শস্যের মাঠ অতিক্রম করছেন। আকবর তার ধাতব দস্তানা পরিহিত হাতের সাহায্যে চোখের উপর ছায়া সৃষ্টি করে ধূলার তরঙ্গের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। ওটা নিশ্চয়ই গুজরাটের স্বঘোষিত শাহ্ ইত্তিমাদ খানের বাহিনী। মির্জা মুকিমের অনুমানই সঠিক। তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সে বলেছিলো আকবর যদি দ্রুত অগ্রসর হোন তাহলে আহমেদাবাদের কাছে মোগল বাহিনী ইত্তিমাদ খানের মুখোমুখী হতে পারে। আমি নিশ্চিত ওটা ইত্তিমাদ খানের বাহিনী। যদি তাই হয়, তহলে আমরা ওদের চমকে দেয়ার সুবিধা পাবো।

আমরা শীঘ্রই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবো জাঁহাপনা। আমি কি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আদেশ দেবো?

নিশ্চয়ই।

কয়েক মিনিট পর কালো স্ট্যালিয়নের পিঠে সওয়ার আকবর একদল ঘনবিন্যস্ত সৈন্যকে নেতৃত্ব দান করে পাকা ফসলের ক্ষেত মাড়িয়ে ধূলি মেঘের দিকে অগ্রসর হলেন। আকবরের মাথায় ময়ূর পুচ্ছ যুক্ত গম্বুজাকৃতির শিরোস্ত্রাণ, দেহে সোনার পাত মোড়া বক্ষবর্ম এবং হাতে উন্মুক্ত তলোয়ার আলমগীর। তার ঠিক পেছনেই দুইজন কোৰ্চি সবুজ মোগল পতাকা বহন করছে ঘোড়ায় চড়ে। তাঁদের ঘোড়ার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে গুজরাটি অশ্বারোহীদের অবয়ব অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আকবর পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে শত্রুপক্ষ তাঁর বাহিনীকে চিনতে পেরেছে এবং পিছিয়ে গিয়ে আহমেদাবাদ এর প্রাচীরের আড়ালে আশ্রয় নেয়ার পরিবর্তে তারা সোজা তদের দিকে ধেয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাপিয়ে আকবর চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা সংখ্যায় কতো জন হবে আহমেদ খান?

বলা কঠিন, হয়তো পাঁচ হাজার জাঁহাপনা।

তারা নিশ্চয়ই ভাবছে তারা সংখ্যায় আমাদের তুলনায় যথেষ্ট বেশি, কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না, কি বলেন?

এই মুহূর্তে উভয় বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব এক হাজার গজেরও কম এবং দ্রুত এই দূরত্ব কমে আসছে। আকবরের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে তার অশ্বারোহী তিরন্দাজেরা রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথম পশলা তীর ছুড়লো গুজরাটিদের দিকে। এ সময় গুজরাটিরাও পাল্টা তীর ছুড়লো। আকবর দেখলেন অগ্রবর্তী একজন গুজরাটির ঘোড়া ঘাড়ে দুটি তীর বিদ্ধ হয়ে আছড়ে পড়লো। সেই সাথে সেটির সওয়ারী ফসলের উপর ছিটকে পড়লো। একই সঙ্গে আরেকজন সওয়ারী গালে তীর বিদ্ধ হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে লুটিয়ে পড়লো। আকবর নিজের পিছনে পতনের শব্দ পেলেন এবং সেই সঙ্গে আর্তচিৎকার। তার সৈন্যদের কেউ তীর বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু পেছনে দেখার সময় নেই কারণ তখনই উভয় পক্ষের ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে মুখোমুখী তীব্র সংঘর্ষ হলো। শেষ মুহূর্তে এক গুজরাটি আকবরকে চিনতে পেরে নিজের বাদামি ঘোড়াটি তার ঘোড়র উপর উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। আকবরের মাঝে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো। লাগামে হেচকা টান মেরে তিনি নিজের স্ট্যালিয়নটিকে কিছুটা ঘোরাতে সক্ষম হলেন। কিন্তু তার ঘোড়াটি প্রতিপক্ষের ঘোড়াটির নিতম্বে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত হানলো। ফলে ঘোড়াটি যেমন পড়ে গেলো একই সাথে এর সাহসী সওয়ারীটিও সেটার পিঠ থেকে যেনো প্রায় উড়ে গেলো। সংঘর্ষের তীব্র বেদনা নিয়ে আকবরের স্ট্যালিয়নটি পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে প্রায় দাঁড়িয়ে গেলো এবং আকবর সেটার পিঠ থেকে নিজের পতন ঠেকাতে সেটার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে দুই হাঁটু দিয়ে সর্বশক্তিতে সেটার পেট আকড়ে থাকলেন। তিনি প্রায় সফল হচ্ছিলেন, কিন্তু ঘোড়াটির সামনের পা দুটি যখন মাটি স্পর্শ করলো সেটা একদিকে কাত হয়ে গেলো এবং মাটিতে পড়ে থাকা মোগল পতাকার কাপড়ে সেটার পা জড়িয়ে গেলো। প্রথম সংঘর্ষের সময়ই আকবরের এক পায়ের রেকাব ছুটে গিয়েছিলো, এবার তিনি আর আসনে স্থির থাকতে পারলেন না-জিন থেকে একপাশে পিছলে নেমে গেলেন এবং বাম হাতে লাগাম ধরে স্ট্যালিয়নটির সঙ্গে ঝুলে রইলেন।

কয়েক মুহূর্ত পর আরেক জন গুজরাটি তাঁর দিকে ধেয়ে এলো, উদ্দেশ্য বর্শার ফলায় তাঁকে বিদ্ধ করা। আকবর লাগাম ছেড়ে একপাশে ঝাঁপ দিলেন। তবে পড়ার সময় তিনি শত্রুকে লক্ষ করে দ্রুত তলোয়ার চালালেন। কঠোর মুষ্ঠিতে আলমগীর ধরে থাকা সত্ত্বেও সেটি অপর হাতের ধতব দস্তানার সঙ্গে সশব্দে ঘসা খেলো, তবে লক্ষ্যচ্যুত হলো না। আলমগীরের ধারালো ফলা শত্রুর হাঁটুর হাড়মাংস ভেদ করে তার ঘোড়ার নিতম্বে আঘাত করলো। ঘোড়া সহ সে ভূপাতিত হলো এবং আকবরের এক অগ্রসরমান সৈনের ঘোড়ার খুরের নিচে তার মস্তক পিষ্ট হলো।

মোগলদের প্রথমিক আক্রমণের চাপে গুজরাটিরা কিছুটা পিছিয়ে গেছে এবং এই মুহূর্তে আকবরের দেহরক্ষীরা তাঁকে ঘিরে আছে। তার স্ট্যালিয়নটি মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। আলমগীর কোষবদ্ধ করে তিনি মাটিতে পতিত পতাকাটি উঠিয়ে নিলেন এবং ছুটে গিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠে চড়লেন। সকলে অগ্রসর হও, আমাদের এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে, তিনি চিৎকার করে হুকুম দিলেন। স্ট্যালিয়নটি তার প্রণোদনা পেয়ে সামনে এগুলো এবং উড়ন্ত পতাকা নিয়ে আকবর গুজরাটি অশ্বারোহীদের দিকে ধেয়ে গেলেন। দাঁত দিয়ে লাগাম কামড়ে ধরে তিনি এক স্থূলকায় শত্রুর দিকে আলমগীর চালালেন কিন্তু তলোয়ারটির ফলা তার বক্ষবর্মের উপর ঘষা খেয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু তার পরবর্তী আঘাত অপর একজন গুজরাটির বাহুর সামনের অংশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলো এবং পর মুহূর্তে তিনি বিশৃঙ্খল লড়াই এর আরেক পাশে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। এখানে আবার তাঁর দেহরক্ষীরা তাকে ঘিরে ফেললো। তাদের একজনের হাতে পতাকা দিয়ে আকবর চারদিকে তাকাতে তাকাতে দম নিলেন। এখনো তীব্র লড়াই চলছে, বিশেষ করে তার বাম পাশে প্রায় দুইশ গজ দূরে যেখানে গুজরাটিদের লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে। দ্রুত চোখের উপর জমা ঘাম মুছে তিনি সেদিকে ঘোড়া ছুটালেন। সেই মুহূর্তে একরাশ অক্ষত থাকা শস্য গাছের মধ্যে তিনি একজন লাল পাগড়ি পড়া গুজরাটিকে টলমলপায়ে উঠে দাঁড়াতে দেখলেন। সে তার হাতে থাকা লম্বা ছোরাটি আকবরকে লক্ষ্য করে ছুড়লো। তার হাতের টিপ উত্তম, কিন্তু আকবর সময়মতো তাঁর ঘোড়ার ঘাড়ের উপর নুয়ে পড়ায় ছোরাটির ফলা তার শিরোস্ত্রাণের সঙ্গে ঘষা খেয়ে ছিটকে পড়লো। অন্যদের হাতে যোদ্ধাটিকে ছেড়ে আকবর সামনে এগিয়ে গেলেন। শীঘ্রই তিনি লাল পতাকার চারদিকের বিশৃঙ্খলা ঠেলে এগুতে লাগলেন এবং ডানে বামে প্রচণ্ড শক্তিতে তলোয়ার চালাতে লাগলেন।

বাদামি রঙের ঘোড়ার পিঠে বসা একজন লম্বা গড়নের গুজরাটি বর্শা নিয়ে আকবরকে আক্রমণ করলো। শেষ মুহূর্তে আকবর তাকে দেখলেন এবং তলোয়ার চালিয়ে বর্শার আঘাত প্রতিহত করলেন। সর্বশক্তিতে লাগাম টেনে ধরে গুজরাটি যোদ্ধাটি আবার আকবরকে আক্রমণ করলো কিন্তু এবার তিনি প্রস্তুত ছিলেন। যোদ্ধাটির আক্রমণকে পাশ কাটিয়ে তিনি তার শরীরের বাম অংশে গভীর ভাবে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলেন এবং আক্রমণের ধাক্কায় সে ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়লো।

আকবর ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন, তিনি দেখলেন সংখ্যা গরিষ্ঠ মোগলদের প্রচণ্ড আক্রমণে ধীরে ধীরে গুজরাটিরা পিছু হটছে এবং অনেকে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে আহমেদাবাদ এর প্রাচীরের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। আকবর একদল পলায়নরত প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করতে চাইলেন কিন্তু তার হাঁপ ধরা স্ট্যালিয়নটি প্রথমে তেমন সাড়া দিলো না। সেই মুহূর্তে ফসলে জলসেচের নালা ঘোড়া সহ লাফিয়ে পার হওয়ার সময় এক গুজরাটির ঘোড়া ভেজা মাটিতে পিছলে পড়ে গেলো। ক্রমান্বয়ে আরো তিন জন ঘোড় সওয়ার প্রথম জনের পিছনে ধারাবাহিক ভাবে হোঁচট খেয়ে পড়লো। পড়ে যাওয়া একজন যোদ্ধা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করলো কিন্তু গলায় আকবরের একজন দেহরক্ষীর তলোয়ারের কোপ খেয়ে নালার মধ্যে পড়ে গেলো। তার ক্ষত থেকে উৎক্ষিপ্ত লাল রক্ত নালার সবুজ পানিতে ছড়িয়ে পড়লো। বেশ কয়েকজন গুজরাটি তাদের ঘোড়ার গতি কমিয়ে ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া সঙ্গীদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিলো। আকবর তাদের একজনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। নিজেদের জীবন বাঁচাও। আমার দেহরক্ষীরা তোমাদের ঘিরে ফেলেছে এবং উত্তম লড়াই এর পর আত্মসমর্পণ করার মাঝে কোনো লজ্জা নেই। আকবর প্রতিপক্ষের যোদ্ধাটিকে চিৎকার করে বললেন। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করতে করতে সে তার আশেপাশে থাকা অবশিষ্ট সঙ্গীদের পর্যবেক্ষণ করলো, তার গালে সৃষ্ট ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে-তারপর নিজের তলোয়ারটি হাত থেকে ফেলে দিলো। তার সঙ্গীরাও তাকে অনুসরণ করলো।

আকবরের রক্ষীরা যখন যুদ্ধবন্দীদের বাঁধছিলো তখন তিনি দেখলেন মোহাম্মদ বেগ কিছু সৈন্য নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সৈন্য একটি ছাই রঙের ঘোড়ার লাগাম ধরে রয়েছে। ঘোড়াটির পিঠে ছিপছিপে গড়নের একজন অল্পবয়সী তরুণ বসা। সে সাদা আলখাল্লার উপর চুনি খচিত বক্ষবর্ম পড়ে আছে। এটি ইত্তিমাদ খান জাঁহাপনা। আমরা তাকে তার মৃত ঘোড়ার পাশে শস্য ক্ষেতের মধ্যে লুকানো অবস্থায় আবিষ্কার করেছি। তার দেহরক্ষীরা তাকে ত্যাগ করে পালিয়েছে।

তুমি কি সত্যিই ইত্তিমাদ খান? আকবর জিজ্ঞেস করলেন।

জ্বী এবং আমি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করছি, তরুণটি মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বললো।

তুমি কি তোমার সৈন্যদের লড়াই বন্ধ করার আদেশ দিতে প্রস্তুত এবং আহমেদাবাদ সহ তোমার নিয়ন্ত্রিত গুজরাটের অন্যান্য অঞ্চল আমার অধীনে ছেড়ে দিতে রাজি আছো? যদি এতে সম্মত হও তাহলে তোমাকে এবং তোমার অধীনস্ত লোকদেরকে প্রাণে মারবো না এবং তোমার পছন্দ মতো গুজরাটের কোনো একটি ছোট রাজ্যে তোমাকে পুনর্বাসিত করবো।

ইত্তিমাদ খানের মসৃণ মুখে স্বস্তি ফিরে এলো। আমি স্বেচ্ছায় আপনার আদেশ পালন করবো। আপনি যদি আটককৃত, ঐ বন্দীদের কয়েকজনকে মুক্তি দেন তাহলে আমি তাঁদের দূত হিসেবে পাঠাতে পারি।

আকবরের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তার কয়েকজন রক্ষী বন্দীদের মুক্ত করতে এগিয়ে গেলো কিন্তু তাদের বাধন খোলার আগেই ইত্তিমাদ খান আবার কথা বলে উঠলো। জাহাপনা, আপনাকে জানাতে চাই যে ক্যাম্বে ও সুরাত বন্দরের উপকূল এবং তাদের পশ্চাত্বর্তী অঞ্চল সমূহ আমার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আমার বিদ্রোহী চাচাতো ভাই ইব্রাহিম হোসেন ঐ সব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। ইত্তিমাদ খান একটু থামলো, তারপর আবার নিচু স্বরে বলতে লাগলো, এছাড়াও আশঙ্কা করছি আমি আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়া সত্ত্বেও আমার কতিপয় সেনাপতি হয়তো আমার হুকুম মানবে না।

আমি উপকূল এলাকার পরিস্থিতি জানি এবং শীঘ্রই সেখানে হামলা করে হিব্রাহিম হোসেনকে পরাস্ত করবো। আর তোমার সেনাপতিরা তোমার অদেশ পালন করলেই ভালো করবে। আমার পক্ষ থেকে তাদের কাছে নির্দেশ পাঠাও যে তারা একবার মাত্র আত্মসমর্পণের সুযোগ পাবে। এই সুযোগ যদি কাজে না লাগায় তাহলে নিশ্চিত ভাবে তারা মৃত্যুবরণ করবে। ইত্তিমাদ খান সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। আকবর ঘোড়া ঘুরিয়ে অন্য দিকে রওনা হলেন। ইত্তিমাদ খানের করুণ পরিণতি তাকে কিছুটা বিব্রত করেছে। আকবর অনুভব করছিলেন এমন লজ্জাকর পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর মতো পর্যাপ্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট এবং শক্তি তার রয়েছে এবং এজন্য তিনি কৃতজ্ঞও বোধ করলেন। যখন তাঁর পুত্র এবং তাদের পুত্ররা আবুল ফজলের লিখিত ঘটনাপঞ্জি পাঠ করবে তখন তারা তার যুদ্ধাভিযানে এমন লজ্জাকর দুর্বলতা বা ব্যর্থতার নিদর্শন পাবে না, বরং তার বিজয় এবং ক্ষমতার প্রতিপত্তি প্রত্যক্ষ করে উল্লাসিত হবে।

*

সাগর তখন শান্ত, ছোট ছোট ঢেউ গুলি কমলা বর্ণের বালুতীরে ধীরে অছড়ে পড়ছে। সৈকত ঘিরে থাকা নারকেল গাছের পাতা মৃদুমন্দ উত্তরা বাতাসে দুলছে। আকবর দেখতে পাচ্ছিলেন সোয়া মাইল দূরে উপকূল রেখা বরাবর সাগরের দিকে বর্ধিত হয়ে থাকা উচ্চভূমিতে (শৈলান্তরীপ) অবস্থিত ছোট আকারের একটি দূর্গের ভিতরে এবং বাইরে ইব্রাহিম হোসেনের সৈন্যরা সন্নিবেশিত হচ্ছে। ঐ দূর্গটি সমুদ্র বা স্থলপথে ক্যাম্বেতে আগতদের প্রতিরোধ করার লক্ষে নির্মাণ করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি জাহাজ উচ্চভূমি সংলগ্ন বন্দরে নোঙর করা রয়েছে। আকবর আহমেদ খানের দিকে ফিরলেন। আপনি তো আমার বাবার সঙ্গে ক্যাম্বেতে এসেছিলেন, বলতে পারেন ঐ জাহাজ গুলো কিসের জন্য ওখানে নোঙর করা?

ওগুলোর বেশির ভাগই আরবদের জাহাজ। তারা হজ্জ্বের তীর্থ যাত্রীদের আরব দেশে আনা নেওয়া করে এবং অন্য সময় মশলা এবং কাপড়ের বাণিজ্য করে। আমি আগে যখন এখানে এসেছিলাম তখনো ওগুলোকে দেখেছি। তবে ঐ যে তিনটি কালো রঙ্গের চৌকো আকৃতির উঁচু কিনার বিশিষ্ট জাহাজ দেখা যাচ্ছে ঐ ধরনের জলযান আমি আগে দেখিনি।

ওগুলোর একটার পেছন দিকের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে থাকা নলটি কি কামান?

আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না জাঁহাপনা।

আহমেদ খান যখন কথা বলছিলেন তখন তিনটি জাহাজের মধ্যে যেটি তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী, সেটার নাবিকদের পাল তুলতে দেখা গেলো। পাল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হওয়ার পর আকবর সেটাতে বিশাল আকারের লাল রঙে আঁকা ক্রুশচিহ্ন দেখতে পেলেন। কিছু নাবিক জাহাজটি থেকে নামানো একটি দাঁড়বাওয়া নৌকায় চড়ছিলো এবং জাহাজটির সঙ্গে নৌকাটি দড়ির সাহায্যে যুক্ত ছিলো। শীঘ্রই ছোট নৌকাটির নাবিকদের দাঁড় বাওয়ার টানে এবং উন্মুক্ত পালে লাগা বাতাসের চাপে বড় জাহাজটি ধীরে ধীরে অকবরদের অবস্থানের দিকে ঘুরতে লাগলো।

ইত্তিমাদ খানকে পরাজিত করার পর এই সমুদ্র উপকূলে পৌঁছাতে আকবরের ছয় সপ্তাহ সময় লেগেছে। তিনি তাঁর সকল ভারী সরঞ্জাম পেছনে ফেলে ক্লান্তিহীন ভাবে ঘোড়া ছুটিয়েছেন। পথে যেখানেই ইব্রাহিম হোসেনের সৈন্যদের সম্মুখীন হয়েছেন তাঁদের পরাজিত করে ছত্রভঙ্গ করেছেন। গতকাল আকবরের সৈন্যরা উপকূল বরাবর কয়েক মাইল দূরে একটি অর্ধভগ্ন ছোট আকৃতির দূর্গ দখল করে। দূর্গটির ভিতর তারা পাঁচটি প্রাচীন নকশার কামান আবিষ্কার করে। আকবরের নির্দেশে তার লোকেরা আশেপাশের গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে মালটানা ষাঁড় ক্রয় করে। আকবর সেই কামানগুলি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন এই ভেবে যে ক্যাম্বে আক্রমণের সময় হয়তো সেগুলি কাজে লাগতে পারে। তাই এই মুহূর্তে কামান বিশিষ্ট জাহাজটিকে তাঁদের দিকে ঘুরতে দেখে তিনি ঘাবড়ালেন না।

কামান প্রস্তুত করো, যাতে প্রয়োজনে ঐ জাহাটির দিকে গোলা বর্ষণ করা যায় এবং বন্দুকধারীদের তৈরি হতে বলো, আকবর আদেশ দিলেন। আধ ঘন্টা পর মোগলদের অবস্থানের ঠিক বিপরীত দিকে, সমুদ্র উপকূল থেকে মাত্র পৌনে একমাইল দূরে পালে কুশ অঙ্কিত কালো রঙের জাহাজটি নোঙর করলো। দেহে উজ্জল বক্ষবর্ম পরিহিত লম্বা গড়নের একটি লোক দড়ির মই বেয়ে জাহাজটি থেকে দাঁড়বাওয়া নৌকাটিতে নামলো যোটি জাহাজটিকে অবস্থান নিতে এতোক্ষণ সাহায্য করেছে। লম্বা লোকটিকে অনুসরণ করে সাদা পাগড়ি এবং বেগুনি আলখাল্লা পরিহিত আরেকটি লোক নৌকায় চড়লো। তারা দুজন যখন ছোট নৌকাটিতে বসলো তখন নাবিকরা সেটার বড় জাহাজটির সঙ্গে যুক্ত বাঁধন খুলে দাঁড় বেয়ে তীরের দিকে রওনা হলো। নৌকাটি যে মুহূর্তে অগভীর জলে পৌঁছালো লম্বা লোকটি তার সঙ্গীকে নিয়ে পানিতে লাফিয়ে নেমে পানি ভেঙে তীরের দিকে আসতে লাগলো। তারা উভয়েই মাথার উপর হাত তুলে রেখেছে বোঝানোর জন্য যে তারা নিরস্ত্র।

আকবর কৌতূহল নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে জানে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী তখন কি উদ্দেশ্যে তারা তার কাছে আসছে? অস্ত্র আছে কিনা দেখার জন্য ওদের দেহ তল্লাশী করে আমার কাছে নিয়ে এসো, তিনি তাঁর দেহরক্ষীদের অধিনায়ককে আদেশ দিলেন। অধিনায়কটি দৌড়ে আগন্তুকদের দিকে এগিয়ে গেলো এবং তারা তাকে তল্লাশী করার সুযোগ দিলো। তারা নিরস্ত্র এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে অধিনায়কটি তাঁদের আকবরের কাছে নিয়ে এলো। তারা কাছে আসার পর আকবর বুঝতে পারলেন বেগুনি পোষাক পরিহিত লোকটি গুজরাটি কিন্তু তার লম্বা সঙ্গীটি একজন বিদেশী। বিদেশীটির মুখভর্তি বাদামি রঙের দাড়ি এবং নাকটি অত্যন্ত খাড়া ও লম্বা। তার সমতল বক্ষবমটি কেবল বুক ঢেকে রেখেছে এবং শরীরের নিচের অংশে হাঁটু পর্যন্ত দীর্ঘ কালো এবং সোনালী ডোরা বিশিষ্ট পাৎলুনের মতো পোশাক। তার হাঁটুর নিচের অংশে মোজা রয়েছে এবং তার লবনের দাগ বিশিষ্ট কালো পাদুকাটি এমন নকশার যা আকবর আগে কখনোও দেখেননি।

তোমরা কে? আকবর জিজ্ঞেস করলেন যখন তারা তাঁকে কুর্ণিশ করছিলো।

আমি সৈয়দ মোহাম্মদ, গুজরাটের লোক, বেগুনি পোশাক পরিহিত লোকটি উত্তর দিলো, এবং ইনি হলেন ডন ইগনাসিও লোপেজ, পর্তুগালের লোক। ঐ তিনিটি বড় জাহাজের অধিনায়ক তিনি। আমি ওনার দোভাষীর কাজ করি।

তাহলে এই বাদামি দাড়ি বিশিষ্ট লোকটি একজন পোর্তুগীজ এরা ইউরোপের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে কয়েক বছর আগে গোয়ায় এসেছে নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য। আকবর সতর্কতার সঙ্গে অশান্তুকটির যোগ্যতা নিরূপণের চেষ্টা করলেন। তিনি আগেই পোর্তুগীজদের কষ্মা শুনেছেন। তারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সরবরাহের জন্য প্রশংসা অর্জন করেছে, এছাড়া তারা জাহাজ নিয়ে যুদ্ধ করতেও বেশ পারদর্শী। কিন্তু এই প্রথম তিনি তাদের একজনের মুখোমুখী হলেন।

ও আমাকে কি বলতে চায়? আকবর জিজ্ঞেস করলেন। দোভাষীটি পোর্তুগীজটির সঙ্গে এমন এক ভাষায় কথা বললো আকবর যা আগে শুনেননি এবং উত্তর জেনে নিয়ে সে আকবরের দিকে ফিরলো৷ ডন ইগনাসিও নিজ রাজার পক্ষ থেকে আপনাকে সম্ভাষণ জানিয়েছেন। দুঃসাহসী যোদ্ধা এবং শক্তিশালী সম্রাট হিসেবে তিনি আপনার পরিচয় জানেন। তার ঐ তিনটি জাহাজ বহু শক্তিশালী কামান এবং গোলাবারুদে সজ্জিত। ইব্রাহিম হোসেন তাকে একাধিক সিন্দুক ভর্তি ধন-রত্নের বিনিময়ে তার পক্ষে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু তিনি এই যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে চান।

এ কথা শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের বিনিময়ে সে কি আমার কাছে কোনো উপকার আশা করে?

দোভাষীটি আবার বিদেশী ভাষায় তার প্রভুর সঙ্গে আলাপ করলো, তারপর বললো, আপনি ক্যাম্বে বন্দর জয় করার পর তিনি এখানে বাণিজ্য করার অনুমতি চান।

যখন এই বন্দর আমার হবে তখন আবার ওকে বলবে আমার কাছে প্রস্তাব পেশ করতে এবং সে তখন ইতিবাচক উত্তর পাবে। এখন তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। ইব্রাহিম হোসেনের উপর আক্রমণের জন্য আমি আর দেরি করতে চাই না।

ডন ইগনাসিও এবং তার দোভাষী আকবরকে ঝুঁকে কুর্ণিশ করলো, তারপর যে পথে এসেছিলো সেই পথেই নৌকায় ফিরে গিয়ে নিজেদের জাহাজের দিকে অগ্রসর হলো। তাদেরকে আকবরের অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু এই মুহূর্তটি কৌতূহল মেটানোর উপযুক্ত সময় নয়, তিনি যুদ্ধের ময়দানে রয়েছেন। তিনি আহমেদ খানের দিকে ফিরলেন। আক্রমণের আদেশ দিন। আমরা সৈকতের ধারে অবস্থিত নারকেল গাছ গুলি বরাবর অগ্রসর হবো যেখানে বালু অপেক্ষাকৃত দৃঢ়। ইব্রাহিম হোসেন এবং তার লোকেরা এখন শঙ্কিত হয়ে আছে কারণ পোর্তুগীজটির কাছে তাদের সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এছাড়া ধারাবাহিক ভাবে আমরা তাদের সকল প্রতিরোধ মোকাবেলা করে এসেছি এবং বর্তমানে তাদের তুলনায় আমাদের সৈন্য সংখ্যা বেশি।

আধ ঘন্টা পরে, আকবর সৈকতের উপর দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তার কালো স্ট্যালিয়নটির খুরের আঘাতে বালু ছিটকে পড়ছিলো। তার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে তার দেহরক্ষীরা, এদের মধ্যে চারজন সবুজ মোগল পতাকা বহন করছে, আরো দুইজন শিঙ্গা বাজাচ্ছে। তারা যখন ইব্রাহিম হোসেনের অগ্রবর্তী প্রতিরোধ প্রাচীরের কাছাকাছি পৌঁছালো বোঝা গেলো সেগুলি তাড়াহুড়া করে বালু খুঁড়ে অস্থায়ী ভাবে বানানো হয়েছে। এর পেছনে অবস্থিত দূর্গের ইটের প্রাচীর অত্যন্ত নিচু এবং ভাঙাচোরা। কিন্তু স্পষ্ট বুঝা গেলো ইব্রাহিম খানের কামান রয়েছে। কারণ আকবর দেখতে পেলেন দূর্গের ভিতরে অবস্থিত একটি দোতলা ভবন থেকে কমলা বর্ণের আগুনের হল্কা এবং ধোঁয়া ছুটছে। সেই মুহূর্তে কামানের প্রথম গোলার আঘাতে তার একজন শিঙ্গাবাদকের মস্তক বিচ্ছিন্ন হলো।

আরো কিছু অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে ভূপাতিত হলো, তারা বন্দুকের গুলি বা তীর বিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ইব্রাহিম হোসেনের লোকেরা কামান পুনরায় ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত করতে অনেক বেশি সময় নিচ্ছিলো। ইতোমধ্যে আকবর ঘোড়া সহ লাফিয়ে প্রথম প্রতিরোধ এবং তার পেছনের খাদ পেরিয়ে গেছেন। তবে খাদ পেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তার মধ্যে অবস্থিত এক তীরন্দাজকে লক্ষ করে তলোয়ার চালিয়েছেন। আঘাতটি তার মুখের একপাশ কেটে দিয়েছে।

আকবর এ সময় আরেকবার কামান দাগার শব্দ শুনলেন এবং তার উপর বালুকণার বৃষ্টি হলো। গোলাটি তাঁর সামনে অবস্থিত প্রতিরোধের উপর আঘাত হেনেছে। গুজরাটি গোলন্দাজ কামানের নল নিচু করে অগ্রসরমান মোগল সেনাদের দিকে গোলা বর্ষন করতে চেয়েছিলো কিন্তু সেই গোলার আঘাতে তাদেরই তৈরি করা প্রতিরোধ প্রাচীর ভেঙে গেছে। ঘোড়ার লাগাম সবলে টেনে ধরে আকবর নতুন সৃষ্ট ফাটলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেন। সেখানে বালুর উপর দুজন গুজরাটি যোদ্ধার ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে ছিলো।

আকবর পাশে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর সহযোদ্ধারা একই পদ্ধতিতে প্রতিরোধ পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে। তার থেকে কিছুটা সামনে এক দল মোগল যোদ্ধা ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের ভাঙা প্রাচীর বেয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। তিনি তাঁদের দিকে অগ্রসর হলেন। ইতোমধ্যে কয়েক জন দূর্গের ভিতর ঢুকে পড়েছে। আকবর লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন এবং তাঁর সৈন্যদের অনুসরণ করলেন। বাম হাতের মুষ্টিতে দেয়ালে গাঁথা একটি ধাতব শলাকা আকড়ে ধরে নিজের শরীরকে টেনে তুললেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের পিছু পিছু শত্রুদের শক্ত ঘাঁটি দোতলা ভবনটির দিকে অগ্রসর হলেন। এখান থেকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন দূর্গের প্রাচীরের ভিতর ওটাই একমাত্র ভবন।

আবার কামানের গোলা বর্ষিত হলো। তার একজন সৈন্য পড়ে গেলো কিন্তু পরমুহূর্তেই ধড়মড় করে আবার উঠে দাঁড়ালো, বুঝা গেলো গোলার আঘাতে নয়, সে হোঁচট খেয়ে পড়েছে। সম্ভবত একটি কামান ভবনের ভিতর এখনো সক্রিয় আছে। পলায়নকারী গোলন্দাজদের খুলে রেখে যাওয়া দরজা দিয়ে আকবর এবং তার সৈন্যরা ঢুকে পড়লো। ভেতরের অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই তারা একটি পাথরে তৈরি খাড়া সিঁড়িপথ দেখতে পেলো এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। সিঁড়ি পেরিয়ে এসে তারা দেখলো সেখানে এক গুজরাটি সেনাকর্তা একাই কামানের একটি ভারী গোলা কামানে ব্রার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পেছন থেকে আকবরের এক সৈন্য প্রায় এক ফুট লম্বা ফলা বিশিষ্ট একটি ছোরা তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। পিঠে ছোরাবিদ্ধ হয়ে সেনাকর্তাটি কামানের কাঠ নির্মিত গাত্তি উপর পড়ে গেলো।

জলদি করো, আকবর তার দুইজন দেহরক্ষীকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠলেন, তুমি ছাদে গিয়ে আমাদের পতাকা উড়িয়ে দাও, এর ফলে বুঝা যাবে আমরা দূর্গটি দখল করতে পেরেছি। আর তুমি, মোহাম্মদ বেগকে খুঁজে বের করো। তাঁকে বলো তিনি যাতে বাকি সৈন্যদের আদেশ দেন যতো দ্রুত সম্ভব এই দূর্গটির চারদিক ঘিরে ফেলার জন্য যাতে গুজরাটিরা পালিয়ে উত্তরে ক্যাম্বে শহরে ফিরে যেতে না পারে।

*

ঐদিন সন্ধ্যায় আকবর ক্যাষে বন্দর রক্ষাকারী বাঁধের উপর নির্মিত ছোট একটি পাহারাচৌকির উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই মুহূর্তে তিনি যুদ্ধের উত্তেজনার সঙ্গে মিশ্রিত বিজয়োল্লাস অনুভব করছেন। গুজরাট এখন নিশ্চিতভাবে তার বর্ধিষ্ণু সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত। বন্দরের প্রধান ভবনগুলির ছাদে মোগল পতাকা শোভা পাচ্ছে। ইব্রাহিম হোসেন কাঁধে কুঠার বিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় আত্মসমর্পণ করেছে এবং বন্দীত্ব বরণ করে সে এখন নিয়তির অপেক্ষায় রয়েছে।

সম্মুখে অবস্থিত সাগরটি কি অপূর্ব এর ধূসর তরঙ্গের উপর বেলা শেষের সূর্যটি বেগুনি মেঘের আগ্রাসনে পশ্চিম দিগন্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আকবর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি স্বশরীরে সমুদ্রের সান্নিধ্য গ্রহণ করবেন, সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে তার হয়নি।

একঘন্টা পর দেখা গেলো আকবর একটি পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ আরবী জাহাজের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে আছেন। সেটি ক্রমশ উঁচু হতে থাকা ঢেউ এর ধাক্কায় উঠা নামা করছিলো। জাহাজের অধিনায়ক আকবরকে আগেই সতর্ক করেছেন যে দিগন্তে আবির্ভূত কালো মেঘ সামুদ্রিক ঝড়ের পূর্বসংকেত। কিন্তু আকবর জেদ ধরেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও জাহাজ থেকে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করবেন। আকবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ কোৰ্চিটি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে নিজের পোশাকের উপর বমিও করে দিয়েছে। আরেকজন মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রাণে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা কছে।

হঠাৎ বিশাল আকারের একটি ঢেউ জাহাজের কিনার অতিক্রম করে আকবর এবং তার পাশে দাঁড়ানো আহমেদ খানকে উষ্ণ ফেনিল জলে গোসল করিয়ে দিলো। আহমেদ খানকে বেশ বিচলিত মনে হলো যখন তিনি আকবরের দিকে ফিরলেন। জাহাপনা চলুন আমরা আরেকটু নিরাপদ অবস্থানে যাই, সেটাই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে। আকবরের দীর্ঘ ভেজা চুল বাতাসে পেছন দিকে উড়ছিলো। তিনি তাঁর পা দুটি ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে জাহাজের এই অপরিচিত দোলার সঙ্গে একাত্ব হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি আহমেদ খানের প্রস্তাবের উত্তরে মাখা নাড়লেন। সমুদ্রের এই স্পন্দন আমাকেও কিছুটা ভীত করছে। কিন্তু জাহাজের অধিনায়ক আমাকে জানিয়েছে বড়টির প্রচগুতা কিছুক্ষণের মধ্যেই কমে যাবে। সমুদ্রের ঝঙা উপেক্ষা করে আমি আমার নিজের সাহস পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। এই মুহূর্তে ঝড়ের তান্ডব এবং এর ফলে সৃষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আমি শিখছি…আছড়ে পড়া প্রলয়ঙ্করী ঢেউ এবং সমুদ্রের অসীম শক্তি আমাকে বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে অতিঅহঙ্কারী বা সীমাহীন আত্মবিশ্বাসী হওয়া আমরা উচিত হবে না। যদিও আমি অন্য অনেক রাজার তুলনায় অধিক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছি, মহান বিজয় অর্জন করেছি, কোষাগার উপচে পড়া ধন-রত্ন আহরণ করেছি এক কোটি কোটি মানুষের শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছি-তবুও আমি একজন সাধারণ মানুষ, নগন্য এবং প্রকৃতির অনন্ত অস্তিত্বের তুলনায় নিতান্তই রূণশীল একটি প্রাণী।

.

১২. এক ডেকচি ভর্তি মস্তক

চমৎকার নকশা করেছ। বাঘটিকে দেখে মনে হচ্ছে সেটা যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপ দেবে, আকবর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কারিগরটিকে বললেন। তারা দুজন শিক্রির বালুপাথর খোদাই করা আকর্ষণীয় ভবনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন না যা আকবর গুজরাট বিজয়ের পর ফিরে এসে পরিদর্শন করেছেন। তারা আগ্রার যমুনা তীরবর্তী কাঠের জেটিতে দাঁড়িয়ে একটি নতুন তৈরি করা জাহাজের সম্মুখের চেহারা দেখছিলেন। সম্মুখে বাঘ বিশিষ্ট এই জাহাজটি বংলায় যুদ্ধাভিযানে আমার প্রতীক হিসেবে চমৎকার ভূমিকা পালন করবে।

আকবর শিক্রিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার দায়িত্বে নিয়োজিত তাঁর প্রধান সেনাপতি মুনিম খানের কাছ থেকে সংবাদ আসে। প্রথম সংবাদটি থেকে জানা যায়, বাংলার তরুণ শাসনকর্তা শাহ দাউদ, যে কিছুদিন আগে পিতার মৃত্যুর পর ঐ এলাকার জায়গিরদার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে সে বিদ্রোহ করেছে। এছাড়াও সে রাজকীয় কোষাগার সমূহ এবং প্রধান মোগল অস্ত্রাগার লুট করেছে। তবে বার্তাটিতে মুনিম খান উল্লেখ করেন যে তিনি নিজেই দাউদকে এই ধৃষ্টতার জন্য শাস্তি দেবেন। দ্বিতীয় বার্তাটি অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত, উল্লেখ করা হয়েছে, শাহ দাউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান যেমন অনুমান করা হয়েছিলো তার তুলনায় কঠিন হয়ে পড়েছে এবং মুনিম খানের আরো সৈন্য সহায়তা প্রয়োজন। এই বার্তা দুটি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তৃতীয় আরেকটি বার্তা আসে। এতে স্বয়ং আকবরকে সেখানে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে এই জন্য যে, সেখানে মারাত্মক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মুনিম খান দাউদের পাটনা দূর্গ অবরোধ করেছেন ঠিকই কিন্তু পর্যাপ্ত সৈন্যের অভাবে তার এই অবরোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

সদ্য পশ্চিম উপকূলে সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে পূর্বদিকে বাংলা এবং এর উপকূলবর্তী অঞ্চল নিজের করতলগত করার সুযোগ আকবরকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে। তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই মুনিম খানের তৃতীয় বার্তাটির তাৎক্ষণিক উত্তর প্রদান করেছেন। উত্তরে আকবর মুনিম খানকে জানিয়েছেন তিনি যাতে নিজের বাহিনীর সদস্যদের অহেতুক বিপদের সম্মুখীন না করেন। পাশাপাশি আকবর সেখানে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত রসদ এবং যুদ্ধসরঞ্জাম যথাসম্ভব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। এছাড়াও আকবর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মুনিম খানকে জানিয়েছেন, নিশ্চিত বিজয়ের জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য সংগৃহীত হওয়ার আগে তিনি যাত্রা শুরু করবেন না। তাছাড়া তার সৈন্যদের নিয়ে জলপথে পাটনা আসার জন্য পর্যাপ্ত জলযান যোগাড় করতেও কিছুটা সময় লাগবে। এর অর্থ পাটনা পৌঁছাতে তার কমপক্ষে তিন মাস বা তার কিছু বেশি সময় লাগবে।

আকবর তাৎক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেহেতু পাটনা যেতে হলে তাঁকে তাঁর সাম্রাজ্যেন প্রধান দুটি নদীপথ যমুনা ও গঙ্গা দিয়ে অগ্রসর হতে হবে তাই এর উভয় পারের প্রজাদের মধ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টির জন্য বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে এমন আকর্ষণীয় একটি নৌবহর নিয়ে অগ্রসর হতে হবে যা ঐসব অঞ্চলের মানুষ আগে কখনোও দেখেনি। যেদিন মুনিম খানের চিঠির উত্তর দিয়েছেন সেই দিনই তিনি তার প্রকৌশলী এবং জাহাজ নির্মাতাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁদের প্রশস্ততল বিশিষ্ট নৌকা ও জাহাজ নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন যেগুলিতে করে যুদ্ধতি এবং বিশাল আকৃতির কামন ও গোলা বহন করা সম্ভব হবে। তার সৈন্যদের বহন করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক নদীগামী জলযানও সংগ্রহ ও পুনর্নির্মাণ করতে বলেছেন।

*

জাহাপনা, আজ আমাদের পক্ষে যাত্রা করা সম্ভব হবে না, আহমেদ খান বললেন। প্রচণ্ড বর্ষণের কারণে বন্যার পানি এতো তীব্র বেগে ভাটির দিকে প্রবাহিত হচ্ছে যে জাহাজের অধিনায়করা আশঙ্কা করছেন এই মুহূর্তে রওনা হলে জাহাজের গতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং দিন শেষে যাত্রা বিরতির সময় সেগুলিকে নোঙর ফেলে একস্থানে স্থির রাখাও সম্ভব হবে না। এছাড়া যে অশ্বারোহী বাহিনী নদী তীর দিয়ে আমাদের সঙ্গে অগ্রসর হবে তারাও গভীর কাদা এবং ডোবা নালা অতিক্রম করতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে।

আকবর এক মুহূর্ত ভাবলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আহমেদ খান অনেক বেশি সাবধানী হয়ে উঠছেন। না, আজই রওনা হওয়ার ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমাদের যদি ধীরেও অগ্রসর হতে হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করবো এবং প্রয়োজনে একটার বেশি জাহাজ ছাড়বো না। কিন্তু যাত্রা আমরা আজই শুরু করবো। যখন কেউ নদী পথে যাত্রা করার সাহস করবে না তখন যদি আমরা অগ্রসর হই সেটা আমাদের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা প্রকাশ হবে, যা সম্পর্কে আমি আমার প্রজাদের অবগত করতে চাই। বিশেষ করে শাহ্ দাউদকে। আমি যতোটা ভাবছি সে যদি তার তুলনায় অধিক নির্বোধ না হয়, তহলে সে অবশ্যই আমার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য গুপ্তচর নিযুক্ত করেছে।

এক ঘন্টা পরের ঘটনা। বৃষ্টি পড়া সাময়িক ভাবে বন্ধ আছে এবং সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিস্নাত আবছা সূর্য দেখা যাচ্ছে। আকবর তার পতাকাবাহী জাহাজের অগ্রভাগে খোদাই করা বাঘের মস্তকের ঠিক উপরে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধুমাত্র নেংটি পরিহিত দাড়িরা (বইঠা বাওয়ার লোক) সামনে পিছনে নুয়ে বইঠা বাইছে আর দরদর করে ঘামছে। তারা বহু কষ্টে স্রোতের বিপরীতে জাহাজটিকে মাঝ নদীতে রাখার চেষ্টা করছে। অন্যান্য বিশাল আকৃতির নৌকা গুলিকে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের নৌকার সাহায্যে টানা হচ্ছে। দুই একবার প্রশস্ততল নৌকাগুলি পরস্পরের সঙ্গে বাড়ি খাওয়া ছাড়া বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। আকবর ঈশ্বরের কাছে এই মর্মে প্রার্থনা করলেন যাতে তার অভিযানে কোনো বড় ধরনের বিঘ্ন না ঘটে। তাছাড়া এই অভিযানের সাফল্যের জন্য তার নিজের সতর্কতা ও পরিকল্পনারও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

*

দিগন্তে বিস্তৃত কালো মেঘে উজ্জ্বল পাতের মতো বিদুৎ ঝলসে উঠছে। তার মাঝে ভৃত্যরা সারিবদ্ধভাবে জাহাজ থেকে তীরে ফেলা কাঠ নির্মিত ঢালু সিঁড়ি বেয়ে কিছুক্ষণ আগে শিকার করা পশুর মৃতদেহ বয়ে আনছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আটটি বাঘ-তার মধ্যে একটির মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাত ফুটের কম নয়-বাঁশের সাথে বেঁধে চারজনের এক একটি দল সেগুলো কাঁধে বয়ে আনছে। তাদের পিছনে অন্যরা বয়ে আনছে নাড়িভুড়ি অপসারিত হরিণের দেহ, সেগুলি চামড়া ছিলে টুকরো করলেই সান্ধ্য ভোজের জন্য রান্না করা যাবে। লাইনের শেষের ভৃত্যদের কাঁধে ঝুলছে স্থির হয়ে থাকা হাঁসের গুচ্ছ।

আকবর ইতোমধ্যে তাঁর বৃষ্টিতে ভেজা কাদামাখা পোষাক ছেড়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন পোষাক পরিধান করছেন। লাল শাস বিশিষ্ট তরমুজের রসে চুমুক দিতে দিতে তিনি যাত্রার চুড়ান্ত প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। রওনা হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ অপরাহ্নেই আকবর শিকার করার উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন। জাহাজের নাবিকরা তাঁর এই ইচ্ছার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। আকবর যুক্তি দেখান যে, শিকার করার ফলে অশ্বারোহীরা অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছে এবং বন্দকধারীরাও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারছে। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের শখও পূরণ হচ্ছে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে সপ্তাহে অন্তত একবার। তখন তিনি মোহাম্মদ বেগ, রবি সিং এবং অন্যান্য সেনাপতিদের আদেশ করেছেন- যেকোনো শুকনো নদীপারে পদাতিক সৈন্যদের কুচকাওয়াজ করানোর জন্য। দশ দিন আগে তিনি যমুনা এবং গঙ্গা নদীর সঙ্গম স্থলের পাশে অবস্থিত পবিত্র নগরী এলাহাবাদে নেমেছিলেন। তারপর সেখানকার প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে ঐ নগরীতে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। পরে সন্ধ্যায় তাঁর সফর সঙ্গী হিসেবে আগত কাশগড়ের জাদুকরেরা শহর প্রাচীরের উপর এক বর্ণাঢ্য আতশবাজি প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

আকবর তাঁর পাশে থাকা আহমেদ খানের দিকে ফিরলেন। পাটনা পৌঁছাতে আমাদের আর কয় সপ্তাহ সময় লাগবে বলতে পারেন?

হয়তো এক মাস লাগবে, কিন্তু এক্ষেত্রে মূলত, বর্ষা পরিস্থিতির উপর সবকিছু নির্ভর করছে। এখনো পর্যন্ত আমাদের ভাগ্য ভালোই রয়েছে স্বীকার করতে হবে। সবচেয়ে ক্ষতিকর দুর্ঘটনা ছিলো সেটাই, যখন দুটি প্রশস্ততল নৌকা পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিনটি কামান যমুনা গর্ভে হারিয়ে যায়। তবে এখন যেহেতু গঙ্গা নদী ক্রমশ চওড়া হচ্ছে তাই আমরা আমাদের গতিপথে অধিক সংখ্যক অগভীর এবং কর্দমাক্ত তীর পাবো। ফলে তীরে নামার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। শাহ দাউদ আমাদেরকে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য ঐসব জায়গায় গুপ্ত আক্রমণের পরিকল্পনাও করতে পারে। আমি জানতে পেরেছি সে কতিপয় নদীদস্যুকে আমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য উৎকোচ প্রদানের চেষ্টা করেছে।

কিন্তু নদীদস্যুরা বিচক্ষণতার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, তাই না?

জ্বী জাহাপনা। তাঁদের কেউ কেউ বিষয়টি সরাসরি আমাদেরকে জানিয়েছেও। তাছাড়া আমাদেরকে নদীদূর্গ গুলির প্রতিও সতর্ক থাকতে হবে যেগুলি পাটনার প্রবেশপথ রক্ষায় নিয়োজিত। আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা জানিয়েছে সেগুলি পর্যাপ্ত লোকবল এবং রসদ সমৃদ্ধ।

নদী পথে চলতে চলতে আমি এ বিষয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি যে কীভাবে তরুণ শাহ দাউদ এর মনোবল নষ্ট করা যায় এবং তার প্রতি তার সৈন্যদের আস্থা দুর্বল করা যায়। এখন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার উপযুক্ত সময়।

আপনি কি বোঝাতে চাইছেন জাঁহাপনা? কীভাবে তা সম্ভব? আহমেদ খানকে ভীষণ অবাক মনে হলো।

আমার সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আমি তাকে একটি চিঠি লিখতে পারি এবং প্রস্তাব দিতে পারি সে যাতে প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমার দাবি যাচাই করে। তাকে আরো জানাতে পারি যে- সৈন্য সংখ্যা, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য রসদ সমৃদ্ধ হয়ে আমি যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি তা কাজে লাগানো থেকে আমি বিরত হবো যদি সে কেবল একটি যুদ্ধের মাধ্যমে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে রাজি হয়।

কিন্তু সে রাজি হলে কি করবেন?

আমি নিশ্চিত সে রাজি হবে না, কিন্তু রাজি হলেও সমস্যা নেই। যে কোনো লোকের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, আর সে তো একজন অনভিজ্ঞ তরুণ হিসেবে সুপরিচিত। একটি যুদ্ধে সবকিছু সমাধান হয়ে গেলে অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে, সেইসঙ্গে সময় এবং জটিলতাও।

সে ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে বলে আপনি মনে করেন?

সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, কিন্তু সে যদি সত্যিকার সাহসী না হয় অথবা ভালো অভিনেতা, তাহলে তার আশেপাশের লোকজন তাকে বিচলিত হতে দেখবে। তার সৈন্যরা যখন আমার প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সেটা আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে-তখন তারা আমাদের আত্মবিশ্বাস প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হবে। একক যুদ্ধের প্রস্তাব দাউদ প্রত্যাখ্যান করার পর তারা তাকে কাপুরুষ বলে গণ্য করবে এবং তাদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়বে।

এই বুদ্ধিতে কাজ হতে পারে জাঁহাপনা, আহমেদ খান বললেন, তবে তাকে সন্দিহান মনে হলো।

কাজ হবেই। আমার নিজের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে আমার পিতামহ বাবরের এই বক্তব্যটি সঠিক ছিলো। সেটা হলো যতো যুদ্ধ সৈন্যরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুখোমুখী লড়াই করে জয়ী হয় ঠিক সম সংখ্যক যুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক ভাবে বিজিত হয়। তবে যাই হোক, শাহ দাউদকে প্রস্তাব পাঠাতে আমাদের তেমন কোনো ক্ষয় স্বীকার করতে হবে না।

সেই মুহূর্তে মাথার উপর বজ্রপাতের গর্জন শোনা গেলো এবং পুনরায় বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সেই ঘন বর্ষার মাঝে আকবরের নৌবহর যাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

*

আকবর ও আহমেদ খান গঙ্গা নদীর কর্দমাক্ত পারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের দৃষ্টি পাটনার প্রবেশ মুখের পাশে অবস্থিত দূর্গের দিকে। দূর্গটির দেয়াল প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু। দেয়ালের নিচের অংশ পাথরে তৈরি এবং উপরের দিকে ইটের গাথুনি। দূর্গ প্রাচীরের ফোকরে ব্রোঞ্জ নির্মিত কামানের নল দেখা যাচ্ছিলো। নদী এবং নদী তীরের ধান ক্ষেত কামানগুলির নিশানার আওতায় রয়েছে। নদী তীরের অধিকাংশ ভূমি জুড়ে ফলে থাকা ধানগাছ গুলি উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের। দূর্গের প্রাচীরে আঘাত হানার জন্য মোগল সৈন্যদের এই ধান ক্ষেত পেরিয়ে দ্রুত বেগে অগ্রসর হতে হবে।

আকবরের অনুমান অনুযায়ী একক যুদ্ধের প্রস্তাবের কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি শাহ্ দাউদ। তাঁর রণতরী সমূহ বর্ষা জনিত অসুবিধা অতিক্রম করে গঙ্গা নদীর বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে দুই দিন আগে। গত রাতে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ সভা শেষে আকবর আদেশ দেন তাঁর নৌবহরের একাংশ যাতে রবি সিং এর নেতৃত্বে রাতের আধার আড়ালকে ব্যবহার করে দূর্গ পেরিয়ে অগ্রসর হয় এবং কিছুটা ভাটিতে পৌঁছে একটি শক্তিশালী বাহিনী তীরে নামিয়ে দেয়। যাতে তারা সেদিক থেকে দূর্গ আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসতে পারে। আকবর বুঝতে পারছিলেন যে ভাগ্য তাকে সহায়তা করছে। কারণ ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সময় বর্ষার কালো মেঘ চাঁদকে ঢেকে রেখেছিলো এবং অবিরাম বৃষ্টি ঝরছিলো। ফলে দূর্গের প্রায় সামনে দিয়ে জাহাজ গুলি পেরিয়ে যাচ্ছিলো অস্তিত্ব গোপন রেখে। কিন্তু শেষ দিকে দূর্গের এক প্রহরী বিপদ সংকেত দিলে সেখান থেকে কামানের গোলা বর্ষণ শুরু হয়। পাঁচটি হাতি বহনকারী একটি প্রশস্ততল পোর্টুন (মালবাহী বড় আকারের নৌকা) কামানের গোলার আঘাতে ডুবতে শুরু করে, ভাটিগামী প্রচণ্ড স্রোতের তোড়ে কিছু তীরন্দাজ বহনকারী নৌকা অর্ধনিমজ্জিত পোনটুনটির সঙ্গে ধাক্কা খেলে জলসীমার নিম্নভাগে ফুটো হয়ে যায়। ফলে সেটিও ডুবতে শুরু করে এবং দূর্গ থেকে সেটার যাত্রীদের লক্ষ্যকরে কামান ও বন্দুকের গোলা বর্ষণ শুরু হয়। বহু তীরন্দাজ আহত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। যারা বেচে ছিলো তারা তাদের বক্ষবর্ম এবং অস্ত্র ত্যাগ করে সাঁতড়ে পারে উঠার চেষ্টা করে বা অন্য নৌকা গুলিতে উঠার চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ কালো জলে কিছু সর্পিল আকৃতিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়- একটু পরে বুঝা যায় সেগুলি রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে আসা কুমির। পানিতে থাকা লোকগুলি একে একে অদৃশ্য হতে শুরু করে এবং কুমিরের ধারাল দাঁতের আগ্রাসনে হাতিগুলি রক্তাক্ত মাংস পিণ্ডে পরিণত হয়।

সকালের প্রথম আলোতে আকবরের লোকেরা তীরন্দাজদের ডজন খানেক ছিন্নভিন্ন মৃত দেহ আবিষ্কার করে যেগুলি ভাটির দিকের অগভীর জলে ভাসছিলো। মৃতদেহ ভক্ষণ করতে এগিয়ে আসা একদল হাড্ডিসার বেওয়ারিশ কুকুরের দলকেও তাড়া করে সরিয়ে দিতে হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আকবর এই মর্মে শুভ সংবাদ পেলেন যে রবি সিং এর নেতৃত্বাধীন বাকি জাহাজগুলি সংঘর্ষ এড়িয়ে নিরাপদে দূর্গের ভাটি এলাকায় পৌঁছেছে অপেক্ষাকৃত কম হতাহত যাত্রী নিয়ে এবং সেখানে সৈন্য ও সরঞ্জাম পারে নামাচ্ছে। যুদ্ধসভায় গৃহীত কৌশল অনুযায়ী দূর্গটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করার প্রস্তুতি চলছে।

আহমেদ খান, আমরা যে সৈন্যদের উজানে নামিয়ে দিয়েছি তাদের সঙ্গে ভাটিতে নামা সৈন্যদের মিলিত হতে কততক্ষণ সময় লাগবে?

হয়তো আর এক ঘন্টা জাহাপনা। দূর্গ থেকে তাদের বাধা দানের কোনো চেষ্টার খবর পাওয়া যায়নি।

ভালো। আর কামানবাহী পোন্টুন গুলি কি দূর্গের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে, যেখান থেকে আমার আদেশ পেলে তারা আমাদের সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য দূর্গের দিকে গোলা বর্ষণ করতে পারবে?

জ্বী, গোলন্দাজেরা কামানে গোলা ভরে প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া যেসব সৈন্য দূর্গের নদীমুখী প্রবেশ পথ আক্রমণ করবে তারাও দাঁড়বাওয়া নৌকায় চড়ে প্রস্তুত রয়েছে।

এক ঘন্টা পর আকবরের আদেশ পেয়ে মধ্য নদীতে অবস্থান করা কামানবাহী দশটি পন্টুন নোঙ্গর তুলে অগ্রসর হতে লাগলো। নাবিকদের বৈঠার টানে বিশাল কাঠের জাহাজগুলি দ্রুত ভাটির দিকে অগ্রসর হলো। কামানবাহী পন্টুনগুলিকে নেতৃত্বদানকারি লোকটি লম্বা গড়নের, তার মুখভর্তি দাড়ি এবং সর্বাঙ্গে লাল পোশাক পরিহিত। দূর্গটি গোলাবর্ষণের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সে তার অধীনস্ত দুটি কামান ছোঁড়ার আদেশ দিলো।

ক্যানভাসের আচ্ছাদনের নিচে থাকা সত্ত্বেও কামানগুলির কাছে বৃষ্টির ছাট আসছিলো। সাবধানে হাতের সাহায্যে অগ্নিসংযোগকারী লাঠি ঢেকে দুই গোলন্দাজ কামানের স্পর্শরন্ধ্রে আগুন ছোঁয়ালো। আর্দ্রতার আগ্রাসন সত্ত্বেও দুটি কামানই প্রচণ্ড শব্দে গোলাবর্ষণ করলো এবং বিস্ফোরণের ধাক্কায় পন্টুনটি ভীষণভাবে দুলে উঠলো। ফলে একজন গোলন্দাজ ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো, তবে সঙ্গীর সহায়তায় পরক্ষণেই সে আবার জলযানে উঠে পড়তে সক্ষম হলো। তারা যখন তাদের আন্দোলিত হতে থাকা জলযানে আবার মরিয়া হয়ে কামান প্রস্তুত করতে লাগলো তখন অন্য পন্টুনে থাকা কামানের গোলা বর্ষিত হলো এবং নদীর ঐ অংশ বিস্ফোরণের সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হতে লাগলো।

পার থেকে নদীর মধ্যে বর্ধিত হয়ে থাকা একটি উদগ্রভূমিতে আকবর দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধোঁয়ার মাঝে সৃষ্ট সাময়িক ফাঁক দিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন দূর্গের জলদ্বার (পানি পথে দূর্গে প্রবেশের দরজা) কামানের গোলার আঘাতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর বিশাল কাগুলি দেয়াল থেকে প্রায় আলগা হয়ে গিয়েছে। প্রতিপক্ষ ক্ষতি মেরামত করার আগেই এখন আক্রমণ করতে হবে। নৌকার সৈন্যদের অগ্রসর হতে বলল, তিনি চিৎকার করে উভয় দিকের কামানের গর্জন ছাপিয়ে নিজের কণ্ঠস্বর শ্রবনযোগ্য করতে চাইলেন।

এ সময় আকবর দেখতে পেলেন তার যুদ্ধ হাতিগুলো কাদাপানি পূর্ণ ধানক্ষেত মাড়িয়ে দূর্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। হাতির পিঠে অবস্থিত হাওদা থেকে বন্দুকধারীরা দূর্গের গোলন্দাজদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। পদাতিক সৈন্যরা বহুকষ্টে কাদাপানির উপর দিয়ে হাতির দেহকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে দূর্গের প্রাচীর বেয়ে উঠার জন্য লম্বা মই বহন করছিলো। একটি হাতি মাথায় কামানের গোলার আঘাত লেগে ধান ক্ষেতে লুটিয়ে পড়লো। মোগল পদাতিকরা সেটার আড়ালে জড়ো হতে লাগলো দূর্গের প্রাচীরে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। বর্তমানে সব কিছু ভালো মতোই আগাচ্ছে।

হঠাৎ গঙ্গা নদীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আকবর দেখতে পেলেন মোগল সৈন্যতে পূর্ণ একটি নৌকা সৈকত থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে যেটি দূর্গের জলদ্বারে (পানি পথে দূর্গে প্রবেশের দরজা) আঘাত হানার জন্য অগ্রসর হয়েছে। আহমেদ খান হাত বাড়িয়ে আকবরকে বিরত করতে চাইলেন কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে অগভীর পানির উপর দিয়ে দৌড়ে নৌকাটির দিকে অগ্রসর হলেন, কুমিরের আক্রমণের আশঙ্কাকেও গুরুত্ব দিলেন না। সোনা মোড়া বক্ষবর্ম দেখে নৌকার সৈন্যরা আকবরকে চিনতে পারলো এবং উল্লাসে চিৎকার করতে করতে তাকে সবলে টেনে নৌকায় তুললো। দ্রুত তিনি নৌকার সম্মুখ ভাগে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং দাঁড়িদের দূর্গের জলদ্বারের কাছে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে থাকলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎ আকবরের মনে হলো কোনো দৈত্যাকৃতি হাত তাকে বুকের উপর সজোরে ধাক্কা মেরেছে। তিনি বেশ খানিটা পিছিয়ে বেকায়দাভাবে নৌকার পাটাতনের উপর পড়ে গেলেন। কি হলো? তিনি বিভ্রান্তবোধ করলেন। তিনি রক্তক্ষরণের কোনো আলামত পেলেন না কিন্তু তার শরীরের ডান পাশটা অবশ মনে হলো। আকবর হাতড়ে তাঁর বক্ষবর্মটি পরীক্ষা করতে লাগলেন। সেটা কোথাও ফুটো হয়নি তবে এক জায়গায় টোল খেয়েছে এবং শরীরের সেই স্থানে ভোঁতা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এখন আকবর অনুমান করতে পারলেন এটা গাদাবন্দুকের গুলির আঘাত।

তাকে ঘিরে থাকা সৈন্যদের হাত নেড়ে সরিয়ে তিনি উঠে বসলেন নৌকার অবস্থান জানার জন্য। দেখলেন নৌকাটি দূর্গের জলদ্বার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে। ভাগ্যের সহায়তায় বা খুব ভালো নিশানার বদৌলতে তার ভাসমান কামান থেকে ছোঁড়া গোলার আঘাতে দশ ফুট উঁচু কাঠের দরজাটির সম্মুখের লোহার জাফরিটি(গ্রিল) ভেঙ্গে গেছে এবং কাঠের দরজাটিও উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে অন্য আরেকটি মোগল নৌকা থেকে সৈন্যরা লাফিয়ে তীরে নেমে আকাবাকা গতিতে দ্বারটির দিকে ছুটছিলো যাতে দূর্গ প্রাচীরের উপর থেকে তাঁদের দিকে ছোঁড়া তীর বা গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয়। কিন্তু তবুও আকবর দেখলেন তাঁদের অনেকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গেলো এবং বাকিরা পালাতে লাগলো। কেউ কেউ তাদের আহত সঙ্গীদের টেনে দরজা থেকে দশ গজ দূরে অবস্থিত জেটির পাশের ছোট পাথরের কুটিরের আড়ালে কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। আকবর তাঁর নৌকাটি তীর স্পর্শ করার আগেই এক ফুট পানির মধ্যে লাফিয়ে নামলেন, পানি ছিটিয়ে তীরের দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় তিনি চিৎকার করলেন, জলদ্বারের দিকে আমাকে অনুসরণ করো সবাই। যতো দ্রুত দৌড়াবে বিপদ তত কমে যাবে। যতোটা সম্ভব সামনের দিকে ঝুঁকে তলোয়ার বাগিয়ে ধরে তিনি এগিয়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তিরিশ জনের মতো সৈন্য তাঁকে অনুসরণ করলো, বন্দুকের গুলি এবং তীর তাঁদের আশপাশের বাতাস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। আকবরকে অগ্রসর হতে দেখে পাথরের কুটিরটির আড়ালে আশ্রয় নেয়া সৈন্যরাও এগিয়ে এলো।

সবুজ পাগড়ি পরিহিত আকবরের এক সেনাকর্তা প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত দরজাটি পার হলো। কিন্তু সে চিৎকার করে নিজের লোকদের অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেয়ার পর পরই কপালে বন্দুকের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো। তবে তার লোকেরা তার শেষ আদেশ পালন করলো এবং আকবর যখন সেখানে পৌঁছালেন তার আগেই প্রায় এক ডজন সৈন্য সেখানে পৌঁছে গেলো। তারা যতোটা সম্ভব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এগুতে লাগলো যাতে প্রতিপক্ষের গুলি এবং তীর থেকে রক্ষা পেতে পারে। আরো অনেকগুলি নৌকা থেকে নামা সৈন্যরাও তখন এগিয়ে আসছে।

আকবর উপরে দূর্গপ্রাচীরের দিকে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন দূর্গরক্ষাকারী সৈন্যরা স্থলভাগ দিয়ে এগিয়ে আসা মোগলদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ফলে জলদ্বার দিয়ে অগ্রসর হওয়া সৈন্যদের দিকে তাদের মনোযোগ কমে গেছে। চল্লিশ গজ দূরে অবস্থিত একটি পাথরের ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ি পথের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে আকবর চিৎকার করে বললেন, চলো আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি এবং দূর্গরক্ষাকারীদের পেছন থেকে আক্রমণ করি, এবং নিজে দেয়াল ঘেষে দৌড়ে এগিয়ে গেলেন। একটি তীর আকবরের বক্ষবর্মে আঘাত করে ছিটকে পড়লো কিন্তু আরেকটি তার ঠিক পেছনে অবস্থিত সৈন্যটির গলায় বিধলো। আকবর থামলেন না, জোরে শ্বাস টানতে টানতে খাড়া সিঁড়ি পথের গোড়ায় পৌঁছে গেলেন এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন।

হঠাৎ দূর্গ প্রাচীরের উপর থেকে বর্শাবিদ্ধ এক সৈনিক আকবরের ঠিক সামনে সিঁড়ির উপর সশব্দে আছড়ে পড়লো। তিনি দেহটিকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলেন এবং সেটা গড়িয়ে নিচে চলে গেলো। বাকি ধাপ গুলি লাফ দিয়ে দিয়ে পার হয়ে তিনি দূর্গপ্রাচীরের উপরে পৌঁছে গেলেন। সেখানে একজন ছোটখাট গড়নের সৈন্য প্রাচীরের গায়ে আকবরের সৈন্যদের স্থাপন করা মই ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছিলো। আকবরের তলোয়ার তার গলায় আঘাত করলো। সে পড়ে যেতেই দ্বিতীয় আরেক জনকে আকবর আঘাত করলেন যে কার্ণিশের উপর ঝুঁকে মই বেয়ে উঠতে থাকা মোগলদের দিকে গুলি করছিলো। আঘাতটি তার হাঁটুর পেছনের মাংসপেশী কেটে দিলো এবং সে প্রচীরের উপর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেলো। তৃতীয় একজন আকবরের মুখোমুখী হলো এবং তিনি তার আনাড়ি হাতের তলোয়ারের আক্রমণ সহজেই নিজ তলোয়ার দ্বারা প্রতিহত করলেন, তারপর আরেক হাতে থাকা লম্বা ফলাযুক্ত ছোরা লোকটির পাঁজরের মধ্যদিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। ছোরাটা টেনে বের করতেই লোকটি পড়ে গেলো এবং তার মুখ এবং ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হতে লাগলো।

আশেপাশে তাকিয়ে আকবর দেখতে পেলেন তার সৈন্যদের অনেকেই এই মুহূর্তে মই বেয়ে অথবা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। এবং দূর্গরক্ষাকারীদের তুলনায় তারা সংখ্যায় বেড়ে গেছে। দূর্গের সৈন্যরা কিছুক্ষণ সাহসের সঙ্গে লড়াই করলো, কিন্তু তারপর আহত এবং কোণঠাসা হয়ে নিজেদের তলোয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করতে লাগলো।

দূর্গটি এখন আমাদের, আকবর বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। খেয়াল রেখ দূর্গের কেউ যাতে পালাতে না পারে।

তার আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো।

*

সেইদিন সন্ধ্যায় আকবর পাটনায় প্রবেশ পথের সদ্য অধিকার করা দূর্গের উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অগণিত মশা তার চারপাশে বিরক্তিকর ভন ভন শব্দে পাক খাচ্ছে। মানুষ অথবা জানোয়ার কেউই তাঁদের সূচাল হুলের আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আহমেদ খানের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে কি?

একজন উচ্চ পদস্থ সেনাকর্তা আমাদের জানিয়েছে আপনার একক যুদ্ধের প্রস্তাবে শাহ্ দাউদ এর মাঝে অস্বস্তি প্রকাশ পেয়েছে। সে আরো বলে, দাউদ চিঠিটি দুই তিন বার পাঠ করে, প্রতিবার পাঠের সময় তার চেহারা ফ্যাকাশে থেকে ফ্যাকাশেতর হতে থাকে, তারপর সে তার কপালে জমে উঠা ঘাম মুছতে মুছতে চিঠিটি দলামোচড়া করে আগুনে নিক্ষেপ করে। চিঠিটি পাওয়ার দুই দিন পরে সে এ বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করে। সে বলে যে, সাধারণ চোর ডাকাতরা তাদের ঝগড়া মেটানোর জন্য এমন কৌশল অবলম্বন করে, রাজাদের বিরোধ মেটানোর উপায় এটা নয়। যাইহোক সেনাকর্তাটি আমাদের আরো জানিয়েছে যে, দাউদ তার দেহরক্ষীর সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে আপনি তার উপর গুপ্ত আক্রমণ করতে পারেন এই আশঙ্কায়।

তরুণ দাউদের সাহস এবং সিদ্ধান্তকে আমাদের এ ধরনের পরীক্ষা দ্বারা যদি সহজেই প্রভাবিত করা যায়, তাহলে তাকে আরেকটু ভয় দেখানোর জন্য আমাদের নতুন কিছু চিন্তা করা উচিত। কথা বলতে বলতে আকবরের দৃষ্টি উঠানের অপরিচ্ছন্ন একটি কোণের দিকে নিবদ্ধ হলো। সেখানে তার একজন নিম্নপদস্থ সেনাকর্তা শত্রু সৈন্যদের মৃতদেহ স্তূপ আকারে জড়ো করার কাজ তদারক করছিলো। হঠাৎ তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো এবং তিনি আবার বলা শুরু করলেন,ঐ মৃত লোকগুলির আত্মা তাদের দেহ ত্যাগ করে বহু দূরে চলে গেছে, তাই না আদম খান?

আমাদের ধর্ম থেকে আমরা এমন শিক্ষাই পাই জাঁহাপনা।

কিন্তু তবুও ঐ মৃতদেহগুলি তাদের স্বপক্ষের যোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে শাহ্ দাউদকে অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণে প্ররোচিত করে।

কীভাবে তা সম্ভব?

পঞ্চাশটি মৃতদেহের ধর থেকে মাথা আলাদা করে মাথাগুলিকে একটি বড় রান্নার ডেকচির মধ্যে ভরুন। তারপর ডেকচির মুখ সোনালী রেশমের কাপড় দিয়ে ঢেকে শক্ত করে বাধুন। এরপর সেটিকে যুদ্ধবিরতির সাদা পতাকাবাহী নৌকায় করে পাটনা শহরের দিকে পাঠিয়ে দিন। সঙ্গে একটি চিঠিও যুক্ত করে দিবেন। তাতে লেখা থাকবে, আবারও আমি তাকে একক যুদ্ধের সুযোগ দিতে চাই এবং সে যদি এবারও আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তার আরো সৈন্য এভাবে অকারণে মাথা হারাবে এবং এই মৃত্যুর জন্য সেই দায়ি থাকবে।

এ ধরনের কিছু করলে আমাদেরকে কি অসভ্য বর্বর মনে হবে না, আমাদের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ প্রায়শই করে থাকে? আহমেদ খানকে কিছুটা মর্মাহত মনে হলো।

অধিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর এটাই একমাত্র উপায়। আমরা নিজেরা জানি আমরা বর্বর নই এবং শাহ্ দাউদ ও তার দলের লোকদের মাঝে আমরা যতো বেশি ভীতি সৃষ্টি করতে পারবো ততো দ্রুত তারা আত্মসমর্পণ করবে। এখনই গলা কাটার কাজ শুরু করতে বলুন।

*

মুণ্ডু ভর্তি ডেকচি আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে জাঁহাপনা। যখন সেটি শাহ্ দাউদের কাছে পৌঁছায় তখন গরমের কারণে মাথা গুলিতে পচন ধরে গিয়েছিলো। যখন সে বাঁধন খুলে ঢাকনাটি উন্মুক্ত করিয়ে ভিতরে কি আছে দেখার জন্য উঁকি দেয়, সেই মুহূর্তে কড়াই এর মুখ দিয়ে সহস্র মাছি দ্বারা সৃষ্ট কালো মেঘের পাশাপাশি অকল্পনীয় পচা গন্ধ বেরিয়ে আসে। শাহ্ দাউদ ছিটকে সরে গিয়ে হরহর করে বমি করতে থাকে এবং সেখানে উপস্থিত সকলের একই অবস্থা হয়। এর অল্পক্ষণ পরেই সে পাটনা ত্যাগের আদেশ দেয় এবং দুই ঘন্টার মধ্যেই সৈন্যসামন্ত সহ পাটনার সিংহদ্বার অতিক্রম করে চলে যায়।

আকবরের মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দেখা গেলো। তাঁর শাহ্ দাউদ সম্পর্কিত মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে এবং হাড়ি ভর্তি মাথা অনেক প্রাণ রক্ষা করতে নিশ্চিতভাবে সফল হয়েছে। একেই বলে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আপনি এভোকিছু জানলেন কীভাবে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

কিছু সৈন্য সহ একজন সেনাপতিকে শাহ্ দাউদ পিছনে রেখে যায় এবং তাকে আদেশ দেয় যতোক্ষণ সম্ভব শহরটিকে আমাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে। সেনাপতিটি সময় নষ্ট না করে আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে, তার জীবনের বিনিময়ে সে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত।

নিশ্চয়ই আপনি তার প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেছেন?

জ্বী।

প্রমাণ করুন আমরা আদতেই বর্বর বা অসভ্য নই। ঐ সেনাদলের সঙ্গে উত্তম আচরণ করার আদেশ দিন। এক মুহূর্ত পর আকবর যোগ করলেন, দুই তিন দিন পরে কিছু সৈন্যকে পালানোর সুযোগ করে দেবেন। পলাতক সৈন্যরা দূরবর্তী দূর্গগুলিতে অবস্থিত তাদের স্বপক্ষের লোকদের কাছে এই সংবাদ বয়ে নিয়ে যাবে যে তাদের প্রতি অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে তাদের সঙ্গীরাও আত্মসমর্পণ করতে প্রলুব্ধ হবে।

জ্বী জাঁহাপনা।

শাহ্ দাউদ এর গন্তব্য কোথায়?

সে প্রাচীর বেষ্টিত শহর গোমরার দিকে অগ্রসর হচ্ছে যেটি তার পূর্বপূরুষের অধিকৃত ভূখণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।

শহরটির অবস্থান কোনো দিকে এবং সেটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন?

শহটি উত্তর দিকে অবস্থিত জাঁহাপনা। এটি প্রাচীরে ঘেরা এবং শাহ্ দাউদ হয়তো সেখানে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া সেখানে অবস্থানকারী তার বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়রা হয়তো তার তুলনায় অধিক সাহসী এবং তাদের সহায়তায় সে পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারে।

সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমাদের উচিত তাকে বাধা দেয়া।

*

পাটনার আত্মসমর্পণের পর দুই সপ্তাহ পার হেয়েছে। ভারী বর্ষণ স্থগিত হলেও নিচু দিয়ে ভেসে চলা ধূসর মেঘ গুলি সকালের সূর্যের আলো ফোঁটায় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। একটি নিচু পাহাড়ের উপর আকবর দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথার উপরের নারকেল গাছের আচ্ছাদন থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ছে। তিনি যেখানে রয়েছেন সেখান থেকে পৌনে এক মাইল দূরে আরেকটি পাহাড়ের উপরে মাটির দেয়াল ঘেরা ছোট একটি শহরে শাহ্ দাউদ শিবির স্থাপন করেছে। আকবর যে পাহাড়টির উপর দাঁড়িয়ে আছেন সেটার উচ্চতা মধ্যম পর্যায়ের হলেও এখান থেকে আশপাশের জলাভূমি স্পষ্ট নজরে আসে। মোগলদের বিশ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল অগ্রগামী দল, যাদের মধ্যে বহু অশ্বারোহী বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজ রয়েছে, গতকাল বিকালে এই অবস্থানে এসে পৌঁছায়। তাঁদের দেখে শাহ্ দাউদের বাহিনী অবস্থান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেনি। পক্ষান্ত রে সারা রাত ঝড়ো আবহাওয়ায় মধ্যে তারা মশালের আলোতে সাধ্যমতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। মালগাড়ী উল্টে মাটির প্রাচীরের ফাঁক পূরণ করেছে এবং বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া অংশ ঠেকা দেয়ার চেষ্টা করেছে।

আকবর ভাবছেন তার প্রতিপক্ষ অল্প সময়ের মধ্যে যথেষ্ট ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করলেন। কারণ শাহ্ দাউদ তাঁর মতোই দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য সাথে করে কেবল হালকা ছোট আকারের কামান গুলি নিয়ে এসেছে। তাছাড়া দাউদের সৈন্য সংখ্যা তার সৈন্যদের প্রায় কাছাকাছি হলেও তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ গাদাবন্দুক রয়েছে এবং তাদের অবরোধ উপস্থিত উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হলেও যথেষ্ট দৃঢ় মনে হচ্ছে। আকবরের তথ্য সংগ্রহকারীরা জানিয়েছে তাদের শত্রুপক্ষ শহরবাসীদের বিছানা, তৈজসপত্র এবং ঘরের দরজাও অবরোধ তৈরির কাজে ব্যবহার করেছে। তাদের এতো ঐকান্তিক পরিশ্রম সত্ত্বেও আকবর উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে, একটি সমন্বিত আক্রমণই শহরটিকে দখল করার শ্রেষ্ঠ উপায়। আর শাহ্ দাউদকে পরাজিত করার মাধ্যমেই বাংলার বিদ্রোহের অবসান ঘটবে এবং এই উর্বর সমৃদ্ধ ভূমি তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হবে। আহমেদ খান যথারীতি আকবরের পাশেই ছিলেন। আকবর তার দিকে ফিরলেন। আমাদের অশ্বারোহীদের কি শহর ঘেরাও করা শেষ হয়েছে?

জ্বী। এক ঘন্টা আগেই সে কাজ সমাপ্ত হয়েছে।

তাহলে এখন কেবল শিঙ্গাবাদক এবং দুলিদের আদেশ দিলেই তারা আমাদের সৈন্যদের চারদিক থেকে সমন্বিত আক্রমণের জন্য সশব্দ সংকেত দিতে পারে।

জ্বী জাঁহাপনা, তবে আপনার পিতার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে এবং আপনার বর্ষিয়ান প্রধান সেনাপতি হিসেবে আপনার কাছে আমি একটি বিনীত অনুরোধ করতে চাই। নদী দূর্গে আক্রমণের সময় যেরকম ঝুঁকি আপনি নিয়েছিলেন দয়া করে এবার আর তেমনটা করবেন না। আমার মনে আছে আপনার পিতা হুমায়ূন আপনাকে রাজবংশের স্বার্থে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে আদেশ দিয়েছিলেন এবং একইভাবে বৈরাম খান আপনাকে উপদেশ দিয়েছিলেন হিমুর বিরুদ্ধে লড়াই এর সময়। আপনার পুত্ররা এখনো শিশু। আপনার কিছু হলে তাঁদের জীবন বিপন্ন হবে এবং সাম্রাজ্যেরও অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

আমি জানি আপনি বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কথাগুলি বলেছেন এবং আপনি যা বললেন তা নিঃসন্দেহে উত্তম উপদেশ। কিন্তু আমি আমার সহজাত প্রতিক্রিয়ার কারণে ঝুঁকি নেই, হয়তো এর আরেকটি কারণ এই যে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা আমার ভাগ্যে লেখা নেই- অন্তত এতো তাড়াতাড়ি নয় যখন আমি আমার সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ বিস্তৃত করতে পারিনি। আমার নিজের বিশ্বাস এবং জ্ঞানী সাধুগণ, যাদের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি তারাও মতো দিয়েছেন যে, আমার জন্য যা মারাত্মক বিপদ বলে গণ্য হতে পারে তার অবস্থান যুদ্ধক্ষেত্রে নয়।

কিন্তু আপনার পিতা উপলব্ধি করেছিলেন, কোনো মানুষের কর্মই তার চূড়ান্ত নিয়তি নির্ধারণ করে, তারা পরিকল্পনা বা নিয়তি সম্পর্কিত ভাবনা নয়…যদিও আপনার আত্মবিশ্বাস এবং সাহস অদ্যাবধি অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে আপনাকে সাফল্য এনে দিয়েছে যেখানে অন্যরা হয়তো ব্যর্থ হতো, আপনার উচিত নয় সর্বদা এমন অনুভূতির উপর নির্ভর করা।

আকবর সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। যুদ্ধের সময় তাকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কখনো কখনো একজন নেতা হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করা এবং বেপরোয়া আচরণের মধ্যকার পার্থক্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়, সেটা আমি জানি। এই বাস্তবতা যতোটা সম্ভব আমি স্মরণ রাখার চেষ্টা করবো। ইতোমধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকের প্রথম আক্রমণটি মোহাম্মদ বেগের নেতৃত্বে ছেড়ে দেবো। আমি এবং আমার দেহরক্ষীরা সঞ্চিত শক্তি হিসেবে অবস্থান করবো যাতে প্রয়োজনের সময় আপনাদের আক্রমণে সহায়তা করতে পারি।

তাহলে আমি কি এখন মোহাম্মদ বেগকে আক্রমণ শুরু করতে আদেশ দেবো?

হ্যাঁ।

আকবর এবং আহমেদ খান দর্শকের ভূমিকা নিলেন যখন শিঙ্গার সূচনা সংকেত পেয়ে মোগল অশ্বারোহীরা চারদিক থেকে জলাবদ্ধ মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত শহরটির দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। গভীর জল এড়িয়ে, চকচকে কালো পিচ্ছিল কাদা পেরিয়ে যেতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। মোহাম্মদ বেগ এবং তার দেহরক্ষী একদম সম্মুখবর্তী দলে সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। তাদের কয়েক জন সবুজ মোগল পতাকা বহন করছিলো। তারা যখন গাদাবন্দুকের নিশানার আওতার মধ্যে পৌঁছালো, তখন থেমে থেমে দাউদের সৈন্যদের বন্দুক ছোঁড়ার ধোঁয়া দেখা যেতে লাগলো। এখানে সেখানে কয়েকটি ঘোড়া গুলি বিদ্ধ হলো এবং আরোহী সহ কাদাপনিতে আছড়ে পড়লো। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া সৈন্যরা পিছন থেকে এগিয়ে আসা অশ্বারোহীদের ঘোড়ার খুরের নিচে চাপা পড়ছিলো। পিঠে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলি ভারমুক্ত হওয়ায় দৌড়ে অনেক সামনে চলে যাচ্ছিলো। এরকম একটি ঘোড়া সর্বপ্রথম, সবচেয়ে সম্মুখবর্তী একটি প্রতিরোধ লাফিয়ে পেরিয়ে গেলো।

সৈন্যদের অগ্রগতি ভালোভাবেই সম্পন্ন হচ্ছে, আকবর ভাবলেন। কিন্তু হঠাৎ মোহাম্মদ বেগ তার লোকদের নিয়ে যেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন সেদিকের মাটির প্রতিরোধের উপর থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্মিলিত গুলিবর্ষণের শব্দ পাওয়া গেলো। তারপর মাটির দেয়ালের একটি ফাঁক অবরোধ করে রাখা মালগাড়ি ঠেলে সরানো হলো এবং সেখান দিয়ে একদল অশ্বারোহী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রতিআক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এলো। তাদের দেহ ঘোড়ার ঘাড়ের উপর নুয়ে আছে, হাতে বর্শা। মোহাম্মদ বেগের অগ্রসরমান সৈন্যরা এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা পিছিয়ে এলো। তাদের অনেকে তাল সামলাতে না পেরে ঘোড়াসহ কাদার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এ সময় দেয়ালে আরো ফাঁক সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে আরো অশ্বারোহী যুদ্ধে অংশ নিতে এগিয়ে এলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরো বেশি সংখ্যক মোহাম্মদ বেগের লোক হতাহত হলো এবং একটি মাত্র মোগল পতাকা খাড়া থাকলো।

আকবর আর স্থির থাকতে পারলেন না-যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফলের জন্য এই লড়াইটির গুরুত্ব অপরিসীম এবং তার এখন উচিত স্বশরীরে মোগলদের নেতৃত্ব দেয়া। তিনি এক টানে খাপ থেকে আলমগীর বের করে আনলেন এবং সংঘর্ষের এলাকার দিকে তার ঘোড়া ছুটালেন। বিশ্বস্ত দেহরক্ষীরা তাকে অনুসরণ করলো। পাহাড়ে পৌঁছাতে তার সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় লাগলো, যদিও একটি জলাশয় লাফিয়ে পার হওয়ার সময় তার ঘোড়াটি কাদায় পিছলা খেলো।

তিনি যখন তার ঘোড়াটিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে লড়াই এর এলাকায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে লাগলেন, তখন তিনি শাহ দাউদের বন্দুকধারীদের নিশানার আওতায় পৌঁছে গেলেন। শাহ দাউদের লোকেরা তার সোনা মোড়া বক্ষবর্ম দেখে তাকে চিনতে পারলো এবং তার উপর গুলি বর্ষণে মনোযোগী হয়ে উঠলো। আকবর শুনতে পেলেন বন্দুকের গুলি এবং তীর তার দুপাশ দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর ঘোড়াটি এক মুহূর্তের জন্য টলমল করে উঠলো এবং তিনি অনুভব করলেন সেটার রক্ত তাঁর ডান উরু ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাঁজর এবং পায়ের সংযোগস্থলে বন্দুকের গুলি খেয়ে ঘোড়াটি আর এগুতে পারছিলো না, সেটার মাথাটিও ক্রমশ মাটির দিকে নুয়ে পড়ছিলো। ঘোড়াটি আছড়ে পড়ার আগমুহূর্তে আকবর কাদার উপর লাফ দিলেন এবং ঝট করে এক পাশে সরে গেলেন তাকে কাছ থেকে অনুসরণ করা দেহরক্ষীটির সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য।

দেহের ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার পর তিনি চিৎকার করে তার এক রক্ষীর কাছে আরেকটি ঘোড়া চাইলেন। তৎক্ষণাৎ রক্ষীটি ঘুরে এসে তার ঘোড়ার লাগামটি আকবরের হাতে দিলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আবার ঘোড়ায় চড়ে বসলেন এবং কাদার পুরু আবরণযুক্ত বুট জোড়া সেটার রেকাবে ঢুকিয়ে নিলেন।

আকবরের ঘোড়াটি আহত হওয়ার কারণে তার এবং তার দেহরক্ষীদের আক্রমণের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে। শাহ্ দাউদের কিছু অশ্বারোহী সৈন্য প্রায় তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। আকবর ঠিক সময় মতো ঘোড়া নিয়ে কিছুটা সরে গেলেন যখন বিশাল দেহী একজন বাঙ্গালী তার কাটাযুক্ত যুদ্ধকাস্তে আকবরের শিরোস্ত্রাণবিহীন মাথা লক্ষ্য করে ঘুরালো। কিন্তু লোকটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপর থেকে ছুটে আসার কারণে নিজ ঘোড়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সবলে লাগাম টেনে ধরা সত্ত্বেও সে আকবরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো, তবে আকবর লোকটির মাথার পেছনে আলমগীরের কোপ বসাতে দেরি করলেন না। আকবর নিজের হাতে তীব্র ঝাঁকি অনুভব করলেন তবে এটা নিশ্চিত হলেন যে তাঁর তলোয়ারের আঘাত লক্ষ্যভেদ করেছে।

কয়েক মুহূর্ত পর আকবর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসা দ্বিতীয় অশ্বারোহী বাঙ্গালীটিকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালেন কিন্তু সে মাথা নিচু করে আঘাতটি ব্যর্থ করে দিলো। লোকটি ঘুরে আবার আকবরের দিকে এগিয়ে এলো কিন্তু এবারে আকবর ঢালের উপরের দিকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। ফলে বাঙ্গালীটি পুরু কাদার স্তর পেরিয়ে আকবরের কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি তার কাছে গিয়ে তলোয়ারের আঘাতে তার হাতের বর্শটি ফেলে দিলেন এবং তারপর আলমগীরের ধারালো ফলা লোকটির উরু ও পেটের সংযোগ স্থলে ঢুকিয়ে দিলেন।

আসন্ন বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে আকবর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখে জমে উঠা ঘাম মুছলেন এবং আশেপাশে তাকালেন। বাম দিকে তাঁর কাছ থেকে ষাট গজ দূরে মোহাম্মদ বেগের খাড়া থাকা সবুজ পতাকাকে ঘিরে তুমুল লড়াই চলছে। দেহরক্ষীদের তাঁকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রের বিশৃঙ্খল ভীড় ঠেলে মোহাম্মদ বেগের দিকে অগ্রসর হলেন। বন্দুক এবং কামানের সম্মিলিত গোলা বর্ষণের চাপে মোহাম্মদ বেগের আক্রমণ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। বহু ঘোড়া কাদার মধ্যে পড়ে ছিলো। আকবর খেয়াল করলেন একটি ঘোড়া নিস্তেজভাবে সেটার পিছনে পা ছুড়ছে। আরেকটি ঘোড়ার নিচে চাপা পড়া অবস্থায় তিনি মোহাম্মদ বেগের মৃত কোর্চিকে দেখতে পেলেন।

তীব্র লড়াই চলছে। কিছু সংখ্যক বাঙ্গলীকে দেখা গেলো মোহাম্মদ বেগের ঘোড়াচ্যুত সৈন্যদের বর্শায় গেথে ফেলার চেষ্টা করছে। ঐ সৈন্যরা একটি পাথরে হেলান দিয়ে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে থাকা কাদা মাখা দেহকে রক্ষার চেষ্টা করছিলো। সেটা স্বয়ং মোহাম্মদ বেগ, তাকে চিনতে পেরে আকবর আতঙ্কিত বোধ করলেন। তিনি মরিয়া হয়ে সেদিকে অগ্রসর হলেন। যুদ্ধরত উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের কেউই তাঁর উপস্থিতি খেয়াল করলো না। তিনি তাঁর কাছাকাছি অবস্থিত এক বাঙ্গালীর ঘোড়ার পাছায় তলোয়ারের চআপ্টা অংশ দিয়ে আঘাত করলেন। তিনি যা চেয়েছিলেন তাই ঘটলো, ঘোড়াটি পিছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে সেটার আরোহীকে ফেলে দিলো এবং আরোহীটি আকবরের ঘোড়ার খুরের আঘাতে পিষ্ট হলো।

এরপর আকবর আরেকজন বাঙ্গালীর ঘাড়ে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন যে একজন কোর্চিকে বর্শাবিদ্ধ করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। আঘাতের পর তার হাত থেকে বর্শাটি খসে পড়লো। এই সময়ের মধ্যে আকবরের দেহরক্ষীরা আরো তিনজন বাঙ্গালীকে ধরাশায়ী করলো এবং বাকিরা লড়াই করার সাহস হারিয়ে ঘুরে শহর প্রাচীরের দিকে ফিরতে চেষ্টা করলো আঠালো মাটি পেরিয়ে। তাঁদের মধ্যে একজন কেবল সফল হলো তবে প্রাচীর অতিক্রম করার পূর্বে সে তার বাহুর উপরের অংশে নিক্ষিপ্ত ছোরা বিদ্ধ হলো।

একটু থেমে অকবর একজন কোর্চিকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, মোহাম্মদ বেগের কি হয়েছে?

তিনি যখন আমাদের সবুজ পতাকার সাথে অগ্রসর হচ্ছিলেন বাঙ্গালীরা তাকে আমাদের একজন সেনাপতি হিসেবে চিনে ফেলে। একটি কামানের গোলা তার কাঁধে আঘাত করে। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার সময় তিনি মাথায় আঘাত পান এবং পরে একজন বাঙ্গালী তার উরুতে বর্শা দিয়ে আঘাত করে।

তাকে যতদ্রুত সম্ভব হেকিমের কাছে নিয়ে যাও। তিনি যথেষ্ট শক্ত না হলে এতোক্ষণ পর্যন্ত বাঁচতেন না।

এবারে আকবর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে শহরের প্রতিরোধ প্রাচীরের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর কিছু সৈন্য ইতোমধ্যে দেয়ালের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে ঢুকে গেছে এবং এখন তারা গুচ্ছ গুচ্ছ মাটির কুটিরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আকবরের তিন জন বন্দুকধারী একটি কুয়ার আড়ালে নিচু হয়ে বসে সেটার দেয়ালের উপর বন্দুক রেখে গুলি বর্ষণ করছিলো এগিয়ে যাওয়া সঙ্গীদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য।

এ সময় অকবর দেখলেন শাহ্ দাউদ এর হলুদ পতাকা বিশিষ্ট কুটির গুলির পিছনে পাহাড়ে সবুজ মোগল পাতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। স্পষ্ট বুঝা গেলো তার লোকেরা শহরের বিভিন্ন অংশের প্রাচীর অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে এবং লড়াই করে শত্রুদের পর্যদস্ত করতে পেরেছে। কয়েক মুহূর্ত পর তিনজন লোক কয়েকটি কুটির থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের একজন আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে হাত তুলে আকবরের লোকেদের দিকে এগিয়ে এলো। বাকি দুজন প্রথমে তাদের হাতে থাকা হলুদ পতাকা কাদায় ছুঁড়ে ফেললো এবং তারপর মাথার উপর হাত তুললো। তার বিজয় হয়েছে, ভবতে ভাবতে আকবর তার মাথার উপর শূন্যে ঘুষি চালালেন। কি ঘটেছে। উপলব্ধি করে তার সৈন্যরাও বিজয় এবং বেঁচে যাওয়ার মিলিত আনন্দে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগলো।

ওকে বল শাহ দাউদকে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসতে, আকবর চিৎকার করে আদেশ দিলেন। যে বাঙ্গলীটির উপর আদেশটি বর্তালো তার চেহারা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো কিন্তু সে বিলম্ব না করে পেছন দিকের একটি কুটিরের মধ্যে অদৃশ্য হলো। কয়েক মিনিট কাউকে দেখা গেলো না এবং যেই আকবর বলপূর্বক তাদের ধরে আনার আদেশ দিতে যাবেন সেই মুহূর্তে একজন শীর্ণ চেহারা বিশিষ্ট দীর্ঘদেহী লোক কুটিরের দ্বারে আবির্ভূত হলো এবং মাথা নিচু করে আকবরের দিকে এগিয়ে এলো। আকবরের কাছ থেকে পনেরো ফুট দূরে থাকতে সে অধোমুখে মাটির উপর পতিত হলো। স্পষ্টই বোঝা গেলো তার বয়স শাহ্ দাউদের মতো উনিশ বছর নয় বরং এর দ্বিগুণ।

তুমি কে? শাহ্ দাউদ কোথায়? সে যদি ভিতরে লুকিয়ে থাকে, এক্ষুণি তাকে আমার সামনে হাজির হতে বলল।

আমার নাম ওস্তাদ আলী, আমি শাহ্ দাউদের মামা। তার উত্থানের সমগ্র সময়টায় আমি তার প্রধান উপদেষ্টা ছিলাম। সে যা কিছু করেছে তার সকল দায়ভার আমার। আমি যখন গতরাতে বুঝতে পারলাম কঠিন লড়াই সত্ত্বেও আমরা জিততে পারবো না তখন আমি শাহ্ দাউদকে ছদ্মবেশে এখান থেকে সরিয়ে দেই। তার সমস্ত ধন-রত্ন ঐ কুটির গুলির মধ্যে রয়েছে। এই ধন-সম্পদ এবং বাংলাকে আমি তার পক্ষ থেকে আপনার কাছে সমর্পণ করছি।

*

একটি উঁচু অগ্রভাগ বিশিষ্ট কাঠের ডাউ (আরব নাবিকদের ব্যবহৃত এক মাস্তুল বিশিষ্ট জাহাজ) এর পাটাতনে দাঁড়িয়ে আকবর বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গুজরাটের পশ্চিম উপকূলে সমুদ্র দর্শনের পর পুনরায় তা দেখার আকাঙ্ক্ষা তার মনে রয়ে যায়। তাই এবারে তিনি পূর্বের সমুদ্র দর্শন করে তার সেই ইচ্ছা পূরণ করছেন। এ সময় হঠাৎ উষ্ণ দমকা হাওয়া ডাউটির তিনকোণা পালে আঘাত করলে সেটি দুলে উঠলো এবং আকবর তাঁর পা দুটি আরেকটু ফাঁক করে দাঁড়ালেন। তখন মধ্যাহ্নের পর কিছু সময় পেরিয়েছে এবং সাগরের জল এতো উজ্জ্বল রূপালী বর্ণের দেখাচ্ছিলো যে সেদিকে তাকিয়ে থাকাই কষ্টকর মনে হচ্ছিলো। আকবর ঠোঁটে সাগরের লোনা স্বাদ পাচ্ছিলেন।

তাঁর সেনাবাহিনী বাংলার সকল প্রধান শহর বন্দর করতলগত করেছে। কিন্তু শাহ দাউদকে এখনো পাকড়াও করা সম্ভব হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে বন্দী করা যাবে। সমগ্র বাংলা এখন মোগল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ। আজ সকালেই তিনি অবুল ফজলের কাছ থেকে আরো সুসংবাদ পেয়েছেন। সে জানিয়েছে পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে শান্তি বজায় রয়েছে এবং শিক্রির নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে তিনি হাসলেন। আকবরের মনে হচ্ছিল তাঁর শাসন আমলের একটি অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছে। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে তাঁর পিতা, পিতামহ এবং নিজের আকাক্ষার চেয়েও অধিক বিস্তৃত করতে পেরেছেন। তবে তিনি তার এই সাম্রাজ্য বিস্তার অব্যাহত রাখবেন, কেবল তাঁর অনুসারীদের যুদ্ধের উত্তেজনা ও লুষ্ঠিত সম্পদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই নয়, বরং এই বিস্তৃত সাম্রাজ্যের উপর তাঁর শাসন ক্ষমতা সুদৃঢ় করার জন্যেও। একদিন যে সাম্রাজ্য তিনি তাঁর বংশধরদের দান করে যাবেন তা অবশ্যই অজেয় হতে হবে। এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য তাকে নতুন, পুরাতন, হিন্দু, মুসলিম সকল প্রজার সম্মান অর্জন করতে হবে। প্রজারা যাতে তাকে একজন শক্তিশালী দখলকারী বা বহিরাগত শত্রু মনে না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনটা ভাবা যতো সহজ, বাস্তবায়ন করা ততোটা সহজ নয়। কিন্তু তিনি এই নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এবার লড়াই শুরু করবেন।

৩. ক্ষমতা এবং গৌরব

Exit mobile version