কর্নেলসাহেব, এই কথাটা আমার আপনার কাছে যাওয়ার আগেই মাথায় এসেছিল, কারণ হঠাৎ করে পাগলা বিনোদের মড়া দেখা নিয়ে গুজব আর রাতবিরেতে আমাদের বাড়িতে ভূতুড়ে উৎপাত কেন হচ্ছে। আপনার কাছ থেকে ফিরে এসে যখন আমাদের মন্দিরের হাড়িকাঠের কাছে রক্ত দেখতে পেলুম, তখনই বুঝলুম আমার কাকা হয়তো মোহর ভরতি ঘড়াটা কোথায় আছে তা দেখিয়ে দেয়নি বলেই তাকে ভুতু আর গোপেন মিলে খুন করেছে। তারপর বডিটা গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আমি ভুতু আর গোপেনের নাম সাহস করে পুলিশকে বলতে পারিনি। ওদের ভালো চেনে, তাই পিসিমাও মুখ বুজে থেকেছে।
হালদারমশাই বললেন,–ওদের মধ্যে একজনের কি একটা চক্ষু নাই?
শচীনবাবু আবার চমকে উঠে বললেন,–ভুতুর একটা চোখ জন্ম থেকেই নেই। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?
আমি বললুম,–আপনি ভুলে গেছেন, উনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। কাজেই উনি এখানে এসেই এখানে-ওখানে ওত পেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
কর্নেল বলে উঠলেন,–ভুতু আর গোপেনের না কি ডাকাতের দল আছে?
শচীনবাবু চাপাস্বরে বললেন,–ছিল। থানায় নতুন ওসি আসার পর থেকে এ-এলাকা ছেড়ে ওদের দলের লোকেরা শুনেছি পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভুতু আর গোপেনের একজন শক্ত গার্জেন আছে। তাই তারা এখনও বেপরোয়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ওরা তেমন সাংঘাতিক কাজ করে ফেললে নতুন ওসি ওদের রেহাই দেবেন বলে মনে হয় না।
কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–সেই প্রভাবশালী গার্জেন কী করেন? তার নাম কী?
শচীনবাবু আবার চাপাস্বরে বললেন,–এসব কথা কানে গেলে লোকটা উলটে আমাকেই পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে।
কর্নেল একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,–আহা, আমি জানতে চাইছি, সে কে? কী করে?
শচীনবাবু এবার ফিসফিস করে বললেন, তার নাম মনীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী। তিনি এই চণ্ডীবাবুদেরই জ্ঞাতি। কিন্তু চণ্ডীবাবুর ঘোর শত্রু। উনি এখানকার একটা রাজনৈতিক দলের নেতা।
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। এবার বলুন আপনাদের দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, অ্যাডভোকেট শরদিন্দু চ্যাটার্জির কাছে আপনাদের পূর্বপুরুষের যে দলিলটা আছে, তা কি আপনি কখনও দেখেছেন?
শচীনবাবু বললেন, আমি দেখিনি। বাবাকে একবার শরদিন্দু জেঠু ওটা দেখিয়েছিলেন। বাবা কিছু বুঝতে পারেননি। কিন্তু চণ্ডীকাকুর সঙ্গে আমার অ্যাডভোকেট জেঠুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আছে। ছুটি পেলে শরদিন্দু জেঠু এখানে চলে আসেন। চণ্ডীকাকুর বাড়িতেই ওঠেন। উনি একসময়কার নামকরা শিকারি। এখনও বিলে বুনো হাঁস মারতে আসেন।
কর্নেল এবার পকেট থেকে সেই প্রাচীন তুলোট কাগজে নাগরি লিপিতে লেখা দলিলের কপিটা শচীনবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, এটা আপনার পূর্বপুরুষের সেই দলিলের কপি।
শচীনবাবু কাগজটা কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, এটা তো কোনও দলিল নয়, কী সব অং বং হং লেখা আছে। কয়েকটা তীর আঁকা আছে।
কর্নেল বললেন,–এটা দেখে আপনার মাথায় কিছু আসছে না?
শচীনবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,–না। বাবাও বলেছিলেন কিছুই মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না।
কর্নেল তার হাত থেকে কাগজটা ফিরিয়ে নিয়ে পকেটে ভাঁজ করে রাখলেন। তারপর বললেন,–ভুতু এবং গোপেনকে আপনি এই কাগজে যা লেখা আছে তার একটা কপি পৌঁছে দিতে পারবেন? না, শুধু পৌঁছে দিলে হবে না, তাদের বলতে হবে, যে-গুপ্তধনের লোভে আপনার কাকুকে খুন করেছে তারা, এই কাগজটা সেই কাকার কাছ থেকে পাওয়া। এতেই গুপ্তধনের খোঁজ পাওয়া যাবে।
শচীনবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন,–এটা যদি সত্যি আমাকে পূর্বপুরুষের লেখা হয়, তাহলে এটা কি ওদের হাতে দেওয়া ঠিক হবে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–হবে। ওদের যা বিদ্যে, তাতে ওরা এটা থেকে কোনও সূত্রই বের করতে পারবে না। কিন্তু ওরা যদি সত্যি গুপ্তধন হাতানোর উদ্দেশ্যে আপনার সঙ্গে ভাব জমায়, আর রাত-বিরেতে ভূতুড়ে উৎপাত করে থাকে তাহলে ওরা টোপ গিলবে। অর্থাৎ এটার অর্থ উদ্ধারে কারও সাহায্য নেবে।
শচীনবাবু মাথা নেড়ে বললেন,–না কর্নেলসাহেব, এটা ওদের হাতে দেওয়া ঠিক হবে না। ওরা এটার অর্থ উদ্ধারের জন্যে আমার বা আমার রুগ্ণ বাবার ওপর জুলুম চালাবে। সারাবছর তো পুলিশ আমাদের রক্ষা করবে না।
কর্নেল বললেন, তাহলে আমাদের যে-কোনও উপায়ে হোক এই টোপটা ওদের গেলাতে হবে। শচীনবাবু, আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা একটা ফাঁদ। ঠিক আছে, আপনি এ-বেলা ভেবে দেখার সময় নিন, তারপর বিকেলের দিকে কিংবা রাত্রে আমাদের জানিয়ে দেবেন। কিন্তু একটা কথা, এ-নিয়ে আপনার পিসিমা বা বাবার সঙ্গে কক্ষনো আলোচনা করবেন না।
শচীনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন,–আচ্ছা কর্নেলসাহেব, আমাদের বাড়িতে রাতবিরেতে যে পাথরের নুড়িগুলো ছোঁড়া হয়, সেগুলো তো পাহাড়ি মুলুকের নদীতে পাওয়া যায়। ভুতু বা গোপেন কখনও অতদুরে কোথাও গেছে বলে মনে হয় না। তাহলে ওরা ওগুলো পেল কোথায়?
কর্নেল বললেন,–আপনার কাকার ঘর তো পুলিশ সার্চ করেছে। তাঁর ঘরে কি কোনও সন্দেহজনক জিনিস, কিংবা ধরুন ওরকম নুড়ি-পাথর পাওয়া গেছে?
শচীনবাবু আবার চাপাস্বরে বললেন,–পিসিমা একদিন কাকার ঘর পরিষ্কার করতে ঢুকেছিল। কাকা তার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতেন না। ওঁর ঘরে সব নানারকম শাস্ত্রীয় বই আর একটা মড়ার খুলি–এইসব নানারকমের অদ্ভুত-অদ্ভুত জিনিস থাকে। তা একদিন পিসিমা কাকার ঘরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল। কাকা দরজায় তালা না দিয়ে বাথরুমে ঢুকেছিলেন। পিসিমা ভেতরে উঁকি মেরে বিছানার পাশে তিনটে ওইরকম ডিমালো নুড়ি দেখতে পেয়েছিলেন। উনি ভেবেছিলেন, ভূতের ঢিলগুলো কুড়িয়ে কাকাই বোধহয় ওখানে রেখেছেন। তাই উনি ঢিল তিনটে কুড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরের পাশের পাঁচিল গলিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন।