যখন ভাবি একটা ব্যক্তির মধ্যে আধা বুদ্ধিসম্পন্ন কোন জাতির বিধানকর্তা হিসেবে রাইখষ্টাগের সমালোচনা করার অধিকার রাখে ও জনতাকে লেলিয়ে দেয় এবং তার দ্বারা রাজমুকুটকে কঠোর ভৎসনা জনতার কাছ থেকে শুনতে হয়, তখন এসব নির্বোধ বিধান সভার সভ্যগুলোর ওপরে প্রচণ্ড রকমের রেগে যাই।
সবচেয়ে বিরক্তিকর যখন দেখি ভিয়েনা প্রেস রোজই গিরগিটির মত ভোল পাল্টায়। হাসবুর্গ রাজপ্রাসাদের গাড়ি টানার ঘোড়াগুলোর লেজ ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিয়েনা প্রেসেরও মত বদলায়। সাথে সাথে এ প্রেস ভিয়েনার জনতার মধ্যে জার্মান সাম্রাজ্য সম্পর্কেও একটা শত্রুতার আতংক জাগিয়ে তোলার প্রয়াস করে। কিন্তু আমার মতে সেই শক্রতা দৈন্যবেশে সাজানো। সঙ্গে সঙ্গে এও আবার জানায় যে জার্মানির আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনরকম ইচ্ছেই নেই। ইশ্বরের দোহাই, তারা এরকম ভাণ করে যে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তারা বিশেষ বন্ধুরই কাজ করেছে। এবং দুই দেশের বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য এটা হল সাংবাদিকসুলভ সততা; এ কথার আড়ালে তারা একটা বিষাক্ত ক্ষতে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে আর বিষাক্ত করে তোলে।
এ ধরনের ব্যাপারগুলো আমার রক্তকে যেন টগবগিয়ে ফোঁটাচ্ছে।
একথা অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এ বিষয়ে ইহুদী বিরোধী পত্রিকা দ্য ডয়েচে ভল্কসূব্ল্যাটের বক্তব্য অনেক বেশি পরিষ্কার এবং সুন্দর।
বড় বড় নামী পত্রিকাগুলো যেভাবে ফ্রান্সের জয়গানে মুখর, ভাবলেও আমার শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে ওঠে। একজন জার্মান হিসেবে তথাকথিত মহৎ সংস্কৃতি সম্পন্ন একটা জাতির শ্রুতিমধুর জয়গানে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। এ নষ্টামী ভরা জয়গানের জন্যই একাধিক বার এ বিখ্যাত পত্রিকাগুলো আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। সেই কারণেই আমি বর্তমানে একমাত্র ভল্টকব্লাটের পত্রিকাটা পড়ি। মাপে ছোট হলেও এসব বিষয়ে পত্রিকাটার লেখা বেশ পরিচ্ছন্ন। যদিও ওদের চড়া ইহুদী বিদ্বেষী সুর আমার মনের সঙ্গে মিলত না; তবু ওদের যুক্তি আমাকে বারে বারে ভাবিয়ে তুলত।
যাহোক, এসব পড়াশোনার জন্যই আমি ভিয়েনার সেই বিশেষ মানুষটা, সংগ্রামটাকে, এবং ভিয়েনার ভবিষ্যত বুঝতে পারি। মানুষটা হল ডক্টর কার্ল লয়েগার আর তার সংগ্রামের নাম হল ক্রিশ্চান সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট। যখন প্রথম ভিয়েনায় আসি, তখন কিন্তু উভয়েরই বিরোধিতা করেছিলাম। মানুষটা এবং তার সংগ্রাম সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল–এরা উভয়েই প্রতিক্রিয়াশীল।
এমন কি ডক্টর লয়েগার এবং তার কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করার পরেই আমার অভিমত আমি বদলে ফেলি। ধীরে ধীরে সেটা প্রশংসায় রূপান্তরিত হয়; কারণ তখন আমি বিচার করতে সক্ষম। শুধু সেদিনই নয়, আজকে পর্যন্ত আমি ডক্টর কার্ল লয়েগারকে শ্রেষ্ঠ জার্মান মেয়র বা নগরপালের সঙ্গে তুলনা করি। এবং ক্রিশ্চান সোশ্যালিস্ট মুভমেন্টের প্রতি আমার এ মানসিক পরিবর্তন আমাকে অনেক কুসংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে দিতে সাহায্য করেছে।
আমার ইহুদী বিদ্বেষী মনোভাবের পরিবর্তন হয়, তবে সহজে নয়। বরং কষ্ট করেই এ মতবাদের পরিবর্তন করতে হয় আমাকে। সত্যি বলতে কি তার জন্য আমাকে মানসিক অনেক সংঘাত সহ্য করতে হয়েছে। এবং এ সংঘর্ষ হল ভাবালুতার সঙ্গে বাস্তবতার। শেষ পর্যন্ত বাস্তবই জয়ী হয়েছে সেই মানসিক টানাপোড়েনের সংঘাতে।
বছর দুই বাস্তবতার কাছে ভাবালুতা ছিন্নভিন্ন হয়ে পলায়ন করে এবং বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিই অভিভাবক ও আমার মনোজগতের পরিচালক হয়ে বসে।
সেই তিক্ত মানসিক সংঘর্ষের দিনগুলোতে যখন ভাবালুতার আর বাস্তবতার টানাপোড়েনিতে দিনগুলো পাড়ি দিচ্ছি, তখন ভিয়েনার রাস্তায় প্রত্যক্ষ কতগুলো শিক্ষা আমার আমূল পরিবর্তনে সাহায্য করে। এমন একটা সময় আসে যখন আমি আর আগের মত অন্ধের ন্যায় রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি না; বরং চোখ কান এমনভাবে খুলে রাখি যাতে শুধু বাড়িঘরই নয়, মানুষগুলোকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
একদিন শহরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আজানুলম্বিত কালো রঙের কোট পরা একজনের মুখোমুখি হই, প্রথমেই ভাবি : এ কি একজন ইহুদী? কিন্তু লিনৎসে তো এ ধরনের চেহারা আগে দেখিনি। আমি গোপনে সতর্কতার সঙ্গে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করি। সেই বিদেশী চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মনে হয় এ জার্মান নয় তো?
আমার বরাবরের অভ্যাসের মত আমি এর সমাধানে বইপত্র হাতড়াতে শুরু করি। এ প্রথম জীবনে অনেক কটা পয়সার বিনিময়ে ইহুদী বিদ্বেষী প্রচারপত্রও কিনে ফেলি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রচারপত্রগুলোয় কিছুই পাইনি। কারণ এগুলো লেখা হয়েছে এভাবে–যে পাঠকদের ইহুদী সম্পর্কে জ্ঞান আগে থেকেই রয়েছে বা ইহুদীদের সঙ্গে এরা বিশেষভাবে পরিচিত। উপরন্তু প্রচারপত্রগুলোর ঢংটাই এরকম যে সেগুলো শুধু ভাসা ভাসা তাই নয়; অবৈজ্ঞানিক মতবাদেও ভর্তি। কয়েকটা সপ্তাহ এবং মাসের পর আমি আমার পুরনো চিন্তার রাজ্যে ফিরে আসি। কিন্তু বিষয়বস্তুটা এত বিস্তৃত এবং পরস্পর বিরোধী যে আবার মনে দ্বিধা আসে হয়ত বা বিষয়বস্তুটার প্রতি সঠিক মর্যাদা দেওয়া হবে না।