Site icon BnBoi.Com

প্রেম – সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রেম – সৈয়দ মুজতবা আলী

০১. নর-নারীর আবির্ভাব

প্রেম – সৈয়দ মুজতবা আলী

নিকোলাস লেসকফ
রচিত
মৎসেনস্ক জেলার
লেডি ম্যাকবেৎ

শ্রীমান অবধূতের করকমলে

.

অনুবাদকের নিবেদন

নিকোলাই সেমোনোভিচ লেস্কফের প্রেম (আসলে নাম মৃৎসেনস্ক জেলার লেডি ম্যাকবেৎ) গল্পটি আমার কাছে অনবদ্য এবং বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয় বলে মনে হয়। লেস্কফের জন্ম ১৮৩১-এ এবং মৃত্যু ১৮৯৫-এ। প্রেম প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। ওই সময় তলস্তয় ও তুর্গেনিয়ে তাঁদের খ্যাতির মধ্যগগনে। সে সময় লেখক হিসেবে নাম করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। আরেকটি কথা বললেই যথেষ্ট হবে। এর কয়েক বৎসর পরে যখন ফ্রান্সে মপাসার ছোটগল্প মাসিকপত্রে বেরোতে আরম্ভ করে তখন সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই সেগুলোর অনুবাদ অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় হতে থাকে, এক রুশ ভাষা ছাড়া যদিও রুশদেশই সে যুগে ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি নকল করত। তার কারণ রুশাকাশে তখন একাধিক অত্যুজ্জ্বল গ্রহ উপগ্রহের সংযোগ।

এই উপন্যাসটি প্রায় যেন গ্রিক ট্র্যাজেডি। নিয়তির অলঙ্ নির্দেশ, কিংবা বলতে পারেন প্রকৃতিদত্ত রজোগুণের কাম-তাড়নায় (কাতেরিনা) কিংবা নীচাশয়তায় (সেরগেই) এরা যেন কোন এক অজানিত করাল অস্তাচলের পানে এগিয়ে চলেছে। নিদারুণ কঠিন অবস্থায় পড়ে এরা তখন কীসব অমানুষিক কাজ করে তারই উল্লেখ করতে গিয়ে স্বয়ং লেকই বলেছেন, যারা এই উপদেশবাণীতে কর্ণপাত করে না, এ রকম বীভৎস অবস্থায় যাদের হৃদয়ে মৃত্যু-চিন্তা প্রলোভনের চেয়ে ভয়ের সৃষ্টি করে বেশি তাদের করতে হয় বীভৎসতর এমন কিছু যেটা এই আর্ত ক্রন্দন-ধ্বনির টুটি চেপে ধরে তাকে নীরব করে দেবে। এই তত্ত্বটি আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ সাদামাটা সরল মানুষ উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করতে জানে; এ অবস্থায় সে লাগাম ছেড়ে তার নির্ভেজাল নীচ পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয়; সে তখন সাজে সঙ, নিজেকে নিয়ে আরম্ভ করে নিষ্ঠুর খেলা, আর-পাঁচজন মানুষকে নিয়েও তাদের কোমলতম হৃদয়ানুভূতি নিয়ে। এরা (এস্থলে সাইবেরিয়াগামী যাবজ্জীবন কঠোর কারাদণ্ডে কয়েদির পাল) এমনিতেই অত্যধিক কোমল স্বভাব ধরে না– এরকম অবস্থায় পড়ে তারা হয়ে যায় দ্বিগুণ পিশাচ।

এবং বীভৎস রসের সঙ্গে সঙ্গে এতে আছে অতি মধুর গীতিরস, রুশ নিদাঘ দিনান্তের অপূর্ব বর্ণনা, প্রেমের আকুতি-মিনতি, অভিমান, ক্ষণকলহ, মিলন-বিচ্ছেদ- এবং সর্বশেষে দয়িতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ।

এস্থলে আমি ব্যক্তিগতভাবে সভয়ে সবিনয় নিবেদন করি, এবং যুক্তি না দেখিয়ে সংক্ষেপেই করি, কাতেরিনা যত পাপাচারই করে থাকুক, তার একনিষ্ঠ প্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। তথাকথিত ভদ্র মানবসমাজেও এ জাতীয় প্রেম বিরল। চেখফের দুলালি পড়ে তলস্তয় পরবর্তী যুগে যা বলেছেন, হয়তো এস্থলেও তা-ই বলতেন।

মপাসাঁর বেল আমি-র সঙ্গে পাঠক এ নভেলিকার মিল দেখতে পাবেন। কিন্তু বে আমি প্রকাশিত হয় লেস্কফের বইয়ের কুড়ি বৎসর পরে। মপাসার যৌবনে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত তুর্গেনিয়েফের ফ্লোবেরের বাড়িতে। হয়তো-বা সে সময় তুর্গেনিয়ে গল্পটি মুখে মুখে মপাসাঁকে বলে থাকতে পারেন– কারণ মপাসা যখন প্লটের জন্য মাকে চিঠি লিখতে পারেন তখন তাঁর প্রতি সদাস্নেহশীল গুরুসম তুর্গেনিয়েফকে যে তিনি এ বিষয়ে অনুরোধ করবেন তাতে আর বিচিত্র কী? মপাসার চিঠিতেই রয়েছে, তিনি একবার তুর্গেনিয়েকে জিগ্যেস করেন, মাতাল ইংরেজ খালাসি যদি হঠাৎ গান ধরে তবে তারা কি গান গাইবে– গড় সেভ দি কুইন? তুর্গেনিয়ে বললেন, বরঞ্চ গাইবে রুল ব্রিটানিয়া এবং সেইটি অনুবাদ করে তাঁকে সাহায্য করেন।

এ পুস্তকে আদিরসের প্রাধান্য হয়তো বাঙালি পাঠকের কিঞ্চিৎ পীড়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু রুশ-সাহিত্যের মহারথীরাও এই ধরনেই লিখেছেন (তলস্তয়ের নেখলুদ-মাসলভা, এবং গোর্কির তো কথাই নেই)। বস্তুত এ বই যদি লিখতেই হয় তবে এছাড়া গতি নেই। কুমারসম্ভব লিখতে হলে কালিদাসের মতোই লিখতে হয়, চৌরপঞ্চাশিকা লিখতে হলে চূড়ের মতো লিখতে হয়।

অনুবাদ করতে হলে যে-কটি গুণের প্রয়োজন হয়, তার একটিও আমার নেই। তাই আমি আমার একাধিক মিত্র তথা শিষ্যকে এই নভেলিকাটি অনুবাদ করার জন্য অনুরোধ করেছি। তাঁরা করেননি বলেই (মাঝখান থেকে বইখানি আমাকে তিন-তিনবার কিনতে হয়েছে!) আমি এটাতে হাত দিয়েছিলুম। করতে গিয়ে বুঝতে পারলুম, অনুবাদ-কর্ম কী কঠিন গর্ভযন্ত্রণা। নিজের আপন লেখা আপন পাঁঠা, কিন্তু পরেরটা বলি দিতে হয় শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে। তদুপরি যে সমস্যা আমাকে সবচেয়ে চিন্তায় ফেলছে সেটি এই : যদি সেটাকে মধুর বাঙলায় হুবহু আপন মাতৃভাষায় যেরকম বলি, শুনি, সেরকম অনুবাদ করি তবে বাঙালি পাঠক সেটি হোঁচট না খেয়ে খেয়ে আরামে পড়ে যাবেন কিন্তু তাতে রুশ-বৈশিষ্ট্য মারা যাবে। পক্ষান্তরে সে বৈশিষ্ট্য রাখতে গেলে অনুবাদ হয়ে যায় আড়ষ্ট, পাঠক রস পায় না– তা হলে আর বৃথা পরিশ্রম করলুম কেন? তবে মাঝে মাঝে ইক, সামোভার, আপেলগাছ, ভগা, নিজনি নভগরদ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে প্রয়োজনীয় রুশ আবহাওয়া তৈরি করে। তবু বলি, অনুবাদটি যোগ্য ব্যক্তির করা উচিত ছিল।

সর্বশেষে নিবেদন, কয়েক মাস ধরে নিদ্রাকৃতায় ভুগি। তখন চিকিৎসক উপদেশ দেন, কোনও মৌলিক রচনায় হাত না দিয়ে যেন অনুবাদ-কর্ম আরম্ভ করি– তাতে করে রোগশয্যার একঘেয়েমি থেকে খানিকটে মুক্তি পাব। রোগশয্যার অজুহাত শুনে আমার অনুরাগী পাঠক (এ নিবেদনটি একমাত্র তাদেরই উদ্দেশে) যে অনুবাদ পছন্দ করে বসবেন, এ আশা আমার করা অনুচিত, কিন্তু কটু-কাটব্য করার সময় হয়তো সেকথা ভেবে খানিকটে ক্ষমার চোখে দেখবেন। এবং অতি সর্বশেষ নিবেদন, অনিদ্রারোগে অনুবাদকর্ম অতিশয় উপকারী। এটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললুম। আমার মতো যারা অন্দ্রিায় ভুগছেন তারা উপকৃত হবেন। কিমধিকমিতি ॥

—সৈয়দ মুজতবা আলী

.

পাত্রপাত্রী

রুশ উপন্যাসে একই পাত্রকে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রপাত্রী ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে বলে নিম্নে তাদের নির্ঘণ্ট দেওয়া হল :

পরিবারের নাম –ইসমাইলফ

বাড়ির কর্তা — বরিস তিমোতেইয়েভিচ ইসমাইলফ, বরিস তিমোতেইয়েভিচ

পুত্র –জিনোভিই বরিসিচ

বরিসের পুত্রবধূ, জিনোভিইয়ের স্ত্রী –কাতেরিনা লভভনা ইসমাইলভা, কেট, কেতারিনা লভভনা, লভভনা

পুত্রবধূর প্রণয়ী –গেই ফিলিপচ, সেরেজকা, জেশকা, সেরেজেঙ্কা, সেরেজা

পাচিকা –সনিয়া

সম্পত্তির অংশীদার বালক –দর জাখাফর লিয়ামিন, ফেদিয়া

কয়েদি –য়োনা, সোনেৎকা ও অন্যান্য

.

.

০১.

মাঝে মাঝে আমাদের এই অঞ্চলে এমন সব নর-নারীর আবির্ভাব হয় যে, তার পর যত দীর্ঘকালই কেটে যাক না কেন, তাদের কথা স্মরণে এলেই যেন অন্তরাত্মা পর্যন্ত শিউরে ওঠে। এবং এদের মধ্যে নিশ্চয়ই পড়ে এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী, কাতেরিনা লভভূনা ইসমাইল। এর জীবন এমনই বীভৎস নাটকীয় রূপ নিয়েছিল যে, আমাদের সমাজের পাঁচজন ভদ্রলোক কোনও এক মশকরাবাজের অনুকরণে একে নাম দিয়েছিল, মৃৎসেন জেলার লেডি ম্যাকবেৎ।

কাতেরিনা তেমন কিছু অপূর্ব রূপসী ছিল না, কিন্তু চেহারাটি ছিল সত্যই সুশ্রী। তখন তার বয়েস সবে চব্বিশ; মাঝারি রকমের খাড়াই, ভালো গড়ন আর গলাটি যেন মার্বেল পাথরে কোদাই। ঘাড় থেকে বাহু নেমে এসেছে সুন্দর বাঁক নিয়ে, বুক আঁটসাঁট, নাকটি বাঁশির মতো শক্ত আর সোজা, শুভ্র উন্নত ললাট আর চুল এমনিই মিশমিশে কালো যে আসলে ওটাকে কালোয়-নীলে মেশানো বলা যেতে পারে। তার বিয়ে হয়েছিল ব্যবসায়ী ইসমাইলফের সঙ্গে। সে বিয়েটা প্রেম বা ওই ধরনের অন্য কোনও কারণে হয়নি– আসলে ইসমাইল তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ওই যা, আর কাতেরিনা গরিবের ঘরের মেয়ে বলে বিশেষ বাছবিচার করার উপায় তার ছিল না।

ইসমাইলফ পরিবার আমাদের শহরে গণ্যমান্যদের ভিতরই। তাদের ব্যবসা ছিল সবচেয়ে সেরা ময়দার, গম পেষার জন্য বড় কল তারা ভাড়া নিয়েছিল, শহরের বাইরে ফলের বাগান থেকে তাদের বেশ দু পয়সা আসত এবং শহরের ভিতরে উত্তম বসতবাড়ি। মোদ্দা কথায়, তারা ধনী ব্যবসায়ীগুষ্ঠির ভিতরেরই একটি পরিবার। তার ওপর পরিবারটিও মোটেই পুষ্যিতে ভর্তি নয়। শ্বশুর তিমোতেইয়েভি ইসমাইল, আশির মতো বয়েস, বহুকাল পূর্বে তার স্ত্রী মারা গেছে। তার ছেলে, কাতেরিনার স্বামী জিনোভিই বরিসিছ, পঞ্চাশের চেয়েও বেশ কিছু বেশি আর সর্বশেষে কাতেরিনা, ব্যস। পাঁচ বছর হল কাতেরিনার বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও ছেলেপুলে কিছু হয়নি। প্রথম পক্ষের স্ত্রীও কোনও সন্তান রেখে যায়নি– জিনোভিইয়ের সঙ্গে কুড়ি বছর ঘর করার পরও। তার মৃত্যুর পর সে কাতেরিনাকে বিয়ে করে। এবারে সে আশা করেছিল, বুঝি ভগবানের আশীর্বাদ এ-বিয়ের ওপর নেমে আসবে বংশের সুখ্যাতি সম্পত্তি বাঁচাবার জন্য সন্তান হবে, কিন্তু কপাল মন্দ, কাতেরিনার কাছ থেকেও কিছু পেল না।

এই নিয়ে জিনোভিইয়ের মনস্তাপের অন্ত ছিল না, এবং শুধু সে-ই না, বুড়ো বরিসেরও। কাতেরিনারও মনে এই নিয়ে গভীর দুঃখ ছিল। আর কিছু না হোক– এই যে অন্তহীন একঘেয়ে জীবন তাকে মূঢ় মুহ্যমান করে তুলছে তার থেকে সে নিষ্কৃতি পেত, ভগবান জানেন। কতখানি আনন্দ পেত সে, যদি নাওয়ানো খাওয়ানো জামা-কাপড় পরানোর জন্য একটি বাচ্চা থাকত তার নিষ্কৃতি পেত এই বন্ধ, উঁচু পাঁচিলওলা, মারমুখো কুকুরে ভর্তি বাড়িটার অসহ্য একঘেয়েমি থেকে। শুধু তাই নয়, ওই এক খোটা শুনে শুনে তার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল– বিয়ে করতে গেলি কেন, তুই? একটা ভদ্রলোকের জীবন সর্বনাশ করলি তুই মাগী, বাঁজা পাঁঠী। যেন মারাত্মক পাপটা তারই, সে পাপ তার স্বামীর বিরুদ্ধে, শ্বশুরের বিরুদ্ধে, এমনকি তাদের কুল্লে সাধু ব্যবসায়ীগুষ্ঠির বিরুদ্ধে!

ধনৈশ্বর্য, আরাম-আয়েশে পরিপূর্ণ এই বাড়িতে কাতেরিনার ছিল সবচেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন। দেখাটেখা করতে সে যেত খুবই কম এবং যদি-বা তার স্বামীর সঙ্গে তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের বাড়িতে যেত তাতেও কোনও আনন্দ ছিল না। ওরা সব প্রাচীন ধরনের কড়া লোক। তারা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত, সে কীভাবে বসে, তার আচরণ কীরকম, সে কীভাবে আসন ত্যাগ করে; ওদিকে কাতেরিনা তেজি মেয়ে এবং দুঃখদৈন্যে শৈশব কেটেছে বলে সে অনাড়ম্বর ও মুক্ত জীবনে অভ্যস্ত। পারলে সে এখখুনি দুটো বালতি, দু হাতে নিয়ে ছুটে যায় জাহাজঘাটে। সেখানে শুধু শেমিজ গায়ে স্নান করতে। কিংবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওই ছোঁড়াটার গায়ে বাদামের খোসা ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু হায়, এখানে সবকিছু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভোর হওয়ার পূর্বেই তার শ্বশুর আর স্বামী ঘুম থেকে উঠে জালা জালা চা খেয়ে ছ-টার ভিতর কাজ কারবারে বেরিয়ে যান, আর সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ একা একা আলস্যে আলস্যে এ-ঘর ও-ঘর করে করে ঘুরে মরে। সবকিছু ছিমছাম, ফাঁকা। দেব-দেবীদের সামনে স্তিমিত প্রদীপ জ্বলছে। সমস্ত বাড়িতে আর কোনও জনমানবের চিহ্ন নেই, কারও কণ্ঠস্বরের লেশমাত্র নেই।

কাতেরিনা ফাঁকা এ-ঘর থেকে ফাঁকা ও-ঘরে যায়, তার পর আরেক দফা আরো খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, তার পর একঘেয়েমির জন্য হাই তোলে। তার পর সরু সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওঠে উঁচুতে নিজেদের শোবার ঘরে। সেখানে খানিকক্ষণ অলস নয়নে তাকিয়ে থাকে নিচের দিকে যেখানে দড়ি বানাবার পাটসুতো ওজন করা হচ্ছে কিংবা অতি উৎকৃষ্ট মিহিন ময়দা গুদামে পোরা হচ্ছে। আবার সে হাই তোলে– তাই করে যেন সে খানিকটে আরাম পায়। তার পর ঘণ্টাখানেক, ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে ওঠার পর আবার আসবে সেই একঘেয়েমি রুশদেশের খাঁটি একঘেয়েমি, ব্যবসায়ী বাড়ির একঘেয়েমি। সে-একটানা, বৈচিত্র্যহীন একঘেয়েমি এমনই নিরস্ত্র যে তাই লোকে বলে, তখন কোনও গতিকে কোনও একটা বৈচিত্র্য আনার জন্য মানুষ সানন্দে গলায় দড়ি দিয়ে দেখতে চায় তাতে করে কিছু একটা হয় কি না। কাতেরিনার আবার বই পড়ারও বিশেষ শখ ছিল না; আর থাকলেই-বা কী? বাড়িতে ছিল সর্বসুদ্ধ একখানা বই– কিয়েফ শহরে সংকলিত সন্তদের জীবনী।

ধনদৌলতে ভরা শ্বশুরের এই বাড়িতে কাতেরিনার পুরো পাঁচটি বছর কেটে গেল অসহ্য একঘেয়েমিতে– মমতাহীন স্বামীর সঙ্গে সহবাস করে। কিন্তু আকছারই যা হয়– এক্ষেত্রেও কেউ সেদিকে ক্ষণতরেও ভ্রুক্ষেপ করল না।

.

০২.

কাতেরিনার বিয়ের ছ-বছর পর যে-বাঁধের জলে ইসমাইলদের গম-পেষার কল চলত সেটা ফেটে গেল। আর অদৃষ্ট যেন ওদের ভেংচি কাটবার জন্যই ঠিক ওই সময়ে মিলের ওপর পড়ল প্রচণ্ড কাজের চাপ। তখন ধরা পড়ল যে ভাঙনটা প্রকাণ্ড। জল পৌঁছেছে সক্কলের নিচের ধাপে। জোড়াতালি দিয়ে কোনও গতিকে ভাঙনটাকে মেরামত করার সর্ব প্রচেষ্টা হল নিষ্ফল। জিনোভিই আশপাশের চতুর্দিক থেকে আপন লোকজন গম-কলে জড় করে সেখানে ঠায় বসে রইল দিনের পর দিন, রাত্তিরের পর রাত্তির। বুড়ো বাপ ওদিকে শহরের ব্যবসা-কারবার সামলাল। আর কাতেরিনার কাটতে লাগল আরও নিঃসঙ্গ একটানা জীবন। গোড়ার দিকে স্বামী না থাকায় তার জীবনের একঘেয়েমি যেন চূড়ান্তে পৌঁছল, পরে আস্তে আস্তে তার মনে হল, এটা তবু ভালো–এতে করে যেন সে খানিকটে মুক্তি পেল। স্বামীর দিকে তার হৃদয়ের টান কখনও ছিল না। স্বামী না থাকায় তার ওপর হাম্বাই-তাম্বাই করার মতো লোক অন্তত একজন তো কমলো।

একদিন কাতেরিনা ছাতের উপরের ছোট্ট ঘরে জানালার পাশে বসে ক্রমাগত হাই তুলছিল। বিশেষ কিছু নিয়ে যে চিন্তা করছিল তা নয়। করে করে আপন হাই তোলা নিয়ে নিজেই যেন নিজের কাছে লজ্জা পেল। ওদিকে, বাইরের আঙিনায় চমৎকার দিনটি ফুটে উঠেছে; কুসুম কুসুম গরম, রৌদ্রোজ্জ্বল, আনন্দময়। বাগানের সবুজ বেড়ার ভিতর দিয়ে কাতেরিনা দেখছিল, ছোট্ট-ছোট্ট চঞ্চল পাখিগুলো কীরকম এক ডাল থেকে আরেক ডালে ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছিল।

কাতেরিনা ভাবছিল, আচ্ছা, আমি সমস্ত দিন ধরে টানা হাই তুলি কেন? কী জানি। তার চেয়ে বরঞ্চ বেরিয়ে আঙিনায় গিয়ে বসি কিংবা বাগানে বেড়িয়ে আসি।

কিংখাপের একটি পুরনো জামা পিঠে-কাঁধে ফেলে কাতেরিনা বেরিয়ে পড়ল।

বাইরে উজ্জ্বল আলো আর বাতাস যেন নবজীবন দেবার জন্য বইছে। ওদিকে গুদামঘরের কাছে উঁচু চকে সবাই প্রাণ-ভরা খুশিতে ঠাঠা করে আসছিল।

অত রগড় কিসের? কাতেরিনা তার শ্বশুরের কেরানিদের জিগ্যেস করল।

অর্থাৎ, ব্যাপারটা হচ্ছে, মা-ঠাকরুন– একাতেরিনা, ল — আমরা একটা জ্যান্ত শূয়োরী ওজন করছিলুম।

শূয়োরী? সে আবার কী?

ওই যে আকসিনিয়া শূয়োরীটা। বাচ্চা ভাসিলিইকে বিইয়ে গির্জের পরবে আমাদের নেমন্তন্ন করল না, তাকে–উত্তর দিল হাসিভরা বেপরোয়া গলায় একটি ছোকরা। বেশ সাহসী সুন্দর চেহারা। মিশকালো চুল, অল্প অল্প দাড়ি সবে গজাচ্ছে। সেরগেই তার নাম।

ওই মুহূর্তেই দাঁড়ে ঝোলানো ময়দা মাপার ধামা থেকে উঁকি মেরে উঠল রাঁধুনী আকসিনিয়ার চর্বিতে ভর্তি চেহারা আর গোলাপি গাল।

বদমাইশ ব্যাটারা, শয়তান ব্যাটারা–রাঁধুনী তখন গালাগালি জুড়েছে। সে তখন ধামা ঝোলানোর ডাণ্ডাটি ধরে কোনও গতিকে পাল্লা থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে।

খাবার আগে তার ওজন ছিল প্রায় চার মণ। এখন যদি ভালো করে খড় খায় তবে আমাদের সব বাটখারা ফুরিয়ে যাবে।– সেই সুন্দর ছোকরা বুঝিয়ে বলল। তার পর পাল্লাটা উল্টে রাঁধুনীকে ফেলে দিল এককোণের কতকগুলি বস্তার উপর।

রাঁধুনী হাসতে হাসতে গালমন্দ করছিল আর কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করাতে মন দিল।

আচ্ছা, ভাবছি আমার ওজন কত হবে। হাসতে হাসতে দড়ি ধরে মালের দিকটায় উঠে কাতেরিনা শুধলো।

একশো পনেরো পাউন্ডের সামান্য কম। বাটখারা ফেলে সেরগেই বলল, আশ্চর্য!

এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?

আপনার যে অতখানি ওজন হবে আমি মোটেই ভাবতে পারিনি, কাতেরিনা লভভুনা। আমার কী মনে হয় জানেন? আপনাকে দু হাতে তুলে সমস্ত দিন কারও বয়ে বেড়ানো উচিত। এবং সে তাতে করে ক্লান্ত তো হবেই না, বরঞ্চ শুধু আনন্দই পাবে।

হুঃ! আমি তো আর পাঁচজনেরই মতো মাটির মানুষ। তুমিও ক্লান্ত হয়ে পড়বে।– এ ধরনের কথাবার্তা বলতে কাতেরিনা অভ্যস্ত ছিল না বলে উত্তর দিতে গিয়ে তার মুখ একটুখানি রাঙা হয়ে গেল এবং হঠাৎ তার এক অদম্য ইচ্ছা হল অফুরন্ত আনন্দ আর সরস কথাবার্তা বলে তার হৃদয়-মন ভরে নেয়।

সেরগেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে উঠল, কখনও না, ভগবান সাক্ষী, আমি আপনাকে আমাদের পুণ্যভূমি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাব।

সাদামাটা পাতলা-দুবলা একজন চাষা ময়দা মাপতে মাপতে বলল, ও হিসাব চলে না, সোনা। আমাদের কার কত ওজন তা দিয়ে কী হয়? তুমি কি মনে কর আমাদের মাংস সবকিছু করে? আমাদের মাংসের ওজনের কোনও দাম নেই, বুঝলে দোস্ত। আমাদের ভিতর যে শক্তি আছে সেই শক্তিই সবকিছু করে আমাদের মাংস কিছুই করে না!

আবার কাতেরিনা নিজেকে সংযত না করতে পেরে বলে ফেলল, বাহ্! আমার বয়েস যখন কম ছিল তখন আমার গায়ে ছিল বেশ জোর; সব পুরুষই যে আমার সঙ্গে তখন পেরে উঠত সেকথাটা আদপেই মনের কোণে ঠাই দিয়ো না।

সুশ্রী ছোকরা অনুরোধ জানিয়ে বলল, খুব ভালো কথা। তাই যদি হয় তবে আপনার ছোট হাতটি আমায় একটু ধরতে দিন তো!

কাতেরিনা হকচকিয়ে গেল কিন্তু হাত তবু দিল বাড়িয়ে।

লাগছে, লাগছে– ওহ! আংটিটা ছেড়ে দাও। ওটাতে লাগছে– সেরগেই কাতেরিনার হাত চেপে ধরতেই সে চিৎকার করে উঠল আর অন্য হাত দিয়ে দিল তার বুকে ধাক্কা। সেরগেই সঙ্গে সঙ্গে তার কত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কার চোটে তাল সামলাতে না পেরে পাশের দিকে দু পা সরে গেল।

সেই ছোটখাটো সাদামাটা চাষা অবাক হয়ে বলল, হুম! লাও ঠেলা। মেয়েদের কথা আর বলছ না যে?

সেরগেই মাথার চুল ঝাঁকুনি মেরে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, না, না। আমাদের ধরাধরিটা ঠিকমতো হোক, তবে তো।

কাতেরিনা বলল, তবে এসো৷ ততক্ষণে তারও মনে ফুর্তির ছোঁয়া লেগেছে। দুটি সুডৌল কনুই উপরের দিকে তুলে ধরে বলল, তবে এসো।

সেরগেই তার তরুণী কত্রীকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে তার সুঠাম বুক আপন লাল শাটের উপর চেপে ধরল। কাতেরিনা তার কাঁধ সরাবার পূর্বেই সেরগেই তাকে শূন্যে তুলে ধরে দু হাতে উপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে আপন বুকে চেপে ধরেছে। তার পর আস্তে আস্তে নামিয়ে নিয়ে একটা উল্টো ধামার উপর বসিয়ে দিল।

আপন দেহের যে শক্তি সম্বন্ধে কাতেরিনা দম্ভ করেছিল তার একরত্তিও সে কাজে লাগাতে পারেনি। এবারে সে লালে লাল হয়ে গিয়ে ধামায় বসে কিংখাপের জামাটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে গায়ে ঠিকমতো বসাল। তার পর চুপচাপ গুদামবাড়ি ছেড়ে রওনা দিল। মেকার মাফিক যতখানি দরকার ঠিক ততখানি দেমাকের সঙ্গে সেরগেই গলা সাফ করে মজুরদের উদ্দেশে হাঁক দিয়ে বলল, ওরে ও গাধার পাল! ময়দার স্রোত বন্ধ হতে দিসনি, হালের উপর এলিয়ে পড়ে আরাম করিসনি। যদি কিছু থাকে বাকি, মোরা তো যাব না ফাঁকি।

ভাবখানা করল যে এক্ষুনি যা হয়ে গেল সে যেন তার কোনও পরোয়াই করে না।

কাতেরিনার পিছনে হাঁপাতে হাঁপাতে যেতে যেতে রাঁধুনী তাকে বলল, ব্যাটাচ্ছেলে সেরেজুকা মেয়েছেলের পিছনে কীরকম ডালকুত্তার মতোই না লাগতে জানে! ওই চোরটার নেই কি? শরীরের গঠন, চেহারা, মুখের ছবি– সবকিছুই আছে। দুনিয়ার যে কোনও মেয়েই হোক, ওই বদমায়েশটা এক লহমায় তাকে মাৎ করে দেবে, তার পর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠেলে দেবে পাপের রাস্তায়। আর কাউকে ভালোবেসে তার প্রতি অনুগত থাকার কথা যদি তোলেন, তবে ওরকম হাড়েটক বেইমানের জুড়ি পাবেন না।

আগে যেতে যেতে যুবতী কী শুধাল, আচ্ছা, কী বলছিলুম, ওই যে… তোমার ছেলেটি বেঁচে আছে তো?

বেঁচে আছে, মা ঠাকরুন, দিব্য জলজ্যান্ত বেঁচে আছে ওর আর ভাবনা কিসের? ওদের যখন কেউ চায় না তখনই তারা প্রাণটাকে আঁকড়ে ধরে আরও জোর দিয়ে।

বাচ্চাটাকে দিল কে?

কে জানে? ঘটে গেল–বলতে পারেন মোটামুটি। মেলা বন্ধু-বান্ধব থাকলে ওরকম ধারা ঘটে যায় বইকি।

ওই ছোঁড়াটা আমাদের সঙ্গে কি অনেকদিন ধরে আছে?

কার কথা বলছেন? সেরগেই?

হ্যাঁ।

মাসখানেক হবে। আগে সে কচনদের ওখানে কাজ করত। সেখানকার মুনিব ওকে খেদিয়ে দেন। তার পর গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, লোকে বলে সেখানে খুদ কত্রীর সঙ্গে প্রেম করেছিল… জাহান্নমে যাক ব্যাটা। সাহসটা দেখুন তো।

.

০৩.

মধুর মধুর গরম, দুধের মতো সাদা প্রায়ান্ধকার নেমে এসেছে শহরের ওপর। জলের বাঁধের মেরামতির কাজ থেকে জিনোভিই এখনও ফেরেনি। সে রাত্রে শ্বশুরও বাড়িতে নেই। তার এক প্রাচীন দিনের বন্ধুর জন্মদিনের পরবে বুড়ো সেখানে গেছে। বলে গেছে রাত্রেও বাড়িতে খাবে না; কেউ যেন তার জন্য অপেক্ষা না করে। আর কিছু করবার ছিল না বলে কাতেরিনা সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে শোবার ঘরের খোলা জানালার উপর হেলান দিয়ে বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। রান্নাঘরে মজুরদের খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন তারা আঙিনার উপর দিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আপন আপন শোবার জায়গায় যাচ্ছে। কেউ গোলাবাড়িতে, কেউ মরাইয়ে, কেউ মিঠে মিঠে গন্ধের খড়ের গাদার দিকে। রান্নাঘর থেকে বেরুল সেরগেই সর্বশেষে। সে প্রথম আঙিনার চতুর্দিকে ব্লোদ দিয়ে তদারকি করল, কুকুরগুলোর চেন খুলে দিল, শিষ দিতে দিতে কাতেরিনার জানালার নিচে দিয়ে যাবার সময় উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন জানাল।

জানালার পাশে বসে কাতেরিনা মৃদুকণ্ঠে প্রত্যাভিবাদন জানাল– বিরাট আঙিনা খানিকক্ষণের ভিতরই নির্জন প্রান্তরের মতো নিঃশেষ হয়ে গেল।

মিনিট দুই যেতে না যেতে কাতেরিনার চাবি-বন্ধ ঘরের বাইরে কে যেন ডাকল, ঠাকরুন!

কাতেরিনা ভীতকণ্ঠে জিগ্যেস করল, কে?

কেরানি উত্তর দিল, দয়া করে ভয় পাবেন না। আমি। আমি সেরগেই।

কী চাই তোমার, সেরগেই?

আমি আপনার দয়া ভিক্ষা করতে এসেছি, কাতেরিনা ভড়না; একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনার অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে এসেছি– আমাকে কৃপা করে এক মিনিটের জন্য ভিতরে আসতে দিন।

কাতেরিনা চাবি ঘুরিয়ে দোর খুলে দিয়ে সেরগেইকে ঘরে ঢুকতে দিল।

কী ব্যাপার, কী চাই? জানালার কাছে ফিরে গিয়ে কাতেরিনা শুধালো।

আমি আপনার কাছে এলুম জিগ্যেস করতে, আপনার কাছে চটি বই-টই কিছু আছে? আমাকে যদি দয়া করে পড়তে দেন। এখানে কী দুর্বিষহ একঘেয়ে জীবন।

কাতেরিনা উত্তর দিল, আমার কাছে কোনওপ্রকারেরই বই নেই, সেরগেই। আমি তো পড়িনে।

সেরগেই ফরিয়াদ করল, কী একঘেয়ে জীবন!

তোমার জীবন একঘেয়ে হবে কেন?

অপরাধ যদি না নেন তবে নিবেদন করি, একঘেয়ে লাগবে না কেন? আমার এখন যৌবন কাল, অথচ আমরা এখানে আছি মঠের সন্ন্যাসীদের মতো। আর ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, এই নির্জনতাতেই আমাকে পচে হেজে খতম হতে হবে, যতদিন না আমার কফিন-বাক্সের*[* বাঙালি মুসলমান কফন বা কাফন বলতে শবাচ্ছাদনের বস্ত্র বোঝে। (ইংরেজি শ্রাউড) শব্দটি ফারসির মাধ্যমে আরবি থেকে এসেছে। ইউরোপীয় ভাষায় কফিন বলতে যে কাঠের বা পাথরের বাক্সে মৃতদেহ রেখে গোর দেওয়া হয় সেই বাক্স বোঝায়। উভয় শব্দই খুব সম্ভব গ্রিক কফিনস থেকে এসেছে। ইংরেজি কফার পেটিকা- এই শব্দ থেকেই এসেছে। –অনুবাদক।] ডালায় পেরেক ঠোকা হয়। মাঝে মাঝে আমি যে নৈরাশ্যের কোন চরমে পৌঁছই তা আর কী করে বোঝাই!

বিয়ে কর না কেন?

বিয়ে করব? বলা বড় সোজা! এখানে আমি বিয়ে করব কাকে? আমি তো বিশেষ কিছু জমিয়ে উঠতে পারিনে, আর বড়লোকের মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন? ওদিকে গরিব বলেই আমাদের শ্রেণির মেয়ে মাত্রই লেখাপড়ার ধার ধারে না– সে তো আপনি জানেন, কাতেরিনা ভভূনা। তারা কি কখনও সত্যি সত্যি বুঝতে পারে, প্রেম বলতে কী বোঝায়! শুধু তাই নয়, বড়লোকদের ভিতর এ বিষয়ে কী ধারণা সেটাও একবার চিন্তা করুন তো। এই ধরুন আপনার কথা; আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, সামান্যতম স্পর্শকাতরতা যার হৃদয়ে আছে তার কাছে আপনি সান্তনার চিরন্তন উৎস। অথচ দেখুন দিকিনি তারা আপনাকে নিয়ে কী করছে? ময়না পাখিটির মতো খাঁচায় পুরে রেখেছে।

কাতেরিনার মুখ থেকে ফস্কে গেল, কথাটা সত্যি। আমি নিঃসঙ্গ।

তাই একঘেয়ে লাগবে না তো কী লাগবে মাদাম যেভাবে আপনি জীবনযাপন করছেন? আপনার অবস্থায় অন্যেরা যা করে থাকে, আপনার যদি সেরকম উপরি কেউ থাকতও, তবুই-বা কী হত? তার সঙ্গে দেখা করাও তো আপনার পক্ষে অসম্ভব।

এই! তুমি… একটু সীমা পেরিয়ে যাচ্ছ। আমার একটি বাচ্চা থাকলেই, আমার তো মনে হয় আমি সুখী হতুম।

কিন্তু একটু চিন্তা করুন; আমাকে যদি অনুমতি দেন তবে বলি, বাচ্চা জন্মাবার জন্য তার পিছনে তো কোনও-কিছু-একটা চাই বাচ্চা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না। আপনি কি মনে করেন আমি জানিনে আমাদের ব্যবসায়ীদের বউ-ঝিরা কীভাবে জীবন কাটায়– এত বছর আমার মুনিবদের মাঝখানে বাস করেও? আমাদের একটা গীত আছে, আপন হৃদয়ে প্রেম না থাকলে, জীবন সে তো শুধু বিষণ্ণ দুরাশা! আর সেই দুরাশা, সেই কামনা– আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি কাতেরিনা ভভূনা, আমার হৃদয় এমনই বেদনায় ভরে দিয়েছে যে, ইচ্ছে করে ইস্পাতের ছুরি দিয়ে হৃদয়টাকে বুকের মাঝখান থেকে কেটে বের করে আপনার কচি দুটি পায়ের উপর রাখি। আমি তা হলেই শান্ত হব শতগুণ শান্তি ফিরে পাব।

তোমার হৃদয় সম্বন্ধে কী যা-তা সব তুমি আমাকে বলছ? তার সঙ্গে আমার তো কোনও সম্পর্ক নেই। তুমি এইবার আস্তে আস্তে রওনা দাও।

না, দয়া করুন, ঠাকরুন। সেরগেই ততক্ষণে কাতেরিনার দিকে এক পা এগিয়ে এসেছে, তার সমস্ত শরীর তখন কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে উঠছে। আমি জানি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি, স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনার জীবনও এ পৃথিবীতে আমার জীবনের মতোই অত সহজ সরলভাবে বয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু এখন শুধুমাত্র একটি কথা– একথাগুলো সে। বলে গেল এক নিশ্বাসে– এখন, এই মুহূর্তে, সবকিছু আপনার হাতে, আপনার তাঁবেতে।

কী চাও তুমি? এসব কী হচ্ছে? এখানে আমার কাছে তুমি এসেছ কেন? আমি এখুনি জানালা দিয়ে লাফ দেব–কাতেরিনা যখন একথাগুলো বলছিল তখন তার মনে হচ্ছিল, কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় ভয় তাকে অসহ্য বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে। সে তখন জানালার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরে আছে।

ওগো, আমার তুলনাহীনা, ও আমার জীবনসমা! জানালা দিয়ে লাফ দেবার কী প্রয়োজন?—সহজ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সেরগেই এ কথাগুলো কাতেরিনার কানে কানে মৃদুস্বরে বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানালা থেকে টেনে এনে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল।

ও, ও! আমাকে ছাড়– মৃদু কাতর কণ্ঠে কাতেরিনা বলল; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সেরগেইর নিবিড় চুম্বনবর্ষণে তার শক্তি যেন ক্রমেই লোপ পাচ্ছিল! আপন অনিচ্ছায় তার দেহ কিন্তু সেরগেইয়ের দেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।

সেরগেই তার কত্রীকে শূন্যে তুলে নিয়ে দুই বাহুতে করে যেন একটি ছোট্ট বাচ্চাকে তুলে ধরেছে– ঘরের অন্ধকার কোণে নিয়ে গেল।

সমস্ত ঘরে নীরবতা– শুধু শিয়রের খাড়া তক্তাতে ঝোলানো কাতেরিনার স্বামীর পোশাকি ট্র্যাকঘড়িটি টিকটিক করে যাচ্ছে; কিন্তু সে আর কী বাধা দেবে!

যাও। আধঘণ্টা পরে কাতেরিনা সেরগেইয়ের দিকে না তাকিয়েই আলুথালু চুল ছোট্ট একটি আয়নার সামনে ঠিক করতে করতে বলল।

এখন আর আমি যাব কেন? বিশ্ব-সংসার খুঁজলেও তো এখন আর কোনও কারণ পাওয়া যাবে না। সেরগেইয়ের কণ্ঠে এখন উল্লাসের সুর।

শ্বশুরমশাই বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দেবেন যে।

কী বললে, আমার পরানের মণি? এতদিন ধরে তুমি কি শুধু তাদেরই নিয়ে নাড়াচাড়া করেছ যারা রমণীর কাছে পৌঁছতে হলে দরজা ভিন্ন অন্য কোনও পথ জানে না? আমার ভিন্ন। ব্যবস্থা। তোমার কাছে আসতে হলে, তোমার কাছ থেকে যেতে হলে আমার জন্য বহু দরজা খোলা রয়েছে। ব্যালকনির খুঁটি দেখিয়ে উত্তর দিল তরুণ।

.

০৪.

জিনোভিই সাত দিন হল বাড়ি ফেরেনি, আর এই সমস্ত সপ্তাহ ধরে তার স্ত্রী প্রতিটি রাত্রি সেরগেইয়ের সঙ্গে কাটিয়েছে সরস রভসে– শুভ্র প্রভাতের প্রথম আলোর প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত।

এই সাত রাত ধরে জিনোভিই বরিসিচের বেডরুমে শ্বশুরমশাইয়ের ভাড়ার থেকে নিয়ে আসা প্রচুর ওয়াইন পান করা হল, প্রচুর মিষ্ট-মিষ্টান্ন খাওয়া হল, তরুণী গৃহকত্রীর মধুভরা ঠোঁট থেকে প্রচুর চুম্বন চুমুকে চুমুকে তোলা হল, তুলতুলে বালিশের উপর ঘন কৃষ্ণ অলকগুচ্ছ নিয়ে খেলাভরে প্রচুর আদর-সোহাগ করা হল। কিন্তু হায়, কোনও পথই আদ্যন্ত মসৃণ নয়– মাঝে মাঝে হোঁচট-ঠোক্করও খেতে হয়।

বরিস তিমোতেইচের চোখে সে-রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বুড়ো রাত্রির লম্বা রঙিন ঝোল্লা পরে এ-ঘর ও-ঘর বেড়াচ্ছিল; জানালার কাছে এসে বাইরের দিকে তাকাল, তার পর আরেকটা জানালার কাছে এসে দেখে, লাল শার্ট পরা সেই খাপসুরৎ ছোকরা সেরগেই তার পুত্রবধূর জানালার একটা খুঁটি বেয়ে অতিশয় নীরব নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে। বরিস তিমোতেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়ে চেপে ধরল রোমিও নটবরের পা দুখানা। সে তখন সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় চেয়েছিল বুড়োকে একখানা খাঁটি বিরাশি সিক্কা লাগায়– আকস্মিক উৎপাতে তারও মেজাজটা গিয়েছিল বিগড়ে– কিন্তু সেটা আর লাগল না, ভাবল, তা হলে একটা হট্টগোল আরম্ভ হয়ে যাবে।

বরিস তিমোতেই জিগ্যেস করল, বল্ ব্যাটা চোর, কোথায় গিয়েছিলি?

সেরগেই উত্তর দিল, লাও! শুধোচ্ছি, কোথায় গিয়েছিলুম আমি! যেখানেই গিয়ে থাকি না কেন, সেখানে আমি আর এখন নেই। হল, বরিস তিমোতেই মহাশয়, প্রিয়বরেষু!

আমার ছেলের বউয়ের ঘরে তুই রাত কাটিয়েছিস?

ওই কথাটাই যদি জিগ্যেস করলেন কর্তা-ঠাকুর, তা হলে আবার বলি, আমি জানি, আমি রাত্তিরটা কোথায় কাটিয়েছি; কিন্তু এইবেলা তোমাকে একটি খাঁটি তত্ত্বকথা বলছি আমি, বরিস তিমোতেইচ; যা হয়ে গিয়েছে সেটা তুমি আর কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারবে না। খামোখা কেন তোমাদের শিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবারের ওপর এখন ফালতো কেলেঙ্কারি টেনে আনবে– অন্তত সেটা তো ঠেকাতে পারো। এখন আমাকে সরল ভাষায় বল, আমাকে কী করতে হবে। তুমি কী দান পেলে সন্তুষ্ট হবে?

তোকে আমি পাঁচশো ঘা চাবুক কশাব, ব্যাটা পিচেশ।

দোষ আমারই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক! সাহসী নাগর স্বীকৃত হল। এবারে বল তোমার সঙ্গে কোথায় যেতে হবে; প্রাণ যা চায় সেই আনন্দ করে নাও আমার রক্ত চেটে নাও।

বরিস তখন সেরগেইকে শানে তৈরি তার ছোট্ট একটি গুদামঘরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক চাবকাতে আরম্ভ করল। যখন বুড়োর আর চাবুক মারার মতো শক্তি একরত্তিও রইল না তখনই থামল। সেরগেইয়ের গলা থেকে কিন্তু একবারের তরেও এতটুকু আৰ্তরব বেরোয়নি, তবে হ্যাঁ, শার্টের আস্তিনে সে যে দাঁত কিড়িমিড়ি করে কামড়ে ধরেছিল তার অর্ধেকখানা শেষ পর্যন্ত সে চিবিয়ে কুটি কুটি করে ফেলেছিল।

সেরগেই মাটিতে পড়ে রইল। চাবুকে চাবুকে তার পিঠ তখন কামারের আগুনে পোড়া কড়াইয়ের মতো লাল হয়ে গেছে। সেটা শুকোবার সময় দিয়ে বুড়ো তার পাশে একঘটি জল রেখে গুদামঘরের দোরে বিরাট একটা তালায় চাবি মারল। তার পর ছেলেকে আনবার জন্য লোক পাঠাল।

কিন্তু এই আজকের দিনেও*[* ১৮৬৫ খ্রি.] রাশার বড় রাস্তা ছাড়া অন্য রাস্তায় ছ মাইল পথ আসা-যাওয়া সাততাড়াতাড়িতে হয়ে ওঠে না, ওদিকে আবার কাতেরিনা যে সময়টুকু না হবার নয় তার বেশি একটি মাত্র ঘণ্টাও সেরগেই বিহনে কাটাতে পারে না। তার সুপ্ত প্রবৃত্তি তখন অকস্মাৎ পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়ে উঠেছে এবং ফলে সে এমনই দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উঠেছে যে, তখন তার পথ রোধ করে কার সাধ্য! আতিপাতি খুঁজে সে বের করে ফেলেছে সেরগেই কোথায়। সেখানে লোহার দরজার ভিতর দিয়ে সেরগেইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে ছুটল চাবির সন্ধানে।

শ্বশুরের কাছে গিয়ে মিনতি জানাল, সেরগেইকে ছেড়ে দাও, বাবা, লক্ষ্মীটি।

বুড়োর মুখের রঙ সেফ সবুজ হয়ে গেল। এতখানি বেহায়ামির দুঃসাহস সে তার পাপিষ্ঠা পুত্রবধূর কাছে প্রত্যাশা করেনি– কারণ পাপিষ্ঠা হোক আর বেহায়াই হোক, এতদিন সে ছিল বড় বাধ্য মেয়ে।

এ কী আরম্ভ করলি তুই, তুই অমুক-তমুক?– বুড়ো অশ্লীল ভাষায় তার বেহায়াপনা নিয়ে কটুকাটব্য আরম্ভ করল।

ওকে যেতে দাও, বাবা। আমি আমার বিবেক সাক্ষী রেখে শপথ করছি আমরা এখনও কোনও পাপাচার করিনি।

পাপাচার করেনি! ওহ! বলে কী?– বুড়ো যেন আর কিছু না করতে পেরে শুধু দাঁত কিড়িমিড়ি দিতে লাগল। এ ক-রাত্তির ধরে তোমরা উপরে কী করে সময় কাটাচ্ছিলে? দুজনাতে মিলে তোমার স্বামীর বালিশের ফেঁসো ফুলিয়ে ফালিয়ে তার জন্য জুৎসই করে রাখছিলে।– বুড়ো ব্যঙ্গ করে উঠল।

কাতেরিনা কিন্তু নাছোড়বান্দা; সেই এক বুলি ক্রমাগত বলে যেতে লাগল, ওকে ছেড়ে দাও, ফের আবার ওকে ছেড়ে দাও।

বুড়ো বরিস বলল, এই যদি তোর বাসনা হয় তবে শুনে নে; তোর স্বামী ফেরার পর তোকে বাইরের ওই আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে আমরা দুজনাতে আপন হাতে চাবুক মারব–সতী সাধ্বী রমণী কি না তুই! আর ওই ব্যাটাকে নিয়ে কী করা হবে শুনবি–ইতর বদমাইশটাকে কালই পাঠাব জেলে!।

এই ছিল বরিস তিমোতেইচের সিদ্ধান্ত; শুধু এইটুকু বলার আছে যে, সে সিদ্ধান্ত কখনও কর্মে রূপান্তরিত হল না।

০৫. ব্যাঙের ছাতা আর গমের পরিজ

০৫.

সেই রাত্রে বরিস ব্যাঙের ছাতা আর গমের পরিজ খেয়েছিল। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তার বুক-জ্বালা আরম্ভ হল। হঠাৎ তলপেটে তার অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হতে লাগল। খানিকক্ষণ পর বমির চোটে যেন তার নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতে লাগল এবং ভোরের দিকে সে ভবলীলা সংবরণ করল; হুবহু যেরকম গুদামবাড়ির ইঁদুরগুলো মারা যায়। এদেরই উপকারার্থে কাতেরিনা আপন হাতে একরকমের মারাত্মক সাদা গুঁড়ো মাখিয়ে খাবার তৈরি করত– এ গুড়োটা কাতেরিনার হেফাজতেই থাকত।

কাতেরিনা তার আপন সেরগেইকে বুড়োর গুদামঘর থেকে মুক্ত করে নিয়ে সক্কলের চোখের সামনে, কণামাত্র লজ্জা-শরম না মেনে, শৃশুরের চাবকানো থেকে সেরে ওঠার জন্য। তাকে তার স্বামীর বিছানায় আরাম করে শুইয়ে দিল। ওদিকে কালবিলম্ব না করে শ্বশুরকে খ্রিস্টধর্মের আচার-অনুষ্ঠানসহ গোর দেওয়া হল। অবশ্য লক্ষণীয় বলে মনে হতে পারে, কারও মনে কোনও সন্দেহের উদয় হয়নি; বরিস তিমোতেই যদি মরে গিয়ে থাকে তবে, যা, সে নিশ্চয়ই মারা গেছে ব্যাঙের ছাতা খেয়ে আর, ওরকম কত লোক তো ব্যাঙের ছাতা খেয়ে আকছারই মারা যায়। ছেলের জন্য অপেক্ষা না করেই বুড়ো বরিসকে সাত-তাড়াতাড়ি গোর দেওয়া হয়েছিল, কারণ বছরের ওই সময়টার ভাপসা গরম পড়ে*[* ফলে মৃতদেহ খুব তাড়াতাড়ি পচতে আরম্ভ করে। অনুবাদক।] আর যে লোকটা খবর নিয়ে গিয়েছিল সে জিনোভিই বরিসিচকে মিলে পায়নি। ষাট মাইল আরও দূরে সে সস্তা কিছু জঙ্গলা জমির খবর পায় এবং সেটা দেখতে সে ওইদিকে চলে গিয়েছিল। যাবার সময় সে আবার কাউকে পরিষ্কার করে বলে যায়নি ঠিক কোন জায়গায় যাচ্ছে।

সব ব্যবস্থা করে নেবার পর কাতেরিনা একদম বে-লাগাম হয়ে গেল। ভীরু সে কোনও কালেই ছিল না, কিন্তু এখন তার মনের ভিতর কী খেলছে তার কোনও পাত্তাই কেউ পেল না। পুরো পাক্কা হিম্মতভরে সে চলাফেরা করতে লাগল, বাড়ির সর্বপ্রকার কাজকর্মে ঠিকমতো তদারকি করল এবং সেরগেইকে এক লহমার তরে চোখের আড়াল হতে দিত না। বাড়িতে যারা কাজ করত তারা সবাই এসব দেখে তাজ্জব; কিন্তু কাতেরিনা দরাজ হাত দিয়ে প্রত্যেককে বশীভূত করার তত্ত্বটি বিলক্ষণ জানত, সর্ববিস্ময় তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

যে যার আপন মনে অনুমান করল, কীঠাকুরানী আর সেরগেইয়ের ভিতর চলছে বেলেল্লাপনা– ওই হল গিয়ে মোদ্দা কথা! এখন তো ওটা তারই শিরঃপীড়া, আমাদের কী, আর জবাবদিহি তো করতে হবে একলা তাকেই।

ইতোমধ্যে সেরগেই তার স্বাস্থ্য, তার নমনীয় মাধুর্য পুনরায় ফিরে পেয়েছে আর বীরদের সেরা বীরের মতো আবার কাতেরিনার উপরে শিকারি পাখির মতো চক্কর খেতে শুরু করেছে। আবার আরম্ভ হয়েছে তাদের আনন্দময় দিন-যামিনী! কিন্তু কালবেগ শুধু ওদের দুজনার তরেই তো আর এগিয়ে যাচ্ছিল না। ওদিকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর স্বামী হিসেবে বিড়ম্বিত জিনোভিই বরিসি দ্রুতবেগে আপন গৃহমুখে ধাবিত হয়েছে।

.

০৬.

আহারাদি শেষ করা হয়েছে। বাইরে তখনও দুর্দান্ত গরম আর চটপট যেদিক-খুশি সেদিকে মোড় নিতে ওস্তাদ মাছিগুলোর উৎপাত অসহ্য হয়ে উঠেছে। কাতেরিনা তার শোবার ঘরের জানালার খড়খড়িগুলো বন্ধ করে তার উপরে ভিতরের দিকে একখানা ফ্ল্যানেলের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে বণিক সম্প্রদায়ের সমাদৃত উঁচু খাটে সেরগেইকে নিয়ে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়েছে। কাতেরিনা ন্দ্রিা জাগরণে আসা-যাওয়া করছে, কিন্তু নিদ্রাই হোক আর জাগরণই হোক, তার মনে হচ্ছিল যেন তার মুখ ঘামে ভেসে যাচ্ছে আর প্রত্যেকটি নিশ্বাস অত্যন্ত গরম আর অতিশয় কষ্টের সঙ্গে ভিতরে যাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল ঘুম থেকে উঠে বাইরের বাগানে বসে চা খাবার বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আপ্রাণ শত চেষ্টাতেও সে কিছুতেই উঠে বসতে পারছিল না। শেষটায় রাঁধুনী এসে দরজায় টোকা দিল।

প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সে পাশ ফিরল, তার পর একটা হুলো বেড়ালকে আদর করতে লাগল। কারণ ইতোমধ্যে একটা খাসা সুন্দর, পুরোবাড়ন্ত, …র মতো মোটাসোটা, খাজনা উশুলের পেয়াদার মতো বিরাট একজোড়া গোঁফওলা বাদামি রঙের বেড়াল এসে তার আর সেরগেইয়ের মাঝখানে গা ঘষতে আরম্ভ করেছে। কাতেরিনা তার ঘন লোমের ভিতর আঙুল চালিয়ে তাকে আদর করতে লাগল আর বেড়ালটাও তার ভোতা মুখ আর বোঁচা নাক দিয়ে কাতেরিনার কঠোর-কোমল বুকে চাপ দিচ্ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সোহাগের ঘর ঘরর শব্দ ছেড়ে যেন গান গাইছিল– কাতেরিনার প্রেম নিয়ে, অতি কোমল মোলায়েম সুরে।

কাতেরিনা অবাক হয়ে ভাবছিল, এই হোল্কা মোটকা বেড়ালটা ঘরে ঢুকলই-বা কী করে আর এলই-বা কেন? কাতেরিনা আবার আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, আমি খানিকটে সর জানালার চৌকাঠের উপর রেখেছিলুম; এই পাজি হুলোটাকে যদি তাড়া লাগিয়ে খেদিয়ে না দিই তবে সে বেবাক সর চেটে মেরে দেবে। বেড়ালটাকে পাকড়ে ধরে বাইরে ফেলে দেবার সে যতই চেষ্টা করতে লাগল ততই সে যেন ঠিক কুয়াশার মতো তার আঙুলের ভিতর দিয়ে বার বার গলে যেতে লাগল। বোবায় ধরা দুঃস্বপ্নের ভিতরও কাতেরিনা মনে মনে তর্ক করতে লাগল, তা সে যাকগে, কিন্তু এই হুলো বেড়ালটা এখানে আদৌ এল কোত্থেকে? আমাদের শোবার ঘরে তো কস্মিনকালেও কোনও হুলো বেড়াল ছিল না; তবু, দেখ, কীরকম একটা ইয়া লাশ এখানে ঢুকে পড়েছে! আবার কাতেরিনা তাকে পাকড়াবার চেষ্টা করল, আবার বেড়ালটা হাওয়া হয়ে গেল। মনে তার ধোঁকা লাগল, বা রে! এটা তবে কী? দেখি ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে- এটা কি আদপেই হুলো বেড়াল নাকি? হঠাৎ এক দারুণ ভয়ের বিভীষিকা যেন তার সর্বাঙ্গ চেপে ধরে কুলে নিদ্রা আর ন্দ্রিালু ভাব খেদিয়ে দিল। কাতেরিনা ঘরের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখে বেড়ালটার নামগন্ধও নেই। শুধু তার সুদর্শন সেরগেই পাশে শুয়ে তার বুকের মাঝখানে আপন গরম মুখটি খুঁজে দিয়েছে।

কাতেরিনা বিছানায় উঠে বসল; চুম্বনে চুম্বনে সে সেরগেইকে আচ্ছন্ন করে দিল। তার আদর সোহাগ যেন শেষ হতেই চায় না। তার পর হাঁসের বুকের নরম পালকের আলুথালু বিছানাটাকে ছিমছাম করে দিয়ে বাগানে চা খেতে চলে গেল। সূর্য তখন অস্তাচলে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে আর উষ্ণগর্ভা পৃথিবীর উপরে নেমে আসছে অপূর্বসুন্দর, সম্মোহনী সন্ধ্যা।

ফুলে ফুলে ঢাকা আপেলগাছের তলায় রাগ-এর উপর বসল কাতেরিনা চা খেতে। আকসিনিয়াকে বলল, বড্ড বেশি ঘুমোতে ঘুমোতে অবেলা হয়ে গেল। তার পর বাসন পোছার কাপড় দিয়ে একটা পিরিচ পুঁছতে পুঁছতে রাঁধুনীকে শুধালো, আচ্ছা, বল তো, এসবের অর্থ কী আকসিনিয়া, সোনা?

কী? কিসের কী অর্থ, মা?

ওটা কিন্তু নিছক স্বপ্ন ছিল না। কোথাকার কোন এক হুলো বেড়াল বার বার শুধু আমার গা বেয়ে উঠছিল। আর-পাঁচটা বেড়ালের মতো হুবহু জলজ্যান্ত বেড়াল। এর অর্থ কী?

এসব আপনি কী বলছেন?

সত্যি বলছি, একটা বেড়াল আমার গা বেয়ে উঠছিল।

কীভাবে বেড়ালটা তার গা বেয়ে উঠছিল সেসব কথা তখন কাতেরিনা তাকে বলল।

আপনি আবার ওটাকে আদর করতে গেলেন কেন?

তা, বাপু, আমাকে জিগ্যেস করছ কেন? আমি নিজেই জানিনে, ওটাকে আদর করলুম কেন।

সত্যি সত্যি, বড়ড়ই তাজ্জব ব্যাপার এটা!

আমার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা নেই। এটাতে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে কেউ না কেউ আপনার শত্রুতা না করে ছাড়বে না। কিংবা ওই ধরনেরই কিছু একটা হবে।

হ্যা। কিন্তু ঠিক কী?

ঠিক ঠিক হুবহু কী হবে সেটা কেউই আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না, –ঠিক ঠিক, হুবহু কেউই পারবে না, সোনা মা, শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, একটা না একটা কিছু ঘটবেই ঘটবে।

কাতেরিনা বলল, আমি ঘুমে বার বার শুক্লপক্ষের ফালি চাঁদ দেখছিলুম, আর সেই বেড়ালটা।

ফালি চাঁদ?– তার অর্থ বাচ্চা হবে।

কাতেরিনার মুখ লাল হয়ে উঠল।

সেরগেইকে কি তোমার কাছে এখানে নিচে পাঠিয়ে দেব, মা-মণি?– কলে-কৌশলে ইঙ্গিত দিলে আকসিনিয়া। আসলে কাতেরিনার বিশ্বাসের পাত্রী হওয়ার জন্যে তার প্রাণ যেন বেরিয়ে আসছিল।

হ্যা, সে-ও তো বেশ কথা! ওকে গিয়ে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে চা দেবখন।

আমিও তাই বলি– এখানে পাঠিয়ে দিই। আকসিনিয়াই প্রস্তাবটার নিষ্পত্তি করে দিল। তার পর পাতিহাঁসের মতো হেলেদুলে বাগানের গেটের দিকে চলল।

কাতেরিনা সেরগেইকেও বেড়ালটার কথা বলল।

সেরগেই বলল, কিছু না, স্রেফ দিবাস্বপ্ন।

কিন্তু সেরেজা, আমি এর আগে এরকম দিবাস্বপ্ন কখনও দেখিনি কেন, সেইটে বুঝিয়ে বল।

আগে কখনও হয়নি, এই প্রথম হল, এরকম জিনিস তো নিত্যি নিত্যি হচ্ছে। এমন দিনও ছিল যখন আমি শুধু তোমাকে আড়চোখে একটুখানি দেখে নেবার সাহস করতে পারতুম না, আর তোমার জন্য আপন দুঃখে গুমরে মরতুম। আর এখন দেখ, সবকিছু বদলে গিয়েছে। এই যে তোমার শ্বেতশুভ্র দেহ– এর সমস্তটি এখন আমার।

সেরগেই কাতেরিনাকে বুকে ধরে আলিঙ্গন করল, তার পর শূন্যে তুলে ঘুরিয়ে নিয়ে কৌতুকভরে তাকে নরম কম্বলের উপর ফেলে দিল।

কাতেরিনা বলল, ওগো, আমার মাথা ঘুরছে। সেরেজা, এই দিকে এসো। আমার পাশে এসে বস।– সেরগেইকে ডাক দিয়ে কাতেরিনার অলস রভসার মৌন ইঙ্গিত দিয়ে শুয়ে পড়ল।

শুভ্র কুসুমদামে আচ্ছাদিত আপেলগাছের তলায় বেপরোয়া রসের নাগর হামা দিয়ে এসে কাতেরিনার পায়ের কাছে বসল।

আমাকে পাবার জন্য তুমি কাতর হয়েছিলে, না? সেরেজা?

তুমি যদি শুধু জানতে কতখানি কাতর হয়েছিলুম!

সেটা কীরকম ছিল, আমাকে বুঝিয়ে বল।

সে আমি কী করে বুঝিয়ে বলব? অপূর্ণ আকাক্ষার মর্মবেদনায় তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া কি কেউ কখনও বোঝাতে পারে? আমার ছিল সেই।

তা হলে, সেজো, তুমি যে নিজেকে তিলে তিলে মেরে ফেলছিলে সেটা আমি অনুভব করলুম না কেন? লোকে তো বলে সেটা নাকি অনুভব করা যায়।

সেরগেই নীরব থেকে এ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।

তা হলে তুমি হরদম গান গাইছিলে কী করে, যদি আমার জন্য এতখানি তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে মরছিলে? কিছু ভয় নেই। আমি সব জানি। তুমি যে উঁচু বারান্দায় গান গাইতে সে তো আমি শুনতে পেতুম।–কাতেরিনা সেরগেইকে আদর করতে করতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে যেতে লাগল।

গান গেয়েছিলুম তো কী হয়েছিল? একটা মশা জীবনভর গান গায়– সেটা কি ফুর্তির তোড়ে?– বিরস কণ্ঠে সেরগেই উত্তর দিল।

খানিকক্ষণের জন্য দুজনাই চুপচাপ। সেরগেইয়ের পূর্বরাগকীর্তন শুনে কাতেরিনার হৃদয় পরিপূর্ণ ভাবাবেশে বিহ্বল হয়ে গিয়েছে। কাতেরিনার বাসনা আরও কথা বলে কিন্তু সেরগেই ভুরু কুঁচকে কেমন যেন মৌত অবলম্বন করেছে।

ফুলে ফুলে ভরা আপেলগাছের শাখা-প্রশাখার পর্দার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ নীলাকাশ আর শান্ত প্রশান্ত পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে কাতেরিনা আবেশভরা কণ্ঠে বলে উঠল, দেখ দেখ, সেরেজা– এ যে স্বর্গপুরী, স্বর্গপুরীতে যেন মেলা বসেছে।

কাতেরিনা শুয়ে ছিল চিৎ হয়ে চাঁদের আলো আপেলগাছের ফুল আর পাতার ভিতর দিয়ে এসে কাতেরিনার মুখ আর দেহের উপর বিচিত্র শুভ্র আলপনার কম্প্রমান শিহরণ জাগাচ্ছিল; বাতাস স্তব্ধ, শুধু সামান্যতম ক্ষীণ মলয় অর্ধসুপ্ত পত্রাবলিতে ঈষৎ কম্পন জাগিয়ে পূর্ণকুসুমিত তরু আর নব উদাত তুণের মৃদু সৌরভ দূর-দূরান্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বাতাস যেন অলসাবেশে পরিপূর্ণ যেন সে বাতাস এনে দেয় সর্ব কর্মে অরুচি, আত্মার অসংযম, আর মনের ভিতর দুর্বোধ যত কামনারাজি।

কাতেরিনা কোনও সাড়া না পেয়ে আবার চুপ করে গেল, আর তাকিয়ে রইল ফিকে গোলাপি আপেলফুলগুচ্ছের ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে। সেরগেইও কথা বলছিল না কিন্তু তার চিত্তকে আকাশ বিমোহিত করেনি। আপন হাঁটু দুটো দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল আপন বুট-জোড়ার দিকে।

আহা, যেন স্বর্ণজ্যোতি দিয়ে তৈরি রাত্রিটি। শান্ত, লঘু, সৌরভভরা আর প্রাণদায়িনী ঈষৎ উষ্ণতা! দূরে বহুদূরে, উপত্যকার পিছনে, বাগানের বহুদূরে কে যেন ধরেছে সুরেলা গীত; ঘন চেরি-তরু-ভরা বাগানের বেড়ার কাছে গেয়ে উঠল একটি পাপিয়া শিহরিত উচ্চকণ্ঠে; উঁচু খুঁটিতে ঝোলানো কুয়েইল পাখিটি উত্তেজিত কণ্ঠে গেয়ে চলেছে সুরের প্রলাপ; ওদিকে আস্তাবলের দেয়ালের পিছনে বিরাট একটা অশ্ব তালু হ্রেষারব তুলল, আর বাগানের বাইরে গোচারণ মাঠের উপর দিয়ে একপাল কুকুর দ্রুতবেগে ছুটে চলে গিয়ে অর্ধভগ্ন প্রাচীন নুনের ভাণ্ডারের কালো আবছায়ায় বিলীন হয়ে গেল।

কনুইয়ের উপর ভর করে কাতেরিনা একটুখানি উঠে বাগানের লম্বা লম্বা ঘাসের দিকে তাকাল– উজ্জ্বল চন্দ্রালোক ঘাসের উপর পড়ে ঝিলিমিলি লাগিয়েছে, তারই আভা গাছগুলোর ফুলে পাতায় নেচে নেচে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যেন কল্পলোকের অবর্ণনীয়, অত্যুজ্জ্বল লক্ষ লক্ষ চন্দ্রচূর্ণ দীর্ঘ তৃণরাজিকে স্বর্ণমণ্ডিত করে দিয়েছে; এমনই তাদের নিরবচ্ছিন্ন কম্পন, এমনই তাদের নিরবচ্ছিন্ন স্পন্দন যে মনে হয় এরা বহ্নিশিখার প্রজাপতি কিংবা যেন বৃক্ষ নিম্নের তুণরাজি চন্দ্ররশ্মির জাল-আবরণে বন্দি হয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।

কাতেরিনা তাকিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, আহা, সেরেজা, কী মধুর, কী সুন্দর সব সব!

সেরগেই চতুর্দিকের দৃশ্যের দিকে তাচ্ছিল্য নয়নে একবার শুধু তাকাল।

তুমি অমন মনমরা হয়ে আছ কেন, সেরেজা? না, আমার ভালোবাসার প্রতিও তোমার অবসাদ এসে গেছে?

কী আবোল-তাবোল বকছ?– সেরগেই নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল; তার পর নিচু হয়ে কাতেরিনাকে অলসভাবে চুমো দিল।

কাতেরিনার হৃদয়ে হিংসা এসেছে; বলল, তুমি প্রতারণা করছ সেরেজা; তোমার প্রেমে স্থিরতা নেই।

সেরগেই শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল, তোমার কথাগুলো আমার উদ্দেশে বলেছ একথাই আমি স্বীকার করব না।

তা হলে তুমি আমাকে এভাবে চুমো খেলে কেন?

সেরগেই তাচ্ছিল্যভরে এর কোনও উত্তরই দিল না।

সেরগেইয়ের কোঁকড়া চুল নিয়ে খেলা করতে করতে কাতেরিনা বলে যেতে লাগল, স্বামী-স্ত্রীই তো শুধু একে অন্যকে এরকম চুমো খায়– যেন একে অন্যের ঠোঁট থেকে ঠোনা মেরে ময়লা মুছে দেয়। তুমি আমাকে এমন চুমো খাও, যেন আপেলগাছ উপর থেকে আমাদের উপর সবে-ফোঁটা ফুলের বর্ষণ লাগিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক এইরকম ঠিক এইরকম, ঠিক এইরকম! চুপি চুপি কানে কানে গুঞ্জন করল কাতেরিনা।- দয়িতকে ঘনতর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সে তখন হৃদয়াবেগে নিজেকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে কাতেরিনা বলল, সেরেজা, এবারে যা বলছি, তুমি মন দিয়ে শোন। আচ্ছা বল তো, সবাই কেন একবাক্যে বলে, তোমার প্রেমে স্থিরতা নেই।

আমার সম্বন্ধে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে এসব মিথ্যে কথা বলে কে?

সবাই তো এই কথা বলে।

হয়তো যেসব হাড়ে হাড়ে অপদার্থগুলোকে আমি ত্যাগ করেছি, তারাই।

ওরে হাবা, ওসব অপদার্থগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার তোমার কী দরকার ছিল? যে মেয়ে সত্যি অপদার্থ তার সঙ্গে তুমি আদপেই প্রেম করতে যাবে কেন?

বল, বলে যাও, বলা বড় সোজা। মানুষ কি সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা করে প্রেমে পড়ে? এর পিছনে কাজ করে একমাত্র প্রলোভন। ওদের কোনও একটার সঙ্গে বিধিভঙ্গ করলে অতি সোজা, কোনও মতলব না, কিছু না, ব্যস্ হয়ে গেল। তার পর মেয়েটা রইল তোমার গলায় ঝুলে! গুলে খাওগে তার পর সেই প্রেম।

তা হলে, শোন, সেরেজা! আমার পূর্বে কারা সব এসেছিল তাদের সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনে, আর আমি ওদের সম্বন্ধে কোনও কিছু জানতেও চাইনে। শুধু এইটুকু বলার আছে : তুমি নিজে আমাদের এই প্রেমের পথে আমাকে প্রলোভিত করে টেনে এনেছ, এবং তুমি নিজে খুব ভালো করেই জানো, আমি যে এতে পা দিয়েছি তার জন্য তোমার ছলা-কৌশল যতখানি দায়ী আমার নিজের কামনাও ততখানি– আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, সেরেজা, তুমি যদি কোনওদিন বেইমানি কর, তুমি যদি অন্য কারওর জন্য তা সে যে-ই হোক না কেন, আমাকে বর্জন কর, আমি তা হলে কস্মিনকালেও– মাফ কর, আমার হৃদয়ের বন্ধু এ-দেহে প্রাণ থাকতে কস্মিনকালেও তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে যাব না।

সেরগেই চমকে উঠল।

এসব কী বলছ, কাতেরিনা লুভরা, আমার চোখের মণি। আমাদের অবস্থাটার দিকে একবার ভালো করে চেয়ে দেখ। তুমি এখুনি লক্ষ করেছ, আমি কীরকম আনমনা হয়ে বসে ছিলুম কিন্তু তুমি একবারও শান্ত হয়ে ভাবো না, এই আনমনা হওয়াটা আমি ঠেকাতে পারি কি না। তুমি তো জানোই না, আমার বুকের ভিতর কীরকম শক্ত শক্ত রক্তের টুকরো জমা হয়ে আছে।

তোমার কী বেদনা, সেরেজা, তোমার বেদনা আমায় বল!

এর আবার বলার কী থাকতে পারে? প্রথম দেখ অল্পদিনের মধ্যেই, ঈশ্বরের আশীর্বাদে তোমার স্বামী এসে উদয় হবেন, আর তুমি বলবে– সেরগেই ফিলেপিচ, দূর দূর বেরো এখান থেকে আর যা তুই ওই পেছনের আঙিনায়, ছোকরারা যেখানে গান-টান গাইছে। আর সেখান থেকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ, কাতেরিনা ভার শোবার ঘরে ছোট্ট পিদিমটি জ্বলছে, আর তিনি কীরকম পালকের তুলতুলে বিছানাটি দু-হাত দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জুৎসই করে তার সাতপাকের সোয়ামীর সঙ্গে শুয়ে আরাম করতে যাচ্ছেন।

অসম্ভব! ওরকমধারা কখনোই হবে না- সোল্লাসে টানা টানা সুরে কাতেরিনা কথাগুলো বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে কচি একখানি হাত নাড়িয়ে সেরগেইয়ের কথাগুলো যেন সামনের থেকে সরিয়ে দিল।

কেন হবে না? আমি যতদূর দেখতে পাচ্ছি, এ পরিস্থিতি থেকে বেরোবার জন্যে তোমার তো কোনও পথই নেই। তা সত্ত্বেও, বুঝলে কাতেরিনা ভনা, আমারও একটা আপন হৃদয় আছে, আর নিদারুণ যন্ত্রণাটি আমি অনুভব করতে পারি।

ব্যস্ ব্যস, হয়েছে। তোমার যথেষ্ট বলা হয়ে গিয়েছে।

সেরগেইয়ের এই হিংসের অনুভূতিটা কাতেরিনাকে বড়ই আনন্দ দিল। জোরে হেসে উঠে সে ফের সেরগেইকে চুমোর পর চুমো খেতে লাগল।

অতি সাবধানে কাতেরিনার সম্পূর্ণ অনাচ্ছাদিত বাহুপাশ থেকে নিজের মস্তকটি মুক্ত করতে করতে সেরগেই কথার খেই ধরে বলে যেতে লাগল, দ্বিতীয়ত, সমাজে আমার যে হীনতম অবস্থা সেটাই আমাকে বহুবার বাধ্য করেছে ব্যাপারটা সবদিক দিয়ে বিবেচনা করতে। এই মনে কর, আমি যদি সমাজে, তোমার ধাপের মানুষ হতুম, আমি যদি ভদ্রলোক বা ব্যবসায়ী হতুম, তা হলে এ দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি হতুম না– কাতেরিনা ভনা। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতিটা–তুমি নিজেই বিবেচনা করে দেখ তোমার কাছে দাঁড়ালে আমি কে? অল্প দিনের ভিতরই তোমার স্বামী যখন তোমার কচি সাদা হাতটি ধরে তোমাদের শোবার ঘরে তোমাকে নিয়ে যাবে, আমাকে তখন সেটা নীরব হৃদয়ে সয়ে নিতে হবে, এবং হয়তো সেই কারণেই আমি নিজেকে বাকি জীবন ধরে ঘেন্না করব। কাতেরিনা ভা! বুঝলে আমি তো সে দলের নই যারা যে কোনও একটা রমণীর সঙ্গে ফুর্তি করতে পারলেই অন্য কোনও কিছুর পরোয়া করে না। প্রেম সত্য সত্য কী, সে অনুভূতি আমার আছে, আর সেটা যেন কালনাগিনীর মতো আমার বুকের রক্ত শুষে শুষে খাচ্ছে।

কাতেরিনা বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু এসব কথা তুমি আমাকে বার বার বুঝিয়ে বলছ কেন?

কাতেরিনা লভভনা! না বলে করি কী, বল। কী করি বল। হয়তো-বা এতদিনে সবকিছু তোমার স্বামীকে কাগজে-কলমে ভালো করে বুঝিয়ে রিপোর্ট করা হয়ে গিয়েছে, খুব বেশি দূরের কথা নয়, হয়তো-বা আসছে কাল থেকেই এখানে আর সেগেইকে দেখতে পাওয়া যাবে না, তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না।

না, না, ও নিয়ে তুমি একটি মাত্র কথা বল না, সেরেজা! এটা কস্মিনকালেও হতে পারে। যা হোক তা হোক, তোমাকে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। চুম্বনে-আলিঙ্গনে সোহাগ করে কাতেরিনা সেরগেইকে প্রবোধ দিতে লাগল। চূড়ান্ত নিষ্পত্তি যদি একদিন করবার সময়ই আসে, তবে… হয় নিয়তি তাকে ওপারে নিয়ে যাবেন, নয় আমাকে, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে থাকবেই।

সেটা তো সম্ভব নয়, কাতেরিনা ভা!- বিষণ্ণ কণ্ঠে সেরগেই উত্তর দিল। তার পর মাথায় যেন দুঃখের ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আমি যে এই প্রেম নিয়ে বেঁচে আছি তার জন্যে আমার নিজেরই দুঃখ হয়। সমাজে আমি যে ধাপে আছি সেই ধাপের কাউকে ভালোবাসলে হয়তো আমি সন্তুষ্টই হতুম। এ-ও কি কখনও সম্ভব যে, তুমি চিরকাল আমার সত্য প্রেম হয়ে থাকবে? আর এখন আমার প্রণয়িনী হয়ে থাকাও কি তোমার পক্ষে গৌরবের বিষয়? আমি তো চাই পূত চিরন্তন দেউলের সামনে তোমার স্বামী হতে; তার পর তোমার তুলনায় তখন আমি নিজেকে হীন মনে করলেও আমি সমাজের সামনে বুক চেতিয়ে দেখাতে পারব, আমার স্ত্রী আমাকে কতখানি সম্মানের চোখে দেখেন– কারণ আমি তাকে সম্মান করি

সেরগেইয়ের কথাগুলো কাতেরিনার মাথা ঘুলিয়ে দিয়েছে। তার ঈর্ষা, কাতেরিনাকে বিয়ে করার তার কামনা– এ কামনা মেয়েছেলে মাত্রেরই বড় প্রিয়, তা সে হোক না, বিয়ের পূর্বে তাদের অল্পদিনেরই পরিচয়। কাতেরিনা এখন সেরগেইয়ের জন্যে আগুনের ভিতর দিয়ে যেতে প্রস্তুত, অতলে তলাতে তৈরি, কিংবা ভয়ঙ্কর কারাগারে অথবা ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরতে। সেরগেই তখন কাতেরিনাকে তার প্রেমে এমনই মজিয়েছে যে, সে তার অন্তহীন আত্মসমর্পণ সেগেইয়ের পদপ্রান্তে করে ফেলেছে। আনন্দে সে তখন আত্মহারা, তার রক্তে রিনিঝিনি বাজছে– আর কোনও কথা শোনবার সব শক্তি তার তখন নেই। তাড়াতাড়ি হাতের তেলো দিয়ে সে সেরগেইয়ের মুখ বন্ধ করে দিয়ে তার মাথা আপন বুকে চেপে ধরে বলল, শোন, এখন আমার জানা হয়ে গিয়েছে, তোমাকেও কী করে ব্যবসায়ী করে তোলা যায়, আর তোমার সঙ্গে কীভাবে যথারীতি সসম্মানে বাস করা যায়। যতদিন না আমাদের অবস্থার চরম বোঝাঁপড়ার সময় এসেছে—- ততদিন কোনওকিছু নিয়ে আমাকে আর বেদনা দিও না।

আবার আরম্ভ হল চুম্বন আর আদর-সোহাগ।

নিঃশব্দ নিশীথে, গভীর নিদ্ৰায় মগ্ন থাকা সত্ত্বেও গুদামঘরের চালার ভিতর বুড়ো কেরানি শুনতে পাচ্ছিল ক্ষণে মৃদু আলাপের গুঞ্জন, ক্ষণে চাপা হাসির ইঙ্গিত– যেন কতকগুলি দুবৃত্ত বালক কোনও নির্বীর্য বৃদ্ধকে নিয়ে নিদারুণতম ঘৃণ্য ব্যঙ্গ করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছে ক্ষণে আনন্দের উচ্চহাস্য কলরোল– যেমন সরোবরের পরীরা কাউকে নির্মমভাবে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এ-সবের উৎস কাতেরিনা। চাঁদের আলোতে সে যেন সাঁতার কাটছে, নরম কম্বলের উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে আর রসকেলি করছে তার স্বামীর ছোকরা কেরানির সঙ্গে। কুসুমাচ্ছাদিত আপেলবৃক্ষের কোমল ফুলদল তাদের উপর ক্ষণে ক্ষণে বর্ষিত হচ্ছিল– অবশেষে সে বর্ষণও ক্ষান্ত হল। ইতোমধ্যে নাতিদীর্ঘ নিদাঘ রজনী প্রবহমান চন্দ্রমা উচ্চ ভাণ্ডারগৃহের চূড়ান্তরালে লুক্কায়িত থেকে পাণ্ড হতে পারতর নয়নে ধরণীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। হঠাৎ রান্নাঘরের ছাতের উপর দুটো বেড়ালের কানফাটানো দ্বৈতকণ্ঠ শোনা গেল। তার পর আরম্ভ হল খামচাখামচি, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তীক্ষ্ণ গোঙরানোর শব্দ এবং সর্বশেষে পা হড়কে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ছাদের সঙ্গে ঠেকনা দেওয়া তক্তার ডাই পিছলে গোটা দু-ত্তিন বেড়াল।

চল শুতে যাই–অতিশয় ক্লান্তির আবেশে রাগ ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল কাতেরিনা। শায়িত অবস্থায় সেই সামান্য শেমিজ আর সাদা সায়া তার পরনে ছিল, সেই বেশেই গণ্যমান্য সদাগর-বাড়ির আঙিনার উপর দিয়ে সে চলল। সেখানে তখন মরা-বাড়ির নিশ্চলতা আর নৈস্তব্ধ। সেরগেই রাগ, আর কাতেরিনার খেলা-ভরে ছুঁড়ে-ফেলে-দেওয়া ব্লাউজ নিয়ে পিছনে পিছনে চলল।

.

০৭.

কাপড়-জামার শেষ রত্তিটুকু ছেড়ে ফেলে, মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে পালকের তুলতুলে বিছানাতে শুতে না শুতে কাতেরিনা সুষুপ্তি-গহ্বরে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেল। দিনভর ক্রীড়াকৌতুক আর উল্লাসরস এতই আকণ্ঠ পান করেছিল যে, সে এখন এমনই গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হল যে তার পা যেন ঘুমিয়ে পড়ল, হাতও যেন ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের ভিতর দিয়েও সে পরিষ্কার দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল এবং সেই আগের দিনের চেনা বেড়ালটা দুম্ করে তার বিছানায় পড়ল।

বেড়ালটার এখানে আগমনের ব্যাপারটা আসলে তবে কী?– ক্লান্ত কাতেরিনা আপন মনে যুক্তিতর্ক করতে লাগল। আমি দোরের চাবি নিজেই লাগিয়েছি– বেশ ভেবে-চিন্তে বিবেচনা করেই আর জানালাটাও বন্ধ। তবু দেখি সেটা আবার এসে জুটেছে। দাঁড়াও, আমি ওটাকে এই মুহূর্তেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। কাতেরিনা উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তার হাত-পা যেন তার বশে নেই; ইতোমধ্যে বেড়ালটা তার শরীরের উপর দিয়ে সর্বত্র হাঁটাহাঁটি লাগিয়ে দিয়েছে। এবং তার গলার গরুর গরু, এমনই আশ্চর্য রকমের যে, সে যেন মানুষের গলায় কথা কইছিল। কাতেরিনার মনে হচ্ছিল যেন একপাল ক্ষুদে ক্ষুদে পিঁপড়ে তার সর্বশরীরের উপর দিয়ে ছুটোছুটি লাগিয়েছে।

কাতেরিনা মনস্থির করে বলল, নাহ, কালই আমাকে বিছানার উপর মঙ্গলজল ছিটোতে হবে– এছাড়া আর কোনও গতি নেই যেভাবে বেড়ালটা ভূতের মতো আমার পিছনে লেগেছে তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা তাজ্জব ধরনের বেড়াল।

ওদিকে বেড়ালটার সোহাগের গরুর গরুর একদম তার কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। বোচা নাকটা তার শরীরের উপর চেপে দিয়ে বেড়ালটা বলে উঠল, আচ্ছা, আমি কোন ধরনের বেড়াল সেই কথাটা ভাবছ না? কিন্তু এ সন্দেহে তুমি এলে কিসের থেকে? সত্যি, তুমি কী অসম্ভব চালাক মেয়ে, কাতেরিনা ভ; ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছ আমি আদপেই বেড়াল নই, কারণ আমি আসলে আর কেউ না, আমি হচ্ছি সেই বিখ্যাত সম্মানিত সদাগর বরিস। তিমোতেই। অবশ্য এটা হক কথা যে, ঠিক এই মুহূর্তেই আমি খুব বহাল তবিয়তে নেই– কারণ আমার ছেলের বউ আমাকে যেসব খাসা খানা খাইয়ে আমার সেবা করেছে তারই চোটে আমার নাড়িভুড়ি ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। তাই হয়েছে কী–বেড়ালটা সোহাগের গরুর গরুর করে যেতে লাগল– আমি বড় কুঁকড়ে-সুকড়ে গিয়ে এখন শুধু হুলো বেড়াল হয়ে, যারা আমাকে সত্যি সত্যি জানে আমি কে, তাদের সামনেই আত্মপ্রকাশ করতে পারি। তা যেন হল; আচ্ছা, আপনি এখন আপন বাড়িতে কীরকম আছেন, কী করছেন, কাতেরিনা লভভূনা? আপ্তবাক্যের সবকটি বিধি*[* অন্যতম বিধি ব্যভিচার করবে না।] আপনি কি ভক্তিভরে পালন করে যাচ্ছেন? আমি সুচিন্তিত উদ্দেশ্য নিয়েই গোরস্তান থেকে এখানে এসেছি সুদ্ধমাত্র দেখতে আপনি আর সেরগেই ফিলিপি আপনার স্বামীর বিছানাটাতে কীরকম ওঁম লাগাচ্ছেন। কিন্তু এখন তো আমি আর কিছু দেখতে পারিনে। আপনি খামোখা অত ভরাচ্ছেন কেন; ব্যাপারটা হয়েছে কী, আপনি যে আমায় ফিস্টিটা খাইয়ে জান্তর করে দিয়েছিলেন তারই ঠেলায় আমার আদরের পুতুল চোখ দুটি কোটর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার চোখদুটোর দিকে সোজাসুজি তাকাও, পরান আমার ভয় পেও না, মাইরি!

কাতেরিনা সত্য সত্যই তাকিয়েছিল– আর সঙ্গে সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। হুলো বেড়ালটা ফের তার আর সেরগেইয়ের মাঝখানে শুয়ে পড়েছে, আর তার মাথাটার জায়গায় বরিস তিমোতেইচের মাথা। ঠিক তারই মাথার মতো বিরাট আকারের মাথা। আর দুটি কোটরে চোখের বদলে আগুনের দুটো চাকা ঘুরছে আর পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে আর ঘুরছে– যেদিকে যেমন খুশি!

সেরগেই জেগে উঠল, কাতেরিনাকে শান্ত করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু নিদ্রাদেবী কাতেরিনাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন– ভাললাই, এক হিসেবে ভালোই।

বিস্ফারিত নয়নে কাতেরিনা শুয়ে আছে, হঠাৎ তার কানে এল কে যেন গেট বেয়ে উঠে বাড়ির ভিতরের আঙিনার সামনে পৌঁছে গেছে। সে তোক যেই হোক, কুকুরগুলো তার দিকে ধাওয়া করেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তারা শান্ত হয়ে গেল হয়তো-বা তারা নবাগতের পা চাটতে আরম্ভ করেছে। তার পর আরও এক মিনিট গেল। ক্লিক করে নিচের লোহার খিল খুলে গেল এবং দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।

হয় আমি শব্দগুলো কল্পনায় শুনছি, অথবা আমার জিনোভিই বরিসি ফিরে এসেছেন– এবং দরজা খুলেছেন ফালতো চাবিটি দিয়ে–চট করে চিন্তাটা কাতেরিনার মাথায় খেলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেরগেইকে কনুই দিয়ে গুতো দিল।

কান পেতে শোন, সেরেজা, বলে কাতেরিনা কনুইয়ের উপর ভর করে উঠে কানদুটো খাড়া করল।

সত্যই কে যেন ধীর পদক্ষেপে, সাবধানে শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে সরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের চাবিরা শোবার ঘরের দিকে আসছে।

সুদ্ধমাত্র শেমিজ পরা অবস্থাতেই এক লাফ দিয়ে কাতেরিনা খাট ছেড়ে ব্যালকনির জানালা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সেরগেইও খালি পায়ে লাফ দিয়ে ব্যালকনিতে এসে নামবার জন্য তারই খুঁটিতে পা দিয়ে জড়িয়ে ধরল– ওই খুঁটি বেয়েই সে একাধিকবার তার প্রভুপত্নীর শোবার ঘর থেকে নিচে নেমেছে।

কাতেরিনা তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, না, না; দরকার নেই, দরকার নেই। তুমি এইখানে শুয়ে থাকো… এখান থেকে নোড় না। তার পর সেরগেইয়ের জুতো, কোট-পাতলুন তার পিছনে ছুঁড়ে দিয়ে লাফ মেরে কম্বলের তলায় ঢুকে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

সেরগেই কাতেরিনার আদেশ পালন করল; খুঁটি বেয়ে নিচে না নেমে ছোট্ট ব্যালকনিটির কাঠের ছাতার নিচে আরাম করে লুকিয়ে রইল।

ইতোমধ্যে কাতেরিনা শুনতে পেয়েছে, তার স্বামী কীভাবে দরজার কাছে এল, এবং দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল। এমনকি সে তার হিংসাভরা বুকের দ্রুত স্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পেল। কিন্তু কাতেরিনার হৃদয়ে করুণার উদয় হল না। বরঞ্চ তাকে যেন ছেয়ে ফেলল পিশাচের অট্টহাস্য।

মনে মনে সে তার স্বামীকে উদ্দেশ করে বলল, যাও, গতকাল খোঁজ গে– মৃদু হেসে সে যতদূর সম্ভব তালে তালে নিষ্পাপ শিশুটির মতো দম ফেলতে লাগল।

প্রায় দশ মিনিট ধরে এই লীলা চলল; অবশেষে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর ঘুমনোর শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করাটা জিনোভিইয়ের কাছে ক্লান্তিজনক হয়ে দাঁড়াল। সে তখন দরজায় টোকা দিল।

কে? কাতেরিনা সাড়া দিল কিন্তু একদম সঙ্গে সঙ্গে না, এবং গলাটা যেন নিদ্রায় জড়ানো।

জিনোভিই উত্তর দিল, তোমাদেরই একজন।

তুমি নাকি, জিনোভিই বরিসি?

হ্যাঁ, আমি যেন আমার গলা শুনতে পারছ না।

কাতেরিনা সেই যে শুধু শেমিজ পরে শুয়েছিল সেইভাবেই লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে দিল, তার পর ফের লাফ দিয়ে গরম বিছানায় ঢুকল।

কম্বল দিয়ে গা জড়াতে জড়াতে বলল, ঠিক ভোরের আগে কেমন যেন শীতটা জমে আসে।

জিনোভিই বরিসি ঘরে ঢুকে চতুর্দিকে তাকাল, তার পর ইকনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল, মোমবাতি জ্বালিয়ে আবার চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখল। স্ত্রীকে শুধালো, কীরকম আছ– সব ঠিক চলছে?

কাতেরিনা উত্তর দিল, নালিশ করার মতো তেমন কিছু নয়। তার পর উঠে বসে একটা ঢিলে সুতির ব্লাউজ পরতে লাগল।

শুধল, তোমার জন্য একটা সামোভারে আঁচ দেব কি?

তোমার কিছু করতে হবে না; আকসিনিয়াকে ডাক– সে তৈরি করুক।

কাতেরিনা চটি পরে ছুটে বেরোল এবং ফিরল আধঘণ্টাটাক পরে। এরই ভিতরে সে ছোট্ট সামোভারটিতে কাঠ-কয়লার আগুন ধরিয়ে নিয়েছে এবং অতিশয় সন্তর্পণে বিদ্যুৎবেগে একবার ছুটে গেছে ছোট্ট ব্যালকনিটির নিচে সেরগেইয়ের কাছে।

এইখানে থাক–ফিসফিস করে কাতেরিনা সেরগেইকে বলল।

সেরগেইও ফিসফিস করে প্রশ্ন শুধাল, এখানে বসে থেকে কী লাভ হবে?

ওহ্! তোমার মাথায় কি রত্তিভর মগজ নেই! আমি যতক্ষণ না অন্য ব্যবস্থা করি, তুমি এইখানে থাক।

কাতেরিনা স্বয়ং তাকে আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সেরগেই বাইরের ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে ভিতরে যা-কিছু হচ্ছিল সবই শুনতে পারছিল। কাতেরিনা যে দরজা বন্ধ করে স্বামীর কাছে ফিরে এল সেটাও শুনতে পেল। ঘরের ভিতরকার টু শব্দটিও পরিষ্কার তার কানে আসছিল।

জিনোভিই স্ত্রীকে জিগ্যেস করল, এতক্ষণ ধরে কোথায় আলসেমি করে সময় কাটালে?

শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল, আমি সামোভার তৈরি করছিলুম।

কিছুক্ষণ ধরে আর কোনও কথাবার্তা হল না। বাইরের থেকে সেরগেই পরিষ্কার শুনতে পেল, জিনোভিই তার লম্বা কোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল। তার পর সে চতুর্দিকে জল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, জোরসে নাক সাফ করে হাতমুখ ধুলো। এইবারে সে একখানা ভোয়ালে চাইল– সেটাও শোনা গেল। আবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে।

স্বামী শুধাল, আচ্ছা, বল তো তোমরা ঠিক কীভাবে আমার বাপকে গোর দিলে?

ঠিক যেভাবে হয়ে থাকে–উত্তর দিল তার স্ত্রী। তিনি মারা গেলেন, সবাই মিলে তাকে গোর দিল।

কিন্তু সক্কলের কাছেই এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে!

ভগবান জানেন শুধু।- কাতেরিনা উত্তর দিয়ে ঠুং-ঠাং করে পেয়ালাগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল।

জিনোভিই বিষণ্ণ মুখে ঘরের ভিতর পাইচারি করতে লাগল।

তার পর স্ত্রীকে আবার শুধাল, আর এখানে তুমি সময় কাটালে কী করে?

এখানে আমাদের আমোদ-আহ্লাদ কী, সে তো সবাই জানে আমি আর কী বলব; আমরা বল নাচে যাইনে, থিয়েটারও দেখিনে।

আমার তো মনে হল তোমার স্বামীকে দেখে তুমি বিশেষ কোনও আমোদ-আহ্লাদ অনুভব করনি– আমোদ-আহ্লাদ কথাটাই যদি উঠল। আড় নয়নে তাকিয়ে জিনোভিই বলল। এইবারে সে অবতরণিকায় পা দিয়েছে।

তোমাতে-আমাতে তো পরশুদিন বিয়ে হয়নি যে দেখা হওয়ামাত্রই প্রেমে পাগল হয়ে একে অন্যের দিকে ধাওয়া করব। বাড়ির কাজকর্মে ছুটোছুটি করতে করতে আমার পা দু খানি ক্ষয়ে গেল– আর সেসব তোমারই সুখের জন্য। কী করে যে আশা কর তোমাকে দেখামাত্র আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব?

কাতেরিনা সামোভার আনবার জন্য ছুটে বেরিয়ে গেল আর ধাওয়া করল সেরগেইয়ের দিকে। জামায় টান দিয়ে বলল, হাই তোলা বন্ধ কর! চোখদুটো খোলা রাখ সেরেজা!

শ্রাদ্ধের জল যে কোন দিকে কতখানি গড়াবে সে সম্বন্ধে সেরগেই কোনও স্পষ্ট ধারণা করতে পারেনি, তাই সজাগ হয়ে রইল সে।

কাতেরিনা ফিরে এল। দেখে, জিনোভিই খাটের উপর হাঁটু গেড়ে পুঁতির কেসসুদ্ধ তার ভ্রমণের ঘড়িটা শিয়রের খাড়া তক্তার সঙ্গে ঝোলাচ্ছে।

হঠাৎ সে তার স্ত্রীকে জিগ্যেস করল– কেমন যেন একটু বাঁকা-বাঁকা ভাবে, আচ্ছা, বল তো কাতেরিনা, তুমি তো ছিলে এক্কেবারে একা; তবে ওটা কী করে হল যে, তুমি জোড়া বিছানা সাজিয়ে রেখেছ?

শান্তনয়নে তার দিকে তাকিয়ে কাতেরিনা বলল, কেন, আমি তো সর্বক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলুম।

কৃতজ্ঞতার ধন্যবাদ জানাচ্ছি তার জন্য। আচ্ছা, এইবার দেখ, একটা জিনিস; এটা তোমার পালকের বিছানায় প্রবেশপথ পেল কী করে? জিনোভিই বরিসিচু বিছানার চাদরের উপর থেকে উলে বোনা সরু একটি বেল্ট তুলে নিয়ে এক প্রান্ত উপরের দিকে ধরে তার স্ত্রীর চোখের সামনে দোলাতে লাগল। আসলে এটা সেরগেইয়ের।

কাতেরিনা সামান্যতম দ্বিধা না করে বলল, আমি ওটা বাগানে কুড়িয়ে পেয়ে আমার স্কার্ট বাঁধার জন্য কাজে লাগিয়েছি।

বটে! কথাগুলোয় বদখদ জোর দিয়ে জিনোভিই বলল, তোমার ওই যে স্কার্ট, সে সম্বন্ধে আমরাও আরও দু একটা কথা জানতে পেরেছি।

ঠিক কী শুনতে পেয়েছ?

ও! তোমার সব পুণ্যকর্ম!

সেরকম কিছু হয়নি!

আচ্ছা, আচ্ছা; পরে সেসব দেখা যাবে, পরে সবকিছু দেখা যাবে, খালি পেয়ালাটা ঠেলা মেরে তার স্ত্রীর সামনে ফেলে দিয়ে জিনোভিই উত্তর দিল।

কাতেরিনা একথার উত্তরে কোনও সাড়া দিল না।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিনোভিই ভুরু কপালে তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার তাবৎ কীর্তিকলাপ আমরা প্রশস্ত দিবালোকে টেনে বের করব, বুঝলে কাতেরিনা ভভূনা?

কাতেরিনা উত্তর দিল, ভয়ে যারা ইঁদুরের গর্ত খোঁজে তোমার কাতেরিনা সে দলের নয়। সে অত সহজে ভয় পায় না।

কী বললে? কী বললে? জিনোভিই গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

যাগগে ও-সব… আমি আমার ফেরির পসরা দু-বার হকিনে। স্ত্রী উত্তর দিল!

বটে! সাবধান! একটু সাবধান হও দিকিনি–বড্ড বেশি বকর বকর করতে শিখে গেছ তুমি, যবে থেকে একলা-একলি থাকছ– কী জানি কী করে?

কাতেরিনা চোপা দিয়ে বলল, বকর বকর করতে আমার যদি প্রাণ চায় তবে তার বিরুদ্ধে কোনও মহামূল্যবান কারণ আছে কি?

দেখ, এখনও নিজের ওপর নজর রাখ।

আমার নিজের ওপর নজর রাখবার মতো কিছুই নেই। কোথাকার কে লম্বা জিভ নাড়িয়ে তোমাকে যা-তা শুনিয়েছে, আর আমাকে বসে বসে হরেক রকমের গালি-গালাজ শুনতে হবে নাকি? এ আবার কী এক নতুন তামাশা আরম্ভ হল!

লম্বা জিভ হোক আর নাই হোক, তোমার ঢলাঢলির কেচ্ছা এখানে বিস্তর লোকই জেনে গিয়েছে।

কাতেরিনা এবারে সত্যি সত্যি ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কী ঢলাঢলি আমার?

আমি জানি কোনটা।

তাই নাকি? যদি জানোই তবে চালাও : সাফ সাফ খুলে বল।

জিনোভিই কোনও উত্তর না দিয়ে খালি পেয়ালাটা আবার ঠেলা মেরে তার স্ত্রীর সামনে ফেলল।

স্বামীকে যেন খোঁচা দেবার জন্যে একটা চামচ তার স্বামীর পিরিচে খটাং করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘেন্নার সুরে বলল, আসলে পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তেমন কিছু বলবার মতো নেই। না হলে বল না, বল, বল আমাকে, কার সম্বন্ধে তারা তোমাকে বলেছে? কে সে আমার প্রেমিক যাকে আমি তোমার চেয়ে বেশি পছন্দ করি?

জানতে পাবে– অত তাড়া কিসের?

বল না! তবে কি কেউ কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে সেরগেইয়ের সম্বন্ধে মিথ্যে মিথ্যে লাগিয়েছে। তাই কি না?

আমরা সব বের করব, আমরা সব বের করব, বাহারে বিবি কাতেরিনা ভভূনা। তোমার ওপর আমাদের যে অধিকার সেটা কেউ কেড়ে নেয়নি, কেউ নিতে পারবেও না… তুমি শায়েস্তা হয়ে নিজের থেকেই নিজের সম্বন্ধে সবকিছু বলবে—

আখ! আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে! দাঁত কিড়িমিড়ি খেয়ে কাতেরিনা চিষ্কার করে উঠল– রাগে তার মুখের রঙ সাদা বিছানার চাদরের মতো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সে লাফ দিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কয়েক সেকেন্ড পরে সেরগেইয়ের আস্তিন ধরে ঘরের ভিতর তাকে টেনে এনে কাতেরিনা বলল, এই তো, এখানে সে। ওকে আর আমাকে জিগ্যেস কর, যখন এতসব তোমার জানাই আছে। হয়তো যতখানি জেনে তৃপ্ত হও তার চেয়েও বেশি জানতে পাবে।

আসলে জিনোভিই বরিসিচের মাথা তখন ঘুলিয়ে গিয়েছে। সে প্রথমটায় সেরগেইয়ের দিকে তাকাল– সে তখন দোরের খুঁটিটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পর তাকাল তার স্ত্রীর দিকে সে ততক্ষণে খাটের বাজুতে বসে বুকের উপর এক হাত দিয়ে আরেক হাতের কনুই ধরে আছে; সমস্ত ব্যাপারটা যে কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে সে সম্বন্ধে জিনোভিই কোনও অনুমানই করতে পারছিল না।

এখানে তুই কী করছিস রে বিচ্ছ? চেয়ার থেকে না উঠেই কোনও গতিকে সে বলল।

বেহায়ার মতো কাতেরিনাই উত্তর দিল, তুমি যা-সব খুব ভালো করে জানো সেগুলো সম্বন্ধে আমাদের জিগ্যেস কর না? তুমি ভেবেছিলে আমাকে ঠ্যাঙাবার ভয় দেখাবে– কাতেরিনা বলে যেতে লাগল; তার চোখে কুমতলব মিটমিট করছে, কিন্তু সেটা আর কখনই হয়ে উঠবে না। আর আমি? আমার যা করার সে আমি তোমার ওই প্রতিজ্ঞাগুলো শোনার পূর্বেই স্থির করে রেখেছি, আর এখন সেগুলো তোমার ওপর খাটাব।

জিনোভিই সেরগেইয়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠল, কী করছিস এখানে? বেরো!

কাতেরিনা তাকে চোপা দিয়ে বলল, বেশ, বেশ, তার পর?

ঝটপট দোরটা নিখুঁতভাবে বন্ধ করে চাবিটা সে পকেটে রাখল, তার পর ঢিলে। ব্লাউজসর্বদা বিছানায় ফের গড়াগড়ি দিতে লাগল।

কেরানিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, এখানে তবে এসো সেরেজেচকা এসো, এখানে এসো, আমার প্রাণের দুলাল।

সেরগেই মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বাবরি চুল পিছনে ফেরাল; তার পর সাহসীর মতো বাড়ির কত্রীর পাশে এসে বসল।

হে ভগবান, হে প্রভু! এসব কী হচ্ছে? তোরা কী করছিস- ওরে কাফেরের বাচ্চা জিনোভিইয়ের মুখ বেগুনি হয়ে গিয়েছে, আরাম-কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

বটে? তোমার পছন্দ হচ্ছে না? একবার তাকিয়ে দেখ না, ভালো করে তাকিয়ে দেখ আমার বাজপাখিটির চোখ কীরকম জ্বলজ্বল করে, দেখ না, কী সুন্দরই না সে!

কাতেরিনা অট্টহাস্য করে উঠল এবং স্বামীর সামনে সেরগেইকে আবেগভরে চুম্বন দিতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে তার গালে একটা চড় পড়ে যেন সেখানে আগুন ধরিয়ে দিল আর জিনোভিই লাফ দিয়ে ধাওয়া করল ব্যালকনির খোলা জানালার দিকে।

.

০৮.

আহহা! তা হলে এই ব্যবস্থাই হল! বেশ বন্ধু! তোমাকে আমার অনেক ধন্যবাদ জানাই! শুধু এইটের জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলুম উঁচু গলায় বলে উঠল কাতেরিনা, বেশ, বেশ, তা হলে পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আমারই মর্জি-মাফিক সবকিছু হবে, তোমার মর্জি আর চলবে না।

এক ধাক্কায় সেরগেইকে পাশ থেকে ঠেলে দিয়ে, বিদ্যুৎবেগে সে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল তার স্বামীর ঘাড়ে; জিনোভিইও লাফ দিয়েছিল ব্যালকনির জানালার দিকে কিন্তু তার পূর্বেই কাতেরিনা তার সরু আঙুল জিনোভিইয়ের গলায় প্রায় ঢুকিয়ে দিয়ে চেপে ধরে তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে মেঝের উপর একগুচ্ছ কাটা তাজা শন মানুষ যেরকম অবহেলে ফেলে।

শরীরের সমস্ত ওজন নিয়ে বেগে পড়ার ফলে তার মাথা সজোরে ঠোক্কর খেল মেঝের উপর– আর মাথা গেল ঘুলিয়ে। সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি তার চরমে পৌঁছে গিয়ে স্বপ্রকাশ হতে পারে তার সম্ভাবনা সে মোটেই আন্দাজ করতে পারেনি। তার ওপর তার স্ত্রীর জীবনে এই প্রথম প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে সে বুঝে গেল যে, তার হাত থেকে ছাড়ান পাওয়ার জন্য হেন কর্ম নেই যে তার স্ত্রী করবে না, এবং তার বর্তমান অবস্থা সাতিশয় সঙ্কটময়। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করে ফেলছিল বলে সে আর আর্তনাদ করে ওঠেনি– ভালো করেই সে বুঝে গিয়েছিল যে তার আর্তনাদ কারও কানে পৌঁছবে না, বরঞ্চ তাতে করে তার পরিণাম আরও দ্রুতগতিতে পৌঁছে যাবে। নীরবে সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অবশেষে তার দৃষ্টি স্ত্রীর ওপর ফেলল। সে দৃষ্টিতে ছিল জিঘাংসা, অভিসম্পাত আর তীব্রতম যন্ত্রণা। ওদিকে তার স্ত্রী সজোরে তার গলা যেন নিংড়ে ফেলছিল।

জিনোভিই আত্মরক্ষার চেষ্টা করল না। তার মুষ্টিবদ্ধ প্রসারিত দুই বাহু আচমকা আচমকা খিচুনি দিয়ে উঠছিল। তার এক বাহু তখনও সম্পূর্ণ মুক্ত; অন্য বাহু কাতেরিনা তার হাঁটু দিয়ে মাটির সঙ্গে জোরে চেপে ধরেছে।

ধরো জোরসে ওকে। বিন্দুমাত্র উত্তেজনার রেশ না দেখিয়ে সে সেরগেইকে ফিসফিস করে আদেশ দিল। তার পর ফের স্বামীর দিকে মনোনিবেশ করল।

সেরগেই তার মুনিবের উপর বসে তার দুটি হাঁটু দিয়ে মুনিবের দুই বাহু চেপে ধরল। তার পর যেই সে কাতেরিনার হাতের নিচে জিনোভিইয়ের টুটি চেপে ধরতে গেছে অমনি সে নিজেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। যে লোকটা তার এমন অন্যায় সর্বনাশ করেছে, তার ওপর চোখ পড়তে, রক্ত দিয়ে রক্তের প্রতিশোধ নেবার দুর্বার কামনা জিনোভিইয়ের অবশিষ্ট সর্বশক্তি উত্তেজিত করে দিল। ভয়াবহ বিক্রম প্রয়োগ করে সে সেরগেইয়ের হাঁটুর চাপ থেকে দুই হাত মুক্ত করে সেরগেইয়ের মিশকালো বাবরি বজ্রমুষ্টিতে ধরে নিয়ে তার গলায় কামড় মেরে বসিয়ে দিল– হুবহু হিংস্র পশুর মতো তার দাঁত। কিন্তু এ আক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিনোভিই গোঁ গোঁ করে কাতরাতে আরম্ভ করল; মাথা একপাশে হেলে পড়ল।

নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে, বিবর্ণ কাতেরিনা তার স্বামী ও প্রেমিকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে; তার ডান হাতে ছাঁচে ঢালাই ভারী একটা মোমবাতিদান– তার ভারী দিকটা নিচের দিকে ঝুলছে। জিনোভিইয়ের রগ আর গাল বেয়ে একটি অতি সূক্ষ্ম সুতোর মতো বয়ে নামছিল চুনি রঙের লাল রক্ত।

পাদ্রি সাহেবকে ডেকে পাঠাও স্তিমিত কণ্ঠে গোঙরে গোঙরে কোনও গতিকে জিনোভিই এ কটি কথা উচ্চারণ করল– তার বুকের উপর সোয়ার সেরগেইয়ের থেকে সে ঘেন্নার সঙ্গে যতখানি পারে তার মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমার অন্তিম অনুষ্ঠান করাতে চাই একটি কথা বেরুল আরও ক্ষীণস্বরে।

সে তখন ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে আর চোখ বাঁকা করে দেখছে, তার চুলের নিচে যেখানটায় গরম রক্ত জমাট বাঁধছে।

তুমি যেরকম আছ, সেই বেশ চলবে। কাতেরিনা ফিসফিস করল, তার পর সেরগেইকে বলল, ব্যস, ওকে নিয়ে আর আমাদের ঝামেলা বাড়াবার প্রয়োজন নেই; উঁটিটা কষে চেপে ধরো।

জিনোভিইয়ের গলা ঘড়ঘড় করে উঠল।

কাতেরিনা উবু হয়ে তার দু হাত দিয়ে সেরগেইয়ের দু হাতে ভর দিয়ে জিনোভিইয়ের টুটি আরও চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা জিনোভিইয়ের বুকের উপর কান পেতে শুনতে লাগল। পাঁচ মিনিট পর উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ব্যস, তার যা প্রাপ্য সে তাই পেয়েছে।

সেরগেইও উঠে দাঁড়িয়ে গভীর নিশ্বাস নিল। জিনোভিই খতম হয়ে গেছে তার শ্বাসনালী থেলে গিয়েছে, তার কপালের রগ ফেটে গিয়েছে। তার মাথার বাঁ দিকের নিচে রক্তের ছোট একটা থ্যাবড়া কিন্তু এতক্ষণে জমাট রক্ত আর চুলে সেঁটে গিয়েছে বলে জখম থেকে আর রক্ত বইছিল না।

সেরগেই বরিসিচকে মাটির নিচের মদের ভাঁড়ারে বয়ে নিয়ে গেল– এ কুঠুরিটা ঠিক সেই পাথরের ছোট ভাড়ারঘরের নিচে যেখানে মাত্র কিছুদিন পূর্বে স্বর্গীয় বরিস তিমোতেই এই সেরগেইকে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তার পর ফের কাতেরিনাদের শোবার ঘরে ফিরে এল। ইতোমধ্যে কাতেরিনা হাতের আস্তিন আর পরনের স্কার্ট গুটিয়ে নিয়ে সাবান আর ঘরপোছার ন্যাকড়া দিয়ে শোবার ঘরের মেঝের উপরকার জিনোভিইয়ের রক্তের দাগ অতিশয় কষ্ট-সহিষ্ণুতার সঙ্গে সাফ করতে লাগল। সামোভারের বিষ-মাখানো যে জল দিয়ে চা বানিয়ে জিনোভিই তার স্বাধিকার-চেতন, ক্ষুদ্র পুণ্যাত্মাটিকে গরম করে তুলছিল, সে জল তখনও ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। তারই কৃপায় রক্তের দাগ নিশ্চিহ্ন অবলুপ্ত হল।

সামোভারের সঙ্গে কাপ ধোবার যে জাম-বাটি থাকে সেইটে এবং সাবান-মাখানো ন্যাকড়া তুলে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে কাতেরিনা সেরগেইকে বলল, এসো, আমাকে আলো দেখাবে। দরজার কাছে এসে বলে, আলো নিচু করে ধরো- টুকরো টুকরো তক্তা জোড়া দিয়ে যে মেঝে এবং সিঁড়ির উপর দিয়ে সেরগেই জিনোভিইয়ের মৃতদেহ টেনে টেনে মাটির নিচের মদের ভাড়ার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল, কাতেরিনা সেই তক্তার প্রত্যেকটি গভীর মনোযোগর সঙ্গে পরীক্ষা করল।

রঙ করা তক্তাগুলোর উপরে মাত্র দুটি জায়গায় রক্তের দাগ পাওয়া গেল– আকারে কালোজামের চেয়েও বড় নয়। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে কাতেরিনা সেগুলো ঘষা মাত্রই দাগগুলো লোপ পেল।

এইবারে ঠিক হয়েছে যেমন কর্ম তেমন ফল– আপন বউয়ের পিছনে ওরকম গুপ্তচরের মতো তক্কে তক্কে লেগে থেক না– তার ঘাড়ে লাফ দেবার জন্য ওঁৎ পেতে থেক না। কাতেরিনা বলতে বলতে শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে শানবাঁধানো যে ছোট্ট কুঠুরিতে সেরগেই বন্দি ছিল সে দিকে তাকাল।

সেরগেই বলল, সবকিছু খতম হল–নিজের গলা শুনে সে শিউরে উঠল।

শোবার ঘরে যখন তারা ফিরে এল তখন সরু গোলাপি রেখার মতো পূর্বাকাশ ছিন্ন করে ঊষার উদয় হচ্ছে– ফুলে ঢাকা আপেলগাছের উপর দিয়ে আলতোভাবে ঢলে পড়ে, দেয়ালের উঁচু বেড়ার রেলিঙের ভিতর দিয়ে কাতেরিনার শোবার ঘরে উষা উঁকি মারলেন।

ঘরের বাইরে উঠোনের উপর দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো কেরানি কাঁধের উপর ভেড়ার লোমের কোটটা চড়িয়ে, হাই তুলতে তুলতে, আর ডান হাতের তিন আঙুল দিয়ে গাঁয়ের উপর ক্রুশের প্রতীক আঁকতে আঁকতে বুড়ো চলেছে রান্নাঘরের দিকে।

কাতেরিনা সাবধানে খড়খড়ির ফিতে টেনে সেটাকে বন্ধ করে দিয়ে সেরগেইকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, যেন সে তার অন্তরের আত্মসত্তাটি পর্যন্ত দেখে নিয়ে সেই সত্তাটিকে চিনতে চায়।

সেরগেইয়ের কাঁধের উপর তার শ্বেতশুভ্র হাত দুখানা রেখে বলল, কী গো, এইবারে তুমি তো সদাগরদের একজন হতে চললে।

উত্তরে সেরগেই একটি শব্দমাত্র করল না।

তার ঠোঁট দুটি স্কুরিত হচ্ছিল; কোন যেন এক পীড়া তার দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আর কাতেরিনার কিছুই হয়নি, শুধু তার ঠোঁট দুটিতে যেন শীত-শীত করছিল।

লোহার ডাণ্ডা আর ভারী শাবল ব্যবহার করার ফলে দু-একদিনের ভিতরই সেরগেইয়ের হাতে মোটা মোটা ফোস্কা দেখা দিল। তাতে কী এসে-যায়– জিনোভিই বরিসিচুকে এমনই পরিপাটিরূপে তারই মাটির তলার কুঠুরিতে পুঁতে ফেলা হল যে, তার বিধবা কিংবা বিধবার প্রেমিকের সাহায্য ছাড়া শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।

.

০৯.

সেরগেই লাল একখানা স্কার্ফ জড়িয়ে চলাফেরা করে। ইতোমধ্যে সেরগেইয়ের গলায় বরিস যে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল তার দাগ শুকোবার পূর্বেই কাতেরিনার স্বামীর অনুপস্থিতি আশঙ্কাভরা জল্পনা-কল্পনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। বরিস সম্বন্ধে আর সকলের চেয়ে বেশি কথা বলত সেরগেই নিজে। বিকেলের দিকে কোনও কোনও দিন ছোকরাদের সঙ্গে বেঞ্চিতে বসে সে বলে উঠত, সত্যি, বল তো, ভায়ারা, আমাদের কর্তা এখনও ফিরে এলেন না যে?

তারাও তখন অবাক হয়ে ভাবত ব্যাপারটি কী।

এমন সময় মিল থেকে খবর এল, অনেকদিন হল কর্তা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। যে কোচম্যান গাড়িটি চালিয়েছিল সে বলল, জিনোভিইকে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হচ্ছিল এবং কেমন যেন বেখাপ্পাভাবেই সে তাকে বিদায় দিয়েছিল; শহরের মঠের কাছে পৌঁছে সে তার কার্পেট-ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে চলে যায়। এ কাহিনী শুনে তাদের মনের ধাঁধা আরও যেন বেড়ে গেল।

জিনোভিই বরিসিচ অন্তর্ধান করেছে; ব্যস, এ সম্বন্ধে আর কারও কিছু বলার নেই। তাকে খুঁজে বের করবার জন্য চেষ্টা ও অনুসন্ধান আরম্ভ হল, কিন্তু তার ফলে কিছুই প্রকাশ পেল না; সে যেন হাওয়ার সঙ্গে গলে গিয়ে মিশে গিয়েছে। কোচম্যানটাকে অবশ্য গ্রেফতার করা হয়েছিল; তার কাছ থেকে মাত্র এইটুকু জানা গেল যে, জিনোভিই তাকে মঠের কাছে ছেড়ে দিয়ে একা চলে যায়। সমস্ত ব্যাপারটা মোটেই পরিষ্কার হল না। ওদিকে বিধবা কাতেরিনা সেরগেইয়ের সঙ্গে শান্তভাবে বেপরোয়া জীবনযাপন করতে লাগল। মাঝে মাঝে গুজব রটত, জিনোভিইকে কখনও এখানে দেখা গিয়েছে, কখনও ওখানে দেখা গিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আর বাড়ি ফিরে এল না। কাতেরিনা আর সকলের চেয়ে ভালো করেই জানত, জিনোভিই আর কখনও ফিরে আসবে না, ফিরে আসতে পারে না।

এক মাস গেল, দু মাস গেল, তিন মাস গেল–কাতেরিনা পেটের বাচ্চার ভার বেশ টের পেতে লাগল।

একদিন সে বলল, সেরেজেশকা, এবারে আমাদের ধন-দৌলত নিরাপদ হল। আমি তোমাকে একটি বংশধর দেব। সঙ্গে সঙ্গে শহরের কর্মকর্তাগণের কাছে দরখাস্ত করে জানাল : তার এবং তার বিষয়সম্পত্তি– অমুক, তমুক এবং সে বুঝতে পেরেছে সন্দেহ নেই, সে অন্তঃসত্ত্বা; ইতোমধ্যে ইসমাইল পরিবারের ব্যবসা-কারবার এক কদম এগোচ্ছে না; তাকে যেন তাবৎ লেনদেনের ওপর সর্ব কর্তৃত্ব এবং স্থাবর সম্পত্তির সর্বত্র অবাধ গতিবিধির অধিকার দেওয়া হয়।

এত বড় একটা কারবার সম্পূর্ণ উচ্ছন্ন যাবে–এ তো কল্পনাতীত। কাতেরিনা তার স্বামীর আইনসঙ্গত স্ত্রী, নোটারকমের কিংবা সন্দেহজনক দেনাও নেই; সুতরাং স্পষ্টই বোঝা গেল দরখাস্ত মঞ্জুর হবে। মঞ্জুর হলও।

অতএব কাতেরিনা জীবনযাপন করতে লাগল– মহারানির মতো চলন-বলন হল এবং তার দেখাদেখি অন্য পাঁচজন আটপৌরে সেরেগাকে পোশাকি সেরগেই ফিলিপিচু, কেষ্টাকে শ্রীকৃষ্ণ নামে সম্মানিত করতে লাগল। এমন সময় বলা-নেই-কওয়া-নেই আসমান থেকে বিনামেঘে বজ্রাঘাত। লিভেন শহর থেকে আমাদের মেয়রের কাছে এই মর্মে চিঠি এল যে, বরিস তিমোতেই যে মূলধন নিয়ে কাজ-কারবার করছিল সেটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব ছিল না : তার অধিকাংশ এসেছিল তার এক নাবালক ভাগ্নের কাছ থেকে তার নাম ফেদোর জাখার লিয়ামিন; এবং আইনত একটা ফয়সালা না করে কারবারটা একা কাতেরিনার হাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। নোটিশটা এলে পর মেয়র ব্যাপারটা নিয়ে কাতেরিনার সঙ্গে আলোচনা করলেন এবং তার পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে হঠাৎ লিভেন থেকে এসে উপস্থিত হলেন ছোট্টখাটো একটি বৃদ্ধা মহিলা– সঙ্গে একটি ছোট ছেলে।

মহিলাটি বললেন, আমি স্বৰ্গত বরিস তিমোতেইভিচের সম্পর্কে বোন হই আর ইটি আমার ভাইপো ফেদোর লিয়ামিন।

কাতেরিনা তাদের অভ্যর্থনা জানাল।

আঙিনায় দাঁড়িয়ে সেরগেই এদের আগমন এবং নবাগতদের প্রতি কাতেরিনার অভ্যর্থনা জ্ঞাপন দেখে পাদ্রিদের সাদা জোব্বার মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল!

বাড়ির কর্ত্রী কাতেরিনা সেরগেইকে জিগ্যেস করল, এ কী? তোমার কী হয়েছে? সে আঙিনা ছেড়ে অতিথিদের পিছনে পিছনে হলঘর পর্যন্ত এসে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

কিসসু না, কিসসুটি না। হলঘর ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে সেরগেই উত্তর দিয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছিল এই লিভে গুষ্ঠি বাজি হারার পড়তা, জেতার নয়। তার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গিয়ে পিছনের সদর দরজা বন্ধ করে দিল।

***

সে রাত্রে সামোভার ঘিরে বসে সেরগেই কাতেরিনাকে শুধল, তা হলে আমরা এখন করি কী? তোমার আমার আমাদের দুজনার– সবকিছু যে ছাইভস্ম হয়ে গেল।

ছাইভস্ম কেন, সেরেজা?

নয় তো কী? এখন তো সবকিছু ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আমাদের হিস্যেয় যা পড়বে তা দিয়ে আমরা চালাব কী করে?

কেন, সেরেজা? তোমার কি ভয় হচ্ছে, তুমি যথেষ্ট পাবে না?

আমি নিজের হিস্যের কথা ভাবছিনে। আমার শুধু সন্দেহ হচ্ছে, আমরা কি আর সুখী হতে পারব?

এ দুর্ভাবনা তোমার মনে কেন উদয় হল? আমরা সুখী হতে পারব না কেন?

সেরগেই উত্তর দিল, তার কারণ, তোমার প্রতি আমার যে প্রেম, সে প্রেম চায় তোমাকে সমাজের উচ্চস্থানের মহিলারূপে দেখতে; আগে যেরকম নগণ্য জীবন যাপন করতে, সেরকম নয়। আর এখন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে; আমাদের আমদানি কমে যাওয়ার ফলে এখন আমাদের আরও টানাটানি করে চালাতে হবে।

তাতে করে আমার জীবনে তো কোনও হেরফের হবে না, সেরেজা।

ঠিক সেই কথাই তো হচ্ছে, কাতেরিনা ভনা; তোমার কাছে সবকিছু পছন্দসই বলে মনে হতে পারে, আমার কিন্তু কস্মিনকালেও তা মনে হবে না এবং তার একমাত্র কারণ তোমাকে আমি মাত্রাধিক শ্রদ্ধা করি। তার ওপর দেখ, সমস্তটা ঘটবে যতসব হিংসুটে ছোটলোকদের চোখের সামনে সেসব দেখে আমার বেদনার আর অন্ত থাকবে না। তুমি অবশ্য যা-খুশি তাই করতে পার কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পরিস্থিতিতে আমি কখনও সুখী হতে পারব না।

আর সেরগেই বার বার একটানা ওই একই রাগিণী কাতেরিনার সম্মুখে গাইতে লাগল; ওই ফেদোর লিয়ামিন ছোঁড়াটার জন্যে তার সর্বনাশ হয়েছে। সে যে আশা করেছিল, একদিন সে বণিকগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে কাতেরিনা ভড়কে বসাবে সে আশা পূরণের সম্ভাবনা থেকে সে বঞ্চিত হল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে করেই হোক, এ ধরনের আলাপ সেরগেই শেষ পর্যন্ত এই সমাধানেই নিয়ে আসত যে, স্বামীর অন্তর্ধানের ন মাসের ভিতর যদি কাতেরিনা তার পেটের বাচ্চাটিকে প্রসব করে তাবৎ সম্পত্তির অধিকারী হয়, তবে তাদের সুখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না–কিন্তু মাঝখানে এই ফেদোর ছোঁড়াটা উড়ে এসে জুড়ে বসে তাদের সর্বনাশ করেছে।

১০. মালিকানা স্বত্ব

১০.

অকস্মাৎ সেরগেই ফেদোর লিয়ামি এবং তার মালিকানা স্বত্ব সম্বন্ধে সর্ব আলোচনা বন্ধ করে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে ফেদোরের চিন্তা কাতেরিনার সর্ব হৃদয়-মন যেন গ্রাস করে বসল। দুশ্চিন্তা আশঙ্কা তাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করে তুলল যে, সে যেন তার জাল ছিন্ন করে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না। এমনকি সেরগেইকে আদর-সোহাগ করা পর্যন্ত তার আর রুচছিল না। ঘুমন্ত অবস্থায়ই হোক, কিংবা ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম করার সময়েই হোক, অথবা তার ইষ্ট-দেবতাকে স্মরণ করার সময়ই হোক– উদয়াস্ত তার মনে মাত্র একটি চিন্তা : এ যে এক্কেবারে ডাহা অবিচার। বাস্তবিকই এ আবার কী? কোত্থেকে পুঁচকে একটা ছোঁড়া এসে জুটল, আর আমি আমার সর্বস্ব থেকে বঞ্চিত হব? আমি এতখানি যন্ত্রণা সইলুম, পর্বতপ্রমাণ পাপের বোঝা আমার আত্মসত্তার ওপর চাপালুম, আর কোনও হাঙ্গামা-হুজ্জৎ না পুইয়ে, খড়ের কুটোটি পর্যন্ত কুড়িয়ে না তুলে হঠাৎ এই ছোঁড়াটা এসে আমার তাবৎ-সর্বস্ব কেড়ে নেবে?… তা-ও না হয় বুঝতুম, দাবিদার ভারিক্কি বয়েসের কেউ যদি হত– তা নয়, একটা নাবালক কোথাকার,- পুঁচকে ছোঁড়া।

***

বাইরে প্রথম শীতের আমেজ লেগেছে। জিনোভিই বরিসিচের কোনও খবরই কোনওদিক থেকে এল না– আর আসবেই-বা কী করে? কাতেরিনা ক্রমেই মোটা হয়ে উঠেছিল আর সমস্তক্ষণ ভাবনা-ভরা মন নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। ওদিকে শহরের লম্বা রসনা তাকে নিয়ে, তার কী করে এটা হল, তার কী করে সেটা হল তাই নিয়ে সুবোসাম জল্পনা-কল্পনা গুজব-গুল নিয়ে মেতে উঠেছিল : যেমন– এই যে হুঁড়ি কাতেরিনাটা অ্যাদ্দিন ধরে ছিল বাজা পাঠীটা আর দিনকে দিন শুকোতে শুকোতে হয়ে যাচ্ছিল পুঁই ডাটাটির মতন, এখন হঠাৎ তার সামনের দিকটা ওরকমধারা কেঁপে উঠতে লাগল কেন? এবং এদিকে সম্পত্তির ছোকরা মালিক ফেদিয়া লিয়ামিন খরগোশের চামড়ার হালকা কোটটি পরে বাড়ির আঙিনায় খেলাধুলো করে আর ছোট ছোট গর্তে জমে-যাওয়া বরফ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভেঙে ভেঙে দিন কাটাচ্ছিল।

রাঁধুনী আকসিনিয়া আঙিনার উপর দিয়ে তার পিছনে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে করে ডাকছে, এ কী হচ্ছে ফেদোর ইগনাতিচ? খানদানি সদাগরের ছেলে তুমি, এ কী হচ্ছে সব? গর্তের জলে-কাদায় মাখামাখি করা কি শেঠজির ছেলের সাজে?

কাতেরিনা আর তার বল্লভের সবকিছু ওলোট-পালোট করে সম্পত্তির হিস্যেদারটি নিরীহ ছাগলছানার মতো বাড়িময় তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে, তার চেয়েও নিরীহ অকাতর নিদ্রায় ঘুমোয় মাত্রাধিক স্নেহময়ী দিদিমার পাশে। জাগরণে বা স্বপ্নে কখনও তার মনে এক মুহূর্তের তরেও উদয় হয়নি, সে কারও পাকা ধানে মই দিয়েছে কিংবা কারও সুখে এতটুকু ব্যাঘাত-ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে।

বড় বেশি ছুটোছুটির ফলে অবশেষে ফেদিয়ার জল-বসন্ত হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুকের ব্যথা। বেচারিকে তখন বাধ্য হয়ে শয্যাগ্রহণ করতে হল। গোড়ার দিকে জড়িমড়ি দিয়ে তার চিকিৎসা করা হল, শেষটায় ডাক্তার ডাকতে হল।

ডাক্তার ভিজিট দিতে শুরু করলেন। তাঁর প্রেসক্রিপশনমতো ওষুধ ফেদিয়াকে প্রতি ঘণ্টায় খাওয়ানো হল– কখনও দিদিমা খাওয়াতেন, কখনও বা তার অনুরোধে কাতেরিনা।

দিদিমা কাতেরিনাকে বলতেন, মা লক্ষ্মী সোনামণি কাতেরিনা আমার! বাচ্চাটিকে একটু দেখ-ভাল্ কর মা আমার। আমি জানি, শরীরের ভারে তোমার নিজেরই বড় বেশি চলাফেরা করতে কষ্ট হচ্ছে, আর মা ষষ্ঠীর কৃপার জন্য তুমিও অপেক্ষা করছ– তবু বাচ্চাটির দিকে একটু নজর রেখ, লক্ষ্মীটি।

কাতেরিনা অসম্মত হয়নি। বুড়ি যখনই গির্জার সন্ধ্যারতিতে যেত, কিংবা অহোরাত্র উপাসনায় রোগশয্যায় যন্ত্রণায় কাতর বাছা ফেদিয়ার জন্য প্রার্থনা করতে অথবা ভোরবেলাকার প্রথম পূজার প্রসাদ ফেদিয়ার জন্য আনতে যেতে হত, কাতেরিনা তখন অসুস্থ বাচ্চাটির পাশে বসত, জল খাওয়াত, সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দিত।

এই করে করে তাই যখন শীতের উপবাস আরম্ভের পরব উপলক্ষে বুড়ি সন্ধ্যারতি আর অহোরাত্র উপাসনা করার জন্য গির্জেয় গেল তার যাবার পূর্বে আদরের কাতেরিনাকে অনুরোধ করে গেল সে যেন ফেদিয়ার যত্নআত্তি করে। ততদিনে ছেলেটি অবশ্য আরোগ্যলাভ করে উঠছিল।

কাতেরিনা ফেদিয়ার ঘরে ঢুকে দেখে সে কাঠবিড়ালির চামড়ার তৈরি কোট পরে বিছানায় বসে সন্তদের জীবনকাহিনী পড়ছে।

গদিওলা কুর্সিতে আরাম করে বসে কাতেরিনা শুধলো, কী পড়ছ, ফেদিয়া? আমি সন্তদের জীবনকাহিনী পড়ছি, কাকিমা।*[* আসলে বউদি, কিন্তু রাশানরা আমাদের মতো যৌথ পরিবারে বাস করে না বলে একে অন্যকে সম্বোধনের সময় আমাদের মতো বাছবিচার করে না।]

ভালো লাগছে?

ভারি চমৎকার, কাকিমা।

ফেদিয়া যখন কথা বলছিল তখন কনুইয়ের উপর ভর করে কাতেরিনা তার দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে দেখছিল। অকস্মাৎ তার অন্তস্তলে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাক্ষসের পাল যেন মুক্ত হয়ে আবার তার সেই পুরনো চিন্তাগুলো সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলল : এই ছোকরাটা তার কী সর্বনাশই না করেছে, এবং সে অন্তর্ধান করলে তার জীবন কত না আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কাতেরিনা চিন্তা-সাগরে ডুব দিয়ে ভাবতে লাগল, এখন আর কীই-বা হতে পারে? ছেলেটা এমনিতেই অসুস্থ, তাকে ওষুধ খেতে হচ্ছে .. আর অসুখের সময় কত অঘটনই না ঘটতে পারে। লোকে আর কী বলবে? ডাক্তার ভুল ওষুধ দিয়েছিল!

তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে, ফেদিয়া?

হ্যাঁ কাকিমা। তোমার যদি কোনও অসুবিধা না হয়। তার পর চামচে ভরা ওষুধ গিলে বলল, সন্তদের এই জীবনকাহিনী কী অদ্ভুত সুন্দর, কাকিমা।

কাতেরিনা বলল, আরও পড়, বেশ করে পড়। কাতেরিনা তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চতুর্দিকে তাকাতে গিয়ে তার দৃষ্টি নকশা-কাটা ঘষা কাঁচের জানালাগুলোর ওপর গিয়ে পড়ল। তখন বলল, এগুলোর খড়খড়ি বন্ধ করিয়ে নিতে হবে। দাঁড়িয়ে উঠে কাতেরিনা পাশের ঘরে গেল, সেখান থেকে বসবার ঘর হয়ে উপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে বসল।

পাঁচ মিনিটের ভিতর সরূগেই তার কাছে এল। পরনে ফুলবাবুটির মতো সিলের চামড়ার অস্তরদার পুস্তিনের পোশাক।

কাতেরিনা শুধাল, জানালার খড়খড়িগুলো বন্ধ করা হয়েছে?

কাটখোট্টা সংক্ষেপে সেরগেই হ্যাঁ, বলে, কাঁচি দিয়ে মোমবাতির পোড়া পলতেটুকু কেটে ফেলে স্টোভটার কাছে এসে দাঁড়াল।

সবকিছু চুপচাপ।

কাতেরিনা জিগ্যেস করল, আজ রাত্রে গির্জার উপাসনা অনেকক্ষণ অবধি চলবে না?

সেরগেই উত্তর দিল, কালকের পরবটা বড় রকমের; উপাসনা দীর্ঘ হবে। আবার সবকিছু চুপচাপ।

কাতেরিনা দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আমাকে নিচে ফেদিয়ার কাছে যেতে হবে; সে সেখানে একেবারে একলা।

ভুরু নিচু করে কাতেরিনার দিকে সোজা তাকিয়ে সেরগেই শুধাল, একেবারে একলা?

একেবারে একলা। কাতেরিনা ফিসফিস করে উত্তর দিয়ে শুধাল, কেন? তাতে কী হয়েছে?

দুজনের চোখে চোখে যেন বিদ্যুতে বিদ্যুতে ধারাবহ্নি জ্বলে উঠল; কিন্তু দুজনার ভিতর শব্দমাত্র বিনিময় হল না।

কাতেরিনা নিচের তলায় গিয়ে এ-ঘর ও-ঘর প্রত্যেকটি খালি ঘর ভালো করে তদারক করে নিল। সর্বত্র শান্ত– নিঃশব্দ নৈস্তব্ধ্য। ইকনগুলোর নিচে মঙ্গলপ্রদীপ নিষ্কম্প জ্যোতি বিচ্ছুরিত করছে। কাতেরিনার ছায়া তার সমুখ দিকে যেন দ্রুততর গতিতে এগিয়ে গিয়ে প্রাচীর-গাত্রে প্রসারিত হচ্ছে। খড়খড়ি তুলে দেওয়ার ফলে জানলার উপর জমে-যাওয়া বরফ গলে গিয়ে চোখের জলের মতো ঝরে পড়ছে। বিছানার উপর বালিশে ভর করে বসে ফেদিয়া তখনও পড়ছিল। কাতেরিনাকে দেখে সে শুধু বলল, কাকিমা, এ বইখানা নাও, লক্ষ্মীটি, আর ইকনের তাক থেকে ওই বইখানা দাও তো।

কাতেরিনা তার অনুরোধ পালন করে বইখানা তাকে দিল।

ফেদিয়া, এখন তুমি ঘুমিয়ে পড়লে ভালো হয় না?

না, কাকিমা, আমি দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করব।

দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করবে কেন?

আমার জন্য অহোরাত্র-উপাসনার নৈবেদ্য আনার কথা দিয়েছে দিদিমণি।

কাতেরিনার মুখ হঠাৎ একদম পাংশু হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ডের নিচে সে এই প্রথম তার সন্তানের স্পন্দন অনুভব করল। সমস্ত বুক তার হিম হয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে আপন ঠাণ্ডা হাত দু-খানা গরম করবার জন্য ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেল।

শোবার ঘরে নিঃশব্দে ঢুকে দেখল সেরগেই স্টোভের কছে দাঁড়িয়ে। ফিসফিস করে তাকে বলল, ওইখানে।

প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে সেরগেই শুধল, কী? তার গলাতে কী যেন আটকে গেল।

সে একেবারে একলা।

সেরগেই ভুরু কোঁচকাল। তার শাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।

কাতেরিনা হঠাৎ দোরের দিকে রওনা দিয়ে বলল, চল।

সেরগেই তাড়াতাড়ি জুতো খুলে ফেলে শুধাল, সঙ্গে কী নেব?

কাতেরিনা অতি অস্ফুট কণ্ঠে বলল, কিছু না। তার পর নীরবে সেরগেইয়ের হাত ধরে তাকে পিছনে পিছনে নিয়ে চলল।

.

১১.

এই নিয়ে তিন বারের বার কাতেরিনা যখন অসুস্থ বালকের ঘরে ঢুকল তখন সে হঠাৎ ভয়ে কেঁপে ওঠাতে বইখানা তার কোলে পড়ে গেল।

কী হল, ফেদিয়া?

বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে ফেদিয়া ভীত স্মিত হাস্যে বলল, ও, হঠাৎ যেন কিসের ভয় পেলুম কাকিমা।

কিসের ভয় পেলে?

তোমার সঙ্গে কে ছিল, কাকিমা?

কোথায়? আমার সঙ্গে তো কেউ ছিল না। লক্ষ্মীটি।

কেউ ছিল না?

ফেদিয়া খাটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা হয়ে, তার কাকিমা যে দোর দিয়ে ঢুকেছিল সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন খানিকটা আশ্বস্ত হল!

বলল, বোধহয় আমার নিছক কল্পনাই হবে।

কাতেরিনা খাটের খাড়া তক্তায় কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। ফেদিয়া তার কাকির দিকে তাকিয়ে বলল, তার মনে হচ্ছে, কেন জানিনে, তাকে বড় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।

উত্তরে কাতেরিনা ইচ্ছে করে কেশে দরজার দিকে তাকিয়ে কী যেন প্রতীক্ষা করল। সেখান থেকে এল– কাঠের মেঝে থেকে সামান্যতম মচমচ শব্দ।

আমার নামে যে কুলগুরুর নাম– তাঁর জীবনকথা আমি পড়ছি, কাকিমা! বীরযোদ্ধা শহিদ হয়ে কীরকম পরমেশ্বরের কাছে প্রিয়রূপে গণ্য হলেন।

কাতেরিনা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ভাইপো সোহাগ করে বলল, তুমি বসবে, কাকিমা? আমি তা হলে তোমাকে কাহিনীটা পড়ে শোনাই।

কাতেরিনা উত্তর দিল, একটু দাঁড়াও, আমি এখখুনি আসছি। বসবার ঘরের মঙ্গলপ্রদীপটি ঠিক জ্বলছে কি না দেখে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল।

পাশের ঘরে যে ফিসফিস করে কথা আরম্ভ হল সেটা অতিশয় নীরবের চেয়েও ক্ষীণ, কিন্তু চতুর্দিকে যে গভীর নৈস্তব্ধ্য বিরাজ করছিল তার ভিতর সেটা ফেদিয়ার তীক্ষ্ণ কর্ণে এসে পৌঁছল।

কান্নার জলভরা কণ্ঠে ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল, কাকিমা, ওখানে কী হচ্ছে? কার সঙ্গে তুমি কথা বলছ? এক মুহূর্ত পরে আরও অশ্রু-ভরা কণ্ঠে আবার চেঁচিয়ে বলল, কাকিমা! এদিকে এসো আমার বড় ভয় করছে। এবার সে যেন কাতেরিনার কণ্ঠে ঠিক আছে শুনতে পেল এবং ভাবল সেটা তারই উদ্দেশে বলা হয়েছে।

দৃঢ় পদক্ষেপে কাতেরিনা এসে এমনভাবে দাঁড়াল যে, তার শরীর ফেদিয়া আর বাইরে যাবার দরজার মাঝখানে। বেশ কড়া গলায় বলল, তুমি খালি খালি কিসের ভয় পাচ্ছ? ঠিক তার পরই বলল, এইবারে তুমি শুয়ে পড়।

আমার যে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না, কাকিমা।

না, না। তুমি এবারে ঘুমোও, ফেদিয়া আমার কথা শোন, শুয়ে পড়… সত্যি, রাত হয়েছে।

কিন্তু কেন এসব, কাকিমা। আমার যে মোটেই শুতে ইচ্ছে করছে না।

না, তুমি শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। কাতেরিনার স্বর আবার বদলে গিয়েছে, অল্প অল্প কাঁপছে। তার পর বাহু দু-খানা তুলে ছেলেটাকে দুই কান দিয়ে চেপে ধরে খাটের শিয়রের দিকে শুইয়ে দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ফেদিয়া আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল; সে দেখতে পেয়েছে সেরগেইকে– ফ্যাকাসে মুখ, আর খালি পায়ে সে ঘরে ঢুকছে।

ত্রাসে, ভয়ের বিভীষিকায় ছেলেটা তালু পর্যন্ত মুখ খুলে ফেলেছে। কাতেরিনা সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। কড়া গলায় বলল, শিগগির কর, তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসো– চেপে ধরো ছেলেটাকে, ধস্তাধস্তি না করে।

সেরগেই ছেলেটার দু হাত-পা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা এক ঝটকায় বড় একটা পালকের বালিশ নিয়ে বলির পাঠা সেই ছোট্ট বালকের কচি মুখটি ঢেকে দিয়ে, বালিশের উপর ঝাঁপটে পড়ে তার শক্ত নরম স্তনের উপর চাপ দিতে লাগল।

কবরের ভিতর যে স্তব্ধতা– প্রায় চার মিনিট ধরে সেটা সে ঘরে বিরাজ করল।

অতি মৃদুকণ্ঠে কাতেরিনা বলল, ওর হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু– কিন্তু দাঁড়িয়ে উঠে সবকিছু গোছগাছ করাতে লাগতে না লাগতে, বহু লুকনো পাপের রঙ্গভূমি, নিস্তব্ধ বাড়িটার দেওয়ালগুলো সশব্দ তীব্র মুষ্ট্যাঘাতের পর মুষ্ট্যাঘাতে টলমল করে উঠল; জানালাগুলো খড়খড়িয়ে উঠল, ঘরের মেঝে দুলতে লাগল, মঙ্গলপ্রদীপ ঝোলানোর সরু শিকল দুলে দুলে দেওয়ালের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের উপর অদ্ভুত ছায়াছবির দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দিল।

সেরগেই আতঙ্কে শিউরে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে লাগাল ছুট। কাতেরিনাও ছুটল তাকে ধরবার জন্য। ওদিকে হট্টগোল তোলপাড় যেন তাদের পিছনে আসছে। যেন কোনও অপার্থিব শক্তি এই পাপালয়কে তার ভিত্তিতল পর্যন্ত ঝাঁকুনি দিয়ে ওলট-পালট করে দিচ্ছে।

কাতেরিনার ভয় হচ্ছিল, পাছে সেরগেই ত্রাসের তাড়নায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে তার আর্ত চেহারা দিয়ে সবকিছু ফাঁস করে দেয়; সে কিন্তু ছুটল সিঁড়ির দিকে উপরের তলায় যাবে বলে।

সেরগেই মাত্র কয়েকটি ধাপ উঠতেই অন্ধকারে একটা আধখোলা দরজার সঙ্গে খেল সরাসরি প্রচণ্ড এক ধাক্কা। আর্তনাদ করে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচের দিকে– কুসংস্কার-ভরা আতঙ্কে সে তখন সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে গিয়েছে।

গড়গড় করে তার গলা দিয়ে শুধু বেরুচ্ছে, জিনোভিই বরিসিছ! জিনোভিই বরিসিছ! আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচের দিকে পা উপরের দিকে করে হুড়মুড়িয়ে পড়ার সময় কাতেরিনাকেও ফেলে দিয়ে নিয়ে চলেছে তার সঙ্গে।

কাতেরিনা শুধাল, কোথায়?

সেরগেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ওই যে, ওই তো ওইখানে সে একটা লোহার পর্দার উপর বসে বসে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ওই তো ওই– আবার আসছে সে। শোন, সে গর্জন করছে- গর্জন করছে সে আবার।

এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, অসংখ্য হস্ত রাস্তার দিকে মুখ-করা জানালাগুলোর উপর প্রচণ্ড ঘা দিচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে কে একজন বাড়ির দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।

কাতেরিনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ওরে হাবা। ওঠ, উঠে পড়, হাবা কোথাকার! কথা ক-টি বলা শেষ করতে না করতে সে তীরের মতো ছুটে গেল ফেদিয়ার কাছে। মরা ছেলেটার মাথা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বালিশের উপর এমনিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখল যে মনে হয় সে ঘুমুচ্ছে। তার পর শত শত মুষ্টি যে দরজাটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল সেইটে দৃঢ়হস্তে খুলে দিল।

সম্মুখে ভীষণ দৃশ্য। দলে দলে লোক রোয়াকের উপর উঠবার চেষ্টা করছে। তাদের মাথার উপর দিয়ে কাতেরিনা দেখতে পেল সারি সারি অপরিচিত লোক উঁচু পাঁচিল টপকে বাড়ির আঙ্গিনায় নামছে– আর বাইরের রাস্তা উত্তেজিত কণ্ঠের কথা-বলাবলিতে গগম্ করছে।

কোনওকিছু ভালো করে বোঝবার পূর্বে রোয়াকের দল কাতেরিনাকে উল্টে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঘরের ভিতরে।

.

১২.

এই প্রচণ্ড উত্তেজনা, তুলকালাম কাণ্ড এল কী করে?

বছরের বারোটা প্রধান পর্বের যে কোনওটির আগের রাতে কাতেরিনা ভদের শহরের হাজার হাজার লোক শহরের সবকটা গির্জা ভরে দিত। শহরটা যদিও মফস্বলের, তবু তার ব্যবসাবাণিজ্য শিল্পোৎপাদন নগণ্য নয়। ফলে যেসব গির্জায় ভোরবেলাকার ঈশ্বরের-সংযোগ উপাসনা করা হত সেখানে এমনই প্রচণ্ড ভিড় জমত যে, বলতে গেলে পোকামাকড়টিও সেখানে নড়াচড়া করার মতো জায়গা পেত না। এসব গির্জের সমবেত ধর্মসঙ্গীত গাইত শহরের বণিক সম্প্রদায়ের তরুণের দল। তাদের মূল-গায়েন, আপন ওস্তাদও সেখানে নিযুক্ত থাকত।

আমাদের শহরবাসীরা প্রভুর গির্জার প্রতি অনুরক্ত উৎসাহী ভক্ত– তাই তাদের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তারা সঙ্গীত ও অন্যান্য কলার সমঝদার। গির্জায় বৈভব-উজ্জ্বল চাকচিক্য এবং অর্গেনসহ বহু কণ্ঠে গীত সঙ্গীত তাদের জীবনের একটি উচ্চতম পবিত্রতম বিমলানন্দ। যে গির্জায় যেদিন ঐক্যসঙ্গীত হত সেখানে আধখানা শহরের ভিড় লেগে যেত, বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের তরুণ দলের, কেরানি-কুল, ছোকরার দল, ফুলবাবুর পাল, কল-কারখানার ছোট বড় হুনুরি-কারিগর, এমনকি মিল কারখানার মালিকরাও তাঁদের ভামিনীগণ সমভিব্যাহারে উপস্থিত হতেন। সবাই ভিড় লাগাত একই গির্জায় : সবাই চাইত যে করেই হোক অৰ্গেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অষ্ট কণ্ঠ-সঙ্গীত, কিংবা কোনও ওস্তাদ যখন সপ্তমে উঠে কঠিন কারুকার্য করেন সেগুলো শুনতে– তা সে নরকের অগ্নিকুণ্ডের গরম দিনেই হোক, আর পাথর-ফাটা কনকনে শীতেই হোক; গির্জার ঢাকা আঙিনাতেই হোক, আর জানালার নিচে দাঁড়িয়েই থোক।

ইসমাইলফদের পাড়ার গির্জেয় হবে সর্বমঙ্গলময়ী কুমারী মা-মেরির স্মরণে পরব। তাই তার আগের রাত্রে যখন ইসমাইল পরিবারে ফেদিয়াকে নিয়ে পূর্ববর্ণিত নাটক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন তাবৎ শহরের তরুণদল ওই গির্জেয় জড় হয়েছিল। গির্জে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বেশ শোরগোল তুলে তারা সে সন্ধ্যার বিখ্যাত তার-সপ্তক-গায়কের গুণ নিয়ে, এবং ওঁরই মতো সমান বিখ্যাত খাদ-গায়কের দৈব পদস্খলন নিয়ে আলোচনা করছিল।

কিন্তু সবাই যে কণ্ঠসঙ্গীত-আলোচনায় মেতে উঠেছিল তা নয়; দলের মধ্যে আর পাঁচজন আর পাঁচটা বিষয়ে অনুরাগী।

এদের মধ্যে ছিল একটি ছোকরা কলকজার হুনুরি। তাকে সম্প্রতি এখানকার একটি স্টিম-মিলের মালিক পেতের্সবুর্গ থেকে আমদানি করেছেন। ইসমাইলদের বাড়ির কাছে আসতে সে বলে উঠল, সবাই বলছে, মেয়েটা তাদের কেরানি সেরগেইকে নিয়ে রসকেলিতে অষ্টপ্রহর মেতে আছে।

ভেড়ার চামড়ার অস্তরদার নীল সুতি কোটপরা একজন বলল, যাহ! সে তো সব্বাই জানে। আর সেই কথাই যখন উঠল– আজ রাত্রে সে গির্জেয় পর্যন্ত আসেনি।

গির্জেয়? কী যে বলছ? বদমাইশ মাগীটা পাপের কাদামাটি এমনই সর্বাঙ্গে মেখেছে যে, সে এখন না ডরায় ভগবানকে, না ডরায় আপনি বিবেককে, না ডরায় দ্রজনের দৃষ্টিকে।

কলকজার ছোকরাটি বলল, ওই হোথা দেখ, ওদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। আঙুল তুলে সে দেখাল, খড়খড়ির ভিতর দিয়ে আসছে আলোর রেখা।

একাধিক গলা তাকে টুইয়ে দিয়ে বলল, ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ না, এবারে তারা কোন তালে আছে।

দুই বন্ধুর কাঁধের উপর ভর করে কলকজার ছোকরাটি ফাঁকের ভিতর দিয়ে ভালো করে তাকাতে না তাকাতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ভাইরা সব, ওরা কার যেন দম বন্ধ করে তাকে মারছে– বন্ধুরা সব, দম বন্ধ করে কাউকে মারছে!

সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে দু হাত দিয়ে খড়খড়ির উপর থাবড়াতে লাগল। তার দেখাদেখি আরও জনা দশেক লাফ দিয়ে জানালার উপর উঠে হাতের মুঠো দিয়ে খড়খড়ির উপর হাতুড়ি পেটা করতে আরম্ভ করে দিল।

প্রতি মুহূর্তে ভিড় বাড়তে লাগল, এবং এই করেই ইসমাইলফুদের বাড়ি পূর্বোল্লিখিতভাবে আক্রান্ত হল।

***

ফেদিয়ার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে কলকজার লোকটি সাক্ষ্য দিল, আমি নিজে দেখেছি; আমি স্বচক্ষে দেখেছি; বাচ্চাটাকে চিত করে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে দুজনাতে মিলে তার দম বন্ধ করে মারছিল।

সেরগেইকে সেই রাত্রেই পুলিশ-থানায় নিয়ে যাওয়া হল; দুজন প্রহরী কাতেরিনাকে তার শোবার-ঘরে নজরবন্দি করে রাখল।

***

ইসমাইলদের বাড়িতে অসহ্য শীত ছেয়ে পড়েছে। ঘর গরম করার স্টোভগুলো জ্বালানো হয়নি, সদর দরজা সর্বক্ষণ খোলা, কারণ দঙ্গলের পর দঙ্গল কৌতূহলীর দল একটার পর আরেকটা বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকছে। সবাই গিয়ে দেখছে কফিনের ভিতর শুয়ে ফেদিয়া– আরেকটা ডালা-বন্ধ পুরো মখমলের পর্দা দিয়ে ঢাকা বড় কফিন।*[* পরে বলা হয়েছে, এটাতে ছিল কাতেরিনার স্বামীর মৃতদেহ। এটা পচে গিয়েছিল বলে কফিনের ডালা বন্ধ করে তার উপর ভারী পর্দা ফেলে দেওয়া হয়েছিল– যাতে করে দুর্গন্ধ না বেরোয়।] ফেদিয়ার কপালের যেখানটায় ডাক্তার ময়নাতদন্তের জন্য কেটেছিলেন সেখানকার লাল দাগটি ঢাকার জন্য তার উপর রাখা হয়েছিল সাটিনের ফুল-পাতা দিয়ে তৈরি একটি মালা। তদন্তে প্রকাশ পায় যে, ফেদিয়া দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মারা যায়। সেরগেইকে ফেদিয়ার মৃতদেহের পাশে নিয়ে যাওয়ার পর, পাদ্রি ভয়াবহ শেষ বিচারের দিন এবং যারা কৃত পাপের জন্য অনুশোচনা করে না তাদের কী হবে সে সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে না বলতেই সে হাউ হাউ করে চোখের জলে ভেঙে পড়ল। সমস্ত প্রাণ খুলে দিয়ে সে যে ফেদিয়ার খুনি একথাই যে স্বীকার করল তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষা জানাল জিনোভিই বরিসিচের মরা লাশও যেন খুঁড়ে তোলা হয়– স্বীকার করল যে, পাদ্রি-কৃত শেষ-অন্ত্যেষ্টির পুণ্যফল থেকে জিনোভিইকে বঞ্চিত করে সে তাকে মাটিতে পুঁতেছিল।

তখনও তার লাশ সম্পূর্ণ পচে যায়নি; সেটা খুঁড়ে তুলে একটা বিরাট সাইজের কফিনে রাখা হল। সর্বসাধারণকে ত্রাসে আতঙ্কিত করে সে তার দুটি পাপের সহকর্মিণীরূপে যুবতী গৃহকত্রীর নাম উল্লেখ করল।

সর্ব প্রশ্নের উত্তরে কাতেরিনা লভভূনার মাত্র একটি উত্তর : আমি কিছু জানিনে; আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানিনে।

সেরগেইকে কাতেরিনার সামনে মুখোমুখি করে তাকে দিয়ে কাতেরিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো হল। তার সব স্বীকৃতি শুনে কাতেরিনা নীরব বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল– সে দৃষ্টিতে কিন্তু কোনও রোষের চিহ্ন ছিল না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সে যখন সবকিছু বলার জন্য এতই উৎসুক তখন আমার কোনও কিছু অস্বীকার করে আর কী হবে? আমি তাদের খুন করেছি।

সবাই শুধল, কিন্তু কেন, কিসের জন্য?

কাতেরিনা সেরগেইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওর জন্য।

সেরগেই মাথা হেঁট করল।

আসামি দুজনাকে জেলে পোরা হল। এই বীভৎস কাণ্ডটা জনসাধারণের ভিতর এমনই কৌতূহল, ঘৃণা আর ক্রোধের সঞ্চার করেছিল যে, ঝটপটু তার ফয়সালা হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে সেরগেই এবং তৃতীয় বণিক সঙ্রে জনৈক বণিকের বিধবা কাতেরিনা লুভভনাকে ফৌজদারি আদালতের রায় শোনানো হল : তাদের আপন শহরের খোলা হাটে প্রথম তাদের চাবুক মারা হবে এবং তার পর সাইবেরিয়াতে কঠিন সশ্রম কারাদণ্ডে উভয়ের নির্বাসন। মার্চ মাসের এক ভোরবেলাকার নিদারুণ হিমের শীতে চাবুকদার কাতেরিনার অনাচ্ছাদিত দুগ্ধধবল পৃষ্ঠে আদালতের স্থির করা সংখ্যা গুনে গুনে চাবুকের ঘা মেরে মেরে নীল-লাল রঙের উঁচু ফুলে-ওঠা দাগড়ার দাগ তুলল। তার পর সেরগেই পিঠে-কাঁধে তার হিস্যে পেল। সর্বশেষে তার সুন্দর মুখের উপর জ্বলন্ত লোহা দিয়ে তিনটি রেখা কেটে ভ্রাতৃহন্তা ‘কেন’-এর লাঞ্ছনা অঙ্কন করে দিল।*[* বাইবেলের প্রথম অধ্যায় সৃষ্টি পর্বে বর্ণিত আছে, আদমের পুত্র কে তার ভ্রাতা আবেলকে হত্যা করে; যেহেতু মানুষ মাত্রই একে অন্যের ভ্রাতা তাই খুনির কপালে ছ্যাকা দিয়ে তিনটি চিরস্থায়ী লাঞ্ছন অঙ্কনের বর্বর প্রথা ইউরোপের প্রায় সর্বদেশেই উনবিংশ শতাব্দী অবধি প্রচলিত ছিল।]

এসব ঘটনা ঘটার সময় আগা-গোড়া দেখা গেল, যে কোনও কারণেই হোক, সেরগেই কিন্তু কাতেরিনার চেয়ে জনসাধারণের বেশি সহানুভূতি পেল। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত অবস্থায় কৃষ্ণবর্ণ দণ্ডমঞ্চ থেকে নামবার সময় সে বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পক্ষান্তরে কাতেরিনা নেমে এল দৃঢ় পদক্ষেপে তার একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল যাতে করে তার খসখসে শেমিজ আর কয়েদিদের কর্কশ কোটটা তার পিঠে সেঁটে না যায়।** [** অনুবাদকের মনে হয়, তার ভয় ছিল, কর্কশ উলের সুতো পিঠের ঘায়ে ঢুকে গেলে শুকোবার সময় সমস্ত পিঠের চামড়া অসমান হয়ে গিয়ে তার পিঠের মসৃণ সৌন্দর্য নষ্ট করবে। কিন্তু অতি অবশ্য মনে রাখা উচিত, সে শুধু তার বল্লভের ভোগের জন্য। আপন সৌন্দর্য নিয়ে কাতেরিনার নিজস্ব কোনও দম্ভ ছিল না– কাহিনীতে তার কোনও চিহ্ন নেই।]

এমনকি জেল-হাসপাতালে যখন তাকে তার সদ্যোজাত শিশুকে দেখানো হল সে মাত্র এইটুকু বলল, আহ, কে ওটাকে চায়? কস্মিনকালেও গোঙরানো কাতরানোর একটি মাত্র শব্দ না করে, কস্মিনকালেও কারও বিরুদ্ধে কণামাত্র অভিযোগ না জানিয়ে সে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত তক্তার উপর বুকের ভার রেখে কুঁকড়ে পড়ে রইল।

.

১৩.

সেরগেই ও কাতেরিনা অন্যান্য কয়েদির সঙ্গে দল বেঁধে সাইবেরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরোল বসন্ত ঋতুতে। পঞ্জিকায় সেটা বসন্ত ঋতু বলে লেখা আছে বটে, কিন্তু আসলে তখন সেই প্রবাদটাই সত্য যে, সূর্য আলোক দেন যথেষ্ট, কিন্তু গরমি দেন অতি অল্পই।

কাতেরিনার বাচ্চাটাকে বরিস তিমোতেইয়েভিচের সেই বুড়ি মামাত বোনের হাতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেওয়া হল। কারণ সে দণ্ডিতা রমণীর নিহত স্বামীর আইনসম্মত সন্তানরূপে স্বীকৃত হল বলে এখন সে ইসমাইল এবং ফেদিয়ার তাবৎ সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারী। এ ব্যবস্থাতে কাতেরিনা যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল এবং বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিল পরিপূর্ণ তাচ্ছিল্যভরে। বহু অবাধ প্রণয়াবেগবিহ্বল রমণীর মতো তার প্রেমও আপন দয়িতে অবিচল হয়ে রইল– দয়িতের সন্তানে সঞ্চারিত হল না।

আর শুধু বাচ্চাটার ব্যাপারেই নয়, সত্য বলতে কী, কাতেরিনার জীবনে এখন আর কোনওকিছুর অস্তিত্ব নেই, আলো নেই, অন্ধকারও নেই; না আছে অমঙ্গল, না আছে মঙ্গল, দুঃখ নেই সুখও নেই, সে কিছুই বুঝতে পারে না, কাউকে ভালোবাসে না– নিজেকে পর্যন্ত না। অস্থির হয়ে সে শুধু প্রতীক্ষা করছিল একটি জিনিসের : কয়েদির দল রওনা হবে কবে, কারণ তার হৃদয়ে তখন একমাত্র আশা, দলের ভিতর সে সেরগেইকে আবার দেখতে পাবে। আপন শিশুটির কথা ততদিনে সে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে।

তার আশা তাকে ফাঁকি দিল না। মুখে কে-এর লাঞ্ছনা আঁকা, সর্বাঙ্গে ভারী শিকল বয়ে সেরগেইও রওনা দিল তারই সঙ্গে একই ছোট দলটাতে।

যতই ঘৃণ্য হোক না কেন, মানুষ সর্ব অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় এবং সর্ব অবস্থাতেই নিজ নিজ ক্ষুদ্র আনন্দের সন্ধান সাধ্যমতো করে থাকে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার প্রয়োজন, কণামাত্র প্রয়োজন, কাতেরিনার ছিল না। সে সেরগেইকে আবার দেখতে পাচ্ছে এবং তার সঙ্গ পাওয়ার ফলে এই যে রাস্তা তাকে কঠিন কারাগারের নির্বাসনে নিয়ে যাচ্ছে সে-রাস্তাও তার কাছে আনন্দ-কুসুমে পুষ্পচ্ছাদিত বলে মনে হতে লাগল।

কাতেরিনা তার ছিটের তৈরি ব্যাগে করে মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়েছিল অল্পই, এবং রোক টাকাকড়ি নিয়েছিল তার চেয়েও কম। এবং সেসবও খর্চা হয়ে গেল নিনি নগরদ*[* বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মাসি গর্কির নামে বর্তমান গর্কি।] পৌঁছবার বহু পূর্বেই পাহারাওলাদের ঘুষ দিতে দিতে– যাতে করে সে রাস্তায় সেরগেইয়ের পাশে পাশে যেতে পারে, যাতে করে পথিমধ্যে রাত্রিযাপন আশ্রয়ের হিমশীতল এক কোণে, গভীর অন্ধকারে সে তার সেরগেইকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক আলিঙ্গন করতে পারে।

ওদিকে কিন্তু কাতেরিনার কে-মার্কা মারা বল্লভের হৃদয়ে কী জানি কী করে তার প্রতি স্নেহ-প্রেম শুকিয়ে গিয়েছে। কথা সে বলত কমই, আর বললে মনে হত যেন আঁকশি দিয়ে কথাগুলো অতি কষ্টে টেনে বের করছে, আর এসব গোপন মিলনের মূল্য দিত সে অত্যল্পই– যার জন্য কাতেরিনাকে তার খাদ্য-পানীয়, আর তার আপন অত্যাবশ্যক প্রয়োজনের জন্য যে-কটি সামান্য দু-চার পয়সা তার তখনও ছিল, সবকিছু বিলিয়ে দিতে হত। এমনকি সেরগেই একাধিকবার বলতেও কসুর করল না, ওই যে অন্ধকার কোণে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচের ধুলো সরাবার জন্য তুমি পাহারাওলাদের পয়সা দিচ্ছ সেগুলো আমাকে দিলেই পার।

মিনতিভরা কণ্ঠে কাতেরিনা বলল, আমি তো কুল্লে পঁচিশটি কপে দিয়েছি, সেরেজেঙ্কা।

আর পঁচিশটি কপেক কি পয়সা নয়? পঁচিশটি কপেক্‌ কি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়? অতগুলো কপে কবার পেয়েছ তুমি? ওদিকে কবার অতগুলো তুমি দিয়ে দিয়েছ, কে জানে।

কিন্তু ওই করেই তো আমরা একে অন্যকে দেখতে পাই।

বটে? সেটা কি সহজ? ওতে করে আমরা কী আনন্দ পাই– এতসব নরক-যন্ত্রণার পর? আমার তো ইচ্ছে করে আমার জীবনটাকে পর্যন্ত অভিসম্পাত করি, আর এ ধরনের মিলনের ওপর তো কথাই নেই।

কিন্তু সেরেজা, তোমাকে দেখতে পেলে আমার তো অন্য কোনও কিছুতেই এসে-যায় না।

এসব ঘোর আহাম্মকি।– এই হল সেরগেইয়ের উত্তর।

এসব উত্তরে কাতেরিনা কখনও আপন ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে রক্ত বের করত, আর কখনও-বা নিশাকালীন মিলনের অন্ধকার অশ্রুবর্ষণে অনভ্যস্ত তার সে দুটি চোখও তিক্ততার তীব্র বেদনায় ভরে যেত, কিন্তু সে সবকিছু বরদাস্ত করে গেল, নীরবে যা ঘটার ঘটতে দিল এবং নিজেকে নিজে ফাঁকি দিতে কসুর করল না।

উভয়ের মধ্যে এই নতুন এক সম্পর্ক নিয়ে তারা নিজনি নগর পৌঁছল। এখানে পৌঁছে তারা আরেক দল কয়েদির সঙ্গে যোগ দিল– তারা এসেছে মস্কো অঞ্চল থেকে, যাবে ওই একই সাইবেরিয়ায়।

নবাগত এই বিরাট বাহিনীর হরেক রকম চিড়িয়ার মাঝখানে, মেয়েদের দলে ছিল দুটি মেয়ে যারা সত্যই মনোযোগ আকর্ষণ করে। একটির নাম তিয়োনা, ইয়ারোস্লাভূলের এক সিপাইয়ের স্ত্রী। এরকম চমৎকার কামবিলাসিনী মোহিনী আর হয় না। সে লম্বা, আর আছে একমাথা চুলের ঘন কুন্তল বেণি, মদিরালস্ হরিদ্রাভ নয়ন, তার উপর নেমে এসে ছায়া দিচ্ছে নিবিড় আঁখিপল্লবের রহস্যময় অবগুণ্ঠন। অন্যটি সতেরো বছরের নিখুঁত খোদাই করা তরুণী। গাঁয়ের বর্ণটি মোলায়েম গোলাপি, মুখটি ছোট্ট, কচি তাজা দুটি গালের উপর দুটি টোল, আর কয়েদিদের মাথা-বাঁধবার ছিটের রুমালের নিচে থেকে কপালে নেমে এসে এখানে-ওখানে নাচছে ঢেউখেলানো সোনালি চুল। দলের সবাই তাকে সোনেৎকা নামে ডাকত।

সুন্দরী রমণী তিয়োনার স্বভাবটি ছিল শান্ত, মদিরালস। দলের সবাই তাকে ভালো করেই চিনত, এবং তাকে জয় করতে সক্ষম হয়ে কোনও পুরুষই অত্যধিক উল্লাসভরে নৃত্য করত না, কিংবা সে যখন তার তাবৎ কৃপাভিলাষীদের মস্তকে সমমূল্যের বিজয়-মুকুট পরিয়ে দিত তখন অত্যধিক শোকেও কেউ মুহ্যমান হত না।

পুরুষ-কয়েদির দল মশকরার সুরে সমস্বরে বলত, মেয়েদের ভিতর আমাদের তিয়োনা পিসি সবচেয়ে দরদি দিল ধরেন; কারও বুকে তিনি কস্মিনকালেও আঘাত দিতে পারেন না!

সোনেৎকা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ঝোপের চিড়িয়া।

তার সম্বন্ধে তারা বলত, যেন বান্ মাছ পাক দেবে, মোচড় খাবে, কিন্তু কখনও শক্ত মুঠোয় ধরতে পারবে না।

সোনেৎকার রুচি ছিল; চট করে যা-তা সে তো নিতই না, বরঞ্চ বলা যেতে পারে, বাড়াবাড়িই করত। সে চাইত কাম যেন তার সামনে ধরা হয় সাজসজ্জায় যেন সাদামাটা তরি-তরকারি তার সামনে না ধরে সেটা যেন তৈরি হয় তীক্ষ্ণ স্বাদের ঝাল-টকের সস্ দিয়ে কামে যেন থাকে হৃদয়দহন, আত্মত্যাগ। আর তিয়োনা ছিল খাঁটি, নির্ভেজাল রুশ সরলতার নির্যাস। আর সে সরলতায় ভরা থাকত এমনই অলসের আবেশ যে, কোনও পুরুষকে, কেন জ্বালাচ্ছ, ছেড়ে দাও আমাকে বলবার মতো উৎসাহ তার ছিল না। সে শুধু জানত, সে স্ত্রীলিঙ্গের রমণী। এ জাতীয় রমণীকে বড়ই আদর করে ডাকাত-ডাকু, কয়েদির দল আর পেতেসবুর্গের সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক গুষ্ঠী।

এই দুই রমণীসহ মস্কো থেকে আগত কয়েদির দল যখন সেরগেই-কাতেরিনার দলের সঙ্গে মিলিত হল তখন এ দুটি রমণী নিয়ে এল কাতেরিনার জীবনে ট্র্যাজেডি।

.

১৪.

দুই দলে সম্মিলিত হয়ে নিজনি থেকে কাজান রওনা হওয়ার প্রথমদিন থেকেই সেরগেই কোনওপ্রকারের ঢাক-ঢাক গুড়গুড় না করে উঠে-পড়ে লেগে গেল সৈনিক বধূ তিয়োনার প্রণয়লাভের জন্য এবং স্পষ্টই বোঝা গেল কোনওপ্রকারের অলঙ্ঘ্য প্রতিবন্ধক তার সামনে। উপস্থিত হয়নি। অলসাবেশা তিয়োনা সেরগেইকে অযথা হতাশায় মনমরা হতে দিল না– সে তার হৃদয়বশত কদাচ কোনও পুরুষকেই হতাশায় মনমরা হতে দিত না। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ রাত্রির আশ্রয়স্থলে সন্ধ্যার সময় কাতেরিনা ঘুষ দিয়ে তার সেরেজেকার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল; এখন সে ন্দ্রিাহীন চোখে প্রতীক্ষা করছিল, যে কোনও মুহূর্তে প্রহরী এসে আস্তে আস্তে তাকে নাড়া দিয়ে কানে কানে বলবে, ছুটে যাও! ঝটপট সেরে নিয়ো। দরজা খুলে গেল, আর কে যেন, কোন এক রমণী তীরবেগে করিডর পানে ধাওয়া করল; দরজা আবার খুলে গেল, আবার আরেক রমণী তিলার্ধ নষ্ট না করে তার শোবার তক্তা থেকে লাফ দিয়ে উঠে প্রহরীর পিছনে অন্তর্ধান করল; অবশেষে কে যেন এসে তার সর্বাঙ্গ ঢাকা কর্কশ কোটে আস্তে আস্তে টান দিল। তৎক্ষণাৎ সে তার শোবার তক্তা থেকে লাফ দিয়ে উঠল– তক্তাখানা কত না কয়েদির গাত্ৰ-ঘর্ষণে চিকুণ-মসৃণ হয়ে গিয়েছে– কোটটা কাঁধের উপর ফেলে আস্তে আস্তে প্রহরীর গায়ে ধাক্কা দিল তাকে গন্তব্যস্থল দেখিয়ে দেবার জন্য নিয়ে যেতে।

করিডরের মাত্র একটি জায়গায় অগভীর পিরিচের উপর ঢালাই মোমে প্রদীপের নিষ্প্রভ পলতেটি ক্ষীণ আলো দিচ্ছে। কাতেরিনা চলতে চলতে দু-তিনটি যুগল-মিলনের সঙ্গে ঠোক্কর খেল– গা মিলিয়ে দিয়ে তারা যতদূর সম্ভব অদৃশ্য হবার চেষ্টা করছিল। পুরুষদের ওয়ার্ড পেরিয়ে যাবার সময় কাতেরিনা শুনতে পেল তাদের দরজায় কাটা ছোট জানালার ভিতর দিয়ে চাপা হাসির শব্দ আসছিল।

পাহারাওলা বিড়বিড় করে কাতেরিনাকে বলল, হাসাহাসির রকমটা দেখছ? তার পর তার কাঁধে ধরে একটা কোণের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে গেল।

হাতড়াতে গিয়ে কাতেরিনার একটা হাত পড়ল কর্কশ কোট আর দাড়ির উপর, দ্বিতীয় হাতটা স্পর্শ করল কোন এক রমণীর গরম মুখের উপর।

সেরগেই নিচু গলায় শুধল, কে?

কী, কী করছ তুমি এখানে? তোমার সঙ্গে এ কে?

অন্ধকারে কাতেরিনা সজোরে তার সপত্নীর মাথা বাঁধার রুমালখানা ছিনিয়ে নিল। সে-ও সঙ্গে সঙ্গে তাকে এড়িয়ে দিল ছুট। করিডরে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে সে বায়ুবেগে অন্তর্ধান করল।

সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের ওয়ার্ড থেকে উচ্চকণ্ঠে ফেটে উঠল একশো অট্টহাস্য!

কাতেরিনা ফিসফিসিয়ে বলল, বদমাইশ, আর সেরগেইয়ের নবীন নাগরীর মাথা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রুমালের কোণ দিয়ে মারল তার মুখে ঝাঁপটা। সেরগেই তার দিকে হাত তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে-ও ইতোমধ্যে ছায়ার মতো লঘুপদে করিডর দিয়ে ছুটে গিয়ে ধরেছে তার কুঠুরির হাতল। পুরুষদের ওয়ার্ড থেকে যে অট্টহাস্য তার পিছনে পিছনে ধাওয়া করেছিল সেটা আবার এমনি কলরবে ধ্বনিত হল যে, যে-পাহারাওয়ালাটা পিরিচের গালামোমের কাঁপা কাঁপা বাতিটার সামনে বসে সময় কাটাবার জন্য আপন বুটজুতোর ডগাটাকে লক্ষ করে মুখ থেকে থুথুর তীর ছুড়ছিল সে পর্যন্ত মাথা তুলে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, চোপ্ ব্যাটারা!

কাতেরিনা চুপচাপ শুয়ে পড়ে অবধি সামান্যতম নড়াচড়া না করে সেইরকমই পড়ে রইল। সে চাইছিল নিজেকে বলে, আমি তাকে আর ভালোবাসিনে– আর অনুভব করছিল তাকে সে ভালোবাসে আরও গভীরভাবে, আরও বেশি আবেগভরা উচ্ছ্বাসে। বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই একই ছবি: তার ডান হাত অন্যটার মাথার নিচে থেকে থেকে কাঁপছে, তার বাঁ হাত চেপে ধরেছে অন্যটার কামাগ্নিতে জ্বলন্ত স্বন্ধদ্বয়।

হতভাগিনী কাঁদতে আরম্ভ করল। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে সর্ব দেহ-মন দিয়ে কামনা করতে লাগল, ওই সেই হাতটি যেন থাকে তার মাথার নিচে, সেই হাতটি যেন চেপে ধরে তার কাঁধ- হায়, সে কাঁধ এখন মৃগী রোগীর মতো থেকে থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে।

সেপাইয়ের বউ তিয়োনা তাকে ভোরবেলা জাগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি অন্তত আমার রুমালখানা ফেরত দিতে পার!

ও! তুমিই ছিলে তবে?

লক্ষ্মীটি, দাও না ফেরত!

কিন্তু তুমি আমাদের মাঝখানে আসছ কেন?

কেন, আমি কী করছি? তুমি কি ভেবেছ আমাদের ভিতর গভীর প্রণয়, নাকি? না এমন কিছু সত্যি একটা মারাত্মক ব্যাপার যে যার জন্য তুমি রেগে টং হবে!

কাতেরিনা একটুখানি চিন্তা করে বালিশের তলা থেকে আগের রাত্রের ছিনিয়ে নেওয়া রুমালখানা বের করে তিয়োনার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরাল।

তার হৃদয় হালকা হয়ে গেল।

আপন মনে বললে, ছিঃ! আমি কি এই রঙ-করা পিপেটাকে হিংসে করব? চুলোয় যাক গে ওটা। তার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতেই আমার ঘেন্না ধরে।

পরের দিন পথে যেতে যেতে সেরগেই তাকে বলতে লাগল, শোন, কাতেরিনা ভভূনা, তোমাকে আমি কী বলতে চাই। দয়া করে তুমি তোমার মাথার ভিতর এই তত্ত্ব-কথাটি ভালো করে ঢুকিয়ে নাও তো যে, প্রথমত আমি তোমার জিনোভিই বরিসি নই, দ্বিতীয়ত তুমি এখন আর কোনও গেরেম্ভারি সদাগরের বউ নও; সুতরাং মেহেরবানি করে এখন আর বড়মানষির চাল মারবে না। আমার ব্যাপারে আস্ত একটা পাঁঠীর মতো যত্রতত্র ছুঁ মারলে সেটা আমি বরদাস্ত করব না।

এর উত্তরে কাতেরিনা কিছু বলল না এবং তার পর এক সপ্তাহ ধরে সে সেরগেইয়ের পাশে পাশে হাঁটল বটে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে একটিমাত্র দৃষ্টি বা বাক্য-বিনিময় হল না। তাকেই করা হয়েছে আঘাত, তাই সে নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে তার এই সেরগেইয়ের সঙ্গে তার এই সর্বপ্রথম কলহ মিটিয়ে সমঝাওতা আনার জন্য তার দিকে এগিয়ে যেতে চাইল না।

এদিকে যখন সেরগেইয়ের প্রতি কাতেরিনার রাগ, ততদিনে সেরগেই কুলধবলা তন্বী সোনেৎকার দিকে হরিণের মতো কাতর নয়নে তাকাতে আরম্ভ করেছে এবং নর্মভরে তার হৃদয়-দুয়ারে প্রথম করাঘাত আরম্ভ করে দিয়েছে। কখনও সে তার সামনে নম্রতাভরে মাথা নিচু করে বলে, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিবাদন আর কখনও-বা তার দিকে তাকিয়ে মধুর স্মিত হাস্য করে, আর পাশাপাশি এলে ছল করে তাকে হাত দিয়ে ঘিরে দেয় সোহাগের চাপ। কাতেরিনা সবকিছুই লক্ষ করল, আর তার বুকের ভিতরটা যেন আরও সিদ্ধ হতে লাগল।

মাটির দিকে না তাকিয়ে যেন ধাক্কা খেতে খেতে এগুতে এগুতে কাতেরিনা তোলপাড় করতে লাগল, কী জানি, তবে কি ওর সঙ্গে মিটিয়ে ফেলব? কিন্তু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বাধা দিতে লাগল তার আত্মসম্মান– এগিয়ে গিয়ে মিটমাট করে ফেলতে। ইতোমধ্যে সেরগেই আরও নাছোড়বান্দা হয়ে সেঁটে রইল সোনেৎকার পিছনে; এবং সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, নাগালের বাইরের যে-সেনোক্তা এতদিন পাক দিতেন মোচড় খেতেন কিন্তু ধরা দিতেন না, এইবারে তিনি, যে কোনও কারণেই হোক, হঠাৎ যেন পোষ মেনে নিচ্ছেন।

কথায় কথায় তিয়োনা একদিন কাতেরিনাকে বলল, তুমি আমাকে নিয়ে নালিশ করছিলে না? কিন্তু আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। আমারটা ছিল আজ-আছে-কাল-নেই ধরনের দৈবাৎ ঘটে যাওয়ার একটা ব্যাপার; এসেছিল, চলে গেল, মিলিয়ে গেল; কিন্তু সাবধান, এই সোনেৎকাটার ওপর নজর রেখ।

কাতেরিনা মনস্থির করে আপন মনে বলল, জাহান্নমে যা আমার এই আত্মসম্মান; আজই আমি তার সঙ্গে মিটমাট করে ফেলব। এবং তার পর ওই একটিমাত্র চিন্তা নিয়ে পড়ে রইল, মিটমাট করে ফেলার জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশলটা কী হবে?

কিন্তু কিছু করতে হল না; সেরগেই নিজেই তাকে এই ধাঁধা থেকে বেরোবার পথ তৈরি করে দিল।

পরের আশ্রয়ে পৌঁছতেই সেরগেই কাতেরিনাকে ডেকে বলল, ভা, আজ রাত্রে এক মিনিটের তরে আমার কাছে এসো তো; তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কাতেরিনা চুপ করে রইল।

কী হল? আমার ওপর এখনও রেগে আছ নাকি? কথা বলবে না?

কাতেরিনা এবারেও কোনও সাড়া দিল না।

কিন্তু পরের ঘাঁটির কাছে আসার সময় শুধু সেরগেই না, সবাই লক্ষ করল যে, কাতেরিনা সরদার পাহারাওলার চতুর্দিকে ঘুর ঘুর করছে, শেষটায় ভিক্ষায় পাওয়া তার সতেরোটি কপেক সে সরদারের হাতে গুঁজে দিল। মিনতিভরা কণ্ঠে তাকে বলল, আরও দশটা জমাতে পারলেই তোমাকে দেব।

সরদার পয়সা কটি আস্তিনের ভঁজে লুকল। বলল, ঠিক আছে।

লেনদেন শেষ হয়ে গেলে সেরগেই ঘোঁৎ করে খুশি প্রকাশ করে সোনেৎকার দিকে। চোখের ইশারা মারল।

ঘাঁটির সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে কাতেরিনাকে জড়িয়ে ধরে আর সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ওগো, কাতেরিনা, লক্ষ্মীটি, শুনছিস ছোঁড়ারা, এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন মেয়ে তো সারা সংসারেও পাওয়া যায় না।

কাতেরিনার মুখ লাল হয়ে উঠল– আনন্দে সে তখন হাঁফাচ্ছে।

সন্ধ্যা হতে না হতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল; একলফে সে বেরিয়ে এল বললে কমই বলা হয়; তার সর্বাঙ্গ তখন ঘন ঘন শিহরিত হচ্ছে আর অন্ধকারে তার হাত সেরগেইয়ের সন্ধানে এখানে-ওখানে খুঁজছে।

তাকে আলিঙ্গন করে আপন বুকে চেপে যেন দম বের করে সেগেই বলল, আমার কেট।

চোখের জলের ভিতর দিয়ে কাতেরিনা উত্তর দিল, ওগো, আমার সর্বনাশের নিধি। তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সে যেন ঝুলে রইল।

পাহারাওলা করিডরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি পাইচারি করতে করতে মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছিল; বুটজুতোর ডগায় থুথুর তীর ছোঁড়া অভ্যাস করে ফের পাইকারি আরম্ভ করছিল; ক্লান্তিতে জীর্ণ কয়েদিরা দরজার ভিতরে নাক ডাকিয়ে যাচ্ছে; ঘর গরম করার স্টোভের নিচে কোথায় যেন একটা ইঁদুর কুট কুট করে কম্বল কাটছে; ঝিঁঝির দল একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাণপণ চিৎকার করে যাচ্ছে–কাতেরিনা তখনও সপ্তম স্বর্গে।

কিন্তু হৃদয়াবেগ ভাবোচ্ছ্বাস স্তিমিত হল এবং রসকষহীন অনিবার্য বাক্যালাপ আরম্ভ হল।

করিডরের এক কোণে মেঝের উপর বসে সেরগেই নালিশ জানাল, আমি কী মারাত্মক যন্ত্রণায়ই না কষ্ট পাচ্ছি; পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি হাড়গুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমায় পাগল করে তুলেছে।

সেরগেইয়ের লম্বা কোটের ভিতর সোহাগভরে মাথা গুঁজে কাতেরিনা শুধাল, তা হলে কী করা যায়, সেরেজেশ্বকা?

যদি না… কী জানি, হয়তো-বা ওদের বলতে হবে, কাজানে পৌঁছলে আমাকে সেখানকার হাসপাতালে জায়গা করে দিতে। তাই করব নাকি?

সে কী? কী যে বলছ, সেরেজা!

এছাড়া অন্য কী গতি আছে বল; যন্ত্রণায় আমার যে প্রাণ যায়।

কিন্তু তা হলে তারা তো আমাকে আগে আগে খেদিয়ে নিয়ে যাবে, আর তুমি পড়ে রইবে পিছনে!

ঠিক কথা, কিন্তু আমি কী করি? আমি তোমাকে বললুম তো, পায়ের শিলি ঘষে ঘষে আমাকে যে মেরে ফেলল। শিকলিগুলো যেন ঘষতে ঘষতে আমার হাড়গুলোর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। হয়তো-বা কয়েকদিনের জন্য মেয়েদের লম্বা পশমের মোজা পরলে কিছু-একটা হয়।

লম্বা মোজা? আমার কাছে এখনও আনকোরা একজোড়া তো রয়েছে, সেরেজা!

তা হলে তো আর কথাই নেই।

একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে কাতেরিনা ছুট দিয়ে ঢুকল তার কুঠুরিতে। শোবার তক্তার নিচের থেকে হাতড়ে হাতড়ে বের করল তার ব্যাগটা। ফের ছুট দিল সেরগেইয়ের কাছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নীল রঙের পুরু পশমের একজোড়া লম্বা মোজা; দু পাশে রঙিন সিল্কের মিহিন নক্শা জ্বলজ্বল করছে–বক শহরের তৈরি মোজা, এ মোজা তৈরি করেই সে শহর তার ন্যায্য খ্যাতি পেয়েছে।

কাতেরিনার শেষ মোজাজোড়াটি নিয়ে যেতে যেতে সেরগেই জোর দিয়ে বলল, এগুলো পরলে আর ভাবনা কী!

কাতেরিনার কী আনন্দ! ফিরে এসে কঠিন তক্তায় অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। শুনতেই পেল না, সে ফিরে আসার পর সোনেৎকা করিডরে বেরিয়ে গেল আর সেখানে সমস্ত রাত কাটিয়ে চুপে চুপে ভোরের ঠিক অল্প একটু আগে কখন ফিরে এল।

এ সমস্ত ঘটল কাজান পৌঁছবার দু ঘাঁটি পূর্বে।

১৫. ঘাঁটির বন্ধ গুমোট ঘর

১৫.

ঘাঁটির বন্ধ গুমোট ঘরের দেউড়ি থেকে বেরুবামাত্রই কয়েদিদের রুদ্র অভ্যর্থনা জানাল শীতে জর্জর বৃষ্টি-বরফে মেশা অকরুণ দিবস। কাতেরিনা বেরিয়েছিল বুকে যথেষ্ট সাহস বেঁধে কিন্তু আপন সারিতে যোগ দেওয়া মাত্রই তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল, মুখের রঙ সবুজে পরিবর্তিত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে বিশ্ব-সংসার অন্ধকার হয়ে গেল; তার প্রত্যেকটি হাড়ের জোড়া যেন তাকে ছুঁচের মতো খোঁচাতে আরম্ভ করল, যেন তার দুটি হাঁটু ভেঙে গেছে। ওই তার সামনে সোনেৎকা দেমাক করে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে পায়ের নীল পশমের মোজা– তার উপরের সিল্কের মিহিন কাজ– কাতেরিনা কত না ভালো করেই চেনে!

কাতেরিনা চলতে লাগল– যেন তার সর্বাঙ্গের কোনও জায়গায় জীবন-রসের বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। শুধু তার চোখদুটো পূর্ণ জীবন্ত, চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে যেন ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেরগেইয়ের দিকে সে দৃষ্টি তাকে ছাড়ল না, এক পলকের তরেও না।

জিরোবার পরের ঘাটিতে পৌঁছানো মাত্রই কাতেরিনা শান্ত পদক্ষেপে সেরগেইয়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, পিশাচ! সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ সোজা তার চোখে থুথু ফেলল।

সেরগেই লাফ দিয়ে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু আর সবাই তাকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখল।

শুধু বলল, দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।– আর হাত দিয়ে মুখ মুছল।

আর-সবাই ব্যঙ্গ করে বলল, অত রোয়াব কিসের, সে-ও তোমার মোকাবেলা করতে ডরায় না। আর-সকলের ঠাট্টা-হাসির মাঝখানে সোনেৎকার কলহাস্য শোনাল বড়ই ফুর্তিতে ভরা।

সোনেৎকার সাহায্যে যে গোটা ষড়যন্ত্রটা গড়ে উঠেছিল সেটা এখন তার সম্পূর্ণ পছন্দমতোই বিকশিত হচ্ছিল।

সেরগেই কাতেরিনাকে শাসাল, এত সহজে এর শেষ হবে না।

জলঝড়ের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত অবসন্ন, ছিন্নভিন্ন হৃদয় নিয়ে কাতেরিনা সে রাত্রিতে কয়েদিদের শক্ত বেঞ্চে ছেঁড়া তন্দ্রার ভিতর মোটেই টের পেল না, কখন দুটো কয়েদি মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকল।

ওরা ঢোকা মাত্রই সোনেল্কা তার বেঞ্চি থেকে গা তুলে নীরবে কাতেরিনাকে দেখিয়ে দিয়ে, ফের শুয়ে পড়ে কয়েদিদের লম্বা কোট দিয়ে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে নিল।

সেই মুহূর্তেই কে যেন কাতেরিনার লম্বা কোট তার গা থেকে তুলে নিয়ে মুখের উপর ছুঁড়ে ঢেকে দিল আর তার পিঠের সুদ্ধমাত্র খসখসে শেমিজের উপর মোটা ডবল দড়ির শেষ প্রান্ত দিয়ে নির্মম চাষাড়ে বলপ্রয়োগ করে বেধড়ক চাবকাতে লাগল।

কাতেরিনা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু মুখে-মাথায় জড়ানো কোটের ভিতর দিয়ে তার কণ্ঠস্বর বেরোতে পারল না। সে উঠে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতেও ওই একই অবস্থা– এক তাগড়া কয়েদি তার কাঁধের উপর বসে তার বাহু দু-খানা জোরে চেপে ধরে রেখেছিল।

পঞ্চাশ! শেষ পর্যন্ত গুনে শেষ হল। কারওরই বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না, এটা সেরগেইয়ের গলা। দুই নিশাচর দোর দিয়ে অন্তর্ধান করল।

কাতেরিনা কোট থেকে মাথা ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠল; সেখানে কেউ নেই, কিন্তু অদূরে লম্বা কোটের নিচে কে যেন হাসছে, নির্মম ব্যঙ্গের ঘেন্না ঈর্ষার হাসি। কাতেরিনা সোনেৎকার হাসি চিনতে পারল।

এ অপমান যে সর্ব-সীমানা পেরিয়ে গেল। আর সীমাহীন ঘৃণা যন্ত্রণা সেই মুহূর্তে কাতেরিনার অন্তরের অন্তস্তলকে যেন সিদ্ধ করতে লাগল। মতিচ্ছন্ন পাগলের মতো সে সমুখপানে ধেয়ে গেল, মতিচ্ছন্নের মতো টলে পড়ল তিয়েনার বুকের উপর পড়ার সময় সে তাকে তুলে ধরল।

কাতেরিনা ঢলে পড়ল তিয়োনার বুকের উপর। এই পূর্ণ উরসই কিছুদিন পূর্বে তারই বিশ্বাসঘাতক প্রেমিককে আনন্দ দিয়েছে পাপাত্মার কাম্য হেয় মাধুর্য দিয়ে। তারই উপর সে কেঁদে ভেঙে পড়ল তার অসহ বেদনার শোক নিয়ে। তারই সরলা কোমলা সপত্নীকে সে জড়িয়ে ধরল, শিশু যেরকম মাকে জড়িয়ে ধরে। তখন তারা দুজনাই এক সমান; দুজনাকে একই মূল্যে নামানো হয়েছে, দুজনাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

দুজনাই এক সমান… তিয়োনা– যার দিকে তার পয়লা খেয়াল গেল তার কাছেই যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, আর কাতেরিনা– সে তার হৃদয়-নাট্যের শেষ দৃশ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।

কিন্তু সত্য বলতে কী, এখন আর কোনও অবমাননা তার কাছে অবমাননা বলে মনে হয় না। তার চোখের জল শেষ করে সে এখন শক্ত হয়ে গিয়েছে, যেন সে পাথর হয়ে গিয়েছে, আর এখন সে কাঠের পুতুলের মতো শান্ত হয়ে রোল কলে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল।

ড্রাম বেজে উঠল, দ্রম্-দ্রমাদ-দ্রমাদ-দ্রম্। শিকলে বাঁধা শিকলহীন উভয় শ্রেণির নিরানন্দ নিষ্প্রভ কয়েদির দল যেন অদৃশ্য হস্তের ধাক্কা খেতে খেতে ঘাঁটির চত্বরে বেরিয়ে এল। সেরগেই আছে সেখানে, আর আছে তিয়োনা, সোনেৎকা, কাতেরিনা, আছে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দণ্ডিত আদর্শবাদী এক কয়েদি এক ইহুদির সঙ্গে শিকলে বাঁধা, একই শিকলে বাঁধা এক পোল আর তাতার।

প্রথম তারা একসঙ্গে জটলা করে দাঁড়িয়েছিল; পরে চলনসই রকমের শৃঙ্খলায় সারি বেঁধে তারা রওনা দিল।

এরকম নিরানন্দ দৃশ্য বড়ই বিরল; পাঁচজনের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হৃদয়ে যাদের কণামাত্র আশার ছায়াটুকু পর্যন্ত নেই– এরা কয়েকজন লোক কাঁচা রাস্তার হিমশীতল কালো কাদায় ডুবতে ডুবতে যেন এগিয়ে চলেছে। তাদের চতুর্দিকের সবকিছু এমনি বিসদৃশ যে, আতঙ্কে মানুষের গা শিউরে ওঠে; অন্তহীন কাদামাটি, সিসার মতো বিবর্ণ আকাশ, সর্বশেষ-পত্রবর্জিত নগ্ন সিক্ত উইলো গাছ–আর তাদের লম্বা লম্বা শাখায় বসে আছে উস্কোখুস্কো পালকসুদ্ধ দাঁড়কাকের দল। বাতাস কখনও গুমরে গুমরে ওঠে, তার কণ্ঠস্বর কখনও বা ক্রুদ্ধ, আর কখনও ছাড়ে তীব্র ক্রন্দনরব, আর কখনও-বা ভীষণ হুঙ্কার।

এই বীভৎস দৃশ্য দৃশ্যের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে নরকের সেই গর্জন, যে গর্জন মানুষের আত্মাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সে গর্জনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাইবেলের মহাপুরুষ আইয়ুবের অভিসম্পাত ধ্বংস হোক সেই দিন যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করি, আর তাঁর প্রতি তাঁর স্ত্রীর উপদেশ : তোমার ভগবানকে অভিশাপ জানিয়ে মরে যাও।

যারা এই উপদেশ-বাণীতে কর্ণপাত করে না, এরকম বীভৎস অবস্থায় যাদের মনে মৃত্যু-চিন্তা প্রলোভনের চেয়ে ভয়ের সৃষ্টি করে বেশি তাদের করতে হয় বীভৎসতর এমন কিছু যেটা এই আর্ত ক্রন্দনধ্বনির টুটি চেপে ধরে তাকে নীরব করে দেবে। এই তত্ত্বটি আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ সাদামাটা সরল মানুষ উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করতে জানে; এরকম অবস্থায় সে লাগাম ছেড়ে তার নির্ভেজাল নীচ পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয়; সে তখন সাজতে যায় সঙ, নিজেকে নিয়ে আরম্ভ করে নিষ্ঠুর খেলা, অন্য পাঁচজন মানুষকে নিয়েও, তাদের কোমলতম হৃদয়ানুভূতি নিয়ে। এরা এমনিতেই অত্যধিক কোমল স্বভাব ধরে না– এরকম অবস্থায় পড়ে তারা হয়ে যায় দ্বিগুণ পিশাচ।

***

কাতেরিনা-নিগ্রহের পরের দিন ভোরবেলা কয়েদির দল যখন গ্রামের ভিতরকার ঘাটি ছেড়ে সবেমাত্র রাস্তায় নেমেছে তখন সেরগেই ইতর কণ্ঠে কাতেরিনাকে শুধাল, ওগো আমার পটের বিবি, সদাগরের ঘরণী–সম্মানিতা মহাশয়া সর্বাঙ্গীণ কুশলে স্বাস্থ্য উপভোগ করছেন তো?

কথা কটা শেষ করেই সে তৎক্ষণাৎ সোনেৎকার দিকে ফিরে তাকে তার লম্বা কোটের এক পাশ দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে তার তীব্র কণ্ঠ তীব্রতর করে গেয়ে উঠল :

সোনালি চুলের কোমল মাথাটি দেখিনু জানালা দিয়া,
কুগ্রহ মোর,* ঘুমোও নি তুমি? আবার ভাঙিবে হিয়া! বুকের ভিতর জড়ায়ে রাখিব মম গুণ্ঠনে, প্রিয়া।

[* যে রাত্রে সেরগেই ফাঁকি দিয়ে কাতেরিনার কাছ থেকে মোজাজোড়াটি আদায় করে, তখন কাতেরিনা তাকে আমার সর্বনাশের নিধি বলে সোহাগ করেছিল। এখানে সেটা কুগ্রহ মোর। কাতেরিনাকে সেই সোহাগ স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই সেরগেই বিশেষ করে এই গানটাই ধরল।]

গানটা গাইতে গাইতে সেরগেই সোনেৎকাকে জড়িয়ে ধরে তামাম কয়েদির পালের চোখের সম্মুখে তাকে সশব্দে চুম্বন করল।

কাতেরিনা এসব দেখল, অথচ সত্যই যেন দেখতে পেল না। এমন অবস্থায় সে তখন পৌঁছেছে যেন প্রাণহীনা একটা পুতুল হেঁটে চলেছে আর সবাই তাকে খোঁচাতে আরম্ভ করেছে; তাকে দেখাচ্ছে, সেরগেই কীরকম অশ্লীলভাবে সোনেৎকার সঙ্গে ঢলাঢলি লাগিয়েছে। সে তখন সকলের সর্বপ্রকার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বলির পাঁঠা।

যেন পিছন থেকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কাতেরিনা এগোচ্ছে। এ অবস্থায়ও কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা জুড়ে দিলে তিয়োনা মাঝখানে পড়ত; বলত, ছেড়ে দে না ওকে, পিচেশের দল, দেখছিসনে, ওর যে হয়ে এসেছে।

এক ছোকরা কয়েদি যেন বাক্‌পটু হয়ে বলল, ওর ছোট্ট পা দুখানি বোধহয় ভিজে গিয়েছে।

সেরগেই পাল্লা দিয়ে বলল, এ তথ্য সর্বজন-স্বীকৃত যে, আমাদের সম্রান্ত বণিক সম্প্রদায়ের মহিলাগণকে সাতিশয় সুকোমলভাবে লালনপালন করা হয়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তার যদি একজোড়া গরম বিবিয়ানির মোজা থাকত তা হলে হাঙ্গামা কমে যেত।

কাতেরিনা যেন গভীর ন্দ্রিা থেকে সাড়া দিল, জেগে উঠল।

গুঁতোতে গুঁতোতে তাকে যেন সহ্যের সীমানার ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে- ঘাসেতে লুকনো জঘন্য সাপ তুমি! ঠাট্টা করে হাসো আমাকে নিয়ে ইতর বদমায়েশ হাসো, আরও হাসো!

কী বলছেন আপনি, সদাগরের পটের বিবি! আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করার কোনও মতলবই আমার নেই। আসলে সোনেল্কা হেথায় যখন সত্যই এত সুন্দর মোজা বিক্রি করছে, তখন ভাবলুম– কেন, দোষ করেছি নাকি? আমাদের সদাগরের বেগম সায়েবা হয়তো একজোড়া কিনলেও কিনতে পারেন।

প্রচুর হাস্যধ্বনি উঠল। দম দেওয়া কলের মতো কাতেরিনা সামনের দিকে পা ফেলল।

আবহাওয়া ক্রমাগত আরও খারাপ হচ্ছে। এতদিন যে ধূসর মেঘ আকাশ ঢেকে রেখেছিল এখন তার থেকে নেমে এল স্তরে স্তরে ভেজা-বরফের পাঁজ। মাটি ছোঁয়া মাত্রই এরা গলে গিয়ে রাস্তার কাদার গর্তকে করে দেয় আরও গভীর– সেটাকে ঠেলে ঠেলে পা চালানো করে দেয় আরও অসহ্য কঠিন কঠোর। অবশেষে সম্মুখে দেখা দিল সিসার রঙের একটা রেখা। সে রেখার অন্য তীর চোখে ধরা পড়ে না। এই রেখাঁটি ভলগা নদী। অল্প অল্প জোর হাওয়া ভলগার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বড় বড় কাটা কাটা ঢেউ সামনে পিছনে খেদিয়ে নিয়ে চলেছে।

সর্বাঙ্গ জবজবে ভেজা, শীতে কাঁপতে কাঁপতে কয়েদির দল আস্তে আস্তে ঘাটে পৌঁছে খেয়ার বিরাট কাঠের ভেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

কালো ভেলার কাঠ থেকে জল ঝরছে। পাড়ে এসে ভিড়তে প্রহরীরা কয়েদিদের ভেলাতে ওঠবার ব্যবস্থা করতে লাগল।

সর্বত্র ভেজা বরফের পোঁচ-মাখা ভেলা ঘাট ছেড়ে উন্মত্ত নদীর ঢেউয়ের উপর দোলা খেতে লাগল। ভেলা ছাড়ার সময় কয়েদিদের একজন বলল, কারা সব বলাবলি করছিল, ভেলাতে কার কাছে যেন বিক্রির জন্য ভদ্কা শরাব আছে।

সেরগেই বলল, সত্যি বলতে কি, সামান্য কোনও মাল দিয়ে গলার নালিটা ভেজাবার এই সুযোগটা হারানো বড়ই পরিতাপের বিষয় হবে। সোনেৎকার ফুর্তির জন্য সে তখন কাতেরিনাকে পি খোঁচা দিয়ে উৎপীড়ন করতে শুরু করেছে– আপনি কী বলেন, আমাদের সদাগরের পটের বিবি? পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে এক পাত্তর ভদ্কা দিয়ে আমাদের চিত্তবিনোদন করলে কীরকম হয়? আহা, কিপটেমি করবেন না। স্মরণ কর, প্রিয়তমা, আমাদের অতীতের প্রেমের কথা! আমি আর তুমি ওগো আমার জীবনের আনন্দময়ী, তোমাতে-আমাতে দুজনাতে কত না দীর্ঘ শরৎ-হেমন্তের রাত কাটিয়েছি পাশাপাশি বসে, তোমাতে-আমাতে কত না আনন্দে সময় কাটিয়েছি কত না হেলাফেলায়; কেবলমাত্র তোমাতে-আমাতে দুজনাতে মিলে তোমার প্রিয় আত্মীয়-আত্মজনকে ওপারের চিরশান্তিতে পাঠিয়েছি– একটিমাত্র পাত্রিপুরুতের কণামাত্র সাহায্য না নিয়ে।

শীতে কাতেরিনার সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছিল। সে শীত তার জবজবে ভেজা কাপড়-জামা ভেদ করে তার অস্থি-মজ্জা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল… তার ওপর আরও কী যেন কী একটা তার সর্বসত্তা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। তার মাথা জুলছিল… সত্যই যেন তার ভিতরে আগুন ধরানো হয়েছে… তার চোখের মণি অস্বাভাবিক রকমে বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছে, এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ জ্যোতি এসে সে মণির এখানে-ওখানে নাচছে, আর তার দৃষ্টি ঢেউয়ের দোলার দিকে নিশ্চল-নিবদ্ধ।

সোনেৎকার গলা ছোট্ট একটি রুপোর ঘণ্টার মতো রিনিঝিনি করে উঠল, মাইরি বলছি, এক ফোঁটা ভদকা পেলে আমি বেঁচে যেতুম; এ শীতটা যে আমি কিছুতেই সইতে পারছিনে।

সেরগেই ক্রমাগত খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল, আসুন না, আমার সদাগরের বেগম, আমাদের একটু খাইয়েই দিন না।

ভর্ৎসনা-ভরা মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে তিয়োনা বলল, ছিঃ! তুমি আবার কেন? বিবেক বলে কি তোমার কোনও বস্তু নেই?

ছোকরা কয়েদি গদিউশকা তার সাহায্যে নেমে বলল, সত্যি, এসব ভালো হচ্ছে না।

ওর সম্বন্ধে তোমার বিবেকে না বাধলেও, অন্তত আর পাঁচজনের সামনে তোমার হায়া-শরম থাকা উচিত।

সেরগেই তিয়োনার দিকে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, তুই মাগী বিশ্বতোষক! তুই আর তোর বিবেক! তুই কি সত্যি ভাবিস ওর জন্যে আমাকে আমার বিবেক খোঁচাবে? কে জানে, আমি আদপেই তাকে কখনও ভালোবেসেছিলুম কি না, আর এখন– এখন তো সোনেৎকার হেঁড়া চটিজুতোটি পর্যন্ত ওই চামড়া-ছোলা বেড়ালটার জঘন্য মুখের চেয়ে আমার ঢের বেশি ভালো লাগে। কিছু বলছ না যে? শোন, আমি কি বলি। সে বরঞ্চ ওই বাকামুখো গদিউশকাটার সঙ্গে পিরিত করুক; কিংবা এবারে সে সন্তর্পণে চতুর্দিক দেখে নিয়ে হিজড়েপানা, ফেলুটের জোব্বা-পরা, মাথায়-ঝুঁটিদার-মিলিটারি-টুপিওলা, কয়েদিদের ঘোড়সওয়ার অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, তার চেয়েও ভালো হয় যদি দলের ওই বড় অফিসারের সঙ্গে জুটে যায় আর কিছু না হোক ওই জোব্বার নিচে সে বৃষ্টিতে ভিজবে না।

আবার সোনেৎকার গলা ছোট্ট একটি ঘণ্টার মতো রিনিঝিনি করে উঠল, আর, তখন সবাই তাকে অফিসারের বিবি বলে ডাকবে।

ফোড়ন দিয়ে সেরগেই বলল, একদম খাঁটি কথা… আর একজোড়া গোঁজার জন্য তার কাছ থেকে পয়সা জোগাড় করাটা হবে ছেলে-খেলা!

কাতেরিনা আত্মপক্ষ সমর্থন করল না; সে আরও স্থির অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঢেউগুলোর দিকে, শুধু তার ঠোঁট দুটি নড়ছে। সেরগেইয়ের জঘন্য কুবাক্যের ভিতর দিয়ে তার কানে আসছিল নদীর উত্তাল তরঙ্গের জুম্ভন-বিজড়নের বিক্ষোভিত ধ্বনি, যন্ত্রণাসূচক আতাঁরব। হঠাৎ একটা ঢেউ বিরাট হাই তুলে ভেঙেপড়ার সময় তার মাঝখানে কাতেরিনার সামনে দেখা দিল বরিস তিমোতেইয়েভিচের বিবর্ণ মুখ, আরেকটার মাঝখান থেকে উঁকি মেরে তাকাল তার স্বামী, তার পর সে ফেদিয়াকে কোলে নিয়ে ডাইনে-বায়ে দুলতে লাগল– ফেদিয়ার অবশ্য মাথা ঢলে পড়েছে। কাতেরিনা তার দেবতার উদ্দেশে কোনও প্রার্থনা স্মরণে আনবার চেষ্টা করে ঠোঁট নাড়াল, কিন্তু ক্ষীণস্বরে বেরিয়ে এল, তোমাতে-আমাতে দুজনাতে। কত না দীর্ঘ শরৎ-হেমন্তের রাত কাটিয়েছি পাশাপাশি বসে, তোমাতে-আমাতে কত না আনন্দে সময় কাটিয়েছি কত না হেলাফেলায়; এই বিরাট বিশ্ব থেকে তোমাতে-আমাতে মানুষ ওপারে পাঠিয়েছি নিষ্ঠুর মৃত্যুর ভিতর দিয়ে।

কাতেরিনা লভভনা কাঁপছিল। তার দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটোছুটি ছেড়ে ক্রমেই একটি বিন্দুতে নিবদ্ধ হয়ে আসছিল। সে দৃষ্টি পাগলিনীর মতো। দু-একবার তার হাত দু-খানি মহাশূন্যের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে উঠে আবার পড়ে গেল। আরেক মিনিটকাল অতীত হল—- হঠাৎ তার সমস্ত শরীর সামনে-পিছনে দুলতে আরম্ভ করল; একবার এক মুহূর্তের তরেও তার দৃষ্টি কালো একটা ঢেউয়ের থেকে না সরিয়ে সে সামনের দিকে নিচু হয়ে সোনেৎকার পা দু-খানি চেপে ধরে এক ঝটকায় ভেলার পাশ ডিঙিয়ে তাকে সুদ্ধ নিয়ে ঝাঁপ দিল নদীর তরঙ্গে।

বিস্ময়ে সবাই যেন পাথর হয়ে গিয়েছে।

একটা ঢেউয়ের চূড়ায় কাতেরিনা ভনা দেখা দিয়ে আবার তলিয়ে গেল, আরেকটা ঢেউ সোনোকে তুলে ধরল।

নৌকোর আঁকশিটা! নৌকোর আঁকশিটা ছুঁড়ে দাও!– ভেলা থেকে সমস্বরে চিৎকার উঠল।

লম্বা দড়িতে বাঁধা নৌকার ভারী আঁকশিটা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে জলের উপর পড়ল। সোনেল্কা আবার জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ভেলার পিছনকার স্রোতের টানে জলের নিচে অদৃশ্য অবস্থায় দ্রুতবেগে পিছিয়ে পড়ে সোনেৎকা দু সেকেন্ড পরে আবার উপরের দিকে তার দুবাহু উৎক্ষেপ করল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা আরেকটা ঢেউয়ের উপরে প্রায় কোমর পর্যন্ত জলের উপর তুলে সোনেৎকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল– দৃঢ় বর্ষা যেরকম ক্ষুদ্র মৎস্য-শাবকের ক্ষীণ প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তাকে ভেদ করে চেপে ধরে।

দুজনার কেউই আর উপরে উঠল না।

Exit mobile version