বললাম, হয়তো বেরিয়েছে। পরে রিং করে দেখবেন। কিন্তু একটা কথা। তার যখন আপনাকে এত দরকার, সে এখানে আপনাকে রিং করছে না কেন?
এ-প্রশ্নের জবাবও পেদ্রো গার্সিয়াই দিতে পারে। বলে কর্নেল বোতাম টিপে হুয়াকে ডেকে ডিনার রেডি করতে নির্দেশ দিলেন!
ডিনারে ডঃ ভাস্কো বর্ণিত সামুদ্রিক শ্যাওলা ছিল। আমার খারাপ লাগল। কিন্তু হালদারমশাই এবং কর্নেল খেতে-খেতে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। খাওয়া শেষ করে সবে ড্রেসিংরুমে ঢুকেছি, টেলিফোন বাজল। কর্নেল সাড়া দিলেন। ডঃ ভাস্কো?…সে কী! কোথায়?… আপনি দয়া করে আসুন। আমি যেতে চাই। বডি যেন না নড়ানো হয়।… না, না ডঃ ভাস্কো! এটা গুরুত্বপূর্ণ।
কর্নেল ফোন রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, পেদ্রো গার্সিয়াকে তার ঘরে কেউ খুন করে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে ডঃ ভাস্কোর গাড়ি এল। মা-আ-উ-আ ইনের দিকে ছুটে চলল গাড়ি। পাপেনু নদীর ধারে নিরিবিলি জায়গায় একতলা হোটেল। কেন ইন বা সরাইখানা নাম দেওয়া হয়েছে কে জানে! গিয়ে দেখি, বন্দুকবাজ নিরাপত্তাবাহিনী আর পুলিশ হোটেল ঘিরে রেখেছে। ৩১নং রুম দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং তার নিচেই নদী। নদীর ওপারে উঁচু গাছের জঙ্গলে চোখে পড়ল।
পেদ্রো বাথরুমের দরজায় খুন হয়েছে। দরজাটা খোলা। মাথা বাথরুমের ভেতর এবং ধড় বাইরে। উপুড় হয়ে আছে মৃতদেহ। বোঝা যায়, বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছিল, সেই সময় আততায়ী মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ডঃ ভাস্কো বললেন, ডাক্তার ফ্লোরোয়াঁর মতে, আপাতদৃষ্টে এই ভদ্রলোক খুন হয়েছেন রাত আটটার আগে। পেছনের দরজা খোলা ছিল। দরজার বাইরে ব্যালকনি। ব্যালকনির নিচে নদী। কাজেই আততায়ীর পালানো সহজ ছিল। রাত সাড়ে আটটায় ডিনার দিতে এসে পরিচারক দরজায় নক করে। বারবার নক করে সাড়া না পেয়ে ম্যানেজারকে খবর দেয়। ইন্টারলকিং সিস্টেমের দরজা। ড়ুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ম্যানেজার দরজা খুলেই আঁতকে ওঠেন। পুলিশে খবর দেন। আপনার নির্দেশে মিঃ পেদ্রোর দিকে ম্যানেজারকে নজর রাখতে বলেছিলাম। ম্যানেজার আমাকেও খবর দেন। টেলিফোন অপারেটর বলেছে, রাত আটটা পঞ্চাশে কেউ মিঃ পেদ্রোকে রিং করেছিল।
আমি। অপারেটর বলল, ঘরে রিং হয়ে যাচ্ছে। বলে কর্নেল পেছনের ব্যালকনিতে গেলেন। ফিরে এসে ঘরের ভেতরে চোখ বুলিয়ে বললেন, পেদ্রোর লাগেজ সার্চ করা হয়েছে?
হ্যাঁ। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। কয়েকটা বই, ট্রাভেলগাইড আর জামাকাপড় আছে। একটা ব্যাগে পাসপোর্ট আছে। ক্যামেরা আর ভিউফাইন্ডার আছে—ওই দেখুন!
কর্নেল লাশের দিকে ঝুঁকলেন। পেদ্রোর গায়ে চকরবকরা রঙিন গেঞ্জি। বাঁ বাহুর ওপর কর্নেল টর্চের আলো ফেলে আতস কাচ দিয়ে সম্ভবত হয়ঞ্জীবের উল্কি খুঁজলেন। দেখলাম, একটা মোটা জজুল আছে। হঠাৎ কর্নেল জড়ুলটা একটানে উপড়ে ফেললেন। একটা হয়গ্রীবের উল্কি দেখে চমকে উঠলাম। ডঃ ভাস্কো বললেন, কী আশ্চর্য!
টা নকল। ইঞ্চিটাক চৌকো স্বচ্ছ সেলোফেনজাতীয় জিনিসের ওপর বসানো। কর্নেল বললেন, লাশটা চিত করতে হবে।
ডঃ ভাস্কো একজন পুলিশ চিফকে ফরাসিতে কথাটা বললেন, পুলিশ চিফের মুখ বেজায় গোমড়া। বুঝলাম বিদেশির নাক গলানোতে খচে গেছেন। তাঁর নির্দেশে দুজন পুলিশ লাশ চিত করে শোওয়াল। কর্নেল মৃত পেদ্রোর জিনসের প্যান্ট তল্লাশ করে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরে উজ্জ্বল আলো, তবু কর্নেল মেঝের কার্পেটে টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে বিছানার কাছে ঝুঁকে পড়লেন। কী একটা তুলে নিয়ে পেদ্রোর লাশের কাছে গেলেন। পেদ্রোর ডান হাতের আঙুল আতস কাচে পরীক্ষা করে সটান উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার কাজ শেষ। ডঃ ভাস্কো! আমরা বাংলোয় ফিরে যাব।
বাংলোয় ফেরার পথে কর্নেল বললেন, ডঃ ভাস্কো, আপনি ফিরে গিয়ে মাছধরা ট্রলারের মালিক আইউংয়ের সঙ্গে কথা বলুন। আমরা আজ রাতেই কোকো দ্বীপের দিকে পাড়ি জমাতে চাই। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। পেদ্রোর খুনি কোকোর দিকে এতক্ষণ রওনা হয়ে গেছে। সব কথা যথাসময়ে খুলে বলব।
ডঃ ভাস্কো চিন্তিত মুখে বললেন, কিন্তু আমার সহকারী পিটার গিলম্যান যে হাওয়াই দ্বীপের হনলুলুতে দুসপ্তাহের ছুটি কাটাতে গেছে। কাল সকালের প্লেনে সে ফিরবে। তাকে সঙ্গে না নিয়ে
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, তাঁকে দরকার হবে না।
হালদারমশাই এতক্ষণ উসখুস করছিলেন। নিজস্ব ভাষায় বললেন, কর্নেলসার, ওনারে কইয়া আমারে একখান রিভলভার দেওনের ব্যবস্থা করতে পারেন না?
পাখিরা ভয় পেল কেন?
রাত বারোটায় মৎস্যবন্দর হোয়ালাহা থেকে গোপনে চিনা জেলে আইউংয়ের ট্রলারে আমরা পাড়ি জমিয়েছিলাম। পেদ্রো গার্সিয়ার খুনি ভয়ঙ্কর দ্বীপ কোকোর দিকে কোন আক্কেলে ছুটে যাবে বুঝতে পারছিলাম না। সেখানে নাকি সাংঘাতিক হিংস্র ঘোড়া-মুখো মানুষের ডেরা! আমার বৃদ্ধ বন্ধু তখনও মৌনীবাবা। মুখে চুরুট। চোখ বন্ধ। সাদা দাড়িতে একটুকরো ছাই।
আইউংয়ের মাছধরা ট্রলারের নিচের খোলটা মাছের গুদাম। ওপরে এঞ্জিনঘর সংলগ্ন একটা কেবিন। দুপাশে রেলিংয়ের খোলা ডেক। আমাদের দলে দুজন সশস্ত্র রক্ষী কোয়া এবং তিকি। তারা তাহিতির আদিবাসিন্দাদের বংশধর। প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই এঞ্জিনঘরে উঁকি মেরে সম্ভবত ট্রলার চালানো দেখছিলেন। চালকের নাম চিচিন। সে বুড়ো জেলে আইউংয়ের ছেলে। বাবা-ছেলে মাত্র দুজনে মিলে প্রশান্ত মহাসাগরে মাছ ধরে বেড়ায়। তাদের সাহস আছে