Site icon BnBoi.Com

লীলা মজুমদারের গল্প – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদারের গল্প – লীলা মজুমদার

আচার

অমৃতবাজার পত্রিকার টুকরোটা হাতে নিয়ে বাবার প্রকাণ্ড চটি-জোড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে সঘোতন খুব লক্ষ করে দেখল, পিসিমা এসে নিবিষ্ট মনে থোকনাকে ঠ্যাঙাচ্ছেন।

প্রথমে ডান কান প্যাঁচালেন, তারপর বললেন, হতভাগা ছেলে! তারপর বাঁ গালপট্টিতে চাঁটালেন, তারপর বললেন, তোকে আজ আমি–তারপর বাঁ-কান প্যাচালেন– আদা লঙ্কা দিয়ে ছেঁচব! তারপর ডান গালপট্টিতে চাঁটালেন– তেল-নুন দিয়ে আমসি বানাব। তারপর পিঠে গুমগুম করে পিঠে গোটা দশেক কিল কষিয়ে, মাথা থেকে চিমটি চিমটি চুল ছিঁড়ে, জুলপি ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, ঠিক ভাড়ার ঘরের দরজার বাইরে! টিপ দেখে ঘোতন তাকে শ্রদ্ধা না করে পারল না।

আরেকটু হলে নিজেই ধরা পড়ে যাচ্ছিল। তবেই হয়েছিল! ভীষণ না রাগলে পিসিমার নাক খনো ও-রকম ফোলে না। অমৃতবাজারের কুচিটুচি ফেলে ঘোতন তো হাওয়া! খোকনটারও যা বুদ্ধি! এত করে বলে দেওয়া হল যেখানে হেয়ারপিন সেই পর্যন্ত পিসিমা পড়েছেন, আচারের জন্য তার এদিক থেকে কাগজ ছিড়িস! বোকা ভাবলে কি না এদিক মানে পিছন দিক, মনেও গজালো না যে একটু পড়লেই ছেঁড়া পাতা এসে যাবে। মাথায় কিচ্ছু নেই, এক যদি গোবর থাকে! বেশ হল! আচারও পেল না, ঠ্যাঙাও খেলো।

আবার পিসিমার টিপের কথা মনে হল। কী চমৎকার টিপ! সেই যে সেবার ক্রিকেট সিজন-এ পানু নিজের ব্যাট দিয়ে খুঁচিয়ে স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে, জিভ কেটে, মাথা চুলকে, তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে বাউন্ডারির দড়িতে ঠ্যাং আটকে খুঁটিসুদ্ধ দড়ি উপড়ে এনেছিল। বড়োকাকা ছিলেন ক্যাপ্টেন, তিনি এক হাতে পানুর শার্টের কলার আর এক হাতে পেন্টেলুন ধরে তাঁবু থেকে তাকে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়া টপকে ওপারে ফেলে দিয়েছিলেন, আর পিছন পিছন ওর জুতো, প্যাড, গ্লাভস, ব্যাট ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন, প্রত্যেকটি ওর গায়ে লেগেছিল! বাজে প্লেয়ার হলে কি হবে কী-রকম টিপ! পিসিমারই-বা হবে না কেন, ওঁরই তো দিদি!

ঘোতন এদিক ওদিক ঘুরে আচারের কথা ভুলতে চেষ্টা করল। নাঃ! খোকনটা আবার কোথায় উধাও মারল, তার যে পাত্তাই নেই!

অনেক খুঁজে দেখা গেল, ওই রেগেমেগে ভালো ভালো ব্যবহার-না-করা ডাকটিকিটগুলো টেবিলের ঠ্যাঙে একটার নীচে একটা লাইন করে দিব্যি থুতু দিয়ে সাঁটছে! ছোঁড়ার সাহস আছে!

ঘোতনা কাছে এসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল– লেগেছিল?

খোকনা বললে, কী লেগেছিল?

কী মুশকিল! লাগবে আবার কীসে?

আরে ঠ্যাঙানিতে, ঠ্যাঙানিতে!

উঁহু!

তবে যে দেখলুম মাথাটা এমনি হয়ে গেল?

ও-রকম মাঝে মাঝে হয়।

খাবি নাকি আচার?

না।

ঘেবড়ে গেছিস?

দুৎ! সত্যি বলছি, না। আচ্ছা তুই আন তো দেখি।

ঘোতন এক ছুটে ভাড়ার ঘরের দরজার কাছে চলে গেল। দরজার বাইরে সারি সারি বড়ির থালা অন্ধকারে এ-ওকে ঠেলাঠেলি করে চোখ টিপছে। সারা সকাল মা চিনু মিনুকে নিয়ে বড়ি দিয়েছেন। ঘোতন দেখেছিল মেয়েগুলোর কী বুদ্ধি! প্রথমটা বড়ি চ্যাপটা চ্যাপটা ঘুঁটের মতন হচ্ছিল। যেই মা বললেন যার বড়ি যত উঁচু তার বরের নাক তত উঁচু, অমনি বোকাগুলো টেনে টেনে বড়ির নাক তুলতে লাগল। বুঝবে শেষটা!

যাক, কিন্তু দরজায় যে তালা মারা! অ্যাঃ, মিলার লক! হেয়ারপিন পাকিয়ে ঘোতন তাকে এক মিনিটে শায়েস্তা করে দিল। আজ আর কোনো ভয় নেই। কী করবে পিসি? ঠ্যাঙাবে? ওঃ! ঠ্যাং নেই?

তাকে তাকে আচার! বড়ো বয়ামে, ছোটো বয়ামে, মাটির ভাঁড়ে পাথরের থালায়, শিশিতে, বোতলে। ঘোতনের চোখ দুটো চারদিকে পায়চারি করতে লাগল। ঠিক সেবারের বাঙালি পল্টনের মতন–একটা এগোনো, একটা পেছোনো, একটা লম্বা, একটা বেঁটে! বাঁকা লাইন, দুধের দাঁত পড়ে থোকনার যেমন ত্যাড়াবাকা দাঁত উঠেছিল সেইরকম। সত্যি সেপায়ের মতন। আনাড়ি সেপাইকে যেমন কাঁচা কাঁচা ধরে এনে এক পায়ে ঘাস বেঁধে মার্চ করায়– ঘাস বিচালি ঘাস বিচালি! লেফট রাইট লেফট রাইট তো আর বোঝে না!

আজ কে পিসিমাকে কেয়ার করে!

বয়ামের গায়ে টোকা মেরে মেরে ইচ্ছে করে ভিতরের আচারের ঘুম ভাঙিয়ে দিল।

কীরকম একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে আসছিল। ঘরের আনাচে-কানাচে ছুঁচোদের বাবা, মা, দাদা, দিদিরা চুপ মেরে কীসের যেন অপেক্ষা করছে! দেয়ালের গায়ে সুপুরির মতন কেঁদে কেঁদো মাকড়সা খাপ পেতে রেয়েছে। ছাদের উপর টিকটিকিরা খচমচ করে চলাফেরা করছে। তারা অনেক দিন পায়ের নখ কাটেনি। বড় বয়ামের পাশে ওটা কী? নিশ্চয় আমতেল, কেটে পড়ার চেষ্টায় আছে। তুলে দেখে–এ মা! আম তো নয়, আরশুলা চ্যাপটা! যেই পেন্টেলুনে হাতটা মুছতে যাবে–এই রে, পিসিমা! ঘোতনের আত্মারাম শুকিয়ে জুতোর সুখতলার মতন হয়ে গেল, হাত-পাগুলো পেটের ভিতর সেঁদিয়ে গেল।

পিসিমা বললেন, দরজার কাছে হাওয়া আটকে দাঁড়ালে আচার ভেপসে উঠবে। ঘোতন ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, পিসিমা আবার ডেকে বললেন, আচার নিয়ে যাও।

পিসিমা যে কী! বকলেও বিপদে ফেলেন, না বকলেও বিপদে ফেলেন। ঠেঙিয়েও হার মানান, আবার না ঠেঙিয়েও হার মানান। অন্য বুড়োদের মতন একটুও না।

ঘোতনের ভারি লজ্জা করল।

আপদ

আয়না দেখে আঁতকে উঠলুম। এ তো আমার সেই চিরকেলে চেহারা নয়! সেই যাকে ছোটোবেলা দেখেছিলুম, ন্যাড়া মাথা নাকে সর্দি, চোখ ফুলো! তারপর দেখেছিলুম চুল খোঁচা, নাক খাঁদা, গালেটালে কাজল! এই সেদিনও দেখলুম খাকি পেন্টেলুন, ময়লা শার্ট, মুখে কালি! এমনকী, আজ সকালেও দেখেছি কালো কোট, ঝাঁকড়া চুল, রাগী রাগী ভাব!

এই সেই চিরকেলে আমি নয়। দেখলুম বয়েসে ঢের, মুখভরা নোংরা ঘেমো কঁচা-পাকা দাড়ি, ঝুলো ঝুলো গোঁফ, চোখে নীল চশমা, গলায় হলদে লাল ডোরাকাটা কম্ফর্টার, গায়ে গলাবন্ধ লম্বা কালো কোট, বুকের কাছে বোতাম নেই, মরচে ধরা সেফটিপিন আঁটা। অবাক হয়ে গেলুম!

আয়নার পিছনে হাতড়ে দেখলুম কেউ যদি লুকিয়ে বসে থাকে। দেখলুম কেউ নেই, খালি কাঠের উপর আঙুলগুলো খচমচ করে উঠল, নখের মধ্যে খানিকটা বার্নিশ না ময়লা কী যেন ঢুকে গেল।

বিরক্ত লাগল।

গলা হহম করে সাফ করে বললুম, কে?

সেই লোকটা দাড়ি চুলকে মুচকি হেসে বলল, ন্যাকা! চেন না যেন! বলে এক হাতে গোঁফ আঁচড়ে উপরে তুলে দিল, অন্য হাতে দাড়ি খামচে নীচে ঝুলিয়ে দিল। দেখলুম নীচে আমারই নাক-মুখ ঢাকাঁচাপা রয়েছে!

বললুম, য়্যাঁ!

লোকটা সিঁড়ি না কী যেন বেয়ে তরতর করে খানিকটা উপরে উঠে গেল, চাপা গলায় বলল, বাকিটাও পছন্দ হল কি? দেখলুম তার মুন্ডু দেখা যাচ্ছে না। তার জায়গায় নোংরা ধুতি হাঁটু অবধি, গোড়ালি-ছেঁড়া লাল মোজা গুটিয়ে নেমেছে; পাম্প-শুর ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে, নখগুলো আঁকাবাঁকা মাংসে ঢাকা।

ব্যাপারটা কোনোদিক দিয়ে সুবিধে বুঝলুম না। মুন্ডু ফিরিয়ে চলে গেলুম। যাবার আগে বাতি নিবিয়ে ছায়াটাকে নিকেশ করে দিলুম। তবু মনে হল আয়নার ভিতর বুনো অন্ধকার থেকে কে যেন বুড়ো মানুষ হ্যাঃ হ্যাঃ করে বিশ্রী হাসি হেসে আনন্দ করছে। কী আর বলব! রাগলুম, ভয়ও পেলুম। খেতে গিয়ে মনে হল সবাই যেন একটু অন্যরকম করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হল যেন সুবিধে পেলেই সব কটা গোঁফের ফাঁকে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হেসে নিচ্ছে। যেন সেই বুড়ো লোকটার কথা আর গোপন নেই, সবাই জেনে ফেলে আমোদ করছে!

খাবারগুলো বদ লাগল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম। তবু রক্ষে নেই। যেখানে যাই কে যেন নীল চশমা পরে সঙ্গে সঙ্গে চলে। ভালো করে লক্ষ করলুম, কানে তার পাকা লোম, শোনবার সময়ে খাড়া হয়ে ওঠে। একবার জোর করে বললুম, এইয়ো। আমি অন্য লোক। তুই কে রে? বলতেই সে কোথায় মিশিয়ে গেল। শার্টের গলার চারপাশে আঙুল চালিয়ে তাগড়া হয়ে নিলুম।

এমন সময় গঙ্গুদা বলল, এদিকে আয়।

গেলুম– বাপরে, না গিয়ে উপায় আছে? ও বাপু ভীষণ লোক। মুখে দাড়ি, রোগা শরীর, বাবাজিদের সঙ্গে ভাব। সাদা শিমুলের শেকড় খাইয়ে নাকি পড়া দাঁত গজিয়ে দিতে পারে। দেখলুম সে চোখ পাকিয়ে পায়ের পাতা উলটে, সটাং হয়ে খাটে বসে দুই হাঁটুতে হাত বুলুচ্ছে, মুখে একটা খিদে খিদে ভাব। বললে, ঘাড়ে সুড়সুড়ি দে। ভাবলুম বলি, এখন পারব না। কিন্তু সে এমন কটমট করে চেয়ে বললে–

ও পারে যেও না ভাই, ফটিংটিঙের ভয়,
তিন মিনসের মাথা কাটা, পায়ে কথা কয়।
তাদের সঙ্গেতে মোর চেনাশোনা আছে রে,
সুড়সুড়ি না দিস যদি বিপদ ঘটতে পারে রে।

দেড়টি ঘণ্টা সে গুনগুন করে গাইতে লাগল–

কেরোসিন! কেরোসিন!
কেরোসিনের সুবাতাসে
মহাপ্রাণী খইসে আসে,
খাও, খাও, ভইরে টিন,
কেরোসিন! কেরোসিন!

রেগে ভাবলুম দিই ব্যাটার ঘাড়ে চিমটি। সে আরও গাইলে–

অনুতাপে দগ্ধ হবি,
ড্যাও দুদু চেটে খাবি।

জিজ্ঞেস করলুম, ড্যাও দুদু কী?

বললে, ড্যাও পিঁপড়ের দুধ। দে, সুড়সুড়ি দে, অত খবরে কাজ কী?

.

খানিক পরে আয়নার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখলুম আবার সেই লোকটা। এবার আবার মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। বড়ো কান্না পেল। বললুম, এমনিই তো যথেষ্ট ছিল, আবার ওটা কেন?

সে বললে, ছ্যাঃ। গঙ্গুদাকে ভয় পাও, আবার কথা! দুকানে যে তুলো গুজিনি সে তোমার ভাগ্যি আর আমি দয়ালু বলে। ছ্যাঃ, এত প্রাণের ভয়!

আবার বললুম, একটু আগে তো অমন ছিল না। ওটা খুলে ফেলুন বড়ো বদ, বড়ো বদ।

সে বললে, তাপ্পর অনেক জল বয়ে গেছে, অনেক জিনিস অদল-বদল হয়ে গেছে। আর চল্লিশটা বছর সবুর করো, এই এমনটিই হবে। ছ্যাঃ! গঙ্গুটাকে মানুষ হতে দেখলুম, তাকে ভয় পায়! আরে তার দাঁত পড়তে ক্যায়সা চেঁচিয়েছিল আজও মনে আছে। চোখ পিট পিট করে বললুম, আপনি বুড়ো মানুষ, আর কি বেশি বাঁচবেন!

লোকটা চকাত চকাত করে হেসে বলল, ফ্যাচর! ফ্যাচর! সেই আনন্দেই থাকো! বুঝলে না হে? আমিই হচ্ছি তুমি। তুমি যেমন ভীতু, কাপুরুষ, হাঁদা, বুড়ো হলে আমার মতন সাবধান-সাবধান গোছের হবে। তাই তো আমার রাগ ধরে। ইচ্ছে করলেই লক্ষ্মী ডাক্তারের মতন হতে পার। হাফপ্যান্ট আর মাদ্রাজি চটি পরে ফলমূল খেয়ে তেজি-তেজি ভাবে ঘুরে বেড়াতে পার। তা নয়! আরে ছোঁড়া, ওই তো টিকটিকির মতন শরীর, ছারপোকার মতন মন! অত ভয় কীসের? এতে অসুখ করবে, ওতে বকুনি খাব, অত ভাবনা কেন? কর আরও, আর এইরকম চেহারা হবে। আজ মাঙ্কি ক্যাপ, কাল মাথায় কম্বল মুড়ি। আরে হতভাগা তোর মতো একটা অপদার্থ মলেই-বা কী?

এই অবধি শুনে এমন রাগ হল যে ঠাস করে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম।

তাতে এক আশ্চর্য কাণ্ড হল।

চড়ের চোটে গাল ঘুরে গেল। দেখি ওমা! সে লক্ষ্মী ডাক্তার হয়ে গেছে! একগাল হেসে সেলাম ঠুকে বললে, সাবাস বেটা! এই তো চাই। বলেই কোথায় মিলিয়ে গেল। আর তাকে দেখিনি। কিন্তু তারপর থেকেই লোকে আমায় বলে: তেজি বুড়ো।

আমি

এই যেটাকে আমি কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছি, সেটাকে কি লাঠি ভেবেছ? মোটেই না। ওটা হল গিয়ে আমাদের চাকর জগুর ছাতার বাঁট। জগু ওটাকে হাঁটুর ফাঁকে খুঁজে ট্রামে চেপে বাজারে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা দুষ্টু লোক ওর মধ্যে একটা আধপোড়া বিড়ি ফেলে দিয়েছিল। তাই ছাতার কাপড়চোপড় পুড়ে একাকার। জগুর রাগ দেখে কে। বাড়ি এসে ছুঁড়ে ওটাকে সিঁড়ির নীচে ফেলে দিয়েছিল। আমি লোহার খোঁচাগুলো ছাড়িয়ে ওটাকে নিয়েছি।

লাঠির আগায় পুঁটলি বাঁধা দেখেছ? ওতে আমার টিফিন আছে। পিসিমার ডুলি থেকে বের করে নিয়েছি। ওরা আমাকে কেউ কিছু দেয় না, তাই নিজেই নিতে হয়।

আমার সঙ্গে সঙ্গে কালোমতন একটা কী যাচ্ছে দেখেছ? ওটা ছোটুকার কুকুর, পুকি। কোনো কিছু আমার নয়। খালি প্যান্টটা আর শার্টটা। জুতোটাও গন্টুর। ওকে না বলে নিয়েছি।

কোথায় যাচ্ছি জানো? রামধনুর খোঁজে। কেন জানো? রামধনুর গোড়ার খুঁটিতে এক ঘড়া সোনা পোঁতা থাকে নাকি, তাই। সোনা দিয়ে কী করব জানো? এক-শিংওয়ালা একটা ঘোড়া কিনব। কেন কিনব বলব? ওতে চেপে দিদিমার কাছে ফিরে যাব বলে।

দিদিমার কাছে কেন যাব জানতে চাও? দিদিমা আমাকে দারুণ ভালোবাসে, তাই। আমার জন্যে নারকেল-নাড় বানায়, ঘুড়ি কেনে, আপেল কেনে, রাত জাগতে দেয়ে, পড়তে বলে না, কেউ বকলে রাগ করে, কেউ নালিশ করলে বুকে টেনে নেয়, ঢোল পিটিয়ে ঘুম ভাঙালে হাসে, পড়ে গিয়ে সারা গায়ে কাদা লাগলে কোলে নেয়।

আমি খুব খারাপ ছেলে, তা জানো? মা বাবা ছোটকা, পিসিমা, বড়দি, মেজদি, সব্বাই বলেছে, আমার মতো খারাপ ছেলে ওরা কোথাও দেখেনি। আমি ঘুম থেকে উঠতে চাই না, দাঁত মাজি না, পড়তে চাই না, খাতা পেন্সিল খুঁজে পাই না, বই ছিড়ি, স্নান করতে দেরি করি, মুখোমুখি উত্তর দিই, বড়োদের কথার অবাধ্য হই। আমার মতো দুষ্টু ছেলে হয় না। জানো, আমি না বলে ছোড়দির লজেঞ্জুষ সব খেয়ে ফেলেছিলাম, একটাও রাখিনি!

জানো, আমি ভালো করে ভাত খাইনা, ফেলি, ছড়াই, রাগমাগ করি, খালিখালি কঁচা আম খেতে চাই, বাতাসা খেতে চাই। আমি দিদিমার কাছে চলে যাচ্ছি। দিদিমা আমাকে ঝকঝকে মাজা কাসার গেলাসে করে জল খেতে দেয় আর হাতে একটা লালচে বাতাসা দেয়। আমি জলের মধ্যে, বাতাসাটাকে যেই ফেলি, বাতাসাটাও অমনি জল-টুস-টুস হয়ে ডুবে যায়। তক্ষুনি চো চো করে জলটা খেয়ে ফেলতে হয়। নইলে গুঁড়ো হয়ে যায়।

আমার দিদিমা দুপুরবেলায় কেষ্টচূড়া গাছের নীচে মাদুর পেতে, বালিশ নিয়ে আমার পাশে শুয়ে, আমাকে গল্প বলে। সব সত্যি গল্প। দিদিমার বাবা-কাকারা কেমন গোরাই নদীতে কুমির দেখেছিল, তাদের বুড়ি জেঠিমাকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর যেই-না মাঝিরা নৌকো করে গিয়ে কুমিরের মাথায় দাঁড়ের বাড়ি মেরেছে, অমনি বুড়িকে ছেড়ে দিয়েছে। আর ওরাও নৌকোতে তুলে নিয়েছে। আর বুড়ি কেঁদে কেঁদে বলছে, বাঁচালি বাপ, বেঁচে থাক বাপ আমার আমসত্ত্ব শুকোয়নি আর আমাকে কিনা কুমিরে নিলে!

আমার দিদিমা এই সব গল্প বলে আর ছোট্ট কাগজের ঠোঙা থেকে আমার জন্যে আমসত্ত্ব বের করে দেয়। আমি চেটে চেটে খাই আর দিদিমা আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দেয়।

ওরা বলে, বাবা-কাকারা যখন কাটোয়া গেছিল আর আমি দিদিমার কাছে দু-মাস ছিলুম, দিদিমা তখন আমার মাথাটি চিবিয়ে খেয়েছে। আমার বাবা মা এইরকম বলে।

একদিন কিন্তু সত্যি সত্যি দিদিমা আর আমি মট্‌কা চিবিয়ে খেয়েছিলুম। আমরা বাঁধের ধারে গেছলুম ফেরবার সময় আর হাঁটতে পারি না। শেষটা একটা আলো ওপর বসলুম দু-জনায়। দিদিমা আমার পায়ের গুলি ধরে নেড়ে দিল, অমনি আমার সব জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে গেল। তারপর সেখান দিয়ে মটকাওয়ালা যাচ্ছিল, দিদিমা মট্‌কা কিনে বলল কাল বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে যা। মাওয়ালাকে চেনে আমার দিদিমা। তারপর আমরা মটকা চিবোতে চিবোতে বাড়ি চলে এলুম। এসে লুচি খেলুম। দিদিমা আমার জন্যে রোজ রাত্রে লুচি করে দিত। বলত, মাকে যেন আবার বলিসনে, সে হয়তো রোজ লুচি খেলে রাগ করবে। মাকে আমি কিছু বলিনি।

দিদিমা আমাকে বেড়াল কোলে নিয়ে শুতে দিত। পুষি আমার বালিশে মাথা রেখে আমার পাশে রোজ ঘুমোত। আর আজ দেখোনা পুষিকে আমার থালার কোনায় একটু খেতে দিয়েছিলুম বলে সে কী বকাবকি!তাই আমি আর এখানে থাকবনা। রামধনু খুঁজে তার খুঁটির গোড়া থেকে সোনার ঘড়া বের করে তাই দিয়ে এক-শিংওয়ালা ঘোড়া কিনে, তাতে চেপে দিদিমার কাছে গিয়ে হাজির হবো। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যাবে না দিদিমা? আমি জানি, ওসব ঘড়া-টড়ার গল্প, এক-শিংওয়ালা ঘোড়ার গল্প দিদিমা সব বানিয়ে বলে। তাই সত্যি করে যখন এক-শিংওয়ালা ঘোড়া চেপে হাজির হব, কেমন চমকে যাবে না দিদিমা?

ক্যাবলাকান্ত

ক্যাবলাদের বাড়ির পুকুরে কোথায় এক গোপন জায়গায় সেই লাল-নীল মাছটা ডিম দিয়েছিল। জানত শুধু লাল-নীল মাছ আর শংকর মালী। ব্যাঙেরা তাকে খুঁজে পায়নি। হাঁসরা তাকে খুঁজে পায়নি। ক্যাবলা যেদিন শংকর মালীর কাছে খবর পেল সেই দিনই পুকুরপাড়ে ছুটে গিয়েছিল কিন্তু সেও খুঁজে পায়নি। দেখল ব্যাঙরা ডিম খুঁজে খুঁজে পুকুরের নীল জল ছুঁটে ঘোলাটে করে দিয়েছে, হাঁসরা পদ্ম ফুলের মধ্যে প্যাতপেতে চামড়াওয়ালা ঠ্যাং চালিয়ে শেকড়-বাকল পর্যন্ত তুলে এনেছে, কিন্তু ডিমের কোনো পাত্তাই নেই।

বুড়ো হাঁসখুড়ো বলেছিলেন– চোখ রাখিস, তা দেবার সময়ে কাঁক করে ধরিস। কিন্তু সকাল-সন্ধ্যে লাল-নীল মাছটাকে গোমড়া মুখে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল, তা দেবার নামটি করলে না। সারা দুপুর মাছটা এখানে এক কামড় শেকড়, ওখানে দুটো কীসের দানা খেয়ে বেড়াল, তা দেবার গরজই নেই!

হাঁসরা তো রেগে কাই! আরে মশাই, আমরা ডিম দিলে ভর-সন্ধে তার ওপর চেপে বসে থাকি। ত্রিসীমানায় কেউ এলে খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে যাই, আর এ দেখি দিব্যি আছে!

ব্যাঙরা তাগ করে থেকে থেকে শেষটা ঝিমিয়ে এল। হাঁসরা ম্যাদা মেরে গেল, ক্যাবলাও দু-তিন দিন ঘুরে গেল।

শংকর মালীকে অনেক পেড়াপীড়ি করাতে সে বললে– অ রাম-অ! সে বলিবাকু বারণ-অ অচ্ছি!

ক্যাবলা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, লাল-নীল মাছটা ছোটো ছোটো ডানি-ওয়ালা পোকা ধরে ধরে কপাকপ গিলছে দেখল। কী মোটকা মাছ বাবা। পাঁজরের একটা হাড় গোনা যায় না।

ক্যাবলার একটু দুঃখও হল, পগারের মধ্যিখানে কে জানে কোথায় ডিম ফেলে লোকটা দিব্যি মাকড়গুলো মেরে খাচ্ছে। কাল হোক, পরশু হোক, যেদিনই হোক, মেজোমামার মস্ত ছিপটা এনে এটাকে ধরবেই ধরবে। বামুনদিদিকে দিয়ে দেবে, ঝোল বেঁধে খাবে, কাঁটাগুলো বিল্লিকে খাওয়াবে।

.

এ তো গেল ক্যাবলার কথা। এদিকে লাল-নীল মাছটার ভাবগতিক দেখে পুকুরের আর সবার গা জ্বলছে। শংকর মালী ভাত দিলেই ও তেড়েমেড়ে আগেভাগে গিয়ে সব সাফাই করে দেয়। হাঁসরা সময়মতো উপস্থিতই হতে পারে না, ব্যাঙরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেললে, তবু সে গ্রাহ্যই। করে না।

শেষটা একদিন চাঁদনি রাতে লাল-নীল মাছের ডিম ফুটে ছোটো একটা ছানা বেরুল। শংকরমালী জানত তাই দেখতে পেল কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। আর ক্যাবলা তো ছিপই পায় না, মেজোমামা সেটাকে ডাল-কুত্তোর মতন পাহারা দেন।

ছোটো ছোটো দাঁতের দাগ কারো চোখেই পড়ল না। ব্যাঙাচিগুলোকে কে যে একা পেলেই ভয় দেখায়, ব্যাঙাচি বেচারাদের বোল ফোটেনি, তারা বলতে পারল না, তারা কেবল দিন দিন ভয়ের চোটে আমসির মতন শুকিয়ে যেতে লাগল। তাদের ল্যাজগুলো খসে যাবার অনেক আগেই নারকোল-দড়ি হয়ে গেল।

.

এমনি করে আরও কদিন গেল। তারপর বিকেল বেলায় ক্যাবলা ছিপ ছাড়াই পুকুর পাড়ে চলল। পথে দেখল ওদের তাল গাছ থেকে সর সর করে কী একটা যেন নামছে, তার ঠ্যাং দুটো দড়ি দিয়ে একসঙ্গে বাঁধা, পাঁচু ধোপার গাধার মতন, তার কোমরে দুটো হাঁড়ি ঝোলানো। ক্যাবলা ভাবছিল লোকটাকে দেখে সুবিধের মনে হচ্ছে না,সকান দেবে কিনা ভাবছে, এমন সময় লোকটা তাকে ডাকল।

ক্যাবলা দেখল হাঁড়ির ভিতর সাদা ফেনা, তার গন্ধের চোটে ভূত ভাগে। লোকটা ক্যাবলার সঙ্গে অনেক কথা বললে, লাল-নীল মাছের কথা শুনে, কেমন যেন ভাবুক ভাবুক হয়ে গেল। বললে ছপের কী দরকার? ছোটোবেলায় তারা নাকি কাপড় দিয়ে কচি কচি মাছ ধরত। এখনও ছুটির দিনে সাঁওতালরা দল বেঁধে কোপাই নদীতে মাছ ধরে। তাদের ছিপ নেই, মাঝখানে ফুটো ধামার মতন জনিস দিয়ে গপাগপা চাপা দিয়ে ধরে। কাছাড়ের কাছে কোথায় পাহাড়ি নদীতে রাত্রে নাকি জাল বেঁধে রাখে এপার থেকে ওপার, সকালে দেখে তাতে কত মাছ, ছোটোগুলো ছেড়ে দেয় আর বড়োগুলো ধরে নিয়ে যায়।

লোকটা এমনি কত কী বলল। যাবার সময়ে বলে গেল হাঁড়ির কথা যেন কাউকে না বলে।

সে চলে গেলে ক্যাবলা কাপড়ের খুঁট বাগিয়ে ঘটম্যাক ঘটম্যাক করে জলের দিকে চলল। আজ মাছ ব্যাটাকে কে রক্ষা করে?

এমন সময় টুপ করে জল থেকে মাছের ছানা মুণ্ডু বের করে বিষম এক ভেংচি কাটল।ওরে– বাবারে, সে কী মেছো ভেংচি! ক্যাবলা তো শাঁই শাঁই ছুট লাগাল, আর হাঁসেরা ব্যাঙেরা কে যে কোথায় ভাগল তার পাত্তাই নেই!

সন্ধ্যে বেলা শংকর মালী যখন ওদের জন্য ভাত আনল, দেখল কেউ কোথাও নেই, খালি লাল-নীল মাছ আর সবুজ ছানা পাশাপাশি বসে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছে।

 গণশার চিঠি

ভাই সন্দেশ, অনেক দিন পর তোমায় চিঠি লিখছি। এর মধ্যে কত কী যে সব ঘটে গেল যদি জানতে, তোমার গায়ের লোম ভাই খাড়া হয়ে গেঞ্জিটা উঁচু হয়ে যেত, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসত, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকঠক হয়ে কড়া পড়ে যেত!

আজকাল আমি মামাবাড়ি থাকি। আমার মনে হয় ওঁরা কেউ ভালো লোক নন। এঁদের মধ্যে মাস্টারমশাই তো আবার ম্যাজিক জানেন। আমি ম্যাজিক করতে দেখিনি, কিন্তু মন্দা বলেছে ওর ইস্কুলে বছরের প্রথম প্রথম মেলাই ছেলেপুলে থাকে, আর শেষের দিকে গুটিকতক টিমটিম করে। এদিকে মাস্টারমশাইয়ের ছাগলের ব্যাবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ কিন্তু বাবা সুবিধের কথা নয়। ছেলেগুলো যায় কোথা? মাস্টারমশাইয়ের চেহারাটাও ভাই কীরকম যেন! সরু-ঠ্যাং পেন্টেলুন উনি কক্ষনো ধোপর বাড়ি দেন না। সাদা-কালো চৌকোকাটা কোট পরছেন তে পরছেনই! আবার চুলগুলো সামনের দিকে খুদে খুদে, পিছনের দিকে লম্বা মতন, মধ্যিখানে দাঁড় করানো! মাঝের গোঁফ বেঁটেখাটো, পাশের গোঁফ ঝুলে ঝুলো! ওঁর জুতোগুলো কে জানে বাব কীসের চামড়া, কীসের তেলে চুবিয়ে, কীসের লোম দিয়ে সেলাই করা! ও বাবাগো, মাগো! ইচ্ছে করে ওঁর ইস্কুলে কে যাবে! মান্‌কে স্বচক্ষে দেখেছে, প্রথম সপ্তাহে ঘরের ভিতর সাতটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে, আর ঘরের বাইরে দুটো ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই গা নাচাচ্ছেন!পরের সপ্তাহে মাকে আবার দেখেছে ঘরের ভিতর ছটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে তিনটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই জিভ দিয়ে দাঁতের ফোকর থেকে পানের কুচি বের কচ্ছেন। আবার তার পরের সপ্তাহে হয়তো দেখবে ঘরের ভিতর পাঁচটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে, আর ঘরের বাইরে চারটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই সেফটিপিন দিয়ে কান চুলকোচ্ছেন! শেষটা হয়তো ঘরের দরজায় তালা মারা থাকবে, আর ঘরের বাইরে ন-টা ছাগল নটে চিবিয়ে দিন কাটাবে! মাস্টারমশাই খাড়ায় শান দেবেন!

তা ছাড়া সেই যে বিভু আরশুল্লা পুষত, এবার গুবরেপোকাও খেয়েছিল, সে বলেছে সে দেখেছে– মাস্টারমশাইয়ের বাস্কে হলদেটে তুলোট কাগজে লাল দিয়ে লেখা খাতা আছে, সে লাল কালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে! ওঁর লেবু গাছে মাকড়সারা কেন জানি জাল বোনে না; পেঁপে গাছে সেই গোল-চোখ চকচকে জন্তু নেই, দেয়ালে টিকটিকি নেই। একটা হতে পারে মাস্টারমশাইয়ের রোগা গিন্নি মোটা বাঁশের ডগায় ঝটা বেঁধে দিনরাত ওত পেতে থাকেন। কিন্তু কিছু বলা যায় না! মন্দা তো ওবাড়ি কোনোমতেই যায় না, মেজোও বাড়ির ছায়াটি মাড়ায় না, আর ছোটো ছেলে ধনা, তার তোওবাড়ির হাওয়া গায়ে লাগলেই সর্দি কাশি হয়ে যায়। রামশরণ পর্যন্ত বাড়ির কুল খায় না, গুঁড়িয়ার মা শজনেডাঁটা নেয় না!

মা কিন্তু ওদের কুমড়োডাঁটা দিব্যি খান; আর বড়োমামা তো ওঁরই দাদা, ওই একই ধাত! ওঁরা চমৎকার গল্প বলতে পারেন, কিন্তু ভূত কী ম্যাজিক, কী মন্তর-পড়া এসব একেবারে বিশ্বাস করেন না! কে জানে কোনদিন হয়তো কানে ধরে ওইইস্কুলেই আমাকে ভরতি করে দেবেন, আর শেষটা কি সারাজীবন ব্যা-ব্যা করে নটে চিবুবঃ ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে বড়োমামা হয়তো চটি পায়েই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখবেন, পাথরের উপর শিং ঘষে শান দিচ্ছি! কেঁউ কেঁউ, ফেঁৎ ফোৎ!– কান্না পেয়ে গেল ভাই।

অ্যাদ্দিনে তোমায় লিখছি ভাই, আর হয়তো লেখা হবে না। দিব্যি টের পাচ্ছি দিন ঘনিয়ে আসছে। বড়োমামা যখন-তখন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁকে বিশ্রী ফ্যাচরফ্যাচার হাসেন। বুঝছি গতিক ভালোনয়। দু-একবার তিন তলার ছাদে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে ডেকে দেখেছি, সে আমার ঠিক হয় না। কেউ যখন দেখছে না গোটাকতক দুব্বো ঘাস চিবিয়ে দেখেছি– বদ খেতে, তাতে আবার ছোট্ট শুয়ো পোকা ছিল! খোনকে বলেছি গলায় দড়ি বেঁধে একটু টেনে বেড়াতে, ও কিন্তু রাজি হল না। এদিকে অভ্যেস না থাকলে কী যে হবে তাও তো জানি না!

এইসব নানা কারণে এতকাল চিঠি লিকতে পারিনি, বুঝতেই তো পারছ।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আর তর সইল না। কেডস পায়ে দিয়ে সুটসুট মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বেড়া টপকে, ছাগলদড়ি ডিঙিয়ে, জানলার গরাদ খিমচে ধরে, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে চিংড়িমাছের মতন ডান্ডার আগায় চোখ বাগিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি মারলাম।

দেখলাম মাস্টারমশাই গলাবন্ধ কোট খুলে রেখে মোড়ায় বসে হুঁকো খেতে চেষ্টা করছেন, আর গিন্নি মাটিতে বসে কুলো থেকে খাবলা খাবলা শুকনো বড়ি তুলছেন– কোনটা আস্ত উঠছে, গিন্নি হাসছেন; কোনটা আধখাচড়া উঠছে, গিন্নি দাঁত কিড়মিড় করছেন। আর মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙেছেন বসে সমস্তক্ষণ বকবক করছেন ভাই, বড়ো ভালো লাগল।

কিন্তু আনন্দের চোটে যেই খচমচ করে উঠেছি, মাস্টারমশাই চমকে বললেন, ওটা কী রে? ভাবলুম এবার তো গেছি! কান ধরে ঝুলিয়ে ঘরে টেনে আনলেন,নখ দিয়ে খিমচে দিয়ে গিরগিটির মতন মুখ করে বললেন-ও বাঁদর! বললুম, আজ্ঞে সার, ছাগল বানাবেন না স্যার! বললেন, বাঁদর আবার কবে ছাগল হয় রে? গিন্নিও ফিসফিস করে যেন বললেন, ওটিকে রাখো, আমি পুষব।

ভয়ের চোটে কেঁদে ফেললুম। গিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে শিং আছে কিনা দেখে বললেন, তোমার মতন আমার একটি খোকা ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, তার কী হল? বললেন, তার এখন দাড়ি গজিয়েছে। বলে বড়ো বড়ো বাতাসা খেতে দিলেন। তারপর বাড়ি চলে গেলাম। জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না, দাড়ির সঙ্গে সঙ্গে খুরও গজিয়েছিল কি না।

ইস্কুলের কথা এখনও কিছু ঠিক হয়নি, এই ফাঁকে তোমায় লিখছি। এ চিঠির আর উত্তর দিয়ো। দেখা করতে চাও তো খোঁয়াড়ে-টোয়াড়ে খোঁজ কোরো। ইতি–
তোমার গণশা

গুপে

ও পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে ফিরতে বড্ড সন্ধ্যে হয়ে গেল। আমি আর গুপে দু-জনে অন্ধকার দিয়ে ফিরছি খেলার গল্প করতে করতে, এমন সময় গুপে বলল– ওই বাঁশঝাড়টা দেখেছিস? বললুম কই? সে বললে, ওই যে হোথা। মনে হয় ওখানে কী একটা লোমহর্ষক ব্যাপার ঘটেছিল, না?

গুপের দিকে তাকালুম, এমন সময়ে এমন কথা আশা করিনি।

আমি বললুম, গুপে, তুই কিছু খেয়েছিস নাকি?

গুপে বলল, চোখ থাকলেই দেখা যায়, কান থাকলেই শোনা যায়। আমি বললুম, নিশ্চয়ই। মাথা না থাকলে মাথা ব্যথা হবে কী করে? গুপে বলল, তুই ঠিক আমার কথা বুঝলি না! দেখবি চল আমার সঙ্গে।

বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। পেঁচোর মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেও সন্ধেবেলা মাছ কিনে ফিরছে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে আসছে, এমন সময় কানের কাছে শুনতে পেল, পেঁ-চোঁর মাঁ, মাঁছ দেঁ! পেঁচোর মা হনহনিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু সেও সঙ্গে চলল দে বঁলছি, মাঁছ দেঁ!

গুপে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা লোমহর্ষণ সিরিজের বিকট বই পড়ত। আমায় একটা দিয়েছিল, তার নাম তিব্বতি গুহার ভয়ংকর কি ওই ধরনের একটা কিছু। আমায় বলেছিল, দেখ, রাত্রে যখন সবাই ঘুমুবে, একা ঘরে পিদিম জ্বেলে পড়বি। দেয়ালে পিদিমের ছায়া নড়বে, ভারি গা শিরশির করবে, খুব মজা লাগবে। আমি কিন্তু এক বার চেষ্টা করেই টের পেয়েছিলুম ও-রকম মজা আমার ধাতে সইবে না। আজ আবার এই!

গুপে বললে, কী ভাবছিস? চল্ দেখি গিয়ে। বাবার কে এক বন্ধু একবার দিল্লিতে একটা সেকেলে পুরোনো বাড়িতে একটা শুকনো মরা বুড়ি আর এক ঘড়া সোনা পেয়েছিলেন। দেখেই আসি-না। হয়তো গুপ্তধন পোঁতা আছে। যক্ষ পাহারা দিচ্ছে। তারার আলোয় দেখলুম, তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে। তাই দেখেই আমার ভয় করতে লাগল– আবার বাঁশঝাড়ের যক্ষ!

কিন্তু কী করি, গুপেটা আঠালির মতন লেগে রইল। অগত্যা দু-জনে অন্ধকার ঘন ঝোঁপের মাঝ দিয়ে আস্তে আস্তে চললুম। গুপে আবার কী-একটা মস্তকহীন খুনির গল্প শুরু করল।

কবে নাকি কোন পুরোনো ডাকবাংলোয় কেউ রাত কাটাতে চাইত না। লোকে বলত, যারাই থেকেছে রাতারাতি মরে গেছে। কেউ কিছু ধরতে পারে না। বাবুর্চি বলে, হাম তো মুরগি পকাকে আউর পরটা সেঁককে সাবকো খিলাকে ওই হামারা কোঠি চালা গিয়া। রাতমে কভি ইধার আতা নেই, বহুত গা ছমছম করতা, আউর যে সব কাণ্ড হোতা যো মালুম হোতা আলবত শয়তান আতা হ্যাঁয়।

শেষে কে-এক সাহসী, মস্ত এক কুকুর নিয়ে বন্দুকে গুলি ভরে বসে রইল, কী হয় দেখবে। কোথাও কিছু নেই, ঘর-দোর ঝাড়াপোঁছা পরিষ্কার। আশ্চর্য, দেয়ালে একটা টিকটিকি কী ঘুমন্ত মাছি অবধি নেই! অনেক যখন রাত, লোকটা আর জেগে থাকতে পারছে না, দেশলাই বের করছে, সিগরেট খাবে, কুকুরটাও ঝিমোচ্ছে, এমন সময় পাশের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। সঙ্গেসঙ্গে আলোটাও কমে এল…

গল্প বলতে বলতে আমাদের চারিদিকের আলোও কমে এসেছিল, আর গুপের স্বর নীচু হতে হতে একেবারে ফিসফিসে দাঁড়িয়েছিল। আর তার চোখ দুটো আমার কপাল ছাদা করে ভিতরের মগজগুলোকে ঠান্ডায় জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

আমার গলা শুকিয়ে এল, কান বোঁ বোঁ করতে লাগল। নিশ্চয়ই মূৰ্ছা যেতাম, তারপর সেখান থেকে টেনে আনো রে, কিন্তু হঠাৎ চেয়ে দেখি সামনেই বাঁশঝাড়। দেখে থমকে দাঁড়ালুম, অন্য একটা ভয় এসে কাঁধে চাপল। বাঁশঝাড়ের মধ্যে স্পষ্ট শুনলুম, খপখপ শব্দ– যেন বুড়ো সাপ নিবিষ্টমনে একটার-পর-একটা কোলাব্যাঙ গিলে যাচ্ছে।

গুপের দিকে তাকালুম, জায়গাটার থমথমে ভাব নিশ্চয়ই সেও লক্ষ করেছে। তার মুখটা অন্ধকারে সাদা মড়ার মতন দেখাচ্ছিল। জায়গাটাতে হাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঝিঁঝি পোকার ডাক ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না।

আমার মনে হতে লাগল আর কখনো কি বাড়ি যাব না? পিসিমা আজ মালপো ভেজেছেন। সে কি দাদা একা খাবে? মাস্টারমশাইও এতক্ষণে এসে বসে রয়েছেন, হয়তো শক্ত শক্ত অঙ্ক ভেবে রাখছেন। আঃ, গুপেটা কেন জন্মেছিল?

গুপে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে বলল, চল্ কাছে যাই। বাঁশঝাড়গুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল তারার আলোয় মধ্যিখানটা একেবারে ফাঁকা। আশেপাশে ঘন বিছুটি পাতা, সে জায়গাটা শুকনো ঘাসে ঢাকা। থেকে থেকে দু-একটা বুনন কচু গাছ, বিষম ভুতুড়ে গাছ।

তারপর চোখ তুলে আর যা দেখলাম, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মনে হল ছেলেবেলায় এক বার মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি ঘরের আলো নিবে গেছে, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আর তার মধ্যে খসখস শব্দ, যেন কীসে বসে বসে শুকনো কীসের ছাল ছাড়াচ্ছে! এত কথা মনে করবার তখন সময় ছিল না, কারণ আবার ভালো করে দেখলাম দুটো সাদা জিনিস, মানুষের মতন, কিন্তু মানুষ তারা হতেই পারে না। জায়গাটা যে শাকচুন্নির আস্তানা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। স্পষ্ট একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধও নাকে এল। অন্ধকারে দেখলাম দুটো খুব লম্বা আর খুব রোগা কী, আপাদমস্তক সাদা কাপড় জড়ানো, মাথায় অবধি ঘোমটা দেওয়া, নড়ছে চড়ছে। দেখলাম তাদের মধ্যে এক জন ছোট্ট কোদাল দিয়ে নরম মাটি অতি সাবধানে খুঁড়ছে, অন্য জন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ল জ্যাঠামশাই একবার কলকাতায় পুরোনো চক-মেলানো বাড়িতে ছিলেন, সেখানে একদিন দুপুররাতে দিদিরা ভূত দেখেছিল– কলতলায় গোছ গোছ বাসন মাজছে। তারপর থেকেই তো ছোড়দির ফিটের রোগ। কিছুই না, ভূতের কুদৃষ্টি!

আবার তাকিয়ে দেখি খোঁড়া শেষ হয়েছে, গভীর গর্ত মনে হল। এতক্ষণ অত্যন্ত অস্বায়াস্তি বোধ হচ্ছিল। ঘাড়ে মশা কামড়াচ্ছিল, চুলের মধ্যে কাঠপিঁপড়ে হাঁটছিল, আর পা বেয়ে কী একটা প্রাণপণে উঠতে চেষ্টা করছিল। গুপের পাশে তো অনেকক্ষণ থেকে একটা গোসাপের বাচ্চা ওত পেতে বসেছিল। গুপে দেখছিল না, আমি কিছু বলছিলাম না। ওকে কামড়াক, আমার ভালোই লাগবে।

সেই সাদা দুটো এবার উঠে দাঁড়িয়ে কী-একটা ভারী জিনিস অন্ধকার থেকে টেনে বের করল। গর্তের পাশে একবার নামাল, মনে হল ছালায় বাঁধা মাগো কী!

একটা নতুন কথা মনে করে ভয়ে কাদা হয়ে গেলাম। এরা হয়তো ভূত নয়, খুনি-ডাকাত, কাকে যেন মেরে ছালায় বেঁধে গভীর অন্ধকারে বাঁশঝাড়ে নিরিবিলি পুঁতে বাড়ি চলে যাবে। কেউ টের পাবে না।

ভাবলাম নিশ্বাস অবধি বন্ধ করে থাকি। তারা এদিকে কালো জিনিসটাকে পুঁতে এ ওর দিকে তাকিয়ে বিশ্রী ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে লাগল কালো মুখে সাদা লম্বা লম্বা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। তারপর তারা অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল।

সে-সন্ধ্যের কথা কাউকে বলতে সাহস হয়নি, বিশেষত গুপে যখন বাড়ির দরজার কাছে এসে আস্তে আস্তে বলল, কাউকে বলিস না, বুঝলি? কাল আবার যাব, এর মধ্যে নিশ্চয় সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার জড়িত আছে।

আমি কথা না বলে মাথা নাড়লাম। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না জ্যান্ত বাড়ি ফিরছি!

পরদিন মনে করলাম আজ কিছুতেই গুপের কাছে যাব না। এ তো ভারি আহ্লাদ! উনি শখ করে আগাড়ে-বাগাড়ে ভূততাড়িয়ে বেড়াবেন আর আমায় ওঁর সঙ্গে ঘুরে মরতে হবে! কেন রে বাপু! শাকচুন্নি যদি অতই ভালো লাগে– একাই যা না। আমায় কেন? অনেক করে মন শক্ত করে রাখলুম, আজ কোনোমতেই যাব না। এমনকী মেজোদাদামশাইয়ের বাড়ি চণ্ডীপাঠ শুনতে যাব, তবু বাঁশঝাড়ে যাব না।

সারাদিন গুপের ত্রিসীমানায় গেলুম না। ক্লাসে ফাস্ট বেঞ্চে বসলুম। টিফিনের সময় পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ব্যাকরণ বুঝতে গেলুম। এমনি করে কোনোমতে দিনটা কাটল। কিন্তু বাড়ি ফেরবার পথে কে যেন পিছন থেকে এসে কাঁধে হাত দিল! আঁতকে উঠে ফিরে দেখি গুপে! সে বললে মনে থাকে যেন সন্ধ্যে বেলা!

হঠাৎ বলে ফেললুম, গুপে, আমি যাব না।

সে একটু চুপ করে থেকে বললে, ও বুঝেছি, ভয় পেয়েছিস। তা তুই বাড়ি গিয়ে দিদিমার কাছে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমির গল্প শোন গে, আমি কেলোকে নিয়ে যাব। তোর চেয়ে ছোটো হলেও তার খুব সাহস।

বড়ো রাগ হল, বললুম, ওরে গুপে, সত্যিই কি ভয় পেয়েছি, ঝোঁপ-জঙ্গলে সাপখোপের বাসা তাই ভাবছিলুম। আচ্ছা, না হয় যাওয়াই যাবে।

গুপে বলল, তাই বল!

আবার চারদিক ঝাঁপসা করে সন্ধ্যে এল। মাঠ থেকে ফিরতে গুপে ইচ্ছে করে দেরি করল। সূর্য ডুবে গেল, আমরাও বাঁশঝাড়ের দিকে রওনা হলুম। আজ আমি প্রাণ হাতে নিয়ে এসেছি, মারা যাব তবু শব্দটি করব না! বাঁশঝাড়ের কাছে এসেই কেমন গা-কেমন করতে লাগল। সত্যিই জায়গাটাতে ভূতে আনাগোনা করে। এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে এই মশাওয়ালা বাঁশঝাড়ে আড্ডা গাড়বার আমি কোনো কারণ ভেবে পেলাম না।

আজ তারার আলো একটু বেশি ছিল, সেই আলোতে দেখতে পেলাম, তারা আবার এসেছে। ঠিক মানুষের মতন দেখতে, তবে পা উলটো কিনা বুঝতে পারলাম না। মনে হল এদের উলটো হয়ে গাছে ঝোলা কিছুই আশ্চর্য নয়।

তারা এ ওর দিকে তাকিয়ে শকুনের মতন হাসতে লাগল। তারপর কোদাল বের করে ঠিক সেই জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। দম আটকে আসছিল। কে জানে কী বীভৎস ভোজের আশায় ওরা এসেছে! খুঁড়ে সেই কালো জিনিসটা টেনে তুলল, দেখলুম ছালা নয়, চিত্তির-আঁকা কলসি। ভাবলুম গুপ্তধন।

তারা কলসির মুখ খুলতেই আবার সেই দুর্গন্ধ!নিশ্চিত কিছু বিশ্রী জিনিস আছে ওর মধ্যে। কিন্তু তারা খাবার কোনো আয়োজন করলে না।

এক জন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট খুদির মায়ের গলায় বলল, হ্যাঁলা বাগদিবউ, পদিপিসি ঠিকই বলেছিল, দেখু-না বাঁশঝাড়ে পুঁতে শুঁটকিগুলো কেমন মজেছে!

গুপে একটা প্রচণ্ড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শিউরে উঠল। বলল, চল, পৃথিবীতে দেখছি অ্যাডভেঞ্চার বলে কিছু নেই! আমি তৎক্ষণাৎ বাড়িমুখো রওনা দিলাম।

গুপে বাড়ির কাছে এসে বলল, কোথায় মড়া, কোথায় গুপ্তধন আর শুঁটকিমাছ! আর কারু কাছে কিছু আশা করব না। আমি কিন্তু ব্যাপারটাতে খুশি হলাম।

কিছু বললাম না, কেবল মনে মনে সংকল্প করলাম, খোক্কসের হাতে বরং পড়ব, তবু গুপের হাতে কখনো নয়।

ঘোতন কোথায়?

সকালে খুব দেরি করে উঠলাম। উঠেই গায়ের চাদরটা এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারই উপর দাঁড়ালাম। চটি খুঁজে পেলাম না। খালি পায়ে স্নানের ঘরে গেলাম। দাঁত মাজলাম না, তাতে যে সময়টুকু বাঁচল সে সময়টা কলের মুখ টিপে ধরে পিচকিরির মতন দেয়ালে-টেয়ালে জল ছিটোলাম। খানিকটা আবার বাবার তোয়ালের উপরও পড়ল দেখলাম। তারপর চোখে-মুখে জল দিয়ে, মুখ-হাত মুছে সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ঘরের কোনায় ছুঁড়ে মারলাম। তারপর একমুখ জল ভরে নিয়ে, শোবার ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে নীচে রাস্তায় একজন বুড়ো লোকের গায়ে পু চূ করে ফেলেই তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে চুলটাকে খুব যত্ন করে আঁচড়াতে লাগলাম।

ততক্ষণে নীচের তলায় মহা শোরগোল লেগে গেছে। পিসিমা দুধের বাটি নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?মা আমার চটি-জোড়া নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?আর সব থেকে বিরক্ত লাগল শুনে যে মাস্টারমশাইও সেইসঙ্গে ম্যাও ধরেছেন: প্রশান্তকুমার কি আজ পড়বে না?ভীষণ রাগ হল। জীবনে কি আমার কোনো শান্তি নেই? এই সক্কাল বেলা থেকে সবাই মিলে পেছু নিয়েছে!

পিসিমাকে সিঁড়ির উপর থেকে ডেকে বললাম– দুধ খাব না। সিঁড়ির নীচে মাকে এসে বললাম–চটি পরা ছেড়ে দিয়েছি। বসবার ঘরে গিয়ে গলা নীচু করে মাস্টারমশাইকে বললাম– মা বলে দিয়েছেন, আজ আমার পেট ব্যথা হয়েছে, আজ আমি পড়ব না। তারপর একেবারে তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, সারাটা সকাল রোয়াকে রোদ্দুরে বসে বসে পা দোলালাম, আর রাস্তা দিয়ে যত ছ্যাকড়া গাড়ি গেল তার গাড়োয়ানদের ভ্যাংচালাম।

দশটা বাজতেই উঠে গিয়ে বই-টই কতক কতক গুছিয়ে, আর কতক কতক খুঁজেই পাওয়া গেল না বলে ফেলে রেখে, ঝুপ ঝুপ করে একটু স্নান করে নিয়ে, খুব যত্ন করে চুলটা ফের আঁচড়ে নিয়ে খাবার ঘরে গেলাম।

মা জলের গেলাস দিতে দিতে বললেন: হারে মাস্টারমশাই কখন গেলেন। শুনতে পেলাম না তো?

আমি সত্যি করেই বললাম: সে ক-খ-ন চলে গেছেন কেবা তার খবর রাখে!

ভাত কতক খেলাম, কতক চার পাশে ছড়ালাম, কতক পুসিকে দিলাম, আর কতক পাতে পড়ে রইল। মাছটা খেলাম, ডাল খেলাম, আর ঝিঙে, বেগুন ইত্যাদি রাবিশগুলো সব ফেলে দিলাম। মা রান্নাঘর থেকে দেখতেও পেলেন না। ট্রামভাড়াটা পকেটে নিয়ে মাকে বললাম: মা যাচ্ছি। এই পর্যন্ত প্রায় রোজই যেমন হয় তেমনই হল। অবিশ্যি মাস্টারমশাইর ব্যাপারটা রোজ হয় না, তাই যদি হত তাহলে বাবা-টাবাকে বলে মাস্টারমশাই এক মহাকাণ্ড বাধাতেন সন্দেহ নেই।

কিন্তু এরপর থেকে সেদিন সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। মনে আছে ট্রামে উঠে ডান দিকের একটা কোনা দেখে আরাম করে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আর খালি মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে দেখছে। একবার ট্রামসুদ্ধ সবাইকে দেখে নিলাম, বুঝতে পারলাম না। কে। তারপর আবার যেই বাইরে চোখ ফিরিয়েছি আবার মনে হল কে আমাকে এমন করে দেখছে। যে আমার খুলি ভেদ করে ব্রেন পর্যন্ত দেখে ফেলছে। তাইতে আমার ভারি ভাবনা হল। এমনিতেই নানান আপদ, তার উপর আবার ব্রেনের ভিতরকার কথাগুলো জেনে ফেললে তো আর রক্ষে নেই।

কিছুতেই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা ঘুরিয়ে ট্রামের প্রত্যেকটি লোককে ভালো করে দেখলাম।

এবার লক্ষ করলাম ঠিক আমার সামনে কালো পোশাক পরা একটি অদ্ভুত লোক। তার মুখটা তিনকোনা মতন, মাথায় গাধার টুপির মতন কালো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে লাল নীল হলদে সবুজ চড়াবড়া তারা-চাঁদ আঁকা, পায়ে শুড়ওয়ালা কালো জুতো, দুই হাঁটুর মাঝে হাতে ঝুলছে একটা সন্দেহজনক কালো থলে।

এরকম লোক সচরাচর দেখা। যায় না। অবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ভীষণ চমকে উঠলাম। দেখলাম মাথায় টুপি নয়, চুলটাই কীরকম উঁচু হয়ে বাগিয়ে আছে। গায়ে সাধারণ ধুতির উপর কালো আলোয়ান, তাতে ট্রামের ছাতের কাছের রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে রং বেরং। হয়ে আলো পড়ছে। আর পায়ে নাকতোলা বিদ্যাসাগরি চটি। খালি হাতের থলেটা সেইরকমই আছে।

কীরকম একটু ভয় ভয় করতে লাগল।

লোকটা খুশি হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল: অতই যদি খারাপ লাগে ইস্কুলে যাও কেন? বড়োরা যখন এতই অবুঝ তাদের কথা মেনে নাও কেন?

আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম: তবে কী করব?

লোকটি বলল: কী করবে? তাকিয়ে দেখো নীল আকাশে ছোটো ছোটো সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছেরা সব ভিজে পাতায় সোনালি রঙের রোদ মেখে বসে আছে। গড়ের মাঠের ধার ঘেঁষে পুকুরটাকে দেখো, ঘোর সবুজ জলে টলমল করছে। আর, টের পাচ্ছ দখিন হাওয়া দিচ্ছে?

তারপর লোকটা তার বড়ো বড়ো ফুটোওয়ালা নাকটা তুলে বাতাসে কী যেন শুকে বলল: , পেঙ্গুইনের গন্ধ পাচ্ছি। গড়ের মাঠের ওপারে, গঙ্গার ওপারে, বঙ্গোপসাগরের ওপারে, ভারত-মহাসাগরের ওপারে, কোনো একটা বরফজমা দ্বীপের উপর সারি সারি পেঙ্গুইন চলাফেরা করছে, তাদের মুখেচোখে রোদ এসে পড়েছে, ঠোঁট দিয়ে ডানা পরিষ্কার করছে, দু-একটা সাদা নরম পালক উড়ে গিয়ে এখানে ওখানে পড়ছে– দেখতে পাচ্ছ না? কী আর বলব, তখন আমি যেন স্পষ্ট ওইসব দেখতে পেলাম, আর আমার সমস্ত মনটা আনচান করে উঠল। মনে হল এমন দিনে কি কেউ ইস্কুলে যায়? এমন পৃথিবীতে কোনো দিনও কেউ ইস্কুলে যায়?

আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আর একটু আস্তে আস্তে বলল: জানো ভোররাতে বড়ো বড়ো চিংড়ি মাছ ধরতে হয়, তার এক-একটার ওজন এক সেরের বেশি। দু-দিন ধরে সমুদ্রের নীচে দড়ি-বাঁধা সব হাঁড়ার মতন ডুবিয়ে রাখতে হয়। আর ভোরবেলা গিয়ে ওই দড়ি ধরে টেনে হাঁড়াসুদ্ধ চিংড়ি তুলতে হয়। তারপর বাড়ি ফেরবার সময় আস্তে আস্তে সকাল হয়। তুমি তো জান যে পুব দিকে সূর্য ওঠে, কিন্তু একথা জান কি যে পশ্চিম দিকের আকাশটা আগে লাল হয়, তারপর পুব দিকে সূর্য ওঠে। তারও পর পশ্চিম দিকের লাল রং মিলিয়ে যায়, আর সমস্ত আকাশটা ফিকে পোড়া ছাইয়ের মতন হয়ে যায়। তারাগুলোকে নিবে যেতে কখনো দেখেছ কি?

আমার মনে হল আমার নিশ্চয় এখানে কিছু বলা উচিত কিন্তু আমার জিভ দেখলাম শুকিয়ে কাঠের মতন হয়ে গেছে। কিছু আর বলা হল না। খালি মনটা হু হু করতে লাগল। সে লোকটা আমার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে বলল: কীজন্য কলকাতায় পড়ে থাক আর ইস্কুলে যাও? জান রবিঠাকুর ইস্কুল পালিয়ে পালিয়ে অত বড়ো কবি হয়েছিলেন! আর জান, সাঁওতাল পরগনায় যখন মহুয়া গাছের ফল পাকে, তার গন্ধে জঙ্গলসুদ্ধ সব জিনিসে নেশা লেগে যায়। আর বনের ভাল্লুকগুলো মহুয়া খেয়ে খেয়ে নেশায় বেহুঁশ হয়ে গাছতলায় পড়ে থাকে। পরদিন সকালে কাঠুরেরা তাদের ওইরকমভাবে দেখতে পায়। তুমি জানতে যে মহুয়া ফল খেলে নেশায় ধরে? আমার তখন মনে হল দিনের-পর-দিন ইস্কুলে গিয়ে আমি বৃথাই জীবন নষ্ট করছি। ওই লোকটা নিশ্চয় কখনো ইস্কুলেই যায়নি।

হঠাৎ দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে ফিরে অম্লানবদনে বলল, এসো৷ এমন করে বলল যেন বহুক্ষণ থেকে ওইরকমই কথা ছিল। ও-ও নামবে আর সেই সঙ্গে আমিও নামব।

আমি নামলাম। যদিও আমি জানতাম অচেনা লোক ডাকলে সঙ্গে যেতে নেই। যদিও দিনের-পর-দিন পিসিমা বলেছেন– দুষ্টু লোকেরা বলে: মন্ডা খাবি? সার্কাস দেখবি? এই সব বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে হয় আসামের চা বাগানে চালান দেয়, নয় ঘোর জঙ্গলে মা কালীর কাছে ঘ্যাচ করে বলি দেয়।

তবুও আমি নামলাম। কারণ রোজ রোজ ওই ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, পড়া তৈরি করা, স্নান করে ভাত খাওয়া, ইস্কুলে যাওয়া, ইস্কুল থেকে সারাটা দিনমান নষ্ট করে বিকেলে আবার বাড়ি ফেরা, সেই খাওয়া, সেই শোয়া– ওইরকম দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর বছর– যতদিন না অনিশ্চিত ভবিষ্যতে, কবে আমি বড়ো হয়ে ভালো চাকরি করে এইসব জিনিসের ভালো ফল দেখাব-ও আর আমার সহ্য হচ্ছিল না।

বইগুলো ট্রামের কোনায় আমার জায়গায় পড়ে রইল। আমি সেই লোকটার সঙ্গে গেলাম।

তখন মোড়ের ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজেছে।

সে আমাকে একটা চায়ের দোকানের ভিতর দিয়ে পিছন দিকের ছোটো একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে একটা টিনের চেয়ারে বসিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। একটু পরেই সে আবার ফিরে এল, সঙ্গে একটা একচোখা লোক, অন্য চোখটার গায়ে একটা সবুজ তাপ্পি মারা। একটা পা আছে, আরেকটা পা কাঠের তৈরি।

এই লোকটা আমার দিকে একচোখ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল: কী হে ছোঁকরা, পড়াশুনোর উপর নাকি এমনই ঘেন্না ধরে গেছে যে একেবারে সেসব ত্যাগ করে এসেছ? তার গলাটা এমন কর্কশ আর চেহারাটাও এমন বিশ্রী যে আমি সত্যি ভারি ভড়কে গেলাম।

কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকাতেই সে গ্রামোফোনের চাকতির মতো বলে যেতে লাগল– পড়াশুনো করে কী হবে? জান, আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যেসব বিরাট বিরাট নদী আছে তার ধারে ধারে কুমিরেরা আর হিপ্পোপটেমাসরা শুয়ে শুয়ে দিন কাটায় আর লম্বা লাল ঠ্যাঙে ভর দিয়ে গোলাপি রঙের ফ্ল্যামিংগো পাখিরা রোদ পোয়ায়? আর ওইসব জঙ্গলের মধ্যে এমন বিশাল বিশাল অর্কিড জাতের ফুল ফোটে যে তার মধ্যে একটা মানুষ দিব্যি আরামে শুয়ে থাকতে পারে?

বুঝতে পারছিলাম এ লোকটা জাদু জানে। কারণ তক্ষুনি আমার ভয়টয় কোথায় উড়ে গেল– অন্য লোকটাকে জোর গলায় বললাম: হাঁ, সেসব চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এসেছি। লোকটা হাসল, বলল: চিরদিন বড়ো দীর্ঘকাল হে ছোঁকরা চিরদিনের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু তোমার সাহস আছে, উৎসাহ আছে, তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। স্বাস্থ্যটাও তো ভালো দেখছি। আশা করি বাড়ির জন্য মনের টান ইত্যাদি কোনো দুর্বলতা নেই?

হঠাৎ মনে হল মা এতক্ষণে স্নানের জোগাড় করছেন, বাবা আপিস গেছেন, এবং দু-জনেই মনে ভাবছেন আমি বুঝি ইস্কুলে গেছি। গলার কাছটা সবে একটু ব্যথা করতে শুরু করেছিল এমন সময় কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: ইস্কুলের বাইরে, বাড়ির বাইরে, কলকাতা থেকে বহুদূরে নরওয়ের উত্তরে চাঁদনি রাতে হারপুন দিয়ে তিমি শিকার হয়। তিমির গায়ে হারপুন বিঁধলে তিমি এমনি ল্যাজ আছড়ায় যে সমুদ্র তোলপাড় হয়ে যায়। কত নৌকো ডুবে যায়। আবার তিমি মরে গিয়ে যখন উলটে গিয়ে ভেসে ওঠে দেখবে তার বুকের রঙটা পিঠের চেয়ে ফিকে। আর, জান, ইংল্যান্ডে শীত কালে সোয়ালো পাখিরা থাকে না। তারা দলে দলে উড়ে স্পেনে চলে যায়, আর যেই শীত কমে আসে আবার তারা দলে দলে সমুদ্রের উপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে ফিরে আসে। এসে দেখে তাদের আগেই শীতের বাতাসকে তুচ্ছ করে ড্যাফোডিল ফুলরা ফুটে গেছে।

আমার মন পাখির মতন উড়ে যেতে চাচ্ছিল।

একচোখা বলল: কিন্তু শুধু তিমি মারলে হবে না। তার বহু অসুবিধাও আছে, বহু দূরও। এই কাছাকাছি মানুষ-টানুষ মারতে পারবে? পরে যাবে আফ্রিকা, নরওয়ে, আলাস্কা– আপাতত অন্ধকার রাত্রে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বাঁকা ছুরি হাতে নিয়ে ঘচ করে সেটাকে লোকের বুকে আমূল বসিয়ে দিতে পারবে? যেমন রক্তের নদী ছুটবে তুমিও হো হো করে রাত কাপিয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে। উঠবে? মাথায় বাঁধা থাকবে লাল রুমাল?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। সেই কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: উত্তর মেরুতে সিল মাছেরা বরফের মধ্যে বাসা করে—

আমি বললাম: কুড়ি বছর পরে উত্তর মেরুর কথা শুনব, এখন আমি ইস্কুলেই বরং যাই, মাথায় আমি লাল রুমাল কিছুতেই বাঁধতে পারব না।

লোকটা বলল: কে জানে ভুল করছ কি না?

আমি ততক্ষণ চায়ের দোকানের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে ট্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। প্রথম যে ট্রাম এল তাতেই উঠে পড়লাম। উঠেই ভীষণ চমকে গেলাম। দেখলাম ট্রামের কোনায় ডানদিকের সিটে আমার বইগুলো পড়ে রয়েছে। কেমন করে হল বুঝতে না পেরে ফুটপাথে চায়ের দোকানের সামনে কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকালাম।

আবার মনে হল তার মাথায় গাধার টুপির মতো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে রং-বেরঙের চড়াবড়া আঁকা, আর পায়ে শুড়োলা কালো জাদুকরের জুতো।

সে আমাকে হাত তুলে ইশারা করে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। আর আমি মোড়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনও সাড়ে দশটাই বেজে রয়েছে।

চোর ধরা

নন্দর আজ বেজায় মন খারাপ। সেই সকাল থেকে সব জিনিসকে কীসে যেন পেয়েছে! ঘুম থেকে উঠেই ভোদাকে ঠ্যাঙাতে গিয়ে অত ভালো হকি স্টিকটার হ্যাঁন্ডেলের সুতো কতখানি এল খুলে! তায় আবার ভোদা হতভাগা এমনি চেঁচাল যে বড়োমামা এসে নন্দর কান পেঁচিয়ে মাথায় খটাং খটাং করে দুই গাঁট্টা বসিয়ে দিলেন।

তারপর, সেই দেয়ালে কাজলকালি দিয়ে কুকুর তাড়া করছে, মোটা লোটার ছবি আঁকবার জন্যে বাবা মন্টুর সঙ্গে সেই চমৎকার জায়গায় সেই মজার জিনিস দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। নন্দ আর কী বলে! ছি, মই-বা কী ভাবল বলো তো? নাঃ! বুড়োরা যে কেন পৃথিবীতে জন্মায় বোঝা যায় না!

আচ্ছা, অন্যদের বাড়ির লোকেরাও কি এমন হাঁদা? এরা কিছু বোঝে না। এই তো কালই দিদির নাগরাইয়ের শুড় পাকিয়ে দেবার জন্য দিদি চাটাল। আচ্ছা, শুড় পাকিয়ে কী এমন খারাপটা দেখাচ্ছিল? ভারি তো নাগরাই! এর। চেয়ে আর কোথাও চলে যাওয়া ভালো–ইজিপ্টে যেখানে নীল নদীর ধারে ফ্লেমিংগো পাখিরা মাছ ধরে খায়, আর মস্ত মস্ত কুমিররা বালির উপর রোদ পোহায়।নয় তো মানস সরোবরে যেখানে এক-শো বছরে একটা নীল পদ্মফুল ফোটে। সেজদা বলেছে, কাগজে আছে কারা নাকি ছোটো ছোটো ঘোড়ার পিঠে বোঁচকা বেঁধে, টিনের দুধ, বিস্কুট, কম্বল-টম্বল নিয়ে সেখানে যাচ্ছে।

কিংবা তাদের ছেড়ে নন্দ আরও উপরে যাবে, যেখানে লোমওয়ালা মানুষরা কীসের জানি রস খায়, সে খেলেই গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিংবা যাবার তো কত জায়গাই আছে!

খিদিরপুরের ডকেই যদি কাজ নেয় কে খুঁজে পাবে! সেই যে একবার নন্দ দেখেছিল, একটা পুলের তলায় ইট দিয়ে উনুন বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে কী বেঁধে খাচ্ছিল কারা সব, ডকের কুলি হবেও-বা। সেইরকম করে থাকবে। কিংবা যারা গান করে করে গায়ে গায়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের সঙ্গেও তো জুটে যাওয়া যায়। গোরুর গাড়ি নিয়ে মেলাতে মেলাতে বেড়ানো যাবে। কিন্তু তার আবার একটা অসুবিধে আছে। দিদিকে গান শেখাতে এসে গোপেশ্বরবাবু বলে গেছেন, কোকিলের ডিম ভেঙে খেলেও এ ছেলের কিছু হবে না।

গান করতে না পারুক, গোরুর গাড়ি তো চালাতে পারবে! হঠাৎ একটা ভীষণ সংকল্প করে নন্দ সটান উঠে একেবারে ঘোরানো সিঁড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

মা বলেছেন, খবরদার ও দরজা খুলবি নি। বিপদে পড়বি। কী বিপদ অনেক ভেবে নন্দ মাসিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। মাসিমা বলেছিলেন, ওরে বাবা! সে ভীষণ বিপদ!

কী ভীষণ? জিজ্ঞেস করাতে আবার বললেন, সিঁড়ির মোড়ে মোড়ে বেজায় হিংস্র লোকেরা নাকি বাঁকা ছুরি হাতে চকচকে চোখ করে ওত পেতে আছে সারা রাত, ভোর বেলা গঙ্গায় জাহাজের বাঁশিগুলো যেই বেজে ওঠে ওরাও কোথায় আবছায়াতে চলে যায়। নন্দ জানতে চাইল তারা কোত্থেকে এসেছে। মাসিমা বললেন, কেউ এসেছে জাভা থেকে, কেউ সানফ্রানসিস্কো, কেউ কাম্বোডিয়া থেকে। আউটরাম ঘাটের কাছে তাদের জাহাজ নোঙর দেওয়া আছে, জাহাজের পাশের রেলিং না-দেওয়া সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে রাত দুপুরে নেমে এসেছে, ভোর না হতেই আবার ফিরে গিয়ে জাহাজের নীচে অন্ধকার ঘরে প্রকাণ্ড উনুনে কয়লা পুরবে।

একবার অনেক রাতে নন্দ কোথা থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ঘরে ফিরছিল। তখন নিজের চোখে দেখেছিল ছোটো ছোটো টিমটিমে আলো নিয়ে কারা যেন ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করছে। তাই দরজার সামনে এসে নন্দ একবার থামল। বেশ রাত হয়েছে, বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে, কেমন অদ্ভুত একটা আওয়াজ হচ্ছে। হাওয়া তো রোজই দেয় আজকাল, কিন্তু এ-রকম তো কখনো মনে হয় না।

নন্দ দরজা খুলল, চামচিকের খোকার কান্নার মতন একটা শব্দ হল। একটা বড়ো সাইজের ঠ্যাঙে লোমওয়ালা মাকড়সা সড়সড় করে নন্দর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।

প্রথম সিঁড়িতে পা দেবার আগে নন্দ উপর দিকে তাকাল, যতদূর দেখা যায় সিঁড়ি ঘুরে পাঁচ তলার ছাদ পর্যন্ত উঠেছে, আর নীচের দিকে যতদূর দেখা যায় ঘুরে ঘুরে এক তলার শানবাঁধানো গলি পর্যন্ত নেমেছে।

সিঁড়ির রেলিংটা ক্যাঁ-কোঁ করে নড়ে উঠল, কার জুতো জানি চাপাগলায় মচমচ করে উপর থেকে নেমে আসতে লাগল। নন্দর হাত-পা হিম হয়ে গেল, অন্ধকারে দেয়ালের গায়ে চ্যাপটা হয়ে টিকটিকির মতন লেগে রইল।

তারপর দেখল বুড়ো-আঙুল-বার-করা, জিভ-কাটা ছেঁড়া হলদে বুট-পায়ে, তালি-দেওয়া সুতো-ঝোলা লম্বা পেন্টেলুন-পরা দুটো ঠ্যাঙ সিঁড়ির বঁক ঘুরে নামতে লাগল। তারপর দেখল, পিঠে তার মস্ত ঝুলি, থুতনিতে খোঁচা দাড়ি, নাকের উপর আঁচিল, তার উপর তিনটে লোম, ন্যাড়া মাথায় নোংরা টুপি বোঝ হয় সেই হিংস্র লোকদের কেউ একজন! ভয়ের চোটে নন্দর একপাটি চটি ছিটকে খুলে, ঠুংঠং করে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে চলল, আর সেই হলদে বুটপরা হিংস্র লোকটা থতমত খেয়ে বোঁচকা ফেলে দে ছুট!

নন্দর কিন্তু আর কিছু মনে নেই। কেমন ভেড় বানিয়ে গিয়েছিল! লোকটা কিন্তু নিজেই টেনে কোথায় দৌড় লাগাল!

.

এদিকে পাঁচ তলার লোকেরা আজও গল্প করে নন্দ নামে একটি ছোটো ছেলে চোর ভাগিয়ে জিনিস বাঁচিয়েছিল।

শুনে শুনে নন্দ মনে ভাবে– বুড়োরা কী হাঁদা! কিন্তু বাইরে কিচ্ছু বলে না, চালাক কিনা!

টাকা চুরির খেলা

প্রথম যখন গণশার সঙ্গে আলাপ হল সে তখন সদ্য সদ্য নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস থেকে নেমেছে। চেহারাটা বেশ একটু ক্যাবলা প্যাটার্নের, হলদে বুট পরেছে–তার ফিতেয় আবার দু-জায়গায় গিট দেওয়া; খাকি হাফ প্যান্ট, আর গলাবন্ধ কালো কোট– তার একটাও বোম নেই, গোটা তিনেক বড়ো বড়ো মরচে-ধরা সেফটিপিন আঁটা। তার উপর মাথায় দিয়েছে সামনে বারান্ডওয়ালা হলদে কালো ডোরাকাটা টুপি। দেখে হেসে আর বাঁচিনে।

ছোটোকাকা সঙ্গে ছিল, গণশার দাদাকে ডেকে বলল, ওহে হরিচরণ, এটি আমার ভাইপো। তোমার ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে মিলবে ভালো। তাই শুনে গণশা রেগে কাই, অত ছোটো ভাই ছোটো ভাই করবেন না মশাই। আর ওই কুচো চিংড়িটার সঙ্গে মিলব ভালো, শুনলেও হাসি পায়।

ছোটোকাকার মুখের রংটা কীরকম পাটকিলে মতন হয়ে গেল। সেঁক গিলে বললেন বটে! সে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ! অথচ শেষ অবধি ওই গণশাকেই আমি বিষম ভক্তি করলুম।

সে এক মস্ত উপাখ্যান।

ছুটির দিন দুপুর বেলায় নিরিবিলি ছাদের ঘরের মেঝেতে বেশ আরাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে, পা দুটোকে উঁচুবাগে তুলে একটা চেয়ারের পায়াতে লটকে, দিব্যি করে নিজের মনে দাদার টিকিটের অ্যালবামে নতুন নতুন পাঁচ পয়সার টিকিট সারি সারি মারছি, কারু কোনো অসুবিধা করছি না, কিছু না, এমন সময়ে ওরে গবা, গবা রে! বলে বাপরে সে কী চিল্লানো! আর এরা আমায় কিনা বলে যে গোলমাল করি! সেই বিকট গোলযোগ শুনে তাড়াতাড়ি টিকিট অ্যালবামটা লুকিয়ে ফেলে নীচে যেতে যাব, ভুলেই গেছি যে পা দুটো চেয়ারে লটকানো, তাড়াতাড়ি না টেনে নামাতে গিয়ে চেয়ার উলটে গেল, তার উপর দিদিটা হাঁদার মতন দুটো কাঁচের ফুলদানি রেখেছিল, সে তো গেল ভেঙে; সবচেয়ে খারাপ হল, আমার আধ-খাওয়া পেয়ারাটা ছিটকে গিয়ে ঘরের কোণে পিসিমার গঙ্গাজলের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেল।

এই সমস্ত ঘটনাতে আমার যে একেবারে কোনো দোষ ছিল না একথা যে শুনবে সেই বলবে। অথচ এই একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে দাদা, দিদি, পিসিমা এমন হইচই লাগাল, যেন তাদের ঘরে চোর সিঁদ কেটেছে! বাবা পর্যন্ত আমার দিকটা বুঝলেন না, বললেন–দোষ করে আবার কথা!

এরপর যখন ছোটোকাকা গোলমাল শুনে দাড়ি কামাতে কামাতে এসে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল– অনেক দিন থেকেই বলছি ও ঝুরিভাজা ছেলেকে বিদেয় কর। তা তো কেউ শুনলে না। এখন জেলখানাতেও ওকে নিতে রাজি হবেনা। সময় থাকতে নারানবাবুর ইস্কুলে দিয়ে দাও, নইলে নাকের জলে চোখের জলে এক হবে। মনে মনে বুঝলাম, ছোটোকাকার নতুন সাদা জুতোয় সেই যে কলম ঝাড়বার সময়ে সামান্য তিন-চার ফোঁটা কালি পড়েছিল, ছোটোকাকা এখনো সেকথা ভোলেনি।দিকগে বোর্ডিঙে, এদের চেয়ে খারাপ বোর্ডিঙে কেন নরকেও কেউ হতে পারে না। তাই রেগে, চেঁচিয়ে, হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগলাম–তাই দাওনা, তাই দাওনা, তাই দাওনা। এদিকে নিজে যখন বায়োস্কোপ দেখে দেরি করে ফিরে বাবার কাছে তাড়া খাও, তখন

বাবা বললেন– চোপ!

এরই ফলে ছুটির পর যখন ইস্কুল খুলল, আমি গেলুম নারানবাবুদের বোর্ডিঙে। বেশ জায়গা, বাড়ি থেকে ঢের ভালো। প্রথমটা সকাল বেলা হালুয়া খেতে বিশ্রী লাগত। তারপর দেখলাম ওতে খুব ভালো ঘুড়ি জুড়বার আঠা হয়। এ ছাড়া বোর্ডিঙের আর সব ভালো। গণশাও দেখলাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবে সে আমাদের ঘরে থাকে না।

প্রথম দিন শুতে গিয়ে দেখি আমাদের ঘরে ছ-জন ছেলে, পাঁচজন ছোটো আর একজন বড়ো। আমাদের ঘরের বড়ো ছেলেটি ঠিক বড়ো নয়, বরং মাঝারি সাইজের বললে চলে। কিন্তু তার তেজ কী! তার নাম পানুদা, তার কাজ নাকি আমাদের সামলানো, আর তাই করে করে নাকি তার ঠান্ডা মেজাজ খ্যাকখ্যাক করার ফলে দিন দিন বিগড়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানলুম পানুদা সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। নিয়ম করে ক্লাসের লাস্ট বয়ের ঠিক উপরে হয়। কিন্তু তার মন খুব ভালো, লাস্ট বয়কে খুব সাহায্য করে। আমাদের ঘরের নীলু বলল, সেই সাহায্যের ফলেই নাকি লাস্ট বয় বেচারা চিরটা কাল লাস্টই হচ্ছে!

যাই হোক, আমি এ-সমস্ত কথা বিশ্বাস করিনি, কারণ আমাদের ঘরে দেখতাম তার খুব বুদ্ধি খোলে। নিজে লুকিয়ে ডিটেকটিভ বই পড়তে আর আমরা কোনো অন্যায় করলে ধরে ফেলতে তার মতন ওস্তাদ আর দুটি হয় না। এই পানুদাই যেদিন বিপদে পড়ল, আমরা তো সবাই থ! সে এক অদ্ভুত আশ্চর্য ব্যাপার!

পানুদা আর তার গুটি পাঁচেক ক্লাসের বন্ধু প্রায়ই ভোজ মারে। সবাই মিলে টাকা জমিয়ে পানুদার কাছে দেয় আর এক শনিবার বাদে এক শনিবার চপ, কাটলেট, ডিমের ডেভিল– আরও কত কী-র ব্যবস্থা হয়! আমায় একবার একটা ঠোঙা ফেলতে দিয়েছিল, আমি সেটা একটু শুকে আর একবার চেটে সারারাত কী পেলুম না, কী পেলুম না করে আর ঘুমুতে পারিনি।

পানুদার কাছে তো পিঁপড়েটি আদায় করা দায়, তাই আমরা ছোটো ছেলেরা নিজেরা একবার পয়সা জমাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে আর এক কেলেঙ্কারি! জগা আজ চার আনা দিল, আবার কাল বলে, দে বলছি আমার চার আনা, আমি পেনসিল কিনব। যত বলি পেনসিল কিনবি কীরে, ও দিয়ে যে আমরা চপ কাটলেট খাব রে! জগা বলে, ইয়ার্কি করবার আর জায়গা পাসনি! দে বলছি, নইলে এইসা এক রদ্দা কষিয়ে দেব! পারলে বোধ হয় চার আনার জায়গায় ছ-আনা নেয়। এমনি করে আমাদের সাড়ে তিন আনার বেশি জমলই না। তাও জমত না, নেহাত মন্টুর জ্বর-টর হয়ে বাড়ি চলে গেল, আর পয়সাগুলো চেয়ে নিতে ভুলে গেল।

যাই হোক, পানুদারা এদিকে সাড়ে তিন টাকা জমিয়েছিল। রাত্রে শুনলাম পাশের খাট থেকে পানুদা বলছে– আট আনার বরফি, আট আনার চিংড়ি মাছের কাটলেট, চার আনার ছাঁচি পান শুনে শুনে আমার গা জ্বলতে লাগল। জিভের জল গিলে গিলে পেটটা ঢাক হয়ে উঠল।

পরদিনই কিন্তু পানুদা বিষম বিপদে পড়ল। লাইব্রেরিতে পানুদা আর সমীরদা আর কে যেন একটা ছেলে পেল্লায় আড্ডা দিচ্ছে, পানুদা চাল মেরে কী-একটা কুস্তির প্যাঁচ দেখাতে গেছে আর স্লিপ করে কাঁচের আলমারির দরজা-টরজা ভেঙে চুরমার! পানুদা উঠে দাঁড়িয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছে, এমন সময়ে হেডমাস্টারমশাই এসে এমনি বকুনি লাগালেন যে পানুদা চমকে গিয়ে নিজের আলজিভ-টিভ গিলে বিষম-টিষম খেয়ে যায় আর কী! হেডমাস্টারমশাই এমনি রেগে গিয়েছিলেন যে এসব কিছু না দেখে বললেন– বাঁদুরে ব্যাবসা ছেড়ে এখন মানুষের মতন ব্যবহার শেখো। তোমাকে বেশি জরিমানা কোত্থেকে আর করি, কিন্তু তোমার বাক্সে যা টাকাকড়ি আছে সমস্ত দিয়ে যতগুলি কাঁচ হয় কিনে দেবে, তা দিয়েও যে অর্ধেকের বেশি হবে তা তো মনে হয় না।

সেদিন পানুদার মেজাজ দেখে কে! রাত্রে আমরা ঘরে বসে শুনলাম সিঁড়ি দিয়ে পানুদার চটির শব্দ–অন্যান্য দিনের মতন চটচট চটাং চটচট চটাং না হয়ে একেবারে চটাং চটাং চটাং! বুঝলাম পানুদা রেগেছে।

যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দেখলাম আসলে আরও ঢের বেশি রেগেছে। ঘরে ঢুকেই পানুদা আমার আর কেষ্টর মাথা একসঙ্গে ঠুকে দিয়ে বললে অত হাসি হাসি মুখ কেন রে বেয়াড়া ছোঁড়ারা? আমরা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেলাম। তারপর পানুদা জগার দিকে চেয়ে বলল, ফের ফোঁস ফোঁস করছিস রাস্কেল? বলে তার কানে দিল এক প্যাঁচ। হিরু বলল, ওর সর্দি হয়েছে কিনা–পানুদা তার গালে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বলল-চুপ কর বেয়াদপ, তোর কে মতামত চেয়েছে?তারপর সময় কাটাবার জন্য শিবুর কানের কাছে খোঁচাখোঁচা চুলগুলো নখ দিয়ে কুটকুট করে টানতে টানতে দাঁতে দাঁত ঘষে বললে– আজ তোদের কাছ থেকে যদি টু শব্দটি শুনি, সব ক-টাকে কচুকাটা করে ফেলব বলে রাখলাম।

ঘরের মধ্যে একদম চুপ। পানুদা খাটে বসে পা দোলাতে লাগল আর বোধ হয় হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতে লাগল। এমন সময়ে সেই গণশাটা এসে হাজির। এসেই পানুদার পিঠ থাবড়ে একগাল হেসে বললে– কী রে পেনো, ফিস্টিটা ভেস্তে গেছে বলে বুঝি মুখোনা হাঁড়ি আর কচি ছেলের উপর উৎপাত? রোজ বলি:ওরে পেনো, একা একা অত খাসনি!

পানুদা গুম হয়ে রইল।

গণশা বলল– তাই বলে কি টাকাগুলো সত্যি দিবি না কি?

পানুদা বলল, দেব না তো কি তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে?

গণশা হেসে বললে, আরে রামঃ! এমন এক উপায় বাতলাতে এলুম, তোকেও দিতে হবে না, আমাকেও দিতে হবে না। আজ রাত্রে দরজা খুলে শুবি, দেখবি একটা ডাকাত এসে সব টাকা নিয়ে যাবে। পরে হয়তো ফিরে পাবি, কিন্তু ডাকাতটাকে খাওয়াতে হবে বলে রাখলুম।

পানুদা হাঁ করে খানিক তাকিয়ে বলল–সে দেখা যাবে এখন। এ সময়ে তুমি এঘরে যে বড়ো এসেছ, জানো না রুল থ্রি?

গণশা বললে– সাধে শাস্ত্রে বলে কদাচ কাহারও উপকার করিয়ো না।

মুখে পানুদা যতই তেজ দেখাক না কেন, শোবার সময়ে দেখলুম দরজাটা ঠিক খুলে শুল। অন্য দিন তো পারলে জানলাও বন্ধ করে, আমাকে দিয়ে খাটের নীচে খোঁজায়, রাত্রে উঠবার দরকার হলে জগাকে আগে একবার পাঠায়, আর সেদিন দেখি বেজায় সাহস! বালিশে মুখ গুঁজে একটু হেসে নিলাম।

উৎসাহের চোটে আমার অনেকক্ষণ ঘুম হয়নি, অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি কে যেন টর্চের আলো ফেলেছে। পানুদা ভোঁসভাঁস করে ঘুমোচ্ছে আর বাকিরা কেউ যদি জেগেও থাকে। ভয়ের চোটে চোখ বুজে পড়ে আছে। আমি দেখলুম কে একটা লোক পা টিপে টিপে এসে পানুদার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করল, পানুদার বাক্স খুলল, কী যেন নিল, আবার বাক্স বন্ধ করে চাবি বালিশের নীচে রেখে আস্তে আস্তে চলে গেল। পরদিন সকালে ইস্কুলময় হইচই, পানুদার টাকা চুরি গেছে। হেডমাস্টারমশাই সবাইকে ডেকে যাচ্ছে-তাই করে বলেন, সকলের বাক্স খোঁজা হল। কোথাও কিছু নেই। গণশার বাক্সে তো এত কম জিনিস, এবং তাও এত নোংরা যে তাই নিয়ে গণশা। বেজায় বকুনি খেল।

সেদিন রাত্রে পানুদার হাসি হাসি মুখ।

আজ কাউকে কিছু তো বললই না, এমনকী যে-পানুদা শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে আমাদের শার্ট থেকে বোতাম ফেটে নিজের শার্টে লাগিয়ে নিত সে নিজের থেকেই জগাকে দুটো আস্ত খড়ি দিয়ে ফেলল!

এমন সময়ে গণশা আবার ঘরে ঢুকল।

কী রে পেনো! শেষটা সত্যি ডাকাত পোলো তোদের ঘরে?

পানুদা খুব হেসে বলল– দিস ভাই, তোরও নেমন্তন্ন রইল। গণশা যেন আকাশ থেকে পড়ল– কী দেব রে পেনো! বলছিস কী?

কেন, টাকা!

কীসের টাকা? টাকা আবার কোথায় পাব রে? দানছত্তর খুলেছি না কি? আর তা যদি খুলিও, তোকে টাকা দেব কেন রে এত যোগ্য লোক থাকতে?

পানুদা ভয়ংকর চটে বললে– দেখ গণশা, ইয়ার্কি ভালো লাগে না। দে বলছি!

গণশা বললে– ইয়ার্কি কি আমারই ভালো লাগে নাকি রে?

তারপর গুনগুন করে গাইতে লাগল–

নিশুত রাতে চোরের সাথে টাকা চুরির খেলা,
ওই চোর বেটা নিলে সেটা পেনো বুঝল ঠেলা!

সেই অবধি গণশাকে আমি ভক্তি করি।

 দিন-দুপুরে

দুপুর বেলা বাড়িসুদ্ধ সব্বাই ঘুমোচ্ছে। বাবা ঘুমোচ্ছেন, মা ঘুমোচ্ছেন, মেজোমামা পর্যন্ত এ খবরের কাগজে মুখ ঢাকা দিয়ে বেজায় ঘুমোচ্ছন। কিন্তু টুনুর আর ঘুমই আসে না। তাকিয়ে দেখল হাবুটা অবধি চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে আছে। তাকে ডাকা চলে না মেজোমামা যদি জেগে যান! টুনু শুয়ে শুয়ে ভাবছে বাবার নতুন ঘোড়া খুব সুন্দর হলেও দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালুর কাছে লাগে না। লালু কত কালের পুরোনো, সেই কবে মেজোমামা যখন ইস্কুলে যেতেন তখনকার! কীরকম প্রভুভক্ত! ওর গায়ে কী জোর! ভাবতে ভাবতে টুনুর মনে হল– বাদলা দিন বলে বাবা আবার আজ ঘোড়ায় চড়তে বারণ করেছেন। বড়োদের যদি কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে। আচ্ছা, আজকের দিনই যদি ঘোড়ানা চড়বে, তা চড়বে কবে!

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই টুনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, চোখ দুটো গোলমাল হয়ে গেল। দেখল দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালু কেমন যেন মুচকি হাসতে হাসতে উঠোন পার হয়ে বাবার নতুন ঘোড়া রতনের আস্তাবলে ঢুকল। টুনু উঠে এসে জানলার আড়ালে দাঁড়াল। একটু বাদেই রতন লালু দুজনেই আস্তাবলের কোণ ঘুরে কোথায় যেন চলে গেল।

টুনু ডাকল– ও কেশরী, ও সই-ই-স! লালু-রতন যে পালিয়ে গেল! কিন্তু গলা দিয়ে আর স্বরই বেরুল না। বাইরে এসে ইদিক-ঊদিক তাকিয়ে যখন কেশরী সিং কিম্বা সইসের পাত্তা পেল না, টুনু নিজেই চলল আস্তাবলের কোণ ঘুরে রতন-লালুর পিছন পিছন।

কী আশ্চর্য! আস্তাবলের পিছনে সেইসব ধোপাদের কুঁড়ে ঘর, তার সামনে নোংরা মাঠে ধোপাদের গাধা বাঁধা থাকত, আর ময়লা দড়িতে সাহেবদের কোট পেন্টেলুন রোদে শুকুত, সেইসব গেল কোথায়? টুনু দেখল দু-পাশে গা ঘেঁষে ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনোটা আলু কাবলির, কোনোটা লাল-নীল পেনসিলের, কোনোটা কাঁচের মার্বেলের। চারিদিকে দোকানে দোকানে বড়ো বড়ো নোটিস ঝোলানো।

এগজিবিসন!
এই দিকেà

আর একটা দাড়িমুখো মোটকা বুড়ো একটা ফুটো বালতি পিটোচ্ছে আর ষাঁড়ের মতন গলায় চাঁচাচ্ছে পয়সা না ফেলেই ঢুকে যান! পয়সা-টয়সা কিছু চাই না, গেলেই বাঁচি!

টুনু আরও এগজিবিশন দেখেছিল, কতরকম আশ্চর্য জিনিস থাকে সেখানে: দোকান, বাতিওয়ালা থাম, বায়স্কোপ, নাগরদোলা, গোলকধাঁধা!

তাই টুনু তাড়াতাড়ি চলল, মাঝপথে একটা ষণ্ডামার্কা লোক পথ আগলে বলল, এইয়ো! টুনু তাকে দেখতেই পেল না, পায়ের ফাঁক দিয়ে সুট করে গলে এগিয়ে চলল।

হঠাৎ একটা মস্ত খোলা জায়গায় উপস্থিত হল, তার যেদিকে তাকায় কেবল ঘোড়া! বড়ো ঘোড়া, ছোটো ঘোড়া, সাহেবের ঘোড়া, গাড়োয়ানের ঘোড়া, ভালো ঘোড়া, বিশ্রী ঘোড়া। আবার একটা মড়াখেকো হলদে ঘোড়া, ওলটানো টবে চড়ে গার্গেসে গলায় বক্তৃতা দিচ্ছে :

হে ব্যাকুল ঘোড়াভাই-ভগিনী, আজ আপনারা কীসের জন্য এখানে আসিয়াছেন? পুরাকালে আপনারা বন-বাদাড়ে সুখে বিচরণ করিতেন, এই দুষ্ট মানুষগুলাই তো আপনাদের পাকড়াও করিয়া বিশ্রী গাড়িতে জুতিয়াছে। পায়ে নাল বাঁধাইয়া, পিঠে জিন চড়াইয়া, দুই পাশে অভদ্রভাবে ঠ্যাং ঝুলাইয়া চড়িয়া বেড়াইতেছে। ছিঃ! ছিঃ! আপনারা কী করিয়া এই দু-পেয়েদের কুৎসিত চেহারা সহ্য করেন?

পিছন থেকে গাড়োয়ানদের ছোটো ছোটো ঘোড়াগুলো চেঁচিয়ে উঠল, কক্ষনো সইব না! সইব না! সইব না! মিটিং করে, রেজলিউশন করে, দানা না খেয়ে মানুষদের জব্দ করব!

হলদে ঘোড়া ঠ্যাং তুলে ওদের চুপ করিয়ে দিল, টুনুর মনে হল সে নিজের ছাড়া আর কারুর গলার আওয়াজ সইতে পারে না।

এক কোণে লালু রতন দাঁড়িয়েছিল, হলদে ঘোড়া হঠাৎ লালুকে বলল, আপনি প্রবীণ ব্যক্তি! আপনি কিছু বলুন। বলবামাত্র লালু তড়বড় করে টব থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বিনা ভূমিকায় আরম্ভ করলে :

বহুকাল ধরে আমি চৌধুরিদের বাড়িতে থাকি। তাদের মতন ছোটোলোক আর জগতে নেই– টুনুর শুনে ভারী দুঃখ হল। তার ওপর তারা এমন নিরেট মুখ যে বড়োবাবু পর্যন্ত সামান্য–যাক আমি কখনো কারো নিন্দে করি না। ওদের বাড়ির ছেলেগুলো আহাম্মুকের একশেষ। আমি শিক্ষা দেবার জন্য ইচ্ছে করে ওদের কাপড় রোদে দিলে মাড়িয়ে দিই, জানলা দিয়ে ঘরে মুখ বাড়াই, বোকারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে চিনি খেতে দেয়, আর কেউ যখন দেখছে না গিন্নির হিসেবের খাতা চিবিয়ে রাখি। তা ছাড়া নোংরা জিব দিয়ে ওদের সইসের মুখ চেটে দিই, ছোটো ছেলে একা পেলেই তেড়ে গিয়ে পা মাড়িয়ে দিই, এইরকম নানা উপায়ে জাতির মান রক্ষা করি।

সবচেয়ে বিশ্রী ওদের টুনু আর হাবু বলে দুটো পোষা বাঁদর। অমন বদ চেহারার বাঁদর কেউ যে পোষে জানতাম না। ওরা আমাদের ঘুমের সময়ে এসে ঘেমো হাতে উলটো করে আমাদের গায়ে হাত বুলোয়, এমন ঘেন্না করে যে কী বলব! আবার পাতায় করে যত অখাদ্য জিনিস এনে গদগদ হয়ে শুয়োরের মতো ছুঁচলো মুখ করে, চুচু শব্দ করে খাওয়াতে চেষ্টা করে–ইচ্ছে করে দিই ঘেঁচে! কিন্তু অমন নিকৃষ্ট জীবকে মারতেও ঘেন্না করে।

.

টুনু বিশ্বাসঘাতক লালুর কথায় অবাক হয়ে গেল, এমন অকৃতজ্ঞতা দেখে তার বড্ড কান্না পেল! ছি, লালুর জন্য দাদামশাই ভালো দানা আনান– সে কথা কই লালু তো বলল না! রতনের নতুন জিনের কথাও বোধ করি সে, ভুলে গেছে! টুনু প্রতিজ্ঞা করল আর কখনো আস্তাবলের দিকে যাবে না, ঘোড়া চড়তেও সে চাইবে না। লালুকে সে কত ভালোবাসে আর লালুর তাকে নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে! টুনু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেই চমকে দেখল, সে কখন জানি মেজোমামার ঘরে এসে শুয়ে রয়েছে আর লালুটাও ইতিমধ্যে এসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মেজোমামার হাত থেকে চিনি খাচ্ছে!

টুনুর বড্ড রাগ হল, ডেকে বলল, দিয়ো না ওকে মেজোমামা, ও বলেছে আমরা আহাম্মুক ছোটোলোক, নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে! মেজোমামা আহাঃ! বলে টুনুকে চুপ করিয়ে দিয়ে একমনে চিনি খাওয়াতে লাগলেন। টুনু হাঁ করে দেখল লালু দিব্যি চিনি সাবাড় করল, কিন্তু যাবার সময় মনে হল চোখ টিপে জিব বের করে বিশ্রী ভেংচে গেল! কিন্তু সে কথা কাকেই-বা বলে।

নটবরের কারসাজি

নেই ছেলেটা প্রথম যেদিন মাস্টারমশাইয়ের পিছন পিছন ক্লাসে ঢুকল, গায়ে নীল ডোরাকাটা গলাবন্ধ কোট আর খাকি হাফ-প্যান্ট, চুলগুলো লম্বা হয়ে নোটানোটা কানের উপর ঝুলে পড়েছে, তেল-চুকচুকে আহ্লাদে আহ্লাদে বোকামতন ভাবখানা দেখেই আমার গায়ে জ্বর এল। আবার আমোদও লাগল, একে নিয়ে বেশ একটু রগড় করা যাবে মনে করে।

ছেলেটার পায়ে ফিতে-দেওয়া কালো জুতো একটু কিচকিচ করছিল, তাইতে নগা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, জুতোর দামটা বুঝি আসছে মাসে দেওয়া হবে।

ছেলেটা কিন্তু কিছু না বলে খাতা-পেনসিল নিয়ে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে চুপ করে বসল। মাস্টারমশাই বললেন, ওহে নটবরচন্দ্র, বছরের মাঝখানে এয়েচ, ভালো করে পড়াশোনা কোরো। নাম শুনে আমরা তো হেসেই কুটোপাটি, নগা তক্ষুনি তার নাম দিয়ে ফেলল– লটবহর। সত্যি নগার মতন রসিক ছেলে খুঁজে পাওয়া দায়!

টিফিনের সময় নটবরচন্দ্র একটা ছোট্ট বইয়েরমতন টিনের বাক্স খুলে লুচি আলুরদম খেয়ে, হাত চাটতে চাটতে বার বার আমাদের দিকে তাকাতে লাগল। তাই-না দেখে নগা বললে, কী রে ছোঁড়া, মানুষ দেখে বুঝি অভ্যেস নেই?

আমরা তাগ করেছিলাম, চটেমটে ছেলেটা কী করে দেখব। ছেলেটা কিন্তু খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎমুখে হাত দিয়ে বিশ্রী রকম ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে লাগল।নগা রেগে বলল– অত হাসির কথা কী হল শুনতে পারি?

ছেলেটা অমনি নরম সুরে বলল– কিছু মনে কোরো না ভাই, সত্যি আমার হাসা উচিত হয়নি, কিন্তু তোমাদের দেখে আমার হঠাৎ মেজোমামার পোষা বাঁদরগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কেবল ওই ওকে ছাড়া বলে আমাকে দেখিয়ে দিল।

নগারা রেগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, আমি কিন্তু একটু খুশি না হয়ে পারলাম না, অল্প হেসে জিজ্ঞেস করলাম আর আমাকে দেখে কীসের কথা মনে হচ্ছে?

সে অম্লানবদনে বললে–মূলতানি গোরুর কথা।ভীষণ রাগ হল। ভাবলাম ছোটোবেলা থেকে এই যে শ্যামবাবুর কাছে স্যান্ডো শিখেছি সে কি মিছিমিছি! তেড়ে গিয়ে এইসা এক প্যাঁচ কষে দেবার চেষ্টা করলাম যে কী বলব! সে কিন্তু কী একটা ছোটোলোকি কায়দা করে এক সেকেন্ডে আমাকে আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক তক্ষুনি ক্লাসের ঘণ্টা পড়ল, নইলে তাকে বিষম সাজা দিতাম।

ক্লাসের পর বাড়ি যাবার পথে তার জন্য ওত পেতে রইলাম, আমি আর একটা ছেলে। দেখা হতেই সে হাসিমুখে বলল, কী হে, চীনাবাদাম খেতে আপত্তি আছে? আমরা আর কী করি একেবারে তো আর অভদ্র হতে পারি না, তাই চীনাবাদাম নিয়ে তাকে বুঝিয়ে বললাম দেখ, নতুন ছেলে এসেছিস, নতুন ছেলের মতো থাকবি, আজ দয়া করে তোর চীনাবাদাম খেলুম বলে যেন মনে করিস না যে দুপুরের কথা ভুলে গেছি।

সে বললে, রাগ কোরো না ভাই। আমি যদি জানতাম অমন হোঁতকা শরীর নিয়েও তুমি এমন ল্যাদাড়ে তবে কি আর কষ্ট করে জনসেসানিয়ান প্যাঁচ লাগাতাম, এই এমনি দু-আঙুলে ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিতাম। এই বলে আমাকে কী একটা কায়দা করে চিতপাত করে দিয়ে নিমেষের মধ্যে সে তো হাওয়া! এর থেকেই বোঝা গেল সে কী ভীষণ ছেলে! সারারাত মাথা ঘামিয়েও তাকে জব্দ করবার উপায় দেখলুম না। পরদিন সকালে ছোটোমামা বলল, কী রে ভোদা, মুখ শুকনো কেন? পেট কামড়াচ্ছে বুঝি? রোজ বলি অত খাসনি। যা বুদ্ধি এদের! বললুম–যে-বিষয়ে কিছু বোঝ না, সে-বিষয়ে কিছু বলতে এসো না।

নটবরকে না পারতে পারি, তাই বলে যে অন্যদেরও এক কথায় চুপ করিয়ে দিতে পারি না, একথা যেন কেউ মনে না করে। হাবুটার কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া গেল না। নিজের বেলা তো খুব বুদ্ধি খোলে, কিন্তু আমি যখন সব খুলে বলে পরামর্শ চাইলাম সে উলটে বললে, তুই আর তোর নগা না বগা, দু-টি মানিকজোড়! আমার কাছে যে বড়ো পরামর্শ চাইতে এসেছিস! ওরে ছোঁড়া, আগে পরামর্শ নেবার মতন একটু বুদ্ধি গজা!

নাক সিঁটকে চলে এলুম। হ্যাঁ! পরামর্শ আবার কী! মেয়েদের সঙ্গে আবার পরামর্শ! জানে তো কেবল হি হি করে হাসতে আর কালো গায়ে লাল জামা চড়িয়ে সং সাজতে! সাধে কি মুনি-ঋষিরা ওদের বিষয়ে ওইসব লিখে গেছেন!

ইস্কুলে গিয়ে দেখি ছেলেটা আজ ফাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। একদিনেই দেখি মাস্টারদের বেশ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল! বোকার মতন মুখ করে থাকলে সবাই অমন পারে। আর বুঝি আন্দাজে। আন্দাজে কতকগুলো সোজা সোজা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। পড়ত ওর ঘাড়ে আমাদের সব শক্ত শক্ত প্রশ্নগুলো, তবে দেখা যেত। যাই হোক, এক দিনেই নাম করবার তার এমন কিছু তাড়াহুড়ো ছিল না।

নগা বললে–ব্যাটা খোশামুদে!

ছেলেটা শুনে বললে, ছিঃ, হিংসে করতে নেই, পরে কষ্ট পাবে। রাগে নগা হাতের মুঠো খুব তাড়াতাড়ি খুলতে ও বন্ধ করতে লাগল। গেল বছর যদি ওর টাইফয়েড না হত নিশ্চয় সেদিন একটা কিছু হয়ে যেত।

.

এমনি করে কদ্দিন যেতে পারে! শেষটা একদিন গবুই এক বিষম ফন্দি বার করল। গবুটা দেখতে রোগাপটকা, আর প্রত্যেক পরীক্ষায়, প্রত্যেক বিষয়ে লাস্ট হলে কী হবে ছেলেটার খুব বুদ্ধি আছে। সেদিন ক্লাসে এসেই সে নগাকে কানে কানে কী বলল। তাই-না শুনে উৎসাহের চোটে নগা অঙ্ক-টঙ্ক ভুল করে কোণে দাঁড়িয়ে একাকার! তাতে বরং একদিক দিয়ে সুবিধেই হল, নগা কোণে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে মতলবটা দিব্যি পাকিয়ে নিল।

সেইদিনই টিফিনের সময় নটবরকে ডেকে নগা বলল, ভাই নটবর, যা হবার তা হয়ে গেছে, একটা বড়ো দুর্ঘটনা ঘটেছে, হেডমাস্টারকে তাই একটু সাহায্য করা চাই। তুমি ক্লাসের ভালো ছেলে, তুমি বললে দেখাবেও ভালো, তা ছাড়া তোমার মতন গুছিয়ে কেই-বা বলতে পারবে?

নটবর খুশি হয়ে বলল– তা তো বটেই! ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তোতলা, আর বাকিগুলো একেবারে গবচন্দ্র।

নগা আশ্চর্য রকমভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা হয়ে বলল– তা, তুমি গিয়ে তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবে যে তার বাবার শ্রাদ্ধে তুমি কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে সাহায্য করতে চাও এই একটু সম্মান দেখাবার জন্য আর কী! বুঝলে তো? ভালো করে বুঝিয়ে বলল, এই কাল ওঁর বাবা মারা গেছেন কি না।

নটবর হাঁ করে শুনে বলল– আহা, তাই নাকি? তোমরা ভেবনা, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। তোমরা একটু অপেক্ষা করে থাকলে ফল টের পাবে। বলে হেডমাস্টারের ঘরের দিকে চলে গেল। তার ওই টের পাওয়ার কথাটা আমার ভালো লাগল না। টের পাওয়া বলতে আমরা অন্য মানে বুঝি। সে যাই হোক গে। ক্লাসের ঘণ্টা পড়বামাত্র নটবর ছুটতে ছুটতে এসে বলল–হেডমাস্টার রাজি হয়েছেন। তোমাদের ক-জনকে এক্ষুনি ডেকেছেন কীসব কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য। তোমরা কী করে জানলে তাও জিজ্ঞেস করছিলেন। মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। তোমরা এক্ষুনি যাও।

আমরা প্রথম তো অবাক! শ্রাদ্ধের কথাটা গবুর সম্পূর্ণ বানানো। কোথায় নটবর ইয়ার্কি দেবার জন্য মার খাবে, না সত্যি হেডমাস্টারের বাপের শ্রাদ্ধ! এ-রকম কিন্তু আরও হয়। আমি একবার একটা অচেনা ছেলেকে মজা দেখবার জন্য বলেছিলাম, কী হে, চাটগাঁ থেকে কবে এলে? সে বলল– কাল এলাম, তুমি কী করে জানলে? আমি অবিশ্যি আর কিছু ভেঙে বলিনি।

যাই হোক, আমরা তো গেলাম। দেখলাম হেডমাস্টার গোমড়া মুখ করে ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেদের ইংরেজি খাতায় লাল পেনসিলের দাগ কাটছেন। আমাদের দেখে খেঁকিয়ে বললেন– কী, ব্যাপার কী তোমাদের? ক্লাস নেই নাকি, এখানে যে বড়ো দঙ্গল বেঁধে এসেছ?

নগা গলা পরিষ্কার করে বলল– আজ্ঞে, আপনার বাবার শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছি। এই আমরা–এইটুকু বলতেই হেডমাস্টারের এক ভীষণ পরিবর্তন হল। মুখটা লাল হয়ে বেগুনি হল, হাতের পেনসিলের মোটা সিস মট করে ভেঙে গেল, গোঁফ-চুল সবখাড়া হয়ে গেল, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে লাগল। তার চোটে শার্টের গলার বোতাম ফট করে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেল। কীরকম একটা শব্দ করে আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমরা এতক্ষণ হাঁ করে দেখছিলাম, এবার হঠাৎ একটা বিকট সন্দেহ হল। নটবর আগাগোড়া মিছে কথা বলেছে। হেডমাস্টার ডাকেননি। সে হয়তো দেখাই করেনি! হেডমাস্টার গর্জন করে উঠলেন, জানলার খড়খড়ি কেঁপে উঠল। আমরা ছিটকে বাইরে এসে পড়লাম, তিনি ফেলে দিলেন কী আমরাই পালিয়ে গেলাম, আজও ঠিক জানি না। কাঁপতে কাঁপতে ক্লাসে ঢুকেই শুনলাম, পণ্ডিতমশাইনটবরকে বলছেন, সে কী নটবর, হেডমাস্টারের ভাইপো তুমি, সেকথা অ্যাদ্দিন বলনি!

নটবর বললে- বাবা বলেন ও সম্পর্কটা কিছু ঢাক পেটাবার মতো নয়। তা ছাড়া ইস্কুলটা বাজে। এইমাত্র কাকাকে সেই কথা বলে এলাম। তিনি তো রেগে কাই।

এমন সময় দরোয়ান এসে বলল, গবুবাবু আর ভোঁদাবাবুকে বেত খেতে হেডমাস্টারবাবু ডাকছেন।

তাই শুনে পণ্ডিতমশাইও বললেন–আর, বেত খেয়ে এসে আধ ঘণ্টা বেঞ্চে দাঁড়াবে, লেট করে ক্লাসে এসেছ।

তাই বলি পৃথিবীটাই অসার!

পেয়ারা গাছের নীচে

বুড়ো দাদু আর মনুয়া দিনভর পেয়ারা গাছতলায় বসে থাকে। শীত এসে যায়, পেয়ারা গাছের পাতা বড়ো কম, ডালের মাঝখান দিয়ে রোদ এসে ওদের গায়ে পড়ে, ডালপালার আঁকাবাঁকা ছায়া ওদের গায়ে পড়ে। সেই ছায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ওপর দিকে চেয়ে মনুয়া দেখে আকাশের নীল গায়েও ওইরকম ডালপালা সাদা রং দিয়ে আঁকা।

মনুয়া একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে, বুড়ো দাদু, কাল আমার জন্মদিন, আমার বন্ধু কাকরের তাই নেমন্তন্ন।

বুড়ো দাদু নীল আকাশ যেখানে নীল বনের পেছনে ডুবে গেছে, সেদিকে চেয়ে বলেন, কাল আমারও জন্মদিন, আমার বন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করতে হবে।

মনুয়া বলে, কারা তোমার বন্ধুরা, বুড়ো দাদু? তাদের চিঠি দিতে হবে-না? মা কাল কিশমিশ দিয়ে পায়েস রাঁধবে।

বুড়ো দাদু আরাম কেদারার তলা থেকে ছোট্ট টিনের হাতবাক্স বের করে, কাগজপত্র ঘেঁটে বলেন, কী জানি, তাদের নাম তো মনে পড়ছে না। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমি যে কোপাই নদীতে চান করতে যেতুম, তাদের না বললে যে তারা মনে দুঃখ পাবে।

মনুয়া উঠে এসে বলে, দাও তো দেখি তোমার হাতবাক্স, আমি খুঁজে দেখি তাদের নাম ঠিকানা পাই কি না।

কিন্তু বুড়ো দাদু কিছুতেই বাক্স দেবেন না। বলেন, না রে মনুয়া, তোর বাবাকে, নাকি তার বাবাকে কাকে যেন একবার দিয়েছিলুম সে ঘেঁটেঘুঁটে তছনছ করে দেছল। পরে রসিদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুই বরং অন্য কোথাও খুঁজে দেখি।

তাহলে মাকে ক-জনার জন্যে পায়েস রাঁধতে বলব, বুড়ো দাদু?

–বল গে এই পাঁচজনার জন্যে। না রে, দাঁড়া দাঁড়া, যে আমার নতুন চটি কোপাইয়ের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল তাকে বলে কাজ নেই। তার নষ্টামির আর শেষ নেই। কী জানি তোদের এসব ফুলগাছটাছ যদি ছিঁড়ে মাড়িয়ে একাকার করে। ওকে বাদ দিলেই ভালো।

বেশ তাহলে বলি চার জন?

–না রে দাঁড়া, দাঁড়া। ওই যার কটা চোখ, সে ভারি ঝগড়ুটি রে মনুয়া। শেষটা যদি তোর বন্ধু কাকরের সঙ্গে মারপিট করে? ওকেও না বলাই ভালো।

–তবে কি তিন জনকে বলা হবে বুড়ো দাদু?

বুড়ো দাদু অবাক হয়ে বলেন, তিন জন আবার কোথায় পেলি মনুয়া? গয়লাবাড়ির ওপারে যে থাকে, গয়লাদের কাছ থেকে চুরি করে সর মাখন খেয়ে খেয়ে, তার যে শরীরের আর কিছু নেই। অত পায়েস তার সইবে কেন? ওর নামটাও কেটে দে।

মনুয়া বললে, তাহলে আমার বন্ধু কঁকর আর কাকরের ছোটো ভাই উদো আসবে। আর তোমার বন্ধু দু-জন তো? যাই মাকে বলে আসি গে।

বুড়ো দাদু তাই শুনে মহা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কী জ্বালা! অত তাড়াটা তোর কীসের শুনি? ওই দুজনের এক জনের মুখে সারাক্ষণ মন্দ কথা লেগেই আছে, সেসব শুনে যদি তোরা শিখে ফেলিস? থাক, ওকে না বলাই ভালো।

মনুয়া বুড়ো দাদুর কাছে ঘেঁষে এসে বলে, তবে কি মোটে এক জনকে বলব?

বুড়ো দাদু, এদিকে-ওদিকে বাগানের চারদিকে, দূরে পাকড়াশিদের বাঁশঝাড়ের দিকে আমতলির পথের দিকে চেয়ে বলেন, আবার একজন কোথায় পেলি রেমনুয়া? আমাকে সুষ্ঠু নিয়ে বলেছিলুম পাঁচ জন।

মনুয়া বুড়ো দাদুর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে, তবে কি তোমার বন্ধুরা কেউ আসবে না? বুড়ো দাদু শুনে অবাক হন।

–কেউ আসবে না কীরে? ওরা ক-জনাই শুধু আসবে না, আর তো সবাই থাকবে। কাকর, কাকরের ভাই উদো, তুই, তোর মা বাবা, কাকা, পিসি, তাদের বাবা আর ভুলো। ভুলোকে ভুলিস নে যেন নেড়িকুত্তো হলে কী হবে, কী গায়ের জোর ভুলোর। ও হয়তো একটু বেশিই খাবে। কিন্তু

মনুয়া বুড়ো দাদুর পায়ে হাত বুলিয়ে বলে, কিন্তু কী বুড়ো দাদু।

–আমি তোকে কী দেব? দে তো দেখি আমার হাতবাক্সটা। বল কী চাস্? গয়না চাস?

–গয়না তুমি কোথায় পাবে বুড়ো দাদু?

–কেন? আমার ঠাকুমার কত গয়না ছিল! ডাকাতদের সর্দার ছিল আমার ঠাকুমার বাবা। তার ভয়ে এ-অঞ্চলে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। সন্ধ্যের পর ভয়ে কেউ পথে বেরুত না। বেরুলে তাদের মেরে কেটে, গয়নাগাটি যা ছিল কেড়েকুড়ে,–ও কী মনুয়া মুখ ঢাকছিস কেন? আচ্ছা, আচ্ছা, গয়নাগাটি না-ই নিলি। তা ছাড়া সেসব নেইও। মোহর নিবি? থোলো থোলো সোনার মোহর একটাও ডাকাতি করে পাওয়া নয়। রাজা ছিল রে আমার ঠাকুরদা। ওদের বাড়িতে সবাই দুধে চান করত, সোনার খাটে বসে রুপোর খাটে পা রাখত, তকমা-পরা দাস-দাসীরা সোনা-বাঁধানো চামর দোলাত।

মনুয়া বললে, কোথায় পেত থোলো থোলো সোনার মোহর ওরা?

বুড়ো দাদু হেসে বললেন, ওমা তাও জানিস নে বুঝি? প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হত যে, না দিয়ে সব যাবে কোথা! ধান কেটে, ঘর জ্বালিয়ে

–ও কী মনুয়া, কঁদছিস নাকি? আচ্ছা মোহর না-ই নিলি, সেসব হয়তো খরচও হয়ে গেছে। অ্যাদ্দিনে। তুই বরং এই মোটা কাচের কাগজ চাপাটা নে। বুড়ো দাদু মোটা কাচের কাগজ চাপা উঁচু করে তুলে ধরেন। বুড়ো দাদুর পায়ের কাছে মাদুরে শুয়ে মনুয়া সেই কাচের মধ্যে দিয়ে ঘন নীল আকাশ দেখতে পায়। কাচের ওপর রোদ পড়ে; ধার দিয়ে রামধনুর রং ছিটোয়। রামধনুর রং এসে বুড়ো দাদুর গায়ে, মনুয়ার গায়ে বেগনি, নীল, কমলা, লাল রঙের আঁকিবুকি কাটে। পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ে। পেয়ারা গাছের আঁকাবাঁকা ডালপালার ছায়া ওদের গায়ে এসে পড়ে।

মা এসে বাটি করে ওদের জন্যে গরম দুধ, পাঁউরুটি আর নরম নরম লাল চিনি দিয়ে যান। বলেন, ও মনুয়া, কাল তোর জন্মদিনে কাঁকরদের নেমন্তন্ন করে আসিস।

মনুয়া বলে, কাল বুড়ো দাদুরও জন্মদিন। বুড়ো দাদুও কাঁকরদের নেমন্তন্ন করবে।

বদ্যিনাথের বড়ি

কোন সকালে কলু কদ্দিন দেখেছে রাস্তার মধ্যিখানে লোহার গোল ঢাকনি খুলে খ্যাংরাকাঠির মতন গোঁফওয়ালা লোক, ছোটো বালতি-হাতে দড়িবাঁধা কালো ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওত পেতে বসে থাকে। লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কাদার ছিটে- অমুদা যখন দাড়ি কামাত না তখন তাকে যেমন দেখাত সেইরকম দেখায়। ছোটো ছেলেটা হয়তো ওর ভাইপো হবেও-বা। ওর নাম হয়তো ছক্কু, ওর গায়ে মোটে কাপড় নেই, কিন্তু কানে সোনালি রঙের মাকড়ি, গলায় মাদুলি বাঁধা। বুবু বলে নাকি সত্যি সোনার নয়; ওরা গরিব কিনা, খেতেই পায় না, ও পেতলের হবে। কলু আর বুবু ছাড়া ওদের কেউ দেখেই না। সামনে দিয়ে দেবরঞ্জন মামা, অমুদা, ননিগোপালরা সবাই চলে যায়, তাড়াতাড়ি কোথায় কোন বন্ধুর বাড়ি ওদের চোখেই পড়ে না। কিন্তু কলু দেখেছে লোকটা মাঝে মাঝে বালতি টেনেটুনে উপরে তোলে, সেটা থাকে কাদায় ভরা; সেই নোংরা কাদা রাস্তার পরিষ্কার ডাস্টবিনে ঢেলে আবার বালতি নামিয়ে দেয়। কাদা ছাড়া কখনো কিচ্ছু ওঠে না। কত কী তো হারিয়ে যায়, কিন্তু ওর ভিতর থেকে কিছু কক্ষনো বেরোয় না। দাদা বলেছিল বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে ওর সোজাসুজি যোগ আছে, ওর ভিতর কুঁদো কুমির ছেলেপুলে নিয়ে হুমো দিয়ে থাকে, কই বালতিতে তার ডিমটিম তো কক্ষনো পাওয়া যায় না!

দাদার ফাউন্টেন পেন হারিয়ে গেল; চিনুদার কবিতার খাতা হারিয়ে গেল; বদ্যিনাথের নতুন চটি হারিয়ে গেল গোরামামার বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে; সেইদিনই আবার পাল সাহেবের ছাতাও কোথায় হারিয়ে গেল; ছোড়দির চুড়ি ড্রেনের ভিতর তলিয়ে গেল; এতসব গেল কোথায়? তার কিছু মোটে কোথাও পাওয়াই গেল না। অথচ সেই লোক দুটো কত কাদা ওঠাল!

রাত্রে মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন, বুবু পড়ে না, কলু পড়ে। রোজ রাত্রে, রবিবার ছাড়া। কলু কত সময়ে সেই দু-জনের কথা ভাবে, সন্ধি-সমাস গোল হয়ে যায়, মাস্টারমশাই রেগে কাই! বলেন, ওরে আহাম্মুক! আমার ছেলে বিধুশেখর তোর অর্ধেক বয়েসে তোর তিন গুণ পড়া শিখত!

ছেলে বটে ওই বিধুশেখর! তার কথা শুনে শুনে কলু তো হেদিয়ে গেল। সে কক্ষনো হাই তুলত না, কক্ষনো চেয়ারে মচমচ শব্দ করত না, কক্ষনো চটি নাচাত না। প্রথম প্রথম ভাবত, তা হলে সে বোধ হয় এতদিনে নিশ্চয় মরে গিয়েছে। কিন্তু মাস্টারমশাই বলেছেন সে নাকি বিয়ে করে কোথায় পোস্টমাস্টারি করে।

একদিন বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনেছিল। বলেছিল ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি, কোন কবিরাজের কাছ থেকে এনেছে। নাকি অনেকদিন আগে মানুষদের পূর্বপুরুষরা বাঁদর ছিল, সেই বাঁদুরে রক্ত মানুষের গায়ে আছেই আছে, ওই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে–ওই একরকম ধাত কিনা! কলু তার দুটো বড়ি চেয়ে রাখল, কাজে লাগতে পারে।

মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বহুদূরে, উনি তবু রোজ ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হতেন। কী শখ বাবা পড়াবার! মাঝে মাঝে দাদারা এসে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ত, কলুকে শব্দরূপ মুখস্থ করতে হত। কলুর চোখ বুজে আসত, মাথা ঝিমঝিম করত, আর দাদারা শুধু কথাই বলত। কলু দড়িবাঁধা ছেলেটার কথা ভাবত, আর শুনতে পেত পাশের বাড়ির ছোটো ছেলেরা খেতে বসে হল্লা করছে। আর ভাবত, এমন অবস্থায় পড়লে মাস্টারমশাইয়ের ছেলে সেই বিধুশেখর কী করত!

এক-এক দিন যেই পড়া শেষ হয়ে আসত, বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামত। মাস্টারমশাই হয়তো বাড়িতে ছাতা ফেলে আসতেন, আটকা পড়তেন।

কলু ব্যস্তভাবে বলত, ছাতা এনে দিই, ভালো ছাতা?

মাস্টারমশাই বলতেন, না না, থাক, থাক। একটু বসে যাই।

কলু আবার সেই মচমচে চেয়ারটাতে বসত।

মাস্টারমশাই তাঁর ছোটোবেলাকার অনেক গল্প বলতেন। তখন বাবাও নাকি ছোটো ছিলেন, একসঙ্গে ইস্কুলে পড়তেন, পুজোর সময় কাঁদের বাড়ি যাত্রাগান হত, পালিয়ে গিয়ে শুনতেন। কলুর চোখ জড়িয়ে আসত, হাই তুলতে সাহস হত না; ভাবত এতক্ষণে সেই দড়িবাঁধাটা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। হাইগুলো মাথায় গিয়ে জমাট বাঁধত, চম্‌কে জেগে যেত, শুনত মাস্টারমশাই বলছেন, দে বাবা, ছাতাই দে। এ আর আজ থামবে না।

কলু ছুটে ছাতা এনে দিত, মাস্টারমশাই চলে যেতেন আর কলুর ঘুমও ছুটে যেত।

এমনি করে দিন যায়। একদিন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, মাস্টারমশাই বিধুশেখরের কথা বলছেন। সে শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে কক্ষনো বায়োস্কোপ দেখেনি, থিয়েটারে যায়নি, বিড়ি টানেনি, গল্পের বই খোলেনি। বলতে বলতে মাস্টারমশাই বললেন, ওরে, চুপিচুপি দুটো পান সেজে নিয়ে আয় তো দেখি।

কলু দৌড়ে গেল, পান দিল, চুন দিল, দুটো করে এলাচদানা দিল, বড়ো বড়ো সুপুরির কুচি দিল, আর সবশেষে কী মনে করে বদ্যিনাথের সেই আশ্চর্য বড়িও একটা করে গুঁজে দিল।

মাস্টারমশাই একটা পান তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন, একটা বইয়ের মতন দেখতে টিনের কৌটোতে ভরলেন। কলু তাক করে রইল। প্রথমটা কিছু মনে হল না– তারপর ভালো করে দেখল, মনে হল মাস্টারমশাইয়ের কপালের দিকটা কীরকম যেন লম্বাটে দেখাচ্ছে, থুতনিটা যেন। ঢুকে পড়েছে, চোখ দুটোও কীরকম পিটপিট করতে লাগল।

কলুর বুকের ভিতর কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। মাস্টারমশাই বাড়ি যান-না কেন? যদি হঠাৎ ল্যাজ দুলিয়ে হুপ করেন? এমন সময়ে বৃষ্টি থেমে গেল, মাস্টারমশাই ধুতির খুঁটটা কাদা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে গেলেন। কলু ভাবতে লাগল, ক-দিন আর ধুতির খুঁট? অন্য পানটা বিধুশেখর। বোধ হয় আজ রাত্রে চেয়ে নেবে, তারপর সেই-বা ধুতি নিয়ে করবে কী!

.

পরদিন বিকেলে বই নিয়ে কলু অনেকক্ষণ বসে রইল, কিন্তু মাস্টারমশাই এলেন না। সন্ধ্যাবেলা বাবা বললেন, ওরে তোর মাস্টারমশাই যে হেডমাস্টার হয়ে বিষ্টুপুর চলে গেলেন।

কলু ভাবল, বিষ্টুপুর কেন, কিষ্কিন্ধে হলেও বুঝতাম! তারপর বহুদিন চলে গেছে। কলুর নতুন মাস্টার এসেছেন, তার ছেলের নাম বিধুশেখর নয়, তার ছেলেই নেই। তিনি কলুকে রোজ ফুটবলের, ক্রিকেটের গল্প বলেন কিন্তু কলুর থেকে থেকে মনে হয়, অন্ধকারে ওবাড়ির পাঁচিলে দুটো কি ল্যাজঝোলা বসে আছে! একটার মুখ কেমন চেনা চেনা, অন্যটা বোধ হয় বিধুশেখর!

বন্দুক ও ছোরা

ভাই বন্দুক,
কাল যখন গুপ্তস্থানে তোমার চিঠি পেলুম না, তখন আমার মনের অবস্থা যে কী হয়েছিল, সে আর কী বলব! তবে কি তুমি এত সহজেই ভয় খেয়ে গেলে? চিরকাল তো দেখে এসেছি যে, স্বয়ং হেড-সার পেছন ফিরে বোর্ডে কিছু লিখতে গেলেই, তুমি ভেংচি কাটতে, বগ দেখাতে, সে-সময় তো তোমার অন্য মূর্তি দেখতুম!

এমনও নয় যে, তোমার অসুখ করেছে। তাহলে আমার চিঠিটা নিলে কী করে? তা ছাড়া মামার সঙ্গে বুক ফুলিয়ে খেলার মাঠে যাওয়া হচ্ছিল, সে কি আমার চোখে পড়েনি ভেবেছ?

তোমাদের বাড়ির লোকদের ধারণা, আমার সঙ্গে মিশলে তুমি গোল্লায় যাবে। তাই তোমার মন ভোলাবার জন্যেই ওদের এসব চেষ্টা, সে কি তুমি বোঝ না?

তাহলে তোমার এও জানা উচিত যে, আমাদের বাড়ির লোকদের বিশ্বাস, তুমি একটা পাজি বদমায়েশ, তাই আমাকে ও ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে অন্য ইস্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয়েছে।

তোমার সঙ্গে মিশলে আমি খারাপ হয়ে যাব, একথা জেনেও আমি তোমাকে ছাড়িনি; আর তুমি কি শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছ নাকি? আমাদের বাড়ির লোকরা বলে, তোমার টেরি বাগানো দেখেই তোমাকে হাড়ে হাড়ে চেনা যায়। সে কথা কি তবে সত্যি?

অবিশ্যি এক হতে পারে যে, অন্য কোনো দুষ্টু লোকে আমার চিঠিখানা সরিয়েছে, তুমি সেটা পাওইনি। কিন্তু তুমি তাদের বলে না দিলে গুপ্তস্থান খুঁজে বের করা কারো পক্ষে তো সম্ভব নয়!

তোমাদের বাড়ির লোকদের চিনতে আমার বাকি নেই। ওরা যদি তোমার ওপর কোনো রকম জোর-জবরদস্তি করে তো আমাকে একটু জানালেই হয়। ওদের আমি একবার দেখে নিই! যাই হোক, আমাদের বাড়ির লোকদের চেয়ে খারাপ তো আর ওরা হতে পারে না।

এ চিঠির উত্তর তোমার দেওয়া চাই-ই। কারণ সেই তাদের ও-রকম বন্দি অবস্থায় আর বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমার অবস্থা তো সবই জান, ওদের খাবার জোগানো আমার বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠছে না। অথচ কাজ হাসিল হবার আগে মরে গেলেও তো আগাগোড়া লোকসান। ভালো চাও তো চিঠি পেয়েই গুপ্তস্থানে উত্তর রেখে দেবে। ইতি–
ছোরা।

.

ভাই ছোরা,
তা বললে তো চলবে না, এই সময় ওরা মরে গেলে হবে না। আমি আর ধরে আনতে পারব না বলে রাখলাম। প্রাণ হাতে নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। আম বাগানের ও-দিকটাতে কী ঘন কচু বন, তোমার কোনো ধারণাই নেই। আমি বলেই পেরেছিলাম। বড়োজোর আজ বাদে কাল। তারপর তো আর খাবারের দরকার হবে না, এখন আর অত বাছবিচার কীসের? তবে আশা করি ওদের একসঙ্গে রাখনি? তাহলে হিংস্র হয়ে উঠে আবার পরস্পরকে আক্রমণ করে!

আমাদের বাড়ির লোকরা শনিবারের তিনটের শোর জন্যে বাড়িসুদুসকলের টিকিট কিনেছে আর রবিবার ভোরে দল বেঁধে সোনারপুর যাওয়া হচ্ছে, সেখানে লুচি পাঁঠা রান্না হবে। আমাকে হিংসে করে আমার বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে তুমি যা ইচ্ছে বলতে পার, আমার কাচকলাও এসে যাবে না। তা ছাড়া ওরা যে লোক ভালো নয় সে তো আমি বরাবর জানি। গত বছর যাত্রা দেখতে যাওয়া নিয়ে কী কাণ্ড করেছিল, সে আমি আজও ভুলিনি। না বলে যাব না তো কী করে যেতাম? বললে কি ওরা মত দিত বলতে চাও? সে যাক গে, এখন একটু চুপচাপ থাকো, এদের মনের সন্দেহ ঠান্ডা হোক, তারপর আর কোনো ভাবনাই থাকবে না। ওদিকে আমিও বেশ ফ্যাসাদে পড়েছি, টাকাকড়ি না হলে তো কোনো ব্যবস্থাই করা যাচ্ছে না। তোমার জন্মদিনে পাওয়া টাকাগুলো এরইমধ্যে কী করে খরচ হয়ে গেল, ভেবে পেলাম না! সব টাকা আমি জোগাব, আমি কি একটা ব্যাঙ্ক নাকি? ওই যে কী নাম, ভুলে যাচ্ছি যা নিয়ে দেবতারা ঝগড়া করতেন, ইচ্ছে-গাই না কী যেন? ইতি–
বন্দুক।

পুঃ–কালকের চিঠির উত্তর দিইনি, কারণ ফুল্লরা কেবিনে মামার সঙ্গে কাটলেট খেতে যাবার দরুন সময় পাইনি।

.

ভাই বন্দুক,
তোমার চিঠি পড়ে বুঝতে বাকি রইল না, তোমার কতদূর অধঃপতন হয়েছে। জন্মদিনের টাকা দিয়ে তো কবে সেই টিকিটের অ্যালবাম কিনেছিলুম, কোন কালে সে হারিয়েও গেছে।

আর টাকার অভাব আবার একটা কথা নাকি? আমার অনেক হাতের লেখা লিখতে হয়, নইলে টাকা রোজগার করা কী এমন শক্ত, বুঝলুম না। যাই হোক, কয়েকটা উপায় বাতলে দিচ্ছি, তাতে কিছুটাকার উপায় হবেই। যেমন (১) তেলেভাজার দোকান– কোনো মূলধন লাগে না। তোদের রান্নাঘরে ও ভঁড়ার ঘরে সব পাবি। (২) ধারের ব্যাবসা। মামার কাছ থেকে দুটো টাকা চেয়ে দু-টাকার জায়গায় তিন টাকা দেবে। আবার খাটাবি, হবে সাড়ে চার টাকা– তা হলেই হবে। (৩) লটারি করা। তোদের পুরোনো রেডিয়োটা লটারি করে দে, এক টাকা টিকিট। তিন দিনে দুশো টিকিট বিক্রি হবে তার দেড়-শো দিয়ে একটা নতুন রেডিয়ো কিনবি, বাকি টাকা আমাদের। এইগুলো করে দ্যাখ, নিশ্চয়ই যথেষ্ট হবে। ইতি–
ছোরা।

পুঃ– আর দ্যাখ, দু-এক দিনের মধ্যে যা হয় করিস। ওদের মধ্যে তিন জন নড়ছে-চড়ছে না। ভাতটাত খায় না কেউ। রুটিও না।

.

ভাই ছোরা,
তোর আহ্লাদ দেখে অবাক হই! আমি সব করব আর উনি শুধু বুদ্ধি জোগাবেন,এ তো মজা মন্দ না! এদিকে চারদিক থেকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। ওদের ভালো করে তোদের খালি গোয়ালে লুকিয়ে রেখেছিস? শব্দটব্দ করে না আশা করি? কারণ আমার খুব মনে হয় না–আমাদের পিছু নিয়েছে। জানিস তো ওর কীরকম লোভ। আমাকে এক দণ্ড ছাড়ে না, ইস্কুলে সঙ্গে যায় আসে।

গোপন জায়গার পাশ দিয়ে যাই আসি, তবু চিঠি নেওয়া একটা সমস্যা হয়ে পড়েছে। কেউ নিশ্চয় ওকে টাকা দিয়ে বশ করেছে। কারণ চিরকাল তো ওর ব্ল্যাক গড়ের মাঠ বলে জানি, অথচ কাল যখন সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল, পকেট থেকে ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। ও চান করতে বাড়ি গেলে এ-চিঠির ব্যবস্থা করব। যাই হোক, তুই কিছু ভাবিস না, কাল একটা হেস্তনেস্ত করবই। কিন্তু ভাই, মনে থাকে যেন, এবার আমাকে রাজা করতেই হবে, আমি আর ঘৃণ্য হীন পদে থাকতে রাজি নই। এত করছি শুধু ওই জন্যেই। ইতি–
বন্দুক।

.

ভাই বন্দুক,
গুপ্ত জায়গার কথাটা ম-কে বলতে হয়েছে, কারণ এরা আমাকে দু-দিন উপরি উপরি জোলাপ খাওয়াল, চিঠিপত্র নেওয়া আনার আর কোনো ব্যবস্থা করা গেল না। তবে ও কাউকে বলবে না বলেছে।ওর নাকি ভয় ভয় করে, যদি ধরা পড়ে, তাই। তাই ওকে কিন্তু সেনাপতি না করলে হয়তো সবাস করে দেবে। ওদিকে ওদের তো প্রায় সবার দফা শেষ। গোয়ালে আর ঢুকতেও ইচ্ছে করে না। সেই অন্যদের দিয়েই কাজ চালাতে হবে। টাকার কিছু করতে পেরেছিস নাকি? বেশি কেনবার কী দরকার? গোটা পাঁচেক হলেই তো যথেষ্ট। আমি ছোড়দাদুর পাকাচুল তুলে এক টাকা জমিয়েছি, বাকিটা কিন্তু তোকে তুলতেই হবে, নইলে সব মাটি, আর সময়ও নেই একদম। ইতি– ছোরা।

.

ভাই ছোরা,
শুনে খুশি হবি, সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। শই আমার শাপে বর হল। ওকেও দলে টানতে হল। বলেছি মন্ত্রী করে দেব। ওর কাছ থেকে তিন টাকা ধার নিয়ে পাঁচটা কিনেছি। আর যা যা লাগবে তোর টাকাটা দিয়েই হয়ে যাবে। আজ রাত্রে শ– নিজে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। তুইমকে দিয়ে সেই অন্যদের জোগাড় করে পাঠাস আর টাকাটাও দিস। তাহলে কাল ভোরের মধ্যে সব হয়ে যাবে। শুধু তাদের বাঁচিয়ে রাখা গেল না, এই এক দুঃখ থেকে গেল। ইতি
বন্দুক।

.

ভাই বন্দুক,
আমার সত্যি সত্যি সর্দিজ্বর হয়েছে। জানতুম অত জোলাপ আমার সইবে না! তার ওপর সকাল থেকে মন খারাপ, কারণ কিছুই বুঝে উঠতে পারলুম না।ম–র দেখা নেই, সেই কাল সন্ধ্যে বেলা টাকা নিয়ে আর অন্যগুলোকে নিয়ে গেছে তো গেছেই, কাজ হাসিল হয়েছে কিনা তা পর্যন্ত বুঝলুম না। সব জানাস ভাই, নইলে এই রোগশয্যা থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করছে না। ইতি–
ছোরা।

.

ভাই গুপি,
আর গোপনতার কোনো দরকার নেই, যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে। শম্ভু আর মন্টু দু-জনে মিলে রাতে নতুন খুড়োর পুকুরে পাঁচটা ছিপই কেঁচো গেঁথে ফেলে রেখেছিল। ভোরে গিয়ে দেখে পাঁচটা চার-সেরি, সাড়ে-চার-সেরি কাতলা পড়েছে। সেইগুলোকে তুলে নিয়ে চারটেকে ওরা পুজো কমিটির চার জনার বাড়িতে নিজেদের নামে দিয়ে এসেছে আর একটা দিয়েছে নতুন খুড়োকে। এত বড়ো মিথ্যাবাদী যে, বলেছে টালিগঞ্জে গিয়ে নাকি কোন বন্ধুর পুকুর থেকে ধরেছে। তারা তো সব আহ্লাদে আটখানা। মাছের গায়ে তো আর টিকিট ঝোলানো নেই যে, নতুন খুড়োর পুকুর থেকে ধরা।

নতুন খুড়ো এইমাত্র জ্যাঠামশাইকে বলে গেলেন, শম্ভু আর মন্টু নাকি পুজোর নাটকে রাজা আর শত্রু-রাজা হবে, আর তোকে আমাকে নাকি মন্ত্রী আর সেনাপতি করা হবে। সে পার্টগুলো কত ছোটো তোর মনে আছে তো ভাই? আর শম্ভু মন্টুর পেজোমি দেখলি! নতুন খুড়োর পুকুর থেকেই রাতারাতি মাছ চুরি করে চুরি নয় তো কী ভাই?– ওকে আর ওর দলটিকে দিয়ে আমাদের পার্টগুলো বাগিয়ে নিলে। এই বয়সেই এই, আরও বড়ো হলে যে পাকা দাগি চোর হবে, তাই-বা কে বলবে! অথচ বুদ্ধিটা হল তোর আমার! কচুবন থেকে ফড়িং ধরে এনেছিলুম আমি, নেহাত তুই বাঁচাতে পারলি না বলে কেঁচো দিয়ে ধরতে হল। কিন্তু সমস্তটা আমাদের মাথা থেকেই বেরুল, অথচ ফল ভোগ করছে ওরা দুটোতে। তোর বাবা আমাদের বাইরের ঘরে বসেছিলেন, নতুন খুড়ো তাকে কী বললেন জানিস? বললেন, ওই জগু গুপি দু-টি গুণধরকে আলাদা করে দিয়ে খুব বুদ্ধির কাজ করেছেন, দাদা।শম্ভ মন্টুর মতো ভালো ছেলেদের সঙ্গে মিশলে এখনও ওদের সুমতি হতে পারে। নিজের পুকুরের মাছ উপহার পেয়েই একেবারে গলে জল। ওই বুড়োকে কী করে জব্দ করা যায় এখন তাই ভাবছি। সবচেয়ে দুঃখ হচ্ছে, গুপ্ত জায়গাটা ওরা জেনে গেল বলে।নইলে কচু বনের পেছনের ভাঙা দেয়ালের আলগা ইট সরিয়ে তার পেছনে চিঠি রেখে, আবার ইট বন্ধ করার কথা তোর ছাড়া আর কার মাথা থেকে বেরুত ভাই?

ঠিক করেছি, তোর জ্বর হয়েছে বলে বাবা জ্যাঠামশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে একবার তোকে দেখতে যাব। তখন বাকি কথা হবে। ইতি–
তোর প্রাণের বন্ধু
জগু

ভূতের ছেলে

রাত যখন ভোর হয়ে আসে তখন ওই তিন-বাঁকা নিম গাছটায় হুতুম প্যাঁচাটারও ঘুম পায়। নেড়ু দেখেছে ওর কান লোমে ঢাকা, ওর চোখে চশমা, ওর মুখ হাঁড়ি। হুতুমটা কেন যে চিল-ছাদের ছোটো খুপরিতে পায়রাদের সঙ্গে বাসা করে না, নেড়ু ভেবেই পায় না। বোধ হয় ভূতদের জন্যে।

নিম গাছতলায় ভূত আছে।

একদিন ভোর বেলায়, মই বগলে ছাগলদাড়ি লোকটা রাস্তার আলো নিবিয়ে নিবিয়ে চলে গেলে পর, নেড়ু দেখেছিল কোমরে রুপোর ঘুনসিওয়ালা, মাথায় গুটিকতক কোঁকড়া চুল, ভূতদের ছোটো কালো ছেলে নিম গাছতলায় কাঁসার বাটিতে নিম ফুল কুড়চ্ছে। নেড়ুকে দেখেই ছেলেটা এক চোখ বুজে বগ দেখাল। নেড়ু, ভাবল, ভূত কিনা, তাই ভদ্রলোক নয়।

তারপর অনেক দিন নেড়ু অনেক বেলা পর্যন্ত গাঁক গাঁক করে ঘুম লাগিয়েছে, শেষটা এমনকী ভজাদা এসে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়েছে। নেড়ু, কিন্তু একটুও রেগেমেগে যায়নি। ও তো আর সুকুমারদা নয় যে মুখ দেখলে বালতির দুধ দই হয়ে যাবে! কিন্তু সেই ছানাটাকে আর দেখা হয়নি।

শেষটা হঠাৎ একদিন নেড়ু স্বপ্ন দেখল কালো ছেলেটা ওকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে নাকের ফুটোয় কাগের নোংরা পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাগের চোটে নেড়ুর ঘুম ছুটে গেল। ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথায় সুপুরি বসিয়ে লাগায় খড়ম! খানিক চোখ রগড়ে, জিভ দিয়ে তালুতে চুকচুক করে চুলকে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, মই বগলে সেই লোকটা। তারপর নিমতলায় তাকিয়ে দেখল ভূতের ছানাটা একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বেজায় হাসছে, যেন কালো ভাল্লুক মুলো চিবোচ্ছে। সে কী বিশ্রী হাসি! গোটা কতক শুট লাগালে হয়!

ছেলেটা নেড়ুকে দেখে আজ আর বগ দেখাল না, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ভূতের ছেলে বাবা! বিশ্বাস নেই! নেড়ুর একটু ভয় করছিল, ঘরের ভিতর এদিক-ওদিক একবার তাকাল। দেখে ভূতের ছেলে কিনা কুঁজোর পিছন থেকে একটা এয়া বড়া টিকটিকি মুণ্ডু বাড়িয়ে, ঘোলাটে চোখ পিটপিট করে ঘুরিয়ে আহ্লাদে আহ্লাদে ভাব করে টিক-টিকটিক করে আবার মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে নিল, কেমন যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব! নেড়ুর ভারি রাগ হল। কী, ভয় পাই। নাকি!

নেড়ু আস্তে আস্তে নীচে গেল। দাঁত মাজল না। চোখ ধুল না। তাতে কী হয়েছে? সেই ছেলেটার তো নাকে সর্দি!

নিমতলায় যাবার পথে দেখে দুই দিকে দেয়ালে খুঁটে। দেওয়া। কতকগুলো গোল গোল মতন, সেগুলো ধোপার। মা দিয়েছে; আর কতকগুলো ঠ্যাংওয়ালা, সেগুলো ধোপার মায়ের মেয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিমতলায় গিয়ে দেখে ছেলেটা কোথায় যেন সটকে পড়েছে। কী। জানি ভোর হয়ে এসেছে, আলো-টালো দেখে উঠে গেল না তো!

সেই দিনই সন্ধ্যা বেলায় নেডুর দাঁত ব্যথা করছিল, তাই লবঙ্গ-জল দিয়ে মুখ ধুয়ে জানলার উপর বসে ভাবছিল, আচ্ছা নেপাল খুড়োর কেনই-বা অমন সিন্ধুঘোটকের মতন গোঁফ, আর বিধুদাই-বা কেন দিনরাত টিকটিক করেন!

এদিকে ওদের বাড়ির দারোয়ান কী যেন গাইছিল, মনে হচ্ছিল–

নিমতলাতে আর যাব না,
কেলো-ভূ-তে-র-কা-লো-ছা-না!

হঠাৎ শুনল, এইয়ো।

চমকে আর একটু হলে ধুপুস করে পড়েই যাচ্ছিল! আবার শুনল, এইয়ো!

চেয়ে দেখে নিমতলায় আবছায়াতে সেই ভূতের ছানাটা! নেড়ু গলা নামিয়ে হিন্দিতে ফিসফিস করে বললে, হাম শুনতে পাতা।

ছানাটা আবার বাংলায় বললে– সকালে কি পায় শেকড় গজিয়েছিল?

নেড়ু বললে, আমি তো গেলুম, তুমিই আলো দেখে চলে গেছিলে।

ছেলেটা বললে, দ্যুৎ, আলো নয়, বাবাকে দেখে।

নেড়ু, ভাবল– কেন, বাবাকে দেখে চলে যাবে কেন? নেড়ু শুধু এক বার বাবাকে দেখে চলে গিয়েছিল সেই যেবার দরোয়ানের হুঁকা টেনেছিল। তাই জিজ্ঞেস করল– হুঁকো টেনেছিলে?

ছেলেটা মাথা নেড়ে বললে, দুৎ। তার থেকে বিড়ি ভালো।

তোমার বাবা কি গাছে থাকেন?

দুৎ! থাকেন না, চড়েন। আমি অনেক তাগ করে থাকি, কিন্তু কক্ষনো পড়েন না!

তিনি কি প্যাচা?

দুৎ! তারপর ছেলেটা একটা কথা বললে যেটা মা একদম বলতে বারণ করেছেন। নেড়ু বললে ছি!– আচ্ছা, তাঁর পা কি উলটোবাগে লাগানো?

এবার ছেলেটা বেদম রেগে গেল। ভুরু কুঁচকে, ফেসফাস করতে লাগল, আর হাতটাকে ঘুসি পাকাতে আর খুলতে লাগল, যেন এই পেলেই সাবড়ে দেয়। তারপর কী ভেবে ঠান্ডা হয়ে বললে—

ওই যে মিস্ত্রিগুলো সারাদিন বাঁশের টঙে চড়ে তোমাদের বাড়ির বিশ্রী জানালাগুলোতে তোমার গায়ের রঙের মতন বদ সবুজ রং লাগায়, ওদের একটা দড়িবাঁধা রঙের টিন, আর একটা বড়ো চ্যাপটা রং লাগাবার জিনিস যদি আমাকে এক্ষুনি না এনে দাও তাহলে তোমাকে, তোমার বাবাকে, তোমার দাদাকে, আর তোমার মাকে কচুকাটা করব। তোমাদের ছোটো খুকিকে পানের মশলা বানিয়ে কড়কড়িয়ে চিবিয়ে খাব। তোমাদের মাসি-পিসি যে যেখানে আছে তাদের থেতলোকরব! তোমাদের রুটিওয়ালা, ঘিওয়ালা, আর যা যা তোমরা রাখ সব কটাকে লম্বা লম্বা ফালি করে ছিঁড়ে কাপড় শুকুবার দড়িতে ঝুলিয়ে শুঁটকি মাছ বানাব। আর তোমার যত বন্ধু আছে সবগুলোকে নুনজল দিয়ে কঁচা কাঁচা গিলে খাব।

বাপরে, কী হিংস্র খোকা!

নেড়ু তাড়াতাড়ি একটা টিন, আর দু-তিনটে বুরুশ তাকে দিয়ে এল। ছেলেটা ফ্যাচফ্যাচ করে। হাসতে হাসতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

রাতে নেড়ু শুনতে পেল ফিসফিস করে কারা কথা বলছে। কানে আঙুল দিয়ে শুল, তবু মনে হল কে যেন বলছে–

আছে– আছে!
নিম গাছে!

নেড়ু ভাবলে, ওরে বাবা, কী আছে রে?– পান্তভূত? কবন্ধ? পিশাচ? স্কন্ধকাটা? গন্ধবেনে? শাঁখচুন্নি? পেতনি? প্যান্তাখেচি?

নেড়ু তো নাক-মুখ ঢেকে রাম ঘুম লাগ।

.

পরদিন সকালে নীচে যাবার সময় সিঁড়ির জানলা দিয়ে দেখে, রাস্তায় ওবাড়ির বড়ো কর্তা, এবাড়ির দরোয়ান, দাদা, বাবা, মন্টুর বাবা, দিনদা, আরও কত কে। সবাই ঠ্যাং হাত ছুঁড়ে বেজায় চাঁচাচ্ছে!

নেড়ু, আরও দেখল রাস্তার সব বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সবুজ রং দিয়ে নানানরকম চিত্তির করা, পাশের বাড়ির সাদা গেটটা ডোরাকাটা!

হঠাৎ নেড়ুর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবার জোগাড় করল– সেই হিংস্র ছানাটা পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে রভের বুরুশ, আর-এক হাতে রঙের টিন, এক কান ওবাড়ির। দরোয়ান ধরেছে, আর-এক কান এবাড়ির লছমন সিং। আর ছেলেটা জোরসে চেল্লাচ্ছে।

তারপর ভঁকভঁক করে একটা মোটর ডাকল, আর পথ ছেড়ে সকলে চলে এলেন। লছমন সিংও কানে শেষ একটা প্যাঁচ দিয়ে খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেড়ে দিল। তারপর ওদের বাড়ির দরজায়ান ওর হাত থেকে খামচা মেরে রঙের টিন আর বুরুশ নিয়ে গেল, হিন্দিতে আর বাংলাতে বিড়বিড় কীসব বকতে বকতে, শুট মারতে মারতে ওদের বাড়ি দিয়ে গেল!

নেড়ু, পাড়াসুদ্ধ সক্কলের সাহস দেখে এমন হাঁ হয়ে গেল যে দেখতেই ভুলে গেল ছেলেটার পা উলটোবাগে লাগানো কি না!

মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী

প্রেমের এমন একটা অবাধ্য ভাব আছে, তার জন্য বিষম আয়োজন করে প্রতীক্ষা করলে তার দর্শন মেলা দায়, কিন্তু যখন তার আগমন কেবলমাত্র অপ্রত্যাশিত নয়, অসুবিধাজনকও বটে, তখন সে ত্রিভুবন জুড়ে বসে।

মন্দাকিনীও এই ধরনের একটা ঘটনায় জড়িত হয়েছিল। যতদিন পুষ্পিত লতার মতন তার জীবনে প্রথম যৌবনের সুরভি লেগে ছিল, এবং মর্মরিত বেণুকুঞ্জে কোকিল-কণ্ঠের মতন তার মনের কোণে কোণে অনাগত বনমালীর বাঁশরী বেজেছিল ততদিন ধরে সে কল্পনানেত্রে তার প্রিয়তমের অতি প্রত্যক্ষ মূর্তি দেখতে পেতা

বেশ দীর্ঘ গৌরবর্ণ দেহখানি, ভ্রমরকৃষ্ণ কোঁকড়া চুল, হরধনুকে হার মানিয়ে দেয় জ্ব-যুগল, অধরোষ্ঠে কোমল কঠিন অপূর্ব সমাবেশ কিবা বঙ্কিম গ্রীবা, বাঁশির মতন নাসিকার ডান পাশে নীচের দিকে ভুবনভুলোনো ছোট একটি কালো কুচকুচে তিল, দাড়ি-গোঁফ কামানো। কণ্ঠস্বরে কখনও বজ্রনির্ঘোষ শোনা যায়, কখনও বা কলনাদিনী স্রোতস্বিনীর কথা মনে পড়ে। পরিধানে কখনও বা সাদা ধুতি চাদর, কখনও বা সুবিন্যস্ত গ্রে-রঙের পাশ্চাত্য বেশ শোভা পায়।

এই আশ্চর্য ব্যক্তি মানসলোকে হয় জ্যোৎস্নানিশীথে বিজন বেণুকুঞ্জে কিম্বা বর্ষা-সন্ধ্যায় বসবার ঘরের স্তিমিত দীপালোকে মন্দাকিনীর কানে কানে কত যে রোমাঞ্চকর মধু বর্ষণ করত তার লেখাজোখা নেই।

অবশেষে একদিন মন্দাকিনীর ঈষৎ কম্পমান বাঁ হাতখানা ধীরে ধীরে নিজের করকমলে তুলে নিয়ে, নীল মখমলের ছোট বাক্স খুলে নক্ষত্রোজ্জ্বল এক হীরের আংটি পরিয়ে দিল এবং মন্দাকিনীর রক্তিম অধরে…এর বেশি কল্পনা করবার ক্ষমতা মন্দাকিনীর ছিল না। তাছাড়া এতেই তার এমন শিহরণ লেগে যেত যে, সেরাত্রে চোখে ঘুম আর আসত না। বলা বাহুল্য, এই সকল রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর মধ্যে মন্দাকিনীর পরনে থাকত সুযোগ্য নীল শাড়ি, সোনালী তার আঁচল।

দুঃখের বিষয় এমন সুপ্রকাশ যার রূপ, সে ব্যক্তি চিরকাল মন্দাকিনীর আগ্রহাধীর নয়নযুগলকে ফাঁকি দিয়ে যেতে লাগল। কত যে বর্ষা-সন্ধ্যা, কত যে জ্যোৎস্নাময় নিশীথ বিফল হয়ে যেতে লাগল তার কোন হিসাব নেই। শেষ পর্যন্ত মন্দাকিনী তার দুর্লভ আদর্শটিকে ধরা ছোঁয়ার গোচর করবার দুরাশায় তাকে অনেকটা খর্ব করেও এনেছিল।

তার অমন সুঠাম দেহের দৈর্ঘ্য থেকে দু-চার ইঞ্চি হেঁটে দিয়ে, তার ওই উজ্জ্বল গৌর কান্তিতে একটুখানি শ্যামলের ছোপ ধরিয়ে, তার দাড়িকে শেষ পর্যন্ত না-মঞ্জুর করে, (কারণ কে না জানে যে ভক্তির রাজ্যে যাই হোক, প্রেমের রাজ্যে দাড়ি অচল) তার গোঁফ সম্বন্ধে একটু উদার হয়ে, তাকে প্রায় সাধারণত্বের কোটায় এনে ফেলেছিল।

তবু তার দিশা পাওয়া যায় নি। একটি সুকোমল নারীহৃদয়ে তার জন্য এত সম্ভার রক্ষিত আছে, তবু যদি সে নরাধম অনুপস্থিত থাকে তবে সে কোন রকম সহানুভূতিরও অযোগ্য একথা। জেনে অবশেষে একদা নির্দয়ভাবে স্বহস্তে তাকে প্রিয়তমের সিংহাসন থেকে বিদায় দিল। এমন কি মনে-মনে তাকে আহাম্মক আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করলে না। তবু মাঝে মাঝে নির্জন নিশীথে তার মনে সংশয়ের দোলা লাগত, আর ওই শূন্য সিংহাসনখানা অন্ধকারে হাহাকার করত।

সময় কিন্তু লঘুপদে চলে যেতে লাগল আর মন্দাকিনীর যৌবন থেকে একটু একটু করে মধু চুরি করে নিতে লাগল। মন্দাকিনী এতদিন অলস ছিল না, ধীরে ধীরে অনেক বিদ্যাকে অনেক ললিতকলাকে আয়ত্ত করে ফেলেছিল।

তার কাঁচা-রূপের সাজ আভরণে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া গেল। সে রূপসীও নয়, কুরূপাও নয়। দুইয়ের মাঝামাঝি এমনটি, যার মাধুর্য দেখামাত্র চোখে পড়ে না, কিন্তু মন দিয়ে খুঁজলে সুপ্রকাশ হয়ে পড়ে।

যত দিন যেতে লাগল তার কথায়, ভঙ্গিতে, সজ্জায়, এমন কি কবরী রচনাতেও একটা তীব্রতা প্রকাশ পেল, যার মাধুর্য মধুরের চেয়ে তিক্ত বেশি রৌদ্রবর্ণ বহুমূল্য সুরা যেমন বেশিদিন রেখে দিলে তিতিয়ে যায়। আর নিয়ত তার কানে বাজতে লাগল কালের রথের চাকার ধ্বনি।

জীবনটাকে যখন শূন্য বোধ হবার আশঙ্কা হল, মন্দাকিনীরও সুবুদ্ধি হল। হৃদয়ের সমস্ত অপ্রার্থিত প্রেমরাশি একজন অনাগত মানুষের চরণ থেকে অপসারিত করে সে সহজে আয়ত্ত বস্তুর উপর ন্যস্ত করল। বস্তুর পোষমানা ভাবটা তাকে নিগূঢ়ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। যে সকল বস্তুকে কামনা করলে, এবং যে-ভাবে কামনা করলে অন্তঃকরণ স্কুল ও বৈষয়িক হয়ে যায়, তারা সেভাবে মন্দাকিনীকে লুব্ধ করল না। সে ভালবাসল প্রাচীন ও আধুনিক চিত্র, পুঁথি, বাসন, সূচিকর্ম, নকশা-দেওয়া হাতে-বোনা পর্দা, মিনে-করা চৌকি—এমন আরও কত কী!

সৌন্দর্যের এমন একটা মোহিনী শক্তি আছে যে, যে তাকে অর্থ দিয়ে কেনে তাকেও সে নক্ষত্রলোকে নিয়ে যায়। যা কিছু সুন্দর, সৌন্দর্যই তার সার্থকতা। তার আর কোনও গুণের প্রয়োজন নেই। সে নয়নানন্দ। তার কাছে আর কিছু প্রত্যাশা করলে তার প্রাণময় পরিপূর্ণ রূপরাশি অর্থহীন বিলাসে পরিণত হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে।

যে কেউ সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না। কিন্তু মন্দাকিনী জানত। তাই তার বারবার হতাশ হয়ে যাওয়া হৃদয় মরুভূমি না হয়ে গিয়ে নিত্য নূতন রসের উৎসের সন্ধান পেল।

সৌন্দর্যের উপাসকের যে অনাবিল অবসর ও অজস্র অর্থের প্রয়োজন, যে দুষ্ট-শনি মন্দাকিনীর পিছু নিয়েছিল, সে একদিন সে সকল হরণ করে নিল। মন্দাকিনী সৌন্দর্যের উপাসনা তখনকার মতন বন্ধ করে দিয়ে, সৌন্দর্যের সামগ্রীগুলোকে এবাড়ি-ওবাড়ি বাক্সবন্দী করে কেমন করে যেন এক মাস্টারী যোগাড় করে দার্জিলিং চলে গেল।

দার্জিলিংয়ে গুছিয়ে বসলে পর চারিদিকে চেয়ে মন্দাকিনী দেখল হিমালয়ের কোলে কোলে রডোডেনড্রন গাছের সারি, কিন্তু তার একটিরও উদ্ধত শাখার রাঙা পুষ্পস্তবকের নাগাল পাওয়া যায় না। পাহাড়ের কানা ধরে ধরে একটির পর একটি ঝাউ গাছের শ্রেণী, কিন্তু তাদের দীর্ঘ শীর্ণ ছায়াগুলি অগম্য রাজ্যে নিচের উপত্যকায় সাদা মেঘ জমেছে, সেখানে পৌঁছনো অসম্ভব।

এক দিক রোদে স্নান করছে, সেদিকে চাইলে মন গলে জল হয়ে যায় অন্য দিক কুয়াশাচ্ছন্ন, সেদিকে চাইলে মন জমে বরফ হয়ে যায়। কিন্তু এ সৌন্দর্য নৈর্ব্যক্তিক, একে মন্দাকিনীর সেই জয়পুরী চৌকির মতন কোলের কাছে টেনে নেওয়া যায় না। বরং একে বেশিক্ষণ দেখলে মনে একটা নিষ্কাম বৌদ্ধভাব জন্মায়।

ঠিক এই সময়, যখন জগৎটা মন্দাকিনীর কাছে অকিঞ্চিৎকর হয়ে আসছিল তখন সে এক ম্লান গোধূলির আলোতে ডাক্তার চ্যাটার্জির খুদে বাড়িখানা আবিষ্কার করল।

পাহাড়ের গায়ে একটুখানি অপরিসর জমির উপর, সত্যি কথা বলতে কি, খানিকটা শূন্যমার্গে, লোহা ও ইটকাঠের উপর ধৃত হয়ে অতি বিপজ্জনক ভাবে, কায়ক্লেশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সাক্ষ্য দিয়ে কোনও গতিকে বাড়িটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্দাকিনীর হৃদয়ে তার মায়াজাল বিস্তার করল।

এক মুহূর্তে তার চোখে পৃথিবীর রঙ বদলে গেল। তার যে মন দূর বনান্তরালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পদাঙ্গুলির অগ্রভাগে নির্ভর করে দুই পক্ষ বিস্তার করে বিহঙ্গের মতন উড়ে যাচ্ছিল, সে আবার। পাখা বন্ধ করে কুলায়ে ফিরে এল।

চর্মচক্ষে মন্দাকিনী দেখল বহুবর্ষের বৃষ্টিধারায় রঙ-ওঠা, কাঁচেমোড়া, বিবর্ণ সবুজ পর্দা ঘেরা ছোট দোতলা বাড়ি ভাঙা কাঁচের অন্তরালে দৃশ্যমান ধূলিমলিন মনোমোহিনী কাঠের সিঁড়ি। পশ্চিমদিকের ঝাউগাছ তাদের আলম্বিত ছায়াগুলিকে দেওয়ালের উপর ফেলেছে। সামনের শানবাঁধানো জমির ধারে ধারে ক্রিস্যান্থিমাম গাছ, জেরেনিয়াম গাছ, আর তাদের পদপ্রান্তে প্রিমরোজ ও ভায়োলেটা কোথাও একটি ফুল ফোটেনি এবং কখনও ফুটবে কিনা সন্দেহ। জনমানুষের সাড়া নেই।

এই শূন্য বাড়িখানা মন্দাকিনীর হৃদয়কে এক নিমেষে গ্রাস করল। সে তার মাস্টারনীসুলভ গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে গেট খুলে অনধিকার প্রবেশ করল এবং অমার্জনীয় ভাবে পায়ের আঙুলের। উপর দাঁড়িয়ে হেঁড়া পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর দেখল গদি-মোড়া প্রাচীন ও সুশ্রী আসবাবে ধুলো জমেছে।

তারপর ওই বাড়ি তাকে যাদু করল। অনেকদিন পর সে তার মিনে-করা বাসন ইত্যাদির দুঃখ ভুলে গেল। সমস্ত দিনের কর্মব্যস্ততা অসহ্য মনে হত বিকেলবেলা ওই রঙ-ধোওয়া বাড়ির কাছে সে নিজেকে খুঁজে পেত।

দিনের পর সপ্তাহ ও সপ্তাহের পর মাস এই ভাবে গড়িয়ে গেল। মন্দাকিনী মনে মনে বাড়িখানাকে মেজে-ঘষে ফেলল, পুরনো সবুজ পর্দাগুলি ধোপার বাড়ি পাঠিয়ে নতুন ঘোর গোলাপী রঙের পর্দা লাগাল। প্রাচীন আসবাবের ধুলো মুছল, বাগানটির সংস্কার করে অনেক যত্নে সেখানে ফুল ফোঁটালা এমন কি কালো চীনেমাটির চ্যাপটা ফুলদানিতে ফুল সাজাল।

হঠাৎ একদিন মন্দাকিনী মনে মনে একটা বেহিসাবী কাজ করে ফেলল। মনগড়া অপরূপ এক দাঁড়-করানো বিজলী বাতি কিনে ফেলল, কোথায় তাকে মানাবে ভেবে মনে বড় অশান্তি অনুভব করল। মনস্থির করবার জন্য বিকেলবেলা সেখানে গিয়ে গেট খুলে ঢুকেই পটের পুতুলের মতো থমকে দাঁড়ালা

আধ-ময়লা ছাইরঙের পেন্টালুন, গলা-খোলা নীল রঙের শার্ট আর কালো পশমের গেঞ্জি গায়ে একজন লোক ঝাঁঝরি হাতে মরা ফুলগাছে জল দিচ্ছে। তার মুখের ডানপাশে প্রাচীন পাইপ এবং দেখামাত্র বোঝা যায় যে তিনদিন ক্ষৌরকর্ম হয়নি। রান্নাঘরের খোলা জানলা দিয়ে অশুদ্ধ তেলের গন্ধ ভেসে আসছে।

সেই ব্যক্তি মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে, হাত থেকে ঝাঁঝরি নামিয়ে অবাক হয়ে দেখল গেটের উপর হাত রেখে বছর ত্রিশ বয়সের একজন শ্যামবর্ণ মহিলা বেতসলতার মত কাঁপছে। তাকে বিপন্ন মনে করে কাছে যেতেই সে একটু অপ্রতিভ স্বরে বলল, ‘আমি রোজ আসি।’ ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, বাড়ি আর বাগানের অবস্থা থেকে তার পরিচয় পেয়েছি। ‘ তাইতে মন্দাকিনীর একটু রাগ হল এবং রোষকষায়িত নেত্রে ঝাঁঝরিখানা নিয়ে যে গাছে ডাক্তার চ্যাটার্জি একবার জল দিয়েছেন তাতে আবার জল দিতে লাগল আর ডাক্তার চ্যাটার্জি পাইপটা আবার মুখে দিয়ে প্রসন্নচিত্তে মস্ত এক গাছ-ছাঁটা কাঁচি তুলে নিলেন।

এমনি করে মন্দাকিনীর মন আর মন্দাকিনীর মনোবার মাঝে এক অন্তরাল রচনা হল। ডাক্তার চ্যাটার্জির মধ্যে নয়নলোভন কোনও গুণ প্রকাশ পেল না যা বিন্দুমাত্র চিত্তাকর্ষণ করো এমন কি চিত্তাকর্ষণ করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা পর্যন্ত দেখা গেল না।

কোন সুদূর মহানগরীর ছায়াময় খ্যাতি তাঁর নামের সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁর বিষয় অদম্য কৌতূহল ছাড়া মন্দাকিনীর মনের কোন ভাবান্তর ঘটল না। যৌবনে তার স্বপ্নে-দেখা সেই পুরাতন। প্রিয়তমের ইতিবৃত্ত মন্দাকিনীর জানা ছিল না। সে ধনী কি নির্ধন, কোন কাজকর্ম করে কি ঘরে। বসে থাকে, এই সকল অতি তুচ্ছ তথ্য জানবার প্রয়োজনই তার মনে আসে নি সে দ্বিধাবিহীন চিত্তে দর্শনমাত্রেই তার গলায় বরমাল্য দিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার চ্যাটার্জি সম্বন্ধে তার জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না।

এক মাস কাল সময়, অশেষ ধৈর্য ধারণ এবং সমস্ত ছোট বাগানখানার আমূল সংসারের পর মন্দাকিনী জানল তাঁর বয়স চল্লিশ বছর, অবিবাহিত, ধর্ম-বিরোধী, কিন্তু ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটু একটু সন্দেহ আছে, দৈর্ঘ্য ৫ফুট ১১ ইঞ্চি, ওজনের কথা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।

স্ত্রীজনসুলভ নানান চাতুরী অবলম্বন করে মন্দাকিনী তাঁকে দিয়ে নতুন গোলাপী পর্দা কেনাল, দরজা-জানালায় সবুজ সাদা রঙ লাগাল, গেটের পাশে চেরী গাছের কলম বসাল।

এমনি করে মন্দাকিনীর স্বপ্ন ফুলের মতন ফুটতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা মন্দাকিনী আবিষ্কার করল ইডেনে সর্প প্রবেশ করেছে।

কে একজন অতি তরুণী, তনুদেহে সবুজ জজের্টের শাড়ি অপরূপ করে জড়িয়ে, কালো কোঁকড়া চুলগুলিকে মাথার উপরে অভিনব রুচিতে চূড়ো করে বেঁধে ডাক্তার চ্যাটার্জির স্কন্ধ অবলম্বন করে অতি-রক্তিম ঠোঁট দুখানিকে ঈষৎ আলগা করে হিমালয় দেখছে। আর তার সর্বাঙ্গ থেকে মাধুরী ঝরে পড়ছে।

এইটুকু মাত্র। কিন্তু মন্দাকিনীর হৃদয় বিকল হল। ত্বরিত পদে সেখান থেকে সে ফিরে গেল। তার মানসচক্ষের সম্মুখে ওই মেয়েটি তার সবুজ জর্জেটের আঁচলখানা মেলে দিয়ে এমন একটা শ্যামল অন্তরাল সৃষ্টি করল যাকে ভেদ করে মন্দাকিনীর লুব্ধ চোখ আর সেই ছোট বাড়ি কি তার মালিককে দেখতে পেল না।

মন্দাকিনীর হৃদয়ে জীবনে এই প্রথম ঈর্ষা জন্ম নিল এবং তার সবুজ চোখের কাছে সমগ্র জগৎখানা বিষময় হয়ে উঠল। যেখানে কোন দাবি নেই সেখানে নৈরাশ্যের জ্বালা সব থেকে তীব্র, কারণ তার কোনও প্রতিকার হয় না।

মন্দাকিনী নিজেকে শত শত গঞ্জনা দিল। তার কোন অনুযোগের কারণ নেই। ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়িতে তাঁর যে কোনও অতিথি আসুক না কেন, মন্দাকিনীর তাতে কি? কিন্তু তবুও দার্জিলিংয়ের হিমকুজঝটিকা একেবারে হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করল তার ব্যথিত দৃষ্টি হিমালয়ের পুঞ্জিত রূপরাশির মধ্যে কোনও দিন কোন কোমলতা খুঁজে পায় নি, আজও পেল না।

এক সপ্তাহ কাল উত্তরবিহীন আত্মজিজ্ঞাসার পর মন্দাকিনী আবার ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল। আর তার কোন আশঙ্কা নেই, মন তার বর্ম পরেছে। নৈরাশ্যের গভীরতম অতলে যে ডুব দিয়েছে সে আবার চোখে আলোর রেখা দেখতে পায়। সে ঔদাসীন্যের চন্দ্রলোক, শীতল সুন্দর।

মন্দাকিনী তাই সাহসে বুক বেঁধে, দৃষ্টিতে ত্যাগের মহিমা নিয়ে ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল।

দেখল দরজা-জানালা খোলা হয় নি, ফুলগাছে জল দেওয়া হয় নি। উদাসী মনের উপর উদ্বেগের কালো ছায়া নেমে এল। যাকে ত্যাগ করা যায় তার মঙ্গল কামনা করাতে কোন বাধা নেই।

কম্পিত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে মন্দাকিনী দেখল শোবার ঘরের পর্দা উঠানো, জানালা বন্ধ, শার্সিতে ধুলো এবং টেবিলে বই, ড্রেসিংটেবিলে বই, আরামকেদারায় বই, আরামকেদারার নিচে বই, পাশে বই, পিছনে বই, মোড়াতে বই, জলচৌকিতে বই এবং মেঝের গালিচাতে রাশি রাশি দিশী ও বিলেতী বই। স্প্রিংযুক্ত লোহার খাটে বাদামী রঙের কম্বলে ঢাকা রোগপাণ্ডুর মুখে ডাক্তার চ্যাটার্জিকেও দেখা গেল।

আবেগের আতিশয্যে মন্দাকিনীর বাক্যরোধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি হাত থেকে রিলিজিও মেডিচিখানা নামিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

মন্দাকিনী নির্বাক রইল তার অভিজ্ঞতামতে মনে যার অভিমান নেই, তার মনে স্নেহপ্রেমের লেশমাত্রও নেই। মন্দাকিনী তাই হতাশ হল। কিন্তু তার উৎকর্ণ মন মুহূর্তের মধ্যে নৈরাশ্যের চেয়ে ঘরের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ল সে আয়নার সামনে গিয়ে প্রথমে নিজের কেশ-বেশ সংস্কারের পরে রুমাল দিয়ে ওই আয়না সংস্কারে মনোনিবেশ করল।

শান্তকণ্ঠে ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, আমার ভাগ্নী এসেছিল, তোমায় দেখাতে পারলাম না মন্দাকিনী এর উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না। ভাবল, হয়তো মন্দাকিনীর মনোভাব সম্বন্ধে ডাক্তার চ্যাটার্জির কোন কৌতূহল নেই।

হঠাৎ রুমালের আঘাতে ছোট একটা জিনিস মাটিতে পড়ল। মন্দাকিনী অপ্রতিভ হয়ে তুলে নিয়ে দেখল একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল হীরাবসানো মেয়েদের আংটি।

চোখ তুলতেই ডাক্তার চ্যাটার্জির ঈষৎ ক্লান্ত চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি স্নিগ্ধস্বরে বললেন, আমার মায়ের বিয়ের আংটিা মনে করেছি তোমার হাতে মানাবো বলে পরিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ না করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

মন্দাকিনী শেষ পর্যন্ত আংটিটা নিজেই পরল। আর দুটি মুক্তোর মতন দুই বিন্দু অশ্রু আস্তে আস্তে গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল।

ডাক্তার চ্যাটার্জির নিকোটিন-রঞ্জিত ডান হাতখানি মন্দাকিনীর ক্ষীণ মণিবন্ধে নিবদ্ধ হল, আর সেই সঙ্গে মন্দাকিনী অনুভব করল তার হৃদয়ের সকল রুদ্ধ বাতায়নগুলি একে একে খুলে গিয়ে সূর্যালোক আর দক্ষিণ-বাতাস যুগপৎ সেখানে প্রবেশ করল।

লক্ষ্মী ছেলে

এক বেজায় জ্যাঠা ছেলে ছিল। যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন, ততদিন সে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টো টো করে বেড়িয়েছে। শেষটায় যখন বাবা মারা গেলেন, তখন ছেলে ভারি বিপদে পড়ল। কী করে। লেখাপড়া তো আর বেশি জানে না, যে কাজ করে খাবে? তখন সে ভাবল, আমার তো আর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। শুধু আছেন মামা। তিনি আবার আমার উপরে চটা। কী আর করি? তার কাছেই যাই। এই-না,ভেবে সেই দিনই দুপুর বেলা সে মামা বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। মামা এদিকে খেয়ে-দেয়ে দিব্যি ঘুম দিচ্ছেন। তার চেঁচামেচিতে তার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চটে বললেন, হতভাগা। কী করতে এসেছিস? কী চাস?

–আজ্ঞে এখানে থাকতে এসেছি।

মামা আর কী করেন বললেন, আচ্ছা থাক। দেখিস বাঁদরামি করিস না।

সেখানে সে বেশ আছে। খায় দায় ঘুম দেয়। একদিন তার মামি বললেন, ওই হাঁড়িতে রসগোল্লা আছে, দেখিস, কেউ যেন খায় না। এই বলে যেই মামি অন্য ঘরে গেছেন, শ্রীমান সব রসগোল্লা গিলেটিলে বসে আছেন।

একটু পরেই মামি ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কে রসগোল্লা খেয়েছে রে? ছেলে সাধুর মতন বলল, আজ্ঞে আমি।

কেন রে?

খিদে পেয়েছিল বলে।

মামি এসব দেখে হাড়ে হাড়ে চটে গেলেন। ঠিক করলেন, তাকে তাড়াতে হবে। তখন ছেলে ভাবল, তাই তো, মামিকে একটু খুশি করতে হবে।

.

একদিন এক কাণ্ড হয়ে গেল, যাতে মামির মত একেবারে উলটে গেল। তখন বোধ হয় রাত একটা হবে, হঠাৎ মামার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তার মনে হল ঘরের ভিতর কে যেন খচমচ করছে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। টাক মাথায় চুল ক-টা খাড়া হয়ে গেল, কপালে ঘাম দেখা দিল।

অতি কষ্টে বললেন, কে রে? তবু কোনো উত্তর না পেয়ে চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। অমনি কে জানি হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এমন সময় শুনতে পেলেন বাইরে ছেলেটা বলছে, কে মশাই? না বলে চুরি করতে এসেছেন কেন? বলে এলেই তো পারতেন, তাহলে জিনিস সব বের করে রাখতাম, আপনি শুধু নিয়ে যেতেন।

মামি বললেন, দেখো না গিয়ে কে? মামা লেপের তলায় মাথা ঢুকিয়ে শুয়ে ছিলেন, আস্তে আস্তে উঠে দরজাটা একটু ফাঁক করেই দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে, এক দৌড়ে আবার লেপের তলায় ঢুকলেন। মামি শুনলেন ছেলেটা আবার বলছে, চৌবাচ্চায় নাববেন মশাই? গরমের দিন, আরাম লাগবে। তাছাড়া, সাঁতার শেখা ভালো, যদি কখনো জলে

তারপর ঝপাং করে একটা শব্দ হল। মনে হল, একটা ভারী জিনিস জলে পড়ল! আর ভীষণ জল-ছিটকানোর শব্দ।

মামি আবার ডেকে বললেন, ওগো দেখ না গিয়ে কী হয়েছে। মামা আবার মাথাটা একবারে বের করে তক্ষুনি ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর উঠে দরজাটা ফাঁক করে নাকটা বের করে দিলেন, বের করেই আবার ঢুকিয়ে নিয়ে দৌড়ে খাটে উঠলেন গিয়ে। তারপর সেই যে দেয়ালের দিকে গিয়ে শুলেন আর হাজার চ্যাঁচামেচিতেও টু শব্দটি করলেন না।

এদিকে জলের শব্দ থেমে গিয়েছে। ছেলেটা জানি কী একটাতে লাথি মেরে বলল– যান, মশাই! বাড়ি যান! তার পর সব চুপচাপ।

খানিক বাদে আবার ছেলেটি এসে ডাকল, ভয় নাই মামা! বেরিয়ে আসুন। সে ভেগেছে।

হঠাৎ মামার ঘুম ভেঙে গেল, তিনি দৌড়ে বাইরে গিয়ে ছেলেকে ধরে যা আদর! মামিরও রাগ চলে গেছে। কী সাহসী ছেলে! যদি চোরটা কামড়িয়ে দিত বা পা মচকে দিত।

তার পরদিন মামি কতগুলো ভিজে কাপড় দেখে ছেলেটাকে বললেন, ওকী! তোমার কাপড় ভিজল কী করে? সে বলল, কাল রাত্রে চোরটা জল ছিটকিয়ে দিয়েছিল।

মামি বললেন, আহা! যদি নিউমোনিয়া হত!

তখন হতে আর ছেলের আদরের সীমা নেই।

সর্বনেশে মাদুলি

পুজোর ছুটির পর যখন স্কুল খুলল, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম গুপে ডান হাতে মাদুলি বেঁধে এসেছে। কনুইয়ের একটু উপরে ময়লা লাল সুতো দিয়ে বাঁধা চকচকে এক মাদুলি। আমি ভাবলাম সোনার বুঝি, কিন্তু গুপে পরে বলল নাকি পেতলের। ঘাম লেগে লেগে সোনার মতো হয়ে গেছে।

টিফিনের সময় জিজ্ঞেস করলাম, কেন রে? তাতে সে এক আশ্চর্য কথা বলল।

তার দাদামশায়ের নাকি যখন অল্প বয়েস, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের তলায় চকচকে এক কুচকুচে কাগের পালক। প্রথমটা খুব খুশি হলেন। ভাবলেন দিব্যি এক খাগের কলম বানিয়ে বন্ধুদের লম্বা লম্বা চিঠি লেখা যাবে। পরে শিউরে উঠলেন। কী সর্বনাশ! কাগ যে ছুঁতে নেই, ইয়ে-টিয়ে খায়, তার পালক বালিশের তলায় এল কোত্থেকে? আর কেউ দেখবার আগেই সেটাকে জানলার শিকের ফঁক দিয়ে উঠোনে ফেলে দিলেন।

কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পরদিনও ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের নীচে আবার আরেকটা কাগের পালক! এবার আর কোনো সন্দেহই নেই, দস্তুরমতো কাগ কাগ গন্ধ পর্যন্ত পেলেন। দাদামশাই সেইদিনই মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেন, চুল ন্যাড়া করলেন, পাশের বাড়ির লোকদের তাদের গাছ-ছাঁটা কঁচিটা ছ-মাস বাদে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন, গঙ্গাস্নান করলেন।

স্নান করে উঠে, ঘাটের উপর দেখেন দিব্যি ফোঁটা কাটা, তিলক আঁকা, জটাওয়ালা, গেরুয়াপরা এক সন্ন্যাসী বাবা হাসি হাসি মুখ করে তারই দিকে তাকিয়ে আছেন। দাদামশাই তাকে ঢিপ করে প্রণাম করলেন। অমনি সন্ন্যাসী তার ডান হাতের কনুইয়ের উপর ওই লাল সুতো দিয়ে মাদুলিটা বেঁধে দিয়ে, দাদামশাইয়ের ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কু ডর নেই বেটা। শাপখোঁপ সব কেটিয়ে যাবেন।

দাদামশায়ের ঘাড়ে খুব সুড়সুড়ি লাগা সত্ত্বেও তিনি শুধু একটু কিলবিল করে বললেন, ঠিক বলছ তো ঠাকুর?

গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সন্ন্যাসী ঠাকুর ঝুলির মধ্যে থেকে সুতো বাঁধা এক চশমা বের করে নাকে পরেই আঁৎকে উঠে বললেন, তাঁ! এ কী আছে রে? আরে আমি তো তোমাকে চিনতে পারেনি, উ মাদুলি পলটু জমাদার কো আস্তে বনায়া, দে দে রে বেটা, উ তোমারা নেহি।

কিন্তু কে শোনে? দৈবাৎ অমন মাদুলি মানুষের জীবনে এক-আধবার ঘটে যায়। তাকে কি অমনি অমনি দিয়ে দেওয়া যায়? দাদামশাই ছপাত করে মালকোঁচা মেরে দে দৌড়!

বাড়ি এসে অবাক হয়ে দেখলেন পাশের বাড়ির আম গাছের যে ডাল পাকা পাকা আমসুষ্ঠু তাঁদের উঠোনের উপর ঝুলছিল, অথচ পাছে নেপালবাবুপুঁতে ফেলেন সেই ভয়ে কিছু করা যাচ্ছিল না, সেসব আম আপনি-আপনি দাদামশায়ের উঠোনে পড়ে গেছে। দেখা গেল নতুন কুয়োতেও ভোর থেকে ঠান্ডা মিষ্টি জল আসছে। রাত্রে ফেলাদা পুকুরে যে ছিপ ফেলে রেখেছিল তাতে মস্ত এক কাতলা মাছ পড়েছে। বেলা না হতেই দাদামশায়ের শালা, গত বছর যে পাঁচ টাকা ধার নিয়েছিল, নিজে থেকে ফেরত দিয়ে গেল। উপরন্তু রবিবার দুপুরে নেমন্তন্ন করে গেল। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখলেন এমনকী দিদিমার পর্যন্ত হাসিমুখ।

মাদুলির গুণ দেখে দাদামশাই অবাক। মনে মনে সন্ন্যাসী বাবার ময়লা পায়ে শত শত প্রণাম করলেন।

সে থেকে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরে গেল। টাকা-পয়সা হল, গোরু-ভেড়া হল, ছেলেরা বড়ো বড়ো চাকরি পেল, মেয়েদের ভালো ভালো বিয়ে হল। এমনকী মামার বাড়ির গোরুর দুধের ক্ষীর, গাছের আম, আর পুকুরের মাছের কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনার চোটে গুপে লোম-হর্ষণ সিরিজ-এর বিশ নম্বর বইয়ের পাঁচ ছ-টা পাতার কোনা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল।

আরও বলল: এই সেই মাদুলি। একচল্লিশ বছর এক মাস দাদামশায়ের হাতে বাঁধা ছিল, একদিনের জন্যও ভোলা হয়নি, দাদামশায়ের হাতে সুতোবাঁধা মাদুলির সাদা দাগ পড়ে গেছে, গায়ে লেগে শেষটা এমন হয়েছিল যে মাঝে মাঝে নাকি মাদুলিটার উপরও চুলকতো!

সেই মাদুলি দাদামশাই এককথায় গুপের হাতে বেঁধে দিয়েছেন কারণ গুপে বায়না ধরেছিল যে মাদুলি না দিলে নাকি সে তেলও মাখবে না, চানও করবে না, ভাতও খাবে না। আর নেহাত যদি খায়ও তাহলে এত কম খাবে যে কিছুদিন বাদে পেট না ভরে ভরে হাত-পা ঝিমঝিম করবে, মুখ দিয়ে ফেনা উঠবে, চোখ উলটে যাবে–এই অবধি শুনেই দাদামশাই কানে হাত দিলেন ও তখনি পট করে মাদুলির সুতো ছিঁড়ে সেটাকে গুপের হাতে বেঁধে দিলেন।

গুপে দেখলে মাদুলির গুণ একটুও কমেনি। আধ ঘণ্টার ভিতর ছোটোমামার ফাউন্টেন পেনের নব খারাপ হয়ে গেল, ছোটোমামা সেটা গুপেকে দিয়ে দিল। পরে অবিশ্যি আবার চেয়েছিল, তাইতেই তো গুপে ছুটির দু-দিন বাকি থাকতেই মামাবাড়ি থেকে চলে এসেছিল।

বাড়ি এসেই শোনে মাস্টারমশাইয়ের মাম্পস হয়েছে, গাল ফুলে চালকুমড়ো, সেরে যদি-বা ওঠেনও তবু একটি মাসের ধাক্কা।

এরপর গুপে যা-তা বলতে আরম্ভ করল। নাকি মাদুলি হাতে পরা থাকলে গুপে যখন যা বলবে তাই ঘটতে বাধ্য। একথা শুনে আমরা সবাই ভীষণ আপত্তি করলাম, তা কি কখনো হয়?

নগা বললে, এক যিশু ছাড়া আর কেউ

গুপে ভীষণ রেগে সরু লম্বা ময়লা নখওয়ালা একটা আঙুল নগার দিকে বাগিয়ে বলল, আজ বলে দিলাম তুই ভূগোল ক্লাসে দাঁড় খাবি।

ওমা! সত্যি সত্যি ভূগোল ক্লাসে নগা দাঁড় তো খেলই, তার উপর কানমলাও খেল! এরপর আর কারুর কিছু বলবার জো নেই। গুপে এক বার মাদুলির দিকে তাকালেই হল, সে যখন যা বলে সবাই তা মেনে নেয়। যখন যা চায় সবাই তাই দিয়ে ফেলে।

তিন সপ্তাহক্লাসসুদ্ধ সবাই গুপের দৌরাত্ম্যে খাবি খেলাম। সে খুশি তাই করতে আরম্ভ করল। এমনকী কালীপদর চুল ছাঁটা পছন্দ হচ্ছিল না বলে সে বেচারাকে ন্যাড়া করিয়ে ছাড়ল।

সবাই দিন দিন রোগা হয়ে যেতে লাগলাম।নগার তো পেন্টেলুন এমন ঢিলে হয়ে গেল যে শেষে তার দাদা তাই নিয়ে টানাটানি। বলে কি না–দেখছিস না, ও আমার, তোর গায়ে বড়ো হচ্ছে। হয় আমার, নয় বাবার।

এদিকে যার যা ভালো জিনিস গুপে সব গাপ করতে লাগল। পেনসিল, রবার, পেনসিলকাটা, রঙিন খড়ির বোঝায় গুপের পকেট ঝুলে ঝুলে ছেড়ে আর কী! শেষে কি না সেসব রাখবার জন্য আমার নতুন টিফিনের বাক্সটা একদিন চেয়ে বসল। তখন আমি বেজায় চটে গেলাম। একটু তোতলামি এসে গেল। মাথাটাথা নেড়ে বললাম- দ্যা-দ্যাখ গুপে, দিন দিন তোর বাড় বাড়ছে। কাল তোর সব অঙ্ক কষে দিয়েছি। আমার টিফিনের অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলেছিস। ইংরেজি ক্লাসে ছুরি ফটফট করেছিস আর তার জন্য বকুনি খেয়েছি আমি। বেশি বাড়াবাড়ি করিসনে বলে দিলাম!

এক নিশ্বাসে রাগের মাথায় এতগুলো কথা বলে দেখি গুপে আমাকে শাপ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার চোখ দুটো ছোটো হয়ে হয়ে আলপিনের ডগার মতো হয়ে গেল, ঢোক গিলে, গলা হাঁকড়ে, আঙুল বাগিয়ে, খনখনে গলায় বলল– আজ তোর জীবনের শেষ দিন। দিনটা কাটলেও রাত কাটবে না। ক্লাসময় একটা থমথমে চুপচাপ। তার মধ্যে নরেনবাবু এসে গেলেন, আর কিছু হল না।

একটু পরেই আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগল, নিশ্বাসটা কীরকম জোরে জোরে পড়তে লাগল, চুলের গোড়াগুলো শিরশির করতে লাগল, পেটের ভিতর কেমন ফঁকা ফঁকা মনে হতে লাগল। বুঝলাম মাদুলির শাপ আমার লেগেছে। কিছু পড়া-টড়া শুনলাম না, হোমটাস্ক টুকলাম না, ড্রইং ক্লাসে বেয়াদপি করলাম। যার দিন কাটলেও রাত কাটবে না, তার আবার ভাবনা কী? টিফিন বাক্সটা ক্লাসের মধ্যেইনগার হাতে তুলে দিলাম, আমি মরি আর গুপে সেটা ভোগ করুক আর কী! ছুটির ঘণ্টা পড়লে পর মনে হল, আমি তো গেলাম, যাবার আগে ওই সর্বনেশে মাদুলিটাকে শেষ করে তবে যাব।

দেখি গুপেদের পুরোনো চাকর ভদু গুপের বই গুছিয়ে নিচ্ছে, আর গুপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। হঠাৎ খুন চড়ে গেল, ছুটে গিয়ে এক সেকেন্ডে মাদুলিটা কেড়ে মাড়িয়ে ভেঙে একাকার! তার থেকে অন্তত ধোঁয়াও বেরুনো উচিত ছিল, কিন্তু কিছু হল না। গুপে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওদের চাকরটা হই হই করে ছুটে এসে হাত-পা ছুঁড়ে বললে- যা, কী করলে! আমার পেটব্যথার অব্যর্থ মাদুলি, আমি কালীঘাট থেকে দু-পয়সা দিয়ে কিনে এনেছি। আগেই জানি গুপি দাদাকে যা দেওয়া যাবে তাই আর কিছু থাকবে না!

আমরা সবাই হাঁ করে গুপের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার নিশ্চয় কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু সে অম্লানবদনে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভদুকে ছুঁড়ে দিয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বাড়ি চলে গেল।

সেইখানে

আমার মেজোদাদামশাই কখনো কখনো ডেকে বলতেন, ও রে, টুনু মিনু নেগো ধেলো ইলু বিলু মন্টু, শোন। পরিদের দেশে গেছিস কখনো?

শুনে আমরা হেসেই খুন। পরিদের দেশ আবার হয় নাকি? ও তো ঠাকুমাদের বানানো গল্প!

মেজোদাদামশাই বিরক্ত হয়ে বলতেন, তবে কি আমার ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠার মস্ত সিন্দুকটাও ঠাকুমাদের বানানো গল্প বলতে চাস? যাঃ, তোদের আর কোনো কথাই বলব না।

আমরা অমনি তাকে ঘিরে ধরলাম, না মেজোদাদামশাই, না। বলোনা, তোমার ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠার সিন্দুকের গল্প।

মেজোদাদামশাইও তো সেই চান। বলতে লাগলেন, শোন তবে ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠায় ছিল কার হাতে কবেকার তৈরি একটা কাঠের সিন্দুক। এক মানুষ উঁচু, আলমারির মতো দাঁড় করানো, কাঁঠাল কাঠের তৈরি সেটা। পাল্লার ওপর তেল-সিঁদুর দিয়ে লাল রঙের লক্ষ্মীঠাকুরুনের পাচা আঁকা। তার রং এখন স্কুলে গিয়েছে, তারই নীচে সোনালি রঙের একটা দরজা আঁকা। তারই মাঝখানে আবার ছোট্ট একটা চাবির ছাদাও আঁকা রয়েছে।

যখন তোদের মতো ছোটো ছিলাম, রোজ সেটাকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম, আর অবাক হয়ে ভাবতাম, আঁকা ছ্যাদা, তার চারদিকে চাবি ঘোরানোর দাগ কেমন করে হয়!

সত্যিকার চাবির ছ্যাঁদাও ছিল একটা, কিন্তু তাতেও কেউ চাবি ঢুকিয়ে সে সিন্দুক খুলত না, তবে আবার আঁকা ছ্যাঁদার চাবির দাগ পড়ে কী করে? ঠাকুরমাকে জিগেস করলে বলতেন, ষাট ষাট; চুপ, ওকথা মুখেও আনিস নে। তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবার মানতকরা ওই সিন্দুক, ওতে কি চাবি লাগাতে আছে? মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কর এক্ষুনি।

আমি করতামও তাই, আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম আঁকা ছ্যাদার চারদিকে চাবি ঘোরানোর স্পষ্ট দাগ। দেখতাম, আর মনে হত তেল-সিঁদুরের প্যাঁচা বুঝি আমারই দিকে চেয়ে রয়েছে।

রোজ সন্ধ্যে না পড়তেই বাড়ির পণ্ডিতমশাই সংস্কৃত পড়াতে আসতেন। তেলের আলোতে বসে অং-বং পড়া যে কী কষ্ট, সে আর তোরা কী বুঝবি! যেদিন শব্দরূপ মুখস্থ হত না, সেদিন সে কী কান-প্যাঁচানোর ধুম পড়ে যেত!

প্রায়ই এটা-ওটা ভুলে যাই, একদিন সংস্কৃত পড়া তৈরি করে রাখতেই গেছি ভুলে।সন্ধ্যে বেলায় যেই-না দূর থেকে সদরের উঠোনে পণ্ডিতমশাইয়ের খড়ম পায়ের শব্দ শুনেছি, অমনি একদৌড়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে একেবারে চিলেকোঠায়।

ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজায় খিল দিয়ে, ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে খুব হাঁপাচ্ছি। চারদিক থমথম করছে, নিঝুম চুপচাপ, শুধু নিজের বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি, আর দূরে কোথায় একটা খোঁজ খোঁজ ধর ধর শব্দ। ভয়ে মরি, শেষটা যদি এখানে এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে? তবেই তো পুরোনো খিল খসে পড়বে। এদিক-ওদিক পালাবার পথ খুঁজছি, হঠাৎ চোখে পড়ল, কাঠের সিন্দুকের আঁকা দরজায় ছোট্ট একটা সোনালি চাবি লাগানো।

আমি তো অবাক! ছ্যাঁদায় আবার কে চাবি আঁকল! এ ঘরে তো আমি ছাড়া আর কেউ বড়ো-একটা আসে না। আস্তে আস্তে গিয়ে চাবির গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলাম। ওমা, আঁকা তো নয়, সত্যিকার চাবি! চাবিটাকে ঘোরাব কি না ভাবছি, এমন সময় সিঁড়িতে শুনি পায়ের শব্দ।

অমনি সাহস এল, দিলাম চাবি ঘুরিয়ে। ঘোরাতেই খুট করে সোনালি দরজাটা গেল খুলে! আমরা তো মুচ্ছো যাবার জোগাড়।

তারই মধ্যে কানে এল ঘরের বাইরে, দোরের হাতলে টানাটানি। আর কথাটি না বলে, চাবি ধরে টেনে,দরজাটা আবার খুলে ভেতরে সেঁদিয়ে গেলাম। তারপর সোনালি চাবিটা দিয়ে আবার ভেতর থেকে এঁটে দিলাম। দেখি সেখানে ফুট ফুট করছে আলো।

সেই আলোতে চেয়ে দেখি হাতের চাবিটাকে কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে। আরে, এই তো আমার মা-র মিনেকরা বাক্সের হারানো চাবি! ওটাকে একেবার কোথায় যে রেখেছিলাম আর মনে করতে পারিনি। আর এখানে আঁকা দরজায় দিব্যি লাগানো ছিল!

চারদিকে তাকিয়ে দেখি, আর তো আমি একা নই। কোথা থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েরা এসে হাজির। প্রথমে ভাবলাম এরা সব অচেনা, কাছে আসতে দেখি তা তো নয়। কোন কালে কার সঙ্গে খেলা করেছি, কার সঙ্গে পড়েছি, তাদের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছি, তারাই সব এখন আমাকে দেখে দৌড়ে এল, খুশিতে সবাই ডগমগ! খালি হাতে এল না কেউ, সঙ্গে করে নিয়ে এল কত ছাতা, টর্চ, রুমাল, বই, পেনসিল কাটা কল, মায় একটা ইস্কুলের ব্যাগ পর্যন্ত। সব তারা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। আমি তো লজ্জায় মরি। এত জিনিস কারো কাছ থেকে নেওয়া যায় কখনো?

তারা বলে কী, না, এসব তোমারই জিনিস, তুমি নিজের হাতে এ সমস্ত হারিয়েছ। এখানে-ওখানে ফেলে এসেছ, এর বাড়িতে, ওর বাড়িতে, ট্রামগাড়িতে, মেলায়, ইস্কুলে, খেলার মাঠে। দেখে দিকিনি চিনতে পার কি না, এই তোমার নাম লেখা।

তখন আরেক বার চারিদিকে চেয়ে দেখি, আরে, এ জায়গাটাও যে আমার কত চেনা, কত দিন মনে পড়েনি এখানকার কথা! এই তো এখানকার আম গাছের তলায় ছোটোবেলায় কত খেলাই করেছি! এই দেখো, আমাদের গুলি খেলার গাব্বটা অবধি তেমনি রয়েছে! ওই তো গাছের গায়ের ছোট্ট কোটর থেকে আমার চেনা সেই সাদা কাঠবিড়ালটা মুখ বাড়াচ্ছে, আমাকে দেখে কত খুশি। আহা, আমিই ভুলে গিয়েছিলাম, ও দেখছি আমাকে ঠিক মনে করে রেখেছে।

কোথায় এলাম, এ তো আর নতুন জায়গা নয়, এ যে সবই চেনা, এ সবই যে একসময় আমার ছিল। এদের যে ভুলে গেছি তা পর্যন্ত মনে ছিল না। কানের কাছে কে যেন বললে, ও ছেলে আবার পালাচ্ছে, চেরতা খেতে ভুললে তো চলবে না! এই নাও, হাঁ করো।

চেয়ে দেখি সেই আমার কবেকার ধাইমা। আরে, ধাইমার মুখটা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। ওরই কোলে চেপে কত ঘুরেছি, চুল টেনেছি, চিমটি কেটেছি, ওর গায়ে দুধ ছিটিয়েছি, ওর হাতে ভাত খেয়েছি, ওর পাশে ঘুমিয়েছি। আহা, কেমন করে ভুলে গিয়েছিলাম।

ধাইমার পায়ে পায়ে আমার ছোটোবেলাকার কত আদরের মেনি বেড়ালটাও এসে উপস্থিত। আবার ঠিক তেমনি করে পিঠ বেঁকিয়ে ম্যাও ম্যাও করতে করতে ছুটে এসে আমার পা জাপটে ধরেছে।

বেড়ালটাকে সরিয়ে দিয়ে রাঙা মাস্টারমশাই এগিয়ে এলেন, দুই বগলে তাল তাল বই, হেসে বললেন, কত পড়া ভুলেছ বলো দিকিনি? কত নামতা, বানান, রাজধানী, কী উৎপন্ন হয়, কত সাল তারিখ, রাজার নাম, কত যুদ্ধ, কত জয়-পরাজয়– তার হিসেব রাখো? আজও শব্দরূপ মুখস্থ করতে ভুলেছ?

এই দেশেই তবে যত রাজ্যের ভুলে-যাওয়া জিনিসের হদিশ পাওয়া যায়! আহা, ওই তো আমার হারানো মার্বেলের ঢিবি, আম গাছের তলায় ছোটো একটা পাহাড়ের মতো হয়ে রয়েছে। ওই যে আমার ঘোড়ার-ছবি-দেওয়া টিফিন খাবার বাক্স। ক-বছর আগে চড়িভাতি করতে গিয়ে কাঁদের বাগানে ফেলে এসেছিলাম। যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে, এতটুকু মরচে পড়েনি।

এই কি তবে পরিদের দেশ? কী ভালো এই দেশটি। আর যে ওসব জিনিস কখনো দেখতে পাব, তা ভাবিনি।

ওই তো আমার বুড়ি দিদিমারা তিনজনেই এখানে! যখন পড়তে শিখিনি, কত পরির গল্পই-না বলেছেন আমাকে। আহা, এমন মানুষদেরও ভুলে যেতে আছে? এরা যে ডানাওয়ালা পরিদের চেয়েও অনেক, অনেক ভালো! দু-হাত বাড়িয়ে সবাইকে একসঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

গল্প থামিয়ে মেজোদাদামশাই উঠে পড়েন, আহা, অমন দেশ ছেড়েও লোকে আবার ফিরে আসে! ওরে, ও টুনু মিনু নেগো ধেলো ইলু বিলু মন্টু, তোরা তো নিত্য সব ভুলে যাস, চল চল আমার সঙ্গে পরির দেশে চল। সেখানে যে তোদের জন্যে আলাদিনের ভাড়ার ঘর খোলা রয়েছে, যাবি তো চল।

আর দ্যাখ, আর কিছু নেবার দরকার নেই, খালি একটু টিফিন নিয়ে চল। ওখানে সবই আছে, শুধু খাবারের কোনো ব্যবস্থাই দেখলাম না, খাবার খেতে বুঝি কেউ আর ভোলে না?

তবে আমার ছোটোবেলাকার ওই আম গাছেতে আমের গুটি দেখেছিলাম, আহা, ওই টক আম কী যে মিষ্টি লাগত সে ভুলেই গিয়েছিলাম!

সেজোমামার চন্দ্র-যাত্রা

আমার ছোটোকাকা মাঝে মাঝে আমাদের বলেন, এই যে তোরা আজকাল চাঁদে যাওয়া নিয়ে এত নাচানাচি করিস, সেকথা শুনলে আমার হাসি পায়। কই, এত খরচাপাতি, খবরের কাগজে লেখালেখি করেও তো শুনলাম না কেউ চাদে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে! তোরা আবার এটাকে বৈজ্ঞানিক যুগ বলিস, ছোঃ!

আমরা তখন বলি, তার মানে? কী বলতে চাও খুলে বলোনা।

ছোটোকাকা বলেন, তার মানেটা খুবই সোজা। চাঁদে যাওয়াটা কিছু-একটা তেমন আজকালকার ব্যাপারও নয়। পঞ্চাশ বছর আগে আমি নিজেই তো একরকম বলতে গেলে চাদে ঘুরে এসেছি।

আমরা তো অবাক! একরকম বলতে গেলে কী? গেছিলে, না যাওনি?

ছোটোকাকা বইয়ের পাতার কোনা মুড়ে রেখে পা গুটিয়ে বসে বললেন, তাহলে দেখছি সব কথাই খুলে বলতে হয়। বয়স আমার তখন বারো-তেরো হবে, পুজোর ছুটিতে গেলাম মামাবাড়িতে। সেজোমামা অনেক করে লিখেছেন। এমনিতেই আমি কোথাও গেলে সেখানকার লোকরা খুব যে খুশি হয় বলে মনে হয় না, আর সেজোমামা তো নয়ই। তা ছাড়া দিদিমা সারাক্ষণই এটা-ওটা দেন, খাওয়া-দাওয়া ভালো, পুকুরে ছিপ ফেললেই এই মোটা মোটা মাছ, গাছে চড়লেই ভঁসা পেয়ারা। না যাবার কোনো কারণই ছিল না।

সেখানে পৌঁছে দেখি সেজোমামা কোত্থেকে একটা লড়ঝড়ে মোটর গাড়ি জোগাড় করে আমাকে নিতে স্টেশনে এসেছেন। আমাকে দেখেই, মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আগের চেয়ে যেন একটু ভারী-ভারী লাগছে! হারে, তোর ওজন কত রে?

কিছুদিন আগেই ইস্কুলে সবাইকে ওজন করেছে। বললাম, আটত্রিশ সেরের সামান্য বেশি।

সেজোমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, আবার বেশি কেন? সে যাকগে, ওতেই হবে, এখন গাড়িতে ওঠ, চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, খুব ভালো খাওয়ায় তারা।

সেজোমামাকে গাড়ি চালাতে দেখে আমি তো অবাক, তুমি আবার গাড়ি চালাতে পার নাকি?

সেজোমামা বেজায় রেগে গেলেন, কী যে বলিস! আরে এই সামান্য একটা গাড়িও চালাতে পারব না? বলে কি না যে আমি– যাকগে, চল তো এখন।

সোজা নিয়ে গেলেন কুণাল মিত্তিরের রহস্যময় বাড়িতে। ও বাড়ির ভেতরে এখানকার কেউ কখনো যায়নি, কুণাল মিত্তিরের নাম সবাই জানে, তবে তাকে কেউ চোখে দেখেনি। একটা উঁচু টিলার ওপরেঅদ্ভুত বাড়ি, বাড়ির চারিদিকে দেড়-মানুষ-উঁচু পাঁচিল, তার ওপরে কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল কেটে লোহার গেট বসানো, সে সর্বদাই বন্ধ থাকে। শোনা যায় কুণাল মিত্তির নাকি নানারকম বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন, সেসব সাধারণের জন্য নয়, অতি গোপন ও গুহ্যভাবে করতে হয়।

প্রকাণ্ড টিলাটার গা বেয়ে যদি চড়া যায়, ওপরটা চ্যাপটা, সবটা ঘিরে পাঁচিল, আশেপাশে কোনো গাছগাছড়াও নেই যে তাতে চড়ে পাঁচিলের ভেতরে দেখা যাবে কিছু। তার ওপর মাঝে মাঝে ভেতর থেকে বাড়ি কাঁপানো গর্জন শোনা যায়, লোকে বলে নাকি দু-জোড়া ডালকুত্তা দিনরাত ছাড়া থাকে। মোট কথা, কেউ ওদিকে বড়ো-একটা যায় না। চারিদিকে দু-তিন মাইলের মধ্যে কারো বসতিও নেই। ফঁকা মাঠ আগাছায় ভরা।

সেইখানে তো গেলেন আমাকে নিয়ে সেজোমামা। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাঁ গাঁ করতে করতে গাড়িটা তো টিলার ওপরে চড়ল। তারপর প্যাক-প্যাক করে হর্ন বাজাতেই লোহার দরজা গেল খুলে। আমরাও ভেতরে গেলাম। অবাক হয়ে দেখি চমৎকার ফুলবাগান, একতলা লম্বা একটি বাড়ি, তার বারান্দায় একটা বড়ো কালো বেড়াল সোজা হয়ে বসে সবুজ চোখ দিয়ে আমাদের দেখছে। একটা উঁচু দাঁড়ে নীল কাকাতুয়াও একদৃষ্টে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। আমাদের বলছি কেন, আসলে আমাকে দেখছে।

অমনি চারিদিক থেকে দলে দলে চাকরবাকর ছুটে এসে মহা খাতির করে আমাদের নামাল। বারান্দা থেকে একজন ভদ্রলোকও এগিয়ে এলেন, ফর্সা কোঁকড়া চুল, বেঁটে মোটা, বয়স বেশি নয়। সেজোমামাকে ফিসফিস করে বললাম, ওই নাকি সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কুণাল মিত্তির যাকে কেউ চোখে দেখেনি।

শুনতে পেয়ে ভদ্রলোক চটে গেলেন, কেউ চোখে দেখেনি কী, আমি বিলক্ষণ দেখেছি। বিশ্রী দেখতে।

সেজোমামা বললেন, আহা, বড়ো কথা বলিস। ওই তোর দোষ। কিছু মনে কোরো না, মনোহর-উনি কুণাল মিত্তির হতে যাবেন কেন, কুণাল মিত্তির ওঁর বাবা, ওঁর নাম মনোহর মিত্তির, আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। একদিন উনি ওঁর বাবার চেয়েও অনেক বেশি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবেন। জানিস তো, মিত্তিররা কীরকম চালাক হয়।

মনোহরবাবু তাই শুনে ছোটো গোঁফটাকে একটু নেড়ে বললেন, আর তুমিও তার চেয়ে খুব বেশি কম বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবে না। কী যেন নাম তোমার বললে?

বললাম, আগে বলিনি, এখন বলছি–ইন্দ্র।

খুশি হয়ে বললেন, ইন্দ্র? তা ইন্দ্রই বটে, চাঁদের মাটিতে প্রথম পা দেবার গৌরব হবে যার, সে ইন্দ্রের চেয়ে কোন দিক দিয়ে কম বলো দিকিনি।

চারপাশের লোকজনেরা বলতে লাগল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।

আমার তো চক্ষু ছানাবড়া। চাঁদে যাব নাকি আমি?

বললাম, সে আমার যেতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু একা যাব না। তা ছাড়া, আবার ফিরে আসব তো? ডিসেম্বরে আমার ক্রিকেট ম্যাচের সিট বলা আছে কিন্তু।

সেজোমামা আর মনোহরবাবুমুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। শেষটা মনোহরবাবু বললেন, তা হা– তা ফিরে আসবে বই কী, যাবে আর আসবে না, সে কি একটা কথা হল নাকি! কিন্তু আর দেরি কীসের জন্য? চলো তো দেখি ইন্দ্র, আমার সঙ্গে।

গেলাম বাগান পেরিয়ে একটা জায়গায়। তার মাথার ওপর দিয়ে লম্বা একটা কী বেরিয়ে রয়েছে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে, আগাটা ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।

বেড়ার দরজা চাবি দিয়ে খুলে মনোহরবাবু সরে দাঁড়ালেন, আমিই আগে ঢুকলাম।

গিয়ে যা দেখলাম সে আর কী বলব। আগাগোড়া অ্যালুমিনিয়ামের মতো কী ধাতু দিয়ে তৈরি কী একটা বিশাল যন্ত্র, অবিকল উড়ুক্কু মাছের মতো দেখতে, তবে ডানাগুলো অনেক ছোটো আর পিছন দিকে বেঁকিয়ে বসানো। দেখলেই বোঝা যায় যে একবার ছেড়ে দিলেই অমনি সুড়ুৎ করে তিরের মতো ওপরে উঠে, নীল আকাশের মধ্যে সেঁদিয়ে যাবে। চাদে যাওয়া এর পক্ষে সেরকম কিছুই শক্ত হবে না।

নীচে একটা গোল প্ল্যাটফর্ম ওটাকে চারিদিকে ঘিরে আছে, সেটাই প্রায় একতলার সমান উঁচু হবে, তারো নীচে যন্ত্রটার আরও অনেকখানি রয়েছে। রুপোলি গায়ে কালো দিয়ে লেখা ধূমকেতু। আর এক জোড়া এই বড়ো বড়ো চোখ আঁকা। আশেপাশে কতরকম যন্ত্র দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, বোঝা গেল– একবার সেইগুলো খুলে দিলেই আর দেখতে হবে না!

মনোহরবাবু চোখ ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পকেটে কী? ওরকম ঝুলে আছে যে? ও হবে না, যতটা সম্ভব হালকা চাওয়া চাই। এই বেদে, দেখ তো ওর পকেটে কী।

বেদে বলে লোকটা এগিয়ে আসতেই বললাম, এই খবরদার, তাহলে কিন্তু চাঁদে যাব না বলে রাখলাম।

মনোহরবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও-রকম করিসনে বাপ, চাঁদে যাবি না কী রে? তুই না গেলে কে যাবে বল দিকিনি? কেউ রাজিও হবে না, তা ছাড়া তোর প্যান্টের মাপে সব তৈরি। এখন না গেলে যে আমার জীবনের সব কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে! বলছি আমার শালাকে বলে তোকে মোহনবাগান ক্লাবের লাইফ মেম্বর করে দেব।

ওঁর হাত ধরে বললাম, দেবে তো ঠিক? বাবা! সেজোমামা কত চেষ্টা করেও হতে পারেনি। শেষটা কিন্তু অন্যরকম বললে–

মনোহরবাবু রেগে উঠলেন, বলছি করে দেব, আবার অত কথা কীসের? ফিরে তো এসো আগে।

বেদে বললে, যদি আস!

মনোহরবাবুকে ধমক দিলেন, তোমাকে অত কথা বলতে কে বলেছে বাছা? যাও, নীচে গিয়ে পাওয়ার লাগাও দিকিনি, নইলে–।

বেদে অমনি একটা ছোটো সিঁড়ি দিয়ে যন্ত্রের তলায় চলে গেল।

সেজোমামা মনোহরবাবুকে বললেন, ফিরে আসার কলকজগুলো ওকে বুঝিয়ে দিয়ো, মনোহর।

মনোহরবাবু বললেন, ও কি ওর বাবা-মার একমাত্র সন্তান?

আমি বললাম, আরে না না, আমার দুটো ভাই দুটো বোন।–আচ্ছা, লাইফ-মেম্বর করে দেবেন তো? কারণ বাবা হয়তো চাদা দেবেন না।

মনোহরবাবু বললেন, তাই দেব। পকেটে কী আছে বের করে এইখানে রাখো তো দেখি।

মেশিনের তলা থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হল, তারপর কেমন শোঁ-শোঁ করতে লাগল। মনোহরবাবু একবার নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিলেন। আমি পকেট থেকে লাট্ট লেত্তিইয়ো-ইয়ো রুমাল নীল গুলি রুমেনিয়ার দুটো ডাকটিকিট মনাদা দিয়েছিল– আধঠোঙা নরম ঝাল ছোলা ভাজা, টর্চ, আমার বড়ো গুলতিটা আর এক কৌটো শট বের করে রাখলাম। মনোহরবাবু তো অবাক!

এসব কিচ্ছু নেবার দরকার নেই, শুধু ওজন বাড়ানো। খালি এই নোট বই আর পেনসিলটা নেবে। কী দেখবে না দেখবে, শরীরে কেমন বোধ করবে, সব টুকে রাখবে। আর এই হাতঘড়িটা নেবে, এতে সেকেন্ডের কাঁটা, তারিখের কাঁটা সব দেওয়া আছে। সব লিখবে, কখন পৌঁছোলে ইত্যাদি, ও কী হল, চলে যাচ্ছ যে।

আমি বললাম, গুলতি শট না দিলে আমি যাব না।

সেজোমামা বললেন, থাকগে মনোহর, এখন মনে হচ্ছে তুমি বরং আর কাউকে দেখো।

মনোহরবাবুবললেন, বেশ, তা হলে আমার হাজার টাকা ফিরিয়ে দাও, আমি এক্ষুনি অন্য লোক দেখছি।

সেজোমামা চুপ। আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে সেজোমামা? আমার গুলতি দিলেই আমি যাব। অবিশ্যি বড্ড খিদে পেয়েছে, তাই আগে খানিকটা খেয়েও নেব। আর বলছি তো–একা যাব না।

মনোহরবাবু চটে গেলেন, একা যাব না আবার কী? জানিস, ওই কাকাতুয়াটা আর বেড়ালটা দু-তিনবার একা গেছে, কিছু বলেনি।

বললাম, চাঁদ অবধি গেছে?

মনোহরবাবু বললেন, চাঁদ অবধি গেছে কি বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলেই তো তোমাকে পাঠানো হচ্ছে। নিদেন তোমার খাতা পেনসিলটা ওই যে ছোটো হাউই-মতন দেখছ, ওটাতে পুরে ফেলে দিতে পারবে তো, নিজে যদি নেহাতই–আচ্ছা সে যাকগে, এখন এই বড়িটা খাও দিকিনি, কেমন পেট ভরে যায় দেখো।

বলে আমার মুখে কী-একটা হলদে বড়ি পুরে দিলেন, সে যে কী আশ্চর্য বড়ি আর কী বলব। খেতেই মনে হল আমি লুচি মাংস চপ কাটলেট ভেটকি-ফ্রাই চিংড়িমাছের মালাইকারি রাবড়ি কেক চকলেট ছাঁচিপান সব খাচ্ছি। একেবারে পেট ভরে গেল। সেই বড়ির শিশিটা আমার হাতে দিয়ে মনোহরবাবু বললেন, এই নাও এক মাসের খোরাক। একটার বেশি দুটো বড়ি কোনোদিন খেয়ো না, খেলেই পেটের অসুখ করবে, মোটা হয়ে যাবে, যন্ত্রের ভেতর আঁটবে না। এসো, এই আরাম কেদারাটাতে বসে পড়ো দিকিনি। হাওয়ার কোনো অভাব হবে না, এমন কল করেছি ভেতরে তোমার নিশ্বাসই আবার অক্সিজেন হয়ে যাবে।

বলে সেই লম্বা চোঙার মতন যন্ত্রটার গায়েয় একটা দরজা খুলে, আমাকে একটা চমৎকার হাওয়ার গদি-আঁটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন আর মাথার ওপর দিয়ে একটা অদ্ভুত পোশাক পরিয়ে দিয়ে কোমরে চেয়ারের সঙ্গে বগলেস এঁটে দিলেন। মুখের জায়গাটা বোধ হয় অভ্র দিয়ে তৈরি, সব দেখতে পাচ্ছিলাম। নাকের কাছে ছাদা, নিশ্বাস নিতে পারছিলাম। তারপর দেখি সেজোমামা তাড়াতাড়ি আমার জিনিসপত্র নিজের পকেটে ভরছেন। চেঁচিয়ে বললাম, গুলতি দিলে না? গুলতি না দিলে যাব না বলেছি-না!

অভ্রের মুখোশের ভেতর থেকে কথা শোনা গেল কিনা জানি না। কিন্তু সেজোমামার বোধ হয় একটু মন কেমন করছিল, কাছে এসে কী যেন বলতে লাগলেন, একবর্ণ শুনতে পেলাম না, যন্ত্রের শোঁ-শোঁ গোঁ-গোঁতে কান ঝালাপালা! দারুণ রেগে গিয়ে সেজোমামার কাছা আঁকড়ে ধরে চেঁচাতে লাগলাম, দাও বলছি, গুলতি না নিয়ে আমি কোথাও যাই না।

এদিকে মনোহরবাবু বার বার ঘড়ি দেখছেন, যন্ত্রটা কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে উঠছে, অথচ আমি এমন করে সেজোমামার কাছা আঁকড়েছি যে দরজাটা এঁটে দেওয়া যাচ্ছে না। শেষটা হঠাৎ রেগেমেগে ঠেলে সেজোমামাকে সুষ্ঠু ভেতরে পুরে দিয়ে মনোহরবাবু দরজা এঁটে দিলেন।

বাবা! দিব্যি ফাঁকা ছিল ভেতরটা, সেজোমামা ঢোকাতে একেবারে ঠেঠেসি হয়ে গেল, নড়বার চড়বার জো রইল না। দরজা বন্ধ করাতে বাইরের শব্দ আর কানে আসছিল না, সেজোমামা চিৎকার করতে লাগলেন, ও মনোহর, ফেরবার কল শিখিয়ে দিলে না যে, ফিরব কী করে?

তা কে কার কথা শোনে। ভীষণ জোরে ফুলে উঠে বোঁ করে যন্ত্রটা আকাশে উড়ে গেল। একবার মনে হল চারদিকে চোখ ঝলসানো আলো, তারপরেই মনে হল ঘোর অন্ধকার।

যখন জ্ঞান ফিরে এল বুঝলাম চাঁদে পৌঁছে গেছি। যন্ত্রটা আর নড়ছে না চড়ছে না, কাত হয়ে পড়ে আছে, আমি বসে বসেই শুয়ে আছি, সেজোমামা আমার তলায় একটু একটু নড়ছেন-চড়ছেন। মুখ তুলে কানের কাছে বললেন, আমার ডান পকেটে তোর টর্চটা আছে, দেখ তো নাগাল পাস কি না।

বুঝলাম ওঁর নিজের হাত নাড়বার জায়গা নেই। হাতড়ে হাতড়ে ঠিক পেলাম। ভয়ে ভয়ে জ্বালালাম, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যন্ত্রের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম, ভেতরকার কলকজা সব ঠিক আছে, যে-যার জায়গায় আটকানো। হাত দিয়ে আমার বাঁ-পাশের জিপ ফার খুলে মুখোশ নামিয়ে ফেললাম।

অমনি এক ঝলকা ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগল। আঃ, চাঁদের বাতাসই আলাদা রে, এ পৃথিবীতে সে-রকমটি হয় না।

সেজোমামা বললেন, বেড়ে খাসা কল বানিয়েছে তো মনোহর। বলেইছিল যে নামবার সময় এতটুকু কঁকানি লাগবে না, এতটুকু ভাঙবে না, টসকাবে না।

আমি এদিকে টর্চ ঘুরিয়ে দেখি, পড়বার সময় কাত হয়ে যাওয়াতে দরজার বাইরের ছিটকিনি গেছে খুলে, দরজা এখন হাঁ!

বললাম সে কথা সেজোমামাকে, কিন্তু আমি না সরলে তার নড়বার উপায় নেই। তখন কোমরের বগলেস খুলে সেজোমামার পেটের ওপরে দুই পা রেখে এক লাফে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে পড়া আমার কাছে কিছুই নয়। পৃথিবীতে যখন থাকতাম এরচেয়ে কত উঁচু উঁচু জায়গা থেকে লাফাতে হয়েছে। সেজোমামা শুধু একটু কোঁৎ করে উঠলেন।

বেরিয়ে বুঝলাম বোধ হয় চাঁদের কোনো একটা নিভে-যাওয়া আগ্নেয়গিরির মুখের মধ্যে পড়ে গেছি। চারদিকে মনে হল নরম ঘাস। মাথার ওপর তারাও দেখতে পেলাম, আবার এক কোনা দিয়ে বোধ হয় আমাদের এই পৃথিবীটাকেই একবার একটু দেখতে পেলাম। ঠিক যেন আরেকটা চাঁদ। মনে হল আফ্রিকাটাকে যেন একটু একটু দেখতে পেলাম। তারপরেই আবার সেটা টুক করে ডুবে গেল।

তখন কানে এল যন্ত্রের ভেতর থেকে সেজোমামা মহা চেঁচামেচি লাগিয়েছেন, টর্চের আলো দেখা, আমিও নামব।

অনেক কষ্টে নেমে আমার পাশে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেই বললেন, খিদেয় পেট জ্বলে গেল, সেই বড়ি একটা দেনা।

টের পেলাম আমারও বেজায় খিদে পেয়েছে, দুজনে দুটো বড়ি খেলাম, তারপর ঘাসের ওপর শুয়ে থেকে থেকে অন্ধকারটা একটু চোখ-সওয়া হয়ে এল। আমরা যে একটা বেশ বড়ো গর্তের মতো জায়গাতে শুয়ে আছি সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই, ঠিক যেন একটা বিরাট পেয়ালার মধ্যে রয়েছি। একটু একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল।

সেজোমামা বললেন, কী রে, উঠে একটু দেখবি না?

বললাম, ভোর হোক আগে।

সেজোমামা বললেন, আবার ভোর কী রে? এটা যদি চাঁদের উলটো পিঠ হয়ে থাকে তা হলে তো ভোরই হবে না।

এবারে উঠলাম। তাই-ই নিশ্চয় সেজোমামা। এ-পিঠটাতে তো সর্বদা আলো থাকে। দিনের বেলাও তাই দেখেছি, রাতেও দেখেছি।

–ফোঁস।

তিন হাত লাফিয়ে উঠলাম। ফোঁস করল কী? তবে কি চাঁদে হিংস্র জন্তুও আছে? বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। কিন্তু স্পষ্ট শুনলাম জন্তুটা কচর-মচর করে নরম ঘাসগুলোকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

সেজোমামা বললেন, তবে কোনো ভয় নেই। ওরা নিরামিষ খায়।

আবার শুনলাম জোরে একটা ফোঁস ফোঁস। আমার মোটেই ভালো লাগল না। সেজোমামা কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, কী হবে রে?

কী আবার হবে? এক নিমেষে গুলতিতে শট লাগিয়ে শব্দ লক্ষ করে দিলাম ছেড়ে। অমনি সে যে কী চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল সে আর কী বলব। একটা কেন, মনে হল এক লাখ জানোয়ার একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে! সেই চেঁচানি শুনে চাঁদের মানুষেরা জেগে উঠে সব বড়ো বড়ো মশাল নিয়ে দেখি পেয়ালার একদিকের কানা বেয়ে নেমেছে। কী হিংস্র সব চেহারা!কী ষণ্ডা, পৃথিবীর মানুষদের চেয়ে তিনগুণ জোরালো। আর সে কী গর্জন, কান ফেটে যায়।

আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলাম না। তারা হয়তো ওই অন্ধকারে আমাদের দেখতে পেল না। পড়িমরি প্রাণপণ ছুটে অন্য ধারের ঘাসে ঢাকা ঢালু দেয়াল বেয়ে পিঁপড়ের মতো আমরা উঠে গেলাম। শরীরে আর এতটুকু ক্লান্তি বোধ করলাম না।

ওপরে উঠেই ছুট লাগালাম। আন্দাজে অন্ধকারের মধ্যে দু-পা না যেতেই চাঁদের পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুপ করে খানিকটা পড়েই গড়াতে লাগলাম।

সব সইতে পারি বুঝলি, শুধু ওই গড়ানিটা আমার সহ্য হয় না। তখুনি মুচ্ছো গেলাম।

আবার যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখি সেজোমামা আমার মুখে-চোখে ঠান্ডা জল ছিটোচ্ছেন। আমি নড়ে উঠতেই বললেন, বাপ, বেঁচে আছিস তাহলে? দাঁড়া, গাড়িটা আনি, আর এখানে নয়, চল একেবারে ভোরের গাড়িটা ধরা যাক।

সেজোমামা গাড়ি আনতে গেলেন, আমি একটা পাথরে ঠেসান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। আস্তে আস্তে মাথাটা খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এলে বুঝলাম কুণাল মিত্তিরদের টিলার নীচেই এসে পড়েছি। সেজোমামা গাড়ি আনতেই বললাম, কী আশ্চর্য, না সেজোমামা? যেখান থেকে চাঁদে গেলাম আবার ঠিক সেই একই জায়গায় এসে নামলাম।

সেজোমামা বললেন, আশ্চর্য বই কী। আমরা যে বেঁচে আছি সেটা আরও আশ্চর্য!

তাই তো, যন্ত্রটা চাদেই পড়ে আছে। পকেট হাতড়াতে লাগলাম। সেজোমামা বললেন, আবার কী?

–কেন সব লিখে রাখতে হবে-না? ওখানে ঠান্ডা বাতাস আছে, জন্তু মানুষ সব আছে।

সেজোমামা বললেন, সে আমি মনোহরকে বলে দেবখন। আর দেখ, এসব কথা খবরদার বাড়িতে বলবি নে।

বাবা-মারা আমাদের দেখে অবাক। এ কী, কাল গেলে, আজই ফিরে এলে?

সেজোমামা বললেন, সেখানে মহামারি লেগেছে। আমাকে আজই ফিরে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে আমি কাউকে কিছু বলতে পারছি না, পেট ফেঁপে মরি আর কী!

.

ছোটোকাকা থামলে আমরা বললাম, তবে কেন বললে একরকম বলতে গেলে চাঁদে গিছলে? ছোটোকাকা বললেন, তার কারণ এই ঘটনার মাস চারেক বাদে মা হাতে করে সেজোমামার একটা চিঠি নিয়ে বাবাকে বললেন, শোনো একবার কাণ্ড। ওই যে আমাদের কুণাল মিত্তিরের ছেলে মনোহর না, সে নাকি এক উড়োজাহাজ বানিয়ে, যেখানে কুণাল মিত্তিরের গবেষণা-গোরুরা চরছিল সেখানে নামিয়ে একাকার কাণ্ড করেছে। কুণাল মিত্তির দারুণ রেগে ওকে চাকরি দিয়ে বোম্বাই পাঠিয়েছেন।

বাবা বললেন, গবেষণা-গোরু আবার কী জিনিস?

মা বললেন, ওমা, তাও জান না? কুণাল মিত্তির একরকম বড়ি বানিয়েছেন, তাতে সবরকম পুষ্টিকর জিনিস আছে, সে খেলেই পেট ভরে যায়। ওই টিলার মাথায় খানিকটা জায়গাকে পুকুরের মতো করে কেটে, অবিশ্যি তাতে জল নেই, সেখানে গোরুগুলো ছাড়া থাকত ওই বড়ি খেত আর মন ভালো করবার জন্য একটু একটু ঘাসও চিবুত। বাইশ সের দুধ দিত এক-একটা। ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া মনোহর সেইখানে উড়োজাহাজ নামিয়েছে। ব্যস, আর যাবে কোথা, গোরুরা সব দুধ বন্ধ করে দিয়েছে। কুণাল মিত্তির রেগে টং! ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে, এখন বলে নাকি ছেলের কোনো দোষ নেই, চমৎকার উড়োজাহাজ করেছে, কিন্তু পাড়ার কয়েকটা দুষ্টু লোক মিলেই নাকি ওর মাথাটা খেল। শুনলে একবার কথা!

আমি আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠে গিয়ে গুলতিটা বের করে কাগদের মারতে লাগলাম।

–হ্যাঁ রে, তোরা এখনও বসে রয়েছিস যে, আমাকে কি বইটা শেষ করতে দিবি না? এই বলে ছোটোকাকা আবার পা মেলে দিয়ে বই পড়তে লাগলেন।

হুঁশিয়ার

যখন সামনের লোকটার লোমওয়ালা ঘেমো ঘাড়টার দিকে আর চেয়ে থাকা অসম্ভব মনে হল, চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম। অমনি কার জানি একরাশি খোঁচা খোঁচা গোঁফ আমার ডান দিকের কানের ভিতর ঢুকে গেল। চমকে গিয়ে ফিরে দেখি ভীষণ রোগা, ভীষণ লম্বা, ভীষণ কালো একটা লোক গলাবন্ধ কালো কোট পরে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। তার পিছনে আরও অনেক লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কোন পা জোড়া তার বুঝে নিতে আমার একটু সময় লাগল। শেষটা টের পেলাম খুব সরু, খুব নোমওয়ালা, আর খুব কালো ঠ্যাং দুটো ওর। তায় আবার একজোড়া দাঁত-বেরকরা ছেঁড়া চটি পরা, তার ফুটো দিয়ে নোংরা বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে।

এই লোকটা হাসি হাসি মুখ করে আস্তে আস্তে আমার কানের মধ্যে থেকে তার গোঁফটাকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, মনিব্যাগটা আরেকটু খামচে ধরুন, যা চোর-চামারের উপদ্রব! লোকটার কথাগুলো যেন কতদূর থেকে এল, কীরকম একটা হালকা ফিসফিস আওয়াজ। তার চোখ দুটোও যেন আর কিছুতেই গর্তের মধ্যে থাকছিল না, একেবারে বেরিয়ে এসে আমার মনিব্যাগের ভিতরের খোপের মধ্যে পড়ে যেতে চাচ্ছিল।

সবাই এক জনের পিছনে এক জন দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে শেয়ালদা স্টেশনের ইন্টার ক্লাস টিকিটঘরের দিকে এগোচ্ছিলাম। খুব সাবধানে, কারণ একটু এক পাশেসরলেই ধাক্কার চোটে লাইন থেকে বেরিয়ে পড়বার ভয়। এমনি করে যখন খাঁচার ভিতরে বেশ কালোকালো মেমসাহেবের কাছে পৌঁছোলাম, তখনও টের পাচ্ছিলাম, পিছনে সেই লোকটার ফোঁসফোঁস নিশ্বাস আর আস্তে আস্তে গোঁফ নাড়া।

লোকটা দেখলাম আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। মেমসাহেবকে যখন টাকা দিলাম লোকটা ঝুঁকে ব্যাগের মধ্যে দেখতে দেখতে বলল–চেঞ্জ গুনে নেবেন, বেটিরা ভারি হঁচড়। মেম রেগে এ-গাল থেকে ও-গালে চুইংগামটা ঠুসে দিয়ে বলল– চোপরাও বাবু। তারপর লোকটা আমাকে সেইরকম যত্ন করে উপদেশ দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে নিয়ে চলল। একটা কলার খোসা আর কী যেন খানিকটা খুব কসরত করে এড়িয়ে বলল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। সবাই সবারটা গিলবার ফিকিরে আছে। গেটের কাছে চেকারবাবু চিকিৎ চিকিৎকরে টিকিট হেঁটে দিলে পর আমার সঙ্গে সঙ্গে সেও প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। বলল–এই যে গাড়ি–অবিশ্যি সেটা বলবার কিছু দরকার ছিল না।

আমার সঙ্গে একটা ইন্টার ক্লাস গাড়িতে ঢুকে আমার পাশে বসে বলল- জিনিসপত্র আগলে রাখুন, সুটকেসটা দূরে রাখবেন না, নিজের সিটের তলায় রাখাই ভালো। এটা জেনে রাখবেন শিয়ালদা স্টেশন চোর-বাটপাড়ের আড়ত। তারপর আমরা দুজনেই জুতো খুলে পা তুলে আরাম করে বসলে পর বলতে লাগল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। আমি নিজে যতগুলো চোর-জোচ্চর দেখেছি সবগুলোকে একটার পেছনে একটা দাঁড় করালে এখান থেকে বোলপুর স্টেশন অবধি লম্বা একটা লাইন হয়। একথা শুনে আমি অবাক হলাম।

তখন সে আরও বলতে লাগল, আর ছিচকে চুরির জন্য তারা যে অধ্যবসায়, ধৈর্য ও বুদ্ধি দেখিয়েছে, ভালো কাজে যদি লাগাত এতদিনে ভারতবর্ষ উদ্ধার হয়ে যেত।

তারপর তার কালো কোটের পকেট থেকে একটা চারকোনা পানের ডিবে বের করে বলল গিরিডির মতন সভ্য শহরে, যে জায়গা সজ্জনের বাস বলে বিখ্যাত এমন শহরে, সেবার পুজোর সময়ে সচ্চিদানন্দ জ্যাঠামশাইয়ের পাজামা সুটের ইজের গা থেকে খুলে চোরে নিয়ে চলে গেল, এর বেশি আর কী বলা যায়!

আমি নিবিষ্ট মনে শুনতে লাগলাম। আর সে গোটা দুই পান মুখে পুরে, একটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বলে যেতে লাগল– গরমের জন্য বাইরে মাদুর পেতে, তায় চাদর বিছিয়ে, বালিশ মাথায়, চাদর গায়, পায়ের কাছে চটি, বালিশের নীচে হাতঘড়ি, মাথার কাছে জলের গেলাশ নিয়ে, ভগবানের নাম নিয়ে রোজকার মতন শুয়ে পড়েছেন। আর সকালে উঠে দেখেন কিনা চটি নেই, গেলাশ নেই, বালিশ নেই, হাতঘড়ি নেই, এমনকী পরনের ইজেরটা পর্যন্ত কখন যেন আস্তে আস্তে খুলে নিয়েছে!

তখন সে বলল–কাউকে মশাই বিশ্বাস করা যায়? অরুণবাবু ট্রেনে করে আসছেন। সেকেন কেলাস গাড়ি, সঙ্গে উঠলেন দিব্যি খাকি প্যান্ট শার্ট হ্যাঁট পরা বাঙালি সাহেব। ক্যায়সা ভাব জমে গেল দেখতে দেখতে। ইনি ওঁর বিস্কুট খেলেন, আবার উনি এঁর সিগারেট টানলেন। তারপর মুড়ি-সুড়ি দিয়ে দু-জনে ঘুম। সকালে উঠে অরুণবাবু দেখলেন বাঙালি সাহেবও নেই, তার জিনিসপত্রও নেই, আর অরুণবাবুর সুটকেশও নেই।

আমি একবার আমার সুটকেস ও পুঁটলিটা দেখে নিয়ে ঠ্যাং বদলে বসলাম। আর সে বাইরে এঁদো পুকুরে ধোপাদের কাপড় কাঁচা দেখতে দেখতে নীচু গলায় বলতে লাগল।

ছোটোবেলায় পাড়াগাঁয়ে পিসিমার কাছে থাকতাম। গ্রামের একধারে বাঁশঝাড়ের কাছে খড়ের চালের বাড়ি। যেই-না সন্ধ্যে হওয়া আর অমনি বাড়ির আর উঠোনের আনাচে-কানাচে ভয়ভীতিরা ভিড় করে আসত। বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা খসার শব্দ থেকে আরম্ভ করে আমাদের মেনি বেড়ালটারকাঁক করেইঁদুর ধরার আওয়াজটা পর্যন্ত সূর্য ডোবার পর কেমন যেন অন্যরকম লাগত। আরপিসিমা শোবার আগে প্রত্যেক ঘরের প্রত্যেকটা খিল ভালো করে দেখে নিতেন, বাক্স প্যাটরার উপর নানানভাবে ঘণ্টা বাসন সব এমন করে সাজিয়ে রাখতেন যাতে একটু সরালেই সব দুমদাম পড়ে আমাদের কেন, পাড়ার অন্য লোকদেরও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এইসব করতে করতে পিদ্দিমের তেলটুকু পুড়ে যেত আর আলো নিবে যেত। পিসিমাও অমনি খচমচ করে বিছানায় ঢুকতেন। মাঝে মাঝে ওঁর ঠান্ডা খড়খড়ে পা আমার পায়ে লেগে যেত, আমি শিউরে উঠতাম। শুয়েই আবার পিসিমার মনে হত–কী হবে, খাটের তলা দেখা হয়নি, যদি কোনো ধূর্ত চোর ছোরা-হাতে সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে! আমাকে বলতেন–এই, তোর একটা মার্বেল খাটের তলা দিয়ে গড়িয়ে দে না, ওদিক দিয়ে বেরোলে বুঝব খাটের তলায় কেউ নেই।ভয়ে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যেত, পিসিমা যা বলতেন তাই করতাম। একবার খাটের পায়ায় মার্বেল আটকে গেল, আর সারারাত পিসিমা আর আমি জেগে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। আর কখনো যদি পিসিমা আগে শুতেন আর আমাকে অন্ধকারে পরে শুতে হত, খাটের তিন হাত দূর থেকে এক লাফ মেরে খাটে উঠে পড়তাম, যাতে খাটের তলায় লুকিয়েবসা বদমায়েশটা তার ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার ঠ্যাং ধরে টেনে নিতে না পারে। একদিন হিসেব ভুল হওয়াতে পিসিমার পেটের উপরল্যান্ড করেছিলাম, আর পিসিমা আমার কানটান মলে বার বার বলতে লাগলেন যে উনি পষ্ট টের পাচ্ছেন ওঁর নাড়িভুঁড়ি সব এলিয়ে গেছে!

এতটা বলে লোকটা এক বার আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল–ছোটোবেলা থেকে এমনি আমার ট্রেনিং যে কোনো শা–র চোরও আমার কাছ থেকে কানাকড়িও পায়নি! এই দেখুন নোটের তাড়া নিয়ে নির্বিঘ্নে যাচ্ছি!

এই অবধি বলেই হঠাৎ সে এদিক-ওদিক চেয়ে সটাং শুয়ে পড়ে নাক ডাকতে লাগল। গাড়িতে আর যে দু-চারজন ছিল তারাও সবাই একসঙ্গে নেমে গেল। আর আমিও আমার যে দু-একটা কাজ ছিল সেরে নিয়ে অন্য এক বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম ও একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর হয়ে এসেছে, চোখ ঘষে উঠে দেখি আমার সঙ্গীটি কখন জানি নেমে গেছে। তার কথা মনে উঠতেই আর তার চোরের ভয় মনে করতেই বেজায় হাসি পেল। ঠিক এই সময় চোখে পড়ল বেঞ্চির তলায় আমার সুটকেস, পুটলি ও চটি কিচ্ছু নেই। আছে কেবল তার সেই দাঁত বের করা ছেঁড়া চটি জোড়া!

ভীষণ রাগ হল। ভণ্ড, জোচ্চর, বকধার্মিক কোথাকার! রাগের চোটে হঠাৎ নিজের ট্র্যাকের উপর হাত পড়ে গেল। ট্র্যাক খুলে দেখলাম, কাল রাত্রে লোকটা ঘুমিয়ে পড়বার পর তার বুকপকেট থেকে যে নোটের তাড়াটা সরিয়েছিলাম আমার সুটকেস্ ইত্যাদি চুরি যেতে পারে কিন্তু সেটি ঠিকই আছে।

বেশ একটু খুশি মনে আবার শুয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠলাম।

Exit mobile version