কথাটা ঠিক। এই ছোট্ট জমিতে ছোটবেলাটা কাটিয়ে ছেলেরা বড় মাঠে চলে যায় বড় হওয়া মাত্র। আনন্দ ফুটবল খেলে না আর। ভাল লাগে না। টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার স্তরও পেরিয়ে গেছে। বটতলার মাঠ থেকে গতবছরই সে নেতাজি পার্কে চলে এসেছে। মাঠে এখন যারা খেলে তাদের অনেকেই আনন্দর অচেনা। মাঠটাতে ঘাস নেই। বর্ষায় লরির চাকা যে গর্তগুলো করে, সেগুলো রোদে শুকিয়ে স্থায়ী হয়ে রয়েই যায়। যত্ন করার কেউ নেই। ডগুদার কথাটাই ঠিক, এ-মাঠের বাপ-মা নেই। আসলে, মাঠটার মা নেই।
ঘুমটা ভাঙল দুপুরে। সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। প্রচণ্ড খিদে পেটের মধ্যে দাউদাউ করছে। হাবুর মা ঘরের দরজার বাইরে ঠাণ্ডা মেঝেয় ঘুমোচ্ছ। ওকে জাগিয়ে কিছু খেতে দেবার কথা বললেই বিপদ। জ্বর হয়েছে শোনার পরই বার্লি এনে দেবার জন্য বিপিনদাকে বার দুয়েক বলেছে। আনন্দ ধরেই নিল, তার জন্য বার্লি তৈরি হয়ে আছে। পা টিপে টিপে হাবুর মার পাশ দিয়ে সে নীচে রান্নাঘরে এল। রাত্রের খাবার রান্না করাই থাকে। লাউ-চিংড়ি, ঘন মুগের ডাল, বেগুন ভাজা আর পেঁপের চাটনি ঢাকা দেওয়া রয়েছে। রাত্রে শুধু রুটি তৈরি হবে। প্রত্যেকটি থেকে কিছু কিছু নিয়ে খেয়ে আনন্দ ঝরঝরে বোধ করল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে রওনা হয়ে গেল নেতাজি পার্কের উদ্দেশে কিটব্যাগ হাতে।
.
০৩.
অ্যান্ডি, দেরি হল যে, বুকের ব্যথাটা কেমন?
ঠিক হয়ে গেছে। নেটের পিছনে মাটিতে বসে বুট পরতে পরতে আনন্দ বলল। কোচ কাছে এসে ঝুকে দাঁড়ালেন।
নতুন বল রেখেছি তোমার জন্য। জোরে করবে না। আগে বলের সুইং কন্ট্রোলে রেখে লেংথ আর ডাইরেকশনে মাস্টারি আনা, তারপর পেসের কথা ভাবা যাবে। ফাস্ট বোলিং মানেই শুধু জোরে বল করা নয়। চকচকে বলের সঙ্গে আঙুলের ভাব জমাও।
কোচ পকেট থেকে একটি বল বার করলেন। পাকা আপেলের রঙ। দেখেই লোভীর মতো চিকচিক করল আনন্দর চোখ।
কাউকে দিইনি এতক্ষণ। তরুণ ব্যাট করবে, টেকনিক ভাল, মাথাটা ঠাণ্ডা। ওকে মন দিয়ে বল করবে। মার খেলেও মাথা গরম করবে না। জোরে বল দেবার চেষ্টা করবে না। সুইংয়ে বিট করাই হবে তোমার উদ্দেশ্য।
আনন্দর ভয় ছিল, বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানিটা হয়তো শুরু হবে। ইনসুইং গ্রিপে চার পাঁচ কদম ছুটে এসে পুরনো বলে কয়েকটা বল করল। শ্বাসকষ্ট হল না।
ঠিক আছে, নতুন বল আনন্দর হাতে তুলে দিয়ে কোচ চেঁচিয়ে বললেন, ডেনেস, হয়ে গেছে সময়, এবার টার্নার যাবে।
দেবেশ একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েই বেরিয়ে এল। এইমাত্র সে পরপর তিনটে স্কোয়ারকাটে নেট ঝাঁকিয়েছে। তরুণ নেটে ঢুকে বিজ্ঞের মতো লেগ স্টাম্পের সামনে ব্যাট খাড়া করে ওয়ান লেগ গার্ড চাইল একজন বোলারের কাছে।
নতুন বল নিয়ে আনন্দ এই যে প্রথম বল করছে, তা নয়। কিন্তু তিন আঙুলে ধরে, হাত থেকে ছাড়ার সময় কান-ঘেঁষা হাতটাকে অনেক উঁচু থেকে চাবুক মারার মতো নামিয়ে আনা, তালুটাকে লেগ সাইডের দিকে ফিরিয়ে রাখা—এভাবে কোনওদিন বল করতে সে বাধ্য হয়নি। ভয়ে ভয়ে আস্তে বল করতে লাগল। মাথার মধ্যে আছে শুধু একটা কথা-লেংথ এবং শুধুই লেংথ।
দুটো বল ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে ও গোটাচারেক ছেড়ে দেবার পর তরুণ একটা ফুলটসকে অফ ড্রাইভ করল চমৎকার স্টাইলে। কান দুটো গরম হয়ে উঠল আনন্দর। বিড়বিড় করল: মাথা ঠাণ্ডা, অ্যান্ডি, মাথা ঠাণ্ডা রাখো। শ্বাস নিতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহ্যে আনল না। এবার বলে একটু জোর আনল।
পিছিয়ে ব্যাকফুটে তরুণ গ্লান্স করল লেগ স্টাম্প থেকে। কোচ তারিফ জানিয়ে মাথা নাড়তেই আনন্দর মনের মধ্যে ঈর্ষা চুলকে উঠল। নেটে আরও তিনজন বল করছে। তাদের বল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বলটা নেটের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সে নেটের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়াল।
কী লাভলি, আলতো করে ঘুরিয়ে দিল দেখলি। নিখুঁত টাইমিং!
তরুণের লেটকাটও দেখার মতো। সূক্ষ্ম মারগুলো ওর হাতে দারুণ খোলে। অফ স্টাম্পের বাইরে একবার বল পাক, দেখবি কী চমৎকার কাট করবে।
এই আন্দ, দে তো একটা অফ স্টাম্পের বাইরে একটু শর্ট পিচ।
ওরা তরুণের বন্ধু। আনন্দ ছেলে দুটির দিকে ক্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, কেন?
তরুণের লেটকাট দেখব।
দেখার আরও জিনিস আছে ব্যাটিং ছাড়াও।
ব্যাটের ঠোক্কর দিয়ে মেরে তরুণ বলগুলোকে বার করে দিচ্ছে নেটের ভিতর থেকে। নিজের বলটি কুড়িয়ে আনন্দ বলল, ফাস্ট বোলিংও দেখার মতো একটা জিনিস।
যেমন তুই এখন করছিস। এর থেকে মেয়েরাও তো জোরে বল করে।
ঝাঁ করে রক্ত ছুটে এল আনন্দর মাথায়। বটে! চোয়াল চেপে সে বোলিং মার্কে ফিরে এল। কোচ যা বলে বলুক, একটা বল অন্তত সুইং টুইং সিকেয় তুলে জোরে, ভীষণ জোরে দেবে।
বলটা এত জোরে আসবে এবং গুডলেংথ থেকে আচমকা লাফিয়ে উঠবে, তরুণ কল্পনা করেনি। ফরোয়ার্ড খেলতে গিয়ে থমকে যায় আর ব্যাট তুলে মুখ আড়াল করার আগেই বলটা কপাল ঘষড়ে নেটের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।
আনন্দ তা দেখেনি। ডেলিভারি দিয়েই তার চোখ থেকে সব দৃশ্য মুছে অন্ধকার হয়ে যায়। ফুসফুসে সেই মুহূর্তে যেন একটা ছুরি গেঁথে গেল। ফলো-থুর সঙ্গেই সে বুক চেপে বসে পড়ে। তার সারা বুকটা থেকে যেন দৈত্যাকার একটা মুঠো এখন কচলে কচলে বাতাস বার করছে। যখন সে মুখ তুলল, তখন নেট থেকে তরুণকে ওরা ধরে বার করে আনছে। সাদা জামায় টপটপ রক্ত পড়ছে।