Site icon BnBoi.Com

দুষ্কালের দিবানিশি – শওকত আলী

দুষ্কালের দিবানিশি - শওকত আলী

০১. উজুবট গ্রামখানি যখন লুণ্ঠিত

০১.

উজুবট গ্রামখানি যখন লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয় তখন বসন্তদাস পুনর্ভবার পশ্চিম তীরের গ্রামগুলিতে ভিক্ষু মিত্রানন্দের সন্ধান করে ফিরছে। মিত্রানন্দকে তার বিশেষ প্রয়োজন। তাকে যে উজুবট গ্রামের উত্তরপাটক পল্লী থেকে পলায়ন করে আসতে হয়েছে শুধু সেই কারণেই নয়। তার আশঙ্কা হচ্ছিলো, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির শীঘ্রই পুনরাবৃত্তি হবে। সামন্ত হরিসেন তো আর একাকী ঘটনাটি ঘটাননি। তাঁর সঙ্গে বহু অনুচর ছিলো। ঐদিন যারা ঘটনাটি ঘটাতে সহায়তাদান করেছিলো তারা নিজেরাও যদি ঐ প্রকার ঘটনা ঘটাতে চায়, তাহলে কে বাধা দেবে? ব্যাঘ একবার শোণিতের স্বাদ পেলে তা কি আর ত্যাগ করে? একইসঙ্গে আবার সে শুনতে পাচ্ছিলো, যবন সেনাদল নাকি পশ্চিমে অবস্থান করছে। অশ্বারোহণে দশ/পঞ্চদশ ক্রোশ আর এমন কি দূরত্ব? তদুপরি জানে, লাঞ্ছিত অপমানিত ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ এই পথেই গমন করেছেন। এখন যদি তরুণ ভিক্ষুদের আগ্রহাতিশয্যে শুদ্ধানন্দ যবন সেনাদলকে আহ্বান করেন, তাহলে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হবে। নিকটবর্তী গ্রাম জনপদগুলি একেবারে শ্মশান হয়ে যাবে। তার ধারণা, এই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিত্রাণের পথ কেউ যদি উদ্ভাবন করতে পারে তো সে হলো মিত্রানন্দ এবং তার সহচরেরা।

কিন্তু কোথায় মিত্ৰানন্দ? যে স্থানেই সে উপনীত হয়, সে স্থানেই শোনে, আহা দিনেক পূর্বে এলেন না–মাত্র গতকালই তিনি এ গ্রাম ত্যাগ করেছেন।

সে গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে যাচ্ছিলো। ঐ সময় মালঞ্চ হাটে এক গন্ধবণিক তাকে সংবাদটি দেয়। বিশদ কিছুই বলতে পারেনি সে। শুধু জানায় যে, উজুবট গ্রামখানি একেবারেই ভস্মসাৎ হয়েছে–একটি প্রাণীও নাকি রক্ষা পায়নি।

সংবাদটি আকস্মিক এবং ভয়াবহ। বসন্তদাস কয়েকমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। পরক্ষণেই সে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে। বলা বাহুল্য, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থা হয় তার। তখন অপরাহ্নকাল, পথ নির্বিঘ্ন নয় এবং যেতেও হবে তিন ক্রোশাধিক পথ। কিন্তু সেসব বিষয়ে চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিলো না।

দ্রুত পথক্ৰমণ করছিলো সে, আর ঐ সময় ক্ষণে ক্ষণে মায়াবতীর মুখখানি সে মনের ভেতরে দেখতে পাচ্ছিলো। বড় মায়া মুখখানিতে। তার বাহু দুখানির উষ্ণ স্পর্শ সে গণ্ডদেশে এখনও অনুভব করে। কি স্নিগ্ধ, কি পবিত্র এবং কি গম্ভীর হতে পারে প্রিয়তমা নারী, তা সে মায়াবতাঁকে না পেলে কখনই জানতে পারতো না। মায়াবতীর সান্নিধ্যই তাকে সেই উপলব্ধি দান করেছে যার কারণে মুক্তস্বভাব পুরুষ সংসার–জীবনে স্থির থাকতে পারে। সন্তানের কথাও তার কল্পনায় উদিত হচ্ছিলো। আহা, শিশু কোলে না থাকলে রমণী কি আর রমণী? তার এখন মনে হয়, সে সংসার–জীবনের সারাৎসারে প্রায় উপনীত হতে যাচ্ছিলো। ক্রমেই তার উপলব্ধি হচ্ছিলো, জীবন এইভাবেই ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়, পূর্ণতা লাভ করে এবং ক্রমে একটি পরমার্থতায় উপনীত হয়। তার বিশ্বাস, জীবনের পরমার্থতা অন্য কিছুতে প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় সৃজনে। আর এও তার মনে হয় যে, সংসারই সৃজনের আধার, সংসার ধ্বংস হয়ে গেলে সৃজন প্রক্রিয়া আর থাকে না। ধর্ম বলো, সংঘ বলো, রাষ্ট্র বলো, সকলই সংসারকে রক্ষা করার কারণে। সংসারের কারণেই মানুষের যাবতীয় বৃত্তি এবং কর্মকাণ্ড। সুতরাং সংসারকেই জগতের সকল অস্তিত্বের কেন্দ্রে স্থাপন করতে হবে। এই প্রকার একটি সরল মীমাংসায় উপনীত হচ্ছিলো সে। এবং ঐ সংসার সম্পর্কেই প্রেমধর্মের কথাটি এসে যাচ্ছিলো। প্রেম না হলে কি সংসার হয়? আর সংসার না হলে তো জীবন হয় না। এবং জীবন যদি না থাকে, তাহলে জগতের অস্তিত্ব কোথায়? মীমাংসাটি এইভাবে বিন্যস্ত করে সে মিত্রানন্দের কাছে জানিয়েছিলো। এবং ঐ সূত্রেই মানুষে মানুষে প্রীতি ও সদ্ভাবের কথাটি তুলেছিলো। সনাতন ও সদ্ধর্মীদের মিলন যে ঐ সূত্রেই হতে পারে তাও সে জানিয়েছিলো। মিত্রানন্দ জগদ্দল মহাবিহারে একখানি পত্র নিয়ে যাচ্ছে তখন। ঐ সময়ই সে অনুরোধটি করে। মহাভিক্ষু ও মহাশ্রমণদের মধ্যে ঐ সরল মীমাংসার কথাটিও যেন আলোচিত হয়।

কিন্তু এ কোন দুষ্কালের আবির্ভাব ঘটলো! জীবনের ধ্বংস প্রক্রিয়া কি এতোই দ্রুত অগ্রসর হয়? সময় এত বৈরী কেন? মানুষ কি সামান্য কিছুকালও ধৈর্য ধারণ করতে পারে না? বলাধিকার থাকলেই তা প্রয়োগ করতে হবে? তার কিছুতেই বোধগম্য হয় না একজন বয়স্ক, বুদ্ধিমান, সম্ভ্রান্ত ও সামাজিক মানুষ কীভাবে অন্যের ধনসম্পদ, সংসার, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত হরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতে পারে। এ কি শুধুই লোভ? শুধুই জিঘাংসা? তোমার পুত্র তোমার নয়, সে আমার দাস হবে। তোমার সুন্দরী স্ত্রী তোমার নয়–সে আমার শয্যাসঙ্গিনী হবে। তোমার ধনসম্পদ কেন থাকবে তোমার অধিকারে? তা থাকবে আমার অধিকারে।

তার একেক সময় জানার বাসনা হয়, এ কি তাহলে মানুষের চূড়ান্ত পতন? এখন পাশবিকতার জয়জয়কারই হবে সত্য? মহাকাল তার শেষ ঘোষণাটি দিয়ে বসে আছেন– কেবল মৃত্যু ও মিথ্যাই সত্য–অন্য কিছু নয়।

আবার একেক সময় মনে হয়, এ হলো এক প্রকার ক্ষয়। জরা এসে তোমার দেহের শক্তি হরণ করছে, তোমার মনের চিন্তাকে স্থবির করে দিচ্ছে, তোমার উদ্যমকে বিনষ্ট করছে। তোমার অস্তিত্বকে ধারণ করে যে শক্তি, সেই শক্তিই ক্ষয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক থেকে। ফলে তোমার দেহ মন কিছুই আর তোমার নয়। এ হলো সেই পুত্তলির মতো যার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গাদি আর একত্র থাকছে না। তোমার হস্তপদ তোমার নয়। সমস্তই ক্ষয় হয়ে, শিথিল হয়ে, ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংসারেরই কি কোনো গঠন থাকে?

অথচ সংসারই মূল। আমার হস্তপদাদি আমার থাকতে হবে–চক্ষু দুইটিকেও আমি সংলগ্ন চাই। স্ত্রী–পুত্র, পরিবার–পরিজন, গৃহ, কর্মক্ষেত্র সমস্তই আমি সংলগ্ন চাই। ঐ সব সংলগ্ন না থাকলে আমি যে আর আমি থাকতে পারি না। সুতরাং এই সংলগ্নতাই সংসারের সৃষ্টি করে। এরই অন্য নাম প্রেম। প্রেমে জগৎ হয়ে ওঠে একান্ত আপন। সৃজনের আধার সংসার, সংসারের আধার আবার জগৎ। যে পথেই অগ্রসর হই, প্রেম ব্যতীত জগৎ নেই।

একাকী মনের চিন্তা এসব। একদিনের নয়। বাণিজ্য যাত্রার সময় থেকে আরম্ভ। নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসব চিন্তার জন্ম হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে–অসংলগ্নভাবে। পরে এগুলি ক্রমশ স্পষ্টতর হয়েছে শ্বশুরালয়ে অবস্থানকালে, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি ঘটবার পর, যখন ভিক্ষুরা একাদিক্রমে তার কাছে আসতে আরম্ভ করে, তখন।

কিন্তু এখন এসব চিন্তার কি আর আদৌ কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে? সমস্ত কিছুর এখন ছিন্নভিন্ন অবস্থা। মস্তিষ্কের চিন্তার যেমন, বাইরের দৃশ্যাবলীরও তেমনই।

সমস্ত পথ তার মনে অসংলগ্ন আরও নানান চিন্তার উদয় হচ্ছিলো। সেই সঙ্গে আবার মায়াবতীর প্রণয়ভাষণের কথাগুলিও থেকে থেকে কর্ণকুহরে মর্মরিত হচ্ছে তখন। ফলে সে নিজের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছিলো নিমজ্জিত। পথের প্রতিকূলতা তার সম্মুখে কোনো বাধারই সৃষ্টি করতে পারেনি।

খিল ভূমির মধ্য দিয়ে পথ। কোথাও ঈষদুচ্চ ঝোপ, কোথাও আইল, কোথাও বা জল প্রবাহিনী নালিকা। কিন্তু কিছুই তার বোধগোচর হচ্ছিলো না। তবে সৌভাগ্য যে। আকাশে ছিলো পূর্ণচন্দ্র এবং তার দৃষ্টিশক্তিও ছিলো প্রখর। তার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ এবং স্বাভাবিক অনুভূতিগুলি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতোই ছিলো সচল।

অবশেষে রাত্রির মধ্যমে পুনর্ভবা তীরের একটি হাটে এসে উপস্থিত হলো। পদযুগল আর বশে ছিলো না তখন। একটি হট্টকুটিরের চালার নীচে ভূমিতেই সে শয়ান হলো। ভয়ানক তৃষ্ণার্ত ছিলো সে। কিন্তু নদীর জলধারা পর্যন্ত যাবে, এমন ক্ষমতা দেহে তখন আর অবশিষ্ট ছিলো না।

হাটের প্রান্তে ছিলো একটি হড়ডিপল্লী। পল্লী বলতে সামান্য কয়েকটি পর্ণ কুটির মাত্র। ঐ কুটিরবাসীদের মধ্যে সম্ভবত কেউ তার আগমন লক্ষ্য করে থাকবে। এক সময় সে দেখলো, অদূরে কয়েকটি মানবমূর্তি দাঁড়িয়ে। একজন আবার প্রশ্নও করছে, মহাশয় আপনি কে? কি হেতু এ স্থানে আগমন, এই দশাই বা কেন?

আমাকে জল দিন, বসন্তদাসের মুখে ঐ একটি কথা তখন। প্রশ্নগুলি কর্ণে প্রবেশ করলেও কোনো উত্তরই তার মুখে আসছিলো না।

মহাশয় কি আমাদের হাতে জলপান করবেন?

বসন্তদাসের কাছে প্রশ্নটি ভয়ানক হাস্যকর বোধ হয়। ঐ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে পুনরায় জল চায়। বলে, জল দিন ভ্রাতঃ, আমি তৃষ্ণার্ত, পরে কথা বলবেন।

এক বৃদ্ধ মৃৎপাত্রে জল এনে দিলে সে তা পান করে এবং স্বস্থ হয়। শেষে নিজ পরিচয় জানিয়ে সে তার উজুবট যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।

শুভ্রকেশ এক বৃদ্ধ ছিলেন ঐ স্থানে। তিনি বললেন, মহাশয়, উজুবট যাওয়া একেবারেই অর্থহীন, শুকদেব মহাশয়কে আমি জানি, অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি–তার সন্ধান করার জন্য আমরাও গিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকেই পাইনি–আপনিও পাবেন না–বরং এই আশঙ্কা যে, সামন্ত হরিসেনের গুপ্তচরদের হাতে বন্দী হয়ে যেতে পারেন।

হ্যাঁ মহাশয়, যাবেন না! অধিকতর বয়স্ক আরেকজন বললেন। পরামর্শ দিলেন, আপনি বরং নদীর এই পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতেই সন্ধান করে দেখুন।

বসন্তদাস লোকগুলির কথা শোনে এবং তার অদ্ভুত বোধ হয়। শেষে সে বলে, এ আপনারা কী বলছেন, আমার আদৌ বোধগম্য হচ্ছে না। মায়াবতী আমার স্ত্রী, আমার ধর্মপত্নী, অগ্নিসাক্ষ্য করে তাকে আমি বিবাহ করেছি। সে মৃত, না জীবিত, সে সংবাদ আমি নেব না? যদি মৃত হয়, তাহলে তার শেষকৃত্যেরও তো একটি প্রশ্ন আছে।

বৃদ্ধটি বসন্তদাসের কথা শুনে করুণ ও মলিন হাসি হাসেন। বলেন, মহাশয়, আমি পকূকেশ বৃদ্ধ, নিম্নজাতি, কিন্তু কেশগুলি আমার অহেতুক পাকেনি। সেই জন্যই বলছি, বুদ্ধিভ্রষ্ট হবেন না–এ বড় দুঃসময়–এখন স্থির এবং শান্তচিত্তে সমস্ত কাজে হাত দেওয়া উচিত। আপনি কিঞ্চিৎ স্বস্থ হয়ে বাস্তব অবস্থাটি চিন্তা করে দেখুন। আজ ষষ্ঠ দিবস, তায় গ্রীষ্মকাল, আপনি কি মনে করেন শৃগাল–কুক্কুর মৃতদেহগুলিকে অক্ষত রেখেছে? প্রকৃত ব্যাপার তো মহাশয় ললাটে, ললাটলিপি আর কে খণ্ডাতে পারে?

বসন্তদাসের মনেও যে ঐ প্রকার চিন্তা আসেনি তা নয়। সে অনুমান করতে পারে, উজুবটে গেলে হয়তো সে কাউকেই পাবে না, কিন্তু তথাপি সে অন্তরের হাহাকারটি প্রশমিত করতে পারছিলো না। তার কেবলি মনে হচ্ছিলো থেকে থেকে–আছে, জীবিত আছে মায়াবতী, লোকে যা–ই বলুক।

অতি প্রত্যুষে বনকুকুটের ডাক আরম্ভ হতেই সে আর স্থির থাকতে পারলো না। হডিপল্লীর ঘাটে বাঁধা ক্ষুদ্র কোষা নৌকাখানি নিয়ে সে নদী অতিক্রম করে পূর্বতীরে উপনীত হলো।

নদীতীর একেবারেই নিঃশব্দ। কেবল ঊষাকালের শীতল বায়ুতাড়নায় বৃক্ষরাজির পত্রপল্লবে মর্মরধ্বনি উঠছে। ঐ তো বট এবং অশ্বত্থ বৃক্ষগুলি, বৃক্ষতলের উচ্চবেদীসমূহ। ঐ সকল বেদীতে কতদিন অপরাহ্নে সে বিশ্রাম নিয়েছে। বটবৃক্ষের সংখ্যাধিক্যের কারণেই কি গ্রামখানির নাম উজুবট? বটবৃক্ষ কি ঋজু হয়? সে একবার নামটির তাৎপর্য ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলো, সফল হয়নি। গ্রাম বৃদ্ধেরাও কেউ তাকে ঐ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেনি। আহা মাত্র সেদিনই না সে এই নদীতীরে ভ্রমণ করেছে! বালক ও কিশোরদের খেলার সঙ্গী হয়েছে! কি নাম ছিলো যেন বালকটির? অর্কাস? হ্যাঁ, ভারী সুন্দর নামটি আর মুখখানি কেমন ভারী কোমল, আর এতো মায়া চক্ষু দুটিতে যে দৃষ্টিপাত হলে সে দৃষ্টিকে আর সরানো যেতো না। সেই অর্কাস এখন কোথায়? এবং সেই বৃষস্কন্ধ বলশালী কিশোরটি? প্রতিটি কথায় যার হাসি উচ্ছ্বসিত হতো?

নদীতীরে নৌকা নেই কেন? এখানে না বীথির পর বীথি নৌকা ভাসমান থাকতো! তার মনে পড়ে, পল্লীটি কোলাহলে মুখর হয়ে জেগে উঠতো প্রত্যুষকালে। গোধনের হাম্বা রব, ক্ষেত্রকরদের সচিৎকার আহ্বান, ধার্মিক প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের কণ্ঠে শিবের মঙ্গলগীতি, সমস্ত একত্রে পল্লীটির প্রাণ–চাঞ্চল্য প্রকাশ করতো। এখন একেবারেই নিঃশব্দ। ভ্রম হয়, যেন কোনো শোনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

এখানে ভস্মস্তূপ, ওখানে অর্ধদগ্ধ কুটির চালা, চারিদিকে ভগ্ন তৈজসাদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কোনো এক গৃহবধূর হাতে সীবনকৃত একখানি অর্ধদগ্ধ কন্থার প্রান্তদেশে বৃক্ষশাখার তোতাপাখিটি বড় মনোহর। সে হাতে তুলে নিতে গিয়েও নিলো না। অনুমান করতে চেষ্টা করলো, কার গৃহ ছিলো এ স্থানে? দেখলো, বৃথা চেষ্টা। কিছুই অনুমান করা যায় না। সমস্ত কিছু একাকার। উকট একটি দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসছিলো। ক্রমে দুর্গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠলো। ঐ সময় সে একটি পথকুক্কুর দেখলো। তার স্ফীতোদরটি দেখবার মতো। এবং আরও দেখলো, অনতিদূরে একটি শিশুর ছিন্নবাহু নিয়ে দুটি শ্মশান শৃগাল কলহ করছে। শৃগাল ও কুকুরের যে সহাবস্থান হতে পারে, তার জানা ছিলো না।

বসন্তদাস অধিকদূর অগ্রসর হতে পারলো না। দূরে ব্রাহ্মণপল্লীর মন্দিরে ঐ সময় ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। সে ঘণ্টাধ্বনিটি শুনলো অনেকক্ষণ ধরে। কল্যাণ ও মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা আরম্ভ হয়েছে। শ্লোকটি তার মনে পড়লো, যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি …. ধর্মে যখন গ্লানির অনুপ্রবেশ ঘটে, জগত পাপে পূর্ণ হয়ে যায়, দুষ্কৃতকারীদের শাস্তির নিমিত্ত এবং সাধু ব্যক্তিদের পরিত্রাণের জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই। বড় আশ্বাসের কথা। ধর্মে এবং জীবনে মানুষকে সুস্থির করার জন্য এতদপেক্ষা বৃহৎ ও মহৎ আশ্বাস আর কী হতে পারে।

ভগবান বিষ্ণুর অধিষ্ঠান কোথায়? তার মনে প্রশ্ন জাগে। যেখানে এবং যাদের মধ্যে তাঁর অধিষ্ঠান, সেখানে কি গ্লানি আছে? নির্যাতিত মানব শিশুর রোদন ধ্বনি কি অতদূরে কারও শ্রবণ স্পর্শ করে? কে জানে, বসন্তদাসের অন্তত জানা নেই। ভগবান বিষ্ণু, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, নৃসিংহ ইত্যাদি সকল রূপেই মর্তে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু চণ্ডালের, কি ব্রাত্য শূদ্রের গৃহে কখনও কি তাঁর জন্ম হয়েছে? কেন হয়নি, বলা কঠিন। তবে হলে বড় ভালো হতো। চণ্ডাল ডোম হড়ডিরা ভাবতে পারতো যে নর সত্য সত্যই নারায়ণ। এই চিন্তা করে সুস্থ ও সাহসী হতে পারতো যে তারাও একই ভগবানের আশ্রিত।

পুরাণ-কথার সঙ্গে সঙ্গে তার জাতক–কাহিনীও মনে পড়লো। কিন্তু সবই বিচ্ছিন্ন, সংলগ্নতাবিহীন ও পারম্পর্যশূন্য–ক্ষণে ক্ষণেক আলোকোদ্ভাসের মতো। সে জানে, এমন তুলনা একেবারেই অনর্থক–কেউ এমন তুলনা কখনও করবে না। ন্যায় এবং মীমাংসার পদ্ধতিগুলিও তার জানা নেই। আর জানা থাকলেই বা লাভ কি? তার কি সাধ্য যে পুরাণ ও জাতক কাহিনীর তুলনামূলক বিচার করবে? বিশেষত এই সময়ে? সুতরাং চারিদিকে যা ঘটছে তা স্বীকার করে নাও। তোমার মানবজন্মের এই-ই ললাট লিপি।

সে আরেকবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে। এখন তার চারিদিকে ধ্বংস ও মৃত্যু। নরক কি এই প্রকার? হতে পারে–তার অনুমান হয়। জীবনহীনতা এবং সম্ভাবনাহীনতা একত্রিত হওয়ার নামই সম্ভবত নরক। বিকৃতি, পচন, পাপ, পতন–এ সমস্তই নরকের লক্ষণ। আর সমস্তই সম্ভব হয় জীবনের অনন্ত প্রবাহটি স্তব্ধ হয়ে গেলে। সৃজন ও জীবনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেই নরকের আরম্ভ। সে যেখানে দাঁড়িয়ে তা এখন নরকই, অন্য কিছু নয়। এবং একইসঙ্গে বাইরের যে জগৎ বিস্তৃত, যেখানে পিপ্পলী হাটের মতো ঘটনা ঘটে, সে স্থানও নরক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তার মনে হয় না দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য আছে।

বিধ্বস্ত পল্লীটির বুকে দাঁড়িয়ে বসন্তদাস কেবলই উদভ্রান্ত হচ্ছিলো। নানান কথা আসছিলো মনে। বেদনা-শোক-ক্ষোভ-ক্রোধ ইত্যাকার অনুভূতিগুলি তখন আর সজাগ ছিলো না। যেন বিচিত্র এবং প্রকাণ্ড শূন্যতার মধ্যে সে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে, তার কিছুই করণীয় নেই। কোনো কিছুর সঙ্গেই সে আর সম্পর্কিত নয়।

ঐ সময় সে দূরে দেখতে পায় দুজন লোক আসছে। লোক দুটিকে এক সময় হঠাৎ ধাবমান হতে দেখে তার সন্দেহ হলো। এবং পরক্ষণেই তাদের হাতের অস্ত্র দুখানিও দৃষ্টিতে এলো। সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই, সুতরাং সে আর কোনো প্রকার বিলম্ব করতে পারে না। দ্রুত নদীতীরে এসে নৌকাখানি নিয়ে সে পশ্চিমতীরে চলে এলো। দেখলো, হড়ডি বৃদ্ধটির কথাই যথার্থ। পূর্বতীরে তার বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে।

তুমি এখন তবে কার? বৃক্ষছায়ার নীচে, হট্টকুটিরে অর্ধশয়ান অবস্থায় নিজেকে প্রশ্ন করে সে। তুমি কি পিতামাতার? নাকি প্রিয়তমা পত্নীর? নাকি সেই বালগ্রামের কৃষ্ণা নাম্নী মন্দিরদাসীটির?

সে যেমন এখন কারও নয়, তেমনই আবার নিজেরও নয়। তুমি কি তোমার বসন্তদাস? প্রশ্ন করে সে উত্তর পায় না। ব্যক্তির অস্তিত্ব তো সম্পর্কে–তা সে যেমনই হোক বস্তুসম্পর্ক হোক, অথবা হোক ব্যক্তিসম্পর্ক। আমি আমি বলে চিৎকার করলেই কি তাতে কিছু প্রমাণিত হয়? আমার এখন মানবসম্পর্ক নেই–পিতামাতা, আত্মীয়–পরিজন, স্ত্রী বন্ধু, কোনো সম্পর্কেই তো আমি এখন যুক্ত বোধ করি না। আর বস্তু সম্পর্ক? সেখানেও কি আমি যুক্ত? কোন পরিচয়টি আমার? আমি কি বণিক? বণিক হলে বিত্তহীন সম্বলহীন অবস্থায় আমি হট্টগৃহে একাকী শয়ান কেন? নাকি আমি ক্ষেত্ৰকর? তাহলে তো আমার গৃহবাসী হয়ে ক্ষেত্রকর্মে যুক্ত থাকার কথা।

না সে বণিক নয়। ঐ পরিচয় তার অপহৃত হয়ে গেছে ফরুগ্রাম জনপদে। এবং ক্ষেত্রকর পরিচয়টি ত্যক্ত হয়েছে আরও পূর্বে। এখন তাহলে কি সে ভূত্য? দাস? নাকি সাধু অথবা যোগী? সে নিজের জন্য কোনো অভিধা আবিষ্কার করতে পারে না। দুর্বাত্যা প্রবাহে উন্মুলিত ক্ষুদ্র পাদপের মতো অবস্থা তার। সে উপলব্ধি করে, এই অবস্থা তার একার নয়। প্রায় সকল মানুষেরই এই অবস্থা। তুমি ক্ষেত্রকর? কিন্তু ঐ পরিচয়ে তুমি স্থিত থাকতে পারবে না। একজন সামন্ত বা রাজপাদোপজীবী তোমাকে ভূমি থেকে উচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তুমি বণিক? তোমার ধন–সম্পদ, পণ্যসামগ্রী সমস্তই এক সুন্দর প্রভাতে দেখবে যে অপহৃত হয়ে গেছে। তুমি গৃহবধূ? তোমার রূপ–যৌবন দেখবে একদিন লম্পটের ভোগ্য হয়ে উঠেছে। বসন্তদাস উঠলো। শরীরে ক্লান্তি, মনে অবসাদ। আপাতত একটি কাজ তার এখন। আর তা হলো, মায়াবতীর অনুসন্ধান করা। হড়ডি বৃদ্ধের অনুমানটি সম্ভবত যথার্থ। পশ্চিম তীরের গ্রামগুলিতেই, যদি জীবিত থাকে, মায়াবতীর সন্ধান করতে হবে।

০২. পথ আর পথ

পথ আর পথ। শুধুই পথ অতিক্রমণ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করেও তার যাত্রা শেষ হলো না।

পথের আকর্ষণ অবশ্য বাল্যকাল থেকেই। ক্ষেত্রকরের পুত্র সে, কিন্তু কুলবৃত্তিতে তার মতি ছিলো না। গোচারণে গেলে কোনো না কোনো অঘটন ঘটাতোই সে। হয় তার গাভীটি প্রতিবেশীর ক্ষেত্র নষ্ট করেছে, নয় তার একটি গোবৎসকে সন্ধ্যাকালে পাওয়া যাচ্ছে না। পিতা হেমন্তদাস লাঠৌষধি কম প্রয়োগ করেননি–কিন্তু কাজ হয়নি তাতে। দেওয়া হলো তাকে হল চালনার কাজ, দেখা গেলো, দ্বিপ্রহর না হতেই বলীর্বদ দুটির পশ্চাৎপদগুলি রক্তাক্ত। লাঙলে তার মুষ্টি কখনই দৃঢ় হয় না। অমন কৰ্ষণকারীকে সহ্য করবে কোন গৃহস্থ? হোক না সে নিজ পুত্র!

দেখা যেতো সংসারে তার মন নেই। যখনই তার সন্ধান হতো, দেখা যেতো নদীতীরে ভাসমান নৌকাগুলির নিকটে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নৌযানের মানুষগুলির মুখে সে দূর দূর দেশের নাম শুনতো–বারাণসী, প্রয়াগ, কামরূপ, সোমদ্বীপ, বিক্রমপুর আর এইসব নাম তার কিশোর মনের কল্পনায় নানান চিত্র মুদ্রিত করে দিতো।

বণিক নতুন হলেই হলো, সে তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাবেই। বলতো, মহাশয় কি দূর দেশ থেকে আসছেন? রাজধানীতে গিয়েছিলেন কি? আপনার নৌযানে কি প্রকার পণ্য? এ স্থানে কতদিন অবস্থান করবেন? এই প্রকার সব উপর্যুপরি প্রশ্ন। কোনো বণিক বিরক্ত হতো। বলতো, কেন হে, এতো প্রশ্ন কেন তোমার? তুমি কি ভগিনী দান করবে? কোনো আসবমত্ত বনিক অশ্লীল ইঙ্গিত করতো। বলতো, বৎস, তোমার বোধ হয় পিতা নেই, তাই পিতার সন্ধান করতে এসেছো–যাও, তোমার মাতাকে আসতে বলো–তিনিই উত্তমরূপে আমার পরিচয়টি জেনে যাবেন।

কিন্তু ঐ প্রকার কর্কশ স্থূল বিদ্রুপেও বসন্তদাস নিবৃত্ত হতো না। শুধু বণিকেরা নয়, আর একটি আকর্ষণ ছিলো নদীতীরে। সে হলো কুটিরবাসী একজন যোগী। প্রায়, অষ্টপ্রহরই তিনি গীত গাইতেন। রামায়ণ–কাহিনী, ভারত–কথা, পুরাণ–বৃত্তান্ত–সমস্তই থাকতো তাঁর গীতে। ঐ প্রৌঢ় যোগীটি আবার শিক্ষাদানও করতেন। এক প্রকার উন্মাদ ছিলেন সম্ভবত। না হলে ধর্মহীন চণ্ডাল, হড্‌ডি, শবর ইত্যাদি নীচ জাতীয় বালকদের কেউ শিক্ষাদান করে? মৃত্তিকায় রেখা টেনে টেনে বর্ণপরিচয় হতো। কাজটি ছিলো গর্হিত। কেননা কে কবে শুনেছে যে, ডোমের পুত্র, হড়ডির পুত্র, বিদ্যাভ্যাস করে?

একদিকে বণিকদের মুখে দূর দেশের কাহিনী, অন্যদিকে উন্মাদ যোগীর কাছে বিদ্যাভ্যাস–এই দুটি আকর্ষণ ছিলো প্রবল। ঐ সঙ্গে ছিলো আবার প্রাকৃত গীতগুলি। ঐ গীতগুলি তার বড় প্রিয় ছিলো। আর সেই কাহিনী, রামের বনগমনের দৃশ্যটি–পিতা মূৰ্ছাহত, মাতা উন্মাদিনীপ্রায়, নগরবাসী হা রাম হা রাম বলে হাহাকার করছে–কিন্তু। রাম অবিচল। দৃঢ় পদক্ষেপে বনবাসে চলেছেন। কিংবা ধরো, গঙ্গা শান্তনুর বৃত্তান্তটি সত্যভঙ্গ হয়েছে বলে গঙ্গা চলে যাচ্ছেন, শিশু সন্তান কাতরস্বরে মা মা বলে ডাকছে, স্বামী মিনতি করছেন, কিন্তু দেবী গঙ্গা অবিচল। শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যেতো কিশোর বসন্তদাস। ওদিকে পিতার লাঠৌষধি প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তাতে গ্রাহ্য ছিলো না বসন্তদাসের।

এবং প্রায়ই সে পলায়ন করতো। শীত আরম্ভ হলো–তারপর দেখো বসন্তদাস আর গৃহে নেই। সন্ধান করো, দেখবে, কিশোর বসন্তদাস মেলায় মেলায় পুত্তলি বিক্রয় করছে। শেষে কৈশোর অতিক্রান্ত হলে, নবীন যৌবনে একদা সত্য সত্যই সে পলায়ন করলো। কোথায় গেলো, কি বৃত্তান্ত, কেউ জানলো না। স্ত্রী রোদন করলে হেমন্তদাস শাসন করতেন। বলতেন, ঐ কুৰ্মাণ্ডটার জন্য অহেতুক অশ্রুপাত করছো, ওর কি পিতামাতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আছে? অমন পুত্র না থাকাই উত্তম।

কিন্তু যখন সে ফিরলো, পিতা কিছু বলতে পারলেন না। কি বলবেন? ঐ যুবা পুরুষকে কি আর তখন কিছু বলা যায়? দেখছেন, দীর্ঘদেহ যুবা পুরুষটি–পরিধানে শুভ্র বস্ত্র, মস্তকে দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ, কর্ণে দুটি স্বর্ণ কুণ্ডল, ঊধ্বাঙ্গের উত্তরীয়খানি স্বর্ণাভ চীনাংশুক, অন্তরাল থেকে অঙ্গদের উজ্জ্বলতা চমকিত হচ্ছে। আর গমন ভঙ্গিটি এমত যে মনে হয় দূর দেশাগত ধনী কোনো শ্রেষ্ঠী অথবা সার্থবাহ ভ্রমণে বাহির হয়েছেন। অমন বয়স্ক সুপুরুষ পুত্রকে কি কিছু বলা যায়? বিশেষত সে পুত্র যখন বাণিজ্য করে গৃহে ফিরছে।

হেমন্তদাসের অর্থের প্রয়োজন ছিলো। গৃহসংস্কার হয়নি বহুকাল। গো–শালার খুঁটিগুলি হয়ে পড়েছিলো দুর্বল ও কীটদষ্ট, ভাণ্ডার গৃহের চালাগুলিতে পচন ধরেছিলো, শয়ন প্রকোষ্ঠের গবাক্ষ ও দ্বারগুলির অবস্থা ছিলো শোচনীয়। এমতাবস্থায় পুত্রের উপার্জিত অর্থ তিনি সদ্ব্যবহার করলেন নিঃসংকোচে। ওদিকে আবার মাতৃদেবীরও সাধ, গৃহে বধূ আনবেন। পিতারও ঐ ব্যাপারে সমর্থন ছিলো। কারণ তিনি ভালো জানেন যে, যুবতী রমণীর বাহুপাশ ছিন্ন করে কোনো নবীন যুবকের পক্ষে বিদেশ যাত্রা করা সম্ভব নয়। সুতরাং সন্ধান করো, কন্যা যেন যুবতী এবং রূপসী হয়। পুনর্ভবা তীরের দীনদাস নামক একটি লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো হেমন্তদাসের। সে–ই এনে দিলো প্রকৃত সংবাদ।

কন্যাটি প্রকৃতই রূপবতী, যদিও বর্ণটি শ্যামল ভিন্ন অন্য কিছু বলা যায় না। বসন্তদাসের মাতা কন্যাটিকে দেখে আনন্দিত হলেন। সধবা রমণীরা হুলুধ্বনি করছিলো, তিনি ধানদূর্বা দিয়ে বধূবরণ করবেন। গৃহদ্বারে পিঁড়িখানি পাতা, বধূ পিঁড়িতে দাঁড়াবার পরও মাতা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছেন রূপবতী বধূটিকে। আহা কপালখানি যেন নবচন্দ্রিকা। ওষ্ঠ দুটির তো তুলনা হয় না–যদি হতো, তাহলে বলা যেতো কামকুসুম–আর গ্রীবাটি দেখো, কী মসৃণ, বাহু দুখানি কেমন সুগোল–আর বক্ষোদেশ? অমন কি দেখেছেন কোথাও? না, মনে পড়ে না।

অমন রূপবতী যুবতী যদি বাহুপাশে বাঁধতে না পারে নিজ পুরুষকে, তাহলে ধিক সে যুবতাঁকে।

কি হলো, বিলম্ব কেন? বধূবরণ করো? স্বামীর তাড়নায় বসন্তদাসের মাতা ধান–দূর্বা কুসুম–চন্দনাদি দিয়ে বধূকে বরণ করলেন।

অতঃপর বলাই বাহুল্য যে বসন্তদাসের দিবারাত্রির জ্ঞান লোপ পেয়েছিলো। পক্ষকাল যেন কাটলো ভয়ানক এক ঘোরের মধ্যে, রমণীদেহ তাকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছিলো বলতে হবে। ওদিকে পিতা নিশ্চিন্ত, মাতার আনন্দ আর ধরে না।

তবে ভোগেরও শেষ আছে। পক্ষকালও গত হয়নি, বসন্তদাস পুনরায় উন্মন হয়ে। উঠলো। ঐ সময় নদীতীরের ঘাটে নতুন বণিকেরা এসেছে। বসন্তদাসের সময় অতিবাহিত হয় তাদের সান্নিধ্যে। উপার্জিত অর্থও ততদিনে নিঃশেষিত প্রায়। সে বুঝে নিয়েছিলো, যাত্রার সময় হয়ে এসেছে।

কিন্তু ব্যাপারটিকে ত্বরান্বিত করলো গ্রামপতি কুশল দত্ত। কার মুখে কী শুনেছিলো ঈশ্বর জানেন, একদা এসে হস্ত প্রসারিত করে দাঁড়াল। বললো, আমাকে দুইশত মুদ্রা ঋণ দাও।

কুশল দত্ত এমন ব্যক্তি যার হস্ত প্রসারিত হলে প্রত্যাহৃত হয় না। তা সে রমণী হোক অথবা ধনসম্পদ। তার এক কথা, তোমার নেই, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। তিন দিবসের মধ্যে আমার দুইশত মুদ্রা চাই–যদি স্বেচ্ছায় দাও, উত্তম, না হলে আমাকে বলপ্রয়োগ করতে হবে।

বসন্তদাস ঘটনাটি কাউকে জানতে দিলো না। কেবল পিতাকে জানালো, আপনার পুত্রবধূ পিত্রালয়ে যেতে চায়। ঐটুকুই কথা। একই শকটে দুজনে গৃহত্যাগ করলো অতঃপর। শেষে দেখা গেলো, পুত্রবধূ যথাস্থানে উপনীত হয়েছে কিন্তু পুত্র নিরুদ্দেশ।

আত্রেয়ীবক্ষে অপেক্ষমাণ অন্যান্য বণিকদের সঙ্গে যাত্রারম্ভ। তারপর শকটারোহণ– দক্ষিণে যাত্রা, কখনও আবার ঈষৎ পশ্চিমে। এক জনপদ থেকে আর এক জনপদে। এক হাট থেকে অন্য হাটে–যদি শকট দুস্পাপ্য হয়, তাহলে অশ্বারোহণ, কিংবা পদব্রজ। কোথাও তৈজসাদি কেনে, কোথাও কেনে গন্ধদ্রব্য, কোথাও লবণ, কোথাও ক্ষৌমবস্ত্র, কোথাও আবার দুকূল–জীনাংশুক। এই প্রকার ক্রয় এবং বিক্রয়। কখনও ক্ষতি এমন হয় যে, মনে হয়, এইবার তার বাণিজ্য শেষ। কিন্তু পরবর্তী উদ্যোগই তাকে আশাতীত লাভবান করে দেয়। দু দুবার তার আশাতীত লাভ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ লাভ থাকেনি। দস্যু এবং রাজ পুরুষদের উপদ্রব এমনই প্রবল যে বণিকের পক্ষে তিষ্ঠানে কঠিন। দস্যুরা কিছুই বলে না, আকস্মিকভাবে আসে এবং পণ্যসামগ্রী লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। কখনও কখনও প্রহারও করে। কিন্তু রাজপুরুষেরা তোমার বিপণীতে এলে ব্যবহার এমন করবে, যেন কততদিনের পরিচয়। পানগুবাক খাবে, আলাপে নিমগ্ন হবে, হাস্যকৌতুকও করবে। শেষে প্রসারিত হস্তের অঙ্গুলি নির্দেশে একে একে দ্রব্যগুলি ভূত্যের হাতে উঠতে থাকবে। ঐ ওঠার যেন শেষ নেই। মনে হবে, পারলে যেন সমস্ত বিপণীটিই স্কন্ধে তুলে নিয়ে যায়।

দুকূল বস্ত্রখানি নিলাম হে, ভারী সুন্দর এর রঞ্জনটি–মুক্তামালাগুলি বুঝি নব্যা বকাশিকার? দুখানি দাও, গৃহিণী পেলে সুখী হবে–আরে! তোমার কাংস্য স্থালীগুলি তো চমৎকার–এগুলি কি পশ্চিমের? আমার গৃহে কয়েকখানির প্রয়োজন, ওরে সুখদাস, স্থালীগুলি গৃহে নিয়ে যা।

বসন্তদাস ক্লান্তি বোধ করে একেক সময়। গণনা করে দেখে, লাভালাভ শেষে একই প্রকার থেকে যাচ্ছে। অতিরিক্ত উপার্জন চলে যাচ্ছে দস্যু নয়তো সামন্তপতি গ্রামপতিদের হাতে। সে ক্রমে হতাশ হতে আরম্ভ করে। যখন যাত্রারম্ভ করে তখন শীতের শেষ। আশা ছিলো, বর্ষার পূর্বেই গৃহে ফিরবে। কিন্তু দেখলো অসম্ভব। সঞ্চয়ে প্রায় কিছুই নেই। অগত্যা স্থির করে, পথিমধ্যেই বর্ষাযাপন করবে। এবং সেই সিদ্ধান্ত মতে সে গ্রাম্য বণিকের মতো হাটে হাটে সামান্য পণ্য ক্রয় বিক্রয় আরম্ভ করে। ঐভাবেই যায় বর্ষাকাল। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না। অবস্থা থেকে যায় যথাপূর্বং তথাপরং। সর্বত্রই কোনো না কোনো দুর্বিপাক। ধবলদীর্ঘিকা হাটে বন্ধু শখদত্ত করে প্রতারণা। সমস্ত পণ্য সে ক্রয় করে কিন্তু মূল্য পরিশোধ না করেই পলায়। ফলে বাণিজ্যে আর তার উৎসাহ থাকে না। শঙ্খদত্তের সন্ধানে তাকে যেতে হয় দেবীকোটের মেলায়। প্রাচীন নগরী দেবীকোট তখন পরিত্যক্তপ্রায়। কিন্তু বৎসরান্তে মেলাটি নিয়মিত বসে। শুনেছিলো শঙ্খদত্ত মেলায় অশ্ব ক্রয় করবে। কিন্তু দেখলো, ঐ মেলায় শঙ্খদত্তকে সন্ধান করা কঠিন। তার সঙ্গে তখনও কয়েকখানি মুক্তামালা ছিলো। সে মণিকার বিপণীগুলিতে ঐ মালা কয়খানি একে একে বিক্রয় করলো। বলা বাহুল্য, মূল্য পাওয়া গেলো আশাতীত। কিন্তু তারপর? তারপর আর তার বিক্রয় করার মতো কিছু নেই। সে স্থির করলো, এখন কদিন সে মেলা দেখবে এবং শঙ্খদত্তের সন্ধান করবে।

এও বোধ হয় ভবিতব্যই। না হলে সে বিলম্ব না করে গৃহে ফিরতে পারতো। জীবন তার হতো অন্য প্রকার। কেননা ঘটনা মানুষকে নানা বিষয়ের সঙ্গে সংলগ্ন করে দেয়। মেলার ঘটনাগুলি আকস্মিক, কৌতূহলপ্রদ, কৌতুকময় এবং কোনো কোনোটি দুঃখবহও বটে। আর ঐ সকল ঘটনাই তাকে বিচিত্র পথে চালিত করে।

মেলার প্রান্তে একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই এবং বড়ই জীর্ণদশা তার। কোনো এক সময় সম্ভবত পূজা হতো–এখন একেবারেই পরিত্যক্ত। শোনা যায়, ঐ মন্দিরে দেবী বজ্রতারা অধিষ্ঠিতা ছিলেন। কোনো এক সময় নাকি মঞ্জুশ্রী মূর্তিও সেখানে স্থাপিত হয়েছিলো। নিকটবর্তী দুখানি গ্রামের নাম বজ্রেশ্বর ও মঞ্জুকল্প। গ্রাম দুখানিই কেবল ঐ দুই দেবদেবীর নাম ধারণ করে আছে–নতুবা আর কোনো চিহ্ন তাদের নেই। মেলাটি যে কি উপলক্ষে বসে, তাও কেউ বলতে পারে না এখন।

বসন্তদাস পরিত্যক্ত মন্দিরটি দেখতে গেলে পরিচিত হয় এক যবন বৃদ্ধের সঙ্গে। বৃদ্ধটিও মন্দির দেখতে এসেছিলেন। সৌম্য শান্ত মুখাবয়ব, দেখলেই শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। আলাপে বসন্তদাস জানলো বৃদ্ধটি অশ্ববিক্রেতা। দশটি অশ্ব এনেছিলেন, সবই প্রায় বিক্রয় হয়েছে, অবশিষ্ট দুটি বিক্রয় হলেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন। ঐ অশ্ব বিক্রেতাই জানালেন, শঙ্খদত্তের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সে দুএকদিনের মধ্যেই একটি অশ্ব ক্রয় করবে বলে অঙ্গীকার করেছে।

ঐ সংবাদের পর কে আর স্থির থাকতে পারে। বসন্তদাস মেলার পশু হাটে শঙ্খদত্তের সন্ধান করতে থাকে। স্থানটি একেবারে নরকবিশেষ। অশ্ববিক্রয়ের স্থানটি সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। দুদিকে অশ্বের সারি, মধ্যস্থলে প্রশস্ত পথ। ঐ পথেই চলেছে অশ্বের পরীক্ষা। কোন অশ্ব কতখানি শিক্ষিত ক্রেতারা তা পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। ফলে কখন যে ধাবমান অশ্ব কার স্কন্ধে এসে পতিত হবে তার স্থিরতা নেই। হৈ চৈ চিৎকার, ধাবমান অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, তাদের গ্রীবায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘুন্টিকা মালার ঝুম ঝুম শব্দ এবং মানুষের উল্লম্ফ পলায়ন, সমস্ত একত্রে স্থানটিকে যুগপৎ আকর্ষণীয় ও বিপজ্জনক করে রেখেছে।

আর হস্তি বিক্রয়ের স্থানটি তো একেবারেই অসহ্য। কপি পড়ে আছে ইতস্তত আর স্থানে স্থানে পুরীষপ। সেই স্থূপ আবার প্রায়শঃই মূত্রস্রোতে বিগলিত ও ভাসমান। দুর্গন্ধে ও স্থানে দাঁড়ানো যায় না। তদুপরি সময় নেই, অসময় নেই, মাহুতেরা কুলিশাঘাত করে আর দিগন্তকম্পী বৃংহণধ্বনি ওঠে। সে এমন চিৎকার যে কর্ণপটাহ ছিন্নভিন্ন হবার উপক্রম হয়। তবে সর্বাপেক্ষা অধিক জনসমাগম হয় গো–হট্টে। কতো প্রকার, কতো আকারের যে গোধন হতে পারে তা এই মেলায় না এলে ধারণা করা যাবে না। এ স্থানেও দুসারি গবাদিপশুর মধ্যবর্তী একটি প্রশস্ত পথ রাখা হয়েছে। সেখানে শকটবাহী বলীবর্দদের শক্তি এবং কৌশলের পরীক্ষা হচ্ছে। তাদের সুচিক্কণ লোমাবৃত দেহ, গর্বোচ্চ গ্রীবাভঙ্গী এবং সুছন্দ গমন দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না যে এগুলি বলীবদ। মনে হয় এগুলি অন্য কোনো প্রাণী। আর গাভীগুলিকে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। পশ্চিম দেশীয় গাভীগুলি বিদ্ধনাসা, তবে নথের সঙ্গে রঞ্জু বাঁধা থাকলেও ক্রেতাদের পীড়নে একেকবার এমন লম্ফ দিয়ে উঠছে যে তাদের শান্ত করতে বিক্রেতাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তাদের দুগ্ধস্থলীটি বিশাল এবং বাটগুলি প্রায় ভূমিস্পর্শী। প্রতিদিন নাকি দশ ভাণ্ড দুগ্ধ দিতে পারে এরা। দেশীয় গাভীগুলিই কি কম! খর্বাকার, কিন্তু এদের ওলানগুলিও কম স্ফীত নয়। শোনা যায়, এদের দুগ্ধদানের ক্ষমতাও প্রতিদিন পাঁচ ছয় ভাণ্ডের মতো।

বসন্তদাসের এই এক কাজ। প্রতিদিন পশুহট্টে বিচরণ, আর শঙ্খদত্তের সন্ধান। প্রতিদিনই যবন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তিনিও অপেক্ষায় আছেন, কখন লোকটি আসে এবং তার শেষ অশ্বটি ক্রয় করে নিয়ে যায়। বৃদ্ধটি একই পান্থশালার অতিথি, যদিও রাত্রিযাপন করেন ভিন্ন একটি প্রকোষ্ঠে। তবে অন্তরঙ্গতা হতে বিলম্ব হয়নি। দেখা হলেই বলেন, কি বৎস, তোমার মিত্র শঙ্খদত্তের দর্শন পেলে?

বৃদ্ধটি একেবারেই বৃদ্ধ–পক্ককেশ, শ্বেত শ্মশ্রু, এমনকি ভ্রূ–যুগল পর্যন্ত শুভ্র। তাঁর কাছে কতো যে কাহিনী সংখ্যায় গণনা করা যায় না। একবার আরম্ভ করলেই হলো, বিরতি হবে না সহজে, ক্লান্তিবিহীনভাবে বলে যেতে থাকবেন। অতিথিশালার অন্য আর একজনের সঙ্গেও বসন্তদাসের হৃদ্যতা হয়েছে–তবে সে হৃদ্যতা অন্য প্রকারের। বৃদ্ধ যখন তার কাহিনী বলেন, তখন তাতে কৌতুক থাকলেও মাথা নত করে শুনতে হয়। শ্রদ্ধা ও প্রীতির এমন একাকার ভাব পূর্বে কখনও বসন্তদাস অনুভব করেনি।

বৃদ্ধ এবার গৃহাভিমুখে যাত্রা করবেন। বাণিজ্য যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। গৃহে সকলে অপেক্ষা করে রয়েছে। একটি বালিকা কন্যা আছে তাঁর। কন্যাটি বড় আদরের। ইতোমধ্যে হয়তো বিবাহের বয়স হয়েছে। বৎস বলতে পারো, বিবাহের বয়স হলে দুহিতারা প্রবাসী পিতার কথা চিন্তা করে, না ভাবী স্বামীর চিন্তায় অধিক সময় ব্যয় করে? সাধ্য কি বসন্তদাসের যে ঐ দুরূহ প্রশ্নের উত্তর দেবে। সে হাসে প্রশ্ন শুনে। বলে, মহাশয় বুঝি আশা করেন যে কন্যারা সকলেই পিতার চিন্তায় নিশিদিনযাপন করুক?

না, তা নয়, একটি দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত হয় বৃদ্ধের বক্ষ থেকে। বলেন, বড় আদর করতাম কন্যাটিকে–ঐটিই কনিষ্ঠা কিনা–আর অপরূপ সুন্দরী হয়েছে সে দেখতে, যদি তুমি দেখতে! তুমি স্বজাতীয় হলে আমি তোমাকে জামাতা করতাম।

কথাটি কৌতুক, না সত্যভাষণ, কিছুই বোঝা যায় না। তথাপি সে জানায়, মহাশয়, আমি কিন্তু বিবাহিত।

তাতে কি, আমাদের সমাজে চারিটি পর্যন্ত স্ত্রী রাখার বিধান রয়েছে।

তাই বলে আপনি সপত্নী গৃহে কন্যাদান করবেন?

হ্যাঁ করবো, বৃদ্ধ হাসেন। বলেন, কারণ আমি জানি, আমার কন্যাটিই হবে জামাতার সর্বাপেক্ষা আদরণীয়া।

বস্ত্র ব্যবসায়ী অক্রূরদাস একেবারেই বয়স্য স্বভাবের। তার কৌতুকাদিতে বারণ থাকে না। যতো উদ্ভট প্রসঙ্গ তার আলাপে। একদা জানতে চাইলো, সখা বসন্ত, এদেশে রমণীদের বক্ষ স্তনশূন্য কেন বলতে পারো?

কি অদ্ভুত কথা! স্তনশূন্য বক্ষ যার সে রমণী হবে কি প্রকারে? বোঝে সে, পীতাঙ্গী পার্বত্যজাতীয়া রমণীদের কথা বলছে অক্রূরদাস।

সে জানায়, অক্রূরদাস, একবস্ত্রা ঐ রমণীদের বক্ষদেশে স্তন দুর্লক্ষ্য হলেও তাদের নারীত্বে সন্দেহ পোষণ করো না–বিপদে পড়বে–রমণ রণে কিন্তু তারাই প্রথম আক্রমণ করে এবং পুরুষকে নিঃশেষিত না করে ত্যাগ করে না।

বসন্তদাস লক্ষ্য করছে, রাঢ়দেশবাসী অক্রূরদাসের নারী বিষয়ে আগ্রহ অত্যধিক। ঐ প্রসঙ্গ একবার পেলেই হলো, প্রহরের পর প্রহর সে আলাপ করে যাবে।

শঙ্খদত্তের সন্ধান করার সময় একটি বিচিত্র দৃশ্য দেখলো সে একদিন। কাষায় বস্ত্রধারী, পীতবর্ণ, মুণ্ডিতমস্তক একদল লোক সারিবদ্ধভাবে প্রাচীন মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। সকলের মতো তারও কৌতূহল হলো, এরা কারা? কেউ বললো, এরা বণিক–কেউ বললো, এরা সদ্ধর্মী ভিক্ষু, হিমালয়ের পরপর তিব্বত দেশ থেকে এসেছে–আবার কেউ বললো, না হে, এরা সমুদ্রপারের মানুষ, তীর্থস্নানে চলেছে।

প্রকৃত পরিচয় কেউ দিতে পারে না। তবে লক্ষ্য করা গেলো, দেশী ভিক্ষুরা তাদের সঙ্গে সাগ্রহে আলাপ করছে।

পরদিন প্রভাতে আর তাদের দেখা গেলো না। তবে জল্পনা–কল্পনা চললো পরদিনও। অশ্বহট্টের লোকদের মুখে উদ্বেগ চিহ্ন। তাদের আশঙ্কা, ভয়ানক কিছু ঘটবে–সদ্ধর্মীদের এতো সংখ্যক লোক একত্র হয়েছে, এ শুভ লক্ষণ নয়। বসন্তদাস শঙ্খদত্তের কথা জিজ্ঞাসা করলে একজন বিরক্ত হয়ে জানায়, মহাশয়, আপনার কি মস্তিষ্কের দোষ হয়েছে, প্রতিদিন এক কথা? আমরা কি রাজার গূঢ় পুরুষ যে প্রতিটি লোকের আগমন নির্গমনের সন্ধান জেনে রেখেছি? এখন যান, বিরক্ত করবেন না।

সন্ধ্যাকালে দেখা গেলো মেলার নোক পলায়ন করছে। কি বৃত্তান্ত, কেউ জানে না। শুধু জনরব শোনে। ঐ আসে তারা, শীঘ্র পলাও–ঐ এসে গেলো। পলায়ন করুন মহাশয়, যদি প্রাণ রক্ষা করতে চান।

ক্রমে জানা গেলো, নিকটেই কোথাও ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হবে। রাজার সেনাদল আসছে বিদেশী সদ্ধর্মীদের দমন করতে। যতো শীঘ পারা যায়, পলায়ন করা উত্তম। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।

কোথায় কি! শেষাবধি কিছুই হলো না। পরদিন দ্বিপ্রহরে দুজন অশ্বারোহী দেখা গেলো–তারা ভিক্ষুদের সন্ধান করলো প্রথমে, তারপর মন্দিরগৃহে বিশ্রাম করতে গেলো। অপরাহ্বে দেখা গেলো ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদল আসছে। তারা মেলার কিছু খাদ্যদ্রব্য ও কয়েকটি বিপণী লুণ্ঠন করে বিদায় হলো।

কিন্তু ততক্ষণে মেলার অর্ধাংশ শূন্য হয়ে গেছে।

ঘটনাটি বসন্তদাসকে হতাশ করে দিলো। সে বুঝলো, শঙ্খদত্তকে আর পাওয়া যাবে না।

অপরাহ্নের দিকে একদিন অক্রূরদাস তাকে শয্যা থেকে তুললো। বললো, চলো সখা, আজ কিঞ্চিৎ আনন্দ উপভোগ করে আসি। তোমাকে আজ অতীব উপভোগ্য বস্তু দেখাবো।

অক্রূরদাসের স্ফূর্তির কারণ ছিলো। সমস্ত বস্ত্র তার বিক্রয় হয়ে গেছে, এখন সে মুক্ত পুরুষ। দিন দুই আমোদ উপভোগ করবে, তারপর গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যাবে। সে ইতোমধ্যে দুখানি শাটিকা বসন্তদাসকে উপহার দান করেছে। ভারী সুন্দর বস্ত্র দুখানি। একখানি স্বর্ণাভ চীনাংশুক–কল্পনায় মায়াবতীর দেহে ঐ বস্ত্র দেখে সে সাগ্রহে বস্ত্রখানি গ্রহণ করে। আর অন্যখানি গাঢ় নীল বর্ণের পট্টবস্ত্র। তাতে আবার স্বর্ণসূত্রের সূচিকর্ম। শাটিকাখানি মেলে ধরলে মনে হবে তারকাখচিত রাত্রির আকাশ। শ্যামবর্ণা মায়াবতীর দেহে ঐ বর্ণের বস্ত্র যে মানাবে না, তা সে জানতো। তাই বস্ত্রখানি গ্রহণ করতে তার ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো। তাতে অক্রূরদাস হেসে ওঠে। বলেছিলো, নাও সখা, নিয়ে রাখো–সমস্তই যে পত্নীকে দিতে হবে এমন তো কথা নেই–পত্নী ব্যতিরেকেও তো কোনো রমণী বাঞ্ছিতা হতে পারে।

অক্রূরদাসের আগ্রহে সে সঙ্গী হলো। কিন্তু এমন স্থানে সে নিয়ে গেলো যেখানে যাবার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। অক্রূরদাস তাকে নিয়ে তুললো একেবারে বারাঙ্গনা পল্লীতে। তাকে অপ্রতিভ দেখে জানতে চাইলো, সখা বসন্ত, এই কি তোমার প্রথম? পূর্বে কখনও এরূপ স্থানে আসোনি?

বসন্তদাস বিরক্ত হচ্ছিলো। উত্তর না দিয়ে বললো, চলো, কোথায় যাবে।

সে এক অদ্ভুত জগৎ। কুটিরের দ্বারে দ্বারে বাররমণীরা। ওষ্ঠ রক্তিম, কপোলে শঙ্খচূর্ণ এবং তদুপরি কুঙ্কুম বিন্দু। কঞ্চলিগুলি এতোই স্ফীত যে সন্দেহ হয় ভিতরে গোলাকার প্রস্তরখণ্ড বাঁধা। সে এমন কখনও দেখেনি। নিজ গ্রামে হাটের প্রান্তে কয়েকটি ডোম এবং হড়ডি কুটিরের কথা সে জানে, যেখানে কয়েকটি শিথিলশাসনা রমণী বাস করতো। তারা এমন সাজসজ্জা করতো না। অন্য দশটি রমণীর মতোই ছিলো তাদের বেশবাস। জনরব ছিলো যে তারা অর্থের বিনিময়ে দেহোপভোগ করতে দিতো। কিন্তু এ যে দেখছে, একেবারেই অন্য রূপে যেমন, তেমন আকার প্রকারেও।

মাদকসেবী নাগরেরা যথেচ্ছ ব্যবহার করছিলো। কেউ নীবিবন্ধন ছিন্ন করার কপট ভঙ্গি করছিলো, কেউ মুখ চুম্বন করছিলো, কেউবা অহেতুক চিৎকার করছিলো। অক্রূরদাস একটি কুটিরের দ্বারদেশে উপনীত হয়ে বললো, সখা, এখানে দাঁড়াও। অতঃপর কুটিরের রুদ্ধদ্বারে করাঘাত করলে ভিতর থেকে চিৎকার শোনা গেলো। রমণীকণ্ঠ চিত্তার করে বলছে, রে কুক্কুরীপুত্র, রজ্জু দিয়ে বেঁধে রাখ নিজেকে, আমার কুটিরে এখন লোক আছে।

ঐ কথা শুনে বসন্তদাস আমূল বিচলিত হলো। একটি বিবমিষার ভাব তার সমগ্র দেহাভ্যন্তরকে আলোড়িত করতে লাগলো। অন্য লোক যে রমণীতে উপগত হয়েছে সেই রমণীতেই তুমি গমন করবে? এ কীভাবে সম্ভব? তোমার কি ঘৃণা নেই? যদি অন্যজনের উপগমন হতো তোমার অজ্ঞাতে, তাহলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু এ–তো স্পষ্ট, তবু তোমার রুচি থাকবে? ছি ছি। সে ডেকে বললো, অক্রূরদাস, আমি চললাম–তোমার আনন্দ নিয়ে তুমি থাকো।

অক্রূরদাস আসব পান করেছিলো। তার তখন ঈষৎ মত্তাবস্থা। বললো, কেন সখা, তোমার কি যুবতী রমণী অভিপ্রেত নয়? যদি বলল, তাহলে কিশোরী অথবা বালিকা সন্ধান করি।

বসন্তদাস কি বলবে ভেবে পায় না। তবু বলে, অক্রূরদাস, তোমার ঘৃণা হবে না? যে রমণীকে ক্ষণমাত্র পূর্বে অন্য লোকে ব্যবহার করেছে তার কাছে যেতে তোমার রুচি হবে?

কেন হবে না? অক্রূরদাস বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে বসন্তদাসের মুখপানে চায়। ক্রমে যেন বোঝে কথাটি। শেষে হা হা রবে হেসে ওঠে। বলে, তুমি হাসালে সখা, অন্যের উপগমনের চিহ্ন কি ঐ স্থানে খোদিত হয়ে থাকবে? বারেক ধৌত করে নিলেই হলো।

ঐ সময় একটি কোলাহল সৃষ্টি হয় স্থানটিতে। দেখা যায়, সশস্ত্র প্রহরীদের একটি ক্ষুদ্র দল সদর্পে অগ্রসর হচ্ছে কুটিরগুলির দিকে। বসন্তদাস অনুমান করে, একটি গোলযোগ আসন্ন। সে বিলম্ব না করে ঐ স্থান ত্যাগ করে।

পান্থশালার দ্বারদেশে উপবিষ্ট ছিলেন যবন বৃদ্ধটি। বসন্তকে দেখে বললেন, বস তুমি না বন্ধুর সঙ্গে আনন্দোপভোগের জন্য গেলে–তা এতো শীঘ্র ফিরলে যে? কি দেখলে, নাটগীত নাকি বাজিকরের খেলা?

বসন্তদাস সামান্য ইতস্তত করে। তারপর ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, না মহাশয়, ওসব নয়–আমরা বারাঙ্গনাদের পল্লীতে গিয়েছিলাম।

বৃদ্ধ অপ্রস্তুত হলেন। শেষে সহজ হওয়ার জন্য ঈষৎ হেসে বললেন, তাহলে শীঘ ফিরলে যে?

বসন্তদাস নিজেরই কাছে অপমানিত বোধ করছিলো ঐ সময়–ক্রোধ হচ্ছিলো তার। বৃদ্ধের কথা তার বিরক্তি উৎপাদন করলো। বললো, হ্যাঁ, শীঘ্রই ফিরলাম। সকলের রুচি কি একপ্রকার?

না, তা বলিনি আমি, বৃদ্ধ সহজ স্বরে বলেন–সে তুমি যা-ই বলো, কেউ তোমার কথা এখন বিশ্বাস করবে না!

মানুষের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য কি আমার কোনো প্রকার দায় আছে?

না, তা নেই, বৃদ্ধ স্বীকার করেন। বলেন, বরং তুমি চলে এসে উত্তম কাজই করেছো–ঐ অভ্যাস কুৎসিত, শাস্ত্রে বলে, অত্যধিক রমণীআসক্তি পুরুষকে দরিদ্র ও নির্বীর্য করে।

ঐ সময় একটি কোলাহল শোনা গেলো। স্থলিত কণ্ঠে চিৎকার এবং গালাগালি করতে করতে একদল লোক এদিকেই আসছে। নিকটে এলে দেখা গেলো, সকলেই পান্থশালাবাসী এবং বিভিন্ন শ্রেণীর বণিক। এরা সকলেই আনন্দ সম্ভোগের সন্ধানে সন্ধ্যাকালে পান্থশালা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলো।

একজন বললো, ওহে বালিকাটি বোধ হয় সত্যই সুভগা ছিলো।

অপরজন বললো, আর ঐ যুবতীটি! নিতম্ব দুটি যেন পূর্ণকুম্ভ।

অন্য আরেকজন জানতে চাইলো, ওহে এতো বাক্যব্যয় যে করছো, অগ্রে বলল, তোমরা ঐ বালিকা এবং যুবতীটিকে কি শয্যায় পেয়েছিলে?

না সখা, পাইনি, শূকরপুত্র সৈনিকেরা এমত তাড়না করলো যে আমাদের পলায়ন করে উপায় রইলো না–আহা, বালিকাটি এতো কোমল–যদি একবারের জন্যও পেতাম।

আরে মর্কট, অন্য আর একজন ধিক্কার দিয়ে উঠলো, ধিক তোকে যে, যুবা পুরুষ হয়েও বালিকা বালিকা করছিস। বালিকা রমণে আর এমন কি সুখ! পারঙ্গমা যুবতী রমণরণে স্বেদাক্ত হলে কেমন দেখায়, দেখেছিস কখনও?

ঐ সময় হঠাৎ এক ক্ষীণাঙ্গ প্রৌঢ় ছুটে এসে বৃদ্ধের পদপ্রান্তে উপবেশন করে। বলে, আপনিই বিচার করুন মহাশয়, রাজপ্রহরীরা কী মনে করে নিজেদের? রমণী সম্ভোগের অধিকার কেবল কি ওদেরই? আমাদের দেহে কি বস্তুটি নেই, আঁ? এ কি বিচার তাদের!

প্রত্যেকেই লম্পট এবং প্রত্যেকেই মাদক সেবন করে এসেছে। তাদের প্রমত্তাবস্থার ব্যবহার ন্যক্কারজনক–প্রত্যেকের মুখে দুর্গন্ধ। আর কথা কি তাদের! ঐ স্থানে তিষ্ঠানো দায়। দেখা গেলো বসন্তদাস নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। সে চিৎকার করে গালাগালি করতে লাগলো। বললো, তোমরা কৃমিকীট, বুঝেছো? মলভাণ্ডই তোমাদের যথার্থ স্থান–তোমাদের শাস্তির এখনই কি হয়েছে? অচিরেই তোমরা শিক্ষা পাবে, চোরের দল, লম্পটের দল কোথাকার।

কিন্তু ঐ ভর্ৎসনায় কী লাভ! সম্বিৎহীনদের কানে তো ঐ প্রকার ভর্ৎসনা পশে না। তাকে উত্তেজিত দেখে বৃদ্ধ হাত ধরে নিয়ে গেলেন অদূরে এক বৃক্ষতলে। বললেন, তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছে বৎস–এ–তো তোমার একার দায় নয়–তুমি একাকী উত্তেজিত হয়ে কোনো লাভ আছে, বলো?

বড় বিচিত্র তোমাদের এই দেশ, বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, এতো দস্যু এতো মাদকপায়ী এবং এমন বিশৃঙ্খল শাসন আমি আর কোথাও দেখিনি। এদেশের মানুষ যে কীভাবে জীবনযাপন করে, আমি ভেবে পাই না। বণিকবৃত্তি ধনাগমের প্রধান উৎস। কিন্তু দেখছি। এদেশে বণিকবৃত্তি অসম্ভব। সকল দেশে রাজপুরুষেরা বণিকদের রক্ষা করে–কিন্তু এদেশে দেখছি ভিন্ন রীতি, এখানে রাজপুরুষেরা পারলে বণিকের সমস্তই গ্রাস করে। এদিকে বণিকদের মধ্যেও দেখো, নিজ বৃত্তি রক্ষার কোনো চেষ্টা নেই। এই যে দেখছো ক্ষুদ্র বণিকদের, এদের কারও মধ্যে উচ্চাশা লক্ষ্য করেছো? অল্পেই এরা তুষ্ট। আর যেটুকু বা উপার্জন করে, তার প্রায় সমস্তটাই ব্যয় হয়ে যায় ব্যসনে। ঐ যে গন্ধ বণিকটিকে দেখলে, আসবপান ও গণিকালয়ের ব্যয় সংকুলানের পর তার আর কী অবশিষ্ট থাকবে, ভাবো তো?

এ আবার অধিক হয়ে যাচ্ছে, বসন্তদাসের মনে হলো। বিদেশী মানুষ তিনি, কেন এতো অধিক কথা বলবেন? সামান্য বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্বদান একেই বলে। সে বলে উঠলো, মহাশয় দেখছি ক্ষুদ্র বিষয়কে অহেতুক গুরুত্বদান করছেন, আপনার কথা মিথ্যা নয়–কিন্তু সংসারের তো এই–ই রূপ, সমস্ত কিছুই উত্তমানুত্তমে মিশ্রিত। রাজপুরুষের শাসনের মধ্যেও কি প্রকারভেদে পার্থক্য অধিক থাকে? পীড়ন ও যথেচ্ছাচারকেই তো শাসন বলা হয়, এর অন্যথা যদি কোথাও কিছু থাকে, তাহলে বলতে হবে সেটি ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমকে কি বিধান বলবেন? আজীবন আমরা এই–ই দেখে আসছি। আর বণিকেরা বিলাসব্যসন না করলে কে করবে বলুন? শুধু বণিক কেন, অর্থবান মানুষমাত্রই বিলাসব্যসন করে। দরিদ্রকে বিলাসী হতে দেখেছেন কখনও?

যবন বণিকটি মৃদু হাসেন বসন্তদাসের কথা শুনে। বলেন, তুমি আহত হবে জানলে কথাটি আমি ঐভাবে বলতাম না। বৎস, চিন্তা করে দেখো, কিরূপ বেদনার কথা। বঙ্গ ও বরেন্দ্রে বণিকবৃত্তিই ছিল প্রধান–এদেশের পণ্য এতো দূর দূর দেশে যেতো যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সমুদ্র পর্বত অতিক্রম করে দূরদূরান্তরে পণ্য বিক্রয় সহজ কথা নয়। অথচ সেই কাজটিই করতো এ দেশীয় বণিকেরা। এখন স্বর্ণরৌপ্য তোমরা দেখতে পাও না–কিন্তু এদেশে গৃহে গৃহে এতো স্বর্ণরৌপ্য ছিলো যে বলার কথা নয়।

বৃদ্ধ ভিন্ন দেশবাসী কিন্তু এদেশের কতো সংবাদ জানেন। বসন্তদাসকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। তার শোনা ছিলো, কয়েকশতাব্দ পূর্বে বঙ্গ বরেন্দ্রের সেনাবাহিনী দিগ্বিজয় সম্পন্ন করে অঙ্গ কলিঙ্গ মগধ মিথিলা বিদেহ কোশল ইত্যাদি কতো যে দেশ জয় করেছিলো তার নাকি ইয়ত্তা ছিলো না। সে বুঝতে ঐ সব অতীতের কল্পকথা ব্যতীত অন্য কিছুই। নয়। কিন্তু এখন, বৃদ্ধের কথা শোনার পর, মনে হচ্ছে, কে জানে, হয়তো ঐ দিগ্বিজয়ের ঘটনাটিও সত্য সত্যই ঘটেছিলো। তবে বৃদ্ধের সকল কথায় আর তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। এতো অকল্পনীয় ঘটনার কথা কি বিশ্বাস করা যায়?

সে জানতে চাইলো একদা, মহাশয় এতো কথা আপনি কোথায় জেনেছেন? আমি তো কখনও শুনিনি।

বৃদ্ধ বসন্তদাসের মুখপানে চেয়ে হাসেন। বলেন, বৎস, তোমরা নিজেকে জানো –আত্মবিস্মৃতির মতো পাপ আর নেই। এ সকল সংবাদ তুমি যেমন আমার কাছ থেকে জানছো, সেই রূপই আমি অন্যের কাছ থেকে জেনেছি। প্রয়াগের এক বৃদ্ধ বণিক তোমাদের এই সমৃদ্ধ দেশের কাহিনী আমাকে বলেছিলেন। তোমার সন্দেহ হলে কোনো জ্ঞানী পণ্ডিতের নিকট সন্ধান করে জেনে এসো, আমার কথা সত্য না মিথ্যা।

বসন্তদাস দুতিনটি দিন মাত্র বৃদ্ধের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে। কিন্তু ঐ দুতিন দিনেই বৃদ্ধ তার কাছে বহু কথা বলেছেন। পশ্চিম দেশে নাকি এক শ্রেণীর শস্ত্রধারী যবনের। আবির্ভাব হয়েছে যাদের নাম তুরুক। ঐ যবনেরা একের পর এক রাজ্য জয় করছে। তারা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনই নাকি বর্বর। ধ্বংস ও লুণ্ঠন ব্যতীত তারা অন্য কিছু বোঝে না। আবার এও এক অদ্ভুত কথা যে যবন বণিকদের ধর্ম ও তুরুকদের ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব নেই–বরং শত্রুতা ভাবই পোষণ করে গোপনে গোপনে এইরূপ নানান কথা বৃদ্ধের। তবে এই সকল কথার মধ্য দিয়ে বসন্তদাস একটি ভিন্নতর জগতের সন্ধান পাচ্ছিলো। যেমন, সমস্ত কিছুই ললাটলিপি নয়–রাজা রাজপুরুষ কেউ অজেয় নয়। রাজার বিরুদ্ধে প্রজা দ্রোহ উত্থাপন করতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সফলও হয়। আরও বুঝছিলো, ছুম্মার্গ একেবারেই অহেতুক। স্পর্শ মাত্রই খাদ্যবস্তু নষ্ট হয় না। যে মনে করে হয়, সে মূর্খ। চণ্ডাল ব্রাহ্মণভেদে জলের গুণাগুণের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না–জল জলই থাকে। কেবল দেবতা সম্পর্কিত বিষয়টি সে বোঝেনি। প্রকৃত কথা এই যে, মেলায় অবস্থান এবং যবন বণিকের সান্নিধ্য বসন্তদাসের মনের মধ্যে একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে দেয়। বস্তুর আপাত অবয়বের পশ্চাতেও যে অন্যকিছু থাকতে পারে, সে বিষয়ে সে এখন সজাগ ও সচেতন।

শঙ্খদত্তের আশা সে ত্যাগ করেছিলো। সুতরাং মেলায় অবস্থানের কোনো যুক্তিই তার ছিলো না। কেবলি মনে হচ্ছিলো, অহেতুক তার কালক্ষেপণ। অতঃপর সে গৃহে প্রত্যাগমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধান করে সে পূর্বগামী একদল বণিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। হ্যাঁ, তারা জানায়, শকটারোহণে বসন্তদাস স্বচ্ছন্দে তাদের সঙ্গে যেতে পারে।

সুতরাং বিলম্ব কেন, শিবনাম স্মরণ করে এবার যাত্রা করো, অক্রূরদাস পরামর্শ দেয়।

মেলায় সে তিনটি ক্ষুদ্র দ্রব্য ক্রয় করে। বলাবাহুল্য, সবই মায়াবতীর জন্য। একটি স্বর্ণাঙ্গুরীয়, যার পৃষ্ঠে তিনখানি ক্ষুদ্র বর্ণাঢ্য প্রস্তুরখণ্ড, দুটি রক্তবর্ণ চুনির মধ্যস্থলে একটি শুভ্র মুক্তাফল। দেখলে নয়ন জুড়ায়। তার দ্বিতীয় ক্রয়ের বস্তু একটি ক্ষুদ্র তৈলপাত্র। কাংস্যনির্মিত, কিন্তু এমনই উজ্জ্বল যে চক্ষু ধাধে–ভ্রম হয়, বুঝিবা স্বর্ণ। তবে পাত্রটির আকর্ষণ উজ্জ্বলতার কারণে নয়। তার আকর্ষণ বহিরঙ্গের খোদিত ফুল লতাপাতার কারণে। আর তৃতীয় বস্তুটি হলো গজদন্ত নির্মিত ক্ষুদ্র একটি সিন্দুর পাত্র। পাত্রটি এমনই হৃদয়গ্রাহী যে একবার দৃষ্টিপাত করলেই মনে হবে, আহা এমন আর হয় না।

সন্ধ্যাকালে মেলায় যখন ঐ দ্রব্যগুলি ক্রয়ে সে ব্যস্ত, ঐ সময় যবন বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি তরল পদার্থে পূর্ণ ক্ষুদ্র একটি পাত্র এনে দিলেন হাতে। পাত্রটির মুখ বন্ধ ছিলো। এবং আকারে সেটি অঙ্গুলি পরিমাণ হবে কি না সন্দেহ। পাত্রটি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের বাতাস সুগন্ধে এমন আমোদিত হয়ে উঠলো যে বলার কথা নয়। তরল পদার্থটি নাকি পুষ্পসব। তথ্যটি জানিয়ে বৃদ্ধ বললেন, বধূমাতাকে দিও এটি, শয়নকালে যেন বিন্দু পরিমাণ অঙ্গে লেপন করেন।

পদার্থটির নাম নাকি ইতর। হাস্যকর নাম বলতে হবে। বসন্তদাসের কৌতুক বোধ হয় নাম শুনে। বলে, এক দেশের বুলি তাহলে সত্যসত্যই অন্য দেশের গালি হয়ে থাকে।

বৃদ্ধের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা পূর্বেই হয়েছে। তথাপি ঐ স্নেহের দান গ্রহণ করে সে অভিভূত বোধ করে। বলে, মহাশয়, আমি আপনাকে বিনিময়ে কী দেবো বুঝতে পারছি না। বৃদ্ধ হাসেন। অতঃপর জানান, তোমার কিছু দেওয়ার প্রয়োজন নেই–তুমি এই বৃদ্ধকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তাতেই আমি অভিভূত–এদেশে এমন আত্মীয়জ্ঞান আমাকে কেউ করেনি।

বৃদ্ধ বিদায় নিলেন। বললেন, আমি কিঞ্চিৎ অসুস্থ বোধ করছি। প্রভাতে যদি নিদ্রিত থাকি, কিছু মনে করো না।

ইতস্তত ভ্রমণকালে অক্রূরদাসের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ।

সে কৌতুক স্বরে বললো, সখা বসন্ত, যাবে নাকি একবার, শেষবারের মতো?

বারাঙ্গনা পল্লীতে যাবার ইঙ্গিত। বসন্তদাস হাসে। বলে, না সখা, আমার সঞ্চয়ে অতো রস নেই যে যত্র তত্র ঢালবো, তুমি যাও।

সে আরও দ্রব্য ক্রয় করতে পারতো, কিন্তু করলো না। নিজের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে যা আছে। তা সে অন্যভাবে ব্যয় করতে চায়। অর্থোপার্জন যে কি বস্তু, সে তো তার দেখা হয়েছে। না, আর বাণিজ্য নয়। বন্ধু শঙ্খদাস তাকে যথোপযুক্ত শিক্ষাটি দিয়ে গেছে। ক্ষেত্রকরের পুত্র সে, তার ক্ষেত্রকর হওয়াই উচিত। গৃহে যদি স্বর্ণমুদ্রা কটি অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে, তাহলেই সে নিজেকে সৌভাগ্যবান বিবেচনা করবে। যা তার সঞ্চয়ে আছে, একজন ক্ষেত্রকরের কাছে তার মূল্য বিপুল। এই অর্থে সে দুই কূলব্যাপ পরিমাণ ভূমি ক্রয় অনায়াসে করতে পারে। ঐ পরিমাণ ভূমি ক্রয় কম কথা নয়। দুই না হোক, এক কূলব্যাপ ভূমি অবশ্যই ক্রয় করবে সে। সামন্তপতিরা কেউ না কেউ স্বর্ণের বিনিময়ে নিশ্চয়ই ভূমিদান করতে সম্মত হবে। অন্য কেউ না হোক, কুশলদত্ত তো নিশ্চয়ই হবে। কেননা তার অর্থাভাব সর্বক্ষণ থাকে। সুতরাং এখন থেকে বসন্তদাস ক্ষেত্রকরের পুত্র ক্ষেত্রকর। সে চিন্তা করে দেখেছে, এই ব্যবস্থাই উত্তম। দেশে দেশে ভ্রমণ–কিন্তু পরিণামে লাভ বন্ধুর প্রতারণা, দস্যুর আক্রমণ এবং রাজপুরুষদের তাড়না। কি প্রয়োজন ঐ বৃত্তির। ক্ষেত্ৰকৰ্মই তার জন্য উত্তম।

পরদিন প্রত্যুষে সে যাত্রার আয়োজন দেখতে গিয়েছিলো। সেখানেই গৃহগামী বণিকদের সঙ্গে আলাপে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়। পান্থশালায় যখন প্রত্যাগমন করছে তখন সূর্যোদয়ের পর দণ্ডাধিককাল অতিক্রান্তপ্রায়। ঐ সময় লক্ষ্য করে মেলার লোকেরা পলায়ন করছে। কি ব্যাপার! সে একজনকে ডাকলো। জানতে চাইলো, কিছু হয়েছে কি?

সর্বনাশ হয়েছে মহাশয়, প্রাণরক্ষা করতে চান তো পলায়ন করুন। বিসূচিকা, বিসূচিকা দেখা দিয়েছে।

বসন্তদাস ক্ষণেক দাঁড়ায়। সে জানে বিসূচিকা মারী রোগ। এবং মেলায় যদি ঐ রোগ দেখা দেয়, তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। সে পলায়নকারীদের ত্রস্ত ভঙ্গি ও মুখভাবে ভয়ানক আতঙ্ক দেখতে পায়। মনে মনে চিন্তা করে, তারও বিলম্ব করা উচিত। নয়।

কিছুদূর অগ্রসর হলে দেখে অক্রূরদাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। নিকটে এসে বলে, সখা বসন্ত, চললাম, যদি জীবিত থাকি দেখা হবে।

বসন্তদাস কঠিন মুষ্টিতে অক্রূরদাসের হাত ধরে। বলে, কি হয়েছে তোমার, উন্মাদের মতো আচরণ করছো কেন?

সখা, আমার, আমারও যেন বমন ভাব হচ্ছে, শেষে আমিও কি আক্রান্ত হলাম? হে ভগবান রক্ষা করো–আমি ছিলাম তার পার্শ্বের শয্যাটিতে। হায়, হায়, কেন যে পান্থশালায় স্লেচ্ছ যবনদের স্থান দেওয়া হয়।

ঐ কথা শোনার পর বসন্তদাস আর মুহূর্তেকও দাঁড়ায় না। তার অনুমান হয়, অন্য কেউ নয়, যবন বৃদ্ধটিই আক্রান্ত হয়েছেন। গত রাত্রে তিনি অসুস্থতার কথা বলেছিলেন।

পান্থশালায় এসে দেখে একটি লোকও নেই। প্রকোষ্ঠে বৃদ্ধ একাকী শয্যাশায়ী। একবার উঠতে চাইলেন, পারলেন না। চক্ষু দুটি কোটরাগত। সুন্দর গৌর মুখখানিতে পাণ্ডুর ছায়া। একটি দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসছিলো। লক্ষ্য করে দেখলো, বৃদ্ধের নিম্নাঙ্গের শয্যা সিক্ত। শয্যার দুপাশের ভূমিতে বমন চিহ্ন। বোঝা যায়, তাঁর দেহ এখন উত্থানশক্তিরহিত। সে কী করবে বোধগম্য হচ্ছিলো না। একবার ভাবলো, পলায়ন করে। কিন্তু ঐ সময়ই বৃদ্ধ হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন। বসন্তদাসের আর পশ্চাদপসরণ করা হলো না। নিকটে গেলে বৃদ্ধ বললেন, জল দিতে পারো? সে কলস থেকে জল এনে বৃদ্ধের মুখে ধরলো। জলপান করে বৃদ্ধ চক্ষু দুটি মুদিত করে বললেন–তুমি চলে যাও, আমার মৃত্যুর আর বিলম্ব নেই।

মাত্র ঐ কটি কথা উচ্চারণ করেন বৃদ্ধ। কিন্তু বসন্তদাসের মনে হয়, ঐ কথা কটি উচ্চারণ করে যেন জগৎ সংসারকে তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। কথা কটির মধ্যে দারুণ তাচ্ছিল্যের ভাব। যেন বলতে চাইলেন, তোমরা আমাকে ত্যাগ করলে, আমিও তোমাদের ত্যাগ করলাম। সে ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে, বসন্তদাস তুমি কি পলায়ন করবে? তৎক্ষণাৎ মনে হয়, পলায়ন করাই তার উচিত। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার মনে হয়, বৃদ্ধের শয্যাটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পুনরপি লক্ষ্য করে, তার পানের জন্য জলও আবশ্যক হবে। পলায়ন তো সে করতেই পারে। পদযুগল সচল করলেই হয়। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী লোকটির মুখে জল কে দেবে? ঐ নষ্ট শয্যাতেই বা তিনি কেমন করে থাকেন। সে বৃদ্ধকে তুলে পার্শ্ববর্তী শয্যায় নিয়ে গেলো। এবং পুনর্বার জিজ্ঞাসা করলো, জল পান করবেন? জল দেবো?

বৃদ্ধের সম্ভবত আর জ্ঞান ছিলো না। আল্লাহ আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করলেন কয়েকবার, নিজ ভাষায় কিছু যেন বললেন কাউকে। কিছুই বোধগম্য হয় না বসন্তদাসের। সে তখন পান্থশালার বাইরে আসে। মেলার লোক তখনও পলায়ন করছে। পলায়নপর একজনকে ডাকলে লোকটি কর্ণপাত করে না। সে ছুটে লোকটিকে ধরলো। জানতে চাইলো, একজন বৈদ্যের সন্ধান দিতে পারেন? লোকটি আর্তনাদ করতে লাগলো, ভ্রাতঃ আমাকে যেতে দিন–গৃহে আমার স্ত্রী-পুত্র আছে।

মুক্ত হয়ে লোকটি এমন গতিতে ধাবমান হলো যে মুহূর্তেক পরে আর তাকে দেখা গেলো না।

বসন্তদাসকে অবিলম্বে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে একজন বৈদ্য ডেকে আনতে হয়। বৈদ্য এসে দূর থেকে রোগীর অবস্থা দেখে আর অগ্রসর হন না। বলেন, ম্লেচ্ছ যবনদের চিকিৎসা আমি করি না।

বসন্তদাস তখন একপ্রকার মরিয়া। বৃদ্ধের স্কন্ধে হাত রেখে বলে, মহাশয়, আমি আপনার শমন, ঐ ম্লেচ্ছ যবনের সঙ্গে যদি একত্রে যমালয়ে গমনের বাসনা না থাকে, তাহলে রোগীর চিকিৎসা করুন।

বৈদ্যটি অম্বোষ্ট কায়স্থ, সম্ভবত তাঁর কৌলীন্যেরও দাবি আছে–অন্তত উপবীতটি দেখে তাই মনে হয়। উপবীত স্পর্শ করে তিনি বসন্তদাসকে যথেচ্ছ অভিসম্পাত দিলেন। তারপর রোগীকে পরীক্ষা করলেন। শেষে বললেন, এ রোগীর আশা নেই–পারলে প্রস্তর লবণের চূর্ণ মিশ্রিত করে জলপান করাও। অন্য কিছু করণীয় নেই।

বৈদ্যটি প্রস্থান করার সময় হস্ত প্রসারণ করতে ভুললেন না। একটি মুদ্রা হাতে পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বিদায় হলেন।

বৃদ্ধ পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন। প্রস্তর–লবণ তখন আর কোথায় সন্ধান করবে? পান্থশালার রন্ধনস্থলে কৃষ্ণ–লবণ ছিলো, তাই জলে মিশ্রিত করে বার দুই দেওয়া সম্ভব হলো। তারপরই বৃদ্ধের শেষ নিঃশ্বাসটি নির্গত হয়ে চলে গেলো।

শিয়রে তখন সে উপবিষ্ট। মৃত্যুকে এতো নিকট থেকে পূর্বে সে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। তার অদ্ভুত লাগছিলো। এই লোকটির সঙ্গে গত রাত্রেই না তার আলাপ হয়েছে। এরই দেওয়া পুষ্পসবের সুগন্ধ পাত্রটি এখনও না তার সঙ্গে। অথচ লোকটি জগৎ থেকে বিদায় হয়ে গেলেন। দূরদেশে স্ত্রী–সন্তান পরিবার অপেক্ষায় রয়েছে আর ইনি নির্বান্ধব অবস্থায়, প্রবাসে এক পান্থশালায়, শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করে বসলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ কেউ জানতেও পারলো না। সে বৃদ্ধের চক্ষু দুটি মুদিত করে দিলো। একখানি হাত শয্যার বাইরে ভূমিস্পর্শ করেছিলো। হাতখানি সে বক্ষোপরি স্থাপন করলো। তারপর বললো, মহাশয় বিদায়, এবার আমি যাই, পরকালে আপনার মঙ্গল হোক।

কুটির ত্যাগ করে সে অগ্রসর হলো। মন ভারাক্রান্ত। অনিত্য মানব জীবনের কথা বারংবার মনে উদিত হচ্ছে। এই জীবনের কি কোনো অর্থ আছে? জীবন যদি এই প্রকার অজ্ঞাতে, অগোচরে, মৃত্যুতে সমর্পিত হয়, তাহলে সংসার কেন? পুত্র কলত্রেরই বা কি। প্রয়োজন?

সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। মেলায় এখন জনপ্রাণী নেই। সামান্য পথ অতিক্রম করেছে, এমন সময় দেখলো, দুটি শ্মশান শৃগাল অগ্রসর হয়ে আসছে।

শৃগাল দুটি দেখে সে দাঁড়ায়। তার স্পষ্ট অনুমান হয়, বৃদ্ধের দেহ এখন শৃগাল দুটির উপাদেয় ভক্ষ্য হবে।

যবন বৃদ্ধের মৃতদেহের পরিণাম অনুমান করে সে আর পদক্ষেপণ করতে পারলো। সৌম্য সুন্দর মুখখানি, কোমল মমতাময় হাতের অঙ্গুলিগুলি, শ্বেত শুভ্র কেশভার– সমস্তই এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে শৃগাল দুটির দ্রংষ্ট্রাঘাতে। দৃশ্যটি কল্পনায় আসা মাত্র সে ফিরলো।

সে জানে না, যাবনী ধর্মে শেষকৃত্যের বিধান কী। শুনেছিলো যে যবনেরা মৃতের দাহ করে না, সমাধি দেয়। কিন্তু কি মন্ত্র, কোন দেবতাকেই বা আহ্বান করা হয়, কিছুই তার জানা নেই। কিন্তু হতোদ্যম হলো না সে। পান্থশালাতেই পাওয়া গেলো খনিত্র খানি। সে কালবিলম্ব না করে খনন আরম্ভ করে দিলো।

পিঙ্গল পশ্চিমাকাশে তখন বঙ্কিম চন্দ্রটি উদিত হয়েছে, পরিত্যক্ত জনহীন মেলায় একটি ভৌতিক ভাব, দূরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। সম্ভবত যজ্ঞানুষ্ঠান করে মারী–ভয় দূর করার চেষ্টা করছে পল্লীবাসীরা। দুটি কুকুরের ক্রন্দনধ্বনি শোনা গেলো অদূরে। বসন্তদাসের খনন যখন সমাপ্ত হলো তখন রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।

অতিশয় ক্লান্ত সে তখন। দেহ আর চলে না। পান্থশালা থেকে মৃতদেহটি বহন করে আনার সময় দুবার তার পদস্খলন হয়। তথাপি কাজটি করে সে। মৃতদেহটি সমাধিগর্ভে নিক্ষেপ করে দেখে, নিক্ষেপ যথাযথ হয়নি। ঊর্ধ্বাঙ্গ সমাধিগর্ভে গেলেও পদযুগল রয়েছে বাইরে। তখন আবার নামতে হয় সমাধিগর্ভে। দেহটিকে লম্বমান করে শায়িত করতে হয়। ঐ সময় সে আবিষ্কার করে বৃদ্ধের কটিবন্ধটি স্কুল এবং কঠিন, সম্ভবত সেখানে কোনো কঠিন বস্তু গ্রন্থিবদ্ধ। তখন সেটি সে মোচন করে নেয়। শেষে উঠে এসে মৃত্তিকা নিক্ষেপ করে পূর্ণ করে দেয় সমাধিগৰ্ভটি।

প্রক্রিয়াটি যেমন দীর্ঘ তেমনই কষ্টকর। সমাধি পার্শ্বের ভূমিতে সে কিছুক্ষণ লম্বমান হয়, এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে সে। তারপর বিদায়।

কতক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে জানে না। বোধ হয় তখন মধ্যরাত্রি। শীত বোধ হওয়াতে সে উঠলো। এবং তখনই দৃষ্টি পতিত হলো বৃদ্ধের স্কুল কটিবন্ধটির উপর। সেটির গ্রন্থিমোচন করার পর যা দেখলো তাতে তার চক্ষুস্থির।

একেবারেই অবিশ্বাস্য কাণ্ড। স্বর্ণমুদ্রাগুলি সে চেনে কিন্তু ক্ষুদ্র প্রস্তরবৎ বস্তুগুলি কী? একটি হাতে তুললে দেখলো তার মধ্য থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এগুলি হীরক? নাকি পদ্মরাগ? নাকি বৈদূর্য? সংখ্যায় সাতটি, কিন্তু কোনোটির পরিচয়ই সে জানে না। তার চিন্তা হলো, এখন সে কী করবে? এই স্বর্ণখণ্ড ও মণিমাণিক্যগুলি কি নিজে নেবে, না সমাধির কাছেই রেখে যাবে?

বিচিত্র এক মানসিক অবস্থা তখন তার। স্বাভাবিক চিন্তা করার অবস্থাটুকুও নেই। না হলে অমন মূল্যবান বস্তু সে সমাধি পার্শ্বে রেখে আসার চিন্তা করে? কি অদ্ভুত কাণ্ড, হঠাৎ সে বিপুল সম্পদের অধিকারী। হীরক মাণিক্যের মূল্য সে জানে না, কিন্তু দশখানি স্বর্ণখণ্ড? এক কূলব্যাপ ভূমির মূল্য তিন দীনার। তার অর্থ চারি কূলব্যাপ ভূমি সে ক্রয় করতে পারবে। কি ভয়াবহ কাণ্ড। হায়, হায়, মানুষ জানলে একেবারে নিশ্চিত মরণ। পিতা হেমন্তদাস জানলে তাকে গৃহ থেকে বিতাড়ন করবেন। যদি তা নাও করেন, ধনরত্নগুলি নিশ্চয়ই আত্রেয়ী জলে নিক্ষেপ করবেন। দস্যু হস্তে প্রাণ কে দিতে চায়?

একবার মনে হলো, সন্ধান করলে যবন বণিকের স্বদেশবাসী কাউকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে–আর তার হাতে স্থলীটি তুলে দিতে পারলেই সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। পরক্ষণেই তার ভিন্ন চিন্তা হয় আবার। যার হাতে সে স্থলীটি দেবে সে যদি যথাস্থানে সেটি না দেয়, তাহলে?

অর্থাৎ এই দশখানি স্বর্ণখণ্ড এবং মণিমাণিক্যগুলি তাকে নিতেই হচ্ছে–অন্য কোনো গত্যন্তর নেই।

০৩. বসন্তদাসের বাণিজ্য যাত্রার কাহিনী

বসন্তদাসের বাণিজ্য যাত্রার কাহিনী ঐ স্থানে অর্থাৎ দেবীকোটের পরিত্যক্ত ঐ মেলাতেই সমাপ্ত হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। তার গৃহের পথ তখনও বহুদূর। আরও বহুবিধ ঘটনা ঘটেছে পরবর্তী পর্যায়ে, যে ঘটনাগুলি বর্তমানের বসন্তদাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেগুলি আমরা পরে জানবো একে একে।

পুনর্ভবার পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতে সে অনুসন্ধান করতে করতে উত্তরে অগ্রসর হচ্ছিলো। তার অনুমান, পূর্বে বা দক্ষিণে প্রাণ ভয়ে ভীত পলায়নকারীরা যাবে না। শুকদেব যদি জীবিত থাকেন, তাহলে তিনি পশ্চিমে অথবা উত্তরেই এসেছেন। ইতোমধ্যে সে সংবাদ নিয়েছে যে মাতুল দীনদাসও গৃহে ফেরেননি। তাঁর এক ভাগিনেয় পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতে সন্ধান করতে এসেছিলো।

মদনপুরের দিকে সে অগ্রসর হচ্ছিলো। জানা ছিলো, শুকদেবের এক বন্ধু থাকেন ঐ গ্রামে–যাঁর কন্যার সঙ্গে মৃত চন্দ্ৰদাসের বিবাহের কথা স্থির হয়েছিলো। শুকদেব সম্ভবত বন্ধুগৃহেই আশ্রয় নিয়েছেন, এই প্রকার অনুমান করেছিলো সে। কিন্তু দেখলো, মদনপুরে শুকদেব আসেননি। বৃদ্ধ প্রফুল্ল দাস জানালেন, বৎস, আমিও তাদের সন্ধান করছি, কিন্তু এখনও সফল হইনি, মঙ্গলময় শিব জানেন, তাঁরা কোথায় আছেন। আমার সন্দেহ, তাঁরা কেউ পশ্চিম তীরে আসেননি। যদি জীবিত থাকেন, তাহলে পূর্বতীরেই কোনো গ্রামে তাঁরা রয়েছেন–তুমি বরং পূর্বতীরেই তাদের সন্ধান করো।

এ অঞ্চলে পথ এখন প্রায়শই নির্জন থাকে। বণিকদের গোশকটগুলিও আর চোখে পড়ে না। হাটগুলি বিষণ্ণ, সন্ত্রস্ত এবং ক্ষণস্থায়ী। মানুষ দিবাভাগেই গৃহে ফেরে। গ্রামে গেলে লোকেরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। লোকে সন্দেহ করে, সামন্তপতির কোনো গুপ্তচর এসেছে। একদিন একজন তো স্পষ্টতই বললো, মহাশয়, যদি যথোচিত পুরস্কার দান করেন, তাহলে আমি একটি সদ্ধর্মী ভিক্ষু দলের সন্ধান দিতে পারি।

সে লোকটিকে কী বলবে ভেবে পায় না। শেষে ভ্ৰম অপনোদনের জন্য বলে, মহাশয়, আমি গূঢ়-পুরুষ নই যে আপনাকে পুরস্কৃত করবো। তবে একটা কথা বলি, নিশ্চিত না হয়ে অপরিচিত লোকের কাছে এ প্রকার প্রস্তাব করবেন না, সে কোন পক্ষের লোক তার কি কোনো স্থিরতা আছে?

বলাবাহুল্য লোকটি প্রথমে হতাশ, পরে ভীত হয়ে প্রস্থান করে।

প্রফুল্লদাস তাঁকে জামাতা জ্ঞানেই সমাদর করলেন। তাঁর কন্যাটি এখনও সুস্থ হয়নি। তার শোনা ছিলো যে চন্দ্রদাস দস্যুহস্তে নিহত হওয়ার পর কন্যাটি উন্মাদিনীপ্রায় হয়ে রয়েছে। দেখলো, মধুমতী সম্মুখ দিয়ে গমনাগমন করছে কিন্তু তার যেন সম্বিত নেই। নারীসুলভ লজ্জার ভাবটি তার মুখে অনুপস্থিত। বিকার ঐটুকুই, না হলে সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক। উত্তম স্বাস্থ্য, গঠনটিও সুন্দর, তদুপরি মধুমতী রূপসীও। একবার সম্মুখে এসে বললো, আপনি বুঝি মেলায় যাবেন? সেখানে চন্দ্রদাস গেছে, বলবেন তো, যেন বিলম্ব না করে। আর স্মরণ করিয়ে দেবেন, আমার জন্য যেন একখানি মুক্তামালা অবশ্যই নিয়ে আসে।

প্রফুলদাস বললেন, বৎস, এই-ই আমার ললাটলিপি, এই উন্মাদিনীকে কে রক্ষা করবে? দুশ্চিন্তায় আমার নিদ্রা হয় না।

সকলের মনেই অদ্ভুত একটি আতঙ্ক। কখনও শঙ্কা, এই বুঝি যবন সেনাদল এলো–কখনও ভয়, আজ রাত্রে আর নিস্তার নেই, পূর্বতীরে সামন্তপতির লোকদের দেখা গেছে। কখনও আবার হতাশা, যদি যুগপৎ আক্রমণ হয়, তাহলে আমাদের তো পলায়নের পথ নেই।

কেউ কোনো কাজ করে না। গোচারণে রাখাল নেই, গোরুগুলি ইচ্ছামতো ক্ষেত্র নষ্ট করছে–কর্ষিত ভূমিতে বীজ ফেলে না কেউ–নতুন ধান্যক্ষেত্রে প্রচুর আগাছা, কেউ সেগুলি উৎপাটন করতে আসে না। চতুর্দিকে এমন একটি নিরুদ্যম হতাশ ভাব যে অধিকক্ষণ বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মন পীড়িত হয়ে ওঠে।

বসন্তদাস রাত্রিযাপন করে পরদিনই মদনপুর গ্রাম থেকে বিদায় নেয়। এখন ক্রমাগত উত্তরে চলেছে সে। তিন–চারখানি গ্রাম অতিক্রম করে সে এক হট্টকুটিরে তিনজন সদ্ধর্মী ভিক্ষুকে দেখতে পায়। তারা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অল্পক্ষণ পূর্বে ঐ স্থানে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমত তারা আলাপে একেবারেই অনাগ্রহ প্রকাশ করে। শেষে একজন বললো, মহাশয় আমরা সাধারণ ভিক্ষু, আপনি যা যা জানতে চাইছেন, সে সব সংবাদ আমরা কোথায় পাবো, বলুন?

তবে তারা একত্রে আহারের আয়োজন করে। এবং ঐটুকু অন্তরঙ্গতার সুযোগে বসন্তদাস নানান বিষয়ে কথা বলতে আরম্ভ করে। ফলে রাত্রি গম্ভীর হতে হতে পরস্পরের মধ্যে স্বচ্ছন্দ আলাপ আরম্ভ হয়ে যায়। ভিক্ষুরা নানান সংবাদ জানে। যেমন ভিক্ষু মিত্রানন্দকে এখন নিকটে কোথাও পাওয়া যাবে না, তিনি দূরের এক মহাবিহারে অবস্থান করছেন, তাঁর প্রত্যাবর্তনে বেশ বিলম্ব হবে।

তারা আরও সংবাদ জানায়। যবন সেনাদের একটি দল নাকি দক্ষিণ-পশ্চিমে মহানন্দার অপরপারে অবস্থান করছে। সম্ভবত রাজধানীতে কোনো ঘটনা ঘটবে, এবং সেটি ঘটলে, তারা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে পারে। তাদের কেউই বাধা দিচ্ছে না। রাজপুরুষেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। মন্ত্রী–মহামন্ত্রীরা পরস্পর কলহে লিপ্ত। বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। রাজপুরোহিত বিধান দিয়েছেন যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের। অলৌকিক শক্তিবলেই নাকি শত্রু দমন সম্ভব হবে।

পিপ্পলী হাটের সংবাদটিও তারা জানে, কিন্তু উজুবট গ্রামে কী ঘটেছে, তা তাদের জানা নেই। তবে তারা পথিমধ্যে দেখেছে, উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলিতে কিছু সংখ্যক লোক আশ্রয় নিয়ে আছে। এবং আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তাহলে কি আরও গ্রাম উপদ্রুত হয়েছে?

ঐ প্রশ্নে একজন হেসে ওঠে। বলে, মহাশয় দেখছি নিজ দেশের কোনো সংবাদই রাখেন না। কোন অঞ্চলটি অনুপদ্রুত বলতে পারেন? পূর্বে যান, দক্ষিণে যান, উত্তরে যান, সর্বত্র একই কাহিনী। সর্বত্রই ধর ধর রব, সর্বত্রই মার মার চিৎকার।

অপর ভিক্ষুটি সহাস্যে মন্তব্য করে, এ স্থানেও ঐ দৃশ্য অচিরেই দেখতে পাবেন চিন্তার কোনো কারণ নেই।

গভীর রাত্রি পর্যন্ত চললো আলাপ। মনে হয়েছিলো তারা সাধারণ ভিক্ষু। কিন্তু জানা গেলো, একজন উচ্চতর সম্মানের অধিকারী। তিনি পশ্চিমে যাচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছা, যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

কেন? বসন্তদাস জানতে চাইলো, আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে তাদের সঙ্গে প্রকৃত সম্প্রীতি সম্ভব? এবং তারা এলে এদেশবাসী উপকৃত হবে?

ঐ প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু ভ্রূকুঞ্চিত করলেন। ঈষৎ চিন্তা করলেন মনে হলো। শেষে বললেন, না মিত্র, তা নয়–যা আপনি ভাবছেন। লোকে সন্দেহ করে যে আমরা ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো যবনদের এদেশে ডেকে আনছি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। আমরা শুধু জানাবো, যে লোক ক্ষয় যেন না হয়। প্রকৃতিপুঞ্জ তো কোনো দোষ করেনি, তারা কেন নিপীড়িত হবে? বিশেষত সাধারণ মানুষ যখন রাজশক্তির সমর্থক নয়, তখন যবন সেনারা কেন তাদের হত্যা করবে?

বসন্তদাস ভিক্ষু তিনটিকে লক্ষ্য করে দেখলো। কেশশ্মশ্রুহীন গোলাকার শান্ত সৌম্য মুখ। কোনো প্রতিক্রিয়াই সে মুখে আভাসিত হয় না। তার দুর্বোধ্য লাগে। আবার কেমন সন্দেহও হয়, তবে কি মিত্রানন্দ আর তার সঙ্গীরা একরূপ চিন্তা করে এবং এরা অন্য চিন্তা করে? মিত্রানন্দের সঙ্গে এরা যে সম্পর্কবিহীন তা–ও নয়। যদি মিত্রানন্দের। সেই কথা সত্য হয় যে, যবনদের সঙ্গে সদ্ধর্মীদের কী সম্পর্ক হবে তা এখনও স্থির হয়নি, তাহলে এই ভিক্ষুরা কীভাবে যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়? সে জানতে চাইলো, সকল সদ্ধর্মীর সম্মতিক্রমে কি আপনি যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন?

এই প্রশ্নে তিনজনই গম্ভীর হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি বলেন, এতে সম্মতির কি প্রয়োজন? এতো সংঘের কাজ নয়, একেবারেই দৈনন্দিন ধর্মের কাজ। শুধু বলবো, জীবে দয়া করো এই কাজের জন্য কারও সম্মতি প্রয়োজন নেই।

বসন্তদাসের অনুমান হয় মিত্রানন্দের প্রচেষ্টা কোনো কাজেই আসেনি, তাদের সংঘ এখনও সংগঠিত নয়। কোনো কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নেই, ভিক্ষুরা স্বেচ্ছাচারীর মতো আচরণ করছে। সে কৌতূহল বশত পুনরশি জিজ্ঞাসা করে, মহাশয়, যবন সেনাপতির নিকট না গিয়ে ঐ একই আবেদন কি রাজ পুরুষদের কাছে করা যেতো না?

এবার বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি হাসেন। বলেন, না ভ্রাতঃ, তা করা যেতো না–প্রথমত আমাকে রাজার সমীপে যেতে দেওয়া হতো না। এবং দ্বিতীয়ত যদি কোনোক্রমে যেতামও, তাহলেও কেউ আমার আবেদন শুনতো না।

কেন, শুনতো না কেন? বসন্তদাস জানতে চাইলো।

মিত্র, আপনি দেখছি নিতান্তই বালসুলভ প্রশ্ন করছেন। জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু বললেন, চিন্তা করে দেখুন, আমার আবেদন ওঁরা কেন শুনবেন? তাতে কারও কোনো লাভ নেই। রাজসভার লোকেরা প্রায় প্রত্যেকেই সামন্ত মহাসামন্ত, নিজ শ্রেণীর বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কথা তারা রাজসভায় উত্থাপিত হতে দেবেন না, এ তো সহজ কথা।

রাজসভায় তো মহারাজও থাকেন, তিনিই তো সর্বেসর্বাবসন্তদাস স্মরণ করিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, মহারাজ অবশ্যই থাকেন। কিন্তু রাজার নিজস্ব শক্তি আর কতোটুকু–অশীতিপর বৃদ্ধ আমাদের রাজা। সামন্তপতিদের শক্তিতেই রাজার শক্তি। কেউ কি স্বেচ্ছায় নিজ হস্ত ছেদন করে, বলুন?

না, তা করে না, বসন্তদাস স্বীকার করে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা কি চিন্তা করে না মানুষ? সে জানতে চাইলো।

অবশ্যই করে, ভিক্ষুটি বললেন, কিন্তু সে তো সুস্থ মানুষ। দেহ মনে সুস্থ মানুষ অবশ্যই ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। কিন্তু তেমন সুস্থ মানুষ রাজসভায় আর কয়জন? রাজসভা অর্থ ও ক্ষমতার পীঠস্থান আর দুই–এরই প্রবণতা হচ্ছে কালক্রমে স্বয়ং–বিকৃত হওয়া। প্রায় দ্বিশতাধিক বর্ষের রাজসভা, মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালই প্রায় অশীতিবর্ষ। এমতাবস্থায় সভার প্রায় সকল লোকই যে বিকারগ্রস্ত হবে এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই। আর সেই বিকারগ্রস্তদের মানসচক্ষু কি স্বচ্ছ, বলুন? যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ কি তাদের পক্ষে সম্ভব? এরা অচিরেই ধ্বংস হবে দেখবেন। কেউ এদের রক্ষা করতে পারবে না।

যেন জটিল একটি বিতর্ক ক্রমেই প্রসারিত ও দীর্ঘ হয়ে চলেছে। বসন্তদাস বললো, শুনুন মহাশয়, আমি অতো কথা জানি না, মহারাজ লক্ষ্মণ সেন, তাঁর রাজসভা, কিংবা তার সামন্তবর্গ, এরা রক্ষা পাবে কি পাবে না, এ বিষয়ে আমার সামান্যতম শিরোবেদনা নেই। জানি, স্বকৃত পাপই এদের ধ্বংস করবে। আমার চিন্তার বিষয় বহিরাগত যবনেরা। এরা একেবারেই বহির্দেশীয় এবং ধর্মে ভিন্ন, আচারে ভিন্ন, ভাষায় ভিন্ন–এরা যে কী করবে, কেউ জানে না।

ভিক্ষুরা বসন্তদাসের কথা শুনে অনেকক্ষণ নীরব রইলো। শেষে জ্যেষ্ঠভিক্ষু বললেন, আপনার কথাটি আমাদের মনে থাকবে–ভিক্ষু মিত্রানন্দের মুখেও আমরা এইরূপ কথা শুনেছি–দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়–তথাগতের কী ইচ্ছা।

রাত্রি শেষে প্রত্যুষকালে ভিক্ষুরা প্রস্থান করলে বসন্তদাসও নদী অতিক্রমের আশায় পূর্বাভিমুখে যাত্রা করে।

 ০৪. নদী এ স্থানে অগভীর

নদী এ স্থানে অগভীর। উজুবট থেকে স্থানটি ক্রোশ চারেক উত্তরে। নদীবক্ষে স্থানে স্থানে বালুকাস্তূপ। নৌকাটি পরপারে উপনীত হতে সময় নেয়। নৌকার অন্যান্য আরোহীদের আলাপ শ্রবণে অনুমান হয় নদীর পূর্বতীরে গোহালিহাট, বিল্বগ্রাম, সুনন্দপুর ইত্যাদি গ্রাম জনপদগুলি পরস্পর নিকটবর্তী। পরপারের কদম্বঘাট থেকে ঐ সকল গ্রামের দিকে যাওয়ার সুব্যবস্থাও নাকি আছে। প্রায় প্রতিদিনই দুএকখানি গো অথবা মহিষ শকট ঐ সকল গ্রামে যায়।

বসন্তদাসের গন্তব্য স্থির নয়। নদীতীরে সংবাদাদি নিয়ে তবে নিজ গন্তব্য স্থির করতে হবে।

নৌযানটি যখন তীরবর্তী হলো তখন সকাল। সবে সূর্যোদয় হয়েছে। নদীবক্ষে বীচিমালার শীর্ষে শীর্ষে নবীন সূর্যালোক এমত ঝলকিত হচ্ছে যে সেদিকে দৃষ্টি রাখা যায় না। রাখলে নয়ন ধাঁধে। নদীজলে কয়েকজন স্নানার্থী ছিলো, তাদের একজন সূর্যস্তর সমাপন করে একজন নৌকারোহীকে ডেকে বললো, ওহে পীতাম্বর, তুমি এতো বিলম্ব করলে কেন, তোমার শ্যলিকাটির অবস্থা ওদিকে এখন–তখন, শীঘ গৃহে যাও।

পীতাম্বর কিছু বলে না, সে অধোমুখে থাকে। তার বন্ধুটি মৃদু ভৎর্সনা করে বলে, এ তোমার উচিত হয়নি, ছি ছি!

তারা আরও কিছু বলাবলি করে, কিন্তু সেদিকে মনোযোগী হবার আর অবকাশ ছিলো না। কারণ নৌকাটি ঐ মুহূর্তেই ভূমিস্পর্শ করেছে। বসন্তদাস পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিটির কাছে জানতে চাইলো, বিল্বগ্রামের পথ কোনদিকে, বলবেন?

আহা দণ্ডকাল পূর্বে এলে তো শকটারোহণে যেতে পারতেন, লোকটি জানায়। বলে, পথ খুবই সহজ, এই পথই গোহালিহাট হয়ে বিশ্বগ্রামে গেছে।

মহাশয়, মনে হচ্ছে, নতুন এসেছেন এদিকে?

লোকটির কৌতূহল নিবৃত্ত করে বসন্তদাস। বলে, হ্যাঁ, নতুনই বলতে পারেন।

ক্ষণকাল পরে ঐ লোকটির কাছেই সে জানতে চাইলো, এখানে পান্থশালা নেই?

আজ্ঞে না, পান্থশালা নেই, তবে ঐ যে মন্দির দেখতে পাচ্ছেন, লোকটি হাত তুলে দেখায়, ওখানে যান, দূরের যাত্রীরা ওখানেই রাত্রিযাপন করে।

মন্দিরে তখন ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিলো। সেখানে জনসমাগমও হয়েছে দেখলো। সে মন্দিরের দিকেই অগ্রসর হলো।

একেবারে নিকটে নয় মন্দিরটি। পদব্রজে যেতে সময় লাগে। যখন উপস্থিত হলো, তখন আরতি চলছে। ভক্তরা চত্বরে যুক্ত করে দাঁড়িয়ে।

সেও দুই কর যুক্ত করে প্রথমে বিগ্রহের উদ্দেশে প্রণাম জানালো, তারপর অন্যদের মতো করযুগল যুক্ত করে দাঁড়ালো। সংক্ষিপ্ত আরতি, অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রসাদ বিতরণ আরম্ভ হয়ে যায়। তাতে বালক-বালিকারা প্রসাদ সংগ্রহের জন্য হয়ে ওঠে তৎপর। ফলে চাঞ্চল্য জাগে ক্ষণেকের জন্য।

প্রসাদ বিতরণ করছিলো একজন তরুণ এবং একজন যুবতী। তারা সম্ভবত মন্দিরের সেবক এবং সেবিকা। সেবিকাটি অপরূপ সুন্দরী। মস্তকোপরি অবগুণ্ঠন ছিলো, তথাপি উত্তোলিত হাত দুখানি ব্যস্ত থাকায় প্রভাতকালের বায়ুতাড়না তাকে বিস্ৰস্তবাসা করে দিলো। এবং ঐ মুহূর্তটিতে যা দৃষ্টিগোচর হলো তা যে কোনো পুরুষ মানুষকে আমূল চঞ্চল করে দেবার জন্য যথেষ্ট। বলাবাহুল্য, এমন রূপ–যৌবন কদাচিৎ দেখা যায়। কৃষ্ণার কথা মনে পড়ে গেলো বসন্তদাসের। ক্ষুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে দুই পা পশ্চাতে ফিরলো। এবং ক্ষুদ্র জনসমাবেশটি থেকে কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়ালো।

ভক্ত এবং প্রসাদ প্রার্থীরা একে একে সকলেই বিদায় হলো। বসন্তদাস দুএকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তারা কেউ-ই তার প্রতি মনোযোগী হয়নি। মন্দিরের সেবিকাটি সম্ভবত বসন্তদাসকে দেখে থাকবে। সে মন্দিরের দ্বারান্তরাল থেকে মন্দিরসেবক বালকটিকে ডেকে বললো, দেখো তো অংশুমান, লোকটি কি চায়?

মন্দিরটি সূর্যদেবতার। বিগ্রহটি ক্ষুদ্র কিন্তু ধাতু নির্মিত, প্রদীপের আলোকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। তরুণটি নিকটে এলে বসন্তদাস পুরোহিতের সন্ধান করলো। তাতে জানলো, পুরোহিত মন্দিরে থাকেন না, পূজা শেষে স্বগৃহে গমন করেন। স্বল্প পূর্বে যে বৃদ্ধটি চলে গেলেন, বসন্তদাস বুঝলো, তিনিই পুরোহিত। সন্ধ্যাকালে পুনরায় আসবেন। তখন সাক্ষাৎ হতে পারে।

মন্দিরের সেবিকা তখনও দ্বারান্তরালে এবং কৌতূহলী। অনুচ্চ কণ্ঠে জানতে চাইলো, আপনার কি বিশেষ প্রয়োজন? বৃদ্ধ মানুষ, সন্ধ্যাকালে নাও আসতে পারেন, তাহলে আপনাকে তাঁর গৃহে যেতে হবে।

বসন্তদাস চারিদিকে দৃষ্টিপাত করছিলো। এদেশে সূর্যদেবতার পূজা হয় জানে, কিন্তু মন্দির এই প্রথম দেখলো। এতদঞ্চলে সম্ভবত এই একটিই মন্দির। প্রাচীনতার চিহ্ন মন্দির গাত্রের প্রায় সর্বত্রই প্রকট। এইরূপ প্রায় অযত্নরক্ষিত মন্দিরেও সেবাদাসী রয়েছে দেখে সে অবাক হচ্ছিলো। দাসীটি সপ্রতিভ ভঙ্গীতে তখনও দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বসন্তদাস জানালো, ভদ্রে, আমি কতিপয় আত্মীয়ের সন্ধান করছি, তারা একটি যবন উপদ্রুত গ্রাম থেকে পলায়ন করে এসেছেন–এই গ্রাম বা নিকটবর্তী কোনো গ্রামে, ঐ প্রকার পলায়নপর লোকেদের আগমনের সংবাদ কি আপনার জানা আছে?

দাসীটি দ্বারান্তরাল থেকে এবার বাইরে এলো। বললো, না জানা নেই তেমন লোকের সংবাদ–কিন্তু যবনরা কি সত্যই গ্রাম লুণ্ঠন আরম্ভ করে দিয়েছে?

মনে হলো, সেবিকাটি একেবারে অন্তঃপুরবাসিনী নয়। জগৎ সংসারের বহুবিধ বিষয় তার জানা। সে বললো, আপনি বরং মন্দিরের ভিতরে এসে কথা বলুন। মন্দির বলেই ভাববেন না যে এ স্থান নিরাপদ। এ স্থানেও গূঢ়পুরুষদের দৃষ্টি আছে।

কি অদ্ভুত কথা। সে বিস্ময় মানে, এই দেবমন্দিরের উপরও কেন দৃষ্টি রাখবে গূঢ়পুরুষেরা!

যুবতীটির মুখপানে দৃষ্টিপাত করা যায় না। বসন্তদাসের দৃষ্টি বার বার নত হয়ে আসছিলো। দৃষ্টি যে লগ্ন হয়ে থাকতে চায় ওষ্ঠদ্বয়ে, গ্রীবাদেশে, বক্ষে। এ তো বড় যন্ত্রণা। কৃষ্ণাকে দেখে তো এমন মনে হয়নি। সে নিদারুণ ব্ৰিত বোধ করে। সেবিকাটি তখনও বলছিলো, ক্রোশ দুই দূরে বিল্বগ্রাম। সেখানে সামন্ত সুধীমিত্র একটি বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করছেন। তার ধারণা, ঐ মন্দিরই হবে এতদঞ্চলের ধর্মীয় পীঠস্থান। তিনি মনে করেন, আমরা সূর্যোপাসকরা অন্তরে সদ্ধর্মী–সূর্যদেবতার পূজা করলেও। এবং এই মন্দির নাকি সদ্ধর্মীদের মিলিত হবার গোপন স্থান। এই সন্দেহের কথাটি তিনি প্রচারও করছেন।

মন্দিরদাসী আরও সংবাদ জানে। বললো, কেবল আপনাদের গ্রামেই নয়–আরও কয়েকটি গ্রামে ঐ প্রকার কাণ্ড ঘটেছে।

পূর্বে প্রতি পক্ষকালে দু’দশজন ভিক্ষু এসে এই মন্দিরে রাত্রিযাপন করতো, এখন তারা কেউ আসে না। পক্ষকাল পূর্বে এক যোগীর সঙ্গে দুটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক এই মন্দিরে রাত্রিযাপন করে গেছে–পরিচয় জানায়নি। তবে আমার সন্দেহ, তারা কোনো আক্রান্ত গ্রামের লোক।

দীর্ঘ আলাপ, বসন্তদাস ক্রমে সহজ হয়ে উঠলো। কথা বললো নানান প্রসঙ্গে। শেষে উঠলো, আমি এবার যাই।

সে কি, কোথায় যাবেন? দ্বিপ্রহরের তো বিলম্ব নেই, মন্দিরের প্রসাদ আছে, আহারাদি সম্পন্ন এখানেই করুন।

বসন্তদাস রীতিমতো সঙ্কোচ বোধ করে। এতো অল্প সময়ের পরিচয়–এই পরিচয়ে কি আতিথ্য গ্রহণ করা উচিত? সে সবিনয়ে মস্তক আনত করে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছিলো। ঐ সময় যেন নারী কন্ঠে আদেশ শুনলো। হ্যাঁ আদেশই বলতে হবে। দ্বারে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে রমণীটি। বলছে, আপনি মন্দিরে প্রবেশ করে দেবতাকে অপমান করতে চান?

অপমান! কী বলে এই উন্মাদিনী? সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চায়।

নিশ্চয়ই অপমান! মন্দিরদাসীর কণ্ঠে যেন ক্রোধ শাণিত হয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ স্বরে সে বলে, পূজার প্রসাদ প্রত্যাখ্যান কি দেবতার অপমান নয়?

বসন্তদাস অনুধাবন করার চেষ্টা করে, সত্যই কি তার আচরণে কোনো অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে? মন্দিরদাসীর মুখপানে দৃষ্টি তোলে সে এবং বিভ্রান্ত বোধ করে। কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেলেও রমণীর চক্ষু দুটিতে ক্রোধ কোথায়? বরং দেখতে পায় সেখানে কৌতুকের অস্পষ্ট একটি আভা কম্পমান।

যাক, তবে এ কৌতুক, অন্য কিছু নয়–স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বসন্তদাস। তার ভয় হচ্ছিলো। না জানি কী করে বসে রহস্যময়ী এই মন্দিরদাসী। সে কৃতাঞ্জলি হয়ে বিনয়সহকারে জানালো, উত্তম কথা ভদ্রে, আমি আপনার কথামতোই কাজ করবো।

এখানেই আপনি বিশ্রাম নিন। আদেশটি উচ্চারণ করে রমণীটি তৎক্ষণাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দ্বার পথে অন্তর্হিত হয়।

মন্দিরের গর্ভগৃহটি অন্ধকার। সেখানে দিবানিশি প্রদীপ জ্বলে, কিন্তু বাহিরের অংশে প্রদীপের প্রয়োজন হয় না। মন্দিরচূড়ার গঠন কৌশলে সম্ভবত কোনো ব্যবস্থা করা আছে যাতে বাইরের আলোক মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। বসন্তদাস একটি স্তম্ভে পৃষ্ঠদেশ এলায়িত করে বসে ছিলো। ঐ সময় মন্দির গাত্রের একটি চিত্রণ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের ধাতুমূর্তিটির গঠন কিরূপ তা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে অনুমান, সপ্তাশ্ববাহী রথে আকাশমণ্ডল পরিক্রমণরত সূর্যদেবের মূর্তিটিই এই মন্দিরের বিগ্রহ। কিন্তু মন্দির গাত্রে এ কিরূপ অলংকরণ? তার বিস্ময় জাগে। একদিকে একটি বৃক্ষ অপরদিকে সকিরণ সূর্য, সেই সঙ্গে একটি সর্প বৃক্ষের কাণ্ডটি বেষ্টন করে আছে। বৃক্ষ, সূর্য এবং সর্পের এমন একত্র যোজনা তো সে পূর্বে কোথাও দেখেনি! সে মন্দির গাত্রে হাত রাখে–অসম্ভব শীতল বোধ হয়। তার মনে হয়, কাল যেন সংহত শিলীভূত ও স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে এই স্থানে। তার স্মরণ হয়, বালিগ্রামের অবলোকিতেশ্বর মন্দিরটির গাত্রেও এইরূপই শীতলতা অনুভব করেছিলো সে।

অংশুমান নিকটে এলে সে জিজ্ঞাসা করে, ভ্রাতঃ, মন্দির গাত্রে এ কিরূপ চিত্ৰণ? এমন চিত্ৰণ তো আমি অন্য কোথাও দেখিনি।

অংশুমান চিত্রণের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে, মহাশয়, এর ব্যাখ্যা আমরাও জানি না। তবে পুরোহিত বলেন যে, বহু প্রাচীনকালে সূর্যদেব এইরূপেই পূজিত হতেন–আমি শুধু এইটুকু জানি যে, এই মন্দির বহু প্রাচীন–এর অধিক আমি আর কিছু বলতে পারবো না।

মন্দিরদাসী কখনও সম্মুখে আসছিলো, কখনও অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো না যে বসন্তদাসের উপস্থিতি সম্পর্কে সে সচেতন। মন্দিরপ্রাঙ্গণে ইতোমধ্যে কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠের আলাপ শুনতে পেয়েছে সে। একবার মনে হচ্ছিলো, মন্দিরদাসী যেন কাউকে তিরস্কার করছে। কাদের সঙ্গে ঐ বাদানুবাদ সে কিছু অনুমান করতে পারেনি। সে কৌতূহলী মনকে শাসন করেছে। নিজেকেই ডেকে বলেছে, ওহে বসন্তদাস, অধিক কৌতূহলী হয়ো না, নিজের চক্রে অগ্রে তৈলদান করো, পরে অন্যের কথা চিন্তা করতে যেও।

বাহিরে রৌদ্রদগ্ধ প্রাঙ্গণে বৃক্ষছায়া কাণ্ডের নিকটবর্তী হয়ে আসছিলো। বোঝা যাচ্ছিলো দ্বিপ্রহরের আর বিলম্ব নেই। বাহিরে যে বাদানুবাদ শোনা যাচ্ছিলো, এখন আর তা নেই। বসন্তদাসের চিন্তা হচ্ছিলো, অতঃপর মন্দির ত্যাগ করে কোন পথে গমন তার কর্তব্য? সে কি বিল্বগ্রামের দিকে যাবে, নাকি যাবে সুনন্দপুরের দিকে? একটি সূত্র তার। জানা প্রয়োজন। মন্দিরদাসীর কাছ থেকে শোনা সংবাদটি তাকে আশান্বিত করে তুলেছে। পক্ষকাল পূর্বে এ মন্দিরে এক যোগী পুরুষের সঙ্গে যে রমণী ও পুরুষ দুটি এসেছিলো, তারা যদি কোনো আক্রান্ত গ্রাম থেকে পলায়ন করে থাকে, তাহলে ওদের পক্ষেই শুকদেব ও মায়াবতীদের সংবাদ জানা সম্ভব। তার ধারণা, এই অঞ্চলেই কোথাও শুকদেব ও মায়াবতীরা আছে।

ঐ সময় মন্দিরের দাসী ক্ষণে ক্ষণে চত্বরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো এবং আসছিলো। কেন, সেই জানে। তবে চক্ষুতে চক্ষুতে মিলন হলেই অতীব রহস্যময় হাসি ফুটছিলো তার ওষ্ঠপ্রান্তে।

বসন্তদাসের মনে হচ্ছিলো, বালিগ্রামের কৃষ্ণার চাইতেও অধিক রহস্যময়ী এই মন্দিরসেবিকাটি। কেন যে সে এভাবে তাকে আতিথ্য গ্রহণে বাধ্য করলো, তার ধারণায় আসে না। তবে হ্যাঁ, একটি বিষয়ে সে নিশ্চিত, তীব্র আকর্ষণ এই রূপসী নারীর। যদি সে প্রগলভা হয়ে বারেক আহ্বান করে, তাহলে যে কী হবে, সে চিন্তা করতে পারে না। কারণ পুরুষের সংযমী থাকার ক্ষমতা কতটুকু সে তো তার উত্তম রূপে জানা।

মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে ক্ষুদ্র চত্বরটিতে আসন দেওয়া হয়। প্রসাদে উপচার ছিলো বহুবিধ। তবে কিছু মিষ্টান্ন এবং কয়েকটি ফল মাত্র গ্রহণ করে সে। দুগ্ধ ক্ষীরাদি স্পর্শ করে না।

মন্দিরদাসী দ্বারদেশে উপস্থিত ছিলো। বললো, আপনি বোধ হয় এরূপ আহারে অভ্যস্ত নন।

কি যে বলেন, এ তো রাজভোগেরও অধিক, বসন্ত নতমুখে জানায়।

এ আপনার বিনয় ভাষণ।

কেন, বিনয় ভাষণ কেন হবে! বসন্ত রমণীর মুখপানে সপ্রশ্ন দৃষ্টি তোলে।

গৃহী মানুষের রুচি কিরূপ তা আমি জানি–মনে রাখবেন, এ মন্দিরে যারা প্রতিদিন আসে, তারা প্রত্যেকেই গৃহী।

হতে পারে, বসন্তদাস জানায়। কিন্তু এখন তো আমি গৃহে নেই, পথে পথে দিনযাপন করি। আজ আমার পরম সৌভাগ্য যে দেবতার প্রসাদ পেলাম–কাল যে কী পাবো, তার কি নিশ্চয়তা আছে কিছু, বলুন? এ মন্দিরে কি কাল আমার অবস্থান সম্ভব হবে?

মন্দিরদাসী ঐ কথায় গম্ভীর হয়। কিছু বলে না, দূর আকাশে তার দৃষ্টি প্রসারিত থাকে। ক্ষণকাল পরে সে ধীর কণ্ঠে বলে, ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্য জানেন–বড় অনিশ্চিত আমাদের বর্তমান, আজো সামন্তপতির দুই অনুচর এসেছিলো মন্দিরে।

কেন, এখানে ওরা কী চায়? বসন্তদাস প্রশ্ন না করে পারে না।

কেন, জানেন না? মন্দিরদাসীর ওষ্ঠ প্রান্তে ঐ মুহূর্তে ক্ষীণ একটি শ্লেষের রেখা দেখা যায়। বলে, ওরা সদ্ধর্মীদের চায়, নাথযোগীদের চায়, সূর্যোপাসকদের চায়–প্রত্যেককেই ওদের সন্দেহ।

বসন্তদাসের মস্তিষ্কে হঠাৎ একটি নতুন চিন্তার উদয় হয়। সে বলে, মন্দির প্রাচীন হলেই ওদের সন্দেহ হয়–কেন, বলতে পারেন?

মন্দিরদাসীর মুখে পুনরায় ক্ষীণ হাসির রেখাটি দেখা যায়। বলে, জানি না, হয়তো প্রাকৃতজন ওদের ভয়ের কারণ–প্রাচীন মন্দিরগুলিই তো প্রাকৃতজনের সঙ্গে যুক্ত, বিষ্ণুমন্দির তো সেদিনকার ঘটনা–বৈষ্ণব আর কয়জন?

ব্যাখ্যাটি একেবারে অযৌক্তিক মনে হয় না। নতুবা প্রাচীন মন্দিরগুলিকে কেন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে? দেবীকোটের বজ্রতারা মন্দির, বালিগ্রামের অবলোকিতেশ্বর মন্দির, এবং কদম্বঘাটের এই সূর্যদেবতার মন্দির–এই তিনটি মন্দিরই প্রাচীন এবং এই প্রাচীন মন্দিরগুলিই একেকটি গোপন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র–অন্তত সামন্তপতি এবং রাজপুরুষেরা এইরূপই প্রচার করছে। এখন বোঝা যায়, কেবল সদ্ধর্মীরাই তাদের সন্দেহের পাত্র নয়। তারা সূর্যোপাসকদের সন্দেহ করছে, নাথযোগীদের সন্দেহ করছে, ব্রাত্যশ্রেণীর ডোম চণ্ডালদের সন্দেহ করছে–সন্দেহের আর শেষে নেই।

একটা কথা চিন্তা করেছেন? আচমন শেষে বসন্তদাস বলে।

কী কথা? মন্দিরদাসী সাগ্রহে অতিথির মুখপানে চায়।

যাদের ওরা সন্দেহ করে, সেই সন্দেহের পাত্ররা সকলে যদি একত্রিত হয়? যদি কোনো কারণে নির্যাতিত মানুষের অপমান–জ্বালা–বেদনা–হাহাকার–ক্রোধ–হিংস্রতা সমস্তই একত্রিত হয়ে বিস্ফোরিত হয়? তাহলে সামন্ত মহাসামন্ত রাজপুরুষদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

চুপ, বলবেন না–আর বলবেন না।

বসন্তদাস দেখে মন্দিরদাসীর মুখভাবে শঙ্কা ও ত্রাসের ছায়া। সে প্রায় গোপন স্বরে জানায়, সাবধান, অমন কথা ভ্রান্তিবশতও মুখে আনবেন না।

বিদায়কালে মন্দিরদাসী বললো, আপনার পরিচয় কিন্তু জানা হলো না।

তার কি আর প্রয়োজন আছে? বসন্তদাস হাসে।

ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? মন্দিরদাসীর মুখভাবে বিষাদের ছায়া নামে। বলে, যে দুষ্কালের মধ্যে আমরা পতিত হয়েছি, তাতে কিছুই বলা যায় না–এই হীনা মন্দিরদাসীরও আপনাকে প্রয়োজন হতে পারে–অবশ্য নিজ পরিচয় যদি আপনি গোপন রাখতে চান, তাহলে ভিন্ন কথা–

ঐ উক্তির পর নিজের পরিচয়দানে কুণ্ঠাবোধ থাকার কথা নয়। বসন্তদাসেরও রইলো না। সে জানালো, অধমের নাম বসন্তদাস, নিবাস আত্রেয়ী–তীরের আম্রপট্টলী– রজতপট অঞ্চলে, পিতা ক্ষেত্রকর্ম করেন, তাঁর নাম–

থাক হয়েছে, মন্দিরদাসী ছায়ার জন্য ঐটুকুই যথেষ্ট।

বসন্তদাস রমণীটির বাকপটুতায় চমকিত হয়। নাম জানতে পেরে সে ঈষৎ হাসেও। বলে, আপনি তাহলে ছায়া–কিন্তু কিসের ছায়া?

কেন, ছায়ার বঙ্কিম ভ্রূধনুতে চকিতে শর যোজিত হয়। বলে, সূর্যের ছায়া, সূর্যদেব ব্যতীত ছায়া সৃষ্টি আর কে করতে পারে, বলুন?

ছায়ার হাসি শতধারে বিচ্ছুরিত হয় ঐ কথার পর। কিন্তু বসন্তদাস হাসিতে যোগ দিতে পারে না। এ কি কৌতুক? তার মনে প্রশ্ন জাগে। প্রত্যয় হতে চায় না যে ঐ ভ্রূভঙ্গী, ঐ হাস্যধারা, ঐ ভাষা, নিতান্তই কৌতুক সৃষ্টির কারণে।

অবশেষে ছায়া জানায়, আপনি যদি এ অঞ্চলে দিবস দুই অপেক্ষা করতে পারেন, তাহলে আশা করি, কোনো না কোনো সংবাদ অবশ্যই জানাতে পারবো।

আর হ্যাঁ, ছায়ার চক্ষু দুটিতে পুনরায় বিদ্যুৎ চমকিত হয়। বলে, আপনার রাত্রিযাপনের সমস্যা হলে স্মরণ রাখবেন, এ মন্দিরের দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।

এ কি আমন্ত্রণ! বসন্তদাসের বিশ্বাস হতে চায় না। মন্দিরদাসীরা কি সর্বত্রই তাকে কণ্ঠলগ্ন করার জন্য উদ্বাহু হয়ে আছে? এ কি সম্ভব? সে মনের গোপনে একটি মধুর বিভ্রান্তি নিয়ে মন্দির ত্যাগ করে।

০৫. প্রথমে বনভূমি, তারপর বিস্তীর্ণ জলাশয়

প্রথমে বনভূমি, তারপর বিস্তীর্ণ জলাশয়, তারই পাশে নতুন গ্রাম নবপাটক। এই গ্রামে লীলাবতীরা আশ্রয় নিয়েছে–এখানে নিয়ে এসেছেন মাতুল সিদ্ধপা। মধ্যপথে তারা অবস্থান করেছিলো বিল্বগ্রামে। উজুবট থেকে পলায়ন করে তারা প্রথমে বনভূমিতে প্রবেশ করে। সেখানে দিন দুই অপেক্ষা করে এই আশায়, যে নিজ গ্রামে ফিরতে পারবে। কিন্তু যখন জানা গেলো যে হরিসেনের অনুচরদল একজন যোগী, হরকান্ত এবং এক কুম্ভকারের অনুসন্ধান করছে, তখন তারা গ্রামে যাওয়ার আশা ত্যাগ করে উপনীত হলো কদম্বঘাটে। ঐ স্থানের সূর্যমন্দিরে দিন দুই অবস্থান করে তারা। হয়তো আরও কদিন থাকতো, কিন্তু জনাকয় রাজার চর এমন উপদ্রব আরম্ভ করলো যে সে স্থানে তিষ্ঠানো অসম্ভব হয়ে উঠলো। সে স্থান থেকে শ্যামাঙ্গ তাদের নিয়ে যায় বিশ্বগ্রামে। তার আশা ছিলো, গুরু বসুদেব আছেন, মিত্র নীলাম্বর আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দুর্গত পরিবারটির জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। সর্বাপেক্ষা বড় আশা ছিলো এই যে, গুরু বসুদেব অন্তত সুধীমিত্রকে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, হরকান্ত বা সিদ্ধপা আর যাই হোন, ষড়যন্ত্রকারী নন।

কিন্তু বিল্বগ্রামে উপস্থিত হয়ে সে আশা ত্যাগ করতে হলো। গুরু বসুদেব নেই, নীলাম্বরও নেই। সিদ্ধপা তাঁর এক শিষ্যের জ্ঞাতি সুভদ্ৰদাসের গৃহে আশ্রয় নিলেন। দুর্যোগের উপর দুর্যোগ, হরকান্ত বিল্বগ্রামেই দেহ ত্যাগ করলেন। উজুবটের সেই ভয়াবহ রাত্রিকালে তাঁর মস্তকে তরবারির আঘাত লেগেছিলো। ক্ষতটি নিরাময় হয়নি। প্রায়ই রক্তক্ষরণ হতো। শেষে ওই পরিণতি।

সামন্তপতির চর এখানেও উৎপাত আরম্ভ করলো। তারা প্রায়ই সংবাদ নিতে আসতো। যোগী পুরুষটি কে? কোন স্থান থেকে এদের আগমন? আর যুবাপুরুষটিই বা কেন এদের সঙ্গেইত্যাকার তাদের প্রশ্ন। সুভদ্রদাস বলতেন, যোগী পুরুষটি প্রকৃতপক্ষে যোগী নন–নিতান্তই দরিদ্র ভিক্ষাজীবী–তবে গতায়ু বৃদ্ধটি আমার মাতুল। মাতুলের সঙ্গেই যোগীটি এসেছেন। আর ঐ যুবাপুরুষটি মাতুলের ভ্রাতুষ্পুত্র।

ঐ কথা বলে তাদের বোঝানো গেলেও, সিদ্ধপা যেমন, তেমনি শ্যামাঙ্গও বুঝছিলো যে বিল্বগ্রাম তাদের জন্য নিরাপদ নয়। সুধীমিত্র প্রজাপীড়ক না হলেও ঘোর বৈষ্ণব। ওদিকে পিপ্পলীহাট এবং উজুবটের কাহিনী দুটি ভিন্ন আকারে এ অঞ্চলে প্রচারিত হয়েছে। প্রচারণাটি এইরূপ যে, সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের প্ররোচনায় চণ্ডাল ডোম ও নিম্নশূদ্র ক্ষেত্রকররা দ্রোহ উত্থাপন করে গ্রামবাসীদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করেছিলো–পরম সৌভাগ্য যে মহাসামন্ত হরিসেন ও তাঁর অনুগামীরা ছিলেন সজাগ, ফলে ঐ দ্রোহ ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

কাহিনীটি ঐরূপেই সকলের জানা। সুধীমিত্র ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি, ধর্মরক্ষার জন্য হেন কাজ নেই যা তিনি করেন না। ভিক্ষু যোগীদের তিনি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। তাঁর চর প্রায় সর্বত্রই। চণ্ডাল ডোম হড়ডিদের পল্লীগুলিতে তাঁর অনুচরেরা প্রায়ই ভ্রমণ করে। তেমন কোনো সন্দেহের কারণ ঘটলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শোনা যায়, ইতোমধ্যে তারা কয়েকজন ভিক্ষুকে বন্দী করে নিয়ে গেছে–ঐ বন্দীদের কী পরিণতি হয়েছে, তা কেউ জানে না।

এসব সংবাদ জ্ঞাত হবার পর ঐ স্থানে কে থাকতে পারে? তাই সিদ্ধপা ভাগিনেয়ীকে নিয়ে এসেছেন এই নবপাটক গ্রামে, শিষ্য শীলনাথের গৃহে। ধীবর ও জালিকদের বাস গ্রামটিতে, সুতরাং গ্রামটি সন্দেহের ঊর্ধ্বে। অন্তত সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের গমনাগমন যে ঐ গ্রামে নেই, এ বিষয়ে সামন্তপতির অনুচরেরা নাকি নিশ্চিত–এইরূপ একটি কথা পথিমধ্যেই সিদ্ধপা শুনেছিলেন। সুতরাং নবপাটক গ্রামে লীলাবতীরা দীর্ঘকালই অবস্থান করতে পারবে। সিদ্ধপা শ্যামাঙ্গকে বলেছেন, বৎস, তোমাকেও এই স্থানে থাকতে হবে কিছুকাল, যতোদিন না লীলাবতীর একটি সদ্ব্যবস্থা হচ্ছে।

ব্যবস্থা হয়েছে, লীলাবতী অন্তঃপুরে গৃহস্থের পত্নী কন্যাদের সঙ্গে থাকবে আর শ্যামাঙ্গের স্থান হবে বহির্বাটিতে। এই ব্যবস্থা করে সিদ্ধপা বিদায় নিয়েছেন। কোথায় গন্তব্য, কবে ফিরবেন, কিছুই বলে যাননি।

তবে সমস্যাও কিছু হয়নি। শীলনাথের পরিবারের সকলেই পরমাত্মীয় জ্ঞানে আতিথ্যদান করেছেন। শীলনাথ সম্পন্ন গৃহস্থ। একদিকে তার ক্ষেত্রকর্ম, অন্যদিকে জালিকবৃত্তি। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর উপার্জন যথেষ্ট। গৃহে কত যে দাসদাসী আত্মীয় পরিজন তা গণনা করা যায় না। শ্যামাঙ্গ কখনও কখনও ক্ষেত্র কর্মে সাহায্য করে। কখনও আবার জালিকদের সঙ্গে নৌকাযোগে মৎস্যাহরণে যায়। যখন কোথাও যায় না, তখন সে বসে বসে পুত্তলি নির্মাণ করে।

লীলাবতীর সঙ্গে কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়, কোনোদিন হয় না। তার পিতৃশোক এখনও প্রশমিত হয়নি। যদিও সে পিতৃশোকে অত্যধিক কাতর হয়েছিলো, এমন দেখা যায়নি। পিতার মৃত্যুর পর সে অধিকতর গম্ভীর হয়েছে। কথা বলে কম। তার এই নীরবতার আবরণটি আর কেউ অনুভব করতে পারে না, কেবল শ্যামাঙ্গ অনুভব করে। সে বুঝতে পারে, লীলাবতী এখন হাসে না–তার কথায় এখন বুদ্ধিদীপ্ত বিচ্ছুরণ নেই তার দুচোখের চঞ্চল দৃষ্টিতে পলকে পলকে যে নতুন আলোর চমক দেখা যেতো, সেটি আর দেখা যায় না।

জীবনে চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে যাবার পর সান্ত্বনার কি কিছু থাকে? শ্যামাঙ্গ মুখপানে দৃষ্টিপাত করলে সেও শ্যামাঙ্গের মুখপানে নিঃসঙ্কোচ দৃষ্টিপাত করে। কী দেখে, শ্যামাঙ্গ জানে না। তবে তার সম্ভবত কোনো প্রশ্ন আছে, এমন মনে হয়। সে জানতে চায়, কিছু বলবে লীলাবতী? লীলাবতী দক্ষিণে বামে মাথা দোলায়।

তোমার কি কথা বলতে ইচ্ছা করে না?

না, আর প্রয়োজনও কি আছে?

এ বড় কঠিন প্রশ্ন। প্রয়োজন কি আছে? সত্যিই তো, কোন প্রয়োজনের কথা সে বলবে? আর থাকলেও সে কথা শ্যামাঙ্গকে কেন বলবে?

উজুবট গ্রামে আক্রান্ত হওয়ার পর সে শ্যামাঙ্গকে হাতে ধরে কুটিরের বাইরে নিয়ে এসেছিলো। বলা যায়, শ্যামাঙ্গের প্রাণ সেদিন সে-ই রক্ষা করেছে।

সেদিনকার সেই প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা, ধূম্রকুণ্ডলী, আর্তচিৎকার ও নরহত্যার দৃশ্যগুলির মধ্যে সে লোকটিকে দেখেছিলো তার স্পষ্ট মনে আছে–ওই মুখ বিস্মৃত হওয়া যায় না। মার মার রবে ধাবমান লোকগুলির সঙ্গে ঘাতকরূপী অভিমন্যু দাস ছুটে এসেছিলো। সে জানে না, তার উত্তোলিত তরবারির আঘাতই পিতার মস্তকে এসে পতিত হয়েছিলো কিনা। মৃত্যুশয্যায় শায়িত পিতা বারবার বলেছেন, মা জামাতাকে সংবাদ দিই, সে আসুক, তোকে নিয়ে যাক।

লীলাবতী মাথা কুটেছে পিতার পদপ্রান্তে। বলেছে, পিতা ও কাজ করবেন না। যদি করেন, তাহলে আমি আত্মঘাতিনী হবো।

শ্যামাঙ্গের তখন কিছুই করণীয় ছিলো না। একেবারেই নীরব থাকতো। লীলাবতী প্রশ্ন করতো, আমি কী করবো বলুন? বলুন, আমি কি সেই ঘাতকের গৃহে যাবো?

শ্যামাঙ্গ কোনো উত্তর দিতে পারতো না। তখন তীক্ষ্ণ শাণিত বিদ্রূপ আর অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত করতো সে শ্যামাঙ্গকে। বলতো, আপনি কেমন পুরুষ যে একটি রমণীর জীবিত থাকবার পথ করে দিতে পারেন না? তাহলে কেন ফিরে এসেছিলেন আপনি? বলুন, কোন আশা ছিলো আপনার মনে?

এই প্রকার তীব্র আক্রমণ প্রায় প্রতিরাত্রেই হতো। প্রতিরাত্রেই শ্যামাঙ্গ নীরব থাকতো। শেষে হরকান্তের মৃত্যু হলো এবং তখন থেকেই সে নীরব। আর তার কোনো প্রয়োজন নেই। তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ নেই তার কথায়–ক্ষোভ নেই, আক্রমণ নেই। সে অন্তঃপুরে সম্ভবত শীলনাথের গৃহিণীকে গৃহকর্মে সাহায্য করে। দিনান্তে বারেক কোনোদিন দেখা হয়, কোনোদিন তাও হয় না। দেখা হলে কেবল নির্বিকার দৃষ্টি বিনিময়টুকু হয়। যেন অপরিচিত লোক দেখছে সে।

শ্যামাঙ্গ জানে না, এই অপেক্ষার শেষ কখন। সে কার জন্য অপেক্ষা করছে, লীলাবতীর জন্য কি? লীলাবতী তাকে কী দেবে, যে তাকে অপেক্ষা করতে হবে? তার মনে প্রশ্ন জাগে একে একে। নাকি সে অরক্ষণীয়া এক রমণীর রক্ষকমাত্র? তার মাতুল এসে যাবে তারপর আর শ্যামাঙ্গের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। এই কি প্রকৃত অবস্থা তাহলে? পরস্পরের কাছে পরস্পরের কোনোই ভূমিকা নেই?

সে কিছুই বলতে পারে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ভবিষ্যতে প্রকাণ্ড একটি শূন্যতা ব্যতীত কিছু নেই। তার বলার কিছু নেই, করারও কিছু নেই।

সে ইদানীং প্রায় প্রতিদিনই দুচারটি করে পুত্তলি গড়ে। এবং প্রতিটি পুত্তলিতেই অবিকল লীলাবতী এসে ধরা দেয়। কোথাও লীলাবতী কক্ষে কলসটি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, কোথাও সে কেশ পরিচর্যায় রত, কোথাও বা মেষ শাবকটিকে ক্রোড়ে নিয়ে সে আদর করছে–এই প্রকার নানান ভঙ্গি পুত্তলিগুলিতে। এগুলি সে এখনও কাউকে দিতে পারেনি। রৌদ্রে শুষ্ক করা হয়েছে, এখন প্রজ্বলিত অঙ্গারে দগ্ধ করলেই ব্যবহারের উপযোগী হবে। এই জন্য সে নির্জন আম্রকাননের নিকটে একটি স্থানে অগ্নিকুণ্ড নির্মাণের আয়োজন করছিলো। কোথায় যে সংবাদ পেয়েছিলো বলা কঠিন, দ্বিপ্রহরে লীলাবতীকে সেই বিজন কাননে দেখা গেলো।

তাকে দেখে শ্যামাঙ্গ অবাক। বললো, তুমি?

হ্যাঁ, আমি এখানে অগ্নিকুণ্ড কেন?

কিছু পুত্তলি গড়েছি, সেগুলি পোড়াবো।

কিন্তু এভাবে অগ্নি জ্বালালে গৃহস্থ রুষ্ট হতে পারেন, সে কথা ভেবেছেন?

শ্যামাঙ্গের জানা ছিলো না যে, পল্লীপ্রান্তের আম্রকাননপার্শ্বে, প্রায় সকলের অগোচরে, একটি ক্ষুদ্র অগ্নিকুণ্ড জ্বালালেও তা অন্যের বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে।

কাননভূমি নির্জন। লীলাবতী একটি পুত্তলি হাতে তুলে নিলো। দেখলো সেটি, অতঃপর সেটি রেখে পুনরায় অন্য একটি পুত্তলি তুলে নিলো, সেটিও দেখলো। সম্মুখেই শ্যামাঙ্গ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে–সেদিকেও বার দুয়েক দৃষ্টিপাত করলো। লীলাবতীর অবয়ব ফুটে রয়েছে পুত্তলিগুলিতে, সম্ভবত সেই কারণেই তার দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে প্রকাশ পাচ্ছিলো লজ্জা এবং অপরাধ বোধ। শ্যামাঙ্গকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার অন্তরাত্মা জ্বলে গেলো। বললো, কী দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

তুমি বড় কৃশা হয়েছে।

কেন, স্থূলা হলে উত্তম হতো? দেখতে আরও আকর্ষণীয়া হতাম? নতুন একটি পুত্তলি গড়তেন?

শ্যামাঙ্গ কিছু বললো না।

আচ্ছা আপনি এখানে কেন রয়েছেন, বলতে পারেন?

এবারও শ্যামাঙ্গ নীরব।

সে তখন রুক্ষকেশী কৃশা রমণী মূর্তিটির মধ্যে সন্ধান করছে সোমপুর বিহারে দেখা সেই যক্ষী মূর্তিটির সাদৃশ্য। কোথায় সেই প্রগল্ভা তরুণীটি যার হাস্যাননে সূর্যালোক চমকিত হতো? যার কথা শুনলে হৃদয় হতো উৎফুল্ল, সে তো সম্মুখে নেই। এমন বিষাদ, এমন নিঃস্বতা কি কোনো নীরব মুখভাবে সে দেখেছে কখনও? তার মনে পড়ে না।

শুনুন, আমি এখানে থাকবো না, হঠাৎ লীলাবতী জানায়।

কেন? কেন থাকবে না?

এখানে থাকা এবং ভাদ্রপাদের পথকুক্কুরী হওয়া একই কথা।

এ তুমি কি বলছো? শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় বোধ করে। জানতে চায়, শীলনাথ কিছু বলেছেন?

হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি যোগব্রত নিয়েছি কিনা–আমাকে তাঁর সাধনসঙ্গিনী করতে চান। আগামী অমাবস্যায় শীনাথ যোগাচারে প্রবেশ করবেন।

শ্যামাঙ্গ যোগাচারের প্রক্রিয়া কী জানে না। তবে শুনেছে, নানান ক্রিয়াকাণ্ড থাকে ঐ আচারের অনুষ্ঠানাদিতে। নারী–সঙ্গের একটি কুৎসিত ব্যাপারও নাকি ঐ আচারের আবশ্যিক অঙ্গ। সে বললো, লীলা, এবার তোমাকে মনস্থির করতে হবে।

লীলা শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়।

শ্যামাঙ্গ বলে, আমি এযাবৎ কিছুই বলিনি। কেননা আমার বলবার কথা ছিলো না। তোমার পিতা ও মাতুল ছিলেন। আমি যদি কিছু বলতামও, তাহলে তা গ্রাহ্য হতো না আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা তুমিও করতে। ভাবতে, আমি লোভ ও বাসনার বশবর্তী হয়ে কথা বলছি। কিন্তু এখন তোমার পশ্চাতে কেউ নেই। এখন তুমি কেবল তোমার। সুতরাং সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। আমি তোমার পশ্চাতে পশ্চাতে বহুদূর চলে এসেছি। আমার আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তবে পুরুষ মানুষ বলে আমি হয়তো পথে পথেই থেকে যেতে পারি। তথাপি তোমার সিদ্ধান্তটি আমার জানা প্রয়োজন–কেননা সিদ্ধান্তটি হবে প্রকৃতপক্ষে আমাদের উভয়ের। আজ যদি সিদ্ধান্ত নিতে না পারি আমরা, তাহলে সে ব্যর্থতার দুর্ভার গ্লানি সমস্ত জীবন আমাদের বহন করতে হবে। আমি বলি, তুমি স্বামীর কাছে চলো, আমি নিয়ে যাই। সামাজিক জীবনে তুমি স্থিতা হবে, সংসারে তোমার স্থান হবে, সে এক পথ। নতুবা চলো, আমরা এ স্থান ত্যাগ করে দূর দেশে চলে যাই। আমরা দুজনে যদি একত্র জীবনযাপন করতে চাই তাহলে দূর দেশে গমন ব্যতিরেকে গত্যন্তর নেই–তুমি ভেবে দেখো, অমাবস্যার এখনও বিলম্ব আছে–

হঠাৎ লীলা বাধা দেয়। তখন তার চক্ষু দুটির ভিতরে কোমল একটি আলো ফুটে উঠেছে। বিষাদ–করুণ মুখখানিতে অস্পষ্ট হাসির ছায়া দেখা যাচ্ছে। সে শ্যামাঙ্গের হাত ধরে বলে, অতো কথায় কি প্রয়োজন–তুমি অহেতুক অধিক কথা বলল। আজ রাত্রেই এ স্থান ত্যাগ করলে হয় না? ঐ বনের মধ্যে পথ নেই? ও পথে কি ব্যাঘ ভল্লুকের সংখ্যা অত্যধিক?

ঐ কথা বলেই লীলাবতী প্রস্থান করে। শ্যামাঙ্গ নির্বোধের মতো তার গমনপথে চেয়ে থাকে। এ কী ঘটলো? এ যে কল্পনারও অতীত। লীলাবতী সমাজ সংসারের কথা কি কিছুই চিন্তা করতে চায় না? পথের বিপদ আপদের বিবেচনাও কি তার নেই?

কিন্তু ঐদিন সন্ধ্যাকালেই মাতুল সিদ্ধপা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বহুদূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বললেন, আমি পুনর্ভবার উভয় তীরের গ্রামগুলি দেখে এলাম। অবস্থা বড় বিপজ্জনক। সর্বত্রই আশঙ্কা এবং ত্রাস। দক্ষিণের এক সামন্তপতি দুখানি গ্রাম ধ্বংস করেছেন–একখানি হড়ডিদের, অন্যখানি ডোমদের। এখন তোমাদের এ স্থানে অবস্থান করাই উত্তম।

শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর কথাটি জানালে সিদ্ধপা গম্ভীর হলেন। এবং বললেন, বৎস, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম না। কেননা শীলনাথের আমি দীক্ষাগুরু। আমার যোত কঠোর সংযম এবং রিপু শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি কামাচারী নই– শীলনাথেরও হবার কথা নয়। তবু আমি গোপনে সন্ধান নিয়ে দেখবো। যদি তোমাদের কথা সত্য হয়, তাহলে এ স্থানে আর কোনোক্রমেই থাকা যাবে না। আর যদি তোমাদের কথা সত্য না হয়, তাহলে কিন্তু কঠিন শাস্তি দেবো তোমাকে।

মহাশয়, আমি বলেছি, কথাটি আমার নয়, আপনার ভাগিনেয়ীর, শ্যামাঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে, আপনি বরং তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।

লীলাবতী রাত্রে এসে জানায়, যাত্রা স্থগিত রাখতে হবে, মাতুলের উপস্থিতিতে পলায়ন করলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে।

শ্যামাঙ্গ হাত ধরে, লীলা, তোমার মত পরিবর্তিত হয়নি তো?

লীলা স্থির হয় মুহূর্তের জন্য। তারপর চোখের মধ্যে দৃষ্টিপাত করে বলে, তুমি কি উন্মাদ হয়েছো? আমার যে আর গত্যন্তর নেই, তুমি বুঝতে পারো না?

সিদ্ধপার মুখে দুশ্চিন্তার ছায়াটি ইদানীং সর্বক্ষণ থাকে। তিনি উজুবটেও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে অনেক সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। যেমন মহাসামন্ত হরিসেন এখন রাজধানীতে। ওদিকে সামন্তপতিদের উপর আদেশ হয়েছে, যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হবে। রাজজ্যোতিষেরা নাকি বলেছেন, গ্রহ নক্ষত্রাদির অবস্থান বিপজ্জনক–রাজ্যনাশ অবশ্যম্ভাবী, এবং তা ঘটবে যবনদেরই হাতে। সুতরাং জ্যোতিষীদের বিধান, যজ্ঞ করো, যজ্ঞের মন্ত্রেই যবনের উপদ্রব দূরীভূত হবে।

একদা রাত্রিকালে অকস্মাৎ শ্যামাঙ্গকে শয্যা থেকে ডেকে তুললেন সিদ্ধপা। বললেন, চলো, তোমাকে যোত গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমাকে দীক্ষাদান করবো।

শ্যামাঙ্গ কিছুই বলার অবকাশ পেলো না। একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন শ্যামাঙ্গকে। সেখানে কক্ষের মধ্যস্থলে ভূমিতে চক্র ও রেখা অঙ্কিত দেখলো শ্যামাঙ্গ। ঐ মধ্যস্থলেই ধূপ জ্বলছে, প্রদীপ জ্বলছে, কয়েকটি পদ্মফুল সেখানে, সেই সঙ্গে আবার জবা ফুলও। ঐ মধ্যস্থলেই দেখলো, বসে আছে লীলাবতী। শীলনাথ দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। সে বললো, গুরুদেব, আজ রাত্রে তো কোনো শুভলগ্ন নেই, উপরন্তু জাতক জাতিকার কায়াশুদ্ধিরও একটি ব্যাপার আছে–অনুষ্ঠানটি পরে করলে হতো না?

সে চিন্তা আমার, সিদ্ধপা জানালেন। বললেন, কালযোগ বলে একটি কথা আছে আর কায়াশুদ্ধির তুমি কী জানো? আমি জানি, আমি কী করছি, আমাকে শুভকার্য সমাধা করতে দাও, বাধা দিও না–এই বলে তিনি দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন।

শ্যামাঙ্গের কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না। উচ্চৈঃস্বরে কয়েকবার মন্ত্র পাঠ করলেন সিদ্ধপা, তারপর নিম্নস্বরে বললেন, এ তোমাদের দীক্ষা নয়–দীক্ষাগ্রহণের জন্য সাধনা প্রয়োজন–তা তোমাদের নেই। আমি লীলাবতীর কথা চিন্তা করে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম। আমাকে এ স্থান ত্যাগ করে দূর দেশে চলে যেতে হচ্ছে। এই রাত্রেই তোমরা এ গ্রাম ত্যাগ করে চলে যাবে, যত দ্রুত সম্ভব, দূরে চলে যেও। পথিমধ্যে কোথাও বিলম্ব করবে না। পুন্ড্রনগরে উপনীত হলে তখন বুঝবে যে, আর ভয় নেই। পথিমধ্যে যদি কোথাও কোনো যবন কেন্দ্র দেখো, তাহলে সেখানে আশ্রয় নেবে।

ঐ পর্যন্ত বলেই তিনি অগ্নিতে ধূপ নিক্ষেপ করলেন। অগ্ন্যায় স্বাহাঃ বললেন কয়েকবার, তাতে কক্ষটি ধূপের গন্ধে এবং ধূমে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। শেষে দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। ডাকলেন শীলনাথকে। বললেন, তোমার কে দীক্ষাপ্রার্থী আছে, তাকে ডেকে নিয়ে এসো।

গুরুদেব, সে তো ভিন্ন গ্রামে থাকে।

তবু ডেকে আনো, রাত্রির শেষ যামে তার দীক্ষা হবে।

শীলনাথ চলে গেলে তিনি পুনরায় দ্বার রুদ্ধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার দ্বার উন্মুক্ত করে শ্যামাঙ্গকে ডেকে বললেন, চলো, আমি তোমাদের পথে রেখে আসি।

মধ্যরাত্রির নিঃশব্দতা এবং অন্ধকার। নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে শ্যামাঙ্গ। তার মনে প্রশ্ন জাগে, এ তুমি কোথায় চলেছো শ্যামাঙ্গ? একি তোমার জীবনের পথে যাত্রা? নাকি এই পথেই তোমার মরণ? সে পার্শ্বে সহগামিনী লীলাবতীকে জিজ্ঞাসা করে মৃদুস্বরে, আমরা কোথায় যাচ্ছি লীলা?

লীলা বলে, জানি না।

গ্রাম প্রান্তে উপনীত হলে সিদ্ধপা দাঁড়ালেন। ঊর্ধ্বাকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, নক্ষত্রমালা সাক্ষী, রাত্রির অন্ধকার সাক্ষী, তোমার আমার নিঃশ্বাস বায়ু সাক্ষী শ্যামাঙ্গ, লীলাবতীকে আমি তোমার হাতে সমর্পণ করলাম, ওকে তুমি রক্ষা করো। তোমাদের বিবাহ হবে না–কেননা শাস্ত্রের কোনো বিধান নেই যে তোমাদের বিবাহ হয়–এ বড় দুষ্কাল বৎস, জানি, তোমাদের সংসার হবে না–তথাপি আমি তোমাদের মিলিত করে দিলাম–পারলে যোব্রত পালন করো, শিব তোমাদের মঙ্গল করুন।

মাতুলকে প্রণাম করে দুজনেই দ্রুত পদক্ষেপে সম্মুখে অগ্রসর হলো। জ্যৈষ্ঠ গত হয়ে আষাঢ়ের আরম্ভ এখন। কিন্তু সৌভাগ্য যে বর্ষা এখনও নামেনি। আকাশের নক্ষত্রমালা দেখতে দেখতে দুজনে পথ অতিক্রম করে চললো। লীলাবতীর মুখে কোনো কথা নেই। বস্ত্রের অঞ্চলটি মাথায় তোলা, তথাপি বোঝা যায়, অবগুণ্ঠনবতী এই রমণী মাথা নীচু করতে জানে না। সঙ্কোচহীন একটি দৃপ্ত ভঙ্গী তার মস্তককে উন্নত করে রেখেছে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো, ওষ্ঠদ্বয় দৃঢ় সংবদ্ধ, দৃষ্টি দিগন্ত লগ্ন এবং প্রতিটি পদক্ষেপ জড়তাবিহীন। একবার শ্যামাঙ্গ বললো, একটু দ্রুত চলো।

লীলাবতী মৃদু স্বরে জানতে চাইলো, কেন?

শীলনাথের লোক অনুসরণ করতে পারে।

করুক।

ক্ষুদ্র একটি শব্দ। কিন্তু শতকথা যেন সে ঐ একটি শব্দে উচ্চারণ করে।

শ্যামাঙ্গ পুনরায় বলে, লীলা, আমরা কোথায় চলেছি জানো?

ঐ কথায় মস্তক আন্দোলিত করে লীলাবতী, না। তারপর বলে, সম্ভবত মরতে।

না, কৌতুকের কথা নয় লীলা, শ্যামাঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলে, তোমার জানা প্রয়োজন, তুমি কোথায় চলেছো–তোমার মাতুলের কথাগুলি নিশ্চয়ই শুনেছো?

না, আমার প্রয়োজন ছিলো না।

কি কাণ্ড, নারী জাতি দেখছি সত্যিই ভয়ঙ্কর! এবার শ্যামাঙ্গের কণ্ঠে ঈষৎ কৌতুক ধ্বনিত হয়।

লীলা ঐ কথায় মুহূর্তেক দাঁড়ায়। তারপর বলে, এভাবে পথে বিলম্ব করো না তো! সম্মুখে আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হবে।

রাত্রি তখন শেষ হয়ে আসছে। পূর্বাকাশে আলোকোদ্ভাস, বনকুকুট ডাকছে পথিপার্শ্বের ঝোপগুলিতে। একটি গোধিকা বামদিক থেকে দক্ষিণে গেলো। দিগন্তে ঐ সময় মেঘ দেখা গেলো–তবে ঐ মেঘ ঝড়েরও নয়, বৃষ্টিরও নয়। সম্মুখে একটি গ্রাম দেখা যায়। শ্যামাঙ্গ শুধালো, এখানে ক্ষণেক বিশ্রাম নেবে? না, লীলাবতী জানায়, আমি ক্লান্ত নই পরবর্তী কোনো স্থানে বিশ্রামের কথা চিন্তা করবো।

কিন্তু আমি যে বিশ্রাম চাই? শ্যামাঙ্গের স্বরে কি কৌতুক?

তুমি দেখছি নারীরও অধম। ধিক তোমার পুরুষ জীবনে।

এই তো লীলা আবার সহজ হচ্ছে। শ্যামাঙ্গ উৎফুল্ল হয় মনে মনে। লীলাবতীর হাতখানি সে ধরে। বলে, লীলা ক্ষণেক দাঁড়াও, আমি তোমাকে দেখি।

তুমি আমাকে দেখবার কে? লীলার কণ্ঠে শাসন।

শ্যামাঙ্গ অপ্রস্তুত বোধ করে। বলে, আমাদের যে মিলিত করে দিয়েছেন তোমার মাতুল।

সে তো যোগব্রতের মিলন, সংযম আচরণ করতে হবে দুজনকেই।

হঠাৎ লীলাবতী দাঁড়ালো। পূর্বাকাশ এখন পরিষ্কার–পরস্পরের মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। বললো, শ্যামাঙ্গ, তুমি কী চাও বলো তো?

আমি তোমাকে চাই, অকপটে দাবি করে শ্যামাঙ্গ।

আমাকে চাও, অর্থ কি আমার এই দেহটিকে চাও। দেহ পেলেই তোমার চলবে?

শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে। কী বলতে চায় এই নারী? সে বলে, লীলা, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

উত্তম কথা, ভালোবাসো বলেই তো আমাকে চাও তুমি, তাই না? তোমার কথা আমার কাছে দুর্বোধ্য নয়। বলো, আমার এই দেহটি চাও? যদি অতীব প্রয়োজনীয় মনে করো, তাহলে নাও।

এই কথা বলে সে উধ্বাঙ্গের বস্ত্র অপসারিত করলো। শ্যামাঙ্গ দেখলো তার গ্রীবা, সুগোল স্কন্ধ দুটি, উন্নত ও মহিমান্বিত স্তন যুগল, ক্ষীণ কটিদেশ–

বলো, আরও দেখতে চাও, তাহলে নিম্নাঙ্গের বস্ত্রও আমি অপসারিত করি।

শ্যামাঙ্গের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে আহত বোধ করে। বলে, তুমি কি আমাকে লম্পট ভেবেছো?

না, তা কেন ভাববো, লীলাবতীর কণ্ঠ অতীব সুস্থির।

তাহলে তুমি ওভাবে কেন নিজেকে অপমানিত করলে?

শ্যামাঙ্গ, তুমি কি কলহ করবে পথে? লীলাবতী বলে, আমি তোমাকে মনে স্থান। দিয়েছি সেই প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে, মনে আছে তোমার, পুনর্ভবা তীরের বটতলের উচ্চ বেদীটির কথা? আমি তারপর থেকে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে তোমাকে কামনা করেছি। লম্পট মদ্যপ অথবা নির্বোধ লোক নিয়ে রমণীরা সংসার করছে না? আমিও হয়তো একদিন অভিমন্যু দাসের কাছে চলে যেতাম। কিন্তু তুমি এলে আমার সম্মুখে, আর জীবনের অর্থ আমার নিকট অন্যরূপ হয়ে গেলো। এখন আমার পূর্বজীবন বলে কিছু নেই, আমি মনে করি, সেই জীবন উজুবটেই ভস্মীভূত হয়ে গেছে। তুমি ব্যতীত এখন আমার কেউ নেই। আমার দেহ মন আমি সমস্তই তোমাকে দান করে রেখেছি–তবু তুমি কেন লোভী বালকের মতো আচরণ করো, বলো? প্রিয়তমাকে বক্ষলগ্ন করার এই কি সময়? এই কি স্থান?

লীলাবতীর সমস্ত সংযম ঐ কথার পর ধসে পড়ে, তার কণ্ঠ রোদনউদ্বেল হয়ে ওঠে। সে শ্যামাঙ্গের বক্ষে নিজেকে সমর্পণ করে।

এ কি দেখছে শ্যামাঙ্গ, কে এই রমণী, যে তার বক্ষে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লো? সে দুহাতে লীলাবতীকে বক্ষে ধারণ করে রাখে। তারপর ক্ষমা চায়, লীলা, ক্ষমা করো আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি–ক্ষমা করে দিও আমাকে।

 ০৬. সোমজিৎ লক্ষ্মণাবতী

সোমজিৎ লক্ষ্মণাবতীর অভিজাত পল্লী থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে রাজপথ অতিক্রম করছিলেন। বার্ধক্যের কারণে স্বভাবতই ঋজুতা হারিয়েছেন–যেমন দেহের, তেমনি মনেরও। তথাপি তাঁকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে রাজধানীতে আসতে হয়েছে। মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। রাজধানীতে এসে অবধি নানান জনরব শুনছেন। কেউ বলছে, বৃদ্ধ মহারাজ রাজধানীতে নেই, গঙ্গাতীরে গিয়েছেন। কেউ বলছে, তিনি অত্যধিক রুগ্ন, রাজকার্য এখন দেখেন না। এক স্থানে আবার শুনলেন, মহারাজ নাকি যবনাক্রমণ আসন্ন দেখে প্রাণরক্ষার জন্য পলায়ন করেছেন। প্রকৃত সংবাদটি যে কী, কিছুই জানবার। উপায় নেই। হলায়ুধ মিশ্র তার সতীর্থ ছিলেন গুরুগৃহে। সেই সূত্রে এখনও উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা রয়েছে। বর্ষকাল পূর্বেও তিনি রাজধানীতে এসেছিলেন–তখনও সাক্ষাৎ হয়েছে। এবার তিনি হলায়ুধের মাধ্যমে মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের নিকটে যেতে চান। মহারাজের নিকট তিনি একটি আবেদন জানাবেন।

কিন্তু জনরবের পর জনরব শুনছেন। যদি আজ শুনলেন যে, রাজসভার এখন মান্যপুরুষ গোবর্ধন আচার্য, তো কালই আবার জানলেন, গোবর্ধন আচার্য নয়, প্রকৃত পুরুষ হচ্ছেন মহাপণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্র। পরদিন আবার জানতে পারলেন–ও সমস্ত কিছুই সত্য নয়। মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন, পাণ্ডিত্যের পীড়নে ইদানীং বিরক্ত হন। এখন রাজসভার আনন্দদানকারী নট গাঙ্গোকই হচ্ছে মূল ব্যক্তি। যদি কেউ পারে, তো সেই পারবে, রাজার সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে। আর একজন আবার বললো, রাজসভার যে সংবাদ শুনছেন কোনোটিই সত্য নয়–এসব সংবাদের আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। রাজসভায় কিছুই হয় না, মহারাজের অতো সময় কোথায়? আপনি বরং রানী বল্লভার সাক্ষাপ্রার্থী হন। রানী বল্লভা একে যুবতী, তায় সুন্দরীশ্রেষ্ঠা। রাজা যা-কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা শয্যাতেই, বিশ্রাম গ্রহণকালে।

জনরবগুলির ভিত্তি যে কী, এবং কেন যে ঐ প্রকার একের-পর-এক জনরবের জন্ম। হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যাই কেউ তাকে দিতে পারলো না। না তার কন্যা, না জামাতা।

রাজপথটি প্রশস্ত। অপরাহ্নের রৌদ্র এসে পতিত হয়েছে অট্টালিকাসমূহের প্রাচীর গাত্রে। পথচারীদের সংখ্যা এখনও যথেষ্ট নয়। সম্ভবত গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতাই কারণ। আষাঢ় মার্তণ্ডের প্রচণ্ড তেজ সংসারকে ঝলসিত করে দিচ্ছে। অনুমান হয়, দুই চারিদিনের মধ্যেই বৃষ্টি হবে। সোমজিৎ বুঝলেন, শীঘ্রই তাঁকে স্বগ্রামাভিমুখে যাত্রা করতে হবে–নতুবা বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেলে পথে কষ্টের সীমা থাকবে না।

দুই পার্শ্বে গৃহাঙ্গনের বৃক্ষছায়ায় বিশ্রামরত নগরবাসীদের দেখতে দেখতে চললেন সোমজিৎ। সম্ভবত গন্তব্যের নিকটে এসে গিয়েছেন। জলসিক্ত বাতাসের স্পর্শ অনুভব করছেন দেহে। গঙ্গাতীরেই তো চতুস্পাঠীটির অবস্থান বলে শুনেছেন। চক্ৰায়ুধ মিশ্র প্রতিষ্ঠিত এই নব চতুষ্পাঠীটি ইতোমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে, জামাতা কেশবাচার্য এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তিনিই হলায়ুধের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন। হলায়ুধ নাকি প্রতি পক্ষে একটি অপরাহু এ স্থানে অতিবাহিত করেন। আজই সেই দিনটি, এবং অপরাহ্নকালও সমাগত। কষ্ট হচ্ছে তার দ্রুত পদক্ষেপণ করতে।

কন্যা সরস্বতী বলেছিলো, পিতঃ, ঐ দীর্ঘপথ পদব্রজে যাবেন না, আমি একটি দোলার। ব্যবস্থা করে দিই।

সোমজিৎ সম্মত হননি। সহাস্যে বলেছিলেন, মাতঃ ঠাকুরের কাছে এই প্রার্থনা করো যে, আমি যেন একবারই মানুষের স্কন্ধে উঠি, বারংবার ওঠা নামায় এ বৃদ্ধের বড় কষ্ট হবে।

অপরাহ্নকাল বলেই চতুষ্পাঠীটি নীরব। ইতস্তত কয়েকজন স্নাতককে দেখা যাচ্ছে। বালক ও কিশোরের দল যে কোথায়, বোঝা যাচ্ছে না। বৃহৎ চতুঃশালা সম্মেলক–গৃহটির পর বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। মধ্যে একদিকে দুটি বকুল বৃক্ষ, অন্যদিকে দুটি চম্পক। বৃক্ষলতা, পুষ্প ও পত্র–পল্লবে স্থানটি স্নিগ্ধ ও মনোরম। কেশবাচার্য দ্বারেই ছিলেন। জানতে চাইলেন, আপনি কি বৃক্ষতলে উপবেশন করবেন, না অলিন্দে?

বৃক্ষতলেই বসি, কি বলো? সোমজিৎ হাসলেন।

একটি তরুণ ব্রাহ্মণ সম্মুখে এসে প্রণাম করলে সোমজিৎ অবাক হলেন। বললেন, এটিকে যেন পরিচিত মনে হচ্ছে?

সেকি, মনে নেই আপনার? এ তো আমার অনুজ, মাধব–এবার স্নাতক হলো।

দীর্ঘায়ু হও বৎস। তুমি দেখছি দিব্য যুবাপুরুষটি হয়ে উঠেছো। তোমার কী ভালো লাগেন্যায় না স্মৃতি? নাকি ব্যাকরণ?

আজ্ঞে না, আমি কাব্যানুরাগী।

তা বটে, এই বয়সে কাব্যেই তো শিক্ষার্থীর অনুরাগ থাকে–কী পাঠ করছো এখন?

তরুণটির মুখে সলজ্জ হাসি দেখা গেলো। বললো, আমার বানভট্ট, ভবভূতি, দণ্ডী এঁদের ভালো লাগে। তবে এখন জয়দেব পাঠ করছি।

সে কি। সোমজিৎ অবাক হলেন। জয়দেব গোস্বামী কি তাঁর গীতগোবিন্দ সমাপ্ত করেছেন? তার পুঁথিও কি প্রস্তুত হয়ে গেছে? জানতে চাইলেন, তোমরা সম্পূর্ণ পুঁথি পেয়েছো?

আজ্ঞে না, কবি স্বয়ং আমাদের কাছে অংশে অংশে দিচ্ছেন এবং সেই অনুক্রমে আমরা লিপি প্রস্তুত করছি।

ক্ষুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন সোমজিৎ। রাঢ়ের সেই যুবকটি–পীত ধটিকা পরিধানে, উত্তলবাসীদের মতো মস্তকোপরি প্রকাণ্ড স্কুল শিখাঁটি, উপবীতখানিও রজ্জুসদৃশ সেই গ্রাম্য যুবকটি একদা সকলের মন জয় করে নিলো। ঐ কবিসভায় সোমজিৎও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর শ্লোকও প্রশংসিত হয়েছিলো। কিন্তু জয়দেবের শ্লোকাবলীর মতো নয়। তথাপি অনেকের মত সোমজিতেরও সন্দেহ ছিলো। তারও মনে হয়েছিলো, ঐ পদ চলবে না–একেবারেই প্রাকৃতগন্ধী। কিন্তু চললো–রাজসভা সাদরে গ্রহণ করে নিলো। জয়দেব গোস্বামীকে।

জয়দেব বুঝি তোমাদের অত্যন্ত প্রিয়? সোমজিৎ তরুণটির মুখোপরি দৃষ্টি রাখলেন।

আজ্ঞে, তরুণ মাধবাচার্য পুনরায় সলজ্জ মুখখানি নমিত করে। তারপর বলে, তবে প্রাকৃত পদাবলী বোধ হয় আমার অধিকতর প্রিয়।

কেন? সোমজিতের ভ্রূ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। দেখা যায়, কেশবাচার্যের দৃষ্টিও আর সরল নেই।

ঐ প্রকার ভ্রূকুটি কুটিল প্রশ্ন হওয়াতে মাধব প্রথমে অপ্রস্তুত, পরে শঙ্কিত হয়। অনুমান করে, তার কথায় সম্ভবত বয়োজ্যেষ্ঠ দুজনই আহত হয়েছেন। সে অনুমতি প্রার্থনা করে। বলে, আমার কাজ আছে, অনুমতি দিন, আমি যাই।

তরুণটি প্রস্থান করলে সোমজিৎ মন্তব্য করলেন, এই তাহলে তোমাদের বিদ্যাদান। রুচি তো দেখছি ক্রমেই প্রাকৃত হয়ে যাচ্ছে–এ তো ঠিক নয়।

কেন, পিতঃ, গৌড়ীয় রীতিও তো একটি রীতি।

হ্যাঁ, এক প্রকার রীতি–কিন্তু সে রীতি অক্ষমের, আর্যত্বের তোমরা আর কিছু রাখলে না।

ঐ সময় দূরে দ্বারদেশে রাজপ্রহরীদের দেখা গেলো। পরে দেখা গেলো, একখানি দোলা। হলায়ুধ মিশ্র আসছেন।

নিকটে এসেই হলায়ুধ বাল্যবন্ধুকে উদ্বাহু হয়ে আলিঙ্গন করলেন। হলায়ুধ এখনও শক্তিমান–দেহ ঋজু, বর্ণ তপ্ত কাঞ্চনের মতো। কপালে চন্দন–লেখা, শিখাগ্রে পূজার পুষ্প, উপবীতখানি শুভ্র–সমগ্রদেহে পৌরুষের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সোমজিৎ বললেন, তুমি দেখছি সেইরূপই আছো।

হ্যাঁ, বলতে পারো, হলায়ুধ বলেন,তবে এ কৃতিত্ব আমার নয়, ব্রাহ্মণীর–তিনি যেভাবে রাখেন, সেইভাবেই থাকি।

কিন্তু আমি কিরূপ বৃদ্ধ হয়েছি দেখেছো?

ও কিছু নয়, দেহ দেখে কিছুই বোধগম্য করা যায় না, অন্তরটি বৃদ্ধ না হলেই হলো।

ক্ষণপরে পুনরায় হলায়ুধ বলেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যবস্থা কি জানো?

কি, সোমজিৎ কৌতূহলী হন।

নিজের নিকট কিছুই না রাখা, নিজেকেও না রাখা। নিজেকে অন্যের হাতে তুলে দাও, দেখবে যথার্থ যত্ন হচ্ছে, এবং তোমার দিনও অতিবাহিত হচ্ছে দায়হীন আনন্দের মধ্য দিয়ে।

কৌতুকালাপে কিছুক্ষণ গেলে সোমজিৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। বললেন, হলায়ুধ, তুমি রাজপুরুষ, তোমার কাছেই আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি, যদি আমার আবেদনটি তোমার অনুমোদন লাভ করে, তাহলে আমি সেটি মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের পাদপদ্মে নিবেদন করতে চাই।

হলায়ুধ গম্ভীর হলেন। সোমজিৎকে তিনি বাল্যকাল থেকে জানেন। সকল ব্যাপারেই সে গভীর এবং গুরুপ্রশ্ন ব্যতীত অযথা চিন্তা করে সময় ব্যয় করে না। হলায়ুধ বললেন, তোমার আবেদনটি কী, সেইটি আগে বলল।

ঐ কথার পরও সোমজিৎ ইতস্তত করেন। তিনি নিশ্চিত নন হলায়ুধ কতখানি আগ্রহী হবেন শুনতে। তথাপি তিনি আরম্ভ করলেন

তুমি জ্ঞাত কিনা জানি না, পুনর্ভবা তীরে আমাদের অঞ্চলে হরিসেন অত্যন্ত প্রতাপশালী সামন্তপতি। সম্প্রতি ঐ অঞ্চলে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের গমনাগমন লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো–বিশেষত অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে তাদের হৃদ্যতা হয়ে উঠেছিলো নিবিড়। ডোম রমণীরা কেমন হয় নিশ্চয় শুনেছো। তারা যেমন শিথিল–শাসনা তেমনই উদ্ধৃঙ্খল, তাদের এই স্বভাব প্রায় সর্বত্র। ঐ অঞ্চলে পিপ্পলী হাট নামক একটি হাট আছে। ঐ হাটে একদা হরিসেনের অনুচর বজ্রসেন কয়েকটি কুলটা ডোম রমণীকে শাসন করতে যায়। ফল হয় ভয়াবহ, হাটের ক্ষিপ্ত মানুষ বজ্ৰসেন ও তার দুই অনুচরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে–তাদের দেহ এমনই ছিন্নভিন্ন করে দেয় যে তাদের পরিচয় উদ্ধার করাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। সামন্ত হরিসেন ঐ ঘটনার প্রতিশোধ নেন–এবং সেই প্রতিশোধটিও ভয়ঙ্কর। ঐ পিপ্পলী হাটেই কয়েকদিন পর বিশাল এক জনসমাবেশে একটি কুলটা ডোম রমণীর মধ্যদেশে অগ্নিতপ্ত লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় এবং তার দুই শিশুপুত্রকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। একটি সদ্ধর্মী ভিক্ষুকে ঐ স্থানেই অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। হত্যা করা হয়।

হলায়ুধ মিশ্র শুনছিলেন। বললেন, এ যে দেখছি একেবারেই পাশবিক কাণ্ড।

হ্যাঁ, পাশবিক কাণ্ডই বলতে পারো। সোমজিৎ পুনরায় বলতে থাকেন, কিন্তু হরিসেন। সেখানেই নিরস্ত হননি। আমাদের নিজগ্রাম উজুবটের উত্তরপাটক পল্লীটি হরিসেনের অনুচরদের হাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। বহু শিশু, নারী ও বৃদ্ধ নিহত হয়। এবং আশ্চর্য কাণ্ড কি জানো, ঐ আক্রমণের মুহূর্তেই পল্লীটি পুনরপি আক্রান্ত হয় অন্য আর একদল অশ্বারোহী সেনাদল দ্বারা। শোনা যায়, তারা পশ্চিম দেশাগত এবং জাতিতে যবন। কোনদিক থেকে আগমন এবং কোথায় প্রস্থান, তার কিছুই জানা যায়নি। তবে প্রকৃত কথা এই যে, উজুবট গ্রামের উত্তরপাটক পল্লীটি একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

হলায়ুধ মিশ্র সংবাদটি শুনে ঈষৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, তুমি যবন সেনাদলের কথা কী জানো, তাই বলো।

না হলায়ুধ, আমি ও বিষয়ে কিছুই জানি না, সোমজিৎ জানান। বলেন, এবং এ বিষয়ে আমি কিছু বলতেও আসিনি। যে কারণে আমি রাজধানীতে এসেছি সেটি শুনতে হবে তোমাকে। পিপ্পলী হাট ও উজুবটে ঘটনা দুটি ঘটে যাওয়ার পর থেকে সমগ্র অঞ্চলটি হয়ে রয়েছে সন্ত্রস্ত। গ্রামবাসী কেউ গৃহে রাত্রিযাপন করে না। কোনো রাজ–পুরুষকে দেখামাত্র মানুষ শত হস্তেন দূরাৎ পলায়ন করে। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গৃহীদের গৃহে দাসদাসী নেই। ভূমি কর্ষিত হয় না, বীজ উপ্ত হয় না, শস্য কর্তনের লোক নেই–এক ভয়ানক অবস্থা সর্বত্র। এমতাবস্থায় মহারাজের কিছু করা উচিত। যদি তিনি তাঁর সামন্তদের শাসন না করেন, তাহলে ঐ অঞ্চলগুলিতে মানুষ থাকবে না। তাই আমার আবেদন, মহারাজ তার সামন্ত হরিসেনকে আদেশ দিন, যেন তিনি প্রজাপীড়ন না করেন–ঐ প্রকার দুষ্কর্ম যেন আর না হয়।

পণ্ডিত, কত ধান্যে কত তণ্ডুল যদি বুঝতে! হলায়ুধ হাসতে হাসতে বললেন। জানালেন, তোমার কথা আমি মহারাজের গোচরে আনতে পারি–এমনকি তোমাকেও আমি রাজসভায় নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু মনে হয় না, তাতে তোমার লাভ হবে। প্রথমত, সামন্তদের রাজা শাসন করবেন না–কারণ, বহিঃশত্রু রাষ্ট্রের দ্বারদেশে উপনীত। দ্বিতীয়ত, সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের আচরণ সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। সুতরাং বিষয়টি শ্রবণ করে মহারাজ যখন মন্ত্রীদের অভিমত চাইবেন তখন মন্ত্রীদের তো যুক্তিসঙ্গত অভিমত দিতে হবে। বলো, কে তখন অযৌক্তিক অভিমতটি দেবে? বিশেষত একজন সামন্তপতির বিরুদ্ধে যেখানে অভিযোগ। উঁহু, অসম্ভব।

সোমজিৎ উপাধ্যায় হলায়ুধ মিশ্রের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিলেন। দেখছিলেন, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি বর্ণনার সময় হলায়ুধ ঈষৎ আন্দোলিত হলেও যখন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আসছে, তখন তিনি অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছেন। তখন তিনি যুক্তির প্রশ্ন তুলছেন, সম্ভাব্যতা অনুমান করছেন, এবং ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর ঘটনাবলীর নায়কদের শাস্তি না দিয়ে বরং সমর্থন করতেই আগ্রহী।

তিনি হতাশ হলেন। বললেন, শোনো হলায়ুধ, আমি জানি না, যবন জাতি সম্বন্ধে তোমার কি অভিমত। আপাতত তাদের শত্রু বলেই বিবেচনা করতে হবে। অপরদিকে সদ্ধমী বৌদ্ধদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এখন এই দুই শত্রুর মধ্যে কি একটির সঙ্গে মিত্রতা করা যায় না? বৌদ্ধরা এদেশবাসী, তাদের সঙ্গে আমাদের বহু সাদৃশ্য, দেশাচারে লোকাঁচারে আমরা ভিন্ন নই। কিন্তু যবন জাতি একেবারেই বহিরাগত। তারা এলে ধর্ম যাবে, কুল যাবে, জাতি যাবে। সেই সমূহ পতন থেকে দেশ ধর্ম ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য কি সদ্ধর্মীদের সঙ্গে মিত্রতা করা যায় না?

তুমি বৌদ্ধ পাষণ্ডদের সাথে মিত্রতা করতে বলছো? হলায়ুধ সন্দেহান্বিত দৃষ্টিপাত করেন।

হ্যাঁ, চিন্তা করে দেখো, তাহলে তোমার ধর্ম রক্ষা পাচ্ছে, জাতি রক্ষা পাচ্ছে, রাজ্য রক্ষা পাচ্ছে–তুমি নিজে রক্ষা পাচ্ছে। আমার এই আবেদনটি তুমি রাজার কাছে নিবেদন। করো।

তুমি উন্মাদ সোমজিৎ, হলায়ুধ উঠে বসলেন। বললেন, তুমি বিলক্ষণ উন্মাদ! রাষ্ট্র। কি একজন ব্যক্তির ইচ্ছায়, ক্ষণিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে চলে? আজ ইচ্ছা করলে আর অমনি সদ্ধর্মী বৌদ্ধরা তোমার বন্ধু হয়ে গেলো? সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা আর্য ধর্মের শত্রু, এ আজকের কথা নয়–বহুযুগ পূর্ব থেকেই এই শত্রুতা হয়ে আসছে। তুমি দেখো চিন্তা করে, ঐ ধর্মে স্বর্গ নরক নেই, যাগ যজ্ঞ নেই, বলিউপচার নেই, ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ নেই, একেবারেই তৃণমূলে যে অন্ত্যজ থাকে, যারা যথার্থই তৃণভোজী–এ হলো তাদের ধর্ম। এদের প্রধান দেবতা শূকর পালকের গৃহে খাদ্যগ্রহণ করেছে, তুমি চিন্তা করতে পারো? তুমি আমাদের আর্য ধর্মের কথা ভাবো, এ ধর্ম উচ্চশ্রেণীর। আর্যত্বের অর্থ হলো। শ্রেষ্ঠত্ব–এর কৌলীন্য ভিন্ন প্রকার–এর দানধ্যান আছে, উৎসব আছে, মেধযজ্ঞ আছে, স্বর্গ–নরক আছে, এ ধর্ম কর্মফলে বিশ্বাস করে এবং মনে করে না যে, সকল মানুষ সমান হতে পারে। সুতরাং মূলেই রয়েছে বিরোধ। বহু শতাব্দীর চেষ্টায় বৌদ্ধশক্তি বিনষ্ট করা। গেছে–আজ আর কোথাও বৌদ্ধশক্তি বলে কিছু নেই। কিন্তু আজ যদি তুমি তাদের। প্রশ্রয় দাও, তাদের সঙ্গে মিত্রতা করো, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছো? চণ্ডাল হড়ডি ক্ষেত্রকর ইত্যাদি সকল ব্রাত্যজন হয়ে উঠবে স্বেচ্ছাচারী, তোমার দাসদাসী বলে কেউ থাকবে না, সামন্তপতিদের ধনজন গৃহ সংসার সমস্তই লুণ্ঠিত হয়ে যাবে। কোট্টপাল নেই, মন্ত্রী নেই, সেনাপতি নেই, সামন্ত নেই, প্রহরী নেই, কী ভয়ানক অবস্থা হবে, কল্পনা করতে পারো?

দীর্ঘ বক্তৃতা প্রায়। সোমজিৎ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। শেষে বললেন, তোমার সঙ্গে তর্কে নামার ইচ্ছা আমার নেই। বৌদ্ধ সদ্ধর্মীদের সঙ্গে মিত্রতা করলে সমস্তই ধ্বংস হয়ে যাবে–এ আমার বিশ্বাস হয় না হলায়ুধ। এদেশে বৌদ্ধ ও সনাতন উভয় ধর্মের সহাবস্থান ছিলো–সে তো মাত্রই শতাব্দ দুই পূর্বের ঘটনা। পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু কই, তাদের কালে তো ব্রাহ্মণ নিগ্রহের কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। বরং সকল ধর্মের লোক সহাবস্থান করতো। সনাতনধর্মী ব্রাহ্মণ যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো সদ্ধর্মী ভিক্ষুও।

শুনতে শুনতে হলায়ুধ মিশ্র বিস্ময় মানেন, এ কী কথা সোমজিতের মুখে? এই বয়সে এসে কি লোকটার চিন্তায় বিকৃতি দেখা দিয়েছে? বিরক্তি বোধ করলেন তিনি। বললেন, সোমজিৎ, এসব বিতর্ক কেন তুলছো? আমি বুঝতে পারছি না, এসব শুধুই তর্ক, না এসব কথা তোমার মনের। আজ যদি তুমি বলো, তখনও ব্রাহ্মণ ছিলো, ধর্ম ছলো, তাহলে তো তোমার সঙ্গে তর্কই বৃথা। যদি তখন এদেশে ব্রাহ্মণই ছিলো, তাহলে সনাতনধর্মীদের দীক্ষাদানের জন্য তোমার আমার পূর্বপুরুষদের এদেশে কেন আনা হয়েছিলো? আজ নিজের অতীতকেই বিস্মৃত হতে চাও, এই তোমার ধর্মরক্ষা! ধিক তোমার পাণ্ডিত্যে!

সোমজিৎ আহত হলেন। বুঝলেন, হলায়ুধ তার কথা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন, কোনো সাহায্যই তিনি করবেন না। তবু শেষ চেষ্টা করলেন। বললেন, রুষ্ট হয়ো না হলায়ুধ, আমি তোমার সুহৃদ, তোমার কাছে যদি অন্তরের কথা প্রকাশ না করি, তাহলে কার কাছে করবো? আমার মনে হয়, ধর্ম জাতি উভয়ই এখন সংকটাপন্ন। যদি বিহিত না করা হয়, তাহলে সমস্তই ধ্বংস হবে। এতোকাল যা করা হয়েছে তা ভুল। তাতে বিরোধ বৃদ্ধি পেয়েছে, ঘৃণা, সন্দেহ ও প্রতিহিংসার ভাব লালিত হয়ে এমন আকার ধারণ করেছে যে এখন পরস্পর প্রত্যেকেই শক্র। এ না করে আমরা যদি প্রীতির কথা বলি, সহাবস্থানের কথা বলি, মিলনের কথা বলি–তাহলেই তো ঘৃণা দূর হয়, সন্দেহ যায় ও প্রতিহিংসার অবকাশ থাকে না। চিন্তা করে দেখো তুমি। বস্তুকণা বিচ্ছিন্ন হলে তার একরূপ আর ঐ বস্তুকণাই ঘনসংবদ্ধ হলে তার অন্যরূপ। আজ যদি এমন হয় যে, যবনাক্রমণের বিরুদ্ধে রাজার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রকৃতিপুঞ্জও প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে, তাহলে এই যবনদের আক্রমণ আর কয়দিন? তুমি মহামন্ত্রী, আমার কথাটি বিবেচনা করে দেখো। অন্তত রাজসভায় আমার প্রস্তাবটি দিয়ে দেখো।

হলায়ুধ মিশ্র উঠলেন। অহেতুক অনেক বিলম্ব হয়েছে। এই প্রকার প্রলাপ শুনতে হবে, তিনি কল্পনাও করেননি। তবু বললেন, বন্ধু সোমজিৎ, রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করে তুমি অহেতুক মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করছো, ওতে কোনো ফল হবে না। আর জেনো, ব্যক্তির ইচ্ছায় কিছুই হয় না–সমস্তই হয় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। আর এও জেনো, কর্মফল থাকবেই–দাসও থাকবে, প্রভুও থাকবে। প্রভু যে শাসন করে, সে যেমন কর্মফল, দাস যে শাসিত হয়, সেও তেমনি কর্মফল। যবনদের আগমনে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েই বা কী করবে–যা ভবিতব্য তাই হবে। এও কর্মফল বলতে পারো। আমার বিশ্বাস, যবনদের আগমনে ধর্ম বলো, জাতি বলো, সমাজ বলল, কোনো কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তারা যদি এদেশ জয় করে নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের এদেশ শাসন করতে হবে। সামন্ত বলো, মন্ত্রী বলো, সেনাপতি বলো, এমনকি গ্রামপতি বীথিপতি বলো–এদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে কি রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব? সুতরাং অহেতুক তোমার দুশ্চিন্তা। যবনরা যদি আসে, তখনও দেখবে তাদের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা সদ্ভাব করছে আমাদের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে। নীচ যে, সে সর্ব অবস্থায় নীচই থাকবে।

সোমজিৎ উঠলেন। হলায়ুধ মিশ্রের কথা শুনে ক্ষীণ হাসি ফুটলো তার মুখে। বললেন, মনে হচ্ছে যবনদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করার জন্য রাজধানীর লোকেরা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে?

হলায়ুধ স্থির করেছেন পুরাতন বন্ধুর উপর কুপিত হবেন না। শান্ত কণ্ঠে বললেন, বিদ্রূপ করো না সোমজিৎ। যবনেরা কীরূপ শক্তি ধরে তা কি জানো? দৈহিক, শাস্ত্রিক, আধ্যাত্মিক সকল বলেই তারা অধিকতর পারঙ্গম। একটি যবন সাধুপুরুষকে দেখলাম, একটি মৃত বালককে মন্ত্রবলে জীবিত করে দিলো। তুমি কল্পনা করতে পারো, তিনটি বন্য ব্যাঘ নিমেষে বশীভূত হয়ে গেলো ঐ সাধুপুরুষটির সামান্য একটি ইঙ্গিতে। এদিকে রাজ জ্যোতিষীরা গণনা করে যা দেখেছেন, তাতে মঙ্গল কিছুই দেখা যাচ্ছে না মহারাজের জন্য। এমতাবস্থায় যজ্ঞানুষ্ঠানের বিধান দেওয়া হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস, ওতেই কাজ হবে।

সোমজিৎ বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে হলায়ুধের কথা শুনছিলেন। তাঁর বিশ্বাস হতে চাইছিলো না যে ঐ প্রকার কথা বলতে পারে হলায়ুধ মিশ্রের মতো লোক। তিনি ভেবেছিলেন, জিজ্ঞাসা করবেন, ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থখানির রচনা সমাপ্ত হয়েছে কি না–আর সেই আখ্যান গ্রন্থখানির কি হলো, যেখানি তিনি গত বৎসর আরম্ভ করেছিলেন। আরও জানার ইচ্ছা ছিলো, বল্লাল রচিত অদ্ভুত সাগর গ্রন্থখানি মহারাজ সমাপ্ত করছেন বলে তিনি শুনেছিলেন, গ্রন্থখানির রচনা কি সমাপ্ত হয়েছে? কিন্তু হলায়ুধের কথা শুনে ঐ সকল প্রসঙ্গ আর তুললেন না। তাঁর প্রবৃত্তি হলো না। তার তখন মনে হচ্ছে, গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেন দেবের মহামন্ত্রীর কোনো উদ্বেগ নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কী ঘটবে, তা যেন সমস্তই জানা হয়ে গেছে সবার–এবং সেই সঙ্গে কার কি করণীয় তা–ও যেন স্থির করে রেখেছে প্রত্যেকে।

সোমজিৎ ক্লান্তপদে চতুষ্পঠী থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। কেশবাচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, পিতঃ আপনি পদব্রজে যাবেন?

তিনি কিছুই বললেন না জামাতার প্রশ্নের উত্তরে।

সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। রাজপথে এখন বহু লোক। বিপণীগুলিতে তৈলদীপ জ্বালানো হচ্ছে। দূরে কোনো এক মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেলো। সোমজিৎ ক্লান্ত পদক্ষেপে ধীরগতিতে পথক্রমণ করছিলেন। একটি ভবনের সম্মুখ দিয়ে যাবার সময় দেখলেন ভবনটির সম্মুখে ক্ষুদ্র একটি জনসমাবেশ। একটি লোককে পরিচিত মনে হলো। মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছেন। লোকটি নিকটে এসে প্রণাম করলে চিনলেন–সামন্ত হরিসেনের অনুচর উল্লাসদত্ত। বললেন, তুমি এখানে?

হ্যাঁ মহাশয়, উল্লাস জানায়, আমাদের প্রভু রাজধানীতে এসেছেন।

সোমজিৎ দক্ষিণে বামে দৃষ্টিপাত করে বলেন, তিনি কোথায়?

লোকটি ইতস্তত করে ক্ষণেক। শেষে বলে, উনি ঐ ভবনে এসেছেন। আপনি কি সাক্ষাৎ করবেন?

কে থাকে ওখানে, কার ভবন ওটি?

লোকটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, আপনার যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলে বলুন।

সোমজিৎ বুঝলেন, হরিসেন কোথায় এসেছে সেই সংবাদটি তাঁর অনুচর গোপন রাখতে চায়। বললেন, সংবাদ গোপন রেখে কি হবে, আমি মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, তোমার প্রভুকে বলে দিও, তার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, তিনি যা। করছেন, তা-ই এখন করণীয় সকলের।

লোকটি প্রায় বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখে সোমজিৎকে। তারপর জানায়, না মহাশয়, আপনি যা ভাবছেন তা নয়–ঐ ভবনে কোনো রাজপুরুষ থাকেন না, ওটি নগর নটিনী বিদ্যুপ্রভার ভবন। আপনি কি অভ্যন্তরে যাবেন?

সোমজিৎ কী বলবেন ভেবে পান না। লোকটির কি হ্রস্ব দীর্ঘ কোনো জ্ঞানই নেই? বললেন, না বৎস, আমি বৃদ্ধ লোক, দেখতেই পাচ্ছো

তাতে কি? লোকটি সলজ্জ হাসি হেসে জানায়, এখানে বহু বৃদ্ধ রাজপুরুষ আসেন। বিদ্যুত্বভার নৃত্য দেখলে জীবনে ভুলতে পারবেন না।

সোমজিৎ আর বাক্য ব্যয় করলেন না। না, আর কিছু জানবার বা বুঝবার নেই। লোকমুখে এবং জনরবে যা শুনেছিলেন, সবই সত্য। সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, ব্যস্ত আনন্দ আর ব্যসনে। রাজকর্ম কী, প্রজাপালন কী, যুদ্ধবিগ্রহ কী,এ সকল বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। উত্তম লক্ষ্মণাবতী, তিনি মনে মনে বললেন, উত্তম রাজ চক্রবর্তী পরম ভট্টারক ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়কুলতিলক মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মণ সেন দেব, সমস্তই উত্তম, কারোই কিছু করণীয় নেই–না তোমার, না তোমার অনুচরদের। ভবিতব্য তোমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা–ই ঘটবে, বৃথাই আমরা চিন্তা করে মরি।

 ০৭. সন্ধ্যার পর রাত্রির প্রথম প্রহরে

সন্ধ্যার পর রাত্রির প্রথম প্রহরে বসন্তদাস মন্দিরের চত্বরে এসে দাঁড়ায়। অধিকক্ষণ দাঁড়াতে হয় না–একটি ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে পশ্চাতে এসে বলে, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

মন্দিরের পার্শ্বে সংকীর্ণ পথ। সেই পথ দিয়ে যেতে হয় মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে। দেখা যায়, মন্দিরের পশ্চাতেও বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। সেখানেও একটি ক্ষুদ্র কুসুমিত উদ্যান–এবং ঐ উদ্যান সংলগ্ন পাশাপাশি কয়েকটি প্রকোষ্ঠ। এক প্রকোষ্ঠে ঘৃতদীপ জ্বলছিলো। কক্ষটির দ্বার উন্মুক্ত করে লোকটি বললো, ভিতরে যান, ছায়াবতীর আসতে বিলম্ব হবে, আপনি এখানেই বিশ্রাম নিন।

লোকটি অন্য কেউ নয়, দীপের আলোয় দেখা গেলো, সে অংশুমান। প্রকোষ্ঠের চারিদিক দৃষ্টিপাত করে নিলো বসন্তদাস। প্রকোষ্ঠটি ক্ষুদ্র, কিন্তু সুন্দর। দেওয়ালগাত্রে দীপস্থান, শয়নবেদীটি সামান্য নীচু, এক কোণে একখানি কাষ্ঠাসন, তাতে একখানি অজিন পাতা। দেখে মনে হয়, এ প্রকোষ্ঠে সম্মানিত ব্যক্তিরাই অবস্থান করেন। অংশুমান বললো, রাত্রে আপনি এখানেই আহার করবেন, ছায়াবতীর অনুরোধ।

অংশুমান ঐ কথাটি জানিয়ে প্রস্থান করে। বসন্তদাসের অদ্ভুত লাগছিলো সমস্ত ব্যাপারটি। আজই পরিচয় এবং ঐ স্বল্প পরিচয়েই ছায়াবতী তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে মন্দিরে রাত্রিযাপনের জন্য। সে কিছুই অনুমান করতে পারে না। সত্যই কি কোনো সংবাদ দিতে পারবে ছায়াবতী? নাকি শুধুই রাত্রিযাপনের সঙ্গী হবার আমন্ত্রণ? তার জীবনে যে কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে, ঈশ্বর জানেন।

রাত্রির প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হয় দেখতে দেখতে। এক সময় অংশুমান ফলাহারাদি সম্মুখে এনে রাখে। বলে, আপনি আহার করে বিশ্রাম নিন। ছায়াবতী সম্ভবত প্রত্যুষে আপনার সঙ্গে কথা বলবে।

এ যে অতিথিকে আমন্ত্রণ করে এনে তার মুখের উপর সশব্দে দ্বার বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা! হাসি পায় বসন্তদাসের। ছায়াবতীর সম্ভবত এটি এক প্রকারের রসিকতা। পুরুষকে চঞ্চল করে কৌতুক উপভোগ করার যে একটি সহজাত প্রবণতা ছলনাময়ী নারীর থাকে, সম্ভবত সেই প্রবণতার বশেই ছায়াবতী তাকে আমন্ত্রণ করে এনেছে এবং অন্তরাল থেকে দারুণ কৌতুক উপভোগ করছে। উত্তম কথা ছায়াবতী, সে মনে মনে বলে, তোমার ক্রীড়নক হতে আমার আপত্তি নেই, দেখি, তোমার কতক্ষণ এবং কতো প্রকারে ক্রীড়ামত্তা থাকতে পারে। সে ঘৃতদীপটি ফুৎকারে নির্বাপিত করে শয্যায় দেহ স্থাপন করে।

কিন্তু নিদ্রা আসে না। আজ সে নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে সন্ধান করে এসেছে। প্রকাশ্যে তো কিছুই বলা যায় না। পান্থশালায়, নয়তো মন্দিরপ্রাঙ্গণে অথবা বটবৃক্ষতলে অপেক্ষা করতে হয়। যদি কোনো মানুষকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, তখন সন্তর্পণে তার কাছে প্রশ্নটি করতে হয়। তবে একটি বিষয়ে সে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়েছে–আর তা হলো এই যে, পূর্বতীরে যোগীদের দুএকজনকে যদি বা দেখা গেছে–ভিক্ষু একজনকেও নয়। ভিক্ষুদের উপর কোনো রাজকীয় নির্দেশ আছে কি না কে জানে। যদি ফল্পগ্রাম অথবা বালিগ্রামের মতো অবস্থা এখানেও হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে চিন্তার কথা। চিন্তা নিজের জন্য নয়। চিন্তা ছায়াবতী এবং অংশুমানের জন্য।

শুনে এসেছে, বিল্বগ্রামের সামন্তপতি সুধীমিত্র পরম বৈষ্ণব এমন একটি আকাশচুম্বী বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ করেছেন, যে না দেখলে বিশ্বাস হওয়া কঠিন। তিনি প্রজাবৎসল, সনাতন ধর্মীরা এতো সুখে জীবনযাপন করে যে ধর্মদ্বেষী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখলেই তাদের দূর দূর শব্দে বিতাড়ন করে।

হঠাৎ মনে হয়, বাহিরে কার যেন পদশব্দ। সে উৎকর্ণ হয়। এ কি সেই বালিগ্রামে অবলোকিতেশ্বর মন্দিরের মতো অবস্থা হলো না কি? হঠাৎ যদি এখন সেইরূপ কোনো গ্রন্থিছেদকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? সে অপেক্ষা করতে লাগলো।

না, পদশব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। বোধ হয় আদৌ পদশব্দই নয়। রাত্রির কোনো মার্জার সম্ভবত অলিন্দে পতিত হয়েছিলো।

আবার শব্দ হয়। এবার রুদ্ধদ্বারে মৃদু করাঘাত। অগত্যা বসন্তদাসকে উঠতে হলো। দ্বার উন্মোচন করবে কি না দুমুহূর্ত চিন্তা করলো। শেষে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, বাহিরে কে?

মহাশয় কি নিদ্রিত? নারীকণ্ঠের মৃদু ডাক। প্রথমে সে উত্তর দিলো না। দ্বিতীয়বার। যখন ডাকটি পুনরায় শোনা গেলো, তখন সে জানতে চাইলো, কে আপনি?

আমি ছায়াবতী, দ্বার খুলুন।

বসন্তদাস দ্বার উন্মোচন করলে ছায়াবতী কক্ষে প্রবেশ করে। অন্ধকারে বার দুই দুজনের শরীর স্পৃষ্ট হয়। কিন্তু বসন্তদাস সংযম ত্যাগ করে না। ছায়াবতাঁকে মনে হয় পরিশ্রান্ত, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলো সে। বসন্তদাস বললো, আমি দীপ জ্বালি, আপনি বসুন।

কেন দীপ জ্বালাবার কি প্রয়োজন? কথা তো অন্ধকারেই হতে পারে।

বসন্তদাস আমূল কম্পিত হয়। সত্যই কি এই নারী তার প্রতি প্রণয়াসক্তা হয়েছে? সে বললো, ভদ্রে অন্ধকারে তো কিছুই বোধগম্য হয় না, যার সঙ্গে কথা বলছি, তার মুখ না দেখলে কি নিশ্চিন্তে কথা বলা যায়, বলুন?

ছায়াবতী হাসে মৃদু। অন্ধকারে দেখা যায় না, কিন্তু শোনা যায় হাসিটি। বলে, দীপ জ্বালবেন না–বরং দ্বার মুক্ত করুন, বাহিরে চন্দ্রালোক আছে, তাতে কাজ হবে।

দ্বার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করতেই বাহিরের চন্দ্রালোক ভিতরে প্রবেশ করে। কৃষ্ণপক্ষের ভগ্নচন্দ্রের মলিন জ্যোৎস্না। কিন্তু তাতেও ছায়াবতাঁকে দেখা যায়। তার দেহে বাসকসজ্জার বেশ। সে মনে মনে প্রমাদ গণনা করে। বলে, বসন্তদাস, তোমার ললাটলিপি খণ্ডাবে কেমন করে?

শয্যায় আসন নিয়েছিলো ছায়াবতী। সে ডাকলো, এখানে এসো, পাশে বসো আর অনুগ্রহ করে গ্রাম্য ষণ্ডের মতো গাঁক গাঁক করে চিৎকার করো না, মৃদু স্বরে কথা বলল।

বসন্তদাসের ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো। ছায়াবতী তার ইতস্তত ভাব দেখে তিরস্কার করে। বলে, তুমি যে দেখছি অনভ্যস্ত বালকের মতো আড়ষ্ট হয়ে রইলে। ভয় পেয়ো না হে সাধুপুরুষ, তোমার সংযমের প্রাচীর ভঙ্গ করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই–আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত–আর এ বাসকসজ্জাও তোমার জন্য নয়। এটি ইতোমধ্যেই উচ্ছিষ্ট হয়ে রয়েছে। তুমি অতিথি, দেবতাতুল্য, উচ্ছিষ্ট দিয়ে তোমার পূজা করবো, এ কি হয়?

শোনো, বসন্তদাস পার্শ্বে উপবেশন করলে ছায়াবতী পুনরায় বলতে আরম্ভ করে, সংবাদ পেয়েছি, তোমার আত্মীয়রা সুনন্দগ্রামে অবস্থান করছেন। বৃদ্ধ শুকদেব, তাঁর স্ত্রী ও কন্যা এবং অপর একজন প্রৌঢ় একত্রে আছেন। আশ্রয়দাতা এক ক্ষেত্রকর গৃহস্থ। প্রত্যেকেই সুস্থ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওদিকে উজুবটের অবস্থা এখন শান্ত, হরিসেন এখন রাজধানীতে। তবে মনে করো না যে তুমি নিরাপদ। তোমার নাম গূঢ় পুরুষেরা জানে। তোমাকে যদি পায়, তাহলে অবশ্যই বন্দী করবে। তোমার ঐ স্থানে গমন নিষিদ্ধ।

বিস্ময়ে বসন্তদাসের বিমূঢ়াবস্থা হয়–এ নারী কি দৈবজ্ঞ নাকি। এতো সংবাদ সে কীভাবে সংগ্রহ করলো? একেবারে মায়াবতীর পিতার নাম পর্যন্ত বলে দিচ্ছে। সে বললো, ভদ্রে, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো জানি না–আপনি আমাকে স্বস্থ ও নিশ্চিন্ত করলেন, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।

ভগবান ইতোমধ্যে আমার প্রচুর মঙ্গল করেছেন, ছায়াবতী হাসে। বলে, এতো মঙ্গল করেছেন যে তা রাখবার মতো আমার স্থান নেই–এখন তুমি আমাকে কিছু সংবাদ দাও দেখি, বলল, যবনেরা কি সত্য সত্যই গ্রাম লুণ্ঠন করছে?

কেন, আপনি কি যবনদের ত্রাতা এবং দয়ালু জ্ঞান করেন?

না, তা নয়, ছায়াবতী বলে, আক্রমণকারী বহিরাগত সৈন্যদলের আচরণ সর্বত্রই এবং সর্বদাই একরূপ হওয়ার কথা, এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি বলেই আমার ধারণা। কিন্তু কেউ কেউ যে বলছিলেন, যবন জাতি এলে প্রকৃতিপুঞ্জ রক্ষা পাবে, সামন্তপতিদের অত্যাচার দূর হবে, রাজানুচরদের প্রতাপ দমিত থাকবে–সেই জন্যই কিঞ্চিৎ আশা হচ্ছিলো, হয়তো বা এই যবন জাতির আচরণ অন্যরূপ হবে–এখন দেখছি, আমার পূর্বধারণাই সত্য, আমি যাই।

ছায়াবতী উঠে দাঁড়ালে বসন্তদাস বললো, আমার একটি কৌতূহল আছে।

বলো।

আপনি কেন এই গোপনতা অবলম্বন করেছেন–প্রকাশ্যে কি এসব কথা বলা যেতো না?

না হে নাগর, তা বলা যেতো না, হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে বেপথু হয় ছায়াবতী। বলে, প্রণয় ভাষণ কি প্রকাশ্যে সম্ভব? না তাতে আনন্দ আছে? আমি যে তোমার প্রণয় প্রার্থিনী হে, তা কি বোঝোনি?

হাসির উচ্ছ্বাস দমন করে যখন স্বাভাবিক হলো ছায়াবতী তখন সে আবার অন্য রমণী। বললো, বসন্তদাস, একটা কাজ করে দেবে?

বলুন, কী কাজ?

পুন্ড্রনগরীর একটি সংবাদ চাই। নিরঞ্জন আমার ভ্রাতা, বাল্যকাল থেকে নিরুদ্দেশ শুনেছি, সে সদ্ধর্মীদের সঙ্গে থাকে এবং প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছে, যদি পারো, সংবাদটি আমাকে এনে দিও।

ছায়াবতীর কথা শুনে বসন্তদাসের মনে একইসঙ্গে নানান প্রশ্নের উদয় হয়। মন্দিরদাসীরও তাহলে ভ্রাতা থাকে, এবং সেই ভ্রাতার জন্য আবার উৎকণ্ঠাও থাকে? ওমন তো কখনও শোনেনি সে। উপরন্তু সংবাদ সংগ্রহের জন্য সে কি উপযুক্ত ব্যক্তি?

বললো, আপনি নিজেই তো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন–আপনার মতো কি আমি পারবো?

ছায়াবতী নীরব থাকে কয়েকমুহূর্ত। তারপর বলে, তার সংবাদ তো আমি পেয়েছি কিন্তু সে আমার সংবাদ পাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।

বসন্তদাস স্বীকৃতি দান করে। বলে, যদি আমি তার সাক্ষাৎ পাই, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আপনার কথা বলবো।

ছায়াবতী আরও কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর বলে, আমি যাই এবার, রাত্রি হয়েছে।

আর হ্যাঁ, শোনো, ছায়াবতী পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে, কাল প্রভাতে যখন পূজারম্ভে লোকসমাগম হবে, তখন মন্দির ত্যাগ করো, পূর্বে বা পরে নয়। আমার দুই প্রেমিক প্রায় সর্বক্ষণই মন্দিরের উপর দৃষ্টি রাখে।

ছায়াবতী অন্ধকারে ছায়ার মতোই অদৃশ্য হলো। বসন্তদাস দ্বারের বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার অবাক লাগছিল, অদ্ভুত রহস্যময়ী এই নারী। কেন যে অমন কৌতুক করে, বোধগম্য হয় না। তবে অস্পষ্ট অনুমান হয়, তার জীবনে কোথাও একটি গভীর বেদনা রয়েছে। সে যখন হাসে, তখন মনে হয়, সে হাসি কান্নারও অধিক। আর কি মমতাময়ী! বসন্তদাস তার কেউ নয়, অথচ তার নিরাপত্তার জন্য কতই না চিন্তিত। সে ছায়াবতীর উদ্দেশে মনে মনে প্রণতি জানালো।

কৃষ্ণার কথা মনে পড়লো ঐ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেও এক মন্দিরদাসী, মাত্র এক রজনীর জন্য এসেছিলো তার জীবনে। কিন্তু ঐ একটি রজনী দুরপনেয়ভাবে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে তার স্মৃতিতে। কৃষ্ণার সঙ্গে কি আর কোনোদিন দেখা হবে না? তাকে। কি প্রাণ দিতে হয়েছে শেষাবধি? সে জানে না, প্রকৃত সংবাদ কেউ দিতে পারেনি। মিত্রানন্দকে সে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছে–যেদিন শেষ সাক্ষাৎ হলো উজুবটে, সেদিনও। কিন্তু না, মিত্রানন্দ কোনো সংবাদই জানে না।

সে আর এক কাহিনী–যে কাহিনী তাকে মিত্রানন্দের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, যে কাহিনীর মধ্য দিয়ে, বলা যায়, তার জন্মান্তর হয়েছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, বসন্তদাস, তুমি কি এমন ছিলে?

 ০৮. দেবীকোট মেলায় যবন বৃদ্ধটি

দেবীকোট মেলায় যবন বৃদ্ধটিকে সমাধিস্থ করে বসন্তদাস যে স্বর্ণ ও মণিখণ্ডগুলি পায়, সেগুলি ক্রমে তার কাছে হয়ে ওঠে দুর্ভার। সে জানতে, ঐ সকল মণিমাণিক্য যদি বিক্রয় করতে হয়, তাহলে পুন্ড্রনগরীতে যেতে হবে। সেই চিন্তাক্রমে সে যাত্রাও করেছিলো পুন্ড্রনগরী অভিমুখে। সেই সঙ্গে আবার পথিমধ্যে ধনী বণিকের সন্ধানেও ছিলো তৎপর। তবে সমস্তই সাবধানে। নিজের কাছে যে মূল্যবান কিছু আছে, তা সে কখনই প্রকাশ হতে দেয়নি।

পথিমধ্যেই সাক্ষাৎ হয় এক বৃদ্ধ সুবর্ণবণিকের সঙ্গে। বণিকটি বৃদ্ধ এবং সজ্জন। তিনি বসন্তদাসকে নিজ গৃহে নিয়ে যান। সেখানে বসন্তদাস একটি হীরকখণ্ড বৃদ্ধকে দেখায়। জানতে চায়, এর প্রকৃত মূল্য কত হতে পারে, বলবেন?

বৃদ্ধ প্রথমত বিমূঢ় হয়ে যান। পরে হীরকখণ্ডটি হাতে নিয়ে মনোযোগসহকারে পরীক্ষা করে বলেন, মহাশয় যদি বিক্রয় করতে চান, তাহলে আমি দুইটি পর্যন্ত দীনার দিতে পারি।

ঐ কথা শুনে বসন্তদাস প্রমাদ গণনা করে। কী কাণ্ড দেখো, যেটি ক্ষুদ্রতম, তারই মূল্য দুই দীনার! এখন তার নিকট মণিমাণিক্য আছে, এই সংবাদটি প্রচারিত হলেই হয়েছে। আর দেখতে হবে না, দস্যুহস্তে মৃত্যু একেবারে অবধারিত। সে জানায়, মহাশয়, এই মণিটি আমি আপনার কাছে বিক্রয় করছি–কিন্তু এই ক্রয়–বিক্রয়ের কথাটি আপনাকে গোপন রাখতে হবে, আমি এইরূপ আরও কয়েকটি মণি আপনার কাছে বিক্রয়ের আশা রাখি।

বয়সে বৃদ্ধ হলেও বণিকটির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। মণিমাণিক্যাদি যেমন চেনেন, তেমনি চেনেন মানুষকেও। বসন্তদাসকে বললেন, মহাশয়, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে আমি যে মূল্য দিয়েছি সেটি প্রচার করলে বিপদ কি শুধু আপনার? আমার নয়? আপনি নিশ্চিন্তে অন্য হীরকগুলি নিয়ে আসবেন–সমস্তই আমি ক্রয় করবো।

বসন্তদাসের একেকবার লোভ হচ্ছিলো হীরকগুলি বাহির করে। কিন্তু আবার ভয়ও হচ্ছিলো। সে নিজেকে সংযত রাখলো। এবং জানতে চাইলো, মহাশয়, যদি এমন হয় যে পুন্ড্রনগরীর বণিকেরা অধিক মূল্য দিতে চাইলো, তখন কি হবে?

বৃদ্ধ হাসলেন। বললেন, মহাশয়ের বোধ হয় সন্দেহ হচ্ছে যে কম মূল্য পেয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধের একটি কথা মনে রাখবেন, ভুলেও যেন মণিমাণিক্যাদি নিয়ে পুন্ড্রনগরীর বণিকদের কাছে যাবেন না। গেলে সর্বনাশ হবে, তারা দস্যু লুণ্ঠকদের পোষকতা করে। আপনি আমার কাছে না আসুন, অন্যত্র যান, কিন্তু কখনই ঐ পুন্ড্রনগরীর বণিকদের কাছে যাবেন না। প্রকৃত ধনী বণিকেরা কি এখন আর প্রকাশ্যে বণিকবৃত্তি করতে পারে? দেখছেন না, স্বর্ণ বণিকেরা কীভাবে রাজপুরুষদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। এখন প্রকৃত বণিক নেই–যারা আছে, তারা প্রতারক, নয়তো লুণ্ঠক।

বৃদ্ধের কথা যে অমূলক নয় তা বসন্তদাস অপেক্ষা অধিক আর কে জানে। সে কৌতূহলী হলো। বললো, আমি না হয় বণিকদের কাছে গেলাম না, কিন্তু আপনি ঐ মণিমাণিক্যাদি নিয়ে কি করবেন? নিশ্চয়ই আপনাকে বিক্রয় করতে হবে।

বৃদ্ধ ঐ কথা প্রসঙ্গেই সেদিন ফল্পগ্রামের সামন্তপতি শ্রীনাথবর্মণের সংবাদ জানান। দশ ক্রোশ উত্তর–পূর্বে গেলে ফল্পগ্রামে উপনীত হওয়া যাবে। ঐ ফরুগ্রামের সামন্তপতি শ্রীনাথবর্মণ বিলাসী, ব্যসনপ্রিয় এবং ধনী। মণিমাণিক্য সংগ্রহের উৎসাহ তাঁর প্রবল।

নামের সঙ্গে গ্রাম শব্দটি যুক্ত থাকলে কি হবে, ফল্পগ্রাম সমৃদ্ধ জনপদ। এই জনপদে ক্ষুদ্র একটি জয়স্কন্ধাবার বর্তমান। নিকটবর্তী সমৃদ্ধতর জনপদ বালিগ্রাম, সে স্থানের জয়স্কন্ধাবারটি বৃহত্তর। বসন্তদাস ফরুগ্রামে উপনীত হয়ে নিজের বণিক পরিচয়টিই প্রচারিত করে।

শ্রীনাথবর্মণের সম্মুখীন হয়ে বসন্তদাস প্রণাম জানিয়ে বলে, মহারাজ, আমি দূর দেশ থেকে এসেছি, আপনার খ্যাতি ও মহিমা বহুদূর বিস্তৃত–তদুপরি আপনার সৌন্দর্য বোধ ও সুরুচির পরিচয় লোকের মুখে মুখে প্রচারিত–আমি সেই কারণেই সামান্য কিছু সামগ্রী নিয়ে এসেছি–আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করলে আমি নিজের বণিকজীবন সার্থক মনে করবো।

শ্রীনাথবর্মণ প্রথমে বস্ত্র দুখানি দেখলেন। দেখে বললেন, তুমি দেখছি প্রকৃতই রুচিবান লোক হে, বস্ত্ৰ দুখানি তুমি আমাকে দিতে পারো।

গন্ধাসবের আধার দুটি শ্রীনাথবর্মণের হাতে দেওয়া হলে তিনি একেবারে উল্লসিত হয়ে উঠেন। বলেন, অহহ! কী সুগন্ধ! পারিজাত পুষ্পের সুগন্ধ কি এই প্রকার হয়? তুমি যে আমাকে অত্যাশ্চর্য বস্তু দেখালে হে!

অতঃপর একটি হীরকখণ্ড তার সম্মুখে রাখলো বসন্তদাস। হীরকখণ্ডটি অত্যধিক দ্যুতিময়। নিজ হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন সামন্তপতি। মনে হলো, চিন্তা করলেন কিছু। তারপর জানতে চাইলেন, আর কি আছে তোমার দেখি?

প্রভু যা দেখছেন, এই-ই আমার সম্বল, অধিক কোথায় পাবো–ক্ষুদ্র বণিক আমি এসব পণ্যের কিরূপ মূল্য তাতে আপনার অবিদিত নয়।

হুঁ, শ্রীনাথবর্মণ অর্ধশায়িত অবস্থা থেকে দেহটিকে সামান্য তুললেন। বললেন, বাকপটুতাতে দেখছি কম যাও না। কিন্তু ঐ বাকপটুতা অন্যত্র প্রদর্শন করো–এখন যা আছে, বাহির করো, আমি দেখবো।

বসন্তদাসের ইতস্তত ভাব দেখে শ্রীনাথবর্মণ দুজন প্রহরীকে ডাকলেন। আদেশ করলেন, দেখো তো এই দুর্বিনীত লোকটার কাছে আর কি কি আছে?

ঘোর বিপদ সম্মুখে। বসন্তদাস আর বাক্যব্যয় না করে কটিবন্ধের স্থলীটি উন্মোচিত করে সমুদয় দ্রব্যাদি ভূমিতে সামন্তপতির পদপ্রান্তে রাখলো।

শ্রীনাথবর্মণ কিছু বললেন না। প্রথমে হীরক খণ্ডগুলি হাতে তুলে নিলেন। তারপর এক দুই করে স্বর্ণখণ্ডগুলি গণনা শেষ হলে বললেন, নিলাম হে বণিক, সমস্তই নিলাম।

ঐ কথা বলে আসন থেকে উঠে তিনি অন্তঃপুরের দিকে পদক্ষেপণ করলেন। বসন্তদাসের মনে হলো, তার যথাসর্বস্ব চলে যাচ্ছে। সে কাতর কণ্ঠে বললো, প্রভু মূল্য কখন পাবো?

অ, মূল্য–না? শ্রীনাথবর্মণ ফিরলেন। পুনরায় আসনে উপবেশন করে বললেন, নাম কি?

আজ্ঞে বসন্ত।

বসন্ত কী?

বসন্তদাস।

উত্তম কথা, কুলবৃত্তি কী, সেটি বলছো না কেন?

আজ্ঞে আমরা ক্ষেত্রকর, আমার পিতা হেমন্তদাস আত্রেয়ী তীরে ক্ষেত্রকর্ম করেন।

উত্তম উত্তম–পিতৃনাম স্মরণে আছে তাহলে। তা ক্ষেত্রকররা কি ইদানীং বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেছে নাকি, আঁ? বৃত্তি সাংকর্য সৃষ্টি করে চলেছো, তোমার লজ্জা করে। না? পাপবোধ নেই, আঁ?

অদ্ভুত কথা! বসন্তদাস কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। শেষে সবিনয়ে বলে, প্রভু ক্ষমা করবেন, যদি অপরাধ হয়–কিন্তু প্রত্যেক বৃত্তিতেই তো এমন কিছু লোক থাকে যারা কুলবৃত্তি ত্যাগ করে অন্যবৃত্তি গ্রহণ করে।

মিথ্যা ভাষণ করো না বসন্তদাস। শ্রীনাথবর্মণ রোষ কষায়িত দৃষ্টি রাখেন বসন্তের মুখের উপর। বসন্তদাসের মনে ভয় ঈষৎ শিহরিত হয়।

শোন হে ক্ষেত্রকরের পুত্র, শ্রীনাথবর্মণ বলতে লাগলেন, তোমার অপরাধ সীমাহীন প্রথমত, তুমি মিথ্যা কথা বলেছো, অতঃপর এখন যা বলছো, তা যদি সত্য হয়, তাহলে তুমি ধর্মদ্রোহীও বটে। উপরন্তু আমার সন্দেহ, এ সমস্তই তোমার অপহৃত সম্পদ। নাহলে ক্ষেত্রকরের পুত্র হয়ে এতো মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী তুমি কোথায় পাবে? এমতাবস্থায়। এ দ্রব্যগুলি রাজকোষে গচ্ছিত থাকবে। তুমি যার কাছ থেকে এই মণিমাণিক্যাদি সংগ্রহ করেছে তাকে যদি আমার সম্মুখে আনতে পারো, তাহলেই এগুলির মূল্য পাবে, নচেৎ নয়। এখন তুমি যেতে পারো।

প্রভু, দয়া করুন, বলে বসন্তদাস কাকুবাদ করতে আরম্ভ করে। কিন্তু ফল হয় না তাতে। প্রাসাদের প্রহরীরা তাকে তুলে এনে প্রাসাদদ্বারের বাহিরে রেখে যায়। যাবার সময় এক প্রৌঢ় প্রহরী বলে যায়, বৎস তুমি নির্বোধ। ঐভাবে সমুদয় পণ্য নিয়ে কেউ যায় সামন্তপতির কাছে? যা হয়েছে, হয়েছে–এবার গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যাও। এ স্থানে গোলযোগ করলে হয়তো তোমাকে শূলেও দিতে পারেন, সামন্তপতি ভয়ানক ক্রোধী পুরুষ। তিনি যে তোমাকে বন্দী না করে প্রাসাদের বাহিরে পাঠিয়েছেন এ তোমার চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য মনে করবে।

বসন্তদাস হতবাক, এ কি হলো! মুহূর্তের মধ্যে তার সর্বস্ব অপহৃত হয়ে গেলো? তার কিছুই করণীয় নেই? সে বিভ্রান্ত হয়ে পথে পথে ভ্রমণ করতে লাগলো।

শেষে এক বিপণীকার পরামর্শ দিলো, মহাশয়, এভাবে শক্তিক্ষয় করে কোনো ফল হবে না–আপনি বরং মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের কাছে যান–তিনি অত্যন্ত প্রতাপশালী, যদি তার দয়া হয়, তাহলে আপনার পণ্যের আংশিক মূল্য পেয়েও যেতে পারেন।

আবার এও জানালো লোকটি–তবে দেখবেন, যেন কোনো কারণে রুষ্ট না হন। তিনি, হলে কিন্তু বিপদ।

ফল্গুগ্রাম থেকে বালিগ্রামের দূরত্ব অধিক নয়–দুই প্রহরের পথ। বালিগ্রাম সমৃদ্ধতর জনপদ–এ স্থানের জয়স্কন্ধাবারটি বৃহত্তর। এটি নির্মিত হয়েছিলো বৈরী সমতট এবং কামরূপের উপর গৌড়াধিপের দৃষ্টি রাখার জন্য। এখন বৈরী কেউ–ই নয়, সুতরাং সেনাবাহিনীর তৎপরতাও সেরূপ নয়। তারা নগরে ভ্রমণ করে এবং আনন্দর্তিতে কালযাপন করে। পথিপার্শ্বের বিপণীগুলিতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত ক্রয়–বিক্রয় চলে। ভগবান বিষ্ণুর বিরাটাকার মন্দিরটিতে লোকজনের গমনাগমনের বিরতি নেই। শৌণ্ডিকালয়গুলিতে মাদকপায়ীদের সোল্লাস চিৎকার প্রায় সর্বক্ষণই শোনা যায়। অর্থাৎ জনপদটি যথার্থই সজীব এবং প্রাণময়।

বসন্তদাস মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের প্রাসাদে প্রবেশের কোনো ব্যবস্থাই করতে পারে। না। প্রতিদিন প্রাসাদদ্বারে যায়, প্রহরীদের অনুনয় বিনয় করে এবং ব্যর্থ হয়। প্রতিদিনই এই ঘটনাক্রমে দ্বাররক্ষীরা বিরক্ত হয়ে উঠলো। একদা এক প্রৌঢ় রক্ষী কাছে ডেকে নিয়ে বললো, বৎস, তুমি অহেতুক নিজের বিপদ সৃষ্টি করছো, মহাসামন্তের গূঢ়পুরুষেরা তোমার আচরণে সন্দেহান্বিত হয়ে উঠেছে। আমি বলি কি, তুমি মঙ্গলমতে বিদায় হও, যদি একবার তাদের হাতে বন্দী হও, তাহলে কিন্তু তারা পিতৃনাম বিস্মরণ করিয়ে তবে ছাড়বে।

কিন্তু বসন্তদাসের সংকল্প টলে না। বলে, মহাশয়, তবে কি সুবিচার পাবো না? এদেশে আমাকে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে যেতে হবে?

লোকটি বিরক্ত হয়ে চলে যায়। বলে, তোমার মঙ্গলের জন্যই সৎ পরামর্শ দিলাম, এখন তোমার অভিরুচি–যা উত্তম বিবেচনা মনে হয়, তাই করো।

সে রাত্রিযাপন করতো একটি প্রাচীন মন্দিরের অতিথিশালায়। মন্দিরটি পরিত্যক্ত প্রায়। অবলোকিতেশ্বরের বিগ্রহটি অবশ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল কিন্তু বিগ্রহের পূজা হতো কি না। বলা কঠিন। কয়েকজন ভিক্ষু ও শ্রমণকে কখনও কখনও দেখা যেতো, কিন্তু তাদের যে। কী কাজ, তা কিছুই বুঝবার উপায় ছিল না।

পান্থশালাটির অবস্থা আরও শোচনীয়। অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মনে হতো যেন বা গুহায় প্রবেশ করেছি। দ্বিপ্রহরেও সেখানে রাত্রির মতো অন্ধকার এবং সেই সঙ্গে বহুকালের প্রাচীন একটি শীতল ভাব। একাকী সেখানে দিবসকালেও অবস্থান করা যেতো না। অধিকক্ষণ অবস্থান করলে মনে হতো, যেন প্রাচীরের কঠিন শীতলতা সজীব প্রাণটিকে পিষ্ট করতে আসছে। তাই সে রাত্রিকালে নিদ্রার সময়টুকু ব্যতীত প্রায় সর্বক্ষণই। বাহিরে অতিবাহিত করতো।

তবে শয়নকালে প্রতিদিনই অনুভব করতো, কক্ষে সে একাকী নয়, আরও দুএকজন উপস্থিত আছে। তারা কে, কখন আসে, কখন যায়–কিছুই তার পক্ষে জানা সম্ভব হয় না।

একদা রাত্রে, প্রথম যামই হবে তখন, হঠাৎ তার নিদ্রা ভঙ্গ হলো। অনুভব করলো কে একজন তার কটিবন্ধটি মোচন করতে চাইছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না, তবে অনুমান করলো, পান্থশালাটি গ্রন্থিছেদকদেরও নিদ্রার স্থান। অন্য সময় হলে কি করতো বলা কঠিন। কিন্তু তখন তার অবস্থা মরিয়া। সামান্য কিছু অর্থ আছে সঙ্গে। ঐ অর্থটুকু চলে গেলে তাকে প্রকৃত অর্থেই পথে বসতে হবে। সে বিলম্ব করলো না, ক্ষিপ্রগতিতে লোকটিকে ধরাশায়ী করে তার বক্ষে দেহভার এবং গলদেশে দুহাত রেখে জানতে চাইলো, কে তুই বল–কেন তুই আমার কটিদেশে হাত দিয়েছিস? শীঘ্র বল, নতুবা এই তোর শেষ!

লোকটির কণ্ঠ থেকে বিচিত্র স্বর নির্গত হচ্ছিলো। বললো, আমাকে ছেড়ে দিন মহাশয়, এমন কাজ আর কখনও করবো না, অপরাধ মার্জনা করুন। আমি বড় ক্ষুধার্ত, ক্ষুধা নিবৃত্তির আশায় আমি এই দুষ্কার্যে প্রবৃত্ত হয়েছি–আপনি আমার প্রভু। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে–দয়া করুন।

লোকটির সমস্ত কথাই মিথ্যা। সে ক্ষুধাকাতর নিশ্চয়ই নয়–ক্ষুধাকাতর মানুষ অমন শক্তিমান হয় না–আর তখন হাত দুটি গলদেশে রাখা ছিলো মাত্র, তাতে শ্বাস রুদ্ধ হবার কথা নয়। একেকবার ইচ্ছা হচ্ছিলো, দুহাতের মুষ্টিতে গলাটি পিষ্ট করে। কিন্তু পরিণামের কথা চিন্তা করে বিরত হলো। সে চায় না, তাকে নিয়ে কোনো গোলযোগ সৃষ্টি হোক আর তাতে কোনো রাজপুরুষের দৃষ্টি তার উপর পতিত হোক। লোকটি নানান কথা বলে যাচ্ছিলো। তার কথায় জানা গেলো, ঐ স্থানে আরও দুজন গ্রন্থিছেদক রাত্রিযাপন করে। আজ তাদের উত্তম উপার্জন হয়েছে বলে শৌণ্ডিকালয়ে স্ফুর্তিতে মত্ত। শুধু তারই মন্দভাগ্য, নতুবা এমন হয়? বিদেশী পথিক যে এরূপ সাহসী আর শক্তিমান হবে, তা জানলে, কোন শ্যালক এই কাজ করতে আসে। সে মিনতি করে বললো, মহাশয়, আমি আপনাকে পিতা ডাকছি, আপনি আমাকে চলে যেতে দিন–আমি আর কদাপি এমন কাজ করবো না।

বসন্তদাসের মনে হলো, লোকটি সরল এবং কিঞ্চিৎ রসিকও। সে তার বক্ষ থেকে নেমে বসলো। লোকটি পারতো, কিন্তু তৎক্ষণাৎ পলায়ন করলো না। বললো, আমার চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য যে আপনার মত দয়ালু লোকের হাতে পড়েছিলাম, মহাশয় যে এমন মার্জার–চক্ষু, রাত্রিকালেও দেখতে পাবেন, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

গৃহস্থ নয়, পথিক নয়–ভিক্ষু কিংবা যোগীও নয়, এই দূর দেশে যে লোকটির সঙ্গে তার আলাপ হচ্ছে সে একজন গ্রন্থিছেদক। উত্তম বসন্তদাস–নতুন স্থানে এসে অত্যন্ত উত্তম ব্যক্তির সঙ্গে হৃদ্যতা হচ্ছে তোমার। এই না হলে কপাল? সে ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে লাগলো।

গ্রন্থিছেদকের কাছে অনেক সংবাদ। যেমন, এই স্থানের লোকেরা বহিরাগতদের সম্পর্কে অতিমাত্রায় সাবধান। গূঢ়পুরুষ প্রায় সর্বত্রই আছে। বিশেষত যেদিন মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ প্রাসাদের বাহিরে আসেন, সেদিন প্রায় সকলেই তটস্থ থাকে। বহিরাগত ভিক্ষু যোগী ইত্যাদি দেখলেই নগরবাসী সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কেনো ভিক্ষু এবং যোগীরাই নানান অনর্থের মূল। কোথায় যে কোন নিরীহ গৃহস্থকে বিপদাপন্ন করবে তার স্থিরতা নেই।

ভিক্ষু যদি এতোই পরিত্যাজ্য হয়, তাহলে এই মন্দির তো থাকবার কথা নয়– বসন্তদাস মন্তব্য করে।

প্রশ্ন শুনে গ্রন্থিছেদক হাসে। বলে, না মহাশয়, আপনার ধারণা ভুল–এই মন্দির থাকবারই কথা। যদি মন্দিরটি না থাকতো, তাহলে মহাসামন্ত একটি বৌদ্ধ মন্দির এখানে নির্মাণ করতেন। এও তার একটি কৌশল। এই মন্দিরটি আছে বলেই সদ্ধর্মীদের উপর সহজে দৃষ্টি রাখতে পারেন। এই তো দিন কয় পূর্বের কথা। চারিদিকে হৈ হৈ রব। প্রহরীর দল পথে পথে ধাবমান। কি ব্যাপার? না একজন ভিক্ষুকে পাওয়া যাচ্ছে না। গূঢ়পুরুষদের কাছে সংবাদ ছিলো, এক ষড়যন্ত্রী ভিক্ষু নাকি নগরে প্রবেশ করেছে–তার কাছে নাকি রয়েছে একখানি গোপন পত্র। নগরের সমস্ত ভিক্ষু ও যোগীদের বন্দী করা হলো, কিন্তু দেখা গেলো, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি নেই। সে এক বিষম কাণ্ড, নগরবাসীর গৃহে গৃহে চললো অনুসন্ধান। এবং দেখা গেলো, শেষ পর্যন্ত সমস্তই নিষ্ফল।

বসন্তদাস যা শুনছিলো তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি আবার আতঙ্কজনকও। বহিরাগত ব্যক্তি হওয়াতে তার শঙ্কিত হওয়ার কথা কিন্তু সে অধিকতর কৌতূহল বোধ। করছিলো। জানতে চাইলো, এই ভিক্ষুরা কী চায় বলতে পারো?

মহাশয়, ও বিষয়ে আমি একেবারেই অজ্ঞ, লোকটি জানায়। অতঃপর বলতে থাকে, তবে জনরব শুনেছি, তারা নাকি দ্রোহ উত্থাপন করতে চায়। ক্ষেত্রকর এবং অন্ত্যজদের সঙ্গে তাদের সবিশেষ মিত্রতা। অবশ্য আমার ধারণা তারা নির্বোধ, পিপীলিকার পক্ষ উদ্গয়ের মতো ব্যাপার আর কি! না হলে শস্ত্রধারী সুশিক্ষিত কুশলী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ডোম আর ক্ষেত্রকরেরা যুদ্ধ করতে পারবে, এই ধারণা কারও হয়?

সে ঐ কথার পর উঠলো। বললো, মহাশয়, আমি যাই, কিছু উপার্জনের সন্ধান করি–উদরে ক্ষুধা থাকলে নিদ্রা দেবী নিকটে আসতে চান না।

বসন্তদাস লোকটিকে দুই কুড়ি কড়ি দান করলে সে অভিভূত হয়ে পাদস্পর্শ করে প্রণাম করলো। তারপর বললো, মহাশয়, একটা কথা বলি আপনাকে–এ অধমকে অর্থ দান করলেন, এ বড় উত্তম কথা–কিন্তু সাবধান, এরূপ দয়া সর্বত্র প্রদর্শন করবেন না, বিপদ হবে।

কেন, বিপদ হবে কেন? বসন্তদাসকে অবাক হতে হয়।

বিপদ অন্য কিছুতে নয়, লোকটি জানায়, কোট্টপালের অনুচরেরা এ নগরীতে স্নানক তৎপর। ধনী পথিকের সর্বস্ব আত্মসাৎ করার কৌশল তাদের মতো আর কেউ জানে

–সুতরাং সাবধান।

গ্রন্থিছেদক দুই পদ অগ্রসর হয়েও ফিরে এলো। বললো, আর একটি কথা–আপনার মঙ্গলের জন্য বলি, যা শুনলেন সে বিষয়ে কোনোরূপ কৌতূহল প্রকাশ করবেন না। করলে সে আর এক বিপদ।

তুমি কি আবার এ স্থানে আসবে?

না মহাশয়, আজ মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ সপারিষদ প্রাসাদের বাহিরে এসেছেন– রাত্রিকালে বিষ্ণুমন্দিরে পূজা, ওদিকে আবার শৌণ্ডিকালয়ের দ্বার সমস্ত রাত্রি মুক্ত থাকবে সুতরাং বুঝতেই পারছেন

গ্রন্থিছেদক চলে গেলে বসন্তদাস পুনরায় শয়ন করলো। আশা, এবার নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবে। কিন্তু নিদ্রা আর আসে না–কেবলই ঘুরে ঘুরে গ্রন্থিছেদকের কথা স্মরণ হয়। কেবলই মনে প্রশ্ন জাগে, মহারাজ শক্তিবর্মণ কি তাহলে শঙ্কিত হয়ে রয়েছেন? বৃহৎ। কোনো যুদ্ধবিগ্রহ কি আসন্ন হয়ে উঠেছে?

সে পূর্বে কখনও এ সকল বিষয় নিয়ে চিন্তা করেনি। দেবীকোট মেলায় তিব্বতী ভিক্ষু দলটি এবং তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারী রাজসেনাদের দেখে তার মনে চিন্তার উদয় হয়েছিলো প্রথম–কিন্তু ঐ চিন্তা নিতান্তই কৌতূহলাচ্ছন্ন। যবন বৃদ্ধটিও আলাপ প্রসঙ্গে দেশ–বিদেশের অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন–কিন্তু তখনও তার কাছে ব্যাপারটি নিজের জীবন–সংলগ্ন বলে মনে হয়নি। এখন হচ্ছে–বারংবার মনে হচ্ছে, কি কুক্ষণেই না তার আলাপ হয়েছিলো যবন বৃদ্ধটির সঙ্গে। যদি না হতো, তাহলে আজ তার এই অবস্থা হয়? না জানি এরপরও কোনো দুর্দশা তার ভাগ্যে আছে। ঐ রত্নগুলির সদগতি করতে এসেই না তার এখন এমন দুর্দশা।

তৃষ্ণা বোধ হওয়ায় সে উঠলো। বাহিরেই কূপ, সে কূপস্থলের দিকে চললো।

হঠাৎ নারী কণ্ঠের আলাপ তার শ্রবণে আসে। দুটি নারী–স্বর ঐ কূপস্থলের দিক থেকেই আসছে–সে দূর থেকেই নারীমূর্তি দুটিকে দেখতে পায়। তার অবাক লাগে, এখন রাত্রিকাল, এই সময়ে মন্দিরকূপে নারীর আগমন কেন? এই ক্ষুদ্র নগরীর নারীরা কি এতোই অসূর্যম্পশ্যা যে গভীর রাত্রি ব্যতিরেকে জলাহরণ করতে পারে না? সম্মুখে দৃষ্টিপাত করতেই সে পুনরপি দেখতে পায়, অদূরে মন্দিরদ্বার উন্মুক্ত এবং সেই দ্বারপথে একজন রমণী নিষ্ক্রান্ত হয়ে আসছে। সে নিজেকে বৃক্ষতলে অন্তরাল করে।

অর্ধাঙ্গ চন্দ্রটি তখন মন্দিরশীর্ষে আরোহণ করেছে। তার আলোকে কূপস্থলের সমস্তটাই দৃশ্যগোচর। দেখা গেলো, পুরুষটি মন্দিরেরই একজন ভিক্ষু। রমণীরা কে, সে অনুমান করতে পারে না। তবে দেখলো, তিন রমণীই যুবতী এবং রূপসী।

ভিক্ষুটি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বললেন, কি সংবাদ বিভাবতী, তুমি নাকি ভয় পেয়েছো?

ভয়, বিভাবতী সম্ভবত মৃদু হাস্য করে। বলে, বিভাবতী যদি ভয় পায়, তাহলে অনাথ মিত্রানন্দের কি দশা হবে প্রভু?

না, অর্হৎ, বিভাবতীর এক সঙ্গিনী জানায়, সে ভয় পাওয়ার পাত্রী নয়, তবে শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন–আমরা মিত্রানন্দকে আর রাখতে পারছি না, প্রতিদিনই বিপদাশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, মহাসামন্তের চরেরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে।

এই রমণীরা কারা? আর এই ভিক্ষুটিই বা কে? বসন্তদাস কিছুই অনুমান করতে পারে না। শুধু এটুকু বুঝলো যে কিছু একটা অতীব গোপন ব্যাপারের সঙ্গে এরা যুক্ত।

একেকবার মনে হচ্ছিলো, এসব ষড়যন্ত্রমূলক ব্যাপার–এসব তার শোনা উচিত নয়–এই মুহূর্তেই তার এ স্থান ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু ঐ সঙ্গেই আবার এও মনে হচ্ছিলো, আহা রমণী এতো সুন্দর হয়! এমন তো পূর্বে কখনও দেখিনি। ঐ মুহূর্তে রমণী–কণ্ঠের মাদকতা তার কর্ণে মধুবর্ষণ করছিলো। চন্দ্রালোকেও রমণীদের দেহরেখা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। সূক্ষ্ম চীনাংশুকে ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত হলেও সুগোল স্কন্ধ, বঙ্কিম গ্রীবা, পীবরোন্নত বক্ষ, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব, নিতম্ববেষ্টিত রত্নখচিত মেখলায় বিম্বিত চন্দ্রালোক–সমস্তই সে দেখতে পাচ্ছিলো। তার মনে হচ্ছিলো, এরা কি রাজপ্রাসাদের কন্যা ও বধূ? নাকি স্বয়ং রাণী আর তার দুই সহচরী? সে কিঞ্চিৎ আবিষ্টও হয়ে পড়েছিলো। একইসঙ্গে ভীতি ও কৌতূহল, রহস্য ও সৌন্দর্য, চন্দ্রালোকের মায়া এবং মধ্যরাত্রির নির্জনতা–সমস্ত একত্রে মিলিত হয়ে বিচিত্র একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিলো তার মনে। স্থানকালের চেতনা প্রায় লুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিলো ঐ সময়।

ফলে যা ঘটবার তা–ই ঘটলো। কখন যে সে বৃক্ষতলের অন্ধকার থেকে বাহিরের চন্দ্রালোকে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেই জানে না। হঠাৎ সে একইসঙ্গে তিনটি কণ্ঠের অনুচ্চ চিৎকার শুনলো, কে, কে ওখানে?

ভিক্ষুটি ছুটে এলেন, পশ্চাৎ পশ্চাৎ এলো তিন যুবতী।

কে তুমি?

আমি পথিক, এই পান্থশালায় রাত্রিযাপন করি।

এই স্থানে কেন? মধ্যরাত্রে এই স্থানে কি করছিলে তুমি?

ভিক্ষুটির উত্তেজিত অবস্থা দেখে বসন্তদাস সবিনয়ে জানায়, অর্হৎ, আপনি উত্তেজিত হবেন না, আমি জলপানের নিমিত্তে এই স্থানে

চুপ করো, কোনো কথা নয়।

ভিক্ষু বসন্তদাসকে কোনো কথা বলতে দিলেন না। ইঙ্গিতে মন্দিরদ্বারের দিকে নির্দেশ করে বললেন, চলো।

মন্দিরের ভিতরে অন্ধকার। সেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে অগ্রসর হওয়ার সময় এক তরুণী বসন্তদাসের সঙ্গে স্পৃষ্ট হয়–ক্ষণিকের স্পর্শমাত্র, কিন্তু তাতেই তটিনীকূলে মৃদু তরঙ্গাঘাতের শব্দের মতো অস্পষ্ট হাসি ছলকিত হলো। পশ্চাতে আবার মৃদু শাসনও শোনা গেলো। এক রমণী বললো, ওলো কৃষ্ণা, এতো হাসি কেন? হাসলে কাঁদতে হয় জানিস তো?

হ্যাঁ জানি, সময় হোক, কাঁদবো।

স্থান–কাল কিছুরই বিবেচনা নেই, কেবল কৌতুক। গুহাপথের মতোই পথ, অন্ধকারে নিজের হাত পর্যন্ত গোচরে আসে না। কিন্তু তথাপি কৌতুকের যেন শেষ নেই।

অবশেষে আলোর সন্ধান পাওয়া গেলো। ভিক্ষু যে প্রকোষ্ঠটিতে সবাইকে নিয়ে গেলেন, সেটি সম্ভবত তাঁর নিজেরই বসবাসের স্থান। এক পার্শ্বে শয়নবেদী, প্রাচীর গাত্রে দীপস্থান, সেখানে প্রদীপ জ্বলছিলো ঐ প্রদীপের আলোকে পরস্পরকে স্পষ্টভাবে দেখার সুযোগ হলো। বসন্তদাসের মুখপানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ভিক্ষু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সত্যই পথিক?

আজ্ঞে হ্যাঁ অর্হৎ, এখন আমি পথিক ব্যতীত অন্যকিছু নই, আত্রেয়ী তীরে আমার নিবাস, পিতা হেমন্তদাস, ক্ষেত্রকর্ম করেন।

তা এ স্থানে আগমনের কারণটি বলো।

বসন্তদাস তখন তার প্রতি শ্রীনাথবর্মণের আচরণের কাহিনীটি বর্ণনা করে। বর্ণনা সমাপ্ত হলে জানতে চায়, বলুন আপনারা, আমি কি ন্যায় বিচার আশা করতে পারি না?

তার কথা শুনে ভিক্ষুটি হাসেন। বলেন, বৎস, ন্যায় কাকে বলে সেটি জানা থাকলে তবে না বিচার হবে?

ক্ষণেক পরে বলেন, যাক সে কথা, এখন বলল, এই নগরীতে তোমাকে কে জানে?

আজ্ঞে না, এ নগরীতে কেউ আমাকে জানে না।

তুমি যে গোপন চর নও, তার নিশ্চয়তা কি?

আজ্ঞে নিশ্চয়তা আমি এবং আমার কথা, এই মাত্র বলতে পারি–আর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তুমি আমাদের কথা শুনেছো?

বসন্তদাস মুহূর্তে ইতস্তত করে, সত্য কথা বলবে কিনা। তারপর সহজ স্বরে বলে ওঠে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি শুনেছি।

কিছু বুঝতে পেরেছেন? এবার রমণীদের একজন জানতে আগ্রহী হয়।

বসন্তদাস পূর্ণদৃষ্টিতে রমণীটির মুখপানে চেয়ে দেখে। অত্যন্ত পরিপূর্ণ যুবতী এই রমণী, আর দেহকান্তি যে কি অপরূপ, তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। রমণীটির মুখপানে দৃষ্টি রেখে সে অকপটে স্বীকার করে, আজ্ঞে হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি যে মিত্রানন্দ নামক কোনো এক ব্যক্তিকে আপনারা লুক্কায়িত রেখেছেন, কিন্তু এখন আর রাখতে পারছেন না–মহাসামন্তের চরেরা আপনাদের সন্দেহ করছে।

অকপট ঐ স্বীকৃতির পর কেউ–ই কথা বলে না, কিছুক্ষণ। শেষে তিন রমণীর মধ্যে যে সুন্দরীতমা, সে বললো, শুনুন, আপনাকে আমি মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের কাছে নিয়ে যাবো–আপনার পণ্যসামগ্রী উদ্ধার হবে কিনা বলতে পারি না, আপনি যাবেন?

বসন্তদাস সাগ্রহে সম্মত হয়, অবশ্যই যাবো।

তাহলে একটি শর্ত আছে।

বলুন কি শর্ত? বসন্ত এবার রমণীটির মুখের উপর তার পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।

আপনি আমাদের অতিথি হবেন কয়েকদিনের জন্য–গোপন কিছু নয়, আপনি নিজ পরিচয়েই আমাদের সঙ্গে অবস্থান করবেন, তবে আমাদের এই মন্দিরে আগমন, মিত্রানন্দ প্রসঙ্গ, অথবা যা শুনেছেন–কিছুই অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনার প্রিয়তমা রমণীর কাছেও নয়–মনে করবেন, আজ রাত্রের ঘটনাটি আদৌ ঘটেনি–পারবেন?

বসন্তদাস এবার অন্য দুই রমণীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। কৃষ্ণা সম্ভবত শ্যামাঙ্গীর নাম, আর সুন্দরীতমা রমণীটি বোধ হয় বিভাবতী। সে লক্ষ্য করে দেখে, প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর। বুঝতে পারে, গম্ভীর হলে রমণী মুখ সত্যিই মলিন হয়। ক্ষণকাল পূর্বেও সকলের মুখে কৌতুকোজ্জ্বল ভাব লক্ষ্য করা গেছে। সে ভিক্ষুর মুখে দৃষ্টিপাত করে বলে, অর্হৎ, আপনি জ্ঞানী ব্যক্তি এবং সাধু–আমার অবস্থাটি নিশ্চয়ই আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। দেখুন, আমি এদেশের বিষয়ে কিছুই জানতাম না–আজ রাত্রেই এই পান্থশালায় এক গ্রন্থিছেদকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে–তার মুখেই শুনলাম যে এদেশে বৌদ্ধ সদ্ধর্মীরা রাজরোষে পতিত হয়েছে, তারা নাকি এদেশে দ্রোহ উত্থাপন করতে চায়। এখন দেখছি, তার কথা অমূলক নয়। এমতাবস্থায় আমি কোনো প্রকার বিপদে পতিত হতে চাই না–যদি আমার পণ্যাদি উদ্ধারের আদৌ কোনো আশা না থাকে, তাহলে অহেতুক এ স্থানে আমি কেন থাকবো? রাত্রি প্রভাত হলেই আমি চলে যাবো–আমাকে আপনারা অনুমতি দিন।

শুক্লা, এ পথিক দেখছি বড়ই চতুর–বিভাবতীর চটুল মন্তব্য বসন্তের শ্রবণে আসে।

হ্যাঁ, আমারও মনে হয়, একেবারে গভীর জলের মৎস্য, শুল্কা তৎক্ষণাৎ নিজ মত ব্যক্ত করে।

মন্তব্য দুটি শুনে বসন্তদাস হাসে। বলতে পারতো যে অবস্থাগুণে সকলেই চতুর হয়। কিন্তু কিছুই না বলে সে পুনরায় অনুমতি চায়, অর্হৎ, আদেশ করুন, আমি এবার যাই।

ওলো কৃষ্ণা, পথিককে তুই আমন্ত্রণ কর না, ও যে চলে যায়। সুন্দরীতমা বিভাবতীর কৌতুকস্বর এবার মাদকতাময়।

বসন্তদাস হাস্যাননা বিভাবতীর মুখপানে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে। দুকূল উত্তরীয় ঈষৎ বিস্রস্ত, কণ্ঠের মুক্তামালা উন্নত বক্ষশয্যায় একবার উঠছে একবার নামছে। মুখে সে কিছুই বলে না। ভিক্ষুককে প্রণাম করে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়।

কিন্তু অন্ধকার অলিন্দে এসে উপনীত হতে না হতেই ডাক শুনতে পায়, পথিক কি নিদ্রার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন?

না, শেষ পর্যন্ত আর পারেনি, বসন্তদাসের এখনও স্পষ্ট স্মরণ হয়। বিভাবতী নয়, শুল্কা নয়, কৃষ্ণাই এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন। বলেছিলো, আপনাকে আমাদের বিশ্বাস নেই, তাই চক্ষুরান্তরাল করবো না–আপনি আমাদের হাতে বন্দী।

কী ভেবেছিলো তারা, বসন্তদাস জানতে পারেনি, তবে তার অনুমান, কৃষ্ণার কথা একেবারেই কৌতুকের ছিলো না। সম্ভবত তাদের আশঙ্কা ছিলো যে সে রাজপ্রহরীদের। হাতে বন্দী হলে সমস্ত কথা প্রকাশ করে দেবে। সে জন্যেই তাদের চেষ্টা, যাতে সে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকে এবং তুষ্ট থাকে।

বসন্তদাসের ততক্ষণে প্রত্যেকের পরিচয় জানা হয়ে গেছে। তিনজনই বিষ্ণু মন্দিরের। দাসী এবং তিনজনই নর্তকী। রাত্রির তখন মাত্রই মধ্য যাম। শুক্লা, কৃষ্ণা উভয়েই চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। একজন বিভাবতাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলো, ওদিকে বিলম্ব হয়ে না যায়, চলো, শীঘ্র যাই।

মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি কানে আসছিলো না, হয়তো ওদিকে ততক্ষণে পূজা সমাপ্ত হয়েছে।

কৃষ্ণা নিকটে এসে বললো, চলো হে ক্ষেত্রকর, এবার বন্দীশালায় চলল।

আম্রকাননের মধ্য দিয়ে পথ, সম্ভবত এই পথেই তারা গমনগমন করে। ভিক্ষু ব্ৰজানন্দ তাদের সঙ্গে এলেন কানন পর্যন্ত। বিদায়কালে বললেন, মিত্রানন্দকে আজ রাত্রেই নগর ত্যাগ করতে বলবে–আজই সুযোগ।

পথিমধ্যে তিন সখীর পরামর্শ হয়। সিদ্ধান্ত হয় কৃষ্ণা বসন্তদাসকে নিয়ে গৃহে যাবে এবং বিভাবতী শুক্লাকে নিয়ে যাবে প্রথমে মন্দিরে, তারপর গৃহে। গৃহে ফিরতেই হবে কারণ পূজা শেষে মহাসামন্ত বিভার গৃহে যাবেন।

কাজটি বিপজ্জনক, কিন্তু ঐভাবেই তারা ভিক্ষু ব্ৰজানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। যেদিনই রাত্রে মন্দিরে পূজার বৃহৎ আয়োজন হয়, সেদিনই তারা পূজার আয়োজন সমাপ্ত করে অন্য দুই সেবক ও দাসীকে মন্দিরে রেখে দর্শনার্থী নারীপুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়। ঐভাবেই তারা মন্দিরের বাহিরে যায় এবং কাননের মধ্য দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে অবলোকিতশ্বরের মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হয়। বোঝা যায়, তাদের এইভাবে গমনাগমনের ব্যাপারটি লোকচক্ষুর অগোচরেই ঘটে চলেছে। বসন্তদাস অনুমান করে মাত্র, প্রত্যক্ষ কিছুই সে দেখে না। তার অনুমান, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ভয়ানক কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত এই মন্দিরদাসীরাও। তার অবাক লাগে। মন্দিরদাসীদের আচরণ এমন কেন? দেশে যদি সত্য সত্যই দ্রোহ উত্থিত হয়, তাহলে এদের তো লাভালাভ কিছু নেই, তাহলে এরা কেন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত? বিভাবতী, কৃষ্ণা ও শুক্লার আচরণ সে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে না।

মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ বিভাবতীর গৃহদ্বারে উপনীত হয়ে অন্যান্য সহচরদের বিদায় দিলেন। সঙ্গে রাখলেন দুই বয়স্যকে। মন্দির থেকে এলেও তাঁর পদক্ষেপ স্থির নয়। থেকে থেকেই স্খলিত কণ্ঠে চিৎকার করছিলেন।

বিভা প্রস্তুত হয়েই ছিলো, সে রাজপুরুষদের সমাদরে কোনো ত্রুটি রাখে না। শক্তিবর্মণ বিভাবতাঁকে দেখে বললেন, সখী বিভু, তোমাকে যে মন্দিরে দেখলাম না?

মহারাজ সম্ভবত লক্ষ্য করেননি, আমার বেশ তখন অন্যরূপ ছিলো।

ও, তাই হবে তাহলে–ওহে তোমরা দেখেছিলে?

বয়স্য দুজন ইতস্তত করে বার দুই। তাদের বোধগম্য হচ্ছিলো না কোন উত্তরটি প্রভুর অভিপ্রেত। একজন বললো, না মহারাজ, দেখিনি–অন্যজন বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, দেখেছি।

দুজনের দুই প্রকার উক্তিতে হা হা অট্টরবে হেসে উঠলেন শক্তিবর্মণ। বললেন, ওহে, দেখছি তোমাদের দুজনেরই বিভ্রম, কিন্তু বিভ্রম কিসে? দৃষ্টিতে না জিহ্বায়?

দাসী পুষ্পমালা রেখে গিয়েছিলো। শক্তিবর্মণ মালাগুলি দেখলেন হাতে নিয়ে। একখানি মালা এক বয়স্যের গলায় দিয়ে বললেন, নাও হে মর্কট, এটিকেই মুক্তামালা জ্ঞান করো।

অল্পক্ষণ পরই সঙ্গীত আরম্ভ হয়। শুক্লার গীতটিতে ছিলো বিষাদময় ভাব–একটি শুকপক্ষীর পিঞ্জর ত্যাগ করে পলায়নের কারণে নায়িকার যে বেদনা ও বিরহ, তাই সে বার বার গেয়ে প্রকাশ করছিলো। শক্তিবর্মণ বিরক্তি বোধ করেন। গীতের মধ্যস্থানেই বলে উঠলেন, রমণীর রোদন শুনতে আসিনি আমরা–বিভু কোথায়–আমরা যে নৃত্য দেখবো বলে এসেছি।

অচিরেই বিভাবতী নৃত্য আরম্ভ করলো। এই কলায় সে অসাধারণ পারদর্শিনী। যৌবনে মহারাজ লক্ষ্মণ সেন কয়েকজন নৃত্যপটিয়সী মন্দিরদাসী আনয়ন করেছিলেন কান্যকুজের দক্ষিণাঞ্চল থেকে, বিভাবতীর মাতামহী তাদেরই একজন। মন্দিরদাসীদের। পিতৃপরিচয় থাকে না–কিন্তু বিভাবতীর মাতা জানতেন তাঁর পিতৃপরিচয় কী, এবং বিভাবতী নিজেও জানে নিজ পিতার পরিচয়। সে যা–ই হোক, দৌহিত্রীর নৃত্যকলা শিক্ষা হয়েছে মাতামহীর কাছে। সুতরাং বিভাবতীর নৃত্য দেখবার মতো। শক্তিবর্মণ নৃত্য দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। তিনি মধুকাসব পান করে পাত্রের পর পাত্র শূন্য করে দূরে নিক্ষেপ করছেন আর প্রমত্ত খলিত কণ্ঠে হা হা রবে অট্টহাসি হাসছেন। কখনও বামে, কখনও দক্ষিণে দুই বয়স্যের উপর ঢলে পড়ছেন। ওদিকে তখন নৃত্য উঠেছে তুঙ্গে–বয়স্য দুজন মহাসামন্তকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু শক্তিবর্মণ কি আর স্থির থাকার লোক? তিনি অট্টরবে হাসতে হাসতে বললেন, আমাকে স্থির থাকতে বলছো কেন হে, জানো না, শৃঙ্খলিত ও স্থির থাকে ভারবাহী পশুরা! শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করলে কি কেউ শৃঙ্খলা রক্ষক হতে পারে? সম্ভব নয় হে, অনুশাসন শৃঙ্খলিত সন্ন্যাসী কি এই অপ্সরা রমণীর নৃত্যলীলা উপভোগ করতে পারবে? পারবে না। সদ্ধর্মী ভিক্ষু আর পাষণ্ড যোগীদের দ্রোহদমনও কি সাধুসন্ন্যাসীদের পক্ষে সম্ভব? বলো?

শক্তিবর্মণ তাঁর বিপুল দেহ নিয়ে উল্লাসে হাসিতে একেবারে ভূমিতে লুণ্ঠিত হচ্ছেন তখন। সম্মুখে নৃত্য হচ্ছে কিন্তু সেদিকে তার মনোযোগ নেই। নানান কথা তার মনে উদিত হচ্ছে এবং সেগুলি তিনি বলে যাচ্ছেন একে একে।

বয়স্যদের ডেকে বললেন, ওহে বলীবর্দ, বলো দেখি, ক্ষাত্ৰতেজ কিসে উদ্দীপ্ত হয়?

বয়স্যটি বিপাকে পতিত হয়। পিতৃপুরুষের জন্মে সে এমন প্রশ্ন শোনেনি। অপ্রতিভ হয়ে সে বলে, মহারাজ, ক্ষাত্ৰতেজের কথা বলছেন? শুনেছি ময়ূর মাংস ভক্ষণে ….

কুক্কুর, তুমি প্রকৃতই একটি কুক্কুর হে–কেবল খাদ্যের দিকে মন তোমার। পারবে বলতে? হা হা হা–পারবে না হে, পারবে না–শুনে রাখো, ক্ষাত্ৰতেজ উদ্দীপ্ত হয় রণে ও রমণে।

ওদিকে বিভাবতীর নৃত্য সমাপ্ত হয়েছিলো। সে নিকটে এলে কোমলস্বরে ডেকে বললেন, অয়ি সখী বিভু, তুমি সেই নৃত্যটি দেখাবে? সেই যে কেশব বাসনা লক্ষ্মী মন্থন শেষে সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে আসছেন, হাতে তাঁর অমৃতভাণ্ডটি?

বিভাবতী প্রণাম জানিয়ে সহচরীদের নির্দেশ দিলো। তারপর আরম্ভ করলো সেই নৃত্যটি। স্বভাবতঃই সে মুদ্রা এবং তালে নতুন ভুবন সৃষ্টি করতে পারতো, তায় তখন রাত্রির মধ্যযাম এবং প্রদীপালোকের মায়ালোক। উপরন্তু আসবমত্ত দর্শকদের দৃষ্টি মদিরাতুর–ফলে চোখের সম্মুখে নানান বিভ্রম সৃষ্টি হতে লাগলো। দ্বারান্তরালে বাদিকা সুললিতার হাতে ছিলো মৃদঙ্গ এবং নীলাঞ্জনার হাতে বীণা। দৃশ্য এবং শ্ৰব্য উভয়ের এমন সুসমঞ্জস মিলন কদাচিৎ ঘটে। আরক্ত নেত্রে মহাসামন্তপতি এবং তার সহচর দুই বয়স্য যা দেখতে লাগলেন, তাতে ভাবলেন, তাঁরা ইন্দ্রসভায় বসে আছেন।

প্রদীপালোকের সম্মুখে কে একজন অন্তরাল সৃষ্টি করলো, তাতে আলোহীন অন্ধকারবিহীন একটি মায়ালোক জন্ম নিলো। অদৃশ্যে কোথায় যেন তখন অস্ফুট মৃদঙ্গের শব্দ হচ্ছে। যেন আলো অন্ধকারে সৃষ্টির প্রথম লগ্ন। সাগর–মৃত্তিকা–অন্তরীক্ষ ব্যাপ্ত সমগ্র চরাচরে গভীর, ধীর, অথচ প্রাণময় ওঙ্কার নাদটি সবে আরম্ভ হয়েছে, এমন মনে হলো। সেই অন্ধকারের বুকে রত্নখচিত মুকুটটি প্রথমে দেখা গেলো, তারপর লক্ষ্মীর বিদ্যানন, শেষে পূর্ণ দেহাবয়বটি। মেনকা কি এমন যৌবনধন্যা ছিলেন? নাকি ইনি উর্বশী? রম্ভার কটিদেশ কি এরূপ ক্ষীণ ছিলো এবং নিতম্ব এমন গুরুভার? বয়স্যরা চক্ষু কচালিত করলো। সূক্ষ্ম চীনাংশুকের অন্তরাল থেকে লক্ষ্মীর উরুদেশের যেটুকু সৌন্দর্য নৃত্যের প্রতিটি তালের সঙ্গে ঝলকে ঝলকে গোচরে আসছিলো তাতে স্তম্ভিত ও বিমূঢ় হওয়া ছাড়া দর্শকদের গত্যন্তর ছিলো না। গভীর তলদেশের স্থিরতায় প্রথমে কম্পন, তারপরে যেন কলরোল জেগেছে। মন্থিত সমুদ্রের জলরাশিতে নয়, বিষ্ণুবাসনা লক্ষ্মীর যৌবনময় দেহবল্লরীতেই যেন বিপুল উল্লসিত এবং ফেনাময় কলরোল উন্মথিত হচ্ছে। এই ঘটনা কি মর্ত্যের? দর্শকেরা বলতে পারবে না। ক্রমে লক্ষ্মী তার কক্ষে সুবর্ণ কলসটি নিয়ে স্মিত হাস্যে স্থির হলেন।

অর্থাৎ এতক্ষণে দেবীর পূর্ণ প্রকাশ ঘটলো। দীপাধারের ঘৃত প্রদীপগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এখন আর আলোছায়ার বিভ্রম নয়। উজ্জ্বল আলোক লক্ষ্মীর দেহত্বকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে–পরিপূর্ণ উরুদেশ, ক্ষীণ কটি, বিপুল নিতম্ব ও প্রমত্ত জঘন মানবী দেহে বিন্যস্ত হয়ে ক্রমে যেন দর্শকদের চোখের সম্মুখে একটি স্পর্শাতীত বাসনার মূর্তি হয়ে উঠলো। দর্শকরা বিভ্রান্ত। কেউ নিঃশ্বাস ত্যাগও করে না–কি জানি, যদি এই স্বপ্নঘোর ভেঙে যায়?

কিন্তু প্রকৃতই কি স্বপ্নঘোর? বিভাবতী স্বপ্নঘোর সৃষ্টি করতে চায়নি, তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে ধীর পদক্ষেপে এক সময় নিকটে এসে সুবর্ণ কলসের অমৃত ঢেলে পানপাত্রগুলি পূর্ণ করে দিলো।

নৃত্য শেষ হয়েছে, কিন্তু তখনও কক্ষের মধ্যে রেশটির গুঞ্জরণ শোনা যাচ্ছে–মৃদঙ্গ ও বীণার মূৰ্ছনা তখনও কক্ষের চারিদিকে কম্পমান–ঐ সময় বিভাবতীর মুখে কথা ফুটলো–মহারাজ, লক্ষ্মীর অমৃত পান করুন।

ও হ্যাঁ, সম্বিত ফিরলো যেন প্রত্যেকের। শক্তিবর্মণ ডেকে বললেন, ওহে অমৃত পান করো–অমর হবার এই–ই সুযোগ।

অতঃপর স্বল্প কিছু কথা, কয়েকমুহূর্তের উল্লাস এবং বিভাবতাঁকে নিকটে পাওয়ার জন্য উদ্বাহু আহ্বান–এই পর্যন্তই। অর্ধদণ্ডকালও অতিক্রম হয়নি, দেখা গেলো, বিশালাকার তিন ষণ্ডই ভূমিতে লুণ্ঠিত–তাদের নাসিকা গর্জনে পৃথিবী থরথর কম্পমান।

ঔষধি ক্রিয়ায় সম্ভবত কাণ্ডটি ঘটে থাকবে, বসন্তদাস অনুমান করে। সে সমস্ত প্রক্রিয়াটি দ্বারান্তরাল থেকে প্রত্যক্ষ করছিলো–কৃষ্ণাও ছিলো নিকটে উপবিষ্টা। শক্তিবর্মণ পপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রমোদ কক্ষে প্রবেশ করে প্রদীপগুলি নির্বাপিত করতে থাকে। শুক্লার কণ্ঠস্বর শোনা যায় ঐ সময়, সে বাহিরের প্রহরীদের ডেকে বলছে, মহারাজ নিদ্রাগত হয়েছেন–তোমরাও বিশ্রাম নিতে পারো।

ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে অসম্ভব এস্ত ব্যস্ত দেখা যায় তিনজনকেই। একজন মুণ্ডিতমস্তক ব্যক্তি যে কোন স্থান থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন সে এক রহস্য, আর তৎক্ষণাৎ কোথায় যে চলে গেলেন সে আরেক রহস্য। কৃষ্ণা ঐ মুহূর্তে বলে যায়, পলায়ন করবেন না, আমি এক্ষুনি আসছি।

স্বল্পক্ষণ পরই সে ফিরলো। মুখে বিজয়িনীর হাসি। বললো, এবার চল হে পথিক, তোমার সঙ্গে আলাপ করি।

পশ্চাতে শুক্লা কটাক্ষ করে। ওলো দগ্ধাননা রাক্ষুসি, রাত্রি কিন্তু অধিক নেই, ওকে স্বল্পক্ষণের জন্য হলেও ঘুমোতে দিস।

ঐরূপ সংলাপ বিলক্ষণ উত্তেজক। কিন্তু বসন্তদাসের মনে ভয় ছিলো। মনে হচ্ছিলো, এক সর্বনাশা খেলায় মত্ত হয়েছে ঐ তিন রমণী। তাদের সান্নিধ্য পরিহার করতে না পারলে বিপদ অনিবার্য। তাদের কৌতুকালাপের ইঙ্গিতগুলি তাই অযথা নষ্ট হচ্ছিলো। কৃষ্ণা তো একবার বলে বসলো, কি হে ক্ষেত্রকর, কর্ণে কি জল পশে না? বলল না, তোমার বধূটি বালিকা, না যুবতী?

তাকে নিজ কক্ষে নিয়ে যায় কৃষ্ণা। তারপর দ্বার অর্গলবদ্ধ করে। বসন্তদাস তখন শঙ্কিত, তবে কি সত্য সত্যই একটি ভয়ঙ্কর অবস্থার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সে? কিন্তু কিছুই করণীয় ছিলো না তার। তবু সে বললো, আপনারা আমাকে কেন ভুল বুঝছেন, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না আমার দ্বারা, বিশ্বাস করুন।

কৃষ্ণা উত্তরীয়খানি হেলাভরে দূরে নিক্ষেপ করলে সে অধর দংশন করে নিজেকে সংযত করে। কিন্তু যখন হাত ধরে কৃষ্ণা আহ্বান করে, এসো, শয্যায় এসো, তখন আর তার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব হয় না। বলে, কেন আমাকে প্রলুব্ধ করছেন, আমি আপনাদের কোনো কথাই কোথাও প্রকাশ করবো না–বিশ্বাস করুন।

হ্যাঁ, বিশ্বাস করলাম, কৃষ্ণার ওষ্ঠদ্বয়ে ঐ সময় হাসি বিলোলিত হয়। বলে, বারংবার এক কথা বলার কি প্রয়োজন, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি, এসো শয়ন করি, রাত্রি যে চলে যায়।

তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কৃষ্ণা এভাবে নিজের অবমাননা করো না। কিন্তু কথাটি ঐ ভাষায় সে বলতে পারে না। বললো, ভদ্রে, দক্ষিণাদানের কোনো সামর্থ্যই আমার নেই–আপনি আমাকে মার্জনা করবেন।

ঐ কথার কৃষ্ণায় যুগল ক্ষণিকের জন্য তীক্ষ্ণধার হয়ে ওঠে। পরক্ষণে সে স্মিতহাস্যে জানায়, মন্দিরদাসী সর্বদা দক্ষিণার প্রত্যাশা করে না হে নির্বোধ ক্ষেত্রকর, তাদের প্রণয়ও হয়।

না ভদ্রে, আমি বিশ্বাস করি না, বসন্তদাস জানায় উত্তরে। বলে, প্রণয় অতো সুলভ নয়, এতো অল্পকালের প্রণয় সেই প্রকার গম্ভীর হতে পারে না, যাতে দুজনে একত্রে শয্যাগ্রহণ করা যায়–আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন, আমি লম্পট নই।

কী যে হয় কৃষ্ণার, বোঝা যায় না। সে তার বিশাল চক্ষু দুটি মেলে ধরে বসন্তদাসের দৃষ্টির সম্মুখে। কী দেখে, ভগবান জানেন–তারপরই ওষ্ঠে ভারী ক্ষীণ একটি হাসি ফুটিয়ে বলে, না হে ক্ষেত্রকর, আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি–এ পর্যন্ত বলে সে হাত ধরে বসন্তদাসের। তারপর বলে, আত্রেয়ীতীরের পুরুষ, মানুষই–অন্যকিছু নয়।

না, আবার আপনি ভুল বুঝলেন, বসন্তদাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। বলে, পৌরুষ বিচারের প্রশ্ন নয় এটা–আর সে বিচারও আপনারা করছেন না বরং আমি দেখছি, আপনারা আমাকে এমনভাবে প্রণয়পাশে আবদ্ধ করতে চান, যাতে আমি আপনাদের কোনো গোপন কথা কখনও প্রকাশ করে না দিই। আমি বলি, আপনার এই প্রণয়পাশের প্রয়োজন নেই, নিশ্চিত থাকুন, আমি কখনই কিছু বলবো না

হয়েছে হে বাক্যবাগীশ ক্ষেত্রকর, অধিক কথা বলো না–এসো ক্ষেত্রকর্ম করো।

কৃষ্ণা তখন কৌতুকে, কপট ক্রোধে এবং লীলাবিলাসে এমন হয়ে উঠেছে যে, সাধ্য কি বসন্তদাসের তাকে নিরস্ত করে। সে দেখে, প্রগলভা মন্দিরদাসী প্রেমদানে উন্মুখ হলে পুরুষ বড়ই অসহায়।

এবং রাত্রির ঐ শেষ যামে বসন্তদাসকে কৃষ্ণার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

.

মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ যখন চক্ষুরুন্মীলন করলেন, তখন সকাল। নগরীর কর্মকোলাহল শোনা যাচ্ছে। প্রথমে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলেন। চিন্তা করলেন, তিনি কোথায়? তাঁর পূর্ব রাত্রির কথা স্মরণ হলো–কিন্তু সম্পূর্ণ ঘটনাটি স্মরণ করতে পারলেন না।

মস্তক আন্দোলন করলেন কয়েকবার। যদি ঘোর কাটে–কিন্তু কাটলো না ঘোর। শরীরময় মেদুর একটি অবসাদ, প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে শিথিলতা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, কক্ষের বাইরে অলিন্দের চত্বরে পদচারণা করলেন কয়েকবার। অদূরেই একটি আম্রকানন–সেখানে বৃক্ষ শাখায় পীতবর্ণ পক্কা দুলতে দেখলেন। বৃক্ষতলের প্রহরীটিও তাঁর দৃষ্টিতে এলো। আকাশে মেঘ দেখা দিয়েছে। তিনি পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করলেন।

বয়স্য দুজন তখনও নিদ্রিত। একজনের নাসিকা গর্জনে তখনও কক্ষটি প্রকম্পিত হচ্ছে। তাকে পদাঘাত করে বললেন, ওহে নাসিক্যানন্দ, তোমার বাদ্য কি থামাবে? ভূকম্পনে ধরণী যে রসাতলে গেলো।

বয়স্য দুজন জাগ্রত হয়ে উঠে বসলে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে–প্রাসাদে চলো।

ওদিকে তখন প্রাতরাশের ব্যবস্থা হয়েছে। শূলপ ময়ূর, মৃগমাংস, পলান্ন, পক্ক আম্র, পনসকোষ, দধি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি নিয়ে ষোড়শোপচার আয়োজন। মধুকাসবের স্বর্ণকলসটি যথাস্থানেই রাখা হয়েছে।

আহার যখন শেষ পর্বে, ঐ সময় বিভাবতী তার প্রার্থনা নিবেদন করে। বলে, মহারাজ, অনুমতিদান করলে এক হৃতসর্বস্ব বণিককে আপনার পদপ্রান্তে আনি, সে আপনার সাক্ষাপ্রার্থী।

শক্তিবর্মণ শূলপকু ময়ুরমাংস চর্বণ করছিলেন। বললেন, আরে অধিক বিনয়ের কি প্রয়োজন–যাও, নিয়ে এসো তোমার বণিককে।

বসন্তদাস তখন কৃতাঞ্জলি হয়ে সম্মুখে দাঁড়ায়, মহারাজের জয় হোক।

কি হে বণিক পুত্র, সংবাদ কি তোমার?

বসন্তদাস তখন নিজ পরিচয় জানিয়ে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে। শক্তিবর্মণ মনোযোগ দিয়ে শোনেন। শেষে বলেন, সমস্তই বুঝলাম, তুমি এখন কী চাও?

প্রভু, আমার পণ্যসামগ্রীর প্রত্যর্পণ প্রার্থনা করি।

রে মূর্খ, তা কি হয়, শক্তিবর্মণ প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন। যেন কোনো বালকের অবাস্তব আবেদন শুনছেন। অতঃপর বলেন, সামন্ত হচ্ছেন রাজার প্রতিভূ, তাঁর কাজ রাজকার্যের সমতুল্য। রাজার গৃহীত সামগ্রীর কি প্রত্যর্পণ হয়? তুমি অন্য কিছু প্রার্থনা করো।

মহারাজ তাহলে অনুগ্রহ করে আমার পণ্যাদির মূল্য পরিশোধ করার জন্য আদেশ দিন।

বসন্তদাসের কথা শুনে মহাসামন্তের জ কুঞ্চিত হয়। তিনি চর্বণে বিরত হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখেন বসন্তদাসকে। মনে হয় যেন বহুকষ্টে নিজেকে আত্মস্থ করছেন। তারপর বলেন, তুমি দূরের লোক–অধিকন্তু পথিক এবং বিভাবতীর আশ্রয়ে আছে, তাই রক্ষা পেলে, ভবিষ্যতে কদাপি এরূপ বাক্য উচ্চারণ করবে না, সামন্ত বা মহাসামন্ত কারও প্ররোচনায় আদেশ প্রদান করেন না–কথাটি স্মরণ রেখো, এখন যাও।

বসন্তদাসের কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না, এরূপ উম্মার কারণ কি! সে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। একজন বয়স্য বলে উঠলো, কি হে বণিক পুত্র, কর্ণে কি জল প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে?

মহাসামন্ত বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন। বিভাবতাঁকে বললেন, কে এই বণিক? এ কেন তোমার গৃহে?

ঐ সময় একজন লোক এসে তাকে কিছু বললে তিনি বিলম্ব করলেন না। আহার ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং কিছুই না বলে বিভাবতীর গৃহ ত্যাগ করলেন।

মহাসামন্ত বিদায় হবার সঙ্গে সঙ্গে বিভাবতী চঞ্চল হয়ে উঠলো। বসন্তদাসকে বললো, আপনি কেন ঐ কথা বললেন? এখন কী হবে কে জানে, মহাসামন্তের রোষ ভয়ানক, আপনি শীঘ এ স্থান ত্যাগ করুন।

কেন, কি হয়েছে, ইত্যাকার প্রশ্ন করতে পারতো। কিন্তু দেখলো, ঐসব প্রশ্ন শোনার মতো মানসিক অবস্থা কারও নেই। ওরা তিনজনই নিদারুণ বিচলিত। বিভাবতী বারবার বলছে, গত রাত্রে মিত্রানন্দকে স্থানান্তরিত করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম–আজ আবার এ কোন বিপদ সৃষ্টি করলেন আপনি, কেন ওকথা বলতে গেলেন?

বসন্তদাস কিছু বলতে পারে না। সমস্ত অপরাধ যেন তার একার। সে বিভ্রান্ত বোধ করছিলো। প্রকাণ্ড এক অপরাধের ভার নিয়ে কি সে পলায়ন করবে, না সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে রাজরোষের সম্মুখীন হবে। সে শেষে জানালো, আমার কারণে আর চিন্তিত হবেন না–আমি চলে যাচ্ছি।

ঐ সময় কৃষ্ণা এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। বলে, তুমি চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা? আমরা কোথায় যাবো?

তোমাদের তো কোনো দোষ নেই, অপরাধ আমি করেছি, যদি শাস্তি দেয়–আমাকে দেবে।

এই তোমার বুদ্ধি! জানো, শক্তিবর্মণের চরেরা কত প্রকার উৎপীড়নের প্রক্রিয়া জানে? তুমি জানতেও পারবে না, কখন তুমি সমস্ত কথা প্রকাশ করে দিয়েছো আর সকল সংবাদ যদি তারা জানতে পারে, তাহলে আমাদের কি দশা হবে ভাবো তো?

বসন্তদাসের ক্রোধ হয় এ কথা শুনে। বলে, ষড়যন্ত্র করলে তার শাস্তি হবে না?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই শাস্তি হবে, তার জন্য আমরা প্রস্তুতও কিন্তু তুমি? নিষ্কৃতি পাবে কি? তুমিও নিষ্কৃতি পাবে না–এই সামন্তরাই তোমার সর্বস্ব অপহরণ করেছে। তোমার কোনো অপরাধ ছিলো না, তথাপি তুমি অপহৃত হয়েছে। নিরপরাধ হলেই যে তুমি রক্ষা পাবে–এমন নিশ্চয়তা কি কেউ তোমাকে দেবে?

না, দেবে না, বসন্তদাসকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু বারবার একই প্রশ্ন সে করে, আমি তো কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত নই–আমি তো কোনো প্রকার দ্রোহের উত্থান সমর্থন করি না, তথাপি কেন আমি পলায়ন করবো?

কৃষ্ণার দুচোখে অগ্নি স্কুরিত হয়। বলে, এই তোমার পৌরুষ? নির্বোধ, একাকী, দায়হীন–বিদ্রোহ যদি হয়, তাহলে তা হবে কার জন্য, আমার জন্য? বলো? আমাকে কী দেবে সেই উপপ্লব? আমরা মন্দিরদাসী, আমাদের গৃহ নেই, সংসার নেই, ভবিষ্যৎ। নেই–তথাপি আমাদের মনে হয়েছে, অনাচারের অবসান হওয়া প্রয়োজন, অত্যাচার দূর হওয়া উচিত, মানুষের অপমান এবং লাঞ্ছনা আর সহ্য হয় না। যদি আমাদের নিষ্ফল জীবন মানুষের জন্য কল্যাণময় ভবিষ্যৎ এনে দিতে পারে, তাহলেই মনে করবো জীবন আমাদের সার্থক হয়েছে। কল্যাণ ও মঙ্গলময় সেই ভবিষ্যৎ আমাদের হবে না, হবে তোমাদের, যাদের গৃহ আছে, সংসার আছে–তথাপি আমরা মনে করবো, আমাদের জীবন জগতের কাজে লাগলো।

বসন্তদাস শুনছিলো। কৃষ্ণার প্রতিটি কথা তার মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো। একেকবার স্মরণ হচ্ছিলো বিগত রাত্রির কথা। এ কোন রমণী, এ কি গত রাতের সেই কামবিলাসিনী মন্দিরবারাঙ্গনা? যার কাছে আত্মসমর্পণ না করে উপায় ছিলো না? নাকি এ অন্য কোনো তেজস্বিনী নারী। স্বয়ং আদ্যাশক্তি কি আশ্রয় নিয়েছেন এই সুন্দর রমণী দেহের ভিতরে? পরিশেষে সে বিগত রাত্রির মতোই আত্মসমর্পণ করলো। বললো, উত্তম কথা, আমি নগরী ত্যাগ করছি এবং সেই সঙ্গে তোমাদের সংসর্গও।

তুমি বড় নিষ্ঠুর হে ক্ষেত্রকর! কৃষ্ণা সহাস্য মন্তব্য করেছে তারপর। নিজ কক্ষে নিয়ে গিয়েছে। দুটি সুবর্ণ মুদ্রা কটিবন্ধে বেঁধে দিয়েছে। বলেছে, তুমি মঙ্গলদ্বীপ গ্রামে যাবে, দক্ষিণে নয়, বামে নয়–একেবারে স্থির পশ্চিমেমঙ্গলদ্বীপে তুমি দিবানাথের গৃহে আশ্রয় নেবে, যদি সেখানে মিত্রানন্দকে পাও, উত্তম, যদি না পাও, তাহলে দিবানাথের পরামর্শ মতো অন্যত্র যাবে।

সর্বশেষে কৃষ্ণা দুহাত ধরে মুখপানে দৃষ্টিপাত করেছে। বলেছে, ওহে, আত্রেয়ী তীরের ক্ষেত্রকর, এক রাত্রির সাক্ষাতেও মন্দিরদাসী প্রণয়ীকে হৃদয়দান করতে জানে এখন বিশ্বাস হয় সে কথা?

দারুণ হাসছিলো তখন কৃষ্ণা। আর ঐ একটি প্রশ্নই বারবার করছিলো, বিশ্বাস হয় না তোমার? বলো, বিশ্বাস হয় না?

বসন্তদাস ঐ কথার উত্তর দিতে পারেনি। উত্তরের ভাষা তার জানা ছিলো না। শুধু দুহাতে আকর্ষণ করে কৃষ্ণার সীমন্তে একটি চুম্বন এঁকে দিয়েছে।

ঐ তার শেষ সাক্ষাৎ।

এবং ঐ শেষ সাক্ষাই তাকে যুক্ত করে দিয়েছে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে। ঐ বিদায় যেন বিদায় নয়, বন্ধন। তারপর সে একাকী নয়। জগতের নানান প্রসঙ্গ এখন তার চিন্তা ভাবনার বিষয় হয়ে যায়। তার বণিক জীবনের মৃত্যু ঘটেছে ফল্পগ্রামে, বালিগ্রামে হয়েছে। তার অন্ত্যেষ্টি এবং ঐ অন্ত্যেষ্টির পর আরম্ভ হয়েছে তার নতুন জীবন। সে জানে না, এই নতুন জীবনের কী নাম–কিন্তু সে একটি গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধিটি মুক্তির। সীমারেখা থেকে মুক্তি, গণ্ডিরেখা থেকে মুক্তি, স্বার্থবুদ্ধি থেকে মুক্তি–এবং এইভাবে ঘৃণা থেকে, সংকোচ থেকে, হীনমন্যতা থেকে ক্রমাগত একের পর এক মুক্তি।

অবশ্য এই গভীর তাৎপর্যময় উপলব্ধিটি স্পষ্ট হয়েছে অনেক পরে। তবে তার সূচনা ঐদিন, যেদিন সে বালিগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আসে।

বালিগ্রাম ত্যাগ করে সে মঙ্গলদ্বীপে যায়, সেখানে তার জন্য যেন অপেক্ষা করে ছিলেন দিবানাথ, তার আশ্রয়েই সাক্ষাৎ হয় ভিক্ষু মিত্রানন্দের সঙ্গে।

বসন্তদাসের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে নবীন ভিক্ষু মিত্রানন্দ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। নিঃসংকোচে বলে, মহাশয়, আপনি সর্বনাশ করেছেন–আপনার শাস্তি হওয়া উচিত।

তীব্র উল্কণ্ঠা তখন বসন্তদাসের মনে, কলহে প্রবৃত্তি ছিলো না। তথাপি বলে, মহাশয় অহেতুক ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, আপনি ভিক্ষু, ক্রোধ আপনাতে শোভা পায় না।

ঐ কথায় মিত্রানন্দ সত্য সত্যই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। বলে, ক্রোধের এখনই আপনি কি দেখেছেন, ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন–অপেক্ষা করুন।

ভ্রাতঃ আমি তো বুঝলাম না আমার অপরাধ কোথায়! বসন্তদাস বিনয় ত্যাগ করে না।

আপনি তিনটি তরুণীর সর্বনাশ করেছেন, মিত্রানন্দ তীব্রস্বরে বলে, আমাদের মহান একটি কার্য–সম্পাদনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন, তথাপি বলছেন, আপনার অপরাধ নেই? আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।

কিন্তু আমি তো তাদের কিছু করতে বলিনি–তারাই আমাকে আমন্ত্রণ করে গৃহে নিয়ে গিয়েছিলেন।

চুপ করুন, লোভী, লম্পট, মিথ্যাচারী!

বসন্তদাস দেখলো, এ ভারী অদ্ভুত কাণ্ড। ক্রোধে মিত্রানন্দের একেবারে হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছে। সে বললো, মহাশয়, আপনার মুখে সংযম আনুন, না হলে আমিও অসংযমী হয়ে উঠতে পারি।

মিত্রানন্দ আরও কী বলতো কে জানে! ঐ সময় দিবানাথ মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এ কী করছেন আপনারা–ছি ছি–বিপদে মানুষকে ধীরস্থির থাকতে হয়, আপনারা ধৈর্যহারা হয়ে যদি কলহ করতে থাকেন, তাহলে লাভ কার হবে? এখন না আপনাদের উচিত বিপর্যয় কতখানি হয়েছে সেইটি জানা, আর তা না করে আপনারা কলহে প্রবৃত্ত হয়েছেন?

এ কথায় মিত্রানন্দের যেন সম্বিৎ হয়। সে নত মুখে ঐ স্থান ত্যাগ করে। দিবানাথ জানালেন, আমি এখনই নগরীর উদ্দেশে যাত্রা করছি–সংবাদ নিয়ে আসি–প্রকৃত ঘটনা কী।

দিবানাথ প্রত্যাগমন করলেন সন্ধ্যাকালে। জানালেন, বিভাবতী ও শুক্লা প্রাসাদে বন্দিনী–শত পীড়নেও তারা কোনো কথা প্রকাশ করেনি–আর কৃষ্ণার কোনো সংবাদ নেই, কেউই তার সংবাদ জানে না।

আরও সংবাদ এই যে, মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ যথার্থই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, নগরীর গৃহে গৃহে সন্ধান করা হচ্ছে–মিত্রানন্দ এবং বসন্তদাসকে চাই–সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।

কৃষ্ণার সংবাদ নেই শুনে বসন্তদাস বিচলিত হয়। কৃষ্ণার মুখখানি সে বিস্মৃত হতে পারছিলো না। তার উচ্ছল হাসি, কপট ক্রোধের ভ্রূ-ভঙ্গি, তার প্রগাঢ় আলিঙ্গন, তার আশ্লেষ গভীর চুম্বন এবং অশ্রু উদ্বেলিত অথচ হাস্যমুখরিত বিদায় জ্ঞাপন–সমস্তই বারংবার তার মনে পড়ছিলো। কে জানে, হয়তো শক্তিবর্মণের অনুচরেরা এতোক্ষণে তার দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সন্ধ্যাকাশের উজ্জ্বল তারকাটির দিকে দৃষ্টি রেখে সে উচ্চারণ করে, কৃষ্ণা ক্ষমা করো আমি তোমার অক্ষম প্রণয়ী, তোমাকে রক্ষা না করে আমি পলায়ন করে এসেছি।

মিত্রানন্দ সন্ধ্যাকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলো। তার চিন্তা ভিন্ন। তার চিন্তা হচ্ছিল, বিপুল একটি উপপ্লব কি সত্যই আসন্ন? দাসত্ব ও লাঞ্ছনা থেকে মানুষ কি মুক্তি পেতে চলেছে? মনের আকাক্ষা কি এখন বিশ্বাসে পরিণত হবার পথে? না হলে ঐ তিনটি মন্দিরবাসী যুবতী কেন বিপজ্জনক সহযোগিতাদান করতে এসেছিলো?

মিত্রানন্দের কষ্ট হয় বিভাবতী ও তার সহচরী তরুণী দুটির জন্য। আবার সেই সঙ্গে আশাও গভীরতর হয়। মনে হয়, ঐ তিন মন্দিরবাসীর আত্মাহুতি মানুষের মুক্তি ত্বরান্বিত করে আনছে।

সে বসন্তদাসের কাছে যায়। বসন্তদাসের মুখে বিষাদের ছায়া দেখে বলে, মিত্র বসন্ত, দুঃখ করবেন না–যুদ্ধ আরম্ভ হলে আঘাত তো আসবেই–মনে করুন, এ সেই প্রকারেরই একটি আঘাত।

বসন্তদাস জানায়, আমি তো যুদ্ধ চাইনি, কোথায় যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কিছুই। জানি না–আমি সাধারণ মানুষ। কৃষ্ণাদেরও কি যুদ্ধ প্রয়োজন ছিলো? আমি বুঝি না ভিক্ষু মিত্ৰানন্দ, কেন এই দ্রোহ উত্থাপনের প্রস্তাবনা, এতে তো মৃত্যু এবং ধ্বংস ব্যতীত অন্য কিছুই আমি দেখছি না।

মিত্রানন্দের সন্দেহ হয়, তবে কি এই লোকটি তাদের কাজের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন, কোনো সংবাদই জানে না? তাহলে দিবানাথের গৃহেই বা তার আশ্রয় কেন হলো? সে নিশ্চিত হতে পারে না।

তথাপি সে বলে, বসন্তদাস, আমি জানি না, আপনি কী চিন্তা করেন। কিন্তু নিজের জীবনের কথা কখনও ভেবেছেন? আপনার, আপনার পিতার, আপনার পিতামহের? মনে হয় না কি আপনি পুরুষানুক্রমে দাস? সামন্তপতির দাস, কায়স্থের দাস? আপনার কি ভগবান আছে? আপনি ভগবানের পূজা করতে পারেন? চণ্ডালদের কথা চিন্তা করুন, ডোম হড়ডিদের কথা চিন্তা করুন। নিমশূদ্রে কত বর্ণ ভেবে দেখেছেন? শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ, একে অপরের ওপর লাঞ্ছনা করে, শোষণ করে, লুণ্ঠন করে। আপনি কি লুণ্ঠিত হননি, বলুন? সামন্তপতি যে আপনার সমস্ত কিছু অপহরণ করলো, তার প্রতিকার কোথায়?

মিত্রানন্দের কথায় বসন্তদাসের প্রত্যয় হয় না। তার মনে হয় না যে এতো সরলভাবে প্রশ্নগুলি করা যায়। সে বলে, এভাবে প্রশ্ন করলে তো সমাধান পাওয়া যাবে না। রাজপুরুষ অত্যাচারী হলে রাজার কাছে যেতে হবে–সে জন্য দ্রোহের প্রয়োজন নেই। আর শ্রেণীর কথা বলেছেন, ব্রাহ্মণ শূদ্র এক হতে পারে কখনও? ভগবান যদি কারও জন্য শূদ্র জন্ম নির্দিষ্ট করে থাকেন, তাহলে শূদ্রের কাজই তার কর্তব্য। সে কেন ব্রাহ্মণের কাজ করতে যাবে? সকলেই কি রাজা হয়? যার সৌভাগ্য ভগবান নির্দিষ্ট করে দেন সে–ই রাজা হয়। মনে করুন, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ও সেইরূপ।

আপনি যুক্তির কথা বলুন–আপনি তো দেখছি বিশ্বাসের কথা বলছেন?

না যুক্তি আমারও আছে, বসন্তদাস জানায়। বলে, সকার্য যে করে, সৎ জীবন যে যাপন করে, জ্ঞানালোচনা করে, যে মানুষকে পথ নির্দেশ করে, সে মানুষকে আমি শ্রেষ্ঠ বলবো না? ব্রাহ্মণ তো সেই বিচারেই শ্রেষ্ঠ। নীচ–স্বভাব যে, হীন যে, যার মুখে সর্বদা মিথ্যা ভাষণ, যে তস্কর–সেই লোক এবং ব্রাহ্মণ এক হওয়া কখনই সম্ভব নয়।

হ্যাঁ, আমারও সেই কথা, মিত্রানন্দ স্বীকার করে। বলে, শ্রেষ্ঠমানব তার গুণে, জন্মে নয়, কুলক্রমে নয়। যদি কোনো ব্রাহ্মণ লুণ্ঠন করে, হত্যা করে, আপাদমস্তক যে লম্পট, তাকে আমি ব্রাহ্মণ কেন বলতে যাবো? বাস্তবে আমরা কী দেখি, বলুন? সকল ব্রাহ্মণ কি ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করে? ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য প্রজা পালন, সে কি প্রজা পালন করে? আবার দেখুন, আপনি পুরুষানুক্রমে সৎ জীবনযাপন করলেও ব্রাহ্মণ হতে পারবেন না।

বসন্তদাস তথাপি সংশয়মুক্ত হতে পারে না। বলে, মিত্রানন্দ শ্রেণীভেদের এ বিধান সনাতন–হঠাৎ পরিবর্তন করতে চাইলেই পরিবর্তন হবে না। সদ্ধর্মী বৌদ্ধরাও ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ ভেদ লুপ্ত করতে পারেনি।

এই প্রশ্নে সদ্ধর্মীরা দুর্বল, মিত্রানন্দ জানে। তাই সে ব্রাহ্মণব্রাহ্মণ প্রশ্নে ভগবান তথাগতের কথা স্মরণ করে। তার বিশ্বাস, ব্রাহ্মণব্রাহ্মণে যে ভেদ করে, সে প্রকৃত সদ্ধর্মী নয়। সেই একই কথা সে বসন্তদাসকে জানালো, বললো, মানুষের অপমান যদি কোনো সদ্ধর্মী কখনও সমর্থন করে, তাহলে বুঝবেন, সে সদ্ধর্মী নয়।

সে না হয় হলো, বসন্তদাস এবার সহজ হয়। বলে, ধরে নিলাম দ্রোহের পতাকা উত্থাপিত হলো, রাজাও হলো নতুন–কিন্তু তারপর? ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদির আধিপত্য না থাকলেও অন্য কোনো শ্রেণীর আধিপত্য যে থাকবে না–তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? তথাগত ধর্ম তো সর্বত্রই ছিলো একদা–সেইকালে কি সামন্ত মহাসামন্তদের দৌরাত্ম ছিলো না? চণ্ডাল ডোমেরা কি তখনও নিগৃহীত হয়নি? বলুন আপনি?

মিত্রানন্দ কিন্তু নিজ বিশ্বাসে অবিচল। সে হাসে। বলে, প্রশ্নটা ধর্মীয়, যৌক্তিকতার নয় বসন্তদাস, প্রশ্নটা হলো মানব মুক্তির, মানব মুক্তির পথে যা অন্তরায় তা–ই অধর্ম এবং পরিত্যাজ্য–আমাদের এই দৃষ্টিতে সমগ্র বিষয়টি বিচার করে দেখতে হবে।

বসন্তদাস বিভ্রান্ত বোধ করে। বলে, আপনি যা বলছেন তা আমার ধারণায় আসে। মুক্তি কথাটি তো বিপজ্জনক–কোন বন্ধন থেকে মুক্তি সেটার নিশ্চয়ই উল্লেখ থাকতে হবে। অর্থাৎ একটি বিধিমালা আপনার থাকতে হবে–তার অর্থ আর একখানি অর্থশাস্ত্র। মানব মুক্তি তো বায়বীয় ব্যাপার হয়ে থাকলে চলবে না। এবং তখনই আপনার কার্যক্রমের ভিত্তিটি লোকে পেতে চাইবে–সেখানেই আসে ধর্ম এবং শাস্ত্র। বলতে হবে, আপনার ধর্ম কি প্রকার–বলতে হবে, সমাজ কি প্রকার বলতে হবে, ধন ব্যবস্থা কি প্রকার–মিত্রানন্দ, তাই বলছিলাম, যত সরল ও সহজভাবে আমরা প্রশ্নগুলি তুলছি–এগুলি এত সহজ ও সরল নয়।

আপনি কি তাহলে বিশ্বাস করেন, যে ব্যবস্থা এখন প্রচলিত, তাতেই মানুষ সুখী হবে? তাতেই জীবনের বিকাশ ধারা প্রবাহিত হবে? মিত্রানন্দ এবার স্পষ্ট উত্তর চায়।

না, আমি প্রচলিত ব্যবস্থায় তুষ্ট নই, বসন্তদাস জানায়। বলে, আমি জানি এই ব্যবস্থা আমার ধনার্জনের পথ উন্মুক্ত রাখেনি, আমাকে বিদ্যার্জন করতে দেয়নি–এমনকি, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষও যে নিরুপদ্রব সংসার জীবনযাপন করবে, তারও কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেনি–আমি প্রচলিত ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ ও বিধ্বস্ত করতে চাই কিন্তু এও আমি জানতে চাই যে, পরিবর্তে আমি কী পাবো।

মিত্ৰানন্দ হাসে। বলে, জীবনের প্রক্রিয়ায় পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হবে বন্ধু, নতুন সৃষ্টি হোক অথবা না হোক।

না, তা সম্ভব নয়, বসন্তদাস জানায়, শূন্যতায় জীবন বিধৃত থাকে না।

তাহলে কি বলতে চান, তৃতীয় কোনো শক্তির আগমন ঘটবে? যার মধ্য দিয়ে ধর্ম সমাজ রাষ্ট্র সর্বত্র নতুন বিন্যাসের সূচনা হবে?

বসন্তদাস সচকিত হয়, এ কোন কথা বলছে মিত্রানন্দ? তার মনে ঐ তৃতীয় শক্তির কথাটি বিদ্ধ হয়ে যায়। সে আর কিছু বলে না। মিত্রানন্দের মুখপানে চায়। লক্ষ্য করে দেখে, সেখানে দুরভিসন্ধির কোনো ছায়াপাত দেখা যায় কিনা। দেখে, কোনো ছায়া নেই মিত্রানন্দের মুখে। সহজ, স্বচ্ছ, তপশ্চর্যায় শান্ত পবিত্র একখানি মুখ। তবু অস্বস্তি বোধ হয় তার। এবং তখন সে জানতে চায়, ভিক্ষু মিত্রানন্দ, সত্য সত্যই কি তৃতীয় শক্তির কথা আপনারা চিন্তা করেছেন?

না বসন্ত, সে কথা আমি জানি না, বিশ্বাস করুন। তবে আমার মনে হয়, বর্তমান ব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত না হলে জীবনের বিকাশ অসম্ভব। আমরা মানুষকে স্বপরিচয়ে উখিত হতে বলছি, নতজানু দাসত্বের জড়তা থেকে মুক্ত হতে বলছি–আমি এই পর্যন্ত জানি–এর অধিক আমার জানা নেই।

মিত্রানন্দ একখানি গোপন পত্র বহন করছে। পট্টিকেরা রাজ্যের যুবরাজ রণবঙ্কমল্লদের রচিত ঐ পত্রখানি তুলে দিতে হবে মহাভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দের হাতে। তিনি এখন কোথায় সে সংবাদটিও জানা নেই। পুন্ড্রবর্ধনে গেলে তবে জানা যাবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারে এখনও অবস্থান করছেন, না জগদ্দল মহাবিহারে প্রস্থান করেছেন। ঐ পত্রের বিষয় কী তা সে জানে না। সে বাহক মাত্র, পত্রের বিষয় তার জানবার কথা নয়। তবে এটুকু সে অনুমান করতে পারে যে রণবঙ্কমল্লদের তাঁর নিজস্ব কোনো অভিমত জানিয়েছেন। ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ যে সংবাদ অথবা প্রস্তাব প্রেরণ করেছিলেন তারই প্রত্যুত্তরে এই অভিমত। এই অভিমত বিচার করেই ভিক্ষুসংঘ সিদ্ধান্ত নেবে। কী সিদ্ধান্ত হতে পারে তাও সে অনুমান করতে পারে না। তবে নিজে যখন ভিক্ষুসংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন অবশ্যই জানতে পাবে কী সিদ্ধান্ত হলো শেষ পর্যন্ত। সে অস্থির হয় না।

বালিগ্রামে মন্দিরদাসীদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে তা জানবার জন্য দিন দুই অপেক্ষা করে অবশেষে মিত্রানন্দের সঙ্গে বসন্তদাস যাত্রা করলো। এবার গন্তব্য পুন্ড্রনগর, সে স্থান থেকে সংবাদ নিয়ে মিত্ৰানন্দকে যেতে হবে জগদ্দল অথবা বিক্রমশীলা আর বসন্তদাস যাবে স্বগৃহে।

আর কোনো ঘটনা ঘটেনি পথিমধ্যে। বিলম্বও হয়নি। পথিমধ্যে দুই বন্ধুর আলাপ হয়েছে জগতের নানান বিষয় নিয়ে। ক্রমে বন্ধুত্ব হয়েছে গাঢ়–সম্বোধন নেমে এসেছে তুমিতে। বসন্তদাস এখন অন্য মানুষ। গৃহ ত্যাগের সময় যে বসন্তের মনে চিন্তা ছিলো কি উপায়ে সে ধনী বণিক হবে, এখন সেই বসন্তের মনে ভিন্ন চিন্তা। তার দৃষ্টি এখন মানবজীবনের লাঞ্ছনা, অপমান এবং দাসত্বের দিকে। মনে এখন জ্বালা ও বেদনা। সেই সঙ্গে আর একটি নতুন ভাব জন্ম নিয়েছে মনে। অসহায় মানুষ দেখলে সে যুগপৎ ক্রুদ্ধ। ও করুণার্দ্র হয়ে ওঠে।

অবশেষে, দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে, প্রায় অর্ধ-বর্ষকাল শেষে, বসন্তদাস পত্নী মায়াবতীর কাছে প্রত্যাগমন করলো।

কিন্তু আমরা জানি, বসন্তদাস যুবতী স্ত্রী মায়াবতীর বাহুডোরে বাঁধা থাকতে পারেনি। কেননা তার স্বল্পকাল পূর্বে ঘটেছিলো পিপ্পলী হাটের ঘটনা। ফলে বসন্তদাসের গৃহীর জীবনযাপন আর হলো না। ভয়ানক দুষ্কাল তাকে তাড়িত করছে–তার সাধ্য কি যে সে গৃহসুখের আস্বাদ ভোগ করবে।

০৯. পথ যে দীর্ঘ

পথ যে দীর্ঘ তা অনুমানে জানা ছিল। কিন্তু তা যে এতো দীর্ঘ কল্পনা করেনি কখনও। প্রথমে পদব্রজে, অতঃপর গো-শকটে। শেষে নৌকায়। অপরিচিত জনপদ, কেউ প্রশ্ন করে না, তোমাদের সম্পর্কটি কি? প্রশ্নের অবকাশ কোথায়? লীলা প্রায় দেহলগ্ন হয়ে বসে। অবগুণ্ঠনটি দীর্ঘ করে নববধূর মতো, আর সর্বক্ষণই প্রায় নীরব সে। চকিতে কখনও মুখখানি দেখা গেলে, কিংবা তার মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও কিছুই বোধগম্য হয় না। ফলে সকলেই সরল অনুমানটিই করে। মনে করে, নববধূ স্বামীগৃহে চলেছে।

তবে বিপদ হয়েছিলো আত্রেয়ী তীরের একটি গ্রামে। সেদিন ছিলো গ্রামের হাট। ক্ষুদ্র পান্থশালাটিতে স্থান ছিলো না। মন্দিরেও স্থান পাওয়া গেলো না। মহাসমস্যা, কোথায় রাত্রিযাপন করে। এদিকে রাত্রি গভীরতর হচ্ছে, ক্ষুধা তৃষ্ণা ক্লান্তি ইত্যাদির ভারে দেহ আর চলে না। এমন সময় পান্থশালার প্রৌঢ় অধিকারীটি ডাকলেন। বললেন, আপনারা আমার গৃহে চলুন, সেখানে আপনাদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হবে।

ব্যবস্থাটি অভাবিতপূর্ব, বহির্বাটির একটি সম্পূর্ণ প্রকোষ্ঠ পাওয়া গেলো–এমনকি তৈল প্রদীপটি পর্যন্ত। ফলাহারের উপকরণাদি তারা সঙ্গে বহন করে–সুতরাং আহার পর্ব সহজেই সমাধা হলো। তারপরই নিদ্রা চাই। কিন্তু শয্যা মাত্র একখানিই এবং তা এতোই ক্ষুদ্র যে একাধিক লোকের, স্বামী স্ত্রী না হলে, স্থান সংকুলান অসম্ভব। পূর্বে এমন অবস্থা হয়নি। কারণ পথিমধ্যে যে দুদিন রাত্রিযাপন করেছে সে দুদিন লীলাবতীর স্থান হয়েছে অন্তঃপুরে। বলা যায়, দুজনে এক প্রকোষ্ঠে রাত্রিযাপন এই প্রথম। শ্যামাঙ্গ কোনো প্রকার চিন্তা না করে দ্বারের কাছে ভূমিতে লম্বমান হলো। লীলাকে শয্যাখানির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো, তুমি ঐখানে শয়ন করো।

লীলাবতী কিছু বললো না। স্থাণু মূর্তির মতো দীর্ঘক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।

শ্যামাঙ্গ কী বলবে ভেবে পায় না। যদি সে শয্যায় শয়ন করে, তাহলে লীলাবতীর ধারণা হবে যে সে লোভী এবং সুযোগ সন্ধানী, আর যদি ভূমিতে রাত্রিযাপন করে, তাহলে লীলাবতী শয্যায় শয়ান হয়ে সমস্ত রাত্রি অস্বস্তি বোধ করবে। সে পুনরায় বললো, লীলা, তুমি শয়ন করো, রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।

লীলাবতী গুণ্ঠন উন্মোচন করে বলে, তুমি শয়ন করবে ভূমিতে আর আমি শয়ন করবো শয্যায়? এ কথা চিন্তা করবার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?

এ তো মহাজ্বালা! শ্যামাঙ্গ উঠে দাঁড়ায়। বলে, তুমি আমাকে কী করতে বলো?

তুমি শয্যায় শয়ন করো, আমি ভূমিতে থাকি।

তোমার এ ব্যবস্থাই বা আমি মানবো কেন?

শ্যামাঙ্গের এই কথায় লীলাবতী ঈষৎ কুপিতা হয়। বলে, উত্তম কথা, তুমি মেনন না–এসো, তাহলে অশ্বের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনে নিদ্রা যাই।

না, তা কেন?

কেন নয়, তাহলে কি বলতে চাও দুজনেই এক শয্যায় রাত্রিযাপন করবো? যদি ঐরূপই তোমার ইচ্ছা থাকে, তাহলে বলো–আমি সেইভাবে রাত্রিযাপনের জন্য প্রস্তুত হই।

ক্লান্ত অবসন্ন দেহে মধ্যরাত্রে বাদানুবাদে শ্যামাঙ্গের প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। তার চক্ষু দুটি মুদিত হয়ে আসছিলো। ফলে আর সে কথা বললো না, শয্যায় নিজেকে নিক্ষেপ করলোএবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায়, বলা যায়, সে নিদ্রায় নিমজ্জিত হয়ে গেলো।

তৈলদীপ কখন নির্বাপিত হয়েছে জানে না। গভীর রাত্রে অনুভব করলো একখানি কোমল হাত তার কেশ বিলুলিত করছে। সে নিদ্রার ভান করে রইলো। এক সময় অনুভব হলো, হাত নয়, দুটি ওষ্ঠ তার কপাল চুম্বন করছে। এবং ঐ মুহূর্তে সে দুবাহুতে গলদেশ বেষ্টন করে নিজের মুখখানি লীলাবতীর পরিপূর্ণ বক্ষে নিমজ্জিত করলো। শ্যামাঙ্গের ঐ আচরণে মুহূর্তের জন্য যেন বিমূঢ় হলো লীলাবতী। সজোরে নিজেকে মুক্ত করে ভারাক্রান্ত স্বরে বললো, ছাড়ো আমাকে শ্যামাঙ্গ, আমাকে তুমি এভাবে প্রলুব্ধ করো না।

ঐ মুহূর্তে দুই বিন্দু অশ্রু কপোলে এসে পড়লে সে চমকিত হয়। বলে, কি ব্যাপার, লীলা, তুমি কাঁদছো কেন?

রুদ্ধবাক লীলার দমিত কান্না ঐ কথার পর যেন সকল সংযমের বাধা অতিক্রম করে। সে শ্যামাঙ্গের বক্ষে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। শ্যামাঙ্গ নির্বাক। সর্বস্বহৃতা এই রমণীকে সে কী বলবে? আত্মীয়–পরিজনহীন, বর্তমান ভবিষ্যৎহীন, এই নারীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কি কোনো ভাষা রচিত হয়েছে কোথাও? সে জানে না। বারংবার সে একটি কথাই বলতে পারলো। আর তা হলো, কেঁদো না লীলা, জীবন যেভাবে এসেছে সেভাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে না হলে আমাদের মরণ।

গবাক্ষ পথে চন্দ্রালোকের আভা প্রকোষ্ঠে আসছিলো। তাতে লীলার অশ্রুসিক্ত মুখখানি, উজ্জ্বল চোখ দুটি, চন্দ্রকলার মতো কপালখানি, ভারী সুন্দর হয়ে অন্ধকারের মধ্যে ফুটে উঠলো। কান্নায় তার অধরোষ্ঠ স্ফুরিত হলো বারেক, বারেক তার অশ্রুময় চোখের দৃষ্টি বাহিরের শীতল জ্যোৎস্নায় অবগাহন করলো–তারপর সে বললো, শ্যামাঙ্গ, তুমি আমাকে ত্যাগ করে যাও–আমার ক্ষমতা নেই যে আমি তোমাকে গ্রহণ করি যখনই তুমি আমার দিকে চাও, তখনই নিজেকে অপরাধী মনে হয়–কিন্তু তবু আমি নিজেকে নিঃশেষে দান করতে পারি না। কখনও দেহ উন্মুখ হয়, কখনও মন। বড় জটিল অবস্থা আমার তুমি আমাকে ত্যাগ করো।

শ্যামাঙ্গ হাসে। বলে উত্তম কথা, ত্যাগ না হয় করলাম। অতঃপর তুমি কোথায় যাবে?

আমি জানি না, শ্যামাঙ্গ, পুনরায় লীলার কান্না উদ্বেলিত হয়। বলে, যখনই তুমি আমার দেহে হাত রাখো, তখনই যেন মনে হয় এক লম্পট আমার দেহে হাত রাখছে। যখনই তুমি আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাও, মনে হয় তুমি দেহ সম্ভোগের পরিকল্পনা করছো। মনে হয়, কেবল ঐ একটি কারণের জন্য সঙ্গে সঙ্গে চলেছো তুমি। বরং তুমি যদি এমন না হয়ে অন্যদের মতো হতে, যদি কোনো বাধা না মেনে আমাকে বলাকার করতে–তাহলে যেন ছিলো ভালো। আমি তোমাকে ভাবতে পারতাম লম্পট, লোভী এবং স্বার্থান্বেষী বলে, এবং তাহলে তোমাকে আমি ঘৃণা করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তুমি তা নও। তুমি এতো ভালো, মুখপানে চাইলে তোমার পদতলে নিজেকে নিবেদন করার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু নিকটে গেলেই আর পারি না। তুমি যাও প্রিয়তম। আমার ললাটে যা আছে তাই হবে–আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যাচার করতে পারবো না।

ঐ সময় শ্যামাঙ্গ উঠে বসে লীলাবতীর স্কন্ধে হাত রাখে। বলে, তুমি কি উন্মাদিনী হয়েছো? এমন অদ্ভুত কথা কেন বলছো? দেখো আমার চক্ষু দুটির দিকে। এই মুহূর্তে আমার কী ইচ্ছা করছে, জানো? ইচ্ছা করছে তোমাকে চুম্বন করি, বক্ষে পিষ্ট করি এবং তারপর প্রাণভরে তোমাকে সম্ভোগ করি–কিন্তু আমি তা করছি না–কারণ জানো?

কী? বলো, কী? লীলাবতীর চক্ষু দুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

শ্যামাঙ্গ জানায়, আমি যে তোমাকে হৃদয় দান করেছি–আমি কেন লম্পটের মতো অপহরণ করবো? প্রেম নিঃশেষে নিবেদন করার–তাই আমি অপেক্ষা করে আছি।

বলো না শ্যামাঙ্গ। ওভাবে বলো না–আমি জটিল হয়ে পড়েছি–আমাকে উন্মাদিনী জ্ঞান করে ত্যাগ করো।

তবে রে রমণী, ফের ঐ কথা? হঠাৎ শ্যামাঙ্গ ক্রোধের ভান করে। বলে, দেখ তবে জীবন কাকে বলে–এই বলতে বলতে সে দুবাহুতে সজোরে বেষ্টন করে লীলাবতীকে এবং তারপর তার অধরোষ্ঠে পরিপূর্ণ এবং দীর্ঘ একটি চুম্বন দান করে।

ঐ পর্যন্তই–-লীলাবতীর সমগ্র অস্তিত্ব স্তব্ধ হয়ে যায়–আকাঙ্ক্ষায় না ঘৃণায় বলা দুষ্কর। শ্যামাঙ্গ আর অগ্রসর হয় না। সে শয্যায় দেহ রাখে এবং লীলাবতী তার ভূমি শয্যায় ফিরে যায়।

পরদিন তারা শয্যা ত্যাগ করে বিলম্বে। প্রকোষ্ঠের বাইরে এসে দাঁড়ালে অধিকারীটি সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। জানতে চায়, মহাশয়ের বোধ হয় জাগরণে রাত্রি অতিবাহিত হয়েছে?

শ্যামাঙ্গের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। জানতে চায়, কেন–একথা কেন বলছেন–কেন আমরা রাত্রি জাগরণ করবো?

হেঁ হেঁ হেঁ, ক্রুদ্ধ হবেন না মহাশয়, লোকটি বিনয়ে বিগলিত হতে আরম্ভ করে। বলে, সমস্ত রাত্রি আপনারা আলাপ করেছেন তো, তাই বলছি

শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে প্রৌঢ়টির দৃষ্টি যেমন, তেমনি হাসিটিও কদর্য। তার ক্রোধ হয়। বলে, আপনি দেখছি ছিদ্রান্বেষী–ছিদ্রপথে অন্যের গোপন ক্রিয়াকলাপ দেখে থাকেন।

না না ওকথা বলবেন না, আমার বয়স হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছেন

হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, বৃদ্ধ শালিক পক্ষীর গ্রীবায় নতুন পালকের উদগম হয়েছে, শ্যামাঙ্গ নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।

হেঁ হেঁ আপনি দেখছি রসিকও, প্রৌঢ়টির চাটুকারিতা দেখবার মতো। লীলাবতীর দিকে ইঙ্গিত করে বলে, তা ইনি কি আপনার বিবাহিতা পত্নী?

শ্যামাঙ্গ বুঝলো, লোকটি অসম্ভব ধূর্ত এবং বদ–স্বভাব। সে সংযত হলো, কে জানে, এই বদলোক কোন গোলযোগ সৃষ্টি করে। বললো, ইনি আমার সহধর্মিণী–আমরা যোব্রতী।

হেঁ হেঁ, তাই বলুন, আমার সন্দেহ তাহলে অমূলক নয়–আপনারা যোগী। যোগ সাধনায় সঙ্গিনীর অবশ্যই প্রয়োজন, হেঁ হেঁ–তা এই কথাটা পূর্বে বললে হতো না?

কোন কথা? শ্যামাঙ্গ বিভ্রান্ত বোধ করে।

এই যে, আপনারা যোগী, আমার গৃহে রাত্রিকালে যোগ সাধনা করবেন? ছি ছি কি অনাচার। এখন আমাকে গৃহশুদ্ধি করতে হবে। দেখুন তো, আপনারা আমার কি সর্বনাশ করেছেন?

শ্যামাঙ্গ অনুমান করে প্রৌঢ়টি তাকে বিপদাপন্ন করবে। সে বললো, মহাশয়, এতো বিচলিত হচ্ছেন কেন? আমরা তো রাত্রিযাপনের জন্য অর্থ দিচ্ছিই, সেই সঙ্গে না হয় আরও কিছু অধিক দেবো।

ঐ কথায় কাজ হয়, প্রৌঢ়টি শান্ত হয়। কিন্তু তার মুখ শান্ত হয় না। তখন তার আবার অন্যরূপ বিনয়। বলতে লাগলো, আমার দোষ নেবেন না মহাশয়, গৃহশুদ্ধি আমাদের বাধ্য হয়ে করতে হয়–এ গ্রামের সমাজপতিরা শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারে অত্যধিক তৎপর থাকেন। সামান্য ত্রুটি হলেই তারা সমাজে পতিত ঘোষণা করে দেন, সুতরাং বুঝতেই পারছেন…

শ্যামাঙ্গ জানতে চাইলোতা আপনারা কি শূদ্রের মধ্যেও জলাচল শ্রেণীভেদ করে রেখেছেন নাকি?

না তা করিনি?

তাহলে যোগী স্পর্শে গৃহশুদ্ধি করতে হবে কেন?

আমি তো বৈশ্য, অম্বো০ষ্ঠ বৈশ্য।

শ্যামাঙ্গের বিশ্বাস হতে চায় না। বলে, আপনি অঘোষ্ঠ বৈশ্য হলে পান্থশালার রক্ষক হন কি প্রকারে?

মহাশয় আর বলবেন না, সবই সমাজপতিদের ইচ্ছা। সামাজিক যতো বিধান, সবই তাঁদের প্রয়োজনে। ব্রাহ্মণ যখন কুলবৃত্তি যজ্ঞ–যাজনাদি ত্যাগ করে রাজকার্য করে, তখন কেউ তাদের দোষ দেয় না, বরং ঐ নববৃত্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন কুলের উদ্ভাবন করা হয়। ব্রাহ্মণ হয়ে যায় ব্রহ্মক্ষত্রিয়–আমার ক্ষেত্রেও ঐ প্রকার ব্যবস্থা হয়েছে আর কি! গ্রামপতি ও ব্রাহ্মণরা বললেন যে, তোমার পান্থশালা–রক্ষক হতে বাধা নেই। কারণ তোমার বৈদ্য পিতা যা করেন, তোমার কাজও তাই। তিনি রুগ্ন মানুষের সেবা করেন। আর তুমি করবে শ্রান্ত ক্লান্ত মানুষের সেবা–সুতরাং বাধা কোথায়? তাই অঘোষ্ঠ বৈশ্য হয়েও আমরা পান্থশালার অধিকারী।

শ্যামাঙ্গ ততক্ষণে মনস্থির করে নিয়েছে–আর এক মুহূর্ত নয় এ স্থানে। প্রৌঢ়ের কথা শেষ হলে সে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলি উর্ধ্বে তুলে বললো, আপনারা প্রকৃত কী, জানেন? আপনারা হচ্ছেন অশ্বডিম্ব–বুঝলেন? উৎকৃষ্ট এবং সুগোলাকার একটি অশ্বডিম্ব।

প্রাপ্তিটি অভাবিতপূর্ব এবং অত্যধিক। এক রাত্রির জন্য একেবারে একটি সম্পূর্ণ মুদ্রা! প্রৌঢ়টি সবিস্ময়ে নিজের প্রসারিত হস্তপানে চেয়ে থাকে। তার ধারণা হয়, লোকটি নিশ্চয়ই উন্মাদ।

পথে লীলাবতী জানায়, দেখলে তো আমাদের স্থান কোথায়? গৃহে অবস্থান করলে লোকে গৃহশুদ্ধি করে।

সে তো করবেই, যোগীদের অনেকেই ঘৃণ্য মনে করে। তুমি যোগী–এই পরিচয় ব্যতিরেকে অন্য আর কী পরিচয় দিতে পারতে?

কেন স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলে হতো না?

শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়। তার ধারণা ছিলো না যে ঐ পরিচয়দানের জন্য লীলাবতী এখন প্রস্তুত! বললো, উত্তম কথা, এবার থেকে স্বামী–স্ত্রী পরিচয়টিই প্রচার করবো।

১০. করতোয়া তীরে এসে

করতোয়া তীরে এসে উপনীত হয় তারা এক প্রকার নির্বিঘ্নেই। নদীতীরেই একখানি গ্রাম, সেখানে কুম্ভকারদের বাস। ঐ গ্রামে সহজেই তারা স্থান পায়। প্রবীণ কুম্ভকার অবনীদাস সম্পন্ন গৃহস্থ! তাঁরই আশ্রয়, কুটিরটিও তাঁরই। অবনীদাসের লোকের প্রয়োজন ছিলো, তাই তিনি শ্যামাঙ্গকে সাদরে স্থান দিয়েছেন।

বর্ষা গত হয়েছে, শরৎ আসন্ন, তাই ব্যস্ততাও অধিক। মধুপুর গ্রামখানি পুন্ড্রনগরী থেকে মাত্রই দুই ক্রোশ। ফলে নগরীর প্রয়োজনীয় তৈজসাদি অধিকাংশই এই গ্রাম থেকে যায়।

শ্যামাঙ্গ সহজেই নিজেকে কর্মব্যস্ততার সঙ্গে যুক্ত করে। বাহির থেকে মনে হয়, দম্পতিটির জীবন ভারী সুখী। নবীনা গৃহিণীটি সর্বক্ষণ সংসার–কর্মে ব্যস্ত। কখনও অঙ্গন লেপন করছে, কখনও নদী থেকে জল আনছে, কখনও রন্ধন করছে। প্রতিবেশিনীরা দেখে বধূটি নিতান্তই স্বল্পভাষিণী। প্রশ্ন ব্যতিরেকে কোনো কথাই বলে না। যদি পিতৃগৃহের কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে তার ক্ষুদ্র উত্তর, আমার পিতা–মাতা নেই, কেবল একজন মাতুল আছেন। শ্বশুরগৃহের কথা জানতে চাইলে বলে, তাঁরাও গত হয়েছেন, আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্য। বিবাহ কতোদিন, সন্তানাদি কি একেবারেই হয়নি, দেশত্যাগ কেন করেছো–ইত্যাকার প্রশ্ন হলে সে উত্তর দেয় না, অধোমুখে নিজ কাজে অধিকতর মনোযোগী হয়ে ওঠে।

দিবসকালে সে কুটিরটির দ্বার ক্বচিৎ উন্মুক্ত রাখে। যখনই দেখো, তার কুটির দ্বারে অর্গল। কেন সে কুটির দ্বার রুদ্ধ রাখে নিজেও জানে না। তার অস্পষ্ট কেমন একটি ধারণা হয়েছে যে, অন্তঃপুরে কী আছে তা অন্যলোকের দৃশ্যগোচর করা অনুচিত। কিন্তু নারীর স্বভাবে যে এক প্রকার দুর্নিবার কৌতূহল আছে, সে ঐ কৌতূহল নিবৃত্ত করবে। কোন্ উপায়ে? অবনীদাসের নববিবাহিতা কন্যাটি এসে যখন বলে, ভগিনী, তোমার কুটিরে চলো, নিভৃতে দুটি কথা বলি–তখন সে বিপদে পড়ে। বহু ছলনা করে সুকৌশলে সে তখন প্রভু কন্যার মনকে প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? মনে প্রশ্ন জাগে।

শয়নগৃহে এলে এমন কিছু দেখতো না। রাত্রিকালে তারা শয়ন করে এক শয্যায় না দুশয্যায় এই সংবাদ দিবাভাগে আর কে জানতে পারছে? তথাপি লীলার মনে হয়, এভাবে আর কতোদিন?

শ্যামাঙ্গেরও দুশ্চিন্তা হয় একেকদিন। কেনো নিজেকে একেবারেই অপরিচিত রাখবে এমন আশা আর করা যাচ্ছে না। বিমূলের এক কুম্ভকার একদা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি সামন্তপতি সুধীমিত্রের বিষ্ণুমন্দির নির্মাণের সময় আমাদের গ্রামে ছিলেন না? আর একদিন একজন আগন্তুক বললো, আপনাকে তো আমি জানি, কুসুম্বী গ্রামে আপনি মনোহরদাসের গৃহে ছিলেন, আপনি কি এখনও পুত্তলি গঠন করেন?

এইভাবে হঠাৎ দুএকজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আর তাতেই দুশ্চিন্তা হয়। সে অনুভব করে, পরিচয় গোপন করে এক স্থানে অবস্থান করা প্রকৃতই কঠিন কাজ। যদি স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করতো, পরিধানে থাকতো যোগীবেশ, তাহলে কথা ছিলো না। জীবনযাপন করবে গৃহীর অথচ স্বামী–স্ত্রী নয়, এমন নরনারীকে কোনো লোক সহ্য করবে? লোকচক্ষে এ তো চূড়ান্ত ব্যভিচার।

কথাটি সে লীলাবতীকে অন্যভাবে জানায়। সাবধান করে দেয়। বলে, নিজ গ্রামের কথা কাউকে জানাবে না, তাতে আমাদের বিপদ।

লীলাবতী শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়। তাহলে কি লোকের সন্দেহ হচ্ছে–তার অর্থ আবার পথে পথে ভ্রমণ! এক প্রকার অস্বস্তিতে তার মন আক্রান্ত হয়ে যায়।

ঐ অস্বস্তি ক্রমে যন্ত্রণা হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী রমণীদের প্রশ্নে সে নীরব থাকে। কিন্তু ঐ নীরবতারও তো শেষ আছে। একেকদিন একেকজন একেক মন্তব্য করে। একজন বলে, হ্যাঁ লো সাধুর ঝি, তোকে কেউ দেখতে আসে না? তোর কি কোনোই আত্মীয় পরিজন নেই? একদিন একজন দূর থেকে মন্তব্য করে–ঐ বন্ধ্যা নারীর মুখ দর্শন যেন সকালে না করতে হয় ঠাকুর। অন্য আরেকদিন শোনে, একজন অন্যজনকে বলছে, তোমার কন্যাকে ঐ বিদেশিনীর কুটিরে যেতে দিও না বাছা–আমার সন্দেহ, ওটি কামরূপ কামাখ্যার ডাকিনী যোগিনীদের কেউ, তা না হলে তার পুরুষ অমন বশ হয়?

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর নিত্যকার কলহ শুনতে পায় না কেউ–এও একটি দোষ।

অবনীদাসের মাতা তাকে নিজ পৌত্রীর মতোই জ্ঞান করেন। কুটিরে এলে নানান হাস্য কৌতুক হয়। একদিন হাত দিয়ে লীলার মুখখানি তুলে ধরে জানতে চাইলেন, হ্যাঁ লো সুন্দরী, তোর পুরুষ কেমন আদর–সোহাগ করে বল দেখি? গতরাত্রে কবার চুম্বন করছে তোকে? গ্রীবায় কখনও চিহ্ন অঙ্কন করেছে? হ্যাঁ লো, লজ্জা কি, এ্যাঁ?

এ প্রকার প্রশ্ন হলে লীলার সহ্য হয় না। বক্ষের ভেতরে জ্বালা ধরে। সেদিন যখন বললেন, হ্যাঁ লো, তোর পুরুষ তোকে অলঙ্কার দেয় না কেন? এই শাটিকা ব্যতীত কি। তোর অন্য শাটিকা নেই? তখন সে আর সংযত থাকতে পারলো না। দুহাতে মুখ ঢেকে বেপথু কান্নায় ভেঙে পড়লো।

ঐদিন রাত্রিকালে শ্যামাঙ্গকে জানালো, চলো আর এ স্থানে নয়।

শ্যামাঙ্গ কোনো প্রশ্ন করলো না। বললো, তাই চলো, আর এ স্থানে নয়।

শ্যামাঙ্গ যেন প্রস্তুত। লীলাবতী শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়, এ কি বিদ্রূপ, না কৌতুক? কিন্তু দেখলো, না শ্যামাঙ্গ সত্য সত্যই প্রস্তুত। তখন সে জানতে চাইলো, এ স্থানে নয়, তো কোথায়, বলো?

কোথায় তাদের স্থান হবে তা কি শ্যামাঙ্গ জানে? কোন স্থানে দুজনের একত্র–জীবন বিকশিত হবে, প্রস্ফুটিত হবে, ফলবান হবে? না কোনো স্থানের কথা তার জানা নেই। বললো, চলো, পথই আমাদের ভবিতব্য–আর গত্যন্তর দেখি না।

লীলাবতীর কান্না উদ্বেলিত হয়। বলে, এভাবে আর কতদিন, বলো? জীবন কি পথে পথে যাপিত হয়? এমন জীবন তো আমি চাইনি–আমার যে সংসার প্রয়োজন। লীলাবতী দুবাহু দিয়ে শ্যামাঙ্গকে সজোরে আলিঙ্গন করে রাখে আর কাঁদে। বলে, আমি তোমার জীবনে কেন এলাম–মরণ হয় না আমার?

ঐ রাত্রে কুটিরের প্রদীপালোক হয়ে ওঠে অপরূপ। ক্ষুব্ধ, বেপথু এবং ক্রন্দনময় রাত্রিকে যেন ঐ আলোক নিরাবরণ করে দেয়। লীলা উন্মাদিনীর মতো বলে, তুমি ত্যাগ করে যাও আমাকে। আমি তাহলে মরতে পারি। তুমি ত্যাগ না করলে যে আমার বাসনা শতবাহু মেলে জীবনকে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু এ কেমন জীবন বলল, এ জীবনযাপন। করা অসম্ভব, তুমি যাও শ্যামাঙ্গ, আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও।

আলুলায়িত কেশভার, বিস্ৰস্তবাস আর ঐ প্রকার অবরুদ্ধ হাহাকার। শ্যামাঙ্গ লীলাকে বক্ষলগ্ন করে। পৃষ্ঠে হাত রাখে, সীমন্তে চুম্বন করে। যতোবার করে, ততোবার হাহাকার উদ্বেল হয়, রোদন উচ্ছ্বসিত হয়, ক্ষোভ তীব্রতর হয়। এবং ঐ তীব্র, ক্ষুব্ধ এবং হাহাকারময় আবেগের মধ্যেই, অত্যন্ত গভীর তলদেশে, ছিলো ভিন্ন, অনির্বচনীয়, একটি আনন্দ স্রোতের প্রবাহ। যে প্রবাহটির পরিচয় দুজনের কেউই জানতো না। হঠাৎ প্রদীপটি নির্বাপিত হলে শিল্পী শ্যামাঙ্গের হাত দুখানি যেন শিল্প নির্মাণ আরম্ভ করে দেয়। আহা এইভাবেই না। সে লীলাবতী পুত্তলিটির সুগোল অথচ বঙ্কিম গ্রীবাটি গঠন করেছিলো, এইভাবেই না গঠিত হয়েছিলো স্তনযুগল, ক্রমে কটিদেশ, নিতম্ব, জঙ্দ্বয়। পুত্তলি নির্মাণকালের আনন্দ ঐ সময় শত গুণে তার সমগ্র অস্তিত্বকে আন্দোলিত করতে থাকে।

বাইরে উন্মথিত রাত্রি অতিবাহিত হয়। দক্ষিণে বামে দোল খায় মহাকাশের তারকামালা, অনাহত ডমরু ধ্বনির মত স্পন্দিত হয় জগতের প্রাণ স্পন্দন–আর সেই সঙ্গে লীলাবতী যেন তার অনিশ্চিত অস্তিত্বের মধ্যে একটি মূলের সন্ধান পেয়ে যায়। নিজেকে সে নিঃশেষে নিবেদন করে। তার মনে হয়, এরপরে যদি মৃত্যু হয়, তো হোক। জীবনের মর্মে কোথায় যেন সে নিজেকে প্রোথিত বোধ করে।

এক সময় দুজনেরই সম্বিত ফেরে। লীলাবতী শ্যামাঙ্গের কণ্ঠ বেষ্টন করে মৃদু স্বরে বলে, দস্যু কোথাকার, সমস্তই তো হরণ করলে–এবার?

শ্যামাঙ্গ জানায়–চলো, এ স্থান ত্যাগ করি। আর এখানে নয়।

রাত্রির মধ্য প্রহরে তারা পথে নামে এবং যাত্রা করে পুন্ড্রনগরীর উদ্দেশে। কিঞ্চিদধিক দুই দণ্ডকালের পথ। যখন নগরীতে উপনীত হয় তখন প্রত্যুষকাল। এক প্রাচীন নির্জন অট্টালিকার বহিরলিন্দে দুজনে অপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের। সূর্যোদয় হলেই তারা কোনো পান্থশালা সন্ধান করে নেবে। এবং ঐ সময়ই প্রমত্ত মাদকসেবীদের একটি ক্ষুদ্র দল ঐ স্থানে উপনীত হয়। একাকী যুবতী ও গ্রাম্য পুরুষ দেখলে নগরবাসী তস্করেরা যা চিন্তা করে–এরাও সেই চিন্তা করলো। সামান্য কথায় বচসা হলো এবং সেইসূত্রে শ্যামাঙ্গকে আহত ও সংজ্ঞাহীন করে লীলাবতীকে স্কন্ধে তুলে নিয়ে তারা ধাবমান হলো। লীলাবতী তখন প্রাণপণ চিৎকার করে। ঐ সময়ই সে দেখে দীর্ঘ পরিচ্ছদধারী শ্মশ্রুমণ্ডিত–মুখ কয়েকজন লোক ছুটে আসছে। তাদের আসতে দেখে তস্করের দল লীলাবতীকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে পলায়ন করলো। লীলাবতী তখনও চিৎকার করছিলো। একজন নিকটে এসে জানালো, ভয় নেই ভগিনী–আর ভয় নেই, তুমি কে? কোথায় যাবে?

অতঃপর লীলাবতীর নতুন আশ্রয় হলো পুন্ড্রনগরীর যবন কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রের লোকেরাই আহত, অচেতন, শ্যামাঙ্গকে সন্ধান করে নিয়ে আসে এবং চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে।

১১. দীনদাস স্বগৃহে এসেছেন

দীনদাস স্বগৃহে এসেছেন। তারপর পক্ষকাল গত। ইতোমধ্যে তিনি উজুবটেও গিয়েছিলেন। ভস্মীভূত ক্ষেত্রকর পল্লীটিতে এখন আর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় না। বাতাস এবং বৃষ্টি ভস্ম ও অঙ্গারগুলি মৃত্তিকার সঙ্গে মিশ্রিত করে দিয়েছে। তদুপরি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরুলতার আবির্ভাবে এমন হয়েছে স্থানটি, যে ঈষদুচ্চ গৃহ–পীঠগুলি না থাকলে অনুমানই করা যেতো না যে একদা এই স্থানে একটি সমৃদ্ধ পল্লী ছিলো।

শুনেছিলেন কোনো কোনো পল্লীবাসী ফিরে এসে পুনরায় গৃহ নির্মাণ করেছে। কিন্তু দেখলেন, কথাটি জনরব মাত্র। দুএকখানি গৃহ অবশ্য উঠেছে কিন্তু ঐ স্থানে নয় কিঞ্চিৎ দূরবর্তী স্থানে, ব্রাহ্মণপল্লীর একেবারে প্রান্তসীমায় সংলগ্ন। বোঝা যায়, ব্রাহ্মণরাই ব্যবস্থাটি করেছেন। দাস ভৃত্য না হলে তাঁদের চলবে কীভাবে?

তিনি বহু সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। যেমন মহাসামন্ত হরিসেন রাজধানীতে ছিলেন মাসাধিককাল। সেখান থেকে এসে তার প্রতাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রক্ষা এই যে, এখনও নতুন কোনো ঘটনা ঘটাননি। কেবল তাঁর চরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষেত্রকরদের নিশ্চিহ্ন পল্লীটির উপর এখনও তাঁর ক্রোধ। তাঁর নাকি অনুমান ঐ পল্লীর লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো যুগপৎ যবন ও সদ্ধর্মীদের। তাদেরই ষড়যন্ত্রের কারণে যবনেরা হরিসেনের বাহিনীকে আঘাত করে। ঘটনাটির কথা যতোবার স্মরণ হয় ততোবারই নাকি তাঁর ক্রোধ উদ্দীপ্ত হয়। ঐ পল্লীর শিশু বৃদ্ধ রমণী কাউকেই তিনি জীবিত রাখতে চান না। শোনা যায়, একটি কিশোর বালককে বন্দী করা হয়েছিলো সেই বালকটিকে সন্ধান করে আর কেউ পায়নি। কাজটি নাকি অভিমন্যুদাসের। এই লোকটি এখন হরিসেনের দক্ষিণ হস্ত হয়ে উঠেছে। যাবতীয় দুষ্কর্ম এখন অভিমন্যুদাসই সম্পাদন করে। সে উজুবটের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে চর নিয়োগ করে রেখেছে–ভিক্ষু অথবা যোগী বলে কোনো লোককে সন্দেহ হলেই তারা যেন সংবাদ দেয়। সে যোগী এবং ভিক্ষুদের লাঞ্ছনা করতে অত্যধিক আগ্রহী। ঐ কাজে সে যারপরনাই আনন্দ পায়। এও শোনা যায় যে হরকান্ত ও তার কন্যাটির সে সন্ধান করছে। হরকান্তের গৃহে একটি যোগী এসেছিলেন, সেই যোগীটিকেও নাকি তার বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নাকি আরও একটি কুম্ভকার যুবকের সন্ধান করছে সে। দীনদাসের অনুমান, এই কুম্ভকার যুবক শ্যামাঙ্গ ব্যতীত আর কেউ নয়। শ্যামাঙ্গের যে কী অপরাধ তিনি ভেবে পান না।

দীনদাস এতো সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন এই জন্য যে, এই সকল সংবাদের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বগ্রামে শুকদেবের প্রত্যাবর্তন সমীচীন কিনা। যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে অন্য কোথাও গৃহ নির্মাণ করতে হবে–তা সে যে স্থানেই হোক। দূরদেশে অন্যের আশ্রয়ে কতোদিন থাকবেন। সর্বোপরি জামাতা বসন্তদাস সম্পর্কে হরিসেনের অনুচরদের কি মনোভাব সেইটি জানা অধিক প্রয়োজন। কেননা বসন্তদাসের সঙ্গে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের সংস্রবের সংবাদটি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। এবং হরিসেনের অনুচরেরা যে উজুবটের ক্ষেত্রকর পল্লীটি আক্রমণ করে, তাও কিন্তু বসন্তদাসকে বন্দী করার জন্যই। এমতাবস্থায় বসন্তদাসের প্রতি হরিসেন ও তার অনুচরদের মনোভাবের। পরিবর্তন যদি না ঘটে, তাহলে শুকদেবের উজুবট গ্রাম তো দূর স্থান, এতদঞ্চলেই প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

অথচ ওদিকে ভগিনী যোগমায়া ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। মায়াবতী চিন্তায় চিন্তায় শীর্ণকায়া, শুকদেব তো প্রায় সর্বক্ষণই নীরব ও নির্জীব থাকেন। তবে সৌভাগ্য যে, জামাতা বসন্তদাসের সংবাদ পাওয়া গেছে, সে জীবিত এবং সুস্থ। দীনদাস জানেন, এই সংবাদটি শ্রবণ করলেই শুকদেব পুনরায় সচল ও সজীব হয়ে উঠবেন, যোগমায়ার মুখে হাসি ফুটবে এবং মায়াবতী হয়ে উঠবে চঞ্চলা হরিণীটির মতো–যেমন সে পূর্বে ছিলো।

যবনদের আগমন সংক্রান্ত সংবাদ তাকে কেউ-ই দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলে, তারা পশ্চিমে তঙ্গন নদীর পরপারে অবস্থান করছে, কেউ আবার বলে, তারা দক্ষিণ–পশ্চিমে মহানন্দার তীরে শিবির স্থাপন করে আছে–প্রকৃত সংবাদ কেউ জানে না। তবে স্বস্তির কথা এই যে, তাদের নতুন কোনো কার্যকলাপ দেখা যায়নি। কিন্তু একটি চিন্তার বিষয়ও আছে। শোনা যাচ্ছে যে, সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা নাকি সত্য সত্যই যবনদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

দীনদাসের বহু কাজ–প্রথমত মদনপুর গ্রামে শুকদেবের সুহৃদ প্রফুল্লদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। তারপর সন্ধান করতে হবে বসন্তদাসের। যদি সাক্ষাৎ হয় উত্তম, না হলে প্রফুল্লদাসের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করতে হবে, শুকদেব আর তাঁর স্ত্রী কন্যাকে কোথায় আনা যায়–নিজ গ্রামে উদয়পুরে, না প্রফুল্লদাসের গৃহ মদনপুরে।

শুকদেব উজুবটের ব্রাহ্মণপল্লীতেও যেতে বলেছেন। সোমজিৎ উপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার অভিমতটি যেন সংগ্রহ করেন দীনদাস।

সোমজিৎ উপাধ্যায় বহির্বাটিতেই ছিলেন। দীনদাস প্রণাম করে সম্মুখে দাঁড়ালে জানতে চাইলেন, কে তুমি? তোমাকে তো পরিচিত মনে হচ্ছে না?

আজ্ঞে আমি উদয়পুরের লোক, এই গ্রামের ক্ষেত্রকর শুকদেব আমার ভগিনীপতি।

শুকদেবের নাম শুনে সোমজিৎ আগ্রহী হলেন। বললেন, শুকদেব কোথায়? তার কি সংবাদ, কুশলে আছে তো?

দীনদাস সত্য গোপন করলেন। বললেন, তিনি আমার গৃহে আছেন। শরীর অসুস্থ, বৃদ্ধ হয়েছেন তো–তিনি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন। আপনার পরামর্শ চান শুকদেব, তিনি কি উজুবটে ফিরে আসবেন? আপনি বললেই তিনি আসবেন।

সোমজিৎ দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন একটি। কী বলবেন? এই অপরিচিত ক্ষেত্ৰকরটির কাছে কি বলা যায়, রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে তিনি কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন? বলবেন কি, যে মহাসামন্ত হরিসেনের স্বেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ নেই। তিনি আপন মনে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, শুকদেব পরমকুটুম্বের গৃহে গেছে, সেখানে থাক কিছুদিন, এতো শীঘ প্রত্যাবর্তনের কি প্রয়োজন? নাকি শ্যালক শ্যালক–পত্নী যথেষ্ট সমাদর করছেন না।

ঈষৎ কৌতুকে হাস্য করলেন কথাটি বলে। শেষে জানালেন, শুকদেবকে আগমনের পরামর্শ আমি দেবো না, কারণ আমি বৃদ্ধ হয়েছি, দেহবল মনোবল উভয়ই আমার গত প্রায়। তবে যদি আগমন করতেই হয়, তাহলে তাকে বলল সে যেন আমার গৃহের নিকটে কুটির নির্মাণ করে থাকে। ঐ যে ব্রাহ্মণপল্লীর সীমানা দেখছো, সোমজিৎ হাত তুলে দেখালেন। বললেন, তারপরই আমার দুই কূলব্যাপ ভূমি–ঐ স্থানে আরও দুটি পরিবার গৃহ নির্মাণ করে আছে–শুকদেব এলে ওখানেই তাকে গৃহ নির্মাণ করতে হবে, তার নিজের পল্লীতে বসবাস এখনও বিপজ্জনক।

উপাধ্যায় মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে একটি লোক তার সম্মুখে দাঁড়ালো। তারপর আপাদমস্তক দৃষ্টিপাত করে বললো, মহাশয়কে নতুন দেখছি মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, আমি উদয়পুরের লোক, আপনি?

আমি এই গ্রামেরই লোক, একজন দীন অভাজন বলতে পারেন।

দীনদাস লক্ষ্য করলেন লোকটির দৃষ্টি অদ্ভুত। বিনয়ে মুখখানি নত। কিন্তু যখন দৃষ্টি তোলে তখন চক্ষু দুটির বহুদূর ভেতরে কপিশবর্ণের আলোকরেখা দেখা যায় একটি। যেন বিষধর সর্পের দৃষ্টি।

তা মহাশয় বুঝি উপাধ্যায় মহাশয়ের ক্ষেত্রকর? লোকটি জানতে চায়।

না, আমি নই, আমার ভগ্নীপতি তার ক্ষেত্রকর।

ও, তাই হবে, আপনি তাঁর ক্ষেত্রকর হলে তো নিশ্চয়ই আপনাকে পূর্বে দেখতাম। আমি নির্বোধ, জানেন, সকলেই আমাকে উন্মাদ বলে। কখন কোন কথা বলি কিছুরই স্থিরতা নেই–তা মহাশয়ের ভগ্নীপতিটির পরিচয় তো জানা হলো না?

দীনদাস দেখলেন, লোকটি সুবিধার নয়। বললেন, আমার ভগ্নীপতির নাম শুকদেব, এবার পথ ছাড়ুন, আমি যাবো।

কি যে বলেন, হেঁ হেঁ কি যে বলেন–শুকদেব আমার শ্বশুর স্থানীয় ব্যক্তি। তার আত্মীয় হলে তো আপনি আমারও আত্মীয়–আপনাকে এভাবে পথ থেকেই যেতে দিই কীভাবে–হেঁ হেঁ–আপনি গুরুজন, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন, শুকদেব কোথায় আছেন? কেমন আছেন? তার জন্য আমরা এতো উদ্বিগ্ন যে বলার কথা নয়। তার কন্যা মায়াবতী কোথায়? তার জামাতা বসন্তদাস কোথায়?

দীনদাস বুঝলেন, সমস্তই লোকটির অভিনয়, নিশ্চয় সে হরিসেনের অনুচর। তিনি সাবধান হলেন। বললেন, আমি মদনপুরে প্রফুল্লদাসের কাছে যাচ্ছি, এখানে উপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে আমার আলাপ সমাপ্ত হয়নি–সন্ধ্যাকালে আবার হবে–রাত্রি আমি তার গৃহেই যাপন করবো, আর বিলম্ব করাবেন না–যেতে দিন।

অবশ্যই যাবেন, হেঁ হেঁ, বিলম্ব করা আদৌ উচিত নয়, ঐ যে আমার কুটির, বড় অভাজন আমি, যদি পদধূলি দিতেন একবার, এ দীন অভাজন ধন্য হতো।

সোমজিৎ দূর থেকে দেখছিলেন ব্যাপারটি। তিনি সম্মুখে এলেন। জানতে চাইলেন, কি হয়েছে অভিমন্যুদাস? এঁকে তুমি যেতে দিচ্ছো না কেন?

অভিমন্যুদাস তাহলে এই লোক, দীনদাস লোকটিকে দেখে নিলেন উত্তমরূপে।

সে তখনও বলে চলেছে–হেঁ হেঁ গুরুদেব, আমি কে? আমি তো নিমিত্ত মাত্র সবই ভবিতব্য বলতে হবে। ইনি আত্মীয়জন, শুকদেবের শ্যালক, কি প্রকারে যেতে দিই বলুন–হেঁ হেঁ হেঁ–আপনিই বলুন শুকদেবের সংবাদ নিতে হবে না? তার জামাতাটির জন্য কতো ব্যাকুল আমরা।

অভিমন্যুদাস, সোমজিৎ বুঝিয়ে বললেন, দেখো, তুমি অহেতুক এঁর উপর উপদ্রব সৃষ্টি করেছো–এঁকে যেতে দাও–আমি উত্তম মতো জানি, এ কোনো প্রকার দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়।

কিন্তু অভিমন্যুদাসের দন্তবিকাশের শেষ নেই। অনবরত হেঁ হেঁ রবে হেসে যাচ্ছে। শেষে জানালো, আমার প্রভু হরিসেন কিন্তু আপনার উপরও দৃষ্টি রাখতে বলেছেন, হেঁ হেঁ গুরুদেব। আপনার ভাবগতিকও নাকি সুবিধার নয়। কী যে বলেন, রাজপুরুষেরা, তাই না গুরুদেব? হেঁ হেঁ, কিছুই বোধগম্য হয় না, তাই না? আসুন আপনি, আমার সঙ্গে আসুন।

সোমজিৎ কিছুই বলতে পারলেন না। দীনদাস তাঁর মুখের দিকে চাইলে তিনি শুধু বললেন, তুমি আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করো না–আমি বৃদ্ধ।

দীনদাস ততক্ষণে বুঝে নিয়েছেন, তাঁর সমূহ বিপদ। তিনি মহাসামন্ত হরিসেনের এক উন্মাদপ্রায় বিকৃত–বুদ্ধি লোকের হাতে পড়েছেন, তার আর আশা নেই। তিনি ইতি কর্তব্য স্থির করে নিলেন। অভিমদাসের খর্বাকৃতি দেহাবয়বটি আপাদমস্তক দেখলেন, দূরে যে গৃহের দিকে অভিমন্যু তাকে নিয়ে যেতে চায় সেই গৃহখানি দেখলেন, তারপর মনে মনে বললেন, দীনদাস, এবার তোমার ইষ্ট নাম জপ করার সময় হয়েছে–যদি কিছু করতে চাও, তো এখনই করো।

সোমজিৎকে বললেন, গুরুদেব চলুন, আপনার গৃহে জলপান করি প্রথমে, তারপর অভিমন্যুদাসের গৃহে যাবো–দেখি কী প্রকার সমাদর করে সে।

অভিমন্যু দন্ত বিকাশ করে হাসে শুধু।

সোমজিতের গৃহের বহির্দ্বারে গৃহ সংস্কারের নানাবিধ উপকরণাদি সংগ্রহ করে রাখা ছিলো। দীনদাস বহির্দ্বারের নিকটে এসে অভাবিত এবং দুঃসাহসী কাজটি করলেন। কারও কিছু বোধগম্য হবার পূর্বেই তিনি একখানি বংশখণ্ড হাতে তুলে নিলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে আঘাত করলেন। কি হলো বুঝতে পারেননি সোমজিৎ। যখন বুঝলেন, তখন দেখেন, অভিমন্যুদাস ভূমিতে পপাত এবং দীনদাস অনতিদূরে ধাবমান।

ঐ ঘটনার পর দীনদাসের ঐ অঞ্চলে থাকবার কথা নয়–এবং তিনি ছিলেনও না। কিন্তু অভিমন্যুদাস নিজ সঙ্গীদের নিয়ে উদয়পুর পর্যন্ত যেতে বিলম্ব করেনি। সেখানে কি হতো বলা যায় না। কেননা দীনদাসকে না পেয়ে অভিমন্যুর লোকেরা তার গৃহে অগ্নিসংযোগ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো। ওদিকে আবার প্রস্তুত হয়েছিলো গ্রামবাসীরাও। অভিমন্যুদাস অবস্থা দেখে নিজ সঙ্গীদের নিবৃত্ত করে এবং উদয়পুর গ্রাম থেকে চলে আসে।

তার নানান গুণ। আচরণে সে অত্যধিক ভদ্র এবং বিনয়ী। প্রথম আলাপে তাকে নির্বোধও মনে হতে পারে। কেউ কেউ বলে, সে নাকি নপুংসক। কিন্তু যে পরিচিতি, সে জানে কি প্রকার চতুর এবং কৌশলী সে। অমন নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা সচরাচর দেখা যায় না। হরিসেনের বিশ্বাসভাজন হয়েছে সে এই গুণটির জন্য। তার মস্তিষ্ক কখনই তপ্ত হয় না। সে এক উদ্দেশ্য নিয়ে বৎসরের পর বৎসর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে।

দীনদাসের জন্যও অপেক্ষা করতে পারবে, মনে মনে সে সিদ্ধান্তগ্রহণ করে। তার এক অপেক্ষা সেই অপরিচিত কুম্ভকার যুবকটির জন্য, উজুবটে অগ্নিসংযোগের রাত্রে যাকে সে লীলাবতীর সঙ্গে পলায়ন করতে দেখেছিলো, আর দ্বিতীয় অপেক্ষা, এই দীনদাসের জন্য। তার নিশ্চিত ধারণা, লীলাবতী একদিন না একদিন উজুবট গ্রামে আসবে। সে না আসুক, ঐ যুবকটি আসবে আর দীনদাসকে তো উদয়পুর আসতেই হবে। কেননা ঐ গ্রামে তার গৃহ-সংসার।

দীন অভাজন ব্যক্তি সে, মস্তকাবনত করে যতোদিন প্রয়োজন, সে অপেক্ষা করে থাকবে।

অপেক্ষা করার প্রয়োজন হতো না। মহাসামন্তের শস্ত্রধারী সুশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে ঐ লগুড়ধারী গ্রামবাসীদের তুলনা? সে চিন্তা করে দেখেছে। ও তো মাত্রই এক রাত্রির ব্যাপার, গ্রামখানির চিহ্ন পর্যন্ত থাকতো না। তবে সময় এখন অন্যরূপ। বলা যায় না, কখন যবন অশ্বারোহীদের উপদ্রব এসে উপস্থিত হয়। কেমন করে যে তারা সংবাদ পায় ভগবান, জানেন। কোন স্থান থেকে আসে, কোথায় যায়–কিছুই বলতে পারে না কেউ। না হলে লীলাবতী কি যুবাপুরুষটির হাত ধরে সেদিন ঐভাবে পলায়ন করতে পারে? যদি পশ্চাতে অশ্বারোহীটি ছুটে না আসতো, তাহলে একটি বর্শাঘাতের অপেক্ষামাত্র ছিলো। তারপর দেখা যেতো, লীলাবতীর অহঙ্কারখানি কত উচ্চ হয়েছে।

কিন্তু দেখা যায়নি শেষ পর্যন্ত। লীলাবতীর মাতুল সেই যোগী পুরুষটিকেও সে দেখতে চায়। আর শুকদেবের জামাতাটি, তাকেও তার প্রয়োজন। সুতরাং সে অপেক্ষা করবে।

কিন্তু কেন এই অপেক্ষা? কেউ–ই জানে না কিসের অপেক্ষায় দিন গণনা করছে। বরেন্দ্র–বঙ্গ–সমতটের জনপদগুলি। লোভ হিংসা প্রতিহিংসা প্রতারণা যুদ্ধ ধ্বংস প্রেম সমস্ত কিছু একাকার হয়ে অপেক্ষায় আছে সেই অনাগত প্রহরটির জন্য।

রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে গোবর্ধন আচার্য ও হলায়ুধ মিশ্রের মতো লোকেরা অপেক্ষায় আছেন–অপেক্ষায় আছেন উজুবট গ্রামের সোমজিৎ উপাধ্যায়–হরিসেনও সম্ভবত অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা বসন্তদাসের, লীলাবতীর, শ্যামাঙ্গের, ছায়াবতীর, শুকদেবের, মিত্রানন্দের। কার অপেক্ষা নয়? সকলেই উপলব্ধি করে, যে জীবনযাপিত হচ্ছে, সে জীবন থাকবে না–এই অস্থিরতার অবশ্যই অবসান হবে। কিন্তু সেই অবসান কিসে? মৃত্যুর হতাশায়? না নবীন জীবনের উন্মেষে? কেউ-ই বলতে পারে না।

দীনদাস সুনন্দপুরে এসে শুকদেবকে ঐ অপেক্ষা করার কথাই বলেন। জানান, ভ্রাতঃ, উপায় নেই এখন অপেক্ষা করা ব্যতীত, উজুবটে প্রত্যাগমন এখন অসম্ভব।

শুকদেব কিঞ্চিৎ সুস্থ এখন। তাঁর বিষণ্ণ নির্জীব ভাবটি আর নেই। যোগমায়ার মুখেও হাসি দেখা যায়–আর মায়াবতী হয়ে উঠেছে পূর্বের মতোই। এই পরিবর্তনের কারণ একটিই আর তা হলো বসন্তদাসের আগমন। বসন্তদাস সুনন্দপুরে আসে দীনদাসের আগমনের সপ্তাহকাল পূর্বে। তার আগমনে, বলাই বাহুল্য, নির্জীব এবং হতাশ এই উদ্বাস্তু পরিবারে স্বস্তি আনন্দ এবং উল্লাস একইসঙ্গে জেগে ওঠে। বসন্তদাস উজুবট ও নিকটবর্তী গ্রামগুলির অবস্থা জানিয়েছে শুকদেবকে। শুধু গ্রামের কথা নয়, রাজধানীর সংবাদও। যবনদের সংবাদ, ভিক্ষুদের সংবাদ, সমস্তই জানিয়েছে। এবং শেষ কথা বলেছে, আপাতত কিছুই করণীয় নেই, এ স্থানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

সমস্ত কিছু শোনার পর শুকদেবের মনে হয়েছে ঐ একই কথা। এখন সত্যই কিছু করণীয় নেই–অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু যোগমায়ার কষ্ট হচ্ছে। দান ঋণ এবং স্বল্প সঞ্চয়ে তার সংসার আর কতোদিন চলে? প্রতিবেশীরা করুণা করে, নানান মন্তব্য করে একেকজন, তাতে তার অসহ্য বোধ হয়। নিজ গৃহে তাঁর কোনো অভাব ছিলো না–কিন্তু এখানে অভাব বোধ করছেন প্রতি পদে। তাঁর আশা হয়েছিলো, দীনদাস শুভ সংবাদ নিয়ে আসবেন এবং তারপরই তিনি স্বামী সংসার নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু এ কোন কথা শুনছেন? আরও নাকি অপেক্ষা করতে হবে? কতদিন? স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন। শুকদেব দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলেন, জানি না।

কিন্তু মায়াবতী ঐ কথা শুনবে না। অভিমানে ওষ্ঠ স্কুরিত হয়, চোখে অশ্রু উদ্বেল হতে দেখা যায়। আর বলে, না আমি আর একদণ্ডও থাকবে না এ স্থানে। স্বামীকে কাছে পেয়ে তার অভিমান হয়েছে আরও অধিক। বসন্তদাসের সঙ্গে সে কলহে প্রবৃত্ত হয়। বসন্তদাস স্ত্রীর অভিমান এবং ক্রোধের কারণ বোঝে, কিন্তু কোনো পথ যে সত্যই নেই, সে কথাটি সে স্ত্রীকে বোঝাতে পারে না।

অবকাশও স্বল্প। কারণ একটি কুটিরে বাস–কুটিরের ভিতরে শয়ন করেন শুকদেব স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আর দীনদাস এবং বসন্তদাসকে বাইরে রাত্রিযাপন করতে হয়। ফলে স্বামী–স্ত্রীর একান্ত হবার সুযোগ প্রায় একেবারেই নেই। মায়াবতীর অস্থিরতার এক কারণ সে অন্তঃসত্ত্বা। তার স্বামীসঙ্গ প্রয়োজন। একেকদিন নির্লজ্জ রমণীর মতো দ্বিপ্রহরে স্বামীকে সে কুটিরের ভিতরে ডাকে। দুবাহুতে স্বামীকে কণ্ঠলগ্ন করে বলে, তুমি আমাকে নিয়ে চলোতোমাকে আমি সর্বক্ষণ পাই না–এখানে থাকলে কখনই পাবো না–আমি এখানে থাকবো না।

বসন্তদাস নির্বোধের মতো আচরণ করে। অস্থির আবেগময়ী স্ত্রীকে সে শান্ত করতে পারে না। একেক সময় বহুক্ষণ রোদন করতে থাকলে বিরক্তি, ক্রোধ, ক্ষোভ ইত্যাকার মানসিক প্রতিক্রিয়া যে হয় না তা নয়–কিন্তু তথাপি সে সংযত থাকে। এখন কোনো প্রকার অস্থিরতাকে সে প্রশ্রয় দেবে না।

ইতোমধ্যে একটি সংবাদ পাওয়া যায় যে, পুনর্ভবা তীরের মদনপুর গ্রামখানি যবনদের দ্বারা উপদ্রুত হয়েছে। তাতে শুকদেব চঞ্চল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার শক্তি নেই যে একাকী অতদূর যান। জামাতাকে বলেন, বসন্ত, দেখো, যদি প্ৰফুল্লের কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারো, ওর কন্যাটির জন্য আমার বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

বসন্তদাস কোনোদিন পান্থশালায় যায়, কোনোদিন হাটে যায় আর চারিদিকের অবস্থা দেখে। তার অস্পষ্ট মনে হয়–সময় ঘনিয়ে আসছে। আর বোধ হয় কিছু করতে পারলো না কেউ।

একদিন সুনন্দপুরের হাটেই সংবাদ পাওয়া গেলো যে মহাসামন্ত সুধীমিত্র বিল্বগ্রামে নেই। কোথায় গেছেন, কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে যে তিনি তীর্থে গেছেন, অন্য জনরব আবার এই যে, যবনাক্রমণ আসন্ন দেখে তিনি দক্ষিণ দেশে পলায়ন করেছেন।

মিত্রানন্দ ইতোমধ্যে একদিন কদম্বঘাটে ছায়াবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছে। সেখানেও নতুন সংবাদ এই যে, নদীপথে দক্ষিণগামী বৃহৎ নৌকার সংখ্যা অধিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামন্তপতিরাই শুধু নয় তাদের অনুচরদের পরিবারও দক্ষিণে এবং পূর্বে চলে যাচ্ছে। ঐ ঘাটেই সাক্ষাৎ হলো এক বৃদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে। তিনি দেখে এসেছেন পশ্চিমের গ্রামগুলি থেকেও লোক পলায়ন করছে। প্রত্যেকের মুখেই যবনাক্রমণের সংবাদ। হ্যাঁ, তিনিও শুনেছেন মদনপুর গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে। তবে আক্রমণকারীরা গ্রামখানি ধ্বংস করে দেয়নি। দুতিনটি যুবতী রমণী এবং কয়েকটি গাভী ও ছাগল নিয়ে গেছে। না, কেউ নিহত হয়নি। তবে যাবার সময় মন্দিরটি অপবিত্র করে গেছে। মন্দির প্রাঙ্গণে গো–হত্যা করে সেই গো–মাংস দগ্ধ করে ভক্ষণ করেছে–এবং ঐ মন্দিরেই নাকি রমণীদের বলাকার করা হয়েছে। তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন দুই আত্মঘাতিনী রমণীর মৃতদেহ। তৃতীয়টি নাকি পূর্ব থেকেই উন্মাদিনী ছিলোসে এখন পথে পথে ঘুরছে।

মিত্রানন্দ অস্থির হয়ে উঠেছেন মনে মনে। তাঁর ধারণা, এখনও কিছু করা সম্ভব। যবনেরা বহিরাগত, স্থানীয় লোকের সহায়তা না পেলে তাদের পক্ষে এদেশে অধিককাল থাকা সম্ভব হবে না। সে সুযোগের অপেক্ষায় রইলো।

মায়াবতী যেন অনুভব করে তার স্বামী উন্মন। উজুবটে যেমন মনে হতো–এ তার চাইতেও অধিক। সর্বক্ষণ যেন কী চিন্তা করে। একদিন দ্বিপ্রহরে হঠাৎ বললো, তুমি কি আবার চলে যাবে?

না, কোথায় যাবো? তুমি অহেতুক চিন্তা করো না–আমি তোমাকে ত্যাগ করে কোথাও যাবো না। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বসন্তদাস।

না, আমার মন বলছে, তুমি চলে যাবে, বলল, তুমি কী ভাবছো?

বসন্তদাস স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে দেখে বারেক। ভাবে, সরলা এই গৃহবধূর কাছে সে নিজ চিন্তা–ভাবনার কথা বলবে কি বলবে না। তারপর সে বলে, আমি কি চিন্তা করি শুনবে? শোনো তাহলে, আমি তোমার আমার মতো মানুষের কথা ভাবি। দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে–এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতোদিন এভাবে চলবে? গ্রামপতি, সামন্তপতিরা যথেচ্ছ অত্যাচার করে যাবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না–ওদিকে আবার যবনরা ধেয়ে আসছে, তাদের তরবারির নীচে কত মানুষের শির ছিন্ন। হবে তাও কেউ বলতে পারে না। আমি চিন্তা করি এই অবস্থার পরিবর্তনের কথা।

কিন্তু তুমি কী করবে, যুদ্ধ করবে? মায়াবতীর স্বরে আতঙ্ক ফোটে। বলে, তুমি একাকী কেমন করে যুদ্ধ করবে–যুদ্ধ করলে তো মানুষের মৃত্যু হয়।

মায়াবতী স্বামীকে দুবাহুতে বেষ্টন করে ধরে।

বসন্তদাস স্ত্রীর কথায় হাসে। বলে, না আমি কেন যুদ্ধ করবো, যারা যুদ্ধ করতে চায়, আমি তাদের বলবো যে যুদ্ধ করো না, যুদ্ধ করলে মানুষ ধ্বংস হয়।

না, সে কথা বলার তুমি কে? এ সকল কথা ভয়ানক–তুমি সামন্তপতিদের সঙ্গে কথা বলতে যাবে না–তাদের ভারী ক্রোধ–দেখোনি, তুমি ভিক্ষুদের সঙ্গে মিত্রতা করেছিলে বলে কতো কাণ্ড ঘটলো?

বসন্তদাস বিমূঢ় বোধ করে। কোন্ ভাষায় সে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বোঝাবে। তথাপি বলে, এ একজনের ব্যাপার নয় মায়া–এ হচ্ছে সকল মানুষের ব্যাপার। আমি যদি ঐ সকল কথা নাও বলি, তাহলেও আমরা রক্ষা পাবো না। যদি বিলম্ব হয়ে যায় যুদ্ধকারীদের বোঝানো না যায়–তাহলে সর্বত্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাবে। কেউ রক্ষা পাবে

না, আমরাও না। এ অবস্থার কিছু একটা করা প্রয়োজন।

মায়াবতীর কিছুই বোধগম্য হয় না। তার এক কথা, তুমি ঐ সকল ভয়ঙ্কর ব্যাপারে যাবে না। গেলে আমি আত্মঘাতিনী হবো।

কিন্তু এভাবে কতদিন? একেবারে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা আর চরম সর্বনাশের জন্য অপেক্ষা করা? তার মনে হয়, এভাবে দিনযাপন একেবারেই অর্থহীন। সমূহ সর্বনাশ আসন্ন অথচ সে কিছুই করছে না, কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই তার। ধিক বসন্তদাস, ধিক তোমার এই জীবনে! সে একাকী কেবলি নিজেকে ধিক্কার দেয়। ভিক্ষু মিত্রানন্দ জীবন বিপন্ন করে কোন স্থান থেকে কোন স্থানে চলে যাচ্ছে–বিভাবতী কৃষ্ণা শুক্লার মতো রমণীরা আত্মাহুতি দিচ্ছে আর তুমি গৃহসুখ উপভোগ করছো? অল্প কদিনের মধ্যেই সে ক্লান্ত হয়ে উঠলো। এবং একদা হঠাৎ জানালো, আমি নিজ গৃহে যাবো, পিতা–মাতাকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়েছে।

এই কথার পর কারও কিছু বলার থাকে না। যোগমায়া মৃদু আপত্তি করেন, কিন্তু সেই আপত্তি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অবশেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়াবতী স্বামীকে বিদায় দেয়। বিদায়কালে বলে, শীঘ্র ফিরে এসো, বিলম্ব হলে আর আমাকে জীবিত দেখবে না।

স্বগৃহে যাওয়া তার প্রয়োজন বটে, কিন্তু সে যাত্রা করে বিপরীত দিকে, পুন্ড্রনগরীর উদ্দেশে।

সেখানে গিয়ে দেখে, মিত্রান ফিরে এসেছে। এবং সে অত্যধিক ব্যস্ত। কেন ব্যস্ত, কিসে ব্যস্ত, কিছুই বলে না সে। নগরপ্রান্তে প্রকাণ্ড একটি বিহার–যেমন প্রাচীন, তেমনই তার ভগ্নদশা। সে অবাকই হলো এক প্রকার। এতে ভিক্ষু একত্রে সে জীবনে দেখেনি। বাহির থেকে দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এতো অধিক সংখ্যক ভিক্ষু এ স্থানে বসবাস করে।

মিত্রানন্দ অবশ্য জানিয়েছে যে ভিক্ষুদের সকলেই এই স্থানের নয়। বহুসংখ্যক ভিক্ষু বহিরাগত। কিন্তু তথাপি এতো অধিকসংখ্যক ভিক্ষুর একত্র সমাবেশ তার কাছে বিস্ময়কর বলেই মনে হয়েছে। মিত্রানন্দকে সংবাদ জিজ্ঞাসা করলে বলে, অপেক্ষা করো, অচিরেই সমস্ত কিছু জানতে পারবে। সম্ভবত আমরা শীঘ্রই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছি।

আবার সেই অপেক্ষার কথা।

অবশেষে দেখলো, ঐটিই হলো মূল কথা–অপেক্ষা করা হবে, কি হবে না। তরুণ ভিক্ষু নিরঞ্জন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ঐ অপেক্ষার কথা শুনে।

বসন্তদাস লক্ষ্য করে দেখলো, অত্যন্ত তেজস্বী এই তরুণ ভিক্ষুটি। লক্ষ্য করে দেখার আরও একটি কারণ ছিলো। ছায়াবতীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা এই নিরঞ্জন।

ভিক্ষুসভায় তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নিরঞ্জন। বলে, আর কতোকাল আমরা অপেক্ষা করবো, বলুন? বহুকাল অপেক্ষায় অতিবাহিত হয়েছে, আমাদের ধর্ম নিঃশেষ প্রায়, জ্ঞান আচ্ছন্ন, বুদ্ধি অবসাদগ্রস্ত–এরপরও কি অপেক্ষা করতে হবে? এ অপেক্ষার অপর নাম তাহলে মরণ। এভাবে আমরা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে চাই না। আপনারা মহাভিক্ষুদের নির্দেশ নিয়ে আসুন।

অপরাহ্নের রৌদ্র এসে পড়েছিলো তার মুখে–এবং ঐ রৌদ্রে তার কাষায় বস্ত্র, গৌরবোজ্জ্বল মুখ, মুণ্ডিত মস্তক–সমস্ত একত্রে অগ্নিশিখার মতো জ্বলছিলো।

একজন বয়স্ক ভিক্ষু তাকে নিবৃত্ত করার জন্য বললেন, ভ্রাতঃ নিরঞ্জন, বলতে পারো, আমাদের ক্ষমতা কতোখানি? তোমার পরিকল্পনা কী, আমাদের কাছে বলবে?

নিরঞ্জনের ঐ কথায় যেন সম্বিত হয়, ঈষৎ লজ্জায় মাথা নত করে। তবে সে দমিত হয় না। বলে, মহাভিক্ষুরা সমবেত হয়ে বিচার করুন, এবং শীঘ সিদ্ধান্ত নিন, এইটিই আমাদের কথা।

না, ঐভাবে বললে হবে না, আমরা আপনার কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব চাই–দূর থেকে একটি তরুণ ভিক্ষু চিৎকার করে বলে।

সুস্পষ্ট প্রস্তাব আমি অবশ্যই আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো বলে আশা করি। কিন্তু তার পূর্বে আমাদের বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে হবে, নিরঞ্জন বলতে থাকে, আমি পশ্চিমের গ্রামগুলি ভ্রমণ করে এসেছি। দেখেছি মানুষের জীবন অতিষ্ঠ এবং অসহ্য। সর্বত্রই দেখেছি উচ্চশ্রেণীর লোকদের হাতে নিম্নশ্রেণীর লোকদের নিপীড়ন হবেই–প্রত্যক্ষে হোক আর পরোক্ষে হোক। লুণ্ঠন, হত্যা, দস্যুবৃত্তি–এগুলি প্রায় নিত্যসঙ্গী মানুষের জীবনে। রাজপাদোপজীবী যারা, তারা কিছুই করেন না–সম্ভোগ ও ব্যসনে তাঁদের আসক্তি সীমাহীন। প্রজারা তাঁদের কাছে যেন পীড়নের পাত্র–পালনের নয়। ছিন্নমূল ক্ষুদ্রতরুর মতোই তাদের অবস্থা। ফলে যখনই দেখি যবনেরা আসে, তখনই তারা হয় পলায়ন করে, নতুবা বশ্যতা স্বীকার করে–কখনই যুদ্ধ করে না। যবন শক্তি ভিন্নদেশীয়। তারা আজ আছে কাল নেই–এমতাবস্থায় এই–ই মাহেন্দ্রক্ষণ, রাষ্ট্রশক্তি একেবারে শতধা বিচ্ছিন্ন–এই ক্ষয়িত রাষ্ট্রশক্তিকে আঘাত করলেই ধসে পড়বে।

আঘাত কে করবে, আমরা? আমাদের কি তাহলে যুদ্ধ করতে হবে? কোন শাস্ত্রে আছে যে ভিক্ষুরা যুদ্ধ করে? সেন রাজার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কতো জানো? অশ্বারোহী কতো বলো? যুদ্ধহস্তির সংখ্যাটি বলতে পারো?

শ্রোতারা একের পর এক প্রশ্ন করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সন্দেহের কথা জানায়।

কেন, আমরা কি যুদ্ধ করতে পারি না? নিরঞ্জন প্রত্যুত্তরে বলতে আরম্ভ করে, আমি আপনাদের দীপঙ্কর অতীশের কথা স্মরণ করিয়ে দিই–তিনি তিব্বতে বলেছেন, ধর্মকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্রশক্তি যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সংঘকে সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, সংঘই হবে সমস্ত কিছুর নির্ধারক। প্রয়োজনবোধে সে–ই রাষ্ট্রশক্তির পরিবর্তন ঘটাবে।

কিন্তু এ কথা তো তিব্বতী ভিক্ষুদের উদ্দেশে বলেছিলেন দীপঙ্কর, এদেশ তো তিব্বত নয়।

নিরঞ্জন গ্রীবা ঈষৎ বঙ্কিম করে। মন্তব্যকারীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে একবার, তারপর বলে, ভ্রাতঃ এ তর্ক অর্থহীন। মহাপণ্ডিতের বাণী কেবল এক দেশের সমস্যা সমাধান করবে, অন্য দেশের সমস্যা সমাধানে তা ব্যবহার করা যাবে না–এমন কি হতে পারে? আপনারা জানেন, হতে পারে না, তথাগত বাণীর কথা চিন্তা করুন, বোধিসত্ত্বের কথা চিন্তা করুন। আমার বিশ্বাস, মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের বাণী সকল দেশের সদ্ধর্মীদের জন্য অবশ্যই পালনীয়–বিশেষত এই দেশে–কারণ এদেশ তাঁর জন্মভূমি।

মিত্ৰানন্দ জানতো না এই প্রকার একটি নির্দেশ মহাপণ্ডিত দান করেছেন। দীপঙ্করের তিব্বতে পরিনির্বাণ হয়েছে সে আজ প্রায় শতাব্দকালের কথা। তার গ্রন্থগুলির কয়েকখানি, শোনা যায়, জগদ্দলে আনা হয়েছে। অতঃপর সেগুলির কি হলো, সন্ধান নেই। নিরঞ্জন কোথায় শুনেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সংঘের করণীয় বিষয়ের নির্দেশটি সেই জানে। তবে মনে হচ্ছে, নিরঞ্জন অধিক আবেগপ্রবণ, সে আবেগ নিয়ে একটি সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই সে বাধা দিলো। বললো, না এখনও সময় হয়নি, ভ্রাতঃ নিরঞ্জন; তোমার বক্তব্যের প্রথম অংশ আমি সমর্থন করি–তোমার বিশ্লেষণও চমৎকার এবং যুক্তিযুক্ত–কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করতে পারি না–আমার বিশ্বাস, এ সিদ্ধান্ত হঠকারী যে, বহিরাগত যবনদের সঙ্গে সহযোগিতা করে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তোমার বক্তব্যের ঐ অংশ যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি যে, সত্যই সংঘকে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণও করতে হবে। রাষ্ট্রের শাসন যদি ধর্মবিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে সেই শাসনকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমার অনুমান, অতীশ সদ্ধর্মীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। শঙ্করাচার্য সনাতন ধর্মের যে পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন, তা সম্ভব হতো না, যদি রাষ্ট্রব্যবস্থায় সদ্ধর্মীরা মনোযোগী হতেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সংঘ কি যথেষ্ট শক্তিশালী এখন? ভিক্ষুরা পলায়নপর, শাসকরা মারমুখী। এক্ষেত্রে ব্রাত্য এবং অন্ত্যজ ক্ষেত্রকরেরা দ্রোহের পতাকা উত্তোলন করলেই কি সাফল্য আসবে? কয়েকটি স্থানের সংবাদ আমরা জানি, ডোম এবং চণ্ডালেরা ক্রুদ্ধ হয়ে শাসকদের আক্রমণ করেছে, কিন্তু সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত। শাসকদের আক্রমণে নিজেরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; ক্ষেত্রকরেরা কেউ সক্রিয় সহযোগিতা দান করেনি। যদি ধরেও নিই যে দ্রোহ সফল হয়েছে, তাহলে তারপরে কে নেবে রাজদণ্ড? সামন্ত মহাসামন্তদের স্থানে কারা আসবে? আমার ধারণায় আসে না সমগ্র ব্যাপারটি।

মিত্রানন্দ পুনরায় জানায়, না ভ্রাতঃ নিরঞ্জন, এখনও সময় হয়নি, আরও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

নিরঞ্জনের ঋজুদেহ অধিকতর ঋজু হয়। দুই চক্ষুতে বিদ্যুৎ চমকিত হয়–সে দক্ষিণে বামে দৃষ্টিপাত করে উপস্থিত ভিক্ষুমণ্ডলীকে দেখে নেয়। তারপর মিত্রানন্দের উদ্দেশে বলে, না ভ্রাতঃ মিত্রানন্দ, আমাদের অপেক্ষার আর সময় নেই। মগধ এখন যবন সেনাদলের অধিকারে। ওদন্তপুরী বিহার তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। গৌড় পর্যন্ত আগমন এখন তাদের ইচ্ছার ব্যাপার মাত্র–চলে এলেই হয়।

এই যদি প্রকৃত অবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে আর আমাদের ভূমিকা কোথায়? অন্য এক ভিক্ষু প্রশ্নটি করে। বলে, আমরা দ্রোহ করলাম, রাজাকে বিতাড়ন করলাম, আর রাজ্যের অধিকারী হয়ে গেলো যবন রাজা–এ কেমন ব্যবস্থা হবে, চিন্তা করেছেন?

হ্যাঁ, চিন্তা করেছি, নিরঞ্জন জানায়। বলে, যবনরা বহিরাগত, এসেছে, ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে চলে যাবে। তারপর আর কে? তারপর তো আমরা, প্রকৃতিপুঞ্জ। আমাদেরই মনোমতো নির্বাচিত রাজা আমাদের শাসন করবেন, যেমন একদা করেছিলেন গোপালদেব।

নিরঞ্জনের অদ্ভুত শাণিত যুক্তি–এবং অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত তার বক্তব্য–কিন্তু তথাপি মনে হয় না যে তার কথায় কারও মনে আস্থার ভাব সঞ্চারিত হচ্ছে। বসন্তদাসের নিজেরও মনে হয় সমস্ত পরিকল্পনাটিই মিথ্যা ও সুযোগ সন্ধানের উপর নির্মিত। যেন আর এক কৌটিল্যের প্রস্তাবনা। আর সেই সঙ্গে বাস্তব সম্পর্ক বর্জিত অহেতুক উচ্চাশা।

বসন্তদাস দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমস্তই দেখছিলো এবং শুনছিলো। তার নিকটেই কয়েকজন শ্ৰমণও দাঁড়িয়ে ছিলো। লক্ষ্য করলো শ্রমণরা স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য করছে। তাদের মধ্যে তীব্র ক্রোধ এবং আক্রোশ–তারা চিষ্কার করে নিরঞ্জনকে সমর্থন জানাচ্ছে।

কিন্তু সে নিজে নিরঞ্জনের বক্তব্যকে যুক্তিসহ বলে গ্রহণ করতে পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো, এরা অর্থহীন একটা উচ্চাশা নিয়ে বসে আছে। মাত্র জনা কয় ভিক্ষু গ্রাম গ্রামান্তরে চণ্ডাল ব্রাত্যদের বলবে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ জেগে উঠবে? বিদ্রোহ কি অতোই সহজ? তার অনুমান, এরা প্রকৃত অবস্থা কিছুই জানে না–গ্রামে ব্রাত্য আর কয়জন? অধিকাংশই তো ক্ষেত্রকর। ক্ষেত্রকরেরা সদ্ধর্মীদের কথা শুনবেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ঐ সময় একজন ভিক্ষুর বক্তব্য তার শ্রবণে আসে। খর্বকায় প্রৌঢ় ভিক্ষুটি গম্ভীর স্বরে কথা বলছিলেন, বসন্তদাস শুনলো।

ভ্রাতা নিরঞ্জন উচিত কথা বলেছেন, তার কথা আমি সমর্থন করি। তবে তাঁর মূল প্রস্তাবটির বিচার হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলছেন, সংঘকেই সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র ব্যাপারেও সংঘের ভূমিকা আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সংঘের কথা কেউ চিন্তা করেছেন? আমার তো মনে হয় না, কোনো লোক আমাদের ধর্ম অনুসরণ করতে আসবে। আমাদের মধ্যে কতো বিভাগ, চিন্তা করে দেখুন। সিদ্ধাচার্যরা কতো প্রকার সাধনরীতির কথা বলেন। সংসারত্যাগী সাধকদের ঐ সাধনাচার কি সকলের জন্য গ্রহণীয়? আপনারাই বলুন? আর যদি সাধারণ মানুষ আমাদের সহজভাবে গ্রহণ না করতে পারে, তাহলে আমাদের স্থান কোথায়? আপনারা চিন্তা করুন, আমাদের প্রকৃত শক্তি কতখানি। পক্ষান্তরে দেখুন, একজন গ্রামপতি কিরূপ শক্তিমান। দুই চারিজন সামন্তানুচরই একখানি সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করে দিতে পারে। গ্রামবাসীরা জানে না প্রতিবাদ কাকে বলে, সমস্তই তারা ললাটলিপি বলে গ্রহণ করে।

তাহলে কি আমরা একেবারেই নিশ্চেষ্ট থাকবো? নিরঞ্জনের স্বরে তীব্র বিদ্রূপ।

না, তা কেন, জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুরা সমস্বরে বলতে লাগলেন, আমাদের প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন–সংঘকে শক্তিশালী করা, জনগণকে সত্যধর্মে দীক্ষা দেওয়া, এই সকল কাজ আমাদের অবশ্যই করে যেতে হবে। অপেক্ষা ব্যতীত এখন আর আমাদের পথ নেই।

শুধু অপেক্ষাই নয়, আমার মনে হয়, আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত সমাজের সকল শ্ৰেণীর সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টি করা।

বসন্তদাস দেখলো, দূরে প্রায়ান্ধকার ছায়ায় একজন ভিক্ষু উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে দেখে মৃদু কোলাহল আরম্ভ হয়ে গেলো। কোলাহল শান্ত করার জন্য মিত্রানন্দ চিৎকার করে বললো, বলুন শিবানন্দ, আপনার বক্তব্য বলুন।

সদ্ধর্মী ভিক্ষুটির নাম শিবানন্দ, অদ্ভুত কাণ্ড বলতে হবে, বসন্ত অবাক হয়। পার্শ্ববর্তী শ্ৰমণটি জানালো, লোকটির মস্তিষ্কে দোষ আছে–উনি সর্বধর্মের সমন্বয় চান–তার ধারণা, শিব বোধিসত্ত্ব ছিলেন।

শুনুন, ভিক্ষু শিবানন্দের কথা শুনুন।

যা বলছিলাম, সদ্ভাবের কথা, শিবানন্দ বলতে লাগলেন, আমাদের সদ্ভাব ও মিত্রতা করতে হবে, রাজশক্তির সঙ্গে। তাদের বোঝাতে হবে প্রকৃত পরিস্থিতিটি কি

ভিক্ষু শিবানন্দ কি শৃগাল সমীপে মিনতি করতে বলেন, কুম্ভীর শাবকদের যেন সে ভক্ষণ না করে? একজন তরুণ শ্ৰমণ প্রশ্নটি করে।

না, তা নয়, ব্যাঘ্রকে করজোড়ে অনুরোধ করতে হবে, প্রভু আপনি তৃণ ভোজন করুন! সহাস্যে মন্তব্য করে অন্য আর এক তরুণ ভিক্ষু।

নিরঞ্জন পুনরায় উঠে দাঁড়ায়। বলে, ভিক্ষু শিবানন্দ, আপনার প্রস্তাব উত্তম। অবশ্যই আমরা সদ্ভাব ও প্রীতির হস্ত প্রসারণ করবো। কিন্তু প্রশ্ন, সদ্ভাব ও প্রীতি কিসে উপজাত হয়? নিশ্চয়ই বিশ্বাসে, আন্তরিকতায়, উদারতায়–কিন্তু তার চিহ্ন কি কোথাও দেখেছেন সেন রাষ্ট্রব্যবস্থায়?

সে ত্রুটি তো উভয় পক্ষেই নিরঞ্জন, শিবানন্দ ক্ষুব্ধ স্বরে জানান, সদ্ধর্মীরাও তো উদার হতে পারছে না!

এ আপনি কি বলছেন ভিক্ষু শিবানন্দ? সদ্ধর্মীরা যদি উদার না হয় তো উদার কে? নিরঞ্জন বলতে থাকে, মহারাজ শশাঙ্ক এই পুন্ড্রবর্ধনের কতিপয় সদ্ধর্মীর বিসদৃশ আচরণের কারণে কয়েক সহস্র সদ্ধর্মীকে হত্যা করেছিলেন, সে কথা স্মরণ করুন–স্মরণ করুন, সোমপুর বিহারের কথা–মহারাজ জাতবর্মণের সৈন্যদল বিহার ধ্বংস করে প্রধান ভিক্ষুকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিলো। একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানও কি সামান্যতম রাজানুকূল্য পেয়েছে সমগ্র সেন শাসনকালে? বলুন, দেখাতে পারবেন কোনো প্রমাণ? আপনি উদারতার কথা বলছেন, সেন রাজাদের মতো যদি হতেন পাল রাজারা, তাহলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এ অঞ্চলে থাকতে পারতো? ও কথা বলবেন না–রাজপুরুষদের সঙ্গে মিত্রতা সম্ভব নয়, অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই। আসুন, আমরা ভিক্ষুমণ্ডলীর এই সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করি যে, সেন রাজশক্তি লুণ্ঠক, অপহারক ঘাতক এবং নারী হরণকারী, এই রাজশক্তি প্রকৃতিপুঞ্জের সকল বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে–তাই আমরা এই রাজশক্তির অপসারণ চাই।

অসম্ভব, মিত্রানন্দ তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে। চিৎকার করে জানায়, ভিক্ষুসভায় এ প্রস্তাব গ্রহণ সম্ভব নয়–এ প্রস্তাব ঈর্ষা ও ক্রোধ প্রসূত, হঠকারী এবং একদেশদর্শী। আমরা মনে করি, এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে যবনদের আগমনের পথ সুগম হবে–সে ব্যবস্থা আমাদের অভিপ্রেত নয়। আমরা অবশ্যই মানব মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবো, প্রয়োজন হলে শতাব্দকাল পর্যন্ত আমাদের সগ্রাম চলবে–কিন্তু বহিঃশক্তির এ দেশে আগমন সহ্য করবো না, আমাদের সংগ্রাম আমাদেরই করতে হবে। আমরা যবন আহ্বানের বিপক্ষেই অভিমত জ্ঞাপন করি। আসুন, সেইমর্মে প্রস্তাব গৃহীত হোক।

হ্যাঁ-হ্যাঁ, না–না, এই প্রকার কোলাহল উঠলো। ভিক্ষুরা একে একে সভাস্থল থেকে বাহিরে চলে যেতে আরম্ভ করলো। এবং এক সময় দেখা গেলো, সভাস্থলে কেউ নেই, সকলেই বাহিরে।

নিরঞ্জনকে দেখলো বসন্তদাস। অতিশয় ক্ষুব্ধ মুখভাব, বাহিরে এসে চীবরের প্রান্তখানি স্কন্ধে তুলে অগ্রসর হচ্ছিলো। বসন্তদাস ডাকলো, ভিক্ষু নিরঞ্জন, আপনার সঙ্গে দুটি কথা আছে আমার।

নিরঞ্জন দাঁড়ায়, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বসন্তদাসের মুখে। তারপর জানতে চায়, আপনি কে?

আমার নাম বসন্তদাস, আমি সদ্ধর্মী নই, তবে বলতে পারেন আপনাদের একপ্রকার সহগামী।

মুহূর্তে নিরঞ্জনের মুখভাব শান্ত এবং ধীর হয়, নমস্কার করে বলে, বলুন আপনার কী কথা আছে?

আপনি ছায়াবতীর কোনো সংবাদ জানেন?

নিরঞ্জনের ভ্রূরেখা ঈষৎ কুঞ্চিত হয়। বলে, হ্যাঁ, ছায়াবতী আমার ভগিনী, তার কোনো সংবাদ আছে?

হ্যাঁ, তিনি আপনার কুশল জানতে চেয়েছেন–আপনি কি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন?

নিরঞ্জন হাসে। বলে, নারীদের নিয়ে সমস্যা কি জানেন, তাঁরা চিরন্তন মাতা এবং ভগিনী। তিনি জানেন, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি–গৃহীর মানসিকতা আমার নেই, তথাপি তিনি আমাকে কাছে পেতে চান–আমার কি সময় আছে, আপনিই বলুন? তাঁকে। বুঝিয়ে বলবেন, আমি অবশ্যই কদম্বঘাটে যাবো, তবে বিলম্ব হবে। জানাবেন, আমি সুস্থ আছি, ভগবান তথাগতের কৃপায় সুখী আছি।

সবিনয়ে নমস্কার করে অতঃপর নিরঞ্জন আবার সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়।

বসন্তদাস দেখলো, দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে চলেছে তরুণ ভিক্ষুটি। মস্তক উন্নত, গম্ভীর এবং ধীর। মনে মনে সে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলো না। এ তরুণ সাধারণ ভিক্ষু নয়, সে বুঝলল, এ সম্মুখে বহুদূর পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পারবে।

মিত্রানন্দ হতাশ। সভায় সিদ্ধান্ত কিছুই হলো না। মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দ সাধারণ ভিক্ষুদের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন–তা আর জানানো সম্ভব নয়। বসন্তদাসকে ডেকে বললো, বসন্ত তুমি কি এবার যাবে?

মিত্রানন্দ আর কী করবে–তার কোনোই কাজ নেই। সেও একপ্রকার হতাশ। আশা ছিলো, সদ্ধর্মীরা মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ঐক্যভাব সৃষ্টির চেষ্টা করবে। তাতে অন্যকিছু না হোক, অন্তত সামন্ত মহাসামন্তরা কিছুকালের জন্য দমিত থাকতো। কিন্তু দেখছে, সে পথ একেবারেই বন্ধ–সদ্ধর্মীরা রাজশক্তির মিত্র হতে চায় না। কী যে তারা চায়, কিছুই অনুমান করা গেলো না। একপক্ষ যা চায়, অন্যপক্ষ চায় তার বিপরীত। সুতরাং আর পুন্ড্রনগরীতে অবস্থান কেন? এবার সে যাবে। বললো, মিত্রানন্দ, আমার আর বিলম্ব করে কোনো লাভ আছে, বলো?

না, আর কি লাভ বিলম্ব করে, মিত্রানন্দ জানায়, আমিও এ স্থানে থাকবো না, তবে একটি কাজ এখনও বাকি আছে–আর একটি সংবাদ জানা প্রয়োজন, সেটি হলে আমিও যাবো–তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?

তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। ভিক্ষুরা উপাসনার আয়োজন করছিলো। মিত্রানন্দের এক সহচর এসে জানালো, আসুন উপাসনার আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে।

মিত্রানন্দ বললো, তুমি যাও, আমি আসছি।

লোকটি চলে গেলে সে আবার বললো, বসন্ত, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

কোথায়, উপাসনায়?

না, আমি যেখানে যাবার কথা বলছিলাম।

অধিক দূরে কি?

না, দূরে নয়, নিকটেই, নগরীর পশ্চিমপ্রান্তে।

চলো যাই।

তাহলে তুমি কিছুক্ষণ দাঁড়াও, উপাসনা আরম্ভ হলেই আমি চলে আসছি–বিলম্ব হবে না।

সত্যই অধিক বিলম্ব হলো না। অল্পক্ষণ পরই ফিরে এলো বসন্ত। বললো, এবার চলো।

সন্ধ্যা গত হয়েছে, তথাপি পশ্চিম আকাশে পাটল মেঘগুলির প্রান্তভাগ রক্তিম ভাব। সেদিকে ইঙ্গিত করে মিত্রানন্দ বললো, দেখেছো, আকাশে কেমন রঙ?

হ্যাঁ, যেন সিন্দুর বর্ণ।

না বসন্ত, আমার মনে হয়, বর্ণটি রক্তের মতোই, সন্ধ্যারম্ভে তুমি দেখোনি, দেখলে বুঝতে। বৃদ্ধরা বলে, আকাশে ঐরূপ রক্ত বর্ণের মেঘ রক্তপাতের ইঙ্গিত বহন করে।

ওসব কুসংস্কার মাত্র, লোকের কল্পনা।

কয়েক পদ অগ্রসর হয়েছে, ঐ সময়ই আবার অদূরে একটি পথকুক্কুর কেঁদে উঠলো।

শুনছো বসন্ত?

হ্যাঁ, পথকুক্কুর কাঁদছে–পথকুক্কুর কাঁদলে মন্বন্তর হয়, এই প্রকার লোকপ্রবাদ আছে।

তুমি বিশ্বাস করো?

না, মিত্রানন্দ। এসব আমার বিশ্বাস হয় না–জ্যেষ্ঠী, শূন্যকুম্ভ, শৃগাল, গোধিকা এসব দেখলে নাকি বহুকিছু হয়, সবই অমঙ্গল–চিহ্ন, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।

আমারও হয় না, মিত্রানন্দও জানায়। তারপর বলে, কিন্তু মধ্যরাত্রে গভীর নিঃশব্দতার মধ্যে যখন কুকুরের ঐ প্রকার কান্না ওঠে, তখন সত্যই ভয়াবহ কিছু ঘটবে বলে আশঙ্কা হয়। আজ কদিন ধরেই সন্ধ্যাকাশে রক্তিমাভা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস করি না, তথাপি মনের মধ্যে কেমন আশঙ্কার ছায়া দোলে।

যে স্থানে মিত্রানন্দ নিয়ে এলো সেটি একটি যবন কেন্দ্র। দ্বারদেশে বহু লোক। সকলেই বলছে, দরবেশ দর্শন চাই, দরবেশ দর্শন চাই।

বসন্তদাস শুনে অবাক। জানতে চাইলো, দরবেশ কি বস্তু? এ কি কারও নাম?

হ্যাঁ, যবনদের এ স্থানীয় প্রধানকে এরা দরবেশ বলে থাকে–শব্দটি যাবনী ভাষায়–এর অর্থ নাকি সংসার ত্যাগী সাধুপুরুষ।

বিচিত্র স্থান, দ্বারদেশে নারী পুরুষের কোলাহল, কিন্তু অভ্যন্তর একেবারেই নীরব। প্রলম্বিত শ্বেতবস্ত্রধারী, দীর্ঘদেহ, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ, ধীর পদে যবনেরা গমনাগমন করছে। তাদের দেখিয়ে মিত্ৰানন্দ বললো, এরা এই কেন্দ্রের অধিকারীটির শিষ্য–প্রত্যেকেই ধর্মপ্রাণ।

বসন্তদাসের মনে পড়লো দেবীকোট মেলার সেই যবন বৃদ্ধটির কথা। বললো, এরা তো দেখছি শান্ত এবং ভদ্র–কিন্তু জনরব যে শুনি, যবন জাতি নাকি নিষ্ঠুর এবং দুর্ধর্ষ? এরা কি সত্যই এক জাতি?

আমি বলতে পারবো না। পরিচিত মুখ দেখে মিত্রানন্দ ডাকলো, এই যে মহাশয়, শুনছেন?

এক যবন পুরুষ সম্মুখে এগিয়ে এলো। মুখে স্মিত হাস্য। বললো, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, কি সংবাদ? বহুদিন পরে এলেন মনে হচ্ছে?

মহাত্মা আহমদের সঙ্গে কি সাক্ষাৎ হবে? মিত্ৰানন্দ জানালো, বলবেন, মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দের একটি সংবাদ নিয়ে এসেছি।

নিশ্চয় সাক্ষাৎ হবে, আসুন।

লোকটি নিজ ভাষায় অপর একজন সহচরকে কিছু বললে সহচরটি দ্রুত প্রস্থান করে। অতঃপর এক কুটিরের সম্মুখ প্রাঙ্গণে একটি বেদী দেখিয়ে লোকটি বলে, এখানে বসুন, আমি প্রভুকে আপনার আগমন সংবাদ দিয়ে আসি।

কুটিরের সম্মুখে কয়েকজন লোক অপেক্ষমাণ। দেশীয় লোক তারা, কেন অপেক্ষা করছে, কিছুই অনুমান করতে পারে না বসন্তদাস।

ক্ষণকাল অতিবাহিত না হতেই দেখা গেলো, একটি লোক ক্ষুদ্র একটি কলস এবং পানপাত্র এনে সম্মুখে রাখছে। লোকটি নিজ ভাষায় কিছু বলে ইঙ্গিত করলো। বোঝা গেলো, ঐ পানীয় পান করতে হবে। বসন্তদাস অনুমান করে, নিশ্চয়ই কোনো প্রকার আসব। সে উৎফুল্ল বোধ করলো, যাক, বহুদিন পর আসব পানের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু পান করে দেখলো নিতান্তই মিষ্ট জল–তবে সুগন্ধী এবং তৃপ্তিদায়ক।

পান শেষ হবার পূর্বেই প্রথম লোকটি ফিরে এসে জানালো, বন্ধু মিত্রানন্দ, আসুন, এখনই তিনি আপনাদের সাক্ষাৎ দান করবেন।

কুটিরের ভিতরটি শুভ্র বস্ত্রাচ্ছাদিত। এক প্রান্তে কৃষ্ণাম্বরধারী শক্তিমান এক প্রৌঢ় বসে আছেন। নিকটেই কোথাও ধূপজাতীয় কিছু দগ্ধ হচ্ছে, সুগন্ধে কক্ষটি আমোদিত। প্রৌঢ়ের সম্মুখে একটি উপাধান, সেই উপাধানের উপর একখানি পুঁথি। মনে হলো, কিছুক্ষণ আগেও পুঁথি পাঠ হচ্ছিলো।

দুজনে সম্মুখে বসে প্রথমে প্রণাম জানালো। সাধুপুরুষ বললেন, ঈশ্বরের শান্তি বর্ষিত হোক তোমাদের উপর। তারপর জানতে চাইলেন, মিত্রানন্দ, তোমাদের সমস্ত কুশল তো, মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দ কি ফিরেছেন?

আজ্ঞে না।

না ফেরাই মঙ্গল। ইনি কে? বসন্তদাসের মুখপানে দৃষ্টিপাত করলেন সাধুপুরুষ।

ইনি আমার মিত্র, এবং সহগামী।

উত্তম, বলো, কী সংবাদ?

অর্হৎ জ্ঞানানন্দ আপনার অভিমত জানতে চেয়েছেন–যবন সেনাদলের সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে আমাদের? মিত্রতার, না অসহযোগের?

সাধুপুরুষ স্মিত হাসলেন। বললেন, যারা আসছে তারা ভাগ্যান্বেষী সৈনিক, অসহযোগিতা করে কী লাভ বলো? আমি তো মনে করি, মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রথম সম্পর্কই হওয়া উচিত মিত্রতার।

কিন্তু একটি বিষয় চিন্তা করার আছে, এই পর্যন্ত বলে সাধুপুরুষটি বিরত হলেন। নিজ ভাষায় মৃদুকণ্ঠে মন্ত্রজাতীয় কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন, চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে, কার সঙ্গে মিত্ৰতা করবে? তারা কি মিত্রতার হস্ত সম্প্রসারণ করে দিয়েছে তোমাদের দিকে? যারা তরবারি উত্তোলন করেছে আঘাত করার জন্য, তোমার হস্ত সম্প্রসারণ করে দিলে তাদেরই দিকে, তাতে ফল কী হবে? তোমাদের হাতগুলি অহেতুক ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং কার সঙ্গে মিত্রতা, সেইটি বিবেচনা করা প্রয়োজন। জ্ঞানানন্দকে বলো আমি সংবাদ পেয়েছি যে সদ্ধর্মীদের কেউ কেউ সামন্তপতিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যবন বাহিনীকে পথ দেখিয়ে আনতে চান–সাবধান, ঐ কাজ যেন কেউ না করে–এই যবনেরা তুর্কি, এরা বর্বর, জ্ঞান বিদ্যা ধর্ম কোনো কিছুতেই এদের শ্রদ্ধা নেই। এদের ডেকে আনা আর আত্মঘাতী হওয়া একই ব্যাপার।

প্রভু, আপনি কি মনে করেন, যবন সেনারা এদেশে আসবে? বসন্তদাস প্রশ্নটি না করে পারে না।

অবশ্যই আসবে–দস্যু যদি জানতে পারে যে দস্যুবৃত্তি করলে কেউ বাধা দেবার। নেই, তাহলে সে কি করে, বলো?

তাহলে এদেশের মানুষের উপায়?

উপায় তো আমি দেখি না, পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা ব্যতীত। তবে মনে হয় না, তারা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারবে, কারণ তাদের সংখ্যা অধিক নয়।

আর একটা কথা বলি তোমাদের, মহাত্মা আহমদ জানান, যারা বহিরাগত, তারা যদি মনে প্রাণে বহিরাগতই থেকে যায়, তাহলে এদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু যদি তারা মৃত্তিকালগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে, প্রকৃতিপুঞ্জের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়, তবে কিন্তু তাদের এদেশ থেকে বিতাড়ন করা অসম্ভব হবে।

ঐ পর্যন্তই কথা। দুজনে উঠে আসছিলো। সাধুপুরুষটি বললেন, তোমরা সাবধানে নগরীতে থাকবে–আমি সংকেত পেয়েছি, যবনেরা রাজধানী আক্রমণ যে কোনোদিন করতে পারে। যদি আগামীকালই শুনতে পাই যে এই নগরীও আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে আমি অবাক হবো না।

এই পর্যন্ত বলে তিনি হাসলেন। বললেন, জ্ঞানানন্দকে বলো তো, তিনি আমাদের ধর্মগ্রহণ করবেন কি না? তোমাদের ধর্মের সঙ্গে আমাদের ধর্মের তো বহু সাদৃশ্য আছে, সেটি জানো তো?

ঐ কথার পর হাসতে হাসতে বিদায়।

বাইরে এসে মিত্রানন্দ বললো, দেখলে তো? যবন সেনাদল সম্পর্কে যবন সাধুপুরুষটির কী ধারণা? নিরঞ্জন হঠকারী ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

বহির্দ্বারের নিকটে এসে হঠাৎ বসন্তদাস দাঁড়ালো, আশ্চর্য, এ কে? উজুবটের লীলাবতী?

তরুণীটিকে দেখলো মিত্রানন্দও। বললো, তুমি ওকে চেনো?

হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর বাল্যসখী, ও এখানে কেন?

নিকটবর্তী হতেই লীলাবতীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ভ্রাতঃ আপনি?

হ্যাঁ, তুমি এখানে কেন?

তারপর লীলাবতী কাঁদলো হাসলো ক্রমান্বয়ে কয়েকবার এবং ঐ হাসি কান্নার মধ্যেই নিজ দুর্ভাগ্যের কথা বর্ণনা করলো। শেষে জানতে চাইলো, মায়াবতী কেমন আছে, তার বিপদ হয়নি তো?

অল্প সময়, কতোটুকুই বা বলা যায়। কখনও এ কথা মনে হয়, কখনও ও কথা মনে হয়। বসন্তদাস লক্ষ্য করলো, লীলাবতীর কথায় সংলগ্নতা নেই।

অদূরে মিত্ৰানন্দ অপেক্ষা করছিলো। সে বললো, এখন যাই লীলা, পরে সাক্ষাৎ হবে।

মিত্রানন্দকে আর কিছু জিজ্ঞাসার নেই। সবই তো জানা হয়ে গেছে। কি অসম্ভব দুরাশা মিত্রানন্দের। কতো স্বপ্ন, মানুষের মুক্তি হবে দাসত্ব থেকে, যুগযুগ ধরে লাঞ্ছিত মানুষ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত হবে, মানুষের সৃজন ক্ষমতা শত স্রোতোধারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ কী হতে যাচ্ছে, মিত্রানন্দ?

মিত্রানন্দ নীরব। কতো দীর্ঘ পথ তাকে পরিক্রমা করতে হয়েছে। কোথায় পট্টিকেরা রাজ্য আর কোথায় জগদ্দল মহাবিহার। সমগ্র ভূ-ভাগের ধূলিকণা তার দুই পায়ে লেগে আছে–সমস্তই কি বৃথা? কৃষ্ণা শুক্লা বিভাবতীর লাঞ্ছনা, সেও কি বৃথা? তার মন স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু স্বীকার না করেও উপায় নেই। সে বসন্তদাসের হাত ধরলো। বললো, মিত্র বসন্ত, আমাদের স্বপ্ন রচনা কি স্বপ্নই থেকে যাবে? এতো শ্রম, এতো স্বেদ, এতো আত্মদান–সমস্তই বৃথা? বলো, তোমারও কি মনে হয় সমস্তই বৃথা যাবে?

বসন্তদাস রাত্রির আকাশে নক্ষত্রমালা দেখে। কোন তারকাটির নাম সে কৃষ্ণা রেখেছিলো, এখন সন্ধান করে পায় না। বলে, না মিত্ৰানন্দ, ও কথা আমার কাছে জানতে চেয়ো না–আমি বলতে পারবো না। কারণ, আমি জানি না।

তাহলে কে জানে? মিত্ৰানন্দ বিভ্রান্ত বোধ করে। একদিকে হতাশা আর অন্যদিকে বেদনা। কিছুই কি করণীয় নেই? পথক্ৰমণকালে তার মনে নানান চিন্তা আলোড়িত হয়। জগৎ কি বস্তুপুঞ্জ মাত্র। জীব কি তাহলে বস্তুতেই জাত হয় এবং বস্তুতেই হয় বিলীন? অনন্ত তার বন্দীদশা–বস্তুকে অতিক্রম করার কোনো ক্ষমতাই তার নেই? যদি থাকতো, তাহলো জ্ঞান এবং করুণার আবির্ভাব অবশ্যই প্রত্যক্ষ করা যেতো–বিচ্ছিন্ন মানুষ ঐকমত্যে উপনীত হতে পারতো। কিন্তু তা তো হলো না। অথচ তার বিশ্বাস ছিলো একটি ঐকমত্য হবে। কারণ জ্ঞানানন্দ বলেছিলেন, চিন্তা করো না মিত্রানন্দ, বস্তুময় জগৎ পরুষ, কঠোর এবং ক্ষেত্রবিশেষে নির্মমও বটে, কিন্তু এও আবার সত্য যে ঐ বস্তুময় জগতে অবগাহন করেই জীবসত্তা জ্ঞানের অধিকারী হয়। সুতরাং সাময়িক বিপর্যয় দেখে ভীত হবার কারণ নেই–দেখবে, ঘাতসংঘাতের মধ্য দিয়ে যথাসময়েই জ্ঞান এবং করুণার আবির্ভাব হচ্ছে, আর তা হলেই তখন আর চিন্তার কিছু থাকবে না।

জ্ঞানানন্দের ঐ স্থির বিশ্বাসের এখন কি হবে? সে ভেবে পায় না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপারটি ঘটেছে। নিরঞ্জনের মতো নিষ্ঠাবান ভিক্ষুও হিংসাকে প্রতিরোধ করতে চায় প্রতিহিংসা দিয়ে–অত্যাচারী ভ্রাতাকে বিতাড়ন করার জন্য বহিরাগত দস্যুকে আহ্বান করতে দ্বিধা নেই তার। সুতরাং সকল উদ্দেশ্যই তার বিফলে গেলো। এ অবস্থায় জীবের রক্ষা এখন কীভাবে সম্ভব? সে চিন্তা করে কূল পায় না।

ত্রিশরণ মন্ত্রটি সে এখন প্রায় সর্বক্ষণই মনে মনে জপ করে, কিন্তু তথাপি স্বস্তি বোধ হয় না। চক্ষু মুদিত করলে দিব্যচক্রটি আর সে দেখে না–দেখে লেলিহান অগ্নিশিখা এবং রক্তস্রোত। মনে হয়, বহুদূরে কোথায় যেন অসংখ্য আর্ত মানুষ হাহাকার করে যাচ্ছে। ফলে সে প্রায় নীরবেই পথ চলে।

বসন্তদাস জিজ্ঞাসা করে, সখা, তুমি কী ভাবো, বলো তো?

মিত্রানন্দ ম্লান হাসে। বলে, নতুন কিছু নয় বসন্ত, পুরাতন কথাই ভাবি–চিন্তা হয়, ভবিষ্যতে কী হবে।

বসন্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে–আর ভবিষ্যৎ! ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কি আর লাভ আছে কিছু! বরং এখন কী করবে সেইটি চিন্তা করো।

আমার তো করণীয় কিছু নেই এখন, মিত্রানন্দ জানায়। তারপর বলে, তুমি কি কিছু করবে বলে ভাবছো?

নাহ্, আমি আর কী করবো–ভাবছি সত্বর গৃহে ফিরবো–তুমি?

আমি, মিত্রানন্দ দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলে, হ্যাঁ, আমাকেও ফিরতে হবে মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দের সন্ধান করে তার কাছে যাবো।

তারপর?

তারপর আর জানি না। বসন্তদাসের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়–যদি জানাই না থাকে তোমাদের, তাহলে কেন এতো আয়োজন করতে নেমেছিলে? যারা তোমাদের ভরসায় নবীন আশায় উজ্জীবিত হয়েছিলো, তাদের কী হবে? প্রশ্নটা জাগে বসন্তদাসের মনে, কিন্তু প্রকাশ করে না সে। মিত্রানন্দ নিজেই যে অসম্ভব মনোকষ্টে পীড়িত হচ্ছে সেটা তো তার অগোচর নয়। সুতরাং কিছু বলতে পারে না সে। একত্রে পথ ভ্রমণ তাদের–কিন্তু দুজনের মধ্যে বিপুল একটা দূরত্ব থেকে যায়।

১২. সন্ধ্যাকালে পথিপার্শ্বের এক গ্রামে

সন্ধ্যাকালে পথিপার্শ্বের এক গ্রামে তারা যাত্রা বিরতি করে। দেহ আর চলছিলো না। দুই দিবসের ক্রমাগত, এবং বিরতিবিহীন পদক্ষেপণ–শরীরের দোষ কি! গ্রাম প্রান্তের মন্দিরটি দেখে বসন্তদাস বললো, সখা চলো, এই মন্দিরেই আশ্রয় নেওয়া যাক।

মন্দিরটি শিবের, এবং অতিশয় প্রাচীন। গর্ভগৃহে একটি তৈল দীপ জ্বলছিলো। কিন্তু নিকটে কোনো জনপ্রাণী দেখা গেলো না।

মন্দির সংলগ্ন কুটির আছে একটি–কিন্তু সেখানেও কোনো মানুষ আছে বলে মনে হলো না। ক্রমে এক সময় দুজনেরই সন্দেহ হলো, এ তারা কোথায় এসেছে? সমগ্র গ্রামটিই যে নিঃশব্দ। কোনো গৃহে শিশুর রোদন নেই, প্রদীপালোক নেই কোনো গবাক্ষে, রমণীকন্ঠের তীব্র কলহ শোনা যাচ্ছে না একবারও। অদ্ভুত কাণ্ড–দুজনেই হতবাক হয়–গ্রামের লোকেরা গেলো কোথায়?

বসন্তদাসের আশঙ্কা হয়–তবে কি এই গ্রামটিও উপদ্রুত হয়েছে? কয়েকটি গৃহের দ্বারদেশ পর্যন্ত সন্ধান করে তারা। দেখে, না–সত্যই কোনো জনপ্রাণী নেই। তবে এও বোঝা যায় যে গ্রামখানি আক্রান্ত হয়নি। হলে, কুটিরগুলির দশা অক্ষত থাকতো না। মনে হয় এরা নিকটস্থ বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে–মিত্রানন্দ নিজ অনুমানের কথা ব্যক্ত করে। বলে, দেখছো না, এই গ্রামের অবস্থান একেবারেই পথের উপর।

মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে বসন্তদাস বলে, সখা, এ গ্রামে রাত্রিযাপন বোধ হয় সমীচীন হবে না।

কেন? মিত্রানন্দ হাসে। বলে, তোমার কি ভয় হচ্ছে?

বসন্তদাস হাসে না। বলে, অবশ্যই হচ্ছে–ভয়ের কারণ থাকলেও যে ভয় না পায়, সে তো নির্বোধ।

মিত্রানন্দ পুনরপি হাসে। বলে, মিত্র বসন্ত, ভয় পেয়ে কোনো লাভ আছে, বলো? ভয়ের কারণ যেক্ষেত্রে সর্বক্ষণ এবং সর্বত্র উপস্থিত, সেক্ষেত্রে ভয়ের কি আর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব থাকে? ভয় পেয়ে তুমি নিজেকে কোথায় লুক্কায়িত করবে? বরং ও চিন্তা ত্যাগ করো–মনে করো, তথাগতের যা ইচ্ছা, তাই হবে।

বসন্তদাস মিত্রানন্দের মতো হতাশ হতে পারে না। বলে, মিত্রানন্দ, ভীতির একটা মঙ্গলজনক দিক কী জানো? ভীতি জীবনকে অন্তরাল করে রাখে–আর তাতে সে বাঁচে।

ধিক অমন বেঁচে থাকায়!

তুমি ধিক্কার দিতে পারো, বসন্তদাস বলে, কিন্তু আমার কাছে বাঁচবার ঐ কৌশলটি ধিক্কারের বস্তু বলে মনে হয় না। কারণ জীবের প্রাণরক্ষা করা মানুষের একটি পবিত্র কর্তব্য–নিজের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি অন্যের ক্ষেত্রেও। চিন্তা করে দেখো, জীব থাকলেই না জগৎ আছে, এবং তা থাকলে তবেই না পরিবর্তনের সম্ভাবনাটিও থাকবে।

ধরো, তুমি নির্বোধের মতো প্রাণ দিয়ে দিলে, বসন্তদাস নিজের ধারণা ব্যাখ্যা করে। বলে, তাতে কারও কোনো লাভ হবে, বলো? অহেতুক তোমার প্রাণটি চলে যাবে, বরং তুমি যদি এই দুর্যোগে নিজেকে রক্ষা করতে পারো, তাতে যদি তৃণাদপি নীচ এবং অবহেলিত হতে হয় তোমাকে, তথাপি সেই কৌশলটি তোমার জন্য উত্তম। কারণ তুমি বেঁচে থাকলে প্রাণ বাঁচলোএবং সেই সজীব জাগ্রত প্রাণ অবশ্যই তোমার আরব্ধ। কাজটি একদা সম্পন্ন করবে–যদি না পারে, অন্তত সম্ভাবনাটিকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু প্রাণই যদি না থাকে, তাহলে সকলি তো গেলো। সুতরাং চলো, এই বিপজ্জনক স্থান ত্যাগ করি।

মিত্রানন্দ সম্মত হতে পারে না। বলে, আমি দেখতে চাই বসন্ত, শেষ পর্যন্ত কী হয়।

ঐ কথায় বসন্ত হাত ধরে মিত্রানন্দের। বলে, তোমাকে এই অবস্থায় ত্যাগ করতে বলো? তা কি আমি পারবো? পারবো না। এদিকে যদি আমার প্রাণ যায়, তাহলে কী হবে চিন্তা করে দেখো–আমার স্ত্রী, তার উদরের সন্তানটি, নিজের পিতা–মাতা, স্ত্রীর পিতা–মাতা–এতোগুলি জীবন অকূলে পতিত হবে–সে অবস্থায় আমার প্রাণ দানের কোন যৌক্তিকতা থাকবে বলতে পারো?

মিত্রানন্দ কিছু বলে না ক্ষণকাল। শেষে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে, চলো, তাহলে।

আহার্য সংগ্রহ করা যায়নি। তারা মন্দির কূপে জলপান করে রাত্রির মধ্যমে পুনরায় পথে নামে।

কিন্তু দুজনের পথ কি এক? কতদূর তারা একত্রে যেতে পারবে? একজন গৃহী, অন্যজন ভিক্ষু। একজনের গন্তব্য সংসারে, অন্যজন যাবে সংঘে। সুতরাং পথ শীঘ্রই পৃথক হয়ে যাবে তা দুজনেই বুঝতে পারছিলো। বসন্তদাসের কষ্ট হচ্ছিলো মনে। বড় আপনজন হয়ে উঠেছিলো দুজনে পরস্পরের কাছে। মঙ্গলদীপ গ্রামে প্রথম পরিচয় তারপর কতো ঘটনা এবং কতো দীর্ঘ পথ একত্রে রয়েছে তারা। অবশেষে বিদায়–আর বিদায়ও এমনকালে যে পুনরায় সাক্ষাৎ হবে কিনা কেউ বলতে পারে না।

তৃতীয় দিবসে অপরাহ্নকালে তারা এক ক্ষুদ্র হাটে উপনীত হলো। জনসমাগম অধিক নয়–কিন্তু বিচিত্র একটি স্তব্যস্ত ভাব চারিদিকে–প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয় সমাপন করে শীঘ্র গৃহে ফিরতে চায় সকলে। তবে হাট বলে কথা–তার নিজস্ব স্বভাব কিছু না কিছু থাকবেই। ঐ ব্যস্ততার মধ্যেই কুশল জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছে পরিচিত লোকেরা–পিতার সঙ্গী বালকটি ক্ষুদ্র বংশীটিতে ফুঙ্কার দিয়ে চলেছে ক্রমাগত একজন তার কন্যাকে বলছে, তুমি কি ঐ খণ্ড মিষ্টান্নটি নেবে, না এই মঠটি হলে তোমার চলবে–একপ্রান্তে আবার দুটি বানর নিয়ে এক বাজিকর তার ক্ষুদ্র ডমরুটি বাজিয়ে চলেছে। বসন্তদাস চারিদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বললো, এ স্থানে লোকদের মধ্যে দেখছি এখনও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়নি।

সে একটি লোককে ডেকে বলে, মহাশয়, এদিকে কি যবন সেনাদলের আগমনের কথা শুনেছেন?

লোকটি হাসে। বলে, তাদের কথা কে না শুনেছে, তবে আমরা ভীত নই–দেখছেন, নিকটেই আমাদের নদী–এদিকে কোনো অঘটন ঘটলেই আমরা পরপারে চলে যাই।

তাতে লাভ হয় কিছু?

হ্যাঁ, হয়–নদী অতিক্রম করতে যায় না কেউ। লোকটি বিদায়কালে হাসতে হাসতে বলে, মহাশয়, বুদ্ধি থাকলে পুরুষ শ্বশুর গৃহে দেহপাত করতে যায় না কখনও, বুঝলেন?

লোকটি চলে গেলে বসন্তদাস বললো, শুনলে মিত্র, লোকটির কথা? ও কেমন কটাক্ষটি করলো আমার উদ্দেশে?

মিত্রানন্দ হাসে। বলে, এ স্থানের লোকেরা অতিশয় বুদ্ধিমান–সাবধানে কথা বলল।

হ্যাঁ তা-ই দেখছি। বসন্তদাস জানায়, কিন্তু নদীর পরপারে গিয়ে আত্মরক্ষার কথাটি চিন্তা করো দেখি–এদের কে বলেছে এই কৌশলের কথা?

মিত্রানন্দেরও আশ্চর্য মনে হয়। তাহলে কি নিজেকে রক্ষার জন্য এরা নিজেরাই যথেষ্ট?

আহারাদি সম্পন্ন করে দুজনে এক বৃক্ষতলে বিশ্রাম নিচ্ছে ঐ সময় হঠাৎ দেখা গেলোলা, হাটের লোকেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে। ব্যাপারটা কী বোধগম্য হবার পূর্বেই বসন্তদাস দুজন শস্ত্রধারী অশ্বারোহীকে হাটে বিচরণ করতে দেখলো।

মিত্রানন্দ বললো, এরা মনে হচ্ছে যবন সেনা, হঠাৎ এখানে কেন? তার প্রশ্নের উত্তর তখন কে দেবে। বসন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বললো, চলো, আমরা বিদায় হই।

হাটে তখনও অনেক লোক। প্রত্যেকেই বিমূঢ়–যে যার ভূমিতে স্থির। মিত্রানন্দ বললো, অস্থির হয়ো না–পলায়ন করতে কি পারবে?

সৈনিক পুরুষ দুটি মনে হয় কোনো লোকের সন্ধান করছে। বার দুই এদিক ওদিক যায়। অতঃপর এগিয়ে আসে মিত্রানন্দের দিকে। বসন্তদাসের ভয় হচ্ছিলো, মিত্রানন্দের ভিক্ষুবেশই তার কাল হয়ে না দাঁড়ায়!

কিন্তু দেখা গেলো, তাদের কোনো হিংস্র অভিলাষ নেই। তারা কোনো এক হর্ষ দত্তের সন্ধান করছে।

মিত্রানন্দ বললো, আমরা দুজনই বহিরাগত–তবে দেখি, যদি কেউ সন্ধান দিতে পারে।

পাওয়া গেলো হর্ষ দত্তের সন্ধান। তার নিবাস পলাশবাটি গ্রামে, ক্রোশ দুই উত্তরে ক্ষণকাল পূর্বেও তাকে হাটে দেখা গেছে–এখন নেই।

সংবাদটি জেনে একজন অশ্ব থেকে অবতরণ করে বললো, আহার্য কিছু পাওয়া যাবে এখানে?

বিপণীতে কয়েকটি মিষ্টান্ন ভাণ্ড ছিলো। সৈনিকটি তার একটি তুলে নিলো। মিষ্টান্ন নিলো, কিন্তু মূল্যদানের ব্যাপারে তার আর হৃক্ষেপ নেই। এদিকে যে প্রৌঢ়াটির বিপণী, সে অতশত বোঝে না। সে অবলীলাক্রমে হস্ত প্রসারণ করে বলে, ও মহাশয়, মূল্য দেননি তো, মূল্য দিয়ে যান।

হায় হায়, করে কি মূর্খ রমণী–অস্ফুটে প্রায় সকল মানুষই বলাবলি করতে লাগলো।

সৈনিক পুরুষটি বারেক ফিরে তাকায়, তারপর পুনরায় সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং মিটি মিটি হাসে–যেন বড়ই কৌতুককর একটি ঘটনা ঘটিয়েছে সে।

প্রৌঢ়াটির সম্ভবত আশঙ্কা হয়ে থাকবে তার মিষ্টান্নগুলি অপহৃত হয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার আরম্ভ করে দিলো। সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো। হারে ড্যাকরা, মূল্য দিবি না কেন, অ্যাঁ? একি তোর মায়ের সেই বস্তু যে মূল্য ব্যতীতই খাওয়া যাবে? তুই ভেবেছিস কি, অ্যাঁ, মূল্য না দিয়েই চলে যাবি–তুই কেন, তোর পিতা এসে মূল্য দিয়ে যাবে–বুঝেছিস, ওরে দগ্ধমুখ হনুমান!

সৈনিকটির দেশীয় ভাষাজ্ঞান সম্ভবত যথেষ্ট নয়। তাকে কী কী বলা হচ্ছে, তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না। তবে অনুমান করছিলো সে, নিশ্চয়ই তাকে মধুর সম্ভাষণে আপ্যায়ন করা হচ্ছে না। ফলে তার বিরক্তি জাগে সম্ভবত এবং সে ক্রুদ্ধ হয়ে তরবারিটি কোষমুক্ত করে উর্ধ্বে আস্ফালন করে।

আর তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্তা প্রৌঢ়াটি তবে রে বলে একটি ভাণ্ড পূর্ণ ঈষদুষ্ণ মিষ্টান্নরস তার মুখে নিক্ষেপ করে। ঘটনাটি এতই অভাবিতপূর্ব এবং আকস্মিক যে সৈনিক পুরুষটি বিমূঢ় হয়ে থাকে ক্ষণকালের জন্য। বিলক্ষণ একটি বিচিত্র দশায় পতিত হয় সে ঐ সময়। তার শিরোবেষ্টনী থেকে, শ্মশ্রু থেকে, কেশ থেকে মিষ্টান্নরস ঝরে পরিচ্ছদাদি সিক্ত করে দিচ্ছে আর সে তরবারিধৃত হস্তেই চক্ষুমার্জনায় ব্যস্ত। বাম হস্তের মিষ্টান্ন ভাণ্ডটি তখনও সে ত্যাগ করেনি।

কিন্তু করতে হলো। কারণ সুপক্ক মিষ্টান্নরসের মধুর আস্বাদন রসনার পক্ষে সম্ভব চক্ষুর সাধ্য কি যে সেই মিষ্ট স্বাদগ্রহণ করে? সেখানে আরম্ভ হয় বিপরীত প্রতিক্রিয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় সৈনিকটি অস্থির হয়ে পড়ে এবং সে মিষ্টান্ন ভাণ্ডটি ভূমিতে নিক্ষেপ করে দুই হাতে চক্ষু মার্জনা ও উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। হাটের লোকেরা কোলাহল করে ওঠে তার অবস্থা দেখে। অপর সৈনিক পুরুষটি তরবারি আস্ফালন করতে করতে বন্ধুর সাহায্যার্থে ছুটে আসে। এদিকে কোন এক দুষ্টমতি বালক প্রজ্বলিত একখানি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে আরোহীবিহীন অশ্বটির সুচিক্কণ পুচ্ছে অগ্নি স্পর্শ করে। ফলে অশ্বটি লম্ফ দিয়ে নিমেষে কোথায় যেন চলে যায়।

মনে হচ্ছিলো, সমূহ একটি সর্বনাশ অত্যাসন্ন। তরবারির আঘাতে ছিন্ন শির ভূলুণ্ঠিত হতে আর বিলম্ব নেই। কিন্তু দেখা গেলো কিছুই ঘটলো না তেমন। দ্বিতীয় অশ্বারোহীটি তার সঙ্গীকে তুলে নিয়ে যথাশীঘ্র হাট ত্যাগ করলো।

সম্পূর্ণ ব্যাপারটি যেমন আকস্মিক, তেমনই আতঙ্কজনক, আবার সেই প্রকারই হাস্যকর।

মিত্রানন্দ বললো, দেখলে, উন্মাদ রমণীটি কি কাণ্ড করলো–এখন তো এদের আর রক্ষা নেই।

বসন্ত সকৌতুকে হাসছিলো। বললো, সে না হয় হলো কিন্তু এও তো দেখলে বঙ্গবাসিনী রমণী কিরূপ ভয়শূন্যা হতে পারে। আর নিষ্কোশিত তরবারির বিরুদ্ধে তার অস্ত্রখানি কি প্রকার–কল্পনা করতে পারবে কেউ?

হয়েছে হয়েছে, আর বিলম্ব নয়–মিত্রান বন্ধুকে তাড়না করে। বলে মূর্খা রমণীর কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে এখন লোকালয়টি ধ্বংস না হয়ে যায়।

বসন্তদাস গম্ভীর হয়। বলে, মিত্র, এদেশে ধ্বংসের কি অবশেষ আছে কিছু? ধ্বংস তো হয়েই আসছে। তুমি ধ্বংসের দিকটা দেখলে, কিন্তু তোমার দেশের এক জননী দস্যু আক্রমণ কীভাবে প্রতিহত করতে পারে, সেটি তোমার দৃষ্টিগোচর হলো না। ভাবো তো, যদি সকল প্রাকৃতজন একত্রে এই প্রকারই প্রতিরোধ করে, তাহলে কী হতে পারে? মিত্র, প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমরা কিছুই করতে পারোনি। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজন এইভাবেই প্রতিরোধ করে। লাঞ্ছিত হয়, নিহত হয়, ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তথাপি ঐ একইসঙ্গে সে প্রতিরোধ করতে ভোলে না–হয়তো বিচ্ছিন্ন, হয়তো একাকী এবং শস্ত্রবিহীন–তথাপি তার দিক থেকে প্রতিরোধ থেকেই যায়।

হাট শূন্য হয়ে গেছে ততক্ষণে। কেবল প্রৌঢ়াটি তখনও তার ভগ্ন পাত্রাদি সম্মুখে নিয়ে রোদন এবং বিলাপ করছে। বসন্ত আর মিত্রানন্দ হাট পরিত্যাগ করলো। এবার আর রাজপথ নয়–প্রাকৃতজনের পথ, যা সঙ্কীর্ণ, কখনও যা জলাভূমিতে গেছে, কখনও গেছে বনভূমিতে। দুজনেরই এখন ধারণা, এই পথই নিরাপদ, গমনাগমন যদি করতে হয়, তাহলে এই পথেই করতে হবে।

গ্রামপ্রান্তের অখ্যাত নদীটির কূলে যখন উপস্থিত হলো তখন দিবা অবসান–প্রায়। উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় দিকেরই নৌকা ছিলো। বসন্তদাস মিত্রানন্দের হাত ধরলো। বললো, সখা, চলো আমার সঙ্গে।

মিত্রানন্দ হাসে বন্ধুর কথা শুনে। বলে, অবশ্যই যাবো, তবে এখন নয়–ভিক্ষু জ্ঞানানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন আমার। এখনও জানি না, কী বলবেন তিনি এবং ভিক্ষু সংঘেরই বা কী অভিমত হবে শেষ পর্যন্ত। তবে জেনে রাখো, তোমার কাছে আমাকে আসতেই হবে, যদি বেঁচে থাকি–কারণ তুমিই আমার প্রকৃত বন্ধু–প্রাকৃতজনের অমিত শক্তির দিকটি তুমিই নির্দেশ করে দেখিয়েছে, সখা, আমি আসবো–মায়াবতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে আমার পক্ষ থেকে আশির্বাদ চুম্বনটি দিতে বলল।

সন্ধ্যাকালে নৌযান দুটি দুই মুখে জলে ভাসলো–একটি দক্ষিণে, স্রোতের অনুকূলে অন্যটি উত্তরে, স্রোতের প্রতিকূলে।

বহু পথ, বহু লোকালয়, বহু বিঘ্ন এবং প্রণয়–প্রতিহিংসা অতিক্রম করে বসন্তদাস এখন স্বদেশে এবং স্বভূমিতে প্রত্যাগমন করছে। ক্লান্তি এবং অবসাদে তার দেহমন ভারাতুর। তার দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয় একটি। ভিক্ষু সংঘ কিছুই করতে পারেনি–হরিসেনের অত্যাচারের কোনো প্রতিকার হলো না, মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ কিংবা সামন্ত শ্রীনাথবর্মণও রয়ে গেলো একই প্রকার। লাভ হলো না কিছু–পথে পথে ভ্রমণই সার।

বসন্তদাস নদীর ছলোচ্ছল তরঙ্গাভিঘাত শোনে আর দৃষ্টি প্রসারিত করে রাখে দিগন্তের দিকে। কৃষ্ণার কথা স্মরণ হয় তার, স্মরণ হয় ছায়াবতীর কথা এবং নিরঞ্জনের কথা আর দীর্ঘশ্বাস পড়ে একটি একটি করে। স্বপ্ন থেকে, ক্রোধ থেকে, জ্বালা থেকে, প্রণয় থেকে, এখন আবার সংসারের উদ্দেশে যাত্রা। মনে হয়–আপাতত এইটিই তার পথ। কারণ সংসারে মায়াবতী আছে এবং মায়াবতীর গর্ভে তার সন্তান জন্ম লাভের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। আর সংসার ব্যতীত অপেক্ষাকালের। যোগ্য আশ্রয় অন্য কোথাও কি আছে? থাকলেও সে আশ্রয়ের কথা বসন্তদাসের জানা নেই।

১৩. যবন কেন্দ্রের মধ্যে দুই ভাগ

যবন কেন্দ্রের মধ্যে দুই ভাগ। একদিকে বণিকদের অবস্থান, অন্যদিকে সাধুপুরুষ আহমদ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে থাকেন। দুর্বৃত্তদের কবল থেকে উদ্ধার করে আনার পর যবন কেন্দ্রেই আশ্রয় হয়েছে লীলাবতীর। কেন্দ্রে রমণীদের থাকবার কোনোই ব্যবস্থা। ছিলো না–ঐ দিনই আরও দুটি নিরাশ্রয়া তরুণী মহাত্মা আহমদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা। করে। অগত্যা আহমদ একটি গৃহের ব্যবস্থা করেন। গৃহটি দারু নির্মিত এবং প্রাচীন, কিন্তু সুন্দর।

আহমদ শেষ মুহূর্তেও বলেছিলেন, তুমি কি এই স্থানে থাকবে, না অন্য কোথাও যাবে?

প্রশ্ন শুনে লীলাবতী শেষবারের মতো শ্যামাঙ্গের মুখপানে চেয়েছিলো। তারপরে নিঃসংশয়ে বলেছিলো, আমরা আপনাদের আশ্রয়ে থাকতে চাই।

শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর কথা শুনে আহত হয়েছিলো। পরে এক সময় বলেছিলো, তুমি ঐ কথা কেন বললে? সত্যি সত্যি তো আমরা এই স্থানে অবস্থান করছি না।

তবে আমরা এখন কোথায় যাবো, বলো? মাতুল বিদায়কালে একটি কথা বলেছিলেন, মনে আছে?

শ্যামাঙ্গের স্মরণ হয়, সিদ্ধপা বলেছিলেন, পথে যদি কোনো যবন কেন্দ্র দেখো, তাহলে সেখানে আশ্রয় নিও। তবে কি যবন কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে সিদ্ধপার সম্যক ধারণা ছিলো?

সিদ্ধপার উপদেশটি স্মরণ হলো, কিন্তু তথাপি শ্যামাঙ্গ যবন কেন্দ্রে আশ্রয়গ্রহণ। করলো না। লীলাবতীকে বলে গেলো, তুমি দিবস কয়েক এখানে অবস্থান করো, আমি শীঘ্রই বাসস্থলের ব্যবস্থা করছি।

শ্যামাঙ্গ যবনদের আচার–আচরণ সম্পর্কে শুনেছিলো মায়াবতীদের গৃহে। মায়াবতীর মাতুল দীনদাস একদল যবন অশ্ব ব্যবসায়ীর উপাসনা ও অনুগ্রহণের রীতিটি বর্ণনা করেছিলেন। দেখলো, দীনদাস যা যা বলেছিলেন সমস্তই সত্য। এদের উপাসনায়। কোনো বিগ্রহ থাকে না। নির্দিষ্ট উপাসনা গৃহ থাকলেও তারা ভূ–পৃষ্ঠের কোনো স্থানকেই অপবিত্র জ্ঞান করে না–পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলেই হলো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যে কোনো স্থানেই তারা নামাজ পাঠ করে। উপাসনাকে এরা বলে নামাজ। শ্যামাঙ্গ শুনতে পায়, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ এদের ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করছে।

আর করবেই বা না কেন? মাত্রই দিবস কয় পূর্বের কথা। একটি বালক করতোয়া নদীবক্ষে নিমজ্জিত হয়ে প্রাণ হারায়। বালকটি এক বিধবা রমণীর একমাত্র সন্তান, তাকে মৃতাবস্থায় তুলে আনা হয়। সকারের আয়োজন হচ্ছিলো। ঐ সময় পুত্রহারা মায়ের শোকার্ত রোদনধ্বনি শুনতে পান দরবেশ সাধুপুরুষ। তিনি বিধবার গৃহে প্রবেশ করে সমস্ত জানলেন তারপর বালকটির পা ধরে উর্ধ্বে তুলে চক্রাকারে ঘূর্ণন আরম্ভ করে দিলেন, বালকটির মুখ দিয়ে প্রচুর জল নির্গত হয়ে গেলে তিনি বালকটিকে ভূমিতে শায়িত করে। বক্ষদেশে চাপ প্রয়োগ করলেন বার কয়েক এবং শেষে মন্ত্রপাঠ করলেন কয়েকবার। আর তাতেই বালকটি চক্ষুরুন্মীলন করলো এবং মা বলে ডেকে উঠলো।

এই দৃশ্য যারা প্রত্যক্ষ করেছিলো তারা জানে, কি অসাধারণ দিব্য ক্ষমতার অধিকারী ঐ সাধুপুরুষ। তিনি মৃত বালকটিকে বললেন, ওঠো, তোমার মাকে গৃহে নিয়ে যাও, আর অবাক কাণ্ড, সত্য সত্যই বালকটি হাত ধরে নিজ মাতাকে গৃহে নিয়ে গেলো। আহা, তখন নাকি প্রভুর দেহ থেকে দিব্যালোক বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো! এই প্রকার সব কথা মানুষের।

প্রতিদিন কেন্দ্রের বহির্দ্বারে কুষ্ঠ রোগীদের সারিটি দেখবার মতো। সাধুপুরুষ স্বহস্তে তাদের চিকিৎসা করে থাকেন। কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত এতো মানুষ এ দেশে আছে, না দেখলে বিশ্বাস হতো না। কোথায় কোন রমণীটি নিগৃহীত হয়েছে, সে এসে দাঁড়াবে বহির্দ্বারে। ডোম কন্যাটি স্বামীগৃহে যাবে না, তাকেও তুমি দেখতে পাবে ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সর্ববিধ পীড়ন থেকে মুক্তিলাভের জন্য যেন এই স্থান। হড়ডি কন্যাটি চর্মকারের পুত্রের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে, এদিকে চর্মকার গৃহিণী ঐ কন্যাকে পুত্রবধূ বলে গ্রহণ করতে চান না। এখন প্রভু, কি হবে এই কন্যার? এ সমস্যা সমাধানের দায়ও যেন যবন সাধুপুরুষটির। স্বয়ং সামন্তপতি প্রতিপক্ষে একবার তাঁকে প্রণাম জানাতে আসেন। এমন জনরবও আছে যে, এই সাধুপুরুষের অগণিত অনুচরদের মধ্যে অনেকেই রক্ত মাংসের মানুষ নয়–ঐ অশরীরীদের নাম নাকি জ্বীন। আরও জনরব এই প্রকার যে, তাঁকে সর্পে দংশন করে না, ব্যাঘ্নে ভক্ষণ করে না।

লীলাবতী বলে, জানো, এদের ধর্ম একেবারেই অন্যরূপ। বিবাহ যদি সুখের না হয়, তাহলে এরা দাম্পত্য বন্ধন ছিন্ন করতে পারে এবং স্বামী–স্ত্রী উভয়েই পুনর্বিবাহ করে। আর উচ্চ নীচ ভেদাভেদ একেবারেই নেই। না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না যে, প্রভু ভৃত্য একত্রে, একস্থালীতে, আহার করে। মা গো, কি ঘৃণার কথা! একস্থালী থেকে আহার করলে একে অন্যের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে না, বলো? আরও অদ্ভুত কাণ্ড, এদের ভগবানের বিগ্রহ মূর্তি নেই–এমন ধর্মের কথা শুনেছো কোথাও?

কেন যবন ধর্মের প্রসঙ্গ লীলাবতী বারবার তোলে, শ্যামাঙ্গের বোধগম্য হয় না। যখনই ওর সঙ্গে কথা বলতে যাও ঐ সকল প্রসঙ্গ সে তুলবেই। জানায়, হডি এবং চণ্ডালেরা প্রায় প্রতিদিনই দীক্ষিত হচ্ছে, আর ক্ষেত্রকররা আসছে দলে দলে–তবে প্রতিদিন নয়। এদের দীক্ষাগ্রহণের অনুষ্ঠানটিও সহজ। স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে পবিত্র দেহে তুমি দীক্ষাগুরুর কাছে ক্ষুদ্র একটি মন্ত্রপাঠ করলে–তারপর আর কিছু নেই, হয়ে গেলে তুমি নতুন ধর্মের লোক। আর যদি দেখতে তুমি উপাসনাকালের দৃশ্য, হাসতে হাসতে মরে যেতে। বারংবার পশ্চাদ্দেশটি ঊর্ধ্বে তুলে এরা ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে। একসঙ্গে বহুলোক সারি সারি পশ্চাদ্দেশ তুলে রয়েছে–দৃশ্যটি কল্পনা করো তো?

লীলাবতী আনন্দেই আছে বলতে হবে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে, সে আবার পূর্বের মতো হয়ে উঠেছে। সেই পূর্বের মতোই চটুল, হাস্যমুখর এবং বুদ্ধিদীপ্ত। সে বলে, এখানে একটি নবদীক্ষিত বালক আছে, তারও নাম বসন্তদাস–তার যাবনী নাম কী হয়েছে জানো? তার নাম হয়েছে, বাতেন। তোমার নাম যদি ঐরূপ কিছু হয়? মা গো, লীলাবতী হাস্যাবেগে বেপথু হয়ে পড়ে। আর শোনো, বাতেন আমাকে দীক্ষামন্ত্রটিও শিখিয়ে দিয়েছে–অত্যধিক সহজ, কয়টি শব্দমাত্রতুমি শিখবে? বলো, লা–ইলাহা ইল্লাল্লা, মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লা। আচ্ছা, এদের ভাষায় এতো ল কেন জানো?

ঐ প্রকার কথা শুনে শ্যামাঙ্গ হতবুদ্ধি হয়ে থাকে। ইতস্তত করে, সদ্যলব্ধ বাসভবনের কথাটি জানাবে কি না। শেষে বলে, তুমি কি এখানেই থাকবে মনস্থির করেছো, নাকি বাইরে অন্য বাসভবনে যাবে?

কথা শুনে লীলাবতীর মুখ ম্লান হয়ে যায়। বলে, কই তুমি যে বললে, গৃহের সন্ধান পাও না–এভাবে একাকী থাকতে বুঝি আমার ইচ্ছা হয়? লীলার অভিমানী স্বর শুনে শ্যামাঙ্গ স্বস্তি বোধ করে। বলে, আগামীকালই আমরা নিজেদের বাসগৃহে যাবো।

লীলাবতীর চোখে নতুন আলো চমকিত হয়। বলে, সত্য বলছো, তাহলে আগামীকাল কেন? এখন গেলে কী হয়? তাকে অত্যন্ত অস্থির এবং চঞ্চল মনে হয়। পারলে যেন এই মুহূর্তেই সে যবন কেন্দ্র ত্যাগ করে। কিন্তু যখন শ্যামাঙ্গের বিদায়ের মুহূর্তটি এলো, তখন সে ইতস্তত করতে থাকে। বলে, ঐ স্থানে আমাদের বাস করতে দেবে তো, নাকি আবার পূর্বের মতো

কথাটি অসমাপ্ত রাখে লীলা। তারপরেই হঠাৎ বলে, এই সাধুপুরুষের কাছে দীক্ষা নিলে হয় না?

অত্যন্ত দ্রুত ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ উচ্চারিত একটি কথা। কিন্তু শ্যামাঙ্গ গভীরভাবে আহত হয়। বলে, লীলা, স্বধর্ম ত্যাগ যে করে, সে পাপিষ্ঠ–আমরা কি পাপ করেছি, বলো? কেন আমরা নিজ ধর্ম ত্যাগ করবো?

লীলা কী ভাবে অনুমান করা যায় না। চকিতে তার জ্বরেখা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে এবং চোখে দেখা দেয় বহ্নিজ্বালা। বলে, এ তুমি কী বলো শ্যামাঙ্গ, পাপ করিনি আমরা? তাহলে এভাবে নিজ পরিচয় গোপন করে পলায়ন করছি কেন? আমরা যা করেছি তা যদি পাপ না হয়, তাহলে পাপ আর কাকে বলে? তুমি কি আমাকে এই অবস্থায় রেখে দিতে চাও? বলল, আমার কী অপরাধ? আমি কেন সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত হব। আমি তো বলেছি তোমাকে, জীবনকে আমি পরিপূর্ণভাবেই চাই। আমি সংসার চাই, স্বামী চাই, সন্তান চাই–প্রত্যেকটিই আমার প্রয়োজন, একটি ন্যূন হলে চলবে না। যদি আমার পরিপূর্ণ জীবন হয় উত্তম, না হলে জীবনকে আমি প্রত্যাখ্যান করবো।

তাই বলে তুমি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে চাও?

হ্যাঁ, চাই। আমার ধর্ম কোথায়? আমি তো বুঝি না, সত্য সত্যই আমার ধর্ম বলে কোনো বস্তু কখনও ছিলো কি না। যদি ছিলো ধরে নিই, তাহলে সে ধর্ম আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমন বিবাহ দিয়েছে, যা আমি চাইনি–সে ধর্ম আমার জীবনকে বিপন্ন করেছে, সে ধর্ম আমাকে পিতৃহীন করেছে–বলো, তাকে আমি ধর্ম বলব?

শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় হয়। দেখে, তার সম্মুখে লীলাবতী নয়, যেন অন্য কোনো অপরিচিতা রমণী। সে বলে, লীলাবতী, এ প্রসঙ্গ থাক–এখন চলো, আমরা নিজ গৃহে যাই।

লীলাবতী হাসে। বলে, তুমি আমাকে উন্মাদিনী জ্ঞান করছে। কিন্তু আমি চিন্তা করে দেখেছি, এক গৃহে বাস, এক শয্যায় শয়ন–এতেই কি জীবনকে পাবো আমি, বলো? এক গৃহে বাস করিনি কি? এক শয্যায় শয়ন করিনি কি? কিন্তু তার ফল কি হয়েছে? রাত্রির অন্ধকারে পলায়ন, এই তো? এভাবে কতোবার পলায়ন করবো, কোথায় পলায়ন করবো, বলো? চুরি করেছি, না দস্যুতা করেছি?

শ্যামাঙ্গ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। বলে, তুমি যাদের সাহচর্যে আছে তারা বুঝি সকলেই যবন ধর্মগ্রহণ করেছে, তাই না? বালকটির কি নাম বললে যেন?

লীলাবতী এবারও হাসে। বলে, প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাও শ্যামাঙ্গ, কিন্তু আমি বালিকা নই। জীবন আমার কম বিপর্যস্ত নয়, লাঞ্ছনা কম হয়নি, আমাকে যদি জীবিত থাকতে হয়, তাহলে সেই জীবন আমার নিজেকেই গঠন করে নিতে হবে।

শ্যামাঙ্গ প্রশ্ন করে, একাকী কি জীবন রচনা সম্ভব?

না, সম্ভব নয়, লীলা স্বীকার করে।

প্রণয় কি প্রয়োজন নয়?

হ্যাঁ, শতবার প্রয়োজন।

আমি?

তুমি আমার, তুমি ব্যতীত আমার জীবন অর্থহীন।

যদি আমি স্বধর্ম ত্যাগ না করি?

অমন কথা বলো না শ্যামাঙ্গ। লীলা এবার বিপন্ন দৃষ্টিতে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়। বলে, অমন কথা বলো না তোমাকে না পেলে মরণ ব্যতীত আমার গতি নেই।

শ্যামাঙ্গ বলে তখন, লীলা, আবেগাশ্রয়ী হয়ো না, আমরা এই মৃত্তিকার সন্তান, বহুযুগ ধরে পুরুষানুক্রমে আমরা নিজ ধর্ম পালন করে আসছি। আমাদের চিন্তা–ভাবনা, আনন্দ শোক, আবেগ কল্পনা, সমস্তই যেমন আমাদের ধর্মাশ্রয়ী তেমনি আবার মৃত্তিকাশ্রয়ী–এ ধর্ম ত্যাগ করার অর্থ নিজেকেই ত্যাগ করা–এ অসম্ভব ব্যাপার, তুমি ঐ চিন্তা করো না।

লীলার দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত, কতদূর সে নিজেও জানে না। শ্যামাঙ্গের কথা তার শ্রবণে পশে কি না তাও বোঝা যায় না। এক সময় সে বলে, শ্যামাঙ্গ, জীবন কি বিচিত্র, তাই না? তুমি কী ভাবো আর আমি কী ভাবি। অথচ আমরা একত্র হয়েছিলাম!

তার দীর্ঘশ্বাসটি স্পষ্ট শুনতে পায় শ্যামাঙ্গ। লীলাবতীকে প্রস্থানোদ্যত দেখে সে হাত ধরে। বলে, চলো, আমরা নিজেদের গৃহে যাই।

গৃহে? লীলা যেন অবাক হয়। বলে, গৃহের কথা বলছো, না শয্যার কথা?

শ্যামাঙ্গ নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঐ কথায়। বলে ওভাবে বলল না লীলা, তুমি আমার

আমি তোমার, কিন্তু তোমার কী, সেটি বলো?

শ্যামাঙ্গ স্থির দৃষ্টি মেলে রাখে লীলাবতীর মুখপানে। হৃদয়ে তার রক্তক্ষরণ হয়। ভাবে, এ কোন রমণীকে দেখছে সে? আত্মবিস্মৃতা এই নারী কি সুখের জন্য এতোই লালায়িতা যে নিজ ধর্মকে পর্যন্ত ত্যাগ করতে চায়?

লীলা নিজের হাত মুক্ত করে নেয়। বলে, আমি তোমার পুত্তলিটি নই শ্যামাঙ্গ, আমি জীবন্ত নারী–আমার স্বামী চাই, সংসার চাই, সন্তান চাই–ঐগুলিই আমার ধর্ম, অন্য ধর্ম আমি জানি না আমাকে তুমি প্রকাশ্যে বিবাহ করো।

শ্যামাঙ্গকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। লীলাবতী উদ্গত অশ্রু রোধ করতে করতে দ্বারপথে অন্তর্হিত হয়ে যায়।

১৪. অভিমন্যুদাসকে আহত করে

অভিমন্যুদাসকে আহত করে দীনদাসের পলায়নের কয়েক দিবস পরই সংবাদটি পাওয়া যায়। সংবাদটি নিয়ে আসে কন্যা সরস্বতীর দেবর নবীন স্নাতক মাধবাচার্য।

অভিমন্যু লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় সোমজিৎ ঈষৎ চিন্তিত হয়েছিলেন। আশঙ্কা হয়েছিলো, মহাসামন্ত হরিসেন কোনো না কোনো গোলযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু দেখা গেলো, হরিসেনের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই–এমনকি অভিমন্যুদাসও তাঁর কাছে অতিমাত্রায় বিনয়ী হয়ে পড়েছে। তিনি আশ্চর্যই হচ্ছিলেন। একটি ক্ষুদ্র সংবাদ অবশ্য তার কর্ণগোচর হয়েছিলো, কিন্তু তিনি সংবাদটির গুরুত্ব দেননি। হরিসেনের পরিবার পরিজন নাকি কামাখ্যা তীর্থের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। সংবাদটি শুনে তাঁর মনে হয়েছিলো–এ আর এমন কি ঘটনা? এরূপ ঘটনা তো ঘটতেই পারে।

মাধবাচার্যের আনা সংবাদ হরিসেনের আচরণের কারণ উদঘাটিত করে দিলো।

জামাতা কেশবাচার্যের পত্রের বিষয় এইরূপ: দেশে রাষ্ট্রবিপ্লব আসন্ন, শীঘ্রই যবনাক্রমণ হবে, রাজধানীর বণিক এবং ব্রাহ্মণেরা সকলেই পলায়ন করছেন–এমতাবস্থায় দেশত্যাগ করাই ব্রাহ্মণদের পক্ষে বিধেয়–পত্রপাঠ যেন সোমজিৎ সপরিবারে মাধবাচার্যের সঙ্গে যাত্রা করেন।

সোমজিৎ মাধবাচার্যের কাছে নিজ মনোভাব ব্যক্ত করলেন না। শুধু জানালেন, বৎস, তুমি ফিরে যাও–আমি আত্মরক্ষার যথোচিত ব্যবস্থা নিতে পারবো–কেশব ও সরস্বতাঁকে বলল, আমার জন্য চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

মাধবাচার্য বিদায় নিলে সোমজিৎ স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ব্রাহ্মণি, এবার প্রস্তুত হও, মহাবিপদের কাল দ্বারে এসে উপস্থিত।

ব্রাহ্মণী হাসলেন স্বামীর উক্তি শুনে। বললেন, আমার ব্রাহ্মণের ব্ৰহ্মতেজ নিশ্চয়ই নিঃশেষিত হয়ে যায়নি–ঠাকুর আছেন আমাদের।

সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ঘটনা এই যে, এমন দুষ্কালে কয়েকজন যবন অশ্ব বিক্রেতা উজুবটে এলো। আরও আশ্চর্যের কথা এই যে, এই যবন বণিকেরা প্রত্যেকেই শস্ত্রধারী। সংবাদ পাওয়া গেলো, তারা মহাসামন্ত হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সন্ধ্যা সমাগমের পূর্বেই প্রস্থান করেছে।

সোমজিৎ সন্দিগ্ধ হলেন। যবনাক্রমণের সংবাদে তার ভয় হয়নি। কিন্তু হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের এই ঘটনা তাকে চিন্তিত করে তুললো।

পথ এখন শকট চক্রের আর্তনাদে মুখর। শকটের পর শকট চলেছে উত্তরাভিমুখে। নদীতে নৌকা, পথে গো–মহিষাদির শকট। কোথায় যাবে হে, কৌতূহলী গ্রামবাসীর চিৎকার শোনা যায়। কিন্তু উত্তর আসে না, এলেও আসে বিলম্বে এবং অনুচ্চ কণ্ঠে।

অর্থাৎ স্ত্রী-কন্যা-পুত্র ও পিতা-মাতাদের নিয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা কেউ কুটুম্ব গৃহে যাচ্ছেন, কেউ যাচ্ছেন তীর্থস্থানে।

কোন গ্রাম থেকে আগমন হে? প্রশ্ন শুনে নৌকার ক্ষেপণী তুলে নৌবাহক পশ্চাতের দিগন্ত দেখিয়ে বলে, তোমার পিতৃগৃহ যে গ্রামে, সেই গ্রাম থেকে আসছি, ভগিনীর সঙ্গে যেতে চাইলে এসো।

কে যাচ্ছেন? না কুসুম্বীর গ্রামপতি।

ঐ শকট সারি কার? না বিল্বমূলের সুধী মিত্রের।

আরে উদ্ধব দত্ত যে, কোথায় যাচ্ছো?

হেঁ হেঁ ভাই, গৃহিণীর ইচ্ছা, তীর্থস্নান করবেন–তাই

যাচ্ছেন ব্রাহ্মণেরা, যাচ্ছেন বণিকেরা, কিন্তু লক্ষণীয় যে, সামন্ত ও মহাসামন্তরা স্বয়ং যাচ্ছেন না কোথাও–এবং করণ কায়স্থদেরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

ক্রমে পুন্ড্রনগরীতেও যবনাক্রমণের আতঙ্ক স্পর্শ করলো। মুখে মুখে জনরব। কেউ বলে, তারা প্রথমে পুন্ড্রনগরীতে আসবে, রাজধানীতে যাবে পরে। কেউ বলে, পুন্ড্রনগরীতে তারা আদৌ আসবে না, পুন্ড্রনগরী তো আর পূর্বের মতো সমৃদ্ধ নয়। যারা বিজ্ঞলোক, তারা বলতে লাগলেন যে, যবন সেনারা প্রথমে রাজধানী অধিকার করবে, তারপর আসবে অন্যান্য নগরীতে।

স্থানে স্থানে জল্পনা–যুদ্ধ হলে নগরীর কিছুই থাকবে না, সবই যাবে ভস্মসাৎ হয়ে! একজন সংবাদ জানায় যে, যবন সেনাপতির বাহু দুটি ভূমি স্পর্শ করে–আর সে অসুর বিশেষ, নর–রক্তপানে তার দারুণ আগ্রহ। কারও মুখে শোনা যায়, এরা যবন নয়, ভিন্ন। জাতি, এদের বলা হয় তুরুক–কিছুই নেবে না এরা, শুধু তোমার পত্নীটিকে, নয়তো। কন্যাটিকে তুলে নিয়ে যাবে। এই প্রকার সব আতঙ্কজনক জনরব।

একদা দ্বিপ্রহরে হঠাৎ দেখা গেলো, নগরীর লোক পলায়ন করছে। কেউ কিছু বলতে পারে না, শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান হয়। ঐ আসছে, ঐ এসে গেলো–পশ্চিম দ্বারে গিয়ে দেখো রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে। কেউ বলে, নগরপাল যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, আর রক্ষা নাই। কোথায় যুদ্ধ, কি বৃত্তান্ত, কেউ কিছু বলতে পারে না। নগরীতে ভয়ানক বিশৃঙ্খল অবস্থা। অপরাহু হতে না হতে নগরীর পথ নির্জন হয়ে গেলো। যারা সক্ষম ছিলো, পলায়ন করেছে, যারা পারেনি, তারা গৃহের বহিৰ্বার রুদ্ধ করে ভিতরে বসে আছে।

শ্যামাঙ্গ নগরীর ঐ অবস্থা দেখে যবন কেন্দ্রে গেলো। সেখানে অসংখ্য জনসমাবেশ, দ্বারপথ প্রায় অবরুদ্ধ। মানুষের আকুল আগ্রহ। সকলেই জানতে চায়, দরবেশ সাধুপুরুষ কী বলেন, তিনি কি আমাদের রক্ষা করবেন না?

শ্যামাঙ্গ অতিকষ্টে বহির্দ্বার অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে। সংবাদ জানাতে হলো না, লীলাবতী ছুটে এলো। বললো, এতো বিলম্ব করলে কেন–আমার চিন্তা হচ্ছিলো।

লীলাবতীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে শ্যামাঙ্গ বলে, চলো লীলা, আমরা পলায়ন করি–এ নগরী ধ্বংস হয়ে যাবে।

লীলাবতী জানায়, কিছু হবে না, আমরা এখানে থাকবো। সাধুপুরুষ বলেছেন, তুমিও এখানে থাকবে।

শ্যামাঙ্গ চারিদিক দৃষ্টিপাত করে। কেন্দ্রের চারিদিকে অসংখ্য লোক, অধিকাংশই নবদীক্ষিত যবন–ধর্মী মোসলেমিন। সে বললো, আমি তো এদের ধর্মগ্ৰহণ করিনি, এরা কেন আমাকে থাকতে দেবে?

দেবে, তুমি চুপ করো–আমি দীক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করছি।

লীলাবতীর মুখপানে চেয়ে শ্যামাঙ্গ কষ্ট পায় মনে। বলে, লীলাবতী, তুমি এসব কী বলছো? তুমি কি আমার অভিমত জানো না?

জানি, কিন্তু এখন প্রাণরক্ষার জন্যই না হয় দীক্ষা নিলে–পরে প্রায়শ্চিত্ত করো।

না, অসম্ভব, ধর্ম ত্যাগ করে প্রাণ রক্ষা করবো–অমন প্রাণের আমার প্রয়োজন নেই, আমি যাই।

লীলাবতী তার হাত ধরে, কোথায় যাবে, আমাকে কোথায় রেখে যাবে?

শ্যামাঙ্গ উত্তরে কিছু বলতে পারে না।

বলল, আমি কোথায় যাবো? আমি তো এদের ধর্মগ্রহণ করিনি–আমাকেই বা এরা থাকতে দেবে কেন? এরা অস্বীকৃতি না জানালেও যারা নবদীক্ষিত, তারা জানাবে, তখন?

শ্যামাঙ্গ তবু বলে, আমি যাই, আমাকে যেতে দাও।

চলো তাহলে, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।

শ্যামাঙ্গ দেখলো, লীলাবতী সত্যই যাবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তার সাহস হয় না। বাহিরে যদি বিপর্যয় সত্যই আরম্ভ হয়ে যায় তখন লীলাবতীকে সে কীভাবে রক্ষা করবে। সে মিনতি করে বলে, লীলাবতী কথা শোনো, অবুঝ হয়ো না–তোমার জন্য এ স্থান নিরাপদযবনেরা যতো নিষ্ঠুরই হোক, স্বধর্মীদের উপর অত্যাচার করবে না।

তুমি না থাকলে, নিরাপদ স্থানে থেকে আমার কী হবে। শোনো শ্যামাঙ্গ, আমার কথা শোনো, লীলাবতী নিরুপায় স্বরে বলে, আমার কোনো গত্যন্তর নেই–তুমি যেও না, তোমার সন্তান আমার উদরে।

শ্যামাঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায় ঐ কথা শুনে। এ কী বলছে লীলাবতী? চারিদিকে কোলাহল, মানুষ প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে, ভয়ানক অনিশ্চিত অবস্থা–এই অবস্থায় এ কোন কথা বলছে লীলাবতী? সে লীলাবতীর মুখপানে চাইলো। লীলা তখনও তার মুখপানে চেয়ে আছে। শ্যামাঙ্গ লীলার দুচোখে দৃষ্টি রেখে বললো, সত্যি বলছো?

ঐ কথায় চিরন্তনী নারীর মুখে রহস্যময় হাসিটি ফুটলো। বললো, কেন বিশ্বাস হয় আমার কথা?

কথাটি বলবার সময় লীলার দুচোখে কি কৌতুকের ছায়া দেখা গেলো? শ্যামাঙ্গ নিশ্চিত নয়। কিন্তু তবু মনে হলো, যেন দেখা গেলো একটি ছায়া। হঠাৎ তার সন্দেহ হলো, লীলাবতীর এটি একটি ছলনাময় কৌশল নয় তো? পুনরায় সে জিজ্ঞাসা করে, সত্যি বলছো লীলাবতী?

লীলাবতী যেন বিজয়িনী। অশ্রুলাঞ্ছিত মুখে বিজয়িনীর হাসিটি উজ্জ্বল হয়ে ফুটলো। আর তাতেই শ্যামাঙ্গ বুঝলো ভুল। মনে হলো, তার অনুমানটি সত্যলীলাবতী ছলনাই করছে। ক্ষণেক পরে লীলা যখন বললো, পারবে এখন আমাকে একাকী রেখে যেতে? তখন সে প্রায় নিশ্চিত হলো। বুঝলো, লীলাবতী তাকে কাছে রাখতে চায় এবং যবন ধর্মে দীক্ষিত করতে চায়–সেই জন্যই তার এই ছলনাময় কৌশল। সেও হাসলো এবার। বললো, উত্তম কথা, তোমারই জয় হলো–আমি এ নগরী ত্যাগ করবো না নবধর্মে দীক্ষাও আমি নেবো, কিন্তু এখন নয়–বাইরে যখন অবস্থান করা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে তখন, তখন আমি তোমাদের এই কেন্দ্রে আসবো–এখন আমাকে যেতে দাও।

লীলাবতীর মুখে হাসি উচ্ছল হয়ে উঠলো ঐ কথায়। শ্যামাঙ্গের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, তোমাকে দেখে এখন আমার লোভ হচ্ছে, ইচ্ছা হচ্ছে রাক্ষসীর মতো তোমাকে চর্বণ করে খাই।

শ্যামাঙ্গ আহত এবং প্রতারিত বোধ করতে লাগলো নিজেকে। লীলাবতী এমন হতে পারলো? এমন হীন কৌশল গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হলো! নিজে তো ধর্ম ত্যাগ করতেই চায়, অন্যকেও সে প্ররোচিত করে! তবে কি যবন কেন্দ্রের সাধুপুরুষটি কোনো প্রকার যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেছেন লীলাবতীর উপরে? তার মনে সন্দেহ উপস্থিত হয়।

আবার কখনও মনে হয়, লীলাবতীর সন্তান সম্ভাবনা কি একেবারেই অসম্ভব? নারী পুরুষে মিলিত হলে সন্তান সম্ভাবনা তো হতেই পারে। যদি লীলাবতীর কথা সত্য হয়? সে অতঃপর আর চিন্তা করতে পারে না। নিজের অনিবার্য পরিণামটি সে স্পষ্ট দেখতে পায় মানসচক্ষুতে। অমন পরিণাম তো সে চিন্তা করেনি কখনও। ।

১৫. প্রায় পরিত্যক্ত নগরীর নির্জন পথে

প্রায় পরিত্যক্ত নগরীর নির্জন পথে পথে কয়দিন সে ভ্রমণ করলো। চোর দস্যু এবং পথকুক্কুর ব্যতীত আর জনপ্রাণী গোচরে আসে না। যারা নগরীতে তখনও আছে, তারা গৃহের বাহির হয় না।

তথাপি সংবাদ পাওয়া যায়। এখন আর অবিদিত নয় কিছু। মহারাজ লক্ষ্মণ সেন নওদীয়ার প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেছেন। নওদীয়ার প্রাসাদ ধ্বংস হতে বিলম্ব হয়নি। লক্ষ্মণাবতীও হয়েছে যথেচ্ছ লুণ্ঠিত। সেনাপতিরা পলায়ন করেছেন। সৈন্যরা কেউ পলায়িত, কেউ নিহত আর অবশিষ্টরা এখন যবন সেনাদলের সহযোগী। তারা সদলে এখন নগরের পর নগর লুণ্ঠন করে চলেছে। যে কোনোদিন পুন্ড্রনগরীতেও তারা এসে যেতে পারে।

একাকী ভ্রমণ করতে করতে সে নগরপ্রান্তে সদ্ধর্মীদের প্রাচীন বিহারের দিকে গেলো একদা। তার জনরব শোনা ছিলো যে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের নাকি যবনদের সঙ্গে মিত্রতা হয়েছে এবং ভিক্ষুদের কোনো ভয় নেই। কিন্তু দেখলো, বিহারটি প্রায় পরিত্যক্ত। কয়েকজন তরুণ তখনও অপেক্ষা করছে।

একজন তাকে দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি মহাশয়, আপনি নগর ত্যাগ করেননি?

না, সকলেই নগরী ত্যাগ করলে অতিথিদের অভ্যর্থনা কে করবে?

উত্তম, ভিক্ষুটি হাসলো। বললো, উত্তম বলেছেন, জিজ্ঞাসিত হলে আমরাও ঐ উত্তরই। দিই।

ভিক্ষুরা ঐ একই সংবাদ জানে। এবং তাদেরও ধারণা, ভিক্ষুদের যবনেরা কিছু বলবে। একজন বললো, কেন বলবে, বলুন? আমরা তো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনোভাবেই নই। এক হতে পারতো ধন-সম্পদের কারণ, ধন-সম্পদের লোভে আমাদের আক্রমণ করতো–কিন্তু সে গুড়ে তো এখানে বালি–অধিক হলে আমরা ভিক্ষাপাত্রটি দিয়ে দিতে পারি।

যেন কৌতুকের বিষয়। শ্যামাঙ্গ বললো, এ কি কৌতুকের সময়?

বাহ্, কৌতুক ব্যতিরেকে কী করবো বলুন? রোদন করবো? রোদনের কোনো কারণ আছে কি? রক্তপাত, লাঞ্ছনা, অপমান ইত্যাদি আমরা পূর্বেও দেখেছি, এখনও দেখছি। অন্ধের কি বা রাত্রি, কি বা দিন। তখন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা নির্যাতন করতো, এখন যবনেরা করবে–একই ব্যাপার।

শ্যামাঙ্গ সমস্ত দিন বিহারে অবস্থান করে।

অবস্থানের কারণ ছিলো। বিহারের প্রাচীন গাত্রের মৃৎপটগুলি দেখছিলো সে। প্রস্তর মূর্তিগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়। দেখতে দেখতে তার দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। কিন্তু মন রয়ে যায় অতৃপ্ত। সে রাত্রিযাপন করলো বিহারে, পরদিন পুনরায় সে শিল্পকর্মগুলি দেখতে গেলো। কি অদ্ভুত কাজ–কঠিন প্রস্তর, কিন্তু লাবণ্যের যেন শেষ নেই। স্থবির প্রস্তর থেকে সম্পূর্ণ মানুষটি আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি–কিন্তু যতোটুকু এসেছে, ততোটুকুই কতো জীবন্ত। গুরু বসুদেব এই জন্যই বলেছিলেন গৌড়ীয় রীতিটির কথা। তার মনে পড়ে–গৌড়ীয় রীতি কোনো রীতি নয়–এ হলো রীতি ভঙ্গের রীতি–জগতের সত্য রূপটি, শাশ্বত রূপটি যে রীতিতে ধারণ করা যায়, সেইটিই গৌড়ীয় রীতি। সে একটি প্রস্তর মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। তার অনুমান ওটি গৌতম পত্নী গোপার মূর্তি, মস্তকটির ভার বাম হস্তে বিন্যস্ত, ভঙ্গিটি অর্ধশায়িত, পদযুগলে দাসী পরিচর্যারতা, সম্মুখে শিশু রাহুল শায়িত। দেহের বঙ্কিম ভঙ্গিটিতে কি মাধুরী, কি লালিত্য–গ্রীবা দেখো, স্কন্ধ দেখো, বস্ত্রাচ্ছাদিত স্তনযুগল দেখো, কটিদেশ দেখো। সে যতোবার দেখে, ততোবার তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এবং হঠাৎ তার মনে হয়, এই নারী যেন তার পরিচিত–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তার পরিচিত। এবং পরিচয় আবিষ্কার করে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ কেমন করে সম্ভব। এ যে অবিকল লীলাবতী, নারীর পরিপূর্ণ যৌবনময় দেহে একইসঙ্গে শক্তির দৃঢ়তা এবং মাতৃত্বের কোমল সুষমা। অহঙ্কার এবং বিনয়, ছলনা এবং স্নেহ–এমন যে একত্রে মূর্ত হতে পারে সে কল্পনাও করতে পারে না।

সন্ধান নিতে গেলে জানলো, মূর্তিটির নির্মাতা কে, কেউ জানে না। তবে কিংবদন্তী এইরূপ যে, এক তরুণ ভিক্ষু মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন। এবং নির্মাণ করেই তিনি বিহার ত্যাগ করে চলে যান, প্রত্যাগমন করেননি।

শ্যামাঙ্গের মনে হয়, তার পুত্তলিগুলির সঙ্গে এ মূর্তিটির কোথায় যেন গভীর সাদৃশ্য আছে। তবে কি শিল্পী, শিল্পের উপাদান এবং শিল্পের বিষয় মূলত চিরন্তন? বস্তু ভেদে, ব্যক্তি ভেদে, কাল ভেদে–মূলগতভাবে তার কোনোই ব্যত্যয় হয় না?

সে স্থির করে, এই বিহারেই সে অবস্থান করবে–এখানেই সে মৃৎমূর্তি নির্মাণ করবে একটি। ঐ প্রস্তর মূর্তিটিরই পার্শ্বে সে স্থাপন করবে তার মৃন্ময় মূর্তিটি। মূর্তিটিতে বিধৃত থাকবে একটি নারীর গমন ভঙ্গি–-নারী তার নিজ শক্তিতে ক্রমেই অনন্তের দিক অগ্রসর হয়ে চলেছে–এই ভাবটি সে প্রকাশ করবে তার শিল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে।

তৃতীয় দিন প্রত্যুষে নগরীর দিক থেকে কোলাহল শোনা গেলো। একটি তরুণ ভিক্ষু সংবাদ নিয়ে এলো যে, যবন সেনারা নগরীতে প্রবেশ করেছে–আজ অপরাহ্নে সেখানে তাদের বিজয়োৎসব। নগরবাসী প্রত্যেককে সে উৎসবে যোগ দিতে হবে, না হলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।

কি ভ্রাতঃ, বিজয়োৎসব দেখতে যাবেন না কি? একটি ভিক্ষু জানতে চাইলো।

হ্যাঁ, যাবো, শ্যামাঙ্গ জানায়। তারপর বলে, আপনারা?

আমরা, আমরা তো উপদ্রব বিশেষ, ভিক্ষুটি হাসে। বলে, দেখি সংবাদ নিয়ে, প্রকৃত অবস্থাটি কী দাঁড়িয়েছে।

যবন দলটি রাজধানী থেকে আসেনি। এরা প্রথমে ছিলো তঙ্গন নদীর পশ্চিম তীরে, তারপর এরা পূর্বাভিমুখে অগ্রসর হয়। সেনাপতি কাফুর খান এই ক্ষুদ্র দলটির সেনাপতি। দুইশত সৈন্য ছিলো প্রথমে–এখন হয়েছে দুই সহস্র–এদের অধিকাংশই দেশীয় সৈন্য। অবাধ লুণ্ঠনের লোভে এরা কাফুর খানের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

প্রথমে এরা কয়েকটি গ্রাম লুণ্ঠন করে। প্রথম সামন্তপতিদের সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় দুএকটি–তারপর প্রায় সকল সামন্তপতির সঙ্গেই কাফুর খানের মিত্রতা হয়েছে মিত্র সামন্তদের সেনাদল এবং যবন সেনাদল এখন প্রায় একাকার। পথিমধ্যে একত্রেই এখন তারা গ্রাম লুণ্ঠন করছে।

উজুবটে এলে মহাসামন্ত হরিসেন এদের বিপুল সমাদর করেন। তথাপি দলটি উদয়পুরে প্রথমে, তারপর মদনপুরে, এই দুটি গ্রামে অবাধে লুণ্ঠন ও নরহত্যা চালায়। তখন থেকে অভিমন্যুদাস কিছু সংখ্যক সৈন্যের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ে। সে এখন প্রায় সর্বক্ষণই তাদের সঙ্গী। উদয়পুরে দীনদাসকে সে এবারও পায়নি। তবে হ্যাঁ, সোমজিতের গৃহে সে নিজ হস্তে অগ্নিসংযোগ করেছে। প্রফুল্লদাসকে অবশ্য সে নিজে হত্যা করেনি তবে করতো–সেরূপ একটি সংকল্প ছিলো তার। অবশ্য তার কন্যাটির উপযুক্ত শাস্তিই হয়েছে–ঐ শূকরপুত্রী এক পাত্র উত্তপ্ত জল তার উপর নিক্ষেপ করে। ঐ জল চক্ষে এসে লাগলে আর রক্ষা ছিলো না–তার সৌভাগ্য, চক্ষু দুটি রক্ষা পেয়েছে।

পুন্ড্রনগরীতে উপনীত হয়ে সে উল্লাস বোধ করলো। একেকটি গৃহের দ্বার ভঙ্গ করে ভিতরে প্রবেশ করো এবং যথেচ্ছ দ্রব্যাদি নাও, কেউ তোমাকে বাধা দিচ্ছে না।

ইতোমধ্যে সে একটি অশ্বও সংগ্রহ করেছে এবং কয়দিনের চেষ্টায় সে এখন অশ্ব চালনাও করতে পারে। ফলে তার গতি এখন দ্রুত। যথেচ্ছ সে গমনাগমন করে।

সে লোকমুখে শুনেছিলো যে পুন্ড্রনগরীতে সদ্ধর্মী পাষণ্ডদের একটি বিহার আছে। নগরীতে প্রবেশ করেই সে বিহারটির সন্ধান করে। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড, নগরীর লোকেরা এমন ভাব করে, যেন তারা বিহার নামক স্থানের নাম জন্মেও শোনেনি। একজন তো একেবারে মূক হয়ে রইলো। যতোই তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ততোই সে নিজ মুখে অঙ্গুলি স্পর্শ করে যুগপৎ হস্ত এবং মস্তক আন্দোলন করে। বোঝাতে চায় যে সে মূক ও বধির। অভিমন্যুদাস কৌতুক বোধ করে। সে স্থির করে, যে লোকই অসহযোগিতা করবে তারই পশ্চাদ্দেশে বংশদণ্ড প্রবেশ করানো হবে। ঐ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আয়োজনে বিলম্ব হলো না। মূক লোকটির পশ্চাদ্দেশের নিকট বংশদণ্ডটি নিয়ে যেতেই সে ওরে বাবারে বলে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো এবং সমস্ত সংবাদই যন্ত্রবৎ বলতে আরম্ভ করে দিলো।

তার কাণ্ড দেখে যবন সেনারা দারুণ কৌতুক উপভোগ করে। তারা বুদ্ধিতে একেবারে বলীবর্দের মতে, এবং তাদের শাস্তিদানও সেই প্রকার। লোকটি দুর্বিনয় প্রকাশ করছে, দাও তার শিরটি ছেদন করে। কেন বাপু, অন্য কৌশল প্রয়োগ করলে তো তোমার কাজও উদ্ধার হয়, আবার লোকটির প্রাণও বাঁচে। অভিমন্যুদাসের নতুন নতুন শাস্তি উদ্ভাবনের ক্ষমতা তাকে সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সে দ্বিপ্রহরে দুই তিনজন সঙ্গী অশ্বারোহী নিয়ে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করলো।

না, অভিমন্যুদাসের কার্য সমাধা করতে বিলম্ব হয়নি–উৎসব আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই সে নগরে ফিরে এসেছিলো।

তরুণ ভিক্ষু দুটিকে তারা পায় দ্বারদেশেই। যবন সৈন্যদের দিকে তারা সহাস্যে অগ্রসর হয়েছিলো কয়েক পদ। তারপর আর পারেনি। কবন্ধ দেহ দুটি ঐ স্থানেই পপাত হয়। তবে ছিন্ন হয়ে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরও মুণ্ডু দুটির মুখে হাসি ছিলো। আর তৃতীয় লোকটিকে যবনেরা পশ্চাদ্দিক থেকে শূলে বিদ্ধ করে। কিঞ্চিৎ ক্ষোভ রয়েছে অভিমন্যুর। লোকটিকে সে চিনেছে–এ হলো সেই কুম্ভকার, যে লীলাবতীর হাত ধরে পলায়ন করেছিলো। আহা, লোকটিকে সে ঐভাবে হত্যা করতো না। লোকটির মুখে লীলা নামটি উচ্চারিত হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। শূকরপুত্রটা ছিলো নিতান্ত ক্ষীণজীবী। অন্য কিছু বলবার আগেই তার প্রাণ পক্ষীটি দেহপিঞ্জর ত্যাগ করে শূন্যে উড়াল দেয়। কপাল মন্দ তার–এখন কোথায় সে লীলাবতীর সন্ধান করবে? আর্ত চিৎকারে দীর্ণ দিগন্তরেখায় ধূম্রকুণ্ডলী এবং অগ্নিশিখার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে অভিমন্যুদাসের চিন্তা হয়। লীলাবতীকে নিজ অধিকারে তাকে পেতেই হবে, মৃত অথবা জীবিত, যেভাবেই হোক।

 ১৬. প্রদোষে প্রাকৃতজনের কাহিনী

প্রদোষে প্রাকৃতজনের কাহিনী এখানেই সমাপ্ত। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, লীলাবতী, বসন্তদাস, ছায়াবতী, মিত্রানন্দ, নিরঞ্জন প্রমুখ চরিত্রগুলির শেষ পর্যন্ত কী হলো? কেন তাদের পরিণতি লিপিবদ্ধ হলো না?

এ প্রশ্নের উত্তরে সবিনয় নিবেদন এই যে, সীমাবদ্ধ ক্ষমতাই লেখককে অধিক বিস্তারে যেতে সাহসী করেনি। উপরন্তু ঐসব চরিত্রের পরিণতি ইতিহাসে মোটামুটি স্পষ্টভাবেই লিপিবদ্ধ।

বিপুল সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহণ, যে কারণেই হোক, এদেশের ইতিহাসে একটি সর্বজ্ঞাত ঘটনা। উল্লিখিত চরিত্রগুলির মধ্যে কারও কারও বিলুপ্তি এবং কারও কারও আবার শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ভাবধারার মধ্যে পুনর্জন্ম লাভ, এও আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। সুধীমিত্র, হলায়ুধ মিশ্র, সোমজিৎ উপাধ্যায় প্রমুখের উত্তরাধিকার যে পরবর্তীকালে স্মার্ত রঘুনন্দনের টোল এবং চতুষ্পাঠীগুলিতে লালিত এবং প্রচারিত হয়েছে–এ বিষয়েও ইতিহাসে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখা হয়নি। সুতরাং লেখকের আর কল্পনার অবকাশ কোথায়?

তবে হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে শ্যামাঙ্গকে নিয়ে–তার মৃত্যু কি অনিবার্য ছিলো? ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি রেখে আমাদের বলতে হয়, হ্যাঁ, অনিবার্যই ছিলো তার মৃত্যু। তার মতো মৃৎশিল্পীকে জীবিত থাকার অধিকার দেয়নি ঐ সময়ের সমাজ-ইতিহাস। কিন্তু সোমপুর মহাবিহারে প্রকীর্তিত শিল্পধারার উত্তরাধিকারী যে, তার নিঃশেষে মৃত্যু কি সম্ভব? আমাদের বিশ্বাস সম্ভব নয়। দৈহিক মৃত্যু হলেও প্রকৃত মৃত্যু তার হয়নি। তার সমস্ত জীবনোপলব্ধি বীজের মতো প্রোত্থিত ছিলো অনন্ত জন্মধারাবাহী প্রাকৃতজনের নিত্যসংগ্রামী জীবনবৃত্তের মধ্যে। আর সেই কারণেই কয়েক শতাব্দী পরে পুনর্ভবা তীরে এক মন্দির গাত্রের মৃৎফলকে পুনরায় আমরা অপরূপ শিল্পসুষমা ফুটে উঠতে দেখি। এবং ঐ একই শিল্প সুষমা রাঢ়-বরেন্দ্র-বঙ্গ-সমতটের পুত্তলি নির্মাণেও লক্ষ্য করা যায়। যদি কোনো পল্লী বালিকার হাতে কখনও মৃৎপুত্তলি দেখতে পান, তাহলে লেখকের অনুরোধ, লক্ষ্য করে দেখবেন, ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি না–আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওটি শুধু মৃৎপুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দী পূর্বের শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালোবাসাও।

Exit mobile version