চৌকিদার তার ঘরের বারান্দা থেকে বুড়ো কর্নেলকে ওইভাবে দৌড়তে দেখে হকচকিয়ে উঠেছিল।
কিন্তু কর্নেল নদীর ধারে গাবগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করছেন দেখে সে আপন মনে হাসতে লাগল। এই বুড়োসাহেব বড় খামখেয়ালি মানুষ!
ওদিকে শাটার টেপার আগেই পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে চোখের আড়ালে কোথায় উধাও। কর্নেল অপ্রস্তুত।
বাইনোকুলার চোখে রেখে তন্নতন্ন খুঁজেও আর দেখতে পেলেন না। দুঃখিত মনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আনমনে একটা চুরুট ধরালেন।
তারপর গাছের তলায় বসে চুরুটটা টানতে থাকলেন। নিচে নদীর বুকে কোথাও সোনালি বালির চড়া পড়েছে। কোথাও স্বচ্ছ নীল জল তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। কর্নেলের চোখ প্রকৃতির দিকে, কিন্তু কান পাখপাখালির ডাক শুনছে। তন্ময় হয়ে রয়েছে। মনে ক্ষীণ আশা, সেই ছোট্ট সুন্দর পাখিটা আবার যদি ডেকে ওঠে।
১১. কালো হেকিমি দাওয়াই ও খুনখারাপি
হ্যাঁ, আবার পাখিটা ডেকে উঠল। প্রায় এক ঘণ্টা পরে। প্রকৃতি যাকে কণ্ঠস্বর দিয়েছে, সে কি গান না গেয়ে পারে? কর্নেল কান পাতলেন। এবার কিন্তু ডাকটা ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে।
কতক্ষণ ঠাহর করার পর বুঝলেন, কখন পাখিটা নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেছে। ওপারে ঘন বাঁশবন। বাঁশবনের ভেতর সে নিরিবিলিতে মনের সুখে গান ধরেছে।
কর্নেল বাইনোকুলার চোখে রেখে নদীতে নামলেন। এসব সময় তার পা কোথায় পড়ছে, খেয়াল থাকে না। জায়গায় জায়গায় সোনালি বালির চড়া, আবার কোথাও ঝিরঝিরে কাজল জলের স্রোত। কোথাও আবার ডোবার মতো জল জমে রয়েছে। আচমকা কর্নেল তেমনি একটি ডোবামতো জায়গায় হুড়মুড় করে পড়লেন। কোমর অব্দি ড়ুবে গেল।
এই শীতের ঋতুতে ব্যাপারটা আরামদায়ক নয় মোটেও। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়লেন বটে, কিন্তু চোখে বাইনোকুলারটা রয়ে গেল।
এমনি করে ওপারে পৌঁছে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে বাঁশবনে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর ক্যামেরা তাক করে পাখিটার ছবি তুললেন। পরপর কয়েকটা।
তারপরই পাখিটা যেন টের পেল, তার ছবি তোলা হচ্ছে। অমনি সে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল বাঁশবনের ওপর দিয়ে। তাকে লক্ষ করতে গিয়ে কর্নেলের চোখে পড়ল, একটু তফাতে ঝোপের মধ্যে এইমাত্র কেউ হেঁট হল। তার মাথার একটা কিস্তুত গড়নের ছুঁচলো টুপি রয়েছে। টুপি পরে ঝোপের মধ্যে হেট হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার মোটেও নয়। তাই কর্নেল পা টিপে টিপে বাঁশবনের ভেতর ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলতে থাকলেন।
ভেজা প্যান্ট শার্ট কোর্টে কোমর অব্দি হিমে জমে অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু কর্নেল এ বয়সেও হাড়ে প্রচুর তাকত রাখেন। গ্রাহ্য করলেন না।
বাঁশবনের শেষে একটা আগাছার জঙ্গল। তার ওপাশটা মুসলিমদের গোরস্থান বলে মনে হল। একটা উঁচু ও চওড়া ঝোপের পাশে উঁকি মেরে বসে পড়ে কর্নেল।
একটা ঢ্যাঙা রোগা গড়নের লোক হাঁটু দুমড়ে বসে একটা কিছু করছে। তার মাথার ছুঁচোলো টুপিটার মতোই চেহারাও বিদঘুটে। যেন হাড়গিলে শকুন। নাকটা বেজায় লম্বা! গাল বলতে কিছু নেই। চিবুক থেকে লম্বা এক চিলতে ছাগল দাড়ি এসে বুকে নেমেছে। তার পরনে ময়লা জোকারের মতো জামা আর চুস্ত পাজামা। পায়ে নাগরা জুতো। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে।
দু হাতে একটা খুরপি ধরে সে মাটি কোপাচ্ছে।
কর্নেল সামান্য একটু মাথা উঁচু করে যা দেখলেন, তাতে যত অবাক হলেন, তত আতঙ্কে শিউরে উঠলেন।
লোকটা যেখানটায় কোপাচ্ছে, সেখানটা একটা মাটির কবরের অংশ। কবরটা গ্রামের কোনও সাধারণ মানুষেরই কবর। তত বেশি পুরোনো নয়। কবর খুঁড়ছে কেন লোকটা? ও কি কঙ্কালটা চুরি করতে চায়? কঙ্কাল বিক্রি হয় গোপনে। চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োজনে কঙ্কাল লাগে। চোরাবাজারে তাই দেশবিদেশের কঙ্কাল বিক্রি হয় মোটা টাকায়।
এরপর লোকটা বসে পড়ল। কর্নেল শুধু তার মাথার পেছনটা আর কাধের কিছু অংশ দেখতে পাচ্ছিলেন। সে কী করছে পুরোটা দেখতে গেলে অনেকটা ঘুরে ওপাশে যেতে হয়। কিন্তু তা করতে গেলে তার চোখে পড়ার সম্ভাবনা।
একটু পরে লোকটা উঠে দাঁড়াল।
তার হাতে একটা বাঁকাচোরা শেকড় দেখতে পেলেন কর্নেল। তখন কর্নেল মনে মনে হেসে ফেললেন।
না, লোকটা কঙ্কাল চুরি করছিল না। নেহাত একটা গাছের শেকড় সংগ্রহ করছিল। গাছটা কবরে গজিয়েছিল নিশ্চয়।
হুম, এই লোকটাই তাহলে লিটনগঞ্জের সেই হেকিম লতিফ খাঁ নয় তো? কর্নেল চমকে উঠে দেখলেন, সর্বনাশ! লোকটা হন হন করে তার ঝোপটার দিকেই এগিয়ে আসছে যে!
সরে পড়ার ফুরসত পেলেন না কর্নেল। সে ঝোপ ঠেলে হুড়মুড় করে এসে একেবারে তার গায়ের ওপর পড়ল এবং ভয়ে কিংবা রাগে চেঁচিয়ে উঠল—অ্যাই বাপ!
কর্নেল অপ্রস্তুত হেসে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আদাব ঠুকে সসম্ভ্রমে বললেন—সেলাম হেকিমসাহেব! সেলাম, বহুৎ সেলাম!
হ্যাঁ লোকটা হেকিম লতিফ খাঁ-ই বটে। ভুরু কুঁচকে বলল—আপনি কে আছেন? এই জঙ্গলে কী করছেন?
কর্নেল বাইনোকুলার ও ক্যামেরা দেখিয়ে বিনীতভাবে বললেন—আমি পাখপাখালির ছবি তুলতে বেরিয়েছি হেকিমসাহেব। ওই ডালে একটা পাখি বসে ছিল। তার ছবি তুলছিলাম। আপনি তো বুঝতেই পারছেন, পাখির ছবি তুলতে হলে চুপিচুপি এইভাবে গা ঢাকা দিয়ে বসতে হয়।
হেকিম এবার দাঁত বের করে হাসল। হাঁ, হাঁ। আপনারা ইউরোপিয়ান সাহাব আদমির এইসা খ্যাল আছে বটে। একবার এক সাহাবলোকএসে ঠিক এমনি করে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। হামি দেখেছে। তবে আপকা মাফিক বাংলা বোলি সে বলতে পারত না।