Site icon BnBoi.Com

ক্রিকেটের রাজাধিরাজ ডন ব্র্যাডম্যান – মতি নন্দী

ক্রিকেটের রাজাধিরাজ ডন ব্র্যাডম্যান – মতি নন্দী

০. মুখবন্ধ

১৯৩৮ ওভাল টেস্ট ম্যাচের রিপোর্টে উইজডেন লেখে :

তৃতীয় দিন চা-এর সময় হ্যামণ্ড নিশ্চয়ই ইনিংস ঘোষণা হয়তো করত না, যদি বিপক্ষ অধিনায়কের দুর্ঘটনা না ঘটত।

স্কোরবোর্ডে ইংল্যাণ্ডের তখন ৯০৩-৭ এবং ‘বিপক্ষ অধিনায়ক’ ডন ব্র্যাডম্যান পায়ের গোছ মুচড়ে যাওয়ায় আর ব্যাট করতে পারবে না নিশ্চিতভাবে তা জানার পরই হ্যামণ্ড ইনিংস ঘোষণা করে। সেজানত, ডন যদি ব্যাট করতে পারত তাহলে ন-শো রানেও ইংল্যাণ্ড নিরাপদ নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ইটালিতে মুসোলিনির পতন ঘটেছে কিন্তু হিটলারের জার্মানি তখনও লড়ে যাচ্ছে। কমন্স সভায় এক সদস্য বক্তৃতা করতে উঠে বললেন, ‘পন্সফোর্ডকে আমরা অল্পেই আউট করেছি, এবারে ব্র্যাডম্যান।’ সভায় কারোরই এই রূপক হৃদয়ঙ্গমে অসুবিধা হয়নি। নির্দয়ভাবে বোলারদের নিষ্পেষণ করেছে যে ভয়ংকর ডিকটেটর, তার নাম ব্র্যাডম্যান।

ব্র্যাডম্যানের প্রথম ইংল্যাণ্ড সফর ১৯৩০-এ। নটিংহামে প্রথম টেস্টে করে ১৩১। সেযখন ব্যাট করছে নেভিল কার্ডাস জিজ্ঞাসা করলেন সিডনি বার্নেসকে, ‘দেখে কী মনে হচ্ছে?’ বার্নেস জবাব দেন, ‘একথা বলব না যে, আমি যখন দারুণভাবে বল করছি তখন ওকে আউট করতে পারতাম না। তবে আমাকে অত্যন্ত দারুণভাবে বল করতে হত।’ বার্নেস ২৭ টেস্টে ১৮৯ উইকেট নিয়েছেন ১৬.৪৩ গড় রানে, এক সিরিজে ৪৯ উইকেট ১০.৯৩ গড়ে। বার্নেসের ‘অত্যন্ত দারুণ’ অতিমানবদের জন্য।

১৯৭৪ সালে ব্র্যাডম্যানের ১৯৩৬-৩৭ টেস্ট রেজার লণ্ডনে বিক্রি হয়েছে ৭০০ গিনিতে, স্বাক্ষরিত ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ বইয়ের কপি ১৫০ পাউণ্ডে।

কয়েকটি ব্যাপার মাত্র উল্লেখিত হল ডন ব্র্যাডম্যান কী ধরনের শ্রদ্ধা, ভয়, বিহ্বলতা আকর্ষণ করেছে বোঝাতে। শেষ টেস্ট ইনিংস খেলেছে ১৯৪৮-এ কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রবাদে পরিণত হয়ে, প্রবাদের নিজস্ব ভঙ্গি অনুসারে ক্রিকেটার হিসাবে মানবিক আবেদন থেকে চ্যুত হয়েছে। ওর সম্পর্কে এমন একটা ধারণা গড়ে উঠেছে যাতে মনে হয় ডন যেন যান্ত্রিক ব্যাটসম্যান, নিজের হৃদয়হীন টেকনিকের দাস, ক্রিকেট থেকে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা ও মহান অনিশ্চয়তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, রান যোগ দেওয়ার এমন একটি যন্ত্র। এই ধারণাটা, ডনের দক্ষতার ওস্তাদিকে মর্যাদায় ভূষিত করে বটে কিন্তু অপ্রত্যক্ষভাবে ধারণাটা ভুলও। কেননা এর মধ্যে মোটেই ধরা পড়ে না তার চমৎকারিত্বের ধারাবাহিকতা বা স্ট্রোকের গভীর ব্যাপ্তি। উইকেটে ব্র্যাডম্যান বিরস, কল্পনাবোধহীন এবং ব্যক্তিগত স্পর্শরহিত এই ধারণাটাও মিথ্যা।

ব্র্যাডম্যান যেভাবে ক্রিকেট মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে, তার আগে বা পরে কেউ সেভাবে পারেনি। অবিশ্বাস্য তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা। জ্যাক হবসও ধারাবাহিক সাফল্যে দীপ্যমান, ডা. গ্রেসকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে খামখেয়ালি পিচের, কিন্তু ব্র্যাডম্যান সকলের মাঝে একা দাঁড়িয়ে। কিশোর উপন্যাসের কোনো লেখকও তার নায়ককে এইরকম বিস্ময়কর সাফল্য দিতে সাহস পাবে না। ব্র্যাডম্যান যা করেছে : ইংল্যাণ্ডে প্রথম ম্যাচে ২৩৬; আগন্তুক প্রথম ব্যাটসম্যান মে মাসের মধ্যে ১০০০ রান; ইংল্যাণ্ডে প্রথম টেস্টে ১৩১, লর্ডসে প্রথম খেলায় ২৫৪; একপক্ষ পরেই লিডসে একদিনে ৩০৯ এবং লাঞ্চের আগে ১০৫ (সবই ২২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে); এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত এইভাবেই প্রতি দ্বিতীয় ম্যাচে এবং প্রতি তৃতীয় ইনিংসে একটি শতরান দ্বারা ১১৭টি শতরান করেছে যতদিন-না অবসর নিয়েছে। সব রকমের ম্যাচে ৬৬৯ ইনিংসে রান ৫০,৭৩১; গড় ৯০.২৭। শুধু প্রথম শ্রেণির ম্যাচেই ২৮,০৬৭ রান ৩৩৮ ইনিংসে, গড় ৯৫.১৪ এবং টেস্ট ম্যাচে করেছে ৬,৯৯৬ রান, ৮০ ইনিংসে গড় ৯৯.৯৪। স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো হিসাব। ৮০ টেস্ট ইনিংসের ৬৩টি ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে খেলায়। অবশ্যই বলা দরকার— ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে, যেখানে ঝুড়ি ঝুড়ি রান জমা, সেখানে খেলেনি; নিউজিল্যাণ্ডেও না।

শুধু পরিসংখ্যানেই ব্র্যাডম্যানের অবিসংবাদী বিরাটত্বের কাহিনি বিধৃত। কিন্তু তার প্রচন্ড ক্ষমতার একটি দিক মাত্র এই পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়। ওর সঙ্গে যারা ব্যাট করেছে বা বিরুদ্ধে বল ও ফিল্ড করেছে অথবা খেলা বোঝেন এমন লোকেরা যাঁরা ওর খেলার টেকনিক বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁরাই বুঝতে সক্ষম কী প্রচন্ড বৈপ্লবিক আধিপত্য ব্র্যাডম্যান ক্রিকেটে এনেছিল। এখনকার টেস্ট ম্যাচে রান তোলার হার অর্ধেক করে দিয়েছে যেসব বোলিং কৌশল, ফিল্ড সাজানোর ছক বা উইকেট তৈরির পদ্ধতি, তার হদিশ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, ব্র্যাডম্যানের দ্রুত রান তোলার ভগ্নাংশ মাত্র কমাবার প্রয়াসে বোলারদের দ্বারা এইসব ব্যাপার সেই আমলেই শুরু হয়েছিল। ট্রাম্পার, ম্যাককেব বা মে যে-অর্থে ক্ল্যাসিকাল, ব্র্যাডম্যান তা নয়। ওর দেহের গঠন দোহারা, পেশিসমন্বিত এবং কবজিতে নমনীয়তা। অথচ সূক্ষ্ম, স্নিগ্ধ আলতো ছোঁয়ার সেইসব মার (দলীপ সিংহজির ধরনে), যাতে মনে হয় মাঠের ওপর সম্মোহন ছড়াচ্ছে কোনো জাদুদন্ড— এমন কিছু ডনের ব্যাটিংয়ে ছিল না। হয়তো কোনো বোলারের মনে হল ম্যাকার্টনির রক্ষণ ভেদ করে স্টাম্পে বল প্রায় লাগিয়ে ফেলেছে এবং এইরকম মনে হতে হতেই সেদেখল ব্যাটের শেষ মুহূর্তের একটা মোচড়ে বিদ্যুৎগতিতে বল বাউণ্ডারির দিকে চলেছে। সোবার্সের ক্ষেত্রেও বোলারদের এইরকম মনে হতে পারে কিন্তু ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে নয়। ক্রিকেটে এমন কোনো স্ট্রোক নেই যা মারতে পারত না, কিন্তু বাস্তববোধে ভরা ছিল তার পা থেকে চুলের ডগা।

ব্যাটিংয়ে নতুন ও বৈপ্লবিক পথ নির্দেশ করেছিলেন রঞ্জিত সিংহজি : ‘পিছিয়ে খেলো নয়তো ড্রাইভ।’ এর পরই বলের পিচের দিকে ঝুঁকে পড়া বাতিল হয়ে যায় বা ক্রমশ হতে থাকে। সি বি ফ্রাই লিখলেন :

পা বাড়িয়ে খেলতেই হবে, এই অযৌক্তিক ধারণাটি নিখুঁত ক্রিকেটে অত্যন্ত মারাত্মক। একমাত্র দৈত্য ছাড়া আর কারও পক্ষে বঁা-পা বাড়িয়ে ঝুঁকে, গুড লেংথ ফাস্ট বলের পিচের দু-ফুটের মধ্যেও পৌঁছোনো সম্ভব নয়। বোলার যেটা করতে চায় বা করবার জন্য চেষ্টা করে, সেটা হল ব্যাটসম্যান যেন তার বোলিংয়ের পিচের দিকে পা বাড়িয়ে ঝোঁকে।

ব্র্যাডম্যান যখন মধ্যাহ্নে দীপ্যমান তখন কদাচিৎ তাকে ক্রিজ থেকে পা বাড়িয়ে সামনে ঝুঁকতে দেখা গেছে। ফুটওয়ার্ক তার শরীরকে নিয়ে গেছে বলের কাছে, বলের পিচের উপরে। তার পূর্ববর্তী কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষেই এতটা করা সম্ভব হয়নি। টেকনিককে আরও এগিয়ে এনে ব্র্যাডম্যান নতুন কোনো অধ্যায় সংযোজিত করেনি। আবিষ্কৃত যাবতীয় নিয়মকে সমন্বিত করে ব্যাটসম্যানশিপকে জ্যাক হবস এমন এক জায়গায় নিয়ে যান, যেখান থেকে আর এগিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় এবং আজও তার প্রয়োজন হয়নি। ব্র্যাডম্যানের অবদান— অতন্দ্র প্রহরা ও নতুন এক মিতাচার।

‘স্টাইল না কার্যকারিতা, কোনটা নিয়ে ব্যস্ত হবে?’ প্রশ্নটা স্বয়ং ব্র্যাডম্যানেরই। নিজেই বলেছে, ‘কার্ডাস লিখেছিলেন, ইগলের ওড়া আধুনিক জেট প্লেনের থেকে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর, কিন্তু কে যে দ্রুতগামী তাতে কারও সন্দেহ নেই।’

ব্র্যাডম্যান এমনই প্রতিভাসম্পন্ন যে, ইচ্ছা করলে সেতার ব্যাটিংকে সৌকুমার্যে ভূষিত করার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে তার বাস্তববোধ ছিল অতি সজাগ। বোলারদের সম্পর্কে দুটি মূল জিনিস সেজানত :কেউই ব্যাটের পুরো মুখের সঙ্গে অনবরত মোলাকাত পছন্দ করে না; কেউই সাধারণভাবে গুড লেংথ বোলিং পলকের ফুটওয়ার্কে ওভারপিচ বলে রূপান্তরিত দেখতে পছন্দ করে না। বাউণ্ডারি-ফেন্সে বলের সংঘর্ষের শব্দ শুনতে সেভালোবাসত; স্কোরবোর্ডে তার নামের পাশে রানের সংখ্যা ঘুরতে দেখলে খুশি হত; বোলারদের খুন করায় এবং বিপক্ষ অধিনায়কের মুখ বিমূঢ় করে তোলায় তার আনন্দ হত।

সূক্ষ্ম আলতো মিহি মার ছিল না; কিন্তু ব্র্যাডম্যানের সেরা দিনগুলিতে প্রত্যেক বোলার, প্রত্যেক ফিল্ডসম্যান, প্রত্যেক দর্শক অনুভব করত— তার হাতের জিনিসটি ব্যাট নয় কুঠার এবং তা থেকে ঝরে পড়ছে বোলারের রক্ত। দয়া জানত না। একটি শতরানে কদাচ সেতৃপ্ত হয়েছে। দুশো, তিনশো এমনকী চারশো রানেও পৌঁছোতে চায় সে। কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ৪৫২ করেও ব্যাট সমর্পণ করেনি। দর্শকদের কাছে তার আবেদনের প্রচন্ডতা ও ক্ষিপ্ততা এখনও কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। স্কোরবোর্ডে তার নাম ওঠামাত্র যে-গর্জন মাঠ ঘিরে ধ্বনিত হত, তা নিছকই পূর্ব-অনুমিত হর্ষধ্বনি। ব্র্যাডম্যান কদাচিৎ তার ‘বাহিনী’কে হতাশ করেছে।

ব্র্যাডম্যান যেমন বোলারের শিরঃপীড়ার, তেমনই অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানের মানসিক শান্তি হরণের কারণ। একগাল হাসি নিয়ে সেগার্ড নেবে, সাজানো ফিল্ড দেখবে, ট্রাউজার্সে হ্যাঁচকা টান দেবে, ব্যাট হাতে তৈরি হয়ে দাঁড়াবে এবং তারপর তীক্ষ্ণস্বরে ‘রাইট’ বলেই প্রথম বল থেকে প্রথম রানটি নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়বে। এটাকে সেঅভ্যাসে পরিণত করেছিল। তারপর কখন যেন সে২০, ৩০, ৪০, ৫০ এবং অবশ্যম্ভাবী শতরানে পৌঁছে যেত। সেএকাই খেলে যেত এবং অন্যপ্রান্তের ব্যাটসম্যান ক্রমশই হীনতা ভাবে মধ্যে ডুবত। সব কিছুই যেন অতি সহজ, এইরকমভাবে ব্যাপারটাকে সেসবার চোখে প্রতিভাত করাত এবং ঘড়িকে আর একটি উৎখাতযোগ্য শত্রু বিবেচনা করত। তার আমলে বহু ব্যাটসম্যান তার বিরাট ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়ে অনুযোগ করেছে, অন্য সকলের থেকে ব্র্যাডম্যান বেশি ফুলটস ও শর্টপিচ বল পেয়েছে। তারা এটাই বোঝাতে চায়, ওর কপালটা ভালো। অবশ্যই সেভাগ্যক্রমে বলগুলি পেত না। আসলে যেভাবে সেচেয়েছে বোলাররা সেইভাবেই বল করেছে। সব কিছু তারই ইচ্ছানুযায়ী হত। তার ফুটওয়ার্ক, নিজের ওপর অগাধ আস্থা, তছনছ করে দিত বোলারদের; তাদের সম্মোহিত করত এবং তারা বুঝে উঠতে পারত না ওকে ঠাণ্ডা করার জন্য কোথায় বল ফেলতে হবে।

বোলিংয়ে বিপ্লবের কারণ হয়েছিল ব্র্যাডম্যান। লারউডকে ফলাগ্রে রেখে জার্ডিনের পরিকল্পনা—লেগসাইডে ফাস্ট বোলিং, মাথার উচ্চতায় বল লাফাবে, লেগসাইড ঘিরে ফিল্ডসম্যান—ছকা হয়েছিল তার ব্যাটিং গড়কে সম্ভব হলে অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য। সফল হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই (আট ইনিংসে ৫৬.৫৭ গড় রান)।কিন্তু ব্র্যাডম্যান যেভাবে এই বোলিংয়ের—লারউডের জীবনের দ্রুততম অধ্যায়—মোকাবিলা করেছিল, কোনো যুগের কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে তা সম্ভব হত না। আশ্চর্যজনক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ সেই মোকাবিলা! হয়তো বেপরোয়াও। কিন্তু অবস্থা বিচারে আর কী পন্থা নেওয়া যেতে পারে! সাহস এবং মৌলিকতা তখন দরকার ছিল। ব্র্যাডম্যান তা দেখিয়েছিল। লেগসাইডে দেওয়া লারউডের বল অন-এর দিকে সরে এসে অফ-এ মারা এবং এমন দ্রুততম বলকে, যা অস্ট্রেলিয়াবাসীরা আগে কখনো দেখেনি। লারউড ও লেগ-ফিল্ডের বিরুদ্ধে পরিকল্পনার দ্বারা ইচ্ছানুযায়ী সুদীর্ঘ ইনিংস গড়ার বা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কোনো যৌক্তিক উপায় সম্ভবপর ছিল না। ১৯৩২-৩৩-এ জার্ডিনের নিষ্ঠুর চ্যালেঞ্জের সামনে ব্র্যাডম্যান যে চোখ-ধাঁধানো উদ্ভাবনক্ষমতা, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে সংকল্প, চারিত্রিক কাঠিন্য দেখিয়েছিল, তার সারা জীবনে এর থেকে বিস্ময়কর আর কিছু সেকরেনি।

অনেকে বলেন ব্র্যাডম্যান কেতাব-ছাড়া। এ কথাটাও ঠিক নয়। তার ব্যাটিং জমাট বনিয়াদের ওপর গড়া। দুই পায়ের মাঝে সেব্যাট রাখত, স্টান্সটা অস্বাভাবিক; এবং বঁা-হাত বেশ খানিকটা তফাতে থাকত হ্যাণ্ডেলের ডান দিকে, এটা কেতাব-ছাড়া। ওর মারাত্মক পুল দ্রুত জমিমুখীন করায় এইভাবে ব্যাট ধরাটা দ্বিগুণ কার্যকরী হয়। কেতাব-বহির্ভূত কিছু যদি থেকে থাকে, তা ওর দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যরা যে গুডলেংথ বলকে বিপজ্জনক সন্দেহ করবে, ব্র্যাডম্যান সেটিকে ঘৃণাভরে শাস্তি দেবে। ওর কাছে গুডলেংথ নামক কোনো ব্যাপারই ছিল না। অকল্পনীয় আত্মবিশ্বাস, অসাধারণ বিচারবোধ, অসম্ভব রানের ক্ষুধা, অনতিক্রমণীয় মানসিক স্থৈর্য ও আত্মশৃঙ্খলা। যদি আভাস দেওয়া হত, (এবং এইসব আভাস কখনোই তার কান এড়াত না) অমুক বোলার তাকে বুঝে ফেলেছে, তাহলে সেই বোলারের ধ্বংসই আমন্ত্রণ করা হত।

কেউ কেউ বলেন, এখনকার আঁটো বঁাধুনির অধিনায়কত্বের বিরুদ্ধে ব্র্যাডম্যান টিকতে পারত না। চক্রাকারে সাজানো আধুনিক ফিল্ড, যার উদ্দেশ্য অক্ষম করে দেওয়া এবং অধুনা যা বহুল প্রচলিত, ব্র্যাডম্যানকে নাকি তা সীমিত করে দিত। আসলে ব্র্যাডম্যান মুচকি হেসে এই চ্যালেঞ্জ নিত। এই চক্রাকার ফিল্ড সেদেখেছে, কঠোর অধিনায়কদের বিরুদ্ধেও খেলেছে। ফিল্ড কীভাবে সাজানো হবে সেটা ব্র্যাডম্যানই ঠিক করে দিত, এটা ছিল তার কাছে মর্যাদার প্রশ্ন। বিপক্ষ অধিনায়করা বস্তুত তার ব্যাটিংয়ের সময় হাস্যকর হয়ে পড়ত। ব্র্যাডম্যানের বাউণ্ডারি-প্রবাহ রোধ করতে অধিনায়ক হয়তো এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ফিল্ডসম্যান সরালেন। অবধারিত সেই সরানো জায়গা দিয়ে ব্র্যাডম্যান পরের বলটি পাঠাবেই এবং একগাল হাসবে। জনতার এটা ভালো লাগত। বলের কাছে পৌঁছোতে তার ফুটওয়ার্ক ছিল বিদ্যুৎগতির, তাকে আটকে রাখা ছিল দুঃসাধ্য। পলকের মধ্যে চক্রাকার ফিল্ডের চাকার স্পোকগুলোকে সেবেঁকিয়ে দিত। বডিলাইন তাকে কিছুটা দমিয়েছিল বটে (তবু গড় ৫০-এর উপর), কিন্তু সেটা মূলত ছিল দৈহিক আক্রমণ এবং অপরোক্ষে ব্র্যাডম্যানের বিরাটত্বের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। তার সেরা বছর ১৯৩০-এইংল্যাণ্ডে এক সিরিজে ৯৭৪ রান। ৪০ বছর বয়সে ১৯৪৮-এ যখন শেষ বার ইংল্যাণ্ডে খেলতে আসে তখন খুনি মেজাজটা অনেক কোমল, তবু ১১টি শতরান করেছে। ১৯৫৬-এ ওভালে অস্ট্রেলীয় এক ইনিংসে দশ জনকেই জিম লেকার আউট করে সারের পক্ষে বল করে এবং ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে ১৯জনকে। ১৯৪৮-এ ব্র্যাডম্যান প্রায় ১,০০০ রান তোলে সেই ম্যাচগুলিতে, যাতে লেকার খেলেছে। এক বারও সেব্র্যাডম্যানের উইকেট পায়নি। তার ফুটওয়ার্ক ৪০ বছর বয়সেও স্পিনারদের খুন করেছে।

ব্র্যাডম্যানকে সর্বকালের সর্বোত্তম ব্যাটসম্যান বলতে অনেকেরই আপত্তি। কারণ একটিই : ‘স্টিকি’ উইকেটকে সেচাকর বানাতে পারেনি। এই একটি ব্যাপার ধন্দ হয়ে রয়ে গেছে ব্র্যাডম্যানের খেলার মধ্যে। দেখা গেছে তার বিজয়রথের চাকা মাঝে মাঝেই বসে গেছে সেইসব বৃষ্টিভেজা পিচে, যা মালিদের তদবিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে অসুবিধাজনক লেংথ থেকে ফাস্ট বলকে ফণা তুলতে বা স্পিনিং বলকে আরও মোচড় দিয়ে লাফিয়ে উঠতে প্ররোচিত করে। এই কারণেই ব্র্যাডম্যানকে বড়ো ব্যাটসম্যান বলার সময় হারবার্ট সাটক্লিফ সবসময় সযত্নে যোগ করতেন, ‘ভালো উইকেটে’।

টেস্টে এক দিনে ৩০০ রান করা ছাড়াও ব্র্যাডম্যান ছয় বার দ্বিশতাধিক রান করেছে এক দিনে। অথচ বৃষ্টিভেজা পিচে ইংরেজ বোলাররা ২০০-র কম রানে অস্ট্রেলীয় দলের ইনিংস যেসব খেলায় শেষ করে দেয়, তার ১৫টিতে ব্র্যাডম্যান খেলেছে। এই ১৫ ইনিংসে মাত্র চার বার সে১৫ রান অতিক্রম করে। যে লোক ১৯২৭ থেকে ১৯৪৮, ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি বিস্ময় তৈরি করে গেছে, যে লোক অলৌকিক ফুটওয়ার্ক ও দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জন্মেছে, স্পিন বোলিং জয় করতে সেকেন কবচকুন্ডলহারা কর্ণের মতো অসহায় হয়ে পড়ে বৃষ্টিভেজা পিচে! এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, বৃষ্টিভেজা পিচ ক্রিকেটের যাবতীয় স্বাভাবিক ব্যাপারেরই একটি অংশ এবং বিরাট ব্যাটসম্যান অবশ্যই জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি থাকবে যখন স্টিকি পিচের চ্যালেঞ্জ আসবে।

সি বি ফ্রাই এ সম্পর্কে লিখছেন :

মনে হয় যেন, নিখুঁত ফাস্ট উইকেটে বিরাটভাবে রান তোলার জন্য তার ক্ষমতা সম্পর্কে এবং সেই কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা নিজস্ব স্টাইলে সে(ব্র্যাডম্যান) এতই নিশ্চিত—যে স্টাইল খারাপ উইকেটে সফল হতে পারে না—তাই অস্বাচ্ছন্দ্যকর পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য স্টাইলের অদলবদল করাটা সেঘৃণিত কাজ মনে করত। টেকনিক বদল করলে খারাপ উইকেটে সেও যে কত ভালো খেলোয়াড় হত, তা আমি জানি। বিপজ্জনক উইকেটের জন্য দরকারি এমন কিছুই নেই যা কিনা ও নিজের খেলার অঙ্গীভূত করতে না পারত। সোজা বলের বিরুদ্ধে যেমনটি, ব্রেক করা বলের বিরুদ্ধেও নিখুঁতভাবে সেই ডিফেন্সই সেগড়ে তুলতে পারত…

এ সম্পর্কে ব্র্যাডম্যান কী বলে? তার ধারণা, স্টিকি উইকেট তো ব্যাটিংয়ের বিজ্ঞানকে পরিহাসের বস্তু করে তোলে। তাহলে তো ছেঁড়া টেবিলে নামি খেলোয়াড়রা বিলিয়ার্ডস খেলবে আশা করতে হয়। তার বক্তব্য, সেজানে বৃষ্টিভেজা নরম পিচে কদাচিৎই ব্যাট করতে হবে। সুতরাং শক্ত পিচে খেলার জন্য যে-টেকনিকটি সেরা, তাই সেপ্রয়োগ করে এবং তাতেই সেঅভ্যস্ত। এর মধ্যে স্টিকি উইকেটের টেকনিককে নাক গলাতে দিতে রাজি নয়। এবং এই টেকনিক অনায়ত্ত রেখেই সেটেস্ট ক্রিকেটে হ্যামণ্ডের থেকে সাতটি ও হাটনের থেকে দশটি বেশি শতরান করেছে এবং ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে তার ৩৭টি ম্যাচে ১৭টি অস্ট্রেলীয় জয়ের মধ্যে ১৩টিতে দিয়েছে শতরান এবং ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে হেরে যাওয়া তার ১১টি ম্যাচে দিয়েছে দুটি শতরান।

স্টিকি উইকেটে সফল হওয়ার যাবতীয় টেকনিক্যাল প্রয়োজনই ব্র্যাডম্যানের ছিল। যথা, দ্রুত ফুটওয়ার্ক, সুদক্ষ ব্যাক-প্লে, বলের লাইনে এসে খেলা, দেরি করে ব্যাট চালনা, ওভার পিচ বলের কাছে পৌঁছোনোর এবং পেটানোর ক্ষমতা, বাকি যাবতীয় ফরোয়ার্ড খেলা ছাঁটাই করা এবং অসুবিধাজনক লেংথের বল থেকে ব্যাটকে সরিয়ে রাখা। এতৎসত্ত্বেও চক্ষু, মস্তিষ্ক ও পদদ্বয়ের মধ্যে অকল্পনীয় দ্রুততায় সমন্বয় ঘটাবার অধিকারী ব্র্যাডম্যান স্টিকি উইকেটে অসফল। রে রবিনসনের ধারণা, এর কারণ পা বা হাত যতটা নয় তার থেকেও বেশি মানসিকতা। যে-পিচে বল আপন খেয়ালখুশিমতো আচরণ করে, সেখানে ব্যাট করায় ব্র্যাডম্যানের তীব্র বিরাগ। দাপটে প্রভুত্ব করায় সেএতই অভ্যস্ত ছিল যে, উইকেটের বিদ্রোহ বা বাম্পারের চক্রান্ত তার ব্যাটিং থেকে কতৃত্ব হরণ করত। তাকে তখন মনে হত সেই অসুখী ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বহু বছর যাকে লিমুজিনে অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখন সাইকেলে অফিসে যাচ্ছেন। ১৯২৮-এ ব্রিসবেনে তার প্রথম টেস্ট খেলার আগে পর্যন্ত ব্র্যাডম্যান স্টিকি উইকেট কখনো চোখে দেখেনি।

শুকনো উইকেটে এবং যখন সেতুঙ্গে, কোনো বোলারই ব্র্যাডম্যানকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। রান তোলার দ্রুতলয় সত্ত্বেও খুব কমই সেঅসুন্দরভাবে বল মাটি থেকে তুলে মেরেছে। ব্যাটসম্যানশিপের দাবাগ্নি সেজ্বালিয়েছে, জ্বালাতে গিয়ে নিজের হাত কখনও পোড়ায়নি। প্রত্যেক বোলার চেষ্টা করেছে মুহূর্তের জন্যও অন্তত ব্র্যাডম্যানকে খ্যাতিচ্যুত করতে। প্রথম রানটি বা দ্বিশত কি ত্রিশত সম্পূর্ণ করার রানটি পাওয়ার জন্য কেউ তাকে একটিও সহজ বল দেয়নি। সেইজন্য ব্র্যাডম্যানও কখনো কোনো ব্যাটসম্যানকে তার দাতব্যের পাত্র করতে উৎসুক হয়নি। দিনের পর দিন তাকে ব্যাট করে যেতে হয়েছে দূরান্ত থেকে আসা, সকাল থেকে লাইন-দেওয়া দর্শকদের মন ভরানোর জন্য। ইংল্যাণ্ড সফরকালে শারীরিক বা মানসিক অবসাদের জন্য যদি সেজানাত— খেলব না, তাহলে বহু কাউন্টি ক্লাব দেউলিয়া হওয়ার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে যেত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে খেলতে হয়েছে, পরিস্থিতি দাসে পরিণত করেছিল প্রভুকেই। এ যুগের আর কোনো ক্রিকেটারই দাবি মেটাতে বা আশা পূরণ করতে ব্র্যাডম্যানের মতো বিবেকের ডাকে এতটা সাড়া দিয়েছে কি না সন্দেহ। শতরান করেও সেউইকেট ছুড়ে দিয়ে আসত না। দলকে জেতানোর মতো অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ার বা পরাজয় থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন ছাড়াও ছেলে, বুড়ো, রসিক ও অজ্ঞ সব রকমের দর্শককে মাতিয়ে রাখার কাজ তাকে করতে হত।

ব্র্যাডম্যান কঠিনভাবে খেলেছে ঠিকই কিন্তু নীচভাবে খেলেনি। আয়াস এবং প্রয়াস বাদ দিয়ে সেক্রিকেটকে ভাবতে পারেনি। প্রতিপক্ষকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে কিন্তু তাকে দাক্ষিণ্যে রাজি হয়নি। প্রবল বিরোধিতার সেকদাচ অবমাননা করেছে বা তার থেকে দূরে সরে গেছে কিন্তু নির্দয় হয়েছে অযোগ্য দুর্বলচিত্ততার প্রতি। ভালোবাসা যত-না পেয়েছে তার থেকেও বেশি আদায় করেছে শ্রদ্ধা। সহজে সেবন্ধু করে না, বন্ধুত্ব রক্ষার জন্যও নিজের পথ ছেড়ে বেপথে যায় না। অসামাজিক আখ্যা সেপেয়েছে তার কারণ, যেকোনো লোকের সঙ্গে দহরম-মহরম করায় তার রুচি কম। তার অ-জনপ্রিয়তার আংশিক কারণ তার প্রচন্ড ক্ষমতা এবং ওস্তাদি। তার সাফল্য সহজেই মানুষের দুর্বল রিপু ঈর্ষাকে জাগিয়ে তুলেছিল। ব্র্যাডম্যান তার সেরা সময় নি:সঙ্গ কাটিয়েছে। প্রতিভাই তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল অন্যদের থেকে।

কঠোর এবং চতুর অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানের করায়ত্ত ছিল প্রতিটি কূট চাল। চমকপ্রদ তৎপর ফিল্ডসম্যান, হরিণের মতো দ্রুতগতি, বাউণ্ডারি থেকে নির্ভুল নিক্ষেপে বল পৌঁছে দিত উইকেট-কিপারের হাতে। পরিহাসরসিক বক্তারূপে ক্রিকেটে তার জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। সেআগেও যেমন এখনও তাই, অসাধারণ মানুষ। যতগুলি টেস্ট রেকর্ড এখনও তার নামে রয়েছে, একদা ততগুলি ব্যবসায় সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।

ব্র্যাডম্যান ১৯৭৪-এ লণ্ডনে আসে ১৩ বছর পর। প্রশ্নোত্তরে জানায়, ইংল্যাণ্ডে তার দেখা সেরা ব্যাটিং নটিংহামে ম্যাককেবের ২৩২, অস্ট্রেলিয়ায় দেখা সেরা ব্যাটিং মেলবোর্নে বিশ্ব একাদশের পক্ষে সোবার্সের ‘অবিশ্বাস্য’ ২৫৪। তার খেলার জীবনে সেরা বোলার বিল ও রিলি, ইংল্যাণ্ডের সেরা অ্যালেক বেডসার। নিজের সেরা ব্যাটিং? ১৯৩০-এ লর্ডসের ২৫৪ আর লিডসে একদিনে ৩০০ রান। আজকে এমন সুস্বাস্থ্য বজায় আছে কী করে?—‘‘গত ৬৫ বছর যাবৎ সু-জীবন যাপনে।’’ একটি নৈশভোজে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ৬৫ বছরের ব্র্যাডম্যান এই কথাগুলি বলে :

আইনের অধীনে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নুরেমবার্গে লর্ড বারকেট যা বলেছিলেন সেই সততা, আন্তরিকতা, বিশুদ্ধতা ও মানবিকতাই আমাদের চাই, নয়তো এই পিচ খেলার অযোগ্য হয়ে উঠবে।

ডন ব্র্যাডম্যান সারাজীবন আইন মেনে ‘ক্রিকেট’ খেলে গেছে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে ‘অযোগ্য পিচ’ সেপ্রত্যাখ্যান করেছে। তার বিরাটত্বের পরিলেখ মাত্র এই বইয়ে আঁকতে চেষ্টা করেছি। মাঠে যত বড়ো ক্রিকেটার, মাঠের বাইরেও তত বড়ো চরিত্র। অতি সামান্য থেকে সংকল্প, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণবলে অসামান্য হয়েছে। খেলার ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে ডনের মতো সুদীর্ঘকাল এতখানি মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব কোনো খেলায় আর কেউ বোধ হয় বজায় রাখতে পারেনি। ওর জীবনকথা ওর খেলার মতোই অভিভূতকারী, প্রেরণাদায়ক এবং মানুষের ক্ষমতাকে নতুন সীমান্তের দিকে ঠেলে দিতে উত্তেজিত করায়। অনুভব করছি, ডনের সঙ্গে আমাদের এখনকার ছেলেমেয়েদের পরিচয় হওয়া দরকার। আর সেই উদ্দেশ্যেই কিশোরদের পড়ার জন্য এই বইটি লিখলাম।

মতি নন্দী

০১. প্রথম খেলা

দুটি স্কুলের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ। খেলা এইবার শুরু হবে। আগন্তুক স্কুল দলের ফাস্ট বোলার উইকেট থেকে পা মেপে অনেক দূরে গিয়ে দাগ কাটল। জবরদস্ত বোলার, তাতে আর সন্দেহ নেই। ঘুরে দাঁড়াল সে, তারপর ছুটতে ছুটতে এসে বল করল। বিদ্যুৎগতি বল। ব্যাটসম্যান পলক ফেলার আগেই একটা স্টাম্প সামারসল্ট নিয়ে হাঁফ ছাড়ল।

পরের ছেলেটি এল ব্যাট করতে। ছেলেটি গার্ড নিচ্ছে, বোলার অধৈর্য হয়ে বলটা লোফালুফি করছে এ-হাত ও-হাতে। তারপর আবার সেছুটে এল বল হাতে, আর একবার আম্পায়ারের আঙুল আকাশমুখো হল আউটের সংকেত জানিয়ে।

ছাত্র-দর্শকদের মুখ আমশি হয়ে এল। হ্যাটট্রিক করবে নাকি? পরের ছেলেটি ব্যাট করতে নামছে। তাকে দেখে কারুর সন্দেহ রইল না আর—হ্যাটট্রিক হবেই। অ্যাত্তোটুকু এগারো বছরের টিংটিঙে, এখানকারই এক ছুতোরের ছেলে। বাওরাল ইন্টারমিডিয়েট হাই স্কুলের এই ছাত্রটি যে আগে কখনো ক্রিকেট ম্যাচ খেলেনি, একথা স্কুলের সব ছেলেই জানে। সুতরাং হ্যাটট্রিক অবধারিত। তাই নয়, বড়ো বড়ো ছেলেদের ব্যাট বহন করা ছাড়া ছেলেটি জীবনে কখনো ব্যাটও ধরেনি। খেলার অভিজ্ঞতা বলতে গাছের ডালের ব্যাট নিয়ে খেলা ছাড়া আর কিছু নেই।

ছেলেটির নাম ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।

বস্তুত অন্য ছেলেদের খেলা দূর থেকে দেখে সেযতটুকু বুঝেছে, তার বেশি আর কিছু ধারণা ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে তার ছিল না। যে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে, সেখানে কোনো খেলার পাট ছিল না। এখন যে আপার স্কুলে পড়ছে, সেখানেও প্র্যাকটিসের জন্য ব্যাট, স্টাম্প মেলে না, ক্রিকেট পিচও নেই। এসব ১৯১৯ সালের অস্ট্রেলিয়ার কথা। ওই বছরই প্রথম মহাযুদ্ধ থামল, ওই বছরই এরোপ্লেনে সরাসরি প্রথম আটলান্টিক পার হয় অ্যালকক এবং ব্রাউন।

ডনকে খেলতে নেওয়া হয়েছে তার কারণ আট মাইল দূরে স্কুলটার সঙ্গে এই ম্যাচের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। সেটা অবশ্য বোঝাই যাচ্ছে। কেননা, বাওরালে একমাত্র যে ভালো পিচটা আছে, খেলাটা সেখানে না হয়ে হচ্ছে ফুটবল মাঠে। মাঠে ঘাসের একটা শিষও নেই; শুধুই ধুলো।

ডন গার্ড নিল। বোলার ছুটতে শুরু করল। বল করল। সেই একই বল যা আগের দুজনকে আউট করেছে। স্থির চোখে ডন বলটাকে লক্ষ করে এক পা পিছিয়ে এসে ব্যাট পাতল। বল ব্যাটে লেগে পায়ের কাছে মাটিতে ঢলে পড়ল।

হ্যাটট্রিক হয়নি। দর্শকরা চোখ কচলে মাঠের দিকে তাকাল। বোলারের চোখ-মুখে হতাশা, বিরক্তি, রাগ। হ্যাটট্রিকটা হল না এই হতচ্ছাড়ার জন্য। রাগে গরগর করে এবার সেআরও জোরে বল দিল। ডন এবার ক্রিজ থেকে বেরিয়ে হাঁকড়ে ব্যাট চালাল। মারটা অবশ্য কেতাবে মিলবে না, কিন্তু কাজের মার। চারটে রান এর থেকে ডন পেয়ে গেল।

বোলারটি যতভাবে সম্ভব চেষ্টা করেও পেরে উঠল না। নতুন ছেলেটি মাঠের সর্বদিকে ঠেঙিয়ে বল পাঠাচ্ছে। ওর ব্যাট ধরা গ্রিপটি একটি অদ্ভুত রকমের, খেলার স্টাইলও ভালো, কোচেরা যেরকমটি শেখান সেরকম নয়। কিন্তু তাতে কী যায় আসে! ছেলেটি নিজের ওপর যেরকম আস্থা নিয়ে আর নিশ্চিত ভঙ্গিতে খেলে যাচ্ছে, তাতে ওকে ক্রিকেটারের মতোই দেখাচ্ছে; এবং রানও পেয়ে যাচ্ছে।

এবার বোলার বদল করা হল। প্রথম বোলার যে ভগ্নহৃদয় হল ডন ব্র্যাডম্যান দ্বারা। ডনের স্কোর বাড়ছে। অন্য প্রান্তে ব্যাটসম্যানরা আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। ডন রয়ে গেল। যখন খেলা শেষ হল তখন সে৫৫ নট আউট।

ডনের ক্রিকেট জীবন শুরু এই খেলা থেকে। ডি জি ব্র্যাডম্যান (‘জি’ হচ্ছে জর্জ) নামটা এই প্রথম স্কোর বুকে লেখা হল। সেদিন যারা মাঠে ছিল তাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না এই ধুলো-ভরতি ফুটবল মাঠটা একদিন তকতকে সবুজ ক্রিকেট মাঠে রূপান্তরিত হয়ে নাম নেবে ব্র্যাডম্যান ওভাল।

কারুর পক্ষে সেদিন ভবিষদবাণী করাও সম্ভব ছিল না একদিন ডন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটের প্রতিভারূপে স্বীকৃত হবে; এক দশকেরও বেশিকাল অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব এবং তার দ্বিগুণ সময়কাল ধরে ক্রিকেটের ওপর আধিপত্য করবে; সংগ্রহ করে জড়ো করবে ব্যাটিং রেকর্ড, যা বিশ্লেষিত ও আলোচিত হবে যতদিন পৃথিবীতে ক্রিকেট খেলা হবে।

সেদিন যারা মাঠে ছিল তারা কী করেই-বা বুঝবে, ব্র্যাডম্যান নামটা একদিন পৃথিবীতে বিখ্যাত ও সম্মানিতদের অন্যতমরূপে গণ্য হবে; গ্রাম্য ছুতোরের ছেলেটি রাজরাজড়া, প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলবে; নাইট হয়ে স্যার খেতাব পাবে এবং টুরিস্টরা অ্যাডিলেডের অন্যতম দ্রষ্টব্যরূপে তার বাড়িটিকে গণ্য করবে।

এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই হয়েছে। অসুস্থতা তার খেলার জীবনকে পঙ্গু করলেও, অত্যধিকরূপে সফল লোকেদের বিরুদ্ধে যেরকম ঈর্ষাকাতর বিষাক্ত সমালোচনা হয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে সেরকম হওয়া সত্ত্বেও, ব্র্যাডম্যান টেস্ট ক্রিকেটে প্রতি তিন বার ক্রিজে গিয়ে একটি করে সেঞ্চুরি করেছে। চার রানের জন্য তার টেস্ট গড় ১০০ হতে পারেনি, কিন্তু তাতে কীই-বা আসে যায়! ডন যখনই ব্যাট করে তখন হুড়হুড় করে লোক টিকিট কেটে মাঠে ঢুকেছে। যে ম্যাচে খেলেনি, লোকেও সে-খেলা দেখতে আসেনি। ক্রিকেটে খুব বেশি আগ্রহ নেই এমন লোকেদের কাছেও নায়কের শ্রদ্ধা পেয়েছে। ক্রিকেট দুনিয়াকে সেবেঁধেছিল একই বঁাধনে— তার খেলার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলে। ভারতে, দক্ষিণ আফ্রিকায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজে, নিউজিল্যাণ্ডে, ইংল্যাণ্ডে এবং অস্ট্রেলিয়াতে সর্বত্রই ডন ছিল খবর।

বিরাট বিরাট রান করে সেক্রিকেটের প্রকৃতিটাই বদলে দেয়। ব্র্যাডম্যান-পূর্ব আমলে ক্যাপ্টেনরা ফিল্ড সাজাতেন এবং বোলাররা বল করতেন উইকেট লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্র্যাডম্যান আসার পর তাঁরা মনোনিবেশ করলেন রান ওঠা কমাবার চেষ্টার দিকে, আউট করার দিকে নয়। এই পরিবর্তনে খেলা মন্থর হয়ে পড়ে। অন্যদের মতো ডনও এতে ব্যথিত হয়।

এগারো বছর বয়সে ক্রিকেটে ডনের নাটকীয়ভাবে প্রবেশের পিছনে যে-জিনিসটি কাজ করেছে, সেটি হল তার নি:সঙ্গতা।

নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনির প্রায় দুশো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কুটামুন্ড্রা নামে একটা গ্রামে ১৯০৮-এর ২৭ আগস্ট ডনের জন্ম। যখন তার বয়স তিন, তাদের পরিবারটি চলে আসে সিডনির ৮০ মাইল দক্ষিণে, প্রায় তিন হাজার লোকের বাস বাওরাল নামে এক গ্রামে। কুটামুন্ড্রা ও বাওরাল কৃষি অঞ্চলের গ্রাম।

ডন তার পরিবারে কনিষ্ঠতম সন্তান। বাবা জর্জ ব্র্যাডম্যান, মা এমিলি, তিন দিদি আইলেট, লিলি এবং মে; দাদা ভিক্টর ডনের ঠিক উপরে, চার বছরের বড়ো। ওদের বাড়ির কাছাকাছি ডনের সমবয়সি কোনো ছেলে ছিল না, ফলে স্কুলের সময় ছাড়া ডনকে বাকি সময় একাই কাটাতে হত।

তার বাবা, দাদা এবং দুই মামা ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন। ক্রিকেটের প্রতি আসক্তিটা ডন এঁদের কাছ থেকেই পায়। কিন্তু তাঁদের এমন সামর্থ্য ছিল না যে, ডনকে ক্রিকেটের সরঞ্জাম বা খেলা শেখার বই কিনে দিতে পারেন।

তাই ডনের সময় কাটানোর উপায় ছিল একা একা ক্রিকেট খেলা। খেলাটা নিজেই বার করেছিল।

বাড়ির পিছনে ইটের দুটো ছোটো থামের ওপর একটা ৮০০ গ্যালনের বড়ো জলের ট্যাঙ্ক ছিল, তার তিন দিকে গোলাঘরের দেওয়াল। উপরে ছাদ, বর্ষা হলেও খেলা যেত। একটা পুরোনো গলফ বল দেওয়ালে ছুড়ত, দেওয়াল থেকে ফেরার সময় ডন বলটাকে একটা ছোটো ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে মারার চেষ্টা করত। ইটের দেওয়ালে ছোড়া গলফ বল খুব জোরেই ফিরে আসে। সুতরাং ডন যা করার চেষ্টা করত, সেটা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু দিনের পর দিন চেষ্টা করে নি:সঙ্গ ডন এই খেলায় সড়োগড়ো হয়ে ওঠে।

তিন দিকে দেওয়াল এক দিকে খোলা, তাই লেগের দিকে ঘুরিয়ে যতদূর সম্ভব ততদূরে বল মারতে পারত। একা একাই ডন ম্যাচ খেলত আর দলের এগারো জনের প্রত্যেকের হয়ে ব্যাট করত। দলে থাকত তার হিরোরা, অস্ট্রেলিয়ার সেই আমলের ক্রিকেট তারকারা : চার্লি ম্যাকার্টনি, জনি টেলর, জ্যাক গ্রেগরি, কলিন্স প্রভৃতিরা।

দেওয়ালে বল মেরে খেলায় পোক্ত হয়ে যাওয়ার পর ডন খেলাটাকে আরও কঠিন করার একটা উপায় বার করে। বাড়ির কাছে লোহার রেলিং-ঘেরা একটা ছোটো গোচারণ ভূমি ছিল। গলফ বলটাকে সেতিরিশ বা চল্লিশ ফুট দূরে থেকে রেলিংয়ে ছুড়ত আর ফিরতি বলটাকে লোফার বা মারার চেষ্টা করত। এজন্য প্রচন্ড নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে তাকে ছুড়তে হত, যাতে বলটা তার দিকেই আসে; বলটা যখন আচমকা সামনের দিক থেকে আসে, তখন সেটা লোফার জন্য তীক্ষ্ণ আন্দাজ করতে ও শরীরটাতে লহমায় গতিসঞ্চার করতে হত।

ডন নিছকই পরিবেশের চাপে, চোখ ও কবজিকে প্রশিক্ষিত করার, সময়বোধ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সংযুক্ত চালনা নিখুঁত করে তোলার অদ্ভুত এক পদ্ধতি বার করে ফেলে। সন্দেহ নেই, বাওরালে বাড়ির পিছনে ডন যে-দক্ষতা অর্জন করে, তার সঙ্গে তার মেধা এবং একাগ্রতা যুক্ত হয়ে তাকে ক্রিকেটের সবথেকে ওস্তাদ ব্যাটসম্যানে, নিরাপদতম ফিল্ডারদের একজনে পরিণত করে।

০২. প্রথম শতরান

বারো বছর বয়সে ডন ব্র্যাডম্যান বাওরাল হাই স্কুলের প্রথম টিমের কনিষ্ঠতম সদস্য হয় এবং ‘সত্যিকারের’ পিচে জীবনে প্রথম খেলতে নামে। অস্ট্রেলিয়ার জেলাগুলিতে যেরকম পিচ হয়ে থাকে কংক্রিটের ওপর ম্যাটিং ঢাকা। সিডনিতে এসে গ্রেড ক্রিকেট খেলার আগে পর্যন্ত ডন কখনো ঘাসের পিচে খেলেনি। অস্ট্রেলীয় আবহাওয়ায় ঘাসের পিচ রক্ষণাবেক্ষণের যা খরচ, গ্রামের ক্লাবগুলির পক্ষে তা সামলানোর সাধ্য ছিল না।

প্রথম একাদশের পক্ষে প্রথম খেলাতেই ডন মিটাগং স্কুলের বিরুদ্ধে শতরান করে। মোট ১৫৬ রানের মধ্যে ডনের রান ১১৫ নট আউট। বলা বাহুল্য, ডন খুশিতে ডগমগ। পরের দিন হেড মাস্টারমশাই গোটা টিমটাকে মাঠে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘কাল তোমাদের মধ্যে একজন শতরান করেছে শুনলাম। ভালো কথা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, খেলতে গিয়ে সেখানে স্কুলের একটা ব্যাট ফেলে রেখে দিয়ে আসতে পার।’ ডনের শতরানটা একদমই মাঠে মারা যায়।

ডন স্কুলের হয়ে আর একটি মাত্র খেলায় নেমেছিল। রান ছিল ৭২ নট আউট। অর্থাৎ আউট না-হয়ে ১৯৭ রান করে দুটি খেলায়। আজকের দিনে হলে নিশ্চয়ই এইরকম ছেলে সঙ্গে সঙ্গে স্কুল কোচ বা গেমস মাস্টারের নজরে পড়ত এবং তার খেলার বিকাশ যাতে ঘটে তার ব্যবস্থা হত। কিন্তু ডনের আমলে স্কুলে স্কুলে তখন খেলা নিয়ে এখনকার মতো মাতামাতি ছিল না।

ক্রিকেট সবচেয়ে প্রিয় হলেও ডন কিন্তু স্কুলের হয়ে টেনিস ও রাগবি খেলেছে আর অ্যাথলেটিকসে ১০০ গজ থেকে আধ মাইল পর্যন্ত সব ক-টি পাল্লার দৌড় চ্যাম্পিয়ন হয়। গ্রামের ছেলেদের মতোই সেঅনেক দূর দূর হেঁটে শিকার করত, নদীতে মাছ ধরত। সাঁতার শিখতে গিয়ে দু-বার প্রাণান্তকর ব্যাপার ঘটায় আর জলে নামতে যায়নি, পড়ার মধ্যে অঙ্কটাই ডনের ভালো লাগত, তারপরই বিজ্ঞান।

তেরো বছর বয়সে ডন বাওরাল ক্রিকেট টিমের স্কোরার হয়, মামা জর্জ হোয়াটম্যান যেহেতু অধিনায়ক তাই ডনের এই পদপ্রাপ্তি। ২৫-৩০ মাইলের মধ্যে যেসব গ্রাম, তাদের সঙ্গেই ম্যাচ খেলা হত। টিমের সঙ্গে ডনও যেত, লরিতে কেরোসিন কাঠের একটা বাক্সের ওপর বসে।

একদিন ওরা খেলতে গেছে ছয় মাইল দূরে মস ভেল নামে একটা জায়গায়, সেদিন বাওরাল টিমের একজন আসেনি, দশ জন খেলোয়াড় আর ডন ছাড়া বাওরালের সঙ্গে বাড়তি একটি লোকও নেই। ‘ডন, খেলবি নাকি?’ মামা জিজ্ঞাসা করলেন। ডন তো খেলার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়েই।

ডনকে ব্যাট করতে পাঠানো হল দশ নম্বরে, ওকে দেখে দর্শকরা তো হেসেই খুন। হাফপ্যান্ট-পরা একটা ছেলেকে প্রায় তারই সমান উচ্চতার ব্যাট হাতে গম্ভীরভাবে মন্থর গতিতে উইকেটের দিকে যেতে দেখে (সারাজীবন ব্র্যাডম্যান সর্বদা উইকেটে যেত মন্থরভাবে) মস ভেলের এক সমর্থক চিৎকার করে বলে, ‘ওরা এখন দেখছি খোকাদের খেলাচ্ছে।’

দয়াপরবশ হয়ে মস ভেলের বোলার প্রথম বলটি দেয় শিশুদের উপযোগী করে। একঘণ্টা পরে দেখা গেল অপ্রতিভতায় এবং পরিশ্রমে রক্তিম মুখে বোলারটি তার যাবতীয় অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধি ঢেলে বল করে যাচ্ছে আর ছেলেটি তাকে পেটাচ্ছে। ডন সেদিন বড়ো রান করতে পারেনি ব্যাটের আকারের জন্য। মস ভেল টিমেরও সেদিন লজ্জা রাখার জায়গা ছিল না। তারা ডনকে আউট করতে পারেনি। ডন ৩৭ রানে অপরাজিত থাকে। ম্যাচটি পরের শনিবারেও গড়ায়। ডনকে দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেন করতে পাঠানো হয়, এবারও খেলা শেষে অপরাজিত থাকে ২৯ রানে।

সিড কুপিট নামে বাওরাল টিমের একজন এরপর ডনকে একটি ফাটা পুরোনো ব্যাট উপহার দেন। গর্বে বুক ফুলে উঠল ডনের। বড়োদের সাইজের এবং তার পক্ষে খুব ভারী হলেও জীবনে এই প্রথম নিজস্ব একটা ব্যাট তার হল। ব্যাটটার তলার দিক থেকে তিন ইঞ্চি কেটে দেন ডনের বাবা। প্রত্যেক ম্যাচে ডন ব্যাটটাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। কিন্তু বাওরাল দলের আর কেউ অনুপস্থিত হয়নি, ব্যাটটা বওয়াই সার হত।

ঠিক এই সময়ই গিলিগ্যানের ইংল্যাণ্ড দল পঞ্চম টেস্ট খেলতে সিডনিতে আসে ১৯২১ সালের ফেব্র¦য়ারি মাসে। ডনের বাবা ক্রিকেট খুবই ভালোবাসেন। ঠিক করলেন, সিডনিতে গিয়ে প্রথম দু-দিনের খেলা দেখবেন। ডন বায়না ধরল, সেও দেখতে যাবে। নিয়ে অবশ্য যেতেই হল। জীবনে প্রথম ডন সিডনি ক্রিকেট মাঠ দেখল। দেখে অভিভূত হল। অস্ট্রেলিয়ার তখনকার সেরা ব্যাটসম্যান চার্লি ম্যাকার্টনিকে ১৭০ রান করতে দেখল। পরবর্তীকালে প্রায়শই ডনের সঙ্গে ম্যাকার্টনির তুলনা করা হত। এই খেলাতেই সেপ্রথম চাক্ষুষ দেখল ফ্র্যাঙ্ক উলি, প্যাটসি হেনড্রেন, টেড ম্যাকডোনাল্ড, জনি টেলর, ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংকে। এদের নিয়েই দল গড়ে সেবাড়ির পেছনে টেস্ট ম্যাচ খেলত। তার হিরোদের আরও কাছ থেকে দেখার জন্য ডন সিডনি প্যাভিলিয়নে উঁকিঝুঁকিও দিয়েছিল। তখন সেজানত না কয়েক বছর পর তাকে দেখার জন্য ছেলেরা এইভাবেই প্যাভিলিয়নে উঁকি দেবে।

তখন পর্যন্ত ডনের জীবনে, এই টেস্ট ম্যাচ দেখাটাই প্রচন্ডতম ঘটনা। বাবাকে সেতখনই বলেছিল, ‘এই মাঠে না-খেলে আমি ছাড়ব না।’ বাবা শুনে অবশ্যই হেসে উঠেছিলেন। সিডনি মাঠে ডন এরপর যে-খেলাটি দেখে, তাতে সেও একজন অংশগ্রহণকারী। ডন এরপর যত প্রথম শ্রেণির খেলা দেখেছে তা দর্শক হিসেবে নয়, অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় হিসেবে। জর্জ ব্র্যাডম্যান তাঁর ছেলের বহু ইনিংস সিডনি মাঠে দেখেছেন, এমনকী ১৯৪৯-এ এই মাঠে ডনের শেষ খেলাটিও।

স্কুলের পড়া ছেড়ে ডন এরপর চাকরি নেয় বাওরালেই পার্সি ওয়েস্টব্রুক নামে সম্পত্তি বেচাকেনার এক দালালের অফিসে। বাওরালে খেলার পক্ষে বয়সটা তখন খুবই কম, মাত্র ১৬। অন্য আর কোনো টিমও নেই যেখানে সেনিয়মিত খেলতে পারে, তাই ডন এই সময় মন দেয় টেনিসে। মামার একটা কোর্ট ছিল। সেখানে এক বছর সেশুধু টেনিসই খেলে। পরের বছরও টেনিসে মন দেয় বটে কিন্তু রক্তে রয়েছে ক্রিকেটের ডাক, সুতরাং বাওরাল ক্রিকেট টিমে খেলার সুযোগ পেতেই ডন টেনিস ছেড়ে দেয়।

ডনের প্রথম ইনিংস স্কোরারকে খুবই খুশি করে। প্রথম বলেই সেআউট হয়ে যায়। ডনের পক্ষে এই ব্যর্থতা ভালোই হয়, কেননা পরাজয়কে সেকখনোই মেনে নিতে পারেনি। পরাজয় তাকে আরও কঠিন, আরও দৃঢ় করে তোলে। ওর ক্রিকেট জীবনটাই এইভাবে কেটেছে। যদি কোনো বোলার এক ইনিংসে অল্পেই ওকে আউট করে থাকে, তাহলে অন্য ইনিংসে সেই বোলারকে বার বার বাউণ্ডারিতে আছড়ে পড়তেই হবে। প্রথম বলে আউট হওয়ার লজ্জা আর রাগ কাটাতে সেক্রিকেটে মনপ্রাণ ঢেলে দেবে ঠিক করল।

০৩. প্রথম দ্বিশত রান

সতেরো বছর বয়সেই ডন সর্বকনিষ্ঠ নিয়মিত খেলোয়াড় বাওরাল টিমের। ক্রিকেটের বড়ো রানের যুগ আসন্ন হয়ে পড়ল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাওরালের মানুষ বিস্ময়ে ও গর্বে ‘আমাদের ডন-এর’ ব্যাটিং কীর্তির কথা বলতে শুরু করে। এই কীর্তির প্রথমটি প্রতিবেশী উইঙ্গেলোর বিরুদ্ধে একদিনে ২৩৪ নট আউট। শেষ ৫০ রানে আছে চারটি ছয় ও ছয়টি চার। ডন এত রান করে—বিল ওরিলি নামে উইঙ্গেলো দলের একজন লেগব্রেক বোলার চমৎকার বল করা সত্ত্বেও। ডনের সঙ্গে বিলের বহু সংঘর্ষের প্রথমটি ঘটে এই খেলায়।

এই খেলাগুলি হত পর পর দুই শনিবার, প্রথম দিন এক দলের, পরের দিনে অন্য দলের মাঠে। ডন ২৩৪ নট আউট থাকে বাওরালের মাঠে। পরের শনিবার উইঙ্গেলোয় খেলা। সারা বাওরাল সেখানে হাজির ডনের ব্যাটিং দেখতে। তারা দেখল, প্রথম ওভারেই ওরিলির একটা দ্রুত লেগব্রেক বল ছত্রাকার করে দিল ডনের উইকেট। কয়েক বছর পর এই দুজন একসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে টেস্ট খেলে এবং ডনের ব্যাটিং, ওরিলির বোলিং ম্যাচ জেতার এক ভয়ংকর জুড়ি হয়ে ওঠে। ওরিলি ২৭ টেস্টে ১৪৪ উইকেট পায়, তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের ব্যাটসম্যান ১০২ জন। ডন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছে, জীবনে ওরিলির থেকে বড়ো কোনো বোলারের বিরুদ্ধে সেখেলেনি।

এরপর মরশুমের সবথেকে বড়ো খেলা এল সেই মস ভেল-এর সঙ্গে, যার বিরুদ্ধে ডন ১৩ বছর বয়সে খেলেছিল। ম্যাচের নিয়ম, খেলাটির মীমাংসা হতেই হবে; সেজন্য যত সময় লাগে তো লাগুক। খেলা প্রতি শনিবার চার ঘণ্টা করে। ডনের জন্য ম্যাচটি শেষ হতে সময় লাগে পাঁচটি শনিবার।

প্রথম শনিবারে ডন বাওরালের ইনিংস ওপেন করে ৮০ রানে অপরাজিত থাকে। পরের শনিবারে ২৭৯ নট আউট, বাওরালের এক উইকেটে ৪৭৫। তৃতীয় শনিবারে ডন বাউণ্ডারির কিনারে ক্যাচ আউট হয় ঠিক ৩০০ রানে। বাওরালের হয় ৯ উইকেটে ৬৭২ রান। ডনের মামা হোয়াটম্যান করেন ২২৭, দুজনে সাড়ে তিন ঘণ্টায় তোলে ৩২৩ রান। ডনের দাদা ভিক্টর করে এক রান। বাওরাল জেতে ইনিংস ও ৩৩৮ রানে। ডন ৩৯ রানে চারটি উইকেটও পেয়েছিল।

ডনের মা বলেছিলেন, ডন শতরান করতে পারলে একটি ব্যাট দেবেন। তিনশো রান করার জন্য চেয়ে বসল তিনটি ব্যাট। অবশেষে অনেক যুক্তিতর্কের পর ডনকে একটি ব্যাটই দেওয়া স্থির হয়। ডন অবশ্য তাতেই খুশি হল। জীবনে এই প্রথম তার নতুন সত্যিকারের ব্যাট পাওয়া। যে-প্রতিষ্ঠানের ব্যাট ডন পছন্দ করে কেনে, পরে তারাই ডনের সইয়ের ছাপ দেওয়া ব্যাট বাজারে বিক্রি করত।

পাঁচ সপ্তাহ ধরে খেলা হওয়ায় এই ম্যাচটার খবর ‘সিডনি সান’ পত্রিকায় মজা করে বেরিয়েছিল। সেইসঙ্গে ডনের নামও বাওরালের বাইরে পৌঁছোয়। একটা কার্টুনে দেখানো হয়, বাচ্চা ডন এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত উইকেটের ওপর খরগোশের মতো দৌড়োচ্ছে; তার পরের ছবিতে সেপূর্ণবয়স্ক লোক; তার পরের ছবিতে সেবৃদ্ধ, বেতো রুগির মতো নুয়ে পড়েছে, দাড়ি ঠেকে গেছে মাটিতে এবং শেষ ছবিতে বাওরালের দুজন স্বর্গে সন্ত পিটারকে জিজ্ঞাসা করছে— ম্যাচটা শেষ করতে হবে, মস ভেল ক্রিকেট মাঠটা কোথায় বলতে পারেন?

এই কার্টুনটা নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য ক্রিকেট দলের নির্বাচকদের মনে গেঁথে যায়। মস ভেলও ডনের এই ইনিংসের কথা ভোলেনি। কয়েক বছর পর ডন যখন বাওরাল ছেড়ে সিডনিতে এসে বাস করছে এবং রাজ্য দলের হয়ে খেলছে, তখন একজন ক্রিকেটার মস ভেলে এসে সেখানকার একজনকে কথাপ্রসঙ্গে বলে— ‘ব্র্যাডম্যান চলে যাওয়ায় আপনারা নিশ্চয়ই দুঃখিত হয়েছেন!’

‘দুঃখিত?’ মস ভেলের লোকটি কটমটিয়ে তাকাল। ‘দুঃখিত? চলে গেছে, বঁাচা গেছে। ও শেষ বার যখন এখানে খেলে, টানা চারটে শনিবার আমাকে ফিল্ড করতে হয়েছে। আমাদের বরাত ভালো তাই ও আউট হয়।’ (ম্যাচটার দৈর্ঘ্য যতদিন গেছে পল্লবিত হতে হতে বেড়ে গেছে।)

এই মরশুমে ডনের মোট রান হয় ১,৩১৮, গড় ১০১; উইকেট পায় ৫১, গড় ৭.৮ রানে। ক্যাচ ধরে ২৬টি। এই চমকপ্রদ সংখ্যাগুলি নিউ সাউথ ওয়েলস নির্বাচকদের চোখ এড়াতে পারেনি। বড়ো কয়েক জন ব্যাটসম্যান তখন অবসর নেওয়ায় তাঁরা নতুন প্রতিভার সন্ধান করছিলেন। ডনকে তাঁরা ১৯২৬-এর অক্টোবরে চিঠি দিলেন (ডনের ঠিকানা তারা জানত না, চিঠি আসে বাওয়াল দলের অধিনায়কের ঠিকানায়)। সিডনিতে এসে নেট প্র্যাকটিসে যোগ দেওয়ার জন্য। যাতায়াত ও থাকাখরচ তাঁদেরই।

ডন সিডনিতে এল বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। আগে ঘাসের উইকেটে কখনো খেলেনি, তার ওপর নেটের ধারে দাঁড়িয়ে তার ছেলেবেলার হিরোরা, তবু আঠারো বছরের ডন একেবারে ব্যর্থ হল না। তার অমার্জিত টেকনিক ও ফুটওয়ার্ক সত্ত্বেও নির্বাচকরা তার মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন। ছেলেটির ব্যাটিং মোটামুটি নির্ভুল, হুক ও ড্রাইভ করে খুব জোরে, ফুটওয়ার্ক বিদ্যুৎগতির। ওঁরা বুঝলেন, ছেলেটির যা কিছু ত্রুটি তা ঠিকমতো কোচিং না পাওয়ার এবং কংক্রিট উইকেটে খেলার জন্য। ওঁরা ডনকে সিডনির কোনো ক্লাবে এসে খেলতে বললেন। ডন প্রথমে যে-ক্লাবের কাছে গেল, তারা রাজি হল না ওকে নিতে। সেন্ট জর্জেস ক্লাব রাজি হল। ডন ট্রায়াল ম্যাচে খেলে ৩৭ ও ৬২ রান করে দু-বারই অপরাজিত থাকলেও রাজ্য নির্বাচকদের চোখে পড়ল না। কিন্তু কানট্রি উইক দলে স্থান পেল। কানট্রি উইক হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সপ্তাহব্যাপী ক্রিকেট উৎসব। এতে বিভিন্ন জেলা ক্রিকেট দল খেলে। টেনিসেও এইরকম কানট্রি উইক উৎসব হয়। ডন টেনিসেও তার জেলা দলে স্থান পায়।

মুশকিলে পড়ল ডন। ক্রিকেট না টেনিস, কোনটায় খেলবে। ডন যার কাছে চাকরি করে, সেই পার্সি ওয়েস্টব্রুক বললেন, ‘খেলার জন্য এক সপ্তাহ ছুটি দিতে পারি, দু-সপ্তাহ নয়। এবার তুমিই ঠিক করো।’

ডন বেছে নিল ক্রিকেটকেই। কানট্রি উইকের পর সেনিউ সাউথ ওয়েলস দ্বিতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়ে ৪৩ এবং ৮ রান করে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে। ওরিলি এই খেলায় ডনের দলে ছিল। প্রতি শনিবার সেন্ট জর্জেসের হয়ে ডন এখন নিয়মিত খেলে, মায়ের দেওয়া সেই ব্যাটটি নিয়েই। প্রতি শনিবার তাকে ভোর পাঁচটায় উঠে ছ-টার ট্রেন ধরতে হয়। বাওরাল থেকে সিডনি ৮০ মাইল পথ ট্রেনে কাটিয়ে খেলতে নামে, বাওরালে ফেরে মাঝরাতে। ক্লান্তিকর ব্যাপার সন্দেহ নেই। এই মরশুমে তার রান হল ২,২৮৯, গড় ৪৮।

বাওরালের হয়ে ডন আর একটি ম্যাচ খেলেছিল এবং হতভাগ্য মস ভেলের বিরুদ্ধেই। এবার ডন করে ৩২০ রান, ৬টি ছয় ও ৪৩টি চার মেরেছিল। এ পর্যন্ত ডনের সর্বোচ্চ রান। এরপরই স্থানীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আইন করে, স্থানীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম গ্রেডের খেলোয়াড়রা আর খেলতে পারবে না। ব্র্যাডম্যানের ঝুড়ি ঝুড়ি রান বহন করে মস ভেল ক্লান্ত হয়ে গেছে। এবার শীঘ্রই ক্লান্ত হবার পালা আসছে ইংল্যাণ্ডের।

 ০৪. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট

ডন নিউ সাউথ ওয়েলস দলে আসার সুযোগ পেল ১৯২৭ সালের বড়োদিনের ঠিক আগে, যখন জ্যাক গ্রেগরি ও লাভ অবসর নিলেন। অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা। ডন নতুন ছেলে, সুতরাং দলে সেদ্বাদশ ব্যক্তি। নিজের রাজ্যের বাইরে ডন এই প্রথম খেলতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আরচি জ্যাকসনের হাঁটুতে ফোড়া হওয়ায় ডন তার জায়গায় দলে এসে গেল। বয়স তখন ১৯। তখনও সে‘বাওরাল বয়’ নামে পরিচিত এবং ক্রিকেটের উপর মহলে একদমই নবাগত। এবার সেঅস্ট্রেলিয়ার ধুরন্ধর ক্রিকেটারদের সামনে পড়ল।

প্রথম খেলার প্রথম ইনিংসেই ডন অ্যাডিলেডে করল ১১৮। বোলারদের মধ্যে ছিল বিশ্বখ্যাত লেগব্রেক-গুগলি বোলার ক্ল্যারি (ক্ল্যারেন্স-এর সংক্ষেপ) গ্রিমেট। সহজ কথা নয়, কেননা গ্রিমেট একদমই রান দিতে চায় না। ওর বলে একটা রান হলেও বিরক্ত হয়ে ওঠে।

ডন ১১৮ রান করে হোটেলে ফিরে সান্ধ্য পত্রিকায় দেখল সেই দিনই ভিক্টোরিয়ার বিল পন্সফোর্ড কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ৪৩৭ রান করে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড করেছে। ডনের আবির্ভাবের আগে পন্সফোর্ডই ছিল অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বড়ো রান সংগ্রাহক আর এই ৪৩৭ রানটাই বিশ্বরেকর্ড হয়ে থেকেছিল যতদিন-না ডন সেটা অতিক্রম করে। পন্সফোর্ডের সঙ্গে ডন অবশ্য পরে অনেকগুলি বড়ো রানের পার্টনারশিপে খেলেছে।

কিন্তু ডন যে এখনও অনেক কাঁচা, সেটা বোঝা গেল দ্বিতীয় ইনিংসে। নিউ সাউথ ওয়েলসের ১৫০ রানের মধ্যে ডন ৩৩ করে বোল্ড হয় গ্রিমেটের বলে। কিন্তু টারনিং উইকেটে উচ্চ পর্যায়ের লেগব্রেক বল যে কী জিনিস, এই প্রথম সেসেটা বুঝতে পারে। গ্রিমেট ৫৭ রানে ৫ উইকেট পায়। এই অ্যাডিলেড মাঠেই ডন তার জীবনের প্রথম ও শেষ (মার্চ, ১৯৪৯) প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে।

অ্যাডিলেড থেকে ভিক্টোরিয়া। ডন এবার ব্যর্থ। মাত্র ৩১ ও ৫ রান করল। আর ফিল্ড করল পন্সফোর্ডের ২০২ ও ৩৮ এবং বিল উডফুলের ৯৯ ও ১৯১ নট আউট রান করা দেখতে দেখতে। এরপর সিডনিতে ফিরে এল কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে খেলতে। রান করল আরও শোচনীয়, প্রথম বলেই বোল্ড আউট গুফ নামে এক স্পিনারের বলে।

ডন যখন খেলতে নামে তখন ব্যাট করছে অ্যালান কিপ্যাক্স। ডন দেখল কিপ্যাক্স কী অনায়াসে সেই বলটা মিড অনে ঠেলে একটা রান নিল। পরের বলের আগেই ডন ভাবল, আমিও ওইভাবে রান নেব। ডন ঠিক কিপ্যাক্সের নকল করে ব্যাট চালাল। বলটা স্পিন না নিয়ে জোরে এসে ব্যাটের তলা দিয়ে গলে মিডল স্ট্যাম্পে লাগল। এই গোল্লা করা থেকে ডন সারা জীবনের জন্য এই শিক্ষাই পায়—বল হওয়ার আগে কখনোই মনস্থির করবে না—কীভাবে খেলবে। কিপ্যাক্স অনেকক্ষণ ধরে উইকেটে থেকে (৩১৫ নট আউট) সব কিছুর সঙ্গে রপ্ত হয়ে যেভাবে ব্যাট চালাচ্ছিল ডন খেলতে নেমেই তাই করতে গিয়ে আউট হয়।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে ‘বাওরাল বয়’ যে নতুন আশা জাগিয়েছে, সেকি তবে মরীচিকা? উচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটার হওয়ার যোগ্যতা কি ওর নেই? ১৯২৭-২৮ ক্রিকেট মরশুমে তার মনের মধ্যে কী ঘটেছিল সেকথা ডন কখনো আমাদের জানায়নি। তার পরিবারের বাইরের কোনো লোকের কাছে সেতার মনের জানালা কদাচ খুলেছে। দুঃখে-সুখে, জয়ে-পরাজয়ে ডন তার সারা খেলার জীবনে অচঞ্চল থেকেছে। মুখ ফুটে একটি কথাও বলেনি।

অনেকেই বলেছে, ‘বাওরাল বয়’ তার গ্রাম্য চালচলনের, শহুরেপনা না জানার জন্য দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের কাছে খুবই হেনস্থা হত। তারা ওকে নিজেদের একজন বলে মনে করত না। তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত ওকে নিয়ে। হয়তো এইজন্যই পরবর্তীকালে ডন দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করত না। এমনকী টেস্ট সফরেও সেনিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকত, পার্টি এবং আমোদ-উৎসব এড়িয়ে চলত। যেজন্য তাকে অসামাজিক অভিযোগও শুনতে হয়।

হয়তো তাই। কিন্তু ডন তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম মরশুমেই অনেক কিছু শিখে নেয়। খেলার পর নিজের ভুলত্রুটি বিশ্লেষণ করে তা শোধরানোর জন্য চিন্তা করার যে অভ্যাস, এই সময় রপ্ত করে সারা খেলার জীবনে ডন তা বজায় রেখে যায়।

যখনই ডন ব্যর্থ হয়েছে, সাফল্যের জন্য তার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হয়েছে, রোখ বেড়েছে এবং মনোনিবেশ আরও কঠিন রূপ নিয়েছে। এই মরশুমের কঠিন প্রতিবন্ধকতা হয়তো দরকার ছিল আকাঁড়া ধাতুটিকে পিটিয়ে অস্ট্রেলিয়ার শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য।

সৌভাগ্যের বিষয় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের কর্তারা ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। ডনের প্রথম মরশুমে যদিও ধাঁধানোর মতো স্কোর হয়নি (দশ ইনিংসে ৪১৬ রান, গড় ৪৬.২২, দুটি শতরান) তবু তারা ১৯ বছরের ছেলেটির মধ্যে আশা করার মতো জিনিস খুঁজে পান এবং পরের মরশুমে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে খেলার জন্য অস্ট্রেলীয় দলের সম্ভাব্যদের তালিকায় ডন ব্র্যাডম্যান নামটির নীচে দাগ দিয়ে রাখেন।

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের অবস্থা তখন ভালো নয়। রীতিমতো দুর্দিন উপস্থিত হয়েছে একসঙ্গে কয়েক জন নামি খেলোয়াড় অবসর নেওয়ায়। চ্যাপম্যান যে-দল নিয়ে অভিযানে আসছে তাতে আছে বাঘা বাঘা খেলোয়াড়রা— হ্যামণ্ড, হবস, সাটক্লিফ, হেনড্রেন, টেট প্রভৃতিরা।

অস্ট্রেলিয়ার ভয় বেদম পিটুনি খাওয়ার। মনে ক্ষীণ আশা, ডন হয়তো ভেলকি দেখালেও দেখাতে পারে।

ডন বুঝেছে যদি বড়ো ক্রিকেটার হতে হয়, টেস্ট খেলার স্বপ্ন সার্থক করতে হয়, তাহলে বাওরাল থেকে সিডনি যাতায়াত করে খেললে চলবে না। সিডনিতে গিয়ে বাস করতে হবে এবং ঘাসের উইকেটে নিয়মিত খেলতে হবে। ভাগ্য সহায় হল। ডন যার কাছে চাকরি করত সেই সম্পত্তি কেনাবেচার দালাল ঠিক করলেন সিডনিতে অফিস খুলবেন। ডনের প্রয়োজনের কথা ভেবে তিনি ওকে সিডনি অফিসে চাকরি দিলেন। ডন কালক্ষেপ না করে বাওরাল ছেড়ে সিডনিতে চলে এল।

 ০৫. প্রথম টেস্ট

অস্ট্রেলীয় টেস্ট দল গড়ার জন্য ১৯২৮-২৯ মরশুমের শুরুতেই যে ট্রায়াল খেলা হয়, তাতে ডন ব্র্যাডম্যানের রান দেখে সারা অস্ট্রেলিয়া হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে। ১৪ এবং ৫। সে-দেশের লোক বলাবলি করল, ট্রায়ালেই যদি সবথেকে সম্ভাবনাময় ছেলেটি এই রান করে তাহলে টেস্টে করবে কী?

এক সপ্তাহ পর কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ডন ১৩১ ও ১৩৩ নট আউট করায় অস্ট্রেলিয়া আবার মুখর হয়ে উঠল।

ইংরেজ খেলোয়াড়দের সঙ্গে ডন মুখোমুখি হল সিডনিতে নিউ সাউথ ওয়েলস বনাম এমসিসি-র খেলায়। তাকে খেলতে হল টেট, হ্যামণ্ড, লারউড এবং ‘টিচ’ ফ্রিম্যানের বল। চার বছর পরই অবশ্য ব্র্যাডম্যান-লারউড নাম দুটি ক্রিকেট ইতিহাসের সবথেকে বিশ্রী এক অধ্যায়ের সঙ্গে চিরকালের মতো যুক্ত হয়ে যায়।

ডন প্রথম ইনিংসে ৮৭ দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩২নট আউট থাকে। তার খেলা হ্যামণ্ডকেও অবাক করে।

খেলাটি যখন আরম্ভ হচ্ছে হ্যামণ্ড তখনও ডি জি ব্র্যাডম্যানের নামটি পর্যন্ত শোনেনি। গেঁয়ো ধরনের ছেলেটি যখন বল করতে এল, উইকেটে হ্যামণ্ড ও হেনড্রেন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে মনস্থ করে ছোকরাকে কিছু ক্রিকেট শিক্ষা দেওয়া যাক। অনেকের মতে ফাস্ট বোলিংয়ে যত হুকার দেখা গেছে হেনড্রেন তাদের সেরা। ডনের বলে হেনড্রেন একটি চার ও দুটি ছয় মেরে আর একটি ছয় মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়।

পরের ওভারে হ্যামণ্ড ২৪ রান নিল ডনের বলে। বলা বাহুল্য, ডনকে আর বল করতে দেওয়া হয়নি। মরিস লেল্যাণ্ড মিড অফে বল মেরে রান নেওয়ার জন্য ডাক দেয়, হ্যামণ্ড দৌড়ে অপর প্রান্তে পৌঁছোনোর আগেই ব্র্যাডম্যান বিদ্যুৎগতিতে বল পাঠিয়ে দেয় উইকেটকিপার বার্টি ওল্ডফিল্ডের হাতে। হ্যামণ্ড রান আউট হয়ে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওর নাম কী?’

‘ডন ব্র্যাডম্যান’ কে একজন বলল।

‘মনে রাখব নামটা।’

হ্যামণ্ডকে মনে রাখতে হয়েছিল। যখন দুজনেই অধিনায়ক হয়েছিল নিজ নিজ দেশের তখন ডনের নাম এবং তার পারদর্শিতার কথা প্রতি মুহূর্তে হ্যামণ্ডকে স্মরণ করতে হয়েছে।

এই সময়ে ডন বল করা ছেড়ে দেয়। এমসিসি-র বিরুদ্ধে ডন আর একটি ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলীয় একাদশের পক্ষে। ডন প্রথম ইনিংসে ২০০ মিনিটে ৫৮ রান করে অপরাজিত থাকে। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮।

এরপর এল ভয়ংকর প্রতীক্ষার পালা। ডনের মনে একটিই চিন্তা, টেস্ট দলে সেআসতে পারবে কি পারবে না। প্রথমদিকে যে-সাফল্য সেদেখিয়েছে, পরের ব্যর্থতাকে তা কি ঢেকে দেবে না?

রাত্রে টেস্ট দলের নাম ঘোষণা হবে রেডিয়োয়। দেরি হচ্ছে ঘোষণা হতে, ডন রেডিয়ো নিয়ে বিছানায় শুয়ে। নাম ঘোষিত হবে বর্ণমালা অনুসারে। প্রথমেই শোনা গেল তার নাম। কুড়ি বছর বয়সে ডন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলবে। অধিকাংশ ছেলের কাছে এটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষার চুড়োয় পৌঁছে যাওয়া। হয়তো ডনের নজর তখনই আরও উঁচুতে অধিনায়কত্বের ওপরে গিয়ে পড়েছিল।

প্রথম টেস্ট খেলা হল ব্রিসবেনে। অমন অকল্পনীয়ভাবে মার খাওয়া ডন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ৬৭৫ রানে ইংল্যাণ্ডের কাছে হার? এত রানে আগে অস্ট্রেলিয়া কখনো হারেনি। ইংল্যাণ্ড প্রথম ব্যাট করে তুলল ৫২১ রান। অস্ট্রেলিয়া জবাব দিল মাত্র ১২২ রান করে। তার মধ্যে ডনের রান মাত্র ১৮। টেটের একটা ধীর বলে সেএলবিডব্লু আউট হয়। ইংল্যাণ্ড ফলো অন না করিয়ে আবার ব্যাট করে দ্বিতীয় ইনিংস ছাড়ে ভিজে উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে ৭৪১ রান তুলে জেতার সুযোগ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া তোলে ৬৬ রান। তার মধ্যে ডনের অবদান একটি মাত্র রান। কাদার আঠালো উইকেটে কীভাবে খেলতে হয় ডন তখনও তা জানে না।

এরপর ডন ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নির্মমতার সঙ্গে টেস্ট খেলেছে; এবং তার কারণ হয়তো প্রথম টেস্ট খেলাতেই এই অপমানকর পরাজয়ের জ্বালা সেকিছুতেই ভুলতে পারেনি। ইংল্যাণ্ডকে ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতায় হারানোর জন্য যখনই তার সমালোচনা হয়েছে সেসবসময়ই পালটা জবাবে বলেছে, ‘১৯২৮-এ চ্যাপম্যান কী করেছিল?’

ব্রিসবেন টেস্ট অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে ‘কালা টেস্ট’, ডনের পক্ষেও বিপর্যয়কর। ব্যাটে ব্যর্থ, সম্ভাব্য দুটি ক্যাচও ফেলেছে। ভবিষ্যতে যে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রান সংগ্রাহক হবে তার কোনো আভাস এ খেলায় নেই। সেব্যর্থ, তার ওপর ভরসা রাখা যায় না। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটভক্তরা বিরক্ত হয়ে উঠল।

এর ফলে সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে ডন দ্বাদশ ব্যক্তি হল। ব্যাট করতে পারল না। কিন্তু প্রায় সারা ম্যাচে তাকে ফিল্ড করতে হল, লারউডের বলে পন্সফোর্ডের আঙুলের হাড় ভেঙে যাওয়ায়। টেটের ক্যাচ ধরা ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছুই সেকরেনি। এই খেলাতেও অস্ট্রেলিয়া ভালোভাবেই হারল, ৮ ইউকেটে।

মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ খেলা। পন্সফোর্ডের আঙুল তখনও সারেনি তাই ডনকে দলে নেওয়া হল। ডনের যা চরিত্র ব্যর্থতার পরই তার দ্বিগুণ বিক্রমে ফিরে আসা—এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। রান করল ৭৯ ও ১১২। অবশ্য তা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া হারে ৩ উইকেটে। সেই সময়ে ডনই বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট শতরানকারীর সম্মান পায়। পাঁচ মিনিট ধরে দর্শকরা দাঁড়িয়ে থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ব্যর্থতার স্মৃতি আর কারুর মনে নেই। নতুন ছেলেটি তার নির্বাচনকে অবশেষে সার্থকতা দিয়েছে। এরপর ডন আর কখনো অস্ট্রেলিয়া দল থেকে বাদ পড়েনি।

প্রথম শ্রেণির খেলায় ডনের প্রথম ত্রিশত রান হল এর পরের ম্যাচেই সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে—৩৪০ নট আউট।

ব্র্যাডম্যানের প্রথম টেস্ট রেকর্ড—বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট শতরানকারীর খেতাবটি অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্টেই তার মাথা থেকে তুলে নেয় ১৯ বছরের আর্চি জ্যাকসন ১৫৪ রান করে। এটি জ্যাকসনের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলাও! এর চার বছর পরই সেটিবি রোগে মারা যায়।

অ্যাডিলেডে ইংল্যাণ্ড ১২ রানে জেতে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৮ রান করে ডন এক চুলের জন্য রান আউট না হলে এ খেলায় ইংল্যাণ্ড জিতত কি না সন্দেহ। প্রথম ইনিংসে সে৪০ করেছিল। ইংল্যাণ্ডের হ্যামণ্ড করে ১১৯ নট আউট ও ১৭৭।

মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ শুরু করে ০-৪ ম্যাচে পিছিয়ে থেকে। সিরিজে প্রথম জিত হল ৫ উইকেটে। ডনের রান ১২৩ ও ৩৭ নট আউট।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডনের প্রথম পুরো মরসুমটি যখন শেষ হল, দেখা গেল তার ১,৬৯০ রান হয়েছে। এক মরশুমে অস্ট্রেলিয়ায় আগে কেউ এত রান করেনি। আর ২৪ ইনিংসে সাতটি শতরান করে গড় দাঁড়িয়েছে ৯৩.৮৮; এটাও রেকর্ড। ডন নিজে না ভাঙা পর্যন্ত রেকর্ডটি অটুট ছিল।

এই এক বছরে ডন অনেক কিছু শিখে নেয়। শেখার এখনও অনেকই বাকি। ১৭ বছর বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত ডন কখনো ভিজে উইকেটে খেলেনি। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে গভীর মনোযোগে সেহবস ও সাটক্লিফের ভিজে উইকেটে ব্যাট করার ওস্তাদি দেখে তাজ্জব বনে যায়। কিন্তু ডন এই একটা ব্যাপারে কোনোদিনই দক্ষতা দেখাতে পারেনি। অত বিরাট ব্যাটসম্যানের এই একটিই দুর্বলতা ছিল—ভিজে উইকেটে।

কিন্তু সারা সিডনি এখন মেতে উঠেছে আমাদের ডনকে নিয়ে। যেভাবে ওরা ‘আমাদের বন্দর’ ‘আমাদের ব্রিজ’ বলে গর্ব করে, ঠিক সেইভাবে তারা ‘আমাদের ডন’ কথাটি উচ্চারণ করতে শুরু করে। নিউ সাউথ ওয়েলসবাসীদের ধারণায় বিশ্বে যে ক-টি আধুনিক বিস্ময় আছে তার মধ্যে সিডনি বন্দরের ব্রিজটি অন্যতম। ডনও তাই।

ইংল্যাণ্ড ৪-১ ম্যাচে টেস্ট সিরিজটি জিতেছে। কিন্তু এরপর প্রধানত ডনের জন্যই ইংল্যাণ্ড পরবর্তী সিরিজটি জিতবে ডনের অবসর নেওয়ার পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে।

০৬. বিশ্বরেকর্ড

এই আমলে ব্র্যাডম্যানকে কেমন দেখতে ছিল? খোলামেলা কিন্তু শক্ত চোয়াল, সজীব ঝকঝকে হাসি, সাজানো সবল দাঁত। হ্রস্ব কাঠামোর দেহটি প্রচন্ডভাবে নমনীয় ও চটপটে। ওর সারা অবয়ব থেকে বিচ্ছুরিত হত স্বনির্ভরতা। হাঁকড়াত প্রবলভাবে, খেলত আত্মবিশ্বাস নিয়ে। মাঠে ইগলের মতো ছোঁ মেরে বল কুড়োত, ছুড়ত মারণাস্ত্রের মতো।

উচ্ছল ব্যাটধারী, উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকার জন্য নয়, খেলত রান সংগ্রহের জন্য। প্রতিটি বলে সেরান খুঁজত। যতক্ষণ-না সাবধান হওয়া একান্তই দরকার, ততক্ষণ সেব্যগ্র। বিশ্বাস করত মাঠে রাজত্ব করবে ব্যাটধারী, বোলার নয়। ব্যাটধারীর প্রাধান্য সবাইকে মানতে হবে।

ডন এমনই ব্যাটধারী, যার দিকে দর্শকরা তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসত। ওর স্ট্রোকগুলি ঠিক শাস্ত্রীয় রীতি অনুসারী নয়, কিন্তু দেখে আনন্দ হয়। পন্সফোর্ডের মতো গোমড়া পদ্ধতির ব্যাটধারীর পাশাপাশি ডনকে দেখলে মনে হত, সেযেন ক্রিজে থাকতে খুব মজা পায়; এবং সত্যিই পেত।

তখনও পর্যন্ত তার সামনে দেখা দেয়নি—দল নির্বাচনের, কৌশল উদ্ভাবনের দলগত সমস্যা সমাধানের বা নৈশভোজের পর বক্তৃতা দেওয়ার দুশ্চিন্তা, যেগুলি অধিনায়ক হিসাবে তার কর্তব্যের অন্তর্গত হবে। তখনও পর্যন্ত খবরের কাগজের রিপোর্টার, ফোটোগ্রাফার, অটোগ্রাফ-শিকারি এবং ভক্তদের ভনভনানি তাকে অসুখী বা বিরক্ত করে তোলেনি। সন্দেহ নেই এসব ব্যাপার খুশি হওয়ার মতোই, কিন্তু ডনকে এগুলো ক্ষয় করে দিত। সেচাইত মাঠের বাইরে তার ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগতই থাকুক। তখন পর্যন্ত সেগায়ে-পড়া পূর্ব বন্ধুত্বের দাবিদার, অজানা লোকদের আবদার ও জ্বালাতনের শিকার হয়নি। তখনও পর্যন্ত ভগ্নস্বাস্থ্য তাকে বিব্রত করেনি; ডন ব্র্যাডম্যান তখন কর্মঠ, চঞ্চল, দুর্বার শারীরিক সক্ষমতার অধিকারী।

ডনের ব্যাটের হাতল-ধরা মুঠোটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে এবং তাই নিয়ে ডন প্রায়শই বিবেচনা করেছে। কংক্রিট পিচে খেলার জন্যই তার ব্যাট ধরার ভঙ্গিটি অন্যরকম হয়।

ডান হাতের ব্যাটধারীরা যখন ব্যাটের হ্যাণ্ডেলটি মুঠো করে ধরে, তখন হ্যাণ্ডেলটি তালুর মাঝ বরাবর দিয়ে বঁা-হাতের বুড়ো আঙুলের গোড়ায় ঢিবির মতো গোল অংশটির ওপর রক্ষিত হয়। কিন্তু ডন এমনভাবে হ্যাণ্ডেলটি ধরত যার ফলে বাম কবজিটা থাকত হ্যাণ্ডেলের পিছন দিকে—উদ্দেশ্য, আঘাত থেকে বাম হাতের আঙুলগুলিকে লুকিয়ে রাখা।

এই মুঠিতে কভার ড্রাইভ করতে তার কিছুটা অসুবিধা ঘটত ও প্রত্যেক বার বল মারার সময় তার বুড়ো আঙুলে ধাক্কা লাগত, কিন্তু তার ব্যাট ধরার মুঠি আঙুলগুলোকে ও তালুর পিছনকে আঘাতের কবল থেকে রক্ষা করেছিল এবং এইরকম মুঠির জন্য ব্যাটটিকে সেজমির ওপর ৪৫ ডিগ্রি কোণ পর্যন্ত ঝুঁকিয়ে দিতে পারত, ফলে ব্যাটে লেগে বল আর উঠত না। এইরকম মুঠিতে ব্যাট ধরলে হুক এবং কাট করায় খুবই সুবিধা হয় এবং এই দুটিতে ডন ভয়ংকর ছিল। যখন হুক করত, ব্যাটের মুখটা বলের উপরে থাকত, ফলে আঘাত পেয়েই বল জমির দিকে নেমে আসত। অন্য ব্যাটধারীদের পক্ষে হুক শটে বলকে নামিয়ে রাখাটা শক্ত হয়, ডনের পক্ষে বল তোলাটাই শক্ত ছিল।

নিজের খেলার স্টাইল নিয়েও ডন এই সময় ভেবেছে। তার খেলাটা গড়ে উঠেছিল প্রধানতই পিছিয়ে এসে খেলার ওপর। তার গাঁট্টাগোট্টা চেহারা পা এগিয়ে ড্রাইভ করে খেলার অনুকূল ছিল না। বলের পিচের কাছে পা বাড়িয়ে পৌঁছোবার মতো শরীরের আকার ছিল না, যদি-না বলটা একটু ওভারপিচ হত।

রান তোলার জন্য তার সেরা মারগুলির অন্যতম ছিল অফ স্টাম্পের বাইরের শর্ট পিচ বল পুল করে লেগের দিকে মারা। এইভাবে মারতে গিয়ে বল যাতে উঁচুতে না ওঠে সেজন্য সেক্রস ব্যাটে অর্থাৎ ব্যাটটিকে আড়াআড়িভাবে চালাত। এতে ঝুঁকি ছিল খুবই।

প্রবীণ ক্রিকেটাররা ডনকে এ সম্পর্কে সুপরামর্শ দেন। মরিস টেট বলেন, ইংল্যাণ্ডে যদি রান পেতে চাও, তাহলে ব্যাট সিধে রেখে খেলতে হবে। ফ্রাঙ্ক উলিও তাই বলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সবথেকে কম সময়ে মাত্র ৩৫ মিনিটে শতরানকারী পার্সি ফেণ্ডারও ডনকে একই উপদেশ দেন।

ডন উপদেশ-পরামর্শ প্রচুর পেয়েছে, কিন্তু সব কিছু ভেবে ঠিক করে নিজের মতো করেই সেখেলবে। এইভাবে খেলে সেপ্রচুর রান পাচ্ছে এবং রান পাওয়ার জন্যই তো ব্যাট করা, সুতরাং মুঠি বা স্ট্রোক বদল করার দরকার কী। তার মতে, ‘অন্যরকমভাবে খেলা মানেই ভুল খেলা নয়।’

পরের মরশুমেই সেএকথার সত্যতা প্রমাণ করল সর্বোচ্চ রানের নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়ে।

১৯২৯-৩০ মরশুমে নিউজিল্যাণ্ডগামী এমসিসি-র বিরুদ্ধে একটি খেলায় ১৫৭ ও একটি টেস্ট ট্রায়ালে ডন ১২৪ রান করে সর্বশেষ আউট হয় এবং তার দলকে ফলো অন করতে হওয়ায় প্রথম ব্যাট করতে পাঠানো হয়। দিনের শেষে ডন ২০৫ রানে অপরাজিত থাকে।

এই মরশুমে শেফিল্ড শিল্ডের খেলায় ডন একটিই তিন অঙ্কের রান করে কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে।

দোষ কুইন্সল্যাণ্ডেরই। তারা প্রথম ইনিংসে ডন ৩ রান করা মাত্র ক্যাচ ধরে তাকে আউট করে দেয়। ফলে যথারীতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নির্মম হয়ে ওঠে। ঘটনাটি সিডনি মাঠে ঘটেছিল।

ডন ইনিংস শুরু করে শনিবারে। প্রথম ৫০ রান করে ৫৪ মিনিটে, শতরান ১০৩ মিনিটে। তারপর অভ্যাসমতো রান তোলার গতি বাড়িয়ে দেয়। ১৫০ করল ১৪০ মিনিটে, ২০০ হল ১৮৫ মিনিটে। শনিবার খেলা শেষে ডন ২০৫ রানে অপরাজিত।

রবিবার বিশ্রাম নিয়ে ডন ঝরঝরে তাজা হয়ে সোমবার খেলতে নামল। লাঞ্চের আগে যোগ করল আরও ১০৫ রান। তিনশো রান করার পরই সেঠিক করে পন্সফোর্ডের ৪৩৭ রানের বিশ্বরেকর্ডটি ভাঙতে হবে। এবং ডন যা ইচ্ছা করে, সচরাচর সেটি সেপূরণই করবে।

সেদিন তার একটি মারেও ভুল হয়নি। তার ব্যাট ঝলসেছে আর বোলার এবং ফিল্ডকারীরা ঘেমেছে। ডন ড্রাইভ, হুক আর কাট করছে পরম আনন্দে। ২০৩ মিনিটে ২৫০ রান, ২৮৮ মিনিটে ৩০০ রান, ৩৩৩ মিনিটে ৩৫০ রান এবং ৩৭৭ মিনিটে ৪০০ রানে পৌঁছোয়। পন্সফোর্ডের ৪৩৭ রান অতিক্রম করতে চার রান বাকি, বল করছে থারলো এবং ডন জানে বলটি হবে শর্ট পিচ লেগ স্টাম্পের ওপর। হলও তাই। হুক করে চার রানটি নিয়ে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করে। সে৪৫০ রানে পৌঁছোয়, তখন ৪১৪ মিনিট ক্রিজে থাকা তার সম্পূর্ণ হয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলস ইনিংস ডিক্লেয়ার করার সময় ডনের রান ৪৫২ অপরাজিত ৪১৫ মিনিটে। পনসফোর্ড ৪৩৭ রান তুলতে সময় নেয় ৬২১ মিনিট।

এই খেলার পর আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, ১৯৩০-এর ইংল্যাণ্ড সফরে ডন দলভুক্ত হবে কি না।

 ০৭. প্রথম সফর

প্রথম বার ইংল্যাণ্ডে এসে ডন যা-কিছু দেখে তাতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে; এবং ইংল্যাণ্ড উত্তেজিত হয় তার ব্যাটিংয়ে। ইংল্যাণ্ড বোলাররা যত বিপন্ন হয়েছে, ইংরেজরা ততই তাকে পছন্দ করেছে। ১৯৩০ মরশুমে সকলের মুখে মুখে ব্র্যাডম্যানের নাম। দলে দলে ইংরেজ দর্শকরা মাঠে ভিড় করেছে তাদের নিজেদের সেরা বোলারদের দুর্দশা দেখতে এবং সেতা দেখিয়েছেও। তার রানকে ঘিরে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস গড়ে উঠত, তার রানই দলকে সফল করে তোলে।

সফরের প্রথম খেলা উরস্টারে। ডন ২৯০ মিনিটে করল ২৩৬ রান। পরের ম্যাচ লিস্টারে, রইল ১৮৫ নট আউট। সফরের প্রথমদিকেই ডন ইংল্যাণ্ডের মাঠের উইকেটের চরিত্র বুঝে নেয়। ভারী আবহাওয়া বলকে সুইংয়ে সাহায্য করে, উইকেটে ঘাস বেশি তাই বোলাররা পিচ থেকে কিছুটা সাহায্য পায় বটে কিন্তু পিচে পড়ার পর বল আসে মন্থরগতিতে। যেহেতু ডন হ্রস্বাকৃতি এবং পিছিয়ে এসে খেলার অভ্যাসটাই বেশি, তাই মন্থর উইকেট তার পছন্দই হল। কিন্তু অসুবিধায় পড়ল কনকনে ঠাণ্ডায়। সোয়েটার, ব্লেজার, ওভারকোট পরে আগুনের ধারে বসে অপেক্ষার পর মাঠে নেমে ব্যাট চালানোর মতো অস্বস্তিকর ব্যাপার আর কী হতে পারে!

কিন্তু ডন মনে আঘাত পেল খবরের কাগজে একটা লেখা পড়ে। তাতে লেখা হয়েছে, সারের অধিনায়ক পার্সি ফেণ্ডার ডন সম্পর্কে বলেছেন, ‘ও সবসময়ই চমকপ্রদ এবং অনির্ভর পর্যায়ভুক্ত থাকবে।’ ফেণ্ডার বলেন, ডনকে দেখে ওর ওপর আমার ভরসা জাগেনি। সেনিজের ত্রুটি শোধরায় না বা মনে হয় না সেজন্য কোনো চেষ্টা তার আছে। এরপর ডন স্থির করে সারের সঙ্গে খেলায় এসব কথার জবাব দেবে।

বৃষ্টির জন্য মাত্র এক দিনই খেলা হয়। নরম পিচে অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করে পাঁচ উইকেটে ৩৭৯ রান তুলেছিল। তার মধ্যে ডনের রান ২৫২ নট আউট। নিখুঁত নির্ভুল চমকপ্রদভাবে সংগৃহীত। দ্বিতীয় শতরানটি মাত্র ৮০ মিনিটে তোলা।

হ্যাম্পশায়ারের সঙ্গে খেলা শুরু হল মে মাসের শেষ দিনে। ডনের তখন ইংল্যাণ্ড সফরে হাজার রান পূর্ণ হতে আর মাত্র ৪৬ রান বাকি। মে মাসের মধ্যে হাজার রান ৪ জন ইংরেজ— গ্রেস, হেওয়ার্ড, হ্যামণ্ড ও হ্যালোজ— করতে পেরেছে। কোনো অস্ট্রেলিয়ান পারেনি। সুতরাং ডন বদ্ধপরিকর, করতেই হবে। কিন্তু টস হতেই মাথায় হাত। হ্যাম্পশায়ার টসে উডফুলকে হারিয়ে ব্যাট করবে ঠিক করেছে। মে মাসের শেষ দিন, সুতরাং ডনের ভাগ্যে এই মাসে ব্যাট করার আর সুযোগ হবে না।

কিন্তু ক্ল্যারি গ্রিমেট তা সম্ভব করল! হ্যাম্পশায়ার ইনিংস সেই দিনই শেষ হল এবং ডনকে তাড়াতাড়ি ইনিংস ওপেন করতে পাঠানো হয়। ডন যখন ৪৭ রান করেছে তখন বৃষ্টি নেমে খেলা বন্ধ হয়। ডনের তখন ১,০০১ রান।

ডনের রান সংগ্রহের বহর নিরন্তর বেড়েই চলল। নটিংহামে প্রথম টেস্ট ম্যাচে সেকরল ৮ ও ১৩১, লর্ডস টেস্টে ২৫৪ ও ১। নিষ্ঠুরভাবে সেবোলারদের পিটিয়ে যেখানে বল পাঠাতে চেয়েছে সেখানে পাঠিয়েছে। ১৬০ মিনিটে ১৫৫ রান তোলে। বলা হয়েছিল ডনের ব্যাটে আগুন ধরে যাবে। পরদিন ২৫৪ রানের মাথায় পার্সি চ্যাপম্যান অলৌকিকভাবে ক্যাচ ধরে তাকে আউট করে। ডনের মতে ব্যাটিং কৌশলের দিক থেকে এটি তার জীবনের সেরা ইনিংস। এই টেস্টে দলীপ সিংহজি ১৭৩ করেছিল।

প্রথম টেস্টে ৯৩ রানে হারের পর অস্ট্রেলিয়া লর্ডসে জেতে ৭ উইকেটে। চার দিনের এই খেলায় অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে ৭২৯ রানে ইনিংস ঘোষণা করে। লর্ডসে এত রান উঠবে কতৃপক্ষ আশা করেননি। স্কোর বোর্ডে মোট রানের ঘরে সাত সংখ্যাটি তাদের ছিল না।

লিডসে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে ডন ৩৩৪ রান করে টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ড করে। জ্যাকসন ওপেন করতে নেমে এক রানে আউট হয়ে ফিরে আসতে ডন খেলতে নামে। লাঞ্চের আগে ৯৯ মিনিটে সম্পূর্ণ করল শতরান। বোলার ছিল লারউড ও টেট। প্রথম দিন লাঞ্চের আগে টেস্ট ম্যাচে শতরান তার আগে করেছে দুই অস্ট্রেলিয়ান, ভিক্টর ট্রাম্পার (ম্যানচেস্টার, ১৯০২) ও চার্লি ম্যাকার্টনি (লিডস, ১৯২৬)।

তবে ইনিংসটি নিখুঁত নয়, টেটের প্রথম বলে ডন পরাস্ত হয়। স্টাম্প ঘেঁষে বল চলে যায়। ১৪১ ও ২০২ রানে মিড অনের মাথার উপর ক্যাচ তুলেছিল। লাঞ্চের আগে ডন ১০৫, চা-পানের সময় ২২০ এবং দিনশেষে ৩৪০ মিনিট ব্যাট করে ৩০৯ রানে অপরাজিত থাকে, দলের ৪৫৬ রানের মধ্যে। যখন ক্রিজ থেকে ফিরছে তখন তাকে ঝরঝরে তাজা দেখাচ্ছিল যেন এইমাত্র স্নান সেরে এল। সারাদিন সে৪০ বার বাউণ্ডারিতে বল পাঠিয়েছে একথা তাকে দেখে বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না। এই সময় সেএকটি উক্তি করে যা ক্রিকেট ইতিহাসে বরাবর থেকে যাবে। ক্লান্ত এক ইংল্যাণ্ড ফিল্ডারকে ডন খুব খুশিয়াল মেজাজে বলে, ‘কালকের খেলার জন্য খুব ভালোই প্র্যাকটিস হল।’

তবে পরদিন ডন বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকেনি আর ছটি ৪ মেরে (মোট ৪৬টি) ৩৩৪ রানে ডন উইকেটকিপার ডাকওয়ার্থের হাতে আউট হয় টেটের বলে। ডন ৩৩৪ রান করে ৩৭৫ মিনিটে (এখন কল্পনা করা যায় না)। ১৯৩৮-এ হাটন ৩৬৪ করে ৮০০ মিনিটে (৩৫টি চার)। ১৯৫৭-৫৮-তে সোবার্সের অপরাজিত ৩৬৫ রান ৬০৮ মিনিটে (৩৮টি চার) সংগৃহীত। ১৯৯৩-৯৪-এ ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রান ওঠে ৭৬৬ মিনিটে (৪৫টি চার)। মার্ক টেলরের অপরাজিত ৩৩৪ হয় ৭২০ মিনিটে (৩৫টি চার)। ১৯৯৬-৯৭-এ জয়সূর্যের ৩৪০ রান আসে ৭৯৯ মিনিটে (২ ছয়, ৩৫ চার)।টেস্ট ম্যাচে একদিনে ত্রিশতাধিক রান আজ পর্যন্ত ডন ছাড়া আর কেউ সংগ্রহ করতে পারেনি। এই রানে একটিও ছয় নেই।

ম্যানচেস্টারে চতুর্থ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে ডন ১৪ রান করে। বৃষ্টির জন্য খেলার মীমাংসা হয়নি। ওভালে ডনের প্রথম টেস্ট খেলাটি জ্যাক হবসের শেষ খেলা। হবসকে মাঠের মধ্যে সকলের সঙ্গে ডনও সংবর্ধনা জানায় এবং দুঃখবোধ করে হবস যখন মাত্র ৯ রান করে আউট হন। ১৮ বছর পর এই মাঠে একই দৃশ্য দেখা যায়। ডনকে তার শেষ টেস্ট খেলায় মাঠের মধ্যে সংবর্ধিত করে ইংল্যাণ্ড দল। হবসের থেকে ডন ৯টি রান কম করেছিল।

ওভালে ১৯৩০-এর টেস্টে ডন ২৩২ রান করে সিরিজে ৭ ইনিংসে ৯৭৪ রান তুলে ১৩৯.১৪ রানের গড় রাখে। এক সিরিজে এত রান আজও কেউ করতে পারেনি। পাঁচ টেস্টে চারটি শতরান, তার মধ্যে তিনটি দ্বিশতাধিক। সফরে করে ২,৯৬০ রান, গড় ৯৮.৬৬। অস্ট্রেলিয়া দলের এই সফরকে ‘ব্র্যাডম্যানের সফর’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল, এটা কোনো আশ্চর্যের কথা নয়!

 ০৮. একাগ্র ও নিঃসঙ্গ

ব্র্যাডম্যানের প্রথম ইংল্যাণ্ড সফরে (১৯৩০) টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে অনুমান করা হয়েছিল ইংল্যাণ্ডই সিরিজ জিতবে। অভিজ্ঞ বলতে অস্ট্রেলিয়া দলে আছে তো মাত্র চার জন- উডফুল, পন্সফোর্ড, গ্রিমেট আর ওল্ডফিল্ড। কিন্তু সিরিজ শেষে দেখা গেল অস্ট্রেলিয়া দুটি ও ইংল্যাণ্ড একটি টেস্ট ম্যাচ জিতেছে আর বাকি দুটি ড্র।

মাত্র চার বছর আগে ‘জংলি ক্রিকেটার’ বলে অভিহিত যে— ছেলেটি সিডনিতে ট্রায়াল দিতে এসেছিল, তাকে এখন সদ্য অবসর নেওয়া জ্যাক হবসের উত্তরাধিকারীরূপে বিশ্বের চমৎকারতম ব্যাটসম্যান হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। হবসের থেকেও সেবড়ো হবে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। প্রথম সফরেই সেক্রিকেটে রূপান্তর ঘটিয়েছে। ডন দেখিয়ে দিয়েছে, পরাজয় থেকে রক্ষার গ্যারান্টি হিসাবে ৪০০ রানের ইনিংস হলেও কোনো দল আর নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারবে না। তখন পর্যন্ত তাই ভাবা হত। কিন্তু ডন দেখাল অন্যে যতক্ষণে ১০০ করে, সেততক্ষণে ২০০ রান তুলতে পারে।

কিন্তু আর একদিক থেকে দেখলে বলা যায়, ডনের আগমনে ক্রিকেট আরও বিরস হয়ে পড়ল। এখন থেকে কোনো দল আর চট করে ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে সাহস পায় না। উইকেট কামড়ে তারা বড়ো রান তোলার চেষ্টা করে বিপক্ষের সম্ভাব্য বড়ো রানের সামনে দাঁড়াবার জন্য। ত্রিশের দশকে অস্ট্রেলিয়া দল গড়ে ওঠে তার ব্যাটিংকে ঘিরে। জনসাধারণের কাছে ডন ছিল চুম্বক। ডন হয়ে ওঠে নায়ক।

সাফল্যের পর সাফল্য আর তার ফলেই ডন নিজের জন্য ডেকে আনে এক মুশকিলের ব্যাপার। লোকে এখন আশা করে ব্যাট হাতে নামলেই ডন শতরান করবে। একশোর কম রান করলেই রব ওঠে, ডন ব্যর্থ হয়েছে। একবার ৫৮ রান করায় খবরের কাগজে হেডলাইন বেরোল ‘ডন ব্যর্থ’। অন্য কেউ ৭০ বা ৮০ রান করলে চমকপ্রদ ইনিংস হিসাবে সেটা হয়তো গ্রাহ্য হবে, ডন করলে হয় না। সাফল্যের এটা অন্যতম জরিমানা।

লেখকরা তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রান-সংগ্রাহক যন্ত্র বলেছেন। বলাটা খুব সুপ্রযুক্ত নয়। যদিও ডনের মসৃণ স্ট্রোক তার বড়ো বড়ো ইনিংসগুলিকে যেন অনায়াসে নির্মিত হিসাবে চোখের সামনে তুলে ধরে, কিন্তু যন্ত্র ছিল না সে। উইকেটে দীর্ঘকাল থেকে বোলিংকে ছত্রখান করার কাজ তাকে দৈহিক এবং মানসিক দিক থেকে ক্ষয় করিয়ে দিত। দৈহিক ধকলটা প্রচন্ড ছিল। প্রায়ই তাকে সারাদিন ব্যাট করার পর স্নান করে, পোশাক বদলে, ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠতে হত পরের ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্য। হয়তো মধ্যরাত্রের আগে পেটে কিছু পড়ত না। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার খেলতে নামতে হত। কিন্তু মানসিক ধকলটাই ছিল ক্ষতিকর। বড়ো ইনিংস খেলতে হলে অত্যন্ত কঠোর একাগ্রতা, মনোনিবেশ দরকার হয়। নেভিল কার্ডাস একবার ডনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার এই সাফল্যের মূলমন্ত্রটি কী? ডন বলেছিল, ‘একাগ্র মনোনিবেশ। আমার কাছে প্রত্যেকটা বলই প্রথম বল, তখন আমার স্কোর শূন্য বা ২০০ যাই-হোক-না।’

ডন যখন উইকেটে থাকে তখন তার দৃষ্টি থেকে দর্শকরা একদম মুছে যায়। শুধু সেদেখতে পায় বোলার ও তার সাজানো ফিল্ডকে। ঠিক যেমন অর্জুন একমাত্র পাখিটির চোখ ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়নি, তেমনিই ডন কিংবা বলা যায় যারাই একাগ্র হয়ে উদ্দেশ্যসাধনে মনোনিবেশ করে, তাদেরই এই অবস্থা হয়। ডন লক্ষ করেছে, বহু ব্যাটসম্যান স্বচ্ছন্দে রান তুলে যায়, যতক্ষণ-না তাদের একাগ্রতায় চিড় ধরে। ডনের একাগ্রতায় চিড় ধরত না। একবার বোল্ড আউট হবার পর ডন অবাক হয়ে উইকেটকিপারকে বলে, ‘নিশ্চয়ই আমি একাগ্রতা হারিয়েছি!’

অন্যরা শতরান করার পরই ঢিলে দেয়, মজাদার ব্যাট চালিয়ে আউট হয়ে যায়। একশোটা রান কষ্ট করে সংগ্রহ করা সুতরাং ঢিলে দেবে নাই-বা কেন? কিন্তু একশো রান হয়ে যাওয়ার পরও ডনের একাগ্রতায় ঢিলেমি আসে না, এমনকী দ্বিশত বা ত্রিশত রানের পরেও। যতক্ষণ সেউইকেটে থাকে ততক্ষণ যাকে বলা হয় স্নায়বিক, এমন কোনো ব্যাপারে ডন কখনো ভোগেনি। তবে বড়ো ম্যাচের আগে সেউদবিগ্ন হয়ে উঠত। যখন উইকেটে এসে দাঁড়াত, উদবেগটা রূপান্তরিত হত শীতল উত্তেজনায়। টেস্ট সিরিজ চলাকালে ডন ঠিকমতো আহার করতে পারত না। পাকস্থলী তখন সহ্য করতে পারত না আহার্য।

দীর্ঘক্ষণ ব্যাট করার পর ডনের দরকার হত শান্ত নিরালা পরিবেশ, যেখানে সেসারাদিনে গুটিয়ে থাকা একাগ্রতার স্প্রিংটিকে ধীরে ধীরে শিথিল করে দিতে পারে। শিথিল করার জন্য ডন গান শুনত—শাস্ত্রীয় সংগীত অথবা বিলিয়ার্ডস খেলত। তখন সেচাইত পারিবারিক সান্নিধ্য, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই গৃহকোণের বদলে তাকে কাটাতে হয়েছে হোটেলকক্ষে। তার দলের বহু খেলোয়াড়ই নির্জনতার প্রতি ডনের আসক্তির এই ব্যাপারটা বুঝত না। তাদের কাছে রেকর্ড ইনিংসের অর্থ হইহল্লা আর পার্টি। কিন্তু গ্রামের ছেলে ডন কখনোই মদ বা সিগারেট খায়নি, হুল্লোড় পছন্দ করেনি। কয়েক কাপ চা আর শান্ত পরিবেশে আহার সেপছন্দ করত।

এই মনোভঙ্গির জন্যই সেউন্নাসিক, অসামাজিক আখ্যা পেয়েছিল। ১৯৩০ সালে ইংল্যাণ্ড সফরে ডন ৩৩৪ রান করে বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড করার পর দলের খেলোয়াড়রা আশা করেছিল সেপার্টি দেবে। কিন্তু তার বদলে ডন তার হোটেলঘরের দরজা বন্ধ করে গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে শুনছিল। এতে অন্যরা অসন্তুষ্ট হয়, ডনকে সেকথা বলা হলে সেমনে আঘাত পায়। ‘আমাকে ওরা কী করতে দেখলে খুশি হত?’ ডন বলেছিল, ‘রাস্তায় নেমে প্যারেড?’ এ সম্পর্কে ডনের বক্তব্য ছিল খুবই সরল। ওরা যখন মাতামাতি করে তখন সেআপত্তি করে না, সুতরাং সেযখন নি:সঙ্গতা চায় তখন অন্যে কেন আপত্তি করবে?

নিজের শিক্ষা ও রুচি উন্নীত করার জন্য ডন একাকীই চেষ্টা করেছে। যাতে মানসিক বিকাশ ঘটে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা যায় এমন বই পড়ার জন্য ডন তালিকা চায় নেভিল কার্ডাসের কাছে। কার্ডাস তাকে যে বইয়ের তালিকা দেন, সেগুলি মোটেই সহজ বা সুখপাঠ্য ছিল না। ডন তার প্রত্যেকটিই গভীরভাবে পড়েছিল।

নি:সঙ্গ কিন্তু স্বয়ংনির্ভর, বন্ধু সংগ্রহে অনিচ্ছুক ডন তার খেলার জীবনে সহ-খেলোয়াড়দের কাছে চিরদিনই ধাঁধা ছিল। যদি ডন তাদের মতো হত তাহলে সম্ভবত আর পাঁচজন টেস্ট খেলোয়াড়ের মতোই সেহয়তো আর একজন হত। তা না হয়ে ডন সকলকে ছাড়িয়ে উপরে ওঠে।

 ০৯. শিরোনামকারী

ইংল্যাণ্ড সফর (১৯৩০) থেকে ফিরে আসামাত্র ডনকে ঘিরে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়। সফরকালে একটি পত্রিকায় তার আত্মজীবনী ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। অস্ট্রেলীয় দলের ম্যানেজার এটা পছন্দ করেননি। তিনি অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডকে ব্যাপারটা জানান। অমনি রটে যায় ডনের সঙ্গে বোর্ডের ঝগড়া হয়েছে। রটনা এমন জায়গায় পৌঁছোয় যে, বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয় যে এসব মিথ্যা, অন্যায় কথা। দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকেরা ঝগড়া পাকাবার জন্যই এসব রটাচ্ছে।

ইংল্যাণ্ড থেকে জাহাজে অস্ট্রেলীয় দল অ্যাডিলেডে পৌঁছোয়। যে সম্পত্তি-দালালের অফিসে ডন চাকরি করত তার ব্যবসায়ে মন্দা পড়ায় সেটা ছেড়ে দিয়ে সিডনিতে ক্রীড়া সরঞ্জামের এক প্রতিষ্ঠানে সেচাকরি নিয়েছিল। তারা জাহাজেই টেলিগ্রাম করে ডনকে বলে তাড়াতাড়ি সিডনিতে চলে এসো। ডন জাহাজ থেকে অ্যাডিলেডে নেমে বিমানে সিডনি পৌঁছোয় দলের সকলের আগে।

সকলের আগে দেশে ফিরেছে, তার ওপর সফরের প্রধান নায়ক সুতরাং সাংবাদিকরা, ফোটোগ্রাফাররা ঝাঁপিয়ে পড়ল। এরপরই ডনের প্রতি ক্রিকেট জগতের প্রথম ঈর্ষা প্রকাশ পেল। রটনার মধ্য দিয়ে এই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা হল, প্রশংসা ও স্তুতি নিজে সবটা দখল করার জন্যই ডন সবার আগে দেশে ফিরেছে। ওকে বলা হল ‘প্রশংসা-শিকারি’।

ব্যাপারটা কিন্তু আদপেই তা নয়। ডন বরাবরই প্রচার জিনিসটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। নিজের ব্যাটিং, ফিল্ডিং এবং পরে অধিনায়কত্ব সম্পর্কে রচনা পাঠ করেই সেখুশি, তার বেশি আর কিছু সেচায়নি। তার পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে সমালোচনা সেঅকুন্ঠে মেনে নেয়, যদি তা বিদ্বেষপ্রসূত না হয় এবং যুক্তিপূর্ণ হয়। তার খেলা যে জনসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, এটা বোঝার মতো বোধ তার ছিল। সুতরাং সমঝদারদের সঙ্গে নিজের খেলা নিয়ে আলাপ করতে তার আপত্তি হত না। কিন্তু কোনো সাংবাদিক যদি তার সম্পর্কে বেফাঁস কিছু লিখত, তাহলে ডন তার সঙ্গে আর কখনো কথা বলত না।

মাঠের বাইরে ডন নিজের জীবনকে নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপাররূপে গণ্য করত। তার বন্ধুবান্ধব, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, পছন্দ-অপছন্দ, মতামত এইসব তার ব্যক্তিগত জীবনের এক-একটি অংশ, এগুলি নিয়ে কথা বলায় তার ঘোরতর আপত্তি ছিল। সাংবাদিকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করেও এ সম্পর্কে তার মুখ খোলাতে পারেনি, ব্যক্তিগত প্রশ্ন বা রাস্তায় বেরোলে ছবি তোলা, ডন রীতিমতো ঘৃণা করত। ডন কিছুতেই ভেবে পেত না সাফল্যের জন্য তাকে কেন এইভাবে দাম চোকাতে হবে। কিন্তু ডন এটাও বুঝতে পারেনি, লোকে ডন ব্র্যাডম্যানের বিষয়ে যতটা জানতে চায়, ততটুকু তারা পাচ্ছে না। অবশ্য খবরের কাগজ তার সম্পর্কে যথেষ্ট খবরই তাদের দিচ্ছিল।

ডনের সম্পর্কে প্রকাশিত খবরগুলি বিশ্লেষণ করে একজন তিন মাস সময়ের মধ্যে নিম্নোক্ত খবরগুলি পেয়েছেন :

ডন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে।ডন ইংল্যাণ্ডে বসবাস করতে যাচ্ছে।

ডন ইংরেজ মেয়ে বিয়ে করবে।

ডন মঞ্চে নামছে।

হলিউড ফিলম ডন অভিনয় করবে। রক্তাল্পতা ডনের খেলা শেষ করে দিচ্ছে।

ইংলিশ কাউন্টিতে ডন খেলবে।

এর একটাও সত্য প্রমাণিত হয়নি! এরপরই খবরের কাগজে ডনকে নিয়ে আর এক ঝড়ের খবর বেরোল। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগ ক্রিকেটের অ্যাক্রিংটন ক্লাব ডনকে প্রস্তাব দেয় তাদের ক্লাবে খেলার জন্য। খবরটা অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশ হওয়া মাত্র সেখানে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যেন কোনো দেশ পারমাণবিক ফর্মুলা চুরি করার চেষ্টা করছে।

ইংল্যাণ্ডের কী স্পর্ধা, ডনকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে চায়! খবরের কাগজে নানান খবর, অজস্র চিঠি ছাপা হতে লাগল। এক কাগজ লিখল, ‘ডন মনস্থির করে ফেলেছে; সেযাবেই!’ অন্য কাগজ জোর দিয়ে লিখল, ‘ডন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, অস্ট্রেলিয়াতেই থাকবে।’ তাড়া তাড়া চিঠি আসতে লাগল ডনের কাছে; উপদেশ, পরামর্শ আর অনুনয়ে সেগুলো ভরা। কেউ লিখল, দেশত্যাগ করলে তাকে দেশদ্রোহী বলা হবে; কেউ লিখল, নিজের আখেরটা আগে গুছিয়ে নাও। যে যা-ই বলুক কান দিয়ো না। যদি যেতে চাও তো চলে যাও।

আসলে ডন ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে, সেকী করবে। তার অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আদৌ ছিল না, তবে প্রস্তাবটায় কর্ণপাত করতেও তার আপত্তি ছিল না। চারিদিকে লেখালেখি হইচই-এর ফলে ডনের কাছে বহু পালটা প্রস্তাব এল। ক্রিকেট সম্পর্কে খবরের কাগজে লেখা ও বেতারে আলোচনা করার একটি প্রস্তাব পেয়ে সেতা নিয়ে নিল। এর অর্থ ডন দেশেই থেকে যাচ্ছে, অতএব জাতীয় সংকটও কেটে গেল।

১৯৩০-৩১ মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসে অস্ট্রেলিয়া সফরে। দলটা খুব শক্ত ছিল না, জিতেছিল শুধু শেষ টেস্টটি ভিজে উইকেটে। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রত্যেকটিই ইনিংস ও ১০০ রানেরও বেশি ব্যবধানে। মাত্র পঞ্চম টেস্ট ছাড়া ডন আর কোনো ম্যাচে এক বারের বেশি ব্যাট করেনি। তাতেই সেতিন বার নিজেকে আলোচনার বিষয় করে ফেলল, তৃতীয় টেস্টে ২৩৩ ও চতুর্থে ১৫২ রান এবং পঞ্চম টেস্টে শূন্যরান করে। ফাস্ট বোলার গ্রিফিথের একটি মন্থর বলকে লেগে ঘোরাতে গিয়ে ডন বোল্ড হয়।

টেস্ট সিরিজ শেষে অ্যালান কিপ্যাক্সের নেতৃত্বে একটি দলের সঙ্গে ডন উত্তর কুইন্সল্যাণ্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলস সফর করে। ব্ল্যাকহিথে লিথগো দলের বিরুদ্ধে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির প্রদর্শনী ম্যাচে ডন ২২ বলে শতরান করে তিনটি আট বলের ওভারে! আসলে করেছিল ২৫৬ রান, তাতে ছিল ১৪টি ছয় ও ২৯টি চার। প্রথম ওভারেই ৩৮ রান করার পর ডন তিন ওভারে যুক্ত হওয়া ১০২ রানের মধ্যে নিজে করে ১০০ রান। প্রথম ওভারে ডনের স্কোর— ৬, ৬, ৪, ২, ৪, ৪, ৬, ১। দ্বিতীয় ওভারে— ৬, ৪, ৪, ৬, ৬, ৪, ৬, ৪। তৃতীয় ওভারে তার জুড়ি ওয়েণ্ডেল বিল ১ রান নেওয়ার পর ডন ৬, ৬, ১ রান করে। ওয়েণ্ডেল বিল তারপর ১ রান এবং ওভারের বাকি বলে ডন ৪, ৪, ৬ করে। মোটামুটি মিনিট পনেরোর মধ্যেই এই তিন ওভারের ব্যাপারটা সম্পন্ন হয়।

এই হচ্ছে সেই ডন, যার খেলা দেখতে লোক পাগল হয়। যেখানে খুশি বল মেরে পাঠায়। যত খুশি বোলার বদল হোক, ডন যেখানে মনে করবে সেখানেই বল পাঠাবে। লিথগো দলের হতভাগ্য বোলারদের মধ্যে ছিল বব নিকলসন। সেই মরসুমের শেষে ১৯৩২-এর ৩০ এপ্রিল ডনের বিয়ের দিন বব সিডনিতে এসে বিয়ের আসরে গান গেয়েছিল। ডনের ব্যাটিং তাকে মুগ্ধ করেছিল।

একবার সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার ফ্লিটউড স্মিথ বল করেছিল ডনকে। নাগাড়ে বল, করে যাচ্ছে অফব্রেক বল আর ডন মিড অফ এবং এক্সট্রা কভার পয়েন্টের মাঝের ফাঁক দিয়ে সেগুলো বাউণ্ডারিতে পাঠাচ্ছে।

অবশেষে ডন বোলারকে বলল, ‘ব্যাপার কী, ফাঁকটা বন্ধ করছ না কেন? যত বার অফব্রেক দেবে তত বারই যে আমি ওই ফাঁকটা দিয়ে বল পাঠাব।’

ডনের পক্ষে তা সম্ভব, তাই একজন ফিল্ডসম্যান রাখা হল সেই ফাঁকে। মুচকি হেসে বোলার বলল, ‘এবার কী করবে?’

‘এবার,’ একগাল হেসে ডন বলল, ‘এবার তোমায় গ্যালারিতে পাঠাব।’ এবং পাঠিয়েও ছিল।

চ্যাটসউডে গর্ডন দলের বিরুদ্ধে ডন ১৭১ মিনিটে ২০১ রান করে। দ্বিতীয় শতরানটি ৪৫ মিনিটে। একটা হাফভলি বলে সেওভার বাউণ্ডারি মেরেছিল পয়েন্ট দিয়ে। একজন ফিল্ডার বলল, এটা মিস হিট থেকে হয়ে গেছে। পরের ওভারে ডন একইভাবে বল মেরে পয়েন্ট থেকেই ছয় রান পায়। মাঠটা অবশ্য ছোটো ছিল।

লর্ডসে ১৯৪৮-এ ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি দেখল দুই ফিল্ডারের মাঝ দিয়ে ডন বার বার বল ড্রাইভ করে যাচ্ছে। ফাঁকটা বন্ধ করার জন্য সেএকজন ফিল্ডারকে সরিয়ে আনল। ডন নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে শুধু দেখল। পরের বলটি সেভাবলেশহীন মুখে ঠিক সেই জায়গাটিতেই পাঠাল, যেখান থেকে ফিল্ডারটিকে সরিয়ে আনা হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ পেলে বিশেষ কোনো মার ডন আবার মেরে দেখাতে পারত।

দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট দল ১৯৩১-৩২ মরসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে। অস্ট্রেলিয়া সহজে পাঁচটি টেস্টেই জেতে প্রধানত ডনের জন্য। চারটি টেস্টে খেলে সেচারটি শতরান করে : ২২৬, ১১২, ১৬৭ ও ২৯৯ নট আউট। অন্য দুটি ম্যাচেও দুটি শতরান করে সফরকারীদের বিরুদ্ধে : ১৩৫, ২১৯। সিরিজে চারটি টেস্টে তার গড় ছিল ২০১.৫ রান। ডন পঞ্চম টেস্টেও দলে ছিল। ফিল্ড করতে যাওয়ার আগে ড্রেসিং রুমে পা মচকে যাওয়ায় ব্যাট করতে পারেনি। ক্ল্যারি গ্রিমেট দলে থেকেও ব্যাট করেনি। করার দরকার হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৬ ও ৪৫ রানে আউট হয়। আয়রনমঙ্গার ২৪ রানে ১১ উইকেট নেয়। এই সিরিজে ৮০৬ রান করার পর ডন বিনীতভাবে বলেছিল, ‘খারাপ ফিল্ডিংয়ের জন্যই রান পেয়েছি।’

ডন একদিন এক খবরের কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে; তখন ঢুকছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার স্যান্ডি বেল। ডনের অপস্রিয়মাণ চেহারার দিকে তাকিয়ে বেল মন্তব্য করে : ‘এই সফরে এই প্রথম আমি এর পিঠ দেখলাম!’

কুইন্সল্যাণ্ডের ‘কুকটাউন ইন্ডিপেণ্ডেন্ট’ নামে এক খবরের কাগজ এই টেস্ট সিরিজ চলাকালে ডনকে পরলোকে পাঠিয়ে দেয়। তারা লেখে : ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের পরলোকগমনে অস্ট্রেলিয়া আজ শোকাহত। ব্রিসবেন টেস্ট ম্যাচ চলাকালে ডন ব্র্যাডম্যান আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে শনিবার মারা গেছেন।’

খবরটি পড়ে ডন খুব হেসেছিল। খুব কম লোকেরই নিজের মৃত্যুসংবাদ পাঠের ভাগ্য হয়। এই সময় সেজনপ্রিয়তার তুঙ্গে আরোহণ করেছিল। ট্রেনে কোথাও গেলে প্রত্যেক স্টেশনে দলে দলে ক্রিকেটপাগলরা তার নাম ধরে কামরায় কামরায় খোঁজাখুঁজি করে, রাস্তায় বেরোলে ভিড় জমে যায়। নীরব, নির্বিবাদী ডনের পক্ষে এই বীরপূজা সামলাতে যে ধকল সহ্য করতে হচ্ছিল, তাতে মানসিক দিক থেকে তার ক্ষয় হত।

বাওরালের লোকেরা তাকে উপহার দেয় সোনার ঘড়ি ও চেন। এক মোটর গাড়ির প্রতিষ্ঠান দেয় নতুন একটি স্পোর্টস কার। এই সময় সারা অস্ট্রেলিয়ার চোখে ডন ছিল ভগবানের প্রায় সমতুল।

ডন আবার খবরের কারণ হল ১৯৩২-এর এপ্রিলে বিয়ে করে। বধূ জেসি মেঞ্জিস সিডনিতেই ব্যাঙ্কের চাকুরিয়া। ডনের গ্রাম বাওরালের কাছেই মিটাগং-এর মেয়ে। স্কুল থেকেই দুজনের ভাব। এই মিটাগংয়েই ডন প্রথম শতরান করেছিল ছাত্রাবস্থায় এবং ব্যাটটি ভুলে ফেলে রেখে এসেছিল।

অত্যন্ত সুখের বিবাহ হয়েছে ডনের। পরে সেবলেছিল, ‘এমন অনেক সময় জীবনে এসেছে যখন ওকে ছাড়া আমার পক্ষে চলা একদমই সম্ভব হত না।’ বিয়ের পরই উত্তর আমেরিকা সফরে ডনের সঙ্গে জেসিও যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই সফরের উদ্যোক্তা ছিলেন আর্থার মেইলি। আমেরিকানরা প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিল দলে ডন না থাকলে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই ক্রিকেট সম্পর্কে। মেইলিও ডনকে বলে, তোমাকে যেতে হবেই। ডন দেখল, এই সফরে খেলতে হবে মজা করে সুতরাং আপত্তির আর কারণ কী!

প্রথম খেলা ভ্যাঙ্কুভার আইল্যাণ্ডে ১৮ জনের এক দলের বিরুদ্ধে। ওরা করে ১৯৪। অস্ট্রেলীয়রা ৮ উইকেটে ৫০৩। ম্যাককেব করে ১৫০। অধিনায়ক রিচার্ডসন ও ডন ৭ মিনিটে তোলে ৫০ রান। ঝোপঝাড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় ছয়টি বল। পরের ম্যাচে ডন ছয়টি উইকেট পায় আট বলের এক ওভারে, কিন্তু হ্যাট্রিক হয়নি।

নিউ ইয়র্কে ডন খুশি হয়েছিল রাস্তায় বেরিয়ে। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না, অটোগ্রাফের বই এগিয়ে দিচ্ছে না। আর খুশি হয়েছিল বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড় বেব রুথের সঙ্গে আলাপ করে। ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান যা, বেসবলে বেব রুথ তাই। যুক্তরাষ্ট্রে ওরা মজা করেই ক্রিকেট খেলেছে। কোনো ম্যাচে হয়তো আম্পায়ার খেলা ফেলে রেখে কথা বলতে চলে গেল বাউণ্ডারির ধারে; কোনো ম্যাচে দুই আম্পায়ারের একজন ছয় বলে অন্য জন আট বলে ওভার দিয়েছে; কোনো ম্যাচে বিপক্ষ দলে ১৬ বা ১৭ জন করে খেলেছে। একটি খেলায় আম্পায়ার ছিল চিউইং গামের ব্যবসায়ী। মাঠেই সেখেলোয়াড়দের মধ্যে তার ব্যাবসা সামগ্রীর নমুনা বিতরণ করে এবং হাওয়ায় বেল পড়ে যাচ্ছে দেখে স্থানীয় ব্যাটধারীরা চিউইং গাম দিয়ে স্টাম্পের ওপর বেল আটকে রাখে। একজনকে স্টাম্প আউট করা হলে বেলটি আঠায় ঝুলতে ঝুলতে যতক্ষণ-না ভূমি স্পর্শ করেছে ততক্ষণ আম্পায়ার আউট দেওয়া থেকে নিবৃত্ত ছিল। একটি খেলায় অসমান খারাপ পিচ সম্পর্কে অনুযোগ করায় স্থানীয় কতৃপক্ষ পিচে জল ঢেলে দেয় যাতে বল আর না লাফায়।

একবার বিপক্ষের ১৭ জন ব্যাট করে ও ১৪ জন বল করে। সান ফ্রান্সিসকোয় একটি ম্যাচে বিপক্ষের ১৫ জন ২০ রানে আউট হয়। ডন কয় বার মাত্র বল ছুঁয়েছিল— তিনটি ক্যাচ ধরা ও চারটি রান আউটের জন্য।

আড়াই মাসে অস্ট্রেলীয় দলটি ছয় হাজার মাইল অতিক্রম করে। ডন ৫১ ইনিংসে করে ৩,৭৭৯ রান। ক্রিকেট উচ্চ পর্যায়ের ছিল না, কিন্তু ডনের জীবনের অন্যতম সুখের কাল ছিল এই আড়াই মাস। কিন্তু ঝড় যে আসছে, তার পূর্বাভাস ঘুণাক্ষরেও ডন তখন জানত না। বছর ঘোরার আগে ক্রিকেটের ইতিহাসের সবথেকে প্রলয়ংকর ঘটনার কেন্দ্রে সেএসে গেল। ঝড়ের নাম : ‘বডিলাইন’।

১০. ডনকে থামাও

সারা অস্ট্রেলিয়া ১৯৩২-এ সফরকারী ইংরেজ ক্রিকেটারদের ধিক্কার দিল। আশঙ্কা করা হল জনতা হয়তো মাঠে নেমে এসে ওদের মারধর করতে পারে, তাই সর্বত্র ওদের বিশেষ পুলিশ প্রহরায় রাখা হল। খবরের কাগজে তীব্র কশাঘাত হানা হল ইংরেজদের প্রতি এবং এক-এক সময়ে মনে হচ্ছিল আর বুঝি কখনো টেস্ট খেলা হবে না।

সব কিছুর মূলে : তথাকথিত ‘বডিলাইন বোলিং।’ বলগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ইংল্যাণ্ডের ফাস্ট বোলারদের, বিশেষ করে নটিংহ্যামশায়ারের নানকার্গেটের প্রাক্তন কয়লাখনি শ্রমিক হ্যারল্ড লারউড দ্বারা, যার তুল্য ফাস্ট বোলার তখনও দেখা যায়নি।

এই বিতর্কমূলক বোলিংয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ডন ব্র্যাডম্যান নামক রান সংগ্রাহক অতিমানবকে পরাজিত করা। ডনকে থামানোর জন্যই এই বোলিং পদ্ধতির উদ্ভাবন। গুণের স্বীকৃতি, অবাঞ্ছনীয়ভাবে হলেও, এমন বিরাট ভঙ্গিতে খুব কম লোককেই জানানো হয়েছে।

বডিলাইনটা কী? আজও এই নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। তবে মূলত ব্যাপারটা শর্টপিচে ফাস্ট বোলিং। মতলব : জমিতে বাম্প করে বল তোলা এবং লেগ-সাইডে তখন ছয় থেকে আট জন লোক রাখা হয়।

তর্কটা হল, লেগ স্টাম্প না ব্যাটধারী, লক্ষ্যবস্তু কোনটি? অস্ট্রেলীয়দের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, এই বোলিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যাটধারীকে ভয় পাইয়ে তার মনে এমন এক উদবেগ এনে দেওয়া যাতে সেতার উইকেটের নিরাপত্তার থেকেও বেশি চিন্তা করে নিজের দেহের নিরাপত্তা সম্পর্কে; ব্যাটধারীকে লক্ষ করেই এই বল করা হয় এবং আউট হওয়া নয়তো আঘাত নেওয়া এই দুইয়ের একটি ছাড়া তার আর কিছু করার থাকে না। নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত, অব্যর্থ লক্ষ্য, লারউডের বলের গতি ঘণ্টায় ৯৫ মাইলের মতো। সুতরাং মানুষ আঘাত পেয়েছে, উইকেট হারিয়েছে, এবং সন্ত্রস্ত অস্ট্রেলীয়রা কোমরে-বুকে প্যাড পরেছে।

প্রথম টেস্টে ডন খেলতে পারেনি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড আপত্তি জানিয়ে বলল, খবরের কাগজে ডন লিখতে পারবে না। ডন বলল, চুক্তি করেছি যখন তা রক্ষা করব। তাই নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। অবশেষে খবরের কাগজটিই জানাল, ডনকে লিখতে হবে না। এই নিয়ে ডনকে প্রচুর মানসিক টানাপোড়েন সহ্য করতে হয়।

এরপর শারীরিক ধকল, এমসিসি-র বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের পক্ষে খেলার জন্য সিডনি থেকে পার্থ পাঁচ রাত ট্রেনে কাটিয়ে ডনকে পুরো দু-দিন ফিল্ড করতে হয়। তারপর বৃষ্টিভেজা উইকেটে ৩ ও ১০ রান করে আবার সিডনিতে ফিরেই ডন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খেলতে নামে। সে-খেলায় ডন ১৯৫ মিনিটে ২৩৮ করে এবং প্রথম শতরানটি ৭০ মিনিটে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২ অপরাজিত। বিপক্ষে বোলার ছিল ফ্লিটউড-স্মিথ। এরপর ডনের শরীর পরিশ্রমের ধকল নিতে পারছিল না। তবু মেলবোর্নে গিয়ে আবার এমসিসি-র বিরুদ্ধে আর একটি ম্যাচ খেলে এবং রান করে ৩৬ ও ১৩। দু-বারেই আউট হয় লারউডের বলে। এই ম্যাচে জার্ডিন বডিলাইন আক্রমণের চেহারাটি প্রথম দেখালেন। খেলা, ট্রেনভ্রমণ এবং তর্কবিতর্ক—এই তিনের চাপ ফুটে উঠল নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে এমসিসি-র খেলাটিতে। ডন করল ১৮ ও ২৩।

ডন বোর্ডকে জানাল, তার শরীর টেস্ট ম্যাচ খেলার উপযুক্ত নেই। ডাক্তার জানাল ওর পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। সিডনিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি সেদেখল দর্শকাসন থেকে। দেখল ম্যাককেবের অপরাজিত অসাধারণ ১৮৭, দেখল লারউডের অনবদ্য ফাস্ট বোলিং, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে দীর্ঘক্ষণের প্রচন্ড গতি বলের দ্বারা ২৮ রানে পাঁচটি উইকেট পাওয়া ১৮ ওভারে। অস্ট্রেলিয়া হারল ১০ উইকেটে।

মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ডন খেলতে নামল। তার আগে ডনকে অনেকেই হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘তোমার জন্য ইংল্যাণ্ড ফাস্ট বোলারদের এনেছে। তোমার ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ ডন শুনেছে, এমসিসি-দল অস্ট্রেলিয়ায় আসার পথে জাহাজে রোজই শলাপরামর্শ করত। প্রধানত ডনকে রোখার জন্যই হত শলাপরামর্শ। সেজানত তার ১৯৩০ সফরের প্রতিটি ইনিংস তন্নতন্ন করে ওরা বিশ্লেষণ করেছে তাকে অকেজো করার পথ খুঁজে বার করতে।

ওদের বিশ্বাস, শুধু ডনকে যদি বড়ো রান তোলা থেকে নিবৃত্ত করা যায়, তাহলেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। ওরা খুঁজেপেতে দেখল ডনের একমাত্র দুর্বলতা, শক্ত পিচে খাঁটি ফাস্ট বোলিংয়ে। তারা এর সঙ্গে মেলাল লেগ থিয়োরিকে।

সমুদ্রতীরে এক বন্ধুর নির্জন সৈকতাবাসে ডন তার পরিকল্পনা তৈরি করল একাকী সারারাত।

সেব্যাটিং মধ্যমণি। সুতরাং লারউডের বজ্র থেকে সরে যাওয়া বা শুধুই ব্যাট দিয়ে আটকানো তার পক্ষে শোভা পায় না। ওসব কাজ বোলাররা করবে, তাকে করতে হবে রান। তাই সেপদ্ধতি বার করল : উইকেট থেকে সরে গিয়ে বল মারতে চেষ্টা করবে অফ-সাইড ফিল্ডের দিকে।

তার মানে, বোলারকে তখন অফ-সাইড জোরদার করতে হবে। যদি তা করে তাহলে তাকে লেগ-সাইড ফিল্ড কমজোরি করতে হবে। তাহলে ডন স্বাভাবিক ব্যাটিংয়ে ফিরে আসতে পারবে।

ঝুঁকি নিয়ে, বে-কেতাবি খেলা। কিন্তু তা ছাড়া উপায় নেই। এখনকার মতো এটাই যা-কিছু কাজের ছক।

মেলবোর্নে ডন যখন ব্যাট হাতে নামল, জনতা তুমুল অভিনন্দনে ফেটে পড়ল। অস্ট্রেলিয়ার ওস্তাদ নেমেছে। প্রথম টেস্ট হারের শোধ নেবেই নেবে। জনতার দারুণ প্রত্যাশা।

ডন ক্রিজের দিকে এগোচ্ছে। হারবার্ট সাটক্লিফ বলল, ‘কী দারুণভাবে স্বাগত জানাচ্ছে।’

‘যখন ফিরব, তখনও এটা এইরকম দারুণ থাকবে কি?’ গম্ভীর স্বরে ডন বলেছিল।

থাকেনি। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে অসাড় স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে ডন হেঁটে ফিরেছিল প্যাভিলিয়নে। বাওয়েসের প্রথম বল শর্টপিচ। ডন পুল করতে চেষ্টা করল এবং বলটিকে টেনে আনল লেগস্টাম্পে। প্রথম বলেই আউট ডনের জীবনে এই প্রথম এবং এই শেষ বারই ঘটল। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে সেআউট হয় দ্বিতীয় বলে।

অস্ট্রেলিয়ার দুঃসময়ে তার নায়ক দেশকে ডুবিয়ে দিল। সাফল্যের এইটাই জরিমানা; যদি একশোর কম রান করে তাহলে ধরে নেওয়া হয় ডন ব্যর্থ হয়েছে। অন্যান্য সাধারণ ব্যাটধারীকে আর ডনকে মাপার মানদন্ড এক নয়।

কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ডন যথারীতি আবার নিজের খেলায় ফিরে এসে ১০৩ করল দলের ১৯১ রানের ইনিংসে। বডি লাইন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এই টেস্টে তা কার্যকরী হয়নি। আগের সপ্তাহে বৃষ্টি হওয়ায় উইকেট অস্বাভাবিক মন্থর ছিল বাউন্সারের পক্ষে।

ডন আবার বিগ্রহরূপে পূজিত হল। মাঠেই চাঁদা তুলে ডনকে দিল দর্শকরা। তাই দিয়ে সেমস্ত এক পিয়ানো কিনেছিল। পিয়ানোবাদনেও ডন রীতিমতো দক্ষ। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় টেস্ট ১১১ রানে জিতেছিল।

অ্যাডিলেডে তৃতীয় টেস্টে বডি-লাইনের ঝড় মাতন তুলল। এমন বিশ্রীভাবে আর কখনো টেস্ট খেলা হয়নি। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল উডফুল দু-বার আঘাত পেলেন লারউডের বাউন্সারে। ওল্ডফিল্ড মুখে আঘাত পেয়ে অবসর নেন। ডন আট রান করে কট হয় লারউডের বলে।

গ্রীষ্মের শুষ্ক দিনে, ইংরেজ বোলিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ ছড়িয়ে পড়ল মাঠ ঘিরে। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন খেলতে নামল চোয়াল শক্ত করে। এবার সেতার পরিকল্পনা অনুযায়ী উইকেট থেকে পিছিয়ে গিয়ে অফের দিকে বল মারার চেষ্টা করতে লাগল। এভাবে খেলার জন্য অরক্ষিত থাকছিল তার স্টাম্প। দর্শকরা হইচই শুরু করে; তারা বুঝতে পারছে না ডনের এভাবে খেলার কী মানে হয়। দেখে মনে হচ্ছিল সেযেন বলের লাইন থেকে সরে যেতে চাইছে।

ডন মাথাখারাপের মতো ইনিংস খেলল। কেতাবে আছে এমন মার বোধ হয় সেএকটিও মারেনি।

বার বার সেক্রস ব্যাট চালাল কিন্তু রানও করল। খেলার যোগ্য বলগুলিকে সেপিটিয়ে ছাতু করল।

শর্ট-স্কোয়্যার লেগে ক্যাচ পাওয়ার জন্য জার্ডিন নিজে দাঁড়ালেন। ঝিকিয়ে উঠল ডনের চোখ। কয়েক মিনিট পরেই সেঘুরিয়ে বল মারল প্রচন্ডভাবে। কোনোক্রমে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে ইংরেজ অধিনায়ক নিজেকে রক্ষাকরলেন। জায়গাটা ছেড়ে আর একজনকে দাঁড় করিয়ে জার্ডিন সরে গেলেন। ডন রসিকতা করছে কি না সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

লারউডের জায়গায় ল্যাটা স্পিনার হেডলি ভেরিটি আসতেই ডন তাকে সদস্য স্ট্যাণ্ডে তুলে দেয় এবং এক বৃদ্ধা অল্পের জন্য রক্ষা পায়। এক ঘণ্টা উইকেটে থেকে ডন ৬৬ রান করে ভেরিটির বলে তার হাতেই কট হয়।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে দ্বিতীয় পরাজয় থেকে রক্ষার জন্য এই প্রয়াস যথেষ্ট নয়। ইংল্যাণ্ড ৩৩৮ রানে জেতে। এই টেস্ট শেষ হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড নজীরবিহীন এক টেলিগ্রাম লণ্ডনে এমসিসি-র কাছে পাঠায়। তাতে বলা হল :

বডিলাইন বোলিং এমন আকার নিয়েছে যে, ক্রিকেটের সর্বোত্তম স্বার্থের পক্ষে তা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ব্যাটধারীদের দেহকে রক্ষাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় করে তুলেছে।

এতদ্বারা খেলোয়াড়দের মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ এবং সেইসঙ্গে চোট-আঘাত ঘটছে। যদি-না এখুনি বন্ধ করা হয় তাহলে এটা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে বর্তমান প্রীতির সম্পর্ককেক্ষুণ্ণ করবে।

ইতিমধ্যে দুই দলের সম্পর্কে প্রীতির লেশটুকুও আর নেই। পরে আরও খারাপ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা যখন ব্যাট করছে, কোনো কোনো অস্ট্রেলীয় ফিল্ডসম্যানকে দেখা গেল উইকেটের দিকে বল ছোড়ার সময় যেন প্রতিযোগিতা করেই চেষ্টা করছে যাতে তা ব্যাটধারীকে আঘাত করে। পালটা জবাব দিতে ইংরেজদেরও মাঝেমধ্যে বাউন্সার দেওয়া হয় বটে কিন্তু উডফুলের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ‘প্রতিশোধ নয়।’

অস্ট্রেলীয়দের সম্পর্কে লারউডের কয়েকটি মন্তব্যও অবস্থার অবনতি ঘটায়। সেবলে, ডন ভয় পেয়ে গেছে আর উডফুলের নড়াচড়া এমনই মন্থর যে, যে-বল লাফিয়ে উঁচু হয়ে ওঠেনি তাতেও সেমাথা নীচু করেছে।

ইংল্যাণ্ড দলের সবারই কিন্তু এই পদ্ধতির বোলিংয়ে সায় ছিল না। এই সফরের ১৪ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ওয়াল্টার হ্যামণ্ড বলেন :

আমি সর্বতোভাবে এর নিন্দা করি। বডি-লাইন বিপজ্জনক। আমি বিশ্বাস করি, নিছক সৌভাগ্যবশতই বডি-লাইনে কেউ মারা যায়নি। যদি এটাকে চলতে দেওয়া হত তাহলে আমি খেলা থেকে বিদায় নিতাম।

কিন্তু লণ্ডনে ক্রিকেটের মাতব্বররা ভেবেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠানো খবরে বাড়াবাড়ি রয়েছে, এমনটা হতেই পারে না। ভালোমতো তদন্ত না করে তারা তখুনি ব্যবস্থা নেবার কোনো দরকার আছে মনে করলেন না। এদিকে লারউড ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠতে লাগল। তার বলের গতি দ্রুত থেকে আরও দ্রুত হচ্ছে। খেলার পর তার শ্রান্ত তপ্ত শরীরে বরফ ঘষে দিত সতীর্থরা। বল করার সময় তার বঁা-পা এত জোরে পড়ত যে তার বুট ফেটে যেতে লাগল। নিজেকে নি:শেষ করে, ক্ষমতার শেষ প্রান্তে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে লারউড এমনভাবে বল করে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সেনিজেকেই বোল্ড আউট করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার রোদে-পোড়া পাথুরে জমিতে বল ডেলিভারির সময় তার বঁা-পা এত কঠিনভাবে ফেলার জন্য গোড়ালিটা প্রায় থেঁতলেই গেছিল। সফর থেকে ফিরে আর সেঅত জোরে বল করতে পারেনি। আটাশ বছর বয়সেই লারউড শেষ হয়ে যায়।

তার বলের গতি অস্ট্রেলীয়দের আপত্তির কারণ ছিল না। তাদের বক্তব্য, সেই গতিকে ব্যাটধারীদের জখম করবার জন্য ব্যবহার করাটাই আপত্তিকর।

ইংল্যাণ্ড চতুর্থ টেস্ট ৬ উইকেটে জিতে ‘রাবার’ পায় প্রধানত লারউডের জন্য। সিরিজে ডন আট ইনিংস থেকে চার বার আউট হয় লারউডের বলে। সেরান করে— ০ ও ১০৩*, ৮ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪, ৪৮ ও ৭১। প্রতি ১০০ বলে ৭৫ রান করে।

সন্দেহ নেই, যে-কাজের জন্য বডিলাইন বোলিংয়ের উদ্ভাবন, তা সম্পন্ন হয়েছিল সফলভাবেই। ডনকে খর্ব করে তার রানের গড়কে (৫৬.৫৭) সাধারণ খেলোয়াড়ের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পেরেছিল। ডনের জীবনে এমনটি শুধু এই এক বারই ঘটে।

বস্তুত বডিলাইন বল খেলা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রথাসিদ্ধ ব্যাটিং— আক্রমণেই হোক বা রক্ষণেই হোক, এর বিরুদ্ধে অক্ষম হয়ে পড়েই। ব্যাটসম্যান যদি মেরে খেলতে চায় তাহলে সাধারণত লেগ ফিল্ডে কট হবে। আর যদি তা না করে, বোল্ড অথবা আহত হবে।

বডিলাইন চূর্ণ করা সম্ভব কি না সেটা দেখা আর সম্ভব হল না যেহেতু এই একটি মরসুমেই তার উদয় ও অস্ত ঘটেছিল।

যেভাবে ডন বডিলাইন খেলার চেষ্টা করে বা তার সচরাচর অভ্যস্ত মোটা অঙ্কের রান করতে না পারার জন্য তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এতে সেমনে আঘাত পায়। তার বক্তব্য : ‘আর কেউ কি এর থেকে কিছু ভালো করেছে?’

নিশ্চয়ই ডনের থেকে কেউ ভালো পারেনি। সিরিজে আট ইনিংসে তার রান ৩৯৬, গড় ৫৬.৫৭। যারা পাঁচটি টেস্টই খেলেছে তাদের থেকে ডনের চার টেস্টে রান বেশি, কিন্তু তার সবথেকে বড়ো মুশকিল, ‘ভেলকিওয়ালা’ হিসাবে এখন তার গায়ে ছাপ পড়ে গেছে। তার কাছ থেকে সবাই এখন একটা-কিছু ভেলকি আশা করে।

ডন ইংল্যাণ্ডের বিজয় রুখতে পারেনি, কিন্তু সেই জয় সর্বত্রই ক্রিকেটারদের মুখ বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে এমসিসি এই সফরের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি জানতে পেরেছে। তারা ফতোয়া জারি করল, যেকোনো ধরনের বোলিং ‘যা বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে সরাসরি আক্রমণ, তা খেলার প্রেরণার প্রতি অপরাধ।’

এমসিসি পরে একথাও মেনে নিল যে, ‘গত ক্রিকেট মরশুমে বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের প্রতি কখনো কখনো সরাসরি আক্রমণ ঘটেছে, এমন ঘটনারও প্রমাণ মিলেছে।’

অবশেষে আঘাতের উদ্দেশ্যে বোলিংয়ের বিরুদ্ধে আইন রচিত হয়। যদি এ ধরনের বোলিং চলতে দেওয়া হত, সন্দেহ নেই তাহলে ক্রিকেট খেলাটাই ধ্বংস হত। বডিলাইনের উৎপত্তিও কিন্তু সম্ভব হত না যদি প্রতিপক্ষ ক্রিকেটাররা ডনকে এত বিরাটভাবে এবং এত সম্মানভরে স্বীকার করে না নিত।

ওই মরসুম সম্পর্কে উইজডেন লিখল :

এ ধরনের বোলিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়—প্রধানত ব্র্যাডম্যানের রান সংগ্রহ প্রবণতাকে খর্ব করার কথা ভেবেই—যাকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা ও দর্শকরা একযোগে ধিক্কৃত করে এবং যখন এর সম্পর্কে আসল সত্যটি এইদেশে শেষপর্যন্ত জানা গেল, তখন ঘরের লোকেরা—তার মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত খেলোয়াড়—বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবে, রাবার জয়ের বিনিময়ে এই বৈরিতালাভ সত্যিই কি লাভজনক হয়েছে!

বডিলাইনের প্রয়োগ সম্পর্কে ক্রিকেট দুনিয়ার অপছন্দ এমনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, জার্ডিন পরের বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় আর খেলেননি। তবে পরবর্তীকালে চমৎকার এক ব্যাপার ঘটে।

১৯৩২-এ অস্ট্রেলিয়ায় যে-লোকটি সবথেকে ঘৃণ্যরূপে গণ্য হয়েছিল, সেই লারউড ১৮ বছর পর ১৯৫০ সালে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সম্মানিত নাগরিকরূপে সেখানে গণ্য হন। তিক্ততা এই ১৮ বছরে ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু অন্যান্য বহু টেস্ট ক্রিকেটারের মতো, ডন ১৯৩২-এর স্মৃতি রোমন্থনে এখনও অনাগ্রহী।

সারা অস্ট্রেলিয়া ১৯৩২-এ সফরকারী ইংরেজ ক্রিকেটারদের ধিক্কার দিল। আশঙ্কা করা হল জনতা হয়তো মাঠে নেমে এসে ওদের মারধর করতে পারে, তাই সর্বত্র ওদের বিশেষ পুলিশ প্রহরায় রাখা হল। খবরের কাগজে তীব্র কশাঘাত হানা হল ইংরেজদের প্রতি এবং এক-এক সময়ে মনে হচ্ছিল আর বুঝি কখনো টেস্ট খেলা হবে না।

সব কিছুর মূলে : তথাকথিত ‘বডিলাইন বোলিং।’ বলগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ইংল্যাণ্ডের ফাস্ট বোলারদের, বিশেষ করে নটিংহ্যামশায়ারের নানকার্গেটের প্রাক্তন কয়লাখনি শ্রমিক হ্যারল্ড লারউড দ্বারা, যার তুল্য ফাস্ট বোলার তখনও দেখা যায়নি।

এই বিতর্কমূলক বোলিংয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ডন ব্র্যাডম্যান নামক রান সংগ্রাহক অতিমানবকে পরাজিত করা। ডনকে থামানোর জন্যই এই বোলিং পদ্ধতির উদ্ভাবন। গুণের স্বীকৃতি, অবাঞ্ছনীয়ভাবে হলেও, এমন বিরাট ভঙ্গিতে খুব কম লোককেই জানানো হয়েছে।

বডিলাইনটা কী? আজও এই নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। তবে মূলত ব্যাপারটা শর্টপিচে ফাস্ট বোলিং। মতলব : জমিতে বাম্প করে বল তোলা এবং লেগ-সাইডে তখন ছয় থেকে আট জন লোক রাখা হয়।

তর্কটা হল, লেগ স্টাম্প না ব্যাটধারী, লক্ষ্যবস্তু কোনটি? অস্ট্রেলীয়দের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, এই বোলিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যাটধারীকে ভয় পাইয়ে তার মনে এমন এক উদবেগ এনে দেওয়া যাতে সেতার উইকেটের নিরাপত্তার থেকেও বেশি চিন্তা করে নিজের দেহের নিরাপত্তা সম্পর্কে; ব্যাটধারীকে লক্ষ করেই এই বল করা হয় এবং আউট হওয়া নয়তো আঘাত নেওয়া এই দুইয়ের একটি ছাড়া তার আর কিছু করার থাকে না। নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত, অব্যর্থ লক্ষ্য, লারউডের বলের গতি ঘণ্টায় ৯৫ মাইলের মতো। সুতরাং মানুষ আঘাত পেয়েছে, উইকেট হারিয়েছে, এবং সন্ত্রস্ত অস্ট্রেলীয়রা কোমরে-বুকে প্যাড পরেছে।

প্রথম টেস্টে ডন খেলতে পারেনি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড আপত্তি জানিয়ে বলল, খবরের কাগজে ডন লিখতে পারবে না। ডন বলল, চুক্তি করেছি যখন তা রক্ষা করব। তাই নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। অবশেষে খবরের কাগজটিই জানাল, ডনকে লিখতে হবে না। এই নিয়ে ডনকে প্রচুর মানসিক টানাপোড়েন সহ্য করতে হয়।

এরপর শারীরিক ধকল, এমসিসি-র বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের পক্ষে খেলার জন্য সিডনি থেকে পার্থ পাঁচ রাত ট্রেনে কাটিয়ে ডনকে পুরো দু-দিন ফিল্ড করতে হয়। তারপর বৃষ্টিভেজা উইকেটে ৩ ও ১০ রান করে আবার সিডনিতে ফিরেই ডন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খেলতে নামে। সে-খেলায় ডন ১৯৫ মিনিটে ২৩৮ করে এবং প্রথম শতরানটি ৭০ মিনিটে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২ অপরাজিত। বিপক্ষে বোলার ছিল ফ্লিটউড-স্মিথ। এরপর ডনের শরীর পরিশ্রমের ধকল নিতে পারছিল না। তবু মেলবোর্নে গিয়ে আবার এমসিসি-র বিরুদ্ধে আর একটি ম্যাচ খেলে এবং রান করে ৩৬ ও ১৩। দু-বারেই আউট হয় লারউডের বলে। এই ম্যাচে জার্ডিন বডিলাইন আক্রমণের চেহারাটি প্রথম দেখালেন। খেলা, ট্রেনভ্রমণ এবং তর্কবিতর্ক—এই তিনের চাপ ফুটে উঠল নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে এমসিসি-র খেলাটিতে। ডন করল ১৮ ও ২৩।

ডন বোর্ডকে জানাল, তার শরীর টেস্ট ম্যাচ খেলার উপযুক্ত নেই। ডাক্তার জানাল ওর পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। সিডনিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি সেদেখল দর্শকাসন থেকে। দেখল ম্যাককেবের অপরাজিত অসাধারণ ১৮৭, দেখল লারউডের অনবদ্য ফাস্ট বোলিং, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে দীর্ঘক্ষণের প্রচন্ড গতি বলের দ্বারা ২৮ রানে পাঁচটি উইকেট পাওয়া ১৮ ওভারে। অস্ট্রেলিয়া হারল ১০ উইকেটে।

মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ডন খেলতে নামল। তার আগে ডনকে অনেকেই হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘তোমার জন্য ইংল্যাণ্ড ফাস্ট বোলারদের এনেছে। তোমার ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ ডন শুনেছে, এমসিসি-দল অস্ট্রেলিয়ায় আসার পথে জাহাজে রোজই শলাপরামর্শ করত। প্রধানত ডনকে রোখার জন্যই হত শলাপরামর্শ। সেজানত তার ১৯৩০ সফরের প্রতিটি ইনিংস তন্নতন্ন করে ওরা বিশ্লেষণ করেছে তাকে অকেজো করার পথ খুঁজে বার করতে।

ওদের বিশ্বাস, শুধু ডনকে যদি বড়ো রান তোলা থেকে নিবৃত্ত করা যায়, তাহলেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। ওরা খুঁজেপেতে দেখল ডনের একমাত্র দুর্বলতা, শক্ত পিচে খাঁটি ফাস্ট বোলিংয়ে। তারা এর সঙ্গে মেলাল লেগ থিয়োরিকে।

সমুদ্রতীরে এক বন্ধুর নির্জন সৈকতাবাসে ডন তার পরিকল্পনা তৈরি করল একাকী সারারাত।

সেব্যাটিং মধ্যমণি। সুতরাং লারউডের বজ্র থেকে সরে যাওয়া বা শুধুই ব্যাট দিয়ে আটকানো তার পক্ষে শোভা পায় না। ওসব কাজ বোলাররা করবে, তাকে করতে হবে রান। তাই সেপদ্ধতি বার করল : উইকেট থেকে সরে গিয়ে বল মারতে চেষ্টা করবে অফ-সাইড ফিল্ডের দিকে।

তার মানে, বোলারকে তখন অফ-সাইড জোরদার করতে হবে। যদি তা করে তাহলে তাকে লেগ-সাইড ফিল্ড কমজোরি করতে হবে। তাহলে ডন স্বাভাবিক ব্যাটিংয়ে ফিরে আসতে পারবে।

ঝুঁকি নিয়ে, বে-কেতাবি খেলা। কিন্তু তা ছাড়া উপায় নেই। এখনকার মতো এটাই যা-কিছু কাজের ছক।

মেলবোর্নে ডন যখন ব্যাট হাতে নামল, জনতা তুমুল অভিনন্দনে ফেটে পড়ল। অস্ট্রেলিয়ার ওস্তাদ নেমেছে। প্রথম টেস্ট হারের শোধ নেবেই নেবে। জনতার দারুণ প্রত্যাশা।

ডন ক্রিজের দিকে এগোচ্ছে। হারবার্ট সাটক্লিফ বলল, ‘কী দারুণভাবে স্বাগত জানাচ্ছে।’

‘যখন ফিরব, তখনও এটা এইরকম দারুণ থাকবে কি?’ গম্ভীর স্বরে ডন বলেছিল।

থাকেনি। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে অসাড় স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে ডন হেঁটে ফিরেছিল প্যাভিলিয়নে। বাওয়েসের প্রথম বল শর্টপিচ। ডন পুল করতে চেষ্টা করল এবং বলটিকে টেনে আনল লেগস্টাম্পে। প্রথম বলেই আউট ডনের জীবনে এই প্রথম এবং এই শেষ বারই ঘটল। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে সেআউট হয় দ্বিতীয় বলে।

অস্ট্রেলিয়ার দুঃসময়ে তার নায়ক দেশকে ডুবিয়ে দিল। সাফল্যের এইটাই জরিমানা; যদি একশোর কম রান করে তাহলে ধরে নেওয়া হয় ডন ব্যর্থ হয়েছে। অন্যান্য সাধারণ ব্যাটধারীকে আর ডনকে মাপার মানদন্ড এক নয়।

কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ডন যথারীতি আবার নিজের খেলায় ফিরে এসে ১০৩ করল দলের ১৯১ রানের ইনিংসে। বডি লাইন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এই টেস্টে তা কার্যকরী হয়নি। আগের সপ্তাহে বৃষ্টি হওয়ায় উইকেট অস্বাভাবিক মন্থর ছিল বাউন্সারের পক্ষে।

ডন আবার বিগ্রহরূপে পূজিত হল। মাঠেই চাঁদা তুলে ডনকে দিল দর্শকরা। তাই দিয়ে সেমস্ত এক পিয়ানো কিনেছিল। পিয়ানোবাদনেও ডন রীতিমতো দক্ষ। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় টেস্ট ১১১ রানে জিতেছিল।

অ্যাডিলেডে তৃতীয় টেস্টে বডি-লাইনের ঝড় মাতন তুলল। এমন বিশ্রীভাবে আর কখনো টেস্ট খেলা হয়নি। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল উডফুল দু-বার আঘাত পেলেন লারউডের বাউন্সারে। ওল্ডফিল্ড মুখে আঘাত পেয়ে অবসর নেন। ডন আট রান করে কট হয় লারউডের বলে।

গ্রীষ্মের শুষ্ক দিনে, ইংরেজ বোলিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ ছড়িয়ে পড়ল মাঠ ঘিরে। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন খেলতে নামল চোয়াল শক্ত করে। এবার সেতার পরিকল্পনা অনুযায়ী উইকেট থেকে পিছিয়ে গিয়ে অফের দিকে বল মারার চেষ্টা করতে লাগল। এভাবে খেলার জন্য অরক্ষিত থাকছিল তার স্টাম্প। দর্শকরা হইচই শুরু করে; তারা বুঝতে পারছে না ডনের এভাবে খেলার কী মানে হয়। দেখে মনে হচ্ছিল সেযেন বলের লাইন থেকে সরে যেতে চাইছে।

ডন মাথাখারাপের মতো ইনিংস খেলল। কেতাবে আছে এমন মার বোধ হয় সেএকটিও মারেনি।

বার বার সেক্রস ব্যাট চালাল কিন্তু রানও করল। খেলার যোগ্য বলগুলিকে সেপিটিয়ে ছাতু করল।

শর্ট-স্কোয়্যার লেগে ক্যাচ পাওয়ার জন্য জার্ডিন নিজে দাঁড়ালেন। ঝিকিয়ে উঠল ডনের চোখ। কয়েক মিনিট পরেই সেঘুরিয়ে বল মারল প্রচন্ডভাবে। কোনোক্রমে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে ইংরেজ অধিনায়ক নিজেকে রক্ষাকরলেন। জায়গাটা ছেড়ে আর একজনকে দাঁড় করিয়ে জার্ডিন সরে গেলেন। ডন রসিকতা করছে কি না সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

লারউডের জায়গায় ল্যাটা স্পিনার হেডলি ভেরিটি আসতেই ডন তাকে সদস্য স্ট্যাণ্ডে তুলে দেয় এবং এক বৃদ্ধা অল্পের জন্য রক্ষা পায়। এক ঘণ্টা উইকেটে থেকে ডন ৬৬ রান করে ভেরিটির বলে তার হাতেই কট হয়।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে দ্বিতীয় পরাজয় থেকে রক্ষার জন্য এই প্রয়াস যথেষ্ট নয়। ইংল্যাণ্ড ৩৩৮ রানে জেতে। এই টেস্ট শেষ হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড নজীরবিহীন এক টেলিগ্রাম লণ্ডনে এমসিসি-র কাছে পাঠায়। তাতে বলা হল :

বডিলাইন বোলিং এমন আকার নিয়েছে যে, ক্রিকেটের সর্বোত্তম স্বার্থের পক্ষে তা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ব্যাটধারীদের দেহকে রক্ষাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় করে তুলেছে।

এতদ্বারা খেলোয়াড়দের মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ এবং সেইসঙ্গে চোট-আঘাত ঘটছে। যদি-না এখুনি বন্ধ করা হয় তাহলে এটা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে বর্তমান প্রীতির সম্পর্ককেক্ষুণ্ণ করবে।

ইতিমধ্যে দুই দলের সম্পর্কে প্রীতির লেশটুকুও আর নেই। পরে আরও খারাপ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা যখন ব্যাট করছে, কোনো কোনো অস্ট্রেলীয় ফিল্ডসম্যানকে দেখা গেল উইকেটের দিকে বল ছোড়ার সময় যেন প্রতিযোগিতা করেই চেষ্টা করছে যাতে তা ব্যাটধারীকে আঘাত করে। পালটা জবাব দিতে ইংরেজদেরও মাঝেমধ্যে বাউন্সার দেওয়া হয় বটে কিন্তু উডফুলের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ‘প্রতিশোধ নয়।’

অস্ট্রেলীয়দের সম্পর্কে লারউডের কয়েকটি মন্তব্যও অবস্থার অবনতি ঘটায়। সেবলে, ডন ভয় পেয়ে গেছে আর উডফুলের নড়াচড়া এমনই মন্থর যে, যে-বল লাফিয়ে উঁচু হয়ে ওঠেনি তাতেও সেমাথা নীচু করেছে।

ইংল্যাণ্ড দলের সবারই কিন্তু এই পদ্ধতির বোলিংয়ে সায় ছিল না। এই সফরের ১৪ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ওয়াল্টার হ্যামণ্ড বলেন :

আমি সর্বতোভাবে এর নিন্দা করি। বডি-লাইন বিপজ্জনক। আমি বিশ্বাস করি, নিছক সৌভাগ্যবশতই বডি-লাইনে কেউ মারা যায়নি। যদি এটাকে চলতে দেওয়া হত তাহলে আমি খেলা থেকে বিদায় নিতাম।

কিন্তু লণ্ডনে ক্রিকেটের মাতব্বররা ভেবেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠানো খবরে বাড়াবাড়ি রয়েছে, এমনটা হতেই পারে না। ভালোমতো তদন্ত না করে তারা তখুনি ব্যবস্থা নেবার কোনো দরকার আছে মনে করলেন না। এদিকে লারউড ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠতে লাগল। তার বলের গতি দ্রুত থেকে আরও দ্রুত হচ্ছে। খেলার পর তার শ্রান্ত তপ্ত শরীরে বরফ ঘষে দিত সতীর্থরা। বল করার সময় তার বঁা-পা এত জোরে পড়ত যে তার বুট ফেটে যেতে লাগল। নিজেকে নি:শেষ করে, ক্ষমতার শেষ প্রান্তে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে লারউড এমনভাবে বল করে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সেনিজেকেই বোল্ড আউট করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার রোদে-পোড়া পাথুরে জমিতে বল ডেলিভারির সময় তার বঁা-পা এত কঠিনভাবে ফেলার জন্য গোড়ালিটা প্রায় থেঁতলেই গেছিল। সফর থেকে ফিরে আর সেঅত জোরে বল করতে পারেনি। আটাশ বছর বয়সেই লারউড শেষ হয়ে যায়।

তার বলের গতি অস্ট্রেলীয়দের আপত্তির কারণ ছিল না। তাদের বক্তব্য, সেই গতিকে ব্যাটধারীদের জখম করবার জন্য ব্যবহার করাটাই আপত্তিকর।

ইংল্যাণ্ড চতুর্থ টেস্ট ৬ উইকেটে জিতে ‘রাবার’ পায় প্রধানত লারউডের জন্য। সিরিজে ডন আট ইনিংস থেকে চার বার আউট হয় লারউডের বলে। সেরান করে— ০ ও ১০৩*, ৮ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪, ৪৮ ও ৭১। প্রতি ১০০ বলে ৭৫ রান করে।

সন্দেহ নেই, যে-কাজের জন্য বডিলাইন বোলিংয়ের উদ্ভাবন, তা সম্পন্ন হয়েছিল সফলভাবেই। ডনকে খর্ব করে তার রানের গড়কে (৫৬.৫৭) সাধারণ খেলোয়াড়ের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পেরেছিল। ডনের জীবনে এমনটি শুধু এই এক বারই ঘটে।

বস্তুত বডিলাইন বল খেলা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রথাসিদ্ধ ব্যাটিং— আক্রমণেই হোক বা রক্ষণেই হোক, এর বিরুদ্ধে অক্ষম হয়ে পড়েই। ব্যাটসম্যান যদি মেরে খেলতে চায় তাহলে সাধারণত লেগ ফিল্ডে কট হবে। আর যদি তা না করে, বোল্ড অথবা আহত হবে।

বডিলাইন চূর্ণ করা সম্ভব কি না সেটা দেখা আর সম্ভব হল না যেহেতু এই একটি মরসুমেই তার উদয় ও অস্ত ঘটেছিল।

যেভাবে ডন বডিলাইন খেলার চেষ্টা করে বা তার সচরাচর অভ্যস্ত মোটা অঙ্কের রান করতে না পারার জন্য তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এতে সেমনে আঘাত পায়। তার বক্তব্য : ‘আর কেউ কি এর থেকে কিছু ভালো করেছে?’

নিশ্চয়ই ডনের থেকে কেউ ভালো পারেনি। সিরিজে আট ইনিংসে তার রান ৩৯৬, গড় ৫৬.৫৭। যারা পাঁচটি টেস্টই খেলেছে তাদের থেকে ডনের চার টেস্টে রান বেশি, কিন্তু তার সবথেকে বড়ো মুশকিল, ‘ভেলকিওয়ালা’ হিসাবে এখন তার গায়ে ছাপ পড়ে গেছে। তার কাছ থেকে সবাই এখন একটা-কিছু ভেলকি আশা করে।

ডন ইংল্যাণ্ডের বিজয় রুখতে পারেনি, কিন্তু সেই জয় সর্বত্রই ক্রিকেটারদের মুখ বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে এমসিসি এই সফরের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি জানতে পেরেছে। তারা ফতোয়া জারি করল, যেকোনো ধরনের বোলিং ‘যা বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে সরাসরি আক্রমণ, তা খেলার প্রেরণার প্রতি অপরাধ।’

এমসিসি পরে একথাও মেনে নিল যে, ‘গত ক্রিকেট মরশুমে বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের প্রতি কখনো কখনো সরাসরি আক্রমণ ঘটেছে, এমন ঘটনারও প্রমাণ মিলেছে।’

অবশেষে আঘাতের উদ্দেশ্যে বোলিংয়ের বিরুদ্ধে আইন রচিত হয়। যদি এ ধরনের বোলিং চলতে দেওয়া হত, সন্দেহ নেই তাহলে ক্রিকেট খেলাটাই ধ্বংস হত। বডিলাইনের উৎপত্তিও কিন্তু সম্ভব হত না যদি প্রতিপক্ষ ক্রিকেটাররা ডনকে এত বিরাটভাবে এবং এত সম্মানভরে স্বীকার করে না নিত।

ওই মরসুম সম্পর্কে উইজডেন লিখল :

এ ধরনের বোলিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়—প্রধানত ব্র্যাডম্যানের রান সংগ্রহ প্রবণতাকে খর্ব করার কথা ভেবেই—যাকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা ও দর্শকরা একযোগে ধিক্কৃত করে এবং যখন এর সম্পর্কে আসল সত্যটি এইদেশে শেষপর্যন্ত জানা গেল, তখন ঘরের লোকেরা—তার মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত খেলোয়াড়—বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবে, রাবার জয়ের বিনিময়ে এই বৈরিতালাভ সত্যিই কি লাভজনক হয়েছে!

বডিলাইনের প্রয়োগ সম্পর্কে ক্রিকেট দুনিয়ার অপছন্দ এমনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, জার্ডিন পরের বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় আর খেলেননি। তবে পরবর্তীকালে চমৎকার এক ব্যাপার ঘটে।

১৯৩২-এ অস্ট্রেলিয়ায় যে-লোকটি সবথেকে ঘৃণ্যরূপে গণ্য হয়েছিল, সেই লারউড ১৮ বছর পর ১৯৫০ সালে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সম্মানিত নাগরিকরূপে সেখানে গণ্য হন। তিক্ততা এই ১৮ বছরে ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু অন্যান্য বহু টেস্ট ক্রিকেটারের মতো, ডন ১৯৩২-এর স্মৃতি রোমন্থনে এখনও অনাগ্রহী।

 ১১. ‘ব্র্যাডম্যান মৃত’

ডন ১৯৩৩-৩৪ মরশুমে প্রায় মারা গিয়েছিল।

মরশুম শুরুতেই সেদেখল পিঠে একটি ব্যথা চাগিয়ে উঠছে। একটা ইনিংস ব্যাট করলে আগের থেকে অনেক বেশি ক্লান্ত লাগে। তার মানে ক্লান্তি নামার আগেই তাড়াহুড়ো করে তাকে রান তোলার কাজ সারতে হচ্ছে। যত রান করা দরকার ততটুকু হয়ে গেলেই ইচ্ছে করে ক্যাচ তুলে বা উইকেট ছেড়ে দিয়ে সেচলে আসত। অপ্রয়োজনেও ব্যাট করে যাওয়া বা মনোনিবেশ করে থাকা আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।

ডনের বিচারবোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সেবুঝতে পারত ঠিক কত রান তাকে করতে হবে ম্যাচ জেতার জন্য। কিন্তু এইভাবে তার পক্ষে বেশিদিন খেলে যাওয়া সম্ভব নয়। আগের মরসুমের বডিলাইনের ঝঞ্ঝাট সেপোহাতে পেরেছিল যেহেতু স্ত্রী তার চিঠিপত্র লেখালেখি এবং খবরের কাগজের ও বেতারের প্রবন্ধগুলির কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করেছিল। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই যা করে, অর্থাৎ অন্যে তাদের প্রবন্ধগুলি লিখে দেয় আর তারা শুধু নিজের নামটুকু সেই লেখার উপরে বসিয়ে দেন, ডন কিন্তু এই অশরীরী লেখকদের লেখাকে কখনোই নিজের নামে চালায়নি। নিজের লেখা সেনিজেই লিখত।

অ্যাডিলেডে সেবিশেষজ্ঞদের দিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাল। তারা বলল, অত্যধিক চিন্তা ও পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে পড়ছে; দেহে ও মনে সেনি:শেষ হয়ে আসছে; তার উচিত সুযোগ পেলেই বিশ্রাম নেওয়া আর সহজ ও হালকাভাবে সব কিছুকে গ্রহণ করা।

ডন তাই করার চেষ্টা করল। একটা বড়ো রকমের সিদ্ধান্ত সেতখন নিল। এই সময় সারাদিনে তার প্রতিটি মুহূর্তই ভরে ছিল ক্রিকেটে। ক্রিকেট খেলা, ক্রিকেট নিয়ে কাগজে লেখা, ক্রিকেট সম্পর্কে বেতারে বলা, ক্রিকেটের সরঞ্জামগুলি খেলে দেখিয়ে-শুনিয়ে তা বিক্রি করা। তখন ক্রিকেটই তার পেশা এবং নেশা। জীবনটা যেন ক্রমশ সংকীর্ণ একঘেয়ে এবং একপেশে হয়ে যাচ্ছে। হাঁফ ছাড়া যাচ্ছে না, বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। সেঠিক করল, তার এমন একটা কাজ চাই যার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ক্রিকেটকে সেরুটি সংগ্রহের হাতিয়ার না করে শুধুই খেলার ব্যাপার করে রাখবে ঠিক করল। এইভাবে তাহলে আবার সেক্রিকেটের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবে।

যে ক্রিকেট সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠানে সেচাকরি করত সেটা ছেড়ে দিল, ক্রিকেট বিষয়ে বক্তৃতা দেবার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করল। চাকরি নিল অ্যাডিলেডে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের একজন সদস্যের শেয়ার দালালির অফিসে। খুব-একটা অবাক হবার মতো ব্যাপার এটা নয়। স্কুলে অঙ্কে দারুণ মাথা ছিল ডনের। আর একবগ্গা মাথামোটা খেলোয়াড়দের মতো তার মাথাটা মোটেই বুদ্ধিহীন ছিল না।

বিচারবোধসম্পন্ন বহু বিখ্যাত লেখক ডন সম্পর্কে বলেছেন, সেযে-কাজই বেছে নিক-না তাতে সেসফলই হবেই যেহেতু সফল হবার জন্য তার সংকল্প, একমুখীনতা এবং কাজের প্রতি মনোনিবেশ অত্যন্ত প্রবল এবং প্রগাঢ়। এবার থেকে ডন তার ব্যাবসায়িক জীবন ও ক্রিকেট জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগল। অফিসে লেনদেনের কথা ছাড়া ক্রিকেট নিয়ে একটি কথাও বলত না, শুনতেও চাইত না। টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে বাড়ির ফোন নম্বরটা সেবাদ দিয়ে দিল যাতে বাড়িতে তাকে কেউ ব্যাঘাত না করে। আর সুযোগ পেলেই সেবিশ্রাম নিত।

১৯৩৪-এ এল ডনের দ্বিতীয় ইংল্যাণ্ড সফর। ডনকে অস্ট্রেলীয় দলের সহ-অধিনায়ক করা হল। সেবুঝতে পারল তাকে ভবিষ্যৎ অধিনায়করূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অস্ট্রেলীয় দল ইংল্যাণ্ডে পৌঁছোল। তারা ওয়েম্বলিতে এফএ কাপ ফাইনাল দেখল, প্রধানমন্ত্রী র্যামসি ম্যাকডোনাল্ডের ভোজের আমন্ত্রণ রক্ষা করল। কিন্তু ডন তার শরীর সম্পর্কে বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না, অধিনায়ক বিল উডফুলকে সেজানাল, প্রথম ম্যাচে তাকে যেন বাদ দেওয়া হয়। উডফুল তাকে বলল, এটা করা ঠিক হবে না, কেননা ইতিমধ্যে চারদিকে গুজব রটেছে যে, ডনের শরীর ভেঙে গেছে, না খেললে গুজবটা সত্য প্রমাণিত হবে। দলের মনোবলও যথেষ্ট ধাক্কা খাবে। তা ছাড়া দর্শকও কমে যাবে, তাতে আয়ও কমে যাবে।

সুতরাং ডন খেলল। দ্রুত ২০৬ করল। এবং শুরুতেই এতটা শক্তিক্ষয়ের ফলে শ্রান্তি তাকে এমনভাবে চেপে ধরল যে, সেই মে মাসের শেষাশেষি একটি পঞ্চাশ রানের ইনিংস ছাড়া আর কিছু সেকরতে পারল না। এর মধ্যে আবার স্কোরবুকে দুটি শূন্যও তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে।

এরপরই এল লর্ডসে মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে, আকর্ষণীয়তার দিক থেকে তার জীবনের একটি অদ্বিতীয় ইনিংস—অন্তত ডন নিজে তাই মনে করে। আগের ম্যাচে হাম্পশায়ারের বিরুদ্ধে শূন্য করেছে। সুতরাং মনে মনে ডন নিজের সম্পর্কে যথেষ্ট নড়বড়ে ছিল। অনবরত শ্রান্তি এবং যন্ত্রণার তাড়া খেয়ে সেমনমরা হয়ে পড়েছিল।

মিডলসেক্স ২৫৮ রানে ইনিংস শেষ করে। অস্ট্রেলিয়া উডফুল ও পন্সফোর্ডকে হারাল শূন্য রানে। এইবার ডনকে অস্ট্রেলিয়ার দরকার, ভীষণভাবে দরকার। ম্যাচ জেতার মতো রান তাকে করতে হবে, করতেই হবে। এবং সেকরল।

প্রথম মিনিট পাঁচেক ডনের অনিশ্চিতভাবে কাটল। বরাবরই দেখা গেছে এইরকমই তার হয়। ফাস্ট বোলার জিম স্মিথের একটা আউট সুইঙ্গারের বাতাসও ডনের স্টাম্পে ছোঁয়া দিল। অস্ট্রেলীয়রা তো তাই দেখে শিউরে উঠল। এরপরই ডন নিজমূর্তি ধারণ করে। প্রতিটি স্ট্রোকে আশ্চর্য নিখুঁত সময় বিচার, প্রতিটি স্ট্রোকে ওস্তাদের স্পর্শ। জিম স্মিথের ফাস্টবল, ওয়াল্ডার রবিন্সের স্লো বল, ইয়ান পিবলসের গুগলি, প্রহারে প্রহারে জর্জরিত হল। ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে ড্রাইভ, পিছিয়ে গিয়ে পুল। যেখানে খুশি সেবল পাঠাল। লোকে যা দেখতে মাঠে আসে তাই দেখা গেল : ব্র্যাডম্যান তার স্বমহিমায়।

দিনের শেষ বলটিতে এক রান নিয়ে ডন ঠিক ১০০ রানে পৌঁছোয়, সময় লাগে ৭৫ মিনিট। তার কয়েকটি শতরানের থেকে সময়টা একটু বেশিই লাগল। এতে আছে ১৯টি চার। পরদিন সে১৬০ রানে আউট হয়। এজন্য মোট সময় লাগে ১২০ মিনিট। লর্ডসে প্যাভিলিয়নের সামনে জ্যাক হিউম ঝাঁপিয়ে পড়ে অসাধারণ ক্যাচ নিয়ে তাকে আউট করে।

বেচারা ডন। এই খেলার পর আবার শ্রান্তি তাকে চেপে ধরল। নটিংহামে প্রথম টেস্টে সেকরল ২৯ ও ২৫। এই টেস্টে এক জনও শতরান করেনি। অস্ট্রেলিয়ার চিপারফিল্ড জীবনের প্রথম টেস্ট খেলায় ৯৯ রানে আউট হয়। ইংল্যাণ্ড দলে নবাগত ফাস্ট বোলার স্কুলশিক্ষক কেনেথ ফার্নেস দুই ইনিংসে পাঁচটি করে উইকেট পায়। খেলা শেষের ১০ মিনিট আগে ওরিলির বলে মিচেল এলবিডব্লু আউট হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ২৩৮ রানে জেতে।

ইংল্যাণ্ডে তখন খেলার মাঠ দড়ি দিয়ে ঘেরা থাকত। খেলার শেষদিকে দর্শকরা উত্তেজনাবশে এগিয়ে আসায় দড়ি ঝুলে পড়েছিল, দেখাও যাচ্ছিল না। খেলা শেষ হতেই খেলোয়াড়রা ছুটে ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছিল, তখন পায়ে দড়ি আটকে ডন পড়ে যায়, তার ওপর আর একজন এসে পড়ে এবং ঊরুতে আঘাত পায়। পরের ম্যাচে সেরানার নিয়ে ব্যাট করে এবং তার পরের ম্যাচে খেলতে পারেনি।

লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া হারল ইনিংস ও ৩৮ রানে। ডনের রান ৩৬ ও ১৩। ইংল্যাণ্ড ৪৪০ রান করার পরই বৃষ্টি এবং ভিজে পিচে হেডলি ভেরিটির মারাত্মক স্পিন অস্ট্রেলিয়াকে অসহায় করে দেয়। ম্যাচে ভেরিটি ১৫টি উইকেট পায়, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮-৪৩। প্রথম ইনিংসে খেলতে নেমেই ফার্নেসের বলে ডন পর পর তিন বলে তিনটি ৪ ও একটি ২ নেয় প্রথম ওভারেই। গিয়ারির বলে ৪। গিয়ারির বদলে ভেরিটি আসতেই তিন বলে আবার তিনটি ৪। ভেরিটির হাতেই ক্যাচ তুলে দিয়ে সেফিরে যায়। কার্ডাস লিখলেন :

ব্র্যাডম্যানের এই ৩৬ রান লিডসে তার ৩৩৪ রানের থেকেও অনেক বেশি মহীয়ান। প্রতিটি স্ট্রোকের পিছনে ছিল প্রেরণা, ছিল সৌন্দর্য যা পৌরুষের চূড়ায় পৌঁছোনো জীবন থেকেই বিচ্ছুরিত হয়।

১৯৩০-এ ডন মে মাসের মধ্যেই হাজার রান সম্পূর্ণ করেছিল। ১৯৩৪-এর জুন মাসের শেষে তার রান দাঁড়াল মাত্র ৭৬০। লর্ডসের ব্যাটিং ছাড়া বলার মতো রান আর সেকরেনি। সাধারণ লোক জানে না ডন কী অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ডন কখনো আলোচনা করত না।

জুলাই এল এবং স্বাস্থ্য তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখল। ম্যাঞ্চেস্টারে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ এসে পড়ল। কিপ্যাক্স অসুস্থ, খেলল না। ডন ও চিপারফিল্ডের গলায় ব্যথা। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল বুঝি ডিপথেরিয়া। সেই অবস্থাতেই ডন খেলে এবং ৩০ রান করে। ম্যাচের মীমাংসা হয়নি।

এরপর ওরা এল লিডসে। ডনের প্রিয় মাঠ। এখানে স্মৃতি হয়ে আছে তার সেরা ইনিংসগুলির কয়েকটি। মাঠটিকে দেখেই বোধ হয় ডন তাজা বোধ করেছিল। ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে খেলা। অস্ট্রেলিয়ার এক উইকেটে ১৬ রান, ডন উইকেটে এসে যোগ দিল উডফুলের সঙ্গে। কয়েক মিনিট যথারীতি সেব্যাটে লাগাম পরিয়ে রাখল। তারপরই খসে গেল লাগাম। টগবগ করে উঠল স্কোরবোর্ড—২৫ মিনিটে ৫০, ১০০ মিনিটে ১০০ রান। পরের ১৫ মিনিটে আরও ৪০ রান। ১১৫ মিনিটে নেওয়া তার ১৪০ রানে দুটি ৬, বাইশটি ৪। বোলারদের মধ্যে অবশ্যই ভেরিটিও ছিল। কোনো বোলারের কাছে অপদস্থ হলে ডন শোধ না নিয়ে ছাড়ত না।

লিডসেই চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ। ডন তখন অপ্রতিরোধ্য মেজাজে এসে গেছে।

প্রথম ব্যাট করে ইংল্যাণ্ড চমৎকার উইকেটে ২০০ রানে আউট হয়ে যায়। দিনের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়া ৩৭ রানে হারায় ব্রাউনকে। নৈশ প্রহরীরূপে উইকেটকিপার ওল্ডফিল্ড আসে এবং দু-রান পরেই আউট হয়ে ফিরে যায়। উডফুল নামে এবং বাওয়েস সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বোল্ড করে। অস্ট্রেলিয়ার তিন উইকেটে ৩৯ রান। এর পরের উইকেট পড়ে পরদিনের খেলা শেষের দশ মিনিট আগে যখন ভেরিটির বল হুক করতে গিয়ে পন্সফোর্ডের পায়ে লেগে বেল পড়ে যায়। তখন তার রান ১৮১।

আর ব্র্যাডম্যান? দ্বিতীয় দিন শেষে ২৭১ অপরাজিত। তৃতীয় দিনে বোল্ড হয় বাওয়েসের বলে, তখন তার রান ৩০৪। সময় লেগেছে ৪২০ মিনিট। তাতে আছে দুটি ৬, তেতাল্লিশটি ৪।

সাধারণ লোক ধরে নিল ডন আবার তার নিজের খেলা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু ডনের সতীর্থরাই জানে কী অসম্ভব কষ্ট তাকে করতে হল। দীর্ঘ ইনিংস খেলার ধকল শুধুই মনের জোরে সহ্য করারও একটা সীমা আছে। ড্রেসিং রুমে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রা পোশাক খুলিয়ে ডনকে বাচ্চা ছেলের মতো কোলে করে মালিশের টেবলে শুইয়ে দেয়। নড়াচড়ার ক্ষমতা তার আর ছিল না। একটা বড়ো ইনিংস খেলা মজবুত লোকের পক্ষেও যে কী পরিশ্রমের ব্যাপার— যে খেলেনি তার পক্ষে বোঝা সহজ নয়। ১৯৩৮-এ ৩৬৪ রানের টেস্ট রেকর্ড করার পর লেন হাটন বলেছিল আবার যে কোনোদিন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে পারব, মনে হচ্ছিল না।

ডন অবশ্য ফিল্ড করতে নামে। কিন্তু আবার বিপত্তি বঁাধায় ঊরুতে পেশিতন্তু ছিঁড়ে ফেলে। মাঠ থেকে নার্সিং হোম তাকে যেতে হয়। তার ফলে তিন সপ্তাহ তার খেলা বন্ধ থাকে। ওভালে পঞ্চম টেস্টের আগে ডন একটিও প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেনি। এই সময়টায় সেইংল্যাণ্ডপ্রবাসী এক ধনী অস্ট্রেলীয় ডাক্তারের গ্রামের বাড়িতে কাটায়—জনতা, ক্রিকেটার, খবরের কাগজের লোকেদের থেকে দূরে নি:সঙ্গ শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে, পাখি আর কাঠবিড়ালিদের ব্যস্ততার মধ্যে।

অস্ট্রেলিয়া থেকে উদবিগ্ন টেলিগ্রাম পাঠাল ডনের স্ত্রী জেসি। কাগজে স্বামীর শরীরের খবর পড়ে ব্যস্ত হয়ে লিখেছে—ইংল্যাণ্ডে আসবে কি না। ডন টেলিগ্রামে জানাল, ওসব কিছু না। ব্যস্ত হতে হবে না।

তারপর পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া জিতল ৫৬২ রানে। ইংল্যাণ্ড ভুল করল ৪৭ বছরের ফ্র্যাঙ্ক উলিকে দলভুক্ত করে। ওরিলির বল খেলার মতো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। উইকেট-কিপার লেসলি এমস খেলার মাঝে কোমরের ব্যথায় আক্রান্ত হয়। উলি তার জায়গা নেয় (বাই রান হয়েছিল ৩৭টি)। বাওয়েসও খেলার মধ্যে অসুখে পড়ে।

পন্সফোর্ড ২৬৬, ব্র্যাডম্যান ২৪৪। দ্বিতীয় উইকেট পার্টনারশিপে ওরা ৪৫১ রান তুলে বিশ্বরেকর্ড করে। ৬২ বছর পর এটি ভাঙে শ্রীলঙ্কার জয়সূর্য ও মহানামা ভারতের বিরুদ্ধে ৫৭৬ রান যোগ করে।

অস্ট্রেলিয়া ‘রাবার’ জিতল। ডন এরপর আরও দুটি শতরান করল। ফোকস্টোনে ইংল্যাণ্ড একাদশের বিরুদ্ধে ১০৫ মিনিটে অপরাজিত ১৪৯। ফ্রিম্যানের ছয় বলের একটি ওভারে তিনটি ৬ ও তিনটি ৪ নিয়ে সে৩০ রান তোলে। তারপর স্কারবরোয় লেভিসন গাওয়ারের বোলারদের (ফার্নেস, বাওয়েস, নিকলস ও ভেরিটি) বিরুদ্ধে ১৩২ রান। ব্রাউন ৩ রান করে আউট হওয়ার পর ডন খেলতে নেমে লাঞ্চের আগেই ফিরে আসে ১৩২ রান নিয়ে। সফরে তার মোট রান ২,০২০। গড় ৮৪.১৬।

দু-সপ্তাহ পরই সারা অস্ট্রেলিয়া স্তব্ধ প্রস্তরবৎ হয়ে শুনল, ডন মারা গেছে।

গুজবটা যদিও গুজবই কিন্তু ডন তখন গুরুতর অসুস্থ। দেশে ফেরার জন্য অস্ট্রেলীয় দল লণ্ডনে তোড়জোড়ে ব্যস্ত। তখন এক বিকেলে ডন পেটে অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করে। ডাক্তার এলেন। পরীক্ষা করে থমথমে হয়ে গেল মুখ! পরদিন সকালেও এলেন এবং ডনকে জানালেন যন্ত্রণার কারণ অ্যাপেন্ডিসাইটিস! এখুনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যবস্থা মানে অপারেশন। তার আগে আর একজন বড়ো ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনিও একমত, এটা থাণ্ডারস্টর্ম অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এখুনি অপারেশন দরকার। তাই করা হল। তা ছাড়া পাকস্থলীর আবরণ ঝিল্লির প্রদাহেও ডন ভুগছিল।

জীবন-মৃত্যুর আলো-আঁধারিতে ডনকে কিছু সময় কাটাতে হয়েছে। সারা অস্ট্রেলিয়ায় গির্জায় গির্জায় যখন ডনের জন্য প্রার্থনা হচ্ছে তখন তার স্ত্রী অ্যাডিলেড থেকে পার্থ রওনা হয়েছে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজ ধরার জন্য। ১৩ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ৩১ দিন পর জেসি লণ্ডন পৌঁছোয়।

লণ্ডনে ডনের ভক্তরা হাসপাতালে বার বার ফোন করে জানাচ্ছে, দরকার হলে তারা রক্ত দিতে রাজি।

শত শত টেলিগ্রাম আসছে, এমনকী ইংল্যাণ্ডের রাজা-রানিও পাঠিয়েছেন। প্রচুর চিঠি আসছে নানান চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে। ডনের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় শুধু জ্যাক হবস ও ‘প্লাম’ ওয়ার্নারকে। তাঁরা গল্প করেন ক্রিকেটের।

ডন কিন্তু খুব ঘাবড়ায়নি। সেবিকা থার্মোমিটারে তার তাপ নিলে, ডন ঠাট্টা করত, ‘স্কোর কত হল, আজ একশো পেরিয়েছি কি?’ সেবিকার মুখ দেখে সেবুঝতে পারত অনুমানটা সঠিক করতে পেরেছে কি না।

জেসি যেদিন লণ্ডন পৌঁছোয়, তার আগের দিন ডন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। নট আউট রয়ে গেল ডন, কিন্তু এ যাত্রা আউট হতে হতে বেঁচে গেল। চোখ দুটো গোলমাল শুরু করেছে তাই পড়াশুনোর জন্য তাকে চশমা পরতে হল কিছু দিন। দেশে ফেরার আগে ডন ও জেসি লম্বা ছুটি কাটাল স্কটল্যাণ্ড ও দক্ষিণ ফ্রান্সে। ওরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরল তখন সেখানে ক্রিকেট মরসুম। কিন্তু ডাক্তারের হুকুমে তার ক্রিকেট খেলা একদমই বারণ। দেশের বাড়ি বাওরালে গিয়ে সেক্রিকেট মরসুমটা কাটাল প্রাকৃতিক পরিবেশে।

তিন মাস সেকোনোরকম খেলায় নামেনি শুধুমাত্র একটু-আধটু গলফ খেলা ছাড়া। গলফকে হালকা পরিশ্রমের খেলা হিসাবেই ধরা হয়। কিন্তু ডনের এমনই স্বভাব যখন যা ধরবে, গভীর মনোনিবেশে তা করবেই। একটা ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ফেলল!

১৯৩৫-এ ডন সিডনি থেকে অ্যাডিলেডে এসে শেয়ার দালালির নতুন কাজে যোগ দিল আর আবার শুরু করল ক্রিকেট খেলা, তার নতুন রাজ্য সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে।

১২. অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক

ডাক্তারের নিষেধে ১৯৩৫-৩৬-এ ডন অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেল না। সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্য দলের অধিনায়কত্ব সেগ্রহণ করল (শেফিল্ড শিল্ডে তার প্রথম অধিনায়কত্ব) এবং আবার সগৌরবে ফিরে আসার কাজে মন দিল।

প্রথমে তার প্রাক্তন রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলসের বিরুদ্ধে করল ১১৭। অসুস্থতার পর প্রথম খেলা। প্রচন্ড লড়াই করতে হল তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে। পেশিগুলো কিছুতেই সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে চাইছিল না। তার ওপর বেশিরভাগই এক রান নিতে হচ্ছিল। কিন্তু পরের খেলায় কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে তার শরীর আবার হারানো ছন্দ ও সামঞ্জস্য ফিরে পায়, সহজেই সে২৩৩ রান করে।

ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খেলায় ডন ৩৫৭ রান করল— মেলবোর্ন মাঠে ডনের সর্বোচ্চ রান। শুরু করেছিল ধীরে, দেড়শো মিনিটে প্রথম শতরান; ১১৫ মিনিটে দ্বিতীয় ও ১২১ মিনিটে তৃতীয় শতরান; বাকি ৫৭ রান ৩০ মিনিটে।

ডন যে আবার নিজের খেলা ফিরে পেয়েছে তাতে কারুর আর সন্দেহ রইল না। পরের খেলা নিউ সাউথ ওয়েলসের বিরুদ্ধে সেশূন্য করল।

ডনের অধিনায়কত্বে সাউথ অস্ট্রেলিয়া অপরাজিত থেকে শেফিল্ড শিল্ড জিতল। নয় বছর পরে প্রথম জয়। ভিক রিচার্ডসন, ক্ল্যারি গ্রিমেট প্রমুখ ছয় জন প্রবীণ ও দক্ষ ক্রিকেটার দলে নেই, তবু ডন দমেনি। নতুন ছেলেদের নিয়ে শিল্ড জিতল দলের মধ্যে প্রেরণাসঞ্চার করে।

মরসুমের শেষ খেলায় টাসমানিয়ার বিরুদ্ধে ডন করল ৩৬৯। অ্যাডিলেড মাঠের সর্বোচ্চ রান, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে যেকোনো ব্যাটসম্যানেরও সর্বোচ্চ রান। এই মাঠেই ৩৫ বছর আগে ক্লেম হিলের অপরাজিত ৩৬৫ রানের রেকর্ড ডন ভেঙে দিল। হিল টেলিগ্রাম পাঠালেন : ‘খুদে শয়তান, আমার রেকর্ডটি ভাঙার জন্য অভিনন্দন’। ডনের এই রাজ্য রেকর্ডটি ভাঙার চেষ্টা করেছিল ব্যারি রিচার্ডস ১৯৭০-৭১ মরসুমে পার্থে, করেছিল ৩৫৬। ডন তার ৩৬৯ রান তুলেছিল এইভাবে—

তৃতীয় উইকেটে ডন ও হ্যামেন্স (১২১) যোগ করে ২৫৬ রান। চারটি ৬ ও ছেচল্লিশটি ৪ ছিল ডনের ইনিংসে। নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মরসুমে ডন দুটি ত্রিশত-সহ ১,১৭৩ রান করে ১৩০.৩৩ গড় রেখে।

ইংল্যাণ্ড ১৯৩৬-৩৭ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ায় দল পাঠাবার তোড়জোড় করছে। ব্র্যাডম্যান যে আবার তার নিজের খেলা ফিরে পেয়ে গেছে এটা ওরা জেনেছে। তাদের বোলাররা তছনছ হবে এবং বিরাট রানের স্কোরের পিছনে তাদের ব্যাটসম্যানদের ধাওয়া করার কাজ বরাদ্দ হবে—এ সম্পর্কে ইংল্যাণ্ড নিশ্চিত। তাহলেও ইংল্যাণ্ড অখুশি হয়নি। ডনকে বাদ দিয়ে তখন ক্রিকেটের আর থাকে কী?

১৯৩৬-৩৭ ডনের পক্ষে গর্বের মরসুম। উডফুল অবসর নিয়েছে, রিচার্ডসন দলভুক্ত হয়নি—ডনকে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক করা হল। একজন টেস্ট নির্বাচকের মৃত্যু হওয়ায় সেনির্বাচক পদেও অধিষ্ঠিত হল। এরপর ভূমিষ্ঠ হল ডনের প্রথম সন্তান।

অধিকাংশ খেলোয়াড়ের মতো ডনও চেয়েছিল ছেলে হোক। ছেলেটিকে সেক্রিকেট শেখাবে, মস্ত খেলোয়াড় হবে তারই মতো। ‘গাবি’ অ্যালেনের এমসিসি দল সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার জন্য অ্যাডিলেডে পৌঁছোবার আগের রাত্রে জেসি উপহার দিল ডনকে প্রথম সন্তান—একটি ছেলে। হইচই পড়ে গেল চারিদিকে। অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেল।

কিন্তু ডাক্তার আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন ডনকে। ‘মিস্টার ব্র্যাডম্যান আপনার স্ত্রী ভালো আছেন, কিন্তু ছেলেটি বঁাচবে কি না বলতে পারছি না।’

সেই রাত্রে এমসিসি সদস্যদের নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, ডনও উপস্থিত। আগামীকাল সেসাউথ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব করবে আগন্তুকদের বিরুদ্ধে। এ সভায় তাকে তো হাজির হতেই হবে। পিতা হওয়ার জন্য সেখানেও তাকে অভিনন্দিত করা হল। ডন হাসিমুখে তা শুনল। কিন্তু মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদবেগ। কোনোদিন কখনো সেতার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার ব্যাপারগুলি সাধারণ্যে প্রকাশ করেনি। আজও করল না। সেই সভায় কেউ জানলও না তখন কষ্টে ডনের বুক ফেটে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে ডনের সদ্যোজাত ছেলেটি মারা গেল। অ্যাডিলেড মাঠের পতাকা অর্ধনমিত হল খেলা শুরুর সময়। খেলার মতো অবস্থা ডনের ছিল না, তাই খেলেনি।

হ্যামণ্ড দারুণভাবে সফরে খেলেছে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুটি, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও দুটি—পর পর চার ইনিংস শতরান। কিন্তু বাকি ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা স্পিন বোলিংয়ে সুবিধা করতে পারছে না। তাহলেও ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচ ইংল্যাণ্ড চার দিনেই জিতল ৩২২ রানে। ডন ২৪টি টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে ১৪টিতে টসে হারে। তার প্রথমটি ঘটে প্রথম অধিনায়কত্বেই। এই ম্যাচে প্রথম দিনের প্রথম বলেই ইংল্যাণ্ডের ওয়ার্দিংটন ক্যাচ আউট হয় ওল্ডফিল্ডের হাতে— বোলার ম্যাককরমিক। ডনের রান ৩৮ ও ০। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া আউট হয় ৫৮ রানে।

ফিঙ্গলটন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পর পর তিনটি টেস্ট ইনিংসে শতরান করে এসে ব্রিসবেনে প্রথম ইনিংসে ১০০ রান তুলে নতুন টেস্ট রেকর্ড করে। এখন রেকর্ড এভার্টন উইকসের—পর পর পাঁচটি টেস্ট ইনিংসে শতরান। চতুর্থ ও পঞ্চমটি হয় কলকাতায় ১৯৪৮-৪৯ এ।

সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে ডন আবার টসে হারল এবং অস্ট্রেলিয়াও—ইনিংস ও ২২ রানে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে রান ৮০। দুই ইনিংসে ডনের ০ রান ও ৮২। বৃষ্টি এই দুটি পরাজয়ের কারণ। আধশুকনো চটচটে পিচে ডনের ব্যাটিং দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। তার ওপর নবীন অধিনায়কের ঘাড়ে জাতীয় দল পরিচালনায় দায়িত্ব, মনের মধ্যে সন্তানবিয়োগের দুঃখের বোঝা।

ডনের দল পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হল। দলের সদস্যদের সঙ্গে তার মতবিরোধ ও ঝগড়ার কথা রটল। শোনা গেল কেউ কেউ অসহযোগিতা করছে। ডন অস্বীকার করল সব কিছু। সর্বসম্মতিক্রমে ডন অধিনায়ক পদ পায়নি। উডফুলের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম উইকেটের জুড়ি পন্সফোর্ডও অবসর নেয়। নয়তো পন্সফোর্ডই অধিনায়ক হত। বাকি থাকে দুই দাবিদার— ভিক রিচার্ডসন (ইয়ান ও গ্রেগ চ্যাপেলের দাদামশাই) এবং ডন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে রিচার্ডসনের অস্ট্রেলীয় দল দুর্দান্তভাবে ৪-০ ম্যাচে সিরিজ জিতে এসেছে। কিন্তু তা হলেও নির্বাচকরা তাঁকে দল থেকেই বাদ দেয় যেহেতু সেদলভুক্ত হবার মতো ভালো খেলছেন না। ডন সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা— ব্যাট হাতে ডনের ক্ষমতার তুলনা হয় না, কিন্তু ভালো অধিনায়ক হবার মতো যথেষ্ট সামাজিক সেনয়। কিন্তু কিছু-একটা করব বললে ডন যে তাতে সফল হবেই, এটা আর কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনল না।

আর তিনটি টেস্ট ম্যাচ বাকি। ডন কোণঠাসা। অস্ট্রেলিয়া ০-২ পিছিয়ে।

ডন ব্র্যাডম্যান রুখে দাঁড়াল।

অস্ট্রেলিয়া মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ জিতল ৩৬৫ রানে। ডন দিয়েছিল ২৭০ রানের একটি ইনিংস।

সবাই জানে ডন বিরাট ব্যাটসম্যান। তারা এবার জানল, ডন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন অধিনায়কও। ডন টসে জেতে। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিনে ৬ উইকেটে ১৮১ রান করল। নামল বৃষ্টি। দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চের পর ৯ উইকেটে ২০০ রান উঠতেই ডন প্রথম ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেয় (তার রান ১৩)। উইকেটের অবস্থা খুবই খারাপ। এই উইকেটে ইংল্যাণ্ডকে উড়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু তাতেই আবার অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে হবে দ্বিতীয় ইনিংসে। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধাজনক হবে না। ডন তার বোলারদের বলল, ‘উইকেট চাই না। ওরা ব্যাট করে যাক। শুধু রান ওঠা বন্ধ রাখো। এখুনি এই উইকেটে আমরা ব্যাট করতে চাই না।’

একটু দেরিতেই অ্যালেন ডনের মতলবটা বুঝে ফেলে। ৯ উইকেটে ৭৬ রানেই সেইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে। আর আধ ঘণ্টা আগে ঘোষণা করলে অস্ট্রেলিয়া যথেষ্ট বিপদে পড়ত। অ্যালেন অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে নামাল দিনের শেষাশেষি।

উইকেটের অবস্থা তখনও বেশ খারাপ, আকাশে মেঘ, আলোও কম। ডন বরাত ঠুকে একটা কান্ড করল। নিয়মিত দুই ওপেনারকে না পাঠিয়ে দুই বোলার ওরিলি এবং ফ্লিটউড স্মিথকে পাঠাল ব্যাট করতে।

ডন খোলাখুলিই ফ্লিটউড স্মিথকে বলল, ‘এই উইকেটে তুমি একটি মাত্র উপায়েই নিজেকে আউট করতে পারো, যদি বল মারতে যাও। কিন্তু ভালো উইকেটেই তুমি বল মারতে পার না, কাজেই এই উইকেটে তোমার ঘাবড়াবার কিছু নেই, বল মারবার সুযোগই পাবে না।’

ওরিলি প্রথম বলেই আউট। নামল আর এক স্পিনার ওয়ার্ড। বাকি সময়টা সেউইকেট কামড়ে পড়ে রইল। ফ্লিটউড স্মিথ অপরাজিত রইল শূন্য রানে এবং দু-দিন পর সোমবারে তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হতে সেপ্রথম বলে ব্যাট ঠেকিয়েই আউট হয়ে যায়। উইকেট ইতিমধ্যে স্বাভাবিক হয়ে ব্যাটসম্যানের সহায়ক। ডন আউট হয় পঞ্চম দিন সকালে ২৭০ রান করে। তখন সেসামান্য ‘ফ্লু’-য়ে ভুগছে। এই রানের জন্য তার সময় লাগে ৪৫৮ মিনিট। ষষ্ঠ উইকেটে সেআর ফিঙ্গলটন (১৩৬) তোলে ৩৪৬ রান। এটা আজও বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড।

জেতার জন্য ইংল্যাণ্ডের দরকার ৬৮৯ রান। লেল্যাণ্ড ১১১ করলেও ইংল্যাণ্ড হেরে যায় ৩৬৫ রানে। প্রথম দুটি টেস্টে পরাজয়ের পর ডন আরও ১৭ বার অধিনায়ক হয়ে আর মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচে পরাজিত হয়েছিল, ১৯৩৮ ওভাল টেস্টে। তৃতীয় টেস্ট ম্যাচের পর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড কিছু ‘রটনা’ বিষয়ে ভর্ৎসনা করেছিল চারজনকে ডাকিয়ে এনে। এরা হল— ম্যাককেব, ওরিলি, ফ্লিটউড স্মিথ এবং ও’ব্রায়েন।

চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ অ্যাডিলেডে। যদি অস্ট্রেলিয়া এটি হারে তা হলে ‘রাবার’ হারবে। ডন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করল ৪৩৭ মিনিট ধরে তার ২১২ রানের জন্য। সেজানে, বড়ো রান তাকে করতেই হবে, নয়তো জেতার আশা নেই। তাই সাবধানে, সময় নিয়ে, খুঁটে খুঁটে রান তুলল। ২১২ রানে চার মাত্র ১৪টি। অসাধারণ সংযত এই ইনিংসে সেএক বারও তার বিখ্যাত হুক স্ট্রোক ব্যবহার করেনি। ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে এটি তার সপ্তম দ্বিশত রান।

ইংল্যাণ্ড ৩৮২ রান তুলে টেস্ট ম্যাচটি জেতার জন্য খেলা শুরু করে ১৪৮ রান তুলল তিন উইকেটে। খেলা তখন ষষ্ঠ দিনে, হ্যামণ্ড দারুণভাবে ব্যাট করে যাচ্ছে। সাত উইকেটে ২৩৪ রান তোলা কিছু অসম্ভব নয় ইংল্যাণ্ডের পক্ষে। ডনের কপালে উদবেগের রেখা ফুটে উঠল। পরাজয় বোধ হয় আর এড়ানো গেল না। হ্যামণ্ড, একমাত্র হ্যামণ্ডই হচ্ছে সবথেকে বড়ো সমস্যা।

ফ্লিটউড স্মিথের হাতে বলটি তুলে দিয়ে ডন তাকে বলল, এই ম্যাচের ভাগ্য তোমার হাতে তুলে দিলাম। তাই শুনে কী যে হয়ে গেল এই ল্যাটা গুগলি বোলারটির! তার ফ্লাইট করা বল, হ্যামণ্ড ফরোয়ার্ড খেলতে পা বাড়াল। বলটি অফ স্টাম্পের বাইরের দিকে ভেসে গিয়ে মাটিতে পড়েই স্পিন করে ঢুকে এল প্যাড ও ব্যাটের ফাঁক দিয়ে। হ্যামণ্ড বোল্ড। শুধু ম্যাচটিরই নয়, সিরিজের ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে গেল ওই একটি বলে। ইংল্যাণ্ড ১৪৮ রানে হেরে গেল। এখন সিরিজের ফল ২-২।

পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ মেলবোর্নে। ডন টসে জিতল এবং প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার হল তিন উইকেটে ৩৪২ রান। তৃতীয় উইকেট জুড়িতে ডন ও ম্যাককেব তুলল ২৪৯ রান। পরদিন ডন ১৬৯ রানে বোল্ড ফার্নেসের বলে মোট ২১০ মিনিট ব্যাট করে। এক বারের জন্যও সেজমি থেকে তুলে বল মারেনি। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে উঠল ৬০৪ রান। ইংল্যাণ্ড ২৩৯ রান করে ফলো অনে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত ইনিংস ও ২০০ রানে হেরে যায়। ০-২ পিছিয়ে থেকে অস্ট্রেলিয়া ৩-২ ম্যাচে সিরিজ জেতে এবং অ্যাসেজও।

ডন দুটি শূন্য করলেও মরসুমে একশোর উপর ইনিংস ছয়টি, তার মধ্যে তিনটি দ্বিশতের। সিরিজে ৯ ইনিংসে ৮১০ রান, ৯০ গড় এবং শতাধিক রানের ইনিংস তিনটি। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়করূপে প্রথম সিরিজে ডন সফল হয়েছে।

১৩. ‘সেনাপতি’ ব্র্যাডম্যান

ব্যাটিংয়ে যেমন, অধিনায়কত্বেও ডন ততখানিই বিরাট হয়ে ওঠে। সেনাপতিরা যুদ্ধের জন্য যেভাবে তৈরি হয়, পরিকল্পনা ছকে ডনও ম্যাচের আগে তাই করত। যেভাবে সেনাধ্যক্ষরা তাদের বাহিনী সমাবেশের পরিকল্পনা করে, ডনও সেইভাবে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের স্ট্রোকের ছক ও তালিকা পর্যালোচনা করে তার ফিল্ড সাজাবার ছকটি তৈরি করে নিত। সেনাপতিদের মতোই আলাদা আলাদা যুদ্ধের ফলের থেকে চূড়ান্ত জয়ের দিকেই তার নজর থাকত। নির্দিষ্ট কোনো টেস্ট জয়ের থেকে তার চিন্তা নিবদ্ধ থাকত রাবার জয়ের দিকে। তার চিন্তাপদ্ধতি যে ফলপ্রসূ হয়েছিল সেটা তার অধিনায়কত্বের পাঁচটি টেস্ট সিরিজের ফল থেকেই বোঝা যায়। চারটিতে অস্ট্রেলিয়া জয়ী, একটি অমীমাংসিত। চারটি জয়ের তিনটি ইংল্যাণ্ডের ও একটি ভারতের বিরুদ্ধে, অমীমাংসিত সিরিজটি ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে। ডন কখনো রাবার হারেনি। তার অবসর নেওয়ার পাঁচ বছর পর ইংল্যাণ্ড প্রথম রাবার জেতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।

তার অধিনায়কত্ব সম্পর্কে সমালোচনা যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। প্রায়শই তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি শোনা যেত সেটি হল— বড়ো বেশি শক্তভাবে সেক্রিকেট খেলে, প্রতিপক্ষকে একটুও ছাড় দেয় না, নির্দয় কৌশল অবলম্বন করে।

ডন স্বীকার করে নির্দয়ভাবেই সেখেলে এবং খেলে শুধুমাত্র জয়ের জন্য। খেলা যদি জয়ের জন্য না হয় তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে আর কিছু থাকে না। যে-পন্থায় সেখেলে সেটা যদি কারুর পছন্দ না হয় তাহলে প্রতিকারের একমাত্র উপায় আইন বদল করা। কেননা সেসবসময় আইন অনুযায়ীই খেলে।

ক্রিকেট আইন ডন ভালোই জানে। ১৯৩৩-এ সেআম্পায়ারিং পরীক্ষা পাস করে। এটা সেকরে এইজন্য যে, তার ধারণা প্রত্যেক খেলোয়াড়েরই উচিত নিজের খেলার সবরকম বিষয় সম্পর্কে যতটা সম্ভব শিখে রাখা। এই একই যুক্তিতে সেক্রিকেটের ইতিহাস পড়েছে এবং ক্রিকেটের শুরুর আমলের বহু গল্প ও ঘটনায় নিজের পুঁজিকে সমৃদ্ধ করেছে।

ক্রিকেটে অজস্র মজার ঠাট্টা আছে। তার একটি হল, অধিনায়কের প্রথম কর্তব্য টসে জেতা। ডন এই কর্তব্যটি কিন্তু খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। যত-না সেটসে জিতেছে হেরেছে তার বেশি। ১৯৩৮ সিরিজে তো সব ক-টি টেস্টেই টসে হারে। তবে যে-টেস্টে সেটস জিতেছে সেই টেস্ট হারেনি। এই ব্যাপার যেন ইঙ্গিতে জানায়, তার সিদ্ধান্তগুলি গভীর বিচারবোধপ্রসূত। আর ক্রিকেটে কত যে সিদ্ধান্ত অধিনায়ককে নিতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। অধিনায়কের পরিপ্রেক্ষিত থেকে যে-অসুবিধাটিসবথেকে বড়ো সেটি হল—তার সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর এবং প্রযুক্ত হওয়ার পর খেলায় সেগুলি সাফল্যের বা অসাফল্যের আলোকে সংবাদপত্র ও জনসাধারণ সেগুলির বিচার ও সমালোচনা করে। সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যা ঘটবে সেগুলি জানার আগেই অধিনায়ককে কিন্তু তার সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলতে হয়।

ডনকে আর একটি জিনিস আবিষ্কার করতে হয়েছে—একই সঙ্গে দর্শকদের তুষ্টিসাধন ও ম্যাচ জেতা। দর্শকরা চায় ঘটনা, ব্যাটসম্যান বল পেটাচ্ছে এবং আউট হয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রয়োজনে বহুক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানকে শিকড় গাড়তে হয়। তখনই শুরু হয় অসন্তুষ্টির বিক্ষোভধ্বনি। ডন কিন্তু বরাবরই চেয়েছে দর্শকদের খুশি করতে। সেমনে করে লোকে খেলা দেখার জন্য যখন পয়সা খরচ করে মাঠে আসছে তখন অর্থদাতা এই পৃষ্ঠপোষকদের উত্তেজক কিছু-একটা অবশ্যই প্রাপ্য যাতে তাদের পয়সা উশুল হয়—এবং তার বেশিরভাগ ইনিংস থেকেই তারা তা পেয়েছে। মন্থর গতিতে সেজীবনে খেলেনি, যদি-না খেলতে বাধ্য হয়েছে। আবার খেলায় যে-পন্থা প্রয়োগের জন্য মস্তিষ্কের নির্দেশ পেত তা অমান্য করে দর্শকের মনোরঞ্জনে কখনোই মেতে ওঠেনি। তার কাছে প্রথম কথা—ম্যাচ জিততে হবে।

ঠিক কোন সময়ে বোলার বদল করতে হবে, দর্শকরা যাকে চায় সেই সেরা বোলারটিকে দিয়ে বল করিয়েই যাবে কি না অথবা পরে কোনো সময়ে ব্যবহার করানোর জন্য এখন তাকে বোলিং থেকে সরিয়ে রাখবে কি না এইসব সিদ্ধান্ত সবসময় নেওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। উইকেট পেলেও দীর্ঘসময় তাকে দিয়ে বল করালে হয়তো সফরের বাকিটুকুর জন্য সেঅকেজো হয়ে পড়তে পারে। মোটকথা অধিনায়ক যে-সিদ্ধান্তই নিক দেখা যাবে তার থেকেও বেশি বিজ্ঞ স্ট্যাণ্ডের দর্শকরা এবং খবরের কাগজের কিছু পন্ডিত সমালোচক।

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংক্রম সাজাবার ব্যাপারে ডনকে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ব্যাটিংক্রম বদল করার জন্য মাঝে মাঝে তাকে এই বলে সমালোচনা করা হয় যে, যাতে ভিজে উইকেটে তাকে ব্যাট করতে না হয় তাই সেব্যাটিংক্রম বদলাত। কথাটা মিথ্যা নয়। উইকেট শুকিয়ে উঠে রান তোলার অবস্থায় না আসা পর্যন্ত ডন নিজেকে সরিয়ে রাখত। ডন জানত এজন্য তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু নিজের ব্যাটিং গড় বৃদ্ধি করতে কি নিজেকে জাহির করতে সেতা করেনি।

দলের দরকার রান। নি:সন্দেহে ডন দলের সেরা ব্যাটসম্যান। এবং রান পাওয়ার সম্ভাবনা তারই বেশি। সুতরাং নিজেকে সেসর্বোত্তম সুযোগ অবশ্যই দেবে। এই যুক্তিগুলি সেছেঁকে বার করে নেয় ঠাণ্ডা মাথায়, আবেগের বশবর্তী না হয়ে এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা সরিয়ে রেখে। তার কাছে সব কিছুর আগে অস্ট্রেলিয়া। যে-সিদ্ধান্ত তার কাছে সঠিক মনে হবে, তাতে পৌঁছে গেলেই ডন তা আর কোনোক্রমেই বদলায় না। সেটা নিজের কোলে ঝোল টানার মতো দেখায় যদি দেখাক, তবু সেঅটল থাকবে।

ফিল্ডারদের মাঠে সঠিক জায়গায় রাখার জন্য অনেক সময় ব্যয় করত। যেখানে সেচায় ঠিক সেই জায়গাটিতে, এক ইঞ্চি এধার-ওধার নয়। তাদের দাঁড় করাতে খুঁতখুঁতানির অন্ত ছিল না। তার একটিই কথা, ‘দশ ফুটের জন্য বল ফসকানো যতটা খারাপ, তিন ইঞ্চির জন্য ফসকানো ততটাই খারাপ।’ বোলারদের সঙ্গে সেএত বার শলাপরামর্শ করত যে একে ‘ব্র্যাডম্যানের লিগ অফ নেশনস বৈঠক’ বলা হত। কিন্তু তা থেকে সেফল পেত।

মাঠের বাইরে ও ভিতরে, নির্বাচক ও অধিনায়করূপে ডন সৃজন-গঠন ও প্রশিক্ষণ দ্বারা যা করেছে তারই চূড়ান্ত রূপ ১৯৪৮-এর অস্ট্রেলীয় দল। সর্বকালের অন্যতম সেরা দল।

ক্রিকেট খেলা এবং ক্রিকেট সমস্যার সমাধান, অধিনায়কের কাজের একটা অংশ মাত্র। মাঠের বাইরে আছে ডিনার, সংবর্ধনা, করমর্দন এবং বক্তৃতা। ডনের পক্ষে কঠিন বোধ হয়েছিল বক্তৃতা করা ব্যাপারটা। সেযে গ্রামের সাধারণ ঘরের ছেলে, গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছে যৎসামান্য, এটা সবসময়ই তার মনে থাকত। তাকে অধিনায়ক মনোনীত করা হয়েছে তার ক্রিকেটদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার জন্য, ডিনার সভায় সরল বক্তৃতা বা লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য নয়। ডনের কাছে এসব ব্যাপার অস্বস্তিকর বোধ হত, মাঝে মাঝে সেফেটে পড়ত।

অথচ এসব ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া হত, ডন ডিনার সভার বক্তৃতায় সমানে পাল্লা দেবে অন্যান্য সহ-বক্তাদের সঙ্গে। অন্যান্যরা বলতে পেশাদার বক্তা— সাধারণত কোনো ক্রিকেটরসিক বিচারপতি, কুইনস কাউন্সিলের কেউ, মন্ত্রীসভার বা পার্লামেন্টের কোনো সদস্য, এরাই। এমন পরিস্থিতি প্রায়ই দেখা দিত, বিশেষত ইংল্যাণ্ড সফরকালে। সেখানে খেলার জন্য ডনকে যতটা সময় খরচ করতে হত, খেলার কাজ বাদে অন্যান্য ব্যাপারেও ততটা বা তার থেকে বেশিই সময় তাকে দিতে হত। এসব ব্যাপার শুরু হয়ে যেত ইংল্যাণ্ড পৌঁছানো মাত্র জাহাজঘাটায় খবরের কাগজের এবং নিউজরিল ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো থেকে।

তারপর অস্ট্রেলিয়া হাউসে সংবর্ধনা। সেখানে হাইকমিশনারের সঙ্গে ডনকে নানাবিধ আলাপ করতে হবেই এবং অন্তত শ-দুয়েক অভ্যাগতের সঙ্গে করমর্দন, কখনো ডনের মনে হত এইসব হস্তচূর্ণকারী সংবর্ধনার পর আর বোধ হয় কখনো সেব্যাট ধরতে পারবে না।

তারপর আরও ফোটোগ্রাফার ও রিপোর্টারদের সঙ্গে মোলাকাত। কসরত করে মুখের হাসি জিইয়ে রাখা, ভদ্র ও বিনীত থাকা, বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিপূর্ণ বা উদ্ধত কি নির্বোধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাওয়া।

তারপর নাগাড়ে লাঞ্চ আর ডিনার। লাঞ্চ ব্রিটিশ স্পোর্টসমেনস ক্লাবে; ডিনার হাউস অফ কমন্সে (প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ); লাঞ্চ ক্রিকেট রাইটার্স ক্লাবে (এবং যেন মনে থাকে, যে-লোকটি কাগজে চুটিয়ে আক্রমণ করেছিল তার সঙ্গে দারুণ হেসে কথা বলতে হবে); ডিনার স্টক এক্সচেঞ্জে (শেয়ার বাজারের লোকদের ব্যাপার তাই ডনের ভালোই লাগত)। লাঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ জার্নালিস্টদের সঙ্গে (আরও সাংবাদিক); ডিনার ম্যানসন হাউসে লর্ড মেয়র অফ লণ্ডনের আমন্ত্রণে; লাঞ্চ রয়াল এম্পায়ার সোসাইটিতে…

কাউন্টি ম্যাচ খেলার জন্য সফরকালে এই একই ছকে ব্যাপারগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটত এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে সবাই ধরে নিত ডন ঝকমকে দুর্দান্ত বক্তৃতা করবে। বহু সময় তাকে প্রিন্স ফিলিপ বা লর্ড অ্যাটলি বা লর্ড বার্কেটের আগে বা পরে বক্তৃতা করতে হয়েছে। কিন্তু আগে যতটা তার বুক টিপটিপ করত পরবর্তীকালে ডনকে আর উদবিগ্ন হতে হয়নি কেননা বক্তৃতা সেচমৎকারভাবেই করতে পারত। বক্তৃতাশেষে তার উদ্দেশ্যে যে প্রবল অভিনন্দন ধ্বনিত হত, ডনের প্রায়ই সন্দেহ হত এটা বোধ হয় নিছকই সৌজন্যমূলক। আসলে কিন্তু তা খাঁটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই।

বক্তৃতার মধ্যে গল্প ঢুকিয়ে বা নিজের সম্পর্কে ছোটোখাটো তথ্য সরবরাহ করে ডন আসরকে হাসাতে পারত। ১৯৩৮-এ এমসিসি সভাপতি এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বল্ডুইন ভোজসভায় জানান, শৈশবে তাঁর স্বপ্ন ছিল কামার হওয়ার। ডন বলল, ‘আমার স্বপ্ন ছিল বাড়ি রং করার মিস্ত্রি হওয়ার, আমরা দুজনেই তাতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে মনে হয় না নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে এখন কেউ আবার রাজি হব।’

সান্ধ্য সম্মিলনে যোগ না দেওয়ার বা তাড়াতাড়ি সম্মিলন থেকে চলে যাওয়ার জন্য লোকেরা যখন ডনের অসামাজিকতা বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তখন সেহোটেলে নিজের ঘরে একা বসে পরবর্তী বক্তৃতা কী বিষয়ে বলবে, আগের বক্তৃতা বা সাক্ষাৎকারে বলা হয়নি এমন কিছু জিনিস আর আছে কি না ইত্যাদি নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ভেবেচিন্তে কিছু-একটা ঠিক করার পর আছে চিঠির উত্তর দেওয়া। রাত দুটোতিনটে বেজে যেত উত্তর লিখতে। ছোটো ছেলেমেয়েদের চিঠিগুলোতার জন্য আলাদা করে রাখা হত। ডন ব্যক্তিগতভাবে সেগুলির উত্তর দিত। ইংল্যাণ্ড সফরে ডন দিনে গড়ে একশোটি ব্যক্তিগত চিঠি পেত। চিঠিগুলিতে তার স্বাক্ষর চাওয়া থেকে শুরু করে এই রকমের অদ্ভুত অনুরোধও থাকত : ‘২৫ বছর আগে আমার ভাই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। তার কোনো খবর আমায় দিতে পারেন কি? তার নাম ডন স্মিথ, বেশ লম্বা, গোঁফও আছে। আপনি নিশ্চয়ই তাকে চেনেন।’ ডন একবার একটি চিঠি পায় যার খামে ঠিকানার বদলে আঁটা ছিল তার মাথা থেকে নাক পর্যন্ত মুখের ছবি ও লেখা ছিল, ‘ইংল্যাণ্ডে কোথাও খেলছেন?’ চিঠিটি লর্ডসে ডনের হাতে পৌঁছেছিল।

ডনের সই সবাই চায়। ডন কিন্তু একটি সই সযত্নে রেখে দিয়েছে— ডব্লি জি গ্রেসের এক ভক্ত এটি তাকে উপহার দিয়েছে। গ্রেসের নামে একটি চেক, পিছনে গ্রেসের স্বাক্ষর। চেকটি ১৯০৭ সালের অর্থাৎ ডনের জন্মের আগের বছরের।

তবে ডন সবথেকে খুশি হত বিদেশি ছেলেদের চিঠি পেয়ে। ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সিংহল, এমনকী আমেরিকা, হল্যাণ্ড, ডেনমার্ক থেকেও ছেলেরা তাকে লিখত।

সন্ধ্যাটা এইভাবে কাটিয়ে ক্লান্ত ডন বিছানায় প্রায় লুটিয়েই পড়ত। ঘুমোবার আগে তার শুধু মনে পড়ত, আবার কাল সকালে রিপোর্টাররা ছেঁকে ধরবে, ফোটোগ্রাফাররা ঘেরাও করবে, আরও চিঠির উত্তর দিতে হবে, আরও বক্তৃতা; আর নিতে হবে দল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত, আর খেলতে হবে ক্রিকেট—আরও ক্রিকেট।

১৪. ইংল্যাণ্ডে তৃতীয় বার

ডন যখন অস্ট্রেলীয় দল নিয়ে ১৯৩৮-এ ইংল্যাণ্ডে এল তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালোছায়া ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে। জাহাজে আসার সময় নেপলস বন্দরে তারা গুনল ৩৬টি ডেস্ট্রয়ার, ৮টি ক্রুজার ও ৭২টি সাবমেরিন। ডকের ধারে কুচকাওয়াজে ব্যস্ত নাবিকরা। লণ্ডনে পার্কে ও খেলার মাঠে বিমান আক্রমণ আশ্রয়স্থল তৈরি হচ্ছে, ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে।

তাই বলে খেলার মাঠে দর্শকের কমতি হল না। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের খেলা দেখতে মাঠ ঠিকই ভরে গেল। বলা বাহুল্য, প্রধান আকর্ষণ ডন। ইংল্যাণ্ডে তখন সেঅসম্ভব খ্যাতিমান। ‘হুজ হু’ পরিচিতি গ্রন্থে ডনের জন্য তখন ২১ লাইন বরাদ্দ অর্থাৎ হিটলারের থেকে আট লাইন কম, স্ট্যালিনের থেকে সতেরো লাইন বেশি। ডনের পায়ে পায়ে তখন ছেলের পাল ঘোরে। রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকায়। হোটেলে অনেকেই দেখা করতে আসে পুরোনো বন্ধুর ভান করে।

জাহাজে ডন ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই কাটায়। তার উপর এক দুর্ঘটনা, দলের সবথেকে ছোটো সিডনি বার্নেস পিছল ডেকে পড়ে গিয়ে কবজির হাড় ভাঙে জিব্রাল্টারে। জুনের শেষে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ শেষ হওয়ার পর বার্নেস সফরে প্রথম ব্যাট করে। জাহাজে অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাটালেও ডন মানসিক বিশ্রাম নেয়নি। কাগজ-পেনসিল নিয়ে বোলিং প্ল্যান ছকেছে, ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের স্কোর আর কীভাবে তারা আউট হয়েছে তাই নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে, বিভিন্ন ধরনের উইকেটে ও বিভিন্ন ধরনের বোলারের বিরুদ্ধে তাদের দক্ষতা সম্পর্কিত রিপোর্টও গভীর মনোযোগে পড়েছে। জাহাজে সামাজিকতা রক্ষার জন্য মেলামেশার থেকেও তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল এই কাজগুলি করা।

ডন ইংল্যাণ্ডে খেলতে ভালোবাসে। অস্ট্রেলিয়ার থেকে ইংলিশ উইকেট মন্থর। তার ব্যাটিং প্রধানত পিছিয়ে গিয়ে খেলার ওপরই ভিত্তি করে, ফলে মন্থর উইকেট তার স্টাইলেরই উপযোগী। ইংল্যাণ্ডের মৃদু কোমল আলোয় বল দেখতেও তার সুবিধা হয়।

যথারীতি সফরের প্রথম খেলা উরস্টারে। প্রথম দুটি সফরের মতো ডন এবারও সফর শুরু করল দ্বিশত রান দিয়ে। ২৯০ মিনিটে ২৫৮ রান, তাতে ৩৩টি চার। উরস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে প্রথম দুটি সফরে করেছিল ২৩৬ ও ২০৬। এই ত্রি-সাফল্যের জন্য সেখানকার এক চিনামাটির দ্রব্যনির্মাতা বিশেষ এক ফুলদানি তৈরি করে ডনকে উপহার দেয়। সেটির একদিকে আঁকা আছে উরস্টার মাঠের ছবি— দর্শকরা, নদীতীরের গাছের সারি, অনবদ্য উরস্টার ক্যাথিড্রাল এবং উইকেটে ব্যাটিংরত ডন ব্র্যাডম্যান। অন্য দিকে উৎকীর্ণ আছে প্রশংসাবাক্য।

সফর শুরু করে ২৭ মে পর্যন্ত ডন সাতটি ম্যাচে এক ইনিংস করে খেলে সাত ইনিংসে করে ১,০২১ রান। মরসুমের শুরু থেকে মে মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে হাজার রান এখন পর্যন্ত সাত জন পূর্ণ করতে পেরেছে। কিন্তু ডনের মতো দু-বার (১৯৩০ ও ১৯৩৮) কেউ পারেনি। অন্য ছয় জন হলেন— গ্রেস (১৮৯৫), টম হেওয়ার্ড (১৯০০), ওয়ালি হ্যামণ্ড (১৯২৭), চার্লি হ্যালোজ (১৯২৮), বিল এডরিচ (১৯৩৮) ও গ্লেন টার্নার (১৯৭৩)। এঁদের মধ্যে গ্রেস, হ্যামণ্ড ও হ্যালোজ ছাড়া বাকি সবাই এপ্রিল থেকে ব্যাটিং শুরু করেন। গ্রেস সবথেকে দ্রুত, ২২ দিনে হাজার রান করেন।

ডনের ১৯৩৮-এর স্কোর : ২৫৮, ৫৮, ১৩৭, ২৭৮, ২, ১৪৩ ও ১৪৫ = ১,০২১ রান। ডনের হাজার রান পূর্ণ হয় হ্যামশায়ারের সঙ্গে খেলায়। ১৯৩০-এর মতো এবারও বৃষ্টি সম্ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকে এই সাফল্য অর্জন করতে হয়েছে। পরের ম্যাচ মিডলসেক্সের সঙ্গে। তাদের বিল এডরিচের এখন পর্যন্ত ৯৮১ রান ১৩ ইনিংস খেলে। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া তারপর মিডলসেক্স ব্যাট করে এবং এডরিচ ৯ রান করে আউট হয়। আর মাত্র দশটি রান যদি দ্বিতীয় ইনিংসে পায় তাহলে সেঅসাধারণ সম্মান অর্জন করবে।

কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংস খেলার সুযোগ মিডলসেক্স পাবে কি! নির্দয় কঠিন চরিত্ররূপে অভিহিত ডন ওকে সুযোগ দেবার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে দিল মাসের শেষ দিনে ৩১ মে। দর্শকরা প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তারা চেঁচামেচি করে ডনের আদ্যশ্রাদ্ধ শুরু করে দেয়। তারপর যখন বুঝল ডন কেন ইনিংস ঘোষণা করেছে, তখন আবার চিৎকার ডনকে সাধুবাদ জানিয়ে। এডরিচের প্রতিটি স্ট্রোকে তারা উল্লাসে ফেটে পড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত সেঅপরাজিত রইল ২০ রানে। অর্থাৎ ৩১ মে এডরিচের ১,০১০ রান।

এই খেলাতেই ডনের পিঠে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়। ডাক্তারের উপদেশে প্রথম টেস্ট ম্যাচ পর্যন্ত সেবিশ্রাম নেয়। অবশ্য তখন সেজানত না এই যন্ত্রণাটাই তার খেলোয়াড় জীবনকে সংক্ষেপিত করবে। তবে প্রথম টেস্ট পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়াটা ভালোই হয়েছিল, কেননা তার সহনশক্তি ও মনোনিবেশ ক্ষমতা আবার যাচাই হয় এই টেস্ট ম্যাচে।

নটিংহামে নিখুঁত ব্যাটিং উইকেটে হ্যামণ্ড টসে জেতে। মাত্র এক রানের জন্য চার্লি বার্নেট রেকর্ড বইয়ে তিন অস্ট্রেলীয়— ট্রাম্পার, ম্যাকার্টনি ও ব্র্যাডম্যানের পাশে নিজেকে রাখতে পারেনি। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে বার্নেট ৯৯ রানে অপরাজিত থাকে। অস্ট্রেলীয়রা তাকে কিছুতেই শতরান পূর্ণের জন্য একটি রান করতে দেয়নি।লাঞ্চের পর অবশ্য বার্নেট ১২৬ রান করে আউট হয়। হাটন ও কম্পটনের এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা। এরা দুজনেই শতরান করে যথাক্রমে ১০০ ও ১০২ এবং তারপরও এডি পেন্টার ২১৬ রানে অপরাজিত থাকে। ইংল্যাণ্ড ইনিংস হ্যামণ্ড ৮ উইকেটে ৬৫৮ রানে ঘোষণা করে দেয়।

অস্ট্রেলিয়া জবাব দিল ৪১১ রান করে। ২৪৭ রানে পিছিয়ে অর্থাৎ ফলো অন এড়ানো গেল না। ডন করেছিল ৫১ কিন্তু স্ট্যানলি ম্যাককেবের ২৩২, ডনের মতে স্তম্ভিতকারী ইনিংস, এমন অসাধারণ ব্যাটিং আর কখনো দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়া ছয় জনকে হারিয়ে ১৯৪, ম্যাককেবকে খেলতে হয়েছিল উইকেট-কিপার বেন বার্নেট ও তিন বোলার ওরিলি, ম্যাককরমিক ও ফ্লিটউড স্মিথকে জুড়ি নিয়ে। যতক্ষণ সেউইকেটে ছিল অস্ট্রেলিয়ার ওঠে ৩০০ রান, তার মধ্যে ২৩০ মিনিটে তার নিজেরই ২৩২। তাতে ৩৪টি চার ও ১টি ছয় অর্থাৎ ১৪২ রান এসেছিল ৩৫টি স্ট্রোক থেকে। খেলা দেখতে দেখতে ডন আর পারছিল না মাঠের দিকে তাকাতে। অকল্পনীয় অসম্ভব ব্যাটিংয়ের মহিমায় তার দু-চোখ জলে ভরে গেছল। নেভিল কার্ডাস তাঁর অনুপম গদ্যে ডনের মতো একই কথা বলেছেন :

হৃদয় আলোড়নকারী ক্রিকেট। তার ব্যাটের নিখুঁত স্পর্শ নান্দনিক বোধকে নাড়া দেয়। ম্যাককেব ইংলিশ আক্রমণকে ধ্বংস করে আভিজাত্যিক বিনয় সহকারে, সুরুচি দ্বারা।

ডগলাস রাইটের তিন ওভারে ম্যাককেব নেয় ৪৪ রান এবং শেষদিকে ৭২ রান করে ২৮ মিনিটে, শেষ উইকেটে যোগ করে ৭৭ রান। তবু ফলো অন এড়ানো গেল না। জয়ের জন্য নয়, ম্যাচ বঁাচানোর জন্য এবার ডনকে খেলতে হবে। উইকেটে ক্ষয় ধরেছে, বোলারদেরই প্রাধান্য এখন। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত ডন ব্যাট করল অসাধারণ সংযমে, প্রকৃতি-বিরুদ্ধ রক্ষণাত্মক মেজাজে নিখুঁত টেকনিকে, শুধু দলের মর্যাদা রক্ষার জন্য। তাকে যোগ্য সাহচর্য দেয় বিল ব্রাউন ১৩৩ রান করে। এমন ডনকে লোকে আগে কখনো দেখেনি। সারাদিন ব্যাট করে ১৪৪ রানে অপরাজিত। পিঠের ব্যথাটাও আবার চাগিয়ে উঠেছে। পিচ থেকে ধুলোর কণা চোখে গিয়ে চোখ করকর করছে। কিন্তু ম্যাচ তাকে বঁাচাতেই হবে। অত্যন্ত বিরক্তিকর ইনিংস সেখেলল, যে-খেলা দর্শকরা দ্রুত মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে হাঁফ ছাড়বে। কিন্তু ডনের কাছে এই ইনিংস তার সেরাগুলির অন্যতম, বীরত্ব ব্যঞ্জনায় শ্রেষ্ঠত্বের থেকে কোনোমতেই ন্যূন নয়। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটে ৪২৭ রান করার পর খেলা শেষ হয়।

লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচও অমীমাংসিত রয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন ১০২ রানে অপরাজিত থাকে ১৪০ মিনিট ব্যাট করে। এই শতরান পর পর পাঁচটি টেস্ট ম্যাচে তার পঞ্চম শতরান। তা ছাড়া তখন ইঙ্গ-অস্ট্রেলীয় দুই দেশের মধ্যে টেস্ট খেলায় জ্যাক হবসের ৩,৬৩৬ মোট রানের রেকর্ডটিও ডন অতিক্রম করে। এই টেস্টে হ্যামণ্ড ২৪০ করে এবং অস্ট্রেলিয়ার ৪২২ রানের প্রথম ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করে বিল ব্রাউন ২০৬ রানে অপরাজিত থেকে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যাণ্ডের অর্ধেক ব্যাটসম্যান ৭৬ রানে ফিরে আসার পর তরুণ কম্পটন অসাধারণভাবে ৭৬ রান না করলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া জেতার সুযোগ পেত। ইংল্যাণ্ড করে ৮ উইকেটে ২৪২। প্রসঙ্গত বলে রাখি, লর্ডস প্যাভিলিয়নে বসেই ডন প্রথম টেলিভিশন সেট চোখে দেখে। দেখেছিল উইম্বলডন টেনিস। টিভি-র তখন শৈশবকাল।

তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটি শুরুই হল না। মাঠে একটা বলও পড়ল না। দুই অধিনায়ক টস করারও দরকার বোধ করল না। কারণ বৃষ্টি, অবিশ্রান্ত অঝোরে দিনের পর দিন বৃষ্টি। তৃতীয় টেস্টম্যাচের স্থান? অবশ্যই ম্যাঞ্চেস্টার ছাড়া আর কোথায়ই-বা হবে!

লিডসে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ। ডনের মতে, আধুনিক কালে অন্যতম সেরা টেস্ট ম্যাচ। ভালো পিচে ইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংস শেষ হল ২২৩ রানে। আকাশে ঘন মেঘ জমে উঠছে। বৃষ্টি আসবে। আসবেই। এইবার অধিনায়ক ডনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আলো কম বটে কিন্তু উইকেটের অবস্থা ভালো, বৃষ্টির পর আলো ভালো হবে বটে কিন্তু উইকেট খারাপ হবে—তাহলে কোন অবস্থায় ব্যাটিং শ্রেয়? ডন ঠিক করল প্রথম অবস্থাটিরই সুযোগ নেওয়া ভালো। ব্যাটসম্যানদের প্রতি তার নির্দেশ : ‘আর যাই করো, আলো কম হওয়ার জন্য আবেদন কোরো না।’

রীতিমতো অন্ধকারেই অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করেছিল। মাঠের মাঝ থেকে ওরা দেখতে পাচ্ছিল গ্যালারিতে দেশলাই জ্বালানো আগুনের শিখা। প্রেসবক্সে এক সাংবাদিক তো রেগে বলেছিল, ‘অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা যদি আপিল না করে তো আমিই করব। আমি নিজের লেখাই দেখতে পাচ্ছি না।’

অন্ধকারে ডন প্রায় তিন ঘণ্টা ব্যাট করে ১০৩ রান করে। এক সাংবাদিক লিখল, ‘পিকাডিলিতে মোমবাতির আলোয়ও ডন শতরান করবে।’ পর পর ছয়টি টেস্টে হল ছয়টি শতরান। পরের টেস্ট ওভালে ডন ব্যাট করেনি এবং তারপরই আবার সেপর পর দুটি টেস্টে দুটি শতরান করে (১৯৪৬-৪৭ অস্ট্রেলিয়া)। লিডসে অস্ট্রেলিয়া ১৯ রানে এগিয়ে ২৪২ রানে ইনিংস শেষ করে। ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ১২৩ রানে শেষ হওয়ার পরই আবার আকাশে ঝঞ্ঝামেঘ দেখা দিল। ঝড়-বৃষ্টি এখনি শুরু হবে। ডন নির্দেশ দিল, পেটাও, রান তাড়া করো। ১০৫ রান সংগ্রহের জন্য ব্যাটসম্যানরা তাই শুরু করল। রান উঠছে উইকেটও পড়ছে। খেলা ধীরে ধীরে উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করল। প্রকৃতির সঙ্গে রেষারেষি করে ইংলিশ প্রতিরোধ ভেঙে জয় সম্ভব হবে কি হবে না। দুটি টেস্ট অমীমাংসিত, একটি পরিত্যক্ত, আর একটির খেলা বাকি, সুতরাং এই টেস্টের বিজয়ীর ‘রাবার’ হারাবার ভয় অন্তত থাকবে না। লিডসে জিতলে অস্ট্রেলিয়ার কাছেই ‘অ্যাশেজ’ থাকবে।

অস্ট্রেলিয়া জিতল পাঁচ উইকেটে ১০৭ রান তুলে। ম্যাচে ওরিলি পায় ১০ উইকেট ১২২ রানে। ডন করে ১৬ রান। শেষদিকে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে সেআর খেলার দিকে তাকাতেই পারছিল না। ডেসিং রুমে বসে কিছু-একটা কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য গাদা গাদা রুটি আর জ্যাম চিবোতে শুরু করে আর বাইরে থেকে একজন রিলে করে তাকে বলে যায় খেলার কী অবস্থা। এত নার্ভাস সেজীবনে হয়নি।

কিন্তু ওভালে ‘টাইমলেস’ শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল অকল্পনীয়, টেস্ট ইতিহাসের বিরাটতম পরাজয়—ইনিংস ও ৫৭৯ রানে। এমন বিপুল ইনিংস হার এখনও কোনো দেশের বরাতে জোটেনি।

এই ওভাল টেস্ট, হাটনের টেস্ট। ২২ বছরের ইয়র্কশায়ার ওপেনিং ব্যাটসম্যান ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট (তখনকার উইকেটে থাকার রেকর্ড) ব্যাট করে বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড স্থাপন করে ৩৬৪ রানের। আগের রেকর্ড ছিল ডনেরই ৩৩৪। বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড হল সর্বোচ্চ ইনিংস রানের ও ইংল্যাণ্ড ৭ উইকেটে ৯০৩। (৫৮ বছর পর শ্রীলঙ্কা এই রেকর্ড ভাঙে ভারতের বিরুদ্ধে ৬ উইকেটে ৯৫২ রান করে।) পার্টনারশিপে ইংল্যাণ্ডের রেকর্ড হল—দ্বিতীয় উইকেটে হাটন-লেল্যাণ্ড ৩৮২ রান; ষষ্ঠ উইকেটে হাটন-হার্ডস্টাফ ২১৫ রান। তার নিখুঁত ইনিংসে হাটন শুধু ৪০ রানের মাথায় ফ্লিটউড স্মিথের বলে স্টাম্পিং সুযোগ দিয়েছিল। টেস্ট ইতিহাসের সবথেকে দামি সুযোগ!

হাটন যখন ৩৩৪ রানের দিকে এগোচ্ছে তখন ডন সিলি মিড-অফে এসে দাঁড়ায়। অনবদ্য কাট করে হাটন ৩৩১ থেকে ৩৩৫-এ পৌঁছোতেই ডন সর্বপ্রথম হাত বাড়িয়ে দেয় অভিনন্দন জানাতে। ৩০ হাজার দর্শক গেয়ে ওঠে ‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলো’। এই টেস্টে ইংল্যাণ্ড দলে ইয়র্কশায়ারের পাঁচ জন মিলে ৬১২ রান করে ও ১০টি উইকেট পায়। তাদের উইকেটকিপার উড তিনটি ক্যাচ ধরে ও ৫৩ রান করে।

খেলার তৃতীয় দিন লাঞ্চের পর ক্লান্ত বোলারদের রেহাই দেবার জন্য ডন নিজে বল করতে এল। ১৯৩০-এর পর ইংল্যাণ্ডের মাঠে এই তার প্রথম বল-করা। দ্বিতীয় বলটি করার সময় বোলারদের পায়ে তৈরি গর্তে তার পা ঘুরে গিয়ে পায়ের গোছের একটা হাড় সামান্য ভাঙল। তাকে তুলে নিয়ে যেতে হল মাঠ থেকে। তৃতীয় দিন চা পানের পর হ্যামণ্ড যখন শুনল ডন ব্যাট করতে পারবে না তখনই নিশ্চিন্ত হয়ে ইনিংস ঘোষণা করে। হ্যামণ্ড জানত, এই সহজ ব্যাটিং উইকেটে ডনের প্রতিভাকে দমিয়ে রাখার সাধ্য তার বোলারদের নেই। নশো রানের মোকাবিলা করতে ডন যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে কেউ তা জানে না।

এই টেস্টে ডন ব্যাট ধরেনি। পায়ের পেশি জখম করে ফিঙ্গলটনও মাঠ থেকে ফিরে এসেছে। মনমরা অস্ট্রেলিয়ার দল ভেঙে পড়ল ২০১ এবং ১২৩ রানে। সিরিজের ফল ১ : ১। ডন সফরের বাকিটুকুতে আর খেলতে পারেনি। তার হাঁটা বারণ, এমনকী বিলিয়ার্ডস খেলা পর্যন্ত। মিডলসেক্সের ও ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত বোলার ওয়াল্টার রবিন্সের বারনহামের বাড়িতে সেবিশ্রাম নেয় তাস খেলে, পিয়ানো বাজিয়ে আর চিঠির উত্তর দিয়ে। দেশের বাইরে ডনের এই প্রথম সফর অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে। দায়িত্বের চাপটা যে কী প্রচন্ড তা সেভালোভাবেই বুঝেছে। প্রায়শই তার মনে হত, ভবিষ্যতে এইরকম আর একটা সফরে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিতে আর সেপারবে না। দেশে ফিরে বড়োজোর আর একটা টেস্ট সিরিজ, তারপরই অবসর।

কিন্তু দশ বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ, অজেয় সফরের নেতৃত্ব দেবার জন্য ডন আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছিল।

ডন ১৯৩৮ ইংল্যাণ্ড সফরে ২৬ ইনিংস খেলে সংগ্রহ করে ২,৪২৯ রান। আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশি দলের কেউ ইংল্যাণ্ডের মাঠ থেকে এত রান বা ১৩টি শতরান (তাতে তিনটি দ্বিশত) তুলতে পারেনি। ডনের গড় হয় ১১৫.৬৬ রান। ইংল্যাণ্ডে একটি মরসুমে ১৫টির বেশি ইনিংস খেলেছে এমন কোনো ব্যাটসম্যান এখনও পর্যন্ত এই গড় স্পর্শ করতে পারেনি। এই মরসুমে ইংল্যাণ্ডে সবথেকে বেশি মোট রান করে হ্যামণ্ড, ৪২ ইনিংসে ৩,০১১ রান; ৭৫.২৭ গড়। ১৯৩৮-এ ডন ইংল্যাণ্ডে ১৩টি শতরান করে ১৯টি ম্যাচে। দশ বছর পর ফিরে এসে ১৯৩৮-এর মোট রান থেকে সেমাত্র একটি রান ও দুটি শতরান কম করে।

১৫. অন্ধকার পাঁচটি বছর

১৯৩৮-এ ইংল্যাণ্ড থেকে ডন সস্ত্রীক দেশে ফেরার পথে ট্রেনে ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে গিয়ে জাহাজে উঠেছিল। ট্রেনে সেশুনেছিল, আর যুদ্ধের ভয় নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন তার ছাতাটিকে সঙ্গে নিয়ে মিউনিখ গিয়ে হিটলারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় এসেছেন।

এক বছর পরই যুদ্ধ শুরু হয়।

কিন্তু তার আগে, ইংল্যাণ্ড থেকে ফিরে ১৯৩৮-৩৯ মরসুমে ডন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়াকে শেফিল্ড শিল্ড বিজয়ী করে। এই সময়ই তার পুত্র জন রাসেল ভূমিষ্ঠ হয়। এটা ডনের জীবনের অসাধারণ মরসুম। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের শতবার্ষিকী ম্যাচে ১১৮ দিয়ে শুরু করে পর পর ইনিংসে সেকরে ১৪৩, ২২৫, ১০৭, ১৮৬, ১৩৫। পর পর ছয় ইনিংসে ছয়টি শতরান। ১৯০১-এ স্থাপিত ইংল্যাণ্ডের সিবি ফ্রাইয়ের বিশ্বরেকর্ডের সমান। পর পর ছয় ইনিংসে শতরান আর করেছে ১৯৭০-৭১ মরসুমে রোডেসিয়ার মাইক প্রোক্টর। ডন অবশ্য চেষ্টা করেছিল সপ্তম শতরানটি করতে, কিন্তু যে-লোকটি খুবই বাজে ফিল্ডার হিসাবে খ্যাত সেই ফ্লিটউড স্মিথ আচমকা ডনের একটি প্রচন্ড ড্রাইভ পায়ের গোড়া থেকে ধরে ফেলায় ফ্রাইয়ের রেকর্ড ভাঙা হল না। ডনের রান তখন ৫।

নিজেকে সক্ষম রাখার জন্য ডন স্কোয়াশ খেলতে শুরু করে। এবং তার যা স্বভাব, যে-খেলায় মন দেবে সেটিতে চূড়ায় পৌঁছোতেই হবে। ডন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া রাজ্য স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়ন হল ডেভিস কাপ খেলোয়াড় ডন টার্নবুলকে এক ঘণ্টা প্রচন্ড লড়াইয়ের পর ৩-২ সেটে হারিয়ে। সারাদিন ব্যাটিংয়ের থেকেও এই এক ঘণ্টার ধকল তার কাছে বেশি মনে হয়েছে। অথচ হ্যারি হপম্যান তাকে উপদেশ দিয়েছিল, আধ ঘণ্টার বেশি কখনো স্কোয়াশ না খেলতে। এরপর ডন আর কখনো প্রতিযোগিতামূলক স্কোয়াশ খেলায় নামেনি।

১৯৩৯ সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ শুরু হলেও ১৯৩৯-৪০ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট খেলা বন্ধ থাকেনি। জাতীয় জীবনে আস্থা ও সাহস বজায় রাখার জন্যই অস্ট্রেলীয় সরকার ক্রিকেট বন্ধ হতে দেয়নি। ডন নাম লেখাল রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সে। বয়স তখন ৩২। এয়ার ফোর্সের পক্ষে বয়সটা একটু বেশিই। তা ছাড়া তখন যত-না বিমান এবং বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষণের সুযোগ তার থেকেও বেশি হয়ে গেছিল মানুষের সংখ্যা। তাই ডনকে বদলি করা হয় সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্টরূপে শারীর প্রশিক্ষকের কাজে।

১৯৩৯-৪০ মরসুমে ডন ৯টি ম্যাচ খেলেছে। তার মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসেই অপরাজিত ২৫১ ও ৯০। তার মতে, শেফিল্ড শিল্ডে জীবনের সেরা খেলা, কারণ বিপক্ষে বল করেছে ওরিলি। এই মরসুমে ওরিলি ছিল মারাত্মক, ৫২ উইকেট নেয় ১৩.৫ গড় রানে। ডন একাই লড়েছিল তার সঙ্গে। প্রথম ইনিংসে গ্রিমেটকে নিয়ে শেষ উইকেটে ১১৩ রানের মধ্যে ডন করে ৮৭। দ্বিতীয় ইনিংসে দলের ১৫৬/৩ এবং তাতে ডনের ৯০ রান।

সেনাবাহিনীতে কঠোর ক্যাম্পজীবনে ডনের পিঠের ব্যথাটা আবার চাগিয়ে ওঠে। চোখেও গোলমাল শুরু হয়। কিন্তু এ সম্পর্কে কাউকে সেকিছু বলেনি। এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ তখন পাইলটদের জন্য দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কে বিশেষ গবেষণা করছিলেন। ডনের দৃষ্টিশক্তি তখন বিশ্বখ্যাত। বিশেষজ্ঞটি যেই খবর পেলেন ডন ক্যাম্পে রয়েছে, অমনি লাফিয়ে উঠলেন। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। হয়তো ডনের চোখ পরীক্ষা দ্বারা আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন তার অকল্পনীয় ব্যাটিং সাফল্যের চাবিকাঠিটি।

ডন তখন রীতিমতো চোখে খারাপ দেখছে। নানা ছুতোয় সেবিশেষজ্ঞটিকে এড়িয়ে যেতে লাগল। নিরুপায় হয়ে বিশেষজ্ঞ তখন ডনের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়ে ডনের ওপর আদেশ জারি করাল চোখ পরীক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করতে। পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ স্তম্ভিত। ডনের চোখে অসুস্থতার লক্ষণ।

তা সত্ত্বেও ডন দুটি ম্যাচ খেলে। রান করে ০ ও ৬ এবং ০ ও ১২। ভালো করে বল দেখতে পাচ্ছিল না। অবশেষে ধরা পড়ল রোগটা—ফাইব্রোসাইটিস। রোগের কারণটা ধরা শক্ত তবে অনুমান করা হয়, অত্যধিক ধকল এবং ক্রমান্বয়ে উদবেগই এর অন্যতম কারণ। ডনের মনে হয়েছে, প্রথমদিকের টেস্ট ম্যাচগুলির ধকল এবং অধিনায়কত্বের উদবেগ থেকেই হয়তো রোগটার শুরু।

বার তিনেক হাসপাতালে কাটিয়ে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে তাকে আসতে হল। তারা রায় দিল, সম্পূর্ণ বিশ্রাম। দীর্ঘ বিশ্রাম। একদম কোনো কাজ বা খেলা নয়।

এর পরের পাঁচটি বছর অন্ধকারে ঢেকে দেয় ডনের খেলোয়াড় জীবনকে।

চটপটে তৎপর যে-মানুষটিকে হাজার ক্রিকেটপাগলরা জেনেছিল সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে, সেএখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। যৌবনের মধ্যাহ্নেই বার্ধক্যের আঁধার নেমে এল। ডান হাতটা একদমই ওঠাতে পারে না। নিজের চুল আঁচড়াতে পারে না। স্ত্রী দাড়ি কামিয়ে দেয়। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনীতে কোনো সাড়া নেই। কোনোদিনই আর সাড় আসেনি। পরবর্তী টেস্ট ম্যাচগুলি সেনি:সাড় দুটি আঙুল নিয়েই খেলেছে।

ডন কয়েক মাস বাওরালে গ্রামীণ পরিবেশে কাটিয়ে আবার অ্যাডিলেডে ফিরে এল। আবার যে ক্রিকেট খেলতে পারবে, এটা তখন তার চিন্তার বাইরে। এই সময়েই ডন এক বন্ধুকে লিখেছিল, ‘এয়ার রেইড ওয়ার্ডেন হওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই।’ দু-বছর সেব্যাট বা বল বা গলফ ক্লাব ছোঁয়নি। শুধুমাত্রই তার শেয়ার দালালি অফিসে কাজ করে গেছে।

ইংল্যাণ্ডে এক বন্ধুকে সেতখন লেখে :

নিশ্চিতভাবেই আমি ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছি, এমনকী ক্লাব ক্রিকেটকেও। এখন বাতগ্রস্ত বুড়োলোকের মতো চলাফেরা করি। যা-কিছু এখন আশা তা হচ্ছে আগামী দিনগুলো সম্পর্কে, যখন আমার ছেলে, এখন যার চার বছর বয়স, ওরই বয়সি স্ট্যান ম্যাককেবের ছেলে, বিল ব্রাউনের ছেলে, তারও বয়স চার, ওরা যখন একদিন তাদের বাবাদের মনে সবুজ করে তুলবে লর্ডসের, ওল্ড ট্রাফোর্ডের, হেডিংলির, টেন্ট ব্রিজের আর ওভালের স্মৃতি।

এই সময়ই জন্মাল ডনের মেয়ে শার্লি। মেয়েটি জন্ম থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত।

ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৯৪৫-এর সেই আনন্দের বছরে ডন একটি বিপদের মুখে পড়ল। যে-ব্যবসায় অফিসে সেকাজ করত সেটি দেউলে হয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলল। নিজে পঙ্গু, একটি পঙ্গু সন্তান, তার ওপর কর্মহীন।

এবার ডন নিজের শেয়ার দালালি ব্যাবসা শুরু করল। শরীরে কুলোয় না তবু খাটতে লাগল অমানুষিকভাবে। এবং এই সময়েই সেবুঝতে পারল তার খেলা কত লোকের মন জয় করে রেখেছে। ধীরে ধীরে তার ব্যাবসা বেড়ে উঠল, ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য ফিরে এল, সেইসঙ্গে দৃষ্টিশক্তিও।

অস্ট্রেলিয়ান সারভিসেস ক্রিকেট দল হ্যাসটের অধিনায়কত্বে ইংল্যাণ্ড ও ভারতে খেলে দেশে ফিরেছে। ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সারভিসেস দলের বিরুদ্ধে খেলার জন্য ডন অনুরুদ্ধ হল। পাঁচটি বছর সেকোনো পর্যায়েরই ক্রিকেট খেলেনি, তাই মনে মনে ইতস্তত করলেও, এখনও তার আগের ক্ষমতা বজায় আছে কি না সেটা যাচাইয়ের এই সুযোগ সেহাতছাড়া করতে পারল না। তবে তার আগে কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলেছিল। করল ৬৮ ও অপরাজিত ৫২। রানগুলো করতে তাকে অসম্ভব কষ্ট করতে হয়। সারভিসেস দলের বিরুদ্ধে ডন করল ১১২ রান। টগবগানির বদলে ধীরস্থির ইনিংস।

এক মাস পরই ফাইব্রোসাইটিস আবার মারাত্মকভাবে আক্রমণ করল ডনকে। লেখার ক্ষমতা পর্যন্ত লোপ পেল। অস্ট্রেলিয়া থেকে ক্রিকেট দল নিউজিল্যাণ্ড যাচ্ছে। ডন জানাল যাওয়া সম্ভব নয়।

নির্বাচক কমিটির এক সদস্য ডনকে বলল, মেলবোর্নে আর্ন সণ্ডার্স নামে এক খুব নামি মালিশওয়ালা আছে, তার কাছে গিয়ে মালিশ করাতে। কিছুটা দৈবের ওপর ভরসা করেই ডন এল সণ্ডার্সের কাছে। প্রথম দিন সণ্ডার্সের আঙুল যখন ডনের পিঠে বেদনার উৎসমূলটি খোঁজাখুঁজি করছিল, যন্ত্রণায় তখন সেঅর্ধমৃত হয়ে পড়ে। সণ্ডার্স সফল হয়েছিল। ডন আর যন্ত্রণাবোধ করেনি। স্বীকার করেছে সণ্ডার্সের চিকিৎসাতেই সেআবার ক্রিকেটে ফিরে আসতে পেরেছে।

 ১৬. প্রত্যাবর্তন

এমসিসি অস্ট্রেলিয়া সফরে আসছে ১৯৪৬-এর শেষে হ্যামণ্ডের নেতৃত্বে। ডন কি ওদের বিরুদ্ধে খেলার যোগ্য স্বাস্থ্য ইতিমধ্যে ফিরে পাবে? সারা অস্ট্রেলিয়ায় তখন এই প্রশ্ন।

ডন নিজেও জানে না এর উত্তর। তবে এটুকু সেজানে, মোটামুটি স্বাস্থ্য আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য পেশির যে তেজিয়ান অবস্থা দরকার এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ আছে। ব্যর্থ হবার জন্য ডন খেলতে রাজি নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার যে তাকে এবং তার অভিজ্ঞতাকে দরকার এটা সেবুঝতে পারে। এইসময় তার স্ত্রীর একটি অনুরোধ তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ‘জন কি এক বারও তার বাবাকে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে দেখবে না?’

নিশ্চয় দেখবে। ডনের মনে হচ্ছে আর একটা মরসুম হয়তো সেখেলতে পারবে। ছেলের সামনে টেস্ট ম্যাচ খেলতে হলে এই মরসুমেই খেলতে হবে। ডন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত চাইল। তারা পরিষ্কার জানালেন, টেস্ট ম্যাচ খেলার চিন্তা ত্যাগ করো।

ডন নাছোড়বান্দার মতো জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি চেষ্টা করি, তাহলে কি চিরকালের জন্য আমার স্বাস্থ্য জখম হবে?’

তাঁরা অনিচ্ছুকভাবেই বললেন, না হবে না, যদি-না বাড়াবাড়ি রকমের ধকল পোহাতে হয়। তবে যুদ্ধের আগে যে-খেলা ছিল তা আর ফিরে পাবে না। চেষ্টা করলেও পাবে না।

ডন দ্বিধায় পড়ল। অনেক ভেবে অবশেষে ঠিক করল, আগে তাহলে কয়েকটা ম্যাচ খেলে দেখি। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে হ্যামণ্ডের এমসিসি দলের বিরুদ্ধে করল ৭৬ ও ৩। ডন আর আগের ডন নেই, ছায়ামাত্র—শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই। খবরের কাগজে লেখা হল, বিরাট এক ক্রিকেটারের প্রেতচ্ছায়া দেখা গেল এবং প্রেতরা কদাচিৎ জীবন ফিরে পায়। যেসব ছেলেরা যুদ্ধের আগে ডনের খেলা দেখেনি, তারা ঠোঁট মোচড়াল।

দমে গেল ডন। এইভাবেই কি তাচ্ছিল্যের মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে হবে ক্রিকেট থেকে? ডন ঝুঁকি নিয়ে মেলবোর্নে এলএমসিসি-র বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের অধিনায়কত্ব করতে। দর্শকরা উৎফুল্ল হয়ে দেখল, প্রেতচ্ছায়া জীবনের কায়া পেয়েছে। ডন যখন ষাটের ঘরে তখন পায়ের একটা পেশি ছিঁড়ে যায়। সেই অবস্থায় সেকরল ১০৬। পরের ম্যাচ ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে, আর একটি শতরান—১১৯।

অস্ট্রেলিয়া জুড়ে এখন শুধু ডনের কথা। আবার ডন নিজেকে ফিরে পেয়েছে। ডন নিজেও ভাবল নিজের সম্পর্কে। ওরিলি অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। অত বড়ো বোলার অবসর নেওয়া মানে অস্ট্রেলিয়ার শক্তির একটি স্তম্ভ সরে যাওয়া। অভিজ্ঞ পুরোনোদের মধ্যে হ্যাসেট, ব্রাউন এবং বার্নেস ছাড়া আর কেউ নেই। তাও বার্নেস খেলেছে মাত্র একটি টেস্ট। ইংল্যাণ্ডের আছে যুদ্ধপূর্ব টেস্ট খেলোয়াড় ছয় জন। অস্ট্রেলিয়ার এখনই সবথেকে বেশি দরকার ডনকে। কিন্তু ছয় দিনের টেস্ট খেলার ক্ষমতা কি তার আছে? ডন জানাল, ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচটিতে খেলব।

ডন টসে জিতল। মরিস ও বার্নেস আউট হবার পরই ডনের রান যখন ২৮, তখন একটি ঘটনা ঘটে যা আজও ক্রিকেট দুনিয়ায় তর্কাতর্কির বিষয় হয়ে আছে। ভোসের একটি প্রায় ইয়র্কার বলকে ডন স্লিপ ফিল্ডারদের বাইরে দিয়ে পাঠাবার জন্য চপ করে। আগের আমলের ডন এই স্ট্রোক নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করত। কিন্তু এক্ষেত্রে বলটি দ্বিতীয় স্লিপ জন আইকিনের হাতে উড়ে এল।

ডন ক্রিজে দাঁড়িয়ে, ফিল্ডাররাও নীরব। তারপরই ক্যাচ আউটের আবেদন উঠল। আম্পায়ার বরউইক বললেন, ‘নট আউট।’ ডন ক্রিজে দাঁড়িয়েছিল যেহেতু তার মতে সেক্যাচ আউট নয়। বল তার ব্যাট থেকে মাটিতে পড়ার পর আইকিনের হাতে গেছে।

ইংল্যাণ্ড খেলোয়াড়রা প্রথমে নীরব ছিল কেন? তাদের বক্তব্য : স্পষ্ট ক্যাচ আউট তাই তারা ভেবেছিল ডন নিজে থেকেই ক্রিজ ত্যাগ করবে। তাই প্রথমে আবেদন করেনি। বোলার ভোস, আইকিন, প্রথম স্লিপে হ্যামশু এবং গালিতে দাঁড়ানো ইয়ার্ডলির ধারণা ডন ক্যাচ দিয়েছে।

ডন সেদিন অপরাজিত থাকে ১৬২ রান করে। পরদিন ১৮৭ রানে আউট হয়। এই নিয়ে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে পর পর সাতটি টেস্ট ম্যাচে তার শতরান হল।

আম্পায়ারের সেই সিদ্ধান্তের ধাক্কা সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। ডনের ১৮৭ রান এবং বৃষ্টি অস্ট্রেলিয়াকে ইনিংস ও ৩৩২ রানে জেতায় প্রথম টেস্টে, যার ফলে অস্ট্রেলিয়া আত্মবিশ্বাস পেয়ে সিরিজ জেতে। তা-ই নয়, ডনের খেলোয়াড় জীবনের মোড়ও ফিরিয়ে দেয় এই সিদ্ধান্ত। যদি ২৮ রানেই তাকে ফিরে যেতে হত, তাহলে সেধরে নিত আর প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। টেস্ট ক্রিকেট থেকেই সেবিদায় নিত। কিন্তু ১৮৭ করার পর সেস্থির করে খেলে যাবে।

সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে ডন ৩৯১ মিনিটে করল ২৩৪ রান। বার্নেসও করল ২৩৪ রান। পঞ্চম উইকেটে দুজনে বিশ্বরেকর্ড করল ৪০৫ রান তুলে। ডন উপর্যুপরি আটটি টেস্টে আটটি শতরান করল। ডন তার পুরো ইনিংসটাই ব্যাকফুটে খেলে যায়। খেলার প্রথম দিনে ফিল্ড করার সময় ঊরুর পেশি ছিঁড়ে যাওয়ায় তার পা-টি বেশ ভালোভাবেই ব্যাণ্ডেজ করা ছিল। পা বাড়িয়ে খেলার উপায় ছিল না।

ডন ও বার্নেসের মধ্যে আগে আউট হয় ডন। বার্নেস ভালোই খেলে যাচ্ছিল। তার রান ২৩৪-এ পৌঁছোতেই ইচ্ছে করে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরে আসে। ব্যাপারটা কী? জবাবে বার্নেস বলে, ডনের সঙ্গে নিজের নামটা এক বারের জন্য পাকাপাকি জুড়ে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ঠিক একই ব্যাপার করেছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মার্ক টেলর ১৯৯৮ পেশোয়ারে দ্বিতীয় টেস্টে ৩৩৪ রানে পৌঁছে ইনিংস ছেড়ে দেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪-এর সঙ্গে নিজেকে জুড়ে রাখার বাসনায়। অমর হতে কে না চায়?

সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া জিতল ইনিংস ও ৩৩ রানে। এটি ইংল্যাণ্ড উইকেট-কিপার গডফ্রে ইভান্সের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার ৬৫৯-৮ ডিক্লেয়ার করা ইনিংসে সেএকটিও বাই-রান দেয়নি। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টে ইয়ার্ডলি তাকে দু-বার আউট করল ৭৯ ও ৪৯ রানে। এই মাঠে ডনের একমাত্র টেস্ট খেলা, যাতে শতরান করতে পারল না। মেলবোর্নে আটটি টেস্ট ম্যাচে তার রান ১,৬৭১। গড় ১১৯.৩। ম্যাচটির মীমাংসা হয়নি এবং ৬৫ বছরে এই প্রথম টেস্ট ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ায় অমীমাংসিত রইল। অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্টেও একই ফল। এখানে বেডসার শূন্য রানে ডনকে বোল্ড করে। ডনের জীবনে ২৮৭ ইনিংসে এটি চতুর্দশতম। তবে একটি ম্যাচের দুই ইনিংসে সেকখনো ‘শূন্য’ করেনি। ডন বরাবরই বলে এসেছে বেডসার বিশ্বের সেরা বোলারদের অন্যতম এবং তার বিরুদ্ধে যত বল খেলেছে তার সেরা ছিল এই বলটি।

সিডনিতেই পঞ্চম টেস্ট খেলা হয়। অস্ট্রেলিয়া ৫ উইকেটে জিতে সিরিজ পায় ৩-০ ম্যাচে। ডন প্রথম ইনিংসে ১২ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে কঠিন সময়ে করে ৬৩ রান। অধিনায়ক ডনের আর একটি সফল মরসুম অতিক্রান্ত হল। অস্ট্রেলিয়া অপরাজিত রইল। এই প্রত্যাবর্তন মরসুমে ডনের রান ১,০৩২, গড় ৭৯.৩৮। যে দুটি লোক কদাচিৎ কোনো ব্যাপারে একমত হতে পেরেছে সেই দুজন পর্যন্ত ডনের চমকপ্রদত্বে একমত হয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। তারা হল অস্ট্রেলিয়ার সহ-প্রধানমন্ত্রী ড. হারবার্ট এভার্ট ও তৎকালীন বিরোধী দলনেতা রবার্ট মেঞ্জিস।

ডন কিন্তু জানে, যুদ্ধের আগে তার যা খেলা ছিল এখন তা আর নেই। এখন তার খেলা ভালো একজন টেস্ট ক্রিকেটারের মতো মাত্র। অথচ যুদ্ধের আগে সেখেলেছে জুড়িহীন প্রতিভাধরের মতো। তার একটা মুশকিল, টেস্ট ম্যাচগুলির মধ্যে সেআর অন্য ম্যাচ খেলেনি। প্র্যাকটিস খুবই দরকার কিন্তু স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ডন ভরসা পায়নি আর খেলতে। কিন্তু এখন সেঠিক করল আরও কিছুদিন খেলবে। ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়া সফরে আসছে। অধিনায়ক লালা অমরনাথ, ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্ত বলেছে, তাদের আশা ডন নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে খেলবে, কেননা তার কাছে অনেক কিছু তারা শিখতে চায়।

ডন জানাল সেখেলার জন্য তৈরি থাকবে অর্থাৎ ভারতীয়দের জন্য প্রচুর শিক্ষা মজুত থাকবে!

 ১৭. শততম শতরান

এখন ডনের প্রত্যাবর্তন সম্পূর্ণ। মাঠের চারিদিকে দর্শকদের অভিনন্দন আবর্তিত হচ্ছে। ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এই প্রথম ক্রিকেট দল আসছে, তাই কৌতূহল অন্যদের মতো ডনেরও প্রবল। দুই দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের মধ্যে খেলার ব্যাপারে স্থিরীকৃত শর্তে একটি বিষয়ে দ্বিমত হয়। ভারত চায় উইকেট অনাচ্ছাদিত থাকবে। অর্থাৎ বৃষ্টি হলে ভিজে উইকেটের সুযোগ নেবে। ডনের মতে, ভারত ভুল করেছে। ভিজে উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা ভারতীয়দের থেকে অস্ট্রেলীয়দের একটু বেশিই। তা ছাড়া তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হলে বা একপেশে জয় ঘটলে দর্শক কমে যাবে, ফলে আর্থিক লোকসান ঘটবে। ডনের এইসব যুক্তি মেনে নিয়েও অমরনাথ কিন্তু উইকেট আচ্ছাদনে রাজি হল না। তবে অমরনাথের সোজাসুজি কথাবার্তা, পরিচ্ছন্ন অমায়িক সহযোগিতামূলক আচরণ ডনকে খুশি করে। সেঅবাক হয়ে ভাবে, এমন লোককে ১৯৩৬-এর ইংল্যাণ্ড সফর থেকে কেন ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

১৯৪৭-৪৮ মরসুমে ডন প্রথম ম্যাচ খেলল অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে। প্রথম ইনিংসে ১৫৬ রান করে মাঁকড়ের বলে সরবটের হাতে ক্যাচ আউট হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে মাঁকড়ের বলে প্রবীর সেন তাকে স্টাম্প করে ১২ রানে। ডন জীবনে ১২ বার স্টাম্পড হয়েছে, এটি একাদশতম। ডনের এই শতরান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ৯৮তম। এই খেলা থেকেই তার ধারণা হয়, ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রচুর রান করবে প্রধানত দুটি কারণে : ওদের প্রকৃত ফাস্ট বোলার এবং উচ্চ শ্রেণির প্রকৃত স্পিনার নেই আর ফিল্ডিংয়ে অত্যন্ত দুর্বল।

ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ডনের ১০০, তার জীবনের ৯৯তম শতরান। এবার সিডনিতে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের অধিনায়করূপে ডন খেলবে। আর একটি শতরান করলেই শততম শতরানটি হবে। তখনও পর্যন্ত ১০ জন ইংরেজ ছাড়া আর কেউ এই কৃতিত্ব অর্জন করেনি। স্বভাবতই ডন ব্যগ্র এই সম্মানের একাদশতম অধিকারী হওয়ার জন্য। সিডনি মাঠেই সেশতরানটি চায়, কেননা এই মাঠকেই সেসবথেকে ভালোবাসে। এই মাঠের দর্শকদের কাছ থেকে সেবরাবরই সহানুভূতি ও স্নেহ পেয়েছে।

সিডনিতে ভারত ৩২৬ করার পর অস্ট্রেলিয়া ব্যাট শুরু করে ব্রাউন ও রজার্সকে হারাল ৩১ রানে। ডন ও কিথ মিলার ব্যাট করছে। দর্শকের ভিড় বাড়ছে। তারা দেখতে এসেছে, ডন হয়তো শততম শতরানটি করবে।

ডন ৯০-এ। আর দশটি রান দরকার। ডন একটু যেন নার্ভাস বোধ করল। একবার দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে প্রায় রান আউট হয়ে যাচ্ছিল।

অবশেষে ৯৯-এ। চা-পানের বিরতি এক ওভার পরেই।

অমরনাথ হঠাৎ বাউণ্ডারি থেকে কিষেণচাঁদকে ডাকল বল করার জন্য। ডন বিভ্রান্ত বোধ করল। এই লোকটি তো কখনো বল করেনি, কী ধরনের বোলার! অমরনাথ কূটচাল চেলেছে। পোক্ত ব্যাটসম্যানরাও ঠকে যেতে পারে। ডন অত্যন্ত সমীহভরে কিষেণচাঁদের প্রথম বলটি দেখে খেলল। মিড অনে দ্বিতীয় বলটি পাঠিয়েই একটি রান নিল। দর্শকরা স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের বন্যায় মাঠ প্লাবিত করল। ডনের ১০০, মিলারের ৬৩। অস্ট্রেলিয়া ৪৭ ওভারে ১৮৮/২।

১০১ রান নিয়ে চা-এর পর ডন আরও ৭১ রান যোগ করল ৪৫ মিনিটে। অর্থাৎ প্রথম ৫০ রান ৭৮ মিনিটে, পরের ১০০ রান ৮৩ মিনিটে। তার ১৭২ রান হয় ১৭৭ মিনিটে। শততম শতরানটি এসেছে ২৯৫টি ইনিংসে।

১৯৪৭-এর ২৮ নভেম্বর ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু হল। প্রথম দিনে ডন ১৬০ অপরাজিত। গত মরসুমের থেকে শরীর অনেক তাজা হয়ে উঠেছে। রাতে বৃষ্টি এল। পরদিন এক ঘণ্টার জন্য খেলা হয়। ডন ১৮৫ রানে হিট উইকেট হয় অমরনাথের বলে। সেব্যাট তুলে এত পিছিয়ে গেছিল ব্যাকফুট ড্রাইভ করতে যে, ব্যাট নামাবার সময় উইকেটে আঘাত করে পিছন থেকে। তৃতীয় দিনে লাঞ্চের পর খেলা শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে ৩৮২ রানে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। চতুর্থ দিনে খেলা হয়েছিল এক ঘণ্টার জন্য। পঞ্চম দিনে খেলা হতে পারেনি। অনাচ্ছাদিত ভিজে পিচে ভারতের ইনিংস শেষ হল ৫৮ রানে। টোসাক দুই ইনিংস বল করে ৬/২৯ ও ৫/২। দারুণ বোলিং। ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৮ করায় অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ও ২২৬ রানে জিতে যায়।

দ্বিতীয় টেস্ট সিডনিতে। ভারত টসে জিতে ব্যাট করতে নামার এক ঘণ্টা পরেই বৃষ্টি। খেলা আবার শুরু হলে পিচ ভারতকে সুবিধা করতে দিল না। ১৮৮ রানে ইনিংস শেষ। ফাড়কর করে ৫১। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতেই চাঞ্চল্য।বিনু মাঁকড় বল করতে আসার সময় বেল ফেলে দিয়ে ব্রাউনকে আবার রান আউট করেছে। প্রথম বার করেছিল কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে খেলায়, বল করার আগেই ব্রাউন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। মাঁকড়ের স্পোর্টসম্যানশিপ নিয়ে কথা উঠতে ডন জানাল, মাঁকড় কিছু অন্যায় করেনি। আইনে যা আছে সেতাই করেছে, নয়তো আইনটা আছে কী করতে? অন্যায় সুযোগ নিয়েছিল ব্রাউনই, তাই শাস্তি পেয়েছে। তা ছাড়া মাঁকড় তো আগেই একবার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।

বৃষ্টিভেজা পিচে ভারত চটপট অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস ১০৭ রানে খতম করে দেয়। ডন করে ১৩ রান। অস্ট্রেলিয়াকে তাড়াতাড়ি আউট করে ভারত ভুল করেছিল। পিচ তা ছাড়া খারাপ এবং ভারতকে সেই পিচে ব্যাট করতে নামতে হল। দিনশেষে ভারত ৭ উইকেটে ৬১। এরপর আবার বৃষ্টি এবং ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। ৩০ ঘণ্টা খেলার ১০ঘণ্টাও খেলা হল না।

মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া ৩৯৪ রানে ইনিংস শেষ করে। ডনের রান ১৩২। ভারতের ইনিংস যখন ৯ উইকেটে ২৯১ (মাঁকড় ১১৬), অমরনাথ বৃষ্টি নামতে ইনিংস ঘোষণা করে দিল। ডনের মনে পড়ল ১৯৩৬-এ ‘গাবি’ অ্যালেনের ইংল্যাণ্ড দলের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচটির কথা। সেই একই পন্থা নিয়ে সেদুই বোলার জনসন ও ডুল্যাণ্ডকে ইনিংস শুরু করতে পাঠাল কালক্ষেপের জন্য— পিচ ভালো হয়ে ওঠার জন্য সময় নিতে। জনসন আউট হতে নামল জনস্টন এবং তারপর সিড বার্নেস। চার উইকেটে ৩২ থেকে মরিস ও ডন জুড়ি রান নিয়ে গেল ২৫৫-য়। মরিস ১০০ ও ডন ১২৭ অপরাজিত। তখন আবার বৃষ্টি নেমেছে। টেস্টের দুই ইনিংসে ডন এই প্রথম দুটি শতরান করল। চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ হল ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস ১২৫ রানে কাদা-পিচে শেষ হওয়ায়। অস্ট্রেলিয়া জিতল ২৩৩ রানে। পিচ আচ্ছাদিত রাখার জন্য ডনের প্রস্তাবে কর্ণপাত করলে ভারতের হয়তো এতটা হেনস্থা হত না।

অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ খেলা হয় খটখটে কড়া রোদে। টসে জিতে অস্ট্রেলিয়া রান তুলল ৬৭৪। ডন করল ২০১। এটি তার জীবনের ৩৭তম দ্বিশত। এতদিন সর্বাধিক দ্বিশত রান করার রেকর্ড ছিল ইংল্যাণ্ডের ওয়ালি হ্যামণ্ডের ৩৬টি। ভারত দুই ইনিংসে ৩৮১ ও ২৭৭ করে ইনিংস ও ১৬ রানে হেরে গেলেও বিজয় হাজারে নিজেকে বিরাট ব্যাটসম্যান হিসাবে প্রতিপন্ন করে দুই ইনিংসে ১১৬ ও ১৪৫ রান দ্বারা। প্রথম ইনিংসে ফাড়কর করে ১২৩। দ্বিতীয় ইনিংসে লিণ্ডওয়াল মারাত্মক বল করে সাতটি উইকেটে পায় ৩৮ রানে। হাজারের খেলা সম্পর্কে ডন প্রথম থেকেই শ্রদ্ধাশীল ছিল। বিশেষ করে হাজারের স্ট্রোক দেওয়ার কেতাবি ধরন, খেলার জমাটি গড়ন, ডনের মনে এমনই রেখাপাত করে যে নির্দ্বিধায় সেহাজারেকে ‘গ্রেট প্লেয়ারদের’ পর্যায়ের স্থান দেয়। এই টেস্টে ১৯ বছরের একটি ছেলে প্রথম খেলতে নামে। নিল হার্ভে। রঙ্গচারির বলে ১৩ রানে এলবিডবল্যু আউট হয়।

ইংল্যাণ্ড সফরে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলীয় দলগঠনের সময় এসে পড়েছে। যাবে কি যাবে না, এই নিয়ে ডন চিন্তায় পড়ল। যাওয়ার ইচ্ছা খুবই, কিন্তু ব্যক্তিগত কাজকর্ম ছেড়ে প্রায় আট মাসের জন্য ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হলে তাকে অনেক কিছুই ভাবতে হয়। যেমন, বয়স প্রায় চল্লিশে পৌঁছেছে। সফরের ধকল সহ্য করার পক্ষে বয়স একটু বেশিই। মাত্র তিন জন অস্ট্রেলীয় বেশি বয়সে ইংল্যাণ্ড সফরে অধিনায়কত্ব করেছে : ১৮৯৩-এ ব্ল্যাকহ্যাম (৪০), ১৯১২-য় সিড গ্রিগরি (৪২) ও ১৯২১-এ আর্মস্ট্রং (৪২)।

১৯২৮-এর টেস্ট দলে যাদের সঙ্গে ডন খেলেছে তারা সবাই অবসৃত। ডন জানে তার ২০ বছরের অভিজ্ঞতার দাম আছে, এটা অস্ট্রেলিয়ার কাজে লাগবে। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে আর একটি সফরে অধিনায়কত্বের বিরাট ধকলটাও যে কেমন হবে তা সেজানে। ১৯৩৮ মরসুম শেষে নিজেকেই সেবলেছিল, ‘আর কখনো নয়।’ এখন আবার তার মনে পড়ল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা, বক্তৃতা দেওয়া, সাক্ষাৎকার ও ফোটো তোলানোর ঝামেলা, ভিড়-জনতা, চিঠির উত্তর লেখা, খেলার কৌশল নির্ধারণের জন্য চিন্তা এবং সর্বোপরি ব্যাট হাতে মাঠে নামা।

যুদ্ধপূর্ব সাফল্য অতিক্রম করা আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যর্থও হতে পারে। প্রাপ্তির কিছু নেই, আছে হারানোর ভয়। যে-খেলোয়াড় জানে না কখন তাকে খেলা থেকে সরে যেতে হবে, তার থেকে করুণাকর আর কেউ হতে পারে না।

ডন জানে, এখন সেখেলা ছেড়ে দিতে পারে। খবরের কাগজ থেকে প্রচুর টাকার, কয়েক বছরে তার মোট আয়ের পরিমাণ যত, প্রায় তত টাকার প্রস্তাব এসেছে সাংবাদিক হয়ে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে এই সফর সম্পর্কে লেখার জন্য। কেন সেখেলা ছেড়ে দেবে না? স্বপক্ষে যত যুক্তি আছে সব ক-টি নিয়েই ডন ভাবল।

কিন্তু সব যুক্তি ভেসে গেল কর্তব্যবোধের কাছে। ক্রিকেট তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, ঋণশোধ করতেই হবে। দেশেরও এখন অধিনায়ক দরকার, এখন খেলা থেকে বিদায় নেওয়া অনুচিত।

ভারতের সঙ্গে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের রাতে মেলবোর্নে ডন সাংবাদিক সম্মেলনে বলল, ‘ইংল্যাণ্ড সফরে যেতে রাজি। এইসঙ্গে জানাচ্ছি, ভারতের বিরুদ্ধে খেলাটিই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আমার শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ইংল্যাণ্ড সফর শেষ হলেই ক্লাব, রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেব।’

পঞ্চম টেস্ট ম্যাচে ব্যাট করার সময় ডন ফাইব্রোসাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ৫৭ রানে অবসর নেয়। অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে ৫৭৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে (হার্ভে ১৫৩, ব্রাউন ৯৯); ভারত ৩৩১ (মাঁকড় ১১১) ও নিখুঁত পিচে ৬৭। ইনিংস ও ১৭৭ রানে জিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতল ৪—০ ম্যাচে। মরসুমে ডন ১২ ইনিংসে আটটি শতরান করে গড় রাখল ১২৯.৬। অষ্টম শতরানটি ইংল্যাণ্ড যাত্রার প্রাক্কালে পার্থে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। টেস্টে ছয় বার ব্যাট করে চারটি শতরান-সহ মোট রান ৭১২; গড় ১৭৮.৭৫। একটি সিরিজে টেস্ট ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড়। প্রথমটিও ডনেরই, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে (২০১.৫০)।

মরসুমে ডনকে বেশ হাসিখুশিই দেখাল। দর্শকরা দেখল, মাঠে সেসহখেলোয়াড়দের সঙ্গে হেসে কথা বলছে, অনেক সামাজিক হয়েছে এবং নির্দয়ভাবে খেলাটা যেন কমেছে। ডন নরম হয়ে এসেছে। এইটিই তার ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর বছর।

১৮. শেষ সফর

অধিনায়কের থেকে যদি দলে তার অধীনস্থ কয়েক জনের খেলার বয়স বেশি হয় তাহলে অধিনায়কের যে কী অসুবিধা হয় সে-অভিজ্ঞতা ডনের আছে। কিন্তু ১৯৪৮-এর ইংল্যাণ্ড সফরের জন্য দলে ৪০ বছর বয়সি ডনই সর্বজ্যেষ্ঠ। দলের কেউ তার বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এমন ভয় নেই। স্বচ্ছন্দ মুক্ত মেজাজে সেতার সৃজনশীল ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত বিচারবোধকে প্রয়োগ করতে পারবে। ডন এমনটিই চেয়েছিল। এমন একটি দল, যাদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রশ্নাতীত হবে, যারা তাকে পিতার মতো অনুভব করবে, উপদেশে কান দেবে, নির্দেশ মেনে চলবে এবং প্রশ্ন তুলবে না।

ডনের ধারণা, যে ক-টি দলের সঙ্গে সেইংল্যাণ্ড সফর করেছে, টেকনিক্যাল দিক থেকে ১৯৪৮ দলটিই তার মধ্যে সেরা। দলে আছে দুজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান বার্নেস ও মরিস, তার সঙ্গে বিল ব্রাউন; তারপর ডন নিজে, হ্যাসেট, হ্যামেন্স, হার্ভে, অলরাউণ্ডার মিলার ও লক্সটন; বোলার লিণ্ডওয়াল, জনসন, ম্যাককুল, রিং ও টোশাক; উইকেট-কিপার ট্যালন ও স্যাগার্স।

অস্ট্রেলীয় দলকে নিয়ে জাহাজ ১৯ মার্চ নোঙর তুলল পারথ বন্দর থেকে, ইংল্যাণ্ডের টিলবেরি বন্দরে পৌঁছোল ১৬ এপ্রিল। এর মাঝে তাদের সই করতে হয়েছে দলের ৫ হাজার গ্রূপ ছবিতে। খেলেছে কলম্বোয়। বোম্বাইয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি অ্যান্টনি ডি মেলো, বিজয় মার্চেন্ট প্রভৃতি ব্যক্তিরা জাহাজে এসে ডনকে ভারতীয় ব্লেজার ও দলের অন্যান্য সদস্যদের টাই উপহার দেন। জাহাজে তার দলের অন্যান্যদের সঙ্গে ট্যাকটিকস বিষয়ে আলোচনা ছাড়াও আর একটি ব্যাপার ডন তাদের মনের গভীরে গেঁথে দেয়—এই দল অপরাজিত থাকার ক্ষমতা রাখে।

এ পর্যন্ত কোনো অস্ট্রেলীয় দল সফরে অপরাজিত থাকেনি। ডন চেয়েছিল ১৯৪৮ সফরে অপরাজিত থাকতে। তার বিদায় মরসুমটিকে স্মরণীয় করে রাখতে।

যথারীতি লাঞ্চ, ডিনার, বক্তৃতা, সংবর্ধনা ইত্যাদির পালা শেষ হয়ে ক্রিকেট শুরু হল। শুধু শেষ হল না চিঠির জবাব এবং স্বাক্ষর দেবার পালা।

১৯৩৮ সফরে টেস্ট ম্যাচ বাদে অন্য সব ম্যাচে টস করার সময় ডন ‘টেইল’ ডেকেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হয় প্রতিটি টেস্টে। ১৯৪৮ সফরে সেস্থির করে টেস্টসমেত সব ম্যাচেই ‘হেড’ ডাকবে। উরস্টারের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ। ডন ‘হেড’ ডাকল এবং টসে হেরে গেল। গত তিনটি সফরে উরস্টারে প্রথম খেলায় ডন দ্বিশত রান করেছে, এবারে করল ১০৭। লেস্টারসের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে ৮১। পরের ম্যাচ ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে, ডন খেলল না। শরীরের কথা ভেবে এবং ক্ষমতা মজুত রাখার জন্য ডন এই সফরে অনেকগুলি ম্যাচ খেলেনি বা একটি ম্যাচে দুই ইনিংসে খেলা এড়িয়ে গেছে। তখনও তার পিঠে ব্যথা রয়েছে।

ইংল্যাণ্ডের আবহাওয়ায় ও মাঠে বেডসার কেমন বল করে এটা জানতে ডন উদবিগ্ন ছিল। ওভালে সারের বিরুদ্ধে ১৪৬ করার পর ডন বোল্ড হয় বেডসারের বলে। হুবহু সেই ধরনেরই বল, যা গত বছর অ্যাডিলেড টেস্টে তাকে ০ রানে ফিরিয়ে দিয়েছিল। লেগ স্টাম্পে পড়ে ছিটকে আসে অফ স্টাম্পে। হ্যাসেটও শতরান করার পর বেডসারের ঠিক এই বলেই বোল্ড হয়। সঙ্গে সঙ্গে ডন অনুভূতিবশেই বুঝে যায়, টেস্ট ম্যাচে এই বোলারটিই অস্ট্রেলিয়ার ভয়ের কারণ হবে।

সাউথ এণ্ড-এ এসেক্সের সঙ্গে খেলা। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিনে তুলল ৭২১। একদিনে এত রান আজও বিশ্বরেকর্ড। ডন করে ১৮৭ রান। দ্বিতীয় দিনে এসেক্সকে দু-বার আউট করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া বুঝিয়ে দেয়, ব্যাটিংয়ে ও বোলিংয়ে এই দল অসাধারণ ক্ষমতা ধরে। লর্ডসে এমসিসি-র বিরুদ্ধে ডন করল ৯৮ এবং ইনিংসে পরাজিত হয় এমসিসি। ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে বৃষ্টিভেজা উইকেটে দুই ইনিংসে ডনের উইকেট পায় ল্যাটা স্পিনার ১৯ বছরের হিলটন। ডন করে ১১ ও ৪৩। হিলটনের এটি প্রথম ম্যাচ খেলা। সারা ইংল্যাণ্ডে মাতামাতি শুরু হল ছেলেটিকে নিয়ে। কয়েকটি কাগজ লিখল, এখুনি একে টেস্ট খেলানো হোক। হিলটন পরে চারটি টেস্ট খেলে ১৪ উইকেট পায় গড় ৩৩.৬৪ রানে—দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের বিরুদ্ধে। তারপর ওকে সবাই ভুলে যায়। এরপর ডন নটিংহামের বিরুদ্ধে ৮৬ ও সাসেক্সের বিরুদ্ধে ১০৯ করে। এবার নটিংহামে প্রথম টেস্ট ম্যাচ।

নটিংহামের আকাশে মেঘ, উইকেট তাজা ঝকঝকে। প্রথম টেস্ট ম্যাচের শুরুর মুহূর্তে ডন টস হেরে ড্রেসিং রুমে এসে বলল, ‘এটা বোধ হয় জীবনের সবথেকে পয়া হার হয়েছে।’ চমৎকার উইকেট, বাতাসে বৃষ্টির আমেজ। শুরুতেই মিলার উড়িয়ে দিল হাটনের মিডল স্টাম্প। দিনের শেষদিকে ইংল্যাণ্ড ইনিংস শেষ হল ১৬৫ রানে।

দ্বিতীয় দিনে মরিস ফিরে আসার পর ডন খেলতে নামে। হ্যাসেটের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে যখন তার ব্যাটিং প্রস্ফুটিত হচ্ছে, ইয়ার্ডলি তখন রক্ষণাত্মক ফিল্ড সাজিয়ে রক্ষণাত্মক বল করতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ডনের রান তোলা বন্ধ করা। বোলারদের অধিকাংশ বল লেগ-স্টাম্পের বাইরে। ওরা ছেড়ে দিতে লাগল। খেলা চলল মন্থর গতিতে, রান উঠেছে আরও মন্থরে। মিডিয়াম পেসার বার্নেটের একটা ওভারে ডন শুধু ব্যাট তুলে বলের দিকে তাকিয়ে থাকে, খেলার চেষ্টা না করে। বল লেগ-স্টাম্পের এক ফুট বাইরে দিয়ে যায়। চায়ের আগে ১৫ মিনিট ডন একটিও রান করল না। দর্শকরা বিরক্ত হয়ে তার উদ্দেশ্যে চেঁচামেচি-বিদ্রূপ করতে থাকে।

তৃতীয় দিনে নতুন বল নিয়ে ইংল্যাণ্ড শুরু করল ১৩০ রানে অপরাজিত ডনের বিরুদ্ধে। আরও ৮টি রান করার পরই লেগ-স্টাম্পের উপর বেডসারের ইন-সুইং বল গ্লান্স করে ব্যাকোয়ার্ড শর্ট লেগে হাটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসে। বলটি ডন না খেললেও পারত। কিন্তু লেগ-সাইডে ফিল্ড সাজিয়ে, লেগ-স্টাম্পে মিডিয়াম পেস ইন-সুইং—অধুনা প্রচলিত এই পদ্ধতির বলকে ডন তীব্র অপছন্দ করে। তার মতে এই ধরনের বলই খেলাকে একঘেয়ে নিষ্প্রভ করে দেয়। তাই বেডসারের বলটিকে সেশাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এরপর প্রতিটি খেলায়ইংরেজ বোলাররা এইভাবে বল করে ডনের উইকেট পাওয়ার চেষ্টা করে।

অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষ হয় ৫০৯ রানে। ইংল্যাণ্ড দ্বিতীয় বারে করে ৪৪১। জেতার জন্য ৯৮ রান তুলতে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে হয় মরিস ও ডনকে। এবারও বেডসার-হাটন জুড়ি ডনকে আউট করে এবং শূন্য রানে। ইংল্যাণ্ডে টেস্ট ম্যাচে এই প্রথম তার শূন্য রান।

লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগে ডন একটি ম্যাচ খেলে ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে। সফরে ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার এটি দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাতে ডন খেলেনি। প্রায় হারের মুখে এসে অস্ট্রেলিয়া সে-খেলায় ৪ উইকেটে জিতেছিল। জয়ের জন্য যখন ৬০ রান দরকার তখন তাদের ষষ্ঠ উইকেট পড়ে ৩১ রানে। হার্ভি ও ট্যালন শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে ৬৩ রানে পৌঁছে দেয়। এবারের খেলা অমীমাংসিত থাকে। ডন করে ৫৪ ও ৮৬।

লর্ডসে ডন টসে জিতল। ইংল্যাণ্ডে দুটি সিরিজে অধিনায়কত্ব করে এই এক বারই মাত্র ডন টসে জেতে। অস্ট্রেলিয়ার ৩৫০ রানের ইনিংসে সেদিল মাত্র ৩৮ রান। আবার সেআউট হয় বেডসারের বলে হাটনের হাতে। ইংল্যাণ্ড ৪০৯ রানে দ্বিতীয় টেস্ট হেরে গেল।

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচের আগে ডন একটি মাত্র ইনিংস খেলে। ওভালে সারের বিরুদ্ধে ১২৮। খেলার শেষে ডন উইম্বলডনে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জন ব্রমউইচকে ফাইনালে হারতে দেখল আমেরিকার বব ফকেনবার্গের কাছে।

যথারীতি বৃষ্টি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যাণ্ড যখন ৩১২ রানে এগিয়ে এবং হাতে সাতটি উইকেট, তখনই বৃষ্টি নেমে দেড় দিন খেলা বন্ধ থাকে। অস্ট্রেলিয়া খেলার বাকি সময় ব্যাট করে কাটিয়ে দেয়। এই টেস্টে ডনের রান ৭ ও অপরাজিত ৩০। ইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংসে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ড করার সময় ডিক পোলার্ডের প্রচন্ডভাবে পুল করা বল সিড বার্নেসের বুকে লাগে। বার্নেস প্রাণে বেঁচে যায় সে-যাত্রা।

দুটি টেস্টে জয় ও একটি অমীমাংসিত। ‘রাবার’ হারবার ভয় থেকে মুক্ত অস্ট্রেলিয়া লিডসে চতুর্থ টেস্ট জিতল ৭ উইকেটে। এই ম্যাচে ৩১ উইকেটে সংগৃহীত হয় ১,৭২৩ রান—টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ বৃহত্তম মোট রান। পঞ্চম বৃহত্তম চতুর্থ ইনিংস রানও (৪০৪-৩ ডি:) হয়েছে এই টেস্টে। ডনের প্রিয় হেডিংলি মাঠ। ইয়র্কশায়ারের ক্রিকেটপাগলরা ভোলেনি এই মাঠে ডনের ঐতিহাসিক কীর্তিগুলি— ১৯৩০-এ ৩৩৪, ১৯৩৪-এ ৩০৪, ১৯৩৮-এ ১০৩। ইংল্যাণ্ডের ৪৯৬ রানের ইনিংসের পর ডন যখন ব্যাট করতে আসে দর্শকরা তুমুলভাবে অভিনন্দন জানায়। ডন রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। যখন মাঠে নামল তখন প্রচন্ড কলরব, তারপর একটু কমে গিয়ে আবার উত্তাল হয়ে ফেটে পড়ল ডন যখন ক্রিজে পৌঁছোয়। টুপি তুলে সেনাড়ল; অভিনন্দন তখনও অব্যাহত। দেশের বাইরে সেএমন স্বতঃস্ফূর্ত স্বাগতধ্বনি কখনো পায়নি। বুকের মধ্যে বাষ্প ঠেলে উঠল। ডন ব্যাট তুলে তাদের অভিনন্দন জানায়। ৩৩ রান করে পোলার্ডের বলে বোল্ড হয়ে সেফিরে আসে। ফেরার পথে তার কানে এল : ‘ঘাবড়াও মাত, আর একটা ইনিংস আছে।’

লিডসে ওরা ডনকে জানে। কোনোভাবেই দ্বিতীয় ইনিংসে ওর শতরান করা কেউ বন্ধ করতে পারবে না। ওরা বন্যার মতো এল এবং বাউণ্ডারি লাইন ছাপিয়ে মাঠে উপচে পড়ল ডনের প্রতিশোধ নেওয়া দেখতে। আম্পায়ার দুজন ব্যর্থ হল দর্শকদের ঠেলে লাইনের ওপারে পাঠাতে। পুলিশও পারল না।

অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৩৮ রানে পিছিয়ে থাকার পর ইংল্যাণ্ড ৮ উইকেটে ৩৬৫ রান তুলে ইনিংস ছেড়ে দেয় ৪০৪ রান ৩৪৫ মিনিটে তুলে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ জেতার সুযোগ দিয়ে। চতুর্থ ইনিংসে চারশো রান! ইংল্যাণ্ডের মাঠে টেস্ট ম্যাচে এর আগে কোনো দল তুলতে পারেনি।

চতুর্থ দিনে ইংল্যাণ্ড চারশো রানে এগিয়ে, রাত্রে ডন ডায়েরিতে লিখল, ‘জেতার জন্য আমাদের ৪০০ রান তুলতে হবে এবং আমার ভয় হচ্ছে হয়তো আমরা হেরে যাব।’

দেখে মনে হচ্ছে উইকেটের দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং দারুণ স্পিন ধরবে। ভারী রোলার চালিয়ে উইকেট ভেঙে দিলে অস্ট্রেলিয়া বিপদে পড়বে এই বিশ্বাসে খেলার শেষ দিনে পাঁচ মিনিট ব্যাট করে ইয়ার্ডলি ইনিংস ঘোষণা করে। এই ভারী রোলার ব্যবহারের সিদ্ধান্তটিই অস্ট্রেলিয়াকে সুবিধা করে দেয়। ভারী রোলার কখনোই উইকেট ভাঙে না। কেননা ক্রিকেট পিচ শক্ত হয় এবং সেটি খেটেখুটে তৈরি করা। মাটি সহজে আলগা হয় না। রোলারের ওজন নির্দিষ্ট এবং তার ভার পিচের উপর চারিয়ে থাকে। ভারী রোলারে পিচ তো ভাঙেই না বরং জমিকে চেপে বসিয়ে দিয়ে সহজ করে দেয় ব্যাটিংয়ের পক্ষে। ইয়ার্ডলির সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল, সেটা ম্যাচের ফলই বলে দিল। এর উপর, উইকেট ভালো হয়ে যাওয়া ছাড়াও স্পিন ধরল অতি মন্থরগতিতে। দলে লেকার ছাড়া খাঁটি স্পিন বোলারও কেউ ছিল না এবং ১৯৪৮-এ লেকার যথেষ্টই কাঁচা ছিল।

অস্ট্রেলিয়ার ৫৭ রানে হ্যাসেট ফিরে আসতেই ভিড় সরিয়ে পুলিশ ডনকে পথ করে দিল মাঠে নামার জন্য। উত্তাল অভিনন্দন মাঠে ভেঙে পড়ল।

ডন চটপট রান তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মরিস এবং সেলাঞ্চের আগের আধ ঘণ্টায় তুলল ৬২ রান। ডনের যখন ৫০, পয়েন্টে ইয়ার্ডলিকে ক্যাচ দিয়ে অব্যাহতি পায়, ৫৯ রানে ক্যাচ দিয়েছিল স্লিপে, দু-বারই কম্পটনের বলে, এরপরই ক্র্যানস্টনকে বাউণ্ডারিতে হুক করেই ডন পাঁজর চেপে ধরে। আবার ফাইব্রোসাইটিস তাকে ধরেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খেলা শুরু করল। হুক করে আবার চার এবং আবার যন্ত্রণা! পোলার্ড তার বুকে মালিশ করে দিল, ইংল্যাণ্ডের একজন ছুটে গিয়ে জল আনল। মাঠের চারধারে তখন নিঝুমতা নেমে এসেছে। শুরু করল ডন আবার। তবে যতটা সম্ভব মরিসকে খেলতে সুযোগ দিয়ে, যন্ত্রণাটা কমার জন্য সময় নিল সেএবং ১৪৭ মিনিটে এইভাবেই সেশতরানে পৌঁছোল। এটি তার জীবনের ১১২তম এবং টেস্টের ২৯তম শতরান।

দ্বিতীয় উইকেটে মরিস (১৮২) ও ডন তুলল ৩০১ রান। নীল হার্ভে যখন বাউণ্ডারিতে বল পাঠিয়ে অস্ট্রেলিয়ার রান তিন উইকেটে ৪০৪ করল, ডনের রান তখন ১৭৩। অস্ট্রেলিয়া ৭ উইকেটে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ জিতল। এরপর ম্যাঞ্চেস্টারের ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে ডন ১৩৩ রানে অপরাজিত থাকে।

ওভালে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ। সফরের শেষ এবং ডনের জীবনেরও। অধিনায়ক হিসাবে ১৯৩৮-র প্রথম সফরে এই মাঠেই ডন নিষ্ঠুর এবং জঘন্যভাবে হেরেছিল। এই মাঠ থেকেই তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পায়ের গোছের হাড় ভাঙায়। এই মাঠেই ইংল্যাণ্ড বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড করে এক ইনিংসে ৯০৩ রান। এ সবই দশ বছর আগের কথা।

টেস্ট শুরুর কয়েক দিন আগে লণ্ডনে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। উইকেট ভিজে বটে কিন্তু নির্জীব। অথচ প্রথম ব্যাট করে ইংল্যাণ্ড আউট হয়ে গেল ৫২ রানে। দুই অঙ্কের রান এক জনই মাত্র করে—লেন হাটন। ইনিংসে শেষ আউট হয় ৩০ রানে। লিণ্ডওয়ালের ছয় উইকেট ২০ রানে। নিজের দেশে এত কম রানে ইংল্যাণ্ড কখনো আউট হয়নি। ১৩০ মিনিটে ইনিংস শেষ।

অস্ট্রেলিয়ার ১১৭ রানে ডন ব্যাট হাতে মাঠে নামল। তুমুল অভিনন্দনে ওভাল ফেটে পড়ল। হঠাৎ ডনের মনে এল ১৮ বছর আগে এই মাঠেই শেষ টেস্ট খেলতে নামা জ্যাক হবসের কথা। ঠিক এইভাবেই তাঁকে সেদিন সংবর্ধিত করেছিল অস্ট্রেলীয়রা। ডনও ছিল তাদের মধ্যে। ওভালে তার প্রথম টেস্ট খেলা। সেই একই দৃশ্য আবার আজ।

ইয়ার্ডলি ‘থ্রি চিয়ার্স’ দেবার জন্য দলের সবাইকে ডেকে আনল উইকেটে। ডনের সৌভাগ্য কামনা করল সেএবং হাজার হাজার দর্শক, যাদের মধ্যে অনেকে ১৫ ঘণ্টা আগে থেকে লাইন দিয়ে টিকিট কেটেছে ডনের শেষ টেস্ট ম্যাচ দেখতে।

ডন, কঠিন নির্দয় ডন ব্র্যাডম্যানের হৃদয়, শীতল পেশাদারি মস্তিষ্ক সম্ভবত এই প্রথম বিচলিত হল সাধারণ মানুষের মতো। অতিমানব নয়, যন্ত্র নয়, সেযে আর পাঁচজনের মতোই আবেগবশীভূত তা এই প্রথম প্রমাণিত হল। জীবনে এই প্রথম সেহারাল একাগ্রতা, অভিনিবেশ। এই মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস শুরু করার অনুপযুক্ত। নটিংহাম, লিডস, ম্যাঞ্চেস্টার এবং লর্ডস মাঠে জীবনের শেষ খেলায় ডন শতরান করেছে। ওভালে নয় কেন?

বোলার ওয়ারউইকাশায়ারের এরিক হোলিজ। কিছুদিন আগে সেতার লেগব্রেক ও গুগলি বলে অস্ট্রেলিয়ার আট জনকে আউট করেছে এক ইনিংসে। প্রথম বলটি ডন খেলল যন্ত্রবৎ, অনেকটা আন্দাজেই। দ্বিতীয় বলটি গুগলি, নিখুঁত লেংথে। ডন ফরোয়ার্ড খেলল, ব্যাটের ভিতরে কানায় লেগে বল… মহাকাব্যের উপযুক্ত পরিণতি দেওয়ার জন্য এই মহাখেলোয়াড়ের অফ-স্টাম্পের বেলটি ফেলে দিল।

মাঠে মহাশ্মশানের নৈ:শব্দ্য। স্বপ্নোত্থিতের মতো ডন স্টাম্পের দিকে তাকিয়ে; বিশ্বাস করতে পারছে না তার খেলোয়াড় জীবনের শেষ পরিণতি। শুধু একটি বার ব্যাট চালিয়ে বাউণ্ডারিতে বল পাঠালেই টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংস পিছু গড় রান হত ১০০। মাত্র চারটি রান দরকার ছিল।

শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতে ইনিংস ও ১৪৯ রানে। খেলাশেষে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হল ওভাল প্যাভিলিয়নের সামনে, তারা ডনকে দেখতে চায়। ডন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কিছু বলতে হবে।

আপনারা কাগজে যা-ই পড়ুন-না কেন, নিশ্চিত করেই বলছি এইটিই আমার শেষ টেস্ট ম্যাচ। এতে আমার ব্যক্তিগত অবদান এত কম, যার জন্য দুঃখবোধ করছি। এর দুটি কারণ— আমাকে দেওয়া অভিনন্দনের বিপুল দাক্ষিণ্য এবং দ্বিতীয়ত, আমাকে যে চমৎকার বলটি করা হয়েছিল।

ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি বলল, ‘ডনকে গুড-বাই বলার সঙ্গে সঙ্গে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারকেই আমরা বিদায় জানাচ্ছি।’

এরপর জনতা গেয়ে উঠল—‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলো।’

ডন ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু-একটা সেলুকোতে চাইছে।

ডন পর পর তিনটি ইনিংসে— জেন্টলমেন, সাউথ অফ ইংল্যাণ্ড ও লেভিসন গাওয়ারস একাদশের বিরুদ্ধে তিনটি শতরান করে সফর শেষ করে। সফর শেষ করবে অপরাজিত থেকে, যা কোনোদিন কেউ পারেনি। সিরিজে ৪-০ জয়ের পরও ডন প্রতিটি খেলা টেস্ট ম্যাচের গুরুত্ব দিয়ে খেলে।

ডন লর্ডসে জেন্টলমেন অফ ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১৫০ করল। সফরে পূর্ণ ফল ২,০০০ রান। চার বার ইংল্যাণ্ড সফরে প্রতি বারই দু-হাজার রান, কোনো দেশের কেউ পারেনি। এই খেলার মধ্যেই ডনের জীবন ৪০ বছর অতিক্রম করে। খেলার শেষে দর্শকরা প্যাভিলিয়নের সামনে জড়ো হয়ে গান ধরে— ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ ডন মনে মনে তখন বলেছিল—যেভাবে খেলা উচিত বোধ হয় সেইভাবেই ক্রিকেট খেলেছি, নয়তো এই ভালোবাসা কেন পাব!

হেস্টিংসে সাউথ অফ ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১৪৩। স্কারবরোয় শেষ খেলায় তিন ঘণ্টায় ১৫৩ করে বেডসারের বল হাটনের মাথার উপর তুলে দিয়ে ডন ছুটতে ছুটতে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসে। ইংল্যাণ্ডের মাঠে ডনের শেষ নিষ্ক্রমণ। একটি যুগের প্রস্থান। চারটি সফরে ইংল্যাণ্ডে তার ১২০তম ইনিংসে ৯,৮৩৭ রান। ইংল্যাণ্ডের মাঠে ডন শেষ খেলায় শেষ ওভারটি নিজে বল করে। এরপর অবশ্য স্কটল্যাণ্ডের অ্যাবারডিনে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির খেলায় ডন দেড় ঘণ্টায় ১২৩ রান করে।

ডন দারুণ খুশি। জীবনের সেরা বাসনা পূর্ণ হয়েছে। ইংল্যাণ্ড সফরে অপরাজিত অধিনায়ক থাকার মর্যাদা সেপেয়েছে। ৩১টি ম্যাচে ২৩ জয় (১৫টি ইনিংসে), ৮ অমীমাংসিত। টেস্ট বাদে কোনো দল ৩০০ রানের ইনিংস করতে পারেনি। টেস্ট খেলোয়াড় বাদে কেউ পারেনি তাদের বিরুদ্ধে শতরান করতে। সফরে অস্ট্রেলিয়া করেছে ১৫,১২০ রান, বিরুদ্ধে হয়েছে ১০,৯৩২ রান। সাত জন অস্ট্রেলীয় হাজার রান পূর্ণ করে। ২৭ রানের জন্য পারেনি লক্সটন। ডন সফরে করে ২,৪২৮ রান, ৮৯.৯২ গড় এবং ১১টি শতরান।

শুরু হল সম্মান বর্ষণ। ইয়র্কশায়ার, ল্যাঙ্কাশায়ার, হ্যামশায়ার ও অন্যান্য ক্লাব ডনকে আজীবন সাম্মানিক সদস্য করল। ইংরেজ নয় এমন একজনকে এই প্রথম ইয়র্কশায়ার এই সম্মান দিল। লণ্ডনের রবিবাসরীয় ‘দ্য পিপল’ সংবাদপত্র ডনের জন্য তহবিল খুলল। সব শ্রেণির মানুষ যাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারে তাই দানের পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয় এক শিলিং। তারা বিরাট বিদায়-ভোজের ব্যবস্থা করল। তাতে এল ইংল্যাণ্ডের সাত জন প্রাক্তন ও নয় জন কাউন্টি অধিনায়ক। অতিথিসংখ্যা দুশো। তাদের মধ্যে অনেকেই মাঠে ডনের বিরোধিতা করেছে। দেখা গেল লিণ্ডওয়ালের পাশে বসে আছেন হ্যারল্ড লারউড!

তহবিলের অর্থে তৈরি বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘ওয়ারউইক ভাস’-এর প্রতিকৃতি ব্রিটেনের ক্রিকেটপ্রেমীদের তরফ থেকে ডনকে উপহার দেওয়া হল এই সংবর্ধনা-ভোজে। নিরেট রুপোর তৈরি ২১ ইঞ্চি উচ্চ এই ভাস যার নকল, সেই আসলটি কিন্তু শ্বেতপাথরের এবং গোলাকৃতি। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুট, ব্যাস ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নির্মিত। স্যার উইলিয়াম হ্যামিলটন নেপলসে চতুর্থ ফার্দিনান্দের রাজদরবারে তৃতীয় জর্জের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে ১৭৭০ সালে রোম থেকে ১২ মাইল দূরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে এই ভাসটি পান। এর গাত্রে কতকগুলি অর্ধপশু-অর্ধমানব মুখ খোদাই করা। মুখের একটি নিখোঁজ। হ্যামিলটন ঠিক করেন তাঁর স্ত্রী লেডি হ্যামিলটনের মুখ সেখানে বসাবেন। এক ইটালির ভাস্করকে তিনি নিযুক্ত করেন। লোকটি রগচটা, ততোধিক লেডি হ্যামিলটনও; ফলে খিটিমিটি ঝগড়া দুজনের মধ্যে বেঁধে যায়। শোধ নেওয়ার জন্য ভাস্করটি লেডি হ্যামিলটনের সুন্দর মুখটি নিখুঁত খোদাই করে কান দুটি করে দেয় গাধার। অতঃপর গৃহশান্তি বজায় রাখতে হ্যামিলটন বাড়ি থেকে ভাসটি বিদায় করতে বাধ্য হন। তিনি মামাতো ভাই ওয়ারউইকের আর্ল-কে সেটি দান করেন।

তহবিলের যে-অর্থ ভাসটি তৈরির পরও রয়ে যায়, ডনের অনুরোধে ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন পার্কে ছোটোদের জন্য কংক্রিট ক্রিকেট পিচ তৈরির জন্য তা ব্যয়িত হয়।

এই সময় একটা ব্যাপার কাগজে সামান্য ঝড় তোলে। বামোরালে ষষ্ঠ জর্জ অস্ট্রেলীয় দলকে রাজপরিবারের সঙ্গে চা-পানের নিমন্ত্রণ করেন। কাগজে ছবি বেরোল ডন ইংল্যাণ্ডের রাজার সঙ্গে কথা বলছে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে। হইচই পড়ে গেল ডনের অসৌজন্য ভঙ্গি নিয়ে। কাগজে চিঠি বেরোল। অপ্রতিভ ডন শুধু এইটুকু বলল, ‘এরকম ক্ষেত্রে লোকে হাত দুটো নিয়ে করে কী?’

জাহাজে অস্ট্রেলিয়া রওনা হওয়ার আগে ডন চিঠি পেল ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব ফিলিপ নোয়েল বেকারের কাছ থেকে:

অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত আর কোনো দল এইরকম নিরবচ্ছিন্ন বিস্ময়কর ক্রিকেট সাফল্য লাভ করেনি। আপনার সাফল্য শুধু মাঠেই নয়। আর কোনো খেলায় কোনো সফরকারী দল আপনার দলের মতো জনপ্রিয় হয়নি, এত সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া উভয়েই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ থাকল। আশা করি আপনি যা করেছেন সেজন্য নিশ্চয়ই গর্ববোধ করছেন।

বলা বাহুল্য, ডন মনের নিভৃতে গর্ববোধ করেছে।

১৯. অ্যারাইজ স্যার ডোনাল্ড

ডন যখন স্বদেশের পথে জাহাজে, তখনই অস্ট্রেলিয়ায় রটে যায়— ব্র্যাডম্যান রাজনীতিতে নামছে। জাহাজেই সেটেলিগ্রাম পেল, গুজবটাকি সত্যি?

অস্ট্রেলিয়ায় তখন এই গুজবটিই একমাত্র আলোচ্য ব্যাপার। কাগজে কাগজে প্রবন্ধ বেরোল, রেডিয়োতে আলোচিত হল, এমনকী অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টেও এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যথারীতি ডনের কাছে তাড়া তাড়া চিঠি এল। কেউ বলছে, রাজনীতিতে নামো, একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেই। কেউ লিখল, গত কুড়ি বছরে বিরাট নাম ও খ্যাতি অর্জন করেছ, রাজনীতিতে যেয়ো না। ওটা নোংরা ব্যাপার, দু-এক বছরের মধ্যেই ঘৃণিত হবে, অসম্মানের বোঝা মাথায় চাপবে।

সেই ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের ব্যাপারটাই আবার ফিরে এল। এত যে ডামাডোল, ডন কিন্তু চুপ। যথারীতি নিজের মতামত নিজের মনেই রেখে দিল। রাজনীতিতে সেআসেনি।

ডনের জন্য মেলবোর্ন মাঠে বেনিফিট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। এক দিকের অধিনায়ক সেনিজে, অন্য দিকের হ্যাসেট। ডন ১২৩ রান করে। যখন ৯৭-এ, জনস্টনের বল হুক করে মিড-অনে বল তোলে। ম্যাককুল ছুটে এসে বলটি হাতে পেয়েও ফেলে দেয়। চেষ্টা করলে কি ক্যাচটা লুফতে পারত না ম্যাককুল? ইচ্ছা করেই কি ফেলে দিল যেহেতু এটা ডনের বেনিফিট ম্যাচ এবং ৫০ হাজার দর্শক মাঠে এসেছে ডনের কাছ থেকে একটি শতরানের প্রত্যাশী হয়ে? হয়তো। হয়তো নয়। ম্যাচটি ‘টাই’ হয়েছিল।

এরপর এল ১৯৪৯-এর পয়লা জানুয়ারি। সবিস্ময়ে পৃথিবী জানল ডন ব্র্যাডম্যান নাইটহুড পাচ্ছে। প্রথম ক্রিকেটার, শুধুমাত্র খেলার জন্যই যাকে এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে। ডনের আগে ও পরে কয়েক জন ক্রিকেটার ‘স্যার’ খেতাব পেয়েছেন; কিন্তু অন্য কারণে, শুধুই ক্রীড়া কৃতিত্বের জন্য নয়।

বছরের শেষ দিনটিতে ডন মেলবোর্ন মাঠে এসেছিল খেলা দেখতে। বহুলোক কাছে এসে অভিনন্দন জানায়। ডন জানে কীজন্য এই অভিনন্দন। কেননা নাইটহুড দেওয়া হবে এটা তাকে জানিয়ে রাখা হয়েছে। সেঅবাক হল, অন্য লোক তা জানল কী করে। সরকারিভাবে ঘোষিত হওয়ার আগে এটা জানিয়ে দেওয়া অশোভনতা। তাই ডন মাঠে সারা দুপুর শুধু না জানার ভান করে যায়। সন্ধ্যা থেকে সেপালিয়ে রইল এক বন্ধুর বাড়িতে। রীতি মান্য করায় ডনের আনুগত্য এমনই কঠোর যে সেখানেও সেমুখ খোলেনি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার পর সেবন্ধুদের খবরটি দেয়। বাড়ি ফেরার পথে ডন খবরের কাগজ কিনে দেখে, তার নাম তালিকায় রয়েছে। ভোরে টেলিফোন এল। মিটাগং-এ বাপের বাড়ি থেকে তার স্ত্রী ফোন করে জানাল, রেডিয়োয় খবরটা শুনেছে।

অ্যাডিলেডে ফিরে এসে ডন অভিনন্দনের বন্যার মুখে পড়ল। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আর চিঠির স্রোত। এরই মধ্যে ডনের খুব ভালো লাগে অসম থেকে ৮ বছরের একটি ছেলের চিঠি। ডন অবাক হয়ে ভাবে, কত জনপ্রিয় সেহতে পেরেছে। গাঁয়ের ছেলে, কোথাও কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, শুধুই নিজের কৃতিত্বে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক; তারপর এই সম্মান! বস্তুত সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠার প্রতীকরূপে ডনকে অস্ট্রেলিয়াবাসীরা বিবেচিত করে থাকে।

ইংল্যাণ্ডের কাগজে কচকচি শুরু হয়েছিল; স্যার ডন না স্যার ডোনাল্ড, কী বলা হবে? ডনের স্ত্রী অর্থাৎ নতুন লেডি ব্র্যাডম্যান জবাব দিয়ে দেয়, ‘স্যার ডোনাল্ড’। মেলবোর্নে পার্লামেন্ট ভবনে অস্ট্রেলীয় গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে ডন ‘নাইটহুড’ গ্রহণ করে।

ফেব্রুয়ারিতে কিপ্যাক্স ও ওল্ডফিল্ডের জন্য আয়োজিত টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচ ডন খেলে সিডনিতে। ৬৫ মিনিটে ৫৩ রান করে তার মাঠকে শেষ অভিবাদন জানায়। অ্যাডিলেডে ফিরে এসে আর্থার রিচার্ডসনের টেস্টিমোনিয়াল হিসাবে চিহ্নিত ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে খেলে। বিল জনস্টনের বলে ৩০ রানে বোল্ড হওয়ার পর ফিল্ড করার সময় পা মুচকে যায়। ১৯৩৮-এ ওভালে এই পা-টিই জখম হয়েছিল। জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচটির শেষের প্রহরগুলি ডন ড্রেসিং রুমে বসে কাটাতে বাধ্য হয়।

খেলার আমন্ত্রণ ডনের কাছে এসেছে কিন্তু পরিষ্কারভাবে সেপ্রত্যাখ্যান করে দেয়। বার বার অবসর নেওয়া আর খেলতে নামা, যারা এই কাজ করে, ডনের ধারণা তারা শুধুই হাস্যকর হয়ে ওঠে। এখন থেকে সেতার শেয়ার দালালি ব্যবসায়েই মন দেবে। তবে হালকা মেজাজের, অ্যাডিলেড শেয়ার দালালদের বাৎসরিক ম্যাচের মতো খেলায় তার আপত্তি নেই।

এখন থেকে ডন তার শেয়ার দালালি ব্যবসায়েই ব্যস্ত থাকল। অ্যাডিলেডে এলেই আগন্তুকদের চোখে পড়ে ট্রামওয়ে টার্মিনালের কাছে ‘ডন ব্র্যাডম্যান অ্যাণ্ড কোং’ সাইনবোর্ডটি। অন্যান্য ব্যবসায়েও ডন আগ্রহী। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরপদেও তাকে দেখা গেল। শরীর পোক্ত রাখার জন্য সপ্তাহান্তে এখন সেগলফ খেলে। বাড়িতে বিলিয়ার্ডস টেবিল পাতল এবং কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে বিলিয়ার্ডস খেলে সন্ধ্যা কাটায়। ক্রিকেটে সেনির্বাচক, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এবং জাতীয় দলের।

শুধু একটি ব্যাপার ডনের মানসিক শান্তি হরণ করেছে— তার মেয়ে শার্লি পঙ্গু। ছেলে জন বাবার মতোই ক্রিকেটে আগ্রহী এবং স্কুলে ভালোই নাম করে ব্যাটসম্যান হিসাবে। কিন্তু ১৪ বছর বয়সে হঠাৎ সেআক্রান্ত হল পোলিওয়। কোনো সান্ত্বনাই ডনকে কেউ তখন দিতে পারেনি।

নির্বাচকের পদ ডন ছেড়ে দিল। তার কথা : ‘জনকে আমায় এখন সময় দিতেই হবে; সুতরাং দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার মতো কাজ আমি নিতে পারব না। আমার পরিবারের, ক্রিকেটের এবং নিজের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হলে নির্বাচকের পদটি আমার অন্য কাউকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’

কিন্তু এক বছরের মধ্যেই অকল্পনীয় ব্যাপার ঘটল। জন সুস্থ হয়ে উঠেছে। পরের বছরই সেক্রিকেট, সাঁতার এবং দৌড় শুরু করল। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮-র মধ্যে স্প্রিন্ট এবং হার্ডলসে অস্ট্রেলীয় স্কুল ও কলেজের কয়েকটি নতুন রেকর্ডও করল। ১৯৫৯-এ কুড়ি বছর বয়সে জন প্রথম শতরান করে আন্তঃকলেজ ম্যাচে। তার প্রত্যাবর্তন তার বাবার থেকেও বিস্ময়কর।

ডন আবার ফিরে গেল নির্বাচকপদে। কিন্তু স্বাস্থ্য আর পুরোপুরি ফিরল না। ১৯৫৪-য় সেস্টক এক্সচেঞ্জ থেকে পদত্যাগ করে। তখন সেবলে, ‘গত তিরিশ বছর ধরে শরীর ও মনে আমার যে ধকল ও টানাপোড়েন গেছে তা একমাত্র আমার ঘনিষ্ঠরাই জানে। সহজ শান্ত জীবনযাপনের জন্য ডাক্তারের নির্দেশে অবাক হবার কিছু নেই, এটা বিস্বাদকরও মনে হচ্ছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের কাজের দায় নামিয়ে দিতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।’ ডনের অন্যান্য বিবৃতির মতো এতেও অনেক অকথিত বস্তু রয়ে গেল।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে ডন সব কিছুই সহজে পেয়েছে। তার খেলার প্রতিভাই তাকে যশ, সম্মান ও বিত্ত এনে দিয়েছে।

ক্রিকেটই যে তাকে জীবনের অন্যান্য দিকের পথ খুলে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রত্যেকটিতে সফল হওয়ার জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ভুললে চলবে না, ছুতোরের ছেলেটিকে শিক্ষিত হয়ে ওঠার জন্য একা একাই বই পড়ে রুচি ও জ্ঞান আহরণ করতে হয়েছে। ‘গেঁয়ো ক্রিকেটার’ বলে একদা তাকে হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে। রোগ ও ভগ্নস্বাস্থ্য এবং দুঃখদায়ক পারিবারিক ঘটনার সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। যখন তার চাকুরিদাতা দেউলিয়া হয়ে গেল তখন নিজের ব্যাবসা প্রচন্ড পরিশ্রমে সেগড়ে তোলে।

ডনের ক্রিকেট লক্ষ লক্ষ মানুষের আনন্দের কারণ হয়েছে বটে, কিন্তু তা শুষে নেয় তার দেহশক্তির ভান্ডার। তবু সারাজীবন ডন মাথা উঁচিয়ে চলেছে—কোনো রাখঢাক নেই, আত্মমর্যাদায় দৃপ্ত।

২০. প্রবাদ এবং মানুষটি

ক্রিকেটের ইতিহাসে কোথায় কোন ক্রিকেটারের স্থান হবে, তাই নিয়ে তর্ক চলবে যতদিন ক্রিকেট বেঁচে থাকবে।

ডনের স্থান কোথায় হবে?

যেকোনো ব্যাটসম্যানের থেকে সেবেশি প্রথম শ্রেণির দ্বিশত ও ত্রিশত রান করেছে।

একদা সর্বোচ্চ রান ছিল তারই—অপরাজিত ৪৫২। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে শতরান করেছে, এক দিনে করেছে ৩০০ রান। পর পর ছয় ইনিংসে ছয়টি শতরান আছে তার।

টেস্ট ক্রিকেটে তার থেকে বেশি রান আছে অন্যের, কিন্তু গড় ৯৯.৯৪? ধারেকাছে কেউ নেই। টেস্টে আশি ইনিংসে ৬,৯৯৬ রান এবং দশ বার অপরাজিত থাকার সুবাদে এই গড়। মাত্র চার রান অর্থাৎ বাউণ্ডারিতে এক বার বল পাঠালেই তার টেস্ট গড় ১০০ হত। ওভালে তার শেষ টেস্ট ম্যাচে হোলিজের বলটি না ফসকিয়ে যদি কোনোভাবে বাউণ্ডারিতে পাঠাতে পারত…

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৩৮ ইনিংসে তার মোট রানসংখ্যা ২৮,০৬৭। ইনিংসপিছু গড় ৯৫.১৪ রান। এতে আছে ১১৭টি শতরান। ইংরেজ ছাড়া আর শুধু সোবার্সই মাত্র ডনের মোট রানসংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে।

সারাজীবনে ডনের রানসংগ্রহের গড় হার ঘণ্টায় ৪২-এরও বেশি। বহু ক্ষেত্রে হারটা ৬০ রানেরও বেশি। একটিতে সেঘণ্টায় গড়ে ৯৪.১ হারে রান তুলেছে।

ডন ছিল বিশ্বের দ্রুততম ফিল্ডারদের একজন। প্রচন্ডভাবে বলকে তাড়া করে ছুটত, শূন্যে ক্যাচ তুলে নিত, অবিশ্বাস্য গতিতে উইকেটে ফিরিয়ে দিত।

বিরাট এবং শ্রদ্ধেয় অধিনায়ক ছিল।

ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি, ১৯৪৮-এ ডনের এক বিদায় সভায় ওঁর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার’। এই বিশেষণটিকে নিয়ে তর্কে প্রবৃত্ত হবে এমন লোকের সংখ্যা নিশ্চয়ই খুব কম। অনেকের মতে ডন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। জ্যাক হবসের ভক্তরা দাবি করেন ভিজে উইকেটে ডনের ব্যাটিংক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এজন্যই হবসের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে না। ডনের অনুগামীরা বলবেন, তাতে কী হয়েছে, শেষপর্যন্ত তো ডনই বেশি রান করেছে। ডনের টেস্ট গড় প্রায় ১০০, আর হবসের ৫৬.৯৪। তারা দেখাতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হবস প্রতি ছয় ইনিংসে একটি শতরান করেছে, ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ডনের শতরান প্রতি তিন ইনিংসে।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টর ট্রাম্পারকে অনেকেই চিরকালের সেরা ব্যাটসম্যান বলে থাকেন। ডন-অনুগামীরা বলবেন, ট্রাম্পারের গড় মাত্র ৩৯.০৪ এবং নয়-বার উইকেটে গিয়ে একটি শতরান করেছেন।

বস্তুত এভাবে তুলনা করার কোনো সার্থকতা নেই। ট্রাম্পার খেলেছেন ১৮৯৪ থেকে ১৯১৪; হবস ১৯০৫ থেকে ১৯৩৪ আর ডন ১৯২৭ থেকে ১৯৪৮।

ডন কখনো ট্রাম্পারকে খেলতে দেখেনি। ট্রাম্পারের আর ব্র্যাডম্যানের যুগের যোগসূত্র হবস। এই সময়ের মধ্যে পিচ এবং বোলিং টেকনিক বদলেছে, ফিল্ড সাজানোতেও পরিবর্তন ঘটেছে। তা ছাড়া ট্রাম্পার ও হবস ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান, ডন নামত তিন নম্বরে। তর্কের সময় সাধারণত এই কথাটা ওঠে যে, হবস ও ট্রাম্পার আরও ‘সম্পূর্ণ’ ব্যাটসম্যান। ডনের থেকে তাদের স্ট্রোকে পালিশ আরও বেশি। তবে সবাই স্বীকার করেন ডনই বৃহত্তম রান সংগ্রাহক। ওর উচ্চ রানের ইনিংসগুলি এমনই ও প্রায়শ ভয়ংকরভাবে গড়ে উঠত যে একসময় নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন :

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওর সমগ্র খেলার জীবনে, যদি ম্যাচ খেলার আগে ওকে কিনে নেওয়ার বা আপোশ করার কোনো আইনানুগ উপায় থাকত তাহলে অধিকাংশ বোলারই ওকে কিনে ফেলত বা ব্যাট করবে না এই শর্তে ১০০ রান উপহার দিত।

দুঃখের কথা, ডন যন্ত্রের মতো রান তুলত এই ধারণাটাই বেশি চালু রয়ে গেছে। বিপুল হারে রান সেঅবশ্যই উৎপাদন করেছে, কিন্তু রানগুলির পিছনে ছিল কল্পনা, চিন্তা ও দুঃসাহস; এটা অনেকেই মনে রাখে না।

ডন ক্রিকেট ব্যাট তুলে রাখার পর থেকেই মাঠে মাঠে দর্শকসংখ্যা হ্রাস পায়। দর্শনির অঙ্ক কমে যায়। তারপর ইংল্যাণ্ডে যত অস্ট্রেলীয় দল সফরে গেছে, কেউ আর ভক্তবৃন্দের সেই পরিমাণ চিঠি পায়নি— ডন ও তার দল যত পেয়েছিল।

গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে। কোনোরকম সুযোগ বা সুবিধা নিয়ে ডন ক্রিকেটে আসেনি। নিজেই খেলা শিখেছে, একাকী। কিন্তু ক্রিকেটে সেনিয়ে আসে তোলপাড়-করা চাঞ্চল্য,প্রবল প্রেরণা আর একাগ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সফরে হোটেলের ঘরে টাইপরাইটার নিয়ে বসে সেএক-এক বারে ষাটটি চিঠির জবাব দিত।

ইংল্যাণ্ডে ১৯৪৮-এর সফরে এক ক্রিকেট ব্যাটপ্রস্তুতকারী কয়েক হাজার ব্যাটে সই দেওয়ার জন্য ডনের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রস্তুতকারী এজন্য কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে ধরে নিয়েছিল। একদিন ভোরে ডন ব্যাট তৈরির কারখানায় হাজির হয়ে, গা থেকে কোটটি খুলে, ব্যাট নিয়ে বসল। মাঝে চা খাওয়ার জন্য থামা ছাড়া, ডন সেইদিনই কাজটা শেষ করে দেয়।

বলা হয় ডন নির্দয়ভাবে খেলত। কঠিনভাবেই ডন খেলেছে, কিন্তু হীনতা কখনো প্রশ্রয় পায়নি। বলা হত ডন অসামাজিক। ল্যাঙ্কাশায়ার সম্পাদক তাকে ক্লাবের সদস্যপদ দিয়ে যে-চিঠি লেখেন তাতে বলা হয় :

আমার কমিটি একথাটাও নথিভুক্ত করে রাখতে চায় যে, আপনার ব্যক্তিগত মাধুর্য, সৌজন্য, প্রীতিপূর্ণ সখ্যতা, সম্পূর্ণ দক্ষতা ও বিনয়গুণেই আজ ক্রিকেট এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।

ডনের মনের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু বহু খেলোয়াড় তাকে বন্ধু হিসেবেই পেয়েছে। ১৯৫২-৫৩-তে জ্যাক চিথামের দক্ষিণ আফ্রিকা দল যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে ডন তাদের কাঁচা খেলোয়াড়দের নেটে নিয়ে গিয়ে, কতকগুলো স্ট্রোক কীভাবে করতে হয় দেখিয়ে দিয়েছিল। বহু সময় ডন চিঠি লিখে খেলোয়াড়দের ত্রুটি জানিয়ে দিত, যাতে তাদের সাহায্য হয়। ১৯৪৬-৪৭ অস্ট্রেলিয়া সফরে ডেনিস কম্পটনকে তার কতকগুলো ত্রুটি দেখিয়ে দিয়েছিল। অথচ তখন দ্বিতীয় টেস্ট চলছে এবং ডন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক। অমরনাথ বলেছিলেন :

ওঁর বিরুদ্ধে খেলতে ভালোবাসি এবং আমার সব খেলোয়াড়দেরও এই অভিমত কারণ উনি বিরাট খেলোয়াড় ও আদ্যন্ত ভদ্রলোক। প্রায়ই খেলার পর ব্র্যাডম্যান আসতেন এবং ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে কী কী ত্রুটি ঘটছে এবং কীভাবে সেগুলো শোধরানো যায় আমাদের খেলোয়াড়দের তা বলতেন।

ডন ক্রিকেটকে ভালোবাসে। খেলা ফেলে ক্রিকেট ভাঙিয়ে সেটাকার পিছনে কখনো ছোটেনি। ১৯৩৬-এ তাকে টোপ দেওয়া হয় টেস্ট ম্যাচ খেলার বদলে যদি রিপোর্ট লেখে তাহলে সেহাজার পাউণ্ড পাবে। ডন প্রত্যাখ্যান করেছিল। ১৯৩৬-এ মরসুমশেষে তার কাছে প্রস্তাব আসে, নিউজিল্যাণ্ডে ক্রিকেট সম্পর্কে দিনে পনেরো মিনিটের দুটি বক্তৃতা যদি দেয়, তাহলে সপ্তাহে ১০০ পাউণ্ড ও যাবতীয় খরচখরচা পাবে। ডন যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য সপ্তাহে এক হাজার পাউণ্ডের প্রস্তাবেও ডন সাড়া দেয়নি। ১৯৪৮-এ ইংল্যাণ্ডের সংবাদপত্রগুলি আরও বেশি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল, ডন খেলার জন্য তাও অগ্রাহ্য করেছিল।

বাওরালের শৈশব থেকে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্র ‘ক্যানবেরা টাইমস’ ১৯৪৮-এ ডনের অবসর নেওয়ার সময় যে-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে তা থেকে উদ্ধৃত করে বলা যায় :

এই সুদীর্ঘ সময়কালে তিনি লক্ষ লক্ষ কন্ঠ থেকে উল্লাসধ্বনি নি:সৃত করিয়েছেন এবং কোনো ধ্বনিতেই হিংস্রতা বা অসদিচ্ছা জড়িয়ে ছিল না। যদি হিসাব সম্ভব হয় তাহলে দেখা যাবে হিটলারের দাবিকৃত বা সংগঠিত যত ধ্বনি উত্থিত হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসধ্বনি ততটাই পেয়েছেন ব্র্যাডম্যান। হিংস্রতার মানবটি নিজের ধ্বংস নিজ হাতেই করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনও মারা যাচ্ছে এবং তার কাজের জন্য কষ্টভোগ করছে।

কিন্তু এমন কোনো নারী, পুরুষ বা শিশু নেই যে ব্র্যাডম্যানের খেলার জীবন থেকে সহানুভূতি ও প্রেরণা ছাড়া আর কোনো ক্লেশ পেয়েছে। বিশ্ব-ইতিহাসে বরণীয়রূপে যাচাই হওয়ার এইটাই কষ্টিপাথর।

আর ডন বলেছে :

আমার জন্মের বহু আগে থেকেই ক্রিকেট খেলা চলেছিল, আমার মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরও খেলা চলবে। ঠিক যেভাবে একজন পিয়ানোবাদক বিঠোফেনের রচনাবলি ব্যাখ্যা করে, সেইভাবেই আমার বোধ-বুদ্ধি-ক্ষমতা অনুসারে ক্রিকেটের চরিত্রকে জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করার সুযোগ খেলার জীবনে পেয়েছিলাম।

…ভবিষ্যতে যে-মানুষেরা আমাদের ভাগ্যকে পথ দেখিয়ে দিয়ে যাবে, তাদের দরকার হবে সাহস, উদ্যম এবং শান্ত বিচারবোধ। তাদের সজাগ থাকতে হবে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে।

সন্দেহ নেই, ক্রিকেটের আইন এবং এই খেলার পরিচালন পদ্ধতি বিশ্বের কাছে এক বিরাট দৃষ্টান্ত। এই উত্তরাধিকারটি সম্পর্কে আমাদের সকলের গর্ববোধ করা উচিত…

এবং ক্রিকেট গর্ববোধ করে তার ডনের জন্য। বিশ্বের কাছে সাহস, উদ্যম এবং শান্ত বিচারবোধের বিরাট দৃষ্টান্ত ক্রিকেটের ডন।

২১. ৯০ বছর ডন

১৯৯৮-এর ২৭ আগস্ট ডন পূর্ণ করল ৯০ বছর বয়স (জন্ম ২৭ আগস্ট, ১৯০৮)। হৃৎপিন্ডের অবস্থা ভালো নয়, দু-পায়ে আগের মতো জোরও নেই। ৬৫ বছর সুখে-দুখে একসঙ্গে কাটিয়েছেন যার সঙ্গে, স্ত্রী জেসি এগারো মাস আগে মারা গেছে ক্যান্সারে। সেইসঙ্গেই ডনের প্রাণশক্তির একটা বড়ো অংশও হারিয়ে গেছে। জেসি ছিল তার অনুপ্রেরণা; তার পরামর্শদাত্রী; তার গহন চিন্তার শরিক; তার আত্মার দোসর; তার সব কিছু। ৭০ বছর ধরে বিশাল খ্যাতির অধিকারী ডনের সঙ্গে বিপুল-সংখ্যক মানুষের পরিচয় ঘটেছে বটে কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুসংখ্যা খুব স্বল্পই, তাদেরই একজন ছিল জেসি। স্ত্রী মারা যাবার পর এক বিশাল শূন্যতা তাকে গ্রাস করলেও, শরীর অশক্ত হয়ে পড়লেও ডনের চিন্তাক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি অটুট রয়ে গেছে ২০-৩০ বছর আগের মতোই। ডনের ৯০তম জন্মদিনটি ছিল স্মৃতির ভারে বিষণ্ণ একটি দিন। গতবছর স্বামীর ৮৯-তম জন্মদিনে জেসি অ্যাডিলেডের কেনসিংটন পার্ক অঞ্চলে তাদের হোল্ডেন স্ট্রিটের বাড়ির দোতলা থেকে নেমে এসেছিল শেষ বারের মতো ডনের জন্মদিন পালন করতে। শেষজীবনে জেসির লক্ষ্য ছিল তিনটি সাধ পূরণ করা— ৩০ এপ্রিল তাদের ৬৫তম বিবাহবার্ষিকী পালন, ১১ জুন তার ৮৮তম জন্মদিন পালন এবং ২৭ আগস্ট স্বামীর ৮৯তম জন্মদিন পালন। জেসি মারা যায় ১৪ সেপ্টেম্বর।

তবে তার বিষণ্ণ অস্তিত্ব ভেদ করে এক উজ্জ্বল আলোর রেখা ডনের জীবনকে বিদ্ধ করে—৫৯ বছর বয়সি পুত্র জনের সঙ্গে আবার তার মিলন। বাবার খ্যাতির বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত, সংবাদমাধ্যমের অবিরাম কৌতূহলী জিজ্ঞাসায় অতিষ্ঠ হয়ে জন ২৬ বছর আগে বাবার জীবন ঢেকে-দেওয়া বিপুল খ্যাতির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নামের পদবি অ্যাফিডেট দ্বারা বদলে ব্র্যাডসেন করে নেয়। পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেলেও জনের সঙ্গে বাবা-মা-র যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে। ছেলে পদবি বদল করায় ডন আঘাত পেলেও তাকে দোষ দেয়নি, কারণ সেজানে পাবলিসিটি নামক অভিশাপ ছোবল দিলে কী বিষযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

লেডি ব্র্যাডম্যানের দীর্ঘ অসুস্থতা এবং মৃত্যুই বাবা ও ছেলের মধ্যে মিলন ঘটায়, হোল্ডেন স্ট্রিটের বাড়িতে জেসি যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখন জন মায়ের শয্যাপাশে বহু রাত জেগে কাটিয়েছে, মায়ের মৃত্যুর পর তার জন্য শোকস্মরণ সভার আয়োজন করেছে সুচারু ও শোভনভাবে, এ সবই ডনকে গভীর নাড়া দিয়ে যায়। অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ে জন আইনের অধ্যাপক। প্রতিদিন কাজের পর রাত্রে সেনিয়ম করে এখন নি:সঙ্গ বাবার সঙ্গে কথা বলে। ডনের ৯০তম জন্মদিনে অ্যাডিলেড কনভেনশন সেন্টারে ১১০০ লোক ডনের সম্মানে আয়োজিত ডিনারে যোগ দেয়। এজন্য মাথাপিছু তাদের দক্ষিণা দিতে হয় ১২৫ অস্ট্রেলীয় ডলার (৩১২৫ টাকা প্রায়)। স্টেট লাইব্রেরি অফ সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় ব্র্যাডম্যান সংগ্রহশালার রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য তহবিল সংগ্রহ ছিল এই ভোজসভার উদ্দেশ্য। তারা যখন ভোজসভায় ডনের উদ্দেশ্যে পানপাত্র তুলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিল ঠিক তখনই ডন হোল্ডেন স্ট্রিটের বাড়িতে ছেলে (জন), মেয়ে (৫৭ বছরের শার্লি) ও নাতি-নাতনি (জনের ছেলে ১৭ বছরের টম ও মেয়ে ১৯ বছরের গ্রেটা-র সঙ্গে নিভৃতে জন্মদিন পালন করছিল।

৯০তম জন্মদিনে ডন শুধু দুজন লোককে তার সঙ্গে এক ঘণ্টার জন্য সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল। ভারতের শচীন তেণ্ডুলকর ও অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন ছিল সেই দুই সৌভাগ্যবান। এই প্রথম দুজনে মুখোমুখি হল ডনের। চেন্নাইয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের কন্ডিশনিং ক্যাম্প থেকে তেণ্ডুলকর এই বিরল সৌভাগ্যলাভের জন্য অ্যাডিলেডে উড়ে যায়। ডনের সামনে সেপ্রচন্ড নার্ভাস বোধ করেছিল, কিন্তু অচিরেই সেআশ্বস্ত হয় যখন সেজানল— ডন বর্তমানের ক্রিকেটারদের অনুরাগী, সীমিত ওভারের খেলা ডন নিয়মিত দেখে এবং ক্রিকেট সম্পর্কে সাবেকপন্থীদের মতো নাক সিঁটকানো ভাব নেই, ডনের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক ও প্রগতিশীল। তেণ্ডুলকর জানতে চেয়েছিল, ম্যাচ খেলার জন্য ডন কী প্রস্তুতি নিত? ডন বলে সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত অফিসে কাজ করে, ম্যাচ খেলে ফিরে এসে আবার সেকাজ করতে যেত। তখন ক্রিকেটাররা সম্পূর্ণতই ছিল অ্যামেচার। ভোজসভায় ব্র্যাডম্যানের ছবি, পেইন্টিং, আবক্ষমূর্তি, ব্যাট এবং অন্যান্য দ্রব্যের নিলাম হয়, তাতে সংগৃহীত হয় প্রায় ১৯ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে আছে এক লক্ষ টাকায় তেণ্ডুলকর-ক্রীত ব্র্যাডম্যানের একটি স্বাক্ষরিত ছবি—মেলবোর্নে তার টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচে ১৯৪৮ ডিসেম্বরে ব্যাট করতে যাচ্ছে। ডন জীবনের শেষ ও ১১৭তম শতরানটি এই ম্যাচেই করে। ডনের সঙ্গে তেণ্ডুলকরের একটি ছবি মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব নিলামে কিনে নেয় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকায়।

ডন এখনও প্রতিদিন চার ঘণ্টা সময় দেয় সারা বিশ্ব থেকে পাঠানো চিঠিপত্র পড়ায় ও উত্তর দেওয়ায়। যাবতীয় সইয়ের মধ্যে সবথেকে দামি সইটি পাওয়ার জন্য এত চাহিদা যে সাউথ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের নিরস্ত করার জন্য দক্ষিণা আদায়ের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। বহু ক্লাব ডনের সই নিলামে বিক্রি করে তাদের খরচ চালায়।

ডনের স্মৃতিশক্তি যে এখনও কতটা তীক্ষ্ণ রয়েছে তার একটা উদাহরণ দিয়ে বাওরালের ব্র্যাডম্যান মিউজিয়ামের ডিরেক্টর বলে :

সম্প্রতি আমাদের আর্টিস্টের দরকার পড়ে ১৯৩০ সালে ইংল্যাণ্ডের হেডিংলি মাঠে একটা গ্র্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডের রঙ কেমন ছিল সেটা জানার। ছবি যা পাওয়া গেছে তা সাদাকালো। ডনকে জিজ্ঞাসা করায় রং কেমন ছিল বলে দিলেন।

ডন তার সাদা রঙের হোল্ডেন অ্যাপোলো মোটর গাড়ি এখনও নিজেই চালায়। সেখুবই মজা পায়, সম্প্রতি চক্ষু পরীক্ষার পর যখন জানতে পারে ২০০২ সাল পর্যন্ত তাকে নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স করাবার জন্য টাকা দিতে হবে না। যখন চিঠিপত্র লেখার কাজে সেব্যস্ত থাকে না তখন তার নিজের নামের ফাউণ্ডেশন, মিউজিয়াম, সংগ্রহশালা সম্পর্কিত কাজকর্ম দেখাশোনা করে। অবসর পেলে বই পড়ে, জীবনী ও আত্মজীবনী— ডন কখনো গল্প-উপন্যাস পড়ে না। মাঝেমধ্যে খুব নি:সঙ্গ বোধ করলে সেএকান্তে বসে ভিডিয়ো টেপে দেখে জেসির অন্তিম যাত্রার আর শোকস্মরণ সভার ছবি।

Exit mobile version