Site icon BnBoi.Com

এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার

এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার

 

১.১ ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেম – প্রথম পর্ব

অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার
মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
অনুবাদ 
সাদেকুল আহসান কল্লোল

‘ভ্রাতৃসম আবেগ বিসর্জন দাও,
যদি তুমি সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ কর…
কেউ কারো ভাই নয়!
ওরা সবাই তোমার সাম্রাজ্যের শত্রু!’
—-হুমায়ুনের সৎ-বোন গুলবদন লিখিত হুমায়ুননামা থেকে সংকলিত

প্রধান চরিত্রসমূহ

হমায়ুনের পরিবারবর্গ :

বাবর, হুমায়ুনের আব্বাজান এবং প্রথম মোগল সম্রাট

মাহাম, হুমায়ুনের আম্মিজান এবং বাবরের প্রিয়তমা স্ত্রী

খানজাদা, হুমায়ুনের ফুপিজান এবং বাবরের ভগিনী

বাইসানগার, হুমায়ুনের নানাজান

কামরান, হুমায়ুনের সৎভাইদের ভিতরে বয়োজ্যেষ্ঠ

আসকারি, হুমায়ুনের সৎ-ভাইদের ভিতরে মধ্যম এবং কামরানের আপন ভাই

হিন্দাল, হুমায়ুনের সৎ-ভাইদের ভিতরে কনিষ্ঠতম

গুলবদন, হুমায়ুনের সৎ-বোন এবং হিন্দালের আপন ভগিনী

আকবর, হুমায়ুনের প্রাণপ্রিয় পুত্র

হমায়ুনের বিশ্বস্ত পারিষদবর্গ :

কাশিম, হুমায়ুনের বিশ্বস্ত উজির

জওহর, হুমায়ুনের ব্যক্তিগত পরিচারক এবং পরবর্তীতে তার রাজপ্রাসাদের খরচের নিয়ন্ত্রক

বাবা ইয়াসভালো, হুমায়ুনের অশ্বশালার প্রধান

আহমেদ খান, হুমায়ুনের গুপ্তদূতদের প্রধান এবং পরবর্তীতে আগ্রার শাসনকর্তা

শারাফ, হুমায়ুনের জ্যোতিষী

জাহিদ বেগ, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি

সালিমা, হুমায়ুনের প্রিয়তম উপপত্নী

সুলেয়মান মির্জা, হুমায়ুনের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এবং তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি

মাহাম আগা, আকবরের দুধ-মা

আধম খান, আকবরের দুধ-ভাই

নাদিম খাজা, হুমায়ুনের অন্যতম সেনাপতি এবং মাহাম আগার স্বামী

অন্যান্য :

গুলরুখ, বাবরের স্ত্রী এবং কামরান আর আসকারির আম্মিজান

দিলদার, বাবরের স্ত্রী এবং হিন্দাল এবং গুলবদনের আম্মিজান

নিজাম, একজন ভিস্তিঅলা

জয়নব, হামিদার প্রধান পরিচারিকা

সুলতানা, রাজা মালদেবের মোগল উপপত্নী

ওয়াজিম পাঠান, একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈন্য সাহসিকতার জন্য হুমায়ুন যাকে পুরস্কৃত করেছিল

শেখ আলি আকবর, হিন্দালের উজির এবং হামিদার আব্বাজান

দারয়া, নাসিরের পুত্র, কাবুলে হুমায়ুনের সেনাছাউনির আধিকারিক

মুস্তাফা আরগুন, তূর্কী অশ্বারোহী যোদ্ধা

হিন্দুস্তান :

সুলতান বাহাদুর শাহ, গুজরাতের শাসনকর্তা

তার্তার খান, হুমায়ুনের আব্বাজান বাবরের কাছে পরাস্ত হওয়া পূর্ববর্তী শাসক বংশ, লোধিদের, একজন সদস্য এবং হিন্দুস্তানের তখতের একজন দাবীদার

শেরশাহ, ছোটজাতে জন্ম নেয়া বাংলার এক উচ্চাভিলাষী শাসক

ইসলাম খান, শেরশাহের পুত্র

মির্জা হুসেন, সিন্ধের সুলতান

রাজা মালদেব, মারওয়ারের শাসক

তারিক খান, ফিরোজপুরের শাসক এবং শেরশাহের অনুগত জায়গিরদার

আদিল শাহ, ইসলাম শাহের ভগ্নিপতি এবং হিন্দুস্তানের তখতের একজন দাবীদার সেকুন্দার শাহ, ইসলাম শাহের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এবং হিন্দুস্তানের তখতের একজন দাবীদার

পারস্য :

শাহ তামান্স

রুস্তম বেগ, বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি এবং শাহ তামাস্পের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই

বৈরাম খান, অভিজাত ব্যক্তি, দক্ষ সেনাপতি এবং পরবর্তীতে হুমায়ুনের খান-ই-খানান, প্রধান সেনাপতি

হমায়ুনের পূর্ব-পুরুষ :

চেঙ্গিস খান

তৈমূর পশ্চিমে যাকে তৈমূর লঙ বলা হয়

উলুঘ বেগ, তৈমূরের প্রপৌত্র এবং একজন খ্যাতনামা জ্যোতিষী

.

প্রথম পর্ব – ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেম

০১. বাঘের পিঠে সওয়ারী

কয়েকদিন ধরেই বাতাসে প্রচণ্ড হিমের প্রকোপ। হুমায়ুন যদি চোখ বন্ধ করে তাহলে অনায়াসে আগ্রার এই দূর্গ প্রকারের পরিবর্তে নিজেকে শৈশবের সঙ্গী কাবুলের পাহাড় আর তৃণভূমির প্রেক্ষাপটে কল্পনা করতে পারে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত শীতকাল শেষ হয়ে আসছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই হিন্দুস্তানের সমভূমি আবারও ধূলিকণা আর উষ্ণতায় দগ্ধ হবে।

পশমের পরত দেয়া লাল রঙের আলখাল্লাটায় নিজেকে ভালো করে মুড়ে নিয়ে, মন্থর পায়ে দেয়ালের উপরে পায়চারি করে হুমায়ুন। তার দেহরক্ষীদের আদেশ দিয়েছে তাঁকে একা থাকতে দিতে কারণ একাকী নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকতে চায় সে। মাথা উঁচু করে, তারার ফুলঝুরি নিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তাদের তীব্র, রত্ন-তুল্য উজ্জ্বলতা সবসময়েই মোহিত করে তাকে। এটা প্রায়শই তার মনে হয় যে সেখানে সবকিছু লেখা রয়েছে, কেবল তোমাকে জানতে হবে সেটা কোথায় আর কিভাবেই বা সেই লিখনের পাঠোদ্ধার করতে…।

পেছনে কোথাও থেকে একটা লঘু, সাবলীল পায়ের শব্দ ভেসে এসে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় তার। হুমায়ুন ক্রু কুচতে ঘুরে তাকায়, ভাবে কোনো অমাত্য বা প্রহরী এতটাই হঠকারী যে নির্জনতার জন্য সম্রাটের অভিপ্রায়ের প্রত্যক্ষ আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা দেখাতে পারে। বেগুনী আলখাল্লায় মোড়া একটা লম্বা, ক্ষীণদর্শন অবয়বের উপরে ক্রুদ্ধ নজর আপতিত হয় তার, মুখের নিম্নাংশ একটা মিহি পর্দার অবগুণ্ঠনে ঢাকা, এর উপরে তাঁর ফুপু খানজাদার কিশমিশ রঙের চোখ জ্বলজ্বল করছে। হুমায়ুনের ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি নিমেষে মিলিয়ে গিয়ে সেখানে একটা হাসি ফুটে উঠে।

‘জেনানা মহলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা। তুমি বলেছিলে আজ রাতের খাবারটা আমাদের সাথেই খাবে। তোমার মা অভিযোগ করছিল আজকাল বড্ড বেশী একাকী থাকছো তুমি, আমিও তার সাথে একমত।’

খানজাদা অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়। দেয়ালে ঝোলান জ্বলন্ত মশাল থেকে তামাটে বর্ণের আলো এসে একটা কাটা কাটা মুখাবয়বের উপরে পড়ে যা এখন আর তার যৌবনকালের মতো তত সুন্দর নেই দেখতে কিন্তু এমন একটা মুখ যা হুমায়ুন তার তেইশ বছরের জীবনের পুরোটা সময় ভালোবেসেছে আর বিশ্বাস করেছে। খানজাদা আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতে চন্দনকাঠের হালকা সৌরভ টের পায় সে যা জেনানা মহলে কারুকার্যখচিত সোনার তশতরিতে ক্রমাগত জ্বলছে।

‘আমাকে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হচ্ছে। আমার এখনও পুরোপুরি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে যে আমার বাবা ইন্তেকাল করেছেন।’

‘হুমায়ুন, সেটা আমি বুঝি। আমিও তাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। বাবর তোমার বাবা ছিল বটে কিন্তু ভুলে যেও না আমার আদরের ছোট ভাইও ছিল সে। সে আর আমি একসাথে অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছি, এবং কখনও চিন্তা করিনি এতো শীঘিই আমরা তাকে হারাব…কিন্তু সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা।’

হুমায়ুন দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, প্রথম মুঘল সম্রাট, তার বাবাকে সে আর কখনও দেখতে পাবে না এই ভাবনায় যে তার চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে সেটা সে এমনকি খানজাদাকেও দেখাতে অনিচ্ছুক। শক্তিশালী, পোড় খাওয়া এক যোদ্ধা, যে তার যাযাবর ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে কাবুল থেকে পাহাড়ের গিরিপথের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে এসে, একটা সাম্রাজ্যের খোঁজে সিন্ধু নদ অতিক্রম করেছিল, আজ মৃত, এই ভাবনাটাই কেমন অসম্ভব মনে হয়। এমনকি এই ভাবনাটা আরও বেশী অবাস্তব মনে হয় যে মাত্র তিনমাস আগে কোমরে ঈগলের মস্তক শোভিত হাতলযুক্ত তাঁর পিতার তরবারি আলমগীর আর আঙ্গুলে তাঁর পূর্ব পুরুষ তৈমুরের অঙ্গুরীয় ধারণ করে নিজেই নিজেকে মোগল সম্রাট বলে বিঘোষিত করেছে সে।

‘সবকিছু এতো বিচিত্র… অনেকটা একটা অলীক কল্পনার মতো যা থেকে প্রতিনিয়ত আশা করছি জেগে উঠব আমি।’

‘এটাই বাস্তব দুনিয়া আর তোমার উচিত একে মেনে নেয়া। বাবর যা চেয়েছিল, যার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল সে, সবকিছুর কেবল একটাই উদ্দেশ্য ছিল- একটা সাম্রাজ্য হাসিল করা এবং রাজবংশের পরম্পরার পত্তন। আমি যেমন এটা জানি তুমিও জানো- মোগলদের জন্য হিন্দুস্তান হাসিল করতে পানিপথের যুদ্ধে যখন সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্থ করেছিল সে তুমি কি তোমার পিতার পাশে সেদিন লড়াই করনি?’

হুমায়ুন নিশ্চুপ থাকে। কোনো কথা না বলে আরেকবার আকাশের দিকে তাকায় সে। যখন সে আকাশের দিকে তাকায়, স্বর্গের বুক থেকে একটা উল্কা খসে পড়ে মিলিয়ে যেতে দেখে, এর জ্বলন্ত পুচ্ছের বিন্দুমাত্র চিহ্নও থাকে না। আড়চোখে খানজাদার দিকে তাকালে দেখে যে তিনিও উল্কাপাতটা লক্ষ্য করেছেন।

‘উল্কাপাত সম্ভবত কোনো একটা কিছুর পূর্বলক্ষণ। এটা সম্ভবত ইঙ্গিত করছে লজ্জাকরভাবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে আমার রাজত্ব…আমার কথা কেউ মনে রাখবে না…’।

‘তোমার বাবা যদি এখন এখানে থাকতেন তাহলে নিজের প্রতি এই ধরনের সন্দেহ আর চলচিত্ততা তাকে কুদ্ধ করতো। তোমার নিয়তিকে তুমি বরণ করে নাও বরং এটাই চাইতেন তিনি। নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে তোমার বাকি তিন সৎ-ভাইদের ভিতর থেকে একজনকে পছন্দ করতে পারতেন তিনি কিন্তু তোমাকে মনোনীত করেছেন। তুমি সবার ভিতরে বড় এটাই কারণ না- আমাদের গোত্রের লোকেরা বিষয়টা কখনও এভাবে বিবেচনা করে না। তিনি তোমাকে সবচেয়ে যোগ্য আর গুণী ভেবেছিলেন সেজন্য। হিন্দুস্তানের উপরে আমাদের আধিপত্য এখনও অনিশ্চিত- মাত্র পাঁচ বছর আগে আমরা এদেশে এসেছি এবং চারপাশ থেকে বিপদের আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে। বাবর তোমাকে নির্বাচন করেছিলেন কারণ তিনি কেবল তোমার সাহসিকতায়, যা তুমি ইতিমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণ করেছে, আস্থাশীল ছিলেন না বরং সেইসাথে তোমার আত্মবিশ্বাস, আর তোমার আত্মার শক্তি, আমাদের পরিবারের শাসন করার অধিকার সম্বন্ধে তোমার বিবেচনা বোধ, যা এখানে এই নতুন ভূখণ্ডে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে আর সমৃদ্ধি লাভ করতে আমাদের রাজবংশে অবশ্যই থাকতে হবে।’ খানজাদা দম নেবার জন্য থামেন।

হুমায়ুন যখন কোনো উত্তর দেয় না, তিনি মশালের আলোয় নিজের মুখ তুলে ধরেন এবং তাঁর ডান ভ্র থেকে প্রায় চিবুক পর্যন্ত নেমে আসা একটা সরু সাদা ক্ষতচিহ্নে আলতো করে নিজের আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করেন। আমি মুখে এটা কিভাবে এসেছে, আমি যখন তরুণী ছিলাম আর উজবেকদের হাতে তোমার বাবাকে সমরকন্দ তুলে দিতে হয়েছিল তখন কিভাবে তাদের গোত্রপতি সাইবানি খান আমাকে অপহরণ করেছিল আর তার ইচ্ছার কাছে আমাকে নতজানু হতে বাধ্য করেছিল। সে আমাদের মতো, যাদের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত বইছে, তাদের সবাইকে ঘৃণা করতো। আমাদের বংশের কোনো যুবরাজকে অবমানিত আর তার মর্যাদাহানি তাঁকে পৈশাচিক আনন্দ দিত। আমি কৃতজ্ঞ যে তাঁর হারেমে বন্দিনী অবস্থায় পুরোটা সময় আমি কখনও হতাশ হইনি… কখনও ভুলে যাইনি আমি কে বা এটা আমার দায়িত্ব যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রেখে যে আরেকটা মেয়ে যখন অতর্কিতে আক্রমণ করে আমার সৌন্দর্যের কিছুটা চুরি করেছিল, আমি এই ক্ষতচিহ্ন সম্মানের স্মারক হিসাবে ধারণ করেছিলাম- সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এখনও বেঁচে আছি এবং নিশ্চয়ই একদিন আবারও মুক্ত হব। সেই দিনটা এসেছিল সুদীর্ঘ দশ বছর পরে। আমার ভাইয়ের সাথে আমি পুনরায়– মিলিত হই আর আমার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে সাইবানি খানের করোটি দিয়ে নির্মিত একটা পানপাত্র থেকে তাঁকে পান করতে দেখে সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম আমি। হুমায়ুন আমার যেমন ছিল, তোমাকেও সেই একইরকম আত্মবিশ্বাসে আর চারিত্রিক দৃঢ়তায় বলীয়ান হতে হবে।

‘সাহসিকতায় আপনার সমকক্ষ হওয়া খুব কঠিন, কিন্তু কথা দিচ্ছি আমার বাবার ইচ্ছা বা আমাদের বংশের কোনো অমর্যাদা আমি হতে দেব না।’

‘তাহলে কি নিয়ে এতো চিন্তা করছো? তুমি বয়সে নবীন, উচ্চাকাঙ্খী… তোমার বাবা অসুস্থ হবার বহু পূর্বেই মসনদের প্রতি আগ্রহী ছিলে তুমি; সে আমার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিল।’

‘তাঁর মৃত্যু যখন হয় তখন বিষয়টা খুবই আকষ্মিক ছিল। আমি অনেক কথাই তাকে বলতে পারিনি। সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আমি এখনও নিজেকে প্রস্তুত বলে মনে করি না…নিদেন পক্ষে এত দ্রুত বা এভাবে নয়।’

হুমায়ুন তাঁর মাথা ঝুঁকে পড়তে দেয়। কথাটা সত্যি। তাঁর বাবার অন্তিম মুহূর্তগুলো তাঁকে এখনও তাড়িয়ে নিয়ে ফিরে। বাবর নিজের শেষবিন্দু শক্তি একত্রিত করে, তার ব্যক্তিগত পরিচারকদের আদেশ দিয়েছিলেন রাজকীয় আলখাল্লায় সজ্জিত করে তার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে তাঁকে এবং তাঁর অমাত্যদের তাঁর সামনে হাজির হতে। পরিপূর্ণ রাজদরবারের সামনে, দূর্বল কণ্ঠে কিন্তু নিজের সংকল্পে অবিচল, বাবর তার আঙ্গুল থেকে ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের মস্তক খোদিত তৈমূরের ভারী সোনার অঙ্গুরীয় খুলে নেয়ার জন্য হৃমায়ুনকে আদেশ দেন এবং বলেন, এটা গর্বের সাথে ধারণ করবে এবং এটা তোমার উপরে যে দায়িত্ব অর্পন করছে সেটা কখনও বিস্মৃত হবে না…’ কিন্তু বাবরের তখন মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়স, তখনও নিজের শ্রেষ্ঠ সময়ের তুঙ্গে এবং নিজের বিকাশমান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব আরেকজনের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বড্ড অল্প বয়স।

‘কোনো মানুষ, এমনকি একজন সম্রাটের পক্ষেও জানা সম্ভব না কখন আর কিভাবে তার কাছে বেহেশতের ডাক এসে পৌঁছাবে। আমাদের কারো পক্ষেই নিজেদের জীবনের গতিপথ পুরোপুরি অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। নশ্বরতার চরম অনিশ্চয়তা আর সেই সাথে ভাগ্যের নানা উত্থানপতন মেনে নিয়ে বাঁচতে শেখাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বেড়ে উঠার অংশ।’

‘মানছি। কিন্তু আমি প্রায়শই চিন্তা করি আমাদের জীবনের অন্তরালে মূলগত নকশা অনুধাবনে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে। ঘটনা পরম্পরা যা আপাত দৃষ্টিতে এলোমেলো মনে হয় হয়ত তেমনটা নয়। খালাজান, আপনি এইমাত্র যেমন বললেন যে আমার আব্বাজানের মৃত্যু ছিল পরম করুণাময়ের কাম্য, কিন্তু আপনি ভুল করেছেন। সেটা ছিল আদতে আমার আব্বাজানেরই অভিপ্রায়। আমার জন্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।’

খানজাদা চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তুমি কি বলতে চাইছো?

আমাকে বলা আব্বাজানের শেষ কথাগুলো কখনও কারো কাছে প্রকাশ করিনি আমি। তিনি মারা যাবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ফিসফিস করে বলেছিলেন যে কয়েক মাস পূর্বে আমি যখন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম, আমার জ্যোতিষী শারাফ তাঁকে বলেছিল সে গ্রহ নক্ষত্র বিবেচনা করে জেনেছে আব্বাজান যদি আমাকে জীবিত দেখতে চান তাহলে তাঁর কাছে যা সবচেয়ে মূল্যবান সেটা অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে তাকে। আর তাই সেজদায় নতজানু হয়ে আমার জন্য আল্লাহর কাছে নিজের জীবন অর্পণ করেছিলেন।

তাহলে এটা বাস্তবিকই আল্লাহর অভিপ্রায়-পরম করুণাময় তার ত্যাগস্বীকার গ্রহণ করেছেন।

না! শারাফ আমাকে বলেছে, সে আসলে বলতে চেয়েছিল যে আমার আব্বাজানের উচিত কোহ-ই-নূর হীরকখণ্ডটা নিবেদন করা তাঁর নিজের জীবন নয়। কিন্তু আমার আব্বাজান তার কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছিল…এটা আপাতদৃষ্টিতে আপুতকর যে আমার আব্বাজান আমাকে এতো ভালোবাসতেন, আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য আমাকে এতো গুরুত্বের চোখে দেখতেন যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমার প্রতি এতোটা বিশ্বাসের যোগ্য আমি কিভাবে হয়ে উঠব? আমার মনে হয় একদা যে মসনদের জন্য এত উদগ্রীব ছিলাম আমি বোধহয় তার উপযুক্ত নই। আমার ভয় হয় যে এভাবে সূচিত হওয়া রাজত্বকালের ললাটে কলঙ্কের তিলক জুটবে…

এসব ভাবনা অবান্তর। কার্য আর কারণের পেছনের ছক খুঁজতে তুমি বড্ড পরিশ্রম করছে। অনিশ্চয়তা আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে অনেক রাজত্বেরই সূচনা হয়েছে। তোমার রাজত্বের সমাপ্তি সেরকম হবে না সেটা তোমার নিজের কর্মোদ্যোগের দ্বারা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তোমার উপরেই বর্তায়। বাবর কোনো ত্যাগস্বীকার করে থাকলে তোমার জন্য তাঁর ভালোবাসা আর তোমার প্রতি তাঁর বিশ্বাস থেকেই সেটা করেছে। এটাও মনে রেখো সে কিন্তু সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করেনি- তুমি সুস্থ হয়ে উঠার পরেও সে আরো আট মাস সময় জীবিত ছিল। সেই সময়ে তাঁর মৃত্যু হলে সেটা একটা নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার হত। খানজাদা দম ফিরে পেতে কথার মাঝে একটু বিরতি দেয়। সে কি তার শেষ সময়ে তোমাকে অন্য আর কিছু বলেছিল?

তিনি আমাকে দুঃখ করতে নিষেধ করেছিলেন…চলে যেতে হচ্ছে বলে তাঁর মন মোটেই ভারাক্রান্ত ছিল না। তিনি অবশ্য আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন- আমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কিছু না করতে, যতই সেটা তাদের প্রাপ্য হয়ে থাকুক।

খানজাদার মুখে বিদ্রূপ খেলা করে। হুমায়ুন এক মুহূর্তের জন্য ভাবে তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে সে বোধহয় কোনো মন্তব্য করবে, কিন্তু সেটা না করে, সে নিজের ছোট কিন্তু অভিজাত মাথাটা কেবল আন্দোলিত করে, আপাতদৃষ্টিতে সে কোনো মন্তব্য না করাই শ্রেয় মনে করেছে।

এবার চল। এসব চিন্তাভাবনা অনেক হয়েছে। হারেমে চাদর বিছানো হয়ে গিয়েছে। তোমার আম্মিজান আর অন্যান্য মহিলাদের তুমি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করিয়ে রাখবে না। কিন্তু হুমায়ুন…একটা শেষ অভিপ্রায়। ভুলে যেও না যে তোমার নামের মানে ভাগ্যবান। সৌভাগ্য তোমার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়বে যদি শারীরিক আর মানসিকভাবে তুমি শক্তিশালী হও আর সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। নিজের প্রতি তোমার এসব অর্থহীন সন্দেহ পরিত্যাগ কর। অন্তবীক্ষণ একজন কবি বা সুফিসাধকের জীবনে হয়ত গুরুত্ব বহন করতে পারে কিন্তু একজন ম্রাটের জীবনে এর কোনো স্থান নেই। তোমার আব্বাজান- আর নিয়তি তোমাকে যা দান করেছে দুহাতে সেটা গ্রহণ কর।

শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখে চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে, হুমায়ুন ধীর পায়ে তার খালাজানকে অনুসরণ করে পাথরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় যেটা জেনানা মহলের দিকে নেমে গিয়েছে।

*

কয়েক সপ্তাহ পরের কথা- সম্রাটের ব্যক্তিগত কামরায় হুমায়ুনের সামনে তাঁর অশ্বশালার নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সচরাচর উফুল্ল, আর কিঞ্চিৎ স্কুলবুদ্ধির বাবা ইয়াসভালো নিজেকে ভূম্যবলুণ্ঠিত করে, কোনো বিচিত্র কারণে সে সন্ত্রস্ত। লোকটা আনত অবস্থা থেকে পুনরায় যখন উঠে দাঁড়ায় এবং মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়, হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে লোকটার চোখের নিম্নাংশের চওড়া হাড়ের উপরে তার ত্বক যেন অস্বাভাবিকভাবে টানটান হয়ে প্রসারিত হয়ে রয়েছে এবং তার কপালের পাশে একটা শিরা দপদপ করছে।

সুলতান, আমাকে একাকী যদি আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি দিতেন? বাবা ইয়াসভালো রৌপ্য নির্মিত হুমায়ুনের নীচু বসবার আসনের দুপাশে দণ্ডায়মান প্রহরীদের দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকায়। একটা অস্বাভাবিক অনুরোধ। নিরাপত্তার খাতিরে সম্রাট কদাচিৎ একাকী অবস্থান করেন। এমনকি তিনি যখন হারেমে অবস্থান করেন তখনও ঘাতকের তরবারির আঘাত নাকচ করতে সতর্ক প্রহরীর দল সবসময়ে তার আশেপাশেই অবস্থান করে। কিন্তু বাবা ইয়াসভালো, যে হুমায়ুনের মৃত আব্বাজানের অধীনে বিশ্বস্ততার সাথে যুদ্ধ করেছে, তাকে বিশ্বাস করা যায়।

হুমায়ুন প্রহরীদের কামরা ত্যাগ করতে আদেশ দেয় আর ইঙ্গিতে বাবা ইয়াসভালোকে কাছে আসতে বলে। লোকটা সামনে এগিয়ে আসে বটে কিন্তু কথা বলতে ইতস্তত করে, সে তার মাথার খোঁচা খোঁচা চুল চুলকায়, যা তাঁকে তাঁর গোত্রের সনাতন পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, হিন্দুস্তানে আসবার পরে সে মাথা কামান শুরু করলেও, ধুসর রুক্ষ চুলের একটা গোছা সে রেখে দিয়েছে যা একটা টাসেলের মতো দোল খায়।

বাবা ইয়াসভালো, বলল। তুমি আমাকে কি বলতে চাও?

খারাপ খবর…সুলতান, ভয়াবহ খবর… বাবা ইয়াসভালের মুখ দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয়। আপনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র দানা বেধেছে।

ষড়যন্ত্র? সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুনের হাত তার হলুদ পরিকরের ভাঁজে গোঁজা রত্নখচিত দুধারি খঞ্জর স্পর্শ করে এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। কার এতো বড় দুঃসাহস…?

বাবা ইয়াসভালো নিজের মাথা নত করে। সুলতান, আপনার সৎ-ভাইয়েরা।

আমার ভাইয়েরা…? মাত্র দুমাস আগে সে আর তার ভাইয়েরা আগ্রা দূর্গের প্রাঙ্গণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যখন বারোটা কালো ষাড় জোতা গিল্টি করা গাড়িটা তাঁদের মরহুম আব্বাজানের রূপার শবাধার নিয়ে কাবুলের পথে দীর্ঘ যাত্রায় রওয়ানা হয়, বাবর সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করার অনুরোধ করেছিলেন। তার নিজের মতো তার সৎ-ভাইদের চোখে মুখেও শোকের একটা স্পষ্ট ছাপ ফুটেছিল এবং সেই শোকাবহ মুহূর্তগুলোতে তাঁদের প্রতি স্নেহ আর মমত্ববোধের একটা আকষ্মিক বেগ তাঁকে আপুত করে তুলে এবং আস্থার জন্ম দেয় যে তাঁদের মরহুম আব্বাজানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে তাঁরা তাঁকে সাহায্য করবে: হিন্দুস্তানে মোগলদের আধিপত্যকে অনাক্রম্য করতে।

বাবা ইয়াসভালো হুমায়ুনের চোখে মুখে অবিশ্বাস আর সংক্ষোভ ঠিকই পড়তে পারে। সুলতান, আমি সত্যি কথাই বলছি, যদিও আমাদের সবার স্বার্থে আমাকে এটা বলতে না হলেই আমি খুশী হতাম… বাবা ইয়াসভালো এখন যখন বলতে শুরু করেছে, সে সাহস সঞ্চয় করছে বলে মনে হয়, পুনরায় পানিপথে মোগলদের হয়ে লড়াই করা সেই পোড় খাওয়া যোদ্ধার সত্তা তার ভিতরে ফিরে আসতে থাকে। তার মাথা এখন আর নত না এবং সে হুমায়ুনের চোখের দিকে নিঃশঙ্কভাবে তাকিয়ে রয়। আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন না যখন আমি আপনাকে বলবো যে আমি এই তথ্য আমার ছোট ছেলের কাছ থেকে জানতে পেরেছি…সে ষড়যন্ত্রকারীদেরই একজন। সে মাত্র ঘন্টাখানেক আগে আমার কাছে এসে সবকিছু স্বীকার করেছে।

সে এটা কেন করেছে? হুমায়ুনের চোখ সরু হয়ে আসে।

কারণ নিজের জীবনের জন্য সে ভীত…কারণ সে বুঝতে পেরেছে সে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে…কারণ সে জানে তার কর্মকাণ্ড আমাদের গোত্রের জন্য কেবল অসম্মান আর ধ্বংসই ডেকে আনবে। এই শেষের শব্দগুলো যখন সে বলছে, বাবা ইয়াসভালোকে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ পরিশ্রম করতে হয় বলে তাঁর চোখমুখ কুচকে যায়।

আমার কাছে এসে সবকিছু খুলে বলে তুমি ভালোই করেছে। আমাকে সবকিছু বলো।

মহামান্য সুলতান, আপনার মরহুম আব্বাজানের শবাধার কাবুলের পথে রওয়ানা হওয়ার বড়জোর এক পক্ষকাল পরেই, যুবরাজ কামরান, আসকারি আর হিন্দাল এখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দুদিন লাগে এমন দূরত্বে অবস্থিত একটা দূর্গে মিলিত হয়। আপনি হয়ত অবগত আছেন যে আমার ছেলে কামরানের অনুগত, সে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়ার জন্য তাঁকে প্রচুর পারিতোষিকের লোভ দেখায়। মাথা-গরম অল্পবয়সী নির্বোধ যা সে আসলেও, সে তাদের সাথে যোগ দিতে সম্মত হয়, আর তাই সবকিছু দেখে আর শোনে।

আমার ভাইয়েরা কি পরিকল্পনা করছে?

আপনাকে বন্দি করবে আর তারপরে আপনাকে বাধ্য করবে সাম্রাজ্য ভাগ করতে আর তাঁদের কাছে আপনার কিছু এলাকা সমর্পন করতে। সুলতান তারা সনাতন প্রথায় ফিরে যেতে চায়, যখন প্রত্যেক সন্তানই তাদের বাবার ভূখণ্ডের একটা অংশের অধিকার লাভ করতো।

একটা নিষ্প্রাণ হাসি হুমায়ুনের চেহারায় ভেসে উঠে। আর তারপরে কি হবে? তারা কি এতেই সন্তুষ্ট থাকবে? অবশ্যই না। তারা অচিরেই একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে আর সেই সুযোগে শত্রুরা আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে।

সুলতান, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারা এমনকি এখনই নিজেদের ভিতরে একমত হতে পারছে না। কামরান হল আসল উস্কানিদাতা। পুরো ষড়যন্ত্রটাই তার মস্তিষ্কপ্রসুত আর তার সাথে যোগ দিতে সেই সবাইকে প্ররোচিত করেছে, কিন্তু তারপরেই আসকারি আর তার ভিতরে রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়েছে সমৃদ্ধ প্রদেশগুলো তাদের ভিতরে কে নেবে সেটা নিয়ে। তাদের অনুগত লোকেরা কোনোমতে তাঁদের হাতাহাতি থেকে বিরত করেছে।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে পুনরায় বসে পড়ে। বাবা ইয়াসভালের কথা তার কাছে সত্যিই মনে হয়। তার চেয়ে কেবল পাঁচ মাসের ছোট, তার সৎ-ভাই কামরানকে যখন কাবুল শাসনের জন্য সেখানের রাজপ্রতিভূ হিসাবে রেখে আসা হয় তখন সে নিজের অসন্তোষ গোপনের কোনো চেষ্টাই করেনি। হিন্দুস্তানের অভিযানে হুমায়ুন তাদের আব্বাজানের সঙ্গী হয়। কামরানের আপন ভাই, পনের বছরের আসকারিকে, তাঁদের সাথে যোগ দেবার জন্য খুব বেশী একটা কষ্ট করতে হয়নি। কামরান যেখানে যেত সেখানেই একনিষ্ঠ ভক্তের মতো সে সবসময়ে তাঁকে অনুসরণ করতে যদিও কামরান তাকে কখনও দূর্বল পেয়ে নিপীড়ন করতো আবার কখনওবা তাঁকে প্রশ্রয় দিত। কিন্তু বাবা ইয়াসভালের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, এখন তাহলে আসকারি প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে উঠেছে বড় ভাইকে দ্বৈরথে আহ্বান জানাতে সে মোটেই ভীত নয়। সম্ভবত তাঁদের দুজনকেই তাদের কঠোর মনোভাবসম্পন্ন মা গুলরুখ উসকে দিয়েছে।

কিন্তু তাঁর সৎ-ভাইদের ভিতরে কনিষ্ঠতমের এসবের সাথে কি সম্পর্ক? হিন্দাল কেন এসবের ভিতরে নিজেকে জড়াতে গেল? তার এখন মাত্র বার বছর বয়স আর হুমায়ুনের আপন মা, মাহামের স্নেহ ছায়ায় সে বড় হয়েছে। বহু বছর আগে হুমায়ুনের পরে আর কোনো সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়ে নিজের অপারগতায় বিপর্যস্ত মাহাম বাবরের কাছে মিনতি করে তার অন্য স্ত্রী, দিলদারের সন্তানকে চেয়ে নেয়। হিন্দাল যদিও তখনও মাতৃগর্ভে, বাবর- তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর অনুরোধ ফেলতে পারে না- সদ্যোজাত সন্তান তাঁকে উপহার দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু হিন্দালের এই প্রতারণায় সে অবশ্য খুব একটা অবাক হয় না। বাবরের নিজের যখন মাত্র বার বছর বয়স তখন প্রথম তিনি রাজা হন। উচ্চাকাঙ্খার আগুন এমনকি কনিষ্ঠতম যুবরাজের ভিতরেও জ্বলে উঠতে পারে।

সুলতান, বাবা ইয়াসভালের ব্যগ্র, আন্তরিক কণ্ঠস্বর হুমায়ুনকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আমার ছেলের বিশ্বাস যুবরাজরা নিজেদের ভিতরে একমত হতে পারেনি বলেই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। কিন্তু গতরাতে এখানে এই আগ্রা দূর্গে, তারা পুনরায় মিলিত হয়। আপনাকে তাদের কজায় না আনা পর্যন্ত তারা নিজেদের ভিতরের মতপার্থক্য ভুলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা তাদের ভাষায় আপনার নির্জনতার জন্য সম্রাটের পক্ষে বেমানান আকাঙ্খার সুযোগ নেবে বলে ফন্দি এঁটেছে এবং পরেরবার আপনি যখন ঘোড়া নিয়ে একাকী বের হবেন তখনই তারা আপনাকে আক্রমণ করবে। কামরান আপনাকে এমনকি হত্যা করার কথাও বলেছে এবং পুরো ব্যাপারটাই যেন একটা দূর্ঘটনার মতো দেখায়। আমার ছেলের তখন বোধোদয় ঘটে। মহামান্য সুলতান আপনার আসন্ন বিপদের কথা অনুধাবন করতে পেরে, সে আমাকে সবকিছু খুলে বলে যা কয়েক সপ্তাহ আগেই তার কবুল করা উচিত ছিল।

বাবা ইয়াসভালো, এভাবে সরাসরি আমার কাছে আসার কারণে, আপনার সাহসিকতা আর আনুগত্যের জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি ঠিকই বলেছেন। পুরো ব্যাপারটার ব্যাপ্তি ভয়ঙ্কর বিশেষ করে যখন আমার সৎ-ভাইয়েরা আমারই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আর তারচেয়েও বড় কথা আমাদের আব্বাজানের ইন্তেকালের পরে এতো শীঘই। আপনি কি এ বিষয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করেছেন?

না, সুলতান।

ভালো করেছেন। বিষয়টা নিয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করা থেকে আপনি আপাতত বিরত থাকবেন। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দেন। কর্তব্য করণীয় নিয়ে আমি একটু ভাবতে চাই।

বাবা ইয়াসভালো একটু ইতস্তত করে, তারপরে কক্ষ ত্যাগ না করে সে সরাসরি হুমায়ুনের পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে মেঝে থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়। সুলতান, আমার ছেলে, আমার আহাম্মক ছেলেটা…তাকে এবারের মতো মার্জনা করুন…সে সত্যিই নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত। সে ভালো করেই জানে এবং আমিও জানি আপনার ক্রোধ স্বাভাবিক আর মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য, কিন্তু আমি আপনার কাছে তাঁর প্রাণ ভিক্ষা চাইছি, তার প্রতি একটু করুণা প্রদর্শন দেখান…

বাবা ইয়াসভালো। এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করার জন্যই শুধু আপনার অতীত আনুগত্যের কথা স্মরণে রেখে আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ আমি আপনার ছেলেকে কোনো শাস্তি দেব না। তার কর্মকাণ্ডকে অল্প বয়সের অবৈচক্ষণ্য হিসাবে আমি এবারের মতো বিবেচনা করবো। কিন্তু এই ঝামেলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আশা করবো আপনি তাকে নিরাপদ কোনো স্থানে আটকে রাখবেন।

বাবা ইয়াসভালের দেহের ভিতর দিয়ে যেন একটা কম্পনের রেশ বয়ে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য লোকটা কৃতজ্ঞতায় চোখ বন্ধ করে। তারপরে সে উঠে দাঁড়ায় এবং মুণ্ডিত মস্তক নুইয়ে, ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে যায়।

হুমায়ুন, নিঃসঙ্গ হওয়া মাত্র, দ্রুত নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং কারুকার্যখচিত একটা পানপাত্র আকড়ে ধরে রাজকীয় কক্ষের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যায়। নির্বোধের দল! যত্তসব আহাম্মক! তার ভাইয়েরা যদি নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নিতে শুরু করে তাহলে অচিরেই মোগলরা মামুলি গোত্রগত যুদ্ধেরত যাযাবর জীবনে ফিরে যাবে এবং তাদের এতো কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত সাম্রাজ্য হাতছাড়া হবে। তাদের আব্বাজানের কাছে তাঁরা যে ঋণী সেই বোধটা তাঁদের কোথায় গেল, কোথায় গেল নিয়তি সম্পর্কে তাদের চেতনা?

মাত্র পাঁচ বছর আগের কথা হুমায়ুন বাবরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাইবার গিরিপথ দিয়ে নীচের সমভূমির দিকে ধেয়ে এসেছিল গৌরবের বিজয়তিলক ছিনিয়ে নিতে। যুদ্ধের সেই রক্ত আর গর্জন, তার ঘোড়ার ঘামের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে নাসারন্ধ্র ভরে যাওয়া, সুলতান ইব্রাহিম লোদীর রণহস্তীর বৃংহন, মোগল কামানের হুঙ্কার আর তাদের মাস্কেটের গর্জন যখন এইসব নতুন অস্ত্র কাতারের পর কাতার শত্রু সেনার প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেইসব স্মৃতির কথা মনে পড়তে আজও তাঁর নাড়ীর বেগ দ্রুততর হয়ে উঠে। বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ সে আজও স্পষ্ট স্মরণ করতে পারে যখন- রক্তরঞ্জিত তরবারি হাতে- পানিপথের ধূলোয় ধুসরিত সমভূমি জরিপ করে সে উপলব্ধি করেছিল হিন্দুস্তান মোগলদের করায়ত্ত হয়েছে। আজ তাঁদের সব অর্জন হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

মধ্য এশিয়ায় আমাদের লোকেরা যখন শাসন করতো তখন তারা যেমন বলতো তখত বা তক্তা সিংহাসন বা শবাধার- আমার এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। হুমায়ুন ভাবে, আমরা একটা নতুন দেশে এসেছি এবং অবশ্যই নতুন রীতি গ্রহণ করতে হবে নতুবা আমরা সবকিছু হারাব। সে তার গলায় একটা সুক্ষ সোনার হারের সাথে ঝোলান চাবির খোঁজে তাঁর পরিধানের আলখাল্লার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে, উঠে দাঁড়ায় এবং কক্ষের একপ্রান্তে অবস্থিত গম্বুজাকৃতি বাক্সটার দিকে এগিয়ে যায়। সে বাক্সটার তালা খুলে, ঢাকনিটা পেছনের দিকে সরিয়ে দেয় এবং সে যা খুঁজছিলো সেটা দ্রুত খুঁজে বের করে ফুলের নক্সার একটা রেশমের থলে যেটার মুখ সোনার সুতো দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে বাঁধা। সে খুব ধীরে, প্রায় শ্রদ্ধার সাথে থলের মুখটা খোলে, এবং ভেতরে রক্ষিত সামগ্রী বের করে আনে একটা অতিকায় হীরকখণ্ড যতবারই সে এটা দেখে এর আলোকপ্রবাহী তীব্র ঔজ্জ্বল্যে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। আমার কোহ-ই-নূর, আমার আলোর পর্বত পাথরটার দীপ্তিময় উপরিতলে আলতো করে নিজের আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে সে ফিসফিস করে বলে। পানিপথের যুদ্ধের পরে এক ভারতীয় রাজকুমারী যার পরিবারকে সেই বিশৃঙ্খলার মাঝে রক্ষা করেছিল তাঁকে এটা উপহার হিসাবে দিয়েছিল সে, পাথরটার এমন একটা নিখুঁত সৌন্দর্য আছে যা দেখে তাঁর সবসময়েই মনে হয় ভারতবর্ষে মোগলরা যা খুঁজতে এসেছে- গৌরব আর জাঁকজমকপূর্ণ সমৃদ্ধি যাঁর পাশে পারস্যের শাহকেও ম্লান মনে হবে-তার সবকিছুই এর মাঝে প্রতিভাত হয়ে আছে।

পাথরটা হাতে ধরা অবস্থাতেই, হুমায়ুন চিন্তিত ভঙ্গিতে তাঁর চেয়ারের কাছে ফিরে আসে। সে একাকী আর বিষণ্ণ ভঙ্গিতে সেখানেই বসে থাকে যতক্ষণ না। নিচের প্রাঙ্গনে দরবারের সময়রক্ষক ঘড়িয়ালী নিজের প্রহরের তার প্রহরার সমাপ্তি ঘোষণা করতে তাঁর পিতলের চাকতিতে আঘাতের শব্দ ভেসে আসে- তাঁকে মনে করিয়ে দেয় যে রাত শেষ হয়ে এল।

সে অনুধাবন করে যে এটা তাঁর প্রথম গুরুতর পরীক্ষা আর সে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি যাই হোক- এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে সবগুলো সৎ ভাইয়ের গলা পর্যায়ক্রমে টিপে সব কটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়- সে অবশ্যই হঠকারী কোনো পদক্ষেপ নেবে না, সর্বোপরি এমন কিছু করবে না যার ফলে বোঝা যায় যে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। নিভৃতে দেখা করার জন্য বাবা ইয়াসভালের অনুরোধ কেউ হয়তো খেয়াল করে থাকবে। তার দাদাজান বাইসানগার, বা তার উজির করিম, যে তার মরহুম আব্বাজানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতাদের অন্যতম, যদি এখন কেবল এখানে উপস্থিত থাকতো। কিন্তু দুই বয়োজ্যেষ্ঠ লোকই বাবরের শবাধার বহনকারী কাফেলার সাথে কাবুলের পথে রয়েছে সেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করার বিষয়টা তারা তদারকি করবে। আগামী কয়েক মাসের ভিতরে তাঁদের ফিরে আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজত্বের গুরুভার, এর সাথে বিদ্যমান একাকীত্ব সম্পর্কে, তার সাথে একবার তার মরহুম আব্বাজান আলোচনা করেছিল। সে খুব ভালো করেই জানে, তাঁকে নিজেকে এবং একমাত্র তাঁকে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে করণীয় সম্বন্ধে কিন্তু তার আগে তাঁকে অবশ্যই তার মনোভাব গোপন রাখতে হবে।

হুমায়ুন নিজের ক্রোধকে প্রশমিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, সে সিদ্ধান্ত নেয় রাতটা সে তার প্রিয়তমা রক্ষিতার সাথে কাটাবে- কাবুলের উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোলকার মুখাবয়ব, ধুসর চোখের এক সুনন্যা তরুণী। সালিমা তার রেশমের মতো ত্বক আর কচি ডালিমের মতো স্তনযুগল ব্যবহার করে খুব ভালো করেই জানে কিভাবে তাঁর দেহকে আত্মহারা করে তুলতে হবে এবং পুরো বিষয়টা সে স্পষ্টতই উপভোগ করে। সালিমার প্রণয়স্পর্শ সম্ভবত আজ রাতে তাঁকে মন পরিষ্কার করতে আর তার ভাবনাগুলোকে বিন্যস্ত করতে সাহায্যই করবে এবং তাহলে হয়তো অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা একটু হাল্কা হবে যা সম্ভবত সহসাই আর অলুক্ষণে ভঙ্গিতে কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে।

তিন ঘন্টার পরে, হারেমে সালিমার কক্ষে রেশম-আবৃত একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় হুমায়ুন শুয়ে থাকে। তার পেষল শরীর, পোড় খাওয়া পরীক্ষিত একজন যোদ্ধর পক্ষে মানানসই ক্ষতচিহ্নে অলঙ্কত, বাদাম তেলে সিক্ত হয়ে দীপ্তি ছড়ায় মেয়েটা তার ত্বকে চটুল ভঙ্গিতে সেটা মালিশ করেছে যতক্ষণ না এক মুহূর্তও অপেক্ষা করাটা অসহ্য হয়ে উঠে, হুমায়ুন তাকে বুকে টেনে নেয়। সালিমার ধুসর হলুদ বর্ণের মসলিনের স্বচ্ছ আলখাল্লা- হুমায়ুনের সদ্য অধিকৃত ভূখণ্ডের একটা সামগ্রী, যেখানের তাঁতিরা এতো সূক্ষ আর কমনীয় কাপড় বয়ন করে তারা যার নাম রাখে বায়ুর হৃৎস্পন্দন বা ভোরের শিশির- ফুলের নক্সা ভোলা কার্পেটের উপরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সালিমা যদিও তাঁকে পরিতৃপ্ত করেছে এবং তাঁর প্রতি মেয়েটার সাড়া বরাবরের মতোই প্রবল আর হুমায়ুনের উত্তেজনা শিথিল হয়েছে, তার মনে তখনও বাবা ইয়াসভালের ফাঁস করা কথাগুলোই ফিরে ফিরে আসে, তাঁর ক্রোধ আর হতাশাকে পুনরায় জাগরিত করে।

সালিমা, কষ্ট করে আমাকে পান করার জন্য একটু গোলাপজল এনে দেবে।

সে নিমেষের ভিতরেই রূপার পানপাত্র যাতে মূল্যবান পাথর দিয়ে গোলাপের বৃত্তাকার প্যানেল প্রণিহিত করা রয়েছে নিয়ে ফিরে আসে। পাত্রের পানির উটের কাফেলায় করে উত্তরের পাহাড় থেকে অতিকায় চাইয়ের আকৃতিতে কেটে আনা বরফ দিয়ে শীতল করা গন্ধটা মুখরোচক। বিছানার পাশে রাখা একটা ছোট কাঠের বাক্স থেকে, হুমায়ুন কয়েকটা আফিমের গুলি বের করে এবং সেগুলো পাত্রের ভিতরে ছেড়ে দেয়, গুলিগুলো পানিতে একটা দুধালো ঘূর্ণি সৃষ্টি করে মিলিয়ে যায়।

পান কর। সে পানপাত্রটা সালিমার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে এবং তাকে ঢোক গিলতে দেখে। তার আনন্দে তাঁকে অংশীদার করাই তার অভিপ্রায়, কিন্তু সে কিছুটা লজ্জিতও বটে তার এমন আচরণের পেছনে আরো একটা অন্য উদ্দেশ্যও রয়েছে। তার আব্বাজান প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন যখন বুয়া- পরাজিত শত্রু সুলতান ইবরাহিম লোদির মা তার ছেলের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধ নিতে তাঁকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। সেই সময় থেকে, অন্য কেউ আগে পরীক্ষা করেনি এমন যে কোনো খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে হুমায়ুন সবসময়ে সর্তক থাকে…।

আমার প্রভু, নিন। সালিমা, গোলাপজলে আকর্ষণীয়ভাবে সিক্ত ঠোঁটে, সে তাকে চুমু খায় আর পানপাত্রটা হাতে তুলে দেয়। সে পানপাত্রে গভীর চুমুক দেয়, কামনা করে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আফিম যেভাবে তার শোকাবেগ ভোতা করে দিয়েছে আর তার উদ্বেগ হ্রাস করেছে সেভাবে কাজ শুরু করুক, তার মানসপটে আলতো করে কুণ্ডলীমুক্ত হয়ে তাঁকে প্রীতিপ্রদ বিস্মরণের মাঝে নিয়ে যাক।

কিন্তু আজ রাতে সে বোধহয় মাত্রা অতিক্রম করেছে বা এর প্রশমন ক্ষমতার কাছে অনেক বেশী কিছু প্রত্যাশা করছে। সে তাকিয়ায় দেহ এলিয়ে দিতে, তার মনের অলিন্দে অশুভ লক্ষণযুক্ত নানা অবয়বের সৃষ্টি হতে থাকে। তার সামনে দীপ্তিময় নীল গম্বুজ আর সরু মিনারযুক্ত একটা অপূর্বসুন্দর শহর ভেসে উঠে। যদিও সেখানে তার সংক্ষিপ্ত অবস্থান মনে রাখার পক্ষে তাঁর বয়সটা খুবই অল্প ছিল, তবুও সে বুঝতে পারে শহরটা সমরকন্দ, তাঁর মহান পূর্বপুরুষ তৈমূরের রাজধানী আর সেই শহর যা তার বাবা দখল করেছিলেন, হারিয়েছিলেন আর সারাটা জীবন সে জন্য আকুল হয়ে থেকেছেন। বাবরের রেখে যাওয়া প্রাঞ্জল বর্ণনা পড়া থাকার কারণে হুমায়ুন বুঝতে পারে সে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত রেগিস্তান চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখের সামনে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া তোরণদ্বারের উপরে স্থাপিত গুটিসুটি দিয়ে থাকা কমলা রঙের বাঘটা জীবন্ত হয়ে উঠে, তার কান দুটো মাথার সাথে লেপটে রয়েছে, তীক্ষ্ণ দাঁতের উপরে ঠোঁট টানটান, অবজ্ঞা প্রকাশের জন্য থুতু ফেলতে প্রস্তুত। বাঘটার চোখ দুটো কামরানের চোখের মতো সবুজ।

সহসা, হুমায়ুন নিজেকে বাঘের পিঠের উপরে আবিষ্কার করে, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ওটার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে, টের পায় বাঘটার পেষল শরীর তার নীচে মোচড় খাচ্ছে। সে নিজের উরু দিয়ে তাঁকে শক্ত করে আকড়ে ধরে, প্রাণীটার তপ্ত নিঃশ্বাসের গন্ধ পায় যখন জন্তুটা নিজের দেহ বাকিয়ে, মাথা এপাশ ওপাশ দোলাতে থাকে, তাঁকে ছিটকে ফেলে দেয়ার জন্য বেচারা প্রাণপণ লড়াই করে। হুমায়ুন জটাকে তার দুপা দিয়ে আরও শক্ত করে আটকে ধরে আর টের পায় এর পাঁজর ব্যথায় মোচড়াচ্ছে আর নতুন করে দাপাদাপি শুরু হয়। সে কোনভাবেই ছিটকে যাবে না। সে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে, জটার দেহের নীচে নিজের হাত দুটো পিছলে যেতে দেয়। তার হাতের আঙ্গুলগুলো মাংসপেশী অনুভব করে যা নরম আর মসৃণ এবং তার ভেতরে রয়েছে একটা উষ্ণ, ছন্দোবদ্ধ নাড়ীর স্পন্দন, জটার প্রাণশক্তির উৎস। সে তার মুষ্ঠি শক্ত করার উদ্দেশ্যে চাপ বাড়াতে আর প্রবলভাবে ধাক্কা দিতে থাকলে আচমকা জন্তুটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ কর্কশ হয়ে উঠে আর খিচুনী শুরু হয়।

সম্রাট…দয়া করেন…

আরেকটা দুর্বল কণ্ঠস্বর কোথাও থেকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। কণ্ঠস্বরটা নিঃশ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাঁস করছে। সে চোখ খুলে তাকায় এবং নিজের প্রসারিত তারারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে, হুমায়ুন হিংস্র কোনো বাঘের বদলে সালিমাকে দেখতে পায়। সালিমার দেহ, তার নিজের দেহের মতোই ঘামে চুপচুপে হয়ে ভেজা যেন চুড়ান্ত মুহূর্ত নিকটেই উপস্থিত। কিন্তু যদিও সে আসলেই তাঁর মালিক, হুমায়ুনের পেশল হাতের তালু সালিমার পেলব স্তন প্রচণ্ড জোরে আকড়ে রেখেছে যেন সালিমাই সেই হিংস্র জন্তু যাকে পরাভূত করতে সে লড়াই করছিল। সে তার হাতের মুঠি শীথিল করে কিন্তু রমণের বেগ বাড়িয়ে দেয় যতক্ষণ না তারা দুজনেই সুখানুভূতির শীর্ষে পৌঁছে এবং অবসাদে ভেঙে পড়ে।

সালিমা, আমি দুঃখিত। তোমার উপরে এভাবে হামলে পড়া আমার মোটেই উচিত হয়নি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল তোমার জন্য আমার কামনার সাথে প্রভুত্ব স্থাপনের ভাবনাগুলো কেমন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে।

দুঃখিত হবার মতো কিছু হয়নি- আপনার প্রেমিক-সুলভ আচরণ আমাকে ভোগসুখে উদ্বেল করে তোলে। আপনি অন্য এক জগতে ছিলেন আর আমি এখানে যেমন করে থাকি আমি সেখানেও নির্দ্বিধায় আপনার সেবায় রত ছিলাম। আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে কষ্ট দেবেন না। এখন এসব ফালতু আলোচনা বাদ দিয়ে আমাকে আরেকবার সঙ্গসুখের তুঙ্গে নিয়ে যান, এইবার একটু কোমলতা আমি আপনার কাছে আশা করতেই পারি।

হুমায়ুন সানন্দে তার প্রত্যাশা পূরণ করে। কামনার ঝড় স্তিমিত হয়ে এলে, সে যখন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে এবং তখনও আফিমের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি, হারেমের পরিচারিকার দল সুগন্ধি মেশান শীতল পানি নিয়ে এসে তার গা মুছিয়ে দেয়। অবশেষে সালিমার বাহুডোরে নিজেকে সপে দিয়ে সে নিন্দ্রাদেবীর বরাভয় লাভ করে। এইবার ঘুমের ভেতর কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে না, হারেমের সেই কক্ষের জাফরি-কাটা জানালা দিয়ে যখন দিনের প্রথম আলোর কোমল আভা তীর্যক ভঙ্গিতে প্রবেশ করে তখনই কেবল তার সুপ্তির ঘোর কাটে। সে শুয়ে শুয়ে তার মাথার উপরের বেলেপাথরের নক্সা করা ছাদের নীচের অংশে খেলা করতে থাকা আলোক রশ্মির তীব্রতা বৃদ্ধির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকার সময়েই সে জানে তাকে কি করতে হবে। বাঘের সাথে তার ইচ্ছা শক্তির লড়াই তাকে সে কথা বলে দিয়েছে। সে হল একজন শাসক। সে অবশ্যই সবসময়ে অমায়িক থাকতে পারে না। কখন কঠোর হতে হবে সেটা জানা থাকলেই কেবল কেউ সম্মান অর্জন করতে পারে।

*

মহামান্য সুলতান। আপনার আদেশ পালিত হয়েছে।

দর্শনার্থী কক্ষ-দরবার হলের মর্মরের বেদীতে স্থাপিত তার সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থা থেকে হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষী দলের প্রধানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তাঁর অমাত্য আর সেনাপতিরা কঠোর অগ্রগণ্যতার বিন্যাস বজায় রেখে তার চারপাশে নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করছে। সে ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে আদতেই কি ঘটেছে মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হবার সামান্য পরেই দেহরক্ষী দলের আধিকারিক তার সাথে নিভৃতে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু সেই সাথে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে দরবারের সবাই বিষয়টা শ্রবণ করেছে এবং আসন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে।

তুমি দারুণভাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। কি ঘটেছিল সেটা দরবারের সামনে খুলে বল।

মহামান্য সম্রাট যেমন আদেশ করেছিলেন, আমি আর বাছাই করা দেহরক্ষীদের একটা ছোট দল সম্রাটের সম্ভাইদের গত রাতে গ্রেফতার করেছি যখন তারা শাহজাদা কামরানের প্রাসাদে পানাহারে মত্ত ছিল।

হুমায়ুন তার চারপাশে সশব্দে একটা শ্বাসটানার আওয়াজ হতে, অতিকষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখে। সে সময়টা ভালোই নির্বাচন করেছিল। বাবা ইয়াসভালো তাঁকে সতর্ক করে দেবার পর থেকে পুরো সময়টা নিরাপত্তার খাতিরে সে নিজেকে দূর্গের অভ্যন্তরে অন্তরীণ রেখেছে। তারপরে সপ্তাহখানেক আগের কথা, কাবুলের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, উচ্চণ্ড আর দামী, লাল সুরার একটা চালান গজনী থেকে খচ্চরের কাফিলায় করে এসে পৌঁছে- বাইসানগার, তাঁর নানাজানের কাছ থেকে আগত একটা সময়োচিত উপহার। সুরার প্রতি কামরানের দুর্বলতার কথা জানা থাকার কারণে, হুমায়ুন চালানের একটা অংশ তাঁকে উপহার দেয়। সে যেমনটা আশা করেছিল যে কামরান বাকি ভাইদের তার সাথে পানাহারে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে, তাকে খুব বেশী একটা সময় অপেক্ষা করতে হয় না। হুমায়ুন যথোচিত সৌজন্যের সাথে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে কিন্তু আসকারি আর অল্পবয়সী হিন্দাল, যে এখনও সুরাপান উপভোগ করার মতো বয়সে পৌঁছায়নি, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই যারা সেটা উপভোগ করে তাদের সাহচর্যে থাকতে শ্লাঘাবোধ করে, দ্বিতীয় কিছু না ভেবেই ব্যগ্রতার সাথে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। ষড়যন্ত্রের তিন কুশীলব একসাথে, সর্বোপরি অপ্রস্তুত, নিশ্চায়ক হামলার জন্য উপযুক্ত সুযোগ।

আমার ভাইয়েরা কি প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল?

শাহজাদা কামরান নিজের খঞ্জন বের করেছিলেন আর আমার একজন লোককে তার কানের লতি দ্বিখণ্ডিত করে তাঁকে আহত করেছে, কিন্তু তার এই প্রয়াস ছিল ক্ষণস্থায়ী। অন্যেরা লড়াই করার কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি।

হুমায়ুনের চাহনী তাঁর সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর উপর দিয়ে ভেসে বেড়ায়। কয়েকদিন আগে, আমি আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারি। আমার সৎ-ভাইয়েরা আমাকে অপহরণের এবং বলপ্রয়োগ করে আমার সাম্রাজ্যের কিছুটা আদায়ের পরিকল্পনা করেছে- সম্ভবত তারা আমাকে হত্যাই করতে চেয়েছিল। তার অমাত্যদের আদতেই বিক্ষুব্ধ দেখায়। হুমায়ুন ভাবে, তাদের ভিতরে কতজন অভিনয় করছে। কয়েকজন, অবশ্যই, ষড়যন্ত্রের কথা আগে থেকেই জানতো, এমনকি নিরব সমর্থন দিয়েছে। উপজাতীয় গোত্রপতিদের কয়েকজন যারা হিন্দুস্তান বিজয়ের অভিযানে বাবরের সাথে ছিল কখনই তাদের নতুন বাসস্থানের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। এই নতুন ভূখন্ত্রে বৈচিত্র্যহীন, আপাতদৃষ্টিতে শেষ না হওয়া সমভূমি, এখানকার বাতাসের উষ্ণতা আর তার সাথে প্রবাহিত বালুকণা এবং অঝোর ধারায় সিক্ত করা বর্ষাকাল তারা অপছন্দ করতো। তারা গোপনে অন্তরে লালন করতো, বরফাবৃত পাহাড় এবং খাইবার গিরিপথ আর তার ওপারে তাদের মাতৃভূমির শীতল স্রোতস্বিনীর জন্য তাদের ভেতরে একটা আকুতি ছিল। তাদের ভিতরে অনেকেই হয়তো ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে গোপনে সহযোগিতা করার এই সুযোগকে স্বাগতই জানিয়েছিল যার ফলে তারা হয়তো বেশ ভালো রকমের ধনসম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবে। বেশ, এখন ব্যাটারা উৎকণ্ঠায় একটু ঘামলে মন্দ কি…

আমার গুণধর ভাইদের আমার সামনে এনে হাজির কর যাতে করে তাদের সহযোগিদের বিষয়ে আমি তাদের প্রশ্ন করতে পারি।

হুমায়ুন আর তার অমাত্যের দল যখন অপেক্ষা করে চারপাশে সমাধি গর্ভের পরম নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। অবশেষে, দরবার কক্ষের বাইরের আঙিনায় পাথরের মেঝেতে ধাতব শেকলের ঘষা খাবার শব্দে এই অস্বস্তিকর নিরবতার সমাপ্তি ঘটে। হুমায়ুন মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে প্রহরীদের দ্বারা প্রায় ছেড়ে নিয়ে আসার ভঙ্গিতে টলতে টলতে তার ভাইয়েরা সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করছে। প্রথমেই রয়েছে কামরান, তার পাতলা ঠোঁট আর বাজপাখির মতো নাক বিশিষ্ট মুখাবয়বে পরিষ্কার তাচ্ছিল্য ফুটে আছে। তার পায়ে হয়ত শেকল পরান হয়েছে কিন্তু তার স্পর্ধিত মস্তক বহনকারী দেহটার ভঙ্গিমায় স্পষ্ট বোঝা কোনো প্রকারের ক্ষমা প্রার্থনার অভিপ্রায় তার নেই। আসকারির, খর্বকায় আর হাল্কাপাতলা, ব্যাপারটা আবার একেবারেই ভিন্ন। তাঁর দাড়ি না কামানো মুখের ভাঁজে ভাঁজে আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং তার কালো র নীচের ছোট ছোট চোখ দুটো সকাতরে হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হিন্দাল, তার বড় দুভাইয়ের পেছনে প্রথমে প্রায় ঢাকা পড়ে ছিল, মাথা ভর্তি একরাশ জটপাকান কালো চুলের নীচে তার কিশোর মুখাবয়বে ভয়ের চেয়ে কেমন বোধহীন শূন্য একটা অভিব্যক্তি যেন যা কিছু ঘটতে চলেছে সবকিছুই তার বোধগম্যতার বাইরে।

তাদের কাছ থেকে প্রহরীরা সরে যেতে, আসকারি আর হিন্দাল, প্রথাগত অভিবাদন কুর্নিশ এর রীতি অনুসারে নিজেদের হুমায়ুনের সামনে প্রণিপাতের ভঙ্গিতে আনত করে। আসকারি বেশ কিছুটা সময় ইতস্তত করার পরে, মুখে একটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে তুলে একই কাজ করে।

উঠে দাঁড়াও।

তিনজনের প্রত্যেকের উঠে দাঁড়াবার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস শেষ না হওয়া পর্যন্ত হুমায়ুন চুপ করে থাকে। এখন সে আরও ভালোও করে খুটিয়ে তাঁদের অভিব্যক্তি যাচাই করতে পারে সে দেখে যে কামরানের মুখের একপাশে একটা কালশিটের দাগ রয়েছে।

নিজেদের কার্যকলাপের জন্য তোমরা কি সাফাই দেবে? তোমরা প্রত্যেকে আমার সৎ-ভাই। আমার বিরুদ্ধে কেন তোমরা ষড়যন্ত্র করতে গেলে?

আমরা কিছুই করিনি…এটা মোটেই সত্যি নয়… উদ্বিগ্ন আর কর্কশ, আসকারির কণ্ঠস্বর মোটেই প্রত্যয়দীপ্ত নয়।

তুমি মিথ্যাচার করছে। তোমার চোখে মুখে সেটা স্পষ্ট ফুটে আছে। তুমি আবারও সে চেষ্টা কর, আমি বাধ্য হব তোমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে। কামরান, এদের ভিতরে যেহেতু তুমিই সবার বড়, আমার প্রশ্নের উত্তর তুমিই দাও। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা কেন করতে গেলে?

কামরানের চোখ- তাদের মরহুম আব্বাজান বাবরের চোখের মতোই সবুজাভ দীপ্তিময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হুমায়ুনের দিকে সে যখন মুখ তুলে তাকায়, কুচকে সরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রের ধারণাটা আমার মস্তিষ্কপ্রসুত শাস্তি দিতে হলে আমাকে দাও, ওদের নয়। আমাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে সেটা সংশোধন করার এটাই একমাত্র পথ। তুমি নিজেই বলেছে যে আমরা সবাই বাবরের সন্তান। আমাদের সবার ধমনীতেই কি তৈমূরের রক্ত বইছে না? আর সেই সাথে আমাদের নানীজান খুতলাঘ নিগারের কারণে চেঙ্গিস খানের রক্ত? অথচ দেখো তোমার চামচা করে আমাদের রাখা হয়েছে, তোমার মর্জিমাফিক এদিক সেদিক বিনাবাক্যব্যয়ে ছোটার জন্য। শাহজাদা নয়, ক্রীতদাসের মতো তুমি আমাদের সাথে আচরণ কর।

আর তোমরা তোমাদের সবাই, কেবল কামরান একা না- ভাইয়ের মতো না, বরং ছিঁচকে অপরাধীর মতো আচরণ করেছে। আমার প্রতি নয় নাই থাকলো, কিন্তু আমাদের রাজবংশের প্রতিও কোনো আনুগত্যবোধ তোমাদের ভিতরে নেই? তার সিংহাসনের ডানপাশের দেয়ালের অনেক উঁচুতে স্থাপিত কাঠের সূক্ষ কারুকাজ করা জাফরির দিকে হুমায়ুন আড়চোখে তাকালে, নিমেষের জন্য একজোড়া কালো চোখ সে দেখতে পায়। নিঃসন্দেহে খানজাদা, আর সম্ভবত তার আম্মিজান মাহাম জাফরির পেছনে অবস্থিত ছোট্ট অলিন্দ থেকে, যেখানে রাজঅন্তঃপুরের রমণীরা নিজেদের লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে, দরবারের কার্যক্রম দেখতে আর শুনতে পারেন, তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। গুলরুখ আর দিলদারও সম্ভবত সেখানে রয়েছে, শিহরিত শঙ্কায় প্রতীক্ষা করছে তাদের সন্তানের প্রতি সে কি শাস্তির বিধান ঘোষণা করে।

কিন্তু এখন যখন সেই মুহূর্ত প্রায় সমাগত, হুমায়ুন এক বিচিত্র অনীহা নিজের ভিতরে অনুভব করে। সে কি করবে সে বিষয়ে মাত্র আধঘন্টা আগেও সে ভীষণভাবে নিশ্চিত ছিল- তৈমূরসম নির্মমতায়, সে কোনো প্রকার কালক্ষেপন না করে কামরান আর আসকারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেবে, আর হিন্দালকে প্রত্যন্ত কোনো দূর্গে আজীবনের জন্য নির্বাসনে পাঠাবে। কিন্তু তাঁদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অবাধ্য আর উদ্ধত কামরান, আসকারি আর কিশোর হিন্দাল আক্ষরিক অর্থেই আতঙ্কিত- হুমায়ুন বুঝতে পারে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই তাদের আব্বাজান ইন্তেকাল করেছে, আর তাছাড়া সে কিভাবে বাবরের অন্তিম ইচ্ছার কথা উপেক্ষা করবে? তোমার ভাইদের বিরুদ্ধে কখনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যেও না, সেটা তাঁদের প্রাপ্য বলে তোমার যতই মনে হোক। প্রেমিকসুলভ আচরণের ক্ষেত্রে আমরা যেমন করে থাকি, কখনও এমন সময় আসবে যখন কঠোর হতে হবে, আর কখনও হতে হবে সহৃদয়।

হুমায়ুন তার সিংহাসন থেকে নীচে নেমে এসে, ধীরে ধীরে তার শিকলাবদ্ধ ভাইদের দিকে হেঁটে যায়, এবং তাঁদের আলিঙ্গন করে, কামরানকে বাহুবন্দি করা দিয়ে বিষয়টা শুরু হয়। তাঁর সামনে মৃদু টলতে থাকা ত্রিমূর্তির চোখে মুখে বিভ্রান্ত অভিব্যক্তি, তার এহেন আচরণের মানে খুঁজতে তারা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা ভাইয়েরা নিজেদের ভিতরে লড়াই করবো এটা ঠিক আমাদের শোভা দেয় না। আমাদের এই নতুন ভূখণ্ডের মাটিতে আমারই হাতে আমাদের বংশের কারো রক্ত ঝরুক এটা আমার কাম্য নয়। আমাদের রাজবংশের জন্য সেটা একটা অশুভ লক্ষণ বলে বিবেচিত হবে। আমার প্রতি তোমরা আনুগত্যের শপথ নাও আর তোমরা তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবে। শাসন করার জন্য আমি তোমাদের প্রদেশও প্রদান করবো যা যদিও এই সাম্রাজ্যেরই অংশ, কিন্তু আমার কাছে জবাবদিহি করা ছাড়া, তোমরা স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে।

হুমায়ুন তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অমাত্যবর্গ আর সেনাপতিদের ভেতরে প্রথমে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি শুনতে পায় এবং ধীরে ধীরে সেটা সম্মতির ব্যঞ্জনা লাভ করে, এবং গর্বে তার বুকটা ভরে উঠে। চুড়ান্ত মহত্ত্ব একেই বলে। এটাই একজন সত্যিকারের সম্রাটের আচরণ- শক্তহাতে সব মতপার্থক্যের বিনষ্টিসাধন কিন্তু তারপরেই মহানুভবতা প্রদর্শন করা। সে দ্বিতীয়বারের মতো যখন তাঁর ভাইদের আবার আলিঙ্গন করে, আসকারি আর হিন্দালের চোখে তখন কৃতজ্ঞতার অশ্রু চিকচিক করে। কিন্তু কামরানের সবুজাভ চোখ শুকনো থাকে, আর মুখাবয়বে বিষণ্ণ আর দুর্বোধ্য একটা অভিব্যক্তি।

১.২ এক নিলাজ দুশমন

০২. এক নিলাজ দুশমন

লাল বেলেপাথরে নির্মিত আগ্রা দূর্গের প্রাকার বেষ্টিত প্রাঙ্গনে অবস্থিত জলবুদ্বুদ নিঃসরণরত কৃত্রিম প্রস্রবনের পাশ দিয়ে উঁচু বলভিযুক্ত দরবার হলের দিকে যাবার পথে হুমায়ুনের আগে আগে হেঁটে যাওয়া লম্বা আর সাদা পাগড়ি পরিহিত দুই দেহরক্ষীর বুকের বর্মে সকালের সূর্যের আলো সোনার দ্যোতনা তুলে চিকচিক করে। স্তম্ভযুক্ত দরবার কক্ষের, শীতল বাতাসের অবারিত প্রবাহের জন্য যার তিন দিকই উন্মুক্ত, ভিতর দিয়ে আর সমবেত উপদেষ্টামণ্ডলীর কাতারের মাঝে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে, যারা তার অগ্রসর হবার সাথে সাথে প্রথাগত অভিবাদন জানাবার রীতিতে নিজেদের আনত করে, হুমায়ুন কক্ষের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মার্বেলের বেদীতে আরোহণ করে। সেখানে, পরণের সবুজ রেশমের আলখাল্লাটা সামলে নিয়ে সে তার সোনার পাত দিয়ে গিলটি করা, উঁচু পৃষ্ঠদেশযুক্ত সিংহাসনে নিজেকে উপবিষ্ট করে। তার সাথে আগত দুই দেহরক্ষী তরবারির বাটে হাত রেখে সিংহাসনের ঠিক পেছনে, দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করে।

হুমায়ুন ইঙ্গিতে তার উপদেষ্টাদের এবার উঠে দাঁড়াতে বলে। তোমরা জান কেন আজ আমি তোমাদের একসাথে এখানে ডেকে এনেছি- সুলতান বাহাদুর শাহের প্রভৃষ্ট ঠাট-ঠমকের বিষয়ে আলোচনা করতে। আমাদের রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিমে গুজরাটের সমৃদ্ধ অঞ্চল নিয়ে সে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না, দিল্লীর পরাভূত সুলতান, ইব্রাহিম লোদি যাকে আমি আর আমার মরহুম আব্বাজান তোমাদের চমকপ্রদ সহায়তার দ্বারা সিংহাসনচ্যুত করেছিলাম, তার সন্তানদের সে। শরণ দিয়েছে। তাঁদের সাথে নিজের পারিবারিক বন্ধনের কথা ঘোষণা করে, নিজের চারপাশে মিত্র সংগ্রহ শুরু করেছে সে। রাজপুত আর আফগান গোত্রগুলিকে তার দূতেরা সুকৌশলে বোঝাতে চাইছে যে আমাদের সাম্রাজ্যের ভিত্তি বাস্তবের চাইতে কল্পনার মানসপটে বেশী প্রোথিত। আমাদের সাম্রাজ্য মাত্র দুইশ মাইল প্রশস্ত হবার কারণে সে বিষয়টা নিয়ে ঠাট্টা উপহাস করছে যদিও খাইবার গিরিপথ থেকে এটা হাজার মাইলের বেশী প্রসারিত। বর্বর হানাদার তকমা দিয়ে তারা আমাদের একেবারে খারিজ করে দিতে চাইছে ভোরের শিশিরের মতো সহজেই যাদের শাসনক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যাবে।

আমরা তাদের এই মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং আমাদের ঘৃণারও অযোগ্য বলে বিবেচনা করি কিন্তু আজ সকালে এক বার্তাবাহক- সারারাত ঘোড়া দাবড়ে আসবার কারণে পরিশ্রান্ত- খবর নিয়ে এসেছে যে বাহাদুর শাহের একদল সৈন্য, যার নেতৃত্বে ছিল লোদি রাজ্যাভিযোগী তার্তার খান, আমাদের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে হামলা করেছে। আগ্রা থেকে মাত্র আশি মাইল পশ্চিমে, আমাদের অনুগত এক রাজপুত জায়গিরদারের প্রেরিত উপহারসামগ্রী বহনকারী কাফেলা তারা দখল করেছে। আমি নিশ্চিতভাবে এখন কেবল এটুকুই বলতে পারছি। আমরা কদাপি এমন অসম্মান সহ্য করবো না। আমাদের উচিত এবং অবশ্যই আমরা সুলতানকে এজন্য সমুচিত শিক্ষা দেব। আমাদের উচিত তাঁকে পরাস্ত করা কিনা সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আমি আজ তোমাদের এখানে আসতে বলিনি, আমি তোমাদের ডেকেছি কিভাবে সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করতে। হুমায়ুন দম নেয়ার জন্য কথা বন্ধ করে এবং পুনরায় শুরু করার আগে চারপাশে নিজের উপদেষ্টাদের দিকে ভালো করে তাকায়।

হুমায়ুনের আত্মীয়-সম্পর্কিত এক ভাই, এবং তার অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি, সুলেইমান মির্জা প্রথম নিজের মতামত প্রকাশ করে। বাহাদুর শাহকে মত দেয়াটা খুব একটা সহজ হবে না। সেটা করতে যাবার আগে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের বিষয়টা একটু বিবেচনা করা উচিত। আপনার মরহুম আব্বাজান যখন দিল্লী জয় করেছিলেন তখনকার কথা আলাদা ছিল, এখন আমাদের শত্রুর চেয়ে আমাদের সৈন্য সংখ্যা, আর যুদ্ধোপযোগী রণহস্তি আর ঘোড়ার সংখ্যা অনেকবেশী। সবগুলো প্রাণীই বেশ ভালোভাবেই প্রশিক্ষিত আর সৈন্যরা বিশ্বস্ত। বাহাদুর শাহের উপচে পড়া রাজকোষ থেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের সম্ভাবনা যুদ্ধের জন্য তাদের আগ্রহকে জোরদার করবে। কিন্তু হিন্দুস্তানে মোগলদের প্রথমবার আগমন আর এখনকার বাস্তবতার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। এইবার, কেবল আমরাই না- উভয়পক্ষের কাছেই কামান আর ম্যাচলক গাদাবন্দুক রয়েছে। সুলতান মক্কায় হজ্জ পালন করতে যেসব হজ্জযাত্রী খোলা সমুদ্র অতিক্রম করে সেখানে যায় আর দূরদুরান্ত থেকে আগত বণিককের দল যারা ক্যাম্বে আর সুরাটে অবস্থিত তার সমুদ্রবন্দরে আশেপাশে ভীড় করে উপরে আরোপিত কর থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ অসংখ্য কামান আর বন্দুক কেনার জন্য ব্যয় করেছে এবং অভিজ্ঞ অটোমান অস্ত্রনির্মাতাদের রাজি করিয়েছে তার ঢালাইখানায় কাজ করতে। প্রতিটা যুদ্ধে আমাদের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর উপস্থিতিই যথেষ্ট এমন আত্মশ্লাঘা আমরা আর করতে পারি না। তাদের উপস্থিতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তার আগে আরো একবার আমাদের কৌশল পরিবর্তন করার সময় হয়েছে।

হ্যাঁ, তোমার বক্তব্য বিষয় সহজেই বোধগম্য হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় এটা কিভাবে অর্থবহ হয়ে উঠবে? মাথার টিকি ধরে টানার অবসরে বাবা ইয়াসভালো জানতে চায়।

মহামান্য সম্রাটের আব্বাজান সম্রাট বাবর তাঁর জীবনের শেষ লড়াইগুলোতে যে কৌশল ব্যবহার করেছিলেন এর সাথে তার যৌবনে অনুসৃত কৌশলের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে, সুলেইমান মির্জা উত্তর দেয়। অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত হামলাকারী বাহিনীকে প্রথমে গুজরাটে পাঠান যেতে পারে বাহাদুর শাহের বাহিনীকে তাঁরা যেখানেই দেখতে পাবে সেখানেই তাঁদের আক্রমণ করবে এবং বাহাদুর শাহ তাঁদের বিরুদ্ধে নিজের সৈন্যদের সন্নিবেশিত করার অনেক আগেই তারা বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আমাদের মূলবাহিনী কোথা থেকে আক্রমণ করবে সে বিষয়ে তাঁকে একটা বিভ্রান্তির ভিতরে ফেলে দিতে হবে এবং এই পুরোটা সময়ে আমরা রণহস্তি আর গোলন্দাজদের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের মূল বাহিনী নিয়ে তাঁর ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে নিশ্চিত নির্ভরতার সাথে এগিয়ে যাব।

হুমায়ুনের অধিকাংশ উপদেষ্টাই যদিও মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে, কিন্তু বাবা ইয়াসভালো প্রশ্ন করেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের মূল বাহিনীর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু কি হওয়া উচিত?

গুজরাটের গহীন জঙ্গলে অবস্থিত চম্পনির দূর্গ লক্ষ্যবস্তু হলে কেমন হয়? হুমায়ুন প্রস্তাব করেন। বাহাদুরের রাজকোষের একটা বিপুল অংশ এখানে রক্ষিত আছে। আমরা যদি এটা কুক্ষিগত করতে পারি সে বিষয়টা মেনে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের অবরোধকারী বাহিনীর কাছ থেকে একে মুক্ত করতে সে। বাধ্য হবে আক্রমণ করতে।

সেতো বুঝলাম, কিন্তু আমরা আমাদের অবরোধকারী বাহিনীর পেছনের হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করবো? সুলেমান মির্জা জানতে চায়।

বাবা ইয়াসভালো এবার তার প্রশ্নের উত্তর দেয়, আসন্ন যুদ্ধের ভাবনায় তাঁর চোখ চকচক করছে। সময়ের বরাভয় আমাদের পক্ষে থাকবে। আমরা আমাদের কামানগুলো মাটি খুড়ে এমনভাবে স্থাপণ করতে পারি যাতে তাঁরা দূর্গ আর পেছন থেকে আগুয়ান বাহিনীর উপর একই সাথে গুলিবর্ষণ করতে পারে, এবং আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করবো যাতে তাঁরা দুপাশেই যুদ্ধ করতে পারে। বাহাদুর শাহ যদি অবরোধ ভাঙা চেষ্টা করে তাহলে সে বিপজ্জনক এক চমকের সম্মুখীন হবে।

আপনার বক্তব্যের মাঝে কোনো খুঁত নেই, হুমায়ুন বলে। গুজরাতের সীমানা অতিক্রমকারী প্রথম হানাদার বাহিনীর নেতৃত্বে আমি নিজে থাকব। বাহাদুর শাহ যখন শুনবে- কথাটা নিশ্চয়ই তার কানে পৌঁছাবে- যে আমি নিজে লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত আছি, আমাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এটা তাকে আরও বেশী বিভ্রান্তির ভিতরে ফেলে দেবে। সুলেমান মির্জা, আমি বাবা ইয়াসভালো আর আপনার উপরে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করছি। আলোচনা আজ এই পর্যন্তই মূলতবী থাকল।

কথাটা বলেই হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর দুই দেহরক্ষী আরও একবার তার সামনে অবস্থান নিয়ে আঙ্গিনার অপর প্রান্তে তার খাস কামরার দিকে ধীরে ধীরে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। সেখানে পৌঁছাবার পরে সে জওহরকে, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরিচারক আর রাজ-অনুচর লম্বা, সুদর্শন চেহারার এক তরুণ যার বাবা বাবরের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন অধিনায়ক ছিলেন পাঠায় তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষীকে একঘন্টার ভিতরে তাঁর সামনে উপস্থিত হবার আদেশ দিয়ে যাতে তাঁর এই অভিযান শুরু করার সবচেয়ে মাঙ্গলিক সময় গণনা করা যায়। তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনা খুব দ্রুতই নির্ধারিত হয়। তাঁর আক্রমণ শুরু করার সময়ের প্রতি জ্যোতিষীর রাশিফল আর গণনার বরাভয় রয়েছে এই দৃঢ় আশ্বাস সম্রাট হিসাবে সে যখন তাঁর প্রথম অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে তখন তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাস আর সেই সাথে তার বাহিনীর মনোবলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইত্যবসরে সে তার অভিযানের জন্য নির্বাচিত তার পছন্দের সেনাপতিদের বিষয়ে তাঁর ফুপু খানজাদার বিজ্ঞ পরামর্শের জন্য তাঁর সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অন্য আরেকটা বিষয়ে সে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সাথে আলোচনা করতে চায়। সে অভিযান পরিচালনা করতে যখন দূরদেশে যাবে তখন তাঁর সৎ-ভাইদের তাদের আপন আপন প্রদেশে স্বাধীনভাবে রেখে যাওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে- কামরান রয়েছে উত্তরপশ্চিম দিকে পাঞ্জাবে, আসকারি পূর্বদিকে জুনাপুরে আর হিন্দাল রয়েছে পশ্চিম দিকে আলওয়ারে? তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার এই সুযোগের কি তাঁরা সদ্ব্যবহার করবে? তাঁর কি উচিত তাঁর সেনাবাহিনীতে তাদের সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া এবং সাথে করে গুজরাতে নিয়ে যাওয়া যাতে সে তাদের উপরে লক্ষ্য রাখতে পারে?

তাদের নিজ নিজ প্রদেশ থেকে যে সংবাদ তার কাছে এসেছে তাতে এখনই উদ্বিগ্ন। হবার মতো কোনো কারণ নেই, বিশেষ করে হিন্দাল আর আসকারির ক্ষেত্রে তারা তাঁদের প্রশাসনিক বিষয়ের সবকিছু খুটিনাটি তাকে নিয়মিত লিখে পাঠায় এবং তাদের প্রদেয় কর পুরোপুরি প্রদান করে কখনও সময়ের আগেই। কামরানও তাঁর প্রদেশের রাজস্বের ন্যায্য হিস্যা ঠিকমতোই প্রদান করে যদিও তার প্রেরিত দাপ্তরিক বিবরণী অনিয়মিত আর সংক্ষিপ্ত। কখনও কখনও হুমায়ুনের দরবারের কোনো অসন্তুষ্ট কর্মকর্তা কামরানের প্রদেশে যায় সেখানে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে। আবার কখনও গুজব শোনা যায় যে কামরান তার প্রাদেশিক প্রয়োজনের তুলনায় বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে, কিন্তু এসবই শেষ পর্যন্ত ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় বা আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমন বা অন্য কোনো কারণের দ্বারা সৈন্য সমাবেশের বিষয়টার ন্যায্যতা প্রতিপাদিত হয়।

কিন্তু কামরান তার উচ্চাকাঙ্খ পরিত্যাগ করার বান্দা না আর সে কেবল কালক্ষেপন করছে আর প্রস্তুত হচ্ছে হুমায়ুনের কোনো দুর্ভাগ্যকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহারের জন্য এই অনুভূতি থেকে হুমায়ুন কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তবে তাই হোক। কামরান কোনো কারণে যেন এমন কোনো সুযোগ না পায় সেটা সে নিশ্চিত করবে। সে যাই হোক, এমনও হতে পারে কামরানের, আর সেই সাথে আসকারি আর হিন্দাল, তাঁদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে এবং তারা হুমায়ুনের মহানুভবতার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ যেমনটা তাঁদের কাছ থেকে কাম্য, তার এই বিচার ভুল হয়েছে। সে আশা করে তাঁর প্রথম ধারণাটাই সঠিক। যদি কোনো কারণে ব্যাপারটা এমন না হয়, তাঁর নানাজান আগ্রা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাহাদুর শাহর বিপক্ষে কোনো ধরনের অভিযান শুরু করবে না। তিনি এবং হুমায়ুনের উজির কাশিম কাবুল থেকে ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই দিল্লীতে শাহী খাজানা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন, আশা করা যায় কয়েক দিনের ভিতরেই তারা ফিরে আসবেন। হুমায়ুন তখন তার অনুপস্থিতিতে বাইসানগারকে রাজপ্রতিভূ নির্বাচিত করবে। সে তার নানাজানকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে- সেই সাথে কাশিম আর খানজাদাকেও তারা তাঁর কলহপ্রিয় সৎ-ভাইদের উপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।

তাঁরা তাঁর আম্মিজানকেও দেখে রাখবে। বাবরের অসময়োচিত মৃত্যুর পরে পার্থিব বিষয়ে মাহামের যে সামান্য আগ্রহ ছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিজের সন্তান সম্রাট হবার কারণে সে যদিও গর্বিত কিন্তু সে কখনও তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করে না বা খানজাদার মতো তাকে কোনো পরামর্শও দিতে আসে না। হুমায়ুন তাঁর সাথে যেটুকু সময় কাটায় সে তখন আকুল হয়ে কেবলই অতীতের কথা রোমন্থন করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে হয়তো বুঝতে পারবে যে ভবিষ্যতের ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকাই এখন হুমায়ুনের জন্য বাঞ্ছনীয়।

*

একটা বেলেপাথরের পাহাড়ী ঢালের উপর থেকে হুমায়ুন বাহাদুর শাহের সৈন্যদের লম্বা সারির দিকে তাকিয়ে থাকে, যারা তাঁর উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন, চারশো ফিট নীচে নদীর তীর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগোবার সময়ে পায়ের আঘাতে ধূলোর মেঘ সৃষ্টি করছে। বছরের এই সময়ে- মার্চ মাসের গোড়ার দিকে, সে আগ্রা ছেড়ে আসবার পরে ইতিমধ্যে দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে- নদীর বেশীর ভাগ অংশই শুকিয়ে গিয়েছে কেবল নদীগর্ভের গভীর অংশে কয়েকটা বিক্ষিপ্ত জলাশয় বিরাজ করছে। নদীর তীরে একটা বেমানান তালগাছ সবুজের স্পর্শ হয়ে বিরাজ করছে। হুমায়ুন সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত পদাতিক সেনাদলের সামনে পিছনে অশ্বারোহীবাহিনীর ছোট দল দেখতে পায় এবং এসব আয়োজনের ঠিক মধ্যে একটা মালবাহী গাড়ির একটা বিশাল সারি।

সাফল্যের হাসি লুকিয়ে রাখতে অপারগ, হুমায়ুন তার পর্যাণের উপরে ঘুরে বসে জওহরের সাথে কথা বলার অভিপ্রায়ে, এই অভিযানে তাঁর অনুচর- কর্চি হিসাবে সে তার সাথে এসেছে। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমাদের প্রেরিত রেকিদল ভালোই কাজ দেখিয়েছে আর আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে গুজরাতিদের কোনো ধারণাই নেই। এখন দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে পেছনে যার যেখানে আমরা আমাদের বাকি সঙ্গীসাথীদের রেখে এসেছি। তাদের বলবে আমার আদেশ পাহাড়ী ঢাল বরাবর তাঁরা এগিয়ে আসবে, কিনারা থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে যেন নীচে থেকে তাদের কেউ দেখতে না পায় যতক্ষণ না তারা মাইলখানেক বা আরো কিছুটা সামনে যেখানে ঢালটার নতি অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে আমাদের শত্রুর উপরে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে। তাদের বলবে আমি আমার দেহরক্ষীবাহিনী নিয়ে সেখানে তাদের সাথে যোগ দিব।

জওহর মাথা নাড়ে এবং ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওয়ানা দেয়। হুমায়ুন যখন তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে পাহাড়ের ঢালের কিনারা থেকে সরে এসে পূর্ব নির্ধারিত মিলনস্থলের দিকে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়, সে নিজের ভিতরে আশঙ্কা আর উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিজের ভিতরে অনুভব করে যুদ্ধের আগে সব সময়ে তার এমনই অনুভূত হয়, কিন্তু পূর্বের চেয়ে এবার দায়িত্ববোধের একটা বাড়তি বোঝা সে নিজের উপরে অনুভব করে। পূর্বে, তার মরহুম আব্বাজান, তিনি যদি সমূহ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে উপস্থিত নাও থাকতেন, পুরো অভিযানের সামগ্রিক পরিকল্পনা অনুমোদন করতেন আর সিংহাসন তাঁর আব্বাজানের এক্তিয়ারভুক্ত- তার নিজস্ব নয়- যা ছিল হুমকির মুখে। ভাবটা মাথায় আসতেই হুমায়ুনের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় এবং সে তার সাথের লোকদের কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করতে আদেশ দেয়। সে কি নিশ্চিত- যতটা নিশ্চিত তার পক্ষে হওয়া সম্ভব- যে তার পরিকল্পনা কার্যকরী হবে- সে কি অভিযানের প্রতিটা অনুষঙ্গ যথেষ্ট সময় নিয়ে যাচাই করেছে যাতে ভাগ্যের উপরে যতটা কম সম্ভব নির্ভর করতে হয়? সে যখন এসব ভাবনায় বিপর্যস্ত তখন সে দুটো খয়েরী রঙের অতিকায় বাজপাখিকে পাহাড়ী ঢলের আড়াল থেকে অনায়াস স্পর্ধায় উপরের মেঘহীন নীল আকাশের দিকে উড়ে যেতে দেখে প্রসারিত ডানায় উষ্ণ বাতাসের বরাভয় তাদের ঊর্ধ্বমুখী উড়ান নিশ্চিত করেছে। সহসা তাঁর মনে পড়ে যায় পানিপথের যুদ্ধের সময় দেখা সেই ঈগলদের কথা যা একটা শুভ লক্ষণ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই পাখিগুলোও নিশ্চিতভাবেই সেটাই আবারও প্রমাণিত করবে যখন সে তার গুজরাত অভিযানের প্রথম আঘাত হানতে চলেছে।

নিজের সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, হুমায়ুন তার অবশিষ্ট বাহিনীর সাথে মিলিত হবার জন্য নির্ধারিত মিলনস্থলে পৌঁছে। পুরো বাহিনী রণসাজে বিন্যস্ত হওয়া মাত্র, হুমায়ুন দ্রুত আক্রমণের আদেশ দেয় যা দুটো উপর্যুপরি ঢেউয়ের মতো পরিচালিত হবে। খাড়া উত্রাই বেয়ে বল্পিতবেগে নীচের দিকে ঘোড়া নিয়ে ধেয়ে আসা আক্রমণের প্রথম স্রোত, শত্রুর সেনাসারির পেছনের দিকটা সম্পূর্ণভাবে মোকাবেলা করবে। আক্রমণের পরের স্রোতটা সেনাসারির সামনের যোদ্ধাদের পুরোপুরি ঘিরে ফেলবে যখন তারা থমকে থেমে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে তখন তাদের মাঝে সৃষ্ট বিভ্রান্তি কাজে লাগিয়ে আক্রান্ত পেছনের যোদ্ধাদের সহায়তা করতে সম্মুখের যযাদ্ধারা এহেন আচরণ করতে বাধ্য। হুমায়ুন ময়ান থেকে তার আব্বাজানের প্রিয় তরবারি আলমগীর বের করে এর রত্নখচিত বাটে চুমু খায় এবং তার লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, তোমাদের মনে নিয়ে এসো যোদ্ধার তেজস্বিতা আর কণ্ঠে বীরের দম। আমাদের সদ্য জয় করা ভূখণ্ড রক্ষার জন্য আমরা লড়াই করছি। এসব অহঙ্কারী ভূঁইফোড়দের কাছে আমরা প্রমাণ করবো যে সাহসিকতার জন্য আমাদের সনাতন খ্যাতি আমরা হারিয়ে ফেলিনি। তারপরে মাথার উপরে উত্তোলিত তরবারি আন্দোলিত করে হুমায়ুন আক্রমণের ইঙ্গিত করে এবং কাছাকাছি অবস্থানরত দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে তাঁর বিশাল কালো স্ট্যালিয়নের পাঁজরে খোঁচা দিয়ে ঢাল বেয়ে আক্রমণের জন্য ধেয়ে যায়।

পাহাড়ের গা বেয়ে তারা যখন নীচের দিকে ধেয়ে আসে, পাথরকুচি আর লাল ধূলো তাদের চারপাশে উড়তে থাকে, এরই ভিতরে সে তার সামনে গুজরাতি সেনাদলকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে যখন লোকগুলো তাঁর দিকে ঘুরে তাকায় কিসের এতো শোরগোল সেটা দেখতে। পুরোপুরি অপ্রস্তুত গুজরাতিরা প্রথমে ইতস্তত করে এবং তারপরে তাদের জন্য সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এমন শ্লথ ভঙ্গিতে তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে শুরু করে, তাদের যুদ্ধাস্ত্রের জন্য হাতড়াতে থাকে এবং চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে চারপাশে তাকাতে থাকে তাদের আধিকারিকদের খোঁজে দেখতে চায় তাদের কি আদেশ। কালো শুশ্রুমণ্ডিত এক লোক বাকিদের চেয়ে অনেক দ্রুত, লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামে এবং তার পর্যাণের সাথে মোটা কাপড়ের ব্যাগের সাথে বাঁধা মাস্কেট টেনে বের করতে চেষ্টা করে।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার মুখ বন্দুকধারীর দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং ডানহাতে নিজের তরবারি আকড়ে ধরে সে যখন তার ঘোড়ার গলার কাছে নুয়ে এসে তার বাহনকে বিড়বিড় করে সামনে ধেয়ে যেতে বলে, নিয়তি আর নেতৃত্বের সব ভাবনা তার মন থেকে তিরোহিত হয়ে সেখানে ভর করে মারা, মরা, বেঁচে থাকার আন্ত্রিক প্রবৃত্তি। নিমেষের ভিতরে সে লোকটার কাছে পৌঁছে যায়, যে তখনও তার মাস্কেটে বারুদ ভরার জন্য কসরত করে চলেছে। হুমায়ুন তার শশ্রুমণ্ডিত মুখ বরাবর তরবারি চালায় এবং লোকটার ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলে সে মাটিতে আক্রমণকারী অশ্বারোহী বাহিনীর খুরের নীচে পরে যায়। হুমায়ুন ততক্ষণে শত্ৰুসারির অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছে, অশ্বারূঢ় হয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সময়ে সে দুপাশে পাগলের মতো তরবারি চালাতে থাকে। অকস্মাৎ ভীড়ের মাঝ থেকে বের হয়ে আসতে সে তার হাঁপাতে থাকা, উত্তেজনায় নাক টানতে থাকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তার বাকি লোকেরা অচিরেই তার চারপাশে এসে জড়ো হয়।

অবিলম্বে যথেষ্ট লোক তাঁর সাথে সমবেত হলে, হুমায়ুন দ্বিতীয়বারের মতো শত্রুর সেনাসারির দিকে ফিরতি আক্রমণ শানায়। এক ঢ্যাঙা গুজরাতি তার হাতের বাঁকান তরবারি দিয়ে তাঁকে আঘাত করলে সেটা বুকের বর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং হুমায়ুনকে তাঁর পর্যাণে ছিটকে ফেলে। হুমায়ুন যখন তার পিছু হটতে থাকা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে প্রাণান্ত হচ্ছে, সেই সুযোগে গুজরাতি সেনাটা এবার তার দিকে ঘোড়া নিয়ে ধেয়ে আসে এবং নিজের প্রতিপক্ষকে খতম করার অতি-উৎসাহে, হুমায়ুনের মস্তক বরাবর সে তার আন্দোলিত তরবারির নিশানা স্থির করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুন তরবারির আগ্রাসী ফলার নীচে ঝুঁকে যায় যা তাঁর শিরস্ত্রাণের সামান্য উপর দিয়ে বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। গুজরাতি নিজের ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই, হুমায়ুন দ্রুত আলমগীরের ফলা এক ধাক্কায় তাঁর উদরের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটা তরবারি ফেলে নিজের ক্ষতস্থান চেপে ধরতে, হুমায়ুন ঠাণ্ডা মাথায় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিপক্ষের গলার পেছনে আঘাত করে, কাঁধ থেকে তাঁর মাথা প্রায় আলাদা করে ফেলে।

নিজের চারপাশে তাকিয়ে, আন্দোলিত লাল ধূলোর ভিতর দিয়ে হুমায়ুন দেখে যে গুজরাতি সেনাসারি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর কিছু সৈন্য আতঙ্কে ঘোড়া দাবড়ে পালাচ্ছে। সেনাসারির মাঝে অবস্থানরত অন্যেরা অবশ্য দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে, মালবাহী গাড়িগুলো রক্ষা করছে যেগুলোতে সম্ভবত কামান আর মালপত্র আছে। হুমায়ুন ভালো করেই জানে সে যদি তাদের বন্দি করতেও সক্ষম হয় তবুও সে কোনো কামান বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না কারণ সেগুলো তার বাহিনীর অগ্রসর হবার গতি মন্থর করে দেবে যাদের মূল লক্ষ্যই হল দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। অবশ্য কামানগুলো সে অকেজো করে দিতে পারে। নিজের ধমনীতে টগবগ করতে থাকা যুদ্ধের উন্মাদনার সাথে এবং তাকে অনুসরণ করার আদেশ ঘোষিত করার জন্য তাঁর তূর্যবাদককে চিৎকার করে আদেশ দিয়ে, হুমায়ুন ঝড়ের বেগে কোনো সময় নষ্ট না করে মালবাহী গাড়িগুলোর দিকে ছুটে যায়।

অকস্মাৎ একটা মাস্কেটের গুলিবর্ষণের শব্দ তার কানে ভেসে আসে- তারপরে আরেকটা মাস্কেটের। গুজরাতি বন্দুকবাজদের কয়েকজন অবশেষে নিজেদের মাস্কেট কার্যক্ষম করতে সক্ষম হয়েছে এবং মালবাহী গাড়িগুলোকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে তারা গুলিবর্ষণ করছে। হুমায়ুনের কাছ থেকে দশ গজ দূরে ছুটন্ত ঘোড়াগুলোর একটা আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং ধূলোর ভিতরে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং পিঠের আরোহীকে মাটিতে ছিটকে ফেলে, তাকে অনুসরণরত সহযোদ্ধাদের ঘোড়াগুলো তাঁকে নিজেদের খুরের তলায় পিষে ফেলার আগে সে মাটিতে শুয়ে এক মুহূর্তের জন্য ছটফট করে, তার দেহে প্রাণের শেষ স্পন্দটুকুও শেষ হয়ে যায়।

হুমায়ুন ভালো করেই জানে বন্দুকধারীরা তাদের বন্দুকে পুনরায় বারুদ ভরার আগেই তাকে মালবাহী গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে। আরো একবার আলমগীর আন্দোলিত করে, সে নিজের ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয় এবং প্রায় সাথে সাথে গাড়িগুলোর মাঝে গিয়ে উপস্থিত হয়। এক বন্দুকবাজকে লক্ষ্য করে সে তরবার চালনা করে যে কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে তাঁর মাস্কেটের লম্বা নলে ধাতব বলটা একটা ইস্পাতের শলাকার সাহায্যে প্রবিষ্ট করার প্রচেষ্টায় রত। লোকটার মুখে তরবারির ফলা আঘাত হানতে, হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষ মাল বোঝাই গাড়িগুলোকে টেনে এনে কোনো ধরনের রক্ষণাত্মক বিন্যাস তৈরী করার অবকাশ পায়নি আর তাই হুমায়ুনের লোকেরা, যারা তার পেছন পেছন এসে হাজির হয়, অনায়াসে তাঁদের ঘিরে ফেলে এবং প্রতিটা আলাদা আলাদা গাড়ীর রক্ষীদের পরাভূত করে। গুজরাতি অশ্বারোহী বাহিনীর আরও সেনাসদস্য ঘোড়া দাবড়ে পালায় এবং পদাতিক বাহিনীর সেনা আর সেনাবাহিনীর সাথে আগত অন্যান্য লোকেরা এরপরে কে কত দ্রুত পালাতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।

প্রতিরোধ শেষ- নিদেনপক্ষে এখনকার মতো। হুমায়ুন অবশ্য ভালো করেই জানে যে তাঁর সাথে যে লোক রয়েছে তাদের সংখ্যা বাড়াবাড়ি ধরনের কম আর এই বিষয়টা যখন গুজরাতি বাহিনীর আধিকারিকেরা লক্ষ্য করবে তখন তারা চেষ্টা করবে দলবদ্ধ হয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে। আর তাই নষ্ট করার মতো সময় তাঁদের হাতে নেই। হুমায়ুন তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ক্ষুদে দলকে আদেশ দেয় পলাতকদের পিছু ধাওয়া করতে আর তাঁদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ করার নির্দেশ দেয় কিন্তু কয়েক মাইলের বেশী ধাওয়া করতে নিষেধ করে এরপরে ফিরে এসে একটা চলনসই রক্ষণাত্মক ব্যুহ তৈরীর আদেশ দেয়। সে অন্য লোকদের মালবাহী গাড়িতে কি রয়েছে সেটা দেখতে বলে। তারা সাগ্রহে আদেশ পালন করতে এগিয়ে যায় এবং চটের ভারী আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলতে ভেতরে ছয়টা মাঝারি মাপের কামান, প্রয়োজনীয় বারুদ, কামানের গোলা আর সেই সাথে নতুন তৈরী করা বর্শার একটা গোছা আর পাঁচ বাক্স মাস্কেট দেখতে পায়।

আমরা মাস্কেটগুলো সব নেব। বাক্সগুলো খালি কর। আমাদের সাথে বাড়তি ঘোড়ার পর্যাণে মাস্কেটগুলো গোছা করে বেঁধে দাও। কামানের নলে যতগুলো বারুদ ভর্তি কাপড়ের ব্যাগ প্রবেশ করান যায়, প্রবেশ করাও আর তারপরে মাটিতে বারুদের একটা রেখা তৈরী করে ওখানে ঐ পাথরের পেছনে নিয়ে যাও। পাথরের পেছন থেকে আমরা বারুদে অগ্নি সংযোগ করবো, হুমায়ুন বলে।

সোয়া এক ঘন্টা পরে সব কাজ শেষ হয়। হুমায়ুন তাঁর বেশীর ভাগ লোককে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেয় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ তদারকি করতে নিজে কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে পেছনে থেকে যায়। বারুদে অগ্নি সংযোগের সম্মান সে দীর্ঘদেহী এক তরুণ বাদশানীর উপরে অর্পণ করে বেচারা চকমকি পাথরের বাক্স নিয়ে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে স্ফুলিঙ্গ তৈরীর জন্য কসরত করতে থাকে। সে শেষপর্যন্ত যখন সফল হয়, বারুদের জ্বলন্ত শিখা মাটির উপর দিয়ে ক্রমান্বয়ে থুতু ফেলার মতো একটা শব্দের জন্ম দিয়ে এগিয়ে যায়। একটা ছোট পাথরের সাথে প্রান্ত ঘেঁষে যাবার সময় এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় শিখাটা বুঝি নিভে যাবে কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটা আবার সামনে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে। প্রায় সাথে সাথে এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে আরও পাঁচটা বিস্ফোরণের শব্দ এর পরপরই শোনা যায়। প্রতিটা কামানের নলের ভিতরে বারুদের বিস্ফোরণ ঘটেছে।

ধূলো আর উৎক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষের টুকরো থিতিয়ে আসতে হুমায়ুন, বিস্ফোরণের বিকট শব্দে তখনও কানে তালা লেগে রয়েছে, দেখতে পায় যে চারটা নল লম্বালম্বিভাবে ফেটে গিয়ে পেছনের দিকে বেঁকে এসেছে ঠিক অনেকটা কলার খোসা ছাড়াবার মতো। আরেকটা আক্ষরিক অর্থেই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ষষ্ঠ কামানের নলে কেবল ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে- হুমায়ুন ভাবে, কামানটাকে অকেজো করতে এটাই যথেষ্ট। তাঁর লোকেরা এবার দ্রুত ফিরে আসে এবং অবশিষ্ট মালবাহী গাড়িগুলোতে মূল্যবান দ্রব্যের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কেউ একজন কিছু রেশমের কাপড় খুঁজে পায়, অন্য আরেকজন একটা সিন্দুকের তালার ভিতরে তাঁর খঞ্জরের অগ্রভাগ প্রবিষ্ট করিয়ে সিন্দুকটা জোরপূর্বক খুলতে চায় ভেতরে মূল্যবান কোনো পাথর আছে কিনা দেখতে।

হুমায়ুন এর ভেতরেই তার অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সদস্যকে যাদের উপরে সে রক্ষণাত্মক ব্যুহ তৈরীর আদেশ দিয়েছিল ঘোড়া দাবড়ে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে। সুলতান, গুজরাতিরা পুনরায় একত্রিত হয়েছে। আক্রমণের জন্য তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছে, আমরা সংখ্যায় কত অল্প সেটা এখন তাদের চোখে পড়েছে।

আমরা অবশ্যই ফিরে যাব। তূর্যবাদক পশ্চাদপসারণের-সঙ্কেত ধ্বনিত কর। আমরা পাহাড়ের ঢালের উপরে গিয়ে অবস্থান নেব। তারা আমাদের অনুসরণ করার মতো মূর্খতা দেখাবে না। তারা ভালো করেই জানে যে উপরে উঠার প্রয়াসরত অবস্থায় তারা যদি আমাদের আক্রমণের সুযোগ দেয় তবে তার মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

বিশ মিনিট পরে, বেলেপাথরের সেই ঢালের উপর থেকে নীচের দিকে সেনাসারির ধ্বংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন গুজরাতিদের সেখানে জটলা করতে দেখে। কয়েকজন অতিলোভী নির্বোধ ছাড়া, যারা লুটের সম্ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে মালবাহী গাড়ির দ্রব্যসামগ্রী তল্লাশি করতে অনর্থক দেরী করেছিল, তার বাকি লোকেরা নিরাপদেই ফিরে এসেছে। তাদের ভিতরে, হুমায়ুন বিষণ্ণ মনে ভাবে, সেই তরুণ বাদশানীও রয়েছে, পাহাড়ী ঢালের উদ্দেশ্যে অনেক দেরীতে ঘোড়া ছোটালে পিঠে তীরবিদ্ধ হয়ে বেচারা মাটিতে আছড়ে পড়েছে। তার পর্যাণের সাথে নকশি করা গোলাপি রেশমের চোঙের মতো গোল করে পাকানো রোলের পাক খুলে গিয়ে তার সওয়ারীবিহীন ঘোড়ার পেছনে অবাধে মাটিতে লুটাচ্ছে।

*

চোখের সামনে ওখানে রয়েছে- লম্বা তালগাছের সারি এবং কমলালেবুর ধুসর খোসার মতো বালির পরেই দীপ্তিময় সমুদ্রে মধ্যাহ্নের সূর্যের আলো এমন তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয় যে হুমায়ুন বাধ্য হয় হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আড়াল তৈরী করতে। শক্রর সৈন্যসারির উপরে সাফল্যের সাথে ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করার পরে হুমায়ুন তাঁর সাথের তিন হাজার সৈন্যের বহরের অর্ধেক সৈন্য তাঁর মূল বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য পাঠিয়ে দেয়, যা এই মুহূর্তে অবরোধের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আর অনুষঙ্গ নিয়ে মোগল ভূখণ্ড থেকে চম্পনীর জঙ্গলবেষ্টিত দূর্গের অভিমুখে খুব ধীরে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।

হুমায়ুন বাছাই করা দেড় হাজার অশ্বারোহীর একটা চৌকষ বাহিনী নিয়ে নিজে গুজরাতের আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, যেখানেই শত্রুসেনার কোনো বাহিনীকে খুঁজে পায় সেখানেই তাঁদের পরাস্ত আর বিপর্যস্ত করে তুলে। সে নিশ্চিত, তার মূল বাহিনী কোথায় আসল আঘাত হানবে সে বিষয়ে গুজরাতিদের বিভ্রান্ত আর অনিশ্চিত করে তুলতে সে সফল হয়েছে; ঠিক যেমন সে পরিকল্পনা করে এসেছিল। ঝটিকা আক্রমণের সময়ে ধৃত গুজরাতিদের মুখে সামরিক উপকরণ আর বাণিজ্যিক পণ্য বহনকারী একটা কাফেলা কাম্বের সমুদ্র বন্দরের অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে জানতে পেরে সেটার পশ্চাদ্ধাবন করে সে সমুদ্রের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। হুমায়ুন ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় যে সে কাফেলাটাকে খুঁজতে চেষ্টা করেছিল। সে জওহরকে তার পাশে ডাকে। আমার আদেশ জানিয়ে দাও যে মধ্যাহ্নের খরতাপে আমরা তালগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেব আর নিজেদের সতেজ করে নেব আর সেই সময়ে আমাদের অনুসন্ধানী দূত কাফেলাটার খোঁজ করবে। সেটার এখন আর খুব একটা বেশী দূরে অবস্থান করার কথা না। বস্তুতপক্ষে, আমরা যা জানতে পেরেছি সেটা সত্যি হলে কাম্বে বন্দরের দূরত্ব এখান থেকে দশ মাইলের বেশী হবার কথা না, সমুদ্রের উপকূলের উত্তরপশ্চিমে কোথায় সেটা রয়েছে। প্রহরী আর প্রতিহারী মোতায়েনেরও আদেশ জানিয়ে দাও যাতে করে কেউ আমাদের যেন চমকে দিতে না পারে।

সম্রাটের অভিপ্রায় জেনে নিয়ে জওহর যখন ঘুরে দাঁড়ায়, হুমায়ুন তার বিশাল কালো ঘোড়াটার পাঁজরে আলতো করে গুতো দিতে সেটা তাল গাছের নীচে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তালগাছের গাঢ় সবুজ রঙের লম্বা, তীক্ষাগ্র পাতাগুলো সমুদ্র থেকে আগত এবং নরম বালির উপর দিয়ে প্রবাহিত বাতাসে আন্দোলিত হয়ে মরমর শব্দ করছে। হুমায়ুন এখানে লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে। দাঁড়িয়ে পায়ের জুতো জোড়া খুলে ফেলে সে সোজা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যায়, সে খুব ভালো করেই জানে যে এমনটা করার ব্যাপারে তাদের পরিবারের ভিতরে সেই প্রথম। পায়ের ডিসের নীচের অংশে এসে আছড়ে পড়া পানি শ্রান্তিহর শীতল। পুনরায় নিজের চোখে উপরে হাত দিয়ে একটা আড়াল তৈরী করে সে সোনারমতো চকচক করতে থাকা, দীপ্তিময় দিগন্তের দিকে তাকায়। সে ভাবে সেখানে সে হয়তো একটা জাহাজের অবয়ব দেখতে পেয়েছে–সম্ভবত কাম্বের সাথে বানিজ্য করে তাদেরই কোনো একটা জাহাজ হবে। তাঁরা কি ধরনের মাল বহন করে? তারা কি ধরনের লোক? দিগন্তের ওপাশে কি আছে, এমনকি আরব এবং পবিত্র নগরীদ্বয়ের ওপাশে? সেখানে কি নতুন জ্ঞান আহরণে পর্ব চলছে? সেখানে নতুন শত্রুরা ওঁত পেতে রয়েছে নাকি কেবলই ধুধু বিরান প্রান্তর নাকি অনন্ত সমুদ্র?

হুমায়ুনের নিঃসঙ্গ ভাবনার স্রোত জওহরের চিৎকারের ফলে বিঘ্নিত হয়। সুলতান, আপনার আধিকারিকেরা আপনার সাথে পরামর্শ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। আপনি কি অনুগ্রহ করে তাঁদের সাথে আহার করবেন? আপনি অনেকক্ষণ ধরেই নিবিষ্ট মনে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং আপনার চারধারে পানি বাড়ছে। কথাটা সত্যি। সেই ছোট ঢেউগুলো এখন ফিরে যাবার আগে হুমায়ুনের হাঁটু ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছাসত্তেও সে বিমূর্ত ভাবনার জগৎ থেকে, যা সবসময়ে তাকে আনন্দ দান করে থাকে, বর্তমানের বাস্তবতায় নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং আধিকারিকেরা তালগাছের নীচে টকটকে লাল চাঁদোয়ার তলায় আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে যেখানে প্রতীক্ষা করেছে সেদিকের উদ্দেশ্যে হাঁটতে আরম্ভ করে।

দশ মিনিট পরে, আহমেদ খান, তাঁর প্রধান অনুসন্ধানী দূত, কাবুলের দক্ষিণে, গজনীর পাহাড়ী এলাকা থেকে আগত পাগড়ি পরিহিত পাকান শরীরের ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবককে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, তাঁর কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে এসে তার পাতলা খয়েরী দাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। উপকূলের প্রান্তে তালগাছের চওড়া সারির ঠাস বুনোটের অন্যপাশে সমুদ্র থেকে সোয়া মাইলের মতো ভিতরে অবস্থিত একটা রাস্তা দিয়ে কাফেলাটা এগিয়ে আসছে, এই মুহূর্তে সেটা পাঁচ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থান করছে। কাম্বে শহর থেকে সেটা চার মাইল মতো দূরে রয়েছে, যা ওখানে অবস্থিত ঐ নীচু শৈলান্তরীপের কারণে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে।

আমরা সমুদ্র সৈকতের উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে তালগাছের সারির অন্যপাশে যাব এবং তারা কাম্বে পৌঁছান মাত্র অতর্কিতে তাঁদের আক্রমণ করবো। আল্লাহতালা আমাদের সহায় থাকলে, আমরা হয়ত এমনকি বলপ্রয়োগের দ্বারা বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য নিজেদের পথ করে নিতে পারবো যদি কেবল কাফেলাটাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার জন্য তোরণদ্বার খোলা থাকে।

মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই, হুমায়ুনের ঘোড়া বালুর প্রান্ত বরাবর আস্কন্দিত বেগে ছুটতে থাকে তার চারপাশে, তাঁর দেহরক্ষীর দল খুব কাছ থেকে তাঁকে ঘিরে রেখেছে। এক ঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে তাঁরা পাথুরে শৈলান্তরীপ অতিক্রম করে এবং তালগাছের নিরবিচ্ছিন্ন আড়ালে অবস্থান করে। হুমায়ুন কাম্বে বন্দরে স্থির হয়ে ভেসে থাকা বা বন্দরের বাইরে নোঙ্গরবদ্ধ অবস্থায় থাকা সব জাহাজের মাস্তুল আর পাল দেখতে পায়। কাফেলাটা, যার ভিতরে রয়েছে মালের ভারে টলমল করতে থাকা উট, ভারবাহী হাতি আর তার সাথে খচ্চর আর গাধার পাল, অবসন্ন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বন্দরের ক্ষুদ্র বসতিকে ঘিরে থাকা মাটির দেয়ালে অবস্থিত এখন হাট করে খোলা অবস্থায় রয়েছে এগিয়ে যায়। দেয়ালটা দেখেও খুব একটা উঁচু মনে হয় না–সম্ভবত কেবল দুই মানুষ পরিমাণ উঁচু। কাফেলার রক্ষীদল, সব মিলিয়ে যাঁর জনবল প্রায় চারশোর কাছাকাছি, অশ্বারূঢ় হয়ে এর দুইপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে কিন্তু তাদের দেখে ক্লান্ত মনে হয়, মধ্যাহ্নের খরতাপে মাথা নোয়ানো সেইসাথে তাদের প্রত্যেকের তরবারি কোষবদ্ধ আর ঢাল তাদের পিঠের সাথে আটকানো।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তার লোকদের মূল দলের কাছে ফিরে এসে হুমায়ুন, চেঁচিয়ে বলে, এখনই আক্রমণ করতে হবে। আমরা তাদের ভড়কে দেব। উট আর হাতির দলটাকে আতঙ্কিত করতে চেষ্টা করবে। তাহলে তাঁরাই গুজরাতি রক্ষীবাহিনীর বারোটা বাজিয়ে দেবে। হুমায়ুন এসব কথা বলার মাঝেই নিজের বিশাল কালো ঘোড়াটার পাঁজরে গুতো দেয়, যার পুরো দেহটা ইতিমধ্যেই বিন্দু বিন্দু তেলতেলে ঘামে ভিজে গিয়েছে এবং অচিরেই তাল গাছের ভিতর দিয়ে নিজের লোকদের সাথে নিয়ে সে, বন্দরের তোরণদ্বার আর কাফেলা থেকে তাঁকে পৃথককারী, আধ মাইল বিস্তৃত পাথুরে, বালু ঢাকা পটভূমির উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে ঘোড়া হাকায়। তার আদেশ পাওয়া মাত্র, তার সবচেয়ে অভিজ্ঞ তীরন্দাজদের কয়েকজন দাঁত দিয়ে ঘোড়ার লাগাম কামড়ে ধরে রেকাবের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে কাফেলার অবস্থান লক্ষ্য করে এক পশলা তীর ছুঁড়ে দেয় ঠিক যখন এর রক্ষীবাহিনী বুঝতে পেরেছে যে তাঁদের উপরে আক্রমণ করা হয়েছে। কয়েকটা তীর একটা হাতিকে আহত করলে বেচারা তাঁর দেহের মোটা চামড়া ভেদ করে প্রবিষ্ট শরযষ্টিসহ ঘুরে গিয়ে, ব্যাথায় আর্তনাদ করতে করতে তাঁকে অনুসরণরত কয়েকজনকে মাড়িয়ে ছুটে গেলে, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

ব্যাথায় চাপা আর্তনাদ করে একটা উট ভূমিশয্যা নেয়, ব্যাথায় ছটফট করতে করতে বেচারা বালিতে আছড়ে পড়লে অবোধ জটার পিঠে বাঁধা মালপত্র চারদিখে ছড়িয়ে পড়ে, উটটার বিশাল, তুলতুলে মাংসল পা বাতাসে বৃথাই আন্দোলিত হয়। আরেকটা উট, কালো পালকযুক্ত একটা তীরে এফোড়-ওফোড় হয়ে যাওয়া লম্বা গলা নিয়ে, দুলকি চালে সাগরের দিকে ছুটে যায়। প্রায় সাথে সাথেই হুমায়ুন এবং তার লোকেরা রক্ষীবাহিনীর দুর্বল সারির ভিতরে ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে দুপাশে উন্মত্তের মতো তরবারি চালাতে থাকে। কিছু গুজরাতি আক্রমণের প্রথম ধাক্কা সামলাতে না পেরে আক্ষরিক অর্থেই ভূপাতিত হয়। সামান্য যে কয়েকজন নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, ঘুরে দাঁড়িয়ে অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখোমুখি হবার চেষ্টা করেছিল তাদের স্রেফ কচুকাটা করা হয়। বেশীরভাগই অবশ্য এতসব ঝামেলায় না গিয়ে নিজেদের ঘোড়ার গলা বরাবর ঝুঁকে নীচু হয়ে তখনও ভোলা থাকা কাম্বের প্রধান তোরণ-দ্বারের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছোটার জন্য জন্তুগুলোকে মিনতি করে।

হুমায়ুন আর তার দেহরক্ষীর দল তাদের পিছু ধাওয়া করে। বেশভূষায় আধিকারিকের মতো দেখতে একজনকে তার অধীনস্ত দুজন লোকের সাথে পালিয়ে যেতে দেখে হুমায়ুন যত জোরে সম্ভব ঘোড়া দাবড়ায়। ঘাড়ের উপরে হুমায়ুনের উপস্থিতি টের পেয়ে, পলায়নপর আধিকারিক ঘুরে তাকিয়ে নিজের সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচাবার জন্য নিজের পিঠের সাথে বাঁধা ঢালটা আকড়ে ধরতে চেষ্টা করে। ঢালটা সে ঠিকমতো আকড়ে ধরার আগেই, হুমায়ুনের তরবারির ধারালো ফলা বেচারার ধাতব শৃঙ্খলে নির্মিত বর্মের ঠিক উপরে লোকটার মোটা আর পেষল গলায় একটা গভীর ক্ষতস্থানের জন্ম দিলে, সে ঘোড়া থেকে আছড়ে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার গড়াগড়ি করে এবং একটা সময়ে স্থির হয়ে যায়।

চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে হুমায়ুন কাম্বের তোরণ-দ্বারের নীচে পৌঁছে যায়। উল্টে থাকা একটা টেবিল এড়াতে সে প্রাণপনে টেনে ঘোড়াটা ঘুরিয়ে নেয়, নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায় যে শুল্ক বা কর আদায়ে নিয়োজিত আধিকারিকেরা কিছুক্ষণ আগেই এখান থেকে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেছে, মূল ফটকের পাশে অবস্থিত বাড়িটার পেছনে একটা ছোট চত্বরে সে শীঘ্রই এসে পৌঁছে। সেখানে বোধহয় পূর্ণোদ্যমে একটা বাজার বসেছিল। সেখানের সামনের দিকে উন্মুক্ত ছোট ছোট দোকানগুলোয় যারা ছিল বোঝাই যায় তাঁরা ব্যস্ততার সাথে সেখান থেকে চলে গিয়েছে, আতঙ্কে উজ্জ্বল বর্ণের মশলা ভর্তি ব্যাগগুলো ধূলোয় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, মাটিতে শস্যকণা পড়ে রয়েছে সেখানে উল্টে যাওয়া একটা জালা থেকে গড়িয়ে আসা দুধ আর কমলা রঙের মসুর ডালের সাথে এখন দারুণ সখ্যতা তার। সৈন্যদের টিকিটাও কোথাও দেখা যায় না। কাফেলার রক্ষীবাহিনীর মতোই, কাম্বের প্রতিরক্ষায় যারা নিয়োজিত ছিল তাঁরা বোধহয় লড়াই করার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। গুটিকয়েক দোকানমালিক যারা পালিয়ে যেতে পারেনি। বেশীর ভাগই শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ বা প্রায় কালো পোষাকে সজ্জিত মহিলা- সবাই তাদের আক্রমণকারীদের সামনে বালিতে মুখ গুঁজে বশ্যতা প্রকাশের ভঙ্গিতে নিজেদের প্রণত করে। সৈন্যদের বসবাসের ব্যারাকটা কোথায় খুঁজে বের কর। সেখানে যদি কোনো সৈনিককে দেখতে পাও তাকে সাথে সাথে বন্দি করবে। বন্দরে অবস্থানরত জাহাজ আর গুদামঘর থেকে তোমাদের যা ইচ্ছে নিতে পার। বাকিটা পুড়িয়ে দেবে। কেবল লক্ষ্য রাখবে তোমাদের মালপত্রের ভার যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। সূর্যাস্তের আগেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। কাম্বে বন্দরে আমাদের হামলার খবর যখন গুজরাতিদের কানে যাবে, তারা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে এতটাই শঙ্কিত আর অনিশ্চিত হয়ে পড়বে যে যখন তাঁরা চম্পনীর হুমকির সম্মুখীন জানতে পারবে তখন তাঁদের মূলবাহিনী কোথায় মোতায়েন করবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সেই দূর্গ আক্রমণকারী আমাদের মূলবাহিনীর সাথে পুনরায় মিলিত হবার জন্য আমাদের দ্রুত এখান থেকে ফিরে যেতে হবে। আমরা সেখানেই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবো যার ফলে গুজরাত আমাদের করায়ত্ত হবে।

১.৩ লুট করা সমৃদ্ধি

০৩. লুট করা সমৃদ্ধি

জওহর, আমার জন্য লেবুর রস দেয়া সেই পানিটা নিয়ে এসো- হিন্দুরা এটাকে কি বলে? লিম্বু পানি? এই গরমে সেটা বেশ সতেজ করে তুলে। হুমায়ুন চম্পনীর দূর্গের বাইরে তাঁর সুরক্ষিত সৈন্য শিবিরের ঠিক মাঝে তার লাল রঙের বিশাল তাবুতে দাঁড়িয়ে যেখান থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাবুর গুটিয়ে রাখা নিম্নপ্রান্তের ভিতর দিয়ে, সে দুই-মাইল-দীর্ঘ পাথুরে শিলাস্তরের এক প্রান্তে দূৰ্গটার পাথরের তৈরী অতিকায় অবয়ব দেখতে পায় যা জঙ্গলের করকটে গাছগাছালির মাথার উপরে ভেসে রয়েছে গ্রীষ্মের দাবদাহে সবগুলো গাছের পাতা শুকিয়ে বাদামী আর সোনালী বর্ণ ধারণ করেছে।

আজ থেকে ছয় সপ্তাহ পূর্বে হুমায়ুন অবরোধ-যজ্ঞে এসে শামিল হয়েছে। নিজের পরিষদমণ্ডলীর সাথে সে প্রথমে যেমন আলোচনা করেছিল, তার আধিকারিকেরা নিজেদের অবস্থান অবরোধক আর উভয়পার্শ্বে কামান স্থাপন করে সুরক্ষিত করেছে যাতে করে তারা অবরুদ্ধদের দ্বারা অবরোধকারীদের উপরে পরিচালিত যে কোনো আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে আর সেই সাথে অবরুদ্ধদের স্বস্তি দিতে আগত বাহিনীকে সাফল্যের সাথে প্রতিহত করতে পারবে তারা এই বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। সেই বাহিনী এখনও এসে পৌঁছায়নি আর গুপ্তদূতেরা তাঁদের আগমনের কোনো লক্ষণ এখনও পর্যন্ত বিবরণীতে উল্লেখ করেনি। শোনা যায় যে বাহাদুর শাহ তাঁর ভূখণ্ডের দক্ষিণের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত উচ্চভূমিতে অবস্থান করছেন। তিনি সম্ভবত দূর্গের শক্তিমত্তায় বিশ্বাস করেন, এবং এখানে অবস্থিত সৈন্যদের ব্যারাক হুমায়ুন আর তাঁর দলবলকে বিদায় জানাবার জন্য যথেষ্ট।

হুমায়ুন তন্ময় হয়ে ভাবে, যদি সেটা হয়ে থাকে তবে এখনও পর্যন্ত তার ধারণাই সঠিক বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। সে আর তার ঝানু পোড় খাওয়া সেনাপতিরা সম্ভাব্য সব উপায়ে চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু সাফল্য তাঁদের ধরা দেয়নি। দূর্গের চওড়া পাথরের দেয়ালে তাঁদের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, কিন্তু গোলন্দাজ বাহিনীর অনেক সদস্য দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদ থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে যখন তাঁরা কামানগুলোকে কার্যকর রাখতে প্রযত্ন হয়েছে। গোলন্দাজেরা একবার যখন দূর্গের দেয়ালের একটা ক্ষুদ্র অংশ ভেঙে ফেলতে সফল হয় তখন হুমায়ুনের লোকেরা যখন পাথরে ভাঙা টুকরো টপকে এবং তার ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, গুজরাতিরা তাদের মাস্কেট দিয়ে হুমায়ুনের লোকদের দিকে গুলি করে পাখির মতো তাদের ধরাশায়ী করেছে। তাঁর লোকদের ভেতরে যারা প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল, তারা পরবর্তীতে নিজেদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছে দূর্গ অভ্যন্তরে আরেকটা দেয়াল রয়েছে, গুজরাতিরা যার আড়াল ব্যবহার করে তাঁদের উপরে বুলেট আর তীর নিক্ষেপ করেছে এবং সাফল্যের সাথে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। অন্য আরেকবার, পাথরের দূর্গ প্রাচীরের উন্মুক্ত পরিসরে খুব ভালোভাবে সুরক্ষিত গুজরাতি কামানগুলো, সামনাসামনি আক্রমণের একটা ধাক্কা ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয় মোগলরা তখনও তাদের দেয়াল বেয়ে উঠবার মইগুলো স্থাপণ করার জন্য দূর্গ প্রাচীরের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি।

মৃত মোগল যযাদ্ধাদের কালো হয়ে যাওয়া এবং পচে ফুলে উঠা দেহগুলো দূর্গ প্রাচীরের সামনে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থেকে পচনক্রিয়া শুরু হতে গা-গুলিয়ে উঠা মিষ্টি একটা গন্ধে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠে এবং সেই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে কালচে-বেগুনী রঙের ডুমো মাছির ঝাঁক এসে উপস্থিত হয় যার সংখ্যা এখন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাঁর পুরো শিবিরে এখন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। আহত সহযোদ্ধাদের উদ্ধার করতে বা মৃতদের লাশগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে এতো বেশী লোক প্রাণ হারায় যে রাতের আঁধার ব্যাতীত এমন প্রয়াসের প্রতি হুমায়ুন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বাধ্য হয় এবং তারপরেও হতাহতের সংখ্যা প্রচুর।

জওহর তাঁর প্রিয় পানীয় নিয়ে পুনরায় হাজির হলে ভাবনায় তখনকার মতো ছেদ পড়ে হুমায়ুনের। সে যখন শীতল উপভোগ্য তরল পান করছে তখন আরেকবার বাইরের দিকে তাকায় এবং মধ্যাহ্নের আকাশে কালো মেঘ জমতে দেখে। মেঘের রঙ আরো কালো হবে এবং আসন্ন বর্ষাকালের কারণে এখন আরো ঘন ঘন এমন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির কারণে দূর্গের অভ্যন্তরে অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের পানীয় জলের সমস্যা আপাতত মিটে যাবে আর হুমায়ুনের আক্রমণ প্রয়াসকে আরো বেশী কঠিন করে তুলবে। বর্ষাকাল তাঁর শিবিরে রোগের প্রাদুর্ভাব বয়ে আনতে পারে।

জওহর, স্থানীয় লোকেরা কি বলে আশেপাশের এলাকায় কখন বৃষ্টি হয়?

সুলতান, জুলাই মাসের মাঝামাঝি।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়, সে মনঃস্থির করে ফেলেছে। আমাদের অবশ্যই তার আগে এখানে আসবার উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে। আমাদের সামনাসামনি আক্রমণ একেবারেই ফলপ্রসু হচ্ছে না। আমাদের বিকল্প কিছু একটা খুঁজে বের করতে হবে এবং সেটা অচিরেই করতে হবে। আগামীকাল আমি নিজে আমাদের গুপ্তদূত সর্দারদের সাথে বের হব দেখতে যে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুজরাতিদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে এমন কোনো দুর্বলতা আমরা যদি সনাক্ত করতে পারি।

*

উন্মুক্ত পাথুরে শিলাস্তর, যার একেবারে পূর্বপ্রান্তে আপাতদৃষ্টিতে দুর্ভেদ্য চম্পনীর দূর্গ দাঁড়িয়ে আছে, দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে সে যখন তাঁর ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে তখন হুমায়ুন তাঁর ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের নীচে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। হতাশার একটা তীব্র অনুভূতি তার শারীরিক অস্বস্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে এবং তার গুপ্তদূতের দল শিলাস্তরের উত্তর দিকে এক নিষ্ফল তথ্যানুসন্ধান অভিযানে ইতিমধ্যে পাঁচটি উষ্ণ ঘন্টা অতিবাহিত করছে এবং দক্ষিণদিকের অর্ধেকটা ইতিমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে তারা। সে নিজে বা তার কোনো গুপ্তদূত যখনই ভেবেছে তারা একটা অরক্ষিত স্থান সনাক্ত করতে পেরেছে, যেখান দিয়ে তাঁর লোকেরা হয়ত উপরে উঠবার প্রয়াস পাবে, প্রতিবারই আরোহনকারী সৈনিকের পক্ষে দুরুত্তর কোনো ঝুলে থাকা পাথরে আছড়ে পড়ে সেই সম্ভাবনার সমাপ্তি ঘটেছে। একবার এক গুপ্তদূত বাহুদ্বয় শস্য মাড়ানোর কস্তনীর মতো আন্দোলিত করে, পেছনের দিকে আছড়ে পড়ার আগে পাথুরে দেয়ালের একটা ফাটল দিয়ে উপরের দিকে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পথ বেয়ে উঠে গেলে, মাস্কেটের একটা গুলির শব্দে যখন চারপাশের স্তব্ধতা খানখান হয়ে যায়, তখন সবাই বাস্তবিকই বুঝতে পারে যে পাহাড়ের কিনারে কোনো একটা বলির আড়ালে একটা গুপ্ত প্রতিরক্ষামূলক ফাঁড়ি রয়েছে।

জওহর, আমাকে একটু পানি দাও, একটা সুতির কাপড় দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে হুমায়ুন আদেশ দেয়। বাছা জলদি করো, জওহর তাঁর পর্যানের দুপাশে ঝোলান থলির ভিতরে পানির খোঁজে হাতড়াতে থাকলে সে গলা চড়ায়।

মার্জনা করবেন, সুলতান, দড়িগুলো সব জড়িয়ে গিয়েছে।

বেশ তাহলে যত দ্রুত তোমার পক্ষে সম্ভব, হুমায়ুন এবার আগের চেয়ে অনেক মোলায়েম কণ্ঠে বলে, সে বুঝতে পারে বালকের আনাড়িপনা তাঁর ক্রোধের কারণ না, আক্রমণের পথ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর নিজের হতাশাই তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। আমরা ওখানে ঐ ছোট্ট টিলার উপরে গাছের ছায়ায় ঘোড়া থেকে নেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব।

হুমায়ুন ক্লান্ত ভঙ্গিতে পাঁচশ গজ দূরে অবস্থিত গাছপালাবেষ্টিত ক্ষুদ্র এলাকাটার দিকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এসে ঘোড়া থেকে নামতে নামতে সে টের পায় যে পাহাড়ের উচ্চতা আর নতুন দিক থেকে অবলোকন একেবারে ভিন্ন একটা দৃষ্টিরূপ সৃষ্টি করেছে। সে দেখতে পায় গাছপালার উপরে পাথরের গায়ে একটা গভীর ফাটল রয়েছে যা একেবারে উপর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্ষার মৌসুমে সম্ভবত এর ভিতর দিয়ে একটা জলপ্রপাত প্রবাহিত হয় কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা শুকনো দেখাচ্ছে। নিমেষে তৃষ্ণা আর হতাশা ভুলে গিয়ে হুমায়ুন গুপ্তদূত প্রধান আহমেন খানকে ডেকে পাঠায় তার কাছে।

তুমি কি ওখানে ঐ ফাটলটা দেখতে পাচ্ছ? তোমার কি মনে হয়? ওটা দিয়ে কি উপরে বেয়ে ওঠা সম্ভব?

সুলতান, আমি ঠিক বলতে পারছি না, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সম্ভব। আমি নিজে গিয়ে ফাটলটা পর্যবেক্ষণ করছি।

তুমি যাবার আগে আমাদের বাকি লোকেরা যেন গাছপালার আড়ালে থাকে সেটা নিশ্চিত কর। আমরা চাইনা কেউ তাদের দেখতে পাক…এবং আল্লাহ্ ভরসা।

শুকরিয়া, সুলতান আহমেদ খান তার পর্যান থেকে একজোড়া চামড়ার জুতো বের করে। পাথরের গায়ে ভালো করে আকড়ে ধরার জন্য জুতোর তলিতে চামড়ার অতিরিক্ত পটি সেলাই করা হয়েছে। জুতো জোড়া পরিধান করে আধ মাইল বা তার কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত উঁচু খাড়া পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দেয় সে। পাঁচ কি দশ মিনিট পরেই করকটে ঝোপঝাড় আর বিক্ষিপ্ত গাছপালার আড়ালে দৃশ্যপটের অন্তরালে চলে যায় সে। হুমায়ুন তারপরে উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে একটা অবয়বকে উপরে উঠে যেতে দেখে। অবয়বটা কখনও হারিয়ে যায় কিন্তু পুনরায় দৃশ্যমান হতে মনে হয় অনেকটা যেন উপরে উঠে গিয়েছে। তারপরে অবয়বটা কিছুক্ষণের জন্য একেবারেই দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। হুমায়ুন তার গুপ্তদূতকে এর পরে যখন দেখতে পায় তখন সে অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। হুমায়ুন পায়চারি করে, তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, আশঙ্কিত যে শেষ কয়েক গজ হয়তো অনতিক্রম্য প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু আশা করে যে তার ধারণা হয়তো ভুল। আধঘন্টা পরে আহমেদ খানকে গাছপালাবেষ্টিত সেই পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যায়। তার হাত বেশ কয়েক স্থানে ঘষা খেয়ে ছড়ে গিয়েছে এবং পরনের ঢোলা প্যান্টটা হাঁটুর কাছে ছিঁড়ে গিয়েছে। বন্ধুর পথে সে হেঁটেছিল বলে বাম পায়ের জুতোর তলি অনেকটাই খয়ে গিয়েছে কিন্তু তাঁর মুখে কান পর্যন্ত বিস্তৃত একটা হাসি।

সেখানে কোনো প্রতিরক্ষাকারীকে দেখা যায়নি। চূড়ো থেকে চল্লিশ ফিট নীচ পর্যন্ত বেয়ে উঠতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না কিন্তু পা রাখবার জায়গা খুব কম থাকার জন্য শেষের ফিটগুলো বেয়ে উঠা বেশ কষ্টকর। আমার মতো পাহাড়ী লোকদের পক্ষে সংকীর্ণ ফাটলের কোনো একটার দেয়ালে পিঠ দিয়ে আর অন্য দেয়ালে পা দিয়ে উপরে উঠে যাওয়া সম্ভব। অনেকের পক্ষেই সেটা অসম্ভব প্রতিপন্ন হবে বিশেষ করে যখন অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে হবে। অবশ্য এবং সে পুনরায় হাসতে শুরু করে- পাথরে ফাটল রয়েছে এবং বেশ নমনীয়ও বটে, যারা প্রথমে বেয়ে উঠবে তারা সহজেই ধাতব কিল পাথরের গায়ে গেথে দিতে পারবে ফলে কম দক্ষদের বেয়ে উঠবার ক্ষেত্রে এক ধরনের মই তৈরী হয়ে যাবে।

আমি আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি আর তোমার সাহসিকতা আর দক্ষতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাঁচশো বাছাই করা লোক নিয়ে আগামীকাল রাতে আমরা ফিরে আসবো। আমাদের মূল বাহিনী যখন সামনে থেকে আক্রমণ করে দূর্গ প্রতিরক্ষায় নিয়োজিতদের ব্যস্ত রাখবে তখন দেয়াল বেয়ে উঠে পেছন থেকে দূর্গে প্রবেশ করবো আমরা।

*

চাঁদের ধুসর আলোয়, আহমেদ খানকে পাশে নিয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গাছগুলোর ভিতর দিয়ে পাহাড়ের সেই ফাটলটার দিকে বেয়ে উঠতে থাকে হুমায়ুন। তাঁদের পায়ের নীচে মসৃণ আর আলগা নুড়ি পাথর নিশ্চিত করে যে এটা একটা শুকিয়ে যাওয়া জলস্রোত এবং বর্ষার সময় বাস্তবিকই উপর থেকে পতিত একটা জলপ্রপাত এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়।

যুদ্ধের কেন্দ্রে অবস্থানের জন্য বরাবরের মতোই অসহিষ্ণু হুমায়ুন, বাবা ইয়াসভালের পরামর্শ, যে তার কেন্দ্রে অবস্থান করা উচিত আক্রমণ পরিচালনার স্বার্থে, এবং পাথরের গায়ে কীলক স্থাপনের অভিযানে আহমেদ খান আর তার দেহরক্ষীদের ভিতরে দশজন সেরা পর্বতারোহীদের সাথে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে জানে তাঁদের মতো সেও ক্ষিপ্র, চটপটে এবং প্রথম দলের সাথে গমন করলে সে তার পাঁচশ লোকের বাকিদের মনোবল বৃদ্ধি করতে পারবে। তাদের সম্রাট নিজেই ইতিমধ্যে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছেন এটা জানতে পারলে নিজেদের সম্মানের খাতিরে তারা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হবে না।

সবকিছু এখন পর্যন্ত ভালোই চলছে। তাঁরা তাঁদের ঘোড়াগুলোকে বেশ খানিকটা দূরে বেঁধে রেখে এসেছে এবং কারো চোখে ধরা না পড়ে এই পর্যন্ত আসতে তাই চাঁদ প্রতিবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়তে এবং সেই সময়ে সামান্যতম আড়াল ব্যবহারের সুযোগ তাঁরা নিয়েছে। তাঁদের মাথার উপরে ঝুলে থাকা ডালপালার ভিতর দিয়ে, ঠিক সামনেই হুমায়ুন শুল্ক স্রোতস্বিনীর শুরুটা দেখতে পায়, ঠিক তার উপর থেকে পাহাড়ের কালো দেয়াল উঠে গিয়েছে। আহমেদ খান আর যে দশজন তার সাথে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠবে তাঁদের তাঁর চারপাশে জড়ো হতে ইঙ্গিত করে সে।

আমার নিয়তি এবং সেই সাথে সাম্রাজ্য আর আমাদের সবার জীবন এই প্রয়াসের কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু আমরা যদি সফল হই তাহলে পুরষ্কারের সম্ভাবনাও ব্যাপক, আল্লাহতালা আমাদের সহায় আছেন, আমরা সফল হবই। এখন, সবাই শেষবারের মতো দেখে নাও যে তোমাদের থলেতে তোমাদের উপকরণসমূহ নিরাপদে রয়েছে আর তোমাদের পছন্দসই যে কোনো অস্ত্র বহনের নিমিত্তে ভালোমতো গোঁজা রয়েছে। আমরা চাই না যে কিছু পড়ে গিয়ে আমাদের অবস্থান প্রকাশ হয়ে যায় বা পেছনে যারা অনুসরণ করছে তাদের কোনো ক্ষতি হোক।

হুমায়ুন তাঁর তরবারি আলমগীর জওহরের কাছে রেখে এসেছে, যে বাহিনীর বাকি সদস্য সাথে তাঁকে অনুসরণ করবে। সে তার বাকি লোকদের মতোই সাধারণ কালো কাপড় পরিধান করেছে কেবল তৈমূরের অঙ্গুরীয় একটা সরু চামড়ার ফালি দিয়ে তার গলায় বাঁধা রয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করবার ঠিক আগে সেটা বের করে এবং তাতে চুমু খায় সে। তারপরে তাঁরা উঠতে আরম্ভ করে, আহমেদ খান সামনে আগের দিন হাত এবং পা রাখার জন্য যেসব স্থান ব্যবহার করেছিল তাদের খুঁজতে খুঁজতে এবং ইশারায় ঠিক তার পেছনেই অবস্থানরত হুমায়ুনকে অনুসরণ করতে বলে। কয়েকটা ছোট পাথর মাঝে মাঝে যদিও তাদের কারণে স্থানচ্যুত হয়ে, নীচে মাটির দিকে সেগুলো ঠোকর খেতে খেতে গড়িয়ে গেলে, হুমায়ুন আশা করে তাদের গড়িয়ে যাবার শব্দ বিস্ফোরণের ফলে চাপা পড়ে যাবে যা তাঁর সেনাছাউনির দিক থেকে ভেসে আসছে শত্রুদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য তার কামানগুলো সম্মুখ আক্রমণের বারতা ঘোষণা করছে।

বিশ মিনিটের ভিতরে, শেষ ফাটলের পাদদেশে পৌঁছে যায় দুজনে। হুমায়ুন উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এই অংশটা বেয়ে উঠা কতটা কষ্টসাধ্য বলে প্রতিপন্ন হবে। জলপ্রপাতের প্রাথমিক তোড়ের কারণে এই অংশের পাথর একেবারে মসৃণ দেখায় এবং একপাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আর অন্যপাশের দেয়ালে পা দিয়ে স্বচ্ছন্দে উপরে বেয়ে উঠে যাবার জন্য যথেষ্ট চওড়া ফাটলটা। আহমেদ খান যে কীলকগুলো- পাহাড়ের গা থেকে বের হয়ে থাকা দুফিট চওড়া একটা পার্শ্বদেশের উপরে অবস্থান করে তার দেহের সাথে আড়াআড়িভাবে ঝোলান একটা বগলি থেকে বের করে দরকার হবে বলে তার কোমরের চারপাশে জড়ান একটা কালো পরিকর গুঁজে রাখে। হুমায়ুনও তাঁর নিজের হাতুড়ি কোমর থেকে খুলে হাতে নেয়।

সুলতান, গতকাল প্রথম দশ ফিটই সবচেয়ে মসৃণ বলে মনে হয়েছিল। আমি নিজেকে ফাটলের ভিতরে আটকে রাখবো আর আপনি আমার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে প্রথম কীলকটা দেয়ালে স্থাপনের মতো স্থানে পৌঁছাবেন।

হুমায়ুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে আহমেদ খান পাথুরে ফাটলের ভেতরে নিজেকে আটকে ফেলে। আহমেদ খানের টানটান হয়ে থাকা উরুতে হুমায়ুন তখন এক পা রাখে এবং নিজেকে ঠেলে উপরের দিকে তুলতে থাকে যতক্ষণ না সে আহমেদ খানের কাঁধে চড়ে বসে। মাথার উপরে হাত দিয়ে সে এবার পাথরের উপরিতলে অনুসন্ধান করতে থাকে যতক্ষণ না একটা ছোট্ট ফাটল খুঁজে পায় সে। হাতুড়ি বের করে এবং পরিকর থেকে একটা ফুটখানেক লম্বা কীলক বের করে, পাথরের ভিতরে কীলকটা ঢুকিয়ে দেয়, হাতুড়ির প্রতিটা ধাতব শব্দ উদ্বিগ্ন, ঘামতে থাকা হুমায়ুনের কাছে মনে হয় ফাটলের ভিতরে ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করছে। অবশ্য, উপর থেকে কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ে না এবং শীঘই কীলকটা যথাস্থানে ঢুকে যায়। হুমায়ুন কীলকটা টেনে পরীক্ষা করে এবং সেটাকে দৃঢ়ভাবে প্রবিষ্ট দেখে সেটায় ভর দিয়ে পরবর্তী কীলক প্রবিষ্ট করাবার স্থান নির্বাচন করতে আহমেদ খানের কাঁধ থেকে আধাআধি উপরে উঠে।

এটাও দেয়ালের গায়ে ভালোমতোই প্রবিষ্ট হয় এবং কীলকের উপরেই নিজেকে মূলত স্থাপিত করে আর মাঝে মধ্যে পিঠের সাহায্যে পাথরের গায়ে নিজেকে ঠেসে ধরে, পা রাখবার আরেকটা জায়গার খোঁজে হুমায়ুন উপরে উঠতে থাকে। এবং এভাবেই পুরো বিষয়টা এগিয়ে চলে, ঘামতে ঘামতে এবং জোরে শ্বাস নিতে নিতে, দুজনে শীর্ষদেশের দশ ফিটের ভিতরে পৌঁছে যায় যেখানে একটা পাথুরে শিলাস্তর তাদের আতঙ্কের উদ্রেক করে পথ আটকে রয়েছে। অবশ্য আহমেদ খান, হুমায়ুনের আলখাল্লার প্রান্তদেশ ধরে আধো-অন্ধকারের ভিতরে দেয়ালের শীর্ষদেশ থেকে ঝুলে থাকা পাহাড়ী লতাগুল্মের একটা মোটা ঝাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে, সেটা এমন এক দিকে যেদিকে স্বাভাবিক অবস্থায় সে লক্ষ্যই করতো না এবং সেটা তাদের ডানদিকে ছয়ফিট দূরে ঝুলছে।

সুলতান, আমার মনে হয় আমি ওটা ধরতে পারবো এবং শেষ দূরত্বটুকু ওটা ব্যবহার করে বেয়ে উঠে যাব আর ওঠার সময়ে আমি কীলক গাঁথতে গাঁথতে যাব, আর আপনার চেয়ে আমার ওজন কম বলে আমাকেই চেষ্টাটা করতে হবে, এবং আমাকে মার্জনা করবেন, সুলতান- সেটা করতে হলে আমার সিঁড়ি হিসাবে আপনাকে আমার সাহায্য করতে হবে।

হুমায়ুন মাথা নাড়ে এবং শেষ কীলকগুলো ধরে নিজের দেহকে ডানপাশে কাত করে। সে অচিরেই আহমেদ খানের পায়ের ওজন নিজের বাম কাঁধে অনুভব করে, তারপরে তার গলার পাশে সেটা যন্ত্রণাদায়ক ভঙ্গিতে একবার পিছলে যায় এবং হঠাৎ ভরটা গায়েব হয়ে যায়। আহমেদ খান লতাগুল্মের ঝাড় ধরে ঝুলতে ঝুলতে, পাথরের গায়ে সজোরে কীলক ঢুকিয়ে দিচ্ছে ঝুলে থাকা শিলাস্তর ঘুরে উপরে পৌঁছাবার একটা রাস্তা তৈরী করতে। তারপরে সে ফাটলের শীর্ষে পৌঁছে যায়, হুমায়ুনের দিকে হাত নেড়ে সে যেভাবে এসেছে সেটা অনুসরণ করতে বলে, সে ঝুলে থাকা বাধা ঘুরে এবং দড়াবাজের ভঙ্গিমায় উপরে ওঠার সময়ে বহু কষ্টে চোখ বন্ধ করে রাখার প্রবণতা দমন করে। তারপরে সে হঠাৎ নিজেকে উপরে আবিষ্কার করে। জোরে জোরে হাঁফাতে থাকার কারণে সে ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না, হুমায়ুন কোনোমতে ফিসফিস করে বলে, আহমেদ খান, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার সাহসিকতা আমার মনে থাকবে।

পরবর্তী আধঘন্টার ভিতরে যথেষ্ট সংখ্যক লোক ফাটলের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আসে, আসবার সময়ে তারা আরও বেশী সংখ্যক কীলক দেয়ালে প্রবিষ্ট করায় এবং দড়ির সাহায্যে চলনসই মই তৈরী করে, দূর্গ অভিমুখে অগ্রসর হবার জন্য অগ্রগামী দল গঠন করতে যারা পরবর্তীতে অনুসরণ করবে, তাদের জন্য উপরে ওঠাটা সহজ করতে। হুমায়ুন তাঁর পাশে সমবেত হওয়া প্রথম একশ জনের মতো লোকের উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দেয়। মনে রাখবে আমরা কোনো প্রকার শব্দ করবো না, এবং সেজন্য আমাদের পুরাতন নিরব আয়ুধের উপরে নির্ভর করবো তীর, ধনুক আর তরবারি- কোনো শত্রুকে খুঁজে পেলে খালি হাতে আমরা তাদের বধ করবো। একবার ভেতরে প্রবেশ করলে, তোমাদের ভিতরে যাঁরা তূর্য আর ঢাক বহন করছে, তাঁদের চারজনকে বাইরে থেকে আক্রমণরত আমাদের বাহিনীকে সতর্ক করতে পূর্বনির্ধারিত সংকেত ধ্বনি করতে আমি নির্দেশ দেব যার অর্থ আমরা ভেতরে প্রবেশ করেছি আর তাই এবার তারা তাদের আক্রমণ উদ্যোগ দ্বিগুন করতে পারে। আর এখন আমরা সবাই সামনে অগ্রসর হব।

ঝোপঝাড়ের আড়ালে অগ্রসর হয়ে, আঁধারের গা বেয়ে উঠে আসা লোকগুলো সন্তপনে আরও আধ মাইল এগিয়ে যাবার পরে ঝোপঝাড়ের আড়াল হাল্কা হয়ে আসে এবং সম্মুখে প্রায় এক হাজার গজ দূরত্বে দূর্গের পেছনের দেয়ালের দিকে তাদের অগ্রসর হতে আর কোনো বাধা থাকে না। সামনের আর পাশের দেয়ালের চেয়ে পেছনের দেয়ালটা অনেকটাই নীচু আর প্রহরীর কোনো চিহ্ন দৃশ্যমান হয় না। নীচু হয়ে বসে এবং অবশিষ্ট গুটিকয়েক ঝোপঝাড়ের আড়ালের সুযোগ নিয়ে আর চাঁদকে ঢেকে দিয়ে উড়ে যাওয়া মেঘের ফলে সৃষ্ট অন্ধকারে, আগন্তুক লোকগুলো মধ্যবর্তী খালি জমি দৌড়ে অতিক্রম করে নিজেদের দূর্গের দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দেয়, তাঁদের নড়াচড়ার ফলে যদি কোনো শব্দ হয়েও থাকে তবে দূর্গের সামনের অংশ থেকে আগত যুদ্ধের হৈ-হট্টগোলে সেটা চাপা পড়ে যায়। আগন্তুক লোকগুলোর অনেকেই সাথে করে দড়ি নিয়ে এসেছে, এবং হুমায়ুনের একটা আদেশে, আহমেদ খান একটা দড়ির গোছা আকড়ে ধরে আর এক কোণে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে যেখানে ভূমির বাক বরাবর দেয়ালটা প্রায় সমকোণে বেঁকে গিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরে, ফাটলের ভিতরে অনুসৃত কৌশল ব্যবহার করে সে দেয়ালের শীর্ষে পৌঁছে যায় এবং অন্যদের অনুসরণের জন্য নিজের হাতের দড়িটা নীচের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। অচিরেই আরও কয়েকজন দড়ি নিয়ে উপরে উঠে আসে আর আরও বেশী সংখ্যক দড়ি ঝুলতে দেখা যায়।

হুমায়ুন নিজে দ্রুত সমতল দূর্গপ্রাকারে উঠে আসে এবং অন্যদের সাথে উঁকি দিয়ে দেখে পেছনে প্রহরীদের কোনো চৌকি আছে কিনা। হ্যাঁ, প্রহরীদের একটা চৌকি দেখা যায়- প্রায় একশ গজ দূরে অবস্থিত। সহসা সেটার দরজা খুলে যায় এবং মশাল হাতে সেখানে ছয়জন লোকের আবির্ভাব ঘটে- সম্ভবত ন্যূনতম সংখ্যক প্রহরী পেছনে রেখে বাকিরা সামনের দেয়ালে যোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ছুটে গিয়েছে। হৈচৈ আর উত্তেজনার শব্দ শুনে বলা যায় যে সেখানে পূর্ণোদমে আক্রমণ করা হয়েছে। প্রহরীর দল নীচের দিকে দেখার জন্য দেয়ালের দিকে এগিয়ে আসে এবং, তারা যখন এগিয়ে আসছে হুমায়ুন তখন তাঁর তীরন্দাজদের আদেশ দেয় প্রহরীরা কোনো ধরনের হুশিয়ারী উচ্চারণ করার পূর্বেই যত দ্রুত সম্ভব তীর ছুঁড়তে। ফলায় মৃত্যুর শীষ বাজিয়ে প্রায় সাথে সাথে তীরের ঝাক বাতাসে ভাসে এবং হতভাগ্য ছয় প্রহরীকে বিদ্ধ করে, যে দেয়ালের উপর দিয়ে তাঁরা তাকিয়েছিল দুজন সেখান থেকে মাথা নীচের দিকে দিয়ে শূন্যে ভাসে, প্রাকারবেষ্টিত দূর্গের সমতল পাথরের ছাদে আরেকজনের পা যন্ত্রণায় মৃত্যুর বোল তুলে আছড়াতে থাকে, বাকি তিনজন কিছু বুঝে উঠার আগেই নিথর হয়ে যায়।

প্রহরীচৌকির দিকে হুমায়ুন আক্রমণ পরিচালনা করে। সে যখন সেখানে পৌঁছে, ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরেক গুজরাতি ছিটকে বের হয়ে এসে মাত্র দশ গজ দূরে ছাদ দেয়া একটা সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যায় যেটা নীচের আঙ্গিনার দিকে নেমে গিয়েছে। সে সিঁড়িটার এতত নিকটে যে তীর নিক্ষেপের আগেই সে এর রক্ষাকারী ছাদের নীচের নির্ভরতায় পৌঁছে যাবে। হুমায়ুন তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার পিছু ধাওয়া করে, তার হাত পা দপদপ করতে থাকে, এবং প্রথম ধাপের কাছে পৌঁছে দেখে প্রহরীটা সিঁড়ির বিশটা বা কিছু কম বেশী হতে পারে- পাথুরে ধাপের বেশীরভাগই অতিক্রম করে নীচে নেমে গিয়েছে। চিন্তা করার জন্য সময় ক্ষেপন না করে, হুমায়ুন উপরের ধাপ থেকে প্রহরীকে লক্ষ্য করে লাফ দেয়, আর তাকে নীচের চাতালে আছড়ে ফেলে। পতনের কারণে দুজনেরই ফুসফুসের সব বাতাস বের হয়ে যায় কিন্তু প্রহরী লোকটাই প্রথমে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় আর পালাবার পায়তারা করে। হুমায়ুন শোয়া অবস্থা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁকে ধরতে যায় এবং পায়ের গোড়ালি ধরে তাকে আবারও মাটিতে পেড়ে ফেলে। কুস্তিগীর হিসাবে নিজের সমস্ত নৈপুণ্য প্রয়োগ করে সে পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়তে থাকা লোকটাকে নিজের নীচে এমন করে আটকায় যাতে বেচারা নড়তে না পারে, হুমায়ুন এবার লোকটার গলা আঙ্গুল দিয়ে আকড়ে ধরতে সমর্থ হয় এবং তার দেহ থেকে প্রাণবায়ু নিংড়ে বের করতে শুরু করে যতক্ষণ না সে লোকটার নিঃশ্বাস তার গলার কাছে এসে ঘড়ঘড় করতে না শোনে এবং তারপর অসাড় দেহটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। হুমায়ুনের লোকেরা পুনরায় তাকে ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করে।

আমাদের সাথে এখন কম করে হলেও চারশ লোক রয়েছে, আহমেদ খান হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। এখন কি করবো?

আমাদের কেউ দেখে ফেলার আগে আমরা চেষ্টা করবো যতটা সম্ভব দূর্গের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।

লোকগুলো সামনে কামানের ঝলসানি দেখতে পায় এবং তাঁদের বুম শব্দ আর মাস্কেটের কড়াৎ আওয়াজের সাথে সাথে যুদ্ধের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর চিৎকারও তাঁদের কানে আসে। আঙ্গিনাটার উপর দিয়ে ধোয়া ভেসে যায় বিশেষ করে বিপরীত দিকে দেয়ালে অবস্থিত একটা বিশাল তোরণদ্বার দিয়ে ধোয়া প্রবেশ করছে। হুমায়ুন ভাবে এর মানে এই যে এই তোরণটা দিয়ে সরাসরি দূর্গের মূল অংশে প্রবেশ করা সম্ভব যেখানে দূর্গের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা সমবেত হয়েছে। আমাদের লোকদের দুভাগে বিভক্ত হয়ে তোরণটার দুপাশে দাঁড়াতে বল এবং তারপরে শত্রুকে পেছন থেকে আক্রমণ করার পূর্বে আমরা তূর্যনিনাদ আর ঢাকের বোলে দূর্গের সামনের দেয়াল আক্রমণকারী আমাদের সাথী যোদ্ধাদের হুশিয়ার করে দেব, সে আদেশ দেয়। তার আদেশ দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং হুমায়ুন সংকেত দিতে তার লোকেরা তোরণদ্বারের দিকে ধেয়ে যায়। তোরণের এক কোণ থেকে চারপাশে উঁকি দিয়ে, হুমায়ুন ধোয়ার কুণ্ডলীর ভিতরেও সামনের দেয়ালে অবস্থিত কামানের অবস্থান দেখতে পায় এবং প্রতিরোধকারীরা সেই সাথে গুলিবর্ষণ করছে এবং ফুটন্ত আলকাতরা এবং তেল নীচে আক্রমণরত তার লোকদের উপরে ঢালছে।

তূর্যবাদক আর ঢাকির দল, সংকেত দিতে শুরু কর এবং আমি আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত দিতে থাকো। তোমাদের ভেতর বাকীরা, আমাকে অনুসরণ কর! বাদ্যযন্ত্র থেকে সংকেত প্রদান শুরু হবার সাথে সাথে হুমায়ুন তোরণ অতিক্রম করে ভেতরের দিকে ধেয়ে যায়। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথে, তাঁর তীরন্দাজদের বর্ষিত প্রথম পশলা তীর বেশীরভাগ গুজরাতির পিঠে বিদ্ধ হয়, একটা কামানের সব গোলন্দাজ একসাথে ভূপাতিত হয়। বিস্ময় আর বিভ্রান্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করে। অন্যদের দেখে মনে হয় তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে আশ্রয়ের জন্য ভবনের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে শুরু করে।

মূল তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে চল। প্রতিরোধকারীদের হত্যা করে সেটা আমাদের সৈন্যদের জন্য খুলে দাও।

হুমায়ুনের লোকেরা তাঁর আদেশ পালন করতে ধেয়ে যায়, তাদের সামনে থাকে তার এক তূর্যবাদক, তখনও সে তাঁর আদেশ বাজিয়ে চলেছে। অবশ্য নিজের মৃত সাথীদের লাশের স্তূপের আড়াল থেকে এক গুজরাতি তীর নিক্ষেপ করলে সেটা তূর্যবাদকের কণ্ঠনালীতে বিদ্ধ হয় এবং সে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের সাথে রক্তের বুদ্বুদ মিশে গিয়ে তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র থেকে এক বিকট আর্তনাদ বের হয়ে আসে। সে যাই হোক, হুমায়ুন সাথে আহমেদ খান এবং কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক নিয়ে তোরণদ্বারে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে বা এর প্রতিরোধকারীদের পলায়নপর মনোবৃত্তিকে চাঙ্গা করে তুলে। তারা শীঘ্রই কপিকলের সাহায্যে মূল তোরণ খুলে দেয়। তোরণ-দ্বারের সিকি অংশ খোলা হতেই স্রোতের মতো মোগল সেনারা ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। মোগলদের প্রবেশ করতে দেখে অবশিষ্ট প্রতিরোধকারীরা হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে পালাতে শুরু করে কিন্তু কয়েকজন দূর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে হুমায়ুনের লোকদের উপরে নিয়মিত বিরতিতে গুলিবর্ষণ করতে থাকে, তাঁদের অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

আমাদের লোকদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসো। আমাদের আর প্রাণহানির ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন নেই। দূর্গ এখন আমাদের দখলে। আমাদের হাতে ধৃত সবচেয়ে বরিষ্ঠ গুজরাতিকে আমার সামনে এনে হাজির কর।

অচিরেই, দীর্ঘদেহী, বিরলকেশ এক আধিকারিককে, যার হাত এবং পা থেকে তরবারির আঘাতজনিত ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে, টানতে টানতে হুমায়ুনের সামনে হাজির করে জোর করে নতজানু করা হয়। আমি বর্বর নই, হুমায়ুন তাঁকে বলে। আমি অনর্থক রক্তপাত করবো না। দূর্গের ভিতরে যারা অবস্থান করছে আপনি তাঁদের কাছে গিয়ে বলবেন তাঁদের এই প্রতিরোধ মূল্যহীন। তারা যদি এই মুহূর্তে আত্মসমর্থন করে তবে আমি পবিত্র কোরআন শরীফের নামে শপথ করে বলছি তাঁদের আমি প্রাণ ভিক্ষা দেব। যদি তাঁরা বাঁধা দেয়, সবাই মারা পড়বে, সেই সাথে আমি ইতিমধ্যে যাদের বন্দি করেছি তারাও বেঘোরো প্রাণ হারাবে।

হুমায়ুন বৃদ্ধ লোকটার চোখে একসাথে ভয় আর আশঙ্কা খেলা করতে দেখে। সে তাঁর কথা বিশ্বাস করেছে এবং তার অনুসারীদের বোঝাতে চেষ্টা করবে।

আপনি এবার যেতে পারেন। আপনাকে দশ মিনিট সময় দিলাম এর ভিতরে আপনাকে একটা উত্তর আনতে হবে।

হুমায়ুন তার লোকদের গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে বলে যখন বৃদ্ধ আধিকারিক খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রতিরোধকারীদের সুরক্ষিত অবস্থানের দিকে গমন করে। আধিকারিককে চিনতে পেরে, প্রতিরোধকারীরা ঘুন্টি শোভিত ওক কাঠের ভারী দরজাটা খুলে দেয় এবং সে ভিতরে হারিয়ে যায়। পাঁচ মিনিট পরে সে পুনরায় দরজার কাছে হাজির হয় এবং স্থান পরিবর্তন করে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে আসে। তারা আত্মসমর্পন করতে রাজি আছে যদি তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র সাথে রাখতে দেয়া হয়।

ঠিক আছে, হুমায়ুন বলে এবং সাথে সাথে স্বস্তির একটা জোয়ার তাঁকে আপুত করে ফেলে। সম্রাট হিসাবে সে তাঁর প্রথম অভিযানে বিজয়ী হয়েছে। আমরা একটা দারুণ বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। আমাদের আহত যোদ্ধাদের যথাযথ শুশ্রূষার বন্দোবস্ত করা হোক। তারপরে রাজকোষের সিন্দুকগুলো খোঁজা শুরু কর।

*

সুলতান, রাজকোষের ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারের প্রবেশ পথ আমরা এখনও খুঁজে পাইনি, ছত্রিশ ঘন্টা পরে হুমায়ুনের এক আধিকারিক তাঁকে জানায়। আমরা কি যারা বাকি ছিল সেইসব বন্দি গুজরাতিদের কাউকে নির্যাতন করে দেখবো?

না, পবিত্র কোরআন শরীফের নামে আমি শপথ করেছি কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন না হয়ে নিরাপদে তাঁরা প্রস্থান করতে পারবে। রাজকোষ নিরাপদ করা আমাদের দরকার। কিন্তু নির্যাতন ছাড়া মানুষের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের আরও অনেক পথ আছে। বাবা ইয়াসভালোকে বল বন্দি বলিষ্ঠ গুজরাতি আধিকারিকদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করতে যার উদ্দেশ্য হবে তাদের সাহসিকতাকে সম্মান জানান। তারপরে যখন অসংখ্য শুভকামনায় পানপাত্র উজাড় হবে এবং সুরা তাঁদের জীহ্বার জড়তা আলগা করবে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে রাজকোষে নিয়ে এসো আর তখন দেখো এভাবে তাঁদের কাছ থেকে তুমি কি জানতে পার।

সেদিনই মধ্যরাত্রি নাগাদ, হুমায়ুনের অস্থায়ী বাসস্থানের দরজায় টলতে টলতে বাবা ইয়াসভালো এসে উপস্থিত হয়। তাঁর হাঁটায় যদিও জড়তা রয়েছে এবং চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, একটা চওড়া হাসি তার এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত লেপ্টে রয়েছে। মহামান্য সুলতানের সাথে আমি কি কথা বলতে পারি?

কয়েক মুহূর্ত পরে তাঁকে হুমায়ুনের সামনে উপস্থিত করা হয়। সুলতান আমি নিশ্চিত আমি উত্তরটা জানি। আজ রাতের বেশীর ভাগ সময় আমি আঙ্গিনায় গুজরাতি আধিকারিকদের সাথে আহার আর সুরাপানে অতিবাহিত করেছি। তাঁদের একজন- আলুম খান তার নাম- গজনীর উত্তম লাল মদিরা আকণ্ঠ পান করতে তার দেহমন প্রশমিত হয় এবং সে আরও বেশী বাঁচাল হয়ে উঠে, গুজরাতি রাজপরিবার এবং তাঁর সাথী আধিকারিকদের সম্বন্ধে প্রচলিত রটন্তির রসালো অংশ বলতে শুরু করে। আমার যখন মনে হয় যে সময় হয়েছে তখন আমি রাজকোষ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আলতো করে উপস্থাপন করি। সে চমকে উঠে, রাজকোষের অবস্থান কথায় প্রকাশ করে সে বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করেনি কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি তার চোখ এক মুহূর্তের জন্য মার্বেলের জলাধারের একটার দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল এবং সে বিচলিত বোধ করতে থাকে।

সহজাত প্রবৃত্তির বশে আমি বুঝতে পারি যে জলাশয়ের রাজকোষের সাথে একটা সম্পর্ক না থেকেই যায় না তাই আমি তাকে এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন করতে আরম্ভ করি। আপনি বুঝতেই পারছেন- জলাশয়টা কতদিনের পুরাতন, এর গভীরতা কত, এর নির্মাণশৈলী, কতদিন পর পর একে জলশূন্য করে পুনরায় জলপূর্ণ করা হয়। প্রতিটা প্রশ্নের সাথে সাথে সে উত্তরোত্তর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে সেই সাথে সে অপ্রত্যয়জনকভাবে তোতলাতে থাকে এবং পরস্পরবিরোধী উত্তর দেয়। আমি নিশ্চিত রাজকোষে প্রবেশের পথ জলাশয়ের নীচে লুকান রয়েছে। বাবা ইয়াসভালো কথা শেষ করে, তার ব্যাপক পানাহারের পরে এতো প্রাঞ্জলভাবে কথা বলতে নিজেকে বাধ্য করার প্রয়াস তাঁকে আপাতদৃষ্টিতে ক্লান্ত করে দিয়েছে।

আপনি আপনার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দিনের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমরা জলাশয়ের পানি নিষ্কাশন করে এর তলদেশ খনন করবো। এখন যান এবং পড়ে যাবার আগে একটু বিশ্রাম করে নিন।

পরের দিন খুব সকালে, দূর্গের চারপাশের জঙ্গল থেকে সবুজ তোতাপাখির পাখির কর্কশ ডাকের মাঝে, হুমায়ুন কিছুটা বিপর্যস্ত আর নোংরা বাবা ইয়াসভালোকে পাশে নিয়ে, তাকিয়ে দেখে কেবল সাদা নেংটি পরিহিত মজুরদের একটা দল তাদের চামড়ার থলে নিয়ে জলাশয় পানিশূন্য করতে একটা মানবশেকল তৈরী করেছে। তারপরে জলাশয় পানিশূন্য হতে তাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে তলদেশে নেমে এর তলদেশের আস্তরণ গঠনকারী মার্বেলের টুকরো একটা একটা করে চাপ দিয়ে খুলতে শুরু করে। সেগুলো জলাশয়ের পাশেই স্তূপাকারে রাখতে থাকে যেখান থেকে অন্যেরা সেগুলো যত্নের সাথে আঙ্গিনায় নিয়ে গিয়ে সতর্কতার সাথে একটার উপরে একটা সাজিয়ে রাখে।

প্রথম পাথরের খণ্ডগুলো সরিয়ে নেয়ার পরে, বাবা ইয়াসভালো নিশ্চিতভাবেই বিমর্ষ হয়ে পড়ে, নীচে লালচে রঙের বেলেমাটি দেখে। তারপরে, হুমায়ুন যখন অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে জলাশয়ের পাশে পায়চারি করছে, বাবা ইয়াসভালো আচমকা চেঁচিয়ে উঠে, সুলতান, দেখেন! মাঝের ঐ চারটে খণ্ডে খাঁজ রয়েছে এবং তাঁদের চারপাশে পাথরের কুচি পড়ে রয়েছে। পাথরের টুকরোগুলো আগেও ওঠান হয়েছে।

আপনি ঠিক বলেছেন, হুমায়ুন জবাব দেয়। টুকরোগুলো সরাবার ব্যবস্থা করেন।

বাঁকা প্রান্তবিশিষ্ট লৌহদণ্ড পাথরের খণ্ডগুলোর নীচে প্রবিষ্ট করাবার সাথে সাথে সেগুলো দ্রুত উঠে আসে এবং দরদর করে ঘামতে থাকা মজুরদের দল সেগুলো তুলতে, হুমায়ুন কাঠের একজোড়া ঝুলন্ত দরজার একাংশ তাঁদের নীচ থেকে বের হতে দেখে।

পাওয়া গেছে! বাবা ইয়াসভালো আপনার সহজাত প্রবৃত্তি আপনার সাথে প্রতারণা করেনি, আমি নিশ্চিত। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না আপনার এই মাথা ব্যাথার জন্য আমি আপনাকে কি পুরষ্কার দেব।

লাফিয়ে জলাশয়ের তলদেশে নেমে, হুমায়ুন নিজে ঝুলন্ত দরজা ধরে টানতে শুরু করে। দরজাটার পাল্লা সহজেই উঠে আসলে এর নীচে চেটালো সিঁড়ির বেশ কয়েকটা ধাপ দেখা যায় যা একটা নীচু, লোহার গজালশোভিত দরজার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বিশাল ধাতব তালা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করা।

আমাকে একটা বাঁকান প্রান্তযুক্ত লৌহদণ্ড দিন, সে আদেশ করে। দণ্ডটা নিয়ে সে এর প্রান্তদেশ তালার ভিতরে প্রবেশ করিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে দ্বিখণ্ডিত করে। ধাক্কা দিয়ে দরজার পাল্লা খুলে সে মাথা নীচু করে ভিতরে প্রবেশ করে। আধো আলোতে সোনার জ্বলজ্বলে আভা তার চোখে ধরা দেয়। তার চোখ আলোতে সয়ে আসতে সে দেখে যে মেঝেতে পুরু সোনার পিণ্ড সাজিয়ে রাখা আছে এবং খোলা সিন্দুক দেখে মনে হয় রত্নপাথরে ভর্তি। প্রথম কক্ষের ন্যায় আলো বিকিরণকারী আরো কয়েকটা প্রকোষ্ঠ আছে বলে মনে হয়। হুমায়ুন চেঁচিয়ে মশাল নিয়ে আসতে বলে এবং ভৃত্যের দল মশাল আনতে সে দেখে যে সিন্দুকে আসলেই পান্না, রুবি, পোখরাজ আর অন্যান্য দীপ্তিময় পাথর রয়েছে এবং অন্য প্রকোষ্ঠগুলোতে আরও ধনসম্পদ রয়েছে যার ভিতরে আছে রূপার বাসনকোসন আর পানপাত্র এবং কারুকার্যখচিত অস্ত্রশস্ত্র আর বর্ম। তাঁর বিশ্বস্ত আর সাহসী যোদ্ধাদের পুরস্কৃত করার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সে এখানে পেয়েছে।

সব স্বর্ণপিণ্ড, রত্নপাথর আর অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য সরিয়ে নাও। সেগুলো ভালো করে পাহারার ব্যবস্থা কর আর সবকিছু নথীভুক্ত কর। আজ রাতে আমরা উৎসব পালন করবো এবং লুটের মাল ভাগ করে নেব।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে, পরিচারক আর সৈন্যরা একসাথে কঠোর পরিশ্রম করে। তাঁদের প্রথম কাজ দূর্গ প্রাঙ্গণের কেন্দ্রে একটা নীচু কাঠের পাটাতন নির্মাণ করা যেখান থেকে হুমায়ুন তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারবে এবং লুটের মালে তাঁদের প্রত্যেকের অংশ বিতরণ করবে যা পাটাতনের পেছনে প্রহরাধীন অবস্থায় স্তূপীকৃত করে রাখা হয়েছে। এরপরে দূর্গপ্রাঙ্গণে তারা যেখানে যে কাপড় খুঁজে পেয়েছে, হোক সেটা পশমের, সুতার বা কেবল পাটের তৈরী, হোক সেটা উজ্জ্বল লাল বা বেগুনী রঙের বা কেবল ধুসর পিঙ্গল এবং সবুজ বর্ণের, সুন্দর কারুকার্যখচিত কিংবা সাদামাটা, সব ব্যবহার করে অতিরিক্ত চাদোয়া লাগাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। চাঁদোয়ার নীচে তারা কোনোমতে নীচু কাঠের টেবিল পাতে এবং তার চারপাশে ভোজসভায় আগত অতিথিদের হেলান দেবার জন্য যেখানে যা গদি, তোষক বা তাকিয়া খুঁজে পায় সব এনে বিছিয়ে রাখে। মশালের জন্য তারা কোনমতে মশালদানি তৈরী করে এবং সেগুলো এমন জায়গায় স্থাপন করে যেসব জায়গায়, ভোজসভার আনন্দ আয়োজন বুনো উদ্দামতায় রূপান্তরিত হলে যা অভ্যাগতরা নিশ্চিতভাবেই পরিণত হবে, সুগুলোর উল্টে পরার সম্ভাবনা কম।

তারা যখন তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, তখন কাছাকাছি মাঠে স্থাপিত রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খাবারের গন্ধে তাঁদের রসনা তীব্র হয়ে উঠে। লম্বা সরু ধাতব শলাকায় বিধিয়ে আস্ত ভেড়া ঝলসানো হচ্ছে, ভোজসভা উপলক্ষ্যে রাধুনির দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকে বিশাল তামার পাত্রে ফুটন্ত সজির ভিতরে মশলা দিয়ে নাড়ছে, বেশী অভিজ্ঞ রাধুনির দল ছোট ছোট তামার পাত্রে মিষ্টি তৈরী করতে দই, চিনি, গোলাপজল আর নানা পদের মশলা মিশাচ্ছে। অনেক সৈনিকরা মনে, হুমায়ুন এবং তাঁর বেশীর ভাগ অমাত্যদের মতোই, ভালো মুসলমান কিন্তু সুরাপান একেবারে নিষিদ্ধ এই বিষয়টা পুরোপুরি মেনে নিতে অপারগ, দূর্গ থেকে প্রাপ্ত এবং হুমায়ুনের নিজস্ব ভাড়ার থেকে যোগান দেয়া সুরার- যার ভিতরে গজনীর লাল মদিরাও রয়েছে যা আলুম খানের বেঁফাস কথাবার্তার জন্য দায়ী ভাগ নিতে যেখানে যে পাত্র পেয়েছে সেটা নিয়ে সমবেত হয়েছে, সম্ভবত তাঁদের কাছে পানের মোহ বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

সূর্যাস্তের একঘন্টা পরে, বাদুরের দল যখন উষ্ণ নিকষ অন্ধকারের মাঝে বিচরণ করতে আরম্ভ করেছে এবং ঝি ঝি পোকার ডাক সপ্তমে পৌঁছেছে, হুমায়ুনের দুই খাস তূর্যবাদক ছয়-ফুট-লম্বা পিতলের বাদ্যযন্ত্রে নিজেদের ঠোঁট স্থাপন করে। তাঁদের বাজনার প্রতিধ্বনি শুনে যখন সেনাপতি আর সাধারণ সৈনিকের গলার স্বর একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায় তখন সোনালী রঙের কাপড়ে তৈরী চোগা ও আচকান পরিহিত উপরে রাজকোষের গোপন ভাণ্ডারে প্রাপ্ত একটা সোনার শৃঙ্খলে নির্মিত বর্ম পরিধান করে হুমায়ুন দূর্গের মূল তোরণ-দ্বারে এসে দাঁড়ায়। সূর্যের অবিরাম আওয়াজ এবং উপরে দূর্গপ্রাকারে স্থাপিত যুদ্ধের দামামার গম্ভীর ধ্বনির মাঝে হুমায়ুন তাঁর সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকদের ভিতর দিয়ে নীচু পাটাতনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটায় আরোহন করে, তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ আধিকারিকেরা তাকে অনুসরণ করে এবং স্তূপীকৃত ধনরাশির সামনে দাঁড়ায়। তূর্যবাদক আর ঢালিদের ইঙ্গিতে থামতে বলে সে তার লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়।

আজ রাতে আমরা গুজরাতে আমাদের অভিযানের সাফল্য উদযাপন করতে সমবেত হয়েছি। আমাদের শত্রুরা যেখানেই আমাদের মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছে সেখানেই আমরা তাদের পরাস্ত করেছি। সুলতান বাহাদুর শাহ এমনকি সে সাহসটুকুও না দেখিয়ে, ভীরু ইঁদুরেব মতো আদতেই তিনি যা তাঁর রাজ্যের দুর্গম প্রান্তে গিয়ে লুকিয়েছেন। আমরা তাঁর ভূখণ্ড দখল করেছি এবং আমার পেছনে তোমরা যে ধনরাশির স্তূপ দেখছো সেটা আমরা আমাদের করে নিয়েছি। আমাদের এই বিজয়ের জন্য এসে প্রথমে আমরা আল্লাহ্তালাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

আল্লাহু আকবর, আল্লাহ্ মহান, সমবেত কাতার থেকে সাথে সাথে প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

ভোজসভা শুরু করার আগে এই সম্পদের কিছু অংশ আমি তোমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। আজকের এই সমাবেশে প্রত্যেক বরিষ্ঠ আধিকারিককে তাঁর ঢাল নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। কেন সেটা তোমরা শীঘ্রই দেখতে পাবে। আকষ্মিক আক্রমণের ভয়ে সেটা বলা হয়নি। আমাদের শত্রুরা হতোদ্যম আর ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। বলা হয়েছে নিজের এবং তার লোকদের জন্য উপহার বহনের উদ্দেশ্যে। আধিকারিকেরা নিজ বর্ম নিয়ে সামনে এগিয়ে এসো। বাবা ইয়াসভালো, প্রথমে আপনি!

মুণ্ডিত-মস্তক বাবা ইয়াসভালো সামনে এগিয়ে যায় এবং হুমায়ুনের সামনে নতজানু হয়।

পিঠ থেকে আপনার বর্মটা নামিয়ে সেটা উল্টো করে মাটিতে রাখুন।

বাবা ইয়াসভালো আদেশ পালন করে।

পরিচারকের দল। সোনা আর রূপার পিণ্ড ঢালের উপরে স্তূপ করে সেটার উপরে মূল্যবান পাথর স্থাপন কর।

পরিচারকের দল মশালের আলোয় দীপ্তিময় আর ঝলমল করতে থাকা মূল্যবান ধাতবপিণ্ড আর রত্নপাথর নিয়ে এসে সেগুলো বর্মের উপরে স্তূপ করে রাখে। বাবা ইয়াসভালো আমার আন্তরিক শুভেচ্ছার সাথে এবার বর্মটা নিয়ে যান এবং গতরাতের সুরাপানের কারণে যদি আপনি এখনও দুর্বল বোধ করেন তাহলে আপনার লোকদের ডাকে সাহায্য করতে।

যুবক কিংবা বৃদ্ধ, খোয়ারি আক্রান্ত হোক বা না হোক, যেকোনো মানুষের বহনের পক্ষে বোঝাটা অনেক বেশী, এবং মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বাবা ইয়াসভালো আবারও মাথা নত করে, একহাত মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থায় নিজের হৃৎপিণ্ডের উপরে স্থাপিত এবং নিজের লোকদের ইশারায় সাহায্য করতে বলে। তারা তাদের অর্জিত ধনরাশি একত্রে বয়ে নিয়ে যেতে, হুমায়ুন পরবর্তী আধিকারিক, দীর্ঘদেহী, ক্লান্ত এক আফগানিকে ইঙ্গিত করে পাটাতনে উঠতে এবং পুরো প্রক্রিয়াটা পুনরাবৃত্তি করে। পুরোটা সময় আমাদের সুলতান, আমাদের পাদিশাহ, হুমায়ুন মহান, এই রব শনৈ শনৈ বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুহাত মাথার উপরে তুলে, হাসিমুখে তাঁদের এই ধ্বনিকে স্বাগত জানায় হুমায়ুন। সম্রাট হিসাবে নিজের প্রথম অভিযানে সফল হয়েছে সে। তার পূর্বে তার মরহুম আব্বাজানের মতো তাঁর নিজের এবং লোকদের জন্য গৌরব আর ধনরাশি অর্জন করেছে সে। জীবন বেশ মধুময়- সৌভাগ্যের এই ধারা দীর্ঘস্থায়ী হোক।

১.৪ অনিশ্চিত ভারসাম্য

০৪. অনিশ্চিত ভারসাম্য

বর্ষায় মুষলধারে বৃষ্টি হতে আগ্রা দূর্গের ভিতরের আঙ্গিনা পানিতে থৈ থৈ করছে। বৃষ্টির ভারী ফোঁটা পাথরের আস্তরণে ঠিকরে যাচ্ছে এবং পানির প্রস্রবনগুলো যা থেকে জলের বুদ্বুদ বের হবার কথা সেগুলো জলমগ্ন করে তুলেছে। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার জন্য কাপড়ে ক্ষয়কারী ছত্রাক জন্মাতে শুরু করেছে এবং রাজকীয় পাঠাগারে উদ্বিগ্ন পণ্ডিতেরা হিন্দুস্তানে যেসব পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসেছিলেন বাবর সেগুলোকে আর্দ্র আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের বাৎসরিক প্রয়াসে ব্যস্ত। পাণ্ডুলিপিগুলোর ভিতরে বাবরের রোজনামচাও রয়েছে, যেগুলোকে আর্দ্র আবহাওয়া আর কীটপতঙ্গের ঝাঁকের হাত থেকে বাঁচাতে ভিতরের দিকে সীসার আস্তরণযুক্ত বিশেষভাবে তৈরী ধাতব বাক্সে সংরক্ষণের জন্য তাঁর গ্রন্থাগারিকদের আদেশ দিয়েছে হুমায়ুন। বাক্সটা যে কক্ষে রাখা হয়েছে সেখানের বাতাস শুষ্ক করতে বর্ষা মৌসুমে অবিরত কর্পূর কাঠ জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে।

গতকাল গভীর রাতে, মুষলধারে হতে থাকা বৃষ্টি সম্পর্কে উদাসীন হুমায়ুন তাঁর গুজরাত অভিযান শেষে বিজয়ীর বেশে আগ্রায় ফিরে এসেছে। তার লোকদের পুরস্কৃত করার পরেও সোনা, রূপা আর মূল্যবান রত্নপাথরের বেঁচে যাওয়া অবশিষ্টাংশ ইতিমধ্যে রাজকীয় কোষাগারে স্তূপীকৃত করা হয়েছে। কয়েকটা স্মারক ব্যাতীত- মুক্তাখচিত রূপার একটা পরিকর সালিমার নমনীয় কটিদেশে যা দারুণ মানাবে, তার মা মাহামের জন্য একটা সবুজ জেড পাথরের তৈরী পানপাত্র এবং খানজাদার জন্য রুবী আর আকাটা পান্না খচিত সোনার তৈরী একটা দুই-লহর বিশিষ্ট হার যা বংশ পরম্পরায় গুজরাতের রাজবংশের মহিলাদের কণ্ঠে সুনামের সাথে শোভা পেয়েছে। একটা কলাই করা সিন্দুক খুলে সে হারটা বের করে, গাঢ় সবুজ পান্নার সাথে আগ্নেয় প্রভায় বিন্যস্ত রুবীর দিকে আরও একবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

হুমায়ুন যখন তাঁর ফুপুজানের বাসস্থানের দিকে হেঁটে চলে, তখনও হারটা তাঁর হাতে ধরা। হুমায়ুন জানে অভিযানের খুঁটিনাটি বর্ণনা তাঁকে আগ্রহী করে তুলবে কিন্তু সেই সাথে ফুপুজানের পরামর্শও তার প্রয়োজন। ফুপুজানের কক্ষে প্রবেশ করতে, সে দেখে যে খানজাদা কিছু একটা পাঠ করছে এবং তাঁর পাশে বইয়ের ভিতরে মাথা গুঁজে বসে রয়েছে তার এগার বছর বয়সী সৎ-বোন গুলবদন। মেয়েটা তার মা দিলদার এবং ভাই হিন্দালের মতো গাঢ় তামাটে বর্ণের উজ্জ্বল আর কৌতূহলী চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়।

খানজাদা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর দুই কাঁধ চেপে ধরে তাঁর দুগালে পরম মমতায় চুম্বন করে। হুমায়ুন, তোমাকে স্বাগতম। তুমি বিজয়ী হয়েছে যেমনটা আমি জানতাম তুমি হবে…তোমার অগ্রগতির প্রতিটা বিবরণী আমাকে গর্বিত করেছে।

আমি আপনার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছি, হুমায়ুন তার হাতের মুঠি খুলে এবং তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রুবী আর পান্নার হারটার সৌন্দৰ্য ক্ষরিত হতে দেয়। ভালো করে দেখার জন্য গুলবদন সামনে এগিয়ে আসে, কিন্তু রত্নখচিত হারটা গ্রহণ করে সেটাকে আলোতে ধরার আগে খানজাদা সম্ভবত একটু ইতস্তত করেন। দারুণ সুন্দর কিন্তু আমার জন্য বোধহয় একটু বেশীই মনোরম… এটা। এখন আর আমায় মানাবে না। তুমি যখন বিয়ে করবে তখন তোমার বৌকে আমার হয়ে এটা দিয়ো। হুমায়ুন কিছু বলার আগেই খানজাদা হারটা হুমায়ুনের তালুতে রেখে তার আঙ্গুলগুলো বন্ধ করে সেটাকে তালুবন্দি করে দেয় এবং ইঙ্গিতে তাঁকে পাশে বসতে বলে। গুলবদন- এখন তুমি যাও। আগামীকাল তুমি অবশ্যই আসবে- একটা ফার্সী কবিতা আছে যা আমি তোমাকে দেখাতে চাই।

মেয়েটা বই বন্ধ করে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে খানজাদা পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। গতবছর তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই আমার ভেতরে মেয়েটার প্রতি একটা মমতুবোধ জন্ম নিয়েছে দারুণ বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে এবং চারপাশে কি ঘটছে সবকিছু লক্ষ্য করে।

তার বয়সে আপনি যেমন ছিলেন? আমার আব্বাজান আমাকে প্রায়ই বলতেন কিছুই আপনার দৃষ্টি এড়ায় না।

সে আমার তোষামদ করতো।

আমার সেটা মনে হয় না, এবং সেই কারণেই আমি আরো একবার আপনার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছি। বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার বিজয় প্রমাণ করেছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে অনুসরণ করার জন্য মানুষদের অনুপ্রাণিত করতে পারি এবং নিশ্চিত হয়েছি যে আমি একজন ভালো যোদ্ধা।…আমাকে জীবনে আরও অনেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে এবং আমি সেজন্য ভীত নই- বস্তুতপক্ষে আমি তাঁদের মুখোমুখি হবার জন্য মুখিয়ে আছি যদি তারা আমার সাম্রাজ্য আরও নিরাপদ করতে আমাকে সাহায্য করে…

তুমি ঠিকই বলেছে। প্রমাণ করেছে যে তুমি একজন জাত নেতা। সেই সাথে নির্ভীক। তাহলে তোমার এই উদ্বেগ কিসের জন্য?

আমি যখন অভিযান শেষে আগ্রায় ফিরে আসছিলাম, যুদ্ধের উদ্বেগ আর উত্তেজনা থিতিয়ে আসতে প্রায়ই নিজের মনেই চিন্তা করেছি, এবার কি? আমি জানি কিভাবে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় কিন্তু আমি কি সত্যিই জানি কিভাবে একটা সাম্রাজ্য শাসন করতে হয় এবং টিকিয়ে রাখতে হয়? সোনার কারুকাজ করা সিংহাসনে যখন উপবেশন করি, আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে উপদেষ্টা, মোসাহেব আর শরণার্থীর দল, সবাই নিজ নিজ সমস্যা বা অনুরোধের প্রতি আমার মনোযোগ আকর্ষনে ব্যস্ত, তখন আমার কেমন আচরণ করা উচিত? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এদের সবাইকে বিতাড়িত করি এবং সালিমা বা আমার অন্য কোনো রক্ষিতার সাথে সময় কাটাই কিংবা শিকারে বেড়িয়ে পড়ি।

একজন প্রাণবন্ত যুবকের জন্য সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তোমাকে এমন প্রলোভন দমন করতে হবে। একজন শাসককে তাঁর চারপাশে কি ঘটছে সে বিষয়ে অবশ্যই সজাগ থাকবে এবং অসন্তোষ ঘনিয়ে উঠে বিদ্রোহের রূপ নেবার আগেই সেটা আঁচ করার মতো সংবেদনশীল হতে হবে। তোমার আব্বাজান যেমন শিখেছিলেন তুমিও তেমনি শিখে নিবে। তার জন্য বিষয়টা মোটেই সহজ ছিল না। আল্লাহতালা যখন তাকে সিংহাসনের অধিকারী করেছিল তখন তোমার চেয়েও তার বয়স অল্প ছিল কিন্তু তিনি একজন মহান শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর রোজনামচাগুলো পড়–তুমি যা সন্ধান করছে সেখানের পাতায় তুমি তা খুঁজে পাবে, কঠিন অভিজ্ঞতা আর রক্ত থেকে সৃষ্ট… খানজাদা দম নেবার জন্য থামেন, তারপরে খানিকটা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেসে উঠেন। বাবর যদি এখন এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন, দরবারে তুমি যাদের তোমার নিকটে অবস্থান করতে দাও তাঁদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে তিনি হয়ত তোমায় বলতেন… যাকে তুমি ক্ষমতা প্রদান করছে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে, সবাইকে বিশ্বাস করবে না। সবসময়ে নিজেকে প্রশ্ন করবে কেন- কেন এই লোকটা আমাকে এই পরামর্শ দিচ্ছে? আমি যদি সম্মতি দেই তাহলে তার কি লাভ? আমি যদি সম্মতি না দেই তাহলে তার কি ক্ষতি? তাকে যা দেয়া হয়েছে সেজন্য কি সে কৃতজ্ঞ থাকবে নাকি সে চিন্তা করবে অধিকার বলেই এটা তাঁর প্রাপ্য?

আমার মনে হয় এসব অনেকটাই এখন বুঝতে পারি। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যেন সন্দেহপরায়নতাই একজন শাসকের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। সঙ্গত কারণেই বিষয়টা আমাকে পীড়িত করে, আমার সৎ-ভাইদের বিদ্রোহ মানুষের উপরে কম আস্থা আরোপ এবং বেশী মাত্রায় সতর্ক হবার শিক্ষা আমাকে দিয়েছে, এমনকি পরিবারের সেইসব ঘনিষ্ঠ সদস্যদের ক্ষেত্রেও যাদের আমি অকৃত্রিম মিত্র হিসাবে বিবেচনা করতাম। কিন্তু সাধারণ মানুষ, আমার প্রজারা, যাদের কেবল আমার শরণার্থী হিসাবে দেখি কিংবা রাষ্ট্রীয় ভ্রমণের সময়ে যাদের আনুগত্য আমার প্রয়োজন তাঁদের ক্ষেত্রে আমি কি করবো?

তাদের কাছে তুমি সবসময়ে অন্তরঙ্গতাবর্জিত একজন হিসাবে অবস্থান করবে। তুমি কেমন তারচেয়ে তারা তোমাকে কিভাবে প্রত্যক্ষ করে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তোমার পক্ষে যখনই সম্ভব হবে তুমি তাদের সামনে উপস্থিত হবে এবং যখন দর্শন দেবে তাঁদের কাছে সেটা যেন সূর্যের মতো মনে হয়, দৃষ্টি আরোপের ক্ষেত্রে বড় বেশী দীপ্রময়। তাঁদের সুরক্ষিত রাখতে তোমার ক্ষমতার প্রতি যেন তারা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে…এবং কেউ তোমার বিরুদ্ধাচারণ করলে তোমার শাস্তি দেয়ার ক্ষমতায়। আমাদের পূর্বপুরুষ তৈমূর তার প্রজাদের কেবল নিজের বিজয় না, সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের ঝলকে কিভাবে বিমোহিত করতেন সেটা স্মরণ কর। সমরকন্দে যেসব প্রাসাদ আর মসজিদ তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তিনি যে অভাবিত সম্পদ প্রদর্শন আর দান করেছেন, সেসব তার প্রতিটা বিজয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, পৃথিবীর বুকে তাঁর পদচিহ্ন চিরস্থায়ী করতে।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে জানালার দিকে হেঁটে যায়। বৃষ্টি থেমে এসেছে। এবং বিপ্ন আকাশের ধুসর বুক চিরে সূর্যালোকের কয়েকটা ম্লান রশ্মি নীচে নেমে আসে। তার ফুপুজান ঠিকই বলেছে- দরবারের রাজনীতি অনুধাবনে যে প্রয়াস আর সময় সে ব্যয় করেছে সেজন্য অসন্তষ্ট হওয়া তার উচিত হবে না। কেবল বিজয় না, সে তার লোকদের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী আর বিনোদনের ব্যবস্থা করবে…একজন নশ্বর মানুষ হিসাবে না তাঁরা তাঁকে ক্ষমতা আর উত্তর্ষের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করবে।

হুমায়ুন- এটা একবার দেখো…

ঘুরে তাকিয়ে সে দেখে খানজাদা একটা ঢাউস বইয়ের হাতির দাঁতের তৈরী মলাটের সাথে যুক্ত দুটো রূপার ক্ষুদ্রাকৃতি কজা খুলছে যা তার এক পরিচারিকা তার কাছে নিয়ে এসেছে। বইটা চন্দন কাঠের তৈরী একটা রেহেলের উপরে রেখে সে পাতা উল্টাতে আরম্ভ করে, লাইনের পর লাইন চোখ বুলিয়ে যাবার সময় তাঁর ভ্র কুচকে থাকে, সে যা খুঁজছিলো সেটা পাবার পরেই কেবল সন্তুষ্টির সাথে সে মাথা নাড়ে।

তুমি যখন এখানে ছিলে না, আমি সুলতান ইব্রাহিমের ঘরোয়া নথীপত্র আমাদের ভাষায় অনুবাদের আদেশ দিয়েছিলাম। হিন্দুস্তানের শাসকদের দরবারের রীতিনীতি আমাদের দৃষ্টিতে কেমন অদ্ভুত মনে হয় খানিকটা উদ্ভটও- সেগুলো যত্নের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। যেমন ধরো, এখানে লেখা রয়েছে যে প্রতিবছর তাঁর সিংহাসনে আরোহণের দিনটিতে একটা সর্বজনীন উৎসবের আয়োজন করে সুলতান ইব্রাহিমের ওজন নেয়া হত এবং ওজনের সমপরিমাণ রূপা, খাদ্যবস্তু আর উৎকৃষ্ট কাপড় তাঁর অমাত্য আর প্রজাদের মাঝে তাদের যোগ্যতা আর পদমর্যাদা অনুযায়ী বিলিয়ে দেয়া হত। তুমিও এমন কিছু একটা করতে পার? প্রজাদের কাছে নিজের ক্ষমতা আর সম্পদ-এবং তোমার উদারতা প্রদর্শন করে তুমি তোমার ধনী আর দরিদ্র প্রজাদের আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পার। দেখ- অনুষ্ঠানটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এখানে দেয়া হয়েছে…।

খানজাদার কাছে এসে হুমায়ুন তাঁর কাঁধের উপর দিয়ে লেখাটা পড়ে। প্রথমে, ওজন নেবার অনুষ্ঠানে পালনীয় আচারের বিশদ বর্ণনা পড়ে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই মোগলরা পানিপথে সুলতান ইব্রাহিমের বাহিনীকে সহজেই পরাস্ত করেছিল যদি সুলতান এসব বিষয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। কঠিন যুদ্ধ আর রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে যে সম্পদ অর্জিত হয়নি সেটা অপুরুষোচিত, দুর্বলচিত্তের পরিচায়ক। সে তুলনায় বিজয়ের অব্যবহিত পরেই তাঁর যোদ্ধাদের ঢালে লুষ্ঠিত সম্পদ স্তূপীকৃত করাটা বরং অনেক উত্তম…

সে অবজ্ঞায় ঠোঁট বাঁকায়। হিন্দুস্তানের অতীতের নৃপতিরা যেভাবে শাসন করেছে সেভাবে শাসন করার জন্য মোগলরা হিন্দুস্তানের উপরে প্রভুত্ব স্থাপন করেনি। কিন্তু খানজাদা আগ্রহী চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সে নিজের ভাবনার রাশ সংযত করে এবং সে যখন সংযত হয় তার নিশ্চয়তায় ফাটল ধরে। তাঁর প্রতিক্রিয়া এখনও সম্ভবত মধ্য এশিয়ার বিশুষ্ক তৃণপ্রধান প্রান্তর থেকে আগত সেইসব যাযাবর যোদ্ধাদের মতোই রয়েছে…কিন্তু সে এখন হিন্দুস্তানে রয়েছে এবং অবশ্যই পরিবর্তিত হওয়া শিখতে হবে। খানজাদা সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। একজন নৃপতির যুদ্ধের ময়দানে জয়লাভের সাথে সাথে তার পুরস্কৃত করার এবং সম্ভ্রম উদ্রেকের সামর্থ্যের দ্বারাই ক্ষমতার অধিকারী হয়। এইসব পুরাতন আনুষ্ঠানিকতার মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা রয়েছে। সুলতান ইব্রাহিমের কিছু কিছু রীতি বোধহয় তার গ্রহণ করা উচিত কিন্তু সেগুলোকে নতুন জৌলুসে… জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে…

হুমায়ুন খানজাদার কাঁধে হাত রাখে। আরও একবার আমার কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে আপনি আমাকে পথ দেখালেন…

*

জওহরের ধরে থাকা ঘষা-মাজা করা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে হুমায়ুন তাকিয়ে থাকে। তার পরনে ধুসর নীল বুটিদার রেশমের উপরে সোনার কারুকাজ করা আলখাল্লা এবং তাঁর আঙ্গুলে আর গলার চারপাশে মূল্যবান সব পাথর ঝলমল করছে। নিজের আঁকালো পোষাক আর অলঙ্কারে মুগ্ধ, নিজের উপস্থাপিত অবয়ব দেখে প্রীত হয়ে হাসে সে। বস্তুত পক্ষে, তাঁর কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ যে অলঙ্কারটা সেটা হল কোহ-ঈ-নূর হীরক খণ্ড, তাঁর আলোর পর্বত, যা স্বর্ণখচিত অবস্থায় তার বুকে শোভা পাচ্ছে, এবং– এমনকি এর চেয়েও বেশী। ডান হাতের মধ্যমায় পরিহিত তৈমুরের স্বর্ণ অঙ্গুরীয়। আংটিটা হুমায়ুনের সৌভাগ্যে কবচ- এর পৌরুষত্ব, বস্তুগত দৃঢ়তা তাঁর কাছে সবার প্রত্যাশার মাত্রা অবিরত তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তাকে এখনও কত কিছু অর্জন করতে হবে…

হুমায়ুন ইশারায় জানায় যে আগ্রা দূর্গের বিশাল দর্শনার্থী কক্ষের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হবার জন্য সে প্রস্তুত। ব্রোঞ্জের তৈরী দুটো লম্বা সূর্যের তূর্যনাদ আর পাদিশাহ্ সালামাত, সম্রাটের জয় হোক, সে বহু-স্তম্ভ বিশিষ্ট দরবার হলে প্রবেশ করে যেখানে তার নেতৃস্থানীয় প্রজাবৃন্দ- তাঁর রাষ্ট্রীয় আধিকারিকেরা, তাঁর সেনাপতিরা, তাঁর অমাত্যবৃন্দ এবং তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়া হিন্দুস্তানী রাজারা অপেক্ষা করছে। তারা অধোমুখে প্রণত হতে, তাঁদের কপাল মাটি স্পর্শ করে, উজ্জ্বল আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় তাদের তীব্র বাতাসের ঝাপটায় নুয়ে পড়া ফুলের বাগিচার মতো দেখায়।

আপনারা উঠে দাঁড়াতে পারেন।

দরবার হলের দূরবর্তী প্রান্তে পদ্মপাতার আকৃতির একটা মার্বেলের জলাধারের মাঝে সারিযুক্ত ফোয়ারায় জলপ্রপাতের মতো প্রবাহিত গোলাপজলের সুগন্ধ, চারটা সুরু পদযুক্ত সারসের মতো দেখতে, যাদের চোখের বদলে রুবী বসান রয়েছে, লম্বা সোনালী দাহকে পুড়তে থাকা ধূপের ঝাঁঝালো গন্ধের সাথে এসে মিশে। হুমায়ুনের পায়ের নীচে পাথরের মেঝের উপরে বিছান লাল এবং নীল রঙের কার্পেট, সে যখন ধীরে ধীরে সোনালী ঝালর দেয়া সবুজ মখমলের শামিয়ানার নীচে স্থাপিত উঁচু বেদীর দিকে এগিয়ে যায়, নরম লাগে এবং পা ডুবে যায়, বেদীর উপরে সোনালী রঙের একটা অতিকায় দাড়িপাল্লা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা শক্ত কাঠের আড়া থেকে সোনার শেকলের সাহায্যে দুটো অতিকায় তশতরি ঝুলান হয়েছে, তাঁদের প্রান্তের ধুসর গোলাপী বর্ণের খনিজ পাথরের হীরকাকার খণ্ডের কিনারা মুক্তাখচিত।

দাড়িপাল্লার ঠিক বিপরীত দিকে সাজান রয়েছে দান সামগ্রী যা তার বিপরীতে ওজন করা হবে- কারুকার্যখচিত হাতির দাঁতের বাক্স ভর্তি আকাটা রত্নপাথর, স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা ভর্তি সোনার গিল্টি করা কাঠের গুঁড়ি যার প্রতিটা কক্ষে বয়ে আনতে আটজন করে লোকের দরকার হয়েছে, পশমিনা ছাগলের পশমী কাপড়ের গাঁট যা এতটাই নমনীয় আর কোমল যে একটা ছোট আংটির ভিতর দিয়ে ছয় ফিট চওড়া কাপড়ের বিস্তার অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারে, রংধনু রঙের বেলনাকারে পাকানো রেশম কাপড় এবং পিতলের ট্রে যার উপরে মশলা স্তূপ করে রাখা।

বেদীর সামনে এবং দুপাশে দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শণার্থীদের হুমায়ুন জরিপ করে, যাদের ভিতরে তাঁর নানাজান বাইসানগার এবং তাঁর শুভ্র শুশ্রুমণ্ডিত উজির কাশেমও রয়েছে। দুই প্রবীণ ব্যক্তি সমর্থনের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং এক মুহূর্তের জন্য হুমায়ুন বাবরের কথা ভাবে যার শাসনামলের শুরুর দিকে তাঁরাই তাঁকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছিল…কিন্তু এটা শোক বা আক্ষেপের মুহূর্ত না বরং আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতার সময়। সে আজ একটা রাজকীয় বিবৃতি দেবে।

নয় বছর পূর্বে পানিপথের যুদ্ধে আমি আমার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিলাম। আল্লাহতালা আমাদের একটা মহান বিজয় এবং একটা নতুন রাজ্য দান করেছিলেন। এটাও আল্লাহ্তালার ইচ্ছা যে আমার আব্বাজান তিনি যা জয় করেছিলেন সেটা উপভোগের জন্য বেশীদিন জীবিত থাকেননি। হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাট হিসাবে আমাকে ঘোষণা করে খুতবা পাঠের আজ তৃতীয় বার্ষিকী। আমার সাম্রাজ্য এখনও নবীন কিন্তু এর আয়তন বৃদ্ধি পাবে…বস্তুতপক্ষে অটোমান সুলতান বা পারস্যের শাহদের স্নান করে দিয়ে এই সাম্রাজ্য ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে। মধ্যাহ্নের সূর্যের ন্যায় মোগলদের জৌলুস দ্যুতি ছড়াবে, যারাই এর চোখের দিকে তাকাবার সাহস দেখাবে অন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সীমান্তে যারা হুমকির কারণ হয়ে উঠেছিল আমি ইতিমধ্যে তাদের পরাজিত করে আমার ক্ষমতা প্রমাণ করেছি। বাহাদুর শাহ এবং লোদি রাজ্যাভিযোগী তার্তার খান অসৎ উদ্দেশ্যে পাহাড়ে লুকিয়ে রয়েছে এবং তাঁদের একদা যে বিপুল ধনসম্পদ ছিল এখন আমার কোষাগারে গচ্ছিত রয়েছে। কিন্তু তোমরা যারা আমার এবং আমার বংশের প্রতি বিশ্বস্ত তাঁরা আজ থেকে শুরু হওয়া গৌরব আর প্রাচুর্যের অংশীদার হবে।

তারা ঠিক যেমন যত্নের সাথে পূর্বে মহড়া দিয়েছিল, কাশেম তূর্যবাদকদের ইশারা করতে তারা আরেকদফা দীর্ঘ তূর্যনাদ অনুকীর্তন করে, যা কক্ষের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হুমায়ুন দাঁড়িপাল্লার দিকে এগিয়ে যায়। সোনালী তশতরীর একটাতে উঠে দাঁড়াতে সে টের পায়, তার ওজনে সেটা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কাশেম হাততালি দিতে, পরিচারকের দল বাক্সের পর বাক্স মূল্যবান পাথর অপর তশতরীতে স্তূপীকৃত করতে শুরু করে যতক্ষণ না, ঢাকের সুললিত ধ্বনির সাথে হুমায়ুন ধীরে ধীরে জমিন থেকে উপরে উঠে আসতে থাকে। অবশেষে, পাল্লা যখন ভারসাম্যে আসে তখন আরেকবার তূর্যধ্বনি শোনা যায়।

লাল চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা বই খুলে কাশিম পাঠ আরম্ভ করে। মহামান্য সুলতান, হুমায়ুন, তাঁর অসীম উদারতার বশবর্তী হয়ে ঘোষণা করছেন যে এইসব মূল্যবান রত্নপাথর তাঁর অমাত্য এবং অনুগত প্ৰজাসকল যাদের নাম এখানে রয়েছে তাদের ভিতরে ভাগ করে দেয়া হবে। সে ধীরে কিন্তু সুললিত কণ্ঠে সুর করে একের পর এক নাম পড়তে থাকে। হুমায়ুনের হাসিতে কৃতজ্ঞতা ফুটতে দেখে- এমনকি লোভও।

এবং এভাবেই ব্যাপারটা চলতে থাকে। হুমায়ুনকে এরপরে থলে ভর্তি সোনা আর রূপার বিপরীতে ওজন করা হয় যা তাঁর সেনাপতিদের ভিতরে বাড়তি পুরষ্কার হিসাবে বিতড়িত হবে এবং এরপরে রেশমের থান, মশলা আর কিংখাবের বিপরীতে তাঁকে ওজন করা হয় যা অন্যান্য শহর আর প্রদেশের শীর্ষ আধিকারিক আর প্রজাদের জন্য পাঠান হয়। অবশেষে সে দরিদ্রদের মাঝে খাদ্যশস্য আর রুটি বিতরণের আদেশ দেয় স্মরণ করিয়ে দিতে যে সম্রাট কেবল তাঁর ধনী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রজাদের কথাই না বরং সবার কথাই ভাবেন।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে এবং শুকরিয়া আর সমর্থনের চিৎকারের রেশ মিলিয়ে আসতে হুমায়ুনের মাথা ব্যাথা আরম্ভ হয়। দরবারের আনুষ্ঠানিকতা- সেখান থেকে প্রচারিত বক্তব্য- রাজবংশের জন্য গুরুতুবহ। সে এখন সেটা বোঝে এবং নিজের প্রজাদের মাঝে সম্ভ্রম জাগ্রত করতে তাকে অবশ্যই আরো উপায় খুঁজে বের করতে হবে কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের কক্ষে ফিরে আসতে পেরে সে স্বস্তি পায় এবং পরণের ভারী আলখাল্লাটা ছুঁড়ে ফেলে। তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারকেরা তাঁকে যখন আরামদায়ক চোগা আর আচকানে সজ্জিত করে তখন জওহর তার অলঙ্কারগুলো নিয়ে সিন্দুকে তুলে রাখে, সে বুঝতে পারে তার একটু একা থাকা প্রয়োজন, চিন্তা করার জন্য সময় দরকার। যমুনার তীর থেকে সে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে আসতে পারে যেখানের বাতাস এখানের এই দূর্গের দমবন্ধ করা পরিবেশের চেয়ে নিশ্চয়ই শীতল হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে সে সম্ভবত মিষ্টি-গন্ধযুক্ত হারেম এবং সেখানে বসবাসরত তার কোনো এক সুন্দরী তরুণী রক্ষিতাকে দর্শন দিতে পারে।

সুলতান, মহামান্য গুলরুখ আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। একটা কোমল, অদ্ভুত বাচনভঙ্গি বিশিষ্ট কণ্ঠস্বর তার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে, হুমায়ুন কালো চোখের এক যুবককে দেখে যার মাথা ভর্তি কালো ঝাকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। হুমায়ুন তাঁকে আগে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। নমনীয় এবং পেলব দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী ছেলেটাকে দেখে কোনো মতেই বিশ বছরের বেশী বয়সী বলে মনে হয় না। তাঁর বাহুদ্বয় পরণের লাল কারুকার্যখচিত আস্তিনহীন পোষাকের কারণে নগ্ন সাবলীলভাবে পেশীবহুল।

তোমার নাম কি?

মেহমুদ, সুলতান।

এবং তুমি আমার সৎ মায়ের খিদমত কর।

মেহমুদের চোখের মণি ঝিলিক দিয়ে উঠে। হ্যাঁ, সুলতান।

তোমার দেশ কোথায়?

ইস্তাম্বুলের অটোম্যান দরবার। আমি আমার মশলা ব্যবসায়ী প্রভুর সাথে আগ্রা এসেছিলাম কিন্তু তিনি যখন দেশে ফিরে যান ভাগ্যান্বেষণের জন্য এখানেই থেকে যাই। আমি ভাগ্যবান রাজমহিষীর কৃপা দৃষ্টি আমি লাভ করেছি।

গুলরুখ কি চায়? সে কদাচিৎ তাঁকে বিব্রত করে। বস্তুতপক্ষে তাঁর আব্বাজানের ইন্তেকাল এবং তার সৎ ভাইদের চক্রান্তের পরে গুলরুখের সাথে তার কদাচিৎ দেখা হয়েছে। তিনি আগে কখনও তাঁর সাথে দেখা করতে চাননি। গুলরুখের অনুরোধ তাঁকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতরে ফেলে দেয়। অনিচ্ছাসত্তেও হুমায়ুন তার বেড়াতে যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে। তাঁর সাথে এখন দেখা করতে গেলে সেটা ভদ্রতার পরিচায়ক হবে এবং সে যত তাড়াতাড়ি যাবে তত তাড়াতাড়ি জানতে পারবে পুরো বিষয়টা কি নিয়ে। বেশ, আমাকে তোমার গৃহকত্রীর কাছে নিয়ে চল।

হুমায়ুন মেহমুদকে অনুসরণ করে নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, ভিতরের প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে, যা নীচের ফুলের বাগান দেখা যায় এমন কতগুলো কক্ষের দিকে চলে গিয়েছে যেখানে রাজপরিবারের বয়স্ক মহিলাদের খানজাদা ব্যতীত, যিনি দূর্গের অন্য অংশে থাকতেই পছন্দ করেন- কক্ষ রয়েছে। বাবরের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তাঁর দুই সন্তান, আসকারি এবং কামরানের মা হিসাবে গুলরুখের মর্যাদার সাথে তাঁর বাসস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ। রূপার কারুকার্যখচিত উঁত কাঠের তৈরী দরজার দরজার সামনে তারা যখন পৌঁছায়, পরিচারকের দল দরজার পাল্লা খুলে দিতে হুমায়ুন কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করে।

তুমি হৃদয়বান তাই এতো দ্রুত এসেছো, গুলরুখ তাঁর উষ্ণ, ভারী কণ্ঠে বলে- যা অনায়াসে তাঁর সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুণ- তাঁর দিকে এগিয়ে আসে। এতোটা সম্মান আমি আশা করিনি।

তার আপন মায়ের চেয়ে দুই বছরের বড়, গুলরুখের বয়স চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে, কিন্তু মসৃণ, ঢলঢলে দেহসৌষ্ঠবের কারণে তাকে অনেক অল্পবয়সী মনে হয়। কামরান- পাহাড়ী মার্জারের মতো প্রাণশক্তির অধিকারী যার চোখগুলো সরু আর সবুজ- হুমায়ুন ভাবে, দেখতে বাবরের মতো হয়েছে, মায়ের চেহারা পায়নি। কিন্তু গুলরুখের খুদে কালো চোখ- আগ্রহের সাথে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে- একেবারে আসকারির মতো।

তুমি কি অনুগ্রহ করে একটু বসবে না? সে লাল রেশমের একটা তাকিয়ার দিকে ইঙ্গিত করতে হুমায়ুন সেটায় হেলান দিয়ে বসে।

আমি বিষয়টা নিয়ে কখনও তোমার সাথে আলাপ করিনি কারণ আমি লজ্জিত, কিন্তু আমার ছেলেরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে সেটা আমার যথেষ্ট মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। তোমার আব্বাজান আল্লাহ্তালা তাঁর আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন- তোমাকে তার উত্তরাধিকার নির্বাচিত করেছেন এবং এর বিরুদ্ধাচারণ করা কারও উচিত নয়। আমাকে বিশ্বাস কর আমি তাদের হঠকারী আর ছেলেমানুষী পরিকল্পনার বিষয়ে কিছুই জানতাম না। তারা কি করেছে আমি যখন শুনতে পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি তাদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেবে। যখন তাদের প্রাণভিক্ষা চাইতে তোমার কাছে আসব বলে ঠিক করেছি তখনই আমি তোমার উদারতার কথা শুনতে পাই কিভাবে তুমি তাদের বুকে টেনে নিয়েছে এবং তাদের মার্জনা করেছে আর সমৃদ্ধ প্রদেশের শাসক হিসাবে তাঁদের মনোনীত করেছো…আমার বহুদিনের ইচ্ছা এই বিষয়ে তোমার সাথে আলাপ করি কারণ একজন মা হিসাবে আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমি আজকের দিনটা বেছে নিয়েছি কারণ আজ তোমার রাজত্ব আরম্ভ হবার তৃতীয় বার্ষিকী। আমি বিষয়টাকে মাঙ্গলিক হিসাবে বিবেচনা করছি আর আমি তোমাকে অভিনন্দনও জানাতে চাই। তুমি খুব বেশী দিন হয়নি যে সম্রাট হয়েছে কিন্তু এরই ভিতরে তোমার অর্জন প্রচুর।

আমি বিশ্বাস করি আমার ভাইয়েরা তাদের কৃতকর্মের শিক্ষা পেয়েছে এবং তাঁরা এখন জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পাবে… তাকিয়ার উপরে হুমায়ুন অস্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে উঠে, বিব্রতবোধ করে এবং চলে যাবার জন্য রীতিমতো উৎকণ্ঠায় ভুগতে আরম্ভ করে। কিন্তু, তাঁর সন্দেহ হয়, গুলরুখের আরও কিছু বলবার আছে। গুলরুখ তাঁর মেহেদী রঞ্জিত আঙ্গুল বুকের উপরে চেপে ধরে আরও কাছে। এগিয়ে আসে।

আমি তোমার কাছে একটা অনুগ্রহ আশা করি যদিও আমার ঠিক সাহস হয় না…

কামরান আর আসকারিকে দরবারে ডেকে পাঠাবার অনুরোধ কি গুলরুখ করতে চাইছে? তার কথা শেষ করার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হুমায়ুন নিজের ভিতরে বিরক্তির একটা ঝলক অনুভব করে।

তুমি যদি আমার ইচ্ছাটা রাখো তাহলে সেটা আমাকে ভীষণ প্রীত করবে। হুমায়ুনের নিরবতা আপাতভাবে গুলরুখকে স্পর্শ করে না। তোমার গুজরাত বিজয় উদযাপন করতে, আমি তোমার সম্মানে একটা ভোজসভার আয়োজন করতে চাই। তোমার আম্মিজান আর ফুপু এবং রাজপরিবারের অন্যান্য মহিলারাও আমার অতিথি হবে। তোমার খাতিরে আমাকে এটুকু অন্তত করতে দাও, আমি তাহলে জানব যে তুমি সত্যিই আমার ছেলেদের ক্ষমা করেছে এবং বাবরের পরিবারে সম্প্রীতি ফিরে এসেছে।

হুমায়ুন নিজের ভিতরে স্বস্তির একটা আমেজ অনুভব করে। সে তাহলে এটা চায়- এটা তার ছেলেদের আগ্রায় ফিরিয়ে আনবার জন্য কোনো অশ্রুসিক্ত আবেদন নয়… কেবলই তার বিজয় উদযাপন। গুলরুখের অনুরোধের প্রতি নিজের সম্মতি প্রকাশ করতে সে তার মাথা নাড়ে, এবং শেষবারের মতো মাধুর্যপূর্ণ সৌজন্যতা প্রকাশ করে সে তার কাছ থেকে বিদায় নেয়।

ঘোড়সওয়াড়ীর ধারণা বাদ দিয়ে, সে এর বদলে মায়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাহামের বাসকক্ষের দিকে অগ্রসর হবার সময়ে সে দিলদারের কক্ষের পাশ দিয়ে যায়। খুব অল্প বয়সে- দশ কি বারো দিন হবে- যখন বাবর হিন্দালকে মাহামের হাতে তুলে দিয়েছিল। তাঁর কেবল মনে আছে তার মা তাঁকে ডেকে এনে নিজের কোলের শিশুটিকে তাঁকে দেখিয়েছিল। দেখো, তোমার একজন নতুন ভাই এসেছে, মা বলেছিলেন। বিভ্রান্ত হুমায়ুন জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা শিশুটির দিকে তাকায় সে ভালো করেই জানে তার মা নয় অন্য মহিলার…

সেই মুহূর্তে ভাবনাটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। কাবুলে বড় হয়ে উঠার দিনগুলোতে তরবারি নিয়ে যুদ্ধের কৌশল আয়ত্ত্ব করা, মিনিটে ত্রিশটা তীর নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জন আর পোলো খেলাটা ছিল অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অনেক পরে সে বুঝতে পেরেছিল মাহামের হাতে হিন্দালকে তুলে দেয়াটা ছিল আব্বাজানের জীবনে দুর্বলতার পরিচায়ক নগণ্য কয়েকটা কাজের অন্যতম- যদিও নিখাদ ভালোবাসা থেকে তিনি কাজটা করেছিলেন।

বিষয়টা থেকে কার মঙ্গল হয়েছে? মাহামের শোকের প্রকোপ হয়ত এরফলে প্রশমিত হয়েছে কিন্তু এর ফলে পরিবারের ভিতরে মতানৈক্য পুষ্ট হয়েছে। প্রথম দিকের বছরগুলোতে সে হিন্দালকে দিলদারের কাছ থেকে আলাদা রাখতে সবসময়ে পাহারা দিত। কিন্তু হিন্দালের বয়স হলে এবং তার আসল মা কে সেটা সে জানতে পারলে, সঙ্গত কারণেই মাহামের কাছ থেকে সে দূরে সরে যায়। সম্ভবত এটাই কারণ, সবচেয়ে ছোট হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কামরান আর আসকারির চক্রান্তে হিন্দাল যোগ দিয়েছিল। সম্ভবত সেদিনের জন্য এটা ছিল তাঁর প্রতিশোধ যেদিন দিলদারের কোল থেকে তাঁকে পৃথক করা হয়েছিল।

দিলদারের নিজের কি অবস্থা? এতোগুলো বছর তাঁর মনে কি ভাবনা খেলা করেছে? সে নিদেনপক্ষে গুলবদনকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা লাভ করতে পেরেছে…কিন্তু সে যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, দিলদার কি শঙ্কিত হয়েছিল যে মাহাম মেয়েটাকেও তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করবে? হুমায়ুন আপনমনে মাথা নাড়ে। সে কখনও সেটা জানতে পারবে না। দিলদার এখন মৃত। মাহাম এসব বিষয়ে কখনও কথা বলে না এবং খানজাদাকেও এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে তাঁর দারুণ অনীহা। মেয়েদের জগতটা সম্ভবত অনেক জটিল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জায়গা। পুরুষদের পৃথিবীর যত যুদ্ধ আর সংঘাতের সাথে তুলনা করলে মনে হয়, যেখানে সব বিরোধের মীমাংসা মুষ্ঠাঘাত বা তরবারির এক আঘাতে নিস্পন্ন হতে পারে, সেটা অনেক বেশী পরিচ্ছন্ন আর সহজ।

*

একদম প্রায় সোনালী চাঁদের নীচে, দূর্গপ্রাঙ্গণ যা গুলরুখ তাঁর আয়োজিত উৎসবের জন্য মনোনীত করেছে স্থানটা তামার গোলাকার পাত্র বা দিয়ার মাঝে সঞ্চিত সুগন্ধি তেলের ভিতরে জ্বলতে থাকা অসংখ্য সলতের মৃদু আভায় আলোকিত। দূর্গপ্রাঙ্গণের একটা দেয়ালের সাথে একটা বিশাল তাবু দেখা যায়- মোগলদের মাতৃভূমিতে যেমনটা দেখা যায় অনেকটা তেমনি চোঙাকৃতি। কিন্তু শীতকালের তীব্র বাতাসের ঝাপটা সহ্য করার জন্য মজবুত লাঠি একত্রে আটকে এবং পুরু পশমে আবৃত করে তৈরী করার বদলে, হুমায়ুন দেখতে পায় যে কাঠামোটা সরু রৌপ্য দণ্ড দিয়ে নির্মিত যা ফুলের নক্সা শাভিত রেশমী কাপড় দ্বারা আবৃত। রেশমের কাপড়টাকে দুপাশ থেকে পেছনে টেনে বাঁধা হয়েছে মুক্তাখচিত ফিতা দিয়ে যাতে করে প্রবেশপথ রাতের উষ্ণ বাতাসে অর্ধেক উন্মুক্ত থাকে।

গুলরুখের দুজন পরিচারিকা তাঁকে পথ দেখিয়ে তাবুর ভিতরে নিয়ে যায় যেখানে সে অপেক্ষা করছে, পরণে গাঢ় বেগুনী রঙের আলখাল্লা এবং একই রঙের শাল সেটাতে আবার রূপার জরি দিয়ে কারুকাজ করা যা তার মাথা আর কাঁধ ঢেকে রেখেছে। কিন্তু গুলরুখের তরুণী পরিচারিকার দল অর্ধ-স্বচ্ছ মসলিনের পোষাক পরিহিত। দপদপ করতে থাকা আলোর মাঝ দিয়ে তারা এগিয়ে যাবার সময়, হুমায়ুনের দৃষ্টি তাঁদের নমনীয় কোমড়ের বাঁক, সুগঠিত স্তন আর ইন্দ্রিয়সুখাবহ গোলাকৃতি উরু আর নিতম্ব আটকে যায়। তাঁদের নাভিমূলে মূল্যবান পাথর ঝলসে উঠে এবং তাঁদের ঘন কালো চুল হিন্দুস্তানী রীতিতে সাদা জুই ফুল দিয়ে বেণী বাঁধা।

অনুগ্রহ করে… গুলরুখ একটা নীচু, মখমল মোড়া আসনের দিকে ইঙ্গিত করে। হুমায়ুন সেখানে আসন গ্রহণ করলে, তাঁর পরিচারিকাদের একজন চন্দন-সুবাসিত, শীতল পানি পূর্ণ কলাই করা সোনালী জগ হাতে তাঁর সামনে নতজানু হয় যখন আরেকজন সুতির একটা কাপড় নিয়ে আসে। হুমায়ুন তার হাত বাড়িয়ে দেয় এবং প্রথম পরিচারিকা তাদের উপরে পানির ধারা বইয়ে দেয়। ধীরে, প্রণয়পূর্ণ ভঙ্গিতে অপরজন সেটা মুছে দেয়।

বিভ্রান্ত হুমায়ুন তার মা আর খানজাদা আর অন্যান্য রাজ মহিষীদের খোঁজে চারপাশে ইতিউতি তাকায়, কিন্তু গুলরুখ আর তার পরিচারিকাদের ছাড়া তারা সম্ভবত সেখানে একা।

আমি ভেবেছিলাম, স্বল্প পরিসরে, আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত উৎসব আয়োজন হয়ত তোমার পছন্দ হবে, গুলরুখ বলে। আজ আমি তোমার একমাত্র আতিথ্যকত্রী কিন্তু আশা করি তুমি আমার অসম্পূর্ণতা মার্জনা করবে।

হুমায়ুন এবার তার আসনে একটু সোজা হয়ে বসে, চোখে সতর্ক দৃষ্টি। গুলরুখ কি করতে চায়? নিশ্চয়ই জানে তাঁর আমন্ত্রণ সে সৌজন্যের খাতিরে গ্রহণ করেছিল- তাঁর বেশী কিছু না-কিন্তু সে বোধহয় আয়োজনটাকে অন্তরঙ্গ কিছু একটায় পরিণত করতে চায়। এক মুহূর্তের জন্য সে ভয় পায় যে গুলরুখ বোধহয়। তাঁকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করবে, হয় সে নিজে বা তাঁর পরিচারিকাদের মাধ্যমে।

আমি তোমার জন্য একটা চমকের বন্দোবস্ত করেছি।

হুমায়ুন চারপাশে তাকায়, মনে ক্ষীণ আশা সে ঘন্টা আর মন্দিরার আওয়াজ শুনতে পাবে এবং সারিবদ্ধভাবে নাচিয়ে মেয়েদের এগিয়ে আসতে দেখবে নিদেনপক্ষে টলমল করে এগিয়ে আসা বাজিকর, দড়াবাজ এবং আগুন-খেকোদের দল যা দরবারের মনোরঞ্জনের বাধা উপকরণ। কিন্তু এর বদলে তার ডান পাশের ছায়ার ভিতর থেকে নমনীয় একটা অবয়ব আবির্ভূত হয়। অবয়বটা সরাসরি তার দিকে এগিয়ে আসলে, হুমায়ুন মেহমেদের ধুসর মুখাবয়ব চিনতে পারে। তুর্কী লোকটা তার সামনে নতজানু হয় এবং একটা পানপাত্র তার দিকে এগিয়ে দেয় যেটা লাল সুরার মতো দেখতে একটা পানীয় দ্বারা ভর্তি।

এটা কি? মেহমেদকে উপেক্ষা করে হুমায়ুন এবার সরাসরি গুলরুখের দিকে তাকায়।

কাবুলের দক্ষিণ থেকে সংগৃহীত উচচণ্ড আফিমের একটা বিশেষ মিশ্রণ এবং গজনীর লাল সুরা, আমি নিজের হাতে মিশ্রিত করেছি আমাদের পরিবারের ভিতরে সীমাবদ্ধ একটা প্রস্তুতপ্রণালী অনুসারে। মাঝে মাঝে তোমার আব্বাজান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন-আমি এটা তার জন্য প্রস্তুত করতাম। তিনি বলতেন পানীয়টা তাকে আত্মহারা করে তুলে…

হুমায়ুন গাঢ়, প্রায় বেগুনী তরলটার দিকে যখন তাকিয়ে থাকে, তাঁর মানসপটে বাবরের একটা ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবি ঝলসে উঠে, যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় লাভের পরে আনন্দে অধীর হয়ে আফিম নিয়ে আসতে বলে নিজেকে আরও তুঙ্গস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে যাবার জন্য…সে তার আব্বাজানের মুখাবয়বে পরমানন্দের অনুভূতি লক্ষ্য করেছে, তার আনন্দদায়ক অনুভূতির চাপা গুঞ্জন শুনেছে। তাঁর নিজের কাছেও অবশ্য আফিম অপরিচিত কিছু না। তার আব্বাজানের মৃত্যুর পরে এটা তার শোককে প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। পরবর্তীতে সে ইন্দ্রিয়পরবশ অবসন্নতা আবিষ্কার করেছে যা গোলাপজলে দ্রবীভূত কয়েকটা বড়ি উৎপন্ন করতে পারে এবং যা রমণের উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাবরকে যেমন আত্মহারা দেখাত সে কদাচিৎ সেরকম পুরোপুরি আত্মহারা হতে পেরেছে।

তুমি কি প্রথমে তোমার ব্যক্তিগত খাদ্য আস্বাদকারীকে ডেকে পাঠাতে চাও?গুলরুখ জানতে চায়। কিন্তু হুমায়ুন কোনো উত্তর দেবার আগেই সে সামনে এগিয়ে এসে মেহমেদের হাত থেকে পানপাত্রটা তুলে নেয় এবং সেটাকে নিজের নিখুঁত ঠোঁটের কাছে তুলে আনে। সে ঢোক গেলাতে তাঁর ভরাট গলা কেঁপে উঠে এবং হুমায়ুন দেখে গুলরুখ নিজের হাত উঁচু করে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসা। তরলের কয়েকটা ফোঁটা ধরে এবং তারপরে কমনীয় ভঙ্গিতে চেটে নিজের আঙ্গুল পরিষ্কার করে।

সুলতান, পান করুন। আপনার জন্য এটা আমার উপহার… হুমায়ুন সামান্য ইতস্তত করে তারপরে পানপাত্রটা হাতে নেয়, তখনও সেটা তিন-চতুর্থাংশ পূর্ণ, এবং সেটাকে নিজের ঠোঁটের কাছে তুলে এনে একটা চুমুক দেয়। সুরাটার স্বাদ কেমন একটু অগ্নিগর্ভ মনে হয়- গুলরুখ নিশ্চিতভাবেই আফিমের হাল্কা তিতা স্বাদ ঢাকতে মশলা ব্যবহার করেছে। হুমায়ুন আবারও পান করে, এইবার আরও জোরালভাবে এবং অনুভব করে তার দেহের ভিতরে এক ধরনের কোমল উষ্ণত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে- গলা দিয়ে সেটা প্রথমে নামে, তারপরে তাঁর পাকস্থলীর গর্ভে গিয়ে থিতু হয়। কয়েক মুহূর্ত পরে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ভারী হয়ে উঠতে থাকে। একটা আনন্দদায়ক, দুর্নিবার একটা নিশ্চেষ্টতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে এবং হুমায়ুন পরিশ্রান্ত একজন মানুষের মতো যিনি একটা নরম বিছানা তাঁর জন্য প্রস্তুত দেখতে পেয়ে সেটাতে শোয়ার জন্য অপেক্ষা করতে অপারগ এমনভাবে নিজেকে এই আলস্যের হাতে সঁপে দেয়।

পানপাত্রে থেকে যাওয়া বাকি পানীয়টুকুও গিলে নেয় সে। তার চোখ ইতিমধ্যে অর্ধেক বন্ধ হয়ে গিয়েছে সে অনুভব করে তাঁর কাছ থেকে একটা কোমল হাত পানপাত্রটা নিয়ে নেয় এবং চেয়ার থেকে তাকে তুলে নিয়ে এবং তাকে পথ দেখিয়ে একটা নরম গদির কাছে নিয়ে আসে যেখানে তাঁরা তাঁকে শুইয়ে দেয়। কেউ একজন তার মাথার নীচে একটা বালিশ রাখে এবং সুগন্ধিযুক্ত পানি দিয়ে আলতো করে তার মুখটা মুছিয়ে দেয়। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে এবং হুমায়ুন বিলাসপ্রিয় ভঙ্গিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। শীঘ্রই তাঁর দেহে এমন একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে যেন একটা শূন্যতার মাঝে দেহটা দ্রবীভূত হচ্ছে। সে নিজের দেহের কোনো অংশই অনুভব করতে পারে না কিন্তু এতে কিবা এসে যায়? তাঁর আত্মা- সে যা তাঁর মূল নির্যাস, পৃথিবীর গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, হেঁটমুখ করে থাকা একটা জমতো না সে একদা যেমন ছিল- যেন তারকা-শোভিত স্বর্গের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা সহসা তাঁর সামনে অবারিত হয়েছে।

নিজের দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে, হুমায়ুন ধূমকেতুর মতো ভাসমান অবস্থায় নিজেকে অনুভব করে। সে নীচে যমুনার বুক চিরে বয়ে যাওয়া পানির গাঢ় স্রোত চিনতে পারে যেমন চিনতে পারে আগ্রা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে গুলরুখের সুরা ভর্তি পাত্রটা। সবদিক ছাপিয়ে হিন্দুস্তানের আপাত সীমাহীন সমভূমি প্রসারিত, উষ্ণ তমিস্র বিদীর্ণ হয়, কখনও এখানে, কখনও সেখানে, তাঁর নতুন প্রজাদের গ্রামের জ্বলন্ত ঘুঁটের আগুনের দ্বারা জোনাকির মতো। তাদের মাটির তৈরী বাড়ির বাইরে বটবৃক্ষ আর বাবলা গাছের নীচে নিজেদের মামুলি বিছানায় তারা টানটান হয়ে শুয়ে আছে, তাঁরা সেইসব মানুষদের স্বপ্নে দেখছে যাদের জীবন ঋতুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কখন বীজ বপন করতে হবে আর কখন শস্য কাটতে হবে এবং যাঁদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা নিজেদের ষাড়ের স্বাস্থ্যসম্পর্কিত এবং তাদের দিয়ে কিভাবে জমি চাষ করবে।

তাঁর আত্মা উড়ে যখন সামনের দিকে এগিয়ে যায়, হুমায়ুন সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করে। কমলা রঙের একটা আলোর কুণ্ডু পৃথিবীর কিনারার উপর দিয়ে ক্ষরিত হয়ে উষ্ণতা আর নবায়ন বয়ে আনছে। এবং এখন ধুসর কমলা আভায় তার নীচে সে কি দেখতে পাচ্ছে?–মহান দিল্লী শহরের প্রাসাদসারি, মিনারসমূহ, এবং অতিকায় সব রাজকীয় সমাধিসৌধ, একদা যা লোদি সুলতানদের রাজধানী ছিল কিন্তু মোগলদের দ্বারা অবজ্ঞাত। হুমায়ুনের অবারিত আত্মা এখনও, হিন্দুস্তানের গরম আর ধূলো পেছনে ফেলে, ভেসে চলে। সে নীচে এখন সিন্ধুর নদের শীতল পানি দেখতে পায়। ওপারে হাড়ের মতো শক্ত আর রঙ জ্বলে যাওয়া সব পাহাড়ের সারি আর কাবুলের দিকে এগিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা গিরিপথ এবং সেটা এরপরে হিন্দু কুশের শক্ত, হীরক উজ্জ্বল চূড়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, মোগলদের পিতৃপুরুষের স্বদেশ মধ্য এশিয়ার সমভূমির প্রবেশদ্বার। তারা কতদূর ভ্রমণ করে এসেছে। কি গৌরব তারা লাভ করেছে। এবং এখনও কি বিস্ময় তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে…এই সমস্ত অন্তদৃষ্টির সাহায্যে নতুন কি উচ্চতায় তারা আরোহন করতে পারে? শূন্যে হুমায়ুনের তখনও ভাসমান আত্মার উপরে আকাশ তরল সোনার মতো দীপ্তি ছড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আলিঙ্গন করে।

১.৫ ভাগ্যের পরিহাস

০৫. ভাগ্যের পরিহাস

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেভাবে শাসন করি সেটা পাল্টে ফেলবো। আমি যেমনটা আশা করি রাজ দরবার মোটেই সেরকম নয়।

হুমায়ুনের সোনার গিল্টি শোভিত সিংহাসনের সামনে অর্ধবৃত্তাকারে আসন-পিঁড়ি হয়ে উপবিষ্ট উপদেষ্টারা, চোখে বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাই দেখে বাইসানগার আর কাশিম, তাঁর প্রতি পুনরায় মনোযোগী হবার পূর্বে, পরস্পরের দিকে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। যাই হোক না কেন তারা অচিরেই চমকপ্রদ ধারণাগুলো বুঝতে পারবে যা তার আফিম-ক্রিয়ায় স্বপ্নে সে লাভ করেছে যখন, শাসনকার্যের প্রাত্যহিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত, তাঁর ভাবনাগুলো তখন যেন স্ফটিক স্বচ্ছতায় প্রবাহিত হয়। সে স্বপ্নে যা কিছু দেখেছে- সবই যেন গ্রহ, নক্ষত্রের গতিপথে লিপিবদ্ধ রয়েছে…

হুমায়ুন তার ডান হাত উত্তোলিত করে এবং তাঁর ব্যক্তিগত জ্যোতিষী সারাফ, কৃশকায়, বয়স্ক আর পাখির চঞ্চুর ন্যায় নাকের অধিকারী একটা লোক যার পরনে বাদামী রঙের বাদামী বর্ণের একটা ঢাউস আলখাল্লা, চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা ভারী ঢাউস খণ্ড শিরাবহুল চওড়া হাতে ধরে সামনে এগিয়ে আসে। ঘোঁতঘোঁত শব্দে স্বস্তি প্রকাশ করে, গ্রহমণ্ডলীর প্রতিকৃতি খচিত সাদা মার্বেলের টেবিলে ঢাউস খণ্ডটা সে নামিয়ে রাখে, হুমায়ুন তাঁর সোনার গিল্টি শোভিত সিংহাসনের যা যা স্থাপন করতে বলেছে।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং পাতা উল্টাতে থাকে যতক্ষণ না সে যা খুঁজছিলো সেটা খুঁজে পায়। সেখানে তাঁর পূর্বপুরুষ, মহান জ্যোতিষবিদ উলুঘ বেগের হাতে তৈমূরের পৌত্র- একটা ছক যেখানে মহাকাশে গ্রহমণ্ডলী আর নক্ষত্রের গতিপথ অঙ্কিত রয়েছে। জটিল এই নক্সাটার দিকে যখন তাকিয়ে থাকে সে, তখন দিব্য অনুষঙ্গগুলো যেন নড়তে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় সফরের আঙ্গিকে, প্রথমে ধীরে কিন্তু যখন গতিবেগ সঞ্চিত হয় তখন যেন একে অন্যকে ধাওয়া করতে থাকে। সে চোখের পলক ফেলে এবং ভালো করে তাকায়, দেখে পাতাটা স্থির হয়ে রয়েছে…এটা নিশ্চয়ই গতরাতে সেবন করা আফিমের প্রতিক্রিয়া। গুলরুখের দ্বারা কেবলই তাঁর জন্য বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে প্রস্তুতকৃত মিশ্রণটা এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে, যা তার আবাসকক্ষে মেহমেদ পৌঁছে দিয়েছে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো জোরাল উপাদান তাতে ছিল। সূর্য দিগন্তের উপরে এক বর্শা পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করবার পরেই কেবল তার ঘুম ভাঙে এবং এমন একটা দিনে যেদিন সে তার অর্ন্তদৃষ্টি প্রকাশ করবে, তাঁকে সকাল সকাল ঘুম থেকে না উঠাবার জন্য সে জওহরকে ভর্ৎসনা করে।

হুমায়ুন সহসা সচেতন হয়ে উঠে, টের পায় তার উপদেষ্টারা তাঁর দিকে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে তারাও এখানে উপস্থিত আছে। সে নিজেকে সোজা করে দাঁড় করায়। তোমরা জান আমি গ্রহ আর নক্ষত্রের শেষ না হওয়া আবর্তন পর্যবেক্ষন করেছি, যেমনটা করেছিলেন আমার পূর্বপুরুষ। উলুঘ বেগ। অনেক ভাবনা চিন্তার পরে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে তার গবেষণাকে আমরা অতিক্রম করে যেতে পারি এবং সেই তারকারাজির ছক আর সারণি এবং বহু পূর্বে সংঘঠিত ঘটনাবলীর নথী যখন বিজ্ঞ জ্যোতিষীর সহায়তায় এবং কোনো মানুষের শুদ্ধ ভাবনার আপন ক্ষমতার দ্বারা বিবক্ষিত হয়, সেটা থেকে জীবনযাপন প্রণালীর এমনকি শাসনকার্যের একটা কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব।

তার উপদেষ্টাদের অভিব্যক্তির দ্বারা হুমায়ুন বুঝতে পারে সে কি বিষয়ে কথা বলছে সে সম্বন্ধে এখনও তাদের কোনো ধারণা নেই। কিন্তু তাঁরা তাহলে কিভাবে এটা পারবে? সে যা অবলোকন করেছে তারা সেসব কিছুই দেখেনি যখন গুলরুখের উপাচারের কল্যাণে মুক্তি লাভ করে। তারা কল্পনাও করতে পারবে না সে মানসপটে এমনসব কল্পলোকে সে ভ্রমণ করে এসেছে। কিন্তু সে তার শাসনপদ্ধতিতে যে ব্যাপক উন্নতিসাধনের পরিকল্পনা করেছে তারা সে বিষয়ে অচিরেই জানতে পারবে।

আমি অনুধাবন করতে পেরেছি যে আমরা গ্রহমণ্ডলী আর নক্ষত্র থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার অধীনে তারা আমাদের পরিচালনা করে, কিন্তু একজন ভালো শিক্ষকের ন্যায় আমাদের অনেক কিছু শেখাতেও পারে। আগামীতে আমি কেবল সেদিনের জন্য আদিষ্ট নক্ষত্র যেসব বিষয়কে মঙ্গলময় বলে বিবেচনা করবে কেবল সুনির্দিষ্ট সেসব বিষয় আমি বিবেচনা করবো… এবং সে অনুযায়ী মানানসই পোষাক পরিধান করবো। নক্ষত্ররাজি আমাদের বলছে যে আজকের দিনটাকে, মানে রবিবারকে পরিচালনা করছে সূর্য যাঁর সোনালী রশ্মি সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। সেজন্য এখন থেকে রবিবার, উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের কাপড়ে সজ্জিত হয়ে আমি রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের বিহিত করবো। সোমবার-চন্দ্র এবং প্রশান্তির জন্য নির্দিষ্ট দিন- সেদিন অবসর সময় কাটাব এবং সবুজ রঙের পোষাক পরিধান করবো যা প্রশান্ত অভিব্যক্তির রঙ। মঙ্গলবার এই দিনটা সৈন্যদের পৃষ্টপোষক, মঙ্গলগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট- সেদিন যুদ্ধ আর ন্যায়বিচারের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদির নিষ্পত্তিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। সেদিন আমি মঙ্গলের জন্য নির্দিষ্ট লাল পোষাক পরিধান করবো, প্রতিশোধ আর ক্রোধের রঙ এবং বজ্রপাতের দ্রুততায় একই সাথে শাস্তি আর পুরষ্কার বন্টনে পারদর্শী। পুরস্কৃত করার জন্য কোষাগারের সম্পদ প্রস্তুত রাখা হবে এমন কারো জন্য যাকে উপযুক্ত মনে করবো, একই সাথে রক্ত লাল পাগড়ি মাথায় প্রহরীর দল কুঠার হাতে বর্ম পরিহিত অবস্থায় আমার সিংহাসনের সামনে প্রস্তুত থাকবে সাথে সাথে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে…

শনিবার- শনি গ্রহের জন্য আদিষ্ট দিন- এবং বৃহস্পতিবার বৃহস্পতি গ্রহের দিন-শিক্ষা আর ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি দিনটাকে উৎসর্গ করতে এবং বুধবার- বুধ গ্রহের দিনটা হবে আনন্দোচ্ছল যখন আমরা বেগুনী রঙের পোষাক পরিধানের ব্যাপারটা আসলে ঠিক কি? যেকোনো পুরুষ আর মহিলা ওয়ার্নার ব্রাদার্সের কাছে উপস্থিত হলে, তার বোনের পরণে আজকে বেগুনী বর্ণের পোক। এবং শুক্রবার নীল পোষাকে সজ্জিত হবো, অনেকটা সবকিছুকে আকর্ষণকারী নীল আকাশের মতো, এদিন আমি যেকোনো বিষয়ের বিহিত করতে পারি। যেকোনো নারী কিংবা পুরুষ- তারা কতটা দরিদ্র কিংবা বিনয়ী সেটা বিবেচ্য না আমার কাছে আসতেই পারে…তাদের যা করতে হবে সেটা হল ন্যায়বিচারের দামামাটাকে তাঁদের পরাস্ত করতে হবে আমি সেটাকে দরবার কক্ষের বাইরে স্থাপণের আদেশ দিয়েছি।

হুমায়ুন আরো একবার কথা বন্ধ রাখে। কাশিমকে, যে তাঁর খতিয়ান বইয়ে হুমায়ুনের ঘোষণা লিপিবদ্ধ করছিলো, দেখে মনে হয় সে যেন বাক্যের মাঝখানে থমকে গিয়েছে আর বাইসানগার তার বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে বহু বছর আগে তার কর্তিত ডান হাতের জায়গায় স্থাপিত ধাতব আকর্ষী টানছে। অবশিষ্ট উপদেষ্টারা তার ঘোষণা শুনে চোখেমুখে বিস্ময় এঁকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু তারা একটা সময় তার অন্তৰ্জনকে ঠিকই গ্রহণ করবে। নক্ষত্ররাজি আর গ্রহমণ্ডলীর যান্ত্রিক গতিবিধির মাঝে সবকিছু যথাযথভাবে তাঁদের আদিষ্ট স্থানে রয়েছে। এবং একটা বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ঠিক এমনই হওয়া উচিত। সবকিছু যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে এবং যথাযথ সময়ে…

দুই কি এক মিনিট বিরতির পরে হুমায়ুন ধীরে ধীরে বলতে থাকে, তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট আর আনুষ্ঠানিক। আমি আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আমি পুনর্গঠিত করবো চারটা প্রধান উপাদানের কোনটা- অগ্নি, বায়ু, জল এবং মৃত্তিকা- তাঁদের উপরে আধিপত্য করে। আমার সেনাবাহিনীর জন্য জবাবদিহি করবে অগ্নির আধিপত্য বিশিষ্ট দপ্তর। বায়ুর আধিপত্যযুক্ত দপ্তর জবাবদিহি করবে রন্ধনশালা, অশ্বশালা আর পোশাকভাণ্ডারের। জলের আধিপত্যবিশিষ্ট দপ্তর আমার সাম্রাজ্যের সব নদী আর জলাশয়ের সবকিছুর জন্য জবাবদিহি করবে, সেচের ব্যবস্থা আর রাজকীয় মদ্য-ভাণ্ডারের দায়িত্ব এই দপ্তরের উপরে অর্পিত হবে। আর মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যযুক্ত দপ্তর কৃষিকাজ আর ভূমি প্রদান বা মঞ্জুরির দায়িত্ব পালন করবে। আর সব সিদ্ধান্ত, কর্মোদ্যোগ রাশিফলের গণনার নির্দেশনার সাথে সঙ্গতি রেখে গৃহীত হবে কেবল একটা বিষয় নিশ্চিত করতে যে সবচেয়ে মাঙ্গলিক উপায় অনুসৃত হয়েছে…।

আর তোমরা আমার উপদেষ্টা আর অমাত্যবৃন্দ-এই নতুন কাঠামোর ভিতরে তোমাদের সবার সুনির্দিষ্ট স্থান থাকবে। রাশিফল পর্যালোচনা করলে আমরা জানতে পারি যে মানুষকে সাধারণত তিনটা শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। আমার অভিজাত ব্যক্তি, আধিকারিক আর সেনাপতি, তোমরা সবাই সরকারের মন্ত্রীবর্গ। কিন্তু সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি আর কল্যাণের জন্য অন্য শ্রেণী দুটো গুরুত্বপূর্ণ- মহানুভব মানুষের কাফেলা, যাদের ভিতরে রয়েছে আমাদের ধর্মীয় নেতা, দার্শনিক, জ্যোতিষী আর বিনোদনের কর্তাব্যক্তিরা যাদের ভিতরে আছে কবি, গায়ক, জাদুকর, চারু আর কারুশিল্পী- যারা আমাদের জীবনকে সুন্দর আর সমৃদ্ধ করে ঠিক যেমন করে তারকারাজি আকাশকে সাজিয়ে তুলে। এই তিনটা শ্রেণীর প্রতিটাকে বারোটা স্তরে বিভক্ত করা হবে আর প্রতিটা স্তরে আবার তিনটা করে পদমর্যাদা থাকবে- উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন। আমি যথা সময়ে তোমাদের সবাইকে জানিয়ে দেব কোনো শ্ৰেণী আর পদমর্যাদা তোমাদের জন্য ধার্য করেছি…তোমরা এবার যেতে পার। আমার এখনও অনেককিছু চিন্তা করা বাকি।

শারাফ ব্যতীত নিজের দর্শনাথী কক্ষ থেকে যখন সবাই বিদায় নেয় তখন হুমায়ুন পুনরায় উলুঘ বেগের নক্ষত্রের সারণি পরীক্ষা করে, সময়ের সব বোধ তাঁর লুপ্ত হয়। প্রথম ঘন্টা শেষ হতে পরবর্তী ঘন্টা তার ক্ষণ গণনা শুরু করে। সূর্য অস্ত যেতে শুরু করলে, আগ্রা দূর্গের দিকে বেগুনী ছায়া গুটিসুটি পায়ে এগিয়ে আসতে থাকলে, তখনি কেবল হুমায়ুন সারণির পাতা থেকে মুখ তুলে তাকায়। সে যখন তার আবাসনকক্ষের দিকে ফিরে আসছে তখন আফিমের নির্যাস সিক্ত সেই ঘন সুরার জন্য তার ভিতরে একটা আকুল আকাঙ্খার জন্ম হয় যা তাঁর আত্মাকে বন্ধনমুক্ত করে তাঁর মাঝে পুনরায় উত্থিত করে এবং নিজের অজান্তেই তাঁর হাঁটার গতি দ্রুত হয়ে উঠে।

*

কাশিম, আমি বুঝতেই পারিনি এত সময় অতিবাহিত হয়েছে, হুমায়ুন নিজের চোখ কচলায় এবং যেখানে ছিল সেখান থেকে সটান উঠে দাঁড়ায় আর সেখান থেকে বেগুনী-রেশমী কাপড়ে-আবৃত ডিভানে সে তাসের ঘরের মতো ভেঙেচুরে শুয়ে পড়ে। ডিভানটায় একটা পরস্পরচ্ছেদী নক্ষত্ররাজির জটিল নক্সা সোনার জরি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং হুমায়ুন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এটার উপরে শুয়ে অনেক গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে। পরিষদমণ্ডলী কি এখনও সমবেত রয়েছে? বাংলায় আমার মনোনীত রাজ্যপালের কাছ থেকে আগত প্রতিনিধির কি সংবাদ?

অনেকক্ষণ আগেই পরিষদমণ্ডলীর সভা শেষ হয়েছে। আর আপনার প্রতিনিধির খবর বলতে ইতিমধ্যে বহুবার তার সাথে সাক্ষাঙ্কার বাতিল করেছেন কারণ আপনি মনে করেন এ ধরনের আলোচনার জন্য বর্তমান সময়টা ঠিক উপযুক্ত না এবং একবার- সুলতান, এটা উল্লেখ করার জন্য আমায় মার্জনা করবেন- যখন আপনার উপস্থিতিতে দর্শনার্থী কক্ষে ভুল দরজা দিয়ে প্রবেশ করায় নিজের উপস্থিতিতে দর্শনার্থী কক্ষ থেকে তাঁকে বিবাসিত করেছিলেন, সেই দিনটাও এমন প্রকৃতির আলোচনার জন্য খুব একটা মঙ্গলময় নয় বলে আপনার ধারণা। গঙ্গা আর যমুনার বুক চিরে বাংলায় যাবার সময়টা ক্রমেই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে এবং আরও অপেক্ষা করাটা তার জন্য ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। বাইসানগার আর আমি তাই আপনার পক্ষ অবলম্বনপূর্বক নির্দেশনা প্রদানের গুরু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে কর আরোপের মাত্রা এবং সৈন্য সংখ্যা কতটা বৃদ্ধি করতে হবে সেটা নির্ধারন করেছি। নিজের নৌকায় আরোহন করে সে ফিরতি পথে রওয়ানা হতে দুই ঘন্টা আগে তারা নোঙর তুলেছে।

এই দুই বৃদ্ধ তাঁর কর্তৃত্বের মাঝে অন্যায়ভাবে নাক গলিয়েছে ধরে নিয়ে হুমায়ুন ক্ষনিকের জন্য ক্রুদ্ধ হয়।

সুলতান, আমরা যা বলেছি আপনি যদি তার সাথে ভিন্ন মতো পোষন করেন তাহলে অবশ্যই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আরেকটা দ্রুতগামী নৌকা পাঠাতে পারি।

কাশিম নিশ্চিতভাবেই তাঁর বিরক্তি আঁচ করতে পেরেছে, হুমায়ুন ভাবে। তারই অন্যায় হয়েছে। বার্তাবহ কূটনীতিক লোকটা একাধারে বাঁচাল এবং সেই সাথে বিরক্তিকর। সে ইচ্ছাকৃতভাবেই লোকটার সাথে দেখা করতে দেরী করেছে, কখনও এমনসব অজুহাত দেখিয়েছে যা তার নিজের কাছেই অনেকসময় অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হত। হুমায়ুন তাঁর কণ্ঠস্বরের তীব্রতা হ্রাস করে। কাশিম, আমি নিশ্চিত যে আগামীকাল সকালে আমি যখন শুনবো আপনি আর বাইসানগার কি উপদেশ দিয়েছেন সেটা আমার পছন্দই হবে। এখন আপনি যান, আমি আরেকটু বিশ্রাম আর নিরুদ্বিগ্নভাবে সময় কাটাতে চাই।

কাশিমকে দেখে মনে হয় সে আরও কিছু বলতে চায়, সে দাঁড়িয়ে থেকে কেবল দুই পায়ের উপরে দেহের ভার পরিবর্তন করে আর বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে নিজের আলখাল্লার একটা সোনালী টাসেল নিয়ে আপনমনে নাড়াচাড়া করে। তারপরে সে নিজের মন ঠিক করে এবং যা বলতে চেয়েছিল সেটা বলতে শুরু করে। সুলতান, আপনি বোধহয় অবগত আছেন যে আপনার মরহুম আব্বাজান আর আপনার অধীনে কত দীর্ঘ সময় আমি বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্বপালন করছি।

হ্যাঁ, আর আমি সেটার প্রশংসাও করি।

আমি কি তাহলে আমার এতো বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাকে সামান্য কিছু পরামর্শ দিতে পারি? সুলতান মার্জনা করবেন কিন্তু আমি না বলে পারছি না, আপনি আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। আপনার আব্বাজানও সুরা আর ভাঙ- গাঁজার মতোই আফিমটাও উপভোগ করতেন।

তবে?

আমাদের ভিতরে অনেকেই এসব নেশাজাতীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশী সহজাত সহ্যক্ষমতার অধিকারী হয়। এমনকি আমার যখন বয়স অল্প ছিল, ভাঙের কারণে কখনও এমনও হয়েছে যে পরপর বেশ কয়েকদিন আমি সব কাজ ফেলে নির্জীবের মতো পড়ে রয়েছি তাই আপনার আব্বাজানের শত অনুরোধ সত্ত্বেও এধরনের উপাচার গ্রহণ করা থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিরত রাখি। মহামান্য সুলতান আপনি যতটা অনুমান করছেন এগুলো সম্ভবত তারচেয়েও বেশী আপনাকে প্রভাবিত করছে।

না, কাশিম। তাঁরা আমাকে চিন্তা করতে আর দেহমনকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। আপনি কি আমাকে এটাই বলতে চেয়েছিলেন?

হ্যাঁ, কিন্তু অনুগ্রহ করে কেবল একটা কথা মনে রাখবেন যে এমনকি আপনার আব্বাজানও প্রতিদিন এই জিনিষটাকে প্রশ্রয় দিতেন না, বিশেষ করে যখন তাঁকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। কাশিম মাথা নত করে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে, হুমায়ুন তাঁর বলিরেখা পূর্ণ মুখমণ্ডলে গভীর দুশ্চিন্তার একটা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তার উৎকণ্ঠায় কোনো খাদ নেই। আত্মবিলোপী, স্বল্পভাষী এই বৃদ্ধ লোকটাকে এই অল্প কয়টা কথা বলতে গিয়ে প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। হুমায়ুন তার উপরে রাগ করতে পারে না।

আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার কথাগুলো আমি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবো।

*

হুমায়ুনের সিংহাসনের সামনে পরিচরেরা আকাশের মতো দেখতে রেশমী নীল রঙের একটা বিশালাকৃতি বৃত্তাকার কার্পেট বিছান শুরু করতে সে চোখেমুখে সন্তুষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কার্পেটের জমিনে অনেকগুলো বৃত্তের একটা পর্যায়ক্রমের রূপরেখা- লাল, হলুদ, বেগুনী আর সবুজ রঙের শিকল ফোড়ের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং গ্রহমণ্ডলী উপস্থাপনকারী বৃত্তগুলো- সে যেভাবে আদেশ দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই স্থাপন করা হয়েছে। তাঁতিদের সে পুরস্কৃত করবে তাঁদের এই অসামান্য দক্ষতা এবং যত দ্রুত তারা তার এই পরিষদমণ্ডলীর কার্পেটকে বাস্তবতা দান করেছে।

কয়েকমাস আগে বিশেষভাবে প্রাণবন্ত একটা স্বপ্নবেশের সময় সে প্রথম ধারণাটা লাভ করে- গুলরুখের আফিম আর সুরার মিশ্রণ পান করার পরে বাস্তবিকই তাঁর মাদকজনিত ঘুম প্রতিবারই যেন আরও বেশী চমকপ্রদ আর গুপ্ত তথ্যের বিস্ময়কর প্রকাশ হয়ে উঠছে। তারকাণ্ডলীর একটা যেন বিশেষভাবে তাকে কিছু বলতে চায়, এমন একটা কার্পেট তৈরী করতে বলে যার ফলে তাকে পরামর্শ দেবার কালে তার উপদেষ্টারা যে বিষয়ে সেই বিশেষ মুহূর্তে আলোচনা করছে সেই বিষয়ের সবচেয়ে নিয়ামক গ্রহের উপরে অবস্থান করতে পারে। সে কার্পেট তৈরীর বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রেখেছিল, দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই যেন তাঁতিরা কার্পেটের বয়ন অব্যাহত রাখে সেটা সে নিশ্চিত করেছিল। শারাফ ব্যতীত আর কেউ এই কার্পেট বয়নের কথা জানতো না- না বায়সানগার, না কাশিম এমনকি খানজাদাকেও সে কিছু জানায়নি। তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর সবার মতো, তাঁদের কাছেও ব্যাপারটা একটা চমক হিসাবে থাকুক, তাঁর সাথে যোগ দেবার জন্য তিনজনকেই এখন এখানে আসতে বলেছে সে।

উপদেষ্টাবৃন্দ দ্রুতই এসে উপস্থিত হয়। দিনটা আজকে বুধবার বিধায় হুমায়ুনের মতো তাঁদেরও পরণে উজ্জ্বল বেগুনী রঙের আলখাল্লা এবং কোমরে কমলা রঙের পরিকর। হুমায়ুন সামনে বিস্তৃত হাল্কা নীলের ঝকঝকে বৃত্তের দিকে সবাইকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে। বাবা ইয়াসভালো নিজের বিভ্রান্তি লুকিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না।

এই বিস্ময়কর কার্পেটটা সম্বন্ধে আপনাদের তারিফ শোনার জন্য এখানে আসতে বলেছি। আমাদের মাথার উপরের চিরচেনা আসমানের একটা প্রতিকৃতি এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই বৃত্তগুলো একেকটা গ্রহকে উপস্থাপন করছে এই যে এখানে রয়েছে, মঙ্গল, বুধ আর বৃহস্পতি আর ওখানে দেখছেন আমাদের সবার পরিচিত চাঁদকে। আপনাদের কারও যদি আমাকে কিছু বলার থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই উপযুক্ত বৃত্তের উপরে দাঁড়িয়ে সেটা উপস্থাপন করতে হবে। কেউ যদি আমার সাথে সামরিক বিষয়ে কিছু আলাপ করতে চায় তাকে অবশ্যই সেটা মঙ্গলের উপরে দাঁড়িয়ে বলতে হবে। যার ফলে আপনারা গ্রহমণ্ডলীকে সাহায্য করবেন আপনাদের পরিচালিত…

হুমায়ুন নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে কিন্তু সহসা কোনো উপদেষ্টার মুখ আলাদা করে চিনতে পারে না- ভাবনায় কটি করা ললাট নিয়ে কে ওখানে দাঁড়িয়ে, কাশিম? …সে নিশ্চিত হতে পারে না…তার চারপাশের সবকিছুই যেন কেমন অস্পষ্ট। নিবিষ্টভাবে নক্ষত্রদের অবলোকনের জন্য রাতের বেলা আগ্রা দূর্গের প্রাকারবেষ্টিত ছাদে উঠে একাগ্র দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিংবা দীর্ঘক্ষণ নক্ষত্রদের সারণি পর্যালোচনা করার কারণে হয়ত ক্লান্তি এসে তার চোখের দৃষ্টি এমন ঝাপসা করে তুলেছে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। হ্যাঁ, কাশিমই তার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এবং বাবা ইয়াসভালের চোখে মুখে, সম্ভবত কার্পেটের প্রতীকীত্বের ক্ষমতা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে, অথৈ জলে পড়া সাঁতার না জানা লোকের দৃষ্টি। কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা আসাফ বেগ কি ভাবছে? হুমায়ুনের কার্পেট খুটিয়ে দেখার সময় তার চেহারায় যেন একটা হাসির ভাব ফুটে উঠে- ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার ফণা। হুমায়ুনের দিকে সরাসরি তাকাবার জন্য সে যখন মাথা উঁচু করে তার অভিব্যক্তিতে তখন যেন ব্যঙ্গ-পরিহাসের চেয়েও ভিন্ন কিছু একটা ফুটে উঠে। হুমায়ুনের মাঝে দাবানলের মতো ক্রোধের একটা ঝাপটা বয়ে যায়। কাবুলের এই আকাঁ মূর্খ ছিঁচকে গোত্রপতির এভোবড় স্পর্ধা নিজের সম্রাটকে উপহাস করে?

এই যে আপনি! হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং ক্রোধে কাঁপতে থাকা আঙ্গুল তুলে আসাফ বেগকে নির্দেশ করে। আপনার এতখানি ধৃষ্টতা, ঠিক আছে আপনার এই অবজ্ঞার উপযুক্ত পুরষ্কারই আপনি পাবেন। প্রহরী- এই উজবুকটাকে বাইরের প্রাঙ্গণে নিয়ে গিয়ে পঞ্চাশ ঘা দোররা লাগাও। আসাফ বেগ নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন এই জন্য যে মাথার বদলে আজ কেবল আপনার নিতম্বের চামড়াই খোয়ালেন।

একটা সম্মিলিত শ্বাস নেবার শব্দের সাথে সাথে দরবারের ভিতরে কবরের স্তব্ধতা নেমে আসে। তারপরে একটা কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সুলতান…

সমালোচনা কিংবা মতানৈক্য কোনটাই সহ্য করবে না বলে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে, ক্রুদ্ধ বাঘের ঝাঁপট নিয়ে হুমায়ুন ঘুরে তাকায় কিন্তু দেখে সেটা কাশিমের কণ্ঠস্বর। তার এবং আব্বাজানের অধীনে যে লোকটা দায়িত্বের সাথে কর্তব্যরত ছিল, এবং যাকে সে বিশ্বাস করে, সেই লোকটার চেহারায় সত্যিকারের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ফুটে উঠতে দেখে, তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হতে শুরু করে। একই সাথে সে অনুভব করে তার শ্বাসপ্রশ্বাস অনিয়মিত, নাড়ীর স্পন্দনে ঘোড়ার খুরের বোল আর কপালে স্বেদবিন্দুর সৃষ্টি হয়েছে।

কাশিম, আপনি কি কিছু বলবেন?

সুলতান, আমি নিশ্চিত যে আপনাকে অসম্মান করাটা আসাফ বেগের অভিপ্রায় ছিল না…পুর্নবিবেচনার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।

আসাফ বেগ, ভয়ে বিবর্ণ এবং তাঁর চওড়া ঠোঁটে হাসির লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না আর সচরাচর হাস্যোজ্জ্বল, চোখে মিনতি নিয়ে হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের মতো অসম্মান আসাফ বেগের সাথে সাথে তার গোত্রের জন্যও ভীষণ অপমানজনক বলে বিবেচিত হবে, হুমায়ুন সেটা ভালো করেই জানে। যুদ্ধক্ষেত্রে আসাফ বেগের সাহসিকতার কথা সে বিবেচনা করে। নিজের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য সে ইতিমধ্যেই অনুতপ্ত।

কাশিম- বরাবরের মতোই, আপনি যথার্থই বলেছেন। আসাফ বেগ, আমি এবারের মতো আপনাকে মার্জনা করলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে আর কখনও আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে যাবেন না তখন হয়ত আমি এতটা দয়ালু নাও হতে পারি। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় নিজের উপদেষ্টাদের বিদায় নেবার ইঙ্গিত করতে তারা সবাই সচরাচরের চেয়ে যেন দ্রুতই তাঁর আদেশ পালন করে। হুমায়ুন যখন আবার বসে সে নিজেকে তখন থরথর তরে কাঁপতে দেখে। কার্পেটের আবেদন পুরোপুরি লুপ্ত হয়েছে। রাতও অনেক হয়েছে। বিশ্রামের জন্য বোধহয় তাঁর এখন নিজের আবাসনকক্ষে ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে নিজের কক্ষে যখন প্রবেশ করতে খানজাদাকে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে বিস্মিত হয়।

ফুপুজান, কি ব্যাপার?

তোমার পরিচরদের বিদায় কর। আমি তোমার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই।

হুমায়ুন জওহর আর অন্যান্য পরিচরদের ইঙ্গিতে বাইরে যেতে বলে। দুই পাল্লার দরজা বন্ধ হয়েছে কি হয়নি খানজাদা শুরু করেন। ঝরোকার পেছন থেকে আজ উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনার সময়ে কি হয়েছে আমি সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। হুমায়ুন…এমনটা ঘটা সম্ভব আমি কল্পনাও করতে পারি না…প্রথমে তুমি একজন মোহগ্রস্ত লোকের মতো আচরণ করলে এবং তারপরে বদ্ধ উন্মাদের মতো…

আমার উপদেষ্টারা সবসময়ে বুঝতে পারে না, আমি যা করছি সেটা যে মঙ্গলের জন্য কিন্তু আপনার সেটা বুঝতে পারা উচিত। একজন শাসকের কাছে নিজেকে জাহির করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আপনার কাছেই আমি শিখেছি তুল্যমূল্য অনুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ আপনিই দিয়েছিলেন এবং শাসনকার্যের সহায়ক হিসাবে কৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবহারে আমাকে উৎসাহিত করেছেন…

কিন্তু সেজন্য যুক্তি বা মানবতাকে বিসর্জন দিতে বলিনি…

নক্ষত্রদের বরাভয় স্মরণে রেখে আমি নতুন পদ্ধতি আর রীতির পরিকল্পনা করেছি। শাসনকার্য এর ফলে সহজ হবে। আমার উপদেষ্টা আর পরামর্শদাতারা যদি আমার নির্দেশনা অনুসরণ করে তাহলে দরবার কক্ষে সময়ের বিরক্তিকর অপচয় হ্রাস পাবে, ভাগ্যেচক্রের অথৈই গভীরতায় আরও ব্যাপক অনুসন্ধানের জন্য আমাকে মুক্তি দেবে।

নক্ষত্রের নখরামি আপাতত বাদ দাও। তোমার সমস্ত মনকে তারা আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং তুমি বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। আমি তোমাকে আগেও সতর্ক করতে চেয়েছি কিন্তু তুমি আমার কথায় কর্ণপাত করেনি। এখন তোমাকে নিশ্চয়ই শুনতে হবে নতুবা যা কিছু অর্জনের জন্য তুমি বিচেষ্টিত হয়েছে সেসব কিছু তোমার হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে- তোমার আব্বাজানের অর্জিত সবকিছু… হুমায়ুন আমার কথা কি আদৌ তোমার কানে যাচ্ছে?

হ্যাঁ, আমি শুনছি। কিন্তু সে মনে মনে ভাবে, খানজাদা ভুল করছে…তাকে দীর্ঘদিন ধরে একাধারে কষ্ট দিয়েছে আবার আকর্ষণ করেছে অন্য যেসব প্রশ্নগুলো তাদের উত্তর সে কেবল গ্রহ আর নক্ষত্রের বিন্যাসের মাঝে খুঁজে পেতে পারে। নিয়তির দ্বারা আসলেই কি সবকিছু কোনোভাবে পূর্ববিহিত করা? তার আব্বাজানের অকালমৃত্যু কি আসলে আরেকটা বিশাল পরিকল্পনার একটা অংশ? একটা মানুষের নিয়তির কতটুকু তার নিজের হাতে থাকে? নিয়তির কতটুকু পূর্বনির্ধারিত যেমন অবস্থান বা পরিবার যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এর সাথে প্রাপ্ত সুবিধা আর দায়িত্বসমূহ? এবং সে এসব কিভাবে জানতে পারবে…? একজন বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু হুমায়ুনের যৌবনে যার সাথে তার দেখা হয়েছিল- কাবুল থেকে প্রায় একশ মাইল পশ্চিমে বামিয়ানের উপত্যকায় পাহাড়ে খোদাই করা বিশাল এক বৌদ্ধ মূর্তির পাশে সেই ভিক্ষুর নির্জন আশ্রয়ে, তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে তার জন্মের সময়, স্থান এবং তারিখ নির্ভুল আর ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বলতে পারলে তিনি হুমায়ুনের জীবনের পরিণতি কেবল না সেইসাথে পরবর্তী জীবনে কোনো প্রাণী হিসাবে তাঁর পুনর্জন্ম হবে সবকিছু আগাম বলতে পারবেন। তাঁর কাছে পুনর্জন্মের ধারণাটা অবান্তর মনে হয়েছে কিন্তু সেই ভিক্ষুর বাকি কথাগুলো তাকে ভাবিত করে তুলে। সে ইতিমধ্যে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে- যে রাশিচক্র আর গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান, সারণি এবং বহুকাল পূর্বের ঘটনাবলীর লিপিবদ্ধ ভাষ্য যার অধ্যয়নে সে প্রচুর সময় ব্যয় করেছে এবং তাঁর আফিম-উদ্বুদ্ধ স্বপ্নে তাঁর কাছে জীবন্ত বলে প্রতিয়মান স্বপ্নগুলো দ্বারা সে জীবন যাপন আর শাসনকার্যের একটা কাঠামো সৃষ্টি করতে পারবে এবং ইতিমধ্যে সেই কাজে অনেকদূর অগ্রসরও হয়েছে।

হুমায়ুন! তুমি কি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে?

খানজাদার কণ্ঠস্বর মনে হয় যেন দূরে কোথায় থেকে ভেসে আসছে এবং সে যেন তার দিকে তাকিয়ে থাকায় তার আকৃতি হ্রাস পেতে শুরু করে, সে একটা খর্বকায় পুতুলে পরিণত হয় যে কিনা অনবরত নিজের হাত আন্দোলিত করছে আর মাথা নাড়ছে। পুরো ব্যাপারটাই একটা হাস্যরসাত্মক মাত্রা লাভ করে।

তুমি কি বিপদের ভিতরে আছো, আমি যখন সে বিষয়ে কথা বলছি তুমি হেসেই চলেছো… খানজাদা তার বাহু দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরলে, তার তীক্ষ্ণ নখ হুমায়ুনের বাহুর মাংসের গভীরে গেঁথে বসে, তাঁকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে কথা না বললেই চলছে না… যা কিনা সম্ভবত আমিই তোমাকে বলতে পারি… কিন্তু মনে রেখো তোমায় ভালোবাসি বলেই কথাগুলো আমি বলছি।

আপনি যা বলতে চান বলতে পারেন।

হুমায়ুন, তুমি আফিমে আসক্ত হয়ে বিভ্রান্তির মাঝে দিনযাপন করছে। একটা সময়ে যোদ্ধা হিসাবে, শাসক হিসাবে তোমার সুনাম ছিল। কিন্তু এখন একজন ভাবুক আর কল্পনাবিলাসী ছাড়া তোমাকে কি অন্য কিছু বলা যাবে? আমি কখনও চিন্তাও করিনি এই কথাগুলো আমি কখনও তোমায় বলবো…কিন্তু একজন শাসককে অবশ্যই দৃঢ়চেতা হতে হবে, তাকে অবশ্যই হতে হবে সিদ্ধান্তগ্রহণে সক্ষম। তাঁর প্রজারা সবসময়ে যেন জানে যে তার উপরে তারা নির্ভর করতে পারে। এসব তুমি জান। এসব বিষয়ে তুমি আর আমি অতীতে কতবার না আলোচনা করেছি। আজকাল কদাচিৎ তোমার সাথে আমার দেখা হয়… এবং আমি যখন দরবারের দিকে তাকাই সেখানে আমি কেবল আতঙ্কিত আর অনিশ্চিত অভিব্যক্তি দেখতে পাই, আর তোমার পিঠ পেছনে আড়ষ্ঠ হাসির শব্দে আমার কান বিদীর্ণ হয়। এমনকি যারা তোমায় একসময়ে ভালো করে চিনতো এবং দীর্ঘদিন বিশ্বস্ততার সাথে তোমায় আজ্ঞা পালন করছে- কাশিম আর বাবা ইয়াসভালো যেমন- তাঁদের কাছেও তুমি একজন আগন্তুকে পরিণত হয়েছে। তোমার বিবেচনাবোধের উপরে তারা আজকাল আর আগের মতো আস্থা রাখতে পারছে না। তোমার প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁরা সন্দিহান তাদের আচরণে তুমি প্রসন্ন হবে না ক্রুদ্ধ হবে তাই নিয়ে তারা সবসময়ে সন্ত্রস্ত থাকে। কখনও ঘন্টার পর ঘন্টা তারা তোমার কাছ থেকে নিজেদের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো নির্দেশনা কিংবা মন্তব্য জানতে পারে না… এমনকি কখনও এমন পরিস্থিতি কয়েক দিনও বিরাজ করে…

খানজাদা পূর্বে কখনও তাঁর সাথে এভাবে কথা বলেনি এবং নিজের ভেতরে একটা বিরক্তি জমছে সে বুঝতে পারে। যদি আপনি কিংবা আমার অমাত্যরা আমার সিদ্ধান্তসমূহ এবং সাম্রাজ্য আমি যেভাবে শাসন করবে বলে মনস্থির করেছি। সেটা সম্বন্ধে বৈরী মনোভাব পোষণ করেন তাহলে বুঝতে হবে বিষয়টা আপনাদের কাছে বোধগম্য হয়নি। কিন্তু অচিরেই এমন একটা সময় আসবে যখন দেখবেন আমি আমাদের সবার মঙ্গলের জন্যই সবকিছু করেছি।

সময় এখন আর তোমার অনুকূলে নেই। তুমি যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে ব্যর্থ হও, তোমার অনুগত সেনাপতি আর অভিজাতদের মনোযোগ তখন তোমার সৎ-ভাইদের দিকে আকৃষ্ট হবে। বিশেষ করে আমি কামরানের কথা বলছি। হুমায়ুন, মাথা স্থির করে একবার ভেবে দেখো। সে বয়সে তোমার চেয়ে কয়েকমাসের ছোট এবং ইতিমধ্যে নিজের শাসনাধীন প্রদেশে একজন দক্ষ যোদ্ধা আর কঠোর শাসক হিসাবে সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। তোমার মতোই তারও ধমনীতে বাবর আর সেইসাথে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তুমি জান সে উচ্চাকাঙ্খি- এতটাই উচ্চাকাঙ্খি যে তোমার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একবার ষড়যন্ত্র করেছে। সে আবারও একই কাজ করবে না তোমার এমনটা ভাববার কোনো সুযোগ নেই। তোমার মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগেনি কেন গুলরুখ নিজেকে তোমার সেবাদাসীতে পরিণত করেছে, কেন সে তার সেই পানীয় দিয়ে তোমায় সিক্ত করছে? দূর আকাশের নক্ষত্রের মাঝে নিহিত অপার রহস্যের দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়ে নিজের চারপাশের লোকদের মনের গভীরে ডুব দিয়ে দেখাটাই…তাদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সজাগ থাকা একজন শাসকের পক্ষে শোভনীয়। কামরান আর আসকারির হয়ে তোমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহের সাহস গুলরুখের কখনও হবে না…কতখানি ধুরন্ধর আর কুশলী হলে আফিমের নেশায় আসক্ত করে সে তোমাকে অধঃখাতে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করতে পারে। এবং তোমার ক্ষমতা যখন দুর্বল হবে এবং শীথিল হয়ে আসবে আর তোমার প্রজারা একদা যে শাসককে শ্রদ্ধা করতো তাঁকেই অবজ্ঞা জ্ঞানে তাচ্ছিল্য করতে শুরু করবে, তার কোনো সন্তানের কাছে তখন যদি তারা শরণ প্রার্থনা করে তখন কিন্তু বিষয়টাকে মোটেই অস্বাভাবিক মনে হবে না? উলুঘ বেগের পরিণতির কথা স্মরণে রেখো। তোমার মতোই- সে যখন তারকারাজি এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁরা তাঁকে কি সলুকসন্ধান দিতে পারে সেসব নিয়ে বেশী আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, তখন তারই এক ছেলে তাঁকে হত্যা করে এবং তাঁর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়।

ঈর্ষা আর ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে আপনি কথা বলছেন। উৎসব বিষয়ে আমি আপনার ভাবনাগুলো গ্রহণ করে গণনার সাহায্যে আপনার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছাপিয়ে তাদের উন্নত করেছি বলে আপনি বিষয়টা মেনে নিতে পারছেন না। আমি একদা আপনার উপর যেমন নির্ভরশীল ছিলাম তেমনটা আজ আর নই বলে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে এমন একজন মানুষে পরিণত হয়েছি বলে এবং কোনো স্ত্রীলোকের- আপনার, বা গুলরুখের কারও পরামর্শ তার প্রয়োজন নেই দেখে, আপনি বিরক্ত…আপনাদের সবারই…নিজ নিজ অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হওয়া উচিত।

খানজাদাকে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বুঝতে পারে কতটা আঘাত সে তাঁকে করেছে, কিন্তু কিছু বিষয়ে তাঁকে সতর্ক করাটাও জরুরী ছিল। খানজাদাকে সে খুবই ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তিনি নন, সম্রাট হল সে আর তাই হুমায়ুন নিজে সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে সে রাজ্য পরিচালনা করবে।

তোমাকে সতর্ক করতে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। তুমি যদি মনস্থির করেই থাক যে আমার কোনো কথাই তুমি শুনবে না তাহলে আমার আর কিছু করার থাকে না… খানজাদার কণ্ঠস্বর নীচু আর সংযত কিন্তু হুমায়ুন ঠিকই লক্ষ্য করে তার কপালের পাশে একটা শিরা দপদপ করছে আর তার দেহটা থরথর করে কাঁপছে।

ফুপুজান… হুমায়ুন তাঁর বাহুমূল স্পর্শ করতে চেষ্টা করতে তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দরজার উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেন আর নিজেই এক ধাক্কায় পাল্লা দুটো খুলে দেন। তার জন্য অপেক্ষারত নিজের দুই খাস পরিচারিকাকে ডেকে নিয়ে মশাল আলোকিত করিডোের দিয়ে দ্রুত নিজের কামরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হুমায়ুন তাঁর গমনপথের দিকে নিরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। সে আগে কখনও খানজাদার সাথে কোনো কিছু নিয়ে তর্ক করেনি কিন্তু সে আজ তাঁকে যা বলেছে সেটা বলা প্রয়োজন ছিল, সে নিজেকে সেরকমই বোঝায়। তারকারাজি আর তাদের বয়ে আনা বার্তা কোনোমতেই উপেক্ষণীয় নয়। কোনো মানুষকে- এমনকি সে যদি সম্রাটের মতো ক্ষমতাধরও হয়- কোনোভাবেই অনন্ত বিশ্বের মাঝে তারকারাজির আপাতদৃষ্টিতে এই শেষ না হওয়া আবর্তনের সাথে তুলনা করা যায় না। সে যদি তাঁদের ইঙ্গিত অনুসরণ করে তবে তাঁর রাজত্ব অবশ্যই সমৃদ্ধি লাভ করবে।

আর গুলরুখের ব্যাপারে ফুপিজান যা বলেছেন…সেটাও ভুল। দরবারের আর দশজনের মতোই সেও অবশ্যই সম্রাটের নেক নজরে থাকতে চায়। তাকে তুষ্ট করে গুলরুখ হয়ত আশা করে যে সে নিজের সন্তানদের জন্য, তার সৎ-ভাই কামরান আর আসকারির জন্য সুযোগসুবিধা আর অনুগ্রহ নিশ্চিত করতে পারবে… কিন্তু এর বেশী কিছু না। গুলরুখের আফিম মিশ্রিত গাঢ় বর্ণের সুরা যা তাঁকে মননকে সমৃদ্ধকারী মার্গ দর্শনে সাহায্য করে সেটা তাঁকে দেয়া গুলরুখের উপহার এবং এই সুরা পান করা থেকে সে নিজেকে বিরত রাখতে চায় না, সে সেটা পারবেও না…বিশেষ করে এই সুরা যখন তাকে প্রতিনিয়ত অস্তিত্বের রহস্যময়তা পুরোপুরি আয়ত্ত করার কাছাকাছি নিয়ে চলেছে।

*

ঢাকের আওয়াজ করছে যে তাকে আসতে দাও। আজ শুক্রবার- আজি সেই দিন যেদিন আমি আমার সবচেয়ে দীনহীন প্রজার প্রতিও ন্যায়বিচার করতে প্রস্তুত। হুমায়ুন তাঁর উঁচু পৃষ্টদেশযুক্ত সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে হাসে। গত ছয়মাসের ভিতর আজই প্রথম সিংহাসনটাকে দর্শনার্থীদের সাথে সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত কক্ষের বাইরে এনে রাখা হয়েছে কারণ সম্রাটের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করে অজ্ঞাত কেউ একজন মোষের চামড়া দিয়ে তৈরী অতিকায় ঢাকে বোল তুলেছে। শুরুতে শব্দটা মৃদু আর অনিয়মিত ছিল এবং এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল সেটাও বুঝি বন্ধ হয়েছে। হুমায়ুন তারপরে পুনরায় শব্দটা শুনতে পায়। ন্যায়বিচারের ঢাকে যেই বোল তুলে থাকুক মনে হচ্ছে এবার যেন সে একটু সাহসী হয়েছে। ঢাকের বোলের আওয়াজ জোরাল হয় এবং সেটা এবার দ্রুত লয়ে ধ্বনিত হয়। এই মুহূর্তটার মুখোমুখি তাকে হতে হবে সেটা সে আগেই জানতো ঠিক যেমন সে জানে- সময়ে তার অমাত্যবৃন্দ ঠিকই সে যেসব সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সেসব মেনে নেবে। এমনকি পোড় খাওয়া কাশিমও, যে এই মুহূর্তে তার সিংহাসনের পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, স্বীকার করতে বাধ্য হবে সেই সঠিক ছিল।

নীল পাগড়ি পরিহিত তাঁর দেহরক্ষী দলের ছয়জন সদস্য দূর্গ প্রাঙ্গন থেকে বের হয়ে যেতে তাদের পায়ের শব্দে পাথুরে মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলে। তারা যখন ফিরে আসে তাদের সাথে লাল সিল্কের শাড়ি পরিহিত কপালে লাল তিলক দেয়া একজন অল্পবয়সী হিন্দু রমণীকে দেখা যায়। মেয়েটার মাথার লম্বা কালো চুল তার কাঁধের উপরে ঢেউয়ের মতো ভোলা পড়ে আছে এবং তার অভিব্যক্তির মধ্যে একাধারে উদ্বেগ আর দৃঢ়তা ফুটে আছে। প্রহরীর দল তাঁকে সিংহাসনের দশ ফিটের ভিতর নিয়ে আসতে সে হুমায়ুনের সামনে নিজেকে নতজানু করে।

উঠে দাঁড়ান। সম্রাট আপনার অনুরোধ শ্রবণে প্রস্তুত, কাশিম মন্দ্র কণ্ঠে বলে। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনি অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবেন।

সিংহাসনে উপবিষ্ট হুমায়ুনের রত্নশোভিত, দীপ্তিময় অবয়বের দিকে মেয়েটা কেমন একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তাকিয়ে থাকে যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না সে সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সুলতান, আমার নাম সিতা। আমি আগ্রার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী। আমার স্বামী লবঙ্গ, জাফরান আর দারুচিনির মতো মশলার একজন ব্যবসায়ী। এক সপ্তাহ পূর্বে তিনি দিল্লীর বাজার থেকে মশলা কিনে সেগুলো খচ্চরের একটা ছোট বহরের পিঠে চাপিয়ে আগ্রায় ফিরে আসছিলেন। দিল্লী থেকে দুদিনের দূরত্বে আমাদের পবিত্র হিন্দু শহর মধুরার কাছে তিনি আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা ডাকাতের কবলে পড়েন যাঁরা তাঁদের বহন করে আনা সবকিছু লুট করে নেয়- এমনকি তাদের পরনের কাপড়ও তাঁরা খুলে নেয়। ডাকাতের দল খচ্চরের বহর নিয়ে রওয়ানা দেবে এমন সময় আপনার একদল সৈন্য সেখানে এসে উপস্থিত হয়। সৈন্যরা ডাকাতদের হত্যা করে ঠিকই কিন্তু আমার স্বামীকে তার মালপত্র ফিরিয়ে দেবার বদলে তারা আমার স্বামীকে উপহাস করে। তারা বলে যে তিনি ভেড়ার মতো ভয়ে ভ্যা ভ্যা করছিলেন আর তার সাথে সেরকমই আচরণ করা উচিত। ডাকাতদের বাধা দড়ি খুলে দিয়ে তাঁকে বাধ্য করে নগ্ন অবস্থায় এবং খালি পায়ে তপ্ত বালির উপর দিয়ে দৌড়াতে, ঘোড়ার পিঠে সওয়াড় হয়ে তাঁরা তাঁকে ধাওয়া করে এবং বিদ্রূপ করে আর তাঁদের বর্শার ডগা দিয়ে তাকে নির্মমভাবে খোঁচাতে থাকে। তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডে নিজেরাই হাঁপিয়ে উঠলে, রক্তাক্ত আর পরিশ্রান্ত অবস্থায় আমার স্বামীকে বালির উপরে ফেলে রেখে তারা চলে যায়। এবং যাবার সময় তারা মূল্যবান মশলা বোঝাই আমার স্বামীর সবগুলো খচ্চর তাদের সাথে করে নিয়ে যায়…।

এহেন অবিচারের কারণে সিতার কণ্ঠস্বর ক্রোধে কাঁপতে থাকে কিন্তু সে নির্ভয়ে সরাসরি হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি আমার স্বামীর জন্য ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। সে মহামান্য সুলতানের একজন বিশ্বস্ত প্রজা এবং সর্বোপরি তাঁর বয়স হয়েছে। আপনার সৈন্যদের উচিত ছিল তাঁর প্রতি নির্দয় আচরণ না করে তাঁকে রক্ষা করা। আজ তিনি মৃতবৎ নিজের বাসায় শুয়ে আছেন তাঁদের দেয়া আঘাতের ফলে তার সারা দেহে সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলোতে পূজ জমেছে…

মহিলাকে প্রশ্ন করতে প্রস্তুত কাশিম সামনে এগিয়ে আসে কিন্তু হুমায়ুন তাঁকে পেছনে সরে আসতে ইঙ্গিত করে। সৈন্যদের এহেন আচরণ তাঁর মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর। নিজের প্রজাদের কাছে তাঁকে সূর্যের মহিমায় মহিয়ান হতে হবে। তাঁদের সবার উপরেই যেন তাঁর দীপ্তি আর উষ্ণতা আপতিত হয় কিন্তু এই হতভাগ্য ব্যবসায়ী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছেন…

এই সৈন্যদের সম্পর্কে আপনি আমাকে আর কিছু কি বলতে পারবেন? আপনি কি তাদের নাম জানেন?

আমার স্বামী কেবল বলেছেন যে সৈন্যদের একজন তাদের দলপতিকে মিরাক বেগ বলে সম্বোধন করেছিল এবং সে লম্বা, চওড়া দেখতে আর তার নাক ভাঙা এবং একটা সাদা ক্ষতচিহ্ন তাঁর ঠোঁটকে বিকৃত করেছে।

হুমায়ুন ভালো করেই চেনে মিরাক বেগকে বাদখশানের এক উজ্জ্বল, ন্যায়নীতি বিবর্জিত এক গোত্রপতি যে হিন্দুস্তান অভিযানের সময় হুমায়ুন আর তাঁর আব্বাজানের সাথে সেখান থেকে এসেছিল। পানিপথে নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে শত্রুপক্ষের একটা রণহস্তির পেছনের পায়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শত্রুপক্ষের তিরন্দাজদের হত্যা করতে, যারা জন্তুটার পিঠে স্থাপিত একটা হাওদায় অবস্থান করে হুমায়ুনের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে অনবরত তীর নিক্ষেপ করছিল, সেখান থেকে একলাফে সে জন্তুটার পিঠে উঠে বসে স্বাতন্ত্রমণ্ডিত একজন যোদ্ধা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানের অপরাধের জন্য অতীতের বীরত্ব কোনো অজুহাত হতে পারে না। মিরাক বেগকে অবশ্যই নিজের এই যথেচ্ছাচারের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

আপনি এতোক্ষণ যা বলেছেন সেটা যদি সত্যি হয়, আমি ওয়াদা করছি আপনি ন্যায়বিচার পাবেন। আপনি এখন বাসায় ফিরে যান এবং আমার সমনের জন্য অপেক্ষা করেন। কাশিম- মিরাক বেগকে খুঁজে বের করে যত দ্রুত সম্ভব আমার সামনে এনে হাজির কর।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসে। তার গা গুলিয়ে উঠে বমি পায়। তার মাথা আবার ব্যাথা করছে- তাঁর চোখের পেছনে তীক্ষাগ্র কোনো কিছু দ্বারা আঘাতের যন্ত্রণাটা আজকাল প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে আর সেইসাথে ভুল দেখার মাত্রাও বেড়ে গিয়ে কোনো কিছুর প্রতি মনোনিবেশ করাটা তার জন্য আরও কঠিন করে তুলেছে। যন্ত্রণা উপশমের জন্য, তার মনকে প্রশান্ত করতে আর দরবারের এইসব বিরক্তিকর বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, তাঁর আরও আফিম এবং সুরা প্রয়োজন।

*

সপ্তাহের মঙ্গলবার পরিচালিত হয় মঙ্গল গ্রহ দ্বারা, এদিনের জন্য যথার্থ পোষাক রক্ত লাল রঙের আলখাল্লা পরিহিত হুমায়ুন মিরাক বেগের অবাধ্য মুখাবয়বের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। শিকল দিয়ে বেঁধে তাঁকে দরবার কক্ষে আনা হয়েছে বটে, কিন্তু সে তারপরেও নিজের চিরাচরিত হামবড়াভাব ঠিকই বজায় রেখেছে। হুমায়ুনের মুখের দিকে সে তার কালো চোখ দিয়ে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে এবং তাঁকে দেখে মনেই হয় না সদ্য তেল দেয়া কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জল্লাদদের বা প্রাণবধকারী পাথরের গায়ে জমে যাওয়া লাল রক্তের কালো দাগ- সে লক্ষ্য করেছে। সিংহাসনের ডান পাশে স্থাপিত প্রকাণ্ড কালো গ্রানাইট পাথরটার উপরে একটু আগেই উন্মত্তের হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে মিরাক বেগের চারজন লোক তাদের ডান হাত খুইয়েছে এবং সদ্য কর্তিত হাতের অবিশিষ্টাংশ সংক্রমন রোধে গনগনে লাল লোহার টুকরো দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লোকগুলোকে সরিয়ে নেয়া হলেও, বাতাস এখনও তাদের মাংস পোড়র গন্ধে ভারী হয়ে আছে।

মিরাক বেগ, তোমার সৈন্যদের কপালে কি শাস্তি জুটেছে সেটা যাতে তুমি প্রত্যক্ষ করতে পার, সেজন্য আমি তোমাকে সবার শেষে আনতে বলেছি। তারা অন্যায় করেছে এবং সেজন্য উপযুক্ত শাস্তি পেলেও, তুমি, তাদের নেতা হিসাবে তাদের এই জঘন্য অপরাধের দায়দায়িত্ব তোমাকেই বহন করতে হবে। নিজের অপরাধ তুমি কোনো প্রকারের ভণিতা ছাড়াই স্বীকার করেছে কিন্তু শাস্তির হাত থেকে তুমি বাঁচতে পারবে না… তোমার কর্মকাণ্ডের কারণে আমার যে সম্মানহানি হয়েছে তোমার মৃত্যুই কেবল পারে সেই কলঙ্কমোচন করতে। আরেকটা কথা, জল্লাদের কুঠারাঘাতে তুমি মৃত্যুর অভয় লাভ করবে না। তোমার অপরাধের সম্পূরক মাত্রায় তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। বোন আপনি কাছে এগিয়ে আসেন।

গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দরবারের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বেশর বণিকের স্ত্রী সীতাকে ইঙ্গিতে হুমায়ুন সামনে এগিয়ে আসতে বলে। হুমায়ুন আপন মনে ভাবে, চোখের সামনে অঙ্গচ্ছেদ দেখেও মেয়েটা একটুও বিচলিত হয়নি এবং এবার সে দেখবে সত্যিকারের রাজকীয় ন্যায়বিচার। মিরাক বেগের জন্য যে শাস্তির কথা সে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সেটার ধারণা সে স্বপ্নে লাভ করেছে আর এর যথার্থতা তাঁকে প্রীত করেছে। সবার জন্যই একটা চমক অপেক্ষা করছে সিংহাসনের দুপাশে তাঁর আদেশ অনুযায়ী দরবারে উপস্থিত সব অমাত্যদের মতো লাল পোষাক পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা কাশিম বা বাইসানগারের সাথেও সে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেনি।

মিরাক বেগ, হাঁটু গেড়ে বসে নতজানু হও। গোত্রপতির চেহারায় এতক্ষণে বিস্ময় ফুটে উঠে যেন এর আগ মুহূর্ত পর্যন্তও সে বিশ্বাস করেনি হুমায়ুন তাঁকে সত্যিই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবে। তার মুখ রক্ত শূন্য হয়ে পড়তে তার উপরের ঠোঁটের সাদা ক্ষতচিহ্নটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়ে পুরো মুখে মসৃণ পাণ্ডুর পৃষ্টের মতো একটা অশুভ দীপ্তি ফুটে উঠে। সে জীহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়, তারপরে পুনরায় সাহস সঞ্চয় করে, দরবারে উপস্থিত সবাই শুনতে পাবে এমন কণ্ঠে কিছু বলতে শুরু করে।

সুলতান…প্রথমে পানিপথে এবং পরবর্তীতে গুজরাতে আমি জীবনপণ করে আপনার জন্য লড়াই করেছি…আপনার প্রতি আমি সবসময়ে অবিচল আনুগত্য প্রদর্শন করে এসেছি। পেটমোটা, ভীরু আর কাপুরুষ এক বণিকের সাথে রঙ্গরসিকতা করতে গিয়ে আমি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সেজন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হতে পারে না। আমি আর আমার লোকেরা সবাই যোদ্ধার জাত, কিন্তু গুজরাতের পরে আপনি আমাদের আর কোনো যুদ্ধের সুযোগ দেননি…না কোনো বিজয়ের গৌরব…আফিম সেবন করে তারকারাজির দিকে তাকিয়ে থেকেই আপনি আজকাল সময় অতিবাহিত করছেন যখন আপনার উচিত ছিল নিজের সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়া। নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে আমরা সেজন্যইতো এসেছি…সে প্রতিশ্রুতিই আপনি আমাদের দিয়েছিলেন…একটার পরে একটা বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার সময় আমাদের ঘোড়ার খুরের দাপুটে বোল পৃথিবীর বুকে প্রতিধ্বনি তুলবে…।

যথেষ্ট! দাঁড়িয়ে থাকা দুই জল্লাদকে হুমায়ুন তাঁর হাত তুলে কিছু একটা ইশারা করে। তারা তাদের হাতের কুঠার নামিয়ে রাখে এবং পাশের একটা স্তম্ভের আড়াল থেকে তাদের একজন একটা ছোট বস্তা তুলে নেয়। তারপরে, হুমায়ুনের প্রহরীরা দুপাশ থেকে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা মিরাক বেগের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরতে, জল্লাদদের একজন তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, আকষ্মিকভাবে তার মাথা পেছনের দিকে টেনে ধরে এবং তাঁকে মুখ খুলতে বাধ্য করে। বস্তা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এবার বস্তার ভেতরে হাত ঢুকায়। লোকটা এবার উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের একমুঠো গুড়ো বস্তার ভেতর থেকে বের করে এনে সেটা, মিরাক বেগের ব্যাদান হয়ে থাকা মুখের গহ্বরে ঠেসে গুঁজে দিতে গোলমরিচ আর হলুদ গুড়োর তীব্র ঝাঝালো গন্ধ হুমায়ুনের নাকে এসে ধাক্কা দেয়।

মিরাক বেগ সাথে সাথে নিঃশ্বাস নেবার জন্য খাবি খেতে শুরু করে। তাঁর হা-হয়ে থাকা চোয়ালের ভিতর দিয়ে তাঁর গলার ভেতরে দ্বিতীয়বার তারপরে তৃতীয়বার মুঠোভর্তি গুড়ো ঠেসে দিতে বেচারার দড়দড় করে পানি পড়তে থাকা চোখ দুটো যেন মাথার ভেতর থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়। তার মুখ ইতিমধ্যে বেগুনী বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে এবং তার নির্যাতিত মুখ থেকে হলুদ নিষ্ঠীবনের ধারা গড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে নাক দিয়ে অঝোরে শ্লেষ্ম ঝরছে। নতজানু অবস্থায় তাকে ঠেসে ধরে থাকা লৌহমুষ্ঠির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করতে থাকে এবং উঠে দাঁড়াবার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তির সময়ে ফাঁসিতে ঝোলান কোনো লোকের মতো পা দুটো উদ্দেশ্যহীনভাবে লাথি মারে।

হুমায়ুন তার চারপাশে আঁতকে উঠে দমবন্ধ করার শব্দ শুনতে পায়। কাশিম মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং বাইসানগারও আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ করতে। এমনকি সীতাকেও বিপর্যস্ত দেখায়, নিজের অজান্তে হাতের তালুতে নখ গেঁথে যাওয়া একটা হাত সে মুখের কাছে তুলে আনে এবং তাঁর চোখ দুটো আতঙ্কে গোল দেখায়। আর কয়েকটা মুহূর্ত এবং তারপরেই সবকিছু চুকেবুকে যাবে। মিরাক বেগ শেষবারের মতো দেহের সবটুকু শক্তি জড়ো করে অঝোরে পানি পড়তে থাকা চোখ দুটো খুলে এবং এক মুহূর্তের জন্য সে চোখের দৃষ্টি হুমায়ুনকে বিদ্ধ করে, আর তারপরেই তাঁর দেহ নিথর হয়ে যায়।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়। অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি। আমার আইন অমান্য করার ধৃষ্টতা যারা দেখাবে তাঁদের সবাইকে এই একই পরিণতি বরণ করতে হবে। হুমায়ুনের সোনালী সিংহাসন, সিংহাসনের গদি- দিনটি মঙ্গলের প্রভাবাধীন হওয়ায় লাল মখমলে আবৃত, যে মঞ্চে অবস্থিত সেখান থেকে সে নেমে দাঁড়ায় এবং দুপাশে নিজের দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সে দরবার কক্ষ ত্যাগ করে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সেখানে নিরবতা বিরাজ করে, তারপরে তাঁর অমাত্যরা আরো একবার নিজেদের জীহ্বার উপর দখল ফিরে পেলে তার পেছনে অনেকগুলো কণ্ঠস্বরকে একসাথে হড়বড় করে কথা বলতে শোনে।

সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। যমুনার বুকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে এবং রূপালী আলোয় নদীর তীর ভাসিয়ে দিচ্ছে যেখানে উট আর গরুর পাল জলের তৃষ্ণা মেটাতে এসেছে। সে আজকে সালিমার কাছে যাবে। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার কারণে আজকাল আর সে আগের মতো তাঁর কাছে যায় না। সালিমার তুলতুলে, সোনালী দেহটার কথা ভেবে সে মুচকি হাসে।

রূপালী কারুকার্যখচিত একটা নীচু ডিভানে সালিমা শুয়ে তার খিদমতে নিয়োজিত এক পরিচারিকা তাঁর পায়ের পেলব পাতায় মেহেদীর জটিল নক্সা আঁকছে। গুজরাত অভিযানের সময় হুমায়ুন যে ধনসম্পদ অভিহরণ করেছিল সেখান থেকে সালিমাকে সে রত্নখচিত যে পরিকরটা দিয়েছিল দুই মেয়েটা কেবল সেটাই পরিধান করে রয়েছে।

সেই অভিযানটাকে এখন কতদিন আগের কথা বলে মনে হয় যেন অন্য কোনো জীবনের স্মৃতি। অভিযোগ প্রকাশ করে মিরাক বেগের বলা কথাগুলো আপনি আমাদের কোনো বিজয় এনে দেননি…আফিম সেবন আর তারকারাজির দিকে তাকিয়ে আপনি আপনার সময় অতিবাহিত করছেন। মিরাক বেগের মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য কিন্তু তাঁর অভিযোগের ভিতরে কোথায় যেন সামান্য হলেও সত্যের নিবিড়তা উঁকি দেয়। সে সাম্রাজ্যের শাসনকার্য যেভাবে পরিচালনা করছে, কিংবা তার আফিম সেবনের পরিমাণ সম্বন্ধে তার আব্বাজান কি মন্তব্য করতেন? কাশিম আর খানজাদা যেমন অনুরোধ করেছে, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাঁদের প্রতি আরো বেশী মনোযোগী হবার স্বার্থেই হয়তো মাদক গ্রহণের মাত্রা তার হ্রাস করা উচিত। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে, তাই কি মনে হয় না? মোগলদের যাযাবর, বর্বর সময় এখন কেবলই স্মৃতি। সে একটা সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা এবং সমৃদ্ধি আর অনুপ্রেরণার নতুন উৎস, শাসনকার্য পরিচালনার নতুন পদ্ধতি যে সে খুঁজে চলেছে সেটা আর কারো না একান্তই তার এক্তিয়ারভুক্ত। তারকারাজি যাদের দীপ্তি এমনকি কোহ-ই-নূরের চেয়েও প্রখর তারা তাকে হতাশ করবে না।

হতাশ করবে না সালিমাও। তাঁর পরিচারিকাটি দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করতে, সালিমা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে প্রণয়সিক্ত ভঙ্গিতে সে হুমায়ুনের লাল আলখাল্লার বাধন আলগা করতে শুরু করলে, নরম রেশমের নীচে তার কাঁধ আর বাহুর শক্ত পেশীর উপরে তার আঙ্গুলগুলো আসন্ন আনন্দের বার্তা নিয়ে দৌড়ে বেড়ায়। সে ফিসফিস করে কেবলই আউড়াতে থাকে, আমার সম্রাট। সালিমার নগ্ন স্তনে এলিয়ে থাকা লম্বা কালো চুল সে দুহাতে আকড়ে ধরে এবং সবেগে তাঁকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, সঙ্গসুখের জন্য ব্যগ্র তারা পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করে যতক্ষণ না মোনতা ঘামের ধারায় তাঁদের দুজনের দেহ সিক্ত হয়ে উঠে অবশেষে রিক্ত পরিশ্রান্ত হয়ে একে অপরের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় তারা বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।

কয়েক ঘন্টা পরের কথা, হুমায়ুন সালিমার পাশে শুয়ে আছে। উন্মুক্ত বাতায়ন পথে বাতাসের স্নিগ্ধ একটা স্রোত বয়ে চলে আর পূর্বদিকের আকাশে ইতিমধ্যে ধুসর আলো ফুটতে শুরু করেছে। সালিমা ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলে এবং তারপরে ঘুরে গিয়ে নিজের নরম, মসৃণ কটিদেশ দিয়ে হুমায়ুনকে স্পর্শ করে, নিজের স্বপ্নের মাঝে বিভোর হয়ে যায়। কিন্তু কোনো দুর্বোধ্য কারণে নিদ্রাদেবী হুমায়ুনের কাছ থেকে কেবলই পালিয়ে বেড়ায়। সে চোখ বন্ধ করে যতবার ঘুমাতে চেষ্টা করে প্রতিবারই মিরাক বেগের বিকৃত, নিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা মুখবিবরে ফেনায়িত হলুদ লালা আর করোটি থেকে অর্ধেক বেড়িয়ে আসা আতঙ্কগ্রস্থ দুটো চোখ সে দেখতে পায়। অস্থিরতা সৃষ্টিকারী এসব প্রতিকৃতিগুলোকে মন থেকে বিতাড়িত করতে অনেক আগেই তার উচিত ছিল গুলরুখের বিখ্যাত সুরা পান করা কিন্তু সুরার পাত্রটা সে নিজের আবাসন কক্ষে রেখে এসেছে। সে যাই হোক, নিজের অস্থির চিত্তকে সে এখনও প্রশান্ত করতে পারে। সে নিজের গলায় একটা সরু চেন দিয়ে ঝোলান নীলকান্তমণি খচিত সোনার লকেটের ভেতর থেকে আফিমের বেশ কয়েকটা দলা বের করে এবং একটা পাত্রে পানি নিয়ে সেগুলো গলাধঃকরণ করে। সে গলায় সেই পরিচিত তিক্ত কটু স্বাদ টের পায় কিন্তু তারপরেই সে টের পায় তন্দ্রালু, অবসন্ন একটা উষ্ণতা কোথা থেকে যেন চুঁইয়ে তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে। চোখের পাতা শেষ পর্যন্ত ভারী হয়ে আসতে থাকলে, হুমায়ুন টানটান হয়ে শুয়ে থাকে। চন্দনকাঠের তেলের মানসিক প্রসন্নতা আনয়নকারী মাধুৰ্য যা দিয়ে সালিমা নিজের দেহ সিক্ত করতে পছন্দ করে, হুমায়ুনের নাসারন্ধ্র আপুত করলে সে ধীরে ধীরে তার অতলে তলিয়ে যেতে শুরু করে।

কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই- অন্তত হুমায়ুনের কাছে তাই মনে হয় নির্বন্ধিতভঙ্গিতে একটা নারী কণ্ঠ তাঁকে সম্বোধন করছে সে শুনতে পায়।

সুলতান…সুলতান…একজন বার্তাবাহক এসেছে।

বিমূঢ় অবস্থায়, হুমায়ুন উঠে বসে। সে কোথায় আছে? সে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাতে সালিমাকে দেখতে পায়, তাঁর পাশে এখন উঠে বসছে আর রেশমের একটা গোলাপী রঙের আলখাল্লা টেনে নেয় নিজের নগ্নতাকে আড়াল করতে। কিন্তু যাঁর কণ্ঠস্বরে সে ঘুম থেকে জেগেছে সেটা তাঁর না। সেটা হারেমের এক খিদমতগার, বারলাসের বেটে আর মোটা একটা মহিলা যার মুখের ত্বক আখরোটের মতো বলিরেখায় পূর্ণ।

সুলতান, আমায় মার্জনা করবেন, হুমায়ুনের নগ্ন দেহের উপর থেকে বারলাস নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বার্তাবাহক পূর্ব দিক থেকে এসেছে, সে বলছে আপনার ভাই আসকারির কাছ থেকে জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছে। এখন যদিও অনেক সকাল, সে অবিলম্বে আপনার সাথে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছে এবং কাশিম আমাকে আদেশ করেছে আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সংবাদটা জানাতে।

বারলাসের দিকে হুমায়ুন অমনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে কি বলছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে কিন্তু আফিম তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে অনেক শ্লথ করে ফেলেছে। ঠিক আছে। আমি এখনই আমার আবাসনকক্ষে ফিরছি। কাশেমকে বলবে বার্তাবাহককে নিয়ে সেখানে আমার সাথে দেখা করতে।

নিজের আবাসনকক্ষে ফিরে এসে, চোখে মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে এবং বেগুনী রঙের একটা সাদাসিধে জোব্বা পরিহিত অবস্থায়, আধ ঘন্টা পরে হুমায়ুন পূর্বাঞ্চল থেকে আগত লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে যার আগমনের কারণে বিশ্রামরত অবস্থা থেকে উঠে আসতে সে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘকায়, হালকা পাতলা গড়নের বার্তাবাহক লোকটার ঘামের দাগ লেগে থাকা কাপড় তখনও রাস্তার ধূলোয় ধুসরিত। হুমায়ুনের সাথে কথা বলার জন্য অতিশয় ব্যগ্র থাকায় সে অভিবাদন জ্ঞাপনের কৃত্যানুষ্ঠান প্রায় ভুলতে বসেছিল যতক্ষণ না কাশেম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তাকে সে কথা মনে করিয়ে দেয়। নতজানু অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই সে কথা শুরু করে। সুলতান, আমার নাম কামাল। জৌনপুরে আপনার ভাই আসকারির অধীনে আমি কাজ করি। সেখানে শের শাহের নেতৃত্বে একটা জোরাল বিদ্রোহের কথা আমাদের কানে এসেছে। আপনার ভাই বিষয়টা কতখানি বস্তুনিষ্ট সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন তারপরেই আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে সর্তক করতে।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে তাকিয়ে থাকে। শেরশাহ বাংলায় যদিও বিশাল একটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু ঘোড়া বিক্রেতার নাতি নিশ্চয়ই তাকে হুমকি দেবার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করবে না। মোগলদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে নিজে বাবরের কাছে মুচলেকা দিয়েছে। উচ্চাকাঙ্খ অবশ্য অনেক সময়েই মানুষকে হঠকারী পথের দিকে নিয়ে যায়। সে শের উপাধি গ্রহণ করেছে, যার মানে ব্যাঘ, ব্যাপারটা সম্ভবত একটা অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। সম্ভবত সত্যিকারের ব্যাঘ্র রাজবংশ- মোগলদের, সরাসরি দ্বৈরথে আহবান জানাবার অভিপ্রায়ে সে এসব করছে। হুমায়ুন তার আঙ্গুলের তৈমূরীয় অঙ্গুরীয়টার দিকে তাকায়, কিন্তু আফিমের কারণে তখনও তার চোখের মণি প্রসারিত হয়ে থাকায়, সে অঙ্গুরীয়টার উপরিতলে খোদাই করা ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের খোদাই করা প্রতিকৃতির উপরে ঠিকমতো ফোকাস করতে পারে না।

হুমায়ুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বার্তাবাহকের প্রতি পুনরায় নিজের মনোযোগ নিবদ্ধ করে। আমাকে আরও খুলে বল।

শেরশাহ মোগল এলাকার একটা বিশাল অংশ নিজের বলে দাবী করছে। সে নিজেকে মোগলদের বিরুদ্ধে সমগ্র হিন্দুস্তানের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং শপথ নিয়েছে তৈমূরের বংশে জন্ম নেয়া সব যুবরাজের কবল থেকে হিন্দুস্তানকে রক্ষা করবে। এমনকি সবচেয়ে গর্বিত গোত্রপতিরাও ক্রমশ তাঁর বশংবদে পরিণত হচ্ছে। আপনার ভাইয়ের কাছ থেকে আমি আপনার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছি যা আপনাকে সেখানে আসলে কি ঘটেছে তার সবকিছু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবে- শেরশাহ কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, তার প্রতি কতজন গোত্রপতি নিজেদের সমর্থন ঘোষণা করেছে…–চিঠিটা এখানে রয়েছে, উটের চামড়া দিয়ে তৈরী একটা থলি তার দিকে এগিয়ে দেয়।

ওটা আমার উজিরকে দেবে। আমি যখন বিশ্রাম নেব তখন আমি চিঠিটা পড়ে দেখবো।

বার্তাবাহক লোকটা বিস্মত দেখায় কিন্তু এক মুহূর্তও দেরী না করে সে থলিটা কাশিমের হাতে তুলে দেয়।

কাশিম- আপনি নিজে বিষয়টা লক্ষ্য করবেন যেন দূর্গের ভেতরে বার্তাবাহকের থাকা আর খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু কাশিমও তাঁর দিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। সে বুঝতে পারেনি যে তাড়াহুড়ো করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কোনো লাভ হবে না। হুমায়ুনের মনের ঘোর যখন কেটে যাবে- পরে কখনও- তখন সে নিজের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে ভেবে দেখবে। এখন যাও। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।

বার্তাবাহক আর কাশিমের পেছনে দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে যেতে, হুমায়ুন গবাক্ষ দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। নির্মেঘ আকাশের বুকে একটা নিখুঁত কমলা রঙের চাকতির মতো সকালের সূর্য উঠছে। দূর্গের লাল বেলেপাথর এমন ভাবে আভা ছড়ায় যেন এক্ষুনি পুরো দূর্গটা আগুনের শিখায় ঝলসে উঠবে। হুমায়ুন চোখ কচলায় এবং তার পরিচারককে ইশারায় জানালার শুকনো ঘাসের তৈরী পর্দা টাট্টি নামিয়ে দিয়ে নির্মম উজ্জ্বলতাকে আড়াল করতে বলে যার ফলে তাঁর মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। শেরশাহের খবরটা সত্যিই আতঙ্কিত হবার মতো এবং তাকে অবশ্যই সমুচিত জবাব দিতে হবে কিন্তু তারও আগে তাঁর ঘুম দরকার আর এমন কিছু একটা করা যার ফলে তাঁর মন প্রশান্ত হবে। সে লাল রঙের সুগন্ধিযুক্ত রোজউডের তৈরী একটা কারুকার্যখচিত আলমারির দিকে এগিয়ে যায় এবং সেটা খুলে ভেতর থেকে গুলরুখের তৈরী সুরার একটা বোতল বের করে আনে। এটা তাকে সাহায্য করবে, করার তো কথা? সে বোতলটার ছিপি খুলে কিন্তু তখন তার মনে হয় মধ্যাহ্নের আগে শেরশাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সময় তাঁর মাথা পরিষ্কার থাকা দরকার। কিন্তু কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণটা মধ্যাহ্ন পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়। সে আকিক পাথরের তৈরী পানপাত্রে গুলরুখের তৈরী মিশ্রণটা ঢালে। কয়েক মিনিটের ভিতরের সে ভেসে যেতে থাকে আর প্রায় সাথে সাথে তার স্বপ্নের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা এসে ভর করে।

টাট্টিগুলো তুলে দাও আর সুলতানের সাথে আমাকে একটু একা থাকতে দাও, একটা ক্রুদ্ধ মহিলা কণ্ঠ শোনা যায়। হুমায়ুন। কণ্ঠটা এবার তাঁর নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে এবং ক্রমশ মনে হয় তার দিকে এগিয়ে আসছে। হুমায়ুন! শীতল পানি একটা ঝাপটা তাঁকে সচেতন করে তুলতে সে হাঁসফাঁস করে উঠে বসে। কোনোমতে চোখ খুলে সে খানজাদাকে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হাতে পিতলের একটা খালি পানির কলসি আর দুচোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।

আপনি কি চান? হুমায়ুন নির্বোধের মতো খানজাদার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক বুঝতে পারে না আসলের ফুপিজান সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাকি এটাও একটা কল্পনা।

উঠে বস। তুমি একজন যোদ্ধা- একজন সম্রাট- কিন্তু তোমার সাম্রাজ্য যখন হুমকির সম্মুখীন তখন হারেমের একজন খোঁজার মতো মাদকাচ্ছন্ন অবস্থায় আমি তোমাকে অন্ধকার এক কোণে শুয়ে থাকতে দেখছি…আসকারির বার্তাবাহকের আগমন আর কি খবর সে নিয়ে এসেছে আমি এইমাত্র জানতে পেরেছি। তুমি তোমার উপদেষ্টামণ্ডলীদের তখনই কেন ডেকে পাঠাওনি?

আমি যখন প্রস্তুত হব তখন তাদের ডেকে পাঠাব…

নিজের দিকে একবার চেয়ে দেখো! খানজাদা রুবি দিয়ে কারুকাজ করা একটা আরশি তুলে নিয়ে সেটা হুমায়ুনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বার্ণিশ করা উপরিতলে সে বিষণ্ণ একটা মুখ আর বিস্ফারিত তারারন্ধ্রযুক্ত দূরাগত একজোড়া চোখ আর তাঁদের নীচে সৃষ্ট প্রায় গাঢ় বেগুনী বর্ণের থলের ছবি ফুটে উঠতে দেখে। খুবই পরিচিত মনে হওয়া মুখাবয়বের দিকে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে কিন্তু খানজাদা এক ঝটকায় আরশীটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে আরশীর ধাতব উপরিতল বেঁকে যায় আর অনেকগুলো রুবি স্থানচ্যুত হয়ে মেঝেতে খসে পড়ে। রক্তবিন্দুর মতো লাল পাথরগুলো মেঝেতে পড়ে থাকে।

খানজাদা হুমায়ুনের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে তার কাঁধ আকড়ে ধরে। আফিম তোমার স্মৃতি শক্তিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে…আরশিতে তুমি নিজেকেই নিজে চিনতে পারনি, তাই না? তুমি কে সেটা কি আমাকে তোমায় মনে করিয়ে দিতে হবে… তোমার সাহসিকতা, তোমার আব্বাজানের পক্ষে তোমার অগণিত যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস, তোমার নিয়তি আর মোগল রাজবংশের প্রতি তোমার দায়িত্বের কথা কি আমি তোমায় বলে দিব? আমরা কে- তৈমূরের উত্তরসূরী- আমরা- তুমি আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছি সবকিছু কি তুমি ভুলে গিয়েছে? আমি তোমাকে আগেও সতর্ক করতে চেষ্টা করেছি যে বাস্তবতার সাথে তোমার সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে আসছে কিন্তু তুমি আমার কথায় গুরুত্ব দাওনি। কিন্তু আমি এবার বাধ্য হব জোর করতে। তোমার ধমনীতে যে রক্ত বইছে আমার ধমনীতেও সেই একই রক্ত বইছে। তোমার আব্বাজান আমার ভাই- যার জন্য লড়াই করেছেন এতো কষ্ট সহ্য করেছেন, সেসব কিছু খোয়াবার ভয় ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়েই আমি ভীত নই।

ফুপিজান এসব কি বলছে? সহসা সে হুমায়ুনকে ছেড়ে দিয়ে, পেছনে হেলান দিয়ে বসে, নিজের ডান হাত দিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তিতে হুমায়ুনের একটা চড় বসিয়ে দেয়। খানজাদা পাগলের মতো তাঁকে আঘাত করতে থাকে। প্রথমে ডান গালে তারপরে তাঁর বাম গালে। তার গাল বেয়ে অঝোরে কান্নার ঢল নেমে আসে।

তুমি আবার আগের মতো হও। তোমার আব্বাজানের মনোনীত উত্তরাধিকারীর যোগ্য হয়ে উঠ, সে চিৎকার করে বলতে থাকে। আফিম আর কৃত্যানুষ্ঠানের এই জাল যা তোমার অমাত্যদের বিরূপ করে তুলছে আর শাসক হিসাবে তোমার যোগ্যতাকে আপোসপ্রবণ করে তুলেছে এসব পরিত্যাগ কর। তোমার বাবার মতোই তুমিও একজন যোদ্ধা। তারকারাজি কি বলছে সে সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ কর এবং বাবর যেমন প্রত্যাশা করতেন পারলে সেরকম হয়ে উঠ, দোহাই এই একটা কাজ কর!

ফুপিজান তাকে আঘাত করা বন্ধ করেছে কিন্তু তীব্র ব্যাথায় তার মনের কুয়াশা পরিষ্কার হতে শুরু করে। তিনি প্রথমে কথা শুরু করার পরে সেই কথাগুলো যা প্রথমে অর্থহীন মনে হয়েছিল ধীরে ধীরে অর্থবোধক হয়ে উঠতে থাকে। কথাগুলো তার মনের ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অতীতের প্রতিচ্ছবি যা তারা তাঁর মানসপটে ভাসিয়ে তুলে- যুদ্ধের উন্মাদনা, অমাত্যদের সাথে মল্লযুদ্ধের সময় বা আব্বাজানের সাথে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে শিকারে যাবার সময়ে সে নিজের মাঝে যে আন্ত্রিক উত্তেজনা অনুভব করে। সেই প্রাণবন্ত, পরিপূর্ণ, পার্থিব জগত এক সময়ে সে নিজে যেখানে বাস করতো…

হুমায়ুন, আফিমের নেশা ত্যাগ কর…নেকাটা তোমাকে শেষ করে ফেলছে। আফিম তুমি কোথায় রাখো?।

কয়েকমাস আগে বাংলায় তার মনোনীত শাসনকর্তার প্রতিনিধিকে কাশিম আর বাইসানগার তার পরিবর্তে যখন পরামর্শ দিতে বাধ্য হয় তখন কাশিমের মৃদুকণ্ঠে, উচ্চারিত সতর্কবাণীর কথা তার মনে পড়ে যায়। সে যদি নিজে লোকটার সাথে কথা বলতো তাহলে হয়তো সে লোকটার আচরণে কোনো তারতম্য খেয়াল করতো বা কোনো নির্দেশনা দিতে পারতো যা শেরশাহকে বিদ্রোহ করা থেকে বিরত রাখতে পারতো? বা শেরশাহ সম্ভবত বাংলায় কি ঘটছে সে বিষয়ে তাঁর অনীহা সম্বন্ধে কোনভাবে জানতে পেরেছিল। হুমায়ুনের হাত ধীরে ধীরে তার গলায় মালার ঝুলতে থাকা লকেট স্পর্শ করে। সেটা খুলে নিয়ে সে লকেটটা খানজাদার হাতে তুলে দেয়। তারপরে, একইরকম মন্থরবেগে, সে তখনও আধখোলা অবস্থায় থাকা আলমারির দিকে হেঁটে যায় যেখানে সে গুলরুখের আফিম মিশ্রিত সুরার বোতল রাখে। বোতলের খোঁজে সে ভিতরে হাত দিলে ভেতরের অন্ধকারে গাঢ়, প্রায় বেগুনী বর্ণের তরল চিকচিক করে উঠে। এতো জ্ঞান, এতো আনন্দ এটা তার জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে…চিন্তার এতো খোরাক যুগিয়েছে। কাশিম আর খানজাদার দাবী অনুযায়ী আসলেই কি এটা এতো ধ্বংসাত্মক শক্তির অধিকারী?

আমার মরহুম আব্বাজানও আমি সেবন করতেন… বোতলটা ফিরিয়ে দেবার সময় সে ধীরে ধীরে বলে।

হ্যাঁ, কিন্তু তোমার মতো না…বাবর আফিমকে কখনও তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা তার কোনো কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে দেননি। আফিমের জন্য সে কখনও তার অমাত্য, সেনাপতি বা বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের অবহেলা করেননি। কিন্তু তোমার ভিতরে এটা একজন সম্রাটকে দাসে পরিণত করেছে। তুমি আসক্ত হয়ে পড়েছে…ঠিক অনেকটা সেই মানুষটার মতো যে সুরা ভর্তি পুরো মশকটা খালি করার বাসনা ছাড়া একপাত্র সুরার স্বাদও উপভোগ করতে পারে না। হুমায়ুন এই সর্বনাশা নেশা তোমায় ছাড়তেই হবে, নতুবা এটা তোমাকে ধ্বংস করে ফেলবে। তোমার মরহুম আব্বাজানের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্য তুমি খোয়াবে। অনেক দেরী হয়ে যাবার আগে আফিমের নেশা ত্যাগ কর।

সে এখনও লুকান গোপনীয়তা আর আনন্দের উৎস বোতলজাত তরলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে তারপরে তখনও অশ্রুসিক্ত খানজাদার মুখের দিকে তাকায় এবং দেখে তাকে কতটা ভীত, কতটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। এবং সে ভালো করেই জানে যে এই ভয় হুমায়ুনের জন্য এবং তাঁর রাজবংশের জন্য সে যার একটা অংশ এবং যে বংশের জন্য সে নিজে অশেষ দুর্ভোগ সহ্য করেছে। তার মনের অলিন্দে জমে থাকা আফিমের বিষবাষ্প সরিয়ে ধীরে ধীরে খানজাদা ঠিক কথা বলেছে, কাশিমও ঠিকই বলেছিল এবং অন্যান্য সবাই যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল তারাই ঠিক ছিল এই বোধটা তার মাঝে জন্ম নিতে থাকে। তাকে অবশ্যই শক্ত হতে হবে নিজের ভেতরে শক্ত। বাইরের কারো সহায়তা তার প্রয়োজন নেই। সহসা সে পুনরায় খানজাদার শ্রদ্ধা, তার সম্মতি লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সে তার ঘনিষ্ঠ পরামর্শকদের সাথে আর খানজাদার সাথে কেমন আচরন করেছে সেটা চিন্তা করে নিজের কাছেই লজ্জিত হয়ে উঠে।

হুমায়ুন, বোতলটা আমাকে দাও।

না, ফুপিজান। গবাক্ষের কাছে গিয়ে সে বোতলের তরল বাইরে ঢালতে থাকে তারপরে বোতলটা খালি হলে সেটা নীচের দিকে ছুঁড়ে ফেলতে নীচ থেকে বোতল ভাঙার একটা মৃদু, ভঙ্গুর শব্দ ভেসে আসতে শুনে। গুলরুখের মাদক মিশ্রিত সুরা আমি আর গ্রহণ করবো না- এটা আমি নিজে তাকে বলে দেবো। তৈমূরের এই অঙ্গুরীয়ের নামে আমি আপনার সামনে শপথ করছি যতই কঠিন হোক আমি আর কখনও আফিম বা সুরা পান করবো না। আমি গুলরুখকে তার কোনো এক ছেলের সাথে থাকবার জন্য পাঠিয়ে দেব। আমি আমার মরহুম আব্বাজানের বিশ্বাসের যোগ্য এটা আমি আপনার কাছে এবং সেই সাথে নিজের কাছে আবারও নতুন করে প্রমাণ করবো।

খানজাদা দুহাতে হুমায়ুনের মুখটা ধরে তার কপালে চুমু খায়। এই আসক্তি জয় করতে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আফিমের আসক্তি এতোটাই প্রবল যে সহজে এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। হুমায়ুন তুমি একজন মহান যোদ্ধা, বিশাল মনের মানুষ আমি সেটা সবসময়েই জানতাম তুমি আরও মহীয়ান হয়ে উঠবে।

আর আমি সবসময়েই জানি আপনি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।

আর এখন?

বার্তাবাহককে পুনরায় ডেকে এনে আমি তাকে পুনরায় প্রশ্ন করার আগে আপনি কিছুটা সময় আমার সাথে থাকেন। আমি চাই তার বক্তব্য আপনিও শোনেন। তার কথা যদি সত্য হয় তাহলে অবিলম্বে আমাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

সেদিন অপরাহ্নে হুমায়ুন তাঁর সিংহাসনে গিয়ে বসে। তার অমাত্য আর সেনাপতিরা তাঁর সামনে। সে যেমনটা আদেশ দিয়েছে তারা কেউই। এমনকি সে নিজেও দিনের নিয়ন্ত্রণকারী গ্রহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রঙের পোষাক পরিধান করেনি। খানজাদা ঠিকই বলেছিল। সে যে কৃত্যানুষ্ঠানের প্রচলন করেছিল তার ফলে দরবারে না এসেছিল একতা না একাগ্রতা। তাঁর অমাত্যদের শ্রদ্ধা আর বিশ্বস্ত তা তাঁকে অন্যভাবে অর্জন করতে হবে। এবং সেটা অর্জনের একটা পথ হল যুদ্ধের ময়দানে বিজয় হাসিল করা।

বার্তাবাহক কামালের বয়ে আনা সংবাদ আপনারা ইতিমধ্যে শুনেছেন। মোগলদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শেরশাহের হামলা আমাদের সম্মানের প্রতি প্রকাশ্যে অবমাননা যা আমি কখনও বরদাশত করবো না। সেনাবাহিনী প্রস্তুত হওয়া মাত্র আমরা এই ভুঁইফোড়ের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হব। এবং শেরশাহের সাথে আমার বিরোধের যখন নিষ্পত্তি হবে তখন আমি তাকে দাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেব, শেরশাহের পূর্ব পুরুষেরা যেমন অর্থব ঘোড়া কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিত।

হুমায়ুনের বক্তব্য শেষ হতে, বিগত মাসগুলোতে প্রায় স্তব্ধ হয়ে আসা দরবার কক্ষে একটা প্রবল গর্জন শোনা যায়। হুমায়ুনের সেনাপতিরা তাদের গোত্রের বহু প্রাচীন প্রথা অনুসারে নিজেদের ঢালের সাথে নিজেদের তরবারি আঘাত করতে থাকে এবং তাঁদের মন্দ্র কণ্ঠস্বরে একটা শ্লোগান ধীরে ধীরে ধ্বনিত হতে থাকে মির্জা হুমায়ুন, মির্জা হুমায়ুন, যা তাঁর ধমনীতে বহমান তৈমূরের রক্তের কথা ঘোষণা করে। হুমায়ুন তার সিংহাসনের একপাশের দেয়ালে অনেকটা উপরে অবস্থিত নক্সাকরা জাফরির দিকে তাকায় যার পেছনে দাঁড়িয়ে সে জানে যে খানজাদা তাঁকে দেখছে এবং তাঁর কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আরো একবার মোগল সম্রাট নিজের বাহিনীকে নেতৃত্ব দেবে। শান্তির কুশীলব হিসাবে সে হয়তো নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি কিন্তু একজন সেনাপতি হিসাবে সে নিজের দক্ষতা কি প্রমাণ করেনি?

২.১ সংঘাতময় বিক্ষুব্ধতার কেন্দ্রে অবস্থান – দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব – সংঘাতময় বিক্ষুব্ধতার কেন্দ্রে অবস্থান

০৬. নিজাম ভিস্তি

ভোরের আলো ফোঁটার এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন তাঁর ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, লাল বেলেপাথরে তৈরী আগ্রা দূর্গের অভ্যন্তরে মার্বেল পাথরে বাধান হলাধার আর পানি ছিটাতে থাকা ঝর্ণার সারির ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে সুউচ্চ তোরণদ্বার অতিক্রম করে এবং কুচকাওয়াজ ময়দানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার সেনাবাহিনী সমবেত হয়েছে। রুবিখচিত একটা রূপার বক্ষাবরণের উপরে রূপার সূক্ষ শিকলের তৈরী আলখাল্লায় সে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত। তার দেহের একপাশে পান্নাখচিত ময়ানের শোভা পাচ্ছে তার মরহুম আব্বাজান বাবরের ঈগলের মাথাযুক্ত বাঁটের তরবারি আলমগীর। তাঁর মাথায় শোভা পায় রুবি দিয়ে অলঙ্কৃত একটা শিরস্ত্রাণ এবং স্বর্ণখচিত একটা লম্বা ময়ূরের পালক শিরস্ত্রাণের শীর্ষে মৃদু দুলছে।

লোহার গজালশোভিত দূর্গের মূল দরজার আড়াল থেকে সে যখন বের হয়ে আসে এবং কুচকাওয়াজ ময়দানের কেন্দ্রে স্থাপিত মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তাঁর রাজকীয় হাতি- আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রায় সম্রাট আর তাঁর সেনাপতিদের যাতায়াতের জন্য সচরাচর ব্যবহৃত অপেক্ষা করছে, সে দেখে যে তাঁর সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দল সারিবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে যাবার সময় এতোই গোলাপি-ধুসর বর্ণের ধূলো উড়িয়েছে যে সূর্য তাঁর আলোর তীব্রতা হারিয়ে একটা ধুসর, হলুদ বর্ণের চাকতিতে পরিণত হয়েছে। ধুসর বর্ণের অতিকায় হাতিটা তাঁর পিঠে গিল্টি করা লাল-দোয়ার মতো হাওদা নিয়ে হাটু ভেঙে বসে আছে এবং দুই মাহুত তার মাথার দুপাশে দাঁড়িয়ে। হাতির দুপাশে মর্যাদা অনুসারে তাঁর বয়োজ্যোষ্ঠ আধিকারিকেরা দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তার প্রত্যেক সেনাপতির নতজানু হয়ে জানান অভিবাদন গ্রহণ করে হুমায়ুন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার জন্য দাঁড়ায়।

আমার কাছ থেকে তোমাদের লোকদের কাছে এই বার্তাটা বয়ে নিয়ে যাবে। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি। এই অশিক্ষিত, উঁইফোড়, জবরদখলকারীর কাছ থেকে যা আমাদের আমরা সেটাই উদ্ধার করতে চলেছি। আমাদের সেনাবাহিনী দেখার পরে এটা যে ইতিহাসের বৃহত্তম আর অজেয় সে বিষয়ে কেউ কিভাবে সন্দেহ প্রকাশ করবে? যোদ্ধাদের খুশী মনে বিদায় দাও। বিজয় আর তাঁর সঙ্গী, খ্যাতি আর পুরষ্কার আমাদের সাথী হবে।

আধিকারিকেরা আরও একবার মাথা নত করে এবং গুঁড়ি মেরে বসে থাকা হাতির হাটুতে পা রেখে হুমায়ুন এর পিঠে স্থাপিত হাওদায় সোনার গিল্টি করা ছোট যে সিংহাসনটা রয়েছে সেটায় গিয়ে বসে। জওহর আর দুজন দেহরক্ষী খুব কাছ। থেকে তাঁকে অনুসরণ করে। হুমায়ুনের কাছ থেকে ইশারা পেতে মাহুতেরাও আরোহন করে এবং হাতির ঘাড়ের উপরে একজন আরেকজনের পেছনে নিজেদের নির্ধারিত অবস্থানে বসে জন্তুটার বিশাল কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে আদেশ দিতে থাকে। অতিকায়, অনুগত জন্তুটা আলতোভঙ্গিতে ধীরে ধীরে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে হুমায়ুন তাঁর হাতি আর তাঁর অন্যান্য সেনাপতিদের বহনকারী হাতির বহরকে এগিয়ে যাবার সংকেত বিঘোষিত করতে তূর্যবাদকদের ইঙ্গিত করে। সৈন্যবহরে নিজেদের নির্ধারিত স্থান গ্রহনের জন্য অগ্রসর হবার সময় তারা গোলন্দাজ বাহিনীর চার চাকার উপরে স্থাপিত প্রায় বিশ ফুট লম্বা ব্রোঞ্জের নলযুক্ত কামানগুলো, যার কোনটা টানছে পঞ্চাশটা পর্যন্ত ষাড়ের দল আর কোনটা টানছে ছয়টা থেকে আটটা হাতি- পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। অপেক্ষাকৃত ছোট কামানগুলো ষাড়ে টানা গাড়িতে রাখা হয়েছে।

হুমায়ুন এরপরে ঘন সন্নিবেশিত অশ্বারোহী বাহিনীর পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় প্রথমেই রয়েছে তার বাবার মাতৃভূমি থেকে আগত অশ্বারূঢ় যোদ্ধার দল, তাজিক, বাদশান, কিরঘিজ পর্বত আর ফারগানার উপত্যকা আর সেই সাথে আফগানিস্তান থেকে আগত যোদ্ধারা। সে বিশ্বাস করে, মোগল রাজবংশের প্রতি এরাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত। মধ্য এশিয়ার তৃণাঞ্চল থেকে তাঁদের নিয়ে আসা ঘোড়ার পাল থেকে এখনও প্রজনন করার তাঁদের ঘোড়াগুলোই সবচেয়ে শক্তিশালী। এদের পরে সে তার অনুগত রাজপুত জায়গীরদারদের একটা অংশকে কমলা রঙে সজ্জিত দেখতে পায়। যুদ্ধের জন্য সব রাজপুতের মতোই উদগ্রীব বিশালদেহী, কাল-শুশ্রুমণ্ডিত এই লোকগুলো হুমায়ুন যখন পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন নিজেদের ছোট, বৃত্তাকার আর কারুকার্যময় ঢালে নিজেদের তরবারি দিয়ে আঘাত করে সামরিক ভঙ্গিতে অভিবাদন জানায়।

হুমায়ুন পর্যায়ক্রমে যখন প্রতিটা বাহিনীকে অভিবাদন জানায়, সে মনে মনে ভাবে যে নিশ্চিতভাবেই বিজয়তিলক তার ললাটেই শোভা পাবে। তার সাথে আছে প্রায় সোয়া লক্ষ সৈন্যের একটা বাহিনী- শেরশাহের বাহিনীর চেয়ে কয়েক গুণ বড়। তাঁর সাথে অন্তত দশ গুণ বেশী কামান রয়েছে এবং গুজরাত অভিযানের সময় সে যেমন প্রমাণ করেছে- সে সৌভাগ্যের আশীর্বাদপুষ্ট একজন যোগ্য সেনাপতি। আগুয়ান সেনাবাহিনীর সাথে সঙ্গী হবার আর তার সৎ-বোন চঞ্চল প্রাণবন্ত গুলবদনকে সাথে নিয়ে আসবার জন্য সে তাই তার ফুপু খানজাদার অনুরোধ মঞ্জুর করেছে। প্রতিরক্ষার এহেন বন্দোবস্তের মাঝে তারা আগ্রার চেয়ে খুব একটা বেশী বিপদের সম্মুখীন হবে না, যার প্রতিরক্ষার ভার সে তার নানাজান বাইসানগার আর কাশিমের যোগ্য এবং বিশ্বস্ত হাতে অর্পন করে এসেছে। ফুপুজানের অভিজ্ঞতাঋদ্ধ পরামর্শের সাথে সাথে আবারও কখনও আফিমের আসক্তির মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেবার মতো প্ররোচনা অনুভব করলে সে তার মানসিক সমর্থন লাভ করবে এটা ভেবেই সে কৃতজ্ঞ। তিনি কখনও এর অনুমতি দেবেন না।

সে অবশ্য সালিমা আর তাঁর প্রিয় আরো তিনজন উপপত্নীকে সাথে করে নিয়ে আসবার বিলাসিতা করার অনুমতি নিজেকে দিয়েছে। তাঁর সুরা আর আফিম বর্জন যেন হারেমের কোমল আর ইন্দ্রিয়পরবশ সুখের প্রতি তার আকাঙ্খকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে তিনজন তরুণীকে পছন্দ করেছে- গুজরাত থেকে আগত খেয়ালি আর নমনীয় দেহের অধিকারিনী মেলিতা, লাহোর থেকে আগত ভারী বুক আর পুরু ওষ্ঠের অধিকারিনী পৃথুলা মেহেরুন্নিসা আর খোদ আগ্রার মেয়ে রসিক, কামকলায় পটু, কলহপ্রিয় মীরা- যারা প্রত্যেকেই, সালিমার মতো তাঁদের নমনীয় দেহ, ব্যগ্র ওষ্ঠ আর উৎসুক জীহ্বা নিয়ে, রতিক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন আসনে পারদর্শী। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির ক্লান্তিকর পরিস্থিতির মাঝে কি প্রশান্তি, তাঁর বিজয়ে কি আনন্দই না তারা তার জন্য বয়ে আনবে। অক্ষুব্ধ হাতির পিঠে পর্দা ঘেরা হাওদার অন্তরালে মেয়ের দল ভ্রমণ করছে আর তাঁদের পাহারায় নিয়োজিত আছে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের একটা দল।

*

ছয় সপ্তাহ পরে মধ্যাহ্নের আহারের ঠিক পরপরই, শত্রুর সংবাদ সংগ্রহে প্রেরিত হুমায়ুনের প্রধান গুপ্তদূত আহমেদ খানকে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সেনাছাউনির ঠিক কেন্দ্রে স্থাপিত, তার লাল রঙের নেতৃত্ব দানকারী তাবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। হুমায়ুন সেখানে লালচে খয়েরী রঙের তাকিয়া যুক্ত সোনার কারুকাজ করা জাজিমে শুয়ে বিশ্রাম করছে, প্রশান্তিদায়ক শরবতের পানপাত্র হাতে সে জওহরের বাঁশির কোমল ছন্দোলয়ে বিভোর। আহমেদ খান তাবুর ভিতরে প্রবেশ করতে, হুমায়ুন ইশারায় জওহরকে বাজান বন্ধ করতে বলে।

আহমেদ খান, কি ব্যাপার?

সুলতান, আমাদের ছাউনির চারদিকে পঞ্চাশ মাইল দূর অবধি অনুসন্ধান করেও আমরা শেরশাহের সেনাবাহিনীর কোনো হদিশই খুঁজে পাইনি। অবশ্য এখান থেকে দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রায় পয়তাল্লিশ মাইল দূরে আমরা সহসাই এক ক্ষুদ্র জায়গীরদারকে তার মাটির দূর্গে অবস্থানরত অবস্থায় আবিষ্কার করি। সে শেরশাহের অনুগত জায়গীরদার বলে দাবী করে কিন্তু এমন একজন যে ভীত যে তাঁর প্রভু নিজের অত্যধিক উচ্চাকাঙ্খর বশবর্তী হয়ে আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সবাইকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। শেরশাহের সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য তাই সে কোনো ধরনের ব্যস্ততা প্রদর্শন করেনি। সে আমাদের বলেছে যে তার জানা মতে এলাহাবাদের যেখানে গঙ্গা আর যমুনার স্রোত এসে মিলিত হয়েছে সেখান থেকে অন্তত আরও পঞ্চাশ মাইল দূরে শেরশাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছে। আমাদের বলেছে সে যা জানে আপনাকে বলার জন্য খুশী মনে সে আমাদের সাথে এখানে আসতে রাজি আছে। আমরা তার কথায় গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছি অবশ্য চোখ বেঁধে, যাতে সে আমাদের ছাউনির অবস্থান বা আমাদের সেনাবাহিনীর শক্তি সম্বন্ধে কিছু আঁচ করতে না পারে। আমরা এক ঘন্টা আগেই এসে পৌঁছেছি এবং আমি তার খাবারের বন্দোবস্ত করে তার সাথে কথা বলার ব্যাপারে আপনার আগ্রহ জানতে এসেছি।

তুমি দারুন কাজ করেছে। আধ ঘন্টা পরে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ত্রিশ মিনিট পরে, আহমেদ খান- নিয়মনিষ্ঠার ব্যাপারে বাবরের ঝোঁক সম্পর্কে ভালোমতোই ওয়াকিবহাল- ফিরে আসে। তার পেছনে, দুজন সশস্ত্র প্রহরীর মাঝে, গাঢ় সবুজ রঙের আলখাল্লা আর একই রঙের পাগড়ি পরিহিত খর্বকায়, স্থূলদেহী, কৃষ্ণ বর্ণের বছর চল্লিশের একজন মানুষকে দেখা যায়।

হুমায়ুনের সামনে স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে সে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানায়।

কে তুমি?

তারিক খান, ফিরোজপুরের তাকহালদার।

আর সেই সাথে তুমি শেরশাহের অনুগত।

হ্যাঁ- এবং আমার প্রতি সে সবসময়ে একজন ভালো প্রভুর মতো আচরণ করেছে…কিন্তু সবকিছুর পরেও সুলতান, আমার পরম অধিরাজ, আমি আপনার একজন বিশ্বস্ত প্রজা। বিদ্রোহ করে শেরশাহ বেকুবি করেছে।

তুমি বোধহয় বলতে চাইছে ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে উদ্ধত আর অশ্রদ্ধাপূর্ণ ভঙ্গিতে অপমান করেছে… কিন্তু তার অভিসন্ধি আর অবস্থান সম্পর্কে তুমি কি জান?

তার সেনাবাহিনী আমার এলাকার ভিতর দিয়ে সরাসরি যাতায়াত করে না কিন্তু আমার এলাকার উত্তরে বিশ মাইল দূরে আমার আত্মীয়সম্পর্কিত ভাইয়ের এলাকার ভিতর দিয়ে তারা যাতায়াত করে। সে বলেছে শেরশাহের সেনাবাহিনীর আকার ছোট- লোকবল আশি হাজারের বেশী হবে না। আমার সেই ভাই শেরশাহের সেনাছাউনিতে গিয়েছিল তাঁকে তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে। সে আমাকে বলেছে শেরশাহকে রীতিমতো বিহ্বল মনে হয়েছে যে সে আপনাকে এতো বিশাল এক বাহিনী নিয়ে অভিযানে অগ্রসর হতে প্ররোচিত করেছে। সে আমার ভাইকে বলেছে সে যুদ্ধ করবে না যদি আরো একবার আপনার অধীনে জায়গীরদার থেকে নিজের এলাকা নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে পারার শর্তে সে আপনার সাথে কোনো ধরনের শান্তিচুক্তির রফা করতে পারে।

তার ভবিষ্যৎ গতিবিধি সম্বন্ধে তোমার সেই ভাই কিছু জানতে পেরেছে?

শেরশাহের এক গুপ্তদূত অসাবধানতাবশত আমার সেই ভাইয়ের উজিরকে বলেছে যে তারা বাংলার নীচু জলাভূমি আর জঙ্গল অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে যুদ্ধ যদি তাদের করতেই হয়- আপনার পরাক্রমকে তারা হয়তো ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

তুমি এতক্ষণ যা বলেছে আমার উপদেষ্টামণ্ডলীর সাথে সে বিষয়ে আমি আলোচনা করবার আগে তুমি কি আর কিছু বলতে চাও?

কেবল এতোটুকুই যে মহামান্য সুলতানের যদি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে শেরশাহের দৃঢ়তা পরীক্ষা করার কোনো অভিপ্রায় থেকে থাকে, আপনার প্রেরিত যেকোনো দূতের সঙ্গী হতে আমি প্রস্তুত এবং তাকে শেরশাহের শিবিরে তাঁর সামনে হাজির করার পরে নিরাপদে ফিরিয়ে আনবার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।

আমি প্রস্তাবটা বিবেচনা করবো। এখন, আহমেদ খান, আরেকবার তার চোখ বাঁধো এবং তোমার দপ্তরে তাঁকে বদ্ধ কিন্তু আরামদায়ক অবস্থায় অবরুদ্ধ করে রাখো। জওহর, সূর্যাস্তের এক ঘন্টা পূর্বে এখানে আমার সাথে মিলিত হবার জন্য আমার উপদেষ্টামণ্ডলীদের তলব কর। ইত্যবসরে সালিমাকে বল আমার কাছে আসতে। হুমায়ুন ভাবে, উষ্ণ আবহাওয়ায় তার কামনার পারদ দ্রুত বেড়ে যায়, এবং প্রায়শই শীতকালের তুলনায় দ্বিগুণ। মেয়েটা জানে কিভাবে এই কামনা প্রশমিত করতে আর আসন্ন আলোচনায় মনোনিবেশের জন্য তার মনকে প্রশান্ত করতে হয়।

সালিমা, বরাবরের মতোই, নিজের দায়িত্ব নিপূণভাবে পালন করে। তার উপদেষ্টামণ্ডলী যখন সমবেত হয়, হুমায়ুন শমিত বোধ করে, তার পরামর্শদাতাদের সম্বোধন করার সময় অতিকায় একটা ব্যাঘ্রের মতো হুঙ্কার দিতে প্রস্তুত। আপনার তারিক খানের কথা শুনেছেন এবং তাঁর বয়ান যে শেরশাহ আমাদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে যাবার অভিপ্রায়ে বাংলার জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতে চলেছে এবং সেই সাথে তার অনুমানের জন্য দুঃখবোধ করছি- সে শান্তির জন্য আমাদের আপোষ করতে বাধ্য করবে। আপনারা কি মনে করেন?

আমাদের সাথে শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনী রয়েছে এবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমরা তাকে খুঁজে বের করে স্রেফ পিষে ফেলি না কেন, বাবা ইয়াসভালো নিজের চারপাশে সাথী সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলার সময় তার কামান মাথা থেকে ধুসর চুলের বেনীটা দুলতে থাকে।

কিন্তু একটু ধৈর্য্য ধরেন, হুমায়ুনের চাচাত ভাই সুলেমান মির্জা বলে। আমাদের সাথে যদি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকে এবং নিজেদের লোকদের আনুগত্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাস থাকে তাহলে একজন দূত প্রেরণ করে কিছুটা বিলম্ব করলে আমাদের কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে? তারা ফিরে আসবার পরেও যদি প্রয়োজন হয়- দুমাস পরে বর্ষা মরসুমের আগে অগ্রসর হবার জন্য আমাদের হাতে প্রচুর সময় থাকবে।

তাকে এখনই শেষ করে দেয়াটাই অধিক বাঞ্ছনীয়। বাবা ইয়াসভালো তবুও অনড়। তাঁকে দিয়ে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করলে অন্য বিদ্রোহীরা সমঝে যাবে।

কিন্তু আমাদের লোক ক্ষয় হবে আর সময়ও যা আমরা আমাদের সাম্রাজ্য বর্ধিত করার জন্য নিয়োজিত করতে পারি। আমি সবসময়েই দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অতিক্রম করে গোলকুণ্ডার হীরকখনিতে অভিযান পরিচালনায় আগ্রহী, সুলেমান মির্জা বলে।

আমি একমত, হুমায়ুনের দক্ষ সেনাপতিদের একজন, ইউসুফ পাঠান ভাবলেশহীন কণ্ঠে মন্তব্য করে। শেরশাহকে একজন দক্ষ শাসক বলা হয়ে থাকে আর বাংলা উর্বর, সমৃদ্ধ একটা প্রদেশ। আমরা যদি তাকে আর তার প্রধান অমাত্যদের হত্যা করি তাহলে নতুন কাঠামো তৈরী আর নতুন আধিকারিকদের নিয়োগ করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর সময় নষ্ট হবে। আমাদের শক্তিমত্তার অবস্থান থেকে তার সাথে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারলে আমরা তাঁকে আর তাঁর প্রশাসনকে কর আদায়ের জন্য ব্যবহার করে দ্রুত আমাদের বাহিনীর বকেয়া বেতন পরিশোধ আর তাঁদের পুরস্কৃত করতে পারি আর তারপরে গোলকুণ্ডার অভিযানের জন্য অগ্রসর হই।

হুমায়ুন সবার বক্তব্য বিবেচনা করে। ইউসুফ পাঠানের বক্তব্যের ভিতরে একটা প্রত্যয়বোধ রয়েছে। তাছাড়া, মহানুভবতা মহান শাসকদের একটা বৈশিষ্ট্য। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়। সুলেমান মির্জা, একটা ছোট রক্ষী বাহিনী নিয়ে আপনি তারিক খানের সাথে যাবেন, শেরশাহের অবস্থান সনাক্ত করে তাঁর কাছে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পৌঁছে দিতে তবে শর্ত এই যে তাঁকে এখানে এসে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানাতে হবে এবং আমাদের মূল্যবান সময় আর রসদ অপচয় আর সর্বোপরি আমাদের প্রতি সে যে অমার্জিত অবমাননা প্রদর্শন করেছে সেজন্য আমাদের সে উত্তমরূপে ক্ষতিপূরণ দেবে।

*

কিন্তু শেরশাহ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয় সে কেবলই কালক্ষেপন করে চলে, বিলম্বের জন্য ভূরি ভূরি দুঃখপ্রকাশ করে আর কোনো ধরনের শর্তে চুড়ান্তভাবে সম্মতি হবার পূর্বে মিত্রদের সাথে আলোচনার করতে বার্তাবাহক প্রেরণের অনুমতির জন্য বারংবার অনুরোধ করে। ১৫৩৯ সালের গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি একটা সময় সেটা, হুমায়ুন নৈশভোজের পর, বাংলার চৌসা বসতির কাছেই চার বর্গমাইলের চেয়ে বেশী এলাকা জুড়ে অবস্থিত তার সেনাছাউনির ঠিক মধ্যভাগে অবস্থিত তার তাবুর পাশেই খানজাদার তাবুতে অবস্থান করছিল। নীচু পাহাড়ের উপরে হুমায়ুন তার শিবির স্থাপন করেছে যেখান থেকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের কর্দমাক্ত প্লাবিত সমভূমি দেখা যায়। তাবুর বাইরে, রাতের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ এবং নিথর বাতাসে তাবুর আগুনের থোয়া সরাসরি উপরের দিকে উঠে যায়। তাবুর ভিতরে, কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে জেনানাদের রক্ষা করতে যার পার্শ্বদেশ নামিয়ে দেয়া হয়েছে, গুমোট বাতাসে শ্বাস নেয়া কষ্টকর। চিনিগোলা পানির পাত্র দিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা বা তরাসচামর দিয়ে তাঁদের পিষে ফেলার জন্য খানজাদার পরিচারকদের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও মশার ঝক বিরামহীনভাবে ভনভন করতে থাকে। হুমায়ুন দরদর করে ঘামতে থাকে, মাঝে মাঝে সে নিজের উন্মুক্ত ত্বকে তাঁদের তীব্র দংশন অনুভব করে এবং বৃথাই নিজের ক্ষুদ্র আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে চড় হাকায়।

হুমায়ুন কি হয়েছে? আজ খাবারের সময় তুমি প্রায় চুপচাপই ছিলে, খানজাদা জানতে চান।

আমি উদ্বিগ্ন যে আমি এত সময় বৃথা অপচয় করেছি, যে শেরশাহ আমাকে আহাম্মক মনে করে হেলাফেলা করছে। সুলেমান মির্জা আর তারিক খান আমাকে আশ্বস্ত করেছে যে প্রতিবার সাক্ষাতের সময় সে সজ্জনসুলভ আর ভদ্র আচরণ করেছে এবং তাঁকে আন্তরিকই মনে হয়েছে কিন্তু আমি এখন আর সে সম্বন্ধে নিশ্চিত নই। তারিক খানকে এতোটা বিশ্বাস করে আমি কি ভুল করেছি? নিজের জন্য সময় লাভের প্রয়াসে যদি শেরশাহই তাঁকে রোপন করে থাকে?

খানজাদা উঠে দাঁড়ায় এবং দুই এক মুহূর্তের জন্য পায়চারি করে, তশতরী আকৃতির পিতলের দিয়া ভর্তি তেলে জ্বলতে থাকা সলতের সোনালী আভায় তার মুখ গম্ভীর দেখায়।

আমার মনে হয় তোমার সন্দিগ্ধ হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। শক্তিমানই সবসময় বিজয়ী হয় না মাঝে মাঝে ধূর্তও বিজয়ের বরাভয় লাভ করে। বিগত নয় সপ্তাহ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা সম্মেলনে শেরশাহের সাথে মিলিত হবার জন্য গঙ্গার তীর বরাবর নিম্নাভিমুখে তুমি বিশাল একটা দূরত্ব অতিক্রম করেছে কিন্তু প্রতিবারই তুচ্ছ অজুহাত ব্যবহার করে যে সে এলাকার সব খাদ্যশস্য নিঃশেষ করে ফেলেছে বা মহামারীর আকারে জ্বরের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় তাঁকে অবশ্যই সেটা এড়িয়ে যেতে হবে সে আরও সামনে এগিয়ে গিয়েছে।

সত্যি। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে গঙ্গার তীর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে তাঁর মূল বাহিনী এখনও অপেক্ষা করছে।

তুমি কি করতে চাও?

আর কোনো অজুহাত গ্রহণ করবো না, শেরশাহের জন্য একটা সময়সীমা নির্ধারণ করবো এবং সে যদি সেটা অমান্য করে আমি তাকে আক্রমণ করবো। কিন্তু অন্য কারণে উদ্বিগ্ন যে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী আর আমার কামানের সহজ যাতায়াতের জন্য এসব জঙ্গল আর জলাভূমি একেবারেই অনুপযুক্ত।

তাহলে উপযুক্ত ভূখণ্ডে পশ্চাদপসারণের জন্য সাহস সঞ্চয় কর। বা শেরশাহের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে তাঁর শহরগুলো দখল করে নাও… একটা নিঃসঙ্গ বজ্রপাত খানজাদার কথার মাঝে বিঘ্ন ঘটায়। তাবুর ছাদে মুষলধারে বৃষ্টির আওয়াজ একে অনুসরণ করে।

এখনই বর্ষাকাল শুরু হবার কথা না- এখনও সময় হয়নি।

প্রকৃতির ছন্দ সবসময়ে মানুষের তৈরী পঞ্জিকা অনুসরণ করে না।

এটা যদি বর্ষার আগমনী বৃষ্টি হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই উপযুক্ত ভূমি সন্ধান করা উচিত। কিন্তু এখন অনেক রাত হয়েছে, সকালে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমরা অনেক সময় পাব যখন আমরা জানতে পারব যে আসলেই অবিরাম বৃষ্টিপাতের সূচনা হয়েছে। আমাদের শিবির নদীর উপরিভাগ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত ইত্যবসরে তাই বন্যায় ভেসে যাবার কোনো ভয় নেই।

কয়েকঘন্টা পরের কথা, হুমায়ুন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তাঁর বাহুদ্বয় দুপাশে প্রসারিত, তার ঘর্মাক্ত পেশল দেহ পাতলা সুতির চাদরের নীচে নগ্ন। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে, যা মন্থর হবার বদলে যেন আরও জোরে শুরু হয়েছে, আজকে তাঁর ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে। সে এখন স্বপ্ন দেখছে সে আগ্রা দূর্গে ফিরে এসেছে, তার উপপত্নীদের কক্ষের দিকে এগিয়ে চলেছে যেখানে কোনো বিচিত্র কারণে সে জানে তারা গোলাপজলের ঝর্ণার নীচে এখন স্নান করছে। সে টের পায় তাঁর দেহ কামনায় টানটান হয়ে উঠেছে এবং সে দ্রুত পা ফেলতে শুরু করতে চাদরের নীচে তার পা ছটফট করে উঠে, তাঁর রমণীদের কাছে পৌঁছাবার ব্যগ্রতায়। সহসা একটা মেয়েলী আর্তনাদ তাঁর স্বপ্নের গভীরে অনুপ্রবেশ করে। নারী আর পুরুষ কণ্ঠের একটা সম্মিলিত যুগলবন্দি ঠিক এর পরপরই ভেসে আসে। কেউ একজন চিৎকার করে, হাতিয়ার সামলে! জলদি- বর্ম পরার সময় নেই। ছাউনির সীমানায় জনবল বৃদ্ধি কর।

প্রাণপন চেষ্টায় ঘুমের রেশ কাটিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে কণ্ঠগুলো বাস্তব। হামলাকারীরা জেনানাদের তাবু পর্যন্ত সম্ভবত অনুপ্রবেশ করেছে। একটা আলখাল্লায় কোনমতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে সে হাত বাড়িয়ে তাঁর আব্বাজানের তরবারির তুলে নিয়ে নিজের তাবু থেকে টলতে টলতে কোনোমতে বের হয়ে আসে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে এবং তাঁর খালি পা ভেজা কাদায় পিছলে যেতে চায়। তির্যকভাবে নেমে আসা বৃষ্টির ভারী ফোঁটার মাঝ দিয়ে উঁকি দিয়ে এবং অন্ধকারে মরীয়া হয়ে নিজের চোখ সইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে, সে খানজাদার তাবুর দিকে দৌড়ে যায়।

তাবুর কাছাকাছি পৌঁছাতে, চরাচর ঝলসে দেয়া উজ্জ্বল পাতের মতো বিস্তৃত বিদ্যুচ্চমকের ধাতব ঝলকানির মাঝে সে দীর্ঘকায় এক মহিলার অবয়বকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে- খানজাদা। তাঁর মাথার উপরে উত্তোলিত ডান হাতে একটা বাঁকান তরবারি রয়েছে। হুমায়ুন তাকিয়ে থাকতে থাকতেই খানজাদা তরবারিটা এক আক্রমণকারীর মুখ বরাবর নামিয়ে আনে, যে তাঁকে পরাস্ত করার চেষ্টা করছিল। লোকটা কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ে সেখানেই ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। বিদ্যুচ্চমকের পরবর্তী আলোর ঝলসানিতে হুমায়ুন দেখে যে তার ফুপুজানের তরবারির আঘাতে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার মুখের একপাশ উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ফেঁড়ে ফেলায়, লোকটার রক্তাক্ত চোয়াল আর দাঁত বের হয়ে এসেছে। সে আর দেখে যে- খানজাদার অজান্তে- আরেকজন আক্রমণকারী তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার হাতে তরবারির বদলে একটা বিশাল গামছা সেটাকে সে তার মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে খানজাদার গলা শক্ত করে পেচিয়ে ধরবে। হুমায়ুন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে।

সহসাই বিপদ টের পেয়ে, খানজাদা হাতটা পেছনে নিয়ে গিয়ে কনুই দিয়ে লোকটার গলায় আঘাত করে কিন্তু লোকটা কোনোমতে আঘাতটা সামলে নিয়ে গামছাটা শক্ত করে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। হুমায়ুন ততক্ষণে তাঁদের অনেকটা কাছে চলে আসায় সে ফুপুজানের আক্রমণকারীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সবলে তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেলার অভিপ্রায়ে তাঁর সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি আরম্ভ করে। চকচকে, পিচ্ছিল কাদায় তারা কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, দুজনেই সুবিধা আদায়ের জন্য হাঁসফাঁস করে। তারপরে হুমায়ুন তাঁর প্রতিপক্ষের বাম চোখে নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠিপ্রবিষ্ট করাতে সমর্থ হয় এবং জোরে চাপ দিতে সে টের পায়। অক্ষিগোলক বিদীর্ণ হয়ে ভেতরের তরল পদার্থ বের হয়ে আসছে। ব্যাথার তীব্রতায় অধীর হয়ে সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই লোকটার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত শীথিল হয়, এবং সেই সুযোগে হুমায়ুন আলমগীর বের করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা প্রতিপক্ষের কুঁচকির গভীরে গেঁথে দিয়ে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে লোকটা আর্তনাদ করতে থাকে এবং তাদের পায়ের চাপে সৃষ্ট কর্দমাক্ত ডোবায় রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে সে।

হুমায়ুন তখনও তার শিবিরের দূরবর্তী সীমানা থেকে যুদ্ধের হট্টগোল যদিও ভেসে আসতে শুনে, কিন্তু তাঁর দেহরক্ষীর দল ইতিমধ্যে রাজমহিষীদের তাবু আক্রমণ করতে আসা বাকি লোকদের মনে হয় কাবু করতে পেরেছে। তারা সংখ্যায় বিশজনের মতো হবে। লোকগুলোর প্রত্যেকের পরণে কালো পোষাক এবং শিবিরের সীমানায় জোরাল আক্রমণের সুযোগ নিয়ে বোধহয় তারা গোপনে সেনাছাউনির একেবারে কেন্দ্রস্থলে এসে হাজির হয়েছিল। আক্রমণকারীদের কেবল একজন জীবিত রয়েছে।

দুজন প্রহরী দুদিক থেকে লোকটার দুহাত ধরে এবং হাঁটু ভেঙে তাঁকে যেখানে বসিয়ে রেখেছে সেদিকে ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠা মুখ নিয়ে হুমায়ুন দৌড়ে গিয়ে তার গলা চেপে ধরে এক ঝটকায় লোকটাকে তার পায়ের উপরে দাঁড় করায় এবং তার মুখের কাছে নিজের মুখ প্রায় ঠেকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে, তোমরা কেন এটা করেছে? ন্যূনতম মর্যাদাবোধ রয়েছে এমন শত্রুও মেয়েদের আক্রমণ করবে না। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সবাই তাদের রক্ষা করবে। আমাদের ধর্মেও একথা বলা হয়েছে, এটাই নৈতিক শিষ্টাচারের মোদ্দাকথা। তোমার মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু তুমি যদি কথা বল তাহলে সেটা দ্রুত হবে- যদি না বল তাহলে মৃত্যুটা হবে একটা দীর্ঘ আর বিলম্বিত প্রক্রিয়া এবং এত তীব্র যন্ত্রণাদায়ক যে তিলে তিলে সেই যন্ত্রণা ভোগ করার চাইতে তুমি মৃত্যু ভিক্ষা চাইবে।

রাজমহিষীদের হত্যা করার কোনো অভিপ্রায় আমাদের ছিল না আমরা কেবল তাঁদের অপহরণ করতে চেয়েছিলাম বিশেষ করে আপনার ফুপুজানকে। তারিক খান আমাদের বলেছে তিনি আপনার সাথে রয়েছে এবং সাইবানি খানের হাতে তার বন্দী হবার গল্পটা সবাই ভালো করেই জানে। শেরশাহ বলেছে যে আমরা যদি তাকে বন্দি করতে পারি আপনি তাকে দ্বিতীয়বারের মতো অগ্নিপরীক্ষার হাত থেকে রেহাই দিতে যেকোনো শর্তে আপোষ করতে রাজি হবেন।

তারিক খান তাহলে সত্যিই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্রুদ্ধ আর হতাশ হুমায়ুন বন্দির গলা আরও শক্ত করে চেপে ধরে এবং নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি লোকটার কণ্ঠমণির উপরে স্থাপন করে তার গলাটা মোচরাতে থাকে যতক্ষণ না ঘাড় ভাঙার আওয়াজ শুনতে পায় এবং তাঁর গলা চিরে মৃত্যুর আর্তনাদ বুদ্বুদের মতো উঠে আসে। নিথর দেহটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে আবারও খালি পায়ে কাদায় পিছলাতে পিছলাতে খানজাদার কাছে দৌড়ে যায়। বৃষ্টির অঝোর ধারায় সিক্ত হয়ে তরবারি হাতে তিনি তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছেন অবাক করা এক শান্ত অভিব্যক্তি তার চোখে মুখে এবং ঘুমাবার জন্য খুলে রাখা তার লম্বা ধুসর চুলের গোছা বৃষ্টিতে ভিজে অগণিত ইঁদুরের লেজে পরিণত হয়েছে।

আপনাকে ভালোভাবে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমি লজ্জিত- আপনি কি আহত হয়েছেন?

একেবারেই না। আমার মনে হয় আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে তোমার আর তোমার আব্বাজানের মতো আমার ধমনীতেও তৈমূরের রক্ত বইছে। আক্রমণ যখন শুরু হয়, তখন আমি ভয় পাইনি কেবল ক্রুদ্ধ হয়েছি। আমি জানতাম আমাকে অবশ্যই গুলবদন আর তোমার যুবতী উপপত্নীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাবুর খুটিগুলো আমি তাদের ভেঙে ফেলতে বলি এবং তাবুর কাপড়ের নীচে তাঁদের লুকিয়ে থাকতে বলি যতক্ষণ তাঁরা বিপদ কেটে গেছে বলে নিশ্চিত হয়। ওদিকে তাকিয়ে দেখো। তাঁরা কেবল মাত্র বাইরে বের হয়ে আসছে।

মুষলধারে হতে থাকা বৃষ্টির মাঝে হুমায়ুন নিশ্চিতভাবেই তাবুর অতিকায়, আবৃত করা ভাজের নীচ থেকে সালিমাকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে দেখে, তার ঠিক পেছনেই রয়েছে গুলবদন আর অন্যান্য মেয়েরা। হুমায়ুন খানজাদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং জড়িয়ে ধরেই সে বুঝতে পারে যে এখন উপস্থায়ী বিপদের রেশ কেটে যেতে এবং তার মাঝে যুদ্ধের রক্ত গরম করা উন্মাদনা থিতিয়ে আসতে ফুপুজান এতক্ষণে কাঁপতে শুরু করেছেন।

জওহর, আহমেদ খানকে আমার সাথে দেখা করতে বল, এবং খোঁজ নাও যদি আমরা এখনও গঙ্গার বুকে নৌকা ভাসাতে পারি। যদি সেটা বাস্তবসম্মত হয়, মাঝি মাল্লাদের পক্ষে যতটা দ্রুত সম্ভব কয়েকটা নৌকা প্রস্তুত করতে আদেশ দাও যাতে করে আমার ফুপুজান, ভগ্নি, আর উপপত্নীদের নৌকা করে উজানে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসা যায়।

জওহর নৌকার সন্ধানে যাবার প্রায় সাথে সাথে আহমেদ খান দৌড়ে আসে।

আমাদের ছাউনির সীমানা এসব আক্রমণ কিভাবে ঠেকিয়েছে? হুমায়ুন জানতে চায়।

বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছে, সুলতান। তাঁদের প্রবল প্রারম্ভিক আক্রমণের পরে যখন তাদের আক্রমণের তীব্রতা ছিল ভয়াবহ, শত্রুসেনা কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় আক্রমণের মাত্রা হ্রাস করে যেন কিছু একটা ঘটার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছে।

রাজমহিষীদের তাবুতে তাঁদের হামলার সাফল্য জানবার জন্য… হুমায়ুন আপনমনে বিড়বিড় করে। তারা খুব বেশীক্ষণ আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে না। কিন্তু এর ফলে আমরা হয়তো নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পাব।

সুলতান। উজানের নদীপথ নিরাপদ। আমাদের নৌকা প্রস্তুত এবং প্রতিটা নৌকার জন্য দ্বিগুণ মাঝিমাল্লার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, জওহর ফিরে এসে দম নিতে নিতে সব খুলে বলে। অশ্বারোহী বাহিনীর একটা চৌকষ দলকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং তারা নদীর উত্তর দিকের তীর বরাবর নৌকার সাথে সাথে যাবে।

হুমায়ুন এবার খানজাদার দিকে তাকায়। ফুপুজান, আপনার এবার যাওয়া উচিত। আপনি নিজেকে এবং অন্য মহিলাদের রক্ষা করতে পারবেন আমি বিশ্বাস করি। আমি আপনাকে নৌকা বহরের নেত্রী হিসাবে নিয়োগ করছি। জওহর, মাঝিমাল্লা আর সৈন্যদের জানিয়ে দাও যে একজন মহিলার নির্দেশ পালন করাটা তাদের কাছে যতই বিচিত্র বলে মনে হোক, তারা নির্দ্বিধায় সেটা পালন করবে নতুবা আমার রোষের মুখে পড়বে।

তাদেরকে জওহরের কিছুই বলার দরকার নেই, দৃঢ় কণ্ঠে খানজাদা বলেন। বাবরের বোনের আদেশ তারা অবশ্যই পালন করবে। তুমি বিজয়ী হবার পরে আবার আমাদের দেখা হবে। নীতি বিবর্জিত বিশ্বাসঘাতক তারিক খানের কর্তিত মস্তক আমি দেখতে চাই আর আমার পায়খানার মেথর হওয়া থেকে শেরশাহকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কথাটা শেষ করেই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে কাদার উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে গুলবদন আর অন্যান্য মেয়েরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে হেঁটে যায় তারপরে তাঁদের সাথে নিয়ে নদীর তীরের দিকে এগোতে থাকে, শীঘ্রই আলোআধারি আর বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যায়।

হুমায়ুন ভাবে, কি সাহসী এক মহিলা। তাঁর হাল্কা পাতলা আর যৌবন অতিক্রান্ত দেহে তৈমূরের রক্ত কত প্রবলভাবে উপস্থিত। তারিক খানের উপরে আস্থা রেখে এবং শেরশাহের বিলম্বিত উত্তরের কুশলতায় বিশ্বাস করে সে বোকামী করেছে, মারাত্মক বোকামী। সে কেন তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আরও জোরালভাবে প্রশ্ন করেনি? হারেমের আনন্দের মাঝে গা এলিয়ে দিতেই কি সে বেশী আগ্রহী ছিল? তার মানসিক একাগ্রতার এই ঘাটতি তাকে অবশ্যই শারীরিক বীরত্ব দিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে এবং তার লোকদের বিজয়ী হতে অনুপ্রাণিত করতে এটাকে ব্যবহার করবে।

আহমেদ খান আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে আরও বিশদ বিবরণী সংগ্রহ কর। জওহর আমার বর্ম এনে দিয়ে আমার ঘোড়া প্রস্তুত কর।

পনের মিনিটের ভিতরে হুমায়ুন নিজেকে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে ফেলে, এদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বাবা ইয়াসভালের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন সেনাপতি তার সাথে এসে যোগ দেয়। সুলতান, পরিস্থিতি মারাত্মক। শেরশাহ নতুন বাহিনী নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। আমরা কামানগুলোকে গুলি বর্ষণের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারছি না। ওদিকে তাকিয়ে দেখেন। তাঁর আধিকারিকের হাতের নির্দেশের দিক অনুসরণ করে তাকিয়ে হুমায়ুন দেখে, গোলন্দাজবাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য তাঁর সবচেয়ে বড় ব্রোঞ্জের কামানটার সাথে বাঁধা ষাড়ের দুটো দলকে অবিশ্রান্তভাবে চাবুকাঘাত করছে এর মুখটাকে ঘুরিয়ে শত্রুর হুমকির মুখোমুখি করার প্রয়াসে। কিন্তু বিশালদেহী ষাড়গুলোকে যত জোরেই আঘাত করা হোক বা যতই তাদের তোয়াজ করা হোক, অতিকায় জম্ভগুলো কাদায় হোঁচট খেয়ে পিছলে গিয়ে থকথকে কাদার আরো গভীরে ডুবে যায়। দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো এবার ষাড়ের সাথে নিজেরাও পুরো শক্তি দিয়ে ঠেলতে চেষ্টা করে কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় না, মসৃণ বাদামী কাদায় অনেকেই কেবল খাড়া আছাড় খায়।

সুলতান, সবগুলো কামানের একই অবস্থা, বাবা ইয়াসভালো জানায়।

আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। আর তাছাড়া এই বৃষ্টির ভিতরে তবকি বা গোলন্দাজ উভয়ের পক্ষেই বারুদ শুকনো রাখা বা পলিতায় আগুন দেয়া একটা কঠিন কাজ হত। আমাদের উচিত শীতল ইস্পাতের সনাতন অস্ত্র নিয়ে সম্মুখ সমরে নিজেদের সাহসিকতার উপরে নির্ভর করা। শত্রুর চেয়ে এখনও আমাদের লোকবল বেশী। আধিকারিকদের আদেশ দাও, তাৎক্ষণিকভাবে যতটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ রক্ষণাত্মক অবস্থানে পদাতিক সৈন্যদের বিন্যস্ত করা শুরু করতে। অবরোধক হিসাবে মালগাড়ি, তাবু ব্যবহার কর…হুমায়ুন কথা শেষ করে না এবং তারপরে- তার ফুপুজান আর অন্যান্য রাজমহিষীদের বিপজ্জনক অবস্থান আর এর কারণ যে তাঁর নিজের আত্মতুষ্টি এবং অর্বাচীনসুলভ সরলতা সে সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন সে যা তাঁদের বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে- আদেশ দেয়, অশ্বারোহী বাহিনীর আরেকটা শক্তিশালী বাহিনী- দশ হাজার সৈন্য যার অর্ধেক আমার নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনীর- রাজমহিষীদের নিরাপত্তা জোরদার করতে নদীর তীর বরাবর প্রেরণ কর।

কিন্তু সুলতান, এখানে তাদের আমাদের প্রয়োজন।

আমার আদেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করবে না। তাদের রক্ষা করার সাথে সম্মানের প্রশ্ন জড়িত।

বাবা ইয়াসভালো আর তর্ক না করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে একজন বার্তাবাহক প্রেরণ করে।

বাবা ইয়াসভালো, এবার আমাকে বলেন আমার উপস্থিতি কোথায় সবচেয়ে কার্যকর প্রতিপন্ন হবে?

সুলতান, উত্তরপশ্চিম দিকে ওখানে। শক্রর অশ্বারোহী বাহিনী আমাদের সীমানা বেষ্টনী ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়ে আমাদের পদাতিক সৈন্যদের আক্রমণ করেছিল যখন তারা তাদের তাবু ঘুমিয়ে ছিল এবং নিজেদের রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই নির্বিচারে অনেককে হত্যা করে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। বাদশানি আর তাজিক সৈন্যরা দ্রুত এগিয়ে এসে জনবল বৃদ্ধি করার পরেই কেবল আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছি এবং সেটাও আমাদের মূল সীমানা থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আসবার পরেই কেবল সম্ভব হয়েছে।

বেশ উত্তরপশ্চিম দিকেই যাওয়া যাক তাহলে। হুমায়ুন তার বিশাল কালো স্ট্যালিয়নে আরোহন করে এবং দেহরক্ষী বাহিনীর অর্ধেককে সাথে নিয়ে, যাদের সে রাজমহিষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রেরণ করেনি, সে যত দ্রুত সম্ভব উত্তরপশ্চিম প্রান্তের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে যায়। থকথকে কাদার কারণে মাঝে মাঝেই তাদের ঘোড়ার পেট পর্যন্ত কাদায় ডুবে যায়। এক অশ্বারোহী তাঁর বাহনকে যখন দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে, জন্তুটা হোঁচট খায় এবং উল্টে যায়, কাদায় আটকে যাবার কারণে সামনের পায়ে চিড় ধরে।

হুমায়ুনের সেনাছাউনির রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া এলাকাটার কাছাকাছি পৌঁছাতে, সে লক্ষ্য করে যে তার সেনাপতিরা প্রায় ডজনখানেক রণহস্তিতে হাওদাযুক্ত করেছে এবং তাঁদের সামনে নিয়ে এসেছে। হাওদার চাদোয়ার কারণে আপাতদৃষ্টিতে অবিরাম বৃষ্টির হাত থেকে তার তবকিরা সামান্য হলেও রক্ষা পেয়েছে এবং তাদের লম্বা নলের বন্দুক ইন্ধন-বারুদ দিয়ে পূর্ণ করে গুলি করতে সক্ষম হয়েছে আর শেরশাহের আক্রমণকারীদের বেশ কয়েকজনকে ধরাশায়ী করেছে। তবকিদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে, হুমায়ুনের পদাতিক বাহিনী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে উল্টে রাখা মালবাহী গাড়ির আড়াল ব্যবহার করে সেখান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর নিক্ষেপ করছে এবং শেরশাহের লোকদের পর্যায়ক্রমে বাধ্য করছে হুমায়ুনের বিশালাকৃতি পাঁচটা কামানের পিছনে আশ্রয় নিতে যেগুলো তারা তাঁদের প্রথম আক্রমণের সময়ে বিধ্বস্ত করেছিল।

হুমায়ুন সম্মুখবর্তী অবস্থানে যখন উপস্থিত হয় সে তার লোকদের সাহস যোগাতে চিৎকার করে উঠে। আমার অসীম সাহসী যোদ্ধার দল, তোমাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ। শত্রুর আক্রমণ তোমরা প্রতিহত করেছে। এখন সময় হয়েছে আমাদের পরাক্রান্ত কামানগুলোকে পুনরায় দখল করার। শেরশাহের উদ্ধৃঙ্খল লোকজনদের সেগুলো বয়ে নিয়ে যাবার সুযোগ দিলে সেটা আমাদের জন্য চরম অপমানের বিষয় হবে। আমি নিজে তোমাদের নেতৃত্ব দেব। মাহুতের দল নিজ নিজ হাতি নিয়ে এগিয়ে যাও। বীর তকির দল, আমার জন্য ঐসব উদ্ধত উচ্ছল দস্যুদের আরও বেশী বেশী ধরাশায়ী কর।

হুমায়ুন রণহস্তীর সম্মুখে অগ্রসর হওয়া আরম্ভের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। অবশেষে হাতীর দল, কাদার ভিতর দিয়ে টলমল করতে করতে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে এবং তাঁদের পিঠে স্থাপিত হাওদাগুলো এতোবেশী আন্দোলিত হয় যে তবকিদের ভীষণ অসুবিধা হয় লক্ষভেদের জন্য নিজেদের অস্ত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে। হুমায়ুন হাত নেড়ে অশ্বারোহী বাহিনীকেও অগ্রসর হতে বলে। বেদখল হওয়া কামানগুলোর দিকে অগ্রসর হবার সময়ে হুমায়ুন লক্ষ্য করে ব্রোঞ্জের সবচেয়ে বড় কামানগুলোর একটার আড়াল থেকে শেরশাহের গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু সদস্য তাঁর পদাতিক বাহিনীর বাদামি-ধুসর বর্ণের একটা তাবুর ভেতর দৌড়ে প্রবেশ করে, যা আপাতদৃষ্টিতে তাঁর সৈন্যরা পিছু হটে আসার পরেও অক্ষত রয়েছে। গোলন্দাজ বাহিনীর সেই লোকগুলো সহসা তাবুর সামনের অংশটা টেনে সরিয়ে ফেলতে দেখা যায় তাঁদের দখলকৃত ষষ্ঠ কামানটা সেখানে অবস্থান করছে যা তারাই ভালো বলতে পারবে কিভাবে তারা সেটাকে তাবুর ভেতরে টেনে নিয়ে গিয়েছে এবং গোলাবর্ষণের উপযুক্ত করে ফেলেছে। কালক্ষেপন না করে, গোলন্দাজ বাহিনীর এক সৈন্য, বেজন্মাটা এতোক্ষণ তাবুর ভেতরেই লুকিয়ে ছিল, কামানের পলিতায় অগ্নি সংযোগ করে।

বিকট একটা শব্দ আর বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো সাদা ধোয়া উদগীরন করে কামানের মুখের ভেতর থেকে ধাতব গোলাটা ছিটকে বের হয়ে এসে, হুমায়ুনের আগুয়ান হস্তিবাহিনীর একেবারে সামনের হাতিটার গম্বুজাকৃতি কপালের ঠিক মধ্যেখানে মোক্ষমভাবে আঘাত করে। মারাত্মকভাবে আহত হাতিটা, সাথে সাথে পথের একপাশে উল্টে পড়ে, জন্তুটার পিঠের হাওদা স্থানচ্যুত হয় আর ভেতরে অবস্থানরত তবকির দল মাটিতে আছড়ে পড়ে, তাঁদের হাত-পায়ের অবস্থা সঙ্গীন। বহরের পেছনের হাতিগুলো এবার আতঙ্কিত হয়ে উঠে এবং মাটিতে আছড়ে পড়া তবকিদের একজনকে পায়ের নীচে কাদায় পিষে দিয়ে, সোজা সামনের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করে। হাতির সম্মুখগতির উপরে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সে যখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে, জন্তুটা ভয়ে মাথা পেছনে হেলিয়ে রেখে, শুড় আকাশের দিকে তুলে, ভয়ে বিকট ডাক ছাড়ছে এবং হাতিটার দুইজন মাহুতের একজন জন্তুটার গলা থেকে ছিটকে যায় কিন্তু অপরজন কোনোমতে আকড়ে থাকে এবং মনে হয় যেন সে তার আরোহন করা হাতিকে সংযত করতে সক্ষম হয়েছে।

হুমায়ুনের সমস্ত মনোযোগ অবশ্য যে কামানটা থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। সেটার প্রতি নিবদ্ধ। গোলন্দাজের দল পাগলের মতো সেটাকে পুনরায় গোলাবর্ষণের জন্য প্রস্তুত করতে চেষ্টা করছে। গুড়ো পদার্থ ভর্তি একটা কাপড়ের ব্যাগ তারা লোহার সিন্দুক থেকে বের করেছে যা ব্যাগটাকে শুষ্ক রেখেছে এবং কামানের নল বরাবর তারা সাফল্যের সাথে গুড়ো পদার্থটা ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়। গুড়ো পদার্থটা ব্যারেলে ঠেসে দেয়ার পর তাদের দুজন এবার কামানের একটা ধাতব গোলা নিয়ে সেটা ব্যারেল বরাবর গড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় ঠিক এমননি সময় হুমায়ুন তাঁদের সেই জটলার কাছে পৌঁছে। তার বিশাল কালো ঘোড়ার পর্যানের পিঠে ঝুঁকে নীচু হয়ে বসে, হুমায়ুন আলমগীরের প্রথম আঘাতেই কামানের গোলা ধরে থাকা লোকটা হাত প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। কামানের গোলাটা নিয়ে সে মাটিতে আছাড় খেয়েছে, তার ক্ষতস্থানসমূহ থেকে পুনরায় রক্তপাত শুরু হয়েছে। হুমায়ুন অপর লোকটা মুখমণ্ডল লক্ষ্য করে তরবারি চালায় কিন্তু গোলন্দাজ বাহিনীর লোকটা নিচের মাথার উপরে হাত দিয়ে আঘাতটা প্রতিহত করে। সে যাই হোক, মারাত্মকভাবে জখম হাত নিয়ে লোকটা ঘুরে দাঁড়ায় এবং দৌড়াতে শুরু করে। লোকটা কয়েক কদমও যেতে পারে না তার আগে হুমায়ুনের হাতের তরবারি তার গায়ের শেকলের তৈরী বর্মের ঠিক উপরে আর মাথার চূড়াকৃতি শিরোম্রাণের ঠিক নীচে উন্মুক্ত ঘাড়ের মাংসে কোপ বসায়, এবং সে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ইত্যবসরে হুমায়ুনের দেহরক্ষীর দল শত্রুপক্ষের অন্য গোলন্দাজদের হয় হত্যা করেছে কিংবা পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে আর তার তবকিরা হাতির পিঠ থেকে নামতে শুরু করেছে।

দারুন দেখিয়েছে। পদাতিক বাহিনীর অবশিষ্ট সৈন্যদের অগ্রসর হয়ে কামারগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করার আদেশ দাও। আমাদের সাফল্য তাঁদের নতুন করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। সেনাছাউনির কেন্দ্রে এবার আমাকে ফিরে যেতে হবে।

কথা শেষ করে, হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, চিটচিটে কাদার ভিতর দিয়ে আক্রমণ করার ধকলে বেচারার নাক দিয়ে হাপরের মতো বাতাস বের হয়, তাঁর লাল নিয়ন্ত্রক তাবুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সে যখন কামানগুলো আক্রমণ করতে ব্যস্ত সেই ফাঁকে বৃষ্টির বেগ কখন যেন থিতিয়ে এসেছে ফলে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা অনেক পরিষ্কার হয়েছে, এখন বৃষ্টি প্রায় নেই বললেই চলে। হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, সেনাছাউনির কেন্দ্র থেকে সে তাঁর অবস্থান আরও জোরাল করার জন্য পরবর্তী আদেশ প্রদানে সক্ষম হবে।

সে অবশ্য তার তাবুর উদ্দেশ্যে অর্ধেকটা পথও অতিক্রম করেছে কি করেনি এমন সময় জওহর দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে এসে উপস্থিত হয়। সুলতান, সে রুদ্ধশ্বাসে বলে, বাবা ইয়াসভালো আমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে আপনি যদি অনুগ্রহ করে দক্ষিণপশ্চিম সীমানার দূরবর্তী অংশ একবার দর্শন করেন। গঙ্গার তীর বরাবর শেরশাহের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যে আমাদের সম্মুখের প্রতিরক্ষা ফাঁড়ি ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং সেনাপুরঃসর অগ্রদল আমাদের তড়িঘড়ি করে বিন্যস্ত দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা বুহ্যের কাছে অবস্থান করছে।

হুমায়ুন সাথে সাথে তাঁর কালো ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং উৎসুক জন্তুটা তাঁর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সম্ভবত পশ্চিম দিক বরাবর নিখুঁত সারিতে বিন্যস্ত তাবুর মাঝ দিয়ে দুলকি চালে ছুটতে শুরু করে, হুমায়ুনের লোকেরা অপ্রত্যাশিত আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে এই তাবুগুলো থেকেই ছুটে গিয়েছিল। জওহর আর তার দেহরক্ষীর দল তাকে অনুসরণ করে।

হুমায়ুন খুব শীঘ্রই যুদ্ধের শোরগোল আর আর্তনাদ বৃদ্ধি পেতে শুনে এবং তারপরে একটা নীচু ঢাল বেয়ে উঠে এসে নীচের দিকে গঙ্গার প্রশস্ত কর্দমাক্ত পাড়ে একটা বিশৃঙ্খল দৃশ্যপটের দিকে তাকায়। শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর বেশ কয়েকটা দল তাদের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে চলে এসেছে এবং তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী প্রাণপনে এখন চেষ্টা করছে তাদের ঘিরে ফেলতে বা প্রতিরক্ষা ব্যুহের বাইরে তাদের তাড়িয়ে দিতে। অশ্বারূঢ় অন্যান্য আধিকারিকেরা তাদের হাতের উত্তোলিত তরবারি আন্দোলিত করে চেষ্টা করছে তার পদাতিক সৈন্যদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সৃষ্ট ফাঁকগুলোকে পূরণ করতে উৎসাহিত করতে কিন্তু তাঁদের প্রয়াস খুব একটা সফল হচ্ছে বলে মনে হয় না। বস্তুতপক্ষে পদাতিক সেনাদের কেউ কেউ তাদের হাতের গোলাকার ঢাল আর লম্বা বর্শা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, যা দিয়ে তারা সজ্জিত, পিছনের দিকে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে।

এসবের চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, তাঁর টলমল করতে থাকা প্রতিরক্ষা ব্যুহের মাইলখানেক দূরে শেরশাহের বিশাল আরেকটা অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে। এই বাহিনীটার কেন্দ্রস্থলে উজ্জ্বল নিশান আর পতাকার একটা জটলা দেখা যায় এবং হুমায়ুনের কাছে এটা নিশ্চিত প্রতিয়মান হয় যে স্বয়ং শেরশাহ সেখানে রয়েছেন এবং নিজের শক্রদের শেষপর্যন্ত পরাভূত করতে নিজেই এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন।

জওহর, ব্যাটাদের মোকাবেলা করার জন্য আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে খুবই অল্প সময় পেয়েছিলাম। বাবা ইয়াসভালো আর আমার অন্যসব সেনাপতিরা কোথায়?

সুলতান আপনার খোঁজে আমি যখন এখান থেকে যাই, বাবা ইয়াসভালো তার কয়েকজন তরুণ আধিকারিকের সাথে এই ঢালের একটু সামনে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে বলেছিলেন পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক যে তিনি আপনার আগমনের জন্য হয়ত অপেক্ষা করতে পারবেন না তার আগেই প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে আক্রমণ করবেন। দূরে ওখানে ঐ ঘোড়সওয়ার বাহিনীর অগ্রভাগে ওটা কি তারই হলুদ নিশান, আমাদের শত্রুদের একটা দলকে দাবড়ে নিয়ে যাচ্ছে?

জওহর তোমার দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। তাঁকে গিয়ে বল ওখানে ঐ ধুসর তাবুর জটলার কাছে আমার সাথে যত বেশী সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সম্ভব আমার সাথে দেখা করতে। আমার অন্য সেনাপতিদের তলব করে বার্তাবাহক প্রেরণ কর যারা তাদের অধীনস্ত সৈন্য নিয়ে আপাতত আক্রমণ বন্ধ করে এখানে আমার সাথে এসে যোগ দিতে পারবে। আমরা শেরশাহের অগ্রাভিযান সরাসরি মোকাবেলা করবো। তাবুর চারপাশের মাটি এখান থেকে বেশ শক্তই মনে হচ্ছে আমাদের প্রারম্ভিক আক্রমণ জোরদার করে শত্রুর ক্ষতিসাধন করতে আমরা আমাদের ঘোড়াগুলোকে ওখান। থেকে প্রয়োজনীয় গতিতে ছোটাতে পারব।

পরবর্তী দশ মিনিটের ভিতরে হুমায়ুন নিজের চারপাশে তার বেশ কয়েকজন সেনাপতিকে সমবেত দেখে। বাবা ইয়াসভালের মতো- যিনি যুদ্ধে তার শিরোস্ত্রাণ হারিয়েছেন এবং তার মাথার ক্ষতস্থানে একটা হলুদ বর্ণের রক্তরঞ্জিত কাপড় জড়ান- আরও কতজন আহত হয়েছেন কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন চিন্তা করে তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। সুলেমান মির্জা কোথায়?

শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত অবস্থায় একটা বর্শার আঘাতে তিনি শহীদ হয়েছেন, সুলতান।

আর আহমেদ খান?

মারাত্মকভাবে আহত। শেরশাহের আক্রমণের প্রথম প্রহরে তিনি যখন শিবিরের বেষ্টনী পরিদর্শন করছিলেন তখন দুটো তীর এসে তার উরুতে বিদ্ধ হয়। রক্তক্ষরণের কারণে দুর্বল অবস্থায় তার কয়েকজন সৈন্য তাঁকে খুঁজে পায় এবং আরও অন্যান্য আহতদের সাথে তাঁকে গঙ্গার অপর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে আপনি যাদের মোতায়েন রেখেছেন আপাতত তারাই তাঁর যত্ন নিচ্ছে।

নিজেদের নিয়তি আর সাহসের উপর ভরসা করে, এসব সাহসী যোদ্ধাদের উপস্থিতি ছাড়াই আমাদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।

হুমায়ুন নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে তার সেনাপতিরা শেরশাহের পরবর্তী আক্রমণ প্রতিহত করতে, হাজার পাঁচেক অশ্বারোহীর একটা মোটামুটি বাহিনী প্রস্তুত করেছে, তার প্রতিপক্ষের সৈন্যসারিতে সহসা ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে আক্রমণ শুরু হতে বেশী দেরী নেই।

শেরশাহের বাহিনী অগ্রসর হবার সাথে সাথে আমরাও এগিয়ে যাব। আমাদের তাঁদের সমাবেশের ঠিক মাঝামাঝি আক্রমণের লক্ষ্য স্থির করবো, আমার বিশ্বাস তিনি সেখানেই অবস্থান করবেন। আমরা যদি তাঁকে হত্যা বা বন্দি করতে পারি তাহলে তার লোকেরা মনোবল হারিয়ে ফেলবে। আমাদের চরম ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও দিনের শেষে তাহলে আমরাই বিজয়ী হব…

মুহূর্ত পরে, শেরশাহ তার অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝে গতির সঞ্চার করে, দুলকি চালে গতিবেগ বৃদ্ধি করতে করতে তাঁরা হুমায়ুনের প্রতিরক্ষা ব্যুহের দিকে ধেয়ে আসে। হুমায়ুন অলঙ্কারখচিত ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে এবং মাথার উপরে সেটা আন্দোলিত করে চিৎকার করে বলে, আক্রমণ কর! মনে রাখবে পশ্চাদপসারণের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।

শীঘ্রই কাদা আর উঁচু নীচু জমির উপর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব তার বাহিনী ছুটতে শুরু করে। হুমায়ুনকে বহনকারী লম্বা, কালো ঘোড়াটা, সমস্ত সকালের পরিশ্রমের পরেও তাঁকে তাঁর বাহিনীর একেবারে সামনে রেখে, প্রতি মুহূর্তে প্রতিপক্ষের নিকটবর্তী করে তুলে, যারা নিজেরাও উদ্যত সঙ্গীন হাতে ছুটে আসছে নিজেদের সেনাপতির মহিমা কীর্তনে শের, শের রব তুলে।

হুমায়ুনের সব ভাবনা চিন্তা এই মুহূর্তে আসন্ন যুদ্ধের নিরীখে কেন্দ্রীভূত, সে তার কালো স্ট্যালিয়নের ঘাড় বরাবর নীচু হয়ে আসে, আর তার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে শেরশাহের আস্কন্দিত বেগে আগুয়ান বাহিনীর একেবারে কেন্দ্রস্থলে যেখানে ইস্পাতের উজ্জ্বল বর্ম পরিহিত একজন কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত লোক সাদা একটা ঘোড়ায় চেপে বিচরণ করছে আর চিৎকার করে সবাইকে উৎসাহিত করছে। লোকটা শেরশাহ ছাড়া আর কেউ নয়। হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার লাগাম আরও একবার টেনে ধরে নিজেকে শেরশাহ বরাবর ধাবিত করে। কয়েক মিনিটের ভিতরে দুটো সরলরেখা আপতিত হয়। হুমায়ুন শেরশাহকে লক্ষ্য করে আলমগীর দিয়ে কোপ বসায় কিন্তু তরবারির ধারাল ফলা শত্রুর ইস্পাতের বর্মে পানিতে উড়ন্ত চাকতির মতো পিছলে যায় আর পর মুহূর্তে তার নিজ নিজ ভরবেগের কারণে পৃথক হয়ে যায়।

সহসা, হুমায়ুনের মনে হয় একটা বাদামী ঘোড়ায় সে বোধহয় বিশ্বাসঘাতক তারিক খানকে এক ঝলকের জন্য দেখতে পেয়েছে, এখনও বর্মের নীচে তাঁর চিরাচরিত গাঢ় সবুজ বর্ণের আলখাল্লা রয়েছে। হুমায়ুন তাঁর ঘোড়া নিয়ে তারিক খানের দিকে ধেয়ে যায়। যদিও সামনে পেছনে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা একদল বিশৃঙ্খল ঘোড়া আর তরবারির ফলায় মৃত্যু নিয়ে পরস্পরকে আঘাতরত তাদের আরোহীদের কারণে তাঁর গতি বিঘ্নিত হলেও, হুমায়ুন ঠিকই সবুজ আলখাল্লা পরিহিত লোকটার কাছে পৌঁছে। তারিক খানই বটে লোকটা।

তারিক খান, তুমি বাঁচার অধিকার হারিয়েছে। আমাকে মোকাবেলা কর এবং মানুষের মতো মৃত্যুবরণ কর, যেমন পিচ্ছিল সাপের মতো তোমার চরিত্র সেভাবে নয়। কথাটা শেষ করেই হুমায়ুন আঘাত করে কিন্তু তারিক খান একেবারে শেষ মুহূর্তে ঢালটা তুলে আঘাতটা এড়িয়ে যায় আর একই সাথে নিজের দোধারি রণকুঠার দিয়ে হুমায়ুনকে লক্ষ্য করে পাগলের মতো কোপ বসায়। হুমায়ুন চিৎ হয়ে তার পর্যানে শুয়ে পড়তে কুঠারের ফলা বাতাসে মৃত্যুর শিস তুলে তার উপর দিয়ে পার হয়ে যায় কিন্তু সেই ফাঁকে হুমায়ুন কুঠার দিয়ে বেপরোয়া আঘাত করতে গিয়ে অরক্ষিত হয়ে পড়া তারিক খানের বাহুমূলে আলমগীরের ফলা আমূল ঢুকিয়ে দেয়। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে তারিক খান হাত থেকে কুঠারটা ফেলে দেয় এবং বাহুমূল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এসে তার গাঢ় সবুজ আলখাল্লাকে ভিজিয়ে দেয়, সে বোধহয় তার ঘোড়র উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে যা তাঁকে নিয়ে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যায়। মুহূর্ত পরেই হুমায়ুন তাঁকে তাঁর ঘোড়ার পর্যান থেকে পিছলে পেছনের দিকে পড়ে গিয়ে কাদায় অন্য ঘোড়ার খুরের নীচে পিষে যেতে দেখে। হুমায়ুন ভাবে, সব বিশ্বাসঘাতকদের এই পরিণতিই হওয়া উচিত।

নিজের চারপাশে তাকিয়ে সে টের পায় যে তার বেশীর ভাগ দেহরক্ষী তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু মুষ্টিমেয় যে কয়জন তখনও রয়েছে কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে তাঁদের অনুসরণ করতে বলে সে তার কালো ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়, বিশাল জন্তুটার সারা দেহ এখন সাদা, ফেনার মতো ঘামে চুপচুপ করছে, শেরশাহের ঘোড়া তাঁকে যেদিকে নিয়ে যেতে পারে বলে তার ধারণা সেই অভিমুখে সে এবার ঘোড়া ছোটায়। সে যখন ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আরোহীবিহীন একটা ঘোড়া, পেছনের পায়ে তরবারির আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে, তার নিজের ঘোড়ার ডানপাশে এসে ধাক্কা দিতে জন্তুটার গতিপথ বদলে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য হুমায়ুনের বর্ম আবৃত উরু পর্যানের সাথে চাপা খেলে সে ব্যাথায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখে। তারপরে, আর্তস্বরে চিহি করে উঠে আরেকদিকে ঘুরে গিয়ে হুমায়ুনের অবশিষ্ট দেহরক্ষীদের একজনের দিকে এগিয়ে যায়। দেহরক্ষীর ঘোড়াটা হুমড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পরার সময়ে পিঠের আরোহীকে মাটিতে আছড়ে ফেললে বেচারা ঘাড়ের উপরে ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে। আঘাতের ফলে তার মাথার চূড়াকৃতি শিয়োস্ত্রান খুলে গিয়ে মাটিতে দুতিন গড়ান দিয়ে একপাশে কাত হয়ে পড়ে থাকে।

হুমায়ুন তার ঘোড়র উপরে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে, সে বিশাল জটাকে লড়াই যেদিকে ভীষণ রূপ ধারণ করেছে, সেদিকে এগিয়ে যাবার জন্য পা দিয়ে গুতো দেয়। সহসা মাথার উপরের আকাশ বজ্রপাতের শব্দে বিদীর্ণ হয় এবং সেইসাথে আবারও অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়, বৃষ্টির ভারী ফোঁটা মাটির খানাখন্দে জমে থাকা পানিতে আছড়ে পড়ে এবং হুমায়ুনের শিরোস্ত্রানের কিনারা বেয়ে নেমে এসে তাঁর চোখ ভাসিয়ে দেয়। সে তার হাতের চামড়ার দস্তানা খুলে এবং ডান হাত তুলে বৃষ্টির ঝাপটা সরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে। কিন্তু চোখ মোছায় ব্যস্ত থাকার কারণে সে তার দিকে ধেয়ে আসা কালো আলখাল্লা পরিহিত দুই অশ্বারোহীকে সময় মতো লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয় যতক্ষণ না তারা তার উপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করে। সে আক্রমণকারীদের দেখতে পেলে দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে প্রথমজনের আক্রমণ এড়িয়ে যায় কিন্তু তার অরক্ষিত কব্জি আর হাতের পেশীকে দ্বিতীয়জনের তরবারির আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে না, এবং তরবারিটা তার বর্মের নীচে দিয়ে পিছলে গিয়ে তার কনুইয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। কালো ঘোড়াটা তাঁকে তাঁর আততায়ীদের কাছ থেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে আসে, যাঁরা কাদামাটির কারণে তাকে খুব একটা দ্রুত অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়।

হুমায়ুনের আহত ডান হাত থেকে অঝোরে রক্ত ঝরতে থাকে এবং তাঁর আঙ্গুল বেয়ে নেমে এসে তৈমূরের আংটি ঢেকে ফেলে। সে তার বাম হাত দিয়ে গলায় জড়ান দুধ সাদা রঙের গলবস্ত্রটা খুলতে চেষ্টা করে, সেটা দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করবে বলে কিন্তু সে গলবস্ত্রটা খুলতে পারে না। তার ডান হাতের অবশ আঙ্গুলগুলো কোনমতে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখে। তাঁর মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে এবং চোখের সামনে সাদা আলোর ঝলসানি ভেসে উঠে। নিজের এই উদভ্রান্ত অবস্থার ভিতরে সে কোনোমতে নিজের চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে তার আশেপাশে কোনো দেহরক্ষী উপস্থিত নেই। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিন্তু এভাবে মৃত্যুবরণ করাটা অবশ্যই তার নিয়তি হতে পারে না। পরাজয় অনিবার্য নয়। নিজের লোকদের পুনরায় একত্রিত করার জন্য তাকে অবশ্যই তাদের কাছে ফিরে যেতে হবে। হুমায়ুন শরীরের শেষ শক্তিটুকু একত্রিত করে লাগামটা টেনে ধরে হাঁপাতে থাকা, পরিশ্রান্ত ঘোড়ার মুখ তার অবশিষ্ট লোকেরা যেদিকে অবস্থান করছে বলে চেতন অচেতনের মাঝে ভাসতে ভাসতে তার মনে হয় সেদিকে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সে ঘোড়াটার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে, সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে জটার প্রশস্ত কালো গলার উপরে এলিয়ে পড়ে, বাম হাতে জন্তুটার পেষল গলার কেশর আকরে ধরতে তার চোখের মণি থেকে চেতনার শেষ রেশটুকুও উধাও হয়ে যায়।

*

সুলতান।

উজ্জ্বল আলোয় হুমায়ুনের চোখ খোলার চেষ্টা করতে ধবধবানি বেড়ে যায় এবং সে পুনরায় তাদের অর্ধনিমীলিত করে ফেলে। সে যখন পুনরায় চেষ্টা করে তখনও একই দীপ্তি বিরাজ করে। অবশেষে সে বুঝতে পারে যে চিৎ হয়ে শুয়ে সে মধ্যাহ্নের সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সুলতান। সেই একই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে আসে এবং অনিশ্চিত ভঙ্গিতে একজোড়া হাত তার কাঁধ ধরে মৃদুভাবে ঝাঁকায়। তাঁর পরণে এখন আর কোনো রকমের বর্ম নেই। সেসব কোথায় গেল? সে কি তবে ধরা পড়েছে? সে ক্রমশ ধাতস্থ হয়ে উঠার মাঝেই মাথা ঘুরিয়ে কণ্ঠস্বরটার কার খুঁজে দেখতে চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে একটা বাদামী রঙের মুখাবয়ব তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে, যেখানে তার জন্য উদ্বেগের একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে।

আপনি কে?

হুজুর আমার নাম নিজাম। আমি আপনার সেনাবাহিনীর একজন নগন্য ভিত্তি।

আমি এখন কোথায়?

সুলতান, আপনি গঙ্গার তীরে শুয়ে আছেন। চামড়ার মশকে নদী থেকে যখন পানি সংগ্রহ করছিলাম আপনার সৈন্যদের কাছে নিয়ে যাবার জন্য তখন আমি আপনার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে এখান থেকে মাইলখানেকের দূরত্বে অবস্থিত যুদ্ধক্ষেত্রের দিক থেকে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখি, আপনি ঘোড়ার গলা জড়িয়ে অচেতন হয়ে আছেন। ঘোড়াটা যখন আরো নিকটে আসে এর হাটু নিজে থেকেই ভাঁজ হয়ে যায় আর জন্তুটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘোড়াটা যখন ভূপতিত হতে যাচ্ছে তখন আপনি এর পিঠ থেকে পিছলে মাটিতে পড়ে যান।

ঘোড়াটা এখন কোথায়? আমার লোকেরাই বা কোথায়?

ঘোড়াটা দূরে ওখানে পড়ে রয়েছে। মৃত অবস্থায়। সুলতান আমার মনে হয় জন্তুটা ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যদিও বেচারার সারা গায়ে অসংখ্য ছোটখাট ক্ষত রয়েছে আর পশ্চাদভাগে একটা গভীর ক্ষতস্থান।

হুমায়ুনের নিজেকে খানিকটা সুস্থ মনে হতে সে বাম কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে নিজেকে একটু উঁচু করে এবং দেখে যে সত্যিই তার কালো স্ট্যালিয়নটা বিশ গজ দূরে জীহ্বা বের করা অবস্থায় গলা সামনের দিকে প্রসারিত করে মাটিতে পড়ে রয়েছে। কালচে-সবুজ রঙের ডুমো মাছির একটা ঝাক ইতিমধ্যে জন্তুটার মুখ, নাসারন্ধ্র আর অন্যান্য ক্ষতস্থানের কাছে ভীড় করতে শুরু করেছে।

আর আমার লোকেরা?

শেরশাহের বাহিনী পেছন থেকে ধাওয়া করতে যারা অনেককেই তাদের পর্যান থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলেছে, আপনার বেশীর ভাগ লোক নদীর তীর বরাবর পূর্ব দিকে পালিয়েছে। নদী এখান থেকে সিকিমাইল দূরত্বে যেখানে অগভীর অনেকে সেখান দিয়ে নদী পার হয়ে অপর পাড়ে চলে গিয়েছে যেখানে এখনও আপনার কিছু সংখ্যক সৈন্য অবস্থান করছে।

আমাকে কি কেউ অনুসরণ করেনি?

না। আর বিশেষ করে এই স্থানটা কর্দমাক্ত আর ঢালু হবার কারণে সহজে দেখা যায় না, তাই এখন পর্যন্ত কেউ এখানে আসেনি। সুলতান, আপনি কি একটু পানি পান করবেন?

আছে, একটু দাও। সহজাত প্রবৃত্তির বশে মশকের জন্য হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে দেয়। হাতটা আড়ষ্ট আর বোধহীন হয়ে আছে। খণ্ডযুদ্ধ আর নিজের আহত হবার ঘটনা তার মনে পড়ে। তার বামহাতের ক্ষতস্থানে পটি বাঁধা। পটির দিকে তাকিয়ে সে দেখে- যে গলবটা সে খুলতে ব্যর্থ হয়েছিল সেটা দিয়েই সাদা কাপড়টা দিয়েই পটিটা বাঁধা হয়েছে; আর ক্ষতটা যেখানে গভীর সেখানে মনে হয় যেন একটা চ্যাপ্টা পাথরজাতীয় কিছু রয়েছে।

আমাকে পান করতে সাহায্য কর।

নিজাম তাঁর সবচেয়ে বড় মশকের মুখ থেকে ছিপি খুলে, মশকটার আকার আর আকৃতি দেখে মনে হয় ছোট একটা ছাগলের পুরো চামড়া দিয়ে সেটা তৈরী করা হয়েছে। হুমায়ুনের মাথার নীচে হাত দিয়ে, নিজাম তাঁর মুখে একটু একটু করে পানি ঢালতে থাকে। হুমায়ুন দ্রুত পান করে এবং আরেকটু দিতে বলে। প্রতিটা চুমুকে যেন সে নবজীবন লাভ করে।

ক্ষতস্থানে কি তুমি পটি বেঁধেছো?

জ্বী, সুলতান। যুদ্ধের শেষে আমি হেকিমদের কাজ করতে দেখেছি এবং একজন আমাকে বলেছিল যে গভীর ক্ষতস্থান চেপে রেখে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য চ্যাপ্টা পাথর বেশ কাজে দেয়।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

তুমি কিভাবে জানো যে আমিই তোমাদের সম্রাট?

আপনার আঙ্গুলের ব্যাঘখচিত অঙ্গুরীয় আর আপনার কোমরের রত্নখচিত তরবারি দেখে। সেনাছাউনিতে ঐ দুটো জিনিষের গল্প আমি প্রচুর শুনেছি।

হুমায়ুনের মাথা এখন পুরোদমে কাজ করছে এবং উঠে বসতে গিয়ে সে টের পায় সে অঙ্গুরীয় কিংবা তার আব্বাজানের তরবারি আলমগীর, যা সে অথবা নিজাম অবশ্যই পুনরায় কোষবদ্ধ করেছে, দুটোই তাঁর সাথে আছে।

আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য দোর্দণ্ডপ্রতাপে বিরাজমান হবার কারণে ভেজা মাটি থেকে নির্গত বাষ্পের সাথে সকালের কুয়াশার একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে। নিজের ত্রাণকর্তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে নিজাম লোকটা আসলে, যার পরণে কেবল একটা কালো জোব্বা রয়েছে, কৃশকায় আর ছোটখাট এবং সারা গায়ে শুকিয়ে যাওয়া কাদা লেগে রয়েছে, তের কি চৌদ্দ বছরের একটা কিশোর। সে ইচ্ছা করলেই হুমায়ুনের সর্বস্ব হরণ করে পালিয়ে যেতে পারতো কিন্তু সেটা না করে সে নিছক আনুগত্যের খাতিরে তার সাথে রয়েছে। হুমায়ুন পরিষ্কার বুঝতে পারে যে- যদিও যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে যে বিষয়ে সে মোটামুটি নিশ্চিত- তাঁর আব্বাজানের দেয়া সৌভাগ্যবান নামের মহিমা সে এখনও ধারণ করছে। একটা পরাজয়ে কিছুই নির্ধারিত হবে না। বাবর অনেক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর মনে আছে বাবর প্রায়ই বলতেন বিপর্যয়ের সাথে তোমাকে এভাবেই মানিয়ে নিতে হবে। হুমায়ুনের মাথাটা আবার হঠাৎ করে ঝিমঝিম করে উঠে। নিজেকে সে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে, সে খুব ভালো করেই জানে যে তার প্রথম কাজ এখন নিজের সেনাবাহিনীর সাথে পুনরায় মিলিত হওয়া।

নিজাম, সবচেয়ে কাছে কোথায় আমার সৈন্যরা আছে?

আপনাকে আগেই আমি বলেছি, নদীর এই পাড়ে যারা ছিল তাঁরা সবাই পালিয়েছে। কিন্তু অপর তীরে এখনও বিপুল সংখ্যায় তারা অবস্থান করছে- ঐ যে দেখেন। ধোয়া উঠতে থাকা কর্দমাক্ত তীর আর নদীর মাঝে বিদ্যমান চরের অপর পাশে নিজাম আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। হুমায়ুন সেখানে অশ্বারোহী লোকদের বিশাল একটা দলকে দেখতে পায়।

তুমি নিশ্চিত তারা আমার লোক?

জ্বী, সুলতান। এপাড় থেকে অনেকেই সাতরে ওপাড়ের ঐ দলটার সাথে যোগ দিয়েছে।

হুমায়ুন ভাবে, নিজাম নিশ্চয় ঠিকই বলছে। শেরশাহ তাঁর সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে, নদী অতিক্রম করে পেছন থেকে যাতে তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য অপর পাড়ে একদল সৈন্য মোতায়েন করে সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে।

আমাকে অবশ্যই তাদের সাথে মিলিত হতে হবে। হুমায়ুন কথার মাঝে টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তার পা দেহের ভার নিতে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে এবং আবার তার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে।

সুলতান, আমার উপরে ভর দিয়ে দাঁড়ান।

নিজামের হাড়সর্বস্ব কাঁধে হুমায়ুন খুশী মনে নিজের বাম হাত রাখে। আমাকে নীচে পানির কাছে যেতে সাহায্য কর যাতে আমি সাঁতরে নদী পার হতে পারি।

কিন্তু আপনি ভীষণ দুর্বল। আপনি ডুবে যেতে পারেন।

আমার চেষ্টাটা করতেই হবে। শত্রুর হাতে ধরা পড়াটা আমার জন্য দারুণ অসম্মানের একটা ব্যাপার হবে।

নিজাম চারপাশে তাকায় এবং নিজের সবচেয়ে বড় দুটো ছাগলের চামড়ার মশকের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয় আর সে হুমায়ুনের দিকে তাকায়। সুলতান আপনি কি কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন? মনে হয় আমি একটা বুদ্ধি পেয়েছি।

হুমায়ুনের কাছ থেকে সম্মতি লাভ করতে, সে দৌড়ে মশকের কাছে যায় এবং ছিপি খুলে মশক দুটো খালি করে। তারপরে, হুমায়ুনকে বিস্মিত করে, সে বড় মশকটা তুলে নিয়ে সেটার মুখে নিজের ঠোঁট রাখে এবং ফুঁ দিতে শুরু করতে, তার চোখ দুটো ঠিকরে কপাল থেকে বের হয়ে আসতে চায় এবং গালের চামড়া ফুলে উঠে। কিছুক্ষণ পরে হুমায়ুন দেখে যে মশকটা ফুলতে শুরু করেছে এবং অচিরেই মশকটার চামড়া বাতাসে টানটান হয়ে উঠে। নিজাম ছিপি দিয়ে মুখটা বন্ধ করে এবং মশকটা হুমায়ুনের কাছে নিয়ে এসে, দ্রুত অপর মশকটাকেও একইভাবে ফুলিয়ে তোলে এবং খেলাচ্ছলে সেটার গায়ে একটা টোকা দিয়ে আপন মনেই হেসে উঠে। এটা দিয়েই কাজ হবে। সুলতান যা করার আমাদের দ্রুত করতে হবে। শেরশাহের লোকেরা খুব শীঘই লুটপাট করতে তাদের শত্রুদের মৃতদেহের খোঁজে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। আমি আপনার বর্ম লুকিয়ে রেখেছি ফলে আলো পড়ে সেটা চকচক করবে না কিন্তু তারা নদীর পাড় তন্নতন্ন করে খুঁজবে।

আমি জানি কিন্তু আমাকে প্রথমে তুমি আমার সাহসী ঘোড়াটার কাছে নিয়ে চল। আমি নিশ্চিত হতে চাই যে সে মারা গেছে নতুবা তার দুর্দশা থেকে আমি তাকে মুক্তি দিতে চাই। সে আমার অনেক যুদ্ধের সাথী আর নিজের দায়িত্ব সে দারুনভাবে পালন করেছে। ঘোড়াটার কাছে গিয়ে এক ঝলক তাকিয়েই হুমায়ুন বুঝতে পারে যে কালো স্ট্যালিয়নটা আসলেই মারা গেছে। তারপরে নিজামের কাঁধে ভর দিয়ে সে নদীর উঁচু নীচু পাড়ের ভিতর দিয়ে নদী অববাহিকার দিকে এগিয়ে যায়। সে ক্লান্তিতে দুবার বসে পড়ে কিন্তু প্রতিবারই নিজাম- বাতাস ভর্তি মশক দুটো নিয়েই বেচারা হিমশিম খাচ্ছে- তাঁকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। দশ মিনিট প্রাণান্তকর পরিশ্রমের পরে এই অসম জুড়ি গঙ্গার তীরে এসে পৌঁছে। নিজাম বাতাস ভর্তি মশক দুটো হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে দেয়।

নিজাম, তোমাকে ধন্যবাদ। এবার দ্রুত পালাও আর নিজের প্রাণ বাঁচাও।

না, সুলতান, আমি আপনার সাথে থাকবো নতুবা আপনি পানিতে ডুবে যাবেন।

বেশ মরার যখন এতোই শখ, তাহলে আগে আমার পায়ের নাগরা দুটো খুলে দাও, হুমায়ুন নদীর তীরে শোয়া আর বসার মাঝামাঝি বিচিত্র এক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে। নিজাম দ্রুত মোটা চামড়ার তৈরী ভারী নাগরা জোড়া টেনে খুলে দেয়, তার নিজের জন্য চিন্তা নেই কারণ সে আজীবনই খালি পায়ে হেঁটেই অভ্যস্ত এবং হুমায়ুনকে ধরে হাঁটুপানিতে নিয়ে আসে।

সুলতান, আপনার ভালো হাত আর পা দিয়ে সাঁতার কাঁতে চেষ্টা করবেন। আপনার ডান হাতের নীচে বাতাস ভর্তি একটা মশক রাখতে চেষ্টা করবেন আর দ্বিতীয়টা রাখবেন আপনার থুতনির নীচে। আমি আপনাকে সাতারের দিক ঠিক রাখতে সাহায্য করবো।

তারা ধীরে ধীরে সাঁতার কাঁতে থাকে, একটা সময়ে হুমায়ুনের মনে হয় তারা বোধহয় মাঝ নদীতে এসে পৌঁছেছে। পানিতে ভিজে যাওয়াও তাঁর আহত ডান হাতে আবারও তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় কিন্তু ব্যাথার ঝাপটায় তার মাথা পরিষ্কার কাজ করতে শুরু করে। সে কোনোভাবেই মারা যাবে না- এটা তার নিয়তি না- আর সে। আরও দ্রুত নিজের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে প্রাণপনে পা ঝাপটাতে শুরু করে। পানিতে নামার পরে খুব ভালো করেই নিজামের গুরুত্ব টের পাওয়া যায় এবং হুমায়ুনকে টেনে কখনও ধাক্কা দিয়ে অপর তীড়ের দিকে তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কয়েক মিনিট পরে, নদীর দক্ষিণ তীর থেকে তাঁরা যখন মাত্র পাঁচ গজ দূরে নিজাম হঠাৎ করে আতঙ্কিত হয়ে উঠে পা দিয়ে পাগলের মতো পানিতে আঘাত করে আর হাত দিয়ে হুমায়ুনকে টানতে থাকে। সুলতান, একটা কুমীর- ব্যাটা নির্ঘাত আপনার ক্ষতস্থান থেকে বের হওয়া রক্তের গন্ধ পেয়েছে। বদমাশটার সুচালো মাথা আমাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে। জলদি!

হুমায়ুন দ্রুত দুবার হাত ঝাপটায় এবং সে পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পায়, নরম কাদা তার পায়ের পাতার নীচে পিছলে যেতে থাকে। নিজামকে পাশে নিয়ে নিজের শেষটুকু একত্রিত করে সে পানিতে জবজবে হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে টলমল করে পানি থেকে উঠে আসে।

সুলতান, আমাদের পাড়ের আরেকটু ভিতরে যেতে হবে।

নিজামের সাহায্যে হোঁচট খেতে খেতে হুমায়ুন আরও দশ গজ হেঁটে যায়। আপাত নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে, সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে কুমীরটার হলুদাভ চোখ আর তীরে একেবারে নিকটে সুচালো মাথাটা পানিতে ভেসে রয়েছে দেখতে পায়। তার চোখের সামনেই সরীসৃপটা মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং একটা মোচড় খেয়ে গভীর পানিতে তলিয়ে যায়। কুমীরটা বেশ ছোট তাঁকে হয়তো ধরাশায়ী করতে পারতো না কিন্তু ব্যাপারটা সে পর্যন্ত গড়ায়নি বলে সে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায়।

সুলতান, আমি গিয়ে আপনার সেনাপতিদের খুঁজে বের করি এবং আপনার আহত হবার সংবাদ তাদের জানাই আর আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তাদের লোক পাঠাতে বলি। আমি আমার বাবাকে খুঁজতে- তারপরে আবার সাঁতরে নদী পার হব। সেনাছাউনির অস্থায়ী রন্ধনশালায় সে রাঁধুনির কাজ করে এবং শেরশাহের প্রথম আক্রমণের পর থেকে আমি আর তাকে দেখিনি।

কিন্তু এতোক্ষণ তুমি আমাকে এসব কিছুই বলনি।

আমি জানি প্রথমে আপনাকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।

তোমার সাহসিকতা আর আনুগত্যের উপযুক্ত পুরষ্কার আমি যেন তোমাকে দিতে পারি সেজন্য আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে।

না, সুলতান- আমার বাবাকে আমায় খুঁজে পেতেই হবে। নিজাম উত্তর দেয়, তাঁর কচি মুখে একটা অটল সংকল্প ফুটে আছে।

হুমায়ুনের মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে যায়। আবেগতাড়িত হয়ে সে নিজের অজান্তে ভাবনাটা বলে যায়। ভিস্তিদের মাঝে প্রতিপালিত হলেও তুমি স্বভাবে একজন যুবরাজ। আমি আমার রাজধানীতে যখন ফিরে যাব, আমার সাথে দেখা করবে এবং সেখানে আমার সিংহাসনে উপবেশন করে সত্যিকারের সম্রাটের মতো এক কি দুই ঘন্টার জন্য রাজত্ব পরিচালনা করবে। তুমি যে আদেশ দেবে সেটাই পালন করা হবে।

নিজামকে বিভ্রান্ত দেখায় এবং তারপরে সে ফিক করে হেসে উঠে আর খুশীতে তোতলাতে তোতলাতে, জ্বী সুলতান, বলে সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার তীরের কর্দমাক্ত আর উঁচুনীচু পাড়ের উপর দিয়ে হুমায়ুনের অবশিষ্ট সেনাবাহিনীর খোঁজে দৌড়ে যায়।

২.২ একটি প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন

০৭. একটি প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন

চৌসার দুই দিন আগের রণক্ষেত্র থেকে গঙ্গার বিশ মাইল উজানে হুমায়ুন নিজের অস্থায়ী সেনাশিবিরে তাঁর সেনাপতিদের ভিতরে যারা তার চারপাশে উপস্থিত রয়েছে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। সুলেমান মির্জার মৃত্যুর খবর সে আগেই শুনেছে এবং সেদিন তার সাথে আরও যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের সবার রুহের মাগফেরাত কামনায় গভীর শ্রদ্ধাভরে সে মোনাজাতে অংশ নেয়। বাবা ইয়াসভালো এখানে উপস্থিত রয়েছে যদিও হুমায়ুনের চেয়েও মারাত্মকভাবে তিনি আহত। তার চেয়েও বিস্ময়কর, ফ্যাকাশে মুখ আর দড়িরমতো বাদামী শ্মশ্রুমণ্ডিত আহমেদ খানের উপস্থিতি। তার আহত উরুতে ভারী পটি বাঁধা এবং কাঠের শক্তপোক্ত দেখতে একটা ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি ভীড়ের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

নিজাম গঙ্গার তীরে হুমায়ুনকে রেখে যাবার কয়েক মিনিটের ভিতরেই তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর একটা দল তাঁর কাছে উপস্থিত হয়। হাকিমেরা তাঁর হাতের ফাঁক হয়ে থাকা লম্বা আর গভীর ক্ষতস্থানের মুখ ধুয়ে সেলাই করে তারপরে ঔষধি লাগিয়ে সেটার উপরে স্বচ্ছ মসলিনের পটি বেঁধে দিয়েছে কিন্তু ব্যাথানাশক হিসাবে সে আফিম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। এই মুহূর্তে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা তার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সে নিজের আঙ্গুল নাড়াতে পারছে দেখে ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞবোধ করে কিন্তু ক্ষতস্থানটা প্রায়ই আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠে, কখনও সেখানে কোনো বোধ থাকে না আর যতবারই আহত হাতটা কোনো কিছু স্পর্শ করে ততবারই অবর্ণনীয় একটা ব্যাথায় তার সারা শরীর আপ্লুত হয়ে উঠে। কিন্তু এসব সত্ত্বে এযাত্রায় প্রাণে বেঁচে যাবার জন্য সে মনে মনে সুষ্ঠাকে ধন্যবাদ জানায়। যুদ্ধে সে ভীষণভাবে পরাজিত হয়েছে কিন্তু নিজের হারান ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে সে বদ্ধ প্রতিজ্ঞ ঠিক যেমন তাঁর আব্বাজান বাবর বিরুদ্ধতার মুখোমুখি হয়ে যেভাবে তা মোকাবেলা করতেন।

আহমেদ খান, শেরশাহের সর্বশেষ গতিবিধির কি খবর? সে জানতে চায়।

সে চৌসার পরে আর অগ্রসর হয়নি। সে আর তার লোকেরা এই মুহূর্তে আমাদের ফেলে আসা সিন্দুকের ধনসম্পদ ভাগাভাগি আর গঙ্গার কর্দমাক্ত তীরে কাদায় ডুবে থাকা কামানগুলো পানির আরো গভীরে তলিয়ে যাবার আগে সেগুলো উদ্ধার করতেই ব্যস্ত। তারও আমাদের মতে, প্রচুর সৈন্য নিহত হয়েছে। অন্যেরা লুটের মালের বখরা বুঝে নিয়েই হয়ত দেশের দিকে সটকে পড়বে।

আহমেদ খান, তুমি এসব বিষয়ে একদম নিশ্চিত? গতবার শেরশাহের হতবাক করে দেয়া আক্রমণ সম্বন্ধে তুমি আমাদের আগাম অবহিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলে।

জ্বী, সুলতান, আহমেদ খান মাথা নীচু করে এবং পুনরায় কথা বলার পূর্বে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। শেরশাহ শান্তি চায়, আমাদের অনেকের মতো, আমাকেও এই ধারণাটা বিভ্রান্ত করেছিল। আমি তারপরেও গুপ্তদূত প্রেরণ করেছিলাম কিন্তু যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল আমি সেটা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আর আমি যাদের প্রেরণ করেছিলাম সম্ভবত তারাও খুব একটা সতর্ক ছিল না…আর তারপরে আবহাওয়ার এই অবস্থায়…এবং শেরশাহের বাহিনীর দ্রুতগতি

হুমায়ুন হাত তুলে আহমেদ খানের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়াস থামিয়ে দেয়। হুমায়ুন, যা ঘটে গিয়েছে তার দায়দায়িত্ব বিচার বিবেচনা না করেই খানিকটা হলেও অনুগত আর মারাত্মকভাবে আহত আহমেদ খানের উপরে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেটা করা অনুচিত হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার অধিকারী, প্রধান সেনাপতি আর সম্রাট সে নিজে। ব্যাথা আর ক্ষতস্থান শুকাতে শুরু করায় আরম্ভ হওয়া চুলকানির কারণে ঘুমাতে না পেরে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে নিজেকে অনবরত প্রশ্ন করতে থাকে, কেন তাকে এভাবে পরাজয় বরণ করতে হল। মানুষের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখতে খানজাদা তাঁকে যেমন বারবার অনুরোধ করেছে সে কি সেসবের তোয়াক্কা না করে বড় বেশী অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিল, সে যা শুনতে চায় কেবল সেটাই শোনার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। সে জানে যে সে আত্মতুষ্টিতে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল কিন্তু তাঁর রণনীতিতেও কি কোনো খুঁত ছিল? অবশ্য, অতীত রোমন্থন করে সে নিজেকে বিষণ্ণ করে তুলতে চায় না বরং পরাজয়ের এই তিক্ততা কাটিয়ে এহেন পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটাই নিশ্চিত করতে চায়। এই বিষয়ে সে স্থিরপ্রতিজ্ঞ। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রাজ্য শাসনের অভিপ্রায় তার মাঝে আরও তীব্র হয়ে উঠে।

আহমেদ খান, আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না কিন্তু ভবিষ্যতে নদীর উভয় তীরে যেন আমাদের যতবেশী সম্ভব গুপ্তদূত মোতায়েন থাকে। আমার ফুপুজান এবং অন্যান্য রাজমহিষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের সঙ্গে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর কি খবর?

এতে বিপর্যয়ের ভিতরে একমাত্র সুসংবাদ কেবল তাদের কাছ থেকেই এসেছে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের ভিতরেও তারা বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চলেছে এবং আশা করছে সাত কি আট সপ্তাহের ভিতরে তাঁরা আগ্রা পৌঁছে যাবে।

বেশ। বাবা ইয়াসভালের দিকে ঘুরে এবার হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে, আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে আমাকে বলেন।

সুলতান, আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। আমাদের পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী সৈন্য হয় মৃত নতুবা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে বা পালিয়ে গেছে, এবং আমরা সেইসাথে নিদেনপক্ষে প্রায় সমসংখ্যক ঘোড়া, হাতি আর বারবাহী পশুও হারিয়েছি। আমরা আমাদের কয়েকটা মাত্র কামান নিয়ে আসতে পেরেছি এবং সেগুলোর বেশীরভাগই আবার ছোট। যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য গচ্ছিত অর্থ আর অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের সিংহভাগও আমরা খুইয়েছি।

আমি এমনটাই আশঙ্কা করছিলাম। নিজেদের সংগঠিত আর সুসজ্জিত করতে আমাদের সময় দরকার। আমাদের মিত্রদের মনে বিদ্রোহ বা স্বপক্ষ ত্যাগের মতো কোনো প্রকার হঠকারী ভাবনা সৃষ্টি হবার আগেই তাদের আশ্বস্ত করতে আমাদের দূত প্রেরণ করা উচিত। শেরশাহের মতো, আমরাও ঠিক এই মুহূর্তে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার মতো অবস্থায় নেই। আমাদের উচিত হবে, গঙ্গার তীর বরাবর আমাদের অগ্রযাত্রা বজায় রাখা। এই ধরনের পশ্চাদপসারণে কোনো লজ্জা নেই যদি সেটা বিজয়ের পূর্বাভাস ঘোষণা করে, আর আমাদের কর্তব্য হবে সেটাই নিশ্চিত করা।

*

বৃষ্টিপাত যদিও থেমে গেছে এবং সূর্য এখন আকাশে স্বমহিমায় বিরাজমান থাকায়, হুমায়ুনের দরবার কক্ষের সামনের প্রাঙ্গণের ফোয়ারাগুলোর বুদ্বুদে রঙধনুর মাত্রা সৃষ্টি হয়েছে, আগ্রা দূর্গে তাঁর দর্শনার্থী কক্ষ এখনও জলীয় বাষ্পের কারণে ভেজা আর চিকচিক করছে। চৌসার সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত যুদ্ধের পরে প্রায় চারমাস অতিক্রান্ত হয়েছে। হুমায়ুন আগ্রার দক্ষিণে প্রায় একশ বিশ মাইল দূরে শেরশাহের যেকোনো অপ্রত্যাশিত অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে নিজের মূল বাহিনীকে মোতায়েন রেখে, সে নিজে রাজধানী আগ্রায় ফিরে এসেছে আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে।

আগ্রা পৌঁছাবার পরে সেখানে তার জন্য আরও দুঃসংবাদ অপেক্ষা করেছিল। বাংলায় শেরশাহজনিত কারণে তার ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ আর তার মিত্র লোদীদের রাজ্যাভিযোগী পাহাড়ের গোপন আশ্রয় ছেড়ে নেমে এসে গুজরাতের শক্তঘাঁটি থেকে সেখানে হুমায়ুনের রেখে আসা শাসক আর তাদের সামান্য সংখ্যক সৈন্যদের বিতাড়িত করেছে। হুমায়ুন বুঝতে পারে যে তাঁর পক্ষে দুটো রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করা অসম্ভব, সে তাঁর উজির এবং তাঁর মরহুম আব্বাজানের সময়ে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ দৌত্য অভিযানে অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কাশিমকে গুজরাতে প্রেরণ করে একটা শান্তি চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে। গুজরাত যদি তাকে তাদের নামেমাত্র অধিরাজ হিসাবে স্বীকার করে নেয় তাহলে সে গুজরাতের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাজি আছে।

এক সপ্তাহ পূর্বে ক্লান্ত, ধূলায় ধুসরিত কিন্তু কান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসি নিয়ে কাশিম তাঁর ঘোড়া থেকে নেমে হুমায়ুনকে বলে যে গুজরাতের সুলতান তার প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। দরবারে অপেক্ষমান অমাত্য আর সেনাপতিদের সাথে মিলিত হতে দূর্গ প্রাঙ্গন অতিক্রম করার সময় হুমায়ুন অন্যান্য আরও উৎসাহব্যঞ্জক অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে। তাঁর সৎ-ভাইয়েরা তাদের নিজ নিজ প্রদেশ থেকে আপাতত অল্প সংখ্যক সৈন্যের দল প্রেরণ করেছে ভবিষ্যতে আরও বেশী সংখ্যক সৈন্য প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কামরান আর তাঁর অন্যান্য সৎ-ভাইদের ভিতরে অন্তত এখনও পর্যন্ত তার দুর্ভাগ্যকে তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উসিলা হিসাবে ব্যবহারের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি বরং শেরশাহের বিদ্রোহ যেন তাদের ভাইদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। হুমায়ুন নিজেকে আশ্বস্ত করতে চায়, সবকিছু আবার আগের মতো হবে এবং তার মুখে হাল্কা হাসির একটা আভাস ফুটে উঠে।

হঠ যাও। মহামান্য সুলতানের কাছাকাছি যাবার কথা কল্পনাও করতে যেও না।

হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তার পেছনে যেখান থেকে চিৎকারটা এসেছে সেদিকে তাকায়। দীর্ঘকায়, কালো পাগড়ি পরিহিত এক প্রহরী তার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা একটা ছোটখাট অবয়বের কব্জি শক্ত করে ধরে রেখেছে।

তিনি আমাকে আসতে বলেছেন- দুই এক ঘন্টার জন্য তাঁর সিংহাসনে আমাকে বসতে দেবেন।

বাছা রোদে কি তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছে? তাঁকে অসম্মান করলে- কপাল যদি ভালো হয় তাহলে তোমাকে কেবল চাবকে ছেড়ে দেয়া হবে আর খারাপ হলে হাত আর পা বেঁধে হাতির পায়ের নীচে ফেলে দেয়া হবে।

হুমায়ুন প্রহরীর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে মোচড়াতে থাকা দৃঢ় কণ্ঠের অধিকারী অবয়বের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। অবয়বটা আর কারও না, তার প্রাণ রক্ষাকারী ভিস্তি নিজামের।

ওকে আসতে দাও। প্রহরী সাথে সাথে আদেশ পালন করে এবং নিজাম হুমায়ুনের সামনে মাথা নত করে হাটু ভেঙে বসে পড়ে।

নিজাম, তুমি উঠে দাঁড়াতে পার। গঙ্গা অতিক্রম করতে আর চৌসার রণক্ষেত্রে তুমি আমাকে কিভাবে সাহায্য করেছিলে আমার সেটা ভালোই মনে আছে। আমার এটাও মনে আছে কোনো পুরষ্কারের জন্য তুমি কিভাবে নিষেধ করেছিলে এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমি বলেছিলাম যে সামান্য সময়ের জন্য তুমি আমার সিংহাসনে উপবেশন করতে পারবে আর সে সময়ে তোমার যেকোনো আদেশ পালন করা হবে। হুমায়ুনের দেহরক্ষী আর সেখানে উপস্থিত অমাত্যবৃন্দ যাদের ভিতরে কাশিম আর বাইসানগারও রয়েছেন যারা দরবার কক্ষে যাবার তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন সবাই নিজেদের ভিতরে বিস্মিত দৃষ্টি বিনিময় করে কিন্তু হুমায়ুন তাঁদের সবার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে। আমাদের অস্থায়ী সম্রাটের পক্ষে মানানসই একটা আলখাল্লা নিয়ে এসো, হুমায়ুন জওহরকে আদেশ দিতে, কয়েক মিনিটের ভিতরে সে লাল মখমলের তৈরী একটা আলখাল্লা এবং একই উপকরণ দিয়ে তৈরী সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা পরিকর এনে হাজির করে।

নিজাম তার চারপাশে গোলাপজলের বুদ্বুদ উঠতে থাকা ঝর্ণা আর দূর্গ প্রাঙ্গণের ফুলের বাগানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তাকে এখন আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী দেখায় না এবং জওহর আলখাল্লা হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে সে গুটিয়ে যায়।

নিজাম, ভয় পেয়ো না। হুমায়ুন কিশোর ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে দেয়। অনায়াসে নিজের সবচেয়ে প্রিয় অভিপ্রায় সবসময়ে সিদ্ধ হয় না। জওহরের হাত থেকে আলখাল্লাটা নিয়ে সে নিজে সেটা নিজামকে পরিয়ে দেয় এবং কোমর আর ডান কাঁধের রূপার বকলেস এঁটে দিয়ে পরিকরটা নিজামের ছোটখাট দেখতে অবয়বের চারপাশে জড়িয়ে দেয়। মখমলের আলখাল্লায় ঝাঁকড়া মাথার কিশোর ভিস্তিকে হয়ত খানিকটা হাস্যকর দেখায় কিন্তু নিজাম সোজাভাবে উঠে দাঁড়ালে তাঁর মস্তকবাহী দেহখাঁচায় উপযুক্ত মর্যাদা ফুটে উঠে।

চল, এবার এগোন যাক। হুমায়ুন দরবার হলের বাইরে অবস্থানরত ঢাকির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মাথা নোয়াতে, সম্রাটের আগমন বার্তা ঘোষণা করে, তারা সাথে সাথে সোনার উপরে নীলকান্তমণির কারুকাজ করা কাঠামোতে রক্ষিত মোষের চামড়া দিয়ে মোড়ান লম্বা ঢাকে হাতের তালু দিয়ে বোল তুলতে আরম্ভ করে।

নিজাম এসো, আমরা দুজন একসাথে যাই- তুমি এক ঘন্টার সম্রাট, আমি কবর পর্যন্ত নেতৃত্বের বোঝা বহনের জন্য জন্ম নেয়া সম্রাট।

হুমায়ুনের অমাত্য আর সেনাপতিরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দরবার হলের দিকে হুমায়ুন আর নিজাম শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়ে যায়। সিংহাসনের দিকে তারা এগিয়ে যাবার সময়, হুমায়ুন থমকে থেমে নিজামকে আলতো করে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। বিস্ময়ের একটা তুমুল শব্দের ভিতরে, নিজাম ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সিংহাসনে আরোহন করে, ঘুরে দাঁড়ায় এবং সবশেষে উপবেশন করে।

হুমায়ুন হাত তুলে নিরবতা বজায় রাখতে বলে। চৌসার বিপর্যয়ের পরে আমার জীবন বাঁচাবার জন্য, এই কিশোর নিজাম ভিস্তির আনুগত্য আর সাহসিকতার কথা আমি পুরো দরবারের সামনে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। আমি নিজামকে সেদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমার সিংহাসনে কিছুক্ষণের জন্য আরোহন করে সে তার ইচ্ছামতো যেকোনো ঘোষণা করতে পারবে। সে ইতিমধ্যে নিজেকে এর যোগ্য হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে এবং আমি জানি, তাঁর হাতে আমি যে ক্ষমতা তুলে দিয়েছি সেই ক্ষমতার সে অপব্যবহার করবে না। নিজাম- কি তোমার অভিপ্রায়?

হুমায়ুন কৌতূহলী হয়ে উঠে। নিজাম নিজের জন্য কি চাইবে? অর্থসম্পদ, জমিদারী নাকি ধনরত্ন? সে অবশ্যই জানে যে তাঁর জীবন এবং তার পরিবারের সবার জীবন আর কখনও আগের মতো থাকবে না। নিজামের অভিপ্রায় মঞ্জুর করতে পেরে তাঁর ভালো লাগে।

সুলতান… সিংহাসনের উপর থেকে নিজামের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ আর কীচকী শোনায়। নিজামও বোধহয় সেটা বুঝতে পারে, সে আবার চেষ্টা করে। সুলতান। তার কিশোর কণ্ঠ এইবার স্পষ্ট আর যথার্থভাবে ধ্বনিত হয়। আমি কেবল দুটো আদেশ করতে চাই। গঙ্গার তীরে আমি যেন অনুদান হিসাবে একখণ্ড জমি লাভ করি যেখানে আমি শস্য উৎপাদন করতে পারবো এবং এক বছরের জন্য সব ভিস্তিদের কর মুওকুফ করা হোক।

হুমায়ুন চাপা হাসির একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। এমনকি কাশিমের সচরাচর গম্ভীর, আত্মনিরোধী মুখেও যেন একটা ক্ষীণ হাসির রেশ ফুটে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, কিন্তু নিজামের অনুদ্ধত অনুরোধ হুমায়ুনকে আবেগপ্রবন করে তুলে। দরবারের অনেকের মতো সে নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত রকমের সম্পদশালী করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেনি।

আপনার আদেশ যথাযথভাবে পালিত হবে।

আমিও তাহলে সিংহাসন থেকে নেমে আসতে প্রস্তুত। নিজাম লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তাঁর ক্ষুদ্র অবয়বে স্বস্তির একটা রেশ ফুটে উঠে, এবং হোঁচট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে দুহাতে আলখাল্লাটা গোড়ালীর উপরে তুলে ধরে আলতো পায়ে নেমে আসে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন অনুধাবন করে সত্যিকারের সাহস কাকে বলে সে এই প্রত্যক্ষ করেছে। দরবারে এসে হুমায়ুনকে নিজের প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার কথা বলার জন্য নিজামকে কি বিশাল একটা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল? সে ভালো করেই জানতো, তাঁর কথা হয়ত হুমায়ুন ভুলেই গেছেন বা তার ঔদ্ধত্যের কারণে তিনি কুদ্ধও হতে পারেন। ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা ছেলেটার প্রতি সেই প্রহরী যদি চিৎকার না করতো তাহলে চেঁচিয়ে সম্রাটকে জবাবদিহি করতে বলার ধৃষ্টতা চাবুকের মূল্যে পরিশোধ করার কিংবা নিজের হঠকারীতার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবারও একটা সমূহ সম্ভাবনা ছিল।

হুমায়ুন এবার সিংহাসনে আরোহন করে। পুনরায় সম্রাটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমিও এবার কিছু আদেশ করতে চাই। আদেশগুলো হল নিজাম ভিস্তিকে এমনভাবে জমির অনুদান দেয়া হোক যাতে সে নিজে এবং তার পুরো পরিবার স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারে এবং সেই সাথে তাকে পাঁচশ স্বর্ণমুদ্রাও যেন প্রদান করা হয়। হুমায়ুন দেখে প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় দরবার হল থেকে যাবার আগে ক্ষুদে অবয়বটা, তার দিকে মাত্র একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

সেদিন অপরাহ্নে, সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন শেষে, ফ্যাকাশে চাঁদ আকাশে যখন মাত্র উঠতে শুরু করেছে এবং রাতের রান্নার জন্য নতুন করে আগুন জ্বালাবার পরে, হুমায়ুন আগ্রা দূর্গের প্রাকারবেষ্টিত ছাদে উঠে আসে। কিছুক্ষণের জন্য নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকবার অভিপ্রায়ে সে তার সব প্রহরীদের চলে যাবার অনুমতি দিয়েছে। তার নির্জনতা প্রীতি বাবর একজন শাসকের জন্য যা মারাত্মক দোষ হিসাবে বিবেচনা করতেন কখনই হুমায়ুনকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। নক্ষত্রের আবর্তনের প্রতি তাঁর এখনও আগের মতোই কৌতূহল রয়েছে। যদিও এসব অনুভূতি সে নিয়ন্ত্রণ করেছে, সে জানে যে তাঁর সেটাই করা উচিত, অনুভূতিগুলো এখনও আগের মতোই প্রবল- যার আসক্তি গুলরুখের তৈরী আফিম আর সুরার মিশ্রণের চেয়ে অনেকবেশী শক্তিশালী।

রাজত্বের নিপীড়ন নিয়ে তার আব্বাজান একবার তার সাথে আলোচনা করেছিলেন এবং তিনি ঠিকই বলেছিলেন। একজন শাসকের চেয়ে একজন দরিদ্র মানুষ হওয়াটা অনেক দিক দিয়েই উত্তম প্রস্তাবনা। নিজাম অন্তত, একজন স্বাধীন মানুষের মতো, গঙ্গার পানিতে তাঁর মশক ডুবিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। একটা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের বোঝা বহন করা মোটেই সহজ নয়, যদিও সে ভালো করেই জানে তাঁর কখনও এই পবিত্র দায়িত্ব পরিত্যাগ করার অভিপ্রায় হবে না।

সে যখন নিজের ভাবনা নিয়ে তন্ময় চারপাশ অন্ধকার করে তখন রাত নামছে। নিজের আবাসন কক্ষে ফিরে যাবার সময় হয়েছে যেখানে জওহর আর তাঁর অন্যান্য পরিচারকেরা রাতের খাবার পরিবেশন শুরু করবে- পাত্র ভর্তি ভেড়ার মাংস, মাখন দেয়া ভাত আর মোগলদের স্বদেশের কন্দজাতীয় সজি এবং জাফরান ও হলুদ দিয়ে রান্না করা হিন্দুস্তানের মশলাযুক্ত নানা পদ, তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের সমভূমি দিনে যে সূর্যের প্রতাপে দগ্ধ হয় স্বাদে গন্ধে ঠিক সেরকমই প্রখর। দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা জ্বলন্ত মশালের আলোয় নিজের আবাসন কক্ষে ফিরে যাবার জন্য হুমায়ুন তিন অংশে বিভক্ত ঢালু পাথুরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে সে সিঁড়ির প্রথম অংশ অতিক্রম করে তারপরে বাঁক ঘুরে সিঁড়ির দ্বিতীয় অংশ অতিক্রম করার ঠিক আগ মুহূর্তে সে কয়েকটা কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে যায়।

আমি ভেবেছিলাম সম্রাট নিজের পাগলামি থেকে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছেন। মাসের পর মাস বিনা প্রতিবাদে আমরা তাঁর পাগলামি সহ্য করেছি…গ্রহের প্রভাবযুক্ত দিন সম্বন্ধে আর সৌরমণ্ডল অঙ্কিত সেই আহাম্মকের সতরঞ্জি যতসব ফালতু ধারণা। আমাদের নিজের ইচ্ছামতো মূত্র বিসর্জনের অনুমতি ছিল বলে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম…।

সেই ঘামের গন্ধঅলা ক্ষুদে চাষার ব্যাটার দরবার হলের কাছাকাছি কখনও পৌঁছাতে পারারই কথা না, রাজকীয় সিংহাসনে উপবেশনের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিছুক্ষণ বিরতির পরে আরেকটা কণ্ঠস্বর মন্তব্য করে। সম্রাট যদি তাঁকে একান্তই পুরস্কৃত করতে চাইতেন, একটা তামার মুদ্রা দিয়ে পাছায় কষে একটা লাথি দিয়ে বিদায় দিলেও চলতো। আমি আশা করি এটা কোনো নতুন পাগলামি সূচনা নয়। ঘাড়ের উপরে শেরশাহের যোদ্ধারা যখন নিঃশ্বাস ফেলছে তখন স্বপ্নদর্শীর চেয়ে আমাদের একজন যোদ্ধার বেশী প্রয়োজন।

আমাদের সম্রাট একজন দুর্দান্ত যোদ্ধা- যুদ্ধক্ষেত্রে তারমতো সাহসী আর কেউ নেই… তৃতীয় একজন মন্তব্য করে। তাঁর কণ্ঠস্বর মন্দ্র এবং বয়সের ছাপ স্পষ্ট কিন্তু কিন্তু অন্যদের মতো- হুমায়ুন একেও চিনতে পারে না।

আমরা অবশ্য আশা করতে পারি যে তিনি মনে রাখবেন যে কি জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। বাবর ছিলেন একজন সত্যিকারের পুরুষ- সেজন্যই কাবুল থেকে তাঁর অভিযাত্রী দলের সাথে আমি এখানে এসেছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারিনা কল্পনাপ্রবণ এক জ্যোতিষীর জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করিনি…

কিন্তু তিনি কি ইতিমধ্যে অসাধারণ বিজয় অর্জন করেননি… গুজরাতের কথা একবার স্মরণ কর এবং কিভাবে আমরা… মন্দ্র কণ্ঠের অধিকারী বলতে থাকে, কিন্তু লোকগুলো হাঁটতে আরম্ভ করায় হুমায়ুন তাঁদের আলোচনার অবশিষ্টাংশ শুনতে পায় না।

তাদের কথাবার্তা তাঁকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। ছুটে গিয়ে তাঁদের মুখোমুখি হবার অভিপ্রায় তাঁকে বেশ প্রলুব্ধ করতে থাকে কিন্তু তারা যা বলেছে সেগুলো খানিকটা হলেও সত্যি। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে গোধূলির আলোয় দিনের সূচনা করে সে তাঁর সেনাপতি আর অমাত্যদের সাথে নিজের সম্পর্ক নষ্ট করেছে আর তার প্রজাদের হতাশ করেছে। কিন্তু নিজামের ব্যাপারে তাঁদের ধারণা ভুল। নিজামকে সে কথা দিয়েছিল এবং সে কথা রেখেছে। যা একজন সম্মানিত ব্যক্তির উপযুক্ত আচরণ। অন্য কিছু করলে, ইহকালে না হোক পরকালে তাকে অবশ্যই সেজন্য শাস্তি পেতে হতো…

*

আহমেদ খান, প্রথমে আমাকে বল, আমাদের শত্রু সম্বন্ধে আমরা কি জানি?

হুমায়ুন নিজের চারপাশে তার সামরিক উপদেষ্টাদের সাথে সম্রাটের লাল নিয়ন্ত্রিত তাবুতে আবারও একবার বৈঠকে বসেছে। শেরশাহের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে গত সন্ধ্যায় আগ্রা থেকে একশ বিশ মাইল দক্ষিণে সে তার সেনাবাহিনীর শিবিরে এসে হাজির হয়েছে।

সুলতান, সংবাদ খুব একটা ভালো না। শেরশাহ যুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদের সমাধিস্থ করে খুব মন্থর গতিতে কাকরি ফিরে গেছে, এই শহরটাকে সে তার নেতৃত্বের অগ্রবর্তী কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। দশ সপ্তাহ আগে, সেখানেই তার বিজয় উদযাপন উপলক্ষ্যে একটা বিশাল কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছিল। ঢাকের তালে তালে তাঁর সবচেয়ে চৌকষ অশ্বারোহীদের একটা দল নিজেদের বেগুনী নিশান বহন করে কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব দেয়। তারা উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে তাঁরা গলার স্বর সপ্তমে তুলে তাঁদের উৎসাহিত করে। শেরশাহ আমাদের কাছ থেকে ব্রোঞ্জের যে কামানগুলো জব্দ করেছিল গঙ্গার তীরের কাদা থেকে তাঁদের বেশীর ভাগই টেনে তুলতে সফল হয়েছে এবং পুনরায় তাদের কার্যক্ষম করে তুলেছে। কুচকাওয়াজে এর পরেই ছিল কামানগুলো, রাস্তা দিয়ে সেগুলোকে টেনে নিয়ে যায় আমাদেরই কিছু হাতি যা সে তাড়া করে ধরেছে। কামানের ঠিক পেছনেই ছিল আমাদের যুদ্ধবন্দিদের সারি, শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় তাদের হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমাদের এক গুপ্তচরের বয়ান অনুসারে, মিষ্টি বিক্রেতার ছদ্মবেশে সে খুব কাছ থেকে তাঁদের দেখেছে, বন্দিদের অনেকেই খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো বা তাদের ক্ষতস্থানসমূহে নোংরা কাপড় দিয়ে পটি বাঁধা ছিল। বাকিদের দেহের যেখানে শেকল দংশন করেছে সেখানেই রয়েছে দগদগে যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত। বন্দিদের সবাইকে ক্ষুধার্ত আর রোগা দেখাচ্ছিল আর তাদের চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ ছিল। গুপ্তচর আরও বলেছে যে দর্শকরা তাদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, ধাক্কা দেয় আর তাঁদের দিকে পচা আবর্জনা ছুঁড়ে মারে এমনকি কেউ কেউ তাদের লাঠি দিয়েও আঘাত করে।

শেরশাহের উল্লসিত বাহিনীর আরও অনেকগুলো দল পর্যায়ক্রমে তাদের অনুসরণ করে এবং সবশেষে শেরশাহ নিজে লম্বা একটা হাতির পিঠে স্থাপিত গিল্টি করা হাওদায় আরোহন করে এগিয়ে আসে, হাতিটার লম্বা দাঁতগুলো সোনার পাতা দিয়ে মোড়ান এবং এর পর্যানের ঢাউস কাপড়টায়, যা মাটি পর্যন্ত বিস্তৃত, মুক্তা আর মূল্যবান পাথর দিয়ে কারুকাজ করা। শোভাযাত্রাটা যখন শহরের মূল চত্বরে পৌঁছায় শেরশাহ হাতির পিঠ থেকে নেমে আসে বেগুনী কাপড় দিয়ে আবৃত একটা অতিকায় মঞ্চে নিজের নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করতে।

সে এখানে আমাদের কাছ থেকে অধিকৃত সম্পদ তাঁর প্রধান সমর্থকদের মাঝে উপহার হিসাবে বিলিয়ে দেয় এবং আমাদের কাছ থেকে দখল করা জমি তাদের ভিতরে বিলিবণ্টন করে, এবং তাদের মাঠে আর খনিতে কৃতদাস হিসাবে কাজ করার জন্য আমাদের ভাগ্যপ্রপীড়িত বন্দিদের কয়েকটা দলকে দান করে। তারপরে, যা বলা আরো লজ্জাজনক, আমাদের অনেক প্রাক্তন মিত্র এবং অনুগত জায়গীরদার নিজেদের আনুষ্ঠানিক পোষাকে সজ্জিত হয়ে সামনে এগিয়ে আসে। শেরশাহের সামনে নোংরায় তারা খুশীমনে নিজেদের অধধামুখে প্রণত হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করে এবং সে তার সেনাবাহিনীতে তাদের বিভিন্ন পদ দিয়ে পুরস্কৃত করে এবং আপনি যখন পরাজিত হবেন তখন আরও পরিমাণে দান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের অনুসরণ করে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর শাসকদের প্রেরিত রাজদূতেরা যেমন হীরক-সমৃদ্ধ গোলকুণ্ডা, যিনি আমাদের দুর্বলতা থেকে নিজেদের আরও শক্তিশালী করার সুযোগ দেখতে পেয়ে, শেরশাহকে সবধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিনিময়ে তাদের খুশী করতে আমাদের ভূখণ্ডের কিয়দংশ তাঁদের অধিকারে ছেড়ে দেবার সাড়ম্বর প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়।

সবশেষে, উচ্চনাদের আরেকদফা তূর্যবাদনের মাধ্যমে, আপনার প্রাক্তন অনুগত রাজাদের ভিতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাঁরা তাঁদের একজন- গোলপুরের রাজা- এগিয়ে আসে এবং শেরশাহের সেনাপতিদের অনেককে সাথে নিয়ে সে শেরশাহের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে। শেরশাহকে সম্রাটের পদবী- পাদিশাহ গ্রহণের জন্য তারা একসাথে তাকে অনুরোধ করে, তাকে বশংবদ আর বিশ্বাসঘাতকের মতো আশ্বাস দেয় যে এই পদবীর জন্য সে সবসময়েই আপনার চেয়ে অনেকবেশী যোগ্য। শেরশাহ দুইবার নিজের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন পূর্বক বক্তব্য প্রদান করে বলেন যে তিনি কেবল আপনার দ্বারা অত্যাচারিতদের সাহায্য করতে চান। নিজের জন্য পুরষ্কার কিংবা ক্ষমতা কিছুই চান না। অবশ্য তৃতীয়দফা দর্পোদ্ধত আর আরো বেশী চাটুকারী বিশেষণ প্রয়োগ করে সনির্বন্ধ প্রার্থনা করা হলে তাঁদের অতিরঞ্জিত বাক্য ব্যবহার ততক্ষণে মাত্রা ছাড়িয়েছে। তিনি রাজি হয়ে বলেন, যদি এটাই তোমাদের অনড় আকাঙ্খ হয়, আমি কেবল সম্মতি জানাতে পারি। বিচক্ষণতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা আর সবাইকে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি আমি দিলাম। তারপরে সোনার উপরে রুবি দিয়ে কারুকাজ করা একটা মুকুট- সবসময়ে যা প্রস্তুত ছিল; পুরো ব্যাপারটাই মঞ্চে অভিনীত একটা প্রহসন, তাঁর প্রাথমিক প্রত্যাখ্যান কেবলই লোক দেখান- শেরশাহের তিনজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক আর গোলপুরের রাজা তাঁর মাথায় স্থাপন করে। উপস্থিত সবাই নিজেদের তার সামনে প্রণত করে, মাটিতে নিজেদের বিশ্বাসঘাতক নাক চেপে ধরে।

পরে সেই রাতে, শেরশাহ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাপূর্ণ এক গণউৎসব মঞ্চস্থ করে। মশালের ধকধক করে জ্বলতে থাকা আলোতে প্রতিটা রাজ্য এবং গোত্রের একজন তরুণ যোদ্ধা যারা এখন তার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ শেরশাহের সামনে সামরিক কসরত প্রদর্শন করে, এসময়ে সে সোনার কারুকাজ করা চাঁদোয়ার নীচে একটা লম্বা, খাড়া পৃষ্ঠদেশযুক্ত সোনার গিল্টি করা একটা সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিল। সিংহাসনে শেরশাহের মাথার ঠিক উপরে গর্জনরত একটা ক্রুদ্ধ ব্যাঘ খোদাই করা রয়েছে। বাঘটার চোখের স্থানে দুটো প্রকাণ্ড রুবি শোভা পাচ্ছে যেগুলো আমাকে বলা হয়েছে- আধারেও তীব্রভাবে জ্বলজ্বল করে। প্রদর্শনী শেষ হবার পরে সবাই তথাকথিত সম্রাটের সামনে পর্যায়ক্রমে মাথা নত করে এবং তিনি তাদের ঘামে ভেজা কামান মাথায় তাদের আর তারা যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে সবাইকে তিনি যে সাফল্য আর সমৃদ্ধির অংশীদার করবেন তার লক্ষণস্বরূপ জাফরান, মুক্তা চূর্ণ, কস্তরীমৃগ আর তিমি মাছের অন্ত্রে প্রাপ্ত মোমসদৃশ গন্ধদ্রব্য ছিটিয়ে দেন।

পরের দিনটা ছিল শুক্রবার, শহরের প্রধান মসজিদে- শেরশাহের সেনাপতিদের উপস্থিতির কারণে জনাকীর্ণ- ইমাম সাহেবও শেরশাহের নামে খোতবা পাঠ করে শেরশাহকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে এবং বিশ্বাসঘাতকসুলভ আর তীব্র কটাক্ষপূর্ণ ভঙ্গিতে আপনার সমুদয় ভূখণ্ড হোক সেটা বাংলায় তার দ্বারা ইতিমধ্যে জবরদখলকৃত বা তার নাগালের বাইরে পাঞ্জাব আর আফগানিস্তান, শেরশাহকে বরাদ্দ দেয়া হয়। পরের দিন, শেরশাহ আমাদের বিরুদ্ধে নতুন করে তার অগ্রাভিযান শুরুর অভিপ্রায়ে কুচকাওয়াজের সাথে রওয়ানা দেয়। তার নতুন মিত্রদের কল্যাণে, এখন তার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি।

সে এই মুহূর্তে কোথায় অবস্থান করছে?

এখান থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে, আগ্রা অভিমুখে ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

বাবা ইয়াসভালো, আমাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর কি অবস্থা? নতুন করে সমর-সজ্জার অগ্রগতি কি ভালোমতো চলছে?

হ্যাঁ, অস্ত্র আর বর্ম নির্মাতারা দারুণ কাজ দেখিয়েছে। আমাদের লোকেরা সবাই নতুন অস্ত্র পেয়েছে। আরো বেশী সংখ্যক কামান উৎপাদনের লক্ষ্যে আমাদের ঢালাইখানার চুল্লী দিনরাত জ্বলছে। আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীকে পুনরায় সচল করতে ঘোড়ার দালালেরা আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে ঘোড়া সরবরাহ করেছে। যদিও অনেকগুলোই আমাদের পিতৃপুরুষের স্বদেশের তৃণভূমিতে জন্ম নেয়া ঘোড়ার মতো বিশাল আর শক্তিশালী না।

আর আমাদের মিত্র এবং আমার সৎ-ভাইদের দ্বারা আরও সৈন্য প্রেরণের প্রতিশ্রুতির কি খবর?

এই বিষয়ে খবর খুব একটা ভালো না। আমাদের অনেক মিত্রই গড়িমসি করছে, সৈন্য প্রেরণে বিলম্বের কারণ হিসাবে তারা বর্ষাকাল বা স্থানীয় বিদ্রোহের অজুহাত দিচ্ছে বা পাঠালেও খুব ছোট বাহিনী প্রেরণ করছে। হিন্দাল আর আসকারি অবশ্য প্রতিশ্রুতি পালন করেছে বিশেষ করে হিন্দাল প্রতিশ্রুত সংখ্যার চেয়েও বেশী সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করেছে কিন্তু আপনার সৎ-ভাইদের ভিতরে সবচেয়ে বড় যে কামরান সে পাঞ্জাব থেকে মাত্র আড়াইশ অশ্বারোহীর একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করেছে যাদের ঘোড়াগুলো দারুণ। আমরা অধিকতর সহযোগিতার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে সে প্রত্যুত্তরে স্পষ্ট করে কোনো সময়সীমা উল্লেখ করেনি এবং আপনি আরও ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে কিছু সৈন্য সে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছে।

কিন্তু আমরা যাতে আরও পরাজয়ের সম্মুখীন হই, সেটা নিশ্চিত করার জন্য এটা একটা অনিবার্য পন্থা, হুমায়ুন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গর্জে উঠে কিন্তু তারপরে বেশী কিছু বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। প্রকাশ্যে নিজের সৎ-ভাইদের সমালোচনা করাটা মোটেই সমীচিন হবে না। কামরানের সাথে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদানপ্রদানের সাথে তার সেনাপতির বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়। তার সৎ-ভাই চিঠির উত্তর দিতে দেরী করে এবং যখন সে উত্তর পাঠায় শেরশাহের প্রতি নিজের বৈরিতা যদিও সে যথার্থ মারমুখো ভঙ্গিতে প্রকাশ করে, কিন্তু হুমায়ুনের নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধের জন্য সৈন্য প্রেরণের ক্ষেত্রে সে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয় না। কামরান তার সব সৈন্য নিয়ে বরং নিজে যুদ্ধে যোগদানের প্রস্তাব দিয়েছে। সে খুব ভালো করেই জানে হুমায়ুন ইহা প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ তার প্রস্তাবে রাজি হওয়া মানে পাঞ্জাবকে শাসকহীন করা এবং সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সৈন্যহীন করা। কামরান মনে হয় প্রতীক্ষা করার খেলা শুরু করেছে, সে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান সংরক্ষণের বিষয়ে বেশী উদগ্রীব তাঁদের আব্বাজানের সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হওয়া প্রদেশগুলো পুনরুদ্ধারের চেয়ে যদি এর মানে হয় তাঁর নিজস্ব গৌরব বৃদ্ধির চেয়ে হুমায়ুনের গৌরব বৃদ্ধি করা।

আমি আমার সৎ-ভাইদের সাথে যোগাযোগ করবো। কিন্তু আমাদের সেনাপতিরা এই মুহূর্তে ঠিক কতজন সৈন্য মোতায়েন করতে সক্ষম?

সুলতান, এক লক্ষ সত্তর হাজার।

তার মানে বর্তমান পরিস্থিতিতে শেরশাহের সৈন্য সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশী।

জ্বী, সুলতান। আপনার ভাই কামরান আর অন্যান্যদের কাছ থেকে যতক্ষণ না বাড়তি লোকবল এসে পৌঁছায়।

*

হুমায়ুন নিজের গালে সন্ধ্যার উষ্ণ, কোমল বাতাসের স্পর্শ অনুভব করে যখন, স্থানটা গঙ্গার তীরে কনৌজের বসতি থেকে খুব একটা দূরে অবস্থিত না, সে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মান ঝোপঝাড় আর ইতস্ততভাবে বেড়ে উঠা বামনাকৃতি গাছপালা শোভিত বেলেপাথরের একটা সরু চূড়ায় নিজের আদেশপ্রদানকারী অবস্থান থেকে বিপরীতপার্শ্বের শৈলচূড়া অভিমুখে তাকায় যেখানে, যদি তার গুপ্তচরদের বিবরণী নির্ভুল হয়, আগামীকাল সকালে শেরশাহের বাহিনী এসে উপস্থিত হবে। মৃদুমন্দ এই বায়ু প্রবাহটা কিছুক্ষণের জন্য হুমায়ুনকে তাঁর জন্মস্থান, আফগানিস্তানে গ্রীষ্মকালে প্রবাহিত শীতল বাতাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অতীতের স্মৃতি মনে পড়তে তার মুখে ফুটে উঠা আধো হাসির আভাস তার মাথার পেছনে সতত বর্তমান জ্ঞানের কারণে নিমেষে বিতাড়িত হয়, যে গত দুইমাস কাল ধরে তার সামরিক পরিষদমণ্ডলী দুঃসংবাদব্যাতীত আর কিছুই বয়ে আনেনি।

শেরশাহের ধীর কিন্তু অবিশ্রান্ত অগ্রগতি বজায় আছে। যা সম্ভবত একেবারে অপ্রত্যাশিত না কিন্তু হুমায়ুন যেটা একেবারেই আঁচ করতে পারেনি সেটা হল মুরাদাবাদের রাজা, হানিফ খানের স্বপক্ষত্যাগ করে শেরশাহের সাথে যোগ দেবার বিষয়টা, সুলেমান মির্জা মৃত্যুবরণ করার পরে যিনি এখন হুমায়ুনের অশ্বারোহী বাহিনীর সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ অধিনায়ক, তার সাথে রয়েছে পনের হাজার অশ্বারোহীর একটা বিশাল বাহিনী, দিল্লীর পূর্বে হানিফ খানের জমিদারী এলাকা থেকে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর কাপুরুষোচিত পলায়নের ঠিক পরপরই, শেরশাহ নিশ্চিতভাবেই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে- গঙ্গার তীরবর্তী সুরক্ষিত একটা শহরে আক্রমণ চালায় যা ইতিপূর্বে হানিফ খানের অধীনস্ত ছিল। হানিফ খানের স্বপক্ষত্যাগের কারণ হতোদ্যম হয়ে পড়ায়, হুমায়ুনের কয়েক হাজার সৈন্য যাঁরা তখনও তাঁর প্রতি অনুগত ছিল সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং অচিরেই শহরটা আত্মসমর্পন করলে শেরশাহের অগ্রযাত্রার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। হুমায়ুন কোনোভাবেই সেইসব সৈন্যদের কোনো দোষ দিতে পারে না। সে বরং নিজেকেই ভৎর্সনা করে যে যাঁরা তাঁকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে তাঁদের উচ্চাকাঙ্খ আর চরিত্র অনুধাবনে সে মোটেই সময় দেয়নি ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল সে পরিহার করতে চেষ্টা করবে।

হুমায়ুনের পেছনে যা ঘটছে সে সবের বিবরণও তাঁকে সমানভাবে বিব্রত করে। হিন্দালের শাসনাধীন প্রদেশ আলওয়ারে শেরশাহের সমর্থনে একটা সশস্ত্র বিদ্রোহ দানা বেঁধেছিল যা হিন্দাল চিঠিতে জানায়, বহু কষ্টে সে এই বিদ্রোহ দমন করেছে। দিল্লীর কাছে অবস্থিত পার্বত্য এলাকায় হানিফ খানের অনুগত জায়গীরদারদের ভিতরেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে এবং হুমায়ুন বাধ্য হয় একদল সৈন্য প্রেরণ করে বিদ্রোহীদের দমন করতে, যাদের তার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার প্রস্তুতি স্বরূপ প্রশিক্ষিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

কামরানের কাছ থেকে প্রেরণ করা চিঠিটা সবকিছুর ভিতরে নিকৃষ্টতম। হুমায়ুনের প্রতি এবং রাজবংশের প্রতি আর শেরশাহের সাথে তার বিরোধিতার প্রতি সে নিজের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে একই সাথে তাঁর ভাইয়ের আগ্রা ছাড়িয়ে আরও দুইশ মাইল পূর্বে গিয়ে শেরশাহকে মোকাবেলা করার সামরিক কৌশলকে সে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সে এর পরিবর্তে প্রস্তাব দিয়েছে হয় দিল্লী নতুবা আগ্রাকে অবরোধের জন্য প্রস্তুত করতে আর তাঁদের উঁচু দেয়ালে ফাটল সৃষ্টির অভিপ্রায়ে বৃথা উদযোগ গ্রহণ করে শেরশাহকে নিজ শক্তি ক্ষয়ের একটা সুযোগ দেয়া। কামরান আরও সৈন্য প্রেরণের বিষয়টা প্রত্যাখ্যান করতে অজুহাত হিসাবে নিজের উদ্বেগকে ব্যবহার করে সেই সাথে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে হুমায়ুনের ক্রুটিযুক্ত কৌশল যদি ব্যর্থ হয়, কামরান মনে করে যে পরিকল্পনাটার ব্যর্থ হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তখন তাঁর নেতৃত্বে প্রতিরক্ষার দ্বিতীয় ব্যুহ কার্যকর করতে সে প্রতিশ্রুত বাহিনীকে না পাঠিয়ে আটকে রাখছে।

সুলতান, বাবা ইয়াসভালো আপনার সেনাবাহিনী পরিদর্শনের সময় আপনাকে সঙ্গ দেবার জন্য অপেক্ষা করছেন। জওহর হুমায়ুনের স্বপ্ন-কল্পনায় বিঘ্ন ঘটায়। সে হুমায়ুনের খয়েরী রঙের উঁচু ঘোড়াটার লাগাম ধরে রয়েছে।

উত্তম প্রস্তাব। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়ায় এবং ঘোড়ায় চড়ে সরু চূড়া বরাবর খানিকটা এগিয়ে যায় বাবা ইয়াসভালের সাথে মিলিত হতে। দুজনে সামনে এগোন শুরু করতে, হুমায়ুন জানতে চায়, আমাদের গুপ্তদূতদের সর্বশেষ বিবরণীর কি বক্তব্য? কোনো পরিবর্তন কি হয়েছে?

না, সুলতান। বিপরীত পার্শ্বের চূড়া থেকে প্রায় দুই মাইল ভিতরে শেরশাহ তার তাবু ফেলেছে এবং আজরাতে তাঁর শিবির থেকে প্রস্তুতির যে দৃশ্য আর শব্দ শোনা গেছে, তাতে মনে হয় আগামীকাল সকালে সে সত্যিই আক্রমণ শুরু করবে।

আমি এই সরু চূড়ার মাঝামাঝি মাটি দিয়ে যে রক্ষণাত্মক বাঁধ নির্মাণ করতে বলেছিলাম সেটা কি শেষ হয়েছে?

হ্যাঁ, সুলতান- আমরা যখন আমাদের প্রস্তুতি পরিদর্শন করবো তখন আপনি দেখতে পাবেন।

ভালো। বাঁধের আড়ালে সুরক্ষিত থেকে আমরা শেরশাহের হামলা অথধামুখে ছুটে গিয়ে আক্রমণ করে লোকবলক্ষয়কারী হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হবার বদলে, কামান আর তবকিদের গুলিবর্ষণ আর সেই সাথে আমাদের তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত তীরের সাহায্যে প্রতিহত করতে পারবো।

কিন্তু সুলতান কেবল পরাস্ত হওয়া এড়িয়ে যাবার চেয়ে আমরা যদি তাদের পরাভূত করতে চাই তাহলে তাদের কাছাকাছি আমাদের পৌঁছাতে হবে।

অবশ্যই। আমরা যখন শেরশাহের সংখ্যাধিক্যের সুবিধা নাকচ করতে পারবো এবং তাঁর লোকেরা যখন পরিশ্রান্ত হয়ে উঠবে আমরা তখন আকষ্মিক বেগে আক্রমণ করে তাদের ধবংস করবো। আমি সেই সাথে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কোনো অপর্যাপ্ত উপায় গ্রহণ করতে চাই না। আমাদের আক্রমণ শুরুর সময়টা কেবল আমি সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

তারা ততক্ষণে ঘোড়ায় চড়ে বাঁধের লাল মাটি বরাবর এগিয়ে চলেছে। তারা এখানে, গঙ্গা আর কনৌজের রাস্তায় আড়াআড়িভাবে, অস্থায়ী শিবির স্থাপনের পর তাঁর লোকেরা এই গরমের ভিতরে গাঁইতি আর শাবল দিয়ে চারদিনে দারুণ কাজ করেছে। মাটি আর পাথরের স্তূপটা সব জায়গায় ছয় ফিট উঁচু এবং বেশীর ভাগ স্থানে এর উচ্চতা দশ ফিট। সরু চূড়ার মধ্যবর্তী অংশের, যা মোটামুটিভাবে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত, পুরো এলাকাটা জুড়ে বাঁধটা বিস্তৃত।

বাবা ইয়াসভালো, এই পর্যবেক্ষণের সময়ে আমি কাকে পুরস্কৃত বা পদোন্নতি প্রদান করবো?

সুলতান, আমরা তিনজনকে বাছাই করেছি। ওয়াজিম পাঠান নামে কাবুলের দক্ষিণ থেকে আগত এক আহত আফগানি শেরশাহের অগ্রাভিযানের সময়ে সংগঠিত এক খণ্ডযুদ্ধে সে দারুণ লড়াই করেছে। সে তাঁর আধিকারিকদের একজনকে নিজের ডান হাত আর তাঁর কনুইয়ের নীচের অংশ বিসর্জন দিয়ে রক্ষা করেছে। তাঁর জন্য আমরা এক ব্যাগ রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে এসেছি, সে নিজের গ্রামে ফিরে যাবার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার সময় ব্যাগটা সাথে করে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয়জন লাহোর থেকে আগত বয়ঃকনিষ্ঠ এক আধিকারিক, যে আমাদের যুদ্ধের উপকরণ বহনকারী সরবরাহ যানবাহনের একটা বহরে শেরশাহের লোকেরা অতর্কিতে আক্রমণ করলে সে দারুন সাহসিকতা প্রদর্শন পূর্বক তাঁদের যুদ্ধ করে তাড়িয়ে দেয়। আপনার পক্ষ থেকে তাঁকে পুরষ্কার হিসাবে দেবার জন্য আমাদের সাথে একটা রত্নখচিত তরবারি আছে। আমাদের মনোনীত তৃতীয়জনকে আপনি ভালোমতো চেনেন- গজনীর তরুণ হাসান বাট্ট। আপনার অনুরোধ অনুযায়ী, অশ্বারোহী বাহিনীতে তাঁকে উচ্চতর অবস্থান প্রদান করা হবে।

হুমায়ুনের পরিদর্শনের জন্য সৈন্যদের যে দলটাকে পছন্দ করা হয়েছিল তারা বাঁধ থেকে খানিকটা দূরে ষাড় আর হাতির দল যার কাছে তাঁর কামানগুলোকে নির্ধারিত স্থানে স্থাপনের জন্য পরিশ্রম করছে সেখানে শ্ৰেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান রয়েছে। হুমায়ুন অশ্বারোহী সৈন্যদের সারির এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে দেখে, যাদের কারো কারো ঘোড়া গরমে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠে, নিজেদের মাথা ঝাঁকাচ্ছে বা মাটিতে পা ঠুকছে, এবং তারপরে গোলন্দাজ, পদাতিক সৈন্য আর তীরন্দাজদের অপেক্ষাকৃত সোজা সারি অতিক্রম করে কেন্দ্রে যেখানে একটা মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে সেইদিকে এগিয়ে যায়। যাদের পুরস্কৃত বা পদোন্নতি দেয়া হবে তাদের সামনে এগিয়ে আসতে বলা হয়। ধুসর চুলের আহত ওয়াজিম খানের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে, যাকে হুমায়ুনের অনেক সৈন্যদের চেয়ে বয়স্ক দেখায়। রৌপ্যমুদ্রা ভর্তি লাল মখমলের ব্যাগটা সে যখন নিজের ভালো হাতটা দিয়ে গ্রহণ করে, সে থেমে থেমে কোনোমতে কেবল বলে, পাদিশাহ, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার গ্রামে আমি নিজের মাথা উঁচু করে রাখতে পারবো আর সেই সাথে আমার মেয়েদের বিয়েতে যৌতুকও দিতে পারবো।

তোমার অর্জিত সম্মানের পুরোটাই তোমার প্রাপ্য, হুমায়ুন বলে। লাহোর থেকে আগত আধিকারিকের হাতে কারুকাজ করা তরবারিটা হুমায়ুন যখন তুলে দেয় গর্বে তার সারা মুখ হেসে উঠে। বয়ঃকনিষ্ঠ হাসান বাউ, বরাবরের মতোই ধুসর নীল রঙের পাগড়ি পরিহিত রয়েছে, হুমায়ুন যখন পুরো সেনাবাহিনীর সামনে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা চৌকষ দলের অধিনায়ক হিসাবে তার নিয়োগ ঘোষণা করে তার মুখেও একই অভিব্যক্তি ফুটে উঠে।

পুরস্কৃত তিনজন নিজ নিজ কাতারে ফিরে যাবার পরে, হুমায়ুন তার সামনে সমবেত সৈন্যদের উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দেয়। আগামীকাল শেরশাহ আর তার বাহিনীর সাথে আমরা যুদ্ধ করার প্রত্যাশা রাখি। তার সেনাবাহিনী যদিও শক্তিশালী কিন্তু তার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার উদ্দেশ্য দুর্বল। তৈমূরের বংশধর আর বাবরের সন্তান হিসাবে হিন্দুস্তানের সিংহাসন সত্যিকার অর্থে আমার। শেরশাহ একজন অশ্ববিক্রেতার সন্তান এবং নামগোত্রহীন অজ্ঞাত জারজের বংশধর। এসো আমরা এমন একটা লড়াই করি যে আগামীকাল সন্ধ্যে নাগাদ বিশ্বাসঘাতকের কবরে তাঁর ঠাঁই হয় এবং তখনও তার যতটুকু প্রাপ্য তারচেয়ে বেশী ভূখণ্ড দখল করে রাখবে। আমাদের উদ্দেশ্যে ন্যায্যতা সম্পর্কে কখনও বিস্মৃত হয়ো না। মনে রাখবে যে আমি এই মাত্র যে লোকগুলো পুরস্কৃত করলাম তাঁদের মতো নির্ভীকভাবে তোমরা লড়াই করবে, তোমাদের কাছে আমি এটুকুই কেবল বলতে চাই। আমি তোমাদের হলফ করে বলছি, আমি নিজে তাঁদের চেয়েও নির্ভীকতা প্রদর্শনের প্রয়াস নেব।

২.৩ রক্ত আর ঘামের গন্ধ

০৮. রক্ত আর ঘামের গন্ধ

রাতের বেলা আক্রমণের দ্বারা তাঁকে পুনরায় চমকে দেবার ব্যাপারে, যেমনটা সে চৌসায় করেছিল, হুমায়ুন কোনো প্রকার ঝুঁকি নেয় না। সে তাদের জাগিয়ে রাখে এবং সূর্য উঠার তিনঘন্টা আগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখে। কিন্তু কোনো আক্রমণ হয় না এবং অনেক আগেই সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হয়েছে আর রাধুনি আগুন নিভিয়ে দিয়েছে। আজকের সকালটা বেশ পরিষ্কার এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে সরু চূড়া বরাবর আরো একবার হেঁটে আসবার সময় হুমায়ুন এমনকি নয়টার সময়েও টের পায় এরই মধ্যে বেশ গরম পড়েছে। তাঁর গুপ্তদূতেরা খবর দিয়েছে যে প্রায় এক ঘন্টা আগেই শেরশাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছে এবং শীঘ্রই বিপরীতপার্শ্বের চূড়ায় তাঁর পৌঁছে যাবার কথা।

তাঁরা ঠিকই অনুমান করেছিল। কয়েক মিনিট পরেই হুমায়ুন চূড়ায় প্রথম বেগুনী নিশান দেখতে পায়। তারপরে সে বর্ম পরিহিত একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, তারপরে আরেকজনকে, তারপরে শতশত। দীর্ঘদেহী এক অবয়বের, যার বর্মের সম্মুখভাগ আর শিয়োস্ত্রাণে সকালের সূর্য ঝিলিক তোলে, আদেশ অনুযায়ী শেরশাহের সবচেয়ে চৌকষ অশ্বারোহী বাহিনীর একটা অগ্রবর্তী দল হুমায়ুনের প্রত্যাশিত স্থানেই অবস্থান গ্রহণ করতে আরম্ভ করে। দুই চূড়ার মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেক বেশী হবার কারণে ঠিকমতো চেনা যায় না ওখানে কে রয়েছে কিন্তু হুমায়ুন ধারণা করে কিছুটা আশাও- যে ওটা স্বয়ং শেরশাহ। শেরশাহের সাথে ব্যক্তিগত দ্বৈরথে সে আরো একবার অবতীর্ণ হয়ে নিজেকে দুজনের ভিতরে সেরা যোদ্ধা হিসাবে প্রমাণ করতে এবং তার শত্রু রক্তাক্ত অবস্থায় ধূলোয় লুটিয়ে রয়েছে দেখতে চায়। কিন্তু সে এটাও ভালো করে জানে যে তার লোকদের মতো তাকেও অবশ্যই সহসা সর্বশক্তি নিয়ে এক বেপরোয়া আক্রমণের ঝুঁকি নেয়ার প্ররোচনা জয় করতে হবে।

প্রায় সোয়া ঘন্টা পরে, হুমায়ুন দীর্ঘদেহী সেই অবয়বকে নিজের তরবারি আন্দোলিত করে তার অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম সারির মাঝে চলৎশক্তি সঞ্চারিত করতে দেখে। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম সারিটা চূড়া থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে রণহুঙ্কার দিয়ে পুতগতিতে নেমে আসতে শুরু করতে হুমায়ুনের কাছে মনে হয় তারা সংখ্যায় প্রায় হাজার পাঁচেক হবে, তাদের বেগুনী নিশানগুলো তাদের পেছনে বিরতিহীনভাবে আন্দোলিত হয়। তাঁদের ভঙ্গি দেখে মনে হয়, হুমায়ুন যেমন প্রত্যাশা করেছিল, তারা সরু চূড়ার মাঝামাঝি বরাবর তার তৈরী অস্থায়ী বাঁধের, যেটার উপরে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, উপরে হামলা করতে এগিয়ে আসছে।

বাবা ইয়াসভালো ইতিমধ্যে হুমায়ুনের গোলন্দাজদের গোলা বর্ষণ আরম্ভ করার আদেশ দিয়েছেন এবং আক্রমণ শুরু করা শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম দলটা গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নীচের উপত্যকায় ঘুরপাক খেতে থাকা কামানের সাদা ধোয়ার মাঝে হুমায়ুন দেখে গাদাবন্দুকের ছররা বা তীরের আঘাতে পেছনের যোদ্ধারা তাদের ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়েছে। মাটিতে ধরাশায়ী হওয়া লোকগুলোর ভিতরে একজন নিশান-বাহক ছিল, যে মাটিতে আছড়ে পরার সময় যার হাত থেকে নিশানের দণ্ডটা ছুটে যায়। তাঁর বেগুনী নিশানটা উড়ে গিয়ে আরেক আগুয়ান অশ্বারোহীর সামনে পড়ে তার ঘোড়ার পায়ের সাথে পেচিয়ে যায় এবং ঘোড়াটা তার আরোহীসহ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পরে হুমায়ুন চোখেমুখে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে তার অবস্থানের দিকে আক্রমণ অভিপ্রায়ে সর্বোচ্চ বেগে ধাতি হবার বদলে অশ্বারোহী যোদ্ধারা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একদল তর মাটির বাধের দূরবর্তী প্রান্তের দিকে ছুটতে শুরু করেছে এবং আরেকদল বিপরীত প্রান্তের দিকে। তাঁরা বৃত্তাবদ্ধ করার এক তৎপরতায় প্রবৃত্ত হয়েছে, হুমায়ুনের মূল প্রতিরক্ষা ব্যুহের সামনে দিয়ে হঠাৎ গতি পরিবর্তন করে একপাশে সরে যাবার সময় তাঁর তবকি আর তীরন্দাজদের কারণে জানমালের অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়ক্ষতি আপাতদৃষ্টিতে তারা মেনে নিয়েছে।

নিমেষ পরে, হুমায়ুন তাঁর চোখের কোণ দিয়ে শেরশাহের বিশাল আরেকটা অশ্বারোহী বাহিনীকে দুলকিচালে ঢালু শৈলশিরার নীচু অংশ দিয়ে উঠে এসে দুটো চূড়ার উত্তরপ্রান্তের সংযোগকারী অংশের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে এবং তার প্রতিরক্ষা ব্যুহের অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত প্রান্তে তারা স্পষ্টতই হামলা করতে চলেছে।

জওহর, একজন বার্তাবাহককে পাঠিয়ে বাবা ইয়াসভালোকে এখনই বল উত্তরদিক থেকে শৈলশিরায় হতে যাওয়া আক্রমণ প্রতিহত করতে, এখনই আমাদের অশ্বারোহীদের কয়েকটা দলকে সেখানে সরিয়ে নেয়। তাদের নেতৃত্ব দিতে আমি নিজে সেখানে যাচ্ছি। জওহর আদেশটা ঠিকমতো শুনেছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য অপেক্ষা না করেই, হুমায়ুন তার কব্জি পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার শক্ত দস্তানাযুক্ত হাত নেড়ে তাঁর দেহরক্ষীদের তাঁকে অনুসরণ করতে বলে এবং তার বাদামী ঘোড়ার পাজরে গুতো দিয়ে পর্বতশীর্ষের সংকীর্ণ ভূমিরেখা বরাবর জন্তুটাকে পুতগতিতে ধাবিত করে। কয়েক গজ যাবার পরেই শৈলশিরার দিকে মাটি ঢালু হয়ে নামতে শুরু করে এবং হুমায়ুন দূর থেকেই লক্ষ্য করে যে শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ভালো অংশ ইতিমধ্যে তাঁর অস্থায়ী বাঁধের উত্তরের প্রান্তসীমার পেছনে পৌঁছাতে সফল হয়েছে। তাঁর তবকি আর তীরন্দাজেরা পাথরের আড়াল থেকে তাদের দিকে গুলিবর্ষণ করছে। তারপরে সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তীরন্দাজদের একটা দল ঘুরে দাঁড়ায় এবং ধনুক ফেলে দিয়ে পেছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, নিজেদের শেরশাহের অশ্বারোহীদের সহজ নিশানায় পরিণত করে। নিজেদের পর্যানে উঠে দাঁড়িয়ে তারা তীরন্দাজদের পিঠ বরাবর তরবারি দিয়ে আঘাত করে, তাদের অধিকাংশকেই আক্ষরিক অর্থে কচুকাটা করে।

হুমায়ুন ভাবে, পদাতিক সৈন্যরা অভিজ্ঞতা থেকে কেবল যদি শিক্ষা নিত যে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের কবল থেকে দৌড়ে পালানটা অসম্ভব। পাথরের আড়ালে অবস্থান করা এবং সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করাটা কেবল অনেকবেশী সম্মানজনকই না, সেই সাথে নিরাপদও। তার পেছন থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসতে, সে পর্যানে বসা অবস্থায় পেছনে তাকিয়ে তার অনুরোধে বাবা ইয়াসভালের কাছ থেকে আগত অশ্বারোহী যোদ্ধার দলটাকে দেখতে পায়। দলটা তাঁর নিজের সাথে একটা সমকেন্দ্রিক পথে রয়েছে এবং মিনিটখানেকের মধ্যে আর নিজেদের অগ্রসর হবার গতি লক্ষণীয়ভাবে না কমিয়ে, দলটা হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের সাথে এসে যোগ দেয় এবং একটা সঘবদ্ধ দলের মতো তারা সবাই সামনের দিকে পুতবেগে এগিয়ে যায়।

আক্রমণ কর! আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পার্শ্বদেশে নিজের পদাতিক বাহিনীকে নিয়ে এসে সে তার অবস্থান মজবুত করার আগেই শত্রুকে আমাদের অবশ্যই তাড়িয়ে দিতে হবে। আক্রমণকারীদের ছোট ছোট দলে পৃথক করতে চেষ্টা কর। তাঁদের তাহলে সহজে ঘিরে ফেলে হত্যা করা যাবে।

হুমায়ুনের অশ্বারোহী দলটা যখন ঢাল বেয়ে নীচের রণক্ষেত্রের দিকে দুলকি চালে এগোচ্ছে, শেরশাহের অশ্বারোহীদের ভেতর থেকে অশ্বারূঢ় একদল তীরন্দাজ বের হয়ে আসে। হুমায়ুনের অশ্বারোহীদের লক্ষ্য করে তারা এক পশলা তীর নিক্ষেপ করেই দ্রুত পিছু হটে তাঁদের সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতরে ফিরে যায়। সকালের বাতাসে মৃত্যুর শীষ তুলে তীরগুলো ছুটে আসে এবং হুমায়ুনের অশ্বারোহীদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে থাকা ঢাল তুলে নিজেদের রক্ষা করতে ঘোড়ার গতি হ্রাস করে। অনেকগুলো ঘোড়া তাদের আরোহীদের ছিটকে ফেলে দিয়ে ভূপাতিত হয় প্রকারান্তরে যা আরো অন্যদের পতনের কারণ হয়ে পুরো আক্রমণের প্রণোদনা ভঙ্গ করে বা ছন্দপতন ঘটায়। হুমায়ুন অবশ্য তার লোকদের এগিয়ে যাওয়া বজায় রাখতে অনুরোধ করে, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে, এসব বিরক্তিকর উৎপাত অগ্রাহ্য কর, তারা আবারও তীর ছোঁড়ার আগেই আমরা তাঁদের কাছে পৌঁছে যাব। সে তখন তাঁর বামদিক থেকে আরেকটা শব্দ ভেসে আসতে শুনে- শিলা আর প্রস্তরখণ্ডের একটা স্তূপের পেছন থেকে গাদাবন্দুকের গুলিবর্ষনের পটপট শব্দ। শেরশাহ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে কিছু তবকিদেরও যে পাঠিয়েছিলেন বোঝা যায়।

হাসসান বাট্ট, তরুণ সেনাপতি হুমায়ুন আগের দিনই যাকে পদোন্নতি দিয়েছে, আক্রমণের একেবারে পুরোভাগের যোদ্ধাদের ভিতরে সে তার সাদা ঘোড়া আর ধুসর নীল পাগড়ির কারণে সহজেই চোখে পড়ে। গাদাবন্দুক থেকে নিক্ষিপ্ত একটা ধাতব বল তার ঘোড়ার মাথায় এসে আঘাত করতে ঘোড়াটা ভিত নড়ে যাওয়া ইমারতের ন্যায় হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে এবং হাস্সান বাট্ট পর্যান থেকে বিকট শব্দে মাটিতে পতিত হয়, হাতগুলো কস্তনীরমতো দুলছে, এবং শক্ত পাথুরে মাটিতে বেশ কয়েকবার গড়িয়ে যায়। সে প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে এরপরেও টলমল করে উঠে দাঁড়ায়। আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসা তার অশ্বারোহী বাহিনীর মূল দলটার মাঝে হারিয়ে যাবার আগে হুমায়ুন শেষবারের মতো তাকে, উত্তোলিত তরবারি দুলিয়ে তাঁর সহযোদ্ধাদের এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিতে দেখে।

হুমায়ুন তাঁর সাহসিকতা নিয়ে খুব বেশী কিছু চিন্তা করার সুযোগ পায় না কারণ সে নিজে ততক্ষণে শেরশাহের অশ্বারোহীদের মাঝে পৌঁছে গেছে। কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক যোদ্ধার আন্দোলিত কস্তনীর ছোবল এড়াতে একপাশে সরে গিয়ে, সে লালচে হলুদ ঘোড়ায় আরূঢ় এবং ইস্পাতের বর্ম পরিহিত এক লম্বা লোকের দিকে এগিয়ে যায় নিশ্চিতভাবেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক। লোকটাকে ঘিরে থাকা দুজন অশ্বারোহী সাথে সাথে নিজেদের বাহনের মুখ হুমায়ুনের দিকে ঘোরায়, সে তখন তাদের তরবারির আঘাত এড়াতে নীচু হয়ে রয়েছে এবং সেই অবস্থায় দুজনের একজনের মুখে বসন্তের দাগ ভর্তি শ্মশ্রুমণ্ডিত, খর্বকায় দেখতে- কাঁধে চোখের পলকে তরবারির কোপ বসিয়ে দিলে সে বাধ্য হয় হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিতে।

হুমায়ুন দ্রুত আধিকারিকের পাশে যাবার জন্য নিজের ঘোড়াকে তাড়া দেয়। লোকটা হুমায়ুনকে আঘাত করার নিমিত্তে তার হাতের লম্বা বাঁকান তরবারি তাক করে কিন্তু খুব কাছাকাছি অবস্থান করার ফলে হুমায়ুনের বর্ম ভেদ করার মতো। পর্যাপ্ত শক্তিতে সে তার তরবারি ঘোরাতে পারে না। আঘাতে প্রচণ্ডতা সত্ত্বেও হুমায়ুনকে একপাশে কাত করে ফেলে আর তার ঘোড়াও তাঁকে নিয়ে দূরে সরে আসে। দ্রুত টাল সামলে নিয়ে হুমায়ুন তাঁর বাহনের মুখ ঘোরাবার জন্য লাগাম টেনে ধরে এবং আক্রমণ করতে আধিকারিকের মুখোমুখি হয়। হুমায়ুনের তরবারির প্রথম আঘাত লোকটা তার সাথের ধাতব ঢাল তুলে ঠেকায় কিন্তু ভারী ঢালটা নামিয়ে হুমায়ুনের দ্বিতীয় আঘাত প্রতিহত করতে বড্ড দেরী করে ফেলে, আঘাতটা পাশ থেকে তাকে স্পর্শ করে, বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্মটার কারণে সেই জায়গাটা অরক্ষিত ছিল। লোকটার গায়ে শেকলের তৈরী সূক্ষ বর্ম না থাকায় তরবারিটা মাংসপেশী এবং পাঁজরের উপস্থির গভীরে প্রবেশ করে। আধিকারিক লোকটা সহজাত প্রবৃত্তির কারণে হাত থেকে ঢাল ফেলে দেয় এবং নিজের দেহের ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে। হুমায়ুন পুররায় তরবারি চালায় এইদফা লোকটার গলা লক্ষ্য করে আড়াআড়িভাবে, আরেকটু হলেই লোকটাকে সে কবন্ধ করে ফেলেছিল এবং আধিকারিক লোকটা তার ঘোড়ার পর্যান থেকে পিছলে পড়ে যায়।

প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে, আধিকারিকের আরেকজন দেহরক্ষী এরপরে দুই মাথাযুক্ত রণকুঠার নিয়ে হুমায়ুনকে আক্রমণ করে। তার সাথে শীঘ্রই আরেকজন এসে যোগ দেয় এবং তারপরে আরেকজন তৃতীয়জন, দুজনের কাছেই লম্বা তরবারি, যার ফলার দুদিকই ধারাল। আক্রমণকারীদের হুমায়ুন কাছে আসতে দেয় না, তাঁর বাদামী রঙের ক্ষিপ্রগামী ঘোড়াটা চক্রাকারে ঘোরাতে থাকে এবং তাদের আঘাত ঠেকাতে থাকে, যদিও কারও একটা ধারাল তরবারি তার গালে হাল্কা আচড় দিয়েছে, যতক্ষণ না তার নিজস্ব দেহরক্ষীদের কয়েকজন দ্রুত তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তার দুই আক্রমণকারীকে অচিরেই পাথুরে মাটিতে, বুকে মাথায় হুমায়ুনের তরবারির মৃত্যু স্মারক নিয়ে টানটান হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তৃতীয়জন হাত থেকে তরবারি ফেলে দিয়ে এবং পালাতে থাকে, হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের একজন তার উরুতে বর্শা দিয়ে বেমক্কা আঘাত করায় রক্ত সেখানের ক্ষতস্থান থেকে তার পর্যাণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এবং তাঁর হাল্কা রঙের ঘোড়াকে রক্তরঞ্জিত করে তুলেছে।

আমরা শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর একটা বিশাল অংশকে তাড়িয়ে দিয়েছি। তার তবকি আর তীরন্দাজেরাও পিছু হটেছে, রুদ্ধশ্বাসে একজন আধিকারিক তাঁকে জানায়।

দারুণ। আমাদের তবকি আর তীরন্দাজদের শেরশাহের লোকেরা পাথরের। আড়ালে যেখানে অবস্থান করছিল সেখানে মোতায়েন কর। ওখানে যেসব মালবাহী শকট রয়েছে তাঁদের কয়েকটাকে উল্টে দিয়ে অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর এবং শেরশাহ যদি আবারও আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পার্শ্বদেশে আক্রমণ করতে চেষ্টা করে তাঁদের হুশিয়ার করতে কয়েকটা কামানকে গোলাবর্ষণের জন্য প্রস্তুত রাখা।

তার লোকেরা কাজে লেগে পড়ে, কাঠের অতিকায় মালবাহী শকটগুলোকে ধাক্কা দিয়ে এবং টেনে নিয়ে এসে সেগুলোকে উল্টে দেয় এবং কামান স্থানান্তরের জন্য ষাড়ের পাল নিয়ে আসলে, হুমায়ুন ঘোড়ায় চড়ে কয়েকশ গজ দূরে চূড়ার উপরে একটা নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যায়, যেখান থেকে পুরো রণক্ষেত্রটা ভালো করে অবলোকন করতে এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবার অবকাশ পাবে। সেখানে পৌঁছাতে, সে দেখে তাঁর সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে গৃহীত হয়ে গিয়েছে। শেরশাহের অশ্বারোহী যোদ্ধারা প্রায় পৌনে এক মাইল দূরে তাঁর তৈরী মাটির অস্থায়ী বাঁধের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং তাঁদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তার লোকেরা পিছু হটছে।

কি ব্যাপার? হুমায়ুন খয়েরী আর সাদার মিশেল দেয়া একটা ঘোড়ায় উপবিষ্ট শ্যাম বর্ণের খর্বকায় এক আধিকারিকের কাছে জানতে চায়, যে প্রায় পঞ্চাশজন পোড় খাওয়া চেহারার বাদশানি তীরন্দাজের একটা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সুলতান, আমি নিশ্চিত বলতে পারছি না, কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে শেরশাহের প্রথম আক্রমণ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ উভয় প্রান্ত দিয়ে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলার মাধ্যমে আমাদের অপ্রস্তুত করার পরে, সে অশ্বারোহী যোদ্ধার দ্বিতীয় একটা দলকে চূড়া থেকে আস্কন্দিত বেগে ধেয়ে এসে আমাদের প্রতিরক্ষা বাঁধের ঠিক মাঝ বরাবর নিচ্ছিদ্র বিন্যাসে আক্রমণের আদেশ দেয়, প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রান্তদেশের সুরক্ষায় আমরা সেখান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছি বলে- এমনটা যে ঘটবে, আমি নিশ্চিত, সে আগেই জানতো। এই স্থানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাদের আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে তারা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত আমাদের অবশিষ্ট সৈন্যদের প্রতিরোধ একেবারে গুঁড়িয়ে দেয় এবং আমাদের সেনাছাউনির একেবারে কেন্দ্রস্থলে এসে হাজির হয়। বাবা ইয়াসভালো শিলাস্তরের পাদদেশে ওখানে একটা প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুলে আমাদের সবাইকে আদেশ করেছেন, সেই অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

আধিকারিকের বাহুর নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে, হুমায়ুন বিশৃঙ্খল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের একটা বিশাল ভীড় দেখতে পায় এবং কোননামতে বাবা ইয়াসভালের হলুদ নিশান খুঁজে পায়। তুমি আর তোমার লোকদের সাহসিকতার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা নিশ্চয়ই শেরশাহকে তাড়িয়ে দেব। আমি আমার অশ্বারূঢ় দেহরক্ষীদের ডেকে পাঠিয়েছি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের পুরোভাগে অবস্থান করবো।

সুলতান।

হুমায়ুন ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং তাঁর দেহরক্ষীদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে, শিলাস্তর অভিমুখে পুতবেগে চূড়ার ঢাল বরাবর ফিরতি পথে এগিয়ে যায় যেখানে মূল লড়াই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সে ঘোড়া দাবড়ে এগিয়ে যেতে যেতে, শেরশাহের আরো বেশী বেশী সংখ্যক যোদ্ধাদের তার তৈরী অস্থায়ী মাটির বাঁধের প্রতিরক্ষাহীন ফাটল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, শিলাস্তরের চারপাশে চলমান যুদ্ধে যোগ দিতে দেখে। সে শিলাস্তরের কাছাকাছি পৌঁছে তারপক্ষের পদাতিক সৈন্যের একটা ছোট দলের মুখোমুখি হয়, যারা নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে আসছে যা এখনও সরাসরি আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে সে চিৎকার করে তাদের ফিরে আসতে বলে যে, এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু পলকহীন আর আতঙ্কিত চোখে, তাঁরা কনৌজের এবং নিকটবর্তী গঙ্গায় সেখানের পারাপারের স্থানের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে থাকে।

এক কি দুই মিনিট পরেই, শিলাস্তরের চারপাশে মানুষ আর ঘোড়ার একটা জীবন্ত জটলার প্রান্তদেশে হুমায়ুন নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে আরোহীবিহীন একটা ঘোড়াকে পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখে জন্তুটার পেটে একটা বিশাল কাটা স্থান থেকে অবলা প্রাণীটার পরিপাকতন্ত্রের একটা কিংদয়শ বের হয়ে আছে। মাটিতে অনেকগুলো দেহ হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে, মৃত্যুর কারণে আক্রমণকারী আর প্রতিরোধকারীদের এখন আর পৃথক করা যায় না। বাবা ইয়াসভালের সৈন্যরা মনে হয় যেন ধীরে ধীরে জমির অধিকার ত্যাগ করছে এবং তাঁদের শিলাস্তরের পার্শ্বদেশে দুরারোহভাবে খাড়া জমিতে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয় কিন্তু হুমায়ুন এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে মাঝে বাবা ইয়াসভালের হলুদ নিশান উডডীন অবস্থায় দেখতে পায়। তাঁর দেহরক্ষী দলের পক্ষে যতটা সম্ভব অনুসরণের দায়িত্ব দিয়ে, সে কালবিলম্ব না করে সেদিকে আক্রমণ করতে ছুটে যায়।

হুমায়ুনের বাদামী ঘোড়াটা মাথায় মুখব্যাদান করা এক রক্তাক্ত ফাটল নিয়ে পড়ে থাকা অশ্বারোহীর ক্ষতবিক্ষত দেহে হোঁচট খায় কিন্তু হুমায়ুন নিজে একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার হবার কারণে আর তাঁর ঘোড়াটাও ক্ষিপ্রগামী বলে তারা দ্রুত ভারসাম্য ফিরে পায় এবং হুমায়ুনকে নিয়ে জন্তুটা আক্রমণের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনকে শত্রুর আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। সে পর্যানে বসেই শেরশাহের এক অশ্বারোহীকে তার তরবারি আলমগীর দিয়ে একবার আঘাত করে, তার দ্বিতীয় আঘাতে ঘোড়াটার গলায় একটা ক্ষতচিহ্নের জন্ম দেয়, জন্তুটা দ্বিখণ্ডিত শ্বাসনালী নিয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগে তার আরোহীকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়, জন্তুটা পেছন থেকে হুমায়ুনকে আক্রমণের পায়তারা করতে থাকা আরেক অশ্বারোহীকেও ধরাশায়ী করে। বাবা ইয়াসভালের কাছ থেকে হুমায়ুন এখন কেবল বিশ গজের মতো দূরে রয়েছে। রণক্ষেত্রের জটলার মাঝে একটা ফাঁক দেখতে পেয়ে, হুমায়ুন পরস্পরের সাথে ভীষণভাবে যুদ্ধমান অশ্বারোহীদের ভিতর দিয়ে তাকে লক্ষ্য করার আগেই তার সেনাপতির দিকে এগিয়ে যায়।

সে এগিয়ে যাবার ফাঁকে লক্ষ্য করে যে বস্তুত পক্ষে বাবা ইয়াসভালের চারপাশে কেবল ডজনখানেকের মতো তাঁর যোদ্ধারা রয়েছে। তাঁদের ভিতরে তিন কি চারজন আবার নিজেদের ঘোড়া খুইয়েছে এবং বাবা ইয়াসভালো আর তার সহযোদ্ধারা শেরশাহের অসংখ্য আক্রমণকারীকে আটকে রেখে তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করছে। তার চোখের সামনে অবশ্য ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁদের আক্রমণকারীদের একজন- লম্বা একটা বর্শা নিয়ে বেগুনী পাগড়ি পরিহিত বিশালদেহী এক যোদ্ধা, যার মুখ ভর্তি কালো চাপ দাড়ি- মাটিতে বাহনহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর একজনকে দলছুট হতে দেখে নিজের ঘোড়ার পাজরে গুতো দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। মাটিতে দাঁড়ান লোকটা তার ঢাল নিজের সামনে এনে বর্শার সূচাল অগ্রভাগ প্রতিহত করলেও আঘাতের প্রচণ্ডতায় সে মাটিতে ছিটকে যায়। লোকটা তার আক্রমণকারীর ঘোড়ার খুরের নীচে থেকে মরীয়া হয়ে গড়িয়ে সরে গিয়ে নিজের সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে কিন্তু সে যখন এসবে ব্যস্ত তখন বেগুনী পাগড়ি পরিহিত অশ্বারোহী পুনরায় নিজের বর্শা তুলে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নিশানা স্থির করে, লোকটার পেট বর্শা দিয়ে এফেঁড়ওফোঁড় করে দেয় বাবা ইয়াসভালের অন্যান্য যোদ্ধারা তাকে বাধা দেয়ার সময়ই পায় না। বেগুনী পাগড়ি পরিহিত মৃত্যুদূত রক্ত রঞ্জিত বর্শার অগ্রভাগ আহত লোকটার দেহ থেকে দ্রুত মোচড় দিয়ে বের করে নিশ্চিতভাবেই সে একজন আধিকারিক পিছিয়ে গিয়ে নিজের লোকদের ভীড়ের ভিতরে হারিয়ে যায়। হুমায়ুন যখন বাবা ইয়াসভালের কাছে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে তখনই এক মিনিটেরও কম সময়ে মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে যায়।

সুলতান, আপনার দেহরক্ষীরা সব কোথায়? বাবা ইয়াসভালো হাত নেড়ে তার নিজের লোকদের পুনরায় নিচ্ছিদ্র ব্যুহে বিন্যস্ত করার অবসরে জিজ্ঞেস করেন। হুমায়ুন সহসা বুঝতে পারে যে তাঁদের একজনও শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করে তাকে অনুসরণ করতে সফল হয়নি এবং যে পথ দিয়ে সে এখানে এসেছে সেই করিডোরটা এখন শেরশাহের যোদ্ধারা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। তাঁরা তাঁকে এবং বাবা ইয়াসভালো আর তার সঙ্গীদের প্রায় ঘিরে ফেলেছে এবং পশ্চাদপসারণ বা সাহায্য আসবার যেকোনো সম্ভাবনা থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

বাবা ইয়াসভালো, যতক্ষণ আমাদের আরও যোদ্ধারা এসে পৌঁছে বা এখান থেকে পালাবার কোনো রাস্তা আমরা খুঁজে পাই ততক্ষণ নিজেদের আর পরস্পরকে রক্ষা করার জন্য আমাদের উচিত হবে ঘনবদ্ধ হয়ে অবস্থান করা। আমরা যদি শৈলশিরার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অবস্থান করি তাহলে অন্তত আমাদের পিঠ সুরক্ষিত থাকবে।

হুমায়ুন আর বাবা ইয়াসভালো একত্রে তাঁদের অন্য সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে, কিন্তু তারা যখন তাঁদের আদেশ পালন করার প্রয়াস নেয়, সেই মুহূর্তে শেরশাহের তিনজন অশ্বারোহী এক ঘোড়সওয়ারকে ঘিরে ফেলে এবং তাঁদের একজন লোকটাকে তার বাহন থেকে কস্তনীর এক বেকায়দা আঘাতে মাটিতে ফেলে দেয়। মাটিতে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকা লোকটার এক সঙ্গী তাঁকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গেলে, দুই মাথাবিশিষ্ট রণকুঠারের মোক্ষম আঘাতে সাথে সাথে মারা যায়, কুঠারটা তার কণ্ঠমণিতে আঘাত করে তাকে কবন্ধ করে দেয়। শেরশাহের অন্য আরেকজন যোদ্ধা মাটিতে পরে যাওয়া লোকটার ভবলীলা কস্তনীর এক ঘায়ে নিভিয়ে দেয়। সেই সময়েই বেগুনী পাগড়ি পরিহিত সেই আধিকারিক বাবা ইয়াসভালের ঘোড়া খোয়ান লোকদের একজনকে তার রক্ষাকারীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং বর্শা দিয়ে তার কুচকিতে আঘাত করে। আহত সৈন্যটার পা আর গোড়ালি জবাই করা পশুর মতো কয়েক মিনিট মাটিতে আছড়াতে থাকে এবং তারপরে সে নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে।

বাবা ইয়াসভালো আর হুমায়ুনের সাথের মাত্র নয়জন তোক এখন বেঁচে আছে এবং তাঁদের মধ্যে দুইজনের আবার কোনো ঘোড়া নেই এবং আরেকজন মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। হুমায়ুন আর তাঁর সৈন্যরা যখন শৈলশিরার পার্শ্বদেশ থেকে মাত্র কয়েকগজ দূরে অবস্থান করছে, বেগুনী পাগড়ি পরিহিত আধিকারিক তখন শেরশাহের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করার জন্য ইশারা করে। শৈলশিরার এই স্থানটা প্রায় বিশ ফিট উঁচু এবং প্রায় খাড়াভাবে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে, স্পষ্টতই ঘোড়া নিয়ে সেখানে আরোহন করাটা অসম্ভব এবং খালি হাতে দেয়াল বেয়ে উঠার মতো কোনো রাস্তা চোখে পড়ে না।

বাবা ইয়াসভালের সঙ্গের নয়জন লোকের মধ্যে সদ্য কৈশোর অতিক্রম করা একজন তূর্যবাদক রয়েছে, যার মসৃণ গালে এখনও নাপিতের ক্ষুর পড়েনি। তাঁর বাদ্যযন্ত্র এখনও তার পিঠের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। বাবা ইয়াসভালো তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে তোমার সঙ্গে থাকা তূর্য এবার বাজাও যাতে আমরা বাইরে থেকে সাহায্য পেতে পারি। সে যখন তূর্যধ্বনি করবে তোমরা বাকিরা তখন তাঁকে আগলে রাখবে। তূর্যবাদক ছেলেটা তাঁর পিঠ থেকে তিন ফিট লম্বা তূর্যটা খুলে হাতে নেয় এবং সেটা তার ঠোঁটের কাছে ধরে। প্রথমে অবশ্য কোনো শব্দ হয় না সদ্য যুবা ছেলেটা তখন চোখে মুখে উদ্বেগ আর আতঙ্ক নিয়ে বাবা ইয়াসভালের দিকে তাকায়।

বাছা, শান্ত হও, বাবা ইয়াসভালো অভয় দেয়ার সুরে বলে। যুদ্ধের উত্তেজনা আর ভয়ে তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে। কেশে গলাটা একটু খাকরে নিয়ে জীহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা একটু ভিজিয়ে নাও।

যুবক ছেলেটা অনুগত ভঙ্গিতে কাশে এবং পুনরায় চেষ্টা করার আগে জীহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। এইবার ভূর্যের পিতলের তৈরী মুখ থেকে উচ্চনাদে শব্দ ধ্বনিত হয়- হুমায়ুনের যোদ্ধাদের পুনরায় একত্রিত হবার আহ্বান।

আবার বাজাও বাছা, এবং তারপরে আবার।

তরুণ তূর্যবাদককে রক্ষা করতে গিয়ে হুমায়ুনের তিনজন অশ্বারোহী বীরের মতো মৃত্যুবরণ করার পরে, বেগুনী পাগড়ি পরিহিত মূর্তিমান ব্রাস হয়ে উঠা সেই আধিকারিক সবাইকে পাস কাটিয়ে সহসা নিজের কালো ঘোড়াটা নিয়ে তূর্যবাদকের দিকে এগিয়ে আসে এবং তার হাতের লম্বা বর্শাটা দিয়ে ছেলেটার ডান বাহুমূলে, ঠোঁটের কাছে পিতলের তৈরী ভারী তূর্যটা ধরে থাকার কারণে অরক্ষিত, আঘাত করে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দেয়। সে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় তার হন্তারকের বর্শার আরেকটা আঘাতে মারা যায়।

হুমায়ুন, শেরশাহের আরেকজন অশ্বারোহী যোদ্ধাকে অবশিষ্ট দুজন লোকের একজনের দিকে, যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এগিয়ে যেতে দেখে তার নিজের ঘোড়া নিয়ে হন্তারকের আক্রমণ প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়, শত্রুর নিশানা লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া আটকে দেয়। শত্রুপক্ষের লোকটা তার ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে টেনে ধরে হুমায়ুনকে পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য নিজের বাহনকে পরিচালিত করতে চেষ্টা করতে, হুমায়ুন তাঁর কব্জিতে এক কোপ দিয়ে একটা হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে লোকটা ঘোড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং বিশৃঙ্খলার ভিতরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে দিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে নিজের ঘোড়ার উপরে টেনে তুলে নিজের পিছনে বসিয়ে দেয়। কিন্তু সে যখন লোকটাকে টেনে তুলতে ব্যস্ত তখন অজ্ঞাতনামা হন্তারকের নিক্ষিপ্ত বর্শা হতভাগ্য সেই সৈনিকের বুক ভেদ করে যায় এবং আরেকটা বর্শা এসে হুমায়ুনের ঘোড়ার গলায় বিদ্ধ হয়। বিশাল ঘোড়াটা একবার টলমল করে উঠে তারপরে হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে, ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।

হুমায়ুন তার পর্যান থেক পিছলে নেমে আসে এবং বেগুনী পাগড়ি তাকে আক্রমণ করার জন্য পাগলের মতো ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয়া শুরু করলে সে শৈলশিলার খাড়া দেয়ালের দিকে দৌড়াতে শুরু করে এবং অশ্বারোহীর মারাত্মক নিশানা ব্যর্থ করতে ডানে-বামে আকস্মিক বাকা-চোরা পথে দৌড়াতে থাকে। শৈলশিরার পাথুরে দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছাবার পরে, হুমায়ুন বুঝতে পারে আসলেই দেয়ালটা বেয়ে উপরে উঠা সম্ভব না, বিশেষ করে পেছনে খুব কাছে থেকে যদি লম্বা একটা বর্শা নিয়ে কোনো হন্তারক ধাওয়া করতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে হুমায়ুন এবার আক্রমণকারীর মুখোমুখি হয়, তাঁর ডানহাতে আলমগীর আর বামহাতে কোমরের পরিকর থেকে বের করে আনা প্রায় ফুটখানেক লম্বা করাতের মতো খাজকাটা ফলাবিশিষ্ট একটা খঞ্জর। সে তার পায়ের গোড়ালীর উপরে ভর দিয়ে আবর্তিত হতে থাকে যাতে করে সে এই পথ দিয়ে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে দৌড়াতে পারে, এবং হুমায়ুন তাঁকে ধাওয়া করা আধিকারিক কখন আক্রমণ করবে সেজন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

আধিকারিক লোকটা কয়েক সেকেণ্ড পরেই আক্রমণ করে, তার হাতের বর্শার সূচালো অগ্রভাগ হুমায়ুনের দিকে তাক করা সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপরে লাফ দিয়ে একপাশে সরে এসে বর্শার ফলাটা এড়িয়ে যায়। আক্রমণ ব্যর্থ হতে লোকটা একপাশে সরে গিয়ে তারপর পুনরায় আক্রমণ করার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। আক্রমণকারী যখন প্রস্তুত হচ্ছে, বাবা ইয়াসভালো- এখন তারও ঘোড়া নেই এবং মুখে তরবারির আঘাতে সৃষ্ট একটা গভীর ক্ষত থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে- দৌড়ে হুমায়ুনের সামনে আসে এবং আধিকারিক আক্রমণ করতে ছুটে আসতে তার ঘোড়াকে আঘাত করে। সে অতিকায় জন্তুটাকে ভূপাতিত করতে সফল হয় বটে কিন্তু তলপেটে অশ্বারোহীর বর্শার পুরো ফলাটা গ্রহণ করে তাঁকে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। হুমায়ুন বেগুনী পাগড়ি পরিহিত লোকটার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে দৌড়ে যায় সে, ঘোড়ার পিঠ থেকে আছড়ে পরার কারণে যদিও তাঁর বুকের সব বাতাস বের হয়ে গিয়েছে, অবশ্য দ্রুতই তরবারি বের করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় আলমগীর দিয়ে হুমায়ুনের প্রথম আঘাত মোকাবেলা করতে। সে তার দ্বিতীয় আঘাত কোনোমতে প্রতিহত করে কিন্তু লোকটা যখন সেটা ঠেকাতে যায় হুমায়ুন তাঁর বাম হাতের খঞ্জর দিয়ে লোকটার গলায় আঘাত করে এবং খঞ্জরের খাঁজকাটা ফলাটা গলায় ঢুকিয়ে দেবার সময়ে মোচড় দেয় যাতে প্রাণসংহারক ক্ষতি হয়। আধিকারিকের উষ্ণ রক্ত ছিটকে উঠে হুমায়ুনের হাত ভিজিয়ে দেয়।

সুলতান, আমরা তূর্যবাদন শুনেছি, শিলাস্তরের উল্লম্ব উপরিতল থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। হুমায়ুন উপরের দিকে তাকায়। তার লোকদের কয়েকজন তাঁদের মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্য, এবং তাদের পরণের কমলা রঙের পোষাকের রঙ আর ছাট দেখে বোঝা যায় তাঁরা তাঁর অনুগত রাজপুত রাজার সৈন্য- শিলাস্তরের উপরিভাগে পৌঁছাতে সফল হয়েছে এবং কিনারা দিয়ে এখন নীচের দিকে উঁকি দিচ্ছে। হুমায়ুন যখন পুনরায় তাঁর আক্রমণকারীর মুখোমুখি হবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। তার মনে হয় শিলাস্তরের নিম্নভাগে যারা আটকা পড়েছিল তাঁদের ভিতরে কেবল সে একাই বেঁচে আছে- রাজপুত বাহিনীর একজন সৈন্য কালো শরযষ্টিযুক্ত একটা বাণ ছুঁড়ে মারতে শেরশাহের একজন্য অশ্বারোহীর ঘোড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরবর্তী তীরটা আরেকজন যোদ্ধার পায়ে বিদ্ধ হয়। হুমায়ুনকে আক্রমণকারী লোকগুলো এবার নিজেদের গুটিয়ে নেয় যেন তারা তাদের পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে নিজেদের ভিতরে আলোচনা করবে। তারা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত সেই কয়েক সেকেণ্ডের ভিতরে রাজপূত তীরন্দাজ নিজের মাথার কমলা রঙের পাগড়ি খুলে ফেলে। সে কাপড়ের টুকরোটার একটা প্রান্ত কাপড়টা প্রায় দশফিট লম্বা হবে শিলাস্তরের কিনারা থেকে নীচের দিকে ছুঁড়ে দেয়, কাপড়টা হুমায়ুনের মাথার ফিট খানেক উপরে এসে শেষ হয়, যেখানে এটা বাতাসে মৃদুমন্দ দুলতে থাক।

সুলতান আমার পাগড়ির কাপড়টা শক্ত করে আকড়ে ধরেন। আমি আপনাকে নিরাপদ স্থানে টেনে তুলে আনব।

হুমায়ুন নিজের চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে এবং ইতস্তত করে। বাবা ইয়াসভালো এখনও খাড়া শিলাস্তরের যেখানে আহত হয়েছিলেন সেখানেই শুয়ে আছেন। খোঁচা খোঁচা ধুসর চুলযুক্ত তার শিরোস্ত্রাণবিহীন মাথা এই মুহূর্তে বুকের উপরে ঝুঁকে আছে এবং এখনও তার নাক আর ঠোঁটের কিনারা দিয়ে টপটপ করে রক্ত তার বুকের কাছে বর্মে চুঁইয়ে পড়ছে। তাঁর হাত দুটো দেহের দুপাশে পড়ে আছে কিন্তু তার দুই পা দুদিকে ছড়ান এবং তলপেট থেকে এখনও বর্শার ফলাটা বের হয়ে আসে। তিনি নিশ্চিতভাবেই মারা গেছেন এবং হুমায়ুন তার অন্য কোনো লোকদের ভিতরে প্রাণের স্পন্দন দেখতে পায় না।

হুমায়ুন বুঝতে পারে, তার আক্রমণকারীরা যেকোনো মুহূর্তে আবার কাছে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করবে তাকে শেষ করে দেবার জন্য। রাজবংশ এবং নিয়তি উভয়ের প্রতি তাঁর দায়িত্ব হল যেকোনো মূল্যে নিজেকে রক্ষা করা। হাতবদল করে সে আলমগীর বামহাতে ধরে এবং ডানহাত উপরে তুলে কমলা রঙের পাগড়ির কাপড়টা শক্ত করে আকড়ে ধরে। সে সাথে সাথে টের পায় যে কাপড়টা টানটান হয়ে উঠেছে এবং সে যখন পাহাড়ী শিলার খাড়া উপরিভাগ বেয়ে আরোহন থাকে তখন বাড়তি প্রণোদনা আনয়নের জন্য সে নিজেও উঠতে আরম্ভ করে। তাঁর আক্রমণকারীরা, এতোক্ষণে বুঝতে পারে যে সে এখনই পালিয়ে যাবে, তাঁর দিকে হুড়মুড় করে ছুটে আসে।

হুমায়ুন বেকায়দা ভঙ্গিতে তাঁদের একেবারে সামনের জনকে দেখে এবং পুনরায় উঠে বসার জন্য পায়তারা শুরু করে। তাকে বিস্মিত হতে দেখে সে চমকে উঠে।

আলমগীরের বা বামহাতে ধরে হুমায়ুন বেকায়দা ভঙ্গিকে তাদের একেবারে সামনে আঘাত করে কিন্তু আঘাতটা করার উদ্দেশ্যে সফল হয়। সে উপরে দিকে তাকিয়ে থাকার সময় সে আরেকটু হলেই তাঁদের সৈন্যরা দুদলে ভাগ হয়ে গিয়েছে এবং নিজের বাসায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে কিছু করার আগে সবকিছু ভালো করে ধুয়ে নেয়া উচিত। সহসা তার আক্রমণকারীরা বুঝতে পারে সে একটু পরেই পালিয়ে যাবে, তারা তাঁর দিকে মরিয়া হয়ে ছুটে আসে।

হুমায়ুন বামহাতে ধরা আলমগীর দিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে আন্দোলিত করতে থাকে এবং ধারাল ফলা দিয়ে মানুষটার কপালে হয়ত কিছু আঁকা যাবে এবং হুমায়ুন উপরের দিকে তাকালে সে নির্বিকার ভাবে ত্বকের প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটা অংশ দেখতে পায়, যেখান থেকে তার চোখে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। একই সাথে রাজপূত লোকটা নিজের রণকুঠার পরবর্তী আক্রমণকারীকে ছুঁড়ে মারলে হুমায়ুন টের পায় তার আশেপাশের বাতাস নড়ে উঠেছে এবং কুঠারটা লোকটার বাহুর উপরিভাড়ে গেঁথে যায় এবং সেও পিছনের দিকে উল্টে পড়ে যায়। তৃতীয় আক্রমণকারী মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে এবং ইতস্তত করার কারণে হুমায়ুন সুযোগ পেয়ে দ্রুত দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকে এবং কিনারা থেকে নিজেকে টেনে উপরে তুলে এবং শিলাস্তরে উপরে উঠে আসে। সে উত্তেজনার কারণে খেয়ালই করে না তার ডানহাতের উপরিভাগ আর কব্জির ক্ষতস্থানের মুখ খুলে গেছে যখন সে নিজেকে টেনে টেনে উপরে তুলে এনেছে এবং এখন তুমূল বৃষ্টি হচ্ছে।

সুলতান। রাজপুত যে লোকটা পাগড়ির কাপড় নীচে ছুঁড়ে দিয়েছিল সে হুমায়ুনকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করার ফাঁকে সনির্বন্ধ কণ্ঠে কথা বলতে থাকে। আমরা আপনার জন্য একটা নতুন ঘোড়া নিয়ে এসেছি। আপনার সৈন্যরা সবজায়গা থেকে পিছু হটছে। আপনি যদি এখনই এখান থেকে চলে না যান তাহলে শক্রর হাতে ধরা পড়বেন বা মারা যাবেন।

চারপাশে তাকিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে যে তার সামনে আসলেই দুটো পথ খোলা আছে- আরেকদিন লড়াই করার জন্য এখন পশ্চাদপসারণ করা বা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা। তার যোদ্ধার মানসিকতার কাছে শেষের পথটা যতই আবেদনপূর্ণ মনে হয়, সে অনুভব করে যে আকাঙ্খ আর বেঁচে থাকার অভিলাষ এখনও তার ভিতরে তীব্রভাবে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে এবং নিয়তি তাঁর সৌভাগ্যবান সন্তানের জন্য ভবিষ্যতের গর্ভে ভালো কিছু জমিয়ে রেখেছেন সাহসী কিন্তু নিষ্ফল মৃত্যুর বদলে। তাঁকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।

আমরা তাহলে ঘোড়া নিয়ে বের হই এবং আমাদের পক্ষে আমাদের সৈন্যবাহিনীর যতবেশী জনকে সম্ভব পুনরায় নতুন করে দলভুক্ত করি।

২.৪ ভাইয়ে ভাইয়ে রেষারেষি

০৯. ভাইয়ে ভাইয়ে রেষারেষি

উষ্ণ, নিথর হয়ে থাকা বাতাস, ইতিমধ্যে আর্দ্রতায় ভারী হয়ে উঠেছে যা সপ্তাহখানেকের ভিতরেই আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়বে, অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তার পরনের ইস্পাতের শিকল দিয়ে তৈরী বর্ম আর মিহি সুতির কাপড় দিয়ে তৈরী জোব্বার নীচে, হুমায়ুনের পিঠ বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। তাঁর মুখাবয়বেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অসহিষ্ণুভাবে সে একটা রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে গিয়ে টের পায়ে নোনতা বিন্দুগুলো প্রায় সাথে সাথে আবার পূর্বের আকৃতি লাভ করেছে। সে পুতবেগে যখন, সামনে দেহরক্ষী আর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের একটা দল তাঁর অনুগত কমলা রঙের আলখাল্লা পরিহিত রাজপুতরা সেখানে রয়েছে তাঁর পেছনে পেছনে আসছে, আগ্রা অভিমুখে ফিরে চলেছে তাঁর তাম্রবর্ণের ঘোড়াটার খুরের ছন্দোবদ্ধ বোলে, মনে হয় যেন তিক্ত একটা বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। পরাজয় আর ব্যর্থতা। পরাজয় আর ব্যর্থতা। শব্দ দুটো তার মাথার ভিতরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে কিন্তু তারপরেও যা ঘটে গিয়েছে সেই পুরো। বিষয়টা তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

সে সৈন্যদের যে দলকে পুনরায় সমবেত করার আশা করেছিল তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ তাদের নিজ নিজ প্রদেশে ফিরে গিয়েছে কিন্তু বেশীরভাগই শেরশাহের অগ্রগামী বাহিনীর সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েছে। তারা বিশ্বাস করে যে এক অন্ত্যজ ঘোড়ার কারবারীর ছেলে মোগলদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম… যে কোনো দৈহিক ক্ষতের চেয়েও এর বিশালতা অনেকবেশী যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু তারচেয়েও মারাত্মক এই ভাবনাটা যে যুদ্ধক্ষেত্রে সে অমিত সাহসের সাথে লড়াই করা সত্ত্বেও সে এমন একটা ব্যাপার মেনে নিয়েছে।

তার সৌভাগ্য এখন কোথায় গেল? পানিপথে, টসটসে পাকা একটা ডালিমের মতো হিন্দুস্তান মোগলদের হাতে এসে ধরা দিয়েছিল। বাহাদুর শাহ আর লোদি রাজ্যাভিযোগীকে হেলাফেলা করে মাত দেবার পরে তাঁর বুঝি ধারণা হয়েছিল মোগল সাম্রাজ্য অজেয়। সে সম্ভবত তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের প্রকৃতি এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি- বিদ্রোহ এই অঞ্চলের সহজাত বৈশিষ্ট্য। সে যত অভ্যুত্থানই দমন করুক, যত বিদ্রোহীকেই কবন্ধ করুক, তারপরেও আবারও বিদ্রোহের সম্ভাবনা ঠিকই রয়ে যাবে। শেরশাহের সাফল্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, শক্ররা এখন দক্ষিণ আর পশ্চিমদিক থেকে আর সেই সাথে পূর্বদিক থেকেও হুমকি দিতে আরম্ভ করেছে।

হুমায়ুন নিজের হতাশায় বিমূঢ় হয়ে তার দস্তানা পরিহিত হাত দিয়ে এতোই জোরে তার ঘোড়ার পর্যানের সামনের দিকে উঁচু হয়ে থাকা বাঁকানো অংশে আঘাত করে যে, ঘোড়াটা ভড়কে গিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আর চিহি শব্দ করে বেমক্কা একদিকে দৌড়াতে শুরু করে যে আরেকটু হলে সে নিজেই ঘোড়া থেকে পড়ে যেত। হাঁটু দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে সে জন্তুটাকে বশে আনে, তারপরে লাগামে ঢিল দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে এবং জন্তুটার ঘামে ভেজা গলায় আলতো চাপড় দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করে। সে মনে মনে ভাবে, যাই হোক, ভাগ্য সহায় থাকলে রাতের আগেই সে আর তার সাথের অগ্রবর্তী দলটা আগ্রা পৌঁছে যাবে। তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যসামন্তের যদিও কামানবাহী শকট, মালবাহী গাড়ি, আর হাজারের উপরে ভারবাহী পশুর দল- আরো এক সপ্তাহ বা হয়তো আরো বেশী দিন লাগবে শহরে পৌঁছাতে, পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করার জন্য তাঁর হাতে খুব একটা বেশী সময় নেই। তার গুপ্তদূতদের ভাষ্য অনুযায়ী, শেরশাহ তাঁর অগ্রযাত্রা স্থগিত রেখেছেন, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও, কনৌজেই তিনি অবস্থান করছেন। তিনিও সম্ভবত রসদপত্রের মজুদ মিলিয়ে দেখছেন…

বস্ততপক্ষে মধ্যরাতের অনেক পরে, যমুনার পাড় বরাবর আগ্রার অন্ধকারাচ্ছন্ন সড়কের উপর দিয়ে হুমায়ুনের পরিশ্রান্ত ঘোড়াটা তাঁকে নিয়ে আগ্রা দূর্গের দিকে উঠে আসে। দূর্গের মূল তোরণদ্বারের উপরে রক্ষিত নাকাড়াগুলো রাতের আবহে গমগম করে উঠতে, দূর্গপ্রাকারের উপরে মশালদানিতে রাখা জ্বলন্ত মশালের দপদপ করতে থাকা কমলা আলোর মাঝে অশ্বারূঢ় হয়ে সে খাড়াভাবে দূর্গ অভিমুখে উঠে যাওয়া পথটা দিয়ে সোজা ভিতরের প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হয়। হুমায়ুন পরিশ্রান্ত অবস্থায় ঘোড়ার পর্যান থেকে নীচে নেমে আসতে একজন সহিস দৌড়ে এসে তার হাত থেকে ঘোড়ার লাগামটা নিয়ে নেয়।

সুলতান। কালো আলখাল্লায় মোড়া একটা অবয়ব সামনের দিকে এগিয়ে আসে। অবয়বটা আরো কাছে আসতে, সে তার নানাজান বাইসানগারকে চিনতে পারে। স্বাভাবিকভাবে বেশ সবল, এমনকি বলিষ্ঠ, তাঁর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা যায়, তাঁর বাহাত্তর বছর বয়সে এই প্রথম সবাই তার এই চেহারা দেখছে এবং তাঁর দিকে এক পলক তাকিয়েই হুমায়ুন সাথে সতর্ক হয়ে উঠে যে অপরিজ্ঞেয় আর অনাকাঙ্খিত কিছু একটা ঘটে গেছে।

কি ব্যাপার? কি হয়েছে?

আপনার আম্মিজান অসুস্থ। গত ছয় সপ্তাহ ধরে তিনি তাঁর বুকে একটা ব্যাথা অনুভব করছিলেন, এতোটাই তীব্র তাঁর মাত্রা যে কেবলমাত্র আফিম দিয়েই তাঁর কষ্টের খানিকটা উপশম ঘটতো। হাকিমেরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তার ব্যাপারে তাঁদের কিছুই করার নেই। আমি আপনার কাছে বার্তাবাহক প্রেরণ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনিই আমাকে নিষেধ করেছেন সামরিক অভিযানের সময় আপনার মনোযোগ ভিন্নমুখী করা আমার উচিত হবে না…কিন্তু আমি এটাই জানতাম আপনাকে এক পলক দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে আছেন। এই একটা আকাঙ্খাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল…

আমি তাঁর সাথে দেখা করবো। বর্গাকার প্রস্তরফলকের মেঝের উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে মায়ের আবাসন কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময়, হুমায়ুনের চারপাশের লাল বেলেপাথরের দূর্গটা যেন শূন্যে মিলিয়ে যায়। সে আবারও কাবুলের একটা বালকে পরিণত হয়- তৃণভূমির উপর দিয়ে তাঁর টাটু ঘোড়াটা দুলকি চালে ছুটিয়ে, বাইসানগারের স্থাপিত খড়ের লক্ষ্যবস্তুর দিকে পর্যানে উপবিষ্ট অবস্থায় ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করছে এবং মাহামকে মুগ্ধ করার জন্য নিজের দক্ষতা আর সাহসিকতার অতিরঞ্জিত গল্পগুলো ইতিমধ্যে মনে মনে আউড়াতে শুরু করেছে।

সে যখন তার আম্মিজানের অসুস্থতার জন্য সংরক্ষিত কক্ষে প্রবেশ করতে, তাঁর নাসারন্ধ্র প্রশান্তিদায়ক সুগন্ধিতে ভরে যায়। গন্ধটা তাঁর আম্মিজানের খাটের চারপাশে স্থাপিত চারটা লম্বা ধূপাধার থেকে আসছে যেখানে রেজিনের সোনালী রঙের স্ফটিক ধিকিধিকি জ্বলছে। সবুজ শুজনির নীচে মাহামকে খুবই ছোট দেখায়, তাঁর মুখের ত্বক কাগজের মতো পাতলা কিন্তু তাঁর বিশাল কালো চোখ আজও তাদের সৌন্দর্য ধরে রেখেছে এবং চোখের তারায় নিজের ছেলেকে দেখতে পেয়ে সেখানে আন্তরিকতা, আবেগ এসে ভীড় করে। হুমায়ুন ঝুঁকে মায়ের কপালে চুমু খায়। আমাকে মার্জনা করবেন- আমি যাত্রাপথের ঘাম আর ধূলো নিয়েই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।

আমার সুদর্শন যোদ্ধা…তোমার আব্বাজান ভীষণ গর্ব করতেন তোমাকে নিয়ে…তিনি সবসময়েই বলতেন তার সব সন্তানের ভিতরে তুমিই সবচেয়ে যোগ্য, শাসক হবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত…আমাকে তিনি শেষ যে কথাগুলো বলেছিলেন, মাহাম, আমার যদিও আরও সন্তান আছে, আমি তাদের কাউকে হুমায়ুনের মতো ভালোবাসি না। সে তার হৃদয়ের অভিলাস হাসিল করবে। তাঁর সমকক্ষ কেউ হবে না। তিনি তাঁর শুষ্ক হাত দিয়ে হুমায়ুনের গাল স্পর্শ করেন। আমার সম্রাট, আমার বাছা, তুমি কেমন আছো? আমাদের শত্রুকে তুমি কি পরাস্ত করেছে?

হুমায়ুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবে, যাক তাঁর দুর্ভাগ্যের খবর তাহলে আম্মিজানকে কেউ জানায়নি। জ্বী আম্মিজান, সবকিছু ঠিক আছে। এখন আপনি ঘুমান। সকালে আমি আবার আসবো এবং তখন আমরা প্রাণ খুলে কথা বলবো। কিন্তু মাহাম ইতিমধ্যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন এবং হুমায়ুন সন্দিহান যে তিনি তার কথা শুনতে পেয়েছেন।

খানজাদা পাশের উপকক্ষে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে বিধ্বস্ত দেখায়- হুমায়ুন ধারণা করে মাহামের শয্যাপার্শ্বে অসংখ্য প্রহর তিনি নিন্দ্রাবিহীন কাটিয়েছেন কিন্তু হুমায়ুনকে দেখতে পেয়ে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আগ্রায় নিরাপদে তোমার পৌঁছাবার সংবাদ জানতে পেরে আমি আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করেছি, তিনি তাঁর গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলেন।

আমাকে হেকিমদের সাথে কথা বলতে হবে…

তাদের সাধ্যমতো তারা করেছে। আমরা এমনকি আব্দুল-মালিকের সাথে আলোচনা করার জন্যও তোক পাঠিয়েছিলাম, তোমার আব্বাজানকে যখন বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তখন কিভাবে তার হাতযশ তাকে সুস্থ করে তুলেছিল সেটা সম্বন্ধে অবগত থাকায়। যদিও এখন তাঁর বয়স হয়েছে এবং চোখে ভালোমতো দেখতে পান না, কিন্তু তার মস্তিষ্ক এখনও পরিষ্কার কাজ করে। কিন্তু তাকে যখন রোগের উপসর্গগুলো বলা হয় তিনি সাফ জানিয়ে দেন মাহামের যন্ত্রণা উপশম করা ব্যাতীত আমাদের আর কিছুই করার নেই। খানজাদা চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবেন। মাহাম কেবল একটা বিষয়ের জন্য প্রতীক্ষা করেছিল- হুমায়ুন, তোমাকে আরেকবার চোখে দেখবে। এখন সে শান্তিতে মরতে পারবে…

হুমায়ুন চোখ নামিয়ে যুদ্ধের ক্ষতযুক্ত হাতে তৈমূরের অঙ্গুরীয়ের দিকে তাকায়। আমি এইমাত্র তাকে মিথ্যা কথা বলেছি…আমি তাকে বলে এসেছি আমাদের শত্রুদের আমি পরাস্ত করেছি। কিন্তু তিনি যখন বেহেশত থেকে আমাকে দেখবেন আমার জন্য তখন তিনি গর্ববোধ করবেন- আমি দিব্য করে বলছি… কিছু বুঝে উঠবার আগেই সে টের পায় তার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে।

দুইদিন পরে, আরও তিনজন লোকের সাথে হুমায়ুনকে তাঁর মায়ের চন্দনকাঠের শবাধারে, কর্পূর পানিতে গোসল করিয়ে সাদা কাফনে জড়ান অবস্থায়, বহন করতে দেখা যায়, যমুনাতে অপেক্ষমান একটা নৌকা তাদের গন্তব্য। একটা দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান- নদীর অপর পাড় থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে তাঁর মরহুম আব্বাজান বাবরের তৈরী অনেকগুলো বাগানের একটা, যেখানে মাত্র ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে তার সমাধির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। হুমায়ুন আড়চোখে একবার তার পাশে পাশে হাঁটতে থাকা বাইসানগারের দিকে তাকায়। তাঁর নিজেরই অনেক বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি খানিকটা পীড়াপীড়ি করেই নিজের মেয়ের অন্তিমযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া লোকটাকে এখন কি ভীষণ রোগা লাগছে- বাবরকে সমরকন্দ দখলে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা সেই যোদ্ধার ছায়া মাত্র এখন তাঁকে দেখে মনে হয়।

হুমায়ুনকে আরও গভীর এক বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করে তোলে- মাহামের মৃত্যুই কেবল না বরং যৌবনের অনেক নিশ্চয়তার নিরাপত্তা শেষ হয়ে আসছে এই বোধটা তাকে আরও বেশী ব্যাকুল করে। সারা জীবন সে ছিল অত্যধিক প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠা এক যুবরাজ, পৃথিবীর বুকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত, জীবনে যা কিছু পরম কাম্য সবকিছুতেই তার ন্যায্য অধিকার এমন একটা ধারণা নিয়ে সে বড় হয়েছে। অন্যদের কাজের কারণে বিড়ম্বনার শিকার হয়ে নিজেকে তার কখনও এতো নগন্য আর অরক্ষিত মনে হয়নি। তার আগে কখনও মনে হয়নি নিজের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করা এতো কঠিন।

হুমায়ুন বাকি সবার সাথে শবাধার বয়ে নিয়ে নদীর তীরে পৌঁছাবার পরে, সে মুখ তুলে আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকায়। কোনো আগাম সতর্কতা না জানিয়েই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়, প্রথমে বড়, ভারী ফোঁটা শীঘ্রই সেটা মুষলধারে নামতে শুরু করে হুমায়ুনের পরণের শোকের কালো আলখাল্লাটা ভিজিয়ে চুপচুপে করে তুলে। বৃষ্টিটা সম্ভবত একটা ইঙ্গিত, তাঁর মনে জমে উঠা সন্দেহ দূর করতে পাঠান হয়েছে, তাঁকে বলার জন্য যে যদিও কিছু বিষয়ের অবশ্যই সমাপ্তি ঘটবে, একজন নেতার জন্য সবসময়ে নতুন সূচনা অপেক্ষা করছে যে কখনও শোক কিংবা বিরুদ্ধতার মুখোমুখি হয়ে মুষড়ে পড়বে না বরং নিজের ক্ষমতা আর তার চূড়ান্ত বিজয়ের উপরে সে বিশ্বাস রাখবে।

*

হুমায়ুন তার চারপাশে উপস্থিত উপদেষ্টাদের দিকে তাকায়, সবার পরণে তার মতোই শোকের পোষাক, রীতি অনুযায়ী যা তাঁদের চল্লিশ দিন পরিধান করতে হবে। মাহামের মৃত্যুর পরে মাত্র চৌদ্দ দিন অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদাশঙ্কাপূর্ণ যে খবর সে পেয়েছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য তাঁদের হাতে খুব অল্প সময়ই রয়েছে।

আহমেদ খান, আপনি নিশ্চিত…?

জ্বী, সুলতান, সারা দেহে সদ্য ভ্রমণ থেকে আসবার লক্ষণ স্পষ্ট ফুটে থাকা তার গুপ্তদূতদের প্রধান উত্তর দেয়। শেরশাহ প্রায় তিন লক্ষাধিক সৈন্যের একটা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমি নিজের চোখে এখান থেকে ঘোড়ায় মাত্র পাঁচ দিনের দূরত্বে তাদের অগ্রগামী বাহিনীকে দেখে আসছে।

সুলতান, তাঁর কথার সাথে আমরা যেসব খবর শুনেছি তার যথেষ্ট মিল আছে, কাশিম মন্তব্য করে। বৃষ্টি আরম্ভ হওয়া সত্ত্বেও শেরশাহ যথেষ্ট দ্রুতই এগিয়ে আসছে।

হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, শেরশাহ অন্তত তাঁর পশ্চাদপসারনকারী বাহিনীর নাগাল পায়নি। এক সপ্তাহ আগে মূল বাহিনীটা নিরাপদে আগ্রা এসেছে যদিও আসবার পথে অনেকেই দলত্যাগ করেছে। তার মানে সে আগ্রা এসে আমাদের এখানেই আক্রমণ করতে চায়…আমাদের এই মুহূর্তে কত সৈন্য অবশিষ্ট রয়েছে? বাবা ইয়াসভালের স্থানে অশ্বারোহী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক যাকে মনোনীত করেছে সেই হাল্কা পাতলা আর লম্বা আধিকারিক জাহিদ বেগের দিকে হুমায়ুন তাকায়।

সুলতান, কনৌজ থেকে যারা ফিরে এসেছে তাদের নিয়ে প্রায় আশি হাজার হবে, কিন্তু এই সংখ্যাটা প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে কমছে…

মাথা উঁচু করে হুমায়ুন তাঁর দরবার হলের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত দূর্গচত্বরের দিকে তাকায়। বৃষ্টিপাত আপাতত বন্ধ রয়েছে এবং মেঘের ফাঁক দিয়ে নেমে আসা সূর্যরশ্মিতে লাল বেলেপাথর থেকে এক ধরনের আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তারা ঝড়ের বেগে হিন্দুস্তান অধিকার করার পরে এই দূর্গটা এখন পর্যন্ত মোগলদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। গতরাতে হারেমের বিলাসিতা ঘুমাতে যাবার আগে প্রাকারবেষ্টিত দূর্গের ছাদে সে তাঁর ব্যক্তিগত জ্যোতিষী শারাফের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল, অনেকদিন পরে তাঁরা দুজনে একসাথে রাতের আকাশ দেখেছে। কিন্তু শারাফ সেখানে কিংবা রাশিচক্রে বা গণনায়- নিয়তির কোনো বাণী খুঁজে পায়নি। নক্ষত্ররাজির এই মৌনতার মাধ্যমে কি আল্লাহতালা তাঁকে বলতে চায় যে তাঁকে নিজে এবং একাকী তাকেই নিজের রাজত্ব রক্ষার পথ খুঁজে বের করতে হবে…?

আমি যে ভয়টা করছিলাম আহমেদ খানের সংবাদ সেটাই কেবল নিশ্চিত করেছে। আমাদের সামনে আগ্রা পরিত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, হুমায়ুন অবশেষে বাক্যটা উচ্চারণ করে। সবাই চমকে গিয়ে সশব্দে শ্বাস টানে।

সুলতান, আগ্রা পরিত্যাগ করবো? কাশিমকে স্পষ্টতই বিহ্বল দেখায়।

হ্যাঁ। সেটাই একমাত্র পথ।

কিন্তু আমরা কোথায় যাব?

উত্তরপশ্চিম দিকে, লাহোরে। আমরা এরফলে কিছুটা সময় পাব আর আমি কাবুল থেকে আরো সৈন্য নিয়ে আসতে পারবো- সেখানের গোত্রগুলো লুটপাটের সুযোগকে খুশী মনে স্বাগত জানাবে…

অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না অবশেষে বাইসানগার কথা শুরু করেন। বহু বছর আগের কথা আমি তখনও একজন যুবক আর সম্রাট বাবরের সাথে সমরকন্দে অবস্থান করার সময়, আমরা এক শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিলাম- সাইবানি খান আর তার অগণিত উজবেক সাথী, আমরা খুব ভালো করেই জানতাম যাদের পরাস্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের হাজার হাজার সহযোদ্ধাদের মৃত্যুই ছিল পশ্চাদপসারণের একমাত্র বিকল্প। বাবর, তাঁর সাহস আর দূরদৃষ্টি দিয়ে, যা তাকে একজন মহান শাসকে পরিণত করেছিল, বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। বর্বর উজবেকদের হাতে তৈমূরের শহর তুলে দিতে যদিও তার ভেতরের যোদ্ধার সত্ত্বা বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়েছিল, তিনি জানতেন তাঁকে এটা করতেই হবে…ঠিক যেমন আমাদের আগা ছেড়ে যেতে হবে…

হুমায়ুন দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। বাইসানগার ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তিনি যেটা উহ্য রেখেছেন সেটা হল এই যে সমঝোতার শর্ত হিসাবে সাইবানি খান নিজের স্ত্রী হিসাবে খানজাদাকে দাবী করেছিল আর বাবর বাধ্য হয়েছিলেন নিজের বোনকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে। দশ বছর তৈমূরের বংশধরদের রক্তপিপাসু এক লোকের হারেমে খানজাদা জীবনযাপন করেছিলেন, যে খানজাদার মনোবল ভাঙতে খুশীমনে চেষ্টা করতো। তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে, হুমায়ুন, যাই ঘটুক না কেন, খানজাদাকে এমন নির্মম নিয়তি আর বরণ করতে দেবে না।

আমরা পশ্চাদপসারণ করছি, পালিয়ে যাচ্ছি না। যদিও আগামীকাল ভোরের প্রথম প্রহরে আমরা যাত্রা শুরু করবো, সবকিছু যেন শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে করা হয়…কাশিম, রাজকীয় বাজার সরকার আর তার কর্মচারীদের সমবেত হতে বলেন এবং আমার আদেশ দ্রুত আর কোনো প্রশ্ন না করে তাঁরা যেন পালন করে সেটা আপনি নিশ্চিত করবেন। আগ্রায় রক্ষিত রাজকীয় কোষাগারে যা কিছু রয়েছে সবকিছু অবশ্যই সিন্দুকে স্থানান্তরিত করতে হবে। মূল্যবান বাকি অন্য জিনিষ আমাদের সাথে করে নিয়ে যাবার জন্য মোড়ক করতে আদেশ দেন- শেরশাহের কাজে লাগতে পারে এমন কিছুই রেখে যেতে চাই না আমি। জাহিদ বেগ, আমাদের সৈন্যদের যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তাঁদের বলবেন কাবুল থেকে আমাদের যে সৈন্যবাহিনী আসছে তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য আমরা লাহোর যাচ্ছি। আর আমাদের সব গাদাবন্দুক আর বারুদ যেন নিরাপদে গোশকটে ভোলা হয় সেটা নিশ্চিত করবেন আর কামানগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করেন। এমনকিছু করবেন না বা বলবেন না যার ফলে কারো মনে পরাজয় বা পলায়ন বা আমরা শেরশাহের ভয়ে ভীত এমন ভাবনার জন্ম হয়।

হুমায়ুন কথা বন্ধ করে এবং চারপাশে তাকায়। আর আহমেদ খান আপনি, আমার সৎ-ভাইয়েরা নিজ নিজ প্রদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করে, বাকি সৈন্য নিয়ে লাহোরে আমার সাথে তাদের যোগ দেবার আদেশ সম্বলিত চিঠি বয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপনার সবচেয়ে দ্রুতগামী আর সেরা তরুণ অশ্বারোহীদের নির্বাচিত করেন। আমি নিজে চিঠিগুলো লিখব আর তাতে রাজকীয় মোহরের ছাপ দিয়ে দেব যাতে সম্রাট তাঁদের আদেশ দিয়েছেন- সে বিষয়ে আমার ভাইদের মনে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ না থাকে। এখন দ্রুত যা বললাম করেন, আমাদের হাতে সময় খুব অল্প…

সেই রাতে হুমায়ুন এক মুহূর্তের জন্য চোখের পাতা বন্ধ করে না বা হারেমো যায় না তাকে অনেককিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। রাতের অন্ধকার ছিন্ন করে অবশ্য নিয়মিত বিরতিতে শেরশাহের অগ্রগামী সৈন্যের অগ্রসর হবার তাজা আর প্রতিবার আরো বেশী মাত্রায় উদ্বেগজনক হয়ে উঠা খবর নিয়ে গুপ্তদূতের আগমন অব্যাহত থাকে। হুমায়ুন হিসাব করে দেখে, শেরশাহ যদি তাঁর অগ্রসর হবার বর্তমান গতি বজায় রাখে তাহলে তার অগ্রবর্তী সৈন্যরা তিন কি চারদিনের ভিতরে আগ্রার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হবে।

পূর্বাকাশে ভোরের আলো ফোঁটার অনেক আগেই, উষ্ণ বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা নিশান নিয়ে হুমায়ুনের সেনাবাহিনীর প্রথম দলটা সামনের রাস্তা নিরাপদ করার দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সে আগ্রা ত্যাগ করছে এই খবরটা একবার চাউর হলে, জনগণ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে আর ডাকাতের দল সেই সুযোগে হয়ত কোনো অপকর্ম ঘটাবে। হুমায়ুনের অগ্রবর্তী সেনাদলের দায়িত্ব হল ইস্পাতের চকচকে বর্ম আর রাজকীয় অশ্বশালা থেকে সরবরাহ করা তাজা ঘোড়ায় চেপে- শক্তির প্রদর্শন করে দুবৃত্তদের কোনো ধরনের অপকর্ম ঘটান থেকে বিরত রাখা। হুমায়ুন নিজের মনে বলে, আর সেই সাথে আমি এখনও শক্তিশালী। তার অধীনে এখনও আশি হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী রয়েছে। পানিপথের সময় তাঁর আর তাঁর আব্বাজানের সাথে যা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী।

হুমায়ুন তাঁর আবাসন কক্ষের জানালা দিয়ে নীচের আঙ্গিনার দিকে তাকিয়ে দেখে, রাজঅন্তঃপুরের মহিলা এবং তাঁদের পরিচারিকার দল তাদের জন্য প্রস্তুত করা পালকি আর গোশকটে অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেনাসারির একেবারে মধ্যে তাঁরা ভ্রমণ করবেন, তাদের চারপাশে অবস্থানরত প্রহরীরা একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী বজায় রাখবে, এবং সামনে আর পেছনে থাকবে আরও কয়েকসারি বিশেষভাবে তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত অশ্বারোহী বাহিনী। হুমায়ুন অবশ্য খানজাদা আর তার সৎ-বোন গুলবদনকে তাঁর কাছাকাছি আরেকটা রাজকীয় হাতিতে ভ্রমণের বন্দোবস্ত করতে আদেশ দিয়েছেন। সালিমা, এখনও তার প্রিয়তম উপপত্নী, পেছনে আরেকটা হাতিতে অবস্থান করবে।

মহিলাদের দলটার পেছনে থাকবে রাজকীয় শিবির স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বহনকারী শকট- তাবু এবং ভ্রাম্যমান হাম্মামখানা, রান্নার উপকরণ এবং উত্তরপশ্চিমে চারশো মাইল যাত্রার জন্য দরকারী অন্যান্য সামগ্রী। এবং সেই সাথে অবশ্যই ভ্রমণের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত লোহার অতিকায় সিন্দুক যার জটিল তালা খুলতে চারটা আলাদা আলাদা রূপার চাবি- প্রতিটা চাবি আলাদা আলাদা আধিকারিকের কাছে রক্ষিত এবং একটা সোনার চাবি প্রয়োজন যা এই মুহূর্তে হুমায়ুনের গলায় ঝুলছে। হুমায়ুন নিজের ভিতরে শেরশাহের সাথে প্রথমবার মুখোমুখি হতে যাবার দিল্লীতে রক্ষিত ধনসম্পদ নিরাপত্তার খাতিরে আগ্রায় পাঠাবার আদেশ দেয়ার মতো দূরদৃষ্টি দেখিয়েছিল বলে নিজের কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তাঁর নিজের যা অর্থ আর রত্নপাথর রয়েছে আর সেই সাথে বাহাদুর শাহের কাছ থেকে সে যা দখল করেছে সেটা যোগ করলে, শেরশাহের সাথে টক্কর দেবার মতো একটা নতুন বাহিনী তৈরীর জন্য যথেষ্ট তহবিল তার কাছে রয়েছে।

বহরের একেবারে শেষে থাকবে অশ্বারোহী আর পদাতিক সৈন্যদের আরো কয়েকটা দল, যাদের ভিতরে তাঁর শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজেরাও রয়েছে, তাঁরা মিনিটে চল্লিশটা তীর নিক্ষেপের মতো দক্ষ। আর পুরো সেনাসারির ভিতরে ছড়িয়ে থেকে এবং বেশীরভাগ সময় দৃশ্যপটের আড়ালে আহমেদ খানের গুপ্তদূতেরা অবস্থান করবে, যেকোনো ঝামেলার জন্য তারা সর্তক দৃষ্টি রাখবে।

দুই ঘন্টা পরে, পিঙ্গল বর্ণের লম্বা পায়ের অধিকারী পেষল স্ট্যালিয়নটায়, যা তাঁকে কনৌজের বিপর্যয়ের পরে খুব দ্রুত আগ্ৰায় ফিরিয়ে এনেছিল, উপবিষ্ট অবস্থায় আগ্রা দূর্গের মূল তোরণদ্বারের নীচে ঢালু পথের উপরে দিয়ে হুমায়ুনকে মন্থর গতিতে ঘোড়া চড়ে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। মাথার রত্নখচিত শিরোস্ত্রাণের নীচে, তাঁর চোখের দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে নিবদ্ধ। এটা পেছন দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখা বা কোনো ধরনের স্মৃতি রোমন্থনের সময় না। এটা একটা সাময়িক বিপর্যয় আর শীঘ্রই খুব শীঘ্রই, যদি আল্লাহতালা সহায় থাকেন- নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার বুঝে নেবার জন্য সে ফিরে আসবে। আপাতত বিদায় নেয়ার আগে সে শেষ একটা কাজ করতে চায়। ঘোড়ায় করে নদীর তীরে পৌঁছে সে সেখানে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে তাঁকে যমুনার অপর তীরে মাহামের কবরের কাছে নিয়ে যাবে বলে যে ছোট নৌকাটা অপেক্ষা করছিল সেটায় আরোহন করে। সাদা মার্বেলের আয়তাকার চ্যাপ্টা খণ্ডটার কাছে পৌঁছে সে হাটু ভেঙে বসে এবং পাথরটায় চুমু খায়। শেরশাহ আমাদের ধর্মের অনুসারী লোক, সে ফিসফিস করে বলে। সে আপনার কবরের কোনো ক্ষতি করবে না এবং একদিন আমি আপনার কাছে ফিরে আসবো। আম্মিজান আমাকে মার্জনা করবেন যে আমি চল্লিশ দিনের শোক পালন করতে পারছি না, কারণ আমাদের রাজবংশের ভাগ্য অনিশ্চয়তার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আমাকে দেহের প্রতিটা স্নায়ু আর পেশীকে সহ্যের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে একে রক্ষা করার জন্য আমাকে চেষ্টা…

*

তারা আগ্রা ছেড়ে আসবার পরে প্রতিদিনই নিয়মিত বৃষ্টিপাতের প্রকোপ মনে হয় যেন অনেকটা কমে এসেছে এবং হুমায়ুন ঠিক যেমনটা আশা করেছিল- শেরশাহ যদিও আগ্রা দখল করেছে কিন্তু সে তাকে আর অনুসরণ করেনি। হুমায়ুনের গুপ্তচরদের ভাষ্য অনুসারে শেরশাহকে হিন্দুস্তানের পাদিশাহ ঘোষণা করে আরো একবার তাঁর নামে আগ্রা দূর্গের মসজিদে খুতবা পাঠ করা হয়েছে এবং সে এখন নিয়মিত খিলানযুক্ত দর্শনার্থী হলে দরবার করছে। বেশ, ভুইফোড়টা তার গৌরবোজ্জ্বল মূহূর্ত উপভোগ করুক- যদিও সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত হবে।

হুমায়ুন মনে মনে ভাবে তাঁর সেনাসারি বেশ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। প্রতিদিন সম্ভবত বারো কি তের মাইল, সম্ভবত আরো বেশী, যেহেতু তারা উত্তরপশ্চিম দিক অভিমুখে বৈচিত্রহীন ভূখণ্ডের উপর দিয়ে ভ্রমণ করছে। তারা যদি তাদের সামরিক বহরের এই গতি বজায় রাখতে পারে তাহলে আশা করা যায় একমাসের ভিতরে তারা লাহোরে পৌঁছে যাবে। এখনও পর্যন্ত কোনো ভয়াবহ আক্রমণের সম্মুখীন তাদের হতে হয়নি। মোগলদের সৈন্যসারি যখন কোনো গ্রামের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন সেখানে বসবাসকারী লোকেরা মনে হয় যেন কাছে আসতে ভয় পায় তাঁরা বৃষ্টির পানি জমে থাকা ফসলের মাঠের নিরাপদ আশ্রয়ে কিংবা তাঁদের মাটির দেয়াল আর খড় দিয়ে ছাওয়া বাড়ি থেকে অগ্রসরমান সৈন্যদের কাতার আর মালবাহী শকটের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাড়ের মাংসে চামড়া ঢুকে যাওয়া কুকুরের পাল আর হাড্ডিসার হলুদ পালকযুক্ত মুরগীর ঝাকই কেবল চারপাশে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়।

তাঁর সেনাসারির উপর এখন পর্যন্ত একবার মাত্র হামলা হয়েছে। ঝিরঝির বৃষ্টির পর্দায় চারপাশ জড়িয়ে নিয়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা যখন দ্রুত আঁধার নামছিলো, কাদায় আটকে গিয়ে অতিরিক্ত তাবু আর রান্নার সরঞ্জামাদি বহনকারী একটা শকট মূলবহর থেকে আলাদা হয়ে গেলে, ডাকাতের দল সেটাকে আক্রমণ করে। বেশ কয়েক ঘন্টা পরে মালবাহী শকটটার অনুপস্থিতি সবার নজরে পড়ে এবং আহমেদ খান দ্রুত গুপ্তদূত পাঠায় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে। তারা পিঠে তীরবিদ্ধ অবস্থায় মালবাহী শকটের চালকদের বৃষ্টিতে ভেজা মৃতদেহ খুঁজে পায় এবং আশেপাশে কোথায় মালবাহী শকট নেই। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলেও চোর আর চুরি করা শকটটি খুঁজে বের করতে খুব একটা দেরী হয়না। রাতের প্রথম আগুন জ্বালাবার প্রায় সাথে সাথে, আহমেদ খানের প্রেরিত লোকেরা, বাজারে যেভাবে মুরগী বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক সেভাবে সেরাতের অস্থায়ী শিবিরে ডাকাতদের বেঁধে আনে। হুমায়ুন কালবিলম্ব না করে তাদের শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয় এবং পাথরের একটা পিরামিডে ছিন্ন মুণ্ডুগুলো দেখা যায়, এমনভাবে গেঁথে দিতে বলে একটা হুশিয়ারি হিসাবে যে প্রজাদের ভিতরে আইন অমান্য করার কোনো ধরনের প্রবণতা সে বরদাশত করবে না।

সে এমনকি নিজের সৈন্যদের ভিতরেও এসব বরদাশত করতে রাজি না। রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও হিন্দুস্তানের এইসব লোকগুলো তাঁর আপন তাঁর প্রজা- এবং সে কখনও তার লোকদের বলেনি যে হিন্দুস্তানীদের উপরে তাঁরা ইচ্ছামতো লুটপাট চালাতে পারবে। সে কঠোরভাবে আদেশ দিয়ে রেখেছে যে কোনো ধরনের লুটপাট করা চলবে না এবং ইতিমধ্যে ছয়জন সৈন্যকে কাঠের কাঠামোতে হাতপা ছড়ান পক্ষবিস্তারকারী ঈগলের মতো আটকে তাদের সহযোদ্ধাদের সামনে তাদের ভালোকরে চাবকানো হয়েছে, একটা ভেড়া চুরি করার অপরাধে এবং সপ্তম আরেকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে গ্রামের এক কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করার দায়ে।

সে যাই হোক, গাদাফুল দিয়ে তারা যখন তাদের মন্দিরের সামনে খোদাই করা মোষের মূর্তির পাশ দিয়ে যায়, এবং তাদের উদ্ভটসব দেবতার মূর্তিসমূহ অনেকেরই একাধিক হাত রয়েছে, কেউ দেখতে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক হাতির মতো- সে না ভেবে থাকতে পারে না যে রাজত্ব লাভের আকাঙ্খ আর নিয়তি মোগলদের যে স্থানে নিয়ে এসেছে সেখানের গতিপ্রকৃতি কি সে কখনও পুরোপুরি বুঝতে পারবে। তার আপন ঈশ্বর হলেন একটি নিঃসঙ্গ সত্ত্বা, অদৃশ্য এবং নিজে নিজে শেভ করার জন্য এবং সর্বময়ক্ষমতায় স্পর্ধিত হয়ে উঠে, তার আদলে কিছু একটা তৈরী করাটা ধর্মদ্রোহীতার সামিল। হিন্দুদের দেবতাদের দেখলে মনে হবে তারা কোনো বাহিনীর অংশ এবং তাঁদের ইন্দ্রিয়পরায়ন দেহ আর পেষল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখলে চিরন্তত পরিত্রাণের চেয়ে পার্থিব ভোগবিলাসের কথাই মনে পড়ে।

তাঁরা যখন হাতির পিঠে চেপে ভ্রমণ করে, হুমায়ুন তখন নিজের ভাবনাগুলো নিয়ে, তার সেরা হাতিগুলোর একটার পিঠে সোনার শেকল দিয়ে বাঁধা খানজাদা আর গুলবদনের দুলতে থাকা হাওদায়, তাদের সাথে ধুসর গোলাপী রেশমের কাপড়ের মাঝে দিয়ে যা তাদের পুরো হাওদা আবৃত করে রেখেছে, আলোচনা করে। প্রখর ব্যবহারিক জ্ঞানের অধিকারী খানজাদা তাঁর হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় আচরণের বিষয়ে তাঁর মতো আগ্রহ পোষন করেন না- পাথরের তৈরী যোনি আর লিঙ্গম- পুরুষ আর নারীর যৌনাঙ্গের প্রতীক- কেন তাদের কাছে এতো পবিত্র তাদের পুরোহিতেরা কেন কপালে ছাই লেপন করেন এবং কেন তাঁরা তাঁদের ডান কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে দেহের সাথে একটা সুতির লম্বা সুতা ঝোলে।

গুলবদন অবশ্য অবিশ্বাসীদের এসব ধর্মাচরণ দ্বারা মনে হয় কেবল অভিভূতই না সে এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। হুমায়ুন অবশ্য নিজেকে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে কাবুল থেকে বাবরের রাজধানী আগ্রায় তাঁকে যখন নিয়ে আসা হয়েছিল তখন তার বয়স একেবারেই অল্প ছিল। সে হিন্দুস্তানেই বড় হয়েছে এবং খাইবার পাসের ওপাশে মোগলদের পাহাড়ী স্বদেশ সম্বন্ধে তাঁর স্মৃতি খুবই সামান্য প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁকে লালনপালনের দায়িত্বে হিন্দুস্তানী মহিলারা ছিল তারা তাদের আয়া বলে- যারা নিশ্চয়ই তাদের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠানের আঙ্গিক তাঁকে ব্যাখ্যা করেছে। সময় যখন আবারও শান্ত হবে, সে তখন অবশ্যই গুলবদনের সাথে আরো বেশী সময় অতিবাহিত করবে, তার নতুন প্রজাদের আরো ভালো করে বুঝতে।

*

হুমায়ুনের সৈন্যসারি আপাতভাবে শান্ত ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে নিরূপদ্রবভাবে এগিয়ে যায়, যতক্ষণ না তাদের সামনে লাহোর ভেসে উঠে। শহরটার চারপাশে যদিও কোনো প্রতিরক্ষা বেষ্টনী নেই, শহরের কেন্দ্রস্থলে কয়েক শতাব্দি পূর্বে হিন্দু শাসকদের দ্বারা নির্মিত প্রাচীন রাজপ্রাসাদের সামনে হুমায়ুন যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে তখন লক্ষ্য করে যে প্রাসাদটার কাঠামো বেশ শক্তিশালী এবং মজবুত। এসবের চেয়েও ভালো খবর হল তার সৎ-ভাইয়েরা ইতিমধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে এবং প্রাসাদের অভ্যন্তরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে কখনও কোনো অলুক্ষণে মুহূর্ত অনেকবারই ভেবেছে তাঁরা তাঁর আদেশ পালন করবে কি না কিন্তু তারা আদেশ পালন করেছে… এমনকি কামরানও।

তাঁদের সাথে মিলিত হবার জন্য নিজের ভেতরের ব্যাকুলতা দেখে সে বিস্মিত হয়। তারা এখন দেখতে কেমন হয়েছে? বাবরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যখন তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের পরে সে আর তাঁদের দেখেনি। সে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী কৃতজ্ঞ, তাদের অপরাধ সে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছিল- কারণ কেবল যে বাবর তাঁর মৃত্যুশয্যায় তাঁর কাছ থেকে কথা আদায় করেছিল তাদের সে সহানুভূতিপূর্ণ আচরন করবে আর তারচেয়েও বড় কথা এবং তাদেরও নিশ্চিতভাবেই তাকে প্রয়োজন রয়েছে। মোগল যুবরাজ হবার কারণে শেরশাহ তাঁদের সব ভাইদের জন্যই হুমকি স্বরূপ। বাবরের সন্তানেরা যদিও একত্রিত হতে পারে, তাহলে তারা বাংলার জলাজঙ্গল ভর্তি যে এলাকা থেকে শেরশাহ এসেছে, তাকে পুনরায় সেখানে পাঠিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা এই যে এই বিপর্যয়টা হয়তো তাদের সবকিছু নতুন করে শুরু করার একটা সুযোগ দেবে, কেবল রক্তের সম্পর্কই না ভ্রাতৃত্বের স্নেহশীল মনোভাব যা কখনও ছিন্ন হয়নি, সবকিছু পুনরায় মুসাকিদা করতে পারবে। তারাও অতীতের ক্ষত নিরাময় করতে আগ্রহী এমন আশা করাটা কি বোকামী হবে?

পরের দিন সকালের আলো ফোঁটার সাথে সাথে, হুমায়ুন তার সৎ-ভাইদের নিজেন আবাসন কক্ষে ডেকে পাঠায়। কাশিম, জাহিদ বেগ আর ক্লান্ত দেখতে বাইসানগারের উপস্থিতিতে কামরান, হিন্দাল আর আসকারি কক্ষে প্রবেশ করতে হুমায়ুন একে একে তাঁদের আলিঙ্গন করে, স্বতস্ফূর্ত আন্তরিকতায় প্রত্যেকের সম্বন্ধে মন্তব্য করে যা তাদের নিজেদের কৌতূহলের সাথে মিলে যায় যখন তারা অবাক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় ছয় বছর আগে শেষবারের মতো সে যখন তাঁদের দেখেছিল, আসকারি আর হিন্দাল তখন সদ্য যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে আর কামরান তার চেয়ে মাত্র পাঁচ মাসের ছোট, একটু পরিণত। এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।

কামরানের চোখ- যা ঠিক তাঁদের আব্বাজানের মতো উজ্জ্বল সবুজ- নাকের উপরে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে যা এখনও দেখতে বাজপাখির মতো, বস্তুত পক্ষে এখন সাদৃশ্য আরও বেশী মাত্রায় লক্ষণীয়। নাকটা ভাঙা পরিষ্কার বোঝা যায়- খুব সম্ভবত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বা সংক্ষিপ্ত কোনো লড়াইয়ের ফল- এবং হেকিমেরা ভাঙা জায়গাটা ঠিকমতো বসাতে পারেনি। সেটাই একমাত্র পরিবর্তন– কামরান বেশ লম্বা চওড়া হয়েছে। তার পরণের হলুদ জোব্বার নীচে কাঁধের পেশল মাংসপেশী আর বাহুর উধ্বভাগ ফুলে রয়েছে। আসকারির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তাঁর যে চেহারা হুমায়ুনের মনে ছিল তার চেয়ে আসকারির মুখ অনেকবেশী সরু আর লম্বা দেখায় এবং তার মুখে এখন সুন্দর করে ছাটা দাড়ি শোভা পাচ্ছে, সে আগের মতোই হাল্কা পাতলা রয়ে গেছে। হুমায়ুন বা কামরানের চেয়ে সে লম্বায় কম করে একমাথা খাট। হুমায়ুন হিন্দালকে একেবারেই চিনতে পারেনা। দিলদারের ছেলে- গুলবদনের ভাই- চোখে পড়ার মতো লম্বা চওড়া হয়ে উঠেছে। তার যেকোনো ভাইয়ের চেয়ে কম করে হলেও চার ইঞ্চি লম্বা আর চওড়া পেশল দেহ, মাথাভর্তি ঝাকড়া লালচে চুলের নীচে ডান ভ্রুর উপরে একটা আড়াআড়ি কাটা দাগ এবং হুমায়ুনকে স্বাগত জানাবার সময় তাঁর মন্দ্র, গমগমে কণ্ঠস্বরের কারণে তাঁকে আঠার বছরের চেয়ে অনেক বড় মনে হয়।

পারস্পরিক কুশল বিনিময় শেষ হতে, হুমায়ুন কাশিম, বাইসানগার আর জাহিদ বেগের সাথে তাঁর সৎ-ভাইদেরও নিজের চারপাশে অর্ধ-বৃত্তাকারে উপবেশনের ইঙ্গিত করে এবং কোনো প্রকার ভণিতা না করে কাজের কথায় আসে। আমি তোমাদের এখানে দেখে খুব খুশী হয়েছি। বহুদিন পরে আমরা সবাই আবার একসাথে হলাম। তোমরা ভালো করেই জান- কেন আমি তোমাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। আমরা যুদ্ধের পরামর্শসভায় মিলিত হয়েছি এবং আমাদের প্রত্যেকের ভাগ্য- আমাদের পুরো রাজবংশের- আজকের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। অতীতে আমাদের নিজেদের ভিতরে অনেক মতানৈক্য ছিল কিন্তু আমরা চারজনই বাবরের সন্তান। আমাদের প্রত্যেকের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে এবং চারপাশে ঘনিয়ে আসা বিপদের সম্মুখীন হয়ে আমাদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে। তোমরা অবহিত আহো যে শেরশাহ তিন লক্ষ সৈন্যের একটা বিশাল বাহিনী নিয়ে আমাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী, আগ্রা দখল করে নিয়েছে…

এটা দুঃখজনক যে শেরশাহের বিরুদ্ধে আপনার অভিযান সফল হয়নি, কামরান মৃদু কণ্ঠে বলে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় অন্তত একবারের জন্য হলেও নক্ষত্ররাজির গণনা আপনাকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করেছে।

হুমায়ুনের চোখমুখ লাল হয়ে উঠে, কামরান কথা বলার সাথে সাথে মৈত্রীর জন্য তার আকাঙ্খ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। শেরশাহের সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে আমার দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং অনেক ভালো মানুষ- বাবা ইয়াসভালের মতো মানুষ- শহীদ হয়েছে। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তুমি যদি সাহায্য পাঠাতে, শেরশাহকে আমি পরাস্ত করতে পারতাম, এবং আমার চারপাশে যেসব বীর যোদ্ধারা শহীদ হয়েছে তারা হয়ত আজও বেঁচে থাকতো…

আমি আমার নিজের বাহিনীর প্রধান হিসাবে আসবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আপনি সেটা মানতে অস্বীকার করেছেন…

কারণ আমি চাইনি তোমার নিজের প্রদেশ অরক্ষিত অবস্থায় থাকুক।

কিন্তু আমি আপনাকে এতো পূর্বদিকে গিয়ে শেরশাহকে মোকাবেলা করার ব্যাপারে হুশিয়ার করেছিলাম- আমি আপনাকে দিল্লী অথবা আগ্রায় দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের জন্য প্রস্তুতি নেবার পরামর্শ দিয়েছিলাম। শহরের দেয়ালের ভিতরে সুরক্ষিত অবস্থায় এবং পর্যাপ্ত রসদের বন্দোবস্ত করে আপনি শেরশাহের বাহিনীকে উদ্যমহীন করতে পারতেন এবং আপনার অন্যান্য বাহিনী তাঁকে পেছন থেকে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো। কিন্তু বরাবরের মতোই আপনি আমার পরামর্শের প্রতি কোনো গুরুত্বই দেননি… হুমায়ুনের মনে হয় কামরান নিজের চোখে মুখে হাল্কা বিদ্রুপের একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে নিজের যুক্তির পক্ষে নাছোড়বান্দার মতো সাফাই দিচ্ছে।

এবং আমার প্রতি তোমার আনুগত্য বরাবরের মতোই সন্দেহজনক… বালিঘড়ির বালুর মতোই ইতিমধ্যে এর অবত শুরু হয়েছে…তোমার প্রতারক চোখের মণিতে আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি… হুমায়ুন কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায়। তাঁদের ছেলেবেলায় সে ছিল সবসময়ে সেরা যোদ্ধা আর কুস্তিগীর। সে কামরানকে বহুবার আড়ং ধোলাই করেছে এবং প্রয়োজন হলে আবার করবে… কামরানও মার্জারের দ্রুততায় উঠে দাঁড়ায়, তাঁর হাত কোমরের গাঢ় বেগুনী পরিকরে গোঁজা রত্নখচিত খঞ্জরের বাটের দিকে এগিয়ে যায়।

সুলতান আপনারা… বাইসানগারের শান্ত সমাহিত কণ্ঠস্বর তাঁদের দুজনের মাঝে সম্বিত ফিরিয়ে আনে। হুমায়ুন নিজেই লজ্জিত বোধ করে যে তাকে প্ররোচিত করতে সে কামরানকে সুযোগ দিয়েছে। তারা এখন আর কাবুলের সেই লড়াকু বালক নয় বরং মোগল যুবরাজ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মারাত্মক এক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কামরানকে দেখেও মনে হয় সে নিজের আচরণের জন্য অনুতপ্ত। সে পরিকরের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং চোখ নীচের দিকে নামিয়ে নিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে পুনরায় আলোচনার উদ্দেশ্যে মাটিতে বসে। আসকারি আর হিন্দালও অধোমুখে তাকিয়ে রয়েছে, যেন তারা একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে চায় যে বাবরের বড় দুই ছেলের ঝগড়ার মাঝে তারা কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে পারবে না।

বরাবরের মতোই বাইসানগার, তুমি হলে বিবেকের কণ্ঠস্বর। হুমায়ুন নিজেও এবার মাটিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে। অতীতের ঘটনা অতীতের গর্ভে বিলীন হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হল ভবিষ্যতের খেয়াল রাখা। আমাদের মরহুম আব্বাজান তাঁর জীবনের প্রায় অর্ধেক সময়কাল যুদ্ধ করেই অতিবাহিত করেছেন- তাঁর যখন মাত্র বারো বছর বয়স তখন থেকেই একটা সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করতে। আল্লাহতালা তাকে আমাদের পৈতৃক জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে নতুন দেশে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন, এবং এটা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব, যে জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন সেটা যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। আমি এজন্যই তোমাদের এখানে ডেকে এনেছি- যাতে আমরা চারজন মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিভাবে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা যায়… এবং আমাদের চূড়ান্ত শক্তি, আর পরম নিরাপত্তা আমাদের ঐক্যের ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে।

তার সৎ-ভাইয়েরা একসাথে মাথা নাড়ে এবং সেটা দেখে হুমায়ুনেরও শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। জাহিদ বেগ আমাদের সামরিক পরিকল্পনার একটা রূপরেখা আমার ভাইদের সামনে উপস্থাপন করেন। আমি তাদের যেকোনো মতামতকে স্বাগত জানাব।

হুমায়ুন একটা রূপার কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসলে, তার অশ্বশালার প্রধান সিপাহসালার সামরিক কৌশলের সারাংশ ব্যাখ্যা করে, যা হুমায়ুন তার এবং বাইসানগারের সাহায্যে তৈরী করেছে।

মহামান্য যুবরাজবৃন্দ, জাহিদ বেগ বক্তব্য শুরু করে, তার প্রশস্ত মুখাবয়ব গম্ভীর, আমরা শেরশাহের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না কিন্তু বর্তমানে তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে সে নিজের অবস্থান সংহত করতে বেশী আগ্রহী- সে তার সেনাবাহিনীকে বাংলা থেকে পশ্চিমে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে তাই তাঁর আরো রসদের আশ্বাস প্রয়োজন। সে সেইসাথে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের জলাভূমি অঞ্চলে বসবাসকারী বর্বর উপজাতিগুলি তার পেছনে বিদ্রোহ করে বসতে পারে সেই ঝুঁকির ভেতরেও রয়েছে। তাঁর তাই নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ মনে না হওয়া পর্যন্ত সে আগ্রা থেকে আমাদের ধাওয়া করে এখানে আসবে না, তার মানে এই দাঁড়ায় যে আমাদের হাতে সামান্য হলেও খানিকটা সময় রয়েছে…যদি সত্যি সত্যি এটাই তার ইচ্ছা হয়ে থাকে এবং এটা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। এই সময়টায় আমাদের অবশ্যই নিজেদের বাহিনীর জন্য নতুন সৈন্য সংগ্রহ করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে কাবুলের প্রশাসকের কাছে বাড়তি লোকবল প্রেরণের জন্য দূত পাঠিয়েছি। তারা একবার পৌঁছে গেলে, আমাদের অবস্থান তখন অনেকবেশী শক্তিশালী হবে আর আমাদের তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক বেশী স্বাধীনতা থাকবে।

আমরা কি এইসব নতুন সৈন্যদের বেতন দিতে পারবো? আসকারি জিজ্ঞেস করে তার ছোট ছোট কালো চোখের মনিতে একাগ্রতা স্পষ্ট। নাকি আমরা আশা করি যে তাঁরা আমাদের পক্ষে লড়াই করবে কেবল লুটের মালের প্রতিশ্রুতির কারণে?

আমাদের কাছে যথেষ্ট তহবিল আছে- আগ্রা এবং সেই সাথে দিল্লীর রাজকোষ থেকে প্রাপ্ত, কাশিম উত্তর দেয়।

এবং তাঁরা এসে পৌঁছাবার আগে…? কামরান জানতে চায়।

আমরা সেই সময়ে লাহোরকে শক্তিশালী আর রসদের পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করবো, হুমায়ুন বলে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে শহরটায় কোনো প্রতিরক্ষা দেয়াল নেই কিন্তু উত্তরে রাভি নদী আমাদের নিরাপত্তা দেবে এবং আমরা পশ্চিম, দক্ষিণ আর পূর্বদিকে প্রতিরক্ষা পরিখা খনন করে সেখানে আমাদের কামান এবং তবকিদের মোতায়েন করতে পারি। রাজপ্রাসাদটা বেশ মজবুত করে নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন সৈন্যের আগমনের জন্য অপেক্ষা করার সময়ে আমরা কিছু সময়ের জন্য শহরটাকে রক্ষা করতে পারবো।

কামরানের সবুজ চোখ পিট পিট করে কিন্তু সে কিছু বলা থেকে বিরত থাকে।

মহামান্য যুবরাজবৃন্দ, আপনারা প্রত্যেকে নিজেদের সাথে কতজন সৈন্যের বাহিনী নিয়ে এসেছেন? কাশিম তাঁর উঁত কাঠের প্রচ্ছদযুক্ত খেরো খাতাটা খুলে যেখানে হুমায়ুনের যতদূর মনে পড়ে তার উজির গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপার লিখে রাখে। কাশিম নিজের গলায় একটা মালা থেকে ঝুলতে থাকা ছোট জেড পাথরের দোয়াতদানির মুখটা খুলে এবং সেটায় নিজের ব্যবহৃত লেখনী ডুবিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

আমার সাথে পাঁচ হাজার অশ্বারোহীর একটা বাহিনী আছে, যাদের ভিতরে এক হাজার হল অশ্বারোহী তীরন্দাজ, আসকারি বলে, এবং সেই সাথে অতিরিক্ত পাঁচশ ঘোড়ার পাল।

আমার বাহিনীতে তিন হাজার অশ্বারোহী আর পাঁচশ পদাতিক সৈন্য রয়েছে, হিন্দাল বলে। সবাই দক্ষ যোদ্ধা।

তারা সবাই কামরানের দিকে একসাথে তাকায়। আমার সাথে কেবল দুই হাজার অশ্বারোহীর একটা বাহিনী রয়েছে। আর তাছাড়া, তুমিইতো আমাকে কয়েক সপ্তাহ পূর্বে কখনও আক্রমণের সম্মুখীন হলে আমার প্রদেশকে প্রতিরক্ষাহীন অবস্থায় ফেরে রাখার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলে… তার কণ্ঠস্বর সহ্য করাটাই হুমায়ুনের জন্য জুলুম হয়ে দাঁড়ায়-কামরানের প্রদেশ সবচেয়ে বড় আর সবার চেয়ে সমৃদ্ধ এবং শেরশাহের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত আর নিজের প্রদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে না ফেলে সে অনায়াসে দুই হাজারের অনেক বেশী সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারতো, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করেন। কিছুক্ষণের জন্য কেবল কাশিমের লেখনীর খসখস আওয়াজ শোনা যায়, তারপরে উজির লেখা শেষ করে মুখ তুলে তাকান। বেশ, মহামান্য যুবরাজবৃন্দ, এইসব অতিরিক্ত লোক এসে যোগ দেয়ায় আমাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা নব্বই হাজারে উন্নীত হয়েছে।

তাদের এখানে আটকে রাখার জন্য আমাদের সব রকমের চেষ্টা করতে হবে আমি চাই না তারা বাসায় যাবার জন্য গায়েব হতে শুরু করুক…হুমায়ুন বলে।

সেটা এড়াবার একমাত্র পথ হল তাঁদের শীঘ্রই যুদ্ধ আর লুটের মাল লাভের প্রশ্রুিতি দেয়া। লাহোরে রাজকোষ আর রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরে আমাদের এখন উচিত পুনরায় শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা তাঁকে চমকে দিয়ে…কামরান উত্তর দেয়।

হ্যাঁ, আসকারিও ব্যথভাবে সায় দেয়। কামরান ঠিকই বলেছে। সেটাই কি শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত হবে না?

সেটা হবে একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত, হুমায়ুন উত্তর দেয়। তোমরা ভুলে গেছো আমাদের বাহিনীর চেয়ে কত বিশাল তার সৈন্যসংখ্যা। চূড়ান্ত বিজয়ের সামান্যতম সম্ভাবনার জন্য আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সাথে একটা যুগলবন্দি দরকার হবে। সেটা করতে গেলে আমাদের অগ্রসর হবার গতি হ্রাস পাবে আর সেই সাথে আমাদের অগ্রসর হবার খবর তার কাছে পৌঁছাবার জন্য সময়ের একটা ব্যাপার আছে। কামরান, আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। দিল্লী কিংবা আগ্রায় শেরশাহের হাতে নিজেকে অবরুদ্ধ হতে না দিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করায় তুমি আমার সমালোচনা করেছে কিন্তু এখন আমি যখন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য লাহোরকে সুরক্ষিত করতে চাইছি, তুমি আমাকে অনুরোধ করছে তার বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করতে…

পরিস্থিতিগুলো ভিন্ন। কিন্তু মোদ্দা কথা একটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তোমার প্রয়োজন নেই। তুমি সেটা চাও না। তুমি কেবল তোমার নিজেরটা আমাদের বলতে চাও, কামরান নিজের চোখে মুখে একটা মনখারাপ করা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে বলে। আমি আর বেশী কিছু বলতে চাই না।

হুমায়ুন তাঁর নানাজানের চোখে হুশিয়ারী দৃষ্টি খেয়াল করে, এই দফা সে কামরানের দ্বারা তাকে প্ররোচিত করার প্রলোভন বহুকষ্টে দমন করে। সে বরং হিন্দাল আর আসকারির দিকে ঘুরে তাকায়। কামরান ভুল করছে। আমি সত্যিই তোমাদের ভাবনা জানতে আগ্রহী। তাঁরা চুপ করে থাকে, তাদের বড়ভাইদের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা সম্ভবত তাঁদের সংযত করে তুলেছে। হুমায়ুনের ভিতরে হতাশার সাথে অনুশোচনার ক্ষরণ শুরু হয়। এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অতীতের সবকিছু ভুলে যাবার জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার নিকট স্বজন, তার সৎ-ভাইয়েরা মনে হয় না সেরকম কিছু করতে ইচ্ছুক।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অবশ্য হিন্দা কথা বলে। কাবুল থেকে বাড়তি লোকবল একবার এসে পৌঁছাবার পরে জাহিদ বেগ কি সব পছন্দের কথা বলছিলো। সেগুলো কি?

হুমায়ুন তার প্রশ্নের উত্তর দেয়। কম করে হলেও আমি পঞ্চাশ হাজার লোকের একটা বাহিনী প্রত্যাশা করছি। আমি তাঁদের কাছে আদেশ পাঠিয়েছি যে আমরা যদি ইতিমধ্যে এখানে অবরোধে সম্মুখীন হই তাহলে তারা অবরোধকারী বাহিনীকে পেছন থেকে এসে আক্রমণ করবে। আর তারা যদি শেরশাহ আগ্রা থেকে অগ্রসর হবার আগেই আমাদের সাথে এসে যোগ দেয়- আমি যেমন আশা করছি তখন শেরশাহের আগুয়ান বাহিনীর পার্শ্বদেশে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক লোক আমাদের সঙ্গে থাকবে। অধিক লোকবলের সুবিধা তাঁর থাকবে কিন্তু আমাদের পক্ষে থাকবে গতি আর ঘোড়সওয়ারীর কুশলতা যা আমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে সবসময়ে আমাদের দারুণ সহায়তা করেছে। কামরান তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, শেরশাহের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করার ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত- কেবল এই মুহূর্তে সেটা আমরা করতে পারছি না…।

কামরান কথা না বলে কেবল কাঁধ ঝাঁকায় এবং পুনরায় নিরবতা এসে বিরাজমান হয়। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়। শেরশাহের অভিপ্রায় সম্বন্ধে আর কাবুল থেকে আমাদের অতিরিক্ত বাহিনীর অগ্রসর হবার সংবাদ যখন আমাদের কাছে আরও বিশদভাবে থাকবে তখন আবার আমরা আলোচনার জন্য মিলিত হতে পারি। কিন্তু তার আগে আজ রাতে একটা ভোজসভার আয়োজন করলে কেমন হয় বহুদিন পরে আমরা আবার সবাই একত্রিত হয়েছি। বর্তমান বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও বাবরের ছেলেরা একতাবদ্ধ রয়েছে এসো দুনিয়াকে সেটা আমরা দেখিয়ে দেই।

হুমায়ুন করিডোর দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের আবাসন কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময় মহিলাদের কক্ষে যাবার দরজা সে পার হয়ে আসে। সেখানে ভেতরে কোথাও গুলরুখের থাকার কথা তাঁকে বলা হয়েছে কামরানের সাথে সে লাহোরে এসেছে। হুমায়ুন তাঁকে তাঁর দরবারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার পরে সঙ্গত কারণেই তিনি তাঁর বড় ছেলে, উচ্চাকাঙ্খি কামরানের সাথে থাকাটাই বেছে নিয়েছেন। মহিলা কি কোনোভাবে তাঁর ছেলেদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছে এবং সেটা যদি হয়ে থাকে, কিভাবে? এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। হুমায়ুন মুহূর্তের জন্য চিন্তা করে তার সৎ-ভাইদের পুনরায় একত্রিত করাটা তার ঠিক হয়েছে কিনা। তাঁদের চারজনের ভিতরে সত্যিকারের বিশ্বাস, সত্যিকারের একতাবোধ কখনও জন্ম নেবে এমন চিন্তা করাটা হয়ত বোকামী হবে- আকাঙ্খ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবসময়ে মাথা চাড়া দেবে। আর এজন্য কি সে তাঁদের দোষ দিতে পারে? তাঁদের অবস্থানে থাকলে যে ভাই উত্তরাধিকার সূত্রে সবকিছু পেয়েছে তাঁর প্রতি কি সে ক্ষোভ অনুভব করতো না? তাঁকে তাঁদের সবাইকে বিশেষ করে কামরানকে-চোখে চোখে রাখতে হবে এবং অবাধ্যতার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘরের বাইরে যখন শত্রু কড়া নাড়ছে তখন ঘরের ভেতরের শত্রুকে সে কোনমতেই বরদাশত করবে না।

হুমায়ুনের হঠাৎ সালিমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা হয়। তাঁর উষ্ণ, ঐকান্তিক আলিঙ্গনে দৈহিক সুখে উদ্বেলিত হয়ে সে অস্বস্তিকর ভাবনাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পাবে। তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠে এবং তাঁর হাটার গতি সহসা বেড়ে যায়।

*

সুলতান, শেরশাহের অগ্রবর্তী বাহিনী আগ্রা থেকে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। হুমায়ুনের বিশৃঙ্খল স্বপ্নের রেশ জওহরের কণ্ঠস্বরে ভেঙে যায়। সে কষ্ট করে ঘুমের রেশ কাটিয়ে সজাগ হবার মাঝে জওহরের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা তার ডানহাতে ধরা মোমের দপদপ করতে থাকা আলোক রশ্মির মাঝে উদ্ভাসিত দেখতে পায়। আহমেদ খান, এখনই আপনার সাথে দেখা করতে চায়। সে এমনকি ভোরের আলো ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি হয়নি। তাঁর গুপ্তদূতদের একজন তার সাথেই রয়েছে। গত ছয় দিন লোকটা পথেই ছিল এবং এখনই ফিরে এসেছে।

হুমায়ুন উঠে বসে, তার বিছানার পাশে একটা কাঠের পাদানির উপরে রাখা পিতলের পাত্রে রক্ষিত পানি দিয়ে মুখে ঝাপটা দেয় এবং একটা সবুজ আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে নেয়। কয়েক মিনিট পরে, আহমেদ খান আর পথের ধকলের ফলে ক্লান্তিতে টলতে থাকা গুপ্তদূতকে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

তুমি নিশ্চিত শেরশাহ পুনরায় সামনের দিকে এগিয়ে আসছে?

জ্বি,সুলতান। আমার গুপ্তদূতের বক্তব্য আপনি নিজের কানেই শোনেন।

গুপ্তদূত কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে আসে। আমি এর উপরে আমার জীবন বাজি রাখতে পারি। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি আর নিজের কানে যা শুনেছি সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছি এবং কেবল তারপরেই আমি লাহোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি, পথে ঘোড়া পরিবর্তন করার জন্য আমি কেবল দেরী হয়েছে।

কতজন সৈন্যের বাহিনী?

সেটা গণনা করাটা একটু কঠিন কিন্তু চলার পথে তারা যে পরিমাণ ধূলো উড়াচ্ছে, বেশ কয়েক হাজার অশ্বারোহী হবে, সুলতান।

আর শেরশাহর নিজের কি খবর?

আমি যা শুনেছি সে অনুযায়ী তিনি এখনও আগ্রায় অবস্থান করছেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি নিজেও যাত্রা করবেন, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত। আমি রওয়ানা হবার ঠিক আগ মুহূর্তে, আগ্রা দূর্গের নীচে নদীর তীরে মালবাহী একটা বিরাট বহরকে সেখানে অবস্থান করতে দেখেছি- ভারবাহী খচ্চর, ষাড় আর উটের কোনো সীমা সংখ্যা নেই আর সেই সাথে রয়েছে কয়েকশ হাতি। মালবাহী শকটে বেগুনী রঙের আচ্ছাদনযুক্ত শেরশাহের নিজস্ব তাবু ভাঁজ করা অবস্থায় তুলতে দেখেছি। গুপ্তদূত নিজের দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করায় এখন তাঁর নোংরা, টানটান মুখটা দৃশ্যত স্বাভাবিক হয়ে উঠে।

সে বিদায় নেয়া মাত্র, হুমায়ুন তাঁর নীচু টেবিলের সামনে আসনপিড়ি হয়ে বসে। তার ভাইদের সাথে আরো আলোচনা করে কোনো লাভ হবে না। গত কয়েক দিন ধরে, আসকারি আর হিন্দাল তাদের বড় ভাইদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুনতেই বেশী পছন্দ করেছে, নিজেরা গঠনমূলক কোনো পরামর্শ না দিয়ে। শেরশাহের সাথে যুদ্ধযাত্রার পক্ষে কামরান এখনও তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে এবং হুমায়ুন দৃঢ়তার সাথে সেটা নাকচ করে বলছে যে আরো অনেক বেশী যোদ্ধা সমবেত করা ছাড়া এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং সেই সাথে কামরানকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সে নিজে ইতিমধ্যে দুবার শেরশাহের সাথে দুটো বিশাল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরাজিত হয়েছে। তার শত্রু শেষবারের যুদ্ধের পর আরও অনেকবেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যখন সে নিজে আরও দুর্বল হয়েছে। আরেকটা সম্মুখ সমরের সুযোগ সন্ধান করার সময় এটা না।

গত কয়েকদিন ধরে এসব আলোচনার সময়ে, তার আব্বাজানের রোজনামচায় একবার পড়েছিল এমন একটা বিষয় হুমায়ুনের বারবার মনে হতে থাকে। অস্ত্রের বলে যদি তুমি তোমার শত্রুকে পরাজিত করতে না পার, হতাশ হয়ো না। অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের কর। তেল দেয়া, ধারালো, দো-ধারি রণকুঠার নিঃসন্দেহে একটা দারুন অস্ত্র কিন্তু সেই সাথে বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক নিজেও একটা অস্ত্র যা বিজয়ের সুবেদী পথ খুঁজে বের করতে পারে…

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে, হুমায়ুন লিখতে শুরু করে। শেরশাহ, তুমি হিন্দুস্তান আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চাইছো যদিও তৈমূরের অধস্তন পুরুষের রক্ত নিজের ধমনীতে ধারণ করার কারণে এটা আমার সাম্রাজ্য। আমার সাথে একলা দ্বৈরথে অবতীর্ণ হও এবং এসো আমরা এই বিরোধ চিরতরে মীমাংসা করি। কিন্তু তুমি যদি আমার সাথে দ্বৈরথে রাজি না হও, তাহলে এসো আমরা অন্তত আরো রক্তপাত পরিহার করতে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে নিজেদের ভিতরের মতপার্থক্য সমাধানের জন্য ভিন্ন কোনো পথের সন্ধান করি।

গালার একটা কালচে লাল রঙের দণ্ড নিয়ে হুমায়ুন সেটা জ্বলন্ত মোমের শিখার উপরে ধরে এবং তাকিয়ে দেখে গালাটা নরম হয়, তারপরে রক্তের ফোঁটার মতো ফোঁটা ফোঁটা লালচে গালা ঝরতে শুরু করে। দণ্ডটা আগুন থেকে বের করে এনে সে চিঠির নীচে সেটা ধরে থাকে যতক্ষণ না সেখানে গালার একটা ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা হয়। তারপরে ডানহাত উল্টো করে সে তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয় শক্ত করে গালার উপরে চেপে ধরে গর্জনরত ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের একটা নিখুঁত প্রতিকৃতি সেখানে সৃষ্টি করে।

এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে আহমেদ খানের দুজন লোক শেরশাহকে খুঁজে বের করে তাঁর চিঠিটা তাঁকে পৌঁছে দেবার জন্য লাহোর থেকে পুত বেগে ঘোড়া হাকিয়ে রওয়ানা হয়েছে। শেরশাহ কখনও ব্যক্তিগত দ্বৈরথে রাজি হবে না- কেবল আহাম্মকরাই এই ধরনের আহ্বানে সাড়া দিবে কিন্তু যুদ্ধবিরতির ধারণা তাঁকে হয়তো প্ররোচিত করতে পারে। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রচারিত কিছু গল্প সর্বজনস্বীকৃতভাবে যা গুজবের চেয়ে বেশী কিছু না- অনুসারে শেরশাহের কয়েকজন সেনাপতির ভিতরে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এইসব গল্পে যদি সত্যের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা থেকে থাকে, শেরশাহ তাহলে হয়তো নিজের কর্তৃত্ব পুর্নপ্রতিষ্ঠায় নিজেকে সাহায্য করতে যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব স্বাগত জানাবে। সেটা যদি হয়, তাহলে হুমায়ুনও কিছুটা সময় পাবে। কাবুল থেকে তাঁর ডেকে পাঠান সৈন্যের পৌঁছাবার এখনও কোনো লক্ষণ নেই এবং সম্ভবত আগামী কয়েক সপ্তাহের আগে তারা এসে পৌঁছাবে না। শেরশাহের যতদিন বিলম্ব হবে প্রতিটা দিন তাকে সাহায্য করবে…

সাতদিন পরে একটা অশুভ লক্ষণের ন্যায় শেরশাহ এখন লাহোরের কত নিকটে- হুমায়ুন তাঁর চিঠির উত্তর পায়। তার আবাসন কক্ষে সেটা কাশিম নিয়ে আসে। অবাক করার মতো ব্যাপার হল চিঠি দুটো একটা শেরশাহের মোটা অমার্জিত হাতে লেখা এবং তার মোহর অঙ্কিত আর অন্যটা চিঠিটা বাঁশের একটা চোঙ্গার ভেতরে মোড়ার অবস্থায় রাখা- কাশিমকে গুপ্তদূতেরা যা বলেছে সে অনুযায়ী চিঠিটা হুমায়ুনের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবার জন্য শেরশাহ অনুরোধ করেছে।

হুমায়ুন শেরশাহের চিঠিটা প্রথমে পড়ে। আমি হিন্দুস্তান জয় করেছি। যা ইতিমধ্যে আমার নিজের তাঁর জন্য আমি কেন আপনার সাথে লড়াই করবো? আমি কাবুল আপনাকে ছেড়ে দিলাম। সেখানে চলে যান। কিন্তু চিঠিতে আরো কিছু লেখা আছে: একটা সাম্রাজ্য রক্ষার প্রত্যাশা আপনি কিভাবে করেন যখন আপনি আপনার নিজের পরিবারের আনুগত্য অর্জন করতে ব্যর্থ? আপনার সৎ-ভাই কামরান আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে ইচ্ছুক। কিন্তু আপনাদের মতো মোগলদের কাছ থেকে আমি কিছু চাই না কেবল তাঁদের ছিন্ন মস্তক যেখানে তাঁদের থাকার কথা সেই ধূলোতে গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখা ছাড়া। আমি আপনার ভাইয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে তাঁকে লিখে পাঠিয়েছি। ঠিক যেমন আমি আপনার প্রস্তাবও প্রত্যাখান করছি- এবং তাঁকে এটাও অভিহিত করেছি তাঁর প্রতারণার কথা আমি আপনাকে জানাব।

হুমায়ুন বাঁশের চোঙ্গাট নিয়ে ভেতর থেকে হলুদ পার্চমেন্টের টুকরো বের করে আনে। সেটাকে টেবিলের উপরে বিছানোর সাথে সাথে কামরানের সুচালো হাতের লেখা হুমায়ুন চিনতে পারে। এটা শেরশাহের কাছে তার লেখা চিঠি। আমার ভাই আমার জন্মগত অধিকার থেকে আমায় বঞ্চিত করেছে, ক্রোধে কাঁপতে থাকা কণ্ঠে সে উচ্চস্বরে চিঠিটা পড়ে। শেরশাহ, আপনি যদি পাঞ্জাব আর কাবুলসহ উত্তরের মোগল ভূখণ্ড শাসনের জন্য আমাকে ছেড়ে দেন, আমি হুমায়ুনকে আপনার হাতে তুলে দেব বা যদি আপনি চান- আমি শপথ করে বলছি, আমি নিজের হাতে তাকে হত্যা করবো।

কাশিম মাটি থেকে কামরানের চিঠিটা তুলে নেয় যেখানে হুমায়ুন সেটা ছুঁড়ে ফেলেছে এবং পুনরায় সেটা পড়ে, কামরানের উদ্ধত, রক্তলোলুপ শব্দগুলো পাঠ করার সময় সংক্ষোভে তার চোখ মুখ কুচকে যায়। হুমায়ুন নিজে দরজার কাছে হেঁটে যায় এবং এক ধাক্কায় পাল্লা খুলে চিৎকার করে, প্রহরী, আমার ভাই কামরানকে এখনই আমার কাছে নিয়ে এসো। সে যদি বাধা দেয়, শক্তির দ্বারা পরাভূত করবে এবং বেঁধে নিয়ে আসবে। সে সন্দেহ করেছিল তার ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে হয়ত চক্রান্ত করতে পারে কিন্তু তাঁদের একজন এতটাই বিবেচনাহীন হতে পারে যে রাজবংশের কাছে সে ঋণী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে গিয়ে সেটাকেই একজন বহিরাগতের কাছে বলি দিতে চাইছে। হুমায়ুন উদ্বিগ্ন আর নিরব কাশিমের সামনে নিজের কক্ষে পায়চারি করতে থাকে, যতক্ষণ না প্রহরীদের একজন ফিরে আসে।

সুলতান, তাকে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি। আমরা প্রথমে তার আবাসন কক্ষে যাই কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না। তারপরে আমরা পুরো দূর্গটা খুঁজে দেখি আমরা এমনকি জেনানা মহলে লোক পাঠিয়েছিলাম খুঁজে দেখতে, তাঁর আম্মিজান মহামান্য রাজমাতা গুলরুখের সাথে হয়তো তিনি আছেন, কিন্তু তার আম্মিজানও সেখানে ছিলেন না…

হুমায়ুন আর কাশিম পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। প্রধান তোরণদ্বারের পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত আধিকারিককে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও- দ্রুত, পা চালাও!

কয়েক মিনিটের ভিতরে হুমায়ুনের সামনে সন্ত্রস্ত দর্শন এক আধিকারিককে নিয়ে আসা হয়।

আজ সারাদিনে আমার কোনো ভাইকে তুমি দেখেছো?

জ্বী, সুলতান। আজ সকালে শাহজাদা কামরান আর শাহজাদা আসকারি ঘোড়ায় চড়ে বের হয়েছেন। তারা এখনও ফিরে আসেননি…

আর তাঁদের আম্মিজান গুলরুখ আর তাঁর পরিচারিক?

একটা পালকিতে করে তারাও প্রাসাদ ত্যাগ করেছে। বেগম সাহিবা বলেছেন তাঁর বোন, লাহোরের প্রধান কোষাধ্যক্ষের স্ত্রীর সাথে তিনি, শহরের উত্তরে তার হাভেলীতে দেখা করতে চান।

হুমায়ুন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গালিগালাজ করে উঠে। কোনো সন্দেহ নেই মহিলা এতোক্ষণে তার ছেলেরা এবং তাদের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং এই মুহূর্তে তারা সবাই ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে তার নাগালের বাইরে যেতে। সে আরেকটু হলেই তাদের পিছু ধাওয়া করার আদেশ দিত কিন্তু মুশকিল হল শেরশাহও চায় সে ঠিক সেটাই করুক। তাঁর শত্রু দারুণ এক চাল দিয়েছে, একদিকে সে হুমায়ুনের হাতে তার ভাইয়ের শঠতার প্রমাণ তুলে দিয়েছে আর অন্যদিকে কামরানকেও পালাবার কারণ আর সময় দিয়েছে। কিন্তু সে শেরশাহের হুমকি অবহেলা করে তাঁর জন্য এত চতুরতার সাথে পাতা ফাঁদে পা দেবে না এবং এখনই কামরান আর আসকারির পিছু নিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইদের যুদ্ধের সূত্রপাত করবে না।

প্রতিশোধের সময় পরেও পাওয়া যাবে।

২.৫ পলায়নের সূত্রপাত

১০. পলায়নের সূত্রপাত

হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার পর্যানে উপবিষ্ট অবস্থায় কোমড় মোচড়ায়। সে ছত্রিশ ঘন্টা আগে শেরশাহের হাতে লাহোর তুলে দিয়ে এসেছে। তার পেছনে তার বাহিনীর অবশিষ্ট লোকেরা, মাত্র হাজার পনের হবে তারা সংখ্যায়, ভাসতে ভাসতে চলেছে বেশীর ভাগই পালিয়েছে। তাঁদের পেছনে গরম ধূলোর ভিতরে প্রায় দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে বেপরোয়া মানুষের কয়েক মাইল দীর্ঘ একটা স্রোত বিশৃঙ্খল অবস্থায়, গাধা, খচ্চর আর মালবাহী শকটে তাঁদের সমুদয় সহায়সম্পদ হাল-বাণ্ডুল করে বোঝাই করে এগিয়ে আসছে।

ভ্রমণ-ক্লান্ত বণিকদের একটা দল মাত্র চারদিন আগে ঘোড়ার মুখে ফেনা তুলে ছুটতে ছুটতে লাহোরে প্রবেশ করে তাঁরা এতোটাই আতঙ্কিত যে নিজেদের মালবোঝাই খচ্চরের বহর পথের ধারেই পরিত্যাগ করে এসেছে- সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে থাকে যে শেরশাহ শহরের অধিবাসীদের হত্যা করার হুমকি দিয়েছেন। কয়েক ঘন্টা পরে, শেরশাহের কাছ থেকে এক বার্তাবাহক এসে উপস্থিত হয়। তাঁর বহন করে আনা চিঠিটার ভাষা এবং বক্তব্য একেবারে সরল আর স্পষ্ট। শেরশাহ সত্যি সত্যি শহরটা ধ্বংস করে এখানকার অধিবাসীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু সেটা কেবল হুমায়ুন যদি শহর ত্যাগ করতে অস্বীকার করে।

লাহোর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত ঠিক যেমন সে আগ্রা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল চূড়ান্ত অপমানজনক। কিন্তু শেরশাহের অধীনে বিশাল একটা বাহিনী রয়েছে যা- হুমায়ুনের কাছে যেসব খবর এসেছে তা যদি সত্যি হয় এবং সেগুলোকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই- তাঁর নিজের বাহিনীর চেয়ে প্রায় বিশগুন বড় সম্ভবত এরচেয়েও বেশী। দূর্গকরণের আর পরিখা খননের আদেশ দেয়া সত্ত্বেও, শহরে কোনো প্রতিরক্ষা দেয়াল থাকায় এতো বিশাল একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে লাহোরকে রক্ষা করার কোনো প্রচেষ্টা অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনবে, এমনকি যদি সে কাবুল থেকে যে বাহিনী আসতে বলেছে তারা সময়মতো এসে পৌঁছালেও।

হুমায়ুন বিষয়টা কয়েক ঘন্টা বিবেচনা করেই, তাঁর সেনাপতিদের লাহোর পরিত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিতে আদেশ দেয়। শহর পরিত্যাগের খবরটা জানাজানি হতেই, শহরের বাসিন্দারা বিশ্বাস করতে চায় না যে হুমায়ুন চলে যাবার পরে শেরশাহ তাঁদের রেহাই দেবার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা রক্ষা করবেন। পুরো শহরে দ্রুত একটা অনিয়ন্ত্রিত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নগরদূর্গের একটা পাথরের গম্বুজ থেকে, হুমায়ুন শহরের বাড়িঘর থেকে, বুকের কাছে কাপড়ের পুটলির ভেতরে নিজেদের মূল্যবান সামগ্রী বেধে নিয়ে, উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে, মানুষজনকে পিলপিল করে বের হয়ে আসতে দেখে। কয়েকজনকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে পিঠে বহন করতে দেখা যায়। শহরের সংকীর্ণ সড়কে অচিরেই হাতে টানা ঠেলাগাড়ি আর টলতে থাকা ভারবাহী পশুত্র শকটের একটা ভীড় জমে উঠে। শহরের সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে নিজেদের বিচারবুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে উন্মত্ত আর অপদার্থ জনস্রোতে পরিণত হয়েছে, পালিয়ে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করার জন্য যারা বেপরোয়া। দোকানে লুটপাট শুরু হয় এবং দুর্বলদের ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং অনেকেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে মানুষের পায়ের নীচে পিষে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা প্রলয়কাণ্ডে পৃথিবীর ধ্বংস হওয়া প্রত্যক্ষ করার মতো মনে হয়।

রাজপ্রাসাদের কাছে বিশাল কুচকাওয়াজের ময়দান থেকে যেখানে, বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এসে শহরের লোকদের কানে অনুরণিত হতে থাকলে আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে, হুমায়ুনের আদেশে তাঁর বাহিনীর সবচেয়ে বড় ব্রোঞ্জের কামানগুলো, যেগুলো সাথে করে নিয়ে যাওয়া পরিশ্রমসাধ্য আর যা অগ্রসর হবার গতি মন্থর করে দেবে, ধ্বংস করা হচ্ছে। কামানগুলো ষাড়ের দল প্রাণপন শক্তিতে কোনোমতে টেনে খোলা ময়দানে নিয়ে আসে যেখানে হুমায়ুনের গোলন্দাজ বাহিনীর লোকেরা, তাদের দেহের নগ্ন উপরিভাগ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে, দ্রুত কামানের নল বারুদ দিয়ে পূর্ণ। করছে এবং তুলার লম্বা পলিতা যুক্ত করার পরে- সেটায় অগ্নি সংযোগ করতে, বিকট বিস্ফোরনে উত্তপ্ত, দোমড়ানো, ধাতব খণ্ড বাতাসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।

নিজের ভাবনাকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে, হুমায়ুন আড়চোখে তার বামপাশে একটা বিশাল সাদা স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট হিন্দালের শক্তিশালী অবয়বের দিকে তাকায়, সে নিজের ক্ষুদ্র বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। শেরশাহের বার্তার বিষয়বস্তু শোনার সাথে সাথে হিন্দাল হুমায়ুনকে খুঁজে বের করে এবং তাদের পিতার নামে শপথ করে বলে যে কামরান আর আসকারির আনুগত্য পরিহারের বিষয়ে সে বিন্দুবিসর্গও জানতো না। হিন্দাল ছোট থেকে নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারে

এবং নিজের এই খুদে সৎ-ভাইটির মুখাবয়বে ফুটে উঠা সংক্ষোভ আর কামরান এবং আসকারির এহেন অপকর্মের প্রতি অবিশ্বাস দেখতে পেয়ে হুমায়ুন তাঁর কথা বিশ্বাস করে। পরে, ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে সে বুঝেছে তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি ভুল করেনি। অন্যথায়, হিন্দাল কেন লাহোরে থেকে গিয়ে শাস্তির ঝুঁকি নেবে? আর তাছাড়া, কামরান আর আসকারি আপন ভাই। হিন্দাল- হুমায়ুনের মতো তাঁদের কেবল সৎ-ভাই, আর সেজন্য রক্ত ও সম্মানের বন্ধনটাও অনেক দুর্বল। হুমায়ুন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে যেন হিন্দাল মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায় আর আলতো করে হাসে। হুমায়ুন ভাবে, হিন্দাল তার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ভালোই হয়েছে। সম্ভবত তাঁদের রাজবংশের বর্তমান বিপদের সময়ে বাবরের সন্তানদের অন্তত দুজন নিজেদের ভিতরে স্থায়ী একটা বন্ধন সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং সেটা থেকে শক্তি লাভ করেছে।

হুমায়ুন তার দ্রুত এগিয়ে আসা শত্রুর সামনে লাহোর পরিত্যাগের আগে সেখানে তাঁদের অবস্থানের একেবারে শেষ মুহূর্তে, সে বাইসানগারকে আলিঙ্গন করে এবং তাকে বিদায় জানায়, সম্ভবত এই শেষবার। তার নানাজানের কাছ থেকে পৃথক হওয়াটা একটা কঠিন কাজ আর তারচেয়েও কঠিন বুড়ো মানুষটাকে রাজি করান যে তাঁর উচিত একদল সৈন্য নিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে হুমায়ুনের জন্য কাবুলকে আগলে রাখা। হুমায়ুন তাকে বারবার যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে যে কামরান আর আসকারি তার ভাগ্য বিপর্যয়ের সুযোগ গ্রহণ করে সেখানের রাজত্ব দখল করার চেষ্টা করতে পারে, সেজন্য সেখানে তার মনোনীত শাসকের উপরে সে আর আস্থা রাখতে পারছে না যে বাড়তি সৈন্য পাঠাতে আগেই অনেক কালক্ষেপন করেছে এবং বাইসানগার মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন লোকের অন্যতম তার জন্য কাবুল আগলে রাখবে বলে তাঁর অবিচল আস্থা রয়েছে।

কথাটা সত্যি কিন্তু এরসাথে আরো একটা কারণও রয়েছে যেজন্য হুমায়ুন চেয়েছে যে তার নানাজান উত্তর দিকে এগিয়ে যাক, যদিও বাইসানগারের কাছে সেটা সে স্বীকার করবে না। যোদ্ধার সত্ত্বা এখনও যদিও তাঁর মাঝে বিদ্যমান এবং তার মস্তিষ্ক এখনও পরিষ্কার, তারপরেও লোকটার বয়স হয়েছে- আশি বছর এমনকি কাশিমের চেয়েও তার বয়স বেশী আর দ্রুত তার শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। হুমায়ুনের সঙ্গী হিসাবে, সে যে দীর্ঘ আর বিপজ্জনক যাত্রায় রওয়ানা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে: রাভি আর সিন্ধু নদের ভাটিতে ছয়শ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে সিন্ধ অভিমুখে, তিনি তাঁর স্বল্প শারীরিক শক্তির নিঃশেষ না করে কাবুলে অনেকবেশী কার্যকর আর নিরাপদে থাকবেন। সিন্ধের সুলতান, মির্জা হুসেন, হুমায়ুনের রক্তসম্পকের আত্মীয়- তাঁর আম্মিজান ছিলেন বাবরের আত্মীয়সম্পর্কিত বোন হুমায়ুনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সে তাই নৈতিকভাবে দায়ী। কিন্তু তার সৎ-ভাইদের চেয়ে, যাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক অনেকবেশী গাঢ়, মির্জা হুসেনের কাছে এই নৈতিকতা ঠিক কতখানি মূল্য বহন করে?

বাইসানগার, একটা পর্যায়ে, হুমায়ুনের যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে, তাঁর কথায় রাজি হন। অবশ্য খানজাদা আর গুলবদনকে এতো সহজে রাজি করান সম্ভব হয় না এবং এই যাত্রায় হুমায়ুনকে তাঁদের কাছে পরাভব মানতে হয়। তাঁর ফুপিজান আর সৎ-বোন সরাসরি বাইসানগারের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। আমার নিজের নিয়তি নির্ধারণের অধিকার আমি অর্জন করেছি, মৃদু কিন্তু দৃঢ়ভাবে খানজাদা বলেন। সাইবানি খানের হারেমে আমি যতবছর নিগৃহিত হয়েছি, ততবছর আমি। নিজেকে কেবল একটা কথাই বলেছি, আমি যদি এই দুরাবস্থা সামলে নিতে পারি তাহলে আমি আর কখনও নিজের ভাগ্য, নিজের জীবনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাব না যদি কেবল মৃত্যুই একমাত্র বিকল্প হয়। প্রিয় ভাস্তে, আমি তোমার সাথে যাবার নিয়তিই বেছে নিয়েছি। এই কথোপকথনের পুরোটা সময় গুলবদন চুপ করে থাকে কিন্তু হুমায়ুন ঠিকই খেয়াল করে পুরোটা সময় সে কি দৃঢ়ভাবে খানজাদার হাত আকড়ে রয়েছে এবং তাঁর অভিব্যক্তিতে কেমন দৃঢ় একটা সংকল্প ফুটে রয়েছে। খানজাদা যখন নিজের বক্তব্য শেষ করেন গুলবদনও হিন্দাল আর হুমায়ুনের সঙ্গী হবার জন্য নিজের অভিপ্রায়ের কথা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়।

হুমায়ুন মনে মনে কৃতজ্ঞবোধ করে তাঁরা তাঁর সাথে রয়েছে বলে। তাঁরা শক্তসমর্থ টাটুঘোড়ায় সওয়াড় হয়ে তার পাশে পাশে অবস্থান করে, তাদের নিজস্ব পরিচারিকারদল এবং তার আর হিন্দালের সেনাপতিদের কয়েকজনের জায়া আর কন্যারাও তাদের অনুসরণ করে, যাদের ভিতরে জাহিদ বেগের স্ত্রীও রয়েছে, তিনিও টাটুঘোড়ায় সওয়ার। গতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং যাতায়াতের জাঁকজমকপূর্ণ মাধ্যমের, সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে পালকি কিংবা হাওদার পর্দার পেছনে অবস্থানের, সময় এটা না। এসব সত্ত্বেও, মহিলাদের এই ক্ষুদ্র দলটাকে হুমায়ুনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর দল পাহারা দেয় এবং ভারী পোষাকের আড়ালে, চুল বেধে মাথায় আঁটসাঁট টুপি পরিহিত অবস্থায় উৎসুক দৃষ্টির কবল থেকে তাঁদের ভালোমতোই লুকিয়ে রাখা হয়। বাতাস আর ধূলো কবল থেকে রক্ষা করার জন্য মুখের অবগুণ্ঠনের উপরে কেবল তাদের চোখজোড়াই দৃশ্যমান থাকে।

আরও একজোড়া চোখ তাঁদের সাথে থাকবার কথা ছিল- ধুসর একজোড়া চোখ- হুমায়ুন ভাবে তাঁর আত্মাকে তুষ্ট করতে। লাহোর প্রাসাদ শেষবারের মতো ছেড়ে যাবার পূর্বে হুমায়ুন নতুন খোঁড়া কবরটা দ্রুত জিয়ারত করতে যায় যেখানে দুদিন আগে সালিমাকে দাফন করা হয়েছে। মেয়েটা নিশ্চিতভাবেই তার সাথেই আসতো- এ বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শহর ত্যাগ করতে শেরশাহের বেধে দেয়া চূড়ান্ত সময়ের খবরের সাথে সাথে চারপাশের দ্রুত বাড়তে থাকা গোলমালের ভিতরে মেয়েটা হঠাৎ একটা জ্বরের কবলে পড়ে যা সংক্রমনের মাত্র চব্বিশ ঘন্টার ভিতরে তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। হুমায়ুন যখন নিজের বিশাল হাতের থাবায় তাঁর ছোট্ট হাতের মুঠি আকড়ে ধরে তার ক্ষুদ্র দেহ থেকে প্রাণের শেষ স্পন্দনটুকু মিলিয়ে যেতে দেখে তখন কালঘামে জবজবে অবস্থায় সে চিত্তবৈকল্যের শেষ সময়গুলোতে সে কেবল তাকিয়ে ছিল, ঘোলাটে চোখের দৃষ্টিতে কোনো স্মৃতি ছিল না বা সে তাঁর চোখের অশ্রুও চিনতে পারেনি। মেয়েটার কথা তার বড্ড মনে পড়বে। গুলরুখের আফিম মিশ্রিত সুরা পানের অভ্যাস সে ত্যাগ করার পড়ে এবং শেরশাহের হাতে তাঁর পরাজয়ের পর থেকে আরও বেশী করে সালিমা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, মানসিক দ্বন্দ্ব, প্রাত্যহিক কর্তব্য আর দায়িত্ব থেকে তার শারীরিক প্রশান্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ নিমিত্ত হয়ে উঠেছিল।

মানুষের অস্তিত্বের নশ্বরতা নিয়ে ভাবনার কিংবা শোক প্রকাশের সময় এখন তার নেই। ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে যাবার সময় একটা প্রশ্নই বারবার হুমায়ুনকে জর্জরিত করেছে। লাহোর ত্যাগ করে কি সে ঠিক কাজটাই করেছে? উত্তরটা অবশ্য বারবার একই পেয়েছে। আসন্ন রক্তগঙ্গার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্বিচারে এতো হাজার হাজার নিরীহ নাগরিকদের হত্যা- শহরের উত্তরে রাভি মদীর উপরে স্থাপিত কাঠের সেতুর উপর দিয়ে তার বাহিনীকে পশ্চাদপসারণের আদেশ দেয়া তাঁর সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাঁর শেষ লোকটা নিরাপদে সেতু অতিক্রমের সাথে সাথে তাকে অনুসরনরত শেরশাহের বাহিনীর গতি খানিকটা হলেও বিঘ্ন করার লক্ষ্যে সে সেতুটা ধ্বংস করে দেয়। সেনাবাহিনীকে অনুসরনকারীরা যে যেভাবে পেরেছে, মাছ ধরার কিংবা নদী পারাপারের নৌকার সাহায্যে, নদী অতিক্রম করেছে।

কিন্তু হুমায়ুনকে ধাওয়া করার কোনো অভিপ্রায়ই শেরশাহ প্রকাশ করেনি, সে এক নাগাড়ে প্রায় দেড়দিন ঘোড়া দাবড়ে এখন লাহোর থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে। অতিক্রান্ত প্রতিটা মাইল আর ঘন্টার সাথে সাথে সে আরও বেশী মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে যে পুনরায় সংঘটিত হবার সময় সে পাবে। আরেকটা সুসংবাদ হল যে কামানগুলো সে সাথে করে নিয়ে আসতে পেরেছে- ষাড় দিয়ে টেনে রাভির তীরে নিয়ে এসে নিরাপদে সেগুলো ভেলায় তুলে দিয়ে হুমায়ুনের গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি আর তার সৈন্যদের অধীনে ভাটির উদ্দেশ্যে সেগুলো ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। লাহোর থেকে আড়াইশ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে মূলতানে, অবশিষ্ট বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য তাঁদের আদেশ দেয়া হয়েছে। সিন্ধের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রার সময় সৈন্যদের রসদ আর তাদের বেতন দেবার জন্য মোহর আর রত্নপাথরে বেশ ভালো রকমের সম্পদের সাথে সাথে গাদাবন্দুক, বারুদ আর সীসার গুলিও পর্যাপ্ত পরিমাণে তার সাথে রয়েছে। পরিস্থিতি সম্ভবত যতটা খারাপ বলে প্রতিয়মান হচ্ছে ততটা খারাপ না।

কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন ধুসর আকাশের দিকে তাকাতে হুমায়ুন কিছু মৃত অথবা মৃতপ্রায় জন্তুর উপরে নিঃশঙ্কচিত্তে বৃত্তাকারে দুটো শকুনকে উড়তে দেখে। পানিপথে মোগলদের মহান বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে সে ঈগলদের রণক্ষেত্রের উপরে চক্রাকারে উড়তে দেখেছিল। সম্ভ্রান্ত ঈগল থেকে নোংরা, অশুভ-বিবেচিত, গলিত শবদেহ গোগ্রাসে ভক্ষণকারী…তার সৌভাগ্য কিভাবে হ্রাস পেয়েছে এটা কি তারই একটা প্রতীক? হুমায়ুন তার পিঠে আড়াআড়ি ঝোলান চামড়ার গিল্টি করা তৃণ থেকে একটা তীর তুলে নিয়ে পর্যান থেকে তাঁর দুই বাঁকঅলা ধনুক খুলে নেয় এবং গরম বাতাসে মৃত্যু লেখা তীর ছুঁড়ে দেয়। নিক্ষিপ্ত তীর তার লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পায়। সে দ্রুত আরেকটা তীর তুলে এনে ব্যগ্র দৃষ্টিতে আকাশে তাঁর দ্বিতীয় লক্ষ্যটা খুঁজতে গিয়ে দেখে তাঁর মাথার উপরের আকাশ শূন্য খাঁ খাঁ করছে।

*

সুলতান, আমার গুপ্তদূতেরা এখান থেকে তিন কি চার মাইল দূরে একটা ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনীকে দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেছে, আহমেদ খান তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে ধরতে কথাগুলো জানায়।

আল্লাহ মেহেরবান, আমি যে বার্তাবাহককে মির্জা হুসেনের কাছে পাঠিয়েছিলাম এটা সে না হয়ে যায় না, একদল নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে এখন ফিরে আসছে। কিন্তু তারপরেও সাবধানের মার নেই, সেনাসারির অগ্রগতি মূলতবি রাখ এবং আমার লোকদের বলে দাও নিজেদের অবস্থানের চারপাশে একটা রক্ষণাত্মক ব্যুহ নির্মাণ করতে। কোষাগার আর জেনানাদের প্রহরায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন যেন করা হয়।

জ্বি, সুলতান।

ভাগ্য ভালো হলে, মূলতান থেকে দীর্ঘ ছয় সপ্তাহের দুর্গম যাত্রা, যেখানে সে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার গোলন্দাজবাহিনী আর কামানের সাথে মিলিত হয়েছে এবং তারপরে সিন্ধু নদের তীর বরাবর এগিয়ে এসেছে শীঘই শেষ হতে চলেছে এবং শেরশাহের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রত্যুপক্রম সূচনা করা যায় এবার সেটা সে পরিকল্পনা করতে পারবে। হুমায়ুন চোখ কুচকে পশ্চিমের দিগন্তের দিকে তাকায়, সেখানে অতিকায়, রক্তলাল সূর্যটা দ্রুত দিগন্তের ওপাশে বিলীন হচ্ছে। সে অচিরেই সামনের এলোমেলো পাথর আর খর্বকায় বৃক্ষরাজির মাঝে ধূলার একটা মেঘ সনাক্ত করতে পারে এবং তারপরে অশ্বারোহীদের সে দেখতে পায় তারা সংখ্যায় প্রায় ত্রিশজন হবে- একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছে, দিনের শেষ সূর্যের আলোয় তার মাথার ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণ ঝিকিয়ে উঠছে। অশ্বারোহী যোদ্ধার দলটা তাদের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে, দলটার ভিতরে প্রায় দুই সপ্তাহ পূর্বে মির্জা হুসেনের কাছে চিঠি নিয়ে যে পত্রবাহকে হুমায়ুন পাঠিয়েছিল আসলেই তাকে দেখতে পায়। নেতৃত্বদানকারী অশ্বারোহী তাঁর মাথার শিরোস্ত্রাণ খুলে, ঘোড়া থেকে নেমে এসে তাঁকে অভিবাদন জানায়।

মহামান্য সুলতান, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। সিন্ধের সুলতান, মির্জা হুসেন তার ভূখণ্ডে আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে। তিনি আপনার জন্য এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা অস্থায়ী সেনাছাউনিতে অপেক্ষা করছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে স্বাগত জানাবার সম্মান থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছেন কারণ তিনি চেয়েছেন আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার সব প্রস্তুতি তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করবেন। আমি তার দেহরক্ষীদলের সেনাপতি এবং আমার লোকেরা আপনার প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে এখান থেকে আপনাকে নিয়ে যাবে।

হুমায়ুন গাছের গাঢ় ছায়ার মাঝে অস্থায়ী ছাউনির মশালের কমলা রঙের আলো যখন দেখে ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মির্জা হুসেনকে সে বহু বছর আগে একবার দেখেছিল যখন তিনি কাবুল এসেছিলেন বাবরকে সম্মান প্রদর্শন করতে এবং তিনি দেখতে কেমন সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। অস্থায়ী ছাউনির ঠিক মধ্যখানে, দীর্ঘকায়, পিঠ টানটান করে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে এবং চমৎকার লাল আলখাল্লার সাথে মাথায় শক্ত করে বাঁধা সোনালী পাগড়ি পরিহিত লোকটা তার এক অর্থে তার কাছে একজন আগন্তুক।

স্বাগতম, সুলতান। আমার রাজ্যে আপনার আগমন আমাকে সম্মানিত করেছে।

আমার ভাই, আপনার আতিথিয়তা আমাদের একান্ত কাম্য। আমি আর আমার ভাই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

সৌজন্যতা প্রকাশের কৃত্যানুষ্ঠান বজায় থাকার মাঝেই হুমায়ুন ভাবে মির্জা হুসেন লোকটা সুদর্শন যদিও খানিকটা নাদুসনুদুস দেখেতে। নিজের দেহে মেদ জমতে দেবার আগে লোক্টা নিশ্চয়ই একজন ভালো যোদ্ধা ছিল। মির্জা হুসেন কিভাবে নিজের রাজ্যের সীমানা বাড়িয়েছেন এবং সেটাকে স্থায়ী করেছেন সেই বিষয়ে সে বাবরের গল্পগুলো মনে করতে চেষ্টা করে, এমনকি দক্ষিণে তার প্রতিবেশী বাহাদুর শাহের কাছ থেকেই তিনি ভূখণ্ড দখল করেছেন। গুজরাতে হুমায়ুন যখন লড়াই করছিল তখন মির্জা হুসেন সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে বার্তা প্রেরণ করলেও কোনো সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেননি। হুমায়ুনও অবশ্য তাঁর এই আত্মীয় সম্পর্কিত ভাইয়ের কাছে সাহায্য চেয়ে কোনো অনুরোধ করেনি। বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকার কারণে সে গুজরাতের প্রাচুর্যময় ধনসম্পদ প্রয়োজনের চেয়ে বেশী অন্য কারো সাথে ভাগ করতে আগ্রহী ছিল না।

সুলতান, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। আপনার বাসস্থানের কাছেই মেয়েদের থাকবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে এবং আপনার সৈন্যদের জন্য সারিবদ্ধভাবে তাবু তৈরী করা হয়েছে। আজ রাতটা আপনি অবশ্যই বিশ্রাম নিবেন। আপনার জন্য আমি খাবার তৈরী করতে বলে দিয়েছি। আজ থেকে তিনদিন পরে, সারকারে আমার প্রাসাদে আপনারা পৌঁছাবার পরে পুরনো দিনের কথা আমরা আলোচনা করবো।

হুমায়ুন নিজের মনে ভাবে, সেই সাথে ভবিষ্যতের কথাও। মির্জা হুসেনের সাহায্য তার দরকার অবশ্য যদি সে সাহায্য করতে রাজি হয়। কিন্তু তার পূর্বে অবশ্যই সৌজন্যতা প্রকাশ করতে হবে…

সেদিন সন্ধ্যাবেলা, নিজের তাবুতে রেশমের কারুকাজ করা গদিতে শুয়ে লাহোর ত্যাগ করার পরে প্রথমবারের মতো হুমায়ুন নিজের ভিতরে প্রশান্তির একটা পরশ অনুভব করে। সে তার পরিবার আর অবশিষ্ট সেনাবাহিনীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছে। আল্লাহ্ সহায় থাকলে, সে শীঘ্রই পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করবে।

*

ষাট ঘন্টা পরে গনগনে সূর্যের নীচে একপাশে হিন্দাল আর অন্যপাশে মির্জা হুসেনকে নিয়ে হুমায়ুন সরকারের দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করে, যেটা সাগর দেখা যায় এমন একটা উঁচু শৈলান্তরীপের উপরে চওড়া দেয়ালের অভ্যন্তরে অবস্থিত। মূল তোরণদ্বারের উপরে পরিষ্কার আকাশে দুটো নিশান পতপত করে উড়ছে- সিন্ধের টকটকে লাল আর তারপাশে মোগলদের উজ্জ্বল সবুজ। তোরণদ্বার থেকে একটা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু খাড়া একটা ঢাল অতিক্রম করে তবে, তিনপাশে আঙ্গিনাযুক্ত সোনালী পাথরের তৈরী প্রাসাদে পৌঁছান যায়।

প্রাসাদের পশ্চিম ভাগে মধ্যম তলার প্রায় পুরোটা জুড়ে বিলাসবহুল আবাসন কক্ষে নিজেকে থিতু করে, হুমায়ুন হিন্দাল আর কাশিমকে তার সাথে দেখা করতে বলে। নিজের পরিচারকদের, কেবল জওহর বাদে যাকে সে নিজের জীবন দিয়ে বিশ্বাস করে এবং এই মুহূর্তে যে দরজায় পাহারা দিচ্ছে, উৎসুক কানের উপস্থিতি ব্যতীত সে তাঁদের সাথে কিছু আলোচনা করতে ইচ্ছুক।

হুমায়ুন ইশারায় কাশিম আর হিন্দালকে আসন গ্রহণ করতে বলে। বৃদ্ধ উজির অনেক কষ্টে মেঝেতে উপবিষ্ট হন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর দুর্ভোগ তাদের মাশুল আদায় করে নিয়েছে। কাশিমকে আগের চেয়ে কৃশকায় দেখায় এবং আগের তুলনায় ঝুঁকে পড়েছেন। কথা শুরু করার আগে তাঁর বৃদ্ধ পরামর্শদাতা নিজেকে গুছিয়ে নেয়া পর্যন্ত হুমায়ুন অপেক্ষা করে। সৌজন্যতার খাতিরে আমি এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলিনি যদিও মির্জা হুসেন ভালো করেই জানেন আমি কেন এখানে এসেছি- যে শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমি তাঁর সাহায্য চাই। অবশ্য শীঘ্রই আমি বিষয়টা উত্থাপন করবো এবং সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই। কাশিম, তার আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের কাছ থেকে আপনি কি তার অভিপ্রায় বা ভাবনা সম্বন্ধে কিছু কি জানতে পেরেছেন?

তার মনে কি খেলা করছে আমি হয়তো সে সম্বন্ধে কিছু অবগত হতে পেরেছি… কাশিম সৌজন্য দেখিয়ে বলে। আপনি যদি একজন ভালো শ্রোতা হন তাহলে দেখবেন মানুষ নিজের অজান্তে অনেকবেশী কথা প্রকাশ করে থাকে…আমি শুনেছি যে আপনাকে স্বাগত জানাবার অনুরোধ জানিয়ে আপনি তাঁকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মির্জা হুসেন যখন সেটা প্রথম পড়ে, প্রচণ্ড ক্ষোভে সে চিঠিটা প্রথমে ছুঁড়ে ফেলেছিল। তার রাজ্যের সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী আর আরব থেকে আগত মাল বোঝাই ঢাউয়ে গিজগিজ করতে থাকা বন্দরকে কোনো ধরনের বিরোধের ভিতরে সে জড়াতে চায় না। তার মনে এমন ভয়ও রয়েছে যে আপনি হয়ত তার রাজ্যই কেড়ে নেবেন…

তাহলে সে আমাকে স্বাগত জানিয়ে এখানে কেন নিয়ে এলো? সে কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে পারতো, হিন্দাল প্রশ্ন করে।

হুমায়ুন একটা দুর্বোধ্য আওয়াজ করে। তার কিছু করারও ছিল না। সে আমাদের রক্ত সম্পর্কের ভাই এবং আমার মনে হয় তার কাছে এ বিষয়টার একটা পৃথক আবেদন রয়েছে। তাছাড়া, আমার সাম্প্রতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও আমি নিজের ভূখণ্ড উদ্ধারে আগ্রহী একজন সম্রাট এবং আমি যখন সেটা করবো, তাকে পুরস্কৃত করতে আর তার উচ্চাকাঙ্খাকে আরও বাড়িয়ে তোলার মতো অবস্থানে আমি থাকবো। মির্জা হুসেন এটা ভালো করেই জানে। আর তাছাড়া প্রকাশ্যে বিরোধিতার অভিপ্রায়ব্যতীত সে আমার মুখের উপরে না বলতে পারে না। কিন্তু তাঁর মনে আর হৃদয়ে যাই থাকুক, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ অবশ্যই আমাকে চিন্তা করতে হবে। গত তিনদিনে শেরশাহের বাহিনীর অগ্রগতির কোনো সংবাদ কি আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে?

না, সুলতান, কাশিম উত্তর দেয়। পর্যটক আর অন্যান্যদের কাছ থেকে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, সে এখনও লাহোর ছেড়ে এগিয়ে আসেনি।

আর কামরান এবং আসকারির কি খবর?

সুলতান, বর্তমানে তারা কোথায় রয়েছে সেটা কেউ বলতে পারছে না। কিছু গুজব শোনা যাচ্ছে যে কাবুল নদীর উত্তরে বাদশানে তাঁরা চলে গিয়েছে। কিন্তু সুলতান আমি আগেই বলেছি এগুলো কেবলই গুজব…

হুমায়ুন ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে থাকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কামরান আর তারসাথে শেরশাহ কি আমার ধারণার চেয়েও গভীর কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কামরানের বিশ্বাসঘাতকতা করার প্রস্তাব আর শেরশাহের সেটা প্রত্যাখ্যান করা পুরোটাই যদি মানিকজোড়ের একটা চক্রান্ত হয়ে থাকে, লাহোর থেকে আমাকে বের করে আনার জন্য যাতে তারা তাদের বাহিনী নিয়ে আমার বাহিনীকে আক্রমণ করতে আর ধ্বংস করতে পারে, ব্যাপারটা যদি এমন হয়?

সেটাও সম্ভব, সুলতান, কাশিম মৃদু কণ্ঠে বলে। আমরা সেটা উপেক্ষা করতে পারি না।

কামরানের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আসকারি কতটা জানে সে বিষয়টাও আমাকে ভাবিত করে। শেরশাহের পক্ষে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার ষড়যন্ত্র কি তাঁরা দুজনে একসাথে করেছিল নাকি আসকারি কামরানের সাথে পালিয়েছে কারণ সে ভেবেছে যে আমি কখনও বিশ্বাস করবে না সে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত নয়?

হিন্দাল এতক্ষণে কথা বলে। আমি নিশ্চিত আসকারি আগে থেকেই জানতো। কামরান যেখানেই যায় সে সবসময়ে তাঁকে অনুসরণ করে। আমি কোনো ধরনের বিদ্বেষপ্রসুত হয়ে কথাগুলো বলছি না কিন্তু আমার জানার কারণ আছে- আমিও একটা সময়ে তাই ছিলাম।

আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলছে। কামরানের মতো না, আসকারি দুর্বল এবং বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে সবসময়ে আতঙ্কিত থাকে, হুমায়ুন মন্তব্য করে। সে কারণেই তার বিশ্বাসঘাতকতায় আমি কম আঘাত পেয়েছি। আমার ছেলেবেলায় কামরানের সাথে বয়সে সে প্রায় আমার সমান- আমি খেলেছি, শিকার করেছি আর তর্কাতর্কি করেছি। আমরা যদিও প্রায়ই ঝগড়া করতাম। মাঝেমাঝে মারামারি পর্যন্ত গড়িয়েছে ব্যাপারটা স্বল্পসময়ের জন্য হলেও আমাদের মাঝে একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল…অনেকটা আপন ভাইয়ের মতো। সে যে আমার মৃত্যু কামনা করতে পারে এই ধারণাটাই আমাকে একই সাথে ক্রুদ্ধ আর শশাকার্ত করে তুলছে…

দরজায় একটা টোকার শব্দ তার কথার মাঝে বিঘ্ন ঘটায় এবং জওহর কে এসেছে দেখার জন্য ভালোমতো তেল দেয়া বিশাল গোলাপকাঠের দরজার পাল্লাটা খুলতে সে কথা থামিয়ে মৌন হয়ে যায়। হুমায়ুন বাইরে থেকে নীচু গলায় কথোপকথনের শব্দ ভেসে আসতে শুনে, তারপরে জওহর আবার হাজির হয়।

সুলতান, মার্জনা করবেন, কিন্তু মির্জা হুসেন তার উজিরকে একটা বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন।

তাকে আসতে দাও।

হাল্কা-পাতলা কিন্তু নিখুঁত গড়নের অধিকারী চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত আর দ্ব্যর্থহীন চাহনির অধিকারী উজির সাড়ম্বরে অভিবাদন জানায়। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন সুলতান, কিন্তু মির্জা হুসেন অনুরোধ করেছেন, আজ রাতের ভোজসভায় আপনি আর আপনার ভাই উপস্থিত থাকলে তিনি সম্মানিতবোধ করবেন।

অবশ্যই, হুমায়ুন উদারভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমরা যোগ দিতে পারলে খুশীই হব এবং মির্জাকে তাঁর এই আতিথিয়তার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাবেন।

উজির আরো একবার মাথা নত করে এবং কক্ষ থেকে প্রস্থান করে।

দরজার পাল্লা বন্ধ হওয়া মাত্র, হিন্দালের মুখে হাল্কা হাসির আভাস ফুটে উঠে। একটা ভালো লক্ষণ, আপনার কি তা মনে হয় না? মির্জা হুসেন আমাদের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কি করতে…

তুমি হয়তো ঠিকই বলছে কিন্তু সে হয়তো আমাদের ছোটখাট জিনিষ দিয়ে তুষ্ট করতে চাইছে, একই সাথে আমরা আসলেই যেটা চাই সেটা দিতে অস্বীকার করার সুযোগ খোঁজার অবসরে… আমরা অচিরেই সেটা বুঝতে পারবো…।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা চারপাশে ঘোলাটে গোলাপী রঙের একটা ভাব নেমে আসতে মৃদুভাবে ঢাকের বোল শোনা যেতে থাকে। মির্জা হুসেনের প্রেরিত পরিচারকদের সাথে হুমায়ুন আর হিন্দাল প্রাসাদের কেন্দ্রীয় অংশে উপস্থিত হয় এবং জেসমিন ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজান আর সুগন্ধি তেলের দিয়ার সলতে দ্বারা আলোকিত দীর্ঘ আর চেটালো একটা সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে উঠতে থাকে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে হুমায়ুন আর হিন্দাল মার্বেলের কারুকাজ করা একটা চৌকাঠের নীচে দিয়ে অতিক্রম করে একটা অষ্টভূজাকৃতি কক্ষে প্রবেশ করে, কক্ষটা দেয়ালের গিল্টি করা মশালদানিতে রক্ষিত জ্বলন্ত মশাল আর রূপার অতিকায় ঝাড়বাতিদানের আলোয় ঝলমল করছে। সোনার জ্বলজ্বল করতে থাকা জরির কারুকাজ করা গালিচা মেঝেতে পাতা আর দেয়ালে মুক্তা আর কাঁচের পুতির ঝালর দেয়া রেশমের উজ্জ্বল রঙের ব্রোকেডের পর্দা ঝুলছে। তাদের ঠিক বিপরীতে রূপার জরির ঠাস বুনোটের কারুকাজ করা কাপড় দিয়ে মোড়া একটা মঞ্চে স্তূপাকারে তাকিয়া রাখা রয়েছে।

হুমায়ুন আর হিন্দাল প্রবেশ করা মাত্র বাদ্যযন্ত্রীর দল সরব হয়ে উঠে। হাস্যোজ্জ্বল মির্জা হুসেন এগিয়ে আসেন তার ভাইদের স্বাগত জানাতে। হিন্দুস্তানী রীতিতে গলায় মালা দিয়ে তাঁদের বরণ করে নিয়ে মঞ্চের নির্ধারিত সম্মানিত স্থানের দিকে তাদের নিয়ে যায়। তারা আরাম করে বসবার পরে, সে হাততালি দিতে মঞ্চের পাশের একটা প্রবেশ পথ দিয়ে পিলপিল করে বেয়ারার দল প্রবেশ করতে শুরু করে সবার কাঁধে সোনালী গামলায় স্তূপ করা খাবার- কলা পাতা দিয়ে মোড়া সিদ্ধ ভেটকি মাছ কিংবা নারকেলের ঘন ঝোলে ভাসা রান্না করা মাছ, রোস্ট করা হরিণের মাংসের ফালি, মসলা দিয়ে রান্না করা ভেড়ার পাজরের মাংস, সিদ্ধ বেগুনের ঘাট, মটরশুটি দিয়ে রান্না করা পোলাও আর আখরোট এবং কিশমিশ দিয়ে প্রস্তুত নানরুটি।

সুলতান, শুরু করেন আর যুবরাজ হিন্দাল আপনিও। আমার ভাইয়েরা, অনুগ্রহ করে আহার শুরু করেন আপনারা আজকে আমার সম্মানিত অতিথি। দেখেন, সব উপাদেয় খাদ্য…আমাকে কেবল বলেন কোনো খাবারটা আপনার কাছে। সবচেয়ে উপাদেয় মনে হচ্ছে, আমি নিজে আপনার খাদ্য পরীক্ষকের ভূমিকা পালন করবো। আমার ছাদের নীচে অবস্থানের সময় আপনার ভীত হবার কোনো কারণ নেই…

আমার ভাই, আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। এবং আমি মোটেই ভীত নই। তার এই ভাইয়ের সাহায্য লাভ করতে হলে হুমায়ুন ভালো করেই জানে তাঁকে বিশ্বাসের প্রাঞ্জল প্রদর্শন করতে হবে। কোনো প্রকারের ইতস্তত ভাব না দেখিয়ে সে এক টুকরো গরম নান তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে রান্না করা মাছের একটা টুকরো মুড়ে নিয়ে মুখে দেয়। খাবার আসলেই উপাদেয় হয়েছে।

হুমায়ুন পরে যখন তাঁর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে, মির্জা হুসেন আবার হাততালি দেয় এবং পাশের সেই একই প্রবেশ পথ দিয়ে তিনটা মেয়ে কক্ষের ভিতরে এসে তাঁর সামনে নতজানু হয়, সবার চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ। কয়েক মিনিট পরে, সদ্য ঘুমভাঙা চোখে ভেড়ার চামড়ার জারকিন বাঁধতে বাঁধতে সে এসে হাজির হয়। এত ভোরে ডেকে পাঠানোর কারণে স্পষ্টতই বিভ্রান্ত বাবর তার মুখ থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাসের সাদা কুণ্ডলী নির্গত হতে দেখে। এসো, অনেক ঘুমিয়েছো…আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। বাবর তাকে ডেকে বলে। কি?…

আমার কথা তুমি ঠিকই শুনেছে- এবার চল অলস কোথাকার…

দশ মিনিট পরে, সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে বের হতে দেখা যায়। সূর্যের আলোয় রাতের তুষার গলতে শুরু করায় তাদের ঘোড়ার খুরের কারণে গুটি বসন্তের মত দাগ পড়ে মাটির বুকে। যা কিছুই হোক, বেঁচে থাকা। আর তারুণ্যের চেয়ে মঙ্গলময় আর কিছুই হতে পারে না।

*

প্রথমে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। বছরের এই সময়ে, ধুসর প্রায় নিপ্রভ আলো মানুষের চোখকে অনায়াসে প্রতারিত করতে পারে। কোলবা পাহাড়ের দিকে বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকার মাঝেই সে ভাবে সে আরো লোক দেখতে পেয়েছে- হ্যাঁ: সে ঠিকই দেখেছে- দূরের কালো অবয়বগুলো ঘোড়সওয়ারের।

ওয়াজির খানও স্থির চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

উজবেক…?

আমারও তাই মনে হয়, সুলতান। সম্ভবত অগ্রগামী গুপ্তদূতের দল।

বাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। গত তিন সপ্তাহ ধরে সমরকন্দে গুজব- প্রথম প্রথম অস্পষ্ট, ভিত্তিহীন তারপরে অনেক বিশদ বর্ণনা- ছড়াতে শুরু করেছে। সবাই দেখা যায় দুটো বিষয়ে একমত যে, সাইবানি খান সমরকন্দের পশ্চিমে বোখারায় অবস্থান করে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তুলছে আর শীতকালটা নিজের লোকদের সাথে একত্রে অতিবাহিত করা সব উজবেক যোদ্ধাকে মোটা পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।

বাবরের আদেশে সমরকন্দের অস্ত্র নির্মাতারা, পুরো শীতকালটা যারা কঠোর পরিশ্রম করেছে, এখন তাদের প্রয়াস বৃদ্ধি করে দিন-রাত নাগাড়ে কাজ করছে। বাতাসে এখন কেবল ধাতুর সাথে ধাতুর আঘাত করার শব্দ ভাসছে। তারা চুল্লীতে তীক্ষ্ণ প্রান্ত বিশিষ্ট ফলা আর বর্শার আকৃতি তৈরি করে সেটা নেহাইয়ে রেখে সেটাতে পান দিচ্ছে। অস্ত্রের কোনো কমতি তার নেই এবং সাধ্যমত চেষ্টা করেছে শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে। কিন্তু মানুষ কোথায় পাবে?

সে ভ্রূকুটি করে। শেষবার গণনা করার সময়ে সংখ্যাটা ছিল সাত হাজার। যার ভিতরে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনীও রয়েছে যারা পুরোটা শীতকাল শহরেই অতিবাহিত করেছে। উজবেকরা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে জানার পরেই সে এই অঞ্চলের অন্য সর্দারদের কাছে দূত পাঠিয়েছে- এমন কি তামবাল আর জাহাঙ্গীরের কাছেও সে লোক পাঠিয়েছে। সমরকন্দের পতনের পরে তাদের সেনাবাহিনী আকশি ফিরে গিয়েছে- সম্মিলিতভাবে সাধারণ শত্রুকে প্রতিহত করার আবেদন জানিয়ে। এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।

ওয়াজির খান, আমি উজবেকদের ফিরে আসতে দেখে মোটেই অবাক হচ্ছি না। আমি জানতাম তাদের ফিরে আসাটা কেবল সময়ের ব্যাপার। আপনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন বাবুরী আর আমি প্রায়ই বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতাম… আর সেই বাজারের ছোকরা কি বলতো?

ওয়াজির খানের কণ্ঠের অপ্রত্যাশিত রুক্ষতায় বাবর অবাক হয়। হতে পারে সে বাজারের ছেলে, কিন্তু তারপরেও তার কথায় যুক্তি আছে…এবং সে সমরকন্দ আর এর লোকদের ভালো করেই চেনে…

সুলতান, তার ভুলে গেলে চলবে না সে কে, এবং আপনার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য…আপনি হলেন আমাদের সরতাজ…তার মতো একজন উঁইফোড়ের সাথে আপনি পরামর্শ করছেন বয়োজ্যেষ্ঠ, বিজ্ঞ আর অভিজাত-বংশীয় কাউকে বিবেচনায় না এনে সেটা ভালো দেখায় না…আল্লাহতালা যদি আপনার পিতার হায়াত দরাজ করতেন তাহলে এসব কথা তিনিই আপনাকে বলতেন…

বাবর পারলে ওয়াজির খানকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেয়। সম্ভবত এসব তার জানের শত্রু সেই বুড়ির কাজ বাবুরীর প্রতি এসান দৌলত তার বিতৃষ্ণা বা বাবুরীর সাথে তার মেলামেশার ব্যাপারে নিজের আপত্তির কথা কখনও গোপন করার চেষ্টা করেননি। বাবরের তারপরেই মনে পড়ে ওয়াজির খানের কাছে সে নানাভাবে ঋণী আর সম্প্রতি বুড়ো লোকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী আর একজন সুলতান এই দুটো বিষয় আমি কখনও ভুলবো না। বাবুরীর সঙ্গ আমার ভালো লাগে…কিন্তু তার পরামর্শ আমি গ্রহণ করি কারণ সেগুলো যুক্তিসঙ্গত। আপনার মতোই আমি যা শুনতে চাই বলে সে বিশ্বাস করে সেরকম মন রাখা কথা বলে না…বরং সে নিজে যা বিশ্বাস করে সেটাই কেবল বলে। তার মানে এই না যে সবসময়ে আমি তার সাথে একমত হই… আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই…।

আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রণাদাতা হিসাবে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। হতে পারে বাবুরী বিচক্ষণ, কিন্তু একই সাথে সে বদরাগী আর একটা হামবড়া ভাব তার মধ্যে রয়েছে। আপনি যদি তার সাথে আপনার বন্ধুত্বের ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হন, অন্যরা তাহলে নিজেদের অবহেলিত মনে করে ঈর্ষান্বিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে…আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই মাঝে মাঝে আমিও এর উর্ধ্বে উঠতে পারি না…

ওয়াজির খানের চোখমুখের বিব্রতভাব লক্ষ্য করে বাবর আলতো করে তার কাঁধ স্পর্শ করে। আপনি আমার সবচেয়ে বড় সহায় এবং অন্যসব ইচকিসের চেয়ে আমি আপনার পরামর্শ বেশি গুরুত্ব দেই। আমি সতর্ক থাকবো…এখন এসব নিয়ে আর শুধু শুধু বিব্রত হবেন না, মন্ত্রণা সভা আহ্বান করেন। তাদের জানা উচিত আমরা পাহাড়ের উপরে কি দেখেছি…

[মনে হয় এখানে কিছু একটা মিসিং, কিন্তু বইতে এমনই আছে। পেজ ১৯৪-১৯৫]

রয়েছে। কেন না? সে মনে মনে ভাবে। বাবর নিজের অবস্থান সুসংহত করতে একাধিক রাজবংশের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন। খানম যদিও তাকে খুব একটা আলোড়িত করেনি, তবে তার চাহনীর ভিতরে কেমন একটা মাদকতা রয়েছে। মেয়েটার ধমনীতে তারই বংশের রক্ত বইছে এবং শেরশাহের বিরুদ্ধে সগ্রামে তার বাবা একজন দরকারী বন্ধু হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। বিয়ের দিন ফুলশয্যায় পূর্ণাঙ্গতা পাবে এমন একটা মৈত্রীর সম্বন্ধ করতে বাধা কোথায়? কাশিমের তথ্য প্রথমবারের মতো যেন ভুল বলে প্রতিয়মান হতে চলেছে- মির্জা হুসেন তাঁকে আদতেই সাহায্য করতে ইচ্ছুক। কিন্তু একটা বিষয়ে হুমায়ুন নিশ্চিত। স্ত্রী হিসাবে কাউকে গ্রহণ করার পূর্বে তাকে অবশ্যই তার শত্রুদের পরাস্ত করতে এবং নিজের সিংহাসন সুরক্ষিত করতে হবে। খোলাখুলি কথা বলার এবার সময় হয়েছে।

মির্জা হুসেন, খানমকে কোনোদিন স্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করতে পারলে আমি খুশীই হব। সে আকর্ষণীয় দেখতে, বিষয়নিপূণা একজন রমণী। আমরা ভাবনার পুরোটা জুড়ে যদিও এখন কেবলই যুদ্ধ এবং আমার হারানো ভূখণ্ড উদ্ধারের কথা বিরাজ করছে, বিয়ে নয় এবং সেজন্য আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী। আপনি আপনার আতিথিয়তা আর উপঢৌকনের ব্যাপারে যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন কিন্তু আমি আপনার সেনাবাহিনীর সহায়তা চাইছি। আসুন সবার সামনে আমরা আমাদের মৈত্রীর কথা ঘোষণা করি।

হুমায়ুন কথা শেষ করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে মির্জা হুসেনকে কৃতজ্ঞ এমনকি উল্লসিত হতে দেখবে বলে প্রতিক্ষা করে। নিজের মেয়ের সাথে মোগল ম্রাটের বিয়ের সম্ভাবনা সুলতানের কাছে কল্পনাতীত একটা বিষয়। কিন্তু সে তাকিয়ে দেখে তাঁর নিমন্ত্রাতার মুখের হাসিতে কেমন যেন আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। তার ঠোঁটের কোণা যেন কঠিন হয়ে, চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের শীতলতা ফুটে উঠেছে। খানম অনেক বাজিয়েছে! এবার আমাদের একটু একলা থাকতে দাও। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে বলে।

খানম চমকে উঠে এবং সাথে সাথে বাজানো বন্ধ করে। উঠে দাঁড়িয়ে সে তার পরণের গাঢ় নীল রঙের লম্বা আলখাল্লায় একটা খসখস শব্দ তুলে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে।

আমার ভাই, পরস্পরকে আমরা আগে একটু বুঝতে চেষ্টা করি। মির্জা হুসেন আবেগহীন কণ্ঠে কথা শুরু করে। আমি তোমাকে এখানে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ করিনি। তুমি নিজে এসেছে। নৈতিকতার খাতিরে আমি তোমায় স্বাগত জানিয়েছি। শেরশাহ, এখান থেকে মাত্র ছয়শ মাইল দূরে- সম্ভবত আমরা সবাই যা জানি তারচেয়েও নিকটে- লাহোরে অবস্থান করছে, তোমার আর আমার সম্মিলিত বাহিনীর চেয়েও বিশাল একটা বাহিনী তার সাথে রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি তার বিরুদ্ধাচারণ করতে চাই না। আমি তোমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারি এবং তুমি যদি প্রতিশ্রুতি দাও যে আমার মেয়ের সম্মান আর সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে তাহলে আমি আন্তরিকতার সাথেই তোমার সাথে তার বিয়ের বন্দোবস্ত করতে পারি কিন্তু এর বেশী কিছু প্রত্যাশা করতে যেও না। আমার আশীর্বাদের সাথে খানমকে গ্রহণ করো, তোমার বর্তমান সমস্যা তোমার প্রতি আমার আর কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা থাকবে না এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমার উপঢৌকন হিসাবে, কিন্তু আমার প্রজাদের আর আমার উপরে তোমার কারণে কোনো বিপর্যয় নেমে আসবার আগেই আমার ভূখণ্ড ত্যাগ কর।

মির্জা হুসেন ইচ্ছা করেই উচ্চকণ্ঠে কথাগুলো বলেন যাতে সকলে শুনতে পায় এবং হুমায়ুন দেখে হিন্দাল চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ক্রোধের একটা স্রোত তাঁকে আপুত করে। কাশিমই দেখা যাচ্ছে ঠিক আন্দাজ করেছিল। মির্জা হুসেন, আমিরজাদা তৈমূরের রক্ত আপনার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে কিন্তু তারপরেও আপনার কণ্ঠে যোদ্ধার চেয়ে বেনিয়ার সুরই প্রকটিত…

মির্জা হুসেনের চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। হুমায়ুন সন্তুষ্টির সাথে লক্ষ্য করে যে খোঁচাটা একেবারে জায়গামতো বিদ্ধ হয়েছে। কোনো মানুষই এমন কথা শুনতে পছন্দ করবে না। বিশেষ করে নিজের ঘরের নিরাপত্তার মাঝে বসে।

তোমার পরিকল্পনা বিপজ্জনক, মির্জা হুসেন কোনোমতে বলেন। নিজের ভাগ্য বিপর্যয়ের বিষয়টা মেনে নাও। হিন্দুস্তান ত্যাগ কর। তোমার যেখানে জন্ম হয়েছে সেই কাবুলে ফিরে যাও। সেখানে একটা সমৃদ্ধ রাজত্ব রয়েছে। তুমি যেখানে আগম্ভক সেখানে কোনমতেই তুমি সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবে না।

আপনি নিজের অতীত বিস্মৃত হয়েছেন। আমার মরহুম আব্বাজান হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন এবং একটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা তিনি আমায় দান করে গেছেন। আমি এই স্থানের সাথেই নিজেকে একাত্মবোধ করি। নিজের কন্যা আর কিছু ধনসম্পদ দিয়ে আমায় কেনার কথা চিন্তাও করতে যাবেন না… আমাদের উচিত এসব না করে দুজনে মিলে পরিকল্পনা করা কিভাবে আমার ভূখণ্ড পুনরায় দখল করা যায়। আমরা আমাদের প্রথম বিজয় অর্জন করার সাথে সাথে, অন্যরা আরো একবার আমার নিশানের নীচে এসে সমবেত হবে। কিন্তু আপনি এটা স্বীকার করতে চাইছেন না। বাণিজ্য আপনাকে এতোটাই পৃথুল করে তুলেছে যে আপনি বোধহয় আমাদের যোদ্ধার রীতি ভুলে গিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে এর সাথে সম্পৃক্ত দায়বদ্ধতা আর আকাঙ্খিত লক্ষ্য…

হুমায়ুন ক্রোধে এতোটাই উন্মত্ত হয়ে পড়ে যে ভুলে যায় তার ভাই ছাড়াও আরো অন্যান্যরা আশেপাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। মঞ্চের নীচে মির্জা হুসেনের কয়েকজন অমাত্য নীচু টেবিলের চারপাশে বৃত্তাকারে উপবিষ্ট রয়েছে এবং সে সহসা তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা আর তাঁদের চোখে ফুটে উঠা বিস্ময় সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। এটা কাউকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করা কিংবা কারো সাথে প্রকাশ্য বিরোধিতায় জড়াবার সময় না। হুমায়ুন বহু কষ্টে নিজের মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে যদিও তার খুব ইচ্ছে করছিল তার নাদুসনুদুস এই নিমন্ত্রাতার মাংসল গলাটা টিপে ধরতে। কিন্তু আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আপনার অতিথি। আমি আসলে আমার মনের কথা খোলাখুলি বলে ফেলেছি। মির্জা হুসেন, এসব আলোচনার উপযুক্ত সময় বা স্থান এটা না। আমাকে মার্জনা করবেন। আগামীকাল সকালে আমরা যখন একা থাকবো এবং আমরা যখন উভয়েই বিষয়টা নিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ পাব তখন এবিষয়ে আবার আলোচনা হবে।

কিন্তু মির্জা হুসেনের মুখের অভিব্যক্তি দেখে হুমায়ুন স্পষ্ট বুঝতে পারে যে সিন্ধের সুলতানের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্যের প্রত্যাশা না করাই উত্তম।

২.৫ সশ্রম আর সংক্ষোভ

২৫. সশ্রম আর সংক্ষোভ

হুমায়ুন পাদিশাহ! সম্রাট হুমায়ুন দীর্ঘজীবি হোন! লাহোরের অধিবাসীদের সম্মিলিত চিৎকারে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে যখন ১৫৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক উষ্ণ দিনে, হুমায়ুন আর আকবর একটা লম্বা হাতির পিঠে সোনার গিল্টি করা হাওদায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করে, অতিকায় প্রাণীটার পর্যাণের জন্য ব্যবহৃত সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা আর মাঝে মাঝে মুক্তাখচিত দীর্ঘ কাপড়টা এই মুহূর্তে শহরের প্রশস্ত সড়কের ধূলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। শোভাযাত্রাটার একেবারে সামনে রয়েছে হুমায়ুনের অশ্বারোহী বাহিনীর একটা চৌকষ দল, যাদের সবাই কালো ঘোড়ার পিঠে আসীন এবং প্রত্যেকের মাথায় রয়েছে সোনালী রঙের পাগড়ি। দলটা দুলকি চালে এগিয়ে যাবার সময় মধ্যাহ্নের সূর্যালোক তাদের হাতে সোজা অবস্থায় ধরে রাখা লম্বা বর্শার ইস্পাতের ফলায় প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাধিয়ে দেয়। তাদের পিছনে, হুমায়ুনের ঠিক সামনে, ছয়জন অশ্বারোহী তূর্যবাদক আর ছয়জন ঢুলী তাঁদের খিলানাকৃতি পর্যাণের উভয়পার্শ্বে স্থাপিত ছোট ছোট দুটো নাকাড়া দক্ষতা আর বলিষ্ঠতার সাথে বাজিয়ে চলেছে। সমবেত জনতার উন্মত্ত চিৎকারের সাথে তাদের সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে এমন একটা পরিস্থিতির জন্ম দেয় যে আকবরের কথা শোনার জন্য হুমায়ুনকে বেশ বেগ পেতে হয়।

আব্বাজান আমরা কাবুল থেকে রওয়ানা দেবার পরে এখানে ওখানে কেবল খণ্ডযুদ্ধেরই সম্মুখীন হয়েছি। রোহতাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব দূর্গই আমরা উপস্থিত হওয়া মাত্র আত্মসমর্পণ করেছে আর এখন লাহোরের মতো বিশাল শহরও একই ভাগ্যবরণ করেছে। সত্যিকারের কোনো যুদ্ধের মুখোমুখি না হয়ে হিন্দুস্তানের ভেতরে এভাবে নির্বিঘ্নে আমরা আর কতদূর যাব?

আমার মনে হয়, খুব বেশী দূর না। আমরা খুব শীঘ্রই শেরশাহ আর ইসলাম শাহের রাজত্বের কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করতে চলেছি। সিংহাসনের জন্য তাঁদের যে তিনজন দাবীদার রয়েছে তারা সম্ভবত আমাদের অগ্রসর হবার সংবাদ পেয়ে থাকবে এবং নিশ্চয়ই জানে যে আমরা হিন্দুস্তানের সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত দাবীদাব তাঁদের অন্যান্য যেকোনো সাথী রাজ্যাভিযোগীদের চেয়ে অনেক বড় হুমকির কারণ। তাঁদের সবাই বা যেকোনো একজন নিজেদের ভিতরে বিদ্যমান ঝগড়া থেকে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের আক্রমণ করবে।

আপনার কি মনে হয় আমাদের বিরুদ্ধে তারা সঙ্বদ্ধ হতে পারবে?

সম্ভবত, কিন্তু তারা একে অপরের যে পরিমাণ মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে যে সেটা হয়ত আর সম্ভব হবে না। অবশ্য, তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তির নিরিখে দুর্দান্ত প্রতিপক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হবে।

লাহোরে আমরা কতদিন অবস্থান করবো?

শহরের প্রধান ইমামসাহেব শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে মসজিদে আমার নামে খুৎবা- অনুশাসন- পাঠ করে আমাকে আরো একবার সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করার পরেই আমরা আবার যাত্রা শুরু করবো। তালগাছের ভিতর দিয়ে তাকালে তুমি মসজিদের লম্বা মিনার দুটো দেখতে পাবে। আমাদের অগ্রযাত্রার প্রণোদনা যেভাবেই হোক বজায় রাখতে হবে। আমি প্রায়ই দেরী করে ফেলি আর আমার প্রতিপক্ষকে প্রত্যুপক্রমের সুযোগ করে দেই।

দুই সপ্তাহ পরে, প্রথম সকালের কুয়াশায় অবগুণ্ঠিত অবস্থায় তার সৈন্যরা নিজেদের জন্য দ্রুত কিছু একটা খাবার প্রস্তুতের লক্ষ্যে রান্নার করার জন্য আগুন জ্বালাচ্ছে, হুমায়ুন তখন তাঁর সেনাছাউনির একেবারে মধ্যেখানে তার জন্য স্থাপিত লাল রঙের নিয়ন্ত্রক তাবুতে চারপাশে নিজের সামরিক পরিষদমণ্ডলী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে রয়েছে। আটদিন পূর্বে লাহোর ত্যাগ করার পরে, সে আর তার বাহিনী দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রায় নব্বই মাইল পথ অতিক্রম করে, বৈচিত্র্যহীন, লাল মাটির উপর দিয়ে হিন্দুস্তানের আরও গভীবে প্রবেশ করেছে।

আহমেদ খান, তুমি নিশ্চিত যে আদিল শাহের বাহিনী আমাদের অগ্রসর হবার দিকের সাথে আড়াআড়িভাবে পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছে?

হ্যাঁ। পাঁচ দিন পূর্বে, তাঁরা তাঁদের প্রতিপক্ষ সিকান্দার শাহের সৈন্যদের সাথে আরেকটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বাজেভাবে পরাস্ত হয়েছে এবং এখন তারা নিজেদের শক্তঘাঁটি সুন্দরনগরের দূর্গের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে পুনরায় নিজেদের সংঘটিত করতে।

তারা কতদূরে অবস্থান করছে?

সুলতান, তারা সম্ভবত আমাদের থেকে আট মাইল সামনে রয়েছে।

সেখানে তাদের সাথে কত লোক রয়েছে?

তাদের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি হবে, প্রায় সবাই অশ্বারোহী। তাঁরা তাঁদের বেশীরভাগ কামান আর ভারী যুদ্ধ উপকরণ পথে কোথাও ফেলে এসেছে।

তারা কি অশ্বারোহী প্রহরী কিংবা পাহারা দেয়ার জন্য লোক মোতায়েন করেছে?

সুলতান, নিয়োগ করেছে তবে তাঁদের সংখ্যা খুবই অল্প; তাঁদের নিজেদের ভিতরে মাত্রাছাড়া বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। তারা রাতের বেলা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার নিতে কয়েকঘন্টার জন্য কেবল যাত্রা বিরতি করে এবং যাত্রা শুরু করতে ভোর হবার আগেই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। তাদের মাথায় কেবল যত দ্রুত সম্ভব সুন্দরনগর পৌঁছাবার ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।

আমরা তাহলে কালবিলম্ব না করে, কুয়াশার আড়াল যতক্ষণ রয়েছে এর সুবিধা নিয়ে আক্রমণ করবো। আমার লোকদের রান্না করার জন্য জ্বালান আগুন নিভিয়ে ফেলতে বলল। আহার করার মতো সময় হাতে নেই। আমরা অশ্বারোহী যোদ্ধা আর তীরন্দাজদের নিয়ে যাব। সেই সাথে, কিছু নির্বাচিত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আদেশ দেন তারা যেন তাদের ঘোড়ায় নিজেদের পেছনে তবকিদের উঠিয়ে নেয়। বৈরাম খান, আপনি, আকবরের সাথে সেনাছাউনির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। আপনি মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যুহ মোতায়েনের বিষয়টা নিশ্চিত করবেন আর পাহারার ব্যবস্থা করবেন। আমি আসন্ন যুদ্ধে বিজয়ী হবার প্রত্যাশা করছি কিন্তু তারপরেও কোনো কারণে আদিল শাহ্ আমাদের কৌশলে এড়িয়ে গেলে বা কোনো কারণবশত সাময়িকভাবে সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করলে তখনকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এখানে সেনাছাউনির নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখতে হবে।

দুই ঘন্টা পরে, কুয়াশা পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে যায়। হুমায়ুন আহমেদ খান আর তাঁর গুপ্তদূতের একটা দল নিয়ে নিজে তার অগ্রসর হতে থাকা মূল বাহিনী থেকে মাইল খানেকের মতো সামনে অবস্থান করছে। সামনে অবস্থিত একটা গ্রামের মাটির দেয়ালের উপর দিয়ে তাকিয়ে থাকে গ্রামটায় মানুষ বলতে কয়েক ঘর দরিদ্র কৃষক পরিবার আর তাদের পোষা মুরগী আর ছাগল রয়েছে। সূর্যের অসহনীয় আলোর উত্তাপের হাত থেকে চোখ বাঁচাতে সে মাথার উপর হাত দিয়ে একটা আড়াল তৈরী করেছে, সে পৌনে একমাইল দূরে, ধূলোবালির তৈরী বিশালাকৃতি একটা মেঘকে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত হতে দেখে, তার সামনে দিয়ে, ধূলিঝড়টা ডানদিক থেকে বামদিকে এগিয়ে যায়। ধূলিঝড়ের ভিতরে, হুমায়ুন কোনমতে একদল অশ্বারোহী আর কয়েকটা ছোট মালবাহী শকটের অবয়ব চিনতে পারে, খচ্চর বা ষাড় দিয়ে শকটগুলো টেনে নেয়া হচ্ছে। কাফেলাটার সামনে দুটো বিশালাকৃতি নিশান বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। ধূলো ভিতর দিয়ে এবং এতদূর থেকে হুমায়ুন নিশানের রঙ বা নিশানের বুকে কিসের প্রতিকৃতি রয়েছে ঠিকমতো বুঝতে পারে না, কিন্তু এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে এহেন ধূলিঝড়ের ভিতরে কেবল আদিল শাহের সৈন্যবাহিনীই এখন পথচলা অব্যাহত রাখবে। দলটা কোনো গুপ্তদূত মোতায়েন করেনি এবং তাঁদের দেখে মনে হয় কোনো ধরনের বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা একেবারেই উদাসীন।

নাদিম খাজাকে তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার নির্দেশ পাঠাও। জাহিদ বেগকে তার লোকজন নিয়ে এখানে উপস্থিত হতে বলো এবং সম্মুখভাগে আক্রমণ পরিচালনার সময় আমি নিজে তাদের নেতৃত্ব দেব। আর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের যাদের সাথে তবকিরা রয়েছে তাদের বলো সরাসরি শত্রু সৈন্যসারির অগ্রসর হবার পথের একশ গজের ভিতরে অবস্থান নিতে এবং সেখান থেকে তবকিরা শত্রু সেনার বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি করবে।

হুমায়ুনের তবকিদের অচিরেই ঘোড়া থেকে নেমে এসে তেপায়ার উপরে তাঁদের লম্বা নলযুক্ত বন্দুকগুলোকে স্থাপন করতে দেখা যায় এবং হুমায়ুন আর তার নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা ততক্ষনে প্রায় আদিল শাহের সৈন্যসারির সম্মুখভাগের যোদ্ধাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। তাঁদের প্রতিপক্ষ একেবারে শেষমুহূর্তে সহসা শত্রুর উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ময়ান থেকে তরবারি বের করতে করতে ঘুরে দাঁড়ায় তাদের মুখোমুখি হতে। প্রতিপক্ষের আধিকারিকেরা সৈন্যদের কাছাকাছি অবস্থান করে আক্রমণের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দেয়। হুমায়ুনের তবকিরা প্রায় সেই সময়েই আদিল শাহের সৈন্যদের অবস্থান লক্ষ্য করে একযোগে প্রথমবার গুলি বর্ষণ করলে, বেশ কয়েকজন সৈন্য পর্যাণ থেকে মাটিতে ছিটকে যায় এবং তাঁদের অনেকের ঘোড়া আহত হয় আর আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

হুমায়ুন তার অশ্বারোহী বাহিনীর সম্মুখে অবস্থান করে, মুহূর্ত পরেই, শত্রুপক্ষের সৈন্যসারির অগ্রদলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে প্রথমেই দুই নিশানাধারীর একজনের মাথার লক্ষ্য করে তরবারি চালিয়ে তাকে কবন্ধ করে ফেলে। লোকটা কাটা কলাগাছের মতো পেছনের দিকে উল্টে পড়ার সময়, তার হাত থেকে বিশাল নিশানাটা ছিটকে যায়, হুমায়ুন এবার স্পষ্ট দেখতে পায় নিশানায় কমলা রঙের প্রেক্ষাপটে সোনালী সূর্য খচিত রয়েছে। বিশাল কাপড়টা হুমায়ুনের কালো ঘোড়ার পেছনের পায়ে জড়িয়ে গেলে প্রাণীটা হোঁচট খায়। হুমায়ুন, দ্বিতীয় নিশানবাহককে তরবারি দিয়ে আঘাতের উদ্দেশ্যে পর্যাণের উপরে সামনে ঝুঁকে পড়ে নিশানা স্থির করার কারণে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, মাটিতে পড়ে যায়। পাথুরে মাটিতে বেকায়দায় আছড়ে পড়ায়, তাঁর হাত থেকে তরবারি ছিটকে যায়।

আদিল শাহের অন্য একজন লোক, কমলা রঙের পালক শোভিত চূড়াকৃতি শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত গাট্টাগোট্টা দেহের অধিকারী এক আধিকারিক, হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের চেয়ে দ্রুত সুযোগটা চিনতে পারে। সে হুমায়ুনের দিকে নিজের খয়েরী রঙের ঘোড়াটা নিয়ে এগিয়ে আসে এবং তার হাতের লম্বা বর্শাটা দিয়ে হুমায়ুনকে মাটিতেই গেঁথে ফেলতে চায়। হুমায়ুন দ্রুত একপাশে গড়িয়ে সরে যাবার ফাঁকে হাত থেকে দাস্তানা খুলে ফেলে কোমরের সাথে ঝোলান রত্নখচিত ময়ান থেকে তার খঞ্জরটা টেনে বের করতে চেষ্টা করে। তাঁর মনে হয় কয়েক যুগ পরে, সে খঞ্জরটা ময়ান থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এবং ফুটখানেক লম্বা ফলাযুক্ত অস্ত্রটা সামুনের প্রতিপক্ষের ঘোড়ার গলা লক্ষ্য করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে, যে তখন আরেকবার নিজের ঘোড়র পায়ের নীচে তাঁকে পিষে ফেলতে চেষ্টা করছে। খঞ্জরের ফলাটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে এবং গলা দিয়ে ফিনকে দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকা অবস্থায় জটা টলমল করে উঠে, তারপরে মাটিতে পড়ে যাবার সময় পিঠ থেকে তার আরোহীকে ছিটকে দেয়, লোকটা বিকট শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

হুমায়ুন ইতিমধ্যে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ত্বরিতগতিতে সে বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করতে থাকা শত্রুপক্ষের লোকটার দিকে এগিয়ে যায়, মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় মাথার লোকটার মাথা থেকে শিরোস্ত্রাণটা ছিটকে গিয়েছে। লোকটা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করার সময় হুমায়ুন পেছন থেকে গিয়ে তাঁর বৃষস্কন্ধের ন্যায় গলাটা পেঁচিয়ে ধরে। হতভম্ব লোকটা আঁতকে উঠে নিজের মাথা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পরবর্তী কয়েক সেকেণ্ড তাঁরা দুজনে উন্মত্তের ন্যায় ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকে। সে তারপরে হুমায়ুনের কব্জি আর হাতের আবরণহীন মাংসপেশীতে প্রাণপনে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। হুমায়ুনের তার হাতের বাঁধন খানিকটা শীথিল করলে আধিকারিক লোকটা এক মোচড়ে নিজের মাথা হুমায়ুনের হাতের প্যাঁচ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। লোকটা হুমায়ুনের রক্তে রঞ্জিত দাঁত বের করে আধো হাসির একটা বীভৎস ভঙ্গি করে এবং কালক্ষেপন না করে সোজা হুমায়ুনের কুঁচকি লক্ষ্য করে লাথি বসিয়ে দিয়ে চেষ্টা করে। কিন্তু হুমায়ুন লাফিয়ে উঠে পেছনে সরে যেতে তাঁর প্রতিপক্ষের লাথি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সে ভারসাম্য হারিয়ে টলমল করতে থাকে। হুমায়ুন এক লাথিতে লোকটার দেহের নীচে থেকে বাকি পাটাকেও শূন্যে তুলে দেয় এবং নোকটা মাটিতে পড়ে গেলে সে তাকে লক্ষ্য করে লাফ দেয় এবং দুই হাঁটু একসাথে লোকটার বুকের উপর নামিয়ে আনে। আধিকারিক লোকটা আবারও বাতাসের অভাবে খাবি খেতে থাকলেও সে কোনোমতে হাটু দিয়ে হুমায়ুনের পিঠে আঘাত করে এবং বুকের উপর থেকে ফেলে দেয়। তারা এবার জড়াজড়ি করে ধূলোতে গড়াতে থাকে যতক্ষণ না হুমায়ুন নিজের পেশী শক্তি আর ক্ষিপ্রতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রয়োগ করে তার প্রতিপক্ষের গলা দুহাতে শক্ত করে আকড়ে ধরে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে লোকটার শ্বাসনালীতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দিয়ে তাঁর গলাটা হেচকা টানে মুচড়ে দেয়। একটা বীভৎস শব্দ শোনা যায় এবং আধিকারিক লোকটার পুরো মুখ ধীরে ধীরে বেগুনী হয়ে যায় এবং তার ঠিকরে বের হয়ে থাকা চোখের মণিতে দৃষ্টির স্বচ্ছতা মুছে গিয়ে সে ধীরে ধীরে নিথর হয়ে যায়। নিথর দেহটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে হুমায়ুন কোনমতে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজের তরবারিটা খুঁজে বের করে হাতে তুলে নেয়। সে চোখমুখ কুঁচকে ভাবে বায়েজিদ খানের সাথে মল্লযুদ্ধের কসরতের প্রশিক্ষণ না নিলে আজ এখানেই তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের ইতি ঘটতো। যুদ্ধের ময়দানে সে একবার ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁর দেহরক্ষীদের পক্ষে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা তখন প্রায় অসম্ভব।

হুমায়ুনের সেই দেহরক্ষীরাই এবার তার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করে এবং সে এবার সুস্থির ভঙ্গিতে চারপাশে তাকিয়ে দেখে আদিল শাহের অনেকেই ইতিমধ্যে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। বাকিরা আত্মসমর্পন করে অস্ত্র নামিয়ে রাখছে। কৃষিজীবি গ্রামটার আশ্রয়স্থল থেকে ধূলিঝড়ের মাঝে অশরীরি কোনো কাফেলার মতো আদিল শাহের বাহিনীকে প্রথমবার দেখার পরে এক ঘন্টা সময়ও এখনও অতিক্রান্ত হয়নি। পুরো বাহিনীটা এখন পুরোপুরি বিভ্রান্ত আর ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে, সেই সাথে হিন্দুস্তানের সিংহাসনের উপরে আদিল শাহের নিজের দাবী জোরদার করার সুযোগও একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমাদের শত্রুসেনাদের পিছু ধাওয়া কর। তোমাদের পক্ষে যতগুলো প্রাণী আর যুদ্ধের উপকরণ দখল করা সম্ভব দখল কর। উপকরণগুলো সামনে আরও কঠিন যুদ্ধের সময় কাজে লাগবে নিশ্চিতভাবেই যা ভবিষ্যতের গর্ভে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তোমাদের হাতে যদি আদিল শাহ বন্দি হয় তবে তাকে বিন্দুমাত্র করুণা প্রদর্শন করবে না কারণ নিজের শিশু ভাস্তেকে সে কোনো প্রকার করুণা করেনি।

খণ্ডযুদ্ধের তিনঘন্টা পরে, পরাজিত শত্রুকে ধাওয়া করার জন্য হুমায়ুন প্রেরিত সৈন্যদের একটা দল ফিরে আসে। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে যে তাদের একজন একটা ঘোড়ার লাগাম ধরে টেনে আনছে, যার পিঠে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে শুইয়ে রেখে দেহটার হাত-পাগুলো ঘোড়াটার পেটের নীচে একত্রে বেঁধে রাখা হয়েছে। দলটার নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধা ঘোড়া থেকে নেমে এসে হুমায়ুনকে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানায়। সুলতান, আদিল শাহের মৃতদেহ আমরা নিয়ে এসেছি। তাঁর দেহরক্ষী দলের যেসব সদস্যদের এখান থেকে মাত্র দুই কি তিন মাইল দূরে আমরা পেছন থেকে ধাওয়া করে গিয়ে বন্দি করেছিলাম তারাই দেহটা আমাদের কাছে সমর্পন করেছে। তারা বলেছে যে আমাদের অতর্কিত আক্রমণের শুরুতে গাদাবন্দুকের একটা গুলিতে বুকে সৃষ্ট ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতের ফলে সে মারা গিয়েছে।

হুমায়ুন ধীরে ধীরে মৃতদেহটার কাছে এগিয়ে যায় এবং মাথাটা পেছনে টেনে এনে তাঁর প্রতিপক্ষের মুখের দিকে তাকায়। ধূলো আর রক্তের পুরু আস্তরণের নীচে আদিল শাহকে সাধারণ দেখায়। হুমায়ুন তাঁর চোখে মুখে লোকটা উচ্চাশার ধূর্ত গভীরতার কোনো বাহ্যিক লক্ষণ দেখতে পায় না, যার কারণে সে আপন বোনের সন্তানকেও হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আদিল শাহের মাথাটা ছেড়ে দিয়ে, নিজের শত্রুর প্রতি তাঁর ক্রোধের বহিপ্রকাশের প্রমাণস্বরূপ মৃতদেহটা সমাধিস্থ না করে কুকুর শেয়ালের খাবার হিসাবে ফেলে রাখার জন্য ক্রমশ তার ভিতরে জোরাল হতে থাকা একটা প্রবণতা সে বহু কষ্টে দমন করে। সে বরং ঘুরে দাঁড়াবার কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে আদেশ দেয়, তাকে নামহীন একটা কবরে দাফন করবে।

সেইদিন রাতের বেলা, হুমায়ুন তার তাবুর নিরবতার মাঝে, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে শোকরানা নামাজ আদায় করে। হিন্দুস্তানের সিংহাসনের প্রবল তিন দাবীদারের একজনকে সে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে খুব ভালো করেই জানে এখনও নিরুদ্বিগ্ন হবার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। নিজের বিজয়ের প্রণোদনা আর উদ্যম তাকে অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য নিজেকে আর তার বাহিনীকে উৎসাহিত করতে হবে। অন্যথায়, তার সিংহাসন পুনরুদ্ধার এবং ব্যর্থতা থেকে নিজেকে সাফল্যে অভিষিক্ত করার সুযোগ সে হারাবে এবং কখনও হয়তো আর সুযোগ পাবে না।

আহমেদ খানের গুপ্তদূতেরা পরের দিন সকালে আরেকটা সম্ভাবনার সন্ধান নিয়ে আসে। দক্ষিণ দিক থেকে আগত ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে তাঁরা জানতে পারে যে পাঁচদিন আগে আসবার পথে তারা তার্তার খানের দুইজন সেনাপতির অধীনে একটা মাঝারি মাপের সৈন্যবাহিনীকে অতিক্রম করেছিল, দলটা উত্তরে তাদের অবস্থানের অভিমুখে এগিয়ে আসছে। আদিল শাহের মুখোমুখি হওয়াই তাদের আপাত অভিপ্রায় যার পরাজিত হবার সংবাদ সম্বন্ধে তারা এখনও অন্ধকারে রয়েছে। তার সামনে হিন্দুস্তানের সিংহাসনের দ্বিতীয় দাবীদারকে মারাত্মকভাবে আঘাত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে এবং তাঁকে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে অনুধাবন করে হুমায়ুন তখনই তার্তার খানের বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে দক্ষিণে যাত্রা করার জন্য তার বাহিনীকে আদেশ দেয়।

এক সপ্তাহ পরে, হুমায়ুন আরেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। সেদিনই সকালের দিকে তাঁর বাহিনী নিজেদের ঘোড়াগুলোকে সহ্যের প্রায় শেষ সীমায় দিয়ে, পেছন থেকে ধাওয়া করে এসে তাদের শত্রুদের আক্রমণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে তাঁদের প্রতিপক্ষ দুটো পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের ভিতরে এক মাইল দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হচ্ছে। দুটো দলের কোনটাতেই চার হাজারের বেশী সৈন্য হবে না। হুমায়ুন কালক্ষেপন না করে সামনের বাহিনীকে আক্রমণ করার আদেশ দেয়, প্রথম দলটা আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে দ্রুত সমভূমির উপরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অতর্কিত হামলায় বিপর্যস্ত সাথী যোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে না এসে দ্বিতীয় দলটা পিছু হটে গিয়ে একটা ছোট টিলার মাথায় অবস্থান গ্রহণ করে রক্ষণাত্মক ব্যুহ রচনা করে, হুমায়ুনের অনুগত যোদ্ধারা সময় নষ্ট না করে পুরো টিলাটা ঘিরে ফেলে।

হুমায়ুন ঠিক তখনই টিলার মাথায় একদল আধিকারিককে সমবেত হতে দেখে। তাঁর পাশে অবস্থানরত আহমেদ খানের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, আমরা কি ঐ দলটার নেতৃত্বদানকারী সেনাপতির নাম জানি?

সুলতান, সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর একজন দলপতি যুদ্ধ করার কোনো চেষ্টা না করেই আত্মসমর্পন করে আমাদের জানায় যে সে আর তার লোকেরা আপনার অধীনে যুদ্ধ করতে আগ্রহী। আমরা তাঁর লোকদের পাহারা দিয়ে রেখেছি এবং তাঁকে আমাদের একটা তাবুতে অন্তরীণ রেখেছি যেখানে সে স্বেচ্ছায় আমাদের শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর গঠনতন্ত্র আর তাদের মনোবল সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানিয়েছে। সে নিশ্চয়ই তাকে চিনবে।

লোকটাকে আমার সামনে হাজির করো।

কয়েক মিনিটের ভিতরে আহমেদ খানের দুইজন সৈন্য নিখুঁতভাবে কামান কালো দাড়ির অধিকারী প্রায় ত্রিশ বছর বয়সের দীর্ঘদেহী একজন লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। তাঁর পক্ষে হুমায়ুনকে আক্রমণের ন্যূনতম সম্ভাবনাও নাকচ করতে তারা লোকটার দুপায়ে এমনভাবে শিকল পরিয়ে রেখেছে যে সে কোনোমতে পা টেনে টেনে হাঁটতে পারে। সে যখন হুমায়ুনের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে সে অভিবাদন জানাবার ভঙ্গিতে মাটিতে শুয়ে পড়ে।

হুমায়ুন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবে তারপরে কথা বলে। তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দাও। তারপরে সে জিজ্ঞেস করে, কে তুমি?

মুস্তাফা আর্গুন, তার্তার খানের বাহিনীতে কর্মরত একজন তূর্কী সেনাপতি।

আমাকে বলা হয়েছে যে তুমি আমার প্রতি নিজের আনুগত্য পরিবর্তনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।

আমার অধীনস্ত একশ লোকেরও একই অভিপ্রায়।

কেন?

আমরা তার্তার খানের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম ধনসম্পদের এবং সে যদি হিন্দুস্তানের পাদিশাহ্ হয় তাহলে পদবী পাবার আশায়। কিন্তু আমরা দেখেছি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সে মোটেই উৎসাহী নয়। গুজরাতে সীমান্ত এলাকায় নিজের উপপত্নীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে সে যখন অলস সময় অতিবাহিত করছে, তখন তাঁর মতোই সিংহাসনের দাবীদারদের ভিতরে সবচেয়ে দূর্বল, আদিল শাহের বিরুদ্ধে এই আপাত অর্থহীন অভিযানে সে আমাদের প্রেরণ করেছে। আমাদের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সে আমাদের সাথে পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকবল, যুদ্ধের উপকরণ কিংবা অস্ত্র প্রেরণ করেনি এবং গত তিনমাস আমরা কোনো বেতনও পাইনি। আমাদের ধারণা রাজসিংহাসন পুনরুদ্ধারের বিষয়ে একনিষ্ঠ এবং আপনি যখন সেই লক্ষ্য অর্জনে সফল হবেন তখন আমাদের পুরস্কৃত করতে কোনো রকম কার্পণ্য দেখাবেন না।

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার আব্বাজান তার অধীনস্ত তূর্কী তোপচিদের সম্বন্ধে কতখানি উচ্চধারণা পোষণ করতেন। আমিও অন্য সম্প্রদায় থেকে আগত যোদ্ধাদের দ্বারা দারুণভাবে উপকৃত হয়েছি। পারস্যের শাহের সৈন্যবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বৈরাম খান আমার সাথে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তোমার অভিপ্রায়ের আন্তরিকতার বিষয়ে আমি কিভাবে নিশ্চিত হবো?

আমরা পবিত্র কোরান শরীফ ছুঁয়ে আপনার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শপথ নিতে প্রস্তুত বা আপনার পরবর্তী আক্রমণের সময় নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য আপনি আমাদের আক্রমণ শুরু করার দায়িত্ব দিতে পারেন।

আমি দুটো প্রস্তাবই বিবেচনা করে দেখবো কিন্তু তার আগে তোমার জন্য প্রাথমিক একটা পরীক্ষা রয়েছে। তোমাদের বাহিনীর অন্য অংশের যেসব সৈন্যরা ঐ টিলার মাথায় আমাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় রয়েছে তাদের নিকটে গিয়ে, আত্মসমর্পণের জন্য তাঁদের প্ররোচিত করো। তাদের আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করতে আমার শর্তগুলো হল- ভারী যুদ্ধাস্ত্র রেখে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত অস্ত্র সাথে নিয়ে কোনোভাবে নিগৃহীত না হয়ে এখান থেকে বিদায় নিতে পারে বা তোমার মতো স্বেচ্ছায় আমার বাহিনীতে যোগ দিতে পারে। তারা যদি আত্মসমর্পন না করে, পরবর্তী আক্রমণের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তোমার প্রস্তাব আমি হয়তো বিবেচনা করবো, যা তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে। তুমি কি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি আছো?

জ্বী, সুলতান।

তার পায়ের শেকল খুলে দাও।

মুস্তাফা আর্গুনকে, সোয়া ঘন্টা পরে নিজের দশজন লোককে নিয়ে হুমায়ুনের শিবির থেকে ঘোড়ায় চেপে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। তাঁর সহযোদ্ধারা যেখানে সমবেত হয়েছে সেই টিলার কাছে সে পৌঁছালে তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে একটা ফাটলের জন্ম দিয়ে তাঁকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। হুমায়ুন দূর থেকে মুস্তাফা আর তার লোকদের গাছপালা শূন্য টিলার উপরে উঠতে দেখে সেখানে সমবেত হওয়া আধিকারিকদের সাথে আলোচনা করতে। অচিরেই সমবেত মানুষের জটলায় ভাঙ্গণের সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যেক আধিকারিককে নিজেদের লোকদের সাথে আলোচনা করতে দেখা যায়। প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখ সারির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পুনরায় উন্মোচিত হয়ে সেখান দিয়ে মুস্তাফা আর্গুন তার দশজন লোককে পেছনে নিয়ে বের হয়ে এসে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আগে টিলার উপর থেকে মাঝেমাঝেই উৎফুল্ল চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে।

বৈরাম খান আর আকবরকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ুনের দিকে সে হাসি মুখে এগিয়ে যেতে শুরু করলে হুমায়ুনের দুজন দেহরক্ষী তার দুপাশে নিজেদের স্থান করে নেয়। কেমন সাফল্য তুমি লাভ করেছে বলে মনে হয়?

সুলতান, আজ এখানে আর কোনো রক্তপাত হবে না। টিলার উপরে অবস্থানরত বাহিনীটার নেতৃত্বে রয়েছে সেলিম নামে এক গুজরাতি যুবরাজ এবং তার বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ গুজরাতি সৈন্য তার্তার খান রাজসিংহাসন অধিকার করার জন্য প্রথম যখন সিদ্ধান্ত নেন তখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তাঁরা এই অভিযানের ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে এবং বাড়ি ফিরে যেতে আগ্রহী আর সেজন্য আপনার শর্ত গ্রহণ করতে রাজি আছে।

ভালো কথা। আর বাকি এক তৃতীয়াংশের কি মতামত?

বিভিন্ন স্থান থেকে সমবেত হওয়া যোদ্ধাদের একটা দল। অনেকে একেবারেই কিশোর আমরা যাত্রাপথে তাঁদের গ্রামের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় অভিযানের নেশায় তারা আমাদের দলে যোগ দিয়েছিল কিন্তু এই মুহূর্তে তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বেশী আগ্রহী। বাকিরা আমাদের মতোই পোড়খাওয়া ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা, যাদের ভিতরে কেমিল আত্তাক নামে একজন সেনাপতির অধীনে আমার দেশ থেকে আগত একশ বকি, এবং প্রায় সমান সংখ্যক পার্সী তোপচি, আমাদের সাথে সামান্য সংখ্যক যে কামান রয়েছে সেগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। দুটো দলই আমাদের মতো তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আপনার বাহিনীর সাথে যোগ দিতে আগ্রহী।

তুমি তোমার উপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোমতো পালন করেছে। তোমার আর তোমার লোকদের আমার অধীনে চাকরি করার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করছি এবং আমার বাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগ দিতে আগ্রহী অন্যদের আমি গ্রহণ করবো যদি তাঁদের আধিকারিকেরা তাদের আন্তরিকতার ব্যাপারে তোমার মতো করে আমাকে বোঝাতে পারে। তারপরে হুমায়ুন, বৈরাম খানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, প্রতিটা বিজয় আমাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের হোঁচট খাওয়া চলবে না নতুবা আমরা এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছি সব হারিয়ে ফেলবো। আজ রাতে আমরা আমাদের বিজয় উদযাপন এবং আমাদের সাথে যোগ দেয়া নতুন সহযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে ভোজসভার আয়োজন করবো কিন্তু আগামীকাল সকালেই আমার সিংহাসনের শেষ দাবীদার, সিকান্দার শাহকে পরাস্ত করতে যাত্রা শুরু করবো। সে একজন চৌকষ সেনাপতি এবং তিন দাবীদারের ভিতরে তার সেনাবাহিনীই সবচেয়ে বড়। দিল্লী তার নিয়োজিত শাসনকর্তার অধিকারে রয়েছে এবং সে তার সেনাবাহিনী নিয়ে রাজধানী অভিমুখী সড়কের পাশে অবস্থান করছে। আমাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি।

সেদিন গভীর রাতে, কর্কশ কণ্ঠের গান আর আমোদ-ফুর্তির শব্দ অস্থায়ী ছাউনির চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলে, হুমায়ুন উৎসবের অনুষ্ঠান ত্যাগ করে। সে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে রাতের মখমল কালো আকাশের বুকে মিটমিট করতে থাকা তারকারাজির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু তারপরে মন্থর পায়ে হেঁটে নিজের তাবুতে ফিরে যায়। তাবুর সামনে অপেক্ষমান একজন প্রহরী পর্দা তুলে ধরতে হুমায়ুন ভেতরে প্রবেশ করে নীচু একটা টেবিলের সামনে আসন গ্রহণ করে। সে লেখার জন্য একটা লেখনী তুলে নিয়ে সেটা জেড পাথরের তৈরী কালির দোয়াতে ডুবিয়ে তুলে নিয়ে তেলের প্রদীপের মিটমিট করতে থাকা আলোয়, পরের দিন সকালে কাবুলের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথে ডাকবাহক দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার পূর্বে তাঁর হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য, হামিদাকে চিঠি লিখতে আরম্ভ করে। সে লিখে যে সে আর আকবর নিরাপদে রয়েছে, হামিদার প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা আরো একবার কবুল করে এবং সেই সাথে আরো জানায় যে সে নিশ্চিতভাবেই হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আরো একবার সে অধিষ্ঠিত হতে চলেছে।

*

বাতাস উষ্ণ আর নিশ্চল, এবং হুমায়ুন নীচু বেলেপাথরের পাহাড়ের উপরে তাঁর সুবিধাজনক অবস্থান থেকে চারপাশে তাকালে সে দেখে যে দূরে দিগন্তের কোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে যেমনটা বর্ষাকাল আসন্ন হওয়ায় গ্রীষ্মের শুরুর দিকের দুপুরবেলা প্রায়ই জমে থাকে। তার্তার খানের সেনাপতিদের পরাস্ত করার ঘটনা এখন প্রায় একমাসের পুরাতন একটা ব্যাপার। এই সময়ে সে নিজের যাত্রাপথ পূর্বদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সেকান্দার শাহের বাহিনীর পিছু ধাওয়া করেছে, লোকটার বাহিনীতে, গুপ্তদূতদের ধারণা অনুসারে প্রায় সোয়া লক্ষ সৈন্য রয়েছে সংখ্যাটা হেসেখেলে হুমায়ুনের বাহিনীর চেয়ে অনেক বেশী যদিও তাঁর নিজের বাহিনীর সংখ্যা এই মুহূর্তে এক লাখের কাছাকাছি।

হুমায়ুন দ্রুত অনুধাবন করে যে বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হলে সংখ্যার কারণে শত্রুর সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের ব্যাপারটাকে ক্ষয়িষ্ণু করতে হবে, উন্মুক্ত ভোলামাঠে তাঁদের মোকাবেলা করার আগে। হুমায়ুন সেজন্য, পক্ষকাল পূর্বে বৈরাম খানের অধীনে একদল হানাদার প্রেরণ করেছে এই আদেশ দিয়ে যে যতটা অল্প সংখ্যক জিনিষপত্র নিয়ে দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে গিয়ে হাজির হয়ে তার শত্রুদের পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়ি তছনচ করতে এবং দিল্লীর সাথে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটাতে। সে এখন রুক্ষ প্রান্তরের উপর দিয়ে বৈরাম খানের বাহিনী ফিরে আসছে। দেখতে পায়। বার্তাবাহক তাঁকে ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে তারা সামান্য সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু বৈরাম খানের নিজের মুখ থেকে সে এই সাফল্যের মাত্রা জানতে চায় এবং সে আর তার লোকেরা তাদের শত্রুর শক্তিমাত্রা আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে আর কি জানতে পেরেছে।

সংবাদের জন্য বড়বেশী উদগ্রীব থাকায় বৈরাম খান তাঁর সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে হুমায়ুন দেহরক্ষীদের তাঁর কাছে ডেকে পাঠায় এবং তার বিশাল কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে আস্কন্দিত বেগে পাহাড়ের উপর থেকে বৈরাম খানের সৈন্যসারি অভিমুখে নামতে আরম্ভ করে। হুমায়ুন আর বৈরাম খানকে একটা নিঃসঙ্গ গাছের সীমিত ছায়ার নীচে এক ঘন্টা পরে, লাল আর নীলের নক্সা করা একটা গালিচার উপরে ছড়িয়ে রাখা তাকিয়ার মাঝে বসে থাকতে দেখা যায়।

সুলতান, অতর্কিত হামলায় আমাদের সাফল্য বহু কষ্টার্জিত বিজয়। সিকান্দার শাহের সৈন্যরা আমাদের অন্যান্য প্রতিপক্ষের মতো না তারা যথেষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ। অতর্কিত হামলায় তারা যখন চমকে যায় এবং সংখ্যায় প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক কম তখনও তারা আতঙ্কিত হয় না বা পলায়ন করে না বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আরও প্রবলভাবে লড়াই করতে থাকে, কখনও কখনও আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগে তারা আমাদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে।

আমরা যেমন আশঙ্কা করেছিলাম, তারা আসলেই তবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। সিকান্দার শাহের সৈন্য সমাবেশ সম্বন্ধে কি কিছু জানতে পেরেছেন?

সে তার পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বে তাঁর প্রধান বাহিনীকে শদ্র নদীর একটা শাখানদীর দক্ষিণ তীরে শিরহিন্দ বলে একটা শহরের কাছাকাছি জড়ো করছে। তিনদিন পূর্বে সিকান্দার শাহের বার্তাবাহকদের একটা দলের কাছে আমাদের লোকেরা কিছু চিঠিপত্র জব্দ করেছিল সেগুলো থেকে জানা যায়, দিল্লী থেকে তিনি আরও অতিরিক্ত সৈন্য আসতে বলেছেন এবং আগামী দশদিনের ভিতরে তাদের একটা বিশাল বাহিনী তার অন্য সৈন্যদের বেতনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ আর সেই সাথে আরো যুদ্ধ উপকরণ নিয়ে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা করছেন।

আপনি নিশ্চিত সংবাদটার ভিতরে কোনো ঝামেলা নেই, একেবারে খাঁটি?

বার্তাটার উপরে সিকান্দার শাহের সিলমোহর করা ছিল, এই দেখেন…

বৈরাম খান তার বুকের সাথে ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা বহু ব্যবহারে জীর্ণ চামড়ার একটা বটুয়া খুলে ভেতর থেকে ভাঁজ করা কাগজের বিশাল একটা গোছা বের করে যার উপরে লাল মোম গলিয়ে সিল করা রয়েছে এবং সেটা হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে দেয়।

চিঠিটা দেখে আসলই মনে হচ্ছে কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কি কোনো কূটচালের অংশ হিসাবে সাজানও হতে পারে না?

সুলতান, আমার সেটা মনে হয় না। বার্তাবাহকদের আমাদের লোকদের যে দলটা বন্দি করেছিল তারা আমাদের মূল বাহিনী থেকে অনেক দূরে প্রায় চল্লিশ মাইল পূর্বদিকে রেকি করছিল। তারা বলেছে যে বার্তাবাহকদের তারা যখন পেছন থেকে ধাওয়া করেছিল তখন ইতস্তত বিচরণ করার বদলে, যেমনটা তাঁদের কাছে প্রত্যাশিত যদি তাঁরা ধরা দিতে আগ্রহী হতো, লোকগুলো প্রাণপনে ঘোড়া হাকিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি যখন বার্তাবাহকদের সাথে কথা বলি, সিকান্দার শাহের লোকেদের চোখে মুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি আর ধরা পড়ার জন্য তারা লজ্জিত সেটা স্পষ্ট ফুটে ছিল। তারা যদি অভিনয় করে থাকে তাহলে বলতেই হবে ব্যাটারা জাত অভিনেতা।

ঘটনা যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে শক্তিবৃদ্ধির জন্য প্রেরিত অতিরিক্ত বাহিনীর অভিগ্রহণের জন্য আমরা তাহলে দেহের প্রতিটা পেশী ব্যবহার করবো এবং অর্থ আর যুদ্ধ উপকরণ বাজেয়াপ্ত করবো। সম্ভাব্য সব যাত্রাপথের উপর নজর রাখতে অবিলম্বে গুপ্তদূতদের পথে নামার আদেশ দেন।

*

সুলতান, আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে তাঁদের নিয়োজিত প্রহরীরা সতর্ক করে দিয়েছে, আহমেদ খান সামান্য হাঁপাতে হাঁপাতে হুমায়ুনকে বলে। তারা সামনে অগ্রসর হওয়া বন্ধ করে এখান থেকে দুই মাইল দূরে ঐ উচ্চভূমিরেখার শীর্ষদেশের ওপাশে অবস্থিত একটা ছোট গ্রামের চারপাশে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে এসে একটা রক্ষণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করেছে আর এদিকে গ্রামটার বাসিন্দারা তাদের আসতে দেখে আগেই ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তারা গ্রামটার মাটির দেয়ালের পেছনে নিজেদের লোকদের মোতায়েন করছে এবং বাড়তি অবরোধক সৃষ্টির জন্য নিজেদের মালবাহী শকটগুলো উল্টো করে এলোপাথাড়ি ফেলে রাখছে।

তারা সেখানে কতজন লোক রয়েছে?

প্রায় পাঁচ হাজার হবে, বেশীরভাগই অশ্বারোহী যোদ্ধা যাদের ভিতরে, একটা অতিকায় মালবাহী শকটকে পাহারা দেবার জন্য, কিছু তবকিও রয়েছে। তাঁদের সাথে বেশ কিছু সংখ্যক ছোট কামানও রয়েছে।

তাদের চমকে দেয়ার আর কোনো সুযোগ এখন আমরা পাব না, তাঁরা নিজেদের যুদ্ধ প্রস্তুতি শেষ করার আগে এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হলো আক্রমণ করা। বৈরাম খান আপনার লোকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন।

হুমায়ুনকে ঘন্টা দেড়েক পরে গ্রামটার উপরে উচ্চভূমিরেখার শীর্ষদেশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং তাকিয়ে দেখে তার লোকদের আক্রমণের প্রথম ঝাপটা বৈরাম খানের নেতৃত্বে অস্থায়ী অবরোধকের পেছনে অবস্থান গ্রহণকারী সেকান্দার শাহের সৈন্যদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সেকান্দার শাহের কামান গোলাবর্ষণ শুরু করতে বিকট একটা শব্দ ভেসে আসে। বৈরাম খানের বেশ কয়েকজন লোক ভূমিশয্যা গ্রহণ করে। তবকির চাপা শব্দ এর ঠিক পরেই ভেসে এসে আরো কয়েকটা পর্যাণ আরোহী শূন্য করে। অবরোধকের কাছে পৌঁছাবার পূর্বে দ্বিতীয়বারের মতো কামান গোলাবর্ষণ করলে আরো বেশী সৈন্য হত হয় কিন্তু তারপরেও নাছোড়বান্দার মতো বৈরাম খানের লোকেরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।

আব্বাজান ওদিকে দেখেন ওখানে কি মুস্তাফা আর্গুন সৈন্যসারির সামনে অবস্থান করছে? আকবর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠে।

হুমায়ুন তাঁর সন্তানের নির্দেশক আঙ্গুলের গতিপথ অনুসরণ করে এবং গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া কামানের সাদা ধোয়ার ভিতরে তাঁর নতুন নিযুক্ত সেনাপতিকে নিজের মাদি ঘোড়া নিয়ে একটা মাটির দেয়ালে লাফিয়ে অতিক্রম করতে দেখে, তার বেশ কয়েকজন লোককে ঠিক পেছনেই অবস্থান করতে দেখা যায়। হুমায়ুন অন্যত্র দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখে যে তাঁর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের একটা বিশাল অংশ এমন জোরাল কামানের গোলার সম্মুখীন হয়েছে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে তারা পিছু হটে আসছে, সিকান্দার শাহের লোকদের তৈরী করা অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাঠামোর ঠিক সামনের এলাকায় মানুষ আর ঘোড়ার হত-আহত দেহ বিছিয়ে রয়েছে।

হুমায়ুন তারপরেই বৈরাম খানকে তাঁর একদল লোকের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করতে দেখে, ইতিপূর্বে যাদের জরুরী প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে কামানের আওতা থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মুস্তাফা আর্গুন আর তার লোকেরা অবরোধকের যে অঞ্চল অতিক্রম করেছে তারা আস্কন্দিত বেগে সেদিকে এগিয়ে যায় এবং তাঁদের অনুসরণ করে দ্রুত শত্রু শিবিরের ভেতরে প্রবেশ করে। তারা গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করেই পেছন থেকে প্রতিপক্ষের অবস্থানের উপরে হামলা শুরু করে। অশ্বারোহী যযাদ্ধারা বেশ কিছুক্ষণ মরীয়া হয়ে লড়াই করতে থাকে, কখনও আক্রমণ করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়, কখনও আবার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে করতে পিছিয়ে যায় কিন্তু সিকান্দার শাহের তবকিদের দৃঢ়তার কারণে ক্রমাগত ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হওয়া সত্ত্বেও অবরোধক অতিক্রম করে আরো বেশী সংখ্যক সৈন্য ভিতরে প্রবেশ করলে ধীরে ধীরে হুমায়ুনের সৈন্যরা প্রতিপক্ষের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। এক পা, এক পা করে আক্রমণ প্রতিহতকারীদের তাদের মূল অবস্থান থেকে। অপেক্ষাকৃত ছোট একটা জায়গায় পশুর পালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সিকান্দার শাহের একদল অশ্বারোহী সহসা নিজেদের সহযোদ্ধাদের জটলার ভিতর থেকে ছিটকে বের হয়ে এসে অবরোধকের একটা শূন্যস্থানের ভিতর দিয়ে লড়াই করে নিজেদের জায়গা করে নিয়ে তারপরে সেকান্দার শাহের মূল বাহিনীর অবস্থানের অভিমুখে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে ঘোড়ার খুরে তুফানের বোল তুলে ছুটতে শুরু করে।

তাদের আমাদের থামাতেই হবে, হুমায়ুন চিৎকার করে বলে। আমাকে অনুসরণ কর!

আকবরকে পাশে নিয়ে, হুমায়ুন তার ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নীচু করে রেখে প্রতিপক্ষের অশ্বারোহীদের পেছনে ধাওয়া করতে শুরু করে। ইস্পাতের বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম পরিহিত, গাট্টাগোট্টা দেহের একজন সেনাপতির নেতৃত্বে, দলটা পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে একত্রিত থেকে আর প্রতিরক্ষা বিন্যাস বজায় রেখে এগিয়ে যেতে থাকে, তারা স্পষ্টতই নিজের জীবনের পরোয়া না করে তাদের সহযোদ্ধাদের ভাগ্য বিপর্যয় সম্বন্ধে যত দ্রুত সম্ভব সিকান্দার শাহকে সতর্ক করাই আপাতভাবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

হুমায়ুন আর তার লোকেরা ধীরে ধীরে সামনের দলটার সাথে দূরত্ব কমিয়ে আনে। তারা যখন তীর নিক্ষেপের দূরত্বে অবস্থান করছে তখন হুমায়ুন পিঠ থেকে তাঁর ধনুক আলগা করে নিয়ে তীরের তূণীরের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায়। দাঁত দিয়ে লাগাম কামড়ে ধরে সে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষের সেনাপতিকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তাঁর তীর ইঞ্চিখানেকের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তার নিক্ষিপ্ত তীর লোকটার পর্যাণে বিদ্ধ হয়। সে ধনুকে দ্বিতীয় তীর জোড়ার আগেই শত্রু সেনাপতি গলায় তীরবিদ্ধ অবস্থায় ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে। তার পা রেকাবে আটকে গিয়ে সেভাবেই সে তাঁর আতঙ্কিত ঘোড়ার পেছন পেছন বেশ কিছুদূর ছেচড়ে যায়- পাথুরে মাটিতে তার মাথা লাফাতে থাকে- যতক্ষণ না রেকাব ভেঙে যায়। সে তারপরে মাটিতে দুবার গড়িয়ে গিয়ে নিথর হয়ে পড়ে থাকে। হুমায়ুন বুঝতে পারে প্রাণঘাতি তীরটা আর কেউ না, আকবর নিক্ষেপ করেছিল। সেকান্দার শাহের অন্যান্য লোকেরাও নিজেদের ঘোড়া থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।

শাবাস, দারুণ নিশানা ভেদ! হুমায়ুন নিজের ছেলেকে চিৎকার করে বাহবা দেয়, কিন্তু এখন আমার পেছনে থাকো।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে আবারও জন্তুটাকে প্রতিপক্ষের ডজনখানেক অবশিষ্ট যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে পুতবেগে ছোটায়। সে অচিরেই দলটার একেবারে পেছনের আরোহীর পাশে চলে আসে, বেচারা তাঁর ঘামে ভেজা, হাঁপাতে থাকা টাটু ঘোড়াটাকে বেপরোয়া ভাবে সামনের দিকে দাবড়াতে চেষ্টা করছে। হুমায়ুনকে দেখতে পেয়ে সে তার গোলাকৃতি ঢালটা কোনমতে অর্ধেক তুলে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। হুমায়ুনের তরবারির মৃত্যুদায়ী ফলা লোকটার শিরোস্ত্রাণের নীচে তাঁর গলার পেছনের দিকে আড়াআড়ি ছোবল বসায়। তার গোলাপী রক্ত ছিটকে আসে এবং শক্ত মাটির উপরে সে আছড়ে পড়ে।

হুমায়ুন পিছনে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না বরং পলাতক অশ্বারোহীদের একজনকে যাকে এখনও কেউ ধরতে পারেনি এবং তার একজন লোক তাঁকে ধাওয়া করছে কিন্তু সে এখনও প্রাণপনে ঘোড়া দাবড়ে চলেছে তার দিকে নিজের ঘোড়া ছোটায়। একটা দ্রুতগামী কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট লোকটা দুর্দান্ত, সাবলীল অশ্বারোহী তার ঘোড়ার খুর মাটিতে আঘাত করতে সেখান থেকে পাথরের টুকরো ছিটকে উঠে। হুমায়ুনের ঘোড়াটা অনেক তাজা হলেও সে প্রাণপনে দাবড়েও তাঁকে খুব একটা কাবু করতে পারে না। হুমায়ুন অবশেষে তাঁর আরও তিনজন দেহরক্ষীসহ লোকটার পাশে পৌঁছালে লোকটা তার একজন দেহরক্ষীকে হাতের বাকান তরবারি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করে। লোকটা হাত তুলে নিজের মাথা কোনমতে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচায় কিন্তু কলাচীতে একটা গভীর ক্ষত প্রাপ্ত হয়ে লড়াই থেকে পিছিয়ে আসে। দেহরক্ষীকে আঘাত করতে গিয়ে অবশ্য প্রতিপক্ষের অশ্বারোহী নিজেকে হুমায়ুনের তরবারির ধাক্কার সামনে নিজেকে অরক্ষিত করে ফেলে যা তাঁর উরুর গভীরে কেটে বসে যায় এবং সেও ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেলে তার ঘোড়াটা একাকী ছুটে দূরে চলে যায়।

হুমায়ুন নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং পর্যাণের উপর ঘুরে গিয়ে, সে পেছনে তাকিয়ে দেখে অবরোধের ভিতর থেকে পালিয়ে আসা সবাইকেই পরাভূত করা হয়েছে আর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আকবর নিরাপদ রয়েছে। তাঁরা সবাই যখন একত্রে আবার গ্রামের চারপাশের মূল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ফিরে যায় হুমায়ুন দেখে বেশীর ভাগ স্থানেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা মাটির ঘরের চারপাশে কেবল যা একটু যুদ্ধ চলছে। সেখানে একটা ঘরের খড়ের চালায় আগুন জ্বলছে, সম্ভবত মাস্কেট বা কামানের গোলাবর্ষণের সময় কোনো ফুলিঙ্গ এসে পড়েছিল বা তাঁর নিজের লোকেরাই ইচ্ছাকৃতভাবে ভেতরে আশ্রয় নেয়া লোকদের বাইরে বের করে আনবার জন্য আগুন ধরিয়েছে। হুমায়ুন কাছাকাছি এগিয়ে আসবার পরে দেখে যে সেখানের লড়াইও শেষ হয়েছে এবং প্রতিপক্ষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করছে।

চার ঘন্টা পরে, কালো প্রায় গাঢ় বেগুনী বর্ণের মেঘে আকাশ ছেয়ে যায় এবং একটা উষ্ণ বাতাস বইতে থাকে- হুমায়ুন ভাবে, যেকোনো দিন বর্ষাকাল শুরু হয়ে যাবে, সম্ভবত আজ দুপুরবেলায়ও ব্যাপারটা ঘটতে পারে। তাঁর টকটকে লাল রঙের নিয়ন্ত্রক তাবুর চাঁদোয়ার নীচে হুমায়ুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকবরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে, সে তার সন্তানের কাধ একটা হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি সবসময়ে নিজের তীরন্দাজির দক্ষতার জন্য গর্ববোধ করতাম কিন্তু আজ প্রতিপক্ষের সেনাপতিকে লক্ষ্য করে তোমার ছোঁড়া তীরটা অসাধারণ ছিল।

আপনাকে ধন্যবাদ, কিন্তু ব্যাপারটা সম্ভবত হঠাৎ ঘটে গিয়েছে।

আমার সেটা মনে হয় না- তোমাকে আমি তীর ছোঁড়া চর্চা করতে দেখেছি… হুমায়ুন চুপ করে থাকে, কোনো কথা না বলে কেবল তার কাঁধে জোরে একটা চাপ দেয়। নিশানা ভেদের চমৎকার নিদর্শন এবং আমি খুশী যে তুমি সেটা করেছে, প্রতিপক্ষের পলায়নরত অশ্বারোহীদের ধাওয়া করার সময় আমার উচিত ছিল তোমাকে আমার সঙ্গ নেয়া থেকে বিরত রাখা। কপালগুণে ছোঁড়া কোনো তীরের আঘাতে আমাদের দুজনেরই মৃত্যু ঘটে, আমাদের পরিবারের নিয়তি সম্পর্কে আমার সমস্ত আশা ধবংস হবার সাথে সাথে ঘটনাটা তোমার আম্মিজানকেও চরম বিষাদে আপুত করতো। আমরা ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে আলাদাভাবে অবস্থান করবো এবং আমি চাই তুমি সবসময়ে পশ্চাদে অবস্থান করবে।

কিন্তু আব্বাজান… আকবর প্রতিবাদের ভঙ্গিতে শুরু করে কিন্তু তার আব্বাজানের চোখে দৃঢ়সংকল্পের ইঙ্গিত দেখে সে কথা খুঁজে পায় না এবং তাঁর কথার যুক্তি সে তখন অনুধাবন করতে পারে।

যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বৈরাম খানের নেতৃত্বে আমাদের সেনাপতিরা আসছে, যুদ্ধের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে আলোচনা করতে। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তাবুর ভিতরে প্রবেশ করে যেখানে তার সিংহাসনের সামনে অর্ধবৃত্তাকারে তাকিয়া বিছিয়ে রাখা হয়েছে আর তার সিংহাসনের ঠিক ডানপাশে আকবরের জন্য একটা গিল্টি করা তেপায়া পাতা হয়েছে। সবাই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করার পরে, হুমায়ুন জানতে চায়, আমাদের কতজন লোক হতাহত হয়েছে?

আমাদের কমপক্ষে দুইশজন সৈন্য নিহত হয়েছে, এবং ছয়শর বেশী আহত হয়েছে, বেশীর ভাগেরই আঘাত মারাত্মক যাদের ভিতরে মুস্তাফা আগুনের বেশ কয়েকজন তূর্কী যোদ্ধা রয়েছে যারা প্রথমে অবরোধকের পেছনে পৌঁছেছিল।

মুস্তাফা আর্গুন আর তাঁর লোকেরা দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা যখন লুটের মাল বিলি বণ্টন করবো তখন তাদের অংশ দ্বিগুন করার কথাটা মনে রাখতে হবে, কিন্তু সেটা করার আগে আমাদের জানতে হবে আমরা ঠিক কতখানি সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পেরেছি।

সোনার মোহর ভর্তি দুটো অতিকায় সিন্দুক, বৈরাম খান জানায়, এবং পাঁচটা রূপার মোহর ভর্তি যেগুলো সিকান্দার শাহের সৈন্যদের বেতন হিসাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তাঁর লোকেরা তাঁদের এই ক্ষতির কারণে আশাহত হবে এবং এর ফলে হয়তো তাঁদের লড়াই করার প্রবৃত্তিরও পরিবর্তন হতে পারে।

আমরা সেটা কেবল আশা করতে পারি। আমরা যুদ্ধের উপকরণ কেমন দখল করেছি?

দুটো গরুর গাড়ি বোঝাই করা নতুন মাস্কেট ভর্তি কাঠের বাক্স এবং তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় বারুদ আর সীসার বল। দুটো একেবারে নতুন ব্রোঞ্জের কামান আর দশটা ছোটমাপের কামান। সেকান্দার শাহের লোকেরা ছয়টা কামানের নলে অতিরিক্ত বারুদ ভরে সেগুলো ধবংস করতে সক্ষম হয়েছে। তরবারি আর রণকুঠার ভর্তি অসংখ্য বাক্স ছাড়াও প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘোড়া আর বেশ কিছু সংখ্যক ষাড় আর মালবাহী খচ্চরও আমরা দখল করেছি। মোটামুটি বলা যায় আমাদের যুদ্ধের রসদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য আর সন্তোষজনক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে আর সেই সাথে সেকান্দার শাহের রসদ ঠিক একই পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

তার মোট কতজন লোক আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে?

প্রায় হাজার চারেক হবে। বাকিরা সবাই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। সুলতান আমরা বন্দিদের নিয়ে কি করবো?

তাদের আটচল্লিশ ঘন্টা বন্দি করে রাখো এবং তারপরে যারা পবিত্র কোরানশরীফ স্পর্শ করে শপথ করে বলবে যে তারা আর আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবে না, তাদের কোনো অস্ত্র ছাড়া পায়ে হেঁটে দক্ষিণে যাবার অনুমতি দেবে। সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের ব্যাপারে আমরা এবার আমাদের আলোচনা শুরু করতে পারি। জাহিদ বেগ, আপনার কি মনে হয় আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত?

বর্ষাকাল প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের পক্ষে এসময় সন্তোষজনকভাবে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হবে না- আমাদের কামান আর মালবাহী শকটগুলো এসময়ে খুব সামান্যই চলাফেরা করতে পারবে। আমাদের সাময়িকভাবে কোথায় শিবির স্থাপন করে দক্ষিণে গুপ্তদূতদের প্রেরণ করে সেকান্দার শাহ আর দিল্লীর মধ্যবর্তী প্রধান সংযোগ সড়কের উপর নজর রাখা উচিত, এবং তারপরে বর্ষাকাল সমাপ্ত হলে…।

না, হুমায়ুন তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমি চাই না বর্ষাকালের কারণে আমরা থেমে থাকি। সেকান্দার শাহও সেটাই প্রত্যাশা করবে। হিন্দুস্তানের সিংহাসন কল্পনাতীত রকমের মূল্যবান। আমি সেটা বহুদিন আগে হারিয়েছি। সেটা ফিরে পাবার সময় এখন হয়েছে। আমরা যদি এখনই তাঁকে আক্রমণ করার জন্য জোর দেই তাহলে আমরা তাকে চমকে দেবার একটা সুযোগ লাভ করবো। অতীতে আমি প্রায়ই দেরী করে ফেলতাম আর সুযোগ হারাতাম। এইবার সেটা আর হবে না। আহমেদ খান, সেকান্দার শাহের মূল বাহিনী এখান থেকে কতদূরে অবস্থান করছে? আমাদের কতদিন পথে থাকতে হবে তাঁর কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে?

তারা শতদ্রুর তীরে শিরহিন্দে এখনও অবস্থান করছে, জায়গাটা এখান থেকে প্রায় একশ মাইল পূর্বদিকে অবস্থিত, আমাদের বাহিনীকে তার সমস্ত উপকরণসহ সেখানে পৌঁছাতে খুব সম্ভবত দশদিন সময় লাগবে। আমাদের গুপ্তচরেরা জানিয়েছে তারা সেখানে বেশভাবে শিবির স্থাপন করেছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার আগে সেখানেই এবারের বর্ষাকালটা আরামে অতিবাহিত করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

বেশ, তাঁদের জন্য দারুণ একটা চমক অপেক্ষা করছে।

২.৬ আকবর জননী, হামিদাবানু

১১. আকবর জননী, হামিদাবানু

হুমায়ুন নিজে সর্বাগ্রে অবস্থান করে প্রধান তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে, যার চূড়া থেকে মোগলদের সবুজ নিশান নামিয়ে নেয়া হয়েছে, অতিক্রম করার চার ঘন্টা পরে দূর্গ প্রাসাদ সরকার অবশেষে তাঁদের দৃশ্যপট থেকে মিলিয়ে যায়। উত্তরপশ্চিম দিকে মন্থর গতিতে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলার সময় হুমায়ুন নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে পড়ে। মির্জা হুসেনের বাড়াবাড়ি রকমের আতিথিয়তার মাত্রা যদিও অব্যাহত ছিল কিন্তু সিন্ধে শুধু শুধু বসে থেকে সময়ক্ষেপনের কোনো মানে হয়না। তাঁকে সমর্থন করার লোকের সংখ্যা যখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, তাকে সাহায্য করার জন্য মির্জা হুসেনের উপরে চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা এখন হুমায়ুনের নেই এবং প্রতিটা দিন মনে হয় যেন তার জন্য অভিভব বয়ে আনছে।

পুনরায় যাত্রা শুরু কায়, সে একদিক দিয়ে স্বস্তি লাভ করে আর তাঁর অগ্রসর হবার গতি শ্লথ করে দেবে বলে যে চারটা কামান সে রেখে আসবে বলে মনস্থির করেছিল তার বদলে সে মির্জা হুসেনের কাছ থেকে বেশ ভালো রকমের মূল্যই উসুল করে নিয়েছে। নিজের অনাকাঙ্খিত অতিথির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য ব্যগ্র সুলতান দুই হাতে অর্থ ব্যয় করেছেন। নিজের বাহিনীর আহারের জন্য হুমায়ুনকে রসদ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা ছাড়াও তার বাহিনীকে বহন করার জন্য তিনি তাজা ঘোড়াও দিয়েছেন। সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে দুই মাসের ভিতরে সে মারওয়ারের মরুরাজ্যে উপস্থিত হবে সেখানের রাজপুত অধিপতি মালদেও তাঁকে সহায়তা করার জন্য মনে হয় যেন তার ভাইয়ের চেয়ে অনেক বেশী উদগ্রীব হয়ে আছে। রাজার প্রেরিত দূত, উজ্জ্বল রঙের আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায়, রোগা দেখতে এক লোক, তাঁর মাথার লম্বা চুল রাজপুত রীতিতে বেণী করে বাঁধা, সপ্তাহ দুয়েক পূর্বে সরকার এসেছিল। শেরশাহ সম্বন্ধে রাজা মালদেওয়ের ক্ষোভের কথা এবং তাঁর প্রতি রাজার শত্রতার কথা হুমায়ুনের কাছে সে বিস্তারিত বর্ণনা করেছে।

মোগলদের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধে পরাধিকারপ্রবেশক শেরশাহ রাজার সহযোগিতা দাবী করেছেন। আমার প্রভু যদি তার সাথে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন তাহলে মারওয়ার রাজ্যকে হুমকি দেবার ধৃষ্টতা দেখিয়ে সে আমার প্রভুকে অপমান করেছে। কিন্তু বাংলার জলাভূমি থেকে আগত একটা বর্ণসংকর কুকুরের সাথে আমার প্রভু কখনও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবে না। সুলতান, তিনি এর পরিবর্তে তার হাত বরং আপনার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন। মারওয়ারে তার সম্মানিত অতিথি হিসাবে তিনি আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যাতে করে আপনি আর আমার প্রভু আলোচনা করতে পারেন ভূঁইফোড়টার বিরুদ্ধে কিভাবে একত্রিত হওয়া যায়। আপনার সম্মতি নিয়ে তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজাদের ডেকে পাঠাতে চান, শেরশাহের ধৃষ্টতায় যারা তার মতোই অপমানিতবোধ করেছে।

মাথার উপর দিয়ে নীচু হয়ে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক সবুজ টিয়াপাখির তীক্ষ্ণ কলরব হুমায়ুনকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সে তারপাশে, সিন্ধে এক আরব ঘোড়া-ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা বাদামী রঙের দীর্ঘ গ্রীবার শক্তসমর্থ গড়নের স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট হিন্দালের দিকে আড়চোখে তাকায়।

আর দশ মাইল পরে আজ রাতের মতো আমরা ছাউনি ফেলবো, হুমায়ুন বলে।

আমাদের সেটাই করা উচিত। মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে…

কয়েকটা ভেড়া জবাই করে আমি বলবো রোস্ট করতে। আজ রাতে তুমি, আমি আর আমাদের পরিবারের মেয়েরা আমার তাবুতে আমাদের প্রধান সেনাপতি আর অমাত্যদের সাথে একসাথে আহার করবো। আমাদের সৈন্যদের জন্য আমি তাবুর বাইরে টেবিলের বন্দোবস্ত করতে বলবো। এটা আমাদের সবার মনোবল চাঙ্গা করবে…

আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে মারওয়ারের রাজা আমাদের সাহায্য করবে?

কেন করবে না? আমি আমাদের মরহুম আব্বাজানকে প্রায়ই রাজপুত গর্বের কথা বলতে শুনেছি। মালদেও যদি সত্যিই বিশ্বাস করে যে শেরশাহ তাকে অপমান করেছে, সে সেই অপমানের প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং শেরশাহকে পরাভূত করতে নিজের রাজপুত যোদ্ধাদের সাথে করে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করার চেয়ে আর উত্তম পন্থা কি হতে পারে? অবশ্য রাজা এর প্রতিদান প্রত্যাশা করেন কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না রাজপুতদের সাহসিকতা কিংবদন্তীতুল্য। মালদেও একজন উপযুক্ত মিত্র বলে প্রতিপন্ন হতে পারে এবং আমি আগ্রায় নিজের সিংহাসনে যখন পুনরায় আরোহন করবো আমি তাকে এজন্য উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করব।

আপনি এখনও আমাদের রাজবংশ আর এর নিয়তিতে বিশ্বাস করেন, এতসব কিছু ঘটে যাবার পরেও…?

হ্যাঁ। কামরান আর আসকারির বিশ্বাসঘাতকতা আর এতো রক্তপাতের পরেও যখন আমি আমার সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক মুহূর্তে এসব চিন্তা করি তখনও আমি এটা নিয়ে কোনো রকমের সন্দেহের দোলাচালে ভুগি না। আমি বিশ্বাস করি নিয়তি মোগলদের হিন্দুস্তানে নিয়ে এসেছে। তুমিও কি সেটা বিশ্বাস করো না?

হিন্দাল অবশ্য কোনো মন্তব্য করে না।

আমাদের মরহুম আব্বাজান তাঁর জীবনে বহু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন এবং কখনও হতাশ হননি, হুমায়ুন জোর দিয়ে বলে। তোমার যদি আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তবে তাঁর লেখা রোজনামচাগুলো পড়ে দেখতে কিংবা ফুপুজানের সাথে কথা বলতে পার। খানজাদার বয়স হয়েছে কিন্তু আমাদের আব্বাজানের, আবেগ আমাদের পূর্বপুরুষদের আবেগ, তার মাঝে এখন সমুজ্জ্বল রয়েছে। তিনিই আমার আফিমের নেশা থেকে আমাকে মুক্ত করেছেন এবং আমাকে অনুধাবন করতে সাহায্য করেছেন যে মহত্বের বোধই কেবল যথেষ্ট না- যা ন্যায্যত আমাদের তাঁর জন্য ঘাম রক্ত ঝরাতে, এবং যুদ্ধ আর সংগ্রাম করতে আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমাদের?

অবশ্যই। আমাদের মরহুম আব্বাজান যদিও আমাকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেছেন, কিন্তু আমরা সবাই বাবরের সন্তান, সবাই মোগল নিয়তির অংশীদার তুমি, আমি এবং এমনকি কামরান আর আসকারিও। আমাদের সবার দায়িত্বও একই। আমাদের রাজবংশ বয়সে নবীন, ভিনদেশী এই মাটিতে এর শেকড় এখনও ভালোমতো প্রোথিত হয়নি, কিন্তু আমরা পারবো- আমরা হবও মহান যতক্ষণ না আমরা নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে না ফেলবো বা একে অপরের সাথে লড়াই করে নিজেদের রাজবংশকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবো।

আপনি সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। মাঝেমাঝে, যদিও পুরো ব্যাপারটাই একটা বোঝার মতো মনে হয় যে আমার তখন কাবুলে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, যে আমাদের মরহুম আব্বাজান হিন্দুস্তানের কথা কখনও শোনেননি… হিন্দালের তামাটে চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা অপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তি এবং তাঁর দীর্ঘ, চওড়া দেহের কাঠামোটা মনে হয় যেন হতাশ হয়ে ঘোড়ার পর্যানে নুইয়ে পড়েছে।

হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে ভাইয়ের পেষল কাঁধ স্পর্শ করে। আমি বুঝি, সে মৃদুকণ্ঠে বলে, কিন্তু জন্মগত কারণে আমরা যা পরিচয় সেখানে আমাদের আমাদের পছন্দের কোনো অবকাশ ছিল না।

তিনঘন্টা পরে, একটা নীচু, পাথুরে পাহাড়ের বায়ু আচ্ছাদিত দিকে রাতের মতো অস্থায়ী ছাউনির আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হয় যা আহমেদ খান- নিজের গুপ্তদূতদের সাথে পুরো বহরের অগ্রে গমন করে- যা খুঁজে পেয়েছেন। হিন্দালের তাবুর ঠিক পাশে হুমায়ুনের টকটকে লাল রঙের বিশাল তাবুটা অস্থায়ী শিবিরের ঠিক কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়। পঞ্চাশ গজ দূরে খানজাদা এবং গুলবদন আর তাঁদের পরিচারিকা এবং হিন্দালের সফরসঙ্গী হিসাবে যে গুটিকয়েক মহিলা রয়েছে তাদের জন্য তাবুর বন্দোবস্ত করা হয়েছে, পুরো এলাকাটার চারপাশে বৃত্তাকারে মালবাহী শকটের ঘোড়ার গায়ের দড়িগুলো পরস্পরের সাথে গিট বাঁধা অবস্থায় নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরা করে রয়েছে।

মাটিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে লোকেরা, তন্দুরের আগুনে সেঁকার জন্য ময়দা আর পানি দিয়ে মণ্ড তৈরী করছে। কাঠের ধোয়ার গন্ধের সাথে অচিরেই ভেড়ার মাংসের সুগন্ধ মিলেমিশে যেতে থাকে যখন রাঁধুনির সহকারীরা সদ্য জবাই করা ভেড়ার মাংসের টুকরোয় নুন মসলা মাখিয়ে সূক্ষপ্রান্তযুক্ত দণ্ডে বিদ্ধ করে আগুনের উপরে ঘোরাতে শুরু করে। আগুনের লকলক করতে থাকা শিখায় চর্বি গলে পরতে একটা হিসহিস শব্দ ভেসে আসে। তাবুর ভিতরে হুমায়ুন যখন হাতের দস্তানা খুলছে আর জওহর তার কোমর থেকে তরবারির পরিকর আলগা করছে তখন তার পাকস্থলী এই গন্ধে মোচড় দিয়ে উঠে।

জওহর লাহোর ত্যাগ করার পরে আমি এই প্রথম কোনো ভোজের আয়োজন করলাম। আমি নিজের প্রাসাদে একসময়ে যেমন ভোজসভার আয়োজন করেছি তার তুলনায় আজকের আয়োজনটা বেশ গরীবি হালে করা হয়েছে, চমৎকার একটা প্রদর্শনী করে আমাদের অবশ্যই সেটা পুষিয়ে নিতে হবে। প্রত্যেকে অবশ্যই তাদের পেট ভরে পানাহার করবে…আমার তাবুতে যারা আহার করবে তাদের জন্য সোনা আর রূপার পাত্র বের কর…এবং আমি চাই আজ তুমি আমাদের বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে। আমি অনেক দিন তোমার বাঁশি বাজান শুনিনি।

সেদিন রাতে, হরিণের চামড়ার নরম পাতলুনের উপরে গাঢ় সবুজ রঙের জোব্বা পরিহিত হয়ে এবং কোমড়ের হলুদ পরিকরে রত্নখচিত খঞ্জর খুঁজে নিয়ে হুমায়ুন নিজের চারপাশে সন্তুষ্টির সাথে তাকায়। তার বামপাশে, হিন্দাল আর অন্যান্য বয়োজ্যোষ্ঠ আধিকারিকেরা অর্ধবৃত্তাকারে মাটিতে উপবিষ্ঠ অবস্থায় গল্পগুজবে মত্ত। জাহিদ বেগ ভেড়ার একটা হাড় নিয়ে মনের সুখে কামড়াচ্ছে। লোকটা দেখতে হ্যাংলা পাতলা হলে কি হবে, হুমায়ুনের যেকোনো সেনাপতিকে সে অনায়াসে খাবার প্রতিযোগিতায় হারাতে সক্ষম এবং সে নিজের এই দানবিক খাদ্যরুচির জন্য যারপরনাই গর্বিত। হুমায়ুন হাসিমুখে তাকিয়ে দেখে সে হাড়টা ফেলে দিয়ে নিজের ছুরির সাহায্যে রোস্ট করা মাংসের আরেকটা বড় টুকরো কেটে নেয়।

তাবুর দূরবর্তী প্রান্তে উঁচু পর্দার একটা ঘেরাটোপ যা তাঁদের অন্যদের দৃষ্টির আড়ালে রেখেছে, মহিলাদের ছোট দলটা আহারে বসেছে যেখানে গুলবদন আর খানজাদাও রয়েছে। তাঁদের কথোপকথনের ধ্বনি প্রায় নম্র নিঃশব্দ এবং তাঁদের হাসি পুরুষদের চেয়েও বেশী চাপা যদিও প্রায় একই রকম নিয়মিত। হুমায়ুন আশা করে যে তারা তাদের চাহিদামতো সবকিছু পেয়েছে এবং নিজে গিয়ে সেটা দেখবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ঘেরাটোপের কিনারা থেকে ঘুরে তাকিয়ে সে গুলবদনকে পা নিজের দেহের নীচে মার্জিত ভঙ্গিতে ভাঁজ করে রেখে, তাঁর পাশেই বসা এক অল্পবয়সী মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখে। মেয়েটার মুখের উপরে আলো আধারি খেলা করছে কিন্তু একটা পাত্র থেকে মিষ্টান্ন তুলতে সে যখন সামনে ঝুঁকে আসে, মোমের আলো তার মুখাবয়ব আলোকিত করে তুলে।

মেয়েটার মরাল গ্রীবার উপরে মার্জিত ভঙ্গিতে স্থাপিত তাঁর ছোট মাথা, তাঁর মুখমণ্ডলের ধুসর উপবৃত্তাকৃতি, মাথার ঝলমলে কালো চুল পেছন দিকে টেনে নিয়ে কারুকার্যখচিত চিরুনি দিয়ে আটকানো, আর তাঁর উজ্জ্বল দুটো চোখ, তাকিয়ে দেখতে গিয়ে হুমায়ুন টের পায় তার তলপেটে হাজার প্রজাপতির ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে, সহসা তাঁর দৃষ্টির আবেক্ষণ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে, সে ঘুরে তাঁর দিকে তাকায়। তার চাহনীতে একাধারে বিস্ময় এবং বাস্তবতা- সম্রাটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে সেখানে কোনো প্রকার উত্তেজনা ছাপ পড়েনি- এবং এটা প্রায় আন্ত্রিক বিহ্বলতার একটা ঝাপটার মতো তাঁকে আপুত করে। হুমায়ুন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে মেয়েটা তাঁর চোখ নীচু করে এবং পুনরায় গুলবদনের দিকে তাকায়। তাঁর মুখপার্শ্বে- তার হাসির ভঙ্গি দেখে মনে হয় দুজনে কোনো একটা রসিকতা উপভোগ করছে- নিখুঁত চিবুক আর ক্ষুদে একটা নাক ফুটে আছে। তারপরে, পেছনে হেলান দিতে সে পুনরায় অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

হুমায়ুন পুরুষদের মাঝে নিজের অবস্থানে ফিরে আসে, সৌজন্যতাবশত মেয়েদের ভালোমন্দের খোঁজ খবর নিতে গিয়ে সে নিজের হালহকিকত বিপর্যস্ত করে ফিরে এসেছে। এক ঝলক দেখা সেই অচেনা মুখটা তাঁকে এতোটাই তাড়িত করে যে খাবারের প্রতি মনোযোগ দেয়াটা তার কাছে অসম্ভব মনে হয়। সে অগত্যা তাঁর ভাইয়ের কাঁধে আলতো টোকা দেয়।

হিন্দাল, তোমার বোনের পাশে একজন অল্পবয়সী মেয়ে বসে রয়েছে, তাঁকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। একটু গিয়ে দেখে আসবে, যদি তুমি তাকে চেনো তাহলে আমাকে জানাবে। হিন্দাল উঠে দাঁড়িয়ে ঘেরাটোপের দিকে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকায়। তারপরে ধীরপায়ে ফিরে এসে হুমায়ুনের পাশে বসে।

চিনেছো?

হুমায়ুনের কাছে মনে হয় যে হিন্দাল উত্তর দেবার আগে একটু যেন ইতস্তত করে। মেয়েটার নাম হামিদা। আমার উজির, শেখ আলি আকবরের, কন্যা…

মেয়েটার বয়স কত?

চৌদ্দ কি পনের বছর হবে…

শেখ আলি আকবর কোনো গোত্রের লোক?

তার পরিবার পারস্য বংশোদ্ভূত, কিন্তু আমাদের আব্বাজানের সময়ে, উজবেকরা তাদের বিতাড়িত করার আগে, বহু যুগ ধরে তারা সমরকন্দের স্থায়ী অধিবাসী হিসাবে বসবাস করছিল। শেখ আলি আকবর যখন তরুণ তখন সেখান থেকে পালিয়ে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত আমার আলওয়ার প্রদেশে এসে থিতু হন। সেখানে আমি তাকে আমার প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ করি।

তাকে কি একজন ভালো পরামর্শদাতা বলা যাবে?

হ্যাঁ। এবং সম্ভবত তারচেয়েও বেশী কিছু। খ্যাতনামা এক সুফী সাধকের রক্ত তার ধমনীতে বইছে- জাম নগরের আহমেদ, যার ভবিষ্যতের ঘটনা আগাম বলতে পারার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নিজের এই ক্ষমতার কারণে জিনদা-ফিল, সংহারক হস্তি নামে পরিচিত ছিলেন।

আগামীকাল সকালে আমরা রওয়ানা হবার পূর্বে শেখ আকবর আলিতে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।

সেই রাতে হুমায়ুন দুচোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ করতে পারে না। সরকারে অবস্থানকালে মির্জা হুসেনকে যদিও সে বলেছিল নিজের সিংহাসন পুনরুদ্ধার না করে সে দার পরিগ্রহ করবে না, নিজের মনে সে খুব ভালো করেই জানে যে হামিদাকে সে অবশ্যই বিয়ে করবে। যুক্তি কিংবা ভাবনার কোনো স্থান নেই এখানে, তার পূর্বেকার কোনো প্রেমিকার জন্য সে নিজের এতো তীব্র আবেগ কখনও অনুভব করেনি, এমনকি সালিমাকেও সে এতোটা পছন্দ করতো না। এটা হামিদাকে একান্তভাবে নিজের করে পাবার আকাঙ্খ কেবল না- যদিও এটা নিশ্চিতভাবে এর একটা অংশ। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে বুঝতে পেরেছে মেয়েটার একটা সুন্দর মন আছে, সেখান থেকে তাঁর দিকে আধ্যাত্মিক শক্তির একটা বিকিরণ ঘটছে। সে জানে যে হামিদা কেবল তাকে সুখীই করবে না, সেই সাথে সে তার পাশে থাকলে হুমায়ুন নিজেকে প্রজাপ্রিয় একজন শাসক হিসাবে গড়ে তুলতে পারবে, নিজের আকাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে আরও যোগ্য হয়ে উঠবে। সে যতই এসব ভাবনাকে অযৌক্তিক বলে বাতিল করতে এবং এসব বয়ঃসন্ধিকালের লাজুক নম্রতার সাথে বেশী মানানসই বলে নিজেকে যতই বোঝাতে চেষ্টা করে, ভাবনাগুলো নতুন করে প্রবলভাবে ফিরে ফিরে আসতে চায়। চারণকবির দল একেই কি প্রেমে পড়া বলেছেন?

পরের দিন সকালে দিনের আলো ফোঁটার অনেক আগে হুমায়ুন শয্যা ত্যাগ করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে রাজোচিত আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় পরিচারকদের সবাইকে বিদায় করে দিয়ে অসহিষ্ণুচিত্তে অপেক্ষা করতে থাকে। তাঁর লোকদের মাঝে অনেকক্ষণ পরে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিতে শুরু করে, গতরাতের আগুনকুণ্ডের গনগনে কয়লায় তারা লাথি মেরে আগুন উসকে দিয়ে নিজেদের তাবু আর অন্যান্য সরঞ্জামাদি গুছিয়ে নিতে শুরু করে যাত্রা আরম্ভ করার জন্য নিজের প্রস্তুত করতে থাকে। হুমায়ুন এবার তার তাবুর বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনে এবং জওহর তাবুতে প্রবেশপথের পর্দা তুলে ধরতে শেখ আলি আকবর মাথা নীচু করে ভেতরে প্রবেশ করে।

সুলতান, আপনি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। শেখ সাহেব দেখতে বেশ লম্বা এবং নিজের মেয়ের মতোই চমৎকার দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। তিনি মার্জিত ভঙ্গিতে হুমায়ুনকে কুর্নিশ করে এবং অপেক্ষা করতে থাকে।

গতরাতে আয়োজিত ভোজসভায়, আমি আপনার মেয়ে হামিদাকে দেখেছি। আমি তাকে আমার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে চাই। সে হবে আমার সম্রাজ্ঞী এবং ভবিষ্যত সম্রাটের জননী… হুমায়ুন গড়গড় করে বলতে শুরু করে।

শেখ আলি আকবর বিস্মিত দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে।

শেখ আলি আকবর, আসলে ব্যাপারটা হল? হুমায়ুন নাছোড়বান্দার মতো বলতে থাকে।

মেয়েটা এখনও কিশোরী…

তাঁর বয়সী অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তার কোনো রকমের অযত্ন আমি হতে দেবো না…

কিন্তু আমাদের পরিবার এই সম্মানের উপযুক্ত না…।

আপনারা সমরকন্দ থেকে আগত সম্ভ্রান্তজন…আমার নিজের আম্মিজানের সাথে আমার আব্বাজান যে আচরণ করেছিলেন আমি যদি আপনার কন্যাকে সেভাবে আরও সম্মানিত করতে চাই তাহলে কেন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন? আমার আম্মিজানের পিতা- আমার নানাজী বাইসানগার- আপনার মতোই সমরকন্দের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন।

শেখ আলি আকবর চুপ করে থাকে, কোনো কথা বলে না। বিমূঢ় হুমায়ুন এবার তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। লোকটার চোখে মুখে ফুটে উঠা অস্বস্তি দেখে বোঝা যায় কোনো একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কি ব্যাপার বলেনতো? এমন প্রস্তাবে বেশীর ভাগ পিতারই উল্লসিতবোধ করার কথা।

সুলতান, আমার জন্য এটা একটা অকল্পনীয় সম্মান। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি…না ভুল বললাম, আমি জানি… আপনার সৎ-ভাই হিলাল হামিদার প্রতি দুর্বল। হিন্দাল তাঁকে খুব অল্প বয়স থেকেই চেনে। আমি তার নুন খেয়েছি এবং সুলতান, আপনাকে এসব বিষয়ে অবহিত না করে তাঁকে যদি আমি অন্যকারো হাতে তুলে দেই, এমনকি সেটা যদি আপনিও হন, ব্যাপারটা আমার জন্য অবাধ্যতারই পরিচায়ক হবে।

তাঁদের বাগদান কি হয়ে গিয়েছে?

না, সুলতান।

আর হামিদা। তার কি অভিপ্রায়?

সুলতান, এটা আমি ঠিক বলতে পারবো না। এসব বিষয়ে আমি কখনও তাঁর সাথে আলোচনা করিনি এবং আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তিনি এসব বিষয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করতে পারতো… হামিদার জন্মের ঠিক পরপরই তাঁর মা একটা অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

আপনি নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আমি এটা সম্মান করি কিন্তু সেই সাথে আমি আপনার মেয়ের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে চাই। আজ থেকে এক সপ্তাহের ভিতরে আশা করি আমি আপনার মনোভাব জানতে পারবো। আর শেখ আলী…আমার ভাই আমাকে বলেছে যে এক মহান ভবিষ্যদর্শীর রক্ত আপনার ধমনীতে বহমান, যিনি ভবিষ্যতের ঘটনাবলী আগাম বলে দিতে পারতেন…আপনি যদি তার বিন্দুমাত্র গুণ লাভ করে থাকেন তবে ভবিষ্যত দেখতে পাবার সেই ক্ষমতা আপনি এবার কাজে লাগাতে পারেন। আপনি দেখতে পাবেন যে আপনার কন্যা মহীয়সী আর সুখী হবে যদি আপনি তাকে আমার হাতে তুলে দেন।

সুলতান। কিন্তু শেখ আকবর আলি বিদায় নেবার জন্য যখন ঘুরে দাঁড়ায় তাঁর মুখাবয়বে তখনও উদ্বেগ আর অশান্তি খেলা করে। শেখ আলি আকবর যখন বাইরে বের হবার জন্য প্রবেশপথের পর্দা একপাশে সরিয়ে দিতে, তাবুর ভিতরটা দিনের প্রথম সূর্যালোক উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে, একমুহূর্তের জন্য হুমায়ুনের চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

সেদিনই দুপুরের দিকে, হুমায়ুন কিছুক্ষণ একাকী থাকবার অভিপ্রায়ে মূলসৈন্যসারি ত্যাগ করে এবং দুলকীচালে একাকী ঘোড়া দাবড়াতে আরম্ভ করে। ঘোড়ার খুরের ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ তাঁর কানে তালা লাগিয়ে দেয়, সে এখনও এতো আকষ্মিক, এতো প্রবল, আর এতো অপ্রত্যাশিত অনুভূতির সাথে খাপ নিতে চেষ্টা করছে। অন্য আর কোনো মেয়ে তার মাঝে এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর হৃদয়ের ভিতরে অবশ্য একটা অশুভ ভাবনা ঘাপটি মেরে থাকে একটা অপরাধবোধ যে নিজের সৎ-ভাইয়ের ভালোবাসার নারীকে সে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাইছে। কিন্তু সে কিছুতেই হামিদার অপরূপ মুখশ্রী, তার ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব নিজের মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। সে হামিদাকে তাঁর সম্রাজ্ঞী করবে আর সে হিন্দালের অনুভূতিকে তার যতই আঘাত করতে হোক।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা, একটা পিতলের গামলায় জওহরের নিয়ে আসা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হুমায়ুন যখন তার চোখেমুখে ঝাপটা দিচ্ছে তখন সে তার তাবুর বাইরে বেশ কয়েকজনকে উচ্চকণ্ঠে আলাপ করতে শোনে। তারপরেই ঝড়ের বেগে হিন্দাল তাবুর ভিতরে প্রবেশ করে, তার পরনে তখনও সারাদিনের যাত্রার পরে ধূলো আর ঘামে ভেজা অশ্বারোহীর পোষাক।

এটা কি সত্যি? হিন্দালের কণ্ঠস্বর সংযত কিন্তু চোখে দাবানলের পূর্বাভাষ।

কোনটা কি সত্যি? হুমায়ুন জওহরকে ইঙ্গিতে বাইরে যেতে বলে।

শেখ আলি আকবর আমাকে বলেছে আপনি নাকি হামিদাকে বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করেছেন।

হ্যাঁ। তাকে আমি আমার স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই।

সে… সে আমার উজিরের কন্যা। আমি তাকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি… তার প্রতি আপনার চেয়ে আমার দাবী অনেকবেশী জোরাল… হিন্দালকে স্নায়ুবিকারগ্রস্থ একজন মানুষের মতো দেখায়।

তোমাকে আঘাত দেয়াটা আমার অভিপ্রায় না কিন্তু একটা সময় এটা প্রশমিত হবে। তুমি আরেকজন রমণীকে খুঁজে পাবে যে তোমাকে প্রীত করবে…

গত কয়েকমাস একসাথে কাটাবার পরে আমি মনে করেছিলাম আমরা বোধহয় পরস্পরকে খানিকটা হলেও চিনতে পেরেছি। আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম। আমি আপনাকে সমর্থন করেছি যখন কামরান আর আসকারির মতো আমিও অন্য কোথাও নিজের ভাগ্য অন্বেষণ করতে পারতাম আর তার ফলাফল হয়ত ভালোই হত। আপনাকে অনুসরণ করে এটা আমি কি পুরষ্কার পেলাম? কিস্যু না! লাহোর থেকে আমরা বলতে গেলে প্রায় দুপায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেঁচেছি। সিন্ধে আমাদের ভাগ্য বলতে হবে প্রসন্নই ছিল- নিজেদের মানসম্মান নিয়ে সরে আসবার পূর্বে মির্জা হুসেন আমাদের সাথে পোষা কুকুরের মতো আচরন করেছে। কিন্তু আমি তারপরেও বিশ্বস্ত থেকেছি আর আমার অধীনস্ত যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করেছি, এই আশায় যে শীঘ্রই শেরশাহের বিরুদ্ধে আমি আর আপনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হব। আপনি এর পরিবর্তে, নিশিকুটুম্বের মতো, তিলেকমাত্র চিন্তা ভাবনা না করে, আমাদের পরিবারের প্রধান হিসাবে নিজের অবস্থানের অপব্যবহার করে আমি যে মেয়েকে ভালোবাসি তাকে আমার কাছ থেকে চুরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন…

বিশ্বাস কর, তাঁর বাবার সাথে কথা বলার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না যে তুমি তাকে পছন্দ কর।

কিন্তু আপনি যখন বিষয়টা জানতে পেরেছেন তখনও আপনি নিজেকে সংযত করেননি, তাই না? হিন্দাল তার দিকে এগিয়ে আসে। কামরান আর আসকারি

ন ৩২.পণ ও এ এম এম ঠিকই বলতো। আপনি হলেন আপনার নিজের ব্রহ্মাণ্ডের স্বনিয়োজিত কেন্দ্র। বছরের পর বছর আপনি আমাদের কেবল অবহেলাই করেছেন, আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ প্রদেশে পড়ে পড়ে পচার জন্য ফেলে রেখে পুরোটা সময় আপনি মহান সম্রাটের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। শেরশাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবার পরে আমাদের সাহায্য যখন আপনার প্রয়োজন হয়েছে। কেবল তখনই আপনি আমাদের সবার অলিখিত শত্রুর বিরুদ্ধে একতা আনয়ন, ভ্রাতৃসুলভ দায়িত্ব নিয়ে বড় বড় কথা বলতে আরম্ভ করেছেন।

হিন্দালের কণ্ঠস্বর এখন প্রায় চিল্কারের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং অবদমিত ক্রোধের কারণে সে প্রায় থরথর করে কাঁপছে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, হুমায়ুন সিন্দুকের দিকে তাকায় যার উপরে জওহর কিছুক্ষণ আগে কারুকার্যময় ময়ানে রক্ষিত আলমগীর রেখে গিয়েছে। তাঁর খঞ্জর অবশ্য এখনও তার সাথেই রয়েছে এবং তার কোমরের পরিকরের নীচে পাঁজরের কাছে সে এর শক্ত ধাতব বাটের অস্তি ত্ব বেশ অনুভব করতে পারে।

ছোট ভাই, যা বলছো একটু ভেবেচিন্তে বল…

কেবল সৎ-ভাই।

তুমি এখন ভুলে গেছো কেন অন্যদের সাথে তোমাকেও আমি আগ্রা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তোমরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলে। তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আমি মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতাম… আমি তোমাদের সবার জান বখশ দিয়েছিলাম।

আমি তখন মাত্র কৈশোর অতিক্রম করেছি, বয়সটাই ছিল সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার। আপনি যদি আমার প্রতি সামান্যতম আগ্রহ প্রদর্শন করতেন, আমার দ্বারা এমন ঘটনা কখনও সংঘটিত হতো না। কিন্তু আপনি তখন কেবলই নক্ষত্রের দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকতেন… আমি ছেলেটা আসলেই কেমন, আমার আশা এবং আকাঙ্খগুলোর রং কেমন, আপনি কখনও এসব জানবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেননি। আমার কাছ থেকে আপনি কেবল প্রশ্নতীত আনুগত্য এবং আজ্ঞানুবর্তিতা কামনা করেছেন যাতে করে আপনি নিজের উচ্চাকাঙ্খ বাস্তবায়িত করতে পারেন…

হুমায়ুন তার এই সৎ-ভাইটিকে এতো প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে কথা বলতে বা চোখে দেখেনি। সে ঘনঘন শ্বাস নেয়। তার পুরো মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে এবং নাসারন্ধ্র প্রসারিত আর কপালের পাশে রক্তবাহী একটা শিরা দপদপ করছে।

হিন্দাল, এই বিষয়টা নিয়ে তর্ক করাটা আমাদের উচিত হবে না। বিশ্বাস কর, নতুন মেয়ে মানুষের জন্য এটা কোনো খেয়াল বা ক্ষনিকের মোহ নয়। আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনো প্রকার পরিকল্পনা করিনি- ব্যাপার কেমন করে যেন ঘটে গিয়েছে। ভোজসভায় তাকে আমি যখন দেখেছি তখনই আমি জানি…

কিন্তু হিন্দালকে দেখে মনে হয় এসব কিছুই শুনছে না। কোনো ধরনের আগাম পূর্বাভাষ না দিয়ে সে সহসা হুমায়ুনকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, অপ্রস্তুত থাকার কারণে সে দ্রুত সরে যেতে পারে না। হিন্দালের পেষল হাতের মুঠি হুমায়ুনের কাঁধে চেপে বসে এবং পরমুহূর্তে হুমায়ুন নিজেকে ঢালাই লোহার লম্বা ধূপদানের উপরে। আছড়ে পড়তে দেখে।

তাবুর ভেতরে ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনে হুমায়ুনের দেহরক্ষীরা দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে। না! সে চিৎকার করে উঠে, ইঙ্গিতে তাঁদের হস্তক্ষেপ করতে মানা করে। হিন্দাল আবারও তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে শুরু করে এবং হুমায়ুন টের পায় তাঁর পাঁজরে সৎ-ভাইয়ের নাগড়া পরা পা এসে সজোরে আঘাত করেছে, তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে গেলে সে নিঃশ্বাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে শুরু করে। কিন্তু যৌবনের উদ্যম দিনগুলোতেই হুমায়ুন নিজেকে একজন তুখোড় কুস্তিগীর হিসাবে গড়ে তুলেছে- শক্তিধর এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নিজের সেই নৈপূণ্য সে এখনও বিস্মৃত হয়নি। হিন্দাল তাকে আবারও লাথি মারতে চেষ্টা করতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার পা আকড়ে ধরে এবং গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা মুচড়ে দেয়। দেহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে, হিন্দালের ভারী দেহটা একপাশে কাত হয়ে যায় এবং হুমায়ুন যেখানে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখে কোহ-ই-নূর আর তার আব্বাজানের নিজের হাতে লেখা রোজনামচার খাতাগুলো লোহা দিয়ে মোড়া সেই সিন্দুকের কিনারায় সে নিজের মাথা দিয়ে সজোরে আঘাত করে।

কপাল থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া রক্ত আর চোখেমুখে একটা বিমূঢ় অভিব্যক্তি নিয়ে হিন্দাল টলমল করতে করতে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে নিজেকে সুস্থির করার আগেই হুমায়ুন মাথা নীচু করে সামনে এগিয়ে আসে এবং নিজের গতি আর ভরবেগ ব্যবহার করে হিন্দালের ভারী দেহ মোকাবেলা করে। হিন্দালের বাম পা পেছন থেকে নিজের ডান পা দিয়ে আকড়ে ধরে, সে তাঁকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয় এবং নিজের দেহের ভর তার উপরে চাপিয়ে দিয়ে দুজনে একসাথে মাটিতে আছড়ে পড়ে, হুমায়ুন তার উপরে থাকে। হিন্দালের মোষের মতো মাথাটা সে দুহাত দিয়ে আকড়ে ধরে টেনে তুলে এবং তারপরে সেটা সজোরে মাটিতে ঠুকে দেয়। হিন্দাল তার দেহের নীচে যন্ত্রণায় মোচড়াতে শুরু করে, চেষ্টা করে তাকে সরিয়ে দিতে কিন্তু হুমায়ুনের আঙ্গুলগুলো ততক্ষণে মৃত্যুর বারতা নিয়ে তার শ্বাসনালীতে চেপে বসতে শুরু করেছে। হিন্দালের শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগ ঘ্যঁসঘেঁসে ফোপানির সাথে দ্রুততর হতে থাকে, পাগলের মতো তার দেহ মোচড়াতে শুরু করলে আরেকটু হলেই হুমায়ুন ছিটকে পড়তো। অবশ্য নিজের দুই উরু দিয়ে যত জোরে সম্ভব হিন্দালকে আকড়ে ধরে থাকায় হুমায়ুন তার উপরেই অবস্থান করে এবং তার হাত আরো জোরে ভাইয়ের গলায় চেপে বসতে থাকে।

নিজের দেহের নীচে হিন্দালের দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে টের পেয়ে, সে চোখ নামিয়ে তার মুখের দিকে তাকায়। পুরো ব্যাপারটা ভাওতা হতে পারে, মল্লযুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সে নিজেও বহুবার এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু হিন্দালের চোখ বন্ধ এবং রক্ত জমে তার মুখ বেগুনী বর্ণ ধারণ করেছে। হুমায়ুন নিজের মুঠি শীথিল করে এবং ভাইয়ের উপুড় হয়ে থাকা দেহের কাছ থেকে সাবধানে উঠে দাঁড়ায়, পুরোটা সময় এক মুহূর্তের জন্যও তার উপর থেকে চোখ সরায় না।

বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা হিন্দাল হাপড়ের মতো মুখ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে এবং হাত দিয়ে নিজের গলা আকড়ে ধরে, হুমায়ুন সেদিকে তাকিয়ে দেখে ইতিমধ্যে সেখানে কালসিটে পড়তে আরম্ভ করেছে। কিছুক্ষণ পরে, সদ্য লড়াইয়ে পরাভূত হওয়া বিশাল একটা ভালোকের মতো টলোমলো পায়ে সে উঠে দাঁড়ায়। তার কপালের ক্ষতস্থান থেকে এবার প্রবলভাবে রক্তপাত শুরু হতে তাঁর পরনের জোব্বার সামনের অংশ নিমেষে রক্তে লাল হয়ে উঠে। কিন্তু সে ঘুরে হুমায়ুনের দিকে পরিষ্কার, উজ্জ্বল আর অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

বেশ তাহলে আপনিই তাকে গ্রহণ করেন। আপনি আমাদের সম্রাট আর এই একটা বিষয় আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে আপনি কখনও ক্লান্তিবোধ করেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে আবারও আপনার সাথে আমার দেখা হতে পারে এমন আশা পোষণ করবেন না। আজ এখানে আমাদের মৈত্রীর সমাপ্তি ঘটল। আজ রাতেই আমি আমার লোকজন নিয়ে এখান থেকে বিদায় নেব।

আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছে। মাথা গরম করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যেও না…হামিদাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেবার কোনো পরিকল্পনা আমার মাথায় ছিল না… কিন্তু তাঁকে যখন আমি দেখি আমি সেই মুহূর্তে বুঝতে পারি এটাই নিয়তির লিখন…।

হিন্দালের রক্তাক্ত মুখে বিদ্রুপাত্মক একটা হাসি ফুটে উঠে। নিয়তির লিখন…? মানুষের অভিব্যক্তি আপনি এখনও বুঝতে পারেন না, তাই না, এমনকি আপনার নিজের ভাইদেরও না। আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগতের বাসিন্দা যেখানে আপনি নিজের আকাঙ্খাকে ভুল করে নিয়তি ভেবে বসেছেন এবং কামনা করছি এটা আপনার জন্য সৌভাগ্যই বয়ে আনবে। ভাইজান, বিদায়। হিন্দাল এবার দেহের শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করে সোজাভাবে দণ্ডায়মান হয় এবং ধীরে কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে মেঝের গালিচার উপরে থুতু ফেলে, আর রক্তাক্ত শ্লেষ্মার একটা দলা গিয়ে হুমায়ুনের ডান পায়ের নাগড়ার ঠিক সামনে পড়ে। তারপরে, পিছন দিকে একবারও না তাকিয়ে তাবুর প্রবেশ পথের দিকে ধীরে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভঙ্গিতে হেঁটে যায় কিন্তু পুরোটা পথ তাঁর পিঠ টানটান সোজা হয়ে থাকে, হুমায়ুনের দেহরক্ষীর দল দুপাশে সরে গিয়ে তাকে যাবার স্থান করে দিতে সে ডানেবামে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা তাবু থেকে বের হয়ে যায়।

হুমায়ুন মুহূর্তের জন্য আবেগআপ্লুত হয়ে তাকে আটকাবার জন্য যেতে চায় কিন্তু কি লাভ হবে গিয়ে? রাগের বশবর্তী হয়ে তারা পরস্পরকে যা বলেছে এরপরে সম্পর্ক আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে না। জওহর, সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে। জওহর তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান মাত্র, হুমায়ুন অন্য কেউ যাতে আড়ি পেতে শুনতে না পায় সেজন্য নীচুকণ্ঠে দ্রুত আদেশ দিতে শুরু করে। আমার দেহরক্ষী বাহিনীকে কালক্ষেপন না করে দ্রুত আমার ভাইয়ের সফরসঙ্গী হিসাবে আগত মহিলাদের নির্ধারিত তাবুতে প্রেরণ কর। আমার ভাইয়ের উজির, শেখ আলি আকবরের কন্যা, হামিদাবানুকে তাঁরা খুঁজে বের করবে, এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাকে আমার ফুপুজানের কাছে পৌঁছে দেবে। আমার আদেশটা দ্রুত তাঁদের কাছে পৌঁছে দাও এবং আদেশটা পালিত হওয়া মাত্র আমি যেন খবরটা পাই…

আধঘন্টা পরে, জওহর এসে হুমায়ুনকে জানায় যে হামিদাবানুকে তাঁর ফুপুজান খানজাদার হেফাজতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন তাবুর বাইরে থেকে লোকজনের ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি আর চিৎকারের শব্দ, ষাড়ের হাম্বা ডাক, লাগামের রিনিঝিনি শব্দ আর ঘোড়ার চিহি রব ভেসে আসতে শুনে। তাবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে। উঁকি দিয়ে পাত্রে রক্ষিত জ্বলন্ত কয়লার কমলা আগুনে সে দেখে যে হিন্দালের লোকেরা শিবিরের মাঝে সহসা একটা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। তার সৎ-ভাইয়ের তাবু এর ভিতরে গুটিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সেটা এখন একটা মালবাহী শকটে তোলা হচ্ছে। হুমায়ুন বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ একটা পরিচিত অবয়বকে হট্টগোলের ভিতরে দ্রুত তার তাবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।

হুমায়ুন, তুমি এটা কি করেছো? …শেষ পর্যন্ত কি তোমার বুদ্ধিনাশ হল? হুমায়ুনের তাবুর ভেতরে প্রবেশ করার আগেই খানজাদা বাইরে থেকেই চিৎকার জুড়ে দেন। হিন্দাল এইসময়ে চলে গেলে তুমি কিভাবে সফলতা আশা করতে পার? এবং এসবের পেছনে রয়েছে এক পলকের জন্য তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এমন একটা মেয়ে, সেই মেয়ে যার সাথে তুমি এমনকি কখনও কথাও বলনি এবং আমাকে কিছু না জানিয়ে যাকে তুমি আমার হেফাজতে প্রেরণ করেছে। সে তার ফুপুজানকে এর আগেও বহুবার ক্রুদ্ধ হতে দেখেছে কিন্তু কখনও তাঁর চোখের তারায় এমন হতবুদ্ধি করা নির্মমতা ভাসতে দেখেনি। এসব পাগলামি বন্ধ কর। দেরী হয়ে যাবার আগেই এখনই হিন্দালের সাথে দেখা কর এবং তাঁকে বলল যে মেয়েটার উপর থেকে তুমি তোমার দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছো।

ফুপুজান, আমি এটা পারবো না। ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছে যে আমার আর কিছুই করার নেই…

যত্তসব ফালতু কথা! অব্যাহত গতিতে কাছে এগিয়ে এসে, তিনি তার চোখের দিকে তাকান। তুমি কি আবার আফিম সেবন শুরু করেছো? দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছে? সেজন্যই কি তুমি এমন পাগলের মতো আচরণ করছো? আমি হিন্দালের রক্তাক্ত মুখ আর গলার কালসিটে দাগ দেখেছি… সেটা কি কোনো সম্রাটের মতো আচরণ হয়েছে, ঠ্যাঙারে মার দিয়ে তাঁকে ধরাশায়ী করে তারপরে তাঁকে নিজের শিবির থেকে বিতাড়িত করা?

সে আমাকে আক্রমণ করেছিল…

সেটা কোনো কাজের কথা না। হিন্দুস্তানে তোমার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত যখন সবচেয়ে বেশী অনিশ্চিত, যখন তোমার মিত্রের সংখ্যা হাতে গোনা যায় তখন সে তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে। তোমার এই সর্বশেষ পাগলামি আমাদের ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলেছে- লাহোর থেকে তোমার সাথে যারা এসেছিল তাঁদের ভিতরে কতজন এখনও তোমার সাথে রয়েছে? মাত্র আট কি নয় হাজার হবে। সংখ্যাটা আমি জানি কারণ কাশিম আমাকে বলেছে। এখন যদি হিন্দালও চলে যায় তাহলে তোমার সাথে আর কতজন লোক থাকবে? খুব বেশী হলে পাঁচ কি ছয় হাজার। আর তারা যদি একবার তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠে তাহলে তাদের ভেতরে কতজন লোক শেষ পর্যন্ত তোমার সাথে থাকবে? শীঘ্রই ডাকাতি আর রাহাজানির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকই তোমার সাথে থাকবে না, সিংহাসন পুনরুদ্ধারের কথা না হয় বাদই দিলাম। আর এসব ঘটবে স্বার্থপর, অসংযত, বল্গাহীন কামনার বশবর্তী…।

না। হামিদার প্রতি যখনই আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, কেবল শারীরিক কামনা ছাড়াও আমার একেবারে ভিন্ন একটা অনুভূতি হয়েছে, এমন একটা অনুভূতি যার অভিজ্ঞতা আগে কখনও আমার হয়নি…আমি বুঝতে পেরেছি যে ভালোবাসা আমাকে আপুত করে ফেলেছে এবং তাকে আমি আমার স্ত্রী হিসাবে চাই। আমি কখনও কল্পনাও করিনি যে এমন কিছু একটা আমার জীবনে ঘটতে পারে কিন্তু তারপরেও সেটাই ঘটেছে। আমি শপথ করছি সুরা আর আফিম আমার মাথা ঘুলিয়ে দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করেনি। আমার মন পরিষ্কার আর আমি জানি আমি যা করছি ঠিক করছি। ফুপুজান … সে তার কাঁধে আলতো করে একটা হাত রাখে, আমার প্রতি একটু ভরসা রাখেন এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে আমাকে সাহায্য করেন…আমি আপনার কাছে মিনতি করছি…।

আমি পারবোনা। হুমায়ুন, আমার বয়স হয়েছে। এই জীবনে অনেক কিছু আমি দেখেছি, অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, নতুন করে কোনো ঝামেলা কাঁধে নেবার মতো শক্তি আমার আর নেই। বাবর মারা যাবার সময় থেকে তাকে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি চেষ্টা করেছি তোমাকে সাহায্য করতে। নির্ভীক যোদ্ধা হিসাবে তুমি নিজেকে প্রমাণ করেছে কিন্তু সত্যিকারের একজন সম্রাট হতে হলে তোমাকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে আর আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তুমি সেটা আদৌ শিখতে পারবে। তোমার আব্বাজানের থেকে তুমি একেবারেই আলাদা। বাবর সবসময়ে মাথা খাঁটিয়ে চলতো। তাঁর বিয়েগুলো- এমনকি তোমার আম্মিজান যাকে সে ভালোবাসতো তার সাথে বিয়েটাও ছিল বিবেচনাপ্রসুত পদক্ষেপ। সে কখনও একজন স্বার্থপর ছেলের মতো আচরণ করতে না যে পরিণতি বিচার না করেই সবসময়ে নিজের কামনা আর লালসাকে প্রাধান্য দেয়। প্রথমে আফিম। আর এখন এটা।

কিন্তু ফুপিজান, আমি আপনাকে বারবার একটা কথা বোঝাতে চাইছি যে হামিদার প্রতি আমার অনুভূতি মামুলি কামনার চেয়ে অনেক বেশী গভীর…

আর বাবাকে ছাড়া অসহায় অবস্থায় এখানে আটকে থাকার পরে হামিদার অনুভূতির বিষয়ে কি বলবে। তুমি অবশ্যই জানো যে শেখ আলি আকবর হিন্দালের সাথেই থাকবেন? তিনি একটু আগেই নিজের মেয়েকে বিদায় জানিয়ে গিয়েছেন।

আমি এটা জানতাম না।

গুলবদন চেষ্টা করছে হাদিমাকে শান্ত করতে কিন্তু বেচারী একদম হতবিহ্বল হয়ে আছে। সত্যি কথা বলতে কি, গুলবদন নিজেও মর্মপীড়ায় ভুগছে যদিও সে নিজের আপন ভাইকে সঙ্গ দেবার চেয়ে আমার সাথে থাকাকেই বেছে নিয়েছে।

আমার কখনও এসব অভিপ্রায় ছিল না…আমি…

হুমায়ুন অনেক হয়েছে।

খানজাদা ঘুরে দাঁড়ায় এবং আর একটা কথাও না বলে সোজা তাবু থেকে বের হয়ে যায়। হুমায়ুন অপেক্ষা করে, আশা করে তিনি বোধহয় নরম হবেন এবং ফিরে আসবেন কিন্তু তিনি ফিরে আসেন না। সে স্থবির হয়ে নিজের তাবুতে বসে থাকে এবং তেলের প্রদীপের হলুদাভ জ্বলন্ত শিখার দিকে সময়ের হিসাব ভুলে গিয়ে আনমনে তাকিয়ে থাকে। বরাবরের মতো তার ফুপিজান কি এবারও ঠিক কথাই বলছেন? একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত, ঝোঁকের বশে কাজটা করা হয়েছে- বোধহয় হঠকারীও হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা সে হামিদার অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। হিন্দাল আর তার ভিতরে যে ভঙ্গুর কিন্তু সম্ভাবনাময় বন্ধন গড়ে উঠছিল সে সেটাকেও ছিন্ন করেছে।

সুলতান। জওহর ভিতরে প্রবেশ করে এবং হুমায়ুনের দিকে সে তার হাতে ধরা কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দেয়। শেখ আলি আকবর আপনাকে এটা দেবার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছে।

আপনি আমাদের সম্রাট, হুমায়ুন পড়তে শুরু করে, আমার কন্যাকে আপনি যদি চান আমি আপনাকে না বলতে পারবো না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি তাঁকে এখানে রেখে যাচ্ছি কিন্তু আপনার ভাইয়ের সাথে আমাকে অবশ্যই যেতে হবে বহুবছর আগে যাঁর কাছে আমি বিশ্বস্ত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম। আশা করি আপনি হামিদার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। তাঁকে রক্ষা করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই এবং আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন এটা বিশ্বাস করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই। শেখ আলি আকবর।

হিন্দালের প্রতি নিজের আচরণ সম্বন্ধে যত অপরাধবোধ আর দ্বিধাকে ছাপিয়ে তীব্র আনন্দের একটা রেশ হুমায়ুনকে জারিত করে। শেখ আলি আকবর, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি তাকে আগলে রাখবো। আমি তাকে দারুণ সুখী করবো। আপনার ভীত হবার কোনো কারণ নেই, সে নিজেকে ফিসফিস করে বলে।

পরের দিন, সূর্যের দাবদাহে শুষ্ক হয়ে উঠা একটা ধুসর প্রান্তরের উপর দিয়ে নিজের হীনবল হয়ে পড়া সৈন্যবাহিনীর সামনে ঘোড়ায় চড়ে যাবার সময়েও, হুমায়ুন নিজের ভিতরে তীব্র আনন্দের একটা শিহরন টের পায়। হিন্দালের সাথে তাঁর সম্পর্কে ফাটলের জন্য যদি কেবল এই মূল্যটা তাকে দিতে না হত। কয়েক ঘন্টা আগে, তার সামনে প্রসারিত রাস্তায় ধূলো উড়তে দেখে তাঁর হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়ে উঠে। নিজের মতো পরিবর্তন করে হিন্দাল ফিরে আসছে এই আশার দ্বারা তাড়িত হয়ে, সে তার গুপ্তদূতদের একটা দলকে বিষয়টা অনুসন্ধান করতে পাঠায় কিন্তু তারা গিয়ে কেবল খচ্চরের একটা বহরের সাথে একদল রেশম ব্যবসায়ীকে দেখতে পায়। হিন্দাল এতক্ষণে সম্ভবত হুমায়ুনের সৈন্যসারির উত্তরশ্চিমে বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে গিয়েছে। কাশিমের ভাষ্য অনুযায়ী, হিন্দালের এক সেনাপতির সাথে তার সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার ভিত্তিতে, তাঁর সৎ-ভাই সিন্ধু নদী অতিক্রম করে উত্তরের দিকে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেছে।

হিন্দাল কি কামরান আর আসকারিকে খুঁজে বের করতে চায়? তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর সৎ-ভাইদের তিনই যদি আবারও মৈত্রীর বন্ধনে একত্রিত হয় তাহলে তার নিজের অবস্থান আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। হিন্দাল খুব ভালো করেই জানে হুমায়ুন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কোথায় যাচ্ছে এবং কি তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা। কামরান আর আসকারির কাছে এহেন তথ্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিয়মান হতে পারে এমনকি শেরশাহের কাছেও। হুমায়ুন নিজের ভাগ্যের এই সাম্প্রতিক বিড়ম্বনা নিয়ে আপনমনে ভাবতে ভাবতে চারপাশের রৌদ্র ঝলসিত প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে একেবারে বেখেয়াল হয়ে এগিয়ে যায়। হিন্দাল ফিরে না আসায় সে একজন পরীক্ষিত মিত্র হারিয়েছে এবং একজন তৎপর শক্ত লাভ করেছে এই কারণেই যে সে আশাহত হয়েছে তা না, বিগত কয়েক মাসে তার এই ছোট ভাইটির সাথে, হোক সৎ-ভাই, তাঁর বেশ একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং কখন জানি সঙ্গী হিসাবে সে তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল।

সেই দিনই রাতের মতো অস্থায়ী ছাউনি আর রান্নার জন্য আগুন জ্বালান হতে, মেয়েদের তাবু যেখানে স্থাপন করা হয়েছে সে তৃষিতের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হামিদা এখন কি করছে এবং তার মনে কি ভাবনা খেলা করছে? তাঁকে একবার দেখার আকাঙ্খর সাথে সে তাঁকে যে মর্মপীড়ার মধ্যে ফেলেছে সেজন্য তার ভেতরে জমে উঠা অপরাধবোধের সাথে কেমন যেন মিশে যেতে থাকে এবং সে ইতস্তত করে, একজন তরুণ প্রেমিক হিসাবে নিজের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে একেবারেই অনিশ্চিত। তারপরে তাঁর বোধোদয় হয়। জওহরকে ডেকে এনে, খানজাদাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তাঁকে আদেশ দেয়। হুমায়ুন প্রতিটা ক্ষণ অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে শঙ্কাকুল মনে অপেক্ষা করতে থাকে। তার ফুপিজান যদি তার সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে তাহলে সে মোটেই অবাক হবে না, কিন্তু জওহর অবশেষে খানজাদাকে সাথে নিয়েই ফিরে আসে।

বেশ আমার প্রিয় ভাস্তে, তুমি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে আমি জানি।

ফুপিজান, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ… যথাযথ শব্দ খুঁজতে খুঁজতে, হুমায়ুন ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে। গতরাতে রাগারাগি করে আমরা বিদায় নিয়েছিলাম। আপনি যা বলেছিলেন তাঁর অধিকাংশই ন্যায্য। কিন্তু যা ঘটে গিয়েছে আমার পক্ষে সেটা পূর্বাবস্তায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কি আমার পক্ষে যদি সেটা সম্ভবও হত আমি সেটা করতাম না। তবে আপনার কথাগুলো নিয়ে আমি আজ সারাদিন চিন্তা করেছি। আমি আপনাকে আমার সব বিপদে পাশে পেয়েছি, বরাভয় লাভ করেছি। এই বিপদের মুহূর্তে আমি আশা করবো আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না।

খানজাদার চোখমুখের অভিব্যক্তি এখনও কঠোর এবং তিনি একটা কথাও বলেন না কিন্তু তাঁর খয়েরী চোখের দৃষ্টি কোমল হয়ে উঠে তাঁকে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে সাহস জোগায়।

হামিদা আপনি অনুগ্রহ করে বলবেন যে আমি আমার কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্য দুঃখিত এবং তাকে কষ্ট দেয়াটা কখনওই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। সে কয়েক পা সামনে এগিয়ে আসে। আমার মানসিক অবস্থার কথা তাকে বলেন। তাঁকে বলেন প্রেমের বশবর্তী হয়েই আমি সবকিছু করেছি। আমার বিষয়টা তাকে একটু বোঝন… সে আপনার কথা নিশ্চয়ই শুনবে। আর তাকে আরও বলবেন যে রাতের আহারের পরে আমি আপনাদের সবার সাথে দেখা করতে যাব- অবশ্য যদি সে সম্মতি জানায় তবেই।

দুঘন্টা পরে, খানজাদার কয়েকজন পরিচারিকাকে অনুসরণ করে হুমায়ুনকে অস্থায়ী ছাউনির মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখা যায়, জলন্ত মশালের আলোয় তারা তাঁকে মেয়েদের তাবুর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। খানজাদার তাবুর অভ্যন্তরে নীচু হয়ে প্রবেশ করতে, প্রদীপের কমলা রঙের কোমল আলোয় এবং দিয়ার জ্বলন্ত শলতের দ্বারা উদ্ভাসিত তাবুর কেন্দ্রস্থলে নীচু আসনে সে গুলবদন আর খানজাদাকে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পায়। তাঁকে স্বাগত জানাতে তারা উঠে দাঁড়ায় এবং সে যখন তাদের দিকে এগিয়ে যায় অবগুণ্ঠিত একটা অবয়ব- সে জানে হামিদা ছাড়া সেটা আর কেউ না আলো আঁধারির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে খানজাদার পাশে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বলার আগেই অনাদিষ্ট ভঙ্গিতে, হামিদা তাঁর মুখের নিম্নাংশ আবৃতকারী নেকাব সরিয়ে দেয় এবং তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। হুমায়ুন আগে বুঝতে পারেনি যে হামিদা এত দীর্ঘকায়- গুলবদন কিংবা খানজাদার চেয়ে কমপক্ষে তিন কি চার ইঞ্চি সে লম্বা। নীল আলখাল্লা আর একই রঙের কাচুলির সাথে কোমরে সবুজাভ-হলুদ রঙের ফিরোজা পাথরখচিত পরিকর পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে বোঝা সে সেই সাথে হাল্কা পাতলা গড়নের।

হামিদা। আমার সাথে এখানে দেখা করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি কি জানো আমি কেন এসেছি। আমি তোমাকে আমার স্ত্রী করতে চাই…

হামিদা কোনো কথা বলে না কিন্তু পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার কালো, দীর্ঘ অক্ষি-পযুক্ত চোখ কান্নার স্মৃতিতে লাল হয়ে আছে এবং সেই দৃষ্টির সামনে হুমায়ুনই প্রথম নিজের দৃষ্টি আনত করে।

তুমি আমাকে কি উত্তর দেবে?

আব্বাজান আমাকে আদেশ পালন করতে বলেছেন…

আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই না… তুমি একেবারে তোমার মন থেকে আমাকে বল তোমার কি ইচ্ছা?

আমি জানি না। আমি আপনাকে উত্তর দিতে পারবো না। আমার আব্বাজানের কাছ থেকে মাত্র গতকালই আমি আলাদা হয়েছি। তাকে আমি আর হয়ত কখনও দেখতে পাব না…

আমার ভাইয়ের সাথে গমন করার সিদ্ধান্ত একেবারেই তোমার আব্বাজানের নিজস্ব। শেখ আলি আকবর একজন ভালোমানুষ, সৎ আর বিশ্বস্ত এবং তার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমি আমার সামর্থ্যের ভিতরে আছে, এমন সবকিছু করতো- এটা নিশ্চিত করতে যে একদিন- আল্লাহর যদি মর্জি হয়- তার সাথে তুমি পুনরায় মিলিত হবে। এবং আমি তোমাকে আরও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমি তোমার খুব ভালো স্বামী হব। আমি তোমাকে ভালোবাসবো আবার সম্মানও করবো। এবং বর্তমানে যদিও আমার ভাগ্য বিরূপ কিন্তু আমার প্রত্যাশা অনেক উঁচু এবং একদিন আমি তোমাকে মহান একজন সম্রাজ্ঞীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করব… নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি শপথ করে বলছি।

হামিদা সোজা টানটান হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু কথা বলে না। হুমায়ুন ভাবে, মেয়েটার এখনও নিতান্তই অল্পবয়স। নিজের আব্বাজানের এবং পরিচিত পারিপার্শ্বিকের কাছ থেকে সহসা বিচ্যুত হবার শোকে সে এখনও কাতর। গত কয়েকদিনে অনেক কিছু ঘটেছে, হুমায়ুন কোমল কণ্ঠে বলে, এবং তুমিও ক্লান্ত। আমি তোমাকে এখন আর বিব্রত করবো না কিন্তু আমি যা বলেছি সেসব নিয়ে একটু ভেবে দেখবে।

আমি বিষয়টা ভেবে দেখবো। হামিদা এখনও ব্যগ্রভাবে তাঁকে আবেক্ষণ করছে, যেন চেষ্টা করছে ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে সেটা জানতে। হুমায়ুন বুঝতে পারে সে পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে এবং জীবনে এই তাঁর আত্মবিশ্বাস মাতাল হয়ে উঠে। সে অনুধাবন করে যে তার স্ত্রী হিসাবে সে যদি কাউকে নির্বাচিত করে তাহলে যেকোনো মেয়েরই মাথা ঘুরে যাবে বিশ্বাস করে, নিজের সাফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই সে আজ রাতে হামিদার সাথে দেখা করতে এসেছিল।

*

হুমায়ুন নিজের অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই ক্ষেত্রে সে যা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশীদিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়। হামিদাকে একপলক দেখার জন্য প্রতিরাতে খানজাদার তাবুতে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সে হিমশিম খেয়ে যায় কিন্তু সে জোর করে নিজেকে নিরস্ত করে। তার প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য সে হামিদাকে সময় দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সে অবশ্যই নিজের দেয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করবে না। অবশেষে, প্রায় মাসাধিক কাল অতিবাহিত হবার পরে এক জেলো সন্ধ্যাবেলা সেনাছাউনির অস্থায়ী শিবিরের চারপাশের অন্ধকারে সেদিন জোনাকির ঝাঁক হীরককুচির মতো জ্বলজ্বল করছিল, খানজাদা শেষ পর্যন্ত তার জন্য সংবাদ নিয়ে হাজির হয়।

হুমায়ুন, হামিদা সম্মতি জানিয়েছে। তুমি যখন চাইবে সে তোমার স্ত্রী হতে রাজি আছে।

প্রবল আনন্দের একটা জোয়ার এসে তাঁকে ভাসিয়ে নেয় এবং সে তাঁর ফুপিজানকে জড়িয়ে ধরে। তাকে রাজি করাতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে আপনি কি বলেছিলেন?

তাকে আমার শরণে নেয়ার পর থেকেই আমি তাকে যা বলে আসছি সেই একই কথা- তাকে যদি কাউকে বিয়ে করতেই হয় তবে রাজার চেয়ে ভালো পাত্র আর কে হতে পারে- বস্তুতপক্ষে একজন সম্রাট? তাকে আমি স্মরণ করিয়ে দেই যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেক মেয়েই বাধ্য হয় বুড়ো অথর্বকে বিয়ে করতে কিন্তু সেই তুলনায় তুমি নিজের যৌবনে পা দেয়া সুদর্শন এক যোদ্ধা মেয়েদের ভিতরে যার বিশেষ একটা সুনাম আছে… খানজাদা চোখ মটকে বলে।

আপনি নিশ্চিত এই বিয়েতে সে আগ্রহী?

হ্যাঁ। আমার প্রতিশ্রুতি তাঁকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছে যে তুমি তাকে সত্যিই ভালোবাস।

আমি তাকে সত্যিই ভালোবাসি।

আমি জানি। তাঁর সম্পর্কে তুমি যতবারই কিছু বল তোমার চোখেমুখে প্রতিবারই আমি সেই ভালোবাসা ঝলসে উঠতে দেখি, নয়তো এই ক্ষেত্রে আমি তোমাকে কখনও সাহায্য করতাম না।

হিন্দালের ব্যাপারটা? তার কথা কি সে কখনও জানতে চেয়েছে?

না। হিন্দাল সত্যিই হয়তো হামিদাকে ভালোবাসতো কিন্তু মেয়েটা এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। তুমি যদি হামিদার অন্তরে প্রবেশের পথ খুঁজে পাও, সেখানে তুমি কোনো প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হবে না…

ফুপিজান, আপনাকে ধন্যবাদ। বরাবরের মতোই, এবারও আপনি আমার ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

আর বরাবরের মতোই, হুমায়ুন তোমার সুখই আমার কাম্য।

একটু অপেক্ষা করেন। আমি চাই হামিদার জন্য আমার তরফ থেকে একটা উপহার আপনি নিয়ে যান। লোহা দিয়ে বাধান তাঁর সিন্দুকের দিকে সে এগিয়ে গিয়ে ভেতর থেকে ফুল ভোলা রেশমের একটা কাপড় বের করে এবং সেটার ভাঁজ খুলতে দেখা যায় ভেতরে রয়েছে সোনার উপরে আগুনের শিখারমতো দেখতে রুবি আর গাঢ় সবুজ রঙের আকাটা পান্নার একটা দু-লহরী হার যা গুজরাতে দখল করা ধনসম্পদের ভিতরে সে পেয়েছিল। মোমবাতির আলোতে পাথরগুলো দারুণভাবে জ্বলজ্বল করতে থাকে এবং কালো চোখের অধিকারিণী হামিদার সৌন্দর্যের সাথে দারুণ মানাবে। আপনি আমাকে একবার বলেছিলেন, আমার স্ত্রীকে দেয়ার জন্য আমি যেন হারটা নিজের কাছে সামলে রাখি… সেই মুহূর্ত এখন এসেছে…

পরের দিন সকাল বেলা, হুমায়ুন সেদিনের জন্য অগ্রযাত্রা বাতিল করে এবং তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী সারাফকে তার তাবুতে ডেকে পাঠায়। রাজকীয় বিয়ের জন্য সবচেয়ে শুভদিনের সন্ধানে তারা একসাথে গ্রহ-নক্ষত্রের মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে, রাহু-কেতুর অবস্থান পর্যালোচনা করে। শারাফ তার হাতের অ্যাস্ট্রোলেইব নামিয়ে রেখে অবশেষে বলে, অতি সত্ত্বর আয়োজন করতে হবে- আমাদের হাতে মাত্র তিন সপ্তাহ সময় আছে। হুমায়ুনও সেটা মেনে নেয়। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে রাজস্থান অভিমুখে তাঁদের অগ্রযাত্রা স্থগিত রাখবে যাতে করে প্রস্তুতির জন্য সময় পাওয়া যায়। সে এখন যদিও ভূমিহীন আর সিংহাসনহীন, তথাপি হামিদার সাথে তার বিয়েটা কোনো মামুলি ঘটনা নয়। সৈন্যবাহিনীর সাথে আগত নগন্য কোনো অনুসারীদের বিয়ে আর বাসরের অনুষ্ঠান এটা নয় বরং সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীর বিবাহ।

*

সোনালী রেশমের ঝলমল করতে থাকা কয়েক পরতের নীচে হামিদা নিশ্চল ভঙ্গিতে বসে আছে, মুক্তার সাথে ফারগানার প্রতীক হিসাবে হলুদ বৈদুর্যমণি আর সমরকন্দের স্মারকসম সবুজ পান্না একত্রে পাকিয়ে তৈরী করা শিরোমালা, যা গুলবদন বিশেষভাবে তার জন্য তৈরী করেছে, অবগুণ্ঠন আটকে রেখেছে। মাওলানারা সুর করে তাঁদের মোনাজাত শেষ করার পরে, হামিদার মেহেদী রাঙা হাত হুমায়ুন স্পর্শ করে এবং অনুকূল একটা স্পন্দন অপরপক্ষের মাঝে অনুভব করে। তার উজির কাশিম পাদিশাহ জিন্দাবাদ শ্লোগান শুরু করতে হুমায়ুন আর হামিদা উঠে দাঁড়ায় এবং বিয়ের মঞ্চ থেকে নিজের তাবুর দিকে তাঁকে নিয়ে এগিয়ে যায় যেখানে বিয়ের ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে।

ভোজসভায় আমন্ত্রিত মেহমানের সংখ্যা অবশ্য সামান্য কয়েকজনই কাশিম,জাহিদ বেগ, আহমেদ খান আর অন্য কয়েকজন আধিকারিক এবং সেই সাথে খানজাদা, গুলবদন আর তাদের স্ত্রীরা। আগ্রায় যদি এখনও সে সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকতো, সেখানে তাহলে হাজার লোকের জমায়েত হত। ট্রে ভর্তি বিয়ের উপঢৌকন বিরল মশলা, রেশম আর রত্নপাথর- তার সামনে ছড়িয়ে পড়ে থাকতো। দূর্গের প্রাঙ্গণে এসে জমা হত জীবন্ত সব উপঢৌকন- মূল্যবান পাথরে সজ্জিত হাতি যার দাঁতগুলো সোনা দিয়ে গিল্টি করা এবং প্রাণবন্ত আর তরতাজা ঘোড়ার পাল। আজ্ঞাবাহী, আর বশংবদ রাজারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো অভিবাদন জানাতে এবং রাত ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে দূর্গের সুবাসিত আঙ্গিনা সঙ্গীতের কোমল মূৰ্ছনায় মাতোয়ারা হয়ে উঠতো এবং আতশবাজির আলোকচ্ছটায় রাতের আকাশ দিনের দ্যোতনা লাভ করতো।

কিন্তু তার পাশে মখমলের লাল একটা তাকিয়ার উপরে বসে থাকা হামিদার দিকে আড়চোখে তাকাতে এবং সে যেন তার নিখুঁত অবয়ব দেখতে পায় তারজন্য একটা ছাড়া তাঁর বাকি সব নেকাব পেছনে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাঁর গালের কোমল বাঁক, তার আলখাল্লার মসৃণ কাপড়ের নীচে স্তনযুগলের ভীরু উঠা নামা হুমায়ুন অনুভব করে সত্যিকারের সুখের খুব কাছাকাছি সে অবস্থান করছে। সে অনেক রমণীর সাথেই সঙ্গম করেছে, নিজের দক্ষতা আর বীর্যের পরাভব প্রেমিকের মতো উপভোগ করেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের ভেতরে যে আবেগের ক্ষরণ টের পাচ্ছে সেটা তার কাছে একেবারেই নতুন। এমনকি সে সালিমার জন্যও এমন ভালোবাসা তার মাঝে সৃষ্টি হয়নি।

ভোজসভা শেষ হবার পরে, খাবারের পাত্রগুলো সরিয়ে নেয়া হয় এবং তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচারকের দল ছাড়া আর সবাই এবার বিদায় নিতে, জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো রমণীর সংস্পর্শে আসা বালকের মতো হুমায়ুন লাজুক হয়ে উঠে। তার নিজের পরিচারকেরা তাঁকে যখন নিরাভরণ করে রেশমের একটা আলখাল্লায় তাকে জড়িয়ে দেয়, হামিদার সহচরীরা তাঁকে লাল চামড়া দিয়ে মোড়ান কাঠের অন্তঃপটের সাহায্যে তৈরী কনের শয়নকক্ষে নিয়ে যায়, চামড়ার ফিতার সাহায্যে পরস্পরের সাথে যুক্ত অন্তঃপটগুলো তাবুর একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত বিন্যস্ত। হুমায়ুন একটু থামে তারপরে দুটো অন্তঃপটের মধ্যের ফাঁকাস্থানের উপর টানটান অবস্থায় ঝুলন্ত ব্রোকেডের নীচ দিয়ে মাথা নীচু করে প্রবেশ করে।

হামিদা তখনও প্রস্তুত হয়নি। সে টের পায় হামিদার হাস্যমুখরিত পরিচারিকার দল তাঁকে নিরাবরণ করে, তার মাথার লম্বা কালো ঝলমলে চুল পরিপাটি আঁচড়ে দিয়ে গোলাপজলে সিক্ত বিছানায় তাকে নিয়ে এসে পাতলা একটা চাদরের নীচে তাঁকে যত্ন করে শুইয়ে দেয়ার সময়, সারাক্ষণ সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার ছলে আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। পরিচারিকার দল বিদায় নেবার সময় সে তাদের মৃদু হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে শুনতে পায়। সে কেমন যেন একটু বিভ্রান্ত আর অস্বস্তি বোধ করে। হামিদাকে নিজের করে পাবার জন্য সে এতোটাই স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিল, এতোটাই নিশ্চিত ছিল যে এই মেয়েটার সাথেই তার ভবিষ্যত জড়িত কিন্তু আদতে সেই মেয়েটা তার কাছে একজন অপরিচিত আগন্তুক। তারা আজকের পূর্বে কখনও একসাথে নিভৃতে কখনও সময় অতিবাহিত করেনি। তাদের ভিতরে সামান্য যতটুকু কথা হয়েছে তার পুরোটাই হয়েছে অন্যদের উপস্থিতিতে। অনাহুত অতিথির ন্যয়, ভাবনাটা পুনরায় তার মাঝে ফিরে আসে যে হামিদার সামনে অন্য আর কোনো পথ না থাকায় সে তাঁকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। হামিদার কাছে যাবার সময় এই ভাবনাটার কারণে সে একটু অস্বস্তিবোধ করতে থাকে।

হুমায়ুন… হামিদার কোমল কণ্ঠস্বর অবশেষে চেপে বসা নিরবতার অবসান ঘটায়। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে বাম কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে হামিদা আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় উঠে বসেছে। তার ডান হাত হুমায়ুনের উদ্দেশ্যে প্রসারিত। সে ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসে এবং বিছানার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে হামিদার বাড়িয়ে ধরা হাতটা স্পর্শ করে এবং ঠোঁট দিয়ে আলতো করে তার আঙ্গুলে চুমু খায়। হামিদা শুজনিটা তুলে ধরলে, সে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর পাশে পিছলে শুয়ে পড়ে। হামিদার দেহ আবেগের মন্থনে উষ্ণ অনুভূত হয় এবং ধীরে, প্রায় পূজার ভঙ্গিতে সে তার মুখাবয়ব স্পর্শ করে তারপরে তার আঙ্গুল হামিদার খোলা চুলের গোছা আকড়ে ধরে। তার চোখ চমকে উঠে হুমায়ুনের দিকে তাকায়, সেখানে বিস্ময়ের পাশাপাশি বিশ্বাসের সহাবস্থান। হামিদাকে আলতো করে নিজের দিকে টেনে এনে, সে তার নিখুঁত কাঁধের ঢাল থেকে কোমরের পেলব বাকের ভয়াবহতার মাঝে আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠে। জীহ্বা দিয়ে তাঁর স্তনযুগলে প্রেমময় সোহাগ করার সময় তাঁর ছোট গোলাপী স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে উঠেছে সে বুঝতে পারে আর এটা তাকে আরও সাহসী করে তুলে। হুমায়ুনের হাত প্রেমিকের নমনীয়তায় অনুসন্ধান অব্যাহত রাখলে, হামিদার দেহত্বকে ফিনফিনে ঘামের একটা স্তর ভেসে উঠে। হামিদার চোখ এখন বন্ধ কিন্তু তার ওষ্ঠদ্বয় আলতো ফাঁক হয়ে রয়েছে এবং তাঁদের ভিতর দিয়ে আঁতকে ওঠা শীকার ধ্বনি ভেসে আসে।

নিজের অসহিষ্ণুতাকে সংযত করে হুমায়ুন অপেক্ষা করে যতক্ষণ না তার মনে হয় হামিদা তাকে গ্রহণ করার জন্য তৈরী হয়েছে, তারপরেই কেবল সে উপগত হয়ে তার মাঝে নিজেকে আমূল প্রোথিত করে প্রেমিকের বিশ্বস্ততায়। রমণের মাত্রা জোরাল হতে সে টের পায় হামিদার টানটান হয়ে থাকা দেহ বাঁকতে শুরু করেছে এবং উদ্বিগ্ন চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে মেয়েটার আধখোলা চোখে ব্যাথার বদলে উদ্বেল আনন্দ দেখতে পায়। নিজেকে আরও গভীরে নিবিষ্ট করার মাঝে এই মেয়েটার প্রতি সে আবেগসিক্ত প্রেমময় একটা অনুভূতিতে জারিত হয়, যেকোনো মূল্যে তাকে আগলে রাখার একটা বাসনায় তাঁর অন্তর আপুত হয়ে উঠে। হামিদা এখন কেবলই তার একান্ত আপনার এবং যতদিন তারা জীবিত থাকবে এখন থেকে এটাই হবে বাস্তবতা।

ঈষদুষ্ণু পানিপূর্ণ পাত্র নিয়ে তাঁদের পরিচারকেরা তাবুর আলো আধারিতে প্রবেশ করে তাদের জাগিয়ে তুলতে তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় ঘুম ভেঙে জেগে উঠে। হামিদাই প্রথমে হাতের ইশারায় তাঁদের বিদায় করে কিন্তু তারা যখন পুনরায় পরস্পরকে একান্ত করে পায়, সে তখন নিরবে স্থির হয়ে বসে থাকে।

হামিদা কি হয়েছে? আমি কি তোমাকে আঘাত দিয়েছি…?

লাজুকভঙ্গিতে সে হুমায়ুনের দিকে তাকায় এবং মাথা নাড়ে।

তাহলে কি হয়েছে?

বিগত দিনগুলোতে আমি আতঙ্কিত ছিলাম…

কি জন্য?

আপনার স্ত্রী হিসাবে আপনি আমাকে চান এটা জানতে পেরে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমার ভয় ছিল যে আমি বোধহয় আপনাকে প্রীত করতে পারবো না… আপনাকে আশাহত করবো। কিন্তু গতরাতে আপনার নমনীয়তা, আমার জন্য যে আনন্দ আপনি সৃষ্টি করেছেন, সবকিছু আমার উদ্বেগকে প্রশমিত করেছে… চোখের তারায় আন্তরিকতার সতেজতা নিয়ে হামিদা এখন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হুমায়ুন কিছু বলার চেষ্টা করতে সে আঙ্গুলের অগ্রভাগ দিয়ে তাঁর ঠোঁট চেপে ধরে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে একজন বিশিষ্ট ভবিষ্যদর্শীর রক্ত আমার ধমনীতে বইছে। কিন্তু আরো কিছু আছে যা আপনি জানেন না। ভবিষ্যতের গর্ভে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আদল কখনও কখনও আমিও দেখতে পাই। গতরাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি যে অচিরেই আমি গর্ভবতী হব… একটা পুত্রসন্তান। আপনি জিজ্ঞেস করবেন না আমি কিভাবে জেনেছি কেবল আমাতে বিশ্বাস রাখেন যে ঘটনাটা সত্যি। হুমায়ুন তাকে দুহাতে আকড়ে ধরে। মোগল সাম্রাজ্য আমি আবার গড়ে তুলবো এবং তুমি, আমি আর আমার পুত্রসন্তান আমরা সবাই মহান সম্রাটের গৌরব অর্জন করবো, রমণের রমণীয়তায় হারিয়ে যাবার সূচনালগ্নে সে ফিসফিস করে কথাগুলো হামিদাকে বলে।

২.৭ মরু-পথের দুঃখ-দুর্দৈব

১২. মরু-পথের দুঃখ-দুর্দৈব

সুলতান, আমার গুপ্তদূতেরা এখান থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট শহরে নিঃসঙ্গ এক পথিককে আটক করেছে। তার পোষাক দেখে আর বাচনভঙ্গি শুনে পরিষ্কার বোঝা যায় যে সে এখানে একজন আগন্তুক, শহরের দোকানীদের এবং আশেপাশে কে শুনছে সে বিষয়ে তোয়াক্কা না করে সে বারবার জিজ্ঞেস করেছে যে, আপনি আর আপনার সৈন্যবাহিনী কি এই পথ দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। লোকটা গুপ্তচর হতে পারে ভেবে আমি তাকে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসতে বলি, আহমেদ খান বলে।

লোকটা যদি সত্যিই গুপ্তচর হয়, তবে বলতেই হবে সে খুব একটা কৌশলী না। নিজের কর্তব্যকর্ম গোপন রাখার বিষয়ে আপাত দৃষ্টিতে সে খুব একটা প্রয়াস নেয়নি।

আহমেদ খানের মাঝে হুমায়ুনের হাসি সঞ্চরিত হয় না। সুলতান, লোকটা দাবী করছে যে সে সরাসরি কাবুল থেকে এসেছে এবং বলেছে যে আপনার সাথে তার দেখা করাটা জরুরী। লোকটার উদ্দেশ্য যদি যথার্থ হয়, তাহলে তার মুখ দেখে আমার মনে হয়নি খুব একটা ভালো কোনো সংবাদ সে নিয়ে এসেছে।

এক্ষুনি তাকে আমার সামনে নিয়ে এসো।

জ্বী, সুলতান।

শঙ্কার ছায়ারা গুঁড়ি মেরে হুমায়ুনের মনের প্রান্তরে বিচরণ শুরু করে। কয়েক মিনিট পরে, পরিপাটিভাবে বিন্যস্ত তাবুর সারির মাঝে সে আহমেদ খানকে ফিরে আসতে দেখে এবং তাঁর পেছনে, তারই দুজন গুপ্তদূত লম্বা এক যুবককে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছে। দলটা নিকটবর্তী হলে, হুমায়ুন খেয়াল করে দেখে যে সদ্য আগত লোকটার কাপড়চোপড়ে ভ্রমণের ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। লোকটা দেখতে কৃশকায় এবং তাঁর চোখের নীচের বেগুনী ছায়া তার ভ্রমণের শ্রান্তি প্রশমিত করেছে।

সুলতান। কুনীশের প্রথাগত অভিবাদনের রীতিতে সে মাটিতে অধোমুখে নিজেকে প্রণত করে।

উঠে দাঁড়াও। কে তুমি এবং আমাকে তুমি কি বলতে চাও?

নবাগত লোকটা ধীরে ধীরে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার নাম দারইয়া, কাবুলে আপনার সেনাছাউনির এক সেনাপতি নাসিরের পুত্র।

নাসিরকে হুমায়ুনের ভালোই মনে আছে- পোড় খাওয়া, ঝানু এক তাজিক গোত্রপতি, বহু বছর বিশ্বস্ততার সাথে যে তার অধীনে চাকরি করেছে। যৌনতার প্রতি তাঁর উদগ্র বাসনার কারণে লোকটা সেনাছাউনিতে বেশ পরিচিত ছিল আর সেই সাথে তার চার স্ত্রীর গর্ভে তারই ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানের সংখ্যার কারণে আঠারজন ছেলে আর ষোলজন মেয়ে এবং সেই সাথে তার অগণিত উপপত্নীর গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানতো রয়েইছে। হুমায়ুন বহুবছর নাসিরকে দেখেনি এবং তাঁর সন্তানদের ভিতরে সে কেবল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনকেই দেখেছে।

তুমি নিজেকে যাঁর সন্তান বলে দাবী করেছে আমি হয়তো তাকে চিনি কিন্তু তার আগে আমাকে বলল তোমার বাবা মোট কতজন সন্তানসন্ততির জনক?

দারইয়ার ঠোঁটের কোণে বিষন্নামিশ্ৰিত মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠে। কেউ নিশ্চিত করে সেটা বলতে পারবে না কিন্তু তাঁর প্রথম চার স্ত্রীর গর্ভে আমরা মোট চৌত্রিশ ভাইবোন এবং তাঁদের একজন গতবছর ইন্তেকাল করলে- আমি কৃতজ্ঞ তিনি আমার জন্মদাত্রী নন- সে পঞ্চমবারের মতো বিয়ের করতে এই স্ত্রীর গর্ভে তার পঁয়ত্রিশতম সন্তানের জন্ম হয়। অবশ্য আমার পরিচয়ের স্মারক হিসাবে আমার পোষাকের নীচে একটা থলেতে আমার বাবার গলায় শোভা পাওয়া নেকড়ের দাঁতের একটা মালা রয়েছে। সে তাঁর ধূলিধূসরিত আলখাল্লার নীচে হাত দিয়ে থলেটা বের করতে যায়।

সেটার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বিশ্বাস করেছি তুমি নাসিরের ছেলে। কাবুলের কি খবরাখবর? এবার বল…।

খবর খুবই খারাপ, সুলতান, আমি যে খবর নিয়ে এসেছি তারচেয়ে বোধহয় খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। আপনার নানাজান কাবুলের পৌঁছাবার কয়েকদিনের ভেতরেই তিনি হৃদরোগের আক্রমণের শিকার হন। তিনি প্রায় বাকরহিত হয়ে পড়েন এবং তার সারা শরীর প্রায় অসার হয়ে যায়। তিনি ধীরে ধীরে পুনরায় হাঁটাচলার মতো সুস্থ হয়ে উঠছিলেন কিন্তু…

কি হয়েছে? দারইয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে কিন্তু সে ততক্ষণে উত্তরটা মনে মনে জেনে ফেলেছে।

সুলতান, প্রায় চারমাস আগে, ঘুমের ভিতরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরিচারকেরা সকালবেলায় বিষয়টা টের পায়, তার চোখেমুখে প্রশান্তির একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, বাইসানগার আর নেই এই বিষয়টার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে।

সুলতান, আমার আরো কিছু বলার আছে…আপনার সৎ-ভাই কামরান আর আসকারি, খাইবার গিরিপথের পাদদেশে যারা আধিপত্য বিস্তার করে অবস্থান করছিল, যখন বাইসানগারের অসুস্থতার কথা জানতে পারে তারা তখন এই বিষয়টা থেকে লাভবান হবার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের বাহিনী নিয়ে গিরিপথ অতিক্রম করে কাবুলে এসে উপস্থিত হয়। তারা যখন কাবুলে পৌঁছে ততদিনে আপনার নানাজান ইন্তেকাল করেছেন। কোনো ধরনের আগাম হুশিয়ারি না দিয়েই তারা কাবুলের প্রাসাদদূর্গ আক্রমণ করে এবং সহজেই আমার আব্বাজান আর অন্যানদের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা গুঁড়িয়ে দেয়।

হুমায়ুনের নিমেষের জন্য বাইসানগারের মৃত্যুশোক বিস্মৃত হয়। কামরান আর আসকারি কাবুল দখল করেছে?

জ্বী, সুলতান।

অসম্ভব! আমার সৎ-ভাইয়েরা এতো দ্রুত এমন একটা আক্রমণ উপযোগী সেনাবাহিনী কিভাবে একত্রিত করবে?

সুলতান, গিরিপথে আগত বণিকদের কাফেলা লুট করে সংগৃহীত সোনা তাঁদের কাছে রয়েছে। আমরা শুনেছি পারস্যের ধনবান বণিকদের একটা কাফেলা তারা আটক করেছিল এবং তাঁদের কাছ থেকে জব্দ করা স্বর্ণমুদ্রা তারা উৎকোচ হিসাবে ব্যবহার করে পাহাড়ী গোত্রগুলোকে হাত করেছে। ফাশাইস, বারাকিশ, হাজারা আর অন্যান্য বর্বর গোত্রগুলো তাদের পক্ষে লড়াই করার জন্য তাই বিপুল সংখ্যায় সমবেত হয়েছিল। কিন্তু কাবুলে বস্তুতপক্ষে কোনো লড়াই হয়নি। আপনার সৎ-ভাইয়েরা আমাদের দূর্গপ্রাসাদের এক সেনাপতিকে স্বর্ণমুদ্রার প্রলোভন দেখিয়ে হাত করে যে তাঁদের দূর্গের প্রধান ফটক খুলে দেয়।

পুরো সেনাশিবিরে যদিও সূর্যের আলো ঝলমল করছে কিন্তু হুমায়ুনের মনে হয় সহসা পৃথিবীতে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে এবং কেমন শীত শীত একটা অনুভূতিতে সে আক্রান্ত হয়।

আমার আব্বাজান… দারইয়ার কণ্ঠস্বর এই প্রথমবারের মতো একটু কেঁপে উঠে, আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং শত্রুসেনা দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে- দূর্গের প্রতিরক্ষায় দূর্গের অভ্যন্তরে অবস্থানরত সৈন্যদের সর্তক করতে তিনি যখন প্রধান তোরণদ্বার থেকে দৌড়ে ভেতরের দিকে আসছিলেন তখন একটা ফাশাইস রণকুঠার তার পিঠের ঠিক মধ্যভাগে আঘাত করে। তিনি কোনোমতে একটা দেওড়ির অভ্যন্তরে লুকিয়ে যান যেখানে আমি তাকে খুঁজে পাই। আমাকে অবশ্যই কাবুল থেকে পালাতে হবে…নিজের পরিচয়ের স্মারক হিসাবে তাঁর গলার মালাটা যেন অবশ্যই আমি সাথে রাখি আর আপনার সন্ধান করি এবং আপনাকে জানাই যে এখানে কি ঘটেছে…এবং তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে তিনি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেননি… মারা যাবার আগে আমাকে বলা আব্বাজানের এই ছিল শেষ কথা। আপনার সন্ধানে আমি প্রথমে সরকারে যাই কিন্তু আপনি ততদিনে সেখান থেকে চলে গিয়েছেন। তারপর থেকে আমি ক্রমাগত আপনাকে খুঁজছি। আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় অনেক দেরী করে ফেলেছি, আপনি হয়তো ইতিমধ্যে লোকমুখে কাবুল বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরেছেন…

না। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। হুমায়ুন নিজেকে সুস্থির করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তোমার আব্বাজান মোটেই আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেননি- আমার জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং আমি এটা কখনও ভুলবো না। তুমি অনেকদূরের পথ অতিক্রম করে আসছে, তোমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো। সেখানে ঠিক কি ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমাকে যতটা সম্ভব অবশ্যই জানতে হবে।

আহমেদ খানের লোকেরা দারইয়াকে হুমায়ুনের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে, সে একটু একা থাকতে চায় ইঙ্গিতে জওহরকে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে সে তাবুর ভেতরে প্রবেশ করে। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে চোখে মুখে ঝাপটা দেয়ার সময় সে নিজের মুখে তাঁদের শীতল পরশ খুব একটা টের পায় না। পরস্পরবিরোধী আবেগ- যার কোনটা ব্যক্তিগত, কোনটা রাজনৈতিক, কিন্তু এসবের একটাও সুখকর না- তার মনের ভিতরে হুড়োহুড়ি করছে। তার নানাজানকে সে আর কখনও দেখতে পাবে না এটা জানার পরে শুরুতে এই শোকই ছিল সবচেয়ে প্রবল। তাঁর আব্বাজানের মুখে বাইসানগারের যৌবনের প্রাঞ্জল গল্পগুলো স্মরণ করতে গিয়ে হুমায়ুন চোখ বন্ধ করে ফেলে, অশ্বারোহী বাহিনীর একজন তরুণ যোদ্ধা হিসাবে কিভাবে তিনি তৈমূরের আঙ্গুরীয় বাবরের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, আংটিটা তখনও পূর্ববর্তী ধারকের রক্তে সিক্ত; বাবরের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততার কারণে বাইসানগার কিভাবে নিজের ডানহাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন এবং তাঁর জন্য সমরকন্দের তোরণদ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। হুমায়ুনের আম্মিজান মাহামও নিজের আব্বাজানের অনেক গল্প জানতো- সেগুলো অবশ্য কম সংঘাতময় কিন্তু অনেকবেশী আবেগময়। বাইসানগার এখন মৃত এবং হুমায়ুনের বিয়ের কথা না জেনেই তিনি মারা গেছেন। কামরান আর আসকারি কাবুল আক্রমণের পূর্বেই তিনি মারা গেছেন এই একটা যা বাঁচোয়া।

ভাবনাটা মনের ভিতরে উঁকি দিতেই, শোকের চেয়ে রূঢ় একটা আবেগ তাঁকে আচ্ছন্ন করে- সৎ-ভাইদের প্রতি নির্মম ক্রোধ। ঠিক এই মুহূর্তে যদি তার সামনে হাজির করা হত তাহলে তাদের বিশ্বাসঘাতক মাথাগুলোকে দেহের বরাভয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে লাথি মেরে ধূলোতে সেগুলো গড়িয়ে দেয়া থেকে সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য বাবরের শত অনুরোধও তাঁকে বিরত রাখতে পারতো না। সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুন তার কোমরের পরিকর থেকে খঞ্জরটা টেনে বের করে আনে এবং তাবুর অন্যপ্রান্তে লাল গোলাকার একটা তাকিয়া লক্ষ্য করে- সেটা ছুঁড়ে দিতে খঞ্জরটা গিয়ে তাকিয়ার ঠিক মধ্যস্থলে বাঁট পর্যন্ত গেঁথে যায়, সে মনে মনে ভাবে তাকিয়াটা যদি কামরানের কণ্ঠনালী হত।

কামরান নিজের জন্য সিংহাসনের একটা সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে এবং তাঁর আগ্রহী সহযোগী হিসাবে আসকারীকে সাথে নিয়ে সে সুযোগটা গ্রহণ করেছে। তারা যতদিন কাবুল দখল করে রাখবে, ততদিন হুমায়ুনের পক্ষে হিন্দুস্তানে নিজের কর্তৃত্ব। পুনরায় ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একটা বিষয় বহুদিন আগেই প্রমাণিত হয়েছে। যে পারিবারিক একতা, মোগল রাজবংশের জন্য গর্ব এসব বিষয়ের চেয়ে তাঁদের কাছে নিজেদের ধনবান, লাভবান করার সুযোগ, এবং যেনতেন প্রকারে তার ক্ষতিসাধন করাটাই যেন আপাত দৃষ্টিতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এই প্রতিহিংসাপরায়ন ঈর্ষা কতটা ভয়ঙ্কর, তাঁদের সবাইকে এটা কি বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এই বিষয়টা তারা কেন কখনও বুঝতে চেষ্টা করেনা?

নিজের মনের ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে হুমায়ুন পায়চারি করতে থাকে। তাকে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করে যুক্তিযুক্ত আচরণ করতে হবে কারণ তার সাথে এখন তার স্ত্রী আর তাঁদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতও জড়িয়ে রয়েছে। হামিদার কথা মনে হতে ক্ষণিকের জন্য তার মেজাজ প্রসন্ন হয়ে উঠে। চারপাশের বিপদসঙ্কুল পারিপার্শ্বিকতা সত্ত্বেও, গত কয়েক সপ্তাহ ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়, বিশেষ করে একমাস আগে, চোখের তারায় দারুণ প্রভা নিয়ে হামিদা যখন তাঁকে জানায় যে তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছে। সে আদতেই গর্ভবতী হয়েছে। সে অচিরেই একজন উত্তরাধিকারী লাভ করতে চলেছে সম্ভবত এই কথাটা জানা থাকার কারণেই হুমায়ুনের পক্ষে কামরান আর আসকারির সাম্প্রতিক এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে আরও বেশী কষ্ট হচ্ছে। তাকে আঘাত করার চেষ্টা করে তাঁরা তাঁর স্ত্রী আর ভাবী সন্তানকে- যারা এই পৃথিবীতে হুমায়ুনের কাছে সবচেয়ে প্রিয়- তাদেরও আঘাত করতে চেষ্টা করেছে।

আর সে যদি সত্যিই পুত্রসন্তান গর্ভে ধারণ করে থাকে, যা হামিদা নিজেও বিশ্বাস করে, তবে কাবুল হাতছাড়া হওয়াটা তার সন্তানের ভবিষ্যতকে আরো বেশী বিপদসঙ্কুল করে তুলবে। ছেলেটা যদি হুমায়ুনের শঙ্কা অনুযায়ী দ্রুত এগিয়ে আসা বিপদসঙ্কুল সময়টা কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলেও একটা বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হবার বদলে সে হয়ত- যখন অন্য রাজবংশ হিন্দুস্তান শাসন করছে, তার কোনো কোনো পূর্বপুরুষের মতো যুদ্ধবাজ মামুলি গোত্রপতির জীবন লাভ করবে এবং মাটির দেয়াল দেয়া কয়েকটা গ্রাম আর ভেড়ার পালের মালিকানা নিয়ে নিজের আত্মীয়দের সাথে লড়াই করবে- নগণ্য এমন কিছু একটার উত্তরাধিকারী হবে।

এটাকে কোনোমতেই ঘটতে দেয়া যাবে না, একে কোনোধরনের প্রশয় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। সে এটা ঘটতে দিতে পারে না। হুমায়ুন হাটু ভেঙে বসে পড়ে এবং উঁচু স্বরে একটা প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করে।

যত পরিশ্রমই সহ্য করতে হোক, যতদীর্ঘই হোক আমাদের সগ্রাম, আমি অবশ্যই আবারও হিন্দুস্তানের সম্রাট হব। আর এটা করার জন্য আমি আমার দেহের শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও আমি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমার আব্বাজানের কল্পনার চেয়েও বিশাল একটা সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার সূত্রে আমার সন্তান এবং তাঁদের সন্তানদের জন্য রেখে যাব। আমি, হুমায়ুন এটা শপথ করে বলছি।

*

হুমায়ুন আর তার সৈন্যবাহিনী মারওয়ারের নিকটবর্তী হতে মরুভূমির উষ্ণতা প্রায় অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে। প্রতিটা দিন যেন আগের দিনের চেয়ে উষ্ণতর এবং প্রাণান্তকর বলে মনে হয়। চওড়া, চ্যাপ্টা পায়ের অধিকারী খিটখিটে মেজাজের উটের পাল পরিস্থিতি কোনোমতে সামাল দেয় কিন্তু ঘোড়া আর মালবাহী খচ্চরগুলো কোমর পর্যন্ত বহমান গনগনে বালিতে ডুবে যায়। প্রতি দিনই, নিস্তেজ ভঙ্গিতে পা নেড়ে আর ফাটা ঠোঁটের মাঝ দিয়ে বের হয়ে থাকা খটখটে শুকনো জীহ্বা নিয়ে, ক্লান্তি আর পানি শূন্যতায় আক্রান্ত পশুগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে। হুমায়ুন তার লোকদের আদেশ দিয়েছে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া হাঁটতে অক্ষম পশুগুলোকে জবাই করে সেগুলোর মাংস রান্না দিয়েছে, কিন্তু সেই সাথে সে জম্ভগুলোর রক্ত সংগ্রহ করারও নির্দেশ দিয়েছে। তৈমূরের আমলে, আদিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমিতে নিজেদের ভারবাহী জম্ভর রক্ত পান করে যোদ্ধারা অনেক বিপর্যয় সামাল দিয়েছে।

হুমায়ুন, কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে, হামিদাকে বহনকারী চারদিকে আবদ্ধ পালকিটাকে চোখ ঝলসানো রূপালি অস্পষ্টতার ভেতর থেকে তাঁর শক্তিশালী ছয়জন লোকের কাঁধে স্থাপিত অবস্থায় বের হয়ে আসতে দেখে। খানজাদা, গুলবদন এবং বহরের সাথে ভ্রমণকারী অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলারা টাট্ট ঘোড়ায় ভ্রমণ করলেও, গর্ভবতী হামিদার পথের কষ্ট দূর করতে হুমায়ুন সম্ভাব্য সবকিছু করতে চেষ্টা করছে। পালকিটার বাঁশের তৈরী কাঠামোর দুপাশে ঘাস আর সুগন্ধি লতাপাতা দিয়ে একটা আচ্ছাদনের মতো তৈরী করা হয়েছে এবং কয়েক ঘন্টা পরপর পরিচারকেরা মরুভূমির প্রেক্ষাপটে সোনার চেয়েও মূল্যবান পানি দিয়ে সেটা ভিজিয়ে দিচ্ছে, দাবদাহের কবল থেকে হামিদাকে খানিকটা হলেও সুবাসিত প্রশান্তি দিতে। এতসব প্রয়াসের পরেও, তাঁর মুখ খুবই রুগ্ন দেখায় এবং তাঁর চোখের নীচের প্রায় স্বচ্ছ ত্বকের চারপাশে সৃষ্ট কালো দাগ স্পষ্টই জানিয়ে দেয় যে গর্ভাবস্থা তার জন্য মোটেই কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। হামিদা প্রায়শই বিবমিষা বোধ করে এবং খাবারের প্রতি প্রচণ্ড অরুচি দেখা দেয়।

হামিদাকে বহনকারী পালকিটা নিকটবর্তী হতে দেখে, হামিদাকে হারাবার ভয়টা নতুন করে হুমায়ুনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাকে রক্ষা করতে এবং নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে, হুমায়ুন তাঁর সামর্থ্যের ভিতরে রয়েছে এমন কোনো কিছু করতে দ্বিধা করছে না, কিন্তু তারপরেও বিপদ চারপাশে ওঁত পেতে রয়েছে। সাপ আর বিছে ছোবল দেয়ার জন্য ফণা তুলে রয়েছে। মরুভূমিতে গিজগিজ করতে থাকা দস্যুবাহিনীও তাঁদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেহেতু তার খুব অল্প সংখ্যক সৈন্যই এখন অবশিষ্ট আছে- খুব বেশী হলে হাজারখানেক হবে। কাবুল তাঁর হাতছাড়া হয়েছে জানতে পেরে, তার বাহিনীর একটা বিশাল অংশ ভোজবাজির মতো শূন্যে মিলিয়ে গেছে।

আল্লাহ সহায় থাকলে তারা শীঘ্রই মারওয়ার রাজ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এবং সেখানে আশ্রয় লাভ করবে। রাজা মালদেওয়ের সমর্থনজ্ঞাপক বার্তা হুমায়ুনকে যে রাজদূত সরকার ত্যাগ করতে রাজি করিয়েছিল সেই একই রাজদূত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করছেন- হুমায়ুন তার বাহিনী নিয়ে রাজ্যের নিকটবর্তী হবার সাথে সাথে পাল্লা বেড়ে চলেছে। সে অবশ্য আশা করেছিল মালদেও ব্যবহার উপযোগী সাহায্য করবেন- রসদ, পানি এবং তাজা ঘোড়ার পাল প্রতিশ্রুতির সুললিত বাণীর চেয়ে এই মুহূর্তে তার কাছে অনেকবেশী কাম্য। কিন্তু হুমায়ুন এইসব সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানাতে ইতস্তত বোধ করে। সে মহারাজের অতিথি এবং মিত্র হিসাবে মারওয়ার যাচ্ছে, ভিক্ষুকের মতো সাহায্যপ্রার্থী হিসাবে না।

চামড়া দিয়ে বাঁধান লাল খেরো খাতাটা যেখানে কাশিম দায়িত্বের সাথে প্রতিদিন তাদের রসদ খরচ হবার পরিমাণ লিপিবদ্ধ করেন, ঠিক যেমনটা তিনি রাখতেন বাবর যখন সমরকন্দে অবরুদ্ধ ছিল তখন, সেটায় লিপিবদ্ধ নথি থেকে দেখা যায় বেঁচে থাকার মতো এখনও যথেষ্ট পরিমাণ খেজুর, শস্য আর অন্যান্য শুকনো ফল তাঁদের সংগ্রহে রয়েছে। অবশ্য, রোগাক্রান্ত অথবা ক্লান্ত হাড় জিরজিরে পশুর মাংস, যদি আদৌ সেটাকে তাজা বলা যায় ছাড়া, শেষ কবে তাঁরা তাজা মাংস খেয়েছে মনেই করতে পারবে না। তাদের চলার পথে যেসব গ্রাম পড়ত প্রথম দিকে তারা সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতো। এখন আমের মৌসুম চলছে। এবং চকচকে সবুজ পাতার মাঝে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা মিষ্টি গন্ধযুক্ত, কমলা রঙের, কোমল ফলটার রসাল অংশই হামিদা একটু আগ্রহ করে খায়। কিন্তু ছয়দিন আগে তারা শেষ বসতিটা অতিক্রম করেছে- একটা কুয়ার চারপাশে মাটির তৈরী ঘরবাড়ির একটা জটলা আর তারপরে মরুভূমি তাদের গ্রাস করে ফেলেছে। আহমেদ খানের গুপ্তদূতেরা, চন্দ্রালোকিত রাতের আঁধারে সামনে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও কোনো বসতির সন্ধান খুঁজে পায়নি।

এই মুহূর্তে অবশ্য তাঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম পানির স্বল্পতা, তাঁর আধিকারিকেরা এখন সতর্কতার সাথে পানির সংবিভাগ তদারক করছে। তিন রাত্রি আগে, তাঁর দুজন লোক পানির বদলে কড়া মদ পান করেছিল। তারপরে, তাঁদের তৃষ্ণা মাত্রা ছাড়াতে এবং নিজেদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে পড়লে, পুতিগন্ধময় কয়েক টোক পানি অবশিষ্ট আছে এমন একটা মশকের দখল নিয়ে নিজেদের ভিতরে লড়াই শুরু করে, যার ফলে একজনের মৃত্যু হয় অপর মাতালের খঞ্জরের আঘাত নিজের গলায় ধারণ করায়। হুমায়ুন বেঁচে যাওয়া অপর সৌভাগ্যবানকে তখনই কবন্ধ করার আদেশ দেয় কিন্তু দণ্ডাদেশ প্রত্যক্ষ করতে সমবেত হওয়া সৈন্যদের চোখে সে চাপাক্রোধ ধিকিধিকি করে জ্বলতে দেখে। মরুভূমির হানাদারদের যেকোনো আক্রমণের মতোই বিশৃঙ্খলা আর অবাধ্যতাও সমান বিপজ্জনক…

তার নিজের ঘোড়াও রীতিমতো ধুকছে। বেচারীর গায়ে একটা সময় ছিল যখন সেটা চকচক করতো, এখন কেবল শুকনো ঘামের দাগ আর বালি জমে রয়েছে এবং ঘনঘন হোঁচট খাচ্ছে। হুমায়ুন ভ্রূ কুচকে ঘোড়াটার চারপাশে পায়চারি করে। সূর্যের কমলা রঙের গোলকটা থেকে বিচ্ছুরিত অসহনীয় আলোর তীব্রতা চারপাশের ভূপ্রকৃতিকে মৃতবৎ করে রেখেছে, বালিয়াড়ির সারিগুলোকে চেটালো করে তুলেছে এবং সবকিছুকে চোখে জ্বলুনি ধরান একঘেয়েমী আর হতোদ্যম করে তুলেছে যে কিছুই আগ্রহী সৃষ্টি করা বা মনোবল তাজা করে না। ঘোড়াটাকে কিছুক্ষণের জন্য একটু বিশ্রাম দিতে হুমায়ুন মাটিতে নেমে পড়ে এবং বামহাতে ঘোড়ার লাগামটা ধরে বিশ্বস্ত প্রাণীটার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।

হুমায়ুন সহসা সামনে কোথাও থেকে ভেসে আসা একটা বিশৃঙ্খলার শব্দ শুনতে পায়। তিন কি চারশ গজ দূরে সৈন্যসারির সম্মুখভাগে কি ঘটেছে দেখতে চোখের উপরে হাত দিয়ে একটা আড়াল তৈরী করে কিন্তু সূর্যের দাবদাহের কারণে কিছুই বোঝা যায় না। ওখানে কি ঘটেছে দেখে এসো, সে চিৎকার করে জওহরকে আদেশ দেয়। কিন্তু জওহর তাঁর বাহন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার আগেই তাদের চারপাশে মানুষ আর প্রাণীর একটা সম্মিলিত ঊর্ধ্বশ্বাস ধাবন শুরু হয়। ভারবাহী প্রাণীগুলো এতক্ষণ যারা নির্জীবভঙ্গিতে পেছন পেছন অনুসরণ করে আসছিলো, সহসা তারা উন্মত্তের মতো তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়,নাক বরাবর দাবড়ে যাবার সময় তারা বালুকে কোনোরকম প্রতিবন্ধক হিসাবে গ্রাহ্য করে না। হুমায়ুন বুঝতে পারে, প্রাণীগুলো নিশ্চিতভাবে পানির গন্ধ পেয়েছে এবং তাঁর আত্মা ধক করে উঠে।

সে তার ঘোড়ার পিঠে পুনরায় আরোহন করে, প্রাণীটা উত্তেজনায় এখন চিহি রব করছে, সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সে নিজের হাতে হামিদার জন্য এক পেয়ালা শীতল পানি নিয়ে আসবে। কিন্তু সে যতই কাছাকাছি পৌঁছে, তার চোখে বিশৃঙ্খলা ধরা পড়তে থাকে। প্রথমেতো উন্মত্তের মতো হুড়োহুড়ি করতে থাকা এতগুলো দেহের ভীড়ে- মানুষ আর প্রাণী নির্বিশেষে বোঝাই যায় না ধুলো মলিন কয়েকটা গাট্টাগোট্টা খেজুর গাছের আড়ালে আসলে ঠিক কি ঘটেছে। তারপরে সে কয়েকটা উঁচু হয়ে থাকা মাটির দেয়ালের পার্শ্বভাগ দেখতে পায় যা দেখতে অনেকটা ছোটখাট একটা কুয়োর সমষ্টি বলে প্রতিয়মান হয় এবং একপাশে একটা ঝর্ণা থেকে পানির ধারা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে একটা ছোট স্রোতধারা হয়ে গড়িয়ে এসে বালিতে মিলিয়ে যাচ্ছে। কুয়ো থেকে ভোলা পানি ভর্তি মশকের দখল নিতে তার লোকেরা ইতিমধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু করে মূল্যবান পানি অপচয় করছে।

ভারবাহী প্রাণীগুলো যাদের যত্ন নেয়া তাদের উচিত ছিলো সেগুলোও এখন কেমন খাপছাড়া আচরণ করছে। উটের বহর থুতু ছিটাচ্ছে এবং উন্মত্তের ন্যায় পা। দিয়ে লাথি ছুড়ছে। একটা লোকের পেটে এতো জোরে লাথি লাগে যে বেচারা বালিতে ছিটকে পড়ে এবং নিমেষের ভিতরে ধাবমান পায়ের নীচে পদদলিত হয়ে থেঁতলে যায়। হুমায়ুন তাঁর মাথাটা গুঁড়িয়ে যেতে দেখে, গা গুলিয়ে উঠা একটা দৃশ্যের অবতারণা করে মগজ আর রক্ত মরুভূমির বালুতে ছিটকে গেলে সাথে সাথে তার বাহিনীর সাথে আগত কুকুরের পাল হামলে পড়ে সেটা চাটতে আরম্ভ করে। ভারবাহী খচ্চরের পাল ঝর্ণার কাছে দ্রুত পৌঁছাতে, তাঁদের পিঠের বোঝার কথা ধর্তব্যে ভিতরে না এনে, সবাই তাঁদের বীভৎস হলুদ দাঁত বের করে এবং একে অপরকে কামড়াতে চেষ্টা করে, সবাই একসাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকে।

হুমায়ুন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়ে। তাঁর আধিকারিকেরা কি ভেবেছে…? শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার সংকল্প নিয়ে সে যখন ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে গিয়ে, সে দেখে উন্মত্ত, বিশৃঙ্খল মানুষের ভীড়ের ভিতরে সাধারণ লোকদের সাথে তাঁর আধিকারিকেরাও রয়েছে। সে চিৎকার করে তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে কিন্তু তাঁরা পাত্তাও দেয় না। মাথার উপরে আলমগীর আন্দোলিত করতে করতে সে বল প্রয়োগ করে জটলার আরো ভিতরে প্রবেশ করে এবং চিৎকার করে তিরস্কারের তুবড়ি ফোঁটাতে থাকলে অবশেষে সে নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে সক্ষম হয়। লজ্জিত-মুখে তার আধিকারিকেরা পানির জন্য নিজেদের ভিতরে লড়াই বন্ধ করে এবং নিজেদের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা শুরু করে।

হুমায়ুন এখন সৈন্যসারির পেছনে অবস্থানরত হামিদা এবং অন্যান্য মহিলাদের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠে। সে তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, গরম বালুর উপর দিয়ে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটায় কিন্তু তার নিয়োজিত প্রহরীদের দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায় তারা তখনও শ্লথ কিন্তু সুশৃঙ্খল ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে দেখে স্বস্তির শ্বাস নেয়। সৈন্যসারির অনেক পেছনে তারা অবস্থান করার কারণে আকষ্মিক বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে যেতে পেরেছে। হামিদার পালকির দিকে এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে সে ভিতরে উঁকি দেয়। পালকির ভিতরের আলো-আধারিতে তাঁর দীপ্তিমান হাসি দেখে হুমায়ুন বুঝতে পারে চিন্তার কিছু নেই এবং সে অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠে।

শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে কিন্তু ততক্ষণে পানির কাছে অন্যদের আগে পৌঁছাবার তাগিদের কাছে পরাস্ত হয়ে কিংবা হুড়োহুড়ির ভিতরে থেঁতলে গিয়ে ছয়জন লোক মারা গিয়েছে। অন্যেরা পানি খেয়ে পেট ঢোল করে এখন মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে আর পরিত্রাণ পাবার জন্য চিৎকার করছে। কয়েকজনের বমির সাথে পানি আর পিত্ত উঠছে আর তারা প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। নরকের কোনো দৃশ্য যেন পৃথিবীর বুকে অভিনীত হচ্ছে এবং হুমায়ুন মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। হুমায়ুন আর তার সাথের ছোট বাহিনীটা বিপর্যয়ের কোনো অতলে পতিত হয়েছে জানার জন্য তার শত্রু শেরশাহ অনেক দূরে অবস্থান করায় সে মনে মনে ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

তিনদিন পরে ধুসর দিগন্তের আড়াল ছিন্ন করে একটা উঁচু, পাথুরে শিলাস্তরের এবড়ো থেবড়ো অবয়ব দৃশ্যমান হলে তাঁর মনোবল পুনরায় চাঙ্গা হয়ে উঠে। শিলাস্তরের চূড়ায়, ঈগলের বাসার মতো একটা দূর্গ শোভা পাচ্ছে- মারওয়ারের রাজার দুর্ভেদ্য দূর্গ। দূর্গটা এখনও অবশ্য পনের কি বিশ মাইল দূরে রয়েছে। হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, শীঘ্রই সে হামিদা, খানজাদা আর গুলবদনকে দূর্গপ্রাকারের নিরাপত্তার ভিতরে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। মরুভূমির উপর দিয়ে তাদের বিপদসঙ্কুল যাত্রা শেষে পুনরায় নিরাপত্তা আর স্থিরতার মাঝে প্রীতিকর প্রত্যাবর্তন। মালদেওকে তার শুভেচ্ছা জানিয়ে সে তখনই একজন গুপ্তদূতকে প্রেরণ করে।

গুপ্তদূত পরের দিনই কমলা রঙের আলখাল্লা আর ইস্পাতের বর্ম পরিহিত অবস্থায়, তাদের সাজসজ্জার সাথে মাননসই কালো স্ট্যালিয়নে দর্শনীয়ভঙ্গিতে উপবিষ্ট রাজার চৌকষ প্রহরীদের একটা দলকে নিয়ে ফিরে আসলে দেখা যায়, হুমায়ুন যা আন্দাজ করেছিল কার্যত দূরত্ব তারচেয়ে অনেক কম। যোদ্ধাদের মাথার ঢেউ খেলান লম্বা চুল অনেকটা মেয়েদের মতো করে তাদের মাথার উপরে খোঁপা করে বাঁধা বটে কিন্তু চকচকে ফলার বর্শা বহনকারী বাজপাখির মতো নাকবিশিষ্ট, ছিপছিপে, পেষল দেহের এই লোকগুলোর মাঝে মেয়েলী কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

কাশিম আর জাহিদ বেগকে দুপাশে নিয়ে হুমায়ুন ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রাজপূত দলপতি ছোঁড়া নেমে নেমে এসে হুমায়ুনের সামনে নতজানু হয়ে গরম বালুতে অল্পক্ষণের জন্য নিজের কপাল স্থাপন করে। সুলতান, মারওয়ারের রাজা, মহামান্য মালদেও আপনাকে তাঁর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি অনেকদিন থেকেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং আপনার যাত্রাপথের শেষ কিছু মাইলগুলোতে রক্ষীবাহিনী হিসাবে আপনার সঙ্গী হতে আমাকে আর আমার অধীনস্থ লোকদের পাঠিয়েছেন।

রাজা মালদেওর এই আন্তরিকতার জন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা যত দ্রুত মারওয়ার পৌঁছাতে পারব ততই মঙ্গল- আমার লোকেরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

অবশ্যই, সুলতান। আমরা যদি এখনই যাত্রা করি তবে সূর্যাস্ত নাগাদ আমরা দূর্গে পৌঁছে যাব সেখানে আমার প্রভু আপনি আর আপনার সহযাত্রীদের জন্য বিশ্রামের বন্দোবস্ত করেছেন।

রাজপুত যোদ্ধারা তাঁদের লোকদের কাছে ফিরে যাবার সময় হুমায়ুন তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে, সে মনে মনে ভাবে তার সঙ্গের এই হতশ্রী সেনাবাহিনী কেমন ছাপ ফেলতে পেরেছে। তাঁদের সম্পর্কে অজ্ঞ এমন একজন লোক তার বাহিনীকে এই অবস্থায় দেখলে মোটেই তাদের গর্বিত মোগল বাহিনী বলে ভাববে না বরং পরিশ্রান্ত ঘোড়ায় উপবিষ্ট অপরিচ্ছন্ন একদল লোক, তাঁদের পর্যাণে একটা সময় যেসব উজ্জ্বল ফলাবিশিষ্ট শস্ত্র শোভা পেত তরবারি আর দো-ধারি রণকুঠার- সেগুলো এখন বহুব্যবহারে কার্যকারিতা হারিয়েছে। মরুভূমির গরমে তার লোকদের ভেতরে অনেকেই বৃত্তাকার ধাতব আস্তরণযুক্ত ঢাল ফেলে দিয়েছে বহন না করে এবং তাদের তূণের তীর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মরুভূমির ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার কারণে ভালো কাঠ খুঁজে বের করে তীর তৈরী করার কোনো সুযোগ বা সময় তারা পায়নি। হুমায়ুনের তবকিদের দেখে কেবল মনে হয়- জাহিদ বেগের দ্বারা নিপূণভাবে প্রশিক্ষিত- যে তারা কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু সে যদি একবার কেবল মারওয়ার পৌঁছাতে পারে তাহলে এসব কিছুই বদলে যাবে। তার কাছে এখন বেশ কিছু অর্থসম্পদ রয়েছে যা দিয়ে সে তার সঙ্গের লোকদের পুনরায় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে এমনকি নতুন লোক নিয়োগ করতেও পারবে, এবং মারওয়ারের রাজা স্বয়ং তাঁকে লোক সরবরাহ করবে।

সেই রাতে, সূর্যাস্তের পরে আকাশের কমলাভ-গোলাপী আভার নীচে, হুমায়ুন তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যদলের অগ্রভাগে অবস্থান করে মারওয়ারের আঁকাবাঁকা সড়ক দিয়ে শহরের বসতির পেছনের খাড়াভাবে উঠে যাওয়া উচ্চভূমির শীর্ষে অবস্থিত রাজা মালদেও-এর বিশাল দূর্গপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যায়। বনের শেষভাগ, মাটির বাড়ি আর শিলাস্তরের মধ্যবর্তীস্থানে- যা দেখে মনে হয় সেটা সম্ভবত দেড়শ ফিট উঁচু হবে একটা উন্মুক্ত প্রান্তর রয়েছে যার ডানপাশ দিয়ে একটা শীর্ণকায়া ঝর্ণা বয়ে চলেছে। ঝর্ণা অতিক্রম করে খানিকটা দূরে সারি সারি তাবু আর জ্বালাবার জন্য তৈরী অবস্থায় কাঠ স্তূপ করে রাখা।

সুলতান, আপনার লোকদের বিশ্রামের জন্য নির্মিত ছাউনি, রাজপুত সেনাপতি বিনয়ের সাথে বলে।

হুমায়ুন ঘোড়া নিয়ে না থামিয়ে শিলাস্তরের পাদদেশে অবস্থিত একটা তোরণাকৃতি প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষী, বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি, অমাত্যবৃন্দ আর রাজ পরিবারের মহিলাদের নিয়ে তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে অতিক্রম করার সময় অন্তরাল থেকে অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে জয়ঢাকের গুরুগম্ভীর আওয়াজ তাঁদের স্বাগত জানায়। তোরণের অপর পার্শ্বে, খাড়া কিন্তু প্রশস্ত একটা পথ বামদিকে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়ে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে এবং পাথরের প্রাকৃতিক বাঁক অনুসরণ করে শিলাস্তরের উপরের দিকে উঠে যায়। হুমায়ুনের ক্লান্ত ঘোড়াটা, নাক দিয়ে ফেস-ফোঁস শব্দ করে, ঢালু পথ বেয়ে মন্থর গতিতে উপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করে একটা প্রশস্ত পাথুরে মালভূমির শীর্ষভাগে এসে হাজির হয়। তাঁর সামনে এখন কামানের গোলা নিক্ষেপের জন্য ছিদ্র বিশিষ্ট প্রাকারের একটা বেষ্টনী যা শিলাস্তরের উপরিভাগের প্রায় পুরোটাই ঘিরে রেখেছে। একটা দ্বিতল তোরণগৃহের ভিতর দিয়েই অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায় হুমায়ুন দেখে প্রাকারের সারি পেছনদিকেও প্রসারিত।

তোরণগৃহটা, সরদলের উপরে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠা ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক রাজপুত যোদ্ধার অবয়ব খোদাই করা রয়েছে, দেখতে বেশ প্রাচীন উত্তোলিত ধাতব নিরাপত্তা বেষ্টনীর নিচ দিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সময় হুমায়ুন ভাবে, আগ্রা দূর্গ বা এমনকি কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের চেয়েও অনেক প্রাচীন। এই তোরণের নীচে দিয়ে রাজপুত যোদ্ধাদের কতগুলো প্রজন্ম ঘোড়া নিয়ে দুলকি চালে ছুটে বের হয়েছে এবং নিজেদের যোদ্ধা সংহিতার প্রবর্ধনে পাহাড়ের ঢালু পথ দিয়ে নীচের দিকে ছুটে গিয়েছে যুদ্ধের তুলিতে ধ্বংসের চিত্রকল্প নির্মাণে? হিন্দুস্তানের তাবদ অধিবাসীদের ভিতরে এই রাজপুত গোত্রগুলো সত্যিই মোগলদের সাথে অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ একটা যোদ্ধা জাতি যাদের কাছে মায়ের বুকের উষ্ণ দুধে শিশুর অধিকারের মতোই যুদ্ধ, সম্মান, গৌরব, বিজয় তাদের একটা স্বতসিদ্ধ অধিকার। কিন্তু তার কৌতূহলী চোখে তখনই এমন কিছু একটা ধরা পড়ে যা সে ঠিক পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারে না। তোরণগৃহের দুপাশে ভেতরের দিকে প্রসারিত দেয়ালের উপরে রক্ত-রঞ্জিত ছোট ছোট হাতের পাঞ্জার ধারাবাহিক ছাপ রয়েছে।

ঔই ছাপগুলো কি?

রাজপুত সেনাপতির উত্তর শুনে হুমায়ুনের মনে হয় পরানের গহীন থেকে উঠে আসা গর্ব তার কণ্ঠে খেলা করছে। মারওয়ারের রাজপরিবারের মহিলারা নিজের মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বরণ করতে এগিয়ে যাবার সময় হাতের এই ছাপগুলো রেখে গিয়েছে। একজন রাজপূত রমণীর স্বামী যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয় বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করে তখন সেই রমণীর দায়িত্ব জীবনের স্পন্দনে নিজের অধিকার পরিত্যাগ করা এবং স্বামীর অন্তেষ্টিক্রিয়ার চিতায় তার সাথে মিলিত হওয়া। আগুনের সর্বগ্রাসী শিখার চাদরে নিজেকে আবৃত করার পূর্বে সেইসব রমণীদের জীবিত অবস্থায় শেষ কর্মকাণ্ড এই চিহ্নগুলো যা আপনি এখানে দেখছেন।

হুমায়ুন এরকম গল্প আগেও শুনেছে। বাবর তাকে বলেছিলেন যে তাঁর হিন্দু প্রজারা এই লোকাঁচারকে সতী বলে এবং অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মেয়েরা মোটেই ব্যাপারটায় উৎসাহী নয়। বাবর এক কিশোরী বিধবাকে বড়জোর যযাল বছর বয়স হবে মেয়েটার দেখেছিল, তেলে চুপচুপে করে ভিজিয়ে আক্ষরিক অর্থেই তাকে আগুনের ভিতরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আগে মরীয়া হয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে। মেয়েটার মরণ চিৎকারের ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না এবং বাবরের লোকেরা ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করার আগেই বেচারী আগুনে পুড়ে মারা যায়।

হুমায়ুনের মনের ভাবনা যেন লোকটা বুঝতে পারছে এমন ভঙ্গিতে রাজপুত সেনাপতি কথা বলতে থাকে, আমাদের মেয়েদের জন্য এটা অতীব সম্মানের বিষয়…এবং আমরা যদি কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে এমন শোচনীয় পরাজয়বরণ করি যে শত্রুর হাতে আমাদের মেয়েদের নিগৃহিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সবচেয়ে বয়স্ক। রাজপুত রাজকুমারী পুরোভাগে থেকে অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সাথে নিয়ে তারা প্রত্যেকে তখন বিয়ের অনুষ্ঠানের উপযোগী জাঁকালো পোষাক আর সেরা অলঙ্কার সজ্জিত-জহরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যায়। বিশাল একটা অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করা হয় এবং মর্যাদাহানির মুখোমুখি হবার চেয়ে তারা হাসিমুখে আগুনের কুণ্ডে লাফিয়ে পড়ে। চমকপ্রদ একটা দৃশ্যকল্প যেন তাঁর চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে এমন ভঙ্গিতে লোকটা হাসতে থাকে।

পরমানন্দ বা হতাশায় নেয়া লাল ছাপচিত্রের উপর থেকে হুমায়ুন তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, সে অনুভব করে যে একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি যতই নিবেদিত প্রাণ কিংবা পরিস্থিতি যতই ভয়াবহ হোক, একটা মেয়ের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মতো আপন অস্তিত্ব রয়েছে, তার নিজস্ব কিছু বাধ্যবাধকতাও রয়েছে নিজের প্রতি, যদি সে মা হয় তবে তাঁর সন্তানের প্রতি, এবং তার চারপাশে যারা রয়েছে। খানজাদার অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা যায় যে এমন পরিস্থিতিতে একটা অদম্য সত্ত্বা টিকে থাকতে এবং সেই পরিস্থিতি থেকে, হয়তো। অক্ষত অবস্থায় না কিন্তু আত্মার বলে আরো বলীয়ান হয়ে, বের হয়ে আসতে পারে। তার যদি এখন মৃত্যু হয় তাহলে হামিদা আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে এমন ভাবনাই তার রক্তকে শীতল করে তোলে। রাজপুতরা হিন্দু হিসাবে পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে এবং সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণ করার অর্থই হল আরো উঁচু মর্যাদা নিয়ে পুনরায় ভূমিষ্ঠ হওয়া, যেখানে সে বিশ্বাস করে যে প্রত্যেক মানুষ একবারই জন্ম। গ্রহণ করবে, তাই প্রত্যেকের উচিত সেই জীবনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, এটাই সম্ভবত আচরনগদ ভিন্নতার মূল কারণ।

তাদের ঠিক সামনে নাক বরাবর, নতুন পর্দা দিয়ে আবৃত দেয়ালের ঠিক মধ্যেখানে ছয়ফুট প্রশস্ত একটা গলি দেখা যায় যার ঠিক মাঝবরাবর প্রায় সমকোণী একটা বাঁক রয়েছে বিপুল সংখ্যায় শত্রুপক্ষের সৈন্যদের ধেয়ে আসা প্রতিরোধ করতেই এমনটা করা হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গলিটা গিয়ে কুচকাওয়াজের জন্য ব্যবহৃত একটা বিশাল মাঠে গিয়ে শেষ হয়, যেখানে এখন একদল রণহস্তী অনুশীলন করছে। মাঠের বিপরীত দিকেও আরেকপ্রস্থ দেয়াল দেখা যায়, এরও ঠিক মধ্যে একটা সরু গলিপথ আছে। মোগল দূর্গের নক্সা থেকে একেবারে আলাদা এইসব সমকেন্দ্রিক দেয়াল, হুমায়ুনকে কাবুলের বাজারে কাশগর থেকে আগত ঢুলু ঢুলু চোখের বণিকদের বিক্রি করা জটিল বাক্সের ভিতরে অবস্থিত বাক্সের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

দেয়ালের এই তৃতীয় সারিটাই কিন্তু শেষ বাঁধা। আগের মতো একই ধরনের গলিপথ দিয়ে এগিয়ে যেতে হুমায়ুন চতুষ্কোণাকৃতি একটা বিশাল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়- এটাই মালদেও দূর্গের কেন্দ্রস্থল। প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে, সৌন্দর্যের চেয়ে যার দুর্ভেদ্যতার দিকেই বেশী লক্ষ্য করা হয়েছে। প্রাসাদটার বর্হিভাগের দেয়ালে খিলানযুক্ত ছোট ছোট জানালা যত্রতত্র ইচ্ছামতো যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছে, ফলে বাইরে থেকে দেখে কারো পক্ষে অনুমান করাটা অসম্ভব ভবনটা কত তলা। প্রাসাদের একদিকে একটা চওড়া, মজবুত দর্শন মিনার রয়েছে- যার শীর্ষভাগে রয়েছে পাথরের তৈরী একটা অভিজাত রুচিশীল কক্ষ।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে। তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য এখানে তার নিমন্ত্রাতার অবস্থান করার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই উচ্চনাদে অদৃশ্য এক তূর্যবাদকের তৃর্যধ্বনি ভেসে আসে এবং প্রাসাদের কারুকার্যময় সিংহদ্বার দিয়ে কমলা আলখাল্লা পরিহিত রাজপুত যোদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে আসে এবং হুমায়ুনের দুই পাশে দুটো সারিতে সাবলীল দক্ষতায় বিন্যস্ত হয়। যোদ্ধাদলের ঠিক পেছনেই দীর্ঘদেহী, শক্তিশালী দর্শন একটা লোককে দেখা যায়, পরনে পরিকরযুক্ত কমলা আলখাল্লা যার প্রান্তদেশ রাজকীয় মহিমায় মাটি ছুঁয়ে রয়েছে, মাথার হীরকশোভিত সোনার জরির কারুকাজ করা কাপড়ের পাগড়ির নীচে কালো চুল টানটান করে বাঁধা, রাজা মালদেও। দুহাত বুকের উপরে স্থাপন করে, তিনি হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসেন এবং মাথা নত করে অভিবাদন। জানান।

সম্রাটের জয় হোক। মারওয়ারে আপনাকে স্বাগত জানাই।

রাজা মালদেও, আপনার আতিথিয়তার জন্য আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।

আমাদের রাজপুত প্রথা অনুযায়ী আমার পরিবারের রাজমহিষীদের আবাসন কক্ষের পাশেই আপনার সাথে আগত মোগল রাজবংশের রমণীদের আবাসন কক্ষের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আপনি আর আপনার সাথে আগত অমাত্যবৃন্দ এবং সেনাপতিদের জন্য হাওয়া মহলে কক্ষ প্রস্তুত করা হয়েছে। মালদেও মিনারের দিকে ইশারা করে। আপনার কক্ষটা মিনারের একেবারে শীর্ষদেশে অবস্থিত যেখানে চারপাশ থেকে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।

আমি আবার একবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আর মালদেও আগামীকাল আমরা আলোচনায় বসবো।

অবশ্যই।

*

পরের দিন নরম গদিঅলা বিছানার চারপাশে মিহি তাঁর দিয়ে তৈরী পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ বাতাসের একটা আমেজ অনুভব করতে হুমায়ুন ঘুম থেকে জেগে উঠে, গত রাতে পরিশ্রান্ত অবস্থায় যেখানে স্বপ্নহীন এক দীর্ঘ সুপ্তিতে তাঁর দেহ ভেঙে পড়েছিল। কয়েক মুহূর্ত সে নিথর হয়ে সেখানেই শুয়ে থাকে, নিজের পরিবার আর তার অনুগত লোকদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে পারার কারণে স্বস্তি আর সন্তুষ্টিবোধের কাছে নিজেকে সমর্পিত করে। তারা সবাই কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্তত বিশ্রাম নিতে পারবে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল হামিদা তার প্রয়োজনীয় সেবা আর বিশ্রাম পাবে। হুমায়ুন উঠে বসে এবং বাইরের প্রশস্ত বারান্দায় বের হয়ে এসে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বরাবর যা নীচের বালুকাময় সমভূমিতে নিজের আপন বোনর সাথে বিশ্বাসঘাতকও, একেবারে সরাসরি নেমে গিয়েছে নিজের তাকিয়ে থাকতে থাকতে, সূর্য আকাশে অবশ্য অনেকটা উঁচুতে নেমে আসতে এবং ভবনগুলো মেখগুলো নিথর দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যকে, ইতিমধ্যে বেশ অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছে, দেখে মনে হয় প্রান্তের দিকটা লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে রয়েছে, অনেকটা রক্তাক্ত কমলার আঁশের মতো দেখায়।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নাগাড়ে ভ্রমণ করার ধকলের পরে, হুমায়ুনের কাছে মরুভূমি আর বিন্দুমাত্র আকর্ষণীয় মনে হয় না। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে জওহরকে আদেশ দেয়- কাশিম, জাহিদ বেগ আর অন্যান্য সেনাপতিদের ডেকে আনতে। খবরটা নিশ্চয়ই মালদেও এর কাছেও পৌঁছেছিল কারণ হুমায়ুনের লোকেরা এসে পৌঁছাবার আগেই, রাজার ভূত্যরা নানা ধরনের ফল, বাদাম আর সোনা এবং রূপার তবক দিয়ে মোড়া মিষ্টি বোঝাই পিতলের অতিকায় ট্রে এবং সোনালী জগে শীতল সরবত নিয়ে উপস্থিত হয়। মালদেও নিজে যখন ব্যক্তিগতভাবে সেখানে এসে উপস্থিত হন তাদের পানাহার তখনও শেষ হয়নি। পাতলুন আর গাঢ় বেগুনী রঙের জোব্বা পরিহিত অবস্থায় আজ তাঁকে গতকালের চেয়ে অনেকবেশী মার্জিত দেখায় এবং তাঁর মেদহীন কোমরে একটা সরু ধাতব শিকল থেকে চামড়ার তৈরী সাধারণ কোষের ভেতরে বাঁকান একটা খঞ্জর ঝুলছে।

সুলতান, আমার বিশ্বাস রাতে আপনার ঘুম ভালোই হয়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহের চেয়ে অনেক আরামে ঘুমিয়েছি। আসুন, অনুগ্রহ করে আমাদের সাথে কিছু একটা মুখে দেন। হুমায়ুন তাঁর পাশে রেশমের কমলা রঙের তাকিয়ার দিকে তাঁকে ইঙ্গিত করে।

মালদেও আরাম করে বসে এবং তবক মোড়ান একটা খুবানি তুলে মুখে দেয়। শিষ্টতার খাতিরে, হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নেয় যে শের শাহের প্রসঙ্গ উত্থাপনের পূর্বে তার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করাই সঙ্গত হবে, কিন্তু তাঁর নিমন্ত্ৰাতা দেখা যায় ঠিক অতটা বিনয়ী নন।

আপনি নিশ্চয়ই এই দীর্ঘ আর কষ্টকর সফর আমার সাথে শীতল শরবত পান করার অভিপ্রায়ে করেননি। মালদেও সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। আমাদের বোধহয় রাখঢাক না করে কথা বলা উচিত। আমাদের উভয়েই একই শত্রুর মোকাবেলা করছি। শের শাহকে যদি অবাধে বিচরণের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে সে আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। আপনি ইতিমধ্যেই জেনেছেন যে মারওয়ার আক্রমণের হুমকি দিয়ে সে আমাকে চূড়ান্ত অপমান করেছে, কিন্তু তার ছিন্ন মস্তক ধূলোয় পড়ে রয়েছে দেখার অভিপ্রায় আমার মাঝে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরো জোরাল হয়েছে তারই আরো অধিকতর ঔদ্ধত্যের কারণে।

তা কী করে হয়?

আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠাবার ধৃষ্টতা সে প্রদর্শন করেছে। রাজস্থানের ত্রিশজন নৃপতির রক্ত আমার মেয়ের ধমনীতে বইছে- সাধারণ এক ঘোড়ার দালালের চৌর্যবৃত্তিতে সিদ্ধহস্ত সন্তানের হাতে আমার মেয়েকে আমি তুলে দিতে পারি না। মালদেও এর চোখ দুটো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে এবং তার কণ্ঠস্বরে বিষ ঝরে পড়ছে।

আমার সাথে খুব অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে কিন্তু আপনি যদি আমাকে একটা বাহিনী সংগ্রহ করে দিয়ে, আমার সাথে যুদ্ধে অংশ নেন, অন্যেরা তাহলে অনুসরণ করার জন্য উৎসাহবোধ করবে। মোগলদের মতো আপনার লোকেরাও যোদ্ধার জাত। শেরশাহ আর তাঁর নিকৃষ্টতম সঙ্গীসাথীদের আমরা একসাথে নর্দমায় নিক্ষেপ করতে পারবো। মালদেও, আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- আগ্রায় যখন আমি আবারও সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হব, আপনিই হবেন সর্বাগ্রে পুরষ্কার লাভের অধিকারী।

আমার সাধ্যের ভিতরে রয়েছে এমন সবকিছু আমি করবো- পুরষ্কারের জন্য না বরং আপনার আর আমার নিজের ঐতিহ্যের প্রতি আমার বিশ্বাস আর সম্মান আছে বলে।

মালদেও, আমি জানি সেটা। হুমায়ুন রাজার কাঁধ আকড়ে ধরে এবং তাঁকে বুকে টেনে নেয়।

*

আট সপ্তাহ পরে, হুমায়ুন, রাজা আর তাঁকে নিরাপত্তা দানকারী দেহরক্ষী বাহিনীকে দূর্গের তোরণদ্বার দিয়ে বের হয়ে, রুক্ষ প্রান্তরের উপর দিয়ে জয়সলমীরের মরুশহর অভিমুখে হারিয়ে যেতে দেখে যেখানে পৌঁছে মালদেও শের শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য আরো সৈন্য সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে, রাতের মতো দূর্গপ্রাকারে একটা আশ্রয়স্থল খুঁজতে ব্যস্ত রাজার পোষা ময়ুরের কর্কশ ডাকে শীতল বাতাস খানখান হয়ে যায়। ভবিষ্যত সম্পর্কে নিবিষ্ট মনে চিন্তা ভাবনা করার সময় হুমায়ুন অনেক দিন পরে অনেকটাই প্রশান্তি অনুভব করে। মালদেও একজন মনোযোগী আতিথ্যকর্তা। শুভেচ্ছা স্মারক হিসাবে উপঢৌকন প্রদান বা কোনো ধরনের বিনোদনের আয়োজন- উটের দৌড়, হাতির লড়াই বা অগ্নি-ভক্ষণের প্রদর্শনী এবং রাজপুত সামরিক কসরত- ব্যাতীত খুব কম দিনই অতিবাহিত হয়। গতকালই যেমন, তার জন্য একটা কারুকার্যখচিত ঘোড়ার মাথার সাজ আর হামিদার জন্য স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামী রঙের অ্যাম্বার পাথরের পুতির একটা হার মালদেও পাঠিয়ে দিয়েছে। মালদেও এর বন্ধুত্বের স্মারক হিসাবে এটা যদিও বেশ স্বস্তিদায়ক কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শের শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের চূড়ান্ত পরিকল্পনা রাজা আর সে মিলে প্রায় শেষ করে ফেলেছে। হুমায়ুন শীঘ্রই একটা সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে পুনরায় নিজেকে অধিষ্ঠিত দেখবে।

সুলতান… সে ঘুরে তাকিয়ে দেখে হামিদার এক পরিচারিকা, জয়নব, তার সামনে নতজানু হয়ে রয়েছে। মেয়েটার ছোটখাট মুখাবয়বের ডান পাশটা একটা জরুলের মতো জন্মদাগের কারণে মারাত্মকভাবে কুৎসিত দেখায় এবং মারওয়ার অভিমুখে প্রাণান্তকর যাত্রার সময়ে বেচারীর মা জ্বরে মারা গেলে, মেয়েটার পদাতিক সৈন্য বাবা অন্যান্য সন্তানদের ভরণপোষনের নিমিত্তে মেয়েটাকে নিজের সংস্থান নিজেই করার জন্য পরিত্যাগ করে। হামিদা মেয়েটার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে আবেগপ্রবন হয়ে উঠে এবং জয়নবকে নিজের পরিচারকা করে নেয়।

কি ব্যাপার?

জয়নব তখনও নতজানু অবস্থায়, দ্রুত কথা বলতে থাকে। সুলতান, মহামান্য রাজমহিষী যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে তার সাথে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

হুমায়ুন হাসে। আজরাতে সে হামিদার কাছে যাবার কথা চিন্তা করছিলো। তারা এখন যখন নিরাপদ আর আরামে রয়েছে এবং হামিদাও পুনরায় সুস্থবোধ করতে শুরু করায়, তার মন আজকাল প্রায়ই শারীরিক আনন্দের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে যদিও হামিদার উদর মাতৃত্বের লক্ষণ নিয়ে দ্রুত বেড়ে উঠতে শুরু করায় তাকে শীঘই হামিদার জন্য নিজের আবেগ সংযত করতে অভ্যস্ত হতে হবে। কোনো কারণে যেন অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে জয়নাব যখন কথা শেষ করে তার দিকে চোখ তুলে তাকায় সেখানে সমস্যার সম্ভাবনা ফুটে থাকতে দেখা যায় এবং সে সাথে সাথে বুঝতে পারে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে।

জয়নবকে অযথা প্রশ্ন করার জন্য সময় নষ্ট না করে, হুমায়ুন দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে দুই তলা নীচে হাওয়া মহলের সাথে সংযোগকারী দরদালানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে মালদেও এর রাজপুত রমণীদের আবাসন কক্ষের সংলগ্ন কক্ষগুলোতে হামিদা আর অন্যান্যদের থাকবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। হামিদার কক্ষের চন্দনকাঠের দরজার সামনে অবস্থানরত তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের তোয়াক্কা না করে, হুমায়ুন নিজেই দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে এবং ভিতরে প্রবেশ করে।

হুমায়ুন… হামিদা দৌড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসে এবং দুই হাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে। হামিদার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে এবং হুমায়ুন তার পরনের ফিনফিনে রেশমের জোব্বার নীচে উত্তেজনায় অস্বাভাবিক গতিতে স্পন্দিত হতে থাকা হামিদার হৃৎপিণ্ডের কম্পন অনুভব করে।

কি ব্যাপার? তোমার বাচ্চার…

হামিদা কোনো কথা না বলে দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে কক্ষে তারা কেবল দুজন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। হুমায়ুনের কাছ থেকে কয়েক পা পেছনে সরে গিয়ে আলগে রাখার ভঙ্গিতে সে দুহাত দিয়ে নিজের স্ফীত উদর আড়াল করে। আমাদের সন্তান নিরাপদেই আমার কাছে রয়েছে…অন্তত এই মুহূর্তের জন্য হলেও। কিন্তু আমরা যদি সতর্ক না হই তাহলে আমরা সবাই হয়ত শীঘই মারা পড়ব। হামিদার গলার স্বর এতোই নীচু যে প্রায় শোনাই যায় না এবং কথা বলার সময় সে কক্ষের চারদিকে এমন ভঙ্গিতে খুটিয়ে দেখতে থাকে যেন দেয়ালের ঝুলন্ত ঝালরের পেছনে কেউ আঁড়িপেতে রয়েছে তাঁদের কথোপকথন শুনতে।

কি সব আবোল-তাবোল কথা বলছো?

হামিদা পুনরায় হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসে। আমি জানতে পেরেছি যে আমাদের আশ্রয়দানকারী এই রাজা মোটেই আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয়। তিনি সবসময়ে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার ফন্দি করছেন। এমনকি তিনি এখনও মরুভূমির দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত একটা দূর্গে আগ্রা থেকে শের শাহের প্রেরিত দূতের সাথে গোপন আলোচনায় মিলিত হতে চলেছেন। সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর জয়সলমীর যাবার গল্পটা আর কিছুই না আমাদের কাছ থেকে নিজের আসল অভিপ্রায় আড়াল করার একটা ফন্দি।

কিন্তু সে আমার মিত্র এবং আমার নিমন্ত্রাতা এবং যথাযথ সম্মানের সাথেই আমাদের আচরণ করা হয়েছে। গত দুই মাস ধরে আমরা তার মুঠোর ভিতরেই রয়েছি। সে যদি ইচ্ছা করতো তাহলে অসংখ্যবার সে আমাদের হত্যা করতে পারতো… হুমায়ুন এক দৃষ্টিতে হামিদার দিকে তাকিয়ে থাকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে যে গর্ভধারণের কারণে মেয়েটার বিবেচনাবোধ একেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে।

রাজার লোভই আমাদের এতোদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে- নিজের পারিশ্রমিকের বিষয়ে তিনি দর কষাকষি করছিলেন। নিজেকে সন্তুষ্ট করতেই যে তার সব দাবী পূরণ করা হবে, তিনি শের শাহের প্রেরিত দূতের সাথে এ বিষয়ে মুখোমুখি আলোচনার জন্য এবার তিনি নিজেই গিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে আসা মাত্রই…নিজে পৌঁছাবার আগে যদি তিনি কোনো বার্তা প্রেরণ করেন তাহলে আরো আগেই…তিনি আমাদের সবাইকে হত্যা করবেনই।

হামিদার মুখ ভয়ে টানটান হয়ে আছে যদিও তার কণ্ঠস্বর সংযত। হুমায়ুন তার হাত ধরে, সেগুলোর মর্মর শীতলতা অনুভব করে।

তুমি এতোসব কি করে জানতে পারলে?

একটা মেয়ে তার নাম সুলতানা রাজার হারেম থেকে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। মেয়েটা আমাদের গোত্রের একজন- কাবুলের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী একজন আফ্রিদি। পানিপথের যুদ্ধে তার আব্বাজান শহীদ হলে, সে তাঁর মায়ের সাথে কাবুলগামী একটা কাফেলায় যোগ দেয় কিন্তু সিন্ধু নদী অতিক্রম করার সময়ে দস্যুরা তাদের আক্রমণ করে। বাজারে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য সুলতানাকে অন্যান আরো সব যুবতী মেয়েদের সাথে বন্দি করা হয়। মেয়েটা দেখতে অসাধারণ সুন্দরী। রাজার অনুগত এক অভিজাত ব্যক্তি তাকে কিনে নেয় এবং ভেট হিসাবে মালদেও এর কাছে পাঠিয়ে দেয়।

এই মেয়েটা তোমাকে আর ঠিক কি কি বলেছে?

বলেছে যে মোগলদের প্রতি সে তার অন্তরে বিদ্বেষ পুষে রেখেছে। সে আমাদের একদল বর্বর হানাদার ছাড়া আর কিছুই মনে করে না যাদের হিন্দুস্তানের উপরে কোনো অধিকারই নেই। রাজার মেয়েকে শের শাহর বিয়ে করতে চাওয়ার গল্পটা পুরোপুরি মিথ্যা। আমরা নিশ্চিতভাবেই এখানে আসার জন্য রাস্তায় রয়েছি এই খবরটা পাবার সাথে সাথে, সে আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতে তুলতে শের শাহকে লিখে পাঠায় যে অচিরেই সে আমাদের তার কর্তৃত্বের বলয়ের ভেতরে পাবে এবং শের শাহর কাছে জানতে চায় আমাদের বিনিময়ে সে তাকে কি দিবে। কিছুদিনের জন্য দুপক্ষের মাঝে কথা চালাচালি বন্ধ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত- সুলতানার ভাষ্য অনুযায়ী দুই দিন আগে মারওয়ার রাজ্যের সীমান্তের নিকটে শের শাহের প্রেরিত প্রতিনিধি এসে উপস্থিত হয় এবং মালদেও এর উদ্দেশ্যে একটা বার্তা প্রেরণ করে শের শাহের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তাকে অবহিত করে। শের শাহ যা বলেছে… ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা…এই প্রথমবারের মতো হামিদার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ভাঙা ভাঙা শোনায়।

হুমায়ুন তাঁকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে এবং তাঁকে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বুকের কাছে ধরে রাখে। হামিদা, পুরোটা আমায় বল। আমাকে সবকিছু তোমায় অবশ্যই বলতে হবে…।

নিজেকে সামলে নিয়ে হামিদা এবার হুমায়ুনের বুকে মুখ রেখে চাপা স্বরে পুনরায় বলতে থাকে। মালদেওকে শেরশাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে রাজা যদি আপনার ছিন্ন মস্তক…এবং আমার গর্ভের অজাত সন্তানকে…তার কাছে। পাঠায়…অর্থ আর ধনসম্পদ দিয়েই সে তাঁকে পুরস্কৃত করবে না সেই সাথে তাঁকে নতুন শহর আর ভূখণ্ড দান করবে যা সে শেরশাহের সাম্রাজ্যের বাইরে স্বাধীনভাবে নিজের দখলে রাখতে পারবে। সুলতানা যখন আমাকে এই কথাগুলো জানায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি…কিছুক্ষণের জন্য আমি ঠিকমতো চিন্তাভাবনাও করতে পারছিলাম, কিন্তু আমি মনে মনে জানতাম যে আমাকে শক্ত থাকতে হবে…আমাদের জন্য এবং আমার গর্ভে আমি যাকে বহন করছি তার জন্য…

মালদেও এর হাস্যোজ্জ্বল মুখ, তাঁর কপটতাপূর্ণ মিথ্যাচারের কথা হুমায়ুন যখন চিন্তা করে, তার ভেতরে ক্রোধ আর বিরক্তির মাত্রা এতোই প্রবল হয়ে উঠে যে তাঁর মনে হয় উন্মত্ততায় বুঝি সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়বে। শেরশাহের প্রস্তাব গ্রহণের অভিপ্রায় কি মালদেওর রয়েছে? সে কোনোমতে জিজ্ঞেস করে।

সুলতানা বলেছে রাজা ভীষণ সতর্ক। শের শাহের প্রতিনিধিকে এ কারণেই সে মরুভূমির অভ্যন্তরে অবস্থিত দূর্গে ডেকে পাঠিয়েছে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য যাতে সে নিজে তাঁকে প্রশ্ন করতে পারে। কিন্তু সে যদি একবার বিশ্বাস করে যে শেরশাহ যা বলেছে সেটাই বোঝাতে চেয়েছে, আমাদের হত্যা করতে মালদেও ইতস্তত করবে না। আজ সন্ধ্যাবেলা মালদেও দূর্গ ত্যাগ করার সাথে সাথে, সুলতানা আমার সাথে দেখা করার জন্য একটা অজুহাত তৈরী করে…

তোমার এই সুলতানা বিশ্বস্ত তুমি কি এই বিষয়ে নিশ্চিত? আমাদের জন্য সে এতো বড় ঝুঁকি কেন নেবে?

মেয়েটার প্রতি মালদেও উদাসীন বলে সে তাকে ঘৃণা করে… মালদেও তাকে তৃণভূমি থেকে আগত বর্বর প্রেয়সী বলে সম্বোধন করে। কিন্তু রাজার প্রতি তাঁর বিদ্বেষের কারণ এরচেয়েও গভীরে প্রোথিত। আমার উদরে মেয়েটা যখন হাত রেখেছিল তখন আমি তার ভেতরে নিদারুণ একটা যন্ত্রণা লক্ষ্য করেছি…মেয়েটা আমাকে বলেছে যে মালদেওর একটা পুত্রসন্তানকে যখন সে গর্ভে ধারণ করে তখন সে বলেছিল ছেলেটা প্রাসাদে মানুষ হবার যোগ্য না এবং সে তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটা বেঁচে আছে না মারা গেছে এটাও মা হিসাবে মেয়েটা জানতে পারেনি। আমাদের ভাবী সন্তান এবং আমাকে একজন মা হিসাবে খাতির করার কারণে সে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সে নিজেকে আমার রক্ত-সম্বন্ধীয় বোন বলে ঘোষণা করেছে এবং আমি তাকে বিশ্বাস করি।

হুমায়ুন আলতো করে হামিদাকে ছেড়ে দেয়। হুমায়ুনের দিকে হামিদা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে থাকলে, রাজপুত ঐতিহ্যের মূল দ্যোতনা আতিথিয়তা আর সম্মানের সমস্ত রীতিনীতির মর্যাদাহানি এবং মালদেওর কপটতার কারণে তাঁর ক্রোধের উন্মত্ততা ধীরে ধীরে একটা শীতল সংকল্পে পর্যবসিত হয়। সে যদি তার নিজের পরিবার আর লোকদের জীবন বাঁচাতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে কেবল একটা বিষয়ের প্রতি তাঁর সমস্ত কেন্দ্রীভূত করতে হবে- যে কোনো মূল্যে বেঁচে থাকা।

তোমাকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- তোমার বা তোমার অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না। আমার সম্রাজ্ঞী করবো বলে আমি তোমায় বিয়ে করেছি এবং সম্রাজ্ঞীই তুমি হবে। আর আমাদের সন্তান আমার পরে ম্রাট হবে। মালদেওর নীতিবিগর্হিত ষড়যন্ত্র এসব পরিবর্তিত করতে পারবে না।

হুমায়ুনের এই কথায়, হামিদা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের এখন কি করা উচিত?

এই বিষয়ে তুমি কি আর কারো সাথে আলাপ করেছো? গুলবদন কিংবা খানজাদা?

কারো সাথে আলাপ করিনি।

তোমার খেদমতকারী জয়নব এসব সম্বন্ধে কি জানে?

সে কেবল এটুকু জানে যে সুলতানার সাথে কথা বলে আমার মেজাজ খারাপ হয়েছে…

তুমি কি সুলতানাকে আরেকবার ডেকে আনতে পারবে?

হ্যাঁ। তাঁর কক্ষ কাছেই অবস্থিত এবং প্রাসাদের ভিতরে সে অবাধে চলাফেরা করতে পারে।

নিজের চেহারা দেখাবার খাতিরে আমাকে অবশ্যই কিছুক্ষণের জন্য তোমায় একলা রেখে যেতে হচ্ছে। মালদেওর কতিপয় সেনাপতির আমার এবং আমার আধিকারিকদের সাথে আহার করার কথা রয়েছে সেখানে শেরশাহের বিরুদ্ধে আসন্ন অভিযান নিয়ে আলোচনা হবে। সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে এমন কিছুই আমি এখন করবো না। কিন্তু এখন থেকে ঠিক দুই ঘন্টা পরে সুলতানাকে এখানে আসতে বলো এবং আমার পক্ষে যত শীঘ্রি সম্ভব আমি তোমার সাথে মিলিত হবো। এই মেয়েটাকে আমি নিজে একবার ভালো করে দেখতে চাই। সে ঝুঁকে এসে, হামিদার কোমল অধরে আলতো করে চুমু দেয়। ভয় পেয়ো না, সে ফিসফিস করে বলে, আমি বলছি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে…

তার পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব বটে কিন্তু হুমায়ুন যেমনটা আশা করেছিল তার চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে, তাঁকে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে হামিদার আবাসন কক্ষে পুনরায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। কয়েকশ পিতলের দিয়ায় জ্বলন্ত শলতে এবং দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত মশালের আলোয় হুমায়ুন যাকে আশ্রয়স্থল ভেবেছিল সেই স্থানের রুক্ষ পাথুরে দেয়ালের উপরিভাগ নমনীয় দেখায় কিন্তু সুলতানা যদি সত্যি কথা বলে থাকে- এটা কেবল বন্দিশালাই নয় হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য স্থান। ভোজসভায় অবস্থান করার সময় সারাক্ষণ- যদিও হাবেভাবে মালদেওর লোকদের প্রতি মনোযোগী আর বিনয়ী ছিল- সে নিজের ভেতরে বারবার কেবল একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলো তার কি করা উচিত এবং অবশেষে একটা সাহসী আর বেপরোয়া পরিকল্পনা ধীরে ধীরে তার মাথায় পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্ত হতে থাকে…

সুলতান। হামিদার আবাসন কক্ষে প্রবেশ করতেই একটা মেয়ে তার সামনে নতজানু হয়।

উঠে দাঁড়াও। মেয়েটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, হাত ভাজ করে অপেক্ষা করার মাঝে হুমায়ুন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সুলতানার বয়স প্রায় ত্রিশ বছর হবে কিন্তু তাঁর মুখ ফ্যাকাশে, চোখের নিম্নাংশ প্রশস্ত, যা আফ্রিদি লোকদের বৈশিষ্ট্য এখনও রীতিমতো সুন্দরী এবং মাথার কালো চুলে এখনও রূপালি ক্ষত সৃষ্টি হয়নি। মেয়েটা স্বচ্ছ, লালচে-বাদামি রঙের চোখে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে হুমায়ুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন ভাবছে সম্রাটের আবেক্ষণ উতরানোর মতো যোগ্যতা কি তার রয়েছে।

সম্রাজ্ঞী তোমার কথা আমাকে বলেছে। সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমরা তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবো…

সুলতান, আমি সত্যি কথাই বলেছি। আমি শপথ করে বলছি।

রাজা তার গোপন পরিকল্পনার কথা হঠাৎ তোমায় কেন বলতে গেলেন?

তিনি হারেমে- নিজের সম্বন্ধে মাত্রাতিরিক্ত আত্মগর্ব আর আত্মতুষ্টির আকাঙ্খয়- এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করে থাকেন। সুলতান,এমনকি মরুভূমির উপর দিয়ে আপনার এদিকে আসবার সময়, সে যখন জানতে পারে যে আপনার সাথে খুব সামান্য পরিমাণ রসদ রয়েছে, সে বলেছিল আপনাকে আক্রমণ করতে তাঁর ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু মিষ্টি কথা আর প্রতিশ্রুতির ছলনায় আপনাকে প্রলুব্ধ করাটা তাকে বেশী প্রীত করেছে। লোকটা একজন ওস্তাদ কৈতব আর ষড়যন্ত্রের জটিল পরিকল্পনা করতে পছন্দ করে…আপনাকে সে পুরোপুরি নিজের আয়ত্তের ভেতরে এই বিষয়ে সে একেবারে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। সুলতানার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠে, সুলতান, লোকটা একটা সাক্ষাৎ পিশাচ…

সুলতানার চোখে ফুটে উঠা আতঙ্ক আর মানসিক সংক্ষোভ হুমায়ুন যা সহজেই পড়তে পারে, তাকে বলে দেয় যে মেয়েটা আর যাই হোক মিথ্যা কথা বলছে না।

আমাদের রক্ষা করতে আল্লাহ্তালাই তোমায় এখানে পাঠিয়েছেন, সুলতানা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লে সে বলে।

সুলতান, আমি আশা করি যেন সেটাই হয়। আপনাকে সাহায্য করতে আমার পক্ষে যা সম্ভব সবকিছু আমি করবো।

বেশ, আমার পরিকল্পনার কথা আমাকে তোমায় বলতে দাও… মালদেবের আতিথ্য গ্রহণ করার পরে আমি বাজপাখি নিয়ে বেশ কয়েকবার শিকার করতে গিয়েছি। আমি যদি আবারও শিকারে যেতে চাই তাহলে এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছুই হতে পারে না? আগামীকাল, ভোরের প্রথম আলো ফুটতে শুরু করার সাথে সাথে, আমি এবং আমার সব অমাত্য আর সেনাপতি যারা এখানে এই প্রাসাদে অবস্থান করছে, সবাই এমনভাবে সজ্জিত হবে যেন আমরা সারাদিনের জন্য শিকারে যাচ্ছি। আমাদের মেয়েদের জন্য আমি পালকি প্রস্তুত রাখার আদেশ দেব, বলবো যে আমি চাই সারা দিনব্যাপী আমোদ-প্রমোদ তারাও উপভোগ করুক। আমার সাথে তারা আগেও শিকারে গিয়েছে, তাই তাদের এবারের যাত্রার ভেতরে কেউ বিচিত্র কিছু খুঁজে পাবে না। দূর্গ থেকে আমরা নীচের সমতলে নেমে যাওয়া মাত্র আমরা পূর্বদিকে মরুভূমি অভিমুখে রওয়ানা দেব।

অবশ্য সেই সাথে আমার বাহিনীকেও আমি সরিয়ে দিতে চাই। আমার ব্যক্তিগত পরিচারক জওহরকে আজ রাতেই আমি জাহিদ বেগের কাছে পাঠাব, সে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শহরের বাইরে আমাদের অস্থায়ী সেনাছাউনির নেতৃত্বে রয়েছে। জওহর প্রায়শই আমার কাছ থেকে জাহিদ বেগের কাছে বার্তা নিয়ে যায়, তাই এবারও কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার কথা না। সে জাহিদ বেগকে গিয়ে তখনই লোকদের কিছু বলতে নিষেধ করবে কিন্তু আগামী কাল খুব সকালে সে যেন তাদের নিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করে, পুরো ব্যাপারটা যেন এমনভাবে সাজান হয় যে দেখে মনে হয় তারা সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছে। অস্থায়ী ছাউনি স্থাপনের বেশীর ভাগ সরঞ্জাম তাদের ফেলে আসতে হবে। সেই সাথে আমাদের কামানগুলোও- কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথ নেই। মারওয়ারের দৃষ্টি সীমার বাইরে একবার পৌঁছে গেলে, তাদের বৃত্তাকারে ঘুরে এসে আমাদের বাকি লোকদের সাথে যোগ দিতে হবে। হুমায়ুন চুপ করে থেকে কিছু ভাবে। সুলতানা, তোমার কি মনে হয়? মালদেবের অনুপস্থিতিতে প্রহরীরা কি আমাকে আমার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে দূর্গ ত্যাগ করার অনুমতি দেবে?

আপনি শিকারে যাবেন পুরো ব্যাপারটা যদি এমন দেখায়, তাহলে আপনাকে বাধা দেবার কোনো কারণ তাদের নেই। আমি যত দূর জানি, মালদেব দূর্গের অভ্যন্তরে আপনাকে আটকে রাখার কোনো আদেশ দেয়নি- আপনার সন্দেহ হতে পারে এমন কিছুই করার কোনো অভিপ্রায় তার নেই।

কিন্তু সুলতানা তুমি? হামিদা মেয়েটার বাহু স্পর্শ করে। আমাদের সাথে তোমারও আসা উচিত…এখানে থেকে যাওয়াটা তোমার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তুমি কি করেছে মালদেব এটা ঠিকই অনুমান করবে…

হুমায়ুনকে বিস্মিত করে দিয়ে সুলতানা অসম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে।

কিন্তু নিজের লোকদের সাথে তোমার পুনরায় মিলিত হবার এটা একটা সুযোগ…

মালদেবের হাতে এখানে আমার সাথে যা কিছু হয়েছে তারপরে আমার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না…আমার জীবনের ঐ অংশটার সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু আমি যখন দেখবো তার লোভ, উচ্চাকাঙ্খ বাধা প্রাপ্ত হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে সেটাই হবে আমার পুরষ্কার, পরম প্রাপ্তি… একটা দুখী কিন্তু একই সাথে সাফল্যে উদ্ভাসিত হাসিতে ক্ষনিকের জন্য তার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠে। আর আমার মনে হয় না আমাকে সে সন্দেহ করবে… আমি যা করেছি সেটা করার মতো বুদ্ধি বা সাহস কোনোটা আমার আছে বলে সে মনেই করে না…

আমার রক্ত-সম্পর্কিত বোন, তোমায় আমি কখনও ভুলতে পারবো না। আর আগ্রায় আমি যখন সম্রাজ্ঞী হব, তোমায় সেখানে নিয়ে যাবার জন্য আমি লোক পাঠাব… এবং তখন যদি তোমার যাবার ইচ্ছা হয় তাহলে তোমার সাথে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আচরণ করা হবে। হামিদা সুলতানার গালে আলতো করে একটা চুমু দেয়। আল্লাহ তোমার সহায় হন।

*

আকাশের পূর্বদিকে মাত্র ভোরের লালচে আভা ফুটতে আরম্ভ করেছে, তখনই পুরোদস্তুর শিকারের পোষাকে সজ্জিত হুমায়ুনকে সমকেন্দ্রিক দেয়ালের ভিতর দিয়ে সঙ্গীসাথী পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাদের পরনেও শিকারের পোষাক, প্রধান তোরণগৃহের দিকে ধীরে ধীরে ঘোড়া চেপে এগিয়ে যেতে দেখা যায়, দূর্গ থেকে সেটাই একমাত্র বের হবার রাস্তা। মালদেবের দেয়া একটা চমৎকার কালো রঙের বাজপাখি তাঁর কব্জিতে বসে রয়েছে, হলুদ চামড়ার তৈরী পাথরখচিত গোছা বাঁধা টোপরের নীচে পাখিটার উজ্জ্বল চোখ ঢাকা রয়েছে। তার পেছনে, হামিদা, খানজাদা, গুলবদন আর অন্যান্য মেয়েদের বহনকারী পালকিগুলো কাশিম আর তার অন্যান্য অমাত্য এবং সেনাপতিরা ঘিরে রেখেছে। গতরাতে হামিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে সোজা তার ফুপিজান এবং গুলবদনের সাথে দেখা করে এই বিপদ সম্পর্কে এবং তাদের এখন কি করা উচিত সে সম্পর্কে অবহিত করে। মোগল রাজকুমারীর সহজাত প্রবৃত্তির অধিকারী হবার কারণে, তারা সাথে সাথে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে এবং কোনো প্রশ্ন না করে আর সংযত হয়ে তাঁর কথামতো কাজ করে।

হুমায়ুন তার দলবল নিয়ে তোরণগৃহের নিকটবর্তী হবার সাথে সাথে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সমান দ্রুততায় তার শরীরে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। ভোরের কোমল আলোয় দূর থেকেই সে দেখতে পায় যে ধাতব বেষ্টনী তখনও নামান রয়েছে। তার চোখ সম্ভাব্য অতর্কিত আক্রমণের হুমকি চিহ্নিত করতে দ্রুত ডানে বায়ে তাকাতে থাকে। সুলতানার প্রতিটা কথা সে যদিও বিশ্বাস করেছে কিন্তু এই স্থানে সে আগেও প্রতারিত হয়েছে। সুলতানা নিজেও সম্ভবত হারেমের ভিতরে কোনো শত্রুর দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে পারে, মোগল সম্রাজ্ঞীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার যাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। কিন্তু সবকিছু যেমনটা আশা করা হয়েছিল দেখে তেমনই মনে হয়। তোরণগুহের কোনো আড়াল থেকে তবকির গাঁদা বন্দুক গর্জে উঠে না বা মৃত্যু মুখে নিয়ে তীরের ফলা বাতাসে শিহরন তোলে না। সচরাচর যেমন থাকে তেমনই প্রহরী মোতায়েন রয়েছে। আপাত অমনোযোগী ভঙ্গিতে হুমায়ুন জওহরকে ইশারা করতে সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে, ধাতব বেষ্টনী তুলে দাও। মহামান্য সম্রাট বাজপাখি নিয়ে শিকারে যেতে আগ্রহী। কমলা রঙের জোব্বা আর পাগড়ি পরিহিত এক দীর্ঘদেহী যোদ্ধা, সম্ভবত প্রহরীদের দলনেতা ইতস্তত করে। হুমায়ুন টের পায় তার শিরদাঁড়া দিয়ে টপটপ করে ঘাম গড়িয়ে নামছে এবং আড়চোখে বামপাশে ঝুলন্ত আলমগীরের দিকে তাকায়। তার পিঠে আড়াআড়িভাবে ঝুলছে তীর ভর্তি তূণীর। কিন্তু শক্তি প্রদর্শনের কোনো দরকার হয় না। দুই কি এক সেকেণ্ড পরেই রাজপুত দলনেতা চিৎকার করে আদেশ দেয়, বেষ্টনী উত্তোলন কর।

তোরণের উপরে অবস্থানরত লোকেরা কপিকলের চাকা ঘোরাতে শুরু করে মোটা কালো শিকল গুটিয়ে নিতে, যেটার সাথে ধাতব বেষ্টনী ঝুলে আছে। যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতিতে বা হুমায়ুনের তেমনই মনে হয়- কাঁচকাঁচ, ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ভারী ধাতব বেষ্টনী শূন্যে উঠে যায়। কপিকলের চাকা প্রতিবার ঘোরার সাথে সাথে হুমায়ুনের আশাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে যদিও সে অনেক কষ্টে চোখে মুখে সামান্য বিরক্তিমিশ্রিত অমনোযোগী একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে রাখে।

ধাতব বেষ্টনী পুরোপুরি উত্তোলিত হবার পরেও হুমায়ুন কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো প্রদর্শন করে না বরং সে তার বাজপাখির টোপর ঠিক করতে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপরে, তার হাতের এক ঝটিকা ইঙ্গিতে, সে তার গুটিকয়েক সফরসঙ্গীদের নিয়ে দুলকি চালে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ধীর গতিতে, শিলাস্তরের ধার দিয়ে খাড়া ভাবে নেমে যাওয়া ঢালু রাস্তা দিয়ে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এই ঢালু পথ দিয়েই তারা বিপরীত দিকে আশায় বুক বেধে উঠে গিয়েছিল, তারা নীচের দিকে নামতে থাকে, যাতে এখনও কেউ সন্দিগ্ধ না হয়, এবং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত খিলানাকৃতি আনুষ্ঠানিক তোরণের নীচে দিয়ে বের হয়ে তখনও ঘুমিয়ে থাকা শহরের নিরব জনমানবহীন সড়ক দিয়ে এগিয়ে যায়। ছোট দলটা অচিরেই পূর্বদিকে যাত্রা করে, তাদের সামনের এলাকা উদীয়মান সূর্যের সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত, এবং বালুকাবৃত এই পতিত প্রান্তর যা যদিও মানব অস্তিত্বে পক্ষে বিরূপ এখন তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ।

২.৮ মরুভূমির পিশাচনৃত্য

১৩. মরুভূমির পিশাচনৃত্য

হুমায়ুন হাতের ইশারায় ক্ষুদ্র রেকীকারী দলটাকে থামতে ইঙ্গিত করে, যার সাথে সে তাঁর মূল সৈন্যসারি ত্যাগ করে অনেকটাই সামনে এগিয়ে এসেছে। সে তাঁর ঘোড়ার পর্যানের একপাশে চামড়ার মশকে রক্ষিত মহামূল্যবান পানি থেকে এক ঢোক গলাধঃকরণ করে তারপরে ঘামের তেলতেলে দাগে ছোপ ছোপ হয়ে থাকা ঘোড়ার গলায় আলতো করে চাপড় দেয়। তার চারপাশে যে দিকে দৃষ্টি যায় দাবদাহে চোখ ধাধিয়ে দেয়া মরুভূমি, নিরব, সীমাহীন এবং সর্বগ্রাসী।

ওদিকে দেখেন! গুপ্তদূতদের একজন চেঁচিয়ে উঠে- সদ্য কৈশোর অতিক্রম করেছে- রৌদ্রের চোখ ঝলসানো আলোর হাত থেকে বাঁচতে চোখের দুপাশে হাত দিয়ে আড়াল তৈরী করেছে। বামদিকে!

হুমায়ুন চোখ কুচকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং দাবদাহের আড়াল থেকে প্রথমে একটা পরে আরো দুটো খেজুর গাছের অস্পষ্ট আকৃতি ভেসে উঠতে সে শ্বাস নিতে ভুলে যায় এবং তারপরে আরেকটু দূরে পানির উপরে সূর্যের আলো পড়ে বোধহয় মুহূর্তের জন্য ঝলকে উঠে। আমি খেজুর গাছ দেখতে পাচ্ছি এবং সম্ভবত একটা নদী। আহমেদ খান, তোমার কি মনে হয়?

হ্যাঁ। ঐ গাছগুলোর আড়ালে সম্ভবত বালতোরা বসতি ঢাকা পড়ে রয়েছে যার কথা আমরা আগেই শুনেছি। সূর্যের আলোয় যে পানিতে পড়ে ঝলসে উঠেছে সেটা সম্ভবত কচ্ছের মরুভূমি দিকে বয়ে চলা লুনী নদী।

বালতোরা বসতি সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি?

খুবই সামান্য। কিন্তু বসতিটা দেখে মনে হচ্ছে সেটা এখনও পনের মাইল বা সেরকমই দূরে রয়েছে। সুলতান, আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে আমি আমাদের সাথের কয়েকজন গুপ্তদূতকে সামনে পাঠিয়ে আমরা আমাদের মূল দলের জন্য অপেক্ষা এবং রাতের মতো এখানে অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করতে পারি।

তাই কর, এবং সামনের বসতিতে মালদেওর লোকেরা ওত পেতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে না এই বিষয়ে গুপ্তদূতরা যেন ভালো করে নিশ্চিত হতে।

ভাগ্য এখন পর্যন্ত হুমায়ুনের পক্ষে রয়েছে। কাঁধের উপর দিয়ে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে বহুবার পেছনে তাকান সত্ত্বেও, গত কয়েক সপ্তাহে মারওয়ার থেকে আগত অনুসরণকারীদের এখন পর্যন্ত কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। তাঁর মূল বাহিনীর সাথে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে মিলিত হবার পরে, কয়েক দিনের জন্য হুমায়ুন উত্তরের দিকে তার বাহিনীর মুখ ঘুরিয়ে নেয় মালদেওকে বিভ্রান্ত করার একটা পরিকল্পিত অভিপ্রায়ে। পরবর্তী চারদিনের দুঃসহ যাত্রায় প্রত্যেকের স্নায়ু সতর্কতার চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করে থাকে, সৈন্যসারির চারদিকে প্রতিবন্ধকতা মোতায়েন করা হয়, গুপ্তদূতদের গতিবিধির সীমানা দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত ব্যাপত করা হয় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের গমন পথে বাতিল উপকরণ- এমনকি মালবাহী শকটও পরিত্যাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায় সেখানে আগত মালদেওর গুপ্তদূতদের মনে প্রত্যয় জন্মাতে যে তারা সত্যিই উত্তর দিকে যাচ্ছে, হুমায়ুন এরপরই পূর্বদিকে বৃত্তাকারে ঘুরে যায়। তারপরে সে দক্ষিণ অভিমুখে দিক পরিবর্তন করে, প্রথমদিকে তাঁদের পথচলার চিহ্ন গোপন করতে পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা শুকনো ঝোপঝাড় দিয়ে বালুতে ঝাড় দিতে দিতে অনুসরণ করে।

পুরো যাত্রায় হুমায়ুনের কেবল একবারই মনে হয়েছিল দিগন্তের কাছে সে অশ্বারোহীদের দেখতে পেয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে সেগুলো মরুভূমির এখানে সেখানে দেখতে পাওয়া ঝাকড়া ঝোপঝাড়ে জন্মানো ছোট ছোট টক খাবার লোভে দূরের গ্রাম থেকে আগত ছাগলের একটা পালের চেয়ে বেশী হুমকিদায়ক না। শেরশাহের প্রতিনিধিদের সাথে গোপন বৈঠক শেষে ফিরে এসে অতিথি কাউকে খুঁজে না পেয়ে মালদেওর ক্ষুব্ধ চেহারাটা সে মনে মনে আঁকতে চেষ্টা করে কিন্তু শীঘ্রই নিজের পরিবার আর তার লোকদের জন্য কিভাবে একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে বের করা যায় তার ভাবনার স্রোত সেদিকে ধাবিত হয়। মরুভূমির ভিতরে উদ্দেশ্যহীনভাবে তারা অনন্তকাল ঘুরে বেড়াতে পারে না। রাজপুত তীর আর গাঁদা বন্দুকের গুলির মতো মরুভূমির শ্বাসরুদ্ধকর দাবদাহ এবং তাজা খাবার আর পরিষ্কার পানির স্বল্পতা অনায়াসে তাদের শেষ করে দিতে পারে।

আর সবসময়ে হামিদার জন্য উদ্বেগ তাঁকে বিদ্ধ করে। রাতের বেলা নিষ্ঠুম জেগে থাকার কারণে বিছানায় শুয়ে হামিদার এপাশ ওপাশ আর ছটফট করতে থাকার শব্দ সে শুনতে পায়, সম্ভবত মালদের হাতে ধরা পড়ে নিজের আর তার ভাবী সন্তানের খুন হবার দৃশ্যকল্প তাঁকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করছে। কিন্তু হামিদা কোনো অভিযোগ করে না এবং হুমায়ুন জানতে চাইলে এটা ওটা বলে পাশ কাটিয়ে যায় যে সামান্য বদহজম হয়েছে- গর্ভবতী অবস্থায় সব মেয়েরই নাকি এই সমস্যা হয় হামিদা শুনেছে। গত রাতে হামিদা তাকে বলে, আমরা আমাদের সন্তানের কাছে গল্প করবো যে পরিস্থিতি তখন কেমন ছিল- কিভাবে নরকতুল্য স্থানে আমরা তাঁকে আগলে রেখেছিলাম- আমরা সবাই কিভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলাম সেই গল্প থেকে সে মনোবল সংগ্রহ করবে, নাকি করবে না? হুমায়ুন হামিদাকে কাছে টেনে নেয় এবং মেয়েটার সাহস আর অভিযোগহীন মনোভাবে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে।

সুলতান, আহমদ খান, পরের দিন সকালে হুমায়ুন যখন তাঁর তাবুর বাইরে পানিপূর্ণ ছোট একটা পাত্র আর খামিরবিহীন একটুকরো রুটি, সূর্যের আলোয় শুকিয়ে কটকটে হয়ে যাওয়া খুবানি যা চিবোতে গিয়ে হুমায়ুনের মনে হয় তার দাঁত বুঝি ভেঙে যাবে- সহযোগে প্রাতরাশ করছে, তখন এসে হাজির হয়। আমার গুপ্তদূতেরা মাত্র ফিরে এসেছে। জায়গাটা বালোত্রাই, এখান থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে।

মালদেও বা তার লোকদের কোনো চিহ্ন তাঁর দেখতে পায়নি।

না।

সেখানে কতজন অধিবাসী রয়েছে?

সম্ভবত দুইশোজন, সবাই পশুপালক আর কৃষিজীবি।

আহমেদ খান তুমি তোমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। আমাদের পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে চলো। হুমায়ুন যত অতৃপ্তি নিয়ে খেতে শুরু করেছিল তার চেয়ে অনেকবেশী তৃপ্তি নিয়ে নিজের অপ্রতুল আহার শেষ করে। দূর থেকে বালোত্রাকে দেখে যেমন মনে হয়েছে, জায়গাটা যদি সত্যিই তেমন হয় তাহলে সে তার পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করার সাথে সাথে, সেখানে সে তার দলবল নিয়ে আশ্রয় নিতে পারবে।

সেইদিন মধ্যাহ্নের সামান্য পূর্বে হুমায়ুন তাঁর সাথের লোকজন নিয়ে বসতিটার দিকে এগিয়ে যাবার সময় সে দেখে যে নদীর সমতল তীরে গড়ে উঠা বসতিটা আসলে যত্রতত্র কয়েক ডজন মাটির বাড়ির সমষ্টি ছাড়া আর কিছু না, নদীর লালচে-খয়েরী রঙের পানি গ্রীষ্মকালে যেমনটা হবার কথা তেমনিই নদীগর্ভেও অনেক নীচু দিয়ে মন্থর গতিতে বয়ে চলেছে। কিন্তু শস্য উৎপাদনের জন্য গ্রামবাসীদের চাহিদার চেয়ে বেশী পানিই রয়েছে নদীতে, আর নদীর তীর বরাবর আবাদী জমির চাষ করা মাটি ভেদ করে শস্যের সবুজ শীষ বেশ দেখা যাচ্ছে।

জওহর। গ্রামের মাতব্বরকে গিয়ে খুঁজে বের কর। তাঁকে গিয়ে বলবে আমরা নিতান্তই পর্যটক এবং আমাদের দ্বারা তার বসতির লোকদের কোনো ক্ষতি হবে না এবং আমরা নদীর তীরে তাদের আবাদি জমি যেখানে শেষ হয়েছে তারও পরে আমাদের অস্থায়ী ছাউনি স্থাপণ করতে চাই। তাঁকে আরও বলবে যে আমাদের রসদ আর জ্বালানি এবং সেই সাথে একটা মাটির বাড়ি প্রয়োজন যেখানে আমাদের মেয়েরা বিশ্রাম নিতে পারবে, আর সামান্য আড়াল খুঁজে পাবে- আর এসবের জন্য আমরা উপযুক্ত মূল্য দিব।

*

মাটির তৈরী একটা একতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে, হুমায়ুন একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেপ্টেম্বর মাস চলছে এবং গ্রীষ্মের দাবদাহের তীব্রতাও তাই এখন অনেকটাই সহনীয়। বিরল জনবসতি অধ্যুষিত অঞ্চলের একপ্রান্তে অবস্থিত হবার কারণে যাত্রাবিরতির জন্য বালত্রোরা নিঃসন্দেহে একটা উপযুক্ত স্থান নিরাপদ। বালক্রোরা গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রায় অন্ধ মোড়ল সিম্ভুর ভাষ্যমতে, লুনী নদীর দুপাশে বালত্রোরাসহ হাতে গোনা যে কয়টি বসতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে স্থানীয় জমিদার কিংবা যুদ্ধবাজ গোত্রপতিরা খুব বেশী আগ্রহী না হবার কারণে তারা শান্তিতেই বসবাস করছে। গ্রামবাসীদের একঘেয়ে জীবন ঋতু পরিবর্তনের চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সিম্ভুকে হুমায়ুন সঙ্গত কারণেই নিজের আসল পরিচয় দেয়নি এবং মোড়লও ঘোলাটে চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছু জানতে চায় না। বস্তুতপক্ষে, সে তাঁকে প্রায় কোনো প্রশ্নই করে না এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় হুমায়ুনের গল্পটা সে বিশ্বাস করেছে, যে সে একজন সেনাপতি যে নিজের এলাকা থেকে পথভুল করে বহুদূরে এসে পড়েছে যার সৈন্যদলের বিশ্রাম আর রসদ প্রয়োজন। হুমায়ুন অবশ্য এতকিছুর পরেও সিদ্ভুর অস্বস্তি ঠিকই আঁচ করতে পারে, যে সে আর তাঁর সৈন্যবাহিনী হয়ত তার লোকদের জন্য বড় ধরনের কোনো বিপদ বয়ে আনবে যতই। সে প্রতিশ্রুতি দিক এবং সে টাকা খরচ করুক। তারা যখন এখান থেকে বিদায় নেবে, বৃদ্ধ লোকটা তখন সত্যিই ভারমুক্ত হবে।

হুমায়ুন নিজেও অবশ্য এখান থেকে বিদায় নেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে যতই দুর্গম আর প্রত্যন্তস্থান হোক, বেশীদিন একস্থানে অবস্থান করাটা বড্ডবেশী বিপজ্জনক- কিন্তু মুশকিল হল সে কোথায় যাবে? কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা সামলে নেবার ক্ষমতা এখন তার নেই। তাঁর সমস্থ অনুভূতি চাইছে- এখন যখন তাঁর মনে হচ্ছে যে অনুসরণরত মালদেবের লোকদের সে খসিয়ে ফেলতে পেরেছে উত্তরে খাইবার গিরিপথের দিকে অগ্রসর হতে এবং সেখানের পাহাড়ী গোত্রগুলো। যারা তাঁর কাছে আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ, তাদের একত্রিত করে কাবুল অভিমুখে রওয়ানা দেয়া এবং আসকারি আর কামরান সেখানে নিজেদের আধিপত্য জোরদার করার আগেই শহরটা তাঁদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার প্রয়াস নেয়া। কাবুলে নিজের কর্তৃত্ব যতক্ষণ সে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না করছে এবং পেছন থেকে ধেয়ে আসা হুমকি অপসারিত করছে, ততক্ষণ শেরশাহকে মোকাবেলা করা নিয়ে সে কিছু ভাবতেই পারছে না।

উত্তরদিকে অগ্রসর হলে অবশ্য তাকে পুনরায় মারওয়ারের কাছাকাছি যাবার ঝুঁকি নিতে হবে কিন্তু তাঁর সামনে অন্য যেসব বিকল্প পথ রয়েছে সেগুলোর কোনোটাই তাকে দ্রুত কাবুলে ফিরে যাবার সুবিধা দেবে না কিন্তু সমান ঝুঁকিপূর্ণ। সে যদি পূর্বদিকে অগ্রসর হয় তাহলে সে অচিরেই মেবার আর আম্বারের রাজপুত রাজত্বে প্রবেশ করবে যাদের শাসকদের, সে যতটুকু জানে, মালদেবের সাথে যোগ দেবার জোরাল সম্ভাবনা রয়েছে। একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য যদিও রাজপুতদের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে কিন্তু কোনো লোককে যদি তারা নিজেদের সাধারণ শত্রু হিসাবে বিবেচনা করে তবে তার বিরুদ্ধে তারা দ্রুতই নিজেদের একতাবদ্ধও করতে জানে বা শেরশাহের দেয়া উৎকোচের প্রতিশ্রুতির অঙ্কটা যদি বিশাল হয়।

হুমায়ুন দক্ষিণে অগ্রসর হলে সামনে গুজরাত পড়বে যা এখন শেরশাহের করতলগত সেইসাথে পশ্চিম অভিমুখী পথও ঝুঁকিশূন্য নয়। সিস্তুর ভাষ্য অনুযায়ী, লুনী নদীর অপর তীরে পশ্চিমদিকে সিন্ধ পর্যন্ত প্রায় তিনশ মাইল প্রসারিত আরেকটা মরুভূমি রয়েছে- চোরাবালি আর বিক্ষিপ্ত বাতাসের একটা প্রতারক প্রতিবেশ যেখানে অসতর্ক অভিযাত্রী নিমেষেই মৃত্যুর বরাভয়ে সিক্ত হতে পারে। মরুভূমির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রাচীন মরুদ্যান, অমরকো অভিমুখী পুরো কাফেলা মরুভূমির বুকে হারিয়ে গেছে এমনটাও শোনা যায়। বালত্রোরা অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অমরকে আসা যাওয়া করে এবং একটা নিরাপদ রাস্তাও তারা চেনে কিন্তু সিন্ধু তার অভিজ্ঞতঋদ্ধ বুড়ো মাথাটা গম্ভীরভাবে ঝাঁকিয়ে হুমায়ুনকে সতর্ক করে দেয়, যাত্রাটাকে হাল্কাভাবে নেয়াটা মোটেই ঠিক হবে না।

বৃহত্তর পৃথিবীর ঘটনাবলী সম্বন্ধে হুমায়ুনের অজ্ঞতা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে আরো কঠিন করে তুলে। শেরশাহ বা মালদেব কিংবা তাঁর সৎ-ভাইদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই। হিন্দালই বা এখন কোথায়? কামরান আর আসকারির সাথে? এবং বয়সে তারচেয়ে বড় সত্তাইয়েরা কি ইতিমধ্যে যতখানি ভূখণ্ড চুরি করে দখল করেছে তার পরিধি বাড়াতে আরও বিশাল কোনো অভিযানের পরিকল্পনা করছে। কামরানের উচ্চাভিলাসের মাত্রা সম্বন্ধে অবহিত থাকার কারণে তেমন কিছু একটা ঘটলে সে মোটেই অবাক হবে না। হুমায়ুন এক সময়ে না এক সময়ে তাঁর যে খোঁজ করবে, এটা নিশ্চয়ই তাঁর সৎ-ভাই জানে এবং নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে তাঁর পক্ষে যতটা উদ্যোগী হওয়া সম্ভব সে হবে। অভিজ্ঞতাঋদ্ধ বৃদ্ধ কাশিম কিংবা তার ফুপিজান খানজাদা নিজের জীবনের সব অভিজ্ঞতা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেও তাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারে না, এমনকি তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী শারাফকেও কেমন যেন বিভ্রান্ত মনে হয়। রাতের আকাশে পরিষ্কার আর তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য নিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারকারাজি হুমায়ুনের জন্য কোনো আলোকিত প্রভার বার্তা বয়ে আনে না। সে ভালো করেই জানে যে সারা পৃথিবী যখন তাঁর আব্বাজানের উপর বিরূপ হয়ে উঠেছিল তখন তার আব্বাজান বাবর যা করেছিলেন, উত্তর খুঁজে বের করার জন্য তাকেও নিজের অন্তদৃষ্টির উপরে নির্ভর করতে হবে।

এক মহিলার গানের শব্দ হুমায়ুনকে তার ভাবনার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। নীচু আর সুরেলা এই কণ্ঠস্বরের অধিকারিণীকে হুমায়ুন ভালো করেই চেনে কণ্ঠস্বরটা হামিদার। তরমুজের মতো বৃত্তাকার উদরের অধিকারিনী মহিলাটা অনুযোগের অঙ্গিতে হুমায়ুনকে হয়ত বলবে যে অনাগত সন্তান বিশালদেহী হবে এবং হুমায়ুনের হাত নিজের উদরের উপর নিয়ে স্থাপণ করবে যাতে হুমায়ুনও প্রাণশক্তিতে টগবগ করতে থাকা আবহাওয়া অনুভব করতে চেষ্টা করে। ছেলেটা প্রাণশক্তিতে ভরপুর। নিজের স্ফীত উদরের উপর থেকে হাত সরিয়ে এনে সে বাংলা একাডেমীর সংকীর্ণ ঘিঞ্জি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন।

নদীর তীর দিয়ে হুমায়ুন যখন অস্থায়ী শিবিরে জাহিদ বেগকে খুঁজতে যায় গ্রাম থেকে একজন ঘোড়া দাবড়ে শিবিরের দিকে এগিয়ে আসে। হুমায়ুন চিনকে পারে দারয়া, আহমদ খানের ব্যক্তিগত দেখতে হলে তোমায় সদস্যপদ গ্রহণ করতে হবে। তার ধুসর ঘোড়াটার দেহ ঘামে জবজব করছে এবং তাঁর নিজের দেহের পোষাক সেই ঘামে ভিজে গাঢ় বর্ণ ধারণ করেছে। তাঁকে দেখে কাবুল পতনের সংবাদ সে যখন বয়ে এনেছিল, সেই সময়ের তুলনায় কমই উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়।

সুলতান! দারয়া পিছলে নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে। কি ব্যাপার?

এখান থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল অবস্থান করছে।

কতজনের?

কমপক্ষে তিনহাজার হবে, এবং চৌকষ একটা দল আর তাদের কারো কারো কাছে আবার গাদা বন্দুকও রয়েছে। দলটা কোনো মালপত্র বহন করছে না আর ক্ষিপ্রতার সাথে ভ্রমণ করছে, আমরা তাঁদের সাথে কোনো মালবাহী শকট দেখতে পাইনি।

দলটা কোনদিক থেকে এগিয়ে আসছে?

উত্তরপশ্চিম দিক থেকে।

তার মানে দলটা মারওয়ার থেকে আগত সৈন্যবাহিনীও হতে পারে… পুরষ্কারের প্রাপ্তি যেখানে বিশাল সেখানে মালদেব এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেবে, সে কেন আগেই এমন একটা ধারণা নিজের মনে পোষণ করছিল? আহমেদ খানকে ডেকে আন?

লোকগুলো কারা এবং তাঁদের সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল জানার জন্য তিনি এখনও চেষ্টা করছেন। আপনাকে সর্তক করার জন্যই আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন এবং সেই সাথে এটাও বলেছেন তিনি আমার পেছনেই থাকবেন।

দশ মিনিট পরে, সেনাপতিদের সাথে হুমায়ুনকে কথা বলতে দেখা যায়। দারয়ার নিয়ে আসা সংবাদ তার মনের অনিশ্চয়তা দূর করেছে। নিজের কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে তার এখন স্পষ্ট ধারণা রয়েছে।

পনের মাইল দূরে আমাদের গুপ্তদূতেরা রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা চৌকষ দলকে সনাক্ত করেছে। আমি জানি না, ভাগ্য তাদের আমাদের এতো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে নাকি আমাদের অবস্থান সম্পর্কে তারা আদতেই নিশ্চিতভাবে অবগত রয়েছে। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে এখানে আমাদের পক্ষে লড়াই করা অসম্ভব। দূরের মাটির তৈরী বাড়ির বাইরে হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালিতে পিতলের চকচক করতে থাকা বালায় সজ্জিত সুতির শাড়ি পরিহিত রমণীর দল আসনপিড়ি হয়ে বসে গরুর শুকনো গোবরে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করছে, যাতে তারা রাতের খাবার রান্না করা শুরু করতে পারে তাদের দিকে সে ইঙ্গিত করে।

কিন্তু সুলতান আমরা তাহলে কোথায় যাব? জাহিদ বেগ জানতে চায়।

লুনীর অপর তীরে। এখান থেকে মাইলখানেক উজানে নদী বেশ অগম্ভীর হওয়ায় গভীরতা কয়েক ফিটের বেশী হবে না- অতিক্রম করা সহজ হবে। আমি গতকাল সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা তারপরে মরুভূমির উপর দিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে যাত্রা করবো। গ্রামের মুখিয়া অমরকে বলে একটা প্রত্যন্ত এলাকার কথা বলেছে যেখানে আমরা নিরাপদে থাকতে পারবো।

হুমায়ুন দেখে তার সেনাপতিরা পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। মরুভূমির বিপদের কথা তারাও জানে। আমি জানি, মরুভূমির একটা অশুভ খ্যাতি রয়েছে। আর সেজন্যই আমরা সেদিকে গিয়েছে জানতে পারার পরেও আমাদের শত্রুরা আমাদের অনুসরণ করতে ইতস্ততবোধ করবে। কিন্তু ভয় পেয়ো না- মরুভূমির মাঝে আমাদের পথ দেখাবার জন্য আমরা এখান থেকে একজন পথপ্রদর্শক সাথে নেব… সে নিশ্চিত করবে যে…

দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার খুরের শব্দে কথার খেই হারিয়ে ফেলে হুমায়ুন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে চরতে থাকা মুরগীর পালে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং ধূলোর মেঘ উড়িয়ে আহমেদ খানের বাহন তাঁদের অস্থায়ী ছাউনিতে প্রবেশ করছে।

সুলতান, আমরা যাদের দেখেছি তারা জয়সলমিরের রাজার অনুগত বাহিনী। মালদেবের সাথে সে নিজেকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আমি এক রাখালের কাছ থেকে খবরটা জানতে পেরেছি, যে তাদের কাছে কয়েকটা ভেড়া বিক্রি করেছে। তারা গর্বোদ্ধত ভঙ্গিতে তাকে বলেছে যে তারা একজন সম্রাটকে শিকার করতে এসেছে, যার পালাবার চিহ্ন বেশ তাজা এবং তাঁরা শীঘ্রই চূড়ান্ত আঘাত হানতে চলেছে। কিন্তু আমার মনে হয় তাদের দক্ষতার চেয়ে তাদের মুখটা একটু বেশীই চলে। আমার মনে হয় না আমরা ঠিক কোথায় অবস্থান করছি, সেটা মূর্খগুলো এখনও আবিষ্কার করতে পেরেছে…আমি তাঁদের দক্ষিণদিকে এগিয়ে যেতে দেখে এসেছি…।

সে যাই হোক, আমাদের হাতে খুব একটা বেশী সময় নেই। আহমেদ খান আমাদের অবশ্যই দ্রুত তাবু গুটিয়ে নিয়ে নদী অতিক্রম করে, সোজা পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা শুরু করতে হবে। গ্রামের মোড়লকে ডেকে আন এবং তাঁকে বল যে মরুভূমির ভিতর দিয়ে অমরকো পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের একজন পথপ্রদর্শক প্রয়োজন। তাঁকে আরও বলবে যে আমি তাঁকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবো- তাঁকে স্বর্ণমুদ্রায় পারিশ্রমিক দেয়া হবে।

গ্রামবাসীদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে তার লোকেরা যখন দৌড়ে গিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয় এবং তাবু গুটিয়ে নিয়ে নিজেদের অস্ত্র সংগ্রহ করে পর্যানে তুলতে শুরু করে, হুমায়ুন তখন হামিদার কাছে ফিরে আসে। হামিদা তাঁর চরকা সরিয়ে রেখেছে। গুলবদন এখন তার সাথে রয়েছে এবং তারা দুজনে কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে, কিন্তু হুমায়ুনের চোখেমুখের অভিব্যক্তি দেখে তারা উভয়েই হাসি থামিয়ে নিরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আহমেদ খান খবর নিয়ে এসেছে রাজপুত সৈন্যরা এখান থেকে খুব কাছেই অবস্থান করছে।

গুলবদন আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস নেয় এবং হামিদা সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের অজান্তে নিজের স্ফীত উদর স্পর্শ করে। হুমায়ুন দুহাতে তার মুখটা তুলে ধরে তার ত্বকের উষ্ণ কোমনীয়তা অনুভব করে। মাথা নীচু করে সে তার ঠোঁটে আলতো করে চুমু দেয়। সাহস রাখো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। তুমি যা পারো গুছিয়ে নাও। আমরা ঘন্টাখানেকের ভিতরে রওয়ানা দেব। গুলবদন- খানজাদাকে খুঁজে বের কর এবং তাঁকে এই নতুন উপদ্রব সম্পর্কে অবহিত কর।

*

ওটা কি? দূরে দিগন্তের কাছে ঘূর্ণায়মান এবং আন্দোলিত হতে থাকা মেঘের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে। নিশ্চিতভাবেই কিছুক্ষণ আগে ওটার কোনো অস্তি ত্বই ছিল না। আকাশের পটভূমিও পাল্টে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও যা ছিল উজ্জ্বল সবুজাভ-নীল সেটাই এখন ইস্পাতের ধুসরতা নিয়ে নীচে নেমে এসেছে। হুমায়ুনের ঘোড়াটা প্রলম্বিত হ্রেষাধ্বনি করে এবং অস্বস্তির সাথে মাথা ঝাঁকাতে থাকে। অনিল সিম্ভুর আঠার বছর বয়সী নাতি যে তাঁদের পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করছে এবং হুমায়ুনের ঘোড়ার পাশে পাশেই হাঁটছিলো- সেও পর্যন্ত তরঙ্গের ন্যায় ফুঁসতে থাকা অবয়বটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যা তাদের চোখের সামনেই যেন ক্রমশ বিশাল আকৃতি ধারণ করছে।

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মাত্র একবার আমি এটা দেখেছি। মরুভূমির পর্যটকেরা একে বালিয়াড়ির পিশাচ বলে… ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার…মারাত্মক একটা বালুঝড় যার কেন্দ্রে রয়েছে একটার বেশী ঘূর্ণিঝড়। অনিল একহাত দিয়ে চোখ ডলে যেন এমন করলে তাদের দিকে মুখ ব্যাদান করে ধেয়ে আসা ভয়ঙ্কর দৃশ্যপটটা যেন উবে যাবে। কিন্তু হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে তামাটে বর্ণের চরাচরগ্রাসী মেঘটা সূর্যকে ঢেকে দিয়ে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে। সহসা সে এর কেন্দ্রস্থলে ঘূর্ণিঝড়ের একটাকে দেখতে পায়। ঝড়টাকে দেখে মনে হয় সেটা যেন পৃথিবীর নাড়িভূড়ি শুষে নিয়ে উপরের দিকে ছিটিয়ে দিচ্ছে।

তাড়াতাড়ি…আমাদের কি করতে হবে বল। হুমায়ুন ঝুঁকে এসে অনিলের শীর্ণ কাঁধ ধরে ঝাঁকি দেয়।

বালিতে আমাদের দ্রুত নিজেদের আর আমাদের সাথে প্রাণীগুলোর জন্য গর্ত খুঁড়তে হবে এবং ঝড়ের দিকে পিঠ দিয়ে সেখানে শুয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ না ঝড়টা আমাদের উপর দিয়ে অতিক্রম করে।

আমাদের হাতে কতক্ষণ সময় আছে?

কিশোর ছেলেটা আবার আগুয়ান বিপর্যয়ের দিকে তাকায়। কয়েক মিনিটের বেশী মনে হয় না…

আমার লোকদের বল বালিতে নিজেদের জন্য গর্ত খুঁড়তে এবং বাড়তি নিরাপত্তার জন্য ঘোড়াগুলোকে তারা যেন নিজেদের পেছনে টেনে বসায়, হুমায়ুন জওহর আর জাহিদ বেগকে চিৎকার করে বলে, অনিলের সাথে তাঁর কথোপকথন তাঁরা আগেই শুনতে পেয়েছে। নিজের ভীত সন্ত্রস্ত্র চঞ্চল ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে লাগাম ধরে সেটাকে টেনে নিয়ে যাবার সময় হুমায়ুন হামিদা, গুলবদন, খানজাদা এবং তাঁদের পরিচারিকাদের বহনকারী গরুর গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়।

নিজেদের এবং জেনানাদের আশ্রয়ের জন্য বালিতে গর্ত খুঁড়ো- তারাও তোমাদের গর্ত খুঁড়তে সাহায্য করবে, হুমায়ুন চিৎকার করে দেহরক্ষীদের বলে যারা মেয়েদের প্রহরায় নিয়োজিত ছিল। দ্রুত! নিজেদের ঘোড়াগুলোকে নিজেদের পাশেই শুইয়ে রাখবে কিন্তু ষাড়গুলোর দড়ি খুলে দাও- তাঁরা নিজেদের রক্ষার উপায় খুঁজে নেবে।

হুমায়ুনের কথা শেষ হবার আগেই সে দেখে বয়স হওয়া সত্ত্বেও খানজাদা নিজের গরুর গাড়ির ভেতর থেকে সবার আগে বের হয়ে এসেছে এবং ঝুঁকে পড়ে খালি হাতেই বালিতে গর্ত করতে আরম্ভ করেছে। গুলবদন তার পাশেই রয়েছে। ফুপিজান, ঝড় আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যাবার সময় আপনি আর গুলবদন ঝড়ের দিকে পিঠ করে অবশ্যই একসাথে মাটিতে শুয়ে থাকবেন এবং শক্ত করে পরস্পরকে আকড়ে রাখবেন, আমার কথা বোঝা গেছে?

খানজাদা গর্ত করা বন্ধ না করেই মাথা নাড়ে কিন্তু তার সৎ-বোনকে পাংশুটে দেখায় এবং হুমায়ুন দেখে বেচারী থরথর করে কাঁপছে। গর্ত খোড়ো! খানজাদা চিৎকার করে তাঁকে আদেশ দেয়।

হুমায়ুন তার চারপাশে তাকিয়ে উন্মত্তের ন্যায় বালিতে গর্ত করতে ব্যস্ত অবয়ব দেখতে পায়, সে তার ঘোড়ার পেছনের দুপা বাঁধে তারপরে হামিদাকে গরুর গাড়ি থেকে কোলে তুলে নিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে যায়, যেখানের বালি দেখে নরম আর গর্ত করা সহজ হবে বলে মনে হয়।

আমিও সাহায্য করতে চাই… আসন্নপ্রসবা হামিদা নিজের বিশাল অবয়ব নিয়েও তাঁর পাশে হাটু মুড়ে বসে এবং নখ দিয়ে বালিতে গর্ত করতে শুরু করে। তারা উন্মত্তভাবে কাজ করে, খালি হাতে তাঁদের পক্ষে যতটা সম্ভব একটা স্থানে তাঁরা গর্ত করে। অচিরেই হামিদার নখ ভেঙে রক্তপাত শুরু হয়। হুমায়ুন ঘাড়ের উপর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে ঝড় আরও এগিয়ে এসেছে আর ঝড়ের সাথে উড়তে থাকা আবর্জনায় আকাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। চারপাশের বাতাসে একটা জান্তব গর্জন ভাসতে থাকে এবং সে যদিও হামিদাকে কিছু বলতে দেখে কিন্তু সে তার একটা বর্ণও শুনতে পায় না। সে ক্ষিপ্রভাবে নিজের প্রয়াস আরও জোরদার করে এবং শীঘ্রই বালি আর বাতাসের যুগলবন্দি তাঁদের আচ্ছন্ন করলে, হামিদাকে জড়িয়ে ধরে তাদের খোঁড়া গর্তে তাঁকে নিজের দেহ দিয়ে ঢেকে শুইয়ে দেয়। নিজের দেহ দিয়ে তাঁকে আড়াল করার প্রয়াসে হুমায়ুন তাঁকে দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে শক্ত করে নিজের সাথে আটকে রাখলে হামিদার মুখ তার বুকে ঘষা খায়।

হুমায়ুন হামিদাকে প্রাণপনে আকড়ে থাকে কিন্তু তারপরেও যেন সে তার বাহুর বেষ্টনী থেকে ছিটকে যেতে চায়, চামড়া ছাড়ানোর একটা অনুভূতি তার মুখে এবং তার করোটি থেকে কেউ যেন চুলগুলো উপড়ে ফেলতে চাইছে। তাঁর নাসারন্ধ্র আর মুখ বালিতে ভরে যায় এবং সে শ্বাস নেয়ার জন্য হাঁসফাঁস করলে গরম বাতাস বুকে প্রবেশ করায় তাঁর ফুসফুস বুঝি এখনই বিদীর্ণ হবে মনে হয়। তাঁর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে এবং নিজের জীবন বাঁচাতে প্রাণান্ত প্রয়াসের মাঝে সে টের পায় হামিদাকে আকড়ে ধরা আলিঙ্গন শিথীল হয়ে আসছে।

দেহের শেষ শক্তিটুকু একত্রিত করে সে নিজেকে বাধ্য করে তাঁকে শক্ত করে আকড়ে রাখতে। হামিদা আর তার গর্ভের সন্তানের বেঁচে থাকাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ুন এখন তাঁর আব্বাজানের অনুভূতি বেশ বুঝতে পারে যখন হুমায়ুন মৃত্যু পথযাত্রী বিশ্বাস করে তিনি আগ্রা দূর্গের মসজিদে গিয়ে নিজের প্রিয়তম সন্তানের জীবনের বদলা হিসাবে আল্লাহর কাছে নিজের প্রাণ উৎসর্গ। করেছিলেন। সে মনে মনে দোয়া করে হামিদা যেন বেঁচে থাকে এবং তাঁদের সন্তান যেন সালামত থাকে। তোমার যদি সেটাই অভিপ্রায় হয়ে থাকে তবে তাদের বখশ দিয়ে আমার জীবন গ্রহণ করো…

সে কায়মনো বাক্যে দোয়া করার মাঝেই টের পায় যে ধূলো আর হুড়দঙ্গলের মাত্রা কমছে। সে অবশেষে শ্বাস নিতে সক্ষম হলে তার নির্যাতিত ফুসফুস পুনরায় প্রসারিত হতে পেরেছে সে অনুভব করে। প্রতিবার শ্বাস নেবার সময় যন্ত্রণা হুল ফোঁটায়- ঠোঁট, মুখ গহ্বর, গলা, শ্বাসনালীতে কেমন দগদগে অনুভূতি এবং তার নাসারন্ধ্র এখনও বালিতে কিচকিচ করছে। তার চোখের অবস্থাও তথৈবচ, চোখের পাতার নীচে বালি ঢুকেছে এবং তাঁর মনে হয় কেউ বুঝি তাতানো লাল সুঁই দিয়ে চোখের মণিতে খোঁচা দিচ্ছে। সে চোখ খুলে রাখতে চেষ্টা করে এবং ঝরঝর করে ঝরতে থাকা অশ্রুর কারণে ঝাপসা হয়ে উঠা দৃষ্টি দিয়ে হামিদার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং একটা সময় সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।

সে টের পায় যে হামিদা তাঁর আলিঙ্গনের মাঝে একদম নিথর হয়ে শুয়ে আছে। পালকের মতো নরম বিভঙ্গে তাঁকে আলিঙ্গন মুক্ত করে হুমায়ুন আধ-শোয়া একটা ভঙ্গিতে নিজেকে উঁচু করে। প্রিয়তমা… সে কিছু বলতে চেষ্টা করে কিন্তু কোনো শব্দ খুঁজে পায় না। হামিদা, সে অবশেষে কথা খুঁজে পায় এবং সামনের দিকে ঝুঁকে এসে তাকেও তুলতে চেষ্টা করে। হামিদার কাঁধের অবস্থান খুঁজে পেতে, হুমায়ুনের দুই হাত তার গলার দিকে ধেয়ে যায় দুহাতের তালুতে তাঁর প্রেমময় মুখ স্পর্শ করার বাসনায়। হামিদাকে ভীষণ নিস্তেজ মনে হয়। অনেকটা যেন হাত দিয়ে মৃত পাখি ধরার একটা অনুভূতি….

হুমায়ুনের চারপাশ থেকে রুদ্ধশ্বাস গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করে কিন্তু এই মুহূর্তে হামিদা ছাড়া আর কারও বিষয়ে সে ভাবিত নয়। পরম মমতায় সে আরো একবার হামিদার মুখটা নিজের বুকের কাছে টেনে এনে তার নোংরা জট লাগা চুলে বিলি কাঁতে থাকে অথচ একটা সময় ছিল যখন এই চুলে সূর্য মুখ লুকাত। সে যেন একটা শিশুকে ধরে রয়েছে- এমন ভঙ্গিতে হুমায়ুন সামনে পিছনে দুলতে আরম্ভ করে। দুলুনিটা তাঁকে খানিকটা হলেও স্বস্তি দেয়, এই পৃথিবীতে সে যাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে সেই মানুষটাকে হারাবার শোক স্বীকার করে নেবার সময়টাকে বিলম্বিত করে।

কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে কয়েক জন্মের দ্যোতনাবহ কিন্তু কয়েক পল হয়তো ততক্ষণে সময়ের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে অতিবাহিত হবার পরে সে টের পায় হামিদা নড়ে উঠেছে। তারপরে সে ভীষণভাবে কাশতে শুরু করে, বালি আর লালার কালচে কমলা রঙের মিশ্রণের থুতু ফেলে। হামিদা বেঁচে আছে আনন্দের এই বোধটা হুমায়ুনকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। হামিদাকে উঠে বসতে সাহায্য করার মাঝেই একটু আগে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল অবিকল সেভাবেই তাঁকে লোভী, বুভুক্ষের ন্যায় বাতাসের প্রসাদ গ্রহণ করতে শোনে।

ঘাবড়ে যাবার মতো কিছু হয়নি, সে কর্কশ কণ্ঠে বলে, সবকিছু ঠিক আছে…

হুমায়ুন টের পায় কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরে হামিদা তাঁর হাতটা তুলে নিয়ে নিজের স্ফীত গম্বুজাকৃতি উদরে স্থাপণ করে। নিজের ভাবী সন্তানকে মাতৃগর্ভের নিরাপত্তায় জোরালভাবে লাথি মারতে দেখে তার বালিতে ঢাকা মুখে আবারও তাজা অশ্রু ঝরতে আরম্ভ করে, পার্থক্য কেবল একটাই এবার যন্ত্রণার বদলে আনন্দের অশ্রু ঝরছে।

মানুষজন আর ভারবাহী পশুর পাল ধীরে ধীরে নিজেদের ভর পায়ের উপরে আরোপ করে উঠতে আরম্ভ করে, যদিও অনেকেই অশুভ ভঙ্গিতে নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। হুমায়ুন উঠে দাঁড়াবার ফাঁকে কাছেই বালির পুরু আবরনের নীচে একটা ঘোড়াকে দুর্বল ভাবে নড়ে উঠতে দেখে। সে টলমলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে জন্তুটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে এবং পরম মমতায় প্রাণীটার মুখ থেকে বালি সরাতে নিজের স্ট্যালিয়নকে চিনতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টা তাঁদের উপর দিয়ে বয়ে যাবার পূর্বের ভীতিকর শেষ মুহূর্তগুলোতে প্রাণীটার কথা সে বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিল। জন্তুটা নিশ্চয়ই চারপায়ে দ্রুত দৌড়াতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু পেছনের দুই পা বাঁধা থাকার কারণে মাটিতে আছড়ে পড়েছে। হুমায়ুন ঘোড়াটার পায়ে খুরের উপরের আর পেছনের কেশগুচ্ছে দ্রুত হাত বুলাতে অস্থিভঙ্গের লক্ষণ টের পায়। একহাতে জন্তুটার গলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে এবং কানের কাছে মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে ঘোড়াটাকে আশ্বস্ত করার মাঝে, সে অপর হাতে কোমর থেকে খঞ্জর টেনে বের করে দ্রুত ঘোড়াটার ঘাড়ের মোটা শিরাটা কেটে দিলে, উষ্ণ রক্ত ছিটকে এসে তাঁকে ভিজিয়ে দেয় এবং বালিতে কালচে একটা দাগের সৃষ্টি করে।

সে চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে জয়নাব হামিদার জন্য পানি নিয়ে এসেছে। কিন্তু সে টলোমলো পায়ে আরেকজন রমণীকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মাথার চুল উস্কোখুস্কো, কাপড়ের উপরে বালির স্তর জমে আছে এবং মেয়েটা অঝোরে কাঁদছে বলে তার নোংরা মুখে কান্নার ধারা জ্বলজ্বল করছে, মেয়েটা আর কেউ না গুলবদন। হুমায়ুন নিজের বোনকে আশ্বস্ত করার জন্য তাঁকে জড়িয়ে ধরতে যায় কিন্তু সে নিজেকে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে নেয়।

আমি ঠিক আছি কিন্তু খানজাদা… গুলবদন তাঁকে নিথর হয়ে পড়ে থাকা একটা দেহের কাছে নিয়ে যায় এবং হুমায়ুন চোখ নামিয়ে তাকিয়ে তাঁর ফুপিজানের বালির প্রলেপযুক্ত মুখ দেখতে পায়। ফুপিজানের দুচোখ বন্ধ এবং তার কাত থেকে থাকা মাথার ভঙ্গি দেখে- যুদ্ধক্ষেত্রে সে নিজে যেখানে অসংখ্য মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করেছে- বুঝতে পারে তিনি মারা গিয়েছেন। যান্ত্রিকভাবে, সে তার গলা স্পর্শ করে কিন্তু সেখানে নাড়ীর কোনো স্পন্দন অনুভব করে না। তাঁর নাসারন্ধ্র আর মুখ দেখে বালিতে শ্বাসরোধ হয়েছিল মনে হয় এবং তার দুই হাত এমনভাবে কুচকে রয়েছে। যেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মৃত্যুর সাথে তুমুল লড়াই করেছেন- খানজাদা নিশ্চিতভাবেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন।

আমার নিজের আম্মিজান মারা যাবার পর থেকে তিনি আমার সাথে একেবারে আমার মায়ের মতো আচরণ করতেন। নিজের দেহ দিয়ে তিনি আমাকে আড়াল করে রেখেছিলেন। আমি কতটা ভয় পেয়েছি তিনি ভালো করেই জানতেন… গুলবদন ফিসফিস করে বলে।

গুলবদনকে সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো শব্দ খুঁজে না পেয়ে হুমায়ুন নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে। খানজাদা- বাবরের বিপর্যয় আর সাফল্যের সমান অংশীদার এবং সম্রাট হিসাবে তাঁকে প্রথমদিকে যিনি পথ দেখিয়েছেন, আফিমের নেশার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আর নিজের নিয়তির মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছেন যিনি সেই মহিলা- আর বেঁচে নেই। সারা জীবনে কতকিছু দেখা আর সহ্য করার পরে, খোলা প্রান্তরে বালিঝড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাঁর এভাবে মৃত্যুবরণ করাটা যেন কেমন ভয়ঙ্কর আর নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। তাঁদের রাজবংশের প্রতি তাঁর নিঃশঙ্ক আত্মনিয়োজন এবং তাঁর প্রতি খানজাদার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কিংবা তাঁর সাহসিকতার কথা সে কখনও ভুলবে না। একটা সর্বগ্রাসী বিষণ্ণতা, কিছুক্ষণ পূর্বের আনন্দকে আচ্ছন্ন করে, তাকে আপুত করে ফেলে। কাবুলের উপকণ্ঠে পাহাড়ের পাদদেশে তার ভাই সম্রাট বাবরের সমাধির পাশে বা আগ্রায় যমুনার তীরে কোনো পুষ্পবীথি শোভিত উদ্যান খানজাদার অন্তিম সমাধিস্থল হবার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব না। হুমায়ুন ঝুঁকে গিয়ে তার ফুপিজানের দেহটা তুলে নিয়ে পরম মমতায় তাঁকে নিজের বাহুতে আকড়ে ধরে আপন মনে কথা বলতে থাকে। স্থানটা যদিও মনুষ্যবর্জিত আর বিরান একটা এলাকা, তাঁকে আমাদের এখানেই সমাধিস্থ করতে হবে। তাঁর কবর আমি নিজে খুড়বো।

*

হুমায়ুনের ক্লান্ত অবসন্ন সৈন্যবাহনীর সামনে অবশেষে রৌদ্রদগ্ধ দশটা দীর্ঘ দিনের শেষে অমরকোটের দেয়াল দিগন্তের কাছে ভেসে উঠে। জাহিদ বেগ আর কাশিমকে, স্বস্তির দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখে সে। সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ে হুমায়ুনের দশজন লোক মৃত্যুবরণ করেছিল- ঘূর্ণিঝড়ের তোড়ে বলদে টানা মালবাহী শকটের একটা গুঁড়িয়ে গেলে সেখান থেকে উড়ে আসা কাঠের টুকরো দুজনকে ঘায়েল করেছিল। জওহরের মতো, অনেকেরই দেহের ত্বকে মারাত্মক আঁচড় লেগেছিল এবং কেটে গিয়েছিল, অনেকেরই অস্থিভঙ্গ হয়েছিল আর গাদাবন্দুক সজ্জিত তাঁর সেরা তরকিদের একজন ধারাল পাথরের টুকরোর আঘাতে একচোখের দৃষ্টি হারিয়েছে।

এতো বিপুল সংখ্যক ঘোড়া হয় মারা গিয়েছে বা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে যে বেশীর ভাগ লোককেই পায়ে হেঁটে চলতে হচ্ছে, তাদের ভিতরে হুমায়ুনও রয়েছে। তাদের বেশীরভাগ সাজসরঞ্জাম যার ভিতরে অসংখ্য গাদাবন্দুকও রয়েছে, হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বা বালির নীচে চাপা পড়েছে। সরঞ্জামাদি যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত নাও হতো, মালবাহী শকট ছাড়া এবং গুটিকয়েক ভারবাহী প্রাণী অবশিষ্ট থাকায়- দশটা খচ্চর আর ছয়টা উট- তারা বেশীর ভাগই পথিমধ্যে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হতো। তাদের সাথে যে কয়টা ভারবাহী জন্তু অবশিষ্ট ছিল সেগুলোর পিঠেই তারা যতটা সম্ভব মালপত্র তুলে দিয়েছে। হুমায়ুনের সিন্দুকগুলোর ভিতরে একটাই অক্ষত অবস্থায় ছিল কিন্তু এখন সেটাও খালি করে তার ভিতরে যা কিছু ছিল সব ঘোড়ার পিঠের দুদিকে ঝোলান থলেতে ভরা হয়েছে। হুমায়ুনের গলায় একটা ঝুলন্ত থলেতে কোহ-ই-নূর এখনও নিরাপদেই রয়েছে।

একটা কুৎসিত দর্শন উটের পাশে হুমায়ুন অবসন্ন ভঙ্গিতে পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে জটা, আবার তার চওড়া, চ্যাপটা আর উপরের দিকে উল্টানো পায়ে সামনে এগোবার সময় জান্তব আর্তনাদ করে আর বালিতে দুর্গন্ধযুক্ত শ্লেষ্মর দলা। নিক্ষেপ করে। তার সম্রাজ্ঞীর জন্য মোটেই মানানসই বাহন বলা যাবে না, হামিদার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, সে অবশিষ্ট উটের একটার অস্থিসার পার্শ্বদেশ থেকে ঝুলন্ত ঝুরিতে ভ্রমণ করছে, উটটার অপর পাশে আরেকটা ঝুরিতে অবস্থানরত গুলবদনকে দিয়ে দুপাশের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। হামিদা চোখ বন্ধ করে রয়েছে এবং তাকে দেখে তন্দ্রাচ্ছন্ন মনে হয়। হুমায়ুন ভাবে ভাগ্য সহায় থাকলে রাত নামার আগেই তারা অমরকো পৌঁছে যাবে, তারপরে সে হামিদার বিশ্রামের জন্য ভালো কোনো বন্দোবস্ত করতে পারবে।

কিন্তু সে যেমনটা ধারণা করেছে অমরকে নিশ্চয়ই তার চেয়ে আরও দূরে অবস্থিত। মরুভূমিতে দূরত্বের ধারণা সবসময়েই ছলনাময়ী। পশ্চিমের আকাশে রক্তের লালচে আভা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য যখন দিগন্তের নীচে ডুব দেয়, মরুদ্যানের নীচু সীমারেখা তখনও বেশ কয়েক মাইল দূরে বলে প্রতীয়মান হয়। রাত্রির অন্ধকার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায়, এখন অগ্রসর হওয়াটা বোধহয় অজ্ঞতার পরিচায়ক হবে। হুমায়ুন চিৎকার করে সৈন্যসারিকে যাত্রাবিরতির আদেশ দেয় এবং চারপাশে তাকিয়ে অনিলকে খোঁজে তার সাথে পরামর্শ করবে বলে, এমন সময় সে হামিদাকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠতে শুনে। তারপরে আবারও।

কি হয়েছে?

সন্তান… আমার মনে হয় সন্তান ভূমিষ্ট হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

হুমায়ুন, উটের পায়ে চাপড় দিয়ে ইঙ্গিত করতে জন্তুটা নাক দিয়ে ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লে, হামিদাকে ঝুরি থেকে তুলে নিয়ে কণ্টকযুক্ত পত্রবিশিষ্ট নীচু ঝোপের একটা ঘন ঝাড়ের দিকে নিয়ে গিয়ে তাকে সেখানে আলতো করে শুইয়ে দেয়। গুলবদনও ইতিমধ্যে তাঁর ঝুরি থেকে নেমে এসেছে এবং হামিদার আরেকপাশে আসনপিড়ি হয়ে বসে, তার লালচে হয়ে উঠা মুখে টোকা দেয় আর চুলে বিলি কাঁতে থাকে।

গুলবদন হামিদার কাছে থাকো। আমি জয়নাব আর অন্য মেয়েদের তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি অমরকো থেকে সাহায্যের জন্য কাউকে নিয়ে আসতে চেষ্টা করি।

হুমায়ুনের দলবল যেখানে যাত্রাবিরতি করেছে সেদিকে সে যখন দৌড়ে যায় তার হৃৎপিণ্ড রীতিমতো ধকধক করতে থাকে। সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের সময়ও এমন ভয়ের সাথে সে কখনও পরিচিত ছিল না। সন্তান ভূমিষ্ট হবার সময় এখনও হয়নি। হামিদা নিশ্চিত ছিল যে এখনও একমাস বাকি আছে… হিসাবে যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, এই বিরূপ বিরানপ্রান্তর যা ইতিমধ্যে খানজাদার মৃত্যুর কারণ হয়েছে যদি হামিদাও এখানে মৃত্যুবরণ করে?

জওহর, সে শুনতে পাবার মতো দূরত্বে পৌঁছেই চিৎকার করে উঠে। সম্রাজ্ঞীর প্রসব-বেদনা শুরু হয়েছে। আমাদের অবশিষ্ট ঘোড়াগুলোর ভেতর থেকে সবচেয়ে সেরাটা বেছে নাও এবং তোমার পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব অমরকোটের উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাকাও। সেখানের লোকদের কাছে আমার পরিচয় দেবে এবং এটাও বলবে যে আমার স্ত্রীর জন্য আমাদের আশ্রয় প্রার্থনা করেছি। আতিথিয়তার রীতি অনুসারে তারা আমাকে বিমুখ করতে পারবে না। আমাকে এবং আমার সৈন্যদের যদি তারা ভয়ও পায় হামিদাকে তারা নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। সেখানে অবশ্যই হাকিম এবং ধাত্রীরা রয়েছে। জলদি যাও!

জওহর, চকরাবকরা রঙের ছোটখাট দেখতে একটা মাদী ঘোড়া বেছে নিয়ে, যার পায়ে তখনও সামান্য হলেও দৌড়াবার মতো শক্তি রয়েছে, ক্রমশ ঘনায়মান অন্ধকারের মাঝে যাত্রা করে। হুমায়ুন তড়িঘড়ি হামিদার কাছে ফিরে আসতে তার চারপাশে মেয়েদের একটা ছোটখাট জটলা দেখতে পায়, যারা তাঁকে এগিয়ে আসতে দেখে দুপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। হামিদা চোখ বন্ধ করে, মাটিতে পিঠ দিয়ে শুয়ে রয়েছে এবং ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। ঘামে তার মুখটা চকচক করছে।

সুলতান, বেগম সাহেবার গর্ভমোচন শুরু হয়েছে, জয়নাব বলে। আমি জানি আমার বোনদের আমি অনেকবার সন্তান জন্ম দিতে দেখেছি। এবং তাঁর ব্যাথা ক্রমশ আরও ঘন ঘন উঠছে…আমাদের হাতে বেশী সময় নেই… জয়নাবের কথার গুরুত্ব বোঝাতেই যেন হামিদা ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠে এবং তাঁর চোখের পাতার নীচে থেকে অশ্রু ভেসে উঠে, তাঁর মুখের ঘামের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যা এখন স্রোতের মতো তাঁর দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে। আরেকদফা খিচুনী তাকে যন্ত্রণাদগ্ধ করতে, সে ধনুকের মতো পিছনের দিকে বেঁকে যায় তারপরে হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে তুলে এনে একপাশে কাত হয়ে যায়।

হুমায়ুনের পক্ষে তাকিয়ে থেকে এ দৃশ্য দেখা অসম্ভব। সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে হামিদার আর্তনাদের মাত্রা জোরাল আর দ্রুততর হতে থাকলে, সে অসহায় ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে আর কিছুক্ষণ পর পর হামিদার শিয়রের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গিয়ে পুনরায় পায়চারি করতে থাকে। রাতের নিজস্ব শব্দ- শিয়ালের ডাক, ময়ুরের কর্কশ কণ্ঠের চিৎকারের আকস্মিকতা- তার নিজের অসহায়তার বোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জওহর কোথায়? তার নিজেরই হয়তো যাওয়া উচিত ছিল- বা তার পরিচয়ের প্রমাণ হিসাবে জওহরের সাথে তৈমূরের অঙ্গুরীয়টা পাঠাতে পারতো…

হামিদা আরেক দফা ব্যাথায় চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলে ব্যাথাটা যেন সে নিজেও অনুভব করছে এমন ভঙ্গিতে হুমায়ুন কুঁচকে যায়। একটা ঝোপের নীচে, এই বিরান, উদ্ধৃঙ্খল পরিবেশে হামিদাকে যে সন্তানের জন্ম দিতে হচ্ছে…

সুলতান, হুমায়ুন তাঁর নিজের ব্যক্তিগত মর্মবেদনায় এতোটাই বিভোর হয়েছিল যে, একটা ছোট অশ্বারোহী দলকে পথ দেখিয়ে অন্ধকারের ভিতর থেকে জওহরকে এগিয়ে আসতে সে দেখেনি বা শব্দও শোনেনি, দলটার সাথে কয়েকটা অতিরিক্ত ঘোড়া রয়েছে, তার মধ্যে দুটো ঘোড়ার মাঝে স্ট্রেচারেরমতো একটা কাঠামো ঝুলছে।

সুলতান, জওহর পুনরায় তাকে সম্বোধন করে। অমরকোটের শাসক আপনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি আপনাকে, বেগমসাহেবাকে আর আপনার ব্যক্তিগত সফরসঙ্গীদের তাঁর বাসস্থানে নিয়ে যাবার জন্য একদল সৈন্য আর একজন হাকিম আর ধাত্রীও পাঠিয়ে দিয়েছেন।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হুমায়ুন মাথা নাড়ে।

হুমায়ুন এবং ছয়জন দেহরক্ষী সমেত তার ছোট দলটা, জাহিদ বেগের উপরে অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব অর্পন করে, যখন রওয়ানা দেয় অমরকোটের মাটির কাঁচা দেয়াল চাঁদের ধুসর আলোয় রূপালি রং ধারণ করেছে। জওহরের নিয়ে আসা ধাত্রী হামিদাকে ইতিমধ্যে একটা ঔষধি উপাচার দিয়েছে- যা মনে হয় তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করেছে।

মশালের আলোয় হুমায়ুনের জন্য তাঁর পারিপার্শ্বিকতা অনুধাবন করাটা বেশ কঠিন হয় এবং সৈন্যরা ঘোড়ার পিঠ থেকে হামিদাকে বহনকারী স্ট্রেচারটা আলতো করে খুলে নিয়ে, একটা বেশ বড় ভবনের চৌকাঠের নীচে দিয়ে, দেয়াল থেকে ঝুলন্ত মশালদানিতে রক্ষিত জ্বলন্ত মশালের আলোয় যার দুপাশ আলোকিত, সেটা বহন করে ভেতরে প্রবেশ করলে, তাঁর দৃষ্টি সবকিছু বাদ দিয়ে সেদিকেই নিবদ্ধ থাকে। হামিদাকে বহনকারী স্ট্রেচারটা অনুসরণ করে সে একটা করিডোরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, যার শেষ প্রান্তে সে কাঠের কারুকাজ করা দরজার একজোড়া পাল্লা দেখতে পায়, যার সামনে পরিচারিকার দল অপেক্ষা করে রয়েছে। স্ট্রেচার বহনকারী দলটা দরজার নিকটবর্তী হতে তারা দরজার পাল্লা খুলে দেয়। হামিদাকে সাথে নিয়ে হেকিম এবং তাঁদের পেছন পেছন ধাত্রী মেয়েটা ভেতরে প্রবেশ করে। হুমায়ুনও তাঁদের অনুসরণ করে ভেতরে প্রবেশ করতে যাবে- এমন সময় গাঢ় সবুজ রঙের আলখাল্লা পরিহিত একজন লোক সে তাঁকে আগে লক্ষ্য করেনি সামনে এগিয়ে আসে এবং কুর্নিশ করে।

মহামান্য সুলতান, আমি অমরকোটের রানার উজির, আপনাকে স্বাগত জানাবার জন্য তিনি যাকে প্রেরণ করেছেন। এটা জেনানা মহলে প্রবেশের পথ। রানা ব্যতীত কেবল একজনের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি রয়েছে তিনি হলেন আমাদের হাকিমসাহেব। কিন্তু আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না আপনার আবাসনকক্ষের বন্দোবস্ত পাশেই করা হয়েছে এবং কোনো সংবাদ থাকলে সেটা সাথে সাথে আপনাকে জানানো হবে।

হুমায়ুন ভাবে, এই পরিস্থিতিতে রাজি হওয়া ছাড়া তার আর কিইবা করার আছে এবং সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সেই রাতে ঘন্টার কাঁটা যেন সহসাই মন্থর হয়ে পড়ে বা তার কাছে সেরকমই মনে হয়। গবাক্ষের ভিতর দিয়ে পূর্বাকাশে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে দেখে- ভোর হবার ঠিক আগে আগে সে বোধহয় হাল্কা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কাঁধের উপরে সে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করতে, সাথে সাথে সে সজাগ হয়ে উঠে এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের খঞ্জর আকড়ে ধরে, তখন তাঁর খেয়াল হয় যে অনেক আগেই সকাল হয়েছে আর তাঁকে ঘুম থেকে আর কেউ না গুলবদন উঠিয়েছে। সে এমনভাবে হাসছে যেভাবে হাসতে হুমায়ুন তাকে বহুদিন দেখেনি।

হুমায়ুন আপনার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে, বলিষ্ঠ এবং স্বাস্থ্যবান আর ইতিমধ্যেই চিৎকার করে আকাশ মাথায় করেছে। ধাত্রী তাকে পরিষ্কার করা মাত্র কয়েক মিনিটের ভিতরে আপনার কাছে তাকে নিয়ে আসবে।

আর হামিদা?

তার জন্য প্রসব-বেদনা একটা কষ্টকর অভিজ্ঞতা ছিল। ধাত্রীর সমস্ত দক্ষতা তার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু তিনি ভালোই আছেন এবং এখন ঘুমাচ্ছেন।

আনন্দ আর স্বস্তির একটা যুগপৎ ধারায় সিক্ত হয়ে, হুমায়ুন কিছুক্ষণের জন্য মাথা নীচু করে চুপ করে থাকে। তারপরে তাঁর পরণের আলখাল্লার জেব থেকে সে মূল্যবান কস্তরীর একটা আধার বের করে যা ঠিক এই মুহূর্তের জন্য সে আগলে রেখেছিল এবং থলেটা সে গুলবদনের হাতে দেয়। এটা আতুরঘরে নিয়ে যাও। আমার সন্তানের জন্ম উদযাপনের অভিপ্রায়ে এটা সেখানে ভাঙবে এবং পুরো কামরায় যেন এর সৌরভ ছড়িয়ে পড়তে দেবে- এই পৃথিবীতে আমার সন্তানের প্রথম যে ঘ্রাণ গ্রহণ করবে এটাই হোক তার অন্যতম বস্তু। হামিদাকে বলবে যে এই মুহূর্তে যদিও এরচেয়ে বেশী কিছু তাঁকে দেবার সামর্থ্য আমার নেই তবুও এটা কেবল আমার ভালোবাসার স্মারকই না সেই সাথে এটা আমাদের বংশের ভাবী মহত্বের সৌরভ।

 ২.৯ আকবর

১৪. আকবর

আমি তোমার নাম রাখলাম আকবর- যার মানে মহান এবং মহান তুমি হবেই। হুমায়ুন কথা বলার মাঝেই দুর্লভ ঘিয়ে রঙের জেড পাথরের একটা পেয়ালা তুলে নেয়- অমরকোটের রানার তরফ থেকে প্রেরিত উপহার এবং আকবরের মাথায় পাত্রে রক্ষিত অনুষঙ্গগুলো, শাহরুখি- ছোট ছোট সোনার মোহর- পরম মমতায় বর্ষিত করে, সদ্যোজাত সন্তানের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্মারক হিসাবে। কাশিমের কোলের উপরে একটা মখমলের তাকিয়ায় দিগম্বর অবস্থায় শায়িত আকবর এহেন উৎপাতে চমকে গিয়ে হাত পা আন্দোলিত করে কিন্তু কাঁদে না। হুমায়ুন তাকে পরম মমতায় তাকিয়া থেকে তুলে নিয়ে দুহাতে শূন্যে উঁচু করে ধরে যাতে করে সমবেত হওয়া তার সব সেনাপতি আকবরকে দেখতে পায় এবং বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠে, মহান তৈমূরের অধস্তন সপ্তম পুরুষ, আমার সন্তানকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাদের সামনে উপস্থাপন করছি। আমার প্রতি তোমরা যেমন বিশ্বস্ত ছিলে তাঁর প্রতিও ঠিক তেমনই বিশ্বস্ত থাকবে। তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী নতুন যুবরাজের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনের সেনাপতিরা সবাই নিজেদের ঢালের উপরে নিজ নিজ তরবারি ঠুকে উদাত্তস্বরে ঐতিহ্যবাহী সম্ভাষণ জ্ঞাপন করতে থাকে, মির্জা আকবর! মির্জা আকবর! হুমায়ুন হাত তুলে যতক্ষণ না তাদের শান্ত হতে ইঙ্গিত করে।

এই বিশেষ অনুষ্ঠানে এবার হামিদার অংশ গ্রহণের সময় হয়েছে। একটা নীচু ডিভানে ঠেস দিয়ে শায়িত অবস্থায় তাকে এখনও পরিশ্রান্ত দেখায়- ত্বক গজদন্তের ন্যায় ফ্যাকাশে এবং তাঁর কালো উজ্জ্বল চোখের নীচে গাঢ় কালি পড়েছে। হুমায়ুন যদিও তাকে সুস্থ হয়ে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছিল, হামিদাই বরং তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। আপনার জন্য আপনার লোকেরা অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছে। যত শীঘ্রি সম্ভব আপনার উত্তরাধিকারীকে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত করা তাদের প্রতি আপনার কর্তব্য। এটা আপনাকে তাদের সাথে আরও নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করবে। হুমায়ুন অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকা আকবরকে হামিদার কাছে নিয়ে যায় এবং তাঁর বাহুর নিরাপত্তায় তাঁকে সমর্পণ করে। নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে স্তন্যপান করাবার ভান করে সে সেই শব্দগুলো উচ্চারণ যা তৈমূরের সময়ের পূর্বে থেকে মহাসাগরবৎ শাসক স্বয়ং চেঙ্গিস খানের সময়কাল থেকে মোগলদের সময়কাল পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে: পুত্র আমার পান করো। তোমার মধুর ওষ্ঠদ্বয় আমার মঙ্গলময়ী স্তনে আরোপ করো এবং জীবনদায়ী সুধায় তোমার মুখে মাধুর্য আনয়ন করো।

আকবর যখন আবিষ্কার করে যে আসলে এখনই তাকে স্তন্যদানের কোনো অভিপ্রায় তাঁর মমতাময়ী মায়ের নেই সে গলার স্বর সপ্তমে তুলে চিৎকার শুরু করে। হামিদা যখন তাঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে, তখন হুমায়ুন আরো একবার নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলে। আমার জ্যোতিষী শারাফের সহায়তায় আমি আমার সন্তানের কোষ্ঠী বিচার করেছি। তার জন্ম তারিখের চেয়ে ১৫ অক্টোবর, ১৫৪২, চন্দ্রের প্রভাবযুক্ত সিংহ জাতক- মাঙ্গলিক আর কিছুই হতে পারে না। এই দিনে জন্মগ্রহণকারী সন্তান সৌভাগ্যবান আর দীর্ঘ জীবনের অধিকারী। আমরা অনেক বিপর্যয় আর কষ্ট সহ্য করেছি। ন্যায়সঙ্গত যা আমাদের সেটা আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারার আগে সম্ভবত আরো অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় আমাদের অতিক্রম করতে হতে পারে কিন্তু একটা মহিমান্বিত ভবিষ্যত আকবর আর আমাদের দিকে হাতছানি দিচ্ছে। আজ রাতে অর্জিত হয়নি এমন অনেক বিজয় আমরা উদযাপন করবো এবং তাঁর স্মরণে ভোজে অংশগ্রহণ করবো। তার লোকেরা আরও একবার নিজেদের আয়ুধ ঠুকে সম্মতি জানায়। তাঁদের এবারের পুনরাবৃত্ত শব্দগুচ্ছ ছিল মির্জা হুমায়ুন কিন্তু সে আর একটা কথাও না বলে ঘুরে দাঁড়ায়, আর কোনো বাক্য বলার জন্য তার হৃদয় বড্ড বেশী বেদনাবিধূর।

সেদিন পরবর্তী কোনো এক সময়ে, তারা যখন পুনরায় একাকী হয়, হুমায়ুন দেখে হামিদা তার আলখাল্লার গলা নিচে নামিয়ে এনে আকবরকে স্তন্য দান করে, খুদে শাহজাদা যখন প্রাণপনে নিজের উদরপূর্তি করছে তখন সে তার মাথার কোঁকড়া কালো চুলের দিকে পরম মমতায় তাকিয়ে থাকে। সে এখন এক পুত্র সন্তানের পিতা এই বোধটাই তার ভিতরে অবর্ণনীয় একটা গর্বের জন্ম দেয়। হামিদার পূর্বের দিনগুলোতে, সে যত দূর জানে তার কোনো উপপত্নী তার কোনো সন্তান গর্ভে ধারণ করেনি। এখন, চৌত্রিশ বছরের বৃদ্ধ জীবনে, সে উপলব্ধি করছে একটা পুত্র সন্তান তাঁর জীবনের গূঢ়তর উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর ব্যগ্রতাকে কিভাবে পরিতৃপ্ত করতে পারে।

হামিদা… নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য উপযুক্ত শব্দের খোঁজে সে কথার মাঝে ছেদ টানে। জীবনে প্রথমবারের মতো আমার মনে হচ্ছে আমি একজন পিতার ভালোবাসার গভীরতা অনুধাবন করতে পারছি… পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার চেয়েও কত ব্যাপক এর বিস্তৃতি। আমাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে আমার আব্বাজান যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার দেখিয়েছিলেন, আমি সবসময়ে তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন যখন আমি নিজে একজন পিতা হিসাবে আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমার সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে আমি একে বর্ধিত করবো- যাতে আমি আমার সন্তানের যোগ্য একটা উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারি।

হামিদা মাথা নাড়ে কিন্তু কোনো কথা বলে না। কিন্তু এসব ছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা নিয়ে হামিদার সাথে আলোচনা না করলেই নয়- বিষয়টা আকবরের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হামিদাকে তাঁর জানাতেই হবে যে অচিরেই আরেকজন মহিলা তার সন্তানকে স্তন্যদান করবেন। তাঁদের নিশ্চয়ই একজন দুধ-মা নিয়োগ করতে হবে। মোগল রাজদরবারে কোনো মহিলার জন্য এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই মনোনীত মহিলা শাহজাদার দুধ-মা হবেন, তিনি তাঁর সাথে এমন একটা বন্ধনে আবদ্ধ হবেন যা সারা জীবন তার সাথেই টিকে থাকবে। তার নিজের সব সন্তানই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাহজাদার কুকালদাশে পরিণত হবে, তাঁর দুধ-ভাই, তাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং এর বদলে তারা নানা সুবিধা। ভোগ করবে। তার স্বামীও বিপুল সম্মানের অধিকারী হবে। বয়োজ্যোষ্ঠ অমাত্য আর সেনাপতিরা নিজেদের জন্য কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক পদ লাভে যতটা আগ্রহী ঠিক একই ভাবে তারা নিজেদের স্ত্রীর জন্য এই অবস্থানটা দারুণভাবে কামনা করেন। ব্যাপারটা যদি ঠিকমতো সমাধান করা না যায় তবে এই পরিস্থিতি থেকে হিংসা আর ঈর্ষার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতে পারে।

হামিদা, আমাদের অবশ্যই একটা বিষয়ে একমত হতে হবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে, আমার সেনাপতিদের পুরস্কৃত করার জন্য আমার সামনে খুব সামান্য সুযোগই আছে কিন্তু একটা জিনিষ আমি তাঁদের অনায়াসে দিতে পারি। তৈমূরীয় রীতি অনুসারে, আকবরের জন্য আমাদের অবশ্যই একজন দুধ-মা নির্বাচিত করতে হবে, তিনি এমন একজন মহিলা হবেন যিনি এই দায়িত্বের উপযুক্ত এবং যাকে আমরা বিশ্বাস করতে পারবো কিন্তু একই সাথে তাকে এমন একজন মহিলা হতে হবে যার স্বামী কৃপা লাভের উপযুক্ত এবং আমাদের পছন্দের কারণে নিজেকে যে সম্মানিত মনে করবে।

হামিদা মাথা তুলে এবং তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাজপরিবারের একজন সদস্য হিসাবে অবশ্যই সে বড় হয়নি। পুরাতন রাজকীয় রীতির সবকিছু তার পক্ষে জানা সম্ভব না। সম্ভ্রান্তমহিলারা যদিও প্রায়শই তাদের সন্তানদের স্তন্যদানের জন্য আয়া নিয়োগ করে থাকেন, তারা কেবলই পরিচারিকা যাদের অনায়াসে বরখাস্ত করা যায় এবং সন্তানদের জীবনে তাদের কোনো প্রভাবই পরিলক্ষিত হয় না। হামিদার কাছে হুমায়ুন একেবারেই ভিন্ন একটা কিছু অনুরোধ করেছে- আরেকজন মহিলার সাথে নিজের সন্তানকে ভাগ করে নেয়া।

হামিদা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে তারপরে সে কথা বলতে শুরু করে। আপনার এতোটা উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। এই রীতির বিষয়ে আমি অনেক আগে থেকে অবহিত আছি- খানজাদা আমাকে বলেছিলেন। আমার মনে হয় তিনি আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন, কেবল সন্তান জন্ম দেয়াই না বরং একজন ভবিষ্যত সম্রাটের মাতা হিসাবেও তিনি আমাকে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে আমি ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু খানজাদা মারা যাবার পরে আমি তার কথাগুলো সম্বন্ধে কেবলই ভেবেছি- যে একজন উপযুক্ত দুধ-মা নির্বাচিত করে আমি আমার সন্তানকে তার হাতে তুলে দিচ্ছি না বরং তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করছি। বিষয়টা যদিও আমায় এখনও বিষণ্ণ করে তুলে, তারপরেও আমি জানি তিনি ঠিক কথাই বলেছিলেন… আমাদের বোধহয় প্রয়োগপ্রবণ হওয়া উচিত। আমরা কাকে নির্বাচিত করবো? আমাদের সাথে এখন গুটিকয়েক রমণী রয়েছে আর তাঁদের ভিতরে আরও কম সংখ্যকের শিশুসন্তান রয়েছে।

জাহিদ বেগের স্ত্রীর অনেক বয়স তাঁর স্তন শুষ্ক হতে বাধ্য নতুবা আমি তার সাহসিকতা আর আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসাবে তাকেই নির্বাচিত করতাম। কিন্তু আরো একজন সেনাপতি রয়েছে যাকে আমি পুরস্কৃত করতে চাই- নাদিম খাজা, কান্দাহারের নিকটবর্তী স্থান থেকে আগত এক গোত্রপতি যাঁর স্ত্রী তার সাথেই রয়েছে। মারওয়ার থেকে আমরা পালিয়ে আসবার কিছুদিন পরেই তার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে।

অবশ্যই, আমি চিনি তাকে। মাহাম আগা নামে দীর্ঘদেহী, আর সুদর্শন এক রমণী। তার ছেলের নাম আদম খান।

মাহাম আগাকে তুমি মেনে নেবে? তোমার যদি অন্য কাউকে পছন্দ…

আমি সন্তুষ্ট। মাহাম স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী আর সেই সাথে সৎ এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। তার ছেলেটাও হয়েছে প্রাণবন্ত আর শক্তপোক্ত। আমি যদি কাউকে পছন্দ করি তবে তাকেই করবো। আকবরকে এক স্তন থেকে পরম মমতায় সরিয়ে এনে হামিদা তাকে আরেক স্তনের দিকে নিয়ে আসে। হুমায়ুন ভাবে সন্তান জন্মদানের সময়ে কষ্ট সহিষ্ণুতার পরীক্ষা বা সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ভোগ সত্ত্বেও হামিদা এখনও দেখতে কত সুন্দর। এবং এখনও যদিও তাঁর বয়স অল্প, হুমায়ুনের নিজের চেয়ে প্রায় বিশ বছরের ছোট কিন্তু তারপরেও কত শক্ত। আকবরকে আরেকজন রমণীর বাহুতে কল্পনা করাটা তাঁর জন্য নিশ্চয়ই খুব কঠিন কিন্তু তারপরেও একজন যোদ্ধার মতো সাহসিকতার সাথে নিজের ভয় লুকিয়ে রাখার মতো ঠিক একইভাবে সে তার কষ্ট গোপন করেছে। ভালোবাসার দোহাই দিয়ে হুমায়ুন তাকে পছন্দ করেছিল কিন্তু এই মাটির দেয়াল দেয়া, প্রত্যন্ত মরুদ্যানে নিজের বাড়ি আর তার নিরাপত্তা থেকে অনেক দূরে এখানেও তার মাঝে একজন সম্রাজ্ঞীর সব লক্ষণই বিদ্যমান। নীচু ডিভানটার দিকে এগিয়ে গিয়ে, সে ঝুঁকে এবং হামিদার ওষ্ঠে চুমু দেয় আর তারপরে স্বীয় পুত্রের মাথায় দবদব করতে থাকা কোমল তুলতুলে শীর্ষদেশে চুম্বন করে।

রাণার সাথে আপনার আলোচনার ফলাফল কি হয়েছে? আপনার কি মনে হয় যে আমরা এখানে নিরাপদ? হামিদা জানতে চায়।

আমার তো তাই মনে হয়। রাণা যদিও নিজে একজন রাজপুত, মালদেব আর সে বোধহয় পরস্পরকে অপছন্দই করে। গতবছর, মালদেবের লোকেরা রাজস্থানী মরুভূমি অতিক্রম করার সময় অমরকোটের কাফেলায় হামলা করেছিল। কাফেলায় গমনকারী বণিকেরা যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে রাণার তত্ত্বাবধানে ছিল সে আক্রমণটাকে তাঁর প্রতি চুড়ান্ত অপমান হিসাবে গন্য করেছে। মালদেব অবশ্য রাণার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিধর বিধায় প্রতিশোধের চিন্তা বাতুলতা আর এ কারণেই মালদেবের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখারও তার ইচ্ছে নেই। সে মালদেবের জন্য আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, যদিও আমাদের পক্ষে বেশীদিন এখানে অবস্থান করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অমরকে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত হলেও, একটা সময়ে আমাদের ধরার জন্য এখানে ঠিকই অনুসরণ করে এসে হাজির হবে। আমাদের পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব- যত দ্রুত তুমি হারানো শক্তি ফিরে পাবে- আমরা এখান থেকে বিদায় নেব।

কিন্তু এখান থেকে আমরা কোথায় যাবো?

উত্তরপশ্চিমে কেবলমাত্র কাবুল অভিমুখে গমন করাটাই আমাদের জন্য অর্থবহ বলে প্রতীয়মান হবে। আমি যতক্ষণ না শহরটা পুনরায় দখল করে কামরান আর আসকারিকে তাদের শঠতার জন্য শাস্তি দিচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত হিন্দুস্তানের বুক থেকে শের শাহকে উৎখাত করার কোনো সুযোগ আমি পাবো না… হুমায়ুন ইতস্তত করে। এটা হবে একটা বিপজ্জনক, কষ্টকর যাত্রা। আমি কি একটা নিরাপদ স্থান খুঁজে বের করে আমার সাথে তোমাদের মিলিত হওয়াটা যতক্ষণ নিরাপদ বলে প্রতিপন্ন না হয় সেখানে তোমাদের অবস্থানের বন্দোবস্ত করবো…?

না। আপনি ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আপনি যদি আমার সঙ্গে থাকেন তাহলে অনেক রুক্ষ পরিবেশেও আমি মানিয়ে নিতে পারি। আমি আপনাকে বলেছি যে খানজাদা আমাকে উপযুক্ত দীক্ষাই দিয়েছেন। পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে তিনি কখনও রাজি হতেন না এবং আমিও রাজি হতে পারছি না…

*

এক সপ্তাহ পরের কথা, আবারও একবার হুমায়ুন তার অবশিষ্ট লোকদের পুরোভাগে অবস্থান করে মরুভূমির বিরান প্রান্তরের দিকে এগিয়ে যায় তাদের পেছনে অমরকোটের ধূলিমলিন দেয়াল ভোরের লালচে ধূসর অনিশ্চয়তার মাঝে বিলীন হয়ে যায়। ভাক্কারের দূর্গ, তার আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই, সিন্ধের শাসক, মির্জা হুসেনের স্বত্বাধীন একটা পর্যবেক্ষণ-ফড়ি, আপাতত তাঁদের গন্তব্যস্থল। এলাকাটা এখান থেকে প্রায় দুইশ মাইল দূরে সিন্ধের উত্তর সীমান্তে সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত। তাঁরা দুজনে একটা আপাত লোক দেখান হার্দ্য সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল বলে হুমায়ুন আশা করছে, সেখানে সে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে পারবে। আর ভাক্কার যদিও প্রত্যন্ত এলাকা, বাইরের দুনিয়ায় কি ঘটছে সে হয়তো অবশেষে সে সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে।

অতিক্রান্ত পথের প্রতি মাইল তাঁদের আক্রান্ত হবার ঝুঁকির কবল থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকায়, হুমায়ুন ঘোড়ার গতি দ্রুততর করতে থাকে। প্রতিদিন ভোরে সূর্যের প্রথম কিরণ দিগন্তের কোণে ব্ৰীড়া নম্র ভঙ্গিতে উঁকি দিতেই সৈন্যসারি যাত্রা শুরু করে এবং মধ্যাহ্নে ক্লান্ত প্রাণীগুলোকে খানিকটা বিশ্রাম দিতে আর রুটি, শুকনো মাংস ও কয়েক টুকরো কিশমিশ দিয়ে আহারের সময়টুকু বাদে তাঁদের বহরটা বিরতিহীন ভাবে সামনে এগিয়ে চলে। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের ভিতরে, মরুভূমির উপর দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে, চোখে পড়ার মতো প্রাণবন্ত সবুজের অবারিত সমারোহে মাতোয়ারা ফসলের মাঠ আর গ্রামের মাঝে তাঁরা প্রবেশ করে যে সেখান থেকে সিন্ধু নদীর অববাহিকা খুব একটা দূরে না। অচিরেই ভাক্কারের বেলেপাথরের তৈরী শক্তপোক্ত দেয়াল তারা দেখতে পায় আর পশ্চিমদিকে সিন্ধু নদীর অপর তীরে হুমায়ুন বেগুনী রঙের একটা আবছা অবয়ব দেখতে পায় বেলুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল। কাবুলের পার্বত্য অঞ্চলের সাথে তাদের এতোটাই মিল যে সে টের পায় তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছে।

জওহর, ভাঙ্কারের দিকে এগিয়ে যেতে বলো। হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাট এবং সিন্ধের মির্জা হুসেনের রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়, হুমায়ুনের নামে প্রবেশের অনুমতি চাইবে।

এক ঘন্টা পরে হুমায়ুন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সেখানে তাকে স্বাগত জানাবার জন্য দূর্গের সর্বাধিকারীকে অপেক্ষমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। স্বাগতম, সুলতান, আমার প্রভুর পক্ষ থেকে আমি আপনাকে স্বাগত জানাই। অধমের নাম সাঈয়েদ আলী। দূর্গের সর্বাধিকারী নিজের বুকে হাত রেখে কথাগুলো বলার সময় হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে বাম কপালে একটা পুরাতন সাদা ক্ষতচিহ্ন আর ফিনফিন সাদা দাড়ির অধিকারী বেশ বয়স্ক একটা লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সেই দিন রাতের বেলা, ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আপেল কাঠের টুকরো ভর্তি একটা ধাতব পাত্র যার ওমে নদীর বুক থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসা শীতের প্রকোপ নাকচ হয়ে যায়, হুমায়ুন সাঈয়েদ আলীর সাথে জাহিদ বেগ আর কাশিমকে নিয়ে আলোচনায় বসে। আমার সৎ-ভাই কামরান আর আসকারির হাতে কাবুলের পতন হয়েছে একজন বার্তাবাহকের কাছে এই সংবাদ জানার পরে এই অঞ্চলে নতুন করে আর কি ঘটেছে সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই। আপনি কি আমাকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন?

সাঈয়েদ আলী কেমন বিভ্রান্ত একটা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাননীয় সুলতান, সত্যি বলতে কি, আপনার জানা উচিত এমন অনেক খবরই আছে, এমনকি সেটা জেনে আপনি হয়তো অসন্তুষ্টও হতে পারেন। কান্দাহার থেকে আগত পর্যটকেরা যারা ভাটি অঞ্চলের দিকে যাবার আগে এখানে যাত্রা বিরতি করেছিল, তাদের কাছে আমরা জানতে পেরেছি যে আপনার সৎ-ভাই হিন্দাল শহরটা দখল করে নিয়েছে।

হুমায়ুন এতো দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যে সে কাঠের যে টুলটায় সে বসে ছিল সেটা উল্টে গিয়ে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো ভর্তি ধাতব পাত্রের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। কিভাবে এটা সম্ভব হলো?

আমি যতদূর শুনেছি কোনো ধরনের সংঘর্ষ ছাড়াই সে শহরটা দখল করেছে। শহরের গভর্নর তাকে আপনার মিত্র বলে ভেবেছিল এবং তাকে আর তার সৈন্যবাহিনীকে সাদরে স্বাগত জানিয়েছিল।

হিন্দাল তাহলে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। হুমায়ুন যেমন সন্দেহ করেছিল যে সে কাবুল গিয়ে কামরান আর আসকারির সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন না করে সে পশ্চিমে দিকে এগিয়ে গিয়ে কান্দাহারে নিজের স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছে। জ্বলন্ত কয়লার আগুনের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন শেষবার যখন হিন্দালকে দেখেছিল সেই কথা ভাবে, রক্তাক্ত আর চোখে-মুখে ঔদ্ধত্য কারণ হুমায়ুন হামিদাকে বিয়ে করতে চায় আর তাকে নিষেধ করা অসম্ভব।

হিন্দাল তাহলে কান্দাহার শাসন করছে… সে অবশেষে মন্তব্য করে।

না, সুলতান। কিন্তু আপনি বললেন…

সুলতান আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। হিন্দাল কান্দাহারে অবস্থান করছে জানতে পেরে আপনার সৎ-ভাই কামরান হিন্দালকে আদেশ করে নিজের অধিরাজ হিসাবে তাঁকে নিতে এবং তার অধীনস্ত একজন মামুলি শাসক হিসাবে কান্দাহারে অবস্থান করতে। হিন্দাল যখন অস্বীকৃতি জানালে কামরান আর আসকারি বিশাল একটা বাহিনী নিয়ে গিয়ে শহরটা দখল করে এবং হিন্দালকে বন্দি করে। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে কেউ জানেনা…।

হুমায়ুনের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লয়ে আন্দোলিত হতে থাকে। সে যা ধারণা করেছিল কামরান আর আসকারি তার চেয়েও নিকটে অবস্থান করছে… কাবুল থেকে অনেক নিকটে, কান্দাহারের দূরত্ব এখান থেকে তিনশ মাইলের বেশী হবে না। নিয়তিই হয়তো তাঁকে ভাক্কারে নিয়ে এসেছে। তার সাথে যদিও খুব অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে প্রায় দুইশ হবে তাঁদের সংখ্যা- তারা সবাই মোগল বংশোদ্ভুত, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত যোদ্ধা- তার ইচকির দল। আর তাদের সাথে আরও অনেকেই যোগ দিবে যদি তারা লুটের মালের বখরা পাওয়া যাবে বলে মনে করে। স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে নিজেদের তরবারির নৈপূণ্য বিক্রির জন্য বেলুচিস্তানের পাহাড়ী অধিবাসীদের বেশ সুনাম আছে। সে যদি দ্রুত সব ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে তার সৎ-ভাইয়েরা সর্তক হবার আগেই সে কান্দাহার গিয়ে শহরটা দখল করে তাদের বন্দি করতে পারবে। অবশ্য এহেন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আরো কিছু বিষয় আছে যা তাকে জানতে হবে।

সাঈয়েদ আলী, শের শাহের কি খবর? এই মুহূর্তে সে কোথায় অবস্থান করছে?

সে এই মুহূর্তে বাংলায় রয়েছে, সেখানে তার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু আমি এর চেয়ে বেশী আর কিছু জানি না… কেবল এটাই শুনেছি যে সবাই বলাবলি করছে হিন্দুস্তানে তার শাসন লোহার মতো মজবুত আর শক্তিশালী।

চমৎকার, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে। শের শাহ বহুদূরে আর ব্যস্ত থাকার মানে, তার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বিপদের আশঙ্কা সে করলেও পারবে।

সাঈয়েদ আলী আপনার আতিথিয়তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু আপনি আমাকে যা বলেছেন সে জন্য তারচেয়েও বেশী কৃতজ্ঞ। আমি আমার লোকদের নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সিন্ধু নদ অতিক্রম করতে চাই… নদীতে খুব তীব্র স্রোত আর সে কারণে বিপজ্জনক কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই পার হবার জন্য আমাদের একটা নিরাপদ স্থান দেখাতে পারবেন…

*

বাতাসে শীতের প্রকোপ নতুন করে উদ্যমী হয়ে উঠায় হুমায়ুন ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে এবং তাঁর চারপাশে তুষারকণা এলোমেলো উড়তে থাকে। তার মাথা জমে শক্ত হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয় এবং সে পরণের ভেড়ার চামড়ার তৈরী লম্বা আলখাল্লাটায় শক্ত করে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়। হুমায়ুনের লোকদের পথ দেখাবার জন্য আহমেদ খানের ভাড়া করা দুই বালুচি উপজাতি তার সামনে রয়েছে, যারা একটু আগেই তাকে আশ্বস্ত করেছে যে যাত্রা পথের অর্ধেক দূরত্ব তারা প্রায় অতিক্রম করে এসেছে এবং বরফাবৃত বোলান গিরিপথ দিয়ে নীচের দিকে নামছে, কান্দাহার থেকে খুব বেশী হলে একশ ত্রিশ মাইল দূরে। পথ প্রদর্শক দুজন সম্ভবত প্রশংসা শুনবে বলে আশা করেছিল কিন্তু তুষারপাত এবং পায়ের নীচের বরফের স্তর পুরু হবার সাথে সাথে হুমায়ুনের মনে হয়েছে অগ্রসর হবার গতি যন্ত্রণাদায়কভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে। কিন্তু নিদেনপক্ষে তার অভীষ্ট লক্ষ্য- বিশ বছর পূর্বে মোগলদের জন্য স্বয়ং বাবরের দখল করা সেই বিশেষ শহর- কিছুক্ষণের ভিতরেই দৃষ্টিপটে ভেসে উঠবে।

হামিদা আর গুলবদন, তাঁদের পরণের পুরু উলের গাউনের উপরে ফারের আবরণ দেয়া বিপুলাকৃতি মস্তকাবরনীযুক্ত আলখাল্লা পরিহিত, টাটু ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। সংকীর্ণ, পিচ্ছিল পথে ষাড়ের দল চলাচলে একেবারেই অনুপযোগী হওয়ায় অনেকদিন আগেই তাদের জবাই করা হয়েছে এবং তাঁদের টানা মালবাহী শকটগুলোকে টুকরো করে জ্বালানী কাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মাহাম আগা- আকবর আর তাঁর নিজের পুত্র সন্তানকে নিয়ে, দুজনই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য.গরম কাপড়ের ফালি দিয়ে বেশ পুরু করে জড়ান- উটের পিঠের দুপাশে ঝুলন্ত ঝুরির একটায় রয়েছে ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্য ঝুরিটায় জয়নাব রান্না করার সামান্য কিছু সরঞ্জাম নিয়ে ঝুলে আছে। বরফাবৃত পথ এতোটাই বিপদসঙ্কুল যে তিনটা প্রাণীকে নিরাপদে পথ দেখিয়ে আনতে হুমায়ুন তার লোকদের পায়ে হাঁটতে আদেশ দিয়েছে। কিন্তু এই তাপমাত্রায় উটকেও কেমন যেন কাবু মনে হয়, মাথা নীচু করে পা টেনে টেনে হাঁটছে, তাঁর দেহের পুরু পশমের উপরে সূচাগ্র বরফের স্ফটিক জমতে শুরু করেছে।

তাদের পেছনেই দেহরক্ষীর দল রয়েছে তারপরেই গুটিকয়েক ভারবাহী প্রাণীর একটা দল- পিঠে চাপান বোঝার ভাবে হাঁসফাঁস করতে থাকা কয়েকটা উট এবং খচ্চর- এবং একেবারে শেষে তার বাকী লোকেরা, প্রত্যেকের ঘোড়ার পিঠের দুপাশে পেটমোটা ব্যাগ ঝুলছে, ঢাল পিঠের সাথে শক্ত করে আটকানো আর রণকুঠার এবং গাদাবন্দুকগুলো পর্যাণের সাথে শক্ত করে বাঁধা। তার মতো, তাঁদের মুখের নিম্নাংশ মুখ ঢাকার কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং হাড় কাঁপান তুষারের চাবুক মুখে হন্যে হয়ে উঠা বাতাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাঁদের ঘাড়ের উপরে মাথাগুলো নীচু করে রাখা। আজ রাতে, তাঁর মতো তারাও, একটা বুড়ো খচ্চরের মাংস দিয়ে আহার করবে বেচারা তাঁর পিঠের বোঝর নীচে লুটিয়ে পড়েছিল, যা খামির-বিহীন রুটি, বার্লি বা চালের তৈরী জাউয়ের একঘেয়ে খাবারের তালিকায় তাদের জন্য কিছুটা হলেও বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে।

হুমায়ুন ভেবে দেখে- একজন সম্রাটের সেনাবাহিনীর চেয়ে তার আব্বাজানের আক্রমণকারী দলের সাথেই তাঁদের মিল বেশী- বর্ণিল পোষাক পরিহিত একটা বিচিত্র কাফেলা। এই বরফাচ্ছন্ন বিরান প্রান্তরের ভিতর দিয়ে নিজের খুদে বাহিনীটাকে পা টেনে টেনে হাঁটতে দেখার দৃশ্যটা চাবুকের তীব্র কশাঘাতের মতো তাঁর কতটা অধঃপতন হয়েছে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একই রকম যন্ত্রণাদগ্ধ ব্যাপার যে সে এখন সিন্ধুনদ অতিক্রম করেছে, বেলুচিস্ত স্থানের পাহাড়ে আরোহনের জন্য তারমানে এই মুহূর্তে হিন্দুস্তানে বাবরের চারপুত্রের একজনও নেই। ব্যাপারটা এমন যেন বাবরের অভিযান কখনও ঘটেনি এবং সম্ভবত সে, যদিও আগে কখনও সে বিষয়টা স্বীকার করেনি। বাবরের প্রিয়তম এবং প্রশ্রয়প্রাপ্ত সন্তান নিশ্চয়ই এজন্য কিছুটা হলেও দোষী। নিজের পরিবারের ভিতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে সৃষ্ট বিপদের মাত্রা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা সে আগে বুঝতে পারেনি। বিশেষ করে কামরানের বৈরীতার গভীরতাকে সে ছোট করে দেখেছিল। অনেক দেরী হয়ে যাবার পরে সে বুঝতে পেরেছে যে কামরান নিজের উচ্চাকাঙ্খ ত্যাগ করে তাঁকে মোগল সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখার চেয়ে মোগলদের পতন দেখতেই পছন্দ করবে।

হুমায়ুনের ঘোড়াটা বরফে পিছলে গিয়ে হোঁচট খেতে কল্পলোক থেকে এক ঝটকায় তাকে বাস্তবে নিয়ে আসে। সে পর্যাণের উপরে নিজের পুরো ওজন পিছনের দিকে দিয়ে চেষ্টা জন্তুটাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করতে এবং ফিসফিস করে অভয়বাণী বলতে থাকলে, নাক দিয়ে সজোরে নিঃশ্বাসের সাথে কুয়াশার কুণ্ডলী নির্গত করে, বেচারা কোনোমতে চারপায়ের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে মনে মনে ভাবে এইসব পাহাড়ের আড়াল থেকে বের হতে পারলে তার চেয়ে খুশী আর কেউ হবে না, এবং কনকনে বাতাসের ঢেউ তাঁর দিকে ধেয়ে আসলে কাঁধের উপরে মাথাটা আরো ঝুঁকিয়ে আনে। তাঁর ভাবনায় কিছুক্ষণের ভিতরেই তাঁর সৎ-ভাইয়েরা এসে উঁকি দেয় তুষারের মাঝে অবিশ্রান্ত পথ চলার এই দিনগুলোতে যা তারা প্রায়ই করে থাকে, এইবার এসেছে হিন্দাল। সে এখন যখন বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পায়, অনুধাবন করে দারুণ কৌশলে কান্দাহার দখল করায় সে তাঁর সবচেয়ে ছোট এই সৎ-ভাইটির প্রতি ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে বরং কামরান আর আসকারির হাতে তার নিরাপত্তা নিয়েই বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। সে যদিও উৎকণ্ঠিত গুলবদনকে আশ্বস্ত করেছে যে তাঁরা তাঁর ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করবে না, সে নিজে ততটা নিশ্চিত নয়। একজন প্রতিদ্বন্দ্বিকে ক্ষমতার পথ থেকে সরিয়ে দেবার এমন সুযোগ কামরান অন্তত খুশী মনে গ্রহণ করবে।

দূর থেকে একটা ভৌতিক, বিষণ্ণ গর্জন, যা একে বয়ে আনা বাতাসের মতোই হাড় কাঁপানো, আতঙ্কে হুমায়ুনের ঘোড়াটাকে অস্থির করে তুলে। এইসব বিরান, জনমানবহীন পাহাড়গুলোয় নেকড়ের পাল গিজগিজ করছে। রাতের বেলা তারা কখনও কখনও তাদের শিবিরের এতটাই কাছে চলে আসে যে অন্ধকারে হুমায়ুন তাদের হলুদ সরু চোখ জ্বলজ্বল করতে এবং সকালবেলা তাদের তাবুর চারপাশে পায়ের ছাপের একটা আল্পনা আঁকা থাকতে দেখেছে। তুষারপাত এখন আরও প্রবল হয়েছে এবং সামনের খাড়া পথটা উড়ন্ত তুষারকণায় অবগুণ্ঠিত হয়ে আছে।

আহমেদ খান, হুমায়ুন তার কাঁধের উপর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ডাকে।

জ্বি, সুলতান?

এখনই তুষারঝড় শুরু হবে। আজ রাতের মতো আমরা এখানেই শিবির। স্থাপন করবো। পাহাড়ের গায়ের ঐ পাথুরে অভিক্ষেপটার নীচে আমরা খানিকটা হলেও আড়াল পাবো। হুমায়ুন বায়ু প্রবাহের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকা ধুসর রঙের পাথরের একটা অতিকায় খণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে যা বাতাসের আর তুষারের যুগলবন্দি অনেকটাই সেটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, এবং তাদের তাবুর জন্য অভিক্ষেপের নীচে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে বলে মনে হয়।

হুমায়ুনের লোকেরা ঘোড়ার পেছনের পায়ে ফাঁস বেধে দেয় এবং তাবুর সাজসরঞ্জাম বের করে, অভিক্ষেপের নীচে তাবু টাঙানো শুরু করে। এখনও যদিও দিনের আলো রয়েছে, ধুসর আন্তরিকতায় তুষারপাত শুরু হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে আলোর রেশ কমে আসছে। দুজন লোক বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে কুঁজো হয়ে বসে এবং তাঁদের সাথের চকমকি পাথর আর ইস্পাতের বাক্স থেকে শীতে অসাড় হয়ে থাকা আঙ্গুলের সাহায্যে একটা খচ্চরের পিঠে বয়ে আনা শুকনো লতাগুল্মের খানিকটা নিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে চেষ্টা করে। লতাগুল্মে ভালোমতো আগুন জ্বলে উঠার সাথে সাথে, তাঁরা তেলে ভেজান কাপড় দিয়ে বিশাল একটা মশাল জ্বেলে নিয়ে সেটাকে একটা লম্বা লাঠির অগ্রভাগে ভালোমতো জড়ায় এবং হুমায়ুনের তাবুর বাইরে লাঠিটা এনে পুতে দেয়।

তাঁরা কাছেই একটা ধাতব পাত্র রেখে সেটাতে ভাক্কার থেকে নিয়ে আসা এই মুহূর্তে সোনার চেয়েও দামী কাঠকয়লা দিয়ে ভর্তি করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়- হুমায়ুন বা হামিদার জন্য না বরং আকবরের জন্য সেই রাতে তাবুতে সেও তাঁদের সাথে থাকবে। হামিদা চারপাশের বুনো প্রান্তরের কারণে অনুরোধ করেছে যে তাঁর সন্তান রাতে যেন তাঁর কাছেই ঘুমায়। মাহাম আগা যাত্রাকালীন পূর্ববর্তী রাতগুলোর মতোই তাঁর ছেলের সাথে ঘোড়ার পিঠে বিছাবার কম্বল দিয়ে তাবুর একাংশ পরিবেষ্টিত করে সেখানেই ঘুমাবে। হুমায়ুন তাঁর শিবিরের বাকি অংশ পরিদর্শনের সময় লক্ষ্য করে যে তার লোকেরা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাবু স্থাপন করেছে। তাঁরা গাদাগাদি করে ঘুমাবে, নিজেদের শরীর উষ্ণ রাখতে অন্যের দেহের উষ্ণতা ব্যবহার করবে।

সুলতান, একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আহমেদ খান এসেছে, মাথার মস্তকাবরনী বরফে সাদা হয়ে রয়েছে। জাহিদ বেগ আর আমি শিবিরের চারপাশে প্রহরী মোতায়েন করছি। আপনার দেহরক্ষীদের ভিতর থেকে চারজন আপনার তাবুর বাইরে পাহারায় থাকবে।

হুমায়ুন নিজের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে। ক্রমশ জোরাল হতে থাকা বাতাসের প্রকোপে ঘুরপাক খেতে থাকা তুষার এখন এতোই ঘন যে সে তাঁর সেনাপতির মুখই ঠিকমতো দেখতে পায় না। গত রাতে পাহারায় নিয়োজিত লোকদের একজন হিম-দংশের শিকার হয়েছে এবং হেকিম আশঙ্কা করছেন লোকটার কালো হয়ে থাকা পায়ের আঙ্গুলগুলো শেষ পর্যন্ত হয়তো কেটে ফেলতে হবে। আহমেদ খান নিজেও গতকাল মাঝরাতে প্রহরীদের পরিদর্শন করতে গিয়ে সর্দি-কাঁপুনির সংক্রমনের ফলে আজ সারাদিন কাশির দমকে অস্থির ছিলেন। আপনাকে ধন্যবাদ, আহমেদ খান কিন্তু আমার মনে হয়

এই বুনো প্রান্তরে আমাদের চিন্তিত হবার কোনো কারণ রয়েছে। পথের ধকলে সবাই ক্লান্ত আর শীতও বেশ জাকিয়ে পড়েছে। আজ রাতে সবাইকে বিশ্রাম নিতে দেন। আপনিও বাদ যাবেন না। আপনার কাশি হয়তো তাহলে খানিকটা প্রশমিত হতে পারে।

শিবিরের চারপাশে দমকা বাতাসের গর্জন আর তার তাবুর গায়ে এসে হামলে পড়া সত্ত্বেও, সেই রাতে হামিদাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শোয়ার সাথে সাথে হুমায়ুন ঘুমিয়ে যায়, তাদের দুজনকে ভেড়ার যে চামড়াটা ঢেকে রেখেছে সেটার উপরে হামিদার ফারের আবরন দেয়া আলখাল্লাটা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আকবরের চকিত কান্নার শব্দ তাঁর স্বপ্নে আলোড়ন তুলেই আবার হারিয়ে যায়। হুমায়ুন হামিদার কাছে সরে আসে, নিজের দেহের কাছে তার উষ্ণ পেলব দেহটা টেনে এনে সে নিদ্রার অতলে আবার তলিয়ে যায়। তারপরে সহসাই সে নিজের গলায় শীতল, ধারাল ইস্পাতের স্পর্শ অনুভব করে। সে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে পরিচিত একজোড়া চোখ, কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরী মশালের আলোয় জ্বলজ্বল করছে, আরেকজন লোক মশালটা ধরে রয়েছে। এটা হতে পারে না- বরফাবৃত গিরিপথের শেষে অনেক দূরে অবস্থিত কান্দাহারে তাঁর থাকার কথা। কিন্তু বাজপাখির মতো সরু নাকের উপরে অবস্থিত- তাঁদের আব্বাজানের চোখের মতোই সবুজ- বিজয়োন্মত্ত ঐ চোখ কোনভাবেই আর কারো হতে পারে না। কামরান!

হুমায়ুন সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে মুখটা মাত্র খুলতে যাবে কিন্তু কামরানের খঞ্জরের অগ্রভাগ তাঁর গলায় খোঁচা দিচ্ছে টের পায় এবং এক ফোঁটা রক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। বিছানার পাশেই ছায়ার ভিতরে সে আরো কয়েকটি অবয়বকে আবছাভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সম্ভবত কামরানের হুকুমবরদার, উদ্যত অস্ত্র হাতে নিরবে তাকিয়ে রয়েছে।

একটা শব্দ করো আমি তাহলে খুশী মনে তোমার গলাটা দুভাগ করে দেবো, কামরান বলে। তুমি জানো কাজটা করতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না।

কামরান ফিসফিস করে কথা বলার সময়, তার আওয়াজে হামিদা জেগে উঠে, সে ঘুমঘুম চোখে মুখের উপর থেকে নিজের কালো চুল সরিয়ে দেয়। সে পুরোপুরি চোখ খুলতে, হুমায়ুন তাকে আশ্বস্ত করতে তাঁর বাহুর উপরে আলতো করে একটা হাত রাখে। চারপাশে কি ঘটছে বুঝতে পেরে হামিদা চিৎকার করে না বা কাঁদে না কিন্তু তার পাশেই একটা দোলনায় শুয়ে থাকা আকবরের দিকে তাকায়।

ভাইজান, তুমি অসতর্ক ছিলে। এতো সহজে আমি তোমার তাবুতে প্রবেশ করতে পারবো কখনও চিন্তা করিনি, কামরান বলে। গত কয়েকদিন ধরেই আমার লোকেরা তোমার গতিবিধির উপরে নজর রাখছিলো। তুষারঝড় আমাকে সুযোগটা করে দিয়েছে। কাবুলের চারপাশে অবস্থিত পার্বত্য এলাকায় আমাদের আব্বাজান কি শিখিয়েছিলেন, তুমি নিশ্চয়ই সেটা ভুলে গিয়েছো- তুষার কিভাবে হানাদারের বন্ধু, কিভাবে সে শব্দের কণ্ঠরোধ করে। তোমার লোকেরা কোনো শব্দই টের পায়নি। আমরা তাদের তাবুর ভিতরে অবোধ পশুর মতো গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা অবস্থায় খুঁজে পেয়েছি।

তাদের আর মেয়েদের সাথে তুমি কি করেছো?

কামরান কোনো উত্তর দেয় না, কেবল হাসে।

আমি এই পথ দিয়ে আসছি, তুমি কিভাবে জানতে পারলে?

আমি ধারণা করেছিলাম যে একটা সময়ে তুমি উত্তরে আসতে চেষ্টা করবে। আমি গত কয়েকমাস হিন্দুস্তান থেকে বের হবার সবগুলো পথের দিকে নজর রেখে আসছি।

আসকারি কোথায়?

সে কাবুলে রয়েছে।

আর হিন্দাল, তাঁর সাথে তুমি কি করেছো?

আমি তাঁকে হত্যা করিনি, যদি এটাই তুমি বোঝাতে চাও। আমাকে অসম্মান করার জন্য জালালাবাদে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

আমার সাথে তুমি যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নিজের রক্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শেরশাহের সাথে মৈত্রীর প্রস্তাব দিয়ে তারপরে অসম্মান নিয়ে কথা বলতে তোমার রুচিতে বাধে না? কাবুলে চোরের মতো নিঃশব্দে এসে হাজির হয়েছে?

কাউকে সমালোচনা করার মতো অবস্থানে তুমি নেই। তোমার পাশে যে সুন্দরী শুয়ে রয়েছে- আমি যতদূর শুনেছি তাকে তুমি হিন্দালের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কামরান বিপজ্জনক ভঙ্গিতে হামিদার দিকে ঝুঁকে আসে। কিন্তু তাঁকে দেখে এখন আমি বুঝতে পারছি ছিনিয়ে নেয়ার মতোই একটা মেয়ে বটে। আমিও চাই না ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেম, কিংবা আনুগত্য আমার পথরোধ করে দাঁড়াক।

হুমায়ুন টের পায় উত্তেজনায় হামিদার স্নায়ু টানটান হয়ে আছে এবং সে আরো জোরে তাঁর বাহু চেপে ধরে। কামরান, তুমি কি চাও? তুমি যদি আমাকে হত্যা করতে চাইতে এতক্ষণে তাহলে আমার কবন্ধ দেহটা মাটিতে পড়ে থাকতো।

সত্যি বলেছো। রক্তের বন্ধন আর ভ্রাতৃপ্রতিম ভালোবাসা নিয়ে আমার ভিতরে তোমার মতো কোনো আবেগ কাজ করে না। আমার কাছে, বিষয়টা সবসময়েই ছিল তকতা তখত- সিংহাসন কিংবা শবাধার।

তাই যদি হয় তাহলে তুমি কালক্ষেপন করছো কেন?

আমার তরবারির ফলায় তোমার শ্বাসনালী কেবল একটা কারণেই আমি দ্বিখণ্ডিত করিনি- যদিও আমার হাত নিশপিশ করছিল- সেটা হল তোমায় হত্যা করলে আমাদের বংশে একটা রক্তাক্ত সংঘাত শুরু হবে। কিন্তু তোমাকে পরাজিত করতে এবং তোমার সাথে ক্ষমাসুলভ আচরণ করতে যদি আমায় দেখে, তোমার প্রতি অনুগত গোত্ৰপতিরা তাহলে আমাকে তাদের সমর্থন জানাবে। মৃত্যুর চেয়ে বরং নিগৃহীত অবস্থায় বেঁচে থেকেই তুমি আমার অনেকবেশী উপকার করবে।

তাহলে তোমার অভিপ্রায় এখন কি?

তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে আমাদের পিতৃপুরুষের জন্মভূমি এবং হিন্দুস্তান তুমি ত্যাগ করবে এবং এতোটাই দূরে যাবে যে আমি যেন ভুলে যেতে পারি যে তোমার কখনও অস্তিত্ব ছিল।

কোথায় যাবো?

পারস্যের আবহাওয়া শুনেছি চমৎকার এবং সেখানকার বিলাসবহুল জীবনযাপন পদ্ধতি তোমার পছন্দই হবে- সুন্দরী রমণী আর আফিমের অফুরান জোগান।

এবং আমি যদি যেতে অস্বীকার করি?

আমি তাহলে এখানে এখনই তোমায় হত্যা করবো এবং একাই গোত্রপতিদের ঝামেলার মুখোমুখি হব। আমার হাতে তোমার উষ্ণ রক্তের অনুভূতি আমি উপভোগই করবো।

আমি একটা বিষয় এখনও বুঝতে পারিনা তুমি আমায় কেন এতো ঘৃণা করো। আমাদের আব্বাজান আমাকে উত্তরসূরী নির্বাচিত করেছেন এটা আমার দোষ না।

সেটা তোমার দোষ না? তোমার কারণেই তিনি কদাচিৎ আমাকে নিয়ে চিন্তা করেছেন। একজন পূর্ণাঙ্গ যোদ্ধার ভূমিকায়, তিনি যা অর্জন করার আশা করেছিলেন তাঁর উজ্জ্বল স্মারক হিসাবে, তুমি দারুণ অভিনয় করেছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই আমি নিজের সম্বন্ধে তোমার দর্পোদ্ধত আত্মগর্ব ঘৃণা করেছি এবং তুমি ধরেই নিয়েছিল আমি মুগ্ধ চিত্তে তোমায় খুশী মনে অনুসরণ করছি। আমরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাম, তুমি ধরে নিলে তখনও তুমি আমায় তোমার অধস্তনের মতো পৃষ্ঠপোষকতা করবে…কিন্তু আমারও যে তোমার মতোই প্রবল উচ্চাশা… রক্ত আর ঘাম ঝরিয়ে আমাদের আব্বাজানের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য আমার চাই এবং বাবরের যে কোনো সন্তানের চেয়ে আমি অনেকবেশী যোগ্য। আসকারি ইতিমধ্যে সেটা মেনেও নিয়েছে এবং আমি যা বলবো সেটাই করবে। হিন্দালের ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে তাহলে সেও দ্রুত আদেশ পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আমি যখন প্রস্তুত হব তখন আমি শের শাহের মুখোমুখি হবে আর তাকে আমাদের সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত করবো। আগ্রা আর দিল্লীতে আমার নামে খুতবা পাঠ করা হবে এবং আমি আর আমার সন্তানেরা- তোমার সন্তানেরা নয়- মোগল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবে। তুমি তোমার সুযোগ পেয়েছিলে এবং ব্যর্থ হয়েছে।

তোমার স্বভাব সম্বন্ধে আমাদের আব্বাজান ভালোই অবহিত ছিলেন যে তুমি একাধারে আত্মকেন্দ্রিক, শঠ, এবং সেইসাথে আমার শত্রু… যে তুমি একটা বিশ্বাসঘাতক… তিনি আমাকে সতর্ক করতে চেষ্টা করেছিলেন।

খামোশ শয়তান, কামরানের কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ে যায় এবং আকবর কাঁদতে শুরু করে।

তোমার ছেলের গলা দেখছি জোরাল এবং প্রাণবন্ত, হামিদার পাশে রাখা দোলনার দিকে তাকিয়ে কামরানের চোখের সবুজ মণি জুলজুল করে উঠে। আমার ভান্তেকে আমায় দেখতে দাও, হামিদার দিকে তাকিয়ে সে আদেশের সুরে বলে।

হুমায়ুনের দিকে বেচারী উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকালে, সে মাথা নাড়ে। হামিদা পরণের আলখাল্লাটা ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে, বিছানা থেকে নামে এবং দোলনা থেকে আকবরকে কোলে তুলে নিয়ে ধীর পায়ে তাঁকে কামরানের কাছে নিয়ে যায়।

আমার ভাইয়ের দিকে লক্ষ্য রাখো। সে যদি চোখের পলকও ফেলে তাঁকে খুন করবে, কামরান তার লোকদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলতে, আঁধারের ভিতর থেকে তিনজন বের হয়ে এসে হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে যায়। কামরান ইতিমধ্যে হুমায়ুনের গলা থেকে খঞ্জরের ফলা সরিয়ে নিয়ে, সেটাকে খাপের ভিতর ঢুকিয়ে রাখে এবং হামিদার দিকে এগিয়ে যায়।

হুমায়ুন তার ভাই এবং তার লোকজনের সাথে নিজের দূরত্ব বিবেচনা করে আর ভাবে, আকবর আর হামিদা যদি এই মুহূর্তে তার সাথে কেবল না থাকতো সে তাহলে অনায়াসে কামরানকে ধরাশায়ী করতে পারতো। হুমায়ুন খুব ভালো করেই জানে কামরানের লোকেরা তীর কিংবা খঞ্জর নিক্ষেপ করার আগেই সে লাফিয়ে উঠে তাকে জাপটে ধরে বর্ম হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সে যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবেই থাকে কিছুই করতে পারে না কেবল তাকিয়ে দেখে, আকবরকে ভেড়ার পুরু যে চামড়াটা দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছিল কামরান সেটা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দেয় এবং তার্তস্বরে কাঁদতে থাকা খুদে মুখটার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়।

বেটাকে আমার কোলে দাও।

হামিদা আবারও হুমায়ুনের দিকে তাকায় এবং আবার সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

আকবরকে কামরান কোলে নিতে, সে বোধহয় পরিবর্তনটা পছন্দই করে এবং সহসা কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে যায়। কামরান খুব দ্রুত আকবরকে খুঁটিয়ে দেখে। বেশ, হুমায়ুন, আমার প্রস্তাব মেনে নিতে কি তুমি রাজি? কামরান কথা বলার মাঝেই আকবরের ছোট ছোট হাতগুলোর একটা আলতো করে ধরে, কিন্তু বিছানার অপরপাশে শুয়ে থাকা হুমায়ুনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চোখের তারায় কোনো ভাব খেলা করে না যেন সে মাংসের একটা দলা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

আমি তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি, কারণ মেনে নেয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো। একদিন আমি তোমাকে তোমার আজকের এই কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তি দেবো।

তোমার উত্তরাধিকারী আমার হাতে খেলা করছে, মনে রেখো। আমাকে যদি আরো প্ররোচিত করো, আমি তাহলে আমার লোকদের আদেশ দেবো একে বাইরে নিয়ে গিয়ে খালি গায়ে বরফের উপরে যেন শুইয়ে দেয়। নেকড়ে বা শীতের কবল থেকে তোমার কি মনে হয় কতক্ষণ সে বেঁচে থাকতে পারবে?

হামিদা আতঁকে উঠে জোরে শ্বাস নেয় এবং হুমায়ুন অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখে হাস্যরত আকবরের থুতনির নীচে কামরান খেলাছলে নেড়ে দেয়।

শেষ কোনো কথা, আমার সুবক্তা সৎ-ভাই, এমনকি কোনো বিদায় সম্ভাষণ উচ্চারিত হবে না। তোমার মতো একজন মহান সম্রাটের পক্ষে এটা মানানসই না, এতটা সৌজন্যহীনতা। দুই ভাই পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিন্তু হুমায়ুন দাঁতে দাঁত চেপে রেখে নিজেকে নির্বাক রাখে। কামরান উদ্ধত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাবুর প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায়, আকবর তখনও তার কোলেই রয়েছে।

আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও! হামিদা এবার চিৎকার করে উঠে।

কামরান তার দিকে ঘুরে তাকায়। হুমায়ুনকে আমি এক কানা কড়ি দিয়েও বিশ্বাস করি না, যতই সে বুক ফুলিয়ে বড়াই করুক না কেন যে সে কথা দিয়ে কথা রাখে। সে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেইমতো সে কাজ করবে এবং পারস্যে যাবে, সেজন্য জামিন হিসাবে আমার একটা কিছু প্রয়োজন। আমার প্রিয় ভাস্তে হবে সেই জামিন…।

কামরান তার কথা শেষ করার আগেই হামিদা বাঘিনীর দ্রুততায় তাঁকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আকবরকে টেনে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। আকরব পুনরায় তার্তস্বরে কাঁদতে শুরু করলে, কামরান জোরে একটা ধাক্কা দেয় হামিদাকে। হামিদা ছিটকে পেছনের দিকে উল্টে পরার সময় একটা কাঠের সিন্দুকের কোণের সাথে তাঁর মাথা ধাক্কা খায়। কারমরা তাঁর এক লোকের হাতে আকবরকে তুলে দেয়। আমার ভান্তেকে বাইরে নিয়ে যাও, সে তাকে আদেশ দেয়।

কিন্তু হামিদার তখনও কামরানের সাথে বোঝাঁপড়া শেষ হয়নি। মাথায় বেমক্কা আঘাত পাওয়ায় খানিকটা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে সে হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজেকে পুনরায় কামরানের উপরে আছড়ে ফেলে, তার হাতের নখ বেচারার মুখে আচড় কেটে বসে যায় এবং রক্ত বের হয়ে আসে। কামরান হামিদার দুকাঁধ শক্ত করে ধরে এবং এক ধাক্কায় তাঁকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কি লজ্জার কথা। তোমার এই লড়াকু মনোভাবের জন্য তোমার স্বামীর মতো অপদার্থ সম্রাটের চেয়ে তুমি অনেক দক্ষ একজন সম্রাজ্ঞী হতে পারতে।

এইসব হট্টগোলের মাঝে তাবুর পর্দা-বেষ্টিত অংশের পেছনে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘকায়া মাহাম আগা পর্দার পেছন থেকে বের হয়ে আসে। ঘটনার আকষ্মিকতা আর বিভ্রান্তির কারণে মাহামের কথা হুমায়ুনের মনেই ছিল না। কামরানও একই রকম চমকে গিয়ে, হামিদাকে ছেড়ে দেয় এবং কোমর থেকে ছোরা বের করে। তুমি আবার কে? কামরানের গালে হামিদা যেখানে আচড় দিয়েছে সেখান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে।

মাহাম আগা কামরানকে পাত্তাই দেয় না, সে সরাসরি হামিদার দিকে তাকিয়ে কথা বলে। রাজমাতা, আমি সবকিছু শুনেছি। আকবরের দুধ-মা হবার কারণে আমাকে অবশ্যই তার সাথে থাকতে হবে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে আপনাকে বলছি যে নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি তাকে রক্ষা করবো। তাঁর চোখের নিম্নাংশের চওড়া হাড়যুক্ত, সুদর্শন মুখাবয়বে একটা একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটে উঠে।

হামিদার চোখের অশ্রু টলটল করে কিন্তু কামরানের দিকে ঘুরে দাঁড়াবার অবসরে সে নিজেকে সংযত করে। আমার ছেলের দুধ-মা, ওর নাম মাহাম আগা। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি আমার সন্তানের যত্ন নেবার জন্য তুমি তাঁকে সাথে করে নিয়ে যাবে।

সে চাইলে আসতে পারে। কামরান আবার হুমায়ুনের দিকে তাকায়। তোমার যোদ্ধাদের চেয়ে দেখছি তোমার রমণীরা অনেক বেশী সাহসী। ঘুমন্ত অবস্থায় তোমার লোকদের আমরা বন্দি করেছি। বাজারে বিক্রি করার জন্য মুরগী যেভাবে বেঁধে রাখা হয় তাবুর ভিতরে তাঁদের সেভাবেই বেধে রাখা হয়েছে। আজ রাতে রক্তপাত যা হয়েছে, সেটা তোমার স্ত্রীর কারণেই হয়েছে। মাহাম আগা কিছু নেবার থাকলে দ্রুত গুছিয়ে নাও। আমরা পাঁচ মিনিটের ভিতরে রওয়ানা হব। আর একটা কথা না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে তাবু থেকে বের হয়ে যায়।

দুই রমণী শেষবারের মতো আলিঙ্গণ করার সময়ে, হুমায়ুন দেখে মাহাম আগা হামিদার কানে কিছু একটা বলছে। তারপরে, কামরানে যোদ্ধাদের কড়া দৃষ্টির সামনে দুধ-মা দ্রুত তার সন্তানকে কোলে তুলে নেয় এবং আকবর আর তার নিজের যৎসামান্য জিনিষপত্র আরেক হাতে নিয়ে প্রহরাধীন অবস্থায় তাবু। থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই হুমায়ুন আর হামিদা বাইরে থেকে তুষারের উপরে ঘোড়ার খুরের চাপা আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে এবং তারপরে সব আবার আগের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। হুমায়ুন এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে বাইরে যায়। তুষার ঝড় শেষ হয়েছে এবং বাইরের রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি অনেকটাই মোলায়েম হয়ে উঠেছে বরফাবৃত হয়ে। এতোটাই স্থির আর অকপট যে প্রায় নিখুঁত সৌন্দর্যমণ্ডিত একটা দৃশ্যপট।

৩.১ কোহ-ই-নূর বিসর্জন – তৃতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব – কোহই-নূর বিসর্জন

১৫. শাহ তামাস্প

সেদিন সকালবেলা, বরফের ভিতরে হুমায়ুন তার লোকদের নিজের চারপাশে জড়ো করে, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে তাঁদের নিঃশ্বাস কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। তার লোকদের কেউই মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। তারা হামলার সম্মুখীন হয়েছে এটা বোঝার আগেই চামড়ার ফিতে দিয়ে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু হুমায়ুনের মতোই তাঁদের সবার মেজাজই বিগড়ে রয়েছে এবং সে বুঝতে পারে কেন- তাদের যোদ্ধার সংহিতা লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রত্যেক মানুষই, নিজের অন্তরের অন্তস্থলে লড়াইয়ের একটা সুযোগ প্রত্যাশা করে। তরবারির ফলায় আহত হবার চেয়ে শত্রুর হাতে বেকায়দায় ধরা পড়ার লজ্জা অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক। ক্ষতচিহ্ন নিদেনপক্ষে সম্মানের একটা স্মারকচিহ্ন বটে। তাবুর ভিতরে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ার মাঝে গৌরব কোথায়?

গতরাতে যা ঘটেছে তার জন্য তোমাদের কেউ দায়ী নয়। প্রহরী মোতায়েন না করার সিদ্ধান্ত আমিই নিয়েছিলাম।

আমরা কি ঘোড়া নিয়ে তাঁদের পিছু নেব? জাহিদ বেগ জানতে চায়।

না।

কিন্তু, সুলতান কেন? আমাদের চেয়ে বড়জোর এক কি দুই ঘন্টার পথ তারা এগিয়ে আছে…

জাহিদ বেগ, আমি কথা দিয়েছি, এবং কামরানের কথার দাম না থাকতে পারে কিন্তু আমার কথার মূল্য আছে। তাছাড়া, সে আমার সন্তানকে বন্দি করেছে। সে হুমকি দিয়ে গিয়েছে আকবরকে আমার চোখের সামনে হত্যা করবে এবং আমি বিশ্বাস করি সে সেটা করতে পারবে।

কিন্তু তৈমূর বংশীয় নবজাত যুবরাজদের জীবন পবিত্র বলে গন্য করা হয়। আমরা সবসময়ে সেটা মেনে এসেছি…।

কিন্তু আমার সৎ-ভাইয়ের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। উচ্চাশা তাকে অন্ধ করে ফেলেছে এবং তা গৌরবময় স্বপ্ন সত্য করার পথে সে কোনো ধরনের বাধা বরদাস্ত করবে না। আমার সন্তানকে সে খুশী মনে হত্যা করবে যদি আমি তাকে সামান্যতম কোনো অজুহাতের সুযোগ দেই।

হুমায়ুন দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। গুলবদনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকা হামিদাকে কি কিছুক্ষণ আগেই সে একই কথা বলেনি, যাকে সে অন্য মেয়েদের সাথে মুখে কাপড় গোজা আর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে? গুলবদন যদিও ভীষণ ভয় পেয়েছিল, সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু হামিদাকে প্রশমিত করাতো সম্ভব হয়নি বরং মাঝে মাঝেই উন্মত্ত হয়ে উঠছে। আমাদের ছেলেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসো! হুমায়ুনকে উদ্দেশ্য করে সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করছে। তোমার ধমনীতে যদি মানুষের রক্ত বলে কিছু থাকে তাহলে অন্য কিছু করার কথা তুমি কিভাবে ভাবতে পারছো?

কিন্তু তাঁদের বিয়ের পর এই প্রথম হুমায়ুন হামিদাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। তার সৎ-ভাইয়ের সত্ত্বার ভেতরে অশুভ কিছু একটা ওত পেতে রয়েছে। আকবরের নিষ্পাপ মাথার উপর দিয়ে তারা দুই ভাই যখন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন সেটা সে ভালো করেই দেখতে পেয়েছে। কামরান যা চায় সেটা পাবার জন্য সে যে কোনোকিছু করতে প্রস্তুত… সেজন্যই হামিদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুমায়ুন তাকে বলে কামরানকে অনুসরণ করার কথা চিন্তা করাও তাদের উচিত হবে না। সে আলতো করে হামিদার চুলে বিলি কাঁতে কাঁতে তাকে বলেছে, মাহাম আগা অন্তত আকবরের সাথে রয়েছে এবং এই মুহূর্তে তার উপরে ভরসা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। ধীরে ধীরে প্রতিয়মান হয় যে যোগ্য ব্যক্তির উপরেই আস্থা রাখা হয়েছে। হামিদা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই তাকে বলে যে বিদায়ের আগ মুহূর্তে মাহাম ফিসফিস করে তার কানে কি বলেছিল যে তার কাছে একটা খঞ্জর রয়েছে যার ফলায় বিষ মাখান রয়েছে। আকবরের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে তাকে সেজন্য মৃত্যুবরণ করতে হবে।

নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে, হুমায়ুন তার লোকদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে থাকে। আমার প্রিয় সাথীরা, আমার অবশ্যই তোমাদের আরো কিছু সম্বন্ধে অবহিত করা উচিত। আমি আমার সৎ-ভাইকে আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে এই অঞ্চল ত্যাগ করে পারস্যে গমন করবো। আমার মনে হয় না সেখানে রাজত্বকারী শাহ। তামা আমাকে নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করবেন কিন্তু সেখানের উদ্দেশ্যে যাত্রাটা অনেক কষ্টসাধ্য হবে, রুক্ষ আর বরফাবৃত প্রান্তরের উপর দিয়ে কয়েকশ মাইল পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। যাত্রা শেষ হবার আগে আমাদের হয়ত এমন বিপদ আর বঞ্চনার মুখোমুখি হতে হবে যার কথা আমাদের কল্পনাতেও নেই। আমার অনুগামী হবার জন্য আমি তোমাদের আদেশ করছি না… তোমরা যদি দেশে ফিরে যেতে চাও, তাহলে সসম্মানে যেতে পারো…কিন্তু তোমরা যদি আমার সঙ্গী হও, আমি আমার মরহুম আব্বাজান বাবর আর আমার পূর্বপুরুষ তৈমূরের নামে শপথ করে বলছি যে, পারস্য গমনের প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করার পরে আমাদের সেখানে অবস্থানকাল খুবই সংক্ষিপ্ত হবে। অন্যায়ভাবে জবরদখল করা আমার প্রতি ইঞ্চি ভূমি আমি পুনরায় দখল করবো এবং আমার অনুগামী যারা হবে তারা আমার ইচকিরা- সেইসব গৌরবময় অভিযানের অংশীদার হবে যা নিয়ে একশ বছর পরেও তাঁদের বংশধরেরা গর্বের সাথে আলোচনা করবে।

হুমায়ুন কথা থামিয়ে চারপাশে তাকায়। তার লোকদের চোখ মুখের অভিব্যক্তি তাকে বলে দেয় যে তার কথাগুলো আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকা ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প- বিফলে যায়নি। যাই হোক এখনই তাঁকে ফেলে রেখে কেউ যাচ্ছে না। তাঁকে যে কোনো মূল্যেই তাঁদের এই বিশ্বাসের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।

*

চারপাশের পাহাড়ের হীরক-উজ্জ্বল শৃঙ্গসমূহ- রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা তুষার স্তম্ভের ন্যায়- দীপ্র প্রভায়, প্রায় মোহিনী সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। একমাস পরে, একটা সংকীর্ণ গিরিপথের ভিতর দিয়ে, যেটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে, হুমায়ুন তার সৈন্যসারির পুরোভাগে অবস্থান করে অগ্রসর হবার সময়ে চারপাশের দৃশ্যপট তাকে একেবারেই মোহিত করে না। বালুচ পথ প্রদর্শকদের, যারা পারস্যের সীমান্ত পর্যন্ত তাঁদের পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছে, পরামর্শ অনুসারে হুমায়ুন তার লোকদের যত কম সম্ভব আওয়াজ করার আদেশ দিয়েছে। তারপরেও, হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আড়াল তৈরী করে উপরের চিকচিক করতে থাকা তুষার আর বরফাবৃত প্রান্তরের দিকে সে যখন তাকায়, সে জানে- যেমন তারা প্রত্যেকেই জানে যে জানান না দিয়ে যেকোনো সময় তুষারধ্বস শুরু হয়ে তাঁদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।

বিপদ চারপাশে ওঁত পেতে রয়েছে। গতকালেরই কথা- সদ্য শেষ হওয়া তুষারপাতের কারণে ঢাকা পড়া হিমবাহের উপরিভাগের ফাটলে পড়ে আরেকটু হলেই তার একজন লোক মারা যেত। লোকটা যে খচ্চরটাকে টেনে নিয়ে আসছিলো সেটা তুষার শূন্যতায় উল্টে পড়ে কিন্তু নিয়তির এক অসাধারণ লীলাখেলার কারণে সে দশফিট নীচে একটা পাথুরে তাক আকড়ে ধরে কোনোমতে প্রাণ বাঁচায়। আহমেদ খানের দুই গুপ্তদূত দড়ির সাহায্যে পড়ে তাকে উপরে টেনে তুলে।

তাদের বেঁচে থাকার পথে প্রকৃতিই কেবল একমাত্র অন্তরায় নয়। এই বিরান, জনবসতিহীন অঞ্চলের ভিতর দিয়ে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ অতিক্রম করে না। দস্যুর দল- বালুচ পথ প্রদর্শকেরা যাদের নিষ্ফলা প্রান্তরের পিশাচ বলে, মাটিতে চরম বিতৃষ্ণায় থুতু ফেলে- এইসব উঁচু অঞ্চলেই বিচরণ করে থাকে। কেউ কেউ এমনও গল্প করে যে তারা নাকি মানুষের মাংস খেতেও দ্বিধা করে না। হুমায়ুনের অনেকবারই মনে হয়েছে উপরের তুষারাবৃত গিরিকরের মাঝে সে মানুষের আনাগোনা দেখতে পেয়েছে কিন্তু তারপরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে আর কিছুই তার নজরে পড়েনি। সে যাই হোক, আড়াল থেকে কেউ তাদের উপর নজর রাখছে এই অনুভূতিটা তাঁর যায়নি এবং সে জানে যে আহমেদ খানও একই ধরনের অস্বস্তিবোধ করছে। কামরানের মতো শঠ আর ধূর্ত লোকের পক্ষে- হুমায়ুনের সম্ভাব্য যাত্রাপথ এবং তার সাথে মাত্র দুইশজন লোক রয়েছে জানার পরে খুবই স্বাভাবিক তাকে আক্রমণ করার জন্য ডাকাতদের ঘুষ দেয়া। হুমায়ুনের মৃত্যু, যদি দেখান যায় যে অন্যদের হাতে হয়েছে, কামরানের জন্য সেটা অনেকবেশী সুবিধাজনক হবে। আবহাওয়ার পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন, প্রতিরাতে হুমায়ুন। প্রহরী মোতায়েন করে।

কিন্তু সে এটাও জানে যে তাঁদের ক্রমশ বেঁকে বসতে থাকা শারীরিক দূর্বলতা এই মুহূর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে কারণ দূর্বলতার পেছন পেছন আসে অসাবধানতা। তাঁদের রসদ- শস্যদানা, শুকনো ফল- সব প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গত তিন রাত খাবার বলতে একটা ছোট আগুনের উপরে শিরোস্রাণে ফোঁটান আঁশালে ঘোড়ার মাংস। অচিরেই তারা আর কোনো কিছু রান্না করতেও পারবে না। তাদের সাথে যা কাঠ আর কয়লা ছিল সব প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে।

হুমায়ুন ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠলে তার প্রতিটা হাড়ে যেন ব্যাথার একটা ঢেউ বয়ে যায়- সে তাঁর আব্বাজান বাবরের হিন্দু কুশ অতিক্রমের গল্প স্মরণ করে, কিভাবে উপর থেকে সহসা আছড়ে পড়া বরফ তার লোকদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, কিভাবে গভীর হিমবাহের মুখোমুখি হয়ে সে তার লোকেরা পর্যায়ক্রমে বরফ বিদীর্ণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সেটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বাবর কেবল দৃঢ়সংকল্প হয়ে সব বাধা অতিক্রম করেছে এবং তাকেও ঠিক তাই করতে হবে।

সেদিন অপরাহ্নে, আপাতদৃষ্টিতে তুষারধ্বস হবার সম্ভাবনা নেই এমন এক টুকরো জমিতে তারা যখন সেদিনের মতো অস্থায়ী শিবির স্থাপন করেছে, তীব্র শীতের ভেতরে বেঁচে থাকা সম্বন্ধে বাবরের গল্পগুলো হুমায়ুন অন্য আরেকটা কারণে স্মরণ করে। ভেড়ার চামড়ার পুরু আলখাল্লায় আবৃত, আহমেদ খান, কিনারাবিহীন পশমী বালুচ টুপি একেবারে চোখের উপর পর্যন্ত টেনে নামান এবং তাঁর পুরো মুখটা একটা গরম কাপড় দিয়ে এমনভাবে আড়াল করা রয়েছে যে কেবল তার হলুদাভ-খয়েরী চোখজোড়া দৃশ্যমান, হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে আসে, বরফের উপরে তাঁর পায়ের চামড়ার জুতোজোড়া কেবলই পিছলে যেতে চায়।

সুলতান, গত কয়েকরাত এতো তীব্র শীত পড়েছিল যে পাহারা দেবার দায়িত্ব পালন করার সময় আমার দুজন লোকের পায়ে মারাত্মক হিম-দংশ হয়েছে। আমাদের হেকিমসাহেব এই মুহূর্তে তাদের সাথে রয়েছে…

তিনি কি বলেছেন?

তিনি বলেছেন যে তাঁকে ব্যবচ্ছেদের সহায়তা নিতে হবে। একজনের কপাল ভালোই বলতে হবে তার তিনটা আঙ্গুল কেটে বাদ দিলেই হবে কিন্তু অন্যজনের পুরো পা কেটে ফেলতে হবে…

আমি দেখতে যাবো।

একটা ছোট তাবুর অভ্যন্তরে হেকিমসাহেব এবং দুই হতভাগ্য সৈন্য অবস্থান করছে যেখানে একটা ধাতব পাত্রে মিটমিট করে আগুন জ্বলছে। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে ছেঁড়া পাতলুন আর নগ্ন পা বের করে শুয়ে থাকা দুজনের একজন দারয়া। প্রাণবন্ত ছেলেটাকে ভীষণ ফ্যাকাশে দেখায়, সে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে হেকিমসাহেবকে আগুনের দুর্বল শিখায় তাঁর ছুরির ফলাটাকে জীবাণুমুক্ত করা দেখছে। আরেকটা চওড়া ফলা আগুনের ভেতরে ঠেসে রাখা হয়েছে- বোঝাই যায় ক্ষতস্থানে সংক্রমণ রোধ করতে জায়গাটা পুড়িয়ে দেবার জন্য সেটাকে গরম করে গনগনে-লাল করা হবে। হুমায়ুন দারয়ার পাশে আসনপিড়ি হয়ে বসে তার ডান পায়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। পা ফুলে কালো হয়ে রয়েছে এবং ফোলাটা গোড়ালীর অনেক উপরে ছড়িয়ে গিয়েছে আর অল্প যে কয়েকটা আঙ্গুলের নখ অবশিষ্ট রয়েছে তাঁর নীচ থেকে অশুভ-দুর্গন্ধযুক্ত সবুজাভ পুজ নির্গত হচ্ছে। হেকিমসাহেব কি তোমায় বলেছেন এই অবস্থায় তার কি করা উচিত? দারয়া মাথা নাড়ে কিন্তু হুমায়ুন তাঁর চোখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পায়। হিম্মত রাখো। হেকিমসাহেব খুবই দক্ষ। আল্লাহ সহায় থাকলে, এটা তোমার জীবন বাঁচিয়ে দেবে।

হিম-দংশে আক্রান্ত অপর সৈন্য- এক বাদশানি- তাঁকে দেখে দারয়ার চেয়েও অল্পবয়সী মনে হয়। তাঁর পায়ের তিনটি আঙ্গুল ফুলে উঠে বিবর্ণ হয়ে রয়েছে আর তাঁকে দেখে মনে হয় বেচারা হেকিমের ছুরির ফলা থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না, যা কিছুক্ষণ পরেই তাঁর মাংস আর হাড়ের ভেতর কেটে বসে যাবে।

হেকিমসাহেব, আমি আর আহমেদ খান আপনাকে সাহায্য করবো, হুমায়ুন বলে। প্রথমে কার পালা?

হেকিমসাহেব বাদশানি সৈন্যর দিকে ইঙ্গিত করে। আহমেদ খান যখন তরুণ সৈন্যের কাঁধ শক্ত করে ধরে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে রাখতে তখন হুমায়ুন হাটু মুড়ে তাঁর পায়ের কাছে বসে হাঁটুর ঠিক উপরে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। হেকিমসাহেব যখন তার কাজ করছে তখন পা স্থির রাখতে গিয়ে হুমায়ুনকে তাঁর পুরো শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং বাদশানি ছেলেটা পিঠের ভরে ধনুকেরমতো বেঁকে যায়, আপ্রাণ চেষ্টা করে চিৎকার না করতে। কিন্তু হেকিমসাহেব খুব দ্রুত কাজ করে। তিনটা নিখুঁত পোচে তিনি কালো হয়ে যাওয়া পায়ের আঙ্গুল তিনটি আলাদা করে ফেলেন, তারপরে রক্ত ঝরতে থাকা ক্ষতস্থানের সংক্রমণ রোধে জায়গাটা পুড়িয়ে দিয়ে সেখানে শক্ত করে পটি বেঁধে দেন।

এবার দারয়ার পালা। আরো একবার ছুরির ফলাটা আগুনের মাঝে আন্দোলিত করার সময় হেকিমসাহেবের চোখমুখ থমথম করতে থাকে। সুলতান, এবার কিন্তু অনেকবেশী সময় লাগবে। যন্ত্রণার অনুভূতি নিঃসাড় করতে আমি যদি তাকে একটু আফিম দিতে পারতাম… আমি ওর চেয়ে অনেক শক্তিশালী যোদ্ধাদের দেখেছি, ব্যবচ্ছেদের সময় স্নায়বিক অভ্যাঘাতেই মৃত্যুবরণ করেছে।

হুমায়ুন কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে দেখে যেখানে দারিয়া নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে, ফ্যাকাশে মুখটা ঘামের কারণে চকচক করছে।

সে যদি অচেতন থাকে, তাহলে কি কষ্ট কম হবে?

হাকিমসাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।

হুমায়ুন দারয়ার দিকে এগিয়ে যায়। সব ঠিক হয়ে যাবে, ছেলেটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সে বলে। কষ্ট করে একটু উঠে বসতে পারবে, তোমাকে একটা কথা আমায় বলতেই হবে… চোখে বিভ্রান্তি নিয়ে দারয়া কুনুইয়ের উপর ভর দিয়ে নিজেকে উঁচু করে, হুমায়ুন কোনো হুশিয়ারী ছাড়াই মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে তাঁকে গায়ের সবশক্তি দিয়ে ঘুষি মারে, ঘুষিটা বোমারমতো তার থুতনির শীর্ষভাগে বিস্ফোরিত হয়। তরুণ ছেলেটা বিনা প্রতিবাদে আবার শুয়ে পড়ে। হুমায়ুন তার চোখের পাতা টেনে দেখে- যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সাথে আর অনেক সময় বন্ধুদের সাথে সে বহুবার এমন করেছে- বেচারী কিছু বোঝার আগেই জ্ঞান হারিয়েছে। তার নিশানা ভেদ ভালোই আছে…

হাকিমসাহেব, আপনার যা করণীয় এবার করতে পারেন। হুমায়ুন তাবুর ভিতর থেকে একটু ঝুঁকে বাইরের কনকনে শীতল বাতাসে বের হয়ে আসে, আহমেদ খানকে রেখে আসে চিকিৎসককে সাহায্য করার জন্য, বাইরে থেকে সে ঘাস ঘাস শব্দে ধাতব ফলার হাড় কাটার আওয়াজ শুনতে পায় এবং তাঁর মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠে। তার লোকদের আস্থা আর তাদের আত্মত্যাগের যথাযথ প্রতিদান কিভাবে দেবে? অন্ধকার ঘনিয়ে আসা আকাশের দিকে সে মুখ তুলে তাকায় এবং ক্ষণিকের জন্য তাঁর যত দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা তাঁকে বিব্রত করছে সবকিছু ভুলে থাকতে এবং পরমানন্দে ভেসে যাবার জন্য গুলরুখের আফিম-মিশ্রিত সুরার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। তারপরেই আকাশের নক্ষত্ররাজির মাঝে যেন খানজাদার মুখ ভেসে উঠে, নিরবে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে উদ্বেগহীন জীবনযাপনের নিয়তি নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেনি এবং এর সাথে অনেক বাধ্যবাধকতা আর তার সাথে সংশ্লিষ্ট চাপ জড়িয়ে রয়েছে। সে তার পরণের আলখাল্লাটায় নিজেকে আরও ভালো করে জড়িয়ে নেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে পাহারার কাজে যারা নিয়োজিত রয়েছে, সেখানে গিয়ে সে হিম-দংশের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁদের হুশিয়ার করে দিয়ে নড়াচড়া করতে বলবে, আর ঘনঘন তাদের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেবে।

কিন্তু তিনদিন পরে আপাতদৃষ্টিতে এটা প্রতিয়মান হয় যে, তাঁরা বোধহয় সবচেয়ে জঘন্য পরিস্থিতি অতিক্রম করে এসেছে। একটা সর্পিলাকার সংকীর্ণ পথ দিয়ে তারা যখন সাপের মতো একেবেঁকে নীচের দিকে নামছে, সহসা বাতাসের তীব্র কনকনে ভাবটা তিরোহিত হয় এবং চারপাশে তূলোর মতো ভাসতে থাকা মেঘের ভিতর দিয়ে হুমায়ুন নীচে তাকিয়ে বৃত্তাকারে অবস্থিত তুষারাবৃত বাড়ি ঘর দেখতে পায় এবং তাঁদের চিমনি থেকে বোয়া উঠতে দেখে সে অনুমান করে সেটা কোনো একটা সরাইখানা হবে। সরাইখানার আঙ্গিনায় ভারী আলখাল্লা পরিহিত অবয়বদের জটলা করতে দেখা যায় এবং সে গৃহপালিত পশুদের ইতস্তত বিচরণ করতে দেখে। তুমি যে বসতির কথা বলছিলে এটাই কি সেটা? বালুচ পথ প্রদর্শকদের একজনকে ডেকে এনে সে জিজ্ঞেস করে।

হা, সুলতান। আমরা যাকে গামসির বলি- পাহাড়ের মধ্যবর্তী পশুচারণভূমি যেখানে পশুপালক আর কৃষকেরা তাঁদের শীতকালীন আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করে- আমরা এখন পাহাড়ের উচ্চতা থেকে সেদিকে অবতরণ করছি। আমরা সেখান থেকে জ্বালানী আর রসদ সংগ্রহ করতে পারবো… এবং পুনরায় যাত্রা শুরম্ন করার আগে ইচ্ছা করলে আমরা সেখানে কয়েকদিন বিশ্রামও নিতে পারি।

রসদ প্রাপ্তির সম্ভাবনায় হুমায়ুন উৎফুল্ল হয়ে উঠে কিন্তু সেখানে সে প্রয়োজনের চেয়ে এক মুহূর্তও বেশী সময় নষ্ট করার পক্ষপাতি নয়। আকবর বহু মাইল দূরে কোনো অজানায় কামরানের হাতে বন্দি রয়েছে, এই ভাবনায় জারিত হয়ে হামিদার দিকে প্রতিবার তাকাবার সময় তাঁর চোখে জমাট কষ্টের সাথে তাঁর নিজের অক্ষমতাবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাঁরা যত শীঘ্র পারস্যে পৌঁছাবে, তত দ্রুত সে আবার পরিকল্পনার ছক বিন্যাস শুরু করতে পারবে।

সীমান্ত এখান থেকে কতদূরে?

সুলতান, এখান থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে হেলমান্দ নদীর ঠিক অপর তীরেই পারস্যের সিয়েস্তান প্রদেশ অবস্থিত।

সেখানে পৌঁছাবার পূর্বে আমরা কি ধরনের ভূ-প্রকৃতির মোকাবেলা করবো?

এখন থেকে বেশীর ভাগ সময়েই আমরা নীচের দিকে নামতে থাকবো। আমরা হেলমান্দের কাছাকাছি পৌঁছালে ভূ-প্রকৃতি সমতল হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

নদীর কাছে পৌঁছাতে আমাদের আর কতদিন লাগবে?

নদীর যে অগভীর অংশটা আমি চিনি সেখানে পৌঁছাতে দশ কি বার দিনের বেশী সময় লাগবে না।

সেইদিন রাতের বেলার কথা, নীচের সেই বসতিটায় পৌঁছে বহুদিন পরে তাঁরা সবাই প্রথমবারের মতো উদরপূর্তি করে, হুমায়ুন তার তাবুতে হামিদার সাথে এসে যোগ দেয়। আমরা এখন যখন শাহের রাজ্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, আমাদের স্বাগত জানাবার অনুরোধ জানিয়ে শাহ্ তামাকে আমার অবশ্যই একটা চিঠি লেখা উচিত। নিজেদের অভিপ্রায় না জানিয়ে আমরা যদি তার ভূখণ্ডের দিকে। এগিয়ে যাই, সীমান্তে মোতায়েন করা পারস্যের সীমান্তরক্ষীরা ভাবতেই পারে আমাদের কোনো বৈরী উদ্দেশ্য রয়েছে। জওহরকে আমার বিশেষ বার্তাবাহক করে আমি তাকে দিয়ে চিঠিটা পাঠাতে চাই। হেলমান্দ নদী পার হয়ে সে চিঠিটা নিয়ে যাবে এবং সেখানে প্রাদেশিক শাসক বা সমান পদমর্যাদার অন্যকোন আধিকারিককে খুঁজে বের করে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য তার কাছে ব্যাখ্যা করবে এবং তাকে অনুরোধ করবে অনতিবিলম্বে শাহের কাছে আমার চিঠিটা যেন। পৌঁছে দেয়া হয়।

হুমায়ুন কথা বলার মাঝেই, একটা নীচু টেবিলের সামনে আসন পিঁড়ি হয়ে বসে যেখানে একটা মাত্র তেলের প্রদীপের মৃদু আলোয়, সে চিঠি লেখার জন্য কালি প্রস্তুত করতে শুরু করে। সে খুব ভালো করেই জানে তাঁর শব্দ চয়নের উপর সবকিছু কতখানি নির্ভর করছে। সে পথে আসবার সময়ে তার কি লেখা উচিত সে বিষয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ পেয়েছে এবং এখন কোনো ধরনের ইতস্ত ত না করে সে সাবলীল ভঙ্গিতে লিখতে শুরু করে, চিঠির বক্তব্য জোরে জোরে হামিদার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে যে মোগলদের কাছে পার্সী একটা পরিচিতি ভাষা সেজন্য তার কোনো দোভাষিকের প্রয়োজন হয় না।

প্রথম অনুচ্ছেদে সৌজন্যমূলক শিষ্টাচার, যেখানে বারবার শাহের দীর্ঘ নিরোগ জীবন আর তাঁর শাসনাকালের সাফল্য কামনা করা হয়। হুমায়ুন তারপরে তাসাম্পকে বিনয়ের সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বহুবছর আগে শাহের বাবা শাহ ইসমাঈল, হুমায়ুনের আব্বাজান বাবরকে তার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কেবল সাহায্যই করেননি, একইসাথে মোগলদের কৃপাহীন শত্ৰু উজবেক গোত্রপতি সাইবানি খানের হেরেম থেকে বাবরের বোন খানজাদাকেও উদ্ধার করেছিলেন। হুমায়ুন অবশ্য উল্লেখ করে না যে- যা সম্পর্কে শাহ্ তামাম্প খুব ভালোভাবেই অবহিত আছে ইসমাঈল আর বাবরের মধ্যকার মৈত্রী খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। সে এর পরিবর্তে বিষয়টা প্রগলভ প্রশংসার সুরে এভাবে লেখে যে, এই দুই মহান নৃপতি একদা তাদের দুজনেরই শত্রু, এমন একজনকে ধ্বংস করতে তাদের শক্তি একত্রিত করেছিলেন।

হুমায়ুন পরের অনুচ্ছেদে সরাসরি একটা অনুরোধ জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়: আমাকে অনেক প্রতিকুলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাংলা থেকে আগত এক উঁইফোঁড়, শেরশাহ, আমার পরিবর্তে এখন হিন্দুস্তান শাসন করছে যখন আমার সৎ-ভাইয়েরা কাবুল আর কান্দাহার আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়েছে এবং আমার নবজাত সন্তানকে বন্দি করে রেখেছে। আপনি নিজে একজন সম্রাট মহান একজন সম্রাট- এবং আমি নিশ্চিত, আপনি নিশ্চয়ই আমার দুর্দশার কথা অনুধাবন করতে পারবেন এবং সহানুভূতিশীল হবেন। পারস্যে আমাকে, আমার পরিবারকে আর আমার সাথের ক্ষুদ্রবাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে রাজোচিত ঔদার্য প্রকাশের জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।

তোমার কি মনে হয়? শেষে কিছু রীতিমাফিক আনুষ্ঠানিক সৌজন্য প্রকাশ করে চিঠিটা শেষ করে, কলম দোয়াতদানিতে নামিয়ে রেখে, হুমায়ুন হামিদাকে জিজ্ঞেস করে।

হামিদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে। চিঠিটার বাক্য বিন্যাস সুচারু আর সেইসাথে অকপট আর খোলামেলা। শাহকে প্রভাবিত করা উচিত, চিঠিটার কিন্তু আদৌ সেটা হবে কিনা কে বলতে পারে। আমরা প্রায়শই আশা আর প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে উঠি, কেবলই আশাহতের বেদনা সহ্য করবো বলে।

*

সুলতান, নদীর অগভীর অংশে আমরা পৌঁছে গেছি।

হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আচ্ছাদন তৈরী করে, হুমায়ুন পথ প্রদর্শকের আঙ্গুলিনির্দেশের দিকে তাকায় এবং সামনের ধুসর, সমতল ভূমির উপর পানির একটা স্রোতকে ঝিকিয়ে উঠতে দেখে- হেলমান্দ নদী। নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত একটা অনুচ্চ দালানের ছাদে পতপত করে একটা লম্বা নিশান উড়ছে- খুব সম্ভবত নদী পারাপারের উপর নজর রাখছে এমন একটা পার্সী সেনাছাউনি। এই পথ দিয়েই নিশ্চিতভাবেই তিন কি চারদিন পূর্বে জওহর অতিক্রম করেছে, ধরে নেয়া যায় সেনাছাউনির আধিকারিক হুমায়ুনের আগমন প্রত্যাশা করছেন। অবশ্য একই সাথে, সতর্কতা বজায় রাখাটাও বাঞ্ছনীয়।

আহমেদ খান, সেনাছাউনির নিকটে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি দেখে আসবার জন্য আপনার কয়েকজন গুপ্তদূতদের পাঠান ততক্ষণ আমরা বাকিরা এখানেই অপেক্ষা করি।

সুলতান, আমি নিজেই যাচ্ছি। আহমেদ খান তার দুজন অভিজ্ঞ লোককে ডেকে নিয়ে ধুসর মিহি ধূলোর একটা মেঘ মাথার উপর তৈরী করে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটায়।

ঘোড়ায় টানা ছাউনি দেয়া এক্কা গাড়ির শেষ বসতিটা ছেড়ে আসবার সময় সে বেশ কয়েকটা এমন গাড়ি কিনেছে, অসুস্থ আর মেয়েদের পরিবহনের সুবিধার্থে- দিকে হুমায়ুন খুব ধীরে ধীরে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যায়, সেটাতে হামিদা আর গুলবদন ভ্রমণ করছে। কাঠের তৈরী ঝালর সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে, সে দেখে হামিদা গভীর ঘুমে অচেতন আর গুলবদন কিছু একটা লিখছে নিঃসন্দেহে সেটা তাঁর রোজনামচা। তাঁদের দুজনকেই কৃশকায় আর ফ্যাকাশে দেখায়।

আমরা নদীর কাছে পৌঁছে গিয়েছি, হামিদার ঘুমে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য কথাটা সে খুব আস্তে বলে। আহমেদ খান এসে যদি বলে যে সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে এবং পার্সীরা কোনো আপত্তি না জানালে আমরা নদী অতিক্রম করবো এবং সেখানে রাতেরমতো অস্থায়ী শিবির স্থাপন করবো। হামিদা কেমন আছে?

সে এখনও খুব কম কথা বলে…সে এমনকি আমার সাথেও কদাচিৎ নিজের অনুভূতি বা ভাবনার কথা আলোচনা করে।

আমি যেমন বুঝিয়েছি, তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা কর যে আমাদের সন্তানকে পুনরায় আমাদের কাছে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নেব না। আমি যা কিছু করছি…অনাগত দিনগুলোতে যা করবো…আকবরকে ফিরে পাবার জন্যই আমি সেসব কিছু করবো।

তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, আপনার জন্যই তার শক্ত হওয়া উচিত কিন্তু শাহ আমাদের উপস্থিতি কিভাবে দেখবেন- সেটা নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন…আর সেইসাথে কামরান আকবরের সাথে কেমন আচরণ করছে সেটাতো রয়েইছে।

হামিদা ঘুমের ভিতর নড়েচড়ে উঠলে, ঝালরের ভিতর থেকে হুমায়ুন মুখ বের করে আনে এবং তাঁর সৈন্যসারির সম্মুখভাগে পুনরায় ফিরে আসে। সংবাদের জন্য তাকে খুব বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। আহমেদ খান তার লোকজন নিয়ে রেকি করতে যাবার ঘন্টাখানেকের ভিতরে, হুমায়ুন তাঁদের সদলবলে ফিরে আসতে দেখে। তাঁদের ঠিক পিছনেই আরো দুজন অশ্বারোহীকে অনুসরণ করতে দেখা যায়। পুরো দলটা একটু কাছে আসতে হুমায়ুন দেখে যে একজন অশ্বারোহী যদিও অপরিচিত, অন্যজন দীর্ঘদেহী অবয়বের অধিকারী জওহর। শাহের সাথে দেখা করার জন্য সে এখনও কেন রওয়ানা হয়নি? শাহ্ কি পারস্যে তাঁদের প্রবেশের ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছেন? কামরান কি আগে কোনোভাবে তার প্রশ্রয় লাভ করেছে? দুশ্চিন্তায় অধীর হয়ে উঠে, সে তাদের সাথে দেখা করার জন্য ঘোড়ার পাঁজরে খোঁচা দেয়।

সুলতান। আহমেদ খান মিটিমিটি হাসছে। খবর সব ভালো, সে আগন্তুকের দিকে ইঙ্গিত করে, ইনি আব্বাস বেগ, সিস্তান প্রদেশের প্রশাসক, আপনার সাথে পারস্যের অভ্যন্তরে প্রতিরক্ষা-সহচর হিসাবে যাবার জন্য তিনি এসেছেন।

আব্বাস বেগ, গাঢ় বেগুনী রঙের মখমলের চমৎকার পোষাক পরিহিত কালো শুশ্রুমণ্ডিত বছর চল্লিশেকের দীর্ঘদেহী এক লোক এবং তার মাথার উঁচু করে বাঁধা উষ্ণীষে সাদা সারসের একটা লম্বা পালক অলঙ্কৃত বন্ধনী দিয়ে আঁটকানো, ঘোড়া থেকে নেমে এসে হুমায়ুনের সামনে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করে। সুলতান, আপনার বার্তা আমি শাহের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদের দ্রুতগামী বার্তাবাহকেরা দিনে আশি মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম। আমাকে পরামর্শ দিতে কিভাবে যথাযথ মর্যাদায় আপনাকে স্বাগত জানানো যায় আমি আপনার প্রতিনিধিকে এখানে অবস্থান করতে অনুরোধ করেছি। সবকিছু প্রস্তুত রয়েছে। আপনাকে কেবল নদীর অগভীর অংশ দিয়ে ওপারে যেতে হবে।

হুমায়ুনের বুকের উপর থেকে একটা বিশাল বোঝা যেন নিমেষে নেমে যায়। গত কয়েক মাসের ভিতরে এই প্রথম তার পরিবার আর তাঁর অনুগামী লোকেরা রাতে কোথায় ঘুমাবে, খাবারের জোগান আছে কিনা, তাঁর লোকেরা আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ কিনা, এসব বিষয়ে তাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে এবং কৃতজ্ঞতায় সে মাথা নত করে তারপরেই স্বমূর্তি ধারণ করে বলে, আব্বাস বেগ আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করবেন। আপনার কথাগুলো দারুণ প্রীতিকর।

বেশ তাহলে, পৃথিবীর অধিশ্বর, শাহ্ তামাস্পের নামে, আমি আপনাকে পারস্যে স্বাগত জানাচ্ছি।

*

একশ পরিচারকের দল সামনের রাস্তা ঝাড় দেয় এবং ধূলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোলাপজল ছিটায়। হুমায়ুন আর তার সঙ্গীসাথীদের সামনে চমৎকার বস্ত্রাদিশোভিত এক হাজার অশ্বারোহীর একটা দল দুলকি চালে এগিয়ে যায়, যাদের শাহ্ পাঠিয়েছেন এখান থেকে সাতশ মাইল উত্তরপশ্চিমে, তার রাজধানী, কাঝভিনে, তাদের প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে অনুগামী হতে। পার্সী ঘোড়ার পিঠে হুমায়ুনের নিজের লোকেরাও সমান জাক-জমকপূর্ণ ভঙ্গিমায় আসীন- হুমায়ুনের জন্য রয়েছে কালো স্যাবলের চামড়ার উপরে সোনার কারুকাজ করা লাগামসহ ঘোড়ার মাথার সাজ এবং পর্যান। হামিদা আর গুলবদন মখমলের আস্তরন দেয়া, গিল্টি করা গরুর গাড়িতে অবস্থান করছে যেগুলো টানছে সাদা ষাড়ের দল, যাদের শিঙে মোগলদের সবুজ রঙের ফিতে জড়ান রয়েছে।

হুমায়ুন সীমান্ত অতিক্রম করে পারস্যে প্রবেশের তিন সপ্তাহ পরে শাহ্ তামাস্পের কাছ থেকে তার প্রেরিত চিঠির উত্তর এসে পৌঁছে। তিন পৃষ্ঠাব্যাপী মাত্রাছাড়া সৌজন্যসূচক কথা শেষ হয়েছে এই শব্দগুলো দিয়ে আপনি আমার ভাই, সার্বভৌম ক্ষমতার এক মূল্যবান রত্ন, পৃথিবীকে আলোকিত করা সূর্য- যার দীপ্র প্রভার কাছে ম্লান হয়ে যায়। কাঝভিনে আমার দরবারে আপনাকে স্বাগত জানাবার সুখকর অভিজ্ঞতা আমি লাভ না করা পর্যন্ত আমার দিনগুলো অসার মনে হবে।

হুমায়ুন তার যাত্রাপথে যেসব শহর আর প্রদেশে যাত্রাবিরতি করবে তার প্রতিটার শাসকের কাছে হুমায়ুনের স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ প্রদান করে, লিখিত আদেশ, ফরমান, শাহ্ আগেই প্রেরণ করেছেন। হুমায়ুন এসব জানে কারণ প্রতিটা ফরমানের অনুলিপি শাহ্ তাকেও পাঠিয়েছেন- চারপাশে সোনার প্রান্তযুক্ত মোটা কাগজের উপরে লেখা- যেটা রয়েছে হাতির দাঁতের বাক্সে যাতে আমার ভাই জানতে পারে যে তাঁকে স্বাগত জানাবার কোনো প্রয়াসই আমি বাদ দেইনি।

প্রতি রাতে রাজকীয় কাফেলা ঠিক কোথায় যাত্রা বিরতি করবে শাহ্ সেটাও আদেশ দিয়েছেন, যাতে করে, সারা দিনের যাত্রা শেষে বিশ্রামের সময় মখমল আর রেশমের চাঁদোয়াযুক্ত সুক্ষ কারুকাজ করা সাদা কাপড়ের তাবু ইতিমধ্যে টাঙানো আর অপেক্ষমান অবস্থায় দেখতে পায় তারা। প্রতিটা রাতই রসনা তৃপ্তিকর ভোজনের নতুন অভিজ্ঞতা বহন করে আনে- দুধ আর মাখন সহযোগে উনুনে ঝলসানো মিষ্টি সাদা রুটি ভর্তি সোনালী বারকোশ এবং রুটির উপরে আফিম আর সুগন্ধিযুক্ত হলুদ পুষ্পবিশিষ্ট সজির বীজ ছড়ান রয়েছে, সাথে পাঁচশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদযুক্ত পদ- আখরোটের সসে ফোঁটান হাঁসের মাংস, শুকনো লেবু আর নাশপাতির আচারে রান্না করা কচি ভেড়া- সোনালী আর রূপালি তবক দেয়া সব ধরনের বাদাম, ভেতরে মধু আর কুচো করা বাদামের পুর দেয়া শুকনো খুবানি এবং গোলাপজল ছিটানো স্তূপীকৃত মিষ্টান্ন এবং উপরে মোতির মতো দেখতে ডালিমের দানা ছিটানো রয়েছে।

প্রতিটা দিনই নতুন উপঢৌকনের আগমন ঘটতে দেখা যায়- হুমায়ুনের জন্য সোনার কারুকাজ করা বুটিদার রেশমি কাপড় দিয়ে তৈরী পোষাক এবং রত্নখচিত খঞ্জর এবং হামিদা আর গুলবদনের জন্য শাহের ভগিনী শাহজাদা সুলতানাম পাঠান হলুদাভ বাদামি পাথর অ্যাম্বার আর উৎকৃষ্ট সুগন্ধি। উপঢৌকনের বদান্যতা থেকে হুমায়ুনের অবশিষ্ট ভ্রমণসঙ্গীরাও বাদ যায় না। তার লোকদের জন্য শাহ্ তামাস্প অস্ত্রের শ্রেষ্ঠ কারিগরদের দ্বারা তৈরী খঞ্জর আর তরবারি পাঠিয়ে দেন। প্রত্যেকের জন্য নতুন কাপড় আসে। পরিশ্রান্ত, ছেঁড়া কাপড় পরিহিত যে দলটা হেলমান্দ নদী অতিক্রম করেছিল রাতারাতি তাদের পরিস্থিতি বদলে যায়।

কিন্তু সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে খুবানি আর জামের বেষ্টনীযুক্ত বাগানের ভিতর দিয়ে এবং নদীর তীরের ঝুঁকে আসা উইলোর সারি বরাবর এগিয়ে গিয়ে তাঁরা যতই কাঝভিনের নিকটবর্তী হতে থাকে, হুমায়ুন তখনও তাঁকে বিব্রত করতে থাকা প্রশ্নটার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। শাহ্ তামাস্প এহেন বাড়াবাড়ি ধরনের আতিথ্য প্রদর্শন করছেন কেন? এর কারণ কি কেবলই হুমায়ুনকে অভিভূত করা? মোগল সম্রাট তাঁর কাছে শরণ নেয়া ব্যাপারটা তাঁর অহংবোধকে আপুত করেছে, নাকি এর পেছনে আরও গূঢ় কোনো রহস্য রয়েছে?

কাশিম আর জাহিদ বেগের সাথে হুমায়ুন তার এই অস্বস্তির বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেও সে খুব ভালো করেই জানে হামিদার সাথে এই বিষয় নিয়ে সে কোনো রকমের আলোচনা করতে পারবে না। শাহের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রতিটা উপলক্ষ্য যেন হামিদাকে তার হারিয়ে যাওয়া প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দেয়- আশার বাণী হয়ে যা তার চোখের পাতায় স্পষ্ট উচ্চারিত হয়, যে সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং আকবরকে পুনরায় নিজেদের কাছে ফিরে পেতে শাহ তামাস্প নিশ্চয়ই হুমায়ুনকে সহায়তা করবেন। হামিদার ধারণা অবশ্য একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঠিকই আছে। শাহের সত্যিকারের অভিসন্ধি যাই হোক এবং পুরোটাই হয়তো যথাযথভাবে হিতসংকল্প- তার সাথে তাকে অবশ্যই মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে…

অবশেষে এক গ্রীষ্মের সকালে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয় হুমায়ুন একাগ্রচিত্তে যার প্রতিক্ষা করেছিল। কাঝভিনের নিকটবর্তী এক উজ্জ্বল পুষ্পশোভিত প্রান্তরে, শাহ্ তামাস্প, দশ হাজার অশ্বারোহীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মোগল সম্রাটকে স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শাহের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করা উচিত হুমায়ুন এতোদিনে সে সম্বন্ধে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, এবারও প্রতিটা বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে আগে থেকেই ভেবে রাখা হয়েছে- হুমায়ুন যেখানে ঘোড়া থেকে নামবে, তাঁর লোকেরা যেখানে অপেক্ষা করবে, প্রতিটা স্থান আগে থেকেই নির্ধারিত, গাঢ় লাল রঙের পুরু গালিচা বিছান একটা পথ যার উপরে শুকনো গোলাপের কুড়ি ছড়ান রয়েছে প্রান্তরের একেবারে কেন্দ্রস্থলের দিকে এগিয়ে গিয়েছে, যেখানে সোনালী রঙের একটা বিশাল বৃত্তাকার গালিচা বিছান রয়েছে সূর্যের আলোয় এর রেশমের কারুকাজ দীপ্তি ছড়াচ্ছে।

শাহ্ গালিচার ঠিক কেন্দ্রে একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর সৈন্যেরা প্রায় পঞ্চাশ গজ পেছনে সুবিন্যস্ত ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান, আজ তাঁর পরনে টকটকে লাল মখমলের পোষাক আর মাথায় টকটকে লাল রেশমের উপর সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা লম্বা, সূচালো অগ্রভাগযুক্ত রত্নখচিত উষ্ণীষ। হুমায়ুন ভালো করেই জানে শাহের মাথার ঐ উষ্ণীষ কিসের লক্ষণ। এটা হল তাজ- ইসলামের শিয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রতীক। হুমায়ুন গালিচার প্রান্তদেশের দিকে এগিয়ে যেতে তামাস্প তাঁর দিকে এগিয়ে আসে এবং তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে তাকে আলিঙ্গন করে। সে তারপরে হুমায়ুনকে একটা বিশাল তাকিয়ার দিকে নিয়ে যায় এবং নিজের ডানপাশে হুমায়ুনকে বসতে দিয়ে নিজে তার পাশে উপবেশন করে।

আমার ভাই, আপনাকে স্বাগত জানাই। হুমায়ুন এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে তামাস্প তার সমবয়সীই হবে, কাটা কাটা মুখাবয়ব, ফ্যাকাশে ত্বক আর ঘন ভ্রর নীচে জ্বলজ্বল করতে থাকা কালো চোখের অধিকারী এক ব্যক্তি।

আপনার আতিথিয়তার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। পারস্যের গৌরবগাঁথার কথা আমি শুনেছি এবং এখন আমি স্বচক্ষে সেটা প্রত্যক্ষ করলাম।

তামাস্প মৃদু হাসেন। আপনার যাত্রাকালীন সময়ে এমন কিই আর আমি আপনার জন্য করতে পেরেছি, আমি মোগলদের যে জৌলুসের কথা শুনেছি তাঁর সাথে তুলনা করতে গেলে আমি নিশ্চিত এসব কিছু ধোপেই টিকবে না।

হুমায়ুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর আতিথ্যকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তামাস্প খুব ভালো করেই জানে পারস্যে তাঁর পালিয়ে আসার মাঝে জৌলুসপূর্ন কিছুই নেই। তার এসব খোসামুদি শব্দের আড়ালে কি কোনো মর্মভেদী খোঁচা রয়েছে? সহস্রাধিক উৎসুক দৃষ্টির ব্যাপারে সচেতন দৃষ্টি যারা দেখতে পাবে সে কি করতে চলেছে হুমায়ুন সহসা একটা সিদ্ধান্ত নেই। সে নিশ্চয়ই তাদের দেখিয়ে দেবে যে সে মোটেই একজন ভিক্ষুকের ন্যায় পারস্যে আসেনি। সে এমন জাঁকালো সদিচ্ছাজ্ঞাপক একটা পদক্ষেপ নেবে, এমনকি অসম্ভব সমৃদ্ধশালী পারস্যেও যেটা নিয়ে পুরুষানুক্রমে আলোচনা হবে- এমন একটা সদিচ্ছাজ্ঞাপক পদক্ষেপ যা পারস্যের শাসকেও তাঁর কাছে ঋণী করে তুলবে।

শাহ তামাস্প আমি হিন্দুস্তান থেকে আপনার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছি। হুমায়ুন তার আলখাল্লার গলার ভেতরে হাত দিয়ে ফুলের ছোপঅলা রেশমের একটা বটুয়া বের করে আনে যার ভেতরে, কঠিন আর বিপদসঙ্কুল পুরোটা সময় ধরে সে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নিজের হৃদয়ের কাছে সংরক্ষণ করেছে। ইচ্ছাকৃত আলস্যে হুমায়ুন বটুয়ার ভেতর থেকে কোহ-ই-নূর বের করে এনে সেটাকে শূন্যে তুলে ধরে যাতে সূর্যের আলো এসে পড়ে। নক্ষত্রের দীপ্তিতে পাথরটা ঝলসে উঠে এবং হুমায়ুন শাহ তামাস্পকে সশব্দে শ্বাসরোধ করতে শোনে।

আমাকে যদি এতটা দিন পথে কাটাতে না হত, আপনার জন্য আমি নিশ্চয় আরও মূল্যবান কিছু খুঁজে পেতাম। কিন্তু এই উজ্জ্বল ঝকমকে পাথরটা আমার বিশ্বাস আপনাকে প্রীত করবে। এই পাথরটাকে কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত, বলা হয়। আশা করি আমাদের চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব এবং সেই সাথে শাহ্ তামাস্প আপনাকেও এর আলো উদ্ভাসিত করবে।

৩.২ কান্দাহার

আপনার এই দুর্দশার ভিতরেও যে আপনি আমার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, সেটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবী সাক্ষী যে মোগল সম্রাট যখন আমার সাহায্য কামনা করেছেন, আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আমি আপনাকে সুসজ্জিত একটা সেনাবাহিনী এবং আমার শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের একজন তাদের নেতৃত্ব দেবে যাতে করে আপনার কাছ থেকে যা কেড়ে নেয়া হয়েছে- সেটা আপনি পুনরুদ্ধার করতে পারেন। শাহ্ তামাস্প হুমায়ুনের কাঁধ আঁকড়ে ধরেন। আমাদের আব্বাজানেরা যেমন একদা মিত্র ছিলেন, তেমনি আমরাও তাই হবো… শাহের ব্যক্তিগত উদ্যানে উত্তর দক্ষিণ এবং পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহিত দুটো নহরের সংযোগ স্থলে নির্মিত মর্মরের বেদীর উপরে রেশমের তাকিয়ার উপরে তাঁরা এই মুহূর্তে বসে রয়েছে। নহরের প্রবাহের ফলে সৃষ্ট উদ্যানের চারভাগে ফলজ বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে- আপেল, নাশপাতি, খুবানি, জাম, আর চেরী এবং সেই সাথে বিশেষভাবে রয়েছে শাহের প্রিয় আপেল গাছ- যার ডালে ইতিমধ্যেই সোনালী ফলের আকৃতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। রত্নখচিত গলবন্ধনী পরিহিত গায়ক পাখিরা ইতিমধ্যে তাদের ডালে ডালে বিচরন করছে।

শাহ্ তামাস্প যাকে নিজের বাগে জান্নাত বলে অভিহিত করেন সেখানে যখন তিনি হুমায়ুনকে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান, হুমায়ুন তখন আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু শাহের প্রস্তাব তাঁর অবাস্তবতম কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়। কোহ-ই-নূর বির্সজন বৃথা যায়নি এবং হুমায়ুন বহু কষ্ট করে নিজের উচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখে। আপনি অতিশয় উদার, সে প্রত্যুত্তরে কোনমতে বলে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে যদি আপনার যোদ্ধারা লড়াই করে, বিজয়ের ব্যাপারে আমার ভেতরে কোনো সন্দেহ থাকবে না…

আপনি হয়ত ভাবছেন আপনাকে সহায়তা করার জন্য কেন আমি এত ব্যগ্র হয়ে রয়েছি। আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি এমন সিদ্ধান্ত নেইনি। এর পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমাদের মতো রাজবংশগুলোর ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সাহায্য প্রার্থনা করে আমার কাছে বার্তা প্রেরণকারী আপনিই একমাত্র মোগল নন। আপনার সৎ-ভাই কামরানও আমার কাছে একটা সন্দেশ পাঠিয়েছে- যার বিষয়বস্তু হল আপনি পারস্য অভিমুখে পালিয়ে গিয়েছেন, আমি যদি আপনাকে বন্দি করি সে প্রতিদানে আমাকে অনেককিছু দেবে- স্বর্ণমুদ্রা, মূল্যবান রত্নপাথর এমনকি কান্দাহার শহরটা পর্যন্ত সে আমাকে দিতে চেয়েছে। তামাস্পের কালো চোখের মণি জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে আমার সাথে এমনভাবে দরকষাকষি করতে চেষ্টা করেছে যেন আমি বাজারের একজন মামুলি বেনিয়া। আমি তার এই ঔদ্ধত্য দেখে ক্রুদ্ধ হয়েছি। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হল, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আপন ভাইয়ের রক্তপাতে কুণ্ঠিত নয় এমন একজন যুবরাজকে আমি কিভাবে বিশ্বাস করতে পারি? আমি ইচ্ছা করলে তাঁকে মাছির মতো পিষে মারতে পারি কিন্তু সেই কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে বেশী ইচ্ছুক।

সে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। পূর্বদিকে আমি আমার সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী নই। আপনার মরহুম আব্বাজানের সময়ে পরিস্থিতি যেমন ছিল, আমার সীমান্তে আমি ঠিক তেমনই সুস্থিত অবস্থা কামনা করি। যখন বাবর- আল্লাহতালা তার আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, উপজাতিদের ফাশাইস, কাফির আর অন্যান্য যারা রয়েছে। তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। পারস্যের বণিকেরা মেশহেদ, ইস্ফাহান, এবং সিরাজ থেকে ফারগানা পর্বতমালার অন্যপাশে কাশগড়ে কোনো ধরনের বাধা বিপত্তি ছাড়াই যাতায়াত করেছে। কিন্তু আপনার সৎ-ভাই যেদিন থেকে কাবুল দখল করেছে সেখানে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে আর আমার লোকদের দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। আমার সহায়তায় আপনি সেখানে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।

শাহ্ যখন এসব কথা বলছিলেন, হুমায়ুনের কেবল দারয়ার ভাষ্য মনে পড়ছিল কিভাবে কাবুল দখলের জন্য সেনাবাহিনী গঠনে আর তাঁদের বেতন দিতে কামরান পারস্যের বণিকদের কাছ থেকে লুঠ করা সোনা ব্যবহার করেছে এবং ভাবে যে এসব বিষয়ে শাহ্ তাসাম্প আদৌ কিছু জানেন কিনা।

আমার মাতৃভূমিতে শীতকাল একটু আগেই আসে এবং আপনার আতিথিয়তার মতোই প্রবল সেই শীতের আগমনের যত পূর্বে সম্ভব আমি আমার অভিযান শুরু করতে চাই। প্রথমে আমি কান্দাহার অভিমুখে রওয়ানা হতে চাই এবং তারপরে প্রথম তুষারপাতের আগেই আমি কাবুলে পৌঁছাতে চাই। আমার সাথে রওয়ানা দেবার জন্য আপনার সৈন্যবাহিনী কখন প্রস্তুত হবে বলে আপনি মনে করেন?

আপনি কাঝভিনে পৌঁছাবার এক সপ্তাহ পূর্বেই আমি সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলাম। আমি আপনাকে দশহাজার সৈন্যের একটা বাহিনী দিতে পারবো, যাদের ভেতরে থাকবে অশ্বারোহী তীরন্দাজ, তবকি আর গোলন্দাজ বাহিনী আর সেই সাথে অশ্বারোহী যোদ্ধা। তারা এবং তাঁদের সেনাপতি রুস্তম বেগ- দুই সপ্তাহের ভিতরে তাঁদের কামারসমূহ, অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র আর রসদের সরবরাহ নিয়ে প্রস্তুত হতে পারবে। আপনার পরিবারের জেনানারা কি কাঝভিনে অবস্থান করতে আগ্রহবোধ করবেন? আমার ভগিনীর তত্ত্বাবধায়নে তারা স্বাচ্ছন্দেই থাকবেন।

হুমায়ুন মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। বিপদ আর পথের কষ্ট তাদের কাছে কিছু না। তারা আমার সাথে যেতেই পছন্দ করবেন। আমাদের সন্তানের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেই দুশ্চিন্তা আমার স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। তাঁর সাধ্যের ভিতরে সবকিছু থাকলে আমরা হয়তো আজই রওয়ানা দিতাম।

একজন সম্রাজ্ঞী আর মা হিসাবে তার অনুভূতিগুলো তাকে আরও সম্মানিত করে তুলেছে। মোগল রমণীদের সাহসিকতার গল্প আমি অনেক শুনেছি। আপনার ফুপুজান খানজাদা বেগম সম্পর্কে আমার আব্বাজান ভীষণ উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।

শাহ ইসমাইলের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞ থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে…

তামাস্প তাঁর অলঙ্কারশোভিত হাতের এক অমায়িক ভঙ্গির সাহায্যে প্রশংসাটা গ্রহণ করে। কিন্তু যুদ্ধযাত্রার বিষয়ে আমরা আরো আলোচনা করার পূর্বে, আমার অবশ্যই একটা বিষয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। আপনি একজন সত্যিকারের আল্লাহর বান্দা কিন্তু আমি যখন আপনাকে আমার মতো শিয়া মতাবলম্বীদের অনুসারী না দেখে, সুন্নী মতাবলম্বীদের অনুসারী দেখি ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। আপনি যে সত্যিই আমার ভাই সেটা আমার কাছে প্রকাশ করুন, দেখিয়ে দিন যে আমাদের ভিতরের রক্তের বন্ধনের চেয়েও শক্তিশালী। শিয়া ধর্মমত আপন করে নিন যাতে করে আমি আর আপনি পাশাপাশি নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্তালার কাছে আমাদের অভিযানের জন্য আশীর্বাদ কামনা করতে পারি। হুমায়ুনের মুখের দিকে তামাস্পের কালো চোখের মণি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ যেন সেখানে এসে জমা হয়েছে।

হুমায়ুন নিজের বিস্ময় আর হতাশা গোপন করতে আপ্রাণ প্রয়াস নেয়। সময়টা তামাস্প ভালোই পছন্দ করেছে- হুমায়ুনের কাঙ্খিত সবকিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে নিজের দাবী সামনে নিয়ে এসেছে। জাগতিক বিষয়বস্তু- জমিজায়গা কিংবা সোনারূপার প্রতি লালায়িত একজন মানুষকে অনেক সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে। আপোষ করার জন্য এমন মানুষগুলো তৈরীই থাকে। আরেকজন মানুষের আত্মাকে করায়ত্ত্ব করতে যে আগ্রহী তার সাথে আপোষ করা অসম্ভব। তামাস্পের প্রশ্নের উত্তর তাঁকে ভীষণ কুশলতার সাথে দিতে হবে।

আপনি কেবল আমার কাছ থেকেই এটা প্রত্যাশা করেন, আমার সেনাপতি কিংবা আমার লোকেরা এর বাইরে? সে এক মুহূর্ত পরে পাল্টা প্রশ্ন করে।

কেবল আপনি, কিন্তু একজন সম্রাট যেখানে পথপ্রদর্শন সেখানে অবশ্য প্রায়শই অনেকেই তাকে অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে।

আপনি এইমাত্র যা বললেন সেটা নিয়ে আমাকে একটু চিন্তা করার সময় দিতে হবে।

চিন্তা করতে আমার ভাই আশা করি খুব বেশী সময় নেবেন না। আপনি যেমনটা বলেছেন শীতের তুষার আরেক অতিরিক্ত শত্রুতে পরিণত হবার পূর্বেই আপনি আপনার অভিযান শুরু করতে আগ্রহী… শাহ তামাম্প রেশমের তাকিয়া থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং দুই নৃপতির আলাপচারিতার সময় সতর্কতার সাথে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষীদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে, উঁচু পাটাতন থেকে নেমে এসে বাগানের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় একটা গোলাপঝাড়ে ফুটন্ত রক্তলাল গোলাপফুল তারিফ করার জন্য কেবল একটু দাঁড়ায়।

হুমায়ুন সরাসরি হামিদার কাছে যায়। হামিদার আবাসনকক্ষে প্রবেশের সময় তাঁর মুখের উদগ্রীব, আশান্বিত মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে সে নিজের বিড়ম্বনা যেন আরো ভালো করে অনুভব করতে পারে।

উনি কি বললেন? তিনি কি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন? পরিচারকের দল বিদায় নেয়ার সাথে সাথে হামিদা হুমায়ুনের কাছে জানতে চায়।

কামরানের সাথে শাহের কোনো ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই এবং তাঁকে পরাজিত করার জন্য আমাকে একদল সৈন্য দিয়ে সহায়তা করবেন বলে কথা দিয়েছেন কিন্তু সেজন্য আমাকে একটা মূল্য পরিশোধ করতে হবে…

কি মূল্য? তাকে কোহ-ই-নূরতো দেয়া হয়েছে। আমাদের আরও কত কিছু তাঁকে দিতে হবে?

সে আমাকে শিয়া মতাবলম্বী হিসাবে দেখতে চায়…।

ব্যস এই কথা? হামিদা হুমায়ুনে দিকে এগিয়ে এসে দুহাতে তাঁর মুখটা তুলে ধরে।

ব্যাপারটা মোটেই সাধারণ নয়। শাহ্ ইসমাইল চেষ্টা করেছিলেন আমার মরহুম আব্বাজান বাবরকে শিয়া মতাবলম্বী করতে তাঁকে আরেকটু হলে সে যাত্রা প্রাণ হারাতে হত এবং সমরকন্দের বিনিময়ে তিনি সেবার প্রাণে বেঁচে যান। আমাদের গোত্রের লোকের এই একটা কারণে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে তারা তৈমূরের বংশে জন্ম নেয়া যুবরাজ শিয়া মতাবলম্বীদের অনুসারীতে পরিণত হয়েছে বলে সন্দেহ করায় তার চেয়ে খুনী উজবেক কিন্তু সুন্নী মুসলমান সাইবানি খানের শাসন মেনে নিয়ে তার দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না…

হামিদা তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দুচোখে অবিশ্বাস নিয়ে এবার তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তখনকার কথা ছিল আলাদা। আমরা এখন সমরকন্দে অবস্থান করছি না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আমাদের সন্তানকে আমরা হারিয়েছি। তাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সাধ্যের ভেতরে আছে এমন সবকিছুই আমাদের করা উচিত…সেটা আমাদের কর্তব্য…যেকোনো কিছুর চেয়ে এটাই আমাদের পবিত্রতম দায়িত্ব। আপনার উচিত বিষয়টা মেনে নেয়া ঠিক আমি যেমন কামরান আকবরকে যখন আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছিল তখন তাকে ধাওয়া না করার ব্যাপারে আপনার যুক্তি মেনে নিয়েছিলাম।

কিন্তু এরফলে আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায় কেন শাহ তামাস্প এত খাতির যত্ন করেছিলেন… তিনি আসলে ঠিক এই উদ্দেশ্যটা হাসিল করতে চাইছিলেন…মোগলদের শিয়া মতাবলম্বী করবেন। আমার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার সময় আমি স্পষ্ট সেটা তাঁর চোখে মুখে দেখতে পেয়েছি…

তার কর্তৃত্বের প্রতি একধরনের স্মারক সম্মতি হিসাবে তিনি আপনাকে যে শিয়া মতাবলম্বীদের অনুসারী করতে চাইছেন না সে ব্যাপারে আপনি কি নিশ্চিত?

আমার মনে হয় না যে সে এমন সূক্ষ চিন্তাভাবনার যোগ্য মানসিকতার অধিকারী। আর তুমি কি দেখছো না বিষয়টা? এমনটা যদি হয় তাহলে তো সেটা হবে আরও বিরক্তিকর। আমার সেনাবাহিনীর উপর এর কেমন প্রভাব পড়তে পারে তুমি সেটা একেবারেই বুঝতে পারছে না।

না, আপনিই বরং বিষয়টা বুঝতে চাইছেন না। আমার জন্য না হলেও আমাদের সন্তানের জন্য অন্তত নিজের গর্বকে গলা টিপে হত্যা করুন!

আমার কেবল এই গর্বটুকুই বেঁচে রয়েছে আর তুমি বলছো একেও জলাঞ্জলি দিতে?

আপনার সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। আমাদের পরিস্থিতি এখন এতোটাই বিপজ্জনক যে নৈতিকতা নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করাটা আমাদের মানায় না। বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নম নম করে পালন করুন। নিজের অন্তরে আপনি কি বিশ্বাস করেন সেটা কেবল স্মরণ রাখুন। সত্যিকারের গর্ব লোক দেখান কিছু না সেটা অন্তরে ধারণ করতে হয়। সাইবানি খানের হাতে খানজাদাকে সমর্পন করার সময় আপনার আব্বাজানের বাহ্যিক গর্ব কতটা খর্ব হয়েছিল একবার স্মরণ করুন কিন্তু তিনি নিজের অন্তরের সত্ত্বাকে ঠিকই সমুন্নত রেখেছিলেন।

হুমায়ুন কোনো কথা বলে না এবং হামিদা মৃদু কণ্ঠে বলতে থাকে, ব্যাপারটা যাই হোক না কেন, শিয়া আর সুন্নীরা কি একই আল্লাহ্র

উদ্দেশ্যে সিজদা দেয় না? তাঁদের এই বিভক্তি মানুষের সৃষ্টি কোনো ঐশ্বরিক অভিপ্রায় নয়। মহানবির পারিবারিক বিবাদ থেকে এই বিভেদের সূত্রপাত, ঠিক অনেকটাই আপনার নিজের পরিবারকে বিভক্তকারী বিরোধের ন্যায়…

হুমায়ুন মাথা নীচু করে চুপ করে বসে থাকে। নিজের সন্তানকে এবং সেই সাথে হারানো সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে চাইলে তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই, হামিদা এই বিষয়ে ঠিকই বলেছে। তার সৈন্য এবং সেনাপতিরা যাই ভাবুক না কেন, সাময়িকভাবে হলেও লাল রেশমের রাজকীয় শিয়া তাজ তাঁকে পরিধান করতেই হবে এবং মসজিদে তার অভিযানের সাফল্য কামনা করে শাহ্ তামাস্পের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সেজদা দিতেই হবে। শিয়া হোক কিংবা সুন্নী, তাঁর উদ্দেশ্য ন্যায়সঙ্গত এবং আল্লাহ্তালা- সর্বশক্তিমান স্রষ্ঠা- নিশ্চয় তার পাশেই থাকবেন…

*

কয়েকদিন পরের কথা, হুমায়ুন একটা আত্মতুষ্টির ভাব নিয়ে মনে মনে ভাবে, তাঁরা বেশ দ্রুতই অগ্রসর হচ্ছে- নিদেন পক্ষে শাহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কাঝভিন অভিমুখী যাত্রার চেয়ে অনেক দ্রুততো বটেই। হুমায়ুনের ঠিক সামনেই রয়েছে পার্সী তিরন্দাজ আর তবকির দল আর তার ঠিক পেছনেই রয়েছে হামিদা আর গুলবদন এবং তাঁর দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাঁদের সাথের পরিচারিকার দল নিজ নিজ গরুর গাড়িতে অবস্থান করছে। তার অবশিষ্ট সৈন্যরা এর ঠিক পেছনেই রয়েছে, তারপরে রয়েছে মালবাহী শকটের বহর যার ভেতরে গরুর গাড়ির উপরে বয়ে নেয়া কামানগুলোও রয়েছে এবং বহরের সবশেষে রয়েছে পার্সী অশ্বারোহীর দল, তাঁদের বর্শার ফলা- মোগলদের বর্শার ফলার চেয়ে চওড়া এবং কোনো অংশেই কম কার্যকরী নয়- ভোরের প্রথম সূর্যের আলোয় চকচক করছে।

জাহিদ বেগ হুমায়ুনের বাম পাশে অবস্থান কিন্তু তার ডান পাশে রয়েছে পার্সী সেনাপতি রহিম বেগ। লম্বাটে, নিখুঁত মুখাবয়বের অধিকারী বয়স্ক এক লোক, তিনি শাহের আত্মীয়-সম্পর্কিত ভাই যিনি হুমায়ুনের যুদ্ধকালীন মন্ত্রণাসভায় পার্সী কবিদের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতে পছন্দ করেন কিন্তু নিজের বাহিনীর দৈনন্দিন কর্ম-তৎপরতা দেখাশোনার দায়িত্ব বৈরাম খান নামে এক সহকারীর উপরে ন্যস্ত করেছেন। শেষোক্ত এই যোদ্ধাটিকে এখনও তরুণই বলা চলে- চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশের বেশী তাঁর বয়স হয়নি। কিন্তু দৈহিক কাঠামোয় স্কুলত্বের একটা ধাঁচ থাকায় এবং মুখের ডানপাশে একটা পুরাতন ক্ষতচিহ্নের কারণে তাঁকে অনেক বেশী বয়স্ক বলে মনে হয়। একজন পার্সীর তুলনায় তাঁর চোখের মণির রঙ একটু বিচিত্রই বলতে হবে- গাঢ় প্রায় ধূম্রনীল- এবং চূড়াকৃতি শীর্ষদেশ বিশিষ্ট ইস্পাতের শিরোম্রাণের নীচ দিয়ে তার লম্বা কালো চুলের বেনী উঁকি দিচ্ছে, শিরোস্ত্রাণের সাথে ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের একটা ঝালর রয়েছে গলা এবং মুখাবয়বের উভয়পার্শ্বকে সুরক্ষিত রাখতে আর শিরোস্ত্রাণের উপরে একটা সুদৃশ্য ময়ূরের পালক শোভা পাচ্ছে।

কাঝভিন ত্যাগ করার পরে শুরুর দিকে হুমায়ুন কোনো প্রশ্ন করা ছাড়া বৈরাম খানকে কদাচিৎ কথা বলতে দেখা যেত। অবশ্য যতই দিন যাচ্ছে ততই তাঁর মিশুক স্বভাব বিকশিত হচ্ছে। যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেই সে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করে এবং হুমায়ুনের সেনাপতিদের বক্তব্য সে একই সৌজন্য আর বিচক্ষনতার সাথে শ্রবন করে। যার ফল আখেরে ভালো হয়। রুস্তম বেগ যদি নিজেকে বেশী মাত্রায় সক্রিয় করার প্রয়াস নিতেন এবং বৈরাম খান মাত্রাতিরিক্ত ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতেন তাহলে সেটা হুমায়ুনের মুষ্ঠিমেয় সৈন্য আর তাঁদের চেয়ে সংখ্যা অনেকবেশী পার্সীদের মাঝে নিশ্চিতভাবেই একটা মতবিরোধের জন্ম দিত। অবশ্য সে রকম কিছুই হয় না, দুটো দলই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে। হুমায়ুনের শিয়া মতাবলম্বী হবার বিষয়টা- যা ছিল সময়ের দাবী অনুযায়ী একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত, তার লোকেরা আপাত নিস্পৃহ ভঙ্গিতে গ্রহণ করেছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে যেখানে স্বয়ং শাহ্ নিজে তাঁর মাথায় রক্তলাল রঙের তাজ পরিয়ে দেয়, হুমায়ুনের মতো তারা অনুধাবন করতে পেরেছে যে তাঁদের সবার ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য এটা জরুরী।

হুমায়ুন সামনের দিকে তাকিয়ে অশ্বারোহীদের একটা ছোট দলকে আস্কন্দিত বেগে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, তাঁদের চারপাশের বাতাসে একটা ধূলিঝড় জন্ম নিয়েছে। দলটায় দুজন গুপ্তদূতসহ আহমেদ খান এবং রুস্তম বেগের মনোনীত দুজন পার্সী অশ্বারোহী রয়েছে যাদের পথপ্রদর্শক হিসাবে পাঠান হয়েছে।

সুলতান, আমরা হেলমান্দ নদী থেকে পনের মাইল দূরে অবস্থান করছি।

চমৎকার। হুমায়ুনের ঠোঁটের কোণে হাসির একটা হাল্কা রেখা ফুটে উঠে। আর দুইদিন- খুব সম্ভবত আগামীকালই- সে পুনরায় হেলমান্দের বরফশীতল পানি আরো একবার পার হবে এবং এবার তাকে অনুসরণ করে অমিত শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনীও নদী অতিক্রম করবে।

*

খয়েরী-বেগুনী পর্বতমালার তীক্ষ্ণ অভিক্ষিপ্ত অংশের প্রেক্ষাপটে কান্দাহার দূর্গের চওড়া পাথুরে দেয়াল এবং সরু জানালাযুক্ত গম্বুজকে ভয়ানক দূর্ভেদ্য মনে হয়। এখন যদিও কেবল সেপ্টেম্বর মাস চলছে, দূর্গ থেকে আধ মাইল দূরে একটা জঙ্গলাকীর্ণ পাথুরে টিলার উপরে একটা নিম্নমুখী ঢালের কাছে হুমায়ুন আর তাঁর সেনাপতির দল তাদের রোকের অবস্থান থেকে দূর্গ পর্যবেক্ষণের কালে হিম শীতল বাতাসে তারা রীতিমতো কাঁপতে থাকে।

আকবর ঐ দূর্গের অভ্যন্তরে কোথায় রয়েছে? হুমায়ুন খুব ভালো করেই জানে আর কিছুক্ষণের ভিতরে সে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার উপরেই তাঁর সন্তানের বাঁচামরা নির্ভর করছে। কামরানকে মূর্খ ভাবার কোনো কারণ নেই। হুমায়ুনের অগ্রাভিযান নিশ্চয়ই তার গুপ্তচরদের নজরে এসেছে এবং সে ইতিমধ্যে অবশ্যই জেনে গিয়েছে যে- হুমায়ুনকে পোড় খাওয়া পার্সী সৈন্যদের একটা বিশাল দল সহায়তা করায় শক্তির পাল্লা এবার তার দিকেই ঝুঁকে আছে। আক্রমণ কিংবা অবরোধ করে যেভাবেই হোক কান্দাহারের পতন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে কামরানের কাছ থেকে কি আশা করা যায়? হুমায়ুন যদি অবরোধ তুলে না নেয় তাহলে সে আকবরের ক্ষতি করার হুমকি দিতে পারে? কামরানের দ্বারা এটা সম্ভব। অন্যদিকে হুমায়ুন নিজেকেই আবার নিজকে প্ৰবোধ দিতে চেষ্টা করে যে তার সৎ-ভাই খুব ভালো করেই জানে যে আকবরকে হত্যা করলে- সে দরকষাকষি করার টেবিলে তাঁর সবচেয়ে কার্যকরী সস্তার কাউন্টারের সুবিধা সে হারাবে…

বৈরাম খান এবং রুস্তম বেগ দূর্গের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এবং আক্রমণের জন্য সম্ভাব্য দুর্বল স্থান আর দূর্গের আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নিয়ে নিবিষ্ট মনে আলোচনা করছে। নাদিম খাজাও দূর্গের বহিরঙ্গের দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে রয়েছে। কান্দাহারের মাথার উপরের পর্বতমালা থেকে আগত একজন গোত্রপতি কারণে তার কাছে দূর্গটা একটা পরিচিত দৃশ্যপট কিন্তু হুমায়ুনের মতো তার ভাবনারও একটা বিরাঠ অংশ জুড়ে রয়েছে নিজের পরিবারের জন্য তাঁর উৎকণ্ঠা। তাঁর স্ত্রী মাহাম আগা এবং তাদের আপন সন্তান, আকবরের মতোই, দূর্গের দেয়ালের অভ্যন্তরে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। নাদিম খাজার কাঁধে হুমায়ুন কিছুক্ষণের জন্য নিজের হাত রাখে এবং পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা দুজনেই বুঝতে পারে যে তাঁদের মনের ভিতর একই আবেগ মথিত হচ্ছে। তাঁরা দুজনেই চৌকষ যোদ্ধা, যাদের সহজাত প্রবর্তনাই হল ঝড়ের প্রচণ্ডতা নিয়ে দূর্গের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের প্রিয়জনকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা। কিন্তু এসব হঠকারী প্রণোদনায় যে কার্যসিদ্ধি হবে না সেটাও তারা বুঝতে পারে…

হুমায়ুনের মাথায় ধীরে ধীরে একটা পরিকল্পনা অবয়ব লাভ করতে শুরু করে। কামরানের সাথে আলোচনা শুরুর জন্য একটা উপায় তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে। সমঝোতার ধারণা যদিও তার মাঝে বিবমিষার উদ্রেক ঘটায়, সে ভালো করেই জানে তার জায়গায় তার মরহুম আব্বাজান থাকলে এই একই সিদ্ধান্ত নিতেন। বাবর কি নিজের অহঙ্কার জলাঞ্জলি দেননি এবং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য সাইবানি খানের সাথে সমঝোতা করেননি? খানজাদাও তাঁকে ঠিক এই পরামর্শই দিত। ধৈর্য ধারণের, চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য সাময়িক ত্যাগ স্বিকারের গুরুত্ব সম্বন্ধে তার ধারণা যে কারো চেয়ে অনেক পরিশীলিত ছিল।

কিন্তু তার পক্ষে কথা বলার মতো যোগ্য কে আছে? তাঁর নিজের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। কামরান যদি তার সাথে দেখা করতে রাজিও হয়, তাঁরা যদি মুখোমুখি হতে পারে, তাদের ভেতরে পরস্পরের প্রতি ঘৃণার মাত্রা এতই প্রবল যে সেখানে হাত থাকতে মুখ নিপ্রয়োজন পরিস্থিতি অচিরেই সৃষ্টি হবে। কিন্তু কাশিম বা তার সেনাপতিদের একজনকে সে পাঠাতে পারবে না। পুরো বিষয়টার ভিতরে একটা পারিবারিক আবহ রয়েছে। মোগল রীতিতে বিদ্যমান আনুগত্য আর সম্মানের প্রতিটা মূলনীতি কামরান কিভাবে লঙ্ন করেছে, কিভাবে তাঁর উচ্চাশা বাবরের উত্তরাধিকারকে দুর্বল আর বিভক্ত করেছে, তাকে সেটা অবশ্যই বোঝাতে হবে।

হুমায়ুনের সফরসঙ্গীদের ভিতরে কেবল একজনই রয়েছে যিনি এসব বিষয় কামরানের সাথে উপস্থাপন করতে পারবেন, যার ধমনীতে তাঁর এবং আকবর উভয়ের রক্তই বইছে। মোগল রমনীরা প্রায়শই গোত্রের ভেতরে শান্তি স্থাপনকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে এবং সে তার যেকোনো পরামর্শদাতার সমান ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।

নিজেকে এভাবে জাহির করাটা যদিও অসম্মানজনক, তার সৎ-বোনের কোনো ক্ষতি করার কথা কামরান চিন্তাও করবে না এবং সে এমনকি শুনতেও রাজি হতে পারে এবং সে এমনকি শুনতেও রাজি হতে পারে- যদি তার ব্যত্তিগত অনুরোধে কাজ না হয়, হুমায়ুনের কাছ থেকে সে কি বার্তা বয়ে এনেছে সেটা নিদেনপক্ষে তারা উপস্থাপন করতে পারবে। আকবরের কোনো ক্ষতি না করে কামরান যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়, সে তাহলে আসকারি এবং তাঁদের সাথের লোকজন আর তাঁদের অস্ত্র নিয়ে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই বিদায় নিতে পারবে এবং সেই সাথে হুমায়ুনও তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দেবে- তাদের আব্বাজান বাবরের নামে সে শপথ করছে তাদের পিছু ধাওয়া সে করবে না।

এখন কেবল একটা প্রশ্নই বাকি আছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান গুলবদন কি আদৌ স্বেচ্ছায় আরম্ভ করবেন। কিন্তু হুমায়ুন যখন ইশারায় তার সেনাপতিদের নিজ নিজ ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ঢাল বেয়ে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠে নিজ নিজ বাহিনীর সাথে মিলিত হতে আদেশ দেয়, সে নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর সে ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে।

*

সুলতান, গুলবদন বেগম ফিরে আসছেন।

হুমায়ুন তার নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে, সে যে টুলের উপরে বসে ছিল সেটা থেকে তড়াক করে উঠে এবং তাবুর আচ্ছাদন একপাশে সরিয়ে বাইরে দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আলো আধারির মাঝে এসে দাঁড়ায়। হুমায়ুনের সেনাছাউনি আর দূর্গের মাঝে অবস্থিত উপত্যকার বুকের উপর দিয়ে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা একসারি আলো ধীরে ধীরে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে- গুলবদনের প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে জওহরের সাথে সে প্রহরীদের যে দলটা পাঠিয়েছিল মশালগুলো তারাই বহন করছে, তারা গুলবদনকে বহনকারী শকটের সামনে আর পেছনে রয়েছে।

সাময়িক যুদ্ধবিরতির নিশান বহন করে সাত ঘন্টা আগে সে যাত্রা করেছিল। অন্ধকারের ভিতরে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকার সময়, হুমায়ুনের ক্ষণিকের জন্য মনে হয় যে গুলবদনের কোলে সে হয়ত আকবরকে দেখতে পাবে কিন্তু এমন অভিলাষী ভাবনা অচিরেই কাণ্ডজ্ঞানের কাছে পরাভব মানে। কামরানের মতো পাষণ্ডের কাছে আবেগের কোনো স্থান নেই। সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আকবরকে আটকে রাখতে চেষ্টা করবে, যখন সে নিশ্চিত জানে হুমায়ুনের কথার বরখেলাপ হবে না।

সে যাই হোক, নিজের অস্থিরতাকে বশে রাখতে ব্যর্থ হয়ে, হুমায়ুন দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা স্থানটার দিকে দৌড়ে যায়, যেখানে ঘাস খাবার জন্য তার ঘোড়াকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পর্যানের জন্য অপেক্ষা না করে, সে ঘোড়ার গলার দড়িকেই লাগাম হিসাবে ব্যবহার করে, প্রাণীটার কানে ফিসফিস করে আদেশ দেয়, দড়ি টপকে গিয়ে উপত্যকার মাঝ দিয়ে দৌড়ে যেতে। তাঁর হৃৎপিণ্ড এত জোরে স্পন্দিত হতে থাকে যে ক্ষণিকের জন্য তার মনে হয় নরম ঘাসের বুকে ধাবমান খুরের ধুপধুপ শব্দ বুঝি সেটার শব্দ। নিজের লোকদের সামনে নিজেকে পক্ষপাতহীন আর নিরুত্তাপ নেতা হিসাবে প্রমাণ করতে, হামিদার দিকে আত্মবিশ্বাসী, নিরুদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে গিয়ে নিজের অনুভূতিকে কতবার তাঁকে এভাবে চেপে রাখতে হবে। কিন্তু চারদিক থেকে ধেয়ে আসা অন্ধকারের মাঝে নিজের কাছে তার স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে যে কোনো সাধারণ মানুষের মতোই সে উৎকণ্ঠা আর ভয়ে আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে যখন তার প্রিয়জনদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং সেটা নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্বের ভেতর পড়ে।

সুলতান আসছেন! জওহর চিৎকার করে বলছে, সে শুনতে পায়। সে গুলবদনকে বহনকারী শকট থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে ঘোড়ার মুখটা একপাশে সরিয়ে এনে প্রাণীটাকে দাঁড় করিয়ে পিছলে তার পিঠ থেকে মাটিতে নামে। জওহরও ইতিমধ্যে তাঁর বাহন থেকে নেমে এসেছে এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে হুমায়ুনকে গুলবদনের গাড়ির দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। জওহরের হাতে ধরা মশালটা নিয়ে হুমায়ুন গাড়ির ঝালর একপাশে সরিয়ে ভেতরে অবস্থানরত নিজের সৎ-বোনের দিকে তাকায়।

তুমি নিরাপদে ফিরে এসেছে দেখে আমি ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ। কামরান কি বলেছে? আমার শর্ত কি সে মানতে প্রস্তুত?

গুলবদন আলোর দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসে তার কিশোরী মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। হুমায়ুন, আমি দুঃখিত। কামরান সেখানে ছিল না। কেবল আসকারির সাথে দেখা হয়েছে। আপনার অগ্রযাত্রার খবর শুনে কয়েক সপ্তাহ আগেই সে সদলবলে কাবুল রওয়ানা হয়েছে যার মানে আপনার কবল থেকে সে শহরটাকে রক্ষা করতে চায়।

আর আকবর?

কাবুল যাবার সময় কামরান তাকেও সাথে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হুমায়ুন এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। আসকারি আমাকে নিশ্চিত করেছে, যে আকবর সুস্থ আছে এবং মাহাম আগা তার সাথেই রয়েছে…

আমি কিভাবে আসকারির কথা বিশ্বাস করি, যখন সে এমন একজন মানুষের প্রতি অনুগত যে একটা শিশুকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত?

আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটা নিয়ে আসকারিও মনে মনে লজ্জিত। সেই সাথে তাঁর কথা শুনে আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, সে মনে করে কামরান তাকে এখানে কান্দাহারে অবস্থানের আদেশ দিয়ে রেখে গিয়েছে আপনার ক্রোধের অনলে দগ্ধ হতে।

আসকারি কি কান্দাহার আমার কাছে সমর্পন করতে রাজি আছে?

সে সমর্পন করবে। আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তার এবং তাঁর লোকদের জীবন আপনি বখশ দিবেন।

হুমায়ুনের ঠোঁটের কোণে বিষণ্ণ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে। তার এবং তার লোকদের প্রাণ সংশয় হবার কোনো কারণ এখন ঘটেনি কিন্তু আকবরের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের শর্তেই আমি তাঁদের এখান থেকে যেতে দেব। আমার সন্তানকে খুঁজে পাওয়া এবং কামরানের সাথে আমার বোঝাঁপড়া না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আসকারিকে আমার জিম্মায় থাকতে হবে। হিন্দালের কি খবর? তার ভাগ্য সম্পর্কে কি তুমি কিছু জানতে পেরেছো?

আমার ভাবনায় সবসময়েই আমার ভাইজান উপস্থিত আছে এবং তার ভাগ্যে কি ঘটেছে- সেটা জানার জন্য আমি আসকারিকে রীতিমতো চাপ দিয়েছি… সে আমাকে বলেছে যে কামরান আদেশ দিয়েছিল তাঁকে জালালাবাদের দূর্গে নিয়ে গিয়ে সেখানে তাঁকে বন্দি করে রাখতে। কিন্তু সেখানে যাবার পথে সে কোনোভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। সেটাও প্রায় বেশ কয়েকমাস আগের কথা এবং আসকারি জানে না সে পালিয়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে… আশা করি আমার ভাই নিরাপদেই আছে।

আমিও সেটাই চাই। আমাদের ভিতরের মতবিরোধের জন্য আমার উপরেও খানিকটা দায় বর্তায় এবং অন্যদের চেয়ে তাকেই আমার নিজের ভাই বলে বেশী। মনে হয়। কিন্তু গুলবদন, তুমিই হলে আমার সত্যিকারের আপন বোন এবং হামিদার বিশ্বস্ত বন্ধু। তুমি আজ খুব কঠিন একটা কাজ করেছে এবং সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

বাবরের সন্তানদের মাঝে এমন রক্তক্ষয়ী বিভেদের বিষয়টা মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর। ধীর পদক্ষেপে নিজের ঘোড়র কাছে ফিরে যাবার সময় বিষণ্ণতা আর হতাশার একটা শেকল হুমায়ুনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে। অস্থায়ী শিবিরে ফিরেই সে সরাসরি হামিদার সাথে দেখা করতে যায়। সে জেনানাদের জন্য স্থাপিত তাবুর ভেতর অপেক্ষা করেছিল এবং হুমায়ুনের চোখে মুখে বিষণ্ণতার গাঢ় দেখে তাঁর কালো চোখের মণি থেকে আশার শেষ রশ্মিটুকুও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। কামরান তাহলে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে?

সেটা করলেই বোধহয় ভালো হত। সে এখানেই নেই। হামিদা- সে আকবরকে কাবুলে নিয়ে গিয়েছে…

হামিদার চোখে ধীরে কান্নার বারিধারা জমে উঠতে, হুমায়ুন তাকে নিজের কাছে টেনে আনে। আমার কথা শোন। আমাদের হতাশ হলে চলবে না। আসকারি এখনও কান্দাহারেই আছে এবং গুলবদনকে সে আশ্বস্ত করে বলেছে যে আকবর সুস্থ আছে। এটা অন্তত একটা সুখবর।

কিন্তু এখান থেকে কাবুল অনেক দূরে…।

এখান থেকে কাবুলের দূরত্ব তিনশ মাইল এবং আমাদের সন্তানকে উদ্ধারের জন্য আমি তিন হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত। তুমি জান সেটা…

আমি জানি কিন্তু কাজটা কঠিন। আমি সারাটা দিন কেবল আকবরের কথাই ভাবি এবং তার ভাগ্যে কি ঘটতে পারে, এমনকি আমি যখন ঘুমাতে চেষ্টা করি তখনও আমার স্বপ্নে কেবল এসব ফিরে ফিরে আসে। আমি যখন গর্ভবতী ছিলাম এবং মালদেবের নাগাল থেকে আমার পালাচ্ছিলাম, আমার গর্ভ থেকে জীবন্ত অবস্থায় তাকে আলাদা করার অনুভূতি কেমন হবে, আমি চেষ্টা করেও নিজেকে সেই কল্পনা করা থেকে বিরত রাখতে পারিনি। নিজের দেহে আমি ইস্পাতের ফলার শীতল স্পর্শ যেন অনুভব করতে পারতাম। দুশ্চিন্তাটা এতোই প্রবল ছিল…ঠিক অনেকটা শারীরিক যন্ত্রণার মতো। আমি জানি না আর কতদিন আমি এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবো।

আর কিছুদিন মনটাকে শক্ত রাখো… আমাদের সন্তানের স্বার্থেই তোমাকে শক্ত হতে হবে, মালদেব যখন আমাদের বিনাশের পরিকল্পনা করেছিল তখন তুমি যেমন শক্ত ছিলে। আসকারি কান্দাহার আমার কাছে সমর্পনের প্রস্তাব করেছে। আমি যত শীঘ্রি সম্ভব এখানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো, তত দ্রুত আমরা কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। হামিদার দেহের আড়ষ্ঠতা সামান্য শীথিল হয়েছে, সে টের পায় এবং হুমায়ুনের কাছ থেকে সে এবার এক পা পেছনে সরে আসে।

আপনি ঠিকই বলেছেন- আমি আসলে হতাশা থেকে এসব আবোলতাবোল কথা বলেছি। আমি নিজের মনকে বুঝিয়েছিলাম যে দুই কি একদিনের ভিতরে আমি আকবরকে নিজের কাছে পাবো। আমারই বোকামি হয়েছে এভাবে আশা করা।

সেটাই স্বাভাবিক। আমিও নিজেকে সেইরকম প্রবোধই দিয়েছিলাম। আমাকে এখন অবশ্যই ধৈর্য আর একাগ্রতার পাঠ নিতে হবে। আমরা পরস্পরকে মানসিক শক্তি যুগিয়েই টিকে থাকবে এবং সফল হব।

কয়েক মিনিট পরে, হুমায়ুন নিজের নিয়ন্ত্রক তাবুতে ফিরে এসে, একটা নীচু টুলের উপরে বসে, এক টুকরো কাগজ নিয়ে তার উপরে কয়েকটা বাক্য লিখে। তারপরে, যদিও তখন অনেক রাত হয়েছিল সে তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা পরিষদকে সমবেত হবার আদেশ দেয়।

আহমেদ খান, আমি চাই কান্দাহারে আমার সৎ-ভাই আসকারির কাছে আজ রাতেই এই চিঠিটা পৌঁছে দেবার জন্য আপনি একদল সৈন্য পাঠাবেন। তাঁর প্রতি আমার বক্তব্য একেবারেই সাদামাটা। আগামীকাল সকালে আমার সৈন্যবাহিনীর পুরোভাগে অবস্থান করে আমি তোমার তোরণদ্বারের সামনে উপস্থিত হব। আমাদের বোনের কাছে তুমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেই মোতাবেক তুমি যদি আমার জন্য তোরণদ্বার খুলে দাও, তোমার প্রাণ সংশয় হবে না, যদিও তুমি আমার বন্দি হিসাবে থাকবে। আমার সাথে প্রতারণা করার সামান্যতম প্রয়াসও যদি তুমি নাও, তোমার এবং সেই সাথে তোমার লোকদের জীবনের নিরাপত্তা আমি দিতে পারবো না। পছন্দ করার এক্তিয়ার এখন তোমার।

আহমেদ খান চিঠিটা নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাবু থেকে বের হয়ে যাবার পরে হুমায়ুন তার অন্যান্য সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়।

আগামীকাল, আমার সৎ-ভাই যদি তাঁর কথা রাখে তাহলে কান্দাহার আমাদের করায়ত্ত হবে। বৈরাম খান, আমি আপনাকে অনুরোধ করবো দূর্গে রক্ষীসেনা হিসাবে মোতায়েন করার জন্য, আপনার লোকদের ভেতর থেকে দুই হাজার জনকে নির্বাচিত করতে- যাদের নেতৃত্বে থাকবে আপনার সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ আর বিশ্বস্ত সেনাপতিরা।

বৈরাম খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমি আমার তীরন্দাজ আর তবকিদের ভেতর থেকে সৈন্য বাছাই করবো এবং আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে দূর্গের আশেপাশের এলাকায় টহল দেবার জন্য আমি এদের সাথে একটা অশ্বারোহী বাহিনীও সন্নিবেশিত করবো।

বৈরাম খান, দারুন একটা পরামর্শ দিয়েছেন। কান্দাহার রক্ষার জন্য আমাদের রক্ষীসেনা মোতায়েন করার কাজ শেষ হলেই আমরা কাবুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। কষ্টকর পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে যদিও এটা একটা দীর্ঘ যাত্রা হবে, আমাদের অবশ্যই দ্রুত এবং অনমনীয় ভঙ্গিতে ভ্রমণ করতে হবে। অতিক্রান্ত প্রতিটা দিন আমার সৎ-ভাইকে অন্যদের সাথে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলার এবং সেখানে নিজের অবস্থান সুসংহত করার জন্য অতিরিক্ত সময় দান করবে।

আমাদের রসদবাহী বহরের কি হবে? এটা আমাদের অগ্রযাত্রার গতি শ্লথ করে দেবে, জাহিদ বেগ জানতে চায়।

আমাদের সাথে আমরা কেবল সেটাই রাখবো যা আমরা বহন করতে পারবো এবং আমাদের মালবাহী আর রসদের বহর যার ভিতরে আমাদের কামানগুলোও রয়েছে রক্ষার জন্য একটা ছোট কিন্তু চৌকষ দলকে দায়িত্ব দেয়া হবে, তারা তাঁদের পক্ষে যতটা দ্রুত গতিতে সম্ভব আমাদের অনুসরণ করবে। কিন্তু এখন অনেক রাত হয়েছে। সুবেহ সাদিকের এক ঘন্টা পূর্বে আমরা আবার মিলিত হব, কাবুলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে।

*

উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত ধুসর পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে অবস্থিত, চওড়া উপত্যকা, যেখানে হুমায়ুনের টকটকে লাল নিয়ন্ত্রক তাবু সূর্যকেন্দ্রে রেখে রশ্মির ন্যায় অস্থায়ী তাবুর সারি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রক তাবুর ডানপাশে তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের তাবুগুলো অবস্থিত, সেখানে বৈরাম খানের তাবুর উপরে উজ্জ্বল লাল রঙের একটা নিশান বাতাসে সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বামপাশে চামড়ার ফালি দিয়ে বাঁধা কাঠের তিরস্করণীর মাঝে রয়েছে হারাম তাবুগুলো যেখানে মেয়েরা তাদের নিভৃত বাসস্থানের বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। হামিদা আর গুলবদন মালামাল বহনকারী শ্লথ বহরের চেয়ে হুমায়ুনের সাথেই ভ্রমণের বিষয়ে বেশী আগ্রহী ছিল এবং দুজনের একজনও দিনে চৌদ্দ ঘন্টার আবশ্যিক অগ্রগমন নিয়ে একবারের জন্যও অভিযোগ জানায়নি।

কিন্তু তাঁদের সবার আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও এখনও তারা কাবুল থেকে দেড়শ মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থান করছে এবং তাঁদের অগ্রগমনের গতি বৃদ্ধির ব্যাপারে হুমায়ুনের আর খুব বেশী কিছু একটা করণীয় নেই। যাত্রাপথের পুরোটা সময় জুড়েই শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। এখন যদিও অক্টোবর মাসের গোড়ার দিক, ইতিমধ্যেই দমকা বাতাসের সাথে তুষারকণার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিনের ভিতরেই পুরোদস্তুর শীত পড়বে।

একটা কেবল আশার কথা যে সে কাবুল অভিমুখে যাত্রা শুরু করার পর থেকে তাঁর সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা নতুন সৈন্যের আগমনে ফুলেফেঁপে উঠেছে। আহমেদ খান তাঁকে এইমাত্র জানিয়ে গেল যে কামরানের বাহিনী থেকে আরেকদল স্বপক্ষত্যাগী তাঁর অস্থায়ী শিবিরে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি নিজেদের আনুগত্যের কথা প্রকাশ করেছে। হুমায়ুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের দলনেতাকে তার সামনে হাজির করার আদেশ দিয়েছে।

আধঘন্টা পরের কথা, হুমায়ুনকে তাঁর পায়ের সামনে, কুর্নিশ আনুষ্ঠানিক অভিবাদনজ্ঞাপনের রীতি অনুযায়ী, দুহাত প্রসারিত অবস্থায় শুয়ে থাকা লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে থাকতে দেখা যায়। লোকটার পায়ের কালো নাগরার উপরে লাল তারকার নকশা দেখে, যা তার গোত্রের স্মারকচিহ্ন, হুমায়ুন আন্দাজ করে লোকটা কাফিরদের একজন গোত্রপতি, যাঁরা কাবুলের চারপাশে অবস্থিত কোটালে, সুউচ্চ, সংকীর্ণ গিরিপথগুলোতে বসবাস করে। কাফিররা স্বার্থের খাতিরে পক্ষত্যাগের জন্য কুখ্যাত। হুমায়ুন যখন ছোট ছিল তখন, তাঁর আব্বাজান কাফিরদের কোনো এক গ্রামের কিছু লোককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছিল যারা তাঁর প্রতিনিধিকে খুন করেছিল, তিনি তাঁদের কাবুলের প্রতিরক্ষা দেয়ালের সামনে শূলবিদ্ধ করেছিলেন, যাতে করে তাদের রক্তে মাটি লাল হয়ে যায়।

উঠে দাঁড়াও। তুমি একজন কাফির, তাই না?

জ্বী, সুলতান। আবহাওয়ার কারণে পর্যুদস্ত, পা ভাঁজ করে উবু হয়ে বসে থাকা লোকটা দেখতে কৃশকায় এবং তাঁর পরণের ভেড়ার চামড়ার তৈরী আঁটসাট পোষাকটারও বেহাল অবস্থা।

তুমি আর তোমার লোকজন এখানে কেন এসেছো?

সুলতান, আমরা এসেছি আপনাকে সহায়তা করার প্রস্তাব নিয়ে।

কিন্তু তোমরা আমার সৎ-ভাই কামরানকে সহায়তা করতে, তাই না?

কাপিল লোকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

তোমরা কেন তার পক্ষ ত্যাগ করেছো?

তিনি তার কথার বরখেলাপ করেছেন। তিনি আমাদের স্বর্ণমুদ্রার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কিছুই দেননি। আমার দুইজন লোক এবিষয়ে অভিযোগ জানালে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের উপর থেকে তিনি তাদের নীচে ছুঁড়ে ফেলার আদেশ দেন।

এটা কবেকার ঘটনা?

তিন সপ্তাহ পূর্বের। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে, আপনার ভাই ঘোড়ার বিচালির খোঁজে আমাদের যখন পাহাড়ে পাঠান, আমরা তখন আর কাবুলে ফিরে না গিয়ে আপনার খোঁজে রওয়ানা হই।

তোমরা কাবুল থেকে আসবার আগে সেখানের পরিস্থিতি কেমন ছিল?

আপনার ভাই দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করছিলেন এবং অবরোধ মোকাবেলার জন্য রসদ মজুদে ব্যস্ত ছিলেন- সে কারণেই তিনি অনেকের মতো আমাদেরও ঘোড়ার বিচালির খোঁজে পাহাড়ে প্রেরণ করেছিলেন। সুলতান, তিনি আপনাকে ভয় পান। পুরো কাবুলের অধিবাসীদের ন্যায়, তিনি নিজেও জানেন যে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনি এগিয়ে আসছেন…যে আপনার অধীনে পারস্যের সৈন্যরাও রয়েছে এবং দুনিয়ার কাছে সে নয়, আপনিই হলেন পাদিশাহ…

হুমায়ুন লোকটার মুখের মোসাহেবি অভিব্যক্তি উপেক্ষা করে। আমার নবজাতক সন্তানের কথা কি তুমি কিছু জানো? কাবুলে কি তুমি তাঁকে কখনও দেখেছো?

লোকটার চোখে মুখে একটা অনিশ্চিত ভাব ফুটে উঠে। না, সুলতান। আমি জানতামই না যে তিনি সেখানে রয়েছেন…

তুমি নিশ্চিত- কান্দাহার থেকে রাজপরিবারের এক সন্তান আর তাঁর দুধ-মাকে নিয়ে আসবার ব্যাপারে তুমি কিছুই শোননি?

না, সুলতান, এমন কিছুই আমার কানে আসেনি।

হুমায়ুন কাফির গোত্রপতির দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কারও প্রতি বা কোনো কিছুর প্রতি এই লোকটার বিন্দুমাত্র আনুগত্য নেই। কার কাছে ধনসম্পদপূর্ণ সিন্দুক রয়েছে কেবল সেটা তাঁর কাছে বিবেচ্য বিষয়। আর সে কামরানের বাহিনীতে কাজ করেছে। হুমায়ুনের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বলে যে এই মুহূর্তে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোকটাকে তার সঙ্গীসাথীসহ শিবির থেকে তাড়িয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু তাহলে অন্য যেসব গোত্রের লোকেরা তাঁর সাথে যোগ দেবার কথা ভাবছে, তারা হয়ত এরফলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। একটা কঠিন আর দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং এই সময় সম্ভাব্য প্রতিটা সৈন্যের সহায়তা লাভ করাটা তার জন্য জরুরী। তাঁর নিজের আব্বাজানও বর্বর পাহাড়ী গোত্রগুলোর ভয়ঙ্কর লড়াকু ক্ষমতা খুব ভালোমতো যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন, যদিও তিনি তাদের সবসময়ে কঠোর হাতে শাসন করেছেন।

তুমি আর তোমার লোকেরা আমার বাহিনীতে যোগ দিতে পারো, কিন্তু তাঁর আগে একটা বিষয় ভালোমতো শুনে রাখে। কিন্তু কোনো ধরনের অবাধ্যতা আর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তোমরা যদি আমার অধীনে একজন খাঁটি যোদ্ধার ন্যায় আচরণ কর তাহলে কাবুলের পতন হবার পরে সেজন্য তোমাদের যথোচিতভাবে পুরস্কৃত করা হবে। আমার এই শর্ত তোমরা মানতে রাজি আছো?

জ্বী, সুলতান।

হুমায়ুন তাঁর প্রহরীদের দিকে তাকায়। এই লোকটাকে জাহিদ বেগের কাছে নিয়ে যাঁর যাতে তিনি একে আর এর সঙ্গীসাথীদের কি দায়িত্ব দেয়া যায় সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

অস্তগামী সূর্যের কিরণে পুরো উপত্যকায় একটা বেগুনী ছায়া ছড়িয়ে যেতে এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে, আরো একবার নির্জনতার জন্য হুমায়ুনের ভেতরে একটা আর্তি জেগে উঠে, নিজের উপরে চেপে বসা দায়িত্বের বোঝা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার একটু মুক্তি প্রয়োজন। দেহরক্ষীদের বিদায় করে সে তার গায়ের আলখাল্লাটায় নিজেকে ভালোমতো ঢেকে নিয়ে, সারিবদ্ধ তাবুর ভিতর দিয়ে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করে, সেখানে সেনাছাউনির সীমানা বরাবর সে কিছুক্ষণ একলা পায়চারি করতে চায়। কিন্তু সেনাছাউনির সীমানার কাছে পৌঁছাবার পরেও সে সেখানে না থেমে বেষ্টনী অতিক্রম করে হাঁটতেই থাকে অন্ধকারের মাঝে ক্রমশ মিশে যাওয়া দূরের পাহাড়ের আবছা অবয়বের দিকে সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে যেতে থাকে।

সে কিছুক্ষণের জন্য ছাগলের পাল ব্যবহার করে এমন খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া একটা পথ ধরে হাঁটতে থাকে। সে নীচের দিকে তাকাতে কয়েকশ অগ্নিকুণ্ডের কমলা আলো দেখতে পায় তার লোকেরা তাদের রাতের খাবার রান্না করছে। কয়েক মিনিটের ভিতরে হামিদার এবং গুলবদনের সাথে হারামের তাবুতে রাতের খাবারের পালা শেষ করার জন্য তাকেও ফিরে যেতে হবে, কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশের এই পরম স্তব্ধতার মাঝে এমন কিছু একটা রয়েছে যা তাঁকে অমোঘ আকর্ষণে টানছে। হুমায়ুন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারকারাজি পর্যবেক্ষণ করে। দিগন্তের কাছে খুব নীচুতে ভেসে রয়েছে ক্যানোপস- তার আব্বাজান কাবুল যাবার পথে যে উজ্জ্বল আর মাঙ্গলিক তারাটা দেখেছিলেন এবং যে তারাটা তাকে ভরসা যুগিয়েছিল। এখন সে আশা করে তারাটা বুঝি তার জন্যও জ্বলজ্বল করছে।

৩.৩ আবেগ আর অনুভূতি

১৭. আবেগ আর অনুভূতি

পাহাড়ে শীতকালটা খুব দ্রুত জাকিয়ে বসে। তিন সপ্তাহ পূর্বেও, বাতাসের ঝাপটানিতে অস্থির তুষারকণা মাটিতে সামান্যই থিতু হতে পারতো কিন্তু এখন কাবুলের উত্তরপশ্চিমে বরফাবৃত পাহাড়ের মাঝে একটা সংকীর্ণ গিরিকন্দরের ভিতর দিয়ে হুমায়ুন যখন তার বাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে, বাতাস তখন প্রায় আনুভূমিকভাবে তুষারকণা তাঁদের দিকে পরিচালিত করছে। গিরিকন্দরের ভিতরে দিয়ে ভ্রমণের কষ্ট ক্রমশ খারাপ হতে থাকা পরিস্থিতির সাথে মিলিত হয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। হুমায়ুন তাঁর মূল মালবাহী বহর এসে পৌঁছান পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই শ্রেয় মনে করে। এরফলে যদিও কয়েকটা দিন নষ্ট হবে কিন্তু শীতের এই আবহাওয়ায় কামান আর অন্যান্য ভারী উপকরণ থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকার ঝুঁকি নেয়াটা বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে মনে করে না সে।

সামনের আঁকাবাঁকা পথ জরিপ করার জন্য হুমায়ুন মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতে স্ফটিকাকার বরফের কণা তার মুখে হুল ফোঁটায়। এমনকি তুষারঝড়ের হাড়কাঁপান শীতলতার প্রকোপ থেকে বাঁচতে সিদ্ধান্ত নেয়া ভঙ্গিতে চোখ কুচকে সামনে তাকিয়ে সে প্রায় কিছুই দেখতে পায় না, বিশেষ করে বরফাবৃত উঁচুনীচু চূড়ার শীর্ষদেশ কিংবা গিরিকরটা যার অংশ এবং তাঁর ধারণা অনুযায়ী তাদের সামনে পৌনে এক মাইলের ভিতরে রয়েছে সেই গিরিপথের শীর্ষদেশ কিছুই গোচরীভূত হয় না।

আহমেদ খান শীঘ্রই ফিরে আসবে। সে কয়েকজন লোক দিয়ে তাঁকে সামনে পাঠিয়েছে, একটা বিষয় নিশ্চিত করতে যে এমন তীব্র আবহাওয়ায় তার বাহিনীর মতো একটা বাহিনীর পক্ষে গিরিকরটা অতিক্রম করা সম্ভব এবং সেই সাথে একটা স্থান নির্বাচন করে আসতে- সম্ভবত নিম্নগামী ঢালের কোনো অংশে যেখানে তারা বাতাসের আক্রমণ এড়িয়ে অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করতে পারবে।

সহসা, তুষারঝড়ের গর্জন এবং তাঁর মুখের নিম্নাংশ জড়িয়ে থাকা লাল পশমের কাপড়ের কারণে সৃষ্ট চাপা প্রভাব সত্ত্বেও, হুমায়ুনের মনে হয় সামনে কোথাও বরফের ভিতর থেকে সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছে। সম্ভবত পুরোটাই বাতাসের একটা কারসাজি বা কোনো নেকড়ের কান্না, সে পুনরায় সামনের দিকে তাকিয়ে এবং শব্দটা ভালোমতো শোনার জন্য মুখের কাপড়টা সরিয়ে সেয়ার সময় সে ভাবে। সে যখন এসব সাতসতেরো ভাবছে, সে কাছেই আরেকটা চিৎকারের শব্দ শোনে এবং নিশ্চিতভাবেই মানুষের সামনে শত্রু রয়েছে!

সে ঠিক এরপরেই উড়ন্ত তুষারকণার মাঝে অস্পষ্ট এক অশ্বারোহীর অবয়ব দেখতে পায়, বরফাবৃত পথের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে তাঁর দিকে ছুটে আসছে, বরফ কিংবা তার নীচে চাপা পড়া পাথরে হোঁচট খাবার তোয়াক্কা না করে। ঘোড়সওয়াড় আরেকটু কাছে আসতে হুমায়ুন দেখে লোকটা আর কেউ না আহমেদ খান, পাগলের মতো নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুতো মারতে মারতে ক্রমাগত চিৎকার করে বলছে, হুশিয়ার, সামনে শত্রু! সামনে শত্ৰু, হুশিয়ার! তার গুপ্তদূতদের দুজন তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। সহসা তাঁদের একজন তার ঘোড়র উপর দিয়ে সামনের দিকে ছিটকে পড়ে, সাদা বরফের উপরে গড়াবার সময় নিজের রক্ত দিয়ে এর উপরে লাল আল্পনা এঁকে দিয়ে যায়, তাঁর পিঠ থেকে দুটো তীরের শেষপ্রান্ত বের হয়ে রয়েছে। মুহূর্ত পরে, দ্বিতীয় গুপ্তদূতের খয়েরী রঙের ঘোড়াটা হোঁচট খায় এবং পেছনের পায়ে বেশ কয়েকটা তীরের আঘাত নিয়ে বরফের উপরে লুটিয়ে পড়ে। হতভাগ্য ঘোড়াটার সওয়ারী পর্যান থেকে পিছলে নেমে এসে হাটু পর্যন্ত গভীর বরফের ভিতর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে, তবে দশ পা এগোবার আগেই সে নিজেও বরফে আছড়ে পড়ে, কালো পালকযুক্ত একটা তীর তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

হুমায়ুন এরপরেই বরফের ভিতর দিয়ে অচেনা অশ্বারোহীদের কালো অবয়ব আবির্ভূত হতে দেখে, তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে, তাঁদের কেউ নিজেদের ঘোড়ার গলার উপর ঝুঁকে থেকে, তরবারি কিংবা বর্শা সামনের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে এবং বাকিদের হাতে রয়েছে মৃত্যুবর্ষী ধনুক। বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে হুমায়ুন বৈরাম খানের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে। মালবাহী শকটগুলোকে তোমার পক্ষে যতটা সুচারুভাবে সম্ভব একটা নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরী কর- যেসব শকটে মহিলারা রয়েছে তাঁদের ব্যুহের ভেতরে নিয়ে যাও। শকটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তোমার সেরা যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত সংখ্যায় মোতায়েন করে বাকিদের নিয়ে আমায় অনুসরণ কর।

হুমকির মুখোমুখি হতে হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয় সামনে এগোবার জন্য এবং সেই সাথে তার ঠিক পেছনেই অবস্থানরত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের একটা দলকে তাঁর পক্ষে যতটা জোরে চিৎকার করা সম্ভব, সে চিৎকার করে বলে, তীর ছুঁড়তে শুরু কর! তীরন্দাজেরা, যাঁরা ঠিক এমন অতর্কিত আক্রমণের কথা মাথায় রেখেই ধনুকের ছিলা টানটান করে বেঁধে রেখেছিল ইতিমধ্যেই পিঠ থেকে নিজেদের জোড়া ধনুক নামিয়ে এনে, ঘোড়ার রেকাবে দাঁড়িয়ে উঠে কামরানের লোকদের উদ্দেশ্যে উড়ন্ত তুষারকণার ভেতর দিয়ে এক পশলা তীর নিক্ষেপ করে। আগুয়ান বেশ কয়েকটা ঘোড়া টলমল করে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং পিঠের সওয়ারীদের ছিটকে ফেলে দেয়। বরফের উপর আছড়ে পরার সময় একজন তার মাথার চূড়াকৃতি শিয়োস্ত্রাণ হারায় এবং তার কামান মাথা বরফের ভিতর বের হয়ে থাকা একটা পাথরের সাথে বেমক্কা ধাক্কা খেলে, তার খুলি ফেটে গিয়ে আশেপাশের মাটি রক্ত আর মগজে মাখামাখি হয়ে যায়।

অবশ্য, কামরানের অবশিষ্ট অশ্বারোহীরা ঠিকই ধেয়ে আসে, হানাদারের দল হুমায়ুনের অশ্বারোহীদের প্রথমসারির সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আগে, গিরিকরের নিম্নমুখী ঢাল তাদের আক্রমণে বাড়তি গতি যোগ করে, হুমায়ুনের অশ্বারোহীরা তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার আগে কেবল নিজেদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বৃদ্ধি করে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। ভেড়ার চামড়ার মোটা আলখাল্লা পরিহিত কামরানের এক যোদ্ধা, মাথার উপরে কাঁটাযুক্ত স্তনী ভীমবেগে ঘোরাতে ঘোরাতে হুমায়ুনের দিকে ধেয়ে আসে। সংঘর্ষের সম্ভাবনার কারণে তুঙ্গস্পর্শী উত্তেজনার মাঝে, হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার মাঝেই লক্ষ্য করে তার প্রতিপক্ষের ঘোড়ার কেশরে তুষারকণা কিভাবে আবৃত করে রেখেছে। হুমায়ুন তার শত্রুকে লক্ষ্য করে সামনে এগোতে লোকটার কস্তনীর শেষ প্রান্তে যুক্ত কাঁটাযুক্ত গোলকটা তাঁর পাশ নিয়ে নির্বীষভাবে অতিক্রম করে কিন্তু তাঁর তরবারির আঘাত ঠিকই লোকটার ভেড়ার চামড়ার পুরু আলখাল্লার এক জায়গা পুরু করে চিরে ফেলে।

উভয় যোদ্ধাই নিজ নিজ ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং পুনরায় পরস্পরের দিকে ধেয়ে আসে, শীতল বাতাসে তাদের ঘোড়ার উষ্ণ নিঃশ্বাস বাস্পের ন্যায় ছড়িয়ে যায়। দুজনেই পুনরায় পরস্পরকে লক্ষ্য করে আক্রমণ শানায় কিন্তু পুনরায় দুজনেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। হুমায়ুনের প্রতিপক্ষ যখন প্রাণপনে লাগাম টেনে ধরে তৃতীয়বারের মতো হুমায়ুনকে আক্রমণের প্রয়াসে ব্যস্ত, বরফের উপরে তাঁর ঘোড়ার পা পিছলে যায়। লোকটা যখন প্রাণপনে চেষ্টা করছে পর্যানে কোনোমতে বসে থাকতে, হুমায়ুন তীক্ষ্ণ এক মোচড়ে তাঁর বাহনের মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং প্রতিপক্ষ তার হাতের কস্তনী দিয়ে আঘাত হানার মতো সুস্থির হবার আগেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

হুমায়ুন সপাটে তাঁর তরবারি চালনা করে এবং লোকটা যদিও একটা ঝাঁকি দিয়ে তার দেহের উপরের অংশ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় কিন্তু তরবারির ফলা তার আক্রমণকারীর উরুর নিম্নাংশে ঠিক হাটুর উপরে কামড় বসায়, মাংসপেশী কেটে গিয়ে একেবারে হাড়ে গিয়ে থামে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে লোকটা হাতের কনী ফেলে দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে। লোকটা ভুলের সুযোগ নিয়ে হুমায়ুন তাকে লক্ষ্য করে পুনরায় তরবারি চালায়, এবার লক্ষ্যস্থল কণ্ঠনালী। শীতল বাতাসে নিখুঁত ফোঁটায় রক্ত ছিটকে উঠে এবং লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়ে।

হুমায়ুনের চারপাশে তার লোকেরা প্রতিপক্ষের সাথে প্রাণপনে লড়াই করছে, যাদের চেয়ে আপাতদৃষ্টিতে তারা সংখ্যায় বেশী। হুমায়ুন অবশ্য লক্ষ্য করে যে তিনজন শত্রুসেনা বৈরাম খানকে ঘিরে ফেলায় সে তার বাকি লোকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে তাঁদের দিয়ে এগিয়ে যায়। বৈরাম খান তাঁর মাথার শিরোম্রাণ হারিয়েছে এবং তুষার ঝড়ের কারণে তার মাথার লম্বা কালো চুল তার পেছনে নিশানের মতো উড়ছে। নিজের বিশালাকৃতি কালো ঘোড়াটাকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে দক্ষতার সাথে তার আক্রমণকারীদের পর্যায়ক্রমে মোকাবেলা করে সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে নিজেকে রক্ষা করতে। সে অবশ্য তারপরেও চাপের ভিতরে রয়েছে এবং ইতিমধ্যে বাম কানের নীচে থেকে তার বুকের বর্মের উপরে যেখানে তাঁর গলা শেষ হয়েছে সেখান পর্যন্ত প্রসারিত একটা গভীর ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে।

বৈরাম খানের আক্রমণকারীদের একজন হুমায়ুনের তরবারির এক মোক্ষম আঘাতে পর্যান থেকে ছিটকে পড়ার পরেই কেবল তাঁরা হুমায়ুনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং দ্বিতীয়জন যে বৈরাম খানের অরক্ষিত পার্শ্বদেশে তাঁর হাতের আয়ুধ প্রবিষ্ট করার পায়তারা করছিল, পরবর্তী এক কোপে তার তরবারি ধরা হাত কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৃতীয়জন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাবার জন্য দাঁড়ায় কিন্তু সে পালাতে গেলে বৈরাম খান পেছন থেকে তাকে ধাওয়া করলে, সে নিজের প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও পেছনে তুষারের উপরে রক্তের একটা ধারা তার পলায়নের সাক্ষী হয়ে থাকে। কামরানের বাকি সব যোদ্ধারা যারা নিজেদের লড়াই থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় তাঁরা সবাই তাকে অনুসরণ করে। আক্রমণটা যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল ঠিক তেমনই সহসা সমাপ্ত হয়। পুরো খণ্ডযুদ্ধটা আধঘন্টারও কম সময়ে মিটে যায়।

তাদের পিছু ধাওয়া কর, হুমায়ুন চিৎকার করে জাহিদ বেগকে আদেশ দেয়। তোমার পক্ষে যতজনকে হত্যা কিংবা আটক করা সম্ভব, কর কিন্তু সাবধান সামনে অন্যরা হয়ত অতর্কিত হামলার জন্য ওত পেতে রয়েছে। সে ঘোড়া থেকে নেমে বৈরাম খানের দিকে দৌড়ে যায়, যে নিজের পর্যানের উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। অকুতোভয় পার্সী যোদ্ধা ঘোড়ার উপর থেকে একপাশে টলে পড়ার আগেই সে তার পাশে পৌঁছে যায়। হুমায়ুন তাকে আলতো করে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে, নিজের মুখ ঢাকার লাল রুমালটা দিয়ে তার ক্ষতস্থানের রক্তপাত বন্ধ করতে চেষ্টা করে। সুলতান, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার জীবন বাঁচাবার জন্য আমি আপনার কাছে ঋণী… আমি এর প্রতিদান আপনাকে দেব, ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে বৈরাম খান বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে।

জাহিদ বেগ আর তার লোকেরা পুনরায় যখন গিরিকন্দরে নেমে আসে ততক্ষণে তুষারপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং শীতের ধুসর সূর্য যুদ্ধক্ষেত্রের বুকে লম্বা ছায়ার সৃষ্টি করে, পশ্চিমের চূড়াগুলোর আড়ালে অস্ত যেতে শুরু করেছে, যেখানে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন বৈরাম খানের এবং অন্যান্য আহত যোদ্ধাদের শুশ্রূষার তদারকি করছে। হুমায়ুন খেয়াল করে দেখে আগুয়ান অশ্বারোহীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দি নিজেদের ঘোড়ার পর্যানে বেকায়দা ভঙ্গিতে লাফাচ্ছে, তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং প্রত্যেকের হাটুজোড়া তাদের ঘোড়র পেটের নিচ দিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা।

জাহিদ বেগ, বন্দিদের কেউ কি কথা বলতে আগ্রহী? তারা কি বলতে চায়?

কেবল এটুকুই যে তারা আসলে ঝটিকা আক্রমণে এসেছিল- যাদের সংখ্যা কোনোমতেই দেড় হাজারের বেশী হবে না এবং অধিকাংশই স্থানীয় গোত্রের লোজন। তারা যদি সাফল্য লাভ করে তাহলে আপনার ভাই তাঁদের প্রচুর বখশিশ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষ করে তারা যদি আপনার কাটা মাথা তার কাছে নিয়ে যেতে পারে।

আমাদের আরও আক্রমণের বিষয়ে এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। আরো প্রহরী মোতায়েন কর। আমরা আসছি কামরান এখন জানতে পারবে এবং সেই সাথে কখন আর কোনদিক থেকে।

*

বাইশ বছর পূর্বে তাঁর আব্বাজানের সাথে হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হবার পরে এই প্রথম হুমায়ুন তাঁর চোখের সামনে নিজের জন্মস্থান দেখতে পায়। কাবুল শহর রক্ষাকারী দেয়াল আর তোরণদ্বার, মাত্র আধ মাইল দূরে, বরফাবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেয়ালের উপর দিয়ে শহরের সরাইখানার উঁচু খিলানাকৃতি প্রবেশ পথের কেবল শীর্ষদেশ সে দেখতে পায় যা হাজার হাজার বণিকের দলকে, যাঁরা চিনি, কাপড়, ঘোড়া, মশলা আর রত্নপাথরের মতো তাদের বিভিন্ন পণ্য দ্রব্য নিয়ে শহর অতিক্রম করার সময়, আশ্রয় দেয়, কাবুলের জন্য যা সমৃদ্ধির বারতা বয়ে আনে।

দূর্গপ্রাসাদটা একটা পাথুরে উচ্চভূমিতে অবস্থিত যেখান থেকে শহরটা দেখা যায়। দূর্গপ্রাসাদটার সাথে যদিও তার অনেক সুখকর স্মৃতি রয়েছে, হুমায়ুন সেগুলো এই মুহূর্তে দূরে সরিয়ে রেখে, শহরের চওড়া মাটির দেয়ার আর পোক্ত গম্বুজগুলো আবেগহীন, হানাদারের চোখে জরিপ করে। তাঁর বাল্যের স্মৃতি বিজড়িত বাসস্থান এটা এখন আর না, যার দেয়ালের পাশে দিয়ে সে ঘোড়া দাবড়েছে এবং বাজপাখি নিয়ে শিকার ধরেছে বরং এটা এখন তাঁর শক্রর সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি এবং তার সন্তানের বন্দিশালা। কান্দাহারের মতো এখানেও সে একই বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়। তাঁর সন্তান আকবর ইতিমধ্যে যে ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছে, তাকে তার চেয়ে আরও বেশী বিপন্ন না করে কিভাবে উদ্ধার করবে এবং নিজের শত্রুদের পরাস্ত করবে? হুমায়ুনের গুপ্তদূতেরা যদিও অনেক সময় তাঁদের সৈন্যবহরকে অনুসরণরত অশ্বারোহীদের দেখেছে যারা কামরানের লোকই কেবল হতে পরে এবং তাঁদের ধাওয়া করে তাড়িয়েছে। কামরান আর কোনো আক্রমণ করার আগ্রহ দেখায়নি। সে নিশ্চয়ই মনে করছে যে কাবুলে পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ মজুদ রয়েছে এবং অবরোধ মোকাবেলায় প্রস্তুত।

হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নেয় সে আরো একবার যুক্তি আর উপদেশ দিয়ে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করবে, যদিও দুটোর প্রতিই কামরান নিজের সংবেদনশীলতা সামান্যই প্রকাশ করেছে। আজ রাতে কাবুলের বাইরে বরফাবৃত প্রান্তরের বুকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে স্থাপিত তার অস্থায়ী শিবিরে বসে সে আরো একটা চিঠি লিখবে যা তার সৎ-বোন শত্রুশিবিরে বহন করে নিয়ে যাবে। এবং আরো একবার, খুবই সহজসরল হবে তাঁর প্রস্তাব। কামরান যদি আকবরকে মুক্তি দেয় এবং কাবুল তাঁর হাতে সমর্পন করে, সে আর তার লোকেরা নিরাপদ অতিক্রমনের প্রতিশ্রুতির সাথে শহর ত্যাগ করতে পারবে। হুমায়ুন বিবেচনা করে দেখে, কান্দাহারে আসকারির কাছে গুলবদন যখন যুদ্ধ অনিবার্য এই মর্মে লেখা তাঁর চরমপত্র পৌঁছে দিয়েছিল, অন্তত তার চেয়ে এখন তার অবস্থান অনেকবেশী শক্তিশালী। সে কাবুলের যত নিকটবর্তী হয়েছে, উপজাতিয় লোকজন আরও বেশী সংখ্যায় তাঁর সাথে যোগ দিয়েছে। তাঁর নিজের বাহিনী এখনও যদিও পার্সি যোদ্ধাদের সমকক্ষ হয়ে উঠেনি, তাঁদের সংখ্যা এখন প্রায় আট হাজার।

হুমায়ুন তাঁর দাস্তানাবৃত হাত দিয়ে উষ্ণতার জন্য নিজের দুপাশে চাপড় দিতে দিতে, তাঁর লাল নিয়ন্ত্রক তাবুর দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার জন্য তাঁর যুদ্ধকালীন পরিষদমণ্ডলী অপেক্ষা করছে। আমার ভগিনী বেশ সাহসী। সে আরো একবার আমার প্রতিনিধি হতে রাজি হয়েছে। কিন্তু কামরান যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধপ্রাসাদ আক্রমণের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের কামানের গর্জন এবার সে শুনতে পাবে।

সুলতান, শহরটার কি হবে? বৈরাম খান জানতে চায়। তার ক্ষতস্থানসমূহ খুব দ্রুত শুকিয়ে আসছে, যদিও সে এখনও তার ঘাড় নাড়াতে পারে না, যার চারপাশে এখনও মোটা পট্টি বাঁধা রয়েছে। আরেকটা পৌরুষদীপ্ত ক্ষতচিহ্ন লাভ করার ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত।

সুলতানের সৎ-ভাই, অবশ্যই, এর প্রহরায় রক্ষীসেনা মোতায়েন করেছে, জাহিদ বেগ মন্তব্য করে। দেয়ালের উপর থেকে শহর রক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি বর্ষণ করতে পারে বলে আমাদের অবশ্যই তাদের নিশানা ভেদ করার দূরত্বের বাইরে অবস্থান করতে হবে এবং আমাদের নিজেদের শিবিরের চারপাশে নিরাপত্তা পরিখা খনন করে পাহারার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

কিন্তু এই বাহিনীর মতো বিশাল একটা বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে শহরের রক্ষীসেনা অভিনিষ্ক্রমণের কথা বিবেচনা করলে বোকামীর পরিচয় দেবে, বৈরাম খান নিজের মতামত জানান।

হুমায়ুন এতোক্ষনে কথা বলে। সেইসাথে, শহরের অধিবাসীরাও হয়ত তাঁদের সমর্থন করে না। কাবুলের অধিবাসীরা ব্যবসা করেই তাদের সম্পদ অর্জন করেছে। তাঁরা যুদ্ধ নয়, শান্তি আর সমৃদ্ধি চায়। যদিও তারা হয়ত আমার প্রতি বিশেষ কোনো প্রকার আনুগত্য অনুভব করে না, তারা যদি মনে করে আমি- কামরান নয় শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হব, আমার অনুগ্রহ লাভের আশায় তারা হয়ত তার সৈন্যদলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, আমার আব্বাজানের জন্য তার শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁরা আগেও যেমন করেছিল। পুরো শহরটা বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন কর। কিন্তু দূর্গপ্রাসাদের বিষয়ে আমাদের কি করণীয়, আমাদের কামানগুলো আমরা কোথায় মোতায়েন করবো যার ফলে আমাদের প্রেরিত আত্মসমর্পণের প্রস্তাব আমার সৎ-ভাই যদি প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাৎক্ষণিক আক্রমণের জন্য সেগুলো প্রস্তুত থাকে?

জাহিদ বেগ সমাধান দেয়। দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখী রাস্তা দিয়ে কামানগুলো উপরের দিকে নিয়ে গিয়ে আমরা সেগুলোর জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অগ্রবর্তী স্থান খুঁজে বের করবো, যেখানে আমাদের গোলন্দাজেরা গোলাবর্ষণের সময় দূর্গপ্রাসাদের দেয়াল তাদের লক্ষ্য করে সরাসরি তীর কিংবা মাস্কেটের গুলি বর্ষণ করা অসম্ভব।

আমি একমত। হুমায়ুন মাথা নেড়ে বলে। আমার মনে হয়, দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারের আগে রাস্তাটা শেষবারের মতো যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে ঐ পাথুরে শিলাস্তরটা একটা অবস্থান হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। সেইসাথে, আমাদের লোকেরা যদি সেখানে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারে, তাহলে আমাদের লোকদের উপরে গোলা বর্ষণের জন্য কামরানের নিজস্ব গোলন্দাজ বাহিনীর পক্ষে তাদের কামানগুলোর নল যথেষ্ট পরিমাণে নীচু করাটা একটা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের নিশানা হবে প্রধান প্রবেশদ্বারগুলো। প্রবেশদ্বারগুলো ধাতব পাত দিয়ে বাধান এবং লোহার ভারী গরাদ দ্বারা সুরক্ষিত হলেও তাঁদের পক্ষে অবিরাম বোমাবর্ষণের ধাক্কা সামলান অসম্ভব। তাদের সরাসরি ডানের বৰ্হিদেয়ালকেও আমাদের নিশানা করতে হবে। আমার যতদূর মনে পড়ছে, ঐ দেয়ালটা বেশ পুরাতন এবং বাকী দেয়ালগুলোর মতো পুরু নয়।

আপনার প্রস্তাবিত অবস্থান থেকে জোরালভাবে গোলাবর্ষণ করা সম্ভব কিনা সেটাই হবে আমাদের প্রধান সমস্যা, জাহিদ বেগ মন্তব্য করে।

রুস্তম বেগ, আপনার কি মনে হয়? হুমায়ুন জানতে চায়। আপনার গোলন্দাজেরা ঐ দূরত্ব থেকে কাঙ্খিত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারবে?

প্রবীণ পার্সি সেনাপতি উত্তরের জন্য তার সহযোগীর দিকে তাকান। সুলতান, আশা করি কোনো সমস্যা হবে না, বৈরাম খান জবাব দেয়, গাঢ় নীল চোখ চিন্তিত অভিব্যক্তি। আমাদের কামানগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির এটাই একমাত্র আফসোসের বিষয়। কাঝভিন থেকে যদি আমরা বড় কামানগুলো নিয়ে আসতে পারতাম, প্রতিরক্ষা দেয়ালগুলো তাহলে আমরা অনায়াসে গুঁড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের কাছে অন্তত পর্যাপ্ত পরিমাণে বারুদ আর পাথরের গোলা রয়েছে।

চমৎকার। আমি জানি কামানগুলোর সময় লাগবে নিজেদের প্রভাব জানান দিতে, কিন্তু আমরা কার্যকর ফাটল সৃষ্টি করতে পেরেছি সেটা প্রত্যক্ষ করার সাথে সাথে, আমি আমাদের সৈন্যদের প্রস্তুত দেখতে চাই- দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য আমাদের তীরন্দাজ আর তবকিদের গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় ঢালুপথ দিয়ে ঢেউয়ের মতো ধেয়ে গিয়ে আক্রমণ করছে। বৈরাম খান আর জাহিদ বেগ আমি আপনাদের উপরে আক্রমণের প্রশিক্ষণের জন্য সৈন্যবাহিনী আর তাঁদের নেতৃত্ব দেবার লোকদের নির্বাচনের দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দূর্গপ্রাসাদ থেকে কেউ পালাবার চেষ্টা করলে তাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য সবসময়ে যেন অশ্বারোহী বাহিনীর কয়েকটা দল প্রস্তুত অবস্থায় থাকে। আমার সৎ-ভাইকে কোনমতেই পালিয়ে যাবার বা আমার ছেলেকে আমার নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দেবার অনুমতি দেয়া হবে না।

*

কামরান যদি গুলবদনের অনুরোধ সাথে সাথে নাকচ করে দিত, তাহলে এতোক্ষণে সে ফিরে আসতো, আসতো না? হামিদা জানতে চায়। কনকনে তীব্র শীত আর আকস্মিক তুষারপাত সত্ত্বেও, গুলবদন দুটো খচ্চর দ্বারা টেনে নেয়া পর্দাঘেরা একটা শকটে উঠে বসার পরে, এবং সন্ধির পতাকা হাতে উপস্থিত জওহরের সামনে অবস্থান করে ঢালু পথ দিয়ে দূর্গপ্রাসাদের দিকে রওয়ানা হবার পর থেকেই সে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের মূল তোরণদ্বারের দিকে মেয়েদের তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে। পাঁচমিনিট পরেই একটা তোরণদ্বার খুলে যেতে সে ভেতরে ঢুকে হারিয়ে যায়।

সবসময়ে সেটা অপরিহার্য নয়। কামরান যদি আকবরকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও থাকে, তাহলেও উত্তরের জন্য তাঁকে আর আমাদের অপেক্ষা করিয়ে রেখে মজা দেখার মতো বিদ্বেষপরায়ন কামরান, হুমায়ুন উত্তর দেয়।

ঠিকই বলেছেন। সে যদি নিজের উচ্চাকাঙ্খ চরিতার্থ করতে মায়ের কোল থেকে তার সন্তানকে ছিনিয়ে নেবার মতো বদমায়েসী করতে পারে, তাহলে তাকে দিয়ে যেকোনো খারাপ কাজ সংঘটিত হতে পারে।

কিন্তু এমনও হতে পারে তারা হয়ত আকবরের জিনিষপত্র একত্রিত করছে। হামিদাকে সান্ত্বনা দিতে হুমায়ুন একটা স্তোকবাক্য আউরায়- যা সে নিজেই বিশ্বাস করে না।

দেখেন, তোরণদ্বার পুনরায় খোলা হচ্ছে, মেঘের আড়াল ভেঙে সদ্য বের হওয়া সূর্যের আলো বরফের উপর পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে চোখ আড়াল করে রুদ্ধশ্বাসে হামিদা বলে। রৌদ্রজ্জ্বল পারিপার্শ্বিক হয়ত একটা শুভলক্ষণ।

সম্ভবত, হুমায়ুন উত্তর দেয়। তোরণদ্বারের ভেতর থেকে প্রথমে জওহর তার ধুসর ঘোড়াটা নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসবার মিনিটখানেকের ভিতরে গুলবদনকে বহনকারী শকটটি বের হয়ে, ধীর গতিতে ঢালু পথ বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করে।

ঝালরগুলো এখনও বন্ধ করে রাখা। আকবর সম্ভবত ভেতরে রয়েছে, হামিদা বলে।

সম্ভবত, হুমায়ুন আবারও বলে। তাঁর কথার মাঝেই সূর্য আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।

দশমিনিট পরে ক্ষুদে কাফেলাটা মেয়েদের তাবুর সামনে এসে উপস্থিত হয়। খচ্চর টানা শকটটি পুরোপুরি থামার আগেই গুলবদন ঝালর সরিয়ে দিয়ে নীচে নামতে যায়। তাকে কোনো কথা বলতে হয় না। তার থমথমে মুখ আর সেখানে ফুটে থাকা কঠিন অভিব্যক্তি দেখে হুমায়ুন আর হামিদা বুঝে নেয় ভেতরে আকবর নেই এবং তার চেয়েও খারাপ খবর যে তাকে দ্রুত ফিরে পাবার যে আশা তারা মনের ভেতর লালন করছিল, কামরানের উত্তর সেটাও ব্যর্থ করে দিয়েছে। অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে হামিদা; ভেজা, শীতল তুষারের উপর হাটু মুড়ে বসে পড়ে। হুমায়ুন তাঁকে আলতো করে দাঁড় করিয়ে শক্ত করে তাঁকে ধরে রাখে।

আপনাদের অনুভূতি আমি বুঝতে পারছি।

না, তুমি মোটেই বুঝতে পারছে না, হামিদা ফুঁপিয়ে উঠে। একজন মা কেবল সেটা বুঝতে পারবে। এক মোচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জেনানাদের বরফাবৃত তাবু লক্ষ্য করে সে ছুটে যায়। ক্রোধ আর হতাশায় কাঁপতে কাঁপতে, হুমায়ুন তাঁর ছুটে যাওয়াটা তাকিয়ে দেখে তারপরে, সে গুলবদনের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে নিজের তাবুতে নিয়ে আসে। তাবুর ভেতরে প্রবেশ করে সে তাঁদের সমস্ত পরিচারক আর পরিচারিকাদের ইশারায় বাইরে যেতে বলে। সে ঠিক কি বলেছে? সবাই বের হয়ে যাবার পরে তাবুর ভেতরে যখন কেবল তাঁরা দুজনে রয়েছে সে জিজ্ঞেস করে।

সামান্যই। দীর্ঘ সময় কামরান আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিল… সে একাই ছিল শেষ পর্যন্ত সে যখন আমাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়, আমাদের আব্বাজানের গিল্টি করা সিংহাসনে উপবিষ্ট- কাবুলের রাজসিংহাসন। সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানাবার কোনো চেষ্টাই করেনি। আপনার চিঠিটা আমি তাঁর হাতে তুলে দিতে, সে চিঠিটার দিকে একপলক তাকিয়ে থাকে। তারপরে, আপন মনে হাসতে হাসতে সে এটা লিখেছে। গুলবদন হুমায়ুনের দিকে ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দেয়। সে চিঠিটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কেবল এটুকুই বলে, তাকে গিয়ে এটা দেবে এবং তাকে বিদায় হতে বলবে। আমি তার কাছে মিনতি করি, নাছোড়বান্দার মতো তাকে বলি, আপনার জন্য না হোক তার মা আর আমার খাতিরে হলেও, আকবরকে মুক্তি দিতে। সে কেবল এটাই বলে, আমাকে কি তোমার আহাম্মক মনে হয়? তোমার যদি আর কিছু বলার না থাকে, তাহলে তুমি এবার বিদায় নিতে পার। আমি আর একটা কথাও না বলে ঘুরে দাঁড়াই এবং কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি। আরও মিনতি কিংবা কান্নাকাটি করে নিজেকে তাঁর সামনে আরও অপদস্থ করার সম্ভষ্টি আমি তাকে পেতে দেব না।

তুমি ঠিক কাজই করেছো, গুলবদনকে জড়িয়ে ধরে হামিদা কথাগুলো বলতে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি আর কাঁদব না এবং আপনিও না। হুমায়ুন, কামরান চিঠিতে কি লিখেছে? আমাদের নিশ্চিত হতে হবে সে আবার নতুন কোনো ধূর্ততার আশ্রয় নেয়নি।

হুমায়ুন চিঠির ভাঁজ খুলে এবং অসহিষ্ণু আঁকাবাঁকা হাতে লেখা যা তাঁদের ছেলেবেলা থেকেই হুমায়ুনের পরিচিত, চিঠিটা জোরে জোরে পড়ে।

আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই এলাকা ত্যাগ করে পারস্য যাবেন কিন্তু আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন এবং ভিনদেশী একদল সৈন্য নিয়ে আমাকে হুমকি দেবার জন্য ফিরে এসেছেন। আমার নিজের বাহুবলে গড়া রাজ্য থেকে আমাকেই নিরাপদ সঞ্চারণের প্রস্তাব দেবার ধৃষ্টতা দেখান- আপনি, যে নিজে ব্যর্থ হয়েছে খাইবার গিরিপথের ওপাশে আমাদের আব্বাজানের বিজিত ভূখণ্ড নিজের দখলে রাখতে, আপনি, যে আমাদের আব্বাজানের সৃষ্ট সবকিছু হারিয়েছে। তার সিংহাসনে এখন আমার অধিকার। আপনিই এখানে পরাধিকারপ্রবেশক, আমি নই। ফিরতি পথে পারস্যে এবং নির্বাসনে নিজের যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন।

হামিদাই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করে। মেয়েদের বিনীত নিবেদনে বা আপনার যৌক্তিক আর ক্ষমাপূর্ণ প্রস্তাবে সে কর্ণপাত করবে না। নিজের ঔদাসীন্য আর নিষ্ঠুরতার মূল্য তাকে রক্ত দিয়ে শোধ করতে বাধ্য করুন।

আমি এবার সেটাই করবো, হুমায়ুন প্রতিজ্ঞা করে এবং তাবুর প্রবেশ পথের দিকে হেঁটে যায়। প্রবেশ পথে ঝুলে থাকা পর্দার একটা তুলে সে পা যুক্ত ঝুড়িতে রাখা জ্বলন্ত কয়লার কাছে ওম পোহাতে থাকা জওহরকে ডাকে। জওহর আমার ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা আমাদের জবাব পেয়ে গেছি। যুদ্ধ এড়াবার আর কোনো পথ নেই। আমার পরামর্শদাতাদের ডেকে পাঠাও। আগামী কাল সকালেই আমরা আক্রমণ শুরু করবো।

*

গতকাল দিনে আর রাতের বেলার বেশীর ভাগ সময়ে যে তুষারপাত হয়েছিল এবং হুমায়ুনের পার্সী গোলন্দাজেরা যখন তাঁদের কামানগুলোকে নিজ নিজ অবস্থানে মোতায়েন করার সময়ে তাঁদের জন্য একটা আড়াল তৈরী করেছিল গোলন্দাজের দল তাদের গোলাবর্ষণ শুরু করতেই বরফ গলতে শুরু করে। গোলন্দাজদের থেকে পঞ্চাশ গজ পেছনে আরেকটা পাথুরে শিলাস্তরের আড়ালে হুমায়ুন তার নিয়ন্ত্রক অবস্থান থেকে দলবদ্ধ লোকগুলো তাদের কাজ শুরু করতে সেদিকে তাকিয়ে। থাকে। প্রতিটা কামানের জন্য পাঁচজন- প্রত্যেকের পরণে রয়েছে চামড়ার তৈরী আঁটসাট জামা, পাতলুন এবং মাথায় সূচালো অগ্রভাগযুক্ত শিরোস্ত্রাণ, বারুদ ভর্তি সুতির তৈরী থলেগুলো তোলার সময় একটা ঘোঁতঘোঁত শব্দ হয় এবং তারপরে ব্রোঞ্জের নলের ভেতরে পাথরের গোলাগুলো প্রবিষ্ট করিয়ে সেগুলোকে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নীচের দিকে ঠেলে দেয়। তারা তারপরে তাঁদের সঙ্গের বেধনিকার ধারাল ধাতব কীলক বারুদের থলে ফুটো করতে সংবেদনশীল-গর্তের ভেতরে প্রবেশ করায় এবং গর্তের মুখের চারপাশে সাবধানে সামান্য পরিমাণে আরেকটু বারুদ ছিটিয়ে দেয়। অবশেষে, দলের সবাই বেশ খানিকটা পেছনে সরে এসে দাঁড়াতে, প্রতিটা দল থেকে একজন নিজ নিজ কামানের দিকে এগিয়ে যায়। তাঁর হাতে একটা লম্বা আকর্ষিযুক্ত দণ্ডের একপ্রান্তে তেলে ভিজানো সরু দড়ি লাগানো যার অগ্রভাগে আগুন জ্বালানো রয়েছে এবং ধিকিধিকি করতে থাকা লালচে-কমলাভ অগ্রভাগ দিয়ে সে সংবেদনশীল গর্তের মুখে অগ্নি সংযোগ করেই দ্রুত লাফিয়ে পেছনে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে।

পুরো প্রক্রিয়াটা যদিও দৈহিকভাবে পরিশ্রমসাধ্য- হুমায়ুন দূর থেকে শীতল বাতাসে তাঁদের দেহের ঘাম বাস্পের মতো মিশে যেতে দেখে লোকগুলোর দক্ষতার কারণে পুরো প্রক্রিয়াটা, বিস্ফোরক মাত্রার বারুদে অগ্নি সংযোগ হতে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানির সাথে বারুদ আর গোলার যুগলবন্দি থেকে সৃষ্ট মন্দ্র গর্জনের কারণে, সাবলীল আর দ্রুত দেখায়। হুমায়ুনের চোখের সামনে তারা একের পর এক গোলা বর্ষণ করতে থাকে। প্রথম কয়েকটা গোলা লক্ষ্যবস্তু থেকে খানিকটা পশ্চিমে এবং দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ে কিন্তু বৈরাম খানের লোকেরা দ্রুত কামানবাহী শকটের সামনের চাকার নীচে কাঠের গোঁজ খুঁজে- কামানের নলের নতির প্রয়োজনীয় সংশোধন সাধন করে আর বারুদের পরিমাণ হ্রাস বৃদ্ধি করে বিচ্যুতি শুধরে নেয়। অচিরেই অধিকাংশ গোলা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে শুরু করে তোরণদ্বার আর মাটির দেয়ালে আছড়ে পড়তে শুরু করলে, সেখান থেকে অবিরামভাবে লালচে-খয়েরী রঙের ধূলার মেঘ সৃষ্টি হতে শুরু করে।

দূর্গপ্রাসাদের প্রাকার থেকে কামরানের কয়েকজন গাঁদাবন্দুকধারী তবকিকে গোলন্দাজদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়, কিন্তু কামানগুলোকে রক্ষাকারী পাথরের দেয়ালে আঘাত করা থেকে বিরত থাকতে তাঁদের প্রাকারের উপর অনেকখানি ঝুঁকে এসে গুলি করতে হয় এবং নিজেদের অস্তিত্ব পুরোপুরি প্রকাশ করতে হয়। প্রথমদিকে যদিও তারা হুমায়ুনের বেশ কয়েকজন গোলন্দাজকে আঘাত করতে সক্ষম হয়, তার নিজের তবকিরা ইতিমধ্যে অগ্রবর্তী অবস্থানে পৌঁছে যেতে সেখান থেকে তারা এবার প্রাকারের উপরে কামরানের লোকেরা গুলি করার পায়তারা করলেই পাল্টা গুলি করা আরম্ভ করে। তারা শত্রুপক্ষের দুজনকে গুলিবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়, যাঁরা তাঁদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে প্রাকারের উপর থেকে উল্টে পড়ে বাতাসে খাবি খেতে খেতে নীচের পাথুরে ভূমিতে এসে আছড়ে পড়ে। বাকি যোদ্ধারা এরপরে আড়ালে থাকাই শ্রেয় মনে করে এবং তারা গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখলেও সেগুলো তড়িঘড়ি করে ছোঁড়া যা লক্ষ্যবস্তুর অনেক দূর দিয়ে চলে যায়।

হুমায়ুন একটা চওড়া ছাতিঅলা সাদা ঘোড়ায় চড়ে জাহিদ বেগকে আস্কন্দিত বেগে উপরের দিকে উঠে আসতে দেখে। সুলতান, শহরের পরিস্থিতি শান্ত বলেই মনে হচ্ছে, গাঁদাবন্দুকের গমগম করতে থাকা আওয়াজ ছাপিয়ে সে চিৎকার করে বলে। সৈন্যরা শহর প্রতিরক্ষা দেয়ালের কাছ থেকে দূর্গপ্রাসাদ লক্ষ্য করে আমাদের গোলাবর্ষণ প্রত্যক্ষ করছে কিন্তু কেউ শহর অবরোধ করে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি করেনি বা শহর থেকে বের হয়ে এসে পেছনদিক থেকে আমাদের আক্রমণ করার কোনো চেষ্টা করেনি। আপনি যেমন ধারণা করেছিলেন আদতে তাই হয়েছে- এহেন প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সাহস তাঁদের নেই। কিন্তু তারা যেখানে লুকিয়ে রয়েছে সেই শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল বিশেষ করে দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা দেয়ালগুলো খুবই মজবুত। তাদের পরাস্ত করতে আমাদের সময় লাগবে আর নিরবিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ চালিয়ে যেতে হবে।

*

সুলতান, গোলন্দাজেরা দূর্গপ্রাসাদের প্রাকারে একটা ফাটল সৃষ্টি করেছে। হামিদার পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় জয়নব ঝাঁকি দিয়ে হুমায়ুনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে। বৈরাম খান বাইরে অপেক্ষা করছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠার মাঝেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো খুশীর একটা আমেজ হুমায়ুনকে আপুত করে। কাবুলে এবার নিশ্চিতভাবেই তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আকবরকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সে দ্রুত এবং অমনোযোগী ভঙ্গিতে নিজেকে পোষাক সজ্জিত করে এবং রাতের কনকনে শীতের ভিতরে টলতে টলতে তাবু থেকে বের হয়ে আসে। বৈরাম খান, প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কোথায় ফাটল সৃষ্টি হয়েছে?

প্রধান তোরণদ্বারের ডানপাশে আপনার মতামত অনুযায়ী যেখানে প্রতিরক্ষা প্রাচীর সবচেয়ে দূর্বল হবার কথা।

কত বড় ফাটল?

বেশী বড় না কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা যদি এখনই সক্রিয় হই, আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। আমি ইতিমধ্যে আমাদের তবকি এবং তীরন্দাজদের সাথে সাথে গোলন্দাজদেরও ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করতে বলেছি যাতে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত কেউ প্রাচীরের ফাটল মেরামত করার আগ্রহ না দেখায়। আর দেড় ঘন্টার ভিতরেই সকালের আলো ফুটবে এবং আপনি যদি আদেশ দেন তাহলে এই সময়ের ভিতরে আমি একদল সৈন্যকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবো।

প্রস্তুত করেন।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করার সময়টায় শীতের সূর্য নীচুতে ভেসে থাকা কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আর কনকনে শীতল বাতাস বইতে থাকে আর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হুমায়ুনকে দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখে উঠে যাওয়া ঢালু পথটার পাদদেশে আক্রমণকারী যোদ্ধাদের মাঝে দাঁড়িয়ে উজ্জীবিত ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা যায়।

এখানে যারা উপস্থিত রয়েছে তাঁদের সবার সাহসীকতা আর আনুগত্য সম্বন্ধে অবগত আছি এবং তোমাদের পাশে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করছি বলে আমি গর্বিত। নিজের রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়ের সাথে যুদ্ধ করার চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আর হয় না কিন্তু আমার কুচক্রী সৎ-ভাই কামরান অন্যায়ভাবে আমার সিংহাসন দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, আমার নির্দোষ সন্তানকে চুরি করে রক্তের সম্পর্ক আর সম্মানের প্রচলিত সব রীতি লঙ্ঘন করেছে। সে এসব করে মোগল অহমিকা কলঙ্কিত করেছে। কিন্তু আমরা সবাই একসাথে এই অপমানের প্রতিকার করতে এবং জবরদখলকারীকে শাস্তি দিতে পারি। কোনো কথা নয় আর এবার যুদ্ধ!

বৈরাম খানকে পাশে নিয়ে হুমায়ুন তার লোকদের একেবারে সামনের সারিতে অবস্থান করে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাকায়। দূর্গপ্রাসাদের তোরণদ্বার লক্ষ্য করে ছোঁড়া কামানের গোলার সাদা ধোয়ার মাঝে বরফ জমে থাকা ঢালু পথের উপর দিয়ে ঘোড়া দুটো তাদের সাধ্যমতো দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে, দুটো প্রাণীর পাজর হাপরের মতো উঠানামা করতে থাকে, মাঝে মাঝে যদিও তারা বরফের উপরে পা হড়কায়। তার নিজের সৈন্যদের গাদাবন্দুক আর কামানের শব্দে তার কানে প্রায় তালা লেগে যায় কিন্তু বোয়ার ভিতরে একটা ফাঁকা স্থান দিয়ে সে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, তোরণদ্বারের ডানপাশের দেয়ালে আসলেই একটা আঁকাবাঁকা ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। তার আত্মা প্রফুল্ল হয়ে উঠে। পর মুহূর্তেই সে বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করে যে দূর্গপ্রাকারের প্রাচীরের কাছ থেকে পাল্টা গুলি খুব সামান্যই ছোঁড়া হচ্ছে।

সে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকার মাঝেই সহসা কুণ্ডলীকৃত ধোয়ার মাঝের আরেকটা ফাঁকাস্থান দিয়ে তোরণদ্বারের ঠিক উপরের প্রাকারে একটা কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করে। কামরান কি আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিষয়টা তার বিশ্বাস করতে কষ্টই হয়। সে তার গোলন্দাজ আর তকিদের চিৎকার করে গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে বলে, তারপরে বিষয়টা ভালো করে পর্যবেক্ষন করতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বারুদের তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত ধোঁয়া ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করতে সে দেখে যে দূর্গ প্রকারের উপরে কামরানের সৈন্যরা কাঠের তৈরী সূচালো দণ্ডের মতো কিছু একটা স্থাপণ করছে। তারপরে দীর্ঘকায় একটা অবয়বকে নিজেদের সামনে ঠেলতে ঠেলতে, সেখানে আরও সৈন্য এসে উপস্থিত হয়ে, সকালের ধুসর আকাশের প্রেক্ষাপটে যার মাথার লম্বা খোলা চুল আবছাভাবে দেখা যায়। হুমায়ুন সামনের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করে যতক্ষণ না সে দেখতে পায় যে অবয়বটা একজন মহিলার এবং তার হাতে কিছু একটা ধরা রয়েছে। এমন একটা কিছু যা ছটফট করছে আর মোড় খাচ্ছে- একটা শিশু।

হুমায়ুনের দেহের রক্ত যেন নিমেষে জমাট বরফে পরিণত হয়। সৈন্যরা যখন মেয়েটাকে কাঠের খুঁটির সাথে বাধছে তখন সে স্বপ্নবিষ্ট মানুষের মতো তাকিয়ে থাকে, তারা মেয়েটার সারা শরীর দড়ি বা শেকলের মতো দেখতে কিছু একটা দিয়ে পেঁচিয়ে বাধে কেবল তার হাতের প্রাণবন্ত বোঝাটা ধরে রাখার জন্য হাত দুটো খোলা রাখে। ঐ ক্ষুদে পুটলিটা, হুমায়ুনের মনে সন্দেহের সামান্যতম কোনো অবকাশ থাকে না, তার সন্তান তারই দুধ-মা মাহাম আগা তাকে দুহাতে জড়িয়ে রয়েছে।

একটা অসহায় কান্না তার গলা চিরে বের হয়ে আসে। না! জাহিদ বেগ আর বৈরাম খান ইতিমধ্যে তার পাশে এসে উপস্থিত হয়েছে, রক্ত মাংসের জীবন্ত লক্ষ্যবস্তু হিসাবে প্রাচীরের উপরে প্রদর্শিত মহিলা আর শিশুটির অপার্থিব দৃশ্যপটের দিকে হুমায়ুনের মতো তারা নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা থেকে বহুকষ্টে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হুমায়ুন দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। নিজের সৎ-ভাইয়ের কুটিলতাকে সে আরো একবার ছোট করে দেখেছে। কামরানের এই প্রত্যুত্তরের অর্থ প্রাঞ্জল আর দ্ব্যর্থহীন- আক্রমণ অব্যাহত রাখলে নিজের সন্তানের ঘাতক তুমি নিজেই হবে।

বৈরাম খান, অবিলম্বে গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে বলেন। আমি আমার ছেলের জীবন নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না…জাহিদ বেগ, দূর্গপ্রাসাদ আর শহরের চারপাশে অবরোধ বজায় রাখতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করেন কিন্তু আক্রমণকারী বাহিনীকে এই মুহূতে শিবিরে ফিরে যেতে বলেন।

তূর্যধ্বনি আর দামামার শব্দে তার সৈন্যরা তুষারাবৃত সমভূমির উপর দিয়ে নিজেদের তাবুর দিকে ফিরে যেতে আরম্ভ করতে, হুমায়ুন ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং কারো সাথে আর কোনো কথা না বলে নিজের দেহরক্ষী কিংবা সেনাপতি কারো সাথে কোনো কথা না বলে- সে মন্থর গতিতে তাবুর দিকে ফিরে যেতে থাকে। সূর্য এখন যদিও মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছে, সরু ধুসর আলোরশ্মি আকাশ আলোকিত করতে শুরু করেছে, তার নিজের পৃথিবী এমন অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছে বলে তার আগে কখনও মনে হয়নি। সে সফলভাবে কিভাবে এই অভিযানের পরিসমাপ্তি টানবে। সে ফিরে গিয়ে হামিদাকে কি বলবে?

৩.৪ মধ্যরাতে অতিথি

১৮. মধ্যরাতে অতিথি

রুস্তম বেগ, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। বিদায় নেবার প্রসঙ্গ আপনি এখন কিভাবে বলতে পারলেন?

সুলতান, পৃথিবীর অধিশ্বর, আমার আত্মীয়-সম্পর্কিত ভাই শাহ তামাস্প, কাঝভিন থেকে রওয়ানা দেবার আগে আমাকে সুনির্দিষ্ট আদেশ দিয়েছিলেন যে যদি আপনার অভিযানের সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে- যদি ছয়মাস পরে আপনার সাফল্যের ব্যাপারে আমার মনে সন্দেহের জন্ম হয়। আমি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাহলে যেন স্বদেশে ফিরে যাই। আমি যথেষ্ট ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছি কিন্তু এখন সেই সময় সমাগত। আমরা পারস্য থেকে যাত্রা শুরু করার পরে ছয়মাস অতিক্রান্ত হয়েছে… দুই মাস হতে চলেছে আমরা বোমাবর্ষণ বন্ধ করে এই নিষ্ফল কাবুল অবরোধ আরম্ভ করেছি। তীব্র শীত আর বিরূপ পরিবেশে আমার লোকেরা কষ্ট পাচ্ছে, আর তারচেয়েও বড় কথা এর ফলে কি লাভ হবে? দূর্গপ্রাসাদ আর শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ মজুদ রয়েছে প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর থেকে আপনার ভাইয়ের সৈন্যরাই বরং আমাদের উত্যক্ত করে, আমাদের খাবারের লোভ দেখায়…সুলতান আমি দুঃখিত কিন্তু আমি নিরূপায়। শাহ্ তাঁর বাহিনীকে অন্য কোথায় কার্যকরভাবে মোতায়েন করার পথ নিশ্চয় খুঁজে পাবেন… রুস্তম বেগ তালু বাইরের দিকে রেখে হাত উপরে তুলে যেন তার নিয়ন্ত্রণের অতীত এহেন পরিস্থিতির উদ্ভাবন হওয়াতে সে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনুতপ্ত। কিন্তু হুমায়ুনের সাথে একান্তে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে গত আধঘন্টা ধরে বরাবরের ন্যায় একই রকম বিনয়ের সাথে সে সবকিছু এগিয়ে গিয়েছে।

বিস্মিত আর হতবাক হুমায়ুন অবশ্য এখন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের চরাচরগ্রাসী ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। আমি আপনাকে যেমন বলেছি, শাহ তাসাম্প সময়সীমা বা সময়সূচী সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেননি। তিনি নিজেকে আমার ভাই হিসাবে উল্লেখ করে আমার পুরুষানুক্রমিক স্বদেশ আর সেই সাথে হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারে আমাকে সাহায্য করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন…তিনি ভালো করেই জানতেন কাজটা সময়সাপেক্ষ। আমরা বিষয়টা একত্রে আলোচনা করেছি…

সুলতান আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি যদি আমার সৈন্যদের নিয়ে পারস্যে ফিরে না যাই তাহলে আমি আমার আদেশ অমান্য করবো। যা আমি করতে পারি না।

বেশ, আপনি যখন কাঝভিন পৌঁছাবেন তখন আপনার আত্মীয় সম্পর্কিত ভাইকে এটা বলবেন- যে আমি আমার লড়াই অব্যাহত রাখবো এবং যত সময়ই প্রয়োজন হোক আমি আমার শত্রুদের এমনভাবে পরাস্ত করবো তারা আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এবং আগ্রায় আমার সিংহাসনে যখন আমি পুনরায় অধিষ্ঠিত হব আমি এটা জেনে সন্তুষ্ট থাকবো যে এই অসামান্য গৌরবের অধিকারী মোগলরা এবং একমাত্র মোগলরা।

রুস্তম বেগের মুখাবয়বে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না।

আপনি কখন বিদায় নিতে চান?

তিন কি চারদিন সুলতান আমার লোকেরা যত শীঘি যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করতে পারবে। আমি কামানগুলো আপনার কাছে রেখে যাব। কামানগুলো শাহ্ আপনাকে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ দিয়েছেন।

রুস্তম বেগ যদি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা আশা করে তবে তাকে আশাহত হতে হবে, সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হয়েছে এটা বোঝাতে হুমায়ুন বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াবার সময় ভাবে। আপনি আর আপনার লোকেরা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারবেন বলেই আমি আশা করি। শাহকে বলবেন আমাকে তার দেয়া সহযোগিতার জন্য তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এবং একটাই কেবল খেদ যে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সেটা বলবৎ ছিল।

সুলতান, আপনার বার্তা আমি তাঁকে পৌঁছে দেব। আর আশা করি আপনার প্রতি সৌভাগ্যের দেবী পুনরায় একদিন প্রসন্ন হবেন।

রুস্তম বেগ বিদায় নিয়ে চলে যাবার পরে, হুমায়ুন কিছুক্ষণ একাকী বসে থাকে। কোনো ধরনের আগাম হুশিয়ারি না দিয়েই পার্সী সেনাপতি নিজের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন। এই বিপর্যয় মোকাবেলা করতে এবং এখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে চিন্তাভাবনার জন্য তার সময় প্রয়োজন। একটাই আশার কথা তার নিজের লোকদের সংখ্যা এখন পার্সী সৈন্যদের প্রায় সমান এবং তারা যেখানে লড়াই করছে সেটা তাদের নিজেদের এলাকা। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদের কষ্টসহিষ্ণু করে তুলেছে এবং সমভূমিতে অরক্ষিত অবস্থার মতো অস্থায়ী শিবিরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে যে তুষারপাত, বরফ আর তীব্র বায়ুপ্রবাহ সেসব কিছুই তাঁদের হতোদম করতে পারবে না। পার্সী সৈন্যদের বিদায় নেবার মতো হুমায়ুনকে যা প্রায় একই রকমের মনঃপীড়া দেয়, সেটা হল তার সাফল্য সম্বন্ধে রুস্তম বেগের হতাশাজনক মূল্যায়ন। অবরোধ শুরু করার প্রথম দিন থেকেই হুমায়ুন একদিনের জন্যও নিজেকে আশাহত হতে দেয়নি, প্রতিদিনই শত্রুকে পরাভূত করার পথ খুঁজে পাবার আশা করেছে… কামরানের অবস্থানের কোনো দূর্বলতা সনাক্ত করতে পারবে। তেমন কোনো কাঙ্খিত সাফল্যের দেখা না পেলেও, তাকে কেবল ধৈর্য ধারণ করতে হবে- কামরানের রসদ অনিবার্যভাবে একসময় শেষ হবেই।

অনেকসময়, অবশ্য, যুদ্ধযাত্রার মতোই ধৈর্য ধারণ করতেও আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হয়। দূর্গপ্রাকারে নিজের শিশু সন্তানের স্মৃতিই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দূর্গপ্রাসাদ আক্রমণ করা থেকে হুমায়ুনকে বিরত রেখেছে। নিজের সন্তানের জন্য তার এই অনুভূতি কামরানের ধাপ্পাবাজি বন্ধ করতে তাঁর অনীহা- রুস্তম বেগ সম্ভবত তাঁর দূর্বলতা ভেবে বসেছে। বেশ, তবে তাই হোক। একাকী লড়াই চালিয়ে যেতে- এইমাত্র রুস্তম বেগকে সে ঠিক যা বলেছে- যদি সে বাধ্য হয়, সে তাই করবে।

তাবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে যা তখনও আধখোলা অবস্থায় ঝুলছিল, হুমায়ুন বাইরে তাকিয়ে দেখে শীতের আলোয় খুব দ্রুত অন্ধকার মিশে যায়। সে শীঘ্রই তার সেনাপতিদের ডেকে পাঠাবে কি ঘটেছে তাঁদের বলতে। পার্সীদের বিদায় নিতে দেখলে বোধহয় তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। পারস্য থেকে হুমায়ুনের নেতৃত্বে তার বাহিনী অভিযান শুরু করার প্রথমদিকে যে সৌহার্দ্য বিদ্যমান ছিল কাবুলের আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত গোত্রের লোকজন বর্ধিত সংখ্যায় তাঁর দলে যোগ দিতে শুরু করলে সেটা ততই হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। তিনদিন আগেই, পার্সী আর তাঁর লোকদের ভিতরে সংঘটিত এক সহিংতার কথা জাহিদ বেগ তাঁকে জানিয়েছিল। এক তাজিক গোত্রপতি, কয়েকজন পার্সি তাঁর রসদ চুরি করেছে বলে ধারণা করে, তাদের শিয়া সারমেয় বলে গালি দেয়। বচসার এক পর্যায়ে তাজিকদের একজন মুখে চাকুর পোচ খায় আর পার্সীদের একজনের দেহের একপাশ আগুনে মারাত্মকভাবে ঝলসে যায়, বেচারাকে জ্বলন্ত কয়লার পাত্রের উপর ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। এটা সম্ভবত উভয়পক্ষের জন্যই ভালো হল যে খিজিল-বাঁশ রা- লাল-টুপির দল হুমায়ুনের লোকেরা পার্সীদের শিয়া ধর্মমত ঘোষণা করতে তাঁদের মাথার চোঙাকৃতি টুপি আর এর পেছনদিকে ঝুলন্ত টকটকে লাল কাপড়ের ফালির জন্য তাঁদের এই নাম দিয়েছে- বিদায় নিচ্ছে। সে অবিলম্বে শিয়া ধর্মমতের প্রতি তাঁর স্মারক আনুগত্যের বিষয়টাও আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করবে। তার লোকেরা এটা দেখেও উদ্দীপিত হবে।

হুমায়ুনের নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে থেকে গলার স্বর ভেসে আসতে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। তারপরেই তাবুর পর্দা সরিয়ে দিয়ে জওহর মাথা নীচু করে ভেতরে প্রবেশ করে। সুলতান, বৈরাম খান আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।

চমৎকার!

বৈরাম খান তাবুর ভিতরে আসতে হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে তার গলার ক্ষতস্থানটা এখনও গোলাপি আর জায়গাটা কুঞ্চিত হয়ে আছে এবং নতুনের মতো দগদগ করছে। লোকটা একজন পোড় খাওয়া যোদ্ধা আর চতুর সমরবিদ। রুস্তম বেগ পার্সী সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হলেও, প্রায় শুরুর দিন থেকেই হুমায়ুনের মনে হয়েছে বৈরাম খানই পার্সীদের আসল নেতা আর সেনাপতি। তার খারাপই লাগছে এমন একজন যোদ্ধাকে হারাতে হবে বলে।

বৈরাম খান, আপনি কি কিছু বলতে চান?

বৈরাম খান স্বভাব বিরুদ্ধ ভঙ্গিতে ইতস্তত করে, যেন সে যা বলতে চায় সেটা বলাটা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। তারপরে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে নীল চোখে হুমায়ুনের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থেকে, কথা শুরু করে। রুস্তম বেগ আপনাকে কি বলেছে আমি সেটা জানি…আমি দুঃখিত।

আপনাকে এজন্য কেউ দোষ দেবে না। আমি যেজন্য দুঃখিত সেটা হল যে আপনার সহযোগিতা থেকে আমি বঞ্চিত হব।

সুলতান, বৈরাম খান তাঁর সহজাত ভদ্রতার বিপরীতে কথা বলে উঠে, আমার কথাটা আগে একটু শোনেন। কাবুলে আসবার পথে গিরিকরে আমরা যখন অতর্কিত হামলার সম্মুখীন হয়েছিলাম তখন আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। আমি সারা জীবনে যতবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি কোনোবারই মৃত্যুকে এত কাছে থেকে অনুভব করিনি…আমি মানসপটে ততক্ষণে দেখে ফেলেছি সেই নির্জন প্রান্তরে আমার কবর খোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু আপনি দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়ে আমাকে আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে আপনার এই ঋণ শোধ করার একটা সুযোগ দেবার জন্য আমি অনুরোধ করছি।

বৈরাম খান, তুমি ঋণী নও। একজন মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সহযোদ্ধা বন্ধুর প্রাণসংশয় হয়েছে দেখতে পেলে সে যা করতো আমি ঠিক সেই কাজটাই করেছি।

আমি রুস্তম বেগের সাথে পারস্যে ফিরে যাবার চেয়ে আপনার সাথেই থাকেতে বেশী আগ্রহী আর আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আপনার এই অভিযানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আপনি কি আমাকে আপনার সেনাবাহিনীতে একটা সুযোগ দেবেন?

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ায় এবং সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বৈরাম খানের দুবাহু আকড়ে ধরে তার চোখের দিকে তাকায়। সমগ্র পার্সি সেনাবাহিনীতে একজনও মানুষ, নেই যাকে আমি আমার পাশে লড়াই করার জন্য চাই কেবল…

*

সুলতান…সুলতান…উঠুন। তার কাঁধ ধরে কেউ একজন আলতো করে নাড়া দিচ্ছে… নাকি পুরোটাই কেবল একটা স্বপ্ন? হুমায়ুন তার পাশেই শুয়ে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন হামিদার দেহের কোমল উষ্ণতার আরও কাছাকাছি নিজেকে সরিয়ে আনে। কিন্তু ঝাঁকিটা ক্রমেই আরো প্রবল হয়ে উঠছে। হুমায়ুন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে হাতে তেলের একটা প্রদীপ নিয়ে জয়নাব তাঁদের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দপদপ করতে থাকার আলোর প্রেক্ষাপটে, সে দেখে জয়নবকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে, তার মুখের জন্মচিহ্নটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী গাঢ় মনে হয়।

কি ব্যাপার? তার পাশে শুয়ে থাকা হামিদা ঘুম ভরা চোখ খুলে জানতে চায়।

আধঘন্টা আগে একজন আগত শিবিরে প্রবেশে চেষ্টা করে। প্রহরীরা তাঁকে থামিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে, সে নিজের পরিচয় না দিয়ে তাঁকে জাহিদ বেগের কাছে নিয়ে যেতে বলে। জাহিদ বেগ তার সাথে কথা বলার পরে, আপনি সুলতানার সাথে জেনানাদের তাবুতে অবস্থান করছেন জানা থাকায়, তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে আদেশ দেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে।

এতো তাড়াহুড়ো করার কারণ? সকাল পর্যন্ত কি সে অপেক্ষা করতে পারতো না?

জাহিদ বেগ আমাকে কিছুই বলেনি…কেবল বলতে বলেছে যে আপনি যেন এখনই সেখানে দর্শন দেন…

বেশ, চলো দেখা যায়। হুমায়ুন শয্যা ত্যাগ করে এবং ভেড়ার চামড়ার আস্তরন দেয়া একটা লম্বা আলখাল্লা দেহের চারপাশে ভালো করে মুড়ে নিয়ে তাবুর বাইরে হিমশীতল বাতাসে বের হয়ে আসে। লোকটা কে হতে পারে? কামরান সম্ভবত কোনো বার্তাবাহক প্রেরণ করেছে কিন্তু এভোরাতে সেটা সে কেন করতে যাবে এটা অবশ্য একটা রহস্য। জ্বলন্ত কয়লার একটা ধাতবদানি ব্রাজিয়ার যাকে বলে সেখান থেকে নির্গত আলোয় সে জাহিদ বেগকে লম্বা, চওড়া কাঁধের এক লোকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা পরণে গাঢ় রঙের আলখাল্লা যার মস্ত কাবরণী সামনের দিকে টেনে দিয়ে সে নিজের মুখটা আড়াল করে রেখেছে। কামরানের প্রেরিত কোনো গুপ্তঘাতক কি লোকটা… কিংবা পারস্যের শাহের অনুগত ঘাতক?

জাহিদ বেগ লোকটা কি সশস্ত্র?

না, সুলতান। লোকটা তাকে তল্লাশি করার সময় আমাদের সহযোগিতাই করেছে।

হুমায়ুন লোকটার কাছাকাছি এগিয়ে যেতে, লোকটা ধীরে, ইচ্ছাকৃতভাবে মস্ত কাবরনী পিছনের দিকে সরিয়ে দেয়। ব্রাজিয়ারের আবছা আলোয় হুমায়ুন সাথে সাথে চিনতে পারে যে লোকটা হিন্দাল, চওড়া মুখে ঘন দাড়ির জঙ্গল কিন্তু তার সৎ-ভাইকে এখনও তার চিনতে ভুল হয় না। এক মুহূর্তের জন্য, দুই ভাই নির্নিমেষ ভাবে নিরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতোকিছু ঘটনা ঘটে যাবার পরেও, হুমায়ুনের মনে সহসা হিন্দালের স্মৃতি পুনরায় জাগরুক হয়ে উঠে- মাহামের কোলে শিশু হিন্দাল, কিভাবে ছোট ভাইকে সে প্রথমবারের মতো ঘোড়ায় চড়তে শিখিয়েছিল, প্রথমবারের মতো খরগোশ শিকার করে হিন্দালের সেই উল্লসিত অভিব্যক্তি; তারপরে পরবর্তী সময়ের স্মৃতি হিন্দালের বিদ্রোহের সময় তার মুখের অভিব্যক্তি, মালদেব আর মির্জা হুসেনের কাছে নির্বাসিত হুমায়ুনের প্রথমবার যাত্রার সময় কিভাবে বিশ্বস্ত তার সাথে সে হুমায়ুনের সঙ্গী হয়েছিল; তারপরে সবকিছু ছাপিয়ে যায় তাঁদের শেষবার দেখা হবার স্মৃতি হামিদার কারণে কিভাবে তারা একে অপরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং কিভাবে হুমায়ুনের পায়ের কাছে থুথু ফেলে রক্তাক্ত, চোখে মুখে কালশিরে পড়া কিন্তু তখনও উদ্ধত হিন্দাল ঘোড়া নিয়ে চলে গিয়েছিল।

আমাদের একটু একা থাকতে দাও, আর দেখবে কেউ যেন আমাদের বিরক্ত না করে। জাহিদ বেগ অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত হুমায়ুন অপেক্ষা করে, পুরোটা সময় সে তীক্ষ্ণ চোখে হিন্দালের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপরে জিজ্ঞেস করে, এখানে তুমি কেন এসেছো? এবং এভাবে আমার সামনে নিজেকে কেন একাকী সমর্পন করেছো?

গত কয়েকমাস যাবত কামরানের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার পরে কাবুলের উত্তরপূর্বে জাগিশের উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে আমার শেষ বিশ্বস্ত বন্ধুদের আশ্রয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও খবর পৌঁছে যায়। কামরান কি করেছে জানতে পারি- আপনার কামানগুলো যখন কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরে গোলাবর্ষণ করছিল তখন সে কিভাবে আকবরকে এর দূর্গপ্রাকারে উন্মুক্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। তার কীর্তিকলাপ দেখে আমি শিউরে উঠি- সবকিছুই আমাদের যোদ্ধার রীতিনীতির প্রতি একটা চরম অবমাননা আর আমাদের পরিবারের সম্মানে কলঙ্ক লেপন করেছে।

চমৎকার অনুভূতি, কিন্তু তুমি এখনও আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি। আমরা পরস্পরের সাথে এসো খোলাখুলি আলোচনা করি। তুমি কেন এখানে এসেছে?

আকবরকে উদ্ধারে সাহায্য করতে।

হুমায়ুন এতোটাই চমকে যায় যে কিছুক্ষণের জন্য সে বাকরুদ্ধ হয়ে ব্রাজিয়ারের উপরে শান্তভাবে নিজের বিশাল দুটো হাতে ওম পোহাতে থাকা তার সৎ-ভাইয়ের অবয়বের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। নিরবতা ভঙ্গ করে হিন্দাল কথা বলে উঠে। আপনি নিজেকে প্রশ্ন করছেন যে কেন আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইবো। ব্যাপারটা সহজ। রক্তে বাঁধন যা আমৃত্যু আমরা বহন করবো তারপরেও আপনার আর আমার ভিতরে কোনোমতেই সমঝোতা হওয়া অসম্ভব। এটা অপরিবর্তনীয়। আজ রাতে আমি হামিদা কেবলমাত্র হামিদার কথা ভেবেই এসেছি…তার কাছে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করে তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে…সে নিশ্চয়ই অসম্ভব মনোকষ্টে…।

হুমায়ুন আড়ষ্টভঙ্গিতে দেহের ভর বদলায়, হামিদা প্রসঙ্গে হিন্দালের সাথে আলোচনা করতেই তাঁর অস্বস্তিবোধ হয় এবং তার চেয়েও বড় কথা হামিদার সন্তানকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে কিভাবে সে হামিদাকে আশাহত করেছে, সেসব নিয়ে তো সে হিন্দালের সাথে আরও কথা বলতে চায় না।

যদি সত্যিই তুমি হামিদার কষ্ট লাঘব করার ভাবনা থেকে এখানে এসে থাকো তাহলে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। সে পুনরায় চুপ করে থাকে তারপরে নিজের গর্ব গলধঃকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমি যেমন বলেছি যে আমরা খোলাখুলি আলোচনা করবো সেই বাস্তবতা মেনে বলছি, আকবরকে হারাবার পর থেকে মানসিক শান্তি বা সত্যিকারের বিশ্রাম এই দুটি জিনিষ হামিদা ভুলেই গেছে…কিন্তু তুমি যখন সাহায্যের কথা বলেছে, তখন আসলে কি বোঝাতে চেয়েছো? কোনো ধরনের সফলতা ছাড়াই আমি আজ প্রায় চার মাসাধিক কাল ধরে দূর্গপ্রাসাদ অবরোধ করে রেখেছি। আমি আমার সেনাবাহিনীর সহায়তায় যা করতে পারিনি সেখানে তুমি একাকী কি করতে পারবে বলে মনে করো?

আমি কামরানের আস্থা অর্জন করে দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করতে পারি। একবার ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে আমি আকবরকে উদ্ধারের একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারবো।

কিভাবে? কামরান তোমাকে কেন আমার চেয়ে বেশী বিশ্বাস করবে?

আমি তাঁর আস্থা অর্জন করতে পারবো, কারণ আমি তাকে ভালো করে চিনি কারণ আমি তার দুর্বলতা সম্বন্ধে অবগত রয়েছি। সে আপনাকে ঘৃণা করে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সেই আমাদের পরিবারের স্বাভাবিক প্রধান। নিজের সম্বন্ধে তাঁর আত্মগর্ব, তাঁর আত্মশ্লাঘা ব্যবহার করে আমি তাকে বোঝাব যে আমার বোধোদয় ঘটেছে এবং আমি পুনরায় তার মিত্র হতে আগ্রহী…আপনার বিরুদ্ধে বাবরের অন্যান্য পুত্রদের তার অধীনে একত্রিত করতে চাই। কিন্তু এসব নির্ভর করছে একটা বিভ্রম সৃষ্টি উপরে…

বলতে থাকো।

আপনাকে অবশ্যই প্রথমে অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যেন মনে হয় আপনি আপনার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কাবুল ত্যাগ করছেন। পাহাড় থেকে আমার নিজের লোকদের নিয়ে আসবার জন্য তাহলে আমার সামনে একটা পথ খুলে যায় এবং কামরানকে আমি তাহলে মৈত্রীর প্রস্তাব করতে পারি…

তুমি বলতে চাইছো এত সপ্তাহ পরে আমি অবরোধ তুলে নেব, যখন আমি কামরানের উপরে অবরোধ আরও কঠোর করার কথা ভাবছি।

আপনাকে সেটাই করতে হবে। কাবুলের আশেপাশে আপনি শিবির স্থাপন করে অবস্থান করলে আমার পরিকল্পনা সফল হবে না। কামরানকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আপনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

তুমি বড্ডবেশী দাবী করছো। তোমার এতো সব ভালো কথার পরেও আমার বিশ্বাস তুমি ইতিমধ্যেই কামরানের সাথে সন্ধি করেছে এবং সেই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে আমার সাথে চালাকির চেষ্টা করতে।

আমি আমাদের মরহুম আব্বাজানের স্মৃতির কসম করে বলছি এর মাঝে কোনো ধরনের ছলনা নেই… হুমায়ুনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিঃশঙ্কভাবে হিন্দালের তামাটে চোখ ফিরিয়ে দেয়।

বেশ মানলাম- ধরো আমি তোমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করলাম, তারপরে তাহলে কি ঘটবে?

কামরানের মনে ধারণা জন্মাবে যে সে আপনাকে পরাস্ত করেছে। নিজের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সে তখন আমার গল্প আরো সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকবে- যে স্বয়ং আপনার পক্ষেও যখন তাঁকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি, আমি তাকে আমাদের পিতার প্রকৃত উত্তরাধিকারি হিসাবে মেনে নিতে এবং তার অধীনস্ত থাকতে প্রস্তুত আছি।

তোমার আসলেও মনে হয় সে তোমার কথা বিশ্বাস করবে?

নিজেকে নিয়ে তাঁর আত্মগর্বকে মোটেই ছোট করে দেখবেন না। আর তাছাড়া, সে কেন আমাকে অবিশ্বাস করবে? আমি কেন পাহাড়ে পলাতক পাহাড়ী জীবনের বদলে মোগল যুবরাজের বিচ্ছুরিত গৌরবের একটা অংশের অধিকারী হতে চাইব না যার সৌভাগ্যের সূর্য উদীয়মান যখন আপনি ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আর আমার সাথে আগত অতিরিক্ত লোকদের সাহায্য লাভ করে সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তারপরে একবার দৃর্গপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারলে আমি আকবরকে কাবুল থেকে গোপনে বের করে আনবার একটা পথ ঠিকই খুঁজে পাবো…কিন্তু এজন্য একটু সময় প্রয়োজন। আমাকে যে কেবল কামরানের আস্থাই অর্জন করতে হবে তা নয় আমাকে সেই সাথে উপযুক্ত সুযোগও খুঁজে পেতে হবে…

কামরানের আম্মাজান গুলরুখের কি খবর? সে তাঁর সন্তানের মতোই ধূর্ত সম্ভবত তাঁর সন্তানের চেয়েও ধূর্ততর। সে যদি কামরানের সাথে থাকে তাহলে তাঁকে সহজে প্রতারিত করতে পারবে না।

হিন্দালকে বিস্মিত দেখায়। গুলরুখ মারা গিয়েছে। কাবুল থেকে কান্দাহারে আগমনের সময় তাঁকে বহনকারী গরুর গাড়িটি দরীতে পড়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত খবরটা শুনেছেন।

না। হুমায়ুন ধাক্কাটা হমজ করে। নিজের সন্তানের উচ্চাকাঙ্খ চরিতার্থ করতে যে মহিলা তাঁকে আফিম আর সুরার নেশায় আসক্ত করেছিল তার জন্য সে সামান্যই দুঃখবোধ করে। তারপরেও তুমি নিজেকে ভীষণ বিপদের সম্মুখীন করতে চাইছে। আচ্ছা ধরে নিলাম তোমার উদ্দেশ্য সফল হল, তুমি বিনিময়ে আমার কাছে কি আশা কর?

কিছু না। আমি যা কামনা করতাম আপনি তাঁর পুরোটুকুই ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং আপনার পক্ষে সেটা ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব…

দুই ভাই মুহূর্তের জন্য নিরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন যখন সে হিন্দালকে আবার সামনে পেয়েছে, হুমায়ুন অনুধাবন করে নিজের অপরাধবোধ সম্বন্ধে, তাকে আহত করার কারণে নিজের খেদ সম্বন্ধে কতকিছু সে তাকে বলতে চায়। কিন্তু তার সৎ-ভাই তার কথা বিশ্বাস করবে না এবং তাছাড়া কোনভাবেই আর বাস্তবতাকে পরিবর্তন করা সম্ভব না হামিদাকে হুমায়ুন এতো প্রবল আবেগ দিয়ে ভালোবাসে অন্য কোনো রমণীর জন্য যা সে কখনও অনুভব করেনি। সে যদি আবারও সুযোগ পায় তাহলে হামিদাকে পাবার জন্য তার সংকল্প আগের মতোই নির্মম হবে।

দুই ভাইয়ের কথোপকথনের পুরোটা সময় হুমায়ুনের মুখ থেকে হিন্দাল তার দৃষ্টি একবারের জন্যও সরায়নি। বেশ, আপনার কি মতামত? আপনার শিবির ত্যাগ করার পূর্বে ধরে নিচ্ছি যে আপনি আমাকে যেতে দিতে প্রস্তুত- আমাকে অবশ্যই সেটা জানতে হবে আর সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাকে অবশ্যই এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। আপনার শিবিরের অনেক মানুষই আমায় চেনে এবং তাদের ভিতরে হয়ত গুপ্তচরও রয়েছে। আমার পরিকল্পনা সফল হবার সামান্যতম সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যাবে, এখানে আমার উপস্থিতির কথা যদি কামরানের কানে পৌঁছে…

আমার পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখার জন্য একটু সময় প্রয়োজন। আমি জাহিদ বেগকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে তার তাবুতে নিয়ে যেতে এবং আমি না আসা পর্যন্ত সে তোমার সাথে থাকবে। সকাল হতে এখনও ঘন্টা তিনেক সময় বাকি আছে। তুমি তোমার উত্তর দুই ঘন্টার ভিতরে পেয়ে যাবে।

হিন্দাল চলে যেতে, হুমায়ুন খোলা প্রান্তরে শীতের তোয়াক্কা না করে পায়চারি করতে থাকে। হিন্দালের পরিকল্পনাটা দুর্দান্ত আর সাহসী কিন্তু সে যদি তাঁর কথায় রাজি হয় তাহলে অনেক কিছুই তাকে বিশ্বাসের উপরে ছেড়ে দিতে হবে। সম্রাট হবার পর থেকে নিজের পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস করে কতবার তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে হয়েছে?…কিন্তু আজকে রাতে হিন্দালের কণ্ঠস্বরের প্রতিটা চড়াই উতরাই, তাঁর প্রতিটা অভিব্যক্তির ভিতরে দৃঢ় প্রত্যয়ের একটা ছাপ স্পষ্ট টের পাওয়া গেছে। তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, হামিদার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা না করে সে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, বেচারী কেন তাঁর এতে দেরী হচ্ছে দেখে নিশ্চয়ই এতোক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।

সে ঠিকই অনুমান করেছিল। হুমায়ুন তাঁদের তাবুতে যখন ফিরে আসে তখন দেখে যে হামিদা শয্যায় উঠে বসে রয়েছে এবং তার জন্য অপেক্ষা করছে, আকষ্মিক নিদ্রাভঙ্গের কারণে তাঁর মাথার ঘন কালো চুল কাঁধের উপরে আলুথালু হয়ে পড়ে রয়েছে এবং তার অভিব্যক্তিতে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্টই বোঝা যায়। রাতের বেলা যে লোকটা একাকী শিবিরে এসেছে- সে আর কেউ না, হিন্দাল, হামিদা কোনো কথা বলার আগেই হুমায়ুন তাকে অবগত করে।

হিন্দাল?

হ্যাঁ। আকবরকে উদ্ধারের ব্যাপারে সে আমাদের সাহায্য করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আমি যদি অবরোধ তুলে নেই এবং এখান থেকে চলে যাবার ভাণ করি, সে দূর্গপ্রাসাদের গিয়ে কামরানকে মৈত্রীর প্রস্তাব দেবে। কামরানের আস্থা একবার অর্জন করার পরে সে আকবরকে কাবুল থেকে গোপনে বের করে আনবার একটা উপায় খুঁজে বের করবে।

সে কি সত্যিই আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে…।

হামিদার ভেতরে আশার কুড়ি এরই ভিতরে পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে হুমায়ুন বুঝতে পারে। মানে, সম্ভবত…কিন্তু প্রশ্ন হল আমরা কি হিন্দালকে আদৌ বিশ্বাস করতে পারি?

হামিদার আশাবাদী অভিব্যক্তি হোঁচট খায়। অন্ধকারে একাকী আপনার শিবিরে এসে হিন্দাল বিশাল একটা ঝুঁকি নিয়েছে। সে মারাও যেতে পারতো। আর তাছাড়া পুনরায় আপনার সামনে দাঁড়াতে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন হয়েছে।

মানলাম, কিন্তু সে যদি সাপের গালে আর ব্যাঙের গালে চুমু দেবার খেলায় নেমে থাকে তাহলে ঝুঁকির তুল্যমূল্য সম্ভাব্য পুরষ্কারের কথাও সে হয়তো ঠিকই বুঝতে পেরেছে। যদিও সে শপথ করে বলেছে যে কামরানের সাথে তার কোনো প্রকার সংশ্রব নেই, অবরোধ তুলে নেবার জন্য আমাকে বাধ্য করতে কিংবা হিন্দাল আর তার লোকেরা কাবুলে গিয়ে কামরানের সাথে যাতে যোগ দিতে পারে- এটা কোনো ধরনের চালাকি। হামিদা আর হুমায়ুন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে তাবুর পুরু চামড়ার দেয়ালে কেবল বাতাসের আছড়ে পরার শব্দ শোনা যায়। আমি যদি এখন কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেই তাহলে কামরানের অবস্থা শক্তিশালী হবে এবং তাঁকে পরাস্ত করা আর আমাদের সন্তানকে উদ্ধার করার সুযোগ ক্ষীণ হয়ে যাবে, হুমায়ুন অবশেষে নিরবতা ভেঙে বলে।

হামিদা চোখে মুখে একটা বিষণ্ণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে মুখের উপর থেকে চুলের গোছা পেছনে সরিয়ে দেয়। আপনাকে সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, হিন্দাল কেন আমাদের সাহায্য করতে চায়?

ঠিক এই প্রশ্নটার উত্তর আমি জানতে চেয়েছিলাম। সে বলেছে যে একটা শিশুর জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে কামরান আমাদের পরিবারের সম্মানহানির কারণ হয়েছে…

পারিবারিক সম্মান কি আসলেই তাঁর কাছে এতোটাই মূল্যবান?

সম্ভবত মূল্যবান। তারপরে সে আমাকে আরেকটা, সম্ভবত আরো গাঢ় একটা কারণের কথা বলে। আমাকে না, সে তোমাকে সাহায্য করতে চায়। সে জানে তুমি কেমন মনোকষ্টে আছে এবং সে তোমার যন্ত্রণার উপশম করতে চায়…

হুমায়ুনের কথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে, হামিদার চোখমুখ লাল হয়ে উঠে আর সে মাথা নামিয়ে নেয়। হামিদার জন্য হিন্দালের অনুভূতি নিয়ে তারা দুজনে কখনও খোলাখুলি আলোচনা করেনি কিন্তু অবশ্যই সে বিষয়টা জানে। হামিদা কিছুক্ষণ অস্থির হয়ে পায়চারি করে ঠিক যেমনটা হুমায়ুন সামান্য আগে হিম শীতল শীতের রাতে করেছিল, তারপরে সে মুখাবয়বে দৃঢ়তার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে হুমায়ুনের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার মনে হয় হিন্দাল সত্যি কথা বলছে। সবচেয়ে বড় কথা হল যে তাকে বন্দি করে রেখেছিল সেই কামরানের প্রতি তার কোনো অনুরাগ থাকার কথা নয়… আমাদের উচিত তাঁকে বিশ্বাস করা। সে যদি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে কামরানের মতো সেও আমাদের সন্তানের প্রাণের জন্য আমাদের ভয়কে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাবার দোষে দোষী হবে। আমার বিশ্বাস তাঁকে দিয়ে এমন জঘন্য কাজ সম্ভব নয়। হুমায়ুন অনুগ্রহ করে আসুন এই সুযোগটা আমরা গ্রহণ করি।

হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে তাঁকে নিজের কাছে টেনে আনে এবং তাঁকে সজোরে আকড়ে ধরে রেখে তার দেহের পরিচিত চন্দনের সুগন্ধ প্রাণ ভরে গ্রহণ করে। হিন্দালকে বিশ্বাস করার জন্য তাঁর এই উদগ্রীব বাসনা কিংবা হামিদার জন্য তার ভালোবাসা কোনটার দ্বারাই তার প্রভাবিত হওয়া উচিত হবে না। এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলির একটা। কিন্তু সে মনে মনে যতই বিষয়টা নিয়ে বিশ্লেষণ করুক, তার মনের গভীরে যুক্তির চেয়ে সহজাত কোনো একটা অনুভূতি তাকে বারবার বলতে চায়। হামিদা ঠিকই বলেছে- হিন্দাল যা বিশ্বাস করে সেটাই সে বলেছে এবং তাদের তাকে বিশ্বাস করা উচিত। কিন্তু তার মানে এই না যে হিন্দালের পরিকল্পনা সফল হবেই। তার পরিকল্পনা খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু সবাই যদি নিজেদের অংশ ভালোভাবে সম্পন্ন করে তাহলে হয়তো কাজ হলেও হতে পারে।

বেশ তাই হবে, হুমায়ুন অবশেষে মন্তব্য করে। আমি হিন্দালকে গিয়ে বলছি যে আমরা তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছি যে আমাদের সন্তানের জীবন তার হাতে সমর্পণ করতে তুমি রাজি হয়েছে।

তাকে বলবেন মাহাম আগা আর তার সন্তানকেও যেন সে বের করে নিয়ে আসে। কামরান যখন জানতে পারবে আকবর পালিয়েছে তারা তখন সমূহ বিপদের সম্মুখীন হবে।

হুমায়ুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমাকে আরো অনেক কিছুই তার সাথে আলোচনা করতে হবে- কাবুল থেকে কতদূরে আমি আমার বাহিনী সরিয়ে নিয়ে যাবো। যখন প্রয়োজন হবে তখন সে আমাদের কোথায় খুঁজে পাবে সেটাও তার জানা থাকা দরকার। হুমায়ুন ঝুঁকে গিয়ে হামিদার কপালে চুমু খায়। হামিদা, এবিষয়ে কারো সাথে এখনই আলোচনা করবে না। এই পরিকল্পনা সফল করতে হলে আমার লোকদের আসলেই বিশ্বাস করাতে হবে যে আমরা কামরানের কাছে কাবুল ছেড়ে যাচ্ছি।

রাতের আধারে হুমায়ুন আরো একবার পা রাখলে তাঁর আব্বাজানের রোজনামচার কিছু কথা তার মনে পড়ে।

কোন সম্রাটের জন্য সতর্কতা মূল্যবান আর গ্রহণযোগ্য একটা বিষয় কিন্তু একজন সত্যিকারের মহান শাসকের সেই সাথে এটাও জানা উচিত কখন তাঁকে ঝুঁকি নিতে হবে।

৩.৫ তুষার ঝড়ের কবলে

১৯. তুষার ঝড়ের কবলে

শীতের সূর্য ইতিমধ্যেই দিগন্তের অনেক কাছে নেমে এসেছে, যখন হুমায়ুন কাবুল থেকে তাদের ফিরতি যাত্রার পথে খাড়া নীচের দিকে নেমে যাওয়া একটা গিরিপথ দিয়ে সে আর তার সৈন্যরা নামার সময়ে হিমশীতল বাতাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে ভেড়ার চামড়ার আস্তরন দেয়া একটা আলখাল্লায় নিজেকে ভালো করে মুড়ে নিয়েছে, আহমেদ খানকে তাঁর দিকে ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে আসতে দেখে।

সুলতান, আমরা শিবির স্থাপন করতে পারবো, এমন একটা স্থান এখান থেকে মাইল চারেক সামনে আমার গুপ্তদূতেরা চিহ্নিত করেছে। জায়গাটা পর্বতশীর্ষের কাছাকাছি একটা উঁচুভূমি যা বায়ুপ্রবাহ থেকে রক্ষিত আচ্ছাদিত দিকে অবস্থিত হওয়ায় আমাদের বাতাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে এবং কেউ আমাদের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে, আমাদের প্রহরীরা উঁচুভূমিতে অবস্থান করায় অনেক আগেই তাদের দেখতে পেয়ে আমাদের হুশিয়ার করতে পারবে।

দারুণ দেখিয়েছে, আহমেদ খান।

হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে তার গুপ্তদূতদের প্রধান কথা শেষ করে পুনরায় সৈন্যসারির সম্মুখের দিকে এগিয়ে যায়। কাবুলের উপর থেকে সহসা অবরোধ তুলে নেবার কারণ সম্বন্ধে সে তার কোনো সেনাপতিকে অবহিত করেনি, তাঁর কারণ এই না যে তাদের আনুগত্যের প্রতি সে সন্দেহ পোষণ করে, তার কারণ এই যে তাদের যে কোনো একজনের একটা আলটপকা মন্তব্যে হয়ত পুরো ব্যাপারটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। সে বরং তাঁদের বুঝিয়েছে অবরোধের বিষয়ে সে ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠেছে- বলেছে যে সে পর্বতমালার পূর্বদিকে অবস্থিত বাগে-গজরে যেতে ইচ্ছুক যেখানে কামরানের অনুগত লোকদের প্রহরীধীন অবস্থায় অন্যান্য অনেক ছোট ছোট দূর্গ রয়েছে দখল করার মতো এবং সেখান থেকে সে আরো লোক সংগ্রহ করার আশা রাখে। বরফ একেবারে গলে যাবার পরেই সে কাবুলে ফিরে এসে পুনরায় অবরোধ আরোপ করবে।

জাহিদ বেগ, আহমেদ খান আর নাদিম খাজা নিজেদের ভিতরে বিস্মিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি আদান-প্রদান করে। হিন্দালের নৈশকালীন গোপন অভিসারের সাথে হুমায়ুনের এই আকষ্মিক সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সে বিষয়ে জাহিদ বেগ যদি কিছু আঁচ করতে পারেও তার অভিব্যক্তিতে সেটা প্রকাশ পায় না বরং অন্যান্যদের মতোই সেও সাথে সাথে শিবির গুটিয়ে নেয়ার ঝক্কিপূর্ণ কাজে মনোনিবেশ করে। কেবলমাত্র বৈরাম খানের আগ্রহী চোখের দৃষ্টিতে হুমায়ুনের মনে হয়- তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে সে অনুমানের ঢেউ খেলা করতে দেখেছে কিন্তু অন্যদের মতো পারস্যের অধিবাসীও মুখে কুলুপ এঁটে রাখে। হুমায়ুন এসব কিছুর মূলে যে কারণ রয়েছে সেটা গুলবদনকে খুলে বলেছে। হিন্দালের বোন হবার কারণে তার জানবার অধিকার রয়েছে। হামিদার মতোই, গুলবদনও নিশ্চিত হিন্দালের প্রস্তাবে কোনো গলদ নেই।

হুমায়ুন সহসা নিজের পেছন থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায় এবং তাঁর সৈন্যসারির একেবারে পেছন থেকে অস্পষ্ট হট্টগোলের শব্দ ভেসে আসে। অতর্কিত হামলার জন্য এই আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ গিরিপথটা, যার একদিকে দুরারোহ ঢাল নিচে শীতে জমে থাকা নদীর বুকে গিয়ে থেমেছে একটা আদর্শ স্থান। হুমায়ুন তাঁর পর্যানের উপর ঘুরে পেছনে তাকায় কিন্তু আঁকাবাঁকা বাঁকের কারণে শব্দটা যেখান থেকে আসছে, সেটা দেখতে পায় না। সে যেটা দেখতে পায় সেটা হল তার লোকদের কয়েকজন ইতিমধ্যে নিজেদের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পেছনের পশ্চাক্ষীদের অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। তার ভাবনায় সেই ভয়টা সাথে সাথে ফিরে আসে, যা থেকে সে কখনই আসলে পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। হিন্দাল নিশ্চয়ই তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না এবং কামরান আর তার অনুগত বাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিবে না? তার সৎ-ভাইদের একজনের দ্বারা পুনরায় প্রতারিত হবার মতো এতবড় আহাম্মকি সে করেনি, নাকি করেছে? হুমায়ুন তার কালো ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং তাঁর বিভ্রান্ত সৈন্যদের ভিতর দিয়ে গিরিপথের ভেতর নিজের পথ করে নিয়ে এগিয়ে যায়, তাঁর দেহরক্ষীরা তাঁকে নিরবে অনুসরণ করে।

সে এমনকি যখন প্রথম বাকটা ঘুরে সে তখনও কিছু দেখতে পায় না, কিন্তু পেছন থেকে ভেসে আসা বিক্ষোভের আওয়াজ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতিনিয়ত জোরাল হচ্ছে। তারপরে, হৃৎপিণ্ডে মাদলের বোল নিয়ে সে দ্বিতীয় বাকটা অতিক্রম করে এবং উত্তেজনার কারণটা দেখতে পায়। আল্লাহতালাকে অশেষ শুকরিয়া, ব্যাপারটা কোনো অতর্কিত হামলা নয়। সংকীর্ণ গিরিপথে পাশাপাশি চলতে গিয়ে দুটো গরুর গাড়ির চাকা পরস্পরের সাথে আটকে গিয়েছে। একটা গাড়ি পুরোপুরি উল্টো দিকে ঘুরে গিয়েছে। গাড়িটার পেছনের চাকা শূন্যে ঝুলে আছে আর কিছু লোক ভারী কাঠের জোয়াল ধরে ষাড় দুটোর মাথা নিজেদের দিকে টানছে এবং সামনের চাকার পেছনে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চেষ্টা করছে গাড়িটাকে পুনরায় শক্ত মাটির উপরে নিয়ে দাঁড় করাতে।

কিন্তু মূল সমস্যা সৃষ্টি করেছে দ্বিতীয় গাড়িটা যা সম্ভবত এই পুরো দুর্ঘটনার সূত্রপাতকারী। গাড়িটার অন্তত অর্ধেক লোকজন ষাড়সহ কিনারা দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়েছে। নীচের গিরিসঙ্কটের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন তাদের তিনজনের নিথর দেহগুলো জমে বরফ হয়ে থাকা নদীবক্ষের ধারাল আর এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা পাথরের উপরে পড়ে থাকতে দেখে, তাদের দেহ থেকে বের হওয়া রক্তে চারপাশের বরফ লাল হয়ে উঠেছে। আরেকটা ষাড় ঢালের উপর থেকে ছিটকে গিয়ে ঝুলে আছে, দড়ির প্রান্ত থেকে জীবন্ত ঝুলে আছে এবং গাড়িটার দুজন গাড়োয়ান সামনের দিকে ঝুঁকে এসে, গাড়ির সাথে গরু জুড়ে দেবার সরঞ্জামাদি ধরে বেচারাকে টেনে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। অন্যান্যরা চেষ্টা করছে গাড়িটা যাতে ভারের কারণে ঢাল দিয়ে গড়িয়ে না পড়ে যায় সেজন্য এর চাকার সামনে পাথর দিয়ে উন্মত্তের ন্যায় প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে। হুমায়ুনের চোখের সামনে দুই গাড়োয়ানের একজন বরফের উপরে আছাড় খায় এবং ভারসাম্য হারিয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে গিরিসঙ্কট থেকে ছিটকে যায়। নিচের মাটিতে পড়ে থাকা ষাড়গুলোর একটার পাশে আছড়ে পড়ার আগে তাঁর দেহটা গিরিসঙ্কটের পাথুরে পার্শ্বদেশে দুবার ধাক্কা খায়।

দড়িগুলো কেটে দাও। ষাড়গুলোকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে যেও না, চিৎকার করে হুমায়ুন আদেশ দেয়। আরো প্রাণহানির কোনো অর্থ হয় না। তোমাদের যদি সেজন্য গাড়িগুলোর মায়া ত্যাগ করতে হয় তবে তাই কর।

দীর্ঘদেহী, লাল পাগড়ি পরিহিত এক লোক দ্রুত নিজের কোমরবন্ধ থেকে একটা লম্বা খঞ্জর বের করে এবং বেকায়দায় ঝুলে থাকা ষাড়ের দিকে দৌড়ে যায়। দুই মিনিটেরও কম সময়ে সে চামড়ার দড়িগুলো কেটে ফেলে আর ষাড়টা জান্তব গর্জন করে আর উন্মত্তের মতো শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে গা গুলিয়ে ওঠা একটা আওয়াজ করে নিচের পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ে। গরুর গাড়িটা, হুমায়ুন এতক্ষণে খেয়াল করে সেটায় বিশালাকৃতি কয়েকটা তামার কড়াই আর রান্নার অন্যান্য সরঞ্জামাদি রয়েছে, রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। ভালো, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, এই আবহাওয়ায় তার সৈন্যদের গরম খাবার প্রয়োজন। অন্য গাড়িটাকে যারা শীতের বাতাসে গরম শ্বাস নির্গত করে ধাক্কা দিচ্ছিল আর টানছিলো তারাও শেষ পর্যন্ত, বরফ হয়ে থাকা মাটিতে গাড়িটায় বহন করা তাবুর একটা অংশ নামিয়ে রেখে, এর পেছনের চাকা পুনরায় গিরিসঙ্কটের উপরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

হুমায়ুন স্বস্তির শ্বাস নেয়। পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হতে পারতো। তার আরো লোক মারা যেতে পারতো কিংবা তাঁর সবেধন নীলমনি ভারবাহী হাতির পালের দুই একটা নিচের মাটিতে আছড়ে পড়তে পারতো। তার আর তার লোকদের এবার যাত্রাবিরতি করার সময় হয়েছে এবং হিন্দালের আন্তরিকতার একভাবে বা অন্যভাবে প্রমান পেতে আর পরিস্থিতির অগ্রগতি সম্বন্ধে জানতে সে অপেক্ষা করবে। আজ রাতে, সে তার লোকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করবে যে কাবুলের সাথে চল্লিশ মাইলের বেশী দূরত্ব তৈরী করার পরে আর একটা চমৎকার স্থান পাবার কারণে তারা এখানে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে কয়েকদিন বিশ্রাম নেবে এবং নিজেদের অস্ত্র আর অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের পরিচর্যা করবে। বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে তার লোকদের খুশী হবার কথা, যদিও তাদের সবারই মন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে, বিক্ষুব্ধও বলা যায়। কাবুলের আশেপাশে বসবাসকারী গোত্রগুলোর অনেকেই ইতিমধ্যে অন্যত্র রওয়ানা দিয়েছে, তাঁদের লুটতরাজ করার আশা শেষ হয়ে গিয়েছে বিশ্বাস করে, কিন্তু হুমায়ুন জানতো এমনটা ঘটতেই পারে তাই সে মনে মনে এর জন্য প্রস্তুত ছিল। হিন্দালের পরিকল্পনা যদি সফল হয় তাহলে অচিরেই সে কাবুল ফিরে যাবে সেখানের দূর্গপ্রাসাদ নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আক্রমণ করতে। তাঁর কামানগুলো আরো একবার গোলাবর্ষণ শুরু করলে যারা তাঁকে ত্যাগ করেছিল তারা অচিরেই আবার এসে যোগ দেবে…।

সে তার লোকদের নিয়ে কোনদিকে যাবে এবং মোটামুটি কতটা দূরে সে বিষয়ে হিন্দালের সাথে সে একমত হয়েছিল। তাদের অস্থায়ী শিবির স্থাপণ একবার শেষ হলে সে আহমেদ খানকে আদেশ দেবে- দিন রাত তার গুপ্তদূতেরা যেন নজরদারি বজায় রাখে। তাঁরা তাহলে বিশ্বাস করবে কামরানের সৈন্যদল কর্তৃক অনুসরণের লক্ষণের জন্য তারা পাহারা দিচ্ছে। অবশ্য হিন্দালের পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয় বা হিন্দাল তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে পরিস্থিতি সেদিকেই মোড় নেবে…

*

ভেড়ারচামড়া আর পশমের পুরু একটা স্তরের নীচে শুয়ে হুমায়ুন অস্থিরভঙ্গিতে নড়াচড়া করে, তার ভাবনা আর দুশ্চিন্তাগুলোর কারণে আজকাল ঘুমান তারপক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। হিন্দালকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি, পারি না আমরা? সে জিজ্ঞেস করে। একমাসেরও বেশী সময় অতিক্রান্ত হতে চলেছে এবং আমরা এখনও অন্ধকারেই রয়েছি।

তার পাশে শুয়ে থাকা একই রকম নিদ্রাহীন হামিদাও কেবল এপাশ ওপাশ করে। আমি সত্যিই সেটা বিশ্বাস করি। আমার আব্বাজানের নিকট একজন পরামর্শদাতা হিসাবে কর্মরত থাকার সময়ে তাঁর সম্বন্ধে তিনি যা কিছু বলেছিলেন আমাকে সেটাই বিশ্বাস করতে বলে। ভাইয়ের জন্য গুলবদনের ভালোবাসা আর সমীহবোধও সেই কথাই বলে। আমাদের সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে সেটা না বরং সেই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবে বা কোনো কারণে আকবরকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হবে আমি এটা ভেবেই বেশী উদ্বিগ্ন। কামরান তখন তাহলে কি করবে? সে নিশ্চয়ই আকবরকে হত্যা করবে না, নাকি করতেও পারে…?

প্রশ্নটা এই প্রথমবারের মতো হামিদা উচ্চারণ করে। না, সে যতটা নিশ্চিত তার চেয়ে বেশী নিশ্চয়তা কণ্ঠে আরোপ করে সে বলে। বন্দি হিসাবে আকবরের গুরুত্ব সম্বন্ধে সে আরো বেশীমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠবে- যদিও হিন্দালের জন্য পরিস্থিতিটা সুখকর নাও হতে পারে।

আপনি ঠিকই বলেছেন, কিছুক্ষণ পরে হামিদা সায় দেয়। আর তাছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে এমন ভাববার কোনো কারণ এখনও ঘটেনি। নিজেকে কামরানের অনুগ্রহভাজন করে তুলতে হিন্দালের সময় লাগবে যাতে সে বিশ্বস্ততার এমন একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পারে যা ব্যবহার করে সে আমাদের সন্তানকে উদ্ধার করতে পারবে। আমাদের ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই।

ধৈর্য আর অনিশ্চয়তা বরাবরই আমাকে অস্থির করে তুলে। আমি অধীর হয়ে আছি এই যন্ত্রণাদায়ক অনিশ্চয়তার পরিসমাপ্তি ঘটাতে, যাতে করে কর্ম আর কর্মফলের প্রতি আমি নিজেকে মনোযোগী করতে পারি।

অনিশ্চয়তা আর ধৈর্য সব নশ্বর জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। সান্নিপাতিক জ্বরে আমাদের যেকোনো সময়ে মৃত্যু হয়ে, আমাদের সব আশা আর স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হতে পারে তবুও আমরা প্রতিদিন এটা নিয়ে ভাবি না। আমাদের মেনে নিতেই হবে যে কখনও কখনও পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে।

আমি জানি সেটা, কিন্তু আকবরের পিতা আর সেই সাথে একজন নেতা হিসাবে আমি যেমনটা চাই, সবকিছু যাতে সেভাবে ঘটে, সেই চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব এবং আমি এখানে বসে যতই দুশ্চিন্তা করি কাবুলে এই মুহূর্তে যা ঘটছে আমি কিছুতেই তাঁকে প্রভাবিত করতে পারবো না।

তাহলে আপনার দুশ্চিন্তা না করার চেষ্টাই করা উচিত …এতে কোনো লাভ হবে না। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। হামিদা তাঁর দুহাত দিয়ে হুমায়ুনকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে এবং অবশেষে পশমের পুরু নিরাপত্তার মাঝে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তারা ঘুমিয়ে পড়ে।

শীতের সেই দীর্ঘ রজনীগুলো যখন তাঁরা নিদ্রাদেবীর বরাভয় বঞ্চিত হামিদার সাথে হুমায়ুনের এমন কথোপকথন এই শেষবার না। যাই হোক, মাঝে মাঝে সে কোনভাবেই নিজেকে তাবু থেকে বের হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না, বাইরে এসে সে শীতের তারকারাজির দিকে তাকিয়ে থেকে খুঁজতে চেষ্টা করে যদি সেখানে তার জন্য কোনো বার্তা নিহিত থাকে কিন্তু সেখানেও সে কোনো উত্তর পায় না। বৃদ্ধ শারাফকে সে যখন ডেকে পাঠায়, যার শীর্ণ বিবর্ণ হাত গাঁটঅলা থাবার মতো তার ভেড়ারচামড়ার আলখাল্লার আস্তিনের ভিতর থেকে বের হয়ে থাকে, সেও কিছু খুঁজে পায় না।

একটার পর একটা দিন অতিক্রান্ত হয়, তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটে ব্যস্ত শিয়াল আর পাহাড়ী খরগোসের পাল ছাড়া আর কিছুই নড়াচড়া করে না, যা হুমায়ুনের লোকেরা রান্নার জন্য শিকার করে। হুমায়ুন শারীরিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। বৈরাম খান তাকে তরবারি চালনার পারস্যরীতির কিছু কার্যকরী চালাকি দেখিয়ে দেয়, যার ভিতরে রয়েছে কিভাবে নিজের তরবারির অগ্রভাগ প্রতিপক্ষের হাতের রক্ষাকারী বর্মে আটকে দিয়ে, সে তার শত্রুর কব্জি মোচড় দিয়ে তাকে অস্ত্র ফেলে দিতে বাধ্য করতে পারে। সে একইসাথে, তুষারাবৃত ভূমিতে পোথিত দণ্ডের উপরে রাখা খড়ের নিশানা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে, নিজের তীরন্দাজি চর্চাও করে! তার চোখের দৃষ্টি আগের মতোই ক্ষুরধার আর হাত বরাবরের মতোই নিশ্চল রয়েছে দেখে তার মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে, যদিও এরফলে সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য সে আরও ব্যাকুল হয়ে উঠে হিন্দালের কাছ থেকে কোনো সংবাদ পাবার পরেই কেবল যার সম্ভাবনা মূর্ত হবে। কিন্তু অবশেষে, একদিন দুপুরবেলা হুমায়ুন যখন বাজপাখি নিয়ে শিকার করতে গিয়েছে, হাল্কা নীল আকাশে, যা আসন্ন বসন্তের ইঙ্গিত বহনকারী, বৃত্তাকারে উড়তে থাকা পাখির দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝে সে আহমেদ খানকে গিরিসঙ্কটের উঁচুভূমির দিক থেকে বল্পা চালে ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।

সুলতান, আমার গুপ্তদূতেরা একদল অশ্বারোহীকে এদিকে আসতে দেখেছে।

কতজন অশ্বারোহী?

অল্প কয়েকজন, বেশীর ভাগই খচ্চরের পিঠে রয়েছে- সম্ভবত বণিকদের একটা ক্ষুদ্র কাফেলা। তারা এখনই দুই মাইল দূরে রয়েছে কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে : তাঁরা এদিকেই আসছে।

তাদের কাছে আমাকে নিয়ে চল।

আহমেদ খানকে পাশে নিয়ে দশ মিনিট পরে হুমায়ুন যখন বল্লা চালে ঘোড়া ছোটায় তখন তার হৃৎপিণ্ডে দামামার বোল বাজছে। ব্যাপারটা সম্ভবত কিছুই না। আহমেদ খান যেমন বলেছে তেমনই মামুলি কয়েকজন বণিকের দল- কিন্তু নিজের মনের গভীর একটা বুনো আশার উপচে উঠা সে কিছুতেই দমন করতে পারে না। সে চোখ কুচকে দূরের ঝাপসা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে, আপাতদৃষ্টিতে নিরানন্দ, বিরান সাদা ভূ-দৃশ্যের মাঝে নড়াচড়ার লক্ষণ সনাক্ত করতে অধৈর্য। প্রথমে কোথাও কিছু নজরে পড়ে না, কিন্তু তারপরেই সে জোরে শ্বাস নেয়। পশ্চিমদিক- যেদিকে কাবুল অবস্থিত সেখান থেকে থেকে মন্থরভাবে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তাদের অবস্থানের দিকে কিছু একটা যা দেখে কালো বিন্দুর মালার মতো মনে হয় এগিয়ে আসছে।

হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার গলার কাছে ঝুঁকে এসে জন্তুটার কানের কাছে ফিসফিস করে তাকে ছুটতে বলে এবং অচিরেই আহমেদ খানকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। কালো বিন্দুগুলো পুরোটা সময়েই কেবল বড় আর স্পষ্ট হতে থাকে ধীরে ধীরে অবয়ব গ্রহণ করতে শুরু করে। সে যখন আরো কাছে পৌঁছে যায় এখন মাত্র চারশ কি পাঁচশ গজ হবে দূরত্ব- তাঁর মনে হয় সে আটজন কিংবা নয়জন অশ্বারোহীকে দেখতে পেয়েছে; এমন অনিশ্চিত সময়ে একাকী ভ্রমণের পক্ষে বলতেই হবে খুবই ক্ষুদ্র একটা কাফেলা।

কাফেলাটা দাঁড়িয়ে যায় এবং একেবারে সামনের আরোহী রেকাবের উপরে উঠে দাঁড়ায় আর, একহাতে চোখের উপর আড়াল তৈরী করে, তার অবস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দূরত্ব থেকেও এমনকি, বিশাল অবয়বটার ভিতরে খুবই পরিচিত কিছু একটা রয়েছে বলে মনে হয়… সে নিজেকেই নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত করছে না, করছে কি? অবয়বটা হিন্দালের হতে পারে, সেটা হওয়াটা কি অসম্ভব? হুমায়ুন চক্রাকারে ঘুরিয়ে নিজের বাহনকে দাঁড় করিয়ে ব্যগ্র দৃষ্টিতে সেও এবার সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আহমেদ খান আর তাঁর দেহরক্ষীরা কিছুক্ষণ পরেই বল্লা চালে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে উপস্থিত হয়, তাঁদের ঘোড়ার খুর থেকে ধোয়ার মতো তুষারের গুড়ো বাতাসে ছিটকে উঠছে।

সুলতান, আমি কি তাদের পরিচয় জেনে আসবার জন্য লোক পাঠাব? আহমেদ খান জানতে চায়।

না… আমি নিজেই যাবো… তোমরা সবাই এখানেই অপেক্ষা কর! আহমেদ খানের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে, হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দেয়। তার সন্তানের ভাগ্যে কি ঘটেছে অশ্বারোহীদের দলটা যদি সেই সংবাদ বয়ে নিয়ে এসে থাকে তাহলে কেবল তারই প্রথম সেটা শোনা উচিত এবং সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে রাজি নয়। বরফাবৃত মাটির উপর দিয়ে সে যখন ঘোড়া হাকায়, খুরের শব্দ তাঁর কানে প্রতিধ্বনি তোলে, সে তাকিয়ে দেখে যে সামনের আরোহী নিশ্চল ভঙ্গিতে তখনও তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিশালদেহীকে ছাপিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করতে, হুমায়ুন আবিষ্কার করে যে কাফেলার বাকি সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই ছয়জন পুরুষ আর ছোটখাট অবয়বের হাল্কাপাতলা দেখতে একটা আকৃতি- একজন মহিলা যার মাথার কালো ভেড়ার পশমের তৈরী একটা উস্কোখুস্কো টুপির নীচে থেকে লম্বা বেনী বের হয়ে রয়েছে- সবাই খচ্চরের পিঠে উপবিষ্ট। মহিলাটার হাতে আরেকটা খচ্চরের লাগাম ধরা রয়েছে। সে আরেকটু এগিয়ে গেলে বুঝতে পারে যে আরোহীবিহীন খচ্চরটার পিঠে বেতের একটা ঝুড়ি বাঁধা রয়েছে যার ভিতরে তাঁর মুহূর্তের জন্য মনে হয় সে দুটো বেলনাকারে মোড়ান দুটো বস্ত্রখণ্ড দেখেছে বা সেটা কি দুটো শিশু হওয়া সম্ভব, ভেড়ার চামড়া দিয়ে মোড়ান হলে তাদের দেখতে অবিকল প্রায় গোলকাকার মনে হবে?

হুমায়ুন এখন কাফেলাটা থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য, সে টের পায় সামনে যেতে তার ভয় করছে কি হবে যদি তুষারাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে তাঁর সামনের ঐ লোকগুলো কেবলই, তাঁর নিজের আশা আর আকাঙ্খ দ্বারা সৃষ্ট, একটা বিভ্রম হিসাবে প্রমাণিত হলে। লাগাম টেনে ধরে এবং লোকগুলোর উপর থেকে একবারের জন্যও দৃষ্টি না সরিয়ে হুমায়ুন তার পর্যান থেকে আলতো ভঙ্গিতে পিছলে মাটিতে নেমে আসে এবং পায়ে হেঁটে শেষ কয়েকগজ দূরত্ব অতিক্রম করে, প্রথমে ধীরে ধীরে আর শেষের দিকে তাকে রীতিমতো দৌড়াতে দেখা যায়, বরফের উপরে পা কখনও পিছলে যায় কখনওবা হড়কে যেতে চায়।

তার দিকে উদগ্রীবভাবে তাকিয়ে থাকা, কাফেলাটার একেবারে সামনের অশ্বারোহী, পুরু পশমের আলখাল্লায় আপাদমস্তক আবৃত অবস্থায় আসলেই হিন্দাল। সে কি করছে সেবিষয়ে একেবারেই বেখেয়াল এবং ইতিমধ্যেই তাঁর চোখে আনন্দের অশ্রুর বাণ ডেকেছে হুমায়ুন হিন্দালকে অতিক্রম করে চামড়া দিয়ে মোড়ান পুটলি দুটো বহনকারী খচ্চরটার দিকে এগিয়ে যায়। সে মাহাম আগাকে সুলতান বলে চিৎকার করতে শুনে কিন্তু তারপরে সে দেখে যে চামড়ার পুটলি দুটোতে আসলেই বাচ্চা ছেলে রয়েছে এবং নিজের দুধ-ভাই আদম খানের পাশে শান্তভাবে শুয়ে রয়েছে, আকবর যাঁর কথাই সে এতোদিন কেবল ভেবেছে। হুমায়ুন নীচু হয়ে আকবরের দিকে ঝুঁকে এলে, সে ভেড়ার চামড়ার তৈরী পুটলির ভিতর থেকে হুমায়ুনের দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কামরান তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার পরের চৌদ্দমাসে সে অনেক বদলে গিয়েছে কিন্তু এখনও সন্দেহাতীতভাবে সে সেই আকবরই রয়েছে। আদম খান তাতস্বরে কাঁদতে শুরু করলে হুমায়ুন আকবরকে আলতো করে ঝুরি থেকে তুলে নেয় এবং তাকে বুকের কাছে আকড়ে ধরে তার দেহের উষ্ণ গন্ধে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়।

আমার বেটা, সে ফিসফিস করে বলে, বেটা আমার।

এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন খুদে কাফেলাটার পুরোভাগে অবস্থান করে তাঁর শিবিরে ফিরে আসে। জেনানাদের তাবুর সামনে পৌঁছে, সে ঘোড়া থেকে নামে আর তারপরে সাবধানে আকবরকে ঝুড়ি থেকে কোলে তুলে নেয়। খচ্চরটা পুনরায় চলতে শুরু করায় ছেলেটা শান্ত হয়ে আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মাহাম আগাকে পাশে নিয়ে হুমায়ুন হামিদার তাবুর ভিতরে প্রবেশ করে। হামিদা তাঁর প্রিয় কবিতাগুলো থেকে পাঠ করছিলো কিন্তু পাণ্ডুলিপিটা এখন তার হাত থেকে মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং লাল আর সোনালী জরির কাজ করা মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সেও এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হামিদার মুখের উপরে রেশম চুলের গোছা এলিয়ে থাকায় তাকে এখন কত অল্প বয়সী মনে হচ্ছে আর তাঁর নিটোল স্তনযুগল নিঃশ্বাসের সাথে সাথে মৃদুভঙ্গিতে উঠা নামা করছে।

হামিদা, হুমায়ুন ফিসফিস করে ডাকে, হামিদা…আমি তোমার জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছি- একটা উপহার…

হামিদা যখন চোখ খুলে তাকায় এবং আকবরকে দেখতে পায়, তার চোখমুখ এমন অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে যা হুমায়ুন আগে কখনও কারো ভিতরে প্রত্যক্ষ করেনি। কিন্তু হুমায়ুন আকবরকে হামিদার কোলে তুলে দিতে, সে জেগে উঠে। মুখ তুলে হামিদাকে দেখতে পেয়ে, সে হতভম্ব হয়ে চিৎকার করে উঠে এবং কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করতে শুরু করে। মাহাম আগা দ্রুত সামনে এগিয়ে আসে, এবং তাঁকে দেখা মাত্র আকবর নিমেষে শান্ত হয়ে যায়। সে হাসি হাসি মুখে তাঁর নাদুসনুদুস হাত দুটো দুধ-মার দিকে বাড়িয়ে দেয়।

*

আকবরকে ফিরে পাবার আনন্দে আয়োজিত ভোজসভার উচ্ছিষ্টের মাঝে, হুমায়ুনের লাল টকটকে নিয়ন্ত্রক তাঁবুর ভিতরে যত্নের সাথে বিন্যস্ত বিশালাকৃতি সব তাকিয়ায় হুমায়ুনের চারপাশে তার সব আধিকারিকেরা হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। ভোজসভার পূর্বে সেদিন দুপুরবেলা সে তাঁর সব লোকদের সমবেত হবার আদেশ দেয় এবং তাদের সামনে আকবরের উদ্ধার পাবার বিষয়টা ঘোষণা করে।

আমার অনুগত যোদ্ধারা আমাদের ভবিষ্যতের প্রতীক, আমার কাছে নিরাপদে ফিরে এসেছে, তোমাদের সামনে আমি আমার সন্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত করছি… হুমায়ুন তার অস্থায়ী শিবিরের কেন্দ্রস্থলে তড়িঘড়ি করে নির্মিত একটা কাঠের বেদীর উপরে দাঁড়িয়ে, সে আকবরকে তার মাথার উপরে উঁচুতে তুলে ধরে। ঢালের উপরে তরবারি দিয়ে আঘাতের সাথে একটা হর্ষোফুল্ল চিৎকারে তার চারপাশ গমগম করতে থাকে। হুমায়ুন মাহাম আগার কোলে আকবরকে যখন ফিরিয়ে দেয়- সে তখনও হঠাৎ সৃষ্ট এই হুঙ্কারে বিস্মিত হয়ে চোখ পিটপিট করছে, কিন্তু এবার সে কেঁদে উঠে না। এটা একটা শুভ লক্ষণ। হুমায়ুন হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে ইঙ্গিত করে।

আমরা যা শুরু করেছিলাম সেটা সমাপ্ত করতে আর নিষ্পাপ শিশুদের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকে এমন ষড়যন্ত্রকারীকে উৎখাতের জন্য আমাদের কাবুলে ফিরে যাবার সময় হয়েছে। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি এবং আল্লাহ্তালা আমাদের সাথে আছেন। আজ রাতে আমরা ভোজের আয়োজন করবো কিন্তু কাবুল একবার আমাদের অধিকারে আসবার পরে আমাদের আজকের ভোজসভার সাথে সেদিনের উৎসবের কোনো তুলনায় চলে না। আগামীকাল সকালে আমরা শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।

শিবিরের বাবুর্চিরা তাঁদের রান্নার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে, অতিকায় আগুনের কুণ্ড তৈরী করে শিক কাবার আর মাংস রোস্ট করা হচ্ছে যা থেকে পোয়র রাশি আকাশে ঢেউয়ের মতো উঠে যাচ্ছে। তার সন্তান এখন যখন নিরাপদ হুমায়ুন তখন কতদূর থেকে তাঁর শিবির দৃশ্যমান হচ্ছে সেসব নিয়ে মোটেই পরোয়া করে না।

তার সেনাপতিদের কয়েকজন যুদ্ধক্ষেত্রের কীর্তি নিয়ে রচিত বীরোচিত গান, হারেমের আরো বড় কীর্তিকলাপ নিয়ে রচিত স্থূল, অশ্লীল গান গাইতে আরম্ভ করে। হুমায়ুন তার চারপাশে তাকিয়ে দেখে জাহিদ বেগ সামনে পেছনে দুলছে, করোটির মতো মুখ গজনীর কড়া লাল সুরার প্রভাবে জ্বলজ্বল করছে কাবুল সালতানাত যে সুরার কারণে বিখ্যাত আর তার নিজের আব্বাজানও যা দারুণ পছন্দ করতেন। এমনকি সাধারণত স্বল্পভাষী আর গম্ভীর করিমও তাবুর এককোণে যেখানে নিজের বৃদ্ধ শরীরটার জন্য তিনি একটা আরামদায়ক স্থান খুঁজে পেয়েছেন বসে আপনমনে গান গাইছেন।

হুমায়ুন আর বৃথা কালক্ষেপন না করে তাঁর বিশ্বস্ত সহচরবৃন্দ, তাঁর ইচকিদের বলে যে অবরোধ তুলে নেবার বিষয়টা একটা কূটচাল ছিল। খবরটা শোনার পরে তাঁদের বেশীরভাগকেই দেখে মনে হয় তারা সত্যিই বিস্মিত হয়েছে। বৈরাম খানের অভিব্যক্তিতেই কেবল সামান্য বিস্ময় প্রকাশ পায় এবং ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য হুমায়ুনকে গম্ভীরভাবে অভিনন্দিত করার সময় তাঁর তীক্ষ্ণ নীল চোখে ফুটে থাকা অবগত ভাবের কারণে, হুমায়ুন দ্বিগুণ নিশ্চিত হয় যে পার্সী যোদ্ধা আগা গোড়াই সবকিছু জানতো। একম একটা লোককে মিত্র হিসাবে পাশে পাবার জন্য সে আগের। চেয়েও বেশী কৃতজ্ঞবোধ করে।

হুমায়ুন আড়চোখে তাঁর পাশেই উপবিষ্ট হিন্দালের দিকে তাকায়। উৎসবে মত্ত অন্যান্যদের তুলনায় সে অল্পই কথা বলেছে এবং হুমায়ুন আর তাঁর আধিকারিকদের সাথে বসার কারণে তাকে অন্যমনস্ক আর আড়ষ্ঠ দেখায়। গতকাল সন্ধ্যাবেলা তারা শিবিরে ফিরে আসবার পর থেকে, হুমায়ুন তাঁর সৎ-ভাইয়ের সাথে খুব অল্পই সময় কাটিয়েছে। ছেলের সাথে পুনর্মিলিত হবার স্বস্তিতে সে বরং আকবর আর হামিদার সাথেই বেশী সময় অতিবাহিত করেছে। হামিদার কেবল একটাই দুঃখ, তাঁদের সন্তান এখনও মাহাম আগাকেই আকড়ে রয়েছে। হামিদা যতবারই তাকে কোলে নিতে চেষ্টা করে, সে চিৎকার করে হুলস্থূল বাধায়। হামিদা ছেলের নিরাপদে ফিরে আসার স্বস্তি আর উল্লাসের সাথে এই কয়মাসে ছেলেটা কত বড় হয়ে গিয়েছে এবং কয়েকমাস আলাদা থাকায় তার কাছে আগন্তুকে পরিণত হবার দুঃখে সে একটা টানাপোড়েনের ভিতরে পড়ে, হুমায়ুন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে এটা একটা সাময়িক ব্যাপার কেটে যাবে। তার প্রাণবন্ত হাত পা ছোঁড়া একটা বিষয় অন্তত নিশ্চিত করে যে এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তার স্বাস্থ্য ভালোই আছে, হামিদা ঠোঁটে হাসি আর চোখে কান্না নিয়ে শেষ পর্যন্ত বলে। তারপরে সে ভুলে গিয়েছে এমন ভঙ্গিতে যোগ করে, আমার হয়ে হিন্দালকে আপনি ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না যেন।

হুমায়ুন হিন্দালের আপাত অন্যমনস্ক মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এই কাজটা হামিদা যেমনটা ভেবেছিল কাজটা তারচেয়েও কঠিন।

হিন্দাল… হুমায়ুন তার সৎ-ভাইয়ের পূর্ণ মনোযোগ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তারপরে কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব নীচু করে কথা শুরু করে, যাতে অন্য কেউ তাঁদের আলোচনা আড়ি পেতে শুনতে না পায়। আমি জানি তুমি আমার জন্য না হামিদার কথা চিন্তা করেই যা করবার করেছে। সে আমাকে বলেছে তার পক্ষে আমি যেন তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।

তাকে বলবেন এর কোনো প্রয়োজন নেই। পারিবারিক সম্মানের কথা বিবেচনা করেই…

তুমি হয়ত এসব কথা শুনতে চাও না কিন্তু তারপরেও বলছি আমিও তোমার কাছে চিরতরে ঋণী হয়ে রইলাম। তোমার কর্মকাণ্ডের পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন সেটা তোমার প্রতি আমার দায়বদ্ধতা থেকে আমাকে মুক্তি দেয় না।

হিন্দাল হাল্কা কাঁধ ঝাঁকায় কিন্তু কোনো মন্তব্য করে না।

আমাকে এবার বল, তোমার পরিকল্পনা কি তোমার প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করেছিল? কাবুলে আসলেই কি ঘটেছে সেটা জানার জন্য হামিদা উদগ্রীব হয়ে রয়েছে…

হিন্দালের ঠোঁটের কোণে এততক্ষণ পরে হাল্কা হাসির একটা রেখা ফুটে উঠে। আমি যেমনটা আশাও করিনি তারচেয়েও ভালো কাজ করেছে। কাবুল থেকে আপনার অবরোধ তুলে নেবার খবর আমার গুপ্তদূতদের কাছ থেকে জানবার কয়েকদিন পরে, আমি আমার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসি এবং দূর্গপ্রাসাদে আমার বার্তাবাহককে পাঠাই কামরানকে বলার জন্য যে আমাদের পরিবারের সত্যিকারের প্রধান হিসাবে তাঁকে সমর্থণের অঙ্গীকার করতে আমি প্রস্তুত। কামরানের মতো উদ্ধত আর আত্মগর্বী এবং আপনার প্রস্থানের কারণে খুশীতে আত্মহারা অপদার্থের কাছে, আমি ঠিক যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলাম, সে আমাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়। আহাম্মকটা এমনকি বিষয়টা উদযাপনের জন্য ভোজসভার আয়োজন করে এবং আমাকে নানা উপঢৌকন দেয়…

সে আসলেই কিছু সন্দেহ করেনি?

কিস্যু না। আপনাকে পরাস্ত করতে পেরেছে বিশ্বাস করায় তাঁর আত্মবিশ্বাস তাঁকে অন্ধ করে ফেলেছিল। আমি পৌঁছাবার আগেই সে এমনকি কাবুল শহর আর দূর্গপ্রাসাদ উভয়ের প্রধান প্রবেশদ্বার দিনের বেলায়ও খুলে রাখার আদেশ দিয়েছিল। আমি সেখানে পৌঁছাবার এক সপ্তাহের ভিতরেই সে শীতের তীব্রতা আর ক্ষুধায় আক্রান্ত হয়ে প্যাচান শিংঅলা ভেড়া আর নেকড়ের সন্ধানে দক্ষিণে একটা শিকার অভিযানে যাবার কথা বলতে শুরু করে। আমি তাকে উৎসাহিত করি এমনকি তার সাথে শিকারে যাবার আগ্রহও দেখাই। কিন্তু, আমি তাঁর কাছে থেকে যেমনটা আশা আর ধারণা করেছিলাম, সে আমাকে দূর্গপ্রাসাদেই অবস্থানের আদেশ দেয়। তাঁর দেহরক্ষীদের প্রশিক্ষণ দেবার মতো কাজ সে ইতিমধ্যেই আমার জন্য নির্ধারিত করেছে। সে রসিকতার ছলে বলে যে আমার মনে কাবুল দখলের মতো কোনো দুর্বুদ্ধির যাতে উদয় না হয় সেজন্য যথেষ্ট সংখ্যক বিশ্বস্ত সৈন্য সে মোতায়েন করেই শিকারে যাবে।

কামরান শিকারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে, আমি কেবল আমাকে দেয়া আদেশ পালন করতে থাকি, সতর্ক থাকি এমন কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকতে, যাতে কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। আমি এটাও নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে সে আসলেই কয়েক দিনের জন্য বাইরে গিয়েছে। তারপরে, চতুর্থদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার পরে সেই রাতে কামরানের ফিরে আসবার কোনো লক্ষণ না দেখে আমি আমার পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করি। আপনার কি ছেলেবেলায় দেখা দূর্গপ্রাসাদের পূর্বদিকে অবস্থিত ছোট আঙ্গিনাটার কথা মনে আছে। যার একপাশের দেয়াল জুড়ে অবস্থিত তালাবদ্ধ ঘরে শস্য আর সুরা মজুদ করে রাখা হত?

বেশ, আমি দেখি যে কামরান গুদামঘর হিসাবে ব্যবহৃত সেইসব কক্ষের কয়েকটার পরিবর্তন সাধন করে বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে, যেখানে সে মাহাম আগা আর তার সন্তানের সাথে আকবরকে প্রহরাধীন অবস্থান বন্দি রেখেছে। আমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত চারজন দেহরক্ষীকে সাথে নিয়ে নিরবে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। আমরা আঙ্গিনায় পৌঁছাবার পরে আমার লোকেরা শস্য মজুদের জন্য রক্ষিত বিশালাকৃতি জালার পিছনে আত্মগোপন করে অবস্থান করতে থাকে। আমি একলা বন্ধ দরজায় উঁকি দেবার জন্য নির্মিত ফাঁকা অংশের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে প্রহরায় নিয়োজিত দুই রক্ষীকে বলি যে, তারা যাকে পাহারা দিচ্ছে তার চাচাজান হিসাবে আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে চিনতে পেরে তারা দরজা খুলে দেয়। আমি তাঁদের সাথে কথোপকথন অব্যাহত রাখি, সেই সুযোগে আমার লোকেরা লুকোন স্থান থেকে দ্রুত বেড়িয়ে এসে তাঁদের কাবু করে ফেলে তারপরে তাঁদের হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হয়।

মাহাম আমাকে নিয়েই আমায় সবচেয়ে বেশী ঝামেলা পোহাতে হয়েছে- সে কোথা থেকে একটা লুকান খঞ্জর বের করে আমাকে আঘাত করতে চেষ্টা করে আর সেই সাথে গলার স্বর সপ্তমে তুলে চিৎকার। আমি খঞ্জরটা তার কাছ থেকে সহজেই কেড়ে নেই- সে পরে আমাকে বলে যে খঞ্জরের ফলায় বিষ মাখান ছিল- কিন্তু তার চিৎকার বন্ধ করাটা তত সহজ কাজ ছিল না। আমি তার মুখে হাত চাপা দিয়ে, তার কানে বারবার বলতে থাকি যে আকবরের কোনো ক্ষতি করার অভিপ্রায় আমার নেই… যে আমি আপনাকে জানিয়ে আর সম্মতি নিয়েই তাদের উদ্ধার করতে এসেছি।

অবশেষে সে শান্ত হয়, কিন্তু পুরোটা সময় আমরা সবাই তটস্থ ছিলাম। আমরা যদিও দূর্গপ্রাসাদের একটা নির্জন কোণে ছিলাম কিন্তু আমি জানি যেকোনো মুহূর্তে কেউ আমাদের দেখে ফেলতে পারে। ভাগ্যক্রমে সেখানে কেউ এসে হাজির হয় না। কিন্তু আমাদের সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আমি জানতাম যে দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশদ্বার আগামী আধঘন্টার ভিতরে রাতের মতো বন্ধ করে দেয়া হবে। আমাদের দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে এবং সেটা এমনভাবে যেন কারো দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়। আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রতিদিন দূর্গপ্রাসাদে ব্যবসার উদ্দেশ্যে অবরোধ এখন উঠে যাবার কারণে পুনরায় রসদ সরবরাহ শুরু হয়েছে যেসব বণিকেরা আসে তাদের অনেকেই সন্ধ্যার দিকে সাধারণত শহরে ফিরে যায়। আমি আমার লোকদের তাই আদেশ দেই পাগড়ি আর আলখাল্লা নিয়ে আসতে- মাহাম আগার জন্যও আনতে বলি- যাতে করে আমরা সবাই বণিকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারি। আমরা সাথে করে ভেড়ার চামড়া নিয়ে এসেছিলাম যাতে মুড়ে নিয়ে বাচ্চা দুটোকে লুকিয়ে রাখা যায় এবং একটা শিশিতে গোলাপজলের সাথে আফিম মিশিয়ে আনা হয়েছিল তাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন করতে, যাতে তাঁরা কান্নাকাটি না করে। আমি মাহাম আগাকে আদেশ দেই শিশিতে রক্ষিত তরল থেকে দুজনকেই সামান্য পরিমাণ দিতে। সে ইতস্তত করতে আমি নিজে শিশি থেকে খানিকটা পান করি তাঁকে বোঝাতে যে শিশিতে বিষ দেয়া নেই।

আফিম দ্রুত কাজ করে এবং ভেড়ার চামড়া দিয়ে আমরা যখন তাদের মুড়ে দেই তখন তারা চুপচাপই থাকে। তারপরে, আকবরের অন্তধানের সংবাদ যতক্ষণ সম্ভব গোপন রাখতে বন্দি দুই প্রহরীকে গুদামঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেই, এবং যত শীঘ্র সম্ভব বণিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে দূর্গপ্রাসাদের অলিগলি দিয়ে দ্রুত তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঢালু পথ দিয়ে নীচের শহরের দিকে নামতে থাকা মানুষ আর পশুর ভিড়ে মিশে যাই। কেউ আমাদের সন্দেহ করেনি। আমরা ভিড়ের ভিতরে মিশে গিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে যাই, যেখানে তোরণদ্বারের ঠিক বাইরে আমার আরো লোক দলের সবার জন্য ঘোড়া আর খচ্চর নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি আশা করেছিলাম বাহন হিসাবে খচ্চর ব্যবহার করায় আমাদের দেখে যোদ্ধা মনে না হয়ে বণিক মনে হবে। অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসবার পরে আমরা দ্রুত নিজ নিজ বাহন নিয়ে প্রথমে আমরা উত্তরদিকে যাই, যদি শহর ত্যাগ করার সময় কেউ আমাদের অনুসরণ বা লক্ষ্য করে থাকে তার কাছে আমাদের মূল গন্তব্য গোপন করতে। সারা রাত হাড় কাঁপান শীতের ভিতরে ঘোড়া ছোটাবার পরে সকালের দিকে আমরা বৃত্তাকারে পূর্বদিকে ঘুরে যাই এবং উদীয়মান সূর্যের আলোয় আমাদের মুখ উদ্ভাসিত হলে পরে আমরা সন্ধানে যাত্রা শুরু করি।

হিন্দাল যখন তাঁর অভিযানে গল্প বলছিল, দুরূহ আর বিপজ্জনক কাজে সাফল্য লাভ করায় তার চোখে বালকসুলভ উত্তেজনা আর উল্লাস জ্বলজ্বল করছিল। হিন্দাল এখন তাঁর বর্ণনা শেষ করার পরে, হুমায়ুন তার সবচেয়ে ছোট সৎ-ভাইটির প্রতি তার সতর্ক ও যথাযথ পরিকল্পনা, শান্ত অনুত্তেজিত মনোভাব আর সদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুত বুদ্ধির কারণে এক নতুন আর গভীর শ্রদ্ধাবোধে আপুত হয়। সর্বোপরি, হিন্দাল যেভাবে কামরানকে পুরোপুরি বুঝতে পেরে, তাঁর অহমিকার সুযোগ নিয়ে তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে, সেটা তাঁকে মুগ্ধ করে। নিজেদের শত্রুকে চিনে নিতে, বাবর তাঁদের সবসময়, এমনকি ছেলেবেলায় পর্যন্ত, সতর্ক করে কি দেননি? হিন্দাল সবসময়ে নিরবে শুনে যেত, কিন্তু সে নিজে কি দারুণভাবে অন্যদের কেবল শত্রু না বন্ধু এমনকি পরিবারের সদস্যদের মনোভাবের সাথে একাত্ম হবার প্রয়োজনীয়তা সত্যিই বুঝতে পেরেছে? হিন্দালের মনোভাব বোঝার জন্য সে কি কখনও পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে এবং তার দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখেছে?

তারা দুজনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। তারা হয়ত আবার আগের মতোই হয়ে উঠবে… তার পান করা লাল সুরার প্রভাবে পরের কথাটা তার পক্ষে বলাটা সহজ হয়। হিন্দাল, তুমি এইমাত্র কাবুলে আমাদের ছেলেবেলার কথা বলছিলে। তুমি আর আমি অনেক কিছুই, কেবল আমাদের রক্ত আর ঐতিহ্যই না, আমাদের অতীতের অনেক স্মৃতিও, সমানভাবে ধারণ করি। আমার আম্মিজান তোমাকে নিজের পুত্রবৎ জ্ঞান করতেন। আমার সব সৎ-ভাইদের ভিতরে আমি তোমাকেই আপন মনে করি আর তোমাকেই আমার বন্ধু করতে চাই। আমি জানি যে অনিচ্ছাকৃতভাবে- হয়ত স্বার্থপরতাও ছিল- আমি তোমাকে আঘাত দিয়েছি। আমি সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত আর তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি…

হুমায়ুন…

কিন্তু তাঁর বক্তব্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত হিন্দালকে কথা বলার সুযোগ দিতে অনিচ্ছুক হুমায়ুন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকে। আমাদের ভিতরে অতীতে যা কিছু ঘটেছে- আমরা কি সেটা ভুলে যেতে পারি না? পূর্বের মতো আবার আমার মিত্র হয়ে এসো, আমরা একসাথে কাবুল বিজয়ের অভিযানে অংশ নেই। আমরা যদি কেবল সাহসী হয়ে অগ্রসর হই তাহলে দেখবে ভবিষ্যতের গর্ভে অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে- হিন্দুস্তান একদিন আবার মোগলদের অধিকারে আসবে এবং আমি প্রতিজ্ঞা করছি, সেখানে সম্মান আর ক্ষমতাপূর্ণ একটা স্থান আমি তোমার জন্য নির্ধারিত রাখবো। হিন্দাল… তুমি কি আমাকে একবার ক্ষমা করতে পারো না? আমার সাথে কি তুমি নিয়তির সেই বরাভয় ভাগ করে নিতে চাও না?

কিন্তু হিন্দাল তাঁর মাথা ভর্তি কালো ঝাকড়া চুল নাড়তে থাকে। আমাদের ভিতরে শেষবার যখন কথা হয়েছিল তখনই আমি আপনাকে বলেছিলাম আমাদের ভিতরে কোনো ধরনের আপোষ সম্ভব না এবং সেটাই বাস্তবতা। আমি আমার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেছি আর বিষয়টা এখানেই শেষ হবে। আপনার শিবির আমার বাসস্থান নয়। আমি এতক্ষণ এখানে অপেক্ষা করেছি কেবল একটা বিষয়ে নিশ্চিত হতে যে এখানে আসবার সময়ে আমাকে কেউ অনুসরণ করেনি এবং কামরানকে আপনার এখানে নিয়ে আসিনি আর সেই সাথে অবশ্য আমার বোন গুলবদনের সাথেও কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে চেয়েছি।

তোমার তাহলে এটাই শেষ কথা?

আপনি এখনও আমার কথা বুঝতে পারেন নি, তাই না? আপনি যা চান সেটা পাবার জন্য আপনি আপনার মায়ের মতোই লোভী এবং বঞ্চিত হতে পছন্দ করেন না। অন্যের সুখের তোয়াক্কা না করে কেবল নিজের সুখের কথা ভেবে তিনি আমার মায়ের কাছ থেকে আমায় কেড়ে নিয়েছিলেন। আপনি এখন চাইছেন যে আমাদের ভিতরে অতীতে যা কিছু ঘটেছে- আপনার অচিন্তনীয় ঔদ্ধত্য আর চুড়ান্ত স্বার্থপরতা- সে সব কিছু ভুলে গিয়ে আবারও আপনার অনুগত আর অন্তরঙ্গ ভাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। আমি সেটা পারব না। সেটা করলে মিথ্যাচার করা হবে আর আমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে সেটা করার অনুমতি দেয় না।

হিন্দাল…

না, হুমায়ুন। আপনার স্ত্রী পুত্র রয়েছে। অচিরেই হয়ত আপনি আবার সিংহাসনে উপবেশন করবেন। এত কিছু কি আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট না? আগামীকাল ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমি আমার অবশিষ্ট লোকদের খুঁজতে বের হব, যাদের আমি আদেশ দিয়েছিলাম কামরান ফিরে আসবার আগেই কাবুল ত্যাগ করতে। আমি তাঁদের যখন খুঁজে পাবো, আমরা আবার তখন পাহাড়ে ফিরে যাব। আমি জানিনা কখন কিংবা কোনো পরিস্থিতিতে আবার আমাদের দেখা হবে। হয়ত আর কখনই হবে না…

হিন্দাল কথা শেষ করে চুপ করে থাকে। হুমায়ুনের কাছে মনে হয় সে বুঝি আরো কিছু বলতে চায় কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার সৎ-ভাইটি উঠে দাঁড়ায় এবং পেছন দিকে একবারও না তাকিয়ে ভোজসভার অতিথিদের ভিতর দিয়ে হেঁটে যায় এবং তাবুর পর্দা সরিয়ে রাতের আঁধারে হারিয়ে যায়।

৩.৬ কাবুল

২০. কাবুল

সুলতান, কুয়ার পানিতে তাঁর বিষ দিয়েছে। আহমেদ খানের এক গুপ্তদূত কথাগুলো বলে, কাবুলের দিকে নেমে যাওয়া এক পাহাড়ী ঢলের শীর্ষদেশে হুমায়ুন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে আসার পূর্বে তুষারাবৃত এক প্রান্তরের উপর দিয়ে সে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে বলে শীতের বাতাসে তার খয়েরী রঙের ঘোটকীর গা থেকে বাস্পের মতো ঘাম নির্গত হয়। বরফ যদিও এখনও গলতে শুরু করেনি কিন্তু গত কয়েকদিনে নতুন করে তুষারপাতও হয়নি। পশ্চিমে যেখান থেকে তারা ফিরে গিয়েছিল সেখানে ফিরে আসবার পথে তার আর তার অনুগত বাহিনীর এতো দ্রুত অগ্রসর হবার পেছনে এটা একটা কারণ। অভীষ্ট লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতনতা আর সংক্ষিপ্ত বিশ্রামের ফলে অর্জিত প্রাণশক্তি আরেকটা কারণ। নিজের লোকদের ভিতরে সে এটা বেশ টের পায় এবং নিজের গভীরেও একই আর্তি অনুভব করে।

আমাকে খুলে বল, সে আদেশ দেয়।

দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কাছাকাছি অবস্থিত কুয়া আর নহরগুলোর চারপাশে আমরা মৃত আর মৃতপ্রায় বন্য প্রাণী দেখতে পেয়েছি। শহর আর দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশের তোরণদ্বার আমাদের দেখে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং উভয়ের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে সৈন্য গিজগিজ করছে। আমাদের একজন প্রাচীরের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়ায় তারা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।

দূরের কুয়া আর নহরগুলো পরীক্ষা করে দেখো। আমাদের শিবিরের সীমানার বাইরে জঞ্জালের স্তূপে ঘুরে বেড়ান বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর কয়েকটাকে সেই পানি পান করতে দাও। আমরা যতক্ষণ ভালো পানি খুঁজে না পাই ততক্ষণ শিবিরের অগ্নিকুণ্ডে বরফ গলিয়ে পান করতে পারব।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা প্রায় আটটা নাগাদ, আরো একবার কাবুলের পাদদেশে অবস্থিত সমভূমিতে হুমায়ুনের শিবির স্থাপিত হয় এবং তার লোকেরা নিজেদের জন্য রাতের খাবার তৈরীর প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করতে অন্ধকারে কয়েকশ অগ্নিকুণ্ড জ্বলজ্বল করতে থাকে। কামরানের সৈন্যরা তাদের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেনি। কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীর থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরেই হুমায়ুনের লোকেরা বিশুদ্ধ পানির উৎস খুঁজে পায়। হুমায়ুন তার নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে দূর্গপ্রাসাদের বুরুজের প্রাকারবেষ্টিত ছাদের উপরে এখানে সেখানে বিরক্তিকর আলোর উৎস দেখতে পায়। তার মতো, কামরানও হয়ত এই মুহূর্তে প্রাকারের উপরে দাঁড়িয়ে, এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে এবং মনে মনে চিন্তা করছে। আর যদি তাই হয়, তাহলে কাবুলের প্রধান তোরণদ্বারের বাইরে আরো একবার হুমায়ুনের বাহিনীর আবির্ভাবের ফলে তার মনে কি ভাবনার উদ্রেক ঘটেছে? কামরান যেভাবে অন্যদের সাথে প্রায়শই প্রতারণা করে, ঠিক সেভাবেই প্রতারিত হয়ে তাঁর কেমন অনুভূতি হচ্ছে? তার প্রতিরক্ষা কবচ বন্দি শিশুটিকে হারিয়ে, প্রতিশোধপরায়ন হুমায়ুনকে কিভাবে সে মোকাবেলা করবে বলে চিন্তা করছে? নিজের সহজাত উৎকর্ষতার মানে এটা নিশ্চিতভাবেই নিয়তি নির্ধারিত বিশ্বাস করে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই সে হিন্দালকে একজন অনুগত মিত্র হিসাবে মেনে নেয়ার জন্য নিজের উদ্ধত আত্মবিশ্বাসের কারণে সে কি এখন অনুতপ্ত?

হুমায়ুন মুখাবয়ব সহসা কুঁচকে যায়। অতীতে হিন্দালের প্রশ্নাতীত আনুগত্য, যেন তার প্রাপ্য, এমনটা আশা করে সে নিজেকে কি কামরানের চেয়ে খুব একটা আলাদা বলে দাবী করতে পারে? সম্ভবত না। সে আশা করে যে উৎকণ্ঠা আর ভয়ে কামরান এখন ঘামছে, কিন্তু এটা প্রতিশোধের খেলায় ব্যক্তিগত হিসাবের জের টানার সময় না। বিজয় অর্জনের দ্রুততম পথ খুঁজে পাওয়াটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা মোটেই সহজ কাজ না। দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদ মজুদ রয়েছে। কামরান আর তার অনুগত লোকেরা ভালো করেই জানে যে পরাজিত হলে তাঁদের প্রতি সামান্য অনুকম্পাও প্রদর্শন করা হবে না তাই দূর্গপ্রাসাদে জীবন বাজি রেখে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

হামিদার প্রায়োগিক প্রজ্ঞা আর সান্ত্বনাদায়ক অনুত্তেজিত উপস্থিতির জন্য ব্যাকুল হয়ে হুমায়ুনের মনে হয়, সে যদি এই মুহূর্তে তার পাশে থাকতো। হুমায়ুন যদিও ভালো করেই জানে যে সে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে যে আকবর, গুলবদন আর অন্যান্য অভিজাত রমণীদের সাথে হামিদা মূল বাহিনীর পেছনে সুসজ্জিত দেহরক্ষীদের দ্বারা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যুহের ভিতরে অবস্থান করে তাঁদের অনুসরন করবে এবং কাবুল থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে। সে চায় না তাঁর স্ত্রী আর পুত্রের জীবন আবারও ঝুঁকির সম্মুখীন হোক। কিন্তু যত দ্রুত শহরটা আরো একবার তার আয়ত্বে আসবে, সে দ্রুত তাকে সেখানে নিয়ে আসতে পারবে। অন্তত, এতো কষ্ট আর অন্তর্জালা সহ্য করার পরে তাঁর রাণীর প্রাপ্য সম্মানের গুরুত্ব কেমন সেটা জানা উচিত আর শীঘই, সে নিজেকে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে যে, সম্রাজ্ঞীর মহিমা সে লাভ করবে।

*

সহসা হুমায়ুনের ঠিক পেছনে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ তাকে বধির করে দেয় এবং গরম বাতাসের একটা হলকা তাঁকে মাটিতে ছিটকে ফেলে, সে ভূপাতিত হবার সময়ে পাথরের সাথে মাথা ধাক্কা খেলে হাজার আলোর ঝলকানি দেখে। তার চোখে মুখে কাদা আর বরফে কিচকিচ করতে থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার চোখ খুলতে সক্ষম হয়। সে ধীরে ধীরে অনুধাবন করে যে তার চারপাশে খোলামকুচির মতো পিতলের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে আর বরফাবৃত মাটিতে গেঁথে থাকা তাজা মাংসের টুকরো চুমকির মতো দেখায়। একটা চিল কোথা থেকে উড়ে আসে এবং তার বাঁকান ঠোঁট দিয়ে একটা টুকরো ঠোকরাতে আরম্ভ করে। তাঁর মাথার ভিতরে জমাট বাধা স্তব্ধতা পুরো দৃশ্যটাকে আরো বেশী দুঃস্বপ্নময়তা দান করতে হুমায়ুন দুহাতে তার কান চেপে ধরে। সে কান চেপে ধরলে, কপালের ডান দিকের একটা ক্ষতস্থান থেকে তার ডান হাতের আঙ্গুলে টপটপ করে রক্ত ঝরতে শুরু করে।

তার কানের ভেতরে সহসা আবার পটকা ফোঁটার মতো শব্দ বাজতে আরম্ভ করে- তার শ্রবণশক্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে… সে বুঝতে পারে দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরের উপর থেকে প্রাসাদ রক্ষীদের উন্মত্ত উল্লাসের মতো একটা শব্দ ভেসে আসছে, যার সাথে বিদ্রুপাত্মক চিৎকার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হুমায়ুন পায়ের উপর ভর দিয়ে নিজেকে টেনে তুলে এবং চারপাশে তাকায়, সে এখনও স্তম্ভিত হয়ে রয়েছে এবং প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজের অবোধ্য চিন্তাগুলোকে পুনরায় সন্নিবেশিত করতে। আদতে কি ঘটেছে সে ধীরে ধীরে সেটা বুঝতে পারে। তার বড় কামানগুলোর একটা নিজেই বিস্ফোরিত হয়েছে। কামানটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে এর গোলন্দাজদের একজনকে চাপা দিয়েছে, বেচারার কামানের নীচে আটকে গিয়েছে, ব্যাথায় লোকটা চিৎকার করছে আর মোচড় খাচ্ছে। কমপক্ষে দুজন লোকের ছিন্নভিন্ন দেহখণ্ড চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে, এখানে একটা কাটা পা, ওখানে একটা কাটা হাত, কামানের পাশে একটা রক্তাক্ত কবন্ধ শরীর এবং হুমায়ুনের পায়ের কাছ থেকে মাত্র একগজ দূরে ঝলসে যাওয়া হীনাঙ্গ মস্তক পড়ে রয়েছে, বাতাসে মাথাটিতে ঝলসানোর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েক গাছি চুল এলোমেলো উড়ছে। হুমায়ুন বুঝতে পারে, কামানের নলে নিশ্চয়ই ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। তার লোকেরা নতুন করে তিন সপ্তাহ পূর্বে শহর আর দূর্গপ্রাসাদ অবরোধ শুরু করার পর থেকে কামানটা নিয়মিত ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো। সে পূর্বের মতোই, দূর্গপ্রাসাদকে তাঁর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বেছে নিয়েছে এবং দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখী রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে তার সৈন্যরা তাদের কামানগুলো মাটির উপর দৃশ্যমান শিলাস্তর দ্বারা সুরক্ষিত পূর্ববর্তী স্থানেই মোতায়েন করেছে।

সুলতান, আপনি সুস্থ আছেন? ধুসর ধূলার ছোপছোপ দাগ নিয়ে জওহর পাশে এসে দাঁড়াতে তাকে মানুষের চেয়ে প্রেতাত্মাই বেশী মনে হয়।

মাথায় কেবল একটা আচড় লেগেছে। হুমায়ুন যখন কথা বলছে, বিবমিষার একটা ঢেউ তার শরীরে এসে আছড়ে পড়ে এবং সে মাতালের মতো টলতে থাকলে জওহর দৌড়ে এসে তাকে ধরে।

সুলতান, আপনাকে আমরা হেকিমের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। জওহর তাঁকে প্রায় পাজকোলা করে তুলে যেখানে কয়েকটা ঘোড়া দড়ি বাঁধা অবস্থায় রাখা আছে সেখানে নিয়ে আসে। সে ঘোড়ায় চেপে ধীরে ধীরে যখন শিবিরে ফিরে আসছে তখন, জওহর নিজের ঘোড়ার পাশাপাশি হুমায়ুনের ঘোড়ার লাগামও ধরে থাকে, হুমায়ুনের দপদপ করতে থাকা মাথার ভিতরের চিন্তাগুলো বিষণ্ণতার রূপ নিয়েছে। এই সাম্প্রতিক বিপর্যয় বিবেচনা না করেও, বাস্তবতা হল এই যে অবরোধের দ্বারা সামান্যই অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তার গোলন্দাজদের নিশানা, যদিও তারা হাড় কাঁপান শীতে চামড়ার আটসাট পোষাক পরিহিত অবস্থায় ঘামতে ঘামতে যখন তাঁদের কামানের ব্রোঞ্জের নলের ভিতরে বারুদ আর গোলা ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে স্পর্শক গহ্বরে গনগনে সলতে রাখে, নিখুঁত এবং প্রায় প্রতিটা গোলাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্যস্থল- তোরণদ্বারের অবকাঠামো এবং এর চারপাশের মেরামত করা আর শক্তিবর্ধন করা প্রাচীর থেকে পাথর আর মাটির আস্তর ছিটকে উঠে এবং ধূলোর মেঘ তরঙ্গের মতো আকাশে ভাসে- কিন্তু তারা এখনও সেখানে কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি করতে পারেনি। হুমায়ুন তোরণের বামপাশের দেয়ালের প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য গোলন্দাজদের দুটো দলকে দিয়ে গোলাবর্ষণের আদেশ দিয়ে চেষ্টা করেছেন কিন্তু গোলাবর্ষণের নতি দুরূহ হবার কারণে দেয়ালের বিস্তার বরাবর নিখুঁতভাবে গোলাবর্ষণের একমাত্র উপায় হল শৈলস্তরের পেছন থেকে কামানগুলোকে সরিয়ে উন্মুক্ত স্থানে নিয়ে আসা যেখানে তাঁর গোলন্দাজেরা দূর্গপ্রাকারের ছাদে অবস্থানরত তীরন্দাজ কিংবা তবকিদের সহজ নিশানায় পরিণত হবে। এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার কয়েকজন গোলন্দাজ মারাও গিয়েছে এবং তাদের মতো দক্ষতাবিশিষ্ট লোকদের প্রতিস্থাপণ করাও কঠিন কাজ। তাঁর বারুদের সরবরাহও সীমিত।

হুমায়ুন পর্যাণের উপরে সামান্য দুলতে দুলতে মনে মনে ভাবে, তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে, ঠিক যেমন হিন্দালের কাছ থেকে আকবরের উদ্ধার সংক্রান্ত সংবাদের জন্য সে নিজেকে বাধ্য করেছিল অপেক্ষা করতে। একটাই সমস্যা কামরান এতো কাছে রয়েছে জানবার পরে ধৈর্য ধারণ করা কঠিন। দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখে উঠে যাওয়া ঢালু পথটা দিয়ে ঘোড়া হাকিয়ে গিয়ে নিজের ভাইকে দ্বৈরথে আহবান করার ইচ্ছা অনেক সময়েই হুমায়ুনের মনে প্রবল হয়ে উঠে। ব্যাপারটা এমন নয় যে কামরান আহ্বানে সাড়া দিতে আগ্রহী- গলা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া একটা তীরই বড় জোর হুমায়ুনের কপালে জুটতে পারে।

তার পেছনে অবস্থিত কামানগুলো থেকে পুনরায় গোলাবর্ষণের গমগম শব্দ ভেসে আসে। হুমায়ুন বহুকষ্টে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দূর্গপ্রাসাদের দিকে তাকায়। একটা ভয় যে কামরান আর সেখানে নেই আরো একবার তাকে পেয়ে বসে। ধরা যাক দূর্গপ্রাসাদ থেকে পাথরের ভিতর দিয়ে অবস্থিত একটা গোপন পথ দিয়ে অন্যত্র যাওয়া যায়। সে তাঁর কৈশোরে এমন কোনো পথ আছে বলে শোনেনি কিন্তু এমনটা অসম্ভব না যে কামরান সেরকম একটা পথ খুঁজে পেয়েছে এবং তার পক্ষ থেকে দূর্গ রক্ষার দায়িত্ব অন্যদের উপরে অর্পণ করে সে পালিয়েছে।

তার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। দুর্গপ্রাসাদে প্রচণ্ড আর আকস্মিক আক্রমণের বিষয় নিয়ে সে তার সেনাপতিদের সাথে আলোচনা করবে। এরফলে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু তাঁদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে আক্রমণের ফলাফল নিয়ে নিশ্চিতভাবেই সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সে মাথা নীচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে বরফ গলতে শুরু করায় তার ঘোড়ার খুরের নীচের মাটি আদ্রতার কারণে নরম হয়ে রয়েছে। প্রতিদিনই বরফের নীচ থেকে বের হওয়া বিরান মাঠের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্তত ঋতু তার পক্ষে রয়েছে…

*

নাদিম খাজা আহত হয়েছেন। প্রাচীরের গায়ে তারা আরোহণী মই স্থাপণ করা আগেই দূর্গপ্রাকারের ছাদ থেকে তীরন্দাজ আর তবকির দল তাকে আর তাঁর লোকদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি করেছে, বৈরাম খান চিৎকার করে যখন হুমায়ুনকে একথা জানায় তাঁর আধঘন্টা আগেই দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখে আক্রমণ শুরু হয়েছে। আমাদের লোকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার সময় দূর্গরক্ষীরা নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করলে গুলি করে তাদের নিষ্ক্রিয় করতে আমাদের যতজন তবকিকে সেখানে পাঠান সম্ভব আমি পাঠাতে চেষ্টা করবো।

গোলন্দাজদের গোলাবর্ষণের মাত্রা দ্বিগুণ করার আদেশ দাও। তাঁদের কামান থেকে নির্গত ধোয়া তাদের জন্য কিছুটা হলেও আড়াল তৈরী করবে, হুমায়ুন আদেশ দেয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তাকিয়ে থাকতে সে দেখে দূর্গরক্ষীদের কয়েকজন আপাতদৃষ্টিতে আহত হয়েই, কামানের গোলা নিক্ষেপের জন্য দূর্গের ছাদে অবস্থিত ছিদ্রের পেছনে অবস্থিত দেয়ালের উপর থেকে নীচে আছড়ে পড়েছে। কমপক্ষে আরো দুইজন গুলির আঘাতে পিছনের দিকে উল্টে পরার সময়ে নীচের পাথরের উপরে তাদের মাথা গিয়ে প্রথমে আঘাত করে, কিন্তু এতোকিছুর পরেও দূর্গরক্ষীদের গুলি ছোেড়ার বেগ মোটেই শ্লথ হয় না বরং হুমায়ুনের লোকেরা আর বেশী মাত্রায় আহত হতে শুরু করে। বৈরাম খান, পশ্চাদপসারণের সংকেত ঘোষণা করেন, হুমায়ুন বাধ্য হয়ে আদেশ দেয়। আমাদের আক্রমণ খুব একটা ফলপ্রসু হচ্ছে না এবং এতো বেশী মাত্রায় হতাহতের সংখ্যা আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব না।

হুমায়ুনের সৈন্যদের ভিতরে যারা আক্রমণের ঝাপটা সামলে নিতে পেরেছে শীঘ্রই তাঁরা তাঁর নিয়ন্ত্রক অবস্থানের পাশ দিয়ে শিবিরের দিকে ফিরতে শুরু করে, কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটছে, অন্যদের ক্ষতস্থানে বাঁধা পট্টি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দুইজন লোক তার পাশ দিয়ে একটা খাঁটিয়া বয়ে নিয়ে যায়, হুমায়ুন খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকা লোকটাকে যন্ত্রণায় পশুর মতো চিৎকার করতে শোনে এবং খেয়াল করে দেখে দূর্গপ্রাকারের ছাদ থেকে আক্রমণকারীদের উপরে ঢেলে দেয়া গরম আলকাতরায় লোকটার ডান হাত আর কাঁধ ঝলসে গিয়েছে। হুমায়ুনের চোখের সামনেই লোকটার দেহটা আচমকা মোচড় দেয় এবং লাথি ছুঁড়ে, আর সহসাই যন্ত্রণার হাত থেকে সে চিরতরে মুক্তি লাভ করে। নাদিম খাজা চট আর ডালপালা দিয়ে কোনমতে তৈরী করা একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে সবার শেষে শিবির অভিমুখে বৈরাম খান আর হুমায়ুনকে অতিক্রম করেন, তাঁর উরু থেকে একটা ভাঙা শরযষ্টি বের হয়ে রয়েছে। কিন্তু নাদিম খাজা প্রাণবন্ত কণ্ঠে বলেন, সুলতান, চিন্তা করবেন না আমি ঠিক আছি, ব্যাটাদের গায়ে জোর নেই তীরটা কেবল মাংসে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আবারও আপনার খেদমত করতে আমি বেঁচে থাকবো।

তার এমন বিশ্বস্ত সমর্থক রয়েছে এটা ভালো লক্ষণ, কিন্তু আরো বেশী সংখ্যক প্রাণহানির সম্ভাবনা মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ভেবে নিয়ে সে কি তাঁর বাকি সৈন্যদের উপরে ভরসা করতে পারে? বিজয় অর্জিত হলে সে তাঁদের পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতি তখনই তাঁদের কাছে অর্থবহ হবে যদি তাঁরা বিশ্বাস করে যে শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হবে। সে কিভাবে কাবুল দখল করবে? কামরানকে কিভাবে বন্দি করবে? সে জীবনে প্রথমবারের মতো সত্যিই অসহায় বোধ করে।

বৈরাম খান, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত? আমি জানি আমি বিশ্বাস করতে পারি আমি সত্যি কথাটাই বলবেন।

আমার মনে হয় আমরা দুজনেই জানি সামনাসামনি আক্রমণের সিদ্ধান্তটা একটা ভুল ছিল- হতাশার গর্ভে জন্ম নেয়া একটা ভুল। আমাদের অবশ্যই কঠোর অবরোধ বজায় রেখে আরো একবার ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অতিরিক্ত রসদ সংগ্রহের জন্য আমরা আমাদের লোকদের অন্যত্র প্রেরণ করতে পারি এবং সেটা আমরা করবোও কিন্তু কামরান আর তার বাহিনীর পক্ষে সেটা সম্ভব না। তাঁদের সামনে পরিত্রাণ লাভের কোনো আশাই নেই। আমরা যদি আমাদের স্নায়ুচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে আমাদের অনেক আগেই তাদের মনোবলে ভাঙ্গনের খেলা শুরু হবে।

বিচক্ষণ পরামর্শ। অবরোধ জোরদার করতে সবাইকে প্রয়োজনীয় আদেশ জানিয়ে দেন।

হুমায়ুন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বের হয়ে তাঁর শিবিরের সীমানার চারপাশে পাহারা দেবার জন্য প্রহরীদের এক অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাবার সময় কয়েকটা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায়। ছাগল বা ভেড়ার মালিকানা নিয়ে সম্ভবত আরেকটা বচসা। সে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা চিন্তা করে না। সে আরেকটু এগিয়ে গেলে বচসার কারণ প্রত্যক্ষ করে। হুমায়ুনের ছয়জন সৈন্যের মাঝে, যাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্ধত তরবারি রয়েছে, খঞ্জর হাতে খোঁচা খোঁচা ভাবে কামান এক মাথা চুল নিয়ে একটা লোক অকুতোভয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে। এখানে এসব কি হচ্ছে?

তাকে চিনতে পারার সাথে সাথে, সৈন্যরা নিজেদের বুক হাত দিয়ে স্পর্শ করে। হুমায়ুন দেখে লোকটার চঞ্চল চোখ তার ঘোড়ার সোনার কলাই করা লাগাম আর তার পরনের ভেড়ার চামড়ার আলখাল্লার কারুকার্যখচিত বকলেসের উপর ঘুরে বেড়ায়, সে কে হতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে।

আমি তোমাদের সম্রাট। কে তুমি আর কেন এখানে ঝামেলা করছো?

লোকটাকে হতবাক দেখায় কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। আমার নাম জাভেদ, ঘিলজাই গোত্রের লোক আমি। আমি এসব শুরু করিনি। আপনার সৈন্যরা আমাকে একজন গুপ্তচর মনে করেছে…

সত্যিই কি তুমি?

না। আমি প্রকাশ্যে আপনার শিবিরে এসেছি। আমার কাছে তথ্য আছে।

কি সম্বন্ধে?

সেটা নির্ভর করবে মূল্যের উপর।

জাভেদের উদ্ধত কথাবার্তায় ক্ষিপ্ত হয়ে, সৈন্যদের একজন সামনে এগিয়ে এসে বর্শার বাঁট দিয়ে তার পিঠের কৃশতম অংশে আঘাত করে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়। সম্রাটের সামনে নতজানু হয়ে বসা দস্তুর। শ্রদ্ধা প্রদর্শনের রীতি কি দেশ থেকে উঠে গিয়েছে…

হুমায়ুন কোনো কথা বলার আগে লোকটাকে কিছুক্ষণ সেঁতসেঁতে মাটিতে পড়ে থাকতে দেয়। উঠে দাঁড়াও। জাভেদ টলমল করতে করতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং প্রথমবারের মতো তাঁকে সামান্য বিচলিত দেখায়।

আমি আমার প্রশ্নটা আবার করছি। তোমার কাছে কি তথ্য রয়েছে? আমি তুমি না ঠিক করবো সেটার জন্য মূল্যপ্রদান করা সঙ্গত হবে কিনা। আমাকে যদি তুমি না বলো, আমার লোকেরা তাহলে তোমাকে বাধ্য করবে সেটা বলতে।

জাভেদ ইতস্তত করে। হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, লোকটা কি আসলেই অপরিশীলিত সরলমনা? একজন আহাম্মকের পক্ষেই কেবল সম্ভব সরাসরি কোনো সেনাছাউনিতে এসে সম্রাটের সাথে কোনো কিছু নিয়ে দর কষাকষি করার ধৃষ্টতা দেখান। কিন্তু জাভেদকে দেখে মনে হয় সে মনস্থির করে ফেলেছে। শহরে মহামারী দেখা দিয়েছে। দুই কি তিনশ লোক ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে এবং প্রতি মুহূর্তে বাজারে আরো মৃতদেহ এসে জমা হচ্ছে…

কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে?

কয়েকদিন আগে প্রথম প্রকোপটা দেখা দেয়।

তুমি কিভাবে জানতে পেরেছো?

আমার ভাইয়ের কাছ থেকে সে শহরের ভিতরে রয়েছে। আমি আর আমার ভাই, আমরা খচ্চর আর ঘোড়ার ব্যাপারী। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও আমরা কাবুলের বণিকদের কাছে আমাদের জন্তুগুলো বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছিলাম বরফ গলতে শুরু করার সাথে সাথে কাফেলার বহর যাতায়াত আরম্ভ করলে মালামাল পরিবহণের জন্য যাদের ভারবাহী প্রাণী প্রয়োজন হবে। পাহাড়ে আমি আমাদের জন্তুগুলোকে চরাতে নিয়ে গিয়েছিলাম এমন সময় আপনার আগুয়ান বাহিনীর খবর শুনতে পেয়ে কাবুল সেনানিবাসের অধিনায়ক তোরণদ্বার বন্ধ করার আদেশ দেন। আমার ভাই- যে শহরের সরাইখানাগুলোর একটায় ব্যবসায়িক লেনদেনের তদারকি করছিল- শহরের ভেতরে আটকা পড়ে। অবরোধ শুরু হবার পরবর্তী সপ্তাহগুলোকে আমি অবশ্য তার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারিনি। কিন্তু আমার শিকারী কুকুরটা তাঁর কাছে ছিল। তিন রাত্রি আগের কথা, পাহাড়ের পাদদেশে আমার ছাউনিতে কুকুরটা ফিরে এসেছে জন্তুটার গলার বকলেসে একটা চিঠি আটকান ছিল। আমার ভাই নিশ্চয়ই শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর দিয়ে কুকুরটাকে নীচে নামাবার একটা পথ খুঁজে বের করেছিল, যদিও জন্তুটা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল বেচারার পেটের একপাশ দারুণভাবে ছড়ে গিয়েছে এবং রক্তক্ষরণ হয়েছে আর একটা পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরেও জটা আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করেছে।

বার্তায় আর কি বলা হয়েছে? তোমার কাছে কেন মনে হয়েছে যে খবরটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে?

জাভেদের চোখে মুখে আবার সেই ধূর্ততা ফিরে আসে। আমার ভাই শহরে বিদ্যমান ভয় আর আতঙ্কের কথা লিখেছে। সে বলেছে শহরবাসীরা অবরোধের অবসান চায় যাতে তারা শহর আর সেখানে বিদ্যমান মহামারীর প্রকোপ থেকে দূরে যেতে পারে। সে বিশ্বাস করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে শহরবাসীরা সেনাছাউনির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শহরের মূল তোরণদ্বার আপনার জন্য খুলে দিতে পারে।

আমাকে বার্তাটা দেখাও।

জাভেদ ঝুঁকে নীচু হয়ে তার পায়ের নাগরার ভিতর থেকে বহুবার ভাঁজ করা হয়েছে এমন একটা কাগজের টুকরো বের করে সেটা হুমায়ুনের হাতে তুলে দেয়। হুমায়ুন কাগজের ভাঁজ খুলে এবং বাজে হস্তাক্ষরে তুর্কী ভাষায় লেখা ঘন পংক্তিগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জাভেদ যা বলেছে সবই চিঠিটা নিশ্চিত করে। শেষ বাক্যগুলো অনেকটা এমন: আগাম কোনো পূর্বাভাষ না দিয়েই রোগটার প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং তরুন আর স্বাস্থ্যবানরাও এর প্রকোপ থেকে রেহাই পায়নি। প্রথমে শুরু হয় প্রচণ্ড জ্বর আর সেই সাথে বমি, তারপরে নিয়ন্ত্রণের অতীত উদারাময়, শেষে চিত্তবৈকল্য আর মৃত্যু। প্রতিদিনই দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকা মৃতদেহের স্তূপ বেড়েই চলেছে। আমরা এমন একটা ফাঁদে আটকা পড়েছি যাঁর কবল থেকে কারও রেহাই নেই। আমাদের দেহে শক্তি থাকা অবস্থায় সেনাছাউনির সৈন্যদের হত্যা করে তোরণদ্বার খুলে দেবার বিষয়ে আমরা সবসময়েই আলোচনা করছি কিন্তু আমাদের সম্ভবত সেটা করার প্রয়োজন পড়বে না। সৈন্যরাও মরতে শুরু করেছে। তারাও ভালো করেই জানে যে হয় অবরোধ তুলে নিতে হবে কিংবা আল্লাহতালা আমাদের প্রতি তাঁর করুণা প্রদর্শন করবেন অন্যথায় আরো অনেকেই মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহতালা আমাদের উপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তাঁকে ক্রোধান্বিত করার মতো কি এমন কাজ আমরা করেছি? ভাই আমার, আমি আশা করি এই বার্তা তোমার কাছে পৌঁছাবে কারণ আমাদের হয়ত আর দেখা হবে না।

শব্দগুলোর মর্মার্থ হুমায়ুন যখন পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারে তখন তার নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হয়। সে যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সম্ভবত এটাই সেটা কিন্তু তারপরেও জাভেদকে বিশ্বাস করাটা কি ঠিক হবে? সে হয়ত কামরানের একজন অনুচর। হুমায়ুন তার কণ্ঠস্বর শীতল আর সংযত রাখে। তুমি দেখছি তোমার ভাইয়ের সুস্বাস্থ্যের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত লাভের প্রতি বেশী আগ্রহী, যাই হোক তোমার এই তথ্য সত্যি হলে তুমি এজন্য পুরস্কৃত হবে। কিন্তু এটা যদি মিথ্যা হয় তাহলে আমি তোমার মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিচ্ছি। হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষীদের দিকে ঘুরে তাকায়। একে চোখে চোখে রাখবে।

জাভেদকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে একটা গুতো দিয়ে অস্থায়ী শিবিরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিয়ন্ত্রক তাবুর দিকে অগ্রসর হয়, তার মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। বার্তাটায় যা বলা হয়েছে তা যদি আদতেই সত্যি হয়ে থাকে তাহলে কাবুল অচিরেই তাঁর পদানত হবে, কিন্তু তার আগে তাকে জানতে হবে কিভাবে তথ্যটা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করা সম্ভব।

*

সুলতান, কাবুলের অধিবাসীরা একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। আধ ঘন্টা আগে, শহরের মূল তোরণদ্বার খুলে যায় এবং একটা গরুর গাড়ি একজন বৃদ্ধলোককে নিয়ে আমাদের শিবিরের দিকে হেলতে দুলতে এগিয়ে আসতে থাকে। সে আমাদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী এটা বোঝাবার জন্য সে ছেঁড়া একটা কাপড়ের টুকরো আন্দোলিত করছিল।

ব্যাপারটা ঘটতে তাহলে মাত্র তিনদিন সময় লাগল। জাভেদের কাছ থেকে শহরের পরিস্থিতি সম্পর্কিত সমাচার লাভের সাথে সাথে হুমায়ুন শহরের চারপাশে ফাঁসের ন্যায় মোতায়েন করা সৈন্যের ব্যুহ আরো জোরদার করে। দূর্গপ্রাসাদে আক্রমণের জন্য নিয়োজিত কয়েকটা কামানও সে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে এবং, নিরাপত্তার জন্য সেগুলোকে তড়িঘড়ি করে তৈরী করা নিরাপত্তা আড়ালের পিছনে স্থাপন করে, তার গোলন্দাজদের আদেশ দেয় শহরের অধিবাসীদের আর সেনাছাউনির সৈন্যদের মনোবল দূর্বল করতে শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে। প্রথমদিন হত্যোদম ভঙ্গিতে কয়েকদফা পাল্টা গোলাবর্ষণ ছাড়া দূর্গপ্রাকারের ছাদের কামানগুলো নিরবই থাকে এবং শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে রক্ষীসেনাদের উপস্থিতি তারচেয়েও কম চোখে পড়ে।

প্রতিনিধি লোকটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।

হুমায়ুন তার তাবুর বাইরে যখন অপেক্ষা করছে, সে মুখের উপরে সদ্য আগত বসন্তের সকালের সূর্যের ওম উপভোগ করে। চমৎকার একটা অনুভূতি। সেই সাথে তাঁর আত্মবিশ্বাসও শনৈ শনৈ বাড়তে থাকে যে বিজয় এখন তাদের স্পর্শের ভিতরে নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে। এটাকে তার নাগালের ভিতর থেকে ফসকে যেতে দেয়াটা মোটেই উচিত হবে না।

প্রতিনিধি লোকটা বাস্তবিকই বৃদ্ধ- বস্তুতপক্ষে এতোটাই বয়োবৃদ্ধ যে একটা লম্বা, তেল চকচকে লাঠির সাহায্য ছাড়া বেচারা হাঁটতেই পারে না। হুমায়ুনের সামনে এসে সে ঝুঁকে নীচু হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে চায় কিন্তু পারে না। সুলতান আমাকে মার্জনা করবেন, শ্ৰদ্ধার কমতি না বরং আমার বুড়ো হাড়ই আমাকে বাধা দিচ্ছে… কিন্তু আমি অসুস্থতার কবল এড়িয়ে যেতে পেরেছি। শহরের বার্তাবাহক হিসাবে আমাকে মনোনীত করার সেটাই অন্যতম কারণ।

তাকে বসার জন্য একটা তেপায়া এনে দাও। বৃদ্ধ লোকটা কষ্টকর ভঙ্গিতে নীচু হয়ে বসা পর্যন্ত হুমায়ুন অপেক্ষা করে, তারপরে জিজ্ঞেস করে। আপনি আমার জন্য কি বার্তা নিয়ে এসেছেন?

আমাদের শহরে প্রতিদিনই অসংখ্য লোক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। আমরা এর কোনো কারণই বুঝতে পারছি না- সম্ভবত সেনাছাউনির সৈন্যরা যখন শহরের বাইরের কূপ আর ঝর্ণাগুলোয় বিষ দিয়েছিল তখনই কোনভাবে আমাদের নিজেদের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও দূষিত হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে যুবকরাই সবচেয়ে বেশী ভুগছে। কাবুল শহরের অনেক মায়েরই বুক খালি হয়েছে। এই অহেতুক যুদ্ধের কারণে আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি- এমনকি সেনাছাউনিতেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে, আমাকে তাদের পক্ষেও আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা এই অবরোধের একটা অবসান চাই যাতে করে যারা শহর ত্যাগ করতে চায় চলে যেতে পারে।

পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ভিন্ন আর কোনো কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হব না।

আপনি ঠিক এই কথাটাই বলবেন, আমি শহরের লোকদের সেটা আগেই বলেছি। সুলতান, আপনি কি আমাকে চিনতে পারেননি…

লোকটার সূর্যের আলোয় শুকিয়ে যাওয়া আখরোটের মতো কুচকানো মুখাবয়বের দিকে হুমায়ুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেমন যেন চেনা মনে হয় মুখটা।

আমি ইউসুফ, আপনার মরহুম আব্বাজানের একসময়ের কোষাধক্ষ্য ওয়ালি গুলের সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ ভ্রাতুস্পুত্র। আপনাকে এবং আপনার সৎ-ভাই কামরানকে আমি একেবারে ছোটকালে দেখেছি… এটা সত্যিই দুঃখজনক যে আপনাদের দুজনের ভিতরে সম্পর্কের এতোখানি অবনতি হয়েছে… যুবরাজদের উচ্চাশার কারণে সাধারণ লোকদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে এটাও ঠিক মেনে নেয়া কঠিন। আমি সবসময়েই বিশ্বাস করেছি যে আপনি সম্রাট বাবরের সবচেয়ে প্রিয়পুত্র- কাবুলের ন্যায়সঙ্গত অধিপতি। কিন্তু মানুষের মনোভাব পরিবর্তনশীল এবং আজকাল সম্মানের চেয়ে নিজের স্বার্থই বোধহয় তাঁদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কামরান আপনাকে পরাজিত করতে পারবে বলে তারা যখন বিশ্বাস করেছিল, তারা তখন তার প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল।

শহরের নাগরিকদের এই জন্যই আমার কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পন করতে হবে। আপনি এখন ফিরে যান এবং তাঁদের বলেন যে, যদি প্রতিটা লোক শহরের সাধারণ লোকদের সাথে সাথে সেনাছাউনির সৈন্য সবাই- যদি অস্ত্র সমর্পন করে আমি তাঁদের জান বখশ দেব। আমি চাই কামান থেকে শুরু করে সব যুদ্ধাস্ত্র এবং গাদাবন্দুক থেকে শুরু করে তরবারি আর তীরধনুক সবকিছু নিয়ে এসে শহরের প্রধান তোরণদ্বারের বাইরে স্তূপ করে রাখা হোক। শহরের লোকেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাব শেষ না হওয়া পর্যন্ত শহর ত্যাগ করতে পারবে না। আমি আমার নিজের লোকদের বিপদে ফেলতে চাই না। কিন্তু আমি আমার হেকিমকে পাঠাবো আর সেই সাথে বিশুদ্ধ পানীয় জল আর টাটকা খাবার… তাদের জবাব কি হতে পারে?

ইউসুফের গাঢ় বাদামী চোখ প্রায় অশ্রু সজল হয়ে উঠে। সুলতান, আপনার এই করুণা প্রদর্শনের জন্য তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে।

ইউসুফ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এবং তার হাতের লাঠির উপরে পুরোপুরি ভর দিয়ে সে যে গরুর গাড়িতে করে এখানে এসেছে, সেদিকে এগিয়ে যায় আর তাতে উঠে বসে। অচিরেই দেখা যায় গাড়িটা তাকে নিয়ে ফিরতি পথে শহরের দিকে ফিরে চলেছে এবং তাকে গ্রহণ করার জন্য প্রধান তোরণদ্বারে পাল্লা দুটো খুলে দেয়া হয়। হুমায়ুন তার তাবুর সামনে পায়চারি করতে করতে ভাবে তাঁর বেধে দেয়া শর্তের প্রত্যুত্তরে পাল্লা দুটো কি এত সহজেই তার সামনে খুলে যাবে, নিজের ভাবনায় সে এতোই বিভোর ছিল যে দুপুরের খাবারের জন্য জওহর তাঁকে ডাকতে আসলে উত্তর দেবার কথা তার খেয়াল থাকে না। এক ঘন্টা অতিক্রান্ত হয় এবং তারপরে আরও এক ঘন্টা। তারপরে শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ভেতর থেকে একটা শোরগোলের শব্দ ভেসে আসে, প্রথমে খুবই ক্ষীণ কিন্তু অচিরেই সেটা জোরাল হতে আরম্ভ করে… সহস্র কণ্ঠের উল্লসিত আওয়াজ। এর একটাই অর্থ হতে পারে যে শহরের অধিবাসীরা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পলকের ভিতরে, তোরণদ্বারের পাল্লাগুলো হা করে খুলে দেয়া হয় এবং ভেতর থেকে বেশ কয়েকটা গরুর গাড়ি দ্রুত গতিতে বাইরে বের হয়ে আসে। শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর আর শহরের চারপাশে চক্রব্যুহ তৈরী করে অবস্থানরত হুমায়ুনের সৈন্যদের মধ্যবর্তী ভূমির মাঝামাঝি স্থানে তারা যখন পৌঁছায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে এবং গাড়ির সারথি আর তার পেছনে বসে থাকা লোকেরা গাড়ির পেছনে থাকা মালামাল কোনো ধরনের ভণিতা না করে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র, ধনুক আর গাদাবন্দুকগুলো সূর্যের আলোয় চকচক করে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলে মাটিতে একটা স্তূপের সৃষ্টি হয়।

হুমায়ুন হাসে। আত্মসমর্পনের শর্ত নির্ধারণে তাঁর কোনো ধরনের ভুল হয়নি। শহরটা এখন তার কিন্তু আসল কাজ এখনও কিছুই হয়নি। দৃর্গপ্রাসাদে এখনও বহাল তবিয়তে কামরানের অনুগত সৈন্যরা অবস্থান করছে। হুমায়ুন ভালো করেই জানে যে তার সৎ-ভাই যদি এখনও সেখানে অবস্থান করে থাকে, তাহলে শহরের আত্মসমর্পনের এই দৃশ্য সেও দেখছে। এখন তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হবে?

উত্তরটা জানতে খুব বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয় না। দূর্গপ্রাসাদের প্রাকারবেষ্টিত ছাদ থেকে কামরানের অনুগত সৈন্যরা হুমায়ুনের কামানের অবস্থান লক্ষ্য করে এক ঝাঁক তীর নিক্ষেপ করে। তারা সেই সাথে দূর্গ প্রাচীরের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে স্থাপিত ক্ষুদ্রাকৃতি কামান থেকে গোলা বর্ষণও করে। তারপরে হুমায়ুন দূর্গপ্রাসাদের প্রধান তোরণদ্বারের উপরে স্থাপিত নহবতখানা থেকে ঢাকের গমগমে শব্দ আর সেই সাথে তূর্যবাদন শুনতে পায় এবং তাকিয়ে দেখে তোরণদ্বারের পাল্লা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। কামরান কি তাহলে আত্মসমর্পন করবে বলে মনস্থির করেছে? না। সহসা হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে দূর্গে অবস্থানরত সৈন্যরা বাতাসে লম্বা চাবুক আন্দোলিত করে ডজনখানেক অস্থিচর্মসার ষাড় তাড়িয়ে নিয়ে এসে পশুগুলোকে তোরণদ্বার দিয়ে বের করে এবং দূর্গ থেকে নেমে আসা ঢালু পথ দিয়ে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে তাদের দাবড়ে দেয়, জম্ভগুলোর পিঠে শুকনো খড়ের আটি বেঁধে দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

আতঙ্কিত জম্ভগুলো জীবন্ত মশালের ন্যায় সামনের দিকে ছুটতে থাকে। গোলন্দাজদের তাবু কিংবা তাঁদের বারুদের মজুদ জ্বালিয়ে দেয়ার আগেই জন্তুগুলোকে তীর মেরে ধরাশায়ী করো, হুমায়ুন চিৎকার করে বলে।

শীঘ্রই এগারটা ষাড়কে নীচের দিকে নেমে আসা ঢালু পথের উপরে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তাদের মৃতদেহ থেকে অগণিত তীরযষ্টি বের হয়ে আছে। কেবল একটা ষাড় ব্যাথায় উন্মত্ত হয়ে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে ধেয়ে আসে এবং কোনো ধরনের মারাত্মক ক্ষতি করার আগেই অবশ্য তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। অবশ্য, হুমায়ুনের তিনজন তীরন্দাজ ষাড়গুলোকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ার সময় যখন নিজেদের নিরাপত্তা আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছিল, তখন দূর্গপ্রাসাদের ছাদ থেকে তাদের লক্ষ্য করে ছোঁড়া গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়।

পাল্টা আক্রমণের এই প্রয়াসে হুমায়ুনের মনে প্রত্যয় জন্মায় যে সে যেমনটা ভয় করেছিল সেটাকে সত্যি করে কামরান পালিয়ে যায়নি বরং সে দূর্গপ্রাসাদেই অবস্থান করছে কারণ এমন বুদ্ধি কেবল তার সৎ-ভাইয়ের মাথা থেকেই বের হওয়া সম্ভব। তাঁর চরিত্রের সাথে বিষয়টা দারুণভাবে মিলে যায়। তারা যখন উঠতি কিশোর তখন কামরান খেলা বা অন্য কোনো বিষয়ে পরাজিত হওয়াটা মেনে নিতে পারতো না, হেরে গেলেই বাচ্চাছেলেদের মতো জীহ্বা বের করে হুমায়ুনকে ভেংচি কাতো আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে আস্ফালন করতো এবং তারা যখন যুবক তখন এসব কিছুর সাথে যোগ হয় উচ্চকণ্ঠে অপরের উপর দোষ চাপান আর তাদের পরবর্তী মোকাবেলায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে বলে নিজেকেই প্রবোধ দেয়া। সেই সময়ে, হুমায়ুন হেসে কামরানকে আর তার এসব আচরণকে উপেক্ষা করতে যা তাঁর সৎ-ভাইয়ের ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিত। সে এখন অবশ্য কামরান আর তাঁর চেয়েও যেটা এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কামরানের সঙ্গীসাথীদের, মনোবল পরখ করতে বদ্ধপরিকর। নিবিষ্ট মনে কয়েক মিনিট চিন্তা করে, হুমায়ুন কামরানের উদ্দেশ্যে একটা চিঠির মুসাবিদা শুরু করে তারপরে জওহরকে ডেকে পাঠায়।

আমি চাই দূর্গপ্রাসাদে গিয়ে তুমি নিজে আমার ভাইকে এই চরমপত্রটা পৌঁছে দেবে। আমি এটা তোমাকে পড়ে শোনাব, যাতে করে তোমার জানা থাকে তুমি কি বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খুবই সংক্ষিপ্ত একটা বার্তা আর এর বক্তব্যও চাচাছোলা। আমাদের ভগিনী গুলবদন চেষ্টা করেছিল দায়িত্ববোধ আর পারিবারিক সম্মানের প্রতি তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে। তুমি তাতে কর্ণপাত করনি। তুমি এর বদলে একটা শিশুর জীবনকে তোমার আপন ভাস্তে, তাকে ঝুঁকির মধ্যে আপতিত করে নিজের কপালে চুড়ান্ত কলঙ্কের কালিমা লেপন করেছে। আমার হাতে শহর কাবুলের পতন হয়েছে, সেইসাথে তোমার নিজের ভবিষ্যতও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে, তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি অবশিষ্ট নেই কিন্তু তোমার অনুসারীদের কথা বিবেচনা করে আমি তোমাকে এই একটা সুযোগ দিচ্ছি। দূর্গপ্রাসাদ আমার হাতে সমর্পণ কর এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে তোমার লোকদের জীবন বখশ দেব। তোমার বিষয়ে অবশ্য আমি সিদ্ধান্ত নেব আর আমি তোমাকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না। তুমি যদি এরপরেও আত্মসমর্পণ না কর, তাহলে আমি আমার সর্বশক্তি তোমার বিরুদ্ধে নিয়োজিত করবো। আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যত সময়ই প্রয়োজন হোক, আমার লোকেরা তোমার দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীর গুঁড়িয়েই তবে থামবে এবং একবার ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে দূর্গপ্রাসাদের সবাইকে কোনো ধরনের সহানুভূতি না দেখিয়ে হত্যা করা হবে। তোমার অভিপ্রায় আমাকে জানাবার জন্য আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তুমি সময় পাবে। তোমার উত্তর যদি না হয়, আমি আমার তীরন্দাজদের নির্দেশ দেব রাতের আঁধারে তোমার প্রতিরক্ষা প্রাচীরের অভ্যন্তরে এই একই বার্তা সম্বলিত তীর ছুঁড়তে, যাতে করে তোমার অনুসারীরা বুঝতে পারে তোমার কাছে তাঁদের জীবন কতটা মূল্যহীন।

বস্তুতপক্ষে, জওহর দূর্গপ্রাসাদে চরমপত্রটা পৌঁছে দিয়ে আসবার পরে একঘন্টাও অতিক্রান্ত হয়নি এবং সূর্য তখনও দিগন্তের এক বর্শা উপরে অবস্থান করছে যখন, হুমায়ুন তার অস্থায়ী সেনাছাউনির সীমানার কাছে দাঁড়িয়ে আহমেদ খানের সাথে অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়, সে নিঃসঙ্গ এক অশ্বারোহীকে দূর্গপ্রাসাদ থেকে নীচের দিকে খাড়া হয়ে নেমে আসা ঢালু পথটা দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে দেখে এবং তারপরে সমভূমির উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করে। নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী আরেকটু নিকটবর্তী হতে হুমায়ুন লক্ষ্য করে তাঁর বর্শার অগ্রভাগে যুদ্ধবিরতির নিশান উড়ছে। অপেক্ষা করার সময় হুমায়ুনের কাছে মনে হয় ঘড়ির কাঁটা বুঝি অসম্ভব ধীরে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু অবশেষে আগন্তুক অশ্বারোহী তাঁর কাছ থেকে কয়েকগজ দূরে এসে উপস্থিত হয়- এক তরুণ যোদ্ধা, ধাতব শিকলের তৈরী বর্ম পরিহিত, মাথার শিয়োস্ত্রাণে ঈগলের পালকশোভিত এবং চোখে মুখে গম্ভীর একটা অভিব্যক্তি। সে তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, মাটিতে নেমে দাঁড়ায় এবং সে যে নিরস্ত্র সেটা বোঝাতে দুহাত দেহের দুপাশে তুলে ধরে।

কাছে এসো, হুমায়ুন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে।

হুমায়ুনের কাছ থেকে লোকটা যখন দশ গজ দূরে, সে প্রথাগত অভিবাদনের ভঙ্গি কুর্ণিশের রীতিতে মাটিতে পুরোপুরি আনত হয়। তারপরে সে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করে। মহামান্য সুলতান। আমি খুবই সংক্ষিপ্ত একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। কাবুলের দূর্গপ্রাসাদ আপনার আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করছে।

একটা তীব্র আনন্দের অনুভূতি হুমায়ুনকে একেবারে আপ্লুত করে ফেলে। একই সাথে একটা চিন্তাও তার মনের কোণে উঁকি দেয়। সে অন্য কোনকিছু করার আগে পাহাড়ের উপর থেকে কাবুল দেখা যায় এমন স্থানে তার মরহুম আব্বাজানের গড়ে তোলা উদ্যানে সে যাবে- যেখানে রোদ, বৃষ্টি, তুষারপাত আর বায়ুপ্রবাহের মাঝে বাবরের সমাধিস্থল উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে, মার্বেলের পাটাতনের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে সে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। বাবর যা করেছিলেন ঠিক সেভাবেই সে কাবুলকে ব্যবহার করবে তার হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সূচনাস্থল হিসাবে।

*

ঝকঝকে নীলাকাশের নীচে হুমায়ুন যখন বাছাই করা লোকদের একটা দলের একেবারে অগ্রভাগে অবস্থান করে, তূর্যনিনাদের মাঝে অগ্রসর হতে শুরু করে, যেখানে তাঁর কাবুল অভিযানে অংশগ্রহণকারী সকল গোত্রের প্রতিনিধি রয়েছে, উপরের দূর্গপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হবার সময়ে প্রথমে সে তার মোতায়েন করা কামানগুলোকে অতিক্রম করে, তারপরে সেই স্থান যেখান থেকে সে দূর্গপ্রাকারের ছাদে শিশু আকবরকে মানব বর্ম হিসাবে প্রদর্শিত হতে দেখে ক্ষোভে ফেটে পরেছিল, সবশেষে পিঠে জ্বলন্ত আগুন নিয়ে অস্থিচর্মসার ষাড়ের দল যে উঁচু তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে ধেয়ে এসেছিল সেটা অতিক্রম করে সে দূর্গপ্রাসাদের অভ্যন্তরে সূর্যালোকিত আঙ্গিনায় এসে উপস্থিত হয়। সে যখন তাঁর বিশাল কালো ঘোড়াটার পিঠ থেকে নীচে নামছে তখন পারস্য ত্যাগ করে আসবার পর থেকে সে যা অর্জন করেছে সেজন্য দারুণ একটা গর্ববোধ তাঁকে জারিত করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অবশ্য, সে আকবরকে উদ্ধার করেছে, কিন্তু সেই সাথে সে কামরান আর আসকারির উপরে পুনরায় নিজের কর্তৃত্ব অর্জন করেছে এবং কাবুলের সালতানাত পুনরায় করায়ত্ত করেছে।

বৈরাম খান, নাদিম খাজা এবং তার পেছনে অনুসরণরত অন্যান্য সেনাপতিরা নিজেদের উল্লাস চেপে রাখবার কোনো চেষ্টাই করে না, তার রাস্তার দুপাশে সমবেত শহরবাসীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে এবং নিজেদের এই কষ্টার্জিত বিজয় উপভোগ করে। কিন্তু হুমায়ুনের মনের ভিতরে এই আনন্দের মাঝেও বিষণ্ণ সব চিন্তা উঁকি দেয়। গতরাতে আব্বাজানের কবরের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে সে শপথ করেছে আর কখনও সাম্রাজ্যহীন সম্রাটের ভাগ্য সে বরণ করবে না। বাবরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরো একবার হিন্দুস্তান দখল করার পূর্বে, সে কাবুল এবং এই রাজ্যের পুরো এলাকায় তার শাসনকে অনাক্রম্য করে তুলবে। সে পাশ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের প্রতিটা জমিদার, যারা তাঁর অনুগত হিসাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে তাদের বাধ্য করবে তার অধিরাজত্বের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শন করতে। এইসব জমিদারদের অনেকেই কামরানকে সমর্থণ করেছিল এবং বাবরের সাথে হিন্দুস্তান অভিযানে যখন হুমায়ুন তার সঙ্গী হয় তখন সদ্যযুবা কামরান কাবুলে অবস্থান করে, সেই সময় থেকেই জমিদারদের অনেকের সাথে তার বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এদের বিষয়ে অনেক সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শক্তির দম্ভ দেখিয়ে সাময়িকভাবে হয়ত তাদের আনুগত্য অর্জন করা সম্ভব কিন্তু সে যখন হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হবে তখন কি হবে? তারা তখন নিশ্চিতভাবেই বিদ্রোহ করবে।

প্রথমে, অবশ্য তাঁকে তাঁর সৎ-ভাইয়ের ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করতে হবে যাকে সে দুই বছর আগে শেষবারের মতো সামনা সামনি দেখেছিল যখন এক তুষারঝড়ের রাতে নিজের তাবুতে ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজের গলায় তার খঞ্জরের ফলা দেখতে পেয়েছিল। কামরান কোথায়? সে জওহরের কাছে জানতে চায়, যে বরাবরের মতোই এখনও তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমাকে বলা হয়েছে দূর্গপ্রাসাদের নীচে ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

তাকে এখনই এই প্রাঙ্গণে আমার সামনে নিয়ে এসো।

জ্বী, সুলতান।

কয়েক মিনিট পরে, হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে একটা নীচু দরজা দিয়ে, যার পেছনের সিঁড়ি নীচের ভূগর্ভস্থ কামরার দিকে নেমে গিয়েছে, কামরান বের হয়ে আসছে, সহসা সূর্যালোকসম্পাতের কারণে সে চোখ পিটপিট করছে। তার দুই পায়ে ভারী শিকলের বোঝা এবং দুজন সশস্ত্র প্রহরী তাঁকে অনুসরণ করছে। অবশ্য, তার দুই হাত ভোলাই রয়েছে এবং শহরে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে হুমায়ুনের সেনাপতিদের ঘোড়াগুলোকে আস্তাবলে ফিরিয়ে নিতে ব্যস্ত তিনজন সহিসকে অতিক্রম করার সময়, সে সহসা তাঁদের একজনের কাছ থেকে অশ্বচালনায় ব্যবহৃত একটা লম্বা চাবুক ছিনিয়ে নেয়। তাঁকে অনুসরণরত প্রহরীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিঁচকে অপরাধীদের কড়িকাঠে ঝুলিয়ে চাবকানোর জন্য নিয়ে যাবার সময় যেমন তাদের গলায় চাবুকটা ঝুলিয়ে রাখা হয় ঠিক সেভাবে সে চাবুকটা নিজের গলায় ঝুলিয়ে দেয়।

হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, কামরান কি বোঝাতে চাইছে সে তাঁকে যে শাস্তি দেবে সেটা সে মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত? সে প্রহরীদের ইঙ্গিতে চাবুকটা যেখানে রয়েছে সেখানেই রাখতে বলে নিজেই তাঁর সৎ-ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যায়। সে কামরানের কাছাকাছি পৌঁছালে লক্ষ্য করে যে কামরানের মাথার চুল উস্কখুস্ক এবং চোখের নীচের কালিতে চরম পরিশ্রান্তির ছাপ ফুটে রয়েছে, কিন্তু তার সবুজ চোখের দৃষ্টি সরাসরি হুমায়ুনের দিকে নিবদ্ধ এবং সেখানে আনুগত্য কিংবা অনুতাপের ছায়া নেই কেবলই ঔদ্ধত্য আর তাচ্ছিল্যের চোরাস্রোত। তাঁর ঠোঁটের কোণে এমনকি উৎসিক্ত হাসির একটা আবছা ছায়া যেন খেলা করে।

সে কিভাবে আমার সাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সাহস করে? সে যা কিছু করেছে তারপরেও কিভাবে সে এতোটুকুও অনুতপ্ত না হয়ে থাকতে পারে? হুমায়ুন ভাবে, এতোগুলো বছর আমরা পরস্পরের সাথে যুদ্ধ না করলে এতোদিনে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করতে পারতাম, তার কারণে এতো প্রাণহানি ঘটেছে এতোকিছুর পরেও কিভাবে সামান্যতম অনুশোচনাবোধ তার মাঝে কাজ করে না? হুমায়ুন একদৃষ্টিতে তাঁর সৎ-ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে, তাবুতে আকবরকে ছিনিয়ে নেয়ার সময় কামরান যখন ধাক্কা দিয়ে হামিদাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল তার সেই ছবিটা তার মানসপটে অনাদিষ্টভাবে ফুটে উঠে, এরপরেই সে দেখে কামানের অবিশ্রান্ত গর্জনের মাঝে কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে অরক্ষিত অসহায় আকবরকে প্রদর্শিত করা হচ্ছে। তার মাঝে সহসা আবেগের একটা আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয় এবং সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সে তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কামরানের মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। কামরানের একটা দাঁত ভেঙে যায়, ঠোঁট দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠে বলে, হামিদাকে অসম্মান করার জন্য এটা। সে আবারও চিৎকার করে উঠে, তার দুই চোখ অক্ষিকোটরে ধকধক করে, আর আকবরকে অপহরণের কারণে এটা! হুমায়ুন এরপরে দুহাতে কামরানের গলা টিপে ধরলে, সে মাটিতে শুয়ে পড়ে সেখানেই প্রাণপণে নিজের কুঁচকি চেপে ধরে দেহটা দুভাঁজ করে ফেলে এবং মুখ থেকে রক্ত মিশ্রিত ভাঙা দাঁতের টুকরো থু করে ফেলে কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করে না, এমনকি একটা আর্তনাদও শোনা যায় না।

হুমায়ুন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে এবার পা তুলে, নিজের ধূর্ত আর অবাধ্য সৎ-ভাইয়ের পেটে সপাটে লাথি মারবে বলে, তখনই তার পেছন থেকে আতঙ্কিত কান্নার একটা শব্দ ভেসে আসলে সে নিজেকে সংবরণ করে। সে কাঁধ ঘুরিয়ে তাকিয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধ কাশিমকে দুহাতে হাতির দাঁতের হাতলযুক্ত দুটো ছড়িতে ভর দিয়ে, যার উপরে সে অনেকদিন ধরেই নির্ভরশীল, পা টেনে টেনে তাঁর পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।

সুলতান, একটু সুস্থির হোন। তাকে যদি হত্যা করতেই হয় তাহলে তৈমুরের উত্তরপুরুষের পক্ষে উপযুক্ত সম্মানের সাথেই তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা করেন। আপনার মরহুম আব্বাজান কি মনে করবেন?

তার কথাগুলো শুনে হুমায়ুনের মনে হয় কেউ যেন এক বালতি ঠাণ্ডা পানি তার উপরে ঢেলে দিয়েছে, তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়। সে নিজের ভূপাতিত সৎ-ভাইয়ের কাছ থেকে দুরে সরে আসে। কামরান, আমি আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম। আমি অবিবেচকের ন্যায় নিজেকে তোমার স্তরে নামিয়ে এনেছিলাম। আমি তোমার ভাগ্য সম্বন্ধে পরে সিদ্ধান্ত নেব এবং সেটা কেবল আমার ক্রোধ প্রশমিত হবার পরেই হবে। প্রহরী! তাঁকে দাঁড় করাও। তাঁকে তাঁর কুঠরিতেই আবার নিয়ে যাও, কিন্তু সাবধান কেউ যেন তাঁর সাথে খারাপ আচরণ না করে।

হুমায়ুন সন্তুষ্টির সাথে দরবার কক্ষে সমবেত লোকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুগন্ধি তেলের দিয়ায় জ্বলতে থাকা সলতে আর শত শত মোমবাতির আলোয় মোগলদের ঐতিহ্যবাহী সবুজ ঝালর ঝলমল করে। আজ সত্যিকার একটা বিজয় উদযাপন করতে তারা সমবেত হয়েছে। একজন মোগল শাসক হিসাবে তাঁর যোদ্ধাদের যেভাবে পুরস্কৃত করা উচিত বহুদিন হয়ে গিয়েছে। আসলে বলা উচিত বছর- সে সেভাবে করতে পারেনি। কাবুলের কোষাগার আর অস্ত্রাগার থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কারুকার্যখচিত তরবারি আর খঞ্জর, ধাতব শিকলের তৈরী বর্ম, নিখুঁতভাবে আচ্ছাদিত, কলাই করা আর রত্ন শোভিত পানপাত্র এবং স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যদিও তার আব্বাজানের আমলে এর পরিমাণ আরো বেশী ছিল- সে এবার তাঁর প্রত্যেক সেনাপতি, আধিকারিক আর অনুগত লোকদের পুরস্কৃত করতে পারবে। কামরান যে কাবুলের ঐশ্বর্যের ব্যাপারে এমন বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে হুমায়ুন কল্পনাও করেনি।

তার সেনাপতি আর আধিকারিকেরা এই মুহূর্তে পানাহারে ব্যস্ত- মাখন দিয়ে রোস্ট করা ভেড়ার বাচ্চা আর মুরগীর রসাল, মিষ্টি মাংস, আস্ত কোয়েল আর লম্বা লেজবিশিষ্ট ফিজ্যান্ট শুকনো ফলের ঝোলে মাখান, তাঁদের লেজের পালক এখনও রয়েছে তবে সেটার রঙ এখন সোনালী, এবং সুগন্ধি চাপাতি ইটের উপরে সেঁকার কারণে এখনও গরম আছে। এই বিলাসবহুল প্রাচুর্য- খাদ্য পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত অপরূপ বারকোশগুলো- এতোগুলো বছর বিপদ আর কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা আর শঠতার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করার পরে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। জাহিদ বেগ আর আহমেদ খানের রণক্ষেত্রের ক্ষতচিহ্নে জর্জরিত মুখাবয়ব আর কাশিম আর সারাফের বলিরেখা পূর্ণ মুখের দিকে, যারা তাঁকে অনুসরণ করে নিদাঘতপ্ত মরুভূমি আর তুষারাবৃত পর্বত অতিক্রম করেছে। যেখানে শীত এত প্রবল যে মনে হয় মানুষের হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দিতে পারবে, হুমায়ুনের চোখ সত্যিকারের আন্তরিকতার নিয়ে তাকায়। তার সঙ্গের যোদ্ধার সংখ্যা যখন শদুয়েকে নেমে এসেছিল এবং আজ রাতে এখানে উপস্থিত কোনো গোত্রপতির সাথে এত কম সৈন্য থাকে- এইসব বিশ্বস্ত লোকগুলো তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করেনি।

সেদিন রাতে, ভোজসভার শেষের দিকে, যখন শেষপদ পরিবেশন করা শুরু হয়েছে নানারকম মিষ্টান্ন যার ভেতরে রয়েছে আখরোটের পুর দেয়া শুকনো খুবানি, পেস্তাবাদাম আর কিশমিশ দেয়া দই পনির- সবকিছুই রূপার বারকোশে সাজিয়ে আনা হয়েছে, হুমায়ুন তার সেনাপতিদের দিকে তাকায়, সবাই খাবার উপভোগ করছে আর হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা আর ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করছে। সন্তুষ্টির একটা অনুভূতি তাকে আপুত করে বহুবছর সে এমনটা বোধ করেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সাহস আর দক্ষতা সম্বন্ধে তাঁর মনে কখনও কোনো সংশয় ছিল না; কিংবা নিজের অনুগত লোকদের প্রতি কোনপ্রকার দ্বিধাবোধ। কিন্তু সে জানে সে এখন হয়ত অন্য সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ কোনো শক্তির অধিকারী হয়েছে। সে ক্রমশ একজন প্রকৃত শাসক আর নেতার মতো নিজের কর্তৃত্বের ব্যাপারে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে এবং বৈরাম খানের মতো লোকদের, যাদের সাথে তাঁর পূর্ব-স্বীকৃত কোনো সম্পর্ক নেই, আনুগত্য লাভের ক্ষমতাও সে অর্জন করেছে।

কিন্তু তাঁদের কি হবে যাদের সাথে তাঁর কোনো না কোনো ধরনের সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু যারা আনুগত্যহীন যাদের ভেতরে রয়েছে কামরান আর আসকারিকে সমর্থন করেছিল, এমনসব সেনাপতি আর অভিজাত লোকজন আর অবশ্যই এই একই দোষে দুষ্ট তার নিজের সৎ-ভাইয়েরা? হুমায়ুনের মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। সে দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশ করার পরে থেকে গত ষাট ঘন্টা সে কেবলই এদের বিশেষ করে কামরানের ভবিতব্য নিয়ে চিন্তা করছে। নিজের সন্তানের জীবন হুমকির মুখে ফেলার জন্য খালি হাতে নিজের সৎ-ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নেয়ার আন্ত্রিক আকাঙ্খর কাছে সে আরেকটু হলেই পরাভব মানতো।

কিন্তু তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হবার পরে সে এখন অনেক সংযত হয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছে। সে কামরানকে কখনও মন থেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু তাঁর রাজবংশের মাঝে বিদ্যমান মতবিরোধ গভীর করার চেয়ে উপশমের চেষ্টা করলে সে এই বংশের ভবিষ্যতের জন্য এই প্রয়াসের প্রতি ঋণী থাকবে। তার মরহুম আব্বাজানের পবিত্র মুখাবয়ব- সেই সাথে কামরানের উজ্জ্বল সবুজ চোখ দুটো- তাঁর মানসপটে ভাসতে থাকে। সহসা আত্মবিশ্বাস আর সন্তুষ্টিবোধের একটা যুগপৎ ফরুধারা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। হুমায়ুন উঠে দাঁড়িয়ে জওহরকে তাঁর কাছে ডেকে আনে। কামরান আর আসকারিকে এখনই আমার সামনে উপস্থিত করো, সেই সাথে আমরা যাদের বন্দি করেছি তাদের ভিতরে যারা শীর্ষস্থানীয় সেনাপতি।

সোয়া ঘন্টা পরে, জওহর ফিসফিস করে হুমায়ুনকে জানায় যে দরবার কক্ষের দরজার পুরু পাল্লার বাইরে বন্দিরা অপেক্ষমান। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং হাততালি দিয়ে সবাইকে নিরবতা পালন করতে বলে। তার আধিকারিকেরা তাঁদের হাতের পানপাত্র ও আহারের অনুষঙ্গ নামিয়ে রাখতে গমগম করতে থাকা কক্ষের ভেতরে প্রায় সাথে সাথে একটা অপার্থিব নিরবতা বিরাজমান হয়, তারা মিষ্টান্নের কারণে চটচটে হয়ে উঠা ঠোঁট মুছে নিয়ে এবং তাঁদের সম্রাটের প্রতি তাঁদের অখণ্ড মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে।

আমার অনুগত সেনাপতিবৃন্দ, আমাদের বিজয় আমরা উদযাপন করেছি এবং আমাদের শত্রুকে পরাস্ত করায় আমাদের উল্লসিত হওয়াটা ন্যায়সঙ্গত, কিন্তু আমাদের আরাধ্য কেবল অর্ধেক অর্জিত হয়েছে। আমাদের এখন অবশ্যই ভবিষ্যতের দিকে আর হিন্দুস্তানের উপর পুনরায় প্রভুত্ব স্থাপণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আমাকে অবশ্য প্রথমে সেইসব লোকদের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যারা তোমাদের থেকে আলাদা, আমার প্রতি কোনোরকম আনুগত্য তারা প্রদর্শন করেনি এবং রক্তের সম্পর্ক আর পুরুষানুক্রমিক দায়িত্ববোধ অবহেলা করেছে। বন্দিদের ভেতরে নিয়ে এসো।

দরবার কক্ষের দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পরিচারক পাল্লা দুটো খুলে দিতে কামরান পায়ে হেঁটে দরবারে প্রবেশ করে। তাঁর দুহাত পিছমোড়া করে বাঁধা কিন্তু তাঁর পায়ে কোনরকম বেড়ি পরানো হয়নি। মাথা উঁচু, পিঠ টানটান সোজা করা এবং কালশিটে পড়া, বাজপাখির মতো নাকযুক্ত মুখাবয়বে আবেগের লেশমাত্র নেই, সে ডানে বামে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে হাঁটতে থাকে যতক্ষণ না তাঁকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসা প্রহরীরা হুমায়ুনের দশ ফিট সামনে তাঁকে থামতে ইঙ্গিত করে। তার ঠিক পেছনেই রয়েছে আসকারি, যাকে দূর্গপ্রাসাদে নিয়ে আসার পরে আরামদায়ক ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে অন্তরীণ রাখা হয়েছে কিন্তু তারও হাত অবশ্য পিছমোড়া করে বাঁধা। সে যদিও নিশ্চিতভাবেই জানে যে তাঁর ভাইয়ের চেয়ে তার ভয় কম, কারণ হুমায়ুন নিজে তাঁকে তাঁর প্রাণ বখশ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কামরানের চেয়ে তার অভিব্যক্তি অনেক বেশী আড়ষ্ট। তাঁর কপালে হাল্কা স্বেদবিন্দু ফুটে রয়েছে, এবং চারপাশে তাকিয়ে সে হুমায়ুনের লোকদের ভিতরে যাদের চিনতে পারে তাদের উদ্দেশ্যে সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে হাসতে চেষ্টা করে। কামরান আর আসকারির দশজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। দশজন সেনাপতির ভেতরে রয়েছে ঝাকড়া চুলের মোটাসোটা এক উজবেক যোদ্ধা যার নাম হাসান খলিল, এবং শাহি বেগ নামে আরেকজন, ছোটখাট দেখতে কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী এক তাজিক, যার বাম গালে একটা সাদা সীসা-রঙের একটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। সে ছিল কাবুলে কামরানের প্রধান সেনাপতি এবং বস্তুত পক্ষে হুমায়ুনের নিজের সেনাপতি জাহিদ বেগের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই। শাহি বেগ দরবার কক্ষে যখন প্রবেশ করে, হুমায়ুন লক্ষ্য করে দুই যোদ্ধার দৃষ্টি এক পলকের জন্য পরস্পরের সাথে মিলিত হয় কিন্তু তারপরে দুজনেই সাথে সাথে অন্যদিকে তাকায়।

কামরান আর আসকারির পেছনে তাঁদের নিজ নিজ সেনাপতিরা সারিবদ্ধভাবে অবস্থান গ্রহণের পরে, হুমায়ুন তাঁর নিজের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য শুরু করে। তোমরা দেখো তোমাদের সামনের এই লোকগুলোকেই আমরা পরাস্ত করেছি। তারা সেই লোক যারা আমাদের রক্তপাতের কারণ এবং আমাদের বন্ধুদের হত্যাকারী। কিন্তু আমাদের লড়াই করা এই যুদ্ধটা ছিল আত্মীয় আর ভাইয়ের ভেতরে একটা সংগ্রাম। এটা আমি যেমন খুব ভালো করে জানি তোমাদের ভেতরে আরো অনেকেই সেটা হাড়ে হাড়ে জানে। আমাদের সেই সব লোকদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে যাদের সাথে আমাদের উচিত ছিল একত্রে দলবদ্ধ হয়ে হিন্দুস্তানে আমাদের ভূমি জবরদখলকারী সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী ঈর্ষা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার লক্ষ্য এবং উত্তরাধিকার আর ঐতিহ্য এসব কিছুর উচিত ছিল আমাদের একত্রিত রাখা। আমাদের নিজেদের ভিতরের এই বিভক্তি থাকলে আমরা আর কখনও হিন্দুস্তানের আমাদের প্রভুত্ব অর্জন করতে পারবো না। আমরা একতাবদ্ধ হলে ঠিক এতটাই শক্তিশালী হব যে আমাদের কাউকে ভয় পাবার নেই। আমাদের শত্রুর কেবল তখন ভয় পাওয়া উচিত- আমাদের বিজয় আর উচ্চাশা তখন হবে মাত্রা ছাড়া।

এই একটা কারণের জন্য আমি শাস্তি দেবার চেয়ে, যদিও সেটাই তাঁদের প্রাপ্য, আমি পুনর্মিত্রতার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার প্রাক্তন শত্রুদের ভেতরে তোমাদের সামনে তোমরা যাদের দেখতে পাচ্ছো, আমি তাদের ক্ষমা করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কেবল একটাই শর্ত তারা হিন্দুস্তানে আমাদের সাম্রাজ্য অর্জন আর প্রসারণের জন্য আমাদের সাথে যোগ দেবে।

হুমাযন কথাটা বলেই আসকারির দিকে এগিয়ে যায় এবং একটা ছোট খঞ্জর বের করে তাঁর হাতের বাঁধন কেটে দিয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করে। আসকারিকে আলিঙ্গণ করার সময় সে টের পায় যে আসকারি শমিত হয়েছে এবং তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু তার সৎ-ভাইয়ের কান্নাভেজা গালের সাথে ঘষা খায়। তারপরে সে কামরানের দিকে এগিয়ে যায় এবং তারও হাতের বাঁধন কেটে দিয়ে তাকে বুকে টেনে নেয়। কামরানের দেহ আড়ষ্ট মনে হয় কিন্তু সে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে না। হুমায়ুন যখন তার আর আসকারির হাত শূন্যে তুলে ধরে দরবারে উপস্থিত সবার উল্লাস ধ্বনির সাথে সুর মিলিয়ে চিৎকার করে উঠে বলে, আগামী হিন্দুস্তান পুনরায় আমাদের হবে, তখনও সে কোনো রকম বাধা দেয় না।

এক ঘন্টা পরে, রাজমহিষীদের নির্ধারিত আবাসস্থলে অবস্থিত হামিদার আবাসন কক্ষের দিকে হুমায়ুনকে যেতে দেখা যায়। গতকাল সন্ধ্যাবেলা গুলবদন আর আকবরকে নিয়ে সে এসেছে এবং পরিবারের সবার একসাথে পুনরায় মিলিত হবার আনন্দে তারা কামরান কিংবা তার পরিণতি নিয়ে কোনো আলাপ করেনি। সে যখন কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করছে, তখনই হামিদার অভিব্যক্তি দেখে সে বুঝতে পারে যে তার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে হামিদা আগেই জেনেছে।

আপনি কিভাবে এটা করতে পারলেন! হামিদা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আপনি কামরানকে ক্ষমা করে দিয়েছেন- যে আপনার সন্তানকে অপহরণ করেছিল এবং কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে মানব বর্ম হিসাবে তাঁকে প্রদর্শিত করেছিল। আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? আমার অনুভূতি আর আমাদের সন্তানের প্রতি কি আপনার কোনো দায়িত্ব নেই?

তুমি ভালো করেই জান আমি তোমাদের কতটা ভালোবাসি। এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। একজন শাসককে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির চেয়ে আরো অনেককিছু বিবেচনা করতে হয়। তাঁর সাম্রাজ্যের জন্য কি ভালো হবে তাকে সেটা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। আমি যদি কামরানকে মৃত্যুদণ্ড দিতাম তাহলে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুসারী আর আত্মীয়স্বজনের অনেকেই আমার অপ্রশম্য শত্রুতে পরিণত হতো, আসকারির কথা বাদই দিলাম, কান্দাহার আমার কাছে সমর্পণের কারণে যাকে আমি আগেই জান বখশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমি যদি কামরানকে বন্দি করতাম, তাহলে সে ষড়যন্ত্র আর অসন্তোষের একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। তাঁর সেনাপতিদের শাস্তি দিলেও ফলাফল একই। দাঁড়াতো। বিদ্রোহের কারণে আমাদের পরিবারই কেবল বিপর্যস্ত হয়নি। আমার শত্রুদের সাথে একটা আপোষ করার চেয়ে তাঁদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য উসকে দেয়াটা বোকামী হবে। আমি যদি আবারও হিন্দুস্তান নিজের করায়ত্ত্ব করতে চাই, আমাদের এই পর্যন্ত আসতে যারা আমাদের সমর্থন করেছে তারা ছাড়াও, আমার অধীনস্ত সব জায়গিরদার আর অভিজাতদের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন আমার প্রয়োজন হবে।

আমি অবশ্যই পারি অন্যদের আমার সাথে যুদ্ধযাত্রায় বাধ্য করতে কিংবা খাজনা দিতে, কিন্তু তারা তখন ষড়যন্ত্র শুরু করবে কিংবা পক্ষত্যাগ করার সুযোগ খুঁজবে নিদেনপক্ষে দেশে ফিরে যাবার অজুহাত খুঁজবে। আমি এসব করে আমার হারান রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবো না। সবচেয়ে নিকটজনের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতের ক্ষত নিরাময়ে সবচেয়ে বেশী সময় লাগে। কিন্তু আমি যদি আমার ভাইদের কাছ থেকে আঘাত নিরাময় করতে পারি তাহলে আমার সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং ভবিষ্যতে আকবরের অবস্থান তাহলে আরও নিরাপদ হবে।

আকবরের কথার উল্লেখে, হামিদার মুখাবয়ব খানিকটা কোমল দেখায়, কিন্তু তখনও সেখান থেকে অনিশ্চয়তা আর সন্দিগ্ধচিত্ততর রেশ পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না। হামিদার জন্য বিষয়টা মেনে নেয়াটা খুব কঠিন। কামরানের উপরে নিজের ক্রোধান্বিত আক্রমণের কথা হুমায়ুন ভাবে। সে নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করার সুযোগ অন্তত পেয়েছিল…

আমি কামরানকে ঘৃণা করি। আমি তাঁকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।

হামিদা, কামরানকে ক্ষমা করার কথা আমি তোমাকে বলছি না। আমি খুব ভালো করেই জানি সেটা তুমি কখনও পারবে না। আমি তোমাকে কেবল বলছি যে আমার উপরে…আমার বিচার-বিবেচনায় ভরসা রাখো। কামরানকে মাফ করে দেয়ার পেছনে আমার আরো ব্যক্তিগত একটা কারণ আছে…আমার মরহুম আব্বাজানের প্রতি আমার আনুগত্য এবং সর্বোপরি মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তাঁর ব্যক্ত করা অভিপ্রায় এবং আমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিশোধপরায়ন আচরণ না করা, তাঁরা যতই এর যোগ্য হোক না কেন, অনুসরণ করা। তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যে তার পরে আমিই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবো, সেটা মেনে নিতে তাঁদের ব্যর্থতা, আমি তাঁকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেটা পালন করতে আমাকে বিরত রাখতে পারবে না।

হুমায়ুন সরাসরি হামিদার চোখের দিকে তাকায়। আমার সিদ্ধান্তে যদি তুমি আঘাত পেয়ে থাকো তাহলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত কিন্তু তুমি নিশ্চিতভাবে জেনো কোনো কিছুই তোমার জন্য আর আমাদের সন্তানের জন্য আমার ভালোবাসাকে বদলাতে পারবে না এবং আমার মৃত্যুর সময়ে, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে যার এখনও অনেক দেরী আছে, আমায় আমার আব্বাজান যেমন অধিষ্ঠিত করেছিলেন তেমনি হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আমি আকবরকে নিরাপদে অধিষ্ঠিত করে যাবো।

আপনি যদি আমাকে বলেন যে কামরানকে বেঁচে থাকতে দিলে আকবরের ভবিষ্যত অনেকবেশী নিরাপদ হবে, তাহলে সেটা আমি অবশ্যই মেনে নিতে রাজি আছি। আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি আপনাকে মিথ্যা বলতে পারবো না। আমি সর্বান্তকরণে চাই যে কামরান মারা যাক। আমি অনেক শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম যদি সেটা জানতে পারতাম।

আকবরের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো হবে।

হামিদার মুখে অবশেষে হাসি ফুটে উঠে এবং সে হুমায়ুনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয়। ঘুমাতে আসুন। অনেক রাত হল।

*

হুমায়ুন পরেরদিন সকালবেলা প্রায় দশটার সময় যখন জেনানাদের আবাসস্থল থেকে বের হয়ে আসলে দেখে মুখে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে জওহর তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। সুলতান, সুসংবাদ… দারুণ সংবাদ। আমাদের গুপ্তচরেরা সংবাদ নিয়ে এসেছে যে শেরশাহ মারা গিয়েছে। রাজস্থানে তিনি একটা দূর্গ আক্রমণ করেছিলেন যখন আলকাতরা ভর্তি জ্বলন্ত একটা গোলক যা তার অবরোধে পারদর্শী প্রকৌশলীদের নিক্ষিপ্ত দূর্গের দেয়ালে আঘাত করে ঠিকরে এসে বারুদের গুদামে পড়ে। পুরো গুদাম বিস্ফোরিত হয়ে শেরশাহ আর তার দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তারা বলেছে শেরশাহের দেহের টুকরো কয়েকশ গজ দূরে ছিটকে গিয়েছে।

এই সংবাদ কি নির্ভরযোগ্য?

গুপ্তচরেরা বলেছে বেশ কয়েকটা সূত্র থেকে সংবাদটা তারা জেনেছে। তাঁদের সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই।

সংবাদটা বিশ্বাস করতে হুমায়ুনের বেশ কষ্ট হয়। এটা যেন তাঁর নিজের সৎ-ভাইদের ক্ষমা করা আর প্রজাদের একত্রিত করার সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরায় করতে তাঁদের খুব দ্রুত এবং সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমার সেনাপতিদের আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। আমার সৎ-ভাইদেরও আমাদের সাথে যোগ দিতে দাও। আমাদের পরিবারের নিয়তি পরিপূর্ণ করতে আমরা একত্রে যাত্রা করবো।

৪.১ মোগলদের প্রত্যাবর্তন – চতুর্থ পর্ব

চতুর্থ পর্ব – মোগলদের প্রত্যাবর্তন

২১. এক ভাইয়ের মর্মবেদনা

সুলতান, আপনাকে এখনই একবার আসতে হবে।

হুমায়ুন বুটি দ্বারা খচিত করা কালো চামড়ার ময়ানে ইস্পাতের উপরে হাতির দাঁতের কারুকাজ করা তরবারির ফলাটা- অধীনস্ত এক জায়গীরদার সম্প্রতি উপহারটা পাঠিয়েছে পুনরায় ঢুকিয়ে দেয় যা সে মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। জওহর, কি ব্যাপার?

জওহর দুহাত প্রসারিত করে অসহায় একটা ভঙ্গি করে এবং হুমায়ুন তার মুখাবয়বে ভীষণ বিপর্যস্ত একটা অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করলে সে আর কোনো প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করে। সন্ধ্যা দ্রুত ঘনিয়ে আসছে এবং হুমায়ুন যখন দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচের প্রাঙ্গণে নামতে থাকে, ইট পাথরের কঠিন অবয়ব তখন বেগুনী ছায়ার আড়ালে মসৃণ হতে শুরু করেছে। তোরণদ্বারের ঠিক ভেতরেই আহমেদ খানের চারজন লোক একটা বাদামী রঙের লম্বা ঘোড়ার চারপাশে জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুমায়ুন ঘোড়াটার কাছাকাছি যেতে লক্ষ্য করে যে প্রাণীটার গলা আর কাঁধে গাঢ় একটা কিছুর দাগ রয়েছে যা মাছি আকৃষ্ট করছে, এবং তাঁকে অভিবাদন জানাতে তার লোকেরা ঘোড়াটার কাছ থেকে সরে দাঁড়াতে, সে দেখে পর্যানের উপরে মুখ নীচের দিকে করা অবস্থায় একটা দেহ বাধা রয়েছে, দেহটা মৃত হরিণের মতোই নিথর। ঘোড়াটার গায়ের চামড়ায় রঙের তারতম্য জমাট রক্তের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মৃতদেহটাই কেবল তার অখণ্ড মনোযোগ আকর্ষণ করে। সে যদিও চোখের সামনের দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে চায় না কিন্তু পেষল দেহটা সে বোধহয় চিনতে পেরেছে, যার নির্জীব হাত আর পা এতোই লম্বা যে ঘোড়র পেটের নীচে অব্দি সেগুলো ঝুলে রয়েছে।

হুমায়ুন ক্রমশ প্রবল হতে থাকা অমঙ্গলের পুর্বানুভব নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এবং ঝুঁকে গিয়ে মৃতলোকটার মাথাটা উঁচু করে তুলে ধরে। তার দিকে তাকিয়ে থাকা হিন্দালের তামাটে চোখের মণিতে কোনো ভাষা নেই। ভাইয়ের পলকহীন চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে হুমায়ুন চোখের পাতাগুলো বন্ধ করে দেয়। সে চোখের পাতা বন্ধ করার সময় ভাইয়ের মৃতদেহের উষ্ণতা অনুভব করে চমকে উঠে, তারপরে সে বুঝতে পারে যে হিন্দালের মুখটা ঘোড়ার পাজরের সাথে ঝুলছিল। সে পরিকর থেকে নিজের খঞ্জর বের করে আনে এবং দেহরক্ষীদের দূরে দাঁড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত করে দড়ি কাঁতে শুরু করে যা দিয়ে হিন্দালের মৃতদেহটা কেউ একজন ঘোড়ার সাথে বেঁধে দিয়েছিল। সে তারপরে পরম মমতায় ভাইয়ের মৃতদেহটা আলতো করে তুলে নিয়ে, মুখটা উপরের দিকে রেখে, প্রাঙ্গণের চ্যাপ্টা, বর্গাকার পাথরের উপরে নামিয়ে রাখে। মৃতদেহটার পাশে হাটু মুড়ে বসে থাকা অবস্থায়, ঘনায়মান অন্ধকারের ভেতরে আহমেদ খানের একজন লোকের উঁচু করে ধরে রাখা একটা মশালের দপদপ করতে থাকা হলুদাভ আলোয় সে হিন্দালের গলায় একটা তাজা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পায়- যা কেবল তীরের অগ্রভাগ দ্বারাই হওয়া সম্ভব।

শোকের বেনোজলে তার অস্তিত্ব ধুয়ে যেতে থাকে। তাঁর সৎ-ভাইদের ভিতরে সে হিন্দালকেই সবচেয়ে বেশী পছন্দ করতো। সৎ, সাহসী আর নৈতিকতাসম্পন্ন, এবং তাঁর অন্যান্য ভাইদের চেয়ে অনেক কম উচ্চাভিলাষী, সম্ভবত বাবরের সব সন্তানের ভিতরে হিন্দালই ছিল অন্তরের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। ভাই আমার, আমি দোয়া করি তোমার বেহেশত নসীব হোক এবং বেঁচে থাকা অবস্থায় আমি তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি মৃত্যুতে তুমি আমায় সেজন্য মার্জনা করবে, হুমায়ুন ফিসফিস করে বলে। তারুণ্যে ভরপুর হিন্দালের অবয়ব এবং গর্বিত ভঙ্গিতে তাঁর আকবরকে উদ্ধার করার কাহিনী বর্ণনা করার দৃশ্য হুমায়ুনের মানসপটে ভাসতে থাকে, তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পাতা মুছে, পুনরায় উঠে দাঁড়াবার আগে হুমায়ুন বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, মৃতদেহটা কে খুঁজে পেয়েছে?

সুলতান, আমিই প্রথম দেখেছি, মশালধারী সৈন্যটা বলে, হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে, সদ্য যৌবনে পা দেয়া একটা ছেলে।

কোথায়?

শহর থেকে আধমাইল দূরে সবুজ রঙের কয়েকটা জুনিপার ঝোপের পাশে শাহজাদার ঘোড়াটা দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঘাস খাচ্ছিল।

কেউ একজন তারমানে প্রাণ সংহারক তীরটা বের করে, হিন্দালকে তার ঘোড়ার সাথে বেঁধে তারপরে তাকে এমন স্থানে রেখে গিয়েছে যেখানে তাঁকে কেউ খুঁজে পাবে। হুমায়ুন অবসন্ন মনে ভাবে, পুরো ব্যাপারটার ভিতরে কামরানের কাজের ধারা স্পষ্টভাবে ফুটে রয়েছে। কামরান আর আসকারিকে ক্ষমা করার দুই মাসের ভিতরে, ক্ষমাপ্রদর্শনের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দূরে থাক, দুজনেই কাবুল থেকে পালিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে পুনরায় সবদ্ধ হয়ে, তারা হানাদারে পরিণত হয়, দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত শক্তঘাঁটি থেকে উপজাতীয় লোকদের একটা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে তারা ধেয়ে আসত- বেশীরভাগ সময়েই অরাজক কাফ্রি বা চরখা গোত্রের লোকেরা তাদের সাথে থাকতো, কিন্তু দুই ভাইয়ের কোনো বাছবিচার ছিল না, তারা যাদের খুঁজে পেতো তাদেরই ব্যবহার করতো- হুমায়ুনের সীমান্তচৌকি এবং কাবুলের সমৃদ্ধির উৎস- এর প্রাণশক্তি বণিকদের মালবাহী কাফেলা আক্রমণ করতে। আকবরকে উদ্ধারের সময় হিন্দালের বিশ্বাসঘাতকতাকে কামরান কখনও ক্ষমা করেনি এবং হিন্দালকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহটা একটা বার্তা হিসাবে হুমায়ুনকে পাঠাবার মতো বিদ্বেষী মনোভাব নিশ্চিতভাবেই কামরানের রয়েছে।

কিন্তু আসলেই ঠিক কি ঘটেছিল? কামরানই যদি হত্যাকারী হয়ে থাকে, হিন্দালের মৃত্যু কি তাহলে ভাগ্যচক্রে দেখা হয়ে যাবার ফলে সংঘটিত কোনো ঘটনা নাকি উত্তরের পাহাড়ী এলাকায় কামরান তাঁকে হত্যা করার জন্যই খুঁজে বের করে খুন করেছে, যেখানে আকবরকে উদ্ধার করার পরবর্তী বছরগুলোতে সে নিজের জন্য একটা আশ্রয়স্থল তৈরী করেছিল? আমার ভাইয়ের মৃতদেহ আর তাঁর ঘোড়ার পর্যাণে ঝোলান থলি খুঁজে দেখো। তাঁকে কিভাবে বা কেন এমন পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমাদের জানাতে পারে এমন যেকোনো কিছুর সন্ধান করো। হুমায়ুন আদেশ দিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়, সে দাঁড়িয়ে থেকে এই কাজটা দেখতে পারবে না।

সে অন্ধকারে যেখানে দাঁড়িয়ে, আপন ভাবনা আর স্মৃতি রোমন্থনে বিভোর হয়েছিল, কয়েক মিনিট পরে একজন সৈন্য সেখানে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। সুলতান, তার ঘোড়ার পর্যাণে এই চিরকুটটা ছাড়া আমরা গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই খুঁজে পাইনি। হুমায়ুন কাগজের টুকরোটা নিয়ে মশালের আলোয় সেটা পড়ে। নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য না করে সংক্ষিপ্ত কয়েকটা বাক্যে হিন্দাল জানিয়েছে, যদি তাঁর কিছু হয় তাহলে তাঁকে যেন তাঁর আব্বাজানের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সে আরও লিখেছে যে তাঁর চুনি বসান খঞ্জরটা তাঁর ইচ্ছা যেন আকবরকে দেয়া হয় যা একসময় বাবরের কোমরে শোভা পেত। সুলতান, খঞ্জরটা এখনও তার পরিকরে গোঁজা রয়েছে। সৈন্যটা এবার একটা রূপালী ময়ান এগিয়ে দিতে, এটাও চুনির কারুকাজ করা, মশালের আলোয় সেটা দ্যুতি ছড়াতে থাকে। হিন্দালকে তাহলে যেই হত্যা করে থাকুক সে চোর নয়, হুমায়ুন ভাবে। এটা থেকে সে আরও একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয় যে হিন্দাল সম্ভবত অপ্রত্যাশিতভাবে আর সহসাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, নিজের খঞ্জর ময়ান থেকে বের করার সময়ও সে পায়নি। সে আবারও কামরানের সবুজ চোখ, অবজ্ঞাপূর্ণ চাহনি দেখতে পায়…

*

অনেকেই এখন মোগলদের সবুজ নিশানের নীচে ফিরে আসতে প্রস্তুত।

এইসব না করে, কামরান আর আসকারির এই হুমকি দীর্ঘায়িত কোনো অভিযান সূচনা করা তার জন্য অসম্ভব করে তুলেছে। শেরশাহের প্রধান আধিকারিকেরা একত্রিত হয়ে নতুন সম্রাট পছন্দের সময় পেয়েছে। শেরশাহের বড় ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করে সামরিক দক্ষতার চেয়ে যিনি তাঁর বিলাসিতার কারণে বেশী পরিচিত। তারা তাঁর ছোট ছেলে ইসলাম শাহকে নির্বাচিত করে, যার প্রথম কাজই ছিল বড় ভাইকে হত্যার আদেশ দেয়া। হুমায়ুন বিষয়টার তাৎপর্য ঠিকই বুঝতে পেরেছে। কামরান আর আসকারিকে মার্জনা করার পরিবর্তে সে যদি প্রাণদণ্ড দিত, তাহলে ইসলাম শাহের পরিবর্তে আগ্রার তখতে সে অধিষ্ঠিত থাকতো।

তার সৎ-ভাইয়েরা যে এতোদিন তাঁর পরিকল্পনাকে বিলম্বিত করবে, এটা হুমায়ুনকে একাধারে ক্রুদ্ধ এবং ব্যথিত করে তুলে। তাঁর ক্ষমা প্রদর্শনের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতাবোধ কোথায়? কামরানের ব্যাপারে তাঁর বোধকরি বিস্মিত হওয়াটা মানায় না, তাঁর প্রতি কামরানের ঈর্ষা আর ঘৃণা আপাতভাবেই অপ্রশম্য, কিন্তু আসকারি কিভাবে এমন শঠতার সাথে তাঁর উদারতার প্রতিদান দেয়? কান্দাহারে আসকারি যখন তার কাছে আত্মসমর্পন করে, তাকে দেখে মনে হয়েছিল সে অনুশোচনা বোধ করছে, এমনকি নিজের কৃতকর্মের জন্য সে লজ্জিত। সেই অনুভূতিগুলো হয়ত যথার্থই ছিল কিন্তু কামরানের প্রভাবে প্ররোচনায় সেগুলো বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। আসকারি তাঁর পুরোটা জীবন কামরানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসেছে…

আপেল গাছের নীচে জন্মান মিষ্টি ঘাসের উপর তার ঘোড়াটাকে দিয়ে চরতে দিয়ে জওহর যেখানে প্রাণীটার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিকে মন্থর পায়ে হেঁটে যাবার সময়েও হুমায়ুনের মনের ভিতরে নানা ধরনের চিন্তা খেলা করতে থাকে। ঘোড়ার পর্যাণে উঠে বসেই দূর্গপ্রাসাদে দ্রুত ফিরে যাবার অভিপ্রায়ে হুমায়ুন প্রাণীটার পাজরে গুঁতো দেয়। সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হিন্দালের মৃত্যু একটা ইশারা যে আর অপেক্ষা করাটা সমীচিন হবে না, সত্যের অপলাপ আর না, আবেগপূর্ণ আশায় বুক বাধার দিন শেষ যে তার সৎ-ভাইয়েরা হয়ত এখনও কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারবে। তাদেরকে নিজেদের পাহাড়ী আড্ডাখানা থেকে দাবড়ে বের করার প্রচেষ্টা তাঁর এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে কিছু একটা করতে হবে…

সেদিন রাতের বেলা, হুমায়ুন তার দরবার কক্ষে যখন প্রবেশ করছে, সে দেখে তাঁর সেনাপতি এবং পরামর্শদাতারা ইতিমধ্যেই সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাঁদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে সে এখনও নিজের অজান্তে একজন লোককে খুঁজতে থাকে কাশিম, যার শান্ত বিবেচনাবোধ এবং নিরঙ্কুশ আনুগত্য তাঁর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শাসনামলের গুটিকয়েক অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্যের অন্যতম ছিল। কিন্তু গত শীতে, বরফাবৃত আঙ্গিনা অতিক্রম করার সময়ে কশিম পা পিছলে পড়ে গিয়ে নিজের ডান উরুর হাড় ভেঙে ফেলেন। তাঁর হাকিমেরা আফিম দিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও তাঁর বৃদ্ধ শরীরের জন্য আঘাতটা বড্ড বেশী মারাত্মক ছিল। তিনি সংজ্ঞাহীনতার অতলে ডুবে যান এবং দুইদিন পরে সারাজীবন সবকিছু যেভাবে সম্পন্ন করেছেন ঠিক সেভাবেই নিরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ফারগানার বালক-রাজা হিসাবে তার রাজত্বকালের শুরুর দিকের অনিশ্চিত দিনগুলোতে তিনি বাবরের সাথে ছিলেন, ঠিক যেমন তিনি সবসময়ে হুমায়ুনের পাশে থেকেছেন। হুমায়ুন তার শান্ত, আশ্বাসদায়ক উপস্থিতি আর তাঁর মৃদু কণ্ঠে ক্রমাগত মূল্যবান উপদেশ শুনতে ভীষণভাবে অভ্যস্ত। তাঁর মৃত্যু মানে আক্ষরিক অর্থেই অতীতের সাথে সম্পর্কছেদ।

কিন্তু হুমায়ুনকে এখন ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে হবে। নিজের সিংহাসনে পিঠ সোজা করে উপবিষ্ঠ হয়ে সে শুরু করে। আমার সৎ-ভাইদের ব্যাপারে আমার ধৈৰ্য শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের সেনাবাহিনী যতক্ষণ না ধ্বংস করা হচ্ছে এবং তাঁদের বন্দি করা হচ্ছে তারা সবসময়ে একটা হুমকি হিসাবে বিরাজ করবে।

আমাদের সেনাবাহিনীর বরাত মন্দ…একদিন আমরা নিশ্চয়ই তাদের বন্দি করতে পারবো, জাহিদ বেগ বলে। কামরান আর আসকারিকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হওয়াকে সে নিজের সম্মানের জন্য হানিকর বলে গন্য করে।

আমরা এখন যেভাবে চেষ্টা করছি সেভাবে করতে থাকলে আমরা সন্দেহ আছে- যদি আমাদের কপাল খুব ভালো না হয়। আমার অনেক দিন থেকেই সন্দেহ যে আমাদের সেনাবাহিনীতে আর শহরেও তাদের গুপ্তচর রয়েছে। সেজন্যই তারা সবসময়ে আমাদের ফাঁকি দিতে পারছে, আমাদের শক্তি আর সময় অপচয়ে বাধ্য করছে যা অন্যত্র আরো কার্যকরী উপায়ে ব্যবহৃত হতে পারতো।

কিন্তু আমরা আর কিভাবে চেষ্টা করতে পারি? জাহিদ বেগ।

আমি সেজন্যই আপনাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। কামরান, আসকারি আর তাঁদের পাহাড়ি হানাদারদের পরাস্ত করা কোনোমতেই আমাদের সাধ্যাতীত কোনো ব্যাপার নয়। কাবুল প্রাচুর্যময় একটা রাজ্য। বণিকের দল যারা ব্যবসার কাছে এখানে আসে এবং আমাদের সরাইখানায় অবস্থান করে তাদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের দেয়া খাজনায় আমাদের কোষাগার সমৃদ্ধ করে। আমি এই সম্পদ আমার দীর্ঘ দিন যাবত স্থগিত অবস্থায় থাকা হিন্দুস্তান অভিযানের জন্য সঞ্চিত রাখছিলাম কিন্তু আমি এখন এই সম্পদের কিয়দংশ পরিমাণ আমার সৎ-ভাইদের সমস্যা চিরতরে দূর করার জন্য ব্যয় করছে আগ্রহী…

কিভাবে, সেটা করতে চান, সুলতান? জাহিদ বেগ জানতে চায়।

যে ব্যক্তি আমার সৎ-ভাইদের যে কোনজনকে বন্দি করতে পারবে তাঁকে আমি আমার দেহের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করবো। আমরা সেই সাথে আমাদের নিজেদের প্রয়াসও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবো- তাদের বন্দি করার জন্য আমরা আমাদের পুরো সেনাবাহিনী নিয়োজিত করবো। আমি নিজে তাদের নেতৃত্ব দেবো। আমি সেই সাথে আমাদের সঙ্গে এই অভিযানে অংশ নেবার জন্য উপজাতীয় লোকদের বিশাল অংকের পারিশ্রমিক প্রদান করবো। পাহাড়ের প্রতিটা বলি আর চড়াই উতরাই তাদের চেনা। আশি শপথ করছি আমার সৎ-ভাইদের বন্দি করে তবেই আমি বিশ্রাম নেব।

*

সুলতান, আমাদের একটা পর্যবেক্ষক দল কারাবাগের দিক থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখেছে, আহমেদ বেগ বলে, আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে হুমায়ুনের কাছে এসে সে তার সাদা ঘোড়ার লাগাম এত জোরে টেনে ধরে যে প্রাণীটা ফোঁসফোঁস শব্দে প্রতিবাদ করে উঠে।

তোমার মনে হয় সেখানের বসতি কেউ আক্রমণ করেছে?

সুলতান, আমি একদম নিশ্চিত ভাবে সেটা বলতে পারি।

তাহলে দেরী কেন, চলো এগিয়ে যাই। গনগনে কমলা রঙের সূর্যের নীচে নিদাঘ-তপ্ত শক্ত মাটির বুকে তাঁর ঘোড়ার খুর যখন ঢাকের বোল তুলে, হুমায়ুন নিজেকে এই আকাঁকু অন্তত দেয় যে শেষ পর্যন্ত কামরান আর আসকারির কাছাকাছি সে পৌঁছাতে পেরেছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে কাবুলের উত্তরের পাহাড়ী উপত্যকায় সে আর তার লোকেরা বিশাল এক হানাদার বাহিনীকে ক্রমাগত ধাওয়া করে চলেছে, প্রতিবারই তারা পৌঁছে কেবল পোড়া বসতি, তছনছ হওয়া ফলের বাগান আর প্রচণ্ড গরমে পচতে শুরু করা মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু কারাবাগ থেকে তারা মাত্র চার মাইল দূরে রয়েছে। হুমায়ুন তার যৌবনে বহুবার এখানে শিকারে এসেছে বলে এলাকাটা সে ভালো করেই চেনে- বিশাল, সমৃদ্ধ একটা এলাকা যেখানে আখরোট আর খুবানির বাগান রয়েছে, বাগানের মাটির দেয়ালের পাশে উইলো বনের ধারে দিয়ে বয়ে যাওয়া নহরের পানি দিয়ে, যেখানে চাষাবাদ করা হয়।

তাকে অনুসরণ করছে পাঁচশ সুসজ্জিত সৈন্যের একটা দল- অশ্বারোহী তীরন্দাজ এবং উজ্জ্বল, ইস্পাতের ফলাযুক্ত বর্শা সজ্জিত অশ্বারোহী যোদ্ধা- সে ভাবে কারাবাগ যারাই আক্রমণ করে থাকুক, তাঁদের মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে। চূড়ায় কয়েকটা অল্পবয়সী ওকগাছ সমৃদ্ধ একটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে বাঁক নিতেই তাদের সামনে কারাবাগ এবং এর সমৃদ্ধ ফলের বাগান দৃশ্যমান হয়। হুমায়ুনের যেমনটা মনে আছে সামনের দৃশ্যপট মোটেই তেমন সুখকর নয়। ফসলের মাঠ আর ফলের বাগানে আগুন জ্বলছে এবং মাঠের উপর ভাসতে থাকা ঝাঝালো গন্ধযুক্ত ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে সে দেখে যে বসতির প্রবেশদ্বার ভাঙা। তাঁর মনে হয় ঘোড়ার খুরের বজ্রগম্ভীর শব্দ ছাপিয়ে সে আর্তনাদের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে।

ন্যায়ের তরে! হুমায়ুন মাথার উপরে আলমগীর বৃত্তাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করে উঠে এবং নিজের দেহরক্ষীদের পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সে তার ঘোড়ার পাঁজরে নির্মমভাবে গুতো দিতে থাকে। সেই প্রথম ভাঙা প্রবেশদ্বারের নীচে দিয়ে বসতিতে প্রবেশ করে, বৃদ্ধ এক লোকের মৃতদেহের চারপাশে নিজের ঘোড়া নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে যার রক্তাক্ত পৃষ্টদেশে একটা রণকুঠার গেঁথে রয়েছে। তাঁর ডান দিকে, বিশ গজ দূরে, হুমায়ুন দুজন লোককে দেখে তাদের মাথার ভেড়ার পশমের তৈরী অপরিপাটি, গোলকাকার টুপি দেখে বোঝা যায় লোকগুলো চকরা গোত্রের আতঙ্কিত একটা মেয়েকে বাসার ভেতর থেকে টেনে বের করে আনছে। তাঁদের একজন ইতিমধ্যেই নিজের ঢোলা পাজামার দড়ি খুলে ফেলেছে। হুমায়ুনকে দেখে তাদের চোয়াল ঝুলে পড়ে। মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে, সে হাচড়পাঁচড় করে সামনে থেকে সরে যায়, তারা দুজনেই নিজেদের ধনুকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায় কিন্তু হুমায়ুন তাঁদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সে তার তরবারির এক মোক্ষম কোপে প্রথমজনের দেহ কবন্ধ করে দেয়, লোকটার ছিন্নমুণ্ড উষ্ণ বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পাথরের সরদলে আছড়ে পড়ে। তারপরে, পিছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে টেনে সে তার ঘোড়াকে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলে এবং নিমেষ পরেই প্রাণীটাকে সামনের দিকে এগোতে বলে, যাতে এর সামনের পায়ের খুর দ্বিতীয় চকরার খুলিতে হাড় ভাঙার সন্তোষজনক শব্দ সৃষ্টি করে।

তার লোকেরা যারা তাকে অনুসরণ করে বসতিতে প্রবেশ করেছিল চারপাশে এখন প্রাণ খুলে লড়াই উপভোগ করছে। লুটেরার দল, ধর্ষণ আর লুট করার অভিপ্রায়ে আগত, পুরোপুরি অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়েছে। যে যেখানে পারে আড়ালের সন্ধানে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু হুমায়ুনের পুরো ভাবনা জুড়ে এখন কেবল তার সৎ-ভাইয়েরা বিরাজ করছে। সে তার ঘোড়া চক্রাকারে ঘুরিয়ে, চারপাশে ধ্বস্তাধ্বস্তি, চিৎকার করতে থাকা বিশৃঙ্খল মানুষের ভীড়ে তাদের খুঁজতে চেষ্টা করে। সুলতান, মাথা নীচু করেন! আর্তনাদ, চিৎকার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাপিয়ে সে আহমেদ খানের হুশিয়ারি শুনতে পায় এবং ঠিক সময়ে মাথা নীচু করে পাশের একটা বাড়ির সমতল ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাকড়া চুলের দানবাকৃতি একটা মানুষের তাঁকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত বর্শার ফলা এড়িয়ে যায়। হুমায়ুন তার ঘোড়ার পর্যানের সাথে যুক্ত দড়ি থেকে ঝুলন্ত রণকুঠারটা তুলে নেয় এবং বাতাসের ভিতর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে সেটাকে ছুঁড়ে মারে। কুঠারটা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার বুকে এতো জোরে আঘাত করে যে সে উপর থেকে সোজা পেছনের দিকে উল্টে পড়ে, যেন গাদাবন্দুকের গুলি আঘাত করেছে।

হুমায়ুনের কানে তাঁর রক্ত ধপধপ শব্দে বাড়ি মারতে থাকে। লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করতে পেরে তার বেশ ভালোই লাগে। সে তার মুখ মোছার সবুজ কাপড়টা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে, সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট গুটিকয়েক লুটেরা কুয়ার উপরের কাঠের কাঠামোর সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটা ঘোড়ার দিকে ছুটে যাচ্ছে। একজনও যেন পালাতে না পারে। নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পালাতে থাকা লোকগুলোর দিকে দৌড়াতে শুরু করার আগে সে চিৎকার করে বলে। হানাদারদের একজন মাত্র লাফিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠতে যাবে, এমন সময় সে সামনের দিকে ঝুঁকে এসে তাঁর কাঁধ চেপে ধরে এবং প্রচণ্ড এক ধাক্কায় তাকে মাটিতে ছিটকে ফেলে দেয়। হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে, তুমি কার লোক? এই মুহূর্তে আমার প্রশ্নের জবাব দাও নতুবা আমার তরবারির ফলা তোমার কণ্ঠনালি ছিন্ন করবে। লোকটা বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করে এবং কথা বলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার মাঝেই হুমায়ুন পেছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে।

তারা সবাই আমার লোক। আমি আত্মসমর্পণ করছি। আসেন এসব বিরোধের একেবারে অবসান ঘটাই।

হুমায়ুন ঘুরে তাকিয়ে তাঁর কাছ থেকে মাত্র চারগজ দূরে আসকারিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কৃশকায় মুখটা তার ডান ভ্রর উপরের ক্ষতস্থান থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে ভেজা। তাঁর পায়ের কাছে নিজের বাঁকান তরবারি এবং নিক্ষেপক খঞ্জর পড়ে রয়েছে। আসকারির লোকেরা যখন দেখে তাদের দলপতি কি করেছে, বাকি লোকেরা তখন নিজেদের অস্ত্র ত্যাগ করে।

হুমায়ুনের লোকেরা ইতিমধ্যে চারপাশ থেকে তাঁদের ঘিরে ফেলেছে। সবকটাকে বেঁধে ফেল, সে আদেশ দেয়। তারপরে, ঘোড়া থেকে নেমে সে মন্থর পায়ে আসকারির দিকে এগিয়ে যায়। নিজের ভাইয়ের এহেন আচরণের কারণে খানিকটা বিভ্রান্ত এবং আসকারি যদি নিজের অস্ত্র ফেলে না দিয়ে ব্যবহার করলে সে তার হাতে মৃত্যুর কত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সেটা বুঝতে পেরে, দুটো অনুভূতির সম্মিলন তাকে একটা সহজাত আবেগের শরণ নিতে বাধ্য করে- ক্রোধ।

আমার লোকদের আমাদের লোকদের এমন ক্ষতি আর ধ্বংস সাধনের সাহস তোমার কিভাবে হলো?

আসকারি কোনো উত্তর দেয় না।

একাকি কোনো কিছু করার সাহস তোমার কখনও ছিল না। কামরান নিশ্চয়ই আশেপাশেই কোথাও রয়েছে। কোথায় সে?

আসকারি তাঁর মুখের ক্ষতস্থান থেকে তখনও গড়াতে থাকা রক্ত হাত দিয়ে মুছে নেয়। আপনি ভুল করছেন। গত পাঁচমাস কামরানের সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি জানি না সে কোথায়। তাঁর চোখের কালো মণি হুমায়ুনের দিকে সরাসরি তাকায়।

হুমায়ুন তাঁর কাছে এগিয়ে আসে এবং কেউ যাতে তাদের কথোপকথন শুনতে পায় সেজন্য গলার স্বর নামিয়ে নেয়। আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। তুমি এখানে উপস্থিত রয়েছে সেটা বোঝার আগেই তুমি পেছন থেকে আমাকে আক্রমণ করতে পারতে।

হ্যাঁ।

কি মনে করে তুমি নিজেকে বিরত রাখলে?

আসকারি কাঁধ ঝাঁকায় এবং দৃষ্টি সরিয়ে অন্যত্র তাকিয়ে থাকে। হুমায়ুন শক্ত করে তাঁর কাঁধ চেপে ধরে। নির্দোষ লোকদের আক্রমণ করতে, এইসব দুবৃত্তদের- সে চাপা ক্রোধে যুঁসতে থাকা কয়েকজন চকরার দিকে ইঙ্গিত করে তার লোকেরা দড়ি দিয়ে মুরগীর মতো যাদের দুহাত পিছনে বেঁধেছে- খুন আর ধর্ষণ করার অনুমতি দিতে তুমি দ্বিধা করনা, তাহলে নিজের আপন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়কে আক্রমণ করতে কেন ইতস্তত করলে…?

হুমায়ুন…

না, আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখেছি, আমি আসলে জানতে আগ্রহী নই। ব্যাপারটা সম্ভবত কাপুরুষোচিত। তুমি জানতে যে আমায় আক্রমণ করলে আমার লোকেরা তোমায় খুন করে ফেলবে। তুমি কত অনুতপ্ত আর কিভাবে যা কিছু ঘটেছ সবকিছুর জন্য কামরান দায়ী- সে সম্বন্ধে আমি আর নতুন করে কোনো মিথ্যা কথা শুনতে চাই না। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে, একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যার এবং কাবুলে পৌঁছান পর্যন্ত আমি যেন এর চেহারা আর না দেখি। তার চেহারা দেখলে আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে উঠি।

*

হুমায়ুন কাবুলে ফিরে আসবার পরে দশদিন অতিবাহিত হয়, হেমন্তের আগমনে যখন গাছেরা লাল আর সোনালী রঙে সাজতে শুরু করে, সে অবশেষে আসকারিকে তাঁর সামনে পুনরায় উপস্থিত করার আদেশ দেয়। নিজের লোকদের কাছে সে নির্জলা সত্যি কথাটাই বলে তাঁর সৎ-ভাইয়ের এহেন অধঃপতন আর তাঁদের পরিবারের প্রতি যে অসম্মান সে বয়ে এনেছে সেজন্য নিজের সৎ-ভাইয়ের কারণে সে লজ্জিত। ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দি থাকার কারণে পূর্বের চেয়ে মলিন আর কৃশকায় হয়ে উঠা আসকারি হাত বাঁধা, পায়ে শেকল পরিহিত আর প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় পা টেনে টেনে হুমায়ুনের ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করে। আমাদের একা থাকতে দাও, হুমায়ুন তাঁদের আদেশ দেয়, কিন্তু আমি ডাকলেই শুনতে পাবে এমন জায়গায় থাকো। তাদের পেছনে উঁত কাঠের তৈরী দুই পাল্লার দরজাটা বন্ধ হতে হুমায়ুন তার গিল্টি করা চেয়ারের দিকে হেঁটে গিয়ে, বসে এবং চোয়ালে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে আসকারির মুখের দিকে তাকায়।

একটা জিনিষ আমি কোনোদিনই বুঝতে পারিনি। তুমি আমার জন্য হুমকির কারণ হবার পরেও আমি দুই দুইবার তোমার জান বখশ দিয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা, আমার হিন্দুস্তান অভিযানে আমি কেবল আমার ভাই হিসাবে তোমায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানাইনি বরং আমার একজন মিত্র হিসাবে তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম… আমি তোমায় সবকিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছো যে আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি…

আসকারি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। আপনি কোনো অন্যায় করেননি, নীচু কণ্ঠে সে অবশেষে বলে।

আপনি যা কিছু আমাকে আর কামরানকে দিতে চেয়েছেন সেসবই ছিল আপনার প্রতিভাত গৌরবের একটা ক্ষুদ্রতম অংশ- আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ড কিংবা ক্ষমতা নয়। আমি আপনার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছি আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি, কিন্তু আপনার কাছে জীবন সবসময়েই আপনার তথাকথিত মহান নিয়তি।

এটা কেবল আমার একার নিয়তি নয়- আমাদের সবারই এতে অধিকার আছে।

তাই কি? আমাদের লোকদের মাঝে যে প্রবচন প্রচলিত রয়েছে, তখত, তক্তা, সিংহাসন বা শবাধার সে সম্বন্ধে কি বলবেন? সেটা কিন্তু মোটেই বাটোয়ারা করা নিয়তি না- প্রবচনটার অর্থ একটাই সবকিছুর অধিকার বিজয়ীর। হুমায়ুন, আমরা বরং খোলাখুলি আলোচনা করি- বিগত বছরগুলোতে আমরা যেমন আলোচনা করেছি সম্ভব হলে তার চেয়ে বেশী সতোর সাথে কথা বলি। আমি আপনাকে পছন্দ করি না সত্যি কিন্তু আমি আপনাকে ঘৃণাও করি না…আমি কখনও সেটা করিনি। আমি কেবল আমার নিজের জন্য কিছু একটা অর্জন করতে চাইছিলাম আমার স্থানে থাকলে আপনিও একই কাজ করতেন।

তুমি লোভ আর প্রতিহত উচ্চাশার পক্ষে সাফাই দিতে চেষ্টা করছে।

আসকারি মাথা নীচু করে নিজের হাতের বাঁধনের দিকে তাকায়। আপনি বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতেই পারেন। আমি এটাকে স্বাধীন, স্বাবলম্বী হবার আকাঙ্খ হিসাবে দেখি- আমাদের মরহুম আব্বাজান যদি নিজের সাম্রাজ্য তাঁর সন্তানদের মাঝে যথাযথভাবে ভাগ করে দিতেন যেমনটা আমাদের পূর্বপুরুষেরা করেছিলেন তাহলে আমি যেমন স্বাধীনতা ভোগ করতাম। সে কথা শেষ করে।

কিন্তু আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কোনো দরকার ছিল না। হিন্দাল করেনি।

হিন্দালের উল্লেখ করায় আসকারির সাধুম্নন্য অভিব্যক্তি বদলে যায়। হিন্দাল আমাদের সবার থেকে আলাদা। সে যেমন ভদ্র ছিল তেমনি বিশাল ছিল তাঁর দৈহিক আর মানসিক গুণাবলী। সে ছলনা জানতো না এবং এতটাই অকপট ছিল যে, সে আশা করতে সবাই তার মতো এক কথার মানুষ। হামিদাকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আপনি আপনার একজন বিশ্বস্ত মিত্র খুইয়েছিলেন… সহসা আসকারির চোখে অশ্রু ছলছল করে উঠে। আমি যদি…কিন্তু কি লাভ…।

তুমি পারলে কি করতে? হুমায়ুন তাঁর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং আসকারির কাছে এগিয়ে আসতে বহুদিন বন্দিদশায় কাটাবার কারণে তাঁর কাপড় এবং ত্বক থেকে সেঁতসেঁতে তীব্র কটুগন্ধ হুমায়ুনের নাকে ভেসে আসে।

হিন্দালকে আমি হত্যা না করলেও পারতাম।

তুমি? আমি ভেবেছিলাম কামরান কাজটা করেছে…।

সে নয়। কাজটা আমি করেছি।

কিন্তু কেন? সে কিভাবে তোমার ক্ষতি করেছিল?

আমি তাঁকে হত্যা করতে চাইনি। পুরো ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা। নিয়তির নিষ্ঠুর এক সমস্থানিকতা। এক অমাবস্যার রাতে আমি আমার লোকদের নিয়ে ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। অন্ধকারে দ্রুতগামী একদল অশ্বারোহীর সাথে আমাদের দেখা হয়, যারা নিজেদের পরিচয় দিতে বা থামতে রাজি হয় না। আমি তাদের দলপতিকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে সে তার পর্যান থেকে ঢলে পড়লে তার বাকি লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যায়। আমি যখন দলপতির দেহের দিকে তাকাই… আমি দেখি সেটা হিন্দালের মৃতদেহ… হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকান থেকে বিরত থেকে আসকারি বোকাটে একঘেয়ে সুরে কথাগুলো বলে। আমি আমার লোকদের আদেশ দেই কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে তাঁর মৃতদেহটা রেখে আসতে, যাতে বন্য পশুপাখি তাঁর দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করার আগেই কেউ সেটা খুঁজে পায়, যাতে আপনি তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাধিস্থ করতে পারেন।

আমি সেটা করেছি। তার ইচ্ছা অনুসারেই তাঁকে আমাদের আব্বাজানের পাশেই কবর দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন তখনও তার সৎ-ভাইয়ের চোখে মুখে ফুটে থাকা অনুশোচনাটা মেনে নিতে চেষ্টা করছে এমন সময় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো একটা ভাবনা তার মাথায় খেলে যেতে সহসা একটা অন্ধকার এলাকা আলোকিত হয়ে উঠে।

আমাকে আক্রমণ না করে তুমি আত্মসমর্পণ করেছিলে হিন্দালের কারণেই, তাই না? তুমি অনায়াসে আমাকে খুন করে ফেলতে পারতে…

হ্যাঁ। আমার অপরাধবোধ আমি আর বহন করতে পারছিলাম না। সবকিছুই এত নশ্বর। অনুশোচনার যে বোঝা আমি ইতিমধ্যে বহন করে চলেছি তার সাথে আরেক ভাইয়ের হত্যার দায় যোগ করতে চাইনি।

হুমায়ুন আসকারির বয়ান নিয়ে চিন্তা করার সময় টের পায় তার নিজের চোখের কোণেও অশ্রু টলটল করছে। অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে হিন্দাল দক্ষিণে এসে নিজেকে কেন বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়েছিল, যেখানে সে জানে কামরান আর আসকারির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সাথে তার হয়ত দেখা হতে পারে? হিন্দাল তাঁর সাথে একটা সমঝোতার উদ্দেশ্যে কাবুলের দিকে আসছিলো এমনটা চিন্তা করা কি স্বপ্নচারিতা হবে? সে এখন আর সেটা কখনও জানতে পারবে না…

দুই ভাই কিছুক্ষণ মৌব্রত পালন করে। আসকারি তারপরে মন্থর পায়ে কক্ষের ভিতর দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং নীচের আঙ্গিনার দিকে তাকায়। জানালা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে তার ঠোঁটের কোণে একটা আধো হাসির রেশ ফুটে উঠে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন নীচের আঙ্গিনায় দেহরক্ষীদের প্রশিক্ষণের সময় আমি আর হিন্দাল মাঝেমাঝে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অন্যসময় আমরা আপনাকে আর কামরানকে তরবারি আর খঞ্জর নিয়ে যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করতে দেখতাম। আমাদের ভিতরে একটা মুগ্ধতা কাজ করতো- আমাদের তুলনায় আপনাকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, একজন যোদ্ধা মনে হত… আমরা এখানে দাঁড়িয়েই আমাদের আব্বাজানকে তার হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হতে দেখেছিলাম। আমরা আর কখনও সেরকম কিছু দেখিনি। দূর্গপ্রাসাদের নীচের উপত্যকায় সমবেত হওয়া হাজার হাজার যোদ্ধা, অগণিত রসদবাহী শকট, ভোরের প্রথম আলোয় চরাচর ছাপিয়ে জেগে ওঠা সেই কোলাহল আর উত্তেজনা। হিন্দাল উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠেছিল যদিও কি ঘটছে সেটা সে ঠিকমতো বোঝার বয়স তখনও তার হয়নি… হুমায়ুন…

কি?

আপনি কি আমায় মৃত্যুদণ্ড দিতে চান?

সম্ভবত না।

আসকারি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে। তাই যদি হয়, আমাকে তাহলে আমার নিজের সাথে আর অতীতের সাথে একটা বোঝাঁপড়া করার উপায় খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন…

আমি সেটা কিভাবে করতে পারি?

আমাকে মক্কায়, হজ্জ্ব করতে যাবার অনুমতি দেন। হিন্দালের ভাগ্যে যা ঘটেছে সেজন্য আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই…

তুমি মক্কায় তীর্থযাত্রা করতে আগ্রহী? হুমায়ুন দুই এক মুহূর্ত চিন্তা করে, ক্ষতি কি। হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে আসকারিকে কাবুল থেকে প্রায় হাজারখানেক মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে এবং কয়েক মাস- এমনকি বছরও হতে পারে, কামরানের কাছ থেকে সে দূরে থাকবে। এটা নির্বাসন কিংবা কারারুদ্ধ করার চেয়ে অনেক উত্তম সমাধান এবং আসকারি এরফলে হয়ত মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে, এই মুহূর্তে যা তার ভীষণ প্রয়োজন বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতিয়মান। তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি ঠিক এটাই চাইছো?

আসকারি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

আমি তাহলে তোমার সাথে একদল দেহরক্ষী প্রেরণ করবো যাদের নেতৃত্বে থাকবে আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তরুন সেনাপতি, মোহাম্মদ আজরুদ্দিন।

আমার উপরে গুপ্তচরবৃত্তি করতে? আসকারি বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেসে বলে।

না। তোমার নিরাপত্তার খাতিরে সমুদ্র আর স্থলপথে এটা একটা দীর্ঘ এবং ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা… তুমি হয়ত আমার কথা বিশ্বাস করবে না কিন্তু আমি ভীষণভাবে কামনা করতাম যে আমাদের ভিতরে সম্পর্কটা একটু ভিন্ন হোক। সেজন্য এখন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে- অতীত সবসময়েই আমাদের ভিতরে মুখব্যাদান করে থাকবে- কিন্তু আমি দোয়া করি তুমি যে শান্তির সন্ধান করছে তার দেখা যেন তুমি পাও।

৪.২ পাদিশাহ কামরান

২২. পাদিশাহ কামরান

মক্কার উদ্দেশ্যে দীর্ঘযাত্রায় আসকারি রওয়ানা দেয়ার পাঁচমাস পরে, বসন্তের সূচনালগ্নে একদিন খুব সকালে, হুমায়ুন তাঁর দূর্গ প্রাসাদে নিজের আবাসন কক্ষের পাথরের জানালা যেখান থেকে কাবুল দেখা যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের পাহাড়ী এলাকার দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। গত কয়েক সপ্তাহে যদি তুষারপাত হয়নি কিন্তু তাঁদের উঁচুনীচু চূড়াগুলো এখনও বরফাবৃত। বাতাসে এখনও হাড় কাঁপান শীতের আমজে এবং হুমায়ুন তার পশমের আস্তরণযুক্ত আলখাল্লাটা ভালোমতো শরীরের সাথে জড়িয়ে নেয়। বছরের এই সময়ে হিন্দুস্তান থেকে খুব অল্পসংখ্যক পথিকই গিরিপথ অতিক্রম করে কিন্তু হুমায়ুন যখন তাকিয়ে থাকে, দেখে একটা ক্ষুদ্র কাফেলা দক্ষিণে হিন্দুস্তানের দিকে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে সেটার বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসছে।

কাফেলাটা নিকটবর্তী হলে, হুমায়ুন দেখে সামান্য সংখ্যক অশ্বারোহী, তাঁদের সংখ্যা খুব বেশী হলে বিশজন হবে- সম্ভবত বণিক আর তাঁদের পরিচারক- এবং বিশ ত্রিশটা মালবাহী উট রয়েছে কাফেলায়। শীতের কবল থেকে বাঁচতে অশ্বারোহীদের সবারই পরণে ভেড়ার চামড়ার ভারী আলখাল্লা এবং প্রায় সবাই নিজেদের মুখ গলবস্ত্র দিয়ে মুড়ে রেখেছে। শীতের বাতাসে উটের উষ্ণ নিঃশ্বাস ভেসে থাকে যখন প্রাণীগুলো তাদের পিঠের দুপাশে ঝোলান পণ্যসামগ্রী দিয়ে ঠাসা ভারী ঝুড়ি নিয়ে শ্রান্তভঙ্গিতে মন্থর গতিতে উপরে উঠে আসে এবং শহরের প্রশস্ত প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ঠিক ভিতরে অবস্থিত সরাইখানাগুলোর একটার দিকে এগিয়ে যায়। কাফেলাটা দশ মিনিট পরে শহরের তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সরাইখানায় ঢুকে যেতে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়। হুমায়ুন কিছুক্ষণ পরেই অতিথিদের খাবার আর উষ্ণতা দিতে সরাইখানার চিমনি দিয়ে অতিরিক্ত ঘোয়ার কুণ্ডলী নির্গত হতে দেখে।

কাফেলার বিষয়ে আর কোনো চিন্তা না করে, হুমায়ুন নীচে দূর্গের আঙ্গিনার দিকে তাকায়- যেখানে বৈরাম খান দশ বছরের আকবরকে অসিযুদ্ধের কিছু সূক্ষ কৌশল দেখিয়ে দিচ্ছে এবং আকবরের দুধ-ভাই আধম খান দাঁড়িয়ে দেখছে। আকবর- তাঁর বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় শক্তিশালী, পেশীবহুল- বৈরাম খানের তরবারির আঘাত ঠেকানোর জন্য স্পষ্টতই একটা কৌশলে দক্ষ হয়ে উঠেছে। সে নীচু হয়ে তাঁর ওস্তাদের ঢাল এড়িয়ে গিয়ে নিজের ভোঁতা তরবারি দিয়ে প্রশিক্ষণের সময়ে পরিহিত পুরু প্রতিরক্ষা আবরণে আঘাত করে।

আকবর আর বৈরাম খান দম নেবার জন্য প্রশিক্ষণ বন্ধ করলে, হুমায়ুন দেখে ভেড়ার চামড়ার ভারী হাতাওয়ালা আলখাল্লা পরিহিত একটা লোক, তার মুখ একটা লাল পশমী কাপড়ের নীচে ঢাকা পড়ে রয়েছে, আঙ্গিনায় প্রবেশ করছে। লোকটা জরুরী ভঙ্গিতে প্রহরীদের একজনের সাথে কথা বলে, যে প্রথমে আধিকারিকদের বাসস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে এবং তারপরে হুমায়ুনের নিজস্ব আবাসন কক্ষ দেখিয়ে দেয়। দশ মিনিট পরে, হুমায়ুন দরজায় একটা করাঘাত শুনতে পায় এবং জওহর ভিতরে প্রবেশ করে। সুলতান, আহমেদ খানের গুপ্তচরদের একজন দক্ষিণের সংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছে। আহমেদ খান গুপ্তচরকে সশরীরে আপনার সামনে হাজির করে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে আপনার দর্শন প্রার্থনা করেছেন। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের ভেতরে নিয়ে এসো।

আহমেদ খানের অতি পরিচিত ছোপ ছোপ দাড়িঅলা চেহারা, কিছুক্ষণ পরে দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। হুমায়ুন ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট পরিহিত যে লোকটাকে আঙ্গিনায় দেখেছিল, সে আহমেদ খানের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটা তার মুখ থেকে লাল পশমের গলবস্ত্র আর মাথার টুপি খুলে রাখায় কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মাথার পাতলা হয়ে আসা কালো চুল দেখা যায়, দুটোর কারণেই সম্ভবত তার যা বয়স, তাকে তার চেয়ে বেশী বয়স্ক মনে হয়। আহমেদ খান আর নবাগত লোকটা মাথা নীচু করে অভিবাদন জানায়।

আহমেদ খান, কি ব্যাপার?

সুলতান, এর নাম হুসেন খলিল- আমাদের সবচেয়ে সেরা আর বিশ্বস্ত গুপ্তচর। সে কিছুক্ষণ আগে দক্ষিণে খোস্তের আশেপাশের এলাকার সংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছে।

আমি এইমাত্র যে কাফেলাটা শহরে প্রবেশ করতে দেখেছি, সেই কাফেলার সাথে সে এসেছে, তাই না? শহরে পৌঁছাবার পরে একপাত্র গরম স্যুপ কিংবা সরাইখানায় সদ্য প্রজ্জ্বলিত আগুনের সামনে বসে নিজেকে খানিকটা উষ্ণ না করে এত দ্রুত যদি সে আমাদের সাথে দেখা করতে আসে, তাহলে সে স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বয়ে এনেছে।

সংবাদটা একাধারে গুরুত্বপূর্ণ আর সেই সাথে ভয়ানক। খোস্তের দক্ষিণে সৈন্য সগ্রহ করে আপনার সৎ-ভাই কামরান আরো একটা বিদ্রোহের পায়তারা করছে।

হুমায়ুন চোখ মুখ কুঁচকে চুপ করে থাকে। সে এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য আপাতভাবে প্রস্তুতই ছিল কিন্তু আশা করেছিল যে হয়ত শুনতে হবে না। হিন্দালের মৃত্যু আর হজ্জের উদ্দেশ্যে আসকারি রওয়ানা দেবার পরে, হুমায়ুনের সৈন্যদের নিবিড় তল্লাশি সত্ত্বেও কামরান যেন পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে হারিয়ে গিয়েছিল। হুমায়ুন নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে কামরান হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে তার উচিত সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করা এবং কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় পশ্চাদপসরণ করা কিংবা নির্বাসনে গিয়ে, হিন্দুস্তানের সিংহাসন খোয়াবার পরে এই প্রথম হুমায়ুনকে তাঁর সমস্ত লোকবল আর প্রচেষ্টা স্বাধীনভাবে সেটা পুনরুদ্ধারে নিবদ্ধ করা।

হুমায়ুন অবশ্য মনে মনে ঠিকই জানতো যে তাঁর ভ্রাতৃসম শত্রুদের ভিতরে কামরান সবচেয়ে দৃঢ়সংকল্প আর উদ্যমী এবং এটা অসম্ভব সে তার বিদ্রোহের প্রয়াস পরিহার করে হুমায়ুনকে স্বাধীনভাবে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেবে। তাদের ভিতরে কোনো ধরনের শান্তি, কোনো ধরনের সন্ধি হওয়া অসম্ভব। কামরান কখনও তার মনের গভীরে গেঁথে যাওয়া বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ বর্জন করেনি, যে বয়সে পাঁচ মাসের বড় হবার কারণে বাবর মারা যাবার আগে তাকেই সবকিছু দিয়ে গিয়েছে। সে সম্ভবত এটাও মনে মনে বিশ্বাস করে যে, বাবর তাঁর চেয়ে অপদার্থ হুমায়ুনকে বেশী ভালোবাসতো- খুব সম্ভব তাঁর কুটিল চরিত্রে মা গুলরুখ এই ধারণাটা ছেলের ভেতরে ঢুকিয়েছে। হুমায়ুন এসব কিছুই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না কিন্তু সে জানে, তাঁকে আরো একবার তার সৎ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং এইবার চিরতরে তাঁর হুমকির সমাপ্তি ঘটাতে হবে। কামরান ঠিক কোনো জায়গায় রয়েছে?

বালুচ আর আমাদের আফগান ভূখণ্ডের সীমানার কাছে, আহমেদ খান উত্তর দেয়। উঁচু পাহাড়, নির্জন উপত্যকা আর দূরবর্তী গুহার কারণে এলাকাটা বিদ্রোহী আর ডাকাতদের আত্মগোপন করে থাকার জন্য দারুণ এবং স্থানীয়দের সমর্থণ ছাড়া কারো পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা অসম্ভব। কিন্তু হুসেন খলিল হয়ত তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বলতে আগ্রহী?

অবশ্যই।

হুসেন খলিল এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর স্থানান্তর করে এবং চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ রেখে খানিকটা সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলতে আরম্ভ করে, সে কথা বলার সাথে সাথে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে।

আহমেদ খানের আদেশে আমি অটমান ঔষধবিক্রেতার ছদ্মবেশে দক্ষিণে গমন করি- ঔষধপত্রের বিষয়ে আমার যৎসামান্য জ্ঞান আছে। আমি খোস্তের কাছাকাছি পৌঁছাবার পরে আমি একটা গুজব শুনতে পাই যে সেখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে একটা দুর্গম পাহাড়ী দূর্গে আপনার সৎ-ভাই আশ্রয় নিয়েছে। আমি সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নেই এবং খাড়া, পাথুরে রাস্তা, অগণিত গিরিপথ আর ছোট, আঁকাবাঁকা, কিন্তু খরস্রোতা নদী অতিক্রম করে একাকী রওয়ানা দেই। আমি যখন গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাই, লক্ষ্য করি যে পথের ধারে অবস্থিত বিশ্রামাগার আর চায়ের দোকানগুলোয় লোকের উপচে পড়া ভীড়। দোকানগুলোর প্রায় সব খরিদ্দারই আমার মতো একই দিকে ভ্রমণ করছে। তাদের প্রায় সবাই সশস্ত্র এবং শক্তসমর্থ। আপনার সৎ-ভাইয়ের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য তাঁরা রওয়ানা হয়েছে সেটা বোঝার জন্য খুব একটা মাথা খাটাবার প্রয়োজন হয় না এবং বস্তুত পক্ষে তাঁদের অনেকেই মনেপ্রাণে এতটাই প্রস্তুত যে কথাটা তারা লুকাবার দরকারও মনে করে না। আমি অবশ্য তারপরেও দূর্গটা নিজের চোখে দেখতে এবং ফিরে আসবার আগে সেখানে আপনার সৎ-ভাই কামরানের উপস্থিতি আর তাঁর অনুগত বাহিনীর সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানবার সিদ্ধান্ত নেই।

সেখানে পৌঁছাবার পরে তুমি কি জানতে পারলে?

আমি আরো কয়েকদিন পরে যখন কামরানের দুর্ভেদ্যঘাটিতে উপস্থিত হই, আমি আবিষ্কার করি যে সেটা আসলে উঁচু পাহাড়ে, একটা সংকীর্ণ উপত্যকার একপ্রান্তে অবস্থিত একটা সুরক্ষিত গ্রাম। পুরো গ্রামটা উঁচু আর প্রশস্ত মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং চারপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাপড়ের তাবু টাঙানো হয়েছে সেখানে আসবার পথে আমি যাদের দেখেছি সেইসব নবাগতদের বাসস্থান। ঔষধবিক্রেতা হিসাবে আমার নিজের ছদ্মবেশের উপর আস্থা রেখে আমি মাটির দেয়ালে অবস্থিত লোহার কীলক দেয়া পাল্লা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করি এবং ভেতরে অবস্থিত ছোট একটা বাজারে গিয়ে হাজির হই। পথের দুপাশে অবস্থিত দোকানগুলোতে কাঁচা শাকসজি এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু বাজারের কেন্দ্রস্থলে একটা শক্তসমর্থ লোক স্পষ্টতই একজন আধিকারিক- এক সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভাব্য নবাগত এবং তাঁদের বাহন পরীক্ষা করছে, লোকগুলোর পেটে খোঁচা দিয়ে তাঁদের মাংসপেশী পরীক্ষা করছে, তাঁদের অস্ত্রের ধার দেখছে এবং তাঁদের ঘোড়ার দাঁত এবং পায়ের পেশী খুটিয়ে দেখছে। সে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের এক তৃতীয়াংশ পরীক্ষা করার আগেই একটা হালকা লালচে হলুদ রঙের লম্বা ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে আপনার সৎ-ভাই তার কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে সেখানে হাজির হয় এবং তার চারপাশে নবাগতদের সমবেত হতে বলে। হঠাৎ এক পশলা। তুষারপাত হবার কারণে সেখানের প্রেক্ষাপট আর উপস্থিত সবাইকে সাদা রঙ রাঙিয়ে দেয়ার পরে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য আরম্ভ করেন।

সে ভাষণে কি বলেছে?

সুলতান, আমাকে মার্জনা করবেন। আমি ঠিক নিশ্চিত নই তার রূঢ় কথাগুলো আমার পুনরাবৃত্তি করা উচিত হবে কিনা, কারণ কথাগুলো আপনার সাথে সম্পর্কিত।

বলতে শুরু কর। শব্দগুলো তোমার না আমার সৎ-ভাইয়ের উচ্চারিত এবং আমি সেগুলো শুনতে আগ্রহী।

বক্তব্যটা ছিল অনেকটা এমন: আমার সৎ-ভাই, মহামান্য সম্রাট একজন দুর্বল, অস্থিরচিত্ত লোক, শাসনকার্য পরিচালনার যোগ্য নয়। তাঁর দৃঢ়োক্তি সত্ত্বেও সে এখনও আফিমে আসক্ত। নেকাটা তাঁকে চলচিত্ত আর নিষ্ক্রিয় করে তুলেছে। হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের অনেক সুযোগ সে পেয়েছে কিন্তু সুযোগগুলো সে কাজে লাগাতে পারেনি। সে নয়- আমি আমার রয়েছে সম্পদ আর জমির জন্য সত্যিকারের ক্ষুধা, যা আমার মরহুম আব্বাজান বাবরকে উৎসাহিত করেছিল। আমার প্রতি অনুগত থাকলে আমি তোমাদের জন্য বিশাল পুরষ্কার বয়ে আনব।

হুমায়ুন উত্তেজিত হয়ে নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখে। সত্যের একটা দানার সাথে নিজের মিথ্যের মিশেল দিয়ে এমন কথা বলা ধূর্ত কামরানের চরিত্রের সাথেই মানানসই। হিন্দুস্তানের পুনরুদ্ধারে কোনো ধরনের অগ্রগতি লাভে নিজের ব্যর্থতায় অস্বস্তিকর হতাশার হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য, হ্যাঁ, সে কালেভদ্রে কখনও কখনও আবারও আফিমের প্রবোধের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সেই ব্যর্থতার কারণ কামরান নিজে এবং তাঁর অবিরত বিদ্রোহ। হুমায়ুন নিজেকে সংযত করে। লোকগুলো কিভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে?

তারা তাকে উৎসাহিত করে এবং সে তাঁর সঙ্গীদের একজনকে ইশারা করলে, সে সবুজ চামড়া দিয়ে তৈরী বিশাল একটা বটুয়া বের করে। আপনার সৎ-ভাই সেখান থেকে কিছু রৌপ্যমুদ্রা নিয়ে প্রত্যেককে পাঁচটা করে দিয়ে, বলে, এগুলো তোমরা ভবিষ্যতে লাভ করবে এমন অসংখ্য পুরস্কারের একটা মামুলি স্মারক। লোভে চকচক করতে থাকা চোখে তারা গর্জে উঠে বলে কামরান পাদিশাহ! আমৃত্যু আমরা আপনাকে অনুসরণ করবো।

সেটা হবে খুবই সংক্ষিপ্ত একটা যাত্রা। কামরান আর তারা যদি তাঁদের বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে তাহলে নিশ্চিতভাবেই সবাই বেঘোরে মারা পড়বে। কিন্তু তুমি আপাতত বলতে থাকো।

আমি সেই বসতিতে চারদিন অবস্থান করে, নবাগতদের সাথে কথা বলি এবং তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির উপরে নজর রাখি। একজন পক্ককেশ আধিকারিক, অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে যিনি হাত পায়ের স্ফীতিতে ভুগছিলেন যার জন্য আমি তাঁকে সরিষার একটা পটি লাগাবার পরামর্শ দেই- আমি আল্লাহতালার প্রতি কৃতজ্ঞ- যা থেকে বোধহয় তিনি উপকার লাভ করেন, আমাকে জানান যে আর এক সপ্তাহরে ভিতরে তারা কাবুলের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা আরম্ভ করবেন। আমি এরপরে আর অপেক্ষা করাটা সমীচিন মনে করিনি এবং ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করি। দশদিন আগে, ডাকাত আর যথেচ্ছাচারী গোত্রগুলোর হাত থেকে বাঁচতে আমি একটা কাফেলার সাথে যোগ দেই- যারা আজকে শহরে প্রবেশ করেছে।

হুসেন খলিল, তুমি তোমার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। আহমেদ খান, গুপ্তদূতদের একটা দলকে এই মুহূর্তে পাঠান আমার ভাইয়ের অগ্রসর হবার চিহ্ন খুঁজে দেখতে।

সুলতান, আমি ইতিমধ্যেই আপনার কথামতো কাজ করেছি।

আধঘন্টার ভিতরেই দূর্গপ্রাসাদের অভ্যন্তরের বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড দ্বারা উষ্ণ একটা কামরায় হুমায়ুনের চারপাশে তার সামরিক উপদেষ্টারা সমবেত হয়। হুমায়ুন প্রথমে হুসেন খলিলের প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার সবাইকে জানায় এবং তারপরে চোখে ক্রোধ আর কণ্ঠে ইস্পাতশীতল প্রতিজ্ঞা জারিত করে বলে, আমি আমার সৎ-ভাইয়ের রাষ্ট্রদ্রোহীতা আর সহ্য করবো না। গুপ্তদূত তার আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হবার বিষয়টা নিশ্চিত করায় আমি সে কাবুলের কাছে পৌঁছাবার পূর্বে আমরা এগিয়ে গিয়ে তাকে মোকাবেলা করি, সম্ভব হলে গিরিপথে তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করা। সে কথা থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপরে জিজ্ঞেস করে, বৈরাম খান, আমরা খুব দ্রুত কত সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে পারবো?

সুলতান, প্রায় চার হাজার। একটা ব্যাপার আমাদের পক্ষে রয়েছে যে সিন্ধু নদ অভিমুখে আপনি অনুসন্ধানী অভিযান পরিচালনার বিষয়ে চিন্তা করায় আমরা ইতিমধ্যে কাবুলের আশেপাশে বসবাসরত গোত্রগুলো থেকে লোক নিযুক্ত করা শুরু করেছিলাম।

নতুন যাদের নেয়া হয়েছে তারা কি অনুগত থাকবে? এইসব গোত্রগুলোর মানুষ ভীষণ রগচটা আর গোত্রের ভিতরে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের কারণে নানা উপদলে বিভক্ত।

সুলতান, আমাদেরও সেই রকমই ধারণা। আপনি তো জানেন যে, আমরা তাদের নিয়োগ করার সময়েই থোক একটা অর্থ দিয়েছি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছি প্রতিটা বিজয়ের পরে আরো দেয়া হবে।

ভালো কথা। আমরা তাহলে পাঁচদিনের ভিতরে যাত্রা করবো।

চারদিন পরে- হুমায়ুন প্রথমে যেমনটা ভেবেছিল প্রস্তুতি নিতে তারচেয়ে কম সময় লাগে- সে তার বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের ঢালু পাথুরে পথ দিয়ে নীচের সমভূমিতে অবস্থিত কুচকাওয়াজ ময়দানের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে তাঁর চার হাজার সৈন্যের বাহিনী সমবেত হয়েছে, শীতল জোরাল বাতাসে অসংখ্য নিশান পতপত করে উড়ছে। সৈন্যসারির কেন্দ্রে হুমায়ুন তার নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করার পরে, সে মনে মনে ভাবে যে হিন্দুস্তানে একদা তাঁর অধীনে যে বিশাল বাহিনী থাকতো তারচেয়ে এখন যদিও তারা সংখ্যায় অনেক অল্প, কিন্তু কামরানকে পরাস্ত করার জন্য এই সৈন্য সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশীই হবার কথা। তার প্রায় সব লোকই অশ্বারূঢ় এবং সে যেহেতু দ্রুতগতিতে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই এইদফা তাঁর সাথে কোনো কামান নেই, তাঁর অনেক সৈন্যের সাথেই ছয় ফিট লম্বা গাদাবন্দুক তাদের ঘোড়ার পর্যানে বাধা রয়েছে। অন্যদের সাথে রয়েছে ধনুক আর পিঠে আড়াআড়িভাবে ঝুলছে তীরভর্তি তূনীর।

আহমেদ খানের গুপ্তচরেরা নিশ্চিত করেছে যে কামরান আসলেই অগ্রসর হতে শুরু করেছে এবং সাফেদ পাহাড়ী অঞ্চলের দীর্ঘ গিরিন্দর দিয়ে অগ্রসর হয়ে, এতদিনে কাবুল থেকে দশদিনেরও কম দূরত্বে তার অবস্থান করার কথা। অভিযানের স্থায়ীত্বকাল কম হবার কারণে তারা এক সপ্তাহের কম সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরের মুখোমুখি হবে বলে আশা করছে- হুমায়ুন রসদ আর তাদের বহনকারী অন্যান্য উপকরণের পরিমাণ যতটা সম্ভব সীমিত রাখতে আদেশ দিয়েছে। উপকরণের অধিকাংশই যেমন শেষরাতের কুয়াশার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাপড়ের তাবু, তামার ডেকচি আর বস্তাভর্তি চাল- উটের পিঠে বাঁধা বেতের ঝুড়িতে চাপান হয়েছে। অবশিষ্ট উপকরণ বহনের জন্য সৈন্যসারির পিছনে সারিবদ্ধ অবস্থায় মালবাহী ঘোড়া আর খচ্চরের দল দড়ি বাঁধা অবস্থায় অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছে।

হুমায়ুন তার আধিকারিকদের মাঝে অবস্থান গ্রহণ করা মাত্র, সে তার তূর্যবাদকদের ইঙ্গিত করে তাঁদের লম্বা পিতলের তূর্য সংঘোষণে এবং তাঁর দামামাবাদকদের ঘোড়ার দুপাশে ঝোলান দামামায় রণসংগীতের বোল তুলতে। এটা সৈন্যসারির অগ্রসর হবার সংকেত, যার সাথে যোগ হয় ঘোড়ার চিহি রব আর ঘোড়ার সাজসজ্জার টুংটাং শব্দ এবং উদ্ধত-দর্শন উটের দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।

*

অভিযানের তৃতীয় দিন বিকেলের দিকে, দক্ষিণের দিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া উপত্যকা ঘিরে থাকা উঁচুনীচু পাহাড়ের কাছাকাছি খুব নীচু যখন সূর্য নেমে এসেছে, হুমায়ুন সেদিন রাতের মতো অস্থায়ী শিবির স্থাপনের বিষয় নিয়ে তাঁর আধিকারিকদের সাথে যখন আলোচনা করছে তখন আহমেদ খান ঘোড়া নিয়ে অর্ধবল্পিত বেগে সেখানে উপস্থিত হয়। তাঁর পাশে আরেকটা ঘোড়ায় রয়েছে। সাদা-চুলবিশিষ্ট রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে পোড় খাওয়া চেহারার এক লোক। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে লোকটা তার লম্বা চুলঅলা পাহাড়ী টাটু ঘোড়াটা কেবল একহাতে সামলাচ্ছে এবং তার পরণের খয়েরী পশমের হাতাওয়ালা জ্যাকেটের ডান হাতের কনুইয়ের নীচের অংশটা আলগাভাবে ঝুলে আছে। বৃদ্ধ লোকটা বিস্ময়কর দ্রুততায় ক্ষিপ্রতায় ঘোড়া থেকে নেমে এসে মাথা নত করে হুমায়ুনকে অভিবাদন জানায়।

সুলতান, আহমেদ খান শুরু করে, এর নাম ওয়াসিম পাঠান। আমাদের গুপ্তদূতদের একজন তার গ্রামে গেলে এখানে আসবার জন্য সে অনুরোধ করেছিল। সে দাবী করে সে, কনৌজের যুদ্ধের আগে পুরো সেনাবাহিনীর সামনে আপনার পুরস্কৃত করা তিনজন সৈন্যের, একজন। শেরশাহের আগুয়ান বাহিনীর সাথে এক খণ্ডযুদ্ধে তাঁর ডানহাত কনুইয়ের থেকে কাটা পড়ে এবং দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে দেশে ফিরে যাবার সময় আপনি তাঁকে এক ব্যাগ মোহর দান করেন। সে তার বক্তব্যে স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে এটা দেখিয়েছে। আহমেদ খান একটা ধুসর হয়ে যাওয়া লাল মখমলের ব্যাগ বের করে, যার উপরে মোগল সম্রাটের প্রতীক নক্সা করা রয়েছে।

ওয়াসিম পাঠান আপনাকে এবং সেই ঘটনার কথা দুটোই আমার ভালো করে মনে আছে। আপনার সাথে আবার দেখা হওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ এবং মাঝের। বছরগুলো আপনি ভালোই ছিলেন বোঝা যাচ্ছে।

সুলতান, আহমেদ খানকে আমি বলেছি আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণের একটা সামান্য অংশ আমি পরিশোধ করতে চাই। বিগত বছরগুলোতে, আমি এখান থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে চলাচলের মূল পথের পাশে একটা উপত্যকায় অবস্থিত আমার ছোট্ট গ্রামের মোড়লে পরিণত হয়েছি। আপনি আপনার চারপাশে যে পাহাড়ী এলাকা দেখছেন আমি এখানেই জন্ম নিয়েছি এবং বড় হয়েছি আর এখানের সব পথঘাট আমার নখদর্পণে। আমার গ্রামের পেছন থেকে নুড়ি পাথরে পূর্ণ একটা ঢাল উপরের দিকে উঠে গিয়েছে এবং তারপরে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা পাথরের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গিয়ে উপত্যকার এই প্রধান চলাচলের রাস্তা, যেখান দিয়ে আপনার বিশ্বাসঘাতক সৎ-ভাইকে অবশ্যই যেতে হবে, তাঁর উপরে একটা অবস্থানে গিয়ে শেষ হয়েছে। আপনি এই উচ্চতা থেকে তাঁকে অতর্কিত আক্রমণ করতে পারবেন, গুলিবর্ষণ করে তার লোকদের ধরাশায়ী করতে পারবেন এবং তাঁকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারবেন।

হুমায়ুনের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে ওয়াসিম পাঠান সত্যি কথাই বলছে। আজ রাতে তোমার গ্রামের কাছে আমরা যাত্রাবিরতি করবো এবং আগামীকাল খুব ভোরে তোমার প্রস্তাবিত পথের সম্ভাব্যতা যাচাই করবো। অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসার আগেই আমরা যদি শিবির স্থাপন করতে চাই তাহলে আমাদের এখন। অবশ্যই দ্রুত অগ্রসর হতে হবে।

*

ওয়াসিম পাঠান হুমায়ুনকে অনুরোধ করে তার ছোট জানালাবিহীন সমতল-ছাদযুক্ত মাটির বাসাটা, যাঁর ছাদে একটা ছিদ্রের সাহায্যে ধোঁয়া নির্গমনের ব্যবস্থা করে আগুন জ্বালাবার জন্য কেন্দ্রীয় উনানের বন্দোবস্ত রয়েছে, তাঁর অস্থায়ী সদর দপ্তর হিসাবে ব্যবহার করতে। নিজের বুড়ো যোদ্ধাকে সম্মান দেখাতে হুমায়ুন তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি দেয়, যদিও রাতটা সে জওহরের সতর্ক দৃষ্টির সামনে ওয়াসিম পাঠানের বাড়ির সীমানার নীচু দেয়ালের মধ্যে স্থাপিত নিজের চিরাচরিত তাবুতেই ঘুমায়। পরদিন ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার সামান্য আগে, আহমেদ খান তাঁর কিছু লোক নিয়ে তাদের মতো একটা সৈন্যবাহিনীর জন্য ওয়াসিম পাঠানের প্রস্ত বিত পথের প্রায়োগিক সম্ভাবনা যাচাই করতে রওয়ানা দেয়। এখন সূর্য সরাসরি মাথার উপরে পৌঁছাবার কিছুক্ষণের ভিতরেই, হুমায়ুন কাছের পাহাড়ের ধুসর নুড়িপাথরে পূর্ণ ঢাল বেয়ে তাঁদের ঘোড়াগুলোকে এঁকেবেঁকে পথ করে নিয়ে নীচের দিকে নেমে আসতে দেখে।

সুলতান, পৌনে একঘন্টা পরে আহমেদ খান যখন দিনের বিবরণী, ওয়াসিম পাঠানের আড়ম্বরহীন বাসায় আগুনের চারপাশে বসে থাকা হুমায়ুন আর তার সামরিক আধিকারিকদের সামনে পেশ করার সময়, ঝড়ো বাতাসের কারণে ছাদের ছিদ্র দিয়ে ধোঁয়া ফিরতি পথে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করায় মাঝে মাঝে কাশতে থাকে, ওয়াসিম পাঠান আমাদের যে রাস্তাটা দেখিয়েছে সেটা দিয়ে আসলেই অস্ত্রধারী লোকদের পক্ষে উপরে যাওয়া সম্ভব, যদিও এই পথ দিয়ে পুরো বাহিনীকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। রাস্তাটা এমন একটা অবস্থানে গিয়ে শেষ হয়েছে যেখান থেকে নীচের উপত্যকা দেখা যায়, ঠিক যেখানে সেটা সংকীর্ণ হয়ে এসে একটা গিরিকন্দরে পরিণত হয়েছে। আপনার সৎ-ভাইয়ের লোকদের অতর্কিত আক্রমণের জন্য স্থানটা একেবারে আর্দশ।

কামরানের বাহিনীকে আমাদের গুপ্তদূতরা যারা অনুসরণ করছিলো তারা তাঁর অগ্রসর হবার কি বিবরণ দিয়েছে?

আগামীকালের পরের দিন দুপুরবেলা অতর্কিত আক্রমণের জন্য নির্ধারিত স্থানের নীচে দিয়ে তাঁদের অতিক্রম করার কথা।

তাহলে, সবধরনের বিতর্কের সমাপ্তি টেনে দিয়ে হুমায়ুন বলে, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। আমরা আমাদের ছয়শ সেরা যোদ্ধাকে, যাদের ভিতরে আমাদের বেশীরভাগ গাদাবন্দুকধারী তবকিরা থাকবে, অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থানে পাঠাব। জাহিদ বেগ সৈন্য নির্বাচনের দায়িত্ব আপনার। তাদের বলে দেবেন নিজেদের অস্ত্র ছাড়াও কম্বল আর পশুর চামড়া সাথে নেয়, উপরে আমরা যে রাত অতিবাহিত করবো সেসময় নিজেদের উষ্ণ রাখতে আর সেই সাথে দুইদিনের জন্য পর্যাপ্ত পানি আর শুকনো খাবার। আমাদের অবস্থান যাতে কোনোমতে প্রকাশ না পায় সেজন্য আমরা উষ্ণতার জন্য কিংবা রান্নার জন্য আগুন জ্বালাবো না। বৈরাম খান আমাদের বাকি লোকেরা এখানে আপনার নেতৃত্বে অবস্থান করবে, কামরানের লোকদের ভিতরে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়ে মূল সড়ক দিয়ে কাবুলের পথে উত্তরে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করবে তাদের জন্য রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

পরের দিন সকালবেলা, পরিষ্কার নীল আকাশের নীচে এবং একপাশে নিজের কষ্টসহিষ্ণু টাটুঘোড়ায় উপবিষ্ট ওয়াসিম পাঠান আর অন্যপাশে নিজের চিরাচরিত খয়েরী রঙের ঘোটকীতে উপবিষ্ট আহমেদ খানকে নিয়ে হুমায়ুন ওয়াসিম পাঠানের ছোট গ্রাম ছেড়ে কাছের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া নুড়িপাথরেপূর্ণ ঢাল অনুসরণ করে। এক ঘন্টা পরে, সে আর সৈন্যসারির প্রথমাংশ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরে পূর্ণ এলাকায় এসে পৌঁছে এবং ধীরে ধীরে আর একসারিতে বিন্যস্ত হয়ে পাথরের ভিতর দিয়ে আর গিরিখাতে তুষারপাতের ফলে সংগৃহিত জমাট বরফের ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে আরো উপরে উঠতে থাকে। আরো দেড়ঘন্টা অতিবাহিত হবার পরে, ওয়াসিম পাঠান প্রায় আধ মাইল দূরে পর্বতশীর্ষের একটা সরু দীর্ঘ উচ্চভূমিরেখার দিকে ইঙ্গিত করে। সুলতান, ঐ উঁচু এলাকার অপর পাশেই প্রধান সড়ক অবস্থিত যা কাবুল থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে- ঐ পথ দিয়েই আপনার ভাই আসবে।

হুমায়ুন আর আহমেদ খান ওয়াসিম পাঠানকে অনুসরণ করে যে নিজের অবশিষ্ট হাতটা দিয়েই নিজের ঘোড়াটাকে আরও পাথর এবং বোল্ডারের ভিতর দিয়ে উঁচুভূমির শীর্ষভাগের দিকে এগিয়ে যায়। শীর্ষভাগে উপস্থিত হলে, জায়গাটা তখনও পুরু বরফের আবরণে ঢাকা, হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে নীচের রাস্তার উপরে সেটা একটা ভীষণ সুবিধাজনক অবস্থানের সৃষ্টি করেছে এবং কাবুলের দিকে অগ্রসরমান কোনো অসন্দিগ্ধ বাহিনী লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের জন্য তকিদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে নীচের পাথরের ফাটল একেবারে যথার্থ।

হুমায়ুন আক্রমণ পরিকল্পনা বলতে শুরু করে। কামরান আর তার বাহিনী আমাদের প্রত্যাশার পূর্বেই উপস্থিত হলে কোনো ধরনের জটিলতা পরিহারের উদ্দেশ্যে তবকিরা এইসব পাথরের ফাটলেই নিজেদের আহার আর নিদ্রার ব্যবস্থা করবে। আহমেদ খান অবিলম্বে তাদের নিজেদের অস্ত্র, বিছানা আর রসদ নিয়ে অবস্থান গ্রহণের আদেশ দেন। কিন্তু ওয়াসিম পাঠান আমরা বাকিরা কি করবো? আশেপাশে কি কোনো সমতল এলাকা রয়েছে- যেখানে উচ্চভূমি বরাবর আরো অগ্রসর হয়ে পর্যবেক্ষনের পূর্বে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করতে পারি? আমাদের এমন একটা স্থান খুঁজে বের করতে হবে যেখান থেকে আমরা কামরানের বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারি, যাতে তাঁরা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আমাদের তবকিদের গুলির কবলে পড়বে।

হ্যাঁ, সুলতান আছে। এখান থেকে আরো পৌনে একমাইল দূরে উচ্চভূমির পাশে বায়ুপ্রবাহের বিপরীত দিকে একটা সমতল এলাকা রয়েছে, যেখানে আমরা অস্থায়ী শিবির স্থাপন করতে পারবো। আমি সেখান থেকে পথ দেখিয়ে আপনাকে নীচের দিকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে আলগা পাথরে ভর্তি ঢাল অনেক সহনীয় ভঙ্গিতে নিচের চলাচলের পথের দিকে নেমে গিয়েছে এবং এই পথটা দিয়ে কোনো দক্ষ অশ্বারোহীর পক্ষে এঁকেবেঁকে না নেমে সরাসরি ধেয়ে নেমে এসে আক্রমণ করা সম্ভব।

পরের দিন সকাল হবার একঘন্টা আগে তীব্র শীতের ভিতরে যখন হুমায়ুন দুহাত দিয়ে নিজের পাজরের দুপাশে চাপড় মারছে নিজেকে উষ্ণ রাখতে এবং সামনের দীর্ঘদিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে, আহমেদ খান তাঁকে এসে জানায় যে তবকিদের একজন যে নীচের রাস্তা দেখা যায় এমন একটা বিশেষ উন্মুক্ত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেছিল রাতেরবেলা শীতের তীব্রতায় মারা গিয়েছে। আহাম্মকটার মরাই উচিত, আহমেদ খানের নির্দয় ব্যাখ্যা। ব্যাটা পানির বদলে সুরা নিয়ে গিয়েছিল আর পর্যাপ্ত কম্বল নিতেও তার মনে ছিল না।

অন্য তবকিরা সজাগ আর সতর্ক রয়েছে?

হ্যাঁ, সুলতান।

তারা কি নিজেদের অস্ত্র পরীক্ষা করে অবস্থান গ্রহণ করেছে?

সেটাও করেছে, সুলতান।

দারুণ। বাকি লোকদের এখন ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত হতে বল। ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমি গতকাল ওয়াসিম পাঠানের সাথে যে পথটার সম্ভাব্যতা যাচাই করে এসেছিলাম সেই পথে যাত্রা করবো, যা কামরানের বাহিনীর পেছনের দিকে আক্রমণ করার জন্য সত্যিই একটা আদর্শ সূচনা বিন্দু। পথটা সংকীর্ণ এবং বরফাবৃত আর কয়েক স্থানে খাড়াভাবে নেমে গিয়েছে। আমার লোকদের বলবেন সতর্ক থাকতে, বিশেষ করে বাতাসের বেগ এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন, উত্তরদিক থেকে প্রবাহিত হিম শীতল বাতাসের কারণে তার মুখ পশমের গলবস্ত্র দিয়ে ভালোমতো আবৃত থাকা সত্ত্বেও তাঁর নাকের অগ্রভাগ অসাড় হয়ে উঠেছে, তাদের যাত্রা পথের সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটা মাত্র অতিক্রম করেছে, যা দুই ফিটেরও কম চওড়া আর দুপাশেই খাড়া ঢাল নীচের দিকে নেমে গিয়েছে, এমন সময় পেছন থেকে সে একটা আর্তনাদ শুনতে পায়, সেইসাথে একটা ভোঁতা শব্দ এবং তারপরে নীচ থেকে দ্বিতীয় আরেকটা ভারী পতনের শব্দ ভেসে আসে। সে তার ঘোড়ার পর্যাণের উপরে ঘুরে তাকিয়ে দেখে তাকে অনুসরণরত এক অশ্বারোহী উচ্চভূমির সংকীর্ণ অংশ থেকে ঘোড়াসহ নীচে পড়ে গিয়েছে, সম্ভবত ক্রমশ জোরাল হতে থাকা ভারী দমকা বাতাসের তোড়ে পড়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। হতভাগ্য লোকটার ভেড়ার চামড়ার আলখাল্লা পরিহিত দেহটা মাত্র ত্রিশ ফিট নীচে একটা সরু পাথরের তাকের উপরে চার হাতপা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে কিন্তু তার ঘোড়াটা আরো নীচে পাহাড়ের তীক্ষ্ণ অভিক্ষিপ্ত পাথুরে অংশে আছড়ে পড়েছে যা প্রাণীটার দেহ ছিন্নভিন্ন করে নাড়ীভুড়ি বের করে ফেলেছে।

হুমায়ুনের চোখের সামনেই আরেকজন আরোহী এবং তাঁর ঘোড়া পথের উপর থেকে উল্টে গিয়ে নীচের ধুসর তীক্ষ্ণ অভিক্ষিপ্ত অংশে আছড়ে পড়ে। হুমায়ুন দেরী না করে কণ্ঠস্বরে জরুরীভাব ফুটিয়ে তুলে আদেশ দিতে আরম্ভ করে। আমার কথা পেছনে পৌঁছে দাও। কোনো লোকের যদি নিজের উপর কিংবা তার ঘোড়া সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় তাহলে সে যেন ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে এবং ঘোড়াকে নিয়ে পায়ে হেঁটে সবচেয়ে সংকীর্ণ আর ফাঁকা অংশটা অতিক্রম করে। এর ভিতরে লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই।

এই আদেশের পরে, আর কোনো অসুবিধা হয় না, হুমায়ুনের বাকী লোকেরা নিরাপদে জায়গাটা অতিক্রম করে কেবল একজনের তামাটে বর্ণের ঘোড়া বরফের উপরে হোঁচট খায়, যখন সে লাগাম ধরে প্রাণীটাকে জায়গাটা পার করছিল। বিশাল প্রাণীটা শীতল বাতাসে পাগলের মতো চারপায়ের খুর আন্দোলিত করতে করতে আছড়ে পড়ার সময়, নিজের আরোহীকেও কালো দাড়িঅলা, ছোটখাট চেহারার এক বাদখশানি যোদ্ধা- পতনের শূন্যতায় টেনে নেয়, হতভাগ্য লোকটা মরীয়া হয়ে ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকায় সময়মতো হাতের লাগাম ছেড়ে দেয়ার আগেই সে নিজেও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং পথের জীবন থেকে মৃত্যুতে ঝাঁপ দেয়।

আধঘন্টা পরে, হুমায়ুন আর তাঁর লোকেরা নিজেদের এবং তাঁদের ঘোড়াগুলোকে সবুজাভ-ধুসর নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালের শীর্ষদেশে এলোমেলো পাথরের মাঝে তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখে, যেখান থেকে তারা কামরানের লোকদের অতর্কিতে আক্রমণ করার আশা করে। হুমায়ুন জানে তাদের বেশ কয়েক ঘন্টা এখানে অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর কাছে গুপ্তচরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী কামরানের লোকজন দুপুর দুইটা কি তিনটার আগে এই এলাকা দিয়ে অতিক্রম করবে না। সন্ধ্যা নামার ঠিক আগ মুহূর্তে জয় পরাজয় নির্ধারণী কোনো যুদ্ধের জন্য তারা খুব অল্প সময়ই পাবে।

বস্তুতপক্ষে ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘর অতিক্রম করার আরো কিছুক্ষণ পরে হুমায়ুন নিজে যখন মনোসংযোগের জন্য চোখ কুঁচকে একটা অতিকায় পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয় তখনই সে কামরানের অগ্রবর্তী বাহিনীর প্রথম দলকে নীচের রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের সাথে মনে হয় না যে কোনো প্রহরী বা গুপ্তদূতের দল রয়েছে এবং কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক সারিবদ্ধ বিন্যাসও তারা বজায় রাখার চেষ্টা করে না। স্পষ্টতই, অতর্কিত কোনো আক্রমণের ব্যাপারে তারা একেবারেই অসন্দিগ্ধ রয়েছে। হুমায়ুন ইঙ্গিতে আহমেদ খানকে কাছে আসতে বলে। আমি সংকেত না দেয়া পর্যন্ত আমার লোকেরা যেন আক্রমণ না করে- এই বার্তাটা সবার কাছে পৌঁছে দাও। তাঁদের পশ্চাদভাগে আমরা আক্রমণ করতে সক্ষম হবার আগে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ তাঁদের যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য সামনে এগিয়ে না যায়। আমরা যখন আক্রমণে যাব, সেটা যেন দ্রুত আর তীব্র হয়, কামরানকে নিজের লোকদের একত্রিত করার কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না।

কামরানের লোকদের অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হবার সুযোগ দিতে হুমায়ুন সম্ভবত মিনিট পনের অপেক্ষা করে, তারা গল্পগুজর আর হাসিঠাট্টা করতে করতে এগিয়ে যায়। ওঁত পেতে থাকার সময়ে হুমায়ুনের একবার মনে হয় সে সৈন্যসারির কেন্দ্রভাগে একটা বিশাল খয়েরী রঙের ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তাঁর সৎ-ভাইকে দেখেছে কিন্তু দূরত্ব বেশী হবার কারণে সে নিশ্চিত হতে পারে না। বাহিনীটার পশ্চাদ্ৰক্ষীরা এবং সৈন্যবাহিনীর পিছিয়ে পড়া অনুসরণকারীরা যখন তাঁর লুকিয়ে থাকা স্থানের নীচে দিয়ে অতিক্রম করতে শুরু করে, সে তার লোকদের ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত হতে আদেশ দেয়। তার আদেশ সাথে সাথে পালিত হয় এবং দস্তানা পরিহিত হাতের এক ঝটকায় সে তার চারশ অশ্বারোহীর মাঝে গতির সঞ্চার করে। পুরো দলটা ঢেউয়ের একটা ঝাপটার মতো নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালের উপর দিয়ে নীচের দিকে ধেয়ে যায়।

আশেপাশের অন্য এলাকা থেকে কম দুরারোহ হওয়া সত্ত্বেও, নীচের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাটা বেশ ঢালু এবং হুমায়ুন নীচের দিকে নামার সময় তার পর্যাণের উপরে পিছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঘোড়াটাকে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করার ফাঁকে সে দেখে তার লোকদের একজনের ঘোড়ার পা পিছলায় এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছাড় খায়, পিঠের আরোহী তাঁর গলার উপর দিয়ে ছিটকে যায় এবং মসৃণ আলগা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে গড়াতে থাকে। অবশ্য, হুমায়ুন আর তাঁর আক্রমণকারীবাহিনী প্রায় একই সময়ে কামরানের বাহিনীর পশ্চাক্ষীদের মাঝে পৌঁছে গিয়ে, আঘাত হানতে আর বেপরোয়া তরবারি ঘোরাতে আরম্ভ করে। আক্রমণের প্রথমক্ষণেই, হুমায়ুন কালো পাগড়ি পরিহিত এক যোদ্ধাকে তাঁর পর্যাণ থেকে ছিটকে নীচে ফেলে দেয়, বেচারা তখনও ভেড়ার চামড়ার নীচে থাকা ময়ানের ভিতর থেকে তরবারি বের করতে প্রাণপনে চেষ্টা করছে। সে আরেকজনের উরুতে আঘাত করে অস্ত্রধারণের পূর্বে এই লোকও আহত হয় এবং তৃতীয় আরেকজনের বাহুর গভীরে তরবারির ফলা বসিয়ে দেয়।

কামরানের অশ্বারোহীদের দেখে মনে হয় তারা এই আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সবচেয়ে পেছনের অশ্বারোহীরা সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাঁদের আক্রমণকারীদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করতে গেলে, সামনে তাঁদের সহযোদ্ধাদের উপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা তাঁদের নিজেদের ঘোড়াগুলোকে আকঙ্কিত করে তুলে এবং কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই উপত্যকার রাস্তা ধরে ঘোড়াগুলো প্রাণপনে দৌড়াতে শুরু করে। হুমায়ুন অচিরেই পাহাড়ের গায়ে উঁচুতে বড় বড় পাথরের আড়ালে যেখানে তার তবকিরা লুকিয়ে রয়েছে, সেখান থেকে গাদাবন্দুকের প্রথম গুলির শব্দ ভেসে আসতে শুনে। রণক্ষেত্রের ধূলো আর চাপানউতোরের ভিতরে হুমায়ুন তাঁর নিজের অবস্থান থেকে, গুলির প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করতে পারে না কিন্তু সে নিজের চারপাশে বিভ্রান্তি আর বিস্ময়কে অচিরেই চরম ভয় আর আতঙ্কে রূপান্তরিত হতে দেখে।

কামরানের যোদ্ধাদের অনেকেই দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাবার এবং বন্দুকের গুলির নিশানা থেকে বাঁচার অভিপ্রায়ে চেষ্টা করে নিজেদের ঘোড়াগুলোকে পেছনের দুইপায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে ঘুরিয়ে নিতে এবং পেছনে অবস্থিত আক্রমণকারীদের ভিতর দিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে বাধ্য করতে। তাদের কারো প্রয়াস সফল হয় না; তাঁদের প্রত্যেকেই হয় মৃত্যুবরণ করে কিংবা ঘোড়া থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে। অন্যরা চেষ্টা করে নুড়িপাথরেপূর্ণ খাড়া ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠতে। হুমায়ুন পেছন থেকে তাদের অনেককেই ঘোড়া থেকে ছিটকে মাটিতে পড়তে দেখে, খুব সম্ভবত তার তবকিরা তাদের গুলি করে ঘায়েল করেছে। মাত্র বিশ মিনিটের ভিতরে, কামরানের জোড়াতালি দেয়া সেনাবাহিনীর একাত্তবোধ আর নিয়মানুবর্তিতা উবে যেতে শুরু করে। স্থানে স্থানে তাঁর প্রাণ ভয়ে ভীত, আর জান বাঁচাতে বেপরোয়া লোকেরা নিজেদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে এবং আত্মসমর্পনের প্রতীক হিসাবে দুহাত মাথা উপরে তুলে রেখে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায়।

হুমায়ুন নিজের কিছু সৈন্যকে তাঁর চারপাশে জড়ো করে, সে তার কালো ঘোড়াটাকে কামরানের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া বাহিনীর ভিতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায় তার সৎ-ভাইয়ের খোঁজে, সে এগিয়ে যাবার সময়ে ডানে বামে কোনো বাছবিচার না করে তরবারি চালায়। একবার হুমায়ুনের মনে হয়, সে তাঁকে তাঁর খয়েরী ঘোড়ায় উপবিষ্ট দেখতে পেয়েছে কিন্তু সে মরীয়া হয়ে কাছাকাছি যাবার পরে বুঝতে পারে ঘোড়াটার আরোহী এক তরুণ, সম্ভবত একজন পদস্থ যোদ্ধা যে পালাবার জন্য পাগলের মতো নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিতে থাকে কিন্তু সে তারপরেও তাঁর শিরস্ত্রাণবিহীন মাথা লক্ষ্য করে হুমায়ুনের তরবারির ক্রোধ এড়াতে পারে না এবং পাকা তরমুজের ন্যায় তার ছিন্নমস্তক মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

উত্তরদিক থেকে, যেখানে বৈরাম খানের নেতৃত্বে তাঁর মূল বাহিনীর অবরোধের আড়াল থেকে কামরানের পলায়নপর লোকদের মোকাবেলা করার কথা, চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলে বোঝা যায় যে সেখানেও লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটেছে। পাহাড়ের উপর থেকে নীচের জটলাবদ্ধ যোদ্ধাদের ভিতরে শত্রু এবং মিত্র ঠিকমতো সনাক্ত করতে না পেরে আর নিজেদের গাদাবন্দুকের ধোঁয়ায় নিজেরাই আপাতভাবে ঝাপসা দেখতে শুরু করলে হুমায়ুনের তবকিরা বন্দুক ফেলে দিয়ে ময়ান থেকে তরবারি বের করে মাথার উপরে আন্দোলিত করতে করতে নীচের এলোপাথাড়ি যুদ্ধের দিকে নুড়িপাথরের উপর দিয়ে পিছলে নামতে শুরু করে।

হুমায়ুন, এখনও নিজের সৎ-ভাইকে বন্দি করতেই বেশী আগ্রহী হওয়ায়, সে নিজের সাথে আরও ডজনখানেক যোদ্ধা নিয়ে সরে এসে সামনের অবরোধের দিকে এগিয়ে যায়। সে আধমাইলও যেতে পারেনি, সামনের অবরোধে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পেছনে তাঁদের দিকে পশ্চাদপসরণকারী কামরানের বিশজন যোদ্ধার একটা দল তাঁর সামনে এসে পড়ে। নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে হুমায়ুন গতি বৃদ্ধি করে। তার চারপাশে যারা ছিল তারাই একই কাজ করে। দুটো দল মুখোমুখি সংঘর্ষে মিলিত হয়। কামরানের একজন যোদ্ধা হুমায়ুনের মাথা লক্ষ্য করে তরবারি চালায় কিন্তু আঘাতটা তার শিরস্ত্রাণে লেগে পিছলে যায়। হুমায়ুনের তরবারির ফলাও একই সময়ে আক্রমণকারীর কনুইয়ের উপরে আঘাত হানে। কোনো ধরনের হামলার সম্মুখীন হবার জন্য প্রস্তুত না থাকায়, কামরানের অধিকাংশ যোদ্ধার পরণেই ইস্পাতের জালির তৈরী বর্ম নেই, ফলে হুমায়ুনের তরবারির ফলা গভীরে প্রবেশ করে, অস্থি দ্বিখণ্ডিত করে এবং হাতটা দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

দ্বিতীয় আরেক যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত ধারাল কস্তনী দিয়ে হুমায়ুনকে আঘাত করতে চেষ্টা করে। কস্তনীর শিকলের শেষপ্রান্তেযুক্ত গোলকের সাথে সংযুক্ত সুচালো কীলক তার মুখের সামনে বাতাস কেটে বের হয়ে যাবার সময় তাঁর নাকের অগ্রভাগে একটা আচড় কেটে যায়। তাঁর নাক অসাড় হয়ে পড়ে এবং সাথে সাথে রক্তে তাঁর মুখ আর কণ্ঠনালীর ভেতরের অংশ ভেসে যায়। সে, অবশ্য সাথে সাথে ঘোড়ার মুখ সবেগে ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁর আক্রমণকারীর পিছু ধাওয়া করলে সে তার হাতের কস্তনী তাকে লক্ষ্য করে আরো একবার সপাটে ঘোরায় কিন্তু এবার উদভ্রান্ত ভঙ্গিতে চালাবার কারণে হুমায়ুনের অনেকদূর দিয়ে সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হয়। হুমায়ুন লোকটাকে অতিক্রম করার সময়ে তাঁর ঘাড় বরাবর সপাটে তরবারি চালায়। আঘাতের প্রচণ্ডতায় আক্রমণকারীর শিরোস্ত্রাণ স্থানচ্যুত হয়ে, তরবারির গতি কিছুটা ব্যাহত হয় কিন্তু তারপরেও সেটা ঠিকই লোকটার ঘাড়ে আঘাত হেনে রক্তক্ষরণের জন্ম দেয়। লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকে যেতে সে তার ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারায় আর জন্তুটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে তাঁকে সবেগে মাটিতে আছড়ে ফেলে, সেখানে হতভাগ্য লোকটা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু অচিরেই তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয় এবং নিথর হয়ে সে মাটিতে পড়ে থাকে।

সুলতান, সাবধান, আপনার পেছনে! কামরানের আরেক যোদ্ধা মাথার উপরে নিজের বাঁকান তরবারি উঁচিয়ে ধরে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসতে, হুমায়ুন যথাসময়ে ঘুরে দাঁড়ায় তাঁকে মোকাবেলা করতে। হুমায়ুন এবার যান্ত্রিকভাবে এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে পাল্টা আঘাত হানে- তার আক্রমণকারীর ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে ভেসে গিয়ে তরবারির ফলা তার কুঁচকিতে আঘাত হানে। লোকটা নিমেষে ভূপাতিত হয়।

হুমায়ুন কাশতে কাশতে নোতা, ধাতব স্বাদযুক্ত রক্ত থুতুর সাথে মাটিতে ফেলতে ফেলতে চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে সে আর তার লোকেরা বিশজন আক্রমণকারীর ভিতরে আটজনকেই হত্যা করেছে এবং আরো লক্ষ্য করে, যারা তখনও বেঁচে রয়েছে তাদের যুদ্ধ করার শখ সহসাই উবে গিয়েছে এবং পালাবার পথ খুঁজছে। হুমায়ুন কিছুক্ষণের ভিতরেই আবার পাথুরে পথের চড়াই ভেঙে ঘোড়া ছোটাবার প্রয়াস নিতে গিয়ে প্রায় সাথে সাথে লক্ষ্য করে তার নিজস্ব পাঁচশত অশ্বারোহীর একটা বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বৈরাম খান তার দিকেই এগিয়ে আসছে, তার লাল নিশান গর্বিত ভঙ্গিতে বাতাসে উড়ছে।

বৈরাম খান তাঁর ফেনারমতো ঘামে ভেজা, নাক দিয়ে সজোরে শ্বাস ফেলতে থাকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, তাঁর মুখ বিজয়ের গর্বিত হাসিতে উদ্ভাসিত, সে বলে, কামরানের লোকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। হুমায়ুন তার চারপাশে ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে যে তার বিজয় হাসিল হয়েছে কিন্তু একে কি সত্যিকারের বিজয় বলা যাবে? সে তার সৎ-ভাইকে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছে। হিন্দুস্তান পুনরায় অধিকারের অভিপ্রায়ে তার বিশাল কর্মযজ্ঞ নিরাপদে শুরু করার আগে তাকে অবশ্যই এই কাজটা করতেই হবে।

রাতের অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসবার আগেই একটা বিষয় নিশ্চিত করবেন, আমার লোকেরা যেন কামরানের যত বেশী সংখ্যক লোককে ধাওয়া করে বন্দি করতে পারে। আমার চক্রান্তকারী সৎ-ভাইকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় আমার সামনে যে হাজির করতে পারবে তাঁকে স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ একটা থলে আমি উপহার দেব।

৪.৩ পিশাচের মঙ্গলসাধন

২৩. পিশাচের মঙ্গলসাধন

হুমায়ুন লাল আর সোনালী জরির কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে এবং সোনার পানি দিয়ে গিল্টি করা নীচু টেবিলের উপরে স্তূপীকৃত রূপার বাসনপত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, যেখানে সজ্জিত খাবার দিয়ে সে আর হামিদা কিছুক্ষণ আগেই মধ্যাহ্নভোজন সমাপ্ত করেছে। হুমায়ুনের পছন্দ দই আর মসলা দিয়ে তন্দুরে- মাটির উনুন যা মোগল রসুইখানার আবশ্যিক অনুষঙ্গ এবং তাঁরা যেকোনো অভিযানে রওয়ানা হবার সময় এটা সঙ্গে নিতে ভুলে না- অল্প আঁচে ঝলসানো মুরগীর মাংস। হামিদা কমলা দিয়ে তৈরী আঠাল মিষ্টান্ন এক কামড় খেয়ে খুঁতখুঁতে ভঙ্গিতে তামার তৈরী একটা ছোট কারুকাজ করা পাত্রে রক্ষিত গোলাপজলে নিজের আঙ্গুল পরিষ্কার করছে দেখে সে হামিদার দিকে তাকিয়ে হাসে। হামিদাও তাঁর দিকে হেসে তাকায়। হুমায়ুন হামিদার পেছনে বুদ্বুদ উঠতে থাকা মার্বেলের তৈরী একটা ছোট প্রসবণের উপরে জানালা দিয়ে আপতিত সূর্যরশ্মির দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে তার নিজেকে সন্তুষ্ট মনে হয়।

সে হামিদার দিকে তাকিয়ে আবার হাসে এবং তার ঠোঁটের বিভঙ্গ আর চোখের দ্যুতি দেখে বুঝতে পারে যে মেয়েটা জানে সে আহার পরবর্তী ভালোবাসার-পর্ব নিয়ে চিন্তা করছে এবং বিষয়টাকে সে স্বাগতই জানাবে। হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে হামিদাকে নিজের কাছে টেনে আনবে এমন সময় হামিদার ব্যক্তিগত পরিচারিকা জয়নব বেরসিকের মতো ভেতরে প্রবেশ করে। জয়নব কিছু বলার আগেই, হুমায়ুন তার উদ্বিগ্ন মুখাবয়ব দেখে বুঝে নেয় যে অলস দুপুরবেলা সে যে উষ্ণ আর অলস রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করছিল সেটা আপাতত স্থগিত করতে হবে।

সুলতান, আহমেদ খান আপনার জরুরী উপস্থিতি কামনা করেছেন তারা আপনার সৎ-ভাই কামরানকে বন্দি করেছে। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে জয়নবের কথার মাঝেই হামিদার মুখাবয়ব থেকে রমণ ইচ্ছুক প্রেয়সীর অভিব্যক্তি মুছে গিয়ে সেখানে বিজয়োন্মত্ত, প্রতিশোধ পরায়ন এক মায়ের ক্রুদ্ধ রূপ ফুটে উঠেছে। হামিদা তার একমাত্র ছেলের সাথে কামরানের আচরণের কারণে তাঁকে কখনও ক্ষমা করেনি- ভুলে যাবার প্রশ্নই উঠে না। আর কামরানকে হুমায়ুন এতোবার জীবন বখশ দিয়েছে বলে সে বহুবার তাকে তিরস্কার করেছে। সে প্রায়ই তার প্রিয় ফার্সী কবির কয়েকটা পংক্তি উদ্ধৃতি করে তাঁকে শোনায়: বন্ধ্যা মাটিতে কখনও মিষ্টগন্ধ ফুল ফোটে না তাই বৃথা আশায় বীজ নষ্ট করো না। পিশাচের সাথে ভালো আচরণ ভালো লোকের সাথে পৈশাচিক আচরণের ন্যায় গর্হিত।

হুমায়ুন কোনো মন্তব্য করার পূর্বেই, হামিদা চিৎকার করে উঠে, তাকে বন্দি করার জন্য আল্লাহতালাকে শুকরিয়া জানাই। আমি আশা করি এবার আর ক্ষমা করার মতো বাতুলতা আপনি প্রদর্শন করবেন না। তাঁকে তাঁর প্রাপ্যের চেয়েও বেশী সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং প্রতিবারই সে তাঁকে দেয়া সংশোধনের সুযোগ অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করেছে। আপনার প্রতি তাঁর ক্ষোভের শেকড় এতো গভীরে প্রোথিত যে সে কখনও তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসবে না। দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন না। আমার খাতিরে না হোক, আমাদের সন্তানের খাতিরে যার জীবন নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছিল তাকে এই মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড দিন।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর আব্বাজানের তরবারি আলমগীর নেয়ার জন্য ক্ষণিকের তরে হাঁটবার গতি মন্থর করে, তারপরে কক্ষ ত্যাগ করে। হামিদার কথায় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত ক্ষোভের খানিকটা হলেও সে নিজের ভিতরে পূঞ্জীভূত হচ্ছে টের পায়। পরমানন্দদায়ক স্বস্তির একটা অনুভূতি এই ক্ষোভের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- যে অবশেষে হিন্দুস্তানের উপরে ইসলাম শাহের নিয়ন্ত্রণের প্রাবল্য পরীক্ষা করার জন্য সিন্ধু নদের অপর তীরে সে যে অনুসন্ধানী অভিযানের পরিকল্পনা করেছে, সেটা কার্যে পরিণত করার সময় পশ্চাদে কামরানের হুমকি নিয়ে তাঁকে আট দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

জেনানাদের আবাসন কক্ষে প্রবেশ পথে অবস্থিত রূপার আস্তরণযুক্ত পাল্লার ভিতর দিয়ে হুমায়ুন যখন বাইরের সূর্যালোকিত প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয় আহমেদ খান ইতিমধ্যে সেখানে তার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আহমেদ খান, আপনি তাকে কোথা থেকে বন্দি করেছেন এবং কিভাবে?

দুইদিন পূর্বে কামরানকে তাঁর শেষ বিদ্রোহের সময় সমর্থন করেছিল এমন একজন পাতি গোত্রপতিকে আমরা বন্দি করতে সক্ষম হই। আমরা তাঁকে বন্দি অবস্থায় দূর্গপ্রাসাদে নিয়ে এসে ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে আটকে রাখি। আজ খুব সকালে সে আমার সাথে দেখা করতে চায় এবং নিজের কৃতকর্মের শাস্তি লাঘব করার অভিপ্রায়ে সে আকার ইঙ্গিতে বলে, যে সে জানে কামরানকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে। আমি তাঁকে জানাই যে সুলতানের সাথে আলোচনা না করে তার সাথে কোনো ধরনের চুক্তি করতে পারবো না, কিন্তু নিজের ভালো চাইলে তার উচিত হবে। অনর্থক কালক্ষেপন না করে- সে যা জানে সবকিছু আমাকে খুলে বলা। সে একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে যে কামরানকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তবে আপনিও অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করবেন না। সে তখন বলে, তার বিশ্বাস যে কামরান কাবুল শহরের যেখানে দরিদ্র লোকেরা বাস করে- ট্যানারীর আশেপাশের এলাকা। সেখানে লুকিয়ে রয়েছে। আমি যখন তাঁকে চাপ দেই সে স্বীকার করে যে তার তথ্যটা কমপক্ষে এক সপ্তাহের পুরান এবং তাঁর তথ্যদাতা, কামরানের সামরিক শিবির অনুসরণকারী একটা ছিঁচকে চোর, স্বভাবতই তাঁর কথার উপরে খুব একটা ভরসা রাখা যায় না। আমি অবশ্য সাথে সাথে চিন্তা করে দেখি আমাদের শক্তিশালী একটা বাহিনীকে সেখানে পাঠিয়ে পুরো ট্যানারী এলাকা ঘিরে ফেলে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

সুলতান, আমি সেটা করেছিলাম বলে আমি দারুণ গর্বিত। আমাদের সৈন্যরা যখন এক চামারের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যাঁর পরিবার দক্ষিণ থেকে এসেছে, সেই চামারকে কেন যেন আতঙ্কিত মনে হয় এবং সে সৈন্যদের বাসায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়, দাবী করে যে তার শ্বাশুড়ি ভীষণ অসুস্থ গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছে। আমার সৈন্যরা তাকে ধাক্কা দিয়ে পথ থেকে সরিয়ে দেয় এবং স্তূপ করে রাখা চামড়া একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে, পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে তল্লাশি করে এবং তারা বর্শার ফলা এমনকি চামড়া পাকা করার জন্য তামার পাত্রে রাখা রং আর প্রশাবের ভিতরেও প্রবিষ্ট করায়। তারা কিছুই খুঁজে পায় না, কিন্তু তারা তারপরেও নিশ্চিত যে চামার লোকটা কিছু একটা বা কোনো লোককে গোপন করার চেষ্টা করছে, তারা শেষপর্যন্ত বাড়ির উপরের তলায় পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা অংশে প্রবেশ করে, যেখানে চামার লোকটা দাবী করেছে যে তার অসুস্থ শ্বাশুড়ি অবস্থান করছে। তারা সেখানে কয়েকটা নোংরা কম্বলের নীচে একটা দেহ চাপা দেয়া রয়েছে দেখতে পায়। তাঁরা কম্বল সরিয়ে নীচে বিশাল হাত আর পায়ের বিরাটাকৃতি একটা অবয়ব দেখতে পায় তাঁদের মনে হয়, অবয়বটা কোনো মেয়েমানুষের তুলনা বিশাল শিশুর মতো কুকড়ে শুয়ে রয়েছে। আমাদের তথাকথিত শ্বাশুড়ির পরণে মেয়েদের অপরিচ্ছন্ন পোষাক আর তার মুখটা আরব মেয়েদের মতো মোটা কালো হেজাব দিয়ে ঢাকা। তাঁকে শান্তিতে মরতে দেয়ার জন্য সে উচ্চকণ্ঠে সকরুণ আর্তি জানায়। তল্লাশি পরিচালনাকারী আধিকারিক অবশ্য এসব আর্তিতে কান না দিয়ে হেজাব তুলে দেখার জন্য এগিয়ে যায়। সে হেজাব তুলতে গেলে, অবয়বটা তাঁর পরণের মেয়েলী আলখাল্লার পুরু ভঁজের ভেতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং তার বাহুতে আঘাত করে। আধিকারিকের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সৈন্য দ্রুত মহিলার পোষাক পরিহিত লোকটাকে নিরস্ত্র করে এবং তার হেজাব না তুলেই তারা নিশ্চিত হয়ে যায় সে কোনো মহিলা না বরং কয়েকদিনের না কামান খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত আপনার সৎ-ভাই।

সে প্রথমে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে এবং চিৎকার করে বলে যে আপনি একজন অপদার্থ শাসক এবং সেই ন্যায়সঙ্গত সম্রাট; আরও বলে যে আমার লোকেরা একজন অকালকুষ্মণ্ডের মোসাহেব এবং তাদের উচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া এবং তাকে ছেড়ে দেয়া। অবশ্য, কিছুক্ষণ পরেই সে নিরব হয়ে যায়, মনে হয় ভাগ্যের উপরে সে নিজেকে সোপর্দ করেছে।

আমার সৎ-ভাই এখন কোথায় আছে?

সুলতান, দূর্গপ্রাসাদের নীচে ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে।

হুমায়ুন মানসপটে, কাবুলের দূর্গপ্রাকারের উপরে তিনবছরের আকবরকে যেন দেখতে পায় এবং পুনরায় নিজের সৎ-ভাইয়ের প্রতি একটা অদম্য ক্রোধ তাকে অন্ধ করে তুলে। আকবর কত সহজে মারা যেতে পারতো। কামরানের বিদ্রোহের ফলে কত লোক মারা গিয়েছে? সে রত্নখচিত ময়ান থেকে তার আলমগীর বের করে আনে।

আহমেদ খান, আমাকে কামরানের কাছে নিয়ে চলেন।

আহমেদ খান প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে দ্রুত পথ দেখিয়ে এগিয়ে যায়, একটা নীচু দরজার নীচে দিয়ে, যার উভয়পার্শ্বে প্রহরী মোতায়েন করা রয়েছে, প্রবেশ করে এবং খাড়া একপ্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে যা দূর্গপ্রাসাদের তলদেশে নেমে গিয়েছে। হুমায়ুন চোখ পিটপিট করে অভ্যন্তরের গলিপথের অন্ধকারে দৃষ্টি সইয়ে নিতে চেষ্টা করে, যেখানে কেবল একটা তেলের প্রদীপ একটা চোরকুঠরির ভিতরে জ্বলছে। তার দৃষ্টি কিছুটা পরিষ্কার হতে তাঁর মনে হয় একটা বিশাল উঁদুরকে সে দেয়াল বরাবর দৌড়ে যেতে দেখেছে। সে মনে মনে ভাবে, নিজের বিশ্বাসঘাতক ভাইকে বিদ্রোহের মহামারী দ্বারা অন্যদের আক্রান্ত করা থেকে সে অন্তত থামাতে পেরেছে এবং সে তার তরবারির হাতল আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তারা অবশ্য ইতিমধ্যে কামরানের কারাকক্ষের দরজার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে, আহমেদ খানের চারজন সৈন্য যেখানে পাহারা দিচ্ছে।

আমি একা ভিতরে প্রবেশ করতে চাই, হুমায়ুন গম্ভীর কণ্ঠে বলে। আমি একা অনুশোচনাহীন বিশ্বাসঘাতকের সাথে বোঝাঁপড়া করতে চাই। আমার হাতেই কেবল আমার পরিবারের রক্ত ঝরবে।

পুরু কাঠের দরজার উপরের আর নীচের ভারী লোহার ছিটকিনি একজন প্রহরী খুলে দেয়। হুমায়ুন মাথা নীচু করে কারাকুঠরির ভেতরে প্রবেশ করে এবং কামরান, ভেতরের খড় দেয়া মেঝের উপরে, স্যাঁতসেঁতে পাথরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে, পাঁচ বছরের বেশী সময় যাকে সে চোখে দেখেনি। ধরা পড়ার সময় তাঁর পরণে যা ছিল সেই খয়েরী মেয়েলি আলখাল্লা এখনও তার গায়ে রয়েছে। তাঁর পরণের কাপড়চোপড় শতছিন্ন এবং তার মাথার ভারী কালো হেজাবটা এখন পেছনে তুলে রাখায় তাকে বিদ্রোহী নয় বরং কেমন যেন হাস্যকর দেখায়।

কিছুক্ষণ পরে, কামরান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকান থেকে নিজেকে বিরত রাখে এবং সেই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করে কথা শুরু করে। আমি আমার প্রাণ বখশ দিতে তোমায় বলবো না। তাই মোটেই ভেবো না যে আমি তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে তোমার করুণা ভিক্ষা করবো। তোমার হাতে আমি আমাদের আব্বাজানের তরবারি দেখেছি। ওটা ব্যবহার কর। আমায় হত্যা কর। আমি যদি তোমার অবস্থানে থাকতাম তাহলে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতাম না… আমি কেবল একটা জিনিষ তোমার কাছে চাই… এবং কথা শেষ না করে এই প্রথমবার সে তাঁর সবুজ চোখের দৃষ্টি উঁচু করে আর প্রাসরি হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকায়। আমাদের আব্বাজানের পাশে আমাকে সমাধিস্থ করো।

হুমায়ুন পলকহীন চোখে পাল্টা তাকিয়ে থাকে। তুমি তাঁর স্মৃতিকে অসম্মান দেখাবার পরেও আমি কেন সেটা করবো? আমার কাছে তুমি যত প্রতিশ্রুতি করেছো সবগুলো ভাঙার পরেও, শান্তি আর মীমাংসার জন্য আমার সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরেও, এবং সবচেয়ে যেটা মারাত্মক আমার সন্তানের জীবন বিপদের মুখে ফেলার পরেও আমি কেন সেটা করতে যাব?

নিজেকে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি যা করতে পছন্দ করতে। কিন্তু আমার মৃতদেহ কোথায় শায়িত রয়েছে আমি কেবল সেটা নিয়ে চিন্তিত। ঝামেলাটা শেষ কর। আমার মতো, সবাই তোমায় যেমন দূর্বল ভাবে, প্রমাণ করো, তুমি মোটেই সেরকম নও। হুমায়ুনের মুখের কাছে কামরান নিজের মুখ নিয়ে আসে এবং তার চোখে পচা চর্বির মতো দুর্গন্ধযুক্ত একদলা কফ নিক্ষেপ করে।

কিন্তু হুমায়ুন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মৃত্যুশয্যায় বাবরের শেষ কথাগুলোর পেছনে নিহিত সত্যিকারের প্রাজ্ঞতা, নিজের ভাইদের কখনও কোনো ক্ষতি করবে না, তোমার যতই মনে হোক সেটা তাঁদের প্রাপ্য, এক নতুন মাত্রায় তাঁর সামনে প্রতিভাত হয়। হুমায়ুনের সাথে সাথে তার ভাইদেরও বাবর রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজের ভাইকে যদি সে হত্যা করে তাহলে কি সে শান্তিতে বাঁচতে পারবে? এই নোংরা প্রকোষ্ঠে তাঁকে হত্যা করার জন্য প্ররোচিত করে, কামরান- যে তাকে খুব ভালো করেই চেনে তার জন্য তার শেষ ফাঁদটা পেতেছে, নৈতিকতা বর্জন করে হুমায়ুন যেন নিজেকে তার স্তরে নামিয়ে আনার ধৃষ্টতা দেখায়, আর রাগের মাথায় প্রমাণ করে যে করুণা নয়, দূর্বলতাই তাঁর পূর্ববর্তী সব মীমাংসা প্রয়াসের পেছনে কাজ করেছে।

হুমায়ুন উদ্ধত তরবারিটা নামিয়ে নেয় এবং চোখের উপর থেকে কফের দলাটা মুছে ফেলে। মৃত্যুই তোমার প্রাপ্য তুমি সেটা নিজেই বুঝতে পেরেছে দেখে আমি খুশি হয়েছি কিন্তু আমি আমার পরামর্শদাতাদের সাথে আলোচনা করেই তোমার ভাগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। তোমায় যদি মৃত্যুদণ্ড দিতেই হয় হঠকারী প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে না সেটা ঠাণ্ডা মাথায় বিচার বিবেচনার পরেই দেয়া হবে। হুমায়ুন কক্ষ ত্যাগ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াবার সময়, তাঁর মনে হয় কামরানের ঠোঁটের কোণে সে যেন হাল্কা হাসির একটা ছটা দেখতে পেয়েছে। সে যা দেখেছে তাঁকে তাঁর দূর্বলতা ভেবে নিয়ে কি সে হাসছে, নাকি ভেবেছে যে এইবারের মতো সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে?

সে কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে কামরানের দিকে যখন তাকায়, তাঁর সৎ-ভাইয়ের দৃষ্টি তখন আবারও মাটির দিকে নিবদ্ধ, মুখাবয়ব ভাবলেশহীন।

*

হুমায়ুন তার সূর্যালোকিত দরবার কক্ষে সমবেত, তার পরামর্শদাতাদের মগ্ন দৃষ্টিতে অবেক্ষণ করে। তাঁর নিজের মেজাজ তিক্ত হয়ে রয়েছে। কামরানের ভাগ্য নিয়ে তাকে একটা সিদ্ধান্তে উপণীত হতে হবে। কালক্ষেপণ করাটা দূর্বলতা বলে প্রতিয়মান হবে। সে আলোচনা শুরু করতে তাঁর পরামর্শদাতাদেরও গম্ভীর দেখায়।

আমার সৎ-ভাইয়ের জীবন বখশ দেয়া হবে কি না সেটা আমার এক্তিয়ার কিন্তু তার আগে আমি আপনাদের মতামত জানতে আগ্রহী। আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করে নিঃসন্দেহে বহু লোকের প্রাণহানির জন্য সে দায়ী। তার বিরুদ্ধচারিতা আমার শক্তি খর্ব করেছে, হিন্দুস্তান পুনরায় দখলের নিমিত্তে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটিয়েছে, সেই সাথে আমার একমাত্র সন্তান আকবরকে বিপদের সম্মুখীন করেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সে আমার সৎ-ভাই, আমার আব্বাজানের সন্তান এবং তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী। আমি এই রক্তে আমার হাত তখনই রঞ্জিত করবো যখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হব যে আমার সামনে এটা ছাড়া আর কোনো পথ নেই এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে, আর আমার রাজত্ব ও এর জনগণের মঙ্গলার্থে তার মৃত্যু প্রয়োজন। আপনাদের মতামত আমি শুনতে আগ্রহী।

সুলতান, বৈরাম খান সামনে এগিয়ে আসে, তাঁর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার এবং স্পষ্ট, আমার মনে হয় এখানে উপস্থিত সবার পক্ষে আমি মতামত ব্যক্ত করতে পারি। এটা নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই আপনার স্বার্থে, আপনার সন্তান, আপনার সাম্রাজ্য আর আমাদের সবার স্বার্থে আপনার সৎ-ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। কামরান আপনার ভাই নয়, সে আপনার শত্রু। তার প্রতি আপনার ভ্রাতৃসুলভ অনুভূতি থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। একজন শাসকের সিদ্ধান্তের ভিতরে এসব অনুভূতির কোনো স্থান নেই। আপনি যদি সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকতে চান এবং আপনার আর আপনার সন্তানের জন্য হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারে আমাদের সবার সমবেত অভিলাষ হাসিল করতে চান, তাহলে কেবল একটাই করণীয় রয়েছে। তার প্রাণদণ্ড কার্যকর করেন। সাথীরা আমার, আমি কি ঠিক বলিনি?

দরবারে উপস্থিত সবাই সম্মিলিত কণ্ঠে এবং কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই উত্তর দেয়, হ্যাঁ!

অন্যকোন সমাধানের পক্ষে আপনাদের কারো কি কোনো সাফাই দেবার নেই, হুমায়ুন জানতে চায়।

না, সুলতান।

ধন্যবাদ। আপনাদের পরামর্শ আমি ভেবে দেখবো। হুমায়ুন আর একটা কথা না বলে দরবারকক্ষ ত্যাগ করে, তার ভ্রু কুচকে রয়েছে। তার পরামর্শদাতাদের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব সহজ কাজ না। তাদের কেউই তার মতো কামরানের রক্ত ধারণ করে না। সে কি করছে সেবিষয়ে সচেতনভাবে কোনো চিন্তা না করেই হুমায়ুন জেনানাদের কক্ষের দিকে হাঁটতে শুরু করে এবং সেখানে পৌঁছে সে সরাসরি গুলবদনের কামরায় যায়। তার সৎ-বোন বেগুনী রঙের একটা ঢোলা রেশমের আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে নীচু একটা গিল্টি করা কেদারায় বসে রয়েছে আর তাঁর পরিচারিকা হাতির দাঁতের তৈরী একটা চিরুণী দিয়ে তাঁর কালো চুল আচড়ে দিচ্ছে। গুলবদন হুমায়ুনের মুখের অভিব্যক্তি দেখা মাত্র পরিচারিকাকে বিদায় দেয়। কি ব্যাপার ভাইজান?

তুমি কি জানো তারা আবারও কামরানকে বন্দি করেছে এবং এই মুহূর্তে সে ভূগর্ভস্থ কারাকুঠরিতে বন্দি রয়েছে?

অবশ্যই জানি।

তার নিয়তির ব্যাপারে আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। আমি বুঝতে পারছি যে তার অসংখ্য অপকর্মের জন্য সাধারণ রীতিনীতি অনুযায়ী তার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য এবং আমার পরামর্শদাতারা একবাক্যে রায় দিয়েছে যে এইবার তাকে মরতেই হবে। তাকে পুনরায় আমার কজার ভিতরে পাবার ক্ষণটা আমি প্রায়শই যখন কল্পনা করতাম আকবরের প্রতি তাঁর দুর্ব্যবহারের কারণেই কেবল আমার মনে হত নিজ হাতে তাঁকে হত্যা করি, এবং হামিদা- আকবরের মা হিসাবে- এটা করতে আমাকে মিনতি করতো। অবশ্য, আমার ক্রোধ প্রশমিত হলে আমি বুঝতে পারি রাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমার ঠিক হবে না, আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য কোনটা উত্তম হবে সিদ্ধান্ত নেবার সময় সেটাও মাথায় রাখতে হবে। ভাইদের কোনো ক্ষতি না করার জন্য আব্বাজানের নিষেধের কথা আমার স্মরণ আছে আর তাই সিদ্ধান্ত নিতে আমি ইতস্তত করছি।

আপনার বিড়ম্বনা আমি বুঝতে পারছি, হুমায়ুনের হাত ধরে কোমল কণ্ঠে গুলবদন বলে। আপনি কখনও কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করেননি। মনে আছে আপনার অমার্তদের বিরক্তি সত্ত্বেও ভিস্তিঅলা নিজামকে দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি, যে আপনার সিংহাসনে সে এক কি দুই ঘন্টার জন্য অধিষ্ঠিত হবে, আপনি কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। আপনি সবসময়ে নিজের কথা রাখেন, তাই আপনি মাঝে মাঝে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন যে অন্যরা যেমন শেরশাহ, যে চওসার যুদ্ধের আগে আপনার সাথে ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল বা আপনার নিজের সৎ-ভাইয়েরা তেমন কিছু করবে না। আপনি কামরানকে এত সুযোগ দিয়েছেন এবং সে অবলীলায় যেভাবে আপনার করুণার সুযোগ নিয়েছে যে আমার নিজেরই মনে হয় যে আমাদের আব্বাজানকে আপনি যদি কোনো প্রতিশ্রুতি কখনও দিয়েও থাকেন সেটা তাঁর ক্রমাগত শঠতার কারণে নাকচ হয়ে গিয়েছে… সে চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবে। আমাকে যদি অকপটে বলতে বলেন আমি বলবো তার মরাই উচিত। আমাদের আব্বাজান যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এতো কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন সেই সাম্রাজ্যের জন্য এটা মঙ্গলজনক হবে। কামরানের সমস্যা দূর হলেই কেবল আপনি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করতে পারবেন।

হুমায়ুন অনেকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে থাকে। সে অবশেষে সতর্কতার সাথে বলতে শুরু করে। আমি জানি তোমার যুক্তি ঠিক আছে। আমি এটাও জানি আমাদের আব্বাজান সবসময়ে বলতেন আমি বড় বেশী নিঃসঙ্গতা পছন্দ করি…কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে আমি কোথাও গিয়ে কিছুক্ষণ একাকী বিষয়টা নিতে ভাবতে চাই।

আমাদের আব্বাজানের স্মৃতিকথা আপনি সাথে করে নিয়ে যেয়ে দেখতে পারেন যদি সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা বা সান্ত্বনা পান? আর তাছাড়া, তিনি যেমনটা বলেছেন তেমনি করে সেসব আপনারই লেখা, জীবনযাপন আর শাসন কার্যের জন্য নির্দেশনা প্রদান।

হুমায়ুন, কিছুক্ষণ পরে, কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরে অবস্থিত সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ চৌকির পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। তাঁর হাতে হাতির দাঁত দিয়ে বাধান তাঁর আব্বাজানের স্মৃতিকথা যা সে তার উত্থানপতনের মাঝেও সযত্নে সংরক্ষণ করেছে। সে জওহরকে কঠোর আদেশ দিয়ে পর্যবেক্ষণ চৌকির প্রবেশদ্বারে বসিয়ে রেখে এসেছে, যে কেউ যেন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না পায়। হুমায়ুন যখন সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে, একটা সমতল ছাদে এসে উপস্থিত হয়, সে টের পায় যে দিনের উষ্ণতা হ্রাস পাচ্ছে। ঘন্টাখানেকের ভিতরেই সন্ধ্যা নামবে। তারকারাজি তাকে কি দিক নির্দেশনা দেয় সেটা পর্যবেক্ষণের জন্য তার হয়ত তারা ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত কিন্তু সে তারপরে কি মনে করে ভাবনাটা নাকচ করে দেয়। সে জীবনে যত পরীক্ষা আর আশাহতের বেদনার সম্মুখীন হয়েছে সেখান থেকে সে একটা শিক্ষাই লাভ করেছে যে সে তার স্ত্রী বা রক্তসম্পর্কের আত্মীয়, তার পরামর্শদাতাদের মতো তারকারাজির উপরে নিজের সিদ্ধান্তের দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারে না।

বাবর তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি বাল্যকালেই বুঝতে পেরেছিলেন যে একজন শাসককে শাসনকার্য পরিচালনা করতেই হবে। এটা শাসককে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অতুলনীয় সুযোগ আর স্বাধীনতা দান করে, কিন্তু সেই সাথে এটা তার ভূমিকাকে ভীষণ একাকিত্বে ভরিয়ে দেয়। তাকে কেবল সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না বাকি জীবনটা তাঁকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে হাশরের ময়দানে তাঁকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে শুরু করলে, হুমায়ুন তাঁর আব্বাজানের স্মৃতিকথা খুলে আনমনে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। তার চোখ প্রথমেই একটা অনুচ্ছেদের দিকে আকৃষ্ট হয় যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে, কিভাবে তৈমূর তার এক অভিযানের সময় স্তেপের অধিবাসীদের ভিতরে প্রচলিত সনাতন রীতি অনুযায়ী করুণার বিরল দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছিলেন এবং তাঁর নিজের পরিবারের একজন শক্তিশালী সদস্য যে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করেছিল তাঁকে হত্যা না করে কেবল অন্ধ করে দিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সৃষ্টির সম্ভাবনা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বিদ্রোহ দমনের একটা পন্থা হিসাবে বাবর এটা সমর্থন করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে আজও অনেক গোত্রের ভিতরে এমন শাস্তির বিধান প্রচলিত রয়েছে এবং এটাকে তারা ন্যায্য আর যথার্থ বলে বিবেচনা করে।

হুমায়ুন সাথে সাথে বুঝতে পারে যে কামরানের এটাই নিয়তি হওয়া উচিত। দৃষ্টিহীন হবার সাথে সাথে তাঁর হুমকিও দূর হবে। কোনো বিদ্রোহী গোত্রপতি আর কখনও কামরানকে হুমায়ুনের প্রতিপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করবে না। তার সৎ-ভাইও হয়তো নিজের কৃতকর্ম বিবেচনার সময় পাবে এবং শেষ বিচারের ডাক আসবার আগে হয়তো সে অনুতপ্তও হতে পারে। শাস্তিটা খুবই নিষ্ঠুর হবে, কিন্তু হুমায়ুন জানে যে এটা বলবৎ করে কিছুটা করুণা প্রদর্শনের জন্য নিজের সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি সে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং সেই সাথে নিজের সৎ-ভাইদের প্রতি অচিন্তনীয় হিংস্রতা থেকে বিরত থাকতে তাঁর আব্বাজানের নিষেধাজ্ঞা কিছুটা হলেও মান্য করা হবে।

বাবরের স্মৃতিকথার হাতির দাঁতের মলাট বন্ধ করে, হুমায়ুন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসে। আমার পরামর্শদাতাদের এই মুহূর্তে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো, সে জওহরকে বলে। পাঁচ মিনিটের ভিতরে তাদের সবাইকে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার সৎ-ভাইকে অন্ধ করে দেয়া হবে, তার ক্রমাগত অপকর্মের শাস্তি হিসাবে আর সেই সাথে এখানে আমার রাজত্ব আর হিন্দুস্তানে আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধারে সে যেন কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে। আজ রাতে সূর্য অস্ত যাবার একঘন্টা পরে শাস্তি কার্যকর করা হবে। জাহিদ বেগ, এই দায়িত্বটা আমি আপনাকে দিচ্ছি। আমার ইচ্ছা হেকিমের বিবেচনায় সবচেয়ে দ্রুততম পদ্ধতি যেন অবলম্বন করা হয় এবং আমার সৎ-ভাইকে যেন কোনো রকম হুশিয়ারি দেয়া না হয় যাতে করে কি ঘটতে চলেছে সেজন্য সে ভীত হবার সময় না পায়। আমি তার যন্ত্রণা আর কষ্ট দেখতে চাই না। জওহর, আমার পক্ষে তুমি বিষয়টা প্রত্যক্ষ করবে। অবশ্য, কামরানকে যেন জানান হয় যে আমার প্রত্যক্ষ নির্দেশে শাস্তিটা বলবৎ করা হয়েছে এবং এর পুরো দায়দায়িত্ব আমার একার। আগামীকাল মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পূর্বে তুমি আমার সৎ-ভাইকে এজন্য আমার সামনে হাজির করবে।

*

সুলতান, জওহর দেড়ঘন্টা পরে এসে জানায়, আপনার আদেশ পালিত হয়েছে। জাহিদ বেগের বাছাই করা ছয়জন লোক কারাকুঠরিতে প্রবেশের পাঁচ মিনিট কি তারও কম সময়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। তাদের ভিতরে চারজন আপনার সৎ-ভাইকে মাটিতে চেপে ধরে একেকজন তার একেক হাত পা চেপে ধরে থাকে। সে যখন ধ্বস্তাধ্বস্তি আর লাথি চেষ্টা করছে তখন পঞ্চমজন- মানুষ না বলে তাকে ভালোক বলাই উচিতোর বিশাল হাতের পাঞ্জায় কামরানের মাথাটা চেপে ধরে এবং মাথাটা স্থির রাখে। ষষ্ঠব্যক্তি আগুনের শিখায় আগেই গনগনে লাল করে রাখা সুইয়ের গোছা নিয়ে দ্রুত আপনার সৎ-ভাইয়ের দুই চোখের মণিতে পর্যায়ক্রমে বিদ্ধ করে। কামরান যন্ত্রণায় যখন বুনো পশুর মতো চিৎকার করছিল, লোকটা তখন তার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নষ্ট করার জন্য চোখের মণিতে লবণ আর লেবুর রস ঘষে দেয়। সে তারপরে আপনার সৎ-ভাইয়ের চোখে সুতির পরিষ্কার, নরম কাপড় বেঁধে দেয় এবং জানায় যে তাঁকে আর কোনো কষ্ট দেয়া হবে না। তারপরে তাঁরা তাঁকে তাঁর শাস্তি এবং সে প্রাণে বেঁচে থাকবে- যদিও সেটা হবে একটা বিকলাঙ্গ জীবন- এসব বিবেচনা করার জন্য কারাপ্রকোষ্ঠে একাকী রেখে বের হয়ে আসে…

*

পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা, মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ আগে, কামরানকে হুমায়ুনের সামনে এনে হাজির করা হয়। তাঁর চোখে এখন আর পট্টি বাধা নেই এবং হুমায়ুনের আদেশে তাকে গোসল করিয়ে মোগল যুবরাজের উপযুক্ত পোষাক পরিহিত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। হুমায়ুন প্রহরীদের বিদায় করে দেয় এবং কোমল কণ্ঠে কামরানের সাথে কথা বলতে শুরু করে।

আমি হুমায়ুন, তোমার সৎ-ভাই। আমি তোমায় নিশ্চিত করে বলছি কক্ষে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কামরান যখন দৃষ্টিহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সে বলতে থাকে, আমি তোমাকে জানাতে চাই যে আমার কেবলমাত্র আমারই আদেশে তোমায় অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা কাজটা সম্পন্ন করেছে তাদের কোনো দোষ নেই। আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি কারণ আমার মনে হয়েছে যে আমি তোমার প্রতি যতই ক্ষমাসুলভ আচরণ করি, তুমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হবে না আর আমাকে আমার সিংহাসন আর আকবরের ভবিষ্যত এবং আমাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে হবে। হুমায়ুন চুপ করে থাকে এবং অপেক্ষা করে, খানিকটা হলেও আশা করে কামরান কিছু বলবে বা নিদেনপক্ষে, অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করবে।

কিন্তু কিছুক্ষণ নিরব থাকার পরে কামরান পরাজয় মেনে নেয়া সুরে কথা বলে। আপনি আমার জীবন বখশ দিয়েছেন কিন্তু একই সাথে আমার কাছ থেকে আমার প্রিয় সবকিছু কেড়েও নিয়েছেন- আমার পরিকল্পনা, আমার উচ্চাশা। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনি মহান আর করুণাময় পাদিশাহ হিসাবে এখন আবির্ভূত হতে পারেন যখন আপনি জানেন আমাকে কবন্ধ করে ফেলার চেয়েও নিখুঁতভাবে আপনি আমাকে ধ্বংস করেছেন…

হুমায়ুন কোনো কথা বলে না এবং কামরান কিছুক্ষণ পরে আবার বলতে থাকে। আমি আপনাকে দোষ দেই না। আমি সবসময়ে আপনার ক্ষমাশীলতাকে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেছি এবং জানি আমার শাস্তিই প্রাপ্য। গতকাল রাতে আমি যখন জেগে শুয়েছিলাম আর দৃষ্টিহীন এই চোখের ব্যাথা কমার জন্য প্রার্থনা করছিলাম এবং ভাবছিলাম যে আমি এতদিন যেভাবে জীবনযাপন করেছি সেটার সমাপ্তি ঘটেছে, আমার মনে তখন আরেকটা ভাবনার জন্ম হয়। পুরো ব্যাপারটাই একটু অদ্ভুত কিন্তু আমি যেন কেমন একটা স্বস্তিবোধ করতে থাকি… একটা অনুভূতি, যে অবশেষে, এতোবছর পরে আমি পার্থিব আকাঙ্খার বোঝা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি। আমি আপনার কাছে। কেবল একটাই জিনিস কামনা করি এবং এটা আমি আন্তরিকতার সাথে চাইছি।

কি সেটা?

আমি এখানে আপনার করুণা বা ঘৃণার পাত্র হিসাবে বা আপনি আমাকে যেমন উদারতা প্রদর্শন করতে চান তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চাই না। আসকারির ন্যায়, আমাকেও মক্কায় তীর্থ করতে- হজ্জ্বে যাবার অনুমতি দিন। আমাকে এটা কিছুটা হলেও হয়তো আত্মিক প্রশান্তি দান করবে।

অনুমিত দিলাম, হুমায়ুন বলে, আমি তোমার জন্য দোয়া করবো। সে কথা বলার সময় অনুভব করে কান্নায় তার গাল ভিজে যাচ্ছে। সে অনুধাবন করে, সে কাঁদছে খানিকটা, সে আর তাঁর সৎভাই সামান্য সময়ের জন্য যে নিষ্পাপ সময় অতিবাহিত করেছিল সেটা হারাবার বিষণ্ণতাবোধ থেকে আর খানিকটা নিজেদের ভিতরে যুদ্ধ করে নষ্ট করা সময়ের কথা চিন্তা করে যখন তারা একসাথে তাদের আব্বাজানের সাম্রাজ্য উদ্ধারে উদ্যোগ নিতে পারতো, আর খানিকটা গতরাতে তার ইঙ্গিতে কামরানকে যে কষ্ট দেয়া হয়েছে সেটা ভেবে। তার অশ্রুধারা, অবশ্য একইসাথে, একটা প্রগাঢ় আর সর্বব্যাপী স্বস্তি প্রতিফলিত করে। সে আরো একবার হিন্দুস্তানের পাদিশাহ হতে, এমনকি নিজের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করতে আর বাবর যে মহান সাম্রাজ্য স্থাপণের স্বপ্ন দেখেছিল সেটা অর্জনে স্বাধীনভাবে মনোনিবেশ করতে পারবে।

৪.৪ উষ্ণ রুটি

২৪. উষ্ণ রুটি

সুলতান, ইসলাম শাহ মৃত। হিন্দুস্তানের সিংহাসন শূন্য।

অঙ্গসংবাহক যখন তার পিঠের উপরের অংশে সুগন্ধি নারিকেলের তেল ঘষে দলাইমলাই করে, হুমায়ুন- ছয় সপ্তাহ পূর্বে- যখন উত্তেজিত আহমেদ খানের কাছ থেকে সে শব্দগুলো শুনেছিল, তখনকার কথা স্মরণ করে হাসে। পরবর্তী দিনগুলোতে, হিন্দুস্তান থেকে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে আগত ভ্রমণকারীদের বয়ে আনা গুজব আরো জোরাল হতে থাকে। তাদের কেউ বলে যে ইসলাম খান কয়েক মাস পূর্বে আকষ্মিকভাবে মারা গিয়েছে এবং তার সমর্থকেরা যখন একজন উত্তরাধিকারীর ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করছে তখন কিছু সময়ের জন্য হলেও সাফল্যের সাথে বিষয়টা তারা গোপন করতে পেরেছে। প্রতিটা দিন এবং প্রতিটা সংবাদ সম্পর্কে অতিবাহিত হবার সাথে সাথে, হুমায়ুনের ভিতরে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হতে থাকে। সে অনুভব করে তার সিংহাসন পুনরুদ্ধারের বিশাল একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। সে যদি কাবুল ত্যাগ করে তাহলে তার সৎ-ভাইদের কাছ থেকে কাবুলের জন্য কোনোরকম হুমকির উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হয়ে, সে এই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারে এবং তাঁর হতাশা আর নির্বাসনের লম্বা বছরগুলোর একটা সমাপ্তি ঘটাতে পারে।

সে অতিসত্ত্বর অভিযানের জন্য নিজের বাহিনী প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে। এই মুহূর্তে, দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরের বাইরে, তাঁর আধিকারিকেরা তার তবকিদের গুলিবর্ষণের গতি বৃদ্ধি করতে এবং শৃঙ্খলার সাথে অস্ত্রে বারুদ, আর গুলি ভর্তি করতে এবং নিশানা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা রপ্ত করাতে কসরত করছে। তার রাজ্যের প্রত্যন্ত উপত্যকায় আর রাজ্যের বাইরে তার লোকেরা অতিরিক্ত সৈন্য সগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। অঙ্গসংবাহক এখন হুমায়ুনের উরু আর নিতম্বে উপযুপরি মুষ্ঠাঘাত করছে যা তাঁর শারীরিক আর মানসিক প্রস্তুতির অংশ। নিজের অভিযান পরিকল্পনায় দিক নির্দেশনা লাভ করতে সে তাঁর আব্বাজানের হিন্দুস্তান আক্রমণের স্মৃতিকথা আবার পড়তে শুরু করেছে এবং তাঁর নিজের অভিযানের স্মৃতির সাথে সেগুলো তুলনা করছে।

শেরশাহের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানে সে কোথায় ভুল করেছিল এবং অন্যত্র যেমন গুজরাতে সে কেন সাফল্য লাভ করেছিল সেটার বোঝার জন্য সে তার সেনাপতিদের সাথে, বিশেষ করে আহমেদ খানের সাথে দীর্ঘসময় আলোচনা করেছে। নিজের কক্ষে একাকী বসে থাকার সময় একদিন সন্ধ্যা নামার বেশ কিছুক্ষণ পরে সে নিজের জন্য পুরো ব্যাপারটার একটা সংক্ষিপ্তসার প্রস্তুত করে। ভালোমতো প্রস্তুতি গ্রহণ কর, দ্রুত আর নিশ্চায়করূপে চিন্তা আর কাজ কর। তোমার মোকাবেলা করতে তোমার প্রতিপক্ষকে বাধ্য কর এবং কখনও যেন এর বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি না হয়।

বিগত বছরগুলোতে সে আবারও নিজেকে গজনীর সুরা উপভোগ করার অনুমতি দিয়েছে এবং কাবুল দখল করার পর থেকে সে মাঝে মাঝে কেবল আফিমের উদ্বেগ-হরণকারী স্বস্তির পরিচর্যা গ্রহণ করে। যুদ্ধের কঠোরতার জন্য নিজের দেহকে শক্ত আর মনকে শাণিত করতে এখন নিজের ভিতরে একটা ব্যাপক টানাপোড়েনের পড়ে আর ইচ্ছাশক্তির বিপুল প্রয়োগ ঘটিয়ে সে আফিম আর সুরা দুটো গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত করেছে। সে আবারও মল্লযুদ্ধ শুরু করেছে এবং অঙ্গসংবাহক তাঁকে তাঁর প্রতিদিনের কসরতের জন্য প্রস্তুত করছে। দ্রুত একটা ইশারা করে লোকটাকে তার কাজ বন্ধ করতে বলে, হুমায়ুন গড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে তারপরে উঠে দাঁড়ায়। সে সুতির লম্বা একটা পাজামা কোমড়ে গলিয়ে নেয়, লড়াইয়ের সময় তাঁর পরণে কেবল এটাই থাকে, এবং মসৃণ হলুদ মসলিনের পর্দার ভিতর দিয়ে পাশের কামরার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে লম্বা, পেষল দেহের অধিকারী এক বাদখশানি, তাঁর প্রতিপক্ষ, একইরকম পোষাক পরিহিত অবস্থায় এবং তেল মালিশ করে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

বায়েজিদ খান, একদম ইতস্তত করবে না। হুমায়ুন মৃদু হাসে। তুমি আমাকে দারুণ শিখিয়েছে। আমাকে যদি দশ মিনিটের ভিতরে পরাস্ত করতে পার তাহলে তোমার জন্য মোহর ভর্তি একটা থলি অপেক্ষা করছে। এখন চলো বিষয়টা নিষ্পত্তি করা যাক।

দুইজন লোক বৃত্তাকারে পরস্পরের চারপাশে ঘুরতে থাকে, কে প্রথম আক্রমণ করে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করে। হুমায়ুনই প্রথম দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে বায়েজিদ খানের বাহু আকড়ে ধরে তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। বায়েজিদ খান অবশ্য একটা মোচড় দিয়ে হুমায়ুনের পাঞ্জা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় এবং হুমায়ুনের কাঁধ আকড়ে ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ভারসাম্যহীন করতে চেষ্টা করে। হুমায়ুন ধাক্কাটা সামলে নেয় এবং দুজনে একে অপরের কাঁধ আকড়ে ধরে, ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, নিজেদের শক্তি পরখ করে। তারপরে বায়েজিদ খান হুমায়ুনের হাঁটুর পেছনে চকিতে একটা লাথি মারলে হুমায়ুন হোঁচট খায়। হুমায়ুন মাটিতে পড়ে যায় এবং বায়েজিদ খান মাটির উপরে পাতা গালিচায় তার বাহু চেপে ধরে প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটাতে হুমায়ুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কিন্তু হুমায়ুন দারুণ ক্ষিপ্র আর সে গড়িয়ে নীচ থেকে সরে যায়। বায়েজিদ খান গালিচার উপরে আছড়ে পড়তে হুমায়ুন তাঁর পিঠের উপর লাফিয়ে পড়ে এবং নিজের হাঁটু তার পিঠে চেপে ধরে বায়েজিদের দুই হাত পেছন দিকে টেনে ধরে। বায়েজিদ খান যতই ধ্বস্তাধ্বস্তি করুক, সে নিজেকে হুমায়ুনের হাত থেকে মুক্ত করতে পারে না। সুলতান, অনেক হয়েছে। আপনি দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে পরাস্ত করেছেন।

আমার মনে হয়, প্রথমবারের মতো। আমার তীব্র সন্দেহ আছে যে আগেরবার তুমি আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিলে কিন্তু এবার আমিই জিতেছি।

সুলতানের সন্দেহ হয়ত অমূলক না।

ফাঠেহুমায়ুন তাঁর মালিশ কক্ষে ফিরে আসে এবং মল্লযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর পরিচারকেরা উষ্ণ, কর্পূর-সুবাসিত পানি দিয়ে তামার যে আয়তাকার বিশাল স্নানের পাত্র ভরে রেখেছে সেটায় নিজের ঘাম আর তেলে চকচক করতে থাকা দেহ ধুয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে। সে সুতির একটা মোটা তোয়ালে দিয়ে নিজেকে শুষ্ক করে চন্দন-সুবাসিত চক পাউডার দেহে ছিটিয়ে দেয়ার ফাঁকে, সে সামনের বার্নিশ করা আয়নায় নিজের নগ্ন দেহের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাঁর পেশীসমূহ একমাস আগের তুলনায় এখন অনেক বেশী স্পষ্ট আর সুগঠিত। সে ভাবে তাকে দেখে মনেই হয় না সে ছেচল্লিশ বছরের একজন বৃদ্ধ, এবং তার মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠে। শারীরিক কসরতটা বোধহয় তাঁকে সাহায্য করছে তার মনকে কেন্দ্রীভূত করতে এবং পরিষ্কার করে চিন্তা করতে। একারণেই সে আরও ঘনঘন রতিক্রিয়ায় মিলিত হতে পারছে।

হুমায়ুন তাঁর পরিচারকদের সহায়তায় দ্রুত পোষাক পরিধান করে তাঁর পরামর্শদাতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হবার জন্য প্রস্তুত হয়। কয়েক মিনিট পরে, সোনার বকলেশ দেয়া গাঢ় নীল রঙের টিউনিক আর সম্মুখভাগে ময়ূরের লম্বা পালক শোভিত দুধ সাদা রঙের পাগড়ি পরিধান করে সে মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করে।

আহমেদ খান, হিন্দুস্তানের সর্বশেষ খবরাখবর কি? আজ সকালে কি আরেকটা কাফেলা আসেনি?

জ্বী, সুলতান। কাফেলাটা আমাদের জন্য যা সুসংবাদ সেটাই এসে নিশ্চিত করেছে। ইসমাইল শাহের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। তারচেয়েও বড় কথা, আজকের কাফেলার সাথে আগত ধনাঢ্য এক ব্যবসায়ী বলেছে যে দিল্লীর আশেপাশে সিংহাসনের তিন দাবীদারের ভিতরে লড়াই শুরু হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অভাবে ডাকাতেরা অবাধে ডাকাতি করছে, রাতের বেলা ধনবান ব্যক্তিদের বাড়িতে হামলা করে খুন, ধর্ষণ আর ডাকাতি করছে। আমাদের এই বণিক তাঁর সম্পদের কিছুটা লুকিয়ে রেখে, বাকি সম্পদ আর পরিবার সাথে নিয়ে কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দিয়ে উত্তরে আপনার রাজ্যে নিরাপত্তার আশায় এসেছে, যতক্ষণ না হিন্দুস্তানে কি ঘটছে তিনি বুঝতে পারেন। কাফেলার অন্য সদস্যরা তার কথার সপক্ষে গোলযোগের নানা প্রাসঙ্গিক বর্ণনা দিয়েছে। একজন বলেছে যে ডাকাতেরা গেঁটেবাতে আক্রান্ত এক ধনী বৃদ্ধার আঙ্গুল থেকে মূল্যবান আংটি খুলতে না পেরে, তার আঙ্গুলটাই কেটে ফেলেছে এবং রক্তক্ষরণের ফলে মারা যাবার জন্য তাঁকে ফেলে রেখে গিয়েছে।

সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, লড়াই আর অরাজকতার ফলে আমরা সেই কাঙ্খিত সুযোগ লাভ করবো এবং আমাদের ন্যায়সঙ্গত রাজ্যের অধিবাসীদের ন্যায়বিচার আর আইনের শাসন ফিরিয়ে দিতে পিরবো। এই তিন দাবীদার সম্বন্ধে আমরা কি জানি?

একজন আদিল শাহু, ইসমাইল শাহের প্রিয়তমা স্ত্রীর ভাই- তার পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র সন্তানের জননী। আদিল শাহ্ ক্ষমতার লোভে এতোটাই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে সে রক্তের সম্পর্কের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে হারেমে প্রবেশ করে এবং মাংসের জন্য কসাই যেভাবে পশু জবাই করে সেভাবে সে নিজের বোনের সামনে তাঁর সন্তানের গলা কেটে তাঁকে হত্যা করে। সে তারপরে নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে।

হুমায়ুন বিরক্তিতে মুখ কুচকায়। কামরানের পক্ষেও এতটা নীচে নামা অসম্ভব ছিল। আর বাকি দুজন?

ইসমাইল শাহের আত্মীয় সম্পর্কিত এক ভাই এদের ভিতরে সবচেয়ে শক্তিশালী, যে সিকান্দার শাহ্ হিসাবে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছে। সে আদিল শাহকে ইতিমধ্যে যুদ্ধে একবার পরাজিত করেছে কিন্তু নিজের বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তৃতীয় দাবীদার, তার্তার খান, আমরা যাদের পরাস্ত করেছিলাম সেই পুরাতন লোদী বংশের বর্তমান প্রধান এবং গুজরাতের সুলতানের সাথে মিলিত হয়ে যে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তার কর্মকাণ্ডের কারণে।

এদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে- কারা তাঁদের শত্রু আর মিত্র, তাঁদের ব্যক্তিগত শক্তি আর দূর্বলতা, তাঁদের সৈন্যসংখ্যা, কত টাকা আছে, সবকিছু আমাদের জানতে হবে।

আমরা সম্প্রতি আগত পর্যটকদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এবং সেই সাথে অবশ্যই আরো বেশী সংখ্যায় গুপ্তদূত আর গুপ্তচর প্রেরণ করবো।

আমাদের অভিযান পরিকল্পনা বিস্তারিত আলোচনার উদ্দেশ্যে আমরা আগামীকাল আবার আলোচনা শুরু করবো। হুমায়ুন মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে ঘুরে দাঁড়াবার মাঝেই অবশ্য আহমেদ খান তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট চারকোণাকৃতি কাগজ হুমায়ুনের হাতে গুঁজে দেয়।

ভ্রমণকারীদের একজন এই সীলমোহর করা বার্তাটা নিয়ে এসেছে, সে আমাদের প্রহরীদের কাছে বলেছে কেবল আপনার দেখার জন্য এই বার্তাটা। সে বলেছে তার পরিবারের একজন সদস্য- একজন নাবিক যে সম্প্রতি আরব থেকে ফিরে এসেছে এবং সে কাবুল যাচ্ছে শুনে তাঁকে অনুরোধ করেছে চিঠিটা আপনাকে পৌঁছে দিতে। সুলতান, বিষয়টা হয়ত কিছুই না কিন্তু আমার মনে হয়েছে। আপনার এটা খোলা উচিত।

আহমেদ খান, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি কক্ষে ফিরে গিয়েই বার্তাটা পাঠ করবো।

সোয়া ঘন্টা পরে, হুমায়ুন জেনানাদের আবাসন এলাকায় প্রবেশ করে এবং সরাসরি হামিদার কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। হামিদা মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, আমি শুনলাম হিন্দুস্তান থেকে ভালো খবর এসেছে…।

হুমায়ুন স্মিত হাসে, কিন্তু তার হাসি আর চোখের দৃষ্টিতে বিষণ্ণতার মেঘ ভীড় করে থাকে। হিন্দুস্তানের সংবাদ আসলেই ভালো কিন্তু আমি আজ আরেকটা মনখারাপ করা সংবাদ পেয়েছি। খবরটা আসকারি সংক্রান্ত। তুমি নিশ্চয়ই জানো, আঠার মাস আগে পবিত্র ভূমি মক্কায় যাবার জন্য কাম্বে থেকে জাহাজে আরোহন করার পরে, আমি তার আর কোনো সংবাদ না পেয়ে অনেকদিন থেকে থেকেই। আশঙ্কা করছিলাম যে সে হয়তো কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। আমি আজ তার ভাগ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি…

আহমেদ খান তাঁকে যে কাগজটা দিয়েছিল হুমায়ুন সেটা তাঁর আলখাল্লার পকেট থেকে বের করে আনে। কাগজটায় অসংখ্য ভাঁজ আর সেটা কুঁচকে গিয়েছে। বার্তাটার প্রেরক মোহাম্মদ আজহারুদ্দিন- আমার ভাইয়ের দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসাবে আমি যাকে পাঠিয়েছিলাম। বার্তাটায় সংক্ষেপে বলা হয়েছে কিভাবে কাম্বে থেকে যাত্রা শুরু করার পরে অনুকূল বাতাসের বরাভয়ে তারা কেমন দ্রুতগতিতে মক্কার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছিল, তারা আরব উপকূলে অবস্থিত সালালা বন্দর থেকে যখন মাত্র বিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে, এমন সময় জলদস্যুদের তিনটি দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজের একটা বহর তাঁদের ধাওয়া করে ধরে ফেলে। জলদস্যুরা জাহাজে উঠতে চেষ্টা করলে আসকারি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় কিন্তু প্রতিপক্ষের সংখ্যার কাছে সে পরাজিত হয় এবং তরবারি হাতে মৃত্যুবরণ করে। তাঁর সাথে আরো অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। মোহাম্মদ আজহারুদ্দিন মারাত্মকভাবে আহত হন এবং অবশিষ্ট দেহরক্ষী আর তাদের সাথে থাকা টাকাপয়সাসহ বন্দি হন। তিনি সুস্থ হলে মাস্কাটের বিশাল ক্রীতদাসের বাজারে শহরের বাইরে অবস্থিত খনিতে কাজ করার জন্য তাঁকে বিক্রি করে দেয়া হয়। ছয়মাস পূর্বে তিনি বন্দিদশা থেকে পলায়ন করেন এবং দেশে ফিরে আসবার পূর্বে তিনি প্রথমেই এই বার্তাটা আমার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।

আল্লাহতালা নিশ্চয়ই আসকারিকে তার কৃতকর্মের জন্য মার্জনা করে এবং তার আত্মাকে বেহেশত নসীব করবেন, হামিদা বলে। সে কিছুক্ষণ পরে আবার বলে, সে যাই হোক, তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিতভাবে পাবার পরে আপনি একটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন যে নির্বাসিত অবস্থায় আপনার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করার জন্য সে আত্মগোপন করেনি।

কথা সত্যি, কিন্তু সে কখনও কামরানের মতো জাত প্রতিপক্ষ ছিল না এবং আমার প্রায়ই মনে হয় নিজের ভাই আর মায়ের প্রতি আনুগত্য থেকেই সে আমার বিরুদ্ধাচারণ করেছে। হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার পূর্বে সে বলেছিল বিদ্রোহের সব ভাবনা সে ত্যাগ করেছে। আমি তখন তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। তাঁর মৃত্যু আমাকে আরও সচেতন করে তুলেছে যে আমার আব্বাজান তার পরিবারের জন্য যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা পূরণ করার জন্য এখন কেবল আমি একাই বেঁচে রয়েছি।

আপনি অনেকদিন ধরেই তাঁর স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ত তার একমাত্র সন্তান।

কিন্তু আমি তার গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ হারিয়েছি এবং সেটা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছি, তাঁর রাজত্ব বৃদ্ধি করার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি তোমার এবং আমার নিজের, আর সেই সাথে আমার আব্বাজানের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। আমার নিয়ত পবিত্র ছিল কিন্তু আমি একাগ্রচিত্তে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট প্রয়াস নেইনি।

পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। হজ্জের উদ্দেশ্যে আসকারি আর কামরান রওয়ানা হবার পর থেকে আমি আপনার ভিতরে সত্যিকারের দৃঢ়সংকল্প লক্ষ্য করছি। আপনি এখন আর নিছক আমোদ কিংবা অলস কল্পনায় নিজের মনকে বিভ্রান্ত হতে দেন না। আপনি সবসময় চেয়েছেন যা আপনার নিজের সেটা উদ্ধার করতে, কিন্তু সময় আর একাগ্রতা নিয়ে আপনি এখন সেটা অর্জনের জন্য চেষ্টা করছেন।

আমিও সেটাই আশা করি। আমি কিভাবে আমার সিংহাসন হারিয়েছি, আকবরকে যখন আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল তখন আমাদের সবচেয়ে হতাশ সময়ে তোমার মুখ, বরফে জমে আর অর্ধভুক্ত অবস্থায় শাহের শরণার্থী হিসাবে আমরা পারস্য গমন করেছিলাম, এইসব তিক্ত স্মৃতিগুলো অঙ্কুশের মতো ব্যবহার করে আমি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারে আমার সমস্ত শক্তি নিবদ্ধ করেছি।

আপনি সাফল্য লাভ করছেন। আমি জানি আপনি কেবল এক কদম অগ্রসর হবার কথাই চিন্তা করেন না, বরং পুরো যাত্রাপথের পরিকল্পনা আপনার মাথায় রয়েছে।

আমি প্রার্থনা করি এটা যেন আমাকে আমার সিংহাসনের কাছে পৌঁছে দেয়।

আমাদের সন্তানের খাতিরে যেন তাই হয় সেটা নিশ্চিত করবেন।

হামিদার চোখে মুখে এমন দৃঢ় সংকল্পের অভিব্যক্তি হুমায়ুন আগে কখনও লক্ষ্য করেনি। সে তাকে আর হতাশ করবে না।

*

১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস, হুমায়ুনের সদ্য নিযুক্ত সেনাবাহিনী তার সামনে দিয়ে কুচকাওয়াজ করে অতিক্রম করার সময়ে, শরতের শীতের হাত থেকে বাঁচতে ফারের আস্তরণযুক্ত একটা আলখাল্লায় নিজেকে শক্ত করে জড়িয়ে, সে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের ছাদে আকবরকে পাশে নিয়ে পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আমাদের প্রতিনিধিরা দারুণ কাজ করেছে। আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের সব এলাকা থেকে তাঁরা লোক সংগ্রহ করে এনেছে। ধুসর-ত্বকের অধিকারী ঐ লোকগুলো গজনী থেকে এসেছে। কালো পাগড়ি আর মুখের উপরে কাপড় দেয়া লোকগুলো কান্দাহারের উত্তরের পাহাড়ী এলাকা থেকে এসেছে। বাদখশান আর তাজিখ এলাকায় আমাদের অনুগত জায়গীরদারেরা সৈন্য পাঠিয়েছে। তাঁদের সবসময়ে সাহসী আর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং সেইসাথে সুসজ্জিতও বটে। লক্ষ্য করে দেখো তাঁদের ঘোড়াগুলো কেমন তাগড়া।

কিন্তু আব্বাজান ওখানে ঐ হলুদ নিশানের নিচে কারা দাঁড়িয়ে রয়েছে?

তারা ফারগানা- তোমার দাদাজানের জন্মস্থান থেকে এসেছে। ইসলাম শাহের মৃত্যুর গুজব শুনেই অনাহূতের ন্যায় তারা কাবুলের পথে রওয়ানা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা আমার অধীনে নিয়োজিত করার অভিপ্রায়ে, জানে যে আমি নিশ্চিতভাবেই হিন্দুস্তান আক্রমণ করবো… হুমায়ুন বাক্যের এই পর্যায়ে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে, আবেগে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এসেছে, এবং তারপরে আবেগ সামলে নিয়ে সে আবার শুরু করে, তোমার দাদাজানের ন্যায় আমিও তাদের নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ের পথে ধাবিত করবো। কিন্তু অশ্বারোহী তিরন্দাজদের ঐ দলটাকে লক্ষ্য করেছো? তারা বোখারা আর সমরকন্দের আশেপাশের এলাকা থেকে এসেছে এবং আমাদের মহান পূর্বপুরুষ তৈমূরের নিশানের অনুকরণে তাঁরা নিজেদের সজ্জিত করেছে- তাকিয়ে দেখো কমলা রঙের বাঘ সম্বলিত নিশানটা কেমন পতপত করে উড়ছে…

আমাদের সৈন্য সংখ্যা কত?

বারো হাজার।

আমার দাদাজান যখন হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হয়েছিলেন তখন তার সাথে অনেকবেশী সৈন্য ছিল।

সত্যি কথা, কিন্তু আমাদের সাথে তখনকার তুলনায় অনেক বেশী কামান, আর বন্দুক রয়েছে এবং প্রতিদিনই আমাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের কাছে সংবাদ আছে যে ইসলাম শাহের অনেক জায়গীরদার হিন্দুস্তানে তাঁদের সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়া মাত্র আমাদের সাথে যোগ দেবে।

কিভাবে আপনি এতো নিশ্চিত এই ব্যাপারে?

হুমায়ুনের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। বহু বছর পূর্বে তাঁদের পিতার ঠিক যেমন আমাকে পরিত্যাগ করেছিল, তাঁদের বিশ্বাস তারা জানে কে শেষপর্যন্ত বিজয়ী হবে?

তার মানে আমাদের সাফল্যের ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসই আমাদের বিজয়ী করবে?

হ্যাঁ- তোমার চারপাশের লোকেরা তোমার সাফল্যের ব্যাপারে আস্থাশীল হলে বিজয়ের পথে তুমি অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এই আস্থা একবার নষ্ট হয়ে গেলে সেটা পুনরুদ্ধার করা ভীষণ কঠিন। এই একটা শিক্ষা আমি বহু মূল্যে শিখেছি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এইবার যেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। আমাদের অর্জিত প্রতিটা বিজয়ে আস্থার জোয়ার ফুলে ফেঁপে উঠে আমাদের প্রতিপক্ষের অবশিষ্ট শক্তিটুকুও ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

আব্বাজান, আমি বুঝতে পেরেছি।

হুমায়ুন তাঁর সন্তানের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করে যে আকবর হয়তো আসলেও বুঝতে পেরেছে। গত এক বছরে তার ভিতরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তার দৈহিক গড়ন আর আকৃতির কারণেই কেবল না, তাঁর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আর অন্যদের বিচার করার ব্যাপারে তাঁর ক্রমশ বাড়তে থাকা বিচক্ষণতাবোধের কারণে বয়সের তুলনায় তাকে অনেক পরিণত মনে হয়। হুমায়ুন গত রাতে হামিদার সাথে তাঁর আলোচনার কথা স্মরণ করে যখন, সে তাঁকে জানায় যে কয়েকদিনের ভিতরে সে যখন হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা দিবে তখন তার ইচ্ছা সে আকবরকে সাথে করে নিয়ে যাবে। সে হামিদাকে মনে করিয়ে দেয় যে বাবর আকবরের বয়সীই ছিল যখন সে রাজা হয়েছিল। সে তাকে বলে যে আকবরকে তার সাথে নিয়ে গেলে রাজবংশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আস্থা জোরদার হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলাম শাহের মতো তাঁর পতন ঘটলে সবাই দেখবে যে তার একজন যোগ্য উত্তরাধিকারী রয়েছে।

হুমায়ুন আশা করেছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে আকবরকে যেসব বিপদের সম্মুখীন হতে হবে সেসবের কথা চিন্তা করে, হামিদা প্রতিবাদ করবে কিন্তু যদিও তার চোখ প্রথমে ঠিকই অশ্রুসজল হয়ে উঠে কিন্তু সে প্রাণপন চেষ্টায় নিজেকে সামলে নেয়। আমি জানি সে আপনার সাথে গেলে সেটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। একজন মায়ের পক্ষে নিজের ছেলেকে যুদ্ধযাত্রা করতে দেখাটা ভীষণ কঠিন একটা ব্যাপার কিন্তু সে অচিরেই প্রাপ্তবয়স্ক যুবকে পরিণত হবে। আমার উচিত নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে আমার বয়স মাত্র দুই বেশী ছিল যখন আমি আমার পরিবার পরিজন ত্যাগ করেছিলাম- আপনার জীবন আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিপদ বরণ করে নিতে বিষয়টা নিয়ে আমি কখনও অনুতপ্ত হইনি।

হামিদার কথা বলার মাঝে, হুমায়ুন অনুধাবন করে কেন আরো অনেক মেয়েকে চেনার পরেও হামিদাই কেন তাঁর জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসা। হুমায়ুন তাঁকে অধীর আবেগে আলিঙ্গন করে এবং তাঁর একত্রে দীর্ঘ সময়ব্যাপী নাজুক এক রতিক্রিয়ায় বিভোর হয়ে উঠে।

হুমায়ুন জোর করে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তার সিদ্ধান্তের কথা ছেলেকে জানাবার সময় হয়েছে। আকবর, আমি আমাদের উত্তরাধিকার প্রাপ্তি উদ্ধার করতে যাচ্ছি, তুমি কি আমার সাথে যেতে আগ্রহী?

আকবর ক্ষণিকের তরে ইতস্তত না করে সহজসরল ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, হ্যাঁ, আব্বাজান।

তোমার কি একটুও ভয় করছে না?

ভয় একটু করছে, কিন্তু আমি মনে মনে জানি যে এটাই যুক্তিসঙ্গত। এটাই আমার নিয়তি… তাছাড়া, এবং তাঁর চোখে মুখে বালকসুলভ একটা হাসি ফুটে উঠে, দারুণ একটা অভিযানের অভিজ্ঞতা হবে এবং সব অভিযানেই বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে যা আমি ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছি। আপনাকে এবং আমার আম্মিজানকে আমার জন্য গর্ববোধ করতে আমি বাধ্য করবো।

তুমি সেটা করবে, আমি জানি।

ইত্যবসরে, তবকিরা নীচে দিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভঙ্গিতে সারিবদ্ধভাবে নীচে দিয়ে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়, তাঁদের কেউ কেউ ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট অবস্থায় রয়েছে আর তাঁদের লম্বা আয়ুধ ঘোড়ার পর্যানের সাথে বাঁধা আর অন্যরা বন্দুক কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছে।

আব্বাজান, পদাতিক সৈন্যরা কিভাবে মূল বাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে চলে?

কামানবাহী ষাড়ের গাড়ির মতো দ্রুত গতিতে তারা হাঁটতে পারদর্শী। তাছাড়া, অগ্রসর হবার সাথে সাথে আমরা আরো ঘোড়া সংগ্রহ করবো। আমরা কাবুলের মতো নদীগুলোতে ভেলা ব্যবহার করে আমাদের যাত্রার গতি বৃদ্ধি করবো আর কামান এবং ভারী মালপত্র বহন করবো। যারা পায়ে হেঁটে চলেছে, ভেলাগুলোতে তারা আরোহন করতে পারবে। কাবুল নদীর জন্য আমি ইতিমধ্যে ভেলা নির্মাণের আদেশ দিয়েছি, যেগুলোতে দাঁড় টানার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার সাথে দিক নির্দেশনার জন্য হাল থাকবে।

দুই রাত পরের কথা, হুমায়ুন হামিদার নিরাভরণ মসৃণ দেহের উপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে শুয়ে রয়েছে। তারা কিছুক্ষণ আগেই ভালোবাসার আর্তি মিটিয়েছে এবং হুমায়ুন অনুভব করে যে সঙ্গমের আবেশে আগে কখনও তাঁদের নিজেদের সত্যিকারের একক সত্ত্বা বলে মনে হয়নি। এর পেছনে সম্ভবত একটাই কারণ রয়েছে যে তারা দুজনেই জানে যে আগামীকাল সকালবেলা হুমায়ুন আর আকবর তাঁদের হিন্দুস্তান অভিযানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।

হামিদা এক কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় হুমায়ুনের কালো চোখের দিকে পরম ভালোবাসায় সিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আপনি নিজেকে এবং আমাদের সন্তানকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, তাই না? আপনি যতটা অনুধাবন করেন প্রাসাদে অপেক্ষমান আর পরবর্তী অশ্বারোহী ডাকের জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা একজন মেয়েমানুষ হওয়াটা তারচেয়েও কঠিন একটা কাজ, বিশেষ করে ডাক বহন করে আনা লোকটার মুখ পর্যবেক্ষণ করে যদি মনে হয় তাঁর মুখাবয়ব আলাদা মনে হচ্ছে, তখনই কল্পনার সূতো জট পাকাতে শুরু করে যাত্রার ধকলের কারণে তাঁকে এমন দেখাচ্ছে, নাকি কোনো খারাপ খবর আছে। আপনি মাঝে মাঝে বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করার সময় দূরে কোথাও কি ঘটছে আন্দাজ করার চেষ্টা করেন, যদিও ভালো করেই জানেন ভালো মন্দ যে খবরই আসুক সেটা কয়েক সপ্তাহের পুরান এবং আপনি যে প্রিয়জনের কথা চিন্তা করছেন সে হয়ত ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে এবং নিজের অজান্তেই আপনি একজন বিধবা।

হুমায়ুন তাঁর তর্জনী দিয়ে আলতো করে হামিদার ঠোঁট স্পর্শ করে এবং তারপরে সেখানে সজোরে দীর্ঘ একটা চুম্বন এঁকে দেয়। আমি জানি আকবর আর আমি বেঁচে থাকবো- তারচেয়েও বড় কথা- যে আমরা বিজয়ী হব এবং আগ্রার রাজপ্রাসাদে তুমি হবে আমার সম্রাজ্ঞী। আমি আমার অন্তরের গভীরে এটা অনুভব করি। আমার অতীত ব্যর্থতার গ্লানি মোচনের আর আমার আব্বাজানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে আকবরের জন্য সেটাকে নিরাপদ করার এটাই মোক্ষম সুযোগ, এবং আমি এই সুযোগটা গ্রহণ করবো।

হামিদা মৃদু হাসে এবং হুমায়ুন তাঁকে আবারও কাছে টেনে নিয়ে আবার তারা ভালোবাসার আদিম খেলায় মেতে উঠে, প্রথমে মৃদু মন্থর ভঙ্গিমায় ধীরে ধীরে আবেগের মূচ্ছনায় সর্বগ্রাসী জোয়ারের সুর জেগে উঠে।

*

সিন্ধু নদীর দক্ষিণ তীরে হুমায়ুন তাঁর বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে। উত্তরের হিমালয় থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাসের ঝাপটায় তার মাথার চুল এলোমেলো হয়ে যায়। সে উত্তরের তীরের দিকে তাকিয়ে থাকে অসংখ্য মানুষ। আর ঘোড়া চলাচলের ফলে যা ইতিমধ্যে আঠাল কাদায় পরিণত হয়েছে তাঁর বিশাল ব্রোঞ্জের কামানের একটা টানার জন্য নিয়োজিত ষাড়ের দলের গলার কাঠের সংযোজক ধরে তার গোলন্দাজ বাহিনীর বিশজনের মতো সৈন্য টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। লোকগুলো তাদের হাতের চাবুক আর সেইসাথে বাহবা ধ্বনি দিয়ে অনিচ্ছুক জন্তুগুলোকে হুমায়ুন আর তার লোকেরা নদীতে দুলতে থাকা ভেলা আর নৌকার যে সেতু তৈরী করেছে তার উপরে পা রাখতে প্ররোচিত করতে চেষ্টা করছে, সেতুটা এই স্থানে প্রায় দুইশ ফিট প্রশস্ত।

হুমায়ুন তাঁর আব্বাজানের অভিজ্ঞতা দেখে শিখেছে এবং ভাটির দিকে এমন একটা স্থান নির্বাচিত করেছে- যেখানে নদীটা ডান দিকে একটা প্রায় সমকোণী বাঁক নিয়েছে বলে তার স্রোতের বেগ এখানে অনেক শ্লথ। সে কাবুল ত্যাগ করার পরে গত ছয় সপ্তাহ যাবৎ, তার আগে থেকে তৈরী করে রাখা দাঁড় টানা ভেলার কারণে সে তার বাহিনী নিয়ে ধুসর, বন্ধ্যা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কাবুল নদীর উপর দিয়ে সে যেমনটা আশা করেছিল তার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভেলাগুলো বস্তুত পক্ষে এতোই কার্যকরী যে সিন্ধু নদীর বিশাল জলধারার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক নৌকা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁর আব্বাজানকে কেমন বেগ পেতে হয়েছিল সেটা স্মরণ করে এবং সবসময়ে একটা বিষয়ে সচেতন থেকে যে তাঁকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে যদি সে তাঁর সুযোগ নষ্ট করতে না চায়, হুমায়ুন তাই অর্ধেক ভেলা খুলে সেগুলো হিন্দুস্তান অভিমুখী যাত্রার সময় ভারবাহী পশুর পিঠে চাপিয়ে দেয় যাতে করে সে সিন্ধু নদী অতিক্রম করার সময় সেগুলো পুনরায় ব্যবহার করতে পারে। সে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল বলে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করে যেহেতু সে সামান্য কিছু নৌকা সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেও, তার প্রায় অর্ধেক অস্থায়ী সেতু সাথে করে বয়ে আনা ভেলা বা ভেলার উপকরণ থেকে নির্মিত। সে নদীর তীরে পৌঁছাবার পর থেকে গত তিনদিন যাবৎ তাঁর প্রকৌশলীরা নিজেদের উদ্ভাবনকুশলতার দ্বারা ভেলার টুকরোগুলো একত্রে বাঁধছে। হুমায়ুন তাদের সাথে যোগ দিয়ে, কোমর পর্যন্ত বরফ শীতল পানিতে দাঁড়িয়ে, তাঁর লোকদের উৎসাহ দেয়, নিজেও আঙ্গুল দিয়ে চামড়ার ফালিতে গিঁট দিতে থাকে আঙ্গুলগুলো অচিরেই ঠাণ্ডায় জমে নীল আর অসার হয়ে পড়ে।

সে এখন স্বস্তির সাথে তাকিয়ে দেখে যে ধুসর রঙের ষাড়ের প্রথম জোড়াটা সেতুর উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং পুরো দলটা তাঁদের অনুসরণ করছে। তার গোলন্দাজ বাহিনীর আরো লোকজন এসে কামানবাহী শকটের চারটা বিশালাকৃতি চাকা ধাক্কা দিতে আর টানতে থাকে, কাদার ভিতর দিয়ে সেতুর দিকে এগিয়ে যেতে ষাড়গুলোকে সাহায্য করে। তারা যখন ধাক্কা দিতে ব্যস্ত তখন ওজনের কারণে সেতুর পাটাতন পানির ভেতরে বেশ খানিকটা ডুবে যায়। মিনিটখানেকের ভিতরে, অবশ্য, কামান, মানুষ আর পশুর পাল নিরাপদে সেতু অতিক্রম করে এবং তারপরে ষাড়ের পরবর্তী দলটাকে নদীর উত্তর তীরে উৎসাহিত করার ভিতর দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা আবার আরম্ভ হয়।

হুমায়ুন সহসা নদীর দক্ষিণ তীরের সীমান্তবর্তী নীচু টিলার উপরে সে বৃত্তাকারে যে প্রহরীদের মোতায়েন করেছে যাতে নদী অতিক্রম করার সময় অজ্ঞাত কেউ কাছে এলে সর্তক করে দেয়, তাদের অবস্থান থেকে তূর্যধ্বনি শুনতে পায়। প্রথমে একবার তারপরে দ্বিতীয় এবং তারপরে তৃতীয় ধ্বনি ভেসে আসে মানুষের বিশাল বহর তাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসলে সে আর আহমেদ খান যে হুশিয়ারি সংকেত নির্ধারণ করেছিল।

আমরা যখন অনুসন্ধান করবো, পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা কি দেখেছে তখন যেন সেতুর উপর দিয়ে কামার পার করা না হয়। অশ্বারোহীদের আরো দূরে ছড়িয়ে দাও এবং আমাদের তবকিরা যেন বন্দুকে বারুদ আর গুলি ভরে নিজেদের অস্ত্র প্রস্তুত রাখে।

হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষীদের অনুসরণ করা ইঙ্গিত করে, সে তার বিশাল কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে তাঁকে দুলকি চালে ছোটাতে শুরু করে এবং নীচু যে টিলার উপর থেকে তূর্যবাদকেরা হুশিয়ারি সংকেত ধ্বনিত করেছে সে শীঘ্রই সেখানে পৌঁছে যায়। হুমায়ুন সাথে সাথে দেখতে পায় কেন লোকটা হুশিয়ারি সংকেত ধ্বনিত করেছে। প্রায় পৌনে এক মাইল দূরে, দক্ষিণ দিক থেকে হিন্দুস্তানের দিক থেকে- ঘোড়ায় চেপে বিশাল একটা দল এগিয়ে আসছে। হুমায়ুন এমনকি এই দূরত্ব থেকেও সূর্যালোকে তাঁদের বর্শার ফলার অগ্রভাগ ঝলসাতে দেখে এবং অশ্বারোহী দলটা অগ্রসর হবার সাথে সাথে তাদের নিশান বাতাসে পতপত করে উড়ে। অশ্বারোহী লোকগুলো, যাদের সংখ্যা খুব সম্ভবত একশর কাছাকাছি হবে, মনে হয় আস্কন্দিত বেগের বদলে অর্ধবল্পিত বেগে এগিয়ে আসছে তাঁদের যদি আক্রমণের অভিপ্রায় থাকতো তারা এভাবে আসতো না। হুমায়ুন অবশ্য কোনো ধরনের সুযোগ দিতে রাজি নয়।

আমাদের তবকি আর তীরন্দাজদের দ্রুত আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করার বিষয়টা নিশ্চিত কর, সে চিৎকার করে তার এক আধিকারিককে আদেশ দেয়। অশ্বারোহী দলটা আরো কাছে আসলে হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে তাঁদের কারো মাথায় শিরোম্রাণ নেই আর তাদের অস্ত্রও কোষবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। তারা তিনশ গজ দূরে অবস্থান করার সময় ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং এক কি দুই মিনিট পরে তাদের ভেতর থেকে একজন নিজের ধুসর ঘোড়া নিয়ে একাকী ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। সে স্পষ্টতই একজন ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বা কোনো ধরনের মুখপাত্র এবং হুমায়ুন তাঁর দুইজন দেহরক্ষীকে আদেশ দেয় লোকটাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসবার জন্য ঘোড়া নিয়ে তাঁর প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে সামনে এগিয়ে যেতে।

পাঁচ মিনিটের ভিতরে সেই অশ্বারোহীকে দুধসাদা রঙের আলখাল্লা পরিহিত লম্বা ছিপছিপে এক তরুণ এবং তার গলায় বেশ মোটা একটা সোনার মালা ঝুলছে হুমায়ুনের সামনে হাজির করা হয়। পায়ের নীচের ময়লা আর পাথর সম্পর্কে আপাতদৃষ্টিতে উদাসীন লোকটা হুমায়ুনের সামনে, মুখ নীচের দিকে রেখে, দুহাত প্রসারিত করে নিজেকে প্রণত করে, সে তখনও নিজের বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট জন্তুটা অস্থির ভঙ্গিতে সামনের পায়ের খুর দিয়ে পাথুরে জমিতে ক্রমাগত বোল তুলছে।

কে আপনি? কি চান?

আমি মুরাদ বেগ, মুলতানের সুলতান উজাদ বেগের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আমার আব্বাজানের পক্ষ থেকে আমি এসেছি যিনি নিজের দেহরক্ষীদের সাথে ওইদিকে অপেক্ষা করছেন। তিনি এখানে এসে আপনাকে নিজের জায়গীর আর অভিবাদন নিবেদন করার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। তার ইচ্ছা আপনার ন্যায়সঙ্গত হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার অভিযানে সহযোগিতা করার জন্য তার সৈন্যবাহিনীকে আপনার অধীনে অর্পণ করা।

হুমায়ুন উজাদ বেগের নাম শুনে মুচকি হাসে। কাবুল নদী আর খাইবার গিরিপথ ধরে সে নীচের সমভূমির দিকে নেমে আসবার সময় অনেক গোত্রপ্রধান এসেছে, তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে। তাঁদের অনেকেই পুরাতন রীতি অনুসরণ করে নিজেদের মুখে ঘাস নিয়ে তাঁর আর আকবরের সামনে উপস্থিত হয়েছে এটা দেখাতে যে তাঁরা হুমায়ুনের অনুগত ভারবাহী পশু, তাঁর ষাড়ের পাল, সে নিজের অভিপ্রায় অনুসারে তাঁদের সাথে আচরণ করতে পারে। হুমায়ুন প্রতিবারই তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে এবং তাঁদের লোকজন তার সেনাবাহিনীতে কার্যকর সংযোজন বলে বিবেচিত হয়েছে।

উজাদ বেগের বিষয়টা অবশ্য আলাদা। সে কোনো মামুলি গোত্র প্রধান নয় বরং একজন পরিশীলিত আর ধূর্ত নৃপতি। পনের বছর পূর্বে, চসার যুদ্ধের পরে, শেরশাহের অগ্রগতি বন্ধে সাহায্য করতে হুমায়ুন সৈন্যের জন্য তাঁর কাছে নিজের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল, কিন্তু উজাদ বেগ তার দেখা অন্যতম সেরা নিষ্ঠাবান সত্যের অপলাপকারী। তাঁর বিচিত্র সব অজুহাতের গৰ্তাধা ফিরিস্তির ভিতরে ব্যক্তিগত অসুস্থতা থেকে শুরু করে বিদ্রোহ দমনের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও ছিল তার দূর্গপ্রাসাদে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের গল্প। হুমায়ুন পরবর্তীতে জানতে পারে শেরশাহকে নিজের অধিরাজ হিসাবে প্রথমে যারা স্বীকৃতি দিয়েছিল সে তাদের ভিতরে অন্যতম। সেই লোক এখন আরো একবার হুমায়ুনের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রদর্শন করতে ছুটে আসায় ব্যাপারটা সত্যিকারের ইঙ্গিতবহনকারী যে তারই বিজয়। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এবং সে অচিরেই রাজকীয় সিংহাসনে পুনরায় অধিষ্ঠিত হবে। হুমায়ুন অনুধাবন করে যে এখন পুরাতন বিবাদের বোঝাঁপড়া করার সময় না বরং তাঁর অনুগত প্রাক্তন জায়গীরদার আর তাঁদের প্রজাদের সমর্থণ অর্জনের বিষয়টা নিশ্চিত করা যেন দিল্লী আর আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হবার সময় তার পশ্চাতে শান্তি বজায় থাকে। তাছাড়া তার যতদূর মনে পড়ছে, উজাদ বেগের লোকেরা সাহসী, সুসজ্জিত যোদ্ধা যখন তাদের শাসককে প্ররোচিত করা সম্ভব যুদ্ধের ফলাফল পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ না হয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে। হুমায়ুন ভাবে, সে যাই হোক, উজাদ বেগের খানিকটা ঘাম ঝরাতে দোষ কি…

তোমার আব্বাজানকে আমার ভালোমতোই মনে আছে। আমি খুশী হয়েছি যে তাঁর স্বাস্থ্য, যা তিনি আমাকে প্রায়শই লিখে জানাতেন যে তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে, বিগত বছরগুলোয় এতোটাই উন্নত হয়েছে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তুমি তাকে জানাতে পার যে সূর্য অস্ত যাবার ঠিক আগে আগে এক ঘন্টার ভিতরে, যখন আমার অস্থায়ী ছাউনি তাঁর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ সামন্তরাজকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হবে, তাকে স্বাগত জানাতে পারলে আমি খুশীই হব।

সুলতান, আমি গিয়ে তাঁকে সেটাই বলবো।

একঘণ্টার সামান্য কিছুক্ষণ পরে, হুমায়ুনকে, একজন সম্রাটের পক্ষে মানানসই পোষাক পরিহিত অবস্থায়, তার নিয়ন্ত্রক তাবুর লাল চাঁদোয়ার নীচে একটা গিল্টি করা সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায় আকবর তাঁর পাশে একটা নীচু টুলে বসে রয়েছে। হুমায়ুনের সেনাপতিরা তাঁর সিংহাসনের দুপাশে সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সিংহাসনের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ পাগড়ি আর বুকে ইস্পাতের ঝকঝকে বক্ষনিরোধক বর্ম পরিহিত দুজন দেহরক্ষী। আকাশে গোলাপী আর বেগুনী রঙের আবীর ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে, তখন উজাদ বেগ হুমায়ুনের রক্ষীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং নিজের ছেলেকে সাথে নিয়ে হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে যায়। দলটা তার সামনে উপস্থিত হওয়া মাত্র উজাদ বেগ আর তার ছেলে নিজেদের সাষ্টাঙ্গপ্রণত করে। সে তাঁদের অধধামুখে শীতল স্যাঁতসেঁতে মাটিতে সে মনে মনে ভাবে তারা যেমনটা প্রত্যাশা করেছিল তারচেয়ে কিছুটা বেশী সময় শুইয়ে রাখে। তারপরে সে লক্ষ্য করে কথা বলে।

তোমরা দুজনেই এখন উঠে দাঁড়াতে পার।

উজিদ বেগ উঠে দাঁড়াবার সময় হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে তাঁর অনুগত সামন্তরাজের চুল আর দাড়ি এখন অনেক বেশী সাদা এবং তার কাঁধ সামান্য ঝুঁকে রয়েছে, এবং তার পরণের রেশমের সবুজ টিউনিক একটা নাদুসনুদুস ভূড়ির চাপে টানটান হয়ে রয়েছে। হুমায়ুন প্রায় নিজের অজান্তে তার ইতিমধ্যে অনেকটা সমতল হয়ে আসা পেটের পেশী ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে কথা শুরু করে।

এতো বছর পরে আবার আপনার সাথে দেখা হওয়ায় আমি খুব খুশী হয়েছি। আমার সাথে আপনি হঠাৎ কি মনে করে দেখা করতে এসেছেন?

আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই যে তিনি আমাদের মহামান্য সুলতানকে সহিসালামত রেখেছেন এবং আমিও নিজের মূল্যহীন জীবন বাঁচিয়ে রেখেছি হয়ত আপনার ন্যায়সঙ্গত সিংহাসন পুনরুদ্ধারে আপনার অভিযানের জন্য আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে। আমার অধিরাজ, আমি আপনার কাছে এসেছি আমার নিজের এবং সেই সাথে আমার প্রজাদের বিনীত আনুগত্য নিবেদন করতে। উজিদ বেগ শ্বাস নেয়ার জন্য একটু থামে এবং নিজের পরিচারকদের একজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে যে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করছে। সুলতান, আমি বিনীত অনুরোধ করছি, এই লোকটাকে সামনে অগ্রসর হবার অনুমতি দেন।

হুমায়ুন মাথা নেড়ে নিজের সম্মতি জানায় এবং পরিচারকটা সোনালী রঙের তাকিয়ার উপরে রাখা হাতির দাঁতের তৈরী একটা বিশাল সিন্দুক নিয়ে উজিদ বেগের দিকে এগিয়ে আসে। উজিদ বেগ সিন্দুকের ভিতর থেকে রুবি বসান একটা সোনার পানপাত্র বের করে সেটা বিম্র ভঙ্গিতে হুমায়ুনের সামনে তুলে ধরে।

সুলতান, আমি আমার আনুগত্যের একটা ক্ষুদ্র স্মারক হিসাবে এই উপহারটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।

আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি খুবই প্রীত হয়েছি যে আরো একবার আপনার অধিরাজ হিসাবে আমাকে স্বীকৃতি দিতে আপনি নিজে এসেছেন। আমার আহ্বানে সাড়া দিতে আপনি সচরাচর এতটা উদগ্রীব থাকেন না।

উজিদ বেগের চোখমুখ লাল হয়ে যায়। সুলতান, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণেই কেবল সাময়িকভাবে আমাকে বিরত থাকতে হয়েছিল, এবং এর কিছুদিন পরেই আপনি হিন্দুস্তান ত্যাগ করেছিলেন।

নির্বাসিত অবস্থায় আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে অনুসরণ করতে পারতেন।

আমাকে আমার সিংহাসন আর পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টা লক্ষ্য রাখতে হয়েছিল, উজিদ বেগ কোনমতে তোতলাতে তোতলাতে বলে।

হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নেয় বেচারাকে অনেক অপদস্থ করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমাদের সবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। অতীতে কথা ভুলে যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গল। আপনি আরো একবার আপনার আনুগত্য আমার প্রতি নিবেদন করেছেন বলে আমি খুশী হয়েছি এবং এই আনুগত্য যে আন্তরিকতার সাথে নিবেদন করা হয়েছে আমিও ঠিক সেই আন্তরিকতার সাথেই এটা গ্রহণ করছি। আপনি আমার সৈন্যবাহিনীতে কতজন সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন?

আপনি দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা শুরু করার কয়েক দিনের ভিতরেই আটশ অশ্বারোহীর একটা সুসজ্জিত বাহিনী আপনার বাহিনীর সাথে যোগ দিতে পারবে।

আমি খুব খুশী হবো যদি এখানে উপস্থিত আপনার এই ছেলে অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি হিসাবে আমার সাথে যোগ দেয়, হুমায়ুন বলে, তাঁর মুখের একটা পেশীও টান খায় না, সে খুব ভালো করেই জানে যে তার বাহিনীর সাথে মুরাদ বেগের উপস্থিতি তার আব্বাজানের সুবোধ আচরনের কার্যকর নিশ্চয়তা দান করবে।

সুলতান, আমি নিজেই এটা প্রস্তাব করতে যাচ্ছিলাম।

*

এপ্রিলের প্রথমদিকে সূর্য মাত্র তিনঘন্টা আগে আকাশে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে, যখন হুমায়ুন পাঞ্জাবে অবস্থিত একসারি শৈলচূড়ার শেষটার শিখরে আকবর আর বৈরাম খানকে পাশে নিয়ে উঠে আসে এবং সামনের দিকে তাকিয়ে বেলেপাথরের তৈরী অতিকায় রোহতাস দূর্গের কাঠামো দেখতে পায়। নীচের সমভূমিতে একটা নিচু কিন্তু দৃশ্যমান শিলাস্তরের উপরে দূর্গটা নির্মাণ করা হয়েছে, যেখান থেকে উত্তর আর পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ অভিমুখী রাস্তার সংযোগস্থলের দিকে লক্ষ্য রাখা যায়। হুমায়ুন হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরে ক্রমাগতভাবে প্রবেশ করার পরেও তাকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের লক্ষণীয় বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। উজাদ বেগের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বরং ইসলাম খানের অনুগত জায়গীরদারের স্বপক্ষ ত্যাগ করতে শুরু করে। নিজেদের প্রাক্তন অধিরাজকে তারা এতো উদগ্র ভঙ্গিতে অভিযুক্ত করে এবং নিজেরা আনুগত্য আর সমর্থনের শপথ নেয় যে হুমায়ুন সাথে সাথেই বালক আকবরকে পরামর্শ দেয় এসব দৃঢ়োক্তি সে যেন কখনও অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস না করে। সর্বোপরি, এদের অনেকেই আগে হুমায়ুনকে ত্যাগ করে শেরশাহের প্রতি নিজেদের আনুগত্য জ্ঞাপন করেছিল এবং আকবর লক্ষ্য করে দেখে তাঁর আব্বাজান সম্পর্কে তাদের এই বর্তমান প্রশস্তি আর আনুগত্যের উৎকীর্তন এসবই মূলত অভ্যঞ্জনেরই নামান্তর। হুমায়ুনের সেনাবাহিনী কাবুল থেকে রওয়ানা দেবার পরে যখন সিন্ধু নদী অতিক্রম করছে ততদিনে এর লোকবল বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়ে বাইশ হাজার হয়েছে। এই সংখ্যা বেড়ে এখন প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার হয়েছে এবং প্রতিদিনই আরো বেশী সংখ্যায় নতুন লোক এসে উপস্থিত হচ্ছে।

আব্বাজান, দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার বন্ধ। দূর্গপ্রাকারের উপরে সশস্ত্র লোক অবস্থান করছে এবং আমি রান্নার জন্য প্রজ্জ্বলিত আগুন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখছি। আমাদের কি দূৰ্গটা দখল করা একান্ত জরুরী নাকি এটা পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি? আকবর জিজ্ঞেস করে।

হিন্দুস্তানের উত্তরাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এই দূর্গটা অন্যতম একটা চাবিকাঠি। আমরা এটাকে শত্রুর হাতে রেখে এগিয়ে যেতে পারি না যারা যেকোনো সময়ে আকস্মিকভাবে পেছন থেকে আমাদের আক্রমণ করে বসতে পারে, আমাদের তাই অবশ্যই দূর্গটা নিজেদের দখলে নিতে হবে। অবশ্য গুজবে শোনা যায় যে দূর্গের প্রতিরক্ষায় খুবই সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়োজিত রয়েছে। তাদের সামনে সাহায্যকারী কোনো বাহিনী এসে পৌঁছাবার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং নৈরাশ্যজনক কারণে মৃত্যুবরণ করতে তারা খুব একটা উৎসাহী হবে না। আমি দেখতে চাই প্রাথমিকভাবে শক্তি প্রদর্শন কি ফলাফল বয়ে আনে। বৈরাম খান শত্রুপক্ষের গাদাবন্দুকের লক্ষ্যভেদের নাগালের বাইরে দূর্গের ঠিক সামনে আমাদের কয়েকটা কামান এমনভাবে মোতায়েন করেন, যেন দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার আর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের নিম্নাংশে সেখান থেকেই তারা কিছুটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে। আমাদের অশ্বারোহীদের আদেশ দেন তারা যেন ভূপৃষ্ঠের উপরে দৃশ্যমান শিলাস্তরের চারপাশে ব্যুহ রচনা করে অবস্থান করে এবং আমাদের তবকি আর তীরন্দাজেরা কামানের পিছনে যেন এমনভাবে সমবেত হয় যে দূর্গের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা তাদের সংখ্যা সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে।

দুই ঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে, জোড়ায় জোড়ায় যূথবদ্ধ ষাড়ের দল মোগল তোপ নির্ধারিত স্থানে টেনে নিয়ে আসে এবং হুমায়ুনের অশ্বারোহী সৈন্যরা রোহতাসের চারপাশে ব্যুহ বিন্যাস সমাপ্ত করে, বসন্তের বাতাসে পতপত করে তাঁদের লম্বা, সরু সবুজ নিশান উড়তে শুরু করে। পুরোটা সময় ধরে, যদিও দূর্গপ্রাচীরের উপরে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেলেও, দূর্গ প্রতিরক্ষাকারী সৈন্যরা তাদের অবরোধকারীদের কার্যকলাপে ছন্দপতন ঘটাতে কোনো ধরনের আক্রমণের প্রয়াস নেয়া থেকে বিরত থাকে। সবকিছু জায়গামতো মোতায়েন করা হয়েছে দেখে নেবার পরে হুমায়ুন বৈরাম খানকে আদেশ দেয়, দূর্গপ্রাসাদের তোরণদ্বার লক্ষ্য করে কামানগুলোকে গোলাবর্ষণের আদেশ দেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ ধোঁয়া কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় যখন চারপাশ ঢেকে ফেলে। তোরণদ্বারের চারপাশে উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ধোয়া পর্যাপ্ত পরিমাণে জমা হলে, আমাদের তবকিদের ভিতর থেকে বাছাই করা ছেলেদের ধোঁয়ার আড়াল ব্যবহার করে সামনে শত্রুর নাগালের ভিতরে এগিয়ে যেতে বলেন এবং কামানের গোলা নিক্ষেপের জন্য দূর্গ প্রকারের পিছনে অবস্থিত ছাদ থেকে যারা নিজেদের দেহকাঠামো পর্যবেক্ষণ করে তারপরে, তাদের কেউ আর সেখান থেকে পরে শ্রেণীকক্ষে ফিরে যায়নি। ইত্যবসরে আমাদের বার্তাবাহকেরা দূর্গের প্রতিরক্ষাকারীদের নিরাপদে প্রস্থানের সুযোগ করে দিয়ে। আমাদের পক্ষে কি তা করা সম্ভব, দলিল লেখকেরা কি এখন দলিলও ছেড়ে যেতে শুরু করেছে এবং তারা যখন ঘন্টাখানেকের ভিতরে নিজেদের প্রস্তত করতে আদেশ দেয় তাহলে স্পেন প্রতিরোধকারীদের নিরাপদে প্রস্থান করতে দেবে এটা একটা বার্তা আকারে লিখতে বলে। আমরা কতখানি অনর্থ ঘটাতে পারি সেটার একটা নমুনা প্রদর্শনের পরে আমাদের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজেরা আত্মসমর্পণের বার্তা সম্বলিত তীর শহর লক্ষ্য করে ছুড়বে।

সমভূমির উপর দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই একটা বিকট বুম শব্দ ভেসে আসে, হুমায়ুনের আদেশ অনুসারে তোপচিরা ব্রোঞ্জের তোপের আগ্নেয় গহ্বরে তাদের হাতের জ্বলন্ত নোম লাগান সুতা প্রবিষ্ট করেছে। তোপের প্রথম কয়েকটা গোলা লক্ষ্যবস্তু থেকে বেশ দূরে, শৈলস্তরের একেবারে নীচের ঢালে আঘাত করে এবং তোরণদ্বার আর দূর্গপ্রাকারের ক্ষতি করার বদলে বাতাসে মাটি আর পাথরের টুকরো বৃষ্টির মতো নিক্ষেপ করে। দিন বাড়ার সাথে সাথে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে কোমর পর্যন্ত নিরাভরণ ঘর্মাক্ত দেহে তোপচিরা বড় কামানবাহী শকটের চাকার নীচে পাথর দিয়ে আর ছোট কামানগুলোকে হাতে তুলে উঁচু মাটির ঢিবির উপরে নিয়ে গিয়ে কামানের নতি পরিবর্তনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা যখন এই কাজে ব্যস্ত তখন উঁচু দূর্গপ্রাকার থেকে কয়েকটা গাদাবন্দুকের শব্দ ভেসে আসে কিন্তু হুমায়ুনের পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্যভেদের জন্য দূরত্বটা একটা বিশাল বাঁধা হিসাবে প্রতিয়মান হয়।

দূর্গের নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রহরীদের নিক্ষিপ্ত কয়েকটা তীর, অবশ্য, কামানের অবস্থানের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয় নিক্ষিপের সময় তারা ধনুকের মুখ উপরের দিকে রাখায় তীরগুলো বেশী দূরত্ব অতিক্রম করে। নির্মেঘ আকাশের বুক থেকে মৃত্যু মুখে নিয়ে তাঁরা নীচে নেমে আসে, অধিকাংশই নিরীহ ভঙ্গিতে মাটিতে গেঁথে তিরতির করে কাঁপতে থাকে কিন্তু বেশ কয়েকটা তীর দাঁড়িয়ে থাকা ষাড়ের গায়ে বিদ্ধ হলে, তাঁদের পিঙ্গল বর্ণের চামড়া রক্তে কালচে দেখায়, এবং হুমায়ুন দেখে তাঁর একজন তোপচিকে সবাই ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার পিঠে কালো শরযষ্টি যুক্ত দুটো তীর বিদ্ধ হয়েছে একটা কামানকে জায়গামতো নিয়ে যাবার জন্য প্রাণপনে সেটাকে ধাক্কা দেবার সময় বেচারা পিঠে তীরবিদ্ধ হয়েছে। কামানগুলো সাময়িক বিরতির পরে শীঘ্রই আবার গোলা বর্ষণ শুরু করে এবং এবার নিয়মিতভাবে কামানের গোলা তোরণদ্বার আর এর দুপাশের পাথুরে দেয়ালে লক্ষ্যভেদ করতে থাকে। কাবুলের পার্শ্ববর্তী উপত্যকায় যেমন দেখা যায় অনেকটা সেরকম প্রথম সকালের কুয়াশার মতো সাদা ধোয়ার একটা আচ্ছাদন কামানগুলোর উপরে ভেসে থাকে।

হুমায়ুন তাকিয়ে দেখতে থাকে তার একদল তবকি তাদের গাদাবন্দুক আর গুলি করার সময় বন্দুক রাখার তেপায়া নিয়ে সামনে দৌড়ে গিয়ে ধোয়ার ভিতরে হারিয়ে যায়। তাঁর বেশ কয়েকজন তীরন্দাজ পিঠে তীর ভর্তি তূণীর আর হাতে দুই মাথাযুক্ত ধনুক নিয়ে তবকিদের অনুসরণ করে। এক কি দুই মিনিট পরেই দূর্গপ্রাকারের সমতল ছাদ থেকে একটা দেহ শূন্যে দুহাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে নীচের পাথরে আছড়ে পড়ে। আরেকটা দেহ বাতাসে কিছু একটা আকড়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে প্রথমজনকে অনুসরণ করে, এবার হুমায়ুন স্পষ্ট দেখতে পায় হতভাগ্য লোকটার গলা একটা তীর এফোড়ওফোড় করে দিয়েছে। দূর্গ প্রাকারে অবস্থানরত দূর্গরক্ষীদের বন্দুক থেকে আর কোনো সাদা ধোয়ার মেঘ বাতাসে ভাসতে দেখা যায় না এবং আকাশ থেকে নেমে আসা তীরের সংখ্যাও লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পায় অবশ্য রোহতাস দূর্গের তোরণদ্বারগুলো তখনও দৃঢ়ভাবে ভেতর থেকে বন্ধ করা রয়েছে।

আমরা যেমন ধারণা করেছিলাম, লড়াই করার জন্য স্পষ্টতই দূর্গরক্ষীরা খুব একটা আগ্রহী না। তীরন্দাজদের এবার তাঁদের তীরে আত্মসমর্পনের আহ্বান সম্বলিত বার্তাগুলোকে সংযুক্ত করতে বলেন এবং সামনে এগিয়ে গিয়ে শহর লক্ষ্য করে তীরগুলো ছুঁড়তে বলেন, হুমায়ুন আদেশ দেয়। কয়েক মিনিটের ভিতরে, সে দেখে বার্তাযুক্ত তীরগুলো আকাশে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, বেশীরভাগ তীরই দূর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর দিয়ে উড়ে যায় এবং দূর্গের ভিতরে অবতরণ করে।

আত্মসমর্পণের বার্তাযুক্ত তীর নিক্ষেপের প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে, আকবরকে পাশে নিয়ে, হুমায়ুন ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় রোহতাসের উঁচু, লোহার গজালযুক্ত প্রধান তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে দূর্গের অভ্যন্তরের জনশূন্য, নিরব প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে, পরিত্যক্ত অস্ত্র আর ভারী যুদ্ধ উপকরণে পুরো জায়গাটা গিজগিজ করছে। হুমায়ুনের সৈন্যবাহিনীর শক্তি দেখে, দূর্গের প্রতিরক্ষায় যারা ছিল তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবের উদারতায় সাথে সাথে সমঝদারের মতো সম্মতি দিয়েছে। কয়েক মিনিটের ভিতরে দূর্গের প্রধান তোরণদ্বারের পুরু কাঠের পাল্লা খুলে যায় এবং সেনাছাউনির লোকেরা দুই পাল্লার মাঝের ফাঁকা স্থান দিয়ে, কেউ খালি পায়ে কেউ ঘোড়ায় চড়ে তাঁদের পক্ষে বহন করা সম্ভব এমন মূল্যবান সব কিছু নিয়ে, স্রোতের মতো বাইরে বের হয়ে আসতে শুরু করে এবং সবাই দক্ষিণ দিকে রওয়ানা দিয়ে, হুমায়ুনকে হিন্দুস্তানে প্রবেশপথে অবস্থিত এই ঘাঁটিটার মালিক হিসাবে স্বীকার করে ছেড়ে দিয়ে যায়।

হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষীদের কয়েকজন আধিকারিককে আদেশ দেয় দূর্গের সেনাছাউনি থেকে আসলেই সবাই বিদায় নিয়েছে কিনা তল্লাশি করে দেখতে এবং নিশ্চিত করতে যে অতর্কিত হামলা করার জন্য সেখানে কেউ ওঁত পেতে নেই। তাঁদের কাছ থেকে দ্রুত নিশ্চয়তাজ্ঞাপক সংবাদ লাভ করার পরে, হুমায়ুন দূর্গের দরবার কক্ষের খোলা দরজার দিকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন হাঁটবার গতি না কমিয়ে ডানদিকে তাকিয়ে দেখে মাটির কয়েকটা তন্দুরের নীচে তখনও কয়লার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। সে একটা তন্দুরের ভিতরে উঁকি দিয়ে সেখানে বেশ কয়েকটা গরম আর আফোলা রুটি দেখতে পায়। সে একটা রুটি তুলে নিয়ে সেখান থেকে ছোট একটা টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে, টুকরোটা আকবরের দিকে এগিয়ে দেয়।

রুটিটা উপভোগ করো। রুটির এই টুকরোয় বিজয়ের স্বাদ রয়েছে।

৪.৬ চুড়ান্ত বিজয়

২৬. চুড়ান্ত বিজয়

হুমায়ুনের নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে ইতিমধ্যে সৃষ্ট জলভর্তি পানির বড়বড় সব ডোবায় আবারও সীসার মতো আকাশের বুক থেকে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা অঝোরধারায় ঝরতে শুরু করে। যুদ্ধের জন্য আহবান করা পরামর্শ সভায় তার সাথে যোগ দেবার জন্য সে যখন তাঁর সেনাপতিদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে তখন সে তাবুর কানাতের উপর অঝোরে ঝরতে থাকা বৃষ্টির পানির নীচে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে তাঁর শিবিরের নীচু আর কর্দমাক্ত কিছু এলাকায় পানি জমে সৃষ্ট এইসব ডোবাগুলো পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে জলাশয়ের আকার ধারণ করেছে। পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত তার সৈন্যদের পায়ের পাতা পানিতে পুরোপুরি ডুবে রয়েছে যারা তাদের কাঁধের মাঝে মাথা কুঁজো করে রেখে পায়চারি করার সময় অনবরত পানি ছিটিয়ে চলেছে। সে যেদিকেই তাকিয়ে দেখুক না কেন আকাশের কোথাও বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণ তার চোখে পড়ে না।

হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তাবুতে ফিরে আসে, যেখানে তাঁর সেনাপতিরা ইতিমধ্যে অর্ধবৃত্তাকারে সমবেত হয়েছে, তাঁদের অনেকেই তাঁর তাবুর উল্টোপাশে অবস্থিত নিজেদের তাবু থেকে সামান্য এই দূরত্বটুকু দৌড়ে অতিক্রম করার সময় বৃষ্টিতে একদম কাকভেজা করে ভিজে গিয়ে তখনও কাপড় থেকে বৃষ্টির পানি ঝেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করছে। হুমায়ুন আকবরকে পাশে নিয়ে কেন্দ্রে তাঁর নির্ধারিত স্থানে আসন গ্রহণ করে।

আহমেদ খান, সেকান্দার শাহের সেনাবাহিনীর সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে। আমরা নতুন আর কি জানতে পেরেছি?

শিরহিন্দে নিজের সুরক্ষিত অবস্থানের প্রায় ছয় মাইল ভেতরে সে রয়েছে, আমরা এখানে এসে শিবির স্থাপন করার পূর্বে তাঁর অবস্থান অভিমুখে অগ্রসর হবার সময়ে পক্ষকালব্যাপী সে ঠিক যা করে আসছিল। তাঁর গুপ্তদূত যাদের আমরা সাথে আমাদের মোকাবেলা হয়েছে বা যাদের আমরা বন্দি করেছি তাদের সংখ্যা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে তিনি আমাদের অগ্রসর হবার বিষয়ে অনেক পূর্বে থেকেই অবগত ছিলেন কিন্তু তারপরেও আমাদের মোকাবেলা করার কোনো প্রয়াসই তিনি গ্রহণ করেননি। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তিনি এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে চারদিকে কাদা থাকায় আমাদের চলাফেরার গতি শ্লথ হয়ে গিয়ে তার তবকি আর তীরন্দাজদের আর সেই সাথে তার নিখুঁতভাবে সুরক্ষিত কামানের সহজ নিশানায় পরিণত হবার ভয়ে আমরা বর্ষাকালে আক্রমণ করার মতো হঠকারিতা দেখাব না।

আমি আমাদের আক্রমণ গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিলম্বিত করেছি, এই ভ্রান্ত বিশ্বাসটা সিকান্দার শাহকে বিশ্বাস করার জন্য উৎসাহিত করতে, তাঁকে নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছি যে তাঁর মতোই আমরাও সনাতনধারায় বিশ্বাসী এবং আমরা সতর্ক থাকবে এবং সেই সাথে তাঁর অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছাবার পরে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে মাটি আবারও শক্ত হয়ে উঠা পর্যন্ত আমরা যেকোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করে দেব।

কিন্তু সুলতান, তাঁর বিশ্বাসটাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না, জাহিদ বেগ জানতে চায়, তাঁর কৃশকায় মুখাবয়বে স্পষ্টতই গভীর উদ্বেগের চিহ্ন প্রকাশিত। আমরা আমাদের কামানগুলো একেবারে স্থানান্তরিক করতে পারছি না আর আমাদের মাস্কেটের বারুদ সবসময়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ছে। আমাদের লোকেরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আগুনের কাছে বারুদ নিয়ে গিয়ে শুকাবার চেষ্টা করায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

আমরা আক্রমণ যখন করবো তখন অবশ্যই কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবো, হুমায়ুন বলে, কিন্তু বিহ্বল করে দেয়ার ফলে আমরা যেসব সুবিধা লাভ করবো তার সাথে তুলনায় অসুবিধাগুলো ধর্তব্যের ভিতরেই পড়বে না।

বৈরাম খান সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে কিন্তু অন্যান্যদের তখনও সন্দিহান দেখায়। আকবর সহসা, এতক্ষণ সে যেখানে বসে ছিল সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায়, সে সাধারণত মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুনে থাকে কদাচিৎ কথা বলে, এবং সংযত আর সংকল্পবদ্ধ স্বরে বলতে শুরু করে, আব্বাজান আমার বিশ্বাস আপনি ঠিকই বলেছেন। নিজেদের নিয়তিকে হাসিল করার আর আরও অধিক সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহে সফল হবার পূর্বেই সিকান্দার শাহকে চমকে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আমাদের চেয়ে সৈন্য সংগ্রহের জন্য তার অনেক বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে।

আকবর, দারুণ কথা বলেছো, হুমায়ুন বলে। আমি আহমেদ খানকে বলবো গুপ্তদূত প্রেরণ করে এই মুহূর্তে সিকান্দার শাহের শিবিরে পৌঁছাবার সবচেয়ে শক্ত পথটা খুঁজে বের করতে। আমার মনে হয় এখান থেকে উত্তরপূর্ব দিকে সামান্য উঁচু জমিটার উপরে কোথাও আমরা সেটা খুঁজে পাব। আমরা যদি ঐ দিকে যাই তাহলে আমাদের হয়ত মাইলখানেকের মতো ঘুরে যেতে হবে কিন্তু সেটা করলে আখেরে আমাদের লাভই হবে। আমরা আমাদের কামানগুলোকে সামনে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করবো না কিন্তু আমাদের সাথে অশ্বারোহী তবকিদের একটা বাহিনী থাকবে। ভেজা আবহাওয়ার কারণে যদি তাদের সামান্য সংখ্যক বন্দুকই হয়ত গুলিবর্ষণের উপযোগী প্রতিয়মান হবে কিন্তু সেটাই আমাদের সাহায্য করবে।

কিন্তু আমরা যদি ঐ পথ দিয়ে যাই তাহলে দূর থেকে আমাদের দেখা যাবে আর সিকান্দার শাহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার পর্যাপ্ত সময় পাবে, নাদিম খাজা হঠাৎ কথা বলে উঠে।

আমি সেটা নিয়েও চিন্তা ভাবনা করেছি। আমাদের গতিবিধি লুকিয়ে রাখতে আর চমকের মাত্রা বৃদ্ধি করতে, আমার ইচ্ছা আগামীকাল ভোর হবার ঠিক আগ মুহূর্তে অন্ধকারের আড়াল ব্যবহার করে আক্রমণ করা। আমরা আজ যতটা নিভৃতে সম্ভব আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করবো এবং আগামীকাল সকাল ঠিক তিনটায় সৈন্যদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে ভোর হবার ঠিক এক ঘন্টা আগে আমরা অগ্রসর হতে শুরু করবো। আমরা পাঁচশত লোকের পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হব, অন্ধকারে যেকোনো ধরনের বিভ্রান্তির সম্ভাবনা হ্রাস করতে প্রত্যেকের বাহুতে উজ্জ্বল রঙের একখণ্ড কাপড় বাঁধা থাকবে।

সুলতান, বৈরাম খান বলে, আমি আপনার পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় আমাদের সৈন্যরা এই পরিকল্পনা সফল করার মতো শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দেবে, তাদের নেতাদের উপর তারা ভরসা রাখবে।

আমি সন্ধ্যার দিকে আকবরকে সাথে নিয়ে সৈন্যদের মাঝে উপস্থিত হতে চাই তাঁদের উৎসাহিত করতে এবং আমার পরিকল্পনার কথা তাদের জানাতে আর সেটাকে সফল করতে পরিকল্পনা আর সেই সাথে তাদের উপর আমার যথাযথ আস্থা রয়েছে।

দিনের বেলা বৃষ্টির বেগ সামান্য হ্রাস পায় কিন্তু আকবর, আহমেদ খান আর বৈরাম খানকে পাশে নিয়ে হুমায়ুন যখন ঘোড়ায় চেপে বৈরাম খানের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের যাদের বেশীরভাগই বাদখশানের লোক- অবস্থানের জন্য নির্ধারিত তাবুর দিকে এগিয়ে যায় তখন দিগন্তের উপরের আকাশে আবারও কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। হুমায়ুন এই দলটার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই সবার শেষে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে তার বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং বাদশানিরা তার চারপাশে সমবেত হলে সে শুরু করে।

আমার আব্বাজানকে তোমাদের পিতারা দারুণ সহায়তা করেছিল তিনি যখন তাঁর সাম্রাজ্য জয় করেছিলেন। লোভী ভুইফোড়দের কারণে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড উদ্ধারের এই অভিযানে তোমরাও আমাকে দারুন সহায়তা করেছে। আগামীকাল তোমরা আমার সাথে সম্মুখের কাতারে অবস্থান করবে। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব। আমরা যখন বিজয়ী হব, আমার বিশ্বাস আমরা হবই, আমরা আবার হিন্দুস্তানের অধিকারী হব এবং আমাদের সন্তানের জন্য এর উর্বর জমি নিশঙ্ক করবো।

হুমায়ুন চুপ করে থেকে পুনরায় কথা শুরু করার আগে এক হাতে আকবরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। আমি জানি যে তোমাদের সন্তানেরা এখানে যেমন কিশোর আকবর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা তাদের জন্য যে সম্পত্তি অর্জন করবে তারা সেটার যোগ্য হয়ে উঠবে। একটা কথা মনে রেখে আগামীকাল আমরা তাদের ভবিষ্যতের সাথে সাথে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব। এসো আমরা আমাদের নিয়তিকে অধিগ্রহণ করি। এসো আমরা এমন বীরত্ব প্রদর্শন করি আর এর বরাভয়ে এমন বিজয় অর্জন করি যেন আমাদের নাতিরা এবং তাঁদের সন্তানেরা আমাদের অর্জন সম্বন্ধে কথা বলার সময় তাঁদের কণ্ঠে সম্ভ্রম আর কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠে, ঠিক যেভাবে আমরা তৈমূর আর তার লোকদের রূপকথার মতো অর্জন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করি।

হুমায়ুনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে বাদশানিদের ভিতর থেকে একটা উৎফুল্ল চিৎকার ভেসে আসে। শিবিরে তাঁর এই ঘুরে বেড়াবার সময় অন্য লোকদের উদ্দেশ্যে তার বাক্যচয়ন যেমন কাজ করেছে ঠিক সেভাবেই, তার কথাগুলো একেবারে ঠিক তন্ত্রীতে সুর তুলতে সক্ষম হয়েছে।

*

জওহর সকাল দুইটার দিকে সন্তর্পণে হুমায়ুনের তাবুতে প্রবেশ করে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে কিন্তু সে এসে দেখে যে হুমায়ুন ইতিমধ্যেই জেগে গিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। তাঁর তাবুর উপরে একঘেয়ে সুরে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে মনে মনে যুদ্ধের পরিকল্পনাটা বার বার খুটিয়ে দেখে আগে যদি কিছু তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে থাকে সেটা খুঁজে দেখতে। একটা সময় সে নিজেকে নিশ্চিত করে যে কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।

তার ভাবনার গতিপথ এরপরে অনিচ্ছাকৃতভাবেই সতের বছর পূর্বে শেরশাহকে মোকাবেলার জন্য প্রথমবারের মতো আগ্রা ত্যাগ করার পরে তাঁর জীবনের ঘটনাবলীর দিকে ধাবিত হয়। সেই সময়ে- সে এখন অনুধাবন করে- সে অনেক অপরিণত ছিল, বিশ্বাস করতে মুখিয়ে ছিল যে সাফল্যে তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার এবং সেই কারণে সাফল্য অর্জনের জন্য নিজের ভিতরের সবশক্তি প্রয়োগে যথেষ্ট প্রণোদনা ছিল না। সে অবশ্য কখনও নিজের এবং নিজের নিয়তির উপর বিশ্বাস হারায়নি এবং কোনো বিপর্যয় যতই ভয়ঙ্কর হোক তাঁর মাত্রা কখনও বিশ্বাস করেনি যে তার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে। সে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ যে দ্বিতীয় একটা সুযোগ পেয়েছে এবং এজন্য সে জানে জন্মে সময় তাঁর নাম হুমায়ুন সৌভাগ্যবান রাখা হয়েছিল। অসংখ্য মানুষ। এমনকি রাজারাও একবারই মাত্র সুযোগ লাভ করে এবং তারা যদি সেটা গ্রহণ না করে তাহলে ইতিহাসের গর্ভে তারা এমনভাবে হারিয়ে যায় যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, তাঁদের সমস্ত প্রতিশ্রুতি, তাঁদের সমস্ত আশা আর আকাঙ্খা সবই অনন্ত বিস্মরণের আবর্তে হারিয়ে যায়। সে তার রাজত্বকালে একটা বিষয় ভালোভাবে শিখেছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার ন্যায় সবসময়ে একটা অদম্য মনোভাব পোষণ করাটা শাসকের জন্য অতীব জরুরী। আজ, অবশ্য যুদ্ধের দিন এবং সে জানে তাকে আরো একবার নিজের সাহসিকতার পরীক্ষা দিতে হবে।

ভাবনাটা মাথায় আসবার সাথে সাথে, সে যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করে, এই কাজটা যেটায় জওহর এখন তাকে সাহায্য করছে তাকে তার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হলুদ বুট জুতা পরতে এবং সেই সাথে হুমায়ুনের রত্নখচিত, কারুকার্যময় ইস্পাতের বর্মস্থল আবরণকারী বর্মের বাঁধনগুলো আটকে দেয়- এই কাজগুলো তাঁরা তাঁদের অল্প বয়স থেকে একত্রে করে আসছে। জওহর অবশেষে যখন তার আব্বাজানের মহান তরবারি আলমগীর তার হাতে তুলে দেয়, হুমায়ুন তার দিকে তাকিয়ে হাসে এবং তার বাহু স্পর্শ করে বলে, আমার বিপদের সময়ে তোমার অনুগত সেবার জন্য তোমায় ধন্যবাদ। আমরা শীঘ্রই আগ্রায় আমাদের মনোরম আবাসন কক্ষে ফিরে যাব।

সুলতান, সেটা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই, জওহর, তাবুর পর্দা তুলে ধরে হুমায়ুনকে বাইরে রাতের ভেজা বাতাসে বের হবার পথ করে দেয়ার ফাঁকে, কথাটা বলে।

আকবর বাইরে তার আব্বাজানের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং তারা পরস্পরকে আলিঙ্গণ করে। আকবর তারপরে জানতে চায়, আমি কি আক্রমণে যোগ দিতে পারি না? আমার দুধ-ভাই আধম খানের সৌভাগ্য দেখে আমি ঈর্ষান্বিত যে আক্রমণকারী দলের পুরোভাগে অবস্থান করবে। প্রশিক্ষকের নিকটর যখন আবার আমাদের দেখা হবে যে যুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণের বিষয়ে বড়াই করবে যখন আমি…

না, তুমি আমাদের রাজবংশের ভবিষ্যত, হুমায়ুন কথার মাঝে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে। আল্লাহ না করুন, যুদ্ধক্ষেত্রে আধম খানের মৃত্যু হলে মাহাম আগা তাঁর জন্য কাঁদবে কিন্তু তাঁর মৃত্যুটা হবে একান্তভাবে তাঁর পরিবারের ব্যাপার। আমি আর তুমি যদি একসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হই তাহলে আমাদের বংশই নির্বংশ হয়ে যাবে। আমি সেটা ঘটতে দেবার ঝুঁকি নিতে পারি না তাই তুমি অবশ্যই পেছনে অবস্থান করবে।

হুমায়ুন বুঝতে পারে আকবরের যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার অনুমতি চাওয়া সময়ে তাঁর কণ্ঠে প্রত্যাশার চেয়ে আশার আধিক্য ছিল আর ব্যাপারটা সে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। আকবরের কাছ থেকে সে খানিকটা দূরে বৈরাম খান আর তার অন্যান্য সেনাপতিরা যে নিম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে তার প্রতীক্ষা করছে সেদিকে হেঁটে এগিয়ে যাবার সময় আকাশ ক্রমাগত আলোকিত করতে থাকা বিদ্যুচ্চমকের ফলে চারপাশ আলোকিত করা অশরীরি আলোয় সে দেখে যে কয়েক গজ দূরে বৈরাম খানের তরুণ কৰ্চি- তাঁর সহকারী বৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে নিজের আর তার প্রভুর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে নুয়ে রয়েছে। হুমায়ুন ঘুরে গিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। তাঁকে এগিয়ে আসতে দেখে তরুণ সহকারী প্রাণপন চেষ্টায় সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং একটা রুমাল দিয়ে মুখটা মোছে।

তুমি কি সন্ত্রস্ত, .. বা সামান্য ভীত? হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে।

সুলতান, বোধ হয় দুটোই, তরুণ সহকারী, যার মুখের মসৃণ ত্বক দেখে বোঝা যায় তার বয়স আকবরের সামনই হবে, অপ্রস্তুত হয়ে বলে।

সেটাই স্বাভাবিক, হুমায়ুন তাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধের আগে আমার আব্বাজান আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, সেটা সবসময়ে মনে রাখতে চেষ্টা করবে। ভয় পাওয়া সত্ত্বেও ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করাই সত্যিকারের সাহসিকতার পরিচায়ক।

জ্বী, সুলতান। আমি আপনাকে বা বৈরাম খানকে আশাহত করবো না।

আমি জানি সেটা তুমি করবে না।

এক ঘন্টা পরে- ইতিমধ্যে নাটকীয়ভাবে আবহাওয়া আরো খারাপ হয়ে উঠেছে- হুমায়ুন আর তাঁর বাদশানি অশ্বারোহীদের প্রথম দলটা যাত্রাবিরতি করে। সিকান্দার শাহের ছাউনিতে তাদের চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করার জন্য আহমেদ খান সাফল্যের সাথে যে উত্তরপূর্বমুখী বৃত্তাকার কিন্তু আপাত কঠিন মাটির পথটা খুঁজে বের করেছেন সেটা অনুসরণ করার জন্য নির্ধারিত স্থানে তারা পৌঁছে গিয়েছে। বৃষ্টি এখন আগের চেয়েও জোরাল আর মুষলধারে পড়তে থাকায় অন্ধকারে যতটুকুও দেখা যাচ্ছিল এখন সেটা আরও হ্রাস পেয়েছে। এমনকি বিদ্যুৎ চমকের ফলে সৃষ্ট আলোকছটায় হুমায়ুন আর তাঁর লোকদের বৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টির সামনে বৃষ্টির ফোঁটাগুলিকে রূপালি আর ইস্পাতের মতো দেখায়। মাথার উপরে দূরাগত বজ্রপাতের শব্দ প্রায় অবিরতভাবে ভেসে আসতে থাকে। হিমশীতল সন্তুষ্টির সাথে হুমায়ুন ভাবে যে প্রকৃতির উপাদানগুলিও তাঁর উদ্দেশ্যের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন পরিস্থিতি মোটেই খারাপ না করে বরং উন্নতই করেছে। তারা যখন সিকান্দার শাহের বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে শত্রুপক্ষ আগে থেকে তাঁদের অগ্রগতির কোনো শব্দ শুনতে বা তাঁদের চোখে দেখতে পাবে।

কয়েক মিনিট পূর্বে, অঝোর বৃষ্টির ভিতরে আহমেদ খান তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিল। তার শিরোস্ত্রাণের নীচে দিয়ে ইঁদুরের লেজের মতো ভেজা চুল বের হয়ে রয়েছে যেখানে এখন মাঝে মাঝেই ধুসরের আভা দৃশ্যমান এবং মুখ অসংখ্য বলীরেখায় বিদীর্ণ কিন্তু তাঁর মুখের হাসি আগের মতো প্রশস্ত আর প্রাণবন্ত ঠিক যেমন ছিল চম্পনীরের গুজরাতি দূর্গে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তারা যখন একত্রে উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছিল।

সুলতান, আমরা দিনের আলোয় সিকান্দার শাহের শিবিরে এই পথ দিয়ে অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে অবস্থিত একমাত্র যে পাহারাচৌকি সনাক্ত করেছিলাম সেটা আমরা দখল করে নিয়েছি। আমার ত্রিশজন যোদ্ধা নিরবে গুঁড়ি মেরে চৌকির চারপাশে অবস্থিত নীচু দেয়াল যা বৃষ্টির তোড়ে ভেঙে পড়ছিল সেটার এক অংশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। তারা ভিতরে প্রবেশ করেই সময়ক্ষেপন না করে দ্রুত ছাউনির দিকে দৌড়ে যায়, যেখানে জনা বারো সৈন্য অবস্থান করছিল সবাই ঘুমন্ত, এবং দ্রুত আর নিরবে তাঁদের গলা দ্বিখণ্ডিত করা হয় বা পাতলা দড়ি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়। মূল শিবিরকে হুশিয়ার করার জন্য একজনও পালাতে পারেনি। এমনকি কেউ কোনো শব্দও করতে পারেনি।

আহমেদ খান বরাবরের মতোই আপনি দারুণ কাজ করেছেন, হুমায়ুন বলে এবং আহমেদ খান সেকান্দার শাহের শিবির অভিমুখে নিরবে আরো অধিক সংখ্যক গুপ্তদূত প্রেরণ করার অভিপ্রায়ে বিদায় নেয়। তাদের একমাত্র কাজ এখন এই পরিস্থিতিতে হুমায়ুনের বর্তমান অবস্থান আর সিকান্দার শাহের শিবিরের মধ্যবর্তী ভয়ঙ্কর কাদার অবস্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করা যা অন্ধকারের ভিতরে মুখ ব্যাদান করে সামনের এক মাইলের ভিতরে রয়েছে যাতে করে হুমায়ুনের আক্রমণকারী বাহিনী সেগুলোয় আটকে না গিয়ে এড়িয়ে যেতে পারে।

হুমায়ুন নিজের নিয়তি নির্ধারক যুদ্ধ শুরু করতে অধীর হয়ে উঠে, সে জানে গুপ্তদূতদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের কাজ থেকে পুরো বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সে যাই হোক, দূরতুটা অনেক কম বলে আশা করা যায় তারা অচিরেই ফিরে আসবে। অপেক্ষার সময়টা হুমায়ুনের কাছে এক যুগের সমতুল্য মনে হলেও আসলে সোয়া এক ঘন্টা মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে- এমন সময় আহমেদ খান তার ছয়জন গুপ্তদুতদের নিয়ে আবার হাজির হয়, সবাই তাঁর মতোই বৃষ্টিতে ভেজা আর কাদায় মাখামাখি অবস্থা। আহমেদ খান কথা শুরু করে।

আমাদের অভিযানের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমি এইসব সাহসী লোকদের সাথে নিজেই সামনে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের কেউ দেখতে পায়নি। আমরা বর্শা দিয়ে মাটি কতখানি শক্ত আর কাদার গভীরতা পরখ করেছি। আমরা দেখেছি যে আমরা যদি এখান থেকে সরাসরি সোজা এগিয়ে যাই তাহলে বিশাল কর্দমাক্ত এলাকায় ভিতরে গিয়ে উপস্থিত হব, যা আমাদের অগ্রসর হবার গতি শ্লথ করে দিতে পারে, এমনকি আমাদের বেশ কিছু ঘোড়া কাদায় পুরোপুরি আটকে যাওয়ায় বিচিত্র হবে না। অবশ্য আমরা যদি অর্ধবৃত্তাকারে ডানদিক দিয়ে এগিয়ে যাই তাহলেও আমাদের ভীষণ কর্দমাক্ত এলাকার উপর দিয়ে যেতে হবে কিন্তু সরাসরি এগিয়ে যাবার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। আমরা মাটির অবরোধকের কাছে পৌঁছে যাব যা সিকান্দার শাহ তাঁর শিবিরের উত্তরপার্শ্বে নির্মাণ করেছেন। অবরোধকটা এখানে এক মানুষের চেয়ে বেশী উঁচু। আমাদের হয়ত মই ব্যবহার করতে হতে পারে যা আপনি আগেই সাথে করে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছেন।

আহমেদ খান, আপনাকে ধন্যবাদ। জওহর, বৈরাম খানকে তাঁর অগ্রবর্তী সেনাদের ভেতর থেকে কয়েক জোড়া অশ্বারোহীকে মনোনীত করতে বলে দাও, যাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের ঘোড়ার মাঝে মই ঝুলিয়ে নিয়ে বহন করবে যেগুলো আমরা এতদূর মালবাহী প্রাণীর পিঠে করে এতোদূর বয়ে নিয়ে এসেছি। তিনি প্রস্তুত হওয়া মাত্র তাঁকে বলবে আমাকে জানাতে এবং আমি নিজে তার সাথে অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে যোগ দেব।

জওহর আদেশ নিয়ে রওয়ানা দেয় এবং হুমায়ুন বিদ্যুৎচমকের ভিতরে কোনমতে বৈরাম খানের যযাদ্ধাদের যুদ্ধের বিন্যাসে বিন্যস্ত হতে দেখে। যুদ্ধ এখন আসন্ন হয়ে উঠায়, হুমায়ুন অনুভব করে তার ভিতরে কোনো ভয় কাজ করছে না কেবল তার অনুভূতিগুলো যেন অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে উঠেছে যা প্রতিটা মুহূর্তকে একটা মিনিটের, একেকটা মিনিটকে এক ঘন্টার দ্যোতনা দান করেছে এবং তার দৃষ্টিশক্তিও যেন প্রখর হয়ে উঠেছে যার ফলে জওহর তাঁর কাছে এসে বৈরাম খানের প্রস্তুতির কথা তাঁকে বলার পূর্বেই যেন গাঢ় অন্ধকারের ভিতরে সে দেখতে পায় বৈরাম খান তার উদ্দেশ্যে ইশারা করছে।

হুমায়ুন তার হাতের চামড়ার দাস্তানা আরেকবার ভালোকরে টেনে নেয় এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে তার পাশে রত্নখচিত ময়ানে আবদ্ধ অবস্থায় ঝুলন্ত তার আব্বাজানের তরবারি আলমগীর স্পর্শ করে। সে তারপরে রেকাবে তার পদযুগল ভালোকরে পুনরায় ভালো করে স্থাপন করে যাতে সেগুলো পিছলে না যায় এবং অবশেষে নিজের বিশাল কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে আহমেদ খানের সাথে যেখানে বৈরাম খান অপেক্ষা করছে সেদিকে এগিয়ে যায়। আহমেদ খান তাঁর ছয়জন গুপ্তদূতের সাথে নিজে আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন যারা আগেই তথ্যানুসন্ধানী অভিযানে অংশ নিয়েছিল। পথ প্রদর্শক দলের প্রত্যেকের সাদা সুতির কাপড় জড়ান রয়েছে যাতে করে আলো আধারির মাঝে তাদের সহজেই অনুসরণ করা যায়।

আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, হুমায়ুন বলে। আহমেদ খান, আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করেন।

আহমেদ খান কেবল মাথা নাড়ে এবং সামনে এগিয়ে যায়। অন্য ছয়জন গুপ্তদূত দ্রুত তাকে অনুসরণ করে তারপরেই থাকে বৈরাম খান আর তার তরুণ সহকারী কর্চি তাঁর অল্পবয়সী মুখে আগের চেয়ে এখন দৃঢ় আর প্রতিজ্ঞবদ্ধ অভিব্যক্তি ফুটে থাকায় তাকে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত দেখায়। হুমায়ুনও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁদের সাথে গাঢ় অন্ধকার আর বৃষ্টির ভিতর দিয়ে সিকান্দার শাহের শিবিরের দিকে এগিয়ে যায়।

পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তারা অর্ধবল্পিত বেগের চেয়ে দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছোটাতে পারে না। ঘোড়ার খুরের সাথে এরপরেও কাদামাটির বিশাল চাই আর পানি শূন্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং পেছনের অনুসরণকারীদের মাখামাখি করে দেয়। তারা রওয়ানা দেবার পরে দুই কি তিন মিনিটও অতিবাহিত হয়নি এমন সময় আহমেদ খান নীচু বোল্ডারের একটা জটলার পাশে নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলে হুমায়ুন তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

সুলতান, আহমেদ খান মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে, এই পাথরগুলো শেষ গুরুত্বপূর্ণ নিশানা। আমাদের ঠিক সামনে এখান থেকে প্রায় ছয়শ গজ দূরে সিকান্দার শাহের শিবিরের দেয়াল অবস্থিত।

মই বহনকারী জোড়া অশ্বারোহীদের ডেকে পাঠাও।

যূথবদ্ধ অবস্থায় অশ্বারোহীরা এগিয়ে আসলে দেখা যায় তাঁদের দুই ঘোড়ার মধ্যবর্তী স্থানে চামড়র ফালি দিয়ে বাঁধা রুক্ষ মইগুলো ঝুলছে, বৃষ্টির বেগ ধরে আসে এবং প্রায় অলৌকিক একটা ব্যাপারের মতো আকাশে মেঘের দলের মাঝে তৈরী ফাঁকে ধুসর আর পানি পানি আবহ নিয়ে চাঁদ উঠে। কয়েক মুহূর্ত পরে পুনরায় মেঘের আড়ালে চাঁদটা হারিয়ে যাবার আগে হুমায়ুন সিকান্দার শাহের শিবিরের বিরোধক দেয়ালের একটা ঝলক দেখতে পায়। আহমেদ খানের কথা অনুযায়ী দেয়ালটা প্রায় আট ফিট উঁচু হবে এবং মাটির তৈরী যা কয়েক জায়গায় মনে হয় ধ্বসে গিয়ে সেখানটায় মাটির একটা টিলার মতো রূপ নিয়েছে।

তার লোকেরা কিছুক্ষণ পরেই দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে দ্রুত ঘোড়া থেকে নেমে মইগুলো জায়গামতো স্থাপণ করে এবং সেগুলো বেয়ে তড়বড় করে। দেয়ালের উপরে উঠে যাওয়া পর্যন্ত প্রহরীদের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। মাটির দেয়ালের উপর উঠেই তার লোকেরা কেউ কেউ খালি পায়ে মাটির উপর লাথি মেরে কেউবা পিঠে বেঁধে নিয়ে নিয়ে আসা কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করতে শুরু করে। শীঘ্রই দেয়ালের প্রায় ত্রিশ ফিটের মতো জায়গা ধ্বসে গিয়ে নীচু একটা ঢিবিতে পরিণত হয় আর বৈরাম খান পেছনে অনুগত কর্চিদের নিয়ে নিরবে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে শিবিরের ভিতরে প্রবেশ করে। বৃষ্টি আবার মুষলধারে শুরু হয়েছে এবং হুমায়ুন আর তাঁর দেহরক্ষীরা দেয়ালের অবশিষ্টাংশ অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করার পরেও কোথাও কোনো হুশিয়ারির সংকেত দেখতে পায় না।

সহসা হুমায়ুনের সামনে কোথাও থেকে অবশ্য বিস্মিত চিল্কারের একটা আওয়াজ ভেসে আসে। শত্রু, হুশিয়ার! আরেকটা ক্ষীণ চিৎকারের শব্দ সামনে মাটির দেয়ালের কাছ থেকে ভেসে আসে, তারপরেই একই দিক থেকে উচ্চনাদে শিঙ্গার শব্দ শোনা যায়। প্রহরীকক্ষের কোনো তন্দ্রাচ্ছন্ন সৈন্য সম্ভবত তাঁদের চারপাশে ঘটতে থাকা বিপর্যয়ের মাঝে হয়ত জেগে উঠেছিল এবং সেই হুশিয়ারি ধ্বনিত করেছে। শিবিরের কেন্দ্রস্থল থেকে তূর্যনাদের মাধ্যমে প্রত্যুত্তর ভেসে আসতে শুরু করে।

বিস্ময়ের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরে হুমায়ুন এখন অনুভব করে যে তার এবং তার লোকদের এবার দ্রুত অগ্রসর হয়ে যদ্রুত সম্ভব শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে যাতে তারা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ বিন্যাস করার সময় না পায়। হুমায়ুন শিবিরের কেন্দ্রস্থলের দিকে অগ্রসর হবার আদেশ দেবার জন্য বৈরাম খানের দিকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই প্রহরীদের অবস্থানের দিক থেকে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে তীর্যকভাবে তীরের বিশৃঙ্খলভাবে নিক্ষিপ্ত একটা ঝাঁক এসে তাঁদের অবস্থানের উপরে আছড়ে পড়ে। একটা তীর হুমায়ুনের পর্যানে বিদ্ধ হয়। আরেকটা বৈরাম খানের বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে নিরীহ ভঙ্গিতে ঠিকরে যায় কিন্তু তৃতীয় আরেকটা তীর বৈরাম খানের তরুর কচির উরুতে বিদ্ধ হয়। ছেলেটা মরীয়া ভঙ্গিতে নিজের পা খামচে ধরে এবং তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তার গলা চিরে একটা চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

ছেলেটার ক্ষতস্থানটা শক্ত করে বেঁধে দাও, হুমায়ুন চিৎকার করে বলে। তাকে দ্রুত আমাদের শিবিরের হেকিমের কাছে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। সে অল্পবয়সী আর দারুণ সাহসী। তার বেঁচে থাকার একটা সুযোগ পাওয়া উচিত। হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের একজন দ্রুত এগিয়ে যায় তাঁর আদেশ পালন করতে।

আরেক পশলা তীর এসে আছড়ে পড়ে কিন্তু এবার সংখ্যায় অনেক কম। এই দফা হতাহতের ভিতরে রয়েছে কেবল একজন অশ্বারোহীর মাদী ঘোড়া যা গলায় দুটো কালো পালকযুক্ত তীর বিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে আছড়ে পড়ে। ঘোড়ার আরোহী, গাট্টাগোট্টা দেখতে এক তাজিক, ঘোড়াটা মাটিতে পড়ার সময় লাফিয়ে উঠে সরে যায় ঠিকই কিন্তু ভারী দেহ নিয়ে মাটিতে পরার সময় সে পিছলে গেলে তার বুকের সব বাতাস বের হয়ে যাওয়া কিছুক্ষণ মাটিতে শুয়ে থেকে তারপরে টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ায়।

বৈরাম খান চল্লিশজন যোদ্ধার একটা দল পাঠান এইসব তীর নিক্ষেপের অবস্থান সনাক্ত করতে এবং শত্রুপক্ষের তীরন্দাজদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। আর বাকী যারা এখানে রয়েছে আমাকে বিজয়ের পথে অনুসরণ কর।

বৈরাম খান দ্রুত প্রহরী অবস্থানের দফারফা করতে যখন তোক বাছাই করছে হুমায়ুন সেই ফাঁকে আলমগীর ময়ান থেকে আজ রাতে প্রথমবারের মতো বের করে আনে। তরবারিটা নিজের সামনে টানটান করে ধরে রেখে আর দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং মুস্তাফা আর্গুন আর তাঁর ভাড়াটে যোদ্ধাদের পেছনে নিয়ে সে তার কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে কাদার উপরে যতটা জোরে তাঁকে ছোটান সম্ভব সেই গতিতে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করে শিবিরের অভ্যন্তরভাগ তার লক্ষ্য। ইতিমধ্যে পূর্বাকাশে ভোরের পূর্বাভাষ হয়ে আলো কিঞ্চিত ফুটতে শুরু করেছে কিন্তু ঘোড়ার কাঁধের কাছে মাথা নীচু করে রেখে ধেয়ে যাবার সময়ে বৃষ্টির কারণে এখনও হুমায়ুন খুব ভালো করে চারপাশের কিছুই দেখতে পায় না। তারপরে, মিনিটখানে পরে সে তার সামনে ঘন সন্নিবদ্ধ কালো কালো তাবুর সারি দেখতে পায় এবং একই সময়ে সিকান্দার শাহর লোকেরা তাবুর ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ময়ান থেকে অস্ত্র বের করতে শুরু করলে তাদের সম্মিলিত চিৎকারের শব্দ তার কানে ভেসে আসে।

তাবুগুলো উপরে ফেলো শত্রুদের ভেতরেই আটকে রাখতে। যারা ইতিমধ্যে বের হয়েছে তাঁদের ঘোড়ার পায়ের নীচে পিষ্ট করে দাও। নিজেই নিজের আদেশ অনুসরণ করে হুমায়ুন তার পর্যাণ থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে এবং একটা বিশালাকৃতি তাবুকে টানটান করে ধরে রাখা দড়ি লক্ষ্য করে তরবারি চালায়, যা তাসের ঘরের মতো মাটিতে দুমড়ে পড়ে যায়। তারপরে সে দ্বিতীয় আরেকটা আবছা অবয়ব লক্ষ্য করে তরবারি চালায় যে পরের তাবু থেকে বের হয়ে এসেই নিজের দুই মাথাযুক্ত ধনুকে তীর জুড়তে আরম্ভ করেছিল। হুমায়ুন টের পায় আলমগীর লোকটার অরক্ষিত বুকের মাংসের গভীরে কেটে বসে গিয়ে বেচারার হাড়ে কামড় দেয়। তীরন্দাজ লোকটা ছটফট করে উঠে এবং হুমায়ুনের আগুয়ান এক অশ্বারোহীর ঘোড়ার খুরের নীচে পিষে যায় আর ছিটকে শূন্যে ভাসে।

হুমায়ুনের অন্য সৈন্যরা তার চারপাশে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামতে শুরু করে আরও ভালো করে তাবু বিধ্বস্ত করে শত্রুর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হতে। হুমায়ুন অচিরেই লোকদের মাটিতে গড়াতে গড়াতে কেবল একে অন্যের সাথে লড়তে আর আঘাত করা দেখতে পায়। সে তার এক যোদ্ধাকে চিনতে পারে, কোকড়ানো দাড়ির পেষলদেহী এক বাদখশানি যে প্রতিপক্ষের কাঁধের উপরে বসে মুখে একটা চওড়া হাসি নিয়ে তার মাথাটা গায়ের জোরে পেছনের দিকে টানছে। হুমায়ুন তাকিয়ে রয়েছে দেখে, সে লোকটার মাথাটা এবার সজোরে সামনে দিকে ঠেলে দিয়ে জলকাদায় ভর্তি একটা গর্তে ঠেসে ধরে। সে সেখানেই মাথাটা কয়েক মিনিট ঠেসে ধরে থাকে তারপরে প্রাণহীন দেহটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

তার আরেকজন জন পায়ে দড়ি বাধা একপাল ঘোড়ার দিকে দৌড়ে গিয়ে সেগুলোর পায়ের দড়ি কাতে শুরু করে। সে তাদের পায়ের দড়ি কাটার সময়ে প্রত্যেকের পাছায় সজোরে একটা করে থাপ্পড় দিতে থাকলে ঘোড়াগুলো আবছা আলোর ভিতরে সামনের দিকে দৌড়ে হারিয়ে যায়। বেশ বেশ, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে ঘোড়াগুলো সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে উঠা শত্রুদের ভিতরে কেবল বিভ্রান্তি আর আতঙ্কই বাড়িয়ে তুলবে। তার সৈন্যদের আরেকজন একটা বিধ্বস্ত তাবুর বাইরে বর্শা রাখার স্থান থেকে একটা বর্শা তুলে নিয়ে সেই তাবুর ভাঁজের নীচে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা দুটো অবয়বকে বর্শার ফলা দিয়ে খোঁচাতে আরম্ভ করে। কাতরাতে থাকা দেহ দুটো শীঘ্রই শান্ত হয়ে যায় এবং তাবুর কাপড়ের গায়ে একটা গাঢ় দাগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

এদিকে এসো, হুমায়ুন মুস্তাফা আর্গুনকে চিৎকার করে ডাকে, আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। আমরা এখন অনেক ভালোমতো দেখতে পাব এবার সিকান্দার শাহের ব্যক্তিগত আবাসন স্থান খুঁজে দেখা যেতে পারে। বৈরাম খান আপনিও আপনার লোকদের নিয়ে আমায় অনুসরণ করুন।

দ্রুত জোরাল হতে থাকা আলোর মাঝে প্রায় আধ মাইল দূরে হুমায়ুন অচিরেই একটা নীচু ঢালের উপরে একটা ফাঁকা আয়তাকার স্থানের চারপাশে বিশাল কিছু তাবুর জটলা সনাক্ত করে যেখানে- আয়তাকার স্থানের কেন্দ্রে একটা বিশাল তাবুর বাইরে একটা বিশাল নিশান ঝাণ্ডার মাথায় ভেজা আর ভারী অবস্থান ঝুলছে নিঃসন্দেহে সিকান্দার শাহর নিজস্ব তাবু। হুমায়ুন ঘোড়া নিয়ে কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখে বেশ কিছু সংখ্যক লোক তাবুর চারপাশে জটলা করছে। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্ম আর শিরোস্ত্রাণ ধারণ করেছে, অন্যেরা তাদের ঘোড়ার পিঠে পৰ্যান ছুঁড়ে দিয়ে হাত পায়ের সাহায্যে অরক্ষিত অবস্থায় কোনোমতে সেগুলোর পিঠে চড়ে বসে নিজেদের রক্ষা করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

নিমেষ পরেই, হুমায়ুন তাবুগুলোর কোনো একটার চাঁদোয়ার নীচে থেকে মাস্কেটের কর্কশ শব্দ ভেসে আসতে শুনে- সিকান্দার শাহর অন্তত কিছু লোক নিজেদের বারুদ শুকনো রেখেছে। সে তার চোখের কোণে দেখতে পায় মুস্তাফা আগুনের একজন তূর্কী সৈন্য কপালের পাশে বুলেটের একটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোনো শব্দ না করে নিরবে পর্যান থেকে পিছলে যায়। তাঁর আতঙ্কিত ঘোড়াটা হুমায়ুনের ঘোড়ার গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়। হুমায়ুন দ্রুত নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেও আতঙ্কিত জন্তুটা পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হুমায়ুনের তাঁর দক্ষতার পুরোটা দরকার হয় নিজেকে তাঁর বাহনের পিঠে অধিষ্ঠিত রাখতে, যখন তাঁর ঘোড়াটা পুনরায় চারপা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে, একপাশে পিছলে গিয়ে অন্য অশ্বারোহীদের অগ্রগতি রুদ্ধ করলে। হুমায়ুনের বেকায়দা অবস্থা দেখে তারাও সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজেরাই পালাক্রমে লাগাম টেনে ধরতে শুরু করে, নিজেদের সিকান্দার শাহের লোকদের কাছে একটা লোভনীয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। মাস্কেটের সাদা ধধায়ায় আচ্ছাদিত একটা তাবু থেকে এক ঝাঁক তীর শূন্যে ভাসে। হুমায়ুনের বেশ কয়েকজন লোক আহত হয়। একজন হাতের তরবারি ফেলে দিয়ে কাদায় সটান আছড়ে পড়ে সেখানেই স্থির হয়ে থাকে। অন্যেরা ঘোড়ায় টিকে থাকলেও ক্ষতস্থান পরিচর্যায় সহযোদ্ধাদের কাতার থেকে পিছিয়ে পড়ে।

হুমায়ুনের সৈন্যসারির পার্শ্বদেশ থেকে প্রায় একই সাথে দুটো বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। সে শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে যে সিকান্দার শাহের তোপচিরা তাঁদের দুটো বিশাল কামানকে কর্মক্ষম করে তুলেছে, যেখান থেকে তারা কাঠের রুক্ষ তক্তার ছাদের নীচে অবস্থান করে বৃষ্টির ছাট থেকে সুরক্ষিত অবস্থায় নিজেদের কাজ শুরু করেছে। কামানের দুটো গোলাই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। একটা গোলা একটা কালো ঘোড়ার উদরে আঘাত করে সেটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। জন্তুটা উন্মুক্ত ক্ষতস্থান থেকে নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসা অবস্থায় টলমল করে চেষ্টা করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু তারপরে কাদায় পিছলে গিয়ে করুণস্বরে চিহি শব্দ করতে থাকে। দ্বিতীয় কামানের গোলা আরেকটা ঘোড়ার সামনের পা উড়িয়ে নিয়ে গেলে তাগড়া জন্তুটা কুকড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং পিঠের আরোহীকে মুস্তাফা আগুনের আরেকজন যোদ্ধাকে নিজের মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে।

পুরো ব্যাপারটাই খুব দ্রুত সংঘটিত হয় এবং হুমায়ুন তাঁর নৃত্যরত ঘোড়ার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার মাঝে সহসা একটা চিন্তা তাঁকে একেবারে জমিয়ে দেয়। সে হয়ত সযত্নে রচিত একটা ফাঁদে এসে নিজে ধরা দিয়েছে। সিকান্দার শাহর লোকেরা হয়ত ঘুরে এসে তাদের পিছনের রাস্তা এতক্ষণে আটকে দিয়েছে। তার নাগাল থেকে হিন্দুস্তানের সিংহাসন নিশ্চয়ই আরো একবার কেড়ে নেওয়া হবে না? না, এটা হতে পারে না… তার নিয়তি নির্ধারিতক্ষণে সে নিশ্চয়ই বিচ্যুত হবে, এই ক্ষণিকের বিশৃঙ্খলা থেকে উত্তরণের পথে সন্দেহ কোনমতেই বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।

দলবদ্ধ হও, জড়ো হও সবাই! আমাদের কোনমতেই আক্রমণের বেগ শ্লথ করা চলবে না, সে চিৎকার করে বলে। গাদাবন্দুকধারীরা যে তাবু থেকে গুলি বর্ষণ করছে সে তাঁর হাতের আলমগীর আন্দোলিত করে সরাসরি সেদিকে ঘোড়ার মুখ ঘোরায় এবং পুরু, পিচ্ছিল কাদার উপর দিয়ে যত দ্রুত ছোটা যায় সেজন্য প্রাণীটার পাঁচরে গুঁতো দেয়। তার দেহরক্ষীরা সাথে সাথে তাকে অনুসরণ শুরু করে। আরো কয়েকবার গাদাবন্দুকের আওয়াজ শোনা যায় এবং আরেকজন যোদ্ধা ভূপাতিত হয় কিন্তু তারপরেই হুমায়ুন শত্রু তবকিদের মাঝে গিয়ে হাজির হতে তারা তখন নিজের লম্বা নলের অস্ত্র আর সেটা ধারণকারী তেপায়া একপাশে সরিয়ে ফেলে দিয়ে পালাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠে। হুমায়ুন আলমগীরের এককোপে একজনকে ধরাশায়ী করে কিন্তু তারপরেই সে আর তাঁর দেহরক্ষীরা শত্রুপক্ষের একদল অশ্বারোহীদের আক্রমণের মুখে পড়ে, যাদের তারা আগেই অশ্বারূঢ় হতে দেখেছিল। শক্তপোক্ত দেখতে একজন সেনাপতি বাদামী রঙের একটা ঘোড়ায় চেপে জল্লুটার মুখে হীরক দীপ্তি সরাসরি হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসে, তাঁর বামহাতে ধরা বর্শার ফলা সরাসরি হুমায়ুনের বুক লক্ষ্য করে স্থির রয়েছে।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার মুখটা মোচড় দিয়ে সরিয়ে নেয় এবং বর্শার ফলাটা তাঁর বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে আঘাত করে পিছলে গেলে সে নিজেও খানিকটা ভারসাম্য হারায়, ফলে তাঁর তরবারির ফলাও নিশানায় আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। উভয়েই নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টানটান করে টেনে ধরে রেখে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে এবং শত্রুপক্ষের লোকটা এবার বর্শা ফেলে দিয়ে নিজের কোমর থেকে তরবারি বের করে তার দিকে এগিয়ে আসে। হুমায়ুন মাথা নীচু করে তার তরবারির বৃত্তাকার গতি এড়িয়ে যায়, তরবারির ফলা তার মাথার উপর দিয়ে বাতাস কেটে নিষ্ফল ভঙ্গিতে বের হয়ে যেতে একটা হুশ শব্দ সে শুনতে পায়। সে এবার আলমগীর নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের বক্ষস্থল লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা শিকলের বক্ষাবরণী দ্বারা আবৃত নেই। তরবারির ক্ষুরধার ফলা অনায়াসে নরম, চর্বিযুক্ত পেশীর গভীরে কেটে বসে যায় এবং শত্রুপক্ষের সেনাপতি তার বাদামী ঘোড়ার গলার উপরে নুয়ে পড়ে, ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্তপাত হচ্ছে, যা তাকে পিঠে নিয়ে ভিড়ের ভিতরে হারিয়ে যায়।

হুমায়ুন এবার লাল পাগড়ি পরিহিত এক যোদ্ধার দিকে মনোনিবেশ করে যাকে সে খানিকটা দূরে থেকে লড়াই পরিচালনা করতে দেখে। সে ঘোড়া নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লোকটাকে তাঁর পর্যাণের সাথে সংযুক্ত ময়ান থেকে একটা দোধারি রণকুঠার বের করতে দেখে। সে হাতটা পেছনে নিয়ে রণকুঠারটা সরাসরি হুমায়ুনের অবস্থান লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। হুমায়ুন তাঁর বর্মাবৃত বাহু উঁচু করে নিজের মাথা বাঁচায় কিন্তু রণকুঠারের ধারাল ফলা তার বাহুতে প্রচণ্ড বেগে আঘাত হেনে পিছলে যায়। আঘাতটা এতটাই মারাত্মক যে তাঁর বর্ম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বহুবছর আগে চসারের যুদ্ধে প্রাপ্ত আঘাতের স্থান পুনরায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। উজ্জ্বল বর্ণের লাল-কমলাভ রক্ত তাঁর বাহু বেয়ে হাতে পরিহিত দাস্তানা ভিজিয়ে দেয়। হুমায়ুন বিষয়টা অগ্রাহ্য করে এবং আলমগীর তখনও শক্ত করে আকড়ে ধরে থাকে এবং প্রতিপক্ষের একজনের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে সজোরে তরবারি হাকায়, তারা এতো কাছ দিয়ে পরস্পরকে অতিক্রম করে যে দুজনে পায়ে পায়ে ধাক্কা খায়। হুমায়ুনের তরবারির আঘাত প্রতিপক্ষের লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরে সজোরে আঘাত হেনে, তাঁর কণ্ঠনালী ছিন্ন করে দেয় এবং পর্যাণ থেকে মাটিতে আছড়ে পরার আগে যতটুকু সময় তার দেহটা স্থির হয়ে ঘোড়ায় বসে থাকে ততক্ষণ ফিনকি দিয়ে তাঁর দেহের ভেতর থেকে রক্ত বাতাসে ছিটকে যেতে থাকে।

সজোরে শ্বাস নিয়ে, হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম জোরে টেনে ধরে এবং চারপাশে তাকায়। নিয়ন্ত্রক তাবুর চারপাশের সংঘটিত যুদ্ধে সে আর তার লোকেরা জয়ী হয়েছে। সে তার বামপাশে তাকিয়ে দেখে মুস্তাফা আর্গুন আর তার সাদা পাগড়ি পরিহিত যোদ্ধারা সিকান্দার শাহের একদল অশ্বারোহীকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে, অন্যদিকে তাঁর ডানপাশে বৈরাম খানের লোকেরা যাদের ভিতরে হুমায়ুন লক্ষ্য করে আকবরের দুধ-ভাই আধম খানও রয়েছে বিশাল একটা দলকে ঘিরে ফেলেছে যারা ইতিমধ্যেই অস্ত্র নামিয়ে রাখতে শুরু করেছে।

বৈরাম খান ঘোড়া নিয়ে হুমায়ুনের কাছে এগিয়ে আসে। সুলতান, আমার অধীনস্ত সেনাপতিরা আমাকে জানিয়েছে যে আমাদের অশ্বারোহীদের বিশটা বহর সিকান্দার শাহের শিবিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে এবং প্রতি মিনিটে আরো অধিক সংখ্যক সৈন্যদল ভিতরে অনবরত প্রবেশ করছে। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের একটা বিশাল সংখ্যাকে অস্ত্র ধারণের পূর্বেই হত্যা করেছি এবং আরো বেশী সংখ্যককে বন্দি করেছি যদিও আতঙ্কে তাঁদের অনেকেই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালিয়েও গিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে শিবিরের তিন-চতুর্থাংশ অংশ দখল করে নিয়েছি। শত্রু সৈন্যদের একটা বিশাল অংশ অবশ্য এখনও শিবিরের দক্ষিণপশ্চিম অংশে বিপুল বিক্রমের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমার কিছু যোদ্ধা দাবী করেছে যে আমরা যখন প্রথম নিয়ন্ত্রক তাবু আক্রমণ করি তখন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিকে, তাদের ধারণা লোকটা সম্ভবত সিকান্দার শাহ স্বয়ং, ঐ দিকে পালিয়ে যেতে দেখেছে।

আমরা তাহলে নিজেদের সংগঠিত করে নিয়ে সেই দিকে আক্রমণ জোরদার করি এবং সিকান্দার শাহ যদি সেখানেই আদতেই অবস্থান করে থাকে তাহলে তাঁকে বন্দি করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার আগে আমার এই ক্ষতস্থানটা আমার গলার উত্তরীয় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দাও, হুমায়ুন তার হাতের চামড়ার দাস্তানা খুলে রক্তাক্ত হাতটা বৈরাম খানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বৈরাম খান কয়েক মিনিটের ভিতরে হুমায়ুনের হাতের ক্ষতস্থান শক্ত করে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়, ক্ষতস্থানটা খুব একটা গভীর না হওয়ায় রক্তপাত ইতিমধ্যে মোটামুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

হুমায়ুন আর বৈরাম খান বৃষ্টির ভিতর দিয়ে শিবিরের দক্ষিণপশ্চিম কোণে খানিকটা উঁচুনীচু ভূমির দিকে এগিয়ে যায়। কাদার ভিতরে উপড়ানো তাবু, উল্টানো হাড়িকুড়ি আর মানুষ এবং প্রাণীর মৃত, অর্ধমৃত দেহের মাঝ দিয়ে যেগুলো এখন লালবর্ণ ধারণ করেছে তারা এগিয়ে যায়। তারা ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী হতে যুদ্ধে হৈচৈ আর চিৎকারের আওয়াজ বেড়ে যায়, মাঝে মাঝেই বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে যখনই দুপক্ষের কোনো সৈন্য বৃষ্টির ভিতরে বারুদ শুকনো রাখার মতো কোনো উপযুক্ত আড়ালের পেছন থেকে বারুদের থলে খুলে বন্দুকে দ্রুততার বারুদ পূর্ণ করতে পারে।

নতুন দিনের সীসার মতো বিষণ্ণ আলো ফুটতে শুরু করায় হুমায়ুন দেখে যে সিকান্দার শাহের লোকেরা দৃঢ়সংকল্পের সাথে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। তারা কয়েকটা উঁচু ঢিবির চারপাশে বেশ কিছু মালবাহী শকট উল্টে দিয়েছে, এবং তীরন্দাজ আর তবকিরা সেগুলোর সৃষ্ট আড়াল ব্যবহার করে তার পেছন থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অশ্বারোহীদের বেশ কয়েকটা দল অবরোধকের মাঝে একত্রিত হয়েছে যারা বেশ কয়েকশ গজ ব্যাপী একটা সীমানা অটুট রেখেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েক হাজার সৈন্য এখানে সমবেত হয়েছে। তার নিজের সৈন্যরা অবশ্য এদের পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে।

বৈরাম খান আমার লোকদের সামান্য পিছিয়ে আসতে বলেন কিন্তু সিকান্দার শাহের সৈন্যরা যেন নিচ্ছিদ্রভাবে পরিবেষ্টিত থাকে। তারা যদি অস্ত্র সমর্পণ করে সিকান্দার শাহের অবস্থান আমাদের জানায় তাহলে আমরা তাদের প্রাণ বখশের একটা সুযোগ দেব।

সোয়া ঘন্টা পরে, সিকান্দার শাহের অবরোধকের ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয় এবং হুমায়ুনের প্রতিনিধি বাহাদুর খান নামে এক তরুণ যোদ্ধাকে সেখানে পুনরায় আবির্ভূত হয়ে হুমায়ুন তার কালো ঘোড়ায় চেপে যেখানে অপেক্ষা করছে। সেদিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।

সুলতনি তারা আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে। তারা জোর কণ্ঠে জানিয়েছে যে তাঁদের মাঝে সিকান্দার শাহ নেই এবং তিনি সত্যিই আমরা আক্রমণ শুরু করা মাত্রই দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় নিয়ন্ত্রক তাবু ত্যাগ করেছে বটে কিন্তু তিনি পলায়নের উদ্দেশ্যেই তাবু ত্যাগ করেছিলেন। নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করেছেন বলে তারা অভিযোগ জানিয়েছে আর এই কারণেই তারা আত্মসমর্পণের জন্য রাজি হয়েছে। তাঁর বেশ কয়েকজন সেনাপতি আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার ইচ্ছা পর্যন্ত ব্যক্ত করেছে।

স্বস্তি আর আনন্দের একটা যুগপৎ ধারায় হুমায়ুন জারিত হয়। তাঁর বিজয় হয়েছে। হিন্দুস্তান পুনর্দখলের পথে শেষ বাধাটাও সে অপসারিত করেছে। অবস্থাদৃষ্টে যদি মনে হয় যে সে সিকান্দার শাহকে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু তারপরেও তাঁর বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সিকান্দার শাহের বিশাল বাহিনী দুই ঘন্টারও কম সময়ের ব্যবধানে পর্যদস্ত হয়েছে। যারা এখনও অক্ষত রয়েছে তারা হয় আত্মসমর্পন করেছে নতুবা পালিয়েছে। হুমায়ুন আবেগআপ্লুত ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা শুরু করে।

আমার সকল সেনাপতিকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি একটা মহান বিজয় অর্জন করেছি। হিন্দুস্তান এখন রীতিমতো আমাদের আয়ত্ত্বে হলেও সময় নষ্ট করার কোনো অবকাশ নেই। প্রথমেই আমরা আমাদের আহত যোদ্ধাদের যত্ন নেব এবং তারপরে আমাদের মৃত সঙ্গীদের সমাধিস্থ করবো কিন্তু তারপরেই আর কোনভাবে কালক্ষেপন না করে আমরা বিশাল দিল্লী শহর সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।

*

দিল্লী শহরের বেলেপাথরের তৈরী বিশাল প্রতিরক্ষা দেয়ালের ঠিক বাইরে, নিজের শিবিরের কেন্দ্রে অবস্থিত তার লাল তাবুর ভিতরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে হুমায়ুনের ঘুম ভেঙে যায়। তাকে হিন্দুস্তানের পাদিশাহ্ ঘোষণা করে, শুক্রবার জুম্মার নামাযের শেষে তাঁর নামে পঠিত খুতবা শোনার জন্য সেদিন দুপুরের পরে শহরের উঁচু তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিকভাবে শহরে প্রবেশের কথা রয়েছে। শিরহিন্দের যুদ্ধে সে জয়লাভ করার পর বর্ষার অঝোর বৃষ্টির ভিতর দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে যখন দ্রুত দিল্লীর দিকে অগ্রসর হয়েছে, তখন থেকে দিনগুলি দারুণ ব্যস্ততায় কেটেছে। পথে স্থানীয় শাসকেরা তড়িঘড়ি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং সিংহাসনের অন্য দাবীদারদের অনুগত সৈন্যরা দল বেধে এসে আত্মসমর্পন করেছে এবং স্বেচ্ছায় হুমায়ুনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

হুমায়ুন চারদিন আগে পানিপথের যুদ্ধ সংঘটিত হবার স্থান অতিক্রম করেছে। যেখানে সে তাঁর আব্বাজানের সাথে প্রথমবারের মতো হিন্দুস্তান জয় করেছিল। উনত্রিশ বছর পরে এখনও সমভূমির উপরে বাবরের তবকিদের বন্দুকের গুলিতে মারা যাওয়া সুলতান ইব্রাহিমের অতিকায় রণহস্তীর কিছু কিছু সাদা হাড় ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে।

গত সন্ধ্যায়, হুমায়ুন নিজের তাবুতে শুয়ে নিজের জীবনের সাথে তার আব্বাজানের জীবনের সাদৃশ্য আর ভিন্নতা নিয়ে চিন্তা করছিল। বর্ষাকালে রাতের বেলা এক অতর্কিত আক্রমণে সে তাঁর জীবনের প্রথম বড় যুদ্ধে শেরশাহের কাছে পরাস্ত হয়েছিল এবং সেই একই কৌশল অবলম্বন করে সে সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে তাঁর শেষ বড় যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। উভয় যুদ্ধেই সে তার ডান হাতের উধ্বাংশে আঘাত পেয়েছে। সিকান্দার শাহের এবং অন্যান্য দাবীদারদের পক্ষত্যাগকারী সৈন্যদের যোগদানের কারণে তাঁর শেষ অভিযানের পরে নিজ বাহিনীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক তেমনিভাবে শেরশাহের সাথে পরাজিত হবার পরে তাঁর সৈন্যরা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। তার সৎ-ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তার পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল কিন্তু শেরশাহের পরিবার এই বিষয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আদিল শাহ তাঁর পরিবারের সাথে লড়াই করেই ক্ষান্ত হয়নি নিজেকে দুগ্ধপোষ্য ভাস্তেকে, সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারীকে নিজের মায়ের সামনে, তাঁর নিজের বোনের সামনে হত্যা করেছে, যা করার পূর্বে কামরানও দ্বিতীয়বার চিন্তা করতো।

পানিপথে মোগলদের মহান বিজয়ের পরে হুমায়ুন কোহ-ই-নূর অর্জন করেছিল যা সে তার নিজের এবং তার বংশের দুর্বলতম সময়ে এর পুনরুত্থানের নিমিত্তে ব্যবহার করেছে। তার আব্বাজানের মতো সে তারুণ্যদীপ্ত বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে কিন্তু তারপরেই বিপুল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে যা তার মনোবলের পরীক্ষা নিয়েছে। তার এবং তার পরিবারের জন্য পারস্যের সমর্থণ আর সেই সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় আপোষ কাঙ্খিত সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাবরের মতোই, হিন্দুস্তান দখলের পূর্বে সে কাবুলে যতটা সময় অতিবাহিত করতে চেয়েছিল তারচেয়ে বেশী সময় অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছে।

তারকারাজির আবর্তনের মাঝে এসব কি আসলেই সত্যিকারের ভবিতব্য? আর যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এসব কিভাবে সত্যি হল? ঘটনা পরম্পরা কি আসলেই অনিবার্য, পূর্বনির্ধারিত এবং কোনো মহান শক্তি কর্তৃক পরিকল্পিত, যা অর্ন্তজ্ঞানসম্পন্ন কারো জন্য তারকারাজির মাঝে পূর্বেই লিপিবদ্ধ থাকে, যেমনটা সে একদা বিশ্বাস করতো? নাকি, বিপরীতক্রমে সে তার কল্পনায় মানুষের জীবনের যে ঘটনাবলী দেখতে পায় বলে মনে করতো এবং পরিবর্তিত পৃথিবীতে এসবের একটা ছক খুঁজতে চেষ্টা করতো এবং সেই ঘটনাগুলো কি প্রেক্ষাপটের বোধগম্য সাদৃশ্য বা কোনো সমকালীনতার কারণে সংঘটিত হয়? পারিবারিক দ্বন্দ্ব কি শাসক রাজবংশগুলোর জন্য আনুষঙ্গিক হুমকি বহন করে না? বাবরের আপন সৎ-ভাই কি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি এবং তৈমূরের সন্তানেরা কি তাদের পিতার উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদগ্রস্থ আর বিভক্ত হয়নি? স্বপক্ষ ত্যাগ কি সবসময়ে পরাজয়ের অনুবর্তী নয় এবং মহান বিজয়ের পরে চাটুকার নতুন মিত্র? তার আব্বাজানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ এবং নিজের সংকল্পকে দৃঢ় করতে সেই শিক্ষার ব্যবহার কি তাদের দুজনের জীবনের ভিতরে সাদৃশ্যের জন্ম দেয়নি?

সে তার যৌবনে, নিয়তি নির্ধারিত ছকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করতো। সে এমন বিশ্বাসের কারণে যেন নিজের কৃতকর্ম এবং তার ফলাফলের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ থেকে কেমন বিরত থাকতো। তাঁর আলস্যকে এসব ধারণা প্রশ্রয় দিয়েছিল এবং তার সর্বোচ্চ অবস্থান তার ন্যায়সঙ্গত আর অলঙ্ঘনীয় এমন বালখিল্যসুলভ বিশ্বাসকে যুক্তিসঙ্গত করেছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা তাঁকে পরিবর্তিত করেছে এবং এখন, পরিণত বয়সে এসে সে এমন বাহ্যিক ব্যাখ্যা সাধারণত বর্জন করে এমনকি ব্যর্থতার কারণ হিসাবেও সে একে গন্য করে থাকে। একটা মানুষের জন্মের বিষয়টা যদিও ঈশ্বরের অভিপ্রায় কিন্তু সেখান থেকে নিজের জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁর নিজের উপর এবং তার দক্ষতার যথাযথ প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল। নিয়তি নির্ধারিত থাকার কারণে সে তাঁর সাম্রাজ্য পুনরায় অর্জন করেনি বরং এটা অর্জনের জন্য সে চেষ্টা করেছে, নিজের দুর্বলতাকে জয় করেছে আর সবধরনের বিলাসিতা পরিহার করে কেবল একটা লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। নিজের এই ভাবনার কারণে নিজেই গর্বিত হয়ে হিন্দুস্তান বিজয়ের পরে বাবরের সংক্ষিপ্ত শাসনকালের সাথে তুলনায় নিজের শাসনকালের বিকাশ কেমন ভাবে তুলনীয় হবে ভাবতে ভাবতে হুমায়ুন ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ভেঙে উঠে সে জওহরকে ডাকার প্রস্তুতি নেবার সময় পূর্বদিনের সন্ধ্যাবেলার ভাবনাগুলো আরেকবার চিন্তা করে। সে যখন এসব ভাবছে তখন তারকারাজির একটা বইয়ের দিকে তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সে মুচকি হাসে। সে এখন যদিও বিশ্বাস করে না যে তারকারাজি জীবনের সব গোপন রহস্য ধারণ করে রয়েছে, কিন্তু তাঁদের আবর্তন এবং তাঁর পেছনের কারণ আজও তার বুদ্ধিকে উদ্দীপ্ত করে। জ্যোতিষবিদ্যার আকর্ষণ তার কাছে কখনও ম্লান হবে না।

দুই ঘন্টা পরে, জওহর হুমায়ুনকে সেদিনের জন্য পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত করার পরে তার সামনে একটা লম্বা বার্ণিশ করা আয়না ধরে যাতে হুমায়ুন নিজের রাজকীয় পরিচ্ছদ খুটিয়ে দেখতে পারে। সে আয়নায় প্রথমবার যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল ঠিক তখনকার মতোই সাতচল্লিশ বছরের একজন পুরুষের ঋজু, পেষল অবয়ব দেখতে পায় যদিও তাঁর কপালের দুপাশের চুলে হাল্কা রূপালি ঝোপ দেখা দিয়েছে এবং চোখের চারপাশে আর হাসির সময় ঠোঁটের কোণে হাল্কা বলিরেখা পড়েছে।

তার পরণে সোনার জরির কারুকার্য করা সূর্য আর নক্ষত্রখচিত আজানুলম্বিত আলখাল্লা এবং কিনারায় মূল্যবান মুক্তোখচিত একটা দুধ সাদা রঙের টিউনিক এবং একই রঙের পাতলুন। খাঁটি স্বর্ণের তৈরী একটা পরিকর তাঁর কোমরে এবং সেখানে রত্নখচিত ময়ানে ঝুলছে আলমগীর। তাঁর পায়ের রয়েছে বাদামী বর্ণের সামনের দিকটা বাঁকানো এবং তীক্ষ্ণ একটা নাগড়া এবং যার গোড়ালীর পেছনের দিকে রয়েছে সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা অতিকায় তারকা। তার মাথায় রয়েছে সোনার জরি দিয়ে বোনা একটা কাপড়ের পাগড়ি যার চূড়ায় একটা ময়ূরের পালক যুক্ত রয়েছে এবং গলার সোনার উপর রুবিখচিত ভারী মালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রুবির বলয় রয়েছে পাগড়ির মাঝামাঝি স্থানে। তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয় রয়েছে তাঁর তর্জনীতে এবং অন্য আঙ্গুলে পান্না আর নীলা ঝলসাচ্ছে।

জওহর, তোমাকে ধন্যবাদ; তুমি আমাকে একজন সম্রাটের তুল্য পোষাকেই সজ্জিত করেছে। আমি একটা জিনিষ শিখেছি যে শক্তিশালী আর কর্তৃত্বপরায়ণ হবার সাথে সাথে মানুষের সামনে নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আনুগত্য আর আত্মবিশ্বাস এর ফলে বৃদ্ধি পায়… কিন্তু এসব সাজসজ্জা এখন অনেক হয়েছে। আমার চোখেরমণি কোথায়?

বাইরে অপেক্ষা করছে।

তাকে ভেতরে আসতে বল।

আকবর কিছুক্ষণ পরেই পুরোপুরি সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত দুজন দেহরক্ষী তাবুর সামনের পর্দা তুলে ধরলে ভেতরে প্রবেশ করে। আকবরের বয়স এখনও পুরোপুরি তের বছরও হয়নি কিন্তু এরই ভিতরে সে তাঁর আব্বাজানের মতোই লম্বা আর চওড়া কাঁধের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তার পরণেও বেগুনী আর গোলাপী রঙের রাজকীয় সাজসজ্জা যা তার তারুণ্যদীপ্ত পেষল অভিব্যক্তিই যেন ঘোষণা করছে।

আব্বাজান, মুখে চওড়া হাসি নিয়ে আকবর জীবনে প্রথম হুমায়ুনের আগে কথা বলে, সোয়া ঘন্টা আগে কাবুল থেকে হিন্দুস্তানের ডাকবহনকারী এক বার্তাবাহক এসেছে। সে আমাদের জন্য আমার আম্মাজানের দুটো চিঠি নিয়ে এসেছে। শিরহিন্দের যুদ্ধের পরে আপনি যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী তিনি ইতিমধ্যে আমাদের সাথে মিলিত হবার জন্য কাবুল থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। বর্ষার কারণে বিলম্ব না হলে আগামী ছয় থেকে আট সপ্তাহের ভিতরে তিনি দিল্লী এসে পৌঁছাবেন।

হুমায়ুন তার মনের ভেতরে একটা হাফ ছাড়া অনুভূতি টের পায়। হামিদার উপস্থিতি তার আনন্দের মাত্রাকে পূর্ণতা দেবে। চৌদ্দবছর আগে তাঁদের বিয়ের সময়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি, দিল্লী আর আগ্রার ম্রাজ্ঞীর মর্যাদা সে তাঁকে দেবে, যত দ্রুত পূরণ করা যায় ততই মঙ্গল। আকবর এটা একটা দারুণ সুসংবাদ। আমাদের অবিলম্বে তার সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে দ্রুত এখানে নিয়ে আসবার জন্য একদল সুসজ্জিত সৈন্য প্রেরণের আদেশ দেয়া উচিত।

হুমায়ুন তারপরে আকবরকে সাথে নিয়ে আড়াইশ গজ দূরে যেখানে দুটো রাজকীয় হাতি হাঁটু মুড়ে বসে অপেক্ষা করছে সেদিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। জওহর আর আধম খান যারা তাদের সাথে হাতির পিঠে আরোহন করবে কয়েক পা পেছনে থেকে ভক্তিভরে অনুসরণ করে। বৃষ্টি কয়েকদিন বন্ধ থাকায় তারা যখন হাঁটছে তখন পরিচারকেরা তাঁদের মাথায় যেন রোদ না লাগে সেজন্য রেশমের চাঁদোয়া ধরে থাকে। অন্যেরা ময়ূরের পালকগুচ্ছ আন্দোলিত করে তাদের বাতাস করতে এবং গুনগুন করতে থাকা মশা তাড়াতে, যা শিবিরের চারপাশে এখনও জমে থাকা কাদার কারণে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তারা হাতির কাছে পৌঁছালে, হুমায়ুন সোনার একটা সিঁড়ি দিয়ে দুটোর ভিতরে যেটা বড় সেটার পিঠে উঠে যায়। তাঁকে অনুসরণ করে জওহর আর সবুজ আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একজন দেহরক্ষী যারা দুজনেই তার পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে। হাওদায় খচিত রত্নসমূহ- যার বেশীরভাগই লাল রঙের তামড়ি আর নীলকান্তমণি- প্রথম হাতিটা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে, সামান্য ছোট দ্বিতীয় হাতিটা আকবর, আধম খান আর আরেকজন দেহরক্ষীকে নিয়ে এরপরেই উঠে দাঁড়ায়। আকবর তার দুধ-ভাইয়ের সাথে এমন ভাবে গল্প করছে যেন তারা শিকার করতে যাচ্ছে।

হাতি দুটো একসাথে তাদের অন্যান্য সহযাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকা একটা সারির দিকে ধীরে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন একটা হাওদায় বৈরাম খানকে দেখতে পায়, পার্সী দরবারের রীতিতে উপবিষ্ট। তার পাশেই রয়েছে তাঁর সেই তরুণ কৰ্চি বেচারার উরুর ক্ষত যদিও সেরে গিয়েছে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে রক্তপাত বন্ধের জন্য ক্ষতস্থান পোড়াবার যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি প্রয়োগের পরেই এবং এখন থেকে তাঁকে আজীবন খুড়িয়েই হাঁটতে হবে। বৈরাম খানের ঠিক পেছনের হাতিতেই রয়েছে জাহিদ খান এবং হুমায়ুনের আদেশে একেবারে সামনের হাতিতে রয়েছে আহমেদ খান। এই সম্মান আপনার প্রাপ্য যখন চারিদিকে কেবল বিপদ আর মর্যাদার কোনো অবকাশ ছিল না তখনও আপনি সবসময়ে পথ দেখিয়েছেন, সে তাকে বলে।

হাতির ঠিক পরেই রয়েছে মুস্তাফা আগুনের অশ্বারোহী বাহিনী। হুমায়ুন কিছুক্ষণের জন্য তাঁর পুরো অভিযানে আরো যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেইসব সাধারণ মানুষদের কথা চিন্তা করে। সে একহাতবিশিষ্ট ওয়াজিম পাঠানের কথা ভাবে এমনকি ভিস্তি নিজামের কথাও তার মনে পড়ে কিন্তু কামরান পরাজিত হবার পরে ওয়াজিম খান তার গ্রামেই মোড়ল হিসাবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং নিজামকে খোঁজার সময় হয়নি। হুমায়ুন তারপরে জোর করে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে আদেশ দেয়। অগ্রসর হওয়া যাক।

হুমায়ুনের আদেশ রাজকীয় শোভাযাত্রার শুরুতে অবস্থানকারী হুমায়ুন আর মোগল রাজবংশের সাথে সাথে তৈমূরের অতিকায় নিশানবাহকদের পৌঁছে দেয়া হয়। তাঁরা আধ মাইল দূরে অবস্থিত বেলে পাথরের তৈরী অতিকায় তোরণদ্বারের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে তাদের ঠিক পেছনেই অবস্থানরত তূর্য আর দামামাবাদকের দল বাজনা শুরু করে, প্রথমে ধীর লয়ে তারপরে প্রবল উদ্দামে যখন তারা তোরণদ্বারের কাছে সমবেত জনতার নিকটবর্তী হয় যাদের হুমায়ুনের সৈন্যরা শিবির থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল কিন্তু এখন তারা রাজকীয় শোভাযাত্রার খেজুর পাতা এবং ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরী দড়ির দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুমায়ুন সামনে এগিয়ে যাবার সময় সূর্যের আলোয় সামনের অশ্বারোহীদের বুকের বর্ম আর ঘোড়ার সাজ আর সামনের হাওদাগুলোকে চকচক করতে দেখে এবং লাগামের সাথে যুক্ত ক্ষুদ্র ঘন্টার ধ্বনি আর ঘোড়ার চিঁহি শব্দ মন দিয়ে শোনে- যা সমবেত জনতার উল্লসিক চিৎকারে প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছে। তারপরে, আবেগ আপুত হৃদয়ে সে মুখ তুলে উপরের নীল নির্মেঘ আকাশের দিকে তাকায় এবং দেখে বা তাঁর মনে হয় সে দেখেছে- মোগল মহত্বের প্রতীক দুটো ঈগল আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। হিন্দুস্তান এখন তার। মোগল সিংহাসন সে পুনরুদ্ধার করেছে। তাঁদের রাজবংশ আজকের পরে কেবলই শক্তিশালী হবে। সে আর আকবর- বিষয়টা নিশ্চিত করবে।

৪.৭ তারকার হাসির পতন

২৭. তারকার হাসির পতন

লাল পাথরের দূর্গ পুরানা কেল্লায় নিজ কক্ষে বসে আছেন হুমায়ুন। দূর্গটি দিল্লির পূর্বাঞ্চলের একপ্রান্তে শাসনামলের প্রথম দিকে নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি। তবে এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন শেরশাহ ও তাঁর পূত্র ইসলাম শাহ। দূর্গটির চারপাশে পুরু দেয়াল। এতে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি চৌকিঘর ফটক। প্রায় এক মাইল বিস্তৃত এই দূর্গ সাপের মতো লম্বাটে। একইসঙ্গে এটি রাজকীয় কাজকর্মের কেন্দ্রস্থলও। হুমায়ূনের সামনের গালিচা বিছানো টেবিলে রাজ্যের খতিয়ান বই রাখা হয়েছে। বইতে শেরশাহ ও তাঁর পূত্রের শাসনামলের প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বৃত্তান্তও অন্তর্ভূক্ত আছে। জওহর এই বইটি নিয়ে এখানে উপস্থিত রয়েছেন। তাকে কয়েক বছর নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেয়ার জন্য ব্যবস্থাপক সভার কম্পট্রোলার করা হয়েছে।

দিল্লিতে প্রবেশের পর তাঁকে নিয়ে যে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তার রেশ এখন অনেকটা কেটে উঠছে। হুমায়ূন জানতেন যে তাঁকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় উৎসাহিত হতে হবে এবং খবর রাখতে হবে কীভাবে তাঁর রাজত্ব চলছে এবং নতুন যেসব এলাকা জয় করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে কর্মবিরত থাকলে চলবে না। তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের বলেছিলেন, এখন আমাদের কাজ কেবল অর্ধেক শেষ হয়েছে। হিন্দুস্তানকে আবারও আক্রমণ করা হতে পারে যা খুব কঠিন কাজ নয়। আমাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা হিন্দুস্তানের ক্ষমতা ধরে রাখব এবং সাম্রাজ্য বাড়াবো। দিল্লিতে থাকা শেরশাহ ও ইসলাম শাহের কর্মকর্তাদের তিনি ইতোমধ্যে জিজ্ঞেস করেছেন। তিনি তাঁর বিশ্বস্থ সেনাপতিদের বিভিন্ন রাজ্য শাসনের জন্য পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে আগ্রাতে পাঠানো হয়েছে আহমেদ খানকে।

কিছুটা ভ্রূ কুচকিয়ে তিনি (খতিয়ান বই) পড়তে শুরু করলেন। সবকিছুর পর জবরদখলকারীদের প্রাপ্তিও তাঁকে মুগ্ধ করছে। খতিয়ান খাতায় দেখা গেছে, সাংগঠনিক হিসেবে শেরশাহ ছিলেন দক্ষ, ধূর্ত ও প্রভাবশালী। কারণ তিনি ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার এক হিসেবি যোদ্ধা। কোনো বিশেষ সরকারকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর না করতে রাজ্য সরকারের শাসন পদ্ধতিকে পুনর্গঠন করেছিলেন তিনি। তিনি রাজস্ব আদায়ের বিষয়টিও পুনর্গঠন করেছেন। অবশ্যই সাম্প্রতিক যুদ্ধকালে কর আদায় ছিল জটিল ও সমস্যার কাজ। তবে হুমায়ূনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন যে শেরশাহ যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করে গেছেন সেগুলো এখনও বিদ্যমান আছে এবং সেগুলো আরও সক্রিয়ভাবে চালু করার দাবি রাখে। বিষয়টি হুমায়ুনের জন্য সুবিধার। তাঁর বাবা ডাইরিতে কী লিখে গেছেন? … অন্তত এই জায়গায় যথেষ্ট অর্থ আছে। হিন্দুস্তানের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে হুমায়ূন জানতেন কীভাবে ক্ষমতা রক্ষা করতে হয় ও বিস্তার ঘটাতে হয়।

শেরশাহ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন, বাড়িঘর সংস্কার করেছেন এবং প্রতি পাঁচ মাইল পর ভ্রমনকারীদের জন্য বিশ্রামকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন। তবে এই বিশ্রামকেন্দ্রগুলোর মুল লক্ষ্য ছিল এগুলো খবরের দূত ও ঘোড়ার জন্য ডাক চৌকি। হিসেবে ব্যবহৃত হত। এতে দ্রুত রাজ্যের বিভিন্ন অংশে খবর সরবরাহ করা সম্ভব হত। রাজ্যের এক অংশের খবর আরেক অংশে দ্রুত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হত।

বিদ্রোহ ঠেকাতে ও রাজ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে শেরশাহ নতুন দূর্গ নির্মাণ করেন। তিনি নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। হুমায়ূন একটি অনুচ্ছেদ পুনরায় পাঠ করেন যেখানে তার চোখ নিবদ্ধ হয়: তার অসীম প্রজ্ঞা ও ঈশ্বরপ্রদত্ত ভালোত্ব দিয়ে শেরশাহ প্রতি গ্রামে একজন সর্দার নিয়োগ করেন, যিনি তাঁর নিজ গ্রামকে চোর ও হত্যাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। এছাড়া নিজ এলাকায় কোনো পর্যটক যদি হত্যার শিকার হয় সে জন্য দায়ি থাকবেন ওই সর্দার। এই সর্দার তার কাজকর্মের জন্য প্রশাসনের কাজে দায়বদ্ধ থাকার নির্দেন দেন শেরশাহ। যদি কোনো অপরাধের অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব না হয় তাহলে এর সাজা স্বয়ং ওই সর্দারকে ভোগ করতে হবে বলেও নিয়ম ছিল।

চামড়ার বাঁধাই করা ভারি খতিয়ান বইটি মার্বেল পাথরের টেবিলে রেখে ক্ষমতায় আসার সময়কার সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে হাসলেন হুমায়ূন। কিছু কিছু বিষয় ভেবে তিনি বেশ কিছুটা বিরক্তও হন। রাস্তা নির্মাণ, কিংবা রাজ্যগুলো পুনর্গঠন করা অথবা কর সংগ্রহের মধ্যে বিরত্বের কি আছে? তবে এখন তিনি জানেন ক্ষমতায় থাকার জন্য এগুলো করাটা কতোটা অপরিহার্য।

কোনটি শেরশাহ করেছেন আর কোনটি ইসলাম শাহ করেছেন, তা জেনে এখন কী আসে যায়। বরং ভালো বিষয়গুলোই রাখতে চান তিনি। এতে তিনি হিন্দুস্তানে তাঁর শাসনব্যবস্থাকে আরও জোরদার করতে পারবেন…। তবে একটি বিষয় তিনি পরিবর্তন করবেন। যদিও দিল্লি ছিল শেরশাহের রাজধানী এবং পুরানা কেল্লা সম্রাটের জন্য প্রাসাদদূর্গ ছিল। তিনি আগ্রাকে আবারও রাজধানী করার পক্ষপাতি। বাবর আগ্রাকে রাজধানী করেছিলেন। এটা করা মাত্রই তিনি তাঁর রাজপ্রাসাদ সেখানে স্থানান্তরিত করবেন। হামিদা কখনো আগ্রা দেখেননি। সেখানে তাঁকে নিয়ে তিনি সুন্দর একটি প্রসাদে থাকবেন। এমন এক সুন্দর প্রাসাদ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সভাকবিরা কবিতা লিখবেন। তবে দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ ভালো স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে দিল্লি। এজন্য হিন্দুস্তানের মানুষের কথা বিবেচনা করে তিনি আরও কয়েকমাস দিল্লিতে রাজধানী রাখার কথা ভাবতে থাকেন। তারা (হিন্দুস্তানের মানুষ) বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে অনেকটা বিপর্যস্ত। তিনি তাদের প্রকৃত সম্রাট– তিনি শক্তিশালী…

মহারাজ, মহারানী হামিদার কাফেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে রয়েছে। এক ঘোষণা হুমায়ূনের ভাবনাকে খণ্ডিত করে দিল। তখন তাঁর হৃদয় কেঁপে ওঠল। তিনি জানেন, তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন রাজ্যে সফর করছেন। কিন্তু এতো দ্রুত তিনি এখানে ফিরে আসলেন, যা তাকে খানিকটা বিস্মিত করেছে। তিনি দাঁড়ালেন। তার হৃদয়টা আনন্দে ভরে গেল। কারণ প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আমার রাজকীয় পোষাক এনে দাও। আমি আমার স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে ভালো পোষাকে সাজতে চাই। যদিও পরে সে তার উজ্জল্যে আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন হুমায়ূন।

পুরানা কিল্লার পশ্চিম ফটকের ওপর থেকে হামিদার ধীরগতির কাফেলা দেখছিলেন হুমায়ূন। এই ফটকটি ছিল অন্যান্য ফটকের চেয়ে বেশ জাকজমকপূর্ণ। সাদা মারবেল পাথর দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। দুই পাশে দুটি উঁচু চৌকিঘর। আর এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করবেন হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাজ্ঞি হামিদা। যে হাতির ওপরে করে তিনি আসছেন সেটাতে দামি কাপড়ের ওপর লাগানো আছে পাতলা স্বর্ণের আস্তরণ। এগুলো মাঝেমধ্যে ঝলকে উঠছে। যখনই এটি পশ্চিম ফটকের নিচে চলে আসল, চৌকিঘর থেকে সজোরে তূর্যধ্বনী উঠতে শুরু হল। উপস্থিত সবাই গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপ ছুঁড়তে শুরু করলেন। হুমায়ূন দূর্গের ভেতরে একটি ফাঁকা স্থানে নেমে আসলেন। সেখানে একটি বড় সবুজ মখমলের তাবু তৈরি করা হয়েছে। সবুজ সিল্কের ফিতা দিয়ে এটি আচ্ছাদিত। এর একটি প্রবেশ পথ আছে যেখানে ঝুলে আছে সোনালি ফিতা। তাবুর ভেতরে রাখা হয়েছে বড় একটি মার্বেল পাথরের খণ্ড, যার উপরিভাগ সমান। গোপনীয়তার মধ্যে হামিদ নেমে আসার জন্য এই আয়োজন করা হয়।

হামিদার হাতি এখন প্রাসাদের উঠানে এসে হাজির হচ্ছে। মাহুত হাতির গলার মধ্যে বসে রয়েছেন এবং সতর্কভাবে তাবুর দিকে হাতিটিকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন। তারপর প্রথমে তিনি হাতের ধাতু নির্মিত সরু লাটি দিয়ে হাতিটিকে প্রথমে ডান দিকে এবং পরে বামদিকে নির্দেশ করলেন। তারপর হাতিটি মার্বেলের বড় পাথরটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। যেইমাত্র হাতিটি নিচু হল, মাহুত নেমে গিয়ে একপাশে বিনিত ভঙ্গিমায় দাঁড়ালেন। হুমায়ূন দেখলেন, তাঁর স্ত্রী পাথরের ওপর নরম পায়ে নামছেন। তাঁর জামাকাপড়ের স্বর্ণখণ্ডগুলো ঝলকে উঠছিল।

যেহেতু হুমায়ূনের দিকে চেয়ে তিনি হাসলেন, স্বর্ণ খচিত পোষাকে হামিদাকে আগের চেয়ে আরও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। তাঁর দীর্ঘ কালো সুগন্ধী চুল কাঁধের ওপর এসে পড়ছিল এবং এগুলো তার স্তনের ওপর ওঠানামা করছিল। তার গলায় মনি মুক্তার হার যা অনেক বিপদেও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

মাউত (হাতির পরিচালক) ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের উদ্দেশ্যে হুমায়ূন বললেন, এখন যাও। যখনই তারা একাকী হয়ে গেলেন, তিনি হামিদাকে মার্বেলে সমতল পাথর থেকে নামিয়ে আনলেন এবং তাঁকে তাঁর সামনে দাঁড় করালেন। তিনি বললেন, আমার রানী, আমার সম্রাজ্ঞী।

হামিদাকে নিয়ে সে রাতে যমুনা নদীর তীরে গড়া প্রাসাদে কাটালেন হুমায়ুন। একসময় ইসলাম শাহের হেরেমের মতো গড়ে ছিলেন এক প্রাসাদ। সেখানে দেয়ালে কাঁচের ছোট ছোট টুকরো লাগানো রয়েছে। মোমের আলো এই কাঁচের টুকরোগুলোতে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতো। সোনার থালায় পুড়ানো সুগন্ধি চন্দনের ঘ্রাণ আসছে ঘরের প্রত্যেক কোনো থেকে। একইসঙ্গে মার্বেলের ঝর্ণা থেকে আসছে সুগন্ধী জলের ঘ্রাণ যেখানে গোলাপের পাপড়ি ফেলা হয়েছে।

শুধু গলার হার ছাড়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পড়েন হামিদা। হুমায়ুন তার কোমল ঠোঁটে হাত বুলায়ে দেন। অন্তত আমি আপনাকে সেটা দিতে পারি যা দেয়ার প্রতিজ্ঞা আপনার কাছে আমি করেছি। রাজস্তানের মরুভূমিতে যুদ্ধ চলাকালে মাঝেমধ্যে রাতে যখন আমি ঘুমোতে পারতাম না, তাকিয়ে থাকতাম আকাশের তারার দিকে, তারাগুলো ঘুরে ফিরত, আমি তাতে সামান্য ব্যাথার প্রশমন পেতাম। কিন্তু আপনি আমার ব্যাথার সবচেয়ে বড় প্রশমন।

হামিদা হাসতেন, আমি এখনও মনে করতে পারছি কতোটা আশ্চর্য হয়েছে আমার বাবা যখন আমাকে জানালেন আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন… আমি শুধু আপনাকে দূর থেকে দেখেছি… আপনাকে দেবতার মতো মনে হতো… আমাদের বাসর রাতেও আমি বিচলিত ছিলাম, কিন্তু যখন আপনি আমার কাছে আসলেন, আমি দেখলাম আমার জন্য আপনার জ্বলন্ত ভালোবাসা আর আমি জানতাম আপনি আমার অংশে পরিণত হবেন… আপনি আমার জীবন…

আর আপনি আমার… তবে আমাকে আবার প্রমাণ করতে দিন যে আমি আসলেই মানুষ, দেবতা নই। হুমায়ূন যখন হামিদাকে জড়িয়ে ধরলেন, তিনি দেখলেন তার দুটি চোখে সম্মতির মৃদু দিপ্তী।

*

মহারাজ, এক পত্রবাহক বৈরাম খানের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছেন।

তাঁকে এক্ষুনি আমার কাছে নিয়ে আসো। নিজ কক্ষে পায়চারি করছিলেন হুমায়ুন। অবশেষে… কিন্তু কি খবর নিয়ে এসেছেন সেই ব্যক্তি? হুমায়ূনের শ্রেষ্ঠত্বের গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়ানো শক্তির বিরুদ্ধে গত কয়েক মাস আগে বৈরাম খান বিশ হাজার সেনার নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়েছেন। সর্বশেষ শিরহিন্দে যুদ্ধের পর সিকন্দর শাহ হিমালয়ের পাদদেশে পালিয়ে যান। তিনি আবারও পাঞ্জাবের সমতল ভূমিতে এসেছেন এবং সমর্থন কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। বৈরাম খানের আগের রিপোর্ট ছিল বেশ সাহস যোগানোর মতো, এতে সিকন্দর শাহের বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে ঘায়েল করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সিকন্দর শাহ আবারও পার্বত্যাঞ্চলে পালিয়ে যান। তারপর থেকে সবকিছু বেশ নীরব।

দিনের পর দিন হুমায়ূনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ তাঁর পূত্র আকবর। পূত্রকে বৈরাম খানের সঙ্গে পাঠানোর জন্য চাওয়া হয়েছিল। তখন আগ্রহ না থাকার পরও হুমায়ুন রাজি হয়েছিলেন। নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আকবরকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে হবে। আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানের পিতা নাদিম খাওজার বিশেষ হেফাজতে থাকবেন। আকবরও বৈরাম খানের সঙ্গে যান। যদিও বিষয়টি তাঁর মনকে গর্বে ভরে দিয়েছে, তবে এটা তার জন্য দেখাটা কঠিন যে তাঁর একমাত্র ছেলে স্বতস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। এটা হামিদার জন্য আরও কঠিন। যদিও তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা থেকে বিরত থাকছেন, হুমায়ুন জানেন, হামিদা কতগুলো রাত এ নিয়ে দুচিন্তা করে কাটিয়েছেন। তবে তাঁদের সৌভাগ্য যে

অপেক্ষার পালা এখন শেষ হতে যাচ্ছে।

হুমায়ুনের উপস্থিতির কথা ঘোষণা করা হল। বার্তাবাহকের ধূলোবালিপূর্ন জামা প্রমাণ করে যে তিনি বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে পথে ছিলেন। হুমায়ূন আসার পর তাঁর দিকে সম্মানার্থে মাথা ঝুঁকালেন তিনি। তারপর চামড়ার থলে থেকে একটি পত্র বের করলেন। মহারাজ, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে এই পত্রটি আপনাকে ছাড়া আর কারো কাছে না দেয়ার জন্য। হুমায়ুন আগ্রহের সঙ্গে পত্রটি হাতে নিলেন এবং হঠাই খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে তার এই ভাবনাটা ছিল বোকামী। তিনি ধীরে ধীরে পত্রটি খুললেন এবং ফারসি হরফে বৈরাম খানের হাতের সুন্দর, পরিচ্ছন্ন লেখা দেখতে পেলেন।

মহারাজ, খুশির খবর। আপনার সৈন্য বাহিনী বিশ্বাসঘাতক সিকন্দর শাহকে পরাজিত করেছে। পরাজিত হয়ে নিজের সৈন্য বাহিনীকে তাঁদের ভাগ্যের কাছে ছেড়ে তিনি কাপুরুষের মতো পশ্চিমপ্রান্তে বাংলার দিকে পালিয়ে গেছেন। আমরা পাঁচ হাজার যুদ্ধবন্দিদের আটক করেছি এবং বেশ কিছু জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়েছি। একমাসের মধ্যে, স্রস্টার ইচ্ছা থাকলে, আমি আপনার সৈনাবাহিনী নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসতে পারব এবং আমাদের এই অভিযানের সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত আপনাকে সরাসরি জানাতে পেরে অবশ্যই আনন্দ পাব। আপনার ছেলে ভালো আছেন এবং আপনাকে ও মহারানীকে তাঁর সালাম জানাতে বলেছেন।

কিছুক্ষণ নীরব আনন্দে মাথা নত করলেন হুমায়ুন। তারপর তিনি তার রক্ষীদের উদ্দেশ্যে জোরে বললেন, দূর্গের চৌকিঘর ও নগরীর দেয়ালের ওপর তুর্যধ্বনি শুরু করা হোক। আমরা একটা বড় বিজয় লাভ করেছি এবং সারা বিশ্বের বিষয়টি জানা উচিৎ।

*

যখন পশ্চিমের আকাশ খয়েরি রঙ ধারণ করেছে, হুমায়ূন শুনতে পেলেন তুর্যের উচ্চধ্বনী। ঘোষণা করা হয়েছে পশ্চিমের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছেন বৈরাম খান। কিছুক্ষণ পর হুমায়ুনের ব্যক্তিগত রক্ষীদের একজন তাঁর কাছে আসলেন। তাঁর গায়ে গাঢ় সবুজের একটি ঢিলেঢালা জামা।

বৈরাম খানের পক্ষ থেকে আমার জন্য উপহার আছে বলে আশা করছি?

হ্যাঁ, মহারাজ।

তবে চলো আমরা এগিয়ে যাই। ছয় জন দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে হুমায়ূন সভাকক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর সিংহাসনের ডানপাশের টেরাকোটা ফুল আঁকা দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। জওহরসহ তার সভাসদ, সেনাপতি ও রাজকর্মচারীরা ইতোমধ্যে সভাকক্ষে হাজির হয়ে সিংহাসনের সামনে গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গাউনের উপরের হলুদ, লাল ও নীল লেবাস নিয়ে তাবরিজের উন্নত গারিচার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তাদেরকে বেশ জমকালো মনে হচ্ছিল। তাদের পাগড়ি, গলা ও হাতের আঙ্গুল থেকে বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। হুমায়ুনকে দেখামাত্র সকলেই অবনত হয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন।

তবে তার আগ্রহ এই সভাসদের প্রতি নয়, বরং বৈরাম খান ও আকবরের প্রতি। তিনি দুই দরজা পার হয়ে একটু দূরের একটি কক্ষে তাদের দেখতে পাচ্ছেন। তবে তিনি তার সভাসদদের ডেকেছেন বিজয়ী সেনাপতিদের কথা জানাতে এবং তাঁদের সঙ্গে এই বড় আনন্দ ভাগাভাগি করতে। সিংহাসনে বসে হুমায়ূন তার হাত তুলে বললেন, চলুন বৈরাম খানের সঙ্গে সাক্ষাত করি। এই ঘোষণার পর তার সেনাপতি সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। সিংহাসনের কাছে এসে তিনি শ্রদ্ধাবনত হলেন।

বৈরাম খান, আপনাকে স্বাগতম, বললেন হুমায়ুন। তারপর তিনি তাঁর কয়েকজন রাজকর্মচারির দিকে তাকালেন। এই রাজ কর্মচারীরা তার দিকে ফিরোজা রঙের রত্ন নিয়ে এগিয়ে আসলেন। রেশমি কাপড়ে রূপার তার নিয়ে মোড়ানো এই রত্ন বাম হাত দিয়ে গ্রহণ করলেন হুমায়ূন। তিনি এটি বৈরাম খানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বৈরাম খান দেখতে পেলেন এর ভেতরের রত্নের উজ্জ্বলতা।

বৈরাম খান, আপনি এমন এক যোদ্ধা যার জন্য এই সামান্য রত্ন খুবই তুচ্ছ। তবে আপনার জন্য আরও কিছু আমার দেয়ার আছে। আপনি হবেন খান ই খানান, সারা মোগল সৈন্য বাহিনীর প্রধান নির্দেশদাতা।

মহারাজ, আরও একবার মাথা ঝুঁকালেন বৈরাম খান। তবে এবার হুমায়ূনের সামনে নয়। তার কালো দুই চোখে বিস্ময় ঝলক দিয়ে উঠল। এটা সেনাপতিদের পুরস্কৃত করার বেশ ভালো পন্থা, যাঁরা তাঁদের পারস্য মাতৃভূমি তার জন্য ছেড়েছেন এবং এ ধরনের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। জাহিদ বেগও সম্মাননা। প্রত্যাশা করেন এবং নিশ্চিত তিনি তা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তবে সম্প্রতি তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের ভূমি কাবুলে ফিরে যেতে চাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বয়স্ক এবং তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থাও তেমন ভালো না। যোদ্ধা হিসেবে তার সময়টা প্রায় চলে গেছে, তবে হুমায়ূন যদি চান তাহলে তিনি আসবেন।

হুমায়ূন বৈরাম খানকে উপস্থিত সভাসদদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুযোগ করে দিলেন। পরবর্তী ভরা পুর্ণিমার রাতে আমরা পুরানা কিল্লায় অনেকগুলো প্রদীপ ও মোমবাতি দিয়ে আলো জ্বালব। এই আলোর তেজ পুর্ণিমার জ্যোৎস্নাকেও ম্লান করে দেবে। সে রাতে আমরা বিজয়কে উদযাপন করতে ভোজের আয়োজন করব। হুমায়ূন আবারও তার সভাসদদের দিকে ফিরে তাকালেন। আমার প্রিয় পূত্রকে এবার আমার সামনে নিয়ে আসো।

আকবর সামনে আসার পর হুমায়ূন তাঁর দিকে ভালোবাসা ও গর্ব নিয়ে তাকালেন। বেশ কয়েক মাস পর পূত্রের সঙ্গে পিতার সাক্ষাত। বেশ কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে আকবরের মধ্যে। সবুজ কাপড়ের ওপর তাঁকে আগের চেয়ে লম্বা এবং তাঁর বৃহৎ বক্ষদেশ, দৃঢ় পেশিবহুল তরুণ হিসেবে দেখা যাচ্ছিল। হুমায়ূন লক্ষ্য করলেন তার মধ্যে এতোটা উৎফুল্লতা নেই। যখনই পুত্র আকবর কাছে আসলেন এবং সম্মানার্থে তাঁর ডানহাতটি নিয়ে বুকে লাগালেন হুমায়ূন, তিনি দেখলেন তার একটি হাতে ব্যান্ডেজ করা রয়েছে। হুমায়ূন প্রশ্ন করার আগেই বৈরাম খান এই আঘাত সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন।

মহারাজ, আপনার পরামর্শ অনুযায়ি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলো চলাকালে রাজপূত্রকে রক্ষীরা বেশ ভালোভাবে খেয়াল রেখেছেন। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা সিকন্দর শাহকে একদম ছন্নবিচ্ছন্ন করে দেই। আমার সহযোদ্ধারা জানায়, তারা পর্বতের পাশে একদল সৈন্যের বিচরণ লক্ষ্য করেছে। প্রায় ১ হাজার সেনা বাহিনীর একটি দল নিয়ে আমি সেই সৈন্য বাহিনীর মোকাবেলা করা সিদ্ধান্ত নেই। এরসঙ্গে বেশ কিছু অস্ত্রের মজুত নিয়ে আকবরকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, যাতে তিনি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। আমি ভেবেছিলাম ওই সৈন্য বাহিনী হয়তো সেখানে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। আমরা একটি গিরিপথ ধরে যাই। সেখানে হঠাৎ পাথর ধ্বসের ঘটনা ঘটে। সে সময় পাথরের টুকরো পড়া শুরু হয়। তখন আমাদের তিন সৈনা নিহত হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

আমাদের অধিকাংশ সৈন্য দল সেই স্থান থেকে সামনে চলে যায়, তবে আমাদের শেষ একশ সৈন্য মূল্য বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। তখন অন্ধকার নেমে আসছিল এবং আরও পাথর পতনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। যারা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আমি তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম, তারা যে। পথে এসেছে সে পথে যেনো ফিরে যায়। আমি তখন এই গিরিখাতের সরু পথ থেকে সৈন্যদের নিয়ে বের হয়ে আসি। আমাদের বেশ কিছু শক্তিশালী সৈন্য গিরিপথ বন্ধ করে দেয়া পাথরের স্তূপ সরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা জানতে পারি, ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই কাজ শেষ করতে পারব না… আমি রাজপূত্রের জন্য সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ি, তিনি তাঁর দুদ্ধভাইয়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সেই একশ সৈনের মধ্যে ছিলেন। তবে … বৈরাম খান থামলেন। রাজপূত্রকেই তাঁর গল্পটি বলার সূযোগ দেয়া উচিৎ…

আমি শুনতে পেলাম বৈরাম খান চিৎকার করে বললেন গিরিপথ থেকে বের হয়ে যেতে। আকবর আগ্রহের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আমরা আমাদের রসদগুলো নিয়ে এতোদ্রুত ফেরার সুযোগ পাইনি, গিরিপথটি ছিল খুবই সংকীর্ণ হঠাৎ বেশ কিছু লোক আমাদের ওপর হামলা চালালো। তারা ছিল পাথরের ওপর। নিচ থেকে খুব কমই আমরা দেখতে পাই। আমরা দেখলাম সিকন্দর শাহের সৈন্যদের। তাদের কাছে তেমন অস্ত্রসস্ত্র নেই। কোনো মুখোশ ছিল না। শুধু তীর আর ধনুক। আমরা তাদেরকে প্রথমে পর্বতের উপজাতি গোষ্ঠি মনে করেছিলাম, যারা আমাদের এই পথে যাওয়াটা লক্ষ্য করছে এবং লুণ্ঠন করার চিন্তা করছে। তারা আমাদের ওপর পাথরও ছুঁড়ে মারতে পারে… তারা যারাই হোক, তাঁদের ধনুক আর বর্শা কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের চারপাশে বেশ ঘনভাবে পড়তে থাকল। আমাদের বেশ কয়েকজন এতে আঘাতপ্রাপ্ত হলেন।

.

আমি আমার সৈন্য দলকে বললাম ওয়াগনের পেছনে গিয়ে অবস্থান করতে। হামলাকারিদের ওপর আমাদের সঙ্গে থাকা কয়েকটি বন্দুকের গুলি ছুড়ারও নির্দেশ দিলাম আমি। তাদের চোখে নিরাশায় অস্তাচলের সূর্যের হলুদাভ আভা। তবে সেই বন্দুকের গুলি ছিল হামলাকারীদের ভয় দেখানো জন্য যথেষ্ট। কমপক্ষে তাদের একজনকে আমার পেলাম। তাঁর শরীর নিচে পড়ে গেল। আমরা দেখলাম তাঁর মাথায় একটি বন্দুকের গুলি। আমরা যদিও সারা রাত নিজেদের একটু সুরক্ষিত রাখতে আড়ালে অবস্থান করছিলাম, সে রাতে তারা আর ফিরে আসেনি। পরেরদিন সকালে পাথর সরানোর পর আমরা মুল সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেই।

আর আপনার হাত?

এটা আমার প্রথম যুদ্ধের আঘাত একটি তীরের আঘাত। আদম খান এটি আসতে দেখে আমাকে একপাশে সরিয়ে নেন। তা না হলে এটা আমার দেহে আঘাত হানতে পারত… আকবরের কাজল চোখে জল চলে এলো- অনেকটা হামিদার মতো, কারণ তিনি একটি সৈন্য দলকে রক্ষা করেছেন।

আপনি নিজেকে বীরত্বের সঙ্গে রক্ষা করেছেন বললেন হুমায়ূন। সিংহাসনের ডান দিকে গ্রীলের আড়াল থেকে হামিদা এসব দেখছিলেন ও শুনছিলেন। তবে মাতৃত্বের কারণে ভয় সৃষ্টির পরও তিনি আকবরকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। সংকটের মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে বেঁচে থাকার জন্য যে অপরিহার্য দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন

*

সেই রাতে হামিদা ও হুমায়ুনে সঙ্গে হেরেমে খাবার খেলেন আকবর। যখন হুমায়ূন তাঁর অপরূপ সুন্দরী স্ত্রী আর সুদর্শন, শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী ছেলেকে দেখলেন, তাঁর বুকটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল। অবশেষে যেনো তাঁর জীবনের সকল গৌরব সেই স্থানটিতেই ছড়িয়ে পড়ল। স্রস্টা তাঁর অশেষ দয়ায় যে সাম্রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা এখন নিরাপদ এবং এই সাম্রাজ্যে বিস্তৃতি ঘটাবেন তার পাশে থাকা পূত্র আকবর। একদিন আকবরই সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন যুদ্ধ সামনে থেকে পরিচালনা করবেন। মোগল সাম্রাজ্য সমুদ্রের পর সমুদ্র ছাড়িয়ে যাবে।

হামিদাকেও বেশ খুশি মনে হচ্ছিল। তার মুখে নতুন এক আলোর আভা দেখা যাচ্ছিল এবং তার রেশমের কাপড়ের ওপর দিয়ে শরীরের নম্র ভাঁজগুলোও ভেসে উঠছিল। কৈশোরের দিনগুলোর চেয়ে তার দেহে এখন অনেক বেশি ভোগবিলাসিতার ছাপ। আগের চেয়ে বেশি সুন্দরীও তিনি। আজ রাতে কালো চুলের মধ্যে নীলকান্ত মনির সঙ্গে হীরের টুকরো লাগিয়ে সেজেছেন তিনি। সেখানে হীরা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অনাচ্ছাদিত নাভীতে একটি নীল কান্ত মনিও লাগিয়েছেন হামিদা। পরেছেন একটু ঢিলেঢালা পায়জামা। উপরে একটি জামা যা তাঁর শরীরের সঙ্গে লেগে আছে এবং স্ফিত স্তনদুটিকে অনেকটা স্পষ্ট করে তুলেছে।

নৈশভোজের পর আকবর চলে গেলে হামিদাকে জিজ্ঞেস করেন হুমায়ুন, হে আমার সম্রাজ্ঞী, আপনার কেমন লাগল?

আমি আপনাকে বহুবার বলেছি তিনি হাসলেন খুবই ভালো লেগেছে। শত শত রাজকর্মকর্তা কর্মচারি… আমার চিরায়ত অপেক্ষা… আমার জীবনে আমি কোনো কিছু কল্পনা করা বা আকাঙ্খা করতে পারি। কিন্তু সবকিছুর পর আমাকে যে বিষয়টি বেশি খুশি করে তা হলো আমাদের সন্তান নিরাপদভাবে ফিরে এসেছে। সে। আমাকে এই আনন্দে পুর্ণ করেছে। এটা ভাবা এখনও অদ্ভুত মনে হয় যে আমাদের কাছ থেকে নেয়ার পর যখন হিন্দাল তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিল- আকবরকে মন হচ্ছিল যেন সে আমাকে চেনে না। সে মাহাম আগাকে নিয়ে ঈর্ষাণিত ছিল, আমি দেখলাম সে তার হাত কীভাবে আগার দিকে এগিয়ে দিল এবং তার জন্য হাসল, আমার দিকে নয়। আমি তখন নিজের প্রতি খুব ক্ষুদ্ধ হয়েছিলাম, নিজের ঈর্ষার জন্যও ছিলাম চরম লজ্জিত। বীর মহাম আগার কাছ থেকে আমরা সবকিছুই প্রায় পেয়েছি… তবে এখন সবই অতীত। এখন আমি মনে করি আকবরের মাথায় যে ভাবনাই আসুক আমি তা উপলব্ধি করতে পারি। আমি তাঁর সকল উচ্চাকাঙ্খ ও অভিলাস বুঝতে পারি।

.

আমি স্মরণ করতে পারছি, বিবাহের প্রথম রাতের পর সকালে আপনি আমাকে বলেছিলেন- আপনি জানেন আপনি এক পূত্র সন্তানের জন্ম দেবেন। আর একদিন এবং সেই সন্তান হবে এক শ্রেষ্ঠ শাসক… আপনি ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে এখন কী দেখছেন?

আকবরের জন্মই ছিল শেষ বিষয় যা আমি আগেই স্পষ্টভাবে আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও আমার উত্তরসূরিদের কাছ থেকে নারী হিসেবে আমি আধ্যাত্বিক ক্ষমতা পেয়েছি, সেগুলো আমাকে এখন অনেকটাই ছেড়ে গেছে… তবে ওই ভবিষ্যৎ দর্শনটাই ছিল সবচেয়ে উত্তম। ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা সবসময় সুখ নিয়ে আসতে নাও পারে… কখনো না দেখাটাও ভাল…

৪.৮ স্বর্গের সোপানশ্রেণী

২৮. স্বর্গের সোপানশ্রেণী

নতুন পাঠাগারের পরিকল্পনার একটি তালিকা নিজ কক্ষে বসে পড়ছিলেন হুমায়ূন। বিকেলে তালিকাটি তার স্থপতিরা দিয়ে গেছেন। বিকেলের ম্লান অথচ স্বচ্ছ আলো লাল পাথর আর দুধের মতো সাদা মার্বেল পাথরের প্রাসাদের গায়ে এসে পড়ছে। চারদিকে প্রবেশ দ্বারের গায়ে হুমায়ূনের প্রিয় ইরানী কবিদের পংক্তিমালা লেখা আছে। একদিন হুমায়ূন ভাবলেন তাঁর পূর্বসূরিদের দুর্বল সংগ্রহকে ছাড়িয়ে যাবে তাঁর পাঠাগারের সংগ্রহ। সেখানে থাকবে হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি একটি বাক্সে তাঁর বাবার জীবনের বিভিন্ন স্মৃতিকথা সম্বলিত হলুদ মলাটের বই।

কাবুলে বাবর সুন্দর একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন এবং সেখানে বেশ কিছু সুন্দর বাগানও করেছেন। কিন্তু হিন্দুস্তানে কোনো স্থাপত্যকীর্তি রেখে যাওয়ার সময় তার হয়নি। হুমায়ূন সে সুযোগ পেয়ে খুশি। সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি এখনও বেশ শক্তসামর্থ্য। তিনি একটি পাঠাগারের পরিকল্পনা করছেন। এটি হবে যমুনা নদীর তীরে। এ নিয়ে একটি স্থানও নির্ধারণ করেছেন তিনি। পাঠাগারের চারপাশে থাকবে বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন লেবু, কমলা, ডালিম। আরও থাকবে বিভিন্ন সুগন্ধি ফুলের বাগান।

একইসঙ্গে তিনি আনন্দিত যে শের মন্ডলের ছাদে তিনি একটি পর্যবেক্ষক স্থাপন করেছেন। পুরানা কিল্লার উঠানে এই অষ্টভুজটি স্থাপন করেন শের শাহ, যার কাজ প্রায় শেষের পথে। হিন্দুস্তানের লোকজন এটাকে বলেন চৈত্রি। সাদা থাম দিয়ে এটি দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এখান থেকেই আকাশের তারাদের ভালো করে দেখা যায়। মহাকাশ দেখার জন্য তিনি এগুলো বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। তৈমুরের নাতি উগলুকের লেখা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই জিজ-ই গোরকানির একটি কপিও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। এতে নক্ষত্রের স্বর্গীয় স্থানের কথা উল্লেখ রয়েছে। নতুন রাজকীয় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য সকলেই প্রস্তুত।

নক্ষত্রের তালিকা অনুযায়ী, ২৪ জানুয়ারির এই সন্ধ্যার আকাশে শুক্রগ্রহ দেখার এক বিশেষ সুযোগ থাকবে। জানালা দিয়ে হুমায়ূন দেখলেন সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। প্রাসাদকক্ষ থেকে বের হয়ে বেশ কয়েকজন রাজকর্মচারীদের নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষকের দিকে গেলেন। তিনি সেখানে কারো দ্বারা বিরক্ত হতে চান না। নিজের কক্ষ থেকে দ্রুত বের হয়ে ফুলের বাগানের ভেতর দিয়ে তিনি শের মণ্ডলের দিকে গেলেন। তারপর উঁচু এবং পাথরের সিঁড়ি বেয়ে এর ছাদে ওঠলেন। চৈত্রিতে তিনি দেখলেন রাজজ্যোতির্বিদরা সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন।

হুমায়ূন কদাচিৎ আকাশ দেখতে আসেন। সোনালি ও গোলাপী আকাশ অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি এর। সেখানে সন্ধ্যা তাঁরা শুক্ৰগ্ৰহ অন্ধকার স্বর্গকে আরও সুন্দর করে তুলছে। হুমায়ুন বিমোহিত হয়ে দেখতে থাকলেন আকাশের নক্ষত্র।

পাশের রাজকীয় মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠের আওয়ার আসতে থাকলো। এতে হুমায়ুন তার পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত হলেন। তিনি আরও কিছুক্ষণ সেখানে থাকতেন কিন্তু দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিনে তিনি জনগণ ও সভাসদদের সঙ্গে নামাজ পড়েন। শুক্রগ্রহ থেকে তার চোখের পলক সরিয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন। মুয়াজ্জিন তাঁর আজান প্রায় শেষ করেছেন এবং তাঁকে দ্রুত ফিরে যেতে হবে…

কিন্তু যখনই তিনি সিঁড়িতে তাঁর প্রথম পা ফেললেন, তাঁর চামড়ার জুতোর মাথায় দীর্ঘ নীল রাজকীয় পোষাক আটকে গেল। তিনি সামনের শূন্যতার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তিনি হাত বের করলেন, তবে তাঁর হাতের কাছে কিছু ধরার ছিল না। তিনি মাথা নিচের দিকে দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। তাঁর চোখের সামনে শুধু সিঁড়ি, শুধু সিঁড়ি বেয়ে উল্টো হয়ে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে একদম নিচের সিঁড়িতে এসে প্রচণ্ডভাবে লাগল তার মাথা। কিছু অংশ কেটে গেল। তারপর সবকিছু অন্ধকার, অনড় ও শান্ত।

*

প্রধান হাকিম কি এখানে এসেছেন?

তিনি আসছেন বৈরাম খান। পারস্য দেশীয়দের মতো উদ্বিগ্নতা নিয়ে অসুস্থ হুমায়ূনের স্নান আলোময় কক্ষ থেকে ধীর কণ্ঠে বললেন জওহর। অবশ্যই আমরা তাঁর জন্য এক্ষুণি পাঠিয়েছি, কিন্তু দুর্বাগ্যবশত তিনি এক আত্মীয়ের বিয়েতে এক সপ্তাহ আগে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আমার বার্তাবাহক এই খবর আনতেও সময় নিয়েছে। সে অবশ্য সেখানে যাবে। যা হোক, খবর এসেছে মাত্র একঘণ্টা আগে। তাঁকে পাওয়া গেছে এবং পুরানা কিল্লায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেনো সঠিক সময়ে এখানে আসেন, কারণ তাঁর দক্ষতা তাঁর খ্যাতির মতোই বিশাল…। বৈরাম খানের ঘোর ভাঙলো তিনি যখন বাহির থেকে কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তারপর দরজা খুলে দেয়া হল কালো জামা পরিহিত এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তির জন্য, তার কাঁধে একটি বড় চামড়ার থলে।

বৈরাম খান সামনের দিকে গেলেন। আমি খান-ই-জাহান। আমি বার্তাবাহককে আপনাকে খুঁজে আনার জন্য পাঠিয়েছিলাম। আপনি দিল্লির সবচেয়ে সম্মানিত হাকিম এবং আমাদের সর্বশেষ আশা। আমাদের নিজেদের চিকিৎসকরা কোনো কিছু করতে পারেননি। তবে তাঁদের একজন আপনার কথা আমাদের জানান। তিনি জানান আপনি একবার ইসলাম শাহকে রক্ষা করেছিলেন যখন তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যান।

হাকিম মাথা নাড়লেন।

আমি বিশ্বাস করি যে ইসলাম শাহের সেবা করার কারণে তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতা নেয়ার জন্য এই চিকিৎসায় আপনি অমত করবেন না?

একজন ডাক্তারের দায়িত্ব হল জীবন বাঁচানো। হাকিম শয্যার দিকে একপলক তাকালেন যেখানে শুয়ে রয়েছেন হুমায়ূন। তাঁর মাথা বেশ ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করা, চোখদুটি বন্ধ এবং তিনি অনড়। মহারাজকে পরীক্ষা করার আগে আমাকে বিস্তারিত বলুন, ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে এবং তিনি কীভাবে ছিলেন। আমার এই বিষয়গুলো অবশ্যই জানা উচিৎ।

বলার তেমন কিছু নেই। তিনদিন আগে তিনি একটি পাথরের সিঁড়ি থেকে পড়ে যান। একদম নিচের সিঁড়ির সাথে তিনি মাথায় আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন। সিঁড়ির পার্শ্বদিক ছিল শক্ত ও ধারালো। সভাসদরা তাঁকে রক্তাক্ত মাথায় উদ্ধার করেন এবং অজ্ঞান অবস্থায় প্রাসাদে নিয়ে আসেন। আমাদের হাকিমরা তাকে দেখেছেন এবং কপালের ডান পাশে গভীর আঘাতে ক্ষত খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মুখ ও ডান কান দিয়েও রক্ত ঝরছিল। তখন থেকে তিনি জ্ঞান ফিরে পেয়ে বারবার আবারও অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। কখনো হঠাৎ যদি তাঁর জ্ঞানও আসছে, তিনি কাউকেই চিনতে পারছেন না, নিজের পূত্র ও সম্রাজ্ঞিকেও চিনতে পারছেন না।

গভীর ভাবনার সঙ্গে মাথা নাড়লেন হাকিম। তারপর বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং শান্তভাবে বিছানা চাদর নাড়লেন। হুমায়ুন কোনো সাড়া দিলেন না। মাথা ঝুঁকিয়ে চিকিৎসক তাঁর হৃদস্পন্দন যাচাই করতে চাইলেন। তারপর তাঁর একটি চোখের পাতা তুললেন, এবং এরপর আরেকটি তুললেন। তাঁর মুখভঙ্গিতে এক ধরনের হতাশা ফুটে উঠল। তিনি হুমায়ূনের মাথা কয়েক ইঞ্চি উপরে টেনে তুললেন এবং তাঁর কপালের একাংশ দেখলেন, যা কাটা ও বিবর্ণ। হুমায়ূন অল্পক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরে পেলেন, তবে কোনো শব্দ করলেন না।

হাকিম তখনও তাঁর আঘাতস্থানটি দেখছিলেন। আকবর তখন নারীদের কক্ষ থেকে অসুস্থ পিতার কক্ষে ফিরলেন। সেখানে তিনি তাঁর মা হামিদাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন। তিনি পিতাকে এভাবে অসহায় শুয়ে থাকতে দেখে বিমর্ষ হলেন। একইসঙ্গে তিনি আর দূরে থাকতে পারলেন না। আঘাত পাওয়ার পর বাহাত্তোর ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তিনি হুমায়ূনের কাছাকাছি থেকে তাঁর আরোগ্য কামনা করছেন। তিনি হাকিমকে বললেন, দয়া করে, আপনি অবশ্যই তাঁকে সারিয়ে তুলবেন। আমার পিতার জীবন ফিরিয়ে দেবেন।

আমি চেষ্টা করব, তবে তাঁর জীবন আল্লাহর হাতে।

কাঁধ থেকে নামানো থলেটি খুলে ঔষদি লতার একটি তুড়া বের করলেন। এর তিক্ত গন্ধ চারদিক ছেয়ে গেল। আগুন জালানোর ব্যবস্থা করুন তিনি উপস্থিত রাজ কর্মচারিদের নির্দেশ দিলেন। এই লতাগুল্মগুলো গরম পানিতে সিদ্ধ করা দরকার যাতে এগুলোর রস পানিতে বের হয়। হুমায়ুনের শয্যার পাশেই কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাকিম একটি বড় পানি রাখার পাত্র জোগাড় করলেন। লতাগুল্মগুলো সেই পানির পাত্রে রাখলেন। এটা করার পর, তিনি চিকিৎসার জন্য একটি ছোট ধারালো চাকু বের করলেন। আমি চাচ্ছি তাঁর শরীর থেকে রক্তক্ষরণ ঘটাতে, এতে তার মস্তিস্কের ওপর চাপ কমে যাবে এবং আমি মনে করি আঘাত সেরে উঠবে। কাউকে এই কাপটি ধরতে হবে।

আমি ধরব আকবর তাৎক্ষণিক বললেন। বিছানার কাপড়ের নিচ দিয়ে হুমায়ূনের ডান বাহু ধরলেন হাকিম। তিনি কাছে টেনে চাকু হাতে নিলেন। তিনি ধারালো চাকু দিয়ে কনুইয়ে একটু কেটে দিলেন তিনি। যখন রক্ত পড়া শুরু হলো একটি গোলাকার পাত্র দিয়ে সেই রক্ত জমা করতে লাগলেন আকবর। লাল রক্ত দেখে আশা জেগে উঠল হাকিমের মনে। এটা প্রমাণিত যে তার শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো এখনও সচল রয়েছে। তাঁর পিতা অনেক শক্তিশালী, তিনি ভাবলেন। ইতোমধ্যে কিছুটা জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন তিনি। নিশ্চিতভাবে তিনি এই সংকট উৎরে যাবেন…

কিছুক্ষণ পর হাকিম বোলটি সরিয়ে নিতে আকবরকে বললেন। যে স্থানটি কাটা হয়েছে সেখানে একটি সাদা সুতি কাপড়ের টুকরো লাগিয়ে দিতেও বললেন। হুমায়ূন বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুরু করলেন। আকবর তার ঠোঁটের কাছে নিজের মাথা ঝুঁকালেন। তিনি কী বলছেন তা বুঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। আমি এখানে পিতা, আমি এখানে। তিনি বললেন। তার প্রত্যাশা হুমায়ূন হয়তো তার কথা শুনতে ও বুঝতে পারবেন। হঠাৎ তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং হুমায়ুনকে জড়িয়ে ধরলেন।

যুবরাজ আমাদের উচিৎ চিকিৎসার জন্য হাকিমকে ছেড়ে দেয়া নম্রভাবে আকবরের কাঁধে ধরে বললেন বৈরাম খান।

আপনি ঠিক বলেছেন। পিতার মুখের দিকে শেষবারের মতো এক পলক তাকিয়ে আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং অসুস্থ হুমায়ূনের চিকিৎসা কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন। যখন দরজা পেছন থেকে বন্ধ হয়ে গেল, তিনি দেখতে পারলেন না হাকিম ধীরলয়ে বৈরাম খান ও জওহরের দিকে মাথা নেড়েছেন।

*

মহারানী, এতো দ্রুত মহারাজের মৃত্যুতে আমরাও মর্মাহত। তবে আমার বিশেষ কোনো পছন্দ নেই। যদি আপনি আপনার সন্তানের জীবন প্রত্যাশা করেন তাহলে আপনাকে অবশ্যই আমার কথা শুনা প্রয়োজন…

হামিদা তাঁর ফ্যাকাশে, রঞ্জিত মুখ তুলে বৈরম খানের দিকে তাকালেন। তার চোখ দুটি কান্নায় লাল হয়ে আছে। মুখের নিচের অংশ হাত দিয়ে মুছলেন। কিন্তু আকবর বিপদে পড়তে পারেন বলে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তা হামিদাকে কিছুটা বিব্রত করল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল যথেষ্ঠ ভারি। তিনি বললেন, তুমি কি বলতে চাচ্ছ বৈরাম খান?

হিন্দুস্তানে ক্ষমতায় আসার পর আল্লাহ আপনার স্বামীকে বেহেস্ত তুলে নিয়েছেন। যদিও বিতর্কহীনভাবে আকবর সিংহাসনের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী, কিন্তু রাজপুত্রের বয়স মাত্র ১৩ বছর। যদি আমরা সতর্ক না হই, উচ্চাকাঙ্খি লোকজন তাঁর কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নিতে চাইবে। কামরান ও আসকারির সমর্থকরা বছরের পর বছর ধরে আপনার স্বামীর প্রতি অনুগত। তারপরও তারা এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিতে পারে, যদিও আসকারি মারা গেছেন এবং কামরান অন্ধ ও মক্কায় রয়েছেন। আমরা আমাদের অনুগত রাজ্যের শাসকদের কথাও ভাবতে পারি। উদাহরণসরূপ মুলতানের সুলতান ধূর্ত আজাদ বেগের কথাই ধরুণ। আমরা হিন্দুস্তান জয়ের পর তিনি কেবল আনুগত্য দেখিয়েছেন। হয়তো আবার এই আনুগত্য প্রত্যাহার করতে পারেন। আর এই খবরটি হয়তো বাংলার জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সিকন্দর শাহকেও উৎসাহ যোগাতে পারে। তিনি আবারও শক্তি সামথ্য নিয়ে হামলা চালাতে আসবেন। এছাড়া গুজরাটের সুলতানের মতো আমাদের বহিঃশত্রুও রয়েছে…

বৈরাম খান, যথেষ্ট হয়েছে, হামিদা তাঁকে থামিয়ে দিলেন। আমার স্বামী আপনাকে পছন্দ করেছেন খান ই জাহান হিসেবে, কারণ তিনি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আমিও আপনাকে বিশ্বাস করি- এবার বলুন আমাদের কী করা উচিৎ।

যেসব রাজ্য আমাদের প্রতি অনুগত থাকবে তাদের জড়ো করার জন্য আমরা কয়েক দিন মহারাজের মৃত্যুর খবর গোপন রাখব। এরমধ্যে আগ্রার আহমেদ খানের মতো লোকদের কাছে জানতে চাইবো। যখন আমাদের বিশ্বস্থ সমর্থকরা এখানে আসবেন তাঁদের লোকজন নিয়ে তখন আমরা রাজপূত্রের নামে মসজিদে কোনো ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে খুতবা পড়ব। আমি মনে করি জাহিদ বেগ খুব বেশি দূরে নন। আমি মহারাজের মৃত্যুতে তাঁকে আনতে পাঠিয়েছি। আমরা তাঁকে কাবুল ও খাইবার পথের বিভিন্ন অঞ্চল নিরাপদ রাখতে বলব।

কিন্তু আমার স্বামীর মৃত্যুকে কিভাবে আমরা গোপন রাখব?

দ্রুততা ও বিবেচনার মাধ্যমে কাজ করে। পুরানা কিল্লা ও শহরের বাইরের লোজন জানে যে মহারাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। বর্তমানে মাত্র কয়েকজন, যেমন হাকিমরা, জওহর ও আপনার স্বামীর ব্যক্তিগত কর্মচারীরা শুধু জানেন যে তিনি মারা গেছেন। সকলেই বিষয়টি গোপন রাখবেন। বিভিন্ন রাজ্যে বার্তাবাহক পাঠানোর পর আমি ঘোষণা করে দেব কেউ যেনো দূর্গে প্রবেশ না করেন এবং বের না হন। আমি ঘোষণা করব যে পুরানা কিল্লায় এক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং শহরে যাতে তা ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

কিন্তু আমার স্বামীতো প্রতিদিন পুরানা কিল্লার বেলকনি থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করতেন। আমরা কী বলব লোকজন যখন তাঁকে আর দেখবে না?

আমরা এমন কাউকে নেবো যার উচ্চতা তাঁর মতো এবং তাঁকে রাজকীয় পোষাকে সাজাব। নদীর ওপার থেকে কেউই তাঁকে চিহ্নিত করতে পারবে না।

আকবর কী করবে পরবর্তী দিনগুলোতে?

তিনি হেরামের ভেতরে থাকবেন। আমি উনার জন্য অতিরিক্ত রক্ষী বাহিনী মজুত করার চেষ্টা করব- যারা আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। আপনার কক্ষের চারপাশেও তারা থাকবে। তার প্রত্যেকটি খাবার, পানীয় সব কিছুই প্রথমে পরখ করে তারপর তাঁর কাছে পাঠানো হবে।

আপনি কি পরিস্থিতিতে ভয়াবহ বলে মনে করছেন?

হ্যাঁ, মহারানী, কোনো সন্দেহ নেই। মনে করেন কীভাবে ইসলাম শাহের বড় পূত্রকে এই দিল্লিতেই হত্যা করা হয়। মাত্র তিন বছর আগে গোপনে মায়ের সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।

এবার আপনি যা বলবেন আমরা ঠিক তাই করব। এটাই আমার স্বামী চেয়েছেন।

*

সেই রাতে জ্যোৎস্না ও নক্ষত্র ভরা ছিল আকাশ। পুরানা কিল্লার দেয়ার ভেতরে একটি ছোট বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন আকবর। মাত্র তিন মাস আগে বাগানটি করেছিলেন হুমায়ূন। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বৈরম খান, জওহর ও আরো কয়েকজন বিশ্বস্থ রাজকর্মচারী। মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে সমাধিস্ত করার এই দৃশ্যটি শুধু তারাই দেখতে পারবেন। কোনো নারী সেখানে আসেননি। এমনটি খুব নিকটের যারা তারাও না। হামিদা আর গোলবদন উপর থেকে দেখছেন। সুগন্ধি জলে ধুয়া হয়েছে হুমায়ূনের শরীর। নরম একটি কাপড় দিয়ে মোড়ে দেয়া হয়েছে। তারপর কাঠের একটি বাক্সে রেখে বাগানের মাটিতে কবর দেয়া হয়েছে। একজন মোল্লা জানাজা পড়ালেন এবং হুমায়ূনের মাগফিরাত কামনা করলেন।

আকবর যখন ভাবলেন যে তিনি তাঁর পিতাকে আর দেখতে পারবেন না তখন তাঁর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো। তাঁর মনে উৎকণ্ঠাও ছেয়ে গেল। কয়েক দিন আগে তাঁর জীবন ছিল কতো সুখের ও নিরাপদ। কিন্তু এখন সব কিছুই বদলে গেছে। তাঁর চারিদিকে উদ্বেগ লক্ষ্য করছিলেন। যদিও তার মা ও বৈরাম খান খুব সামন্যই বলেছেন, তিনি তাঁদের মুখভঙ্গি ও কথা শুনে তাঁদের উদ্বেগ লক্ষ্য করেছেন। তবে তাঁদের এই উদ্বেগ তার জন্য নয়।

কিন্তু তিনি ভীত হলে চলবে না। তাঁর রক্ত তৈমুরের। অতীতে রয়েছেন তাঁর দাদা বাবর, তিনি এক নির্দয় সুযোগের কারণে তাঁর নিজের অধিকারের জিনিস হাতছাড়া করতে পারেন না। চোখ বন্ধ করে, আকবর নীরবে তাঁর মৃত পিতার কথা স্মরণ করতে লাগলেন। আমি আপনার কাছে অঙ্গিকার করছি যে আপনি এই সাধারণ সমাধিতে বেশি দিন শায়িত থাকবেন না, সর্বসাধারণের দৃষ্টির বাইরে। যেইমাত্র আমি দিল্লিতে এবং সামর্থ্যবান, আমি আপনার জন্য বিশ্ব যা এখনও দেখেনি সে রকম চমৎকার সমাধিসৌধ বানাবো। আমি নতুন মোগল সম্রাট আকবর হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে এই শপথ নিলাম… আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা, আপনি আমাকে শ্রেষ্ঠ (গ্রেট) উপাধি দিয়েছেন এবং আমি শ্রেষ্ঠই হবো। শুধুমাত্র আপনার স্মৃতিতেই নয়, আমার ভাগ্য নির্মাণের যে স্বপ্ন তাঁর কাছেও শ্ৰেষ্ঠ হবো আমি।

.

ঐতিহাসিক নোট

আমি সৌভাগ্যবান যে দ্বিতীয় মোগল সম্রাট ও যোদ্ধা হুমায়ূনের গল্প যথেষ্ঠ তথ্যসমৃদ্ধ ছিল। তাঁর বাবা বাবরকে নিয়ে লেখা আমার আগের বই রাইডার্স ফ্রম দ্য নর্থ থেকে এটি বেশি সমৃদ্ধ। রোমাঞ্চকর যাত্রা, ট্রাজিডি, দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন বিজয় হুমায়ুন ও তার সৎবোন গুলবদনের জীবনকে জড়িয়ে আছে। মোগল সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী হুমায়ূননামায় গোলাপদেহী রাজকুমারির প্রতি স্নেহের বৃত্তান্ত রয়েছে। হুমায়ূনের সভাসদ জওহর তাদকিরাত আল-ওয়াকিয়াত নামে তাঁর একটি জীবনী গ্রস্থ প্রণয়ন করেছিলেন। এছাড়া হুমায়ূন পুত্র আকবরের বন্ধু ও উপদেষ্টা আবুল ফজল আকবরনামা হুমায়ুনের শাসনামলের বিভিন্ন বৃত্তান্ত উল্লেখ করেন।

সুন্দর বর্ণনায়, অতিশয়োক্তির ফুলঝরিতে হুমায়ূনকে বীর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আধ্যাত্বিক মহিমায় উজ্জল এবং কখনো কিছুটা খামখেয়ালি ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন বিভিন্ন বিষয় আকাশে নক্ষত্রে লেখা থাকে এবং পৃথিবীর শুরুতে সবকিছু চারটি মৌলিক জিনিস- বাতাস, পানি, মাটি ও আগুন ধারা নিয়ন্ত্রিত হতো। নির্দিষ্ট দিনে তিনি নির্দিষ্ট রঙের পোষাক পরতেন, মঙ্গলবার দুষ্কৃতিকারী কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করতেন। এই দিনটিতে প্রতিহিংসা ও ক্রোধের দিন হিসেবে দেখতেন তিনি। ওইদিন তিনি রাজকীয় লাল পোষাক পরতেন এবং মহাকাশে নক্ষত্রের গতিবিধি দেখার জন্য সভাসদদের নির্দেশ দিতেন। তাঁর প্রথম জীবনে আফিম সেবনের অভিজ্ঞতা ছিল যা তাকে পরবর্তীতে সতর্ক, গতিশীল ও আধ্যাত্বিক চিন্তা গ্রহণে সাহায্য করেছে।

মুল সামরিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলার ঘোড়াব্যবসায়ী উচ্চাভিলাসী পুত্র শেরশাহ হুমায়ূনকে হিন্দুস্তানের বাইরে পাঠান। শেরশাহের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের পর হুমায়ূনকে রক্ষা করেন তরুণ নিজাম। তিনি নিজামকে সিংহাসনে বসার অনুমতি দেন। হামিদাকে নিয়ে রাজস্তানের মরুভূমিতে হুমায়ূনের যুদ্ধ, নির্জন উমরকতে আকবরের জন্ম, পারস্যে আশ্রয়ের জন্য যাত্রা করেন- এসব সত্য। তবে হুমায়ুনের খুশি হওয়ার মতো বিষয় হলো তিনি শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্তানে হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পান। হিন্দুস্তানের সিংহাসন লাভের মাত্র ছয় মাস পর তিনি মহাকাশ পর্যবেক্ষকের ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে মারা যান। সেখানে তিনি আকাশের প্রিয় নক্ষত্রদের পর্যবেক্ষণ করতেন। এতে তাঁর বিধবা স্ত্রী হামিদা ও তরুণ আকবর হিন্দুস্তানের সাম্রাজ্য বাঁচানোয় জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন।

হুমায়ূনের সৎ ভাইদের বিশেষত (কামরান ও আসকারির) ষড়যন্ত্র মোকাবেলার বিষয়টিও ছিল তাঁর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। সভাসদরা যখন বারবার বলছিলেন তাদের ফাঁসি দেয়ার জন্য তখন হুমায়ুন তাঁর এই ভাইদের বিভিন্ন সময়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এদের ফাঁসির পক্ষে তারা অনেক যুক্তিও দেখিয়েছেন। হুমায়ূন হিন্দালের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক সৃষ্টি করেন, কারণ তিনি হামিদাকে বিয়ে করার বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। হামিদার প্রতি হিন্দালেরও অনুরক্ততা ছিল বলে জানা গেছে। এদিকে, এক সময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে হুমায়ুন কামরানকে অন্ধ করে দেন। এবং হজ্জের জন্য মক্কায় পাঠান। যা হোক, আমি মাঝে মাঝে তার কাজগুলোকে বিবেচনা করে সহজবোধ্য করে তোলার চেষ্টা করেছি এবং সময়সীমার কথা মাথায় রেখে কিছু ঘটনার বর্ণনা করা থেকে বিরত থেকেছি। মুল ইতিহাসের সঙ্গে সংগতি রেখে উপন্যাসিকের স্বাধিনতা বজায় রাখার চেষ্টাও আমি করেছি। এক্ষেত্রে আমি অনুসাঙ্গিক আরও কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি।

বইটিতে যেসব চরিত্র রয়েছে, হুমায়ুনের তিন সৎ ভাই, তার পূত্র আকবর, সৎ বোন গুলবদন, চাচি খানজাদা, আকবরের দুধভাই মাহাম আগা ও আদম খান, শেরশাহ, ইসলাম শাহ, সিকন্দর শাহ, পারস্যের শাহ তাহমাস, গুজরাটের বাহাদুর শাহ, সিন্দ এর হোসেইন, মারওয়ারের মেলদিও এবং বৈরাম খান। বৈসংহার, হুমায়ূনের দাদি, আহমেদ খান, কাসিম এবং বাবা যশেবালের মতো চরিত্রগুলো যৌগিক।

কয়েক বছরের বেশি সময় ধরে এই বইটি নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে আমি ঐতিহাসিকভাবে বর্ণিত অধিকাংশ অঞ্চলে ভ্রমণ করেছি। এগুলো এখনও সেখানে বিদ্যমান আছে। সেগুলো শুধু ভারতেই নয়, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরানেও রয়েছে। বিশেষত আমি মনে করতে পারছি লাল পাথরের প্রাসাদ, যমুনা নদীর তীরে দিল্লির শের মণ্ডল যেখান থেকে পড়ে হুমায়ূন মারা গেছেন। আমি এখনও কল্পনা করতে পারি, আধ্যাত্বিক নক্ষত্ৰ সন্ধানী পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী ও শক্তিশালী এই সম্রাট সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে পড়ে যাচ্ছেন। তিনি চিরতরের জন্য পড়ে গেলেন।

.

নুসাঙ্গি

অধ্যায় ১ ১৫৩০ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন হুমায়ূন। ১৫০৮ সালে জন্ম গ্রহণের পর হুমায়ুন মাহামের কাছে পাঠানো হয়। কামরান, জন্মের পর তাঁকে গুলরুখের কাছে পাঠানো হয়। তবে তাঁর জন্মের তারিখ বাবরের স্মৃতিকথা বাবরনামায় উল্লেখ নেই। যতদূর জানা যায় তাঁর বয়স ছিল হুমায়ূনের বয়সের কাছাকছি।

১৫১৬ সালে জন্মের পর আসকারিকে গুলরুখের কাছে পাঠানো হয়। তার জন্মের তিন বছর পর ১৫১৯ সালে দিলদারের কাছে পাঠানো হয় হিন্দালকে। মাহাম বাবরকে দিলদারের সন্তান পালন করার জন্য চেয়েছিলেন এবং তিনি রাজিও হন। ঘটনাটি হিন্দালের জন্মেরও আগের।

অবশ্যই হুমায়ূন মুসলিমদের চন্দ্রভিত্তিক ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতেন। তবে আমি তারিখগুলোকে প্রচলিত সূর্য এবং পশ্চিমাদের ব্যবহৃত খ্রিস্টান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মিল রেখে করেছি।

তৈমুর পশ্চিমাদের কাছে টাম্বারল্যান নামে পরিচিত হন। তৈমুর দ্য ল্যাম থেকে এই টাম্বারল্যান শব্দটি এসেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় খোঁড়া তৈমুর। ব্রিটিশ নাট্যকার খ্রিস্টফার মারলো তাঁকে তাঁর একটি নাটকে তোলে ধরেন ঈশ্বরের বিচরণ হিসেবে।

খানজাদার অপহরণ এবং বাবরের মৃত্যুকে ঘিরে অদ্ভূত পরিস্থিতি রাইডার্স ফ্রম দ্য নর্থ এ উল্লেখ করা হয়েছে।

অধ্যায় ২ ১৫৩৫-৩৬ সালে হুমায়ূন গুজরাটে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।

অধ্যায় ৬ ১৫৩৯ সালের জুনে কৌসার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। জওহর নিজামের গল্পটি বলে।

অধ্যায় ৮ কানাউজের যুদ্ধ সম্পন্ন হয় ১৫৪০ সালে।

অধ্যায় ৯ শেরশাহের কাছে কয়েকটি শর্ত দিয়ে হুমায়ূন ও কামরান উভয়েই পত্র লিখেন যা অগ্রাহ্য করেন শেরশাহ।

অধ্যায় ১০ গুলবদন লাহুর প্রত্যাবর্তনের বর্ণনা দেন। এটা যেনো পুনরুত্থানের দিন এবং লোকজন তাদের প্রিয় ও সুসজ্জিত প্রাসাদ ছেড়েছে।

অধ্যায় ১১ ১৫৪১ সালের ২১ আগস্ট মধ্যাহ্নে বিয়ে করেন হামিদা ও হুমায়ূন।

অধ্যায় ১৩ কয়েক বছর পর খানজাদা মারা যান এবং সে সময়ের বিভিন্ন বিষয় এই অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। ১৫৪২ সালের ১৫ অক্টোবর উমরখতে জন্ম গ্রহণ করেন আকবর।

অধ্যায় ১৪ কামরানের কাছে আকবরকে হস্তান্তর সম্পর্কীত বিভিন্ন বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

অধ্যায় ১৫ গুলবদন দুরাচারি পর্বত উপজাতিদের নরখাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনি তাঁদের বর্জ্যের পিশাচ বলে অভিহিত করেন। ১৫৪৩ সালে হুমায়ূন পারস্যের সীমান্তে পৌঁছান। হুমায়ূনকে সাদর সম্ভাষণ জানান শাহ তামাস্প। এককালের জাঁকজমকপূর্ণ শহর কাজবিন ভূমিকম্পে নষ্ট হয়ে যায়। কেস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে ইরানের উত্তরপশ্চিমে এই শহরটির অবস্থান ছিল। শাহ তামাস্প তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানান। এ নিয়ে জওহর ও গুলবদনের কাছে বর্ণনা পাওয়া যায়। কাজবিন শহরের কাছে যান হুমায়ূন। এই ভ্রমণটিকে বেশ সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের আগমনে ঢোল বাজানো হয়। শহর এবং গ্রামে লোকজনকে তাদের সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরার জন্য বলা হয়। লোকজন তাঁদের প্রবেশের পর উল্লাস ধ্বনী করতে থাকে। আবুল ফজল লিখেছেন, কহিনূর একটি মহামূল্যবান হীরা। এটা শাহ তামাস্পের কাছে ছিল। পরে সেটি হিন্দুস্তানে যায় এবং সম্রাট শাহজাহানের কাছে থাকে। পরবর্তীতে এটি ব্রিটেনের রাজকীয় অলংকারের অংশ হয়।

অধ্যায় ১৬ ১৫০১ সালে পারস্যে সাফায়েদ রাজত্বকালে শিয়া মুসলিমদের প্রসার ঘটে। ইসলামের প্রথম শতাব্দিতে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়। মুলত হযরত মুহাম্মদের সুযোগ্য উত্তরাধীকারী কে হবেন- এ নিয়ে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। শিয়ারা দাবি করে প্রথম খলিফা হযরত মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ইমাম হাসান ও হোসেনের পিতা হযরত আলীকে করা উচিৎ। শিয়া শব্দের অর্থ দল এবং আলীর দল শব্দ থেকে এটি এসেছে। সুন্নি বলতে তাঁদের বুঝায় মুহাম্মদের সুন্নাহ যারা অনুসরণ করেন তাঁদের। পরবর্তীতে ইসলামের এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ষোড়শ শতাব্দিতে দূরত্বটা আরো একটু বাড়ে। তখন নামাজের রীতি নিয়েও পার্থক্য তৈরি হয়। হুমায়ূন কিছুটা শিয়াপন্থি হয়ে উঠেছিলেন।

অধ্যায় ১৭ কাবুলের ঐতিহাসিক দেয়াল ঘুরে দেখান কামরান যেখানে হুমায়ূনের কয়েকটি হামলার চিহ্ন আঁকা রয়েছে। একাধিকবার দুই ভাইয়ের মধ্যে শহরটি হাত বদল হয়।

অধ্যায় ২০ ১৫৪৫ সালের মে মাসে শেরশাহ মারা যান।

অধ্যায় ২১ ১৫৫১ সালে এক যুদ্ধে মারা যান হিন্দাল। এ নিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে এতে।

অধ্যায় ২৩ জওহর কামরানকে অন্ধ করার বর্ণনা দেন। কামরানকে মক্কায় পাঠানো হয়। ১৫৫৭ সালে তিনি সৌদি আরবে মারা যান।

অধ্যায় ২৪ ১৫৫৩ সালের অক্টোবরে মারা যান ইসলাম শাহ।

অধ্যায় ২৬ ১৫৫৫ সালের জুনে শিরহিন্দের যুদ্ধ হয়। ১৫৫৫ সালের শেষের দিকে দিল্লিতে প্রবেশ করেন হুমায়ূন।

অধ্যায় ২৭ ১৫৫৯ সালে মারা যান সিকন্দর শাহ।

অধ্যায় ২৮ ১৫৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারিতে মারা যান হুমায়ূন। দিল্লিতে এখনও তার মার্বেল পাথরের সমাধি রয়েছে। এটি একটি সুন্দর স্থাপত্যকীর্তি এবং অবশ্যই তাজমহলের আগের অন্যতম সমাধিক্ষেত্র।

Exit mobile version