ট্যাবলেট খেয়ে আনন্দ দুটো বালিশ মাথায় রেখে চিত হয়ে চোখ বন্ধ করল এবং ক্রমশ তার মনে হতে লাগল জ্বর কমছে, ব্যথাও কমছে। মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখতে লাগল জুলপি বাঁচিয়ে দাড়ি কামানোয় ব্যস্ত মেজদাকে। গত তিন মাসে তিন রকম জুলপি রেখেছে। প্রথমে ছিল বাজারের মাংসওলাদের দা-এর মতো যা দিয়ে টেংরির হাড় টুকরো করে। তারপর রেখেছিল নেপালিদের কুকরির মতো। এখন রয়েছে ক্রিকেট ব্যাটের মতো।
মেজদা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার আসছে?
হু।
অ্যান্ডি রবার্টস আসবে?
সেফটি রেজার গাল থেকে তুলে অরুণ আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুই জুলপির মাপ পরীক্ষা করতে করতে বলল, আসবে না আবার! না এলে উইকেটগুলো নেবে কে?
আমায় একদিন খেলা দেখাবে, যেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফিল্ড করবে?
দেখাব!
আমি শুধু অ্যান্ডির বোলিং দেখব।
কেন? কালিচরণ, রো, লয়েড—এদের ব্যাটিং?
আমি ফাস্ট বোলারের অ্যাকশন দেখব। কখনও দেখিনি। তুমি দেখেছ?
দেখেছি, ওয়েস হল।
লিন্ডওয়ালকে?
নাহ। তোয়ালে-সাবান হাতে একতলার কলঘরে যাবার জন্য অরুণ দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল, তুই নাকি জোরে বল করিস শুনলুম! আমাদের ক্লাবের শুভেন্দু দেখেছে নেতাজি পার্কে তোকে বল করতে। বলল, খুব পেস আর উইকেট থেকেও অনেকটা ওঠে নাকি!
আনন্দর কান দুটো গরম হয়ে গেল। লজ্জিত স্বরে বলল, জোরে বল না হাতি। এখনও এন্তার শর্ট পিচ পড়ে। স্টাম্পের সাত হাত বাইরে দিয়ে যায়।
প্রথম প্রথম ওইরকমই হয়। প্রাকটিস আর ধৈর্য—ওরেব্বাবা, আটটা বেজে গেছে!
অরুণ চলে যাবার পর আনন্দর মুখ হালকা হাসিতে ছেয়ে গেল। কত জোরে বল করি মেজদাটা জানে না। প্যান্ট চাইলে, বুট চাইলে কিনে দিয়েছে, কিন্তু একদিনও আমার খেলা দেখেনি। এবারে সামার ক্রিকেটের সেঞ্চুরিটার পর কাগজে এ ব্যানার্জি নামটা দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই নাকি? হ্যাঁ বলতে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। ওই রকম অবাক আবার করে দেব যেদিন কাগজে দেখবে ইন্ডিয়া টিমে ওয়াড়েকর, এঞ্জিনিয়ার, তারপরই আনন্দ বানার্জি…। ওর চিন্তাটা একটু থমকে গেল। আমি যখন টেস্ট খেলব ততদিনে ওয়াড়েকর এঞ্জিনিয়াররা তো রিটায়ার করে যাবে! অন্তত সাত-আট বছর তো লাগবেই টেস্টম্যাচ পর্যন্ত পৌঁছতে। হয়তো তিন বছরেই এসে যেতে পারি। কিংবা এমন যদি হয়, এই বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের এগেনস্টে! নেতাজি পার্কের ধার দিয়ে যাচ্ছিল পঙ্কজ রায়। নেট প্র্যাকটিস হচ্ছে দেখে, ক্রিকেটার তো, তাই মুখ ফিরিয়ে দেখতে দেখতে একটুখানি দাঁড়াল। তখন আমি বল করছি। তারপর আর চোখ ফেরাতে পারল না। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখে এগিয়ে এসে আমাকে হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়ো? একটা কাগজে লিখে নেবে যাতে ভুলে না যায়। তারপর একদিন হঠাৎ টেলিগ্রাম আসবে স্কুলে জয়েন টেস্ট ট্রায়াল ক্যাম্প ইমিডিয়েটলি। মাদ্রাজ কি বোম্বাই কি বাঙ্গালোর, কোথাও হবে ক্যাম্পটা। একটা ভাল স্যুটকেশ দরকার, তাছাড়া নিজস্ব ব্যাট প্যাড, গ্লাভস, ভাল বুট, দু-তিনজোড়া শার্ট-প্যান্টও চাই। আনন্দ আপন মনে হাসল। মেজদার অনেক টাকা খসবে। তাতে ওর আপত্তি হবে না! মেজদাটা ক্রিকেট পাগল।
খেলার মাঠে লরির শব্দ এবং মজুরদের চিৎকার শুনে আনন্দ জানলা দিকে তাকাল। মাঠটা যেন কারখানারই মাল ভোলা নামানোর জায়গা। খেলার মাঝেই লরি ঢুকে পড়ে। তখন খেলা বন্ধ করে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না। আধঘণ্টা পর্যন্ত ছেলেদের দাঁড়াতে হয়েছে। তিন বছর আগে ফুটবল খেলার মধ্যে লরি ঢুকে পড়ায় ওরা কারখানার হেড দারোয়ানকে বলেছিল, তাড়াতাড়ি মাল খালাস করে লরি সরিয়ে দিতে। লোকটা তাচ্ছিল্যভরে জবাবে বলে, এ জমি তো দত্তবাবুদের। তাদের লরি যতক্ষণ খুশি দাঁড়িয়ে থাকবে। একটি ছেলে বলেছিল, এ মাঠ তো ক্লাবের জমি। তাই শুনে দারোয়ান বলে, ক্লাব তো উঠে গেছে। এ-জমি এখন শিবা দত্তবাবুর। বেশি কথা বললে, খেলা বন্ধ করে দেব।
ছেলেরা বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা নিয়ে কার কাছে নালিশ জানাবে। পাড়ার ছেলেরা চাঁদা তুলে বল কিনে নিজেরাই মাঠে নেমে পড়েছে। তাদের কোনও ক্লাবও নেই। তবে অন্য দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলার সময় নাম নেয় বটতলা ইনস্টিটিউট। কিন্তু ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। না থাকার কারণ, ফুটো ছাদের জীর্ণ একতলা বাড়ি, টিমটিমে একটা লাইব্রেরি, মরচেধরা আধভাঙা কিছু ডাম্বেল, মুগুর ইত্যাদি ছাড়া এখন ইনস্টিটিউটের কোনও অস্তিত্ব নেই। লাইব্রেরির কয়েকজন মেম্বার ছাড়া আর কোনও লোকের যাতায়াত নেই। বছর বারো আগে আনন্দর বড়দা অমলের উদ্যোগে রবীন্দ্র-জন্মােৎসবই ছিল শেষ অনুষ্ঠান। একটা কমিটি আছে। বহু বছর তার নির্বাচন হয়নি। কমিটির প্রেসিডেন্ট শিবা দত্ত, সম্পাদক অনাদিপ্রসাদ।
কিছু ছেলে আনন্দকে বলেছিল, চল তোর বাবাকে গিয়ে বলি। কয়েকজন বলে, আগে প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়াই উচিত। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর স্থির হয়, সবার আগে ডগুদার কাছে যাওয়াই ভাল। বাড়ি ছিল না ডগুদা। পরদিন সকালে ওরা ডগুদার সঙ্গে দেখা করে। আনন্দ যেতে পারেনি।
কী কথা হয়েছিল শিবা দত্তর সঙ্গে, ডগুদা তা আর বলেনি। তাদের শুধু বলেছিল, বিকেলে লরি ঢুকবে না, মাঠের মধ্যে মাল রাখাও হবে না কথা দিয়েছে শিবা দত্ত। মুশকিল কী জানিস! এ মাঠটার তো কোনও বাপ-মা নেই। যদি নিয়মিত সারাবছর জমজমাট করে খেলার ব্যবস্থা হয়, লোকজন খেলা দেখতে আসে, তা হলে কি আর লরি ঢুকতে সাহস পাবে? তোরা তো দু-চারদিন ফুটবল কিংবা ক্রিকেট পিটিয়ে বন্ধ করে দিবি, বাকি সময় তো পোড়া জমি হয়েই থাকে মাঠটা।