Site icon BnBoi.Com

গোপন সত্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

গোপন সত্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

০১.শীতসন্ধ্যার একটি মৃত্যু

জানুয়ারি মাসের এক দিনশেষে সকলের অলক্ষে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল।

বাংলা-বিহার সীমান্তে ছোট্ট শহর মোতিগঞ্জ। হাওড়া-সাহেবগঞ্জ লুপ রেললাইনের একটি মাঝারি স্টেশন এটি। সি লাইন হওয়ার দরুন রেলগাড়ির চলাচল কম। সামান্য দূরে একটা হাইওয়ে থাকায় দিনভর রাতভর এক্সপ্রেস বাস চলে অগুনতি। তাই রেলের যাত্রীসংখ্যাও কমে গেছে।

বিহার মুল্লুকের শীত অতি তুখোড়। দিনশেষে সেই তুখোড় শীত এবার হিংস্র হয়ে উঠেছিল। স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে হলঘরের মতো চওড়া ঘরটিতে একটি চায়ের স্টল-কাম খাবারের দোকান। সামনে ও পাশে বেঞ্চ। একটু তফাতে মেঝেয় কয়েকজন দেহাতি পুরুষ ও স্ত্রীলোক কাচ্চাবাচ্চা ঘিরে তুলোর নোংরা কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করছিল। চা ও খাবারের দোকানটির বেঞ্চে জনা তিনেক লোক বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। তারা ভদ্রজন। নিঝুম শীতের সন্ধ্যায় বাইরের কুয়াশা এই স্টেশনেও ওতপ্রোত ঢুকে পড়ায় বাতিগুলো ম্লান, ঝিমন্ত।

এই তিন যাত্রীর একজন অন্য বেঞ্চে, বাকি দুজন একই বেঞ্চে হাতখানেক তফাত রেখে বসে চা খাচ্ছিলেন। এ দুজনের মধ্যে একজনের গায়ে ওভারকোট, গলায় পুরু করে মাফলার জড়ানো, মাথায় বিদেশী টুপি। তার মুখে সাদা একরাশ দাড়ি। বয়সে বৃদ্ধ, কিন্তু তার হাবভাবে তারুণ্যের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তার পাশে বেঞ্চের ওপর একটি সিন্থেটিক চামড়ার স্যুটকেস। এ ধরনের স্যুটকেস সর্বত্র দেখা যায় ইদানীং। তত কিছু দামীও নয়। তবে তাঁর দুই ঊরুর ওপর রাখা মোটাসোটা কিটব্যাগটা বিদেশী এবং দামীও বটে। বৃদ্ধ চা শেষ করে বেঞ্চের তলায় কাপ প্লেট রেখে ওভারকোটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা চুরুট বের করলেন। সেটি লাইটারে জ্বেলে চোখ বুজে মৃদু-মৃদু টান দিতে থাকলেন। নীল ধোঁয়া আরও নিষ্প্রভ করে ফেলল চায়ের স্টলের বাতিকে।

দ্বিতীয় জন একটু রোগাটে গড়নের এবং বয়স তিরিশের বেশি নয়। কিন্তু চেহারায় রাগীব আর নির্লিপ্ততার অদ্ভুত সংমিশ্রণ। চোখদুটো ভীষণ উজ্জ্বল, অথচ মুখের চামড়া পোড়া খাওয়া, তামাটে, যেন মমির মুখ। তার গায়ে চামড়ার জ্যাকেট; পরনে জিনসের বেরঙা প্যান্ট, পায়ে নীল-সাদা জীর্ণ কেডস জুতো। তার দু পায়ের ফাঁকে একটি স্যুটকেস। সেটিও সিন্থেটিক চামড়ায় তৈরি এবং পাশের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের স্যুটকেসটির অনুরূপ। যুবকটি চা শেষ করে কাপপ্লেট সামনে বাড়িয়ে ধরল, চাওলার বয় এসে সেটা নিয়ে যাক এই তার ইচ্ছা। কিন্তু কেউ এল না দেখে বিরক্তভাবে সে উঠে কাপপ্লেট চাওলার চায়ের সরঞ্জামের ভেতর রাখতে গেল। চাওলা এতে রেগে গেল। এঁটো কাপপ্লেট বোয়া কাপপ্লেটের সঙ্গে রাখা তার কাছে অসঙ্গত। সে বলল, কা করতা বাবুজি? উধার রাখিয়েউধার। ঝুটা কাপ রাখনেকা জাগাহ্ নেহি দেখতা?

অন্য বেঞ্চের যাত্রীটি মুখ নামিয়ে চা খাচ্ছিলেন। পরনে দামী স্যুট। হাতে অ্যাটাচি কেস। মাথায় হনুমান টুপি। কাপপ্লেট পাশে রেখে উঠে গেলেন ট্রেনের সময় জানতে। ঠিক এসময় ঘটনাটি ঘটল।

যুবকটি এঁটো কাপপ্লেটের জায়গায় এদিকে পিছন ফিরে কাপপ্লেট রেখে কড়া কিছু বলতে চাইল। সেই সময় বৃদ্ধ, ওভারকোট পরা লোকটি নিজের স্যুটকেসটি ওই যুবকের স্যুটকেসের পাশে রেখে তার স্যুটকেসটি তুলে নিঃশব্দে এবং অতিদ্রুত নিজের পাশে রাখলেন। এইসময় টিকিটের ঘণ্টা বেজে উঠল।

এই ঘটনা কারুর চোখে পড়ল না। স্যুটকেস-বদল ঘটে গেল একমুহূর্তেই।

যুবকটি রাগ চেপে সিগারেট ধরাল। তারপর স্যুটকেসটি তুলে নিয়ে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। টিকিট কাউন্টার খুলেছে। সম্ভবত সে চায়ের দোকানীর ওপর এমনই ক্রুদ্ধ যে হাতের স্যুটকেসের দিকে লক্ষ্যও নেই।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকও স্যুটকেস নিয়ে ছোট্ট কিউয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার আগে যুবকটি। বৃদ্ধ শুনলেন, সে আপে পরবর্তী জংশন স্টেশন হাথিয়াগড়ের টিকিট চাইল। বৃদ্ধের পালা এলে টিকিটবাবুকে আস্তে বললেন, হাথিয়াগড়।

টিকিট কেটে বৃদ্ধ প্ল্যাটফর্মে গেলেন। প্ল্যাটফর্ম খাঁ খাঁ। বাতিগুলো কুয়াশায় জুগজুগ করছে। কনকনে হাওয়ায় হাড় অব্দি কেঁপে উঠছে। যুবকটি করগেট শিটে ঢাকা প্ল্যাটফর্মের একটি থামে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছিল। দুপায়ের ফাঁকে সেই স্যুটকেস।

দীর্ঘ-সুদীর্ঘ সময় মনে হয় শীত সন্ধ্যায় কোনো ট্রেনের জন্য এই প্রতীক্ষা। অবশেষে ট্রেনটি এল। একদঙ্গল যাত্রী নামল। ব্যস্ততা, কোলাহল, ভিড়, ইঞ্জিনের শব্দ–সবকিছু যেন গিলে নিচ্ছিল তুখোড় ঠাণ্ডা হিম শীতসন্ধ্যার প্রকৃতি।

একই কামরায় বৃদ্ধ ও যুবকটি উঠেছেন। কামরায় তত ভিড় নেই। দুজনে দুই কোণে বসেছেন। ট্রেন ছাড়লে বৃদ্ধ নিভে যাওয়া চুরুটটি জ্বেলে কিটব্যাগ থেকে একটি বই বের করে পাতা খুললেন।

যুবকটি চেইন-স্মোকার। একটার পর একটা সিগারেট টানছে। ভুরু কোঁচকানো। দৃষ্টি উজ্জ্বল, অথচ একই সঙ্গে নির্লিপ্ততাময়। বৃদ্ধের একটা চোখ তাকে লক্ষ্য করছিল।

দুটি ছোট্ট স্টেশন পরে হাথিয়াগড় জংশন এসে গেল। যুবকটি স্যুটকেস হাতে দরজার কাছে গেলে বৃদ্ধও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ট্রেন থামলে দুজনে নামলেন। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে বাইরে রিকশা ও টাঙ্গা গাড়ির ভিড়, ট্যাক্সি, বাস ও প্রাইভেট কারও প্রচুর। যুবকটি একটি সাইকেল রিকশা নিল। বৃদ্ধও একটি সাইকেল রিকশা নিয়ে মৃদুস্বরে রিকশা চালককে বললেন, উও রিকশোকি পিছা চা ভাই! বখশিস মিলেগা।

তিনি যুবকটিকে অনুসরণ করছিলেন।

শহরের ভেতর তত বেশি ভিড় নেই। শীতের রাত্রি। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যুবকের রিকশা থামল একটি সুদৃশ্য হোটেলের সামনে। হোটেলের নাম প্রিয়দর্শী। শহরের সবচেয়ে খরুচে হোটেল। সাহেবি কেতাদুরস্ত। যুবকটি বৃদ্ধকে লক্ষ্য করছিল না। তার মুখে এখন চাঞ্চল্য আর অন্যমনস্কতার সংমিশ্রণ। রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে সে দোতলায় সাত নম্বর সিঙ্গল বেডরুম বুক করল। বৃদ্ধ ঝুঁকে খাতায় লেখা তার নাম ঠিকানা দেখছিলেন। ম্যানেজার আঁকাবাঁকা ইংরেজি হরফে লিখেছেন : সুশোভন রায়। ঠিকানা : ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন, কলকাতা-৬। হাথিয়াগড় আসার উদ্দেশ্য : বিজনেস পারপাস। যুবকটিকে রুমে নিয়ে গেল একজন পরিচারক।

ম্যানেজার বললেন, বোলিয়ে সাব!

বৃদ্ধ বললেন, ফার্স্ট ফ্লোর নাম্বার এইট খালি হ্যাঁয়?

জি। লেকিন আঠ ডাবল বেড।

ঠিক হ্যাঁয়। আঠ। …

একটু পরে আট নম্বরে ঢুকে বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করলেন! স্যুটকেসটিতে তালা আটা। কিটব্যাগ থেকে একটি মাস্টার কি বের করলেন, যার সাহায্যে সবরকমের সাধারণ তালা খেলা যায়। তালা খুললেন, কিন্তু স্যুটকেসটি খুলতে যেন একটু বিব্রত দেখাল তাঁকে। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন সেটির দিকে।

তারপর ওভারকোট খুলে রেখে দুপাশের চেনদুটো টেনে খুললেন। আবার একটু ইতস্তত করে ডালাটা একটু তুলে ধরলেন। ভেতরে কিছু ভঁজকরা পোশাক। ভাঁজকরা কিন্তু যেমন তেমন ভাবে জড়িয়ে রাখার মতো। আর সেই পোশাকগুলোও নোংরা, বেরঙা, ময়লার ছোপে ভরা। আলতো হাতে তুলে ভেতরটা দেখেই রেখে দিলেন। আর কিছুই নেই, শুধু জামাকাপড়!

এইসময় পাশের সাত নম্বর ঘরে চাপা কীসব শব্দ হলো। বৃদ্ধ দ্রুত, কিন্তু নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। করিডর জনশূন্য। এখন তার গলা থেকে ঝুলন্ত একটি বাইনোকুলার দেখা যাচ্ছিল। সাত নম্বরের দরজার কি-হোলে বাইনোকুলারের একটি আই রেখে এক চোখ বুজে দেখার চেষ্টা করলেন ভেতরে কী ঘটছে।

দেখেই চমকে উঠলেন। টেবিলের উপর সেই স্যুটকেসটি খোলা। ভেতরে একগাদা পুরনো খবরের কাগজ দলাপাকানো এবং আরও কিছু ওইরকম কাগজ মেঝেয় ছড়ানো।

যুবকটি হিংস্র চোখে তাকিয়ে সেগুলো দেখছে।

তারপর সে বাকি কাগজগুলোও তুলে মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলল। এবার স্যুটকেসটা ফেলে দিয়ে লাথি মারল। তাকে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। সে চেয়ারের কাছে। দাঁড়িয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরল। ক্রমশ তার চোখের হিংসার উজ্জ্বলতা ক্ষয়ে যেতে থাকল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর ধপাস করে চোরে বসে পড়ল।

সেকেন্ড তিন-চার পরে সে জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পিস্তল। বের করল এবং অতিদ্রুত-এক মুহূর্তের মধ্যেই সে হাঁ করে পিস্তলের নল মুখে ঢুকিয়ে ট্রিগার টানল। চাপা-খুবই চাপা কটাস্ করে একটা শব্দ এবং সে সশব্দে চেয়ারসুদু উল্টে পড়ে গেল।

বৃদ্ধ হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রথম ঘটনার চেয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘটে গেল।…

০২. জামায় রক্তের দাগ

কিছুক্ষণ পরে।

হোটেলের বাইরে পুলিশের দঙ্গল দেখে কিছু ভিড় জমেছে বটে, কিন্তু পাশেই বিস্তীর্ণ গঙ্গার জল ছুঁয়ে উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে। তাই ভিড় নিশ্চপ। হোটেলে কী ঘটেছে, জানার আগ্রহটাও মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিছু লোক রাস্তার ধারে রবার পুড়িয়ে তাপ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। দুর্গন্ধ ছুটেছে। হোটেলে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না কনস্টেবলরা। একটা জিপ এবং অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাছে গেলেই লাঠি উঁচিয়ে গুতো মারতে আসছে পুলিশ। তবে দিনের বেলা হলে ভিড়টা প্রচণ্ডই হত।

দোতলার আটনম্বর ঘরে বসে পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা, এস আই রাকেশ পাণ্ডে, ডিটেকটিভ দপ্তরের ইন্সপেক্টর সুরেশ চতুর্বেদী কথা বলছিলেন। সাত নম্বর সিঙ্গলবেড রুমে দুজন কনস্টেবল এবং একজন এস আই বডি পাহারা দিচ্ছেন। একজন ফোটোগ্রাফার এবং একজন ডাক্তারও আছেন সেখানে। ডাক্তারের নাম হরিনাথ মুখার্জি, বাঙালি। তিনপুরুষ বিহার মুল্লুকের এই হাথিয়াগড় শহরে বসবাস করেছেন।

ডাঃ মুখার্জি আট নম্বরে এসে ঢুকলেন। আস্তে বললেন, ইন্সট্যান্ট ডেথ। সুইসাইড।

মোহন শর্মা বললেন, সুইসাইড তো বটেই। পিস্তলটাও পড়ে আছে। মেঝেয়। বলে সেই বৃদ্ধের দিকে ঘুরলেন। একটু হেসে বললেন, গতবার দিল্লিতে একটা কনফারেন্সে গিয়ে আপনার কথা উঠলো হঠাৎ। কে যেন বললেন, একটা প্রবাদ চালু হয়েছ ভারতব্যাপী, জানেন তো! হোয়্যার ইজ কর্নেল, এ ডেডবডি ইজ দেয়ার! কর্নেল যেখানে, মৃতদেহ সেখানে!

সুরেশ চতুর্বেদী হাসলেন। নিছক মৃতদেহ বললে ভুল হবে। হোয়্যার ইজ কর্নেল, দেয়ার ইজ এ মার্ডার। অবশ্য এক্ষেত্রে মার্ডারটা সুইসাইড! তাহলেও মার্ডার বলা চলে। কারণ আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে খুন করা।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক–স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন। মাথার টুপিটি টেবিলে। প্রশস্ত টাকে আলো টকটক করছে। সাদা দাড়িতে আঙুলের চিরুনি টানছিলেন অভ্যাসে–চোখ দুটি বন্ধ। মুখ তুলে এবার বললেন, আমার জীবনে এই এক অভিশাপ মিঃ চতুর্বেদী! কেন এমন হয়, এ রহস্যের অর্থ খুঁজে পাইনে। দিব্যি খুশমেজাজে বেড়াতে এলুম মোতিগঞ্জে। ওখানে গঙ্গার চরে পাখিটাখি দেখলুম। প্রজাপতি ধরার বিস্তর চেষ্টা করেও পারলুম না। দুপুরে ফিরে পোস্টাপিসে গেলুম একটা টেলিগ্রাম করতে। তারপর–

মোহন শর্মা জিগ্যেস করলেন, কাকে টেলিগ্রাম?

জয়ন্তকে–আই মিন, জয়ন্ত চৌধুরি, কালকাতার দৈনিক সত্যসেববের স্পেশাল রিপোর্টার।

চতুর্বেদী বললেন, হ্যাঁ–তাকে চিনি।

কর্নেল বিষণ্ণভাবে বললেন, জয়ন্তকে আসার জন্য টেলিগ্রাম করতে গেলুম। জায়গাটা তার ভাল লাগত। তো পোস্টাপিসে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। ওই যুবকটি কাউন্টারের এককোণে পিছু ফিরে এক তাড়া একশো টাকার নোট–অন্তত হাজার দশেক টাকা হবে বোধ করি, একটা পাতলা ছোট্ট পত্রিকায় জড়িয়ে পুরু খামে পুরল। গ্রিটিং কার্ডস যেসব খামে পাঠানো হয়, সেইরকম খাম। খামের মুখটা ভেতরে ঢুকিয়ে ডগাটুকু এঁটে দিল আঠা দিয়ে। তারপর আরও অবাক হয়ে দেখি, ওপরে লিখছে প্রিন্টেড ম্যাটার।

শর্মা চমকে উঠলেন।…বলেন কী!

চতুর্বেদী বললেন, আশ্চর্য রিস্ক নেওয়া! পত্রিকায় জড়ানো দশ হাজার টাকা! প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে!

কর্নেল বললেন, অর্ডিনারি বুক পোস্টে অত টাকা ওভাবে পাঠাল দেখে–জানেন তো, আমি একটু নাকগলানে স্বভাবের মানুষ–টেলিগ্রামের লাইনে দাঁড়িয়ে ওকে ফলো করলুম। ওর হাতে স্যুটকেস। এই স্যুটকেসটা। তখনই রাস্তার ধারের দোকানে ঝটপট অবিকল এরকম একটা স্যুটকেস কিনে নিলুম। ফলো করতে অসুবিধে ছিল না। কারণ সামনেই স্টেশন। সে স্টেশনে ঢুকলে তখনই আমার হোটেলে ফিরে বাসি কদিনের খবরের কাগজ ভরে—

বাধা দিয়ে শর্মা বললেন, ওর স্যুটকেসটা সম্পর্কে আপনার সন্দেহ হলো কেন?

ইনটুইশান! কর্নেল আস্তে বললেন। কিংবা হয়তো সে যেভাবে স্যুটকেসটা নিয়ে যাচ্ছিল, যেন ভেতরে কিছু মূল্যবান জিনিস আছে হয়তো সে নিষিদ্ধ মাদকের কারবারি! ঠিক এরকম কিছু ভেবেছিলুম।

ডাঃ মুখার্জি আগ্রহে শুনছিলেন। বললেন, তারপর, তারপর?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, মোতিগঞ্জ স্টেশনে স্যুটকেসটা বদল করলুম এক সুযোগে তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। তাই খুঁটিয়ে স্যুটকেসটা লক্ষ্য করেনি। তাছাড়া সন্ধ্যাবেলা। আলো কম ছিল ওখানে। শীতও একটা ফ্যাক্টর। মানুষকে আপনাদের বিহারী শীত বড় কুঁড়ে করে দেয়।

অফিসাররা হেসে উঠলেন। শর্মা স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে বললেন, কিন্তু এটার মধ্যে তো এমন কিছু দেখছি না, যার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে। নো ড্রাগস–হাশিশ অর ওপিয়ামনাথিং! কিছু কাপড় মাত্র।

কর্নেল বললেন কাপড়গুলো ভাল করে দেখুন, মিঃ শর্মা!

মোহন শর্মা কাপড়গুলো বের করলেন। যেমন-তেমনভাবে ভাঁজ করা পুরনো একটা শার্ট, একটা প্যান্ট, একটা সোয়েটার। শার্টটা খুলেই চমকে উঠলেন। বললেন, মাই গুডনেস! এই ছোপগুলো কিসের?

কর্নেল বললেন, রক্তের।

তার মানে?

মিঃ শর্মা, কবে কাউকে খুন করা হয়েছিল, এ তারই পরনে ছিল। শার্টের কলারে দর্জির দোকানের নামঠিকানা লেখা আছে। আমার ধারণা, এই প্যান্ট শার্ট-সোয়েটার সুশোভন রায়ের কাছে মূল্যবান সম্পদ হয়ে ছিল। অবশ্য এই আত্মহত্যাকারী সুশোভনের আসল নাম সম্পর্কেও আমার সন্দেহ আছে। কারণ বুকপোস্টে পাঠানো খামে আমি দেখে নিয়েছিলুম, নাম ঠিকানা লেখা আছে: তপেশ বসাক। ১৭/২ ফকিরচাঁদ লেন, কলকাতা-১২।

ডাঃ মুখার্জি বললেন, তাহলে রীতিমতো রহস্যজনক ঘটনা!

মোহন শর্মা বিড়বিড় করছিলেন, সুশোভন রায়–তপেশ বসাক! দশহাজার টাকা। রক্তমাখা পোশাক। তারপর আত্মহত্যা। আচ্ছা কর্নেল? কর্নেলের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলেন এবার।

বলুন।

তপেশ বসাকের নামে ডাকে পাঠানো খামটা পৌঁছতে দু-তিনদিন লেগে যাবে। মোহন শর্মা বললেন। এখনই কলকাতা পুলিশকে রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে পোস্টাপিস থেকে ওটা যথাসময়ে সিজ করতে বলা যাক। কী বলেন?

কর্নেলকে এখনও বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। গলার ভেতর বললেন, না।

কেন?

খামটা অন্য কারুর হাতে পৌঁছুচ্ছে কি না জানা দরকার। আর যদি আপত্তি না থাকে, রেডিও মেসেজ আমিই পাঠাই কলকাতা পুলিশের ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর হাতে একটু দায়িত্ব দিলে আশা করি সে তা পালন করবে।

মোহন শর্মা মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেও মুখে বললেন, ওকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সশোভন ওরফে তপেশ মোতিগঞ্জ কেন এসেছিল, সেটা জানার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।

ঠিক তাই। কর্নেল চুরুটে টান দিয়ে ধোঁয়ার ভেতর বললেন। তবে আমার ধারণা, সেটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল। বরং–

কর্নেল হঠাৎ থেমে গেল শর্মা বললেন, বলুন।

বরং হাথিয়াগড়ে সে কেন এল, এটা আগে জানা দরকার।

সুরেশ চতুর্বেদী স্যুটকেসের ভেতর তন্নতন্ন খুঁজছিলেন। জামা, সোয়েটার, প্যান্টের সমস্ত ভঁজ ও পকেট খোঁজা শেষ করে বললেন, আশ্চর্য! একটুকরো কাগজ পর্যন্ত নেই! শুধু রক্তমাখা তিন টুকরো পোশাক।

মোহন শর্মা একটু হেসে বললেন, হাথিয়াগড়ে আসাটাও খড়ের গাদার সুচ খোঁজা, কর্নেল!

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, হয়তো না।

কেন?

কর্নেল এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন, কাল খুব সকালে হাসপাতালের মর্গে আমি উপস্থিত থাকতে চাই। আপনি এবং মিঃ চতুর্বেদীও থাকবেন। এবার চলুন, পাশের ঘরে যাই। বডিটা আবার সার্চ করতে হবে।

পুলিশ অফিসাররা উঠলেন। চতুর্বেদী বিরক্তভাবে বললেন, সার্চ তো অলরেডি করেছি। প্যান্টের পকেটে একটা রুমাল, স্যুটকেসের চাবি, একটা চিরুনি আর পনের টাকা পঞ্চাশ পয়সা ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হেঁটেলের ওই ঘরটার চার্জ চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পঁচাত্তর টাকা। এ ছাড়া খাওয়া খরচ আছে। অথচ পেলেন মাত্র পনের টাকা পঞ্চাশ পয়সা।

মোহন শর্মা ও সুরেশ চতুর্বেদী পরস্পরের দিকে তাকলেন। দুজনেই অগত্যা হাসলেন। চতুর্বেদী বললেন, হ্যাঁ–এটা একটা পয়েন্ট।

মোহন শর্মা বললেন, ইমপর্ট্যান্ট পয়েন্ট।

পাশের ঘরে তখন হাসপাতালের দুজন ডোম এসে গেছে স্ট্রেচার নিয়ে। বডি ওঠাচ্ছে। কর্নেল বললেন, এক মিনিট! বলে সুশোভন ওরফে তপেশের মৃতদেহের পিঠের দিকে জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে কী একটা বের করলেন।

সেটা একটা আইডেন্টিটি কার্ড। তাতে এই মৃতেরই ছবি। কার্ডটি পারিজাত ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির। হেড অফিস কলকাতার একটা ঠিকানায়। শাখা ভারতের বড়-বড় শহরে। কিন্তু মোতিগঞ্জ বা হাথিয়াগড়ে কোন শাখা নেই। কার্ডে লেখা আছে : তপেশ বসাক, রিপ্রেজেন্টেটিভ।

ডাঃ মুখার্জি আবার বলে উঠলেন, রীতিমতো রহস্যজনক! পিঠের দিকে আইডেন্টিটি কার্ড!

কর্নেল বললেন, এটা তত কিছু রহস্যজনক নয়, ডাঃ মুখার্জি! এই চামড়ার জ্যাকেটগুলো সিঙ্গাপুরে তৈরি হয়। পিঠের দিকে ভেতরে একটা পকেট থাকে। আমারও এরকম একটা জ্যাকেট ছিল। যাই হোক, বডি মর্গে চলে যাক। এবার চলুন মিঃ শর্মা, নিচের ডাইনিং হলে গিয়ে এক পেয়ালা করে কড়া কফি খাওয়া যাক। কফি না খেলে আমার মাথা খোলে না।

সিঁড়িতে নামার মুখে ডিটেকটিভ অফিসার চতুর্বেদী বললেন, জামায় রক্তের দাগ ব্যাপারটা খুব জট পাকিয়ে দিয়েছে। আগে ওটার একটা খেই খুঁজে বের করা উচিত। কী বলেন, মিঃ শর্মা? কর্নেল?

কিন্তু এই প্রচণ্ড শীতে গরম কফির চিন্তা শর্মা ও কর্নেলকে ততক্ষণে আবিষ্ট করে ফেলেছে। ওঁরা কোনো জবাবই দিলেন না।…

০৩. শ্যামলকান্তি ও সুভদ্র

কর্নেল যেখানে-সেখানে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারেন–সে জঙ্গলে হোক, কী কুঁড়েঘরে। এমন কী বিপদ-আপদের আশঙ্কার মধ্যেও তাঁর তাক লাগানো ঘুম সম্পর্কে খ্যাতি আছে। অথচ হাথিয়াগড় হোটেলে এ রাতে তিনি ঘুমুতে পারছিলেন না। বারবার মনে একটা দুঃখ চিমটি কাটছিল, জীবনে এই প্রথম তিনি একজন মানুষের মৃত্যুর একান্ত কারণ হয়ে উঠলেন!

শেষ রাতে যদি বা একটু তন্দ্রামতো এল, তাও কেটে গেল। যুবকটির কাছে একটা পিস্তল ছিল। তার মানে যে সে নিজে একজন খুনী, আপাতত প্রমাণ নেই তার। তাছাড়া খুনী কাউকে খুন করে তার রক্তমাখা জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে বেড়ায় না। অথচ সে সঙ্গে পিস্তল রাখত।, এ থেকে সিদ্ধান্ত করা চলে,

অস্ত্রটা তার আত্মরক্ষার জন্য দরকার ছিল।

আর ওই প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে দশ হাজার টাকা পাঠানো! হুঁ, টাকা সে সঙ্গে রাখতে সাহস পায়নি। কিন্তু টাকাগুলো কি সে মোতিগঞ্জে পেয়েছিল? কার কাছে পেয়েছিল? কেন পেয়েছিল?

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : পঁচাত্তর টাকা ভাড়ার ঘর বুক করল এই হোটেলে। অথচ পকেটে মাত্র ১৫ টাকা ৫০ পয়সা সম্বল! তাহলে এ হোটেল ভাড়ার টাকা কী করে মেটাত সে?

হুঁ, এই হাথিয়াগড়েও কি কারুর কাছে টাকা পেত? কার কাছে? হাথিয়াগড়ে পারিজাত ট্রান্সপোর্টের কোনো শাখা নেই। বিহার রাজ্যেই এই কোম্পানির কোনো শাখা নেই। অবশ্য দিল্লি যাওয়ার পথে এখানকার কোন ব্যবসায়ীর মাল পারিজাত কোম্পানির ট্রাকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তা যদি হত, তাহলে তার কাগজপত্রও থাকত। কাজেই হাথিয়াগড়ে কোম্পানির পাওনাকড়ির ভরসায় সে হোটেল ভাড়া করেনি। অন্য কারুর কাছেই টাকা পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা ছিল। নিশ্চিত নয়–সুনিশ্চিত বলা উচিত।

আর ঘুম এল না কর্নেলের। ভোরে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশার মধ্যে, চিরদিনের অভ্যাস মতো, টুপি-ওভারকোট-মাফলার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেলেন। ঘাটের মুখে ঘিঞ্জি বাজার। গরিবগুরবো লোকেরা আগুন জ্বেলে বসে আছে। একটা চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাগিদ দিয়ে এক ভঁড় চা আদায় করলেন চৌগুণ দামে। তারপর গঙ্গার ধারে পিচরাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলেন। এখন তিনি প্রকৃতি-অভিমুখী।

শহরের বাইরে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য উঠল। তখনও ঘন কুয়াশা। পাখি দেখার চেষ্টা করছিলেন বাইনোকুলারে। এত শীতে পাখিরাও বড় কাতর। খড়কুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে বসে রইলেন বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ।

ফেরার পথে রিকশা পেয়ে গেলেন। বললেন, হাসপাতাল।

আটটা বাজে। মর্গের কাছে পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা এবং ডিটেকটিভ অফিসার সুরেশ চতুর্বেদীর সঙ্গে দেখা হলো। শর্মা বললেন, সাতটায় এসেছি। আপনার পাত্তা নেই।

চতুর্বেদীকে বিরক্ত দেখাচ্ছিল। বললেন, মর্গে নতুন কিছু কি জানার আছে কর্নেল?

কর্নেল বললেন, কিছু বলা যায় না। বাই দা বাই, ডাঃ মুখার্জি কখন আসছেন?

শর্মা ঘড়ি দেখে বললেন, আটটার মধ্যেই আসতে বলেছি। সচরাচর নটায় আসেন উনি।

চতুর্বেদী বললেন, পোস্টমর্টেম হবে–সেটা তো নিয়মই। কিন্তু পোস্টমর্টেমে নতুন কী জানা যাবে, ভাবছেন কর্নেল?

কর্নেল জবাব দিলেন না। টানা বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলেন। পুলিশ অফিসদ্বয় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হতাশা ও বিরক্তির ভাব মুখে ফুটিয়ে তাকে অনুসরণ করলেন। কর্নেল যেখানে দাঁড়ালেন, সেখানে বড় বড় হরফে মর্গ লেখা আছে। একটা কটু গন্ধ ছড়াচ্ছে। শর্মা নাকে রুমাল চেপে বললেন, বরং নিচে ওইটতলায় গিয়ে বসা যাক, আসুন।

তিনজনে প্রাঙ্গণের প্রকাণ্ড বটতলায় গেলেন। এদিকটা হাসপাতালের শেষ প্রান্ত। দেয়াল ও ঘন ঝোপঝাড় আছে। কয়েক মিনিট পরে একটা মোটরগাড়ি এসে মর্গের নিচে থামল। ডাঃ মুখার্জি বেরিয়ে এলেন। এঁদের দেখে হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, পোস্টমর্টেমটা শিগগির করে ফেলা দরকার ডাঃ মুখার্জি।

ওক্কে! আই অ্যাম রেডি। বলে ডাঃ মুখার্জি বারান্দায় উঠলেন। তার গাড়িটা পিছিয়ে গিয়ে কিছুদূরে গ্যারেজের কাছে থামল। সেই ডোম দুজনকে দেখা গেল পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। ডাঃ মুখার্জি সদলবলে মর্গের তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

এর মিনিট পাঁচেক পরে টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে দেখা গেল। তার পরনে স্যুট, মাথায় হনুমান টুপি, হাতে অ্যাটাচি কেস। তিনি এদিকে এলেন না। বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে পড়লেন। সিগারেট ধরালেন।

আরও একজন লোক এসে একটু তফাতে বসল। সাধারণ চেহারা ও পোশাকের মানুষ। তারপর এক বৃদ্ধা, সঙ্গে একটি যুবক এবং একটি বালক।

শর্মা হাসলেন।…ভিড় শুরু হলো। আজকাল যত খুনোখুনি বেড়েছে, তত বেড়েছে নিরুদ্দিষ্ট লোকজন। কাজেই বুঝতে পারছেন কর্নেল, প্রতিদিন মর্গের কাছে এই ভিড়। কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। আসলে বেশির ভাগ বডি গলাপচা অবস্থায় পাওয়া যায়। সনাক্ত করার উপায় থাকে না।

ভিড় সত্যিই বাড়ছিল। দুজন কনস্টেবল, একজন এস আই সেখানে এসে গেলেন। চতুর্বেদী মন্তব্য করলেন, আজকাল পুলিশের কাজের ঝামেলা বড্ড বেশি বেড়ে গেছে।

শর্মা হাসতে হাসতে বললেন, দেশের যা অবস্থা হচ্ছে, এরপর পুলিশের আর কোনো ভূমিকা থাকবে না। মাঝে মাঝে চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে।

চতুর্বেদী বললেন, আসলে রাজনৈতিক চাপটা ভীষণ বেশি। দে ইন্টারভেন ইন ইচ অ্যান্ড এভরি কেস। দ্যাটস্ দা রিয়্যাল প্রব্লেম।

কর্নেল বললেন, এক পেয়ালা কফি পেলে ভাল হত।

শর্মা বললেন, কফি! হাসপাতালের ক্যান্টিনের যা অবস্থা, সেখানে কফি পাওয়া গেলেও এক চুমুকেই বমি আসবে। বরং বাইরে গেটের পাশে রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়।

কর্নেল বললেন, আপনারা প্লিজ এখানে অপেক্ষা করুন। যদি আমি না ফিরি, হোটেলে যোগাযোগ করবেন। আপনাদের থাকার দরকার আছে।

দুই অফিসার অবাক। শর্মা বললেন, কী ব্যাপার?

শরীরটা খারাপ বোধ হচ্ছে। কর্নেল আস্তে বললেন। আপনারা শুধু নজর রাখবেন, তপেশবাবুর বডি সনাক্ত করতে বা তার বডি দেখতে কে কে আসছে। তাদের নাম-ঠিকানা জেনে নেবেন। চলি!

দুই অফিসারকে আরও অবাক করে কর্নেল হনহন করে এগিয়ে গেলেন। মোহন শর্মা চাপা স্বরে বললেন; এক পাগলের পাল্লায় পড়া গেল দেখছি! সুরেশ, এই বুড়ো লোকটার সংসর্গ আমার আর সুবিধের ঠেকছে না। লেট আস প্রসিড ইন আওয়ার ওন ওয়ে।

ইয়া। চতুর্বেদী সায় দিলেন। লিভ হিম। হি ইজ আ ম্যাড ফেলা।…

কর্নেল বারান্দায় উঠেছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের ভেতর দিয়ে শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন। তারপর প্রাঙ্গণ পেরিয়ে গেটের দিকে চললেন।

একটু পরে হাসপাতালের গেটের বাইরে একটা রেস্তোরাঁ দেখতে পেলেন। সাইন বোর্ডে লেখা আছে আজাদ রেস্তোরাঁ। হাথিয়াগড়ে লোকের সাচ্ছল্য বেড়েছে। একটু দূরে খনি অঞ্চল। তাই এখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় একেবারে মড পুলিশ। ছিমছাম, সুদৃশ্য, মহার্ঘ।

রেস্তোরাঁর ভেতরে তত ভিড় নেই। মড পোশাক ও চেহারার যুবকেরা, জনাকতক বয়স্ক–চেহারায় বিত্ত ও আভিজাত্যের ছাপ, চা বা কফি খেয়ে শীত দূর করছেন। কোনার দিকে একটি টেবিল খালি ছিল। কর্নেল সেখানে বসে কফি ও পকৌড়ার অর্ডার দিলেন। খিদে পেয়েছিল।

পরপর দু কাপ কফি খেতে আধঘণ্টা কাটল। তারপর ঢুকলেন এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। ফো। মাথায় হনুমান টুপি। পরনে দামী স্যুট। হাতে অ্যাটাচি কেস।

ভেতরে ঢুকেই তিনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে খালি আসন খুঁজছিলেন যেন। ভিড় কিছুটা বেড়েছে। কর্নেলের চোখে চোখ পড়লে একটু ইতস্তত করলেন। তারপর সোজা এগিয়ে এলেন। এ টেবিলে তিনটে চেয়ার খালি। একটু হেসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, বসতে পারি?

কর্নেল বললেন, নিশ্চয়!

ধন্যবাদ। বলে ভদ্রলোক মুখোমুখি বসলেন। বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরেক কাপ কফি হোক, কর্নেল?

কর্নেল চমকে উঠলেন না। স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। দু পেয়ালা হয়ে গেছে।

বেয়ারাকে কফি, স্যান্ডউইচ ও ডবল ওমলেটের অর্ডার দিয়ে ভদ্রলোক একটু হাসলেন।…আমার নাম শ্যামলকান্তি মজুমদার। ইলেকট্রনিক গুডসের ব্যবসা করি। কলকাতায় থাকি।

আমাকে আপনি চেনেন?

চিনি। শ্যামলকান্তি বললেন, আপনি প্রখ্যাত মানুষ। আপনাকে চেনে না কে?

কর্নেল চুরুট ধরালেন এতক্ষণে। বললেন, অসংখ্য লোক চেনে না। যাই হোক, কাল সন্ধ্যায় মোতিগঞ্জ স্টেশনে চায়ের স্টলে আপনি বসে ছিলেন। মোতিগঞ্জে কি ব্যবসার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন?

ঠিক ধরেছেন। হাথিয়াগড়েও একই উদ্দেশ্যে এসেছি। বিহারের শিল্পা ভাল মার্কেট আছে। একটু যোগাযোগ করার দরকার ছিল।

করলেন?

করছি। বাই দা বাই, আপনি এই সুইসাইড কেসের নিষ্পত্তি না করে কলকাতা ফিরবেন না?

কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি অনেক খবর রাখেন।

শ্যামলকান্তি জোরে হাসলেন।… আপনি গোয়েন্দা মানুষ। সবকিছুতেই সন্দেহজনক গন্ধ পান। না কর্নেল! আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব প্রাঞ্জল। কোন রহস্য-টহস্য নেই। আপনার চেহারার বর্ণনা আমি খবরের কাগজ এবং জয়ন্ত চৌধুরির লেখা বইতে পড়েছি, তবে কাল মোতিগঞ্জ স্টেশনে আপনাকে দেখে। চিনতে পারিনি। চিনলুম কিছুক্ষণ আগে, যখন পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে মর্গের ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন। মানে, দুইয়ে দুইয়ে যোগ দিয়ে চার করলুম আর কী!

কর্নেল একটু ঝুঁকে টেবিলের ওপর। বললেন, আপনি মর্গে গিয়েছিলেন কেন মিঃ মজুমদার?

শ্যামলকান্তি এবার একটু দুঃখিত মুখে বললেন, এতেও কোনো রহস্য নেই। আমার এক ভাই অমলকান্তি প্রায় সাত বছর নিরুদ্দেশ। রাত্রে এক বন্ধুর বাসায় ছিলুম। সে বলল, কে এক বাঙালি যুবক আত্মহত্যা করেছে প্রিয়দর্শী হোটেলে। আসলে এ আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, কর্নেল! কলকাতার সমস্ত মর্গে প্রতিদিন একবার করে যাওয়া চাই-ই। বাইরে যেখানেই যাই, কোথাও কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন ধরুন, হোটেলে এক বাঙালি যুবকের আত্মহত্যা, আমি তার খোঁজ না নিয়ে থাকতে পারি না। অমল আমার বুকের একখানা পাঁজর ভেঙে দিয়েছে, কর্নেল!

শ্যামলকান্তি শ্বাস ছেড়ে রুমালে নাক মুছলেন। বেয়ারা খাবার দিয়ে গেল। চুপচাপ খেতে শুরু করলেন। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। হঠাৎ কেউ আস্তে বলল, জেরা লেট কিয়া হাম!

কর্নেল দেখলেন এক শক্তসমর্থ গড়নের জ্যাকেট-জিনস পরা যুবক। বয়স তিরিশ-বত্তিরিশের মধ্যেই–তপেশের প্রায় সমবয়সী। কিন্তু মুখে উজ্জ্বলতা আছে। স্মার্টনেস ঝলমল করছে।

শ্যামলকান্তি পরিচয় করিয়ে দিলেন কর্নেলের সঙ্গে। যুবকটির নাম সুভদ্র সিং। এখানকার এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। বাবা একসময়ে বড় জমিদার ছিলেন। মারা যাওয়ার পর সুভদ্র ব্যবসা করছে। পেট্রলপাম্প, গ্যারেজ এসব আছে। মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল, সো ইউ আর আ ডিটেকটিভ অফিসার?

কর্নেল হাসলেন। মোটেও না! জাস্ট এ ন্যাচারালিস্ট। তবে ক্রিমিনলজি সম্পর্কে একটু কৌতূহল আছে মাত্র।

শ্যামলকান্তি বললেন, কফি অর টি সুভদ্র?

সুভদ্র বলল, নাথিং শ্যামলদা! এইমাত্র খেয়ে বেরিয়েছি। তো গিয়েছিলেন মর্গে? আমি তো গিয়ে আপনাকে খুঁজেই পেলাম না।

শ্যামলকান্তি গম্ভীর ও বিষণ্ণ মুখে বললেন, গিয়েছিলুম।

বডি দেখলেন?

হ্যাঁ। অমল নয়, অন্য কেউ।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা, চলি শ্যামলবাবু!

শ্যামলকান্তি বললেন, থাকছেন, নাকি ফিরে যাচ্ছেন কলকাতা?

থাকছি না। ওবেলা ফিরছি।

ট্রেনে?

কর্নেল হাসলেন।…বাসে বড্ড ভিড় হয়। এ বয়সে ট্রেনেই আরামদায়ক।

শ্যামলকান্তি একটু ভেবে বললেন, ওবেলা সুভদ্র জিপে কলকাতা যাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। চলুন না আমাদের সঙ্গে। আপনার মতো স্বনামধন্য মানুষকে সঙ্গী পেলে আমরা খুশি হব।

কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন।…ভাল হয়। ট্রেন বড্ড দেরি করে এ লাইনে। আমার একটু তাড়াতাড়ি ফেরাও দরকার। আপনারা কখন রওনা দিচ্ছেন?

সুভদ্র বলল, জাস্ট তিনটেতে। বড় জোর ঘণ্টা সাত লাগবে জিপে। রাস্তা খুব ভাল।

ঠিক আছে। আমাকে তাহলে প্রিয়দর্শী থেকে তুলে নেবেন।

কর্নেল বিদায় নিয়ে বেরুলেন রেস্তোরাঁ থেকে। হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের দিকে চললেন। হু, শ্যামলকান্তির কৈফিয়তে সন্দেহজনক কিছু দেখা যাচ্ছে না। যদি তপেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ বা পরিচয় থাকত, মোতিগঞ্জ স্টেশনেই। সেটা বোঝা যেত। ওরা পরস্পর অপরিচিত বলেই মনে হয়েছিল। পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা হতে দেখেননি। এমন কী, চোখে-চোখেও কোনো যোগাযোগ হয়নি।

হোটেলে পৌঁছুনোর কিছুক্ষণ পরে মোহন শর্মা এলেন। বললেন, দুজন ঢুকেছিল বডি দেখতে। একজন–

মাথায় হনুমান টুপি, পরনে স্যুট, হাতে অ্যাটাচি কেস?

অবাক শর্মা বললেন, দ্যাটস রাইট। বাট—

দ্বিতীয় জন কে?

লেট কুমার অমর সিং-এর ছেলে সুভদ্র সিং? তাকে চতুর্বেদী জিগে করেছে, মর্গে কেন? সে বলেছে, তার পরিচিত এক বাঙালি ভদ্রলোকের এখানে আসার কথা। তার এক ভাই নিরুদ্দিষ্ট।

সুভদ্র সিং সম্পর্কে পুলিশ রেকর্ডে কিছু উল্লেখযোগ্য আছে।

মোহন শর্মা হাসলেন।…অতীতে থাকলেও আমার জানার কথা নয়। তবে এটুকু বলতে পারি দুবছর এখানে এসেছি। তার বিরুদ্ধে কোনো রেকর্ড এই দুবছরে পাইনি। আমার পূর্ববর্তী অফিসারও কিছু উল্লেখ করে যাননি। তবে সুভদ্র কলকাতার কলেজে লেখাপড়া করেছে, এটুকু জানি। হি ইজ আ নাইস চ্যাপ!

কর্নেল বললেন, মিঃ শর্মা, শুধু একটা অনুরোধ, তপেশের আইডেন্টিটি কার্ডটা কলকাতার ডিটেকটিভ ডিপার্টে অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দেবেন।

শর্মা হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে। তবে দ্যাটস মাই জব অলসো৷…

০৪. এক সেকেন্ডের জন্য

জিপগাড়িটা প্রচণ্ড গতিতে এগোচ্ছিল।

বাঁদিকে সুভদ্র ড্রাইভার, ডানদিকের সিটে কর্নেল। শ্যামলকান্তি বসেছে পেছনে, ভেতরদিকে। রাস্তা তত ফাঁকা না হলেও ঝকঝকে নতুন। দক্ষিণে পনের কিমি এগিয়ে এবার চাড়াই-উত্রাই শুরু। ছোটনাগপুর পাহাড়ের একটা রেঞ্জ এখানে উঁচিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে দুধারে টিলা, শালের জঙ্গল। গঙ্গা ক্রমশ দূর উত্তরে সরে যাচ্ছে। সমতল মাটির উর্বরতা চোখে পড়ছে না আর। রাস্তা বাঁক নিয়ে পূর্বমুখী হলে শ্যামলকান্তি বললেন, সুভদ্র, এক কাজ করলে হত! সুভদ্র বলল, বলুন শ্যামলদা!

একটা শর্টকাট করলে মন্দ হয় না। শ্যামলকান্তি পরামর্শ দিলেন। আর দশ কিলোমিটার পূর্বে যে চৌমাথাটা পড়বে, ডাইনে ঘুরে দুমকা রোড পাবে। কিন্তু সোজা এগোলে রেললাইন ক্রশ করার ঝামেলা। তাছাড়া মুর্শিদাবাদে ঢুকে চৌত্রিশ নম্বর হাইওয়ে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। হাইওয়েটাও যাচ্ছেতাই। তার চেয়ে দুমকা রোড ধরে চলল।

সুভদ্র হাসল। আরও সাউথে গিয়ে জি টি রোড ধরতেও আপত্তি নেই। বাট মাইন্ড দ্যাট, আরও দুতিনটে ডিস্ট্রিক্ট পেরুতে হবে।

কর্নেল মন্তব্য করলেন, তার মানে প্রায় পুরো বিহারের পূর্বাঞ্চল সফর হয়ে যাবে। আমার অবশ্য আপত্তি নেই।

সুভদ্র বাঁ হাতে একটা রোড-ম্যাপ বের করল। দেখে নিয়ে বলল, এক কাজ করা যায়। তিরিশ কিমি শর্টকাট রাস্তাটা যদিও ভাল না, পাহাড়পুরের কাছে গেলে দিল্লি রোডে!

শ্যামলকান্তি উৎসাহ দিলেন। তাই চলো, সুভদ্র! চৌত্রিশ হাইওয়ে বড় বাজে রাস্তা।

জিপ দুমকা রোড ধরে ফের দক্ষিণে ছুটল। পথে শ্যামলকান্তির তাগিদে একখানে থেমে ছোট্ট বাজারে চা খাওয়া হলো। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে প্রকৃতি দেখতে ভুললেন না। হিম ক্রমশ বাড়ছে। আবার জিপ স্টার্ট দিল। ঘণ্টা খানেক পরে, তখন সাড়ে চারটে বাজে, সুভদ্র জানাল, সামনে সেই শর্টকাট।

রাস্তাটা সত্যিই খারাপ। কোন যুগে পাথরকুচি ও পিচ পড়েছিল। উপড়ে এবং ভেঙেচুরে ছত্রখান। এখানে-ওখানে গর্ত। দুধারে ঘন জঙ্গল। শীতের শেষ বেলায় এখনই গাঢ় ছমছমে ছায়া পড়েছে। কিন্তু সুভদ্র চমৎকার ড্রাইভ করে। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। শ্যামলকান্তি তার উদ্দেশে বকবক করছিলেন। বাঁদিকে একটা পাহাড়ি নদী আছে। তারই বন্যায় রাস্তাটার এ অবস্থা। দেহাত অঞ্চল বলে পূর্ত দপ্তর নিষ্ক্রিয়। ব্যবসার বাজার খুঁজতে শ্যামলকান্তিকে সবখানে ঘুরতে হয়। তাই এ অঞ্চলেরও নাড়িনক্ষত্ৰ চেনেন।

কিছুদূর চলার পর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, রোখো! রোখো।

সুভদ্র ব্রেক কষল। ঝাঁকুনি খেযে কর্নেল চোখ খুললেন। হাত্রে চুরুট নিভে গেছে।

শ্যামলকান্তি বললেন, এখানে একটা বিউটিফুল সাইট আছে। কর্নেলকে দেখাতে চাই। উনি শুনেছি প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ! আসুন কর্নেল! জাস্ট এ ফিউ মিনিট ডিসট্যাম্।

শ্যামলকান্তি পেছন দিয়ে নামলেন। কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার?

বাঁদিকে এই পায়েচলা রাস্তাটা দেখছেন, একটু এগোলে নদীর প্রপাত আছে একটা। অসাধারণ, কর্নেল! একধারে কোন রাজার পুরনো কেল্লা। সব মিলিয়ে এতে সুন্দর ন্যাচারাল স্পট সচরাচর দেখা যায় না। এলুমই যখন, একবার দেখে যাই! আসুন, আসুন! মুগ্ধ হয়ে যাবেন। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে নিয়ে আসুন। ওখানে এখনও যথেষ্ট আলো আছে।

কর্নেল নামলেন। ক্যামেরাও নিলেন সঙ্গে। শ্যামলকান্তিকে অনুসরণ করলেন। পায়েচলা রাস্তায় একটু এগিয়ে ঝরঝর শব্দ কানে এল।

সত্যিই অসাধারণ সুন্দর একটা প্রপাত। ওধারে ন্যাড়া পাথরের টিলার মাথায় একটা পোড়া দুর্গ। প্রপাতটা অন্তত দেড়শো ফুট খাড়াই। নদীতে জল অল্প। পাথরের ফাঁক দিয়ে স্বচ্ছ জল ঝরঝরিয়ে দেড়শো ফুট নিচে পড়ছে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে আসা লালচে রোদ্দুরে জলকণা ঝিলমিলিয়ে উঠছে। তারপর চোখে পড়ল একটা রামধনু। কর্নেল মুগ্ধ দৃষ্টে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন।

শ্যামলকান্তি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, রামধনু! পৃথিবীর বুকে নেমে আসা রামধনু! ভাবা যায়?

কর্নেল কালারফিল্মে প্রপাতের গায়ের রামধনুটিকে প্রতিফলিত করার জন্য একেবারে খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে শ্যামলকান্তি অসম্বদ্ধ প্রলাপের মতো আওড়াচ্ছেন, ভাবা যায় না! ঈশ্বর পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর জিনিস রেখেছেন। আর নির্বোধ হারামজাদা মানুষ খালি ঝগড়াঝাটি করে–কর্নেল! সাপ!

আচমকা কর্নেল শ্যামলকান্তির প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন।

বাঁদিকে ফুটখানেক দূরে একটা তরুণ গাছ। কর্নেলের বাঁ হাত বিদ্যুৎগতিতে সেই গাছের গায়ে পড়ল। ধাক্কাটা সামলে নিলেন। ঝুঁকে পড়েছিলেন, সোজা হলেন। জুতোর ডগার চাপে ছোট-বড় একঝক পাথর সশব্দে দেড়শোফুট প্রপাত-খাদে গিয়ে পড়ল।

ঘুরে তাকালেন শ্যামলকান্তির দিকে। অপ্রস্তুত, বিব্রত মুখে শ্যামলকান্তি আস্তে বললেন, সরি!

কর্নেল শুধু একটু হাসলেন।

শ্যামলকান্তি গলার ভেতর বললেন, ওই কালো লতাটা দেখে–

মিঃ মজুমদার! এখন শীতকালে সাপেদের হাইবারনেশন পিরিয়ড। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন। মুখে তেমনি হাসি। ওরা এখন সারা শীতকাল ঘুমুবে।

সরি! ভেরি সরি! ওই আঁকাবাঁকা লতাটা আপনার পায়ের কাছে হাত–তুলে কর্নেল বললেন, নেভার মাইন্ড!

শ্যামলকান্তিকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তারপর কর্নেলও গম্ভীর হলেন। জিপে গিয়ে যখন বসলেন, তখন কর্নেলের ঊরু ভারী, বুকের ভেতর স্পন্দন বেড়েছে। মাত্র একচুলের জন্য বেঁচে গেছেন। আত্মরক্ষার সহজাত বৃত্তিতে-নাকি বরাবরকার মতো ইনটুইশনবশে বাঁ হাতটা উঠে গিয়েছিল গাছটার দিকে? মাত্র একটা সেকেন্ডের জন্য! নইলে দেড়শো ফুট নিচের ভিজে পাথরে পড়ে শরীর গুঁড়িয়ে যেত।

নাকি এমন কিছু ঘটতেও পারে ভেবে তার অবচেতনায় একটা প্রস্তুতি ছিল?

কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।…

০৫. কিছু তথ্য, কিছু প্রশ্ন

কলকাতার ইলিয়ট রোডে সানি লজের তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট। ছাদে তার সুপরিচিত প্ল্যান্টওয়ার্ল্ড–যেখানে পৃথিবীর যত সব উদ্ভুট্টে গড়নের ক্যাকটাস, অর্কিড, ফুলগাছ। সকালবিকেল সেখানেই কাটান। শীতে অ্যারিজোনা থেকে সংগৃহীত ছিপছিপে ক্যাকটাসে লাল ফুল গজিয়েছে। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ক্যামেরায় ছবি তুলছিলেন কর্নেল। শেষ বেলার নরম আলো তার উদ্ভিদরাজ্যটিকে যেন বিষণ্ণ করে রেখেছে। নাকি নিজেরই মানসিক অবস্থার প্রতিফলন? হাথিয়াগড়ের হোটেলে একটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছেন, কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

ষষ্ঠী এসে খবর দিল, নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব এসেছেন। বইসে রেইখে। বাবামশাইকে ডাকতে এসেছে।

কর্নেল দ্রুত নেমে গিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলেন। হাই ডার্লিং!

ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী মুচকি হেসে বললেন, কলকাতা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপর কোন মুল্লুকের উটকো আপদ এনে চাপিয়ে দিলেন। বাপস্! এবার দেখছি, সত্যিই চাকরি ছেড়ে ফিল্ম করতে নামব।

কর্নেল হাসলেন না এ পরিহাসে। গম্ভীর মুখে বসে বললেন, খবর বলো অরিজিৎ।

ইউ আর টু সিরিয়াস, কর্নেল! কেন?

এ কথার জবাব না দিয়ে কর্নেল আস্তে বললেন, খবর নেই কিছু?

আছে। অরিজিৎ ব্রিফকেস খুলে একটা নোটবই বের করলেন।..তপেশ বসাকের বুকপোস্টে পাঠানো খামটা বউবাজার পোস্টঅফিস থেকে সিজ করা হয়েছে। ওতে ঠিকই একশোটা একশোটাকার নোট ছিল। তপেশের ফ্ল্যাটে তালা আঁটা ছিল। ভেঙে ঢুকেছি। সিঙ্গলরুম ফ্ল্যাট। একটা ফেল্ডিং খাট আর বিছানা ছাড়া কোনো আসবাব নেই। নাথিং! তবে বিছানার তলায় এই ফোটোটা

পেয়েছি। দেখুন!

ফোটোগ্রাফটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবতীর। সাদাসিধে পোশাক। তত কিছু সুন্দর নয়। কর্নেল দেখে ফেরত দিয়ে বললেন, প্রেমিকা?

তাছাড়া আর কে হতে পারে? অরিজিৎ সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, আজ সব কাগজে তপেশের ছবি ছাপানো হয়েছে মিসিং স্কোয়াড মারফত।

দেখেছি। কর্নেল চুরুট বের করে অন্যমনস্কভাবে বললেন, মোহন শর্মাকে বলে এসেছিলুম স্যুটকেসের জামা প্যান্ট সোয়েটার এখানকার ফরেন্সিকে পাঠাতে। খবর নিয়েছ? :

পাঠিয়েছেন। ইউ আর রাইট, কর্নেল! ছোপগুলো রক্তের। সোয়েটারপরা অবস্থায় পিঠের দিকে কাউকে স্ট্যাব করা হয়েছিল।

আচ্ছা অরিজিৎ, খুনের কেস কতদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে?

বারোবছর। তারপর ল্যাপ্স হয়ে যায়। এই পিরিয়ডের পর খুনী কে জানলেও আইনত আর কিছু করার থাকে না।

এটা ১৯৮১ সালের জানুয়ারি! কর্নেল তেমনি অন্যমনস্কভাবে বললেন। বাই দা বাই, পারিজাত ট্রান্সপোর্টের খবর কী?

অরিজিৎ এবার নড়ে বসলেন। হ্যাঁ–এটা আগেই বলা উচিত ছিল। আইডেন্টিটি কার্ডটায় কারচুপি করা হয়েছে। তপেশ বসাক নামে একজন কর্মচারী ওদের ছিলেন বটে; কিন্তু কার্ডের ছবিটা তার নয়।

বলো কী।

প্রকৃত তপেশ বসাকের ছবিটা তুলে ফেলে আপনার দেখা যুবকটির ছবি সাঁটা হয়েছে। ছবির ওপর দিয়ে পারিজাত ট্রান্সপোর্টের মালিকের সই ছিল। সইয়ের আদ্ধেকটা জাল।

ষষ্ঠী ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স আনল। কর্নেল পট থেকে কফি ঢালতে। ঢালতে বললেন, শ্যামলকান্তি মজুমদারের ব্যাকগ্রাউন্ড?

নো স্পট। অন্তত পুলিশ রেকর্ডে কিছু নেই।

পুরনো রেকর্ড ঘাঁটা দরকার, ডার্লিং!

অরিজিৎ কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে একটু হেসে বললেন, ১৯৭০ পর্যন্ত রেকর্ড ঘাঁটা হয়েছে। ওই নামে কিছু পাওয়া যায়নি। ভদ্রলোক একজন মিনিস্টারের আত্মীয়। গে ক্লাবের মেম্বার। গে ক্লাবের বিরুদ্ধেও কোনো বদনাম আমাদের কানে আসেনি।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন। বললেন, তপেশ বসাকের নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না কোনো বাংকে–সেটার খোঁজ নেওয়া দরকার ছিল।

অরিজিৎ বললেন, ওই নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে যাবে কেন? নামটা তো অন্য একজনের।

তবু খোঁজ নেওয়া দরকার। কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে নিলেন। ধোঁয়ার ভেতর বললেন ফের, ফরেন্সিক রিপোর্টে পোশাকের রক্তের দাগ কতদিন আগের, তা বলা হয়েছে?

হ্যাঁ। আনুমানিক আট থেকে দশ বছর আগের বলে এক্সপার্টরা মনে করেন।

পোশাক তিনটে দেখে আমার অনুমান, নিহত লোকটি ছিল সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, রোগা গড়নের।

ঠিক তাই। ফরেন্সিক এক্সপার্টরাও একই কথা বলেছেন। অরিজিৎ হাসলেন। …বোঝাই যায়, এই ভুয়ো তপেশ বসাক ছিল একজন ব্ল্যাকমেইলার। খুনীকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আনতে গিয়েছিল। কর্নেল, খুনী নিশ্চয় মোতিগঞ্জের লোক। মিঃ শর্মা আর বিহার গোয়েন্দা পুলিশ উঠে পড়ে লেগেছে তাকে খুঁজে বের করতে।

কর্নেল স্থির দৃষ্টে ডি সি ডি ডি-র দিকে তাকিয়ে আস্তে বললেন, বাট হোয়াই তপেশ কমিটেড স্যুইসাইড? কেন সে অমন নার্ভাস হয়ে আত্মহত্যা করে বসল?

ব্ল্যাকমেইল করার পুঁজি হারিয়ে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

হুঁ ভয়। কিন্তু–

কোনো কিন্তু নেই। এবার তাকে খুনী সহজেই বাগে পেত। ব্ল্যাকমেইলিং এর শাস্তি দিত।

অরিজিৎ! হেয়ার ইজ দা মিস্ট্রি। এখানেই এ কেসের ভাইটাল পয়েন্ট।

অরিজিৎ হাসতে লাগলেন। আমি বরাবর দেখেছি, আপনি তিলকে তার করে দেখেন। অ্যান্ড উই আর ফোর্সড় টু চেইজ এ রেড হেরিং! বয়স হয়েছে–এখনও এসব ব্যাপারে আপনার আগ্রহ দেখে সত্যি অবাক হয়ে যাই। আপনার বয়সে আমি কিন্তু ধর্মকর্ম নিয়ে থাকব-আই অ্যাসিওর ইউ।

অরিজিৎ কফি শেষ করে উঠে পড়লেন। কর্নেল তাকে তপেশ বসাক নামের ব্যাংক অ্যাকউন্টের কথাটা মনে করিয়ে দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ চোখ বুজে হেলান দিয়ে চুরুট টানতে থাকলেন।

সওয়া পাঁচটা বাজে। এখনই কলকাতা ধোঁয়াশা ভরা সন্ধ্যায় আচ্ছন্ন। কর্নেল উঠে পড়লেন। ঝাকে ঝুঁকে প্রশ্ন তাকে আক্রমণ করেছে। অরিজিৎ লাহিড়ীর তথ্যগুলো থেকে প্রশ্ন উঠে আসছে–মাংসের পিণ্ডে যেমন মাছির ঝাঁক ভনভন করে, সেইরকম একটা শব্দ যেন।…

০৬. এক যুবতীর বৈধব্য

লাল ল্যান্ডরোভার গাড়িটি জ্যামে আটকে যাচ্ছিল বার বার। গতি উত্তরে। কর্নেল বিডন স্ট্রিটের কাছে পৌঁছে বাঁ হাতে জ্যাকেটের ভেতর থেকে ছোট্ট নোট বই বের করে ঠিকানাটি দেখে নিলেন। হাথিয়াগড়ে প্রিয়দর্শী হোটেলে তপেশের লেখা ঠিকানা : সুশোভন রায়, ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন। কলকাতা-৬।

একজন লোককে গলিটার কথা জিজ্ঞেস করলে বাৎলে দিল। গলিটা ঘিঞ্জি নয়। ৫/১ নম্বরে একতালা একটা বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়লে এক প্রৌঢ়া উঁকি দিলেন। কর্নেলকে দেখে একটু হকচকিয়েই গেলেন যেন। তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, এখানে কি সুশোভন রায় নামে কেউ থাকেন?

প্রৌঢ়া চমকে উঠলেন। তারপর ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। কর্নেলের মনে হলো, আচমকা একটা জোর ধাক্কা খেয়েছেন ভদ্রমহিলা। কর্নেল একটু হেসে বললেন, সুশোভন সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

প্রৌঢ়া কাঁপা কাঁপা স্বরে কষ্টে বললেন, কী কথা?

এ ভাবে তো বলা যাবে না। একটা বসা দরকার।

প্রৌঢ়ার পেছনে একটি যুবতী এসে দাঁড়াল। আস্তে বলল, মা, ওঁকে আসতে দাও।

প্রৌঢ়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তাঁকে যুবতীটি ঠেলে ভেতরের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এল। বলল, আপনি ভেতরে আসুন।

ঘরে শুধু একটা জীর্ণ টেবিল, তাকে কিছু বই, দুটো নড়বড়ে চেয়ার এবং একপাশে একটা তক্তাপোশ। গুটোনো বিছানা। কর্নেল চেয়ারে বসলে যুবতী দরজা বন্ধ করে দিল।

এবার কর্নেলের মনে হলো, একে, কোথায় যেন দেখেছেন। হুঁ, অরিজিৎ লাহিড়ী তপেশের বিছানার তলায় যে মেয়েটির ছবি পেয়েছেন, সেই বটে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক চোখে, কিন্তু মুখের ভাবে বিষাদ আছে। কষ্টের ছাপ আছে। কর্নেল বললেন, সুশোভন–

বাধা দিয়ে যুবতী বলল, আপনি কি পুলিশ অফিসার?

কর্নেল হাসলেন।…মোটেও না। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

যুবতীর মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না দেখে কর্নেল বুঝলেন সে এই নামটির সঙ্গে পরিচিত নয়। সে বলল, কী কথা আছে দাদার সম্পর্কে?

বলছি। সুশোভনবাবু কি বেরিয়েছেন কোথাও?

যুবতীর মুখে কষ্টের ভাব ফুটে উঠল। আস্তে বলল, দাদাকে আপনি চিনতেন?

না।

দাদা নাইনটিন সেভেনটির জুন মাসে মারা গেছে।

মাই গড! কর্নেল চমকে উঠলেন। মারা গেছেন? অসুখ হয়েছিল। নাকি–

দাদাকে কারা খুন করেছিল। হাসপাতালে-হাসপাতালে খুঁজে শেষে নীলরতননের মর্গে দাদার বডি দেখতে পাই।

পিঠে স্ট্যাব করা হয়েছিল কি? বডি নেকেড অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল?

যুবতী চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর বলল, আপনি তাহলে পুলিস অফিসার।

কর্নেল একটু হাসলেন।…না।

তাহলে কেমন করে জানলেন—

এক মিনিট। তুমি বলছি, রাগ কোরো না। তোমার নাম?

কেয়া রায়।

কেয়া, এই আমার পরিচয়। বলে কর্নেল তাকে তার কার্ড দিলেন।

কেয়া কার্ডটি দেখে নিয়ে তাকাল। ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আপনি দাদার সম্পর্কে কী ইনভেস্টিগেট করছেন?

কর্নেল সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, কেয়া, তুমি তপেশ বসাক নামে কাউকে চেনো?

কেয়ার চোখে আবার চমক খেলল। আবার ঠোঁট কামড়ে ধরল। তার ধরা গলায় বলল, না। কে তপেশ? ও নামে কাউকে চিনি না।

আজকের কাগজে তার ছবি বেরিয়েছে। বিহারের হাথিয়াগড় হোটেলে সে মুখে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে সুইসাইড করেছে।

কেয়া মুখ নামাল। চল্লিশ ওয়াটের নিষ্প্রভ আলোয় কর্নেল লক্ষ্য করলেন, তার পায়ের নিচে শাড়ির পাড় কঁপছে। কর্নেল আস্তে অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন, আমি তোমার দাদার খুনীদের ধরিয়ে দিতে চাই, কেয়া। প্লিজ হেল্প মি!

কেয়া মুখ তুলল। ভিজে চোখ।

তপেশের আসল নাম কী ছিল, কেয়া?

জানি না।

তুমি জানো! কারণ তপেশের ঘরে তোমার ছবি খুঁজে পাওয়া গেছে।

কেয়া দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। তারপর চেয়ারে বসে পড়ল। একটু পরে সে আত্মসম্বরণ করে মুখ তুলল। শাড়িতে চোখ মুছে বলল, আমি মিথ্যা বলিনি। ওকে আমি তপেশ নামেই জানতাম। তবে দাদা বলত, ওর নাকি আরও কিছ ছদ্মনাম আছে, তখন আমার বয়স সতের-আঠারো মোটে। এ নিয়ে প্রশ্ন করার কথা মাথায় আসত না। পরে–মানে, দাদার মৃত্যুর বছর তিন-চার বাদে ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমি ওকে তপেশ বলেই জানতাম।

কিছু মনে কোরো না ডার্লিং-তুমি তপেশকে ভালবাসতে?

কেয়া চুপ করে রইল। তোমরা কি বিয়ে করেছিলে?

কেয়া মাথাটা একটু দোলাল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, মা ওকে পছন্দ করতেন না। তা ছাড়া দাদার খুন হওয়ার পিছনে তপেশের হাত আছে বলে সন্দেহ করতেন। তাই মাকে জানাইনি।

গোপনে রেজেস্ট্রি ম্যারেজ হয়েছিল?

হুঁ।

তোমার বাবা বেঁচে নেই?

আমার দুবছর বয়সে বাবা মারা যান।

এটা কি তোমাদের নিজের বাড়ি?

না ভাড়ার। তবে—

বলো!

লেকটাউনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। আগামী মাসে সেখানে চলে যাব আমরা।

তুমি কি চাকরি কর?

করি।

কোথায়?

কেয়ার ভিজে চোখ জ্বলে উঠল।…বাবা আমার বিয়ের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডে আর এল আই সিতে পলিসি করে টাকা রেখে গিয়েছিলেন। মায়ের গয়না ছিল। টুরুম ফ্ল্যাট কেনা কি অসম্ভব?

কর্নেল হাসলেন, সরি! সে উদ্দেশ্যে কিছু জিগ্যেস করিনি ডার্লিং! জাস্ট কৌতূহল। বাই দা বাই, তুমি শ্যামলকান্তি মজুমদার নামে কাউকে চেনো?

কেয়া শক্ত গলায় বলল, না।

সুভদ্র সিং নামে কাউকে?

না।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এই শোকদুঃখের সময় তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, কেয়া! আচ্ছা, চলি।

কেয়া বলল, এসব ব্যাপারে আপনি জানতে এসেছেন কেন, বলবেন কি?

পরে যথাসময়ে যোগাযোগ করব। বলে কর্নেল নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।…

০৭. এক খেয়ালি চিত্রকর

লাল ল্যান্ডরোভার গাড়িটার গতি এবার দক্ষিণে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজে। আবার মাঝেমাঝে জ্যাম। গে ক্লাবের কাছে পৌঁছাতে একঘণ্টা লেগে গেল। গেটের সামনে দুদিকে পার্ক করা উজ্জ্বল গাড়ির ঝক। বোঝা যায়, ক্লাবটি বিত্তবানদের সান্ধ্য আড্ডার ডেরা। আরও কিছু ক্লাব লেকের আনাচে-কানাচেয় ইংরেজ আমল থেকেই আছে। তবে গে ক্লাবের বয়স বেশি নয়। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, এমন সব লোকের অবসর বিনোদনের ব্যবস্থা। কর্নেলকে গাড়ি পার্ক করতে একটু ঝামেলা পোহাতেই হলো। শীতের সন্ধ্যায় ক্লাবের সব মেম্বারই আজ এসে জুটেছেন, তার প্রমাণ পার্ক করা ঝকঝকে গাড়ির সার ক্লাবের ভেতরকার অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বিশাল টেন্টের গড়ন ক্লাবঘরের ভেতর ভিড়, চাপা কোলাহল, টেবিল ঘিরে। স্ত্রী-পুরুষের আঁক। হাতে-হাতে রঙিন পানীয় ভরা গেলাস। নানাবয়সী। স্ত্রীলোকগুলিকে রঙকরা প্রতিমা দেখাচ্ছিল। ইতস্তত কিছু সায়েব-মেমসায়েব চোখে পড়ল। সম্ভবত এ শহরে তারা নবাগত এবং এখনও এটাই রেওয়া

যে ইউরোপীয়রা এলেই ঝাঁকে ঝাকে বন্ধু ও খিদমতগার জুটে যায়। কর্নেল শ্যামলকান্তিকে খুঁজছিলেন। ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি। কলোনিয়াল হ্যাংওভার একেই বলে। এইসব ইউরোপীয় হয়তো স্বদেশে নিতান্ত সাধারণ জন, কিন্তু এদেশে তারা ভি আই পি!

বাইরে বাগানে মৃদু আলোয় ইতস্তত রঙিন ছাতার তলাতেও ঝক ঝক মানুষ। সবাই নিশ্চয় মেম্বার নন। অতিথি-অভ্যাগতের সংখ্যাই বেশি। নিজেদের হাই সোসাইটিকালচার দেখাতে মেম্বাররা ডেকে এনেছেন। এটাই নিয়ম। নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য অন্যকে না দেখালে জীবন ও রোজগার নিরর্থক ঠেকে।

কিন্তু কোথায় শ্যামলকান্তি? তন্নতন্ন খুঁজে তার পাত্তা পেলেন না কর্নেল। তাকে কেউ লক্ষ্য করছিল না। করার কথাও নয়। অগত্যা একজন পরিচারককে জিজ্ঞেস করলেন শ্যামলকান্তির কথা। সে কর্নেলকে দেখেই সসম্ভ্রমে সেলাম ঠুকেছিল। তাগড়াই, স্মার্ট, এই দাড়িওয়ালা ও টুপিপরা বৃদ্ধের চেহারায় ইউরোপীয় আদল এবং ভঙ্গি আছে। সে বলল, মজুমদারসাব সামকো আয়া। লেকিন থাড়াসা বাদ চলা গেয়া স্যার! ঠারিয়ে, হাম পুছকে আতা!

একটু পরে সে কাউন্টারের দিক থেকে ফিরে এসে বলল, মজুমদারসাব, বালকে গেয়া, কৈ মেরে লিয়ে আয়ে নে উনিকো বোল দেনা চৌদ্দ নাম্বার গাখেল পার্কমে মুখুর্জি সাবকা কোঠি চলা যাইয়ে।

চোদ্দ নম্বর গোখেল পার্ক। মুখার্জিসায়েব। নিশ্চয় গে ক্লাবের মেম্বার। পরিচারিকাটির বলার ভঙ্গি দেখে সেটা বোঝা গেছে। রাস্তাটা এখান থেকে তত দূরে নয়। পৌঁছুতে মিনিট পাঁচেক লাগল। বাড়িটা নতুন। গেটে দারোয়ান আছে। ভেতরে লন, বাগিচা ও গাড়ি পার্ক করার জায়গা আছে। গেটের পাশে লেখা আছে প্রিয়তমা। নামটা সুন্দর। কিন্তু চারতলা ছিমছাম আধুনিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি বাড়িটা একজনের নয় বলে মনে হলো কর্নেলের। অনেকগুলি ফ্যাট আছে।

ভেতরে গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে গেলেন কর্নেল। এক ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। থমকে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন, মিঃ মুখার্জি।

ভদ্রমহিলা নিঃশব্দে পাশের দেয়ালে লেটারবক্সের দিকে আঙুল তুলে কর্নেলকে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলেন। মনে হলো, মুখার্জি ভদ্রলোককে তিনি পছন্দ করেন না যেন। শুধু তাই নয়, এ বাড়ির সব আগন্তুক সম্পর্কে ওঁর ভুরুকোঁচকানো প্রশ্ন আছে। কর্নেল সিদ্ধান্ত করলেন, মুখার্জি এ বাড়িতে সম্ভবত অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এবং প্রচুর অবাঞ্ছিত লোকজন তার কাছে আসেন!

লেটার বক্সে বিচিত্র ও ছন্দোবদ্ধ রেখায় লেখা আছে : বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনতলা, ৪। তলায় একটা খুদে রঙিন ছবি। মুখের ছবি বলে মনে হয়। বিমূর্ত। ভদ্রলোক কি চিত্রকর?

চিত্রকর। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। বেঁটে, রোগাটে গড়ন। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মাথায় এলোমেলো একরাশ চুল। গোঁফ-দাড়ি আছে। পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে। একটা দিশি চিত্রিত কথার মতো চাঁদর গায়ে কোনোমতে জড়ানো। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন! কী সেবা করতে পারি।

কর্নেল বললেন, আপনি পেইন্টার?

চিত্রকর।

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ, চিত্রকর। তো শ্যামলকান্তি মজুমদার নামে এক ভদ্রলোক–

ও একটা হারামজাদা! বিমলবাবু কুদ্ধস্বরে বললেন! কথা দিয়ে কথা রাখে না। ওকে বিশ্বাস করবেন না।

কর্নেল বুঝলেন, শ্যামলকান্তি এখানে নেই। বললেন, আমি নিজের একটা পোট্রেট আঁকাতে চাই। তো শ্যামলবাবু–

ঠোঁটে আঙুল লম্বালম্বি রেখে বিমলবাবু বললেন, শ্‌-শ্‌-শ্‌! ও একটা শুওরের বাচ্চা।

আপনি কি ভেতরে যেতে দেবেন না আমাকে?

বিমলবাবু হাসলেন। ওরে বাবা! আপনি খদ্দের, মা লক্ষ্মী। আসুন আসন। তবে শ্যামলের কথা নয়। ও এক বিপজ্জনক প্রাণী।

ঘরটি বড়ো। স্টুডিও। এখানে-ওখানে ডাই করা ক্যানভাস–ফ্রেমে বাঁধানো। দেয়াল, মেঝে সবখানে শুধু ছবি। অসংখ্য ছবি। বিমূর্ত। একপাশে সোফাসেট। সেখানেও ছবির গাদা। বিমলবাবু ছবি সরিয়ে বললেন, বসুন। তারপর কথা হচ্ছে।

হুঁ, বিমলকুমার নেশাগ্রস্ত। এককোণে উঁচু টুলের ওপর মদের গেলাস। গিয়ে এক চুমুক টেনে কর্নেলের দিকে ঘুরে হঠাৎ খি খি করে হাসলেন।…আপনি আমার বাপের বয়সী। কিছু মনে করবেন না মশাই! ওই যে কিসব বলে লোকে-সামাজিক নীতিবোধ, মূল্যবোধ-টোধ–ওসব আমার সয় না। ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি-স্বাধীন হয়ে জন্মায়। কিন্তু স্বাধীন হয়ে বাঁচতে বা মরতে পারে না। তাকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে এবং মরতে দেওয়া উচিত নয় কি?

অবশ্যই। বলে কর্নেল টুপি খুলে ফেললেন। চুরুট ধরালেন। অ্যাশট্রে আছে নিচু টেবিলটাতে।

বিমলকুমার খুশি হয়ে আরেক চুমুক গিলে কাছে এলেন।… আপনাকে দাদা বলি বরং!

বলুন না!

বিমলকুমার পাশে বসে পড়লেন।…দাদা, আপনার চেহারা ক্রিসমাসের সান্তা ক্লজের মতো। শুধু একটাই গণ্ডগোলসান্তা ক্লজের টাক নেই। আপনার আছে। সো হোয়াট? টাক নেই তো নেই। যাদের টাক নেই, তারা কি কষ্টে আছে? আমারও টাক নেই। আমি কি কষ্টে আছি? কক্ষনো না। আ হ্যাঁপি লাইফ!

কর্নেলের দৃষ্টি ছবিগুলোর দিকে। একটা ছবি দেখে চমকে উঠলেন। ছবিটা প্রকাণ্ড ক্যানভাসে আঁকা এবং তেলরঙা। বিমূর্ত আকার। কিন্তু একজন মানুষই বটে। একটু লক্ষ্য করার পর শিউরে উঠলেন। পিঠের ওপর ওটা কি ছোরার বাঁট? হুঁ–বিমূর্ত আকৃতির মানুষটি ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। পুতুলের মতো দুটো প্রকাণ্ড চোখের আদল–তাতে বিস্ময়ের ঝলক রঙের তীব্রতায় ছড়িয়ে পড়েছে।

বিমলকুমার অনর্গল অসম্বদ্ধ কথা বলছেন। কর্নেল ছবিটা সম্পর্কে প্রশ্ন . করতে যাচ্ছেন, কলিং বেল বাজল। অমনি বিমলকুমার মদের গেলাসটা সোফার তলায় রেখে ঠোঁটে আঙুল লম্বালম্বি তুলে কর্নেলকে আগের মতো বললেন,– শ্‌-শ্‌! তারপর গিয়ে দরজা খুললেন।

তার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন শ্যামলকান্তি মজুমদার আর সুভদ্র সিং!

ঢুকেই দুজনে কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর শ্যামলকান্তি সহাস্যে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাল্লো কর্নেল!

কর্নেল কিছু বলার আগে বিমলকুমার জড়ানো গলায় বললেন, কর্নেল! ওরে বাবা! মিলিটারির লোক আমার ঘরে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! কেন বাবা? এখানে আবার মিলিটারি কেন?

শ্যামলকান্তি তাকে ধমক দিলেন, শাট আপ! উনি কে জানিস ব্যাটা?

তারপর জানালার পাশে টেবিলে সারবন্দি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ঠেলে সেখানে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলেন। সুভদ্র একটু ইতস্তত করে সোফায় বসল। বিমলকুমার দাঁড়িয়ে আছে। রাগী দৃষ্টি শ্যামলকান্তির দিকে বললেন, কটায় আসার কথা ছিল তোর? রাস্কেল!

শ্যামলকান্তি জিভ কেটে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ছিঃ বিমল! কী হচ্ছে? উনি কে–

উনি আমার দাদা! সান্তা ক্লজদা! বিমলকুমার সোফার তলা থেকে সেই গেলাসটা বের করে চুমুক দিলেন। তারপর ফের বললেন, তাদের জন্য কষ্ট করে খাঁটি ভোদকা সংগ্রহ করলুম। আর তোরা আসতে আসতে রাত পুইয়ে দিলি! তবে হ্যাঁ–আমি এককথার লোক। ছিপি খুলিনি। এটা কী খাচ্ছি। বল্ তো? মহুয়া! ঘাটশিলা থেকে পাঁচ বোতল এনে রেখেছি। আমি বাবা রুশপন্থী নই। ভোদকাতে নেই। আমি বরাবর লিন পিয়াওপন্থী। তোরা তো জানিস–

সুভদ্র রেগে গেল…বিমল! ইউ আর ড্রাংক! ডোন্ট টক।

বিমলকুমার হাসতে হাসতে পাশের ঘরে ঢুকলেন পর্দা তুলে। শ্যামলকান্তিকে এবার গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন, কর্নেল সায়েবকে এখানে দেখে একটু অবাক হয়েছি!

কর্নেল বললেন, গে ক্লাবে আপনার খোঁজে গিয়েছিলুম। শুনলুম, আপনি এখানে আছেন।

আমার খোঁজে কেন জানতে পারি?

কিছু প্রশ্ন ছিল।

বেশ তো! বলুন।

কর্নেল লক্ষ্য করলেন শ্যামলকান্তির চেহারার সেই আমায়িকতা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। আর সুভদ্রেরও চেহারায় অনুরূপ একটা বৈপরীত্য ফুটে উঠছে। হিংস্র ও খাঁচায় ভরা চিতাবাঘের চাঞ্চল্য যেমন। সে কর্নেলের বাঁদিকে এক মিটার দূরে বসে আছে। কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চুরুট বের করলেন। আগেরটা অ্যাসট্রেতে দুমড়ে নিভিয়ে গুঁজে দিলেন। পকেটে হাত ঢোকানোর সময় তার চোখ দুজনকে লক্ষ্য করছিল। ওরা পরস্পর তাকিয়ে যেন কিছু বলল। নাকি দৃষ্টির ভুল কর্নেলের?

চুরুট জ্বেলে বললেন, শ্যামলবাবু! আপনি কি সুশোভন রায় নামে কাউকে চেনেন–আই মিন, চিনতেন?

হু ইজ হি?

বিডন স্ট্রিট এলাকায় গোবিন্দ নস্কর লেনে থাকত।

শ্যামলকান্তি মাথা দুলিয়ে বললেন, না। ও নামে কাউকে চিনতুম না বা এখনও চিনি না।

কেয়া রায়কে?

শ্যামলকান্তি হেসে উঠলেন। অ্যাবসার্ড প্রশ্ন! আপনি গোয়েন্দাগিরি করেন আমি জানি। কিন্তু এক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি ভুল রাস্তায় হাঁটছেন। আপনার বয়সই এজন্য দায়ী, কর্নেল! আপনার মধ্যে সেনিলিটি এসে গেছে। সর্বত্র দুইয়ে-দুইয়ে চার হয় না। তাছাড়া–

বিমলকুমার বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে। হাতে ভোদকার সাদা বোতল, বগলে একটা জলের বোতল এবং অন্য হাতে কয়েকটা গ্লাস। নিচু টেবিলে রেখে বললেন, আয় শ্যামলদা! সান্তা ক্লজদার স্বাস্থ্যপান করা যাক।

শ্যামলকান্তি জের টেনে বললেন, তাছাড়া রিয়েলিটিও দ্রুত বদলাচ্ছে। আপনার বোধবুদ্ধি–প্লিজ এক্সকিউজ মি ফর দা কমেন্ট আপনার বোধবুদ্ধি আটকে আছে পুরনো রিয়েলিটিজে। রিয়েলিটি বদলাচ্ছে বলেই সিচুয়েশন বদলাচ্ছে। দশ বছর আগে যা সত্য ছিল, এখন তা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে।

বিমলকুমার খাপ্পা হয়ে বললেন, কী সারগর্ভ তত্ত্ব আওড়াচ্ছিস শ্যামলদা? শ্‌-শ্‌-শ্‌! আয়, ছিপি খুলে খা। হ্যাঁ–সান্তা ক্লজদা, আপনি কি যেন আঁকার বলছিলেন?

কর্নেল বললেন, পোট্রেট।

বিমল! হি ইজ আ ডিটেকটিভ! শ্যামলকান্তি এগিয়ে এলেন।

বিমলকুমার ভুরু কুঁচকে বললেন, ডিটেকটিভ! সে তো বইয়ে থাকে, বাবা! বইয়ের পাতা থেকে পোকা বেরুতে দেখেছি। কিন্তু ডিটেকটিভ—ইমপসিব্‌ল!

শ্যামলকান্তি মুখোমুখি সোফায় বসে বোতলটির ছিপি খুললেন। একটা গ্লাসে খানিকটা ঢেলে কর্নেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন, থ্যাংকস!

শ্যামলকান্তি গেলাসটাতে জল মিশিয়ে সুভদ্রকে দিলেন। আর একটা গেলাসে ঢেলে নিয়ে জলের বোতল থেকে জল মেশালেন। সুভদ্রের গেলাসে নিজের গেলাস ঠেকিয়ে বললেন, চিয়ার্স!

এইসময় পাশের ঘরে ফোন বাজল। বিমলকুমার টলতে টলতে ফোন ধরতে ঘরে ঢুকলেন। শ্যামলকান্তি ভোদকায় চুমুক দিয়ে বললেন, বাপ! ডেঞ্জারাস জিনিস! গলায় ড্যাগার ঢুকে গেল যেন।

কর্নেল বললেন, মোতিগঞ্জে কেন গিয়েছিলেন শ্যামলবাবু?

বিজনেসের জন্য।

তপেশের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল কি?

হু ইজ হি?

হাথিয়াগড়ের প্রিয়দর্শী হোটেলে যে সুইসাইড করেছে।

শ্যামলকান্তি হাসলেন।…চেইজিং আফটার আ রেড হেরিং!

সুভদ্র ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ইউ ওল্ডম্যান! ডোন্ট স্পয়েল দা প্লেজার!

কিসের প্লেজার, সুভদ্রবাবু?

সুভদ্রকে থামিয়ে শ্যামলকান্তি বললেন, এসব ব্যাপারে নাক নাই বা গলালেন, কর্নেল? এনাফ অফ ইট। আমার মনে হয়, আপনার আর এখানে না থাকাই উচিত। তবে অফ কোর্স, কিসের প্লেজার জেনে যান। অনেকদিন পরে বন্ধুরা একত্র হলে যা হয়, ঠিক তাই। সুভদ্রের অনারে–স্পেশ্যালি। ডু ইয়ু আন্ডারস্ট্যান্ড?

বিমলকুমার পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে বলল, সৌম্য তোর সঙ্গে কথা বলবে শ্যামলদা! ও আসতে পারছে না। বড় আটকেছে মনে হলো! শালা! মানুষ কেন যে বউ পোষে! পয়সা দিয়ে যা কেনা যায়, তার জন্য সরি কান্তা ক্লজদা! শ্‌-শ্‌-শ্‌!

শ্যামলকান্তি গেলাস রেখে উঠে গেলেন। সুভদ্র আস্তে কর্নেলের উদ্দেশে বলল, নাও ইউ গো!

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বিমলকুমার জড়ানো গলায় বললেন, হ্যাঁগো করুন সান্তা ক্লজদা। দিনে আসুন। তখন আমি চিত্রকর থাকি। এখন আমি সত্যিই ড্রাংক। রাত যতই বাড়ব, আরও ড্রাংক হব।…

০৮. আবার এক সেকেন্ডের জন্য

মিটমিটে হয়ে গেছে রাস্তার বাতিগুলো, কুয়াশা না ধোঁয়াশা এত গাঢ়। লাল ল্যান্ডরোভার আস্তে এগোচ্ছিল শরৎ বোস রোড ধরে। সত্যিই কি আলেয়ার পেছনে দৌড়চ্ছেন? কর্নেল ভাবছিলেন। কিন্তু বারবার মনে ভেসে উঠছিল বিমলকুমারের ঘরে দেখা প্রকাণ্ড চৌকো ক্যানভাসে আঁকা বিমূর্ত ছবিটা। ছোরাবিদ্ধ মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়া, দু চোখে বিস্ময়।

নাকি ছবিটাতে ভুল দেখা দেখেছেন? বিমূর্ত চিত্রকলা বড় গোলমেলে। সাপ দেখতে ব্যাং দেখা যায়। দ্রষ্টার নিজের মনের চিন্তাভাবনা, অবচেতন কোনো ধারণা সবসময় কোনো বিমূর্ত চিত্রকলায় প্রতিফলিত হতে পারে, এও সত্য। দেখছি একটা মানুষ অথচ চিত্রকর মানুষই আঁকেননি আদতে। এঁকেছেন হয়তো নিজেরই টুকরো-টুকরো ভাবনা দিয়ে অন্য কিছু। কিংবা নিছক রঙের ছোপে অর্থহীন উদ্ভট যা-খুশি এঁকেছেন। একবার ইউরোপে কোন বিমূর্ত চিত্র প্রদর্শনীতে শিম্পাঞ্জির আঁকা ছবি নাকি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল!

কর্নেল হাসলেন। বিমূর্ত চিত্রকলার মধ্যে চালাকিও থাকে বৈকি! যে সঠিকভাবে একটা দেশলাই আঁকতে পারে না, সেও সহজে বিমূর্ত চিত্র এঁকে আজকাল তাক লাগিয়ে দেয়। কট্টর কলা-সমালোচকও মনের মাধুরী মিশিয়ে সেটি দেখে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হন।

হুঁ, টেকনিকাল বিচার বলে একটা কথা আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, কোনো রীতির কাঠামো তৈরি হয়ে গেলে সেই কাঠামোর অনুকরণ সহজ হয়ে যায়। কবিতায় যেমনটি হয়েছে। একটা স্ট্রাকচার তৈরি হয়ে গেছে। এখন তার নকল করে অসম্বন্ধ শব্দের আঁক সাজিয়ে তোলা স্কুলের বালকের পক্ষেও সহজ।

সত্যিই কি ছোরাবিদ্ধ মানুষের ছবি দেখেছেন বিমলকুমারের ঘরে? আবার একবার যাওয়া দরকার ওখানে। দিনের বেলায় গিয়ে ভাল করে দেখতে হবে এবং চিত্রকরের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে ওটা কিসের ছবি।

সার্কুলার রোডে ঢুকলে ব্যাকভিউ মিররে চোখ রেখে একটু নড়ে বসলেন কর্নেল। তাঁর এক মন চিন্তা করে, অন্য মন চারদিকে লক্ষ্য রাখে। এটা অভ্যাসের ব্যাপার। দেশপ্রিয় পার্কের ওখান থেকে একটা জিপ তার পেছনে আসছে। সার্কুলার রোডেও সেটা তাঁর অনুগামী। বাঁদিকে না ঘুরে সোজা সার্কাস এভিনিউতে ঢুকলেন। দুধারে ঘন গাছ। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো ঢাকা পড়েছে। রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে আছে প্রায়।

এবার দেখলেন পেছনের গাড়িটা গতি বাড়িয়েছে। কামানের একজোড়া গোলার মত হেডলাইট দেখতে দেখতে মুহূর্তে কাছে এসে পড়ল। ইনটুইশন! দ্রুত গিয়ার চেঞ্জ করে অ্যাকসিলেটরে চাপ দিয়ে ল্যান্ডরোভার বাঁদিকের গলিতে ঢুকিয়ে দিলেন। জিপ গাড়িটা পিছলে সোজা চলে গেল। মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য প্রচণ্ড দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেল লাল ল্যান্ডরোভার।

০৯. তুরুপের তাসের খেলা

ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর ফোন এল রাত পৌনে এগারোটায়। …কর্নেল! কী ব্যাপার?

কর্নেল বললেন, তুমি বাড়ি থেকে ফোন করছ নিশ্চয়!

হ্যাঁ। অফিসে গিয়ে শুনলুম আপনি রিং করেছিলেন। তখন ভীষণ টায়ার্ড। তাই ঠিক করলুম বাড়ি ফিরে আপনাকে ঘুম থেকে ওঠাব।

অরিজিতের হাসি ভেসে এল। কর্নেল হাসলেন না। বললেন, তোমার অপেক্ষা করছিলুম। তাছাড়া বারোটার আগে আমি ঘুমোইনে।

হ্যাঁ, বলুন!

রক্তমাখা জামাকাপড়ের মালিককে হয়তো খুঁজে বের করেছি।

মরেনি সে?

অরিজিৎ হাসছিল। কর্নেল বললেন, তুমি এই কেসটাকে গুরুত্ব দিচ্ছ না ডার্লিং!

কর্নেল, বর্তমান নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে যে, অতীত নিয়ে ঝামেলা পাকাতে তার ফুরসত কোথায়?

সেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগাযোগ রয়ে গেছে, অরিজিৎ! রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি পড়োনি? অতীত বর্তমানের মধ্যেও গোপনে-গোপনে কাজ করে?

আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে বলি? আপনি একজনের আত্মহত্যার নিমিত্ত হয়েছেন বলে প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছেন, কর্নেল!

দ্যাটস রাইট। তবে ওই যে বললাম, অতীত বর্তমানের ভেতর কাজ করে। করছে। বাই দা বাই, তোমাকে সুশোভন রায়ের ঠিকানা দিয়েছিলুম। ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন। দশ বছর আগে কে বা কারা তাকে খুন করেছিল। তার বোনের নাম কেয়া। ওর মা বেঁচে আছেন। দুজনকে দিয়ে রক্তমাখা প্যান্ট-শার্ট সোয়েটার সনাক্ত করানো দরকার।

মাই গুডনেস!

তথাকথিত তপেশ–যে হাথিয়াগড়ে সুইসাইড করেছে, সে ছিল কেয়ার দাদা সুশোভনের বন্ধু। কেয়ার সঙ্গে তার গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছিল। সুতরাং কেয়া এখন বিধবা।

এরকম ট্রাজেডি সবসময় ঘটছে। যাই হোক, সকালে ওদের মা-মেয়েকে নিয়ে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে যাব। আর কিছু?

সুশোভন সম্পর্কে পুলিশ রেকর্ডে কী আছে, খুঁজে বের করা দরকার। কেয়া ও তার মায়ের কাছে সুশোভন খুন হওয়ার দিন তারিখ পেয়ে যাবে।

এনিথিং মোর।

আপাতত এই।…

কর্নেল ফোন রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ ফোন থেকে হাত তুললেন না। হুঁ—

আর একটা কী যেন বলার কথা ছিল, অন্যমনস্কতায় ভুলে গেছেন। জীবনে কখনও এমন বিষাদগ্রস্ত আর অন্যমনস্ক হননি কর্নেল। চিরকাল হাসিখুশি মানুষ। রসিকতায় ফেটে পড়েন একটুতেই। অথচ গভীর অপরাধবোধ তার বুকে চেপে বসেছে। কেন যে নাক গলাতে গেলেন তপেশের ব্যাপারে? দশ হাজার টাকার নোট কেউ বুকপোস্টে পাঠাচ্ছে, সে নিষিদ্ধ মাদকের চোরাকারবারি হবেই তার মানে কী? অথচ তার হাতের স্যুটকেসটি এবং টাকা পাঠানোর অদ্ভুত ব্যবস্থা তাঁকে গণ্ডগোলে ফেলে দিয়েছিল। বরং স্যুটকেসটি না বদলে তার সঙ্গে ভাব জমাতে পারতেন। সহজে ভাব জমানোর ক্ষমতা তো তার আছে। তা না করে তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিলেন

কিন্তু এখানেই আবার বড় খটকা। একটা খুনের প্রমাণ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সে এবং সেটা হাতছাড়া হওয়াই কি শুধু তার আত্মহত্যার কারণ?

তারপর শ্যামলকান্তি মজুমদারের প্রপাতের ধারে অতর্কিত ধাক্কা, বিমলকুমারের আঁকা বিমূর্ত ছবিটা, এবং এ রাতে সার্কাস এভেনিউতে একটা জিপগাড়ির যেন তাড়া করে আসা…

এগুলো তাঁর নিজেরই দেখার ভুল কি না? দিনশেষের আবছা আলোয় পায়ের কাছে বাঁকা লতা থেকে শ্যামলকান্তি সাপ ভেবে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতেও পারেন। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিমূর্ত ছবিটা…

নাঃ! চিন্তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিরক্ত কর্নেল ফোনের কাছ থেকে উঠে গেলেন। বুক কেসের সামনে একটু দাঁড়ালেন। কিছু বই পড়তে ইচ্ছে করছে না। বাতি নিভিয়ে বেড রুমে গিয়ে ঢুকলেন। শুয়ে পড়লেন।

সকালে অভ্যাসমতো ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমে এলেন। কাগজ পড়তে পড়তে কফি খেলেন। কাগজে তপেশসংক্রান্ত কোনো খবর নেই। না থাকারই কথা। তবু যেন কিছু খবর আশা করেছিলেন। এও মনের ভুল। এই কেসটা তাকে ক্রমশ যেন বিমলকুমারের আঁকা বিমূর্ত চিত্রকলার জগতে টেনে নিয়ে চলেছে দুর্বোধ্য একটা পরিপ্রেক্ষিতে।

দশটায় বেরিয়ে পড়লেন গাড়ি নিয়ে। ব্র্যাবোর্ন রোডে পারিজাত ট্রান্সপোর্টের হেড অফিস। দশতলা একটা বাড়ির পাঁচতলায় অফিসটা। কার্ড পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ডাক এল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পরিতোষ ব্যানার্জির চেম্বার থেকে। পরিতোষবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রাশভারি চেহারা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। নাদুসনুদুস গড়ন। অনবরত পান খাবার অভ্যাস। কর্নেলকে বসিয়ে করজোড়ে বললেন, বলুন স্যার, কী করতে পারি আপনার জন্য।

তপেশ বসাক—

পরিতোষবাবু নড়ে বসলেন।…ও হ্যাঁ। কাল আমি ছিলুম না। এইমাত্র এসে। শুনলুম, পুলিশ এসে তপেশের খোঁজখবর করেছে। ওর আইডেন্টিটি কার্ডে নাকি অন্য লোকের ছবি আছে। আমি তো স্যার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি নে। এবার আপনি এসেছেন–প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লেখা আছে আপনার কার্ডে।

কী ব্যাপার বলুন তো? কিসের ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে তপেশের নামে? সে তো খুব ভাল লোক ছিল। অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী।

ছিল–মানে এখন নেই উনি?

পরিতোষবাবু বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তলায় টিনের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে মুখ থেকে পানের গুঁড়ো ফেলে বললেন, তপেশ বছর পাঁচেক আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। কোম্পানি ওর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেনি।

তখন তার বয়স কত ছিল?

তা পঁচিশ-পঁচিশ হবে।

ওঁর কোনো ছবি আছে আপনাদের অফিসে?

পরিতোষবাবু হাসলেন।..ছবি রাখার প্রশ্ন ওঠে না। সে নিতান্ত রিপ্রেজেনটেটিভ ছিল। বাইরে টাকাপয়সা আদায়ে যেত। তাছাড়া আমাদের হাউস জার্নালও

বেরোয় না যে কর্মচারীদের ছবি খুঁজে পাবেন।

ওঁর বাড়ির ঠিকানা নিশ্চয় পাওয়া যাবে অফিস রেকর্ডে!

যাবে। তবে কালই পুলিশ নিয়ে গেছে হয়তো–এক মিনিট। ভেরিফাই করে নিই।

পরিতোষবাবু বেলের সুইচ টিপে একজন বেয়ারাকে ডেকে বললেন, সত্যবাবুকো বোলাও। একটু পরে স্মার্ট এবং প্যান্ট শার্ট টাই পরা এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে একটু হেসে বললেন, এঁকে কোথায় দেখেছি যেন?

পরিতোষবাবু বললেন, সত্য! উনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তপেশ সম্পর্কে ইনভেস্টিগেট করতে এসেছেন। কাল পুলিশও এসেছিল বললে!

সত্যবাবু এসে বললেন, তপেশকে নিয়ে এত দিন পরে কিসের তদন্ত? সে তো হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে নাইনটিন সেভেনটি সিক্সের ফোর্থ জুলাই।

কর্নেল বললেন, ওঁর বাড়ির ঠিকানাটা দরকার।

দিচ্ছি। একটু বসুন।

সত্যবাবু উঠে গেলে পরিতোষবাবু বললেন, তপেশের কোনো ইনসিওরেন্স পলিসি নিয়ে ঝামেলা বেধেছে কি স্যার?

কর্নেল মাথাটা একটু দোলালেন। হ্যাঁ বা না দুই-ই বোঝায় এতে।

সত্যবাবু ফিরে এলেন একটা পুরনো ডাইরি নিয়ে। বললেন, ভাগ্যিস ডাইরিগুলো ফেলে দিইনি। এই যে! লিখে নিন স্যার। ৫৩/১ ই মির্জাপুর স্ট্রিট। অবশ্যি যদুর মনে পড়ছে, ওটা ওদের ভাড়ার বাড়ি ছিল। ওর আত্মীয়স্বজনের খবর জানি না। কলকাতায় যা বাসার প্রব্লেম, ওঁরা ওই বাড়িতে থাকতেও পারেন।

কর্নেল ঠিকানাটা নোট বইয়ে টুকে নিয়ে উঠে পড়লেন। সত্যবাবু করিডোরে পৌঁছে ফের বললেন, খালি মনে হচ্ছে আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি, অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। নামটাও চেনা মনে হচ্ছে।

কর্নেল চুপচাপ এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে।.. মির্জাপুর স্ট্রিটের নতুন নাম সূর্য সেন স্ট্রিট। ৫৩/১ ই নম্বর বাড়িটা দোতলা এবং জরাজীর্ণ। অনেকগুলি পরিবারের বাসা। বারো ঘর এক উঠোন বলা চলে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে কর্নেলকে দেখে একটু ভড়কে

গেলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমি তপেশ বসাকের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে এসেছি।

আমি তপেশের বাবা। কিন্তু তপেশ তো—

জানি। উনি ১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

বৃদ্ধ আরও হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার স্যার? আমরা নিরীহ। সজ্জন লোক। প্রতিবেশীদের জিগ্যেস করলেই জানতে পারবেন।

তপেশবাবুর স্ত্রী কোথায় আছেন? আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লেন কর্নেল।

বৃদ্ধ কঁপাকাঁপা গলায় বললেন, আমার কাছেই থাকে। আমার তো আর কেউ নেই। তপেশের ছেলে আছে বছর সাতেক বয়স। আর বউমা। ট্রান্সপোর্টে চাকরি করত তপেশ। সেখানে বউমা কাজ পেল না। অগত্যা–

বিধবা যুবতীদের দেখলে কর্নেল বিচলিত বোধ করেন। বৃদ্ধের পেছনে সে দাঁড়িয়ে ছিল। বৃদ্ধের কথা থামিয়ে সামনে এসে বলল, কী ব্যাপার?

আপনি কি তপেশবাবুর স্ত্রী?

হ্যাঁ। কিন্তু—

বলছি। তবে এভাবে তো কথা বলা যাবে না মা! একটু বসতে চাই।

আসুন।

নিচের তলায় একটা মাত্র ঘরে বাসা। বারান্দার কোনায় ছোট্ট কিচেন। চেয়ারে বসে কর্নেল নিজের কার্ডটি এগিয়ে দিলেন তপেশের বিধবা বউকে। কার্ডটি দেখে সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বৃদ্ধ খাটে বসেছেন। তার পা দুটো কাঁপছে। কর্নেল বললেন, তপেশবাবু পারিজাত ট্রান্সপোর্টে চাকরি করতেন। তাঁর একটা আইডেন্টিটি কার্ড ছিল। সেটা কি আছে?

বিধবা যুবতী আস্তে বলল, না। হারিয়ে গেছে।

হার্ট অ্যাটাক কোথায় হয়েছিল ওঁর?

এই ঘরেই। অফিস-যাবে বলে বেরুচ্ছে, হঠাৎ বুকে ব্যথা বলে খাটে গিয়ে বসল। তারপর–

হুঁ। ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আপনি নিশ্চয় চেনেন?

একটু ভেবে নিয়ে তপেশের বউ বলল, ও তেমন মিশুকে প্রকৃতির ছিল। বন্ধুবান্ধব বলতে শুধু বাসুদেব নামে একজন–ঠিকানা জানি না।

সে কি এ বাসায় আসত?

আসত মাঝেমাঝে। বাসুদেবকে আমি পছন্দ করতুম না।

চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?

রোগা, শ্যামবর্ণ। চোখদুটো কেমন যেন। মেজাজও খিটখিটে।

আপনার স্বামীর হার্ট অ্যাটাকের সময় বাসুদেববাবু এসেছিলেন?

হ্যাঁ। সেই রিকশা ডেকে এন আর এস হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পেছনে আরেকটা রিকশায় আমি গেলাম। হাসপাতাল থেকে ওর অফিসে ফোন করা হয়েছিল।

মেডিকেল কলেজ হসপিট্যাল তো কাছেই ছিল। এন আর এসে কেন?

ওখানে বাসুদেবের চেনা ডাক্তার ছিল।

বাসুদেবের পুরো নাম মনে আছে?

তপেশের বউ একটু ভেবে বলল, বাসুদেব রায় বলে মনে পড়ছে। তবে কোথায় থাকত জানি না। কিন্তু এত দিন পরে কিসের এনকোয়ারি স্যার?

পরে যোগাযোগ করব। বলে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। শ্বশুর ও বউমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।…

কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার মোড়ে জ্যাম। আধঘণ্টা পরে জ্যাম ছাড়ল। কর্নেল বউবাজার ছাড়িয়ে ডাইনে ঘুরলেন। তারপর সেন্ট্রাল এভেনিউ ধরে এগিয়ে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন। সোজা তিন তলার লাইব্রেরি রুমে গিয়ে ঢুকলেন। লাইব্রেরিয়ান এখনও আসেননি। সহকারী সুপ্রিয় কর্নেলকে দেখে লাফিয়ে উঠল। হাই ওল্ড বস! জয়ন্ত আউট অফ স্টেশন বলে কি আমরাও তাই হয়ে গেছি? বসুন, আগে কফি আনাই ক্যান্টিন থেকে।

কর্নেল বললেন, ডার্লিং! কফি পরে। আগে আমি তোমাদের কাগজের পুরনো ফাঁইল দেখতে চাই।

আদেশ করুন।

১৯৭০ সালের জুন মাসের ফাঁইল।

সুপ্রিয় বিশাল লাইব্রেরির বইপত্তরের র‍্যাকের ভেতর অদৃশ্য হলো। একটু পরে বাঁধানো পুরনো দৈনিক সত্যসেবকের ফাঁইল এনে টেবিলে রাখল। তারপর ফোন তুলে ক্যান্টিনে কফির অর্ডার দিল।

কর্নেল জুন মাসের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। ১৭ জুনের কাগজে পাঁচের পাতায় দৃষ্টি আটকে গেল। শেষ কলামে খানিকটা জায়গা কেটে নিয়েছে। বাকি ১৩ দিনের পাতাগুলো ওল্টালেন। সব ঠিক আছে। সুশোভন রায় সম্পর্কে জন মাসে কোনো খবর নেই।

সুপ্রিয় বলল, কী ব্যাপার?

১৭ জুনের কাগজে পাঁচের পাতায় এটা কাটা কেন সুপ্রিয়?

দেখামাত্র সুপ্রিয় জিভ কেটে কপাল চাপড়ে বলল, সর্বনাশ! কে কেটে নিয়ে গেল? কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে চাকরি যাবে! কী কাণ্ড দেখুন তো!

আমি আসার আগে কেউ পুরনো ফাঁইল দেখতে এসেছিল আজ?

সুপ্রিয়কে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল, আমি কঁটায় কাঁটায় দশটায় এসেছি। তবে লাইব্রেরি খোলে নটায়। বেয়ারাদের জিগ্যেস করি।

বেয়ারারা কেউ কিছু বলতে পারল না। সুপ্রিয় বলল, নিশ্চয় আজ এটা ঘটেনি। কেউ গতকাল কিংবা তার আগে এসেছিল ফাঁইল দেখতে। সেই কেটে নিয়ে গেছে। সমস্যা হলো, অসংখ্য লোক রিসার্চ পারপাসে ফাঁইল দেখতে আসেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেন অবশ্যি। কিন্তু ঠিক কবে কে এসে এ কম্মটি করেছে, সেটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল।

কফি এল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন।…চেপে যাও, সুপ্রিয়। কলকাতায় আরও কাগজ বেরোয়। অসুবিধে হবে না।

সুপ্রিয় বেয়ারাদের ধমক দিচ্ছিল। ফাঁইল দিয়ে তারা যেন নজর রাখে।

কফি খেয়ে কর্নেল বেরুলেন। আবার ভুল করছেন না তো? ওই তারিখের কাগজে কাটা জায়গাটায় সুশোভনের মৃত্যুসংবাদ ছিল, তার প্রমাণ কী? মৃত্যুসংবাদ যদি থাকেও, তাতে এমন কী তথ্য পাওয়ার আশা করেছেন?

স্টেটসম্যানে গিয়েও একই কাণ্ড। ১৯৭০ সালের ১৭ জুনের কাগজে নিচের পাতায় তেমনি কাটা। এখানে কাটা অংশটা আরও বড়। তার মানে স্টেটসম্যান গুরুত্ব দিয়ে কোনো খবর ছেপেছিল–একটু বিস্তারিতভাবে।

একটা বেজে গেল কলকাতার সমস্ত বড় কাগজের অফিস ঘুরতে। সমস্ত কাগজে ১৯৭০ সালের ১৭ জুনের একটা জায়গা কেউ কেটে নিয়েছে। অতএব খবরটা বড় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু কী খবর? কেয়া বলেছে, তার দাদার বডি খুঁজে পাওয়া যায় ওই বছর জুন মাসে। ১৭ জুনের খবরটা যে সুশোভন সংক্রান্ত, তার ভিত্তি কী?

ফিয়ার্স লেনে এটা চীনা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে কর্নেল লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেলেন। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর চেম্বারের বাইরে বোর্ডে ইন চোখে পড়ল।

হাই ওল্ড ডাভ! অরিজিৎ হাসলেন। এত নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?

তুরুপের তাসের পাল্লায় পড়েছি ডার্লিং!

অরিজিৎ ঝুঁকে এলেন টেবিলের ওপর। আস্তে বললেন, কী ব্যাপার?

বলছি। ১৯৭০ সালের ১৭ই জুন সম্ভবত সুশোভন রায়-সংক্রান্ত একটা খবর সমস্ত কাগজের লাইব্রেরির ফাঁইলে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। তোমাদের রেকর্ডসে ওই তারিখে সুশোভন রায় সংক্রান্ত–

হাত তুলে ডি সি ডি ডি বললেন, বলেছি–খোঁজা হয়েছে। পাইনি।

১৯৭০ সালের ১৭ জুন নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে ওর বডি সনাক্ত করা হয়।

লেট আস ট্রাই এগেন। অরিজিৎ কলিং বেলের বোতাম টিপলেন। একজন স্মার্ট চেহারার শাদা পোশাকের পুলিশ এসে সেলাম দিল। বললেন, এই স্লিপটা নিয়ে যাও। বাগচিবাবুকে দাও।

স্লিপে কিছু লিখে দিলেন। ফের বললেন, লাস্ট চান্স। দেখা যাক কী হয়।…

দীর্ঘ দশ মিনিট পরে নাদুস নুদুস চেহারার এক অফিসার হন্তদন্ত এলেন। সঙ্গে একজন বেয়ারা। তার হাতে এক গাদা ফাঁইল। অরিজিৎ বললেন, ঠিক আছে। এগুলো থাক আমার কাছে।

অফিসার কর্নেলের দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন। অরিজিৎ বললেন, ১৯৭০, ১৭ জুন এন আর এসে বডি-সুশোভন রায়? বলে ফাঁইল ওল্টাতে থাকলেন।

একটু পরে একখানে থেমে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, এ কী!

মিসিং?

তিনটে পাতা নেই! অরিজিতকে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল। ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি তো হবেই। আগে ওই বাগচিবাবু–রেকর্ড কিপার, ওকে সাসপেন্ড করব। বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা!

কী ভেবেছে?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।…ভুলে গিয়েছিলুম। কেয়া বা তার মা ফরেন্সিকে জামাপ্যাণ্ট সনাক্ত করতে গিয়েছিল কি?

অরিজিৎ আস্তে বললেন, দুজনেই গিয়েছিল। সনাক্ত করেছে। কর্নেল বেরিয়ে এলেন। ঠিক তুরুপের তাসের মতো কেউ বা কারা প্রতিটি দানের তাসগুলো জিতে নিচ্ছে। কে বা কারা তারা? একটা ব্যাপার ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে বা তারা প্রভাবশালী লোক।

লাল ল্যান্ডরোভারের গতি দক্ষিণে রেড রোড ধরে। চৌদ্দ নম্বর গোখেল পার্কের প্রিয়তমা নামে বাড়িটির লনে ঢুকে গাড়ি পার্ক করলেন কর্নেল।

দোতলার ৪ নম্বর ফ্ল্যাটে কলিং বেল টিপলেন। ভেতর থেকে সাড়া এল, চলে এস শ্যামলদা। দরজা তোমার জন্য খুলে রেখেছি।

চিত্রকর বিমলকুমার তাহলে শ্যামলকান্তির জন্য অপেক্ষা করছেন।

কর্নেলকে দেখে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে চেনা মনে হচ্ছে! কে বলুন তো?

বিমলকুমারের হাতে মদের গেলাস। শিল্পী মানুষ। সারাক্ষণ কি মদ ছাড়া চলে না? কর্নেল বললেন, কাল রাত্রে আমি এসেছিলুম।

তাই বুঝি? আমার কিছু মনে থাকে না! বলুন, কী করতে পারি।

পোর্টেট আঁকানোর কথা বলেছিলুম।

মনে নেই। বসুন। এনি ড্রিংক?

ধন্যবাদ। কর্নেল ছবির গাদার পাশে সোফায় বসলেন!

বিমলকুমার ইজেলে ক্যানভাস এঁটে একটা ছবি আঁকছেন। গেলাসে চুমুক দিয়ে ওতে তুলির একটা পোঁচ টেনে পিছিয়ে এলেন। দেখার পর হাসি মুখে ঘুরে বললেন, আপনার পোট্রেট?

হ্যাঁ। আচ্ছা বিমলবাবু, কাল রাত্রে ওখানে যে ছবিটা দেখেছিলুম—

কোন ছবিটা বলুন তো?

অ্যাবস্ট্রাকটু পেন্টিং আমি বুঝি না। মনে হয়েছিল, যেন পিঠে ছুরি বেঁধা একটা মানুষ–সামনে ঝুঁকে পড়েছে।…

বিমলকুমার গেলাস ও তুলি রেখে এগিয়ে গেলেন বড় বড় ফ্রেমে আঁটা ক্যানভাসগুলির দিকে। দুমদাম এদিক-ওদিকে ফেলতে শুরু করলেন। পাগলের হাবভাব মুখে। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, কোন শুয়োরের বাচ্চা ওটা চুরি করল? তাকে আমি মেরে ফেলব। একেবারে খতম করে দেব। তিন বছরের পরিশ্রম! ওঃ! আমার একটা মাস্টারপিস! প্যারি এক্সজিবিশনে পাঠানোর কথা ছিল।

ছবিগুলোতে লাথি মারতে থাকলেন বিমলকুমার। কর্নেল গিয়ে ধরলেন তাকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে বিমলবাবু!

শাট আপ! নো কথা! আমার মাস্টারপিস উধাও। দুহাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন চিত্রকর। তারপর ধপাস করে বসে পড়লেন মেঝেয়।

কর্নেল তাকে শান্ত করতে পারলেন না। তার কোনো প্রশ্নের জবাবও পেলেন না। বিমলকুমার পাগলের মতো লাথি মারতে থাকলেন মেঝেয় পড়ে থাকা ছবিগুলোতে। উন্মত্ত ভাঙচুর শুরু হলো।

একটু দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। হুঁ, এও তুরুপের তাস। আরও একটা দানের তাসগুলি জিতে নিয়েছে ধূর্ত খেলোয়াড়।…

১০. আবার একটি আত্মহত্যা

ভোরে গার্ডেনিং-এর জোব্বা এবং হাতে সিন্থেটিক চামড়ায় দস্তানা পরে খুরপি হাতে ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ডে যান কর্নেল। সূর্য ওঠার পর ষষ্ঠী কফি দিয়ে এল। মোড়ায় বসে কফি খেতে-খেতে বললেন, খবরের কাগজগুলো এখানে দিয়ে যাবি।

ষষ্ঠী দাঁত বের করে বলল, একটা কথা বলি বাবামশাই?

বল!

কিছু গণ্ডগোল বেইধেছে, তাই না? নতুন ক্যাস ধইরেছেন, বাবামশাই!

কর্নেল হাসলেন।…তুই তাহলে সত্যি গোয়েন্দা হয়ে উঠছিস, ষষ্ঠী।

ষষ্ঠী সাহস পেয়ে বলল, আইজ্ঞে বাবামশাই, বাইরে থেকে এসে এইরকম মুখভার, ছাদে বসে কাগজ পড়া–এদিকে এই সক্কালবেলা এক মেয়েছেলে এসে বাবামশাইয়ের জন্যে বসে আছে–

কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, মেয়েছেলে এসে বসে আছে?

আইজ্ঞে!

হতভাগা, বলছিস না সে-কথা?

বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখেছি। ষষ্ঠী বিব্রতভাবে বলল। বললুম, বাবামশাইয়ের লামতে দেরি আছে। বললে, ততক্ষণ রোয়েট করব। তা কী করব? মেয়েছেলে– মুখখানা দেইখ্যে মায়া হল।

কর্নেল কফির পেয়ালা হাতে হন্তদন্ত নেমে গেলেন। ড্রইং রুমের ওধারে ছোট্ট ওয়েটিং রুম। ড্রইং রুমটি বিশাল এবং যাদুঘর-কাম-লাইব্রেরি বলা চলে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। খুলে একটু অবাক হলেন। তপেশ বসাকের বিধবা স্ত্রী বসে আছে! বললেন, আসুন! ভেতরে আসুন!

সে ড্রইং রুমে ঢুকে বলল, কাল আপনি গেলেন, কার্ড দিলেন–তখন। কথাটা মনে পড়েনি।

উত্তেজনা চেপে কর্নেল বললেন, আপনার নাম কী মা?

রমা। আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন।

বেশ, বলো রমা!

রমা বলল, আমি কর্পোরেশন স্কুলের টিচার। খবরের কাগজ কেনার পয়সা জোটে না। কাগজ পড়তেও ভাল লাগে না। তো আমাদের স্কুলে কাগজ আসে। আপনি যাওয়ার পর মনে পড়ল, কাগজে মিতুর বাবার নামে একটা ছবি বেরিয়েছে দেখেছিলুম।

ছবিটা চিনতে পেরেছিলে?

রমা আস্তে বলল, আপনাকে বাসুদেবের কথা বলেছিলুম!

ছবিটা বাসুদেবের?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টে রমাকে লক্ষ্য করছিলেন কর্নেল। বুঝলেন, কাল যখন ওদের বাসায় যান, তখনই যেন রমা জানত-সম্ভবত মনে না পড়াটা একটা অজুহাত। কাল সারাদিন এবং রাত্রি পর্যন্ত ভেবেছে। হয়তো শ্বশুরের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছে। তারপর জানাতে এসেছে। কিছু মানুষ থাকে, ঝটপট সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। রমা সেই দলের। বললেন, চা খাবে? কিংবা কফি?

রমা সলজ্জ মুখে বলল, আজ্ঞে না। আমি উঠি। বাসায় ফিরে স্কুলে যেতে হবে।

তুমি কি আর কিছু বলতে চাও, রমা?

একটা কথা—

স্বচ্ছন্দে বলো।

আমাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না তো?

কেন ও কথা মনে হলো তোমার?

একটু চুপ করে থাকার পর রমা কুণ্ঠিত ভাবে বলল, বাসুদেব কিছুদিন লুকিয়ে বেড়াত। মিতুর বাবা বলতেন। ওকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

কেন জানো? তপেশবাবু কিছু বলেননি?

রমা মাথাটা দোলাল। ফের আস্তে বলল, সে প্রায় আট-ন বছর আগের কথা। তখন খুব খুনোখুনি বোমাবাজি হত আমাদের পাড়ায়। দিনদুপুরে রাস্তার মোড়ে একজনকে ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে–

কলিং বেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী একগাদা খবরের কাগজ নিয়ে এল। কর্নেল অন্যমনস্কভাবে একটা কাগজে চোখ রাখলেন। রমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসি স্যার! কাইন্ডলি দেখবেন যেন কোনো ঝামেলায় না পড়ি। আমরা খুব গরিব মানুষ!

কর্নেল একটু হাসলেন মুখ তুলে।…বাসুদেব কোথায় থাকত জানো না?

আজ্ঞে না। জানলে নিশ্চয় বলতুম।

আচ্ছা, এস।

রমা চলে গেল। কর্নেল খবরের কাগজটার প্রথম পাতার শেষ কলামের নীচে একটা খবর পড়ে চমকে উঠলেন। বক্স করে বোল্ড লেটারে ছবিশুদ্ধ ছেপেছে।

শিল্পীর আত্মহত্যা

স্টাফ রিপোর্টার : প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়কে গতরাত্রে তার স্টুডিওতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশের মতে, বিমলকুমার আত্মহত্যা করেছেন। একটা চিরকুটে তিনি লিখে গেছেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। একটি, ৩২ ক্যালিবারের রিভলবার পাওয়া গেছে। কয়টি কার্তুজের একটি ফায়ার করা, বাকিগুলি আস্ত আছে। মুখের ভেতর নল পুরে ট্রিগার টেনেছেন বলে পুলিশের ধারণা। রিভলবারটির নল মুখের ভিতর আটকে ছিল এবং ট্রিগারে আঙুল ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আগামী এপ্রিল মাসে প্যারিসে তার ছবির প্রদর্শনী হওয়ার কথা।…

এরপর বিমলকুমারের জীবনী সংযোজিত হয়েছে। কর্নেল দীর্ঘ দুমিনিট চুপচাপ বসে রইলেন। একটা ছবি হারিয়ে তাহলে চিত্রকর শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করে বসলেন!

হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, অরিজিৎ, ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত।

দুঃখিত হওয়ার কারণ নেই। আমি উত্থিত।

কিছু খবর পেয়েছ কি?

কিসের? আপনার তপেশ বসাকের কোনো নতুন খবর হয়নি। আপনি এবার দেখছি সত্যিই না–

অরিজিৎ! এইমাত্র কাগজে চিত্রশিল্পী বিমলকুমারের আত্মহত্যার খবর পড়ে তোমাকে রিং করছি।

কী অবাক!

সত্যিই অবাক হবার কেস। তুমি কি দফতরের সূত্রে রাত্রে এ সম্পর্কে কোনো খবর পাওনি?

পেয়েছিলুম। হি ইজ দা ফেমাস পেইন্টার। কিন্তু এ নিয়ে আপনার উত্তেজনার কারণ কী?

প্লিজ, চলে এস। এক মিনিট! একটা কথা।

বলুন!

সঙ্গে এই সুইসাইড কেসের তথ্য যতটা পারো, নিয়ে এস!

টালিগঞ্জ থানা হয়ে আসছি। অপেক্ষা করুন। কেসটা ওরা ডিল করছে।

কর্নেল ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালেন। গার্ডেনিং জোব্বা এবং দস্তানা খুলতে গেলেন। আবার মনে হলো, একটা ছবি হারিয়ে মাথার ঠিক রাখলেন না বিমলকুমার?

কিন্তু–

একটু চমকে উঠলেন। ঠিক একইভাবে তপেশ বসাক নামধারী বাসুদেব রায় আত্মহত্যা করেছে। মুখের ভেতর আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঢুকিয়ে ট্রিগারে চাপ। চাপা শব্দ। তবে বাসুদেব কষ্ট পেয়েছিল। পিস্তলের গুলি মগজ ভেদ করে গিয়েছিল। সোজা তার গতি। রিভলবারের গুলি ক্রুর মতো পেঁচিয়ে মগজটাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। মৃত্যুযন্ত্রণা হয়তো টেরই পাননি বিমলকুমার।…

 ১১. টেলিফোনে হুমকি

ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী এলেন একঘণ্টা পরে। কর্নেল তখন সমস্ত কাগজের বিবরণ খুঁটিয়ে পড়ে ফেলেছেন। ঘটনার বর্ণনায় কাগজে কাগজে হেরফের ঘটেছে। তবে জীবনীটা মোটামুটি একই। বিমলকুমার একসময় ক্যালকাটা গ্রুপ অফ পেইন্টার্সের সদস্য ছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ছাত্রজীবনে। পরে রাজনীতি ছেড়ে দেন। ঠিক স্বেচ্ছায় ছাড়া বলা যায় না। পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন ছয়ের দশকের শেষাশেষি।

অরিজিৎ বসে বললেন, আর্টিস্ট ভদ্রলোককে নিয়ে মাথাব্যথা কেন, বসুন। তারপর আমি ঝুলি খুলছি।

কর্নেল বিষণ্ণভাবে বললেন, ওঁর কাছে একটা পোর্টেট আঁকতে গিয়েছিলুম গতকাল বিকেলে। গিয়ে দেখি স্টুডিওর ভেতর ছবি তছনছ করছেন পাগলের মতো! কী একটা ছবি চুরি গেছে না কি। অবস্থা দেখে ফিরে এলুম। তারপর সকালে কাগজে দেখি, আত্মহত্যা করেছেন।

আসলে খুব হতাশায় ভুগছিলেন ভদ্রলোক। অরিজিৎ পাইপ বের করে তামাক ভরতে ভরতে বললেন, যাই হোক, আপনার কাছে একটা সূত্র পাওয়া গেল। ছবি চুরি গেছে! ভেরি ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট।

ষষ্ঠীকে কফি বলা ছিল। কফি এবং স্ন্যাক্স রেখে গেল। কর্নেল পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, বডি কোথায় কী অবস্থায় পাওয়া যায় এবং কে প্রথম দেখতে পায়?

রাত সাড়ে নটা নাগাদ পাশের ফ্ল্যাটের মিঃ ও মিসেস প্রধান ইভনিং শো দেখে ফেরেন। বিমলবাবু ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। পর্দা ঘেঁড়া ছিল। করিডর থেকে ওঁরা দেখতে পান, ঘর–মানে স্টুডিওর ভেতর সব ভাঙচুর অবস্থা। মেঝেয় চিৎ হয়ে পড়ে আছে বিমলবাবু। মুখে রিভলবারের নল ঢোকানো।

এবং ট্রিগারে আঙুল?

হ্যাঁ। অরিজিৎ পাইপ রেখে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। একটা কাজু বাদাম চিবুতে চিবুতে বললেন, যে পুলিশ অফিসার যান প্রথমে, তার সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল যে, ওভাবে গুলি ছোঁড়ার পর ট্রিগারে হাত এবং মুখে নল ঢোকানো থাকতে পারে কি না। যত সামান্যই হোক, বডি নড়ে যাবেই। রিভলবার ছিটকে পড়বেই।

ঠিক ধরেছ।

তাছাড়া চিরকুটের লেখার তলায় নাম সই নেই!

সে কী!

তবে লেখাটা মিলিয়ে দেখা হয়েছে। বিমলবাবুরই হস্তাক্ষর। ইন্সট্রাকশান দিয়েছি ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে এক্সপার্টদের কাছে পাঠাতে। রিভলবারের বাঁটে এবং ট্রিগারে আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হবে। কিন্তু হঠাৎ আপনার পোর্টেট আঁকানোর সাধ কেন হলো, জানতে পারি?

অরিজিৎ মিটিমিটি হাসছিলেন। কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বুড়ো হয়েছি। কখন কেঁসে যাই, ঠিক নেই। ষষ্ঠী দেখবে আর নমো করবে। সে ছাড়া আর কে আছে আমার, বলো?

অরিজিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, উঁহু ঝুলি খুলুন, আমি খুলেছি। এবার আপনার পালা।

কর্নেল তাকালেন তার দিকে। বিষণ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু কিছু বললেন না।

অরিজিৎ আস্তে বললেন, তপেশ বসাকের সুইসাইডের পদ্ধতির সঙ্গে হুবহু মিল। এখানেই খটকা লাগছে। আচ্ছা কর্নেল, আপনি কি সত্যিই দরজার ফুটো দিয়ে তপেশবাবুকে আত্মহত্যা করতে দেখেছিলেন?

হ্যাঁ।

পিস্তল মুখে ঢোকানো ছিল এবং ট্রিগারে আঙুল?

না। ছিটকে পড়েছিল মেঝেয়। বাসুদেব—

উঁহু, তপেশ।

ওর প্রকৃত নাম বাসুদেব রায়। তপেশ বসাক হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার একটু আগে বাসুদেব তার পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড তুলে নেয়। সে কথা পরে বলবখন।

অরিজিৎ কিছুক্ষণ চুপচাপ কফি খাওয়ার পর বললেন, মোতিগঞ্জের ঘটনার সঙ্গে বিমলবাবুর আত্মহত্যা বা হত্যার সম্পর্ক আছে। ইজ ইট?

কর্নেল আস্তে বললেন, হয়তো আছে–হয়তো নেই।

প্লিজ হেঁয়ালি করবেন না! ঝেড়ে কাসুন।

এখনও আমি গভীর অন্ধকারে, ডার্লিং! কর্নেল চুরুট ধলেন। ধোঁয়ার ভেতর ফের বললেন, হাথিয়াগড় থেকে মিঃ শর্মা কোনো মেসেজ পাঠাননি?

নাঃ!

মোতিগঞ্জে বাসুদেব কার কাছে গিয়েছিল, এটা জানতে পারলে অর্ধেক রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায়।

তাই বুঝি?

বাই দা বাই, তপেশ বসাকের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কথা বলেছিলুম। এটা প্রত্যাহার করছি। বাসুদেব রায় অথবা কেয়া রায়ের নামে কোন-কোন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে, জানা দরকার জরুরি অরিজিৎ!

কেয়া রায়? হু ইজ শি?

বাসুদেবের স্ত্রী।

ও হ্যাঁ–মনে পড়েছে। কাল যে মহিলা তার মায়ের সঙ্গে সুশোভনবাবর জামা প্যান্ট সোয়েটার সনাক্ত করতে গিয়েছিলেন?

কেয়া আমাকে বলেছে, তার বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড আর ইনসিওরেন্সের টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। তাহলে তার অ্যাকাউন্টে বেশি টাকা থাকার কথা না। তার চেয়ে বড় কথা, তার অ্যাকাউন্টে টাকা ডিপোজিটের ফ্রিকোয়েন্সিই বলে দেবে কী ঘটেছে। চেক অথবা ক্যাশ ডিপজিট, সেটাই জানা ভাইটাল।

ঠিক। দেখছি। অরিজিৎ কফি শেষ করে পাইপ জ্বেলে বললেন, বাট দা পয়েন্ট ইজ বাসুদেব রায়ের আত্মহত্যা কেসের সঙ্গে বিমলবাবুর কেসটা আপাতদৃষ্টে এক হয়েও এক নয়। হ্যাঁবাসুদেববাবু রক্তমাখা পোশাক হারিয়ে সুইসাইড করেছেন। আর বিমলবাবু কী একটা ছবি হারিয়ে সুইসাইড করেছেন। সুইসাইডের পদ্ধতিও এক। অন্তত অ্যাজ ইট অ্যাপিয়ার্স!

কিন্তু বিমলবাবুর কেসটা সুইসাইড না হতেও পারে!

এক্সজ্যাক্টলি। অরিজিৎ নড়ে বসলেন। সেজন্যই দুটোকে লিংক আপ করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আপনি কিছু গোপন রেখেছেন এবং সময়মতো টেক্কাটি ঝাড়বেন। অরিজিৎ হাসতে লাগলেন।

কর্নেল চোখ বুজে বললেন, বাসুদেব রায় নামে পুলিশ রেকর্ডে কিছু আছে কি না, জানা দরকার। এক সময় তাকে নাকি পুলিশ খুঁজত। সে গা ঢাকা দিয়ে বেড়াত।

অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, সোর্স?

তপেশ বসাকের স্ত্রী বলেছে। একটু আগে সে এসেছিল।

মাই গুডনেস! আপনি–

এক মিনিট ডার্লিং! বিমলবাবু বামপন্থী রাজনীতি করতেন কাগজে পড়লুম। তার সম্পর্কে পলিটিক্যাল ফাঁইলে কোনো রেকর্ড নিশ্চয় আছে তোমাদের হাতে।

অরিজিৎ হেলান দিয়ে বললেন, তার মানে, পুরো এক দশকের পলিটিক্যাল ফাঁইল খুলে খুঁজতে হবে। বাস্! কিন্তু শেষমেশ লাভটা কী হবে? নাথিং।

ডার্লিং, সুশোভন রায়ের হত্যা রহস্য জানা যায়নি। এখনো বারো বছর পূর্ণ হয়নি, মাইন্ড দ্যাট। সুতরাং এখনও তার খুনীদের ধরার আইনত দায়িত্ব তোমাদের হাতে আছে।

অরিজিৎ চুপচাপ পাইপ টানতে থাকলেন।

কর্নেল ফের বললেন, তোমাকে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কথা বলেছিলুম। অতীত বর্তমানের ভেতরও গোপনে কাজ করে চলে। বিমলকুমারের আত্মহত্যা অথবা হত্যা সেই অতীতেরই কাজ করা।

হুম! পাইপ দাঁতে কামড়ে অরিজিৎ বললেন। কিন্তু কী ছবি চুরি গেছে বিমলকুমারের, জানেন? অবশ্য জানলেও বলবেন না বুঝতে পারছি।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, বিমূর্ত চিত্রকলার ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে না। তবে ধরো, যদি কোনো ছবি দেখে মনে হয়, পিঠে ছুরি বেঁধা একটা মানুষ–অতর্কিতে যাকে ছুরি মারা হয়েছে পেছন থেকে–এমন একটা দৃশ্যত বিমূর্ত করে আঁকা হয়েছে এবং সেই ছবিটা চুরি যায়?

আই সি! আপনি ছবিটা দেখেছিলেন, অর্থাৎ আগেও গিয়েছিলেন ভদ্রলোকের স্টুডিওতে। কেন?

সে-কথার জবাব না দিয়ে কর্নেল বললেন, খুনী অথবা খুনীরা বাসুদেবকে প্রচণ্ড ভয় করত। বাসুদেবের কাছে পিস্তল ছিল বলেও নয়, আমার ধারণা বাসুদেবও একজন কিলার চরিত্রের লোক ছিল। তাই তার গায়ে হাত তুলতে সাহস পায়নি। যেন উল্টে খুনী বা খুনীরা তাকে সহযোগিতা করেছে ব্ল্যাকমেলিংয়ে। কিন্তু বিমলকুমার নিরীহ চিত্রকর। তারা আঁকা ছবিটা দেখে প্রথমে তত আমল দেয়নি। কিন্তু আমি ওঁর স্টুডিওতে যাওয়ায় খুনী বা খুনীরা এবার বিপন্ন বোধ করে থাকবে। অর্থাৎ বিমলকুমার একটা খুনের ঘটনা জানতেন। স্বচক্ষে দেখেও থাকতে পারেন। সেটাকে সরাসরি না এঁকে বিমূর্ত রীতিতে এঁকেছেন। অতএব আমি না যাব, বিমলবাবুর না মৃত্যু হবে!

কর্নেলের কণ্ঠস্বরে বিষণ্ণতা লক্ষ্য করে অরিজিৎ একটু হাসলেন। বললেন, অকারণ আত্মগ্লানিতে ভুগছেন, কর্নেল! আপনি নিমিত্ত মাত্র।

কর্নেল চুরুট কামড়ে ধরে বললেন, কেন যে ছাই এ বয়সেও সবতাতে নাক গলাতে যাই। এখনও আমার শিক্ষা হলো না ডার্লিং!

অরিজিৎ ঘড়ি দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাসতে হাসতে বললেন, আপনার এভাবে দাড়ি ঘেঁড়ার ভঙ্গি দেখলে খুব এনজয় করা যায়। বুঝতে পারি, সব রহস্য ফর্দাফাই হতে চলেছে। ওক্কে, উইশ য়ু গুড লাক, মাই ডিয়ার ওল্ড ডাভ! চলি।

ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে কিছুক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থেকে নিচে ব্রেকফাস্ট খেতে এলেন কর্নেল। খাওয়ার পর বুকশেলফ থেকে একটা বই বার করলেন : দা পলিটিক্যাল টারময়েল ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল তিরিং সিক্সটিজ-সেভেনটিজ। পাতা ওল্টাতে থাকলেন। তারপর শেষের দিকে ইনডেক্সে এ হরফ থেকে পড়তে শুরু করলেন শব্দগুলি। শব্দগুলি টার্ম, কোনোটা নামের পদবি।

ফোন বাজল। সাড়া দিলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

অ্যাই বুড়ো! সাবধান! আর এক পা বাড়ালে খতম হয়ে যাবি।

ডার্লিং! রসিকতার জন্য ধন্যবাদ!

শাট আপ শালা বুড়ো ভাম! নাক গলালে গলা ফাঁক করে দেব।

গলা বাড়িয়েই আছি ডার্লিং!

ঠিক আছে। দ্যাখ, কী হয় এবার।

তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমার জাদু-চোখ আছে ডার্লিং!

তবে মর শালা!

ফোন রাখার শব্দ হলো। কর্নেল হাসলেন। তাহলে ঠিক পথেই পা। বাড়িয়েছেন।…

১২. সরাসরি আক্রমণ

ট্যাক্সি থেকে কর্নেল যখন গে ক্লাবের কাছে নামলেন, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজে। জানুয়ারির দিনশেষে সাড়ে ছটা মানে রাত্রিই। কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশায় ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলি ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। কর্নেলের গায়ে ওভারকোট, মাথায় টুপি, হাতে একটা ছড়ি। সোজা গে ক্লাবে ঢুকে গেলেন।

লেকের কিনারা বরাবর রঙিন ছাতার নিচে মিটমিটে আলোয় একগুচ্ছ করে লোক। হাতে বিয়ার, হুইস্কি বা রাম ভর্তি গেলাস। কিছু মেয়েও আছে, হাতে শ্যাম্পেন অথবা স্রেফ সফ্ট ড্রিংক ভরা গেলাস। টেন্টের গড়ন মূল ক্লাবঘরের ভেতর জমাট ভিড়। শ্যামলকান্তিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। একজন পরিচারককে জিজ্ঞেস করলে সে বাইরে আঙুল তুলে বলল, মজুমদারসাব হুয়াউও দেখিয়ে, পেড়কা নিচে।

গাছটার মাথা অন্ধকার আকাশে ঢুকে আছে। তার তলায় খুদে প্যাগোডা গড়ন এবং নিচে চারদিক ভোলা কাঠের ছত্র। তিনটে সরু কারুকার্যকরা কাঠের থাম। মেঝে মাটি থেকে ফুট তিনেক উঁচুতে এবং সেটা একটা গোলাকার বেদি বলা চলে। আবছা আলো গিয়ে ওখানে পড়েছে বলে তিনটি লোককে দেখা যাচ্ছিল।

কর্নেল গিয়ে বললেন, এক্সকিউজ মি–

হ্যাল্লো কর্নেল! শ্যামলকান্তি হাত তুলে খুশ মেজাজে বললেন। জয়েন আস।

সুভদ্রের চোখ জ্বলে উঠেছে। সে মুখ নামিয়ে গেলাসে চুমুক দিল। তারপর কাঠের সরু থামে হেলান দিল। কর্নৈল শ্যামলকান্তির কাছে পা ঝুলিয়ে বসলেন।

শ্যামলকান্তি বললেন, আলাপ করিয়ে দিই–সৌম্য চৌধুরি। সৌম্য, আই টোল্ড য়ু অ্যাবাউট দিস ওয়াইজম্যান–আ ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড ভেরি পিকিউলারলি আ প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

সৌম্য চৌধুরির বয়স পঁয়ত্রিশের কম নয়। শক্তসমর্থ গড়ন। আবছা আলোয় কর্নেল আঁচ করলেন, মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। শ্যামলকান্তি বললেন, একচুমুক হোক, স্যার!

কর্নেল বললেন, ধন্যবাদ।

আমরা হতভাগা বিমলের আত্মার শান্তিকামনায় একটু খাচ্ছিটাচ্ছি! শ্যামলকান্তি এই হাল্কা চালের বাক্যটি গাম্ভীর্যে উচ্চারণ করলেন। আফটার অল, উই ওয়্যার হিজ ফ্রেন্ডস। উই ক্যান্ট এনজয় হিজ স্যাড ডেথ। কী সৌম্য?

সৌম্য বললেন, কিন্তু এখানে ডিটেকটিভ কেন? হোয়াই?

আঃ সৌম্য! বলে না। শ্যামলকান্তি ভর্ৎসনার সুরে বললেন। হি ইজ নাও আওয়ার গেস্ট।

কর্নেল একটু হাসলেন।…ডিটেকটিভ আসার বদলে পুলিশ এলে কি সৌম্যবাবু খুশি হতেন?

শ্যামলকান্তি গেলাসে চুমুক দিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠলেন। সৌম্য বললেন, হোয়াট?

সুভদ্র বলল, হি হ্যাঁজ কাম টু থ্রেট আস।

সৌম্য বাঁকা হাসলেন। …দেখুন মশাই, আর যাই দেখান, পুলিশ দেখাবেন না। আর একটা কথা, আমরা এখন অন্য মুডে আছি। উই হ্যাঁভ লস্ট আ

শ্যামলকান্তি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, সৌম্য! ওঁর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে জেনে নাও এবং জবাব দাও। ব্যস্! নো প্রব্লেম।

সৌম্য ঘুরে বসল কর্নেলের মুখোমুখি। …কী জানতে চান? কোন বিষয়ে জানতে চান?

কর্নেল শ্যামলকান্তির উদ্দেশে বললেন, মিঃ মজুমদার! আজ সকালে আমাকে টেলিফোনে কেউ শাসিয়েছে। সুশোভন এবং বাসুদেবের ব্যাপারে নাক গলালে আমাকে খতম করবে।

শ্যামলকান্তি হাসতে লাগলেন। …আপনি কি ভাবলেন আমরা কেউ?

কর্নেল সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তার মানে আমি ঠিক পথে এগোচ্ছি।

শ্যামলকান্তি একই হাল্কা চালে বললেন, আপনি জ্ঞানী মানুষ। কেন? এমনও তো হতে পারে, আপনি ভুলপথে এগোচ্ছেন এবং ভুলপথে আরও যাতে এগিয়ে যান, সেজন্য আপনাকে কেউ এভাবে প্ররোচিত করছে।

ভুল পথে এগোনোর প্রমাণ এখনও অন্তত পাইনি, মিঃ মজুমদার।

প্লিজ এক্সপ্লেন!

বিমলবাবুর কাছে আমি না গেলে তার একটা ছবি চুরি যেত না।

ছবি চুরি? শ্যামলকান্তি গেলাস ঢকঢক করে শেষ করে সিগারেট ধরালেন। ছবি চুরির কথা বিমল আমাদের বলেনি। আপনাকে বলেছিল বুঝি?

হাঁ। বলেছিলেন।

সৌম্য গলার ভেতর বললেন, হি ওয়াজ আ জিনিয়াস, বাট অ্যাবসোলিউটলি আ ম্যাড ফেলা। উন্মাদ।

শ্যামলকান্তি বললেন, কী ছবি, কর্নেল?

অতর্কিতে পিঠে ছুরিবিদ্ধ একটা মানুষের ছবি।

ছবিটা কি আপনি দেখেছিলেন?

দেখেছিলুম।

আপনি অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং দেখে বুঝতে পারেন? কী জানি মশাই! আমার মাথায় ওসব হাবিজাবি ঢোকে না। সৌম্য! সুভদ্র! তোমরা বিমলের ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারতে?

সৌম্য বললেন, ম্যাডনেস!

সুভদ্র বলল, ম্যাডনেস অফ কালার অ্যান্ড কম্পোজিশান, হুইচ মিস নাথিং!

শ্যামলকান্তি গেলাসে হুইস্কি ঢেলে সোডা ওয়াটার মিশিয়ে বললেন, যাই হোক–ছবি চুরি গেল এবং ছবিটার শোকে হতভাগা আত্মহত্যা করল।

না মিঃ মজুমদার! কর্নেল দ্রুত বললেন। বিমলবাবুকে খুন করা হয়েছে।

তিনজনের হাতের গেলাস থেমে গেল। একটু পরে শ্যামলকান্তি বললেন, ঠিক আছে। তারপর?

মর্গের রিপোর্ট–তাছাড়া ফরেন্সিক এক্সপার্টদের মতে, বিমলবাবুর ডানহাতে এবং চোয়ালের দুধারে চাপের চিহ্ন আছে। কেউ বা কারা জোর করে ওঁর হাতে রিভলবার খুঁজে মুখ ফাঁক করে ওঁরই আঙুলের চাপে ট্রিগার টেনেছিল। খুব সাবধানী খুনী বা খুনীরা। রুমালে রিভলবার হ্যাঁন্ডেল ধরেছে। কাজেই ট্রিগারে বিমলবাবুর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তাছাড়া তখন বিমলবাবু প্রচণ্ড মাতাল অবস্থায় ছিলেন।

শ্যামলকান্তি গেলাসে চুমুক দিয়ে হাতের চেটোয় ঠোঁট মুছে বললেন, ওকে। পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করুক।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আমার মনে হয়, পুলিশ আপনাদের বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না।

সরি, কর্নেল! তাহলে এসব কথা আলোচনার উদ্দেশ্য কী?

আমি বিমলবাবু সম্পর্কে আগ্রহী নই, মিঃ মজুমদার! কর্নেল আস্তে বললেন। পুলিশ তার কেস নিয়ে মাথা ঘামাক। আমি সুশোভন এবং বাসুদেব সম্পর্কে আগ্রহী।

কে তারা? শ্যামলকান্তি বললেন। আমি ওদের নাম শুনিনি। সৌম্য! সুভদ্র! তোমরা চেন?

দুজনে মাথা নাড়ল। কর্নেল বললেন, বাসুদেব ওরফে তপেশ বসাক মোতিগঞ্জে কাকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল, মিঃ মজুমদার?

শ্যামলকান্তি শক্ত গলায় বললেন, বিমলের বাড়িতেও আপনার এ ধরনের প্রশ্ন শুনেছি। তখন যা জবাব দিয়েছি, এখনও তাই দেব, কর্নেল! প্লিজ, মুড নষ্ট করবেন না। আপনি দয়া করে এবার আসুন।

সুভদ্রের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বললেন, হাথিয়াগড়ে বাসুদেব আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল। বাসুদেবের সঙ্গে ছিলেন মিঃ মজুমদার।

সুভদ্র শ্যামলকান্তির দিকে তাকাল। চোখে বিস্ময়নাকি কর্নেল ভুল দেখলেন? আলো খুব আবছা। তাছাড়া সুভদ্র সিং-এর চোখদুটো সবসময় চিতা বাঘের মতো উজ্জ্বল।

শ্যামলকান্তি ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, সুভদ্র! হি ইজ ট্রাইং টু মিসলিড ইউ। ইউ নো, হায়াই আই ওয়েন্ট টু মিট ইউ।

সুভদ্র শ্বাস ছেড়ে মদে চুমুক দিল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বললেন সৌম্যবাবু!

সৌম্য চৌধুরী হিংস্র মুখে বললেন, ডোন্ট টক। আর একটা কথা বললে দাঁতের পাটি খুলে নেব।

কর্নেল হাসলেন। চেষ্টা করতে পারেন!

সৌম্য উঠে দাঁড়ালেন। শ্যামলকান্তি ও সুভদ্র তাকে ধরে বসিয়ে দিল। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন। সওয়া সাতটা বাজে। লেকভিউ রোড জনহীন। গাছের ঘনছায়া পড়েছে দুধারের ফুটপাতে। ট্যাক্সি চোখে পড়ছে না। ইনটুইশন! কেউ কি অনুসরণ করছে তাকে ছায়ার ভেতর? বাঁদিকের ফুটপাতে চলে গেলেন। সারবন্দি আধুনিক স্থাপত্য। বিত্তবানদের বাসভবন। একটা ব্লকের পর গলিরাস্তা। একটা প্রাইভেট কার চলে গেল। গাড়ির শব্দের ভেতর পিস্তল বা রিভলবারের শব্দ। ট্রেইন্ড কান কর্নেলের। দ্রুত গলিটায় ঢুকে পড়লেন। আবার একটা গুলির শব্দ, খুব কাছে। জনহীন গলিতে কয়েকটা মোটরগাড়ি পার্ক করা আছে। একটা গাড়ির আড়ালে হুমড়ি খেয়ে বসলেন। রিভলবার বের করলেন। কিন্তু লেকভিউ রোডের মোড়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। সম্ভবত আততায়ী ওপাশের ফুটপাতে গাঢ় ছায়ার ভেতর গাছের ছায়ার ভেতর গাছের আড়ালে আছে। গাড়ির পাশ দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললেন। সামনে একটা মাঝারি রাস্তার মোড়। উজ্জ্বল আলো। দোকানপাট আছে কিছু। একটা খালি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, ইলিয়ট রোড। বখশিস মিলেগা। জলদি যানা পড়েগা!

শিখ ড্রাইভার হাসল।…আইয়ে। আইয়ে!

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ফোন করলেন ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে। অরিজিৎ সাড়া দিয়ে বললেন, নো ফাদার ডেভলাপমেন্ট। সরি, কর্নেল!

অরিজিৎ, একটা প্রশ্ন।

বলুন।

বিমলবাবুর নামে কোনো রিভলবারের লাইসেন্স ছিল খোঁজ নিয়েছ?

অলরেডি। লাইসেন্স উইপন। দুবছর আগে লাইসেন্স যোগাড় করেছিলেন ভদ্রলোক।

একজন নিরীহ চিত্রশিল্পীর কেন রিভলভার দরকার হয়, অরিজিৎ? ভেবে দেখেছ কি?

সরি,, এই অ্যাঙ্গল্টা আমরা ভেবে দেখিনি।

উনি আক্রান্ত হবেন টের পেয়েছিলেন। কিন্তু মদই ওঁকে সে সুযোগ দিল।

ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট, কর্নেল! ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে।

ডার্লিং! আজ কিছুক্ষণ আগে আমিও আক্রান্ত হয়েছিলুম।

সর্বনাশ! কী ব্যাপার?

আততায়ী, দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।

কোথায়, কোথায়?

উত্তেজিত হয়ো না। এমন বহুবার ঘটেছে আমার জীবনে।

আহা, জায়গাটা কোথায়?

লেকভিউ রোডে।

ওখানে কী করছিলেন?

গে ক্লাব থেকে ফিরছিলুম–পায়ে হেঁটে।

গে ক্লাবে কেন?

শ্যামলকান্তি মজুমদারের কাছে গিয়েছিলুম। তার কথা আশা করি ভুলে যাওনি। তার ব্যাকগ্রাউন্ড–

এক মিনিস্টারের আত্মীয়। ইলেকট্রনিক গুডসের ব্যবসা করেন।

পলিটিক্যাল ফাঁইল খুঁজতে বলেছিলুম, ডার্লিং!

কাজ চলছে। কিছু থাকলে আগামীকাল নাগাদ জানাতে পারব, আশা করি।

বিমলবাবুর কেসে কাউকে অ্যারেস্ট করার কথা কি ভাবছ তোমরা?

একটু পরে অরিজিৎ বললেন, চাপ আসছে। এটুকু বলতে পারি, খুব প্রভাবশালী মহলের চাপ। কেসটা নিয়ে প্রসিড করতে ভয় পাচ্ছেন অফিসাররা। আমি হেল্পলেস।

কর্নেল হাসলেন। তুমি একা লড়াই দিতে পারবে না, অরিজিৎ?

পারি–কিন্তু একা কতটুকু করা যাবে? অন্যান্য অফিসাররা সহযোগিতা না করলে কিছু করা কি সম্ভব? ভেবে দেখুন। যেমন ফাঁইল থেকে তিনটে পাতা উধাও হওয়ার ব্যাপারটা ধরুন। বড়জোর একটা গতানুগতিক ডিপার্টমেন্টাল তদন্ত হবে। বাগচিবাবুর ট্রান্সফার হবে। আর কী হবে? প্রশাসনের অবস্থা তো জানেন।

ঠিক আছে। ছাড়ি ডার্লিং!

আমার মনে হয়—

বলো!

ছেড়ে দিন। খামোকা কে কখন কোত্থেকে গুলি করবে, আত্মরক্ষার সুযোগই পাবেন না।

ছিঃ অরিজিৎ! এ কী বলছ তুমি?

সরি, কর্নেল! বলতে বাধ্য হলুম। আমারও এ চাকরি করতে আর ইচ্ছে করছে না।

হুঁ, বুঝতে পারছি। কর্নেল শাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, গুডনাইট! ছাড়ছি।

ফোনে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর ওপর যেমন, তেমনি অরিজিতের ওপরও অন্য আকারে হামলা ঘটেছে বোঝা গেল। প্রভাবশালী মহলের চাপ আসছে। তার মানে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি এই কেসের সঙ্গে জড়িত। শ্যামলকান্তির আত্মীয় একজন মিনিস্টার। কে তিনি? কোন মিনিস্টার? গোড়া থেকেই অরিজিতও শুধু এক মিনিস্টার বলে আসছে। তিনি কে, তা বলছে না। নাকি অরিজিৎ-ও জানে না? শুধু তাকে বলা হয়েছে, শ্যামলবাবু একজন মিনিস্টারের আত্মীয়।

কর্নেল জ্বলন্ত চুরুট দাঁতে কামড়ে চোখ বুজে হেলান দিলেন।…

১৩. বৃষ্টিসন্ধ্যার অভিযান

দুদিন ধরে আকাশ মেঘে ঢাকা। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি ঝরছে থেমে-থেমে। ঠাণ্ডাটা। আচমকা প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। কর্নেল দা পলিটিক্যাল টারময়েল ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিওরিং সিক্সটিজ-সেভেনটিজ বইটা খুঁটিয়ে পড়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। ইনডেক্সে বাসুদেব, সুশোভন কিংবা শ্যামলকান্তিদের উল্লেখ নেই। তবু একটা চেষ্টা, যদি দৈবাৎ কোনো সূত্র মেলে। মিলছে না।

আসলে কোনো সময়ের ইতিহাস যিনি লেখেন, তারকাছে বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বগুলিই ধর্তব্য হয়ে ওঠে। আর ইতিহাস লেখা হয় ভাষায়। ভাষার নিজস্ব একটা রূপরীতি, কাঠামো এবং গতি আছে। নিজের অজান্তে ইতিহাস লেখক সেগুলির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাছাড়া তার উপাদান সংগৃহীত হয় খবরের কাগজ, সরকারি দলিল দস্তাবেজ কিংবা সুযোগ থাকলে গোপন পুলিশ রিপোর্ট থেকে। এখন কথা হলো, এগুলি কতখানি নির্ভরযোগ্য? সংবাদদাতারা রং চড়িয়েই লেখেন, যাতে লোকে উত্তেজিতভাবে গিলে খায়। এদিকে সংবাদপত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, স্বার্থ এসবও থাকে। বহু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বেরোয় না–স্থানাভাব এবং আরও নানা কারণে। আর সরকারি রিপোর্টও তাই। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুগত একটা যান্ত্রিক ও দায়সারা নীতি মাত্র। তদন্ত কমিশন বসে। তার মধ্যেও নানামুখী স্বার্থ কাজ করে। যারা কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেয়, নানা কারণে তা সত্যমিথ্যায় মেশা কথাবার্তা। পুলিশ রিপোর্ট তো আরও হাস্যকর। এই বইয়ে মুর্শিদাবাদের বিপ্লবী নেতা একরাম আলির কথা আছে। কর্নেলের মনে পড়ল, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি গিয়েছিল সরেজমিন খবর আনতে। ফিরে এসে বলল, বোগাস। অজ গাঁয়ের এক নিরক্ষর খেতমজুর একরাম তার দাওয়ার ওপর দেয়ালে একটা লাল হরফে ছাপানো বিপ্লবীদের ইশতাহার সেঁটেছিল নেহাত দেয়ালের সৌন্দর্য আনতেই। দারোগাবাবু বিপ্লবীদের না পাকড়াও করতে পেরে রেগেমেগে ফিরে আসছিলেন। খোলামেলা ঘরের দেয়ালে ইশতাহার দেখামাত্র রোগাভোগা খেতমজুরটির বুকে নল ঠেকিয়ে রিভলবারের ট্রিগার টানেন। পরে তার প্রমোশনও হয়ে যায়। এই তো ব্যাপার।

না–পুলিশ রিপোর্ট মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়। আসলে ইতিহাসকাররা দূরে বসে প্রতীয়মান বাস্তবকেই লক্ষ্য করেন। প্রকৃত বাস্তবকে জানতে হলে ঘটনার মধ্যে থাকতে হয়।

কিন্তু ঘটনার মধ্যে থাকারও একটা ব্যাপার আছে। বিপ্লবী নিজে যখন তার বিপ্লবকাজের বর্ণনা করেন, তখন তিনিও ভাষার নিজস্ব নিয়মের অধীন হয়ে পড়েন তো বটেই, উপরন্তু মানুষের সাধারণ স্বভাববশে তিনিও তাঁর কীর্তি ওপররঙ চড়ান।

একরাম আলির বুকে আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঠেকিয়ে দারোগাবাবুর ট্রিগারে টান এবং একরাম আলির মৃত্যু–তথ্য হলো এইটুকুই। বাকিটা গণ্ডগুলে। এই বইটাতে, সুতরাং, কর্নেল শুধু তথ্য–নিছক তথ্য হাতড়াচ্ছিলেন দুদিন ধরে। ৫ তথ্য তার এই কেসে কাজে লাগবে, সেই তথ্য কোথায়?

বইটা মুড়ে চুরুট ধরালেন। হাতের কাছে কফির পেয়ালা। বিকেল চারটেতেই কলকাতা অন্ধকার। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া বইছে তুখোড়। এইসময় কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠী এসে বলল, একজন মেয়েছেলে বাবামশাই! হাতে রাঙা ছাতি, কিন্তু যা বাতাস! ভিজে একশা।

কর্নেল আস্তে বললেন, আসতে বল্!

তপেশ বসাকের স্ত্রী হয়তো। কিছু কি ঘটেছে? সোজা হয়ে বসলেন। কিন্তু তাকে একটু চমকে দিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকল কেয়া রায়। চাঁদর ভিজে গেছে। খালি পা। জুতো ওয়েটিং রুমে খুলে এসেছে বোধ করি। মুখে প্রচণ্ড উদ্বেগ। নমস্কার করে বসে পড়ল। বলল, আমাকে চিনতে পারছেন!

হুঁ। তুমি কেয়া, প্রয়াত বাসুদেব রায়ের স্ত্রী।

কেয়া ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর বলল, ওর নাম বাসুদেব ছিল কি না জানি না। আপনাকে সেদিন বলেছি, ওকে তপেশ বলে জানতাম। ওই নামেই আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছিল।

কর্নেল একটু হাসলেন। অবশ্য ওর আসল নাম বাসুদেব রায় কি না তাও বলা কঠিন। হুঁ, বলো কী হয়েছে?

কেয়া একটু চুপ করে থাকার পর বলল, গতকাল শ্রীলক্ষ্মী ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বউবাজার ব্রাঞ্চ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি রেজেস্ট্রি ডাকে। লিখেছে, তপেশ বসাকের নামে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপজিট আছে এবং তার নমিনি করা আছে আমাকে আমার ঠিকানাও দেওয়া আছে।

স্ত্রী হিসেবে?

হ্যাঁ। কেয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল। ব্যাংক লিখেছে, আরেক ভদ্রমহিলা তপেশ বসাকের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে টাকা ক্লেইম করেছেন। কিন্তু তপেশ বসাকের ডেথ সার্টিফিকেট দুবছর আগেকার। অথচ তারপরও গত আগস্ট পর্যন্ত তপেশ বসাক টাকা জমা দিয়ে গেছে নিয়মিত। কাজেই ব্যাংক তার ক্লেইম নাকচ করেছে। আমাকেই তারা টাকা দেবে।

ভেরি ইন্টারেস্টি! তারপর?

আমি হাথিয়াগড়ে গিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট আনব ঠিক করেছিলুম। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া টাকা তো ব্যাংক দেবে না। কিন্তু আজ সকালে এই বেনামী চিঠিটা লেটার বক্সে পেয়েছি। সাহস হচ্ছে না যেতে।

বলে কেয়া একটা ভাঁজ করা চিঠি দিল কর্নেলকে। কর্নেল চিঠিটা খুললেন। তাতে লেখা আছে :

তপেশ বসাকের টাকা তোমার প্রাপ্য নয়। তুমি ওর ব্যাংকের টাকা দাবি করলে মারা পড়বে। সাবধান।

কিন্তু হরফগুলো মুদ্রিত এবং নানা সাইজের হরফ। ছাপানো কাগজ থেকে কেটে আঠা দিয়ে সাঁটা শব্দগুলি। কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ।

কেয়া বলল, আমি আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি, কর্নেল!

কর্নেল বললেন, হাথিয়াগড়ে না গিয়েও তুমি চিঠি লিখে এবং পুলিশের সাহায্যে ডেথ সার্টিফিকেটটা আনাতে পারো। বিয়ের রেজেস্ট্রি পেপার সাবমিট করতে পারো। কিন্তু–

কিন্তু বেনামী চিঠিতে আমাকে শাসানো হয়েছে।

হ্যাঁ। তুমি মেয়ে। মাথার ওপর কোনো পুরুষ গার্জেন নেই। ভাববার কথা।

ষষ্ঠী ট্রেতে কেয়ার জন্য চা, কর্নেলের জন্য কফি এবং প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স রেখে গেল। কেয়া কর্নেলের কথায় অনিচ্ছার ভঙ্গিতে চায়ের কাপ তুলে নিল। একটু পরে কর্নেল বললেন, তুমি একটা ফ্ল্যাট কিনেছ বলছিলে। সেটার দাম কত?

আড়াই লাখ প্রায়। এর মধ্যে বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইনসিওরেন্স, মায়ের গয়না বেচে এক লাখ দিয়েছি। বাকিটা দু কিস্তিতে দেবার কথা। নইলে ফ্ল্যাটের দখল পাব না। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি একেবারে। ট্রেডিং কনসার্নে টাইপিস্টের চাকরি করি।

কর্নেল ওর দিকে তাকালেন। গোপন কোরো না। তপেশ ওরফে বাসুদেব নিশ্চয় বাকি টাকা দেবে বলেছিল। না হলে ওই এক লাখ দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করতে না?

কেয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, হ্যাঁ। ও প্রতিশ্রুতি না দিলে রিস্ক নিতুম না। ওকে অবিশ্বাস করার কারণ তো ছিল না। তাছাড়া–

তাছাড়া?

কেয়া ধরা গলায় বলল, ও বলেছিল নতুন ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। আমার একটা বড় স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেল!

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। ফ্ল্যাটের দখল না পেলে বেচবেই বা কেমন করে? ভুইফোড় সব হাউসিং কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। তাদের জটিল ব্যবস্থা সরল লোকদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে।

কেয়া কেঁদে ফেলল। আমাকে আপনি বাঁচান, কর্নেল!

অধীর হয়ো না। দেখছি, কী করা যায়। কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন। …, চা খেয়ে নাও। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। ভেবো না, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।

কিছুক্ষণ পরে কেয়াকে লাল ল্যান্ডরোভারে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কর্নেল চললেন দক্ষিণে। মির্জাপুর স্ট্রিটে পৌঁছে তপেশ বসাকের বাড়ির দরগায় কড়া নাড়লেন। সেই বারো ঘর এক উঠোন। দরজা খুললেন এক অচেনা ভদ্রলোক। কর্নেল বললেন, মিসেস রমা বসাকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ভদ্রলোক অবাক হয়েছিলেন। মুখে কেমন হাসি। বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো স্যার? তপেশ কে এমন কেউকেটা ছিল যে তার বউয়ের কাছে হর্দম গাড়ি চেপে সায়েবসুবো লোকেরা যাতায়াত করছেন?

হুঁ, রমার কাছে গাড়ি চেপে কেউ বা কারা যাতায়াত করেছে। কর্নেল বললেন, ইনসিওরেন্সের ব্যাপার। তদন্ত হচ্ছে। প্লিজ, রমা দেবীকে একটু খবর দিন।

একটু পরে রমা এসে কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সেদিন যে তার ঘরে গিয়েছিল, এরমা যেন সেরমা নয়। বিরক্ত এবং বিব্রত। বলল, বলুনকী বলবেন।

কর্নেলের গায়ে বর্ষাতি। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হাসলেন।… এখানে। দাঁড়িয়ে বলা যাবে না। একটু সময় লাগবে।

রমা নির্লিপ্ত মুখে বলল, দেখেছেন তো মোটে একখানা ঘর। উনুন জ্বেলেছি। ধোঁয়ায় ভর্তি!

রমা, ব্যাংকের টাকা তুমি পাবে না–সে তো জানোই। তবু কেন অন্যের প্ররোচনায় বিপজ্জনক ফঁদে পা দিতে যাচ্ছ?

রমা শক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। ঝাঝালো স্বরে বলল, সে আমি দেখব। মামলা লড়ব।

তোমাকে কে এসে লোভ দেখিয়েছে, রমা?

রমার চোখ জ্বলে উঠল। বলল, আমি কি কচি মেয়ে? আমার স্বামীর নামে ডিপজিট–অন্য কেউ তার বউ সেজে দাবি করলেই হলো?

কর্নেল বুঝলেন, ওকে বোঝানো বৃথা। গাড়িওয়ালা কেউ এসে ওকে লোভ দেখিয়েছে।–নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে, সাহসে বাঘিনী হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে না, তার স্বামীর মৃত্যুর পরও একাউন্টে ক্রমাগত টাকা পড়েছে এবং নমিনি কেয়া রায়-কাজেই তার দাবি টিকবে না। হুঁ, কারুর মৃত্যুর পর সেই লোকটির নামে কেউ টাকা জমা দিতেও পারে ধরা যাক, কোনো দেনাকারী দেনার টাকা তার পাওনাদারের মৃত্যুর পরও একাউন্টে জমা দিতে থাকে। এই ছুতো ধরেই রমার মুরুব্বি লড়বে হয়তো। এমন কী সেই মুরুব্বি কেয়ার বিয়ের কাগজটাও জাল বলে প্রমাণ করতে চাইবে। ঘুষ দেবে যথাস্থানে। আজকাল নয়কে ছয় করা কিছু কঠিন নয়। কিন্তু পরিণামে যদি মামলা জেতেও, টাকাটা রমা পাবে না, সেটা নিশ্চিত। তার মুরুব্বির হাতেই যাবে।

কর্নেল বললেন, যে তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে, তার নাম কী রমা?

রমা বলল, অত কথার জবাব দেবার সময় নেই আমার। কোর্টে যা হবাস হবে।

সে চলে গেল। কর্নেল গাড়িতে গিয়ে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ মনে হলো, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের এক কাপ প্রখ্যাত কফি খেয়ে গেলে মন্দ হয় না।

সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেল তিনমূর্তির সঙ্গে। শ্যামলকান্তি, সুভদ্র আর সৌম্য। দুপক্ষই থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর শ্যামলকান্তি সহাস্যে বললেন, হ্যাল্লো কর্নেল!

কর্নেল বললেন, শীতের সন্ধ্যা এবং বৃষ্টি এক পেয়ালা কফি দাবি করে মিঃ মজুমদার।

আমাদের অবশ্য পুরনো অভ্যাস। ছাত্রজীবন থেকে এই কফিহাউসে আনাগোনা।

আমি কোনো প্রশ্ন করিনি, মিঃ মজুমদার।

শ্যামলকান্তি হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে নেমে গেলেন। সৌম্য ও সুভদ্রের মুখে নির্লিপ্ততা। কর্নেল উঠে গেলেন দোতলায়। উঁকি মেরে ভিড় দেখে তিনতলায় গেলেন। ডানদিকে ব্যালকনির মতো অংশে একটা টেবিল খালি দেখে বসলেন সেখানে। তিনতলায় ভিড়টা কম। এখানে কফির দাম বেশি। কফির অর্ডার দিয়ে ঝুঁকে দোতলার ভিড়টা দেখছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল, দোতলার দরজা দিয়ে ফের শ্যামলকান্তি, সুভদ্র ও সৌম্য ঢুকছেন। তিনজনে মিলে কাকে খুঁজছেন যেন। কর্নেলকে? কর্নেল দ্রুত টেবিল থেকে উঠে পড়লেন। দরজা দিয়ে বেরিয়ে সামনে একটা বই কোম্পানির অফিস। দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দুজন কর্মচারী টেবিলে কাজ করছিলেন। একজন বললেন, নিচে স্যার, দোতলায় যান।

কর্নেল বললেন, আমি ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

তিনি তো চলে গেছেন একটু আগে।

কর্নেল চেয়ারে বসে আস্তে বললেন, আমার কয়েকটা বিদেশী বইয়ের অর্ডার দেওয়া ছিল গত অক্টোবরে। একটু খোঁজ করবেন কি, প্লিজ?

রসিদ?

এই রে! রসিদটা তো হারিয়ে ফেলেছি। তবে আপনাদের অক্টোবরের অর্ডার ফাঁইলটা যদি দেখেন দয়া করে। আমার নাম কর্নেল এন সরকার। দুশো টাকা জমা দেওয়া আছে। ওয়েস্ট জার্মানির মেকার অ্যান্ড উইনবার্গার কোম্পানির প্রকাশিত বই।

মণিদা, দেখ তো! ইনি কী অর্ডার দিয়েছেন। ওয়েস্ট জার্মানি।

মিনিট কুড়ি খুঁজেও পাওয়া গেল না। কর্নেল উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। বললেন, কী বিচ্ছিরি বৃষ্টি দেখুন তো!

নিচে শ্যামলকান্তি, সৌম্য ও সুভদ্র একটা কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়ির কাছে যাচ্ছে। তারা গাড়িতে ঢুকল। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে কর্নেল সরে এলেন। বললেন, বরং কাল ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে এসে দেখা করব। উনি চেনেন আমাকে৷ সরি, আপনাদের কষ্ট দিলুম!

না, না। আপনি কাল আসুন সন্ধ্যা ছটার মধ্যে। ম্যানেজারবাবু বলতে পারবেন।…।

কর্নেল তিনতলার সেই ব্যালকনির কাছে গিয়ে দেখেন, পরিচারক ট্রেতে কফি নিয়ে বিরক্ত মুখে ফিরে আসছে। কর্নেলকে দেখে এবার হাসল।

ওদের নিশ্চয় কিছু বলার ছিল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবলেন। বলার ছিল–অথচ এ মুহূর্তে তিনি শুনতে চান না ওদের কথা। বলার তাগিদ কতটা, সেটাই আঁচ করা দরকার আগে। তাগিদ বা গরজ যখন ওদের, তখন কোনোসময় যোগাযোগ করবেই।

বিল মিটিয়ে বখশিস দিয়ে নেমে এলেন নিচে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইচ্ছে হলো, মির্জাপুর স্ট্রিট হয়ে ঘুরে যাবেন। উইন্ডস্ক্রিন তুলে দিলেন। কলেজ স্কোয়ার চক্কর দিয়ে মোড়ে গতি একটু কমালেন।

রমাদের বাড়ির নিচে কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

কর্নেল চললেন বউবাজারের দিকে। ১৭/২ ফকিরচাঁদ লেনে তপেশ বসাক বা বাসুদেব রায় থাকত। পুলিশ তার ঘরে কেয়ার ছবি পেয়েছিল। প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে দশহাজার টাকার নোট ওই ঠিকানায় বুক পোস্টে মোতিগঞ্জ ডাকঘর থেকে পোস্ট করেছিল তপেশ ওরফে বাসুদেব।

বাড়িটা তিনতলা এবং তত বেশি পুরনো নয়। ছিমছাম, সুন্দর। নিচের তলায় একটা অফিস। দরজায় তালা। দোতলায় একটা ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল টিপলেন। একটু পরে এক ভদ্রলোক দরজার ফাঁক দিয়ে বললেন, কাকে চাই?

তপেশ বসাকের ফ্ল্যাটটা কোন তলায় বলতে পারেন?

দরজা খুলে গেল। কর্নেলকে দেখে নিলেন ভদ্রলোক–আপাদমস্তক। তারপর একটু হেসে বললেন, স্যার কি থানা থেকে আসছেন?

কর্নেল তার আইডেন্টিটি কার্ডটা এগিয়ে দিলেন।

ভদ্রলোক ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কথাটা বোধ করি বুঝতে পারলেন না। বললেন, তপেশ আমারই ভাড়াটে ছিল। সে তো বিহারে কোথায় সুইসাইড করে মারা গেছে। সেদিন পুলিশ এসে ঘর সার্চ করে গেছে। ব্যাপারটা কী বলুন তো স্যার?

আপনার নামটা জানতে পারি?

সনকুমার বোস। বিজনেস-টেস করি। নিচে অফিস–দেখেছেন বোধ করি।

তপেশবাবু সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু জানতে চাই। নানা, আপনার বিব্রত হবার কারণ নেই। ওঁর একটা ইন্সিওরেন্সের ব্যাপারে ঝামেলা বেধেছে। তারই তদন্তে এসেছি।

একটু ইতস্তত করে সনৎবাবু বললেন, ভেতরে আসুন।

বসার ঘরটা ছিমছাম সাজানো। ভদ্রলোকের সৌন্দর্যবোধ আছে। সোফায়। বসে কর্নেল বললেন, তপেশবাবু কোন ফ্ল্যাটে থাকতেন?

তিনতলার সিঙ্গলরুম একটা মোটে ফ্ল্যাট। কর্পোরেশন তিনতলায় পার্মিশান দেয়নি। সনাবু কঁচুমাচু মুখে হাসলেন। যাই হোক, ম্যানেজ-ট্যানেজ করে ওই সিঙ্গলরুম ফ্ল্যাটটা টিকিয়ে রেখেছিলুম। বছর দুই আগে আমার বড় ছেলে প্রণব অনুরোধ করল, ওর এক কলেজ লাইফের বন্ধু ফ্ল্যাট খুঁজছে। তো প্রণবের কথায় তপেশকে দিলুম।

প্রণববাবু আছে কি?

বেরিয়েছে কোথায়।

কখন ফিরবেন?

বলা কঠিন। তবে রাত্তির নটার বেশি পর্যন্ত বাইরে থাকে না।

প্রণববাবু বলেছিলেন তপেশ তাঁর বন্ধু?

আজ্ঞে।

তপেশের ফ্ল্যাটে বাইরের লোকটোক আসত, জানেন?

সনৎবাবু একটু ভয় পেলেন যেন। গোঁফের একটা পাশ চুলকে বললেন, আমি তো বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। লক্ষ্য করিনি কিছু। ও তেমন আজেবাজে প্রকৃতির ছিল বলেও শুনিনি। তবে লোকের কথা বলছেন। সব মানুষেরই জানাশোনা লোক আছে। তারা যাতায়াত করতেই পারে। এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করি?

ধন্যবাদ। এইমাত্র কফিহাউসে কফি খেয়ে আসছি।

এক ভদ্রমহিলা পর্দা তুলে উঁকি দিচ্ছিলেন। সনাবু তাঁর উদ্দেশে বললেন, তপেশের ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে ইনি তদন্ত করতে এসেছেন। স্যার, প্রণবের মা।

কর্নেল তাকে নমস্কার করলে উনিও নমস্কার করে এ ঘরে এলেন। চেহারায় জাঁদরেল গিন্নির হাবভাব। সোফার একদিকে বসে বললেন, তপেশের কাছে। লোক-টোক তত আসত না। এমনিতে মেজাজ ভাল কিন্তু খুব রগচটা আর খামখেয়ালি ছিল। হাওর এক পিসতুতো না মাসতুতো বোন মাঝে মাঝে আসতে দেখেছি।

রোগা ছিপছিপে চেহারা–ফর্সা রঙ?

হ্যাঁ। তবে আমার কিন্তু বিশ্বাস হত না, জানেন?

কর্নেল বুঝলেন, মেয়েদের চোখ। ঠিকই ধরেছিলেন। কেয়া আসত মাঝে মাঝে। বললেন, তপেশ কোথায় চাকরি করত জানেন?

বিচক্ষণ ভদ্রমহিলা দ্রুত বললেন, সে তো আপনাদের রেকর্ডে লেখা থাকার কথা। ইনসিওরে কোম্পানি থেকে তদন্ত করতে এসেছেন বলছেন!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভেরিফাই করা একার ম্যাডাম।

বলত তো কোথায় চাকরি করে। কিন্তু বিশ্বাস হত না। ভদ্রমহিলা কড়া মেজাজে বললেন। মাঝে মাঝে দুমাস-তিনমাস বেপাত্তা। আবার হঠাৎ করে এসে গেল।

সনবাবু বললেন, সে ধরো–কোম্পানির কাজে বাইরে যেতেই হয়। ওটা কোনো ব্যাপার নয়। তবে প্রণব ওর সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশি জানতে পারে। যদি ঘণ্টাখানেক ওয়েট করতে পারেন, এসে যাবে।

কর্নেল বললেন, তপেশবাবুর ঘরটা একটু দেখতে চাই।

সনবাবু স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলা চাপা ও ষড়যন্ত্রসংকুল কণ্ঠস্বরে বললেন, ঘরে একটা ক্যাম্পখাট আর বিছানা ছাড়া কিছু নেই। একটা জলের কুঁজো পর্যন্ত না। কিছু না। এটাই কেমন যেন লাগত আমার।

ঘরটা দেখতে চাই। ফের কথাটা কর্নেল শক্ত গলায় বললেন।

সনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। …না, না। দেখাতে আপত্তি কী? আসুন, দেখাচ্ছি। কৈ গো, চাবিটা এনে দাও।

সনৎবাবুর স্ত্রীর কিন্তু খুব উৎসাহ লক্ষ্য করলেন কর্নেল। ঝটপট চাবি এনে দিলেন তিনি। দুপদাপ শব্দ করে পা ফেলে অনুসরণ করলেন। সনবাবু যখন তালা খুলছেন, ভদ্রমহিলা ফের চাপা স্বরে কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, বরাবর আমার কেমন একটা খটকা ছিল তপেশের ওপর। কিন্তু প্রণবের বন্ধু। কিছু বললেই প্রণব মেজাজ দেখাত। একদিন দেখি–

সনবাবু ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলেছেন। কম পাওয়ারের আলো। কর্নেল তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। সনৎবাবুর স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি। উনি হঠাৎ থেমে গেলে বললেন, বলুন ম্যাডাম!

সনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, কী সব বলছ বুঝিনে! ছেড়ে দাও তো। পরের কথায় কাজ কী?

থামো! গৃহিণী প্রায় গর্জন করলেন। কর্নেলের দিকে ঘুরে তেমনি ষড়যন্ত্রসংকুল স্বরে বললেন, একদিন বিকেলে ছাদে ঘুরতে এসেছি এই দরজাটা খোলা। হঠাৎ দেখি, তপেশ বিছানায় বসে নোট গুনছে। এই এত্তো একশোটাকার নোট! সেদিনই সন্দেহ হয়েছিল, ও লোক ভাল নয়।

সনৎবাবু খিক খিক করে হাসলেন। কী আশ্চর্য! টাকা গুনলে লোক ভাল হয় না! একেই বলে ফেমিনিন লজিক।

গৃহিণী চোখ কটমটিয়ে বললেন, অত্তো টাকা যার, সে এমনিভাবে থাকে। কোথায় পায় অত্তো টাকা? তোমায় বললুম তো উড়িয়ে দিলে!

সনৎবাবু বললেন, আহা! ওর কোম্পানির কালেকশানের টাকাও তো হতে পারে।

কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখছিলেন। দেয়ালে একটামাত্র ক্যালেন্ডার ঝুলছে। সেও গত বছরের ক্যালেন্ডার। ক্যাম্পখাটে শুধু একটা গুটোনো বিছানা। বিছানাটা খুলে বিছিয়ে দিলেন। পুলিশ সার্চ করে শুধু কেয়ার ছবি পেয়েছে। তবু তোশকটা টিপে টিপে কর্নেল তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করলেন। কর্তা-গিন্নি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল বালিশের ভেতরটাও খুঁজলেন। কিছু নেই। তারপর দেয়াল-ক্যালেন্ডারটার পাতা ওল্টাতে থাকলেন। দেখলেন কয়েকটা মাসের কিছু-কিছু তারিখের চারিদিকে গোল করে ডটপেনের বর্ডার। তারিখগুলি চিহ্নিত। ১৭ জুন, ২২ জুন, ৫ আগস্ট, ১২ অক্টোবর, ১৯ অক্টোবর, ১৫ ডিসেম্বর। ১৫ ডিসেম্বরে ঢ্যারাচিহ্ন। কর্নেল ভদ্রমহিলার দিকে ঘুরে বললেন, এই ক্যালেন্ডারটা পরীক্ষা করা দরকার। যদি অনুমতি দেন, নিয়ে যাব।

ভদ্রমহিলা উত্তেজিতভাবে বললেন, নিয়ে যান। পরীক্ষা করে দেখুন। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোক!

সনবাবু স্ত্রীর হাবভাব দেখে নীরস ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ–ও দিয়ে আর কী হবে? বিছানাটাও তো সরাতে হবে ঘর থেকে। নতুন ভাড়াটে আসবে সামনে মাসের পয়লা।

কর্নেল ক্যালেন্ডারটা খুলে জড়িয়ে হাতে নিলেন। বললেন, এনাফ! চলুন, নিচে যাই!

সিঁড়ির নিচে এক শক্তসমর্থ চেহারার যুবকের সঙ্গে দেখা হলো। ফিল্ম হিরোর আদলে পোশাক ও চুলের সাজ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে। সনবাবু একটু হেসে বললেন, প্রণব–আমার বড় ছেলে! পিন্টু, ইনি ইনসিওরেন্স থেকে তপেশের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করছেন। মোটা টাকার পলিসি আছে। নাকি।

পলিসির কথাটা একটু বাড়িয়ে বললেন সনত্বাবু। কর্নেল বুঝলেন, সনৎবাবু স্ত্রীকে যেমন, তেমনি ছেলেকেও সমঝে চলেন। হু, একটু দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ–অন্তত পারিবারিক ক্ষেত্রে। তবে এমন মানুষ ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্টোটি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতি জাঁদরেল সম্রাটও ও সম্রাজ্ঞী বা পুত্রের কাছে কাবু থাকার কথা ইতিহাসে বিস্তর আছে।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, প্রণববাবু, আপনাকে আমার খুবই দরকার। কাল সকালে একবার সময় হবে কি? আমার কার্ড দেওয়া আছে আপনার বাবার কাছে।

সনৎবাবুর হাতেই ছিল কার্ডটা। প্রণবকে দিলেন। প্রণব দেখে নিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল। আস্তে বলল, আই সি! আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ?

তার বাবা-মা পরস্পর তাকালাকি করলেন। ইনভেস্টিগেটর কথাটায় যে আসলে ডিটেকটিভ বোঝায়, জীবনে এই প্রথম জানতে পারলেন যেন। দুটি মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, ইয়ং ম্যান! শুনলুম, তপেশ আপনার বন্ধু ছিল। কাজেই আপনার সহযোগিতা আশা করি পাব।

প্রণব বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী? তপেশ তো সুইসাইড করেছে। পুলিশই বলেছে।

হ্যাঁ, সুইসাইড। কর্নেল চুরুট বের করে লাইটার জ্বাললেন। ধোঁয়ার সঙ্গে বললেন, বাট দেয়ার ইজ সামথিং কুয়্যার–কিছু গণ্ডগোল আছে। আপনি আপনার বন্ধুর জন্য আমাকে সাহায্য করুন।

প্রণব কার্ডটা মুঠোয় ধরে বলল, ওকে। কাল মর্নিংয়ে যাব।…

১৪. আবার জটিলতার মুখোমুখি

বৃষ্টিটা এদিনও ছাড়ল না। বরং একটু জোরালো। নিচের রাস্তায় জল না জমলেও লোজন বা গাড়ি চলাচল কম। ছাদে কিছু ক্যাকটাসের ওপর পলিথিন শিট চাপিয়ে রাখতে হয়েছে। বৃষ্টিতে ওই মরুক্যাকটাস পচে যায়। ড্রইং রুমের জানালায় ঝুঁকে কর্নেল উদ্বিগ্নভাবে প্রতীক্ষা করছিলেন প্রণবের। মাঝেমাঝে বিরক্তিকর শব্দে চলে যাচ্ছে একটা করে ট্রাম। অন্যদিন শব্দটা মোটেও বিরক্তিকর মনে হয় না। কানসওয়া হয়ে গেছে। আটটা বাজলে ফের উঁকি দিলেন জানালায়। একটা নীল রঙের ফিয়াট এসে উল্টোদিকের ফুটপাতে পানের দোকানের সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভারকে দেখা যাচ্ছিল না। বোঝা গেল, সে কিছু জানতে চাইছে দোকানদারের কাছে। তারপর গাড়িটা এগিয়ে গিয়ে ঘুরল। সানি লজের নিচের তলার পার্কিং স্পটে ঢুকল। প্রণব কি?

হ্যাঁ, প্রণব। কর্নেল নিজেই দরজা খুলে ড্রইং রুমে নিয়ে এলেন তাকে। প্রণব বলল, সরি কর্নেল সরকার! গাড়িটা গণ্ডগোল করছিল। গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে ফিটফাট করতে দেরি হয়ে গেল!

ষষ্ঠীকে বলা ছিল। সে কফি এবং স্ন্যাসের ট্রে রেখে গেল। কর্নেল কফি ঢেলে পেয়ালা তুলে ওর হাতে দিয়ে বললেন, আগে ঠাণ্ডাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার ডার্লিং।

বৃদ্ধের অমায়িকতায় যুবকটি একটু অভিভূত যেন। তার চেহারার স্মার্টনেস একটু ক্ষয়ে গেল। নম্রভাবে হেসে বলল, হ্যাঁ-ঠাণ্ডাটা বড্ড বেড়ে গেছে।

তুমি আমার পুত্রের বয়সী। অতএব তুমিই বলছি।

স্বচ্ছন্দে। কফিতে চুমুক দিয়ে প্রণব বলল। ..রঞ্জনের ব্যাপারটা কাগজে পড়ে আমি–

এক মিনিট! তপেশের কথা বলছ কি?

প্রণব একটু হাসল।…ওর আরও দুটো নাম ছিল। তপেশ বসাক এবং বাসুদেব রায়।

তুমি জানতে?

কেন জানব না? আমরা একসঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়েছি। হি ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ওর আসল নাম রঞ্জন মিত্র। আ সেলফ-মেড বয় বলা যায় সেভেনটিজের গোড়ায় রঞ্জন কলেজ ছেড়ে পলিটিক্স করতে যায়। আই মিন, হি ওয়াজ আ নকশাল। অ্যাকশান স্কোয়াডে ছিল। আমি ওকে নিষেধ করতুম। কিন্তু ও বড্ড জেদী আর খেয়ালী প্রকৃতির ছেলে। যা একবার মাথায় ঢুকবে, তাই নিয়ে মেতে ওঠা ওর স্বভাব ছিল।

কর্নেল আস্তে বললেন, পরে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিল রঞ্জন?

হ্যাঁ। ফাস্ট্রেশান। প্রণব বাদাম তুলে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, প্রায় সাত বছর পরে ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলো একদিন। রাস্তায় দেখা। তারপরও মাঝেমাঝে দেখা হত। বছর দুই আগে কফিহাউসে একদিন দেখা। একটা ফ্ল্যাট খুঁজছে বলল। তো ওর মধ্যে দারুণ একটা অ্যাট্রাকশান ছিল, জানেন? আমাদের বাড়িটা সবে রিমডেলিং করা হয়েছে।

কর্নেল কথার মধ্যে বললেন, তুমি কেয়াকে নিশ্চয় চেনো!

প্রণব হাসল। ভীষণ চিনি। রঞ্জন আর কেয়ার বিয়ের রেজিস্ট্রেশনে আমি একজন সাক্ষী। দ্বিতীয় সাক্ষী বিমল মুখার্জি নামকরা পেইন্টার। জানেন? বিমল সুইসাইড করেছে। কাগজে বেরিয়েছিল খবর।

কর্নেল উত্তেজনা চেপে বললেন, কেয়ার দাদা সুশোভনকে নিশ্চয় তুমি চিনতে?

খুবই চিনতুম। সেও নকশাল ছিল। কেয়ার কাছে শুনেছি, দলের লোকেরাই তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে খুন করেছিল।

তুমি কি জানতে, পরে রঞ্জন ব্ল্যাকমেলার হয়ে উঠেছিল? কিছু লোককে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করত।

প্রণব নড়ে বসল।…অসম্ভব! অবিশ্বাস্য!

একটু পরে কর্নেল বললেন, সুভদ্র সিং নামে কাউকে তুমি চেনো?

সুভদ্র…সুভদ্রনামটা চেনা মনে হচ্ছে। প্রণব স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল। নন-বেঙ্গলি?

হ্যাঁ।

বুঝেছি। প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। আমাদের ব্যাচে। তার সঙ্গে তত পরিচয় ছিল। তবে রঞ্জনের সঙ্গে ছিল মনে পড়ছে।

সুভদ্র কি পলিটিক্স করত?

প্রণব হাসল। তখন সময়টাই ওইরকম। বিশেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন রাজনীতির তীর্থ। আমার কথা অবশ্য আলাদা। আসলে ফিল্ম-টিল্মের দিকে প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল আমার। হিরো হবার স্বপ্ন দেখতুম। পরে অবশ্য কয়েকটা বাংলা ছবিতে ছোটখাট রোলে চান্স পেয়েছি। তবে বাংলা ছবির ব্যাপার তো! এখানে কিস্যু হবে না। এদিকে বোম্বে যাওয়ারও অসুবিধে। প্রণব একটু গম্ভীর হলো এবার। অসুবিধে মানে–খুলেই বলি, আমি রিস্ক নিতে সাহস পাইনে।

তুমি শ্যামলকান্তি মজুমদার নামে কাউকে চেনো–চিনতে?

প্রণব ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, নাঃ। কে সে?

রঞ্জন তাকে চিনত।

রঞ্জন চিনতে পারে। ওর নানা মিস্টিরিয়াস ব্যাপার ছিল। বুঝতে পারতুম না। বুঝতে চেষ্টাও করিনি। কী দরকার?

কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ, ডার্লিং! আপাতত আর কিছু জানার নেই তোমার কাছে।

প্রণব বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী? প্লিজ কর্নেল সরকার, একটু খুলে বলুন।

কর্নেল বললেন, আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। সব জানতে পারবে।

ফোন বাজল। কর্নেল ফোন ধরে সাড়া দিলেন। অরিজিৎ লাহিড়ীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। …হাই ওল্ড ডাভ! বৃষ্টিবাদলায় কেমন কাটাচ্ছেন?

ফাইন, ডার্লিং! কিছু বলার আছে?

খুব বিজি মনে হচ্ছে। মক্কেল আছে নাকি সামনে?

হ্যাঁ।

নতুন কেস? নাকি তপেশ বসাক সংক্রান্ত?

তোমার খবর বলো, ডার্লিং!

শ্যামল মজুমদারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিমলবাবুকে খুনের অভিযোগে! বলো কি! সেদিন বললে, খুব প্রেসার আসছে—

এসেছিল! মিরাকিউলাসলি হঠাৎ উল্টো প্রেসার এল। আই মিন, চাকাটা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করল। বিমলবাবুর পাশের ফ্ল্যাটের মিঃ অ্যান্ড মিসেস। প্রধান এবং আরও ফ্ল্যাটের কিছু লোককে জেরা করে জানা গেছে, খুনের দিন বিকেলে শ্যামল মজুমদারের সঙ্গে বিমলবাবু চড়া গলায় ঝগড়া করছিলেন।

শ্যামলবাবুর আত্মীয় তো মিনিস্টার বলেছিলে! তিনি নীরব?

অরিজিৎ হাসলেন।…আমার ধারণা খবরটা বোগাস। শ্যামলবাবুর নিজের রটনা। নৈলে সেই মিনিস্টার–যিনিই হোন, ওঁকে বাঁচাতে পাল্টা চাপ দিতেন। জামিন নিতেও কেউ চেষ্টা করছে না পর্যন্ত। এদিকে আরও একজনের নাম এই কেসে জড়িত। তাকে সনাক্ত করেছেন প্রধান দম্পতি। শ্যামলকান্তি এবং বিমলবাবুর এক বন্ধু সৌম্য চৌধুরী। তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। খোঁজা হচ্ছে।

আবার সব জট পাকিয়ে গেল, ডার্লিং! গেরো প্রায় খুলে এনেছিলুম!

সে কী!

পরে বলব। আপাতত শুধু বলছি, আবার অন্ধকারে পড়ে গেলুম। আচ্ছা, রাখছি।…

প্রণব একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। বলল, তাহলে আসি, কর্নেল সরকার।

ঠিক আছে। দরকার হলে পরে যোগাযোগ করব।

কর্নেল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। প্রণব বেরুলে হঠাৎ বললেন, এক মিনিট। তুমি সৌম্য চৌধুরি নামে কাউকে চেনো?

প্রণব হাসল…আমি একটু কম চিনি। তবে কেয়া বেশি চেনে।

কর্নেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টে তাকালেন।

প্রণব বলল, কেয়াকে আপনি তো চেনেন বুঝলুম। কথাটা তার কাছেই জেনে নেবেন।

একটু আভাস দাও, প্রণব!

সৌম্য কেয়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। বাট হি বিট্রেইড হার। তখন রঞ্জন কেয়াকে বিয়ে করে।

প্রণব সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল! কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা বন্ধ করলেন। ড্রইং রুমে ফিরে আরামকেদারায় বসে চোখ বুজে অভ্যাসমতো দুলতে শুরু করলেন। আরও জটিল হয়ে গেল সব। শ্যামলকান্তিকে গ্রেপ্তারের বাধা হঠাৎ সরে গেল কেন? নেপথ্যে অন্ধকারে বসে কে খেলা করছে। এভাবে? সৌম্য চৌধুরী ফেরার হয়ে গেছেন। ঝানু লোক, বোঝা যায়। কিন্তু সুভদ্র সম্পর্কে অরিজিৎ নীরব। তার মানে, সে অভিযুক্ত নয়। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।…

১৫. কেয়ার আবির্ভাব

দুপুরে বৃষ্টি কমে গেছে। মেঘ ভেঙে রোদ্র ফুটেছে। কিন্তু কী হিম! এত হিম কলকাতায় কখনও পড়েনি। কর্নেল টেবিলে রঞ্জন মিত্রের ক্যালেন্ডারটা নিয়ে আবার বসেছেন। ১৭ এবং ২২ জুন ৫ আগস্ট, ১২ এবং ১৯ অক্টোবর, ১৫ ডিসেম্বর চিহ্নিত। ১৫ ডিসেম্বরে ঢ্যারাচিহ্ন। আতস কাঁচে খুঁটিয়ে অন্যান্য মাসগুলোর তারিখ দেখছিলেন কর্নেল।

১৫ ডিসেম্বর ঢ্যারাচিহ্ন কেন? বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন, অথবা কিছুর সমাপ্তি? হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, ডটপেনের কালি ফুরিয়ে গিয়েছিল কারণ ঢ্যারার নিচে বাঁদিকের অংশ পরিষ্কার ফোটেনি।

টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে আতস কাচ রাখলেন। কালিহীন রেখায় একটা হরফের দাগ ফুটে উঠল। ইংরেজি হরফে জে। কী হতে পারে এটা? কোনো নামের আদ্যাক্ষর?

কলিং বেল বাজল। দ্রুত ক্যালেন্ডারটা গুটিয়ে ড্রয়ারে ঢোকালেন। ষষ্ঠী বোধকরি ঘুমোচ্ছিল। দেরি করে দরজা খুলল। কেউ এলে তাকে বসিয়ে রেখে ষষ্ঠী খবর দেয় আগে। কিন্তু সে সে সুযোগ পেল না। কেয়া এসে ঢুকল ড্রইং রুমে। বিপর্যস্ত চেহারা। কর্নেল বললেন, বসো! কেয়া ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়।

কর্নেল গিয়ে মুখোমুখি বসে বললেন, বলো, ডার্লিং!

কেয়া ভাঙা গলায় বলল, পুলিশ আমাদের বাড়ি সার্চ করেছে কিছুক্ষণ আগে সৌম্যদা সম্পর্কে জিগ্যেস করছিল। সৌম্যদা–

সৌম্য চৌধুরি! কর্নেল আস্তে বললেন। ওঁকে চিনি।

কেয়া বলল, সৌম্যদার সঙ্গে এখন আমার কিসের সম্পর্ক? পুলিশ আমাকে খুব থ্রেট করল। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন তো? এ নিশ্চয় ওই মেয়েটার চক্রান্ত। আমার নামে আজেবাজে কথা বলে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে।

কর্নেল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, সৌম্যের সঙ্গে তোমার একসময় সম্পর্ক ছিল, কেয়া!

ছিল। কেয়া স্বীকার করল। কিন্তু সে তো অনেক আগের ব্যাপার। ওর পরিচয় পাওয়ার পর আর ওর সঙ্গে মিশতুম না। ও একটা লম্পট, মাতাল। বাবা পয়সা রেখে গেছে। দুহাতে ওড়ায়।

কেয়া, তুমি রঞ্জন মিত্র নামে কাউকে চেনো?

কেয়া চমকে উঠল। মাথাটা একটু নাড়ল।

কর্নেল শক্ত গলায় বললেন, কেয়া, তুমি রঞ্জনকে ভালই চেনো। সে তপেশ বসাক নামে ব্যাংকে টাকা জমা রাখত। কারণ পুলিশের রেকর্ডে ও ছিল ফেরারী পলিটিক্যাল আসামী। ওর নামে হুলিয়া ছিল।

কেয়া মুখ নামাল। ঠোঁট কামড়ে ধরল।

কর্নেল এবার একটু নরম হয়ে বললেন, তোমার দাদার খুনী কে সে জানত। তাকে নিয়মিত ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করত। ব্যাংকে সেই টাকা তপেশ বসাক নামে জমা রেখে গেছে।

কেয়া মুখ তুলে ভাঙা গলায় বলল, একটা মানুষের জীবনের দাম টাকা নিয়ে যদি কেউ আদায় করে, সেটা খুব অন্যায় বলে আমি মনে করি না।

তোমার দাদা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।

যে খুন করেছিল, সে বিশ্বাসঘাতক নয়? কেয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, সেও যে পার্টির সঙ্গে শেষে বিশ্বাসঘাতকতা করে সবাইকে ধরিয়ে দিয়ে নিজে গুছিয়ে মহাপুরুষ সেজে বসে আছে, তার বেলা? সেও যে এখন জনদরদী নেতা বনে গেছে, ভোট কুড়িয়ে ঝুলি ভরছে–বিশ্বাসঘাতক নয় সে?

কর্নেল তাকালেন। তুমি চেন তাকে?

চিনি। সবাই চেনে। কেয়া চোখে জল নিয়ে বলল। কার সাধ্য তাকে ছোঁয় এখন? পুলিশ–পুলিশেরও সে-হিম্মত আছে?

বুঝলুম। কিন্তু তোমার স্বামী রঞ্জন মিত্র তাকে ব্ল্যাকমেইল করত।

হ্যাঁ, করত।

যদি সত্যিই সে এখন এত শক্তিমান, কীভাবে রঞ্জন তাকে ব্ল্যাকমেইল করত? কেন সে রঞ্জনকে ধরিয়ে দিত না পুলিশের কাছে? কেন সে চুপচাপ টাকা গুনে দিত রঞ্জনকে?

কেয়া একটু চুপ করে থেকে চোখ মুছে আস্তে বলল, রঞ্জন একা তাকে ব্ল্যাকমেইল করত না। রঞ্জনের কাছে দাদার রক্তমাখা পোশাক ছিল শুধু। খুনের সময় যারা সেখানে ছিল, তারাও নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করত। কেউ সরকারি কন্ট্রাক্ট আদায় করত। কেউ বাসের পারমিট। কেউ শুধু বিদেশী মদ আদায় করেই খুশি থাকত।

কর্নেল ঝুঁকে গেলেন তার দিকে।…তুমি নিশ্চয় শ্যামল মজুমদার, সৌম্য চৌধুরী এবং বিমলবাবুর কথা বলছ?

কেয়া চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ওরা ব্ল্যাকমেইল করত নট ইন ক্যাশ, বাট ইন কাইন্ডস্।

আর সুভদ্র সিং?

বিশ্বাস করুন, তাকে আমি চিনি না।

কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে কিছুক্ষণ টানার পর ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে বললেন, কিন্তু তুমি তোমার দাদার খুনীকে তো চেনো। সম্ভবত তিনি এখন একজন মিনিস্টার। ইজ ইট?

কেয়া দু হাত জোড় করে বলল, ক্ষমা করবেন। তার গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা কারুর নেই। যদি আমি নামটা বলি, আপনি পুলিশকে বলবেন এবং উল্টে পুলিশ আমাদের মা-মেয়েকে পথে বসিয়ে ছাড়বে। এমন কি, গুলি করে মেরে একটা কেস সাজাবে।

আমি কথা দিচ্ছি কেয়া, পুলিশকে বলব না। আমি শুধু জানতে চাই তিনি কে।

ক্ষমা করবেন। আপনারও সাধ্য নেই আমাকে বাঁচানোর। আমাকে কেউ মেরে ফেললেও ওই নাম বলব না। বলতে পারব না।

কর্নেল ফের কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু শুধু রক্তমাখা পোশাক আর মুখের সাক্ষ্যের ভয় দেখিয়ে প্রভাবশালী একজন লোককে ব্ল্যাকমেইল করা যায় না। নিশ্চয় আরও কিছু নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ছিল। তুমি জানো, কী সেই প্রমাণ?

কেয়া আস্তে বলল, রঞ্জনের কাছে শুনেছি, একটা ফোটোগ্রাফ ছিল।

কিসের ফোটোগ্রাফ?

দাদাকে যখন খুন করছে, তখন ওদের কেউ একজন ক্যামেরায় ছবি তুলেছিল। এর বেশি এক বর্ণও জানি না। আপনি বিশ্বাস করুন।

কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। সুশোভনকে খুন করা হবে, সেটা যেমন ঠিক করা ছিল, তেমনি কে খুন করবে তাও যেন ঠিক করা ছিল। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, খুন করার সময় ছবি তুলে রাখার ব্যবস্থাও তৈরি ছিল। সমস্তটা যেন প্ল্যান করে সাজানো। তার মানে, (১) সুশোভনের খুনী কোনো বিত্তবান পরিবারের লোক এবং দলের নেতৃস্থানীয় ছিল। (২) সুশোভন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তারই বিরুদ্ধে। (৩) ফিল্মের নেগেটিভ থেকে কয়েকটা প্রিন্ট করা হয়েছিল। তা থেকে বিমলকুমারের মাথায় ওই বিমূর্ত ছবিটার আইডিয়া আসে। (৪) প্রেমিকার দাদা খুন হবে জানলে রঞ্জন আগেই সাবধান করে দিত। তার মানে, সে দৈবাৎ সেখানে উপস্থিত ছিল। (৫) খুনী টের পায়নি তার খুনের ছবি তোলা হচ্ছে। টের পাওয়ার কথাও নয়। হত্যার মুহূর্তে মানুষ অন্ধ হয়ে ওঠে। হিংসা তাকে অন্ধ করে। (৬) খুনী এখন দেশের নেতৃস্থানীয় এবং একজন মন্ত্রী। (৭) মোতিগঞ্জে তার ডেরা আছে একটা। গঙ্গার ধারে ওই ছোট্ট শহরটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। সেখানে বিত্তশালী এবং নেতা লোকেরা একটা বাড়ি করতেই পারে। (৮) রক্তাক্ত পোশাক হারিয়ে বিপন্ন বোধ করাই রঞ্জনের আত্মহত্যার কারণ। কর্নেল ধোঁয়ার রিঙের দিকে তাকালেন। ফিল্মের নেগেটিভটা ছোট্ট জিনিস। সেটা কোথায়, কার কাছে আছে? বোঝা যাচ্ছে, কেয়াকে এর বেশি মুখ খোলানো যাবে না। সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে এবার। বললেন, ঠিক আছে আমি পুলিশকে অনুরোধ করব, যাতে তোমাদের হ্যাঁরাস না করা হয়।

কেয়া আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল। হু, কেয়ার বাড়ি সার্চ করার উদ্দেশ্য সম্ভবত পুলিশের সাহায্যে ফিল্মের নেগেটিভটা উদ্ধার। রঞ্জনের প্রেমিকা এবং বউয়ের কাছে সেটা থাকার সম্ভাবনা ছিল। নিশ্চয় নেই। থাকলে কেয়া মনে জোর পেত। খবরের কাগজের দ্বারস্থ হত। ঢি ঢি পড়ে যেত চারদিকে। আজকাল বহু কাগজ ও ধরনের স্ক্যান্ডালের জন্য ছোঁক ছোঁক করে ঘুরছে।

কর্নেল চুরুট নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। জট অনেকটা ছাড়ল তাহলে।…

১৬. কেন, কেন এবং কেন?

বিকেলে রোদ্দুর আরও ফুটেছে। কিন্তু ছাদের প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে বেশিক্ষণ থাকা কঠিন। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কাছাকাছি উঁচু বাড়ি নেই বলে শীতের হাওয়ার দাপট বরাবরই এমন। তাতে আড়াইদিনের বৃষ্টি গেল। কর্নেল সেই মরু ক্যাকটাসগুলির ওপর থেকে পলিথিন শিট তুলে তাদের রোদ্দুর খেতে দিলেন। তারপর নেমে এলেন নিচের ড্রইংরুমে।

কেয়া চলে যাওয়ার পর থেকে এই কেসের ৮ দফা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বারবার মাথার ভেতর মাছির ঝাঁকের মতো ভনভন করছিল। টেবিলের সামনে বসে সেগুলি কাগজে লিখে ফেলে তাকিয়ে রইলেন। কিছু কি বাদ পড়ে গেছে?

হুঁ, সুশোভন রায়ের মৃত্যুসংক্রান্ত খবর সব কাগজের লাইব্রেরি থেকে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। পুলিশ দফতর থেকেও একটা ফাঁইলের তিনটে পাতা উধাও। এটা ৯ নম্বর সূত্র। সুশোভনের মৃত্যুর খবর এবং পুলিশ ফাঁইলের নথিতে সুশোভন সংক্রান্ত তথ্যে এমন কিছু ছিল, যা ওই প্রভাবশালী খুনী লোকটিকে জড়িত করে থাকবে। তাই এই সতর্কতা।

এর পরের প্রশ্ন, শ্যামলকান্তি মজুমদার বিহার থেকে ফেরার পথে জলপ্রপাতের কাছে কর্নেলকে ধাক্কা মেরেছিল। একটু হলেই কর্নেল দেড়শো ফুট নিচের পাথরে দলা পাকানো হাড়গোড় ভাঙা লাশ হয়ে পড়ে থাকতেন। গে ক্লাব থেকে ফেরার সময় গাছপালার ছায়ার ভিতর লুকিয়ে শ্যামলকান্তিই কি তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিলেন? টেলিফোনে গলার স্বর বদলে তিনিই কি শাসিয়েছিলেন? কেয়াকে বেনামী চিঠিও কি তাঁরই কীর্তি?

যদি তাই হয়, শ্যামলকান্তির মোটিভ কী? উনি কর্নেলকে এই কেস থেকে সরাতে–এমন কী, প্রাণে মেরেও সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কেন? ওঁর আত্মীয় নাকি কোন এক মিনিস্টার। দুয়ে দুয়ে চার করলে সেই মিনিস্টারই সুশোভনের খুনী। তার স্বার্থেই কি শ্যামলকান্তির এই আচরণ?

তাহলে হঠাৎ চাকা উল্টোদিকে ঘুরল কেন? শ্যামলকান্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করল বিমলকুমারকে হত্যার অভিযোগে এবং অরিজিৎ বলেছেন, এ ব্যাপারে উঁচ মহল থেকে চাপ এসেছে–উল্টো চাপ। সেই মিনিস্টারের কাছে হঠাৎ শ্যামলকান্তি বিপজ্জনক বস্তুতে পরিণত হলেন কেন?

কেয়া আভাসে বলে গেল, শ্যামলকান্তিও সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে ব্ল্যাকমেইল করতেন–অন্যভাবে। নট ইন ক্যাশ, বাট ইন কাইডস্। কর্নেল নড়ে বসলেন। নগদ টাকা নয়, পারমিট, কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি আদায় করতেন।

শ্যামলকান্তি এবং সৌম্য চৌধুরী কি বিমলবাবুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে ডবল ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিলেন? নগদ টাকাও দাবি করেছিলেন। কি? এই সিদ্ধান্তে অনিবার্যভাবে আসা যায়। সিদ্ধান্তটি কিছুক্ষণ যাচাই করার পর কর্নেল রঞ্জন মিত্রের দেয়াল ক্যালেন্ডারটি বের করলেন। তারপর ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন।

অরিজিৎ! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

বলুন বস্!

খুশমেজাজে আছ, মনে হচ্ছে ডার্লিং!

ইয়া। রুটিন জব নিয়ে থাকলে মেজাজ খুশ থাকে। করছি তো নেহাত চাকরি।

শ্রীলক্ষ্মী ব্যাংকের ফাঁইলটা কি একটু দেখবে?

কী ব্যাপার?

এই ডেটগুলো বলছি। দেখ তো, এর কাছাকাছি সময়ে তপেশ বসাকের অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ ডিপজিট জমা পড়েছে।

এক মিনিট।…হুঁ, বলুন!

১৯৮০ সালের ১৭ জুন?

পাঁচ হাজার টাকা জমা পড়েছে ২০ জুন। ক্যাশ।

২২ জুন?

২৫ জুন পাঁচ হাজার টাকা। ক্যাশ।

৫ আগস্ট?

৬ আগস্ট দশ হাজার টাকা। ক্যাশ।

১২ অক্টোবর?

১৭ অক্টোবর ক্যাশ দশ হাজার টাকা।

১৯ অক্টোবর?

২৮ অক্টোবর ক্যাশ দশ হাজার টাকা।

দাবি বাড়ছিল উত্তরোত্তর। কর্নেল হাসলেন। ১৫ ডিসেম্বর? ডিসেম্বর–না ডিসেম্বরে নেই। তারপর আর ডিপজিট নেই। ওটাই শেষ ডিপজিট।

আচ্ছা, ছাড়ছি।…

কর্নেল ফোন রেখে কাগজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারিখ এবং টাকার পরিমাণ থেকে কিছু বের করা যায় কি না ভাবতে থাকলেন। জুন মাসের চিহ্নিত তারিখ দুটিতে রঞ্জন যে টাকা আদায় করেছিল, তা ব্যাংকে জমা দিতে তিনদিন সময় লেগেছে। আগস্টের চিহ্নিত তারিখের টাকা জমা দিতে যথাক্রমে পাঁচদিন এবং নদিন লেগেছে।

তা থেকে অনিবার্য সিদ্ধান্ত করা চলে : বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে রঞ্জন টাকা আদায় করেছে এবং কখনও নিরাপত্তার স্বার্থে বুকপোস্টে প্রিন্টেড ম্যাটার লিখে কোনো পত্রিকার পাতার ভেতর নোটগুলি ভরে পাঠিয়েছে নিজের নামে। যেমন এই শেষবার করেছিল।

রঞ্জন তার শিকারের পেছনে সব সময় ওত পেতে বেড়াত, সেটা স্পষ্ট। ২৮ অক্টোবর শেষ ডিপজিট। এদিকে ১৫ ডিসেম্বর ঢ্যারা চিহ্নিত এবং জে লেখা। তার মানে, ওই তারিখে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, পায়নি। তার শিকার সময় চেয়েছিলো।

মাই গুডনেস! কর্নেল নড়ে বসলেন আবার। মোতিগঞ্জের ডাকঘর থেকে রঞ্জন বুকপোস্টে টাকা পাঠিয়েছিল–সেদিন ছিল ১৫ জানুয়ারি! জে অবশ্যই জানুয়ারির আদ্যক্ষর। ১৫ ডিসেম্বরে ঢ্যারা কাটা। তার মানে ১৫ জানুয়ারি টাকা দেবার কথা ছিল–মোতিগঞ্জে। রঞ্জন টাকা পেয়েছিল।

আর বাঘের পেছনে ফেউয়ের মতো শ্যামলকান্তিও যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মোতিগঞ্জে উনিও ছিলেন সেদিন। স্টেশনে ওঁকে দেখেছেন কর্নেল। হাথিয়াগড়েও দেখেছেন ফের। আলাপ হয়েছে। তারপর কোলকাতা ফিরেছেন ওঁর সঙ্গে। জলপ্রপাতের ধারে ধাক্কা।

কিন্তু নিছক রক্তমাখা জামাকাপড়ের জোরেই কি ব্ল্যাকমেল করা সহজ ছিল প্রভাবশালী সিকারকে? হত্যাদৃশ্যের ফোটো পাওয়া যায়নি রঞ্জনের স্যুটকেসে। অথচ শুধু রক্তমাখা পোশাকগুলো হারিয়েই অমন নার্ভাস হয়ে আত্মহত্যা করে বসল রঞ্জন!

হুঁ, এখানেই ভাইটাল পয়েন্ট। স্যুটকেস হারিয়ে সে বিপন্ন বোধ করার দরুন সুইসাইড করে বসল। কেন? আর কী ছিল স্যুটকেসে? কর্নেল চোখ বুজে দুলতে শুরু করলেন অভ্যাসমতো।…

১৭. ক্ষমাশীল, বিষণ্ণ এক পাদ্রী!

আজও উজ্জ্বল রোদ্দুর। আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ছাদে গাছগুলির পরিচর্যা করে কর্নেল নেমে এলেন। শান্তভাবে ব্রেকফাস্ট খেলেন। কাগজ পড়লেন কিছুক্ষণ। তারপর ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী এলেন।

বসেই বলেন, জরুরি তলব কিসের?

কর্নেল একটু পরে বললেন, তোমাদের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিটা তো বেলগাছিয়ায়?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার?

রঞ্জন মিত্রের স্যুটকেসটা–মানে যার ভেতর রক্তমাখা জামাকাপড় ছিল, সেটা কি এখনও ওখানে আছে?

অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, রঞ্জন মিত্র? ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! তপেশ ছিল। হলো বাসুদেব। তারপর এবার রঞ্জন!

হ্যাঁ, রঞ্জন। রঞ্জন মিত্র।

ঠিক আছে। কিন্তু ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে যাবেন নাকি?

যাব বলেই তোমাকে ডেকেছি। আমাকে ওঁরা পাত্তা দেবেন না।

এক মিনিট। আগে জেনে নিই, জিনিসগুলো ওখানে আছে, না আমাদের মালখানায় পাঠিয়েছে।

আরিজিৎ ফোনের কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর লাইন পেলেন। মুখে বিরক্তির ছাপ। বললেন, ডি সি ডি ডি লাহিড়ী বলছি।..ও! তপনবাবু নাকি? কেমন আছেন?…শুনুন, বিহারের হাথিয়াগড়ের সুইসাইড কেসটার ব্যাপারে বলছি। স্যুটকেসে রক্তমাখা জামাকাপড়–হ্যাঁ, হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট।..ও! আচ্ছা! বুঝেছি। থ্যাঙ্ক ইউ!

ফোন রেখে কর্নেলের দিকে ঘুরে অরিজিৎ বললেন, গতকাল ওগুলো লালবাজারে মালখানায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

কর্নেল উঠলেন।…চলো, বেরোই। কফি খাওয়াতুম। কিন্তু এখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।

অরিজিৎ অনিচ্ছার ভাব করে উঠলেন।

জিপে এসেছিলেন অরিজৎ। কর্নেল জিপে বসে চুরুট জ্বেলেছেন, চোখ বন্ধ। এসব সময় ওঁকে প্রশ্ন করেও জবাব পাওয়া যাবে না। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ঢুকে জিপ যথাস্থানে পার্ক করে অরিজিৎ বললেন, মালখানা মানে বহু বছরের অসংখ্য আবর্জনার গাদা। তার ভেতর কিছু খুঁজে বের করার জন্য আইনমাফিক তালিকা, ইনডেক্স নাম্বার, সবই আছে। বাট ইউ নো, অ্যাকচুয়ালি হাউ ইট ওয়ার্কস।

অরিজিতের চেম্বারে বসে কর্নেল নিভন্ত চুরুট লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিলেন। অরিজিৎ ফোনে মালখানায় নির্দেশ পাঠিয়ে হাসলেন।..আমার কাছে অবশ্যি প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান নয়। কাজেই আপনাকে কফি খাওয়াব।

মালখানা থেকে স্যুটকেসটি আসতে একটা ঘণ্টা সময় লেগে গেল। টেবিলে স্যুটকেসটি রেখে গেলেন এক অফিসার। কর্নেল জীর্ণ বেরঙা পোশাকগুলো তুলে রেখে স্যুটকেসটির প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হলেন। অরিজিৎ নিজের কাজে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে মুখ তুলে কর্নেলের কার্যকলাপ দেখছিলেন, মুখে কৌতুক।

হঠাৎ কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ডার্লিং! বাঘের ঘরে ঘোগ। এই দেখ।

অরিজিৎ ঝুঁকে দেখলেন, সিন্থেটিক ফাঁইবারে তৈরি একটা অংশ–স্যুটকেসের ভেতরে কোনার দিকে কাটা। কর্নেল আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছেন। অরিজিৎ, বললেন, কী ব্যাপার?

কর্নেল বলেন, হাথিয়াগড়ের প্রিয়দর্শী হোটেলে পুলিশ আসার আগে আমি স্যুটকেসটি পরীক্ষা করে দেখেছিলুম। তখন এই ভেঁড়া অংশটা ছিল না। কর্নেল গুম হয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। ফের বললেন, যাই হোক, আমার থিওরি প্রমাণিত হলো।

খুলে বলুন!

এখানে একটা খুদে চৌকো জিনিস লুকোনো ছিল। সেটা কেউ পরে হাতিয়েছে। অর্থাৎ সুটকেসটা কলকাতায় আসার পরে জিনিসটা উধাও হয়ে গেছে।

জিনিসটা কী?

একটা ফিল্মের নেগেটিভ। এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি সাইজ।

কর্নেল পোশাকগুলো ঢুকিয়ে রেখে স্যুটকেস বন্ধ করে চেয়ারে বসলেন। অরিজিৎ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে ফের বললেন, রঞ্জনের আত্মহত্যার কারণ স্পষ্ট হলো। তার ব্ল্যাকমেইলিং-এর জোরটা কোথায় ছিল, তাও স্পষ্ট হলো। শুধু রক্তমাখা পোশাক হারিয়ে বিপন্ন বোধ করার কারণ তত ছিল না রঞ্জনের। ফিল্মটা ছিল এই স্যুটকেসের ভেতর এককোণে লুকোনো। স্যুটকেসটা হারানো মানে তার সব শক্তি খতম। সে যাকে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে, এবার তার আঘাত আসা অনিবার্য। কিন্তু রঞ্জন অন্যের হাতে মরার বদলে নিজের হাতে মরাটাই বাঞ্ছনীয় মনে করেছিল। এতে তার চরিত্রের একটা আদলও স্পষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু ফিল্মটা কিসের?

একটা হত্যাদৃশ্যের।…কর্নেল বিষণ্ণ মুখে বললেন, ওটা ছিল একটা সাংঘাতিক ডকুমেন্ট। ওরিজিন্যাল ডকুমেন্ট। যাই হোক, প্রভাবশালী ব্যক্তিটি সেটি কাউকে দিয়ে হাতিয়েছে। বাঘের ঘরে ঘোগ! না–আমি অভিযোগ করছি না। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব? তোমার পক্ষেও এর প্রতিকার সম্ভব নয়। পাইকপাড়া ল্যাবরেটরিতে, অথবা সেখান থেকে আসার পথে, কিংবা মালখানায়–কোনো এক সময় কে এই কাজটি করেছে, তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। মালখানার চার্জে যিনি, তার দায়িত্ব আছে ঠিকই। পাইকপাড়া ল্যাবরেটরিরও দায়িত্ব আছে, সেও ঠিক। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েও এযুগে তা কাটায় কাটায় পালন করা কঠিন। নানামুখী স্বার্থস্রোত প্রশাসনিক কাজকর্মের ভেতর বয়ে চলেছে। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দায়ী করা ভুল। যে এই কাজটি করেছে, সে করতে বাধ্য হয়েছে এমনও তো হতে পারে। ওকে, ডার্লিং! অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি উঠি।

বিস্মিত অরিজিৎ তাকিয়ে রইলেন বুদ্ধের দিকে। পাদ্রীর মতো ক্ষমাশীল, অথচ বিষণ্ণ এক মানুষ ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। অরিজিৎ শাস ছেড়ে বোম টিপলেন। স্যুটকেসটা মালখানায় ফেরত পাঠাতে হবে। সুইসাইড কেসের ব্যাপার। স্যুটকেসটা আবর্জনার অংশ হয়ে যাবে ক্রমশ।…

১৮. ওরা এখানে কেন?

গঙ্গার ধারে মোতিগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। টিলাপাহাড়ের ওপর একটা ভাঙা কেল্লাবাড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে গঙ্গার জলে বুনোহাঁসের ঝাঁক দেখছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এইসময় লেন্সের সামনে হলুদ পর্দা সূক্ষ্ম সরল রেখা সারবদ্ধ এবং লাল ছোপ। রক্তের মতো দগদগে। চমকে উঠেছিলেন। তারপর টের পেলেন, বাইনোকুলারের ওপর একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসেছে। বোকা প্রজাপতিটা জানে না, এই লোকটা জাল পেতে প্রজাপতি ধরে।

কর্নেল একটু হাসলেন। এটুকু ক্ষীণ স্পন্দনেই চমকে উঠে প্রজাপতিটা উড়ে গেল। বাইনোকুলার নামিয়ে তাকে দেখতে থাকলেন। ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে প্রজাপতিটা নিচে উড়ে চলেছে। এক ঝক বুনো ফুল ফুটে আছে ঝোঁপের ভেতর। সেখানে গিয়ে বসল সে।

সাধারণ প্রজাতির প্রজাপতি। আবার চোখে বাইনোকুলার রাখলেন কর্নেল। কিছুক্ষণ হাঁস দেখার পর বাঁদিকে ঘুরলেন। শহরের শেষপ্রান্তে গঙ্গার পাড়েই একটা সুন্দর পার্ক। তার ওদিকে ইতস্তত ছড়ানো সুদৃশ্য সব বাড়ি। বিকেলের রোদ্দুরে আর কুয়াশায় রহস্যময় হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। পার্কের একপ্রান্তে ফুলঝোঁপের আড়ালে একটা বেঞ্চ। বেঞ্চে একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোক বসে আছে। দুজনে মুখোমুখি বসার ফলে বাইনোকুলারে শুধু পুরুষটির পিঠের দিকটা বড় হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল।

তারপর দুজনে সোজা হয়ে বসল। অমনি বাইনোকুলারে প্রকাণ্ড হয়ে পাশাপাশি একই লাইনে দুটি মুখ ভেসে উঠল। সৌম্য চৌধুরি এবং কেয়া রায়!

কর্নেল হন্তদন্ত নামতে থাকলেন কেল্লাবাড়ি থেকে। পার্কটা সিকি কিলোমিটার, দূরে। পৌঁছে ওদের আর দেখতে পেলেন না। বেঞ্চ খালি।

বিমলকুমারকে হত্যার অভিযোগে সৌম্য চৌধুরির নামেও পরোয়ানা ঝুলছে। সেই সৌম্য এই মোতিগঞ্জে এসেছেন এবং সঙ্গে কেয়া! কেয়ার সঙ্গে পুরনো প্রেমের একটা রফা হওয়া সম্ভব। কিন্তু কেন ওঁরা এই মোতিগঞ্জে?

হোটেল পারিজাতে উঠেছেন কর্নেল। হোটেলে পৌঁছে দেখেলেন লবিতে তার জন্য অপেক্ষা করছে হাথিয়াগড়ের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সুরেশ চতুর্বেদী। পরনে সাদা পোশাক। কর্নেলকে দেখে উঠে এলেন। কর্নেল বললেন, কতক্ষণ?

মিনিট পনেরো।

মিঃ শর্মা?

ভীষণ ব্যস্ত। একটা গ্রামে হরিজনদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের।

আসুন।

দোতলায় পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা স্যুট বুক করেছেন কর্নেল। নিচে গঙ্গা। হোটেলটা একটা টিলার গায়ে পাথুরে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। পাড় ধসার সম্ভাবনা নেই। পুবের ব্যালকনিতে বসলেন দুজনে। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটানি আছে। তবু নিচে গঙ্গা। সূর্যাস্তের রাঙা নরম আলোয় ঝলমলে। অলৌকিক বলে মনে হয় এখন।

কর্নেল বললেন, ফোনে সব কথা বলা সম্ভব নয় বলে একটু কষ্ট দিলুম আপনাকে।

সুরেশ চতুর্বেদী হাসলেন।…কোনো কষ্ট না। কেসটা সম্পর্কে আমি আগ্রহী।

সব বলবখন। আগে একটা কথা জানতে চাই।

বলুন!

মোতিগঞ্জে কোনো মিনিস্টারের বাড়ি আছে কি?

চতুর্বেদী আঙুল তুলে একটা দিক দেখিয়ে বললেন, চারজন মিনিস্টারের বাড়ি আছে। দুজন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী, বাকি দুজন বিহার মন্ত্রিসভার সদস্য।

পশ্চিমবঙ্গের কোনো মন্ত্রীর বাড়ি নেই?

না। নেই।

আপনি নিশ্চিত?

অবশ্যই।

এই চারজনের মধ্যে কেউ বাঙালি?

নাঃ।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, এখানে বাঙালি তো প্রচুর আছেন?

তা ঠিক। একসময় মোতিগঞ্জ বাঙালি টাউনই ছিল বলতে পারেন।

বাঙালি বড়লোক আছেন নিশ্চয়?

আছেন। সবাই ব্যবসায়ী। একজন অবশ্য অ্যাডভোকেট আছেন–প্রচুর পয়সা। তিনপুরুষের বাসিন্দা ওঁরা।

নতুন বাড়িও হয়েছে দেখেছি কয়েকটা।

হয়েছে। হচ্ছে।…চতুর্বেদী হাসতে লাগলেন। কতলোকের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে মোতিগঞ্জে। মোতিগঞ্জে মাটির দাম এখন আগুন।

কর্নেল কফি-পকৌড়ার অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন। শিগগির এসে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে চতুর্বেদী বললেন, ফাইন! এবার বলুন শুনি, রহস্যটা কি।

কর্নেল সংক্ষেপে চাপা স্বরে আগাগোড়া সবটা বললেন। শুধু সৌম্য ও কেয়ার কথাটা বললেন না। সৌম্য ফেরারী আসামী। চতুর্বেদী কর্তব্যপরায়ণ অফিসার। বলে ধারণা হয়েছে কর্নেলের। জানলে পরে এখনই থানায় খবর পাঠাবেন। কিন্তু কর্নেল সৌম্যকে ধরিয়ে দিতে চান না। এ মুহূর্তে সৌম্যই তার কম্পাসের কাটা।

চতুর্বেদী সিগারেট ধরিয়ে বললেন, একটা ধারণা আমার মাথায় এসেছে। সেই মন্ত্রী ভদ্রলোক যদি বাঙালি হন এবং পশ্চিমবঙ্গের হন, তিনি বেনামে এখানে একটা বাড়ি করতেও পারেন। সেই বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে থাকতেও পারেন। প্রোটোকল অনুসারে পুলিশকে তার জানানোর কথা–অর্থাৎ তার উপস্থিতির সঙ্গে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত থাকে। কিন্তু এটা সরকারি রীতিনীতির ব্যাপার। কোনো মন্ত্রী পুলিশকে না জানিয়েও এখানে গোপনে মাঝে মাঝে আসতে পারেন বৈকি। নিশ্চয় পারেন। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করতে সময় লাগবে। তারপর ধরুন, খুঁজে বের করা গেল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করবেন কীভাবে? ফিল্মটা তো তিনিই হাতিয়ে নিয়েছেন বলছেন আপনি!

কর্নেল আস্তে বললেন, কিছু করা যাবে না, সেটা ঠিক। কিন্তু অণি শব মুখোমুখি হতে চাই।

লাভটা কী?

সত্যকে জানা।

চতুর্বেদী হেসে বললেন, সত্যকে জানা! বুঝলুম না, কর্নেল!

মিঃ চতুর্বেদী, আমার মানসিক গঠনটাই এরকম। খুনী বা কোনো মারাত্মক অপরাধীকে শাস্তি দেবার জন্য আইনগত পদ্ধতি আছে। আদালত আছে। শেষ পর্যন্ত সে বেকসুর খালাস পেতেও পারে। বহু ক্ষেত্রে পেয়েছে। কিন্তু আমি আসলে ঘটনার মূলটাকে আবিষ্কার করেই তৃপ্তি পাই। মানুষের নাটকীয়তা আমাকে টানে মিঃ চতুর্বেদী! এ আমার নিছক রহস্যভেদের নেশা নয়, জীবনকে তলিয়ে দেখা ও বোঝার একটা আগ্রহ মাত্র।

আপনি দার্শনিক!

মিঃ চতুর্বেদী! বরং আমাকে বিজ্ঞানী বললেই খুশি হবো। ঠিক পদার্থবিজ্ঞানীর পদার্থ সম্পর্কে কৌতূহলের মতোই মানুষের জীবন সম্পর্কে আমার কৌতূহল আছে। বাই দি বাই, আপনি কি আজই হাথিয়াগড়ে ফিরবেন?

না। নাইট হল্ট করব। জিপ আনিনি। ট্রেনে এসেছি। শীতের রাতে ট্রেনজার্নি আমার বিশ্রী লাগে।

কোথায় থাকছেন?

আমার এক কলিগের কোয়ার্টারে। চতুর্বেদী সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, কিন্তু সেই মিনিস্টার ভদ্রলোককে খুঁজে বের করবেন কী ভাবে পুলিশের সাহায্য ছাড়া? বরং এক কাজ করা যায়। এখানে আই বি-র লোকেরা এ ব্যাপারে কিছু জানে কি না, খোঁজ নিতে পারি।

কিন্তু–

চতুর্বেদী বাধা দিয়ে বললেন, ভাববেন না। ইনফর্মেশান ব্রাঞ্চের লোকেদের সঙ্গে সর্বত্র সাধারণ পুলিশের লোকেদের সম্পর্ক ভাল নয়। আদায় কঁচকলায় সম্পর্ক বলা চলে। সমস্যা হলো, আই বি জেনারেল পুলিশের লোকের সাহায্য ছাড়া আবার কোনো অ্যাকশান নিতে পারে না। তবে আমার ডিপার্টের সঙ্গে আই বি ডিপার্টের একটা বোঝাঁপড়া আছে।

এটা গোখরো সাপ নিয়ে খেলা, মিঃ চতুর্বেদী!

বুঝতে পারছি। খুব প্রভাবশালী লোক এবং—

কেরিয়ারিস্টরা যা হয়, তাই।

সুবিধাবাদী লোক বলুন!

ঠিক বলেছেন। কর্নেল আস্তে বললেন, লোকটি একসময় লেফটু এক্সট্রিমিস্ট দলে ছিল। দলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্ভবত দলকে খতম হওয়ার মুখে ফেলে দিয়ে বিপক্ষে ঢুকেছিল এবং পুরস্কার স্বরূপ মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। সুশোভন গোড়ার দিকেই সেটা টের পেয়ে দলকে জানিয়ে দিয়েছিল। পরিণামে পাল্টা সুশোভনকে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করে সে নিজের হাতে ওকে খুন করে। সে একজন খুনী চরিত্রের লোক। মিঃ চতুর্বেদী, লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে–অথচ তাকে দেখলে তা বোঝা যায় না। এই আমার ধারণা।

তেমন মন্ত্রী কেউ পশ্চিমবঙ্গে থাকলে আপনি তো সহজেই জানতে পারতেন!

না মিঃ চতুর্বেদী।

জানাটা সহজ নয়। কেন? বয়স একটা ফ্যাক্টর। নিশ্চয় তিনি প্রবীণ নন। অতএব–চতুর্বেদী থামলেন।

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, একই বয়সের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও রাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড প্রত্যেকের মোটামুটি একই রকম। সবাই এঁরা বামপন্থী ছিলেন আগে। এঁদের মধ্যে মাত্র একজন কিছুকাল উগ্রবামপন্থী হয়েছিলেন। সুশোভনের মৃত্যুসংবাদ প্রসঙ্গে খবরের কাগজে নিশ্চয় সে-সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত ছিল। তাই সেই খবর উধাও হয়ে গেছে সব কাগজের অফিসের ফাইল থেকে! পুলিশের ফাঁইল থেকেও।

হ্যাঁ–এও একটা পয়েন্ট। ওই যে বললেন, মাত্র কিছুকাল–ওটাই গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ বামপন্থী নেতা–হয়তো ওই পিরিয়ডে সে নেতাও ছিল না, বিশিষ্ট কর্মীই ছিল–কিছুকালের জন্য সুবিধাবাদের দরুন উগ্রপন্থী হয়ে উঠেছিল। তাকে নিয়ে আলাদা এবং উল্লেখযোগ্য কোনো খবর কাগজে নাও বেরুতে পারে।

ওই সুশোভনের মৃত্যুর খবরে ছাড়া তার নাম তত আলোচ্য ছিল না।

ঠিক। সুশোভনের মৃত্যুর খবরের মধ্যে একটু উল্লেখ থাকা সম্ভব।

কাজেই দেখুন, তাকে খুঁজে বের করা কঠিন।

হ্যাঁ, সমস্যাটা এবার স্পষ্ট হলো। চতুর্বেদী একটু চুপ করে থেকে বিরক্তভাবে ফের বললেন, কিন্তু কেয়াদেবী তো তাঁকে চেনেন। কেন আপনাকে বলেননি?

ভয়ে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।

ভয়ে, নাকি অন্য কোন কারণে?

কর্নেল একটু ভেবে বললেন, ভয়ও একটা কারণ। তবে অন্য কারণও থাকতে পারে। যাই হোক, আপনি কালকের দিনটা থাকুন মিঃ চতুর্বেদী!

ঠিক আছে। বলে চতুর্বেদী আবার একটা সিগারেট ধরালেন।

মিঃ চতুর্বেদী!

চতুর্বেদী অন্যমনস্কভাবে বললেন, বলুন কর্নেল!

সেই মন্ত্রী এখন মোতিগঞ্জে এসেছেন।

চতুর্বেদী চমকে উঠে তাকালেন।

কর্নেল আস্তে বললেন, হ্যাঁ। তিনি এসেছেন। কারণ–

বলেই থেমে গেলেন। চতুর্বেদী তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কর্নেল আর সে কথায় গেলেন না। কারণটা ব্যাখ্যা করলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন। ঘরে গিয়ে বসি। ঠাণ্ডাটা বেড়ে যাচ্ছে।…

১৯. জবানবন্দি

পার্কটার নাম স্টিফেনস পার্ক। ইংরেজ আমলেও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মোতিগঞ্জের রবরবা ছিল। ইংরেজদের কিছু কিছু কীর্তি এখনও টিকে আছে পার্ক, রাস্তাঘাট, ছিমছাম গড়নের গির্জা আর বাড়িতে। সেই বাড়িগুলোতে এখন সরকারি দফতর, স্কুলকলেজ। স্টিফেনস পার্কে এক কোণে ঘাসের ওপর বসে কর্নেল লক্ষ্য রেখেছিলেন। দশটা বেজে গেল। ভেবেছিলেন, সৌম্য ও কেয়া এখানে আসবে। এলো না। আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কর্নেল পার্ক থেকে বেরুলেন।

গঙ্গার ধারে সুন্দর পিচের রাস্তা, দুধারে গাছ কর্নেল হাঁটছিলেন। একটু চলার পর শহরে ঢোকার মুখে ডানদিকে ঘাট। প্রাচীন যুগের ঘাট। পাথরে বাঁধানো। এই শীতেও ঘাটে ভিড়। কাপড় কাঁচছে কেউ। কেউ জলে নেমে স্নান করছে। কিছু নৌকো ভেসে আছে ইতস্তত। সামনে গঙ্গার বিস্তার প্রায় দু কিলোমিটারের কম নয়। ডাইনে, বাঁয়ে চড়া উঁচু হয়ে আছে। কিন্তু সামনাসামনি কোনো চড়া নেই। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে ওপারটা দেখতে থাকলেন। ঘন গাছপালার ভেতর একটা মন্দির চূড়া লেন্সে বড় হয়ে আটকে গেল। চূড়ায় ধ্বজা উড়ছে।

তারপর লেন্সে ভেসে উঠল একটা যাত্রীবাহী নৌকো। খোলা নৌকো। ভিড়ে ভর্তি।

এবং নৌকোয় সৌম্য, কেয়া!

ওপারে কোথায় যাচ্ছে ওরা? বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটা লোককে জিগ্যেস করলেন, উধার কৈ মন্দির হ্যাঁয়, ভাই?

জি বড়াসাব! লোকটি বিনীতভাবে বলল। নান্নিমাইজিকী আশ্রম ভি হ্যাঁয়! উও ওহি মন্দির।

যানে কা নাও মিলেগা ইধার?

জরুর! উও দেখিয়ে! কুছু জাস্তি দেনেসে লে যায়ে গা।

একটা ছোট্ট নৌকোর মাঝি দাঁও বুঝে যাতায়াতের ভাড়া চল্লিশ রুপেয়া হাঁকলো। কর্নেল রাজি। বললেন, জলদি যানে পড়েগা! বহত জলদি! ঔর পাঁচ বখশিস মিলেগা। সমঝা?

নৌকোর হালে এক মাঝি, বৈঠায় দুজন। ছইয়ের ভেতর বসে কর্নেল বাইনোকুলারে সেই যাত্রীবাহী খোলা নৌকোটা দেখতে থাকলেন। সৌম্য ও কেয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেয়ার কাঁধে একটা ব্যাগ, সৌম্যর হাতে ব্রিফকেস। ওদের নৌকো যখন ঘাটে পৌঁছুল, তখন কর্নেল মাঝনদীতে। তার তাড়ায় বৈঠার মাঝিরা দ্রুত বৈঠা মারছিল।

শক্তিশালী দূরবীন যন্ত্রটিতে (যা আধুনিক পরিভাষায় বাইনোকুলার) ঘাট থেকে যাত্রীদের নেমে গাছপালার ভেতর এক ফালি মোরাম বাঁধানো রাস্তায় ভক্তিভরে হাঁটতে দেখা যাচ্ছিল। আশ্রমের ফটক পর্যন্ত দৃষ্টি যায় এখান থেকে। সৌম্য ও কেয়া পিছিয়ে হাঁটছে। সব যাত্রী আশ্রমে গিয়ে ঢুকলে দুজনে একটা গাছের তলায় দাঁড়াল। তারপর কর্নেল দেখলেন, ব্রিফকেস হাতে সৌম্য দ্রুত বাঁদিকে ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়লেন। কেয়া আশ্রমের ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।

কর্নেল ফের তাড়া দিলেন মাঝিদের। হালের মাঝি হেসে বলল, আবৃতি আভি দের হ্যাঁয় সাব! মাইজি আভি ধ্যানমে। ধ্যানকা বাদ পূজা।

ঘাটে তিনটে বজরা এবং আরও কিছু ছই নৌকো বাঁধা। মাঝিদের অপেক্ষা করতে বলে কর্নেল মোরাম ঢাকা রাস্তায় হাঁটতে থাকলেন। আশ্রমের ফটকের কাছাকাছি গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলেন। জঙ্গলে ঢাকা একটা টিলা উঠে গেছে। বড় বড় পাথর পড়ে আছে জঙ্গলের ভেতর। এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। তারপর নিঃশব্দে টিলা বেয়ে উঠতে থাকলেন। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে নিচের জঙ্গলের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। কোথায় সৌম্য?

টিলার চূড়ার কাছাকাছি একটা ঝাকড়া বটগাছ। সেখানে পৌঁছে আবার বাইনোকুলারে সৌম্যকে খুঁজতে থাকলেন কর্নেল। কিছুক্ষণ পরে কিছুটা নিচে ডানদিকে পাথরের একটুকরো চাতাল এবং চাতালের কিনারায় ঘন ঝোঁপের মাথায় একটু ধোঁয়া, সিগারেটেরই ধোঁয়া, অথচ বাইনোকুলারের লেন্সে তা এক ঝক কুয়াশা হয়ে উঠেছে। বাতাসে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল, আবার উপচে উঠল, আবার ভেঙে মিলিয়ে গেল। কর্নেল সাবধানে গুঁড়ি মেরে নামতে থাকলেন।

চাতাল থেকে মোরাম ঢাকা রাস্তাটা। আন্দাজ দুশো মিটার দূরে এবং একটু ডাইনে ঘাটটাও প্রায় সমান দূরত্বে। চাতালটাকে একটা সমকোণী ত্রিভুজের একটা কোণ ধরলে দূরত্ব তাই দাঁড়ায়। এখানে লুকিয়ে কী করছেন সৌম্য চৌধুরী?

একটা বড় পাথরের ফাঁকে উঁকি মেরে ফুট বিশেক দূরে দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠলেন কর্নেল।

সৌম্য ব্রিফকেস খুলেছেন। ঠোঁটে সিগারেট। পরনে ছাইরঙা জ্যাকেট, জিনস। হাঁটু দুমড়ে বসে কী একটা যন্ত্রের পার্টস জোড়া দিচ্ছেন।

একটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল এবং নলের ডগায় টেলিলেন্স! সিগারেট ঘষটে নিভিয়ে গুঁড়ো করে ফেলে দিলেন সৌম্য চৌধুরী। রাইফেলটা তুলে নলটা ঘুরিয়ে টেলিলেন্সটা অ্যাডজাস্ট করলেন। তারপর পাশে রেখে দিলেন। ঝোঁপের ছায়ায় সরে বসলেন।

একটু পরে দ্রুত পিছু ফিরে কর্নেলকে দেখেই রাইফেলটা তুলতে চেষ্টা করলেন। কর্নেলের হাতে রিভলবার। কঠিন মুখে কর্নেল বললেন, ওটা রেখে দিন সৌম্যবাবু! প্রয়োজনে মানুষের হাত ভেঙে দিতে আমি দ্বিধা করি না।

সৌম্য চৌধুরী হিংস্র দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

কর্নেল নেমে এসে রাইফেলটা তুলে নিয়ে একটু তফাতে বসে পড়লেন। বললেন, তিনি আশ্রমে পুজো দিতে এসেছেন এবং ফেরার পথে তাকে

বাধা দিয়ে সৌম্য বললেন, ও একটা ভণ্ড। মুখে বলে, ধর্ম জনগণের আফিং। কিন্তু গোপনে ধর্মের পায়ে মাথা ভাঙে।

সেটাই তাকে আপনার খতমের চেষ্টার কারণ নয় সৌম্যবাবু! কর্নেল একটু হাসলেন। আপনি আদর্শের জন্য খতম করতে আসেননি। এসেছেন দুটো কারণে। পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে বোঝা-পড়ার তাগিদে এবং নিজের প্রতিহিংসা মেটাতে।

সৌম্য চুপ করে থাকলেন। মুখটা নিচু। কর্নেল বললেন, এটা ঠিকই যে, কেয়া আপনার কাছে প্রেমের বদলে তার দাদার অসহায় মৃত্যুর প্রতিশোধ দাবি করতেই পারে এবং আপনিও প্রতিহিংসায় খেপে উঠতেই পারেন। লোকটা শ্যামলকান্তিকে ধরিয়ে দিয়েছে। আপনাকেও ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। কারণ এবার আপনাদের ব্ল্যাকমেলিং থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ মিলেছে তার। কিন্তু সে-সুযোগ আপনারাই তাকে দিয়েছেন। বিমলকুমারকে খুন না করলে–

সৌম্য দ্রুত বললেন, আমি না ওই শুওয়েরর বাচ্চা শ্যামলদা! আমি নিষেধ করেছিলুম। শোনেনি। বলেছিল, বিমলের মুখ বন্ধ না করলে নাকি আমরা বিপদে পড়বো। ওকে আর ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।

হুঁ, বিমলবাবুর মধ্যে ইনস্যানিটির লক্ষণ দেখেছিলুম। কর্নেল একট হাসলেন।…লেকভিউ রোডে আমাকে লক্ষ্য করে কে গুলি ছুঁড়েছিল সৌম্যবাবঃ আপনি, না সুভদ্র, না শ্যামলকান্তি!

শ্যামলদা। বিশ্বাস করা-না করা আপনার ইচ্ছে।

বিশ্বাস করতে আমি বাধ্য। শ্যামলকান্তি আমাকে একটা জলপ্রপাতের কাছে ধাক্কা মেরে খতম করতে চেয়েছিলেন।

সৌম্য আস্তে বললেন, শ্যামলদা বলেছিল। আপনি নাক গলানোতে আমরা ভয়। পেয়েছিলুম।

সুশোভনকে খুনের দৃশ্যের কত কপি প্রিন্ট করা হয়েছিল সৌম্যবাবু?

মাত্র একটা কপি। সেটা শ্যামলদার কাছেই ছিল।

কার ক্যামেরায় দৃশ্যটা তোলা হয়েছিল?

শ্যামলদার।

পরে ফিল্মটা কীভাবে রঞ্জনের হাতে গেল?

ছবিটা প্রিন্ট করার সময় রঞ্জন, আমি, সুভদ্র, বিমল সবাই শ্যামলদার বাড়িতে উপস্থিত ছিলুম। শ্যামলদার ক্যামেরার হবি ছিল। নিজেই ডেভালাপ এবং প্রিন্ট করতো। ওর ফ্ল্যাটে একটা ডার্করুম ছিল।… সৌম্য চৌধুরী শাস ছেড়ে বললেন ফের, প্রিন্টটা তখনও জলে ভর্তি ট্রেতে আছে। ফিল্মটা শ্যামলদা কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়েছিল আলাদা করে। সেটা তখন ওর হাতে। হঠাৎ পিস্তল বের করে রঞ্জন নেগেটিভটা শ্যামলদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলুম রঞ্জন পিস্তল তুলে সবাইকে শাসিয়ে বেরিয়ে গেল।

তারপর রঞ্জনের সঙ্গে আপনাদের বোঝাঁপড়া হয়েছিল? শ্যামলদার মারফত হয়েছিল। তারপর সুভদ্রের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হয় রঞ্জনের।

হুঁ, শ্যামলবাবু সেই প্রিন্টটার সাহায্যে খুনীকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। কিন্তু আপনারা–

বাধা দিয়ে সৌম্য বললেন, আমরা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাছাড়া আমরা যখন ব্রতীনের কাছে যেতুম, দল বেঁধেই যেতুম। আমি, শ্যামলদা, সুভদ্র আর বিমল। রঞ্জন প্রথম-প্রথম আলাদাভাবে একলা যেতো ব্রতীনের কাছে।

কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, রোড়স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টসের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন দাশ?

হ্যাঁ। ভণ্ড। খুনী। বিশ্বাসঘাতক।

শ্যামলবাবুর প্রিন্টটা সম্পর্কে কিছু জানেন, সৌম্যবাবু?

ও একটা নির্বোধ। ওকে অ্যারেস্ট করার সময় প্রিন্টটা ওর কাছেই থাকা সম্ভব। কারণ সবসময় ওটা তার কাছেই থাকত। কাজেই পুলিশ ওটা যথাস্থানে দিয়ে থাকবে এবং এখন নিশ্চয় তা ছাই হয়ে গেছে। তবে নেগেটিভটা রঞ্জনের কাছে ছিল। সেটার কী হয়েছে জানি না। নাকেয়াকেও রঞ্জন ওটা দেয়ান। কেয়া জানে না ওটা কোথায় আছে।

ব্রতীনবাবু নেগেটিভটাও হাতিয়ে নিয়েছেন।

সৌম্য চৌধুরি তাকালেন। আস্তে বললেন, আর য়ু সিওর?

সিওর। বলে কর্নেল সাবধানে, চোখ সৌম্যের দিকে রেখে রাইফেলটার পাটস খুলতে শুরু করলেন। খোলা হলে বললেন, প্লিজ, ব্রিফকেসটা দিন। আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে।

সৌম্য ব্রিফকেসটা এগিয়ে দিলেন। মুখে অসহায় ও হতাশ ভাব।

কর্নেল পার্টসগুলো ব্রিফকেসে ভরে বুলেটগুলো দেখে নিলেন। ৩০৩ বুলেট। বিদেশী। ব্রিফকেস বগলদাবা করে একটু হেসে বললেন, এটা কোথায় যোগাড় করলেন সৌম্যবাবু?

এটা সুভদ্রের। বিহারে বড়লোক-জমিদার-জোতদারের ঘরে এসব জিনিসের অভাব নেই।

হুঁ, সুভদ্রও ব্রতীনবাবুর মৃত্যু চায়।

খুব স্বাভাবিক। বিমলকে খুনের অন্যতম আসামী সেও।

সুশোভনকে ব্রতীনবাবু কেন খুন করেছিলেন মিঃ চৌধুরি?

সৌম্য একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ছেড়ে বললেন, দ্যাটস আ লং স্টোরি।

সংক্ষেপে বলুন।

সৌম্য হাঁটু মুড়ে বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, প্রায় এগারো বছর আগের কথা। সুশোভন, আমি, রঞ্জন, সুব্রত, সুভদ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র তখনও। আমরা লিন পিয়াওপন্থী গ্রুপের অ্যাকশন স্কোয়াডে ছিলুম। শ্যামলদা তখন আমাদের অ্যাকশন স্কোয়াডের নেতা। পরে ব্রতীন এই স্কোয়াডে আসে–ও স্কটিশে পড়তো। ওকে পাঠানো হয় আমাদের স্কোয়াডে। ওর প্রতি আমাদের প্রত্যেকের সন্দেহ ছিল। তবে কিছু করার ছিল না। উই ওয়্যার নাটবোপ্টস্ অফ আ মেসিন। এভাবেই স্কোয়াড গড়া হয়েছিল। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলা চলবে না। ওপর থেকে যে নির্দেশ আসবে, তা পালন করতে হবে। নয়তো মরতে হবে। নির্দেশ আসতো শ্যামলদার মারফত।

সৌম্য ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, পরে সব বুঝেছিলাম–তখন বুঝিনি। সুশোভন একটু চঞ্চল এবং সন্দেহপরায়ণ ছেলে ছিল। ব্রতীনকে সে ভাল চোখে দেখতো না। আড়ালে আমাদের বলতো, ব্রতীন আসলে কারুর এজেন্ট। ওকে আমরা পাত্তা দিতুম না। তাছাড়া ডিসিপ্লিন ছিল কড়া। আমাদের স্কোয়াডে মোট বারোজন ছেলেমেয়ে ছিল। হঠাৎ একদিন চারজন ধরা পড়ল এবং নিখোঁজ হয়ে গেল। তখন বিমল শ্যামবাজারে থাকতো। সিনেমার পোস্টার আর সাইনবোর্ড আঁকতো–এটা তার বাইরের পরিচয়, এবং সে পড়াশুনা ছেড়ে চলে এসেছে। তার ঘরে আমাদের গোপন বৈঠক হলো। ব্রতীনও ছিল সেখানে। সুশোভন তাকে সোজা চার্জ করলো। ব্রতীন পাল্টা চার্জ করলো ওকে। ব্যাপারটা সেদিনকার মতো মিটে গেল। কদিন পরে সুশোভনকে না জানিয়ে বৈঠক হলো। শ্যামলদা বলল, সুশোভনই পুলিশের এজেন্ট। নির্দেশ এসেছে, ওকে খতম করতে হবে। ব্রতীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাকে কাজটা দেওয়া হোক। পরের বৈঠক ব্রতীনের বাড়িতে। ওরা ময়মনসিংহের এক প্রাক্তন জমিদার ফ্যামিলি। বিশাল বাড়ি। খানিকটা সরকার দখল করেছিলেন। কিছু অংশে ভাড়াটে ছিল। ব্রতীনের বাবা-মা-ভাইবোনেরা টালিগঞ্জে নতুন বাড়িতে থাকতেন। ব্রতীন একা পুরনো বাড়িটার দোতলার একটা অংশে থাকতো। সেখানেও আমাদের বার দু তিন বৈঠক হয়েছে। এবার বৈঠক বসল–মানে সুশোভনকে খতম করার একটা কৌশল সেটা ব্ৰতীনের ঘরে। বিশাল বাড়ি। ভেতরে পুকুর, বাগান, ঠাকুরদালান এসব আছে। ব্রতীনের ঘরে কিছু ঘটলে বাইরের কেউ টের পাবে না। সবচেয়ে সুবিধা, ওর একটা ভিন্টেজ কারও ছিল। বড়লোকের ছেলের হবি আর কী!

সৌম্য চুপ করলে কর্নেল বললেন, হুঁ– তারপর?

শ্যামলদা কেন ছবি তুলেছিল, গোপনে কেন ক্যামেরা এনেছিল–এসব কিছু জানতুম না আমরা। গিয়ে অপেক্ষা করছি। ব্রতীন রেডি। সুশোভন এলো দেরি করে। তখন রাত আটটা-সওয়া আটটা বাজে। শ্যামলদা বলল, সুশোভন, ওই জানলার কাছে দাঁড়াও তুমি। লক্ষ্য রাখো। বিমল, তুমি দরজার ওদিকটায় যাও।…যাইহোক, খুব ঝটপট নির্দেশ। সুশোভন পুবের পুরনো আমলের গরাদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডোতে একটু ঝুঁকেছে, ব্রতীন আচমকা ওর পিঠে হার্টের দিকে ড্যাগার বসিয়ে দিল। সুশোভন পড়ে গেল। গাঁক করে একটা শব্দ বেরুল ওর মুখ থেকে। ব্যস, খতম! কিন্তু সেই সময় শ্যামলদার হাতে ক্যামেরা এবং ফ্ল্যাশবাল্বে ঝিলিক। এক সেকেন্ড। তারপর ছোট্ট ক্যামেরা শ্যামলদার কোটের ভেতর ঢুকে গেল। সে আমাদের চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ব্রতীন তখন সুশোভনের পিঠে পা চেপে ড্যাগারটা তোলার চেষ্টা করছিল। ছবি তোলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। ড্যাগার তোলার সময় শ্যামলদা তাকে বাধা দিল। বলল, ড্যাগার তুললে রক্ত বেরিয়ে আসবে। এখন নয়। একটু পরে বডিটা ব্রতীনের ভিন্টেজ কারে ঢোকানো হল। রঞ্জন, শ্যামলদা আর ব্রতীন গেল লাস ফেলতে। ওরা ফিরে এলো রাত দশটায়। কোনো রেললাইনে ফেলে এসেছে শুনলাম।

রঞ্জনও ফিরে এলো?

সৌম্য তাকালেন। একটু পরে বললেন, না তো! মনে পড়ছে, রঞ্জন ফেরেনি। শ্যামলদা বলল, রঞ্জনের শরীর খারাপ করছিল। চলে গেছে। তারাও কেটে পড়। দেখি, রক্ত-টক্ত কতটা পড়েছে। সাফ করতে হবে।

রঞ্জন সুশোভনের পরনের কাপড় সংগ্রহের জন্য একটা অছিলা করে চলে গিয়েছিল!

কর্নেলের মন্তব্য শুনে সৌম্য বললেন, দ্যাটস রাইট।

বেশ। তারপর?

তারপর আর কী? পরে পুলিশের চাপে স্কোয়াড ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিপ্লব সম্পর্কে আমাদের মোহও খতম হয়ে গেল। যে-যার নিজের জীবন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলুম।

হ্যাঁ, কিন্তু সুশোভনকে খুন করার কতদিন পরে আপনারা শ্যামলবাবুর বাড়িতে গেলেন এবং রঞ্জন ফিল্ম ছিনতাই করলো?

পরদিন বিকেলে। শ্যামলদাই ব্রতীন বাদে আমাদের সবাইকে তার বাড়িতে যেতে বলেছিল।

ব্রতীনবাবুকে ব্ল্যাকমেইল করার কথা কখন আপনাদের মাথায় আসে?

শ্যামলদা ছবি প্রিন্ট করার সময় হঠাৎ কথাটা তোলে। বলে বড়লোকের ছেলে ব্রতীনই আসলে শোধনবাদীদের এজেন্ট। ওর শ্রেণীচরিত্র যাবে কোথায়? তাই ওকে একজন কমরেডের জীবনের মূল্যের বিনিময়ে ফঁদে আটকে রাখা হয়েছে। এই ছবি সেই ফাঁদ।

কর্নেল চুরুট ধরালেন–সাবধানে। হাতে গুলিভরা অটোমেটিক রিভলবার তৈরি। একটু দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রতীনবাবু মাইজির ভক্ত। পুজো দিয়ে ফেরার পথে তাকে আপনি গুলি করতেন। কিন্তু তাতে কি হতো? কেয়াকে নিয়ে আপনি ঘর বাঁধতে পারতেন কি? আপনি একটা খুনের কেসের আসামী। আরও একটা বড় খুনের কেসেরও আসামী হতেন। একজন মন্ত্রীকে খুন করা– মাইন্ড দ্যাট! কেয়াও বিপদে পড়তো। না সৌম্যবাবু, এভাবে বাঁচা যায় না।

কীভাবে বাঁচা যায়?

সেদিন গে ক্লাবে যখন গেলুম, তখন এ প্রশ্ন করলে নিশ্চয় জবাব দিতে পারতুম। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে, সৌম্যবাবু! আমি দুঃখিত।

সৌম্য ভুরু কুঁচকে বললেন, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করছেন?

হু অ্যাম আই? কর্নেল হাসলেন। আমি কি পুলিশ?

তাহলে কেন আপনি এতে নাক গলালেন?

কর্নেল আস্তে বললেন, রঞ্জনের আত্মহত্যার জন্য নিজেকে দায়ী করেছি।

লেনেয়। অবশ্য ব্ল্যাকমেলবাবু তাঁর কাছে করে থাকবেনজির

সেই পাপবোধের দায়ে এতদূর এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, সৌম্যবাবু! তবে। আমার চিরদিনকার এই এক নেশা, গোপন সত্যকে আবিষ্কার।

করলেন?

করলুম।

তাহলে এবার আপনাকে অনুরোধ করবো, সরে যান। আমার কাজ আমাকে। করতে দিন।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ব্রতীনবাবু মোতিগঞ্জে গোপনে যাতায়াত করেন। পুলিশকে কিছু জানান না। এইটে আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছিল। কেন এমন করেন? ব্ল্যাকমেলারদের সঙ্গে রফা করতেই কি? কিন্তু তা তো নয়। অবশ্য ব্ল্যাকমেলাররা তার এই গোপন ডেরার খবর জানতো। গত ১৫ জানুয়ারি রঞ্জন এবং শ্যামলবাবু তার কাছে এসেছিলেন। রঞ্জন দশ হাজার টাকা আদায় করেছিল। শ্যামলকান্তিও কিছু আদায় করে থাকবেন–হয়তো নট ইন ক্যাশ বাট ইন কাইন্ডস্। এবার বুঝলুম, ব্রতীনবাবু আসলে এই মাইজির আশ্রমে পুজো দিতে আসেন।

সৌম্য চৌধুরি বিকৃত মুখে বললেন, ব্রতীনের কমিউনিস্ট ইমেজ আছে দেশে। মার্কসবাদ নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা করে জনসভায়। তাকে এভাবে গোপনেই ধম্মকম্ম করতে হবে। বুর্জোয়া সংস্কার যাবে কোথায়? তাছাড়া সে মানুষ খুন করেছে। পেছনে ব্ল্যাকমেলার লেগে আছে। নানিমাইজি যদি আলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে তাকে বাঁচায়, তবেই নিষ্কৃতি।

কর্নেল হাসলেন।…নানিমাইজির কৃপায় সেই-নিষ্কৃতি অবশেষে মিলেছেও বটে!

বোগাস! আমি ওসবে বিশ্বাস করি না।

আপনি বিশ্বাস না করলেও ব্রতীনবাবু করেন। সুতরাং ব্ল্যাকমেলারদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এবং তাদের ঢিট করতে পেরে তিনি এবার মাইজির কাছে বড় রকমের পুজো দিতে এসেছেন। কর্নেল হাসতে লাগলেন।…তারপর দেখুন, তাঁকে আপনি মার্কিন আততায়ীদের পদ্ধতিতে দুরপাল্লার এই শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে হত্যা করতে চেয়েছিলেন–পারলেন না! হুঁ, সবই মাইজির কৃপা সৌম্যবাবু! কথায় বলে, রাখে হরি মারে কে?

সৌম্য চৌধুরি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে হরি শুধু পাপীদেরই বাঁচান, সে হরিতে আমার বিশ্বাস নেই। ওসব বোগাস থিওরি আওড়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না। প্লিজ। ওটা ফেরত দিন।

কর্নেল কথায় কান দিলেন না। বললেন, আপনারা কোথায় উঠেছেন সৌম্যবাবু?

বলবো না।

শুনুন, মোতিগঞ্জে যেখানে উঠেছেন, সেখানে ফিরে যান। অপেক্ষা করুন। কেয়ার সঙ্গে আমি আশ্রমে দেখা করছি। তাকে বলবো, আপনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। লেট মি ফেস ব্রতীনবাবু। আমি ওঁর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবো।

পারবেন না। ওর সঙ্গে দুজন বডিগার্ড আছে, দুই কুখ্যাত মস্তান।

কর্নেল ব্রিফকেস হাতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চেষ্টা করা যাক। আপনি আর এখানে থাকবেন না। নৌকো পেয়ে যাবেন ঘাটে। চলে যান–শিগগির!

সৌম্য চৌধুরি হিংস্র, হতাশ, অসহায় দুষ্টে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছেন টিলা থেকে। এক হাতে ব্রিফকেস, অন্য হাতে রিভলবার।…

২০. মুখোমুখি

কর্নেল মোরামঢাকা রাস্তায় এগিয়ে আশ্রমের ফটকের সামান্য দূরে একটা আকাশিয়া গাছের তলায় অপেক্ষা করছিলেন। হাতে সৌম্যের সেই মারাত্মক ব্রিফকেস। গলা থেকে ঝুলন্ত বাইনোকুলারে মাঝে মাঝে পাখি দেখছিলেন। শীতকাতুরে পাখিরা ডাকাডাকি করছিল গাছের পাতার আড়াল থেকে। আশ্রমের ভেতর থেকে খোল করতাল আর গানের চাপা শব্দ ভেসে আসছিল।

কিছুক্ষণ পরে তিনজন লোক বেরিয়ে এলো আশ্রমের ফটক দিয়ে। সামনে একজন, পেছনে দুজন। সামনের জনের পরনে পট্টবস্ত্র, খালি পা, গায়ে উত্তরীয় জড়ানো, নাদুস নুদুস বেঁটে গড়ন, কপালে ত্রিপুণ্ড্রক, ফর্সা রঙ, সামান্য গোঁফ আছে। পেছনের দুজনের পরনে প্যান্ট, সোয়েটার, চেহারায় উদ্ধত হাবভাব। একজন লম্বাটে রোগা, অন্যজন শক্তসমর্থ গড়নের লোক। চোখের চাউনি চঞ্চল। চিতাবাঘের মতো।

কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখার ভান করলেন। তাকে ট্যুরিস্ট বলেই মনে হবে লোকের। কাঁধে একটা ক্যামেরাও ঝুলছে। একহাতে ব্রিফকেস।

ওরা কাছে এলে কর্নেল রাস্তার মধ্যিখানে গিয়ে পট্টবস্ত্রপরা ভদ্রলোকের উদ্দেশে করজোড়ে নমস্কার করে বললেন, নমস্কার স্যার!

ভদ্রলোক থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। পেছনের লোকদুটি দুপা এগিয়ে এলো। ভদ্রলোক কপালে একটা হাত ঠেকালেন মাত্র।

কর্নেল বললেন, পুজো দিতে গিয়েছিলেন ব্রতীনবাবু?

ভদ্রলোক চমকে উঠে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।…ক্যা বোস্তা আপ? কৌন ব্রতীনবাবু?

ব্রতীনবাবু, আপনাকে আমি চিনি।…কর্নেল হাসলেন। পশ্চিমবঙ্গের রোড়স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন্দ্রনাথ দাশকে কে না চেনে? কত ছবি বেরোয় কাগজে!

ভদ্রলোক ডাইনে-বাঁয়ে তাকালেন। দেহরক্ষীদ্বয় সামনে এসে বলল, এই বুড়ো! ঝুটঝামেলা কোরো না। কেটে পড়ো বলছি!

কর্নেল একই সুরে বললেন, এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই ব্রতীনবাবু। ধর্মে ব্যক্তিগত বিশ্বাস থাকতেই পারে। বিশেষ করে সঙ্কটে পড়লে মানুষমাত্রই দুর্বল হয়ে যায়।

ভদ্রলোক ফোঁস করে উঠলেন।…ক্যা বোলতা হ্যাঁয় জি? হাম ভগবানদাস শেঠ। আপ ভুল করতা।

সরি ব্রতীনবাবু, আপনার হিন্দি উচ্চারণ আর ভুল টেক্সট্‌ বলে দিচ্ছে আপনি বাঙালি।

দেহরক্ষীদ্বয় কর্নেলকে ঠেলে সরিয়ে দিল। কর্নেল বাধা দিলেন না। দলটা এগিয়ে চলল। কর্নেল অনুসরণ করে বললেন, ব্রতীনবাবু, আপনি এখনও নিরাপদ নন। সৌম্য চৌধুরি এবং সুভদ্র সিং ধরা পড়েনি। তাছাড়া এটা সুভদ্র সিং-এর এলাকা।

পট্টবস্ত্রধারী ঘুরে দাঁড়ালেন। একজন দেহরক্ষী–যে লম্বা ও রোগা, একটা ড্যাগার বের করলো। পট্টবস্ত্রধারী ইশারায় তাকে নিষেধ করে বললেন, আর য়। ফ্রম এনি সেন্ট্রাল এজেন্সি–সি বি আই আর র?

না ব্ৰতীনবাবু।

দেন আর য়ু আ রিপোর্টার?

কর্নেল একটু হাসলেন শুধু।

ফ্রম হুইচ পেপার?

দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা।

মিট মি ইন ক্যালকাটা।

ঘুষ দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করতে চান ব্রতীনবাবু? দিস ইজ দা হিউম্যান সাইকলজি। যে একবার জীবনে ব্ল্যাকমেই হয়, সে সবসময় সবকিছুতেই ব্ল্যাকমেইল্ড হওয়ার প্রবণতায় ভোগে। হি সারেন্ডারস্ হিমসেল ইভ টু দা ইমাজিনারি ব্ল্যাকমেইল। যাকে দেখে, তাকেই ভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছে। না স্যার, এভাবে বাঁচা সত্যিই কষ্টকর।

ব্রতীন দাশ আস্তে বললেন, কে আপনি?

আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

ব্রতীন ভুরু কুঁচকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। তারপর বাঁকা হেসে বললেন, ই-বুঝেছি। সামবডি ইন দা পোলিস্–কে যেন আপনার কথা বলেছিল। য়ু আর দা প্রাইভেট ডিটেকটিভ!

ফিল্মের নেগেটিভটা আশা করি নষ্ট করে ফেলেছেন, ব্রতীনবাবু?

ব্রতীন তাকিয়ে রইলেন। এখন মুখের ভাব নির্বিকার।

কিন্তু সৌম্য চৌধুরি আর সুভদ্র সিং ধরা পড়েনি। মাইন্ড দ্যাট!

দ্যাট ইউ টোল্ড মি। ডোন্ট রিপিটু। বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন ব্রতনি। তারপর বললেন, প্লিজ মিট মি ইন দা আফটারনুন বাই থ্রি টু ফোর ও ক্লক।

কোথায়?

অ্যাট আনন্দভিলা।

কর্নেল একটু হাসলেন।…পুরস্কৃত করবেন কি?

ব্রতীনও হাসলেন।..হোয়াই নট? আফটার অল, ইউ হ্যাঁফ সে মি ফ্রম দা ডার্টি র‍্যাকেট–আইদার উইলিংলি অর আন উইলিংলি, ইউ হ্যাঁভ সেভড় মি। আই মাস্ট গিভ য়ু মাই থ্যাংকস্।

ব্রতীন দাশ হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন ঘাটের দিকে। কর্নেল দাঁড়িয়ে রইলেন। কথাটা ঠিক। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক, প্রকারান্তরে ব্রতীন দাশকে কর্নেলই ব্ল্যাকমেলারদের চক্র থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন তো বটেই! ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় স্যুটকেস বদলের ঘটনাটি না ঘটালে ব্রতীন দাশ নিষ্কৃতি পেতেন না রঞ্জনদের হাত থেকে।

ব্রতীন দাশ একটা বজরায় গিয়ে ঢুকলেন। বজরাটা ইঞ্জিনচালিত। সোজা ভেসে চলেছে ওপারের ঘাট লক্ষ্য করে।

কর্নেল শ্বাস ছেড়ে ঘুরে আশ্রমের দিকে চললেন। তারপর দেখতে পেলেন, কেয়াকে। বাঁদিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে বিস্ময়, হতাশা। আর ক্ষোভের জটিল ছাপ।

কর্নেল ডাকলেন, কেয়া!

কেয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, মাইজির আশ্রমের পুজো দিতে এসেছিলুম।

কর্নেল হাসলেন।…তোমার পুজো ব্যর্থ হয়েছে। ব্রতীন দাশ নিরাপদে চলে গেলেন।

কেয়া এতক্ষণে কর্নেলের হাতের ব্রিফকেসটি লক্ষ্য করলো। চমকে উঠলো। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ওটা কোথায় পেলেন? ওটা তো—

সে থেমে গেল হঠাৎ। কর্নেল বললেন, ঠিক চিনেছো। এটা সৌম্যবাবুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। কারণ বেঁচেবর্তে থাকো এবং ক্ষমা করো, নতুন করে ঘর বাঁধার পথে এই জিনিসটা সাংঘাতিক বাধা হয়ে দাঁড়াতো।

কেয়া ঝরঝর করে কেঁদে ফেলোে।

কর্নেল বললেন, ডার্লিং! আমি প্রফেট নই, মহামানব নই–সামান্য মানুষ। কেঁদো না। মোতিগঞ্জে ফিরে যাও। সৌম্যকে বলেছি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে। একটু পরে পুজো শেষ হলে যাত্রীরা ঘাটে ফিরবে। সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে হোটেল পারিজাতে দেখা করো। সৌম্যকে নিয়ে যেও। অবশ্যই যেও।

কেয়া চোখ মুছে বলল, ব্রতীনের সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন!

হুঁ, বলছিলুম। আমাকে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে দেখা করতে বলল। আনন্দভিলাতে?

হ্যাঁ। আনন্দভিলাতে। মোতিগঞ্জে ওই ভিলার মালিক ভগবানদাস শেঠ। যাই হোক, ডোন্ট ওরি! ঘাটে যাও। ওই বোধ করি পুজো শেষ হলো।

কর্নেল আশ্রমের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফটক দিয়ে ভক্তরা বেরিয়ে আসছে।…

উপসংহার

কর্নেলের ভাড়া করা নৌকোর মাঝিরা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল। সাড়ে বারোটা বাজে প্রায়। কিছুদূর উজিয়ে গিয়ে নৌকো ভাটির মুখে কোনাকুনি ভেসে চলল। কর্নেল ছইয়ে উঠে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। সৌম্যের ব্রিফকেসটা ছইয়ের ওপর রাখলে হালের মাঝি হুঁশিয়ারি দিল, গির যায়েগা সাব! হোশিয়ারি সে রাখিয়ে।

ব্যস, অমনি ছই গড়িয়ে ভারি ব্রিফকেসটা মাঝগঙ্গায় পড়ে তলিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ওই যাঃ!

মাঝিরা হইচই করে উঠলো। হালের মাঝি বলল, হাম বোলা গির যায়ে গা! হায় রামজি! রুপে-উপেয়া কেত্তা তা সাব?

কর্নেল নির্লিপ্তমুখে বললেন, কুছ নেহি! কাপড়-উপড়া থা কুছ! ছোড়!

মনে মনে হাসছিলেন। ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছেন। বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র। কোথায় পেলেন, পুলিশকে বলা যাবে না। কাজেই বিসর্জন দেওয়ার দরকার ছিল।

হোটেল পারিজাতে ফিরতে একটা বাজলো। লবিতে সুরেশ চতুর্বেদী অপেক্ষা করছিলেন। মুখটা গম্ভীর। কর্নেলকে দেখে উঠে এলেন। কর্নেল বললেন, ভেরি সরি মিঃ চতুর্বেদী! ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ওপারে নান্নিমাইজির আশ্রমে চলে গিয়েছিলুম।

চতুর্বেদী ঘড়ি দেখে বললেন, আমিও খুব দুঃখিত, কর্নেল। কোনো পাত্তা করতে পারিনি। লোক্যাল পুলিশ, আই বি–কেউ কিছু বলতে পারলো না। দেড়টা নাগাদ একটা ট্রেন আছে। আমাকে যেতে হবে।

ঠিক আছে। আসুন। অসংখ্য ধন্যবাদ।

চতুর্বেদী ধন্যবাদের অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

স্নান এবং খাওয়ার পর কর্নেল কিছুক্ষণ পুবের ব্যালকনিতে চুপ-চাপ বসে চুরুট টানতে টানতে গায়ে রোদ্দুর নেবার চেষ্টা করছিলেন। রোদ্দুরটা দ্রুত সরে গেল অন্য ব্যালকনিতে। তখন ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। যাবেন ব্রতীন দাশ ওরফে ভগবানদাস শেঠের আনন্দভিলায়? যাওয়াটা কি নিরাপদ হবে? পুরস্কৃত হওয়ার নানারকম অর্থ করা যায়। মৃত্যুও পুরস্কার হয়ে উঠতে পারে। যতটুকু বুঝেছেন, অতি জটিল ও কুটিল চরিত্রের লোক ব্রতীন দাশ। এক সময় সে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারতো। গোপনে ধর্মকর্ম করে। কিন্তু বাইরে মার্কসবাদী। হুঁ, মনে-মনে ভেঙে না পড়লে এমনটা কেউ করে না। তার চেয়ে বড় কথা, সে একজন ক্ষমতালোভী মানুষ। এ ধরনের মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। কর্নেলকে নিজের ডেরায় পেয়ে যদি সুশোভনের মতোই খতম করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়, কেউ টের পাবে না। সুশোভনের বেলায় সাক্ষী ছিল। এখানে সাক্ষী থাকবে না।

নাঃ, যাওয়া উচিত হবে না। কর্নেল পুবের জানলার ধারে গেলেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে দুরে গঙ্গার একটা চরের পাশে হাঁস দেখতে থাকলেন। এ বেলা আর হোটেল থেকে বেরুচ্ছেন না। অনেক কিছু ভাবতে হবে। কেয়ার মুখটা বারবার মনে ভেসে আসছে। কিন্তু কী ভাবে তার ঘর বাঁধার সাধ মেটাতে সাহায্য করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। সৌম্য বিমলকুমারকে খুন করেননি বলেছেন। করেছেন শ্যামলকান্তি। তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শ্যামলকান্তি শাস্তি পেলে কর্নেল বরং খুশিই হবেন। সুভদ্র বিহারের ছেলে। তার বাবা বড়লোক জমিদার। তাকে বাঁচাতে পারবেন তিনি। বিহারের প্রশাসন তো…। শুধু সৌম্য চৌধুরীকে বাঁচানো সমস্যা। একজন মন্ত্রী তার শত্রু। সৌম্য রক্ষা পেলে কেয়া তাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। তপেশ বসাকের রাখা টাকা ব্যাংক কেয়াকে দিতে আইনত বাধ্য। সে টাকায় পাপ কিসের? তার দাদার জীবনের মূল্য পরিশোধ করেছে ব্রতীন।…

পাঁচটাতেই সন্ধ্যা এসে গেল। গঙ্গার ওপর তখন ঘন কুয়াশা। আজ ঠাণ্ডাটা বেড়েছে। ঘরে বসে কফি খাচ্ছিলেন কর্নেল। দরজা বন্ধ। রিভলবার হাতের কাছে রেডি। দেখা করতে যাননি বলে ব্রতীন একজন আততায়ীকেও পাঠাতেও। পারে। সতর্ক থাকা দরকার।

কলিং বেল বাজল। কর্নেল বললেন, কে?

আমি কেয়া।

রিভলবার হাতেই দরজা খুললেন কর্নেল। কেয়া ও সৌম্য দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভেতরে এসো। না–এটা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভগবানদাস শেঠের পাঠানো কিলারদের ফেস করার জন্য আমি তৈরি।

দরজা বন্ধ করে দেখলেন সৌম্য হাসছেন। কেয়ার মুখেও ক্ষীণ হাসি।

কর্নেল মুখোমুখি বসে বললেন, না ডার্লিং! হাসির কথা নয়। হি ইজ আ ডেঞ্জারাস ম্যান।

সৌম্যের হাতে একটা ভাঁজকরা খবরের কাগজ। এগিয়ে দিয়ে বললেন, ফার্স্ট পেজ নিউজ। এখানে কলকাতার কাগজ পৌঁছয় চারটের ট্রেনে। পড়ে দেখুন। তাহলে বুঝবেন, কেন হাসছি।

কর্নেল কাগজটা নিলেন। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা। প্রথম পাতায় সেকেন্ড লিড খবর।

ব্রতীন দাশ বরখাস্তদল থেকে বহিষ্কৃত

স্টাফ রিপোর্টার : মুখ্যমন্ত্রী সরিৎশেখর বসু মন্ত্রিপরিষদ থেকে সড়ক ও পরিবহন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন দাশকে বরখাস্ত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বহুদিন থেকে বহু দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। দলের এবং মন্ত্রিপরিষদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যবস্থা নিয়েছেন। ব্রতীনবাবুর প্রতিক্রিয়া জানবার জন্য তাঁর বাসভবনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি বর্তমানে নাকি কলকাতার বাইরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত রাত্রে তড়িঘড়ি ডাকা মন্ত্রিসভার এক গোপন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নেন। পরে সাংবাদিকদের জানান। এর আগেই পার্টি থেকে তাঁকে দশ বছরের জন্য বহিষ্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নানা কারণে তা কার্যকর করা হয়নি। তাঁর নামে ৫২ লক্ষ টাকা নয়ছয় করার একটি অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত হয়েছিল। সম্প্রতি তদন্ত কমিশনের সেই রিপোর্টটি পেশ করার পর পার্টির ভেতর প্রবল দাবি ওঠে, ব্রতীনবাবুকে বরখাস্ত করা হোক। মুখ্যমন্ত্রী অবশেষে এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাইটার্স বিল্ডিংস এবং পুলিশ মহলের একাংশও খুশি।

সৌম্য চৌধুরি হাসতে হাসতে বললেন, বেলুন ফেঁসে গেছে। এখন আমার ধারণা, এমন একটা কিছু আঁচ করেই ব্রতীন নান্নিমাইজির কাছে পুজো দিতে এসেছিল।

কর্নেল কাগজটা রেখে চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, হুঁ, বেলুন ফেঁসে যাওয়াই বটে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গদি জিনিসটেই এমন। যতক্ষণ ওতে কেউ চেপে আছে, সে যা খুশি করতে পারে। ব্যুরোক্রাট এবং পুলিশকর্তাদের নানা বখশিসের লোভ দেখিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে। কিন্তু যে-মুহূর্তে সে গদিচ্যুত, সেই মুহূর্ত থেকে সে নিতান্ত সাধারণ মানুষ। মাথা ভেঙেও সে ওঁদের সাহায্য পাবে না। আধুনিক গণতন্ত্রের এ একটা সাধারণ নিয়ম বলা যায়। এক্ষেত্রে ব্রতীনবাবু দল থেকেও বহিস্কৃত। এখন পাল্টা দল গড়ার চেষ্টা করতে পারেন। তবে ব্যাপারটা খুর সোজা হবে না। কাগজগুলো এমন কেচ্ছা শুরু করে দেবে, দেখবেন তখন। অতএব এখন ওঁর ভরসা কিছু মস্তান দুবৃত্ত। কিন্তু তা দিয়ে নতুন ইমেজ তৈরি করা অসম্ভব। আমরা জনগণকে যত বোকা ভাবি, তত বোকা নয় তারা। এর প্রমাণ বারবার পাওয়া গেছে।

সৌম্য বললেন, কে যেন বলেছিলেন, ক্ষমতায় ওঠা মানে বাঘের পিঠে চাপা! কোনো কৌশলে চাপা যদি বা যায়, নামলেই বিপদ। বাঘটা খেয়ে ফেলবে। ব্রতীনের দশা দেখতে পাচ্ছি। আই ফিল পিটি ফর হিম।

কর্নেল হোটেলের ইন্টারকম সিস্টেমের ফোনে কফি আর গরম পকৌড়ার অর্ডার দিলেন। তারপর বললেন, বাই দা বাই, ব্রতীনবাবু মোতিগঞ্জে আসছে, কিভাবে খবর পেলেন আপনারা?

সৌম্য চৌধুরী বললেন, আনন্দভিলার মালী-কাম-কেয়ারটেকার রাঘবের সঙ্গে আমাদের গোপন ব্যবস্থা ছিল। সে হাথিয়াগড়ে সংকেতে খবর পাঠাত সুভদ্রের কাছে। সুভদ্র ট্রাংককলে খবর দিত কলকাতা। শ্যামলদা এই অ্যারেঞ্জমেন্ট চালু করেছিল। রাঘব মাসে-মাসে টাকা পেত সুভদ্রের মারফত। সুভদ্র আমাকে পরশু ট্রাংককলে জানিয়েছিল–

সুভদ্র এখন কোথায়?

হাথিয়াগড়ে নিজেদের বাড়িতেই আছে। তার গয়ে হাত দেয় কে? বিহার মুল্লুক বলে কথা।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার রিং ছেড়ে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, একটা পয়েন্ট এখনও আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। রঞ্জন হাথিয়াগড় গিয়েছিল কেম? আমার থিওরি ছিল, সে ওখানে আরও কাউকে হয়তো সুভদ্রকেই ব্ল্যাকমেইল করতে যেত। পরে জানলুম, সুভদ্রও অন্যতম ব্ল্যাকমেইলার। ব্রতীনকে সেও ব্ল্যাকমেইল করে।

করে এসেছে। সুভদ্র একজন কন্ট্রাক্টার। পশ্চিমবঙ্গ-বিহার সীমানা এলাকায় রোড়স্ ডিপার্টের একচ্ছত্র কন্ট্রাক্ট সেই পেয়ে এসেছে এতদিন। ব্রতীন মুখ নিচু করে তার টেন্ডার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু রঞ্জন ১৫ জানুয়ারি হাথিয়াগড়ে গেল কেন?

সৌম্য চৌধুরি সিগারেট জ্বেলে বললেন, বরাবরই তো যেত। আফটার অল উই ওয়্যার ফ্রেন্ডস্। আমি যতবার মোতিগঞ্জ এসেছি, অবশ্য একা আমার সাহস ছিল না শ্যামলদার সঙ্গেই এসেছি। আনন্দভিলায় ব্রতীনের কাছে চা খেয়েছি। কাজ আদায় করে হাথিয়াগড়ে গেছি। তবে রঞ্জন ছিল ডেয়ার ডেভিল। ওর কথা আলাদা। একা চলে আসত। হাথিয়াগড়েও যেত। এবার অবশ্য সে শ্যামলদার সঙ্গে এসেছিল। একসঙ্গে হাথিয়াগড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু সে হোটেলে উঠেছিল কেন?

হ্যাঁ, রঞ্জন খুব সাবধানীও ছিল। আমাদের টেক্কা দিয়ে ব্রতীনের কাছে লায়নস শেয়ার সে আদায় করেছে। তাই আমাদের সম্পর্কে তার সাবধান থাকা। স্বাভাবিক। আমরাও যথেষ্ট ঈর্ষা করতুম তাকে। সেও স্বাভাবিক। বাট উই ওয়্যার ফ্রেন্ডস্। আমাদের মধ্যে একটা বোঝাঁপড়া ছিল।

কেয়া চুপচাপ বসে আঙুল খুঁটছিল। মুখ তুলে আস্তে বলল, রঞ্জনের ব্যাংক ডিপজিটের টাকা আমি কি পাব না কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন।…আর বাধা দেবার কেউ নেই। প্রণবের বাবা এবং প্রণব সাক্ষী দেবে, তাদের ভাড়াটের নাম ছিল তপেশ বসাক। একই নামে দুজন লোক থাকতে পারে বৈকি। তোমার বিয়ের ডকুমেন্ট তো রয়েইছে।

সৌম্য বললেন, ব্যাংক ডিপজিটের কাগজপত্রে আমানতকারীর বাবার নাম লিখতে হয় না। কিন্তু সিগনেচার? পারিজাত ট্রান্সপোর্টের ক্লার্ক তপেশের সিগনেচার ওঁদের কাগজপত্র থেকে উদ্ধার করে দেব। ডোন্ট ওরি! টাকা তুমিই পাবে।

দরজায় টোকার শব্দ। কর্নেল প্যন্টের পকেটের ভেতর রিভলবারে হাত রেখে দরজা খুললেন। হোটেলের পরিচারক কফি-পকৌড়া এনেছে। নিজের সতর্কতায় নিজেই হেসে ফেললেন। বেলুন চুপসে গেছে! ব্রতীন দাশ এখন হয়তো কলকাতার পথে। কাগজের খবর দেখেই ছুটে গেছেন। করুণ অবস্থা!

কফি খেতে খেতে সৌম্য একটু সংকোচের সঙ্গে বললেন, সুভদ্রকে ব্রিফকেসটা ফেরত দিতে হবে। নৈলে আমি রেসপন্সি থেকে যাবো।

কর্নেল চোখ বুজে অভ্যাসমতো দুলতে দুলতে বললেন, আপনারা কলকাতা ফিরছেন কবে?

কালই ফিরতে চাই। কিন্তু সুভদ্রের জিনিসটা—

জিনিসটা বেআইনি। কাজেই গঙ্গায় ফেলে দিয়েছি।

সর্বনাশ! সৌম্য চৌধুরি নড়ে বসলেন। সুভদ্র ফেরত চাইলে কী বললো?

সত্যি যা ঘটেছে, বলবেন। বলবেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কেড়ে নিয়েছেন।

সুভদ্র যদি বিশ্বাস না করে?

ঠিক আছে। আমিই ওকে ট্রাংককল করে জানিয়ে দেবো। আশা করি, সুভদ্র আমাকে চিনেছে। যদি না চিনে থাকে, চিনিয়ে দিতেও পিছপা নই। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের জীবনে অনেক সুভদ্র এসেছে মিঃ চৌধুরি!

কেয়া পাংশু মুখে বলল, শোনো। আমরা রাতের ট্রেনেই ফিরে যাই। রাত দশটায় একা ট্রেন আছে। সকালে পৌঁছে যাবো। এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।

সৌম্য গম্ভীরমুখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলি কর্নেল! দরজার কাছে। গিয়ে হঠাৎ ঘুরলেন। আস্তে বললেন ফের, আমি আর যাই হই, খুনী নই। জীবনে কখনও মানুষের গায়ে হাত তুলিনি। হাবিপ্লবী দলের অ্যাকশান স্কোয়াডে ছিলুম। কিন্তু নিজের হাতে কিছু করিনি। এতকাল পরে মানুষ খুন করতে হাত তুলেছিলুম। আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন সেই পাপ থেকে। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। নমস্কার!

ওরা বেরিয়ে গেলে কর্নেল দরজা বন্ধ করে দিলেন। ইজিচেয়ারে বসে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেন। আবার খুঁটিয়ে খবরটা পড়লেন। তারপর হেলান দিয়ে চুরুট টানতে থাকলেন। চোখ বন্ধ। গোপন সত্যে পৌঁছুতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সত্য জিনিসটাই এমন, কিছুতেই তাকে (পন রাখা যায় না। সত্য নিজের জোরেই বেরিয়ে আসে। ইতিহাসের এই এক নিয়ম। হয়তো সময় লাগে, তবু সে শেষ পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করে। তাকে কিছুতেই চাপা দিয়ে রাখা যায় না।…

Exit mobile version