সে যাই হোক, মেসোর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি একদিন মেসোর সঙ্গে চলে গেলাম বউনি নদীর তীরে। জায়গাটা স্বপ্নের মতো, তবুও কেন যেন গা-ছমছম করে।
বিশাল কয়েকটা চাষের খেত পেরিয়ে তারপর নদীটার দেখা মেলে। নদীর আঁকাবাঁকা পার ধরে আমি আর মেসো হেঁটে চললাম। এবড়োখেবড়ো জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে। শীতের সময় নদীর জল কমে এসেছে। সূর্যের আলোয় বয়ে যাওয়া জলের স্রোত চিকচিক করছে। তারই মধ্যে কয়েক জায়গায় মাছ বুড়বুড়ি কাটছে বলে মনে হল।
নদীর ওপাশে বেশ ঘন জঙ্গল। সেখানে গাঁয়ের কেউ-কেউ কাঠ কাটতে যায়। মেসো বললেন, ওই জঙ্গলে শেয়াল, ভাম, বুনো কুকুর আর ছোটখাটো জন্তুজানোয়ার আছে। ওরা সন্ধের পর বউনি নদীতে জল খেতে আসে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিশাল বটগাছের নীচে আমরা মাছ ধরতে বসলাম। মেসো আমাকে ছিপ, বঁড়শি আর টোপের ব্যাপারে নানান কথা বোঝাচ্ছিলেন। কীভাবে কেঁচোগুলো বঁড়শিতে গাঁথতে হয়, ময়ূরের লেজের পালকের সাদা ‘কাঠি’টা দিয়ে কীভাবে ফাতনা তৈরি করতে হয়, কীভাবে ছিপ বাগিয়ে জলে ভেসে থাকা ফাতনার দিকে নজর রাখতে হয়—এইসব।
আমি হাঁ করে মেসোর কথা গিলছিলাম আর ফাতনার দিকে নজর রাখছিলাম।
হঠাৎই কানে এল ‘বলো হরি, হরিবোল’ ধ্বনি। মুখ ফিরিয়ে দেখি একদল লোক ওপরের মেঠো পথ ধরে খাটিয়া বয়ে নিয়ে আসছে। আমাদের কাছ দিয়ে ওরা চলে গেল।
মেসো কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘ওইদিকে আরও খানিকটা এগিয়ে তারপর শ্মশান—’ আঙুল তুলে সেদিকটা দেখালেন: ‘ওই দিকটায় লোকজন কম যায়…।’
এরই মধ্যে কখন যেন ফাতনা নড়ে উঠেছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে ‘অ্যাংলার’ মেসো ছিপ ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছে।
তখন আমার আনন্দ আর দ্যাখে কে!
কারণ, মেসোর বঁড়শিতে তখন ছটফট করছে ফুটখানেক লম্বা একটা আস্ত রুইমাছ।
সেই মাছটাকে ঘিরে আমার কী উত্তেজনা! বেশ বুঝতে পারছিলাম, নিজের হাতে মাছ ‘শিকার’ করে বাড়ি ফেরার সময় মেসো কেন আনন্দে টগবগ করে ফুটতে থাকেন, কেন চেঁচিয়ে হেঁড়ে গলায় গান করেন।
এমনসময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে হিংস্র গর্জন ভেসে এল।
ছটফট করা মাছটা তখন মেসো নাইলনের থলেতে ঢোকাচ্ছিলেন। থলের মুখটা চেপে ধরে মুখ তুলে নদীর ওপারে নজর দিলেন।
আমিও গর্জনের ব্যাপারটা বোঝার জন্যে জঙ্গলের ওপরে চোখ বোলাতে লাগলাম।
হঠাৎই একপাল কুকুর বেরিয়ে এল গাছপালার আড়াল থেকে। গুনে দেখলাম পাঁচটা। ওরা একটা কুকুরকে তাড়া করে ঘিরে ফেলেছে। কুকুরটার রং হালকা বাদামি আর সাদা। তার ওপরে ছোপগুলো যে রক্তের দাগ সেটা নদীর এপার থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
আমি মেসোকে বললাম, ‘ওই কুকুরটা নিশ্চয়ই অন্য এলাকার—তাই ওই কুকুরগুলো ওকে অ্যাটাক করেছে।’
বড়মেসো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ভয়ের গলায় বললেন, ‘কুকুর নয় রে, বুনো কুকুর। এখানকার মানুষরা ঢোল বলে। দেখছিস না, সবক’টা একইরকম দেখতে—।’
সত্যিই তাই। পাঁচটা বুনো কুকুরই একইরকম দেখতে। গায়ের রং গাঢ় বাদামি। মুখটা ছুঁচলো। লেজটা সাধারণ কুকুরের চেয়ে বেশ মোটাসোটা। আর লেজের ডগায় কালো ছোপ।
এরপর চোখের সামনে যা হল তা দেখা যায় না।
নদীর পাড়ে পাঁচটা কুকুর বাদামি-সাদা কুকুরটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর নানান দিক থেকে বেচারা কুকুরটাকে হিংস্র আক্রমণ করতে লাগল। একবার ছুটে গিয়ে এ কামড়ায় তো পরমুহূর্তেই ছুটে গিয়ে আর-একজন কামড় দেয়। একটা তো এক কামড়ে এক চাকা মাংস খুবলে নিল।
আমার চক্রব্যূহে অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে গেল।
বুনো কুকুরগুলোর ধারালো দাঁতের পাটি দেখা যাচ্ছে। শিকারের দিকে প্রখর চোখে তাকিয়ে ওরা অদ্ভুত স্বরে গর্জন করছে।
ওদের ফাঁদে পড়া কুকুরটা তখন মরিয়া। সে-ও হিংস্র গর্জন করে পালটা কামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এরকম অসম লড়াই বেশিক্ষণ চলার কথা নয়—তাই চললও না। কামড়ে-কামড়ে বাদামি-সাদা কুকুরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। বুনো কুকুরগুলোর আক্রমণের বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসতে লাগল। তারপর একসময় পাঁচটা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারের ওপরে। ওদের শরীরে কোণঠাসা কুকুরটার শরীর ঢাকা পড়ে গেল। শুধু শোনা যেতে লাগল ওর মরণ আর্তনাদ।
ততক্ষণে পাঁচটা বুনো কুকুর ওদের হিংস্র মহাভোজ শুরু করে দিয়েছে।
হঠাৎই খেয়াল করে দেখি বড়মেসোর চোখে জল। মাছ ধরার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে তিনি বললে, ‘শিগগির চল, ফিরে যাই। ওই কুকুরগুলো নদী পার হয়ে এপাশে এলেই বিপদ।’
‘ওরা নদী পার হয়ে চলে আসে?’ আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
‘হ্যাঁ, আসে। একে তো সরু নদী—তার ওপর শীতকাল। কতটুকুই বা জল থাকে! তা ছাড়া ওরা সাঁতারে ওস্তাদ। নদী পার হয়ে ওরা শ্মশানের বেওয়ারিশ মড়া খেতে যায়। তবে সাধারণত রাতে যায়—খুব খিদে না পেলে ওরা দিনের বেলা এপারে আসে না।’
আমরা নদীর পাড় ধরে ফিরে যাচ্ছিলাম। তবে আমি বারবার পেছন ফিরে বুনো কুকুরগুলোকে দেখছিলাম। ওরা তখন খিদে মেটাতে ব্যস্ত। একটা বুনো কুকুরকে দেখলাম জল খেতে নদীর কিনারায় নেমে এসেছে। ওর গায়ে এখানে-ওখানে রক্ত লেগে রয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর যখন আমরা একটা ধানখেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, ‘মেসো, তুমি তখন কাঁদছিলে কেন?’