Site icon BnBoi.Com

মতি নন্দীর গল্পসংগ্রহ

মতি নন্দীর গল্পসংগ্রহ

উৎসবের ছায়ায়

সানাই বসেছে, আবার লাউডস্পিকারও। গোটা পাড়াটাই গমগম করছে। কাল দুপুরে যখন বর-বউ এল তখনই সানাই, বিকালে রেকর্ড। আজ সকালে সানাই, দুপুরে রেকর্ড। সারি সারি চেয়ার রাস্তার দু-ধারে। পথ-চলতি মানুষরা সসংকোচে চেয়ার বাঁচিয়ে টুক করে জায়গাটা পার হয়ে যাচ্ছে। এঁটো পাতার বালতি নিয়ে দুটি ঝি বাড়ি থেকে বেরোতেই চেয়ারের মানুষরা নড়েচড়ে বসল। এক ব্যাচ শেষ হল। খুরি গেলাস ফেলার শব্দ পাশের নন্দী বাড়িতে পৌঁছোতেই কতক–গুলো মানুষ বেরিয়ে এসে চেয়ারে বসল।

ভূতের মতো মানুষগুলো উবু হয়ে এঁটো পাতা গেলাসের মধ্য থেকে খাবার বাছছে। উবু হয়ে ঘাড় নামিয়ে মঞ্জু তাই দেখছিল। ওদের জানলার নাকের তলাতেই আঁস্তাকুড়টা। দেখতে দেখতে মঞ্জু দাঁড়িয়ে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে খুব আস্তে ডাকল—মা।

কণিকা ঘরের ঠিক বাইরের রকটাতেই রাঁধছিল, ডাক শুনে সাড়া দিল মাত্র।

মা, আস্ত আস্ত ছ-টা সন্দেশ।

আচ্ছা আর গুনতে হবে না।

মঞ্জু আর বসল না। দাঁড়িয়েই সে গরাদের ফাঁকে ঠোঁট আর নাকটুকু বার করে দিল। আস্তাকুঁড় থেকে বিয়েবাড়ির গন্ধ আসছে। এ পাড়ায় তারা নতুন এসেছে তাই নেমন্তন্ন হয়নি। সামনের বাড়ির মেয়েরা এখনও সাজছে। হান্টিদি আজ সকালেও ফ্রক পরেছিল, শান্টিদি বিকেলের খোঁপাটা বদলেছে। ওদের সঙ্গে সান্যালদের খুব ভাব। বিয়েবাড়ির ঝি আবার দু বালতি এঁটো ফেলে গেল। ভূতগুলো মাথা নুইয়ে খাবার খুঁজছে।

মা, দেখে যাও কত ফেলে দিয়েছে।

ওদিকে থেকে সাড়া এল না। তাতে কিছু এসে যায় না মঞ্জুর। নাক ফুলিয়ে খুব আস্তে আস্তে নিশ্বাস টানল।

বেড়িয়ে ফিরল কিরণ, অঞ্জু আর রঞ্জ। আর জানলার কাছে মঞ্জুর বসে থাকার উপায় নেই। ওদের নিয়ে এখন খেলতে হবে, নয়তো রান্নার কাছে গিয়ে বিরক্ত করবে।

ঘরের আলো জ্বালল কিরণ। স্কুল ফাইনাল পাস করে মামার কাছে এসেছে। মন্মথ চেষ্টা করছে একটা কাজ ওকে জুটিয়ে দিতে। ডিপো ম্যানেজারকে বলা আছে। সময় হলেই অ্যাপ্রেন্টিস করে ঢুকিয়ে দেবে।

ঘরের আলো নিবিয়ে কিরণ বেরিয়ে গেল। মঞ্জু, অঞ্জু, রঞ্জু অন্ধকারে বসে রইল। আলো জ্বালালে মিটার খরচ বেশি হয়। কণিকা লক্ষ জ্বালিয়ে রান্না করে। জানলার কাছে গুটিগুটি ওরা তিন ভাই-বোন দাঁড়াল। শুধু একটা লোক তখনও খাবার খুঁজছে। আর সবাই দূরে রাস্তার আলোয় নিজের নিজের পুটলি গোছাচ্ছে। রান্না হয়ে গেছে কণিকার। হেঁশেল ঘরে ঢুকল। অন্য দিনের মতো বাচ্চারা হুটোপাটি করেনি তাই সে অবাক ছিল রান্নার সময়, আলো জ্বেলেই দেখল তিন জন জানলায় ঠাসাঠাসি করে রয়েছে। ওদের ওপর দিয়ে উঁকি দিল কণিকা।

কী করছ এই নোংরার সামনে বসে?

দেখছি তো।

দেখার কী আছে, আঁস্তাকুড় কখনো দেখনি?

মা দিদি বলছিল অনেক সন্দেশ ফেলে দিয়েছে। ওখানে আছে। দোষটা আসলে তার নয়, অঞ্জু এই কথাটাই বোঝাতে চাইল। মা বুঝেছে কি না এই কথাটা জানতে তিন জোড়া চোখ কণিকার মুখে বিঁধে রইল। কী বুঝল কণিকা, আলোটা নিভিয়ে জানলার ধারে দাঁড়াল, মাথাটা হেলিয়ে কোনোরকমে এক চোখ দিয়ে সান্যাল বাড়ির দরজা পর্যন্ত দেখা যায়। কণিকা দেখতে লাগল।

ঘাঁটতে ঘাঁটতে লোকটা খাবার মুখে পুরছিল। হঠাৎ হেঁচকি তুলতে শুরু করল।

কণিকা সেই একভাবে এক চোখ দিয়ে দেখছে। হঠাৎ সে বলল, হ্যাঁ রে মঞ্জু, ওই মেয়েটা বাসে করে ইশকুল যায়?

মঞ্জু ঘাড় কাত করে কণিকার মতো এক চোখ দিয়ে দেখল।

হ্যাঁ, ও টিনাদি।

আর ওর পাশেরটা?

দেখতে পাচ্ছি না।

কণিকা মঞ্জুকে আর একটু জায়গা ছেড়ে দিল।

ও তো বাসু, হেঁটে ইশকুল যায়।

দ্যাখ দ্যাখ ওই কোলের ছেলেটাকে।

নিমন্ত্রিত কয়েক জন মহিলাদের একজনের কোলে বাচ্চা। মাস ছয়েক বয়স।

ঠিক ওইরকম একটা ফ্রক বড়োমামি তোকে দিয়েছিল, ঠিক ওই রকম রং। কবে মা?

তোর ভাতের সময়।

রঞ্জু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সানাই বেজে উঠল, ওরা চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রঞ্জু বলল, ওই লোকটাকে ঠিক বাবার মতো দেখতে।

কোনটা?

ওই যে সিগারেট খাচ্ছে।

দূর, ও তো মোটা আর পাঞ্জাবি পরেছে।

মঞ্জুর কথা শেষ হতেই কণিকা বলল, তোদের শম্বুকাকার বিয়েতে তোর বাবা বরযাত্রী গেছল। পাঁচ-ছটা সিগারেট এনেছিল।

তুমি গেছলে?

ওরা তিন জনে মুখ তুলে তাকাল।

মা তুমি নেমন্তন্ন খেয়েছ?

তিন জোড়া চোখ বিধে আছে। কণিকা জবাব দিল না। ওরা একসময় চোখ সরিয়ে নিল।

মঞ্জুর ভাতে অনেকে আমাদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে।

আবার তিনটে মাথা ঘুরে গেল। গরাদে নাক চেপে কণিকা হাসল, ওরা তা দেখতে পেল না।

দুটো রসুই বামুন ভাড়া করা হয়েছিল। রাসবিহারীবাবুদের ছাদে লোক খেয়েছিল। এমনি রাস্তার দু-ধারে চেয়ার পেতে লোক বসেছিল কত যে খাবার ফেলা গেছল।

রেখে দিলে না কেন? পরের দিন খেতে।

অনেক বেঁচেছিল। বিষ্ণুদের বাড়ি, হরিঠাকুরঝিদের বাড়ি, তোর বাবার বন্ধুদের বাড়ি খাবার পাঠানো হয়েছিল।

সান্যাল বাড়ি থেকে একসঙ্গে অনেকে বেরোচ্ছে, কণিকা তাড়াতাড়ি গরাদের ফাঁকে চোখ রাখল। বোধ হয় মেয়ের বাড়ির লোক, বর নিজে এগিয়ে দিতে এসেছে।

মা, আর ভাত হবে না আমাদের বাড়ি?

মা, মঞ্জু কি বোকা দ্যাখো, বড়ো হয়ে গেলে আবার ভাত হয় নাকি?

হঠাৎ জানলা থেকে সরে গেল কণিকা। মন্মথ আসছে।

কলঘর বাড়িওয়ালার এক্তিয়ারে। বাড়িওয়ালার বউ খুঁচিবেয়ে, পাইখানা যেতে গিয়ে মন্মথ এক ফোঁটাও জল পেল না। অশ্রাব্য দু-একটা গাল শুরু করেছিল মন্মথ। কণিকা তাড়াতাড়ি খাবার জলের কলসি থেকে ঢেলে দিল। মন্মথ এলেই ভাত বেড়ে দেবে। ছেলে-মেয়েরাও বসবে ওর সঙ্গে। যাওয়ার সময়কার বিরক্তিটুকু সঙ্গে নিয়ে মন্মথ ফিরে এল। চানের জল নেই। গামছা ভিজিয়ে বুকে-পিঠে জোরে জোরে ঘষল।

টিউকলে যাও-না।

কল টিপবে কে? কিরণ কোথা?

ও তো বেরিয়েছে, সেই খাওয়ায় সময় আসবে। ভালো কথা, ও শোবে কোথা? রকে তো আজ শুতে পারবে না।

শোবে আমার মাথায়।

ঝড়াৎ করে বালতিটা তুলে নিল মন্মথ। মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, আয়। বলেই মন্মথ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।

দাঁড়িয়ে আছিস যে?

যেন ঘুম ভাঙল মঞ্জুর। দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়েই ফিরে এল। লাল টুকটুকে রবারের চটিটা পরে সান্যাল বাড়ির সামনে দিয়ে গুটিগুটি করে ও টিউবওয়েলে পৌঁছোল। মন্মথ বালতি হাতে দাঁড়িয়ে। ওর আগে এসেছে মিষ্টির দোকানের অমূল্যচরণ। কলে বাসন মাজছে টিনের বাড়ির এক বউ। মন্মথকে দেখে বগল চুলকে অমূল্য হাসল।

এয়েচেন।

হুঁ।

ঠক করে বালতি রাখল মন্মথ। বউটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখে আবার মাজতে লাগল।

একটু তাড়াতাড়ি করো গো। তারপর মন্মথবাবু খবর কী?

খবর আর কী, পাপের ভোগ বয়ে যাচ্ছি। চালের কন্ট্রোল তুলে কই দাম তত কমল না। আজ তো বারো আনা দে কিনলুম। দেশে চালের মন সাঁইত্রিশে, তাল খাচ্ছে মানুষে। তোমার আর কী; ছোটো সংসার, দোকানও চলছে ভালো, ছেলেপুলের ঝামেলা নেই।

ভালো আর চলছে কই।

কলে পাম্প করছে বউটি। অমূল্য অন্যমনস্ক হল আবার। মন্মথও দেখছে। কতভাবে কত বারই তো কণিকার পিঠ বগল সে দেখেছে। কই মনের মধ্যে তো এমনটি হয় না।

চাল তুমি কোথেকে কেন?

শ-বাজারে সুধীর সাহার দোকান থেকে। পাড়ার দোকান, ধারেও পাওয়া যায়।

আপনাদের এক সুবিধে, মাস গেলেই বাঁধা মাইনের টাকা। বাসেও টিকিট কাটতে হয় না। সুমুন্ধিটাকে কণ্ডাক্টর-মণ্ডাক্টর করে ঢুকিয়ে দিন-না। দু-বছর ফেল করে বসে আছে।

বউটি চলে গেল। কলে বালতি পাতল অমূল্য। মঞ্জু ওদের থেকে কিছুটা দূরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিয়েবাড়ির আলো ওর মুখে পড়েছে। আর একদফা খাওয়া শেষ হয়েছে। ভরপেট মানুষগুলো মঞ্জুর পাশ দিয়েই চলে গেল। সিগারেট ধরাতে দাঁড়িয়ে একজন তার সঙ্গীকে বলল, তুই একটা নেলা। গুচ্ছের পোলাও বসে বসে গিললি। মাছ খাবি তো।

ছ-টা মাছ খেয়েছি।

আমি শালা তেরোটা।

মন্মথর কানেও কথাগুলো গেছে। অমূল্য জল নিয়ে চলে গেল। মঞ্জু ডাক শুনেই দৌড়ে এল। ঘাড় নুইয়ে বাবু হয়ে মন্মথ বসেছে। হেঁচকি তোলার মতো হ্যাণ্ডেলটা তুলে বুক দিয়ে সাপটে মঞ্জু ঝুলে পড়ল। সরু ধারায় জল পড়ছে। মন্মথ মাথা চাপড়াল, পিঠ-বুক রগড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠল মঞ্জু।

সাবান ঘষতে শুরু করল মন্মথ। ডিপোয় গোলা সাবান দেয়। তাই দিয়ে তেল-কালি ওঠে কিন্তু ডিজেলের গন্ধ চামড়ায় বসে থাকে। গন্ধ সাবান মেখে সেই গন্ধ মারতে হয়। চুলে সাবান ঘষল মন্মথ। গাড়ির তলায় শুলে কি বনেটের মধ্যে মাথা ঢোকালেই চুলে কালি লাগবে। সেই কালি বালিশের ওয়াড় ময়লা করবে।

নেমন্তন্ন খেয়ে আরও কয়েক জন ফিরছে। টিউবওয়েলের কাছটা অন্ধকার। রাস্তার ধারে একজন পেচ্ছাব করতে বসল। সঙ্গীরা তার জন্য দাঁড়িয়ে রইল।

বউটা মাইরি বড় বোগা।

বিয়ের জল লেগে ঠিক হয়ে যাবে। আরে তুই কচ্ছিস কী? শেষকালে পাড়ার লোকদের যে আর একটা ডিভিসি তৈরি করতে হবে।

তাহলে তোকে চেয়ারম্যান করব।

এবার একটু মোটা হয়ে জল পড়ছে। মন্মথ খুশি হল। মাথা পেতে রাখল অনেকক্ষণ। মঞ্জু হাঁপাচ্ছে। ওকে কল টিপতে বারণ করে উঠে দাঁড়াল সে।

এবার বাড়ি চলে যা। দাঁড়া, সাবানটা নিয়ে যা। সাবান হাতে গুটিগুটি মঞ্জু ফিরে এল। সান্যাল বাড়ির সামনে সে একটুখানি দাঁড়িয়েছিল। হাত থেকে সাবানটা পড়ে গিয়েছিল। সাবানে-লাগা-ধুলো ফ্রকে ঘষতে ঘষতে সে দেখতে পেয়েছিল টিনাদি লাল-নীল কাগজ লোকেদের বিলোচ্ছে। ঠিক ওইরকম কাগজ দিয়েই মোড়া ছিল সাবানটা, যখন দোকান থেকে আসে।

রঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে, অঞ্জর প্রায় সেই অবস্থা। কণিকা ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। মন্মথর পাশে বসেছিল মঞ্জু। কিরণ ফিরবে ঠিক যখন কণিকা খেতে বসবে।

তুমি তেরোটা মাছ খেতে পার?

চান করে তাজা বোধ করছে মন্মথ। মঞ্জুর পাত থেকে ফেলে দেওয়া কাঁচালঙ্কাটা নিজের থালায় ঘষতে ঘষতে বলল, তারও বেশি পারি।

কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্মথ হাসল, কণিকাও। ব্যাপারটা মঞ্জুর চোখে পড়ল। বাবা-মার একসঙ্গে হাসি সে দেখেনি, আশকারা পেয়ে। বলল, যাঃ, মিথ্যে কথা।

গ্রাসটা মুখের কাছাকাছি একটু থামিয়ে গিলে ফেলল মন্মথ। অঞ্জু ঢুলে পড়ছে। বাঁ-হাতে ওর ঘাড়টাকে সিধে করে ধরে কণিকা ভাত গুজে দিল।

বিশ্বাস না হয় তোর মাকে জিজ্ঞেস কর। তোর এক মেজদাদু ছিল। মণিমাসিমার বাবা। ভীষণ খাইয়ে। এত্ত ভাত খেত আর গামলা গামলা মাংস। তোর ভাতের সময় নেমন্তন্ন খেয়ে যখন বাড়ি যাবে তখন বলেছিলুম, কাকাবাবু, আপনার আর আগের মতো খাওয়া নেই। শুনেই বললেন, তুমি যা খাবে, আমি এখুনি তার ডবল খেতে পারি। কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা। কম করে অন্তত পঁচিশটা লেডিকেনি, এক হাঁড়ি দই আর পাঁচ-ছ গন্ডা মাছ খেয়েছে, এরপর আর কত খেতে পারবে। তাই দুম করে আমিও রাজি হয়ে গেলুম। বোধ হয় পনেরোটা মাছ খেয়েছিলুম, তাই না?

আ…হা পনেরোটা কোথায়? ছোটো বউদিই তো তোমার পাতে খান বারো দিয়েছিল, তারপর মেজকাকি এক খামচা।

কিরণ এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। মন্মথর সঙ্গে চোখাচোখি হল। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে। ওর চাউনির বাইরে সরে যাবার চেষ্টা করতেই মন্মথ বলল, যাচ্ছিস কোথায়? খেয়ে নে।

তারপর কী হল বাবা?

ও আজ শোবে কোথায়?

ঘরেই শুক।

বাবা, তারপর?

তারপর তো মেজদাদু খেতে বসল।

যেখানে যত লোক ছিল সবাই ছুটে এল। মেজদিদিমা খালি বললেন, ওর শরীরটা ক-দিন ভালো যাচ্ছে না, একটু নজর রেখে পাতে দিয়ো।

থালার কানায় হাতের চেটো ঘষল মন্মথ, কাদার মতো ভাতের চাঁছি জমল। আঙুল দিয়ে সেটুকু মুখে পুরে সে উঠে পড়ল।

কিরণ ভাতে হাত দিয়ে গল্প শুনছিল, এইবার সে তাকাল কণিকার দিকে। খেয়াল হল কণিকার, অঞ্জু এতক্ষণ কিছুই খায়নি। বাকি ভাতটুকু একগ্রাসে ওর মুখে গুঁজে দিল।

কলঘরটা অন্ধকার। মেঝেয়-বসানো বালতিটায় ঠোক্কর লাগল। ঝন ঝন শব্দের মধ্যেই মঞ্জু বলল, মেজদাদু তোমার ডবল খেল?

হ্যাঁ খেল। পইপই বলি বালতি চৌবাচ্চার পাড়ে রাখবে। কে কথা শোনে!

মঞ্জু গা ঘেঁষে এল, কিরণের খাওয়া হয়ে গেছে। কণিকারও প্রায় শেষ। মন্মথর কথার পিঠে কেউ কথা বলল না, সেও চুপ করে রইল। বাইরে একটা লোক বোধ হয় কুকুর তাড়াচ্ছে। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল মন্মথ। ঘরের মধ্যে ভীষণ গরম। রাস্তার হাওয়ায় শরীরটা জুড়োতে সে বেরিয়ে পড়ল।

দাঁ-দের রকটায় মন্মথ বসবার জায়গা পেল। পুঁটলি নিয়ে একটা লোক ওর সামনেই পথে বসল। লোকটা সন্দেশ আর লেডিকেনির দুটো স্থূপ আলাদা করে বেছে রেখে লুচি আর অন্য কীসব দিয়ে খাওয়া শেষ করল, মিষ্টি খেল না। গলা খাঁকিয়ে মন্মথ জিজ্ঞেস করল, ওগুলো খেলি না যে।

ওগুলো বেচব।

কোথায়?

মিষ্টির দোকানে।

লোকটা আর কথা বাড়াল না। হাঁটা শুরু করল। তাড়াতাড়ি মন্মথ ওর পিছু নিল। ও যেদিকে চলেছে সেদিকেই তো অমূল্যের দোকান। ট্রাম-রাস্তায় পৌছে মন্মথ হাঁপ ছাড়ল।

বন্ধ করবে কখন?

বন্ধের অনেক দেরি, সেই সাড়ে এগারোটা-বারোটা। খাটুনি কি কম, সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে ভূতের মতো চরকিবাজি শুরু হয়েছে।

একটু অন্যমনস্কর মতো মন্মথ বলল, তোমার তো তবু ছোটো সংসার। চার-পাঁচটার মুখে অন্ন দিতে হয় না।

কথাটা বোধ হয় শুনতে পেল না অমূল্য। খদ্দের এসেছে। দই ওজন করা দেখল মন্মথ। ধারের খাতায় দাম টুকে রাখল অমূল্য। আবার খদ্দের এল, মন্মথ উঠে পড়ল। আর বসে থাকা যায় না, বসলেই বিড়ি খেতে হবে। ঘরে গিয়ে বসলে আঁস্তাকুড়ে ফেলা বিয়েবাড়ির খাবারের গন্ধ শুকতে হবে। গন্ধটা এমন যে গোগ্রাসে গেলার ইচ্ছে জাগে। অমূল্যর দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা যদি ধারে কেনা যায় কত আর পড়বে? পাঁচ-সাত টাকা। পাঁচ সিকে কি দেড় টাকায় প্রায় অতগুলো মিষ্টিই পাওয়া যেত।

হঠাৎ মন্মথর ভীষণ খিদে পেল। প্রায় পঁচিশটা মাছের টুকরো একসঙ্গে খেতে পারার মতো খিদে। ছ্যাঁৎ করে উঠল ওর বুক। একটা লোক পুঁটলি হাতে আসছে। অবিকল সেই লোকটার মতো। লোকটা চলে গেল পাশ দিয়ে, আর আশ্চর্য, খিদেটাও কমে গেল। বিয়েবাড়ির জলুস নিবু নিবু, হইচইটা হচ্ছে ফুলশয্যার অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে। এবার বর-বউ ঘরে ঢুকবে।

গন্ধ পেল মন্মথ। শব্দ না করে নিশ্বাস টেনে ফিসফিস করে বলল, সাবান মেখেছ বুঝি? আর একটু এগিয়ে এসে মন্মথর চিবুকে প্রায় গাল ঠেকাল কণিকা। হ্যাঁ, কিরণকে দিয়ে এক বালতি আনালুম। গা থেকে বড় টক টক গন্ধ বেরোয়।

দুজনে মাখলে তাড়াতাড়ি ফুরোবে।

আমি কি আর রোজ মাখছি।

সান্যাল বাড়িতে কিছু-একটা হল। অনেকে মিলে হেসে উঠছে। অনেক বাড়ির দেয়াল টপকে হাসিটা কণিকার নিশ্বাসের মতো দ্রুত চাপা হয়ে ঘরে পৌঁছোল।

অঞ্জু আজ কী বলছিল জান?

কী?

বলছিল মা আমাদের বাড়ি আর ভাত হবে না।

অত কাছে আসছ কেন, কিরণ ঘরে রয়েছে না?

মন্মথ কনুই দিয়ে ঠেলল কণিকাকে। কণিকা আরও সরে আসতে চাইল।

কী হচ্ছে কী?

চাপা ধমক দিল মন্মথ, শিথিল হয়ে গেল কণিকা। একটু সরে গেল, আর একটু বাদে কাত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওর পিঠে আলতো হাত রাখল মন্মথ। টিউব ওয়েলের বাসনমাজা বউটিকে মনে পড়ল। কণিকার পাঁজর চেপে মন্মথ টেনে আনল।

অঞ্জু কী বলছিল?

জানি না।

বলো না?

বললুম তো।

মন্মথর বুকে হাত বুলোতে শুরু করে কণিকা। হাতে ঠেকল গামাচি। নখ দিয়ে মেরে দিল। পুট করে উঠল।

বেশ শব্দটা, না?

হ্যাঁ।

মেরে দাও-না।

থাক এখন।

কণিকা হিঁচড়ে নিজেকে মন্মথর বুকের উপর তুলল। মন্মথর ঘাড়ে মুখ ঘষে বলল, সাবানের গন্ধটা বেশ না?

হ্যাঁ, কিন্তু কিরণ ঘরে রয়েছে।

ফিসফিস করে ঠিক একই সুরে কণিকা বলল, বাইরের রকে চলো-না।

রকে নর্দমার গন্ধ।

না, গন্ধ নেই। বিকেলে বাড়িউলি পরিষ্কার করেছে।

রাতে বাড়িউলি কলঘরে নামবে।

এখন নামবে না।

না না, না।

বিরক্তি ভয় আর উত্তেজনা মন্মথর কথাগুলোকে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল। আর ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল কিরণ।

কী হল তোর?

দরজা বন্ধ আছে?

হ্যাঁ আছে, তুই ঘুমো।

কিরণ শুয়ে পড়ল। নিঃশব্দে সাপের মতো শরীরটাকে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে কণিকা সরে গেল। আর একটু পরেই চটাস করে রঞ্জুর পিঠে চড় মেরে উঠে বসল কাঁথা বদলাবার জন্য।

মারলে কেন?

না মারবে না, খেটেখুটে একটু শোব তারও উপায় নেই, শত্তুর এসে জুটেছে।

আঃ, গাল দিচ্ছ কেন।

চুপ করে রইল কণিকা। মন্মথও। সারা ঘরে শুধু নিশ্বাস আর রঞ্জুর বিনিয়ে কান্নার শব্দ, তাও একটু পরে থেমে গেল। খলখল করে মজুমদার বাড়ির মেয়েরা ফিরল। দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে। চাকরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওরা লুটোপুটি খেয়ে গল্প জুড়ল। খড়খড়ির পাখির ফুটো দিয়ে হান্টি কী যেন দেখছে।

কণিকা জলের মতো মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে জানলার কাছে সরে এল। ওদের হাসির জন্য কিছু কিছু কথা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কনুই দুটো পিলসুজের মতো করে দু-হাতের চেটোয় সে মুখটাকে রাখল।

মন্মথ বলল, জানলাটা বন্ধ করে দাও নয়তো আস্তাকুঁড়ের গন্ধ আসবে।

থাক, রোজই তো খোলা থাকে।

আজ জঞ্জাল বেশি।

কণিকা শুধু চাউনিটা নামিয়ে আস্তাকুঁড়টা দেখল। আর দেখতে দেখতেই বলল, জঞ্জাল আর কোথায়, খাবারই তো।

একটু বুঝি হাওয়া দিল। শরীরটা ঠাণ্ডা লাগছে। মন্মথ চোখ খুলল। একভাবেই কণিকা জানলার দিকে তাকিয়ে। শান্ত, নিথর মন্মথর মনে পড়ল বাসনমাজা বউটিকে, তার শরীরের নড়াচড়াকে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে একটা ম্যাজম্যাজে অস্বস্তির চলাফেরা বোধ করল। উপুড় হয়ে দু-হাতে নিজের মাথা জড়িয়ে ধরল সে। সাবানের গন্ধ সরে গেছে শরীর থেকে, শরীরে এখন অস্বস্তি। কণিকার দিকে আড়ে তাকাল। শান্ত, নিথর। আবার একটু হাওয়া এল। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্মথ টের পেল উৎসববাড়ির গন্ধ। বুঝে গেল কেন এখনও কণিকা জানলার দিকে মুখ করে জেগে আছে। কণিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন্মথ ভাবল, এইবার ওকে টেনে হিঁচড়ে বাইরের রকে নিয়ে গেলে কেমন হয়। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই মন্মথ হাত বাড়াল আর চমকে হাতটা সরিয়ে নিল। মঞ্জু অঞ্জু কারোর গায়ে হাতটা পড়েছে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা শরীরের ম্যাজম্যাজে অস্বস্তিটা গুটিয়ে দলা পাকাল পাকস্থলীর মধ্যে। সারা শরীরটা গুলিয়ে উঠে প্রচন্ড খিদেয় আচ্ছন্ন হল। ক্রমশ সে ঝিমিয়ে পড়ল। ঘুম আসবার আগের মুহূর্তে সে দেখতে পেল পুঁটলি হাতে লোকটা ট্রামলাইন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।

 একটি পিকনিকের অপমৃত্যু

কথায় কথায় চিত্রা বলেছিল, তার প্রেমিক অরুণ সাহাদের গ্রামের বাড়িটা বাগান-পুকুর সমেত বিশ বিঘের। ফাঁকাই পড়ে থাকে, কালেভদ্রে বাড়ির লোকেরা পিকনিক করতে যায়। তাই শুনে চিত্রার চার বন্ধু অর্থাৎ ইতিহাস অনার্সের শীলা, করুণা, দীপালি আর সুপ্রিয়া ওকে বলে, আমরাও একদিন গিয়ে পিকনিক করে আসব। কিছুদিন পরে চিত্রা ওদের জানাল, অরুণ রাজি হয়েছে। সামনের রোববার সে বাড়ির স্টেশনওয়াগানটাও পাচ্ছে, সবাইকে এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। কলকাতা থেকে আঠারো মাইল দূরে ওদের গ্রামে যেতে বড়োজোড় আধঘণ্টা লাগবে। অরুণ খুব জোরে চালায়।

কলেজ ছুটির পর কাছের এক চায়ের দোকানে বসে ওরা কথা বলছিল। শীলা তার সরু গলাটা ঝুঁকিয়ে লিকলিকে হাত দুটো টেবিলে রেখে বলল, পারহেড কত করে দিতে হবে

সেটা এখনই ঠিক করে নেওয়া ভালো।

কাউকে কিছু দিতে হবে না, সব খরচ অরুণের। চিত্রা তাচ্ছিল্যভরে বলার খুব চেষ্টা করেও গর্ব লুকোতে পারল না।

না, তা কেন। দীপালি আপত্তি করল এক জনের ঘাড়ে সব খরচ চাপানো উচিত হবে না।

আমাদের পাঁচ জনের জন্য কটাকাই-বা খরচ হবে। ওদের ব্যাবসার পাবলিসিটিতেই তো বছরে যায় চল্লিশ হাজার টাকা। বলতে বলতে চিত্রা নিজেও অবাক হয়ে গেল।

তাহলেও আমাদের বাধো-বাধো ঠেকবেই। অরুণের সঙ্গে তোর ভাব, তোর খরচ নয় সে। দিল। কিন্তু আমাদের কেন দেবে?

তোরা আমার বন্ধু।

হলেই-বা। পিকনিকে সবাই সমান না হলে আনন্দ জমে না। এক জনই সব দিলে বাকিদের মনে হবে অনুগ্রহ নিচ্ছি, তাই না? দীপালি অন্যদের সমর্থন চাইল। শীলা ইতস্তত করল; সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়ল। করুণা বলল, কিন্তু ভালো মনে যদি খরচের সব দায়িত্ব নেয়, তাহলে অবশ্য অনুগ্রহ নিচ্ছি বলে মনে হবে না।

হ্যাঁ হবে। দীপালি হঠাৎ গোঁয়ার হয়ে উঠল। অরুণের সঙ্গে যেদিন চিত্রা আলাপ করিয়ে দিল, মনে আছে তোর সেই চীনে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই তুই কী বলেছিলি?

শীলা সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, কী বলেছিলুম?

এত খরচ করছে আর আমরা এক পয়সাও খরচ করতে পারছি না, কেমন লজ্জা লজ্জা করে। বলেছিলি কি না বল?

বড্ড বড়োলোক বাপু। শীলা আত্মসম্মান বজায় রেখে হাসবার চেষ্টা করল, ফসফস করে যেরকম পাঁচ-দশ টাকার নোট বার করছিল। পিকনিকে অবশ্য বড়োজোর পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিতে পারব, কিন্তু তাতে তো পেট্রোল খরচও উঠবে না।

ট্রেনে যাব। সুপ্রিয়া বলল।

এতই যখন তোমাদের মানসম্মানবোেধ, তাহলে বরং না যাওয়াই ভালো। চিত্রা উঠে দাঁড়াচ্ছিল, করুণা আর সুপ্রিয়া টেনে বসাল।

না না, আমার কাজ আছে।

রাগ দেখাতে হবে না আর। করুণা চিমটি কাটল চিত্রার হাতে। বাড়িতে তাহলে বলে দোব সব।

দে-না। সবাই জেনে গেছে।

এসব কথা এখন থাক। দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল, আগে ঠিক কর যাওয়া হবে কি হবে। মোট কথা একদম কিছু কন্ট্রিবিউট না করে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

জানি, জানতুম, দীপালি একটা-না-একটা ফ্যাঁকড়া বার করবেই। অরুণের বাড়িতে যাচ্ছি, সে তো আতিথেয়তা করবেই। সুপ্রিয়া তোর বাড়িতে যদি যাই, বল তুই কি অ্যালাও করবি আমাদের পয়সা খরচ করতে দিতে?

সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়ল মাদ্রাজি ঢঙে।

এই সময় একটি ছেলে ঢুকল চায়ের দোকানে। ওদের দেখে লাজুক হেসে দূরের একটা টেবিলে বসল। আদ্দির পাঞ্জাবি পরার জন্য জিরজিরে বুকের পকেটে এক টাকার নোট এবং কণ্ঠার হাড় স্পষ্ট। শ্যাম্পু করা চুল ফাঁপিয়ে এলোমেলো। রুমালে সুগন্ধি ঢালে। মেয়েদের ফাইফরমাশ পাওয়ার জন্য সতত ব্যস্ত। মুখটি কচি দেখায় দাড়ি না ওঠায়। কলেজের মেয়েরা হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে।

শিবুটা এখানেও! জ্বালালে। শীলা গম্ভীর হয়ে চেয়ারে হেলান দিলে বুকটা চিতিয়ে।

আঃ, আবার! করুণা কৃত্রিম ধমক দিল শীলাকে।

দেখুক-না, ওটা আবার পুরুষমানুষ নাকি।

ওসব কথা থাক। দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল, কী আমরা দিতে পারি সেটা আগে ফয়সালা হোক।

শীলা বলল, টাকাপয়সার কথা বাদ দে। পিকনিক মানেই তো শুধু খাওয়া নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সময়টাও কাটাতে হবে। সেইরকম কিছু তো আমরা নিয়ে যেতে পারি।

আমাদের একটা ট্রানজিস্টার আছে। করুণা উৎসাহভরে বলল।

অরুণদের তিন-চারটে আছে।

দীপালি তুই কী বলিস?

এরপর পাঁচ জন চুপ করে ভাবতে শুরু করল। চা খেতে খেতে শিবু ওদের দিকে তাকাচ্ছে। টেবিলে টোকা দিয়ে একটু গুনগুন করল। খাতাটা খুলে মনোেযোগে খানিকটা পড়ল। রাস্তা দিয়ে দুটি মেয়েকে যেতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। তারপর ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ করে চা খেতে লাগল।

পেয়েছি! শীলা চাপাস্বরে বলল, শিবুটাকে নিয়ে চল, চমৎকার সময় কাটবে।

চার জনেই প্রথমে খুব অবাক হয়ে গেল শীলার কথায়। কিছুক্ষণ চাপা স্বরে তর্ক করল।

পাঁচটা মেয়ে আর একটা ছেলে পিকনিক করবে, কেমন যেন দেখায়। আর একটা ছেলেও চলুক-না।

পিকনিকে খাটাখাটুনিও তো আছে, করবে কে? ওকে বরং লাগিয়ে দেওয়া যাবে।

না না, অরুণদের মালী আছে, ওসব কাজ কাউকেই করতে হবে না। বরং ওকে জব্দ করব সারাদিন ধরে।

কথা এখন থাক বরং ওকে গিয়ে বল।

হঠাৎ পাঁচ জনকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে শিবু হকচকিয়ে গেল। ওদের অনুরোধ শুনে তার সারা শরীরটাই দুলে উঠল।

না না, তোমরা যাচ্ছ, তার মধ্যে আমি কেন!

তাতে কী হয়েছে। চিত্রা বোঝাবার জন্য বলল, তুমিও তো আমাদের বন্ধু, আমরা ইনভাইট করছি। আমাদের সঙ্গে যাওয়া কি তুমি পছন্দ কর না?

না না, তাই বলেছি নাকি। তবে যার বাড়িতে যাব তারও তো মতামত নেওয়া দরকার।

চিত্রা বলল, তুমি আমাদের গেস্ট, তার নয়। আমরা যাকে খুশি নিয়ে যেতে পারি।

শিবনাথ, তাহলে না কোরো না। অরুণ তো আমাদের কাছেও প্রায় অপরিচিত। অবশ্য চিত্রার অসুবিধে হবে না, কিন্তু আমাদের চেনা একজন পুরুষমানুষ থাকলে স্বস্তি পাওয়া যাবে। ধরো ফট করে কারুর যদি কিছু হয়ে যায়… শীলা গম্ভীর হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল।

নিশ্চয় নিশ্চয়, শিবু জোরে ঘাড় নাড়ল। আজকাল কখন কী হয় কে বলতে পারে। ধরো

পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেল।

তা কেন হবে! অরুণদের গাড়িটা নতুনই, গতবছর কেনা হয়েছে।

চিত্রা তুই থাম। শিবু ঠিকই বলেছে, ধর তেল ফুরিয়ে যায় যদি!

অতঃপর শিবুর যাওয়া ঠিক হয়ে গেল। পাঁচটি মেয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে হাসতে শুরু করল। তারপর যে যার বাড়ির দিকে রওনা হল।

দীপালির বাঁ-কানের উপর দগদগে পোড়া চিহ্ন। বারো বছর বয়সে অ্যাসিডের শিশি তাক থেকে পড়ে যায় ওর মাথায়। কানটা দোমড়ানো, চুলও ওঠেনি। একসঙ্গে কিছু যুবক সামনে দিয়ে আসছে দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে ক্ষত লুকোবার চেষ্টা করল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা দ্বিতীয় বার আর তাকাল না। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের মধ্যে একজন তাকে পিছন থেকে দেখল। দীপালি জানে, যে দেখল তার মুখ দিয়ে আক্ষেপসূচক ধ্বনি নির্গত হবে, দুই চোখে বিস্ময় ফুটবে। তার সুঠাম দেহ বহুক্ষণ ফিরে ফিরে দেখবে—ওই পর্যন্তই; দীপালি তা জানে। গভীর রাতে মাঝে মাঝে সে কাঁদে।

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে শীলার ভাবনা হল, পিকনিকে যাওয়া তার হয়ে উঠবে কি না। আবার ভাই কিংবা বোন হবে। ক-দিন ধরে মা আর নড়াচড়া করতে পারছে না। অতবড়ো সংসার চালানোর ভার এখন তার ঘাড়ে। অবশ্য তেরো বছর বয়স থেকেই সে মা-র আঁতুড় তুলছে। কিন্তু এক দিনের জন্যও কি এখন বাড়ির বাইরে থাকা চলে? ভাবনায় পড়ল শীলা। তারপর মা-বাবা-ভাই–বোনদের উপর প্রচন্ড রাগে দপদপ করে উঠে বাসের অপেক্ষায় না থেকে হাঁটতে শুরু করল।

দ্রুত চলেছে সুপ্রিয়া, টিউশনিতে তার দেরি হয়ে গেছে। কুড়ি টাকার জন্য রোজ দুটো বিচ্ছুকে নিয়ে এক ঘণ্টা বসতে হয়। তার থেকেও সমস্যা ওদের মা-ঠাকুমাকে নিয়ে। রোজ শুনতে হচ্ছে তার মিষ্টিমুখ দেখে নাকি সংসারী হবার সাধ জেগেছে বাড়ির টাকমাথা হোঁতকা চেহারার প্রৌঢ় ছোটোছেলের। প্রায় ছ-শো টাকা মাইনে পায়। সুপ্রিয়া টের পাচ্ছে হয়তো একেই বিয়ে করতে হবে। কেননা ওরা শিগগিরই তার বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসবে এবং তা ফেরাবার সাধ্য চার মেয়ের স্কুলশিক্ষক বাবার নেই। চলতে চলতে সুপ্রিয়ার মনে হল, সামনের মোড়টা ঘুরলেই কেউ যদি তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে দেয়। মোড় ঘুরে দেখল একটি সুদর্শন তরুণ তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সুপ্রিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল।

করুণা একা দাঁড়িয়ে চৌমাথার মোড়ে। কাছেই বাড়ি। কিন্তু বাড়ি গিয়ে কী করবে? বউদি বলবে সিনেমা চলো, বাবা বলবে সেতার বাজিয়ে শোনা, মা বলবে একফোঁটা দুধ ফেলে রাখা চলবে না, মাস্টারমশাই বলবে ফাস্টক্লাস পাবার মতো মাথা আছে, বাবা বলবে ওকে ফরেন পাঠাব, বউদি বলবে রোজ স্কিপিং করো, মা বলবে সন্ধ্যে বেলায় শুয়ে থাকতে নেই, মাস্টারমশাই বলবে যেসব প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দিয়েছি মুখস্ত করনি কেন, বউদি বলবে এখনও কেউ তোমাকে প্রেমপত্র দেয়নি তা কি হয়, বাবা বলবে পছন্দ করে যদি বিয়ে করিস আপত্তি করব না, মাস্টারমশাই বলবে আজকাল আর তুমি মন দিয়ে মোটেই পড়া শোন না।

করুণা একা দাঁড়িয়ে ভাবল, বাড়ি গিয়ে কী করব?

গাড়ি চালাতে চালাতে অরুণ বলল, নিন সিগারেট খান।

শিবু ঘাড় নাড়ল।

সে কী! আপনি তো অ্যাডাল্ট, প্রাপ্তবয়স্ক। বলে অরুণ ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েদের দিকে চেয়ে হাসল।

শিবু, লজ্জার কী আছে, আমরা কি তোমার মা-মাসি? করুণা আঙুল দিয়ে শিবুর কাঁধে খোঁচা দিল।

ইণ্ডিয়ান সিগারেট নয়। খেয়েই দ্যাখো একটা। চিত্রা গম্ভীর স্বরে বলল।

এরপর সকলের অনুরোধে শিবু খেতে শুরু করল। অভ্যাস নেই, একটু পরেই কাশতে লাগল।

ও কী, ছেলেমানুষের মতো কাশছ কেন? আমি হলে তিন টানে শেষ করে দিতুম। শীলা ধমক দেবার ভঙ্গিতে বলল এবং হাত বাড়াল, দাও দেখিয়ে দিচ্ছি।

না না। শিবু সিগারেটটা সরাতে গিয়ে অরুণের স্টিয়ারিং ধরা হাতে ছ্যাঁকা দিল। অরুণ চমকে উঠতেই গাড়িটা বেটাল হয়ে ধাক্কা দিল পথের পাশে দাঁড়ানো একটা সাইকেলরিকশার চাকায়। চাকাটা দুমড়ে গেল।

হইহই করে কোথেকে ছুটে এল একদল লোক। গাড়ি ঘিরে তারা উত্তেজিত কথাবার্তা বলতে থাকল। চিত্রা ভয়ে আঁকড়ে ধরল অরুণের হাতটা। অন্য মেয়েরা শুকনো মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া শিবুর দেহযন্ত্রের বাকি অংশ মৃতবৎ।

হয়েছে কী। অরুণ দরজা খুলে বেরোল। দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে সুন্দর স্বাস্থ্যটা জনতাকে দেখাল। কেউ তো মরেনি, তবে এত কথা কীসের? তার কতৃত্ববাচক কণ্ঠের দাপটে ওরা থ মেরে গেল। সারাতে কত লাগবে? পকেট থেকে জাঁদরেল একটা ওয়ালেট এবং তার মধ্য থেকে অনেকগুলো নোট বেরিয়ে আসতে দেখে নিভন্ত অগ্নিস্তুপ থেকে ফুলকির মতো কিছু ফিসফাস ছিটকে উঠল।

পঞ্চাশ টাকা লাগবে। ওদের মধ্য থেকে একজন বলল।

সারিয়ে নিতে পঞ্চাশ টাকা? – কুঁচকে অরুণ ধমকাল। কতগুলো নোট একজনের হাতে গুঁজে দিয়ে গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিতেই জনতা পথ ছেড়ে দিল।

মাইল খানেক যাবার পর চিত্রা প্রথম কথা বলল, ওরা গাড়িটা পুড়িয়ে দিত, না?

কী জানি। অরুণ শিস দেবার জন্য ঠোঁট সরু করে কী ভেবে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েদের দিকে তাকাল—সব চুপচাপ কেন। আরে ও কিছু নয়, নিন গান ধরুন। বলেই চেঁচিয়ে শুরু করল, আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত… শুধু চিত্রা ওর সঙ্গে যোগ দিল।

পিছনের সিটের চার জন মেয়ে কাঠের মতো বসে। হঠাৎ শিবু প্রাণপণে অরুণের সঙ্গে গলা মেলাতে লাগল। মিহি স্বরকে উধাও করতে গিয়ে স্বর ভেঙে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে খানিক বাদে থেমে গেল।

থামলেন কেন, চলুক। আমরা ভাঙিগড়ি…

শিবু বাকি পথটা চিৎকার করতে করতে একা গান গেয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমেই দীপালি চাপা স্বরে শীলা, সুপ্রিয়া, করুণাকে বলল, ওটাকে না আনলেই হত।

কিছুক্ষণ পরেই ওরা রান্নার উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মালী বারো মাইল দূরে তার গ্রামে গেছে। সকালে খবর এসেছে বাঘে তার বাবাকে মেরে আধ-খাওয়া দেহটা ফেলে রেখেছে। শুনেই সুপ্রিয়া বলল, বাঘটা যদি এখানে আসে?

কেন, শিবু রয়েছে; ভয় কী আমাদের? তিক্তস্বরে দীপালি বলল।

বাঘ কিন্তু মানুষ নয়, অরুণ হাসতে থাকল—টাকা দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।

চিত্রা ছাড়া কেউ উচ্চস্বরে হাসল না। কলকাতা থেকে খাওয়ার সামগ্রী অরুণ এনেছে। শিবু উনুন ধরানোয় ব্যস্ত। কাজের ছুতোয় সে সকলের আড়ালে থাকতে চাইছে। অন্যরা কিছুক্ষণ বাগানে বেড়াল। বেল এবং কলা ছাড়া আর কিছু ফলেনি। কয়েকটা নারকেল গাছ রয়েছে। অরুণ জুতো-জামা খুলে একটা গাছে ওঠার চেষ্টা করল। হাত দশেক উঠে হাল ছেড়ে নেমে এসে বলল, বড় পিচ্ছল। তবে দিনদুপুরে তালিম নিলেই হয়ে যাবে।

করুণা ফিসফিস করে শীলার কানে বলল, সব কিছুতেই বাহাদুরির চেষ্টা, না?

শীলা ঘাড় নাড়ল। চিত্রা লক্ষ করেছে এই কানাকানি। কাছে এসে কারণ জানতে চাইল। শীলা বলল, করুণা বলছিল তোদের দুজনকে বেশ মানায়।

চিত্রা উথলে উঠে কী করবে ভেবে না পেয়ে বলল, শিবুটার এমন মেয়েলি স্বভাব, রান্না ছেড়ে কিছুতেই আসবে না। চল ওকে ধরে আনি।

করুণা আর শীলাকে টানতে টানতে চিত্রা নিয়ে চলল রান্নার দিকে। তখন সে বলল, তোদের ভাল লাগছে অরুণকে? খুব চঞ্চল ছটফটে, না রে?

সেইটাই তো ভালো, তবে কি শিবুর মতো হবে? শীলা বলল এবং করুণা ঘাড় নাড়ল।

ওর সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না। খুব ভালো হত যদি অরুণের মতো তোদেরও কেউ থাকত। চিত্রা সমবেদনা জানাল যেন। তাতে দুজনেই হাসবার চেষ্টা করল। তিন জনকে দেখে শিবু বলল, দ্যাখো তো নুন হয়েছে কি না। বাটিতে খানিকটা ঝোল এগিয়ে ধরল। চোখে মুখে উত্তেজনা। চিত্রা চুমুক দিয়ে জানাল নুন কম হয়েছে।

শিবু, আমরা একসঙ্গে রয়েছি, আর তুমি এভাবে আলাদা হয়ে থাকলে খুব খারাপ লাগবে। চলো।

বাঃ, খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না বুঝি!

হবে। ওসব পরে করলেও চলবে, এখন তুমি বেরিয়ে এসো। শিবু কিছু আপত্তি করে অবশেষে নুন দিয়ে মাংসটা নামিয়েই যাচ্ছি বলে ওদের বিদায় করল।

পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে ওদের আর ভালো লাগল না। তখন অরুণ বলল, সাঁতার কাটা যাক। কেউ সাঁতার জানে না। কস্টিউম পরে অরুণ যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, ওর জানুদ্বয় ও নাভি এই নির্জন স্থানে মেয়েদের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিজেদের মধ্যে আবোল-তাবোল কথা শুরু করল আর অন্যমনস্ক হবার ভান করতে লাগল। অরুণ একাই জলে কিছুক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি করে জলে নামার জন্য ওদের ডাকতে থাকল। অবশেষে চিত্রা নামল এবং তাকে পিঠে নিয়ে অরুণ সাঁতরাতে শুরু করল।

বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

রীতিমতো অসভ্যতা। এসব কী! আমরা রয়েছি খেয়াল নেই?

চার জন মেয়ে এইভাবে কথা বলতে থাকল এবং শিবু চুপ করে দেখছিল সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে। দীপালি বলল, সাঁতার জান না, তুমি যে কী-একটা।

লজ্জায় তোতলা স্বরে শিবু বলল, একটু একটু পারি।

নামো তাহলে। চার জন একসঙ্গে টানতে টানতে শিবুকে জলে ঠেলে দিল। অরুণ খুবই উৎসাহিত হল। চিত্রাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে বলল, চলুন পারাপার করি।

না না পারব না আমি। প্রায় পঞ্চাশ মিটার লম্বা পুকুরের ওপারে তাকিয়ে শিবু বলল। সেই ছোটোবেলায় সাঁতার শিখেছিলাম, বছর দশেক হয়ে গেল। তারপর আর কাটিনি।

কিন্তু সকলের বারংবার অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। অরুণ যখন ওপারে ছুঁয়ে এপারের ঘাটে এসে পৌঁছোল, শিবু তখনও ওপারেই পৌঁছোয়নি। শুরুতে মেয়েরা হইহই করে শিবুকে উৎসাহ দিচ্ছিল। পরে চিত্রা ছাড়া বাকি চার জন চুপ করে গেল এবং ক্রমশ তাদের মুখে কাঠিন্যের জটিলতা এল। সুপ্রিয়া বলল, ইচ্ছে করছে চুলের মুঠি ধরে ওটাকে চুবুনি দিই।

আমারও। দীপালি বলল। তারপরই একসঙ্গে ওরা চেঁচিয়ে উঠল, একী! ডুবে যাচ্ছে নাকি? মাঝপুকুরে শিবু ঘাটের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ছে, হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল অরুণ। শিবু ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই মুখে ঘুসি মেরে চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল ঘাটে। অবসন্ন হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথা নামিয়ে শিবু বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। চিত্রা বলল, ও কি ডুবে যাচ্ছিল?

বোধ হয়। অরুণ কাঁধ ঝাঁকাল।

মাংস-ভাত ছাড়া আর কিছু রান্না হয়নি। ঝোলমাখা ভাত মুখে দিয়েই শিবুর দিকে তাকাল। থু থু করে ফেলে দিয়ে দীপালি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অরুণ উঠে গিয়ে তাকে ধরে আনল! নুন বেশি হয়ে গেছে হোক-না। দই মেখে সন্দেশ দিয়ে ভাত খান।

একটা-কিছুও যদি পারে! শীলা চেঁচিয়েই বলল—খালি বাহার দিয়ে মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করা।

শীলাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য অরুণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, এমন আর কী নুন হয়েছে, আমার তো বেশ লাগছে। শিবনাথবাবু ওদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। ওরা

খায় তো না খাক, আমরা বরং ভাগাভাগি করে সাবড়ে দিই! অরুণ ভাতের গ্রাস মুখে। দিল।

আমি একাই খেয়ে ফেলতে পারি সবটা। শিবু টেনে টেনে হাসতে শুরু করল।

থাক আর বাহাদুরি করতে হবে না। শীলা তাচ্ছিল্যভরে বলতেই শিবু মাংসের হাঁড়িটা নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। কেউ ওকে ফিরিয়ে আনল না।

খাওয়ার পর দোতলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে সবাই গল্প করছে। অরুণ আর চিত্রা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, ভ্রুকুটি করছে, জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটছে, কিল দেখাচ্ছে আর মাঝে মাঝে গল্পে যোগ দিচ্ছে।

চারটি মেয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলে থাকল। কিছু পরেই শিবু এল জ্বলজ্বলে চোখে।

ভেবেছিলে পারব না? সব শেষ করে দিয়েছি।

দু-কিলো মাংস খেয়ে ফেললে?

বাজে কথা। নিশ্চয় কোথাও ফেলে দিয়েছ কি কুকুরগুলোকে খাইয়ে দিয়ে বাহাদুরি ফলাচ্ছ।

মোটেই না। তোমরা চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে পারো।

বসে থাকতে ভালো লাগছে না। একটা উপলক্ষ্য পেয়ে বাগানে বেরিয়ে চার জন চারিদিকে খুঁজতে শুরু করল। একসময় করুণা ছুটতে ছুটতে দীপালির কাছে এসে বলল, একটা ব্যাপার দেখবি আয়।

বাগানের একধারে একটা মাটির ঘর। সম্ভবত চেলাকাঠ, ঝুড়ি-কোদাল ইত্যাদি রাখার। দরজা বন্ধ। দীপালিকে টেনে এনে করুণা বলল, কান পেতে শোন।

সন্তর্পণে দীপালি দরজায় কান ঠেকিয়ে ফিরে এল পাংশু মুখে। অরুণ আর চিত্রা।

হ্যাঁ, ছাদে যাবার ভান করে এখানে!

আগে থাকতেই প্ল্যান করেছিল।

অন্য দুজনকে ডেকে ওরা খবরটা দিল। অবশেষে চার জনেই যখন ফিরে এল শিবু প্রবল উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, পেলে?

কী পাব?

যা খুঁজতে গিয়েছিলে?

ওরা কেউ জবাব দিল না। নিজেদের মধ্যে এলোমেলো কথা শুরু করল।

আজকের খবরের কাগজটা পড়ে আসা হয়নি।

বাবা বারণ করেছিল আসতে, জোর করে এসেছি।

আমার ঠিক উলটো, মা কোন ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে।

বড্ড খিদে পাচ্ছে।

পাবেই তো। ভাত না খেলে মনে হয় খাওয়াই হল না।

দ্যাখ-না কিছু যদি পাওয়া যায়। দেখেছিস কী সুন্দর ডাব হয়েছে।

পাড়বে কে, অরুণ তো উঠতে গিয়ে পারল না। আজ যদি ওদের মালীটা থাকত…

তার বাবাকে এই সময়েই বাঘে খেল।

আমি ডাব পাড়তে পারি। শিবু হঠাৎ বলে উঠল।

ওরা গ্রাহ্য করল না কথাটা। শিবু আবার বলল, যদি পাড়তে পারি তাহলে কী দেবে?

তা হলে? শীলা চোখ সরু করে বলল, আমাদের যাকে চাও ঘরে নিয়ে যেতে পারবে। আঙুল দিয়ে বাগানের মাটির ঘরটা দেখাল। শিবু কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বলল, তাহলে আজ সকাল থেকে যা-যা ঘটেছে সব ভুলে যাবে বলো?

হ্যাঁ যাব। কিন্তু যদি না পাড়তে পার? দীপালি তেরিয়া হয়ে এগিয়ে গেল কয়েক পা।

একটু ভেবে শিবু বলল, তাহলে অন্য কলেজে ট্রান্সফার নোব।

না না, তোমাকে পারতেই হবে। এইটে অন্তত পারতেই হবে। করুণা অদ্ভুত গলায় বলল। শিবু অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তেজিত হিংস্র এবং কাতর চারটি মুখ থেকে কোনো অর্থ বার করতে পারল না।

খালি-গায়ে, পাজামাটা ঊরু পর্যন্ত গুটিয়ে, শিবু প্রায় চার তলা উঁচু একটা নারকেল গাছে

ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ওরা গাছটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। কয়েক হাত উঠেই সে নেমে এল।

পেটে বড় চাপ লাগছে।

জানতুম এইরকম একটা অজুহাত দেবে। দীপালি স্থানত্যাগ করার ভঙ্গি করল।

শিবু কথা না বলে আবার ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ধীরে ধীরে সে দোতলার উচ্চতা পার হল। চারটে মুখে বিস্ময় ফুটল। শিবু তিন-তলার কাছাকাছি পৌঁছোচ্ছে। একজন হাততালি দিয়ে উঠল। শিবু গাছটাকে জড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। দুটো পা পিছলে যাচ্ছে বার বার, আঙুলগুলো বেঁকিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, পারছে না। একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে শীলা শাসানি দিল, শিবু খবরদার। এক ইঞ্চি নেমেছ কি ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দোব। এই বলে সে ইট ছুড়ল। ঠক করে গাছে শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে শিবু ওঠার চেষ্টা আরম্ভ করল। কয়েক হাত উঠে আবার সে জড়িয়ে রইল গাছটা। শরীর থরথর করে কাঁপছে, নিশ্বাস নিতে হাঁ করল, একটুখানি পিছলে নেমে এল!

সঙ্গে সঙ্গে চারটি মেয়েই ইট কুড়িয়ে এলোপাথাড়ি ছুড়তে শুরু করল।

পারতে হবে। পারতেই হবে, নইলে নামতে দেব না। উন্মাদের মতো দীপালি চিৎকার করে উঠল।

আর একটু বাকি। শিবু চেষ্টা করো, চেষ্টা করো। করুণা জোরে ইট ছুড়ল। শিবুর পাশ দিয়ে সেটা এবং এধারে শিবু, একসঙ্গে পড়ল। মাথাটা প্রথমে পাঁচিলে পড়ল, সেখান থেকে দেহটা ছিটকে এল হাত পাঁচেক দূর। বার কয়েক পা দুটো খিঁচিয়ে শিবু মরে পড়ে রইল।

ওরা কেউ কাছে এগোল না। সুপ্রিয়াই প্রথম জড়ানো স্বরে টেনে টেনে বলল, আমি মোটে দু-বার ছুড়েছিলাম, অনেক দূর দিয়ে চলে গেছে।

শীলা শান্ত গলায় বলল, কারুর ইটই ওর গায়ে লাগেনি। বোকার মতো ওঠার চেষ্টা করছিল, এটা অ্যাকসিডেন্ট।

তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়া ছুটতে ছুটতে সেই মাটির ঘরের দরজায় আছড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে অরুণ আর চিত্রা বেরোল। তারপর ছুটে এল শিবুর মৃতদেহের কাছে। তখুনি গাড়িতে তুলে ওরা রওয়না হল কলকাতার দিকে।

সুপ্রিয়া শুধু এক বার বলেছিল, যদি বাঘটা এখন বেরোয়! তাছাড়া পথে কেউ কথা বলেনি। সারাপথ ওদের পায়ের কাছে শাড়িটাকা শিবু শোয়ানো ছিল।

একটি মহাদেশের জন্য

আগামীকাল মধ্যরাত্রে ট্রেনে এই মফস্সল শহর থেকে সরকারি কলেজের ইতিহাসের প্রধান ড. প্রফুল্ল ঘোষাল ও তাঁর স্ত্রী করবী চলে যাবেন। ট্রেনে চার ঘণ্টার পথ, বিহার সীমান্তে একটি ক্ষুদ্র কলেজে অধ্যক্ষের পদ নিয়ে যাচ্ছেন। বিকেল থেকে ওঁরা গোছগাছ করছেন। আসবাব এবং ব্যবহার্য জিনিস নামমাত্র। এখানে এসে যে আসবাব কিনেছিলেন সেগুলি ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন না। বইয়ের ব্যাক ও টেবিলটি দিয়ে যাবেন বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাইমারি বিভাগের হেডমিস্ট্রেস কুমারী গীতা বিশ্বাসকে; চৌকি ও টুল নেবে মুনসেফ অরুণ সোম; বেঞ্চ ও চেয়ারগুলি চেয়েছে এখানকার বৃহত্তম ওষুধের দোকান ও আড়তের মালিক পরিমল সাঁপুই; উকিল মৃগাঙ্ক বসুমল্লিক মৃদু হেসে মাথা নেড়েছে। দু-বছর এখানে থেকে ঘোষাল দম্পত্তির সঙ্গে এই ক-জনেরই শুধু পরিচয়।

বিকেল উতরে গেছে। ঘরে আলো জ্বলছে। প্রফুল্ল র্যাক থেকে বইগুলি নামিয়ে মেঝেয় রাখছেন। করবী সেগুলি গুছিয়ে একটা চটের থলিতে ভরছেন। প্রফুল্ল নাতিউচ্চ, বলিষ্ঠদেহী, কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত চুলে মাথাভরা। চশমার কাচ পুরু। চোয়াল ভারী ও চওড়া। কথা বলেন ধীর ও মৃদু স্বরে; আচরণে শান্ত ও গম্ভীর। ছাত্ররা কলেজে ওঁকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে সরে যায়।

পরিচিত কয়জনেই সন্ধ্যা বেলায় শহরের প্রান্তবর্তী এই এক তলা বাড়িতে গল্প করতে আসে। যেদিন কেউ আসে না ওঁরা স্বামী-স্ত্রী বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাসন্তীর মা রাত্রির আহার ঢাকা দিয়ে রেখে গৃহে ফেরার সময় অস্ফুটে মা যাচ্ছি বলে চলে যায়। করবী তখন বলে, গেটটা বন্ধ করে যেয়ো। করবীর কণ্ঠস্বর মিষ্টি হাসিটিও। হাসলে দুই গালে টোল পড়ে। সে ছিপছিপে, দীর্ঘাঙ্গী, প্রফুল্লর সমানই লম্বা। বোধ হয় উচ্চতা লুকোবার জন্যই ঈষৎ কুঁজো হয়ে থাকে। চুল কিছু পেকেছে। শ্যামবর্ণ গাত্রত্বক তৈলমসৃণ ও উজ্জ্বল, দীর্ঘ চোখ জোড়ায় কিছুক্ষণ তাকালে দর্শক ক্লান্তি ও বিষাদ অনুভব করে। প্রথম স্বামী মারা যাবার দেড় বছরের মধ্যে ওর দুটি ছেলেই মারা যায়। বড়োটি বিমানবাহিনীতে শিক্ষার্থী পাইলট ছিল, পুনার কাছে তার বিমান ভেঙে পড়ে; ছোটোটি ডায়মণ্ডহারবারে কলেজ-বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে যায়। এর ছয় মাস পর করবী তার কলেজের সহপাঠী প্রফুল্ল ঘোষালকে বিয়ে করে এই মফসসল শহরে আসে।

এভাবে হবে না, জ কুঁচকে প্রফুল্ল বলল। বইগুলো বাঁধতে হবে, দড়ি আনি।

রান্নাঘরের পিছনে কলঘরসংলগ্ন অন্ধকার কুঠুরিটা অব্যবহৃত হঠাৎ দরকারি বিবিধ জিনিসে ভরা। সেখান থেকে প্রফুল্ল চেঁচিয়ে বলল, টর্চটা আননা তো, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

টর্চ নিয়ে আসার সময় করবীর মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল। রান্নাঘরে বাসন্তীর মা ব্যস্ত। কুঠুরির সামনে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে করবী বলল, এই যে!

প্রফুল্ল পাশ থেকে নিঃসাড়ে দ্রুত ওর গলায় দড়ির ফাঁস পরিয়ে টান করে এঁটে ধরল। করবী ফাঁসটা আলগা করার চেষ্টায় দশ-বারো সেকেণ্ড টানাটানি করে ক্রমশ শিথিল হতে শুরু করল। প্রফুল্ল তখন চাপাস্বরে হেসে উঠে এটা চৌত্রিশ বলে ধীরে ধীরে ওকে ছেড়ে দিতেই করবী কাত হয়ে দেওয়ালে হেলে পড়ল। ঠিক এই সময়ই বাইরের বারান্দা থেকে উচ্চ পুরুষকণ্ঠে কে বলল, ডক্টর ঘোষাল আছেন নাকি?

প্রফুল্ল তাড়াতাড়ি বৈঠকখানার দিকে যেতে যেতে বলল, অরুণবাবু নাকি? আসুন আসুন।

প্রফুল্ল দরজা খুলে দিতেই টর্চ নিভিয়ে অরুণ সোম বলল, মিরাও সঙ্গে এল দেখা করে যেতে। বৈঠকখানার ভিতরে এসে বলল, ওরা কেউ আসেনি?

প্রফুল্ল একথার উত্তর না দিয়ে স্মিত হেসে মিরাকে বলল, আসুন, আপনি তো অনেক দিন পর এলেন। করবী বইগুলো গোছাচ্ছে, এখনি আসবে।

ঘোমটা আর একটু টেনে মিরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে তারপর প্রফুল্লকে বলল, রোজই আসব আসব করি কিন্তু বাচ্চাদের জ্বরজারি তো নিত্যি লেগেই আছে। এখানকার দুধ-জল কিছুই ওদের সহ্য হচ্ছে না। ছোটোটা কাল থেকে আবার পড়েছে পেটের অসুখে।

মিরার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ এবং ফ্যাসফেসে। সরু হাতে সোনার চুড়িগুলি এবং শাঁখাটি ঢলঢল করছে। সিঁথির চওড়া সিঁদুর ও কপালের টিপে ওর শুভ্র দেহের রক্তাল্পতা ও শীর্ণতা প্রকট। তুলনায় ছত্রিশ বছরের সুদর্শন অরুণকে অন্তত দশ বছরের ছোটো দেখায়। অরুণ প্রতিদিন ভোরে এক মাইল দৌড়ে এসে আধ সের দুধ খায়, রাতে ইংরেজি ডিটেক্টিভ বই পড়ে এবং নিয়মিত গল্প লিখে সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোয় পাঠায়, দু-একটি ছাপাও হয়েছে।

শুনেছেন তো আজকের ঘটনাটা? চেয়ারে বসে অরুণ বলল। প্রফুল্ল অবাক চোখে তাকাতেই সে উত্তেজিত হয়ে সিগারেট বার করল। স্টেশনের গায়েই সারি সারি দরমার তৈরি রিফিউজিদের যে-দোকানগুলো রয়েছে তার মধ্যে একটা চায়ের দোকানও আছে। প্রায় দেড় মাস আগে সেই দোকানদারের বউ থানায় গিয়ে বলে তার স্বামী তিন দিন যাবৎ নিখোঁজ। পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখল ওখানকার একটা যুবতী বিধবাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং দুই আর দুইয়ে চার ধরে নিয়ে ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা পড়ে। আজ সকালে দোকানের মাটির মেঝে খুঁড়ে দুটো লাশ পাওয়া গেছে। দুটোরই মাথার খুলির পিছন দিকটা চুরমার অর্থাৎ পিছন থেকে ভারী কিছু দিয়ে…

করবীকে ঢুকতে দেখে অরুণ থেমে গেল। সিগারেটের কাগজ ও তামাক প্রফুল্লর হাতে তুলে দিয়ে করবী হেসে মিরাকে বলল, বাচ্চারা কেমন আছে? আপনার শরীরও তো ভালো মনে হচ্ছে না।

শোনামাত্র খুশিতে নড়েচড়ে বসল মিরা। কিন্তু অরুণের বিরক্ত চোখে চোখ পড়ামাত্র নিরাসক্ত স্বরে বলল, আমি ভালোই আছি। কাল আপনারা চলে যাবেন তাই দেখা করতে এলুম।

অরুণ ইতিমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। প্রফুল্ল মাথা নীচু করে সিগারেট বানাতে ব্যস্ত। অরুণ গলাখাঁকারি দিল। করবী বলল, গল্পটা শেষ না করা পর্যন্ত অরুণবাবু স্বস্তি পাবেন না, বরং শেষ করেই ফেলুন।

গল্প নয় মিসেস ঘোষাল, ফ্যাক্ট! আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। বউটাকে অ্যারেস্ট করে থানায় যখন ইন্টারোগেট করা হচ্ছে তখন আমি ছিলাম, এসডিও সাহেবও ছিলেন। নিজে থেকেই স্বীকার করল খুন করেছে। কী বীভৎস ব্যাপার ভাবুন! দোকানটার পিছনে একটা খুপরিতে থাকত আর খুন করে তারই তলায় মেঝের মাত্র দেড় হাত নীচে দুটো ডেডবডি পুঁতে রেখে দেড় মাস তার উপর শুয়েছে। ভাবতে পারেন? অথচ এমন কোয়ায়েটলি সব কথা বলে গেল যেন অরুণ যুৎসই উপমা খোঁজার জন্য মুহূর্তেক অবসর নিতেই মিরা বলল, পাপ কখনো কি চাপা থাকে!

প্রফুল্ল বলল, কার পাপ?

মিরার বসার ভঙ্গিটা কঠিন হয়ে গেল। মেঝের দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করল এবং কাঁপা গলায় বলল, কার আবার, স্বামীর পাপ।

আর যে খুন করল তার বুঝি পাপ হয় না।

চোখ তুলে করবীর দিকে এক বার তাকিয়ে মিরা একটু ভেবে বলল, কী জানি।

তিন জনের কেউ কিছুক্ষণ কথা বলল না। নীরবতা ভাঙার জন্য প্রফুল্ল বলল, অরুণবাবু কাল সকালেই ভারী মালগুলো স্টেশনে পাঠাব বুকিংয়ের জন্য। আপনার চৌকিটা নিতে কালই কিন্তু লোক পাঠাবেন।

অরুণ অন্যমনস্কের মতো মাথা কাত করল। বাইরে গেট খোলার শব্দ হল। গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত প্রায় পনেরো মিটার ইট-বাঁধানো পথের উপর দিযে জুতোর শব্দ এগিয়ে আসতেই অরুণ বলল, পরিমলবাবু।

দশাসই লম্বা মধ্যবয়সি পরিমল সাঁপুই ঘরে ঢুকেই বলল, উকিলবাবু, হেড দিদিমণি, ওরা এখনও আসেনি? একটু আগেই দোকান থেকে যেন দেখলুম দুজনকে রিকশায় আসতে।

শুনেই মুখ কালো হয়ে গেল অরুণের। বলল, আপনি বোধ হয় ভুল দেখেছেন।

আর যা-ই ভুল হোক অরুণবাবু, চোখের ভুল আমার হবে না। আগের মাসেও এক জোড়া বুনো শুয়োর মেরেছি পঞ্চাশ গজ দূর থেকে। আর দুটো চেনা মানুষকে পঞ্চাশ হাত দূর থেকে চিনতে পারব না? পরিমল শেষপর্যন্ত বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না।

অরুণ জবাব দিল না। প্রফুল্ল বলল, আজ রোমহর্ষক একটা ব্যাপার নাকি শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে?

পরিমল তাচ্ছিল্যসূচক একটা শব্দ করে বলল, ওরকম আকছারই ঘটে। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না, দোকানে একজনের আসার কথা। যেজন্য এসেছি বলে নিই, একটা বড়ো প্যাকিং বাক্সে মাল এসেছে, মজবুত খুব। আপনার দরকার লাগে যদি কাল পাঠিয়ে দেব।

ভীষণ দরকার, তাহলে দামি বইগুলো আর থলেয় ভরতে হয় না। করবী উৎসাহভরে বলল।

তাহলে চা খাওয়ান। পরিমল হাত বাড়িয়ে অরুণের সিগারেট প্যাকেটটা তুলে নিল।

রিকশার ভেঁপু বাজল রাস্তা থেকে। অরুণ চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে শরীরটাকে তুলে বাইরে তাকিয়েই আবার বসে পড়ল। পরিমল মুচকি হাসল। মিরা হাত মুঠো করে দেওয়ালে তাকিয়ে রইল।

প্রথমে ঘরে ঢুকল গীতা। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। বাল্যে পোলিওয় ডান পা-টি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ চিকিৎসায় সেরে উঠলেও এখন সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে। এই ঘাটতি অবশ্য দেহের অন্যান্য অংশ মনোরমভাবে পুষিয়ে দিয়েছে। মোটা জ্বয়ের নীচে ওর চোখ দুটি সতত চঞ্চল, ঠোঁট দুটি পুরু এবং টসটসে, নাক চাপা, গলায় রক্তাভ জড়ল। কণ্ঠস্বর ঈষৎ কর্কশ।

গীতার পিছনে পাঞ্জাবি ও ঢোলা পায়জামা পরা মৃগাঙ্ক, রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বলল, আজ বড্ড গুমোট। ধনী বনেদি পরিবারের সন্তান, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি মৃগাঙ্ক স্থূলকায়, টকটকে গায়ের রং, মাথায় অল্প টাক পড়েছে।

ঠিক সময়েই এসেছে গীতা, চা করতে যাচ্ছিলাম আর অরুণবাবুও একটা খুনের গল্প বলছিলেন।

কী খুনের? বলেই গীতা খালি চেয়ারের দিকে এগোল।

বাঃ শোননি? করবী বিস্মিত স্বরে বলল। স্টেশনের ধারে এক চায়ের দোকানের মেঝে খুঁড়ে এক জোড়া লাশ পাওয়া গেছে!

না তো! কী ব্যাপার অরুণবাবু?

মিরা আচমকা উঠে করবীকে বলল, এইসব গল্প দু-বার শুনতে আমার ভালো লাগে না। চা করতে যাবেন তো চলুন, আমিও যাব।

মিরা এবং করবী ঘর ছেড়ে যাবার পরও সবাই ভিতরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল। মৃগাঙ্ক বলল, আমি অবশ্য শুনেছি, কিন্তু এইরকম বীভৎস নোংরা একটা ব্যাপার নিয়ে কোনো মহিলার সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছে হয়নি।

গলাখাঁকারি দিয়ে অরুণ তিক্তস্বরে বলল, এটা যে একটা বীভৎস ভালগার ব্যাপার তা আমি জানি। আমার পয়েন্ট হচ্ছে, একটি মেয়েমানুষ নিজের হাতে খুন-করা দুটি লাশের ওপর দেড় মাস শান্ত অচঞ্চল হয়ে কাটিয়ে দিল। কীভাবে সে পারল? ওই সময় সে নিজেই চায়ের দোকানটা চালিয়েছে, খদ্দেরদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলেছে, ঝগড়া করেছে, স্বামীর খোঁজ পাচ্ছে না বলে অনেকের কাছে উদবেগ পর্যন্ত প্রকাশ করেছে।

প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে চাপা হেসে মৃগাঙ্ক বলল, এটাকে সাবজেক্ট করেই অরুণবাবু একটা গল্প লিখে ফেলতে পারবেন।

প্রফুল্ল বলল, মন্দ কী, গল্প হয় না অরুণবাবু?

অরুণ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। দ্বিধাজড়িত স্বরে সাবধানে বলল, হতে পারে। তবে এই দেড় মাস যেরকম স্বাভাবিকভাবে কাটিয়েছে তার একটা ব্যাখ্যা, মনের মধ্যে কী ঘটছিল, তার উৎপত্তি কোন উৎস থেকে, এসব না বোঝা পর্যন্ত এ ধরনের সাবজেক্ট নিয়ে গল্প লেখা যায় না।

আমাদের মধ্যে নরহত্যা কেউই বোধ হয় করেনি, তবে প্রাণী হত্যাকারী আছেন একজন। প্রফুল্ল ঘাড় নেড়ে সহাস্যে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, হত্যা করার পর মনের মধ্যে কী কী ব্যাপার ঘটে তিনিই বলতে পারবেন।

আমি কিন্তু মশা মাছি ছারপোকা ছাড়া জীবনে আর কিছু হত্যা করিনি। গীতা নকল গাম্ভীর্য দ্বারা আবহাওয়া লঘু করার চেষ্টা করল।

কিসসু ঘটে না। তখন একটা দারুণ একসাইটমেন্ট হয় বটে, তারপর যে-কে-সেই। পরিমল ঝুঁকে অরুণের সিগারেট প্যাকেট আবার তুলে নিল। জন্তুজানোয়ার মারা আর মানুষ খুন তো এক জিনিস নয়। মানুষ মারার উত্তেজনাটা অনেক দিন থাকে, হয়তো সারা জীবনই, যদি ধরা না পড়ে।

মৃগাঙ্ক মন্থর স্বরে কাউকে উদ্দেশ না করে বলল, এই উত্তেজনার উৎপত্তি কোন উৎস

থেকে?

ঘরটা চুপ করে রইল, এই সময় দূর থেকে পর পর তিন-চারটি বোমা ফাটার শব্দ এল। গীতা বলল, এই এক ব্যাপার শুরু হয়েছে, সন্ধের পর রোজ আওয়াজ করা। কী যে এর মানে, বুঝি না।

নড়েচড়ে বসল অরুণ। এসডিও সাহেবের কাছে শুনলাম, কাল বড়ো তালপুরে জমি দখলের আন্দোলন শুরু হচ্ছে। জোতদাররাও তৈরি আছে। অনেকগুলো লাশ পড়বে মনে হয়।

কাল মিসেস বসুমল্লিককে দেখলাম ফুটবল গ্রাউণ্ডের মিটিং-এ বক্তৃতা দিচ্ছেন। মাঠটা কিন্তু ভরে গেছল। গীতা এই বলে সপ্রশংস চোখে তাকাতে মৃগাঙ্কের মুখে বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।

অরুণ জানে মৃগাঙ্ক তার স্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা একদমই পছন্দ করে না। তাই বলল, পরশু ওঁকে সিদ্ধেশ্বরীতলায় বক্তৃতা দিতে দেখলাম। দারুণ বলেন, লোকেরা খুব মন দিয়ে শুনছিল। কালকে উনিও নাকি বড়ো তালপুরে যাবেন।

সেকী! না না বারণ করে দিন মৃগাঙ্কবাবু। গীতা উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, খুনোখুনি হতে পারে, বলা যায় না।

অরুণ বলল, আমি এরকম একজন ফিয়ারলেস ওম্যান উইথ স্ট্রং পার্সনালিটি—সত্যি বলছি, কখনো দেখিনি। শুনলাম, বটারহাটে সেদিন জমি দখলের যে মারপিট হল, উনি নাকি তখন কাছাকাছিই ছিলেন। যেমন স্পিরিটেড তেমনি পরিশ্রমও করেন দিনরাত। আচ্ছা, ক বছর জেল খেটেছেন উনি মৃগাঙ্কবাবু?

টর্চের ব্যাটারি দুটো বার করে মৃগাঙ্ক তখন খোলের ভিতরটা গভীর মনোযোগে পরীক্ষায় ব্যস্ত। জবাব দিল না। অরুণ খুশি হল এবং বিষগ্ন ভঙ্গিতে বলল, শুনেছি জেল থেকেই নাকি ওঁর শরীর ভেঙে যায়।

পরিমল চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। শেষ টান দিয়ে জানলার বাইরে ছুড়ে ফেলে হঠাৎ বলল, এটা একটা নেশা, বুঝলেন মুনসেফবাবু? পলিটিকসে অনেক ভয় আছে। শিকারে যাই কেন, যেহেতু সেখানে ভয় আছে। জানোয়ার আমাকেও মেরে দিতে পারে। ওই ভয় থেকেই তো আসে উত্তেজনা। তখন ঝাঁঝাঁ করে শরীরের মধ্যে রক্ত ছোটাছুটি করে, ভারি আরাম হয়, নেশা নেশা লাগে। তবে কী জানেন, শিকার তো আর রোজ রোজ করা হয় না। তাহলে আপনি কি বলতে চান, মিসেস বসুমল্লিক… অরুণ যোগ্য একটি শব্দের জন্য প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে দেখল প্রফুল্ল একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। তখন সে গীতার দিকে তাকাল।

আমার ধারণা, বাচ্চা থাকলে উনি এসব করতেন না। গীতা গলা নামিয়ে কথাগুলো বলার সময় মৃগাঙ্ক এবং পরিমলকে দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখল।

ইয়েস, আমারও তাই মনে হয়, অরুণ হাঁফ ছেড়ে বলল। একটা ভ্যাকুয়াম ওঁর মধ্যে নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে, যেটাকে ভরাবার জন্য উনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

অরুণবাবু, গম্ভীর এবং নিস্পৃহ স্বরে মৃগাঙ্ক বলল, আমরা মোটামুটিভাবে শিক্ষিত এবং রুচির একটা স্তরেও পৌঁছেছি। আমরা নিশ্চয় কিছু কিছু বিধিনিষেধও মেনে থাকি, যেমন অপরের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে অযথা ও অনাবশ্যক আলোচনা প্রকাশ্যে না করা।

অরুণ সকলের মুখের দিকে তাকাল। গীতা বিস্মিত, প্রফুল্ল বিব্রত, পরিমল কৌতূহলী। মুখ নীচু করে অরুণ বলল, আই অ্যাম সরি, আমি মাপ চাইছি।

ঘরে অস্বস্তিকর একটা আবহাওয়ার সঞ্চার হয়েছে। কী করে সেটা কাটানো যায় চার জনেই তা নিয়ে মনে মনে ভাবছে। গীতা হঠাৎ বলে উঠল, এই যাঃ, যেজন্য আসা সেটাই বলা হয়নি এতক্ষণ। কাল রাতে আপনারা দুজন কিন্তু আমার ওখানে খাবেন।

আবার কেন ঝাট করা। প্রফুল্ল আড়ষ্টভঙ্গিতে ক্ষীণ আপত্তি জানাল।

হোক ঝঞ্ঝাট, এক বারই তো। আপনাদের রাতের রান্নার পাট আর তাহলে থাকবে না।

অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল, দিনেও থাকা উচিত নয়। সকালে তাহলে আমার ওখানেই দুটি ঝোল ভাত খেয়ে নেবেন।

না না অরুণবাবু, সকালে আমরা সময় পাব না। অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলার আছে। বইগুলো এখনও বাইরে পড়ে। তা ছাড়া ভারী মালপত্তর বিকেলের মধ্যেই স্টেশনে পাঠিয়ে দেব বুক করার জন্য। পরিমলবাবু আপনার প্যাকিং বাক্সটা কাল কখন পাঠাবেন?

পরিমল কিছু বলার আগে ঘরে ঢুকল করবী এবং মিরা। পিছনে ট্রে হাতে বাসন্তীর মা। ওর হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে টেবলে রাখতে রাখতে করবী বলল, অরুণবাবুর গল্প বলা হয়ে গেছে তো?

গল্প নয় মিসেস ঘোষাল, ফ্যাক্ট। অরুণ ঈষৎ আহত কণ্ঠে বলল, বরং এটার উপর রং দিয়ে একটা গল্প লেখা হতে পারে। আপনি ভাবতে পারেন, একজন স্ত্রীলোক তার স্বামী আর আরেক জন স্ত্রীলোকের মৃতদেহের দেড় হাত উপরে বিছানা পেতে দেড় মাস ধরে শুয়েছে। কী করে পারল? ইয়েস, মাত্র দেড় হাত!

অরুণ থামামাত্র মিরা চাপা কণ্ঠে বলল, এইসব খুনোখুনির গল্প কী করে যে আপনারা শোনেন! কেমন গা-শিরশির করে শুনলে।

মিরার কথাগুলো যেন শুনতে পায়নি এমনভাবে অরুণ বলে চলল— আমি নিজে সেই স্ত্রীলোকটিকে থানায় আজ দেখেছি। অতি স্বাভাবিক মনে হল। একদম উত্তেজনা নেই, ভয়ও নেই। ঘোমটা দিয়ে বসে, যা জিজ্ঞাসা করছে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। একদম নির্লিপ্ত। অথচ দেড় মাস ধরে অপরাধটা লুকিয়ে রেখেছিল, অ্যাকসিডেন্টালি ধরা না পড়লে তো জানাই যেত না।

কী করে খুনটা করল? গীতার কৌতূহলে কিঞ্চিৎ উত্তেজনাও প্রকাশ পেল।

আঃ। মিরা চায়ের কাপ নেবার জন্য করবীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আবার এইসব গল্প।

গীতা ঘাড় ফিরিয়ে মিরার দিকে তাকাল। অরুণ রাগে মুখ লাল করে, অনাবশ্যক গলা চড়িয়ে বলল, পিছন থেকে মাথায় কয়লা ভাঙার লোহা দিয়ে মেরেছিল।

থাক গে এসব আলোচনা। মৃগাঙ্ক হেসে বলল, মিসেস সসামের বোধ হয় ভালো লাগছে না।

সারারাত ধরে গর্তটা খোঁড়ে একটা শাবল দিয়ে।

আমি এখন চলি। দোকানে একজনের আসার কথা। বাক্সটা কাল পাঠিয়ে দেব। পরিমল খালি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল।

ছোটগর্ত, ওরই মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে বডি দুটোকে কোনোরকমে ভরে মাটিচাপা দিয়ে বিছানাটা পেতে ঢেকে রাখে।

ভালো কথা, প্রফুল্ল তাকাল করবীর দিকে। গীতা কাল আমাদের নেমন্তন্ন করেছে। রাত্রে।

ওমা, আমিও তো করবীদিকে রান্নাঘরে বললুম আমাদের ওখানে খাওয়ার জন্য, কাল রাতেই। মিরা উত্তেজিত হয়ে প্রফুল্লর দিকে তাকাল।

অরুণ দাঁতচাপা স্বরে বলল, মিস বিশ্বাস আগে বলেছেন এবং ড. ঘোষাল অ্যাকসেপ্টও করেছেন।

তোমাকে ওর হয়ে ওকালতি করতে হবে না। মিরা ক্ষিপ্তের চাহনিতে স্বামীকে বিদ্ধ করে রাখল কিছুক্ষণ। এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার জন্য গীতা ঝুঁকে মৃগাঙ্ককে বলল, আপনার তো বন্দুক আছে, শিকারটিকার করেন না?

মাঝে মাঝে বেরোই, তাও পাখিটাখি! আসলে আমি খুব ভীতু লোক তো… মৃগাঙ্ক এমনভাবে হেসে উঠল যেটা এখন বিদ্রুপের মতো ধ্বনিত হল। প্রফুল্ল আর করবী অসহায়ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ করে অরুণ গোঁয়ারের মতো বলল, না, মিস বিশ্বাসের নেমন্তন্নই ওঁরা নেবেন, নেওয়া উচিতও।

কেন, আমার নেমন্তন্ন কী অপরাধ করল? আমি কি রাঁধতে জানি না ওঁর মতে, না লোকের সঙ্গে কথা বলতে কি মিশতে পারি না? বলতে বলতে মিরার ঠোঁটের দুই কোণে থুতু জমে ওঠে।

গীতা কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। প্রফুল্ল জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে, কঠিন গলায় বলল, সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে একটু বেশিই ছেলেমানুষি হচ্ছে যেন। আমি বরং আমার নেমন্তন্ন উইথড্র করছি।

অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল, সেকী, তা কেন হবে!

আমার স্কুলের কিছু কাজ রয়ে গেছে, আজ চলি। গীতা উঠে দাঁড়াল। সাধারণভাবে হেসেই পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে সে তার পঙ্গু ডান পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেল। ওর পায়ের শব্দ গেটের কাছে পৌঁছোবার আগেই মিরা দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে বলে উঠল, তুমি চাও আমার অপমান, আমি বুঝতে পারি, সব বুঝতে পারি।

চুপ করো। কর্কশ স্বরে অরুণ ধমকে উঠল। হিংস্র দেখাচ্ছে ওকে। মিরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। বাড়ি চলো। অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে কারুর দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিরা ভীত চোখে ঘরের তিনটি লোকের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে দ্রুত স্বামীর অনুসরণ করল।

প্রত্যাশিত অপ্রতিভতা কাটিয়ে মৃগাঙ্কই প্রথম কথা বলল, মিসেস সোম অরুণবাবুকে খুব ভয় করেন। তারপর হেসে বলল, অর্থাৎ পরিমল সাঁপুইয়ের যুক্তি অনুযায়ী নেশার ঘোরে আছেন।

প্রফুল্ল তামাক দিয়ে কাগজ পাকাতে পাকাতে মাথা নীচু করে বলল, এটা একটা গতানুগতিক ভয়। নেশা হবার মতো উত্তেজনা এতে নেই। নেশা হয় সেই ধরনের ভয়ে যা দিয়ে অনুভব করা যায় জীবনকে। আপনার কী মনে হয়?

প্রফুল্ল মুখ তুলে শান্ত চোখে মৃগাঙ্কের বদলে করবীর দিকে তাকাল। চেয়ারে বসে করবী। হাত-দুটি কোলের উপর দুর্বলভাবে রেখে ক্লান্তভাবে প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে।

মানুষের শ্রেষ্ঠ ভয় মৃত্যুভয়। সেটা সামনে এসে দাঁড়ালে তখনই শ্রেষ্ঠ জীবনযাপন সম্ভব। মৃগাঙ্ক নীচু স্বরে কথাগুলো বলে থামল এবং কয়েক মুহূর্ত পরই দ্রুত যোগ করল, কিন্তু ভয়েরও রকমফের আছে।

কীরকম? পুরু লেন্সের ওধারে চকচক করে উঠল প্রফুল্লর চোখ দুটি। মৃগাঙ্ক চুপ করে রইল।

আপনি কখনো ভয়ের মুখোমুখি হয়েছেন? প্রফুল্ল আবার বলল।

অস্পষ্ট স্বরে মৃগাঙ্ক বলল, আমার সন্তান নেই, হবার সম্ভাবনাও নেই।

করবীর জ কুঞ্চিত হল মৃগাঙ্কের কথায়। প্রফুল্ল দেশলাই জ্বালতে একটু দেরি করল। প্রথম ধোঁয়া ছেড়ে সে অনেকক্ষণ ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সেই স্ত্রীলোকটি দেড় মাসের প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের স্বাদ পেয়েছে। আমার মনে হয় না অরুণবাবুর পক্ষে গল্প লেখা সম্ভব।

মৃগাঙ্কবাবু, আপনি তো আবার বিয়ে করতে পারেন। করবী ধীর সহানুভূতিসূচক স্বরে বলল।

না। মৃগাঙ্ক মাথা নেড়ে হাসল।

করবী বলল, আপনি কি ভয়টাকে জিইয়ে রাখতে চান, কিন্তু এটা তো মোটেই ভয় নয়। মৃত্যুর মতো এ ভয় অমোঘ নয়। ইচ্ছে করলেই আপনি এটা কাটিয়ে উঠতে পারেন।

মৃগাঙ্ক শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। বাসন্তীর মা দরজার বাইরে থেকে ফিসফিস করে কী বলতেই করবী বলল, কাল একটু সকাল সকাল এসো।

মৃগাঙ্ক চেয়ারে সিধে হয়ে টেবল থেকে টর্চটা নিয়ে কবজি তুলে ঘড়ি দেখল। মগাঙ্কবাবু বোধ হয় মানবিকতার শিকার হয়েছেন। প্রফুল্ল তার ভারী গলায় লঘু সুরে হেসে উঠল। কিন্তু আপনি কি অনুভব করেন না, এবার মানবিক বোধগুলোকে তাড়া করে হটাতে হটাতে তার ডায়মেনশনকে বাড়িয়ে এমন-কিছু জিনিসে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যাতে মনে হবে আমার মধ্যে গাঢ়-উষ্ণ একটা জীবন সবসময় নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে? এক ধরনের ফিজিকাল ভয়ের মধ্যে আমার মনে হয় সবসময় বাস করা উচিত, সেটা পরমাণু বোমই হোক আর কয়লা ভাঙার হাতুড়িই হোক। বেঁচে থাকার একটাই শেষ অবলম্বন।

মৃগাঙ্ক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার কথাগুলো আমি ভেবে দেখব। রাস্তায় বেরিয়ে মৃগাঙ্ক টর্চ জ্বালার আগে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর মিনিট পাঁচেক হেঁটে খালের অন্ধকার নির্জন বাঁধে পৌঁছে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ পর বাঁধ থেকে নেমে সে রওনা হল পরিমলের দোকানের উদ্দেশ।

রাস্তায় টিমটিমে ইলেকট্রিক আলোয় মৃগাঙ্ক দেখতে পায়নি, কাছাকাছি হতেই সে অবাক হয়ে বলল, একী, বাড়ি যাননি?

অরুণের হাঁটার ভঙ্গিতে মানকি বিপর্যয়ের বিধ্বস্ততা স্পষ্ট। কণ্ঠস্বরে আরও স্পষ্ট। মিস বিশ্বাসের কাছে অ্যাপোলজি চাইতে যাব ভাবছি, মিরার ব্যবহারের জন্য।

ওহ।

কিন্তু চাওয়াটা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আপনি এখন কোথায়। যাবেন? বাড়ি?

পরিমলবাবুর দোকানে যাব। মৃগাঙ্ক হাসল। এখন সেখানে যাওয়ার অর্থ অরুণ জানে। দোকানের পিছন দিকে একটা খুপরি আছে। রাত্রে সেখানে বসে পরিমল মদ খায়। তখন কেউ কেউ যায় সেখানে।

চলুন আমিও যাব।

মৃগাঙ্ক ইতস্তত করায় অরুণ অধৈর্য হয়ে বলল, এখন বাড়ি ফিরতে পারব না। আমার মাথার মধ্যে এখনও আগুন জ্বলছে। আপনি অনেক ভাগ্যবান যে আমার মতো স্ত্রী পাননি।

দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে ওরা খুপরিতে ঢুকল। পরিমলের মুখোমুখি বসে গোলগাল বেঁটে একটি লোক। বেশবাসে সম্পন্নতার পরিচয়, মুখে উদবেগ। ওদের দুজনকে দেখেই সে টেবিল থেকে হাতটা নামিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে পরিমলের দিকে তাকাল। পরিমল অস্বস্তিভরে এধার-ওধার তাকিয়ে তারপর স্ফুর্তিবাজের মতো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, আরে আসুন আসুন।

টেবিলের উপর অর্ধ নিঃশেষিত রামের একটি বড়ো বোতল ও দুটি সদ্য সমাপ্ত গ্লাস। টেবিলের নীচে কয়েকটি সোডার বোতল, দেওয়ালের ধারে পাঁচ-ছটি প্যাকিং বাক্স। ওরা দুজন তার উপর বসল। পরিমল উঠে তাক থেকে দুটি গ্লাস এনে মদ ঢালতে ঢালতে লোকটিকে বলল, মধু, সোডা খোল তারপর অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার?

অরুণ শুধু হাসল। মৃগাঙ্ক বলল, ওঁরটা একটু কম করে দিয়ে পরিমল, প্রথম দিনেই যেন গোলমাল করে না বসেন।

পরিমল ভ্রূ কুঁচকে কিছু বলতে যাচ্ছে, তার আগেই অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল, কলেজে পড়ার সময় কয়েক বার খেয়েছি, কোনো গোলমাল হয়নি।

বিয়ের পর নিশ্চয় খাননি? মৃগাঙ্ক গ্লাসটা পরিমলের হাত থেকে নেবার সময় মিটমিটিয়ে হাসল, অরুণ জবাব দিল না। হাত বাড়িয়ে সে টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে দুই চুমুকে শেষ করে ফ্যালফ্যাল চোখে সকলের দিকে তাকাল।

পরিমল বিরক্ত হয়ে বলল, কী ব্যাপার?

মিস বিশ্বাসের কাছে ক্ষমা চাইবেন বলে রাস্তায় এতক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিয়ে মৃগাঙ্ক বলল।

পরিমল অ্যা বলে অরুণের গ্লাসে আবার মদ ঢেলে দিল। ওরা কথা না বলে খেয়ে চলল। একসময় পরিমল বলল, এ আমার বাল্যবন্ধু মধুসূদন দাস।

লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বুকে দুই মুঠো ঠেকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

বস পরিমল তর্জনী নাড়িয়ে নির্দেশ জানাল।

টসটসে মুখ নিয়ে অরুণ তাকাল মধুসূদনের দিকে। তারপর পরিমলকে বলল, ইনি বড়ো তালপুরের জোতদার, তাই না?

মৃগাঙ্কর গ্লাসধরা মুঠোটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল, পরিমল অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল, মধুসূদন বিভ্রান্ত চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল টেবিলে।

আপনি কাল এসডিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আপনার বন্দুক আছে কিন্তু আরও চাই। আপনি গুলি চালিয়ে মানুষ মারলে রেহাই পাবেন। আপনাকে এক হাজার লোক ঘেরাও করে কুপিয়ে কুপিয়ে মারলে তারাও রেহাই পাবে। সবাই রেহাই পাবে, শুধু আমি ছাড়া। পাঠশালার পড়ুয়াদের মতো দুলে দুলে অরুণ বলে গেল। মৃগাঙ্ক ও পরিমল তখন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে।

মধু আমার বন্দুকটা নিতে এসেছে, আমাকেও। পরিমল মৃদুস্বরে বলল। কিন্তু স্পিংটা সারাতে, দিন পাঁচেক আগে কলকাতায় পাঠিয়েছি। ও বলছিল কোথাও থেকে বন্দুক জোগাড় করে দিতে!

অরুণ বলল, উকিলবাবুর তো আছে।

মৃগাঙ্ক অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল। পরিমলের গ্লাস ধরা মুঠোটা শক্ত হয়ে গেল। মধুসূদন বিভ্রান্ত চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা টেবলে নামিয়ে রাখল।

তোর বউকে কাল যেতে বারণ করিস। এখানে কাল অনেক কিছু ঘটতে পারে। পরিমল স্কুলজীবনের পর প্রকাশ্যে এই প্রথম মৃগাঙ্গকে তুই বলল।

অরুণ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ে যেতে যেতে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সাবস্টিটিউট চলবে? উকিলবাবুর বউয়ের বদলে আমার বউ যদি ফিলডিং দেয়, আপত্তি আছে?

অরুণকে রূঢ়ভাবে টেনে তুলে পরিমল বসিয়ে দিল প্যাকিং বাক্সের উপর। মৃগাঙ্ক ধীর অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলল, বন্দুকটা কি এখুনি চাই?

মধুসূদন অস্বস্তিতে নড়েচড়ে গলাখাঁকারি দিয়ে পরিমলের দিকে তাকাল। অরুণ হাঁটুগেড়ে বসে মৃগাঙ্কের পা জড়িয়ে ধরল। আমার কিছু নেশা হয়নি মৃগাঙ্কবাবু, আমি বলছি সাবস্টিটিউট নেওয়ার অধিকার আছে। মিরা ক্যাচ-ট্যাচ ফেলবে না…জাস্ট ওয়ান বুলেট..আমি দাম দেব…

পরিমল ওকে টেনে তুলে বলল, এবার বাড়ি যান। আপনার নেশা হয়েছে। তারপর অরুণকে ঠেলতে ঠেলতে দরজার বাইরে এনে বলল, এবার বাড়ি যান। আপনার নেশা হয়েছে। অরুণকে তারপর বলল, হেঁটে যেতে পারবেন তো?

আমাকে আপনারা কী ভাবেন অ্যাঁ? একটা কাওয়ার্ড? আমি পারি, গীতা বিশ্বাসের সঙ্গে যা খুশি করতে পারি, কাউকে পরোয়া করি না। দেখবেন? পারি কি না দেখবেন?

অরুণ ঘুরে তাকিয়ে দেখল পরিমল নেই এবং দরজাটা বন্ধ। ঘাড় কাত করে সে কিছুক্ষণ একটানা ঝিঝির ডাক শুনল। চারদিকের অন্ধকারে চোখ বুলিয়ে, কাওয়ার্ডস, অল আর কাওয়ার্ডস। বলে ধমকে উঠে কুচকাওয়াজের কায়দায় বাড়ির রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। ওকে দেখে হতভম্ব মিরা যখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না তখন কাঁধ থেকে কাল্পনিক রাইফেলটি নামিয়ে, হাঁটু ভেঙে বসে কাঁধে বাঁট রেখে, এক চোখ বুজে অনেকক্ষণ তাক করে অরুণ চিৎকার করে উঠল, দুম।

 

প্রফুল্ল আর করবী তখন বারান্দায় পাশাপাশি চেয়ারে বসে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। বাড়ির সব আলো নেবাননা। একসময় প্রফুল্ল আলতো স্পর্শ করল করবীর বাহু। করবী ঘাড় ফেরাল।

আর ভালো লাগে না।

প্রফুল্ল বলল, তোমার সাকসেস চব্বিশ, আমার চৌত্রিশ। তুমি কিন্তু একসময় এগিয়ে ছিলে।

সংখ্যা দিয়ে কী হবে। জানি তো এটা সত্যি নয়, শুধুই খেলামাত্র। সারাজীবনই এভাবে খেলা যায় না।

প্রফুল্ল হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার যেন মনে হচ্ছে ভ্রমণ করার মতো আর কোনো মহাদেশ আমাদের জন্য অনাবিষ্কৃত নেই।

ক্লান্ত স্বরে করবী বলল, কিন্তু আমাদের বেরোতেই হবে, নইলে বাঁচা যাবে না। আমি ব্যবধান বাড়াতে চাই অতীতের সঙ্গে। নেকড়ের মতো ওরা খালি তাড়া করে, ধরতে পারলে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে।

এইসময় মৃগাঙ্ক তার শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে বন্দুকটা তুলে দেওয়ালে-টাঙানো নিজের ছবিটাকে তাক করছিল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আসা পায়ের শব্দ পেয়েই আলো নিবিয়ে সন্তর্পণে দরজার পাশে দাঁড়াল। বারান্দার অপর প্রান্তের ঘরটি ক্ষণপ্রভার। মৃগাঙ্ক আজ সারাদিন ওকে দেখেনি।

শীর্ণা বালিকার মতো দেহ, হাত দুটি দড়ির মতো ঝুলছে, মাথাটি এক পাশে হেলানো, মৃগাঙ্কের সামনে দিয়েই নিঃশব্দে চলে গেল নিজের ঘরে। বন্দুকটি বিছানার উপর রেখে জানলার ধারের ইজিচেয়ারটাতে দেহ এলিয়ে দিল মৃগাঙ্ক। ধীরে ধীরে চিন্তার মধ্যে সে ডুবে গিয়েছিল, হঠাৎ তার মনে হল ঘরে কে ঢুকছে।

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে ক্ষণপ্রভার অবয়বটি চিনতে পারল। বন্দুকের বাক্স আলমারির নীচেই থাকে। মৃগাঙ্ক দেখল, ও নীচু হয়ে বাক্সটি টেনে বার করল। হাতে তুলেই বোধ হয় লঘু ভারের জন্য বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন চাপাস্বরে মৃগাঙ্ক বলল, আমি বার করে সরিয়ে রেখেছি। ওটা মধুসূধন দাসের লোক একটু পরে এসে নিয়ে যাবে।

কেন? তাতে আমাদের আন্দোলনের ক্ষতি হবে।

আমার কিছু আসে-যায় না।

ক্ষণপ্রভা বাক্সটা নামিয়ে রেখে মৃগাঙ্কের দিকে এগিয়ে এল। বন্দুকটা আমাদের দরকার। এখন তর্কাতর্কি করার সময় আমার নেই, কোথায় রেখেছ?

কী লাভ এইসবের দ্বারা তুমি পাবে? কাল তুমি মারা যেতে পার।

হ্যাঁ, ক্ষণপ্রভার ঝকঝকে দাঁত অন্ধকারেও মৃগাঙ্ক দেখতে পেল। মরার সম্ভাবনা কাল অনেকেরই আছে। তবে একটা শর্তে আমি যাওয়া বন্ধ করতে পারি।

কী শর্ত? মৃগাঙ্ক উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল।

সকলকে জানিয়ে দেব যে আমি বন্ধ্যা নই।

না না। মৃগাঙ্ক কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে উঠল, তা যদি কর আমি নিজে তোমায় গুলি করে মারব।

কী লাভ তার দ্বারা তুমি পাবে?

মৃগাঙ্ক অবসনের মতো বসে পড়ল। মাথা নাড়তে নাড়তে কাতর স্বরে বলল, বোঝাতে পারব না তা, বোঝানো যায় না। পুরুষ হলে বুঝতে পারতে।

আর তোমাকে পুরুষ করে রাখতে আমাকে সাজতে হয়েছে বন্ধ্যা।

মৃগাঙ্ক অস্ফুটে বলল, খাটের ওপর।

পরদিন সকালে মিরাকে হাসপাতালে পাঠাতে হল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে অরুণ কলঘরে গিয়ে অর্ধদগ্ধ অচেতন দেহটি দেখতে পায়। ডাক্তার জানিয়েছে বাঁচবে কি না কাল বলা যাবে।

দুপুরে ক্ষণপ্রভা ফিরে আসে পুলিশের সঙ্গে। বড়ো তালপুর যাবার পথেই সে গ্রেফতার হয়েছে। মৃগাঙ্ক জামিনে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিল, ক্ষণপ্রভা রাজি হয়নি।

রাত্রে গীতার বাড়িতে আহারের পর প্রফুল্ল বলল, ভেবেছিলাম তোমার এখানেই গল্প করে বাকি সময়টা কাটিয়ে দুজনে স্টেশনে রওনা হব। মালপত্র তো সবই পাঠানো হয়ে গেছে।

গীতা বলল, তাহলে থেকে যান। ট্রেন তো মাঝরাতে, আমার কিছু অসুবিধা হবে না।

করবী মাথা নীচু করে তালুতে মৌরি বাছতে বাছতে বলল, পরিমলবাবু প্যাকিং কেসটা এমন সময় পাঠালেন যে বইগুলো ভরে পেরেক এঁটে সেটা অন্য জিনিসগুলোর সঙ্গে আর স্টেশনে পাঠানো গেল না। ওটার জন্যই আমাদের যেতে হবে। রিকশা বলা আছে, পৌনে বারোটায় তুলে নিয়ে যাবে।

তাহলে এখন বাড়ি ফিরে আপনাদের তো অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। চলুন সঙ্গে যাই, খানিকক্ষণ গল্প করে আসা যাবে। গীতা টেবিল থেকে টর্চটা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঝি-কে বলল, বেরোচ্ছি গো। ফিরতে দেরি হলে তুমি আর জেগে বসে থেকো না।

ওরা তিন জন প্রধানত মিরা ও অরুণের কথা বলাবলি করতে করতে পৌঁছে গেল। গেট বন্ধ, বাড়িটা অন্ধকার। তালা খুলে ওরা বসার ঘরে ঢুকল। ঘরের আলো জ্বলতেই গীতা কাঠের বাক্সটা দেখে বলল, বেশ বড়ো তো, একটা মানুষ প্রায় ধরে যেতে পারে।

করবী হেসে বলল, ছোটোখাটো মানুষ হলে ধরে যাবে তোমায় ধরবে না।

আমি এমন-কিছু বিরাট নই, ঠেলেঠুলে এর মধ্যে ঠিক এঁটে যাব। এই বলে গীতা প্যাকিং বাক্সটার উপর বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে উঠে বলল, উফ পেরেক। ঠিকমতো বসানো হয়নি।

মুঠোয় মৌরি রয়ে গেছে। করবী হাত বাড়িয়ে প্রফুল্লকে বলল, খাবে?

দু-আঙুলে মৌরি নিয়ে প্রফুল্ল বাক্সটার উপর ঝুঁকে লক্ষ করতে করতে বলল, তাই তো? তিন চারটে পেরেক দেখছি বেরিয়ে রয়েছে। পথে খোঁচা লাগতে পারে, খুলে বেরিয়ে যেতেও পারে।

লোহা-টোহা কিছু নেই? বসিয়ে দেওয়া উচিত, গীতা ঘরের এধার-ওধার তাকাল লোহার খোঁজে।

দেখি আছে কি না! প্রফুল্ল ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের পিছন দিকে চলে গেল এবং চেঁচিয়ে বলল, টর্চটা আননা তো, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

গীতা তোমার টর্চটা দিয়ে আসবে ভাই। মৃদু-শান্ত স্বরে করবী বলল, তারপর হাতের শেষ কয়েকটি মৌরি মুখে ছুড়ে দিল। গীতা বেরিয়ে যেতেই করবীর মুখ ধীরে ধীরে টসটসে হয়ে উঠল জ্বরগ্রস্তের মতো। দু-হাতে কপাল চেপে সে মাথা নীচু করে বসে রইল।

মিনিট পাঁচেক পর পায়ের শব্দে করবী মুখ তুলল। কয়লাভাঙা হাতুড়ি হাতে প্রফুল্ল দাঁড়িয়ে। ওর জিজ্ঞাসু চাহনির জবাবে প্রফুল্ল বলল, বাক্সটা এক বার খুলতে হবে। থলিটা আনো, বইগুলো তাতেই বরং ভরে নেওয়া যাবে।

এবং তারা ফিরে এল

কারখানায় নাইট ডিউটি সেরে এখন বাসে ফিরেই ফেলা দত্ত রাস্তার টিউবওয়েলে চানটা সেরে নেয়। তারপর ঘণ্টা তিনেক ঘুমোয়। টিউবওয়েলের পাশেই আস্তাকুঁড়। পাম্প করতে করতে হঠাৎ তার চোখে পড়ল। ঝুঁকে সে বস্তুটিকে নিরীক্ষণ করছে, তখন বারান্দা থেকে স্কুলমাস্টার অজিত ধরের বউ তা দেখে স্বামীকে ডেকে আনল। তিনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, অত মন দিয়ে কী দেখছেন ফেলুবাবু?

ফেলা দত্ত গম্ভীর মুখে হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকল। তখন সরকারি ডিপো থেকে দুধ আনতে যাচ্ছিল সুব্রত মৈত্র। সে ওদের দুজনকে আস্তাকুঁড়ের ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অবশেষে ফেলা দত্ত সাব্যস্ত করল, মনে হয় এ পাড়ারই কোনো ঘরে কেলেঙ্কারিটা হয়েছে। ছি ছি ছি! পঞ্চাশ বছর বয়স হতে চলল, এ জিনিস পাড়ায় এই প্রথম দেখলুম।

অজিত ধর মন্তব্য করল, খোঁজ করে বার করা উচিত। আচ্ছা, পুলিশে খবর দিতে হবে কি?

সুব্রত মৈত্র ডি-ফিল পাওয়ার পর থেকে স্ত্রীর নির্দেশে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। রুবির ধারণা পন্ডিত লোকেরা খুব গম্ভীর হয়। ড. মৈত্র যথোপযুক্ত গাম্ভীর্য সহকারে অভিমত দিল, ধরা না পড়লে পুলিশ কী করে বার করবে? আর এসব ব্যাপার মেয়েরাই ভালো ধরতে পারে। আগে ধরুন, তারপর পুলিশে খবর দিন। এই বলে সে দুধ আনতে চলে গেল।

হনহনিয়ে যাচ্ছিল ভেলোর মা। তিন বাড়িতে কাজ, বেশিক্ষণ দাঁড়াবার তার সময় নেই। শুধু বলে গেল—পাড়ার মেয়ে-বউদের ধরে ধরে এগজামিন করলেই তো ন্যাটা চুকে যায়।

খুবই চিন্তিত হয়ে অজিত ধর বাড়িতে ঢুকল। বড়োমেয়ে খুকিকে শুয়ে থাকতে দেখেই আঁতকে উঠল সে। কী ব্যাপার, শুয়ে এখনও?

বউ বলল, কাল থেকে তো ইনফ্লুয়েঞ্জা মতো হয়েছে। কেমন গা-টা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে।

না না, অজিত ধর চাপা চিৎকার করে উঠল, শোয়াটোয়া এখন চলবে না। বারান্দায় যাক, হাসুক, গান করুক, অসুখটসুখ এখন নয়। বিকেল হলেই সব বাড়ির মেয়েরা যখন ছাদে উঠবে তখন যেন স্কিপিং করে। মোটকথা আমার বাড়ির দিকে কেউ যেন সন্দেহের চোখে না তাকায়।

খুবই চিন্তিত হয়ে ফেলা দত্ত বাড়িতে ঢুকল। ব্যাপারটা বউকে বলমাত্র সে তড়বড়িয়ে বলল, তোমার সেজোছেলেকে ছাদে ওঠা বন্ধ করতে বলো। অজিত মাস্টারের মেয়েটার সঙ্গে তো আজকাল খুব ঠ্যাকার চলে, তারপর কোনদিন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ক্ষণ। কারখানায় যাহোক একটা কাজে ঢুকিয়ে দাও, কথা তো গেরাহ্যি কর না। তোক একটা লটঘট।

কাজ কি বললেই আজকাল পাওয়া যায়? ক্লান্তস্বরে ফেলা দত্ত বলল, সবাইকেই তো তেল দিচ্ছি।

দুধ নিয়ে ফিরেই সুব্রত মৈত্র শুনল, কী যেন একটা আস্তাকুঁড়ে পড়েছে, ভেলোর মা চাটুজ্জে গিন্নিকে বলছিল শুনলুম?

রুবির হাসি দেখে ড. মৈত্র বুঝল সবিস্তারে কিছু বলতে হবে না। কোন বাড়ির কেলেঙ্কারি বলে মনে হয়?

কী জানি, ভেলোর মা তো বলছিল মেয়ে-বউ সবাইকে এগজামিন করলেই বেরিয়ে পড়বে।

বউদেরও? তাহলে তো তুমিও পড়ে যাও এর মধ্যে। অবশ্য ডিস্টিংশন নিয়েই পাস করবে, ট্যাবলেট কাল পর্যন্ত তো চলবে?

তাই শুনে হেসে উঠতে উঠতে রুবি ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাল কেন পরশু না? এখনও তো তিন দিন রয়েছে!

সেকী দুটো থাকার তো কথা!

দুজনে একুশ দিন ও একুশ ট্যাবলেটের হিসেব কষতে শুরু করল। এবং একসময়ে ফল বেরোলরুবি কোনো একদিন খেতে ভুলে গেছে। অতঃপর দুজনেই থমথমে মুখ নিয়ে বসে রইল।

ভেলোর মা কাজ সেরে চলে যাবার পরই চাটুজ্জেগিন্নি ছোটোবউয়ের ঘরে এসে ঢুকল।

শুনেছ তো কী কান্ড হয়েছে?

শুয়ে কাগজ পড়ছিল ছোটোবউ, উঠে বসে আঁচলটা স্ফীত মধ্যদেহের উপর বিছিয়ে দিল। তাইতে চাটুজ্জেগিন্নির কুঞ্চন ঘটল বার কয়েক।

আজকাল মেয়েরা তো ছেলেপুলে চায় না, তাই কত কী করে। এই দ্যাখো-না কোন বাড়ির মেয়ের কিত্তি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে।

বউয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন কেন মা, বিধবা কি কুমারীকীর্তিও তো হতে পারে?

তক্ক করা তোমার এক রোগ বাপু, কাপড় টেনে অত ঢাকাটুকি দেবার কী আছে অ্যাঁ, এত লজ্জা কীসের? যাও-না, এবাড়ি-ওবাড়ি একটু ঘুরে এসো। লোকে দেখুক। সবাই জানে এ পাড়ায় তুমিই একমাত্র পোয়াতি। যা সন্দেহবাতিক মন পোড়ারমুখো পাড়ার।

শাশুড়ি চলে যাবার পর ছোটোবউ রাগে গুম হয়ে বসে রইল। সকালের কলেজ থেকে ফেরার পথে থার্ড ইয়ারের স্নিগ্ধা ছোটোবউয়ের হাতছানি পেয়ে দোতলায় এল।

এ পাড়ায় আর কার বাচ্চা হবে বলতে পার?

ভেবেচিন্তে স্নিগ্ধা জানাল, সে বলতে অক্ষম। তবে গৌরীর মা-র হতে পারে, কেননা প্রতিবছরই তার হয়, আট বছর তিনি বিশ্রাম পাননি।

সকাল থেকেই গৌরীর মা অন্যমনস্ক। ছাদে কাপড় মেলতে এসে পাঁচিলে ভর দিয়ে একদৃষ্টে আস্তাকুঁড়ের দিকে তাকিয়ে রইল সে। গৌরীর বাবা ভাত খাচ্ছিল, তখন সে এক বার বলেছিল, যে-ই করুক, বেঁচে গেল।

তাই শুনে গৌরীর বাবা বলে, ওইসব করার শখ হচ্ছে বুঝি?

কেন হবে না, আমি কি পশু, আমি কি একটা বছরও ছাড় পাব না?

ওরে ব্বাবা, তুমি যে খুব আধুনিকা হয়েছ দেখছি, ডিভোর্স করবে না তো?

উপায় থাকলে করতুম।

এই বলার জন্য এঁটো হাতের চড় খেয়েছে গৌরীর মা। দুপুরে পাঁচিলে ভর দিয়ে আস্তাকুঁড়ের দিকে তাকিয়ে টপ টপ করে জল পড়ল তার চোখ দিয়ে।

বিকেলে ছাদে স্কিপিং করতে করতে খুকি টলে পড়ল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্য বাড়ির ছাদগুলো লক্ষ করতে করতে হঠাৎ তার মনে হল, তিন আর চারের-একের ফাঁক দিয়ে ছবিদের ছাদে কেউ নেই। প্রায়ই তো ছবি ওঠে, তবে নেই কেন আজ? ধীরে ধীরে সিধে হয়ে গেল খুকি উত্তেজনায়। তাহলে কি ওই! সাত-আট বছর আগে সে রোজ বিকেলে যেত ছবিদের বাড়ি। শাড়ি পরার সঙ্গে বাড়ির বাইরে যাওয়া কমে গেল। ছবির বাবার কী কারণে যেন চাকরি গেল, জেল হল। পাড়ায় রটল তহবিল তছরুপ করে ফাটকা খেলতে গিয়ে লোকটার সর্বনাশ হয়েছে। ওদের বাড়ি যাওয়া একদম বারণ হয়ে গেল। একদিন শুনল বাড়িওয়ালা মেরেছে আট মাসের বাকি ভাড়ার জন্য। তারপর মা মারা যেতেই পাঁচ ভাই-বোনের সংসার ছবির ঘাড়ে পড়ল! ওর বাবা প্রায়ই বাড়ি ফেরে না। ফিরলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাতাল হয়ে। একদিন পাড়ায় বলাবলি হল, ছবিকে গড়ের মাঠের দিকে সেজেগুজে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে রাত্রে।

জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে খুকির। তবু ছুটে এল সে স্নিগ্ধাদের বাড়ি। গৌরীসমেত আরও তিন-চারটি মেয়ে ছিল। তারা ঘিরে ধরে খুকির কাছ থেকে শুনল। তারপর সাব্যস্ত করল, চল, গিয়ে দেখা যাক।

হঠাৎ উটকোভাবে কি যাওয়া যায়, এত বছর যখন যাইনি!

যদি গিয়ে দেখি ছবির কেলেঙ্কারি নয় তাহলে আমাদের মুখ থাকবে কোথায়?

ওরা সবাই মনে মনে প্রার্থনা করল, কেলেঙ্কারি যেন ছবিরই হয়।

তাহলে গিয়ে বলি, আমরা সবাই রবীন্দ্র-জন্মােৎসব করব, তোকে গান গাইতে হবে। ছবি তো খুব ভালো গান গাইত।

কেন, ওর আবৃত্তিও কী সুন্দর ছিল। স্কুলে একবার প্রতিমাদি কী বলেছিল ওর সম্পর্কে। মনে আছে?

মাস খানেক আগে ওকে একবার দেখেছিলুম, ইস, কী রোগা হয়ে গেছে! গাল দুটো বসা, চোখ গত্তে ঢোকা, আমায় দেখে কেমন জড়সড় হয়ে হাসল। আগে কিন্তু খুব মিশুকে ছিল।

এ লাইনে গেলে এইরকমই হয়ে যায়। আমার তো মনে হয় খুকির আন্দাজই ঠিক।

আমারও তাই মনে হয়।

সকলেই বলল, আমারও।

তারপর দল বেঁধে ওরা ছবিদের বাড়িতে হাজির হল। এক তলায় একখানি ঘরে ছবিরা এখন থাকে। দোতলা থেকে বাড়িওয়ালা নামিয়ে দিয়েছে। তারা কথাও বলে না, উঁকি দিয়েও দেখে না। ঘরটা অন্ধকার। একটি মাত্র জানালা পগারের দিকে, এখন বন্ধ। দরজাটাও ভেজানো।

ছবির ভাই-বোনেদের দেখা যাচ্ছে না। সারা এক তলাটা ছমছমে ঠাণ্ডা, ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

কেউ নেই, চল ফিরে যাই। ফিসফিসিয়ে একজন বলল।

দরজায় তালা নেই যখন, কেউ থাকতেও পারে।

ঠেলে দেখব?

দ্যাখ।

অন্ধকার আর ভ্যাপসা গন্ধ প্রথমেই ওদের এক-পা পিছিয়ে দিল।

কিছু দেখা যাচ্ছে না যে!

আলোটা জ্বাল-না।

একজন ঘরে ঢুকে দেয়াল হাতড়ে সুইচ পেল। টিপতে জ্বলল না।

বাড়িওলা বোধহয় কানেকশন কেটে দিয়েছে।

মনে হচ্ছে কে যেন তক্তায় শুয়ে।

ধ্যাত, কে আবার এখন এইভাবে শুয়ে থাকবে?

সত্যি বলছি, দেখে আয় কেউ।

খুকি ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে ঠোক্কর সামলাবার জন্য দু-হাত বাড়িয়ে এগোল। তারপরই প্রচন্ড ভয় তার চিৎকারটা টিপে ধরল। তক্তায় কেউ শুয়ে। তার কাঁধে খুকির হাত লেগেছে।

বাইরে থেকে তাগিদ এল, কী হল রে, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

খুকি ঝুঁকে হাত বোলাল দেহটায়। ঠাণ্ডা নিথর। নাকের সামনে আঙুল রাখল। নিশ্বাস পড়ছে না। গালে হাত রাখল, চুপসে রয়েছে। ঠোঁট দুটো শুকনো। চোখের পাতা খোলা, কানের পিছনে আঁচিলটাও হাতে ঠেকল।

খুকি বেরিয়ে এসে বলল, ছবিটা মরে পড়ে রয়েছে রে! এবং তারা ফিরে এল সন্তর্পণে, দ্রুত পায়ে, নীরবে।

রাত্রে নাইট ডিউটিতে বোরোবার আগে ফেলা দত্ত টিউবওয়েল থেকে খাবার জল আনতে গিয়ে আস্তাকুঁড়ে ঝুঁকে দেখল। ভেলোর মা তখন যাচ্ছিল, বলল, এতক্ষণ কি আর পড়ে থাকে, কাক-কুকুরে হয়তো খেয়ে ফেলেছে, কি ধাঙড়ে নিয়ে গেছে।

ইডিয়ট গাড়ল কোথাকার ড. মৈত্র গজরে উঠল। রুবি মাথা নামিয়ে বসে। ডাক্তার বলল, হতে পারে ওই একদিনের ভুলের খেসারত দিতে হতে পারে। তখন তো নার্সিং হোমে গিয়ে, ওই যা হয়েছে আজ…

হয় যদি হবে। রুবি হঠাৎ ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো উদ্ধত হয়ে উঠল।

মাথা নামিয়ে মুচকি হেসে গৌরীর মা বলল, রাগ করব কেন, তুমি তো আর পর ভেবে মারনি। রাগ তো নিজের জনের উপরই লোক করে।

তাহলে শাড়িটা পরো, দেখি কেমন মানায়।

আগে আলোটা নিবোও বাপু।

ছ-মাসও তো বিয়ে হয়নি, এত তাড়াতাড়ি সংসারে আটকে পড়ার কী দরকার ছিল? চাটুজ্জেদের ছোটোবউ শান্ত গলায় অনুযোগ করল।

সময় কাটাবার একটা ব্যবস্থা হল, ভালোই তো।

কেন, সেজন্য তুমিই তো আছ।

আমি তো পুরোনো হয়ে যাব একসময়।

কিছুক্ষণ পর ছটোবউ ফিসফিসিয়ে বলল, আচ্ছা ওইরকম কিছু-একটা ব্যবস্থা করা যায় না? সাড়া না পেয়ে বুঝল স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে।

কপিল নাচছে

আমি তো একা নই। হাজার হাজার লোকের…কারুর পাঁচ, কারুর পঞ্চাশ হাজার, কারুর পাঁচ লাখ। রণেনবাবু রিটায়ার করে যা পেয়েছিল, সারা জীবনের সঞ্চয় নব্বই হাজার ওখানে রেখেছিল, সব গেছে। আমি তো সেই তুলনায় ভাগ্যবান, ষাট হাজার মাত্র।

এক মাস ধরে অনবরত এই শুনছি, আর ভালো লাগে না হাজার হাজারের কথা শুনতে। সর্বনাশের মধ্যে এখন আমরা নিজেরাই।

তিন তলার বারান্দায় রবিবারের বিকেলে স্বামী-স্ত্রী অরুণ এবং বাণী রেলিংয়ে কনুই রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। ওদের দেখলে মনে হবে সফল জীবনকে তাদের সামনে স্থির বা ধাবমান প্রকৃতির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়ে তা ফিরিয়ে নেবার জন্য প্রশান্ত আলস্যে যেন অপেক্ষা করছে।

চল্লিশ ফ্ল্যাটের সমবায় আবাসন সসাসাইটির চার তলা এই বাড়ির নাম বসবাস। বাড়ির সামনের রাস্তা পার হলেই পাঁচিলঘেরা পার্ক। পার্কের তিন দিকে খন্ড খন্ড বসতজমি কয়েকটিতে বাড়ি হয়েছে, কয়েকটিতে হচ্ছে। তারপরই ধু-ধু শূন্যতা। দূরে ছাইরঙের সদ্য সমাপ্ত অতিকায় এক বাড়ি, কোনো সরকারি দপ্তর হয়তো বসবে। আরও দূরে ছড়ানো গাছের আড়ালে গ্রামের আভাস দিচ্ছে কয়েকটি খড়ের চালা। তাতে লতানো গাছ, হয়তো লাউ বা চালকুমড়োর। পার্কের ডাইনে একটা ঝিলের কিছুটা অংশ দেখা যায়, কিন্তু দেখা যাবে না বাড়ি উঠলে। সকালে রোদ পড়লে ঝিলটা আয়নার মতো ঝলসায়। বিরাট কিছু গাছ ঝিলের ধার ঘেঁষে। তার কিছু ফুলের। হলুদ আর লাল এ পর্যন্ত দেখা গেছে। বাতাসে কাঁপানো পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তার বা বাড়ির আলো মিটমিট করে জোনাকির মতো। মেয়ে এবং পুরুষরা ঝিলে দুপুরে স্নান করে।

পার্কেও গাছ রয়েছে। উচ্চতায় এবং ঝাড়ে এখনও কৈশোরে কিন্তু হলুদ, সাদা, বেগুনি, লাল ফুল ফুটিয়েছে। সিমেন্টের বেঞ্চগুলো খালিই পড়ে থাকে। অভিজ্ঞতার প্রাচুর্যে উপচানো সঙ্গলোভী বৃদ্ধদের সংখ্যা এখনও হয়তো বাড়েনি এই অঞ্চলে। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে ঝোপ, বড়ো বড়ো ঘাস। পার্কের যত্ন নেওয়ার লোকটি বোধ হয় অলস কিংবা বেতন কম পায়। ঝোপের উপর প্রজাপতি ওড়াউড়ি করে, তিন-তলা থেকে দেখা যায়। পার্কের মধ্যে শালিক নামে, ঝগড়া করে। জোড়া বুলবুলি এ গাছ ও-গাছ উড়ে বেড়ায়। লম্বা লেজওয়ালা কালো পাখি পার্কের পাঁচিলে কখনো-সখনো বসে। সকালে বা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শোনা যায় দূর থেকে ভেসে আসা মোটর বা বাস বা জেনারেটরের শব্দ ছাপিয়েও।

এক বৃষ্টির দিনে মাটির সোঁদা গন্ধ, ঝাপসা গাছপালা এবং ঝম ঝম আওয়াজের মধ্যে প্রান্তরে একটা তাল গাছকে আবিষ্কার করে অরুণ অবাক হয়েছিল।

বসবাসের উত্তরের অংশে একটি ফ্ল্যাটের কিছুটা অভ্যন্তর দেখা যায় যদি পর্দা সরানো থাকে। একদিন ফুটফুটে একটা বাচ্চা হামা দিচ্ছিল। অবাক হয়ে ঝুঁকে দেখছিল বিরলকেশ, কৃষ্ণকায় হাফ প্যান্টপরা স্বাস্থ্যবান এক যুবক। হঠাৎ পর্দার আড়ালে থাকা কারুর দুটি নিটোল বাহু বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর যুবকটি, সম্ভবত বাবা, বাচ্চাটার নকল করে ঘরে হামা দিয়ে এক বার ঘুরেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সেইসঙ্গে ভেসে এল মাঝরাতে ঝম ঝম বর্ষার মতো হাসি। বাণী এই দৃশ্য ও হাসিতে অভিভূত হয়েছিল।

এভাবে ঠকাবে একদমই ভাবিনি।

ভেবে আর লাভ নেই।

প্রসঙ্গটা দুজনেই এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু মনের মধ্যে সারাক্ষণই বিষাদের বোঝা বহন করে চলার সামর্থ্যও আর নেই। অরুণ কঠিন ধাতের মানুষ, যা তার ছোটোখাটো রুগ্নদেহ ও নম্র আচরণ থেকে বোঝা যায় না। স্কুলের পড়া শেষ করেই চাকরিতে ঢুকেছিল এবং গত তিরিশ বছরে ধাপে ধাপে উঠে এখন বিরাট এক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় বিভাগের তিন নম্বর কর্তা। সে জানে আর তার ওঠার যোগ্যতা নেই, এখানেই আরও বছর দশেক থেকে অবসর নিতে হবে।

আজ ভাত খাবার সময় দেবু কিছু বলেনি?

পর পর তিন রোববার মাংস হল না। গাঁইগুঁই করছিল—অভ্যেস হয়ে গেছে তো। এখনও ব্যাপারটা জানে না।

জানতে হবে। নইলে…

কী জানবে?

সতেরো-আঠারো বয়স, এখন তো নানা ব্যাপারে অভ্যস্ত হবার সময়, নানা প্ল্যান মাথায় খেলে, স্বপ্ন দেখে। আমার ক্ষমতার ভরসাতেই তো সব। এখানে ওর বন্ধুবান্ধবরা সবাই সচ্ছল ঘরের। ওর চালচলন, আবদারগুলোও সেইরকম হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার ক্ষমতা যে নেই এটা ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমি যে মার খেয়ে গেছি…

স্বামী-স্ত্রী নীরবে, পাশাপাশি। ভবিষ্যৎ ওদের অস্থির, কাতর ও ভীত করছে এবং অতীতকে সেইজন্যই বার বার এখন মনে পড়ছে, অথচ সেখানে তারা আর আশ্রয় নিতে চায় না। কেউ কারুর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে বর্তমান থেকে তাদের নিস্তার নেই।

বাবু কী বলছে?

ওর অত খাওয়া নিয়ে বাহানা নেই…কুকুরের পেট ভরলেই সন্তুষ্ট।

অরুণের মুখে পাতলা হাসি ভেসে উঠল। আড়চোখে দেখল বাণীও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এগারো বছরের বাবু আর সাত মাসের একটা স্পিৎজ বাচ্চা মিলে চমৎকার এক উৎপাত তৈরি হয়েছে। রাত্রে কুকুরটিকে বুকের কাছে নিয়ে ঘুমোয়, মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ার সময় টেবিলের নীচে বসিয়ে রাখে। স্নান করানো, ললাম আঁচড়ানো, সহবত শেখানো ইত্যাদি ওর নানান কাজের ব্যস্ততায় তারা মজা পায়, দিন দশেক আগেও স্পিৎজ বাচ্চার নাম ছিল বথাম, এখন হয়েছে কপিল। একসময় টারজান ও বেতালকেও সে সম্মানিত করেছে।

অফিসের লিফটম্যান হামিদ কোথা থেকে বাচ্চাটিকে এনে দিয়েছে সাড়ে চারশো টাকায়। সবাই বলেছে, খুব সস্তায় পেয়েছেন। তখন চব্বিশশো টাকা প্রতি মাসে দিয়ে যেত পরিতোষ। মাসিক আয়টা হঠাৎ দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাওয়ার জোয়ারে সংসারটা ফুলে উঠেছিল উচ্ছাসে। ক্রমশ সেটা থিতিয়ে গেল বটে কিন্তু উচ্ছাসের স্তর আর নামল না। এখন ওরা এই সচ্ছলতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

পরিতোষ তার নিজের ভাগনে। সরকারি অফিসের কেরানি। প্রথম যখন বলেছিল, অরুণ বিশ্বাসই করতে পারেনি।

দেওয়া যায় নাকি বছরে শতকরা আটচল্লিশ?

বাণী বলেছিল, হাজারে চল্লিশ টাকা মাসে? তার মানে?

দেওয়া যায় কি না-যায়, টাকা খাটাচ্ছে এমন লোকের কাছে যাচাই করে দ্যাখো। আমিই তোমায় মাসে মাসে সুদের টাকা দিয়ে যাব বাড়িতে।

দিন দশেক পর রাতে বিছানায় নীচু গলায় অরুণ বলেছিল, এবার টাকার দরকার হবে, এবার তোমার হেল্প চাই।

কীভাবে করব!

খরচ আরও কমিয়ে আনতে হবে। জমাতে হবে। ফ্ল্যাটের জন্য সোসাইটি পনেরো হাজার টাকা চেয়েছে, তিন মাস পর আরও দশ হাজার। এই বছরেই আমাকে মোট দিতে হচ্ছে। পঁয়ত্রিশ হাজার, ব্যাঙ্কে যা আছে তাতে হাজার তিরিশ পারব। তা ছাড়া অ্যাপেক্স থেকে লোন চল্লিশ হাজার, তারপর আরও দশ হাজার প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে তুলতেই হবে, ভেবেছিলুম ওখানে হাত দেব না, কিন্তু আর পাবই-বা কোথা থেকে। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে ওরা বলছে পঁচাশি হাজারে পারা সম্ভব নয়, তার মানে আবার টাকা চাইবে।

নতুন জায়গায় নতুনভাবে থাকতে হলে অনেক কিছু কেনার দরকার হবে, তাতেও তো অনেক টাকা লাগবে।

লাগবেই তো। এখানকার পুরোনো ভাঙা ছেঁড়া রংচটা জিনিসগুলো নিয়ে যাব ভেবেছ নাকি? বালিশ তোশক থেকে শুরু করে বাসন কোসন, পর্দা, চেয়ার, টেবিল, পাখা কত কী করাতে হবে।

গ্যাসের জন্য বলেছ?

হ্যাঁ, হয়ে যাবে। সেও হাজার-বারোশোর মতো পড়বে।

এত!

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাণী একগুঁয়ে গলায় বলেছিল, হোক, কয়লার উনুনে আর আমি রাঁধব না।

ওখানে কয়লার উনুন প্রহিবিটেড, কেরোসিন নয়তো গ্যাস।

ডাইনিং টেবিল ছাড়া চলবে না। দেবু আর বাবু আলাদা ঘরে থাকবে। খাট চাই, পড়ার টেবিল চাই।

ওসব পরে হবে, টাকা জমিয়ে জমিয়ে করাব।

আবার কষ্ট করে চলতে হবে?

উপায় কী? অ্যাপেক্সের ধারের টাকা কোয়ার্টারলি শোধ করতে হবে না? তারপর আসবে ট্যাক্স, ইলেকট্রিক, সোসাইটির চাঁদা, সব নিয়ে মাসে অন্তত পাঁচ-ছশো ধরে রাখতে পারো কিংবা তারও বেশি। মাইনের টাকা থেকে এতসব দিতে হলে…

আবার কষ্ট করতে হবে। জীবনে সুখের মুখ দেখা আর…

এসব কথা এক রাত্রে হয়েছিল। তার পরদিনই অফিস থেকে ফিরে অরুণ দেখল পরিতোষ তার জন্য অপেক্ষা করছে।

মামা কমিশনের টাকাটা তাহলে আমার কপালে আর নেই।

চট করে কি এসব করে ফেলা যায়।

কম করে রাখ…হাজার দশেক। মাসে চারশো টাকা…

কাল আসিস।

রাতে ওরা আবার আলোচনা করেছিল।

ওখানে গিয়েও কষ্ট করা, কী লাভ তাহলে ফ্ল্যাট কিনে। মানুষ উপরে উঠতে চায়, নীচের দিকে নামে না।

প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে হাত দেব না ভেবেছিলুম…আজ খোঁজ নিয়ে দেখলুম অফিসের সাত আট জন টাকা রেখেছে, জানতুমই না। হিমাংশুবাবুর ঝি পর্যন্ত চব্বিশ হাজার রেখেছে।

ঝিয়ের…চব্বিশ হাজার! এত?

ঝিয়ের ছেলে কারখানায় কাজ করত অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছল। দু-বছর ধরে কাঠখড় পুড়িয়ে হিমাংশুবাবুই কম্পেনসেশন চব্বিশ হাজার টাকা আদায় করে এনেছে। তারপর এখানে টাকা রাখার জন্য যা-কিছু করার সব করেছে, এখন সে-ঝি বস্তির ঘরে বসে মাসে মাসে প্রায় এক হাজার টাকা পাচ্ছে, ভাবতে পার? পনেরো টাকা মাইনের বাসনমাজা ঝি…

তুমি প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের সবটাই দাও।

বাণীর স্বরে তীব্রতা ছিল। সবটাই বরং বা সম্ভব হলে ধরনের দ্বিধা ছিল না। অরুণ পরদিন প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা তোলার জন্য দরখাস্ত করে। আড়াই মাস পর পরিতোষ একটা খাম দেয়, তাতে তার মাইনের থেকেও বেশি টাকা ছিল।

এখনও ইলেকট্রিক এল না, আজ কী সিনেমা আছে?

জানি না।

এখনও বৃষ্টি নামল না, ধানটান কেমন হবে কে জানে?

টিভিটা বিক্রি করে দাও।

অরুণ না শোনার ভান করল। বহু দূরের রাস্তা দিয়ে কয়েক জন মজুর মেয়ে-পুরুষ চলেছে। শাড়ির লালরংগুলো জমির মাটি ও গাছের পাতার মধ্যে চমৎকার সাম্যতা এনে দিয়েছে। এরকম কিছু-একটা তাদেরও থাকা উচিত ছিল, তাহলে লোভ সংবরণ করা যেত। অরুণ অবাক হল, লোভ শব্দটা এখনও বাণী বা সে ব্যবহার করেনি। হয়তো ভয়ে, কেননা তাহলেই ওটা ছোড়াছুড়ি হবে। তারা কেউই ঝগড়া করতে চায় না। এটা ঝগড়ার ব্যাপার নয়।

আমাদের খরচ কমাতে হবে। ভাবছি কাল থেকে আট টাকা হাতে নিয়ে বাজারে যাব। কুকুরের জন্য আর বাড়তি কেনা সম্ভব নয়।

ওতে আর ক-টাকা সাশ্রয় হবে।

যতটুকু হোক। এভাবেই কিছু কিছু করে ছাঁটতে হবে।

অরুণের চোয়ালে ও ঠোঁটে কাঠিন্য দেখে বাণী কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

কুকুরটাকে বিদেয় করলেই ভালো হয়।

বাবুর মনে লাগবে।

টিভিটা দরকার বাড়িতে সময় কাটাতে। আগে কী বিশ্রীই সন্ধে বেলাটা লাগত।

রাস্তা দিয়ে বাবা-মা দুই মেয়ের একটা পরিবার আসছে বসবাস-এর দিকে তাকাতে তাকাতে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর সারা বাড়িটাতে চোখ বোলাচ্ছে। কোনো ফ্ল্যাটে সম্ভবত ওদের আত্মীয় আছে। গেটের কাছে ওরা দাঁড়াল। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করছে।

তোমার জ্যাঠামশাইরা একদিন ফ্ল্যাট দেখতে আসবেন বলেছিলেন।

হ্যাঁ। সেই বেহালা থেকে আসা..জেঠিমার পক্ষে তিন-তলায় ওঠাও আর সম্ভব নয়। দীপু বলছিল বাংলাদেশ ধরার জন্য অ্যান্টেনায় কী-একটা লাগবে, এখানে অনেকেই লাগিয়েছে।

একদম নয়, কোনো খরচের মধ্যে আর যাওয়া নয়। দরকারটা কী? এভাবেই তো লোভেপড়ে…

অরুণ প্রায় অজান্তেই মুখ ফেরাল বাণীর দিকে এবং বাণীও ফেরাল তার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড দুজনের চাহনি বাঁধা রইল।

ওদের এবার বলতে হবে, এভাবে খরচ-টরচ করা আর সম্ভব নয়। শুধু বাজারই নয়, অন্যান্য ব্যাপারেও কমাতে হবে। অনেক কিছুই তো আমাদের আগে ছিল না।

তাহলে তুমিই ওদের বলে দিয়ো।

মেঝেতে টালি না বসিয়ে সিমেন্টের করালে হাজার ছয়-সাত বাঁচত।

আমি করাইনি, তুমি করিয়েছ।

বাণীর কষ শক্ত, গলায় ঝাঁজ। অরুণ অবসাদ বোধ করল। তারা ঝগড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরাম স্বাচ্ছন্দ্যর জন্য লোভী না হলে টাকাগুলো থাকত। বড়ো কষ্ট করে জমানো টাকা।

তখন অনেকেই বলেছিল গবরমেন্ট এ ব্যাবসা চালাতে দেবে না, কিছু-একটা করবে। বিশ্বাস করিনি। এত লোকের এত টাকা…

বাণীর কানে এসব কথা পৌঁছোল না। সে তখন ভাবছিল বসন্ত দাস স্ট্রিটের জীবনে আবার কী করে ফিরে যাবে? অন্ধকার ঝুলকালিভরা রান্নাঘর, শ্যাওলামাখা উঠোন কলঘর, ফোঁটা ফোঁটা কলের জল, হাজা ফাটা ঘরের মেঝে, দরদর ঘাম, ভ্যাপসা বিছানা, বালিখসা ভিজে দেয়াল, জানলার নীচে আস্তাকুঁড়, রাস্তায় দিনরাত বস্তির বাচ্চাদের চিৎকার, লাউডস্পিকার, বোমা নিয়ে খুনোখুনি..নানাবিধ গন্ধ-শব্দ-রং প্রাক্তন জীবন থেকে তালগোল পাকিয়ে হা-হা করে তার উপর আছড়ে পড়ছে এখন। প্রশস্ত, প্রশান্ত, আলোবাতাস-মাখানো জীবনের জন্যই সে যুদ্ধ করে গেছে। বসন্ত দাস স্ট্রিটে ফিরে যেতে হবে না ঠিকই। কিন্তু এই পরিসর, পরিচ্ছন্নতা, অবকাশ, নীরবতা পেয়েও হারাতে হবে। আবার কষ্ট আবার একটা যুদ্ধ। এখন মাইনের টাকাই সম্বল, তাই দিয়ে সব মেটাতে হবে। বাণী ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করল।

দরজায় ধাক্কা পড়ছে আর কুকুরের ডাক। বাবু ফিরেছে। বাণী দরজা খুলে দিতেই উত্তেজিত বাবু বলে উঠল, জান মা, কপিল আজ হাড় খেয়েছে। ওই যে চায়ের দোকানটা, বাসরাস্তায় ব্যাঙ্কের গায়ে টালির চাল-দেওয়া, ওর যে মালিক সে বলেছে মাংসের হাড়টাড় যা প্লেটে পড়ে থাকবে সব রেখে দেবে। আমাকে বলল একটা টিনের কৌটোমৌটো দিয়ে যেতে। স্কুল থেকে ফেরার সময় বাস থেকে ওখানে নেমে কৌটোটা নিয়ে বাড়ি আসব। আজ এই মোটা একটা হাড় ওকে দিয়েছিল, পারে নাকি চিবোতে! একটা লোক তখন মাংস খাচ্ছিল, একটা নরম হাড় ছুড়ে দিতেই ঝাঁপিয়ে কচমচ করে চিবিয়ে খেল, দাঁতে বেশ জোর হয়েছে। ঘিয়ের কত টিন রয়েছে তো, একটা দেবে? আমার সঙ্গে বলু আর প্রদীপ্ত ছিল, ওরা বলেছে ওদের যেদিন মাংস হবে কপিলের জন্য হাড়গোড় রেখে দেবে।

বাণী বকুনি দিতে গিয়েও দিল না। শুধু বলল, এঁটোকাঁটা ভিক্ষে করে ক-দিন খাওয়াবে, তার থেকে ওকে বরং বিদেয় করাই উচিত।

কথাটা এতই হাস্যকর যে বাবু গ্রাহ্যে না এনে বলল, আচ্ছা, সব ফ্ল্যাটে গিয়ে যদি কপিলের জন্য রাখতে বলি? তাহলে নিশ্চয় এক বালতি হয়ে যাবে। অত খেতে পারবে না।

কুকুরটা ঘুরঘুর করছিল ঘর-বারান্দা। কয়েক বার ওকে মেঝে শুকতে দেখে বাবু ধমকে উঠল, না না এখানে নয়, বাথরুমে।

সে নিজে বাথরুমের ভিতরে গিয়ে ডাকতে লাগল, কাম কাম।

বাণী বারান্দায় আসতেই অরুণ মুখ না ফিরিয়ে বলল, সিগারেট ছেড়ে দেব, শ-খানেক টাকা সেভ হবে।

বাণী নিরুত্তর রইল। বাথরুমের থেকে বাবুর নির্দেশ শোনা যাচ্ছে: নো নো, এইভাবে এইভাবে বোসো। মার খাবে কিন্তু বলছি…

দূরের বাড়িগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। লোডশেডিংয়ের জন্য কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে। কিছু কাক ডাকাডাকি করে চুপ করে গেল। একটু পরে আলো জ্বলে উঠতেই ওরা ঘরে এসে বসল টিভিতে সিনেমা দেখার জন্য।

দু-দিন পর রান্নাঘরের সিঙ্কের নীচে একটা টিনে কিছু হাড় মাছের কাঁটা দেখে অরুণ ব্যাপারটা জানতে চায় এবং বাণী জানায়।

এইভাবে বাইরে থেকে চেয়ে আনলে লোকে ভাববে আমাদের বোধ হয় মাছ-মাংস খাওয়ার পয়সা নেই। এসব বন্ধ করো।

বাচ্চা ছেলে চেয়ে আনছে, এতে কে আর মনে করবে?

পরদিন বাণীকে সকালে ঘর মুছতে দেখে অরুণ প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না। বাণী নিজেই বলল, সামান্য কাজের জন্য মাসে পঞ্চাশ টাকা করে দেওয়া…ছাড়িয়ে দিলুম। একটু খাটাখাটনি না করলে বাত ধরে যাবে।

সেই দিনই রাতে দেবু খাওয়ার টেবিলে হাত গুটিয়ে বসল।

রোজ রোজ দু-বেলা এই ডাল-ভাত, ভাত আর তরকারি ভালো লাগে? একটা ভাজা পর্যন্ত নেই, মাছ নেই।

ভালো না লাগলে খেয়ো না। মাসে চার কিলো সর্ষের তেল খরচ হয় এই কটা লোকের জন্য! এবার থেকে দু-কিলোর বেশি আর কিনব না। আগে তো এইরকমই রান্না হত, তখন মুখে রুচত কী করে?

গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে দেবু উঠে গেল। বাণী কষ্ট পেল এইভাবে কথা বলার জন্য। এখানে আসার পর এই প্রথম বসন্ত দাস স্ট্রিটের কণ্ঠস্বর তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।

টেপরেকর্ডারে বিলিতি বাজনার সুর বাজছে নীচু স্বরে। মাস ছয়েক আগে দেবুকে কিনে দিয়েছিল অরুণ। বাণী ঘরে ঢুকতেই দেবু বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে উপুড় হল। ঘরের অন্য কোণে খাটে বাবু ঘুমোচ্ছে। কুকুরটা তার পায়ের কাছে। বাণীকে দেখে এক বার মুখ তুলেই আবার কুন্ডলী পাকাল।

তোকে একটা কথা বলা দরকার।

সে ঠিক করেই ফেলেছে তাদের অবস্থা এবং ক্ষতির কথাটা দেবুকে এবার বলা দরকার। বয়স প্রায় আঠারো, বুঝতে পারবে।

বাণীর মাত্র দু-মিনিট লাগল দেবুকে বিস্ময়ে উঠে বসাতে।

বাবা ওখানে টাকা রেখেছিল। ও আর ফেরত পাবে না। আমার ক্লাসের এক বন্ধুর বাবার তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

এরপর বাণী দেখল কৈশোরের প্রান্ত থেকে দেবুর তাজা মুখটা ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পৌঁছে যাচ্ছে। কুঁজো হয়ে কাঁধ ঝুকিয়ে স্তিমিত দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। ও রেগে উঠল না, কিছুটা যেন উদাসীন হয়ে পড়েছে। সে ভেবেছিল অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে ছেলেকে, কেন তাদের টেনেটুনে চলতে হবে এবং কেন ভবিষ্যতেও কিছু রেখে যাওয়ার আর উপায় নেই এই ফ্ল্যাটটি ছাড়া।

কিন্তু কিছুই বলার দরকার হল না। খবরের কাগজে পড়েছে নিশ্চয়, শুনেছে অনেক। তবে প্রথমেই বলে উঠেছে মাথা খারাপ হওয়ার কথা কেন?

আমাদের এখন অন্যভাবে চলতে হবে, বুঝতেই তো পারছিস।

বাণী এইটুকু বলে বারান্দায় এল। ইজিচেয়ারে গল্পের বই পড়ছে অরুণ। বইটা হাতে-ধরা, চোখ সামনের অন্ধকারে। একটু ত্ৰস্তে সে বইটায় চোখ ফেরাল।

দূরের জানালার আলো কী সুন্দর লাগে দেখতে।

দেবুকে বলেছি।

কী বলল? কীভাবে নিল?

বাণী মাথা নাড়াল। অরুণ উদবিগ্ন চোখে সিধে হয়ে বসল।

ওর এক বন্ধুর বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

তার মানে আমার হতে পারে…পাগল!

অরুণ হাসতে শুরু করল। হাসিটা যখন টানার ক্ষমতা হারিয়ে থেমে গেল তখন বলল, হিমাংশুবাবুর সেই ঝি কী বলে বেড়াচ্ছে জান? বাবু-ই তার টাকা মেরেছে, কাগজপত্তরে সই করিয়ে লিখিয়ে নিয়ে এখন বাবু বলছে কোম্পানি ফেল করেছে। ঝি রোজ এসে কান্নাকাটি, গালাগালি, শাপশাপান্ত করছে। হিমাংশুবাবুর অবস্থাটা ভাবো। ওর তো পাগল হওয়ার কথা, হয়নি।

নিজের টাকা গেলে হত।

অরুণ বইটা আবার চোখের সামনে তুলল। পার্কের থেকে ঝিঝিপোকার ডাক আসছে। দূরে হর্ন দিল ইলেকট্রিক ট্রেনের ইঞ্জিন। দেবু আবার টেপরেকর্ডার চালিয়েছে। বাণী বারান্দার কোনায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।

পর্দাটা সরানো। ঘরে অনেক সুবেশ নারী ও পুরুষ কোনো কারণে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে, অনেকের হাতে প্লেট। হঠাৎ দমকা সমস্বরে হাসি, চেঁচিয়ে ওঠা একক কণ্ঠ, উজ্জ্বল আলো, টেবিলে রজনিগন্ধার গোছা। এইসবের মধ্যে বাচ্চাটিকে সে দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবাকে বার দুয়েক দেখা গেল ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবিতে। একেবারে অন্য চেহারা; গলায় মোটা বেলফুলের মালা, কপালে চন্দনের ফোঁটা, বরের মতো লাগছে। হয়তো বিবাহবার্ষিকী কিংবা জন্মদিন।

বাণী মুখ ফিরিয়ে অরুণের দিকে তাকাল। দেবুর বন্ধুর বাবা পাগল হয়ে গেছে। সে আরও নিবিষ্ট হয়ে দেবুর বাবার দিকে তাকাল। একইরকম মনে হচ্ছে, বসন্ত দাস স্ট্রিটেরই লোকটা।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বাণীর। দালানে আলো জ্বলছে। ঘরের খোলা দরজা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে অরুণ দাঁড়িয়ে। তাকাচ্ছে এধার-ওধারলাইম পানিংয়ের শঙ্খ মসৃণ দেয়ালে হাত বুলোল, উবু হয়ে মার্বেলাইট টালির মেঝেয় হাত বুলোল, হাত বাড়িয়ে পর্দাটা মুঠোয় ধরে অনেকক্ষণ নকশার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রেফ্রিজারেটর, ডাইনিং টেবিল, টিভি সেট, পপার্সেলিনের বেসিন, ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ড ছুঁয়ে ছুঁয়ে আনমনে দালানটায় ঘুরতে লাগল। এক বার রান্নাঘরের দরজা খুলে পাথরের টেবলের উপর নিকেলের ঝকঝকে হটপ্লেটের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। এরপর সে দালানের মাঝে দাঁড়িয়ে আবার প্রত্যেকটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার দু-চোখে অবিশ্বাস, সন্দেহ।

কয়েক দিন পর দেবু জানাল সে একটা টিউশনি পেয়েছে, ক্লাস থ্রি-র ছাত্র, ষাট টাকা মাইনে।

শুনে অরুণ বলল, স্বাবলম্বী হওয়াই তো উচিত, তোর বয়সেই আমি রোজগারে নেমেছি, তবে নিজের পড়ার যেন ক্ষতি না হয়।

বাণীকে সে বলল, আর বছর দশেক, তারপর এই ফ্ল্যাটের জন্য যা-কিছু ধারদেনা ওকেই তো টানতে হবে। অবশ্য আমি মরে গেলে অ্যাপেক্সের টাকাটা আর দিতে হবে না, ইনশিয়ার করানো আছে।

একথা শুনে বাণী বা দেবু কোনো মন্তব্য করল না। রাতে চাপা গলায় বাবু জানতে চায়, যাট টাকা নিয়ে কী করবি রে দাদা?

পড়ার ব্যাপারে আর বাবার কাছ থেকে কিছু পোব না।

কপিলের জন্য একটা চিরুনি কিনে দিবি?

দোব, ওর নামটা এবার বদলা।

প্রবল বৃষ্টিতে বাস চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ায় অরুণ জল ভেঙে ভিজতে ভিজতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরল। কয়েক দিন সর্দিজ্বরে ভুগে অফিসে গিয়েই শুনল কাজ করতে করতে হিমাংশুবাবুর বুকে ব্যথা ওঠায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখানে সিট না পাওয়ায় নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে। অফিসেরই খরচে। অরুণ জেনে নিল নার্সিং হোমটা বসবাস-এর কাছেই। অফিসের অনেকেই দেখে এসেছে।

টেবিলে মাথা রেখে অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছল..স্ট্রোক হয়নি, হাই ব্লাডপ্রেশার আছে, দুশ্চিন্তায় ভাবনায় এইসব হয়। ভাবলুম এক বার দেখে আসি কিন্তু মাঝপথে আর নামতে ইচ্ছে করল না, রোববার দেখে একদিন যাব।

বাণী মৃদু উদবেগ বোধ করল। ব্লাডপ্রেশার অরুণের আছে তবে নীচুর দিকে। বন্ধুর বাবা সম্পর্কে দেবুকে প্রায়ই সে জিজ্ঞাসা করে। ইতিমধ্যে বসবাস-এর এক সদস্য ক্যানসারে মারা গেলেন। দীর্ঘদিনই ভুগছিলেন। বাকি উনচল্লিশ ফ্ল্যাটের লোকেরা ব্যাপারটা প্রায় লক্ষই করল না। শুধু চার তলার দুই বারান্দার মধ্যে কথাবার্তার টুকরো বাণীর কানে এল— …পুরো টাকাটাই তো উনি দিয়ে দিয়েছেন। যদি না দিতেন এখন আর শশাধ করার দরকার হত না, কত হাজার টাকা তা হলে রাখতে পারতেন ভাবুন তো! …উনি তো ঠাট্টা করে বলেন, এখন যদি মরে যাই ইনশিয়োরেন্সই শোধ করবে, হাজার চল্লিশ বেঁচে যাবে।

খরচ কমাবার জন্য বাণী পরের সাত দিন একের-পর-এক ব্যবস্থা নিল। ট্রানজিস্টরের ব্যাটারি ফুরিয়েছে কেনা হয়নি; লন্ড্রিতে আর কিছু যায় না, সবই নিজে কাচছে; ফিরিওয়ালা ।দেখলেই মাথা নেড়ে দরজা বন্ধ করে দেয়; অরুণের দূরসম্পর্কের কাকার মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়েও তারা যায়নি, তাতে অন্তত একশো টাকা বেঁচেছে; জানালার কাচ বাবু ভাঙল কিন্তু বদলায়নি; জিরজিরে তোয়ালে দুটো আর বদল না করলেই নয়, গামছা কিনল। চা কিনেছে অর্ধেক দামের। তার এই ব্যয়সংকোচন চেষ্টার কোনো প্রতিবাদ উঠল না সংসারে বরং ঠাট্টা করেই দেবু বলল, লোডশেডিং মাকে অনেক সাহায্য করছে ইলেকট্রিক বিল কমিয়ে দিয়ে।

আগের মতোই সাজানো গোছানো অথচ কোথায় যেন একটা ফাটল, যেখান থেকে প্রাণরস চুইয়ে চুইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অরুণ অনুভব করে, বাণীও সেটা জানে। সবাই কথা কম বলে। রুটিন মাফিক কাজগুলো হয়ে যাচ্ছে, অযথা অকারণ কিছু নেই। শুধু কুকুরটার চেঁচামেচি, ছোটাছুটি জিইয়ে রেখেছে মরে আসা উচ্ছাসকে। বাবু তার কপিলের জন্য হাড়গোড় উচ্ছিষ্ট জোগাড় করে আনছে। বসবাস-এর ছেলেরা পিকনিকে যাবে, সে দশ টাকা চেয়েছিল কিন্তু বাণী দেয়নি। ওর মুখ তখন যে-কষ্ট বাণীকে দিয়েছিল সেটা অরুণও পেয়েছে, কেননা তারপর বাবু চুপিচুপি তার কাছেও চেয়েছিল। সেও প্রত্যাখ্যান করে। তখন অরুণের মনে হয়েছিল, তারা যেন বাড়াবাড়িই করছে। তাদের কোনো অধিকার নেই সন্তানদের পীড়ন করার। মানুষ উপরেই উঠতে চায়, নীচের দিকে নামে না, কথাটা তাকে উত্তেজিত করেছিল। কিন্তু এই কি উপরে ওঠা?

কারণটা খুঁজতে খুঁজতে প্রতিবারই সে একটা কানাগলির দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আর বাণী দুজনেই সমান দায়ী, যে-কারণে তারা আর এই মার খাওয়ার প্রসঙ্গ তোলে না, নীরবে প্রাক্তন জীবনে ফিরে যাচ্ছে মুখ নামিয়ে। বারান্দায় বসে গাছ, পাখি, প্রজাপতি, ঘুঘুর ডাক, ধু-ধু মাঠ বা তৈরি-হওয়া বাড়ি কি মাটির গন্ধ এখন তার ভালো লাগে না। এসব শুধুই জড়বস্তু, ওদের কাছ থেকে কিছুই ফিরে আসে না। রোববার হিমাংশুবাবুকে এক বার দেখতে যাব। এই বলে অরুণ খাবার টেবিল থেকে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে লাগল।

আগেই যাওয়া উচিত ছিল। আমিও বরং তোমার সঙ্গে যাব। অসুস্থ মানুষ, লোকজন দেখলে মনটা ভালো থাকবে।

তাহলে আমিও যাব। বাবু বলে উঠল। আমি কখনো হাসপাতাল দেখিনি।

নার্সিং হোম, তফাত আছে হাসপাতালের সঙ্গে।

ওরা তিন জন রবিবার বেরোল। দেবু তার বন্ধুর বাড়ি গেছে। ফিরবে সন্ধ্যার পর। বারান্দায় কুকুরটিকে বেঁধে দরজায় চাবি দিয়ে ওরা রওনা হল। বাসে মিনিট পাঁচেকের পথ। ফাঁকা চওড়া নতুন রাস্তা। হু হু করে বাস যায়।

অরুণ অফিস থেকে ঘরের নম্বরটা জেনেই এসেছিল। হিমাংশুবাবু বিছানায় বসে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। অরুণের থেকে বয়সে কিছু ছোটো, শীর্ণ, চুলের অর্ধেক পাকা। লম্বাটে মুখে গভীর কয়েকটা ভাঁজ, শান্ত চোখ। খাটের পাশে টুলে বয়স্ক একটি লোক বসে।

অরুণদের দেখে হিমাংশু হাসল।

জানালা দিয়ে দেখেছি আপনারা আসছেন। ..খা.টের উপরই বসুন, টুল ওই একটাই।

আমার স্ত্রী আর ছোটোছেলে বাবু, আছেন কেমন?

ইতিমধ্যে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে টুলটা ঠেলে দিয়েছে বাণীর দিকে।

আমার মেজো ভাগনে,…ভালোই আছি। একটা অ্যাটাক হয়েছে, ফাস্ট, তবে আমাকে ডাক্তাররা কিছু বলছে না। না বললেও বুঝতে ঠিকই পারি। অফিস থেকে মাঝে মাঝে ওরা আসে, আজ বউ আসেনি ওরও শরীরটা খারাপ,…রোজ রোজ আসতে কি ভালো লাগে কারুর, নবদম্পতি তো নয়।

হিমাংশুবাবু অবশ্য খুব জোরে হাসবার চেষ্টা করল না। অরুণ জানালা দিয়ে দেখল আকাশের একদিকে ঘন মেঘ দ্রুত আর একদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিন এই সময় কালববাশেখির মতো ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে।

খুঁটিয়ে ঘরের জিনিসগুলো লক্ষ করার পর বাবু গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাণী কয়েকটা মামুলি কথা বলল। এক নার্স এসে হিমাংশুবাবুকে ক্যাপসুল খাইয়ে গেল। তারা পাঁচ টাকার সন্দেশ কিনে এনেছিল। বাক্সটা খুলে হিমাংশুবাবু ডাকল বাবুকে। সে ইতস্তত করে বাবা-মার দিকে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছা নেই কিন্তু অসুস্থ লোকটি খুশি হবে ভেবে বাণী মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ওর ভাগনে আকাশের দিকে আড়চোখে বার কয়েক তাকিয়ে বিদায় নিল।

আপনার সেই ঝিয়ের খবর কী? বলেছিলেন রোজ খুব উৎপাত করে। এখানে কটা দিন তাহলে শান্তিতেই ছিলেন বলুন?

হিমাংশুবাবু বার কয়েক জানালা দিয়ে আকাশে তাকাল। কপালের কুঞ্চন ঝিয়ের অথবা আসন্ন ঝড়-বৃষ্টির জন্য কি না বোঝা গেল না।

উৎপাত ঠিক নয়…আসলে দায়ী তো আমিই। ওকে টাকা রাখতে আমিই পরামর্শ দিয়েছি। অশিক্ষিত, গরিব অসহায়…মরাল রেসপন্সিবিলিটি তো এড়াতে পারি না। মাসে মাসে দুশো করে টাকা দিয়ে শোধ করব, দু-মাস দিয়েছিও।

অরুণ ও বাণী বহু দূরে চমকানো বিদ্যুৎ ও নির্ঘোষের ফলে নিশ্চয় এই রকম বোধরহিতের মতো তাকিয়ে থাকল না।

আপনি টাকা শোধ করবেন? চব্বিশ হাজার!

বাণী তার সঙ্গত বিস্ময় প্রকাশ করল। অরুণও যোগ দিল।

হয় নাকি। এত বছর ধরে কষ্ট করে..ধ্যাত। এ আপনার বাড়াবাড়ি।

হিমাংশুবাবু তার শীর্ণ আঙুলগুলো দিয়ে নিজের দুই গালে চেপে ঝুঁকে বসল বালিশ কোলে নিয়ে।

আই ওয়ান্ট টু এনজয় মাইসেলফ। নিজেকে আনন্দে ডুবিয়ে রাখতে চাই অরুণবাবু। আমাকে অবশ্যই বাঁচতে হবে আরও কিছু বছর…

চব্বিশ হাজার শোধ না হওয়া পর্যন্ত।

চব্বিশ নয়, আর একটু কম। মাস ছয়েক পেয়েছে তো, সেটা বাদ যাবে।

বৃষ্টি হতে পারে নাও হতে পারে এমন এক পরিবেশের মধ্যে ওরা বাস স্টপে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারটা প্রায় সন্ধ্যার মতো। দুটো বাস এসে চলে গেল, তাদের গন্তব্যের নয়।

আর দেরি করা নয়, এবার যেটা আসবে উঠে পড়ব, কাছাকাছি তো পৌঁছোনো যাবে।

অরুণ কথাটা শেষ করামাত্র একটা বাস এল। অন্য দিকে যাবে, তার মোড় ঘুরবে যেখানে, বসবাস হেঁটে সেখান থেকে মিনিট চারের পথ। ওরা উঠল। টিপ টিপ বৃষ্টি, এলোমেলো হাওয়ায় মাছির মতো উড়ে ওদের গায়ে বসল বাস থেকে নামামাত্র।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে ভিজে যাবে, একটু জোরে হাঁটো।

গতি দ্রুত করতে গিয়ে বাণীর জীর্ণ চটির স্ট্র্যাপ ছিড়ল। হাতে তুলে নিল।

বরং পাশের এই মাঠটা দিয়ে…

অরুণকে অনুসরণ করে বাণী ও বাবু মাঠে নামল।

বৃষ্টি আসছে কেমন দ্যাখ।

মাঠের ওপারে বহু দূরে গাছপালা বাড়ির ঝাপসা পর্দা ঝুলছে।

বাণী সেদিকে তাকিয়ে চলতে চলতে হোঁচট খেল।

এগিয়ে আসছে, আমাদের ধরে ফেলবে।

বাবা দ্যাখো।

তীক্ষ্ণ তীব্র স্বরে ওরা দুজন থমকে দাঁড়িয়ে বাবুর তোলা হাতের নির্দেশের দিকে তাকাল। দূরে বসবাস দেখা যাচ্ছে। আধো অন্ধকারে জমি গাছপালা আকাশের মাঝখানে ফিকে কমলা রঙের চৌকো একটা বাড়ি। রুপালি-রেলিং-ঘেরা ছোটো ছোটো বারান্দা। বন্ধ কাচের জানলায় ঘরের আলো। অ্যান্টেনাগুলো শীর্ণ আঙুল মেলেছে আকাশের দিকে ভিক্ষুকের মতো। একটি মানুষও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অরুণ অবাক হয়ে ভাবল, এমন করে তো বাড়িটাকে দেখিনি, অদ্ভুত তো।

কপিল কপিল। বাবা বারান্দায় কপিলকে দ্যাখো, নাচছে।

ক্ষীণভাবে ভেসে আসা কুকুরের ডাক যেন ওরা শুনতে পেল। বাবু দৌড়োচ্ছে।

গলিত সুখ

আমি এখন করব কী তুই বল।

কথাটা দ্বিতীয় বার সে বলল, পূর্ণিমা মুখ নীচু করে ফুটন্ত দুধে হাত নেড়ে যাচ্ছে মন দিয়ে। জবাব না দিয়ে শুধু জ্ব কোঁচকাল। এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে সে জ্যোতির দাম্পত্য বিপর্যয়ের কথা শুনে যাচ্ছিল।

তুই আমার শোবার ঘরে গিয়ে একটুখানি বস আমি এই দুধটা…ছেলে পায়েস খেতে চেয়েছে, এই হয়ে এল।

তুই বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছিস। ফোনে অবিরত ঘ্যানঘ্যান করি, আবার বাড়িতে এসেও সেই একই কথা বলে জ্বালাচ্ছি। কিন্তু তুই ছাড়া আর আমার কে আছে যাকে এসব কথা বলতে পারি! বল কাকে বলব, কাকে শোনাব, কাকে এভাবে জ্বালাতন করব? জ্যোতির স্বর অনুপ্তের মতো, কান্নাভেজা এবং গভীর দুঃখ ও অসহায়তা প্রসূত।

হয়েছে তোকে আর ফরম্যাল হতে হবে না। একশো বার জ্বালাতন করবি। পূর্ণিমা হালকা ধমক দিল। যা ঘরে যা।

ওরা স্কুলজীবন থেকেই বন্ধু। প্রায় বাইশ বছরের বন্ধুত্ব। একসঙ্গে কলেজেও পড়েছে। বুদ্ধি বিবেচনায় পূর্ণিমার থেকে জ্যোতি কিছুটা দুর্বল। এটা সে জানে বলেই পূর্ণিমার যুক্তি পরামর্শ মেনে সে চলে। শুধু এক বার ছাড়া সে আর কোনো ব্যাপারে পূর্ণিমার কথা অগ্রাহ্য করেনি এবং সেই ব্যাপারটাতেই সে ঠকে গেছে। প্রসাদকে বিয়ে করেছিল পূর্ণিমার বারণ সত্ত্বেও।

ওরা দুজনই একসঙ্গে গান শিখতে যায় সঙ্গীতা নামে এক গানবাজনা শেখাবার স্কুলে। সেখানে আধুনিক গান শেখাত প্রসাদ ঘোষ। তখন সে জনপ্রিয়তার প্রথম ধাপে, এখনকার শীর্ষস্থানীয়দের একজন হিসেবে গণ্য হত না। চারখানি রেকর্ড বেরিয়েছে, একটি ফিলমে একখানি মাত্র গান গেয়েছে এবং সেটি হিট করেছে। প্রসাদ গৌরবর্ণ, হৃষ্টপুষ্ট, হ্রস্বাকৃতি, দেখতে পুরুষালি নয়, নারীসুলভ কোমল লাবণ্য তার মুখে এবং দেহের গড়নেও। কথায় ও ব্যবহারে বিনীত, মৃদুভাষী। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় দৃষ্টি বেশিক্ষণ মুখে নিবদ্ধ রাখতে পারে না।

জ্যোতি একটা গানের অনুষ্ঠানে প্রসাদকে দেখে এবং দেখামাত্র ভালো লেগে যায়। গান তো আগেই ভালো লেগেছিল। খোঁজ করে জানল প্রসাদ গান শেখায় সঙ্গীতায়। বাড়ি থেকে হেঁটে দশ মিনিট, পূর্ণিমার সঙ্গে গিয়ে সে ভরতি হল আধুনিক গানের ক্লাসে। জ্যোতির গানের গলা ভালো তবে প্রথাবদ্ধভাবে শেখেনি। রেকর্ড বা রেডিয়ো থেকে শুনে গলায় তুলে নিত। জ্যোতিকে দেখতেও ভালো। হালকা তসরের মতো ত্বক, চোখা নাক, পানের মতো আকৃতির মুখ এবং সুঠাম দেহ। প্রথমদিন ক্লাস করেই সে মুগ্ধ হল এবং প্রসাদকে আরাধ্য করল।

যেসব ফাংশনে প্রসাদ গান গাইতে যেত জ্যোতি টিকিট কেটে সেখানে গিয়ে বাইরে এমনভাবে অপেক্ষা করত যাতে গাড়ি থেকে নেমেই প্রসাদ তাকে দেখতে পায়।

একবার প্রসাদ তাকে দেখতে পেল। কী ব্যাপার? জ্যোতি লাজুক স্বরে বলল, আপনার গান শুনব বলে এসেছি।

প্রসাদ বলল, আমার গান না মান্নাদার গান?

জ্যোতি ব্যস্ত হয়ে প্রতিবাদ করেছিল, না না শুধু আপনার গানই। দেখবেন আপনার গান শেষ হলেই হল থেকে বেরিয়ে যাব, আর কারুর শুনব না। কিছু লোক প্রসাদকে ঘিরে তখন দাঁড়িয়ে। তারা হেসে উঠল। লজ্জায় রাঙা হয়ে প্রসাদ বলে, চলো, ভেতরে চলো।

জ্যোতি মাথা নেড়ে বলে, টিকিট কেটেছি অডিয়েন্সের মধ্যে বসে আপনার গান শুনব বলে। ওদের রিঅ্যাকশনও আমার ভালো লাগে।

প্রসাদ গান গেয়ে বেরিয়ে এসে দেখে জ্যোতি দাঁড়িয়ে। তাকে মোটরে বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় প্রসাদ বলেছিল, তোমার গলা তো ভালো, ফাংশনে গাইতে চাও যদি তাহলে একদিন নয়, রোজ বসতে হবে, এটা সাধনার ব্যাপার।

কুষ্ঠিতভাবে জ্যোতি বলে, একা একা রেওয়াজ করতে ভয় করে, ভুলভাল হলে শুধরে দেবে কে?

প্রসাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, সকালে আমি বাড়িতে আলাদা করে শেখাই।

তার কথা শেষ হওয়া মাত্র জ্যোতি বলেছিল, জানি। আমাকে শেখাবেন? ঘাড় নেড়েছিল প্রসাদ।

ব্যাপারটা পূর্ণিমাকে জানিয়েছিল। শুনে সে বলেছিল, একা এক জনকেই শেখায় না আরও অনেকে থাকে?

জ্যোতি চোখ সরু করে তীব্র স্বরে বলে, তোর সন্দেহ করার একটা বাতিক আছে। যদি একা শুধু আমাকেই শেখায় তাতে হয়েছে কী? পূর্ণিমা শান্ত স্বরে বলেছিল, কিছুই হবে না। পরে কপাল চাপড়াবি!

এরপর ওদের বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি। তবে প্রসাদ এবং গান নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে সে আর কথা বলত না। একদিন পূর্ণিমা বলল, সালকেয় সেজদিদের পাড়ার ফাংশনে তুই গান গেয়েছিস? কই আমাকে তো বলিসনি? জ্যোতি অপ্রতিভ হয়ে বলে, প্রসাদদার কান্ড। ভয়ে তোকে বলিনি, কী জানি বাবা প্যাঁক দিয়ে যদি তুলে দেয়! চেনাশোনা বন্ধুবান্ধবদের সামনে হলে লজ্জাটা বেশি করবে বলে তোকে আর বলিনি। এবার কোথাও গেলে তোকে বলব, যাবি তো? প্রশ্নটা এড়িয়ে পূর্ণিমা বলেছিল, প্রসাদ ঘোষ তাহলে তোকে চান্স করিয়ে দিচ্ছে? জ্যোতি অবাক হয়ে বলে, বাঃ, আমার নিজের কি কোনো নামডাক আছে নাকি যে যেচে ফাংশনে ডাকবে!

জ্যোতি কলকাতার মধ্যে এবং কাছাকাছি অনেক জায়গায় প্রসাদের সঙ্গে গিয়ে গান করেছে কিন্তু পূর্ণিমাকে এক বারও বলেনি। কিন্তু পূর্ণিমার কানে খবর ঠিকই এসেছে। সে আবার একদিন বলল, আমার কাছে লুকোচ্ছিস কেন, আমি তো সবসময় তোর ভাললাটাই চাই। তুই প্রসাদ ঘোষের সঙ্গে এখানে-ওখানে গেয়ে বেড়াচ্ছিস, তোর নামটাম হলে আমার তো আনন্দই হবে। কিন্তু আমাকে কিছু আর কেন বলিস না.প্রেম করছিস? জ্যোতি উদ্ধত ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছিল, আমি! ওর সঙ্গে প্রেম আমি করছি না প্রসাদ করছে আমার সঙ্গে। পূর্ণিমার বিস্ফারিত চোখ দুটি তখন জ্যোতিকে গর্ব এবং অহংকারের চোরাবালির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কথাটা বলে সে যে তৃপ্তি পেয়েছে সেটা আরও গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জ্যোতি তারপর বলেছিল, আমার শরীরে কটা তিল আছে আমি জানতুম না, প্রসাদ গুনে বলে দিয়েছে। মর্মাহত পূর্ণিমা বিড়বিড় করে বলেছিল, এটা বাড়াবাড়ি। এতটা ভালো নয়, তোকে কপাল চাপড়াতে হবে। জ্যোতি একগাল হেসে জবাব দেয়, তাহলে তোর কাছে এসেই চাপড়াব।

এর দশ বছর পর পূর্ণিমার নতুন বাড়িতে একদিন দুপুরে হাজির হয়ে জ্যোতি বলে, তোর কথাই সত্যি হল পুনি, আমি কপাল চাপড়াতেই এসেছি রে।

জ্যোতির বিয়ে হয়েছিল রেজেষ্ট্রি করে। সাক্ষী হবার জন্য সে পূর্ণিমাকে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু সে রাজি হয়নি। বরং জিজ্ঞাসা করেছিল, লোকটাকে ভালো করে চিনেছিস, বুঝেছিস তো? জ্যোতি বলেছিল চেনা বোঝার কী আছে, ওসব হবে বিয়ের পর। একসঙ্গে বসবাস না করলে কি চেনা বোঝা হয়?

সেই কথা তুলে জ্যোতি দশ বছর পর বলেছিল, আমি বরাবরই বোকা রে। তোর কথা আমার শোনা উচিত ছিল। তখন পাগলের মতো হয়ে গেছলাম। ওর গান, ওর খ্যাতি, ওর চেহারা সব আমি দখল করব, সব আমার তাঁবে থাকবে, লোকেরা এসে আমায় খোশামোদ করবে, এইসব ভেবে মাথা ঘুরে গেছল। এখন ও অন্যরকম হয়ে গেছে। দু-হাতে টাকা কামায়, বম্বেতে প্লেব্যাক করতে তো যাচ্ছেই, ইংল্যাণ্ড আমেরিকা কানাডাও ঘুরে এল। আমিও ওর সঙ্গে গেছি।

তাহলে তো সুখেই আছিস!

না।

তাহলে…আর তোকে ভালোবাসে না?

না।

অন্য আর কেউ?

হ্যাঁ। ওর এক ছাত্রী। ইতস্তত করে জ্যোতি বলেছিল, ওর সঙ্গে সঙ্গেই সব জায়গায় যায়, বম্বেতেও গেছল।

কেন, প্রসাদ ঘোষের ক-টা তিল আছে গোনার জন্য?

জ্যোতি ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থেকেছিল। বিদ্রুপটা হঠাৎই মুখ থেকে বেরিয়ে আসার অনুতপ্ত পূর্ণিমা সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিকে বুকে টেনে নিয়েছিল। ফুঁপিয়ে উঠে জ্যোতি বলে এখন আমি কী করব রে পুনি? আমি তো বউয়ের যা-যা করার সবই করি, তবে এমন কেন হল? ও বলল, গান করা ছাড়ো তোমার দ্বারা হবে না। আমি গান ছেড়েদিলুম। বলল মন দিয়ে ছেলে–মেয়েদের মানুষ করো। তাই করছি, এখন এইটেই আমার কাজ। কিন্তু..।

কিন্তু আবার কী, তোকে কি ডিভোর্স করবে বলেছে?

না। কিন্তু করলেই মনে হচ্ছে বেঁচে যাই।

পূর্ণিমা উঠে গেল চা করার জন্য। জ্যোতি একা বসে ঘরের সর্বত্র চোখ বোলাল। মেঝেয়, বিছানায়, দেয়ালে, সিলিঙে যেখানেই দৃষ্টি রাখল কেমন যেন একটা শক্তির আর নিরাপত্তার, যত্নের আর মমতার বাঁধন নড়েচড়ে উঠল। পূর্ণিমার স্বামী জনপ্রিয় নামকরা কেউ নয়। খুব বেশি লেখাপড়া করেনি। কিন্তু মনের সুখ আছে এই সংসারে। বিষগ্ন বোধ করে সে রাস্তার দিকে বারান্দায় বেরিয়ে আসে।

পূর্ণিমার বাড়িটার বয়স ছয় মাসও নয়। তার স্বামী কাঠের ব্যবসায়ী। জ্যোতির এক বছর পর বিয়ে হয়ে পূর্ণিমা অসমে স্বামীর সঙ্গে চলে যায়। দুজনের মধ্যে যোগাযোগটা পত্র মারফত ক্ষীণভাবে ছিল। দশ বছর পর কলকাতায় ফিরে এসে পূর্ণিমাই টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে নম্বর বার করে ফোন করেছিল জ্যোতিকে।

কলকাতার উপকণ্ঠে ইস্টার্ন বাইপাসের কাছাকাছি সদ্য গড়ে-ওঠা এই বসতিটায় বাড়ির সংখ্যা বেশি নয়। কিছু বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। বহু প্লটেই শুধু ঝোপজঙ্গল, রাস্তার উপর দিকে পুরোনো বসত অঞ্চল। পল্লিগ্রামের মতো দুটো কলোনি আর প্রচুর ঝুপড়ি নিয়ে একটা

পাকা রাস্তা ভিতর দিকে গেছে। সেখানে ইন্দ্রনগর নামে একটি ক্ষুদ্র উপনিবেশ। প্রধান রাস্তাটি থেকে মাছের শিরদাঁড়ার কাঁটার মতো দু-ধারে সরু সরু রাস্তা বেরিয়ে গেছে। নানান আকারের ও গড়নের বাড়িগুলোর প্রায় সবই একতলা। কিন্তু ইন্দ্রনগরের বাসিন্দাদের শিক্ষা, রুচি, পেশা এবং আর্থিক সঙ্গতি এক স্তরের নয়। মোটর গাড়ি, স্কুটার ও সাইকেলের সহাবস্থান এখানে মামুলি দৃশ্য, চোখে পড়ার মতো নয়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে জ্যোতি ইন্দ্রনগরের প্রবেশ রাস্তার দিকে আনমনা তাকিয়েছিল। সেখানে রাস্তার মোড়ে চাক বেঁধে রয়েছে ছছাটো-বড়ো কিছু দোকান আর আরোহীর অপেক্ষায় গুটিকয় সাইকেল রিকশা। চায়ের কাপ হাতে পূর্ণিমা বারান্দায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। জ্যোতিকে পিছন থেকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে সে বলল, অত ভাবছিস কেন, ভগবান আছেন তিনিই তোকে দেখবেন।

হ্যাঁ, এখন ভগবানই আমার ভরসা, আর তুই। আমার দিন রাত যে কী করে কাটে তোকে বোঝাতে পারব না। জ্যোতি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বিষাদমাখা চোখে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণিমার মনে হল, তাদের এতকালের বন্ধুত্ব, যা মাঝের দশটা বছরে ঝাপসা হয়ে গেছিল, আবার যেন তা ঝলমলিয়ে ফিরে আসছে। জ্যোতির চোখ দুটো কোটরে ঢুকে নাকটা আরও খাড়া দেখাচ্ছে। চোখের কোলের ছোপটা ঢাকতে কিছু-একটা মেখেছিল যার রং এখন ফিকে হয়ে গেছে, হাতের গড়নে সেই নরম ভাবটা আর নেই। দুটো কাঁধ আড়ষ্ট লাগছে। চল্লিশে পৌঁছোতে এখনও অনেকটা বাকি, বুড়ি বুড়ি দেখাচ্ছে না ঠিকই তবে তারুণ্যের কোনো প্রমাণ চলাফেরা, চাহনি বা স্বরে আর নেই। পূর্ণিমার কষ্ট হল। কিন্তু বন্ধুর দুঃখ কী করে যে লাঘব করবে তার হদিস সে খুঁজে পাচ্ছে না!

ওর নাম কী? কতদিনের ছাত্রী? দেখেছিস ওকে?

ছায়া চ্যাটার্জি। হ্যাঁ দেখেছি। কতদিনের তা বলতে পারব না, তবে আমার বিয়ের আগে থেকে নয়। সবথেকে আমার অবাক লাগে কেন জানিস, মেয়েটাকে কুচ্ছিত দেখতে। দাঁত বার করা চ্যাপটা গোল মুখ, কয়লার মতো রং, রুগ্ন, এইটুকু খোঁপা, মোটেই মিষ্টি নয়। চলনসই গলা, দেখলে ঝি ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। প্রসাদের টেস্ট যে এত নীচু হবে তা আমি কল্পনা করতে পারি না।

তুই এই নিয়ে আর ভাবিসনি। দু-দিন পরেই দেখবি প্রসাদের নেশা ছুটে গেছে।

এত বছরেও যা ছুটল না আর তুই বলছিস কিনা দু-দিনেই সেটা হয়ে যাবে! জ্যোতি অবিশ্বাসভরে মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা তুই ঠিক করতে পারছিস না। পুরোপুরি ভগবানের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। রাক্ষুসিটা ক্যান্সারট্যান্সার বা অন্য কিছুতে যদি মরে যায় তবেই আমি শান্তি পাব। ঠাণ্ডা চা একচুমুকে শেষ করে জ্যোতি বলল, এবার আমি যাব। বড়োছেলের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়েছে। এখান থেকে ভবানীপুর কম দূর তো নয়!

ছোট্ট দুধসাদা রঙের মরিস মাইনরের দরজা খুলে জ্যোতি ড্রাইভারের পাশে বসল। পূর্ণিমা ঝুঁকে বলল, এত নামকরা লোকের এইটুকু গাড়ি কী রে! প্রসাদকে বড়ো একটা কিনতে বল।

এটা তো ছ-বছর আগে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিনেছিল। এখন একটা কন্টেসা হয়েছে। মন কি শরাবি সুপার হিট করল তো প্রসাদেরই গানের জন্য, প্রসিউসার গাড়িটা দিয়েছে। কিন্তু ওর ফেভারিট এই খোকা গাড়িটা। এটা নাকি ওর খুব পয়া তাই রেখে দিয়েছে, নিজেই চালায়।

এবার যখন আসবি কন্টেসায় চড়ে আসবি। পাড়ায় আমার খাতির বাড়বে।

তোর এখানে আবার পাড়া কোথায়, কেমন ফাঁকা ফাঁকা।

আছে, ইন্দ্রনগরের লোকেরা তো এখান দিয়েই যাতায়াত করে। পূর্ণিমার সঙ্গে জ্যোতিও হেসে ওঠে।

গাড়ি রওনা করার জন্য ড্রাইভার যখন গিয়ার দিয়েছে জ্যোতি মুখ বার করে চাপা গলায় তখন বলে, আমি কিন্তু ভগবান নয় তোর ভরসায় রইলুম। কী করব বলে দিস।

গাড়িটা ছেড়ে দেবার পর পূর্ণিমা মাথা হেলিয়ে বলেছিল, বলব। কিন্তু বলা আর হয়নি। গত দু-বছরে জ্যোতি মাঝে মাঝে এসেছে। প্রায়ই ফোন করে একই কথা বলেছে; কখনো কাতর অসহায় স্বরে, কখনো রাগী তিক্ত কণ্ঠে। পূর্ণিমা প্রতিবারই ফোন রাখার আগে বলে, ধৈর্য হারাসনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভগবান আছেন।

অবশেষে একদিন জ্যোতি এসে বলল, আমি এখন করব কী তুই বল।

পূর্ণিমা প্রায় চমকে উঠেছিল ওর মুখটা দেখে। গাল দুটো বসা, দুই হনুর হাড় উঁচু, চোখের কোটর আগের থেকে গভীর, চামড়া খসখসে, কালচে ছোপ পড়া, চোখের নীচের কালিতে আর একটা পরত, ঠোঁট দুটি ফ্যাকাশে, চুল পাতলা নারকোল ছোবড়ার মতো প্রায়। প্রথম দৃষ্টিতেই তাই মনে হয়েছিল সে একটা মড়ার মুখ দেখল। ভুল ভাঙল চোখ দুটি দেখে। বহুদিন খেতে না পাওয়া মানুষের সামনে থালায় ভাত ধরে দিলে তার যেমন চাউনি হবে সেইরকম।

উনুনে দুধ চাপিয়ে এসেছি। এই বলে পূর্ণিমা দ্রুত রান্নাঘরে চলে আসে। তার পিছু নেয় জ্যোতি।

আমি আর ঘুমোতে পারি না পুনি। চোখ বন্ধ করলেই ওই মাগিটার মুখ ভেসে ওঠে। এ যে কী দুঃসহ কষ্ট তোকে বোঝাতে পারব না। কিছু-একটা কর, না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি আমি মরে যাব? টস টস জল ঝরল জ্যোতির গালে।

প্রশস্ত রান্নাঘরের কোণে সিমেন্টের আল দেওয়া ছোট্ট জায়গাটায় বসে বাসন মাজছে ঠিকে-ঝি জোনাকি। বিবাহিতা, রুগণা, মুখটিতে পরিশ্রমের ও দারিদ্রের ঝামেলা থাকলেও শ্ৰী আছে।

জনু তাড়াতাড়ি ডেকচিটা মেজে দাও।

জনুর অবাক হয়ে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থাকাটা প্রত্যাহত হল। পূর্ণিমা চায় না বাইরের কেউ তার বন্ধুর লজ্জার ও দুঃখের কথা জানুক।

জ্যোতিকে শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে সে জনুর অবশ্যম্ভাবী কেতুহলী প্রশ্নগুলোর গোড়া কেটে দেবার জন্য নিজের থেকেই বলল, আমার ছেলেবেলার বন্ধু, দুই বোনের মতো ছিলুম। বিপদে আপদে ও ছুটে আসত, এখনও আসে। আমিও যাই।

কী বিপদ বউদি, উনি কাঁদছেন যে?

স্বামীর সঙ্গে খটাখটি, যা হয়ে থাকে।

জনু নিজের কাজে মন দিল এবং পূর্ণিমাও। কিছুক্ষণ পর জনু আপনমনে বলার মতো স্বরে বলল, স্বামীর সঙ্গে খটাখটি থেকে শেষকালে কী কান্ডই যে হয়ে যায়। আমার ছোটোননদ মলি, পাশের কলোনির গৌতমের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফিরে এল। সবার আপত্তি ছিল বিয়েতে, গলা নামিয়ে জনু ফিসফিস করে বলল, ছেলেটা মাডার করে। দু-বার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছল বাড়ি থেকে, জেলও খেটেছে।

তা খটাখটি থেকে কী কান্ড হল? পূর্ণিমা দুধে চাল ঢালার আগে এক বার তাকাল জনুর দিকে। হাতের কাজ বন্ধ করল জনু।

গৌতম সন্দেহ করত মলিকে, চরিত্রটা তো খুব ভালো নয়। বউদি ওকে তুমি দেখনি, হিন্দি সিনেমার রেখাকে দেখেছ তো, ঠিক ওইরকম দেখতে। গৌতমের আগে আরও অনেকের সঙ্গে মিশেছে। বিয়ের পরও একজনের সঙ্গে ভাব শুরু করেছিল। এই নিয়েই দুজনের খটাখটি হত, মারধরও চলত। শেষে কী হল জান? জনু নাটকীয়ভাবে কথা বন্ধ করল। পূর্ণিমা কৌতূহলভরে ঘুরে দাঁড়াল।

ছেলেটাকে একদিন লোডশেডিংয়ের সময় অন্ধকারে ধরে এই তোমার বাড়ির সামনেই, তখনও তোমরা এখানে আসনি, রাস্তার ওপর মাথায় অ্যাসিড ঢেলে দিল।

ই-ই-ই মাগো! পূর্ণিমা শিউরে উঠল। কী মানুষ গো, একটা লোকের মাথায়…!

তাহলে আর বললুম কী, মাডার করে। এই যে কসবায় ট্যাক্সিওলাটা খুন হল, ও তো গৌতমের কাজ। ইলেকশনে ইন্দর নগরে পিস্তল চালাল তো ওই টাকা দিলে ও মানুষ খুন। করে দেবে।

তা মলি এখন কী করছে? সেই ছেলেটা মরে গেছে না বেঁচে আছে?

বেঁচে আছে। ওকে তো গৌতম মারতে চায়নি। মাস দুই পরে মলিকে নিয়ে গেছল ছেলেটার বাড়িতে। বাইরে থেকে ডাকতেই ছেলেটা বেরিয়ে আসে। ওকে দেখেই মলির ভিরমি লেগে মাথা ঘুরে যায়। বাড়ি এসে বমি করে, একহপ্তা ভালো করে খেতে পারেনি।

কেন? পূর্ণিমা হঠাৎ আগ্রহ বোধ করল মলির এইরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ জানতে।

অ্যাসিডে মুখের আধখানা গলে গিয়ে কী ভয়ংকর যে…। জনু চোখ বন্ধ করে ফেলল।

পূর্ণিমা চাপা স্বরে বলল, তুমি দেখেছ?

না বাবা, আমার আর দেখে কাজ নেই। মলির কাছেই শুনেছি একদিকের গাল কান আর চোখ প্রায় নেইই, কেউ যেন চেঁচে কামিয়ে দিয়েছে। নাকে শুধু দুটো ফুটো। লাল দগদগে..

থাক থাক আর বলতে হবে না।

পূর্ণিমা শোবার ঘরে এসে দেখল জ্যোতি বুকে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে।

ঘুমোচ্ছিলিস?

ঘুম আমার হয় না। জ্যোতি উঠে বসল।

ওনাকেও ইদানীং এই রোগ ধরেছে। পূর্ণিমা ড্রেসিং টেবলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোটো অ্যালুমিনিয়াম কৌটো বার করে জ্যোতিকে দেখিয়ে ড্রয়ারে রেখে বলল, খেতে হয়। অসম থেকে ট্রাক আসছিল, মালদার কোথায় অ্যাকসিডেন্ট করেছে তাই কাল দৌড়েছে। ফিরে এসেই ক-দিন নির্ঘাত খেতে হবে।

জ্যোতি চোখ বন্ধ করে বসে রইল। কথা বলছে না। দাঁতে দাঁত চাপার জন্য চোয়ালের হাড় এক বার প্রকট হল। রগের কাছে শিরা ফুলে দপ দপ করছে। ঢোঁক গিলল।

গরম পায়েস খাবি? লক্ষ করতে করতে পূর্ণিমা বলল।

দে।

পূর্ণিমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই জ্যোতি চোখ খুলে ড্রয়ারের দিকে তাকাল।

সেদিনই রাত এগারোটা নাগাদ পূর্ণিমা জ্যোতিকে ফোন করল বিপন্ন কণ্ঠে; স্লিপিং পিলের কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছি না রে, ওর দরকার, না খেলে ঘুমোতে পারবে না, তুই কি…

হ্যাঁ।

পূর্ণিমার কানের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ ঢুকে তাকে কয়েক সেকেণ্ড অসাড় করে রাখল। তারপরই চিৎকার করে উঠল, না জ্যোতি না, এমন কাজ করিসনি, জ্যোতি করিসনি, জ্যোতি ভুল করিসনি। আমি তোর সুখের ব্যবস্থা করব জ্যোতি, কথা দিচ্ছি তোকে…

পুনি এগারোটা ছিল, এইমাত্র সব ক-টাই খেয়েছি।

হাউহাউ করে কেঁদে উঠল পূর্ণিমা। তার স্বামী সুরেন ছুটে এল।

পুনি, হ্যালো হ্যালো। …প্রসাদ তো বিয়ে করবে আবার, তুই আমার বাবু, বান্টা আর মণিকে তোর কাছে নিয়ে যাবি এই আমার শেষ চাওয়া তোর কাছে।

জ্যোতি এ তুই কী করলি? মাউথপিসে ঠোট ঠেকিয়ে পূর্ণিমা কান্না-জড়ানো গলায় বলল। আমি তোর ব্যবস্থা করব, তোকে কথা দিচ্ছি। তুই ফোন কর ডাক্তারকে, বাড়িতে প্রসাদ থাকলে তাকে ডাক, হাসপাতালে নিয়ে যাবে। জ্যোতি দেরি করিসনি।

আমি একটা চিঠি লিখে যাব। এক লাইন, আমার মৃত্যুর জন্য…তারপর কী লিখব রে? আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, কী লিখব বল তো? কেউ দায়ী নয়, নাকি আমার স্বামী দায়ী? প্রসাদকে ডুবিয়ে গেলে কি ভগবানের কাছে।

পূর্ণিমার মনে হল টেলিফোনটা জ্যোতির হাত থেকে পড়ে গেল। বার কয়েক হ্যালো হ্যালো বলে সে সুরেনের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে বলল, তোমার কৌটোটা জ্যোতি নিয়ে গিয়ে সব খেয়েছে। আমি যাব ওর কাছে, এখনি আমি যাব।

সুরেন ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। পূর্ণিমার হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে কানে দিল। সাড়াশব্দ পেল না।

তুমি আমায় এখনি নিয়ে চলো। এখনও গেলে ওকে বাঁচাতে পারব।

দাঁড়াও। এখন ট্যাক্সি পাব কি পাব না..বাড়ি তো ভবানীপুর থানার আণ্ডারে, ওদের খবর দিচ্ছি।

পুলিশ পৌঁছোতে দেরি করেনি। আর সেইজন্যই জ্যোতি বেঁচে গেল। হাসপাতালে দু-দিন রেখে প্রসাদ ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে। জ্যোতির সঙ্গে হাসপাতালে কাউকেই কথা বলতে দেওয়া হয়নি, পূর্ণিমা বাড়িতে ওকে দেখতে যায়। বিছানায় শোয়া জ্যোতি হাসবার চেষ্টা করে বলল, আমি মরলুম না কেন বল তো?

ভগবান চাননি তাই। হয়তো তাঁর অন্য কোনো ইচ্ছা আছে।

জ্যোতি গভীর দৃষ্টিতে তার বন্ধুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পূর্ণিমা আঁচলে জল মুখে নিয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগল।

তোকে আর নিজের সম্পর্কে কিছু ভাবতে হবে না, আমিই যা ভাবার, যা করার করব। তোকে আমি সুখী করবই।

কর। জ্যোতি সান্ত্বনা দেবার জন্য হাসল।

ছায়া চ্যাটার্জি থাকে কোথায় রে?

ঠিক জানি না। শুনেছিলাম পার্কসার্কাসে থাকে।

ওর কোনো ছবি তোর কাছে আছে?

না। কেন?

এই সময় প্রসাদ ঘরে ঢুকল। পূর্ণিমার আর জবাব দেওয়া হল না।

এর তিন সপ্তাহ পর রবিবার বিকেলে পূর্ণিমা বারান্দায় গাছের টবে জল দেবার সময় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল, সাদা একটা মরিস মাইনর ইন্দ্রনগরে ঢোকার জন্য বাঁক নেবার আগে পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ির চালককে দেখা যাচ্ছে না তবে তার পাশে বসা শ্যামবর্ণা স্ত্রীলোকটির মুখের কিছুটা পূর্ণিমা দেখতে পাচ্ছে। খুবই সাধারণ, দ্বিতীয় বার না তাকানোর মতোই লম্বাটে মুখ, বয়স সম্ভবত ত্রিশের দু-এক বছর এধার ওধার-গলায় কানে অলংকার নেই। খোলাচুল সিথির দু-ধারে নামানো। ঘন প্রচুর চুলেই পূর্ণিমার চোখ আটকে গেল। দোকানি ব্যস্ত বিগলিত হয়ে পানের খিলি ভরা একটা কাগজের দোনা চালককে দিয়ে গেল। তারপর আবার দিয়ে গেল বোধ হয় মিঠামশলা। স্ত্রীলোকটি হাত পেতে চালকের কাছ থেকে মশলা নিয়ে মুখে দিল।

মোটরটা বাঁক নিয়ে ইন্দ্রনগরে যখন ঢুকছে পূর্ণিমা তখন চালকের মুখটি দেখতে পেল এবং কিছুক্ষণ পাথর হয়ে রইল তার মাথাটা। প্রসাদ!

পানওয়ালার হাবভাব দেখে তার মনে হল প্রসাদকে সে চেনে। মিনিট দশেক পর পূর্ণিমা পান কিনতে দোকানটায় এল। খিলিটা হাতে নিয়ে সে বলল, একটু আগে একটা সাদা গাড়িতে করে এসে এক ভদ্রলোক পান কিনলেন, চেনা চেনা মনে হল।

উনি তো প্রসাদ ঘোষ। বিরাট গাইয়ে, বিরাট নাম। ইন্দ্রনগরে নতুন যে গানের স্কুলটা সেখানে প্রতি রোববার শেখাতে আসেন। আমার কাছ থেকে পান নিয়ে ঢোকেন। শোনেননি ওঁর গান?

নিশ্চয় শুনেছি। স্কুলটা কোথায় বলুন তো?

এই তো সোজা গিয়ে, দুটো রাস্তা ছেড়ে থার্ডটার মোড়ে একটা লন্ড্রি, ঠিক তার পাশের বাড়ি, সাইনবোর্ডে গীতিপ্রসাদ লেখা।

কতদিন হল স্কুলটা হয়েছে?

তা মাস খানেক কী আর একটু কমই হবে। একদম নতুনই। ওর পাশে মোটরে যে মহিলা বসেছিলেন তাঁরই স্কুল। প্রসাদ শেখায় বলে খুব ছাত্র-ছাত্রী হয়েছে।

এইটুকুই যথেষ্ট। পূর্ণিমা ধরেই নিল প্রসাদের পাশে যাকে দেখেছে সে-ই ছায়া চ্যাটার্জি। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সে ইন্দ্রনগরে ঢুকল। আগে কখনো সে এখানে পা দেয়নি। রাস্তার একধার দিয়ে ড্রেনের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। মাটির ঢিপির পাশ দিয়ে সাইকেল রিকশার চাকার ধাক্কা সামলে প্রায় ষাট-সত্তর মিটার হেঁটে সে লন্ড্রির সামনে পৌঁছোল। পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা ভিতরে ঢুকেছে তার প্রথম বাড়ির সামনেই সাদা মোটরটা দাঁড়িয়ে।

বাড়িটা একতলা। বুক সমান উঁচু ছোট্ট লোহার গ্রিলের ফটক। একটুখানি বাগান, বারান্দা, জানলায় পর্দা-লাগানো দুখানা ঘর। ফটকের পাশে পাঁচিলের হলুদ রং-করা কাঠের তক্তায় সাদা অক্ষরে লেখা, গীতিপ্রসাদ। তার নীচে, প্রতি রবিবার বৈকাল ৫টা থেকে ৮টা। বারান্দায় দুটি বেঞ্চে কয়েক জন স্ত্রীলোক বসে। ঘরের ভিতর দেখা যাচ্ছে না তবে গান ও হারমোনিয়ামের শব্দ ভেসে আসছে। পূর্ণিমা ভিতরে গিয়ে কাছের থেকে ছায়া চ্যাটার্জিকে দেখে আসবে কি না ভেবে ঠিক করতে পারছে না। প্রসাদ যদি তাকে দেখে ফেলে। এটা সে কোনোমতেই চায় না।

বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এক মা পূর্ণিমার পাশ দিয়ে ফটকের দিকে যাচ্ছে। তাকে থামিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা এখানে কি বড়োদেরও গান শেখানো হয়?

হয় বোধ হয়, আপনি ভেতরে গিয়ে ছায়াদিকে জিজ্ঞেস করুন-না।

ছায়াদি!

ছায়া চ্যাটার্জি, প্রসাদ ঘোষের ছাত্রী। উনিই স্কুলটা করেছেন।

পূর্ণিমা সোজা বাড়ি ফিরে না এসে ইন্দ্রনগর থেকে বেরিয়ে জনু যেখানে থাকে সেই নন্দ কলোনির দিকে গেল। জনুর ঘরটাকে চেনে না। মাঝবয়সি একটি স্ত্রীলোক টিউবওয়েলে জল ভরছে। পূর্ণিমা তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে হাত তুলে দেখাল, আর খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে একটা পেঁপে গাছ, ঘরের চালে দু-তিনটে কুমড়ো, ওইটে জনুর ঘর।

জনু ঘরে নেই। বছর বারোর মেয়েটি পূর্ণিমাকে চেনে। সে বলতে পারল না, তিন বাড়ির কাজ সেরে মা কখন ফিরবে। পূর্ণিমা তাকে বলে এল, তোমার মা ফিরলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলে দিয়ো। খুব দরকার। পারলে আজই যেন দেখা করে।

রাত আটটা নাগাদ জনু এল। কী ব্যাপার বউদি, ডাকতে গেছলে কেন? খুব দরকার বলেছ!

ছেলে আর সুরেন টিভি দেখছে। জনুকে বারান্দায় ডেকে এনে পূর্ণিমা কোনো ভণিতা না করে বলল, গৌতমকে দরকার, আমার একটা কাজ ওকে করে দিতে হবে।

জনু হতভম্বের মতো তাকিয়ে বলল, তোমার দরকার! গৌতমকে?

হ্যাঁ। সে জন্য যা টাকা লাগবে দেব।

কী দরকার গো বউদি? জনুর স্বর ষড়যন্ত্রীর মতো নীচু হয়ে গেল।

সে এখন বলা যাবে না। কর্কশ গলায় পূর্ণিমা বুঝিয়ে দিল কৌতূহল তার পছন্দ হচ্ছে না। তুমি কি ওকে বলতে পারবে আমার সঙ্গে কালই এক বার দেখা করতে?

গৌতম এখন বাড়িতে না অন্য কোথাও এসব নোক ঘরে তো কমই থাকে। আমারও ছছাটো ছেলেটার সকাল থেকে বমি আর পায়খানা–

তার কথা শেষ হবার আগেই পূর্ণিমা দাঁড়াও বলে শোবার ঘরে ঢুকল এবং আধ মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে জনুর হাতে কুড়ি টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল।

চুপচাপ যাবে। গৌতমকে বলবে দুপুরে আসতে। ওকে চিনি না, এসে যেন বলে জোনাকি পাঠিয়ে দিয়েছে, তাহলেই বুঝব।

খারাপ কাজ কিছু নাকি বউদি? জনুর স্বরে আবার কৌতূহল ফুটে উঠল।

খারাপ নয়, একদমই নয়। একজনের খারাপ কাজ বন্ধ করতে হবে, ভালো উদ্দেশ্যেই দরকার। এতে তোমার তো কোনো দায়দায়িত্ব থাকছে না, তুমি শুধু যোগাযোগটা করিয়ে দেবে। কাজটা হলে তোমাকে আরও পঞ্চাশ দেব। নিশ্চয় তুমি এটা নিয়ে কাউকে কিছু বলবে না।

না গো না, গৌতম কি তাহলে আমায় আর আস্ত রাখবে?

জনু চলে যাবার পরও পূর্ণিমা বারান্দার গ্রিল ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রনগরের মোড়ের দিকে। কিছু লোক আর যানবাহন, অস্পষ্ট শব্দ আর আবছা আলো ছাড়া তার চেতনায় আর কিছু পোঁছুচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর সে মুখটা তুলে বিড়বিড় করল, তোকে সুখী করব। একটু ধৈর্য ধর। সেই সময়ই লোডশেডিং হল তল্লাটজুড়ে। দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা হা আ আ রব উঠে তখন ছড়িয়ে পড়তেই পূর্ণিমার গ্রিলধরা মুঠোটা শক্ত হয়ে উঠল।

পরদিন দুপুরে বারান্দায় অপেক্ষা করছিল পূর্ণিমা। দেখতে পেল জনুর সঙ্গে একটা লোক আসছে। তার মনে হল এই লোকটাই গৌতম। পায়ে চটি, খয়েরি রঙের সরু ফাঁদের ট্রাউজার্স যাতে ইস্ত্রির বালাই নেই, হাওয়াই শার্টটা নীল ও কালো ডোরাকাটা, পাতাকাটা চুল, গায়ের রং গাঢ় শ্যাম। পূর্ণিমা খুবই দমে গেল লোকটির স্বাস্থ্য দেখে। কঠিন অসুখ থেকে ওঠার পর মানুষ যেভাবে হাঁটে, রুগ্ন দেহটার চলন সেইরকম।

কাজের মেয়েটির ঘুম না ভাঙিয়ে পূর্ণিমা এক তলায় নেমে এল! সদর দরজা খোলামাত্র জনু বলে উঠল, বউদি এই হল গৌতম, কথা বলো, আমি কাজে যাচ্ছি। এই বলেই সে দোতলায় উঠে গেল কাজ করতে। পূর্ণিমার একটাই সমস্যা দেখা দিল, গৌতমের সঙ্গে তুমি না আপনি সম্বোধনে কথা বলবে।

দুটো ঠোঁট ঢেকে রাখতে পারে না সামনের লম্বা দাঁতগুলোকে, তাই বেরিয়েই থাকে কিন্তু গৌতমের মুখে রাক্ষুসে ধরনের ছাপ নেই। পূর্ণিমা সামান্য হতাশ হল। জনুর গল্প থেকে যে রকম একটা ধারণা ইতিমধ্যেই গড়ে ফেলেছে তার সঙ্গে গৌতমকে কোনোভাবেই সে মেলাতে পারছে না। এক-তলায় বসার ঘরে ঢুকে সোফার দিকে হাত বাড়িয়ে গৌতমকে সে বসতে ইঙ্গিত করল।

কেন দেখা করতে চাই সেটা আর জনুকে বলিনি, ওর কাছেই তোমার একটা ব্যাপার শুনে মনে হয়েছে আমার একটা কাজ তুমি বোধ হয় করে দিতে পারবে। অবশ্য সেজন্য টাকা দেব। চোখ-কান বুজেই প্রায় এক নিঃশ্বাসে পূর্ণিমা কথাগুলো বলে একটু সহজ বোধ করল। তারপরই খেয়াল করল সম্বোধন সমস্যাটা মিটে গেছে।

কী শুনেছেন আমার সম্পর্কে কোনোরকম ঔৎসুক্য নেই গৌতমের চাহনিতে ও কণ্ঠস্বরে। স্বরটা ভরাট। চোখের পাতা দুটোই শুধু সামান্য নেমে মণির আধখানা ঢেকে দিল। পূর্ণিমার মনে হল ভণিতা ও শোভনতার জন্য সময় নষ্ট করার সময় এখন নয়। সোজাসুজি কাজের কথাতেই যাওয়া উচিত।

তুমি একজনকে মুখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিলে, জনু আমায় বলেছে।

অসিত। তা হয়েছে কী? এটা তো পুরোনো ব্যাপার!

হয়েছে এই যে, পূর্ণিমা চেয়ার থেকে উঠে এসে সোফায় বসল। এইরকম একটা কাজ আমার জন্য করে দিতে হবে।

গৌতমের বসাটা ঢিলেঢালা থেকে খাড়া হয়ে উঠল। কেন?

যে কারণে অসিতকে শাস্তি দিয়েছ ঠিক সেই কারণেই। তবে এক্ষেত্রে একটা মেয়ে। আমার খুব ক্ষতি করেছে, করে যাচ্ছে।

আপনি আপনার নিজের স্বামীকে সামলাতে পারেন না? গৌতমের ভৎসনাটা পূর্ণিমার কাছে অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সে নিজেকে ম্রিয়মাণ দেখাবার চেষ্টা করতে করতেই লক্ষ করল গৌতম তার বুক থেকে পেট পর্যন্ত দ্রুত জরিপ করে বোঝার চেষ্টা করছে স্বামী বেহাত হওয়ার কারণটা।

অনেক কাজই আমি করি, তাতে জানের ভয় আছে রিক্স আছে কিন্তু টাকা পেলে সব কাজই করে দিই। থেমে থেমে গৌতম বলল, চোখটা ভেজানো দরজার দিকে রেখে।

কত নেবে?

আগে শুনি কাজটা কেমন। অ্যাসিডের কারবারে ঝামেলা অনেক। চেম্বার দিয়ে হাসিল করা বরং অনেক সোজা। পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে কানেকশন থাকলে তো আরও ঝামেলা।

না না, কোনো পাটিফার্টির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। একদমই নিজস্ব ব্যাপার।

অ্যাসিডের কাজ আমার এলাকার বাইরে গিয়ে আমি করি না, এতে খুব হ্যাপা আছে।

ইন্দ্রনগরে সে আসা-যাওয়া করে। আর এটা তো তোমারই এলাকা!

হ্যাঁ।

এখানেই তো তাহলে কাজ সেরে ফেলতে পারবে।

যত সহজে বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু অত সোজা নয়। নিজের এলাকা হলে কি রিক্স থাকবে না? জনুবউদি আপনাকে কতটা কী বলেছে জানি না, তবে অসিতের কেসটা ছিল আমার নিজের বউকে নিয়ে, টাকার জন্য নয় তাই রিক্সের পরোয়া করিনি। গৌতম অনুত্তেজিত স্বরে বলে গেল। নিজের এলাকায় হলে মিনিমাম পাঁচ হাজার নেব। দেখুন, কেন, কী উদ্দেশ্যে আপনি করতে চান, বা মেয়েছেলেটার নাম কী, ঠিকানা কী এসব জানার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, দরকারও নেই। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল এই হচ্ছে আমার কথা। লেনদেনের ব্যাপারটা তাই গোড়াতেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। আপনি যদি টাকায় এগ্রি না করেন তাহলে আমি এখুনি চলে যাব, করলে বাকি যা জানার জেনে নোব।

পূর্ণিমার মাথার মধ্যে মৃদু একটা গোলমাল ঘটল টাকার অঙ্কটা শুনে। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, পাঁচ একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। অসিতের যা করেছ অতটা না হলেও চলবে।

দেখুন, এ কাজ কম আর বেশি বলে কিছু নেই। রিক্স ইজ রিক্স। ধরা পড়ে গেলে কী হবে জানেন তো!

চার পর্যন্ত উঠতে পারি।

দরাদরির কারবারে আমি যাই না। গৌতম উঠে দাঁড়াল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা বুঝে গেল কথার নড়চড় সম্ভব নয়।

বেশ।

গৌতম ধীরে ধীরে আবার সোফায় বসে বলল, বাকিতে কাজ করি না। এইটি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স চাই, বাকি টাকা কাজ হাসিল হবার সঙ্গে সঙ্গে। পেমেন্ট গোলমাল করলে কিন্তু বিপদে পড়বেন। টাকা নিয়ে রেডি থাকবেন, আমার লোক এসে আপনাকে খবর দেবে, তার হাতেই বাকি টাকাটা দিয়ে দেবেন।

পূর্ণিমা একদৃষ্টে গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিল। তার মনে হল লোকটা বাজে কথার নয়, কাজের। পাঁচ হাজার টাকা ধাপ্পা দিয়ে ঠকিয়ে নেবে না। এই দুবলা সাধারণ চেহারার লোকটার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড ক্ষমতা, সে জ্যোতির সুখের পথের বাধাটাকে অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে দিতে পারে। তার শোবার ঘরে স্টিলের আলমারির লকারে উপার্জন থেকে হিসাবের বাইরে সরানো প্রায় আড়াই লাখ টাকার নোট সুরেন রেখে দিয়েছে। পূর্ণিমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা কোনো সমস্যা নয় যতক্ষণ আলমারির ও লকারের চাবিটা তার কাছে রয়েছে।

আমি রাজি। আজই এইট্টি পার্সেন্ট দেব।

বেশ। তাহলে আমার যা যা জানার দরকার এবার সেগুলো বলুন। কোনো কথা বাইরে যাবে না গ্যারান্টি দিচ্ছি।

পূর্ণিমা দেখল গৌতমের মানুষের মতো মুখটা ধীরে ধীরে রাক্ষসের হয়ে আসছে। সে আশ্বস্ত বোধ করল।

পরের রবিবার বিকেলে পূর্ণিমা বারান্দায় টুলে বসে গ্রিলের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে রইল। সাদা মোটরটাকে পানের দোকানের সামনে সে দাঁড়াতে দেখল, পানওয়ালা পানের দোনা গাড়িতে দিয়ে গেল। ছায়া চ্যাটার্জির চুল কাঁধের উপর দিয়ে পিঠে ছড়ানো। একটা হাত তার সামনে এগিয়ে এল, ছায়া চ্যাটার্জির হাতের তালু থেকে লবঙ্গ বা এলাচ দু-আঙুলে খুঁটে তুলে নিয়ে মুখে দিল। প্রসাদের মুখটা সে দেখতে পেল ইন্দ্রনগরের পথে বাঁক নেবার সময়। তারপর সে অপেক্ষা করতে থাকল। আটটায় গীতিপ্রসাদ বন্ধ হয়। তারপর ওরা গাড়িতে উঠবে, এই পথ দিয়ে ফিরবে। সে-সময়েই কিংবা তারও আগে, গৌতমই তা জানে, কাজটা সারা হবে।

পূর্ণিমা সংসারের কাজের মধ্যে পাঁচ-ছ বার ঘড়ি দেখল। সে ঠিক করেই রেখেছে জ্যোতিকে কিছু জানাবে না। টেলিফোনে তার কাছ থেকে আচমকা খবরটা পেয়ে জ্যোতির যেরকম আবেগভরা মন হয়তো দুঃখও ছড়াতে পারে। অ্যাসিড খুব যন্ত্রণা দিয়ে কুৎসিত করার কাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু গৌতমকে তার বলা আছে শুধু মুখের একটা পাশ, গাল, কান আর চুল বাদে সব যেন অক্ষত থাকে। কিন্তু ওকে দেখে প্রসাদের দ্বিতীয় বার যেন তাকাবার ইচ্ছে না হয়।

আটটার সময় পূর্ণিমা আবার বারান্দায় এল। ইন্দ্রনগরের মোড় অন্যান্য দিনের মতোই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। একটা ভয়ংকর, বুক-হিম-করা ব্যাপার কাছাকাছিই ঘটবে, গানের স্কুল থেকে এই মোড়, এর মধ্যেই নিশ্চয় সেটা ঘটবে।

সময় জানার জন্য ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা দেখে বারান্দায় এসেই পূর্ণিমা বিরক্তি আর হতাশায় গ্রিলের উপর তালু ঠুকল। সাদা মোটরটা হর্ন বাজিয়ে বাঁক নিয়ে স্বচ্ছন্দ গতিতে কলকাতার দিকে চলে গেল।

এইভাবে হর্ন বাজিয়ে পর পর তিনটি রবিবার গাড়িটা ইন্দ্রনগরের মোড় থেকে বাঁক নিয়ে চলে যাবার পর, চতুর্থ রবিবারে পূর্ণিমা যখন বারান্দায় অপেক্ষা করছে তখন দুটি সাধারণ ব্যাপার ঘটল। লোডশেডিং নামল এলাকায় আর ফোন বেজে উঠল।

মা তোমার ফোন। ভিতর থেকে ছেলে ডাকল। মুহূর্তের জন্য পূর্ণিমার হৃদপিন্ডটা কুঁকড়ে যেন সর্ষেদানার মতো হয়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড কুঁজো হয়ে থেকে সে দ্রুত ঘরে এসে ফোন ধরল।

হ্যালো, কে? নীচু স্বরে সে বলল।

পুনি? আমি রে। এত দেরি হয় কেন তোর ফোন ধরতে? ছেলে বলল মা বারান্দায়। কী কচ্ছিলিস বারান্দায়? রাস্তায় কি প্রেমিক দাঁড়িয়ে? জ্যোতির উচ্ছল সুখী কণ্ঠস্বর। পূর্ণিমা অবাক, এভাবে বহু বছর সে জ্যোতিকে কথা বলতে শোনেনি।

ব্যাপার কী, এত খুশি কেন?

আছে আছে, ব্যাপার একটা আছে। শুনলে তুই চমকে যাবি। বল তো কী?

জানি না।

তবু বল?

ছায়া চ্যাটার্জিকে ক্যান্সারে ধরেছে।

খিলখিল হেসে উঠল জ্যোতি। ছি পুনি, ওসব অমঙ্গল চিন্তা আর আমি করব না। একটু আগে ডাক্তার সামন্তর চেম্বার থেকে ফিরেছি। চেক আপ করাতে গেছলুম। প্রসাদের চার নম্বর এসে গেছে। এখন বয়স দেড় মাস।

তার মানে! তোর বাচ্চা হবে?

আমার সেই বোকামির ব্যাপারটায় প্রসাদ খুব ঘাবড়ে গেছে। আর আলাদা শুতে ভরসা পাচ্ছে না। আমি এখন বলে দিতে পারি ওর গায়ে কটা তিল। জ্যোতি কলকলিয়ে হেসে উঠল আর বাইরে থেকে ভেসে আসা একটা ক্ষীণ কলরব একইসঙ্গে পূর্ণিমার কানে ধাক্কা দিল। ভ্রুকুটি করে অন্ধকার বারান্দার দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে বলল, এসব কথা তুই আমায় আগে বলিসনি কেন, তাহলে? সে থেমে গেল অস্বস্তি ভরে।

তাহলে কী?

কিছু না।

তুই খুশি হসনি?

দারুণ, সত্যিই দারুণ খবর তুই দিলি। আমার এত ভালো লাগছে তোর গলা। কতদিন তোর মুখ থেকে হাসি শুনিনি। জ্যোতি, বলেছিলাম ভগবান আছেন, তিনিই তোকে দেখবেন। তোকে সুখী দেখলে আমার যে কী ভালো লাগে। পূর্ণিমা কাঁধে গাল ঘষে জল মুছল।

প্রসাদ আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

সত্যিই!

জার্মানি থেকে চিঠি পেয়েছে, সামনে জুলাইয়ে গাইতে যাবে। বলেছে আমাকে নিয়ে কন্টিনেন্ট ঘুরবে।

ভালোবাসা দেখছি উথলে উঠেছে। স্লিপিং পিল গোটা দশেক পাঠিয়ে দেব নাকি রে!

না বাবা, রক্ষে কর। এখন আমার ঘুম হয়, প্রসাদ বলে নাকও নাকি ডাকে। পুনি, এখন আমি রাখছি, ছেলে-মেয়ে ঝগড়া করছে, না থামালে রক্তারক্তি হয়ে যাবে, রাখছি রে।

টেলিফোন রেখে পূর্ণিমা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, লোডশেডিং।

ইনভার্টার থাকায় পাখা, আলোর সঙ্গে টিভিও চালু হয়েছে। হিন্দি সমাচার শুনতে শুনতেই সুরেন বলল, আবার বাচ্চা হবে?

হ্যাঁ, প্রসাদ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।

তারা আর এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেনি। পূর্ণিমা এক বার বারান্দার গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দোকানগুলোয় মোমবাতি জ্বলছে। মিনিবাস স্টপে কয়েক জন দাঁড়িয়ে। একটা পুলিশের জিপ ইন্দ্রনগরে ঢুকল।

বারান্দা থেকে ভিতরে আসতেই কাজের মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, বউদি একটা মেয়েছেলে নীচে তোমায় ডাকছে।

কে? চিনিস?

আগে কখনো দেখিনি। বলল বউদিকে ডেকে দাও খুব দরকারি কথা আছে।

একতলায় সিঁড়িতে হারিকেন জ্বলছে। সিঁড়ি আর সদর দরজার মধ্যে ছোটো জায়গাটায় স্ত্রীলোকটি দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই পূর্ণিমার মনে হল, এই হল মলি।

গৌতম পাঠিয়ে দিল, আমি ওর বউ।

বুক কেঁপে উঠল পূর্ণিমার। গৌতমের আর তো কোনো দরকার নেই। মিছিমিছি একটা মেয়ের সর্বনাশ সে করল। প্রসাদ তো ফিরেই এসেছে জ্যোতির কাছে। শুধু খবরটা জ্যোতি যদি আজ সকালেও জানাত তাহলে যেভাবেই হোক সে গৌতমকে জানিয়ে দিত, দরকার নেই। টাকাটাও আর ফেরত চাইত না।

হয়ে গেছে। গৌতম বলল বাকি টাকাটা এক্ষুনি দিতে। মলি কাজের মেয়েটির দিকে তাকাল। পূর্ণিমার পাশে দাঁড়িয়ে সে শুনছে।

তুই এখন ওপরে যা, এর সঙ্গে কথা আছে।

পূর্ণিমা মুখ ফিরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওর উপরে ওঠা দেখে, মলির দিকে এগিয়ে এসে ভীত গলায় ফিসফিস করে বলল, মেয়েটিকে কি খুবই… মানে বেশি কিছু তো হয়নি?

মলিও চাপা স্বরে বলল, আমাকে তো ও বলল, যা অন্ধকার ছিল তাতে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। এতে অবশ্য সুবিধেই হয়েছে, কেউ ওকে দেখতে পায়নি। আপনাকে নিশ্চিন্তি থাকতে বলেছে আর কারুর কাছে কখনো গল্প করবেন না। তাতে আপনিই বিপদে পড়বেন।

জানি, কিন্তু মেয়েটির অবস্থাটা জানতে পারলে…। পূর্ণিমার উৎকণ্ঠার সঙ্গে সহানুভূতি মিশে আছে।

মলি ঝুঁকে পূর্ণিমার মুখের কাছে মুখ এনে সান্ত্বনা দেবার মতো স্বরে বলল, মেয়েটার বোধ হয় কিছু হয়নি, হলেও খুব অল্পই হবে। ও বলল পাশের লোকটা মেয়েটাকে দু-হাতে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল। অন্ধকারে ও প্রথমে সেটা টের পায়নি। অ্যাসিড মারার পর লোকটাই প্রথম চেঁচিয়ে ওঠায় ও বুঝতে পারল মালটা কোথায় গিয়ে পড়েছে। কী বজ্জাত পোক বাবা!…বউদি একটু তাড়াতাড়ি এনে দিন।

গুণ্ডাদ্বয়

ভোররাতে সুমিত্রার গর্ভপাত ঘটল।

পান-বসন্তে ছ-দিন ধরে ভুগছে। জ্বর উঠল একশো তিন। নিখিল শুয়েছিল মেঝেয়। সুমিত্রার চিৎকারে ঘুম ভেঙে দেখল বিছানায় বসে চাপা আতঙ্কে ও তখন চ্যাঁচাচ্ছে, বেরিয়ে গেল, বেরিয়ে গেল।

আলো জ্বেলে নিখিল দেখে সুমিত্রার দুই ঊরুর মাঝে কাপড়টা ফুলে রয়েছে। একটু নড়তেই দলমল করে উঠল সেই স্ফীতি। সুমিত্রা সাত মাসের পোয়াতি। ফ্যালফ্যাল করে নিখিলের দিকে তাকিয়েছিল। চোখ সরিয়ে নিল নিখিল। বসন্তের ক্ষতে মুখটা খোদলানো। পাশের ঘরে মা ঘুমোচ্ছে, তাকে ডেকে তুলল।

বাড়িওয়ালার বউ উপর থেকে নেমে এসে পরামর্শ দিল ডাক্তার ঢাকতে। পাড়ার ডাক্তারকে ঘুম থেকে তুলে আনল নিখিল। তিনি সুমিত্রার নাড়ি কেটে পনেরোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেলেন ভয়ের কিছু নেই অর্থাৎ টাকা খরচ হবে না। বিছানার চাদর তোশক রক্তে জবজব করছে। সুমিত্রার শায়ার রং বদলে গেছে, শাড়ির কিছু অংশে রক্ত। এসব ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওকে কাপড় বদলিয়ে মা সেই চাদর, শায়া ও শাড়ি ঘরের এক কোণে জড়ো করে রেখেছেন, সেইসঙ্গে সুমিত্রার পেট থেকে যে-জিনিসটা বেরিয়েছে সেটাও।

বাড়িতে ধাঙড় আসতেই বাড়িওয়ালার বউ তাকে এই জিনিসগুলো ফেলে দিতে বলল। দেখেই সে মাথা নাড়ল। এ কাজ তার দ্বারা হবে না, পুলিশে ধরলে ফাটকে পুরে দেবে। দশ টাকা বকশিশ কবুল করেও তাকে রাজি করানো গেল না। তখন বাড়িওয়ালার বউ বাড়িওয়ালার সঙ্গে পরামর্শ করে এসে বলল, ডাক্তারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট আনো। সেটা দেখালে পুলিশ কিছু বলবে না। উনি বললেন, এ তো আর আইবুড়ো বা রাঁড়ির পেট-খসানো মাল নয়। ভদ্রঘরের বউয়ের অ্যাকসিডেন্ট। তুমি বাপু ডাক্তারের কাছেই যাও।

তাই শুনে নিখিল ডাক্তারের কাছে ছুটল। তখন ডাক্তার বাড়ি ছিল না, কখন আসবে তারও ঠিক নেই। বাড়ি ফিরে সাত মাসের সন্তানটিকে বিছানার চাদর, শাড়ি ও শায়ার উপর রেখে নিখিল পরিপাটি করে ভাঁজ করল। শাড়ির পাড় ছিঁড়ে নিয়ে বেশ শক্ত করে বাঁধল যাতে জিনিসটার আকৃতি ছোটো হয়। তার উপর খবরের কাগজ মুড়ল। তাতে হুবহু মনে হতে লাগল একটা কাপড়ের প্যাকেট। কিছুদিন আগেই হ্যাণ্ডলুম হাউস থেকে পর্দার কাপড় ও ব্লাউজের ছিট কেনা হয়েছে। দোকানের নাম লেখা ছাপা কাগজের থলিতে জিনিসটা এখন রেখে দেওয়া আছে। তাইতে নিখিল প্যাকেটটা ভরে খাটের নীচে রেখে দিল। সুমিত্রা শুয়ে শুয়ে দেখছিল, কাতরস্বরে সে বলল, শাড়িটা তো কাচিয়ে নিয়ে পরা যায়। একটুখানি জায়গায় তো মোটে লেগেছে।

নিখিল একথা গ্রাহ্য করল না। সুমিত্রার দিকে তাকালও না। ওর মুখে বসন্তের ঘা টসটস করছে। সাড়ে বারোটা নাগাদ আবার সে ডাক্তারের বাড়ি গেল। ডাক্তার খেতে বসেছে। সার্টিফিকেটটা পাঠিয়ে দিল ছেলের হাত দিয়ে। ছেলেটি হেসে বলল, বাবা লিখেই রেখেছিল।

বলার ধরনে মনে হল বলতে চায়—কীরকম বুদ্ধি দেখেছেন, বলার আগেই করে রেখেছে। কিন্তু পনেরো টাকা ফি দিয়েছি-এই কথা নিখিল ভোলেনি। কৃতজ্ঞতা না জানিয়েই চলে এল। খুব ভোরে ঘুমভাঙা অভ্যাস নেই, তাই চোখ জ্বালা করছে। ভাত খেয়েই সে মেঝেয় সুমিত্রার খাটের পাশে শুয়ে পড়ল। মা পুরুতমশায়ের বাড়ি গেছে সত্যনারায়ণের পুজোর ব্যবস্থা করতে। ক্যাজুয়াল লিভের হিসাব কষতে কষতে নিখিল ঘুমিয়ে পড়ল।

বিকেলে চা খেয়ে নিখিল থলিটা হাতে ঝুলিয়ে বেরোল। বার বার পকেটে হাত দিয়ে দেখল ডাক্তারের সার্টিফিকেটটা আছে কি না।

গলি থেকে বড়ো রাস্তায় পা দিয়েই নিখিল ভাবল এবার কী করার? চারিদিকেই ঝকঝকে আলো, লোক, গাড়ি। থলিটা এখানেই কোথাও ফেলে রেখে গেলে কেমন হয়! এই ভেবে পায়ের কাছে সেটি রাখল।

অমনি কোথা থেকে একটা লোক এসে বলল, পুজোর বাজার সেরে ফেললেন? লোকটার লন্ড্রি আছে পাড়াতেই। থলিটা হাতে তুলে নিয়ে নিখিল মাথা নেড়ে হাঁটা শুরু করল।

সুদৃশ্য থলিটা রাস্তায় ফেলে রেখে গেলে অনেকেরই চোখে পড়বে, তার মধ্যে পাড়ার লোকও থাকতে পারে। তারপর কেউ হয়তো খুলবে। বস্তুটি দেখেই হাউমাউ করে পুলিশে খবর দেবে। সেই চেনা লোকটি তখন আগ বাড়িয়ে বলবে, হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি লোকটাকে, আমাদের পাড়াতেই ছাব্বিশের দুইয়ে থাকে, নাম নিখিল চাটুজ্যে, ব্যাঙ্কে কাজ করে। তখন পুলিশটা হাতে কাগজের থলিটা ঝুলিয়ে এবং তার পিছনে একপাল লোক মজা দেখা এবং কেচ্ছা রটাবার জন্য বাড়িতে এসে হাজির হবে।

দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে নিখিলের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সামনেই চিলড্রেন্স পার্ক, তারই একটা বেঞ্চে কোলে থলিটা রেখে সে বসল। কিছুক্ষণ সে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল চেনা এমন মানুষ কেউ আছে কি না। কাউকেই সে চিনল না। তবে তাকে চেনে এমন অনেকেই হয়তো থাকতে পারে। চিনেবাদামওয়ালা ডেকে এক আনার কিনল। বাদাম খেতে খেতে ভাঁজতে শুরু করল, কীভাবে থলিটার হাত থেকে বিনা ঝামেলায় রেহাই পাওয়া যায়।

একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। আধমাইলটাক দূরে নির্জন গলি বা মাঠ দেখে থলিটা টুক করে নামিয়ে রেখে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ভেবে নিখিল ভারি সুখবোধ করল। চিনেবাদামওয়ালাকে আবার ডেকে এক আনার কিনল এবং ঝগড়া করে দুটো বাদামও আদায় করল।

একা চুপচাপ বসে থাকা যায় না, বিশেষত তার সামনের দৃশ্য বাচ্চাদের ছুটোছুটি, কিশোরীদের পায়চারিতে নকল গাম্ভীর্য, অফিস-ফেরত বাসের জানলায় সারিবাঁধা বিবর্ণ মুখ, বারান্দায় কনুই রাখা নতদেহ নিঃসঙ্গ যুবতী, রিকশাচালকের ঘামে ভেজা ঘাড়-যদি খুবই একঘেয়ে হয়। নিখিল ভাবল লন্ড্রিওয়ালাটাকে। এমন কোনো বার যায়নি প্যান্টের একটা-না একটা বোম ভেঙেছে। শেষ বার ঝগড়া করতে হয়েছে শার্টে নম্বরি মার্কা দেওয়ার ব্যাপারে। লোকের চোখে পড়ে কালিটা। এই সময়ে হঠাৎ নিখিলের মনে পড়ল, খুব ছেলেবয়সে একটা ডিটেকটিভ বইয়ে সে পড়েছিল ধোপাবাড়িতে কাচা কাপড়ের নম্বরি মার্কা ধরে তদন্ত করতে করতে গোয়েন্দা শেষকালে খুনিকে ধরে ফেলে। এই থলির মধ্যে সুমিত্রার কাপড় এবং বিছানার চাদরে নিশ্চয়ই লন্ড্রিওয়ালাটা নম্বর দিয়েছে। সুতরাং যেখানেই ফেলা যাক-না কেন, পুলিশ ঠিক তাকে বার করে ফেলবেই।

এইবার ঘামতে শুরু করল নিখিল। যদি বছর খানেকেরও বাচ্চা হত, তাহলে সকলের চোখের সামনে দিয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে চিতা সাজিয়ে পোড়ানো যেত। কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে! হইচই করে ভিড় জমাবে। কত কথা জিজ্ঞাসাবাদ করবে। শেষে পুলিশে দেবে। কী ফেললুম সেটা প্রমাণ করা সহজ কথা নয়। সার্টিফিকেটটা দেখালেও বিশ্বাস করবে কেন? ঠিক ওই জিনিসটাই ফেলেছি কি অন্য কাউকে খুন করে কুচিকুচি করে প্যাকেটে বেঁধে ফেলিনি তার প্রমাণ কী!

নিখিলের মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। আর হতে পারে ওই থলিটার রংচং দেখে যদি কেউ এটাকে চুরি করে। চোর নিশ্চয় পুলিশকে খবর দেবে না। নিখিল এধার-ওধার তাকিয়ে চোর খুঁজতে শুরু করল, এবং আশ্চর্য হল একটা লোককেও তার চোর-চোর মনে হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিনই যত লোক দেখে তারমধ্যে প্রায় ডজন খানেককে তার চোর বলে মনে হয়। এমনকী ঘর থেকে ঘড়িটা চুরি যাওয়ায় ঝিকে সবাই সন্দেহ করলেও তার প্রথমেই মনে পড়েছিল বাড়িওয়ালার মুখ। কিন্তু এখন একটাও চোর সে দেখতে পাচ্ছে না।

চোর নিশ্চয়ই কলকাতায় আছে, হয়তো এখন এই জায়গাটায় এক জনও নেই। নিখিল থলি হাতে উঠে পড়ল। থলিটা হাতে ঘুরে বেড়ালে নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো ছিনতাইওয়ালাকে আকর্ষণ করবে। তবে অন্ধকার রাস্তায় ছাড়া তাদের পাওয়া যাবে না। নিখিল আবার বসে পড়ল সন্ধ্যাটা পুরোপুরি নামার অপেক্ষায়।

যখন জাঁকিয়ে সন্ধ্যা নামল নিখিল হাঁটতে শুরু করল উদ্দেশ্যহীনভাবে। বহু ডাস্টবিন সে পেল যেখানে থলিটা ফেলে দেওয়া যায়। কিন্তু একটা ভয় ওর মনে গেঁথে আছে, বলা যায়

কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে—হয়তো অন্ধকার গলিতে কোনো যুবক পাড়ার মেয়েকে চুমু খেতে খেতে কিংবা কোনো বুড়ি অন্ধকার বারান্দায় জপ করতে করতে বা রান্নাঘর থেকে কোনো গৃহিণী। এক বার চেঁচিয়ে উঠলেই হল! তাও যদি না হয়, কাপড়ের নম্বরি মার্কা যাবে কোথায়? পুলিশের গোয়েন্দা তদন্ত করে ঠিক বার করে ফেলবে। তখন অবশ্য সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলা যাবে, মশাই অবৈধ কোনো ব্যাপার নয়। বাড়িওয়ালাকে চোরের মতো দেখতে হলেও বলেছে অ্যাকসিডেন্ট। স্বেচ্ছাকৃত ঘটনা নয়। যেকোনো পরিবারেই এমন ঘটতে পারে। কিন্তু এসব বলার আগেই, পুলিশ দেখে পাড়ায় ফিসফাস শুরু হবে। গুজব রটবে। মাস কয়েক আগেই তো একটা সার্জেন্ট এসেছিল পাড়ায়, অমনি শোনা গেল দেবব্রতবাবু বাড়িতে জুয়া খেলত তাই ধরে নিয়ে গেল। শেষে জানা যায় ভদ্রলোকের একটা রিকশা আছে, সেটা অ্যাকসিডেন্ট করায় থানায় ডাক পড়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে নিখিল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। থলিটা ছিনিয়ে নিতে কেউ তার সামনে ছোরা বার করল না। অথচ বস্তি দেখলেই সে ঢুকেছে। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। প্রায় নির্জন গলি দিয়েও হাঁটল। একটা ঝি শ্রেণির মেয়েমানুষ শুধু তেরছা চোখে তাকে দেখল মাত্র। এ ছাড়া কিছুই না হওয়ায় নিখিল ভাবতে বাধ্য হল, তাহলে?

এইবার সে ভয় পেতে শুরু করল। তাহলে এই সাত মাসের মৃত সন্তানটিকে নিয়ে সে এখন করবে কী? পনেরো-ষোলো ঘণ্টা হয়ে গেল। এবার পচন ধরবে, গন্ধ বেরোবে। অন্তত সুমিত্রার পেটে পুরো সময়টা কাটিয়েও যদি বেরোত। দোষটা অবশ্য কারুরই নয়। অথচ এইরকম একটা নির্দোষ ব্যাপার তাকে বিপাকে ফেলল। নিখিলের খুব রাগও হল। সেইসঙ্গে এটাও টের পেতে লাগল—আসলে সে ভয়ানক ভীতু। রীতিমতো কাপুরুষ। এরকম ঘটনা নিশ্চয় কলকাতায় এই প্রথম ঘটছে না। সেসব ক্ষেত্রে কিছু-একটা অবশ্যই করা হয়েছে। কিন্তু নিখিল ভাবল, তারা তো আমার মতো নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতিগত হুবহু মিল থাকতে পারে না। তারা নিশ্চয়ই সাহসী ছিল অন্তত আমার থেকে।

হঠাৎ নিখিলের মনে হল, তার থেকেও ভীতু এমন কারুর ঘাড়ে যদি দায়িত্বটা চাপিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে রেহাই মিলবে। ভীতুরা পুলিশে যাবে না। থলিটা নিয়ে এইভাবেই ঘুরে বেড়াবে আর ভাববে কী করে রেহাই পাওয়া যায়। অবশ্য গোপনেই তার ঘাড়ে চাপাতে হবে, নয়তো জিনিসটা কার জানতে পারলে বাড়ি বয়ে ফেরত দিয়ে আসবে।

চেনাশুনো ভীতু কে আছে নিখিল তাই ভাববার জন্য একটা ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে পড়ল। বহুজনের নাম তার মনে এল। তারা কী পরিমাণ ভীতু তার নানান উদাহরণ মনে করতে লাগল। অবশেষে শশাঙ্ককেই তার পছন্দ হল। প্রায় চার বছর সুমিত্রার গৃহশিক্ষক ছিল। সুমিত্রাদের তরফ থেকেই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু শশাঙ্ক নানান অজুহাত দেখিয়ে বিয়েতে রাজি হয়নি। নিখিলের সঙ্গে সুমিত্রার আলাপ ওই করিয়ে দেয়। অবশ্য মাস ছয়েক হল ও বিয়ে করেছে। এখন যদি শশাঙ্কর সামনে হাজির হওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয় ওর মনের মধ্যে সুমিত্রা, প্রেম, বিবাহ প্রস্তাব অগ্রাহ্য অর্থাৎ যাবতীয় ধাষ্টামো এবং অন্য আরে এক জনকে বিবাহ সব মিলিয়ে অপরাধবোধ তৈরি করবে। প্রাক্তন প্রেমিকদের তুল্য ভীতু আর কে? এই থলিটা ওর হাতে কোনোরকমে গছাতে পারলে, তারপর শশাঙ্করই ঝামেলা। বস্তুত সুমিত্রার প্রতি ওর বিশ্বাসঘাতকতার এটা ভালো একটা শাস্তিও হবে।

নিখিল এতসব ভেবে প্রফুল্লবোধ করল। তবে পুরোপুরি অস্বস্তি ঘুচল না। শশাঙ্ক থাকে একটা গলির এক-তলায়। কড়া নাড়তে ঝি দরজা খুলল। শশাঙ্ক বেরিয়ে এল, পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। নিখিলকে চিনতে পেরে উচ্চকণ্ঠে সাড়ম্বর অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে গেল।

সন্ধ্যা, দ্যাখো দ্যাখো কে এসেছে। এই বলে শশাঙ্ক ডাকতেই ভিতর থেকে ওর বউ এল। দেখতে মোটামুটি। রেডিয়োয় গান গায়, দু-একটা রেকর্ডও আছে। নিখিল দাঁড়িয়ে উঠে

নমস্কার করল।

আপনার কথা ওর কাছে শুনেছি। সন্ধ্যার এই কথায় নিখিল বিস্মিত হল। সুমিত্রার স্বামীর প্রসঙ্গ বউয়ের কাছে ভীতু শশাঙ্ক কি তুলবে? না কি এটা আলাপ করার একটা কেতা!

আমার সব বন্ধুর গল্পই করেছি সন্ধ্যার কাছে, সুতরাং পরিচয় করিয়ে গুণপনা ব্যাখ্যার দরকার আর হবে না।

শশাঙ্ক একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে পা নাচাতে লাগল। ঘরের সব আসবাবপত্রই যে ওদের বিয়ের পর কেনা তা রঙের ঔজ্জ্বল্যতেই বোঝা যায়।

ওঁর গুণপনার খবর অবশ্য না বললেও আমরা জানি। নিখিল ইচ্ছে করেই আমরা বলল। সন্ধ্যাও যথারীতি বিনয় জানাতে ভারি তো গুণপনা, আমার মতো গাইয়ে গন্ডা গন্ডা আছে ইত্যাদি কথা পরমসুখে বলে গেল। এরই মধ্যে নিখিল শশাঙ্কর হাবভাব জরিপ করে একটা প্ল্যান তৈরিতে হাত দিল।

আমি তো এলাম, এবার আপনারাও একদিন চলুন।

নিশ্চয়। শশাঙ্ক যেন এই প্রস্তাবটার জন্য ওত পেতেই ছিল। কবে যাব বলো, সামনের রোববার? তাহলে ইলিশ খাওয়াতে হবে। তেলাপিয়া খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেল। সুমিত্রা দারুণ ইলিশ-ভাতে করতে পারে।

নিখিলকে হাসতেই হল। সন্ধ্যা কপট উদবিগ্নতা দেখিয়ে বলল, এখন ইলিশ পাওয়া যায়

আর তুমি ভদ্রলোককে বিব্রত করতে বায়না ধরলে ইলিশ খাব। আরে ও আবার ভদ্রলোক কী, ও তো নিখিল। ওকে সবথেকে লেগপুল করতাম আমি আর সনৎ। সনৎ লিখেছে ছুটি পেলে জানুয়ারিতে কলকাতা আসবে। তোর ঠিকানাটা লিখে দিস ওকে পাঠাব। শশাঙ্ক সবিস্তারে সনৎ-এর গল্প করে চলল আর নিখিল ভাবল, একী!

পুজোর বাজার নাকি? হঠাৎ সন্ধ্যা প্রশ্ন করল। নিখিল লাজুক হেসে ঘাড় নাড়ল। শশাঙ্ক ছোঁ মেরে থলিটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, দেখি বউয়ের জন্য কী শাড়ি কিনলি। নিখিল তাড়াতাড়ি ওর হাতটা চেপে ধরল। আরে ধ্যাত, দেখার কী আছে আর। মার থান, ঝিয়ের কমদামি একটা মিলের আর সুমিত্রার একটা তাঁতের ষোলো টাকার শাড়ি। খুলিসনি প্লিজ। বেশ বাঁধাছাদা রয়েছে আবার কেন খাটুনি বাড়াবি।

সন্ধ্যা দেখেছ, বউয়ের শাড়ি আছে কিনা, অন্যের হাতের ছোঁয়াতেও আপত্তি। কী রঙের কিনেছিস? স্লেট না ডিপ মেরুন? একটা রং সুমিত্রা একবায় পরেছিল মেরুনের ওপর গ্রিন

ফুটিফুটি, পাড়টা হোয়াইট, দারুণ দেখাচ্ছিল ওকে।

রং খুব ফর্সা বুঝি? সন্ধ্যাকে খুব কৌতূহলী দেখাল।

না খুব নয়, আপনার মতোই।

ওমা, তাহলে তো বেশ কালো।

আপনি কালো হলে আমরা তো বেশ কালো।

নিখিল হাস্যমুখে শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে সমর্থন চাইল। শশাঙ্ক বড় করে ঘাড় নাড়ল। রঙের প্রশংসায় পুলকিত সন্ধ্যা বলল, দেখেছেন চা দিতেই ভুলে গেছি।

সন্ধ্যা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই নিখিল বলল, শশাঙ্ক, একটা খুব অসুবিধায় পড়ে গেছি। জিজ্ঞাসু নেত্রে শশাঙ্ক তাকিয়ে রইল। তখন নিখিল আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা বলে টেবলের ওপর রাখা কাগজের থলিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওর মধ্যেই সেটা রয়েছে।

শশাঙ্ক চড়াং করে সিধে হয়ে বসল। তার মানে, তুমি ওই কুৎসিত জিনিসটা আমার টেবিলের উপর রেখেছ? নামাও নামাও, বলছি। দাঁত চেপে হিসহিস করে শশাঙ্ক আঙুল দিয়ে মেঝে দেখাল। নিখিল নামিয়ে রাখল।

কী করতে এখানে এনেছ? চাপাস্বরেই শশাঙ্ক বলল, ভিতরের দিকে চোখ রেখে।

এটাকে নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

ফেলে দেবে, আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

বলাটা তো খুবই সোজা, ফেলতে গেলেই লোকে দেখে ফেলবে। তখন চিৎকার হবে, একগাদা লোক জমবে, টানতে টানতে হাজার হাজার লোকের মধ্য দিয়ে থানায় নিয়ে যাবে। অশ্লীল কথা বলাবলি করবে।

তা আমার কী করতে হবে?

এটার একটা বন্দোবস্ত করে দে, শশাঙ্ক, প্লিজ। তোর কথাতেই বিয়ে করেছিলুম। এবার তুই আমার কথা রাখ। নিখিল হাত বাড়াল শশাঙ্কের হাত চেপে ধরার জন্য। হাত দুটো তার আগেই শশাঙ্ক তুলে নিয়েছে। টেবলে নিখিলের দুটো হাত থলিটার পাশে পড়ে রইল।

আমার কথাতেই কি শুধু বিয়ে করেছিলি? সুমিত্রাকে তোর পছন্দ হয়নি?

নিশ্চয়, ওকে নিশ্চয় ভালোবেসেছিলুম, আজও বাসি। কিন্তু তোর সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক ছিল তাও জানি।

তাই এক্সচেঞ্জ করতে এসেছিস এই জিনিসটার বদলে। শশাঙ্ক থলিটার দিকে আঙুল তুলেছে তখন চায়ের কাপ হাতে সন্ধ্যা ঢুকল।

কীসের এক্সচেঞ্জ? হাসিমুখে সন্ধ্যা একটা চেয়ারে বসল।

নিখিল বলছিল তুমি যদি গোটা কতক গান শোনাও। তাইতে বললুম বউয়ের শাড়িটা তার বদলে দিতে হবে।

আহা, পছন্দ করে উনি কিনেছেন। আর গান যা গাই সে এমন কিছু নয়।

সন্ধ্যা মেয়েটি ভালো। এরপর খুব বেশি সাধাসাধি করতে হয়নি। খালি গলায় তিনটি গান করল। শশাঙ্ক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নিখিলকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। পাঞ্জাবিটা দাও।

ওরা দুজন চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। রাত হয়েছে। রাস্তায় লোকজন কম। দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আলোর পরিমাণ খুবই অল্প। নিখিলের মনে হল, রাস্তার যেকোনো জায়গায় থলিটা রেখে নির্বিবাদে চলে যাওয়া যায়।

ওটা দে। শশাঙ্ক দাঁড়িয়ে পড়ল।

কেন!

ওই ডাস্টবিনটায় ফেলে দি।

সে তো আমিও পারতুম, তাহলে তোর কাছে এলুম কেন?

তবে কী মতলব তোর? হঠাৎ শশাঙ্ক গলার স্বর ও দাঁড়াবার ভঙ্গি পালটে ফেলল। নিখিল পা-পা করে পিছোল। দূরে পানের দোকানটা মাত্র খোলা। এখন থলি হাতে ছুটতে শুরু করলে চোর বলে ধরা পড়তেই হবে। নিখিল দাঁড়িয়ে রইল।

তুমি এখন সুমিত্রার বিয়ে করা স্বামী। শশাঙ্ক ওর বুকের জামা মুঠো করে ধরল, তুমি এই জিনিসটার বৈধ অভিভাবক, তার সার্টিফিকেটও পকেটে আছে। অতএব এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। আমার দায়িত্ব বহুদিন আগে শেষ হয়েছে। তবুও আমার কাছে কেন এসেছ? নিখিলকে ঝাঁকাতে শুরু করল শশাঙ্ক।

তুই আমার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিস। তুই কাওয়ার্ড, তুই ইররেসপনন্সিবল। নিখিল মরিয়া হয়ে উঠল শূন্য প্রয়ান্ধকার রাজপথে। শশাঙ্কর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ধাক্কা দিল। বদলে জোর চড় মারল শশাঙ্ক। এইবার ক্রোধে দিশেহারা হয়ে মারবার জন্য নিখিল ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হঠাৎ জানালা খুলে দোতলা থেকে এক পুরুষকণ্ঠ গর্জে উঠল, কী হচ্ছে, অ্যা, গুণ্ডামি? লোকটা চিৎকার করে উঠল! দুড়দাড় করে কিছু লোকের ছুটে আসার শব্দ এল অন্ধকারের মধ্য থেকে।

নিখিল আর চিন্তা করার সুযোগ নিজেকে দিল না। প্রাণপণে রাস্তার নির্জন দিকে ছুটতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতে যখন দম ফুরিয়ে এল, থামল। তখন পায়চারি করতে করতে এক কনস্টেবল তার কাছে এসে কেন সে এমন করে হাঁপাচ্ছে তার কারণ জানতে চাইল। নিখিল বলল, একটা গুণ্ডা তাকে তাড়া করেছিল। কনস্টেবলটি কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে আচ্ছা ঠিক হ্যায় বলে পায়চারি করতে করতে চলে গেল।

নিখিল এইবার টের পেল কাগজের থলিটা তার কাছে নেই। ছোটার সময়ও হাতে ছিল না। সেটি শশাঙ্কর কাছেই রয়ে গেছে। শশাঙ্ককে লোকগুলো জিজ্ঞাসা করলে ও নিশ্চয় বলবে গুণ্ডা তাড়া করেছিল। গুণ্ডা নিশ্চয়ই সুদৃশ্য কাগজের থলিতে ভরা কাপড়ের প্যাকেট ফেলে যায়নি। লোকগুলো খুব খুশি হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করবে, ভাগ্যিস আমরা এসে পড়লুম তাই ভদ্রলোকের এই জিনিসটা রক্ষে পেল। এই বলে তারা তার থলিটা শশাঙ্কর হাতে তুলে দেবে।

নিখিল বুকপকেটে হাত দিয়ে সার্টিফিকেটটা অনুভব করে ভারি আরাম পেল। এবং সে মনশ্চক্ষে দেখল, শশাঙ্ক সেই থলিটা হাতে নিয়ে হেঁটে চলেছে।

ঘর

চারটি ভাই এবং তাদের বউ-ছেলে-মেয়েরা থাকতেও অমলা জানে পৃথিবীতে তার একটি মাত্র ভরসা অন্ধ বুড়ি মা-টি। ছাদের এই ঘরটিতে সে থাকতে পারছে যেহেতু মাকে দেখাশোনা করার আগ্রহ কারুর নেই; এবং মা বলেই বারান্দায় ফেলে না রেখে আস্ত একটি ঘরে থাকতে দিয়েছে। ছোটোভাই কমলের আজও বিয়ে হয়নি, কারণ আলাদা কোনো ঘর নেই। মা মারা গেলে অর্থাৎ তিন-তলার ঘরটি খালি হলে তার বিয়ের উদ্যোগ করা হবে। মেজোবউয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া একটি মেয়েকে পছন্দ করে রাখা হয়েছে।

সিঁড়িতে পিছলে পড়ে মা যেদিন মাথায় চোট পেল সেদিন থেকেই অমলার ভাবনামা তো আর বাঁচবে না, তাহলে কী হবে? একদিন পনেরো টাকার টিউশনিতে যাবার পথে এই কথা ভাবতে ভাবতেই সে হাজির হল প্রভাসের বাড়ি।

প্রভাস মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছিল, অমলাকে দেখে অবাক হল; কেননা গত চব্বিশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ প্রভাসের বিয়ে হওয়ার পর পাঁচ-ছ বারের বেশি তাদের সাক্ষাৎ ঘটেনি। মক্কেলটি বিদায় নিতেই অমলা গম্ভীর হয়ে বলল, একটা ব্যাপারে পরামর্শ নিতে এলুম।

প্রভাস তার পেশাগত গাম্ভীর্য মুখে ছড়িয়ে তাকিয়ে রইল।

মা-র অবস্থা তো গত কয়েক মাস থেকেই সুবিধের নয়। মারা গেলে আমি কী করব?

কী করব মানে?

আমার ভাইদের তো জান, তখন আমি কোথায় দাঁড়াব? ঘর জুড়ে থেকে কমলের বিয়ে বন্ধ করে আছি, ওর বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। মেজো বউ আমাকে দেখতে পারে না, অথচ মেজদাই সংসারের বড়ো খুঁটি। বড়দা আর সুবল কোনোক্রমে দিন চালায়। মা আছে। তাই আমিও আছি, কিন্তু মা বেশিদিন আর বাঁচবে না।

মোটা পেনসিলটা টেবলে ঠুকতে ঠুকতে প্রভাস পেশাদারি পরামর্শ দিল–তোমার উচিত খোরপোশ দাবি করে মামলা করা, বহুদিন আগেই অবশ্য করা উচিত ছিল।

কিন্তু স্বামী তো আমায় ত্যাগ করেনি, আমিই চলে এসেছিলাম।

শুনেছি আবার বিয়ে করেছে। তোমায় যখন ডিভোর্স করেনি তাহলে আইনের চোখে সে বিয়ে অবৈধ, তুমিই তার বৈধ স্ত্রী। আর কে কাকে ত্যাগ করেছে সে নয় উঁকি লে বুঝবে, মোটকথা তোমার ভরণপোষণে সে এখনও বাধ্য।

অমলা ঘাড় হেঁট করে চিন্তা শুরু করল। প্রভাস নাগাড়ে ঠক ঠক করে যাচ্ছে। দেমাক দেখিয়ে যার কাছ থেকে চলে এসেছে এই বাইশ বছর পর তার কাছেই হাত পাততে হবে এটা ভাবতে অমলার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্য কিছু উপায়ে যদি একটা ব্যবস্থা করা যায়…

কী, রাজি নও? ভারী গলায় প্রভাস জানতে চাইল।

তাই তো ভাবছি।

পরিহাস করে প্রভাস বলল, মামলা-টামলা না হলে উকিলদেরই-বা চলে কী করে? দু চারটে ফি তো খাব।

অমলা হেসে বলল, মামলা করার টাকা কোথায়? ওটা তোমাকেই দিতে হবে।

গম্ভীর হল প্রভাস, পেশাগত গাম্ভীর্যটা আবার মুখে লাগিয়ে বলল, আগে তুমি বরং দেখা করো। কী বলে শোনো, যদি কিছু করতে রাজি না হয় তখন মামলার কথা ভাবা যাবে। ও কোথায় থাকে তা জান তো?

বাড়ি জানি না, ভাড়াবাড়িতে থাকে। তবে দোকানটা জানি। মনোহারী দোকান

বাগবাজারে।

তাহলে আগে সেখানে গিয়েই দেখা করে কথা বলল।

অমলার মনে হল তার থেকে বরং মামলা করাই ভালো। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আমাকে খেতে-পরতে দাও বলার মতো লজ্জা আর কী থাকতে পারে। কিন্তু মামলার খরচ কে দেবে?

মামলার খরচ তুমিই দাও-না। অমলার অজান্তে স্বরটা কাকুতির মতো শোনাল।

আমার ফি নয় ছেড়ে দিলুম, কিন্তু কোর্ট খরচ তো আছে।

আশ্চর্য! হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল অমলা, আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? আর কয়েকটা টাকার জন্য সাহায্য করবে না?

প্রভাস এমনভাবে তাকাল যেন শেখানো সাক্ষীটি বক্সে উঠে উলটো কথা বলছে। কে দায়ী, আমি?

তোমার চিঠিগুলোই তো সর্বনাশ করে ওর হাতে পড়ে।

সে তো আর তোমায় তাড়িয়ে দেয়নি। এই তো বললে—নিজেই চলে এসেছি।

হ্যাঁ, তোমার ওপর ভরসা করেই চলে এসেছিলুম।

আমি তো তোমায় চলে আসতে বলিনি, কোনো চিঠিতে কি সেরকম কথা ছিল? বোকামি করেছ যেমন তার ফল তো ভোগ করবেই।

অমলা থিতিয়ে গেল। প্রভাসের মুখে বিরক্তি, অস্বস্তি। শীতকালেও কপালে ঘাম ফুটল, দুটো কাঠি ভেঙে সিগারেট ধরাল।

চিঠিগুলো কি তোমার স্বামী রেখে দিয়েছে?

না।

কী বলেছিল? শুধু বলেছিল, একেই কেন বিয়ে করলে না। ওকে বলিনি যে তুমি আগেই বিয়ে করেছ, বড়োলোকের একমাত্র মেয়েকে।

তাতে কী হয়েছে, প্রভাস জবরদস্ত সাক্ষীর মতো রোখা সুরে বলল, তোমার কি হিংসে হচ্ছে? লীলার বাবা না হলে কি ওকালতিতে দাঁড়াতে পারতাম?

আমি ওসব ভেবে বলিনি, তুমি চটছ কেন? অমলা টেবলে কনুই রেখে ঝুঁকে পড়ল।

গলার স্বর দ্রুত নামিয়ে প্রভাস সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, চটেছি কে বলল? বয়েস পঞ্চাশ পেরোল, এসব ব্যাপার নিয়ে চটাচটি করার ইচ্ছেও হয় না। অল্প বয়সে ছেলে মেয়েতে মেলামেশা হয়, বিয়ে-থা করে সেসব ভুলে যায়। তুমিই-বা ভুলে যাওনি কেন?

আমি পারিনি প্রভাস, আমি পারিনি।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল অমলা।

থামো। প্রবাস রূঢ় ধমক দিল, কান্নাকাটি কোরো না। মনে রেখো, আমার স্ত্রী, ছেলে মেয়েরা এ বাড়িতে রয়েছে। তোমার মামলা আমি করে দেব, একটি পয়সাও লাগবে না, এখন এসো।

কান্নার যে-ইচ্ছেটা অমলাকে পেয়ে বসেছিল, তা প্রভাসের দ্রুত একটানা কথাতে মুছে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলল, যা সব লিখেছিলে তার সব মিথ্যে ছিল?

কী যেন বলতে গিয়ে প্রভাস থেমে গেল। টেবলে গ্লাসভরা জল রয়েছে। এক চুমুকে শেষ করে গ্লাস হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, মুখে মাথায় জল দিয়ে ফিরল।

আমি যাচ্ছি, অমলা উঠে দাঁড়াল। প্রভাস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমার কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা সব কিছুরই একটা ছক তৈরি হয়ে গেছে অমু, তা ভেঙে বেরোনোর সাধ্য এখন আর আমার নেই। আমি সুখে আছি, আমায় তাই থাকতে দাও, আমায় কিছু মনে করতে বোলো না।

অমলা নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল, প্রভাসের কেশবিরল মাথাটা নুয়ে পড়ল টেবিলের উপর। ঘর থেকে বেরিয়ে যখন সে সদর দরজায় পৌঁছেছে, তখন ছুটে এল প্রভাস।

তোমায় আমি বরং মাসে মাসে কিছু দিয়ে সাহায্য করব, মামলা করে দরকার নেই।

অমলার মনে হল প্রভাস যেন প্রায়শ্চিত্ত করতেই কথাটা বলল। ওর ভঙ্গিতেও অপরাধী অনুকরণ। দেখে মায়া হয়, সংসার নিয়ে যেমন আছে থাকুক।

তার দরকার নেই। মনে হবে তোমায় ভয় দেখিয়ে আদায় করেছি।

অমলা আর দাঁড়াল না। বোকামি করেছি কি? আনমনে ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির দিকে চলল। মায়া হয়। প্রভাস এখনও বুকে মোচড় দেয়, ও এখনও অমানুষ হয়ে যায়নি। এর থেকে বেশি আর কী চাইবার আছে? এ বয়সে এ জেনেই সুখ। কিন্তু আমি কী করব এখন? শেষে কি ভিখিরির মতো হাত পেতে খোরপোশ নিতে হবে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে যাচ্ছে, এখন আর কোনোরকমে বোকামি করা চলবে না। প্রভাসের প্রস্তাবটা এক কথায় নাকচ করাটা বোধ হয় ঠিক হল না।

রাস্তা পার হবার জন্যে সে দাঁড়িয়েছে, পিছন থেকে দিদিমণি বলে সরস্বতীবালা ডাক দিল! অমলাদের বাড়িতে কাজ করত, মেজোবউ মাস তিনেক আগে হঠাৎ ছাড়িয়ে দেয়।

দিদিমণি বাড়ি যাচ্ছ নাকি, চলো আমিও যাব।

কেন গো?

হেস্তনেস্ত করব একটা, নয়তো আত্মঘাতী হব। দ্যাখো ছোটোবাবু কী সর্বনাশ করেছে আমার। সরস্বতীবালা দেহের সামনে থেকে আঁচল সরাল।

কদ্দিন! অমলা আঁতকে উঠল।

চার মাস। এখন আমি কী করব বললা তো, ললাকে সন্দেহ শুরু করেছে। ছোটোবাবু বলেছিল আলাদা ঘর ভাড়া নিয়ে আমায় রাখবে।

চোখে জল নিয়ে কথা শুরু করে গনগনে রাগে শেষ করল সে। অমলা সিঁটিয়ে গেল কেলেঙ্কারির কথা ভেবে।

আমার একটু কাজ আছে সরস্বতী, আমি যাই।

বলেই অমলা হাঁটতে শুরু করল। ব্যাপারটা জানাজানি হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? কমল যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করুক ওর। এসব মেয়েমানুষরা তো টাকা পেলেই খুশি। তবে কমল টাকা পাবে কোত্থেকে? তা যদি থাকত আলাদা বাসা করে বিয়েই করতে পারত। এখন যদি এই ঝিটাকেই বিয়ে করে বসে!

হাঁটতে হাঁটতে অমলা বাগবাজারের দিকে চলে এসেছে। আর কিছুটা গেলেই প্রফুল্লর দোকান। আজকেই কথা বলে দেখি, মানসম্মান নিয়ে বসে থাকলে এ বয়সে চলে না। তেজ দেখাবার বয়স চলে গেছে, লজ্জা কীসের, বিয়ে তো হয়েছিল, এই ভেবে অমলা দোকানের সামনে দাঁড়াল।

খদ্দের ভেবে এগিয়ে এসে প্রফুল্ল কাউন্টারে ঝুঁকে বলল, বলুন।

বাইশ বছর দেখেনি, সুতরাং পরিচয় না দিলে চিনতে পারবে না। নিজের নাম বলতে অমলার সংকোচ হল।

কিছু কিনতে আসিনি। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে সে বলল।

চশমার পুরু কাচের পিছনে প্রফুল্লের দুটি চোখ বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে, হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। দোকানের আলো মলিন। সামগ্রীগুলোও মলিন। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে অমলার যাবতীয় উত্তেজনা স্বাভাবিক হয়ে গেল।

তাহলে কী চাই?

স্বরে গাম্ভীর্য পরিমাপ করে অমলা বুঝল, চিনতে পেরেছে।

কথা ছিল।

প্রফুল্ল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ডান গালের আঁচিলটার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেনি, গোঁফটা আগের থেকেও মোটা, জামার কলারে ময়লা, নখগুলো বড়ো, চামড়া খসখসে। এইসব জিনিস অমলাকে একদা বিরক্ত করেছিল। এখন সে তাই বোধ করল।

আমার সম্বন্ধে কী ভেবেছ? স্পষ্ট করে উচ্চারণের জন্য অমলা কেটে কেটে বলল।

আমার তো ভাবার কথা নয়।

স্ত্রীর সম্পর্কে স্বামী ভাববে, এটাই তো নিয়ম।

স্ত্রীরও তো নিয়ম মানার অনেক কিছু আছে। তা ছাড়া তুমি যে আমার স্ত্রী, কে বলল?

আইন।

ওঃ, আইন দেখাতে এসেছ! বোধ হয় তার কাছ থেকেই তালিম পেয়েছ?

ঝগড়া করার জন্য প্রফুল্লর অবয়ব প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। অমলা ধীরকণ্ঠে বলল, তার কাছ থেকে তালিম পেলে এখানে না এসে কোর্টেই যেতাম।

প্রফুল্ল থতমতো খেল। বিচলিত হয়েছে বোঝা গেল হঠাৎ ঝাড়ন নিয়ে প্লাসটিক ব্যাগগুলো ঝাড়ার বহর দেখে। এই সময় এক খদ্দের এল পাঁউরুটি কিনতে। অমলা একধারে। সরে দাঁড়াল। যাবার সময় লোকটি অভিযোগ করল, কালকের রুটি শক্ত বাসি ছিল।

কোম্পানি যেমন দেয়, আমি কী করব বলুন?

কোম্পানিকে জানান।

লোকটি চলে যেতেই অমলা বলল, তাহলে কী? ভাইদের সংসারে আছি। তাদের অবস্থা এমন কিছু ভালো নয়। এই বয়সে রোজগারই-বা কী করব? শাড়ি-গয়না চাই না, খাইখরচের টাকাটা তো দেবে।

কেন, আর কেউ কি দেবার নেই?

আর কেউ মানে?

প্রফুল্ল চুপ করে রইল। অমলা কাউন্টারে চাপড় দিয়ে বলল, তোমাকে দিতে হবে।

যদি না দিই?

তাহলে মামলা করে আদায় করব।

যদি বলি তুমি স্বেচ্ছায় গেছ, আমি বরাবরই তোমাকে কাছে রাখতে রাজি ছিলাম, এখনও আছি।

বলব মিথ্যাকথা। বলব প্রমাণ করো যে আমি স্বেচ্ছায় চলে গেছি। বলব, আর একটা বিয়ে করার জন্য আমায় তাড়িয়ে দিয়েছ; বলব, এখনও আমি তোমার কাছে যেতে চাই।

এ সবই তো মিথ্যাকথা। তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য কি তোমাদের বাড়ি আমি যাইনি? কী বলেছিলে মনে আছে কি? —যখন দরকার বুঝব যাব। দু-বছর অপেক্ষা করে তবেই বিয়ে করি। সেই চিঠিগুলো যদি তোমায় ফেরত না দিতাম, তাহলে কি বলতে পারতে প্রমাণ করার কথা?

চিঠিগুলো রাখনি কেন?

বোকামি করেছি।

খদ্দের ঢুকতেই প্রফুল্ল থেমে গেল। জুতোর ক্রিম চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে নেই বলে দিয়ে কাউন্টারের ডালা খুলে সে বেরোল। দোকানের দরজার পাল্লা বন্ধ করে মাত্র একটুখানি খুলে রাখল।

দাঁড়িয়ে কেন, এই টুলটায় বসো।

অমলা বসল, কী কাজে লাগবে ভেবেছিলে?

প্রফুল্ল কাউন্টারে কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, অন্তত ওগুলো দিয়ে বাধ্য করতে পারতে তোমাকে বিয়ে করতে।

আমার তো বিয়ে হয়ে গেছল। ওরও হয়ে গেছল। ওসব চিন্তা আমি করিনি, করে লাভ হত না।

তোমার না হোক আমার তো হত। তাহলে খোরপোশের কথা আজ উঠত না। এই তো দোকান দেখছ, মাসে কতই-বা রোজগার, বড়োজোর শ-দুই টাকা। এর থেকে চল্লিশ কা করে যদি দিতে হয়, তাহলে আমার সংসার অচল হয়ে পড়বে। তা ছাড়া এখন যদি বলি তোমাকে নিতে রাজি আছি, আসবে তুমি? পারবে আমার সংসারে থাকতে?

প্রফুল্ল চোখ সরিয়ে গণেশমূর্তিটার উপর রাখল। অমলা ইতস্তত করে কোনোক্রমে বলল, ছেলে-মেয়ে ক-টি?

বড়োটি মেয়ে, আঠারোয় পড়ল। সম্বন্ধ করছি, তবে সকলেরই খাঁই বেশি। পরে চার ছেলে, সবাই পড়ছে। এই আয়ে চালাতে পারি না অমলা। ভিখিরিরও অধম হয়ে থাকি। করুণভাবে প্রফুল্ল তাকিয়ে রইল। অমলা বাধ্য হল অন্যত্র তাকাতে।

ওরা কি আমার কথা জানে?

জানে।

কী বলে?

তোমায় নিয়ে কোনো আলোচনাই হয় না।

আর কেউ কিছু বলে না?

গীতা তোমায় শুধু এক বার দেখতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলুম কিনা তুমি ওর থেকেও সুন্দরী।

অমলা উঠে দাঁড়াল। প্রফুল্ল ধড়মড়িয়ে সিধে হয়ে বলল, চললে?

হ্যাঁ।

তুমি কী করবে?

কী আর করব, আমাকে তো বাঁচতে হবে। তোমরা সবাই বলছ বোকামি করেছি। এখন মনে হচ্ছে সত্যি তাই করেছি।

তুমি দাবি করবে? তা অবশ্য পারো। কিন্তু সেটা ফাঁকি দিয়ে ঠকিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না। কী করেছ স্ত্রী হিসাবে, যেজন্য দাবি জানাতে পার?

ফ্যাকাশে মুখে শুনে যাচ্ছিল অমলা, প্রফুল্লের ভাবভঙ্গিতে ভয় পেল। হয়তো ঝাঁপিয়ে গলা টিপে ধরতে পারে। দরজার দিকে এগোতেই প্রফুল্ল দরজা আগলে দাঁড়াল।

যেতে দাও। নইলে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব।

অমলা, আমার সংসারের এই সামান্য আয়ে ভাগ বসিয়ো না। জোড়হাতে মিনতি করছি, ছা-পোষা মানুষ আমি!

তাহলে আমি কী করে বাঁচব! এই বলে ধাক্কা দিয়ে প্রফুল্লকে সরিয়ে অমলা রাস্তায় নেমে এল। ওর সঙ্গে যাবার জন্য কয়েক পা এগিয়ে, দোকান খোলা আছে খেয়াল হতেই প্রফুল্ল দাঁড়িয়ে পড়ল। অমলা ঊর্ধ্বশ্বাসে হেঁটে শীঘ্র দূরে চলে যেতে যেতে ভাবল, এমন একটা জায়গা কি কোথাও নেই, যেখানে মাথা কুটে রক্তারক্তি করা যায়।

বাড়ি ফিরে অমলা নিঃসাড়ে দোতলায় উঠল। মেজোবউয়ের ঘরের দরজায় তালা, বোধ হয় সিনেমা দেখতে গেছে। বড়োবউ দালানে বাচ্চার দুধ গরম করছে। ফিসফিস করে অমলা জিজ্ঞাসা করল, কেউ এসেছিল?

কে আবার আসবে। বড়োবউ কাজে মন দিল। অমলা তিন-তলার সিঁড়ি ধরল। যেখানে বাঁক নিয়েছে সিঁড়িটা, একফালি চাতাল বেরিয়ে গেছে। কমল তার ক্যাম্প-খাটে শুয়ে আছে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। ওর পাশ দিয়ে পা টিপে অমলা উপরে উঠে গেল।

মাঝরাতে অমলার মনে হল সিঁড়িতে কী-যেন একটা হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে পা টিপে সিঁড়ির মাথায় এসে উঁকি দিল। অন্ধকারটা চোখে সয়ে যাবার পর বুঝল, উঁচুমতো কিছু একটার উপর দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূৰ্তি কড়িকাঠে কিছু-একটা বাঁধছে। কমলকে ধমক দেবার জন্য নিশ্বাস টেনে এবং ওকে ব্যাঘাত না করে বিছানায় ফিরে এসে অমলা সেই নিশ্বাস ত্যাগ করল।

চতুর্থ সীমানা

”তাকিয়ে দেখ, সমুদ্র তাই না? মনে হচ্ছে যেন আকাশটা গড়িয়ে পড়েছে।”

রুবি স্বামীর কথা অনুসরণ করে চোখটাকে আকাশ বরাবর উত্তর-দক্ষিণ করিয়ে ঘাড় নাড়ল। রাস্তা সোজা চলে গেছে। মাঝখানে খানিকটা উঁচু হয়ে থাকায় এবং তার ওপারে গাছপালা বাড়ি ইত্যাদি না থাকায় সত্যিই মনে হয় আকাশটা মাটির দিকে নেমেছে।

”যেখানে আকাশটা মাটি ছুচ্ছে ওখানেই জমিটা।” বেসরকারী বাস ওদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ওরা রাস্তা পার হবার আগে এই নতুন কলোনিটার দিকে তাকিয়ে এই সব মুগ্ধ হয়ে রাস্তা পার হল।

কাঁচা ড্রেনের উপর সিমেন্টের সেতু। পার হয়ে কলোনির সদর। সোজা রাস্তাটাই রাজপথ, কলোনিকে দুভাগ করে ‘এ’ এবং ‘বি’ ব্লক তৈরি করেছে। বাস চলাচলের রাস্তার ধার থেকেই বাড়িগুলো তৈরি হতে হতে পিছু হটেছে। প্রায় আধাআধি বাড়িতে ভরে গেছে। পিছন দিকে এখনো মাঠ। মাটি পড়ছে জমি ভরাট হচ্ছে। দুচার বর্ষা না গেলে আর বাড়ি উঠবে না।

বাঁ হাতে কোঁচাটা একটু তুলে নিখিল ছোট্ট একতলা বাড়িটাকে থুতনি দিয়ে দেখিয়ে বলল,”ইউনিভার্সিটির প্রফেসারের বাড়ি। ওর মত ইকনমিস্ট ইন্ডিয়াতে খুব কম আছে।”

রুবি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সমীহভরে বলল, ”বড়লোক?”

”খুব নয়, তবে দিল্লীতে প্রায়ই ডাক পড়ে।”

ওরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। রুবির জুতোটা নতুন। এখনো খাপ খায় নি। নিখিল সিগারেট ধরাতে দাঁড়াল। রুবি বাড়িগুলো দেখতে দেখতে বলল,”ফাঁকা ফাঁকা ঘেষাষেঘি নয়।” দুটো কাঠি নিভেছে, তৃতীয়টা জ্বালাতে অপেক্ষা করছে বাতাস পড়ে যাওয়ার সুতরা্ং নিখিল জবাব দিল না।

কয়েকজন গৃহিণী গল্প করতে করতে বড় রাস্তায় নামল কাছেরই একটা বাড়ি থেকে। তারা একবার পিছু ফিরে তাকালও। গৃহিণীদের পিছনে রুবি এবং নিখিল হাঁটতে শুরু করল।

”এরা সব এখানকারই?”

”নয়তো কোথাকার হবে!”

রুবি হোঁচট খেল। ভ্রু কুচকে নিখিল দেখল রাস্তার খোয়াটাকে। গৃহিণীরা কি কথায় যেন খুব হাসছে।

‌‘‘ওরা রোজ বেরোয় বোধহয়।’’

‘‘বেরোবে না কেন, বেড়াবার এমন রাস্তা রয়েছে, বেশি গাড়ি চলে না, ভিড়ও নেই।’’

‘‘দোকানপাঠও তো কম।’’

‘‘নতুন জায়গা, একি কলকাতার মত পুরানো? সবই হবে, আস্তে আস্তে সব হবে। লোকজন আরও আসুক।’’

বড় রাস্তাটা থেকে দুধারে ছোট ছোট সমান্তরাল রাস্তা বের হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে সিমেন্ট বাঁধান খোলা ড্রেন, ইলেকট্রিকের খুটি। লঙ্গীপরা এক মাঝবয়সী লোক বাড়ির সামরেন ড্রেন খোঁচাচ্ছে বাখারি দিয়ে। ছাতে বাচ্চা কোলে বৌ। বাজারের থলি হাতে একজন পাশের রাস্তা থেকে বেরোল, একটু ব্যস্ত। গৃহিণীরা তাকে কি জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি বলল, নিখিল রুবি তখন তাদের অতিক্রম করে যেতে শুনল, ‘‘হঠাৎ এসে পড়েছে, আজকেই গৌরীকে নিয়ে যাবে।’’

‘‘ওমা সেকি, এই তো সবে বাপের বাড়ি এল।’’

একটু পরেই কয়েকটা চাপা হাসির মধ্য দিয়ে কথা ফুটল, ‘‘বেচারা, দু’দিন জিরোতে এসেই শান্তি নেই।’’

‘‘বেশ রোগা হয়ে এসেছে।’’

‘‘হবে না যা টানের বহর।’’

গৃহিণীরা একটা রাস্তায় ঢুকে পড়ল। আড়ে তাকিয়ে নিখিল লক্ষ্য করল রুবির ঠোট হাসিতে কোঁচকান। নতুন একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এখন শেষ পর্যায়ে। আজ ছুটির দিন, বাড়িতে মিস্ত্রি লাগে নি। মোটরে কর্তা গিন্নি দেখতে এসেছে,সঙ্গে ঠিকাদার। গিন্নি মেঝের দিকে হাত নেড়ে কিছু একটা বলছে, গভীর মনোযোগ কর্তা ও ঠিকাদার শুনছে।

‘‘বেশ পয়সাওলা।’’

জবাব দিল না নিখিল। বাড়ির মাথায় খোঁচা খোঁচা কংক্রীট থামের শিক। জানলায় গ্রীল। দক্ষিণে পোর্টিকো। গ্যারেজ ঘর। দরজাগুলো সেগুনের। সিড়িতে মোজাইক।

‘‘লাখের কম নয়।’’

‘‘এত লাগে।’’

‘‘লাগবেই প্রায় পাঁচ কাঠা জমি।’’

‘‘আমাদের তো তিন কাঠা মোটে।’’

‘‘মোটে মানে? তাই কটা লোকের আছে?’’

নিখিলের স্বরে কিছুটা ঝাঁঝ ছিল। ক্ষুন্ন হয়ে রুবি বলল, ‘‘তা বলছি না, খরচ আমাদেরই কমই হবে। তিনটে লোকের জন্য এত বড় করে তো আর আমাদের দরকার নেই।’’

‘‘তিন কোথায় চারজন তো।’’

‘‘মা আর কদিন বাঁচবেন।’’

ওরা ক্রমশ ফাঁকা অঞ্চলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। বাড়ির সংখ্যা কমছে, তৈরি ‍শুরু হওয়াদের সংখ্যা বাড়ছে। কলোনির প্রায় মাঝামাঝি ওরা এসে পড়েছে।

সাজগোজ করে একটা পরিবার বাস ধরতে চলেছে। তার মধ্য থেকে একটা বাচ্চা ছুটে গেল রাস্তার ধারের বাড়িটার দিকে। নিচু লোহার বেড়া, একটুখানি বাগান। তার মধ্যেই দু’টি চেয়ারে ধূসর হয়ে বসে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী। বাচ্চাটি ফুল চাইল। ওরা ঘাড় নাড়ল। বাচ্চাটি হাত বাড়িয়ে একটি সাদা ফুল ছিড়ে নিয়ে ছুটে পরিবারের মধ্যে ফিরে এল। ঘাড় বাকিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় দেখতে দেখতে স্বামী-স্ত্রী হেসে নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করল।

নিখিল এবং রুবি সবটাই দেখতে দেখতে এগোল। একবার শুধু রুবি মন্তব্য করল: ‘‘নিঃসন্তান বোধ হয়।’’

‘‘বুড়ো বয়সে এদের খুব কষ্ট হয়।’’

রুবি ঘাড় নেড়ে সমর্থন করল। ‘‘আমার এক মামারও ঠিক এই অবস্থা। কেউ তাদের কাছে গেলে যা খুশি হয়। যাবে একদিন?’’

এর জবার নিখিল আঙুল দিয়ে দেখাল: ‘‘ওইটে হচ্ছে পার্ক। ভেতরে পুকুরও আছে।’’

রুবির সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। ফ্রক পরা কয়েকটি কিশোরী ভারিক্কী চালে গল্প করতে করতে পুকুর ধারে ঘুরছে। দুজন যুবক বেঞ্চ এ ঘেষাঘেষি বসে একটা বই পড়ায় ব্যস্ত। গুটিকয় শিশু ছুটোছুটি করছে।

‘‘পুকুরটা ঘেরা নয়। বাবুলকে একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’’

‘‘না যাবে না।’’

দুজনের স্বরেই দুশ্চিন্তার প্রকাশ্।

‘‘তবে ওদিকে একটা খেলার মাঠ আছে, বড়দের জন্য।’’

‘‘বড়দের খেলার মধ্যে গেলে, লেগে-টেগে যাবে।’’

‘‘পুকুরটাকেই ঘেরাও করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ওতো আর এক্ষুনি চলা-ফেরা শিখছে না।’’

নিখিল আশ্বস্ত করল রুবিকে। তারপর আঙুল তুলে দেখাল, ‘‘ওই যে বিরাট ফাঁকা জায়গা, ওই খানে জমিটা।’’

‘‘কোনখানে?’’

”চল দেখাচ্ছি। ওরই মধ্যে একজায়গায়।”

ওরা চলতে শুরু করল। দু’ধারের জমি। কোন কোনটায় সীমানায়-চিহ্ন দেওয়া। সিমেন্টের তৈরি চৌকা ঢিবি, তার ওপর আঁচড় কেটে প্লট নম্বর লেখা। কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা অসমাপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। দরকার পড়েনি কারণ ওদিকে আর বাড়ি ওঠেনি। ইলেকট্রিক খুটিও নেই।

কলোনির লোকালয় ছাড়িয়ে ওরা অনেকদূর এসে পড়েছে। সামনে ধূ ধূ মাঠ তারপর অস্পষ্ট গ্রাম। দু’পাশে অনেক দূরে বাড়ি। সেগুলি অন্য কলোনির।

”এমন ফাঁকার মধ্যে।”

রুবির বক্তব্যটা ঠিক পরিষ্কার হল না। নিখিল মুগ্ধ হয়ে সামনে তাকিয়ে বলর, ”এই তো ভাল, লোকালয়ের কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত নির্জন পরিবেশে মানুষ তো এই ভাবে বাঁচতে চায়।”

”দোকান, বাজার বাস থেকে দূরে হয়ে গেল।”

”দোকান বাজার তো চব্বিশ ঘন্টা করতে হবে না, একবারই , বাসেও একবার অষিস যাওয়া আর আসা। তোমাকে তো কলোনির প্লানটা দেখিয়েছি, এখন যে জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়ে এখানে একটা রাস্তা হবে আড়াআড়ি, এর ওপারে ”সি” আর ”ডি” ব্লক। পয়সাওয়ালা লোকেরা এই দিকটায় জমি কিনেছে।”

”ওদের পোষাবে, গাড়িতে করে তো যাতায়াত করবে।”

কথাটা যেন শুনতে পেল না নিখিল। রাস্তা থেকে পাশের জমিতে নেমে হাঁটতে শুরু করল। বর্ষার কাদায় চটচটে। বুনো গাছ আর লম্বা ঘাসে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে যাচ্ছে। থেকে পিছু ফিরে নিখিল বলল, ”এই জায়গাটায় এলে মনে হয় যেন মাঝ সমুদ্দুরে এসেছি, অবশ্য মনে হওয়াটা নেহাতই আন্দাজি ব্যাপার সমুদ্রই কখনো চোখে দেখিনি।”

”কিসে মনে হল যে জায়গাটা সমুদ্রের মত?”

”এমনিই। মাঝে মাঝে মনে হয় না কি এরকম? কোন কোন লোক দেখলে যেমন মনে হয় পাহাড় দেখছি। কাউকে অরণ্য, কাউকে নদী, বন্যা, উদ্যান; সেই রকম, সবকিছু মিলিয়ে একটা। তাই না?”

ভ্রু তুলে রুবি শুনল। মন্তব্য না করে চারধারে তাকাতে তাকাতে বলল, ”আমাদের জমিতে পিলার দিয়েছে?”

”নিশ্চয়।”

”এখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভাল। বর্ষার সময় সাপখোপ থাকতে পারে।”

”হ্যা, তা পারে।”

এক প্রবীণ গ্রামবাসিনী ওদের কাছ দিয়েই গ্রামের দিকে চলে গেল। একবার শুধু তাকিয়ে ছিল। রুবি তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। বেশ জোরে হাঁটছে। দূরে দূরে আরও কিছু লোক চলাচল করছে। আকাশে ভেসে চলছে মেঘ। বাতাসে আঁচল খসে পড়ল। তুলে নিয়ে রুবি বলল,”এটা ভাদ্র মাস।”

”এইটে আমাদের জমি।”

”কই?”

”এইতো।”

সন্তর্পণে শূন্যে হাত বুলোল নিখিল।

”পিলার কই?”

হঠাৎ রুবি আর্তনাদ করে উঠল।

”পিলার!”

চমকে উঠে বুনোগাছ আর লম্বা ঘাস মাড়িয়ে নিখিল ছুটে গেল। উবু হয়ে গুপ্তধন পাওয়ার মত জমি আঁচড়াতে থাকল। নেই। হামা দিয়ে কিছুটা এগোল। নেই। দুহাতে ঘাসের চাপড়া টেনে তুলতে শুরু করল। নেই। উঠে ছুটে গেল আর এককোণে।

রুবিও পা চেপে চেপে খুজতে শুরু করল। কাদা লাগছে শাড়িতে। হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে তুলল। ঝুকতেই আঁচলটা মাটিতে পড়ল। বুকের কাছে দুহাতে জড়ো করে আরও নিচু হল।

”কোথায় জমি?”

মুখ তুলে ফ্যালফ্যালে চোখে নিখিল তাকাল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে কি বলল।

”কোথায় জমি?”

চীৎকার করল রুবি। নিখিল আরও একটু সরে গিয়ে খুঁজতে শুরু করল। কাটাগাছ ওপড়ানোয় আঙুল মুখে দিয়ে নিখিল দাড়াল।

”ওরা তো বলেছিল করে দেবে।”

রুবি শুনেত পেল না। প্রায় মাটি শুকতে শুকতে সে এগোচ্ছে। হঠাৎ থমকালো। দুহাতে ঘাস সরিয়ে অস্ফুটে বলল, ”এইতো।”

”পেয়েছ?” ছুটে এল নিখিল। রুবির পাশে বসে মুখটা মাটির কাছা-কাছি এনে বলল, ”পশ্চিমে! আমাদের প্লট নম্বর পচিশই তো, না চব্বিশ?”

”পচিশ।”

”ঠিক মনে আছে?”

ঘাড় নেড়ে রুবি বলল, ”রেজিস্ট্রির দিনই তো তুমি বললে, পচিশে ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন। পচিশে আগস্ট প্রমোশনের চিঠে পেয়েছি, পচিশে মে বাবুল জন্মেছে। মনে নেই?”

”বাকি তিনটেও তাহলে আছে।”

প্রথমটির থেকেও কম সময় লাগল বাকি পিলার খুজে বার করতে। তার মধ্যে একটি ভাঙা, ইটগুলে চুরি হয়ে গেছে। নিখিল অস্বস্থি বোধ করল। চারদিকে চারটে না থাকলেও জমির মালিকানা স্বত্ব নষ্ট হবে না, তবুও সাবধান হওয়া ভাল, কালই ব্যবস্থা করব এই ভেবে তিন পিলারের মাঝে দাঁড়িয়ে নিখিল হাসল। বলল, ”এই হল জমি।” বুকে ভরে নিশ্বাস নিল। উদ্ধত ভঙ্গিতে গ্রীবা তুলে চারধারে তাকাল। পাশের স্ত্রীলোকটিকে লক্ষ্য করে হাসল।

”এতক্ষলে স্বস্তি পাওয়া গেল।” চারপাশের পৃথিবীতে চোখ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে রুবি আচল রাখল কাঁধে, ”যা ভয় ধরেছিল।”

”ভয়, ভয় কিসের? টাকা দিয়েছি, দলিলও আছে। জিনিসটা লোপাট হবার মত নয়। জমি হচ্ছে আবহমান কালের, থাকবেও চিরকাল। তবে একটা ভয় রয়েছে পাশের জমির মালিক হয়তো খানিকটা ওই ভাঙা পিলারের দিক থেকে চুরি করে দখল করতে পারে। এ পাশের জমিটা কিনেছে এক আই.এ.এস আর এইটে ব্যারাকপুর কোর্টের মুন্সেফের। পেছনেরটা বায়না করে রেখেছে এক সাব-এডিটর। সব খোজ নিয়ে রেখেছি।”

”তবু নজর রাখা ভাল।”

”নিশ্চয় মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতে হবে।”

দূরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে বোধ হয় জমি দেখতে এসেছে। কয়েকজন যুবক বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় বসল। একটা লরী এসে থামল, ইটে বোঝাই। লাউডস্পীকারে কোথাও রেকর্ড বাজছে, অস্পষ্ট শোনা যায়। একটা চিল মাটিতে ছোঁ মেরে কি তুলে নিয়ে গেল। কুকুরটা যেতে যেতে থমকে চিলটাকে দেখল। তারপর সবুজ ধান চারার মাঠ লক্ষ্য করে দুলকি চালে এগিয়ে গেল।

”এখানে সাপ থাকতে পারে, সরে এস।”

নিখিল সরে এল। ”কোথাও যদি বসার মত একটা জায়গাও থাকত।”

দুজনে চারধারে তাকিয়ে খুজে পেল না। তাই উবু হয়ে বসল জমির কিনার ঘেষে।

”এখন মাটি আলগা, জলে কিছুটা বসবে, রোদ খেয়ে শক্ত হবে।”

”তখন ভিৎ খোড়া হবে?”

স্মিত হাসল নিখিল। বাতাসের বিরুদ্ধে চোখ রেখে নিমীলিত করল। পাঞ্জাবীটা বুকের সঙ্গে লেপটে গেছে। উচু হয়ে উঠেছে মানিব্যাগ।

”দোতলায় ভিৎ করে প্রথমে একতলা তুলতে হবে। কেন জান? পরে দরকার হলে দোতলা তুলে একতলাটা ভাড়া দেওয়া যাবে। ধর আমি মরে গেলুম, তখন তুমি ভাড়ার টাকায়–”

”আহা, কথার কি ছিরি।”

স্মিত হাসি, নিমীলিত চোখে নিখিল আবার বলল, ”ইন্সিওরের টাকাতেই দোতলা তুলতে পারবে।”

”থাক খুব হয়েছে।”

”প্ল্যানটা সেই ভাবেই করব। সিড়িটা এমনভাবে হবে যাতে একতলার সঙ্গে দোতলার কোন সম্পর্ক না থাকে তাহলে বাড়াটেদের সঙ্গে গোলমাল হবার চান্স থাকবে না।”

”এখানে বাড়ি ভাড়া কেমন?”

”তা পুরো একতলা, অবম্য আমাদের মত ছোট বাড়ির, দুশো টাকা তো হবেই।”

শুনে রুবিও বাতাসের বিরুদ্ধে চোখ রাখল। কিছুক্ষণ পরে বলল, ”হাওয়ায় কি রকম সোঁ সোঁ আওয়াজ হয় দেখেছে। ঠিক কানের গোড়াতেই।”

”বলেছিলাম না, মনে হয় সমুদ্রে এসেছি। কি খোলামেলা, যতদূর ইচ্ছে তাকাও, যত বড় ইচ্ছে নিশ্বাস নাও, মনে হয় যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছি।”

”রান্নাঘরে যাতে হাওয়া আসে সে ব্যবস্থা কিন্তু রাখতেই হবে।”

খড় খড় করে উঠল ঘাস। কিছু একটা চলে যাচ্ছে।

ওরা ভয় পেল। নিখিল বলল,” এবার যাওয়া যাক।”

”পিলারের কাছের ঘাসগুলো পরিষ্কার করে দিলে হত।”

”পরে হবে, আর একদিন রোদ থাকতে থাকতে আসা যাবেখন।”

আসার সময় ওরা একটা খালি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে তাকাল। ট্যাক্সিটা তাই দেখে আস্তে হয়ে পড়ল। নিখিল হাত নেড়ে না করে দিল।

”এক পয়সা, দু’পয়সা করেই টাকা জমে। কষ্ট হবে হোক। পরে দেখবে সেই কষ্টের ফল ভোগ করতে কেমন লাগে। অন্তত তিরিশ হাজার টাকা না হলে বাড়ি তৈরিতে নামা চলে না। মাল মশলার দাম যা বেড়েছে দিন দিন।”

”এমনিই তো কত খরচ কমিয়ে দিয়েছি।”

জোরে হেঁটে এসে ওরা বাসে উঠল। সন্ধ্যা উতরে গেছে। ছুটির দিন বলেই শহরতলীর বাসে ভিড়। নিখিল বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুকে পড়ে কলোনিটার দিকে তাকাল।

বাস থেকে নেমে মিনিট চারেক হাঁটতেই কলকাতার মধ্যে চলে এল। এবার ট্রামে উঠল। নেমে দু’মিনিট হেঁটে বাড়ি। বাড়ির পথে রুবি বলল, ”বাবুলের বিস্কুট ফুরিয়েছে কিনবে?”

”অভ্যেসটা ছাড়াও, এক বছরের ছেলেকে ওসব না খাওয়ানোই ভাল।”

”তোমার গেঞ্জি ছিড়েছে।”

”এখানো কটা দিন চলবে।”

”মার কাল একাদশী।”

”আঃ এই তো তোমার দোষ। একটু আগে বললে না কেন, তাহলে আসার পথে নেমে কিনে নিতুম। এখন কে আবার যাবে? কালকে বরং কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিও।”

একতলা ভাড়াটেদের বৌ-এর সঙ্গে সিড়িতেই রুবির দেখা হল। দাঁড়িয়ে পড়ল।

”তোমার ছেলে কি দুরন্ত না হয়েছে। এসেছিল আমাদের ঘরে । এটা টানে, ওটা হাঁটকায়। এই মাত্তর ঘুমোল, তা কেমন দেখতে?’’

”বিরাট কলোনি, আর কি ফাঁকার উপর। হুহু করছে হাওয়া, মনে হয় যেন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। ফিরতেই ইচ্ছে করে না।”

”এখনই এতখানি, বাড়ি হলে না জানি কি হবে।”

”তাই তো ভাবছি, না জানি কি হবে। বিরাট বিরাট বাড়ি, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর ওর মধ্যে আমাদের মত মানুষ গিয়ে কি করে বাস করবে, তাই ভেবে এখনই তো বুক কাঁপছে। পাশের জমিটাই এক জজের।”

ঝকমক করছে রুবির মুখ। কথায় আধো আধো ভাব।

”তোমার ছেলে একপাটি জুতো ফেলে গেছে নিয়ে যাও।”

জুতো নিয়ে রুবি দোতলায় এল। দু’খানি ঘর। বাইরের লোক এলে সামনের ঘরে বসে। রাত্রে নিখিলের বুড়ি মা শোয়। ভিতরেরটি বড়। খাট, আলমারি আছে। রান্নাঘর, বারান্দার ধারে টিনের চালাটা।

বছর পনেরোর একটি ছেলে বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে। শীর্ণ হাত-পা, ড্যাব ড্যাবে চোখ। চেয়ারের হাতল ধরে পা বেকিয়ে মাথা নিচু করে রয়েছে। রুবি ভিতরের ঘরে গেল। নিখিল জামা ছেড়ে লুঙ্গি খুজছে।

”মন্টু, ছোট কাকার ছেলে, ওকে বোধ হয় তুমি দেখনি।”

”কি জানি ওরা তো অনেক ভাইবোন। কি জন্যে এসেছ?”

”একটা চিঠি এনেছে, দেখ তো কি লেখা।”

থুতনি নেড়ে টেবিল দেখাল নিখিল। রুবি চিঠিটা তুলে পড়তে শুরু করল।

” কি লিখেছে?”

লুঙ্গিটা মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দাঁতে চেপে সাবধানে, কাপড়ের পাট রক্ষায় নিখিল ব্যস্ত ছিল হঠাৎ চমকে উঠল,”কি বললে? ছোটকাকীর কি হয়েছে?”

”খুব অসুখ, বাড়াবাড়ি যাচ্ছে।”

”তা আমি কি করব?”

রুবি চিঠি থেকে আবৃত্তি করল-

”এদিকে আমি তো অকর্মণ্য, পঙ্গু।”

”মাতলামি করে গাড়ি চাপা পড়েছিল।”

”সুবোধ মাসে ষাট টাকার বেশি সংসারে দিতে পারে না।”

”ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে বখামি শুরু করে, এখন বুঝি মোটর কারখানায় ঢুকেছে।”

”প্রবোধ ঈশ্বরের দয়ায় স্কুল ফাইন্যাল পাশ করিয়া নাইট কলেজে পড়িতেছে। দুইটা টিউশানিও করে।”

”এছেলেটা ওদের মধ্যে খুব ভাল।”

”সোনা এবং মোনার জন্য পাত্র খুজিতেছি কিন্তু উহারা লেখাপড়া জানে না, দেখিতেও ভাল নয়। বুঝিতেই পারিতেছ আজকালকার বিবাহের বাজারে উহাদের পার করিবার মত সঙ্গতিও আমার নেই। তাহার উপর তোমার কাকীমার ভীষণ অসুখ, বোধহয় বাঁচিবে না।”

”ও বাড়িতে ওই একটি মাত্র মানুষ, সারা জীবন দুঃখে দুঃখে কাটাল, তবু মুখ ফুটে একটা কথা বলে নি। মুখ সর্বদাই হাসি। আমায় খুব ভালবাসত।”

”ডাক্তার একরূপ জবাবই দিয়েছে। বাঁচাইতে হইলে যে অর্থের প্রয়োজন তা আমার নাই। তোমার কাকিমা সর্বদাই তোমার কথা বলে। তুমি তাহাকে যেরূপ ভালবাস, তাহার গর্ভের সন্তানও সেরূপ ভালবাসে না। একথা সে প্রায়ই বলে। তোমার পিতা মারা যাওয়ার পর যে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তা তোমার কাকিমার চেষ্টাতেই বেশি দূর গড়াইতে পারে নাই। তোমার হয়তো এখনো ধারণা থাকিতে পারে, সম্পত্তি ঠকাইয়া লইয়াছি, কিন্তু রাধারমনের নামে দিব্যি করিয়া বলিতে পারি, এক কানাকড়িও ঠকাই নাই। বসত বাড়িটিও বাঁধা পড়িয়াছে এতগুলি সন্তানের মুখে অন্ন যোগাইবার জন্য। কিন্তু আজ বাঁধা দিবার মতও আর কিছু নাই। তুমি বংশের মুখোজ্জ্বলকারী সন্তান। ভাল চাকরী কর, আয়ও শুনিয়াছি ভালই হয়। তোমার কাকিমাকে সুস্থ করিয়া তোলার জন্য আামাদের থেকে তোমার দুশ্চিন্তাই বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তাই সুনীলকে পাঠাইতেছি যদি-”

”টাকা।”

রুবি একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে চিঠির বাকি অংশটুকু পড়ে নিয়ে ঘাড় নাড়ল।

”সেই রকমই বোধ হচ্ছে।”

লুঙ্গিটা পরা হয়ে গেছে। নিখিল গম্ভীর হয়ে খাটে বসে পড়ল। ওঘর থেকে কথার শব্দ আসছে। মন্টুর সঙ্গে মা কথা বলছে।

চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে রুবিও নিখিলের পাশে বসল। দুজনে পাশাপাশি সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘাড় ফিরিয়ে আলমারির আয়নার দুজনের চোখাচোখি হল। তারপর দুজনেই ঘাড় শক্ত করে বসে থাকল। দরজার কাছে গলা খাকারির শব্দে রুবি উঠে দাঁড়াল, শ্বাশুড়ি।

”অনেকক্ষণ এসেছে, প্রায় ঘন্টা দুই।” অস্ফুটে নিখিলের মা বললেন। মেঝের দিকে তাকিয়ে নিখিল বলল, ”তা কি করব?”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, ”দুদিন ধরে নানা জায়গায় ঘুরেছে, মামার বাড়ি গিয়ে পায় নি। পিসীর বাড়িতেও না, শেষে এখানে এসেছে।”

”তাতো বুঝলুম, কিন্তু আমি কি করতে পারি।”

অসহায়োর মতো নিখিল অগত্যা রুবির দিকে তাকাল। সেও তারই দিকে তাকিয়ে। দরজার কাছ থেকে আবার অস্ফুটে উনি বললেন, ”মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে, থাইসিস হয়েছে। অনেকদিনই তো না খেয়ে থাকত।”

”মা বাবুলের দুধ গরম করে রেখেছেন?” ধড়মড় করে রুবি বলে উঠল। নিখিলও সচকিতে তাকাল।

”রেখেছি।”

আশ্বস্ত হয়ে রুবি বলল,”মন্টুকে কিছু খেতে দেওয়া উচিত।”

নিখিল উঠে পড়ল। পাঞ্জাবীটা হাতে নিতেই রুবি বলল,”খাবার আনতে চললে?”

”হ্যা।”

”তাহলে মার জন্যেও কিছু এনো।”

মন্টুর সামনে দিয়েই বেরোতে হবে। নিখিল বেরোতে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াল। ”কাকিমা এখন কেমন আছে?”

উঠে দাড়াল মন্টু। ”ভাল আছে।”

ভ্রু কোঁচকাল নিখিল, ”ভাল আছে?”

মন্টু থতমত হল। ঢোক গিলে বলল,”কাল রক্ত পড়ে নি।”

”কদিন এমন হয়েছে?”

”দু-তিন মাস। কাউকে বলেনি, লুকিয়েছিল।”

”জানার পর কি হল?”

মাথা নামিয়ে মন্টু চেয়ারের হাতল আঁচড়াতে শুরু করল।

”খোকা শোনো।”

মার ডাকে নিখিল ভিতরে এল।

”ওকে এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করিস নি। মুখটা শুকিয়ে আছে কিরকম। ছোট ছেলে চিন্তা ওরও হয়। খাওয়া-দাওয়া বোধ হয় হয় নি।”

কথা না বলে নিখিল হন হন করে বেরিয়ে পড়ল। গলি দিয়ে যাচ্ছে এমন সময় কে ওকে চিৎকার করে ডাকল। ফিরে দেখে অমিয়। পাড়ারই ছেলে, পেশায় ড্রাফটসম্যান।

”আপনার প্ল্যানটা আজই শেষ হল। পারলাম না, হাজার চল্লিশ লাগবেই।”

”কেন, আমি যে ভাবে বললুম তাতে তো অত লাগার কথা না।”

অমিয় ছোট্ট করে হাসল। ”আপনি তো বলেই খালাস, দোতলা বাড়ির ভিৎ, জমি তিন কাঠা, মেটিরিয়ালস কি রকম দেবেন তা আপনিই ঠিক করবেন। তবে যাই দিন না কেন, আমার তো মনে হয় না ওর কমে হবে। দুবছর আগে হলে হত। আইডিয়া আছে বটে আপনার। অফিসে একজনকে আপনার করা প্ল্যানটা দেখিয়েছিলাম, খুব তারিফ করলেন।”

”অনেক ভেবেচিন্তে করা।” অস্ফুটে প্রায় আপন মনেই বলল, নিখিল।

”কবে শুরু করবেন?”

”কি জানি।”

”সেকি এই তো সেদিন বললেন, তাড়াতাড়ি চাই, ইমিডিয়েট স্টার্ট করবেন।”

”টাকা তো চাই। ত্রিশ হাজার পর্যন্ত লোন পেতে পারি গবরমেন্টের কাছ থেকে। ভেবেছিলাম ধার নেব না কিন্তু…….”

অধৈর্যের ভঙ্গিতে নিখিল যাবার জন্য ব্যাকুল। অমিয় সহানুভুতি জানানোর মতো করে বলল,” আসল প্ল্যানটাই হল টাকা জোগাড়। প্ল্যান হলে তখন স্যাংশন করাতেই প্রাণান্ত। নানান বায়ানাক্কা, একে ঘুষ তাকে ঘুষ। দিতে দিতে ফতুর।”

বেশ বড় করে অমিয় হাসল। তারপর বলল, ”দাঁড়ান আপনার প্ল্যানটা নিয়ে আসি।”

অমিয় প্ল্যান আনতে চলে গেল।

তখন নিখিলের সামনে থেকে গলিটা এবং বাড়িগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করল। হু হু হাওয়া বইতে লাগল, সমুদ্রের গর্জন অস্ফুট হয়ে ভেসে আসছে। প্রবল অন্ধকার চুতর্দিকে আর সে তার তিনকাঠা জমির মাঝে দাঁড়িয়ে। জমির তিনকোণে তিনটে পিলারের মাথা উচু হচ্ছে ক্রমশ। চতুর্থটির দিকে তাকাতেই দেখল ছোটকাকী পিলার হয়ে দাড়িয়ে হাসছে। তারপর কাঁদতে শুরু করল: ” বড় কষ্টরে নিখিল, আমাকে সারিয়ে তুলবি?” নিখিল অস্ফুটে বলল, ”ছোটকাকী এইটে আমার জমি এখানে আমি বাড়ি করব। আমি সুখে থাকতে চাই।” শোনামাত্র চুতর্থ পিলারটি মাটির মধ্যে আগাছার মাঝে বসে যেতে শুরু করল। তাই দেখতে দেখতে ভয়ে আঁতকে উঠল নিখিল: ”না না, ছোটকাকী যেও না, আমার জমির সীমানা তাহলে হারিয়ে যাবে।”

নিখিলকে হাত বাড়িয়ে থাকতে দেখে অমিয় প্ল্যানটা এনে দেবার সময় বলল, ” খুব চিন্তার পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে। যদি বলেন তাহলে যাতে আরও কমে হয় এমন প্ল্যানও করে দেওয়া যায়।”

ক্লান্ত কন্ঠে নিখিল বলল, ”বোধহয নতুন প্ল্যানই করতে হবে। বাড়ি করা খুব শক্ত কাজ।”

ছাদ

রােদ্দুরের ঝাঁঝ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই রেখার মন আনচান করে ওঠে। কলটা খােলাই থাকে। বকবক শব্দ হলেই কড়ি বাসনগুলােকে টেনে আনে উঠোনে। প্রত্যহের অভ্যাসে হাত দুটো যেন যন্ত্র হয়ে পড়েছে। বাসনমাজা শেষ করেই ঘর মুছতে বসে যায়। রান্নাঘরটা তবু দুপুরে খাওয়ার শেষেই ধুয়ে রাখে। ঘরমােছা শেষ হবে আর লেখা স্কুল থেকে ফিরবে। এক দিনও নড়চড় হয় না সময়ের। ওদের খাবার দিয়ে চুল বাঁধতে বসবে সে সুধার কাছে। টুকটাক কথা হয় তখন। পাউডার ফুরিয়ে গেছে আজ দেড় হপ্তা, বাবাকে কিনে আনতে বলার জন্য মাকে চাপ দেয়। সুধা প্রতিবাদের মতােই বলে, অত পাউডার মেখে কী হবে, কোথাও তাে আর যাচ্ছিস না।

কোথাও না গেলে বুঝি মাখতে নেই! মুখ গোঁজ করে থাকে রেখা। ছেড়া ব্লাউজের কথা আর বলে না। তারপর কথা হয় ইতিকে নিয়ে।

ইতি এবারে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ কিনেছে। এই নিয়ে তিনটে হল ওর।

সুধা বলে, যাস-না ওদের বাড়িতে, ছােটোবেলায় তাে খুব ভাব ছিল তাদের। ঠোঁট দুটোকে মুচড়িয়ে বলে রেখা, আগে তবু ছাদে উঠত, দু-একটা কথা বলত-টলত; এখন তাে ওর যত ভাব ছেলেদের সঙ্গে। কলেজে পড়ে। চুপ করে শুনে যায় সুধা; তারপর একসময় বলে, লেখাপড়া জানা মেয়ে, ও কি আর যেচে কথা বলতে আসবে। তুই যাবি, গপ্পোটাপ্পা করবি। শিক্ষিত মেয়ে আলাপ-সালাপটা থাকা ভালাে।

হ্যাঁ, এই ছেড়া জামাকাপড় পরে যাই আর কি ওদের বাড়ি। রেখা জবাব দেয়।

এরপর সুধা ও-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও রেখা যেচে আলাপ জমাতে চায় না ইতির সঙ্গে। মনের মধ্যে কোথাও একটা আড়ষ্টতা অনুভব করে। ছােটবেলায় একসঙ্গে খেলাধুলা করেছে, স্কুলে পড়েছে। রেখাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সংসারের কাজে ভরতি করে দেওয়া হল। ইতি স্কুলেই রয়ে গেল। তারপর থেকেই দুজনে সরে গেল দু-দিকে। খিড়কির ডােবা, আবর্জনা আর ছাদ। বাইরের বাতাসে ঢেউ ওঠে না, শুকনাে পাতা উড়ে পড়ে। লালচে হয়ে যায় জল। পাঁক থেকে গ্যাঁজলা উঠে আসে। বাসন-ধােয়া জলে একঘেয়ে দিনগুলােকে দেখে দেখে ক্লান্ত রেখা। বাতাস লাগা, ঢেউতােলা সরােবর কৌতূহল জাগায়। সূর্যের আলােয় বিচিত্র হয়ে ওঠা জলের রং বিস্মিত করে রেখাকে। তবু কোথায় যেন ব্যবধান। ইতিকে আর ছেলেবেলার মতাে ইতু বলে ডাকা যায় না। ইতু যেন আর এক জগতের নাগরিকত্ব নিয়েছে।

চুল বাঁধা শেষ হলে গা ধুয়ে দোতলায় উঠে আসে রেখা। আজ দুপুরে ঘুমিয়ে ফুলাে ফুলাে গাল আর চোখ নিয়ে হয়তো তখন চায়ের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে মঞ্জু। রেখাকে দেখে এটো। বাটিটাই এগিয়ে দেবে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রেখা বলবে, তার হল না এখনও!

বাবারে বাবা, এইতাে বিকেল পড়ল, তাের আর তর সয় না।

গামছা আর সাবানের বাক্স নিয়ে গা ধুতে চলে গেল মঞ্জু। রেখা গল্প শুরু করে মঞ্জুর পিসিমার সঙ্গে। ফিরে এসে মঞ্জু জিজ্ঞেস করে, কী কথা হচ্ছিল রে তােদের?

ছাদে চ বলছি।

প্রতিদিন নয়, যেকোনাে একদিনের ঘটনা। দোতলা আর একতলার সমবয়সি দুটি ভাড়াটে পরিবারের মেয়ে। বিকেল হলেই সাজগােজ করে উঠে আসে ছাদে। শাঁখ বাজলেই নেমে যায়। দিনের পর দিন আজ পাঁচ বছর ধরে।

আজকে রেখার আসতে দেরি হয়ে গেল। মঞ্জু তখন আয়নার সামনে শেষ বারের মতাে নিজের মুখটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছিল। পাউডার পাফটা ডুবিয়ে নিল রেখা কৌটোর মধ্যে। মঞ্জুর ভুরু দুটি টঙ্কার দিল। দেখেও দেখল না রেখা। মঞ্জুকে সরিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল।

তাের বড়াে বদস্বভাব রেখা। না বলে-কয়ে পরের জিনিসে হাত দিস।

পাফটা রেখে দিল রেখা আহত ভঙ্গিতে।

অপ্রস্তুত হল মঞ্জু, এ মাসটা তাে ওই দিয়েই চালাতে হবে। কতটুকুই-বা আর আছে। তা মাখবি তাে মাখ-না।

থাক। গরিব মানুষ গরিবের মতােই থাকব।

অনুতাপ জানাবার জন্যে আঁকুপাঁকু করে উঠল মঞ্জু, আহা-হা, আমরাই যে কত বড়ােলােক! খুব ঠেস দিয়ে কথা বলতে শিখেছিস বাপু। গল্পের বই পড়লে এই হয়। নে মাখ! পাউডার পাফটা তুলে ধরল মঞ্জু।

হাতটা সরিয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়াল রেখা। পাউডার মাখলেই কী আর না মাখলেই কী, যেমন দেখতে তেমনিই থাকব। তুই বরং মাখ তােকে দেখায় ভালাে। মিছিমিছি নষ্ট হবে আমার মুখে। চোখের পাতা আর গলা ভারী হয়ে আসে রেখার।

মন খারাপ শুরু হয়ে যায় মঞ্জুর। দু-হাতে জড়িয়ে ধরে সে রেখাকে। তাের মনটা বড়াে কুচুটে। আমি কি তাই ভেবে বলেছি? তােকে কুচ্ছিত দেখতে কে বলেছে? নিজে নিজেই যত কথা বানাবি আর মন খারাপ করবি। জোর করে পাউডার-পাফটা বুলিয়ে দিল সারা মুখে। রেখার ভুরু আর চোখের পাতা পর্যন্ত সাদা হয়ে গেল। তারপরই আচমকা ওর গালে চুমু দিল মঞ্জু।

ধ্যাৎ, কী করলি বল তাে। মঞ্জুর হাত ছাড়িয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল রেখা। সযত্নে বাড়তি গুড়ােগুলােকে মিলিয়ে দিতে লাগল চামড়ার সঙ্গে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ওর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল রেখা, তাের সবটাতেই বাড়াবাড়ি। অতখানি মাখিয়ে দিলি কেন?

ছাদে উঠে এল ওরা দুজন। ছােট্ট ছাদ। বুক-সমান উঁচু পাঁচিল। ভাঙা কুঁজোর টবে তুলসী আর গাঁদা। চিড়-খাওয়া ছাদের মেঝেয় কালাে কালাে ছাপ। গুল দেওয়া হয়। তিন দিক চাপা তিন বাড়ির দেওয়ালে। ছাদের উত্তর দিকটায় এসে দাঁড়াল ওরা। রাস্তার একটা টুকরাে বুকে পড়লে দেখা যায় এখান থেকে। তা ছাড়া সামনের কয়েকটা বাড়ি দোতলা। চোখ অনেকখানি খােলা জায়গা দেখতে পায়।

পাঁচিলে কনুই রেখে ওরা দাঁড়াল। একই ভঙ্গিতে। আলতাে আঙুলগুলাে ঝুলে পড়ল। শরীরের ভর একপায়ে রেখে আর একটাকে তুলে দিল পাঁচিলের নীচের ঘুলঘুলিতে। চোখ দুটোকে আকাশ থেকে নামিয়ে ওরা দুজনে একসঙ্গেই সিধে হয়ে মুখােমুখি দাঁড়াল।

কথা বলছিস না যে। ভয়ে ভয়ে বললে যেন মঞ্জু।

এমনি। রেখা চোখদুটো আবার ফিরিয়ে নিল আকাশে।

এখনও বুঝি রাগ পড়েনি? তুই বড়াে গালফুলােনি মেয়ে।

হেসে ফেলল রেখা। একটু থেমে বললে, আজ খুনুপিসি এসেছিল।

খুনু পিসি! অবাক হওয়া আর জিজ্ঞাসা দুটোই ফুটে উঠল মঞ্জুর গলায়।

বাবার পিসতুতাে বােন, ভবানীপুরে থাকে। বা রে, তােকে বলিনি খুনুপিসির বডােমেয়ে টুলুদি প্রেম করে বিয়ে করেছে। রেখাকে মর্মাহত দেখাল।

তুই তাে টুলুদির কথা বলেছিস, খুলুপিসির কথা তাে বলিসনি। মঞ্জুও ক্ষুব্ধ হল।

নিশ্চয়ই বলেছিলুম, তাের মনে নেই তাহলে। জানিস, টুলুদি চাকরি করছে! রেখা হঠাৎ বললে।

সেকী, এইতাে বিয়ে হল, এখন তাে কনেবউ!

মঞ্জুর সরল বিস্ময়ে খুশি হল রেখা। আর একটু সরে এল মঞ্জুর কাছে। —টুলুদির বর— মেয়েরা ঘরের মধ্যে বসে থাকবে, একদম পছন্দ করে না। টুলুর্দিকে নিয়ে রােজ সন্ধ্যের সময় বেড়াতে বােরােয়। আর যেদিন বন্ধুরা আসে, টুলুদি তাদের চা দেয়। নিজে হাতে চা এনে দেয় গান পর্যন্ত গেয়েছে। টুলুদির তাে খুব ভালাে গলা।

টুলুদির বন্ধুরা আসে না? উত্তেজনায় থমথমে মুখে জিজ্ঞাসা করল মঞ্জু।

কী জানি? খুনুপিসিকে জিজ্ঞাসা করিনি। আর জানিস, টুলুদির বর রােজ অফিস থেকে ফেরার সময় ফুল কিনে আনে।

সত্যি! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল মঞ্জুর, রােজ আনে?

হ্যাঁ।

আর কী আনে রে?

কী জানি।

টুলুদিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। একদিন দেখাবি?

হঠাৎ বিরক্ত হয়ে উঠল রেখা, দেখে কী করবি, চারটে হাত গজাবে?

মঞ্জু লজ্জা পেল। তাই তাড়াতাড়ি বলল, না, এমনি বলছিলাম। তারও দেখতে ইচ্ছে করে না?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না রেখা। অন্যমনস্কর মতাে দোতলার ছাদগুলাের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রায় আধ মিনিট পর নিজের মনেই বললে, ভালাে বর পেয়েছে, পয়সাওলা ঘরে পড়েছে। এ আর দেখবার কী আছে!

মঞ্জু ও তাকিয়েছিল সামনের দিকে। রেখার কথাগুলাে বােধ হয় শুনতে পায়নি। হঠাৎ কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল সে রেখাকে, ওই দ্যাখ, আবার এসেছে।

নীচু ছাদগুলাের পরেই প্রথম তিনতলার ছাদটায় দাঁড়িয়েছিল একটা লােক। গেঞ্জিটা যত পরিষ্কার, গায়ের রং ততই কালাে। পাঁচিলের ওপর থেকে শুধু দেখা যায় সরু বুক, গলার কণ্ঠা, কনুইয়ের হাড় আর ভুরুর ওপরের খানিকটা। সযত্নে পাট-করা চুলে মাঝে মাঝে আঙুল ছুইয়ে আদর করে। যদিও হাতে একটি বই আছে, তবু চোখ দুটো অন্যদিকে নিবদ্ধ। মঞ্জু আর রেখাকে তার দিকেই তাকাতে দেখে চোখ ঘুরিয়ে নিল।

ছাদে ওঠারও জো নেই। এমন ছাগলের মতাে তাকিয়ে থাকে—ইচ্ছে করে চোখ দুটো গেলে দিই রাগে গরগর করে উঠল মঞ্জু। রেখা শুধু কৌতূহলী চোখে তাকিয়েই রইল।

পুরুষমানুষের আবার ছাদে ওঠা কী? তাও আবার বিকেলে। মঞ্জু কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছে না লােকটার উপস্থিতি।

কী আর করবে বেচারি, বল! যা চেহারা, কেউ বােধ হয় বিয়ে করতে চায় না। তাই মনের দুঃখে…

দুজনেই হেসে উঠল। বােধ হয় শুনতে পেয়েছে লােকটা। কেমন ছটফটিয়ে উঠল। বার কয়েক এদিকে তাকিয়ে পায়চারি শুরু করে দিল।

মনের দুঃখ না আর-কিছু। পরশু দিনই তাে এদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল।

কই বলিসনি তাে আমায়! বিস্মিত হল রেখা। এমন একটা ব্যাপার এখনও মঞ্জু তাকে না বলে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে কী করে? রেখার বিস্মিত হওয়ার কারণটা তাই।

হ্যাঁ ভারি তাে একটা বলার মতাে কথা। কৈফিয়তের সুরে কথাটা বললে মঞ্জু।

পায়চারি থামিয়ে লােকটা ওদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে। শরীরটা কাঁপছে, বােধ হয় পী নাচাচ্ছে।

ওদিকে তাকিয়ে থাকিনি, আশকারা পেয়ে যাবে।

যেজন্যে রেখার কথাটা বলা, তাই হল। লােকটার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়াল মঞ্জু। গাল দুটো ফুলে রয়েছে। অনেকক্ষণের চেপে রাখা নিশ্বাসটা বেরিয়ে এল। কথা বলছে না রেখা। চুলের কাঁটাগুলাে টিপে বসিয়ে দিতে ব্যস্ত সে। মঞ্জুরও হাতটা তার অজান্তেই খোঁপায় উঠে এল। রেখা বুঝতে পারছে, মঞ্জু সত্যি সত্যিই রােগেছে। আর তার চুপ করে থাকাতে রাগটা ক্রমশই বাড়ছে।

খুনপিসি কেন এসেছিল জানিস?

মঞ্জুর জানবার কথা নয়। তাই উশখুশ করল সে।

খুনুপিসির ননদরা তাে দিল্লিতে থাকে। প্রায় পনেরাে বছর আছে।

মঞ্জু শুধু তাকালই না, রেখার গা ঘেঁষে সরে এল।

ছেলেরা সব ওখানেই লেখাপড়া করে চাকরিবাকরি করছে। বড়াে ছেলে, খুনুপিসির ননদের বড়ােছেলে দিব্যেন্দু, বেশ নামটা, না রে? সতর্ক চোখে রেখা তাকাল মঞ্জুর দিকে। খুশিখুশি ভাব ফুটে উঠেছে।

সুন্দর নামটা।

আশ্বস্ত হয়ে রেখা আবার বলতে শুরু করল, দিল্লিতেই ভালাে চাকরি করছে। বিএ পাস, গরমেনট চাকরি…। কথা বলায় ছেদ দিল রেখা। মঞ্জুর মুখে প্রশ্ন জমে উঠেছে।

খুনুপিসির ননদের মেয়ে নেই? ছেলেই বুঝি বড়াে?

হ্যাঁ দিব্যেন্দুই বড়াে। এক বােন দীপিকা, সামনের বছর কলেজে ঢুকবে। বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ছেলে বিলেত থেকে ফিরলেই বিয়ে হবে। ওদের আর ভাই-বােন নেই।

রেখাকে থামিয়ে আবার প্রশ্ন করলে মঞ্জু, বাবা নেই? খুনুপিসির নন্দাই?

ও মা, সে তাে কবে মরে গেছে। আজ দেড় বছর। ছেলেই তাে এখন সংসারের কড়া।

মা তাে বামুন চাকরের হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ঠাকুর নিয়ে পড়ে আছে। আর লােকজনের হাতে সংসার পড়লে যা হয়। চুরিচামারি, নষ্ট, ব্যবস্থা বলে যদি একটা জিনিস থাকে!

কেন, মেয়ে তাে রয়েছে।

হ্যাঁ, সে তাে মেমসাহেব। দিল্লির ব্যাপারস্যাপার অন্যরকম। এ আর কলকাতা নয়, মেয়েরা সেখানে সাইকেল চেপে বেড়ায়।

ওমা, লজ্জা করে না! পারে কী করে!

দিল্লির মেয়ে হলে তুইও পারতিস।

মা গাে, মরে গেলেও না। মঞ্জু হেসে উঠল খিলখিল করে। দিল্লিতে তাে চেনা লােক আছে। যা-না, বেড়িয়ে আয়-না। হাসি থামলে মঞ্জু বললে।

হঠাৎ মুখ নামিয়ে হাতের নখ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রেখা। বিকেলের শেষ আলােটা বিভ্রান্তিকর। মনে হয় যেন লাল হয়ে উঠেছে রেখার মুখ।

খুনুপিসি বলেছিল, দিব্যেন্দুর মা চিঠি দিয়েছে দিব্যেন্দুর জন্যে মেয়ে দেখতে। তাই খুনুপিসি এসেছিল। বাধােবাবাে স্বরে বললে রেখা।

ওমা, বােনের বিয়ে না দিয়েই ভাই বিয়ে করবে?

আহা-হা, বােনের বিয়ে তাে ঠিক হয়েই আছে। এদিকে সংসার ভেসে যাচ্ছে, দেখাশােনার লােক নেই বলে। তখন অত নিয়ম মেনে চলার কোনাে মানে হয়?

খামােকা রেখা রােগে উঠল কেন তার কারণ বুঝতে না পেরে মঞ্জু আমতা আমতা করে বলল, তবু অদ্দিন যা হয়ে আসছে…

হয়ে আসছে বলে চিরদিনই হবে তার কী মানে আছে। বােনের বিয়ের এখনও দু-তিন বছর দেরি। তাই বলে ভাই বিয়ে করবে না? দিন-কে-দিন তুই বােকা হয়ে যাচ্ছিস।

রেখাকে বিরক্ত করে নিজেকে আরও বােকা প্রতিপন্ন করতে চাইল না মঞ্জু। সে চুপ করে রইল।

বিরক্তিবােধটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নিল না রেখা। স্বাভাবিক স্বরে আবার কথা শুরু করল সে, এরই মধ্যে ছ-সাতটা সম্বন্ধ এসেছে। সব ওখানকার মেয়ে। একটাও পছন্দ হয়নি ছেলের। তাইতাে খুনুপিসিকে চিঠি দিয়েছে ছেলের মা।

সেইজন্যেই বুঝি খুনুপিসি এসেছিল? ফিসফিস করে কথাটা বললে মঞ্জু। মাথা নুইয়ে ছােট্ট করে ঘাড় নাড়ল রেখা।

কী কথা হল?

এখন আর কী কথা হবে। ফোটো আর পরিচয় লিখে আগে পাঠাতে হবে। পছন্দ হলে অন্য কথাবার্তা হাব।

সন্ধ্যা অনেকখানি নেমে এসেছে। শাঁখ অনেক বাড়ি থেকে বেজে উঠল। ওরা দুজন নীচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে এগােল। সিঁড়িতে নামার আগেই দুজনেই মুখ ফিরিয়ে থাকল। সাদা গেঞ্জিটাই শুধু দেখা গেল।

এখনও দাঁড়িয়ে আছে রে! হালকা সুরে বলে উঠল রেখা।

থাকুক গে। তাের তাে ফোটো নেই, তাহলে পাঠাবি কী? রেখার পেছনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই জিজ্ঞাসা করল মঞ্জু।

কালকে বাবা অফিস থেকে ফিরে নিয়ে যাবে দোকানে।

পরের দিন দুপুরেই রেখা ডেকে নিয়ে গেল মঞ্জুকে তাদের ঘরে। দুখানি ঘর। একখানিতে সুধা তখন ঘুমােচ্ছে, অন্য ঘরখানিতে ওরা দুজন এসে ঢুকল। তার ওপর দুখানি শাড়ি আর ব্লাউজ। শাড়িতে ইতস্তত ভাঁজ আর ন্যাপথলিনের গন্ধ। দুটি শাড়িই তুলে নিয়ে দেখতে শুরু করল মঞ্জু।

এটা তাে জেঠিমার, না?

ঘাড় নাড়ল রেখা।

আর এটা? তাের?

তবে নাতাে কার?

পরতে দেখিনি তাে।

বিরক্ত বােধ করতে শুরু করল রেখা। মঞ্জুটা বড় বােকা; এমন খুটিয়ে জিজ্ঞেস করে। বল, কোনটা পরব।

চট করে জবাব দিতে পারল না মঞ্জু। মনে মনে সে ভেবে নিয়েছে, অদ্ভুত এইবার সে নিজেকে বুদ্ধিমতী প্রতিপন্ন করবে। মঞ্জুর মুখ চোখের অবস্থা দেখে মনে হয় তার সামনে ছড়ানাে গুটি পঞ্চাশেক শাড়ির মধ্য থেকে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়েছে। রেখাও চুপ করে আছে। মঞ্জুর মতামতের ওপর তার যে খুব আস্থা আছে তা নয়, শাড়ি বাছাই তার কাছে সত্যিই গুরুতর সমস্যা, বিশেষ করে আজকে সে ঘাবড়ে গেছে। তার নিজের মত হালকা বেগুনি রঙের জর্জেটটাই পছন্দ। ওটা তার রঙের সঙ্গে খুলবে ভালাে। এখন মঞ্জুর

কাছ থেকে যাহােক একটা সমর্থন পেলেই সে আশ্বস্ত হতে পারে।

ফোটো তা রাত্তিরে তােলা হবে? নখ খুঁটতে খুটতে গম্ভীর সুরে প্রশ্ন করল মঞ্জু।

হুঁ।

মঞ্জু আপাদমস্তক দেখে নিল রেখাকে। বুঝতে পারল রেখা তার গায়ের রং দেখছে মঞ্জু। গােড়ালি থেকে শাড়িটাকে অল্প তুলে একটা ঘামাচি মারল সে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, মঞ্জুর সামনে সে অনেক দিন হাঁটু পর্যন্তও কাপড় তুলেছে। শাড়িটা নামিয়ে দিল রেখা। মঞ্জুর মুখে বিশেষ কোনাে ভাবান্তর ঘটেছে বলে মনে হল না। রেখার গােড়ালি থেকে মাথার দিকে তাকাল সে। চুল খােলাই আছে। তুব এক বার মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলাে দুলিয়ে দিল রেখা। ঘন কোঁকড়ানাে, কোমর পর্যন্ত এলানাে চুল।

চুলে তেল দিসনি কেন?

মঞ্জুকে শাড়ি বাছাতে বলা হয়েছে, আর সে কিনা এখন চুল নিয়ে পড়ল। বিরক্ত হলেও জবাবটা কোনােরকমে দিল রেখা, বডড মাটি পড়েছিল, তাই মাথাটা ঘষলুম।

কী-একটা বলতে যাচ্ছিল মঞ্জু, থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠল রেখা, যা জিজ্ঞেস করেছি তাই বল। কলে জল এসে গেছে; তিনু, লেখা ওরা এক্ষুনি ইশকুল থেকে ফিরে হইচই লাগবে।

এত তাড়াতাড়ি বলা যায় নাকি! একি তাড়াহুড়াের ব্যাপার। ভেবেচিন্তে ঠিক না করলে যদি…

মঞ্জু কথাটা শেষ করল না বলেই রেখা কৃতজ্ঞ হল ওর ওপর। শেষ করলে কী বিশ্রীই না শােনাত। বােকা মেয়েদের জিভের আড় বলে কিছু থাকে না। দুখানা শাড়ি নিয়ে প্রায় ঘেমে উঠেছে মঞ্জু। রেখার ভবিষ্যতের ভালাে মন্দ সব কিছুই এখন নির্ভর করছে শাড়ি বাজার ওপর! নিজের শুভাশুভের দায়িত্বের ভার তার ওপর তুলে দিয়ে রেখা নিশ্চিন্ত হয়ে রয়েছে, এই চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়তে লাগল মঞ্জু।

তাহলে এইটেই পরি, কী বল? শেষপর্যন্ত সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই জর্জেটটা তুলে নিল রেখা।

দাঁড়া, পরিয়ে দিই।

এখন পরল ময়লা হয়ে যাবে না!

তাহলে চুলটা বেঁধে দিই একটা সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছে মঞ্জু।

কিন্তু চুল বাঁধতে গিয়েও আর একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হল। মঞ্জুর ইচ্ছে, বিড়ে খোঁপা; রেখা চায় চুলটা খােলাই থাক।

আমি কি পেছন ফিরে ছবি তুলব যে, খোঁপার কায়দা দেখাতে হবে?

আসলে রেখা জানে, চুলই হচ্ছে তার একমাত্র গর্বের জিনিস। কিন্তু মঞ্জু সেরকম বােকা, হয়তো খোঁপা না বাঁধিয়ে ছাড়বে না। সরু গলার ওপর মুখটাকে অনাবশ্যক বড়াে মনে হয়, তারপর একটা বিরাট খোঁপা যদি বাড়তি হয়ে আটকে থাকে তাহলে মােটেই সুশ্রী দেখাবে না। নিজের সম্বন্ধে এত রূঢ় সমালােচক আর কোনােদিন হয়নি রেখা। বেশ, তাহলে বিনুনি করে দিই। সামনে ঝুলিয়ে দিবিক্ষণ।

আপত্তি করার মতাে কিছু খুঁজে না পেয়ে রাজি হয়ে গেল রেখা। দুগাছি বিনুনি কাঁধের দু দিক দিয়ে বুকের ওপর ঝুলিয়ে দিল মঞ্জু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে রেখা লাজুক হাসল, বডড খুকি খুকি দেখাচ্ছে।

আহা, খুকি দেখাবে না তাে কী! কুড়ি বছরের মেয়েকে কি বুড়ি দেখাবে?

—দুটো রিবন ফুলের মতাে বেঁধে দিলে কেমন দেখাবে রে? রেখার সুরে সংশয় ছিল, তাই খুব জোর দিয়ে সমর্থন করতে পারল না মঞ্জু। তা ভালােই দেখাবে। তাের তাে রিবন নেই; লেখা আসুক ইশকুল থেকে, ওরটাই নয় বেঁধে নিস।

তাের সাবানটা দিবি? আমারটা ফুরিয়ে গেছে।

কথা না বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মঞ্জু। শুধু সাবান নয়, পাউডারের কৌটো আর। স্নাে-র শিশিটাকেও নামিয়ে আনল।

এখন যেন গা ধূসনি, ঠিক যাবার আগে গা ধুয়ে মাখবি।

বেশিক্ষণ আর বসতে পারল না মঞ্জু। রেখার সংসারের কাজগুলােকে আজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। আজ দুজনের কেউই ছাদে উঠল না। ঘর মুছে, উনুন ধরিয়ে, বাসন মেজে সাজগােজ শেষ করতে করতেই সন্ধ্যা উতরে গেল। বাবার সঙ্গে যখন রেখা বেরিয়ে গেল, মঞ্জু সদর দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল।

ইতিদের ঝি রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। মাকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, সেজেগুজে কোথায় গেল গা?

ফোটো তােলাতে।

হঠাৎ, বিয়ে-থা হবে নাকি?

হ্যাঁ।

মঞ্জুর গা ঘেঁষে সরে এল ইতিদের ঝি। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গাে?

দিল্লিতে। আমাদের দিদিমণিরও বিয়ে, এই শ্রাবণে। ছেলে খুব পন্ডিত, কলেজে পড়ায়। ভাব করে বিয়ে হচ্ছে।

মঞ্জু যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুর খুঁজে পেলে ঝিয়ের কথাতে। ভাব করে বিয়ে যেন একমাত্র ওর দিদিমণিই করতে পারে। আর পন্ডিত ছেলে ভূভারতে ওই একটিই আছে। হালকা, কিছু-না সুরে মঞ্জুও বলল, রেখুরও বিয়ে এই শ্রাবণে। ছেলের গাড়ি আছে। দিল্লিতে বিরাট চাকরি করে। রেখাকে পছন্দ করে বিয়ে করছে।

ওমা! তবে আর ফোটো তােলাতে গেল কেন?

সত্যিই তাে। না দেখে পছন্দই-বা হয় কী করে। ঝি মুখে বুঝে ফেলেছি হাসি এনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

যাই, এখনও সন্ধ্যে দেখানাে হয়নি। প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল মঞ্জু।

ফোটো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা করা। ছাদে সেই গল্পই করে মঞ্জু আর রেখা। দূরের ছাদ থেকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে সেই লােকটা। বই হাতে পায়চারি করে আর চুলে হাত বুলােয়। মঞ্জু বা রেখা তাকে দেখেও দেখে না। সেদিন ছাদে উঠেছিল ইতি। কথা থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল রেখা, দেখেছিস কেমন সুন্দর হয়েছে।

হবেই তাে, এখন তুইও তাে হয়েছিল।

যাঃ, ওর তাে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর আমার কোথায় কী!

রেখার কথায় কান না দিয়ে মঞ্জু আবার বলল, টুলুদির মতাে ইতিও ভাব করে বিয়ে করছে। আচ্ছা, বিয়ের পর ইতিও চাকরি করাবে তাে?

কী জানি! ওর বর যদি চাকরি করতে দেয় তাে করবে।

আচ্ছা, বরের সঙ্গে এ তাে বেড়াতে বেরুবে—সিনেমায় কিংবা পার্কে। ফুল কিনে আনবে, বন্ধুরা এলে চা দেবে, গান গাইবে, তাই না? ঝুকে পড়ল মঞ্জু রেখার চোখের নীচে।

সবাই যে একরকমই করবে, তার কী মানে আছে।

তুই হলে কী করতিস?

আমি! দম বন্ধ হয়ে এল রেখার। এমন করে দম বন্ধ হওয়া তার এই প্রথম।

হ্যাঁ, তুই হলে কী করতিস? আবার ফিরে বলল মঞ্জু। আগ্রহে জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ।

মুখ ফেরাল রেখা। এত সহজে কি বলা যায়। কুড়ি বছর বয়সের যেকোনাে মেয়েই শুধুমাত্র এই একটি কথার ওপরেই মহাভারত লিখতে পারে। কৈশাের থেকে আজ পর্যন্ত দেখা, শােনা এবং পড়ার মধ্য দিয়ে এক রূপকথার প্রদীপ জ্বালিয়েছে রেখা। বাসন মাজা, রান্না আর ছােটো ভাই-বােনদের পরিচর্যার মধ্যে সময় করে টুকরাে টুকরাে মুহূর্তগুলােকে সেই প্রদীপের আলােয় রঙিন করেছে। বয়স বাড়ছে, যথেষ্ট টাকা খরচ করে বিয়ে দেবার ক্ষমতা বাবার নেই, তবু এতটুকু স্তিমিত হয়নি সে-আলাে। সে ভেবেছে তার নিজের একটা সছিল সংসারের কথা, একটি স্বামী স্বেচ্ছায় যার খুশিতে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। দিনরাতের একটা অনুভূতি—যাকে সে লালন করবে তাদের যৌথ ভালােবাসা দিয়ে ঘিরে।

কী দেখছিস অমন করে?

মঞ্জুর নাড়া খেয়ে চমকে উঠল রেখা। কিছু-একটা বলার জন্যেই বলে উঠল, না, ওই লােকটাকে দেখছি।

বিরক্ত হল মঞ্জু রেখার কথায়। আর প্রকাশ্যেই সে তা জানিয়ে দিল, এধার ঘুরে দাঁড়া, নইলে এক্ষুনি হাঁ করে তাকাবে।

মঞ্জুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল রেখা। অল্প হাসল ওকে প্রশ্রয় দিয়ে।

হ্যাঁ রে, ওদের গাড়ি আছে?

কাদের! অবাক হল রেখা।

কাদের আবার, তাের বরেদের। ধ্যাত, তুই এখন থেকেই যা-তা বলতে শুরু করেছিস। মুখ তুলে পশ্চিম আকাশ থেকে আসা আলাের মুখােমুখি হল রেখা। হালকা হলুদের গুঁড়ােয় নরম হয়ে গেছে আলাের তাপ। কনে-দেখা আলাে। সারাদিনের শেষে একুটখানির জন্য ফুটে ওঠে, তারপরই অন্ধকার এসে নি:শেষ করে দেয়। চোখের পাতা কাঁপছে রেখার। দু-চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে সে কেমন করে একটা দিন তার স্বপ্নের সঞ্চয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে রাত্রির আয়ােজনে।

খুনুপিসি বলছিল গাড়ি কিনবে। সত্যি! তাহলে তাে রােজ বেড়াতে পারবি। আকাশ থেকে সবটুকু খুশি কুড়িয়ে নিল মঞ্জু তার দু-চোখে। মিষ্টি হেসে ওর দিকে তাকাল রেখা।

বেড়িয়ে এসে তারপর কী করবি? গল্প?

ধুর, তাের বুদ্ধিসুদ্ধি কোনােদিন হবে না। মা বােন এদের সামনে কেউ বউয়ের সঙ্গে গল্প করতে পারে? লােকে বলবে কী!

তাহলে গল্প করবি কখন?

উত্তর না দিয়ে চোখে রহস্য এনে মুচকি হাসল রেখা।

রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে? রেখার কানে কথাটাকে মিশিয়ে দিল মঞ্জু।

সেইরকম আস্তেই মঞ্জুকে ধাক্কা দিয়ে বলল রেখা, সব কথা কি বলতে আছে?

আমাকেও বলতে নেই?

মঞ্জু রাগ করল না, বরং দু-হাতে জড়িয়ে ধরল রেখাকে—বাদসাদ দিয়েও বলবি না?

আচ্ছা, বলব ক্ষণ।

সারাদিনের শেষে কখন বিকেল আসবে, কখন দুজনে মুখােমুখি হয়ে আর এক জগতে পাড়ি জমাবে তারই প্রত্যাশায় ছটফট করে মঞ্জু আর রেখা। কথা আর কথা। জ্যৈষ্ঠ শেষ হয়ে আষাঢ় পড়ল, তবু ওদের ক্লান্তি নেই। আষাঢ়ও শেষ হয়ে শ্রাবণ ধরল। দিল্লি থেকে চিঠি এসে গেল। মেয়ে পছন্দ হয়নি। কোনাে কারণ তারা জানায়নি। থমথমে মুখ নিয়ে ওরা দাঁড়াল ছাদে। ইতিদের ছাদে ম্যারাপ বাঁধার আয়ােজন শুরু হয়ে গেছে। বাঁশের কঙ্কালের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মঞ্জু শুধােল, কী লিখল ওরা?

উত্তরের জন্য সারা দুপুর নিজেকে তৈরি করেছে রেখা। একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘর। ঘামে জবজবে ছটফটে দুপুর। তারপরেই বিকেলের ছাদ। কিছু আকাশ আর কিশােরী লজ্জা রােদ। কথায় কথায় তৈরি আর এক পৃথিবীর চেনা সংসার। ভয়ে কেঁপে উঠেছিল রেখা। এ সবই হারাতে হবে। ফুরিয়ে যাবে সব কথা, মরে যাবে এই আকাশ, রােদুর আর ছাদের প্রত্যক্ষমান স্পন্দন। শুধু শুনতে হবে হাঁপটানা ক্লান্তিকর দিনরাতের নিশ্বাস…

সযত্নে তৈরি উত্তরটাকে রেখা সাজিয়ে তুলল, লিখেছে পছন্দ হয়েছে; কিন্তু ছেলে এখন মত করছে না। বােনের বিয়ে না দিয়ে বিয়ে করবে না বলেছে। আস্তে আস্তে পড়ন্ত আলাের মতাে থেমে গেল রেখার কথাগুলাে। শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে ইতিদের ছাদের দিকে।

মঞ্জুও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, দুটো বছর তাে, তারপর বােনের বিয়ে হয়ে যাবে। তাই না?

কোনাে কথা বলল না রেখা। মুঠোয় চিবুক রেখে আকাশে তীক্ষ্ণ চোখ মেলল সে। কনে দেখা আলােকে পিষে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য আকাশে আকাশে ষড়যন্ত্রী অন্ধকারের ব্যস্ততা। আর এক ছাদে সাদা গেঞ্জিটায় ঘামে-ভেজা রং ধরেছে। আত্মীয় রং চেনা যায়। কিন্তু দিব্যেন্দু, বড়াে দূরের। মঙ তাে পরে সবই জানতে পারবে। তখন নিভে যাবে রূপকথার প্রদীপ। দমচাপা অন্ধকারের থেকে নিজেকে বাঁচার আকুলতায় টেনে টেনে হেসে বলে উঠল রেখা, না, ভাবছিলুম এই লােকটার কথা। আচ্ছা ধর, যার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে, সেও তাে অনেক…

জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ

বিয়ের পর ঘরের অকুলান এবং ডেইলি প্যাসেঞ্জারির ধকল, এই দুই ঝকমারি সামলাতে, বিশ্বনাথ কলকাতার উত্তরে বাসা পেয়ে গোবরডাঙার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে উঠে এসেছে। সে চাকরি করে বিরাট এক হোটেলে। প্রায় সাড়ে সাতশো কর্মচারির ছুটির হিসাব রাখা তার কাজ। বউ পূর্ণিমা, সাত মাসের পুত্র বুবুন আর বাসু নামে বছর বারোর একটি কাজের মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। হাজার টাকা সেলামি দিয়ে দেড়শো টাকা ভাড়ায় দেড়খানি ঘর, ছোট্ট রান্নাঘর আর সরু একটি দালান নিয়ে তার সংসার। টানাটানি নেই আবার সচ্ছলও নয়, যেমন পূর্ণিমা সাদামাটা নয় আবার সুন্দরীও নয়।

বিশ্বনাথ জন্মরুগ্ন। শরীর কমজোরি হওয়ায় ছোটো থেকেই সে ভীরু প্রকৃতির। পূর্ণিমা কিছুটা বিপরীত। সে চটপটে, পরিশ্রমী এবং কিঞ্চিৎ রাগী। কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে বসবাস পদ্ধতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে তার অসুবিধা হয়নি শুধু জলের ব্যাপারটা বাদে। সে অস্বাচ্ছন্দ্যে পড়ে সকাল বেলাটায়।

এই বাড়ির তিনটি পরিবারের জন্য উঠোনে এজমালি একটি জলের কল। স্নানের ঘরেও একটি কল আছে চৌবাচ্চার উপরে। পূর্ণিমাদের মুখোমুখি উঠোনের ওধারে একটি ঘরে থাকে স্যাকরা কানাই দত্ত, তার দ্বিতীয় পক্ষের বউ সুপ্রিয়া এবং দুই পক্ষের মোট তিনটি ছেলে মেয়ে। বাড়িওয়ালা রূপেন পাল কাঠের ব্যবসায়ী। তার সংসারে স্ত্রী, এমএ পাঠরতা কন্যা আর নিমাই নামে একটি চাকর মাত্র। জনা বারো প্রাণী নির্ভর করে একটি কলের উপর। প্রতিদিন দু-বেলা কে আগে কলের নীচে কলসি বা বালতি বসাবে, এই নিয়ে তিন পরিবারের লোকেদের মধ্যে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো জলধরার প্রতিযোগিতা চলে। মছলন্দপুরের বাপের বাড়িতে টিউবওয়েল, পাতকুয়া এবং পুকুর পূর্ণিমাকে যথেচ্ছ জল খরচ করার অভ্যাস তৈরি করে দেওয়ায় এখন চার বালতি জলের সঙ্গে সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। স্বামীকে সে প্রায়ই অনুযোগ করে, বাড়িওলাকে বলো আর একটা কল বসাতে, এভাবে রোজ পারা যায় না। উঠোন ধুতে দু-বালতি জল ঢেলেছি অমনি ওপর থেকে মাসিমার চিৎকার, চৌবাচ্চা খালি করে দিয়ো না গো। চান করছি আর তখন দরজার কাছে এসে সুপ্রিয়া বলবে, উনি চান করবেন, একটু জল রেখো। বাড়িওলাকে এবার বলো আর একটা কল বসাক।

বললেই কি কল বসানো যায়। কলকাতার জলের অবস্থাটা আগে বোঝো। কল দিয়ে বেরোবার জন্য জলটা কোথায়? জল দেবে কর্পোরেশন, বাড়িওলা তো নয়।।

বিশ্বনাথ সর্বদাই বিরোধ বিসংবাদ এড়িয়ে চলতে চায়, সে জানে চিৎকার ঝগড়া হাতাহাতি করে সামান্য কিছু আদায় করা গেলেও মানসিক উৎপীড়নে অশান্তিতে ভুগতে হবে। পূর্ণিমাকে সে বোঝায়, সব কিছু কি আর করে দেওয়া যায়, মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়, কিছুটা ছেড়ে দিয়ে অ্যাডজাস্ট করতে হয়। যখন যেরকম অবস্থা পড়ে তখন তেমনভাবে চলা।

মানিয়ে চলারই তো চেষ্টা করি। যখন কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছিল না, মাসিমা বোতল হাতে এলেন তখন কি আমি আধ বোতল দিইনি? হঠাৎ যেদিন দুধের ধর্মঘট হল, মিন্টু এসে বলল বাবা চা খেতে পাচ্ছে না একটুখানি দেবে কাকিমা? বুবুনের বেবিফুড থেকে তো দু-চামচ দিলুম। মানিয়ে চলতে একা আমি চাইলেই তো হবে না। লোডশেডিং হলে হারিকেনটা রান্নাঘরের দরজার বাইরে রেখে কাজ করি, তাতে আমার অসুবিধে হলেও কিছুটা আলো তো সদরে পড়ে। এসব কেন করি, মানিয়ে চলার জন্যই তো।

অন্যে আমার জন্য কী করল বা না করল তাই নিয়ে মন খারাপ করে লাভ কী, তোমার কর্তব্য তুমি করে যাও।

সংসার চালাতে গেলে অত ভালোমানুষ হলে চলে না।

বিশ্বনাথ তখন ট্রানজিস্টারের চাবি ঘোরাল ছায়াছবির গান শোনার জন্য।

কয়েক দিন পর সকালে খবরের কাগজ পড়ার মধ্যেই বিশ্বনাথ এক বার রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে উঁচুস্বরে বলল, পলতায় জলের পাইপ বদলানো হবে, বুধবার বিকেল থেকে বারো ঘণ্টা জল আসবে না, জল ধরে রেখো।

কথাটা পূর্ণিমার কানে পৌঁছোল কিন্তু গভীরে নয়। দু-দিন পরে বুধবার এল। প্রতিদিনের মতোই সে সংসারের জন্য জল তুলল। শুধু বিকেল আর রাতে জল বন্ধ, বৃহস্পতিবার সকালেই পাওয়া যাবে এই নিশ্চিন্তিতে সে বাড়তি জল ধরেনি। কিন্তু বিশ্বনাথের নজরে পড়ল কানাই দত্তর বউ আর বড়োমেয়ে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি, ডেকচি, গামলা করে চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে গেল প্রায় চোরের মতো। এভাবে জল নেওয়ার কোনো কথা নয়। এখনও বাড়ির কারুরই স্নান হয়নি। ঠিক তখনই দোতলা থেকে নিমাইও দুটো ঢাউস প্লাস্টিকের বালতি হাতে নামল।

বিশ্বনাথ রান্নায় ব্যস্ত, পূর্ণিমাকে বলল, জল ধরে রেখেছ তো?

খাবার জল দু-বালতি রেখেছি, হবে না ওতে? কাল সকাল পর্যন্ত তো। রাস্তার টিউবয়েল থেকে দরকার হলে বাসু এনে দেবে।

সেটা তো কতদিন ধরে খারাপ হয়ে রয়েছে, ওদিকে চৌবাচ্চা খালি করে ওরা জল নিয়ে গেল।

তাহলে চটপট তুমি কলঘরে ঢুকে পড়ো, চানটা করে নাও। দেখলে তো কেমন স্বার্থপরের মতো নিজেরা চৌবাচ্চার সব জল নিল? যেন ওরা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ নেই।

বুধবার বিকেলে কলে জল এল না। চৌবাচ্চা শুকনো। রাতে সকড়ি বাসন জলে ভিজিয়ে রাখা পূর্ণিমার অভ্যাস। তুলে রাখা দু-বালতি জলের একটি থেকে অর্ধেক খরচ হয়ে গেছে। তাই থেকে দু-গ্লাস জলে গামছা ভিজিয়ে গা মুছল। ভ্যাপসা গরমের জন্য বিশ্বনাথ পাখার নীচে মেঝেয় শোয়। ন্যাতা ভিজিয়ে মেঝে মুছতেও এক গ্লাস খরচ হল। প্রতিদিনের মতো দাঁত ব্রাশ করার জন্য বিশ্বনাথের দু-গ্লাস জল দরকার হল। বালতিটায় তারপর আর কিছু রইল না।

আর এক বালতি তো রইল।

পূর্ণিমার নিশ্চিন্ত মুখে বিশ্বনাথ অনিশ্চিত চাহনি রেখে বলল, কিন্তু সকালে যদি জল না আসে?

পরদিন সকালে জল এল না।

পূর্ণিমার হতভম্ব অবস্থাটা কেটে যেতেই কথার খেলাপ করার জন্য কর্পোরেশনের উপর রেগে উঠল। সংসারের নিত্যকর্মগুলো শুরু করতে গিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। এক বালতি জল কোন কর্মে লাগবে।

বিশ্বনাথ একটা বালতি নিয়ে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পর আধ বালতি জল নিয়ে ফিরল।

কী লাইন আর কী ঝগড়া রে বাবা!

কোথায় গেছলে?

এই পিছনে বাজার যাবার পথে যে-বস্তিটা। ওরা নিতে দিচ্ছিল না, অনেক বলে-কয়ে আধ বালতি নিতে দিল।

চান তো হবে না, তুমি বরং এটা নিয়ে পায়খানায় যাও।

আর তুমি, বাসু?

সে যাহোক করে হয়ে যাবে, তোমাকে তো এখন বেরোতে হবে।

তাহলে থাক, আমি হোটেলেই সব সেরে নেব। ওখানে নিজেদের জলের ব্যবস্থা আছে।

বাজার থেকে কলাপাতা এনো।

বুবুনকে কোলে নিয়ে বাসু শুনছিল, বলল, বউদি চাপাকল থেকে জল আনব?

রাস্তার ওই নোংরা জল, ম্যাগা!

গঙ্গার জল তো, কত লোক নিচ্ছে।

নিক গে, বিকেলেই জল এসে যাবে।

বিকেলে জল এল না। কলের নীচে বালতি রেখে পূর্ণিমা দুপুর থেকে অপেক্ষা করেছে, সেঁকুর তুলে সর্দি ঝাড়ার মতো শব্দ কখনো বেরিয়ে আসে।

বালতি পেতে কোনো লাভ নেই গো৷ উঠোনের ওধার থেকে সুপ্রিয়া বলল, এরকম আগেও তো হয়েছে, এক বেলা বলে চার বেলা, একদিন বলে তিন দিন। এবার কতদিন চলবে তার কি ঠিক আছে। আমি বাবা কাল সকালটা দেখব, এল তো ভালোই নইলে শিবপুরে দিদির বাড়ি চলে যাব।

পূর্ণিমা শুনেই গেল। কলকাতার ত্রিশ-চল্লিশ মাইলের মধ্যে তার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এখন তার শরীরে টোকো গন্ধ। জষ্টি মাসের গরম, বাতাসও বইছে না। এক-তলার ঘরে দরদর ঘামের সঙ্গে ধুলো মিশে চামড়ার উপর কাদার পরত ফেলেছে। সারাদেহে চিটচিটে অস্বস্তি। পায়খানায় যেতে পারেনি, তলপেটে একটা গুমোট ক্রমান্বয়ে চাপ দিচ্ছে।

বুবুনের জন্য দুধ তৈরি করতে হবে কিন্তু জল রয়েছে বড়জোর এক গ্লাস। তেষ্টায় পূর্ণিমার ছাতি ফেটে যাবার মতো অবস্থা অথচ জলটুকু সে খেতে পারছে না, বুবুনের বেবিফুড গুলতে দরকার। সুপ্রিয়ার কাছে এক গ্লাস চাইতেই সে পরিষ্কার বলে দিল, না ভাই, জল এখন চাওয়াচাওয়ি কোরো না। দুপুরে মিনুর বাবা মারামারি করে টিউকল থেকে এক বালতি এনে দিয়েছে…আমাদেরও তো দরকার লাগবে।

গেলাস নিয়ে সে দোতলায় গেছল। মাসিমা বিষগ্ন কণ্ঠে বললে, পোড়া কপাল, দুপুর থেকে গলা ভেজাবার মতো জলও নেই। নিমাই একটা ভারীকে ধরেছিল এক টিন জলের জন্য, ব্যাটা বলে দিল দিতে পারব না। তিন গুণ চার গুণ দাম দিয়ে দোকানদাররা যে নিচ্ছে!

পূর্ণিমা মুখ কালো করে নীচে নেমে এসে দেখল বাসু চাপাকল থেকে বালতি ভরে জল এনে পায়খানার দিকে যাচ্ছে। তাকে দেখেই কুঁকড়ে গেল। তারপর করুণ স্বরে বলল, বউদি আমি আর পারছি না।

দুর্বল স্বরে পূর্ণিমা বলল, সবটা খরচ করিসনি, আমার লাগবে।

সন্ধ্যায় বিশ্বনাথ ফিরল বেশ উদবেগ নিয়েই। শুনছি জল নাকি অনেক দিন পাওয়া যাবে না। পাইপ না ভালভ কী যেন বদলাতে গিয়ে সব ভেঙে পড়েছে, আবার নতুন করে বসাতে হবে।

পূর্ণিমা ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সে আবার বলল, হোটেলে নোটিশ দিয়েছে এমপ্লয়িরা চান করতে পারবে না। আমি অবশ্য একটা খালি রুমে ঢুকে ম্যানেজ করে নিয়েছি।।

বাসু বলল, আমাদের এক ফোঁটা জলও নেই। বউদি খাবার জন্য এক গ্লাস জল চাইতে গেছল, নীচে ওপরে কেউ দিল না, আমি পাশের বাড়ি থেকে দু-গ্লাস জল আনলুম, ওরা লোক খুব ভালো!

বিশ্বনাথ ঈষৎ অপ্রতিভ হয়ে সে কী! বলে এক ঝটকায় দুটো প্লাস্টিকের বালতি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং মিনিট পনেরো পর ফিরে এল খালি বালতি নিয়েই।

চলো তো আমার সঙ্গে, ওরা নিতে দেবে না। মেয়েছেলে দেখলে হয়তো ছেড়ে দেবে…বেশি দূর তো নয়, বস্তিতে ঢুকে সোজা কুড়ি-পঁচিশ পা এগোলেই টিউবওয়েলটা।

গলির তিনটি বাঁক ঘুরেই ডান দিকে পড়ে কয়েকটা টালি। টিন আর খোলার চালের দোকান ঘর, উলটোদিকে ডালখোলা। মুদি আর তেলেভাজা দোকানের মাঝে বট গাছের ধার দিয়ে সাত-আট হাত চওড়া কাঁচা রাস্তা বস্তির মধ্যে ঢুকে গেছে। সবে সন্ধে হয়েছে, রাস্তাটার মুখে এবং ভিতরে কর্পোরেশনের আলো জ্বলছে।

তৃতীয় বাঁকের আগে বিশ্বনাথ দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্তর্পণে কোণের বাড়ি ঘেঁষে উঁকি দিল। দুটো বাচ্চা ছেলে, একজনের হাতে পেট্রোলের টিন, আর খয়েরি লুঙ্গিপরা খালি গা শীর্ণ চেহারার একটি লোক আঙুল তুলে চলে যেতে বলছে। ধমকের তর্জন দূর থেকে বিশ্বনাথ শুনতে পেল। এই লোকটিই তাকে ঢুকতে দেয়নি বস্তিতে। বলেছিল, অনেক হুজ্জত ঝামেলা করে এই কল আদায় করেছি, তখন তো আপনারা সাপোর্ট দিতে আসেননি…জলফল হবে না, অন্য জায়গায় দেখুন। কয়েক জন স্ত্রীলোক তখন দাঁড়িয়েছিল। একজন বলে ওঠে, তিন তলা বাড়িতে থাকার সুখ এবার পিছন দিয়ে বেরুবে।

বাচ্চা দুটো গুটিগুটি ফিরে আসছে। লোকটা লুঙ্গি টেনে তুলে মুদি দোকানের গায়ে ধাপটায় পা ঝুলিয়ে বসল।

কী বলল রে তোদের?

বিশ্বনাথের দিকে এক বার মাত্র তাকিয়ে যেতে যেতেই একজন জবাব দিল, কিনে খেতে বলল।

বিশ্বনাথ ইতস্তত করে পূর্ণিমাকে বলল, তুমি একাই যাও, পারবে তো দু-হাতে দুটো বয়ে আনতে?

পারা না পারা নয়, পারতেই হবে।

পূর্ণিমা বালতি নিয়ে এগোল। তার চলনের মধ্যে গোঁ ফুটে উঠেছে। মুদির দোকান পেরিয়ে বস্তিতে ঢুকতে যাচ্ছে তখন লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, এই যে যাচ্ছেন কোথায় বালতি হাতে? …জল? হবে না।

না শোনার ভান করে পূর্ণিমা এগিয়ে যাচ্ছিল। লোকটা ধাপ থেকে লাফিয়ে নেমে প্রায় ছুটেই তার সামনে পথ জুড়ে দাঁড়াল। শুনতে পাননি, কালা নাকি?

একটু জল নেব।

অন্য জায়গায় যান, এখানে হবে না।

বড্ড দরকার, বাচ্চার খাবার জলটুকুও বাড়িতে নেই। পূর্ণিমার স্বরে অকৃত্রিম কাকুতি। ফুটে উঠল।

বলে তো দিয়েছি, অন্য জায়গায় যান, কলকাতায় আরও অনেক টিউকল আছে।

খাবার মতো জল অন্তত নিতে দিন।

খাবার, জলপটি দেবার, ছোঁচাবার কোনো জলই এখানে মিলবে না।

পূর্ণিমা গলা নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, পয়সা দেব, এক-এক বালতি কত করে নেবেন বলুন?

লোকটার পাশে বস্তিরই আরও দুটি মাঝবয়সি লোক ও একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে। কিশোরীটি হঠাৎ বলল, পয়সার গরম দেখাচ্ছেন?

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা গলা চড়িয়ে বলে উঠল, আমরা বস্তিতে থাকি বলে কি ভেবেছেন পয়সা দিয়ে কিনে নেবেন?

কৌতূহলে পথচারী দু-তিন জন থমকে গেল। বস্তির ভেতর থেকে কয়েক জন এগিয়ে এল, দোকান থেকে মুখ ঝুঁকে পড়ল।

কেনাকেনির কথা তো বলিনি, একটু জল চাই শুধু।

আপনি পয়সার কথা বলেননি, মিথ্যুক। ভদ্দরলোকের মেয়ে যদি হন তো বলুন পয়সার কথা বলেননি?

বলেছি, কিন্তু সে তো জল কিনব বলে!

একই কথা।

আমাদের বাড়ির কাছেরটা ভেঙে পড়ে আছে আজ বারো-চোদ্দো দিন, আর কোথায়…

তাই বলে এখানে পয়সার ফুটুনি মারতে আসা? জল কেনার শখ হয়েছে, তিন-তলা বাড়িতে ফ্যানের হাওয়া খেয়ে জল তুলতে এসেছেন…যান যান জলফল হবে না।

কেন হবে না?

পূর্ণিমা হঠাৎ কোণঠাসা বেড়ালের মতো কুঁজো হয়ে বালতি দুটো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তীক্ষস্বরে বলল, কেন জল পাব না, কলটা কি আপনাদের পৈতৃক সম্পত্তি, মগের মুল্লুক নাকি? আমি জল নেবই।।

সামনের দু-তিন জনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে বস্তির মধ্যে যাবার জন্য হনহনিয়ে এগোতেই কিশোরীটি ছুটে গিয়ে পিছন থেকে তার আঁচল টেনে ধরল। শরীরের উপর থেকে শাড়িটা খুলে কোমরে টান পড়তেই পূর্ণিমা ঘুরে বালতি দিয়ে মেয়েটির বাহুতে আঘাত করল।

ওরে মেজদি, ওরে শেফালি শিগগিরি আয়, আমাকে মারছে রে।

মেয়েটি তারস্বরে চিৎকার করে উঠতেই দু-পাশ থেকে পাঁচ-ছটি স্ত্রীলোক ছুটে এল। নারী পুরুষের একটা ভিড় পূর্ণিমাকে ঘিরে। তার মধ্য থেকে এক বিবাহিতা তরুণী বিশ্রী একটা গালি দিয়ে পূর্ণিমার গালে চড় মারল।

হারামির বাচ্চা মারপিট করতে এসেছিস, দাঁড়া তোর বাপের নাম ভোলাচ্ছি।

একটি অল্পবয়সি মেয়ে পূর্ণিমার চুল টেনে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, হাত ভেঙে দোব, কোতায় খাপ খুলতে এসেচ জান? চোক উপড়ে লোব।

হাত থেকে বালতি দুটো কে ছিনিয়ে নিয়েছে। অপ্রত্যাশিত অকল্পনীয় ঘটনায় পূর্ণিমা বিহ্বল চোখে এধার-ওধার তাকিয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতেই তিন চারটে মেয়ে তাকে আটকে রেখে টানতে শুরু করল। ব্লাউজ ভেঁড়ার শব্দ হল। তার ঘাড়ে নখ বসিয়ে মাংস খুবলে তুলতে চাইল একজন। হাঁটু দিয়ে একজন তার তলপেটে আঘাত করল। অন্ধের মতো দু-হাত ছুড়তে ছুড়তে পূর্ণিমা চিৎকার করে উঠল, ছোটোলোক, ছোটোলোকের দল। …আমায় যেতে দাও, যেতে দাও।

পুরুষ কন্ঠে কে বলল, চোপা কত! হাতটা ভেঙে দে-না।

আর একজন বলল, ন্যাংটো করে দে মাগিকে, পয়সার গরম তাহলে কমবে।

ঠেলাঠেলির মধ্যে কেউ তার শাড়ি ধরে টেনেছে। পূর্ণিমা দুই মুঠোয় শাড়ি ধরে আর্তনাদ করে উঠল, খুলো না, পায়ে পড়ি তোমাদের খুলো না।

টান টান, খুলে দে।

দুটি মেয়ে হ্যাঁচকা টান দিতেই পূর্ণিমা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল। শাড়িটা শক্ত করে সে ধরে রেখেছে। সেইভাবেই হাত দশেক তাকে ওরা টেনে নিয়ে গেল। তখন সে হাউহাউ করে ওঠে, আমার শাড়ি নিয়ো না, ওগগা খুলে নিয়ো না।

একটি স্থূলকায় বিধবা পূর্ণিমার দুই মুঠির উপর দাঁড়াতেই শাড়িটা তার দখল থেকে বেরিয়ে গেল। মাটিতে মুখ চেপে সে ফোঁপাতে শুরু করল। মিনিট তিনেকের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল, সেই সময় ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বিশ্বনাথ উঁকি দিল আর পূর্ণিমাকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠল।

একী একী, অ্যাাঁ একী!

উত্তেজনায় ঠকঠক করে সে কাঁপছে, আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না। শুধু শায়াটা হাঁটুর কাছ থেকে নীচে নামিয়ে দেওয়া ছাড়া তার শরীর আর কোনো আবেগ বা

প্রতিবাদ প্রকাশ করতে পারল না।

বিশ্বনাথ এতক্ষণ সেই রাস্তার বাঁকেই অপেক্ষা করছিল। পূর্ণিমা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে না আসায় সে ধরে নেয় দুটো বালতি ভরার জন্যই সময় লাগছে। স্বস্তি বোধ হতেই সে সিগারেট কিনল সামনের দোকান থেকে। দড়ির আগুন সিগারেটে যখন লাগাচ্ছে তখন কানে এল—বস্তিতে একটা মেয়েলোক জল নিতে এসেছে তাকে ধরে সবাই যা ঝাড় দিচ্ছে-না–শোনামাত্র সে ছুটে গেছে।

শাড়িটা দিন।

বিশ্বনাথ ভিড়ের মুখের দিকে তাকাল। শাড়ির জন্য কেউ ব্যস্ততা দেখাল না। বালতি দুটোরও হদিস নেই। ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে যাচ্ছে।

শাড়িটা ফিরিয়ে দিন।

বিশ্বনাথ প্রার্থনার মতো দু-হাত মুঠো করে মেয়েদের দিকে তাকাল।

শাড়ি না হলে ও যাবে কী করে?

কেন শায়া তো রয়েছে।

বিভ্রান্ত চোখে বিশ্বনাথ তাকিয়ে রইল মাটিতে উবুড় হয়ে থাকা তার স্ত্রীর দেহের দিকে। নিজের শার্টটা খুলে পূর্ণিমার পিঠের উপর রেখে বলল, চলো বাড়ি যাই।

পূর্ণিমার ঘাড় আর গাল থেকে রক্ত ঝরছে। ফালা দেওয়া ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে চামড়ায় রক্তের ছড় দেখা যাচ্ছে। চোখের জল আর মাটিতে মুখ লেপা। বিশ্বনাথ রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে দিল। তখনও সে ঠকঠক করে কাঁপছে।

ওরা বাড়ি ফিরে এল। শার্ট আর শায়াপরা পূর্ণিমাকে রাস্তার দু-ধারের কৌতূহলী চোখ দেখছিল, কিন্তু তাই নিয়ে বিব্রত বা লজ্জিত হবার মতো বোধক্ষমতা তাদের ছিল না। অপমান, রাগ, দুঃখ কিছুর দ্বারাই ওরা পীড়িত হয়নি। অনুভবহীন, শব্দহীন শূন্যতার মধ্য দিয়ে দুজনে ফিরে এল।

সেই রাত্রেই কলে জল এল। বালতি বসাবার জন্য যখন হুড়োহুড়ি চলছে পূর্ণিমা তখন বিছানায় কাঁপছে জ্বরের তাড়সে।

দিন দশেক পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বিশ্বনাথ দেখল রান্নাঘরের প্রায় সিকিভাগ জুড়ে রয়েছে দুটো জালা, যার মধ্যে একটা মানুষ উবু হয়ে থাকতে পারে।

দুপুরে বাজারে গিয়ে কিনে আনলুম। তিরিশ টাকা পড়ল, এক টাকা মুটে। এবার জল জমাব।

জলের ক্রাইসিস কি ঘন ঘন হয় যে চাল বা কেরোসিনের মতো জমিয়ে রাখবে।

যদি দু-বছর, চার বছর, দশ বছর পরও হয় তবুও… রাগটা যন্ত্রণার চাপে পূর্ণিমার গলায় আটকে গেল। বিশ্বনাথ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।

পূর্ণিমা প্রতিদিন এক বালতি করে জল দুটি জালায় ঢালতে লাগল। সকালের প্রথম বালতির এবং বিকালের প্রথম বালতির জল। এজন্য সংসারে ব্যবহারের জন্য জলের পরিমাণ তাকে কমাতে হল। চায়ের জন্য বাসু একদিন দু-বাটি জল জালা থেকে নেওয়ায় চড় খেল। দিনে তিন চার বার সে সরা তুলে দেখে কতটা ভরল।

একদিন জালা দুটি ভরে গেল। পূর্ণিমা দুটি ছোটো ছোটো জালা কিনে বড়ো দুটির মুখের উপর বসিয়ে দিল।

এতে ক-দিন চলবে? একদিন বিশ্বনাথ জিজ্ঞাসা করল।

পূর্ণিমা মনে মনে হিসেব করে বলল, দু-সপ্তাহ চলবে শুধু খাওয়া আর রান্নার জন্য, তবে নির্ভর করছে কীভাবে খরচ করবে। বাসনমাজা, কাচাকাচি, ঘরমোছা চলবে না।

তোমার টার্গেট কত?

আমার টার্গেট নেই।

অবশেষে ছোটো জালা দুটোও ভরে গেল। রান্নাঘরে আর জায়গা নেই। দালানটা অরক্ষিত। শোবার ঘরে রাখা যায় কি না, পূর্ণিমা তাই নিয়ে কয়েক দিন চিন্তা করল। একদিন সে বিশ্বনাথের কাছে জানতে চাইল, বড়ো বড়ো ঘিয়ের টিন কোথায় পাওয়া যায়?

কেন জল রাখবে বলে? টিনে মরচে পড়ে তো ফুটো হয়ে যাবে।

ছাদে কয়েকটা ইট পড়েছিল। কয়েকটা আঁচলের আড়াল দিয়ে নামিয়ে এনে পূর্ণিমা শোবার খাটটাকে উঁচু করল। এরপর মাটির কলসি কিনে জল ভরে খাটের নীচে রাখতে লাগল।

শুধু জল আর জল রাখার পাত্র ছাড়া পূর্ণিমার আর কিছু কথা বলার নেই। বাড়ির বাইরে গেলে ছটফট করে ফেরার জন্য। তার ভয় জালা বা কলসি যদি কেউ ভেঙে ফেলে। খড়ি দিয়ে ওগুলোর গায়ে কেনার তারিখ লিখে রেখেছে। কোনটি থেকে প্রথম খরচ করবে, তারপর কোনটি, তারপর কোনটি, মনে মনে সে পাত্রগুলিকে সাজিয়ে ফেলেছে। কোন কাজের জন্য কোনটি থেকে জল খরচ করবে তাও সে ঠিক করে রেখেছে। দু-তিনটি পাত্রের তলা থেকে জল চুইয়েছিল। দোকান থেকে পুডিং এনে লাগিয়েছে। কী এক ঘোরের মধ্যে তার দিন এবং রাত কেটে যায় এই জল নিয়ে। এক-এক সময় সে বিড়বিড় করে হিসেব করে। বাসুকে বলে, চানটানের কথাই ওঠে না। হাতধােয়া আর কুলকুচোর জন্য এক বাটি তার মানে তিন জনের জন্য তিন বাটি, দু-বেলায় ছ-বাটি। বুবুনের কাঁথা প্রথম দু-তিন দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে…গন্ধ হবে তো কী আর করা যাবে। বাজারের আনাজ ধােয়ার জন্য এক গামলা…হবে না রে?

এখন সে সকালে খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করে। বিশ্বনাথের হাতে দেবার আগে খুঁটিয়ে দেখে, জল সরবরাহ বন্ধের খবরের জন্য।

বাড়ির সকলে জেনে গেছে তার জল-জমানোর ব্যাপারটা। উপরের মাসিমা একদিন এসে তার জলভান্ডার দেখে গেল।

তাকগুলো খালি কেন? বোতলে ভরে ভরে রেখে দাও। ঠাট্টা করেই কথাগুলো বলা, কিন্তু পূর্ণিমার কানে সেটা বিচক্ষণ পরামর্শ মনে হল। শিশি-বোতলওলার দোকান থেকে সে দশটি বোতল কিনে জল ভরে তাকে রাখল।

সুপ্রিয়া মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়। একদিন বলল, তুমি তো বাপু ছোটোখাটো টালার ট্যাঙ্ক করে ফেলেছ। এবার জল বন্ধ হলে তোমার কাছেই হাত পাতব, দেবে তো? অবশ্য পয়সা দিয়েই নোব।।

পয়সা শব্দটা পূর্ণিমার মাথায় ভারী হাতুড়ির মতো পড়ল এবং অবশ করে দিল। সারা দিন সে কথা বলল না, থালায় ভাত ফেলে রেখে উঠে পড়ল। অকারণে বার বার তার কান্না পেল।

আশপাশের বাড়িতেও জেনে গেছে। কিছুদিন হাসাহাসি করে তারা ভুলে গেল। প্রতিদিনই কল থেকে জল বেরিয়ে আসছে, পূর্ণিমা তাই দেখে দেখে এখন বিরক্ত। বিশ্বনাথকে বলল, জল কি আর বন্ধ হবে না?

তোমার তাই নিয়ে ভাবনা করার কী? তিন-চার মাসের তো স্টক হয়েই গেছে।

স্তিমিত ক্লান্ত কণ্ঠে সে বলল, কাজে না লাগলে জমানোর কোনো মানেই হয় না।

এই কথার দু-দিন পরেই ভোরে কাগজ দেখতে দেখতে পূর্ণিমা চিৎকার করে উঠল, হয়েছে হয়েছে, ওগো, শুনছ, ওরে বাসু…সোমবার সকালে জল আসবে না।

কাগজ হাতে সে ছুটে উঠোনে এল। সুপ্রিয়া কলে মুখ ধুচ্ছে। পূর্ণিমা চেঁচিয়ে প্রায় সারা বাড়িকে শুনিয়ে বলল, সোমবার সকালে জল আসবে না গো।।

অদ্ভুত এক সুখ পূর্ণিমাকে গ্রাস করেছে। তিন দিন পর সোমবার। তিনটে দিন সে তীব্রভাবে অপেক্ষা করল। তার ঘর ভরে আছে জলে, সে নিজেও ভরে যাচ্ছে কানায় কানায়। এতদিন ধরে ধিকিধিকি যে দুঃখ তাকে পোড়াচ্ছে এইবার তা নিভবে। উদাসীন চোখে সে দেখল অন্যান্যদের ব্যস্ততা, ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা, ভাবনা। অলসভাবে সংসারের কাজ করে গেল এবং মাঝে মাঝেই উজ্জ্বল হয়ে মৃদু হাসিতে তার মুখ ভরে যাচ্ছিল। বহুদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে এই দিনটির জন্য।

জল তুলে রাখবে না বউদি?

দরকার নেই।

সোমবার সকাল থেকে কলকাতায় কলের জল নেই। বড়ো জালা থেকে পূর্ণিমা সংসারের জন্য জল ব্যবহার শুরু করল। স্নান বন্ধ, কলাপাতায় খাওয়া। বাসু চাপাকলের জলও আনল। অস্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে কিন্তু যেন বিরাট নিরুদবিগ্নতাকে আরও উপভোগ্য করার জন্য। বার বার সে জলের পাত্রগুলোর গায়ে হাত বোলাল, বার বার তাকিয়ে দেখল। এইবার সে তৈরি হয়ে রয়েছে।

দুপুর থেকে সে উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকিয়ে রইল কলের দিকে। জল আসার সময় পেরিয়ে যেতে সে সুখবোধ করল। জল আসেনি। যেন তার মুখ চেয়েই মসৃণভাবে প্রহর গড়িয়ে চলেছে।

এক বেলার জন্য বলেছিল, কথার কোনো দাম নেই গো, কত বেলা যে লেগে যাবে জল আসতে তার কি ঠিক আছে?

সুপ্রিয়া সন্ধ্যায় সময় সদরে ধুনো দিতে এসে বিমর্ষ কণ্ঠে পূর্ণিমাকে বলল, তোমার আর কী, ঘরে টালার ট্যাঙ্ক নিয়ে দিব্যি তো কাটিয়ে যাবে।

রাত্রে সে বিশ্বনাথকে বলল, তোমার কী মনে হয়, এবার কত দিন চলবে?

বিশ্বনাথ দু-চার দিনের বেশি নয় বলায় পূর্ণিমা ক্ষুব্ধ হল। পাশ ফিরতে ফিরতে সে শুধু বলল, দেখা যাক।

মঙ্গলবার সকালে ঘুম ভাঙার পর আধা জাগরণ, আধা অচেতন অবস্থায় পূর্ণিমা ক্ষীণভাবে একটানা একটা শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা বেড়ে উঠতে উঠতে তার মাথার মধ্যে ঝম ঝম কড়া নাড়ার মতো আওয়াজ করে উঠল। ধড়মড়িয়ে সে উঠে বসল।

কলে জল এসে গেছে।

বাব্বাঃ বাঁচালে…ধরেই রেখেছিলুম এবারও ভোগাবে!

তবু কিছুটা কথা রেখেছে…ওরে নিমাই বালতিটা নিয়ে এবার নাম বাবা।

পূর্ণিমা পাথরের মতো বিছানায় বসে রইল। ঘরের বাইরের পৃথিবীটা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু তার নিজের জগৎ চুরমার হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়েছে।

ঘরের দরজা খুলে সে বাইরে এল। ভরা বালতি হাতে নিমাই দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে, সুপ্রিয়া উবু হয়ে উনুন সাজাচ্ছে, কলে বালতি পেতে মিনু ঘাড় হেঁটে করে দাঁড়িয়ে, দোতলা থেকে বাড়িওয়ালার জিবছোলার শব্দ আসছে। পূর্ণিমার মনে হল তার অভ্যস্ত এই দৃশ্য থেকে সে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। এখন যেন সে ছেড়া ব্লাউজের উপর শার্ট আর শায়া পরে সারা মুখে মাটিলেপা অবস্থায় অনুভবহীন শূন্যতার মধ্যে। এইভাবেই কি তাকে দিনযাপন করতে হবে?

পূর্ণিমা দ্রুত সরে এল। ওরা তাকে দেখতে পায়নি। রান্নাঘরে ঢুকে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল। বাটনবাটার নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে জালার তলায় ঘা দিতেই ফুটো থেকে ছিটকে জল বেরিয়ে তার পা ভিজিয়ে দিল।

ঘরের নর্দমার মুখে জলের ঘূর্ণি আর বক বক শব্দটা তাকে অসম্ভব অবাক করে দিল।

জালি

ভোর থেকেই বাড়িতে উদবিগ্ন ব্যস্ততা। ফিসফাস কথা, বিষণ্ণ চাহনি, পা টিপে টিপে চলাফেরা। এক-তলায় সিঁড়ির পাশের ঘর থেকে একটা কাতর একটানা গোঙানি ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে সেটা তীক্ষ্ণ হয়ে সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা ভাইবোন, দেবু আর মিঠুকে কান্নার কিনারে ঠেলে দিচ্ছে। মিঠু তার দাদার গা ঘেঁষে সরে এসে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, দেবু নিজের ঠোঁটে একটা আঙুল চেপে হিস-হিস করে উঠল। তা সত্ত্বেও মিঠু বলে ফেলল, ঠিক মানুষের গলায় চ্যাঁচাচ্ছে, নারে? আমার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে শুনতে।

নীচের ঘরে তখন ওদের মা দীপালি, বাবা বিমান আর চাকর সুকুমার। ঘরে পাখা নেই তাই দোতলা থেকে টেবিল-ফ্যানটা আনা হয়েছে। সেটা একটানা ভোমরা ডেকে যাচ্ছে। মেঝেয় সতরঞ্চিতে শুয়ে আছে একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর। পাখার হাওয়া তার ধূসর মেশানো কালো লোমে কাঁপুনি তুলছে। গত তিন দিন ধরে সে প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। লিজা, লিজা..লক্ষ্মীমেয়ে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু আসছেন তোমার কিছু ভয় নেই। সোনা আমার…আর একটু কষ্ট সহ্য করো তো মা। লিজার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দীপালির স্বর বেদনায় রুদ্ধ হয়ে এল।

পরশুদিনই ডাক্তারকে খবর দিলে ভালো হত। বিমান আফশোস করল।

তুমি গাড়িটা নিয়ে যাও-না, একেবারে সঙ্গে করেই তাহলে আনতে পারবে।

তাই যাই।

আজ আর অফিস যেয়ো না।

না না, অফিস যাওয়ার কথাই ওঠে না। ইসস কী কষ্ট পাচ্ছে দ্যাখো তো!

আমরাই-বা আর কী করতে পারি।

সুকুমার চুপ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। বিমান তাকে বলল, দেবু আর মিঠু যেন নীচে নামে দেখিস। আর রান্নাবান্না আজ আর করে দরকার নেই। তুই বরং— বিমান তাকাল দীপালির দিকে।

যা গরম পড়েছে, দই-চিঁড়ে আর আম নিয়ে আসুক। দীপালি বলল।

আমিও তাই বলতে যাচ্ছিলুম। কাল ম্যাক্সিমাম ছিল, থার্টি এইট পয়েন্ট ফোর, হিউমিডিটি নাইনটি থ্রি পারসেন্ট। অসহনীয়, অসহ্য…রিচ রান্নাবান্না এখন থাক।

বিমান ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, ভাইবোন সিঁড়িতে বিষণ্ণ মুখে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে।

দেবু মিঠু, তোমরা কিন্তু এক-তলায় একদম নামবে না, সিঁড়ি থেকে উঁকিঝুঁকিও নয়। যাও, ওপরে যাও। লিজার বাচ্চা হওয়ার পর নামবে, তার আগে নয়।

বাবা, কখন হবে? দেবু বলল।

ডাক্তারবাবুকে আনতে যাচ্ছি।

ঘর থেকে কাতরানি ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে দীপালির উদবিগ্ন অনুরোধ, তুমি আর দেরি কোরো না। কী রকম যেন করছে।

যাচ্ছি। বিমান তাকাল ছেলে মেয়ের দিকে। তারা গুটিগুটি দোতলায় উঠে গেল। দোতলার বাথরুমের পাশ দিয়ে গেলে পশ্চিমের বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে, রাধাচূড়া গাছের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে বাস, মোটর, অটোরিকশার চলাচল দেখা যায়। আরও দূরে দেখা যায় ট্রেন। বাড়িটার পিছনে এলিট আর স্কাইলাইন নামে দুটো হাউজিং-এর সীমানা পাঁচিলের সংযোগ যেখানে হয়েছে তার পাশেই প্রায় বিঘা পাঁচেক সরকারি জমি। কিছু-একটা ইমারত হয়তো সেখানে একদিন উঠবে। আপাতত পাঁচিলের ধারে দুই হাউজিং-এর ভাঙা ইট, সিমেন্টের চাঙড় আর যাবতীয় আবর্জনার কয়েকটা ঢিপি তৈরি হয়ে গেছে।

সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেওয়া পাশের বাড়ির জগদীশবাবু রবারের নল দিয়ে তাঁর ছোটো বাগানটিতে জল ছিটোচ্ছেন। গোলাপের শখ। মুখ তুলে বারান্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী গো দেবুবাবু, লিজার বাচ্চা হল?

দেবুর আগেই মিঠু বলে উঠল বাবা ডাক্তারবাবুকে আনতে গেছে। লিজার খুব কষ্ট হচ্ছে তো।

তাই নাকি? আহা, বেচারা।

জগদীশবাবু আবার জল দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হলেন। ওরা তা দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দেবু বলল, কাল-পরশুই তো বৃষ্টি নামবে, তাহলে আর জল দিচ্ছেন কেন?

কে বলল বৃষ্টি নামবে?

বাবা। কাগজে লিখেছে আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই এসে যাবে।

আসুক তো আগে। জগদীশবাবু কাজে মন দিলেন তবে বিব্রত মুখে।

দাদা এবারও যদি গতবারের মতো তেমন বৃষ্টি হয়? মাছ ধরবি?

গত বছর টানা তিন দিন প্রায় না থেমে বৃষ্টি হয়েছিল। চারদিকের রাস্তায় কোথাও কোথাও জল বয়স্কদের কোমরেরও উপর উঠে যায়। কাছেই একটা গোরস্থান, তার মধ্যে ছোটো ছোটো ছেলেরা গামছা আর একটু বোরা মশারি দিয়ে মাছ ধরতে শুরু করে। দুপুরে দেবু আর মিঠু বারান্দা থেকে তাই দেখছিল। অবশেষে এই দুর্লভ মজা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টায় আর নিযুক্ত না থেকে, দুজনে বাথরুমে কাচার জন্য রেখে দেওয়া মায়ের হাউসকোটটা হাতে নিয়ে চুপি চুপি নীচে নেমে আসে।

একটি মাছও তারা ধরতে পারেনি। তবে কিছু আদুড় গায়ে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ হইচই করে তারা বুঝতে পেরেছিল বাড়ির বাইরে আলাদা ধরনের একটা জগৎ অপেক্ষা করছে, বেশ কঠিন আর মজাদার। দেবুর হাত থেকে হাউসকোটটা ছিনিয়ে নিয়ে দুটি ছেলে মাছ ধরতে শুরু করে। খুদে খুদে পাঁচ-ছটা ট্যাংরা আর বেলে পেয়েছিল। একটা টিনের মধ্যে সেগুলো রেখে তারা হাউসকোটটা ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, যা ভাগ এবার, আর এগোলে ডুবে যাবি।

যেমনভাবে গেছল, তেমনি চুপি চুপি ওরা বাড়ি ফিরে আসে। মিঠু ভিজে হাউসকোটটা মুখের কাছে ধরে বলেছিল, দাদা এঁকে দ্যাখ, মাছের গন্ধ! দেবু নাকে চেপে ধরে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বলেছিল, মনে হচ্ছে।

দুজনে অবাক চোখে মেঝেয় পড়ে থাকা বস্ত্রটির দিকে তাকিয়ে থাকে আর লিজা তখন দরজার বাইরে থেকে দেখছিল ওদের মুখ। লিজাটা ভাগ্যিস মানুষ না। তাহলে মাকে বলে দিত। মিঠু বলেছিল।

এবার মাছ ধরব না।

কেন রে?

এমনিই।

মাছধরা খুব শক্ত। মিঠু তার সিদ্ধান্ত জানায়।

জগদীশবাবু চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন, সামার ভেকেশন কবে শেষ হবে?

ছাব্বিশে জুন, দেবু জবাব দিয়েই মিঠুকে বলল, বাবা আসছে।

দুজনে বারান্দার গ্রিল থেকে যতটা সম্ভব ঝুঁকে দেখল, বিমান এবং সঙ্গে আর একজন ব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামল।

লিজার এবার কটা বাচ্চা হবে বল তো দাদা?

আটটা।

এমনি, আন্দাজে, আগের বারও আটটা হয়েছিল না?

সব বিক্রি করে দিল। এবার বাবাকে বলবি একটা বাচ্চা রেখে দিতে?

তুই বলিস বাবাকে।

না।

দেবু বোনের মুখের ভাব লক্ষ করে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, এক-একটা বাচ্চার দাম কত জানিস? দেড় হাজার, দু-হাজার টাকা। লিজার পেডিগ্রি আছে-না?

পেডিগ্রি কী রে দাদা?

ফাঁপরে পড়ে যাওয়াটা লুকোবার জন্য দেবু বলল, এসব কথা একদম বলাবলি করবি না। সেদিন বটুকদাকে বাবা বলল-না, তোমাদের এই উঁচুজাত, বড়ো বংশ, বড়ো ঘরের, গল্পোগুলো এবার বন্ধ করো। বড়োলোকি কথাবার্তা বাবা খুব অপছন্দ করে।

লিজা খুব বড়োলোক?

জানি না, আমি তো আর জার্মানিতে গিয়ে লিজার বাড়ি দেখে আসিনি।

আচ্ছা, জার্মানি থেকে প্লেনে এল কী করে বল তো, যদি কাউকে কামড়ে দিত?

কত বার তো শুনেছিস একটা ফাইবার গ্লাসের বাক্সের মধ্যে করে মদনকাকু এনেছিল। অ্যাই, এক বার সিঁড়িতে গিয়ে দেখে আসবি?

বাচ্চা হল কি না?

হ্যাঁ।

মিঠুর সঙ্গে দেবুও সিঁড়ি পর্যন্ত গেল। পা টিপে টিপে মিঠু সিঁড়ি দিয়ে নেমে ল্যাণ্ডিংটা ঘুরেছে আর সঙ্গে সঙ্গে দাঁতচাপা গর্জন উঠল।

বলেছি না একদম নামবে না। যাও, যাও। সুকুমার, দুটোকে ঘরে বন্ধ করে দিয়ে আয় তো।

মিঠু চার লাফে দোতলায় ফিরে এসেছে। দেবুর দিকে অনুযোগের দৃষ্টি রেখে বলল, তোর জন্যই তো।

সুকুমার দোতলায় এসে ঘরের মধ্যে দুজনকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, খুব খারাপ ব্যাপার। লিজার এখন যমে-মানুষে টানাটানি। এখুনি অপারেশন করতে হবে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার টাইম নেই। ডাইনিং টেবিলের ওপর অপারেশন হবে। একদম নীচে যাবে না। দাদা–বউদির এখন মাথার ঠিক নেই, বুঝেছ? একদম শব্দটব্দ করবে না। করলে ডাক্তারবাবুর হাত নড়ে যাবে আর…

লিজা তাহলে মরে যাবে সুকুমারদা?

মিঠু ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে। দেবু ঢোঁক গিলল।

সুকুমার মাঝবয়সি, বারো বছর এ বাড়িতে কাজ করছে। দেবুর জন্ম হয় কাজ নেবার দু মাস পর। তার কোলেপিঠেই এরা বড়ো হয়েছে। দুজনের অবস্থা দেখে সুকুমার কষ্টবোধ করল।

মরবে কেন। খুব মন দিয়ে ভগবানকে ডাকো, দেখবে লিজা ভালো হয়ে যাবে। গরম জল বসিয়ে এসেছি। তোমাদের পরে খেতে দোব। দরজাটা ভেজানো থাক, বেরিয়ে না কিন্তু।

দরজা বন্ধ হওয়ামাত্র মিঠুর চোখ জলে ভরে এল। বিছানায় আছড়ে পড়ে সে বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

দেবু উদভ্রান্তের মতো বলল, কাঁদছিস কেন? সুকুমারদা বলে গেল-না ভগবানকে ডাকতে?

মিঠুর কান্না আরও বেড়ে গেল। দেবু খাটে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইল পা ঝুলিয়ে। কিছুক্ষণ পর সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে উৎকর্ণ হল। কোনোরকম শব্দ, এমনকী কথা বলার ফিসফাসও শুনতে পেল না। ছমছম করল তার বুকের মধ্যে। ধীরে ধীরে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

রাধাচূড়া গাছটার ফাঁক দিয়ে সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। দু-দিক থেকে দুটো ট্রাম এসে চলে গেল। গাছের ডালে বুলবুলি ফুড়ুৎ ফুড়ৎ উড়ছে। শালিক আর কাকও সে লক্ষ করল কিন্তু কোনো কিছুই তার মনের উপর বসছে না।

প্রচন্ড গরম আর রোদের ঝাঁঝের জন্য দেবু বেশিক্ষণ দূরের দিকে তাকাতে পারছে না। বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও দরদরে ঘাম তার কনুই আর ঘাড় বেয়ে নামছে। বারান্দায় এখনও রোদ পড়েনি। ঘামে সপসপে গেঞ্জিটা খুলে দেবু পা ছড়িয়ে বসল।

লিজার অপারেশন হচ্ছে। ব্যাপারটা কতটা গুরুতর সে-সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তবে অপারেশন শব্দটা অনেক বারই শুনেছে। ক্লাসের পুণ্যব্রত আগে বলেছিল তার মায়ের পেটে পাথর হয়েছিল, অপারেশন করে বার করে নেওয়া হয়। ছোটোপিসিমার পা ভেঙেছিল গাড়ির ধাক্কায়, হাড় সেট করতে অপারেশন করতে হয়েছিল। এখন দিব্যি চলাফেরা করে। সুকুমারদার বাবার চোখে কী হয়েছে, তার গ্রামের ডাক্তার বলেছে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে অপারেশন করালে সেরে যাবে। অনেক টাকার ধাক্কা।

দুই হাউজিং-এর সীমানা-পাঁচিলের বাইরে জমে থাকা ভাঙা ইট সিমেন্ট আর জঞ্জালের স্কুপের উপর কিলবিল করে উঠল কয়েকটা প্রাণী। দেবু গলা লম্বা করে সিধে হয়ে বসল। আরে, ওগুলো তো কুকুরছানা!

এরা কোথা থেকে এল। দেবু বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গুনতে শুরু করল, এক দুই, তিন…চার, পাঁচ…ছয়!

রংগুলো সাদার ওপর ব্রাউন আর কালো। হয়তো ডাকছে কিন্তু এতদূর থেকে দেবু শুনতে পাচ্ছে না। ব্যস্ত চঞ্চল হয়ে ওরা চেষ্টা করছে জঞ্জাল থেকে নামতে। মনে হচ্ছে ভালো করে চোখ ফোটেনি, নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। একটা তো গড়িয়ে পড়েই গেল। ওঠার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু পায়ে জোর নেই। এমনকী চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টলছে।

আশ্চর্য তো। এগুলো এল কোথা থেকে? কালকেও তো সে বারান্দা থেকে এদিকে তাকিয়েছে, চোখে তো পড়েনি। কার ছানা? এদের মা কে? দেবু সব কিছু ভুলে, কুকুরছানাগুলোর প্রতি তার মন নিবদ্ধ করল।

কান লেজ আর পিঠের কিছু অংশ কালো, এমন একটা সাদা কুকুর ধীরে ধীরে ছানাগুলোর দিকে এগিয়ে এল। পেটটা ঝুলে রয়েছে। দেবু স্তনের বোঁটাগুলো দেখতে পাচ্ছে। কুকুরটাকে সে স্কুলে যাবার সময় রোজ দেখেছে। জুয়েল কেটারিং-এর দোকান থেকে চিত্তরঞ্জন সুইটস পর্যন্ত পাঁচ ছ-টা বাড়ির সামনের রাস্তায় যে তিন-চারটে কুকুর বসে থাকে, ঘুমোয় আর অন্য কুকুরদের সঙ্গে মারামারি করে, তাদের মধ্যে দেবু একেও দেখেছে। একে সে চেনে।

একদিন লিজার ভিটামিন ট্যাবলেট ফুরিয়ে যাওয়ায় সুকুমার কিনতে যাচ্ছিল। দোকানে ওষুধ ছাড়াও অনেকরকম জিনিস বিক্রি হয়। একধারে আছে সিন্দুকের মতো একটা ডিপ ফ্রিজের বাক্স। সফট ড্রিঙ্কসের বোতল আর আইসক্রিম তাতে রাখা আছে। মা-র কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেবু আর মিঠু সুকুমারের সঙ্গে যায়।

ওরা কাঠের চামচ দিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিল। পাশে পাশে হাঁটছিল একটা কুকুর। মজা করার জন্য মিঠু একটু আইসক্রিম চামচ থেকে উঁচু করে ফেলল। কুকুরটা তৈরি ছিল না, তাই রাস্তায় পড়ল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চেটে নিল। এরপর আরও পাবার আশায় চলতে চলতে মুখ তুলে বার বার সে মিঠুর দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু মিঠু আর ওকে খাওয়াতে রাজি নয়।

দে-না ওকে। দেবু বলেছিল।

আহাহা, তুমি দাও-না। এইটুকু তো কৌটো। একটা খেয়ে কি কিছু হয়?

ঠিক এই সময়ই দেবু হোঁচট খেল একটা ইটে আর পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেও আইসক্রিমের প্লাস্টিকের কৌটোটা হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ল। সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। কুকুরটাও। কিন্তু তাড়াতাড়ি চেটে খেয়ে নেবার বদলে সে দেবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেই সময় দেবু কুকুরটার চোখে কেমন একটা দুঃখ পাওয়ার মতো ভাব যেন দেখতে পায়। তখন ছুটে এসে আর একটা কুকুর জিভ দিয়ে আইসক্রিমটা চেটে নিতে নিতেই গোঁ গোঁ শব্দ করে ভয় দেখাল। কেউ যেন, এমনকী অন্য কুকুরটাও যেন তার খাবারে ভাগ না বসায়।

সুকুমারের কাছে টাকা ছিল, সে দোকানে ফিরে গিয়ে আর এক কৌটো আইসক্রিম কিনে এনে দেবুর হাতে দেয়। মিঠু তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেছিল, দাদা তো কৌটোটা শেষ করেই ফেলেছিল, তাহলে আবার একটা নতুন কেনার কী দরকার।

মোটেই শেষ করে ফেলিনি। আদ্দেকেরও কম খেয়েছি। আচ্ছা তুই একটু নে।

মিঠু আপত্তি করেনি। দেবু লক্ষ করল তখনও কুকুরটা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। মিঠু বলল, এবার তুই ওকে দে।

দোবই তো।

ঝুঁকে নীচু হয়ে দেবু কৌটোটাই ওর মুখের কাছে ধরল। মুখ সরিয়ে নিল কুকুরটা, অপ্রতিভ যতটা নয় তার থেকেও বেশি অবিশ্বাসভরে।

খা খা, খেয়ে নে।

কেমন একটা লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে সে প্রথম জিভ দিয়ে একটু চাটল, তারপর কৌটোয় জিভ ঢুকিয়ে কয়েক সেকেণ্ডেই সাফ করে দিল।

এরপরও সে ওদের পিছন পিছন চলছিল। দেবু ধমক দেয়, আর নয়, এবার এখানে থাম। কুকুরটা আর এগোয়নি।

বোধ হয় জীবনে এই প্রথম আইসক্রিম খেল। মিঠু বলে।

স্বভাবটা ভালো।

খুব লক্ষ্মী। লিজার মতোই।

না, তা কী করে হবে, দুজনের কখনো তুলনা হয়? দেবু মৃদু ভৎসনা করেছিল বোনকে।

দাদা, সুকুমারদা কী বলছে।

দেবু চমকে উঠে আবর্জনা স্তুপের থেকে মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দরজার দিকে তাকাল। মিঠু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তার পিছনে সুকুমার। মুখ বসে গেছে। চোখের কোণে জল।

তোমাদের খাবার দিয়ে যাচ্ছি। ওপরে বসেই খেয়ে নাও। লিজাকে আর বাঁচানো গেল না। দাদা বলে দিলেন ওকে দেখলে মনে আঘাত পাবে, তাই একদম নীচে নামবে না।

ভাইবোন কিছুক্ষণ পরস্পরের চোখের দিকে অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে জীবনের প্রথম শোকসংবাদটা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখল। তারপর মিঠু নীচু গলায় বলল, লিজার পেটের বাচ্চারাও মরে গেছে?

ডাক্তারবাবু পেট কেটে বার করে নিয়েছেন। ছ-টার মধ্যে দুটো মরে গেছে। খুব ফুটফুটে হয়েছে।

সুকুমার সুসংবাদ দেবার মতো উত্তেজনার আমেজ আর উৎফুল্লতা মিশিয়ে ফুটফুটে শব্দটি মুখ থেকে ছড়িয়ে দিল। ভাইবোনের চোখ ঝকমক করে উঠল।

লিজার মতো দেখতে হয়েছে? দেবু জানতে চাইল।

বড়ো হলে নিশ্চয় হবে।

আর রং? মিঠু তার উচ্ছাস ধরে রাখতে পারল না।

একেবারে মায়ের মতো…পরে দেখো, এখন আমি নীচে যাচ্ছি।

সুকুমার নীচে নেমে যাবার পরই ওরা প্রায় ছুটেই সিঁড়ির কাছে এল। চার-পাঁচ ধাপ নেমে মাথা কাত করে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল এবং দুজনের মুখ থেকে বিহ্বল বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে সরে গেল।

আমি শুনতে পেয়েছি।

আমিও। গিয়ে দেখে এলে বাবা কি বকবে?

বকবেই তো। আমরা মনে আঘাত পাই, বাবা কি সেটা চান?

সুকুমার দই-চিঁড়ে-আম দিয়ে তৈরি ফলার বাটিতে করে দিয়ে গেল। দেবুর খাবার ইচ্ছে নেই, মিঠুরও।

না খেলে মা বকবে। খালিপেটে থাকলে অসুখ করে।

ছাই করে, খেতে হয় তুই খা।

বাটি নিয়ে দেবু বারান্দায় এল, জগদীশবাবুর বাড়ির বারান্দা বা জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না দেখল। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে বাটির ফলার বাগানে ছুড়ে ফেলল, একটা গোলাপ গাছের পাতার উপর ছিটিয়ে রইল চিড়ে-দই। দুটো কাক ঝাঁপিয়ে নামল ছাদের পাঁচিল থেকে।

দাদা আমারটাও ফেলে দোব?

আমি কী জানি। ইচ্ছে হয় খাবি নইলে খাবি না। লিজার জন্য তোর দুঃখু হচ্ছে না?

হচ্ছে।

মিঠুও ছুড়ে দিল তার বাটির ফলার। বাথরুমের কলে বাটিটা ধোবার সময় বারান্দা থেকে দেবু তাকে ডাকল।

দেখে যা মিঠু। ওই যে মাঠে, পাঁচিলের ধারে ওই যে নোংরাটোংরা উঁচু হয়ে আছে…।

দেবুর আঙুল লক্ষ করে মিঠু তাকাল।

দাদা কুকুরছানা রে।

মা-টাকে দেখছিস?

কাত হয়ে শুয়ে আছে কুকুরটা আর ছটা বাচ্চা স্তন্যপান করার জন্য নিজেদের মধ্যে হামলাহামলি করে যাচ্ছে। মায়ের পিঠের উপর দিয়ে, মাথার উপর দিয়ে, পিছনের দুই পায়ের মধ্য দিয়ে ওরা স্তন খুঁজে চলেছে আর মুখে পাওয়ামাত্র শান্ত হয়ে পা ছড়িয়ে চুষতে শুরু করছে। লাইন দিয়ে উপুড় হয়ে ছটা ছানা। কুকুরটা মাঝে মাঝে ঘাড় তুলে যে ছানাটিকে কাছে পাচ্ছে তারই গা-মাথা চেটে দিচ্ছে। আবার জঞ্জালে মাথা পেতে শুয়ে পড়ছে।

সেইটে না রে, আমাদের সঙ্গে আসছিল আইসক্রিম খাওয়ার জন্য?

দেবু মাথা নাড়ল।

কী নাম রে ওর?

রাস্তার কুকুরের আবার নাম থাকে না কি।

কবে বাচ্চা হল?

জানি না। কাল-পরশু হবে হয়তো।

দুধ খাবার পর ওরা কী করবে?

ঘুমোবে। তুইও তাই করতিস।

মা আমাকে ওইভাবে দুধ খাওয়াত? তুইও খেয়েছিস?

হ্যাঁ। সবাই খায়। বাবা খেয়েছে, মা খেয়েছে। বুকের দুধ না খেলে বাচ্চারা আর খাবে। কী? দাঁত তো নেই যে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। মা দুধ না খাওয়ালে বাচ্চারা মরে যায়।

লিজার বাচ্চাদের কী হবে?

কথাটা দেবু হৃদয়ঙ্গম করতে মিনিট খানেক সময় নিল। তারপরই সে সচকিত হল।

ওরা মরে যাবে? মিঠু তার ভয়টা প্রকাশ করে ফেলল।

বাবা কিছু-একটা নিশ্চয় করবেই। দেবু জোর দিয়ে কথাটা বলল বটে, কিন্তু তার মুখে ফুটে উঠল অনিশ্চয়তা।

সন্ধ্যার মধ্যেই লিজার মৃতদেহ নিয়ে গেল। সুকুমার দুজন লোক নিয়ে আসে। তারা এই কাজই করে। চট দিয়ে মুড়ে ধরাধরি করে লোহার চাকা-লাগানো ঠেলাগাড়িতে তুলে যখন লিজাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন দোতলার ঘরে দরজা বন্ধ অবস্থায় ছিল দেবু আর মিঠু।

একসময় দীপালি দরজা খুলে দুজনকে নীচে নামিয়ে আনল। সিঁড়ির পাশের অন্ধকার ঘর থেকে কুঁই কুঁই আওয়াজ আসছে। দুজনে ছুটে গেল। দীপালি ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।

মা ওরা খাবে কী?

ঘরের এককোণে সতরঞ্চির উপর কালো বলের মতো চারটি ছানা। থরথর করে কাঁপছে। চোখে দৃষ্টি নেই। ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে আর ডেকে যাচ্ছে। চলার চেষ্টা করলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবু হিঁচড়ে হিঁচড়ে এগিয়ে একটা ছানা দেয়ালে বাধা পেয়ে সেখানেই বসে পড়ল।

মা ধরব? দেবু বলল।

একদম না। অত বাচ্চার গায়ে এখন হাত দিতে নেই। দেখা তো হয়েছে, এবার বাইরে এসো। আলো ওদের চোখে সহ্য হয় না, কষ্ট পায়।

মা ওরা খাবে কী? মিঠু দ্বিতীয় বার জানতে চাইল।

ড্রপারে করে মুখের মধ্যে দুধ ঢেলে দেওয়া হবে। সুকুমার ডুপার কিনতে গেছে।

বিমান বসার ঘরে সোফায় আনমনা মেঝের দিকে তাকিয়ে। ছেলে-মেয়েকে দেখে শুকনো হাসল।

কষ্ট হচ্ছে?

দেবু আর মিঠু মাথা নাড়ল শুধু। দুজনকে কাছে টেনে নিয়ে সে পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, মন খারাপ করার কী আছে। এবার দুটো বাচ্চা রেখে দেব। লিজারই তো বাচ্চা। একটার বদলে দুটো লিজা আমাদের হবে।

মা নেই বলে বাচ্চাদের কষ্ট হবে না? মিঠু করুণচোখে বাবার দিকে তাকাল।

এখন অত কিছু বোঝার মতো মন ওদের হয়নি। এখন শুধু পেটভরে দুধ খেতে পেলেই ওরা খুশি থাকবে।

যখন বড়ো হবে?

যখন হবে তখন দেখা যাবে। বড়ো হলে কি কেউ বাবা-মাকে আর চায় নাকি। তোমরাও আর আমাকে বা মাকে চাও কি?

বিমান দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটমিটে হাসি ছড়িয়ে দিল। মিঠু তার মুখ বাবার কোলে গুঁজে দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে চলল, চাই চাই চাই। দেবু অপ্রতিভ, লাজুক চোখে শুধু অনুযোগ জানাল এইভাবে তাদের বিব্রত করার জন্য।

ছেলের আর মেয়ের কাছ থেকে বিমান তো এটাই চায়। তার জীবনে এটাই এখন শ্রেষ্ঠ সম্পদ—ওদের হৃদয়, এখনও যা দূষিত হয়নি, এখনও যাতে অবিশ্বাস অবহেলা অশ্রদ্ধার থাবা আঁচড় টানেনি। সে তৃপ্ত মনটিকে তারিয়ে উপভোগ করল।

ডাইনিং-কে অপারেশন থিয়েটার বানিয়ে, ক্লোরোফর্ম করে এত বড়ো ব্যাপার কি সাকসেসফুল হয়! বিমান অসহায়ের মতো কৈফিয়ত দিল কারুর দিকে না তাকিয়ে।

দীপালি বলল, দু-দিন ধরে ব্যথা উঠেছে, আমারই বোঝা উচিত ছিল কমপ্লিকেশন দেখা দেবে। হাসপাতালে আগেই পাঠানো উচিত ছিল।

ড্রপার কিনে এনেছে সুকুমার। কিন্তু তাই দিয়ে ছানাদের দুধ-খাওয়ানো যাচ্ছে না। কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ওগরানো দুধ। কিছুটা পেটে যাচ্ছে বটে কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। দীপালি ছেঁড়া কাপড়ে পলতে বানিয়ে সেটা দুধে ভিজিয়ে ওদের মুখে ধরল। তাতেও কাজ হল না। এভাবে ওরা খেতে চাইছে না। বিমানও চেষ্টা করল এবং হতাশ হয়ে অবশেষে বলল, ব্রেস্ট ফিডিং ছাড়া উপায় নেই। বেশি জোরজবরদস্তি করলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে।

নিরুপায় চোখে দীপালি তাকিয়ে। বিমান অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সুকুমার রান্নাঘরে ফিরে গেল। দেবু এবং মিঠু অস্থির হয়ে উঠছে।

মা, না খেলে তো ওরা মরে যাবে।

মিঠু, এসব কথা এখন বলে না। যাও, এখন ঘরের বাইরে যাও। বিমান মানসিক স্থৈর্য আর রাখতে পারছে না। মেয়েটা বিশ্রী রকমের এমন একটা সত্যিকথা বলেছে, সেটা নিয়ে কিছুই করা যাচ্ছে না। এমন একটা সমস্যায় যে পড়তে হবে কে জানত।

কী করা যায় বলো তো? বিমান বিশেষ কাউকে উদ্দেশ না করেই বলল। কেউ উত্তর দিল না। কারুর তা জানাও নেই।

দাদা একটা কথা বলব।

সবাই ফিরে তাকাল সুকুমারের দিকে।

আমার ছোটোমাসির যখন ছেলে হয় তখন ওর ননদেরও ছেলে হয়। কিন্তু ননদটা বাঁচেনি। বাচ্চাটাকে ওরা ছোটোমাসির কাছে দিয়ে যায় বুকের দুধ খাওয়াবার জন্য। চার মাস ছিল।

তা আমি এখন এগুলোর জন্য ছোটোমাসি কোথায় পাব।

সদ্য বিইয়েছে এমন কুকুর একটা খুঁজে বার করতে পারলে হত।

কোথায় এখন খুঁজবি? আর খুঁজে পেলেও এই চারটেকে নিয়ে যাওয়াও এখন সম্ভব নয়।

এই সময় মিঠু কানে কানে দেবুকে জিজ্ঞাসা করল, দাদা বিইয়েছে মানে কী রে?

মানে হয় না। চুপ কর।

সুকুমারদা, তুমি যে বললে খুঁজে বার করলে হত, কী কুকুর সেটা?

সদ্য বাচ্চা হয়েছে এমন কুকুর।

আমাদের পিছন দিকের মাঠে একটা কুকুরের…জান সুকুমারদা, সেই সেইটে গো, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিম খাবার জন্যে আসছিল, মনে আছে তোমার?…তার ছটা বাচ্চা হয়েছে। দাদা গুনেছে!

দু-মিনিটের মধ্যে বাড়ি চঞ্চল হয়ে উঠল। দেবুও জানিয়েছে সে নিজের চোখে দেখেছে, পিছনের মাঠে বাচ্চাদের সমেত মা-কে শুয়ে থাকতে।

কিন্তু ওকে তো আনতে হবে আর কীভাবে তা সম্ভব? মানুষ তো নয় যে বললাম আর চলে এল। বিমান এতক্ষণে আশার ক্ষীণ একটা আলো দেখতে পেয়েছে। কিন্তু সেটাকে উজ্জ্বল করে তুলতে হলে ফন্দি এঁটে এগোতে হবে। বুদ্ধির প্রয়োগ দরকার। বুদ্ধির চর্চার এই সুযোগটা তাকে উত্তেজিত করে তুলল।

কাছে গিয়ে চট করে দড়ির ফাঁস ছুড়ে গলায় যদি… বিমান থেমে গেল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এভাবে টেনে আনলে খেপে যাবে, বাচ্চাগুলোকে হয়তো কামড়ে মেরে ফেলে দেবে।

রাস্তার কুকুর তো, দীপালি নিশ্চিত স্বরে বলল, কিছু খাবারটাবারের লোভ দেখাও, দেখবে সুড়সুড় করে চলে আসবে।

আসবে। দেবু টগবগিয়ে উঠে দু-হাত ঝাঁকাল। আইসক্রিম খেতে ভালোবাসে।

কিন্তু এই অন্ধকারে ধরে আনা, মানে এভাবে লোভ দেখিয়ে আনা কি সম্ভব হবে? তা ছাড়া ওটাকে এখন পাবেই-বা কোথায়?

ওষুদের দোকানের কাছে বসে থাকে। যাব বাবা, আমি আর সুকুমারদা?

অবশেষে দেবু আর সুকুমার গেল। অনুমানটা সঠিকই হয়েছে, কুকুরটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। একটি মেয়ে দই কিনে হাঁটা শুরু করতেই সে লেজ নাড়ল।

তিন কৌটো আইসক্রিম তারা কিনেছিল। দুটো যখন শেষ হল তখন বাড়ির দরজায় কুকুরটা পৌঁছে গেছে। বসার ঘরের জানলার আড়ালে রুদ্ধশ্বাসে বিমান, দীপালি আর মিঠু দেখছে।

দেবু ভিতরে ঢুকে তৃতীয় কৌটোটা নীচু করে ধরে, আয় আয় চু চু…আয়, বলে ডাকল। কুকুরটা ইতস্তত করছে। লেজ নেড়ে, কান দুটো ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে সে দেবুকে তার সুখের খবর দেওয়া ছাড়া ভিতরে জন্য এগোল না। সুকুমার উৎকণ্ঠাভরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে।

তখন মিঠু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেবুর হাত থেকে আইসক্রিমের কৌটোটা নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে হুবহু দীপালির মতো গলা করে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে, কিছু ভয় নেই; এসো, ভেতরে এসো…এসো তো মা।

কুকুরটা জোরে লেজ নাড়তে নাড়তে মিঠুর কাছে এল। মিঠু ওর মাথায় সতর্কভাবে ডান হাত রেখে, বাঁ-হাতে কৌটোটা মুখের কাছে ধরল। জিভ দিয়ে খানিকটা চেটে তুলে নিল।

মিঠু পিছিয়ে গেল, কুকুরটাও দরজা পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। সুকুমার প্রায় ছুটে গিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল, শব্দ না করে।

মিঠু গায়ে হাত দিয়ো না; কামড়ে দিতে পারে। ঘর থেকে উদবিগ্ন কন্ঠে দীপালি বলল।

ওকে ওই ঘরে নিয়ে যা মিঠু। দেবু নির্দেশ দিল।

মিঠুর সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা এগোল। ভেজানো দরজা ঠেলে মিঠু ঘরে ঢুকল, আলো জ্বালল। বাচ্চাগুলোর চোখে আলো লাগামাত্ৰ কুঁই কুঁই করে ডাকতে শুরু করল। কুকুরটা দরজার কাছ থেকে সচকিত হয়ে তাকাল।

এসো লক্ষ্মীমেয়ে…ওদের মা মরে গেছে কিনা তাই কাঁদছে, সারাদিন ওদের খাওয়া হয়নি, খিদে পেয়েছে…তুমি ওদের দুধ খাওয়াবে…খাওয়াবে না?

বাচ্চাদের মতো স্বরে, চোখে-মুখে গভীর দরদ নিয়ে মিঠু কথা বলছে। কুকুরটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে। মিঠু কৌটোটা মেঝেয় রাখল। ও এগিয়ে এসে খেতে শুরু করল। ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল কেউ। টলতে টলতে বাচ্চাগুলো চেষ্টা করছে কাছে আসার। কী ভাবে যেন ওরা টের পেয়েছে, জীবনদায়ী একটা আশ্বাস তাদের কাছাকাছি এসেছে। কুকুরটা কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে। ওরা যে ভাষায় কুঁই কুঁই করছে তার অর্থ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।

মিঠু তখন সাহসভরে একটা বাচ্চাকে দু-হাতে তুলে ওর মুখের কাছে ধরল। মুখটা সরিয়ে নিল। মিঠু আবার ধরল। আবার সরিয়ে নিয়ে তারছা চোখে সে মিঠুর মুখের দিকে তাকাল। বাচ্চাটাকে সে মেঝেয় নামিয়ে রাখল।

ঘরের জানলায় বিমান, দীপালি, দরজা ফাঁক করে দেবু আর সুকুমারের মুখ উঁকি দিচ্ছে।

এই মিঠু, বল আর আইসক্রিম দোব। ভাত ও মাংস দুধ বিস্কুট পাঁউরুটি সব দোব।

কিন্তু মিতু কিছু বলার আগেই কুকুরটা চেটে দিল বাচ্চার মাথা। তারপর আলতোভাবে ঝোলা পেটটা মেঝেয় ছড়িয়ে কাত হয়ে বসল। স্তনের টসটসে কালো বোঁটাগুলো সাদা কোটের বোতামের মতো দেখাচ্ছে।

কী ভালো গো, তাই না মা? মিঠু জানলার দিকে তাকিয়ে বলল।

বাচ্চাটা নিজে থেকেই তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে গেল। মিঠু বাকি তিনটিকেও তুলে এনে বসিয়ে দিল পেটের কাছে।

নিস্তব্ধ হয়ে আছে সারা বাড়ি। জোড়া জোড়া চোখ নিবদ্ধ সারি দিয়ে উপুড় হওয়া চারটি বাচ্চার দিকে। সকালের শোক ঢেকে দিয়ে গাঢ় প্রশান্তি বিরাজ করছে। বিমানের চোখ ছলছল করে উঠল। দীপালি চোখ মুছে বলল, সত্যনারায়ণ দোব।

মাথার কাছে বাবু হয়ে দুজনে বসে। মাঝে মাঝে মিঠু মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কুকুরটা চোখ বুজে উপভোগ করছে আদর।

দাদা, এর নাম কী রে?

নাম নেই।

একটা নাম দে তাহলে।

দেবু নাম খুঁজতে ব্যস্ত হল। একটার পর একটা নাম বলে যায় আর মিঠু সেগুলো বাতিল করে দেয়। অবশেষে দেবু বলে, লিজার মতো অত ভালো নাম কি চট করে পাওয়া যায়। কাল বলব।

কেন, ওকে লিজা বলে ডাকলেই তো হয়।

পাগল, তাই কখনো হয়? রাস্তার কুকুরের নাম লিজা রাখলে লোকে হাসবে।

তাহলে লিজা উলটে জালি নাম রাখা।

লিজা, নিজালি… জালি জালি, জালিকা…ঠিক আছে, জালিই থাক। বসার ঘরে বিমান চিন্তিত, দীপালিও।

ছেড়ে দিলে আবার যে ফিরে আসবে তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি? বিমান অনিশ্চিত, অথচ সমাধান একটা চাই-ই, এমন অবস্থায় পড়ে গেছে।

সারা দিন সারা রাত কি এভাবে থাকতে চাইবে? পোষা কুকুর তো নয় দীপালিও সমাধান চায় কিন্তু বাধাগুলো সে জানে।

না চাইলেও রাখতে হবে। অন্তত দিন সাতেক তো বটেই। একটু নিষ্ঠুরতা হয়তো…কিন্তু লিজার বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে হবে তো। সেটাও ভাবো? বিমান ব্যাপারটাকে এমন জায়গায় নিয়ে এল যেখানে কুকুরছানাগুলো মানুষের গলায় কথা বলতে পারে।

কিন্তু ওর নিজেরও বাচ্চা আছে, ছ-টা।

তাহলে কি ওকে ছেড়ে দেব? আমাদের বাচ্চাগুলোকে মরার পথে ঠেলে দেব?

মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ সে ভাবল। দীপালি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। বিমান ধীরে মাথা তুলে সন্তর্পণে বলল, এরকম ব্যাপার যদি দেবু বা মিঠুর ভাগ্যে ঘটত?

খাবার টেবিলে মিঠু বলল, জালির খুব খিদে পেয়েছিল, অত ভাত মাংস কত তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল।

জালি কে?

দেবু বাবার মুখভাব দেখে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল, লিজা উলটালে জালি হয়, তাই মিঠু ওই নাম দিয়েছে। ও লিজা রাখতে চেয়েছিল, আমি আপত্তি করি।

মন্দ নয়, ভালোই তো নামটা। বিমান স্ত্রীর দিকে তাকাল অনুমোদনের জন্য। দীপালি হাসল শুধু। জালিকে ছেড়ে দেওয়া হবে কি হবে না, সে-সম্পর্কে সুকুমারের মতামত চাওয়া হল।

না দাদা, ছাড়বেন না। ওকে হয়তো আবার ধরে আনা যাবে কিন্তু বুকে দুধ আর তখন অবশিষ্ট থাকবে না, ছ-টা বাচ্চা চুষে শেষ করে রাখবে।

মাই গড, এটা তো ভাবিনি! বিমান কৃতজ্ঞ রইল সুকুমারের কাছে। মানসিক যন্ত্রণার গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার পথটা সুকুমার পাইয়ে দিয়েছে।

রাতে ফিসফিস করে মিঠু পাশের খাটে দেবুর কাছে জানতে চাইল, জালির বাচ্চারা তাহলে কী খেয়ে থাকবে?

জানি না।

ওদের খেতে দেবার তো কেউ নেই।

দেবু উত্তর দিল না।

ওরা খেতে না পেয়ে মরে যাবে দাদা?

যাবে। কিছুক্ষণ পর। তুই-ই তো প্রথম খবরটা দিলি, জানো সুকুমারদা, সেই সেইটে গো, ছ-টা বাচ্চা হয়েছে, কেন বলতে গেলি?

দেবু উঠে বসে বিছানায় ঘুসি বসাল। আমি কি তখন জানতুম যে.. মিঠু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।–লিজার বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে না বুঝি।

আরও পরে মিঠু বিছানায় উঠে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আবার শুয়ে পড়ল।

ভোর হতেই দেবু বারান্দায় এসে মাঠের আবর্জনার দিকে তাকিয়ে স্বস্তি বোধ করল। বাচ্চাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ বসে, কেউ হাঁটার চেষ্টা করছে। তার মনে হল, ওরা ডাকছে, বোধ হয় একা থাকতে ভয় পেয়ে।

নীচে এসে মিঠুর কানে কানে সে বলল, সব কটা বেঁচে আছে, আমি গুনলুম।

খাওয়ার টেবিল থেকে বিমান বলল, আজ অফিসে গল্প করতে হবে। লিজা থেকে জালি, নাটক লেখা যায়।..আমি বরাবরই বলেছি আজও বলছি, মিঠুই বেশি ট্যালেন্টেড দেবুর থেকে।

ওদের সামনে এভাবে বোলো না, দুজনেই তাহলে আঘাত পাবে।

বিমান অপ্রতিভ হয়ে বলল, ওরা এখন কুকুরবাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত।

দেবু দুপুরে আর এক বার বারান্দায় গিয়ে দেখে এল। গনগনে রোদ। রাস্তায় মানুষ নেই। আবর্জনার উপর ছটা ছানাই শুয়ে। বোধহয় ঘুমোচ্ছ।

সারাদিনই ওরা ব্যস্ত রইল। লিজার কলারটা জালির গলায় বেঁধে চেইনটা তাতে লাগিয়ে মিঠু ওকে রাস্তায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল, দীপালি রাজি হল না।

যা করার ছাদে গিয়ে করে আসুক। ওকে আর রাস্তা দেখিয়ো না, তাহলে বিগড়ে যাবে।

ঠিকে ঝি হাজারি জগদীশবাবুর বাড়িতেও কাজ করে। ব্যপারটা শুনে তিনি দেখতে এলেন। জালি চার পা ছড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। তার পেটের কাছে দুটো আর মাথার দিকে দুটো ছানা, তারাও ঘুমোচ্ছে। টেবিল ফ্যানের হাওয়া বিলি কাটছে জালির লোমে।

বাহঃ দিব্যি পোষ মেনে গেছে তো। ভাগ্যিস ঠিক সময় পেয়ে গেছ, কোথায় ছিল এটা?

দীপালি প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, পোষ মানবে না কেন। পুরো নেড়ি তো নয়, মুখের গড়নটা দেখেছেন, ল্যাব্রাডরের ধাঁচ রয়েছে না? হয়তো ওর ঠাকুমা কি ঠাকুরদার জন্ম ক্রস ব্রিডিংয়ে… দেবু শুনছে দেখে দীপালি থেমে গেল।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেবু প্রথমেই বারান্দায় গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ছানাগুলোকে আর তো দেখতে পাচ্ছে না।

গ্রিলে পা দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে মাঠের অনেকটাই তার নজরে এল। দূরে রাস্তা দিয়ে একটা বড়ো কুকুর চলে যাচ্ছে দেখল কিন্তু আবর্জনায় কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ল না। তাহলে ওরা গেল কোথায়? খাবার জন্য সে নীচে নেমে গেল।

দুধ শেষ করে টেবিলেই সে অপেক্ষা করল। বাবা কাগজ নিয়ে বাথরুমে, মা রান্নাঘরে, মিঠু জালির কাছে। আর কেউ নেই যে তাকে লক্ষ করবে। সে নি :সাড়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।

এলিট হাউজিং-এর পাঁচিল ঘুরে সে মাঠের উপর দিয়ে এগোল। দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে তাদের বারান্দাটা দেখতে পাচ্ছে, গ্রিলে-গুঁজে-রাখা বারান্দা মোছার সবুজ ন্যাতাটাও চোখে পড়ল। কিন্তু ওরা?

চারটে কাক কী যেন ঠোকরাচ্ছে। ভাঙা ইট, ভাঙা বোতল, কৌটো, তুলো, ডাবের খোলার কিনারে দেবু দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ সরু করে তাকিয়ে হাত নেড়ে হুশশ হুশশ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কাকগুলো বিরক্ত হল এবং একটি মাত্র সামান্য উড়েই আবার ফিরে এসে ঠুকরে টেনে টেনে বার করে খেতে শুরু করল।

দেবু আর একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল এবং যেন কারুর ধমক খেয়ে পিছিয়ে গেল দু পা। ধীরে ধীরে তার চোখ বিস্ফারিত হল, বিন বিন ঘাম কপালে ফুটল, শ্বাস-প্রশ্বাস গভীর এবং দ্রুত হতে হতে চেতনা থেকে স্বাভাবিক বোধের সংযোগগুলো ছিঁড়ে যাওয়া মাত্র সে নীচু হয়ে বার বার ইট কুড়িয়ে ছুড়তে শুরু করল। তখন গোঙানির মতো অবোধ্য একটানা  শব্দ ওর মুখ থেকে বোররাতে থাকে।

নাহ নাহ নাহ।…খাবি না, ওদের খাবি না।…মেরে ফেলব, সবাইকে মেরে ফেলব…।

হাঁফাচ্ছে দেবু। দুটো হাত পাশে ঝুলছে। দরদর ঘাম গড়াচ্ছে মুখ-গলা-ঘাড় বেয়ে। চোখের পাতা প্রায় বন্ধ। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শনশন একটা দূর থেকে ভেসে আসা ঘূর্ণিঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে।

অ্যাই খোকা, সক্কাল বেলায় ইট ছুড়ছ? বিকেল বেলায় তাহলে কি বোমা ছুড়বে? অ্যা? কাক-চিল যদি খায় তো খাক-না। ভালোই তো, পচা গন্ধ বেরোবে না।..যাও বাড়ি যাও।

স্কাইলাইনের তিন-তলার জানালা থেকে একটা রোগা মুখ খেকিয়ে উঠল। দেবু মুখ তুলে। তাকাল। ঘোলাটে উন্মাদের মতো চাহনি। তারপর ছুটতে ছুটতে সে বাড়ি ফিরে একই গতিতে দোতলায় উঠে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বিকালেই দীপালিকে ডাক্তার ডাকতে হল। তিনি বাবার সময় আশ্বাস দিয়ে বললেন, এই প্রচন্ড গরমে এরকম হয়ই। ওষুধগুলো এখুনি আনিয়ে নিন, মনে হয় রাতের মধ্যেই টেম্পারেচারটা নেমে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। কয়েক দিন রেস্টে থাকুক, ওষুধগুলো খেয়ে যাক। ঘোরাঘুরি যেন না করে।

দেবুর জ্বর একশোর নীচে নামল পাঁচ দিন পর। তারপরও কয়েক দিন তাকে বিছানায়ই থাকতে হল। বাড়ির সকলে তার কাছে এসে গল্প করেছে। মিষ্টি গলায় কথা বলেছে। তাকে খাওয়ানো, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, গল্পের বই এনে দেওয়ার মতো কাজগুলো তারা ব্যস্ত হয়ে করেছে। দেবুও নানা বিষয়ে ছোটো ছোটো প্রশ্ন করেছে কিন্তু জালি এবং লিজার বাচ্চাদের সম্পর্কে সে একবারও কৌতূহল প্রকাশ করেনি। এ ব্যাপারে কেউ কথা তুললে সে শুধু নীরবে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে; তারপর মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে আকাশে চোখ রেখেছে।

একদিন মিঠু বলল, কোন দুটো বাচ্চা আমরা রাখব, বাবা বলল বেছে নিতে। দাদা তুই নীচে আসবি একবার?

দেবু মাথা নাড়ল।

কেন? আয়-না, এক মিনিট। জানিস দাদা, কাল প্লেটে করে দুধ দিয়েছিল মা, কেমন চুক চুক করে ওরা খেল। বাবা বলল, আর জালিকে দরকার হবে না।

কয়েক সেকেণ্ড মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দেবু বলল, জালিকে তো তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ও কোথায় যাবে?

কেন, যেখানে ছিল সেখানেই যাবে। আচ্ছা দাদা, আমরা যখন আইসক্রিম কিনতে যাব। তখন ও আমাদের চিনতে পারবে? কুকুরের তো বুদ্ধি খুব, মানুষের মতোই… বাবা-মা দুজনেই বলছিল কুকুরের মায়াদয়া মানুষের মতো, মা-মরা বাচ্চাদের দেখেই জালি কীরকম যেন হয়ে গেল, তাই না?

জালির জন্য তোর কষ্ট হচ্ছে না?

হচ্ছে না আবার! আমার থেকেও বেশি কষ্ট হবে তো বাচ্চাগুলোর।

তুই যা এখন।

দেবু পাশ ফিরে চোখ বুজল। একসময় সে সিঁড়িতে কথার শব্দ শুনতে পেল, বাবা বলছে, এমন চোব্যচোষ্য খাওয়া পেলে চলে যেতে হলে কষ্ট হবে না?

মা বলল, বাড়ি তো চিনে গেছে, নিশ্চয় আবার আসবে। সুকুমারকে বলেছি, এলে যেন কিছু খেতেটেতে দেয়।

দেবু বিছানা থেকে উঠে জানলায় দাঁড়াল। মেঘ উড়ে আসছে কিন্তু জমা হচ্ছে না। আকাশটা লিজার গায়ের রঙের মতো হয়ে রয়েছে। সে গুটিগুটি বারান্দার দিকে এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। দরজা থেকে উঁকি দিয়ে রাধাচূড়া গাছ, তাতে বসা শালিক, কাক, পাতার ফাঁক দিয়ে ধাবমান মিনিবাসের চাল দেখার পর দৃষ্টিটা আবর্জনাস্তুপের উপর পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে মুখটা টেনে নিল। সদ্য-জন্মানো কুকুরছানার মতো টলমল করতে করতে ঝাপসা চোখে সে খাটের দিকে এগোল।

গরমের ছুটিশেষে স্কুল বাসে যাবার সময় দেবু একদিন দেখল, মিষ্টির দোকানের সামনে তিনটে কুকুরের সঙ্গে জালিও মুখ তুলে বসে। একটা বাচ্চা ছেলে শিঙাড়া খাচ্ছে। জালি ল্যাজ নাড়ছে। জানলা দিয়ে মাথা বার করে দেখতে দেখতে দেবুর মুখে আলতো একটা হাসি ফুটে ওঠে।

টুপু কখন আসবে

টুপু, টুপু, ওই শোনো লুলা আবার ডাকছে। তুমি জান না, যে-রাতে তোমার ঠাকুমা মারা যায় সেদিনও অমন করে ডেকেছিল। টুপু, তোমার ভয় করছে না? পালিয়ে এসো, আমার কাছে। এসো।

দোতলার পুব দিকের গোল বারান্দায় সকালের রোদ, চৌকো নকশার রেলিঙের ফাঁক দিয়ে লাল সিমেন্টে পড়েছে। কাঠের দোলনা ঘোড়ায় দুলতে দুলতে টুপু তাকাল দাদুর দিকে। আবার তাকাল নিজের ছায়াটার দিকে। ছায়াটা দুলছে। খুশিতে আরও জোরে টুপু নিজেকে দোলায়, ঢেউয়ের মতো ওঠা নামা করে কাঠের ঘোড়া।

দাদু, দ্যাখো দ্যাখো।

টুপুর কুচকুচে তারা দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।

আঙুল দিয়ে ছায়াটাকে সে দেখাল। দাদু আগের মতো চাকা-লাগানো চেয়ারটায় চুপ করে বসে। হাসে না, কথা বলে না, নড়াচড়া করে না। আস্তে আস্তে দুলুনি কমে এল টুপুর।

অ্যাই দাদু, কথা বল না কেন? শান্তাদিদি তো এখন চুল আঁচড়াচ্ছে, কেউ তো বকবে।

দাদু একভাবে বসে থাকে, কথা বলে না, নড়াচড়া করে না। টুপু আবার ঘোড়াটাকে দোল দিতে শুরু করল।

দাদু ঘোড়ায় চাপবে?

কথাগুলো ঢেউয়ে-ভাসা ব্লটিং কাগজের মতো ওঠা-নামা করতে কয়তে ডুবে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টুপু নেমে বারান্দার অন্যধারে ছুটে গেল। সেখানে এইমাত্র একটা বোলতা উড়ছিল।

টুপু উঠো না রেলিঙে। বোলতা উড়ে গেছে। হয়তো এখন বুগেনভিলার খোকায় বসেছে। আছে কি গাছটা এখনও গেটের ওপর। তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছ এখান থেকে তো গেটটা দেখা যায়। তোমার ঠাকুমা পুঁতেছিল, সে কি আর এখনও আছে। গাছ-ফুল-পাখি, রঙিন মাছ আর খোকা-খুকুদের সে বড়ো ভালোবাসত। না না, টুপু ওদিকটায় যেয়ো না, আমার চোখের আড়ালে যেয়ো না। আমি কিছু দেখতে পাই না তুমি কাছে না থাকলে। টুপু আকাশ এখন কি তোমার সোয়েটারের রঙের মতো নীল হয়েছে? এক বার দেখে আসবে লনের শিশিরে রোদুর কি তোমার চোখের থেকেও ঝিকমিকে? মাঠি খুঁড়ে ছোট্ট ছোট্ট ঢিপি করেছে কী কেঁচোরা? যদি করে থাকে তাহলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ওগুলো ভেঙে দিয়ে এসো, দেখবে কী মজা লাগে। মাটিগুলো ঝুরঝুরে হয়ে হয়ে যায়। খানিকটা ওই মাটি এনে আমার চোখের সামনে উড়িয়ে দাও, আমি দেখব তোমার চুল না মাটি-কোনটা বেশি ঝুরো। না থাক, টুপু তুমি যেয়ো না, তাহলে ওরা তোমায় বকবে। ওরা তোমায় কেন যে আমার কাছে আসতে দেয় না! আমি কি তোমার কিছু ক্ষতি করতে পারি! টুপু এখন কেউ নেই, এই হচ্ছে সময়। তুমি এসো আমার কাছে। আর আসার সময় দেখে নিয়ে ফুরুস গাছে বুলবুলি এসেছে কি না। ওরা বছরে বছরে আসে।

খোঁজাখুঁজি করে বোলতাটাকে না পেয়ে টুপু ফিরে এল। ঘোড়ায় উঠতে যাবে—কী ভেবে উঠল না। গুটিগুটি দাদুর কাছে এসে দাঁড়াল।

তুমি কথা বল না কেন? বলতে পার না জিভ নেই বলে? কই হাঁ করো তো, করোনা। মুখের কাছে মুখ আনে টুপু, দাদুর চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ে।

তুমি হাঁ করতে পার না? তবে খাও কী করে?

টুপুর জিজ্ঞাসার উত্তরে চোখের পাতা ফেলা ছাড়া আর কিছু করে না দাদু। টুপু রেগে ওঠে। দাদুর হাত ধরে জোরে নাড়া দেয়। চেয়ারের হাতল থেকে ঝুলে পড়ে হাতটা।

খাও কী করে বলো-না? আমি কিন্তু চাইব না। সত্যি বলছি। আমি কি অসভ্য? না বলবে তো বয়ে গেল, যখন তুমি খাবে তখন ঠিক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখব। সত্যি সত্যি দেখব কিন্তু?

খস খস চটির শব্দ আসে। টুপু দাদুর কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। শান্তা এল। মাজা গায়ের রং। পেকে-ওঠা ফোড়ার মতো টসটসে শরীর। পিঠের সাদা আঁচলটাকে মনে হয় একটা কঙ্কাল যেন শ্রান্ত হাত ঝুলিয়ে দিয়েছে। কমলা রঙের অর্গাণ্ডির ব্লাউজটা ক্ষতের ওপর নতুন গজানো চামড়ার থেকেও টানটান, তাই ব্রেসিয়ারটাকে দেখায় একখন্ড হাড়। শান্তার বয়স বোঝা যায় না। ওর গলার স্বর খসখসে ঠাণ্ডা। ওর হাতের নখ সরু আর রঙিন।

টুপু, এখানে কী?

দাদুর চেয়ারের পিছনে সরে এল টুপু। তালুর উলটোপিঠ কামড়ায় আর তাকিয়ে থাকে সে শান্তার চোখে।

এখন যাও, দাদু চান করবে।

টুপু চেয়ারের পিছন থেকে সরে দাঁড়াল। এইবার শান্তা চাকা লাগানো চেয়ারটাকে ঠেলে নিয়ে যাবে বাথরুমে।

আমি দেখব।

না দেখতে নেই।

শান্তা চলতে শুরু করল সামনে চেয়ার রেখে। কাচের মতো মসৃণ মেঝে, দরজায় চৌকাঠ নেই। তবু দুলে উঠল দাদুর শরীর। শান্তার গা ঘেঁষে চলতে চলতে টুপু দাদুর ঝুলন্ত হাতটাকে কোলের ওপর তুলে দিয়ে বলল, কেন দেখতে নেই?

ছোটোদের দেখতে নেই।

দাদু বুঝি ন্যাংটো হবে?

হেসে উঠল শান্তা। ঘাড় নামিয়ে দাদুর কানের কাছে মুখ আনল সে।

হ্যাঁগো বুড়ো, শুনলে কথাটা?

শান্তাকে হাসতে দেখে টুপু যেন বোঝে কথাটা খুব মজার বলেছে সে। বাথরুমের দরজাটা যখন শান্তা খুলছে তখন টুপু আবার বলল :

আমি দাদুকে ন্যাংটো দেখব।

না, দাদু রাগ করবে।

রাগ করবে, কেন?

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল শান্তা। টুপুর মুখে জিজ্ঞাসা আর অবাকের চিহ্নগুলো ভয়ে সমান হয়ে গেল। নিজ থেকেই সে পায়ে পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল। দরজা বন্ধ করে শান্তা তাকাল। দাদুও এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিল, পাহাড়ি পথে সমতলের মানুষ যেমন সবাধানে থেমে থেমে নামে। দাঁতে দাঁত ঘষে শান্তা প্রায় ছুটে এসে চড় মারল দাদুর গালে।

পাজি বুড়ো কোথাকার, অমন প্যাটপ্যাট করে এখনও কী দেখিস? দেখে কী করবি, মারবি? হাত তুলতে পারিস?

দাদুর হাতটা তুলে আবার ছেড়ে দেয় শান্তা। হাতটা চেয়ারের হাতলে খট করে পড়ল। দেখলি? যা খুশি তাই করতে পারি এখন, যা খুশি।

দাদুর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তা চুপ করে গেল। ধক ধক করে জ্বলছে। আস্তে আস্তে সরে এল চেয়ারের পিছনে।

টুপু, টুপু, দরজা ভেঙে তুমি আমার চোখের সামনে দাঁড়াও। তোমায় আমি সব কথা বলব। কবছর আগেও শুধু আমার জুতোর শব্দে এই বাড়িটা ভয় পেত। আজ দেখে যাও আমি মার খাচ্ছি। বাড়ির সবাই-তোমার বাবা-মা-কাকা-কাকি-এমনকী মালীটা পর্যন্ত জানে শান্তা আমায় অপমান করে, তবু কেউ ওকে বারণ করে না। আমি যখন চলাফেরা করতে পারতুম তখন ওদের ভয় পাওয়া দেখে কী খুশিই-না হয়েছি। আমি কি জানতুম এমন একটা দুর্ঘটনা ওত পেতে বসে থাকবে? অসহ্য। অসহ্য, টুপু, আবার আগের জীবন চাই। তুমি দরজা ভেঙে আমার সামনে দাঁড়াও। তোমায় আমি বলব, অনেক কথা বলব। এ-বাড়িতে একটাই সুন্দর মানুষ ছিল, তোমার ঠাকুমা।

জানো টুপু, শান্তা যখন মারে আমার লাগে না। সত্যি বলছি একটুও লাগে না। ব্যথা পাওয়া ভুলে গেছি। অনেক দিন কাঁদি না, অনেক দিন। তাই কি হয়! না টুপু, মিথ্যা বলছি। তোমার কাছে আমি কিছু লুকোব না, রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তুমি যখন ফুলের মতো ছোট্টটি হয়ে মায়ের বুকঘেঁষে আসসা, যখন লুলা তার নখের আওয়াজ অন্ধকারে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটিয়ে আমায় জানালা দিয়ে তাকায়, তখন কাঁদি। জল পড়ে আমার গাল বেয়ে বিছানায়, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমোলে সব কিছু ভুলে যাই। ঘুম তাই আমার ভালো লাগে। তারপর সকালে যখন উঠি তখন আবার এই যন্ত্রণার শুরু। এমনি করে দিনের পর দিন বাঁচা-মরার মধ্য দিয়ে চলেছি। তবু শেষ বারের মতো এক বার চলাফেরা করতে চাই। আমার হাতটা দিয়ে শান্তার টুটি চেপে ধরতে চাই। আমি ঘুম চাই না।

অ্যাই বুড়ো, চোখ বুজে কী ভাবছিস?

চোখ খুলে দাদু সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর জামাটা খুলে নিল শান্তা। ট্রাউজার্সের বোতাম খুলতে খুলতে নাক সিঁটকে বলে উঠল :

আজও, আজও আবার! কেনা বাঁদি পেয়েছে যেন। থাকবি ননাংরা হয়ে, আমার কী।

বাঁ-হাতে জড়িয়ে দাদুকে তুলে ধরে ট্রাউজার্সটা খুলে নিল। বাথরুমের কোনায় সেটাকে ছুড়ে ফেলে দাদুকে ঠেলে দিল চেয়ার থেকে। মুখ থুবড়ে দাদু পড়ে গেল। তাকে জলের ঝারির নীচে হিঁচড়ে টেনে আনল শান্তা।

টুপু তুমি এক বার শুধু দেখে যাও, কিন্তু কিছু বোলো না। ছুটে এসে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর কোরো না। শান্তা জানে আমি কথা বলতে পারি না। লেখার জন্যে আঙুলটুকু পর্যন্ত নাড়তে পারি না, তবু ওর ভয় ঘোচে না। তাই ও আমায় মারে। অথচ আমিই ওকে এ-বাড়িতে আনি। তোমার ঠাকুমা পাগল হলে শান্তা নার্স হয়ে আসে। ওকে প্রথম থেকেই আমার ভালো লেগেছিল। তোমার ঠাকুমার অসুখের পর আমি মদ ছেড়েছিলুম। তুমি বড়ো হলে জানবে যে আমি খুব উদ্ধৃঙ্খল ছিলুম। হাতে প্রচুর টাকা ছিল আর খরচও করতুম। ঠাকুমা আমার জন্যেই সুখী হয়নি। কেন যে পারিনি ওকে সুখী করতে জানি না, বোধ হয় এইটেই ওর ভাগ্যে ছিল। কিংবা টুপু, এমনও তো হতে পারে—উদ্ধৃঙ্খলতা আমার স্বভাবে ছিল, আমার পূর্বপুরুষদের নামে গেরস্থঘরের বউ-ঝিরা কাঁপত, তাদের রক্ত তো আমার শরীরে আছে, আমি কেমন করে ভালো হব বল? কিন্তু আমার রক্ত তো তোমার শরীরেও আছে, তবে তুমি কী করে সুন্দর হলে। এ ভীষণ হেঁয়ালি। তুমি বলবে ঠাকুমা অসুখী হয়েছিল তার নিজের দোষেই। কী জানি, তার মনের খবর আমি পাইনি সেও আমায় দেয়নি। ফুল আর খোকা খুকুদের নিয়েই তার দিন কাটত। নিজের ছেলেরা বড়ো হলে পর সে প্রতিবেশীর বাচ্চাদের এনে আদর করত। টুপু, তুমি কাদের সঙ্গে এখন খেলা কর? তারা আজও আসে তো? ওদের নিয়ে এসো আমার কাছে। সুখী মুখ আমি দেখিনি টুপু।

শান্তা থাকত ঠাকুমার ঘরের লাগোয়া ছোট্ট ঘরটায়, যেটায় সে এখনও আছে। একদিন রাতে দেখলুম শান্তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ভাবলুম বলি রাতে যেন ঘর থেকে না বেরোয়, রাত্রে লুলাকে ছেড়ে রাখা হয়। সাবধান করার জন্যই ওর কাছে গেছলুম। ও কিন্তু আমায় দেখে হাসল মাত্র, কথা কানেই তুলল না। যেন আমার যাবার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়েছিল। অন্ধকার বারান্দায় ঘর থেকে একচিলতে আলো এসে পড়েছে। তাতে ওর মুখের একদিকটা দেখতে পাচ্ছিলুম আর দূরে রাস্তার আলোয় আকাশটা পোড়া ইটের মতো দেখাচ্ছিল। শান্তা দাঁড়িয়েছিল আকাশের দিকে মুখ করে, ওকে আমি জড়িয়ে ধরলুম। অন্য কেউ হলে নিশ্চয় ভয় পেত, ও কিন্তু একটা শব্দও করল না। এরকম ঘটবে যেন জানত। আর কী অশ্চর্যভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে চলে গেল। একচিলতে আলোটা বন্ধ হয়ে গেল। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকিনি কেননা লুলাকে তো জানি। সারাদিন অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকে আর মানুষ না দেখে ও শেখেনি মানুষ আর ইঁদুরের তফাত।

এরপর থেকে রোজ রাতে অপেক্ষা করতুম শান্তার জন্য। কিন্তু ওকে আর বারান্দায় দাঁড়াতে দেখতুম না। দিনের বেলায় কাছে আসত, কথা বলত, হাসত, আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যেত তখন তাকিয়ে থাকতুম ওর শরীরের দিকে। ও বুঝত তাই বার বার আসত আমার কাছে। টুপু, আমি বিশ্বাস করি না পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ তখন ছিল যে না চাইত শান্তার শরীরটাকে ছুঁতে। সাদাঘোড়ার ঊরুতে জড়ানো কালো শিরার মতো শান্তা আমাকে চাবুক মেরে খেপিয়ে তুলেছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। রাত্রে ওর ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে ভয়ে ফিরে এসেছি। ভয় তোমার ঠাকুমাকে নয়, লুলাকে। তছনছ করতে ইচ্ছে করত শান্তাকে। কিন্তু পারতুম না লুলার জন্য।

অ্যাই বুড়ো, এখন কেমন লাগে?

শুকনো তোয়ালে দিয়ে দাদুর গলা ঘষতে ঘষতে শান্তা নাকে টোকা দিল।

কেমন লাগে, অ্যাঁ?

আবার টোকা দিল যেন সে শাড়ি থেকে ছারপোকা ফেলে দিচ্ছে। কৌতূহলী চোখে শান্তা একটুক্ষণ তাকায়, সত্যি সত্যি নাকটা পড়েছে কি না দেখার জন্য। পড়ল না, তাই বিরক্ত হয়ে সে দাদুর পা তুলে ধরে ট্রাউজার্স পরানোর জন্য।

টুপু, সেদিন রাতে যখন বারান্দায় চোখ পেতে অপেক্ষা করছিলুম তখন সারা বাড়ি নিঝুম, আকাশটায় ইটের রং আর তোমার ঠাকুমার ঘরে আলো জ্বলছিল। অপেক্ষা করতে করতে যখন ধৈর্যের সীমায় পৌঁছেছি তখন আলো নিভল। মনে হল, হঠাৎই মনে হল শান্তা আজ বারান্দায় দাঁড়াবে। চুপিচুপি এগিয়ে গেলুম। আজও যদি পালিয়ে যায় তাহলে আমিও ঘরে ঢুকব।

দরজায় টোকা দিলুম। সঙ্গে সঙ্গে ও দরজা খুলল। যেন শব্দটার প্রতীক্ষা করছিল। বলল, ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু আমি তাজা ছিলুম। ওর হাত ধরলুম। বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল কোনো আপত্তিই আমি শুনব না, হাত ছাড়িয়ে বলল, আসছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলুম। নীচের বাগান থেকে গন্ধ আসছিল হাসনুহানার। গাছটা ঠিক আমার নীচেই, ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করলুম। ঘুটঘুটে অন্ধকার, একহাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। টুপু, তুমি জান না, সে কী ভাষণ এক-একটা মুহূর্ত। ঠিক ঘুম আসার আগে, বন্ধ চোখের সামনে যেমন জমাট অন্ধকার গোল গোল হয়ে ফেটে পড়ে আর এক-একটা কালো স্তর আলতো হয়ে নেমে আসে চেতনায়, তার থেকেও ভয়ংকর আর সুখের ছিল অপেক্ষার সেই সময়টা।

ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করলুম ফুলগুলো কিংবা একটা পাতাও যদি দেখা যায়। দেখলুম মোমবাতির দুটো পোড়া সলতে যেন বাতাস পেয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে। বুঝলুম লুলা আমায় দিকে তাকিয়ে আছে। শুনেছ তো টুপু, লুলা একবার একটা চোরের টুটি ছিঁড়ে দিয়েছিল। ভয় করল আমার। ভুল হবে, মেরুদাঁড়া বেয়ে সাপের ছোবলের থেকেও দ্রুত একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। প্রথমেই মনে পড়ল—মৃত্যু। কী মৃত্যু, কেমন মৃত্যু তাও জানি না। মৃত্যু কথাটাই তো একটা গোটা কথা। তার ধরনধারণ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী। এই আমার অস্তিত্ব রয়েছে, মৃত্যু এল, তারপর আর আমি নেই। এই না-থাকার চিন্তাই তো টুপু পৃথিবীর সবথেকে বড় ভয়। এই ভয় যখন আমি পেলুম তখনই খস খস শব্দ উঠল পিছনে। লুলা সিমেন্টের ওপর হাঁটলে অমন শব্দ হয়। নীচে থেকে উঠে আসতে লুলার পাঁচ সেকেণ্ডও লাগবে না আর আমার ঘরে ছুটে যেতে ওইটুকু সময় দরকার। ছুটতে গিয়ে পড়ে গেলুম। সেই পড়াতেই শরীরের ডান দিকটায় পক্ষাঘাত ধরল। পরে জেনেছিলুম ওটা ছিল শান্তার চটির শব্দ। সে আমার কাছেই আসছিল।

দাদুর থুতনি তুলে ধরল শান্তা। ঝুনো নারকেলের মতো মাথাটা, অল্প কয়েকগাছি চুল। চিরুনি বোলাবার সময় খস খস শব্দ উঠল। বাথরুমের দরজার কাছে চেয়ারটা টেনে শান্তা বলল, এইবার বসে বসে ঝিমোও গে যাও।

চেয়ারে-বসা দাদুকে জোরে ঠেলে দিল শান্তা। সিধে ঘরের মাঝখানে এসে হঠাৎ পুরো একটা পাক খেয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল চেয়ারটা। ঘরের আর এক কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সুব্রত—দাদুর ছোটোছেলে। মুখ ঘুরিয়ে দাদুকে দেখে সিগারেটটা ফেলে গোড়ালি দিয়ে হেঁতলাল, তারপর তাকাল বাথরুমের বন্ধ দরজাটার দিকে। কী ভেবে এগিয়ে গেল, ইতস্তত করল, তারপর দরজায় টোকা দিল। ভিতর থেকে সাড়া এল না। সুব্রত দরজায় কান পাতল। এতক্ষণে এক বারও সে তাকায়নি দাদুর দিকে। সে যে ঘরে আছে তাও বোধ হয় মনে নেই।

টুপু, আমার চেয়ারের চাকাটা খুব আলগা। শান্তা যখন ঠেলে দিল, সিধে জানলার শার্সিতে ধাক্কা লাগার বদলে হঠাৎ ঘুরে গেল, ঠিক যেমন করে আমার জীবনটাও ঘুরে গেল। বেপরোয়া উদ্ধৃঙ্খল ছিলুম, হঠাৎ পক্ষাঘাতে ডানদিকটা যখন পড়ে গেল তখন এমনি করেই হলদে দেয়ালটার দিকে এগিয়ে আসার মতো ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলুম। কিন্তু এক দিনেই এগোলুম না; তখনও জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতুম, অর্ধেকটা শরীর নাড়াতে পারতুম, তখনও সবাই ভয় করত, মেনে চলত।

দেখাশুনা করার জন্য তোমার বাবা সুপ্রিয়লোক রাখতে চেয়েছিল, রাখতে দিইনি। শান্তাকেই আমার সেবার ভার দিয়েছিলুম। এর জন্য অবশ্য ওকে বেশি টাকা দিতে হত। তোমার ঠাকুমা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির, তখন আরও শান্ত হয়ে গেছিল, তার কাছে বেশিক্ষণ থাকার দরকার হত না শান্তার। আমরা কথা বলতুম। সাধারণ কথা, কিন্তু নিষ্ফল রাগে জ্বলে মরতুম। একদিন ওকে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে চেয়ার থেকে মুখ থুবড়ে পড়লাম। ব্যথায় কাতরে উঠব কিন্তু থেমে গেলুম শান্তার দিকে তাকিয়ে। মেঝের ওপর পড়ে ছিল আমার মুখ, নীচু থেকে শান্তাকে অদ্ভুত দেখাল। মনে হল শান্তার কাঁধ নেই, মুখটা নেমে এসেছে ওর পেটের মাঝখানে। আমি শিউরে উঠলুম, অথচ আনন্দ পেলুম। শান্তা তাড়াতাড়ি আমায় চেয়ারে বসিয়ে দিল। ধন্যবাদ দিলুম, ও কথা না বলে বেরিয়ে গেল।

রোজ সকালে শান্তা আমায় বারান্দার রোদুরে রেখে যেত। মাঝে মাঝে তোমার ঠাকুমা এসে দাঁড়াত। তাকিয়ে থাকত সে আকাশের দিকে, বাগানের দিকে। বিড়বিড় করে কী যেন বলত আর এধার-ওধার কাকে খুঁজত। একদিন শুনেছিলাম ওর কথা, লুলার খোঁজ করছে। কিন্তু ও একদম ভুলে গেছে যে দিনের বেলা লুলাকে অন্ধকার ঘরে বেঁধে রাখা হয়। টুপু, এই সময়ে বিলেত থেকে ফিরে এল তোমার কাকা সুব্রত। তোমার বাবার মতো অত হিসেবি মানুষ ও নয়। ওর ছোটোবেলা কেটেছে কার্শিয়াঙে মিশনারি বোর্ডিং-এ, কিন্তু কলকাতার অ্যাংলো পাড়ায় বেশিদিন ওর যৌবন কাটাতে দিতে ভরসা পেলুম না। অনেক সুন্দরী বাছাই করে তোমার কাকিমার সঙ্গে ওর বিয়ে দিলুম। বিয়ের এক মাস পরেই ওকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য বিলেত পাঠিয়ে দিই।

সুব্রত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে শান্তাকে বদলে যেতে দেখলুম। ছোটোবউমা কেঁদে পড়ল ওকে বাড়ি থেকে তাড়াবার নালিশ জানিয়ে। কিন্তু তাড়াতে পারিনি। ভালো করে কথা বলতে পারি না, চলাফেরা করতে পারি না, শরীরটা আমার মরে আসছিল। অথচ তলপেট থেকে লকলকে শিখা উঠে আসত অজস্র ছুঁচলো মাথা নিয়ে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝাঁঝরা করে দিত। তাতে মনে হত আমি বেঁচে আছি আগের মতো। আর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে শান্তা। ছোটোবউমা তারপরেও নালিশ করেছিল, হিংসে করেছিলুম নিজের ছেলেকে। শান্তাকে তাড়াবার কথা ভাবিনি, সুব্রতকে সরিয়ে দেবার জন্য ছোটোবউমাকে পরামর্শ দিলুম দিল্লিতে তার বাবাকে চিঠি দিতে। দেশে অনেক পাস করা বেকার ইঞ্জিনিয়ার আছে, কিন্তু কী জাদুমন্ত্রে জানি না সুব্রতর শ্বশুর বিলেতের ফেল-করা ইঞ্জিনিয়ার জামাইয়ের জন্য তেরোশো টাকার চাকরি ঠিক করে দিল। সুব্রত পাঞ্জাব চলে গেল বউকে নিয়ে।

খুট করে খুলে গেল বাথরুমের দরজা। সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধরানো সিগারেটটাকে থেঁতলে সুব্রত জানলা থেকে ঘুরে দাঁড়াল। ওকে দেখেই শান্তা এক-পা পিছিয়ে মুখে অস্ফুট শব্দ করল। সুব্রত হাসল। ফর্সা চামড়া, লাল ঠোঁট, সাদা সারি দাঁত, ছিপছিপে ছ-ফুট শরীর, হাসলে ওকে সুন্দর দেখায়। এগিয়ে এসে দু-হাত রাখল শান্তার কাঁধে। শান্তা তখনও অবাক, কথা বলতে পারছে না।

কী, খুব অশ্চর্য তো?

শান্তাকে ঝাঁকুনি দিল সুব্রত। শান্তা কাঁধ থেকে হাত ঠেলে নামাবার চেষ্টা করায় সুব্রত আরও জোরে আঁকড়ে ধরল।

কখন এলে।

এইমাত্র, এখনও কারও সঙ্গে দেখা করিনি।

একা এলে?

হ্যাঁ, অনুকে সঙ্গে আনলুম না। অবশ্য তুমি এখানে যখন, বুঝতেই পারছ একা ছেড়ে দিতে চায়নি।

সুব্রত মুখ এগিয়ে আনল। শান্তা মাথা সরিয়ে নিল।

শান্তা, চলো আমার সঙ্গে।

হঠাৎ বলল সুব্রত গলার স্বরটা সর্দি ধরার মতো ঘড়ঘড়ে করে। কথা না বলে শান্তা তাকিয়ে রইল সুব্রতর চোখের দিকে। চোখের মণিটা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় আর তাই বেঁধে রাখতে লাল শিরাগুলো হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। আবার বলল সুব্রত, চলো শান্তা আমার কাছে। বিশ্রী, বিশ্রী লাগছে অনুকে। একতাল কাদা রোজ যেন আমায় নোংরা করে দেয়। ওকে আমি ডিভোর্স করব, যাবে?

হাসল শান্তা। চোখ বন্ধ করে কী যেন সে ভাবতে শুরু করল। অধৈর্য হয়ে সুব্রত ওর হাত মুচড়ে ধরল।

লাগছে সুব্রত।

না, লাগছে না।

সুব্রত, তুমি এখন টায়ার্ড।

না, টায়ার্ড নই।

তুমি ক-দিন থাকবে?

ক-দিন থাকব সেটা কোনো কথা নয়। শুধু শুধুই হাজার মাইল পথ ভেঙে তোমার এই কথা শুনতে আসিনি। তা ছাড়া তোমার কাছে এলে আমি কেন, আটলান্টিক সাঁতরে-আসা মানুষও নিজেকে তাজা মনে করবে।

দপ দপ করতে থাকে সুব্রতর কপালের দু-পাশ। চোখের কোল ফুলে উঠেছে, গালের পেশি শক্ত। দূরে দাদুর দিকে তাকিয়ে শান্তা বলল, আমার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে।

ও-বুড়োর জন্য আবার কাজ কী?

বাঃ, খাওয়াতে হবে না।

খুব দরদ দেখছি যে। খেতে একটু দেরি হলে মরে যাবে না, বুড়োর জান ভীষণ কড়া।

উনি তোমার বাবা।

সুব্রত গোটা শরীরের এমন ভঙ্গি করল যেন বলতে চায়, সে আবার কী! শান্তা মুখ টিপে হাসল। দাদুর কাছে যাবার জন্য সে এগিয়েছে, হ্যাঁচকা টানে তাকে থামিয়ে দিয়ে সুব্রত দাদুর সামনে এসে দাঁড়াল।

নড়তে পার না তাই, মেরেই ফেলতে। তাই না?

সুব্রত দাদুর থুতনির নীচে দুটো আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে ধরল।

দাদু চোখ বন্ধ করল। শান্তা হেসে উঠল। সুব্রত ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কুটি করে শান্তা বলল, অসভ্যের মতো দেখছ কী, দরজাটা খোলা রয়েছে না?

টুপু, টুপু, আজ সকাল থেকে লুলা ডাকছে। আজ তুমি বাগানে যেয়ো না। হয়তো লুলাকে বেঁধে রাখা হয়নি। হয়তো ওর ঘরের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করা হয়নি। চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলো তো ওই দিকেই। হলুদ পাপড়িগুলো যদি তোমায় লোভ দেখায় লুলার এগিয়ে আসা নখের শব্দ যেন না শুনতে হয়। শুনতে পাইনি বারান্দা থেকে ঠাকুমার পড়ে যাওয়ার শব্দ। আমার বুকের ওপর শান্তা তখন হাঁপাচ্ছে। ওর মুখ দিয়ে কেমন একটা শব্দ উঠছিল, ভীষণ ভালো লাগছিল শুনতে। পাথর হয়ে বসেছিলুম, কথা বলিনি। আমার ভালো হাতটা দিয়ে ওকে চুঁইনি পর্যন্ত। ভিজে খড়ের মতো জ্বলছিল শরীরটা, জ্বালা করছিল চোখ। আমি দেখতে পাচ্ছিলুম না বারান্দায় কী ঘটছে। শান্তা তখন চুপিচুপি আমায় বলল, ভালোবাসি। আমার অর্ধেক স্থবির শরীরটাকে ও ভালোবাসে! হাত বাড়ালুম ওকে ধরবার জন্য। শান্তা আমার নাগালের বাইরে সরে গেল। আধমরা ইঁদুরের মতো বার বার বেঁচে উঠতে চাইলাম কিন্তু শান্তা বেড়ালের থাবার থেকেও নিরাসক্ত, নিষ্ঠুর। আমার তেষ্টা পেল, ঢোঁক গিলতে পারলুম না, সে-জোরটুকুও আমার ছিল না। শুধু নড়ে উঠল গলার নলিটা, আর শান্তা আস্তে আস্তে মুখটা এগিয়ে এনে তার ঠোঁট রাখল আমার গলায়। ও যদি তখন দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলত টুটিটা, বেঁচে যেতুম। তিল তিল করে এই পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকার থেকে, বেঁচে যেতুম। কিন্তু শান্তা তা করল না। শুধু বলল, ভালোবাসি। সেই সময়েই লুলা চিৎকার করে উঠল, ঠিক আজকের মতো। মনে পড়ল তোমার ঠাকুমা দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। জানলার দিকে তাকালুম। উঁচু জানলা, লুলা দাঁড়িয়ে উঠেছে গরাদের ফাঁকে থাবা রেখে। জিভ বার করে ও হাঁফাচ্ছে, মনে হল ঠাকুমার শাড়ির লালপাড় থরথর করে কাঁপছে। লুলা ঠোঁট চাটল। নোনতা গন্ধ যেন পেলুম। জানি না কেন পেলুম। কনকনে শীতের দিনে ঠাণ্ডাজলে কাউকে চান করতে দেখলে শীত লাগে, জানি না কেন লাগে। দু-হাতে আমার মুখটাকে ধরে শান্তা আবার বলল, ভালোবাসি। শিউরে উঠলুম ওর চোখ দেখে। শান্তা হাসছিল, মনে হল লুলাও বোধ হয় হাসছে। দেখবার জন্য ঘাড় ফেরাতে গেলুম, পারলুম না। শান্তার টুটি চেপে ধরার জন্য হাত তোলার চেষ্টা করলুম, হাত উঠল না। আমার শরীরের সুস্থ অংশটুকুকেও পঙ্গুতা গ্রাস করল। চিৎকার করে উঠতে চাইলুম, গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। আমার শরীর মরে গেল টুপু।

সকালে বাগানে যখন খুঁজে পেল তোমার ঠাকুমাকে তখন সবাই খোঁজ করল মৃত্যুর কারণ। অনুমান করল নানাজনে নানারকম। পুলিশ তার কর্তব্য করে গেল। শুনলুম ওরা রিপোর্টে লিখেছে—আত্মহত্যা। কিন্তু আমি জানি, এটা হত্যা। রাতে শান্তা ইচ্ছে করে দরজা খুলে রেখেছিল। বারান্দা থেকে এ-বাড়ির বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়, তাই তোমার ঠাকুমা ফাঁক পেলেই বারান্দায় এসে দাঁড়াত। সে-রাতেও ঘরের দরজা খোলা পেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। লুলার কথা ওর মনে ছিল না। ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল লুলা। তোমার ঠাকুমার সুস্থবুদ্ধি বোধ হয় কয়েক মুহূর্তের জন্যই ফিরে এসেছিল, তাই সে বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝি না আজও-ঘরে গিয়ে নিজেকে না বাঁচিয়ে কেন বাগানে লাফিয়ে পড়ল। তোমার ঠাকুমা ভুল করেছিল টুপু। মৃত্যু বড়ো ভয়ংকর, এক বার যে এর মুখোমুখি হয়েছে, বেঁচে থাকলেও সে কোনোদিন এই ভয়ংকরের ভয় থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে না। তোমার ঠাকুমা মরে গিয়ে হয়তো বেঁচে গেছে। আমিও ভয়কে দেখেছি। সেকথা আমি বলতে পারিনি। টুপু, মানুষ যেন কথা বলার ক্ষমতা না হারায়। লুলাকে তোমার বাবা মেরে ফেলতে চেয়েছিল, আমি ঘাড়টুকু নেড়েও সম্মতি জানাতে পারিনি। টুপু, মানুষ যেন পঙ্গু না হয়। ভেবেছিলুম শান্তা এরপর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু গেল না। এর একমাত্র কারণ সুপ্রিয়। হ্যাঁ টুপু, তোমার বাবা শান্তাকে চেয়েছিল বাড়িতে রাখতে।

এই দাদু।

চেয়ারের পেছন থেকে টুপু ঝুঁকে পড়ল। দু-হাতে চিবুক ধরে দাদুর মুখটা ঘুরিয়ে আনল। জ্বলজ্বল করে উঠল দাদুর চোখ।

ঘুমোচ্ছিলে? আমি তো ঘুমোচ্ছিলুম, হ্যাঁ সত্যি সত্যি ঘুম! মা বলল, টুপু দুপুর বেলা ঘর থেকে বেরিয়ো না, বাগানে রোদুরে যেয়ো না, দাদুর ঘরে যেয়ো না। তখন জান আমি চুপটি করে জেগে, তখনও ঘুমোইনি। তারপর কী হল জান?

টুপু প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল দাদুর কোলে। দু-চোখ বন্ধ করল দাদু।

টুপু এমনি করে সারাজীবন তুমি থাকো। উঠো না, সরে যেয়ো না। সকাল থেকে এখনও কিছু খাইনি। সুব্রত শান্তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, শান্তা ভুলে গেছে আমার খাওয়ার কথা। আর তো কেউ আসে না, খোঁজ করে না। টুপু তোমার মুখটা আরও কাছে আনো। দুধের গন্ধে আমার ছেলেবেলাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে, প্রথম ছেলে-কোলে তোমার ঠাকুমাকে মনে পড়ে। ছোটোবেলায় তোমার বাবাও এমনি করে আমার কোলে এসে পড়ত। সে হাসত, এখন সুপ্রিয় হাসে না। তাকে চুমু খেলেই মুখে দুধের গন্ধ লেগে থাকত। তখন মদ খেতুম, তবু মনে হত মুখ থেকে দুধের গন্ধটা উঠছে না। বিশ্রী লাগত, তাই আর কোনোদিন ছেলেদের কাছে আসতে দিইনি। কতদিন পরে পাচ্ছি সেই গন্ধ। সুপ্রিয়-সুব্রতকে সেই ছোট্টটি করে দেখতে পাচ্ছি। ওরা ছোটো, ওরা অপরিণত, বোঝে না কোন সর্বনাশ আঁকড়ে ধরছে।

এমনি করে বসে আছ কেন, বারান্দায় নিয়ে যাব?

দাদুর কোল থেকে উঠে পড়ল টুপু। দাদুর চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ে। চেয়ারটাকে যখন ঘরের মাঝ পর্যন্ত টেনে আনল তখন ঘরে ঢুকল টুপুর মা। তাকে দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে জড়সড় হয়ে গেল টুপু। ওর পিছনে বড়োবউও বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী ভেবে ফিরে এল।

মা-র নেকলেস যেটা ছোটোবউকে দিয়েছিলেন, আজ দেখলুম শান্তার গলায়। ঠাকুরপোর সঙ্গে কোথায় যেন বেরোল। যখন আমি চেয়েছিলুম দিলেন না। একটা পাজি মেয়েমানুষের গলায় মা-র গয়না দেখলে কেড়ে নেওয়া উচিত নয়?

দশাসই বড়োবউয়ের নাকের ফুটো বড়ো হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে আবার বলল, আপনার ছেলে আমায় শাসিয়েছে জানেন, সে আমায় চাবকাবে বলেছে যদি শান্তার গায়ে হাত দিই। জানি ছেনালটার জন্য ওর খুব দরদ, কিন্তু সতীসাধ্বীর গয়না আমি ওর গায়ে উঠতে দোব না, এই বলে রাখলুম। আপনি তো ভালো করেই জানেন, ও-গয়নায় আমার দাবি সকলের আগে। ঠিক কি না বলুন?

চোখের জল মুছল বড়োবউ। আঁচলে নাক ঝেড়ে এধার-ওধার তাকাল, তারপর চুপিচুপি বলল, ঠাকুরপো ছোটোবউয়ের সব গয়না ওকে দিয়ে দেবে, দেখবেন এই আমি বলে রাখলুম। মা-র সেকেলে ভারী ভারী গয়না, তার দাম কত আজকের দিনে! ওগুলো যদি আমায় দিতেন তাহলে নষ্ট হত না। ঠাকুরপো যদি ওঁর মতো হিসেবি হত তাহলে ছোটোবউয়ের এই সব্বোনাশ ঘটত না।

সদ্য ডিমপাড়া মুরগির মতো বড়োবউ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টুপু বিকেল হয়ে গেল। বাগানে এখন ঠাণ্ডা ছায়া পড়েছে। তুমি কি সেই বোলতাটাকে এখনও খুঁজছ। তোমার খেলার সাথিদের নিয়ে এসো আমার কাছে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার ঘুম পাচ্ছে টুপু। কখন আসবে, কখন আমায় বারান্দায় নিয়ে যাবে। বেলা পড়ে আসছে, অন্ধকার নেমে আসছে। আর যে কিছু দেখতে পাব না।

বারান্দায় সুপ্রিয় যখন পায়চারি শুরু করেছিল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। যখন আকাশে অর্ধেক তারা দেখা গেল, সে দাদুর ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালল না, একেবারে চেয়ারের পাশে চলে গেল সে।

আমি ওকে তাড়াব। শুনছ, আমি ওকে তাড়াব। আর সহ্য করব না। আমার বউ-মেয়ে আছে, আমার বয়স হয়েছে। যতটা ভীতু ভাবে ততটা আমি নই একথা আজ বুঝিয়ে দোব। কী বল, পারব না? তাই করা উচিত নয় কি?

সুপ্রিয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শান্তার ঘরের সামনে ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজাটা বন্ধ, পর্দা ঝুলছে দরজার সামনে। সুপ্রিয় হাত বাড়িয়ে পর্দাটা ছোঁয়। হঠাৎ দাঁত দিয়ে পর্দাটাকে ছিড়তে শুরু করে।

টুপু তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ? এখন রাত কত? লুলা বাগানে ডেকে উঠল, ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লুলা আজ সকাল থেকে ডাকছে। শান্তা এখনও ফেরেনি। ও আজ ফিরবে না। টুপু, তোমার বাবাকে দেখে সত্যি দুঃখু পাই। হয়তো সুপ্রিয় একদিন আত্মহত্যা করবে তবু শান্তাকে পাবে না, তাকে আমিও পাইনি। সুপ্রিয় স্বেচ্ছায় মরতে চায় কীসের জ্বালায়? এটা কি ওর স্বভাব? সুব্রত জানে সে একদিন মরবেই, তাই ভয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই দিনটার কথা ভেবে।

টুপু, শান্তা যদি আর না ফেরে, তাহলে আমি সেরে উঠব কি? যদি তাই হয় খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হবে, তাই না? শান্তা যেন আর না ফেরে। তুমি আর আমি শুধু থাকব, থাকবে বাগানটা আকাশটা, আর মাঝে মাঝে বোলতা কিংবা ফড়িং।

সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠছে টুপু। শান্তা কি চটি পরে বেরিয়েছিল? কিন্তু শান্তা হবে কেন, সে তো আজ রাতে ফিরবে না। তাহলে কি লুলা? রাত্রে ও সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। বারান্দায় এসে মাথা নীচু করে কী যেন শোঁকে, জানলায় পা রেখে ঘরের মধ্যে তাকায়, চলে যাবার আগে দরজা আঁচড়ায়। টুপু, আমার ঘরের দরজাটা বোধ হয় খোলা। এ ঘরে শেষ এসেছিল সুপ্রিয়। সে চলে গেল শান্তার কথা ভাবতে ভাবতে। বন্ধ করে গেছে কি দরজাটা? কিন্তু বন্ধ করবে কেন, ওর কি তখন মনে ছিল লুলার কথা, তার মা-র কথা?

টুপু শব্দটা সিঁড়ি থেকে বারান্দায় উঠে এল যে! ওখান থেকে ঘরের দরজায় আসতে কতক্ষণ লাগবে? না, তার আগে জানলা দিয়ে দেখবে। অন্ধকার ঘরে চোখ সইয়ে নিতে দেরি হবে ওর। কত দেরি হবে? লুলা আসছে। শীতে-ফাটা চামড়া চুলকোনোর মতো ওর নখের শব্দটা এগিয়ে আসছে। জানলায় শব্দ হল কেন? তোমার ঠাকুমার ঘোমটার লালপাড়ে চুলের তেল লেগে বাসি রক্তের রং ধরত, লুলার জিভে কী লালপাড় জড়িয়ে আছে? কেউ এসে বন্ধ করে দেবে না এখন দরজাটা। আমাকেই বন্ধ করতে হবে, আমায় উঠতে হবে, আমায় বাঁচতে হবে। ওই ঝকঝকে বাঁকানো দাঁত, ফাঁকে ফাঁকে পচা মাংসের গন্ধ, ঠোঁট আর মাড়ির ভাঁজে জমে উঠছে লালা, আর তাই চেটে নেবার শব্দ। আমায় উঠতে হবে, দরজা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আমার ক্ষমতা কই টুপু!

কিন্তু আমার রক্ত কেমন ছুটতে শুরু করেছে। আগুনের স্রোত যেন পুরোনো শিরার ময়লা–গুলোকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ঠেলে নামছে। হালকা হয়ে যাচ্ছি। টুপু, আমি ভোরের অন্ধকারের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছি। আমার হাত কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। হঠাৎ এ কী হল আমার! তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছি কেন! টুপু, মনে হচ্ছে আমি বাঁচব, সুস্থ হয়ে বাঁচব। আমি মরতে চাই না। ইচ্ছে করছে এখন তোমার ঠাকুমাকে দেখতে, তার গায়ে হাত রেখে কথা বলতে, হাসাতে, রাগাতে। আমার দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে এখন বাগানে বেড়াতে চাই টুপু। দরজার কাছে খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর একদিন শুনেছিলুম, সেদিন লুলা ভেবে ভুল করেছিলুম। আঃ, এখন ওই শব্দটা যদি শান্তার চটির হয়! আমি বেঁচে যাব টুপু, আমি বেঁচে যাব।

হঠাৎ খুলে গেল দরজাটা। জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে লুলা গুঁড়ি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকল। থমকে পিছিয়ে এল। চাপা স্বরে গরগর করে উঠল। সে এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। চেয়ারে বসা জমাট মূর্তিটা দূলে উঠেছে। লুলা আরও এগিয়ে এল। ওর পিঠের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠেছে। কাঁপতে কাঁপতে দুটো হাত সামনে এগোল। ওদের ব্যবধান কমে আসছে।

হঠাৎ বিকট স্বরে দু-বার ডেকে উঠল লুলা। কুড়লের প্রচন্ড এক ঘায়ে যেন জমাট মূর্তিটা ভেঙে পড়ল চেয়ারে। লুলা এগিয়ে এসে শুকল ঝুলে-পড়া নিস্পন্দ হাতটা। শুকতে শুকতে হাত বেয়ে উঠে এল তার মুখ। গলার কাছে থমকে গেল তার দাঁত আর টুটির উপর কেঁপে উঠল নাক। লালা গড়িয়ে পড়ল কষ বেয়ে। আর টুটির ওপর থেকে চোখ বুজে তাই চাটতে চাটতে সুখে গরগর করে উঠল লুলা।

তাপের শীর্ষে

নাড়ু, তোর মা মরে গেছে।

সন্তোষ একটু নুয়ে কথাটা বলল। নাড়ু তাকিয়ে ছিল বাসটার দিকে। এইমাত্র যে ছেলেটা উঠল, একটু আগেই সে নাড়কে জিভ দেখিয়েছিল। নাড়ু দোতলা বাসটার দিকে তাই তাকিয়ে ছিল।

হাতের থলিটায় কাপড় আছে, মা আনতে বলেছিল। পেয়ারা আছে, মা খেতে ভালোবাসে। থলিটা দু-হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে নাড়ু তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। চোখ সরিয়ে নিল সন্তোষ। আকাশটা ঘোলাটে। আজকেও বৃষ্টি হবে। ফুটপাথটা ন্যাড়া। নীলরতন সরকার হাসপাতালের দেয়াল ঘেঁষে ঘাস উঠেছে।

ঘাস মাড়িয়ে সন্তোষ হাঁটছিল। পিছনে নাড়ু আসছে। সন্তোষ ঘুরে দাঁড়াল।

তুই আর আসিসনি, এখানেই থাক। আমি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি।

কেন?

ব্যবস্থা করতে হবে তো। সার্টিফিকেট না দিলে কিছুই তো করা যাবে না। নাড়ু দাঁড়িয়ে থাকল। বাবা চলে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ডানদিকের ঘরের কোণের বেডে মা আছে। সিঁড়ির পাশেই খাঁচার মতো লিফট নেমে এল। কখনো সে ওঠেনি। দরজা খোলার সময় ছড়াৎ শব্দ হল। মাথায় রুমালবাঁধা মেয়েলোকটা লিফট থেকে বেরোবার সময় তাকিয়ে গেল। ও কি কমলাদির মতো বিধবা? কমলাদি মাছ খায় না, কমলাদি মা-র কাছে এসে রোজ দুপুরে গল্প করত। একদিন কাঁদছিল মা-র কোলে মুখ গুঁজে। দুটো লোক লিফটে ঢুকল। চৌকো লোহাটা দেয়াল বেয়ে নামতে নামতে থামল। তারের দড়ি কাঁপছে। ওপর থেকে লিফটের দরজা খোলার শব্দ এল।

নাড়ু হাসপাতালের গেট পার হয়ে ফুটপাথে দাঁড়াল। বাস যাচ্ছে। দোতলা থেকে একটা লোক থুথু ফেলল। রাস্তার গর্তে এখনও বৃষ্টির জল জমে। গর্তের চারপাশে খোয়া-ছড়ানো। ট্যাক্সিটা গর্ত মাড়িয়ে গেল। খোয়া ছিটকে এসে গায়ে লাগতে পারত।

নাড়ুর ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সরে এসে গেটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। থলিটা বুকে চেপে কুঁজো হয়ে নাড়ু কাঁদল। কাঁদল অনেকক্ষণ ধরে। শুধু একটি বুড়ি যেতে যেতে ওকে দেখে একটুক্ষণ দাঁড়াল, কাছে আসার জন্য পা বাড়িয়েও কী ভেবে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। নাড়ু জোরে কাঁদেনি। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছিল। পিঠটা অল্প অল্প কাঁপছিল। খুব কাছে কেউ এলে শুনতে পেত গুনগুন গানের মতো একটা সুর। ওর পিছন দিয়ে অনেক মানুষ চলে গেল। কেউ কেউ তাকিয়েছিল। শুধু বুড়িটা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে চলে গেছল। অনেকক্ষণ পরে জামার হাতায় চোখ মুছে নাড়ু দোতলা বাস দেখতে লাগল।

অল্পবয়সি ডাক্তার দুঃখ জানালেন। বললেন, আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি। হঠাৎ পরশু থেকে—আপনি তো দেখেই গেছলেন। কাল থেকে গ্লুকোজ স্যালাইন চলছিল। এরপর ডাক্তারবাবু বলার মতো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে গেলেন। সন্তোষের মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে আবার বললেন, সার্টিফিকেট আমি এখুনি দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি।

সন্তোষ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। পর্দা সরিয়ে একটি নার্স উঁকি দিয়ে গেল। ওষুধের গন্ধ আসছে। ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে বারান্দায়। জমাদার দড়িবাঁধা সোয়াবটা ছুড়ে ছুড়ে নিশ্চয় বারান্দা সাফ করছে। ফরফর করে উড়ল টেবিলের কাগজ। ডাক্তারবাবু কাচের ড্যালাটা নিয়ে লোফালুফি করছেন।

বারান্দায় বেরিয়ে এল সন্তোষ। থুথু ফেলল কাঠগুঁড়োর বাক্সে। বারান্দার বাঁ-ধারে দুটো কেবিন। পর্দা ঝুলছে। খাটে বসে গল্প করছে একটি জোয়ান। সিঁদুরপরা একটি মেয়ে কমলালেবু ছাড়াচ্ছে। ডান দিকে অনেক দরজা। দরজায় পর্দা নেই। সারি সারি ওয়ার্ড। সেই বাচ্চা মেয়েটির পায়ে-বাঁধা ভারী লোহাটা এখনও ঝোলানো রয়েছে। অনেক দিন ও এখানে আছে। হাউহাউ করে একদিন কেঁদেছিল বাড়ি যাবার জন্য। ও ভালো হয়ে যাবে একদিন। একদিন বাড়ি ফিরে যাবে।

হাসপাতালের মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে। একপক্ষ বুঝি গোল দিল। সন্তোষ মুখ ফিরিয়ে এক বার তাকাল। মাঠটাকে ঘিরে থোকা থোকা মানুষ, যেন কালো পিঁপড়ের সারি। দেখতে বেশ লাগে। সেই বইওয়ালাটা আসছে। ও রোজ একগাদা পত্রিকা সঙ্গে করে আনে। পা-ভাঙা মেয়েটিকে একখানা বই কিনে দিলে কেমন হয়। পকেটে হাত দিল সন্তোষ। খড়খড় করল চারখানা দশটাকার নোট।

বুকে হাত জড়ো করে মেয়েটি শুয়ে আছে। সন্তোষ পাশে এসে দাঁড়াল। তাকাল মেয়েটি। অবাক হয়ে গেছে।

কেমন আছ?

ভালো।

বাড়ি থেকে কেউ আসেনি?

এসেছিল, চলে গেছে।

সন্তোষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়েটি।

একে বই কিনে দিয়ে কী লাভ! একে খুশি করে কী আনন্দ পাব! অন্যের আনন্দ দেখে আমার কী দরকার মিটবে! আমার তো কিছুর দরকার নেই। সন্তোষ পাশের বেড়ে তাকাল। বেডটা খালি। লাল কম্বলে ঢাকা। হয়তো আজকেই কেউ এসে যাবে। কোণে সেই হাসিখুশি ফর্সা মেয়েটির নাকে অক্সিজেনের নল। আজ সকালে নিশ্চয় অপারেশন হয়েছে। ওকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চয় ওর মা। উনি কাঁদছেন। মেয়ের বিপদ কেটে গেছে তাই কাঁদছেন। বমি করছে মেয়েটি। আঁচল দিয়ে মা মুখ মুছিয়ে দিলেন। ওই ছেলেটি কালকেও বোকার মতো বসেছিল। মেয়েটিকে কাল বিরক্ত দেখেছিলুম। আজও বিরক্ত করতে এসেছে। কেন আসে?

সন্তোষ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল। সকলে ওর দিকে তাকাল, মেয়েটি কথা বলছে। কথা বলা ওর এখন উচিত নয়। চোখটা ভিজে ভিজে, কাঁদছে, বোধ হয় কষ্ট হচ্ছে। নীচু হয়ে সন্তোষ ছেলেটিকে বলল, কথা বলতে দিচ্ছেন কেন, তাতে বমি আরও বাড়বে।

চুপ করে মেয়েটির মুখের দিকে ছেলেটি তাকিয়ে বসে রইল। ছেলেমানুষ, এখনও সংসারের আঁচ গায়ে লাগেনি। ও চিরকাল হয়তো এমনি করে বোকার মতো তাকিয়ে থাকবে। সন্তোষ পিছন দিকে তাকাল। পাশে তাকাল। সব কটা বেডের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে। ওরা কেন তাকিয়ে রয়েছে তা জানি। ওরা ফিসফিস করে কী বলছে তাও জানি। ওরা কৌতূহলী হয়ে পড়েছে। আমি এখনও কেন কাঁদছি না; ওরা খুশি হবে কাঁদলে। কিন্তু কেন কাঁদব!

ঘরের আর এক কোণের সেই বেডটা লালপর্দায় ঢাকা। সন্তোষ পর্দার পাশে দাঁড়াল। সারা ঘরের মানুষ এখন আমার দেখছে। একটু ঝুঁকে উঁকি  দিলেই পর্দার ভিতরটা দেখা যাবে। কিন্তু কী দেখব? ওই মানুষগুলো রোজ আমায় আসতে দেখেছে, দিনের পর দিন, তবু ওরা আমায় দেখছে। ওরা নতুন কিছু-একটা আমার মধ্যে দেখতে চায়। কিন্তু আমি কী দেখাব? সেই মানুষটা আছে কি? হাসপাতালে আসার আগের মানুষটা! ও আগে হাসত, রাগ করত, রাগ ভাঙাবার জন্য অপেক্ষা করত। তারপর দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে থেকে স্বভাব বদলে গেল, চেহারা বদলে গেল। তার মানেই ও নতুন হল কি? নতুন কথাটার মানে কী? ওকে আগে দিনরাত কাছে পেতুম, কিন্তু হাসপাতালে মাত্র দু-ঘণ্টার সম্পর্ক তৈরি হল। বাঁধা সময়ে রোজ এক ধরনের কথা বলা আর শোনা। ক্লান্ত হয়ে পড়তুম, হাঁপিয়ে উঠতুম, ভালো লাগত না আর আসতে। আজ সেই একঘেয়েমির হাত থেকে রেহাই পেলুম। তবে কেন কাঁদব? ওদের আশা পূরণ করতে কেন কষ্ট করব!

উঁকি দিলেই পর্দার ভিতরটা দেখা যায়। সন্তোষ না দেখে বারান্দায় বেরিয়ে এল। এবার হাঙ্গামা অনেক। আগে সার্টিফিকেটটা নিতে হবে, শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কলকাতায় চেনাশোনা কেউ নেই। কারুর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

সবই ভগবানের হাত।

চমকে উঠল সন্তোষ। বইওয়ালা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। পাশ দিয়ে যাবার সময় আচমকা কথাটা বলেছে।

হ্যাঁ, চেষ্টার তো ত্রুটি হয়নি। বহুদিন ভুগল।

কী হয়েছিল?

টিউমার, দু-বার অপারেশন হয়েছে, ধকলটা সামলাতে পারল না।

সন্তোষ বারান্দার বাইরে তাকাল। পুরো বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘেরা। কেন, রোগীরা যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে! মরাটা কি ভগবানের হাতে? হ্যাঁ তো বললুম, না ভেবেই বললুম। অমন না ভেবে আমরা অনেক কথাই বলি! আমার এখন মুখের ভাব বিষণ্ণ করা উচিত। নয়তো লোকটা কিছু মনে করতে পারে। কিন্তু যদি না করি তাহলে কী হয়। আজ বৃষ্টি হবে। না হলেই ভালো। ক-টা বাজল? যত রাত হবে ততই অসুবিধে। কলকাতাটাকে তো দিনের বেলাতেই ধাঁধা মনে হয়।

বাড়িতে আর কে আছে?

কেউ না! শুধু একটা বছর চারেকের বাচ্চা!

মুখের চুকচুকানি শব্দটা শুনতে বেশ লাগে। লোকটা সত্যিই বেশ ভালো। একটা বই কিনে সাহায্য করা উচিত। বইওয়ালার হাত থেকে সন্তোষ একটা পত্রিকা তুলতে যাচ্ছিল। খপ করে বইওয়ালা কেড়ে নিল। সন্তোষের হাত দুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, শান্ত হোন। ছেলের মুখ চেয়ে বুক বাঁধুন! অস্থির হলে কি চলে?

নাড়টা এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠিকই বলেছে বইওয়ালা। ছোটো ছেলে, ওকে এখনই খাইয়ে দেওয়া উচিত। হাঙ্গামা চুকতে ক-টা বাজবে কে জানে!

কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না! কলকাতায় চেনাশোনা তো কেউ নেই।

চারটে লোকও নেই?

না, কারখানায় ছুটি হয়ে গেছে। এখন আর সেখানেও কাউকে পাব না।

তাহলে তো সৎকার-সমিতিতে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

লোকটা ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছে এরপর করণীয় কাজগুলোর। অনেক কাজ। কিন্তু এখন যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে কী হয়! ওরা অপেক্ষা করবে, আমার বাড়িতে খবর দেবে। না এলে গাদায় ফেলে দেবে।

সঙ্গে টাকা আছে তো?

আছে।

আর দেরি করবেন না।

হ্যাঁ যাচ্ছি।

হাঁটতে শুরু করল সন্তোষ। কালকেই বুঝেছিলাম ও আর বাঁচবে না। আজ পোস্টাপিস থেকে টাকা তুলে রেখেছি। সেভিংসের লোকটা খচ্চর। একেবারে কোনো সময়েই সই মেলে না। আজ মিলে গেছে। বোধ হয় ওর মেজাজ ভালো ছিল। বইওয়ালা জিজ্ঞেস করল সঙ্গে টাকা আছে কি না। যদি বলতুম নেই, তাহলে কি ও দিত! নিশ্চয় দিতে পারত না। ও কি আমায় আশ্বস্ত করতে চাইল? না কি পরে একসময় একথা বলেছি বলে নিজেকে বিবেকবান ঠাউরে আনন্দ পাবে।

বাবা।

তুই এখানে এলি কেন?

সিঁড়ির শেষ ধাপে সন্তোষ দাঁড়িয়ে। দারোয়ান তাকিয়ে আছে, ওর একটা হাত নাড়ুর। কাঁধে। সান্ত্বনা দিচ্ছিল। অথচ ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল।

আমি ওপরে যাব।

কেন?

মাকে দেখতে চায় ছেলেটা। দেখে কী করবে। চোখ উলটে আছে হয়তো, কিংবা জিভটা ঝুলে আছে। ঠোঁট চাটা অভ্যেস। রেগে গিয়ে যখন কথা বলতে পারে না তখন ঠোঁট চাটে। মরার সময় হয়তো রেগে উঠেছিল। বুক পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল তো! কিন্তু রাগার সঙ্গে বুকের কী সম্পর্ক, সে তো মাথার।

বাবা, দেখতে যাব।

কী দেখবি? দেখার আর আছে কী?

নাড়ুর কাঁধে হাত রেখে সন্তোষ হাঁটতে শুরু করল। অন্ধকার হয়ে আসছে। যারা রোগী দেখতে এসেছিল ফিরে যাচ্ছে। নার্সেস কোয়ার্টারে কেউ গান গাইছে। আউটডোরের দরজায় কাতরাচ্ছে মাঝবয়সি এক সধবা। হাতের তিনটে আঙুল ঘেঁচে গেছে।

ট্রামরাস্তা পার হয়ে ওরা তিনটে হোটেল পেল।

নাড়ু, কিছু খেয়ে নিবি নাকি?

খিদে নেই!

পরে পাবে, খেয়ে নিলে হত।

না, খিদে নেই।

নাড়ু তুই এখানে থাক। আমি সৎকার-সমিতির অফিসে যাচ্ছি, এখুনি ফিরব। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে সন্তোষ কথাগুলো বলল।

এক প্যাকেট সিগারেট কিনি।

মা তোমায় সিগারেট খেতে বারণ করেছিল।

থমকে পড়ল সন্তোষ। ছেলেটা মনে করে রেখেছে। ওর সামনেই একদিন কথা হয়েছিল বটে। মরার সঙ্গে স্মৃতির একটা যোগ আছে। পুরোনো মানেই তো মৃত। স্মৃতিও তাই। স্মৃতি জ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলে। কী দরকার পুরোনো কথা মনে রাখার! রাত্রে অপারেশন হয়েছিল। সারারাত গেটে বসেছিলুম। ভোর বেলায় দারোয়ানকে বলেছিলুম একটু খবর এনে দিতে। ও যেতে রাজি হয়নি। ঝগড়া হয়েছিল। আমাকে আটকেছিল, ভেতরে যেতে দেয়নি। গালাগালি দিয়েছিলুম। কিন্তু এখন ও আর আমায় আটকাবে না। এখন আর ওর ওপর রাগ নেই, কিন্তু সেদিন অসম্ভব রেগে হাঁটতে শুরু করি। রাস্তায় তখন জল দিচ্ছিল। দাঁড়ালুম, পাশে ছিল সিগারেটের দোকান। সাড়ে তিন বছর পর খেলুম পর পর তিনটে।

সিকিটা পালটে দাও ভাই।

প্যাকেট খুলতে খুলতে সন্তোষ পিছনে তাকাল। বুকের অসুখ এখনও সারেনি। বেশি জোরে টান দেওয়া ঠিক নয়। ওর ভয় ছিল সিগারেট খেলে আমি শিগগিরই মরে যাব। কিন্তু ও-ই আগে মরল। বেঁচে থাকতে খাইনি, আমার নিজের মরার ভয়ে না ওর কথা রাখতে!

বাবা!

তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমার বেশি দেরি হবে না।

জোরে জোরে টান দিয়ে সন্তোষ সিগারেটটা ফেলে দিল। বাসটা এসে গেছে।

তুই থাক, কেমন।

আকাশটা মেঘলা। মাথা নীচু করে নাড়ু আস্তে আস্তে হাঁটল। মা বলত, নাড়ু বৃষ্টি হবে, ইশকুল যাসনি। বলত, তোর বাবার গেঞ্জিটা এখনও শুকোল না, এসে রাগ করবে। তোর বাবা পোস্তর বড়া খেতে ভালোবাসে, লক্ষ্মীটি চট করে কানাইয়ের দোকান থেকে ঘুরে আয়।

ইটের টুকরোটায় শট মারল নাড়ু, রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পড়ল। ওটা যদি ট্রামলাইনের ওপর পড়ত তাহলে ট্রামটা গুঁড়িয়ে দিয়ে যেত। ট্রামের তার থেকে অমন বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে কেন! মা বলেছিল আকাশের বিদ্যুৎকে মেশিনে জমা করে রাখে। তাই থেকে খরচ হয়। বিদ্যুৎ চমকায় শুধু বর্ষাকালে, তাও মাঝে মাঝে। ওইটুকুতে সারা বছর এত আলো হয় কী করে? সেই ছেলেটা আমায় জিভ ভেঙিয়ে গেছে। ওর মা যদি জানতে পারে তাহলে কি বকবে?

মাথা নীচু করে হাঁটতে হাঁটতে নাড়ু হাসপাতালের মধ্যে ঢুকল। চুপচাপ। থমথমে। আউটডোরে গল্প করছে দুটি ছাত্র। সধবাটির হেঁচা আঙুলে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে কম্পাউণ্ডার। একটা বেড়াল ঢুকল। গোড়ালি ঠুকল একজন। বেড়ালটা বেরিয়ে গেল। হাফ প্যান্টপরা ওয়ার্ডবয় দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমোচ্ছে। এই বাড়িটা ছাড়িয়ে আর একটা রাস্তা। নাড়ু রাস্তায় নামল।

গন্ধ আসছে। ওষুধের গন্ধ। কুনিপিসির ছেলে হবার সময় এমন গন্ধের ওষুধ এসেছিল। মা দু-রাত্তির ওদের বাড়ি ছিল। কুনিপিসি মরে গেল, সবাই কাঁদলে মাও কাঁদল। কুনিপিসি বাবার বোন নয়, পাশের বাড়িতে থাকে। বাবা কাঁদল না।

এসো খোকন, এখানে বসো।

দারোয়ান নাড়কে ডাকল। গুটিগুটি ওর পাশে নাড়ু দাঁড়াল। ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে চুপ করে বসে রইল দারোয়ান। ছড়াৎ করে লিফটের দরজা খুলল। খট খট করে চলে গেল এক ডাক্তার।

ওপরে যাবে, দেখতে?

চুপ করে রইল নাড়ু।

যাও।

দারোয়ান পিঠে হাত রেখে চাপ দিল। পায়ে পায়ে নাড়ু সিঁড়ির দিকে এগোল। জুতোর শব্দ হচ্ছে ঠিক ওই ডাক্তারের মতো। জুতো কিনতে যাবার সময় মা বলে দিয়েছিল ফিতেওয়ালা কালো রঙের জুতো কিনতে। বাবা মা-র জন্য একটা চটি কিনেছিল, কালো রঙের।

খোকা দাঁড়াও, উঠে এল দারোয়ান। লিফটে চড়বে?

নাড়ু ঘাড় কাত করল।

এই জগদীশ, খোকাকে দোতলায় নিয়ে যা।

নাড়ু লিফটের মধ্যে ঢুকল। বোতাম টিপতেই গোঁওও শব্দ উঠল। ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট উঠতে শুরু করল। দারোয়ান হাসছে। ওর জুতো, হাঁটু, পেট, মাথা দেয়ালে ঢাকা পড়ে গেল। বুক শিরশির করছে। সেই চৌকো লোহাটা এখন নীচে নেমে আসছে। পেটের নীচে ব্যথা করছে। মা রোজ রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে নর্দমায় বসিয়ে দিত। মা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, নইলে ঘুমের ঘোরে পড়ে যেতুম।

লিফট থামতে নাড়ু বেরিয়ে এল। লিফট আবার নীচে নেমে গেল। চৌকো লোহাটা ওপরে উঠতে উঠতে থেমে গেল। লোহার দড়িটা কাঁপছে। যদি দড়িটা ছেড়ে। নাড়ুর বুক কাঁপল, বাজ পড়ার শব্দে এমন করে বুক কাঁপত। ছুটে মাকে জড়িয়ে ধরতুম।

বারান্দা ধরে নাড়ু হাঁটতে শুরু করল। কেবিনে একটা লোক খাটে শুয়ে বই পড়ছে। বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘেরা। পাখিরা আসতে পারবে না। জুতোর শব্দ হচ্ছে। রোগীরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। একেবারে শেষের দরজায় নাড়ু দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে চেয়ারে বসে নার্স কী লিখছিল। ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েও আবার বসে পড়ল।

আঙুলে ভর দিয়ে নাড়ু ঘরে ঢুকল। সবাই দেখছে। মাথা নীচু করে লাল পর্দা-ঘেরা খাটের পাশে না দাঁড়াল। এবার কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু রোগীদের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।

এইটিই তো আসত বাপের সঙ্গে।

হাঁ। একটি ছেলে।

তবু রক্ষে, মাত্র দুটি। আমার মতো হলে বাপের অবস্থাটা ভাবুন তো!

ভাবব আর কী, আবার বিয়ে করবে।

ইস, অতই সোজা!

সাদা চাদরে মুখ পর্যন্ত ঢাকা। নাড়ু সাবধানে চাদরটা গলা পর্যন্ত নামিয়ে দিল। চোখ বোজানো। মুখটা একটু ফাঁক করা। চোখের কোলে কালি। নাড়ু দাঁড়াল, চোখের পাতা যেন ভিজে ভিজে। কেঁদেছিল।

চাদর দিয়ে নাড়ু চোখ মুছিয়ে দিল। কপালটা চওড়া দেখাচ্ছে। চুলগুলো পাতলা হয়ে গেছে। জট পড়েছে। কমলাদি মাঝে মাঝে খোঁপা বেঁধে দিত, এখন যদি আঁচড়ে দিই তাহলে কি নার্স এসে আমায় বকবে?

খাটের লাগোয়া ছোট্ট আলমারিটা নাড়ু খুলল। চিরুনি, সিঁদুরকৌটো, আয়না, সাবান, মাজন, তেলের শিশি। সবগুলো এক বার হাতে করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কান পাতল, নার্সের জুতোর শব্দ শোনা যায় কি না।

উনিও বলেন, গানের মধ্যে রবীন্দ্র সংগীতই সবথেকে ভালো। এখানে একটা রেডিয়ো থাকলে বেশ হত।

যাট নম্বর বেডের মেয়েটি গান জানে, ডাকুন-না।

আপনি যান, কাল একটা বই চেয়েছিলুম, দেয়নি।

খস খস শব্দ হল। অনেক দিনের জট, চিরুনি আটকে যাচ্ছে। মাথাটা নড়ে উঠতেই ফ্যাকাশে মুখ করে নাড়ু তাকিয়ে রইল।

চুলের গোছা আঙুলে পাকিয়ে মা চুল আঁচড়াত। না হলে মাথায় খুব ব্যথা লাগে। চুলগুলো সব পিঠের তলায়।

মৃতের কাঁধ ধরে নাড়ু তুলতে গেল। মাথাটা কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল বালিশে। খট খট জুতোর শব্দ আসছে। তাড়াতাড়ি মাথাটা সিধে করে চাদর টেনে দিল। পিছিয়ে আসার সময় থলিতে পা লাগল।

দুটো পেয়ারা গড়িয়ে পড়ল। থলিটা তুলে নিল নাড়।

তুমি একা যে, বাবা কোথায়? এখানে আর থেকো না, বাইরে গিয়ে বোসো।

নার্স ওর কাঁধে হাত রেখে ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। নাড়ু মাথা নামিয়ে হেঁটে গেল বারান্দা ধরে। নীচে নেমে দেখল দারোয়ানের টুল খালি। আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন।

সন্তোষ আর সৎকার-সমিতির ছাইরঙা পোশাকপরা লোকটি গাড়ির মধ্যে স্ট্রেচারটা তুলে দিল। ডালা দুটো বন্ধ করতেই গাড়ির পিছনটা একটা টিনের বাক্স হয়ে গেল। ড্রাইভার আর সমিতির দুজন লোক বসল সামনের সারিতে, পিছনে সন্তোষ আর নাড়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় পড়তেই সন্তোষ বলল, দেরি হয়ে গেল। গাড়ি ছিল না, তাই বসেছিলুম।

রাস্তার দিকে মুখ ফেরাল নাড়। পাশ দিয়ে ট্রাম যাচ্ছে। সমান সমান যাচ্ছে। ঘণ্টা পড়ল। ট্রামের গতি মন্থর হল। নাড়ু হাসল।

বাবা, ট্রামগাড়ি মোটরের সঙ্গে পারে না?

ওকে যে থামতে থামতে যেতে হয়, তোক উঠবে নামবে—তবে তো!

সন্তোষ আড়চোখে তাকাল এক বার। জ্বলজ্বল করছে ছেলেটার চোখ। গোগ্রাসে বাইরের সব কিছু যেন গিলছে।

দোকান, আলো, মানুষ। সমিতির আপিসের কেরানিটি বেশ গপ্পে লোক। ফোন করে ডাকলে ওরা যায় না। অনেক বার গিয়ে বাকি ঠকেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকানা দেওয়া হয় বিয়েবাড়ির। ঠাট্টা করা আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। নাড়ু তখন ছ-মাসের। মুখে রুমাল বেঁধে ডাকাত সেজে এক বার ওর মাকে ভয় দেখিয়েছিলুম। তারপর থেকে রোজ খিলটা খুলেই ছুটে ঘরের মধ্যে পালাত। এক বারও দেখত না কে কড়া নেড়েছে। মাস কয়েক পরেই ও ভুলে গিয়েছিল ব্যাপারটা। ঠাট্টা জিনিসটাই এমন। নাড়ু এখন বাইরে তাকিয়ে। ভুলে গেছে হাত কয়েক পিছনেই ওর মা রয়েছে। ও কি এটাকে ঠাট্টা ভেবেছে? মরাটা কি ঠাট্টা? তাই যদি হয় তাহলে বাঁচাটাও কি তাই? ঠাট্টা মানুষ ভুলে যায়। বাঁচাও কি ভোলে? তাহলে কি আমি বেঁচে নেই?

চমকে উঠল সন্তোষ। গাড়িটা একটা গর্তে পড়েছিল। ঝনঝন করে উঠেছে পিছনের বাক্সটা। তালু দিয়ে পিঠের টিনের পাতাটাকে সে ছুঁল। কনকনে ঠাণ্ডা। এর মধ্যে একটা মড়া আছে। মড়াটা ঝাঁকুনিতে নিশ্চয় নড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে ঠাট্টা কোথায়! চিরজীবন কি এই মড়াটাকে পিছনে নিয়ে আমায় বুঝতে হবে যে বেঁচে আছি?

ট্রাফিক-আলোর নির্দেশে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ খলবল করে নাড়ু বলল, বাবা, সেই ট্রামটা!

তুই বুঝলি কী করে?

বা রে, ওই মোটকা লোকটা যে তখনও বই পড়ছিল।

ছেলেটা ভুলে গেছে পিছনেই একটা মড়া চলেছে। সন্তোষ ড্যাশবোর্ডের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে রইল। অপরিণত মনই পারে জীবন-মৃত্যুর কথা ভুলতে। ওরাই কিন্তু সুখী হয়। সুখের জন্য আমি কি এই মুহূর্তগুলোকে ভুলে যাব? যদি যাই তাহলে ক্ষতি কী!

বাবা, এ রাস্তাটার নাম কী?

সন্তোষ চুপ করে তাকিয়ে রইল বাইরে। চিকচিক করছে রাস্তা। জলে আলো পড়েছে। বৃষ্টি হয়েছে। কাঠগুলো ভিজে থাকবে। ধোঁয়া হবে, চোখ জ্বলবে। পুড়তে দেরি হবে। শুয়োরের বাচ্চা এই বৃষ্টিটা!

বাবা, বৃষ্টি নামলে ওই বইওয়ালারা কী করে?

তেরপল দিয়ে ঢেকে দেয়।

কাঠগুলো কি খোলা জায়গায় রাখে? ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করলেই পারে, করলে কত সুবিধে হয়। হাঙ্গামা বাঁচে। খাটুনি বাঁচে। এখন হয়তো সারারাত চিতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।

বাবা—

চুপ কর দিকিন।

গাড়িটা মেডিকেল কলেজের গেট পার হল। এখান থেকে আর একটা মড়াকে তুলে নেওয়া হবে। পাশবালিশের মতো একটা পুটলি নিয়ে দুটো লোক অপেক্ষা করছিল। পুঁটলিটাকে পিছনের বাক্সে তুলে দিয়ে তোক দুটো সন্তোষের পাশে বসল। এবার গাড়িটা সোজা শ্মশানে যাবে।

সামনের সিটে সৎকার-সমিতির লোক দুটো মাঝে মাঝে কথা বলছে। সন্তোষ ওদের কথায় কান পাতল। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ছে আর প্যাচপেচে বর্ষায় ধোপারা কাপড় দিতে দেরি করে। সন্তোষ বাইরে মুখ ফেরাল।

উনি আপনার কে হন?

স্ত্রী।

আমার ভায়ের মেয়ে। এর আগে দুটিকে শ্মশানে দিতে হয়েছে। বেচারা একদম ভেঙে পড়েছে।

মুখ ফেরাল সন্তোষ। ওপাশের লোকটি গাছের গুঁড়ির মতো বসে। রাস্তার আলোর জ্বলজ্বল করছে চোখ। চোখের নীচে ভাঁজগুলো ঠিক কাকের মতো। ওর চোখ ফুটে যদি এখন দুটো কাকের ছানা বেরিয়ে আসে, কেমন হয়। চিৎকার করবে, মুখের লাল গর্তটা দেখা যাবে। নাড়ুর মা-র পেটের ব্যাণ্ডেজটা কালো হয়ে গেছে।

হঠাৎ গাড়িটা কাঁপতে শুরু করল। ট্রামলাইন সারানো হচ্ছে। রাস্তা খোঁড়া হয়েছে। সন্তোষ কান পাতল, পিছনে যেন একটা শব্দ হচ্ছে। পুটলিটা বোধ হয় গড়িয়ে গেল। ওর মধ্যে একটা বাচ্চা আছে? বাচ্চাটা গড়িয়ে নাড়ুর মা-র কোলের কাছে যাবে কি? ছেলেপুলে খুব ভালোবাসে। হাত বাড়িয়ে পুঁটলিটাকে বুকে চেপে যদি আদর করে।

গাড়িটা কাঁপছে। সন্তোষও কাঁপছে। খপ করে নাড়ুর হাতটা সে আঁকড়ে ধরল। নখ বসে গেল। হাতটা মুচড়ে ছাড়াতে চাইল নাড়। উলটো পাকে সন্তোষ চেপে থাকল। কিসকিস করে উঠল তার কষের দাঁত। নাড়ু অস্ফুট শব্দ করল।

সমান রাস্তায় পড়তেই গাড়ির কাঁপুনি থেমে গেল। সন্তোষ হাতটা ছেড়ে দিল। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, তোর ভয় করছে?

না।

আমারও না।

গাড়িটা দশটার কেরানির মতো শ্মশানের দিকে ছুটছে। হাওয়া আসছে। সন্তোষ চোখ বুজল। পাশের লোক দুটো জবুথবু হয়ে রয়েছে। নাড়ু রাস্তার মানুষ আলো দোকান দেখছে।

উবু হয়ে বসে আছে সন্তোষ। মোটা গুঁড়িগুলো পাতা হয়েছে। চ্যালাকাঠ চৌকো ছকে তার ওপর সাজানো হচ্ছে। নাড়ু দেওয়ালের লেখা পড়ছে। কাঠকয়লায় লেখা মৃতদের নাম আর ঠিকানা। দু-চার লাইনের পদ্যও আছে। পড়তে পড়তে নাড়ু দূরে সরে গেল। ছোট্ট চিতাটা জ্বলছে।

তোমাদের শেষ হতে সেই দুপুর রাত।

দুজন লোকের একজন বলল। চুপ করে রইল নাড়। লোকটা কিছুক্ষণ নাড়ুর দিকে তাকিয়ে পাশের গুম-মেরে-থাকা লোকটিকে বলল, তুই এক বার তারকেশ্বরে যা, কত লোকেরই তো মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছে। আর নয়তো বল, সুকুমারের বোনের সঙ্গে সম্বন্ধ করি, ওদের বাড়ির মেয়েরা এক-একটা আট-বিয়োনি, ছ-বিয়োনি।

হু হু করে চিতাটা জ্বলছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট একটা কচি মুখ। নাড়ু সরে দাঁড়াল। উনুন ধরাবার সময় মা-র চোখ দিয়ে জল পড়ত। পেঁয়াজ কাটার সময়ও জল পড়ত। মা-র নাম আর ঠিকানা যদি দেওয়ালে লিখি তাহলে কি কেউ বকবে? এ দেওয়ালটা কাদের? কাঠ কেনার সময় বাবা যাদের পয়সা দিল, তাদের কি? নাম লিখতে কি পয়সা লাগবে? বাবার কাছে পয়সা চাইলে বকবে। বাবা কাঁদেনি, ওই লোকটা কাঁদছে। ধোঁয়ার জন্য কাঁদছে কি? কিন্তু ওখানে তো ধোঁয়া নেই। আমি কেঁদেছিলুম। আমি মাকে ভালোবাসি।

সন্তোষ একইভাবে বসে ছিল। চিতা সাজানো হয়ে গেছে। এধার-ওধার তাকিয়ে সে নাড়কে ডাকল। চিৎকার করে ডাকল। দেওয়াল ঘেঁষে অন্ধকার দিকটায় নাড়ু সরে গেল। তিনটে লোক দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে। ওদের এড়িয়ে নাড়ু আরও

অন্ধকারে পাঁচিলের ধার পর্যন্ত চলে এল। পাঁচিলের পরেই গঙ্গা।

চিৎকার আসছে। নাড়ু পাঁচিল আঁকড়ে দাঁড়াল, যাব না। কিছুতেই না। এখানকার গন্ধ ভালো লাগছে না। গরম লাগছে। মানুষগুলো সব কেমন কেমন। এখানে থাকব না, দেওয়ালে মা-র নাম লিখব। লুকিয়ে লিখব।

সন্তোষ খুঁজতে খুঁজতে নাড়ুর কাছে এল। নরম সুরে বলল, আয় নাড়ু, এখানে থাকিসনি!

ওরা সাজানো চিতার কাছে এল। সমিতির লোকেরা মৃতদেহটা মাটিতে নামিয়ে দিয়ে গেছে। সেইভাবেই এতক্ষণ পড়ে আছে। তবে পরনের কাপড়টা সন্তোষ বদলিয়ে একটা কোরা থানে ঢেকে দিয়েছে।

পায়ের দিকটা তুই ধর, তুলে দিই।

মৃতের কাঁধ ধরে সন্তোষ তাকাল। নাড়ু ইতস্তত করছে। চিতা সাজানোর ডোম নাড়ুর পাশে দাঁড়াল।

ভয় কী খোকাবাবু, এ তো হালকা লাশ আছে।

গোঁজ হয়ে নাড়ু দাঁড়িয়ে রইল। ডোম হাসল। সন্তোষকে লক্ষ করে বলল, কষ্ট হচ্ছে? হবেই তো।

তুমি একটু ধরো তো ভাই।

সন্তোষ কাঁধটা মাটি থেকে খানিকটা তুলে ধরে তাকিয়ে রইল ডোমের দিকে। নাড়ু অস্বস্তি বোধ করল। কেমন শক্ত চোখে বাবা তাকাচ্ছে। রেগে গেলে অমনভাবে তাকায়, নিতুদের নতুন চুনকাম করা দেওয়ালে ছবি এঁকেছিলুম বলে নালিশ করেছিল। বাবা তখন ওইভাবে তাকিয়েছিল। মা জড়িয়ে ধরেছিল তাই লাঠির ঘা পিঠে পড়েনি। মা-র হাতে কালশিরে পড়েছিল। কাচের চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল। ডোমটা মা-র পা দুটো আঁকড়ে ধরেছে। ঝড় জমাদার ছুঁয়ে দিয়েছিল বলে মা চান করেছিল। বাবা ঝড়কে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। একে বাবা নিজে থেকে ডেকেছে।

সরো, আমি ধরছি।

মৃতের পা-দুটো নাড়ু প্রায় ছিনিয়ে নিল। ডোম হেসে সরে দাঁড়াল। হালকা দেহটা অনায়াসেই চিতায় উঠল। শুধু সাজানো কাঠগুলো এক বার খচমচ করল। কতকগুলো কাঠ মৃতের বুকের ওপর ডোম চাপিয়ে দিল।

নাড়ু আয়, মুখে আগুন দিবি।

সন্তোষ হাতে-মাথায়-কপালে ঘি মাখিয়ে দিল। অল্প আলোতে চুলে-লেগে-থাকা বনস্পতির গুঁড়ো গুড়ো দানাগুলো আকাশের তারার মতো দেখাচ্ছে। চিতা জ্বলে উঠলেই চুলের সঙ্গে ওগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তুলো পাকিয়ে একটা সলতে তৈরি করে সন্তোষ মৃতের ঠোঁটের ওপর রাখল। নাড়ু কাছে আয়।

দেশলাই জ্বেলে সন্তোষ কাঠিটা নাড়ুর হাতে দিল। নিভে গেল কাঠিটা। আর একটা জ্বালতে গেল, জ্বলল না। চারটে কাঠি নষ্ট হতেই বিরক্ত হল সে। ঝিরঝিরিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েই থেমে গেল। ছোট্ট চিতাটা এখনও জ্বলছে। ছুটে গিয়ে সন্তোষ দেশলাইটা সেঁকে আনল। কাঠি জ্বেলে নাড়ুর হাতে তুলে দিয়ে আড়াল করে ধরল।

এক পলকের জন্য নাড়ু সন্তোষের মুখে তাকাল। ঠোঁট দুটো তেলতেলা। ফু দিয়ে যদি নিভিয়ে দিই কাঠিটা? তাহলে ধরে ফেলবে, মারবে!

হয়তো নিজেই আগুন দিয়ে দেবে। মা-র মুখে ছেলেদেরই আগুন দিতে হয়, নয়তো পাপ হয়।

সলতেটা জ্বলে উঠতেই নাড়ু কাঠিটা ফেলে দিল। মড়মড় করে পাটকাঠি ভাঙছে ডোম। পিছিয়ে গেল নাড়।

কতক্ষণ লাগবে পুড়তে?

ঘণ্টা তিন-চার।

কাঠ ভিজে নেই তো, যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ক-দিন ধরে!

নাড়ু হাঁটছে। দুপাশে সার-দেওয়া মাটিখোঁড়া জমি, দুটো নিবুনিবু চিতার পাশে জটলা করছে কতকগুলো লোক। মাঝখানে পথটা সিধে গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। সিঁড়ির মাথায় এসে নাড়ু দাঁড়াল। শ্মশানের আলোয় জল দেখা যাচ্ছে। জল চিকচিক করে কাঁপছে। হাসলে মা-র গোটা শরীরটা অমন কাঁপত। আমার গঙ্গায় চান করতে ইচ্ছে করছে।

হ্যাই, তোজো, হিটলার, সবকোই ফল-ইন হো যাও। হাম গোলি করেঙ্গা।

গলায় শালপাতা-জড়ানো লোকটা বীরদর্পে আকাশের দিকে আঙুল তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।

টে–ন শন।

পা জোড়া করে, গটগটিয়ে লোকটা কুন্ডলী-পাকানো কুকুরটাকে লাথি কষাল। কুকুরটা ছুটে পালাতেই সে ঘুরে দাঁড়াল নাড়ুর দিকে। নাড়ু ছুটে পালিয়ে এল সন্তোষের পাশে। চিতা ধরে গেছে। আধপোড়া পাটকাঠিগুলো গুঁজে দিচ্ছে ডোম।

কোথায় গেছলি?

ওইদিকে, গঙ্গা দেখছিলুম।

একা যাসনি, মাতাল-গেঁজেলরা আছে।

একটানা সুর করে কিছু পড়ার শব্দ আসছে। অনেক লোক একসঙ্গে পড়ছে। উবু হয়ে সন্তোষ দেখছে ডোমের কাজ। মাংস পোড়ার গন্ধ।

আবার কোথায় যাচ্ছিস?

নাড়ু থেমে গেল। সেখান থেকেই বলল, এদিকে গান গাইছে।

না, যেতে হবে না, এখানে থাক।

নাড়ু সন্তোষের কাছে এসে দাঁড়াল। কাঠের ফাঁক দিয়ে আগুন উঠছে। কুঁকড়ে গুটিয়ে গেল চুলগুলো। মুখটা দেখা যাচ্ছে। চোখ-বোজানো। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক-করা। হাতের আঙুল কালো হয়ে উঠেছে। গোড়ালি দুটো ভারী দেখাচ্ছে। একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মাথার কাছে এক ঝলক আগুন হুস করে ঠেলে উঠল।

নাড়ু চোখ ফেরাল। সন্তোষকে আড়চোখে দেখল। চোখ দুটো যেন ঘুমে ভারী। অমন চোখ করে পুজোর সময় বাবা যাত্রা দেখে! মা থাকে চিকের আড়ালে। কৌটো-ভরতি পান না থাকলে মা যাত্রা দেখতে পারে না।

একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। আগুনের আঁচ লাগল নাড়ুর গায়ে।

কোথায় যাচ্ছিস?

ওইদিকে।

না।

হাতের মুঠো শক্ত করে নাড়ু তাকিয়ে রইল। উঠে দাঁড়াল সন্তোষ। চিতার আলোয় তার চোখ জ্বলছে।

তুই এখান থেকে বার বার পালাচ্ছিস কেন?

নাড়ুর কাঁধে নাড়া দিল সন্তোষ। পুট পুট শব্দ হচ্ছে। চিতার পাশে দাঁড়-করানো একটা কাঠ পড়ে গেল।

কথা বলছিস না কেন? মন খারাপ করলে কি মা বেঁচে উঠবে? অমন অনেক কষ্ট আসবে জীবনে, সইবি কী করে!

বলো হরি–হরিবোল।

চমকে ওরা মুখ ফেরাল। অনেকগুলো মানুষ ঢুকল শ্মশানে। আথালিবিথালি কাঁদছে এক মাঝবয়সি বিধবা। কয়েক জন তাকে ধরে নিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। ওদের পাশ দিয়েই খাটটাকে বয়ে নিয়ে গেল। ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধে ঝেঁঝে উঠল জায়গাটা। সন্তোষ মুখ ঘুরিয়ে নিল। সিঁড়ির কাছ থেকে কান্নার রেশ আসছে।

হাওয়াটা এমন বিদঘুটে বইছে…

চিতার ওপর ঝুঁকে সন্তোষ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আবার বলল, আগুন সব মাথার দিকে উঠে এসেছে। পা দুটো এখনও ধরল না।

বাবা আমি দেয়ালে নাম লিখব।

কী লিখবি?

চোখাচোখি হল ওদের। পা দিয়ে এক টুকরো জ্বলন্ত কাঠকে চিতায় ঠেলে সন্তোষ বলল, কী হবে লিখে, কালকেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে।

পাগলটা চিৎকার করছে। বিধবার কান্না শোনা যাচ্ছে। মৃতদেহ নামিয়ে লোকগুলো চাপা স্বরে জটলা করছে। সারা শ্মশানে মাংস পোড়ার গন্ধ চারিয়ে রয়েছে। বাইরে রেলইঞ্জিন হঠাৎ হুইসল দিল।

নীচু হয়ে নাড়ু একটা ফুল তুলে নিল। এইমাত্র খাট থেকে পড়ে গেছে। সন্তোষের নজর এড়ায়নি। হাত বাড়াল সে। নাড়ু হাত মুঠো করে পিছনে রাখল।

কী করবি ওটা নিয়ে?

বাড়িতে নিয়ে যাব।

কেন?

আমি গঙ্গায় দেব।

না, গঙ্গার কাছে যেতে হবে না।

আমি চান করব।

না, অসুখ করবে।

সন্তোষ উঠে দাঁড়াল। নাড়ু পিছিয়ে গেল। পিছনে দেওয়াল। সামনে জুড়ে সন্তোষ এগিয়ে আসছে। থমকে গেল। কুকুরটা নাড়ুর গা ঘেঁষে আসতেই তাড়াতাড়ি একটা ঢিল কুড়িয়ে নিল। মেরো না খোকা, ও কামড়াবে না।

শ্মশানের গেটের কাছে শোয়া লোকটা শুয়ে শুয়েই বলল, আজ সকালেই ওর বাচ্চাটা রেলে কাটা পড়েছে। ওকে মেরো না।

পাগলা একদৃষ্টে তাকিয়ে। সন্তোষ নাড়কে আগলে শক্ত হয়ে দাঁড়াল।

অ্যাই ক্যাপ্টেনসাব, ইধার আও।

গেটের কাছে শোয়া লোকটা পাগলকে ডাকল। মিলিটারি কায়দায় ঘুরে পাগল সেলাম করল। গটগট করে লোকটার কাছে গিয়ে হাত পাতল। মাটি থেকে একটা ঢিল তুলে লোকটা ওর হাতে দিতেই সেলাম করে পাগল চলে গেল সিঁড়ির দিকে। আচমকা ইঞ্জিনের হুইসল বাজল। মালগাড়ি শান্টিং-এর শব্দ আসছে।

ভয় পেয়েছিলি?

চিতার একধারটা ধসে পড়ল। ওঁড়োগুঁড়ো ফুলকি উড়ছে। আগুন গোলাপি হয়ে উঠেছে।

আমাদের ভাগ্যি ভালো এখনও বৃষ্টি নামেনি।

টেনে টেনে কান্নার সুর আসছে। মালগাড়ি শান্টিং হচ্ছে। লোহায় লোহায় ঠোকাঠুকি হয়ে কর্কশ শব্দটা গুড়গুড় করে সরে যাচ্ছে এক গাড়ি থেকে আর এক গাড়িতে।

শম্ভুজ্যাঠার দিদি মালগাড়ির তলা দিয়ে পার হতে গিয়ে কাটা পড়েছিল।

নাড়ু চুপ করে থাকল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে সন্তোষ আবার বলল, সকাল হলেই আগে তোর জন্য কোরা কাপড় কিনতে হবে। কিন্তু ডোম ব্যাটা গেল কোথায়? এক বার ডেকে আনবি?

কেন?

মাথাটা বাঁশ দিয়ে ভেঙে দেবে। দেওয়ালের সঙ্গে সিঁটিয়ে গেল নাড়। থরথর করে কেঁপে উঠল ওর গোটা শরীর। ভয় করছে। হাসপাতালের লিফটের সেই চৌকো লোহাটার মতো বাবা যেন নেমে আসছে। অনেকক্ষণ পেচ্ছাপ করিনি। যন্ত্রণা হচ্ছে। খিদে পাচ্ছে। থলিতে পেয়ারা আছে। মা খেতে ভালোবাসে।

দাঁড়িয়ে রইলি যে?

পারব না।

কথা বললে শুনিস না কেন? তখন বললুম, ফুলটা দিতে দিলি না কেন?

আমার ইচ্ছে, আমার খুশি।

নাড়ু চিৎকার করে উঠল। সন্তোষ থ হয়ে গেছে। গোড়ালি আর পায়ের পাতা এখনও পোড়েনি। ফুলে টসটস করছে। হাওয়া দিচ্ছে। আগুন কাত হয়ে মাথার দিকে জ্বলছে।

আমার কথা শুনবি না?

না।

শুনবি না?

না।

থলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নাড়ু একটা পেয়ারা ধরল। বাবা এগিয়ে আসছে। মারব। চৌকো লোহার মতো এগিয়ে আসছে। পালাব। এই শ্মশান থেকে বেরিয়ে যাব। যেদিকে হোক চলে যাব। ছুটব।

আমার অবাধ্য হবি? বল, অবাধ্য হবি?

নাড়ুর হাত মুচড়ে ধরল সন্তোষ। বিকট চিৎকার করে বিধবাটি ছুটে এল। সাজানো চিতায় মৃতদেহটা তোলা হচ্ছে।

ছিটকে পিছিয়ে গেল সন্তোষ। হাতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। শরীর জ্বলে উঠল। ছেলে আমায় ঘৃণা করে। আমি কী অন্যায় করেছি! ও শাস্তি দিতে চায়, অতটুকু ছেলে কী বোঝে দোষ-গুণের। ওকে শায়েস্তা করতে হবে। মারতে হবে। ভীষণ মারব, ওকে কাঁদিয়ে ছাড়ব।

ছুটে এল সন্তোষ নাড়ুর দিকে। জ্বলন্ত চিতাটাকে পাক দিয়ে নাড়ু ছুটল। শ্মশানের গেট পার হয়ে রাস্তায় পড়ল। পিছনে সন্তোষ ছুটে আসছে। দু-ধারে নির্জন রাস্তা গঙ্গার ধার ঘেঁষে সিধে চলে গেছে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনে সারি দিয়ে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। এক লহমা ইতস্তত করে নাড়ু মালগাড়ির তলা দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

নীচু হয়ে গাড়ির ফাঁক দিয়ে সন্তোষ গলে এল। অন্ধকার। এক হাত দূরেই আর একসার ওয়াগন। লম্বা টানা একটা গলি যেন। চিৎকার করে সন্তোষ ডাকল। কান পাতল। সাড়া নেই। আবার চিৎকার করল। সাড়া নেই। টুকরো পাথরের গলিটা এবড়োখেবড়ো। সন্তোষ টলে পড়ছিল। দু-হাত দিয়ে দু-দিকের ওয়াগন ধরে দাঁড়াল।

লোহার লাইনে কাঁপতে কাঁপতে কাছে আসছে একটা শব্দ। অন্ধকারে ফুলকিগুলো ছিটকে উঠছে। ইঞ্জিন আসছে। কোন লাইনে আসছে। সন্তোষ নাড়ুর নাম ধরে চিৎকার করল। কান পাতল। লাইনে গুড়গুড় শব্দটা জোর হচ্ছে। ওপাশে যেন পাথর ছিটকে পড়ার শব্দ হল। নাড়ু কি হাঁটছে? ইঞ্জিনটা কোন লাইন ধরে আসছে? ও যদি ভয় পেয়ে গাড়ির তলা দিয়ে আবার পালাতে যায় আর সেই সময়ই ইঞ্জিন গাড়িতে ধাক্কা দেয়। শম্ভুজ্যাঠার দিদির মুন্ডুকাটা লাশটা কাঁপছিল। কাঠের স্লিপার ক-টায় অনেক দিন পর্যন্ত কালো ছোপ ধরে ছিল। নাড়ুর মা র পেটের ব্যাণ্ডেজটা কালো হয়ে গিয়েছিল। এই গলিটা অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না।

খড়খড় শব্দ হল গাড়ির ওধারে। কেউ যেন কুচো পাথরের উপর হাঁটছে। সন্তোষ উবু হয়ে গাড়ির তলা দিয়ে তাকাল। অন্ধকার। হাত দিল চাকায় নিরেট, ঠাণ্ডা, এটার ওজন কত? আবার যদি নাড়কে ডাকি তাহলে ও ভয় পাবে। আবার পালাতে চাইবে। তার থেকে চুপিচুপি গিয়ে ধরে ফেলি।

সন্তোষ কুঁজো হয়ে এগোল দু-সারি ওয়াগনের মাঝে ফাঁকটুকুর দিকে। হঠাৎ ঝাঁকুনি খেল একদিকের সারিটা। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সন্তোষ। ইঞ্জিনে ধাক্কা দিয়েছে। সারিটা একটু পিছিয়ে গিয়ে থেমে পড়ল।

মাটি আঁকড়ে সন্তোষ শুয়ে আছে। ওর একদিকের সারিটা অনড়। অন্য দিকেরটা চলতে শুরু করেছে। মাটিতে মুখ চেপে শুয়ে থাকল সে, শব্দ হচ্ছে, লোহায় লোহা ঘষার শব্দ। ওধারে নাড়ু এখন কী করছে? পার হতে যদি দেরি হত? মুন্ডুকাটা লাশটা এতক্ষণে কাঁপতে শুরু করত। লাইনে শব্দ হচ্ছে। মালগাড়িগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। পায়ে পিঁপড়ে উঠেছে। মাটিতে সোঁদা গন্ধ। ঘাম জমেছে কপালে। মরে যাচ্ছিলুম। এমনিভাবে মাটি আঁকড়ে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তীক্ষ্ণ শীতল জলের ধারা। ইঞ্জিনটা মালগাড়ি টেনে নিয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াল সন্তোষ। লাইনের ওধারে মাটির ওপরে একটা অন্ধকার জমাট হয়ে রয়েছে। কেউ কাটা পড়েছে কি? টলতে টলতে ছুটে এল সন্তোষ। ওকে দেখে কুকুরটা হাড়-চিবোননা বন্ধ করল। লেজ নাড়ছে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার সে হাড় চিবোতে শুরু করল।

বৃষ্টি পড়ছে। সারা শরীরে বৃষ্টি পড়ছে। কাঁপতে কাঁপতে সন্তোষ লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করল। নাড়ুর মা-র চিতাটা বোধ হয় নিভে গেল।

সন্তোষ নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল।

নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান

ধূসর অ্যাম্বাসাডারটা ফ্যালাকে লক্ষ করেই যোলো হাত চওড়া রাস্তাটায় থামল। ড্রাইভারের আসন থেকে প্রশ্ন হল, এটাই কি ঘোষপাড়া লেন?

বিমূঢ় হয়ে ফ্যালা উঠে দাঁড়াল। প্রশ্নকারী জানলা থেকে মুখটাকে একটুখানি বার করেছে। ফ্যালার আর কোনো সন্দেহ রইল না। অবশ্য কণ্ঠস্বরেই আধখানা চিনেছিল। ঘাড় নেড়ে পাশের গলিটাকে আঙুল তুলে দেখাল।

থ্যাঙ্ক ইউ।

মোটরটা আধখানা ফিরে তাক করতে লাগল গলির মুখটাকে। রিকশা বা ঠেলাগাড়িচালক হলে এত সময় নিত না। ঘোষপাড়া লেনের প্রবেশমুখ সাত হাত চওড়া। ফ্যালার ইচ্ছে করল, হারকিউলিস হয়ে দু-হাতের চাড়ে বাড়িগুলোকে ঠেলে জায়গাটাকে সতেরো হাত করে দিতে।

তা যখন সম্ভব নয়, ফ্যালা যোলো হাত চওড়া রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে বন্ধুদের খুঁজল। কেউ নেই। দোকানে দোকানি, রাস্তায় পথিক। রাস্তাটায় যদিও মাঝে মাঝে প্রাইভেট মোটর আসে, কিন্তু কৌতূহলী হয়ে এখন এক বারও কেউ মুখ তুলে দেখছে না যে গাড়িটা কে চালাচ্ছে। কিংবা দেখেও চিনল না।

সুতরাং ফ্যালা কিছু বিরক্ত হল, কিছু লজ্জা পেল। সর্বসাধারণের এই উদাসীনতা-দোষ স্খলনের জন্য এগিয়ে গিয়ে বলল, ক-নম্বর বাড়ি খুঁজছেন?

তিন। সুনীতি ভটচায। কর্পোরেশন স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।

অঃ, একটুখানি গিয়ে ডান দিকে রকওলা বাড়ি, তার পরেরটা।

গাড়িটা কষ্টেসৃষ্টে ঢুকে গেল। বেশিদূর যেতে পারবে না, কারণ মাস দুয়েক আগে কর্পোরেশন থেকে রাস্তায় একটি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ওখানে গাড়িটাকে রেখে হেঁটে যেতে হবে। ফ্যালা ঘাড় কাত করে থাকল যাবতীয় ব্যাপার লক্ষ করার জন্য।

টিউবওয়েলে স্নান করছিল গোবিন্দ দত্ত। গাড়িটা ওর পিছনেই থামল। জলটা ঠাণ্ডা, তাই মাথায় জল ঢেলে থাবড়ে থাবড়ে আমোদ করছিল গোবিন্দ। ভোর ছটায় বেরিয়ে সন্ধ্যা ছ টায় ফেরা। এসময় তিন নম্বর বাড়িটা কোথায় জিজ্ঞাসা করল। ও যে জল ঢালা থামিয়ে কথার জবার দেবে না, প্রশ্নকারী তা কেমন করে জানবে? সুতরাং দ্বিতীয় বার জিজ্ঞাসা করে গোবিন্দর দাঁতখিচুনি দেখে আর কথা বাড়াল না।

ফ্যালা ছুটে এসে গোবিন্দকে চাপা স্বরে ধমকাল, ও কে জান, অমন করে যে কথা বললে?

গোবিন্দ হকচকাল। ঘাড়ের কাছেই গাড়িটা, ঘাড় ফিরিয়ে এক বার তাকিয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, কে?

কী ভাবল বলোতো, আমাদের পাড়া সম্পর্কে! ফ্যালা তাকিয়ে রইল তিন নম্বর বাড়ি পর্যন্ত চোখ পেতে। বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু কীরকম লজ্জা করল। তবে তিন নম্বরের সদর দরজাটা রাস্তার ওপরেই, নম্বরটাও স্পষ্ট দেখা যায় রাস্তার আলোয়। তিনের এক কি তিনের দুই হলে নিশ্চয়ই সঙ্গে যেত।

শেফালিদের বাড়িটা এক-তলা, ছাদে পাঁচিল নেই। সন্ধ্যার পর সে ছাদের ধারে বসে থাকে, রক থেকে ওদের ছাদটা দেখা যায়। ফ্যালারা ওকে বলে শাঁকচুন্নি। বত্রিশে পড়লেও বিয়ে হচ্ছে না। শেফালি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদের কিনারে বসে থাকে। পাড়ার মেয়েরা রাস্তা দিয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করে, কোথায় গেছলে গো, সিনেমা? ছোটো ছেলেরা খাবারের ঠোঙা নিয়ে ফিরলে বলে, কে এসেছে রে? পাশের বাড়ির বউ শোবার ঘরের জানালাটা ওর জন্যই সন্ধ্যা থেকে বন্ধ করে দেয়।

শেফালি আগাগোড়া সব দেখেছে। যদিও ফ্যালা পাড়ার ছেলে, বয়সে দু-বছরের ছোটো তবু কথাবার্তা বিশেষ বলে। এখন বলল, এই ফ্যালা, কাদের বাড়িতে রে?

সেই মাস্টারনি, কুকুরকে যে বিস্কুট কিনে খাওয়ায়।

শেফালি এইটুকু শুনেই ইলাবউদির বন্ধ জানালায় কিল বসাতে শুরু করল।

বরুণ মিত্র পাড়ার মাস ছয়েকের ভাড়াটে, কারোর সঙ্গেই মেশে না। ফিরছিল অফিস থেকে। ফ্যালা তাকেই বলল, কার গাড়ি বলতে পারেন?

বাড়িগুলো কলিচটা; বালি বেরিয়ে পান্ডুরবর্ণ। ওর মধ্যেই কালীবাবুর বাড়িটা সদ্য কলি ফেরানো, ফলে মনে হয় গলিটার শ্বেতি হয়েছে। তেইশ নম্বরের ভাঙা ট্যাঙ্কের পাশে অশ্বথ গাছটা বাড়তে চাইলেই লাঠি পিটিয়ে ডালগুলো ভেঙে দেয় ও-বাড়ির সত্যচরণ। ফলে গাছটা ছোট্ট রয়ে গিয়ে ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি-জলের পাইপগুলো শিরার মতো দেওয়াল বেয়ে রাস্তা পর্যন্ত নামাননা, কিন্তু এবারের বল খেলার ধকল সইতে না পেরে তলার অংশ অধিকাংশেরই ভাঙা। জানালাগুলো লটপটে বুকপকেটের থেকেও অর্থহীন, ঝড়বৃষ্টিতে কাজে আসে না। গলিতে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকালে প্রথমেই মনে হবে, চিরকুট শাড়ি ফেঁসে গিয়ে বিব্রত কোনো গৌরাঙ্গীর দেহ। গলিতে ঢোকার সময় মানুষজন মুখ তুলে তাকায়, বেরোবার সময় আড়ে আর এক বার।

টিউবওয়েলটা বসানোর ব্যাপারে অনন্ত সিংগির সঙ্গে বাসুদেব নাগের প্রচন্ড একচোট হয়ে গেছল। কুমার চৌধুরি কাউন্সিলর হয়েছে তাঁরই কৃপায়, এরকম একটা ধারণা সিংগিমশাই বরাবরই পোযণ করে আসছেন। সুতরাং কর্পোরেশনের টিউবওয়েলটা তাঁর বাড়ির সামনে বসবে না কেন? বাসুদেবের যুক্তিগুলো অবশ্য পাবলিক বেনিফিটের কথা ভেবেই বলা। তা ছাড়া সিংগিমশাইয়ের বাড়ির দেওয়ালে রাস্তার ইলেকট্রিক আলো বসেছে, টিউবওয়েলটাকেও কি তিনি নিজের সম্পত্তি করতে চান? পাড়ার পাঁচজনের কাছেই বাসুদেব গলা ফুলিয়ে প্রশ্নটা তুলেছিল। ফলে দু-ভাগ হয়ে যায় পাড়াটা। সিংগিমশায়ের বাড়ির সামনেই টিউবওয়েল বসেছে, মধ্যস্থতা করেছেন কালীবাবু। টিউবওয়েলের খ্যাচাং খ্যাচাং শব্দটা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। তা ছাড়া রাস্তাটাও দিনরাত কাদা হয়ে থাকবে। তাই যুক্তি দিলেন ধরো হঠাৎ কারুর রান্নার জল ফুরিয়ে গেল, বাড়িতেও তখন কোনো পুরুষ বা ছোটো ছেলেপিলে নেই যে এক বালতি জল এনে দেয়, তখন কি বউ-ঝিরা রাস্তার মোড়ে গিয়ে কল থেকে পাম্প করে জল আনবে? বরং পাড়ার ভেতর দিকেই কলটা বসানো ভালো, দেখতেও ডিসেন্ট হয়। বেপাড়ার লোকেরা এসে কলটা খারাপ করে দিতে পারবে না।

বাসু নাগ সেই থেকে কালীবাবুর উপর চটা। বাড়ি সারাবার সময় কালীবাবু দো-তলায় বেআইনি একটা পায়খানা করে। বাসুগিন্নি খবরটা জোগাড় করে আনে, বাসুদেব সেটা কর্পোরেশনে জানিয়ে কালীবাবুর কিছু খসিয়ে দেয়। রাগটা তাতে অনেকখানি কমে গেছে।

ধূসর অ্যাম্বাসাডারটা সিংগিমশায়ের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে তিনি আর পথ খুঁজে পেলেন না। সুতরাং চিৎকার করলেন, গাড়ি কার অ্যা, রাখবার কি জায়গা পেল না; এটা লোকের বেরোবার পথ, এ কী অন্যায়।

কী হল, চ্যাঁচাচ্ছেন কেন?

ফ্যালা ছুটে এল। সিংগিমশায়ের মেয়ে হাসি রেডিয়ো থেকে গান তুলছিল, সে নেমে এল। সামনের বাড়ির ভবদেব অর্থাৎ ভোম্বলও জানালা থেকে উঁকি দিল।

এদের দেখে ফ্যালা কিছুটা ভারিক্কি হয়ে বলল, অচেনা লোক, আমিই বললুম এখানে রাখুন। তা নয় একটু ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছি।

ফ্যালার নির্দেশে গাড়িটা রাখা হয়েছে, এবং ফ্যালা দিন কয়েক আগেই বেপাড়ার একটা ছেলেকে গলির মধ্যে টেনে এনে ঠেঙিয়ে লাট করেছে। সিংগিমশাই চুপ করে রইলেন। বেনেটোলায় তাঁর গন্ধেশ্বর ভান্ডার নামে একটা দোকান আছে। বাড়িওলাটা হজ্জত শুরু করেছে, সিংগিমশায়ের মনোগত বাসনা–ফ্যালাদের দিন কয়েক ঘুরিয়ে আনবেন। সুতরাং ফ্যালাকে চটালেন না, বরং হাত লাগিয়ে তিনিও সাহায্য করলেন।

গাড়িটা দু-হাত এগিয়ে রাখা হল। বাসুদেব অফিস থেকে ফিরছিল। সিংগিমশায়ের বাড়ির সামনে গাড়ি দেখে বিস্মিত হয়ে তাকাল। তাই দেখে সিংগিমশায় ডান পা-টা পিছনের বাম্পারে তুলে দিয়ে শ্লথ ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। গাড়িটা যেন কোনো আত্মীয়ের এবং এতই নিকট যে পা পর্যন্ত তুলতে পারেন। বাসুদেব ঈর্ষাচ্ছন্ন হলেন। ফ্যালা দাঁত কিড়মিড় করে ভাবল, শালার ঠ্যাংটা ভেঙে দোব নাকি।

ভবদেব অর্থাৎ ভোম্বল, ঘোষপাড়া লেনের অত্যন্ত মানী ছেলে। বর্তমান বয়স চব্বিশ। স্কুলের ম্যাগাজিনে ধর্ম সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে পাড়ার মাতব্বরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কলেজের ম্যাগাজিনে প্রগতিশীল কবিতা লিখে বড়দা, মেজদা এবং সেজদার দুশ্চিন্তা, ক্রোধ এবং বিরক্তি উৎপাদন করে। বর্তমানে সে এই পাড়ার একমাত্র যুবক যে গ্র্যাজুয়েট, একটি লাইব্রেরির সদস্য, রকে আড্ডা দেয় না, বড়োদের সামনে সিগারেট ফোঁকে না, মেয়েদের দিকে মুখ তুলে তাকায় না, এবং তিনশো পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকুরিয়া। এ পাড়ার পিতারা সন্তানদের প্রতি হতাশা প্রকাশ করার সময় ভোম্বলকে পুত্ররূপে না পাওয়ায় আক্ষেপ করে থাকেন। ফলে ভোম্বলের সমবয়সিরা তাকে অপছন্দ করে।

ভোম্বল ছেলেটি বড়ো ভাবুক, তাই কম কথা বলে। সিংগিমশায়ের দোরগোড়ায় একটি মোটরগাড়ি দেখে সে ভাবল, কার হতে পারে। ফ্যালাকে জিজ্ঞাসা করলেই ল্যাঠা চোকে। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবৎ কম কথা বলার জন্য তার স্বভাবে একপ্রকার জড়ত্ব এসে গেছে। বাসুদেবের জ্যেষ্ঠা কন্যা মনীষা অর্থাৎ মানু এইবার তিন বছর ডিগ্রি কলেজে ভরতি হয়েছে। বাড়িতে সে মেজোবউদির সখীস্থানীয়া। প্রায়ই আসে। ভোম্বলের সাধ হয় ওর সঙ্গে হাস্যপরিহাসের, কিছুক্ষণের সান্নিধ্য উপভোগের। কিন্তু গত দুই বছরে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে এই যে বলা ছাড়া আর কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি।

লুঙ্গির উপর গেঞ্জি চড়িয়ে ভোম্বল দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। সত্যচরণ গামছা পরে বালতি হাতে এল। ওর স্ত্রীর বাতিকের জন্য জল একটু বেশি দরকার হয়। ভোম্বলকে দেখে বলল, হ্যাঁ গো গাড়িটা কার?

সত্যচরণকে ভোম্বল পছন্দ করে না। তাই স্বল্প কথায় উত্তর দিল, কী জানি।

সত্যচরণ ডিঙি মেরে কিছু-একটা অতিক্রম করে, টিউবওয়েলের চৌহদ্দিতে পৌঁছে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

যত রাজ্যের গু-মুত চাকায় চাকায় এবার পাড়ার মধ্যে ঢুকতে শুরু করল। চেঁচিয়ে বলেছিল যাতে ভোম্বল শুনতে পায়, মোড় থেকে ফ্যালা ছুটে এল। কেন, চাকায় আসে আর লোকের পায়ে পায়ে আসে না? রাস্তাটা কি আপনার ঠাকুরঘর?

সত্যচরণ গভীর মনোযোগে বালতি ধুতে শুরু করল। ভোম্বল কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসাটা করেই বসল, ফ্যালা গাড়িটা কার?

বউ, অ-বউ কোথায় গেলি? খোকাকে বলিস কিন্তু কচুর মুখী আনতে। অ-বউ বাজার যাবার সময় খোকাকে মনে করে বলিস কিন্তু। বড়ি দিয়ে ঝাল করিস।

থুথুড়ে শাশুড়ি, দালানের এক কোনায় সকাল-সন্ধে উবু হয়ে বসে থাকে। হামা দিয়ে নর্দমা পর্যন্তও যেতে পারে না। চোখে দেখে না, কানে কম শোনে।

অ-বউ খোকা ফিরেছে? এরপর বিরক্ত হয়ে—আঁটকুড়ির গেরায্যি নেই। মর তুই, খোকার আবার বিয়ে দোব, দেখি তোর দেমাক থাকে কোথায়।

বুড়ি এখন ঘণ্টা খানেক এইভাবে কথা বলবে। কিন্তু যাকে শোনাবার জন্য, সে তখন দোতলায় ভাড়াটে বাসন্তীর রান্নাঘরের দরজায়।

আচমকা ধাক্কাটা সামলে উঠে বাসন্তী বলল, বলিস কী পারুল, সত্যি? ওগো শুনছ? আমাদের পাড়ায়… বলতে বলতে বাসন্তী পাশের ঘরে ঢুকল।

শুনেছি। মেঝেয় চিত হয়ে গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে পড়তে রবীন জবাব দিল। বাঁ হাতটা যন্ত্রের মতো ঘুমন্ত ছেলের মাথা চাপড়ে যাচ্ছে।

পারুল বলল, আমাকে ওবাড়ির শেফালি এসে বলল, ও দেখেছে। ঠিক ওদের বাড়ির সামনেই গাড়ি রেখে নামল। তারপর হেঁটে তিন নম্বর বাড়িতে গেল।

বাসন্তী বলল, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে?

পারুল বলল, তা না তো আর যাবে কোদ্দিয়ে। রোজই তো বাপু এই সময় জানালার ধারে বসে এটা করি ওটা করি, কেউ গেলে চোখে পড়েই। আর আজকেই বরাত এমন–মাথার ঠিক কি আর আছে, বিকেল থেকে শাশুড়ি খালি খাব খাব করে যাচ্ছে।

অন্য সময় হলে পারুলের শাশুড়ির বিষয়ে শোনার মতো সময় হত বাসন্তীর। এখন হাঁসফাঁস করে বলল, ওগো দেখে এসো-না এক বার।

কেন?

যদি রাস্তা দিয়ে দেখা যায় তাহলে আমরাও গিয়ে দেখব।

রাস্তা থেকে? রবীন মুখ থেকে বই নামাল। বাড়ির বউয়েরা রাস্তায় নেমে আজেবাজে লোকদের ঘা ঘেঁষে অন্যের জানালায় উঁকি দেবে?

অপ্রস্তুতে পড়ল দুজনেই। পারুল তো রেগেও উঠল। নিজের বউকে ঠেস দিয়ে তাকেও তো শোনানো হল। শাসন করতে হয় নিজের বউকে করো, সভ্যতা শেখাতে হয় তো নিজের বউকে শেখাও। দু-চারটে কথা পারুলের ঠোঁটেও এসে গেছল কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারের কথা ভেবে ঢোক গিলল। ব্যাপারগুলি হল : রবীনের অফিসে নব্বই টাকার একটা চাকরি খালি হয়েছে, ভাইয়ের জন্য পারুল কালকেই কথাটা পেড়েছে। এবাড়ির ছাদ ব্যবহারের একমাত্র অধিকারী দোতলার ভাড়াটে যেহেতু ভাড়া বেশি দেয়। যেকোনো মুহূর্তেই একতলার লোকদের ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এ ছাড়াও বাসন্তী মৃতবৎসা দোষ কাটানোর অব্যর্থ মাদুলির হদিস জানে।

আহা, আমরা কি আর ঠেলাঠেলি করতে যাচ্ছি। যদি চলতে চলতে দেখা যায় তাহলে নারুদের বাড়ি যাবার নাম করে এক বার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নেব। ওতে তো দোষ নেই।

দরজার পাশ থেকে উঁচু গলায় পারুল বলল, সেদিন দক্ষিণেশ্বর যেতে কীরকম ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতে হল।

সেদিন রবীন ওদের নিয়ে গেছল। এবং বাড়ি ফিরেই স্ত্রীর কাছে খোঁজ নেয়, যে-লোকটা বরাবর বাসে ওদের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল তার স্বভাবটা কেমন? ফলে বাসন্তী ঝগড়া করে, না খেয়ে আলাদা শয্যা নেয়।

উঠে পড়ল রবীন। পাঞ্জাবিটা ঘাড়ে ফেলে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরোল। সিঁড়িটা অন্ধকার। মুখস্থ থেকেও ভুল হয়ে গেল। দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে টপকে তালগোল পাকিয়ে পড়ল। প্রথমে ছুটে নামল পারুল। হতভম্বের মতো রবীন তখনও বসে। পারুল বগলের নীচে হাত দিয়ে টেনে তুলতে গেল। পিছন থেকে শান্তগলায় বাসন্তী বলে উঠল, আমি দেখছি, তুমি সরো তো।

ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল রবীন। ওঠার সময় পারুলের বুকে কুনুইটা এত জোরে লাগল যে পারুলকে আঃ বলে উঠতে হল।

দালানের কোণ থেকে শাশুড়ি বলল, অ-বউ কী পড়ল রে।

ঠিক এইখানটায় আমি দাঁড়িয়ে আর গাড়িটা ওইখানে। হাত দুয়েক দূরে রাস্তার একটা জায়গা দেখিয়ে ফ্যালা বলল, মাত্র এইটুকু ডিস্টেন্স থেকে কথা হল।

জনা ছয়েক ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তারা সবাই চুপ করে থাকল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে গলিতে দাঁড়িয়ে-থাকা গাড়িটাকে দেখল।

ওর আর একটা গাড়ি আছে। সেটা আনলে গলিতে ঢুকত না। একজন বলল।

সকলে গলির মুখটাকে লক্ষ করল।

কে জানত বাবা গলির মধ্যে মোটর ঢুকবে, তাহলে চওড়া করেই তৈরি করত। আর একজন বলল।

শালার বাড়িগুলো ভেঙে না পড়লে আর গলি চওড়া হবে না। ফ্যালা বলল।

হ্যাঁ, সব বাড়িগুলো মাঠ হয়ে যাক শুধু উনিশের বি-টা বাদে।

এবার সবাই চাপা হাসল। উনিশের বি-তে বরুণ মিত্তির থাকে। সম্প্রতি ওর দূর সম্পর্কের এক বোন এসে রয়েছে। ফ্যালা তাকে ভালোবেসে ফেলেছে এবং ধারণা নমিতাও যে দরজার কাছে মাঝে মাঝে দাঁড়ায়, একমাত্র তাকেই দেখার জন্য।

কথাটা শুনে ফ্যালা স্বভাবতই লাজুক হয়ে পড়ল। খুশিও হল। তাই মোড়ের ঠাকুরের পানের দোকানে গিয়ে হাঁকল, এক প্যাকেট ক্যাপস্টান।

ঠাকুর এক বার আড়ে তাকিয়ে পান সাজায় ব্যস্ত রইল। তাড়া দিল ফ্যালা। শুনেও শুনল না যেন। সাধারণত যা করে থাকে, ফ্যালা নিজেই সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিতে গেল। ঠাকুর ওর হাত চেপে ধরল। বিস্ময়ে ফ্যালা স্তম্ভিত।

তিন মাস ধরে তো দেব দেব কচ্ছেন। আর ধারে হবে না।

আত্মসংবরণ করো। গম্ভীর স্বরে ফ্যালা বলল, ঠিক আছে সামনের হপ্তায় শোধ করে দোব। ঠাকুর নিজ হাতে প্যাকেট এগিয়ে দিল।

ইতস্তত করে ফ্যালা নিল। কানের ডগা দুটো ঝাঁঝাঁ করছে।

কত টাকা বাকি? স্বরটা কেঁপে উঠল।

ছ-টাকা বারো আনা।

ফ্যালা আসতেই ওরা ছোঁ দিয়ে প্যাকেটটা কেড়ে নিল।

ওরেব্বাস, ক্যাপস্টান!

কাল ছাতে উঠেছিল। মালা সিনহা একদম মাইরি, মাইরি।

কেন, মুখের আদলটাও ঠিক হুবহু।

ওর দাদার সঙ্গে ভাব করে নে-না, লোকটা কনজারভেটিভ নয়। অফিসের বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলে, বউ তাদের সঙ্গে খেলে।

কোঁতপেড়ে গিয়ে ফুক ফুক করে ওরা ধোঁয়া ছাড়ল। ফ্যালা রেগে উঠল আপন মনে। কিন্তু রাগটা প্রকাশ করার কোনো মওকা আপাতত পাচ্ছে না। জোরে জোরে টান দিয়ে সিগারেটটাকে নিঃশেষ করে রাস্তায় আছড়ে ফেলল।

কিছু টাকা জোগাড় করতে হবে।

ওরা ফালার দিকে তাকাল। কেউ কিছু বলল না।

কালীবাবু পাঁচ বছর অন্তর বাড়ির কলি ফেরান। দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন ঝাড়া হাত-পা। চারুশীলা ওরফে শীলার সঙ্গে ঝগড়া করা ছাড়া বাহান্ন বছর বয়সে তাঁর আর কোনো শখ নেই। অবশ্য নিয়মিত রেডিয়োর থিয়েটার শশানেন আর সত্যচরণকে মাঝে মাঝে রাজনীতি বুঝিয়ে থাকেন। চারুশীলার জ্বালা ঝিয়েদের নিয়ে। ওরা আসে হতকুচ্ছিত চেহারা নিয়ে। তারপর কেমন যেন পরিপাটি হয়ে যায় চারুশীলার নজরে। চুলে তেল, গায়ে ব্লাউজ, মুখে পান, ঢলানি ঢলানি ভাব। কালীবাবুও সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে উঠোনের ধার ঘেঁষে জানালায় বসে রেডিয়োর কীর্তন শোনেন নয়তো খবরের কাগজ পড়তে শুরু করেন। তুলকালাম ঝগড়া বাঁধে। ঝি বরখাস্ত হয়ে যায়। রাত্রে পারুল-বাসন্তী ও-বাড়ির কর্তা-গিন্নির ঝগড়া শুনে মুখ টিপে হাসে আর ফিসফিস করে।

ওরা যে কী অত ফিসফিস করে চারুশীলা তাও জানে। অনিলের মা এখন আর অতটা আঁটসাট নেই, ওদের বাড়িতে কাজ করার সময় যতটা ছিল। অনিলের ছোটো দুই ভাই নাকি চারুশীলার দুই মেয়ে ভূতি আর টুনুর মতো হুবহু দেখতে। কেন হল? এ বিষয়ে পারুলের গবেষণার ফলাফল চারুশীলা শেফালি মারফত জেনেছে। এবং চারুশীলার মতামত পারুলকে সযত্নে জানিয়ে গেছে শেফালি।

কালীবাবু আজ বাড়ি ফিরলেন সন্দেশের বাক্স হাতে। স্ত্রীর পিসতুতো ভাইয়ের নতুন জামাইয়ের রাত্রে নেমন্তন্ন। ছেলেটি বিলেতফেরত, সাহেব কোম্পানিতে আটশো টাকায় ঢুকেছে। খুব বড়ো ঘরের ছেলে, বাপ রায়বাহাদুর।

বাড়ি ঢোকার মুখেই কালীবাবুর মনে পড়ল, ইসবগুলের ভুসি ফুরিয়েছে। এখনই না কিনে রাখলে রাতে কেনার কথা মনে নাও থাকতে পারে। অতিথিকে ফেলে মুদি-দোকানে ছোটা উচিত হবে না। এইসব ভেবে কালীবাবু নিজের বাড়ির দরজা থেকেই আবার ফিরলেন। বাসুদেববাবুর বাড়ির কাজ সেরে অনিলের মা-ও তখন ফিরছিল।

মুদির দোকানটা ষোলো হাত রাস্তার উপর বস্তির গলিটার মুখেই। সুতরাং দুজনের গন্তব্যই একমুখী। কালীবাবু যখন ইসবগুল কিনছেন তখন অনিলের মা-ও কাপড়কাচা সোডা কিনতে ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফ্যালা সেইমাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। নজরে পড়ল কালীবাবু যেন ফিসফিস করে অনিলের মাকে কী বললেন। অতঃপর ভুসি কিনে কালীবাবু বাড়িমুখো হলেন।

চারুশীলা এটুকু লক্ষ করেছে, বাড়িতে পা দিয়েই কালীবাবু গেলেন। ফেরা মাত্রই সে কারণটা জানতে চাইল। এতে কালীবাবু হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, এত খোঁজে দরকার কী, কোথায় যাই বা না যাই?

চারুশীলা কথা বাড়াল। ব্যাপারটা পরে জেনে নেওয়া যাবে, এখন ময়দা মেখে বেলে রাখতে হবে। হাতের কাজ সেরে না রাখলে জামাইয়ের সঙ্গে গল্প করার সময় পাওয়া যাবে না।

আঙুর অর্থাৎ অনিলের মা দশটা টাকা চেয়েছে। আজকেই চাই। কালীবাবু বলেছেন, রাত্রে গিয়ে দিয়ে আসব। চারুশীলার দাদার জামাই আসবে একটু পরেই, তার সঙ্গে বসে ভ্যাজভ্যাজ করতে হবে। খেয়ে দেয়ে বিদেয় হতে রাত দশটা। অত রাতে বস্তিতে ঢুকলে যদি কেউ দেখে ফেলে। বখাটে ছোঁড়াগুলো তো ওখানেই গুলতানি করে, তাহলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। কমপক্ষে চার মাস আঙুরকে স্পর্শ করা হয়নি। থলথলে, দলমলে মাংসের স্কুপে আঙুল ডুবিয়ে—ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন কালীবাবু। গোটা কতক ভারী নিশ্বাস পড়ল। নানা ধরনের যৌনছবি মাথার মধ্যে ফুটে উঠছে আর তখনই ঘরের আলো জ্বেলে চারুশীলা গনগনে স্বরে বলল, এইমাত্র চাদর ভেঙে পাতলুম, আর ময়লা কচ্ছ। নীচের ঘরে গিয়ে বসো-না। আসার সময় তো হল।

কালীবাবু উঠে বসে বললেন, শরিরটা কীরকম ম্যাজম্যাজ করছে। শীলু, এক কাপ চা করে দাও-না।

বাসু নাগ বাড়ি ফিরেই পায়খানা যান। এটা তাঁর বাইশ বছরের অভ্যাস। পালন করতে গিয়ে টের পেলেন প্যানের মধ্যে কিছু-একটা পড়ে বুজে রয়েছে। বলাই বাহল্য এতে তিনি চটলেন। ধকলটা গিয়ে পড়ল স্ত্রীর উপর। তিনি সাত চড়ে রা করেন না।

তোমরা জেনেশুনেও চুপ করে দেখছিলে। আগে বললে বাঁ-হাত দিয়ে তুলে নিতুম। এখন তুলি কী করে?

অতঃপর ছোটোছেলে নালুকে তিনি বেধড়ক কয়েক ঘা দিলেন। হতচ্ছাড়াটার পড়াশোনা নেই, দিনরাত শুধু বল খেলা আর বল খেলা। এখন এই বল তুলবে কে? স্ত্রী পরামর্শ দিলেন একটা ধাঙড় ডেকে আনলেই সমস্যাটা মিটে যায়।

সন্ধ্যার পর ধাঙড়রা পায়খানা থেকে বল তোলার জন্য নিশ্চয় বসে নেই। স্ত্রীকে এই কথাটা জানিয়ে বাসু নাগ কয়েক বালতি জল ঢেলে বলটিকে তুললেন এবং পাছে নালু সেটিকে হস্তগত করে তাই রাস্তায় বেরোলেন পরিত্যাগ করে আসতে। বল আর বেড়ালে কোনো তফাত নেই, যেখানেই ছেড়ে এসো-না কেন ঠিক বাড়ি ফিরে আসবে। তাই গলির বাইরে বড়ো ডাস্টবিনে ফেলার উদ্দেশ্যে বাসু নাগ রওনা হলেন।

অনন্ত সিংগির বাড়ির দোরে মোটরটাকে দেখতে পেয়ে বাসু নাগ এগোলেন না। ভাবলেন, বেটা নিশ্চয় এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এখান দিয়ে গেলেই দেখিয়ে গাড়িতে পা তুলে দাঁড়াবে। গাড়িটা কি কিনল? হারামজাদার পয়সা আছে বটে তবে কিপটে, তা ছাড়া মুখও।

বাসু নাগ বাড়ি ফিরে সটান ছাদে উঠলেন। বলটা প্রাণপণে ছুড়ে দেবেন যেদিকে খুশি। কিন্তু কোনদিকে ছোড়া যায়? নজর পড়ল অনন্ত সিংগির ছাদের ঘরটা। ওটা ঠাকুরঘর। দরজাটাও ভোলা রয়েছে। বাসু নাগ রাগ করে বলটা ছুড়ে দিলেন।

মনীষা অর্থাৎ মানু এসেছে। মেজোবউদি বাপের বাড়ি গেছে সকালে, এখনও ফেরেনি। বড়োবউদি ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী। দাদারা বাড়ি নেই। ভোম্বল যে কী করবে ভেবে পেল না। তাই যথারীতি বলল, এই যে।

মনীষা হাসল।

পাড়ায় ওটা কার গাড়ি ভোম্বলদা? শুনলুম নাকি…

থেমে গেল। তারপর বুকের আঁচল ঠিক করে একটু আদুরে গলায় ওপরে আপনার ঘর থেকে তো দেখা যায়। রাস্তায় বেরোলে দেখব।

ভোম্বলের মুখে রা নেই। মানুর পিছু পিছু ঘরে এল।

সিনেমায় অনেক বার দেখেছি। এমনি চোখে তো দেখিনি, কেমন দেখায় তাই দেখতে এলুম। এত সুন্দর ন্যাচারাল পার্ট করে-না—জানেন ও কিন্তু মেয়েদের খুব ফেভারিট।

ভোম্বল হাসল। মানুকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু অস্বস্তি লাগছে, বাড়িতে কেউ নেই। মেজোবউদিও যদি থাকত। যদি এই নিয়ে কথা ওঠে? বড়োবউদি অল্পবিস্তর কুচুটে।

নীচের ঘর থেকে দেখলে হত না?

কেন, আপনার ঘরে অসুবিধে কী?

মানুর পালটা প্রশ্নে ভোম্বল দিশাহারা হল।

মানে, কেউ তো বাড়ি নেই, নীচের দরজাটা খোলা।

তাতে কী হয়েছে?

কেউ যদি কিছু বলে?

মানু যেন কুপিত হয়েছে এমন মুখভঙ্গি করে বলল, কেন আমি কি খুব খারাপ মেয়ে যে অপবাদ দেবে?

তা নয়, মানে…

রাগ করে মানু বেরিয়ে যাচ্ছে। হায় হায় করে উঠল ডোম্বলের অন্তরাত্মা। এ কী করে বসল সে, মানু যে চলে যাচ্ছে। প্রায় ছুটে গিয়ে সে মানুর হাত ধরল।

অপবাদে আমিও ভয় পাই না।

মানু হাসল। লাজুক সুরে বলল, কী যে করেন।

হাত ছেড়ে দিয়ে ভোম্বল টুলের উপর বসল। ঘাড় হেঁট করে মানু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকা বা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কেউই প্রস্তুত নয়। সুতরাং মানু ঘরের ভিতর এসে বলল, আপনার ঘরটা খুব টিপটপ, সাজানো, আপনি খুব গোছানো।

ভোম্বল হাসল এবং ভাবল মানুও খুব টিপ টিপ।

আচ্ছা আপনি যে অত বই কিনেছেন, এর সব পড়া হয়ে গেছে?

ভোম্বলের বুক দুলে উঠল।

তা না হলে কি অমনি সাজিয়ে রেখেছি? সগর্বে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে, প্রত্যেকটা লাইন পড়া।

মুগ্ধ হয়ে মানুও বইগুলোর দিকে তাকাল।

বাবা বলছিল, এপাড়ায় আপনার মতো কোনো ছেলে নেই। সত্যি, পাড়ার ছেলেরা যা হয়েছে-না.. জানেন বরুণবাবুর এক বোন এসেছে-না, মেয়েটা ভারি বেহায়া চাল্লুশ। আর পাড়ার যত বখাটে ছেলে ওদের বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করবে। ফ্যালার সঙ্গে নাকি এর মধ্যেই ভাব হয়ে গেছে।

তাই নাকি?

ওমা, পাড়ার সবাই তো জেনে গেছে।

মানু খাটের ওপর বসল। সানের দেয়ালে আয়না, মুখ দেখা যায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে। বলল, আপনি তো নামেও ভোম্বল, কাজেও ভোম্বল।

বটে, তাই নাকি। আমিও অনেক খবর রাখি তা জান?

মানু সচকিত হল। চুলের একটা গুচ্ছ কপালের ওপর ঝুলিয়ে দিলে কেমন দেখাবে সেইটা পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটা দমিয়ে ব্যগ্রস্বরে বলল, কী? কীসের খবর?

মানুর চোখে খানিকক্ষণ চোখ রেখে ভোম্বল বলল, মনীষা বলে একটা মেয়ে এ-পাড়ায় আছে সে খুব সুন্দরী, তা জান?

বুঝতে একটু সময় লাগল। তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে কুঁজো হয়ে মানু বলল, কী। অসভ্য।

মুখটা তোলার সময় মানু আঙুল দিয়ে চুলের গুচ্ছটা চট করে কপালের উপর টেনে ফেলল। ভোম্বল দেখতে পেল না। মুখোমুখি বসে থাকতে লজ্জা করল তার। উঠে জানলায় গেল। ফিরে এল। বসল। আয়না দেখল। ভোম্বলের দিকে তাকাল। বলল, মেজোবউদি কখন আসবে?

সময় তো হয়ে গেছে।

আবার চুপচাপ।

মেজোবউদি বলছিল একদিন প্ল্যানেটোরিয়াম দেখতে যাবে। কেউ না-নিয়ে গেলে বাবা যেতে দেবে না। ওসব দিকে যেতেও কেমন যেন লাগে। গড়ের মাঠটা এমন-না… কোথায় যে বাস থেকে নামতে হবে…

সামনের রোববার চলো-না, যাবে?

আমি কী জানি, মেজোবউদি যদি যেতে চায় তবেই তো।

তোমার বাড়িতে কিছু বলবে না?

ঘাড় নাড়ল মানু। আপনি তো সঙ্গে থাকবেন।

টুল থেকে উঠে খাটে বসল ভোম্বল।

শেফালি এসে বলল, অ বউদি দেখতে যাবে?

পারুল বিছানায় শুয়ে। কপালে হাত, চোখ বন্ধ। মাথা নেড়ে বলল, মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। ভাই, ভীষণ ধরেছে।

বলেই মুখভঙ্গি করল যন্ত্রণায়, তাই দেখে শেফালি কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ির পথ দেখল।

বাসন্তী শাড়ি বদলে চুল আঁচড়াচ্ছে। শেফালি বলল, বউদি, তারকাদের গলির মধ্যে একতলা একটা বাড়ি আছে, তার নীচের ভাড়াটেদের ঘর থেকে কিন্তু মাস্টারনির ঘরের খানিকটা দেখা যায়, যাবে?

বাসন্তী থ। এত বড়ো একটা খবর পেয়ে কী যে করবে সে।

ঠিক জান? দেখা যায়? একটুখানি, একবার হলেই হবে।

ছোটোবেলায় ও-বাড়িতে যে খুব যেতুম। তখন যে ভাড়াটে ছিল তাদের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। আমি জানি, উঠোনের ডান দিকের ঘরটায় একটা ছোট্ট জানলা আছে।

পারুলকে ডেকে বলে নাও। আমি দরজায় তালা দিই।

নীচের বউদির মাথা ধরেছে, যাবে না।

সে কী?

বাসন্তী দরজায় তালা দিয়ে চাবি হাতে নামল।

ওঠ ওঠ, দেখতে যাবি তো চ এইবেলায়। পারুলকে ঠেলা দিল বাসন্তী। যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে পারুল বলল, সত্যি বলছি, ভয়ংকর মাথা ধরেছে।

সাধাসাধি করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। চাবিটা পারুলকে দিয়ে বলল, ছেলেটা রইল. কাঁদলে দেখিস। আমি এখুনি আসছি।

শেফালির সঙ্গে বাসন্তী বেরিয়ে গেল। দালানের কোণ থেকে বুড়ি বলল, অ বউ, তোর কী হয়েছে?

রাস্তার আলোর নীচেই গাড়িটা। একটা বেড়ালবাচ্চা গুটিগুটি এসে গাড়ির নীচে ঢুকল। অনন্ত সিংগি বৈঠকখানা থেকে তা লক্ষ করে উঠে এসে হাঁকডাক শুরু করলেন। ওঁর ভাবভঙ্গিতে সেই জিনিসটিই প্রকট, যার দ্বারা অন্যের এই ধারণা হয়—গাড়িটির অভিভাবক তিনিই। বেড়ালবাচ্চাই হোক আর একটা মাছিই হোক, কাউকেই তিনি রেয়াত করবেন না।

এ সবই হচ্ছে ডেঞ্জারাস। চুপচাপ রয়ে গেল কেউ জানল না, তারপর গাড়ি স্টার্ট দেওয়ামাত্রই চটকে গেল। অযথা একটা প্রাণীহত্যা। দেখেছি যখন, তখন বার করে দেওয়াই ভালো।

নিশ্চয়। সত্যচরণ বলল, মরলে তো রাস্তাটাই নোংরা হয়ে গেল। কাক এসে ঠুকরে নিয়ে এখানে-ওখানে উড়ে বসবে। আপনি ঠিকই বলেছেন।

উবু হয়ে সত্যচরণ হুশ হুশ শুরু করল। বেড়ালবাচ্চা ভয়ে সিঁটিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে রইল। ফ্যালা মোড় থেকে দেখল গাড়ির নীচে সত্যচরণ কী খোঁচাচ্ছে। ছুটে এল সে।

দ্যাখো তো ফ্যালা, ওটাকে বার করা যায় কি না, গাড়ি চললেই তো চাপা যাবে। সিংগিমশাই বললেন।

তাই ওটাকে বার করে দিচ্ছিলুম। সত্যচরণ কৈফিয়ত দিল।

ফ্যালা নীচু হয়ে দেখল। দেখে বলল, স্টার্টের আওয়াজ শুনলেই ব্যাটা সটকান দেবে। আছে থাক।

নীচু হয়ে যখন দেখছিল, তখন একটা ব্যাপার ফ্যালার চোখে পড়ল। গাড়ির পিছনে মাল রাখার ক্যারিয়ারের চাবিটা ভাঙা। ডালাটা একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে।

তাই বলে চীনারা মহান জাতি, চীনাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। নেহরু এই যে সব বলল, এটা কি বলা ঠিক হয়েছে? অ্যাজ এ প্রাইম মিনিস্টার অব ইণ্ডিয়া, তাঁর তো ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত।

কী এমন অন্যায় বলেছে নেহরু। পিসতুতো শালার বিলেতফেরত জামাই গম্ভীর হবার চেষ্টা করল। কালীবাবু নার্ভাস বোধ করলেন।

চীনেরাই তো আমাদের অ্যাটাক করেছে।

তা করেছে।

ওরা তো এনিমি।

নিশ্চয়।

তবে কেন ওরা মহান?

ঊরু চাপড়ালেন কালীবাবু। জামাই কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, থামিয়ে দিয়ে দুলতে দুলতে বললেন, মানি নেহরু খুব শিক্ষিত কালচার্ড। আমরা তাঁর সমকক্ষও নই। কিন্তু ইনিই তো বলেছিলেন সুভাষ যদি আসে তো তরোয়াল নিয়ে তাকে রুখব। কী, বলেছিল তো?

জামাই কিছু বলতে যাচ্ছিল, কালীবাবু হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কাশ্মীরে যখন ইণ্ডিয়ান আর্মি মোচোলমানদের ঠেঙাতে ঠেঙাতে পগারপার করছিল তখন যুদ্ধ বন্ধ করে ইউএনও-তে মামলা করার কী দরকার ছিল? পনেরো বছরেও তো মামলা মিটল না। বুঝলে বাবু, শুধু শিক্ষা কালচার দিয়ে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এজন্য দরকার ডিক্টেটর। চাবুক হাতে নিয়ে দেশশাসন করতে হয়। হিটলার করেছিল, স্ট্যালিন করেছিল, তবেই-না চড়চড় করে ওরা বড়ো হতে পারল।

বাবাজি রীতিমতো ঘায়েল। সত্যচরণ থাকলে কী অবাকটাই-না হত। কালীবাবু দুলে দুলে আপশোস মেটাতে লাগলেন। জামাই অস্ফুটে বিড়বিড় করে দেয়ালে-টাঙানো চারুশীলার সূচিশিল্পের নমুনা দেখতে লাগল।

প্রথম রাউণ্ড জিতে কালীবাবুর উৎসাহ বেড়েছে। দ্বিতীয় রাউণ্ড শুরু করলেন।

আচ্ছা তোমার কী মনে হয়, ইণ্ডিয়ার নন অ্যালাইড থাকা উচিত?

জবাবের জন্য কালীবাবু উদগ্রীব। জামাই তখনও চারুশিল্পে মগ্ন। ঠিক সেই সময়েই দপ করে আলো নিভে গেল। লোডশেডিং। ঘোষপাড়া লেন এলাকায় আজ অন্ধকার নামল।

আঃ, আবার। এই এক জ্বালা হয়েছে রোজ রোজ। চারুশীলা ছুটে এল নীচ থেকে। কালীবাবুকে ঘরের বাইরে ডেকে বলল, মোমবাতি আনতে বলেছিলুম, এনেছ?

এই যা। বলেই দুড়দুড় করে নেমে তিনি রাস্তায় পড়লেন। গোটা অঞ্চলটাই মিশমিশে। এখন দশ চক্ষু হয়েও কেউ কাউকে চিনতে পারবে না।

কে বলেছে ওটা আমার ছেলের বল?

রবারের বলটা বাসু নাগের মুখের সামনে তুলে অনন্ত সিংগি বলল, বলটা তবে কার? কার তা আমি কী করে বলব। উইদাউট এনি প্রুফ বললেই হল? ওরকম বল হাজার হাজার থাউজেণ্ড অ্যাণ্ড থাউজেণ্ড ছেলের কাছে পাওয়া যাবে। আমি জানতে চাই, আই ডিমাণ্ড, আমার ছেলেকে কেন, কীসের ভিত্তিতে দায়ী করা হচ্ছে যে সে বলটা আপনার ঠাকুরঘরে ছুড়েছে?

বাসু নাগ গামছা পরে সদর দরজায় চিৎকার জুড়েছে। আশপাশের বাড়ি থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছে। লোকজন দেখে তার চিৎকার বাড়ল। স্রেফ আহম্মকি। গায়ে পড়ে ঝগড়া। অবশ্য কারণটাও জানি।

কী কারণ? কী জান? সিংগিমশাই রুখে উঠলেন।

গরম, পয়সার গরম। ওরকম পয়সা ঢের ঢের দেখেছি বুঝলেন, গাড়ি একসময় আমাদেরও ছিল। গাড়ি দেখাতে আসবেন না। পয়সা আজ আছে কাল নেই কিন্তু বনেদি বংশের শিক্ষাদীক্ষা চিরকাল রক্তে থেকে যায় বুঝলেন।

সত্যচরণ এই সময় বলল, ব্যাপারটা কী? বাসুদা চটলে কেন গা?

আর বলিস কেন ভাই, ইনি এসে বলছেন এই বলটা নাকি আমার ছেলে ওঁর ছাদে ঠাকুরঘরে ছুড়েছে। কোনো প্রুফ নেই, কোনো উইটনেস নেই। একেবারে চড়াও হয়ে এসে হম্বিতম্বি।

আলবাত তোমার ছেলের বল এটা। এই যে ফুটো, টিপলে চুপসে যায়। বলটা বাসুর মুখের সামনে ধরে সিংগিমশাই টিপলেন। হাওয়াটা বাসুবাবুর মুখে লাগতেই তিনি আঁতকে পিছনে লাফ মারলেন।

হোয়াট ইজ দিস? অ্যাাঁ, নোংরা বলের হাওয়া মুখের উপর? রাগে ঠকঠক করে বাসু নাগ কাঁপতে থাকলেন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, আহ উইল কল পুলিশ, পুলিশ ডাকব। তেল বার করে ছাড়ব।

ডাক তোর পুলিশ, আমিও দেখে নোব তোর বনেদিপনার তেল কত। বুঝলে সত্য, যত রাজ্যের মেয়েলি পরচর্চা, পরনিন্দে হল এই লোকটার পেশা। ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে কী বলেছে জান? বলেছে ইলার মা নাকি অনন্ত সিংগির বিয়ে-করা বউ নয়। মুদির কাছে কী বলেছে জান? নোটজালের কারবারিদের সঙ্গে আমার দোস্তি আছে। আরে বাবা নিজের চরকায় তেল দিয়ে তারপর কথা বলতে আসুক। মাসের মধ্যে দশ দিন তো উনুন ধরে না।

আমার উনুন ধরে কি ধরে না তা দিয়ে কার বাপের কী? বাসু নাগ রাস্তায় লাফাতে শুরু করলেন। অনন্ত সিংগি একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন, খবরদার বাপ তুলবে না, তাহলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে বলছি।

তোমরা শুনে রাখো, আমায় থ্রেট করল। আমাকে খুন করবে বলল।

মিথ্যে কথা, খুন করব বলিনি। সত্য তুমিই বলো?

সত্যচরণ ফাঁপরে পড়ল, এখনও সে মনস্থির করতে পারেনি কার পক্ষ নেবে। সিংগিমশাইকে কোণঠাসা হতে দেখে বাসু নাগের দেহ মনে মত্তহস্তীর বল দেখা দিল। গামছাটাকে মালকোঁচা করে এগিয়ে গেলেন।

বাপের বেটা যদি হোস তো আয়, খুন কর দেখি, চলে আয়।

অনন্ত সিংগির ভাই বসন্ত সদ্য বাড়ি ফিরে ব্যাপার শুনেই সেইমাত্র এসে হাজির হয়েছে। বসন্ত রগচটা লোক। বাসু নাগের আহ্বানে সে এগোল। আর ঠিক সেই সময়েই অন্ধকার নামল ঘোষপাড়া লেনে।

শুয়ে রয়েছে পারুল। সিঁড়ি দিয়ে উঠছে রবীন। উপরে গিয়ে দেখবে তালাবন্ধ। চাবি নিয়ে পারুল উঠল।

অ বউ, কোথায় চললি? খোকা ফিরল? অ বউ সাড়া না দিয়ে যাচ্ছিস কোথা?

যমের বাড়ি। দাঁতে দাঁত ঘষে পারুল।

বুড়ির মুখের সামনে চড় তুলল। বুড়ি দেখতে পেল না, পারুল বেড়ালের মতো উপরে উঠে গেল।

সেই মাথাধরার ওষুধটা আছে?

বন্ধ দরজার সামনে রবীন দাঁড়িয়ে ছিল। পারুলকে দেখে এবং বাসন্তীকে না দেখে জড়সড় হয়ে পড়েছে। তোতলার মতো বলল, কীসের ওষুধ, কোন ওষুধ।

আঃ! আপনাকে দু-বার করে না বললে কিছুই বোঝেন না। মাথাধরার ওষুধ, মাথাধরার। ছিঁড়ে পড়ছে মাথাটা।

দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দু-হাতে চেপে ধরল কপালটা, অস্ফুট যন্ত্রণায় আক্ষেপধ্বনি তুলে মাথা ঝাঁকাল।

ওষুধ তো বহুদিন আগে একটা কিনেছিলুম। মলম। এখনও আছে কি না…

জানেন না। পারুল ধমক দিল যেন, বাড়িতে এমন একটা কেউ নেই যাকে বলব মাথাটা টিপে দিক। আপনাকে বলা তো বৃথা। বউ বাড়িতে নেই, এখন তো আমার দিকে তাকাতেও সাহস পাবেন না।

কেন, আমি কি ভীতু? এই তো তাকাচ্ছি।

সাহস বোঝাবার জন্য রবীন চোখ দুটো বিস্ফারিত করল। পারুল মুখ টিপে হাসল। রবীন সে-হাসি দেখল।

সাহস বোঝা গেছে, তখন যেভাবে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লেন। পারুল আঁচলটা মুখে চাপল হাসি লুকোতে এবং মুখ লুকোতে কুঁজো হয়ে পড়ল। শেষে বউয়ের উপর রেগে আমাকেই এক ঘা দিয়ে দিলেন। আমি কি আপনার বউ?

মোটেই আমি মারিনি। রবীন ব্যাকুল হয়ে পড়ল। মুখ থেকে আঁচল নামিয়ে পারুল গলা খাটো করে বলল, যাক আর মিথ্যেকথা বলতে হবে না। এখনও ব্যথা করছে জায়গাটা। একে মাথার যন্ত্রণা তার ওপর আপনার যন্ত্রণা। বক বক করিয়ে আরও বাড়িয়ে দিলেন, দিন না বাপু মাথাটা টিপে।

রবীনের হাতটা ধরে পারুল হ্যাঁচকা টান দিল। উভয়ের ব্যবধানটুকু তাতে ঘুচে গেল। হাতটা কপালে রেখে পারুল বলল, বউকে অত ভয় করেন কেন।

আর ঠিক সেই সময়েই, ঘোষপাড়া লেনে দপ করে অন্ধকার নামল।

সত্যি বলছি, রোজ জানলার কাছে সেইজন্য অপেক্ষা করি। ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা চোখ, সকালের বাতাসে চুলগুলো কপালের ওপর ফুরফুর করে ওড়ে। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় তোমাকে দেখি। ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়ে তোমার পিছু পিছু কলেজ পর্যন্ত যাই। তারপর ভাবি—না:, চ্যাংড়া ছেলেরা এসব করে। তুমি হয়তো আমাকে তাই ভাবতে পার।

শুনতে শুনতে নুয়ে পড়ল মানুর মাথা। নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, আপনার সম্বন্ধে এইরকম ভাবব তাই-বা আপনি ভাবলেন কী করে? আপনি কি আর সবায়ের মতো।

মানুর স্বরে ক্ষোভ, অভিমান যেন। ভোম্বল ভাবল, এর দ্বারা কি এই বোঝায় যে মানু তাকে মোটেই চ্যাংড়া ভাবে না। তাহলে কী ভাবে?

আচ্ছা যদি তোমার কলেজ পর্যন্ত যাই, অনেকটা পিছনেই থাকব অবশ্য কেউ বুঝতেই পারবে না, তাহলে তুমি কি রাগ করবে?

মানুর মাথা আবার নুয়ে পড়ল। ভোম্বল বাক্যহারা। পলকহীন। মানু এক বার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে হার মেনে জানলার কাছে উঠে গেল। মাথাটা কাত করে ত্যারছা চোখে দেখল ধূসর মোটর গাড়িটা দাঁড়িয়ে।

এখনও বেরোয়নি, শুনেছি নিজের পিসি হয় মাস্টারনি।

আমাদের সঙ্গে এক ইয়ারেই বিএ পাস করেছে। আমি সিটি ও স্কটিশ। ভোম্বল উঠে গিয়ে তাক থেকে একটা বই পেড়ে নিল। বড়োবউদির বাচ্চা ছেলেটা এইমাত্র দরজায় উঁকি দিয়ে গেল। নিশ্চয় মা-র কাছে রিপোর্ট করবে, তিনি হয়তো এক বার এসে ঘুরে যাবেন।

পড়াশুনোয় এমন-কিছু ছিল না, তবু দ্যাখো হাজার হাজার টাকা কামাচ্ছে, শুধু চেহারার জন্য। ওর পার্ট তোমার ভালো লাগে?

মানু এইবার চোখে চোখ রাখল। বড়ো করে মাথা নেড়ে বলল, মা গো, কেমন যেন। মেয়েলি মেয়েলি।

খুশিতে হাসল ভোম্বল। ওকে দেখার জন্য মেয়েরা কেন যে এত ব্যস্ত হয়!

বইয়ের পাতা উলটোতে শুরু করল সে। মানু জানলা থেকে পা-পা করে করে সরে এল। দরজায় দিকে তাকাল ভোল। গলা খাঁকারি দিয়ে নীচু গলায় বলল, কই বললে না তো সেকথার জবাব।

কীসের।

ওই যে বললুম।

মাথা নুয়ে পড়ল মানুর। পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলব?

বাঃ, সেটা কি আমি বলে দেব?

জানি না।

এড়িয়ে যাচ্ছ।

দুজনেই চুপ। দূর থেকে একটা চেঁচামেচির আভাস আসছে।

অনেকেই তো আসে। কলেজের অনেক মেয়ের সঙ্গেই তো আসে, পৌঁছে দিয়ে যায়। একসঙ্গে পাশাপাশি গল্প করতে করতে আসে। মানুর কণ্ঠস্বর যেন মেঝেয় মিশে যাচ্ছে। ওরা কিন্তু খুব ভদ্র। আমাদের ক্লাসের সুলেখা আলাপ করিয়ে দিয়েছে একজনের সঙ্গে। রোজ আসে। ওর সঙ্গে সুলেখার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেল ভোম্বল। কারণ সে ভাবতে শুরু করেছে, এতদ্বারা মানু কি এই বোঝাতে চায় যে, যদি বিয়ে করো তাহলেই কলেজ পর্যন্ত সঙ্গে যেতে পারো। কিন্তু মানুকে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাটা মিথ্যে নয়। ওর সঙ্গে গল্পকরা বা একসঙ্গে পথচলার ইচ্ছাটাও সত্যি। অতএব ভোম্বল আর ভাবনাচিন্তা না করে বলল, একদিনেই তো আর ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়নি, তার আগে.. বলেই ভোম্বল থেমে গেল।

মানু চোখ তোলেনি। হঠাৎ প্রাণপণে কিছু বলার চেষ্টায় মুখটা তুলেই সবটুকু ক্ষমতা যেন ওর ফুরিয়ে গেল।

বাবা সামনের বছর রিটায়ার করছে। আমায় বলেছে খবরের কাগজে কর্মখালির কলম যেন রোজ দেখি। আমিই তো বড়ো। আবার প্রাণপণে ও ক্ষমতা সংগ্রহ করল, আমার বিয়ে করলে চলবে কেন।

ভোম্বল দেখছিল মানুর ঠোঁট কেমন থরথর করে কাঁপছে। ও তখন ভাবতে যাচ্ছিল, আর সেই সময়েই দপ করে ঘোষপাড়া লেন অন্ধকার হয়ে গেল।

উঠোনটা অন্ধকার, ভিজে। সাবধানে পেরিয়ে দরজার কাছে ওরা দাঁড়াল। টিমটিমে বালব জ্বলছে ঘরে। বাসন্তী কনুই দিয়ে শেফালিকে খোঁচাল।

ওই কোণের জানলাটা। ফিসফিস করে শেফালি বলল। বাসন্তী আবার খোঁচা দিল।

বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে পিছু ফিরে বসে বাটিতে কিছু-একটা গুলছে। ছেঁড়া কাগজ কুচিয়ে ভাগা দিচ্ছে একটা বাচ্চা। আর একটি মেঝে থেকে খুঁটে খুঁটে মুড়ি খাচ্ছে। বছর দেড়েকের বাচ্চাটি তক্তায় উঠতে গিয়ে কেঁদে উঠল।

তক্তায় এদের মা শুয়ে, চোখ বোজা। হাত দুটি এলানো। ব্লাউজের বোতাম খোলা। ছোটোটি বোধ হয় মাই খাবার জন্য তক্তায় উঠতে চায়। মায়ের কাপড় অসম্ভব ময়লা। পায়ের আঙুলে হাজা। মুখটি হাঁ করা। সম্পূর্ণ চেহারাটি দেখলে মনে হয় বহুকালের বিসর্জিত প্রতিমাকে জল থেকে টেনে তুলে শুইয়ে রাখা হয়েছে। শেফালির মনে হল, মরে পড়ে আছে।

বাচ্চাগুলো ওদের দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে তাকাল। বড়োমেয়েটি টের পেল। সে ফিরে তাকাল।

এবার একটা-কিছু বলতে হয়। যেহেতু এদের মধ্যে বয়স্ক তাই বাসন্তীই বলল, কী হয়েছে?

অসুখ। ঠাণ্ডা নিরুদবিগ্ন স্বরে কথাটি বলে সে বাটিতে কিছু-একটা গুলতে থাকল।

কী অসুখ। শেফালি বলল। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে পা রাখল।

এমনি অসুখ, অনেক দিনের। মেয়েটি ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।

ডাক্তার দেখে না? এবার বাসন্তী।

হাসপাতালে যেত। এখন বাবা গিয়ে ওষুধ আনে।

ওরা দুজন ঘরের ভিতর ঢুকল।

তোমার মা কথা বলতে পারে?

কাল থেকে খুব জ্বর, অজ্ঞানের মতো হয়ে আছে।

বাসন্তী জানলাটার দিকে তাকাল। বন্ধ রয়েছে।

জানলাটা খুলে দাও, ঘরে হাওয়া চলাচল করুক। বলে সে নিজে এগোচ্ছিল জানলাটা খুলতে।

না।

মেয়েটির ঠাণ্ডা গলার স্বরে বাসন্তী জমে গেল।

পাশের বাড়ির ওরা খুব বিরক্ত হয়। এরা তো গোলমাল চিৎকার করে। বাবা তাই সবসময় বন্ধ রাখতে বলেছে।

শেফালি বলল, বাচ্চা ছেলেপুলে থাকলে গোলমাল তো হবেই তাই বলে অসুস্থ মানুষটার কথাও তো ভাবতে হবে। খুলেই দাও, বলুক ওরা যা বলার।

না, বাবা বারণ করেছে। ঠাণ্ডা গলায় আপত্তি জানাল মেয়েটি। বাসন্তী আর শেফালি, মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাহলে আর থেকে লাভ কী, চলে যাওয়াই ভালো।

কিন্তু কেমন যেন বাধোবাধো লাগছে। এভাবে এসেই চলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। বাসন্তী বলল, ওকে হাসপাতালে দিলেই তো হয়।

জবাব পেল না। খুঁটে খাচ্ছিল যে-বাচ্চাটা তাকে টেনে নিয়ে বাটিতে-গোলা জিনিসটি খাওয়াতে থাকল। বছর দেড়েকের বাচ্চাটা হামা দিয়ে শেফালির পায়ের কাছে বসে মুখ তুলে তাকাল। মজা দেবার জন্য শেফালি চোখ দুটো বড়ো করে জিভ বার করল। বাচ্চাটা ধীরে ধীরে হেসে উঠল।

রান্না করে কে, তুমি?

মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। বাসন্তী আবার বলল, সংসারের ঝামেলাতেই সদাব্যস্ত। এসে যে দেখে যাব তার সময় কোথা? এমনভাবে বলল যেন এরা বহুকালের চেনা। এতদিন না আসায় কৈফিয়ত একটা দেওয়া দরকার।

কাচ্চাবাচ্চার সংসার আমাদেরও তো।

তোমার বাবা কখন ফিরবে? শেফালি অনেকক্ষণ চুপ রয়েছে, তাই বলল।

রাত দুটো-আড়াইটে হয়।

এতক্ষণ?

ইভনিং ডিউটি থাকলে রাত হয়। মর্নিং ডিউটি হলে দুপুরে দুটো-আড়াইটেয় ফেরে।

কী কর অতক্ষণ?

কিছু না।

তক্তা বাদ দিয়ে যতটুকু মেঝে, শুয়োপোকার মতো ছেলেগুলি নড়াচড়া করছে। বাচ্চাটা হামা দিয়ে তক্তা ধরে দাঁড়াল। মায়ের একটা পা ধরে টানতে শুরু করেছে। হঠাৎ চোখ খুলল। হাত মুঠো করে মুখ দিয়ে শ্বাস টানছে। দৃষ্টি কড়িকাঠে ঠায় হয়ে রয়েছে। ঘরের কাউকেই দেখছে না।

বাচ্চাটা পেচ্ছাপ করেছে। মেয়েটি ন্যাতা আনার জন্য উঠোনে বেরোল। সে-সময় বাসন্তী বলল, চলো, চলে যাই এবার।

মেয়েটি আসুক। বলে শেফালি তক্তার দিকে তাকাল। মরামানুষের দৃষ্টির মতো তার মুখেই ঠায় তাকিয়ে। মাথাটা ঘোরায়নি। চোখের মণি দুটো কোণে সরে গিয়ে সাদা অংশটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দাঁতগুলো ফাঁক ফাঁক। তাতে হলুদ ময়লা।

বউদি এবার চলো।

শেফালি কথা শেষ করা মাত্রই ঝুপ করে ঘোষপাড়া লেনে অন্ধকার লাফিয়ে পড়ল। শিউরে কাঠ হয়ে গেল শেফালি। কে কঠিনভাবে তার হাতটা আঁকড়ে ধরেছে। ঘরটা স্তব্ধ। কে যেন ভারী হয়ে শ্বাস টানছে।

প্রথমে কেঁদে উঠল ছোটো বাচ্চাটা, তারপর একে একে বাকিরা। বড়োমেয়েটি অন্ধকারেই ঘরের মেঝেতে ন্যাতা বোলাল। বাসন্তী বলল, মোমবাতি কি। হ্যারিকেন এসব কিছু নেই?

না।

ফিসফিস করে শেফালি বলল, আমার আঁচলে একটা সিকি আছে। খুলে নিয়ে ওকে দাও। মোমবাতি আনুক।

অন্ধকার কঠিনভাবে ওর হাত ধরে রয়েছে। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল মরে গেছে।

বস্তির গলিটা দিয়ে প্রায় ছুটছিল ফ্যালা। হাতে মোটরের চাকা। মোটর গাড়ির পিছনের ক্যারিয়ারে বাড়তি যেটা থাকে সেই জিনিস। অন্ধকারে ধাক্কা লাগল সামনের একজনের সঙ্গে। টায়ারটা হাত থেকে পড়ে গেল। লোকটা বলল, আস্তে চলুন-না, দেখছেন না কী অন্ধকার। ফ্যালা জবাব দিয়ে কথা বাড়াল। লোকটা কালীবাবু।

রাস্তায় উবু হয়ে বসে ফোঁপাচ্ছেন বাসুদেব নাগ। ছেলে-মেয়েরা গোল হয়ে ঘিরে। স্ত্রী মাথায় জল ঢালছে। সামনের বাড়ির একজন লম্প হাতে দাঁড়িয়ে। বাসুবাবুর মাথা ফেটেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তিনি বললেন, সব তোমার জন্য, এ সব তোমার জন্য। ছেলে-মেয়ে-সংসার সব ফেলে রেখে যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাব। বুঝবে কী করে সংসার চলে। কত অপমান সয়ে চলতে হয়।

বাসুবাবুর স্ত্রী সাত চড়ে রা করেন না। তিনি জল ঢালতে লাগলেন।

মানু বলল, আমি এখন যাই।

ভোম্বল বলল, কেন যেতে তো বলছি না।

মানু বলল, না অন্ধকারে আমাদের দুজনের থাকা উচিত নয়।

ভোম্বল বলল, কথা উঠবে, অপবাদ দেবে?

মানু বলল, হ্যাঁ, তাতে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হবে।

দুজনেই চুপ করে থাকল। ভোম্বল হাত বাড়িয়ে মানুর হাত চেপে ধরল। মানু বলল, ছেলেদের অনেক সুবিধে, বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় না। যদি ছেলে হতুম।

তাহলে তোমায় দেখবার জন্য কষ্ট করে জানলায় দাঁড়াতুম না। অবশ্য তুমি যদি চাও তাহলে এবার থেকে মেয়ে হিসেবে তোমায় আর ভাবব না।

বেড়ালের মতো নেমে এসে পারুল বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথাধরা সেরে গেছে। ঘুম পাচ্ছে। বুড়িটা চ্যাঁচাচ্ছে, বলে ছেলের আবার বিয়ে দেব। দিয়ে দ্যাখো না, সেও আটকুড়ি থাকবে। পুজো-মানত-মাদুলি কত কী তো হল, তাতে কি ফল ফলল? যত্তসব ধাপ্পা। বাসন্তীর ছেলে হয়েছে। পারুল ভাবল, তাহলে আমারই-বা হবে না কেন?

একসময় ঘোষপাড়া লেনে আবার আলো জ্বলে উঠল। ইতিমধ্যে ধূসর রঙের সেই মোটর গাড়িটা কখন চলে গেছে। বেড়ালবাচ্চাটা চটকে পড়ে রয়েছে।

একমাত্র সত্যচরণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবল, মৃতদেহটার সদগতি না করলে কাল সকালেই তো কাক আর কুকুরে মিলে সারা রাস্তাটাকে নোংরা করবে।

ফুলদানি

শৈলেনের একবার কিছুদিনের জন্য ইচ্ছে হয়েছিল ডায়রি লেখার। সে প্রথম লাইনটা লেখার জন্য তিন রাত ভেবে একদিন সকালে লিখল— আমার নাম শৈলেন্দ্রনাথ বারিক, আমি ছাব্বিশ বছর যাবৎ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছি।

লেখার পর তার মনে হল, বড্ড সাদামাটা লাগছে। খুব পন্ডিত লোকেরা এইভাবে সাদামাটা লিখে বা কথা বলে নিজেদের জাহির করে। সুতরাং, ভাষায় আড়ম্বর থাকা উচিত। আড়ম্বরপূর্ণ শব্দ খুঁজতে হলে তাকে অভিধানের পাতা ওলটাতে হবে। অবশ্য অভিধান একটা রয়েছে কিন্তু বার বার পাতা উলটে একই শব্দ বার বার ব্যবহার করলে সেটা বোকামিই হবে।

শৈলেন সেদিন খাতাটা বন্ধ করে রাখে। পরদিন সে লিখল—আমার বিবাহ হয় ছাব্বিশ বছর আগে।

তার কাছে এই লাইনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ছাব্বিশ বছর আগেই সে উলটোডাঙা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ভগবতী ইনস্টিটিউশন—যাকে পাড়ার লোকেরা ভগবতী পাঠশালা বলে, সেখানে চাকরি পায়। তার আগে সে স্কুল ফাইনাল ফেল করার পর দপ্তরির কারখানায় ছাপা ফর্মা ভাঁজ করার কাজে ঢুকেছিল। বছর দুই পর সেখান থেকে ছেড়ে সে আসে স্কুল বইয়ের এক প্রকাশকের দোকানে। কাউন্টারে বসে বই বিক্রি করার চাকরি। এখানে থাকাকালেই সে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল আর পি ইউ পরীক্ষা পাস করে। দোকানের মালিক তাকে খুবই সাহায্য করেছিল পড়ার ব্যাপারে।

এই দোকানেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ভগবতী পাঠশালার মালিক এবং হেডস্যার রবীনবাবুর। কথায় কথায় যখন তিনি জানলেন শৈলেন শুধু তাঁর জেলারই নয় একই মহকুমার ছেলে, তারপর তিনি বিশেষ স্নেহভরে তার সঙ্গে কথা বলতেন। রবীনবাবুর একটা প্রাইমারি বাংলা বই ছাপার কাজ চলছিল। ছাপাখানা থেকে খুব জরুরি তাড়া দেওয়ায় শৈলেনকে একদিন দুপুরে প্রুফ নিয়ে পাঠশালায় রবীনবাবুর কাছে যেতে হয়েছিল। যখন তিনি প্রুফ দেখছিলেন শৈলেন তখন খেলাচ্ছলেই হোক, কৌতূহলেই হোক বা সময় কাটাবার জন্যই হোক চারটি ক্লাসের প্রায় পঁচিশটি ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর ভার নিয়েছিল। পড়ানো বললে ভুল হবে, সামলানোই বলা উচিত।

প্রুফের বাণ্ডিল শৈলেনের হাতে দেওয়ার সময় রবীনবাবু বলেছিলেন, এখানে বাপ মায়েদের খুব ইচ্ছে বাচ্চাদের লেখাপড়া করাবার, তবে খুবই গরিব, কাছাকাছি প্রাইমারি স্কুলও নেই। ভাবছি আর একটা ঘর নেব। দেখলুম ভালোই তো পড়ালে, পড়াবে? আরে দোকানের কর্মচারী থাকার চেয়ে মাস্টারিতে সম্মান আছে।

এ হল ছাব্বিশ বছর আগের কথা। শুধুমাত্র সম্মানের লোভেই সে পঁচিশ টাকা কম বেতনে মাস্টার হয়। তখন সে থাকত শ্যামপুকুরে বাবা-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে। পঁচিশ টাকা তখন অনেক টাকা। পরিবারের সবাই, এমনকী পাশাপাশি ঘরের লোকেরাও বলল, এতগুলো টাকা! কাজটা বোকার মতো হল।

কয়েক দিন মাস্টারি করার পর সে বেবিকে তার কর্মস্থল দেখাতে নিয়ে গেছল। বেবির পোশাকি নাম শুভ্রা। বয়সে তার থেকে এক বছরের ছোটো। যোগ-বিয়োগ পর্যন্ত কষতে পারে, গুণ-ভাগ পারে না। সিনেমার ম্যাগাজিন কোনোক্রমে পড়তে পারে, খবরের কাগজ পারে না। বেবি ক্লাস ফাইভেই লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। ওর মা হাসপাতালে আরার কাজ করত, তাকেও ওই কাজে ঢোকাবার চেষ্টা করছিল।

বেবির চোখ মুখের ভাব বদলে গেল চেয়ারে বসে শৈলেনকে পড়াতে দেখে। ছেলে মেয়েদের স্যার বলা, ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ির খসখসে শব্দ, ধমক দেওয়া, বাইরে যাওয়ার জন্য ভয়ে ভয়ে অনুমতি চাওয়া, এসবের থেকেও মুগ্ধ করে এতাবৎকাল তার কাছে অনাবিষ্কৃত শৈলেনের এই গাম্ভীর্য। তার মনে হয়েছিল মুখচোরা ছেলেটা এখন ভারিক্কি একটা লোক হয়ে গেছে!

এসব অবশ্য বিয়ের পর প্রথম সাত দিনের মধ্যেই সে বেবির কাছ থেকে শুনেছিল। বেবি আরও দু-বার নতুন ঘরের পাঠশালায় এসে একধারে বসে তার পড়ানোে দেখেছে। দুখানা বাড়ির পরেই পুরোনো ঘরে রবীনবাবু উঁচু ক্লাসেরর ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। ওই ঘরেই থাকতেন, বেঁধে খেতেন, ছুটিতে গ্রামে যেতেন।

প্রথম যেদিন সে মাইনে পেল সেদিন সন্ধ্যায় সে হাতিবাগানের এক রেস্টুরেন্টে বেবিকে কবিরাজি কাটলেট খাইয়েছিল। খেতে খেতে বেবি বিয়ে করার কথাটা মনে করিয়ে দেয়। শীতলা প্রতিমার সামনে শৈলেন পুজোর ফুল হাতে নিয়ে যেকথা দিয়েছিল, বেবি সেটা তাকে ভুলে যেতে দেবার পাত্রীই নয়।

শৈলেন তখন স্বর্গের কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়। মাথা কাত করে জানিয়ে দিয়েছিল, কথা রাখবে। টিপ টিপ বৃষ্টিটা ঝমঝমিয়ে নামল যখন তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোয়। দৌড়ে বারান্দার নীচে গিয়ে ভিড় ঘেঁষে তারা দাঁড়ায়। বৃষ্টি এবং ভিড় দুটোই যখন বাড়ল, জলের ছাট যখন লোকেদের পিছিয়ে এনে ভিড়টাকে জমাট করে দিল। তখন বেবির পাছা তার দুই ঊরুতে চেপে রয়েছে।

একটা নতুন ধরনের আমেজ এবং শিহরন শৈলেন বোধ করেছিল, তার একটা হাত ধরে বেবি আঙুলে আঙুল জড়িয়ে রাখে। বাঙালি মেয়ের শরীর সাধারণত যেমন হয় বেবি তার থেকে একটু পুষ্ট, দেহে সামঞ্জস্য আছে এবং মুখখানি মোটামুটি সুন্দর। তার হাতটাকে বেবি বুকের কাছে তুলে এনে চেপে ধরেছিল। বেবি শোভনতার ধার বিশেষ ধারত না। বেপরোয়া আচরণ ও তাৎক্ষণিক আবেগ সামলাবার মতো শিক্ষাদীক্ষা তার নেই।

বৃষ্টি ধরে যাবার পর প্রায় নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটার সময় বেবি বলেছিল, দেরি কোরো না। তোমরা নীচু জাত, মা আপত্তি করবেই আর তোমার বাপ-মাও আমাকে বউ করে ঘরে তুলবে না। তাতে বয়েই গেল, আমরা কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করে আসব।

শৈলেন আমতা আমতা করে বলেছিল, এই মাইনেতে কি আলাদা ঘর নিয়ে চালানো যাবে?

ও আমি চালিয়ে নোব। বেবি এই বলে ফুঁ দিয়ে সমস্যাটা উড়িয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে ঢোকার সরু গলিটা অন্ধকার। শৈলেন আচমকা একটা দুর্দান্ত চুমু পেয়েছিল বেবির কাছ থেকে।

বেবির আন্দাজে মোটেই ভুল ছিল না। দুই পরিবার থেকে প্রবল আপত্তি ওঠায় তারা কালীঘাটেই বিয়ে করে এবং দু-দিন পর ভগবতী পাঠশালার কাছাকাছি মুরারিপুকুর বস্তির একটা ঘরে এসে ওঠে।

শুরু থেকেই তাদের যৌথ জীবনে বেবি একদমই সুখী হয়নি। শৈলেনও নয়, কারণ বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই বেবি বলতে শুরু করে, তার মা আর বন্ধুরা নাকি পইপই বলেছে এই বিয়ে এক মাসও টিকবে না। শুনতে শুনতে শৈলেন ব্যাজার হয়ে উঠত বটে কিন্তু প্রকৃতিতে সে ঠাণ্ডা, কোনো কিছুতেই চঞ্চল হয়ে পড়ে না। বিয়েটাকে সে শ্যামপুকুর থেকে মুরারিপুকুর ঘর বদলের ব্যাপার হিসেবে ধরে নেয়।

মাসের শেষে সে মাইনের টাকা বেবির হাতে তুলে দিত। তাই থেকে তিরিশটা সিগারেটের দাম বাবদ দশটা টাকা সে পেত, রাতে শোবার আগে একটি করে সিগারেট খাওয়ার জন্য। মাইনের টাকা যথেষ্ট নয়, তাই সে সকালে ও রাত্রে দুটি টিউশনি নেয় ফলে নব্বই টাকা আয় বাড়ে।

কিন্তু তাদের বিয়ে এক মাসের বেশিই টিকেছিল। পুরো পাঁচ বছর। বেবি তাকে ছেড়ে যখন চলে যায় তখন শৈলেনের বয়স উনত্রিশ, বেবির আটাশ। ঝগড়াঝাঁটি প্রায়ই হত। তার আয়ের স্বল্পতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভীরুতা ইত্যাদি নিয়ে বেবি কুশ্রী ভাষায় আক্রমণ করত, হাতের কাছে যা পেত ছুড়ে মারত। তাদের জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। শৈলেনের তখন মনে হত, যেদিন থেকে পরস্পরের দিকে তারা চোখ ফেলেছে সেই দিন থেকেই ঝগড়া ছাড়া আর কিছু যেন তারা করেনি। চিরজীবন ধরে তারা শুধু যন্ত্রণাই ভোগ করে আসছে, এর আর বিরাম নেই। যতদিন তারা একসঙ্গে থাকবে ততদিন এইভাবেই চলবে। কিন্তু একুশ বছর পর এখন শৈলেনের মনে হচ্ছে—মাঝে মাঝে তখনও অবশ্য মনে হত, তাদের তখনকার জীবনের অনেকটা সময়ই টক ঝাল মিষ্টি স্বাদে ভরা ছিল। বেবিকে তার মন্দ লাগত না।

বেবির গৃহত্যাগের আগেই শৈলেনের মনে এই ধারণাটি তৈরি হয়ে গেছল, স্বামী এবং স্ত্রী হিসেবে তাদের জন্য বরাদ্দ সময়সীমা এবার বোধ হয় তারা অতিক্রম করতে চলেছে। দাম্পত্য জীবনের সবথেকে বিশ্রী ঝগড়াটি একদিন তাদের মধ্যে ঘটে যেতেই সে বুঝেছিল ভাঙন আসবে।

একদিন রাতের খাওয়া সেরে সিগারেট শেষ করে শৈলেন বিছানায় চিত হয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিল। চমৎকার জমাটি গল্প, কুঁদ হয়ে গেছল বইয়ের মধ্যে। বেবি দরজার কাছে মোড়ায় বসে উল বুনছিল। নিজের জন্য কার্ডিগান। হঠাৎ সে বলল, আজকাল তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ, আমার দিকে আর তাকাই না।

শৈলেন কথাটা শুনতে পেল না। উপন্যাসে মগ্ন হয়ে থাকলে শোনা সম্ভব নয়, বিশেষত কথাগুলো খুব মৃদুস্বরে বললে। কিছুক্ষণ পরে বেবি অধৈর্য স্বরে বলল, কথা কানে গেল

হাসিমাখা মুখটা বই থেকে তুলে এক বার বেবির দিকে তাকিয়েই শৈলেন আবার পড়ায় ডুবে গেল।

এত পড়লে চোখ খারাপ হয়ে যায়। বেবি কথাটা বলল, শৈলেনের বই পড়া বন্ধ করার জন্য।

খারাপ হয় না। শৈলেন বই থেকে চোখ না তুলেই বলল।

বাবা বলত শুধু গবেটরাই বই পড়ে, ওদেরই তো শিক্ষাদীক্ষার দরকার হয়।

কথাটা শৈলেনের কানে বাজল, মাথাটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল। বইয়ে চোখ রেখেই গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার বাবা কথাটা বলেছেন যেহেতু তিনি লেখাপড়া কখনো করেননি, তাই যারা লেখাপড়া করে তাদের হিংসে করতেন।

তোমাদের মতো বিদ্যের গোবরপোরা মাথাওলাদের হিংসে করার কোনো দরকার হয় না। বেবি চিবিয়ে কথাটা এমনভাবে বলল যাতে শৈলেনের বুঝতে অসুবিধা না হয় কার উদ্দেশে কথাগুলো বলা। শৈলেন টের পাচ্ছে, ঝড় এল বলে।

তুমিও তো বই পড়তে পার, পড় না কেন? শৈলেন বলল বটে কিন্তু জানে বেবির কাছে। বই বিষবৎ পরিত্যাজ্য বস্তু।

আমার তো ভীমরতি ধরেনি, কাজ করতে হয় আমাকে। মুখ বেঁকিয়ে ঘৃণা ঝরিয়ে সে বলল।

এবার শৈলেন ঝাঁঝিয়ে উঠল তবে গলা নামিয়ে, কেননা বেবিকে খেপিয়ে তুলে বই পড়াটা সে মাটি করতে চায় না। এখন এসব কথা থাক, বলার একটা সময় আছে। বইটা আমায় পড়তে দাও, ক্লান্ত লাগছে।

ক্লান্ত? তুমি তো সবসময়ই ক্লান্ত। বেবি বেশ জোরেই হেসে উঠল। পাঠশালার পন্ডিত তার আবার ক্লান্তি। বসে বসে বাচ্চাদের অ আ না-শিখিয়ে, একটু খাটাখাটনি করে দুটো পয়সা আনার চেষ্টা করো-না যাতে বাসনমাজার একটা লোক অন্তত রাখা যায়।

শৈলেন কথা না বাড়াবার জন্য চুপ করে রইল। তাইতে বেবির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। হাত থেকে বইটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সে বলল, খালি বই বই আর বই, গাধারও অধম। বইটা দরজা দিয়ে সে উঠোনে ছুড়ে ফেলল।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে শৈলেন একটা চড় কষাল বেবির গালে। পড়তে তার খুবই ভালো লাগছিল তো বটেই, তা ছাড়া ওটা লাইব্রেরির বই। নষ্ট হলে, ছিঁড়ে গেলে ফাইন দিতে হবে, তেমন হলে হয়তো পুরো দামটাই।

বেবি গালে হাত দিয়ে অদ্ভুত চোখে শৈলেনের দিকে তাকিয়েছিল জ্বালাভরা চোখে চোখে জল টেনে আনেনি কারণ সেটা তার প্রকৃতিতে নেই। শৈলেনের তখনই মনে হয়েছিল তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক আর টিকবে না। এটা ভেবে সে দুঃখ বোধ করেনি, বুকও ভেঙে যায়নি। বরং ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় তাদের ছেলেপুলে না হওয়ার জন্য। একবার বেবি গর্ভবতী হয়েছিল বটে কিন্তু বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা হলে কে জানে, সংসারটা হয়তো একটু সহনীয় হত।

বইটা উঠোনে ছুড়ে ফেলার এক মাস পর বেবি ঘর ছেড়েছিল। প্রায় দুপুরেই সে শ্যামপুকুরে মা-র কাছে চলে যেত। সেখানেই আলাপ এবং ভাব হয় যাত্রার এক ছোটোখাটো অভিনেতার সঙ্গে। যাত্রায় সুযোগ করে দেবে এই আশায় বেবি লোকটির সঙ্গে পালায়।

একদিন পাঠশালা থেকে ফিরে শৈলেন একটা চিরকুট বিছানার ওপর পেয়েছিল। পাঠশালার পড়য়াদের মতো হাতের লেখায় আমি চিরকালের মতো চলে যাইতেছি আর ফিরিব না কথা ক-টি তাতে লেখা। শৈলেন স্তম্ভিত হওয়ার মধ্যেই হাঁফ ছেড়েছিল। চিৎকার চেঁচামেচি হল না, জিনিসপত্তর ভাঙা বা ছোড়াও হল না। কেমন দিব্যিই সে শান্তিতে একা হয়ে গেল। কাগজটার ওপর চোখের জলের দাগ নেই। মাত্র আটটি শব্দ ছেঁড়া হ্যাণ্ডবিলের উলটোদিকে পেন্সিলে লেখা। কাগজটা ভাঁজ করে সে ঘরের তাকে রাখা অভিধানের পাতার মধ্যে রেখে দিয়েছিল। কেন যে রেখেছিল তা সে জানে না। একুশ বছর পরও সেটা ওখানে রয়েছে।

যাত্রার সেই অভিনেতার সঙ্গে বেবি শ্যামপুকুরেই একটা গলিতে বসবাস শুরু করে। লোকটি মদ খেত এবং প্রায় রাতেই বেবিকে ঠ্যাঙাত। পাড়াপ্রতিবেশীররা অতিষ্ঠ হয়ে থানায় নালিশ জানায়। অবশেষে একদিন তারা কোথায় যেন চলে যায়। এসব কথা শৈলেন শুনেছিল তার ছোটোবোনের কাছে। বাড়ির লোকেরা ভেবেছিল দাম্পত্য সম্পর্ক ফিরে পাবার জন্য, অর্থাৎ পৌরুষের মর্যাদা রাখার জন্য শৈলেন মামলা ঠুকবে বেবির নামে। কিন্তু সে অমন কোনো চিন্তাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেয়নি।

শৈলেনের জীবনের যে-ছকটা বিবাহিত জীবনে গড়ে উঠেছিল সেটা অবশ্যই নাড়া খেয়েছিল এই ঘটনায়। পাঁচ বছর একই ঘরে একটি মেয়ের সঙ্গে বসবাস করার পর তার অভাব তো তারা পেয়েছে। বেবির হঠাৎ চলে যাওয়ার পর ঘরের দেওয়াল, সিলিং, টেবিল, বিছানা সব কিছুই শৈলেনের চোখে অন্যরকম ঠেকেছিল। তার নিজের ভিতরটাও কেমন যেন পালটে গিয়েছিল। তখন সে মনে মনে বার বার নিজেকে বলল, বেবি চলে গেছে তো কী হয়েছে, সব একইরকম আছে, কিছু বদলায়নি। প্রথম প্রথম ঘরে ফিরে সময় কাটাতে তার খুবই অসুবিধা হত। নিজেকে টানতে টানতে একাকী দিন কাটানোটা তাকে শিখতে হয়েছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সকাল আর সন্ধ্যা তার জীবনে এল আর চলে গেল। নিঃসঙ্গতা আর বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সে সুখী বোধ করতে থাকে। পৃথিবী থেমে নেই, শৈলেনের মনে হয় সেও চলেছে এর সঙ্গে।

কয়েক বছর পর রবীনবাবু একবার দেশে গিয়ে অসুস্থ হলেন। চিঠি এল, স্ট্রোক হয়ে শরীরের একটা দিক পড়ে গেছে। চার মাস পর চিঠি এল তিনি মারা গেছেন। ভগবতী ইনস্টিটিউশন চালাবার ভার শৈলেন নিল। দিন তার ভালোই কেটে গেছে। হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করে ঘরেই খাবার এসে যায়। কেরোসিন স্টোভে খাবার গরম করে নেয়, চা বা জলখাবার করে। ট্রানজিস্টর রেডিয়ো শোনে, বই পড়ে। টিউশনি বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে। নিঃসঙ্গ বোধ করলেও শান্তিতেই সে দিন কাটাচ্ছে। দুপুরে স্কুলে-পাওয়া বহু মুখ বহু কথা তাকে রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয়। শৈলেন নিজের মতো করে সুখীজীবন তৈরি করে নিয়েছে।

এইভাবেই বারোটা বছর কেটে গেছে। বেবি সম্পর্কে শৈলেন এইটুকু মাত্র জানতে পেরেছে, সেই যাত্রার অভিনেতা শ্রীরামপুরে লন্ড্রির দোকান এবং বিয়ে করে ছেলেপুলে নিয়ে সংসারী। বেবি এন্টালিতে বাস করছে হোটেলের এক বেয়ারার সঙ্গে। একদিন সন্ধ্যা বেলায় বেবি দেখা করতে এল তার সঙ্গে।

শৈলেন তখন রাস্তার পানের দোকান থেকে প্রতিদিনের মতো রাতের জন্য সিগারেট কিনছিল। পর পর দু-দিন এই সময় লোডশেডিং হওয়ায় দোকানি মোমবাতি আর দেশলাই নিয়ে তৈরি হচ্ছে। উনুন ধরানোর ধোঁয়া বস্তির উপর মেঘের মতো বিছিয়ে রয়েছে। রাস্তায় বাচ্চাদের হুটোপুটি এখনও অব্যাহত। শৈলেন সিগারেট নিয়ে দূরে বাসরাস্তার দিকে তাকিয়েই ওকে দেখল এবং মুহূর্তেই চিনতে পারল।

বারোটা বছরে মানুষ এমন-কিছু বদলায় না যে তাকে দেখে চেনা যাবে না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বারো বছর পর চেনার জন্য অন্তত দ্বিতীয় বার তাকাতে হবে। দ্বিতীয় বার তাকিয়ে শৈলেন অল্প ধাক্কা খেল। বেবির হাটার ভঙ্গিতে আগের ঔদ্ধত্য যেন আর নেই। এখন অনেক মন্থর, যেন বারো বছর ধরে তার স্বাভাবিক মোরগের মতো চলন নিয়ে হাঁটতে গিয়ে অবিরাম সে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে গেছে। অনেক মোটা হয়েছে। ফুল লতাপাতার ছাপ-দেওয়া গোলাপি আর বেগুনি রঙের কমদামি সিন্থেটিক শাড়ি ওর পরনে। চুল এলোমেলো, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা।

ওকে দেখে শৈলেন খুশি বা অখুশি কিছুই হল না, তবে বুকের মধ্যে এক বার ছ্যাঁত করে উঠেছিল আর অবাক তো হলই। বেবিকে সে ভুলেই গেছল। দিনগুলো যতই ওর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে ততই তাদের বিবাহিত জীবন কুঁকড়ে একটা বছরে, একটা মাসে, একটা দিনে, একটা ফুলকিতে পরিণত হয়েছে। নিঃসঙ্গ জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেবি তার স্মৃতির বাইরে চলে গেছে।

যদিও বেবির হাঁটার ধরন বদলে গেছে তবু শৈলেন আশা করল হয়তো বলবে : এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসব এখানে হয়তো ভাবনি, তাই না?

বেবি সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেমন আছ, বলেই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। শৈলেন ওর পিছু নিল। বাড়ির দরজায় এসে বেবি থমকে গিয়ে বলল, অনেক দিন পর।

হ্যাঁ, অনেক দিন পর। শৈলেন ঘরের দরজা খোলার সময় কোনোক্রমে একই কথা বলল তবে বেবির মতো স্বাচ্ছন্দ্যে নয়। আঁচলটা পিঠের উপর টেনে দিয়ে বেবি এমন ভঙ্গিতে ঢুকল যেন ঢোকা নয়, ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

তারপর, চলছে কেমন? শৈলেন চেয়ারের পিঠটা ধরে জিজ্জাসা করল। ওর হঠাৎ আবির্ভাবে খানিকটা নাড়া যে সে খেয়েছেই সেটা বোঝা গেল রাতের সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে দেশলাই খোঁজার মধ্য দিয়ে।

ভালোই চলছে। বেবি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না। দিনে কটা সিগারেট খাও এখন?

শৈলেন তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ঠোঁট থেকে তুলে নিল। একটাই, রাতে। অভ্যেসটা রেখেছি।

একা নিজের দেখাশোনা ভালোই পার দেখছি।

না পেরে উপায় কী। শৈলেনের গলার বিদ্রুপ নেই। সে লক্ষ করল বেবির ঠোঁটে লিপস্টিক, যা আগে কখনো দেখেনি। ঘামে-ভেজা পাউডার গলার ভাঁজে। বেবিকে বয়স্কা মনে হচ্ছে অন্যরকমভাবে। এর বদলে মুখে কিছুই না মাখলেই বরং শৈলেনের মনে হল ওকে কমবয়সি দেখাত। বারো বছর আগে ও যা ছিল সেটা আড়ালে রাখার জন্য যেন হালকা ছদ্মবেশ মুখে পড়েছে।

চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে শৈলেন বলল, বসো, জিরোও।

চেয়ারে বসে মুখ তুলে বেবি সামনের দেওয়ালের কুলঙ্গিটার দিকে চেয়ে রইল। শৈলেন। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তারা এখানে আসার পর রবীনবাবু চিনেমাটির একটি ফুলদানি উপহার দিয়েছিলেন। সাদা জমিতে সবুজ লতাপাতা, সোনালি বর্ডার আর লাল ফুল। গলার কাছটা কলসির মতো সরু। রজনিগন্ধার এক হাত লম্বা ছড় ওতে ভালোমতোই রাখা যায়। প্রথম প্রথম শৈলেন রাখত। বেবিও ফুল কিনে আনত। একদিন তপ্ত কথাকাটাকাটির চূড়ান্ত পর্যায়ে বেবি ফুলদানিটা তাকে লক্ষ করে ছুড়েছিল। শৈলেন হাত দিয়ে আটকায় কিন্তু মেঝেয় পড়ে সেটির তলার কানা ভেঙে যায়, মাঝখানের অংশ থেকে খানিকটা চকলা খসে পড়ে। তা ছাড়া পলকাটা গলা থেকে একটা পলও ভাঙে। ফুলদানিটা বেবির খুব পছন্দের ছিল। ফুল না থাকলে সাবান জলে ধুয়ে সে টেবিলে রেখে দিত ঘরে শোভা আনার জন্য। দুজনের সম্পর্কটা যখন ভালো থাকত তখন শৈলেন বলত, খালি ফুলদানিতে ভূত এসে বাসা বাঁধে।

এখন করছ কী? চলছে কেমন?

ভালোই আছি।

বেবি আগের মতো আর অনর্গল কথা বলছে না। শৈলেন এটার সঙ্গে আরও লক্ষ করল কথার মধ্যে আগের মতো কামড় নেই, স্বরটা চাপা আর সাদামাটা। এর কারণ হিসেবে

শৈলেন ভাবল, হয়তো সেই পুরোনো ঘরে এত বছর পরও আবার তাকে দেখতে পাওয়ায়, যাবার সময় ঘরে সব কিছু যেমন ছিল ঠিক তেমনটিই রয়ে যাওয়ায় বেবি হয়তো আশ্চর্য বোধ করছে। ট্রানজিস্টরটাই শুধু তার কাছে নতুন।

কাজকম্ম কিছু করছ?

প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্যই বোধ হয় না-শোনার ভান করে বেবি ফুলদানির দিকে তাকিয়ে রইল। ভাঙা টুকরোগুলো কুড়িয়ে শৈলেন ওর মধ্যেই রেখে দিয়েছিল। ফুলদানির আর দাঁড়াবার মতো অবস্থা ছিল না, কাগজ মুড়ে শোয়ানো ছিল কয়েক বছর। একদিন শৈলেন আঠা দিয়ে তলার টুকরোগুলো লাগিয়ে ফুলদানিটাকে দাঁড় করায়।

থাক কোথায় এখন?

বেবি মাথায় হাত বোলাল। শৈলেনের চোখে পড়ল দু-তিনটে রুপোলি চুল। এন্টালিতে থাকি।

ইতস্তত করে শৈলেন বলল, একা?

হ্যাঁ। কথাটা বলেই বেবি মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাল। শৈলেনের মনে হল ওর জীবনীশক্তির অনেকটাই ক্ষয়ে বেরিয়ে গেছে। চাহনিতে আগেকার সেই মজাদার ঝকঝকানিটা স্তিমিত পান্ডুর লাগছে। চোখের চারধারে দাগ আর কালি জানিয়ে দিচ্ছে বয়স হয়েছে।

মাথাটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে তুলে বেবি বলল, তুমি সেই আগের মতোই ভ্যাদভ্যাদেই রয়ে গেছ।

তা রয়ে গেছি।

যদি না রইতে, গলায় কোনোরকম আবেগ না এনে বেবি বলল, তাহলে আমরা হয়তো…।

বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হইচই, ঝগড়াঝাঁটি, আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ।

বেবি হেসে মাথাটা হেলাল, অনেক বই দেখছি।

সময় কাটাতে হবে তো।

কিছুক্ষণ কেউ আর কথা বলল না। রেডিয়োয় এই সময় খবর হয়। শৈলেন নিয়মিত তা শোনে। আজ সে রেডিয়ো খুলল না।

ফুলদানিটা আমার খুব পছন্দ।

ওটা চাই তোমার? নিতে পারো।

সত্যি সত্যি দেবে?

নিশ্চয়। আমার তো কোনো কাজে লাগে না এই ভূতের বাসাটাতে। তবে তলাটা আঠা দিয়ে জোড়া, আলতোভাবে বসিয়ে রাখতে হয়।

শৈলেন সন্তর্পণে ফুলদানিটা তুলে নিয়ে ফু দিয়ে ধুলো ঝাড়ল। আরও সবধানে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছল। ঝকঝক করছে সবুজ, লাল, সোনালি, সাদা রং। খবরের কাগজে সেটা মুড়ে সুতো দিয়ে বাঁধল। এই নাও। শৈলেন টেবিলে রাখল ফুলদানিটা।

বেবি উঠে দাঁড়াল। এইবার যাই, পরে আর একদিন আসব।

নিশ্চয় আসবে। যখনই ইচ্ছে হবে…আমরা তো শত্রু নই।

কাগজে-মোড়া ফুলদানিটা তুলে বেবি সারা ঘরে এক বার চোখ বুলিয়ে আসি বলে বেরিয়ে গেল। তাকে এগিয়ে দেবার জন্য শৈলেন ঘর থেকে বেরোল না। অনেকক্ষণ পর, হিমালয়ভ্রমণ বিষয়ে বইটা পড়তে পড়তে মনে হল বেবিকে তো জিজ্ঞাসা করা হল না ছেলেপুলে হয়েছে কি না। তারপর মনে পড়ল, বেবি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সে হেসেছিল, তার উত্তরে বেবি শুধু যান্ত্রিকভাবে ঠোঁট দুটো টেনে ধরে। আগের মতো ঠোঁটটেপা হাসির মতো কিছু-একটা পাবে, শৈলেনের সে-আসা পূর্ণ হয়নি।

কয়েক দিন পর এক সকালে শৈলেন লন্ড্রি থেকে কাপড় আনতে যায়। লন্ড্রির পাশে ভাঙা পুরোনো জিনিসের দোকান। কাচা ধুতি ও পাঞ্জাবি এবং খুচরো পয়সাগুলো নিয়ে ফেরার সময় সে পাশের দোকানটার দিকে এক বার তাকাল। একটা ভাঙা সেতার আর কাঠের টেবিল-ল্যাম্পের মাঝে দেখতে পেল সেই ফুলদানিটা, কয়েক দিন আগে যেটা সে বেবিকে দিয়েছিল। নিশ্চিত হবার জন্য সে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে ফুলদানিটা দেখল। তার ভুল হয়নি, উপরের একটা পল ভাঙা, গায়ের চকলা ওঠা।

প্রায় এক মিনিট সে তাকিয়ে রইল। কী করে এটা এখানে এল তার বোধগম্য হচ্ছিল না। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করবে কি না ভেবেও সে তা করল না। নিশ্চয় বেবিই সেদিন ফেরার সময় এখানে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। অভাবের তাড়না ছাড়া এমন কাজ করবেই-বা কেন। বেচারা বেবি! টাকার যদি দরকার তো চাইলেই পারত।

ফুলদানিটা হাতে নিয়ে শৈলেন দোকানদারের দিকে তাকাল। কত?

লোকটা তীক্ষ্ণ একটা চাউনিতে শৈলেনের মুখটা দেখে নিয়ে বলল, ছ-টাকা।

দরাদরি করলে কমানো যাবে কিন্তু শৈলেনের স্বভাবটা তেমন নয়। এক কথাতেই সে দাম চুকিয়ে ফুলদানিটা তুলে নিল।

কেন জানি শৈলেনের মনে হতে লাগল, বেবি আবার আসবে। এবং কয়েক দিন পর সত্যিই এল, সেই একই সময়ে, সেই একই শাড়ি পরে। ওর মুখ দেখেই তার মন হল বেবি প্রচন্ড ক্ষুধার্ত।

পাঊরুটি আর ডিমসেদ্ধ আছে, চলবে?

বেবি মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবল। দাও। কিন্তু তোমার?

আমি এইমাত্র খেলাম। তবে আর এক কাপ চা খাব, তোমার সঙ্গে। শৈলেন যে মিথ্যা বলল বেবি সেটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এই নিয়ে ঢং না করায় শৈলেন স্বস্তি পেল।

বেবির খাওয়ার সময় ওর মুখের দিকে তাকবে না ঠিক করেই সে পিছন ফিরে চা করতে বসল। কেউ সামনে বসে তাকিয়ে থাকলে খেয়ে তৃপ্তি হয় না। কুলুঙ্গিটা বেবির সামনেই। নিশ্চয় এতক্ষণে ফুলদানিটা নজরে পড়েছে। কিছু-একটা ও বলবে, বলতেই হবে।

একটিই মাত্র কাপ। সেটা বেবির সামনে টেবিলে রেখে শৈলেন কাচের গ্লাস হাতে বিছানায় বসে বেবির চোখের দিকে তাকাল। বেবির প্লেটে আর পাঁউরুটি নেই কিন্তু চিবিয়ে চলেছে। এক বার কুলুঙ্গির দিকে তাকাল। কোনো বিস্ময় চোখে ফুটল না ফুলদানিটাকে দেখে। শৈলেন তাতে একটু হতাশ হল।

একটু তাড়াতাড়িই যাব। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে, কাজের ব্যাপারে। ফুলদানিটার সম্পর্কে একটা কথাও নয়।

কাজ চলছে কেমন?

কাজ নেই, ছাড়িয়ে দিয়েছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাপড়ের ছাঁট এইসব বাছাইয়ের কাজ, রোজ বারো টাকা। যেতে দেরি হয়েছিল বলে কাজে বসতে দেয়নি। দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছি।

মাসে তিনশো টাকা। আজকের দিনে একটা লোক আধপেটা খেয়েও মাস চালাতে পারবে। শৈলেনের মনে হল, বেবি বোধ হয় আবার এখানে থাকতে চায়। যদি চায় তাহলে থাকতে পারে। ও যা মেয়ে তাতে সোজাসুজিই এটা জানাতে পারে। তবে শৈলেন যেচে

একথা বলবে না।

বেবি আবার ফুলদানিটার দিকে তাকাল। আমাকে দশটা টাকা ধার দিতে পার?

নিশ্চয়। বালিশের তলা থেকে দুটো পাঁচ টাকার নোট বার করে শৈলেন ওর হাতে দিল। বেবি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কিছু বলল না।

সামনের হপ্তায় শোধ করে দেব। একটু ঘোরাঘুরি করলেই কাজ একটা পেয়ে যাব। বেবি উঠে দাঁড়াল।

একটা হাফ পাউণ্ড রুটি আছে, নিয়ে যাবে?

না। বেবি আবার ফুলদানিটার দিকে তাকাল। সুন্দর দেখতে তাই না? আমার খুব পছন্দের।

শৈলেন পুরোনো রসিকতাটাই করল, খালি ফুলদানিতে কিন্তু ভূতে বাসা বাঁধে।

সেইজন্যই এটাকে ভালো লাগে।

বেবি চলে গেল। এটাকে পুরোনো জিনিসের দোকানে বেচে দেওয়া নিয়ে একটা কথাও বলল না!

আট-দশ দিন অন্তরই বেবি আসতে শুরু করল, মাসের পর মাস, একই দিনে একই সময়ে। তারা এটা ওটা নিয়ে কথা বলত, বাংলা বনধ, বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা, কাজকর্ম, ভগবতী পাঠশালা, ছিনতাই গুরুতর বিষয়ে কখনো নয়। কখনো চুপ করে দুজনে রেডিয়োর গান বা কথিকা শুনত। কেউই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না। শৈলেন কখনো চা তৈরি করত কখনো করত না। এক বারের জন্য বেবি কিন্তু আসা বন্ধ করেনি। ঝড়, বৃষ্টি, লোডশেডিং, রাস্তায় কোমরজল, এমনকী সর্দি জ্বর অগ্রাহ্য করেও সে এসেছে। একটা আলগা ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তারা পরস্পরের সান্নিধ্য অল্প কিছুক্ষণের জন্য উপভোগ করত তো বটেই, আবার দেখা হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েও থাকত। শৈলেনের ধারণা তারা একসঙ্গে এত ভালো সময় আর কখনো কাটায়নি।

বেবি সেই একই শাড়ি পরে আসত। ক্রমশ সেটার রং জ্বলে গিয়ে বিবর্ণ মলিন দেখাতে লাগল। অবশেষে সেলাইয়ের সুতোও জায়গায় জায়গায় ফুটে উঠল। ফিরে যাবার সময় কয়েকটা টাকা ধার না নিয়ে সে যেত না। শৈলেন প্রতিবারই দিয়েছে এবং ধার কখনোই শোধ হয়নি। তাই নিয়ে সে কিছু মনে করত না কেননা, কিছুক্ষণের এই চমৎকার সময়টা সে মনে করত খুব সস্তাতেই পেয়ে যাচ্ছে। ধারের অঙ্কটা অবশ্য দুশো পঁচিশ টাকা উঠেছিল যখন বেবি মারা যায়।

বেবিকে সাহায্য করতে পেরে শৈলেন আনন্দই পেত। জগৎসংসারে ওর কেউ নেই, এই বাস্তবতা সম্পর্কেও সে সজাগ ছিল। বেবিকে সে এক বারের জন্য জিজ্ঞাসা করেনি কোথায় সে থাকে, কীভাবে থাকে, কারুর সঙ্গে না একাই থাকে, কী কাজ করছে, কত রোজগার করছে। তবে বেবি নিজেই এক বার বলেছিল এখন সে বেনেপুকুরে থাকে, পার্কসার্কাসে একটা কারখানায় চামড়ায় রং মাখাবার কাজ করছে।

শৈলেনের ঘরে বেবি যত বারই এসেছে, মাঝে মাঝেই সে ফুলদানিটার দিকে তাকাত। তার মতে ওটা সুন্দর, ওটাকে শৈলেনের হাতছাড়া করা উচিত নয়, ওর লতাপাতা আর ফুলের রঙের সঙ্গে সোনালি পাড় যে কী দারুণ বাহার তৈরি করেছে সেটাও উল্লেখ করত। আবার এর কয়েক মিনিট পরই সে ফুলদানিটা তাকে দিয়ে দেবার ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলত। শৈলেন অবশ্য পুরোনো জিনিসের দোকানে ফুলদানিটাকে আর দেখতে না চাওয়ার জন্য ইঙ্গিতগুলো না বোঝার ভান করত।

একবার শৈলেন তাকে কিছু বেশি টাকা দিতে চেয়েছিল, বেবি প্রস্তাবটা কানে নেয়নি। তবে তার মনে হয়েছিল, বিক্রি করে টাকা পাবার জন্য বেবি ফুলদানিটা চায় না বা নিজের ঘরে রাখার জন্যও নয়। সে চায় পুরোনো জিনিসের দোকানে বেচলে ওটা অন্য কেউ কিনবে ফলে দুজনের কারুর কাছেই আর ফুলদানিটা থাকবে না।

অবশেষে একদিন বেবি ফুলদানিটা সোজাসুজিই চাইল। শৈলেন তাকে প্রত্যাখ্যান করল। সাত বছর আগে যেভাবে ধুলো ঝেড়ে, কাগজে মুড়ে দিয়েছিল, সেইভাবেই বেবির হাতে সেটা তুলে দিল। বেবিকে তখন খুব খুশিই দেখাচ্ছিল।

তারপর আবার সেই পুরোনো ব্যাপার। শৈলেন পরদিন সকালেই পুরোনো জিনিসের দোকানে কৌতূহল নিয়ে গেল। দোকানটা তখনও খোলেনি। রাত্রে গিয়ে দূর থেকেই দেখতে পেল একটা লেডিজ ব্যাগ আর ছবিহীন একটা নিকেলের ফ্রেমের মাঝখানে ফুলদানিটা দাঁড়িয়ে।

বেবি মারা যায় লরির ধাক্কায়। রাত একটা নাগাদ একটা ট্যাক্সি থেকে সিআইটি রোডে নেমে রাস্তা পার হবার সময় ঘটনাটা ঘটে। ফুটপাথের এক বাসিন্দা দেখেছিল ট্যাক্সি থেকে নেমে বেবি টলছিল এবং সেইভাবেই রাস্তা পার হচ্ছিল। হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাবার আগেই সে মারা যায়। নাক-মুখ থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়েছিল।

শৈলেন এইসব কথা জেনেছে বেবির এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। পর পর তিন সপ্তাহ বেবি না আসায় সে শূন্যতা বোধ করতে শুরু করে। খালি কুলঙ্গিটার দিকে চোখ পড়লেই তার মনে হতে থাকে, ফুলদানিটা ওকে দিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এটা দেখার লোভেই ও আসত। একদিন সে পুরোনো জিনিসের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। ফুলদানিটা দেখতে পেল না। কেউ হয়তো কিনে নিয়েছে। নানারকম ভয়ের সম্ভাবনা তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকায় একদিন স্কুল ছুটির পর বিকেলে সে বেবিকে খুঁজতে বেনেপুকুর রওয়ানা হয়। বেবি বলেছিল বাসরাস্তা থেকে পুবে গলি দিয়ে সে যায়। গলির মুখে একটা পানের দোকান থেকে মিঠে পান কেনে। দোকানের ভিতর চাররকম রঙের কাচের শেড-লাগানো একটা আলো আছে। শেডটা ঘোরে আর রংগুলো ঝিলিক দেয়। বলেছিল, ওই ঝিলিকগুলো দেখবার জন্যই পান কিনতে দাঁড়াই।

আধ ঘণ্টার চেষ্টায় শৈলেন পানের দোকানটা খুঁজে বার করেছিল। তখন দিনের আলো, তাই আলো জ্বালানো হয়নি। পানওয়ালা বিহারি। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলেছিল, সেই মেয়েমানুষটা তো লরিচাপা পড়ে মারা গেছে। ওই জায়গাটায়। আঙুল দিয়ে একটু দূরে রাস্তাটা দেখাল। তা কুড়ি-পঁচিশ দিন তো হয়ে গেল। আপনি ওর কে হন?

আত্মীয় হই। শৈলেনের ভিতরটা কয়েক মুহূর্তের জন্য পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিল। পানওয়ালার কাছ থেকে জানল, এই গলিটার মধ্যে বস্তির কোন ঘরে বেবি থাকত।

শৈলেন খুঁজে পেয়েছিল। অল্পবয়সি রুগ্ন একটি বউ, তাকে ঘিরে তিনটি ছেলে-মেয়ে।

এই তো পাশের ঘরেই শুভ্রাদি থাকত।

ঘরে এখন অন্য পরিবার ভাড়া এসেছে।

আমরা খবর পেলুম তো পরের দিন সকালে। থানা থেকে লোক এসেছিল খোঁজখবর নিতে। আমরা তো ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না, কোনোদিন কাউকে আসতেও দেখিনি। বলেছিল কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, একা।

ওর কোনো জিনিসপত্তর ছিল না।

জিনিস! ওই রান্নার একটা হাঁড়ি আর একটা কড়া, থালা, গেলাস, দুখানা শাড়ি। আর তেমন কিছু থাকার মতো অবস্থা তো ছিল না। রোজগারের যে লাইন ধরেছিল তাতে যৌবন না থাকলে কি আর হয়?

এই সময় বছর ছয়েকের ছেলেটি বলে ফেলে, মা, শুভ্রামাসির ফুলদানিটা?

কড়া চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বউটি বলে, একটা চিনেমাটির ভাঙা ফুলদানিই শুধু ওর ঘরে ছিল, সেটা আমি রেখে দিয়েছি। আপনি নিয়ে যাবেন তো নিয়ে যান।

কই দেখি।

সেই ফুলদানিটাই। হাতে নিয়ে শৈলেন ভাবল, এটা পুরোনো জিনিসের দোকানে অবশ্যই সে দেখেছিল কিন্তু তারপর বেবিই আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। নিশ্চয় বিক্রির দামের থেকে বেশিই ওকে দিতে হয়েছে।

না থাক, এটা রেখে দিন।

এখন শৈলেন রোজ রাতে ঘুমোবার আগে কুলুঙ্গির দিকে তাকায়। বউটি ফুলদানিটা দিতে চেয়েছিল, ফিরিয়ে নিলে ভালো হত কি হত না, এই সমস্যাটা ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তাকে ছটফট করায়। সে ডায়েরি লেখার চেষ্টা করেছিল। আমার বিবাহ হয় ছাব্বিশ বছর আগে, এর বেশি লেখা আর এগোতে পারেনি।

বুড়ো এবং ফুচা

ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করার প্রথম কয়েকটা দিন শব্দটা সে টের পায়নি। বাবান, তনু আর কাজের মেয়ে শম্পা ঘুমিয়ে পড়ার পর বিশ্বনাথ লিখতে বসে। শোবার ঘরটা আজকালকার সাধারণ ঘরের প্রায় আড়াই গুণ। এককোণে কাঠের ছোটো টেবিলে দুটো অভিধান, কলম রাখার জন্য একটা নকশাকাটা পিতলের গ্লাস, লেখার প্যাড, লেখা পাতাগুলো জমা করার একটা ফাইল, কয়েকটা দরকারি বই, সবই গুছিয়ে রাখা। অনাবশ্যক একটি জিনিসও সে টেবিলে রাখে না।

ঝরাপাতার উপর দিয়ে সাপ চললে যেমন শুনলেই শিরশির করে ওঠে গায়ের চামড়া, শব্দটা সেইরকমই। বিশ্বনাথ অবশ্য ঝরাপাতার উপর দিয়ে সাপ কেন কোনো সরীসৃপকেই চলতে দেখেনি বা চলার শব্দও শোনেনি। ছোটোবেলায় একটা অ্যাডভেঞ্চার বইয়ে পড়েছিল, খরখর, সরসর শব্দ করে সাক্ষাৎ মৃত্যু যেন এগিয়ে আসছে গোপনে। এটা এখনও তার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। মুখটা তুলে কড়িকাঠের দিকে তাকায়, গত শতাব্দীর বাড়ি। ছাদটা এখনকার ঘরের প্রায় দ্বিগুণ উঁচুতে। পাখা ঝোলাবার জন্য পাঁচ ফুট লম্বা রড় কিনে দু-ধারে প্যাঁচ কাটিয়ে আনতে হয়েছে। মোটা মোটা পাঁচটা কাঠের কড়ি আর গোটা ষাটেক বরগায় ভর দিয়ে রয়েছে দোতলার ঘরের মেঝেটা। সেটা বরফির মতো সাদা আর কালো পাথরে ঢাকা। অনেকগুলো পাথর ফেটে গেছে। ফাটলে ময়লার দাগটানা। তাদের নীচের ঘরটার মেঝেও হুবহু একই দশায় ফাটা, পাথরের ফাঁকে নোংরা জমে আছে। উপর-নীচের ঘর দুটো আয়তনে উচ্চতায় একই রকমের।

বিশ্বনাথ সরসর শব্দটা শুনেছিল রাত বারোটা নাগাদ। ঠিক মাথার উপর ঘরের একধার থেকে অন্যধার তারপর দরজা দিয়ে পৌঁছোল লম্বা বারান্দাটায়। কয়েক সেকেণ্ড থেমে বারান্দার অন্য প্রান্তে সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত গিয়ে অবশেষে আবার ঘরে ফিরে আসে। সাপ চলার শব্দের সঙ্গে ছিল ছপ ছপ বাড়তি একটা অস্পষ্ট শব্দও। নৌকার দাঁড় জলে পড়ার মতো এই শব্দটা। বিশ্বনাথ নৌকায় গঙ্গা পারাপার করেছে বলেই সেইরকম মনে হল শব্দটাকে। সর্ব অর্থেই প্রায় তখন নিশুতি। পার্টিশন করা পাশের সরিকি বাড়িতে রোজ রাতে কেউ একজন মোটরে ফেরে। বন্ধ করার আগে দু-তিন বার ইঞ্জিনটাকে গোঁ-গোঁ করিয়ে নেয়। সেটা করা হয়ে গেছে। আশেপাশের টিভি সেটগুলো বন্ধ। যদি কোনো রিকশার চাকা রাস্তার গর্তে পড়ে ঘটাং ঘট করে ওঠে সেটা বরং এইসময় সজীব লাগে। কিন্তু মাথার উপরের এই শব্দটা সিলিং থেকে হিমের মতো নেমে এসে শিরদাঁড়ায় যে অনুভূতি দিচ্ছে, এটা তার ভালো লাগছে না। হঠাৎই খরখর সরসর করে সাক্ষাৎ মৃত্যু শব্দ ক-টা মনের মধ্যে কেন যে ঝিলিক দিল তার কোনো কারণ সে নিজের কাছে দর্শাতে পারল না। সে মুখ তুলে শব্দটা কে করছে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করল।

উপরে থাকে একটা বুড়ো। এই বাড়ির মালিক। মাঝারি উচ্চতায় শীর্ণ ছোটোখাটো দেহ। পাতাকাটা কাঁচা পাকা হালকা চুল। টানা সরু চোখ এবং একটু বেমানান লম্বা নাক। গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে ট্রেসিং কাগজের মতো পাতলা। বিশ্বনাথ এক বারই মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্য ওকে খালিগায়ে দেখেছে যখন অ্যাডভান্সের টাকা দিতে আসে। লম্বা বারান্দার শেষে একটা ভারী পায়াওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বুড়ো বসেছিল সামনের দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখেই দ্রুতপায়ে শোবার ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। বুড়োর পায়ে ছিল পাতাঢাকা ক্যানভাসের সাদা চটি। পাঞ্জাবির মতো চটিটাও সবসময় পরে থাকে। চলার সময় শব্দ হয় না।

তাহলে এত রাতে শব্দটা কেন? উপরে বুড়ো ছাড়া আর তো কোনো মানুষ বাস করে না! বিশ্বনাথ ভুলে গিয়েছিল বুড়োর সঙ্গে একটা কুকুরও উপরে থাকে। সেটা মনে পড়তেই কুকুরের চেহারাটা তার চোখে ভেসে উঠল। ঘুমন্ত বউ আর ছেলের দিকে এক বার তাকিয়ে সন্তর্পণে দরজার ছিটকিনি খুলে সে দালানে বেরিয়ে আলো জ্বালল। দোতলার বারান্দার নীচেই তাদের এই দালান, যেটাকে ভাড়াটের জন্য দেয়াল তুলে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে দোতলায় যাবার সিঁড়ির সঙ্গে। এই দেয়ালঘেরা দালানেই রান্নাঘর ইত্যাদি এবং শম্পা রাতে ঘুমোয়। ঘুমন্ত মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে সে বাইরে বেরোবার দরজাটা খুলল।

বাড়িটার তিন দিক ঘিরে সরু জমি। আরও জমি ছিল কিন্তু বিক্রি হতে হতে এবং সম্পত্তি ভাগ হয়ে বুড়োর এই বাড়িটা বড়ো শরিকের পিছনের অংশে পড়ে গেছে। সামনের বাড়ির, যাকে বলা হয় ও-বাড়ি, তাদের ভাগে লোহার ফটক কিন্তু বুড়োর অংশে আসতে হলে পাশের সরু গলিটায় ঢুকে কোমরসমান লোহার পাতের দরজাটা ব্যবহার করতে হয়। সেখান থেকে হাত দশেক চওড়া জমি বাড়িটাকে ঘুরে বিশ্বনাথের দরজার সামনে দিয়ে এগিয়ে একটা দেয়ালে শেষ হয়েছে। সেখানে এক কালোয়ারের টিনের চালা, যাতে জমা করা আছে বাতিল বা নিলামে কেনা মেশিনপত্তর। মাঝে মাঝে কুলিরা লোহালক্কড় রাখতে বা তুলে নিয়ে যেতে আসে। রাতে একজন পাহারাদার চালার নীচে ঘুমোয়।

কালোয়ারের লাগানো একটা ষাট পাওয়ারের বালব চালার বাইরে জ্বলছে। তাইতে অন্ধকার ঘঘাছে না তবে চেনা জায়গাটা চেনা যায়। সামনের দেওয়ালে দুটো হুকে কাপড় মেলতে দেওয়ার নাইলন দড়িটা যেখানে ঝুলে পড়েছে সেখানে আলকাতরায় লেখা ঝাপসা হয়ে-যাওয়া খতম শব্দটাকে বিশ্বনাথ এখন চিনতে পারছে এইজন্যই, ওটা ওখানে যে রয়েছে তা জানে বলেই। নয়তো সে দূর থেকে আসা ষাট পাওয়ারের আলোয় খতম-কে বুঝে উঠতে পারত না। কলকাতার বহু দেওয়ালে এই শব্দটা একসময় সে দেখেছে, এখন আর দেখতে পায় না।

দরজা থেকে বেরিয়ে খতম-এর কাছাকাছি এসে ঘুরে উপর দিকে সে তাকাল। শব্দ কীভাবে এবং কে তৈরি করছে এটাই সে জানতে চায়। ঢালাই লোহার ধূসর নকশাদার রেলিং, দু-তিন জায়গায় লোহা অদৃশ্য। বিশ্বনাথ বারান্দায় দুই প্রান্তে রেলিং-এর উপর দিয়ে কয়েক বার দৃষ্টি টানল। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে কিছুই গোচর হল না। কান পেতেও কোনো শব্দ পেল না। পাহারাদারটা খাটিয়ায় ঘুমোচ্ছে দেখে সে বাড়ির মধ্যে ঢোকার জন্য চার-পাঁচ পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। কেন জানি তার মনে হল বারান্দার কেউ রয়েছে। আর এক বার বারান্দার দিকে তাকাবার ইচ্ছাটা সামলাতে না পেরে সে মুখ তুলল।

একটা সাদা ছুঁচোলো মুখ বারান্দার ভাঙা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে, ঠিক তার মাথার উপর। কলিজাটাকে এক বার কে যেন কচলে দিয়ে ছেড়ে দিল। বিশ্বনাথের প্রায় এক মিনিট সময় লাগল ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে। সে ভূতপ্রেত, দৈত্যদাননা প্রভৃতি ব্যাপারে বিশ্বাসী নয়। মাথার কয়েক হাত উপরে, নিশুত আধা অন্ধকারে অপ্রত্যাশিত একটা সাদা জন্তুর মাথা দেখতে পেয়ে সে ভয় পেল। নীচের দিকে মাথাটা নামিয়ে জন্তুটা তার দিকেই যেন তাকিয়ে। মাথাটা কয়েক সেকেণ্ড রেলিংয়ের বাইরে থাকার পর অদৃশ্য হল। বিশ্বনাথ ছুটে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসার পর মুখ তুলে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে সে নিজের মনে বলল, কুকুরটার চোখ দুটো কী ভীষণ জ্বলজ্বল করছিল।

সেই প্রথম দিন অ্যাডভান্সের টাকা দিতে এসে বুড়োর চেয়ারের পিছনে সে কুকুরটাকে দেয়ালঘেঁষে ঘুমোতে দেখেছিল। তাদের কথাবার্তার শব্দে ওর ঘুম ভাঙেনি। বড়ো সাদা লোম কিন্তু নোংরা। এক নজরেই বোঝা যায় ওকে কখনো স্নান করানো হয় না, কোনো কালে চিরুনিও পড়েনি। লেজের ডগায় চটা পড়ে একটা ডেলা হয়ে রয়েছে। কোমরের দিকে পিঠের উপর লোম গুলো চর্মরোগের চুলকানিতে কামড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলা। জায়গাটায় কাঁচা দগদগে ঘা। পাঁজরের লোম উঠে যাওয়ায় গোলাপি রঙের চামড়া দেখা যাচ্ছে। ওর চার পায়ের নখ কিন্তু বিশ্বনাথকে অবাক করেছিল। সেগুলো প্রায় ইঞ্চি দুয়েক লম্বা। তখন এক বার মনে হয়েছিল এত বড়ো নখ নিয়ে চলাফেরা করে কী করে? সে আরও দেখেছিল কুকুরটার বকলসের বদলে একটা কাপড়ের ফালি গলায় বাঁধা আর তাতে লাগানো রয়েছে একটা লোহার চেনা চেনটা মেঝেয় পড়ে আছে। কুকুরটি পুরুষ, বৃদ্ধ আর তার প্রভুর মতোই রুগ্ন।

পরদিন সকালে তনু স্কুলে যাবার জন্য যখন শায়ার উপর শাড়িটাকে পাক দিয়ে আঁচলটা পিঠে ঝোলাতে ব্যস্ত, বিশ্বনাথ তখন ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বলল, রাতে একটা সরসর শব্দ হয় ওপরের মেঝেয়, শুনেছ কি?

রাতে! কখন?

এই বারোটা নাগাদ।

তখন তো ঘুমে কাদা, শুনব কী করে। এই বলে নাভির উপরে পাট-করা শাড়ির গুছিগুঁজতে খুঁজতে তনু কৌতূহলী চোখে তাকাল। বিশ্বনাথ খুবই পছন্দ করে তনুর ক্ষীণকটি। মা হবার পর মেয়েরা দেহের ছন্দ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে, তনু পড়েনি। ওর চরিত্রের কাঠিন্য দেহতেও বিস্তৃত।

অত রাতে মাথার উপর গা-শিরশির-করা একটা শব্দ, তার সঙ্গে আর একটা ছপ ছপ শব্দ রীতিমতো ভয় লাগিয়ে দেয়।

কীসের শব্দ, বুড়োটা পায়চারি করছিল?

তাই জানতেই তো কাল রাতে বাইরে বেরিয়েছিলুম। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখি রেলিং থেকে মুখ বার করে কুকুরটা আমাকে দেখছে।

তনুর উদবিগ্ন চোখ হাতঘড়ি হয়ে শম্পার কোলে বাবানের মুখের উপর পড়ল। ঠিক তিনটের সময় ওকে মুসুম্বির রস করে খাওয়াবি…দাদা না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যাবি না। … হ্যাঁ তারপর, কুকুরটা দেখছে বললে…

মনে হল চোখ দুটো জ্বলছে।

অন্ধকারে জন্তুজানোয়ারের চোখ অমন দেখায়।

বউদি, দাদাকে সেই কথাটা বলেছ। শম্পা মনে করিয়ে দিল।

কোন কথা?

ওপর থেকে বাড়িওয়ালা আমাদের জানালার পাশে কুকুরের গু ফেলে।

হ্যাঁ, এই এক বিশ্রী ব্যাপার করে বুড়োটা, এটা নিয়ে ওকে বলা দরকার। হাগাতে-মোতাতে রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে তো! জানালার ধারে এইসব নোংরা জমলে রোগভোগ হতে কতক্ষণ। তুমি এক বার ওকে বলো। হাতব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, রামকৃষ্ণের ছবির সামনে চোখ বন্ধ করে সেকেণ্ড পনেরো মাথা নামিয়ে তনু দাঁড়িয়ে থাকল। হাতঘড়িটা আর এক বার দেখেই সে চটি পরে নিয়ে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেল। শম্পা পিছু নিল বাবানকে কোলে নিয়ে, সদর দরজা থেকে বাবান তার মাকে টা-টা করবে।

তনিমা বাস ধরে শেয়ালদা স্টেশন যাবে। ন-টা আটাশের কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে যাবে চাকদা। দেড় ঘণ্টা ট্রেনের পর কুড়ি মিনিট ভ্যান রিকশায় সহজপুর। সীতানাথ আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তার প্রথম ক্লাস সাড়ে এগারোটায়। স্কুল ছুটির পর ছ-টি ছেলে-মেয়েকে সে অঙ্ক আর ফিজিক্যাল সায়েন্স পড়ায় এক ঘণ্টা। এটা সে করে যাতায়াতের আর যৎসামান্য খাওয়ার জন্য খরচটা তুলে নিতে। সাতটা এগারোর কৃষ্ণনগর ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়শই রাত সাড়ে নটা হয়। ক্ষুকাতর, অবসন্নতায় বসে যাওয়া মুখ নিয়ে সে মোটামুটি বারো ঘণ্টা বসবাসের জন্য বাড়ি ফেরে। বিয়ের আগে থেকেই সে জীবনযাপনের এই প্রণালীর সঙ্গে সড়োগড়ো। বিশ্বনাথ ওর জন্য কষ্টবোধ করে, ওকে সমীহ করে, ভয়ও পায়।

স্নান করতে যাবার আগে সে বাইরে গিয়ে ঘরের পিছন দিকটা দেখতে গেল। বুড়োকে বলার আগে ব্যাপারটা দেখে রাখা উচিত। যা দেখল তাতে বিরক্ত হতে হতে মাথা গরম হয়ে উঠল। সরু জমিটা এতরকম জঞ্জাল, আগাছা, ভাঙা ইট-রাবিশে ভরা যে পরিষ্কার করতে ময়লা ফেলার অন্তত তিনটে হাতগাড়ির দরকার হবে। তনু মিথ্যা বলেনি, জানলার গায়েই রোগের ডিপো! বিশ্বনাথের মনে হল, এটা তারই ত্রুটি। যতক্ষণ সে ঘরে থাকে শুধু লেখার চিন্তা নিয়ে সংসারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াতেই ব্যস্ত থাকে। জানলার বাইরে কী জমা রয়েছে সেটা তারও তো লক্ষ করা উচিত ছিল। বাবানের স্বাস্থ্যের কথাটাই আগে ভাবা দরকার। বুড়োকে আজ সন্ধ্যা বেলায়ই সে বলবে দু-দিনের মধ্যে যেন সে পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে। শুধু ঘরভাড়া দিয়েই বাড়িওয়ালার কর্তব্য যে শেষ হয় না, এটা ওঁকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

বাড়ি ফিরতে বিশ্বনাথের একটু বেশিই দেরি হল। এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে সে মার্কেটিং ম্যানেজারের স্টেননা। তা ছাড়া সে চিত্রনাট্য লেখে টিভি সিরিয়ালের জন্য। অফিস ছুটির পর ভবানীপুরে স্নেহময়ের বাড়িতে গেছল চিত্রনাট্যের কিছু অংশ দেখাবার জন্য। স্নেহর সঙ্গে কলেজে পড়ার সময় তার পরিচয়। কলেজের বড়ো ঘরটায় ইউনিয়নের কালচারাল কমিটির উদ্যোগে বছরে তিন-চার বার যেসব অনুষ্ঠান হত তাতে দু-বার বিশ্বনাথের লেখা একাঙ্ক হাসির নাটক অভিনীত হয় স্নেহর পরিচালনায়। সবাই খুব হেসেছিল। বিকম পাস করার পর বিশ্বনাথ নাট্যকার হবার শখটা আর লালন করেনি ভেঙে পড়া সংসারটাকে মেরামত করার জরুরি তাগিদে। এর বছর দশেক পর পাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে সে ওয়ান-ডে ক্রিকেট ম্যাচ টিভিতে দেখতে যায়। ম্যাচ শেষ হবার পর একটা ডকুমেন্টারি হচ্ছিল প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে। সেটা শেষ হতেই বিশ্বনাথ পাঁচ-ছ সেকেণ্ডের জন্য একটা নাম দেখেছিল : পরিচালক স্নেহময় মান্না। তার মনে হল এই লোকটি তার সহপাঠী স্নেহ ছাড়া আর কেউ নয়। অতঃপর সে খুঁজে বার করে স্নেহকে, এবং তার স্ক্রিপ্ট লেখক হয়ে যায়। কয়েকটা ডকুমেন্টারির পর ছোটোগল্পের একটি তেরো পর্বের সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে বিশ্বনাথ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এখন সে স্নেহের সঙ্গে আলোচনা করে অস্ট্রেলীয় একটি সিরিয়ালকে তেরো পর্বে বঙ্গীকরণের কাজে ব্যস্ত। এজন্য প্রায়ই তাকে ভবানীপুরে স্নেহের বাড়িতে যেতে হচ্ছে সিরিয়ালটির ভিডিয়ো ক্যাসেট দেখার জন্য।

ভবানীপুর থেকে তার এবং চাকদা থেকে তনুর ফেরাটা প্রায় একই সময়ে ঘটল। বারান্দায় রেলিঙের ধারে বুড়োটা চেয়ারে বসে মাথা ঝুকিয়ে কিছু-একটা পড়ছে, বাড়ি ঢোকার সময় এটা দুজনেই দেখেছে। বিশ্বনাথই শুরু করল :

রাত হয়ে গেছে, আজ থাক। বুড়োকে কাল কি পরশু বলব।

বলার সময় একটু মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোলো। ঝগড়া করে বোস না। খাটে পা ঝুলিয়ে চিত হয়ে শুয়ে তনু বলল।

চেয়ারে-বসা বিশ্বনাথ মুখ ঘুরিয়ে তনুর দেহের মাঝামাঝি অংশটায় চোখ রেখে বলল, পাগল নাকি। এমন নিরিবিলি পরিবেশ, ভিড়ভাট্টা চ্যাঁ-ভ্যাঁ নেই, ঝুটঝামেলা নেই, এইরকম জায়গায় ঝগড়া করে অশান্তি টেনে আনতে যাব কেন? এই একটা ঘর মানে তো দুটো ঘর, সঙ্গে অতবড়ো দালান, এই ভাড়ায় কলকাতায় এখন কোথায় পাব। বুড়োমানুষ, একা, ওর সঙ্গে মানিয়ে আমাদেরই চলতে হবে।

বুড়োকে কখনো দোতলা থেকে নামতে দেখেছ? তনু মুখ ফিরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল এবং খোলা পেটের উপর শাড়িটা টেনে দিল। বিশ্বনাথের চোয়াল শক্ত হয়েই আবার শিথিল হল। চোখ দেখেই ও বোধ হয় বুঝতে পারে স্বামী কী চায়। তার মনে হচ্ছে রাতে তনু বলবে, আজ থাক, বড্ড ক্লান্ত। তারপর পাশ ফিরে বাবানকে জড়িয়ে ধরে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়বে। তনু অবশ্য সত্যিই ক্লান্ত থাকে।

লক্ষ করিনি। কাজের লোকজন নেই যখন নিশ্চয় বেরোয়। তুমি দেখেছ?

বেরোয়। শম্পা দেখেছে, বেলা দশটায় থলি হাতে বেরোয়। কালোয়ারের দারোয়ানটা কেরোসিন এনে দেয়। বুড়ো নিজের হাতে রান্না, কাচা, ঘরমোছা সব কাজ করে। … খুব কিপটে। তনু স্বামীর দিকে তাকাল কিছু-একটা মন্তব্য আশা করে।

কুকুর পোষার শখ আছে। বিশ্বনাথ মন্তব্য না করে উঠে পড়ল। এখন স্নান করে, কিছু খেয়ে বিছানায় চিত হয়ে সকালে চোখ-বুলোনো খবরের কাগজটা সে খুঁটিয়ে পড়বে।

টিভি সেট-এর কী হল, খোঁজ নিলে? তনু উঠে বসে আলগা স্বরে জানতে চাইল। প্রােগ্রাম গুলো তো তোমার দেখা দরকার।

দেখার আর কী আছে। আমার কাজ গল্প তৈরি করা আর সাজানো। আসল কাজটা তো করবে স্নেহ।

তবু, খোঁজ নাও।

নিয়েছি। ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট দু-হাজারের মধ্যে, কালার চোদ্দো হাজার।

চোদ্দো! অত টাকা দিয়ে তো নেওয়া সম্ভব নয়।

বিশ্বনাথ কথা না বাড়িয়ে স্নানে চলে গেল। সে জানেই তনু চোদ্দো হাজার টাকা খরচে আপত্তি জানাবে। আপত্তি তার নিজের নেই বটে কিন্তু টাকার অঙ্কটার সঙ্গে শখের বনিবনা যে সম্ভব নয় অসহায়ভাবে সেটা তাকে মেনে নিতে হয়েছে। তারা দুজনেই টাকা জমাচ্ছে একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কলকাতার আশেপাশে ছোটো দু-ঘরের ফ্ল্যাট তিন লাখের কমে পাওয়া যাবে না এটা তারা জানে। আজ পর্যন্ত দুজনে যা জমিয়েছে আর নানান জায়গা থেকে ধার বা আগাম হিসেবে যা সংগ্রহ করতে পারবে, সব মিলিয়ে যোগ করে দেখেছে আধখানা ফ্ল্যাটের মালিক হবার মতো অবস্থায় তারা এখন রয়েছে। সুতরাং দু-রকমের টিভি সেট-এর মধ্যে বারো হাজারের ব্যবধানটা তাদের কাছে মাটির মেঝের সঙ্গে মোজাইক টালির মতো। টিভি সেট কেনার বাসনাটা এতদিন তারা দমন করেই রেখেছিল। কিন্তু স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ থেকে বাড়তি আয়ের পথ খুলে যাওয়ায় তারা পরিজনে-ঠাসা পৈতৃক বাড়ির ছোটো একটা ঘর, অবিরাম চেঁচামেচি এবং নিত্য বিবাদের কবল থেকে রেহাই পেতে বেরিয়ে এসেছে। এজন্য প্রতি মাসে আটশো টাকা বেশি খরচ হবে। বিশ্বনাথ তখন সেটা তনুকে বলেছিল।

হোক, তবু এখানে আমি বাবানকে মানুষ হতে দেব না। এত ইতরোমি আর নোংরা কথাবার্তার মধ্যে ও একটা অমানুষ হয়ে উঠবে। ওকে আমি ভালোভাবে মানুষ করব, ওকে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াব। কঠিন গলায় তনু জানিয়ে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে সংসার পেতে সে ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে না। বাপ-ঠাকুরদার বাড়ি ছেড়ে আসতে বিশ্বনাথের কষ্ট হয়েছিল কিন্তু তনুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার কষ্টটাকে ঘাড় ধরে নুইয়ে দিয়েছিল। এখন আর ব্যথা করে না।

রাত্রে লিখতে বসে বিশ্বনাথ অনেকক্ষণ পর আবিষ্কার করল সে এক লাইনও লেখেনি, উৎকর্ণ হয়ে দোতলা থেকে সরসর আর ছপ ছপ শব্দ দুটো কখন নেমে আসবে তার জন্যই সে অপেক্ষা করছে। বার বার সে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। কোনো শব্দ নেই। অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে হতাশ হয়ে পড়ল। আজ আর লেখা হবে না, এমন এক ধারণায় পৌঁছে সে আলো নিভিয়ে শুয়ে বাঁ-হাতটা অঘোরে-ঘুমোনো তনুর কোমরের উপর আলতো রাখল। বিশ্বনাথ আশা করল তনু নড়েচড়ে উঠবে। কিছুই হল না। আঙুলগুলো কোমরে চেপে বসাতে যাচ্ছে আর তখনই দোতলায় সরসর শব্দটা চলতে শুরু করল। আঙুলগুলো প্রথমে অসাড় হল তারপর নেতিয়ে পড়ল। সরসর শব্দের সঙ্গে ছপ ছপটাও যথারীতি দালানের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত তারপর ঘরের মধ্যে, থেমে থেমে যাতায়াত শুরু করল। বিশ্বনাথের মনে হল, বাসি ভাতের মতো তার শরীর কড়কড়ে ঠাণ্ডা লাগছে। তনুর কোমর থেকে হাতটা তুলে নিয়ে সে স্থির করল, বুড়োর সঙ্গে কাল অবশ্যই কথা বলবে।

পরদিন সকালে সে সময় করে উঠতে পারল না। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে নিজের দরজায় না থেমে সে সোজা দোতলার সিঁড়ি ধরল। বাঁকটা নিয়ে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতেই সে দেখল বারান্দায় মাঝখানে কুকুরটা উবু হয়ে সামনের পায়ের থাবা দুটো পাশাপাশি রেখে বসে। সিঁড়ির দিকে মুখ করে সোজা এমনভাবে তাকিয়ে যেন তার জন্যই প্রতীক্ষা করছে। বারান্দার অল্প পাওয়ারের বালবটা কুকুরটার পিছনে, তাই মুখটা বিশ্বনাথের কাছে স্পষ্ট লাগল না। চেয়ারে বসে চশমাপরা বুড়ো মাথা ঝুঁকিয়ে একটা বই পড়ছে। সে থমকে গেল।

আর দুটো ধাপ উঠলেই দালান। কুকুরটার স্বভাব তার জানা নেই, পাশ দিয়ে যেতে গেলে যদি কামড়ে দেয়? বিশ্বনাথ গলাখাঁকারি দিল বুড়োর মুখ ফেরাবার জন্য। মুখ ফিরল। বুড়ো যখন বোঝার চেষ্টা করছে লোকটি কে, তখন বিশ্বনাথ বলল, আমি আপনার ভাড়াটে, নীচে

চশমাটা খুলে ঠাণ্ডা মৃদুস্বরে বুড়ো বলল, দাঁড়িয়ে কেন, আসুন।

আপনার কুকুরটা।

ও কিছু বলবে না, পাশ দিয়ে চলে আসুন। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বুড়ো বলল। কিছু কি দরকার আছে?

হ্যাঁ, একটা কথা বলার জন্য এসেছি। বাকি দুটো ধাপ এখনও ওঠেনি। এখনও সে পুরো ভরসায় পৌঁছোতে পারেনি। কুকুরটা একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে, একইভাবে সিঁড়ির দিকে সোজা তাকিয়ে। ভয়ে ভয়ে বিশ্বনাথ ওর চোখ দুটো লক্ষ করল। ছায়াঢাকা মুখের মধ্যিখানে দুটো অনুজ্জ্বল মার্বেলের গুলি যেন বসানো রয়েছে। মনে মনে সে বলল, তবে কি ভুল দেখেছিলাম সেদিন।

ঘর থেকে একটা মোড়া এনে দালানে রেখে বুড়ো বলল, আসুন আসুন, ভয়ের কিছু নেই। জীবনে ও কখনো কাউকে কামড়ায়নি।

বিশ্বনাথ যখন আড়ষ্ট ভাবে পা টিপে কুকরটিকে অতিক্রম করছে বুড়ো তখন বলল, ফুচা দেখতে পায় না, ও অন্ধ।

বিশ্বনাথ ধাক্কা খেল কথাটা শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে সে ফুচার দিকে তাকিয়ে রইল। একইভাবে ও বসে রয়েছে সিঁড়ির দিকে মুখ করে। বসার ভঙ্গিতে রয়েছে যেন কারুর জন্য অপেক্ষা। নিশ্চয় তার জন্য নয়। সে যে আজ দোতলায় উঠে আসবে ফুচার সেটা জানার কথা নয়।

মোড়ায় বসে বিশ্বনাথ বলল, রোজ রাতে ওপরে একটা সরসর, ছপ ছপ শব্দ শুনতে পাই।

বুড়োর ভ্রু কুঁচকে উঠল। চোখ দুটো সরু করে একটু রুক্ষ স্বরে বলল, তাতে কী হয়েছে? কোনো অসুবিধে হচ্ছে নাকি?

বিশ্বনাথ সাবধান হয়ে গেল। চটাচটির মধ্যে কোনোক্রমেই সে যাবে না। তেমন কিছু নয়, তবে কৌতূহলও হয়।

বুড়ো চাপা গলায় নরম সুরে ডাকল, ফুচা, ফুচা …

এখানে আয়। ফুচা মুখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ পিছনে তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল বুড়োর দিকে। গলার চেনটা মেঝেয় ঘষড়াননার দরুন যে-শব্দটা হচ্ছে বিশ্বনাথ সেটা চিনতে পারল। বড়ো বড়ো নখগুলো ওর প্রত্যেক বার পা ফেলাতে যে শব্দ তৈরি করল, সেটা বুঝে নিতেও তার অসুবিধে হল না।

ফুচা কি সারারাতই ঘুরে বেড়ায়?

হ্যাঁ। এটা ওর অনেক দিনের অভ্যেস। আজীবন একা একাই ওর কেটেছে। জীবনের শেষ সীমায় এখন ও।

বুড়োর থেকে তিন হাত দূরত্বে উবু হয়ে মুখ তুলে ফুচা কথাগুলো শুনছে। বিশ্বনাথ কয়েকটা কালো পোকা ওর চোখের কোণে, কানের পাশে, হাঁটুর কাছে দেখতে পেল।

পোকা হয়েছে, খুব কষ্ট পায় নিশ্চয়।

হয়তো পায়।

পোকা মারার জন্য তো পাউডার পাওয়া যায়।

বুড়ো তীব্র চোখে তাকিয়ে বলল, তা যায়। আপনি কি পোকা নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছেন?

বিশ্বনাথ আর এক বার সাবধান হল।

ওপর থেকে আমার জানলার ধারে যেসব জিনিস পড়ে তাতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। কী পরিমাণ জঞ্জাল, কী ধরনের ময়লা জমে উঠেছে সেটা যদি দয়া করে এক বার দেখে আসেন। যথাসম্ভব বিনীত স্বরে সে বলল।

সচকিত বুড়ো সোজা হয়ে বসল। জঞ্জাল? আপনার জানলার ধারে! ছি ছি ছি, এটা আমারই দোষ। বহুদিনের অভ্যেস তো, নীচে কেউ থাকত না বলে তাই .. বুড়ো দুই তালু চেপে বলল, আমারই অন্যায়।

বিশ্বনাথ আশা করেছিল তিরিক্ষে বা মেজাজি স্বরে দায় এড়িয়ে যাওয়ার মতো জবাব পাবে। তার বদলে ওকে এমন অনুতপ্ত হতে দেখে সে অপ্রতিভ বোধ করল।

কালকেই আমি রামবিলাসকে বলে জঞ্জাল সরাবার ব্যবস্থা করব।

এত ব্যস্ত হবার কী আছে। সে কোনো একদিন পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

বিশ্বনাথ উঠে দাঁড়াল। ফুচা একইভাবে বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো ফুলে উঠে কোটর থেকে অল্প বেরিয়ে, পুরোটাই ঘোলাটে সাদা। বোধ হয় ছানি পড়েছে। কুকুরেরও তো ছানি অপারেশন হয়। বলতে গিয়েও বিশ্বনাথ নিজেকে সামলে নিল। হয়তো চটে গিয়ে বলবে হ্যাঁ হয়। আপনি কি ছানি নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছেন?

ফুচার পাশ দিয়ে এগোতে গিয়ে সে চেনটা মারিয়ে অল্প একটু হড়কে যেতেই পাথরের সঙ্গে লোহা ঘষার শব্দ হল। কর্কশ শব্দটায় তার দুই বাহুর রোমের গোড়া শিরশির করে উঠল। তার মনে হল একটা সাপ যেন সে মারিয়ে ফেলেছে।

মাঝে মাঝে একটু মেজাজ খারাপ করে, তখন বেঁধে রাখতে হয় বলে চেনটা গলায় লাগিয়েই রেখে দিয়েছি। কে আর খোলে-পরায়। বুড়ো নীচু গলায় বলল।

প্রসঙ্গটা বদলাতে বিশ্বনাথ বলল, আপনার তো ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি নেই, টিভি অ্যান্টেনা লাগাই কী করে সেটাই ভাবছি।

কেন, ও-বাড়ি দিয়ে ছাদে আসবেন। আমার ভাইপো রবিকে বলবেন ও আপনাকে ছাদে নিয়ে যাবে। বাড়ি পার্টিশনে সিঁড়িটা ওদের ভাগে পড়ল। আমার দিকে নতুন সিঁড়ি করে নেওয়ার কথা কিন্তু করা আর…

সিঁড়ি দিয়ে নামতে বিশ্বনাথ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফুচা বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে একইভাবে বসে রয়েছে আর বুড়ো তাকিয়ে সিঁড়ির দিকে।

জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেবে বলল, তনু ফেরামাত্রই বিশ্বনাথ জানিয়ে দিল।

ভালো।

কুকুরটাকে ভালো করে দেখলুম … একদম অন্ধ, শুধুই বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে। থাকে। গায়ে পোকা অজস্র। … রাতে যে শব্দ শুনি সেটা যে ওরই কাজ আজ বুঝলুম। গলায় একটা চেনবাঁধা মেঝের উপর দিয়ে টানতে টানতে যায়, আর পায়ের বড়ো বড়ো নখ, তাই থেকেই শব্দটা হয়। … বাবা বাঁচা গেল, যা টেনশন হয়! আমি ভাবতুম না-জানি অন্য কিছু…

অন্য কিছু মানে ভূতটুত?

স্কুলের শাড়িটা খাটের উপর বিছিয়ে তনু আলনা থেকে শাড়ি নিতে এগোল। শায়াটা ধবধবে, বিশ্বনাথ চোখ বুলিয়ে একটা কোনো দাগও দেখতে পেল না। এই বয়সে তনুর শরীর একটু ভারী হওয়ার কথা। কিন্তু সেই রোগাই রয়ে গেল।

প্রায় তাই-ই। সিনেমায় দ্যাখোনা, পোড়াবাড়িতে কুয়াশা আর ঝিঝির ডাকের সঙ্গে কতরকম শব্দ আর গান হয়, অনেকটাই সেইরকম লাগত। কথাটা বলার সঙ্গেই বিশ্বনাথের দৃষ্টি থেকে তনুর নিতম্বের বক্র ভাঁজ অদৃশ্য হয়ে গেল শাড়ি জড়িয়ে নেওয়ায়। আধময়লা ছাপাশাড়ি। সাশ্রয়ের জন্য হপ্তায় এক দিন, রবিবার, তনু সারা পরিবারের কাচাকাচির কাজ করে, ইস্ত্রি করে স্কুলের জন্য মাড় দেওয়া শাড়ি। ছুটির দিনেও নিজেকে ও ক্লান্ত করতে হন্যে হয়ে ওঠে।

শম্পা চা দিয়ে গেল দুজনকে। খাট থেকে শাড়িটা পাট করতে করতে তনু বলল, তুমি আগে গা ধুয়ে এসো।

টিভি শনিবার আনব। রোববার সকালে প্রােগ্রাম চলার সময় ওদের লোক এসে অ্যান্টেনা লাগাবে। বুড়ো বলল ও-বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাওয়া যাবে।

ভালো। তার আগে জঞ্জালগুলো পরিষ্কার হোক তো।

বিশ্বনাথ রাতে সিলিংয়ের দিকে মুখ করে শুয়ে অপেক্ষা করছিল। সরসর শব্দটা শুরু হতেই সে আজ এর মধ্যে কোনো রহস্য অনুভব করল না। ওপাশ ফিরে শোয়া তনুকে কাঁধ ধরে হ্যাঁচকা টানে সোজা করে দিতেই সে কে, কে বলে উঠে বসতে গেল।

কে আবার, আমি।

বিশ্বনাথ বুকে ছোট্ট ঠেলা দিয়ে ওকে শুইয়ে দিল। মিনিট পাঁচেক পর শাড়িটা ঊরু থেকে নামিয়ে, বিড়বিড় করতে করতে তনু আবার পাশ ফিরে শুল।

রবিবার অ্যান্টেনা লাগাবার লোকটিকে নিয়ে বিশ্বনাথ হাজির হল ও-বাড়িতে। বরফিকাটা তকতকে পাথরের মেঝে, দরজা-জানলায় উজ্জ্বল রং, আসবাবে ধুলো নেই অথচ সবই প্রাচীন। বুড়োর ভাইপো রবির কথাবার্তা মার্জিত ও নম্র। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। সাদা পাজামা আর গেঞ্জিটা তনুর শায়ার মতোই নিদাগ। বিশ্বনাথের অস্বস্তি ছিল হয়তো ছাদে যেতে দেবে না। জ্যাঠার সঙ্গে শরিকি সম্পর্কটা কেমন রয়েছে সেটা তার জানা নেই। সাধারণত ভালো থাকে না।

নিশ্চয় যাবেন, এতে আপত্তি করার কী আছে। ওদিকে ছাদটা তো জ্যাঠামশায়েরই।

জলছাদের সুরকির আস্তরণ উঠে গিয়ে খোয়া বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির জল বেরোবার নলের মুখে আবর্জনা। পাঁপড়ের মতো মড়মড়ে হয়ে রয়েছে শুকিয়ে-যাওয়া শ্যাওলা। গাছের পাতা, কাগজ, কাঠকুটোয় ঝাঁঝরির মুখ বন্ধ। পলেস্তারা-খসা ইট বহু জায়গায় বেরিয়ে হাঁটুসমান একটা পাঁচিল দিয়ে ছাদটা ভাগ করা।

আমরা মাঝে মাঝে নর্দমার মুখ পরিষ্কার করে দিই। বৃষ্টির জল বসে বসে জ্যাঠামশায়ের পোর্শানটার যা অবস্থা হয়েছে।

চোখে জ্বালা-ধরানো রোদে দাঁড়িয়ে তারা। লোকটি অ্যান্টেনা লাগাবার কাজে ব্যস্ত। ঘণ্টা খানেক সময় তো লাগবেই। বিশ্বনাথের মনে হল, এখানে তার দাঁড়িয়ে কাজ দেখার কোনো দরকার নেই।

এই রোদে দাঁড়িয়ে থেকে কী লাভ, আপনি নীচে গিয়ে বসতে পারেন, ততক্ষণ ও কাজ করুক।

বিশ্বনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এক তলায় বসার ঘরে গোল একটা মেহগনির টেবিল ঘিরে চারটে কাঠের চেয়ার। সবই পুরোনো আমলের। একটা লোক সামনের চেয়ারে বসে, কিছু একটা বিষয় পেড়ে কথা তো বলতে হবে, তাই বিশ্বনাথ শুরু করল, আমার ঘরের বাইরে বহুদিনের জঞ্জাল জমে ছিল। ওনাকে বলেছিলুম তাই আজ সাফ হচ্ছে।

এসব ব্যাপারে উনি খুব পার্টিকুলার ছিলেন, আপনাকে সাফ করার কথা বলতেই হত না। এখন অবশ্য…।

আপনার জ্যাঠামশাই বোধ হয় একা থাকতেই ভালোবাসেন।

বছর কুড়ি-বাইশ হল উনি এইরকম হয়ে গেছেন। স্বরটাকে গাঢ় করে রবি কিঞ্চিৎ বিষাদ মাখিয়ে বলল, ওঁর একমাত্র ছেলে ভান্তু, আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো, নকশাল আমলে খুন হল। তারপর থেকেই উনি এমন হয়ে গেলেন।

বিশ্বনাথ নড়েচড়ে বসল। বলেন কী! ওঁর ছেলে খুন হয়েছে? কোথায়, কারা করল?

যে দরজা দিয়ে আপনি ঢোকেন ঠিক তার সামনে, সন্ধেবেলায়। আমরা শুধু একটা চিৎকার শুনেছিলুম। আট বার স্ট্যাব করে। ছুটে গিয়ে যখন পৌঁছোলুম তখন ওরা পালিয়ে গেছে। জ্যাঠামশাই দোতলার বারান্দা থেকে ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছিলেন।

নিজের অজান্তে বিশ্বনাথ মুখ তুলেই আবার নামিয়ে নিল। মোটা মোটা কাঠের কড়ি আর বরগা এ বাড়িতেও।

ভান্তুকে আমরাই মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই, তখন আর বেঁচে নেই।

দেয়ালে এখনও আলকাতরার অস্পষ্ট একটা কথা পড়া যায়।

সে কী! এখনও আছে? বিস্ময়ের সঙ্গে ধাক্কাটা সঙ্গে সঙ্গে কাটিয়ে উঠে রবি বলল, সেদিন রাতেই লিখে দিয়ে গেছল, খুন নয় খতম। কথাটার মানে আজও বুঝি না। শুনেছি

জ্যাঠামশাই দোতলায় বসে থাকেন ওই দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে।

হ্যাঁ আমিও দেখেছি, কারণটা এতদিন জানতাম না। ভান্তু পলিটিকস করত কি?

বলতে পারব না। অ্যাপ্লায়েড ফিজিকস নিয়ে পড়ত। মুখচোরা, বাবার মতোই রুগ্ন ছিল। জেঠিমা তো পাগলের মতো হয়ে গেলেন। ওঁদের মেয়ে টরন্টোয় কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে গিয়ে ওখানেই বিয়ে করে সেটল করেছে। সে এসে মাকে নিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে বাবাকে টাকা পাঠাত। জেঠিমা ওখানেই মারা গেছেন, এখন বোধ হয় আর টাকা আসে না। রবি নিশ্চিত ভঙ্গিতে ছোটো করে মাথা নাড়ল। ওর কথা বলার ধরন থেকে বিশ্বনাথের মনে হল, লোকটি গল্প শোনানোর মতো কাউকে পেলে অনর্গল বকে যেতে পারে।

আপনার জ্যাঠামশায়ের একটা কুকুর আছে?

জানি, স্পিৎজ। খুব বুড়ো, মরার টাইম হয়ে গেছে।

ও অন্ধ।

রবি কথাটা কানে নিল না বরং নম্র করে জানতে চাইল, আপনার স্ত্রী কোথাও বোধ হয় পড়াতে যান?

প্রশ্নটা শুনে বিশ্বনাথের ভ্র উঠে গেল। রবি তাহলে তাদের সম্পর্কে খবর রাখে। চাকদায় একটা স্কুলে।

অতদূরে! তাই ফিরতে এত রাত হয়। আপনি তো সিরিয়াল লেখেন, আমার মেয়ের কাছে শুনেছি।

এইসময় চাকর এসে রবিকে জানাল, তাকে ভিতরে ডাকছে। রবি উঠে যাবার পরও বিশ্বনাথ কিছুক্ষণ বসে বুড়োর কথা ভাবল। ছাদে অ্যান্টেনা লাগানোর কাজ আর সে দেখতে গেল না, নিজের ঘরে ফিরে এল।

টিভি সেটটা রাখা আছে তার টেবিলে। ওটাকে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

টেবিলেই থাক-না। তনু বলল। লেখার জন্য তা অনেকটা জায়গা থাকবে।

না থাকবে না। হঠাই রেগে উঠল বিশ্বনাথ। নিজেকে তার মনে হচ্ছে চারদিক থেকে চাপ-খাওয়া কুঁকড়ে-যাওয়া একটা মানুষ। অত অল্প জায়গায় আমি লিখতে পারব না।

একইরকম তিক্ত স্বরে তনু বলল, না পার তো সেটটাকে রান্নাঘরে রেখে এসো, শম্পা বসে বসে দেখবে।

সেই ভালো।

ওটা তোমার জন্যই আনা, আমার বা বাবানের জন্য নয়। শান্ত ধীর গলায় তনু বলল।

এত বড়ো ঘর অথচ এইটুকু একটা জিনিস রাখার জন্য আমার টেবিল ছাড়া কি আর জায়গা নেই।

নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছ, কী আছে কী নেই।

জানলা ঘেঁষে কালো ফিতের মতো অ্যান্টেনার তার ঝুলছে। গোল করে পাকানো তারের বাকিটা জানলা গলিয়ে ঘরের মধ্যে বাড়িয়ে এইসময় লোকটি বলল, ধরুন।

বিশ্বনাথ ধরল। লোকটা এবার ঘরে আসবে। নরম গলায় সে বলল, টেবিলেই এখন থাকুক, পরে দেখা যাবে।

সারাদিন দেখা আর হল না। টেবিলে যতটুকু জায়গা, বিশ্বনাথ সেইটুকুতেই কাজ চালিয়ে রাতে লেখায় বসল। বিকেল থেকে টিভি চালানো হয়েছে। সবাই বাংলা সিনেমা দেখেছে, তিন ভাষায় খবর শুনেছে। ওরা সবাই খুশি। ভোরে উঠতে হবে বলে রোজকার মতো দশটাতেই তনু শুয়ে পড়েছে বাবানকে নিয়ে।

মাথার মধ্যে ছুঁচ ফোটানোর মতো একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। দু-হাতের চেটোয় রগ চেপে বিশ্বনাথ মাথা নামিয়ে বসে আধ ঘণ্টার বেশি। একটা লাইনও লেখা হয়নি। বাড়ির সুইমিং পুলে পূর্ণিমার রাতে জলবিহার করতে নামবে বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের মালিক আর তার স্ত্রী। শিল্পপতির মৃত্যু ঘটিয়ে সাম্রাজ্য দখল করার জন্য চক্রান্ত করেছে শিল্পপতির মধ্যবয়সি স্ত্রী এবং তার তরুণ প্রেমিক। বিশ্বনাথ আপত্তি করে বলেছিল, এই ধরনের অবৈধ প্রেম আমাদের ভিউয়াররা পছন্দ করবে না। স্নেহ বলেছে, পছন্দ করাতে হবে। আমরা তো এই ধরনের প্রেমের বিরুদ্ধেই বলতে চাই। ওদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আনতে চাই বলেই…।

সুইমিং পুলের জলে গলায় চেনবাঁধা একটা কুমির গোপনে রেখে দেওয়া হবে। খিলখিল হেসে মজা করার জন্য স্ত্রী ধাক্কা মেরে স্বামীকে জলে ফেলে দেবে। তারপর একটা বীভৎস কান্ড। কুমিরে–ধরা একটা লোকের চিৎকার, জলের তোলপাড়, চোখের পাতা না ফেলে স্ত্রী কঠিনমুখে তাকিয়ে থাকবে এবং ধীরে ধীরে জল শান্ত হয়ে যাবে জলের রং বদলে যেতে থাকবে। এই দেখিয়ে ঘৃণার সঞ্চার করা যাবে। স্নেহ পাগল নয়, খুব ঠাণ্ডা মাথাতেই সে ঘটনাটা ছকেছে।

দৃশ্যটা কল্পনা করে বিশ্বনাথ নিজের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা বুঝে নিতে গিয়ে দেখল

কোনো প্রকারের ঘৃণা তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে না। বরং মাথার মধ্যে একটা উঁচ অবিরত ফুটে চলেছে। ঘৃণাটাকে ঠিকমতো কবজা করতে না পারলে দৃশ্যটা সে লিখবে কী করে? অসহায়ভাবে বিশ্বনাথ মুখ তুলে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবাক হয়ে পড়ল। একী, কোনো শব্দ তো সে এখনও পেল না। টেবিলে রাখা রিস্টওয়াচে দেখল সওয়া বারোটা।

ফুচার চলাফেরা কি শেষ হয়ে গেছে? কুমিরের মানুষ-খাওয়া দেখতে দেখতে সে খুবই কি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল? কিন্তু সরসর শব্দটা এমনই যে সেটা তার শরীরের যেকোনো জায়গা স্পর্শ করবেই, বীভৎস সুখে তার সর্বাঙ্গ মোড়া থাকলেও। ফুচা আজ সময় রাখতে পারেনি। আলো নিভিয়ে বিশ্বনাথ চিত হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। ফুচার চলাফেরা হল কি না সে জানল না।

পরের রাতেও একই ব্যাপার, ফুচার চলাফেরার আভাসটুকুও নেই। কৌতূহলী হয়ে বিশ্বনাথ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। সামনের দেয়ালে খতম-এ পিঠ লাগিয়ে দোতলার বারান্দায় রেলিঙের ফাঁক দিয়ে যতদূর দেখা যায়, দেখার জন্য গোড়ালিও তুলল। কিছুই নেই। খাটিয়ায় রামবিলাস ঘুমোচ্ছে। ফিরে আসার জন্য দরজার কাছে এসে থমকে সে মুখ তুলল। চোখ বন্ধ করে এক বার শিউরে উঠে চোখ খুলল।

ফুচার মাথাটা বেরিয়ে নেই, সেই জ্বলজ্বলে চোখ দুটোও নেই। জন্তুজানোয়ারের চোখ, তনু বলেছে অন্ধকারে জ্বলে। কিন্তু ফুচার চোখে কোনো আলো থাকার কথা নয়, ও-দুটো তো ছানি পড়ে সাদা হয়ে গেছে। ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে বিশ্বনাথের একটাই চিন্তা, আমি ভুল দেখলাম কেন? কূলকিনারা না পেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে সে তনুকে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, ফুচার নখ অর চেনের শব্দ দু-দিন হল পেলাম না!

শাড়ি পাট করে নাভির উপর গুঁজে দিতে দিতে তনু আড়চোখে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বুড়ো হয়তো কোথাও চেনটা বেঁধে রেখেছে তাই ও চলছে না … শম্পা ঠিক তিনটের সময় মনে করে কিন্তু রসটা খাওয়াবি। রামকৃষ্ণর ছবির সামনে সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল।

বোধ হয় তাই, ফুচাকে বেঁধেই রাখা হয়েছে কেননা আরও চার দিন বিশ্বনাথ শব্দ পেল। এখন তার শব্দ না পাওয়ার অস্বস্তিটা আর হয় না। কিন্তু শম্পার একটা কথায় সে বিচলিত বোধ করল।

আজ সকালে বউদি বলল, জানলা দিয়ে কীরকম যেন একট গন্ধ আসছে। তুমি কি পাচ্ছ?

বিশ্বনাথ জানলার কাছে এসে কয়েক বার শ্বাস টানল। একটা গন্ধ সে পেল। কথা না বলে সে বেরিয়ে এসে জানলার বাইরে দাঁড়াল। ইঁদুর কি বেড়াল কিছু-একটা মরেছে, সকালে দেখা যাবে এই ভেবে সে ফিরে এল।

তনু ফিরে এসে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, আবার ওপর থেকে ফেলা শুরু করেছে। কাল সকালেই গিয়ে বোলো।

বিশ্বনাথ সকালে বলতে যাবার আগে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য জানালার বাইরে এক বার খোঁজাখুঁজি করল। উপর থেকে কোনো কিছু পড়ার চিহ্ন নেই। তবে সে মাংস পচার গন্ধ পেল। কিছুই যখন পাওয়া গেল না তাহলে কী বলতে সে উপরে যাবে? বিশ্বনাথ ফাঁপরে পড়ল।

বলো একটা উৎকট গন্ধ পাচ্ছি। এ ব্যাপারে বাড়িওয়ালা হিসেবে ওঁরও তো কিছু কর্তব্য আছে, নাকি নেই? তনু স্নান করে ভিজে শাড়ি জড়িয়ে ঘরে এসেছে। মাথা দিয়ে গলিয়ে এবার শুকনো শায়াটা পরবে, যাতে একটা দাগও নেই। তারপর শায়াটাকে বগলের আর নিচে না নামিয়ে দড়ি বাঁধবে এবং ভিজে শাড়িটা প্রতিদিনের মতো ঝরে পড়বে পায়ের কাছে। হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা শায়ার তলায় সরু দুটো পা দেখলে বিশ্বনাথের হাসি পায় কিন্তু সে কখনো হাসে না।

শম্পা মেলে দিয়ে আয়। তনু চেঁচিয়ে কথাটা বলে বিশ্বনাথের দিকে ফিরে বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না।

বিশ্বনাথ আর দাঁড়াল না। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই গন্ধটা তার নাকে ধাক্কা দিল। বারান্দার শেষ প্রান্তে বুড়ো মাথা ঝুকিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। তার পিছনেই পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে ফুচা। চেনটা গলায় বাঁধা।

ওটা যে ফুচার মৃতদেহ এটা বুঝতে বিশ্বনাথকে অর্ধসমাপ্ত একটি মাত্র বাক্য খরচ করতে হল।

একটা বিশ্রী পচা গন্ধ আজ দু-দিন ধরে আমরা…

বুড়ো মুখ ফিরে বিশ্বনাথের দিকে শান্ত চোখে তাকাল এবং কয়েক সেকেণ্ড পর আঙুল দিয়ে ফুচাকে দেখাল—মরে গেছে।

হতভম্ব বিশ্বনাথ ধাতস্থ হবার পর বলল, এটা কীরকম ব্যাপার হল? মরে গেছে তো ফেলে দেননি কেন?

থাক-না যতদিন খুশি ও থাক-না। বুড়ো আবার খবরের কাগজে মাথা ঝোঁকাল।

বিশ্বনাথ স্তম্ভিত। একটা মরা কুকুর নিয়ে এটা কী ধরনের আদিখ্যেতা? সে শুনেছে অনেকে ছেলে-মেয়ের মতনই কুকুরকে ভালোবাসে, মারা গেলে কান্নাকাটি করে, নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। খবরের কাগজে ছবি দিয়ে শোকও প্রকাশ করে। কিন্তু এটা কী করছে বুড়ো।

আপনি এই মরা কুকুরটাকে রেখে দেবেন। বিশ্বনাথ অবিশ্বাসভরে বলল।

হ্যাঁ। কেন, তাতে আপনার আপত্তি আছে।

অবশ্যই আছে। আপনি কি এখনও গন্ধটা পাচ্ছেন না?

না তো। বুড়ো মাথা ঘুরিয়ে ফুচার লাশটার দিকে তাকাল। না পাচ্ছি না। শান্ত গলায় আবার বলল।

আমরা নীচের থেকে পাচ্ছি আর আপনি… বিশ্বনাথ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।

আমি কী করতে পারি?

কর্পোরেশনের ধাঙড় ডেকে, কিছু টাকা দিয়ে এটাকে নিয়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা করতে পারেন।

না। বুড়ো খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরল। বসার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল আর সে কোনো কথা শুনতে চায় না।

বিশ্বনাথ প্রায় ছুটেই ফিরে এল। তনু তখন ভাত খেতে শুরু করেছে। ওপরে কুকুরটা মরেছে, তারই পচা গন্ধ। ওটাকে ওইভাবেই রেখে দেবে বলল।

অ্যাঁ! থালার উপর তনুর হাতটা স্থির হয়ে গেল। মরাটাকে রেখে দেবে? কী বলছ তুমি!

তাই তো বলল।

ব্যস্ত হয়ে খাওয়া ফেলে উঠে কোনোক্রমে হাতটা ধুয়েই তনু সিঁড়ির দিকে ছুটল। বিশ্বনাথ ওকে অনুসরণ করে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আপনি নাকি এই মরা কুকুরটাকে রেখে দেবেন?

বুডোর উত্তর বিশ্বনাথ শুনতে পেল না।

আপনার কি কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে? জানেন এর থেকে কত রকমের রোগ ছড়াতে পারে, মহামারিও হতে পারে। ঘরে বাচ্চা রয়েছে।

বিশ্বনাথ দু-ধাপ উঠেও বুড়োর কথাগুলো বুঝতে পারল না। কেন জানি তার মনে হল, বুড়ো তার জেদ থেকে এক ইঞ্চিও সরবে না।

এই পচা গন্ধ নাকে নিয়ে আপনার সঙ্গে আর তর্ক করতে পারব না, বসে বসে প্রাণভরে আপনি খুঁকে যান কিন্তু দয়া করে এটাকে বিদেয় করুন। এটা সভ্যসমাজ, পাঁচজনের কথা

ভেবে চলতে হয়। আপনি যদি আজকেই এটাকে…

গেট আউট, গেট আউট, গেট আউট।

বুড়োর তীক্ষ্ণ চিৎকারের সঙ্গেই চেয়ার সরাবার শব্দ বিশ্বনাথ শুনতে পেল। তারপরই ভীতমুখে তনুকে নেমে আসতে দেখল।

তেড়ে এল আমার দিকে। মনে হচ্চে পাগল হয়ে গেছে। … চোখ দুটো যেন কীরকম… তনু থেমে গেল।

বিশ্বনাথ অস্ফুটে বলল, জ্বলজ্বল করছিল।

জানলে কী করে! তুমি তো নীচে ছিলে।

তনুর ভাত খাওয়া আর হল না। ন-টা আটাশের কৃষ্ণনগরটা এখনও ধরার সময় আছে। বেরোবার সময় সে বলে গেল, এক বার ও-বাড়িতে গিয়ে বরং রবিবাবুকে বললা যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে কুকুরটা ফেলার ব্যবস্থা করতে পারে। আর এখুনি ফিনাইল এনে চারিদিকে ছড়িয়ে দাও …শম্পা মনে করে রসটা খাওয়াস।

ফিনাইল কিনে ফেরার সময় বিশ্বনাথ ও-বাড়িতে ঢুকল। খবর পেয়ে নেমে এল রবি।

কুকুরটা মরে গেছে … আজ চার দিন।

বলেই ছিলাম টাইম হয়ে এসেছে। রবির মুখ তৃপ্তিতে ভরে উঠল।

আপনার জ্যাঠামশায়ের মাথা বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে। উনি ওই মরা কুকুরটাকে রেখে দিয়েছেন।

বলেন কী! রবি খাড়া হয়ে বসল। মরা কুকুরটাকে?

হ্যাঁ। এখন কী করি বলুন তো। আমি বললুম, আমার স্ত্রীও বলল, উনি তো তেড়ে প্রায় মারতেই এলেন। অথচ এই সেদিন জঞ্জাল সাফ করে দেওয়ার কথা বলতেই উনি লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি সাফ করিয়ে দিলেন। … আপনি কি এক বার ওঁকে বলবেন?

আমি কী বলব?

যাতে কুকুরটার ব্যবস্থা করেন।

ও-বাড়িতে আমরা কেউ যাই না। আপনি বরং কর্পোরেশনে কি পুলিশে খবর দিন। ওপরে আমি কাজ ফেলে এসেছি, কিছু মনে করবেন না। রবি চেয়ার থেকে উঠল।

মরা কুকুর পড়ে থাকলে আশপাশের বাড়িতে রোগভোগ তো হতে পারে। বিশ্বনাথ শেষ চেষ্টা করল রবিকে সক্রিয় করে তুলতে।

তা তো পারেই। আচ্ছা।

বিশ্বনাথ দরজা-জানলার বাইরে ফিনাইল ছড়িয়ে তনুর মতো না খেয়েই অফিসে গেল। যাবার আগে শম্পাকে হুঁশিয়ার করল, বাবান যেন ঘরের বাইরে না যায়। অফিস থেকে আজ সে তাড়াতাড়ি ফিরল এবং তনুও ফিরল প্রাইভেট কোচিং না করেই। বিশ্বনাথ আর এক বার ফিনাইল ছড়িয়ে এসে ঘরের জানলা বন্ধ করে দিল।

এভাবে কতদিন চলা যাবে? তনুর প্রশ্নে বিশ্বনাথ অসহায়ভাবে শুধু তাকিয়ে রইল।

কাল সকালেই থানায় যাও। পুলিশ দেখলে হয়তো বুড়ো ভয় পাবে।

কিন্তু পুলিশ যে আসবেই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্যাপারটা একদমই অবাস্তব। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইবে না। কেনই-বা করবে, আমি নিজেকে তো বিশ্বাস করাতে পারছি না।

তবু তুমি সকালে এক বার যাও। লোক পাঠিয়ে অন্তত এক বার ওরা দেখে যাক। ব্যাপারটা সত্যি কি না। পুলিশ ছাড়া তাড়াতাড়ি কিছু করার আর তো উপায় নেই।

পুলিশ তো আর হাতে করে কুকুরটাকে ফেলতে আসবে না, কর্পোরেশনের ডোমকে দিয়ে ফেলবে। গড়িমসি করে, সময় নেবে। আমি তো কেষ্টবিষ্ট্র নই। তবে আমার মনে হয় সোজা যদি কাউন্সিলারের কাছে যাই তাহলে তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা হতে পারে।

সেই ভালো।

ওরা টিভি দেখল না। বিশ্বনাথ লিখতে বসল না। রাতে খেতে বসে তনু বমি করতে ছুটে গেল কলঘরে। বিশ্বনাথ বিষণ্ণ মুখে চেয়ারে বসে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই রকম পাগলের বাড়িতে বাস করা যায় না, অন্য কোথাও ঘর দেখতে হবে। জায়গাটা কিন্তু আমার খুব পছন্দের ছিল।

বালিশে মুখ চেপে তনু উপুড় হয়ে শুয়ে। মুখ ফিরিয়ে শুকনো গলায় বলল, বাবানকে নিয়ে কালই আমি শ্যামপুকুরে চলে যাব।

গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আলো নিভিয়ে বিশ্বনাথ শুয়ে পড়ল। ভোররাত্রের দিকে হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে গেল। জানলার বাইরে কীসের যেন একটা শব্দ। কিছু-একটা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার মতো ধস ধস ধস হয়ে চলেছে।

প্রথমেই তার মনে হল চোর। ভয়ে সে কিছুক্ষণ সিঁটিয়ে রইল। মিনিট কয়েক পর শব্দটা থেমে গেল। বিশ্বনাথ ভাবল, এক বার উঠে জানলাটা খুলে দেখবে কি না। বিছানায় উঠে বসতেই শব্দটা আবার শুরু হল আর সেইসঙ্গে জোরে জোরে শ্বাস ফেলার শব্দ। কোনো মানুষই হবে তবে চোর নয়।

অন্ধকারে পা টিপে জানলায় এসে সন্তর্পণে একটা পাল্লা সে ইঞ্চি চারেক ফাঁক করল। দূর থেকে রাস্তার আলোয় অন্ধকারটা ঈষৎ ফিকে। বিশ্বনাথ চোখ সইয়ে নিতে কিছুটা সময় নিল। জানলার পাশেই গেঞ্জি-ঢাকা একটা পিঠ। কেউ উবু হয়ে বসে। হাতে শাবলের মতো একটা কিছু, তাই দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছে।

এত রাতে এখানে, এমন কাজে ব্যস্ত হল কে? তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিশ্বনাথ প্রায় বলে ফেলছিল, কী করছেন আপনি? তার বদলে সে বিস্ফারিত চোখে বুড়োর দিকে শুধু তাকিয়ে রইল।

হাঁটু গেড়ে বুড়ো এবার দু-হাত দিয়ে গর্ত থেকে মাটি তুলছে। কুঁজো হয়ে ঝুঁকে পড়া দেহ থেকে বিশ্বনাথের মনে হল গর্তটা হাত খানেক গভীর। মাটি তোলার সঙ্গে রয়েছে হাঁফ ধরার শব্দ। কিছুক্ষণ ধরে গর্ত খোঁড়া ও মাটি ভোলা চলল। বুড়ো তারপর শাবলটা মাটিতে রেখে ব্যস্তভাবে জানলার সামনে থেকে চলে গেল। বিশ্বনাথ ভাবল, বেরিয়ে কি দেখে আসবে, বুড়ো এত রাতে গর্ত খুঁড়ছে কেন?

ইতস্তত করে অবশেষে অন্ধকার ঘর থেকে সে দালানে বেরিয়ে আলো জ্বেলে শম্পাকে দেখে নিয়েই নিভিয়ে দিল। বাইরের দরজার খিল নিঃশব্দে নামিয়ে পাল্লাটা খুলতে যাবে তখনই নাকে লাগল একটা মাংসপচা গন্ধের এগিয়ে আসা। বিশ্বনাথ অপেক্ষা করল দরজার ফাঁকে চোখ রেখে। একটা পুঁটুলি বুকের কাছে দু-হাতে ধরে বুড়ো তার সামনে দিয়ে চলে গেল। পুঁটলিটা থেকে ঝুলছে একটা লোহার শিকল যেটাকে সে চেনে। বিশ্বনাথ পায়ে পায়ে ফিরে এসে খাটে শুয়ে পড়ল। জানলার বাইরে মাটি থাবড়ানোর শব্দ হচ্ছে এবং সেটাও একসময় থেমে গেল। তার আর ঘুম এল না।

সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। জানলার ফাঁক-করা পাল্লা দুটোর মাঝে ধূসর রেখাটি একটু উজ্জ্বল হতেই বিশ্বনাথ বাইরে বেরিয়ে এল। বাড়িটা ঘুরে ঘরের জানলার কাছে এসে দেখল হাত দুয়েক লম্বা জায়গায় মাটির রং গাঢ়। ওখানে গর্ত খুঁড়ে আবার তা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। আলগা মাটির উপর পায়ের ছাপ। পা দিয়ে চেপে মাটি বসানো হয়েছে। জায়গাটি কচ্ছপের পিঠের মতো ঈষৎ উঁচু তবে চোখে পড়ার মতো নয়। বৃষ্টি আর রোদ একসময় এটাকে সমান করে দেবে।

বিশ্বনাথ একদৃষ্টে ফুচার কবরের দিকে তাকিয়ে। একটা স্বস্তি ভোরের বাতাসের মতো তার চেতনার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। বুড়ো কেন যে এমন একটা কান্ড করল সেটা কোনোদিনই জানা যাবে না। চিরকাল এটা রহস্যই থেকে যাবে। ফুচা আর বুড়োর সম্পর্কটা এই মাটির নীচেই বরং রয়ে যাক। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে চমকে উঠল। ওটা কী? কবরের মধ্য থেকে ওটা কী বেরিয়ে? সে ঝুঁকে পড়ল।

ফুচার চেনের একটা প্রান্ত সে দেখতে পেল। অন্ধকারে তাড়াহুড়োয় বুড়ো বোধ হয় দেখতে পায়নি চেনটা পুরোপুরি মাটির নীচে চাপা পড়েনি। আঙুলে করে তুলে নিয়ে চেনটায় অল্প টান দিতেই বিশ্বনাথের মনে হল এটা এখনও ফুচার গলায় বাঁধা রয়েছে। অদ্ভুত একটা আতঙ্ক তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল। চেনটা হাত থেকে ফেলে দিতে গিয়ে তার মনে হল এটা তার আঙুলের সঙ্গে আটকে গেছে, হাজার চেষ্টা করলেও সে আঙুল থেকে ছাড়াতে পারবে না। সারাজীবন ফুচা তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে, কিন্তু কোথায়?

বাবানের জন্য, তনুর জন্য তার চোখ জলে ভরে উঠল। চেনটা নরম মাটির মধ্যে চেপে বসিয়ে সে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। ওরা যেন কখনো জানতে না পারে এখানে ফুচা রয়েছে।

ঘরে ফিরে আসার সময় বিশ্বনাথ মুখ তুলল। বারান্দায় বুড়ো চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে সামনের দেয়ালটা দেখছে।

বৃষ্টিতে

সত্যেন বাঁড়ুজ্জের বড়োছেলে বাবুলকে কুকুরে কামড়াচ্ছিল, অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। সিনেমা দেখে রাত সাড়ে নটা নাগাদ সে বাস থেকে নামে। একটা খালি জমির প্লট কোনাকুনি পেরিয়ে রাস্তায় পড়লেই বাঁদিকে বস্তি আর ডান দিকে বিরাট একটা পাঁচিল-ঘেরা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজিং। রাস্তাটাকে দু-ভাগ করে মাঝখানে, প্রায় পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত নানানরকম পাতাবাহার গাছের সারি। এই বস্তিরই কিছু কুকুর রাত ন-টার পর রাস্তাটাকে বিভীষিকায় রূপান্তরিত করে। পদচারী বা সাইকেলে কেউ ওই বস্তির সামনে দিয়ে গেলেই পাঁচ-ছটি কুকুর ঘেউ-ঘেউ রবে ছুটে গোড়ালি পর্যন্ত মুখ নিয়ে আসে। বুদ্ধিমানেরা দাঁড়িয়ে পড়ে, মুখে চু-চু, চুকচুক শব্দ করে ওদের বোঝাবার চেষ্টা করে, আমি ভালো লোক। ওরা তখন কামড়াবার মতো দূরত্বে এসে হিংস্রভাবে দাঁত দেখায়, ঘেউ ঘেউ করে গাছের সারির শেষ পর্যন্ত পায়ে পায়ে চলে। যারা ভীতু তারা চিৎকার করে ওঠে এবং ছুটতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনে। গত তিন মাসে চার জনের হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নানান জায়গার মাংস খুবলে নিয়েছে ওরা। সঠিক বললে, একটি কুকুরই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, কালুয়াটাই। দেখলেই চিনতে পারবে। ইয়া তাগড়াই, কুচকুচে কালো, শুধু বুকের কাছে সাদা আর দুটো চোখের ঠিক উপরে ব্রাউন দুটো স্পট, মনে হবে একস্ট্রা দুটো চোখ। ওটাই পালের গোদা।

প্যান্টের তলার দিকে ফালা হয়ে যাওয়া অংশটা সকলের সুবিধার জন্য বাবুল পা তুলে দেখাল। দাঁতের আঁচড়ে জুতোর পিছনেও ছাল ওঠা।

কী শয়তান কুকুর গো? বাবুলের মা, পুরোনো হাঁপানির রোগী সুপ্রভা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। বাবুল তাদের একমাত্র সন্তান। সেদিন অরুণ দত্তকে কামড়ে পায়ের এতটা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে, এখনও ইঞ্জেকশন চলছে। ভদ্রলোকের পায়ের যা অবস্থা শুনছি হাসপাতাল যেতে হবে।

ভয়ে প্রথমে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। বস্তির পাঠশালার রকে কয়েকটা লোক বসেছিল। তাদের একজন কুকুরগুলোকে ডাকতেই আর আমার দিকে এগোল না! বাবুলের গলা এখনও শুকিয়ে রয়েছে। সন্তর্পণে সে পায়ে হাত বোলাল।

কিছু-একটা করা দরকার। সত্যেন চিন্তিত স্বরে বলল।

কর্পোরেশনে খবর তো মদনদের চাকরকে কামড়াবার পরই দেওয়া হয়েছিল, কিছুই হল না। শুনলুম একদিন নাকি কুকুরধরারা এসেছিল। ওদের দেখেই বস্তির লোকেরা কুকুরগুলোকে ঘরে লুকিয়ে ফেলে।

ওভাবে হবে না, অন্য কিছু ভাবে এই উৎপাত থেকে বাঁচার কথা ভাবতে হবে। সত্যেন বলল বটে কিন্তু কীভাবে বাঁচবে তার হদিস সে জানে না।

পরদিন অফিসে যাবার সময় সত্যেন কয়েকটি কুকুরকে রাস্তায় দেখল। বস্তিতে ঢোকার সরু রাস্তাটার মুখেই টালির চালের পাঠশালার ঘর। হাত তিনেক চওড়া একটা সিমেন্টের রকের উপর পর্যন্ত চাল নামাননা। স্কুলের একমাত্র দরজায় তালা, দশটার পর খুলবে।

দুটি কুকুর রাস্তার কিনারে কুণ্ডলী পাকিয়ে। আর একটা বস্তির ভিতর থেকে ছুটে আসছে আর পিছনে বছর দশেকের একটি মেয়ে বাখারি হাতে তাকে তাড়া করছে। কুকুরটা রাস্তায় বেরিয়ে মাঠের দিকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি ব্যর্থ হয়ে, রাগ প্রকাশ করল ঘুমন্ত দুটির উপর। বাখারির আচমকা আঘাতে কিউ শব্দ করে ধড়মড়িয়ে উঠে তারাও মাঠের দিকে সরে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আক্রমণকারীর চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।

আশ্চর্য! সত্যেন ভাবল, দিনের বেলায় কুকুরগুলো এমন নিরীহ ভীতু আর রাত্তিরে এরাই কিনা অন্য চেহারা নেয়। মেয়েটিকে অনুসরণ করে তার চোখ গিয়ে পড়ল দূরে পাঠশালার রকে। একটি কালো কুকুর সামনের দুই পা ছড়িয়ে কাত হয়ে শুয়ে। দুই পায়ের মধ্যে মুখটা মেঝেয় রাখা। কান দুটি খাড়া। চোখ খোলা না বন্ধ দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। বাবুলের বর্ণনা মতোই ঘোর-কালো এবং দুই জাতে ব্রাউন স্পট। দেখলে মনে হয় রেগে রয়েছে। সত্যেন কুকুরের জাতপাত বোঝে না, তবে মুখের গড়ন, কান আর মসৃণ গা দেখে তার মনে হল দোআঁশলা। নিছকই নেড়ি নয়।

এই তাহলে সেই পালের গোদা, সুপ্রভাকথিত শয়তান যে চার জনের পায়ের মাংস তুলেছে। বস্তির লোকেরা একে কালুয়া নামে ডাকে। কালুয়ার থেকে হাত ছয়েক দূরে কালোয়-সাদায় মেশানো আর একটি লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। পেটটা ঝুলে রয়েছে এবং স্তনের সারি। দূর থেকেই বোঝা যায়, বাচ্চা হবে। ওই শয়তান ব্যাটারই কাজ। সত্যেন নিশ্চিত এ সম্পর্কে। মদ্দা আর তো চোখে পড়ছে না।

এবার সে পাঠশালার কাছাকাছি এবং ইচ্ছে করেই মন্থর হল। মেয়েটি রকে বসল এবং কালুয়ার মাথায় একটা থাপ্পড় মারল। কালুয়া মেঝেয় গড়িয়ে টানটান হয়ে আড়মোড়া ভাঙল। মেয়েটি আবার মারার জন্য হাত তুলেছে, কালুয়াও দু-পা তুলে হাতটা ধরার চেষ্টা করল, আদুরে ভঙ্গিতে।

এইসব দেখতে দেখতে সে পাঠশালা ছাড়িয়ে মাঠে উঠে বাস স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসে কয়েক জনকে সে গত রাত্রে কুকুরের কামড় থেকে ছেলের বেঁচে যাওয়ার কথা বলল। তাইতে অনেকেই নানাবিধ মন্তব্য করল। বস্তির ভোট, কর্পোরেশন ইলেকশন থেকে শুরু করে কুকুর পোষার উপকারিতা, দিশি ও বিলিতি কুকুরের মধ্যে স্বভাবের পার্থক্য, রাস্তায় প্রকাশ্যে তাদের যৌনবিহারের ফলে কতরকম অসুবিধার সামনে পড়তে হয় ইত্যাকার কথাবার্তা অবশেষে পৌঁছোল কুকুরের সঙ্গে মানুষের যৌন তাড়নার তুলনামূলক বাদানুবাদে।

কুকুর জানোয়ার হতে পারে, কিন্তু মানুষের মতো বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই গরম হয়। ওদের সিজন আছে, শুধু সিজনেই মেট করে। আর আমরা, মানুষরা? এক যুবক বাঁকা স্বরে কথাটা বলে জামার গলা ঢিলে করে পাখার নীচে বসল। মাস ছয়েক তার বিয়ে হয়েছে।

এ বিষয়ে বউমা কী বলেন, সেটা না জানা পর্যন্ত আর এসব কথা নয়। কাজে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে এক মাঝবয়সি আলোচনা বন্ধ করে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর মোহিত এসে সত্যেনের কাছে দাঁড়াল। পঁচিশ বছর বেয়ারার কাজ করছে। নম্র, বিনীত, অল্পকথার মানুষ। অল্পবয়সি কেরানিরা ওকে মোহিতদা বলে ডাকে।

বিষ দিয়ে কুকুর মারুন। দু-চারটে মরলেই দেখবেন ঠাণ্ডা, আর কামড়াতে আসবে না। আমার পাড়াতেও কুকুরের উৎপাত ছিল, এখন একদম নেই।

তুমি মেরে দিলে?

হ্যাঁ, একসঙ্গে তিনটে।

বিষ পাব কোথায়?

আমার শালা ওষুধের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে। ওখানকার এক কেমিস্ট তৈরি করে ওকে দিয়েছিল। বললে এনে দিতে পারে।

কী করে বিষ খাওয়াব?

কেন, কিছু-একটা খাবারের মধ্যে, সন্দেশ বা কেক বা পাঁউরুটির মধ্যে পুরে ছুড়ে দেবেন। কপাৎ করে খেয়ে নেবে।

তক্ষুনি মরে যাবে?

না না, তক্ষুনি কি মরে! সকালে দেখবেন মরে পড়ে আছে।

এনে দাও তো আমায়। পয়সা লাগবে?

সে সামান্য দু-পাঁচ টাকা। তবে খুব সাবধান, পাড়ার লোক যেন না জানতে পারে আর নিজেও সাবধান, হাতেটাতে লাগলে তক্ষুনি সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এতে মানুষও কিন্তু মরে।

মোহিত চলে যাবার পরই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সত্যেন ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। তাহলে এবার শয়তানটাকে শায়েস্তা করার মোক্ষম জিনিস সে পেয়েছে। আর কোনোদিন ওখানকার মানুষ আতঙ্কে চলাফেরা করবে না। বাবুলকে যদি কামড়াতই তা হলে কী অবস্থা ওর হত? যন্ত্রণাকর চোদ্দোটা ইঞ্জেকশন। জলাতঙ্কও হতে পারে, মারাও যেতে পারে। অথচ সে কিছুই করেনি, রাস্তা দিয়ে শুধু হেঁটে যাচ্ছিল। এজন্য চড়াও হয়ে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নেওয়া?… সত্যেন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল, বিষ খাইয়ে শয়তানটাকে মারাই উচিত।

অফিস থেকে ফেরার সময় সে একটি ছাড়া কোনো কুকুরই দেখতে পেল না। বস্তির কিছু মেয়ে-পুরুষ রাস্তার ধারে বসে কথা বলছে। বাতির নীচে হাঁড়ি নিয়ে বসে এক ঘুগনিওয়ালা। রাস্তায় এখন লোক চলাচল খুবই কম। রাত আটটার পর একদমই লোক চলে না, কেননা লোকালয় ক্রমশই পাতলা হয়ে গেছে দু-তিনটি হাউজিংয়ের পরই। ট্যাক্সি বা স্কুটার হয়তো কচিৎ দেখা যায়।

কালুয়াকে দেখতে না পেয়ে সত্যেনের কিছুটা আশাভঙ্গ হল এবং সেজন্য রেগেও উঠল। শয়তানটা গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ওর চালাকি ভাঙব… দেখব কেমন করে বাঁচে। হঠাই, একটা চ্যালেঞ্জের মতো ব্যাপার হিসাবে এটাকে মনে করে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

দূর থেকে দুটি কুকুরকে দুলকি চালে আসতে দেখে সত্যেন থমকে গেল। বস্তির লোকেরা তার কাছাকাছিই। ভয় কাটিয়ে পায়ে পায়ে সে এগোল। কালুয়া আর সেই পেট-ঝোলা মাদিটা। ওরা তার পাশ দিয়েই চলে গেল। সত্যেনের মনে হল, শয়তানটা এক বার যেন তার দিতে তাকাল। শিরশির করা শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে সে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছোল।

তিন দিন পর মোহিত তাকে একটা মোড়ক দিল দেশলাই বাক্সের মধ্যে। দাম নিল দশ টাকা।

খুব সাবধানে হাত লাগাবেন কিন্তু।… বড়ো কুকুর হলে এক চিমটেতেই কাজ হবে। মোটামুটি পাঁচ-ছটা মারার মতো মাল এতে আছে।

বাক্সটা পকেটে রেখে সত্যেন অস্বস্তিতে পড়ল। কীরকম একটা ভয় যেন সে পাচ্ছে। কীভাবে এটা খাওয়াবে? যদি বুঝে ফেলে খেতে না চায় আর তাকে যদি খুনিহিসাবে চিনে রাখে? জানোয়াররা নাকি এসব ব্যাপার ভালো বোঝে আর ওদের স্মৃতিশক্তিও নাকি দারুণ! জামাকাপড়ের বা গায়ের গন্ধ ওরা মনে রাখতে পারে বহুদিন। তা ছাড়া এটা খেয়ে যদি না মরে? হয়তো শুধুই পেটখারাপ হল, বমি করল, তারপর ঠিক হয়ে গেল। তখন তো আরও ডেঞ্জারাস হয়ে উঠবে। তবে মোহিত বাজেকথা বলার লোক নয়, পঁচিশ বছর ধরে ওকে সে দেখছে তো!

বাস থেকে নেমে মিনিট ছয়েক হেঁটে একটা মোড়ে পাঁচ-ছটি দোকান। সিগারেট-পানের, স্টেশনারির, মিষ্টির, তারপর মুদির দোকান। সত্যেন সস্তার একটা কেক মুদি দোকান থেকে কিনল। কিন্তু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঠের মাটি ভিজে, রাস্তায় মাঝে মাঝে জল জমে। বস্তির লোকজন কেউ বসে নেই, একটা কুকুরও দেখতে পেল না।

সে একটু দমে গেল। তার মনে হল, মারতে হলে মনের ভিতরে একটা তীব্রতা না থাকলে কাজটা সম্পন্ন করা যায় না। খুনিরা এজন্যই মদটদ খেয়ে নিজেদের খেপিয়ে নিয়ে কাজে নামে। তবে ঠাণ্ডা মাথায়ও অনেকে খুন করে, স্বদেশিরা করত। ওদের একটা সংকল্প বা উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেম, দেশকে স্বাধীন করা, অত্যাচার পীড়ন দেখে দেখে আর সয়ে সয়ে মহৎ আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে ওরা মারত, নিজেরাও মরত। সত্যেনের খুড়শ্বশুর ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়ে ফাঁসিও হয়। তাঁর একটা ছবি শ্বশুরবাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে এখনও ঝোলানো আছে। খুবই মলিন তার কাচ ও ফ্রেম। প্রেরণা পাওয়ার মতো স্বচ্ছ নয়।

কিন্তু সত্যেন এই মুহূর্তে কুকুর মারার জন্য তীব্র ইচ্ছা অনুভব করছে না। কিন্তু এটা তার খুবই দরকার। সামনের বাড়ির অরুণ দত্তর এক-তলার জানলায় আলো জ্বলছে। সত্যেন বাড়িতে ঢুকে কলিং বেল টিপল। দরজা খুলল ঝি। ভিতরের ঘর থেকে উঁকি দিল অরুণ দত্তর বউ।

অরুণবাবু আছেন কেমন?

আজ বিকেলেই নার্সিংহোমে ভরতি হলেন। ধীর কিন্তু উদবিগ্ন স্বরে বলল। পা-টা খুব ভালো ঠেকছিল না। ডাক্তারবাবু সকালে দেখে বললেন, হয়তো অপারেশন করতে হতে পারে।

সত্যেন অবাক হবার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অপারেশন কেন? পা কেটে বাদ দিতে হবে নাকি? কিন্তু একথা তো ওঁকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, তাহলে আরও ভয় পেয়ে যাবেন।

কী কান্ড দেখুন তো, এভাবে কুকুর কামড়ে মানুষের কত ক্ষতি করল। কত অর্থব্যয়, কত শারীরিক কষ্ট, আত্মীয়স্বজনদের দুশ্চিন্তা… কিছু-একটা করা দরকার। সত্যেন টের পাচ্ছে। সে উত্তেজনা অনুভব করছে। তা-ই নয়, অবলম্বনরূপে একটা উদ্দেশ্যও পাচ্ছে…কত ক্ষতি, কত কষ্ট! নিজের উদবেগ, সহানুভূতি ও কিছু সান্ত্বনা জানিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল।

বিকেল থেকে সুপ্রভার শ্বাস ওঠায় সে রান্না করতে পারেনি। কোলে বালিশ নিয়ে বিছানায় বসে। বাবুল আটটার আগে অফিস ও আড্ডা থেকে ফেরে না। সত্যেন ভাত ফুটিয়ে, মাছের ঝাল বেঁধে রেখে কলঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করল।

উবু হয়ে বসে সন্তর্পণে দেশলাই বাক্সটা খুলে দেখল-পাতলা কাগজে ওষুধের পুরিয়ার মতো ভাঁজ-করা। দু-আঙুলে টিপে বুঝল জিনিসটা পাউডারের মতো। ধীরে ধীরে সাবধানে ভাঁজ খুলে দেখল সাদা গুঁড়ো। গন্ধ শুকতে গিয়েও নাক তুলে নিল। নিশ্বাসের সঙ্গে যদি ভিতরে চলে যায়।

কেকটা কপাৎ করে খাওয়ার পক্ষে বড়োই, তাই দু-আধখানা করে নিয়েছে। পেরেক দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে শক্ত একটা কাগজে খানিকটা বিষের গুঁড়ো তুলে সে-গর্তে রাখল। আঙুলে টিপে টিপে গর্তের মুখ বুজিয়ে ফেলে কেকের টুকরোটা কাগজে মুড়ে নিল। কলঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে শক্ত কাগজটা প্যানের মধ্যে ফেলে সিস্টার্ন টেনে দিয়েছিল। সমস্যা হল দেশলাই বাক্সটা কোথায় লুকিয়ে রাখবে? শোবার ঘরে নয়, রান্নাঘরে তো নয়ই। ভেবেচিন্তে অবশেষে ঠিক করল, পাঞ্জাবির পকেটেই থাকুক, অফিসে তার ড্রয়ারে কাল রেখে দেবে। কেকের বাকি আধখানা, যাতে বিষ নেই, সেটা বাড়িতেই থাকুক পরে কাজে লাগতে পারে। তবে বিষাক্ত টুকরোটা পকেটে রাখল। এটাও সঙ্গে নিয়ে অফিসে যাবে, কাল বাড়ি ফেরার সময়, যদি ভগবান সদয় হন, শয়তানটাকে যদি তিনি এগিয়ে দেন কেকটা গেলাবার জন্য! সত্যেন উত্তেজনায় রাতে ঘুমোতে পারল না।

পরদিন অফিসে বেরোনোর মুহূর্ত থেকে তার স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে উঠল। রক্ত চলাচলের বেগ বেড়ে উঠে শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। সারাদিন এই অবস্থায় একটা ঘোরের মধ্যে সে অফিসে কাটাল। কুকুরটার চেহারা, ভাবভঙ্গি অবিরত তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে সে মহড়া দিল কীভাবে কেকটা ওকে দেবে। দূর থেকে ছুড়ে না কাছে এলে হাতে নিয়ে অপেক্ষা করবে? হাত থেকে খাওয়ানোটা কি নিরাপদ? যদি টের পেয়ে যায় তাকে মারার ষড়যন্ত্র হয়েছে, কেকে বিষ আছে, তাহলে কামড়ে দিলেও দিতে পারে। জানোয়ারদের অদ্ভুত একটা সিক্সথ সেন্স আছে। হঠাৎ আদিখ্যেতাকে ওরা সন্দেহ করবেই।

একটু দেরি করে ফেরার জন্য সত্যেন অফিস থেকে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে গেল। অনেক দিন পর এই নদী দেখতে তার ভালো লাগল। কৈশোরে আহিরিটোলা ঘাটে সাঁতার কাটার, পাড়ার দুর্গা আর কালী পুজোর ভাসানের কথা তার মনে পড়ল। বাবুঘাটে অনেকক্ষণ বসে তার শরীর ও মন স্নিগ্ধ, ঢিলেঢালা হয়ে গেল। অবশেষে সে বাসে উঠল বাড়ি ফেরার জন্য।

দূর থেকেই দেখল বস্তির কয়েকটি শিশু রাস্তায় খেলা করছে। কয়েক জন বয়স্কা মেয়েমানুষ বসে গল্প করছে। কুকুর? সত্যেনের চোখ খুঁজে বেড়াল। রাস্তার নিয়ন আলোয় পাতাবাহারিগাছগুলোর নীচে একটা সাদা পুটলির মতো দেখেই তার মাথার মধ্যে রক্ত ছুটে এল। পেয়েছি একটাকে।

স্বাভাবিক কদমে হাঁটার চেষ্টা করেও তার পা জড়িয়ে আসছে। লক্ষ করল তাকে কেউ দেখছে কি না। শিশুরা ওই দিকটায় যাচ্ছে না দেখে সে আশ্বস্ত হল। পকেটে হাত দিয়ে কেক মোড়া কাগজটার সঙ্গে দেশলাইটাও পেল। আশ্চর্য, এটা ড্রয়ারে রেখে দিতে ভুলে গেছে!

সেই মাদি কুকুরটা। সত্যেনকে দেখেই মুখ তুলল।

আয়, আয়, চু-চু।

উঠে দাঁড়িয়েছে। কাগজের মোড়কটা খোলার সময় হাতটা এমনই কেঁপে গেল যে কেকের টুকরোটা রাস্তায় পড়ে গেল। নীচু হয়ে তুলতে গিয়েও তুলল না। যদি ছুটে এসে কামড়ে দেয়?

কিন্তু ছুটে এল না, বরং ল্যাজটা নাড়াল। তারপর সত্যেনকে স্তম্ভিত করে সে এগিয়ে এসে কেকের টুকরোটা এঁকেই মুখে তুলে চিবোতে শুরু করল। আর পায়ে পায়ে পিছিয়ে গিয়ে সত্যেন ভীত একটা আর্তনাদ করে প্রায় ছুটেই পালাতে লাগল।

বাড়িতে ঢুকতেই সুপ্রভার সঙ্গে মুখোমুখি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্রভা অবাক স্বরে বলল, ভূত দেখেছ নাকি?

শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে সে শুয়ে পড়ল। রাত্রে খেল না, ঘুমোতেও পারল না। পরদিন অফিস যাবার সময় দেখল রাস্তা প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিক। বস্তির ভিতর থেকে ঝগড়ার আর কুকুরের ডাকের আওয়াজ পেল। কোথাও মরা কুকুরের চিহ্নও নেই। বুক থেকে একটা ভার নেমে যাওয়ার স্বস্তি নিয়ে সে অফিস পৌছোল।

একসময় মোহিতকে ডেকে সে জানিয়ে দিল, তোমার বিষে ভেজাল আছে। যা বলেছিলে সেইভাবেই একটাকে খাইয়েছি কিন্তু মরেনি। সত্যেন ড্রয়ার থেকে দেশলাই বাক্সটা বার করে টেবিলে রাখল। নিয়ে যাও এটা, যে দিয়েছে তাকে বোলো।

কবে খাইয়েছেন?

কাল সন্ধ্যার পর। রাস্তা থেকে নিজেই খেল। যতটা বলেছিলে ততটাই দিয়েছিলাম।

খোঁজ নিয়ে দেখুন মরেছে কি না, তারপর ফেরত নেব।

বাড়ি ফেরার সময়ও সে দেখল রাস্তা একইরকম। দু-তিনটে কুকুর ঘুরছে, এমনকী শয়তানটাকেও দেখতে পেল গ্রামোফোন রেকর্ডের কুকুরটার মতো বসে আছে বস্তিতে ঢোকার গলিটার কাছে। একটি লোক তার পাশে বসেই ঘুগনি খাচ্ছে। সত্যেন কার কাছে আর খোঁজ নেবে? বাড়িতে কাউকে এসম্পর্কে কিছু বলল না।

তবে সে শুনল, অরুণ দত্তর পায়ে পচ ধরেছে, খুব সিরিয়াস অবস্থা, পা কেটে-না বাদ দিতে হয়। পরের দিনই শয়তানটা কামড়াল কান্তি ঘোবের ভাইপোকে। বাড়িতে আত্মীয়রা এসেছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় তাদের বাসে তুলে দিয়ে সে ফিরছে, তখন তাড়া করে কামড়ায়। তবে বস্তির একজন চেঁচিয়ে ওঠায় কামড়টা ভালোমতো দিতে পারেনি। চারটে সেলাই হয়েছে। শোনামাত্র সত্যেনের মাথা গরম হয়ে গেল।

কিন্তু সকালে ঠিকে ঝি একটা খবর দিল যেটা অপ্রত্যাশিত।

একটা কুকুর পরশু থেকে মরে পড়ে আছে হাউজিং-এর পিছনে পাঁচিলের গায়ে। দুর্গন্ধে ওদিককার ফ্ল্যাটের লোক টিকতে পারছে না। কর্পোরেশন আপিসে খবর দিয়েছে, এখনও কেউ আসেনি।

আর সন্দেহ নেই কোন কুকুরটা। মোহিত খাঁটি মানুষ, ভেজাল জিনিস সে গছাবে না। সত্যেন আবার উত্তেজনার মধ্যে পড়ে গেল। আবার একটা ঘোর তার শরীরে মনে লাগছে। তাহলে বিষটায় কাজ হয়েছে। তাহলে এবার শয়তানটাকে শেষ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

বাসি কেকের টুকরোটা শক্ত হয়ে গেছে। আবর্জনার বালতিতে ফেলে দিয়ে সে স্থির করল, অফিসে মোহিতকে দিয়ে একটা কেক কিনে আনিয়ে নেবে। দেশলাই বাক্সটা ড্রয়ারেই রাখা আছে। অফিস ছুটির পর ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে তখন জিনিসটা তৈরি করে নেবে। আজই সন্ধের পর যদি সুযোগ মেলে, তাহলে আজই পৃথিবীতে ওর শেষ দিন!

বিকেল থেকেই মেঘ ঘনিয়ে আসে। দেরিতে ফিরবে বলে সত্যেন ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে কেকটা তৈরি করে অফিস থেকে যখন বেরোল তখন প্রথম বার বিদ্যুৎ চমকে উঠল। বাতাসে ঠাণ্ডা ভাব। বাসে ঠাসা ভিড়। বৃষ্টি নামার আগেই সবাই বাড়ি পৌঁছোতে চায়। সত্যেন ঠেলেঠুলে তার বাসে উঠল, তাকেও বৃষ্টির আগে পৌঁছোতে হবে। কিন্তু বাস থেকে নামার আগেই ফোঁটা ফোঁটা পড়ছিল। নামামাত্রই চড়বড়িয়ে বড়ো বড়ো ফোঁটায় শুরু হল। একটা কোনো আশ্রয় নেই যার তলায় দাঁড়ানো যায়। সত্যেন বাড়ির দিকে ছুটল।

মাঠটা পার হয়েই বুঝল ছোটাটা অর্থহীন। যে বেগে নামছে তাতে ভিজে ঢোল হয়ে যেতে হবে বাড়ি পৌঁছোনোর আগেই। পাঠশালার ঢাকা রকটা দেখে সে দৌড়ে বস্তির গলিতে ঢুকে রকে উঠে পড়ল। আর সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলসানির সঙ্গে প্রচন্ড শব্দে মেঘ ডাকল আর জলের ধারা প্রবল তোড়ে নামতে থাকল।

খুব বেঁচে গেছি। সত্যেন হাঁফ ছাড়ল। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি হলেই চুবিয়ে দিত। কপালের জল মোছার জন্য রুমাল বার করতে গিয়ে কেকের টুকরোটা হাতে ঠেকল। এটার আজ আর দরকার হচ্ছে না। এমন বৃষ্টিতে জানোয়ারও বেরোবে না।

বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। একই বেগে ঝরছে আর সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটা। রাস্তার নিয়ন আলো ছাড়া চারিদিকে আর কোনো আলো নেই। সব বাড়ির জানলা বন্ধ। বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সে দেখতে পাচ্ছে নির্জন গলি। বৃষ্টিটা চাদরের মতো ঝুলে রয়েছে, দমকা বাতাসে চাদরটা নড়ে উঠলেই নিয়ন আলোর কণিকা ঝলমল করে উঠছে। সত্যেন মুগ্ধচোখে তাকিয়ে ছিল।

হঠাৎ তার শরীর শিরশির করে হাতের নোম খাড়া হয়ে উঠল। কেউ একজন রকে রয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখল রকের একপ্রান্তে বসে আছে শয়তান। মুখটা তার দিকেই ফেরানো। সত্যেন থরথর করে উঠল। এক-পা পিছোতেই দেয়ালে পিঠ লেগে গেল।

কুকুরটা গা ঝাড়া দিল। ধোঁয়ার মতো জলের গুঁড়ো ওর লোম থেকে রাস্তার আলোয় ছিটকে বাষ্পের মতো উঠল। আর সত্যেনের মনে হল একটা অলৌকিক জীব তার সামনে। মুখটা ঘুরিয়ে সত্যেনের দিকে তাকিয়ে। চোখ জ্বলজ্বল করছে।

আমাকে কি চিনেছে? বুঝে গেছে কি পকেটে ওকে মারার বিষ রয়েছে? ওদের সিক্সথ সেন্স নাকি প্রখর! দৌড়, একদম নয়। তাহলে।

বৃষ্টির ছাট হাওয়ার দমকায় রকটায় আছড়ে পড়ল। কুকুরটা সরে এল সত্যেনের দিকে। আর সত্যেন পকেটে হাত ঢুকিয়ে কেকটা আঁকড়ে রইল। কুকুরটা আরও সরে এল। ভয়ে একটা কাতরানি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই কুকুরটা মুখ তুলে তাকাল। অন্ধকারে চোখ দুটো জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে। সত্যেনের মনে হল, যদি দাঁড়িয়ে ওঠে তাহলে গলার কাছে ওর দাঁত পৌঁছোবে শয়তান মুখ তুলে তার গলা পর্যন্ত দূরত্বটা আন্দাজ করছে।

দুজনের মধ্যে হাত ছয়েকের ফাঁকা জায়গা। সত্যেন এখনও দু-হাত পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে কী লাভ, কুকুরটাও তাহলে সরে আসবে। জল উঠতে উঠতে রকের প্রায় সমান সমান। অল্প বৃষ্টিতেই এই অঞ্চলে হাঁটুজল জমে আর এখন তো তোড়ে অন্তত পনেরো মিনিট হচ্ছে।

হঠাৎ প্রচন্ড ঝলসানি দিয়ে ডান দিকে হাউজিং-এর একটা টিভি অ্যান্টেনায় বাজ পড়ল। সত্যেনের মুখে গরম হলকা লাগল, চোখ বন্ধ করে ফেলে সে ঠকঠক কেঁপে উঠল আর ক্ষীণ আর্তনাদ করে কুকুরটা গুঁড়ি মেরে তার পায়ের কাছে সরে এল। দমকা হাওয়ার সঙ্গে জলের একটা ঝাপটা আসতেই সত্যেন পিছিয়ে যাবার জন্য পা সরাতেই মাড়িয়ে ফেলল কুকুরের পা। তার বুকটা হিম হয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। অবধারিত এইবার দাঁতগুলো বসবে তার গোছের কিংবা হাঁটুর কাছে। একটা মোচড় দিয়ে এক খামচা মাংস তুলে নেবে। দাঁতে দাঁত চেপে, দু-হাত মুঠো করে সে তৈরি। তাকে এবার কামড়াবেই, এই সময় আবার একটা বিদ্যুতের ঝলসানি হতেই সে মা গো বলে দু-হাতে কান ঢাকল এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। আগেরটার থেকে কিছুটা দূরে এবারের বাজটা পড়ল। কুকুরের কুঁই কুঁই কাতরানি তার কানে এল।

বিমূঢ়ত্বটা কেটে যেতেই দেখল কুকুরটা তার দু-পায়ের ফাঁকে প্রায় মুখটা গুঁজড়ে। এবার সে সরে যাবার চেষ্টা করল না। তার মনে হচ্ছে, কুকুরটা তাকে আক্রমণ করবে না। আরও মনে হচ্ছে, কুকুরটা ভয় পেয়ে তার কাছ থেকে বোধ হয় ভরসা চাইছে।

সত্যেনের স্নায়ুগুলো ঢিলে হয়ে গেল। বিরক্ত হল সে নিজের উপর। কেন যে মরতে এই পাঠশালার রকে উঠলাম! নয় একটু ভিজতামই, তবু সোজা বাড়ি চলে গেলেই ভালো হত। এই বৃষ্টি কখন যে থামবে কে জানে। এরপর সে কুকুরটার দিকে ঘাড় নীচু করে তাকাল। এটাই-বা এখানে কেন! বস্তির যেকোনো ঘরেই তো গিয়ে ঢুকতে পারত। নাকি তার মতোই ভেবেছিল, বৃষ্টি তো কিছুক্ষণ বাদেই ধরে যাবে, ততক্ষণ বরং এই রকে আশ্রয় নেওয়া যাক। নীচু জমির বস্তিতে এখন আর দাঁড়াবার মতো ডাঙা থাকা সম্ভব নয়।

সত্যেন দ্বিধায় পড়ল। বাড়ির দিকে এখনই রওনা হবে না কি আর একটু অপেক্ষা করে দেখবে। চোখ কুঁচকে মুখ তুলে একদৃষ্টে সে বৃষ্টির চাদরের দোলা দেখছে। মেঘ ভেদ করে দপ দপ করল লালচে বিদ্যুৎ। গুম গুম চার-পাঁচটা শব্দ গড়িয়ে গেল আকাশ দিয়ে। ভয় পাওয়ার মতো কিছু তাতে নেই। মেঘটা সরে যাচ্ছে বাজ ফেলতে ফেলতে।

চমকে পা সরিয়ে নিল সে। কুকুরটা চেটে দিয়েছে।

অ্যাই, ধ্যাত ধ্যাত। সত্যেন ধমকে উঠল, পা ঠুকল এবং জুতোর ডগা দিয়ে মুখটা সরিয়ে দিল। ব্যাটা ভয় পেয়েছে। এখন তাকে কাছে রাখার জন্যই এইসব চাটাফাটা…শালা শয়তান! সত্যেনের মাথা গরম হয়ে উঠল। মনে থাকে না মানুষকে কামড়াবার সময়? এখন যদি তোকে কেকটা দিই কী হবে? কপাৎ করে তো গিলে ফেলবি! নিজের মনেই সে গজগজ করে চলল। ব্যাটা কুত্তা, এতগুলো মানুষকে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নিয়েছিস, একটা লোক তোর জন্যই পা হারাতে বসেছে! আর শালা শয়তান, তুই কিনা সেই মানুষেরই কাছে কিঁউ কিউ করছিস ভয় পেয়ে?

ভাগ ব্যাটা। সত্যেন হঠাৎ লাথি কল পাঁজরে। এক-পা পিছিয়ে গেল কুকুরটা, ভীত শব্দ তুলে।

এইবার যদি তোকে খেতে দিই? সত্যেন পকেট থেকে কাগজে-মোড়া কেকের টুকরো বার করল। তুই তো খাবিই। হ্যাংলার জাত, যা পাবি তাই-ই তো খাস, এটা তো দারুণ জিনিস তোর কাছে। মোড়কটা ভিজে গেছে। কেকের সঙ্গে সেঁটে-যাওয়া কাগজ ছাড়াতে ছাড়াতে সে লক্ষ করল কুকুরটা মুখ তুলে তাকিয়ে লেজটা অল্প অল্প নাড়ছে।

ধীরে ধীরে কেকসমেত হাতটা সে পকেটে ভরে নিল। শয়তানটা বুঝতে পেরেছে এটা খাবার জিনিস।

কী রে, খাবি?

লেজটা জোরে জোরে নেড়ে কুকুরটা ছটফট করে উঠল। কু-কুঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। কোমর থেকে পিছনটা ঘন ঘন নড়ছে। সামনের পা দুটো অধৈর্যে তুলছে আর নামাচ্ছে। এগিয়ে এসে সত্যেনের গা ঘেঁষে মুখটা তুলে ছোট্ট করে তিন বার ডেকে উঠল। পকেট থেকে কেকের টুকরোটা বার করে সে হাতটা উঁচু করে তুলে ধরে রইল। কুকুরটা এবার দ্বিগুণ ছটফটানি শুরু করল।

এইবার? এইবার?

কুকুরটা হঠাৎ সামনের পা দুটো সত্যেনের পেটে ঠেকিয়ে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তখন সে হাতটা আরও উঁচুতে তুলল।

কী রে ব্যাটা, মরতে চাস? তোর প্রাণ এখন আমার হাতে, তা কি জানিস?

বলার পরই সত্যেন অদ্ভুত একটা মজা বোধ করল। প্রাণ এই ছোট্ট শব্দটা ঝনঝন শব্দে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বজ্রের মতো গড়িয়ে নেমে গিয়ে আবার উঠে এল। এই কুকুরটারই হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সেদিন যেমন সে ভয় পেয়ে গেছল, অনেকটা সেইরকম একটা আতঙ্ক এখন তাকে যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই এখন সে আবার খুন করতে পারে, কেউ জানবে না, বুঝতে তো পারবেই না। একটা প্রাণ এখন তার হাতে। তারই দয়ার উপর! অদ্ভুত তো?

বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। ইতিমধ্যে জল রকে উঠে পায়ের গোছ এবং জুতো যে ডুবিয়ে দিয়েছে সে-হুশ তার ছিল না। পেটে নখের অধৈর্য আঁচড় সুড়সুড়ি দেবার মতো লাগছে। সত্যেন কেকের টুকরোটা একটু নামিয়েই আবার তুলে নিল। কুকুরটা কাতরানির মতো শব্দ করে ডেকে উঠল।

হুঁহুঁ বাব্বা, এটা টপাস করে ফেলব আর কপাৎ করে গিলবি, সেটি হচ্ছে না। ভাগ ভাগ। সত্যেন তালু দিয়ে ওর মুখে সজোরে ধাক্কা দিল। টাল খেয়ে কুকুরটা পা দুটো নামিয়ে নিয়েই চাপা গজরানির মতো শব্দ করল।

ওসব ফোতো রাগ আমাকে দেখালে এমন লাথ কষাব-না… তোকে বাঁচিয়ে রাখছি আর শালা আমাকেই কিনা… সত্যেন লাথি ছোঁড়ার জন্য পা তুলে টলে পড়ে যাচ্ছিল। দেয়ালটা ধরে নিজেকে সামলাচ্ছে তখন হাত থেকে কেকের টুকরোটা মেঝের জলের উপর পড়ে গেল। নীচু হয়ে সেটা সবে তুলেছে তখনই কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কবজির কাছে কামড়ে ধরল। ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই কুকুরটা দ্বিতীয় বার আক্রমণ করে বাহু কামড়ে ধরতেই পিছিয়ে যেতে গিয়ে সত্যেন গড়িয়ে রক থেকে জলে পড়ল। কেকের টুকরোটা আবার হাত থেকে মেঝেয় ভাসছে।

রাস্তার আলোয় যতটুকু দেখা যায়, বাহুটা তুলে ফ্যালফ্যাল করে সে তাকিয়ে। সাদা হাড়ের আভাস যেন দেখা যাচ্ছে। খোদলটা ক্রমশ ভরে উঠছে রক্তে। পাঠশালার রকের উপর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে কুকুরটা মুখ নীচু করে চিবোচ্ছে। সত্যেন ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। জল হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে। পালাবার জন্য নিজেকে টানতে টানতে সে জলের মধ্য দিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।

রাস্তায় হাঁটুর নীচে জল। টলতে টলতে সে এগোচ্ছে। বৃষ্টি প্রায় থেমেই গেছে। নিস্তব্ধ এবং জনশূন্য চারিদিক। সে এক বার পিছন ফিরে তাকাল। পাঠশালার রকে জলবন্দি হয়ে একটা অবয়ব নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। সত্যেনের চোখ জলে ভরে উঠল। যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার হাতে।

বৃষ্টির মতো

বৃহস্পতিবার মাঝরাতে জোলো হাওয়ার ঝাপটায় নন্দার ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে দেখল আকাশের রং মেটেলাল। দূরে রাস্তার আলোয় বৃষ্টির ধারা দেখে বুঝল সারারাতই ঝরবে। সাত মাসের ছেলে পাশেই ঘুমোচ্ছে। তার গায়ের চাদরটা টেনেটুনে দিয়ে সে উঠে বসল। দোতলায় জানলার পাল্লা মোট আঠারোটা। বন্ধ করে না দিলে দালান ঘর ভেসে যাবে। খাট থেকে নামার সময় সে জানলা বন্ধ করার শব্দ পেল।

কে বলাইয়ের মা নাকি?

হ্যাঁ।

ছোটাখাটো শীর্ণ চেহারা, বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। অর্ধেক চুলই পাকা। সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর। মাথায় সবসময়ই ঘোমটা। বলাইয়ের মা স্বল্পবাক, ধীর প্রকৃতির। ওর স্বামী ভূপতিও বেঁটে গড়নের। স্ত্রীর থেকে চুল বরং একটু কালোই, ষাট-পঁয়ষট্টির মধ্যে বয়স। মাঝে মাঝে হাঁপানির টান ওঠে। ওর একটা চোখের মণি ঘোলাটে। একদমই দেখতে পায় না। দুজনে থাকে গ্যারেজের লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে।

জানলা বন্ধ করে বলাইয়ের মা নীচে নেমে যাচ্ছে। নন্দা বলল, গ্যারেজের শাটারের তলা দিয়ে জল ঢুকছে কি না একটু দেখতে বলো তো ভূপতিকে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নন্দা দেখল অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশ। ঘরের মধ্যে আবছা আবছা আলো। জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তাটা দেখে তার চক্ষুস্থির! ছুটে নেমে এসে দেখল বলাইয়ের মা বাসন মাজছে।

ভূপতি দুধ এনেছে কি? রাস্তায় যা জল জমেছে দুধের ভ্যান হয়তো নাও আসতে পারে!

এখনও ফেরেনি।

মিনিট দশেক পর ভূপতি ফিরে এসে জানাল, বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়ের গোছ ডোবা জল কিন্তু বড়ো রাস্তায় হাঁটুর কাছাকাছি। একটা দোকানও ভোলা নেই। দুধের গাড়িও আসেনি। পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির ফটক দিয়ে রাস্তার জল ঢুকে ইঞ্চি চারেক গভীর হ্রদের মাঝে বাড়িটাকে দ্বীপ বানিয়ে ফেলেছে।

কী গেরো বলোতো, বৃষ্টি থামলেই বাঁচি। বাজার তো বসবে না, একটাও কি দোকান খোলা নেই?

ভূপতি মাথা নাড়ল।

চালে ডালে খিচুড়ি বসাও, আর কী করা যাবে।

ভিজে জবজবে খবরের কাগজ দিয়ে গেছে। ওড়িশায় বারিপদার কাছে নিম্নচাপ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এর প্রভাবে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া আর কিছু বলা নেই। বলবেই-বা কী করে, মাঝরাতে বৃষ্টি শুরু হলে পরদিন কাগজে সে-খবর দেওয়া সম্ভব নয়। নন্দা গ্র্যাজুয়েট, বুদ্ধিমতী, বিবেচক। তার স্বামী রঞ্জন কাঠের ব্যবসায়ী। চার দিন আগে সে অসম গেছে। প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়।

বৃহস্পতিবার সারাদিন বৃষ্টি পড়ল। তার সঙ্গে দমকা বাতাস। নন্দা মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে রাস্তার অবস্থা দেখল। গাছপালা আর বাড়ির ফাঁক দিয়ে বহু দূরের রাস্তায় চলন্ত বাসের চালটুকু দেখা যায়। সে একটাও বাস দেখতে পেল না। গ্যারেজের শাটারের নীচে এক হাত জল। যদি জল ঢুকে থাকে তা হলে গাড়িটার এঞ্জিনের তলার দিকটা এতক্ষণে ডুবে গেছে। কী আর করা যাবে।

সন্ধ্যাতেও বৃষ্টি বন্ধ হল না। নন্দা টিভি-র খবর থেকে শুনল, বারিপদার থেকে নিম্নচাপ উত্তর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে কলাইকুন্ডার কাছে অবস্থান করছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত গত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে শুক্রবারও সারাদিন জোর বৃষ্টি ও দমকা বাতাস চলবে তবে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে পারে।

শুক্রবার বৃষ্টি কমার বদলে আরও বেড়েই গেল। খবরের কাগজওয়ালা পর্যন্ত আসতে পারেনি যখন, নন্দা বুঝল রাস্তায় অন্তত কোমরের উপর জল উঠেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে বিরক্ত হয়ে পড়ল। সাত মাসের ছেলের সঙ্গে কতক্ষণ আর কথা বলা, খেলা করা যায়! সময় কাটাতে সে ফোন করল তার বাপের বাড়িতে। এত বৃষ্টিতেও ফোন কাজ করছে। দেখে সে অবাকই হল। ভাই জানাল, একতলা থেকে জিনিসপত্র দোতলায় তুলে আনা হচ্ছে, তারা এখন খুব ব্যস্ত।

ফোন রেখে নন্দা কী ভেবে নীচে এল। ডাইনিং টেবিলের ধারে মেঝেয় বুড়োবুড়ি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল।

তোমাদের ঘরে কি জল ঢুকেছে?

দুজনেই মাথা নাড়ল।

জিনিসপত্র এখানেই নিয়ে এসো।

টিভিতে সন্ধ্যার খবরে সে শুনল আজ আলিপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সারাদিনে ২৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। শনিবারও বজ্রবিদ্যুৎ-সহ কয়েক পশলা জোর বৃষ্টি হতে পারে।

রাত্রে একতলায় ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে নন্দা দেখল ঘরের কোনায় একটা টিনের সুটকেস আর ভিজে কাপড়। পোঢ় কার্ড আকারের একটা বাঁধানো ছবি উপুড় করে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। ছবির পিছনের হলদে রঙের কাগজের বোর্ডটা ভিজে ফুলে উঠেছে। সে ধরে নিল ছবিটা মা কালীর অথবা শ্রীকৃষ্ণের।

শনিবার সকালেই বৃষ্টি ঝিরঝিরে হয়ে এল। দুপুরে প্রায় বন্ধই। তা হলেও আকাশ থমথমে, ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। রাস্তায় লোক চলছে না, গাড়ি তো নয়ই। দুটো কাক সামনের বাড়ির কার্নিশে বসে। তা ছাড়া সে আর কোনো জনপ্রাণীও দেখতে পেল না।

টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো, কে দিদি? কী অবস্থা যে…

নন্দা বড়ো বিপদ, শিগগিরি তুই সতুদের…আমার দেওর সতুদের বাড়িতে একটা খবর দেবার ব্যবস্থা কর, যেভাবেই হোক। ওর ছেলে মাস্তু পাঁচ দিন হল আমাদের বাড়িতে রয়েছে। আজ সকালে চুপিচুপি কখন যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে কেউ লক্ষ করিনি। আট বছরের ছেলে। রাস্তাঘাট জলে থইথই। সকাল থেকেই খোঁজাখুঁজি করছি আমরা। এইমাত্রপাশের বাড়ির একজন খবর দিল, রাস্তার পাশে ড্রেনের মধ্যে একটা ছেলের বডি পাওয়া গেছে। জলে ডোবা। বয়সও বেশি নয়। হাসপাতালে নিয়ে গেছে। শুনেই সবাই আর জি কর এ রওনা হয়ে গেছে। তুই এক বার ওদের বাড়িতে খবর দেবার ব্যবস্থা কর। পরের ছেলে বাড়িতে এনে একী বিপদে পড়লাম।

নন্দা কান্নার শব্দ পেল। খবরটা শুনে সেও স্তম্ভিত। মাকে সে দেখেছে। ওরা কাছাকাছি থাকে। হেঁটে মিনিট পনেরো-কুড়ির পথ। মাস দুয়েক আগেই ওরা নন্দার ছেলেকে দেখতে সন্ধ্যে বেলায় এসেছিল। সঙ্গে মান্তুও ছিল। ছটফটে চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে। একদন্ডও বসে থাকতে পারে না।

নন্দা, যদি সম্ভব হত তা হলে আমি এখুনি বেলগাছিয়া থেকে দৌড়ে যেতুম। রাস্তায় বুক সমান জল, একটা গাড়ি নেই। ওদের এখুনি খবর না দিলে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকব। তুই একটা ব্যবস্থা কর। আমার প্রেশার বাড়ছে। আর কথা বলতে পারছি না হাত-পা কাঁপছে, বুকের মধ্যে কী যে হচ্ছে! তোর বাড়ি থেকে তো আর বেশি দূর নয়।

আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি ব্যস্ত হোয়য়া না।

ফোন রেখে নন্দা নীচে নেমে এল। বুড়োবুড়ি দুজনে পাশাপাশি বসে সদর দরজায়। সিঁড়ির প্রথম ধাপটা জলের নীচে। ওরা জলের দিকে তাকিয়ে। নন্দাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

ভূপতি, ভীষণ বিপদে পড়েছে আমার দিদি। তোমাকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে।

ভূপতি তার ভালো চোখটা দিয়ে স্তিমিত চাহনিতে তাকিয়ে। শীর্ণ গলার কণ্ঠটা কয়েক বার ওঠা নামা করল। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়েছে। সকাল থেকে খায়নি।

নন্দা ঝড়ের বেগে কথাটা বলে গেল। ওরা দুজন তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এক বার শুধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল যখন নন্দা বলল, শেষ দেখাটা অন্তত তা হলে ওরা দেখতে পাবে। যাবে তুমি?

ভূপতি বউয়ের মুখের দিকে তাকাল।

যাব। বলাইয়ের মা শান্ত মৃদুস্বরে বলল।

একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি তাহলে, মুখে আর কিছু তোমাকে বলতে হবে না। বাড়ির ঠিকানা তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই, মনে থাকবে না। তবু লিখে দিচ্ছি। কোনো লোককে দেখালে বাড়ি বলে দেবে। আমি তোমাকে বরং জায়গাটা বুঝিয়ে দিচ্ছি, সেইমতো চলে যাও। খুব শক্ত হবে না খুঁজে বার করতে।

মিনিট দশেক পর গেট খুলে ভূপতি রাস্তার দু-দিকে তাকাল। বৃষ্টি আপাতত ধরে গেছে। দূরে একটি লোককে সে দেখল রাস্তা ধরে আসছে টলতে টলতে। তার কোমর থেকে দেহ জলের নীচে। বলাইয়ের মা গেট পর্যন্ত সঙ্গে এসেছে, নন্দাও।

ভূপতির হাতে ছাতা, জামার বুকপকেটে চিঠি। সে পা ঘষড়ে এগিয়ে পাথরের কিনারে পোঁছে, সন্তর্পণে ইঞ্চি ছয়েক নীচে রাস্তায় নামল। জলে স্রোত রয়েছে। কাছেই একটা বড়ো পুকুর আছে, জলের টান সেই দিকে। কয়েক পা টানের বিরুদ্ধে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল।

বলাইয়ের মা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়েছিল। স্বামীর চাহনি থেকে কী বুঝে নিয়ে সেও জলে নামল। মুখ ফিরিয়ে নন্দাকে শুধু বলল, আমি সঙ্গে যাচ্ছি। ওর শরীরটা ভালো নয়।

নামার সঙ্গে সঙ্গে জল তার কোমর ছাড়িয়ে গেল, ভূপতির কাছে এসে সে হাত বাড়াল। ভূপতি হাতটা ধরল। তারপর পায়ে পায়ে দুজনে এগোতে লাগল জলের টান ঠেলে।

পা ঘষে ঘষে হেঁটো না তাহলে ঊরুতে ব্যথা করবে। তুলে তুলে হাঁটো। বলাইয়ের মা বলল। ওরা মোড় ঘুরে না যাওয়া পর্যন্ত না তাকিয়ে রইল। বড়ো রাস্তার মুখে এসে চলা থামিয়ে দুজনে রাস্তা বরাবর তাকাল। চওড়া একটা নদীর মতো দেখাচ্ছে। দু-ধারে ফুটপাথে বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি জলের নীচে। তাদের ডালপালাগুলো বড়ো ছাতার মতো লাগছে। কয়েক জন লোক জল ঠেলে চলেছে। পার্কের রেলিঙের সঙ্গে শেকলবাঁধা একটা ঠেলাগাড়ি জলে ওঠা-নামা করছে নৌকোর মততা, রোল বিক্রির একটা কাঠের গাড়ি হেলে রয়েছে বাড়ির গায়ে। ভাঙা পাইপ দিয়ে ছড়ছড়িয়ে জল ছাদ থেকে পড়ছে। নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার বাঁশের ভারা থেকে একটা বাঁশ ঝুলছে। যেকোনো সময় নীচে পড়বে। ফুটপাথে রাখা দুটো মোটর গাড়ি, জলে তার অর্ধেক ডোবা। জলে ভেসে যাচ্ছে কাঠের টুকরো, গাছের ডাল, পাতা, ন্যাকড়া, রবারের চটি, কৌটো, মরা পায়রা।

আঃ!

ভূপতি হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। বউয়ের হাত ধরে সামলে নিতে গিয়ে বলাইয়ের মাকে নিয়ে জলে পড়ে গেল। মাথা ভিজিয়ে দুজনে উঠে দাঁড়াল। ছাতাটা হাত থেকে পড়ে জলে ভাসছে বলাইয়ের মা খপ করে ধরে নিল।

গর্ত রয়েছে। ভূপতি সাবধান করে দিল।

চিঠিটা ভিজেছে কি না দ্যাখো! ব্যস্ত স্বরে বলল বলাইয়ের মা।

ভূপতি পকেট থেকে চিঠির খামটা বার করল। খামের কাগজ চুপসে গেছে। ঠিকানা লেখা অক্ষরগুলো ধ্যাবড়ানো। ভীত চোখে বউয়ের দিকে সে তাকাল।

আমায় দাও।

বলাইয়ের মা ভিজে খাম ধরা হাতটা উঁচু করে তুলে আবার এগোতে শুরু করল।

প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর ভূপতি দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁফাচ্ছে। ব্যথায় ঊরু দুটো তুলতে পারছে না। কোমরে ব্যথা করছে। চোখে শ্রান্তি। বলাইয়ের মা ওর বাহু ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এক বার স্বামীর কপালে হাত দিয়ে তাপ বুঝে নিল। মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে ভূপতি আবার চলতে শুরু করতেই বলাইয়ের মা হাত টেনে ধরল।

আর একটু জিরোও।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে দুজনে চলতে শুরু করল। কিছু লোক রাস্তায় নেমেছে। একজন ওদের জিজ্ঞাসা করল, সিগারেটের দোকান খোলা দেখেছে কি না। ওরা মাথা নাড়ল। দুটো বড়ো মোড় পেরিয়ে গিয়ে আর একটা মোড় যার মাঝখানে পাঁচিলঘেরা জমি। সেই জমিতে একটা টুপিপরা লোকের দাঁড়ানো মূর্তি। এই পর্যন্ত তারা এসেছে। এবার আরও সোজা এগিয়ে ডান দিকে প্রথম রাস্তাটায়।

ওরা ডান দিকের প্রথম রাস্তা ধরে চলল। জল এখানে হাঁটুর কাছাকাছি। অল্পবয়সি কয়েকটা ছেলে গামছা দিয়ে রাস্তায় মাছ ধরছে। সামনে আলোর থামের পাশে লাল অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড দেখে ওরা দাঁড়াল। এবার এই বাড়ির গা দিয়ে যে কাঁচা রাস্তাটা গেছে তাই ধরে যেতে হবে। কিন্তু জলডোবা রাস্তাটা কাঁচা না পাকা বোঝা যাচ্ছে না।

দুজনে সেই রাস্তাটাই ধরল। বাড়িগুলো সবই ডান দিকে। বাঁ-দিকে থইথই জল। ডান দিকেও বাড়ির কিনার পর্যন্ত সাত-আট হাত জল। বোঝা যাচ্ছে না রাস্তাটা কতটা চওড়া। বোঝা যাচ্ছে না জলের নীচে ডাঙা না পুকুর না রাস্তার নালা কী রয়েছে!

ওরা থমকে দাঁড়াল, ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে। দমকা হাওয়াও চলছে। ভূপতি ছাতা খুলতেই হাওয়ার ঝাপটায় হাত থেকে উড়ে যাবার উপক্রম হল। সে ছাতাটা বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারছে না। বলাইয়ের মা হাত বাড়িয়ে দু-হাতে ছাতার বাঁট চেপে ধরল আর তখন খামটা হাত থেকে জলে পড়ল। তাড়াতাড়ি জল থেকে তুলে নিয়ে সেটা শেমিজের মধ্যে রেখে সে ছাতাটাকে আঁকড়ে ধরে বন্ধ করল। ভূপতির লাজুক চাহনিটা দেখেও দেখল না!

আবার ওরা এগোচ্ছে। পা টিপে, পা ঘষড়ে হুশিয়ার হয়ে। বাঁ-দিকে বাজার বসে কিন্তু এখন জায়গাটা দিঘির মতো। সেটার পর তিন-তলা বাড়ি। তারপর টালির চালের ঘর। কয়লার দোকান, কেরোসিনের উনুন সারাইয়ের দোকান, মুড়ির দোকান। সব বন্ধ। তারপর মুদির দোকান। একটা পাল্লা খুলে মুখ বার করে আছে একটা লোক, তারপরই এক-তলা বাড়িটা। বাইরের দালান লোহার সাদা জাল দিয়ে ঘেরা।

দালানে একজন মহিলা দড়িতে কাপড় মেলছে। ওরা দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বাড়িটাই? ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বৃষ্টি এখন টিপ টিপ পড়ছে। বলাইয়ের মা এগিয়ে গেল জালের দিকে। মহিলাটি এইসময় মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। যেন চেনা চেনা লাগছে তাঁর। জালের কাছে এগিয়ে এলেন।

তুমি কি নন্দার বাড়িতে কাজ কর?

বলাইয়ের মা-র মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ল।

হ্যাঁ। এই চিঠিটা।

কে পাঠিয়েছে, না?

বলাইয়ের মা মাথা কাত করল।

শেমিজের মধ্য থেকে ভেজা খামটা বার করে ভাঁজ করে জালের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল। মুখ ফিরিয়ে ভূপতির দিকে তাকিয়ে মাথাটা হেলাল।

এ তো একেবারে ভিজে কালি লেপটে একশা হয়ে গেছে, একটা লাইনও তো পড়া যাচ্ছে না। তুমি জলে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।

মহিলা দরজা খুলে দিলেন। বলাইয়ের মা ইতস্তত করে এক বার মুখ ফিরিয়ে ভূপতির দিকে তাকাল। ভূপতি ইশারা করল তাকে ভিতরে যাবার জন্য।

তোমার সঙ্গে এসেছে? ওকেও আসতে বলো, জলের মধ্যে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায়?

জ্বর হয়েছে। বলাইয়ের মা কৃতজ্ঞ চাহনি দিয়ে দোষ স্বীকার করার মতো গলায় বলল। তারপর হাতছানি দিয়ে ভূপতিকে ডাকল।

চিঠিটা ভিজিয়ে ফেলেছ। কী লেখা আছে তা তো বুঝতে পারছি না। এই দুর্যোগে এতটা পথ ভেঙে পাঠিয়েছে যখন নিশ্চয় খুব দরকারিই কোনো ব্যাপার হবে!

ওরা দুজনে মুখ ফেরাল পরস্পরের দিকে। চিঠিতে যা বলা হয়েছে সেটা তারা জানে। কিন্তু সেটা কি তারা মুখে বলবে? দুজনে দুজনের কাছে প্রশ্নটা রাখল।

তোমরা কি বলতে পারবে নন্দা কী লিখেছে?

ভূপতির দিকে তাকিয়ে বলাইয়ের মা-র চোখে অনুনয় ফুটে উঠল। ভূপতি ধীরে ধীরে মুখটা ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।

আপনার ছেলে জেঠির বাড়িতে গেছে।

হ্যাঁ, বেলগাছিয়ায়।

বলাইয়ের মা আবার ভূপতির মুখের দিকে তাকাল। আবার সে মুখ ফিরিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে সে জাল আঁকড়ে ধরেছে, চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল।

আজ সকালে সে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে এখনও ফেরেনি।

অ্যাঁ! সেকী কথা? গেল কোথায় তাহলে? সকাল থেকে বাড়ি নেই? নন্দাকে খবরটা দিল কে?

ফোন করে জানিয়েছেন বউদির দিদি।

ঠিক কী বলেছে? আঃ চিঠিটাও এমন ভিজিয়েছ যে কিছু পড়া যায় না। এমন সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, সাবধানে চিঠিটা রাখবে তো।

এই সময় ভিতর থেকে খালিগায়ে পাজামাপরা একটা লোক বেরিয়ে এল। মান্তুর বাবা, মহিলার স্বামী সতু। তাকে দেখেই মহিলা ব্যাকুল হয়ে বললেন, এরা কী বলছে শোনো। নন্দা পাঠিয়েছে এই চিঠি দিয়ে। কিছু পড়া যাচ্ছে না এমনই ভিজিয়েছে। বলছে মান্তু সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখনও ফেরেনি। দিদি ফোন করে নন্দাকে বলেছেন, তাই সে খবরটা চিঠি লিখে এদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু এরা এমনই গাধা যে… এখন কী হবে?

তোমরা ঠিক জান? ঠিক বলছ? সতু উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।

বউদি তো এই কথাই বললেন।

আর কী বললেন?

বলাইয়ের মা পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে ভূপতির চোখ দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না। সে ইতস্তত করল। সতু তখন অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আর কী বললেন সেটা বলো।

হ্যাঁ, বলেছেন…

ওরা তিন জনই ভূপতির দিকে তাকাল।

একটা ছেলে জ্বলে ডুবেছে। তার লাশ পাওয়া গেছে।

কযেক সেকেণ্ডের জন্য প্রাণঘাতী নীরবতা বিরাজ করল। তারপরই মান্তু রে বলে মহিলা চিৎকার করে উঠলেন।

বলাইয়ের মা বিষণ্ণ চোখে ভূপতির দিকে তাকাল, তার চাহনিতে ভৎসনা, কেন কথাটা বলতে গেলে?

ছেলেটা কে? মান্তুই কি? সতু স্তম্ভিত অবস্থা থেকে শান্ত গলায় বলল।

আর কিছু বলেননি।

হ্যাঁ, বলেছেন বাড়ির সবাই হাসপাতালে গেছেন। বলাইয়ের মা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা তুলে দিল।

সেটা এতক্ষণ বলনি কেন? কোন হাসপাতালে? নাম কী হাসপাতালের?

সতুর ব্যগ্র অ্যাকুল স্বরে কুঁকড়ে গেল দুজনেই। পরস্পরের মুখের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে আবার তারা সতুর দিকে তাকিয়ে একইসঙ্গে মাথা নাড়ল। মহিলাটি চিৎকার করে যাচ্ছেন উবু হয়ে বসে। চিঠিটা চোখের সামনে ধরে উন্মাদের মতো চোখে সতু পড়ার চেষ্টা করে হতাশায় ছুড়ে ফেলে দিল।

কথা বলছ না কেন, তোমরা কি বোবা? সতু ফেটে পড়ল, এমন একটা ভয়ংকর খবর, অথচ বলতে পারছ না কোন হাসপাতালে গেছে। ইডিয়ট, উল্লুক কোথাকার! ইচ্ছে করছে জুতোপেটা করি। এখন নন্দার বাড়ি গিয়ে জানতে হবে. ওহহ, মানসবাবুর বাড়ি থেকে তো ফোনই করা যায়। আমি ফোন করতে যাচ্ছি, বুঝলে?

সতু দ্রুত বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে, তোমরা এবার এসো। আর কখনো তোমাদের যেন… বলতে বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল।

দুজনে ব্যথিত চোখে মেঝেয় গড়াগড়ি দেওয়া মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। বলাইয়ের মা এগিয়ে এসে ঝুঁকে মহিলার বাহুতে হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগল।

আয়, চলে আয়। ভূপতি একটু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটা বলেই দরজার দিকে এগোল। সামনের বাড়ির দুজন মহিলা ছুটে আসার সময় তাকে ধাক্কা দিয়েই ভিতরে ঢুকল।

বলাইয়ের মা ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। দুজনে আবার জল ঠেলে ঠেলে ফিরছে। বৃষ্টি এখন বন্ধ। মেঘের জন্য চারিদিক স্যাঁতসেঁতে আলোয় নির্জীব, বিষগ্ন। তাদের জলভাঙার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মুখ নামিয়ে তিন-চার হাত ব্যবধান রেখে ওরা এগোচ্ছে।

হঠাৎ ভূপতি দেখল বলাইয়ের মা হেলে পড়ছে। দু-হাত তুলে বাতাস আঁকড়ে ধরার জন্য তালু আর আঙুলগুলো মুঠো হল, তারপর জলের নীচে চলে গেল, আবার একটুর জন্য ভেসে উঠল মুখ আর দুটো হাত।

ডুবে যাচ্ছে। ভূপতি ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ধর, ধর।

তৃতীয় বার ভেসে উঠে ডুবে যাবার সময় বলাইয়ের মা ছাতার প্রান্তটা মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেল। ভূপতি ওকে টেনে আনল ছাতার সঙ্গে। বলাইয়ের মা-র চোখে ভয়। মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হওয়ার বিস্ময় ছড়িয়ে রয়েছে মণিতে। ঠোঁট দুটো থরথর করছে। ভয়টা এবার কুয়াশা সরে যাবার মতো আবছা হতে হতে একেবারেই সরে গেল। একটা রাগ এবার সেই জায়গায় উঠছে।

তুমি বলাইকে তাহলে কেন ধরনি?

নৌকোটা উলটোতেই বাঁশের খোঁচাটা চোখে তখন যদি…বলেছি তো তোকে কত বার। দু-হাত ঝাঁকিয়ে ভূপতি চেঁচিয়ে উঠল। আমি তো নাম ধরে তারপর চেঁচিয়েছি, চোখে দেখতে পাচ্ছিলুম না অন্ধ হয়ে গেছলুম, সাঁতার দিতে দিতে কত বার চেঁচিয়েছি, ডুবে ডুবে নদীর তল পর্যন্তও গেছি।

সে হাঁফাতে লাগল। বলাইয়ের মা কাছে এসে ওর বুকে কপালে হাত রাখল। সেই সময় উদভ্রান্ত সতু তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল সামনে ঝুঁকে, দৌড়োবার চেষ্টায় শরীরটা পড়ো পড়ো, দু-হাত ভারসাম্য রাখার জন্য পাখির ডানার মতো ঝাপটাচ্ছে। সতু ওদের দেখেও দেখল না। কিছুটা পিছনে সেই মহিলা, মান্তুর মা। লেপটানো শাড়িতে জড়িয়ে-যাওয়া পা ফেলতে গিয়ে বার বার জলে আছাড় খাচ্ছে। কয়েক হাত হামা দিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে চলতে গিয়ে আবার পড়ছে। মুখ থেকে একটা উ উঁ শব্দ একটানা বেরিয়ে আসছে। মান্তুর মাও ওদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল।

ওরা দাঁড়িয়ে দেখল। দু-তিন বার মাথা নাড়াল।

যদি মান্তু না হয় তো ওরা বেঁচে যাবে।

ভূপতি যেন নিজেকেই প্রবোধ দিয়ে শোনাল।

অন্য কোনো বাপ-মায়ের ছেলে তো! তাদের কী অবস্থা হবে?

দুজনে ধীরে ধীরে সতর্ক পায়ে হাঁটতে শুরু করল। যত এগোচ্ছে জল ক্রমশ বাড়ছে। কাঁচা পথটুকুই শুধু যা ভয়ের।

হাঁপির টান কি বোধ করছ? ফিরে গিয়ে মালিশ করে দেব। আজ কিছু খেয়ো না, উপোস দাও। একটু গরম দুধ যদি…।

ওরা কাঁচা রাস্তা পার হয়ে একসময় বড়ো রাস্তায় পৌঁছোল। ধু-ধু নদীর মতো রাস্তাটাকে আবার ওরা অবাক হয়ে দেখল।

না বললেই হত। ফুটপাথ থেকে পা টিপে টিপে রাস্তায় নেমে বলাইয়ের মা-র দিকে হাত বাড়িয়ে ভূপতি বলল। কথাটার উত্তর সে পেল না।

আমার মুখ দিয়ে কেন যে বেরিয়ে এল!

বিস্ময় নিয়ে ভূপতি স্ত্রীর হাত চেপে ধরে জল ঠেলতে ঠেলতে বাড়ি ফিরে এল। গেটের থেকেই তারা দেখল বারান্দায় নন্দা দাঁড়িয়ে। তাদের দেখতে পেয়ে সে অস্বাভাবিক উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, বলাইয়ের মা, ভূপতি..মাস্তু নয়, বডিটা মান্তুর নয়। ওরা হাসপাতাল থেকে একটু আগে ফিরে এসেছে। ভেতরে এসো বলেছি।

ওরা এক-তলার দরজা দিয়ে ঢোকার আগেই নন্দা নেমে এসেছে।

উঃ, কী ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিল! ওটা অন্য ছেলে। এই মান্তুর দিদি আবার ফোন করেছিল, পাঁচ মিনিটও হয়নি। মিছিমিছি চিঠি দিয়ে তোমাদের পাঠালাম। পড়ে কী হল ওদের?

দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হঠাৎ দপ করে বলাইয়ের মা-র চোখ জ্বলে উঠল, হাত মুঠো হল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল চোখের চাহনি।

চিঠিটা জলে পড়ে ভিজে গেছে। পড়া গেল না।

বাঁচা গেছে, বাব্বা! পড়লে কী যে ওদের অবস্থা হত!

ফোন করেননি? ভূপতি জিজ্ঞাসা করল।

না তো? বোধ হয় ওদের লাইন খারাপ। তোমরা আর ভিজে কাপড়ে থেকো না। চা করো…না না আমিই করে দিচ্ছি।

মাঝরাতে ভূপতির ঘুম ভেঙে গেল, টানা বৃষ্টির মতো কান্নার শব্দে। সে শুধু একটা হাত বলাইয়ের মা-র পিঠে রাখল।

বেহুলার ভেলা

অমিয়া বলল, পয়সা কি কামড়াচ্ছিল। কয়লাওয়ালার কাছে এখন দু-মনের দাম বাকি। তা ছাড়া ওই ক-টা আলুতে কী হবে, ঘরে যা আছে তাও দিতে হবে দেখছি। এরপর সে বললে, টাটকা খুব, চর্বিও কম দিয়েছে।

পুতুল বলল, রোববার কোর্মা বেঁধেছিল তৃপ্তির নতুন বউদি। খুব বেশি ঘি দিয়েছিল, তাই ক্যাটক্যাটানি শুরু করেছিল শাশুড়ি। এই নিয়ে সে কী ঝগড়া মায়েতে-ছেলেতে। তারপর সে বলল, আমি কিন্তু রাঁধব বলে দিলুম। বাবুদা বলছিল পাঞ্জাবির হোটেলে নাকি দারুণ রাঁধে, আজ আসুক-না একবার দেখিয়ে দোব ক্ষণ।

চাঁদু বলল, আগে জানলে জোলাপ নিয়ে পেটটাকে রবারের করে রাখতুম। খানিকটা কাল সকালের জন্যে তুলে রেখো, চায়ে বাসি রুটি ভিজিয়ে খেতে খেতে তো জিভে চড়া পড়ে গেল। শেষকালে সে বলল, যেই রাঁধো বাবা, জবাফুলের রসের মতো রং হওয়া চাই কিন্তু।

রাধু এখন বাড়ি নেই। পাঁচ বছরের খোকন শুনে শুনে কথা শেখে, সেও প্রমথর হাঁটু জড়িয়ে বলল, বাবা আমি খাব মাংস।

ওরা যা-ই বলুক প্রমথ লক্ষ করছিল চোখগুলো। ঝিকোচ্ছে বরফকুচির মতো। ওরা খুশি হয়েছে। ব্যাস, এইটুকুই তো সে চেয়েছিল, তা-না-হলে মাসের শেষ শনিবারে একদম পকেট খালি করে ফেলার মতো বোকামি সে করতে যাবে কেন।

অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথটা আরও ছোটো হয়ে যায় শোভাবাজারের মধ্যে দিয়ে গেলে। বিয়ের পর কয়েকটা বছর বাজারের মধ্যে দিয়েই অফিস থেকে ফিরত, সেও প্রায় বাইশ বছর আগের কথা। তারপর বাবা মারা গেলেন, দাদারা আলাদা হলেন, প্রমথও এখনকার বাড়িটায় উঠে এল। উঠে আসার তারিখটা পাওয়া যাবে ভব শ্রীমানির খাতায়। সেই মাস থেকেই অমিয়া মাসকাবারি সওদা বন্ধ করল, ওতে বেশি বেশি খরচ হয়। তারপর কালেভদ্রে দরকার পড়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার। আজ গরমটা যেন অন্য দিনের থেকে বেশি চড়ে উঠেছে, জুতোর তলায় পিচ আটকে যাচ্ছে, কোনোরকমে বাড়ি ফিরলে বাঁচা যায়।

ডাববোঝাই একটা ঠেলাগাড়ি পথজুড়ে মাল খালাস করছে, চারধারে যেন কাটামুণ্ডুর ছড়াছড়ি। তার ওপর বাজারের আঁস্তাকুড়টাও জিনিসপত্রের দামের মতো বেড়ে এসেছে গেট পর্যন্ত। পুব দিকের গেট দিয়েই বেরোনো ঠিক করল প্রমথ। দুটো রকের মাঝখানের পথটায় থইথই করছে জল। চাপা কল থেকে জল এনে ধোয়াধুয়ি শুরু করেছে দুটো লোক। ঝাঁটার জল যেন কাপড়ে না লাগে সেই দিকে নজর ছিল।

আর দু-পা গেলেই বাজারটা শেষ হয়, তখুনি আচমকা জল ছুড়ল লোকটা। কাপড়ে লাগেনি, কিন্তু লাগতে তো পারত। বিরক্ত হয়েই সে পিছন ফিরেছিল আর অবাক হল পিছন ফিরে।

বাজারের শেষ মাথায় দাঁড়িয়েছিল প্রমথ, যতদূর দেখা যায় প্রায় শেষ পর্যন্ত এখন চোখ চলে। ফাঁকা, খাঁ-খাঁ করছে; অদ্ভুত লাগল তার কাছে।

সকালে মাছির মতো বিজবিজ করে, তখন বাজারটা হয়ে যায় কাঁঠালের ভুতি। ঘিনঘিন করে চলতে ফিরতে। আর এখন, চোখটা শুধু যা টক্কর খেল কচ্ছপের মতো চটমোড়া আনাজের ঢিপিতে। নয়তো সিধে মাছের বাজার থেকে ফলের দোকানগুলো, দোকানে ঝোলানো আপেল–গুলো পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আপেল না-হয়ে নাশপাতিও হতে পারে কিন্তু লক্ষ্মী পুজোর দিনটায় একবার ওদিক মাড়াতে হয়। ফুল, পাতা ওই দিকটাতেই পাওয়া যায়, আর তখনই চোখে পড়ে ঝোলানো আপেল, সবরি কলার ছড়া, আনারস আর শীতের সময় চুড়করা কমলা লেবু। শীতের কথা মনে পড়লেই কপির কথা মনে আসে, আগেকার দিনে সের দরে কপি বিক্রি হত না। নাকের সামনে বাঁধাকপি লোফালুফি করতে করতে সগ্নেসিচরণ হাঁক ছাড়ত, খোকাবাবু এই চলল পাঁচ নম্বরি ফুটবল, ছোকা বেঁধে খাও গোস্ট পালের মতো শট হবে। সন্যেসিটা যেন কী করে জেনে ফেলেছিল স্কুল টিমে প্রমথ ব্যাকে খেলে, আর গোষ্ঠ পালকে তো সে পুজো করত মনে মনে। আজকাল অনেকেই নাম করেছে, চাঁদুর মুখে কত নতুন নতুন নাম শোনা যায়। ওই শোনা পর্যন্ত। মাঠে যেতে আর ইচ্ছে করে না। সন্নেসি একদিন ফুটপাথে মরে পড়ে রইল। আজেবাজে জায়গা থেকে রোগ বাধিয়ে শেষকালে বাজারের গেটে বসে ভিক্ষে করত। সন্ন্যেসির সঙ্গে সঙ্গে কুলদাকে মনে পড়ল প্রমথর, চেহারা কী! যাত্রাদলে বদমাইশের পার্ট করত। বাজারে শিবরাত্তিরে যাত্রা শুনতে আসার আগে হিসেব করে আসতে হত বাবার কাছ থেকে কতগুলো চড় পাওনা হবে। কুলদার হাতে আড়াইসেরি রুইগুলোকে পুঁটি বলে মনে হত। ওর মতো ছড়া কাটতে এখন আর কেউ পারে না। আজকাল যেন কী হয়েছে, সেদিন আর নেই। গুইরাম মরে গেছে, ওর ছেলে বসে এখন। ছেলেটা বখা। অথচ গুইরামের পানে পোকা হাজা কিংবা গোছের মধ্যে ছোটো পান ঢোকানো থাকত, কেউ বলতে পারত না সেকথাগুইরামের দোকানের পাশে এখন একটা খোটানি বসে পাতিলেবু নিয়ে। অমিয়ার জন্য রোজ লেবুর দরকার, একদিন ওর কাছ থেকে লেবু কিনেছিল প্রমথ। মাস ছয়েকের একটা বাচ্চা, বয়স দেখে মনে হয় ওইটেই প্রথম, কোলের ওপর হামলাহামলি করছিল, বুকের কাপড়ের দিকে নজর নেই। ওর কাছ থেকে আর কোনোদিন লেবু কেনেনি সে। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের যেন হজমের গোলমাল শুরু হয়েছে আর লেবুও যেন এত বড়ো বাজারটায় ওই একজায়গাতেই পাওয়া যায়। দিন দিন যেন কী হয়ে উঠেছে। বুড়োধাড়িদের কথা নয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু কচিকাঁচারাও তো বাজারে আসে, বাজার পাঁচটা লোকের জায়গা।

প্রমথর বেশ লাগছে এখন বাজারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। ছোটোবেলার অনেক কথা টুকটাক মনে পড়ছে। পেচ্ছাপখানার সামনে চুনো মাছ নিয়ে বসে একটা বুড়ি, ওকে দেখলেই আবছা মনে পড়ে মাকে। বোকার মতো হাসে, আর পায়ের আঙুলগুলো বাঁকা। ওখানটায় এখন থইথই করছে চাপা-কলের জল। মাকে পুড়িয়ে গঙ্গায় চান করেছিল সে, সেই প্রথম গঙ্গায় চান করা। তখন কত ছোট্টই-না ছিল, স্টিমারের ভোঁ শুনে জলে নামতে ভয় করেছিল তার। মাসের শেষে বাজারের ওইদিকটায় আর যাওয়া হয় না। আলু, পান আর দু-একটা আনাজ কিনেই বাজার সারতে হয়। চাঁদুটাই শুধু গাঁইগুঁই করে, কেমন যেন বাঙালে স্বভাব ওর, মাছ না পেলেই পাতে ভাত পড়ে থাকে। খিটিমিটি লাগে তখন অমিয়ার সঙ্গে। চালের সের দশ আনা, পাতে ভাত ফেলা কেই-বা সহ্য করতে পারে, পয়সা রোজগার করতে না শিখলে চাঁদুটা আর শোধরাবে না। রাধু একটা টিউশনি পেয়েছে। তখন আইএ-টা পাস করলে অন্তত গোটাকুড়ি টাকা মাইনে হত। ওর কিংবা পুতুলের খাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই, অমিয়ারও না। পাতে যা পড়ে থাকে অমিয়া পুতুলকে তুলে দেয়, বাড়ের সময় মেয়েদের খিদেটাও বাড়ে। শিগগিরই আর একটা দায় আসবে। পুতুলের বিয়ে। মুখটা মিষ্টি, রংটা মাজা, খাটতে পারে, দেখেশুনে একটা ভালো ছেলের হাতে দিতে হবে।

হটিয়ে বাবুজি।

এবার এইধারটা ধোয়া হবে, পিছিয়ে এল প্রমথ। সেই জায়গা দেখা যাচ্ছে। একটা বুড়ো বসত ওখানে। পেয়ারা, কদবেল ছোট্ট ঝুড়িতে সাজিয়ে বুড়োটা দুপুরে বসে বসে ঝিমোত। সে কি আজকের কথা। বাবা মারা যাওয়ার অনেক আগে, বড়দার তখন থার্ড ক্লাস, যুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। সরু চালের দর এগারো টাকা, কাপড়ের জোড়া বোধ হয় আট টাকায় উঠেছিল, সে আজ চল্লিশ বছর হয়ে গেল। স্কুলের টিফিনে একটা আধলা নিয়ে তিন-চার জন তারা আসত, পয়সায় আটটা কাঁচা আম। আর এ-বছর দশ পয়সা জোড়া দিয়ে একদিন মাত্র সে কাঁচা আম কিনেছে, তাও কুশিকুশি। আহা, সে কী দিন ছিল! প্রমথর ইচ্ছে করে বুড়ো যেখানটায় বসত সেখানে গিয়ে এক বার দাঁড়ায়। ওখানে তখন রক ছিল না, দেয়ালের খানিকটা বালি খসা ছিল। দুটো ইটের ফাঁকে গর্তটায় দোক্তা রাখত বুড়োটা। গর্তটা এখনও। আছে কি না দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটা খুব ছেলেমানুষের মতো। এত বছর পরেও কি আর গর্তটা থাকতে পারে, ইতিমধ্যে কতই তো ওলটপালট হয়ে গেছে, ভেঙেছে, বেড়েছে, কমেনি কিছুই। তবু এই দুপুরের বাজারের চেহারাটা একরকমই আছে। ছেলেমানুষ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, বুকটা টনটন করছে, তবু ঝরঝরে লাগছে গা-হাত-পা।

এই যে আসুন বাবু।

প্রমথ পিছন ফিরল; গোড়ার দোকানটা লক্ষ করে সে এগিয়ে এল। সদ্য ছাল ছাড়িয়ে ঝুলিয়েছে। পাতলা সিল্কের শাড়ি-জড়ানো শরীরের মতো পেশির ভাঁজগুলোকে রাক্ষুসে চোখে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।

কত করে দর যাচ্ছে।

তিন টাকা।

ভাবলে অবাক লাগে। চাঁদুর মতো বয়সে ছ-আনা সের মাংস এই বাজার থেকেই সে কিনেছে। তখন প্রায় সবই ছিল মুসলমান কসাই। ছেচল্লিশ সালের পর কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল।

এক সের দিই বাবু?

উৎসুক হয়ে উঠেছে লোকটার চোখ আর ছুরি। এর মতো মুন্নাও হাসত, তার একটা দাঁত ছিল সোনার, তবে মুন্নাকে কিছু বলার দরকার হত না, গর্দান থেকে আড়াই সের ওজন করে দিত। সেই মুন্না বুড়ো হল, তার ছেলে দোকানে বসল। তখন সংসার আলাদা হয়ে গেছে। দেড় সের নিত তখন প্রমথ। ঘোলাটে চোখে তাকাত বুড়ো মুন্না, চোখাচোখি হলে হাসত, চোখ ঝিকিয়ে উঠত। রায়টের সময় মুন্নাকে কারা যেন মেরে ফেলল।

এক সের দিই বাবু?

না, তিন পো, গর্দান থেকে দাও।

ওজন দেখল প্রমথ, যেন সোনা ওজন করছে। পাসানটা একবার দেখে নেওয়া উচিত ছিল। থাক গে ওরা লোক চেনে। তিনটে টাকা পকেটে ছিল। বাকি বারো আনা থেকে আলু পেঁয়াজ কিনতে হবে। মাইনে হতে এখনও ছ-সাত দিন বাকি। ট্রামভাড়ার পয়সাও রাখতে হবে। মাংসের ঠোঙাটা তুলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল প্রমথ।

মেটুলি দিলে না যে, তিন টাকা দর নিচ্ছ। আমরা কি মাংস কিনি না ভেবেছ।

লোকটা এক টুকরো মেটুলি কেটে দিল। অনেকখানি দিয়েছে, অমিয়া দেখে নিশ্চয় খুশি হবে।

রাস্তায় পড়েই প্রমথর আবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। বাবার সঙ্গে বজ্যাঠা হরি শ্রীমানির দোকানে এসেছিল এক সন্ধ্যায়। পাশেই ছিল মাটির খুরি-গেলাসের দোকান। তখন বিয়ের মরশুম, এক হাজার খুরি-গেলাস কিনল কারা যেন। এক হাজার লোক খাওয়ানোর কথা তো এখন ভাবাই যায় না। স্বদেশ কনফার্মড হওয়ার পর বিয়ে করল। বরযাত্রী হয়েছিল আত্মীয়স্বজন, অফিসের ঘনিষ্ঠ কয়েক জন মিলিয়ে তিরিশ। কন্যাপক্ষ মাংস খাইয়েছিল। কায়দা করে রাঁধলে মাছের থেকে সস্তা হয়। স্বদেশের বিয়েও আজ সাত মাস হয়ে গেল। ছেলেও না কি হবে। তবু তো সে সাত মাস আগে মাংস খেয়েছে। কিন্তু বাড়ির ওরা, অমিয়া, পুতুল। রাধু হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে, একটা পয়সাও বাজে খরচ করে না। চাঁদু ভালো ফুটবল খেলে, হয়তো বন্ধুরা খাওয়ায়ও। ছেলেটা ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসে, আর খেতেও পারে। এইটেই তো খাওয়ার বয়স। অমিয়ার খুড়তুততা বোনের মেয়ে শিলুর বিয়ের কথা শুনে কী লাফালাফিটাই জুড়েছিল। নেমন্তন্নে অবশ্য যাওয়া হয়নি। অন্তত একটা সিঁদুরকৌটোও তো দিতে হয়। চাঁদুটা আজ খুব খুশি হবে, ওরা সকলেই খুশি হবে।

বড়ো রাস্তার ঠিক মধ্যিখানেই কালীমন্দির। হাতে মাংসের ঠোঙা। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দূর থেকেই প্রণাম জানিয়ে প্রমথ রাস্তা পার হল। পর্দা-ফেলা রিকশা থেকে গলা বার করে দুটি বউ প্রমথর পাশ দিয়ে চলে গেল।

সিনেমা হলগুলো আজকাল এয়ারকণ্ডিশন করা হয়েছে। প্রমথ ভাবতে শুরু করল, তা না হলে এই অসহ্য দুপুরে পারে কেউ বন্ধ ঘরে বসে থাকতে। তবু শখ যাদের আছে তারা ঠিক যাবেই, অমিয়ার কোনো কিছুতেই যেন শখ নেই আজকাল। অথচ মেজোবউদি-তার আপন মেজদা, যিনি ডাক্তার হয়েই আলাদা হয়ে গেছেন, তাঁর বউ এখনও না কি এমন সাজে যে ছেলের জন্যে পাত্রী দেখতে গেলে মেয়ে-বাড়ির সকলে গা টেপাটেপি শুরু করেছিল। মেয়েকে ফিরে সাজতে হয়েছিল ওর পাশে মানাবার জন্যে। এ খবর অমিয়াই তাকে দিয়েছিল। ওর শখ এখন এইসব খবর জোগাড় করাতে এসে ঠেকেছে। অথচ সাজলে এখনও হয়তো পুতুলকে হার মানাতে পারে।

গলিটা এবার দেখা যাচ্ছে, ওখানে ছায়া আছে। এইটুকু পথ জোরে পা চালাল প্রমথ। ভাবনারও একটা মাথামুন্ডু আছে। অমিয়া যতই সাজগোজ করুক, পুতুলের বয়সটা তো আর পাবে না। সতেরো বছরের একটা আলাদা জেল্লা আছে, দেখতে ভালো লাগে। অমিয়ার বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছরে, সেও পুতুলের মতো লাজুক আর ছটফটে ছিল।

হাড়গোড়সার ছেলের হাত-পায়ের মতোই ন্যাতানো গলিটা। হলকা বাতাস পর্যন্ত স্যাঁতসেঁতিয়ে যায়। এ গলিতে ঢুকলে গায়ে চিটচিটে ঘাম হয়। কোঁচাটা পকেটে থাকছে না। আলু আর পেঁয়াজের জন্যে। পেটের কাপড়ে গুঁজে দিতে একটুক্ষণ দাঁড়াল প্রমথ। ওপর থেকে উকিলবাবুর বিধবা বোন দেখছে। প্রমথ ঠোঙার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ওপর থেকেও বোঝা যায় এর মধ্যে মাংস আছে। নন্দী বাড়ির সঙ্গে ওর খুব ভাব। ছোটোমেয়ের শ্বশুর বুঝি কোন এক উপমন্ত্রীর বন্ধু। তাই নন্দীগিন্নি ধরাকে সরা দেখে, অমিয়া দুচক্ষে দেখতে পারে না এই মানুষগুলোকে। উকিলবাবুর বোনের দেখা মানেই পাড়ার সব বাড়ির দেখা। খবরটা শুনলে অমিয়া নিশ্চয় খুশি হবে।

বাড়ি ঢোকার মুখে দোতলার মিহিরবাবুর সঙ্গে দেখা হল প্রমথর। এবাড়িতে অল্পদিন এসেছে। মুখচোরা, বউয়ের মতোই মেশে না কারুর সঙ্গে, শুধু কবিতা আর রাজনীতির কথায় মুখে খই ফোটে।

দেখেছেন তো আবার স্ট্রাইক কল করেছে বেস্পতিবার?

শুনেছি বটে, আপিসে বলছিল সবাই, যা মাগগিগন্ডার বাজার, আগের বার এগারো সিকে ছিল, এখন তিন টাকা।

ঠোঙাধরা হাতটা দোলাল প্রমথ। কিন্তু মিহিরবাবুর নজর তাতে আটকাল না।

এখন তবু তিন টাকা। এক-একটা ফাইভ ইয়ার যাবে আর দেখবেন দামও পাঁচগুণ চড়বে।

অন্য সময় হলে মিহিরবাবুর সঙ্গে একমত হত প্রমথ। কিন্তু সে যা চাইছিল তার ধার দিয়েও গেল না কথাগুলো। রোববার মিহিরবাবুদের মাংস রান্না হয়েছিল। গরমমশলাগুঁড়োবার জন্যে হামানদিস্তেটা নিয়েছিল। এখনও ফেরত দেয়নি। বোধ হয় ভেবেছে ওদের আর কীসে দরকার লাগবে, যখন তোক ফিরিয়ে দিলেই হবে। মিহিরবাবু তোক ভালো। তবু প্রমথর মেজাজ তেতে উঠল ক্রমশ।

আরে মশাই স্ট্রাইকফ্রাইক করে হবেটা কী, তাতে পাঁচ টাকার জিনিস এক টাকায় বিকুবে?

কিছুটা তো কমবে।

আপনাদের ওই এক কথা।

প্রমথ উঠোনের কোণে রান্নাঘরের সামনে রকে ঠোঙাটা নামিয়ে রাখল। গলার আওয়াজে অমিয়া বেরিয়ে এল। তার পিছনে পুতুল আর চাঁদু। মিহিরবাবু ওপরে উঠে গেলেন। তারপর ওরা কথা বলল। ওদের চোখগুলো বরফকুচির মতো ঝিকিয়ে জুড়িয়ে দিল প্রমথকে।

এইটুকুই সে চেয়েছিল। খুশি হোক অন্তত আজকের দিনটায়। জিনিসের দাম বাড়ছে, স্ট্রাইক হবে, মিছিল বেরোবে, ঘেরাও হবে, পুলিশ আসবে, রক্তগঙ্গা বইবে, এ তো হামেশাই হচ্ছে। মানুষকে যেন একটা কামার তাতিয়ে তাতিয়ে ক্রমাগত পিটিয়ে চলেছে বিরাট একটা ভারী হাতুড়ি দিয়ে। সুখ নেই, স্বস্তি নেই, হাসি নেই, খুশি নেই।

ওসব ভাবনা আজ থাক। খোকনকে কোলে নিয়ে হাসতে শুরু করল প্রমথ ওদের দিকে তাকিয়ে।

রোদের কটকটে জ্বলুনি এখন আর নেই। বেলা গড়িয়ে এল। অমিয়া তাড়া দিচ্ছে দোকানে যাওয়ার জন্যে। ঘরে আদা নেই। বঁটি সরিয়ে উঠল প্রমথ। এতক্ষণ তার মাংস কোটা দেখছিল খোকন। চাঁদু বিকেলের শুরুতেই বেরিয়েছে। কোথায় ওর ফুটবল ম্যাচ আছে। বাটনা বাটতে বাটতে পুতুল খোঁজ নিচ্ছে চৌবাচ্চার। দেরি হলে বালতিতে শ্যাওলাসুদ্ধ উঠে আসে।

পাড়ার মুদির দোকানে আদা পাওয়া গেল না। তাই দূরে যেতে হল প্রমথকে। ফেরার সময় খোকনকে দেখল রাস্তায় খেলছে। ওর সঙ্গীদের মধ্যে ভুবন গয়লার নাতিকে দেখে ডেকে নেওয়ার ইচ্ছে হল। তারপরেই ভাবল, থাক, এখন বাড়ি গিয়েই-বা করবে কী। তা ছাড়া-ঘুপচি ঘরের মধ্যে আটকা থাকতেই-বা চাইবে কেন। খোকনকে ভালো জামা-প্যান্ট কিনে দিতে হবে, উকিলবাবুর ছেলেদের কাছাকাছি যাতে আসতে পারে। উকিলবাবুর ছেলেরা বাসে স্কুল যায়…বেশ ইংরেজিও বলতে পারে এই বাচ্চা বয়সে।

মাংসে বাটামশলা মাখাচ্ছিল অমিয়া। প্রমথকে দেখামাত্রই ঝেঁঝে উঠল।

এত দেরি করে ফিরলে, এখন বাটবে কে।

কেন, পুতুল কোথায়?

বিকেল হয়েছে, তার কি আর টিকি দেখার জো আছে। সেজেগুজে বিবিটি হয়ে আড্ডা দিতে গেছে।

আচ্ছা, আমিই নয় বাটছি।

বঁটি পাতল প্রমথ আদার খোসা ছাড়াবার জন্যে। অনেকখানি শাঁস উঠে এল খোসার সঙ্গে। সাবধানে বঁটির ধার পরীক্ষা করল, ভোঁতা। তাহলে অত পাতলা করে খোসা ছাড়ায় কী করে অমিয়া, অভ্যাসে! অভ্যাস থাকা ভালো, তাহলে সময় কেমন করে যেন কেটে যায়। অবশ্য আলু বা আদার খোসা ছাড়িয়ে কতক্ষণ সময়ই-বা কাটে। তবু ঘরসংসার, রান্নাবান্না, ছেলেপুলে মানুষ করা, এটাও তো এক রকমের অভ্যাসেই করে যায় মেয়েরা, না কি স্বভাবে করে। অমন স্বভাব যদি তার থাকত—প্রমথ ভাবল, তাহলে বাঁচা যায়। জীবনটা যেন ডালভাত হয়ে গেছে। ওঠা-নামা নেই, স্বাদ-গন্ধ নেই, কিছু নেই, কিছু নেই, তবু কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। আশ্চর্য, এই ভোঁতার মতো বেঁচে থাকাটাও একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বদ অভ্যাস।

থাক, তোমার আর কাজ দেখাতে হবে না।

অমিয়ার হাতে মশলা লেগে, হাত ধুয়ে জলভরা বাটিটা রেখে দিল সে। শিলের ধারে আদাগুলো ঘষে নিয়ে বাটতে শুরু করল। কত সহজে কাজটা করে ফেলল ও, প্রমথ ভাবল, এটাও এসেছে ওই অভ্যাস থেকে। হাত-পোয়া জলটুকু অমিয়া তো নর্দমাতেও ফেলতে পারত।

বাড়িতেই বসে থাকবে নাকি, বেরোবে না?

কোনো কথা বলল না প্রমথ। অমিয়া মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে।

খোকনের একটা ভালো নাম ঠিক করতে হবে।

করো-না।

উকিলবাবুর ছেলেদের নামগুলো বেশ। ও

রা সাহেবি স্কুলে পড়ে শুনেছি, ছছাটোটা তো খোকনের বয়সি।

হ্যাঁ, বড়োটা শুনেছি ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।

রামগতির পাঠশালায় খোকনকে ভরতি করে দিয়ো, দুপুরে বড্ড জ্বালায়।

উঠে পড়ল প্রমথ। ভেবেছিল আজ আর বাড়ি থেকে বেরোবে না। মাংস ফুটবে, ছেলে মেয়েরা কাছাকাছি জড়ো হবে, গল্প হবে এটা-সেটার, আসন পেতে থালা সাজিয়ে দেবে অমিয়া, একসঙ্গে সকলে খেতে বসবে গরম ভাত, গরম মাংস। অমিয়া তাকিয়ে আছে; গলায় চটের মতো ঘামাচি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল প্রমথ।

উকিলবাবুর রকে বসে ছিলেন গৌর দত্ত। প্রমথকে দেখে কাছে ডেকে বললেন, দেখেছ কেমন গরম পড়েছে, এবার জোর কলেরা লাগবে।

নড়েচড়ে বসলেন গৌর দত্ত। প্রমথ ওঁর পাশে বসল।

শুধু কলেরা, আবার ইনফ্লুয়েঞ্জাও শুরু হয়েছে।

লক্ষ করে দেখলুম জানো…

গৌর দত্ত প্রমথর গা ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে প্রায় যে-সুরে অনিল কুন্ডুকে তার সংসার থেকে বিধবা ভাজকে আলাদা করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই সুরে বললেন, লক্ষ করে দেখলুম জানো বোমাটা ফাটার পরই এই ইনফ্লুয়েঞ্জা শুরু হয়েছে, গরমও পড়েছে, ঠিক কি না?

হ্যাঁ, গরমটা এবারে তিষ্টোতে দিচ্ছে না।

লক্ষ করেছ যত বোমা সব জাপানের কাছাকাছি ফাটাচ্ছে। তার মানে কী? ইণ্ডাস্ট্রিতে খুব ফরোয়ার্ড বলেই তো ওদের এত রাগ! আমাদের পুলুর আপিসে একটা জাপানি আসে, ভালো

ইংরেজি জানে না, কথা বলতে খুব অসুবিধে হয় পুলুর, ও তো ফার্স্ট ডিভিশনে বিএ পাস করা। তা জিজ্ঞেস করেছিল নেতাজির কথা। ওরা আবার আমাদের চেয়েও শ্রদ্ধাভক্তি করে। কী উত্তর দিলে জান? বোসের মতো কেউ থাকলে তোমাদের ফাইভ ইয়ার প্ল্যানগুলোয় চুরি হত না। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে?

হ্যাঁ, জিনিসপত্তর যা আক্র হচ্ছে দিন-কে-দিন। মাংস তিন টাকায় উঠেছে।

এনেছ বুঝি আজ?

সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন গৌর দত্ত। অন্যমনস্কের মতো লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে আবার বললেন, কী গরম পড়েছে, টিকে নিয়েছ? খাওয়া-দাওয়া সাবধানে কোরো। ছেলেপুলের সংসার, বলা যায় না কখন কী হয়।

হলে আর কী করা যাবে, সাবধানে থেকেও তো লোকে রোগে পড়ে।

ওই তো ভুল কর। আজ তোমার যদি—ভগবান না করুন, ভালো-মন্দ কিছু-একটা হয় তখন সংসারের অবস্থাটা কী হবে ভেবেছ?

অস্বস্তিতে ছটফট করে উঠল প্রমথ। এসব কথা এখন ভালো লাগছে না। বোধ হয় সংসারে গৌর দত্তর আর কিছু দেওয়ার বা নেওয়ার নেই। চাগিয়ে তোলা দরকার, আহা বুড়ো মানুষ!

একটু চাখবেন নাকি?

কী এনেছ, খাসি? রাং না সিনা?

গর্দানা।

এ হে, খাসির রাং দারুণ জিনিস।

গৌর দত্তর গালে যেন পিঁপড়ে কামড়াল। চুলকোতে চুলকোতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

বুঝলে, আগে খুব খেতুম। সামনে জ্যান্ত পাঁঠা বেঁধে রেখেই হাঁড়ি হাঁড়ি ভাত উড়িয়ে দিতে পারতুম। এখন ছেলেরা লায়েক হয়েছে, রোজগার করছে, বউদের হাতে সংসার। পুলুটাও হয়েছে বইন্যাওটা, বুড়ো বাপের যত্ন-আত্তির দিকে নজর নেই। তোমার বউদি বেঁচে থাকলে এ অবস্থাটা হত না।

টিকিট কাটার সঙ্গে সঙ্গে বাস বিকল হলে যাত্রীদের মনের অবস্থার মতো আস্তে আস্তে থেমে গেলেন গৌর দত্ত।

দুঃখ হচ্ছে প্রমথর। বুড়ো মানুষটার নিজের বলতে আর কিছু নেই। এখন কোনোরকমে টেনেটুনে চিতায় ওঠার অপেক্ষা। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জীবনটা ধুকপুক করবে, সাধ-ইচ্ছে তৈরি হবে, পূরণ করতে চাইবে, অথচ পারবে না। এমন বাঁচার থেকে মরা ভালো। আহা, বুড়ো মানুষটা মরবেই-বা কেন?

চলুন গৌরদা, আজ একটু বেড়িয়ে আসা যাক গঙ্গার ধার থেকে।

সে বড়ো দূর ভাই, তার চেয়ে পার্কে বরং গোটা কতক চক্কর দিয়ে আসি।

দুজনে উঠে দাঁড়াল। রাধু বাড়ি ফিরছে। প্রমথ তাকিয়ে থাকল তার দিকে। জড়সড় ভঙ্গিতে ওদের পাশ দিয়ে রাধু চলে গেল।

তোমার বড়োছেলেটি ভালো।

হাসল প্রমথ।

হাঁটতে হাঁটতে গৌর দত্ত বললেন, ওরা আবার খুঁজবে হয়তো।

পার্কে ঢুকেও আগের কথার জের টেনে তিনি বললেন, খুঁজলে আর কী হবে, নিজেরাই গপ্পোটপ্পো করবে। আশুর মেয়েকে নাকি মারধর করেছে শাশুড়ি, আজ ওর যাওয়ার কথা ছিল, কী ফয়সালা হল কে জানে। আমি তো বলেছিলুম হাতে-পায়ে ধরে মিটিয়ে আসতে। খাট-বিছানা-টাকা তো এজন্মে দেওয়ার ক্ষমতা হবে না আশুর।

প্রমথর এসব কথায় কান নেই, সে তখন ভাবছে পুতুল এতক্ষণে ফিরেছে ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে। উনুন ধরিয়েছে। অমিয়া ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে কেমন করে খুন্তি ধরলে মাংস কষতে সুবিধে হয়। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে মেয়েটার কপালে, নাকের ডগায়। ঠোঁট দুটো শক্ত করে টিপে ধরেছে। চুড়িগুলো টেনে তুলেছে— দপদপে স্বাস্থ্য, বেশিদূর উঠবে না। পাতলা ভাপ উঠছে হাঁড়ি থেকে। না, এখনই কি উঠবে। এখন তো জলই বেরোয়নি। আগে তো কখনো রাঁধেনি, নিশ্চয় বুক দুরদুর করছে আর আড়চোখে তাকাচ্ছে অমিয়ার দিকে। অমিয়া কী করছে? গালে হাত দিয়ে পিঁড়িতে বসে দেখছে। কী দেখছে, পুতুলকে? তাই হবে। হয়তো খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে ওর কচি মুখটা; আর ভাবছে হয়তো যে-কটা গয়না আছে ভেঙে কী কী গড়াবে ওর বিয়ের জন্যে। এতক্ষণে গন্ধে ম-ম করছে বাড়িটা। থোকন নাক কুঁচকে শুকছে। ভালো লাগছে গন্ধটা, তাই মিটিমিটি হাসছে আর হাঁড়ির কাছে আসার তাল খুঁজছে। পারবে না, অমিয়ার নজর বড়ো কড়া।

দু-চার দিন হয়তো বলাবলি করবে, বলবে গল্পে লোক ছিল, বেশ জমিয়ে রাখত সন্ধেটা। তারপর একসময় ভুলে যাবে। যেমন নির্মলদা কি নীলুকাকা মরে যাবার পর আর এখন কেউ নামই করে না। তোমরাও তেমনি ভুলে যাবে আমাকে।

দগদগে লাল হয়ে আছে কেষ্টচুড়ো গাছের চিমসে ডালগুলো। ওদের ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে কেমন অন্যরকম লাগে যেন। লাগে চোখে নয় মনটায়। রাধু টিউশনিতে যাওয়ার আগে নিশ্চয় দেখেছে। দেখে কিছু বলেছে কি? বড়ো কম কথা বলে ছেলেটা। তেইশ বছরেই বুড়িয়ে গেছে ওর শরীর-মন। ওকে দেখলে অস্বস্তি হয়। মনে হয় হাসি-খুশি-আনন্দ যেন কিছুই নয়। জীবনটা শুধু দুঃখ, দুঃখু আর দুঃখু কাটানোর চেষ্টাতেই ভরা। অথচ ওর বয়স তেইশ। ওর বয়সটা যেন চিমসে-কাঠি ডালে ফুল ফোটার মতো। বয়সের ফাঁকফোকর দিয়ে যৌবনটাকে কেমন বুড়োটে দেখায়।

রকে বসে থাকলে এতক্ষণে আরও পাঁচজন জুটে যেত। তখন শুধু আমাকে নয়, চক্ষুলজ্জার খাতিরে ওদেরও বলতে হত। তার চেয়ে এই বরং ভালো হয়েছে, বেমালুম খিদেটাও বেশ চনচনে হল।

কী তখন থেকে ভ্যাজর ভ্যাজর করছে বুড়োটা। বয়স বাড়লে হ্যাংলামোও বাড়ে। আঃ, কী হুড়োচাল্লি শুরু করেছে ছেলেগুলো, মানুষ দেখে ছুটবে তো। লাগল হয়তো বুড়ো মানুষটার। আহা! ছেলেবউরা যত্ন করে না। ফাঁসির আসামিও তো শেষ ইচ্ছাপূরণের সুযোগ পায়, অথচ মুখ ফুটে ওর ইচ্ছের কথা বলতে পারবে না কাউকে। গুমরে গুমরে মনের মধ্যে গুমোট তৈরি করবে। এবারের গরমটা অসহ্য, তবু নাকি বেতিয়াফেরত মানুষগুলো হাওড়া ময়দানে ভাজাভাজা হচ্ছে। বাইরে-ভেতরে সবখানেই অসহ্য হয়ে উঠেছে মানুষ। এই যে সকলে পার্কে বেড়াতে এসেছে, সেও তো গুমোট কাটাতেই। অমিয়াও আসতে পারে। কী এমন কাজ তার, ওইটুকু তো সংসার। না, এখন সংসারের কথা থাক, তার চেয়ে বরং ওই গাছটার দিকে তাকানো যাক। রাধাচুড়ো। একটাও ফুল নেই গাছে। থাকা উচিত ছিল। কেননা কেষ্টচুড়োয় ফুল ধরেছে। এই হয়, একটা আছে তো আর একটা নেই, সুখে জোড় বাঁধে না কোনো কিছুই। এখন তার খুশি থাকতে ইচ্ছে করছে। অথচ অমিয়া, কী জানি এখন হয়তো পুতুলকে বকছে দু-পলা তেল বেশি দিয়ে ফেলেছে বলে।

চলুন গৌরদা, এবার ফেরা যাক।

এর মধ্যে? রান্না হয়ে গেছে কি?

রান্নার দেরি আছে। আপনাকে নয় বাড়িতে পাঠিয়ে দেব চাঁদুকে দিয়ে।

তাই দিয়ে, আমি বরং একটু ঘুরি, আর শোনো, চাঁদুকে বোললা আমার হাতে ছাড়া কাউকে যেন না দেয়, কেমন।

প্রমথ কাঁদুনে গ্যাসের শেল ফাটতে দেখেছে এই সেদিন, অনেকের সঙ্গে সেও রুদ্ধশ্বাসে ছুটেছে, ঘোড়সওয়ার পুলিশের নাগাল ছাড়িয়েও ছুটেছে। তাই সে বোঝে অমিয়ার অবস্থাটা যখন উনুনে আগুন পড়ে। কোথায় পালাবে সে ওইটুকু বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে? যেখানেই যাক-না ধোঁয়া তাকে খেতে হবেই, ওই সময়টায় সকলেই উনুন ধরায়। ছাদে যে উঠবে তারও ফুরসত নেই। ঘরে বিকেলে কেউ থাকে না। ভাড়াটেবাড়ির একতলা, সদর দরজা সবসময় হাট-করা, মুহূর্তের জন্যেও ঘর ছাড়ার উপায় নেই।

আজও সেই রোজকার অবস্থা, তবু রক্ষে উনুন প্রায় ধরে গেছে। নিজের মনে গজগজ করছে অমিয়া, আর হাওয়া দিচ্ছে। সাহায্য করতে গেল প্রমথ। তিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠল অমিয়া।

যাক, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না।

অমিয়া চুল বেঁধেছে, গা ধুয়েছে, শাড়িটাও পরিষ্কার। প্রমথ বলল, তুমি পুতুলকে ডেকে আনো, ততক্ষণে আমি হাওয়া দিচ্ছি।

পাখাটা নামিয়ে দম-কাটা স্পিঙের মতো উঠে দাঁড়াল অমিয়া।

দাঁড়াও, মেয়ের আড্ডা শেষ হোক, তবে তো ঘরের কথা মনে পড়বে। আসুক আজ, ওর। আচ্ছা ঘোচাচ্ছি।

তরতর করে ছাদে উঠে গেল অমিয়া। সেখান থেকে একটু গলা তুলে ডাকলে তৃপ্তিদের বাড়ি শোনা যায়। ছাদ থেকে অমিয়া নামল আর সদর ঠেলে পুতুলও বাড়ি ঢুকল প্রায় একইসঙ্গে। একটুও আভাস না দিয়ে অমিয়া এলোপাথাড়ি কতগুলো চড় বসিয়ে দিল পুতুলের গালে মাথায় পিঠে।

পইপই করে বলি সন্ধে হলেই বাড়ি ফিরবি, সেকথা গ্রাহ্যই হয় না মেয়েরা কী এত কথা ফিসফিস গুজগুজ, তৃপ্তির মাস্টারের সঙ্গে হাসাহাসি কেউ যেন আর দেখতে পায় না, না?

বারে, আমি হাসাহাসি করেছি নাকি?

যেই করুক, তুই ওখানে থাকিস কেন, ঘরে আমি একা, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে সে খেয়াল থাকে না কেন? হাঁড়িটা উনুনে বসা।

অমিয়া ঘরে চলে গেল। উঠোনে গোঁজ হয়ে আঁচলটা মুঠোয় পাকাতে থাকল পুতুল। খামোকা মার খেল মেয়েটা। এইটুকু তো বয়েস, খাঁচার মতো ঘরে কতক্ষণ আর আটকা থাকতে মন চায়। উঠে এল প্রমথ রান্নাঘর থেকে।

মা যা বলল তাই কর।

ওর পিঠে হাত রেখে আস্তে ঠেলে দিল প্রমথ। পিঠটা বেঁকিয়ে ঠেলাটা ফিরিয়ে দিল পুতুল। গঙ্গাজলের ছড়া দিতে দিতে ওদের দেখে গেল অমিয়া।

রাগ করতে হবে না আর, কী এমন অন্যায় বলেছে? আজ বাদে কাল বিয়ে হবে, হাসাহাসি না-করলেই তো হয়।

আমি মোটেই হাসাহাসি করিনি, তবু মিছিমিছি—

ওর পিঠে হাতটা রেখে দিয়েছিল প্রমথ, তাই আঙুল বেয়ে উঠে এল বাকি কথাগুলো। থরথরিয়ে পুতুল কাঁপছে।

বিয়ের পর যত পারিস হাসিস, কেউ বারণ করবে না। বড়ো হয়েছিস, বুদ্ধি হয়েছে। তোর, তৃপ্তিদের যা মানায় আমাদের কি তা সাজে?

শাঁখ বাজাচ্ছে অমিয়া। পুতুলের কাঁপুনি যেন বেড়ে গেল। বিশ্রী শাঁখের আওয়াজটা। শুভকাজে শঙ্খধ্বনি দেওয়া হয়, অথচ এখন মনে হচ্ছে মাটি টলছে ভূমিকম্পে, তাই মেয়েটা কাঁপছে। মৃদু ঠেলা দিল প্রমথ। এক-পা এগিয়ে তারপর ঘরে ছুটে গেল পুতুল।

দাও আরও আদর। দিন দিন যেন বাঁদরি তৈরি হচ্ছে। অনেক দুখ আছে ওর কপালে, বলে রাখলুম।

হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছে অমিয়া প্রমথ নরমসুরে বলল, আজকে না বলেই হত।

কেন, আজ রথ না দোল যে বকব না।

শোওয়ার ঘরে এল প্রমথ। পুতুল ফোঁপাচ্ছে স্তুপ করা বিছানায় মুখ গুঁজে। শব্দটা সর্দি ঝাড়ার মতো শোনাচ্ছে। তার ওপর প্যাচপেচে গরম।

লক্ষ্ম মা আমার ওঠ, যা রান্নাটা শিখে নে। আরে বোকা শ্বশুরবাড়িতে যখন রাঁধতে বলবে

তখন যে লজ্জায় পড়বি, আমাদেরও নিন্দে হবে।

পুতুলের ফোঁপানি থামল। একটা চোখ বার করে, স্বরটাকে নামিয়ে বলল, বিয়ে করলে

হেসে উঠল প্রমথ, পুতুল মুখ লুকোল।

তোর মাও বিয়ের আগে ঠিক অমন কথা বলত।

পুতুল আবার মুখ তুলল। চোখের কাজল ধ্যাবড়া হয়ে গেছে। আহা, মেয়েটা কেঁদেছে।

তুমি কি করে জানলে, মা বুঝি বলেছিল?

একই সঙ্গে দু-জনে দরজার দিকে তাকাল। না অমিয়া নয়, খোকন এল।

চোখাচোখি হল পুতুল আর প্রমথর, হাসল দুজনেই। মেয়েটা দারুণ ভীতু হয়েছে। ওর মাও অমন ছিল, খালি দরজার দিকে তাকাত। রাত্রে ছাদে উঠত, তাও কত ভয়ে ভয়ে।

বল না, মা বুঝি সেসব গপ্পো করেছিল?

হেসে খোকনের চুলে বিলি কাটল প্রমথ। সেসব গল্প কবে করেছিল অমিয়া, তা কি এখনও মনে আছে। চেষ্টা করলে টুকরো টুকরো হয়তো মনে পড়বে। কিন্তু সেকথা কি মেয়েকে বলা যায়। একদিন, গলি দিয়ে গিয়েছিল একটা বেলফুলওয়ালা, কত কান্ড করে মালা কেনা হয়েছিল। আর একদিন, ছাদের উত্তর-পুব কোনায় তুলসীগাছের টবটার পাশে একটা ছোট্ট পৈঠে ছিল, একজন মাত্র বসতে পারে। পাছে বাবার ঘুম ভেঙে যায় তাই চুড়িগুলোকে হাতে চেপে বসিয়ে, পা টিপেটিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ছুট দিয়েছিল অমিয়া রকটা লক্ষ করে। আচারের শিশি বিকেলে তুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিল, ছাদের মধ্যিখানেই পড়েছিল সেগুলো। তারপর সে কী কেলেঙ্কারি। বড়োবউদি ছাদে উঠে এসেছিল, আর অমিয়া পাঁচিল ঘেঁষে বসে পড়েছিল দু-হাতে মুখ লুকিয়ে।

হাসছ কেন!

এমনি। একটা কথা মনে পড়ল তাই।

অমন করে হাসলে কিন্তু তোমায় কেমন কেমন যেন দেখায়। বেশ লাগে দেখতে।

চোখ নামিয়ে হাসল প্রমথ। খোকন চলে গেল রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়ার শব্দ আসছে, গন্ধও আসছে কষা মাংসের, রান্নাঘরে অমিয়ার কাছে এখন কেউ নেই। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে গালে, কপালে, নাকের ডগায়। বার বার কাঁধে গাল ঘষার জন্যে ঘোমটা খুলে গেছে। দুহাত সকড়ি, ঘোমটা তুলে দেওয়ার কেউ নেই কাছে।

বসেই থাকবি, নাকি রান্নাঘরে যাবি।

না, আমি শিখব না।

তোর মার কাছে শেখার জন্যে পাড়ার মেয়েরা আসত, বাটি বাটি মাংস যেত এবাড়ি ওবাড়ি।

অবস্থা ভালো ছিল তাই মা শিখতে পেরেছিল, আমি তো কোনোদিন রাঁধলুমই না।

ওর বয়সেই মেয়েরা বিয়ের কথা ভাবে। অমিয়া বলেছিল, সেও ভাবত, আর ভাবে বলেই একতলার ঘুপচি ঘরে জীবনটা সহনীয় হতে পারে। সচ্ছল ঘরে পুতুলকে দেওয়া যাবে না, টাকা কোথায়। মেয়েটা সে কথা ভেবেও হয়তো ভয় পায়। আসলে ভয় তো সকলেই পাচ্ছে, পুরুষ-মেয়ে সকলে। নতুন বউ অমিয়ার সময় মাংসের সের ছিল ছ আনা আট আনা, পুতুলের সময় তিন টাকা। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ার জন্যে স্ট্রাইক হবে, হোক। মিহিরবাবু কবিতা লিখলেও বাজে কথা বলে না। খুন্তির শব্দ আসছে, কষা মাংসের গন্ধ আসছে, মেয়েটার মুখ শুকনো। অসহ্য লাগছে এই ঘরটা।

পুতুল আর প্রমথকে দেখে গম্ভীর হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসল অমিয়া। আলুর খোসা নিয়ে খেলা করছিল খোকন। পুতুল তাড়াতাড়ি কেড়ে নিয়ে কুটনোর ঝুড়িতে রেখে দিল, খোসা-চচ্চড়ি হবে।

গন্ধ উঠছে। এমন গন্ধ অমিয়ার হাতেই খোলে। ফুসফুস ভরিয়ে ফেলল প্রমথ। অমিয়ার গা ঘেঁষে পুতুল বলল, দাও না আমাকে।

উত্তর না দিয়ে অমিয়া শুধু খুন্তিটা নাকের কাছে ধরল। গনগনে আঁচ। একটুক্ষণ খুন্তি-নাড়া থামলেই তলা ধরে যাবে। পুতুলের কথায় কান দেওয়ার ফুরসত নেই, পুতুল করুণ চোখে তাকাল প্রমথর দিকে।

দাও না ওকে, যখন রাঁধতে চাইছেই।

সবই যখন করলুম তখন বাকিটুকুও করতে পারব। খোকনের ঘুম পেয়েছে শুইয়ে দে।

সত্যিই তো! এখন আর করার আছে কী। জলভরা কাঁসিটা হাঁড়ির মুখে চাপা দেওয়া ছাড়া। মাংসের জল বেরোলে, কাঁসির উষ্ণ জলটা ঢেলে দেওয়া, সে তো একটা আনাড়িতেও পারে। তারপর সেদ্ধ হলে আলু, নুন আর ঘিয়ে রসুন ভেজে সাঁতলানো, ব্যস। হতাশ হয়ে তাকাল প্রমথ। হনুর গড়নের জন্যে এমনিতেই পুতুলের গালদুটো ফুলো দেখায়, এখন যেন আরও টেবো দেখাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা স্বরে সে বলল, তৃপ্তিকে ওর বউদি নিজে থেকে রান্না শিখিয়েছে, গোটা ইলিশ কাটা শিখিয়েছে, এবার ওদের মাংস এলে তৃপ্তি রাঁধবে সেদিন আমায় খাওয়াবে বলেছে।

তাহলে তো তোকেও একদিন খাওয়াতে হয়।

হয়ই তো, আজকেই তো ওকে বললুম আমাদের মাংস এসেছে, মা বলেছে আমি রাঁধব।

অমিয়ার দিকে চোখ রেখে এরপর পুতুল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ওকে আমার রান্না খাওয়াব বলেছি।

গৌরদাও আজ বলল, দিও হে বউমার হাতের রান্না। অনেকদিন খাইনি, কোথেকে শুনল কে জানে, বললুম দেব পাঠিয়ে। আহা বুড়ো মানুষটার যা কষ্ট, ছেলেবউরা তো একটুও যত্ন করে না।

হ্যাঁ, পুলুদার বউ কী ভীষণ চালবাজ, একদিন গেছলুম সে কী কথাবার্তা যেন কত বি এএম এ পাস। কারুর আর জানতে যেন বাকি নেই দু-দুবার আই এ-ফেল, তবু বলে বেড়ায় পাস করেছে। আর রাস্তা দিয়ে হাঁটে যখন, তুমি দেখেছ বাবা যেন, সুচিত্রা সেন চলেছে।

বোকার মতো হেসে প্রমথ বলল কে বলল তোকে।

তৃপ্তি। ও তো ভীষণ বায়স্কোপ দ্যাখে, তবে হিন্দি বই দ্যাখে না, খুব অসভ্য নাকি, মাস্টারমশাইও দ্যাখে না।

এমনি শুনে শুনেই মেয়েটা বায়স্কোপের খবর নেয়। মনে পড়ছে না কোনো দিন বায়স্কোপে যাব বলে বায়না ধরেছে। বাপের অবস্থা বুঝে সাধ-আহ্লাদগুলো চেপে রাখে, বাবা মাকে লজ্জায় ফেলে না। এ একমাত্র মেয়েরাই পারে, পুতুলের মতো মেয়েরা। চাঁদুটা সামান্য হুজুগ উঠলেই পয়সা পয়সা করে ছিঁড়ে খেত, এখন আর পয়সা চায় না। টাকা নিয়ে এখানে ওখানে খেলে খেলে বেড়ায়। ভাড়া খাটলে মান-ইজ্জত থাকে না, কিন্তু কী করবে, উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে কখনও ফাঁকা পকেটে থাকতে পারে? রাধুর মতো ছেলে আর ক-টা হয়, পানটুকু পর্যন্ত খায় না। ভালো, ওরা সবাই ভালো, আহা বেঁচেবর্তে থেকে মানুষ হোক।

একদিন তোর মাকে নিয়ে যাস-না বায়স্কোপে।

খোকনকে কোলে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে এসে গলা চেপে পুতুল বলল, হ্যাঁ, মা আবার যাবে। বলে, কতদিন সাধলুম চলো চলো, সকলেই তো যায়। তা নয়, মার সবটাতেই বাড়াবাড়ি। একমিনিট বাড়ি না থাকলে সে কী ডাকাডাকি যেন পালিয়ে গেছি, এমন বিচ্ছিরি লাগে, সবাই হাসাহাসি করে। বাবুদার সামনেও মা অমন করে।

ঘরে আইবুড়ো মেয়ে থাকলে অমন ডাকাডাকি সবাই করে, তোর মেয়ে থাকলে তুইও করতিস।

প্রথম হাসল। তিতকুটে গলায় পুতুল বলল, তা বলে দিনরাত ঘরে বসে থাকব? বেরোতে ইচ্ছে করে না আমার? ঘরকন্নার কাজ সবসময় ভালো লাগে? তুমি হলে পারতে?

শেষদিকে সপসপ করে উঠল পুতুলের গলা। খোকনকে নিয়ে সে ঘরে চলে গেল। রকে পা ঝুলিয়ে বসল প্রমথ। একতলাটা শান্ত। দোতলায় সামান্য খুটখাট, তিনতলায় ছাদ, বলা যায় বাড়িটা চুপচাপ। শুধু গোলমাল করছে পাশের বাড়ির স্কুল ফাইনাল ফেল-করা ছেলেটা।

ঘরে থাকতে ভালো লাগে না মেয়ের, বাইরেই বা যাবে কোথায়, গিয়ে করবেই বা কী। এবাড়ি-ওবাড়ি যাওয়া আর আজেবাজে কথা বলা—এতে লাভ কী? দেয়ালে ঠেস দিয়ে প্রমথ ঘাড়ের জাড় ভাঙার জন্যে মাথা পিছনে হেলাল। ক্ষতিই বা কী, এমনি করেই তো বাকি জীবনটা কেটে যাবে। মেঘের নামগন্ধ নেই, শুধু ঝকঝক করছে গুচ্ছেরখানেক তারা। অসহ্য গরম, অসহ্য।

হঠাৎ একদমক হাওয়া পেরেকে ঝোলানো বাসনমোছা ন্যাতাটা ফেলে দিল। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে গা এলিয়ে দিল প্রমথ। ছটফটে গরমের মধ্যে একটুখানি হাওয়া বড়ো মিষ্টি লাগে। খোশবাই গন্ধ আসছে, হাঁড়ির ঢাকনাটা বোধ হয় খুলল অমিয়া।

ঝিমুনি এসেছিল প্রমথর, ভেঙে গেল সদর দরজা খোলার শব্দে। চাঁদু এল। অমিয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছে ওর, রাত্রে কিছু খাবে না বলছে। উঠে এল প্রমথ।

খাবি না কেন?

খাইয়ে দিল ওরা রেস্টুরেন্টে, সেমিফাইনালের দিনও খাওয়াবে। দুটো গোল হয়েছে, দুটোই আমার সেন্টার থেকে।

ভালোই হল, কাল তো বাজার আসবে না।

অমিয়া কালকের জন্যে চাঁদুর ভাগটুকু সরিয়ে রাখল। আড্ডা দিতে বেরুচ্ছিল চাঁদু, ডেকে ফেরাল প্রমথ।

তোর গৌর জ্যাঠাকে খানিকটা দিয়ে আয়।

কেন?

বিরক্তি, তাচ্ছিল্য আর প্রশ্ন, একসঙ্গে তিনটিকে অমিয়ার মুখে ফুটতে দেখে দমে গেল প্রমথ।

ওকে যে বলেছি, পাঠিয়ে দেব।

দেব বললেই কি দেওয়া যায়, অমন কথা মানুষ দিনে হাজারবার দেয়। এইটুকু তো মাংস। একে তাকে খয়রাত করলে থাকবে কী, কাল বাজার হবে না, খাবে কী কাল?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেওয়ার দরকার কী, বলে দিও নয় ভুলে গেছলুম।

অমিয়া আর চাঁদুর মুখের দিকে তাকাল প্রমথ। একরকমের হয়ে গেছে ওদের মুখদুটো। ওরা খুশি হয়নি।

কিন্তু বুড়ো মানুষটা যে আশা করে বসে থাকবে।

থাকে থাকবে।

কথাটা বলে চাঁদু দাঁড়াল না। অমিয়া চুপ করে আছে। তার মানে, ওইটে তারও জবাব। আবার পা ঝুলিয়ে বসল প্রমথ। আকাশে গুচ্ছেরখানেক তারা। আচমকা তখন হাওয়াটা এসে পড়েছিল, আর আসছে না। পুতুল চুপিচুপি পাশে এসে বলল, দিলে না তো! জানি, দেবে না। তখন মিথ্যে বলেছিলুম, তৃপ্তিকে মোটেই বলিনি যে মাংস খাওয়াব।

বেড়ালের মতো পুতুল ফিরে গেল। হয়তো তাই, বোকামি হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষটা বসে থাকবে, বসেই থাকবে। ঝিমুনি আসছে আবার, দেয়ালে ঠেস দিয়ে গা এলিয়ে দিল প্রমথ।

সদর দরজায় আবার শব্দ হতে প্রমথর মনে হল গৌরদা বুঝি। ফিটফাট, ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাবু সটান রান্নাঘরের দরজায় এসে চাঁদুর খোঁজ করল, তারপর নাক কুঁচকে গন্ধ টেনে বলল, ফাসক্লাস গন্ধ বেরোচ্ছে কাকিমা।

আঁচল দিয়ে শরীরটাকে মুড়ে পুতুল যেন ভেসে এল।

চেখে যাবেন কিন্তু।

তারপরই তাকাল অমিয়ার দিকে ভয়ে ভয়ে।

বাবারে বাবা, মেয়ের যেন তর সইছে না। খালি বলছে, বাবুদা কখন আসবে, ওকে দিয়ে চাখাব। নিজে বেঁধেছে কিনা।

যে কেউ এখন দেখলে বলবে, অমিয়া হাসছে। কিন্তু প্রমথর মনে হচ্ছে ও হাসছে না। হাসলে অত কুচ্ছিত দেখায় কাউকে? নাকি তার নিজের দেখার ভুল! প্রমথ তাকাল বাবুর দিকে। চৌকো করে কামানো ঘাড়, চুড়ো করে সাজানো রুক্ষ চুল। বুক, কোমর, পাছা সমান। চোঙার মতো আঁটসাঁট প্যান্ট, উলটে দিলেই গুলতির বাঁট হয়ে যাবে চেহারাটা, ভাবলে হাসি পায়। কিন্তু হাসল না প্রমথ, ছেলেটা শ-দেড়েক টাকার মতো চাকরি করে।

মুখে আঁচল চেপে হাসছে পুতুল। আমিয়া জিজ্ঞাসা করল, কেমন হয়েছে।

ফুড়ুত করে হাড়ের মজ্জা টেনে বাবু বলল, গন্ধ শুকেই তো বলেছিলুম, ফাস ক্লাস!

অমিয়া ওর খাওয়া দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল, চাঁদুর সেই কাজের কী হল?

বাবুর জিভ বাটিতে আটকে রইল কিছুক্ষণ, তারপরই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সে আর মনে করিয়ে দিতে হবে না। তবে বুঝলেন তো, স্কুল ফাইনালটাও যদি পাস করত তাহলে ভাবনা ছিল না। আজকাল বেয়ারার চাকরির জন্যে আই এ পাস ছেলেরাও লাইন লাগায়। তবে আমিও এটুলির মতো লেগে আছি সুপারভাইজারের সঙ্গে, রোজ ত্যালাচ্ছি।

চাঁদু না হয়, রাধুর জন্যে দ্যাখো।

না কাকিমা। রাধুটা আজকাল যেন কেমন হয়ে গেছে, চাকরিতে ঢুকে শেষকালে ইউনিয়নে ভিড়ক আর আমায় নিয়ে টানাটানি শুরু করবে তখন। এর ওপর আবার যা গরম বাজার চলছে।

হ্যাঁ, মিহিরকাকু বলছিলেন বেস্পতিবার নাকি স্ট্রাইক হবে।

আরে ও তো খুচরো স্ট্রাইক। বেশ বড়োসড়ো অল ইণ্ডিয়া স্ট্রাইকের কথাবার্তা হচ্ছে নাকি।

হলে হয় একবার, ব্যাটা সুপারভাইজারটাকে বাগে পেলে আচ্ছাসে ধোলাই দিয়ে দেব। মেজাজ কী ব্যাটার, যেন মাইনে বাড়ানোর কথা বললে ওকেই গ্যাট থেকে টাকাটা দিতে হবে। পাবলিকের টাকা নেবে, তাতে ক্ষতিটা কী হয়?

খালি বাটিটা নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল বাবু, পুতুল টেনে নিল হাত বাড়িয়ে, জলের গ্লাসটাও এগিয়ে দিল সে। রুমালে ঠোঁট মুছে বাবু জিজ্ঞেস করল, চাঁদুটা গেল কোথায়, একটা কার্ড ছিল একস্ট্রা।

কার্ড কীসের, আপনাদের সেই অফিসের থিয়েটারের?

উঁহু, যুব উৎসব। বলেছিলুম না আমার এক বন্ধু গল্প-টল্প লেখে, এর মধ্যে আছে, সে-ই জোগাড় করে দিল কার্ডটা। চাঁদু বলেছিল সতীনাথের গানের দিন যাবে, তা সেদিন আর জোগাড় হয়ে উঠল না।

কোন গানটা গাইল? সোনার হাতেটা গেয়েছে।

ওটা, তারপর আকাশ প্রদীপ জ্বলেটাও নাকি গেয়েছে।

আপনাকে তো সেধে-সেধে মুখ ব্যথা হয়ে গেল, তবু গানটা লিখে দিলেন না।

বেশ চলো, এখুনি লিখে দিচ্ছি।

কয়লা দিয়ে উনুনে হাওয়া করছে অমিয়া। পুতুল আর বাবু যেন ভাসতে ভাসতে ঘরে চলে গেল। প্রমথর গা ঘেঁষেই প্রায়।

চটপটে, চালাকচতুর ছেলে। ও কি বিয়ে করবে পুতুলকে? ছেলেমানুষ, বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাবে। তার থেকে ওর বাবাকে গিয়ে ধরতে হবে। মুশকিল বাঁধবে জাত আর দেনা-পাওনা নিয়ে। বাপের মুখের ওপর ওর কথা বলার সাহস হবে না।

তুমি এখানে বসে রইলে কেন, ঘরে ওরা একা রয়েছে না?

প্রমথ তাকিয়ে রইল অমিয়ার দিকে। কত সাবধানে আঙুলের ফাঁক দিয়ে চাল-ধোয়া জলটা ফেলছে। অমন করে মনের কুৎসিত সন্দেহগুলোকেও তো হেঁকে ফেলে দিতে পারে। থাকলই বা ওরা একসঙ্গে একটুক্ষণ, ক্ষতিটা কী তাতে।

ঘরে নয়, ছাদে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল প্রমথ। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে থামল। ঘরে ওরা হাসাহাসি করছে, ছাদে গেলে অমিয়া রাগ করবে নিশ্চয়। আজ ওকে রাগাতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরে গিয়ে গল্প করলে কেমন হয়, আগডুম-বাগডুম যা খুশি। মেজবউদিকে সেদিন দেখলুম ধর্মতলায় গাড়ি থেকে নামছে, এখনও পেট-কাটা জামা পরে; কিংবা, দক্ষিণাবাবু কীসব ওষুধ খাইয়ে বউকে প্রায় মেরে ফেলার জোগাড় করেছিল। তবে কাজ ঠিকই হাসিল হয়েছে। পেটেরটা বাঁচেনি। কিংবা, একটা দিন দেখে গুরুঠাকুরের কাছে গিয়ে মন্তর নেওয়ার কথাটা পাড়লে হয়, ভাবছিল প্রমথ। পুতুল ঘর থেকে বেরিয়ে তার কাছে এল।

ছোড়দা তো নেই, কার্ডটা নষ্ট হবে, ওর বদলে আমি যাব? বাবুদা বলছে এমন উৎসব নাকি এর আগে হয়নি, না দেখলে জীবনে আর দেখা হবে না, নাচ গান সিনেমা থিয়েটার সব নাকি দেখা যাবে, যাব?

গেলে ফিরবি কখন?

কত আর দেরি হবে, ঘণ্টাখানেক দেখেই চলে আসব।

কচি শসার মতো কবজিটা যেন মুট করে ভেঙে ফেলবে পুতুল আঙুলের চাপে। এইটুকু কথা বলেই ও হাঁপিয়ে পড়েছে।

তোর মাকে একবার বলে যা।

রান্নাঘরের দরজা থেকে কোনোরকমে পুতুল বলল, ছোড়দা তো নেই। তাই আমিই যাচ্ছি তাড়াতাড়ি ফিরবক্ষণ।

একটা কাঁচা কয়লা বিরক্ত করে মারছে। সেটাকে তুলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাতে অমিয়া ব্যস্ত। প্রমথ কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, বাড়ি থেকে বেরোয়-টেরোয় না তো, যাক ঘুরে। আসুক।

কে?

সাঁড়াশিতে চেপে ধরে কয়লাটা থেকে বার করে আনতে আনতে অমিয়া বলল, কে পুতুল?

হ্যাঁ, কী যেন উৎসব হচ্ছে বলল।

চলে গেছে?

না, কেন।

রান্নাঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল অমিয়া। পথ আটকে দাঁড়াল প্রমথ।

কেন আবার, রাত্তিরে মেয়েকে ছেড়ে দেবে একটা ছেলের সঙ্গে।

দিলেই বা কী দোষ হবে। হাঁপিয়ে ওঠে না ঘরে বসে থাকতে? শুধু ছাদ আর গপ্পো করা। এ ছাড়াও তো অনেক কিছু আছে। মারধর করলেই কি মেয়ে ভালো হবে?

প্রমথ চুপ করল বুকভরে বাতাস টেনে। দাঁত চেপে কথা বলতে বেশ কষ্ট হয় কিন্তু উপায়ই বা কী, ওঘরে পুতুল আর বাবু রয়েছে। থমথম করছে অমিয়ার মুখ। ঘাম নামছে থুতনি-বেয়ে কিলবিলে পোকার মতো, ফরসা গালে সেঁটে-বসা উড়ো চুলকে চীনেমাটির ফাটা দাগের মতো দেখাচ্ছে। সত্যিই ফেটে পড়ল অমিয়া।

আমি যখন পারি, ও পারবে না কেন, কেন পারবে না। শুধু ওর কথাই ভাবছ, কেন ভাবার আর কিছু নেই তোমার? বলে দিচ্ছি ওর যাওয়া হবে না।

চুপ, আস্তে, দোহাই আজ আর চেঁচিয় না।

আঙুল বাঁকিয়ে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল প্রমথ। দপদপ করছে তার রগের পেশি। পিছু হটে এল অমিয়া। প্রমথর নখের ডগাগুলো ভীষণ সরু।

চুপ করব কেন। আমি অন্যায় কথা বলেছি? মেয়েকে কেন তুমি ছেড়ে দিতে চাও একটা ছেলের সঙ্গে, তা কি বুঝি না ভেবেছ।

চোখে চোখ রেখে ওরা তাকাল। অমিয়ার চাউনি কসাইয়ের ছুরির মতো শান দিচ্ছে। মাংসের খোলা হাঁড়িতে চোখ পড়ল প্রমথর, থকথক করছে যেন রক্ত।

কী বুঝেছ তুমি, বলো কী বুঝেছ?

দু-হাতে অমিয়ার কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিল প্রমথ। খোঁপাটা খুলে পড়ল, চোখদুটো মরা পাঁঠার মতো ঘোলাটে হয়ে এল, ঠোঁট কাঁপিয়ে অমিয়া বলল, তুমি আমার গায়ে হাত তুললে।

অন্ধকার উঠোনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পুতুল আর বাবু। কোনো সাড় নেই যেন ইন্দ্রিয়গুলোর। তবু ছাদে যাওয়ার সময় প্রমথর নাকে চড়াভাবে লাগল পাউডারের গন্ধ। মেয়েটা সেজেগুজে অপেক্ষা করছে, করুক। মাথা নীচু করে প্রমথ ওদের পাশ দিয়েই ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ধরল।

ছাদেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাধু ডেকে তুলল প্রমথকে। থালার সামনে বসে আছে অমিয়া। ঠাণ্ডা ভাত আর মাংস। ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়েছে।

পুতুল শুয়ে পড়ল যে এর মধ্যে।

শরীর খারাপ, কিছু খায়নি।

কথা দুটো শুকনো কড়কড়ে। খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আর কেউ উচ্চবাচ্য করল না। মাংসের সবটুকুই খেল প্রমথ। শুধু মেটুলির টুকরোগুলো ছাড়া। মেটুলি ভীষণ ভালোবাসে অমিয়া, অথচ সবটুকুই সে প্রমথকে দিয়ে দেবে। প্রমথও না খেয়ে বাটিতে রেখে দেবে। তখন মিষ্টি ঝগড়া ভালো লাগত আর মাংসও আসত নিয়মিত। আজকেও প্রমথ মেটুলি রেখে উঠে পড়ল। কলতলায় অনেকক্ষণ ধরে কষের দাঁত থেকে মাংসের আঁশ টেনে বার করল। ভিজে গামছা দিয়ে গা-মুছে যখন সে শুয়ে পড়ল তখনও অমিয়ার রান্নাঘর ধোয়া শেষ হয়নি।

অনেক রাতে উঠোনে বেরিয়ে এল প্রমথ। ঘরের মধ্যে যেন চিতা জ্বলছে। একটুও হাওয়া নেই, মেঘও নেই। পায়চারি শুরু করল সে রকের এমাথা-ওমাথা। একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল। মুখ তুলে তাকল প্রমথ। একটুখানি দেখা গেল, লাল আর সাদা আলোটা পালটা পালটি করে জ্বলছে আর নিভছে। মাত্র কতকগুলো তারা দেখা যায় উঠোন থেকে। ছাদে উঠলে আরও দেখা যাবে। দেখেই বা কী হবে ওরাও তো দেখল আজ মাংস এসেছে অনেকদিন পর, কিন্তু তাতে হল কী? পাতে মেটুলি রেখে সে উঠে পড়ল আর নির্বিকার হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল অমিয়া। এখন মনে হচ্ছে অমিয়া যন্ত্রের মতো তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সেও তো যন্ত্রের মতোই শুধু অভ্যাস মেনে মেটুলিগুলো পাতে রেখে দিয়েছিল। পায়চারি থামাল প্রমথ। অমিয়াও উঠে এসেছে।

ঘুম আসছে না বুঝি?

না, ভয়ানক গরম লাগছে।

পিঠের কতকগুলো ঘামাচি মারল অমিয়া। দু-একটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল প্রমথ।

ছাদে যাবে?

কেন, এই তো বেশ।

বরাবরই তোমার কিন্তু ঘামাচি হয়।

অমিয়া পিঠের উপর কাপড় টেনে দিল।

বসবে?

পাশাপাশি বসল দুজনায়।

পুতুলের জন্য ছেলে দ্যাখো এবার।

হ্যাঁ, দেখব।

চাঁদুটাকেও একটা যা হোক কাজেকম্মে ঢুকিয়ে দাও, কদ্দিন আর টোটো করে কাটাবে।

হ্যাঁ, চেষ্টা করতে হবে।

রাধু বলছিল আই এ পরীক্ষাটা দেবে সামনের বছর।

ভালোই তো।

শান্ত রাত্রির মাঝে ওদের আলাপটা, কল থেকে একটানা জল পড়ার মতো শোনাল। ওরা অনেকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, পাশাপাশি। কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনেরই চোখ সামনের শ্যাওলা-ধরা দেয়ালটাকে লক্ষ করছে।

কী দরকার ছিল মাংস আনার।

অমিয়ার স্বরে ক্ষোভ নেই, তাপ নেই, অনুমোদন নেই। শুধু যেন একটু কৌতূহল। তাও ঘামাচি মারার মতো নিস্পৃহ। মুখ না ফিরিয়ে প্রমথ বলল, কী জানি। তখন কেমন ভালো লাগল, অনেক কথা মনে পড়ল, মনটাও খুশি হল। ভাবলুম আজ সবাই মিলে একটু আনন্দ করব।

চুপ করে রইল প্রমথ। মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল। অমিয়াও তার দিকে তাকিয়ে।

আজ পুতুলকে দেখে বার বার তোমার কথা মনে পড়ছিল। কত মিষ্টি ছিলে, চঞ্চল ছিলে, ছটফটে ছিলে। আর ওকে কাঁদিয়ো না।

মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল প্রমথ, তারা জ্বলছে। একটা কামার মানুষকে তাতিয়ে বিরাট এক হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চলেছে, তারই ফুলকিগুলো ছিটকে উঠেছে আকাশে। ছাদে উঠলে আরও অনেক দেখা যাবে। অমিয়ার পিঠে হাত রাখল প্রমথ। থরথর করে কাঁপছে ওর পিঠটা।

জানো অমি, মনে হচ্ছে আমি আর ভালোবাসি না, বোধহয় তুমিও বসো না। তা-না-হলে তোমার মনে হবে কেন আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে পারি। অথচ সত্যি সত্যি তখন ইচ্ছে হয়েছিল তোমার গলা টিপে ধরি। অমি, এখন একটা মড়া আগলে বসে থাকা ছাড়া আর আমাদের কাজ নেই।

অমিয়ার পিঠে হাত বোলাল প্রমথ। খসখসে চামড়া, মাংসগুলো ঝুলে পড়েছে আলগা হয়ে, মেরুদন্ডের গিটগুলো হাতে আটকাচ্ছে। মুখ তুলল প্রমথ, যে-কটা তারা দেখা যায়, সেদিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, কেঁদো না, মরে গেলেই মানুষ কাঁদে, আমি কি মরে গেছি।

তারপর ওরা বসে রইল অন্ধকারে কথা না বলে।

মুক্তো

গাড়িটা যে এইভাবে পথে বসাবে, চন্দন মিত্র তা ভাবতে পারেনি।

ভোরে দিঘা থেকে রওনা হয়ে খড়গপুর পর্যন্ত মসৃণভাবে এসেছে। ব্রততী আর এক বছরের বাবলুকে জামশেদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়েছে চন্দন। ব্রততী যাবে বড়োদিদির কাছে, থাকবে দিন পনেরো। দিঘায় ওরা দু-দিন ছিল চন্দনের এক অনুরাগীর বাড়িতে।

পুরোনো স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড। চন্দন ছ-হাজার টাকায় কিনেছে চার মাস আগে। গাড়ি চালানোটা শিখবে শিখবে করেও শেখা হয়নি। ড্রাইভার রেখেছে। মাসে তিনশো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা ওর গায়ে লাগে। কেমন একটা ভয় ওর আছে, নিজে গাড়ি চালালে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলবে।

চার বছর আগে জ্যোতিষী কোষ্ঠীবিচার করে যা যা বলেছিল তার অধিকাংশই মিলে গেছে। যেমন বিদেশে ভ্রমণ, যশ-খ্যাতি, আর্থিক সাফল্য, বিয়ে, চাকুরি—সবই প্রায়। এশিয়ান গেমস খেলতে ব্যাঙ্কক, তেহরান, ইণ্ডিয়া টিমের সঙ্গে হংকং, নাইরোবি, সিঙ্গাপুর, কাবুল, কলম্বো, রেঙ্গুন। মারডেকা খেলতে দু-বার কুয়ালালামপুরে। যশ ও খ্যাতি ব্যাপারটা কেমন চন্দন সেটা ঠিক বুঝতে পারে না। সে শুধু লক্ষ করেছে বাড়ির বাইরে মানুষজন তাকে দেখলেই তাকায়, মেয়েরা ফিসফাস করে। গাড়িওলা লোকেরা তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে লিফট দিতে চায়, অপরিচিতরা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। ফুটবল ফাইনালে পুরস্কার বিতরণ ও দু-চার কথা বলার জন্য প্রায়ই ডাক আসে। তার নামে খবরের কাগজে হেডিং হয়; চন্দনের সৌরভ বা সুরভিত চন্দন-জাতীয় বিশেষণ তার খেলার দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এক বার ট্যাক্সিতে যাবার সময় কানে এসেছিল, ভগবানের ছেলে যাচ্ছে রে! তার ক-দিন আগেই শিল্ড ফাইনালে যুগের যাত্রী জিতেছিল তার দেওয়া একমাত্র গোলে। এসব ব্যাপার যদি যশ বা খ্যাতি হয় তাহলে চন্দন যশস্বী এবং খ্যাতিমান।

আর্থিক সাফল্য অবশ্যই চন্দন পেয়েছে। কোনোক্রমে স্কুল ফাইনাল পাস। ক্লাবই ব্যাঙ্কে চাকরি করে দিয়েছে। এখন পাচ্ছে প্রায় আঠারোশো। জ্যোতিষী বলেছিল গোমেদ আর পোখরাজ ধারণ করতে, করেছে। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার তার দর উঠেছিল। সে বছরই। এখন সে ফ্লাটের মালিক, বেনামিতে একটি ওষুধের দোকান করেছে, পঞ্চাশ হাজার টাকা খাটছে সুদে এবং সম্প্রতি এই গাড়িটি।

জ্যোতিষী বলেছিল, সুন্দরী বউ পাবে, বতু অর্থাৎ ব্রততী প্রকৃত সুন্দরীই। চন্দনের ভক্ত এক ফিলম ডিরেক্টর ব্রততীর জন্য কিছুদিন ধরনাও দিয়েছিল। ফিলমে নামাটা চন্দনের পছন্দ নয়। বতু তাকে ভালোবাসে এবং সে বতুকে। বতু চায় চন্দন স্মার্ট লোকদের মতো নিজেই গাড়ি চালাক। কিন্তু জ্যোতিষী বলেছিল ত্রিশ বছরের পর ফাঁড়া আছে, একটা মুক্তো ধারণ করলে হয়। তখন বয়স ছিল সাতাশ। ত্রিশ হোক তো, এই ভেবে মুক্তো আর ধারণ করা হয়নি, আজও হয়নি।

গাড়িটা কিনেই তার মনে পড়েছিল ফাঁড়ার কথাটা। শরীর ছমছম করে উঠেছিল। গোল এরিয়ার হিংস্রতম ডিফেণ্ডারদের মোকাবিলায় যে কখনো ভয় পায়নি সেই চন্দন মিত্র গোপনে ভয় পায় অ্যাকসিডেন্টকে। হাত-পা বিচ্ছিন্ন ধড়, গুঁড়িয়ে-যাওয়া পাঁজর, তালগোল পাকিয়ে চটকানো দেহ—নিজের এইরকম একটা চেহারা যখনই তার চোখে ভেসে ওঠে তখন কিছুক্ষণের জন্য সে বিমর্ষ বোধ করে। গাড়িতে দিঘা রওনা হবার সময় ড্রাইভার ত্রিপিত সিংকে বার বার নির্দেশ দিয়েছিল—ত্রিশ মাইলের বেশি জোরে যাবে না, অন্য গাড়ির সঙ্গে রেস দেবে না, ওভারটেক করবে না, ট্রাক-বাস-লরি সামনে পড়লেই বাঁয়ে সরে যাবে।

এইসব বলার পর তার মনে হয়েছিল বয়সটা বোধ হয় সত্যিই বেড়েছে। খেলার দিন যে ফুরিয়ে আসছে, তা তো এবারই বোঝা গেল। তন্ময়, বাসব, প্রদীপকে ট্রান্সফারের দশ দিন। আগে তুলে রেখেছিল, কিন্তু তাকে ছেড়ে রাখে। এক ধাক্কায় দশ হাজার টাকা এবার কমে গেছে।

বোম্বাই রোডের উপর অচল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে চন্দন ভাবল, বয়স বাড়ছে। দু-এক বছরের মধ্যেই টিম তাকে খারিজ করে দেবেই। আয় কমে যাবে। গাড়িটা কেনার কি কোনো দরকার ছিল? দশ বছর আগেও তো ট্রাম আর বাস ছিল তার সম্বল। তারও আগে আধপেটা দিন আর এখানে-ওখানে খেপ খেলা।

ত্রিপিত সিং খগপুরে ফিরে গেছে ডিস্ট্রিবিউটর বক্সটা সঙ্গে নিয়ে। গোলমাল ওটাতেই ঘটেছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে চন্দন খড়ঙ্গপুরগামী একটা ট্রাককে হাত তুলে থামতে বলেছিল। অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যায়। তার পিছনে একটা প্রাইভেট মোটর ছিল। আপনা থেকেই সেটা থামে। দরজা খুলে দিয়ে পিছনে বসা লোকটি বলেছিল, আসুন।

চন্দন ঈষৎ গর্ব বোধ করেছিল। কিন্তু ত্রিপিত ছাড়া ব্যাপারটা দেখার জন্য আর কেউ ছিল। গত বছরও দুটো পত্রিকা তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছে। লিগ এখন মাঝামাঝি, ইতিমধ্যে তিন বার তার ছবি বেরিয়েছে। কয়েক লক্ষ লোক তার মুখ চেনে। শুধুমাত্র তাকে দেখেই গাড়ি থামে, এখনও থামে— দর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও। বাঙালিরা সত্যিই ফুটবল ভালোবাসে।

ওই গাড়িতে ত্রিপিত গেছে খঙ্গপুর। ফিরতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। মনে হয়, ঘণ্টা দুই। গাড়ি পাহারা দেবার জন্য চন্দন রয়ে গেল। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে নেমে, দরজা লক করে সে পায়চারি শুরু করল।

রাস্তাটা এখানে–পাশাপাশি ছটা লরি যেতে পারে, এমন চওড়া। দু-ধারেই খেত, পাটের আর ধানের। প্রচন্ড গরমের পর বৃষ্টি হয়ে গেছে দু-সপ্তাহ আগে। কাল রাতেও হয়েছে। দূরে জমিতে লাঙল দিচ্ছে এক চাষি। চন্দন অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের জন্য তৃষ্ণা বোধ করল।

বোম্বাই রোড থেকে সরু সরু মাটির পথ বেরিয়ে গ্রামের দিকে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে ওইরকম এক পথের মুখে এসে পড়ল। কয়েকটা চালাঘরের দোকান। তার পাশে পাঁচিল ঘেরা এক কারখানা। গোটা তিনেক এক তলা কোয়াটার্স। একটা গ্রামেরও আভাস পাওয়া যায় গাছপালার আড়ালে।

কামারের দোকানের পাশে সাইকেল সারাইয়ের দোকান, তার পরেরটি চায়ের। দোকানের বাইরে বাঁশের বেঞ্চে দুটি লোক বসেছিল সুটকেস আর থলি নিয়ে। বোধ হয় এখানে বাস থামে। চন্দন তাদের পাশে বসল। হাতঘড়িতে সময় দেখল সাড়ে দশটা।

দোকানটির শীর্ণ এবং জীর্ণ দশার মতো দোকানিটিও। শাড়িটার রং একদা লাল ছিল বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় ওর গায়ের রং একদা গৌর ছিল। হয়তো দেহেও লাবণ্য ছিল এবং তারুণ্যও। এখন দু-চোখে খিটখিটে উত্তাপ এবং পাড়ুর মুখ। একটি বছর দশ বয়সের ছেলে কয়লা ভাঙছে।

চা হবে?

চন্দন গলাটা চড়িয়েই বলল।

হবে।

বিস্কুট, চানাচুর, কেক ছাড়াও পাঊরুটি এবং বাতাসাও আছে। পান, বিড়ি, সিগারেটও একপাশে। সব কিছুই কমদামি, দেখে মনে হয় এদের অনেকগুলিই দীর্ঘকাল পড়ে রয়েছে।

এই মেয়েটি বা বউটিই তাহলে মালিক। এই তো দোকানের অবস্থা, চলে কী করে? স্বামী হয়তো কোথাও কাজটাজ করে। এইসব ভাবতে ভাবতে চন্দন চারধারে চোখ বুলিয়ে, মেদিনীপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে যথেষ্ট রকমের মন-জোড়ানো কিছু না পেয়ে আবার দোকানের দিকে তাকাল। তার মোটরটাকে সে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে।

দোকানে ছ্যাঁচা বেড়ায় একটা ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি আটকানো। চন্দন অলস চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আন্দাজ করার চেষ্টা করল, ছবিটা কীসের। ছবি যতটা বিবর্ণ তার থেকেও অপরিচ্ছন্ন কাচটা। ঠাওর করতে না পেরে, কৌতূহলবশেই সে উঠে ছবির কাছে এল।

স্ত্রীলোকটি চা তৈরি করতে করতে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল। প্রায় উলঙ্গ লোকটি পিটপিট করে তাকিয়ে। বেঞ্চে-বসা লোক দুটি উঠেছে, বোধহয় বাস আসছে।

মলিন কাচের পিছনে, চন্দন ক্রমশ বুঝতে পারল, একটা ফুটবল টিম। আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে সে যা আবিষ্কার করল, তাতে চমকে ওঠারই কথা। আইএফএ-র সাতচল্লিশ সালের টিম, যা বর্মা, সিঙ্গাপুর সফর করেছিল।

এ ছবি এখানে কে টাঙাল।

চন্দন স্ত্রীলোকটিকে লক্ষ করেই বলল।

ওর বাবা।

ছেলেটিকে মুখ তুলে দেখিয়ে দিল। ওর মুখের ভঙ্গির মতো কণ্ঠস্বরও কর্কশ।

ছবিটা যুগের যাত্রীর টেন্টেও টাঙানো আছে। যাত্রীর চার জন এই টিমে ছিল। তাদেরনামগুলো চন্দন জানে।

খুব বুঝি ফুটবল ভালোবাসে?

জবাব এল না। স্ত্রীলোকটির বদলে ছেলেটি বলল, বাবার ছবি আছে ওটায়।

ভাঁড়ে না গেলাসে?

স্ত্রীলোকটি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে।

ভাঁড়ে।

চন্দন কৌতূহলভরে এবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় তোমার বাবা?

ও এগিয়ে এসে মাটিতে বসা চার জনের মধ্যে একজনের মুখে আঙুল রাখল।

শিবকৃষ্ণন।

চন্দন ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ছবির দিকে মুখ ফেরাল।

যুগের যাত্রীরই শিবকৃষ্ণন। ডাকসাইটে লেফট-ইন। ওর আমলে সব থেকে পপুলার প্লেয়ার। হায়দরাবাদের কোনো এক গ্রাম থেকে বাচ্চা বয়সে কলকাতায় এসে কালীঘাট স্পোর্টিং ইউনিয়ন ঘুরে দু-বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলে যুগের যাত্রীতে আসে। যখন ও খেলা ছাড়ে তখন চন্দনের বয়স বছর চারেক। প্রবীণরা যখন পুরোনো আমলের কথা বলে, তখন শিবকৃষ্ণনের নাম অবধারিত ভাবেই ওঠে।

থ্রু পাস দেবার নাকি মাস্টার ছিল। ধীর শান্তভাবে খেলত। হেডিং বা শুটিং তেমন ছিল না। খালিপায়েই খেলে গেছে। পায়ে আঠার মতো বল লাগিয়ে রাখত, জনা তিনেককে অবহেলায় কাটাতে পারত। শিবের মতো ইনসাইড আজ কলকাতার মাঠে নেই। এখন সামনে প্লেয়ার পড়লে কাটিয়ে বেরোতে ক-জন পারে? মনে আছে, কেওএসবি-র হেণ্ডারসনকে ছ-বার কী রকম কাটিয়েছিল।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের বল হোল্ড করে রাখা নাকি দেখার ছিল। নষ্ট হল নেশা করে। গাঁজা, চরস কিছুই বাদ ছিল না। এখনকার মতো পয়সা তো সে-আমলে পেত না। তবু বিশ-পঁচিশ যা পেত উড়িয়ে দিত। আহা, কী বল ছাড়ত।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের গল্প অনেক বার চন্দন শুনেছে। প্রথম দিকে বিস্মিত হত, পরের দিকে বিরক্ত। বুড়োদের কাছে যা ভালো, সবই পুরোনো আমলের। তখন নাকি প্লেয়াররা আদা ছোলা চিবিয়ে ক্লাবের জন্য জান দিত, টাকা পাওয়ার চিন্তাই করতে পারত না, তখনকার প্লেয়াররা নাকি ভদ্রতার বিনয়ে মাখনের মতো ছিল। আজ যে যুগের যাত্রী দেখছ, এত টাকা, এত ট্রফি, এসবের শুরু ওই আমল থেকে। ওরাই ক্লাবকে প্রথম সাসসেস এনে দেয়, রোভার্সে, ডুরাণ্ডে ফাইনালে সেমি-ফাইনালে ক্লাবকে তোলে, যাত্রীকে পপুলার করে, অল ইণ্ডিয়া নাম হয়।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। এসব কথা চন্দন মানে। বহু জায়গায় বক্তৃতায় সে ছটোদের উপদেশও দিয়েছে-বড়োদের শ্রদ্ধা করবে, অতীতকে ভুলবে না। নিজেও সে অতীতের নামি ফুটবলার দেখলেই প্রণাম করে পায়ে হাত দিয়ে। তারপর দেখে চারপাশের লোক সপ্রশংস চোখে তার দিকে তাকিয়ে, তখন নিজেকে খানিকটা লম্বা মনে হয়।

শিবকৃষ্ণন তোমার বাবা?

চন্দনের কণ্ঠে পরিষ্কার অবিশ্বাস। ছেলেটি লাজুক চোখে স্ত্রীলোকটির দিকে তাকায়।

হ্যাঁ। ভাঁড়টা এগিয়ে ধরে বলল।

চন্দন সেটা নিয়ে বলল, আপনি?

বউ।

উনিই তো যুগের যাত্রীর শিবকৃষ্ণন?

কী জানি।

কী জানি।

চন্দনের বিস্মিত প্রতিধ্বনিতে ভ্রূ কুঁচকে স্ত্রীলোকটি তাকাল।

উনি তো ফুটবল খেলতেন?

হবে। আমি ওসব কিছু জানি না!

উনি কোথায়?

ঘরে।

কিছু করছেন কি, মানে ব্যস্ত? দেখা হতে পারে?

করবে আবার কী, যা করার সে তো আমিই করি। দিনরাত তো বিছানাতেই পড়ে থাকে।

কিছু হয়েছে কি ওঁর?

মাথার যন্ত্রণা, হাঁটুতে ব্যথা, বুকে হাঁপানি, সর্দি কাশি—আপনি কি ওর চেনা? হাসপাতালে ভরতি করিয়ে দিতে পারেন?

চেষ্টা করতে পারি।

শিবকৃষ্ণনের বউ চন্দনের মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে ছেলেকে বলল, আমি এখন দোকান ছেড়ে যেতে পারব না, তুই সঙ্গে করে নিয়ে যা।

ছেলেটির সঙ্গে চন্দন কয়েক পা এগোতেই ডাক পড়ল, চায়ের পয়সাটা দিয়ে যান।

দাম চুকিয়ে সে রওনা হল, গাড়িটা খারাপ হওয়া এখন তার কাছে শাপে বর মনে হচ্ছে। কলকাতায় ফিরে সবাইকে চমকে দেবে।

শিবকৃষ্ণনকে সে খুঁজে বার করেছে, কথা বলেছে। সবাই তো ধরেই নিয়েছে, ও মারা

গেছে।

জ্যান্ত শিবকৃষ্ণনকে দেখে আসার গল্প করলে সবার আগে দৌড়ে আসবে তো খবরের কাগজের, ম্যাগাজিনের লোকেরা।

অল্প দূরেই ছোট্ট একটা কুঁড়ে। একখানিই ঘর। দরজায় দাঁড়িয়ে চন্দন ভিতরে তাকাল। দেয়ালে এক হাত গর্ত, এটাই ঘরের জানালা। ওর মনে হল নীচু তাপপাশে একটা লোক শুয়ে। ঘরে আসবাব কিছুই নেই। গোটা দুই অ্যালুমিনিয়াম থালা আর একটা মগ মেঝেয় উপুড় করা। একটা মাটির হাঁড়ি, জলের কলসি, আর কয়েকটা শিশি। তক্তাপপাশের নীচে টিনের সুটকেস, এক জোড়া পুরোনো চটি। দেয়ালে দড়িতে ঝুলছে কাপড়চোপড়। কুলঙ্গিতে কয়েকটা কৌটো আর বিঘতখানেকের আয়না।

লোকটি অর্থাৎ শিবকৃষ্ণন, যে কলকাতা বা ভারতের ফুটবল মাঠে সাতাশ বছর আগে শিব নামে খ্যাত ছিল—পাশ ফিরে শুয়ে। পরনে জীর্ণ লুঙ্গি মাত্র।

ছেলেটি পিঠে ধাক্কা দিতেই চিত হয়ে মুখ ফেরাল।

আমি কলকাতা থেকে এসেছি। গাড়িটা খারাপ হয়ে বন্ধ হতে চা খাবার জন্য দোকানে বসি। ছবিটা দেখে ভাবলুম দেখেই যাই মানুষটাকে, এত গল্প শুনেছি আপনার সম্পর্কে।

শিব উঠে বসল। ছবির লোকটির সঙ্গে চেহারার কোনো মিল নেই। কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফে গালের গর্ত ঢাকা, হাত দুটো লাঠির মতো সরু, বুকের প্রায় সব পাঁজরই গোনা যায়। শুধু মাথাটার আকৃতি থেকে অনুমান করা যায় এই লোকই শিবকৃষ্ণন। দেহের সঙ্গে বেমানান আকারের বেঢপ মাথাটা, কপাল মাত্রাতিরিক্ত চওড়া। অথচ হেডিং নাকি খুবই বাজে ছিল।

আমার বিষয়ে গল্পই শুনেছেন, নিশ্চয় খেলা দেখেননি। বয়স কত?

দুর্বল কণ্ঠস্বর। প্রায় চল্লিশ বছর বাংলায় বাস করে নিখুঁত বাংলা উচ্চারণ।

না, দেখিনি, ওই ছবিটা যখনকার তখনও আমি জন্মাইনি। আপনার কী অসুখ? সিরিয়াস কিছু কি?

না না, অসুখটসুখ কিছু নেই। এরকম শরীর খারাপ ফুটবলারদের তো হয়ই, বল নিয়ে

আধঘণ্টা মাঠ এধার-ওধার করলেই ঠিক হয়ে যায়।

আপনি কি এখনও মাঠে নামেন না কি?

চন্দন অবাক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। এই শরীর, এই বয়স-বলে কী!

মাঠে নামব যে, মাঠ কোথায়, বল কোথায়? একটু হেসে বলল, বয়স কোথায়, হেলথ কোথায়? আসলে আমার মনে হয়, ফুটবলারের শরীরের অসুখ সারাতে পারে শুধু খেলে, বল খেলে। দাঁড়িয়ে কেন বসুন বসুন।

তক্তার তলা থেকে ছেলেটা একটা রবারের বল বার করে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। দূর থেকে ওর মায়ের চিৎকার শুনেই বলটা ফেলে রেখে ছুটে বেরিয়ে গেল।

বউ আমার বাঙালি, এখানকারই মেয়ে। কলকাতার হোটেলে কাজ করত, আমিও করতুম, তখন পরিচয় হয়। আমার জন্য অনেক করেছে, এখনও করে।

আপনার এই অবস্থা—ফুটবলারদের সাহায্য-টাহায্য, পেনশন এসব তো দেওয়া হচ্ছে, অ্যাপ্লাই করুন-না।

যেভাবে তাকিয়ে আছে, চন্দনের মনে হল না তাতে অভিমান রয়েছে। অথচ বুড়োরাই তো বেশি অভিমানী হয়।

টাকার তো সবসময়ই দরকার।

আমি তাহলে ফুটবল খেললাম কেন, অন্য কিছু করে টাকা রোজগার করতে পারতাম তো। খেলে তো টাকা পেতাম না।

চন্দন অস্বস্তি বোধ করল। সত্যিই তো, তারা কীসের জন্য খেলত। হাততালির জন্য। এইটুকু ছাড়া আর কী?

আপনি কোনো খেলাটেলা করেন?

চন্দন বলতে যাচ্ছিল, আপনার ক্লাবেই এখনও আমি স্টার গণ্য হই। কিন্তু বলতে গিয়ে গলাটা কে যেন চেপে ধরল। কোনোক্রমে বলল, একটুআধটু ফুটবলই।

অ।

শরীরে রোগ নেই, আর্থিক কষ্ট নেই, ভালোই আছি। চন্দনের মনে হল এই বুড়োটা একটু যেন হামবড়া ধরনের।

আপনি খেলাটেলা দেখেন?

বছর পাঁচেক আগে খড়গপুরে একটা ম্যাচ দেখেছি, তাও ষোলো বছর বাদে।

পাঁচ বছর আগে চন্দন খঙ্গপুরে একটা এগজিবিশন ম্যাচ খেলে গেছে। দেড়শো টাকা নিয়েছিল। সেই ম্যাচটাই কি?

কী মনে হল, এখনকার প্লেয়ারদের।

চুপ করে রইল।

আপনাদের সময়ে আর এখনকার সময়ের খেলায় অনেক বদল হয়ে গেছে।

কিন্তু স্কিল, সেন্স, শুটিং এসব?

এবার চন্দন চুপ করে রইল।

আমার খালি রসিদের, সোমানার, মেওয়ার, আমার কথা মনে পড়ছিল।

এবার চন্দন আড়চোখে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু-ঘণ্টা কেটেছে, ত্রিপিতের ফেরার সময় হল। দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। কাল ম্যাচ পোর্টের সঙ্গে। ইজি ব্যাপার, তাহলেও তাড়াতাড়ি ফিরে রেস্ট নিতে হবে। তিনটে দিন খুবই ধকলে কেটেছে।

যেসব গোল মিস করছিল…

হঠাৎ চন্দনের ইচ্ছে হল এই লোকটিকে কষ্ট দিতে। এই নাক-সিটকানো ভাবটা সে অনেক দেখেছে। ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।

জানেন কি এখন ফুটবলাররা কেমন টাকা পায়?

না, কাগজ পড়তে পারি না, লেখাপড়া করিনি।

চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট হাজারও।

আমি এক বার দুশো টাকা পেয়েছি মোহনবাগানকে গোল দিয়ে। বকাইবাবু দিয়েছিল খুশি। হয়ে। কমল ওইরকম বল না দিলে গোলটা পেতাম না। ওকে একশো দিয়েছিলাম।

এখনকার অনেক প্লেয়ারেরই গাড়ি আছে, অনেকেই বাড়ি করেছে, দোকান ব্যাবসা কেঁদেছে, হাজার হাজার টাকা জমিয়েছে।

কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের কোনো একটা দিনে ফিরে গিয়ে ও বোধ হয় সেই গোলটা দেখতে পাচ্ছে। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।

আমার হেডিং নাকি খারাপ, অথচ গোলটা পেয়েছিলাম হেড করে। বাজে কথা রটানো হয়েছিল আমার সম্পর্কে। জীবনে অনেক গোলই আমি হেড করে দিয়েছি।

তক্তাপোশ থেকে নেমে রবারের বলটা কুড়িয়ে নিয়ে চন্দনকে দিল। হাত ধরে ওকে ঘরের বাইরে আনল।

এটা ছুড়ুন। আপনাকে দেখাচ্ছি কীভাবে গোলটা করেছি, ছুড়ুন।

চন্দন বিব্রত হয়ে, কিছুটা মজাও পেয়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার উপর তুলে দিল। হাত মুঠো করে, অল্প কুঁজো হয়ে ও তৈরি।

বলটা ওর কাঁধের উপর পড়ল। ফসকে গেছে। চন্দন কুড়িয়ে নিয়ে এবার আরও আলতো আরও উঁচু করে তুলে দিল।

মুখ তুলে অপেক্ষা করছে শিবকৃষ্ণন। বলটা যখন মাথার কাছাকাছি তখন বাঁ ধারে হেড করার জন্য মাথা ঝাঁকাল। ওর থুতনির উপর পড়ল।

অপ্রতিভ হয়ে শিবকৃষ্ণন বলটার দিকে তাকিয়ে রইল মুখ নীচু করে।

আবার দিন।

চন্দন আর তিন বার বল শুন্যে ছুড়ল। তিন বারই ও ফসকাল।

থাক!

না না, আমি পারব, আপনি আবার ছুড়ুন।

দূর থেকে পর পর দু-বার মোটরের হর্ন ভেসে এল। ত্রিপিত নিশ্চয়।

থাক আপনার শরীর খারাপ।

আর এক বার, শুধু এক বার।

বৃদ্ধ যেন ভিক্ষা চাইছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল চন্দনের।

এই শেষ বার।

শিবকৃষ্ণন অপেক্ষা করছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, ঘাড় এবং বাহুরশিরাগুলো ফুলে উঠেছে। উজ্জ্বল ঝকঝকে রোদ। পিছনে শাখাপ্রশাখা মেলা বিরাট এক বট গাছ। তার পিছনে বিস্তৃত খেত। কচি ধানের চারা। লাঙল দিচ্ছে চাষি। ডান দিকে একটা ডোবা। কলা গাছ। দূর থেকে ভেসে এল ইলেকট্রিক ট্রেনের ভেঁপু। এইসবের মধ্যে এককালের ফুটবলার, প্রায় অসমর্থ, পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের যৌবনে ফিরে যাবার জন্য জেদ ধরে দাঁড়িয়ে। জীবনে শেষ বারের মতো ও একটা হেডিং দেখাতে চায়।

যদি এবারও ফসকায়? দূরে অধৈর্যভাবে হর্ন বাজল।

এবার যদি ফসকায়, তাহলে বৃদ্ধ চুরমার হয়ে যাবে। বরং থাক, ওর হেড করা দেখে কোনো লাভ নেই। চন্দন বলটা মাটিতে ফেলে দিল।

কী হল?

না। আমার সময় নেই, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।

শুধু এক বার, এই শেষ!

চন্দন হাঁটতে শুরু করেছে। ওর পিছনে পিছনে আসছে শিবকৃষ্ণন।

কতটুকু সময় আর লাগবে, এক বার…হেড করতে পারি কি না-পারি দেখাব। কলকাতায় গিয়ে আপনি বলবেন, শিবের হেডিং দেখেছি, হ্যাঁ ষাট বছরের শিবের…একটুখানি, এক মিনিটও লাগবে না…

চন্দন হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিল। বৃদ্ধ ওর সঙ্গে তাল রেখে চলতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বোম্বাই রোডে পা দিয়ে চন্দন এক বার তাকায়। বিরাট মাঠ, বিরাট বট গাছের পটভূমিতে জীবনের কিনারায় পৌঁছোনো ক্ষীণ চেহারার একটা মানুষকে সে দেখতে পেল।

একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটতে গিয়েও ঘটল না। চন্দন তখনই ঠিক করল, জ্যোতিষীর কথামতো কালই মুক্তোর আংটি গড়াতে দেবে।

যুক্তফ্রন্ট

তখন ভরদুপুর। খুকি দু-হাতে জানলার গরাদ ধরে, শরীরকে আলগা করে দাঁড়িয়ে। গলিটা খুব সরু। এঁকেবেঁকে একদিকে বড়ো রাস্তায় অন্য দিকে একটা বস্তির মধ্যে পড়েছে। জানলার সামনেই একটা কারখানাবাড়ির টিনের দেয়াল। বস্তুত জানলায় দাঁড়িয়ে খুকি কিছুই দেখতে পায় না যদি না কোনো লোক জানলার সামনে দিয়ে যায়। বস্তির লোকই বেশিরভাগ সময় যাতায়াত করে। তাদের দেখতে খুকির ভালো লাগে না। খুকির স্বাস্থ্য ভালো। দেখতেও মন্দ নয়। পাত্র দেখা হচ্ছে।

মেঝেয় আদুড় গায়ে ওর মা ঘুমোচ্ছে, পাশের ঘরে বউদি বাচ্চা নিয়ে। দুই ছোটোভাই স্কুলে গেছে। বাবা আর দাদা অফিসে। আশেপাশে সমবয়সি মেয়ে নেই যে খুকি দু-দন্ড ঘুরে আসবে। সামনের টিনের দেয়ালে একটা পোস্টারে লেখা–সাম্রাজ্যবাদকে খতম করতে হলে শোধনবাদের সঙ্গে লড়াই করুন। খুকি দেখল গত পনেরো দিনে খতম করতেটা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। করুনটা ছেঁড়া। এ ছাড়া গলিতে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। একটা সিনেমা পোস্টারও ঢোকে না এমন হতভাগা গলি।

বড়ো রাস্তার দিকে পটকা ফাটার শব্দ হল দুটো। কিছু হইচই শোনা গেল। ওরকম হরদমই শোনা যায়। খুকির তখন কারখানাবাড়ির চালায় চোখ। দুটো পায়রা, নিশ্চয়ই মদ্দা এবং মাদি, বকম-বকম করতে করতে যা করার তাই শুরু করে দিয়েছে। খুকি প্রথমেই পিছনে তাকিয়ে ঘুমন্ত মাকে দেখে নিল। অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে, গভীর মনোযোগে যখন মুখটি উপরে তুলে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তখন সে শুনতে পেল না গলি দিয়ে ছুটে আসা পায়ের শব্দ।

তাই বিষম চমকে গেল লোকটিকে একেবারে তার দু-হাতের মধ্যে দেখে। হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগটা জানলা গলিয়ে খুকির পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে, এটা রাখুন তো, পরে নিয়ে যাব। বলেই ছুটে চলে গেল।

খুকির তখন রা কাড়ার ক্ষমতা নেই। নড়াচড়ারও। ফ্যালফ্যাল করে সে ব্যাগটার দিকে শুধু তাকিয়ে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ আর ডাকাত ডাকাত, পাকড়ো পাকড়ো চিৎকার গলি দিয়ে এগিয়ে আসছে। ভয় পেয়ে খুকি জানলা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল ছুটন্ত লোকগুলো বলছে, ব্যাঙ্কের সামনেই—গাড়িতে ওঠার সময় লুট করেছে। একটা ধরা পড়েছে। অবশেষে পায়রাদের কান্ড এবং এই ব্যাগ, দুয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে খুকি। মাকে ডেকে তুলল।

মাঝরাতে বাবা-মা দাদা-বউদি ঘরের দরজা-জানলা এঁটে গুনে দেখল দশটি বাণ্ডিলে মোট দশ হাজার টাকা। সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

ঠিক কী বলেছিল লোকটা, আবার আসব? দাদা ফিসফিস করে বলল।

ওকে দেখলে আর চিনতে পারবে কি? মনে তো হয় না। ফিসফিস করে মা বলল।

তাতে কী আসে-যায়, বাড়িটা তো চিনবে। বউদি চাপা সুরে বলল।

লোকটা ধরা পড়েছে কি না আগে সেই খোঁজ নিতে হবে। বাবা দমবন্ধ করে বলল।

ব্যাগটা এখন কোথায় রাখা হবে?

আমার খাটের তলায় থাক। বউদি পরামর্শ দিল।

ইঁদুর আরশোলার উৎপাত বড়ো। কেটে দেবে। বরং ঠাকুরঘরে থাক। মা প্রতিবাদ করল। রাখা সম্পর্কে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় স্থির হল ভাঁড়ারে আটা রাখার ড্রামে ব্যাগটা ভরে ঢাকনাটা কষে এটে দেওয়া হোক। যদি পুলিশ সার্চ করতে আসে আগেই তো সিন্দুক তোরঙ্গ দেখবে। আটার ড্রাম অনেক নিরাপদ।

পরদিন সকালেই দাদা এবং বাবা খবরের কাগজে হুমড়ি খেয়ে বৃত্তান্তটা খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেল। মাইনে দেবার জন্য দশ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এক কারখানার ক্যাশিয়ার গাড়িতে উঠছিল। তখন দুজন দূবৃত্ত বোমা ছুড়ে টাকার থলি ছিনিয়ে চম্পট দেয়। একজন ধরা পড়েছে, থলি নিয়ে অন্যজন পালিয়ে গেছে। ক্যাশিয়ার হাসপাতালের পথেই মারা যায়।

তখন ফিসফিস করে দুজনে বলাবলি করল

আর কেউ জানে বলে তো মনে হচ্ছে না।

কী করে জানবে? ছুটতে ছুটতে গলিতে ঢুকে বোধ হয় ভয় পেয়েই থলিটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে। আনাড়ি মনে হচ্ছে।

নিশ্চয় নিতে আসবে।

আসুক-না, দেখা যাবে ক্ষণ।

যদি ধরা পড়ে তাহলে ভালোই হয়।

মারের চোটে কোথায় থলিটা রয়েছে পুলিশের কাছে তা ফাঁস করেও তো দিতে পারে?

তা বটে। ধরা না পড়াই ভালো।

অবশ্য বলা যায়, থলির কথা আমরা কিছুই জানি না।

তাহলেও পুলিশ সার্চ করতে আসবেই। গুণ্ডাটাকে যখন ভদ্রলোকের মতোই দেখতে, অবশ্য খুকির মতে, তখন পুলিশ কোনো ওজর আপত্তিই শুনবে না। বহু ভদ্রলোকই তো এসব কাজ করে।

তাহলে থলিটা বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না। আমার শালার কাছে বরং…

না না, এখন কোনো জিনিস হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনো ঠিক নয়। পুলিশ নিশ্চয় নজর রাখছে। তা ছাড়া এই গুণ্ডাটা আগে ধরা পড়ুক তবে তো?

গুণ্ডাটা নিশ্চয় একা নয়, দলও আছে। যদি চড়াও হয়?

দুজন ভীষণ ভাবনায় কথা বন্ধ করে ফেলল। তারপর চান-খাওয়া সেরে যে যার অফিসে চলে গেল। দুপুরে খুকির মা আর বউদি রান্নাঘরে খেতে খেতে বলাবলি করল, দরজা জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ আছে কি না শোবার আগে আবার দেখতে হবে।

কড়া নাড়লেই যেন দরজা খুলো না। আগে দেখে নিয়ে তারপর।

তার থেকে যদি দাদার ওখানে রাখা যেত তাহলে এত ভয়ের কিছু থাকত না।

দরকার কী আবার লোক জানাজানি করে।

দাদা সেরকম লোকই নয়। তাহলে আর ব্যাবসা করে খেতে হত না। আমার বিয়েতে চার হাজার টাকা ধার করেছিল, কক্ষনো কারুর কাছে তা ভাঙেনি, এমন চাপা।

তোমার দাদা ছেলে ভালো। খুব নম্র, ভদ্র।

ওই জন্যই তো দাদা খালি লোকসান দিচ্ছে। কত বার ওর বন্ধুরা, এমনকী খদ্দেররা পর্যন্ত বলেছে অত সৎ হলে ব্যাবসা করা চলে না। একদম মিথ্যা বলতে পারে না। অথচ কী ভালো ব্যাবসা। কত মাড়োয়ারি টাকা নিয়ে সাধাসাধি করেছে পার্টনার হবার জন্যে। যদি নেয় তাহলে এখনও হেসেখেলে মাসে পাঁচ হাজার লাভ করতে পারে। কিন্তু ওই…

তা নিলেই তো পারে!

বাঙালি ছাড়া নেবে না, এমন গোঁয়ার যে কী বলব। আপনার ছেলেকে তো বললুম দাদার সঙ্গে নেমে পড়ো। চাকরির সাড়ে চারশো টাকায় ছেলেপুলে নিয়ে কি বাঁচা যায়? হাজার সাত-আট দিলেই…

অত চ্যাঁচাচ্ছ কেন। এখন চারিদিকে লোক ঘুরে বেড়াবে। এক বার একটুখানি শুনতে পেলেই এসে পড়বে। খুকি কোথায়? কী করছে?

খুকি তখন ছাদে। পাঁচিলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে এমনিই দাঁড়িয়ে। এক তলা বাড়ির ছাদ, তিন দিক থেকে চাপা। একটুখানি মাত্র গলির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। মায়ের ডাকে খুকি নীচে এসে জানলাবন্ধ ঘরের মেঝেয় শুয়ে পড়ল।

রাতে খুকির বাবা-মা চাপা গলায় আলোচনা করার জন্য বহুদিন পরে আজ পাশাপাশি শুল। দুই ছেলে এবং খুকি আঘোরে ঘুমিয়েছে দেখে তবেই খাট থেকে মা নেমে এসেছে।

এই এক ঝামেলা বাপু ছেলে মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে।

আর একটা ঘর থাকলেই হয়।

একটা কেন, দুটো দরকার। খুকির বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে বউ এনে রাখবে কোথায়?

ছাদে দুটো ঘর অবশ্য তোলা যায়। তবে এদের বিয়ে হতে তো এখনও অনেক দেরি।

ততদিনে পাঁচ টাকার জিনিস পঞ্চাশ টাকায় দাঁড়াবে। এখন করলে তবু ভাড়াটে বসানো যায়। মাস মাস অন্তত একশো টাকা তাহলে আসে।

আমি ভাবছিলুম শ্রীরামপুরে এক বার যাব কি না। ছেলেটার প্রসপেক্ট আছে। দু-বছরের মধ্যেই অফিসার হয়ে যাবে, বংশটাও ভালো।

বড্ড বড়োলোক বাপু এরা, খরচ করতে করতে পরে জেরবার হতে হবে। শুধু বিয়েতে খরচ করলেই তো চলবে না। এই বাড়ির একটা বউ আফিং খেয়েছিল কেন খোঁজ নিয়েছিলে কি? তার থেকে বরং শ্যামপুকুরেরটি ভালো। দোজবরে তো কী হয়েছে। অবস্থাপন্ন, কলকাতায় নিজের বাড়ি, খাঁইও একদম নেই। আমার যা গয়না আছে তাই ভাঙিয়েই হয়ে যাবে।

লোকটার বয়স খুকির দু-গুণ। দুটো ছেলেও আছে।

আছে তো কী হয়েছে? খুকির অত বাছবিচার নেই, যা দেবে আমার সোনামুখ করে নেবে।

পাশের ঘরে খুকির দাদা-বউদি প্রথামতো দাম্পত্য-ক্রিয়া সেরে চিত হয়ে বিশ্রাম করছে। একটা আরশোলা ফরফর করে উড়তে শুরু করল। দুজনে তখন খুব বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল, এঁদো ঘরে মানুষ থাকতে পারে?

নোনা লেগে ইটগুলো পর্যন্ত ক্ষয়ে গেছে।

এর থেকে নতুন বাড়িতে ভাড়া থাকাও ভালো।

এরপর তো ঘরে কুলোবে না, তখন কী হবে?

বেরোতে হলে এখনই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাড়িভাড়া টানার মতো রোজগার না হলে আলাদা থেকে সংসার চালানো যে কী অসম্ভব ব্যাপার…

আজ বলেছিলুম দাদার সঙ্গে ব্যাবসায় নামার কথাটা। একদম গা করল না। মনে হয় কোনো মতলব আছে ওঁদের।

যে-মতলবই থাক, খরচ করতে গেলেই নজরে পড়বে। তখন ক্যাঁক করে পুলিশ ধরবে, পেলে কোথায়? কী জবাব দেবে তখন? অবস্থা তো সবাই জানে। বাসনমাজার ঝি তো আমার বিয়ের পর রাখা হল।

বুঝিয়ে বলো-না। ড্রামের মধ্যে রেখে তো কোনো লাভ নেই। বরং নিজেদের লোকের সঙ্গে ব্যাবসায় খাটালে কিছু আসবে। মিনমিন করলে কি চলে! এখন নয় একটা ছেলে, তারপর আরও তো হবে, বাবা-মা আর কদ্দিন!

বলার সুযোগ যে পাচ্ছি না!

পরদিন অফিস যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুকির দাদা মোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে বাবাও অফিসে বেরোল। দুজনে দেখা হতেই কথা শুরু হল –

কাল বড়োশালার সঙ্গে দেখা হল। ব্যাবসাটাকে বড়ো করতে চায়। কিছু টাকা দিয়ে যদি পার্টনার হওয়া যায়—তুমি কী বল?

ভালোই তো, কিন্তু টাকা পাবি কোথায়?

ড্রামের মধ্যে না পচিয়ে কাজে লাগাতে তো হবে।

খুকির বিয়ে দিতে হবে। আবার তোর মা বলছে ছাদে দুটো ঘর তুলতে।

ভালোই তো। কিন্তু খরচ করতে দেখলেই তো কথা হবে হঠাৎ এত টাকা এল কোত্থেকে?

তা বটে। আচ্ছা ভেবে দেখি।

ভেবে দেখতে গিয়ে এক সপ্তাহ কেটে গেল। তার মধ্যে খুকির মা ও বউদির কথা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। বাবা ও দাদা অফিস যাবার সময় ট্রামস্টপে প্রতিদিনই তর্ক করে যাচ্ছে। সংসারখরচের টাকা যেভাবে খরচ হওয়া উচিত তা হচ্ছে না, এই যুক্তিতে দাদা চিৎকার করে মা-র সঙ্গে ঝগড়া করল পর পর তিন দিন। দুটো ঘর থেকেই ভাঁড়ারের দরজা দেখা যায়। দুই ঘর থেকে পালা করে সারারাত ভাঁড়ার ঘরের দিকে সন্দেহকুটিল চোখ পাহারা দিতে শুরু করেছে। আর খুকি, দুপুরে ঘরে জানলা বন্ধ থাকে, তাই ছাদে উঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চড়াই বা পায়রা দেখলে শুধু নাকের পাটা ফুলোয়।

কালো কাচের চশমাপরা, টেরিলিন ট্রাউজার্স ও জামা গায়ে ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, মোটামুটি সুদর্শন একটা লোক গলির বাঁকটায় দাঁড়িয়ে তার দিকেই যে তাকিয়ে আছে, খুকি প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল, দেহটা কাঁপতে শুরু করল। পাঁচিল থেকে কনুইটা নামাবে সে শক্তিও নেই। লোকটা আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে দিয়ে বস্তির দিকে চলে যেতে তখন দেহের উপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ফিরে পেল খুকি। দুড়দুড়িয়ে সে নীচে নেমে এল।

রাত্রে দালানে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে কথা চলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার জন্য।

ভুল দেখেনি খুকি?

না না, আমাদের বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই তো চলে গেল। লুঙ্গি আর। পাঞ্জাবিপরা,নাকটা থ্যাবড়া, কোমরে কিছু-একটা গোঁজা ছিল বলে ওর মনে হল।

ছাদে কি কত্তে দাঁড়িয়ে থাকে অত বড়ো মেয়ে? তোমরা একটু নজরও রাখ না?

আহাহা, দুখানা ঘরের মধ্যে সারাদিন বন্দি থাকবে নাকি? একদিন থাকো না তুমি, বুঝতে

পারবে।

থাক থাক, এখন এই নিয়ে ঝগড়া করে লাভ নেই। সত্যি যদি সেই গুণ্ডাটাই হয় তাহলে কী করা যায় এখন? নিশ্চয় ফেরত নিতেই এসেছে।

পুলিশে ধরিয়ে দিলেই তো হয়।

না না, তাহলে ফাঁসিয়ে দেবে। নিজে যদি বঞ্চিত হয় তাহলে অন্যকেও পেতে দেবে না, এ তো সহজেই বোঝা যায়।

তাহলে ওকে কিছু দিয়ে দিলেই হয়। থলেটা যদি জানলা গলিয়ে না ফেলত তাহলে ধরা পড়তে পারত। তাহলে টাকাও যেত, প্রচুর মা-র খেত আর ফাঁসি তো হতই। এই বাড়িই ওকে বাঁচিয়েছে বলা যায়। এখন ও কোন মুখে দাবি করতে পারে?

কিন্তু গুণ্ডার কি ধর্মবোধ থাকে? দাবি সে করবেই। এর জন্য একটা মানুষ পর্যন্ত খুন করেছে, সেটা ভুলে যেয়ো না। আমাদেরও খুন করতে পারে।

তাহলে দিয়ে দেওয়াই ভালো।

না না, গুণ্ডার দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হবে নাকি? আর দেবারই যদি ইচ্ছে হয়, বেশ তাহলে আমাকেই দাও। আমি বোঝাপড়া করে নেব।

তারপর এ বাড়িতে বোমা ফেলুক, রাস্তায় ছুরি মারুক। তোর জন্যে আমরা মরি আর কি?

টাকাগুলো পেলে কালকেই এ বাড়ির ওপর সব দাবি ছেড়ে চলে যাব। তখন তো আর তোমাদের ভয়ের কিছু থাকবে না।

তা হয় কখনো! হঠাৎ বাড়ি ছাড়লে লোকে বলবে কী?

আরে রেখে দাও তোমার লোক। দু-চার দিন বলাবলি করে তারপর সব ভুলে যাবে।

তাহলেও একটা কারণ না দেখালে কি চলে? জিজ্ঞেস করলে কিছু তো একটা আমাদের বলতে হবে।

মিথ্যে বলার কী দরকার, বলে দেবেন বনিবনা হচ্ছিল না। ঝগড়াঝাঁটি নিত্যিই তো লেগে ছিল, তাই আলাদা হয়ে গেল। ক-দিন নয় লোক জানিয়ে গলা ছাড়া যাবে ক্ষণ।

সবই তো বুঝলুম। কিন্তু গুণ্ডা বুঝবে কী করে যে, টাকা তোমরাই নিয়ে যাচ্ছ, আমাদের কাছে নেই?

এ আর এমন কী শক্ত, গোড়াতেই তো আর ছুরি-বোমা মারবে না। যখন দাবি জানাতে আসবে বলে দেবে।

কিন্তু এ বাড়ির ওপর সব স্বত্ব আগে উকিল দিয়ে লেখাপড়া করে ছাড়তে হবে। মুখের কথায় চলবে না।

সকালেই বাবা এবং দাদা উঁকি লের কাছে গেল। তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন, তাই বলে দিলেন সন্ধ্যায় আসতে, খসড়া তৈরি করে দেবেন, পরদিনই রেজিস্ট্রি হবে। তারপর বাড়িতে তুলকালাম একটা ঝগড়া হবে বলেও ঠিক হয়ে রইল।

খুকির ছছাটো দুই ভাই সেই দিনই স্কুল থেকে ফিরে জানাল, মোটামুটি ভালো দেখতে ছিপছিপে ময়লা রঙের একটা লোক রাস্তায় তাদের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল, বাড়িতে কে কে

আছে, বাবা-দাদা কখন আসে, জানলায় যে-মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে তার নাম কী ইত্যাদি। ওদের চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে কাটলেট খাওয়াতে চেয়েছিল, তবে ওরা যায়নি।

শুনেই মা ও বউদির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল, ছোটো ভাই দুটিকে বিকেলে বেরোতে বারণ করা হল। কিন্তু উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারায় তারা এই নিষেধাজ্ঞা আগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল। কিছু-একটা ঘটবে আশঙ্কা নিয়ে মা ও বউদির মধ্যে বলাবলি হল— ব্যাটাছেলেরা কখন থাকে না-থাকে সেটা জেনে নিচ্ছে।

পইপই বলি অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসবে, আড্ডায় জমে যেয়ো না। এখন যদি বাড়িতে দল নিয়ে আসে তাহলে?

আজ উঁকি লের কাছে যাবার কথা আছে না? খুব জোরে চেঁচালেই হয়তো পালিয়ে যাবে। দিনের বেলায় অত সাহস হবে না।

বাঃ, দিনের বেলাতেই তো কান্ডটা ঘটিয়েছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? ওদের কাছে কিবা দিন কিবা রাত।

তুমি হাতের কাছে কয়লা ভাঙার লোহাটা বরং রাখো।

এই সময় দুজনেরই মনে হল সদরের কড়াটা বোধ হয় কেউ নাড়ল। একটা সচিত্র সিনেমা পত্রিকা হাতে খুকি ছাদে উঠে রয়েছে। বউদি ছুটে রান্নাঘরে গেল। মা পড়িমরি ছাদে উঠে দেখল খুকি পাঁচিলে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখামাত্র বইটায় মন দিল। কিছু না বলেই মা নেমে এল। বউদি কয়লাভাঙা লোহা হাতে দাঁড়িয়ে।

কেউ না।

কী করে বুঝলেন?

খুকি তো দিব্যি দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে, নইলে তো ছুটে নেমে আসত সেদিনের মতো।

আমার শরীর যেন কেমন কচ্ছে। সন্ধে হয়ে এল, বাড়িতে একটা ব্যাটাছেলেও নেই।

খুকিকে বরং ডাকি।

এই সময় ওদের মনে হল আবার যেন কড়া নড়ে উঠল।

আলুওলা নয় তো, বলেছিল বিকেলে দাম নিতে আসবে।

তুমি গিয়ে দ্যাখো-না।

আপনি যান-না। খেয়ে তো আর ফেলবে না।

অবশেষে মা গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বার কয়েক কে কে বলে চ্যাঁচাতে আবার খুট খুট কড়া নড়ে উঠল। খিলটা খোলামাত্র হট করে দরজা ঠেলে একটা লোক ভিতরে ঢুকেই বলল, চ্যাঁচাবেন না। দরজায় খিল দিয়ে বলল, আমার থলি আর টাকা নিতে এসেছি। চটপট দিন। চ্যাঁচালে সবাইকেই খুন করে যাব।

এমন আকস্মিকভাবে ব্যাপারটা হয়ে চলল যে ওরা দুজন এক-পা হটার কথাও ভাবতে পারল না। ছোরার ডগাটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকল। শেষে বউদিই বলল, টাকা তো আমাদের কাছে নেই। পুলিশে জমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাজে কথা রাখুন। সব খবর রাখি। টাকা এই বাড়িতেই আছে। চটপট বার করুন, জানেন তো এর জন্যে খুন পর্যন্ত হয়ে গেছে। আরও খুন হতে পারে।

টাকা বাপু আমার বড়ছেলে নিয়েছে। আমরা ও-টাকা চাই না।

মিথ্যে কথা। হাত দিয়েও উনি টাকা এখন পর্যন্ত ছাঁননি, আর কিনা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন?

কেন, ও কি টাকার বদলে বাড়ির অংশ ছাড়বে বলেনি? ছাড়ক, তবে তো টাকা পাবে। আগেই বলছেন কেন টাকা নিয়েছে? দশ হাজার টাকার বদলে পনেরো হাজার টাকার বাড়ির অংশ নিচ্ছেন, এত বড়ো জোচ্চুরির পরও কিনা বলছেন আপনার ছেলে টাকা নিয়েছে?

টাকা যে দেওয়া হচ্ছে এই ওর ভাগ্যি। বাড়ি ওর বাপের, সে যদি উইল করে ওকে বঞ্চিত করে তাহলে ও কী করবে শুনি?

করে দেখুন-না। কোর্টে গিয়ে আদায় করব।

তোমার চোদ্দোপুরুষের সাধ্যি নেই আদায় করে।

মুখ সামলে কথা বলবেন বলছি।

চুপ কর হারামজাদি।

এরপর বউদি কয়লা ভাঙার লোহাটা ছুড়ে মারে। মা কপাল চেপে ঘুরে পড়ে বার কয়েক হাত-পা খিঁচিয়েই নিথর হয়ে গেল দেখে গুণ্ডাটা ছুটে এল। নাড়ি টিপে, চোখের পাতা তুলে, বুকে কান রেখে সে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, একেবারে মার্ডার করে দিলেন। যাক চটপট আমার থলেটা বার করে দিন তো, চলে যাই।

আমি এখন কী করব?

আমি কী জানি? আমার থলেটা দিন।

ডাক্তার ডাকব?

বললুম তো জানি না।

পুলিশ?

কী বলবেন ডেকে? খুন করেছি? তাহলে তো আপনার ফাঁসি হবে।

এই সময় ছাদ থেকে খুকি নামল। মাকে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে হাউহাউ করে উঠে বলল, ওমা, কে তোমার এমন কান্ড করল?

ওই তো, ওই লোকটা, সেই গুণ্ডাটা!

বউদির আঙুল তোলা দেখে গুণ্ডাটা খুব ঘাবড়ে গেল। তার মানে, এসব কী কথা? বলতে বলতে পিছোতে শুরু করল। খুকি চিৎকার করে ছুটে গিয়ে লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বউদিও ছুটে গেল।

জানো ঠাকুরঝি, খটাং করে লোহাটা দিয়ে মারল। কীরকম শব্দ যে হল।

খুকিকে এক হাতে আটকে গুণ্ডাটা খিল খুলতে যাচ্ছে, বউদি খিল চেপে ধরে বলল, আবার আমার ঘাড়ে দোষ দেবার চেষ্টা করছে। কী বদমাস দেখেছ!

মা কালীর দিব্যি, আমি করিনি।

না করেনি, পাজি গুণ্ডা কোথাকার। টাকা দিন নইলে খুন করব বলে ওটা ছুড়ে মারলে না?

চিৎকার করতে করতে খুকি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। গুণ্ডাটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। খুকির চিৎকারে আশপাশের বাড়ির জানলায় ছাদে উঁকি শুরু হয়ে গেছে। সদর দরজার কাছে কাদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। গুণ্ডাটা হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে এধার-ওধার তাকিয়েই ছাদে যাবার জন্য ছুটল সিঁড়ির দিকে। বউদিও পিছু নিল।

পালাচ্ছ নাকি? কোনো উপায় নেই, ছাদ দিয়ে শুধু রাস্তায় লাফিয়ে পড়া যায়। সেখানে এখন লোক।

তাই যাব। ছুরি দেখিয়ে পালাব। মরিয়া হয়ে গুণ্ডাটা বলল।

আমার কী দোষ! চোদ্দোপুরুষ তুলে গালাগাল দিলে রাগ হবে না? তোমার হত না?

গুণ্ডাটা জবাব না দিয়ে কয়েক ধাপ ওঠা মাত্র বউদি ওর জামা টেনে ধরল। এখন তোমায় আমি যেতে দিতে পারি না। খুনি তোমার হতেই হবে। ফাঁসি অবধারিত তোমার।

তাহলে পুলিশকে বলব লুটের টাকা এ বাড়িতে আছে।

তার আগেই সরিয়ে ফেলব অন্য কোথাও।

এখুনি চেঁচিয়ে সব কথা লোকেদের বলে দিচ্ছি। ফাঁসি যখন হবেই আর পরোয়া কীসের। তবে আপনাদেরও টাকা ভোগ করতে দেব না।

কিন্তু তাই বলে আমি ফাঁসি যেতে রাজি নই, তোমাকেই ফাঁসি যেতে হবে। লোকে সহজেই বিশ্বাস করবে তোমার পক্ষে খুন করা স্বাভাবিক। টাকা আমরা পাব না, কিন্তু তুমি টাকা আর প্রাণ দুটোই হারাচ্ছ, লোকসান তোমারই বেশি।

এই শুনে গুণ্ডা খুবই বিচলিত হয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ল। সদরের কড়া নাড়ছে প্রতিবেশীরা। কী হল, কী ব্যাপার? প্রভৃতি ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। খুকির জ্ঞান এখনও ফেরেনি।

এখন আর ভাবনা করার সময় নেই। বরং এক কাজ করা যাক, তোমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিচ্ছি, টাকার দাবিটা ছেড়ে দাও। মনে রেখো, বেঁচে থাকলে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করতে পারবে। ঠিক বলেছি কি না?

গুণ্ডাটি এইবার ফিক ফিক করে হেসে মাথা হেলাল। সদরে দুম দুম ঘুসি পড়ছে। বউদি ছুটে দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠল, সব্বনাশ হয়ে গেছে, শিগগির ডাক্তার ডেকে আনুন। মা মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। ব্লাডপ্রেশার ছিল। রকের কানায় মাথাটা ঠকাস করে লাগল, উফ কীরকম শব্দটা যে হল!

এই বলে বউদি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগল। প্রতিবেশীরা ছুটোছুটি শুরু করে দিল। ডাক্তার এল, অ্যাম্বুলেন্সও। মাকে হাসপাতালে পাঠানো হল। খুকির জ্ঞান ফিরে এসেছে, তাকে ঘরে শোয়ানো হল। জনৈক প্রতিবেশীর প্রশ্নের উত্তরে বউদি জানাল, খুকির বিয়ের সম্বন্ধ এক জায়গায় ঠিকঠাক। এইমাত্র জানিয়েছে মেয়ের মাথা খারাপ আছে বলে তারা না কি খবর পেয়েছে। তাই শুনেই মা…

খুকির আচ্ছন্নতা তখনও কাটেনি। ফ্যালফ্যাল চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে, সকলের কথাবার্তা তখন তার কানে কম বকমের মতো মনে হতে লাগল।

রাস্তা

দীপু, তাের বাবা এখনও আসছে না যে রে। একবার গেটের কাছে গিয়ে দ্যাখ-না।

মেটারনিটি ওয়ার্ডের গাড়িবারান্দার তলায় তখন একটাই মােটর দাঁড়িয়েছিল। দীপু তার বাম্পারে বসে দেখছিল, উত্তর-পূর্ব কোনার লালবাড়িটার সিঁড়িতে দুটো ছেলে-মেয়ে কথা বলছে। দুজনের হাতেই বুক দেখবার নল। মেয়েটা হেসেই কুটিকুটি। হাসি থামিয়ে সিঁড়িতে উঠছিল। আবার কী শুনে আবার কুটিকুটি। মেয়েটা আটকা পড়ে গেছে। দীপু ভাবল ছেলেটা কি খুব হাসির গল্প জানে, না কি এখনও খিদে পায়নি মেয়েটার!

অ দীপু।

বলেছি তাে, অফিস থেকে ছুটি করিয়ে তবে আসবে।

তােকে একলা পাঠাল কী বলে শুনি? ছেলে-মেয়েগুলাে বাড়িতে এতক্ষণ কী কান্ড করছে কে জানে।

শিকলি দিয়ে এসেছি।

তাতে কী হয়েছে, ঘরের জিনিস ভাঙবে। এত বেলা হল ওদের খিদেও তাে পেয়েছে।

মেয়েটা লালবাড়িতে ঢুকে গেল। সােজা পুবমুখাে রাস্তা ধরে ছেলেটা চলে যাচ্ছে। হাতের নলটা দোলাচ্ছে। দীপু পুব দিকে তাকিয়ে রইল।

কমলা দেখছে সবুজ শাড়িপরাটিকে। গাড়িবারান্দার নীচে আরও তিনটি বউ বসে। সবাই মাঝবয়সি। শুধু একে দেখেই মনে হচ্ছে প্রথম পােয়াতি। চোখে-মুখে ভয় এখনও কাটেনি। বাচ্চাটাকে পর্যন্ত ভরসা করে কোলে নেয়নি। নাতি কিংবা নাতনিকে কোলে নিয়ে দোলাচ্ছে বুড়িটা।

খস করে ট্যাক্সিটা থামল। তর সইছে না ছেলেটার। নেমেই তাড়া দিল ওঠার জন্য। হাসপাতালের বুড়াে দারােয়ান ট্যাক্সির দরজা খুলে ধরেছে। বউকে দু-হাতে ধরে তুলল। দু

পাশে তাকিয়ে বউটা স্বামীর হাত দুটো সরিয়ে দিল।

বুড়ি ট্যাক্সিতে উঠতে পারছে না। হাতজোড়া বাচ্চা। মাথা নীচু করে বুকলে, খাড়া থাকার মতাে জোর আর কোমরে নেই।

আপনি ছেলেকে ধরুন-না। উনি উঠলে পর কোলে দেবেন।

কমলার পরামর্শ শুনল ছেলেটা। দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল দারােয়ান। একটা টাকা বকশিশ পেল।

জানলি দীপু, তােকে নিয়ে ওঠবার সময় টাসকির দরজায় মাথা ঠুকে গেছল। খিঁচিয়ে উঠেছিল তাের বাবা। এমন রাগ ধরেছিল তখন, মনে হয়েছিল দিই তােকে ফেলে, যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাই।

বাবার স্বভাবটা বড়াে বিচ্ছিরি।

তাের ঠাকমা খুব বকেছিল তার বাবাকে। হ্যাঁ রে, মনে আছে ঠাকমাকে? আমায় খুব ভালবাসত।

তুমি ট্যাক্সি করে গেছলে!

এর থেকে বড়াে ছিল টাসকিটা। তাের মেজোমামা, সােনাপিসি সব্বাইকে ধরে গেছল।

নিতু, অপু, বাচ্চু এরাও ট্যাক্সিতে গেছল?

শুধু নিতুটা গেছল, আর সব রিসকোয়।

কমলা তার বাচ্চাকে কোল থেকে হড়ানাে পায়ের উপর শুইয়ে দিল। নাপিত নখ কাটছে ফর্সা বউটার। ওর গায়ে জামা নেই, শরীরেও মাংস নেই। একলা বসে। স্বামী গাড়ি ডাকতে গেছে। নাপিতটা নতুন। মাথায় টিকি। টিকিওলা নাপিত কমলা কখনাে দেখেনি। বার সময়ে ছিল বেঁচে গাট্টাগােট্টা এক নাপিত। পােয়াতিরা খালাস হয়ে যাবার সময় এখানেই নখ কেটে যায়। সে-বার ঝগড়া হয়েছিল। দু-আনার জন্য দীপুর বাপ হাতাহাতি করতে গেছল।

হ্যাঁ রে দীপু দ্যাখ-না ক-পয়সা নেয়।

কী হবে দেখে।

তাহলে এখানেই কেটে নােব।

দীপু উঠে গেল। একটা রিকশা নিয়ে এল বউটার স্বামী। দারােয়ান গাড়িবারান্দার তলায় রিকশাকে দাঁড়াতে দিল না। বউকে ধরে নিয়ে গেল লােকটা। কোমর ভেঙে গেছে। ধুকতে ধুকতে হাঁটছে। হঠাৎ কাপড়টা আলগা হয়ে পড়ছিল, একহাতে বাচ্চাকে অন্যহাতে কাপড়টা ধরে সে অসহায় চোখে কমলার দিকে তাকাল।

অ দীপু, ভাইকে একটু ধর তো।

বাচ্চাকে দীপুর কোলে দিয়ে কমলা গিয়ে বউটাকে কাপড় পরিয়ে দিল। হ্যাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। কমলা ধরে নিয়ে গেল রিকশা পর্যন্ত। উঠতে পারছে না। রিকশাগুলাে এমন গড়ানে হয় যে কমজোরি লােক উঠতে গেলেই টলে পড়ে। বাচ্চাকে চেয়ে নিল কমলা। হামাগুড়ি দিয়ে বউটা রিকশায় উঠল। ওর স্বামীও উঠল। কমলা বাচ্চাকে কোলে তুলে দিল।

আসি দিদি।

নামবার সময় সাবধানে নেবাে।

রিকশাটা চলে গেল। আবার একটা ট্যাক্সি এল। হাতআয়নাটা বাস্কেটে রেখে বাচ্চা বউটা উঠে দাঁড়াল। বেশ শক্তসমর্থ গড়ন। কোন ফাঁকে বুকটাকে আঁটসাঁট করে নিয়েছে। বাচ্চাকে স্বামীর কোলে দিয়ে গটগটিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।

চলে গেল ট্যাক্সিটা। দরজা বন্ধ করে বকশিশ পেল দারােয়ান। এখন গাড়িবারান্দার তলায় বাড়ি যাবার জন্য রইল শুধু কমলা।

দীপুর কাছ থেকে ছেলেকে কোলে নিয়ে মােটরের ধার ঘেঁষে কমলা মেঝেয় বসল। দীপু বসল বাম্পারে। দারােয়ান বসেছে তার টুলে আর নাপিত সিঁড়িতে। হাসপাতালের ভিতর থেকে টুকটুক করে একটা বেড়াল নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে এক মাঝবয়সি দাই এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গেল। খিলেনের কার্নিশে দু-তিনটে কাক উঠে এল। অনেক দূরে, গােলাপি বেল্টআটা সাদা কাপড়ের টুপিপরা পাঁচ-ছটি মেয়ে খাতা হাতে চলে গেল। উত্তরের ছাই রঙের বাড়িটার তিন তলার বারান্দায়, টেবিল ঘিরে তাস খেলছে ক-জানে।

নাপিতটা কত নিল রে?

আট আনা।

তাের বাবা ভােলাকে বলে রেখেছে তাে?

কী জানি। ভােলা তাে বারােটা পর্যন্ত পাড়ায় থাকে। এখন গেলে হয়তাে পাওয়া যাবে।

দ্যাখ-না একটু, তাের বাবা আসছে কি না।

দেখলেই কি বাবা তাড়াতাড়ি আসবে?

দীপু ঝেঁঝে উঠল। বাতাসে হলকা আসছে। বাচ্চাকে আঁচল দিয়ে কমলা ঢেকে দিল। উত্তর-পুবের লালবাড়িটা থেকে তরতরিয়ে দুটি মেয়ে নেমে গেল। দীপু ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল। একটু গিয়েই ওরা বেঁকে গেল।

মা তােমার কাছে পয়সা আছে?

বারােটা পয়সা আছে। কেন?

কতক্ষণ বসে থাকব?

উনি কখন আসেন, কে জানে।

হেসে উঠল নাপিতটা। আর খদ্দের নেই তবু বসে গল্প করছে। দারােয়ানকে খুশি না রাখলে এখানকার পসার বন্ধ হয়ে যাবে। দীপু উঠে গিয়ে দরজার পাশে টাঙানাে রুগি দেখবার নিয়ম পড়তে শুরু করল। কমলা তাকাল বাগানের দিকে। হাওয়া আসছে, তবু গলগলিয়ে ঘাম নামছে। চমকে উঠে হাত ছড়ল বাচ্চাটা। স্বপ্ন দেখছে। বােধ হয় গতজন্মের কথা ভাবছে। ঠোঁট নড়ছে। হাসছে। না কি খিদে পেয়েছে। মােটরটার দিকে পিছন ফিরে মুখে মাই গুজে দিল কমলা। চনমন করে মুখ সরিয়ে নিল। চোখ বুজেই আছে। বড়ড় আলাে, কচি চোখে সইবে কেন। আঁচল দিয়ে বাচ্চাকে আবার ঢেকে দিল কমলা। আঁচলের নীচে নড়ছে। আঁচল ফাঁক করে দেখল। হাত-পা কুঁকড়ে গুটিয়ে রয়েছে। কালাে ঠোঁট দুটো নড়ছে। কী ছিল ও আগের জন্মে, রাজার ছেলে? গতজন্মের কথা মনে পড়ে হাসছে?

হ্যাঁ রে দীপু ট্যাসকির ভাড়া বুঝি কম? সবাই যে গেল।

দীপু সাড়া দিল না। ঘাড় তুলে সে নিয়ম পড়ছে।

এখান থেকে আমাদের বাড়ি যেতে কত নেবে রে?

দীপু এবারও সাড়া দিল না। কমলা দীপুর থেকে চোখ সরিয়ে ফড়িংটার ওপর রাখল, ওটা এইমাত্র মােটারের টায়ারে এসে বসেছে; তারপর রাখল বাচ্চার উপর। বাচ্চাকে দু-হাতে দোলাল। বড়ড হালকা। কালাে বেল্টপরা নার্সটি হেসে বলেছিল, কী সুন্দর বেবি। আহা, বড়াে ভালাে মেয়েটি। বলেছিল দেখা করবে।

কমলা দূরের বারান্দায় তাকাল। একটাও মানুষ নেই। কে থাকবে এই গরমে। তা ছাড়া ওর ডিউটি তাে ওধারে দক্ষিণের বারান্দায়। কালকে এমন সময় দেখা হয়েছিল। কাঁদো কাঁদো মুখ করে ছুটে আসছিল। কে একজন না কি বাড়ি যাবার সময় হাতে আট আনা পয়সা ওঁজে দিয়েছে।

দীপু একটু নজর করিস তাে, সেই কপালে কাটাদাগ আমাদের নার্সটির যদি দেখতে পাস। আমাকে খুব যত্ন করেছিল।

তাকে দেখব কী করে, সে তাে ওয়ার্ডে এখন।

তবু যদি এদিকে এসেটোসে পড়ে। এক জায়গায় বসে তাে আর কাজ করতে হয় না।

দীপু আগের মতো বাম্পারে বসে গাড়ির পিঠে মাথা রাখল।

আর গােটা কতুক পয়সা থাকলে বাসে চলে যেতুম।

কমলা মুখ ফিরিয়ে নিল। পা ছড়িয়ে দিল রােদুরে। সিমেন্ট তেতে উঠেছে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে সেঁকের কাজ হয়ে যাবে। ঠেস দিয়ে সে চোখ বুজল।

এই ওঠো, ওঠো।

ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে দারােয়ান। যার মােটরগাড়ি সে এসে গেছে। উঠে দাঁড়াতে ভুলে গেল দীপু তার দিকে তাকিয়ে।

লেড়ি ডাক্তার দীপুকে নজর না করেই গাড়িতে উঠে বসল। সেলফ স্টার্টারের বােতাম টিপল। খরখর করে উঠল এঞ্জিন, স্টার্ট হল না।

গাড়ি ঘেঁষে কমলা বসেছিল। লেডি ডাক্তারের মুখটুকু শুধু দেখতে পাচ্ছিল সে। সুন্দর। কপাল, সুন্দর রং, সুন্দর চুল।

আবার শব্দ হল স্টার্টারের। বিচ্ছিরি শব্দ। এত সুন্দর গাড়িটা যেন ককাচ্ছে। বার কয়েক এমন হবার পর লেড়ি ডাক্তার গাড়ি থেকে নামল। নীচু হয়ে গাড়ির তলা দিয়ে কমলা শুধু গােড়ালি আর সায়ার লেস দেখতে পেল।

নাপিত আর দারােয়ান এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে যেন গাড়ি স্টার্ট না হবার দোষটুক তাদেরই। দীপু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। হঠাৎ মনে হল, তার পা দুটো খুব সরু আর লােম গুলাে বড়ড় ঘন। থুতনিতে বড়াে বড়াে চুল মুখটাকে কুচ্ছিত করে রেখেছে। মােটরের আড়ালে সরে এসে সে গালে হাত বােলাল। আঙুলে একটা ব্রণ ঠেকল।

গাড়িটা একটু ঠেলে দাওনা।

বলার ভঙ্গিটা আবদের। স্বরটা ঠিঠিনে। নাপিত আর দারােয়ান সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। গাড়িটা মস্ত। ওরা দুজনেই বুড়াে। জায়গাটা খাড়াই। ওদের পিঠ বেঁকে গেল, পায়ের ডিম শক্ত হল, তবু গাড়িটাকে নড়ানাে গেল না।

হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, গিয়ে ঠ্যাল-না?

আমি কেন ঠেলব?

আহা, মানুষ বিপদে পড়েছে সাহায্য করবি না। একটুখানি ঠেলে দিলেই বুঝি মান-ইজ্জত খােয়া যায়?

দীপু গিয়ে হাত লাগাল। নড়ে উঠল গাড়িটা। মুগ্ধ কমলা তাকিয়ে রইল দীপুর কনুইয়ের কাছের গুড়িগুড়ি পেশির দিকে। উঁচু দিকটা কাবার হয়, ঢালুতে পড়েই গাড়ির গতি বাড়ল। ঝকা করে ক্লাচ পড়ল। গড়গড়িয়ে উঠল এঞ্জিন। গাড়িটা কিছুটা ছুটে গিয়ে থামল। হাত নেড়ে লেডি ডাক্তার ডাকছে। দারােয়ান আর নাপিত ছুটে গেল। ওদের হাতে কী যেন দিল, বােধ হয় বকশিশশ।

দীপুর হাঁটুর কাছে নুনছাল উঠে গেছে। ক্লাচ দিতে থমকে যায় গাড়িটা, তখনই মাডগার্ডের ধারটা লেগেছিল।

সামনের বাগানটা চক্কর দিয়ে গাড়িটা পুব দিকে চলে গেল। কমলা তাকিয়ে রইল ওইদিকে। অল্প অল্প ধোঁয়ার গন্ধ আসছে। বেশ লাগে শুকাতে।

ওরা পয়সা নিল।

দিল বুঝি?

হুঁ।

ওরা তাে নেবেই।

আমায় দিলে ছুড়ে ফেলে দিতুম।

তােকে দিতই না। শিক্ষিত তাে, মানুষ চেনে। কাকে দিতে হয় না হয় বােঝে।

পয়সাটা দুজনে ভাগাভাগি করে নেবে।

তা তাে নেবেই।

আমায় যদি দিতে আসে?

আসবে না।

আমি না ঠেললে গাড়ি চলত না।

নাপিত আর দারােয়ান এতক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। নাপিত চলে গেল। দারােয়ান ওদের কাছে এসে দাঁড়াল।

আপনারা যাবেন কখন?

এই তাে এক্ষুনি যাব।

দেরি করলে আরও গরম পড়বে, বাচ্চার কষ্ট হবে। কাল একশো পাঁচ ডিগ্রি হয়েছিল?

ওরা দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে রইল। দারােয়ান টুলে গিয়ে বসল।

কী বলেছিল আসবে তাে?

হ্যাঁ, ছুটি করিয়ে চলে আসবে বলেছিল, বােধ হয় কাজের তাড়া পড়েছে।

জানি, তোকে আর বােঝাতে হবে না। যত কাজ এর আজকেই।

বােধ হয় ছুটি পায়নি। অফিসে খুব গােলমাল চলছে বলছিল। বারাে জনের চাকরি গেছে, সবাই ভয়ে ভয়ে রয়েছে।

একটা দিন ছুটি নিলে কি চাকরি যেত?

উবু হয়ে বসল দীপু। মুখ ফিরিয়ে রয়েছে কমলা। রসালাে লেবু চুষলে অমন হয় ঠোট দুটো। ছেলেমানুষের মতাে দেখতে হয়ে গেছে। দীপু বাচ্চাটার গালে আঙুল ছোঁয়াল। ওকে কনুই দিয়ে ঝটকা দিল কমলা।

মা, তােমাকে এখন তার মতাে লাগছে কিন্তু।

উঠে পড়ল কমলা। কাপড়ের পুঁটলিটা এক হাতে নিয়ে গেটের দিকে চলতে শুরু করল। দীপু পিছু নিল।

কোথায় যাচ্ছ?

কথা বলল না কমলা। গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল সে। এপার-ওধার তাকিয়ে দিশা করতে পারল না কোন দিকে যেতে হবে।

বাড়ি যাবে না কি?

হ্যাঁ।

কী করে যাবে?

হেঁটে যাব। কোনদিকে যাব বল?

থুতনি তুলে দীপু উত্তর দিকে দেখাল। হাঁটতে শুরু করে দিল কমলা। পা ফেলছে আর আঙুলগুলাে কুঁকড়ে যাচ্ছে। দীপু চটি থেকে পা বার করে ফুটপাতে রেখেই চমকে তুলে

ওই বারান্দাটার তলায় দাঁড়াই।

মাথা নামিয়ে চলছিল কমলা। চলতেই লাগল। ওর হাত ধরে দীপু ছায়ায় টেনে আনল।

হেঁটে বাড়ি যাওয়া যাবে না।

এই তাে যাচ্ছি।

রেগে গেছ বলে কষ্ট লাগছে না। সারা রাস্তা তাে আর রাগতে রাগতে যাওয়া যায় না।

তবে কী করব?

ফিরে যাই। হয়তাে বাবা এসে পড়েছে; তাহলে ট্যাক্সিতে যাওয়া যাবে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কমলা। রাগ করে চলে আসাটা বােধ হয় ঠিক হয়নি। এমন করে বাড়ি পৌঁছােনাে যায়। যেতে যেতেই পায়ের তলা ঝলসে যাবে। শরীরের ব্যথাও মরেনি, চলতে কষ্ট হয়। এত গরম বাচ্চাটাই-বা সইবে কী করে।

ওদের দেখে দারােয়ান কাছে এল। দীপুকে লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল, গেলে না যে? চুপ করে রইল দীপু! এবার কমলাকে সে জিজ্ঞেস করল, নিতে আসার কথা আছে বুঝি?

হ্যাঁ।

দারােয়ান চাবির তােড়া বাজাতে বাজাতে চলে গেল। কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে। শব্দটা এগিয়ে আসছে। এসে পড়ল। দুই বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। রাস্তা থেকে লরির টায়ার ফাটার শব্দ এল। কাক ডাকছে।

ব্যাটা দরদ দেখিয়ে গেল।

কেন?

আমি না থাকলে ওর বকশিশ জুটত না।

লােক ডেকে গাড়ি ঠেলত।

তাদের তাে পয়সা দিতে হত।

হলকা আসছে। বাপ্পাটা আরও ছােটো হয়ে গেছে যেন। বুকের আরও কাছে কমলা জড়িয়ে ধরল। দীপুর কানের পিছন দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। আঁচল তুলে মুছিয়ে দিতে গেল, মাথা সরিয়ে নিল দীপু। জামার হাতায় মুছে নিল।

একটা রিকশা করে চলে যাই চলাে।

পয়সা?

তুমি তাে জমিয়ে রাখ।

কে বলল?

সেদিন দুপুরে যে বাসনওলাকে ডাকলে?

সে তাে অমনি ডেকেছিলুম, কিনেছি না কি?

তাহলে দোতলার বউদির কাছে ধার নিলেই হবে।

ধার করতে হবে না।

তা বলে সারাদিন এখানে বসে থাকব না কি?

তুই অত রেগে উঠছিস কেন? অধৈর্য হাস কেন? দ্যাখ-না উনি হয়তাে এসে পড়বেন।

আমার খিদে পেয়েছে।

দীপু প্ৰত এসে ফুটপাথে দাঁড়াল। কমলা আসতেই চটিটা খুলে এগিয়ে দিল।

কী হবে?

পরো, নইলে চলবে কী করে?

তুই?

ততক্ষণ দীপুর পায়ের চোটো জ্বলতে শুরু করেছে। ছুটে সে গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার গাছ। লিকলিকে তার ছায়া।

দাঁড়িয়ে কেন, হাঁটতে আরম্ভ করাে।

অবাক হয়ে কমলা ওর কান্ড দেখছিল। চটিপরা অভ্যাস নেই। আঙুল দিয়ে ফিতেটাকে আঁকড়ে থাপথপিয়ে একটু হেঁটেই থেমে গেল। দীপু পায়ে পা ঘষছে। হেসে ফেলল কমলা।

ধ্যাত, আমি কি এমনভাবে চলতে পারি?

নইলে দেরি হয়ে যাবে। অপু, নিতুদের এখনও খাওয়া হয়নি।

গাছের ছায়ায় কমলা এসে পৌঁছােতেই দীপু আবার ছুট লাগাল অনেক দূরে একটা হাইড্রেট লক্ষ করে। দুটো লােক স্নান করছে। জলে পা ভিজিয়ে দীপু দাঁড়াল। কমলা অনেক দূরে। ছেলে কোলে, পুটলি হাতে থপথপিয়ে আসছে। দু-হাতে জল নিয়ে দীপু মাথায় থাপড়ল।

অ দীপু, অমন করে তুই কত ছুটবি?

দাঁড়ালে কেন, হাঁটো।

নিতুটাকে বার্লি দিয়েছিস তাে?

হ্যাঁ।

ওরা চৌবাচ্চায় নামবে না তাে?

না না না, তুমি হাঁটো।

আবার ছুটল দীপু। এবার একটা রিকশার আড়ালে। রিকশাওয়ালা হুড ফেলে সিটের উপর বসেছিল। কমলাকে তার দিকে তাকিয়ে আসতে দেখে নেমে দাঁড়াল। দীপুও লক্ষ করেছে কমলা রিকশাটার দিকে কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে।

মা, রিকশায় ওঠো।

ধার করলে তার বাবা রাগ করবে।

জানবে কী করে?

তাহলে কার কাছ থেকে নিয়ে ধার শুধবি?

তবে বাবা এল না কেন? কেন আমায় পয়সা না দিয়ে পাঠাল?

চিৎকার করল দীপু। চোখে জল এসে গেছে। ঠোঁট কাঁপছে।

অ দীপু, তুই চুপ কর।

কেন করব? তােমার জন্যই তাে এই কষ্ট। দারােয়ানটার কাছ থেকে ঠিক ভাগ আদায় করে নিতুম।

দীপু তুই রিসকায় ওঠ, আমি ধার শােধ করে দেব।

দীপু রিকশার ছায়া থেকে বেরিয়ে নর্দমায় পা রেখে দাঁড়াল।

লক্ষ্মীছেলে আমার।

না।

দীপু চোখ সরিয়ে নিল। কমলার চোখের থেকে দূরের রাস্তা অনেক ঠাণ্ডা। রিকশাওয়ালা সিটে উঠে বসল। ঘাম গড়াচ্ছে কমলার গাল বেয়ে। ভুরু ভিজে গেছে। চোখ জ্বলছে। ঘাড়ে চোখ ঘষল। চোখ দুটো গর্তে বসে গেছে। শুকনাে বাতাসে চুল উড়ে পড়ল কপালে। ঠোঁট চাটল কমলা। গলার নলিটা তুলতুল করে কাঁপছে।

এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, চল ওখানটায় বসি।

মনােহারী দোকানটার সিঁড়িতে ছায়া। দীপু সিঁড়িতে বসল। কমলা এল না। উঠে এসে দীপু এর হাত ধরে টানল।

আমি যাব না।

মাকে দু-হাতে জড়িয়ে দীপু টেনে আনল। দোকানি খবরের কাগজ পড়ছিল। ওদের দেখে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করল।

মা তােমার খিদে পেয়েছে?

না।

না কেন, এত বেলা হয়েছে।

বেলায় খাওয়া আমার অভ্যেস।

ঘাড় ফিরিয়ে কমলা দোকানের ভিতর তাকাল। সারি সারি বয়ামে বিস্কুট আর টফি।

তাের খিদে পেয়েছে?

না।

বললেই বিশ্বাস করব! সাড়ে নটাতেই ভাত ভাত করে চিৎকার করিস না?

তােমারও তাে পেয়েছে।

আমার গা গুলােচ্ছে। খেলে বমি হয়ে যাবে।

আঁচল থেকে বারােটা পয়সা খুলে নিল। বিস্কুট কিনল দীপু। খেতে খেতে আড়চোখে দেখল কমলা তার খাওয়া দেখছে। দুর্গা প্রতিমার মতাে হাসিটা, মানে বােঝা যায় না। শেষ বিস্কুটটা এগিয়ে দিল দীপু।

না, তুই খা।

বাচ্চার বুকের ওপর বিস্কুটটা রাখতেই গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কমলা ধরে ফেলল। দীপু মুখ ঘুরিয়ে সরে বসল। জিভ দিয়ে মাড়ি পরিষ্কার করে, টাকরায় শব্দ করল।

কমলা তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে একদৃষ্টে। ফুটপাথে বসন্তের ঘায়ের মতাে দাগ। অনেক দিনের অনেক লােকের হাঁটাচলার জায়গায় জায়গায় দাগগুলাে মিলিয়ে গেছে। দীপুর বাবার মুখের দাগগুলো এখনও মেলায়নি। তখন অনেকেই বলেছিল কচি ডাবের জলে মুখ পুতে, ধােয়নি। এই ফুটপাথের মতাে হয়ে আছে ওর মুখটা। মানুষটাও খ্যাপাটে হয়ে গেছে। খেপলে মুখটা বাটনা বাটা শিলের মতাে হয়ে যায়। একঘেয়ে, রােজকার অভ্যাস। আয় বাড়ছে না, ঘর বাড়ছে না, খাটুনিরও কামাই নেই।

কেন যে এমন করে। এতে আমার কী দোষ, আমি কী করতে পারি, উঁ?

ফুটপাথের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে নিজের মনেই কমলা বলল। বাচ্চার গলায় সুতাের মতাে ময়ল্লা। সাবধানে তুলে ফেলে দিল। মাথায় হাত বােলাল। চুল নেই বললেই হয়। দীপুটারও ছিল না।

আস্তে আস্তে কমলার শুন্য চোখ ভরাট হয়ে উঠল। হাসল সে।

তাের বেলায় টাসকি করে এসেছিলুম।

সেকথা তাে বললে।

বলেছি না কি! তুই এর থেকেও বড়ােসড়াে হয়েছিলি, বলেছি? হয়েই কী কান্না। এটা কিন্তু একদম কাঁদেনি।

বাচ্চার ঠোঁট নড়ছে। বােধ হয় খিদে পেয়েছে। কমলা মাই গুঁজে দিল ওর মুখে। দীপু আড়চোখে দোকানির দিকে তাকাল। এইদিকেই তাকিয়েছিল, চোখে চোখ পড়তেই কাগজটা তুলে ধরল।

তাের ষষ্ঠী পুজোর দিন একটা ধনেখালি ডুরে পেয়েছিলুম। ঠাকুরঝির বিয়েতে খোঁচা লেগে ছিড়ে গেছল। পর্দা করেছিলুম।

আমাদের পর্দা ছিল!

জানলায়। ঘন্টুদের বাড়িতে একটা লােক তখন ভাড়া ছিল, খালি তাকাত।

কমলার খেয়াল হল চটিটা এখনও পড়ে আছে। খুলে ফেলল।

থাক-না।

না তুই পর। এটা পরলে কেমন কেমন লাগে। পায়ের পাতায় হাত বোলাল কমলা। আঙুলে হাজা, গােড়ালি ফাটা।

আমার জন্যই এই কষ্ট না রে?

তােমার জন্য কেন হবে।

দীপু মাথা নামিয়ে পায়ের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঘষতে শুরু করল। কমলা মুখ তুলে তাকাল আকাশে। গরমে চোখ পাতা যায় না। তাকাল ফুটপাথে। সেই বসন্তের ঘায়ের মতাে দাগ। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, কষ্ট কি আমি ইচ্ছে করে দিই, সংসারে দুখু বাড়ুক তা কি আমি চাই। কিন্তু তার বাবার যে একটুও কান্ডজ্ঞান নেই। বারণ করলে রেগে ওঠে।

যার কান্ডজ্ঞান নেই তার রাগারও কোনাে মানে নেই। আপিসে বসে মজা দেখছে হয়তাে, আর আমরা এখানে…

মুখ তুলল কমলা। ছেলের চোখে রাগ, ধমকানি, দুঃখ। ও এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। ধক করে উঠল কমলার বুক। ছেলেকে আর এখন চেনা যাচ্ছে না। মস্তবড়াে হয়ে গেছে। বুঝতে শিখেছে, ধমকাতে শিখেছে। কিন্তু ও ধমকাচ্ছে কাকে! আমাকে? আমি কী দোষ করেছি! ইচ্ছে করে কি সংসারে অশান্তি এনেছি? ছেলেটা বাপের স্বভাব পেয়েছে, সবটাতেই রেগে ওঠে। এইটুকু ছেলে রাগে কেন? ওকি সংসারের হালচাল বুঝে ফেলেছে?

কমলা চুপ করে তাকিয়ে রইল। রাস্তার ওপারে ফুটপাথে ছায়া। খাটিয়ায় একটা লােক শুয়ে। কাঠ কাটছে একটা মেয়েমানুষ। হঠাৎ দমকলের ঘণ্টা বাজল। গাড়িগুলাে রাস্তার কিনার ঘেষে এল। ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল একটা দমকলগাড়ি।

আহারে! কাদের আবার কপাল পুড়ল।

যাদেরই পুড়ক-না, তােমার কী?

ক্ষতি তাে হবে!

হােক গে, তা ভেবে আমাদের কী হবে, বাড়ি পৌঁছােতে পারব কি?

ছেলের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে। পিচ গলে যাওয়ায় চড়বড় শব্দ হচ্ছে। গাড়ির চাকায়। এখন অনেকখানি পথ হাঁটলে তবে বাড়ি পৌঁছােনাে যাবে। ছেলে মেয়েগুলােকে শিকলি দিয়ে ঘরে আটকে রেখে এসেছে। তাদের খাওয়া হয়নি। গিয়ে উনুন ধরিয়ে বেঁধে খাওয়াতে হবে। ওরা এতক্ষণ কী করছে কে জানে। হুটোপাটি করে ঘরের জিনিস ভেঙেছে। বালিশ নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলেছে। নিতুটার ভীষণ লােভ চিনিতে। দেয়ালে পা দিয়ে দিয়ে উঠে হয়তাে শিশিটা সাবড়ে দিয়েছে। বাছুর ঘরকন্নার কাজ খুব পছন্দ। কুজো থেকে জল ঢেলে, জামাটামা কিছু একটা দিয়ে ঘর মুছতে শুরু করেছে। কিন্তু কতক্ষণ ওরা খেলা করবে। খিদে পাবে, চিৎকার করবে, কাঁদবে। ওরা তাে সবসময়ই চ্যাঁচায়। পাশের বাড়ির লােকেরা শুনলে গ্রাহ্যই করবে না। হয়তো তারপর কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়বে। নিতুটা আগে ঘুমােবে। ওর স্বাস্থ্যটাই ভালাে। অপুকে হয়তাে বাছুই ঘুম পাড়িয়ে দেবে। জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাচ্চুটাও ঘুমিয়ে পড়বে একসময়।

আবার উঠছ কেন?

আর বসে থাকতে পারছি না রে। আমার কষ্ট হচ্ছে।

হচ্ছে তাে যাও, আমি উঠতে পারব না।

তুই অমন করে আর কথা বলিসনি।

কেন বলব না, কেন পয়সা পর্যন্ত চেয়ে রাখ না?

আমায় যদি না দেয় কী করতে পারি।

তুমি একটা বােকা। মান-ইজ্জতটাই তােমার কাছে বড়াে, নইলে দারােয়ানটা পর্যন্ত…

ফ্যালফ্যাল করে কমলা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। …ও বলছে আমি বােকা। তাহলে একটু আগে কেন আমায় চটি পরতে দিয়েছিল? ওর নিজের পা পুড়বে তা কি ও জানত না?…

মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে দীপু। কমলার চোখ টলটল করছে। দোকানি টেবিলে থুতনি রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। এতক্ষণে একটাও খদ্দের আসেনি।

রােগা জিরজিরে একটা গােরুকে দুটো লােক টানতে টানতে নিয়ে এল। ইলেকট্রিক পােস্টে বেঁধে লােক দুটো এপার-ওধার তাকাচ্ছে। মুচকি হেসে গেল এক পিয়ােন। খাটিয়ায় শােয়া লােকটা উঠে বসেছে। উরু থাবড়ে চা-ওয়ালাকে ডাকল। সামনের বারান্দায় ঘোমটা দিয়ে এক বউ এসে দাঁড়াল।

শালা যা গরম পড়ছে! না যায় ঘরে বসে থাকা, না যায় বাইরে বেরােনাে।

লুঙ্গির কষি আটতে আটতে দোকানি বেরিয়ে এল। গােটা চোখ বুজে জাবর কাটছে।

উধার দেখাে। গলিকা ভিতর এক ঠো হ্যায়।

দোকানি হাত তুলে কাছের গলিটা দেখিয়ে দিল। দুটো লােকের একজন সেইদিকে গেল। একটা মাছি বসেছে গােরুটার পিঠে। থরথরিয়ে চামড়া কাঁপাল। উঠে দাঁড়াল দীপু। হনহন কার খানিকটা গিয়ে পিছু ফিরে তাকাল। কমলা সঙ্গে আসেনি।

কী জন্য দাঁড়িয়ে আছ? চলে আসছ না কেন?

কাছে এসে কমলা বলল, তুই হঠাৎ এমনভাবে হাঁটতে শুরু করে দিলি যে?

কথা না বলে দীপু হাঁটতে লাগল। ঘাড়টা নামানাে। হাত দুটো আড়ষ্ট। মুখ দেখে কিছু বােঝা যায় না।

পা জ্বলছে। জ্বলুক। ওকথা বললেই বিপদ। ছেলে হয়তাে আবার বলবে ছায়ায় দাঁড়াই। তাহলে বাড়ি পৌঁছােনাে যাবে না। কিংবা হয়তাে চটিটা খুলে দেবে। তার চেয়ে এই ভালো। ওকে কষ্টের কথা জানতে না দিলেই হল। এখন অনেক রাস্তা হাঁটতে হবে। দীপু একটু আস্তে চ।

দীপু দাঁড়াল। কমলা পাশে আসতেই বলল, ওটাকে আমার কাছে দাও।

না রে বড় নরম, পারবি না।

খুব পারব।

বাচ্চাকে দীপুর হাতে তুলে দিল কমলা। আস্তে আস্তে পা ফেলে চলতে লাগল দীপু।

হ্যাঁ রে, তাের মনে আছে বাচ্চুকে একবার ফেলে দিয়েছিলি?

জবাব দিল না দীপু। কথা বলতে গেলে রাস্তা দেখে চলা যায় না ঠিকমতাে। ঠোক্কর খেয়ে পড়লে বাচ্চাটা বাঁচবে না।

ঘ্যানঘ্যান করতিস বােনকে কোলে নেব বলে। একদিন দিলুম কোলে তুলে। ওমমা! দেয়ামাত্তরই যেই দাঁড়াতে গেলি আর টলে পড়ে একশা কান্ড।

শালা খচরা কোথাকার।

ইটটাকে লাথি মেরে দীপু ফুটপাথ থেকে রাস্তায় পাঠাল। হাতের পুঁটলিটা দুলিয়ে কমলা একটা খুকির মতাে হাসল। পায়ের তলার জ্বলুনিটা সয়ে এসেছে। রাস্তার সবটাই তাে আর তেতে নেই। মাঝে মাঝে ছায়া আছে, জল আছে, মার্টিও আছে।

আচ্ছা বল তাে, এখন যদি তাের বাবার সঙ্গে দেখা হয়, কিংবা দারােয়ানটা এসে যদি বকশিশের ভাগ দিয়ে যায়। তাহলে টাসকি করে বাড়ি যাওয়া যায় না রে?

দীপুর দিকে আড়ে তাকিয়ে কমলা কুট করে বিস্কুট কামড়াল। তারপর আবার খুকির মতাে হাসল।

শবাগার

মুকুন্দ খবরকাগজের প্রথম পাতায় চারটি মৃত্যুসংবাদ দেখল, বাসিমুখেই। দুজন বিদেশি মন্ত্রী, একজন বাঙালি ডাক্তার ও কেরলের জনৈক এমপি। চার জনই করোনারি থ্রম্বোসিস-এ। ওদের বয়স ৭২, ৫৫, ৫৮ ও ৫৬। মুকুন্দর বয়স ৫১, কিন্তু সে ব্যাঙ্কের প্রবীণ কেরানি। থাকে পৈতৃক বাড়িতে, ছোটো সংসার, এক তলা ভাড়া-দেওয়া।

দোতলার রান্নাঘর ও কলঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সে চিন্তিত স্বরে লীলাবতীকে উদ্দেশ করে বলল, থ্রম্বোসিস-এ আজকাল খুব মরছে।

লীলাবতী চা তৈরিতে ব্যস্ত। বলল, কে আবার মরল?

হাঁ-করে ভিতরের পাটিতে বুরুশ ঘষতে ঘষতে মুকুন্দ বলল, খবরের কাগজে দিয়েছে, চারজন।

থ্রম্বোসিস হয়েই তো ছোটোঠাকুরঝির শ্বশুর আপিস যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে মরে গেল। পাশের লোকটা পর্যন্ত টের পায়নি। কী পাজি রোগ রে বাবা!

এরপর লীলাবতী যা-যা বলবে মুকুন্দর জানা আছে। কী দশাসই চেহারা ছিল, কী দারুণ রগড় করত, কী ভীষণ খাইয়ে ছিল ইত্যাদি। এক-তলার কলঘরের ছিটকিনি খোলার শব্দ হতেই মুকুন্দ বারান্দার ধারে সরে এল। শুকনো শাড়িটা আলগা করে সদ্যস্নাত দেহে জড়িয়ে শিপ্রা বেরোচ্ছে। হাতে গোছা করে ভিজে কাপড়। শীতলপাটির মতো গায়ের চামড়া, দেহটি নধর। লীলাবতী রান্নাঘর থেকে একটানা কথা বলে যাচ্ছে। মিরা স্কুলে যাবার জন্য আয়নার সামনে। মনু তার ঘরে এখনও ঘুমোচ্ছে।

শিপ্রা উঠোনের তারে কাপড় মেলে দিতে দিতে মুকুন্দকে দেখে দ্রুকুটি করেই হাসল। গোড়ালি, মুখ ও দুটি হাত তোলা। চিবুক এবং বগলের কেশ থেকে জল গড়াচ্ছে। হাসতে গিয়েই ভারসাম্যটা টলে গেল সামান্য। তাইতে ওর বুক ও পাছার যৎসামান্য কম্পনটুকু উপভোগ করতে করতে মুকুন্দ মাজনের ফেনা গিলে, চেটো দিয়ে কষ মুছে নিয়ে হেসে লীলাবতীকে বলল, এর থেকেও পাজি রোগ ক্যানসার। নীচের ভাড়াটে শিপ্রার স্বামী গৌরাঙ্গকে দিন কুড়ি আগে জবাব দিয়ে ক্যানসার হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন দিন গুনছে। লীলাবতী গলা নামিয়ে বলল, যা অবস্থা দেখলুম, মনে হচ্ছে এ মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। বউ-মেয়ের যে কী দশা হবে এরপর! মনুকে তুলে দাও তো, চা হয়ে গেছে।

মনুকে ডাকতে গিয়ে মুকুন্দ দরজার কাছে থমকে গেল। কাত হয়ে খাটে ঘুমোচ্ছ, লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে উঠে রয়েছে। বাইশ বছরের ছেলে, কলেজে পড়ে। ঈষৎ গম্ভীর প্রকৃতির। বাপের সঙ্গে কম কথা বলে। মুকুন্দ সন্তর্পণে লুঙ্গিটা নামিয়ে মনুর কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ওঠ, চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে কলঘরে মুখ ধুতে যাবার সময় মুকুন্দ দেখল, মেয়ের ফ্রকটা তারে মেলবার জন্য শিপ্রা ছুড়ে দিল এবং পড়ে গেল উঠোনের মেঝেয়। মুকুন্দর মনে পড়ল, তারটা এত উঁচু করে বেঁধেছিল গৌরাঙ্গই। ও খুব লম্বা। তখন ওর ক্যানসার ধরেনি।

দোতলা থেকে সিঁড়িটা এক-তলায় এসে ঠেকেছে শিপ্রাদের দরজার পাশেই। ডান দিকে ঘুরে গেছে হাত-পনেরোর একটা গলি সদর দরজা পর্যন্ত, বাঁ-দিকে উঠোন ও শিপ্রার রান্নাঘর। মুকুন্দ বাজারের থলি হাতে নীচে নামতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আজ কিন্তু রেশন তোলার শেষ দিন, নইলে হপ্তাটা পচে যাবে।

অফিস যাবার সময় দেব। বলেই মুকুন্দ ওর পাছায় হাত রাখল।

ধ্যাত। শিপ্রা ফাজিল হেসে ছিটকে সরে গেল।

সদর দরজার গায়েই শিপ্রাদের ঘরের জানলা। মুকুন্দ এক বার তাকাল। গৌরাঙ্গ বুকের ওপর হাত রেখে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে। বাজার থেকে ফেরার সময়ও সে তাকাল। গৌরাঙ্গ জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে, চোখ দুটো কঠিন বরফের মতো ঝকঝকে। যেন শীতল ক্রোধ জমাট বেঁধে রয়েছে। অফিসে যাবার সময় মুকুন্দ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নামল। শিপ্রা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ঘরের দরজাটা ভেজানো। মুকুন্দর হাত থেকে দশ টাকার নোটটা নেওয়ামাত্রই শিপ্রাকে সে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেতে যাবে, কিন্তু শিপ্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিছন ফিরে তাকিয়েই তার বুকের মধ্যে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণ ঘটল। মনু সদর দরজার কাছে। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। মুকুন্দর শরীরের মধ্যে তখন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে মাথায় উঠছে, হাড় থেকে মাংস খুলে খুলে পড়ছে।

শিপ্রা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মনু মাথা নীচু করে মুকুন্দর পাশ দিয়েই উপরে উঠে গেল। সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মুকুন্দ অসহায় বোধ করে অবশেষে শিপ্রার ঘরের জানলায় তাকাল। গৌরাঙ্গর চুল ধরে বাচ্চামেয়েটি টানাটানি করছে। গৌরাঙ্গর চোখ থেকে জল গড়িয়ে ঠোঁটের কোল ঘুরে চোয়ালে পৌঁছে টলটলে একটা বিন্দু হয়ে রয়েছে।

বাসে প্রচন্ড চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মুকুন্দর মনে পড়ল, জয়ার শ্বশুর বাসের মধ্যে থ্রম্বোসিসে মরে গেছল। তারপর মনে হল, মনু কি আমায় ঘেন্না করবে?

আজ সকালে আমাদের পাড়ার মধ্যে একটা খুন হয়েছে। মুকুন্দর পিছনে কে একজন কাকে বলল, পাইপগান দিয়ে মেরেছে। বছর আঠারো বয়স হবে।

রাস্তাতেই?

তবে না তো কোথায়? বাড়ি থেকে বার করে রাস্তা-ভরতি লোকের সামনেই।

কেউ কিছু করল না?

পাগল! করতে গিয়ে কে প্রাণ খোয়াবে?

পুলিশ?

এসে বডিটা নিয়ে গেল।

অ্যারেস্ট করেনি তো কাউকে? যা পেটান পেটাচ্ছে তাতে নাকি চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে?

বাসের লোকেরা এরপর পেটানোর নানান বীভৎস পদ্ধতির আলোচনা শুরু করল। মুকুন্দ তখন ভাবতে লাগল, আরও পনেরো-কুড়ি বছর যদি বাঁচি, তাহলে মনুকে নিয়েই তো বাঁচতে হবে। কিন্তু কী করে বাঁচব যদি ও ঘেন্না করে?

অফিসের লিফটে পাঁচ তলায় ওঠার সময় সে ভাবতে লাগল, মনু কি ওর মাকে ব্যাপারটা বলে দেবে? একেবারে ছেলেমানুষ নয়, সিরিয়াস ধরনের। হয়তো লজ্জায় নাও বলতে পারে। এই সময় মুকুন্দ শুনল, তার সামনের লোকটি পাশের জনকে বলছে, না ভাই, শরীর খারাপ নয়। ভাগনাটা পরশু মার্ডার হয়েছে, এখনও লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। মনটা তাই.. লিফট চার-তলায় থামতেই ওরা দুজন বেরিয়ে গেল।

চেয়ারে বসামাত্র পাশের টেবিলের অজিত ধর মাথা হেলিয়ে বলল, মুকুন্দদা আজকের কাগজ দেখেছেন? চার-চারটে থ্রম্বোসিস ডেথ ফ্রন্ট পেজেই। সবাই অ্যাবাভ ফিফটি।

আমার ফিফটি ওয়ান। মুকুন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল টেবিলের ফাটল থেকে উঠে আসা ছারপোকাটার দিকে, এবং সেটা একটা ফাইলের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার পর আবার বলল, আমার একান্ন শুরু হয়েছে।

এবার সাবধান হোন। স্নেহ-জাতীয় জিনিস খাওয়া কমান আর লাইট ধরনের কিছু ব্যায়াম

করুন।

অজিত ধরের স্বাস্থ্যটি চমৎকার। বছর পনেরো আগে ওয়েটলিফটিং-এ স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফেদারওয়েটে। বিয়ে করেনি। এখন তবলা শিখছে। মুকুন্দ ড্রয়ার থেকে দোয়াত বার করে কলমের ক্যাপ খুলতে খুলতে বলল, তোমার এসব হবে না।

কী করে জানলেন?

যারা হ্যাপি যাদের উদবেগ নেই তাদের হয় না। থ্রম্বোসিসে ক-টা মেয়েমানুষ মরেছে?

কিন্তু আমি মেয়েমানুষ নই। অজিত ধর গম্ভীর হয়ে মুখ ফেরাল। মুকুন্দর মনে পড়ল জয়ার শ্বশুরকে পাঁচ দিন পর মর্গে পাওয়া যায়, পচ ধরে বীভৎস দেখাচ্ছিল, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বেরিয়ে এসেই জয়ার ভাশুর বমি করে ফেলে। আইডেন্টিফাই করার মতো কোনোকিছু সঙ্গে থাকলে ভদ্রলোক তার ছেলেকে বমি করাত না।

এবার মুকুন্দ কৌতূহলবশতই ভাবল, বাসে আজ যদি থ্রম্বোসিসে মারা যেতাম, তাহলে আমার লাশটার কী হত? বাসটা নিশ্চয় থেমে যাবে। কেউ বলবে হাসপাতালে, কেউ বলবে থানায় বাসটাকে নিয়ে চলো। তার মধ্যে সেই লোকটা যে বলেছিল, পাগল! করতে গিয়ে কে প্রাণ খোয়াবে? বলবে একদমই যখন মরে গেছে তখন আমাদের অফিস লেট করিয়ে লাভ কী, বরং এখানেই নামিয়ে দিন, পাবলিক কিংবা পুলিশ ব্যবস্থা করে দেবে। শুনে মনে মনে সবাই হাঁফ ছাড়বে, তবে দু-একজন আপত্তি জানিয়ে বলবে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়াটা খুবই নিষ্ঠুর দেখাবে, বরং বাসের একটা সিটে বসে থাকুক। সবাই অফিসে নেমে গেলে তারপর থানায় বা হাসপাতালে পৌঁছে দিলেই হবে। এই কথার পর তর্ক বেঁধে যাবে। তখন ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বাসটা চালিয়ে দেবে। সবাই ড্রাইভারকে তখন, উল্লুক বলবে।

মুকুন্দর মজা লাগছিল এইরকম ভাবতে। কিন্তু সত্যিই যদি থ্রম্বসিসে মারা যেতুম? এই অজিত ধর কি লিফটে উঠতে উঠতে কাউকে বলবে—না মশাই, শরীর আমার ফিট আছে। বারো বছরের কলিগ মুকুন্দ সেন আজ পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ। যা দিনকাল, মার্ডার-টার্ডার হল কি না কে জানে। লোকটা অবশ্য একদিক থেকে ভালোই ছিল, পলিটিক্স করত না তবে মদ-টদ খেত শুনেছি।

আড়চোখে মুকুন্দ তাকাল অজিত ধরের দিকে। শরীর দুর্বল হয়ে যাবে বলে বিয়ে করেনি। শরীর গরম হতে পারে বলে ফুটবল খেলা পর্যন্ত দেখে না। আড়াইটে বাজলেই ড্রয়ার থেকে একটা আপেল বার করে খায়। ওর থ্রম্বোসিস হবে না। ওর ছেলে থাকত যদি, সে বমি করার সুযোগ পাবে না। পকেট হাতড়ে মুকুন্দ কয়েকটা নোট, খুচরো পয়সা আর এলাচের মোড়ক বার করল। এর কোনোটা দিয়েই তাকে আইডেন্টিফাই করা যাবে না। মোড়কটা জনৈক ভোলানাথ গুইয়ের লন্ড্রির বিল। সেটা কুচিয়ে ফেলে মুকুন্দ নিজের নাম-ঠিকানা ইংরেজিতে একটা কাগজে লিখে, বুকপকেটে রেখে স্বস্তি বোধ করল।

অফিস থেকে বেরিয়ে মুকুন্দ শুনল, উত্তর কলকাতায় ট্রাম পুড়েছে তাই ট্রাম বন্ধ। বাস স্টপে গিয়ে দেখল শিশির নামে লিভ সেকশনের নতুন ছেলেটি দাঁড়িয়ে। বছর পঁচিশ বয়স, ফাস্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলে। অফিস টিমে খেলবে বলেই চাকরি পেয়েছে। আঁটসাঁট প্যান্ট, নাভির নীচে বেল্ট, উঁচু গোড়ালির ছুঁচোলো জুতো আর ছিপছিপে শরীর। অফিসের মেয়েরা যে ওর দিকে তাকায় এটা ও জানে। কিন্তু শিশির এখন ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি পরে দাঁড়িয়ে।

ব্যাপার কী? এই বেশে তোমায় ঠিক মানাচ্ছে না ভাই, কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগছে।

শিশিরকে মুহূর্তের জন্য অপ্রতিভ দেখাল। একটি সুঠাম মেয়ে শ্যামবাজারের বাসে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে ধাক্কা দিতে দিতে এগোল এবং হ্যাণ্ডেল ধরে পা রাখামাত্র বাস ছেড়ে দিল। পা-দানির একটি যুবক তৎক্ষণাৎ মেয়েটির পিঠে বাহুর বেড় দিল। শিশির বাসটার থেকে চোখ সরিয়ে তিক্তস্বরে বলল, এখন সব থেকে সেফ বুড়ো হয়ে যাওয়া। আমার পাশের বাড়ির ছেলেটাকে মাস খানেক আগে পুলিশ রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এমন মেরেছে যে হাঁটু দুটো এখনও ভালো করে মুড়তে পারে না। আমি জানি ছেলেটা কোনো গোলমালে নেই। শুধু ডাঁটো বয়সের জন্যই ওর সর্বনাশ হল।

মুকুন্দ চিন্তিত স্বরে বলল, আমার ছেলেও গোলমালে থাকে না, কিন্তু কার সঙ্গে মিশছে তা তো জানি না।

শিশির আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, আমার ভাই কাল বাড়িতে বোমা এনে লুকিয়ে রেখেছিল। জানেন মুকুন্দদা, আমরা খুব গরিব। খেলার জন্যই এই চাকরি। পঙ্গু হয়ে যাই যদি আমায় রাখবে কেন, এখনও তো কনফার্মড হইনি। এই শরীরটাই আমার সব।

মুকুন্দকে আর কিছু বলতে না দিয়ে শিশির প্রায় ছুটেই রাস্তা পার হয়ে ভিড়ে মিশে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুকুন্দও হাটতে শুরু করল। আধ ঘণ্টা হাঁটার পর তার মনে হল রাস্তা ক্রমশ ফাঁকা দেখাচ্ছে, পথচারী কম, গাড়িগুলি জোরে যাচ্ছে, সিআরপি-ভরতি লরি তিন-চার বার চোখে পড়ল, ক্ষীণ বিস্ফোরণের শব্দও শুনতে পেল। মুকুন্দ স্থির করল, গলি ধরে যাওয়াই ভালো।

মিনিট কয়েক পরেই মুকুন্দর গা-ছমছম করতে লাগল। যতই এগোয়, সব কিছু ভূতে পাওয়ার মতো ঠেকছে। বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। চাপা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার ছাদে আবছা মুখের সারি। দূরে দূরে রাস্তার আলো, মাঝেরটা নেভা। দু-ধারের শ্যাওলাধরা, পলেস্তারা খসা, বিবর্ণ দেওয়ালগুলোর মাঝখানে গর্ত, ঢিপি আর আস্তাকুঁড়ভরা রাস্তাটাকে প্রাচীন সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে। নিজের পায়ের শব্দে মুকুন্দর এবার মনে হতে লাগল কেউ পিছু নিয়েছে।

আর একটু এগিয়ে ডান দিকের গলিটা দিয়ে তিন-চার মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছানো যায়। তবু মুকুন্দ আর এগোতে সাহস পেল না। পাশের সরু গলির মধ্যে ঢুকে বড়োরাস্তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আচমকা একটা রাইফেল ও দুটো পিস্তলের মুখোমুখি হয়ে দু-হাত তুলে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কোথায় যাচ্ছেন? সাদা প্যান্ট, হলুদ বুশশার্টপরা লোকটি মুকুন্দর পেটে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করল।

বাড়ি যাচ্ছি স্যার, পাশের বন্ধু সরকার লেনে থাকি।

তাহলে এখানে কেন?

অফিস থেকে ফিরছি। গোলমাল দেখে গলি দিয়ে যাচ্ছিলুম।

পাড়ায় কারা কারা বোমা ছোড়ে?

জানি না স্যার।

না কি বলবেন না?

ইউনিফর্মপরা ভারিক্কি ধরনের যে-লোকটি এতক্ষণ শুধুই মুকুন্দর দিকে তাকিয়েছিল, বলল, নিয়ে গিয়ে দেখাও তো, আইডেন্টিফাই করতে পারে কি না।

মুকুন্দর কোমরে পিস্তলের খোঁচা দিয়ে হলুদ বুশশার্ট বলল, বাঁয়ে।

সে তখুনি বাঁ-দিকে ফিরে, দু-হাত তুলে চলতে শুরু করল। রাস্তার যেখানটায় আলো কম এবং দুটো বাড়ির দেওয়াল দ-এর মতো হয়ে একটা কোণ তৈরি করেছে সেখানে টর্চের আলো ফেলে লোকটি বলল, ওকে চেনেন?

মুকুন্দ দেখল, একটা দেহ উপুড় হয়ে পড়ে, মুখটা পাশে ফেরানো। দু-হাত তোলা অবস্থায় এগিয়ে এসে ঝুঁকে মনু বলে অস্ফুটে কাতরে উঠেই বুঝল, দেখতে অনেকটা মনুর মতোই। চোখের পাতা খোলা, নীল জামাটা ফালা হয়ে পিঠ উন্মুক্ত, কঠিনভাবে আঙুলগুলো মুঠোকরা, ঠোঁট দুটো চেপে রয়েছে, গলায় গভীর ক্ষত। হিঁচড়ে টেনে আনার দাগ প্যান্টে। গলা থেকে চোয়ানো রক্ত থকথকে হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

এর নাম মনু?

না না, আমার ছেলের নাম মনু। একে অনেকটা তার মতো দেখতে। একে আমি একদম চিনি না স্যার।

কখনো একে দেখেননি? ভালো করে দেখে বলুন।

মুকুন্দ আবার ঝুঁকে পড়ল। গোড়ালি থেকে মাথার প্রান্ত জমাটবাঁধা আগ্নেয়গিরি লাভার একটা ঢেউ-খেলানো খন্ডের মতো। এই খন্ডটাই উত্তপ্তকালে ওর সর্বস্ব ছিল। ওর যন্ত্রণা, বিস্ময় আর দাপট। এখন ভোলা চোখ দুটি থেকে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নির্গত হচ্ছে না।

মাথা নেড়ে মুকুন্দ বলল, না, একে কখনো দেখিনি।

আচ্ছা চলে যান, এধার-ওধার করবেন না।

কিছুদূর গিয়ে মুকুন্দ ফিরে তাকাল। বুশশার্ট তাকে লক্ষ করছে। লাশটা এখন অন্ধকারে। মুকুন্দ মনে মনে বলল, আর একটা আনআইডেন্টিফায়েড ডেডবডি। তারপর বুকপকেটে হাত দিয়ে স্বস্তি বোধ করল। এবার গলিটা আর একটা গলিকে কেটে সোজা মুকুন্দর পাড়ায় ঢুকে গেছে। মোড়টা আধো অন্ধকার। দুটি ছেলে হঠাৎ দেওয়াল কুঁড়েই যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। একজনের হাতে ফুট দুয়েক লম্বা ঝকঝকে ইস্পাত।

কী জিজ্ঞাসা করছিল?

মুকুন্দ চিনতে পারল ছেলেটিকে। মনুর বন্ধু ছিল ছোটোবেলায়। তখন বাড়িতে আসত, নাম তাজু। না-থেমে গঙ্গা পারাপার করে বলে শুনেছে। এখন পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানেই প্রায়-সময় কাটায়। মনু এখন ওর সঙ্গে মেশে না।

কিছুই না। শুধু জানতে চাইল লাশটাকে চিনি কি না।

আমাদের কারুর কথা জিজ্ঞেস করল?

না।

খবরদার, বলবেন না কিছু।

ওরা দুজনে আবার দেওয়ালে সেঁধিয়ে গেল। দুটি স্ত্রীলোককে নিয়ে একটি রিকশা আসছে। একজনকে বিরক্ত স্বরে মুকুন্দ বলতে শুনল–ওম্মা, এইতো যাবার সময় দেখে গেলুম সব ঠাণ্ডা।

জানলায় শিপ্রা দাঁড়িয়েছিল। মুকুন্দকে দেখেই আলো জ্বেলে দরজা খুলে বলল, যা ভাবনা হচ্ছিল।

আমার জন্যে?

তবে না তো কী?

শুনে মুকুন্দর ভালো লাগল প্রথমে। তারপর ভাবল গৌরাঙ্গর জন্য একদম না ভাবাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলল, গৌরাঙ্গ আছে কেমন?

একইরকম। শিপ্রা সাধারণভাবে বলল এবং সহসা গলা নামিয়ে যোগ করল, মনু কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিল। কাউকে বলে দেবে না তো? আমার কিন্তু বড় ভয় করছে।

বড়ো হয়েছে। মনে হয় না বলবে।

মুকুন্দ তাড়াতাড়ি উপরে উঠে গেল। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ। মিরা ও লীলাবতী সিঁটিয়ে বসে রয়েছে। তাকে দেখে ওরা হাঁফ ছাড়ল।

মিরা বলল, জান কী কান্ড হয়েছে? একটা ছেলের গলা কেটে ফেলে রেখে গেছে খুদিরাম বসাক স্ট্রিটে!

মনু পাশের ঘর থেকে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, গোলমালের সময় অতুল বোস লেন দিয়ে না ঢুকে শেতলাতলার গলিটা দিয়ে আসাই সেফ।

ওর কথা শুনতে শুনতে মুকুন্দর মনে হল, মনু তাহলে এতক্ষণ উদবেগের মধ্যে ছিল। ছেলেটা আমার জন্য ভাবে, হয়তো বমি করবে না।

পরদিন অফিসে বেলা বারোটা নাগাদ মুকুন্দকে একজন টেলিফোনে উত্তেজিত স্বরে বলল, আপনার ছেলে মানবেন্দ্র সেনকে পুলিশ রাস্তা থেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।

কী বলছেন! মনুকে? মুকুন্দ চিৎকার করে উঠল। আপনি কী করে জানলেন?

আমার ভাইকেও ধরেছে। থানায় গেছলুম। আমাকে নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে আপনার ছেলে জানিয়ে দিতে বলল। এখুনি থানায় গিয়ে চেষ্টা করুন ছাড়াতে পারেন কি না।

ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ পেল মুকুন্দ। তারপরই ওর চোখ-কান দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকতে লাগল। কিছুক্ষণ সে কিছুই দেখতে পেল না, শুনতে পেল না। তারপর কাতর স্বরে অজিত ধরকে বলল, এইমাত্র একজন খবর দিল, ছেলেটাকে পুলিশে ধরেছে রাস্তা থেকে। কিন্তু মনু তো ওসব করে না, অত্যন্ত ভালো ছেলে। এখন কী করি বলো তো?

দেরি করবেন না, এখুনি থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করুন। কেস লিখিয়ে ফেললে আর উপায় নেই, চালান করে দেবে। শুনেছি প্রচন্ড মার দিচ্ছে থানায়।

তোমার কেউ চেনাশোনো থানায় আছে? অন্তত যাকে বললে মারধর করবে না। মনুর ভীষণ দুর্বল শরীর।

অজিত ধর মাথা নাড়ল।

তুমি যাবে আমার সঙ্গে থানায়?

সাড়ে তিনশো লোকের স্যালারি স্টেটমেন্ট তৈরি করছি মুকুন্দদা, চার দিন পরই মাইনে। এখন তো ফেলে রেখে…।

মুকুন্দ পাঁচতলা থেকে নামল সিঁড়ি দিয়ে। ট্যাক্সিতে বার দুয়েক বলল, একটু জোরে চালান ভাই।

থানায় আট-দশটি ছেলের সঙ্গে মনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওসি-কে বলল, আমার ছেলে কোনোকিছুর মধ্যে থাকে না স্যার, ওকে ভুল করে এনেছেন।

কোনটি আপনার ছেলে? গম্ভীর এবং যেন ক্লান্ত, এমন স্বরে ওসি বলল।

মুকুন্দ আঙুল তুলে দেখাবার সময় মনুর পাশে দাঁড়ানো হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটিকে কনুই তুলে খুব মন দিয়ে বাহুর থ্যাঁতলানো জায়গাটা পরীক্ষা করতে দেখল। মনুর দিকে তাকিয়ে ওসি বলল, সব বাপ-মা এসেই বলে, তাদের ছেলে নিরপরাধ। যদি নিরপরাধ হয়, তাহলে ছাড়া পাবে। আগে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি।

কখন ছাড়বেন তাহলে?

ওসি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, মনু হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে বলল, আমি কিছু করিনি। স্যার আমি কিছুই জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি শুধু কলেজে যাচ্ছিলুম। খাতা ছাড়া হাতে আর কিছু ছিল না।

চুপ করো। কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠল ওসি-র পাশে দাঁড়ানো ধুতিপরা লোকটি। থতোমতো হয়ে মনু তাকাল মুকুন্দর দিকে। দুটি ছেলে পাংশুমুখে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। লোকটি ধমকে আবার বলল, তাজু তোমার পাড়ার ছেলে আর তাকে তুমি চেন না?

মুকুন্দ ব্যস্ত হয়ে বলল, আমার ছেলে ওর সঙ্গে মেশে না স্যার।

বাজে কথা। আমাদের কাছে খবর আছে আপনার ছেলে ওর বন্ধু। তাজুকে কোথায় পাওয়া যাবে, দলে আর কে কে আছে বলুক, আপনার ছেলেকে ছেড়ে দোব।

মুকুন্দ দেখল মনু ঠকঠক করে কাঁপছে। ওকে এত ভয় পেতে দেখে সেও কাতর হয়ে পড়ল। চোখের জল মনুর ঠোঁটের কোল ঘুরে চোয়ালে পৌঁছে টলটল করছে। মুকুন্দের চোখ বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে এল। আবছাভাবে গৌরাঙ্গর মুখটা ফুটে উঠল তার মনে। কাল সকালে এইরকম একটা বিন্দু টলটল করছিল ওর থুতনির কাছে। মেয়েটা তখন চুল ধরে টানছিল। কিন্তু মনুর তো ক্যানসার হয়নি! মুকুন্দ বিষগ্নচোখে তাকিয়ে রইল মনুর দিকে। শুধু কি শরীরের জন্যই ওর এই কান্না। রাস্তায় কাল বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল যে-ছেলেটি, সেও কি শরীটাকে ভালোবাসত না!

ওসি ঘরের একধারে গিয়ে লোকটির সঙ্গে চাপাস্বরে মিনিট দুয়েক কথা বলে ফিরে এল। আপনি এখন যান, সন্ধের দিকে এসে খোঁজ নেবেন।

বিশ্বাস করুন স্যার, আমার ছেলে জীবনে কখনো পলিটিকস করেনি। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন। মুকুন্দ ঝুঁকে ওসি-র হাঁটুতে হাত রাখল। হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে ওসি বলল, আচ্ছা, ঘণ্টা দু-তিন পরেই আসুন, নিরাপরাধ হলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব।

বেরিয়ে এসে মুকুন্দ ঠিক করতে পারল না এবার কী করবে। থানার সামনেই একটা বাড়ির রকে বসে পড়ল। এখন অফিসে ফেরা আর এখানে বসে থাকা একই ব্যাপার। লীলাবতীর কান্নাকাটির থেকেও ভালো। বসে থাকতে থাকতে সে অবসন্ন বোধ করতে শুরু করল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে রইল থানার ফটকে। ক্লান্ত মস্তিষ্কে এলোপাথাড়ি নানান বীভৎস দৃশ্য এখন সে দেখতে পাচ্ছে, অদ্ভুত করুণ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। প্রত্যেকটাই স্নায়ুবিদারক।

ছটফট করে মুকুন্দ উঠে পড়ল। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বার বার সে শিপ্রার দেহে, নানাবিধ অশ্লীল শব্দে এবং থ্রম্বোসিসে নিজেকে আবদ্ধ করে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হল না। সব কিছু ছাপিয়ে মনুর কান্নাটা তাকে পেয়ে বসছে। ঘণ্টা খানেক পরে সে আবার থানার সামনে ফিরে এল এবং রকে বসতে গিয়েই দেখল মনু মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসছে।

মনু। তীক্ষ্ণস্বরে মুকুন্দ ডাকল। মনু মুখ তুলে তাকাল। মুকুন্দ ছুটে গিয়ে প্রথমেই তন্নতন্ন করে ওর আপাদমস্তক দেখল। তারপর হেসে বলল, ছেড়ে দিল।

মাথা নেড়ে মনু ফিকে হাসল।

মারধর করেনি?

হাতটা মুচড়ে দিয়েছিল ধরার সময়।

ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে, হাঁটতে হাঁটতে মুকুন্দ বলল, অনেকক্ষণ খাসনি, আয় এই দোকানটায়।

আমার খিদে নেই।

ধরল কেন তোকে?

যে-ছেলেগুলোকে থানায় দেখলে, ওরা একটা স্কুলে ভাঙচুর করে বোমা ফাটিয়ে এসে আমার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ প্লেন-ড্রেস পুলিশ ঘিরে ধরে মারতে মারতে ওদের সঙ্গে আমাকেও ভ্যানে তুলল।

তুই যদি বুড়োমানুষ হতিস তাহলে ধরত না।

মনু জবাব দিল না। মিনিট খানেক পর মুকুন্দ বলল, অফিসে ফোন পেয়েই সোজা থানায় এসেছি। বাড়ির কেউ জানে না, তুই বাড়িতে এ সম্পর্কে কিছু বলিস না, তাহলেই তোর মা কান্না জুড়ে দেবে।

ঘাড় ফিরিয়ে মনু তাকাল ওর দিকে। চোখ দুটো দেখে মুকুন্দর বুকের মধ্যে ক্ষীণ একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে দিয়ে সে গৌরাঙ্গর চোখ দুটি দেখতে পেল। ঠিক এই চাহনিতেই সে চিত হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়েছিল। মুকুন্দর আবার মনে হল, মনুর কেন ক্যানসার হবে!

তোকে আর কিছু কি জিজ্ঞাসা করেছে?

চমকে উঠে মনু ক্রু কুঁচকে অস্বাভাবিক স্বরে বলল, কী জিজ্ঞাসা করবে?

যা জানতে চাইছিল?

কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। মনু দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি এখন বাড়ি যাব না, তুমি কি বাড়ি যাবে?

আমি, মুকুন্দ দু-ধারে তাকিয়ে নিয়ে বলল, দেখি কোথাও গিয়ে সময় কাটাতে পারি কি না।

মনু ভিড়ে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত মুকুন্দ তাকিয়ে রইল। তারপর স্থির করল, ও ক্লাস নাইনে ওঠার পর আর মাতাল হইনি, আজ হব।

রাত প্রায় বারোটায় মুকুন্দ বাড়ি ফিরল। কড়া নাড়ার আগেই সদর দরজা খুলে গেল। অন্ধকারে শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই চাপাস্বরে মনু বলল, এখন এত রাত করে বাড়ি ফিরো না।

মুকুন্দ অন্ধকারের মধ্যে মনুর মুখটা দুই করতলে এক বার চেপে ধরে কথা না বলে দোতলায় উঠে গেল।

সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙল তার। চা খেতে খেতে মনুর খোঁজ করল। দুটি ছেলে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে শুনেই চায়ের কাপ রেখে তাড়াতাড়ি মুকুন্দ রাস্তায় বেরিয়ে এসে মনুকে দেখতে পেল না। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল তার, শিপ্রাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, কারা ডাকতে এসেছিল?

এক জনকে দেখেছি, রোগাপানা, ফর্সা, মনুরই বয়সি।

হাতে কিছু ছিল?

কেন? ভীতস্বরে শিপ্রা বলল।

ধমকে উঠল মুকুন্দ, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।

অতশত দেখিনি।

মুকুন্দ এবার ছুটে বেরোল। পরিচিতদের কাছে খোঁজ নিতে নিতে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছোল। সেখান থেকে দু-তিনটে গলি ঘুরে গলাকাটা লাশটা যেখানে পড়েছিল সেখানে হাজির হল। এইসময় তার বুকফাটা কান্না পেল। বাড়ি ফিরতেই শিপ্রা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, মনু তো অনেকক্ষণ ফিরেছে।

একটা করে সিঁড়ি টপকে মুকুন্দ দোতলায় এল। মনু তার ঘরে চেয়ারে বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে। মুকুন্দ ঘরে ঢুকেই বলল, কেন ওরা এসেছিল?

কারা। মনু স্থির চোখে মুকুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চাহনিটা তুলে নিয়ে আবার জানলার বাইরে রাখল।

ওরা কি জেনেছে? ব্যগ্র স্বরে মুকুন্দ বলল।

কী জানবে? মনু এবার তীব্র চোখে তাকাল।

মুকুন্দ ফিসফিস করে বলল, আমি জানি রে, আমি জানি।

কী জান তুমি?

তোকে ভয় পেতে দেখেছিলুম।

কীসের ভয়?

শরীরটার জন্য ভয়।

তুমি পাও না? প্রশ্নটা করার জন্যই যেন নিজের উপর অভিমানে মনুর বসার ভঙ্গি কঠিন হয়ে গেল।

হ্যাঁ পাই। মুকুন্দ কোমল কণ্ঠে বলল, আমি তোকে দোষ দিচ্ছি না রে। যদি বলতে না চাস তো বলিস না। কিন্তু তুই আমার ছেলে, তোর জন্য আমি ভয় পাচ্ছি। সব বাবাই পায়। এটা কাপুরুষতা নয়।

তোমার ভয়টা ছেলের প্রাণের জন্য, তাই সেটা কাপুরুষতা নয়। মনু যান্ত্রিক স্বরে যেন মুখস্থ বলল।

এভাবে কথাটা নিচ্ছিস কেন! মুকুন্দ বিব্রত হয়ে বলল, আমাকে ঘেন্না করার নিশ্চয় অন্য কারণ আছে কিন্তু এজন্য করিসনি।

তুমি কি আমায় ঘেন্না করছ, আমি যা করেছি?

মোটেই না। আমি চিরকাল তোকে ভালোবাসব।

কিন্তু আমি নিজেকে ঘেন্না করছি। থানায় তুমি অমন করে আমার দিকে তাকালে, মনে হল আমি একটা মরামানুষ। কীরকম যেন ভয় করল আমার। নয়তো একটা কথাও বলতাম না, কিছুতেই না। মনু উঠে দাঁড়াল। টেবিলের বইগুলো অযথা ওলটপালট করতে করতে মমাচড়ানো স্বরে বলল, তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। তুমি আমায় করাপ্ট করেছ।

মনু এক বার শুধু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। মুকুন্দ তখন প্রত্যাশামতো নিশ্চিতরূপে দেখতে পেল, কঠিন বরফের মতো ঝকঝকে ওর চোখ দুটি। যেন শীতল ক্রোধে জমাট বেঁধে রয়েছে।

মুকুন্দর অফিসে যাবার সময় শিপ্রা দাঁড়িয়েছিল তার ঘরের দরজায়। সে হাসল। মুকুন্দ ক্ষেপ করল না। গলির মোড়ে লাল ডোরাকাটা জামা গায়ে তাজু দাঁড়িয়ে। মুকুন্দ তাকাল। বাস মাঝপথে বিকল হয়ে থেমে গেল। মুকুন্দ কণ্ডাক্টরের কাছ থেকে ভাড়ার পয়সা ফেরত নিল না। অফিসে অজিত ধরের প্রশ্নের উত্তরে জানাল, খবরটা ভুল। মনুকে ধরেনি। ছুটির পর ট্রাম থেকে নেমে মিনিট তিনেক হেঁটে বাড়ি। নামমাত্র দেখল জটলা করে লোকেরা ভীতচোখে তার পাড়ার দিকে তাকিয়ে বলাবলি করছে। একজন তাকে বলল, ওদিকে যাবেন না মশাই। এইমাত্র পর পর চারটে গুলির শব্দ হল। মুকুন্দ সেকথায় কান দিল না। একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে। সেটাকে ঘুরে পার হয়েই সে থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপর মাথা নামিয়ে গলিতে ঢুকল। তার পাশ দিয়ে দুটো লোক পিস্তল রাইফেল পরিবৃত একটা লাল ডোরাকাটা নিথরদেহ বহন করে নিয়ে গেল। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। মুকুন্দ পিছন ফিরে তাকাল না। থমথমে গলির দু-পাশে ভীত, বিস্মিত এবং অব্যক্ত চাহনি ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সে বাড়িতে ঢুকল।

মনু তার ঘরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে। মুকুন্দ দরজার কাছ থেকে বলল, তাজুকে পুলিশ নিয়ে গেল। বোধ হয় বেঁচে নেই।

লীলাবতী ও মিরা ছুটে এল বিবরণ শোনার জন্য। মুকুন্দ তখন কলঘরে ঢুকল। হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দে সে ঘাড় ঘোরাতেই দেখল মনু ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে কলঘরের দিকেই আসছে। কী হল! বলে মুকুন্দ দ্রুত গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। মনু তখন হড়হড় করে মুকুন্দর গায়ে বমি করল।

মধ্যরাত্রে মুকুন্দ নীচে নেমে এসে শিপ্রার ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে যেতেই সে ঘরে ঢুকে শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরল।

একী, একী! ঘরের মধ্যে নয়। ও রয়েছে যে!

থাকুক গে। শিপ্রাকে মেঝেতে শোয়াতে শোয়াতে মুকুন্দ বলল, ও তো মরে যাচ্ছেই, তাহলে আবার ভয় কীসের।

সুখীজীবন লাভের উপায়

ক-দিন খটাং খটাং করে অবশেষে পাখাটা মাঝরাতে বন্ধ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণটা বুঝে সুধীন খিঁচিয়ে উঠল, মনে করে একটা পাখা মিস্ত্রিও ডাকতে পারনি? সারারাত এখন ছটফট করি!

মিস্ত্রি কি আমি গিয়ে ডেকে আনব? পাঁচ দিন আগে বলেছি পাখাটা কীরকম বিদঘুটে শব্দ করছে, এক বার দ্যাখো। যতটা চাপা স্বরে নিঝুম রাতে ঝাঁঝ দেখানো যায়, সুধা দেখাল।

খোকাকে দিয়েও তো ডাকাতে পারতে, না সেটাও আমার জন্য তুলে রেখেছ! বিড়বিড় করতে করতে সুধীন মেঝেয় নেমে শুল। হুল ফুটিয়ে পাশের ঘরের টেবল পাখাটা বোলতার মতো শব্দ করে যাচ্ছে। ওটাকে নিয়ে এলে খোকার কষ্ট হবে এই ভেবে সুধা রান্নাঘর থেকে হাতপাখা এনে সুধীনকে বাতাস শুরু করল। বাইরে ফটফটে জ্যোৎস্না, সুধার মনে হল এর বদলে হু-হু হাওয়া দিলে দুর্ভোগ কত কমে যেত।

সকালে বাজার থেকে ফিরে সুধীন বলল, ইলেকট্রিক দোকানটা এখনও খোলেনি, কলেজ যাবার আগে খোকা যেন অবশ্যই মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসে।

ওরা দুজন বেরিয়ে গেলে সুধার আর কিছু করার থাকে না। খাওয়া সেরে দিন রাতের ঝি বন্ধুর মা দুপুরটা মেয়ের বাড়ি কাটাতে যায়। সুধা দরজা-জানলা বন্ধ করে পাখা চালিয়ে মেঝেয় শুয়ে থাকে, আজ শুয়েছে খোকার ঘরে। ঘুমটা সবে জমে উঠছে, তখনই কড়া নাড়ার শব্দ হল।

দরজা খুলে দেখল শীর্ণদেহ আধবুড়ো একটা লোক, পরনে খাকি ট্রাউজার্স আর নীল হাওয়াই শার্ট—দুটোই ময়লা। কানের পিছন দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। জামায় ঘাম মুছে বলল, পাখা খারাপ হয়েছে বলে কি দোকানে খবর দিয়েছিলেন?

আমার ছেলে দিয়ে এসেছে, আসুন। মিস্ত্রিকে ঘরে নিয়ে এল সুধা। গায়ে ব্লাউজ না থাকায় খুব অস্বস্তি হচ্ছে, তবে লোকটা মিস্ত্রি আর ছেলেছোকরা নয়, সুতরাং আঁচলটা শুধু এপার-ওপার টেনে দিল।

মিস্ত্রি সুইচ টিপল, পাখা ঘুরল না। সেলাই কলের টুলটা টেনে নিয়ে বলল, একটা চেয়ারও লাগবে।

খোকার ঘর থেকে নিজেই চেয়ার আনবে কি না ভেবে সুধা ইতস্তত করল। এসব কাজ তো মিস্ত্রিদেরই করার কথা।

পাশের ঘরে আছে।

সুধা সঙ্গে করে মিস্ত্রিকে নিয়ে এল। খোকা কলমটলম ফেলে যায় টেবলে। চেয়ার এনে তার উপর টুলটা রাখল। রাখার জায়গা নেই বললেই হয়। একচুল সরে গেলেই টুলটা পড়ে যাবে। সুধা অবাক হয়ে গেল, অদ্ভুত কায়দায় মিস্ত্রিকে উপরে উঠতে দেখে। তাড়াতাড়ি সে টুলটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরল। মিস্ত্রি পাখার ব্লেড খুলতে খুলতে বলল, আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনি ছেড়ে দিন।

তবু যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়!

সুধার ভয় হল, তাহলেই তো পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করবে। অবশ্য অ্যাকসিডেন্ট মানেই অনিচ্ছাকৃত, তাতে দোষ নেই। মিস্ত্রি পাখার ব্লেডগুলো খোলে আর সুধা সেগুলো নিয়ে মেঝেয় রাখে, তারপর সিলিং-এর আংটা থেকে হাঁড়িটা চাড় দিয়ে তুলে খুলল। কাঁধে রাখল, সিধে অবস্থায় উবু হয়ে বসল, একটা পা সাবধানে টুলের নীচে চেয়ারে রাখল, তারপর অন্য পা। মেঝেয় নামল টুক করে লাফিয়ে। সুধা সারাক্ষণ টুল আঁকড়ে রইল।

পাখার হাঁড়িটা দেখে সুধার মনে হল—ব্লেডসমেত যখন ঘোরে তখন বোঝা যায় না, কিন্তু এখন দেখাচ্ছে ঠিক সুধীনের মুন্ডু। দুটো চোখ, একটু গোঁফ, টাক মাথা। শুধু যা টিকিটাই সুধীনের নেই। এটা ওরই কেনা, খোকা হবার দু-মাস পর। মিস্ত্রি স্ক্রগুলো খুলে মুভুর খুলিটা ফাঁক করল। বাসি রক্তের মতো চিটটিটে কালো তেল, ভুসি ইত্যাদি। সুধীনের মাথার মধ্যেটাও এরকম কি না-এই ধরনের একটা সন্দেহ সুধার মনে দেখা দেওয়ার উপক্রম করতে-না-করতেই মিস্ত্রি বলল, এখানে সারানো যাবে না, নিয়ে যেতে হবে।

কেন!

কম্যুটেটারের মাইকা গেছে। বলে মিস্ত্রি একটা জায়গা দেখাল, সুধার যেটাকে দাঁতের পাটি মনে হল।

ক-দিন লাগবে?

চার-পাঁচ দিন। মিস্ত্রি খুলিটাতে স্ক্রু আঁটতে আঁটতে বলল।

এই গরমে অ্যাদ্দিন পাখা ছাড়া। তাহলে তো মরেই যাব।

মিস্ত্রি হাসল, খুব গূঢ় ধরনের। শিশুরা আপন মনে যেভাবে হাসে বা শিশুদের হাসি দেখে

বয়স্করা।

হাতে এখন প্রচুর কাজ। পাঁচ দিনেও হয় কি না কে জানে।

কত লাগবে?

আঠারো টাকা।

বলল যেন হিসাব কষে, কিন্তু সুধার মনে হল, আগেই যেন ঠিক করে রেখেছিল। তবে পাখা হাতছাড়া করা চলবে না। লোকটা চোরছ্যাঁচড় কি না কে জানে। মিস্ত্রি সেজে এরকম তো অনেকেই আসে। তা ছাড়া আঠারো টাকার মতো ব্যাপার, সুধীনকে না জানিয়ে কী করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

উনি বরং আসুন, পরে জানাব। দু-দিক রেখে সুধা বলল।

পাখার মুন্ডুটা ঘরের একধারে সরিয়ে চেয়ারটা পাশের ঘরে রেখে মিস্ত্রি বেরিয়ে যাচ্ছে। সুধা সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। দরজাটা পার হয়েই মিস্ত্রি হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাকে প্রথমে চিনতেই পারিনি। বেশ মোটা হয়ে গেছেন। গলার জড়লটা দেখে চিনলাম আপনি প্রফুল্লর বউ।

সুধার একটু সময় লাগল মাথাটা ঘুরে উঠতে। ঝাপসা হয়ে গেল দেয়াল, সিঁড়ি এবং সামনের লোকটি। অস্ফুটে বলল, আপনি কার কথা বলছেন? আপনি কে?

আমার নাম হরিশংকর দাঁ। আপনার বিয়েতে আমি একজন সাক্ষী ছিলুম। এতদিন হয়ে গেল, আমাকে অবশ্য চিনতে না পারারই কথা। কতক্ষণই-বা দেখেছেন। আমি আর বলাই চন্দ সাক্ষী ছিলুম। আপনি ট্যাক্সি করে এলেন, চটপট সই করলুম আমরা। বাড়ি থেকে লুকিয়ে এসেছিলেন তাই তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতেই চলে গেলেন। আমার বউ কাগজে মুড়ে সিঁদুর দিয়েছিল। মনে আছে, আপনার সিঁথিতে একটুখানি লাগিয়ে দিয়েছিলুম তাইতে আপনি খুব ভয় পেলেন!

সুধা একদৃষ্টে হরিশংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখে যে অবিশ্বাসটুকু ছিল তা ঘুচে গেছে।

কিন্তু এতদিন পর কীভাবে কোথা থেকে লোকটা হাজির হল! এটা যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তা ছাড়া আর কী, তাহলে ওর আসাটা ইচ্ছাকৃত নয়। সুতরাং ওর কোনো দোষ নেই। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী সুধীনের মুন্ডুর মতো পাখাটা। কেন যে খারাপ হয়, কোম্পানিটাই জোচ্চোর। কিন্তু কী আশ্চর্য, দড়াম করে সুধা দরজাটা বন্ধ করে দিল। এতদিন পর ও চিনতে পারল আর আমি পারলাম না! লোকটা তাহলে মনে করে রেখে দিয়েছে, তার মানে মতলব আছে।

অস্থির হয়ে খুব পায়চারি করল সুধা ঘর বারান্দা দালান ঘুরে। শেষে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। বুকটা ভার হয়ে আসছে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। খুলতেই সিলিং পাখার আংটা দেখল। জায়গাটা খালি খালি লাগল। তাইতে ওর মনে পড়ল এইরকম খালি কিংবা আর একটু বেশিই হবে, লেগেছিল প্রফুল্লর মৃত্যুর খবর পেয়ে। তার আগে অবশ্য বিয়ের ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় দো-তলা থেকে এক-তলায় নামা বন্ধ হয়ে গেছল। খুব খুশি হয়েছিল বাড়ির সবাই। একে বেজাত, তায় চটকলের সামান্য কেরানি, ইউনিয়ন করে, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, মেসে থাকে, এমন ছেলের সঙ্গে বিয়েতে কে অখুশি না হয়! খোকা যদি মেয়ে হত, আর অমন একটা ছেলেকে যদি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে বসত! এই পৃথিবীতে, ব্যাপারটাকে বিরাট এবং জোরালো করার জন্য সুধা ভাবল—কোন বাপ-মা রাজি হবে? ধানবাদের কাছে জিটি রোডে প্রফুল্ল লরি চাপায় মারা গেল বিয়ের পনেরো কি যোলো দিন পরই। প্রফুল্ল ভেঁকুর তুলত, অম্বল ছিল। মাকুন্দও ছিল। বেশ কচি কচি একটা ভাব ছিল ওর মুখে। ছোটোকাকা বলল, যে গেছে তার জন্য দুঃখ করতে হয় কর, আমরা বুঝতেই পারছি। পাঁচ মাস ছ-মাস যত সময় চাস নে। কিন্তু কতবড়ো ভবিষ্যৎ তোর সামনে, বয়স তো মোটে বাইশ। একটা ভালো পাত্তর হাতে এসেছে, বিধবা হয়ে না থেকে বিয়ে করে ফ্যাল। আমরা চার জন ছাড়া কেউ জানতেও পারবে না। চার-জন মানে বাবা-মা কাকা-কাকি।

বাবা মারা গেছেন, তা হলে রইল তিন জন। হঠাৎ এই সাক্ষীটা এসে আবার চার জন হয়ে গেল। তাই-বা কী করে হয়? সুধা বিরক্ত হয়ে উঠল। বলাই চন্দ নামে একটা লোকের নাম করল, সেও তো জানে। তা হলে পাঁচ জন। কোনদিন দরজি কিংবা ছাতাসারাইওলা কিংবা বাস-কণ্ডাক্টর বলবে, আপনি মোটা হলেও, রংটা ময়লা হলেও গলার জড়লটা দেখে ঠিকই চিনেছি। আপনার বিয়েতে আমি সাক্ষী ছিলুম, চিনতে পারছেন না, আমি বলাই চন্দ। এই যে একটা চিহ্ন—শরীরের এত জায়গা থাকতে ভগবান কেন যে গলায় দেগে দিল!

সুধা গলায় হাত বুলোতে লাগল। জীবনের প্রথম চুমুটা এখানেই। প্রফুল্লই দিয়েছিল বেলুড়ে গঙ্গার ধারে বসে। এর কোনো সাক্ষীটাক্ষি নিশ্চয় হাজির হয়ে বলবে না আপনিও তো চুমু দিয়েছিলেন। বলা যায় না, কে ভেবেছিল এতদিন পর এই লোকটা হাজির হবে!

এটাও অ্যাকসিডেন্ট, অতএব সুধা একটু অসুবিধা বোধ করল—কাউকেই তো দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এই হরিশংকর যদি সুধীনকে বলে দেয়, মশাই আপনার বউয়ের আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, তা জানেন কি? শোনামাত্রই রগচটা সুধীন হাতের কাছে যা পাবে দমাস করে কষিয়ে দেবে। যদি হরিশংকরকে কষায় তাহলে ও মরে যাবে।

সুধা মৃত হরিশঙ্করকে ভেবে ভয় পেল। এর জন্য সুধীনের নিশ্চয় ফাঁসি হবে। তবে সুধীন এমএ পাস, একটা ব্যাঙ্কের সাড়ে ন-শো টাকার দায়িত্ববান কর্মচারী। বি এসসি পড়া ছেলের বাবা, বউয়ের নামে সল্ট লেকে তিন কাঠা জমি কিনেছে, সে কি এমন হঠকারিতা করবে! নিশ্চয় প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যাবে। কাতর হয়ে পড়বে। একটা আঘাত তো বটে! শয্যাশায়ীও হতে পারে। সুধার মনে পড়ল, পাঁচ দিন কি চার দিন সে শুয়েছিল। চোখ দিয়ে খালি জল ঝরত। সুধীন যদি ওইভাবে কাঁদতে শুরু করে। আর একটা সম্ভাবনার কথাও ভাবা যায়। তখন মরতে ইচ্ছে করেছিল। এক্ষেত্রে সুধীনের এই খবরটা স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ তুল্যই। সুতরাং সে আত্মহত্যা করলেও করতে পারে। তবে যতদূর মনে হয়, সুধা আশা করল, তা করবে  । তা হলে কী করতে পারে? অর্থাৎ এই কথাটা শোনার পর?

ভেবে ভেবে সুধা গোটা দুপুরটাই নাজেহাল হয়ে গেল।

শোনামাত্র সুধীন চিৎকার করে উঠল।

পাঁচ দিন গরমে পচতে হবে? আঠারো টাকা গচ্চা দিতে হবে যখন দিয়ে দিলেই পারতে। কালকে দেওয়া মানে দু-দিন গরমে পচা! সাধে কি আর বলি… পাশের ঘরে খোকা আছে তাই থেমে গেল।

লোকটা খাঁটি কি না না-জেনেই দিয়ে দোব? যদি ঠগ-জোচ্চোর হয়। এই বলেই সুধার মনে হল, সাক্ষী ছিলুম বললেই তো হয় না, প্রমাণ দিতে হবে। সুধীন যখন বলবে, মুখের কথায় এত বড়ো একটা ব্যাপার কি মেনে নেওয়া যায়। হরিশংকর তখন কীভাবে প্রমাণ করবে? সেই বলাই চন্দকে ডেকে আনবে? ওরকম সাক্ষী তো ভাড়া করেও আনা যায়। আসলে অকাট্য প্রমাণ চাই।

খোকাকে বলে দিয়ে মিস্ত্রিকে যেন বলে আসে পাখাটা নিয়ে যাবার জন্য। আর, একটা পাখা যেন ভাড়া করে আনে। এই বলে সুধীন বাসি খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল। এই তো কত সহজেই ভাড়া করা যায়, সুধা ভাবল। মানুষ ভাড়া করা কি এর থেকেও শক্ত?

রাত্রে ঘুম এল না। সুধা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কাল পূর্ণিমা গেছে। খুব জ্যোৎস্না হয়েছে। হাতটা সে বাড়িয়ে দিল। বেলুড় থেকে নৌকোয় পার হওয়ার সময় এইরকম জ্যোৎস্না ছিল। হাতটা এগিয়ে ধরে প্রফুল্ল বলেছিল, ঠিক যেন বৃষ্টির মতো হাতে পড়ছে।

কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে সুধা টেনে নিল। বৃষ্টি না আর-কিছু, হলে তো বেঁচে যাই। তারপর ঘরে এসে গা আদুড় করে সুধীনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন দুপুরে হরিশংকর একটা পুরোনো কালো পাখা নিয়ে এল। হাঁড়িটা মস্ত বড়ো। তাতে গোটা দশ-বারো গর্ত। সুধা মিষ্টি গলায় ওকে ভেতরে আসতে বলল। খুব ঘেমে গেছে দেখে আরও মিষ্টি করে বলল, এত ভারী একটা জিনিস বয়ে এনেছেন, আগে একটু জিরিয়ে নিন।

তাইতে নিরাসক্ত পেশাদারি গলায় হরিশংকর বলল, এসব অভ্যেস আছে। এবং তাইতে সুধার মনে হল, লোকটা সুবিধের নয়।

হরিশংকর পাশের ঘর থেকে চেয়ার আনল। টুলটা তার উপর রেখে কালো পাখাটা কাঁধে নিয়ে উঠতেই কালকের মতো সুধা আঁকড়ে রইল টুল।

আপনি খুব এক্সপার্ট, কতদিন এ কাজ করছেন? সুধা আলাপ জমাবার চেষ্টা শুরু করল।

অনেক দিন।

আগে তো কারখানায় কাজ করতেন।

হ্যাঁ।

তাহলে!

ঘাড় নীচু করে হরিশংকর তাকাল। গায়ে ব্লাউজ আছে, তবুও কেমন যেন করে উঠল। সুধার সর্বাঙ্গ।

আপনি জানেন না? হরিশংকর নিথর গলায় প্রশ্ন করল।

কী?

প্রফুল্লের জন্য আমরা ছাঁটাই হই।

না তো, কেন?

ব্লেডগুলোর দিকে আঙুল দেখাল হরিশংকর। সুধা এক-এক করে সেগুলো ওর হাতে তুলে দেবার সময় আবার বলল, কেন?

আমাদের স্ট্রাইকটা ভেঙে গেল ওর জন্যই। কোম্পানি ওকে ভালো চাকরি দিয়ে বদলি করে দেবে বলেছিল। ও টোপ গিলল। আমি, বলাই আরও দুজন ছাঁটাই হয়ে গেলুম। হরিশংকরের ভঙ্গি বা স্বরে রাগ নেই। কাজ করতে করতেই বলল, তখনকার দিনে এত কলকারখানা তো ছিল না। ভগ্নীপতির ইলেকট্রিকের দোকান ছিল, ঢুকলুম। তারপর নিজে এক মুসলমানের সঙ্গে দোকান করলুম। আড়াই বছর আগে যে দাঙ্গা হল তাতে দোকানটা লুঠ হয়ে গেল। সেই থেকে এই দোকানে কাজ করছি।

আর সেই ভদ্রলোক! সুধা বলতে যাচ্ছিল সেই সাক্ষী। শেষ মুহূর্তে ভদ্রলোক বেরিয়ে এল।

বলাই? সে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।

অ্যাাঁ। সুধা বজ্রাহত হল পুলকে, মরে গেছে?

টুল থেকে নেমে এল হরিশংকর। সুইচ টিপল। পাখা ঘুরতে লাগল।

কে চাকরি দেবে বলুন। বড়ো সংসার ছিল। বহু চেষ্টা করেও কিছু পারল না। একদিন বলল, হরিদা, কারুর উপর আর আমার বিশ্বাস নেই। সবাইকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে করে। আমি তবে বাঁচব কী করে? দু-দিন পর শুনলুম ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে।

সুধা ধীরে ধীরে খাটে বসল। তাহলে পাঁচ নয়, চার জনই রয়েছে। একটা দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই পেয়েই তার মনে হল বলাই লোকটা বোধ হয় সৎ। বিশ্বাস, ঘেন্না এসব নিয়ে মাথা ঘামানো কি আর বাজে লোকের কর্ম? এই লোকটা বাজে তাই গলায় দড়ি দেয়নি। দিলে চার নয়, তিন জন হয়ে যেত। মা-কাকা-কাকি। মা বুড়ি হয়েছে শিগগিরই মারা যাবে, তাহলে থাকবে দুই। ওরা দুজনই তো বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল। সুতরাং জীবনে মুখ খুলবে না। কাজেই এক্ষেত্রে ওরাও মৃত। শুধু জ্যান্ত রয়েছে এই হরিশংকরটা।

প্রফুল্ল ছেলে খারাপ ছিল না। হরিশংকর সান্ত্বনা দিচ্ছে কি না সুধা বুঝে উঠতে পারল না। লোকটার হাবভাব এখন মোটেই মিস্ত্রির মতো নয়। এটা তার পছন্দ হচ্ছে না।

ওর পতন ঘটে আপনার সঙ্গে মেলামেশা হয়ে। অন্তত আমাদের তো তাই ধারণা। বিয়ে করে বউকে সুখে রাখবে, বোধ হয় সেইজন্যই…।

না না, আমি তো ওরকম কিছু চাইনি। আমি তো বলেছিলাম তুমি যেভাবে রাখবে সেইভাবেই থাকব। সুখে রাখবে এমন ছেলে কি তখন আমি পেতাম না? এই তো নিজের চোখেই এখন দেখুন-না। তবুও তো প্রফুল্লকে বিয়ে করেছিলাম। সুধা কিছুটা ব্যস্ত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করল। লোকটা যেন তাকেই দায়ী করতে চাইছে। এটা খুবই অন্যায়। আসলে প্রফুল্লকে তো আর পাচ্ছে না তাই দোষটা এখন আমার ঘাড়ে চাপাতে চায়। সুধা দুঃখও বোধ করল। কতখানি ত্যাগ সে করেছিল, লোকটা তা নিয়ে একটা কথাও বলল না। সুধা রেগেও উঠল। কৃতকর্মের জন্য প্রফুল্লর নিশ্চয়ই অনুশোচনা হয়েছিল। নয়তো আত্মহত্যা করবে কেন? অথচ প্রফুল্লের এই মহৎ দিকটা একদমই দেখছে না লোকটা। দেখিয়ে দেওয়া উচিত বিবেচনায় সুধা বলল, কত অন্যায় কাজ করে কত লোক বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রফুল্লও তো আত্মহত্যা না করে থাকতে পারত!

আত্মহত্যা? অদ্ভুতভাবে হরিশংকর তাকাল ওর দিকে। স্বরে চিড় ধরিয়ে বলল, কে বলল আপনাকে?

কে আবার বলবে? শুধু প্রফুল্লরই পতন হয়েছিল আর আপনাদের কারুর হয়নি কতটা সত্যি যে অকাট্য কোনো প্রমাণ তো আর এখন পাওয়া যাবে না?

পাখাটা তাহলে নিয়ে যাচ্ছি।

হঠাৎ হরিশংকর আলোচনায় ছেদ টেনে পেশাদারি গলায় বলে উঠল, দিন পাঁচেক পরে পাবেন।

দরজার কাছে এসে আগের দিনের মতো ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার বিয়ের অকাট্য প্রমাণ ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেছে। প্রফুল্ল আমার কাছে রেখেছিল আর ফেরত দেওয়া হয়নি।

সুধা দাঁড়িয়ে রইল আর পাখাটাকে মেরামত করার জন্য নিয়ে চলে গেল হরিশংকর। অন্যের বিয়ের অকাট্য প্রমাণটা আজও রেখে দিয়েছে! কেন? নিশ্চয়ই মতলব আছে। সুধার এই চিন্তায় সারা দুপুর-বিকেল তোলপাড় হয়ে গেল।

খুশি হল সুধীন। এই পাখাটায় হাওয়া যেন বেশিই লাগছে। চটপট সে ঘুমিয়ে পড়ল। সুধার ঘুম এল না। না আসারই কথা, কেননা বুকে পাষাণভার চেপে বসেছে। সার্টিফিকেটটা খুবই সর্বনেশে হয়ে উঠতে পারে। এই বয়সে যদি ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে—সুধার মনে হল পাখাটা সুধীনের ঠিক পেটের উপর পড়বে। বেশ দুলছে মুন্ডু নাড়িয়ে। গর্তগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ চিড়িক দিচ্ছে। যদি খুলে পড়ে! নির্ঘাত মৃত্যু ঘটবে। অ্যাকসিডেন্টই বলা হবে, কিন্তু হরিশংকরকে কি পুলিশে ধরবে না? যদি ধরে তাহলে বাঁচা যায়। তাহলে অবশ্য টেনে সংসার চালাতে হবে। একশো তিরিশ টাকা বাড়িভাড়া আর দেওয়া চলবে না। অফিস ইনশিওরেন্স মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক, সেদিনই তো হিসেব করে সুধীন কত যেন বলল, পাওয়া যাবে। খোকার না দাঁড়ানো পর্যন্ত ওইতেই চলে যাবে। তা ছাড়া জমিটাও আছে। খোকার চাকরি হলে মেয়ে দেখতে হবে। ভালো মেয়ে পাওয়াও মুশকিল।

এই সময় বিড়বিড় করে সুধীন পাশ ফিরল। সুধা আন্দাজে হিসেব করে দেখল পাখাটা যদি পড়ে, ঠিক পেটে নয়, পিঠ ঘেঁষে পড়বে। তাতে মারাত্মক কিছু নাও ঘটতে পারে। এতে সে খুব আশ্বস্ত বোধ করল। গ্লানিও হল। সুধীন একটু রগচটা, খিটখিটে, কিন্তু মানুষ ভালো। এত বছর বিয়ে হলে কোন স্বামী-স্ত্রীর না ঝগড়াঝাঁটি হয়! সুধা হাত বাড়িয়ে সুধীনের পিঠে বোলাতে লাগল। একটা-দুটো ঘামাচিও মেরে দিল। এখন তার মায়া হচ্ছে।

দুপুরে দরজায় তালা দিয়ে সুধা বেরোল। বাস স্টপের কাছেই ইলেকট্রিকের দোকান। রাস্তা থেকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কাউন্টারের পিছনে বসে লাটাইয়ের মতো একটা জিনিসে হরিশংকর তার জড়াচ্ছিল। সুধা বলল, পাখাটা একটু তাড়াতাড়ি করে দিন।

বলেছি তত দিন পাঁচেক লাগবে। রুক্ষ স্বরে হরিশংকর বলল। হঠাৎ পিছন থেকে সুধার গলা শুনে চমকে উঠেছিল। সেই অপ্রতিভতার জন্যই যে রেগেছে সুধা তা বুঝতে পেরে, কাকুতি করে বলল, ইচ্ছে করলেই আপনি তাড়াতাড়ি পারেন। যেটা লাগিয়ে দিয়েছেন স্বরটা আদুরি করে— এমন বিচ্ছিরি দেখতে আর এমন দুলছে, বিদ্যুত চমকাচ্ছে যে ভয় হয় বুঝি খুলে পড়বে। উনি আবার ঠিক পাখার নীচেই শোন।

ওসব পাখা একটু দোলেই। হরিশংকরের নিস্পৃহ ভঙ্গি লক্ষ করে সুধা আহত হল। ভাবল, একটু পাষাণভার চাপিয়ে দিই।

ধরুন, যদি খুলেই পড়ে, তাহলে কাজে অবহেলার জন্য তো আপনাকেই পুলিশে ধরবে!

আমাকে? হরিশংকর ঘাড় বেঁকিয়ে তীব্র চোখে তাকাল। পুলিশ আমার কী করবে? তা ছাড়া… সিনেমার খল চরিত্রাভিনেতার মতো ঠোঁট মুচড়ে, চোখ সরু করে—পাখাটা যে আপনিই আলগা করে রাখেননি তার প্রমাণ কী?

যৎপরোনাস্তি চমকে উঠে সুধা বলল, কেন?

তাতে তো আপনারই লাভ।

কিছুক্ষণ দুজনে তাকিয়ে রইল।

প্রমাণ?

সার্টিফিকেট।

ওটা আপনার কাছে কেন? যার জিনিস তাকে ফেরত দেননি কেন?

সে তো মরে গেছে।

আমি তো বেঁচে আছি।

আপনি তো এখন আর প্রফুল্লর বউ নন।

হ্যাঁ, আমি ওর বউ, আমিই।

প্রমাণ?

সার্টিফিকেট।

ওটা কি আপনি ফেরত চান?

নিশ্চয়। আমার জিনিস আমি রাখব না? আপনি কেন রেখেছেন? নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।

ওরা দুজন চাপা হিংস্রস্বরে কথা বলে যাচ্ছে যেহেতু দোকানটা রাস্তার উপর আর পথচারীরা কয়েক হাত দূরেই। হরিশংকর মুঠো-করা হাতটা কাউন্টারে আঘাত করে বলল, কী মতলব? যদি তাই-ই থাকত তাহলে ওটা ভাঙিয়ে আপনার কাছ থেকে টাকা কি আদায় করতে পারতাম না?

হরিশংকর অতঃপর অট্টহাসি করল না অর্থাৎ সে অভিনয় করছে না। সুধার ক্রোধ ভেস্তে গেল এই শুনে। এরকম হয় বলেই সে শুনেছে। যদি টাকা চেয়ে বসে, তাহলে? সোজা পা জড়িয়ে ধরব। নিশ্চয় দয়া হবে। বলব আমি অবুঝ, না ভেবেই বিয়েটা করেছিলাম। আসলে প্রফুল্লই ফুসলেছিল। খবরের কাগজে মামলার খবরে দেখেন-না?

তা ছাড়া আর যে-মতলব থাকতে পারে তা আপনার মতো থলথলে মুটকি আধবুড়িকে। দেখে মোটেই ইচ্ছে হয় না।

সুধা হাঁফ ছাড়ল। বয়স হওয়ার এই এক সুবিধা। কিন্তু সুধীনকে যদি প্রমাণটা দেখায়। এখনও তো অনেক দিন বাঁচব। সুধার মনে হল অনেক দিন বাঁচার লোভ আগে হয়নি, এখন হচ্ছে। ওই সার্টিফিকেটটা পেলেই আয়ু বেড়ে যাবে। কিন্তু পাওয়া যায় কী করে? হরিশংকর একদৃষ্টে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। কিছু-একটা গভীর হয়ে ভাবছে। সুধা গলাখাঁকারি দিল। হরিশংকর নিথরভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমি জানি আপনি এখন কী ভাবছেন। ভাবছেন লোকটা মরে গেলেই আপদ চোকে।

সে কী, মোটেই তা ভাবিনি। সুধা ক্ষুব্ধ তো বটেই, বিস্ময়ও বোধ করল।

ভাবছেন যদি না-মরে তাহলে খুন করব। এইরকমই মনে হয়। আপনি অস্বীকার করবেন করুন কিন্তু প্রফুল্লর জন্য আমাদের অনেকের সর্বনাশ হয়েছে, তাদের পরিবার ছারখার হয়েছে, এক-আধ জন তো নয়। ওই কাগজটা চাইছেন প্রফুল্লর বউ এই দাবিতে, তাই না?

না না, আমার স্বামী প্রফুল্ল নয়। এই দেখুন, আপনি খোকার বাবার কথাটা ভুলেই যাচ্ছেন। আসলে ওটা রেখে আপনার কী লাভ? দিয়ে দিলে একটি মেয়ের… শুধরে নিয়ে একই স্বরে একটি মায়ের যদি উপকার হয়, তাহলে দিয়ে দেওয়াই উচিত।

কথাগুলো হরিশংকর শুনল কি না কে জানে, তবে অন্যমনস্কর মতো বলল, আপনি এখন যান। পাখাটা সারানো হলেই দিয়ে আসব।

সুধা দু-চার বার কথা বলে জবাব না পেয়ে বাড়ি ফিরে এল রাগ নিয়ে। লোকটা কীভাবে বলতে পারল ওকে খুন করব ভাবছি! তাই কি সম্ভব?

বিছানায় শুয়ে অনেকরকম করে ভাবল তার পক্ষে হরিশংকরকে খুন করা আদৌ সম্ভব কি না। যেদিন পাখা লাগাতে আসবে এক কাপ চা দেব বিষ মিশিয়ে। গন্ধ পাবে না এমন বিষ। তবে বিষটা জোগাড় করতে হবে। ছোটোকাকার বন্ধুর এক ডাক্তার ছেলে আছে। ভালো ভালো বিষ নিশ্চয় তার কাছে থাকে। কিন্তু চাইলেই তো সন্দেহ করবে। আর হয় গলা টিপে মারা। তা পারা যাবে না, ওর গায়ের জোর বেশিই হবে। গঙ্গার ধারে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে যদি ঠেলে দেওয়া যায়? সাঁতার জানে কি না কে জানে! আর এক হয় দরজা খুলে পাশে দাঁড়াব। যেই ঢুকবে কয়লাভাঙা লোহাটা দিয়ে মাথায় কষাব। তিন-চার ঘা দিলেই মরবে। কিন্তু লাশ কীভাবে পাচার করা যায়?

সারা দুপুর সুধা ভাবল। রাতে এবং পরদিন দুপুরেও ভাবল। প্রায় বারো-তেরোটি উপায় পেল খুন করার। গুণ্ডা দিয়ে বোমা মারার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু কোনোটিই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না বুঝে খুব বিমর্ষ হয়ে বিকেলেও বিছানা থেকে উঠল না। বন্ধুর মাকে বলল, শরীর খারাপ। শুনে বন্ধুর মা মুচকি হাসল।

সন্ধ্যার পর সুধীন বাড়ি ফিরল মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায়। জামায় রক্তের ছিট। দেখামাত্রই সুধা হাউমাউ করে উঠল, ও মা কে মারল, কী করেছিলে?

বাস থেকে পড়ে গেছি। সুধীন পাত্তা দিল না সুধার উদবেগকে।

কী করে পড়লে, নামতে গিয়ে না ওঠার সময়? যদি বাসের তলায় যেতে! বলেই সুধার মনে হল, তাহলে হরিশংকরের জারিজুরি আর চলত না।

ওই এক কথা। পড়ে গেলেই যেন বাসের তলায় যেতে হবে। কেন, গেলে কি তোমার সুবিধে হয়?

এই শুনে সুধা বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বিরক্ত হয়ে সুধীন একটু পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাতে বিছানায় সুধা অভিযুক্ত করল সুধীনকে, তখন ওকথা বললে কেন! তুমি মরলে আমার কী সুবিধে হবে শুনি?

সুধীন নিরুত্তর রইল। নাড়া দিয়ে সুধা পুনরাবৃত্তি করতেই সুধীন উত্তেজিত হয়ে বলল, সব আগে ওই কথাটাই-বা তোমার মনে এল কেন যে আমি বাসের তলায় যেতুম! নিশ্চয় মনে মনে তাই ভাবছিলে।

শুনে সুধার মাথাটা গরম হতে শুরু করল। আমি কী ভাবছি তাই নিয়ে সকলেই ভাবছে দেখছি। কেন, এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি তা কি হরিশংকর বা সুধীন মনে করে না? এতই কি আমি খারাপ।

আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?

কী আবার, কিছুই না।

ভালো-মন্দ কিছুই না?

না।

আমি মরে গেলে তোমার দুঃখ হবে না?

সুধীন মিনিট খানেক চুপ থেকে বলল, কী জানি।

সুধার মনে হল সুধীন সত্যি কথাই বলছে। তবে খুবই কম সময় নিল এত বড় একটা কথার জবাব দিতে।

তোমার কি মনে হয় আমাকে বিয়ে করে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে? ভেবে উত্তর দাও। ভাবাভাবির আর কী আছে? সুধীন ক্লান্ত স্বরে বলল, যেমন বরাবর ছিলুম তেমনই আছি।

যদি বলি তোমাকে ভালোবাসি না, শুনে কষ্ট হবে না?

জবাব না দিয়ে সুধীন পাশ ফিরল।

যদি বলি, কোনোদিনই বাসিনি।

জবাব পেল না।

যদি বলি, অন্য একজনকে ভালোবাসতুম।

তাকেই বিয়ে করলে না কেন, তাহলে একটু ঘুমোতে পারতুম এখন। সুধীন পাশবালিশটাকে আরও জোরে আঁকড়ে ঘুমের মহড়া দিল। অপ্রতিভ হয়ে সুধা সরে এল নিজের জায়গায়। আজ দেরিতে চাঁদ উঠেছে। মেঝেয় অল্প একটু জ্যোৎস্না পড়ে। সুধার ইচ্ছা হল হাত বাড়াতে, বাড়িয়ে দিল। তারপর অনেক কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে যত বার মনে পড়ল রাতের কথাবার্তা, সুধার মন ভার হয়ে উঠল, অভিমান হল। ভালো করে কথা বলল না কারুর সঙ্গে। অবশ্য তার জন্য কেউই ব্যস্ত হল না, কারণও জিজ্ঞাসা করল না। শেষে সুধা ভাবল—কী দরকার ছিল এই বয়সে ওইসব কথা তোলার। দিব্যি তো চলে যাচ্ছে। তারপর মনে পড়ল, চলার উপায় নেই হরিশংকরের জন্য। অকাট্য প্রমাণ নিয়ে ও হাজির হয়েছে।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুধা উপায় ভাবতে ভাবতে ঠিক করল একবার হরিশংকরের বাড়িতে যাবে। দরকার হলে কেঁদে ওর বউয়ের পা জড়িয়ে ধরবে। সিঁদুর পাঠিয়েছিল যখন, নিশ্চয় ভালো লোক। চাপ দিয়ে সার্টিফিকেটটা আদায় করিয়ে দেবে, মেয়েমানুষ হয়ে কি সে আর এক জনের বিপদে-সুধা সংশোধন করে ভাবল দুঃখ শব্দটা ব্যবহার করতে হবে, ওতে মনটা অনেক গলিয়ে দেয়। একটি মেয়ের দুঃখে বা একটি মায়ের দুঃখে কি আর এক মা পাশে এসে দাঁড়াবে না!

দুপুরে সে ইলেকট্রিকের দোকানে গেল। হরিশংকর জরুরি ডাক পেয়ে বেরিয়েছে, এখুনি আসবে। একটা অল্পবয়সি ছেলে দোকান আগলাচ্ছে। তার কাছ থেকে জানল হরিশংকরের বাড়ি কাছেই মিনিট পাঁচেকের পথ।

ঠিকানা এবং নির্দেশ নিয়ে সুধা রওনা হল। মিনিট দুয়েক পর পৌঁছোল খালধারে। এইবার ডান দিক। একটুখানি গিয়েই কাঠের ব্রিজ। এপারে এসে দু-ধারে শুধু কাঠের গোলা আর কাঁচা কাঠের চড়া গন্ধ। তাতে মাথা ঝিমঝিম করে, নেশার মতো লাগে। দুটো গোলার ফাঁকে একটা সরু রাস্তা আছে, তাই দিয়ে কিছুটা এগোলেই দোতলা মাঠকোঠা। কিন্তু সরু রাস্তাটাই সুধা বার করতে পারছে না। ওকে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে অনেকেই তাকাচ্ছে, তাতে অস্বস্তি হতে লাগল। শেষে ঠিক করল একজনকে জিজ্ঞাসা করা যাক। জীবনের এত বড়ো একটা ব্যাপারে লজ্জা করলে চলে না।

ছুতোর শ্রেণির তিন জনকে সে জিজ্ঞাসা করল। কেউ বলতে পারল না, কারণ তারা এই অঞ্চলের লোক নয়। তখন ভাবল বিড়ির দোকানদার নিশ্চয় জানবে। মাঝবয়সি লোকটা বিড়ি বাঁধছিল দুলে দুলে। লুঙ্গিটা তাড়াতাড়ি হাঁটুর নীচে নামিয়ে বলল, কালো, রোগাপানা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তো!

হ্যাঁ, ওপারে দোকানে কাজ করে।

বুঝেছি, এই গলিটা দিয়েই ওর বাড়ি। কিন্তু ওকে কী দরকার আপনার?

সুধা বিরক্ত হল, তা দিয়ে তোমার কী দরকার! এই লোকগুলোর কৌতূহল বড়ো বেশিই হয়।

ওর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব।

বিড়িওয়ালা তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকল। সুধা বুঝল, সম্ভ্রান্ত কেউ যে এমন জায়গায় আসতে পারে তা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।

কিন্তু ওর বউ তো বেরিয়ে গেছে।

অ! কখন আসবে?

বেরিয়ে গেছে মানে বছর খানেক আগে এখানকারই এক ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেছে।

সুধা বিমূঢ় হয়ে বলল, মিস্ত্রির বউয়ের বয়স তো কমপক্ষে পঞ্চাশ হবেই।

কী যে বলেন! ওর তো দ্বিতীয় পক্ষের বউ। জোর পঁচিশ বয়স।

প্রথম বউ কি মারা গেছল?

হ্যাঁ, শুনেছি গলায় দড়ি দিয়ে।

ফিরে চলল সুধা। কাঠের ব্রিজে উঠেই দেখল হন্তদন্ত হয়ে হরিশংকর আসছে।

আমার বাড়িতে গেছলেন, কেন কী দরকার?

উত্তেজিত তো বটেই, চোখে ভয়ের ছাপও।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছি না।

কী দরকার অ্যা, তার খুব অসুখ, দেখাটেখা হবে না। আর তার কাছে গিয়েও খুব সুবিধে হবে না বলে রাখছি। হরিশংকর রীতিমতো শাসাল।

কেন, সুবিধে হবে না কেন? আপনি ভেবেছেন আমায় খুব জাঁতাকলে ফেলেছেন, আর আমি বুঝি আপনাকে ফেলতে পারি না? থেমে গেল সুধা, কারণ একটা লোক ওদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। হরিশংকর বিস্ময়াহত! লোকটা কণ্ঠস্বরের পাল্লা ছাড়াতেই সুধা শুরু করল, আপনার বউকে গিয়ে বলব আপনি নাম ভাঁড়িয়ে আমায় বিয়ে করেছিলেন। অল্প বয়স ছিল, অতশত বুঝতে পারিনি। এখন এতদিন পরে সেই দাবিতে আপনি আমায় ফেরত চাইছেন।

সুধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল, লোকটা নিশ্চয় বলবে, যান বলুন গিয়ে। আমার বউই নেই তো কাকে বলবেন।

খুবই আশ্বস্ত দেখাল হরিশংকরকে। মিথ্যে কথা, কেউ বিশ্বাসই করবে না। প্রমাণ আছে, অকাট্য প্রমাণ। আপনার কাছেই সেই বিয়ের সার্টিফিকেট রয়েছে। নিজের না হলে কেউ কি ওটা রেখে দেয়?

কিন্তু ওতে প্রফুল্লর নাম লেখা!

আপনি তো নাম ভাঁড়িয়েছিলেন, প্রমাণ করতে পারবেন আপনি নাম ভাঁড়াননি? আমি ছোটোকাকাকে সাক্ষী মানব।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল হরিশংকর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুধা ভাবল, এইবার নিশ্চয় বুক চিতিয়ে বলবে, কাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আমার বউ মরে গেছে, আবার বিয়ে করেছিলুম, সে-বউ পালিয়ে গেছে। কাকে বলবেন ওসব কথা?

কিন্তু ক্রমশ কুঁজো হয়ে গেল হরিশংকর। অবশেষে ব্রিজের রেলিং ধরে তাকে দাঁড়াতে হল। এসব কথা মিথ্যে হলেও ওকে বলবেন না, খুব আঘাত পাবে। বড়ো ভালোমানুষ। হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে বসবে। আমার তো আর কেউ নেই ও ছাড়া।

সুধা আর কথা বলার দরকার বোধ করল না। বাড়ি ফেরার সময় খুব হালকা লাগল নিজেকে। মানুষ যে কতরকম মনের বাতিক পুষে রাখে আর তাইতেই কীভাবে আটকা পড়ে। সুখী হতে হলে এসব বাতিক থাকা উচিত নয়, সুধা মনে মনে পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোল। অতঃপর, পাখি হয়ে এখন আকাশে উড়তে পারি, এমন কথাও সে ভেবে ফেলল।

Exit mobile version