Site icon BnBoi.Com

গুপির গুপ্তখাতা – লীলা মজুমদার

গুপির গুপ্তখাতা - লীলা মজুমদার

০১. অনেক দিন আগের ঘটনা

০১.

অনেক দিন আগের ঘটনা, ভুলে যাব মনে করে সব এই লিখে দিলাম। রোজ রোজ একরকম হত, হঠাৎ একদিন এমনি হল যে মনে করলে এখনও গা শিরশির করে।

একটা গাড়িতে ঠানদিদি, শ্যামাদাসকাকা, বিরিঞ্চিদা আর আমি!

গাড়ি চলেছে তো চলেইছে, থামবার নামটি করে না। এদের কি খিদে-তেষ্টাও পায় না? সঙ্গে কিছু নেই তা তো নয়। ওই টিফিন-ক্যারিয়ার একদম বোঝাই করা এই বড়ো বড়ো চপ লুচি আলুরদম শোনপাপড়ি।

খিদের চোটে পেটটা ব্যথা ব্যথা করছে। উঠেছি সেই কোন ভোরে; তত সকালে কখনো আমার ঘুম ভাঙে না। কাকেরা ডাকেনি, যারা রাস্তায় জল দেয় তারা আসেনি, আকাশ তখনও নীল হয়নি, তারারা নেবেনি, বগাই ওঠেনি, খাটের পায়ার কাছে নাক ডাকাচ্ছে আর ঘুমের ঘোরেই একটু একটু ল্যাজ নাড়াচ্ছে।

বগাইয়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। বেশ আমার পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকত। কাউকে কিছু করত না।

অত ভোরে উঠতে হয় না। পাশ ফিরে আবার ঘুমুতে যাব, এমনি সময় কানে এল খুটখুট ঠুকঠাক গুজগুজ ফিসফিস। মনে হল ঘর কথা কইছে, ঘরের বাইরের কেষ্টচুডোর গাছ কথা কইছে। এত কথা বলাবলির মধ্যে ঘুমুই কী করে?

উঠে পড়লাম। দোর গোড়ায় গিয়ে দেখি কিনা আমার ঠানদিদি সারা গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে, মস্ত এক পুটলি বগলে ফস ফস করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছেন।

আর কথাটি নয়, ছুটে গিয়ে পেছন থেকে ঠানদিদিকে জাপটে ধরলাম। ঠানদিদি এমনি চমকে গেলেন যে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলেন। তবেই হয়েছিল আর কী! চ্যাঁচামেচি করে একাকার কাণ্ড করতেন, তখন যাওয়া-টাওয়া সব বন্ধ!

আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

কোনোরকমে সামলিয়ে নিয়েই আমার মুখ চেপে ধরে ঠানদিদি বললেন,  স-স-স-স।

বলে আঙুল দিয়ে সিঁড়ির নীচেটা দেখিয়ে দিলেন।

সিঁড়ির নীচে দুটো লোক হাতছানি দিয়ে ঠানদিদিকে ডাকছে। দেখলাম তারা হল পাশের বাড়ির বিরিঞ্চিদা আর আমার শ্যামাদাসকাকা। তা হলে কী হবে, আমাকে দেখে সবাই কী বিরক্ত! একে আবার কেন আনা হল? এখুনি সব মাটি করে দেবে।

রেগে চেঁচিয়ে বললাম, বেশ, বেশ, আমি নাহয় ফিরেই যাচ্ছি। সেজোদাদামশাইকে গিয়ে সব বলে দিচ্ছি– ও সেজোদাদু

অমনি সব ভোল বদলে গেল, তখন আমাকে সে কী সাধাসাধি! লক্ষ্মীটি চুপ কর। চল তোকে কাটলেট খাওয়াব, গাড়ির মধ্যে চেয়ে দ্যাখ, টিফিন-ক্যারিয়ারে ভরতি চপ কাটলেট ডিমের ডেভিল। কারো কাছে কিছু বলিসনি কিন্তু।

অবাক হয়ে দেখি গলির মুখে সত্যি সত্যি বিরিঞ্চিদাদার রংচটা পুরোনো ফোর্ড গাড়িটা দাঁড়িয়ে। ভেতরে মেলা জিনিস আর একটা বিরাট পেতলের টিফিন-ক্যারিয়ার।

মাথার ওপরে চেয়ে দেখি আকাশের রং একটু ফিকে হয়ে এসেছে, তার ওপর দিয়ে কালো এক ঝাঁক পাখি বাঁকা হয়ে উড়ে যাচ্ছে, তাদের ডানার ঝাপটানি শুনতে পেলাম।

আর বলতে হল না। এক দৌড়ে ওপরে গিয়ে নতুন জুতোটা পরে নিলাম, একটা প্যান্ট শার্ট নিলাম, চোখেমুখে জল দিয়ে, ভালো করে চুলটা আঁচড়ে, লাট্টু লেত্তি, খুদে আয়না-চিরুনি ইত্যাদি দরকারি জিনিস পকেটে পুরে, তিন মিনিটের মধ্যে গাড়িতে গিয়ে চেপে বসলাম। মা বাবা বোম্বাই গেছেন, পুটলিও গেছে সঙ্গে, কাউকে কিছু বলতেও হল না। নইলে আর যাওয়া হয়েছিল!

এসে দেখি বিরিঞ্চিদা ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখছে, যেন আমার জন্য কতই-না দেরি হয়ে গেছে। সেধে তো সঙ্গে নিয়েছ বাপু, এখন তেজ দেখালে চলবে কী করে! বুকটা একটু একটু ঢিপ ঢিপ করছিল; এখন এই শেষ মুহূর্তে ধরা পড়লেই তো সব পন্ড! সেজোদাদুর নাকি ইঁদুরের পায়ের শব্দে ঘুম ছুটে যায়।

কিন্তু কিছু হল না। বিরিঞ্চিদার গাড়ি, তবে বিরিঞ্চিদা দারুণ ক্যাবলা, গাড়ি চালাতে ভয় পায়! তাই শ্যামাদাসকাকা চালাচ্ছে। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। পারলে আমি কখনো পেছনে বসি না। শ্যামাদাসকাকা খুব ভালো গাড়ি চালায়, স্টার্ট দিতে এতটুকু আওয়াজ হল না। ওই তো লড়বড়ে গাড়ি, মনে হয় চলতে গেলে এখনি সব খুলে খুলে পড়ে যাবে।

কাছাকাছি কোথাও নয়, চলোম সটান কলকাতার বাইরে। পথঘাট ভোঁ ভোঁ, এত ভোরে কারো ঘুম ভাঙেনি। মাটি থেকে এক হাত ওপরে একটা ধোঁয়ামতো বিছিয়ে রয়েছে। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

আস্তে আস্তে ভোর হয়ে এল, পূর্ব দিক ফর্সা হবার আগেই দেখলাম পশ্চিম দিকটা লাল হয়ে উঠেছে। গোয়ালঘরে সব গোরুরা ডাকতে লাগল, এখান থেকে ওখান থেকে মুরগিরা বেরিয়ে এল। গাঁয়ের লোকদের জেগে ওঠা দেখতে পেলাম।

গাড়িতে কেউ কথা বলে না। এমনিতেই বিরিঞ্চিদার গাড়িতে এমনই দারুণ শব্দ হয় যে খুব না চ্যাঁচালে কিছু শোনা যায় না। তার ওপর মনে হল এদের সবার মনে যা ভয়। দু-একবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কেউ কিছু বলে না, উলটে সে কী ধমক-ধামক করতে লাগল। কী দরকার রে বাবা। তোরা ভয় পেলে আমার আর কী!

খিদে খিদে পাচ্ছিল; কাল রাতে পিসিমার কড়াইতে আঠা তৈরি করা নিয়ে রাগমাগ করে ভালো করে খাইনি, তায় এখন কত বেলা হয়ে যাচ্ছে, কেউ খাওয়া-টাওয়ার কথা বলে না কেন?

নড়ছি-চড়ছি, এমনি সময় বিরিঞ্চিদা আমার কানের কাছে মুণ্ডুটা এনে বলল, এই চুপ করে বোস-না, বেশি কথাটথা বলিস না, তাহলে তোকে এই এত বড়ো একগাদা চুইংগাম দেব!

আমি তো অবাক। একটা টিকটিকির ল্যাজ কাউকে কখনো দেয় না, ও দেবে আমাকে একগাদা চুইংগাম। তবেই হয়েছে!

এমনি করে কত মাইল যে চলে এসেছি তার ঠিক নেই। বেশ বেলা বেড়েছে এমন সময় দূর থেকে দেখি রাস্তা যেখানে রেলের লাইন পার হয়েছে, সেখানে বিরাট তেঁতুলগাছের তলায় মেলা লোকের ভিড়।

বেশ খানিকটা দূরেই আছি, কিন্তু শ্যামাদাসকাকা দেখলাম খুব ঘাবড়েছে। স্টিয়ারিংটাকে কষে চেপে ধরেছে, হাতের গিঁটগুলো সব সাদা সাদা হয়ে উঠেছে। চুলগুলোও খাড়া খাড়া, সারা কপাল জুড়ে এই বড়ো বড়ো ঘামের ফোঁটা।

সত্যি বিষম ভিড়। আর এক বার অবাক হয়ে যেই শ্যামাদাসকাকার দিকে তাকিয়েছি, সে কর্কশ গলায় বলল, কিছু করবার না থাকে তো আমার দিকে না তাকিয়ে বুড়ো আঙুল চোষো।

ততক্ষণে শ্যামাদাসকাকার কপালের পুরোনো ঘামগুলো গলে গিয়ে নদী হয়ে, ওর জামার গলা দিয়ে নামতে লেগেছে আর তার জায়গায় নতুন সব ঘামের ফোঁটা দেখা দিয়েছে।

ভিড়ের কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম। দেখি একটা চা-ওলা তার ছোট্ট তোলা উনুন, চোঙা-দেওয়া পেতলের চা-দানি আর টুকরি করে মাটির ভাঁড় নিয়ে, একেবারে কাছ ঘেঁষে বসে আছে। কিন্তু শ্যামাদাসকাকা যেন দেখতেই পাচ্ছে না।

মুণ্ডু ঘুরিয়ে পেছনের সিটের দিকে চেয়ে দেখলাম। ঠানদিদি আর বিরিঞ্চিদাও চোখ গোল গোল করে এ-ওর দিকে চেয়ে আছেন, গালের রং ফ্যাকাশে, মুখে কথাটি নেই। কী জানি বাবা!

ভিড়ের জন্য গাড়ি থামাতে হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করছিলাম যারা ট্রেনে কাটা পড়েছে তাদের মাথাগুলো একেবারে আলাদা হয়ে গেছে কি না।

কিন্তু কিছু দেখা গেল না, মড়া না, কিছু না। চা-ওলার কাছে দেখলাম কাচের বাক্সে বাঁদর বিস্কুট। কী ভালো খেতে বাঁদর-বিস্কুট, শক্ত, সোঁদা গন্ধ, চমৎকার! কিন্তু পয়সাকড়ি নেই।

এদিকে এরা সব যেন ভয়ে কাঠ।

ভিড়ের মধ্যে চেয়ে দেখি ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে রয়েছে সন্দেহজনক কত যে লোক তার ঠিক নেই। সেইসঙ্গে লাঠি হাতে নীল পাগড়ি কত পুলিশ! কিছু একটা যে ঘটেছে সেটা ঠিক।

ডেকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, এই পাহারাওয়ালা, কুছ হুয়া? কিন্তু জিজ্ঞেস করব কি, মুখ হাঁ করতেই বিরিঞ্চিদা আর ঠানদি ফিরে আমার মুখ চেপে ধরলেন! আর শ্যামাদাসকাকা পর্যন্ত আমার দিকে ফিরে বললে, ইডিয়ট!

সামনেই একটা রোগা লোক দাঁড়িয়েছিল, গায়ে গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, চুল কোঁকড়া তেল-চুকচুকে।

সে আমাদের গাড়ির পাদানির ওপর চড়ে পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসতে লাগল। দেখলাম ওর কানে সোনার মাকড়ি পরা আর একটু করে চুন লাগানো। তাহলে নাকি পান খেলেও মুখ পোড়ে না। একদিন দেখতে হবে।

লোকটা নিজের থেকে বললে, এখানকার জমিদারবাবুর স্ত্রীর মুক্তোর মালা হারিয়েছে। তাই ধরপাকড় চলছে।

আমাদের গাড়ির লোকরা এতক্ষণ কাঠপুতুলের মতো সামনের দিকে চেয়ে বসেছিল, এবার তিন জনে একসঙ্গে বিষম একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, ওই লোকটার সঙ্গে মেলা গল্প জুড়ে দিল।

ওইখানে লেভেল ক্রসিং-এর ধারে, ভিড়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, শ্যামাদাসকাকা ও বিরিঞ্চিদা আর ঠানদিদি সেই লুঙ্গিপরা মাকড়িকানে অচেনা লোকটাকে কী যে না বলল তার ঠিক নেই।

অবাক হয়ে সব শুনলাম, আগে এসব কিছুই জানতাম না।

বলল আমরা নাকি মোটরে গয়া যাচ্ছি ঠানদিদির বাবার পিণ্ডি দিতে। অথচ ঠানদিদির যে আবার বাবা আছে এ তো কখনো শুনিনি। নিজেই উনি যথেষ্ট বুড়ো।

ঠানদিদি নাকি পিণ্ডি দেবেন, বিরিঞ্চিদা জোগাড় দেবে, শ্যামাদাসকাকা গাড়ি চালাবে। আর আমি হলাম ঠানদিদির নাতি, নাকি কেঁদে-কেটে সঙ্গ নিয়েছি, ঠানদিদিকে ছেড়ে একদণ্ড থাকতে পারি না।

এই বলে ঠানদিদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুল নোংরা করে দিলেন। আমি এমনি অবাক হয়ে গেছলাম যে কিছু বললাম না। শুধু পকেট থেকে আয়না-চিরুনি বের করে, চুলটাকে যত্ন করে ফের আঁচড়ে নিলাম। আশা করি এতেই ওঁকে যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া হল।

ঠিক সেই সময় সাদা পেন্টেলুনপরা কালো ইন্সপেক্টরবাবু ভিড় ঠেলে এসে হাজির। আর অমনি লুঙ্গিপরা লোকটা টুপ করে নেমে হাওয়া।

শ্যামাদাসকাকাও ঘন ঘন হর্ন দিতে লাগল, ঠানদিদি আর বিরিঞ্চিদা ইদিক-উদিক গাছপালা দেখতে লাগলেন, যেন কিছুই জানেন না।

ইন্সপেক্টরবাবুকে শ্যামাদাসকাকা সিগারেট খাওয়াল, আর সে বললে, ও-কে।

অমনি ভিড়টা দু-ভাগ হয়ে গেল আর আমরা রেলের লাইন পার হয়ে, ওপারের পথ ধরলাম।

আর থাকতে পারলাম না। স্টিয়ারিঙের ওপর শ্যামাদাসকাকার হাতটা চেপে ধরে বললাম, বলতেই হবে কেন পালাচ্ছ তোমরা।

ওর হাতটা অমনি স্টিয়ারিং থেকে খসে গেল আর গাড়িটাও ল্যাগব্যাগ করে উঠল। শ্যামাদাসকাকা তো হাঁ।

পেছন থেকে ঠানদিদি গম্ভীর গলায় বললেন, পেছনে হুলিয়া লেগেছে, না পালিয়ে উপায় নেই।

 ০২. হুলিয়া লেগেছে

হুলিয়া লেগেছে। ইস্। শ্যামাদাসকাকার কাছে আরেকটু ঘেঁষে বসলাম। সে বললে, উঁ! উঁ! গিয়ার চিপকিয়ো না।

বিরিঞ্চিদা বললে, আমরা ফেরারি, ঘরবাড়ি ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছি। হল এবার? ভোর-ইস্তক খালি বলে– কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। কেমন, এবার খুশি তো?

ঠানদিদি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না চিরদিনের জন্য নয় মোটেই। ডিসেম্বর মাসে ওর পরীক্ষা-না? তা ছাড়া মশলার কৌটো তো ফেলে এসেছি। তারজন্যও এক বার ফেরা দরকার।

তারপর সবাই চুপচাপ।

কে জানে হুলিয়ারা কামড়ায় কি না।

পথটা ক্রমে নির্জন হয়ে এসেছে। দুপাশের বড়ো বড়ো বট গাছ পথের ওপর ঝুঁকে পড়ে, পাতায় পাতায় মিলিয়ে, মাথার ওপর যেন ছাদ তৈরি করছে।

বিষম নিরিবিলি। এত নিঝুম যে দিনের বেলাতেও ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। শুনতে শুনতে কেমনধারা ঘুম এসে যায়। মনে হয় ঝিঁঝিরা কত দূরে চলে যাচ্ছে। আবার কাছে আসছে।

শ্যামাদাসকাকা হঠাৎ পথের ধারে গাছতলা ঘেঁষে গাড়ি থামিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল।

অমনি আমিও সিটের পেছনে চড়ে বসে ঠানদিদির দিকে মুখ করে রেগে বললাম, কেন বললে কান্নাকাটি করে সঙ্গ নিয়েছি? তোমরা নিজেরা আমাকে জোর করে ধরে আননি? কাটলেট খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে, চুইংগাম দেবে বলে আমাকে নিয়ে আসনি? পাছে। সেজোদাদুকে সব বলে দিই সেই ভয়ে।

ওরা তার কোনো উত্তর না দিয়ে, নিশ্বাস বন্ধ করে একসঙ্গে বলল, কী সব বলে দেবে? তুমি তার কী জানো?

কী আর করি, পকেট থেকে টিনের ব্যাং বের করে কট কট করতে লাগলাম। তাই দেখে ওরাও আবার সব আরাম করে বসল। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছবে বলে শ্যামাদাসকাকা পকেটে হাত পুরে দিল। দিয়েই কিন্তু একহাত লাফিয়ে উঠে চাপা গলায় বিরিঞ্চিদাকে বলল, বিরিঞ্চি, দেখ তো পকেটে যা মনে হল, সত্যি সত্যি তাই কি না।

বিরিঞ্চিদা পেছনের সিট থেকে ঝুঁকে পড়ে সোজা শ্যামাদাসকাকার পকেটে হাত চালিয়ে দিল। টেন বের করল এক ছড়া মুক্তোর মালা। ঠিক যেমনটি গোপলার বইতে পড়েছিলাম, গোল গোল জমানো চোখের জলের মতো এক ছড়া মুক্তোর মালা। তাতে সকাল বেলার রোদ পড়ে লাল নীল সবুজ রং ঠিকরোচ্ছে। শুনেছি এসবের জন্য রক্তগঙ্গা বয়।

ঠানদিদি বললেন, ইস্ শ্যামাদাস, তোর পেটেও এত ছিল!

বিরিঞ্চিদা বলল, তুই সব পারিস রে শ্যামাদাস। কিন্তু কখন করলি তাই ভাবছি।

আমি বললাম, শ্যামাদাসকাকা করবে জমিদারগিন্নির মালা চুরি! আরশুলো দেখলে ওর দাঁতকপাটি লেগে যায়, ও করবে চুরি! কী হয়েছে বলব? ওই লুঙ্গিপরা লোকটি নির্ঘাত মালাটা ওর পকেটে চালান করেছে। ধরা পড়বার ভয়ে।

ঠানদিদি শিউরে উঠে বললেন, ওরে শ্যামাদাস, রুমাল দিয়ে ওটাকে মুছে ফেল রে। ছুঁয়েছিস ওটাকে, মুক্তোগুলোতে তোর আঙুলের ছাপ পড়েছে।

বিরিঞ্চিদাও বলল, এবার কে তোকে বাঁচায় দেখব। তোর পেছনে গোয়েন্দা লাগবে দেখিস। আর গোয়েন্দার হাত এড়ালেও ওই লুঙ্গিপরাটা রয়েছে। দেখিস ওই মালা উদ্ধারের জন্য কত রক্তপাত

এই অবধি শুনেই শ্যামাদাসকাকা মালাটা পকেটে পুরে কোনো কথা না বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল।

দেখলাম ওর চেহারাটা কেমন বদলে গেছে। চোখ ছোটো হয়ে গেছে। গায়ের রং, কানের শেপ অন্যরকম লাগছে। মালাটা বোধ হয় ওর ছাড়বার ইচ্ছে নেই।

হঠাৎ বিরিঞ্চিদা বলে উঠল, এই রে শ্যামাদাস! পেছনে একটা গাড়ি লেগেছে!

ব্যস্, আর বলাকওয়া নেই, সটান শ্যামাদাসকাকা বড়ো রাস্তা ছেড়ে বনবাদাড়ে নেমে পড়ল। গাছ-গাছড়ার মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। তারই ওপর দিয়ে শ্যামাদাসকাকা দিব্যি গাড়ি চালিয়ে চলল।

কেউ কোনো আপত্তি করল না। যাকগে যেখানে খুশি, খিদের চোটে আমার কিছু ভালোও লাগছিল না। তবু দু-এক বার বললাম, তোমরা আজ খাবে না?

কী জ্বালা! কেউ কোনো উত্তর দেয় না।

পেছন ফিরে বললাম, তবে আমি খাই?

খড়খড়ে গলায় ঠানদিদি বললেন, সারাক্ষণ শুধু খাই খাই। বলছি পেছনে হুলিয়া লেগেছে।

–হুঁলিয়া আবার কী?

বিরিঞ্চিদা বিরক্ত হয়ে বলল, ন্যাকা! হুলিয়া আবার কী! ধরলে পর টেরটা পাবি।

চারদিকে ঝোপঝাপ, উঁচু উঁচু গাছের শেকড়, মাঝে মাঝে একটুখানি খোলা জায়গা, বড়ো বড়ো কালো পাথর, খানিকটা মাটি ভেঙে গেছে, পাথর আর ছিবড়ের মতো গাছের শেকড় বেরিয়ে রয়েছে। এসব জায়গায় হুণ্ডার থাকে। তারা ছোটো পাঁঠা-টাঠা ধরে তো নিয়ে যায়ই, মানুষদেরও খায়-টায়। আমার দিককার দরজাটা আবার লগবগ করে, একটু একটু করে ঘষটে ঘষটে শ্যামাদাসকাকার দিকে এগুচ্ছি, সে আবার খেঁকিয়ে উঠল, বলছি গিয়ার চিপকিয়ো না। সরে বোসা।

বললাম, দরজাটা যদি খুলে যায়? এত আস্তে চালাচ্ছ কেন? কিছুতে যদি লাফিয়ে পড়ে?

শ্যামাদাসকাকা বিরক্ত হয়ে তখুনি গাড়ি থামিয়ে বলল, বেশ তো, আমার চালানো পছন্দ না হয়, তুমিই চালাও-না। কী সুন্দর রাস্তা দেখছনা। তুমি এদিকে এসো, আমি ওধারে যাই।

ততক্ষণে রাস্তাটা সরু হতে হতে একটা পায়ে-চলা পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছগুলোও ভিড় করে এসেছে। সত্যি বলছি ঝিঁঝির ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। ঝিঁঝির ডাকে কীরকম মনখারাপ লাগে; খিদেও পাচ্ছিল। পকেট থেকে টিনের ব্যাংটা বের করে আবার কটকট করতে লাগলাম।

আরও খানিক দূরে যাওয়া গেল। শেষটা একটা বট গাছের তলায় শ্যামাদাসকাকা গাড়ি থামাল।

চারদিক থমথমে চুপচাপ। ঝিঁঝির ডাক, পাতার শিরশির আর দূরে কোথায় জল পড়ার শব্দ। এইসব জায়গাতেই বোধ হয় হুণ্ডাররা জল খেতে আসে। ছোটো নদীর ধারে, বালির ওপর দিয়ে হেঁচড়ে কিছু নিয়ে গেলে, তার দাগ দেখা যায়। কিন্তু তখন আর কিছু করবার উপায় থাকে না। খিদে।

তখন শ্যামাদাসকাকা নিজে থেকেই বললে, খিদেয় পেটের এদিক-ওদিক জুড়ে গেছে।

যাক, বাঁচা গেল।

বিরিঞ্চিদা আমাকে বলল, ওঠ-না। আমার পায়ের কাছ থেকে টিফিন ক্যারিয়ারটি নামিয়ে খোল দিকিনি। কুঁজোয় জল আছে, বের-টের কর, আমার এখনও হাত-পা কাঁপছে, পেটের ভিতর কেমন যেন করছে। নে, বের কর।

টিফিন ক্যারিয়ার খুলে দেখি লুচি, পটোলভাজা, আলুরদম, মাংসের বড়া, জিবেগজা। যদিও ডিমের ডেভিল, শোনপাপড়ি মোটেই নেই। দরজার খোপে পুরোনো খবরের কাগজ ছিল, তাতে করে যত্ন করে ওদের খাওয়ালাম। শ্যামাদাসকাকা কুড়িটা লুচি খেল; বিরিঞ্চিদারও দেখলাম ভয়ের চোটে খিদে বেড়েছে। খালি ঠানদিদি নাক সিটকে একটু দূরে বসে ফলমূল খেলেন।

কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ খুশি হল বলে মনে হল না। খাবার পর জল খেয়ে, পকেট থেকে একটি লোমওয়ালা ল্যাবেঞ্চস বের করে মুখে পুরে, যেই বলেছি, আঃ! কী আরাম!

অমনি ওরা সব রুখে উঠল, আরাম? আরামটা কোথায় পেলি তাই বল! এখন কী উপায় হবে শুনি? সামনে অঘোর জঙ্গল, পেছনে শব্দুর, এখনি বিকেল হয়ে এসেছে, রাত হতে কতক্ষণ? কী উপায় হবে এবার বল!

বললাম, শ্যামাদাসকাকা যদি জঙ্গলের মধ্যে ইচ্ছে করে না ঢুকত, তাহলে এতক্ষণে আমরা

এমনি সময় ঠানদিদি হঠাৎ চেঁচিয়ে-মেচিয়ে এক লাফে গাড়িতে উঠে পড়ে বললেন, ওরে বাবা রে! বাঘ!

আমিও গাড়িতে উঠে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে, তাকিয়ে দেখি একটি মোষ প্যাটার্নের জন্তু। বিরিঞ্চিদা তাড়া দিতেই চলে গেল। সত্যি, মেয়েরা যে কী দারুণ ভীতু হয়।

একটু পরেই একটা ব্যাং দেখলাম, থপ থপ করে কতকগুলো কালো পাথরের ফোকরের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ফোকরের মধ্যে ব্যাঙের চোখ জ্বলজ্বল করছে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিছু ভয় পাইনি। ঠানদিদিকে কিছু বলিনি পর্যন্ত। কী জানি যদি শেষটা ওঁর হাত পা এলিয়ে যায়। মেয়েদের কিছু বলা যায় না।

খানিকবাদে বিরিঞ্চিদা বলল, কই, দেখি তো মালাটা। ই-স্! লাখ টাকার জিনিস রে শ্যামাদাস। ধরা না পড়িস যদি, রাতারাতি রাজা হয়ে যাবি। তবে যদি ধরা পড়িস– আর সেটারই চান্স বেশি– তা হলে বাকি জীবনটা ঘানি টেনে কাটাবি।

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি দেখেছি, চোখে নারকোল মালার তৈরি চশমা বেঁধে দেয়। নইলে মাথা ঘোরে।

অমনি শ্যামাদাসকাকা ঠাস করে আমার গালে একটা চড় কষিয়ে, মালাটাকে টেনে ঘাসের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল।

সবুজ ঘাসের ওপর মুক্তোগুলো জ্বলতে লাগল, যেন কে সারি সারি বাতি দিয়েছে।

বিরিঞ্চিদা গিয়ে কুড়িয়ে আনল

দেখলাম মাঝখানে আবার একটা মস্ত হিরে ঝোলানো। শ্যামাদাসকাকাকে হুলিয়ায় ধরলে ঠিক হত! কিন্তু তাহলে গাড়ি কে চালাত?

০৩. চার দিকে চেয়ে দেখলাম

চার দিকে চেয়ে দেখলাম। মাথার ওপর বট গাছটা মেঘের মতো অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে। কতকগুলো ঝুরি মাটিতে নেমেছে, কতকগুলো শূন্যে ঝুলছে, বাতাস লেগে একটু একটু দুলছে, আর ডালের ভেতর দিয়ে, পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো, কেমন-একটা সবুজ রং ধরে আমাদের গায়ে এসে পড়েছ। শিরশির বাতাস বইছে।

শ্যামাদাসকাকা বিরিঞ্চিদার হাত থেকে মালাটা ছিনিয়ে নিয়ে আবার পকেটে পুরে ফেলে বলল, এসব সামান্য জিনিসে আমার কোনো লোভ নেই রে বিরিঞ্চি। ও মালা আর কী দেখাচ্ছিস? জানিস আমার ঠাকুমার গায়ে দুপুরে এক লাখ টাকার আর সন্ধ্যে বেলায় তিন লাখ টাকার গয়না থাকত। এত গয়না ছিল যে নিজেই জানতেন না কী আছে না আছে। ওঁদের বাড়িতে বাইরে থেকে গয়না পরে কেউ যদি আসত, তো মনে করতেন বুঝি ওঁরই গয়না নিয়েছে! এমনি করে কত যে শব্দুর তৈরি করেছিলেন। শেষটা তাতেই ওঁর কাল হল!

আমি বললাম, কেন, কেন, কী হয়েছিল?

শ্যামাদাসকাকা বললে, আঃ, গল্প বলবার সময় হুড়ো দিতে হয় না। কী রূপ ছিল তার তা জানিস? ওঁর পাশে যে দাঁড়াত তাকেই বাঁদরের মতো দেখাত। দুধের মতো রং, গোড়ালি পর্যন্ত কালো কোঁকড়া চুল, কান পর্যন্ত টানা চোখ, মুক্তোর সারির মতো দাঁত। তিন লাখ টাকার গয়না পরে শুতে যেতেন!

আমি বললাম, ই–স্! তারপর কী হল? নিশ্চয় খারাপ কিছু?

শ্যামাদাসকাকা বকে যেতে লাগল, একদিন সকালে উঠে দেখেন সব চুরি গেছে। শত্তুরের তো আর অভাব ছিল না। রাতারাতি কে এসে গা থেকে সমস্ত খুলে নিয়ে চলে গেছে। ঠাকুরমা টেরও পাননি। সকাল বেলা তাবিজ ঢিলে হয়ে গেছে মনে করে কনুই খামচাচ্ছেন; চেয়ে দেখেন কোথায় তাবিজ! সোনার তাবিজ নেই, হিরের রতনচূড় হাওয়া, নীলকান্ত মণি-বসানো চরণ পদ্ম, ফিরোজা-দেওয়া মুক্তোর সাতনরি, কিচ্ছু নেই। নাকছাবিটা অবধি খুঁটে তুলে নিয়ে গেছে।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শ্যামাদাসকাকা বলল, আমার মন বলছে এই মালাটাও সেই চুরিকরা জিনিসেরই একটা। কিছুরই ফর্দ করা তো আর ছিল না। তবে এটার কতই-বা দাম হবে? বড়ো জোর বিশ-পঁচিশ হাজার!

বিরিঞ্চিদা সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, দ্যাখ শ্যামাদাস, তোর মনে পাপ ঢুকেছে; তুই খুব ভালো করেই জানিস এটা সেই জমিদার গিন্নির মালা। হয়তো ওই লুঙ্গিপরা লোকটার সঙ্গে তোর ষড় ছিল। দেখিস এরজন্য তোকে ঝুলতে হবে।

দেখলাম হিংসায় বিরিঞ্চিদার মুখটা সবুজ হয়ে গেছে।

শ্যামাদাসকাকাও দেখলাম দারুণ রেগে গেছে, আমি ঝুলব মানে? বাঃ বেশ বললি যা হোক! তুই আর পিসিমা–

বিরিঞ্চিদা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে শ্যামাদাসকাকার মুখটা চেপে ধরে নাক দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললে, স্-স-স-স চুপ কর ভাই। বলেছি তো তোকে চীনে হোটেলে চ্যাং-ব্যাং খাওয়াব। তা ছাড়া তোর নিজেরও তো–

সবাই চুপ করল।

ঠানদিদি মোষ দেখার পর আর কথা বলেননি। এখন হঠাৎ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হরি হে, সবই তোমারই ইচ্ছে। নইলে আমারই-বা সেজোপিসিমার মুক্তোর মালা বাক্স থেকে বেমালুম অদৃশ্য হবে কেন। ভাবতে পারিস তোরা, খাটের তলায় বাক্স, বাক্সের ওপর সের পঁচিশেকের সাঁড়াশি বারকোশ, বাক্সের মুখ মোটা ছাগলদড়ি দিয়ে বাঁধা, খাটের ওপর অষ্টপ্রহর সেজোপিসিমা শুয়ে। আমার বিয়েতে ওই দিয়ে আশীর্বাদ করবেন বলে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, বছরের পর বছর মালা আগলাচ্ছেন। কবে আমার বিয়ে হবে। এদিকে আমি তখনও জন্মাইনি পর্যন্ত! শেষটা একদিন দেখেন কিনা বাক্সের মুখ যেমন দড়ি দিয়ে তেমনি দড়ি দিয়েই বাঁধা; সাঁড়াশি বারকোশ যেমনকে তেমন; খালি বাক্সর মধ্যে লাল চেলির টুকরোয় বাঁধা মালাগাছি নেই। সেই শোকেই তো আমি জন্মাবার আগেই সেজোপিসিমা গেলেন! নইলে কী আর এমন বয়স হয়েছিল! মাত্র একাশি বচ্ছর। অথচ ওঁরই মা দিদিমারা হেসে-খেলে সাতানব্বই আটানব্বইটি বচ্ছর কাটিয়েছিলেন। হরি-নারায়ণ! এ মালাটা যেন অবিকল সেই। একরকম বলতে গেলে এটা আমারই মালা!

বিরিঞ্চিদাও কম যায় না। সে বললে, আমার জীবনেও কি মুক্তোর মালা নেই নাকি? জানিস, যেবার আমি প্রথম বার বি.এ. পরীক্ষা দিই, শেষদিন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, দেখি সামনে এক সন্ন্যিসী। কী করি ট্রামভাড়া ছাড়া হাতে একটি পয়সা নেই। তাই-ই দিয়ে দিলাম। সন্নিসী বললেন, ব্যাটা তোকে পাস করানো কারো কম্ম নয়, তবে এই জিনিসটা নে, কিছুটা শান্তি পাবি। বলে একটা ছোটো পুটলি দিলেন। বিকেলে বাড়ি গিয়ে খুলে দেখি ঠিক এইরকম একটা মুক্তোর মালা।

আমি বললাম, অ্যাঁ। তারপর সেটার কী হল?

বিরিঞ্চিদা বলল, দুঃখের কথা আর বলিস কেন। ভুলে সেটা সুদ্ধই জামাটা বোপর বাড়ি দিয়েছিলাম। তা ধোপর বাড়ি থেকে একটা পেনসিল ফেরত পাওয়া যায় না, ও কি আর ফিরে আসে! ধোপাটাও আবার পরদিন থেকে নিখোঁজ। হয়তো এসব বিশ্বাস করবি না।

আমিও এ কথা শুনে বললাম, ও হ্যাঁ, আমারও মনে পড়ছে—

ওরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, চোপ্। ফের বানাচ্ছিস!

ঠানদিদি নিশ্বাস ফেলে বলে যেতে লাগলেন, ইস্, ভাবতে গিয়েও আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে হাঁসের গায়ের মতো হয়ে গেছে। সেবার সেই যে মেমের পালক-দেওয়া টুপি দেখে ভয় পেয়ে, চিড়িয়াখানার খাঁচা ভেঙে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল, তোদের কারো মনে নেই? তবে মনে থাকা শক্ত, কারণ তোরা কেউ ছিলি না। সেই যে সব একতলার দরজা জানলা বন্ধ করে দোতলায় বসে থাকতে হয়। উঃ! এখনও মনে করলে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদোয়। তার মধ্যেও সেজোপিসিমা মালাগাছি প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছিলেন। শেষে কিনা– বলে ঠানদিদি চোখে আঁচল দিলেন।

শ্যামাদাসকাকা একটু যেন রাগ রাগ ভাব করে বলল, থামো দিকিনি। মনের দুঃখুগুলো এখনকার মতো চেপে রেখে, কী করা যায় তাই ভাবা যাক।

ঠানদিদি বিরক্ত হয়ে বললেন, তা শুনতে ভালো লাগবে কেন? মালাটা কি তুই সহজে হাতছাড়া করবি? বেশ, চল, যা হোক কোথাও একটা ব্যবস্থা করা যাক। ওঠ, চল।

শ্যামাদাসকাকা বলল, চল বললেই তো আর চলা যায় না। আসল কথা হল ও গাড়ি এখনকার মতো এক ইঞ্চিও চলবে না। ওর তেল ফুরিয়ে গেছে, ওর সব কটা টায়ার ফুটো হয়ে গেছে, তা ছাড়া কিছুক্ষণ ধরে ওর পেটের ভেতর থেকে কীরকম একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে, সে আমি একেবারেই ভালো বুঝছি না।

বিরিঞ্চিদা বেজায় চটে গেল, ইয়ে, টায়ার সব ফুটো করে দিয়েছ? ওর দাম কত তা জান? আর গোঁ গোঁ শব্দও তো আগে ছিল না।

শ্যামাদাসকাকা আরও বলল, তা ছাড়া রাস্তাও তো এইখানে শেষ হয়ে গেছে, এখন উপায়টা কী হবে তাই বল।

এই বলে তিনজনেই আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি বললাম, কী আবার হবে? চলো, হাঁটা দেওয়া যাক। হেঁটে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেওয়া যাক। সেখানে মাথা গোঁজা যাবে, ফন্দিও পাকানো যাবে।

ঠানদিদি চটে গেলেন।

ফন্দি পাকানো আবার কী? কোথায় শিখিস এসব কথা? তা ছাড়া ওই লাখ টাকার মালা হাতে নিয়ে, এই ভর সন্ধ্যে বেলা, অঘোর বনের মধ্যে হেঁটে বেড়াব? বেঘোরে অচেনা আস্তানায় আশ্রয় নেব? তোর প্রাণে কি একটুও দয়ামায়া নেই রে?

বললাম, বেশ, তা হলে হেঁটো না, গাড়িতেই বসে থাকো, হুণ্ডারে খেয়ে নিলে আমাকে বোলো! তোমাদের পেছনে না হুলিয়া লেগেছে?

এই বলে আমার দিকের দরজাটা খুলে নেমে পড়লাম।

হুলিয়ার কথা শুনেই ওরাও এ-ওর পা মাড়াতে মাড়াতে ঠেলাঠেলি করে নেমে পড়ল।

উঃ! বসে থেকে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছিল! খানিক হাত-পা সোজা-বাঁকা করে, বাবা যেমন বলেছিলেন, সেইরকম করে খিল ছাড়ালুম। ওরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। তার পর বিরিঞ্চিদা বলল, যত ঢঙ! নে, নে, গাড়ির কাচটাচ তোল, দরজাগুলো এঁটে দে! আমারও যখন-তখন হাতে-পায়ে খিল ধরে যায়।

টিফিন-ক্যারিয়ারে দু-চারটে লুচি-টুচি যা পড়ে ছিল পকেটে ভরে নিলাম, তার পর পেছনের জানলা দরজা বন্ধ করলাম।

তখন শ্যামাদাসকাকা বলল, আর, হ্যাঁ, দ্যাখ, আমি যা ভুলো মানুষ, মালাটাও বরং তোর কাছেই রাখ, আমি আবার কোথায় হারিয়ে ফেলব।

বলে মালাটা একরকম জোর করে আমার হাতের মধ্যে গুঁজে দিল। বেশ একটু হাসি পেল আমার।

মালা হাতে নিয়েই জানলা তুলতে লাগলাম। তারার আলোতে মুক্তোগুলো ঝিকমিক করতে লাগল।

হঠাৎ আমার গা শিউরে উঠল, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল! যা ঘটবার নয়, তাই ঘটে গেল।

কিন্তু কেউ কিচ্ছু খেয়াল করল না। তাই আমিও স্রেফ চেপে গেলাম।

০৪. সে কী ঘন বন

সে কী ঘন বন। চার দিক থেকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। খোলা জায়গায় তবু চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম, এখানে তারার আলো পৌঁছায় না। হাজার হাজার বর্ষার জল খেয়ে খেয়ে গাছপালাগুলো অসম্ভবরকম বেড়ে গিয়ে, মাথার ওপরেও আরেকটা জমাট অন্ধকার বানিয়েছে। তার ওপর বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সেই বৃষ্টির জল পাতা থেকে পাতায় খসে, টুপটাপ করে আমাদের গায়ে মাথায় ঝরে পড়ছে। সে যে কী দারুণ ঠান্ডা ভাবা যায় না। পায়ের নীচে ঝরাপাতার গালচে পাতা, পায়ের শব্দ শোনা যায় না। শুধু একটা শুকনো ডালে কারো পা পড়লে, সেটা মটাত করে ভেঙে যাচ্ছে, আর সেই শব্দে চারদিকটা ঝনঝন করে উঠেছে। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।

সকলের মনে দারুণ দুশ্চিন্তা, বিশেষ করে আমার নিজের মনে। তার কারণ খানিক আগেই যে সর্বনাশটা হয়ে গেছে, সে বিষয় কাউকে কিছু বলবার সাহস নেই আমার।

যাই হোক, সরু বনপথ ধরে, এক জনের পেছন এক জন, কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে চলেছি। টর্চ-ফর্চের বালাই নেই।

বেশ শীত করছে, আবার খিদে খিদেও পাচ্ছে। পকেটের লুচির ঘিগুলো অন্য জিনিসে লেগে গিয়ে, একটা জাবড়া মতো পাকিয়ে যাচ্ছে। ও বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়।

এমনি সময় দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে, ক্ষীণ একটু আলোর রেখা দেখা দিল। ব্যস, আর কী ভাবনা! তার মানে বনের মধ্যে মানুষের বাস আছে, খাবার পাওয়া যাবে, আর শোবার জায়গা পাওয়া যাবে।

অন্ধকারে পকেটে হাত পুরে দিয়ে লুচির দলাটা বের করে ক্যাচর-ম্যাচর করে খেয়ে ফেললাম। সে কী শব্দ রে বাবা। চারদিকের গাছপালাগুলো পর্যন্ত রিরি করে উঠল। ওরা ব্যস্ত হয়ে বলল, ওকী রে, কী হল?

ভাঙা গলায় বললাম, ওই দেখো আলো।

তাই দেখে সবাই তো আহ্লাদে আটখানা! এতক্ষণ মুণ্ড ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে, ঘষটাতে ঘষটাতে চলেছিল, এবার তাড়াতাড়ি হাঁটা দিল। আলোটা ক্রমে কাছে আসতে লাগল।

যখন খুব কাছে পৌঁছোলাম, দেখলাম একটা ফাঁকা মতো জায়গা, তার মাঝখানে ছাই রঙের প্রকাণ্ড পুরোনো বাড়ি, তার চুনবালি খসে যাচ্ছে, দরজা জানালা ঝুলে পড়ছে, দেয়াল ছুঁড়ে বট-অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। তবু একটা আশ্রয় তো বটে।

সদর দরজাটা বন্ধ! জানলার ভাঙা খড়খড়ির ভেতর দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলোটুকু লম্বা হয়ে কত দূর অবধি পড়েছে।

বিরিঞ্চিদা এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল। আমরা বাকিরা ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়িয়ে, এ-ওর ঘাড়ে গরম নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম।

কোনো সাড়াশব্দ নেই।

তখন শ্যামাদাসকাকাও আর থাকতে না পেরে, সাহস করে গিয়ে দরজাতে এমনি জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল যে আশেপাশের জানলাগুলোর ভাঙা খড়খড়িও খটখট করতে শুরু করে দিল।

আমরা ওপর দিকেও তাকাচ্ছিলাম, মনে হল খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে কারা যেন আমাদের খুব নজর করে দেখছে। সিঁড়িটা থেকে নেমে একটু সরে দাঁড়ালাম।

অনেক ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্তির পর শুনতে পেলাম ভারী পায়ের শব্দ। কেমন একটু ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হল কাজ কী আশ্রয়ে। গাড়ির মধ্যেই কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে সকালে যা হয় একটা-কিছু করলেই হয়।

ঠিক সেই সময়ে খট করে দরজার মাঝখানে একটা ছোট্ট খোপ মতো খুলে গেল। সেই ফাঁক দিয়ে একটা কালো বুনো ভুরুর নীচে থেকে একটা কালো জ্বলজ্বলে চোখ আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

ঠানদিদি ডেকে বললেন, আমরা চোর-ডাকাত নই গো! ক্লান্ত পথিক, জলে ভিজে, খিদেয় কাতর হয়ে, একটু আশ্রয় চাইছি। খোলোই-না বাপু।

চোখটা আস্তে আস্তে সরে গেল। তার পর কত সব ছিটকিনি নামানোর, হুড়কো সরানোর, চেন খোলার, চাবি ঘোরানোর আওয়াজ। শেষটা দরজাটা ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে গেল।

অমনি আমরাও হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

মস্ত চারকোনা ঘর, এবড়ো-খেবড়ো দেয়াল, অসমান টালি-ওঠা মেঝে, এক পাশে একটা তেপায়া টুলের ওপর তেলের বাতি জ্বলছে, তার কাছ দিয়ে পুরোনো একটা কাঠের সিঁড়ি ওপরে উঠে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এই তাল-ঢ্যাঙা, ইয়া ষণ্ডামার্কা এক বুড়ি। মাথার ওপর তার ঝুঁটি করে চুল বাঁধা। ঘরময় ভুরভুর করছে খিচুড়ির গন্ধ।

আমরা এদিকে কাগভেজা, গা বেয়ে জল ঝরছে, সেই জল ঘরের মেঝেতে জমা হয়ে ছোটো ছোটো পুকুর তৈরি হচ্ছে। বুড়ি হতাশভাবে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।

ভাবলাম বোধ করি বাঙালি নয়, কথা বোঝেনি। শ্যামাদাসকাকা বলতে লাগল, হামলুগ দুষ্টু আদমি নেই। জলমে কাদামে হোঁচট খাকে খাকে–

বুড়ি বললে, ঢের হয়েছে বাছা। কিন্তু খোঁজ নেই খবর নেই, হঠাৎ এত লোকের ব্যবস্থা কেমন করে হয় বলতে পার?

শ্যামাদাসকাকা অনুনয় করে বলল, কোনো ব্যবস্থা চাই না। শুধু শুকনো গামছা যদি দিতে পারেন ভালো হয়। নিদেন দুটো ছেঁড়া জামা দিলেও তাই দিয়ে গা মাথা মুছে নিতে পারব।

ঠানদিদি আবার জুড়ে দিলেন, আমার বাছা তাও লাগবে না। ওই যার-তার জামা আমি মাথায় ঘষতে পারব না। কিছু দরকার নেই, আমার আঁচলই যথেষ্ট।

বুড়ি ঝড়ের মতো মুখ করে আমাদের কথা শুনতে লাগল। মুখে কথা নেই।

ঠিক সেই সময় শুনতে পেলাম দূরে কড়া নাড়ার শব্দ। এরা তিন জন এমনি আঁতকে উঠল যেন ভূত দেখেছে।

বুড়িও যেন এরই জন্য অপেক্ষা করছিল, টুপ করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমরা চার জন যে-যার পুকুরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম এই জলে ঝড়ে আঁধার রাতে কে আবার এল!

কিন্তু হুলিয়ারা কি এমনি জানান দিয়ে আসে? তার চাইতে ঝোঁপের পেছন থেকে হু–স্ করে–

কানে গেল দরজা খোলার শব্দ। কী বলব, ভাবতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম! কার সঙ্গে বুড়ি চাপা গলায় কথা কইছে। তারপর সে শব্দও দূরে মিলিয়ে গেল; একেবারে চুপচাপ, একটা প্রজাপতির মতো জানোয়ার বাতির চার দিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল, তার ডানার ঝুপঝাঁপ অবধি কানে আসতে লাগল।

হঠাৎ বুড়ি ফিরে এল। দেখলাম তার হাবভাব একদম বদলে গেছে। ই কী, হাতে হাত কচলাতে কচলাতে বললে, গরিবের বাড়িতে এমন অতিথি পাওয়া সৌভাগ্য। তারপর ইয়ে কী যেন বলল মনে পড়ছে না তো– ও হ্যাঁ, চলুন ওপরে চলুন। গরম জল দেব, গামছা দেব, চার জনকে চারখানা শুকনো কাপড় দেব, মাঠাকরুনকে শুদ্ধ কাপড়ই দেব, ভয় নেই। সামান্য যা রান্না হয়েছে, দয়া করে তাই দিয়ে কোনোরকমে ক্ষেমা-ঘেন্না করে চালিয়ে দেবেন, অপরাধ নেবেন না, ইত্যাদি।

খালি খালি মনে হচ্ছিল এখানে না এলেই ছিল ভালো। তবু ওপরে গেলাম বুড়ির সঙ্গে।

ধুলোমাখা পুরোনো কাঠের সিঁড়ির ধাপে ধাপে নানা রকমের আওয়াজ হয়। কত জায়গায় রেলিং নেই, কত জায়গায় কাঠে ঘুণ ধরে গেছে। ওপরে গিয়ে দেখি প্রকাণ্ড ঘর, তার দেয়ালময় কতরকম ছবি আঁকা, তার রং সব জ্বলে গেছে, হরিণ, মানুষ কত কী। বুড়ির হাতের তেলের বাতির আলোতে কীরকম মনে হতে লাগল তারা বুঝি নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছে। শীত করতে লাগল।

কাঠের মেঝেতে পুরু হয়ে ধুলো জমেছে, যেন কতকাল কেউ এসব ঘরে বাস করেনি। চলতে গেলে পায়ের চাপে মনে হয় ধোঁয়া উড়ছে।

তবে সামনের দিকের একটা মস্ত ঘর খানিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারটে বিশাল বিশাল তক্তাপোশ, সর্বাঙ্গে কারিকুরি করা, আর কোথাও কোনো আসবাব নেই। তার পাশেই স্নানের ঘর।

বুড়ি তেলের বাতিটি দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রেখে নিজেই আমাদের জন্য বালতি করে গরম জল এনে দিল। সাবান দিয়ে কাঁচা, রোদের গন্ধলাগা চারখানা কাপড় আর গামছাও এনে দিল। ঘন বনের মধ্যে খালি পুরোনো বাড়িতে এত আয়োজন দেখে আমরা সবাই থ।

তার ওপর ঘণ্টা খানেক বাদে, চারখানা কানাতোলা থালায় করে খিচুড়ি আর মাংস এল। চমৎকার রান্না। ঠানদিদি অবিশ্যি কিছু ছুঁলেন না, আমরা তিন জনেই চার থালা মেরে দিলাম। ঠানদিদির জন্য একটু দুঃখ লাগছিল, বললাম, তা হলে কি একটু চুইংগাম খাবে?

চোখ বুজে বললেন, না বাছা, ওসব মুরগির ডিম-লাগানো জিনিস আমি খাই নে জানোই তো।

আসলে ব্যাপার দেখে আমরা যেমনি অবাক হচ্ছিলাম, তেমনি সন্দেহও হচ্ছিল।

খাওয়া-দাওয়ার পর বুড়ি তক্তাপোশে মাদুর বিছিয়ে, চারখানি ছোটো বালিশ দিয়ে গেল। আমরাও তখুনি যে-যার শুয়ে পড়লাম। বাবা! সারাদিনটা যা গেছে।

কিন্তু কিছুতেই আর ঘুম আসে না। ওরা তিন জন দু-একটা কথা বলবার পর চুপ হয়ে গেল, আর আমি বহুক্ষণ জেগে থেকে থেকে কতরকম যে শব্দ শুনতে লাগলাম সে আর কী বলব!

বৃষ্টি তখনও পড়ছে, ঝুপ ঝুপ, ঝম ঝম করে পুরোনো বাড়িটার ছাদে, কোথায় একটা টিনের চালে, চারদিকের বড়ো বড়ো গাছপালার ওপর। নীচে বুড়ি বাসন-কোসন ধুচ্ছে মাজছে। গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে, ভাঙা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, জলের ছাঁট ঘরে আসছে।

মনে হল থেকে থেকে গোরুর ডাকও শুনতে পাচ্ছি। শুয়ে থাকতে পাচ্ছিলাম না, ও ধারের জানলার ভাঙা খড়খড়ির ভেতর দিয়ে দেখলাম একটা টিনের শেডের নীচে একটা পিদিম জ্বলছে আর একজন নিরীহ মতো বুড়ো একটা বিষম হিংস্র আমিষশোর চেহারার গোরু দুইছে। এত রাতে গোরু দোয়ানো কীসের জন্য ভেবে পেলাম না।

যাই হোক, বাড়িতে তা হলে অন্য লোকও আছে। কেমন যেন ভয়টা খানিকটা কেটে গেল।

জানলা থেকে যেই ফিরেছি, অমনি মনে হল আমাদের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।

আমার গায়ের রক্তও জল হয়ে গেল।

০৬. সকাল হয়েছে বলে

সকাল হয়েছে বলে জীবনে এই বোধ হয় প্রথম খুশি হলাম। নইলে অন্য দিন তো প্রায় রোজই আমাকে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামাতে হয়। শুধু যে মাজন-টাজন নেই বলে দাঁত মাজতে হবে না তা নয়, উঠে দেখি রাত্রের ভয়-ভাবনাগুলো দিনের আলোতে দিব্যি মেঘের মতো কেটে গেছে। তবে থেকে থেকে খালি খালি মনে হতে লাগল, তবে কি শ্যামাদাসকাকা ভেলকি জানে? মালা এল কোত্থেকে? এটা যে সে মালা হতেই পারে না, সে-কথা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি।

জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি শেষটি সত্যি সত্যি সূর্য উঠেছে। বৃষ্টির জলে-ধোয়া গাছের পাতায় পাতায় আলো লেগেছে। গাছের মাঝে মাঝে ঝোলানো বিশাল আটকোনা সব মাকড়সার জাল রোদ লেগে ঝিকমিক করছে।

নীচে থেকে শুনলাম গোরুটা যেন খুশি হয়ে ডাকছে, কিছু পেয়েছে-টেয়েছে হয়তো। ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখি রাত জাগার পর ওরা তিন জনেই অঘোরে ঘুমুচ্ছে।

কী নিয়ে যে ওদের এত ভাবনা ভেবেই পেলাম না। অন্য সময় তো বিরিঞ্চিদার মুখ দেখলেই ঠানদিদির পিত্তি জ্বলে যায়, যা খুশি তাই বলেন। আর শ্যামাদাসকাকাকে পেলে বিরিঞ্চিদাকে ছেড়ে ওকে আগে ধরেন। আর এখন সারাদিন এক গাড়িতে, সারারাত এক ঘরে, অথচ একটা রাগের কথা নেই! এ ভাবা যায় না।

দেখতে দেখতে রোদে ঘর ভরে গেল, ওদের মুখে রোদ পড়ল। বাইরের পাখিরাও মহা গোলমাল শুরু করে দিল। একে একে ওরা সব উঠে বসল। চোখের নীচে কালি, বড়োরা যেমন সকালবেলা চা না পেলে বিরক্ত হয়ে যায়, তেমনি মুখ করে সব কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর উঠে মুখ-টুক ধুয়ে তবে কথা বলতে লাগল।

যতই কথা বলে, মনের ফুর্তিও দেখি ততই বেড়ে যায়। ঠানদিদি বিরিঞ্চিদাকে বললেন, যাক, তাহলে বোধ হয় তোর আর কোনো ভাবনা

বিরিঞ্চিদা আমার দিকে চেয়ে বলল, স-স-স।

আবার একটু বাদেই বিরিঞ্চিদা খুশি হয়ে শ্যামাদাসকাকাকে বলল, কে জানে, বোধ হয় মরেনি, এমনও তো হতে পারে।

শ্যামাদাসকাকা ভীষণ চমকে উঠে বলল, চোপ, ইডিয়ট।

মনে হল রাতের বিপদ কেটে যাওয়াতে ওরা সব অসাবধান হয়ে পড়েছে। হাসি পেল। এমনি সময় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে মনে হল মেলা লোজন আসছে।

জানলার কাছে গিয়ে বাইরে চেয়ে দেখে বললাম, যাক, আর আমাদের কোনো ভয় নেই! পাঁচ-সাতজন পুলিশ-টুলিশ এসে পড়েছে।

যেইনা বলা অমনি ঠানদিদি আর শ্যামাদাসকাকা হুড়মুড় করে গিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকল।

আমি আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখে, ওদের সাহস দেবার জন্য ডেকে বললাম, কোথায় যাচ্ছ? বলছি না কোনো ভয় নেই। ওই তো ওদের সঙ্গে সেজোদাদামশাই, বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই সবাই রয়েছেন।

ও মা, অমনি বিরিঞ্চিদাও পড়িমরি করে ছুটে স্নানের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিল।

আমি তো প্রায় মুচ্ছো যাই আর কী! মনে হল তবে নিশ্চয় আমারও গা ঢাকা দেওয়া উচিত। স্নানের ঘরের দরজায় কত ধাক্কাধাক্কি পেড়াপীড়ি করলাম, কোনো ফল হল না।

শেষ অবধি আর কিছু ভেবে না পেয়ে, জুতো পায়ে দিয়ে খাটের তলায় গিয়ে ঢুকলাম। আমার নতুন জুতো রে বাবা, কী দরকার ফেলে রেখে।

ততক্ষণে ওরাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। আধ মিনিট বাদে দরজায় টোকা।

আমি একেবারে চুপ।

হেঁড়ে গলায় কে ডেকে বললে, ভবিষ্যতে যদি ভালো চান তো বন্দুক- টন্দুক যা সঙ্গে আছে দরজার বাইরে ফেলে দিন। আর নিজেরা মাথার উপরে হাত তুলে, দরজার দিকে মুখ করে সারি সারি দাঁড়িয়ে যান।

আমি নিশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে থাকলাম। তারপর আরও মোটা.গলায় কে বললে, দেখুন, যা হবার তা হয়ে গেছে, আর কেন অপরাধ বাড়াচ্ছেন? নিজেদের ভালোর জন্য বেরিয়ে আসুন।

আমি যেমন শুয়েছিলাম তেমনি রইলাম।

এবার বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই নিজেই রেগেমেগে চেঁচিয়ে বললেন, কী বললেন সবটা বোঝা গেল না, বেশ ইয়ে-টিয়েই বললেন, তার মোটামুটি মানে দাঁড়ায়– দ্যাখ বিরিঞ্চি, কী ভেবেছিস তুই? যা ইচ্ছে তাই করবি আর পার পেয়ে যাবি? ভালো চাস তো দরজা খোল।

কে জানি আবার একটু দূর থেকে বলল, দরজাটা ভেঙে ফেলুন-না, মশাই!

পিসেমশাই বললেন, হ্যাঁ, তাই করি আর গোলা খেয়ে আমার মুণ্ডুটাই উড়ে যাক আর কী!

পেছন থেকে সেজোদাদামশাই বললেন, কেন বাবা, তোমরা সরকারের মাইনে খাও, তোমরাই দরজা ভাঙো-না কেন! তা ছাড়া তোমরা মরেটরে গেলে তো পেনসিল পাবে, তোমাদের আবার অত ভয় কীসের?

এমন কথা শুনে পুলিশরা প্রথমটা চুপ। তারপর পাঁচ-সাত জন মিলে গলা খাঁকরে, বুট ঘষে, লাঠি ঠুকে, খুব আওয়াজটাওয়াজ করে, ভয় দেখাবার চেষ্টা করতে লাগল। এমনি সময় একতলা থেকে বুড়ি এসে হাজির। আধ সিঁড়ি উঠেই, হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচিয়ে বলল, ওমা, কী সব বীরপুরুষ গো! দরজার তো ভিতরকার ছিটকিনিই লাগে না।

আর কী, হুড়মুড়িয়ে সব ভেতরে এল। এসে দেখে ভোঁ ভাঁ, কেউ কোথাও নেই! একি সত্যি ভেলকি নাকি? অতগুলো লোক গেল কোথায়?

ঠ্যাং দেখে বুঝলাম, দাঁড়িওয়ালা লোকটা, কানে-মাকড়ি ছেলে, বুড়ি সব আছে। স্নানের ঘরের রজার দিকে চোখ পড়তে সবাই মিলে মহা গোলমাল শুরু করে দিয়েছে। এবার দরজা যে সত্যি বন্ধ সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।

আমারও হাত-পা পেটে সেঁদিয়েছে। দরজা খুললেই কী কাণ্ডটা না জানি হবে।

এ ঘরটা খালি দেখে ভারি সাহস বেড়ে গেছে ওদের, দু-চারটে ষণ্ডা লোক দু-চার বার ধাক্কা দিতেই মরচে ধরা কবজা ভেঙে দরজা গেল খুলে।

আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এবার ঠানদিদি টেরটা পাবেন! ভেবে খুব খারাপ লাগল না। কিন্তু এমন অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ কেন?

নিজের বিপদের কথা ভুলে গিয়ে, খাটের তলা থেকে মুণ্ডু বের করে দেখতে চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কী।

গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। স্নানের ঘরে কেউ নেই! এইমাত্র তিন-তিনটে ধেড়ে লোককে ঢুকতে দেখলাম আর এখন দেখি কেউ কোথাও নেই! ওদিকে ঘরে আরেকটা দরজা নেই যে পালাবে। একটা ছোট্ট জানলা আছে বটে, তাও মাটি থেকে দশ ফুট উঁচুতে, আবার মোটা মোটা গরাদ লাগানো। তা ছাড়া সেসব খুলে ফেললেও বেড়াল-টেড়াল ছাড়া অন্য কিছু গলবে না সেখান দিয়ে।

এমনি আশ্চর্য হয়ে গেছলাম যে মুণ্ডুটা টেনে খাটের তলায় নিয়ে যেতে ভুলেই গেছলাম!

আর যায় কোথায়! একটা এই মোটা পুলিশ, কথা নেই বার্তা নেই, অমনি আমার দুকান ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে এল। আমি প্রাণপণে খাটের পায়া আঁকড়ে ধরলাম, কিন্তু তাতে কোনো সুবিধে হল না!

তখন সবাই মিলে আমাকে নিয়ে সে যে কী লাগিয়ে দিল সে আর বলার নয়। আমি তো ভেবেছিলাম টানাটানির চোটে এই ছিঁড়েই গেলাম আর কী! এত করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, তা কে কার কথা শোনে! বিরিঞ্চিদার পিসেমশায় আর সেজোদাদামশায় যে কী খারাপ কথা বলতে পারেন!

বার বার বললাম, আমি কী জানি! স্পষ্ট দেখলাম তিন জনে হুড়মুড় করে গিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিল, এখন নেই বললে তো আর হবে না। নিশ্চয়ই আছে ওইখানেই কোথাও, ভালো করে খুঁজলেই বেরিয়ে পড়বে। আর না-ই যদি থাকে, সেও কি আমার দোষ? যাবে আবার কোথায়, খুঁজে দেখোনা, নিশ্চয় পাবে।

সেজোদাদামশাইয়ের সে কী রাগ! বাবার বিষয় পর্যন্ত কী সব বলতে লাগলেন। শেষ অবধি একটা পুলিশের কাছে আমাকে জিম্মা করে দিয়ে সবাই মিলে বিষম খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল।

প্রথমটা তো সেখান থেকে ওরা নড়তেই চায় না, বারে বারে আমাকে জিজ্ঞেস করে তোক তিনটেকে কী করেছি।

শেষে বললাম, খায়ো

রাগের সময় আমার কীরকম হিন্দি বেরিয়ে যায় বললাম, যদি গিলেই ফেলে থাকি, তবু স্নানের ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে কেমন করে বন্ধ করলাম বলতে পার?

তাই শুনে ওরা খানিকটা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিয়ে শেষটা খানাতল্লাশি আরম্ভ করে দিল। সেজোদাদামশাই আর পিসেমশাইও ওদের সঙ্গে চললেন; সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন না। আমার তো তাতে কলাও হল না।

০৭. চুপ করে তক্তাপোশের ওপর

চুপ করে তক্তাপোশের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকলাম। একটু বাদেই একটা খোট্টা পুলিশ মহা চেঁচামেচি লাগাল।

–আরে একঠো কো তো মিল গিয়া। কিন্তু বাকি সব কঁহা গিয়া কুছ পাত্তা ভি তো পাই না রে বাবা!

কাকে পেল দেখবার জন্য দরজার কাছে গেলাম, পুলিশটাও সঙ্গে গেল। দেখি কিনা কোত্থেকে রোগা চিমড়ে একটা লোককে, শার্টের কলার ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে ওপরে নিয়ে এল। এ আবার কে রে বাবা!

লোকটাকে তক্তাপোশের ওপর ফেলে, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, পিছু কা সিঁড়ি থেকে ভাগনে লাগা। ঔর হাম ভি বাঘকা মাফিক উসকো ঘাড়মে লাফায়া।

লোকটার দেখলাম চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, এক পাটি চটি কোথায় খুলে পড়ে গেছে। তার ঠিকানা নেই, খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ, মুখ ভরতি উশকোখুশকো চুল।

ব্যস্ত হয়ে বললাম, আরে, এ আবার কিকো আনলি রে? ই তো ভুল আদমি হ্যায়।

তাই শুনে পুলিশ দুটোই রেগে বললে, হ্যাঁ, ভুল আদমি হ্যায় না তোমরা মুণ্ডু হ্যায়। নিশ্চয়ই তোমার দল কা আদমি হ্যায়। তুম গোপন করতা।

বললাম, নিজেই যখন ধরা পড়েছি, ওদের গোপন করে আর কী লাভ হবে?

কিছুতেই বুঝতে চায় না, শেষে বলে কিনা, দাড়ি গোঁফ লাগাকে ছদ্মবেশ পাকড়া কিনা, ওই আস্তে তুমি চিনতে নেই পারতা।

ভালো রে মজা।

এতক্ষণ লোকটার মুখে একটি কথা নেই। নিমেষের মধ্যে পুলিশ দুটো ওর ঠ্যাং-ট্যাং দড়ি দিয়ে তক্তাপোশের পায়ার সঙ্গে বেঁধে, বেচারাকে তক্তাপোশের একেবারে ধারে বসিয়ে, হাত দুটোকেও আবার পাছামোড়া করে কষে বেঁধে দিল। দেখলাম লোকটা বার বার কী যেন বলবার চেষ্টা করছে, তাতেই আবার ওর মুখের মধ্যে ওদের এক জনের পাগড়ি থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে, ঠুসে দিল।

তারপর নিজেদের হাত-পা ঝেড়ে, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, আই বাপস্! কী দারুণ শুভা হ্যায়! কোই দাগি বদমাশ হোগা জরুর। উঃ আলজিবভি শুকিয়ে খটখটে হো গিয়া! বলে, বিড়ি খাবার জন্য বাইরে চলে গেল।

আমি তখন উঠে লোকটাকে ভালো করে দেখবার জন্য কাছে গেলাম। লিকপিকে হাত-পা, পঞ্চাশ-টঞ্চাশ বয়স হবে মনে হল, নিদেন চল্লিশ-টল্লিশ তো নিশ্চয়, কানে খুব লম্বা লম্বা চুল। বড় মায়া লাগল।

আমাকে কাছে আসতে দেখে হাত-পা নিয়ে কিলবিল করে সে বলল, এ-গ-গ-প-গ-প।

ভারি অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলাম। ততক্ষণে লোকটার মুখ-টুখ লাল হয়ে উঠেছে, সে আবার অনুনয়-বিনয় করে বলল, প-গ-গ-গ-গ-ব-গ-গ।

আমি তো অপ্রস্তুতের একশেষ! দরজার কাছে গেছি পুলিশ দুটোকে ডাকতে, যদি তারা কিছু করতে পারে। লোকটা কিন্তু তাই দেখে, মাটিতে পায়ের গোড়ালি ঘষে রেগে রেগে বলল, শশশশশ।

যাক গে, ঠিক সেই সময় পুলিশরা ফিরে আসতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

ওদিকে যারা খানাতল্লাশি করছিল, তাদের একটু-আধটু শব্দও আমার কানে আসছিল। বোধ হয় কেউ কেউ খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরেও গিয়ে থাকবে। কিন্তু তারা তক্ষুনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল শুনলাম, বুড়ির গলাও শুনলাম, মনে হল খুব খুশি হয়নি।

দুড়দাড় করে তিন-চার জন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমাদেরই ঘরে আশ্রয় খুঁজল, পেছন পেছন বুড়িও একটা গরম খুন্তি নিয়ে বকবক করতে করতে ছুটে এল।

ঘরে ঢুকে হাত-পা-বাঁধা আধাবয়সি লোকটাকে দেখে বুড়ি তো একেবারে থ! হাত থেকে খুন্তিটা ঝনঝন করে মাটিতে পড়ে গেল। আর অমনি পুলিশদের মধ্যে এক জন সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে জানলা দিয়ে গলিয়ে একতলায় ফেলে দিল। এইরকম উপস্থিতবুদ্ধি দিয়েই ওরা চোর ধরে।

বুড়ির হাত-পা কাঁপছে, মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। লোকটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে তো চেয়েই আছে! লোকটাও ঢোক গিলতে গিয়ে, খানিকটা পাগড়ি গিলে কেশে-টেশে একাকার।

পুলিশরা এগিয়ে এসে বুড়িকে সাবধান করে দিল, আরে, মাইজি, বেশি কাছে মত যাইয়ে, বড়া বদমাশ হ্যায়।

বুড়ি চোখ লাল করে, চাপা গলায় বললে, সে কি তোমাদের কাছে শিখতে হবে নাকি। এতকাল ঘর করছি আমি জানি না।

বলে কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, বললে, বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে, উচিত সাজা হয়েছে! খুব খুশি হয়েছি।

লোকটা নরম সুরে ইনিয়ে-বিনিয়ে বললে, ল-ল-ল-ম-ম!

বুড়ি দাঁতে দাঁতে ঘষে, কোনো কথা না বলে আবার নীচে চলে গেল।

পুলিশরা হাঁ করে পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে, বলাবলি করতে লাগল, আরে বাপ্পা! ই তো ভীষণ মাইজি হো!

তারপর বোকার মতো এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল, লোকটাকে নিয়ে কী যে করা উচিত ভেবে পেল না।

এইসব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে এতক্ষণ নিজের বিপদের কথা ভুলেই গেছলাম! এইবার ভাবনা-চিন্তায় মনটা আবার ভারী হয়ে উঠল। খিদেও পেয়েছিল দারুণ। বুড়ির হাতের গরম খুন্তিটা দেখে অবধি জিবে জল আসছিল! তবে খাবার-দাবার সম্বন্ধে আমি কাউকে বিশ্বাস করি, নিজের কাছে সর্বদা একটা স্টক রাখি। কালকের সব জামাটামা এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে, তার পকেট থেকে একটু চুইংগাম বের করতে যাব, ওমা, পুলিশগুলো অমনি হাঁই হই করে ছুটে এসে বলে কি না, খবরদার! ছুরি-ছোরা বার করেগা তো ডান্ডা দেকে মুণ্ডু উড়ায়ে দেগা!

সাহস দেখে হাসি পেল! বুঝিয়ে বললাম, আরে বাবা, ছুরি-ছোরা সঙ্গে থাকলে কি আর এতক্ষণ এখানে বসে থাকি! ওটা আমার খাবার।

কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। শেষপর্যন্ত সবাইকে একটু একটু দিয়ে তবে রেহাই পেলাম। পকেট তো প্রায় গড়ের মাঠ! ওরা দেখলাম কচ কচ করে চিবিয়ে, রবার-টবার সব গিলে ফেলে, বিরস বদন করে বসে থাকল!

এদিকে সময় আর কাটতে চায় না। বাইরে চনচনে রোদ, মনে হচ্ছে বেলা এগারোটাও হতে পারে, বারোটাও হতে পারে। স্কুলের দিনে এর কত আগে আমি খাই।

অথচ এখন অবধি অন্য লোকগুলোর কোনো সাড়াশব্দই নেই! বাড়ি ছেড়ে তারা যে জঙ্গলের মধ্যে তোলপাড় করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ভেবে অবাক হচ্ছি বিরিঞ্চিদারা তাহলে গেল কোথায়। শেষটা হুলিয়াতে খেয়ে নেয়নি তো!

এমনি সময় পুলিশের এক জন আমার কাছে এসে, পিঠে হাত-টাত বুলিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলতে লাগল, আরে ভাই, বোলো না ওলোককো কঁহা গুম কিয়া! তোমকো লজেঞ্চুষ দেগা, লাঠি দেগা, লাটু দেগা–

এত এত ঘুষ দেখাতে লাগল, এমনি খারাপ!

হঠাৎ ঝড়ের মতো দাড়িওয়ালা বুড়োটা এসে ঘরে ঢুকল। হাত-পা-বাঁধা লোকটাকে দেখে রেগেমেগে পুলিশদের বলল, স্টুপিড় কাঁহিকা; চোর ধরতে সব দেখছি সমান ওস্তাদ। আবার আমাদের কর্তাবাবুকে ধরে এনে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরজন্যে এক-একটাকে যদি কুড়ি বছর করে জেলে যেতে না হয় তো কী বলেছি। আর কর্তামশাইকেই জেলে দিবি তো আমার বাকি মাইনেটা কি তোরা দিবি না কে দেবে শুনি!

পুলিশদের আর মুখে কথাটি নেই! বুড়োও কারো অপেক্ষা না রেখে, দড়ি-দড়া খুলতে লেগে গেল। দড়ি খোলা হয়ে গেলে বললাম, ওর মুখ থেকে পাগড়ি বের করে দাও, নইলে কথা বলবে কী করে?

কিন্তু লোকটাকে হাঁ করিয়ে দেখা গেল, মুখে পাগড়ি-টাগড়ি কিছু নেই, কখন সেটা চিবিয়ে গিলে-টিলে বসে আছে!

পাগড়ি গেলার কথা শুনে পুলিশরা বেজায় রেগে গেল। এক জন তো বার বার বলতে লাগল গিলে ফেলেছে আবার কী! ওতে নাকি তার ধাবির হিসসে লেখা ছিল, এখন কী হবে।

ততক্ষণে রোগা লোকটার মুখে কথা ফিরে এসেছে, সেও রেগে বলল, গিলেছি মানে আবার কী? গলা দিয়ে নেমে গেলে আমি আর কী করতে পারি বল? অবশ্যি খেতে যে খুব খারাপ লেগেছে তা বলছি না। বেশ টক-টক নোনতা-নোনতা।

এই বলে সে ঠোঁট চেটে, পাগড়ির যে দুটো-একটা সুতো লেগে ছিল সেগুলোকেও খেয়ে ফেলল।

তাই দেখে আমারও এমনি খিদে পেতে লাগল সে আর কী বলব।

দূরে সেজোদাদামশায়ের, বিরিঞ্চিদার পিসেমশাইয়ের গলার আওয়াজ শুনে বোঝা গেল ঠানদিদিদের কাউকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্যি, গেল কোথায় সব, কে জানে হয়তো কিছুতে–

শুনলাম পুলিশ ইন্সপেক্টর বলছেন, দেখতে ছোটো হলে কী হবে, একেবারে কেউটে সাপের বাচ্চা। ও-ই যে এ-সমস্তর গোড়ায় তার কোনোই সন্দেহ নেই, নইলে ওদের এত বুদ্ধি আসে কোত্থেকে।

পিসেমশাইও তক্ষুনি সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমাদের বিরিঞ্চি তো আগে এমন ছিল না। ওই অতটুকু ছেলে দেখে, তাকে বিশ্বাস করে, দেখুন তো মশাই, শেষটা এই অঘোর জঙ্গলে প্রাণটা খোয়ালে।

তাই শুনে সেজোদাদামশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, রেখে দিন, মশাই। আপনাদের বিরিঞ্চিটি কিছু কম যায় না। বউঠানের মাথায় হাত বুলিয়ে

পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, দেখুন, আপনাদের এইসব পারিবারিক ব্যাপারগুলো অতি ছোটো জিনিস। ওই বিরিঞ্চি কি শ্যামাদাস মোলো কি না মোলো, তাই দিয়ে দেশের কীই-বা এসে যায় বলুন। আসল কথা হল জমিদারমশায়ের মুক্তোর মালাটা গেল কোথায়? বড়োসায়েব আর আমায় আস্ত রাখবে না। আর মালা খুঁজে দিতে না পারলে আমার প্রমোশনেরই-বা কী হবে, তাই বলুন?

০৮. তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে

তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে তো সব যে যার ধুপধাপ তক্তাপোশের ওপর শুয়ে পড়ে, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একসঙ্গে বলতে লাগলেন, ইস্! গাল টিপলে এখনও দুধ বেরোয়, অথচ এত বড়ো আরেকটা খুনে বদমায়েশ দুনিয়াতে আছে কি না সন্দেহ! তিন-তিনটে লোককে রাতারাতি একেবারে হাওয়া করে দিল মশায়!

বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সব থেকে খারাপ হচ্ছে যে বিরিঞ্চি হতভাগা আমার সিল্কের জামাটা গায়ে দিয়েই

সেজোদাদামশাই বললেন, স-স-স– ওঁদের বিষয় অমন করে বলতে নেই। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন ইন্সপেক্টর সায়েবের কর্তব্য হল এই ছোকরাকে জেরা করে সব কথা বের করে নেওয়া।

এতক্ষণ রোগা ভদ্রলোক, পুলিশরা আর আমি হাঁ করে তাঁদের কথাবার্তা শুনছিলাম, কিন্তু কিছুতে যোগ দিচ্ছিলাম না। এবার সবাই মিলে একসঙ্গে কথা বলতে লাগলাম।

ইন্সপেক্টর আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল, বনা বাবা কী করেছিস? মালার কথা নিশ্চয় তোর অজানা নেই, বল-না, নিদেন মালাটাই বের করে দে না। কথা দিচ্ছি তোকে ছেড়ে দেব, কেউ তোকে কিছু করবে না, দে দিকি বাপ মালাটা বের করে।

মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। আমি বেচারা ছেলেমানুষ, কিছুই জানিনে, অথচ কে কাকে বোঝায়! ভাবলাম দেখাই যাক একবার স্নানের ঘরে গিয়ে।

আমাকে উঠতে দেখে ওরাও উঠে পড়ল। স্নানের ঘরে ঢুকে ইগল পাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ঘরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি পরীক্ষা করলাম। দেখলাম ওই একটিমাত্র দরজা, উঁচুতে ওই একটিমাত্র শিক-দেওয়া জানলা। তাই তো, ঠানদিদিদের হল কী?

অন্যরা সবাই এগিয়ে এসে, দরজার কাছটিতে ভিড় করে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নীচের তলা থেকে রাঁধাবাড়া ফেলে বুড়িও ততক্ষণে এসে ওদের সঙ্গে জুটেছে দেখলাম!

ওরা তাকে খুব জোরে ফিসফিস করে বলল, চুপ! এ এবার মালা বের করে দেবে, সেই তাদের যা বাকি আছে বের করে দেবে।

তাই শুনে বুড়িও চোখ গোল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল!

হঠাৎ দেখলাম ঘরের কোণে, বালতির পিছনে একটা জিনিস চিকচিক করছে। অবাক হয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা সোনার আংটি! আমাকে সেদিকে চাইতে দেখে ওরাও সবাই ঘরের কোণে, বালতির পেছনে, সোনার আংটি দেখতে পেল।

সেজোদাদামশাইও চিৎকার করে উঠলেন, চিনেছি, চিনেছি! তবু বলছিস কিছু জানি নে! লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যেবাদী। এমনি করেই পাপের গন্ধমাদন চাপা পড়ে মানুষেরা মরে-চ্যাপটা হয়ে যায়।

ইন্সপেক্টরবাবু হঠাৎ আমার দিকে ফিরতেই আমি এক ছুটে স্নানের ঘরের ঠিক মাঝখানে চলে গেলাম। সঙ্গেসঙ্গে মনে হল আমার পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে গেল, আমি অতল গভীর অন্ধকারে পড়ে গেলাম।

ওপর থেকে হো-হো করে চিৎকার আমার কানে এল।

কী আর বলব আমার মনের অবস্থা। পড়তে আর কতটুকুই-বা সময় লাগল, তবু মনে হল পড়ছি তো পড়ছিই।

ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি যত অন্যায় করেছি, একটার পর একটা করে সব মনে পড়তে লাগল। যেগুলোর কথা একদম ভুলে গেছলাম, এমনকী যেসব ঘটনা কোনোকালে ঘটেইনি, সেরকমও রাশি রাশি মনে পড়ে গেল!

হঠাৎ ধপাস করে মাটি ছুঁলাম।

বুঝলাম কতকগুলো খড়কুটোর ওপর পড়েছি তাই যতটা লাগতে পারত, পেছনে ততটা লাগেনি।

তবু খানিকক্ষণ চোখ বুজে চুপচাপ বসে থাকলাম। তারপর যখন টেন পেলাম যে সত্যি বেঁচে আছি, তখন আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলাম যে যতটা অন্ধকার ভেবেছিলাম, আসলে ততটা নয়।

দেখলাম যেন একটা শুকনো কুয়োর মতনের নীচে পড়ে আছি। পকেট চাপড়ে দেখলাম চিরুনি-টিরুনি ঠিকই আছে। বাঁচা গেল।

ওপর দিকে চেয়ে দেখলাম অন্ধকার সুড়ঙ্গ, চারিদিকে ঘিরে আছে মাকড়সার জালে-ঢাকা পাথরের দেয়াল, নাকে এল সোঁদা সোঁদা একটা গন্ধ আর দেখলাম দেওয়ালের এক দিক দিয়ে একটু আলোর রেখা আসছে।

সেই আলোতেই দেখতে পেলাম খড়ের ওপর জ্বলজ্বল করছে বিরিঞ্চিদার মুক্তোর মালা। মালাগাছি তুলে নিলাম, মাঝখানের রঙিন পাথরটি মিটমিট করে জ্বলতে লাগল।

বসে বসে ভাবলাম কী মালা, কার মালা কে জানে। এই কি তবে জমিদার গিন্নির হারানো মালা? তবে আগেকার সেই আরেকটা মালা সেটি কোত্থেকে এল? এ তো সে মালা হতেই পারে না। কারণ সেটাকে আমি ছাড়া আর কেউ তো বের করতে পারবেই না, আমিও পারব কি না সন্দেহ।

মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মালাটা পকেটে পুরে ফেললাম। বিরিঞ্চিাদের নিশ্চয় সাংঘাতিক কোনো বিপদ হয়েছে, নইলে কি আর মালা ফেলে অমনি অমনি চলে যায়।

ভাবলাম এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ধুপধাপ করে, এক জনের উপর এক জন ওরাও নিশ্চয় পড়েছিল। ওরা যখন বেরুবার পথ পেয়েছে আমিও পাব।

ভালো করে চেয়ে দেখলাম কোথা দিয়ে আলোর রেখা আসছে। মনে হল সেদিকে যেন সরু পথ রয়েছে।

কত কালের পুরোনো বাড়ি, কে জানে কেন এই গোপন সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল, হয়তো কোনো চোরাকারবার চালাত কেউ, তাই এইসব গলিঘুচি তৈরি করে রেখেছিল। হয়তো শব্দুরদের ধরে এনে এখানে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দিত। গা শিরশির করতে লাগল।

অদ্ভুত সেই গলিটা। কে জানে কারা এখান দিয়ে ভারী ভারী বাক্স প্যাটরাতে লাখ লাখ টাকার মোহর বোঝাই করে আনাগোনা করত। ইস, একটা বাক্সও যদি পেতাম, তবে আর আমাকে এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখতে হত না।

দেখলাম দু-পাশে তাক আছে, জিনিস ঝোলাবার আংটা কড়া আছে। মনে হল হঠাৎ যদি দেখি একটা কঙ্কাল ঝুলে আছে। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

অবিশ্যি একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, ওপরকার ওই ঘরের চাইতে আমার পক্ষে এই অন্ধকার ঘুপচিই অনেক বেশি নিরাপদ, তবু যদি হঠাৎ মাথার ওপর থেকে দড়ি ছিঁড়ে ঘাড়ের ওপর কিছু পড়ে।

তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। মনে হল ওপরে যেন ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কীসের যেন হাওয়া মুখে লাগল, অদ্ভুত একটা গন্ধ নাকে এল। মনে মনে বললাম, ও কিছু না, বাদুড়। আরও তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম।

এখানে পথটা খানিক ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। পায়ের তলার মাটি এত নরম যে কিছুমাত্র শব্দ হয় না।

ওপর থেকে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা কী যেন আমার মাথায় পড়ল। সে সাদা কি লাল তা আর দেখবার উপায় ছিল না ওই অন্ধকারে।

খানিক আগেই এই পথ দিয়ে বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা আর ঠানদিদি নিশ্চয় ভয়ে আধমরা হয়ে, এক জনের পেছনে এক জন হেঁটে গেছেন। কোথাও যখন কেউ পড়ে-উড়ে নেই, তখন নিশ্চয় কোনো ভয়ের কারণও নেই।

বলতে-না-বলতে নরম কীসে হোঁচট খেয়ে উবু হয়ে পড়ে গেলাম। অন্ধকারটা যেন আরও কালো হয়ে ঘনিয়ে এল। তখনও মনে হচ্ছিল দূরে একটা হো-হো শব্দ।

নড়ছি-চড়ছি না, কাঠ হয়ে নরম জিনিসটার ওপর পড়ে আছি। কান খাড়া করে রেখেছি সেটার নিশ্বাস ফেলার শব্দের জন্য। কিন্তু যদি নিশ্বাস না-ই ফেলে?

উঠে বসলাম। কানে একটা থুপ-থুপ পায়ের শব্দ। ঘন ঘন নিশ্বাস। তবে কি শেষপর্যন্ত ওদের নাগাল পেয়ে গেলাম নাকি?

কিন্তু শব্দটাকে যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। যেন ভারী কিছু সাবধানে এগুচ্ছে। বুকের ভেতরটা আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল।

উঠে বসে অন্ধকার ভেদ করে দেখতে চেষ্টা করলাম। খানিকক্ষণ কিছু বুঝতে পারলাম না। তারপর দূরে দেখলাম দুটো লাল চোখ জ্বলজ্বল করছে, আর নাকে এল কেমন একটা চেনা চেনা অদ্ভুত গন্ধ।

আমি আর সেখানে বসে থাকবার ছেলেই নই। উঠেই দিলাম টেনে দৌড়।

০৯. দেখি ঢালু পথটা

দেখি ঢালু পথটা হঠাৎ ডান দিকে বেঁকে শেষ হয়ে গেছে। সামনে একটা দরজা, ঠেলা দিতেই সেটা গেল খুলে। ভেতরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে প্রকাণ্ড হুড়কোটাকে লাগিয়ে দিলাম। ব্যস্।

কোথা থেকে যেন অল্প একটু আলোও আসছে, মনে হল হাতের কাছে প্রকাণ্ড এক বাক্সের ওপর দেশলাই আর মোমবাতি।

দেখলাম আলাদিনের সেই গুহায় এসে পড়েছি। ছাদ থেকে ঝুলছে বিশাল বিশাল গালচে। দেওয়ালের সামনে সারি দিয়ে রয়েছে পেতল-কাঁসার বাসন আর ফুলদানির পাহাড়। ঘরের মাঝখানটা কাঠ-খোদাইয়ের টেবিল, হারমোনিয়াম আর বাক্স-প্যাটরা দিয়ে বোঝাই করা।

দুটো-একটা বাক্সের ঢাকনা খুলে আমি তো থ। কোনোটা-বা রেশমি শাড়িতে ভরতি, কোনোটাতে হাতঘড়ি, রুপোর বাসন, ফাউন্টেন-পেনের গাদা। আর একটাতে, বিশ্বাস করবে না হয়তো, সোনার গয়নায় ঠাসা।

কী যে করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শ্যামাদাসকাকা সামান্য একটা মুক্তোর মালা পেয়েই আহ্লাদে আটখানা হচ্ছিল, আর আমার দেখো কত জিনিস। তা ছাড়া একটা মুক্তোর মালা।

মালাটাকে পকেট থেকে বের করে বড়ো বাক্সটার ওপর রাখলাম।

এখন মুশকিল হচ্ছে এই এতগুলো জিনিস যে পেলাম, এগুলোকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় কী করে?

একটা হারমোনিয়াম একটু বাজিয়ে দেখলাম, দিব্যি প্যাঁ-প্যাঁ করে উঠল। বন্ধ ঘরে দারুণ জোরে বাজছে মনে হল। ভাবছিলাম সেবার বিরিঞ্চিদার হারমোনিয়ামে একটু সামান্য জল ফেলেছিলাম বলে আমাকে কী না বলেছিল। এখন আমার নিজেরই চারটে আস্ত আর একটা ভাঙা হারমোনিয়াম।

কিন্তু কতক্ষণ আর এইসব ভেবে আনন্দ করা যায়? খিদেয় পেট তো এদিকে ঢাক।

দেওয়ালে সব চমৎকার ছবি ঝুলোনো। একটাতে দেখলাম একজন বুড়ি মেম মাছভাজা খাবে, তাই হাত জোড় করে কাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, আর একটা বেড়ালও মাছভাজা খাবার জন্য আঁকুপাঁকু করছে।

আরেকটাতে দেখলাম হয়তো ওই বেড়ালটাই হবে, মুখে করে একটা বিরাট চিংড়ি মাছ নিয়ে যাচ্ছে। মুখের এক দিকে চিংড়ি মাছের মুণ্ডু আর অন্য দিক দিয়ে ল্যাজ বেরিয়ে রয়েছে। আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি এ ভাবা যায় না।

আর টিকতে না পেরে, দড়াম করে দরজাটাকে খুলেই দিলাম।

কাষ্ঠ হেসে দাড়িওয়ালা বুড়োটা ভেতরে ঢুকল। কোমরে হাত দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে লাগল। আমার গা শিরশির করে উঠল। বললাম, আর দেরি করছ কেন? সাহস থাকে তো আমাকে মেরে ফেলো-না। আমার গলা কেটে ফেলো, গুলি করো, বুকে ছোরা বসাও, ফাঁসি দাও। আমি আর কিছুকে ভয় করি না। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।

বুড়ো বলল, সেকথা বললেই হয়।

বলে সামনের একটা বাক্স থেকে কতকগুলো কাপড়-চোপড় বের করে ফেলে, তলা থেকে এক টিন বিস্কুট, এক টিন সার্ডিন মাছ, এক বোতল কমলালেবুর রস আর এক টিন-খোলার যন্ত্র বের করল।

তারপর মুক্তোর মালাটাকে দেখে ভারি খুশি হয়ে, সেটাকে ওই বাক্সে পুরে, ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আবার বন্ধ করে দিয়ে, আমার কাছে ফিরে এল।

তারপর বাক্সের ওপর চেপে বসে মহা ভোজ হল।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে, পকেট থেকে বেজায় একটা ময়লা রুমাল বের করে, মুখ মুছে, বুড়ো সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমার ওসব কিছুরই দরকার করে না। আমি সর্বদা হয় প্যান্টে নয় মাথায় হাত মুছি।

তখন বুড়ো বলল, দেখতে তুমি এত খুদে অথচ চালাক তো কম নও। আমাদের দলে যোগ দেবে? পরে হয়তো দলপতিও হতে পারো।

আমি বললাম, এখন দলপতি কে?

সে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললে, ইয়ে, আপাতত আমিই।

আমি বললাম, তুমি তো বুড়ো। ক-দিনই বা দলপতি থাকবে। তাহলে আরেকটু কমলালেবুর রস খাই?

বেশ ভালোই লাগছিল।

এমন সময় কে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। আমরা দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। মোমবাতিটাও ঠিক সেই সময় ছোটো থেকে ছোটো হয়ে গিয়ে শেষ অবধি নিবেই গেল।

নিঃশব্দে আমরা টিন, বোতল, টিন-কাটা সব বাক্সের পিছনে লুকিয়ে ফেলে, চুপচাপ বসে রইলাম।

বুড়োর কানে কানে বললাম, যদি দরজা ভেঙে ঢোকে?

বুড়ো বলল, ইস্, দরজা ভেঙে ঢুকবে। তা হলেই হয়েছিল। এরা নিজেদের পোষা গোরুকে নিজেরা ভয় পায়, তা জান?

আবার কানে কানে বললাম, কিন্তু যদি সঙ্গে পুলিশরা এসে থাকে?

সে বলল, তাই তো দোর খুলছি না।

বাইরে থেকে ওরা মহা ধাক্কাধাক্কি করল, কত কী বলে শাসাল, আগুন লাগিয়ে দেব। বাইরে থেকে তালা দেব। ভূতের ভয় দেখাব। এই সব।

সত্যি বলছি আমার একটু একটু ভয় ভয় করছিল। বুড়ো কিন্তু পা ছড়িয়ে বসে, একটু একটু হাসতে আর দাড়িতে হাত বুলুতে লাগল।

হঠাৎ বুড়ির গলা শোনা গেল।

ভালো চাও তো বেরিয়ে এসো। নইলে এই আমি হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙলাম। গত বছরের আগের বছরের সেই ছাগলদের কথা জানাজানি হয়ে গেলে তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পাবে না বলে রাখলাম।

তাই শুনে বুড়ো ভারি ব্যস্ত হয়ে, ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। আমাকে বলল, মেয়েদের কখনো বিশ্বাস করতে হয় না। ঠগ, জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ।

বুড়ি বলে যেতে লাগল, সেই যে মাঘ মাসের শেষের দিকে, ভোরে উঠে?

বুড়ো চিৎকার করে বলল, এই চোপ খবরদার।

বলে দরজা খুলে একেবারে বাইরে এসে দাঁড়াল। আমিও কী করি, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে, ওর পেছনে যতটা পারি গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।

বুড়োর বগলের তলা দিয়ে উঁকি মেরে, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম পুলিশ-টুলিশ কেউ কোথাও নেই, শুধু বুড়ি এক হাতে একটা খুদে লণ্ঠন, অন্য হাতে একটা খুন্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বুড়ির চালাকি দেখে বুড়ো রেগে কাঁই! পুলিশরা কই?

বুড়ি বললে, সে আমি কি জানি? আমি কি তাদের বটিগাট? তাদের কত কাজ। এখন তারা খানাতল্লাশি করতে করতে, তোমার ঘর অবধি পৌচেছে। দেখে এলাম তোমার বাক্স খুলে তোমার বিড়ি খাচ্ছে আর তোমার খাটে বুটপরা ঠ্যাং তুলে, তোমার ডাইরি পড়ছে। কীসব লিখেছ বানান ভুল।

বুড়ো তো দারুণ রেগে গেল।

–বেশ করেছি বানান ভুল করেছি। তোমার দাদা হই না আমি? তুমি এখানে কেন?

–আহা, আমি তোমার ডাইরি পড়া শুনি, আর তুমি এদিকে আমাদের সকলের চোখে ধুলো দিয়ে, জিনিসপত্রগুলো নিয়ে ভেগে পড় আর কী! উনি আর খোকা আর আমি পথে দাঁড়াই, তোমার তো তাই ইচ্ছে।

তারপর আমার ঠ্যাং দেখতে পেয়ে বললে, বাঃ! এরই মধ্যে সাকরেদও পাকড়ে ফেলেছ দেখছি।

বুড়ো কী যেন বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময় শোনা গেল মেলা লোকের জুতোপরা পায়ের মচমচ শব্দ।

অমনি এদের দু-জনারই মুখ একেবারে পাংশুপানা! নিঃশব্দে ঘরের ভেতর আমাকে সুষ্ঠু টেনে নিয়ে, দরজা বন্ধ করে আগল দিয়ে দিল।

কারো মুখে কথাটি নেই, বুক ঢিপঢিপ! বাইরে এবার সত্যি সত্যি মেলা লোকের পায়ের শব্দ শোনা গেল।

১০. এবার যারা এল

এবার যারা এল কে জানে তারা বন্ধু না শত্রু। তবু মনে হল ঘরের এরা দু-জন ওদের চাইতে ঢের ভালো। বুড়ি কি ভালো রান্না করে।

বাইরে থেকে ধাক্কাধাকি, আর সে কী চাঁচামেচি! কিন্তু ওই বিশাল দরজা, তার এমনি ভারী পাল্লা, ভাঙে কার সাধ্যি!

এমনি সময় ঘরের ভেতর থেকেই কানে এল ঘড়-ঘড় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ! পিলে চমকে উঠল। ইকী-রে-বাবা। বুড়ি গিয়ে অমনি দাড়িওয়ালার পেছনে লুকিয়ে পড়ল।

আমি কী করি? বড়ো একটা বাক্সের ঢাকনি খুলে তার ভেতরেই লুকোতে গেলাম। কী সর্বনাশ! বাক্সে ঠ্যাং গলিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম–

বাক্সে একটা মড়া নাকি! বুড়োবুড়ি তো প্রায় অজ্ঞান!

এমনি সময় মড়াটা আস্তে আস্তে উঠে বসল। আমিও তাড়াতাড়ি ঠ্যাংটা টেনে নিলাম।

মড়াটা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি ফিরে এল। বুড়ো একটা দেশলাই জ্বালাতেই চিনলাম সে বিরিঞ্চিদা। উফ, বাঁচা গেল! আরেকটু হলে ভয়ের চোটে মরে গেছলাম।

বিরিঞ্চিদা বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে বেড়ালের মতো গা মোড়ামুড়ি দিল, তারপর জামা কাপড় ঝেড়েঝুড়ে কাষ্ঠহাসি হাসল।

তখনও কিন্তু সামনে ঘড়-ঘড় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে আমার সাহস বেড়ে গেছিল, ঢকঢক করে আর দুটো বাক্সের ঢাকনা খুলে দিলাম।

দেখি একটার মধ্যে ঠানদিদি মুচ্ছো গেছেন, আরেকটিতে শ্যামাদাসকাকা দিব্যি কুণ্ডলী পাকিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। মনে হল সত্যি সত্যি ঘুমুচ্ছে।

বিরিঞ্চিদা খোঁচা মারতেই সে উঠে বসে, চোখ না খুলেই বলল, মালা পাওয়া গেছে?

–মালা দিয়ে কী হবে? সে তো তোমাদের নয়।

শ্যামাদাসাকা চোখ খুলে বললে, তোমাদেরও নয়।

আমি বললাম, বাইরে কিন্তু বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই, সেজোদাদামশাই, পুলিশ পেয়াদা। তার কী হবে?

তাই শুনে যে যেখানে পারল একেবারে বসে পড়ল!

বিরিঞ্চিদা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশাই কি একাই এসেছেন?

বললাম, বলছি সঙ্গে সেজোদাদামশাই, পুলিশ-টুলিশ মেলা লোক খাপেঝাঁপে।

বিরিঞ্চিদা একটু আমতা আমতা করে বলল, সবাই কি পুরুষ মানুষ?

দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে বিরিঞ্চিদা কি পাগল হয়ে গেল শেষটা?

বুড়ি বললে, মালাটা কোথায়? ওর তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

দাড়িওয়ালা বিরক্ত হয়ে উঠল, মালা তো আর তোমাদের নয়।

এই বলে যে বাক্সে মালা ছিল, তার ওপর চেপে আরাম করে পা উঠিয়ে বসে পড়ল।

আমি বললাম, ঠান্‌দিদির মুচ্ছো ভাঙানোর কিছু হবে না?

শ্যামাদাসকাকা বললে, থাক-না, কী দরকার। উঠলেই তো বাজে বকবেন।

বলবামাত্র ঠানদিদি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বাক্স থেকে বেরিয়ে বললেন, ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া, তোমার সব কথা যদি বলে না দিই–

শ্যামাদাসকাকা বলল, সাবধান, শেষটা নিজে সুদ্ধু না জড়িয়ে পড়।

তখন কী রাগ সকলের! দেখতে দেখতে ঘরের মধ্যে দুটো দল হয়ে গেল। এক দিকে বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা, ঠানদিদি; অন্যদিকে বুড়ি আর দাড়িওয়ালা। মাঝখানে আমি।

বিরিঞ্চিদা আবার জিজ্ঞেস করল, সেজোদাদামশাইকে কি একলা দেখলি নাকি? সঙ্গে বামুন-টামুন কিংবা লাল শাড়িপরা মেয়ে-টেয়ে নেই তো?

বললাম, কই না তো। তবে পুলিশরা সব আছে।

বুড়ি খানিক এপার-ওধার খুঁজে বলল, বল-না মালাটা কোথায়?

বুড়ো আবার বললে, বলছি মালা তোমার নয়।

বুড়ি বসে পড়ে বলতে লাগল, নয়ই-বা কেন বলো? জমিদারগিন্নিরই-বা হবে কেন? কতবার দেখেছি তার ফর্সা মোটা গলায় ছোটো ছোটো পায়রার ডিমের মতো শোভা পাচ্ছে। মাঝখানে একটা এই বড়ো সাদা পাথর ধুকধুক করছে। আচ্ছা তুমিই বলো, রংটাই যা ফর্সা, নইলে আমার চাইতে কোন বিষয়ে উনি ভালোটা তাই বলল।

বুড়ো কাষ্ঠহাসি হাসল।

–তোমার যা বুদ্ধি। ইয়ে তা ছাড়া মাঝখানের পাথরটা মোটেই সাদা রং নয়, সেটা নীল। বুড়ি তো অবাক।

–বল কী? আমি জানি না কী রঙের? কতবার দেখেছি পুজোর সময় ঠাকুরবাড়িতে। যতবার দেখেছি ততবার মনে হয়েছে আমিও ওইরকম চওড়া লাল পাড়ের গরদ পরে, কপালে এই বড়ো সিঁদুরের ফেঁটা এঁকে, পায়রার ডিমের মতো বড়ো বড়ো মুক্তোর ওই মালা গলায় ঝুলিয়ে, ঠাকুরবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসি, আর সবাই দেখতে থাকুক আর হিংসেয় ফুলে ফুলে উঠুক।

দাড়িওয়ালা চেঁচিয়ে বলল, যা খুশি বললেই তো আর হল না। মালার রংই তো জানো না। বিশ্বাস না হয় এই দেখো।

বলে বাক্সের ডালাটা খুলে ফেলে দিয়ে মালা বের করে তুলে ধরল।

আধ-অন্ধকার ঘরে মুক্তোর ছড়া জ্বলজ্বল করতে লাগল।

বুড়ো আবার একটা ছোটো মোমবাতি জ্বালতেই বুড়ি অবাক হয়ে দেখল মধ্যিখানের পাথরটা সত্যিই নীল।

অনেকক্ষণ তার কথা বলবার শক্তিই ছিল না, তারপর বলে উঠল, না না, এ সে মালা নয়। এর জন্য আমি সারা রাত জেগে কাটাইনি। তোমরা ভুল মালা এনেছ।

ঠিক এই সময় ঘরের ছাদে কী যেন মড়মড় করে উঠল। ছোটো মোমবাতি, তার আলো ছাদ অবধি পৌঁছোয় না। দারুণ ঘাবড়ে গেলুম সবাই।

ঠিক সেই সময় ঘরের ছাদ থেকে কীসব ভেঙে-টেঙে, ঝুপ করে একটা জিনিস মাটিতে পড়ল।

অবাক হয়ে দেখলাম সেই খোঁচা-দাড়ি রোগা ভদ্রলোক, যাকে পুলিশরা ভুল করে ধরেছিল।

চিঁ চিঁ করে বললেন, বাবা। ঝুলে ঝুলে হাতের মাসিলগুলো সব টেনে লম্বা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস হাসতে হাসতে পড়েই গেলাম। মনে হল ঘরের ভিতরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে, বোধ। করি লোকের ভিড়ে।

বুড়ি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, অত হাসির কারণটা কী, শুনতে পারি?

ভদ্রলোক বললেন, তুমি গো গিন্নি, তুমি। লালপাড় গরদ পরে, মুক্তোর মালা গলায় ঝুলিয়ে, তোমার কেমন ধারা রূপ খুলবে ভেবে, হাসতে হাসতে প্রায় মরেই গেছলাম।

আমি কান খাড়া করে ছিলাম, এবার না জানি কী হবে।

বুড়ি কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। মালার দিকে চেয়ে ঘুম ঘুম সুরে বলতে লাগল, সমুদ্রের তলায় বালির ওপর ঝিনুক পোকা পড়ে থাকে। খোলার ভেতরে সমুদ্রের বালির কণা ঢুকে যায়। ওর গা কুটকুট করে, তাই সাদা চকচকে রস বের করে, তাই দিয়ে বালির গা ঢেকে দেয়, বালির গা মোলায়েম হয়ে যায়। ঝিনুক পোকার আরাম লাগে। তারপর একদিন, মাথার ওপর কাচ-লাগানো বালটি-মুখোশ পরে, বাতাসের নল নাকে লাগিয়ে, জলের তলায় নেমে গিয়ে, ডুবুরিরা ওই মুক্তো তুলে আনে। তাই দিয়ে মালা গাঁথিয়ে, জমিদার গিন্নি পরেন। কিন্তু এ-মালা সে-মালা নয়।

কেন যেন বাইরের গোলমাল থেমে গিয়েছিল। সবাই একটু আশ্বস্ত হল, মালাটা বুড়োর হাতে রইল।

বিরিঞ্চিদা ব্যাপারটাকে বুঝিয়ে বললে, অন্ধকার গর্ত দিয়ে যখনি পড়ে গেলাম, তখনি জানি আমাদের কপালে দুঃখ আছে। তার ওপর ঠানদিদি পড়লেন আমার ঠিক পেটের ওপর। উঃ, নাড়িভুঁড়ি যে এলিয়ে যায়নি সেই যথেষ্ট। দেখতে রোগা হলে কী হবে, কম ওজন ওঁর!– যাক গে, গলি দিয়ে হাঁটছি, তো হাঁটছি, আবার পেছনে শুনি কীসের পায়ের শব্দ। পাঁই পাঁই করে ছুটে, এ-ঘরে ঢুকে, যে যেখানে পারলাম সেঁধোলাম। ওই গলিতে ডালকুত্তা ছাড়া আছে। তার চোখ জ্বলছে দেখলাম। আর তোরা এখানে খাওয়া-দাওয়া করলি।

বুড়ো বললে, ধেৎ, কীসের বীরপুরুষ। ও ডালকুত্তো হতে যাবে কেন, ও তো টেঁপির বাচ্চা।

–টেঁপি আবার কে?

-কেন আমাদের গোরু।

তাই শুনে সবাই খানিক চুপ করে রইল।

তখন শ্যামাদাসকাকা বলতে লাগল, আচ্ছা, এত জিনিস এরা পেল কোত্থেকে?

কারো মুখে রা নেই। আমরা মোমবাতি নিয়ে ঘরময় ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলাম। একসঙ্গে এত ভালো ভালো জিনিস আমি কখনো দেখিনি।

হঠাৎ বাইরে বিকট চিৎকার। বাঁচাও! বাঁচাও! মেরে ফেললে রে। ওরে বাবা রে। মরে গেলাম রে।

এ আবার কী? বুড়ির দয়া হল, ঠানদিদির বার বার মানা সত্ত্বেও দিল দরজা খুলে। হুড়মুড় করে এসে ঢুকলেন ফর্সা, মোটা, কোঁকড়াচুল, সম্পূর্ণ এক অচেনা ভদ্রলোক। মিহি ধুতি পরা, কোচ-দোলানো, হাতে হিরের আংটি, সামনের চুল বেজায় লম্বা, এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর পড়েছে, ভয়ে সারা গা বেয়ে ঘাম ঝরছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, হাত-পা কাঁপছে।

ধপ করে একটি বাক্সের ওপর বসে পড়তেই, ইনি আবার কোনো নতুন বিপদের কথা বলেন, তাই শোনবার জন্য, আমরা সব ঘিরে দাঁড়ালাম।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ভাগ্যিস প্রাণটা রক্ষা করলেন! আরেকটু হলেই যে গোরুতে খেয়ে ফেলেছিল আমাকে। এতকাল মা কালীকে ফি-বছর জোড়া পাঁঠা দেওয়া সত্ত্বেও আরেকটু হলেই গোরুর পেটে গেছিলাম।

বুড়ি তখন দাড়িওয়ালাকে সে কী ধমক। আবার টেঁপিকে ছেড়ে দিয়েছ? এখন বাচ্চা যদি সব দুধ খেয়ে ফেলে, কাল সকালে কী করে চা হবে শুনি? মোটা ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, কাল সকাল অবধি বাঁচলে পর তবে তো চা খাওয়া হবে।

 ১১. ওই কথা বলে যেই

ওই কথা বলে যেই না ঘাড় ফিরিয়েছেন মুক্তোর মালার ওপর চোখ পড়েছে। ভীষণ চমকে উঠলেন, সাপ দেখলে মানুষেরা যেমন চমকায়।

ও কী, ওটা কোথায় পেলেন?

তারপর ঝুঁকে পড়ে ভালো করে দেখে বললেন, নাঃ, সেটা নয়, এটা অন্য মালা। তাতে অন্য পাথর।

তখন বিরিঞ্চিদারা সবাই মিলে তাকে চেপে ধরল, কী মালা, কেমন মালা, খুলে বলতেই হবে। সবাই মিলে হয়তো-বা সাহায্যও করা যেতে পারে।

বিরিঞ্চিদারা সাহায্য করবে শুনে আমার দারুণ হাসি পেল।

ভদ্রলোক বললেন, আমি হলাম সেই জমিদার, যার গিন্নির মুক্তোর মালা চুরি গেছে। বুঝলেন, বেশ একটা মোটা টাকার ইসিওর ছিল, খোয়া গেলে সেটি পাওয়া যায়, তা গিন্নি দিনরাত মালা আগলে রাখবেন। শেষপর্যন্ত গেল তো গেল, অত একটা হাঁকডাক করবার মতোও কিছু নয় কিন্তু গিন্নির সে কী চ্যাঁচামেচি।

বার বার বললাম, বাড়িতে পুলিশ ঢুকিয়ো না, ওতে দেশের অমঙ্গল হয়। তার ওপর আমার পেট কামড়াচ্ছে, আমি কাউকে ডাকতে-টাকতে পারব না। কিন্তু কে শোনে! ভাইকে পাঠিয়ে গোটা থানাটাকে বাড়িতে তুলে আনলেন, মশায়!

তারপর ধরপাকড় খানাতল্লাশি। মালা তো পাওয়া গেলই না, উপরন্তু আমার অমন ভালো বামুন ঠাকুরটা রাগ করে দেশে চলে গেল, এখন সে ফিরলে হয়– হঠাৎ এ-মালাটাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম, বুঝলেন? ভয় ঢুকে গেছিল, মালাটা বুঝি পাওয়াই গেল আর টাকাগুলো হাতছাড়া হল। না, না ব্যস্ত হবেন না, এটা মোটেই গিন্নির মালা নয়।

আমি চুপ করে থাকতে না পেরে বললাম, তাহলে শেষপর্যন্ত চুরি হয়েছিল কী করে?

-আরে সেই তো হল সমস্যা। কেমন করে চুরি হল জানা থাকলে কে চুরি করল জানতে আর কতক্ষণ? মোট কথা, সেটিও সিন্দুকে নেই, আর গিন্নিও এমনি কাণ্ড লাগিয়েছেন যে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এতটা ভাবিনি।

বিরিঞ্চিদা তখন গায়ে পড়ে বলল, মালা হয়তো আমরা খুঁজে দিতে পারি।

কোথায় খুশি হবেন, না, তাই শুনে জমিদার বিরক্ত হয়ে বললেন, থা মশাই, আপনাদের আর পরোপকার করতে হবে না।

বুড়ো, বুড়ি আর রোগা ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। হঠাৎ তাদের দিকে ফিরে জমিদারবাবু বললেন, আচ্ছা, মাকড়িপরা বাবরিচুল, ছোকরা কাউকে চেনেন আপনারা?

শুনে আমরা চার জন তো চমকে উঠলামই, ওরা তিন জনও কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।

জমিদারবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, চেনেন নাকি তাকে?

বুড়ি সাদা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ফিসফিস করে বলল, কেন? তাকে দিয়ে আপনার কী দরকার?

–মানে তার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কাজ ছিল। সে যে আমাকে কী বিপদেই ফেলেছে, পেলে একবার দেখে নিতুম।

বুড়ি কিছু বলবার আগেই রোগা ভদ্রলোক বাক্সের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে বিষম রেগে বললেন, আচ্ছা, কে কাকে দেখে নেবে দেখা যাবে। তার ডান হাতের একটি থাপ্পড় খেলে, আপনার ওইসব জমিদারি চাল ঘুচে যাবে।

–ও হো! তাহলে তাকে চেনেন দেখছি।

ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।

না, মশায়। বলছি তাকে আমরা চিনিও না, শুনিও না, চোখেও দেখিনি, সে এখানে থাকেও না।

বুড়িও হঠাৎ ফোঁৎ ফোঁৎ করে কেঁদে ফেলে বললে, সে তো আপনার কোনো অনিষ্ট করেনি। এসমস্ত কেবল তাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা। মোটেই আমরা তাকে চিনি না, আর মোটেই সে কাল সন্ধ্যে থেকে এখানে নেই। উঃ! আপনারা কি পশু না পাষণ্ড?

জমিদারবাবু তো এত কথা শুনে ভারি অপ্রস্তুত। ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, আহা, আপনি কেন ও-রকম কচ্ছেন বলুন তো। আমিও তো তাকে ভালো লোকই ঠাউরেছিলাম, কিন্তু কী যে বিপদে ফেলে দিল আমাকে। সামনে জেলখানার লোহার দরজা আর পিছনে গিন্নি।

তারপর মালাটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, এ মালাটার সঙ্গে যে সাদৃশ্য আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এ সে নয়। সে মালা কি আর আমি চিনি নে? আগে ঠাকুমা পরে থাকতেন আর আমার মা হাঁ করে চেয়ে থাকতেন। তারপর ঠাকুমা বুড়ি হলে, মা পরে থাকতেন আর গিন্নি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন। এখন মা বুড়ি হয়েছেন, গিন্নি ওটাকে পরে থাকেন। লাখ টাকা দিয়ে ইনসিওর করা, কিন্তু আজকালকার চোরগুলো পর্যন্ত এমনি ওয়ার্থলেস যে সামান্য একটা লোহার সিন্দুক খুলতে পারে না। আরে ছো, ছো, আজকালকার চোরদের ওপর পর্যন্ত নির্ভর করা যায় না, মশায়।

ভাবতে পারেন শাশুড়ির আগে তার শাশুড়ি, তার আগে তার শাশুড়ি এমনি করে মুক্তোর মালা গলায় ঝুলিয়ে, শাশুড়ির লাইন চলে গেছে সেই মান্ধাতার আমল পর্যন্ত। কিন্তু এবার বাছাধনরা জব্দ! গিন্নি হলেন লাস্ট ম্যান। ওই ছেলেটার সঙ্গে যদি কেউ আমার দেখা করিয়ে দেয়, তাকে এখুনি দশ টাকা দিই।

এ-কথা বলবামাত্র দাড়িওয়ালা এক গাল হেসে এগিয়ে এসে বলল, কই দশ টাকা? দেখি?

বুড়ি আর রোগা ভদ্রলোক তার কোমর জাপটে ধরে তাকে আটকে রেখে চাঁচাতে লাগল, না, না, সে এখানে থাকে না, তাকে আমরা চিনি না। এ লোকটা ভারি মিথ্যাবাদী, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।

বুড়ো ওদের হাতের মুঠোর মধ্যে থেকে দাড়ি ছাড়তে ছাড়াতে বলল, কে মিথ্যাবাদী? কাল রাত্রে কে খেয়েছিল দুধের সর? আমি সাক্ষাৎ বড়ো ভাই হয়ে, সারা দিন খেটে মরি, আর কে এলেই মাছের মুড়ো পায়? নিজেদের গোরুর ভয়ে জুজু, আবার সে-ই খায় ক্ষীরের চাচি? কই, দেখি তো আপনার কাছে সত্যি দশ টাকা আছে কি না, দেখি আপনার মনিব্যাগটা।

তখন জমিদার মাথাটাথা চুলকিয়ে বললেন, ইয়ে মানে আমার মনিব্যাগে সত্যিই দশ টাকা আছে, কিন্তু সেটা আমার সঙ্গে নেই। আসবার সময় তাড়াতাড়িতে ইয়ে–

বুড়ো তো রেগে আগুন।

বেশ, মশায়, বেশ। কাজ বাগাবার ফন্দিটে তো মন্দ নয়। যান, ওকে আমরা কেউ চিনি না। আগে দশ টাকা ফেলুন, তারপর ভেবে দেখা যাবে। কত কথা তো আগে ভুলে যাই, আবার পরে মনে– উঃ।

বুড়ির হাতের প্রচণ্ড চিমটি খেয়ে তবে তার মুখ বন্ধ হল।

ঠিক এই সময় ওপর থেকে খচমচ করে কতকগুলো কাঠকুটো নীচে পড়ল।

সবাই অবাক হয়ে ওপর দিকে তাকাতেই, রোগা ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, ও কিছু নয়, আমি এতক্ষণ মাচাটার ওপর বসেছিলুম কিনা, তাই ওটা দুলছে আর কাঠকুটো ভেঙে পড়ছে। কী মুশকিল। সবাই ওপরে তাকাচ্ছেন কেন? নীচের দিকে চেয়ে দেখুন, একটা বালিশও আমার সঙ্গে পড়েছে কী জ্বালা, তবু চোখ নামায় না।

কিন্তু কে শোনে। সবাই একদৃষ্টে মাচার পানে তাকিয়ে, কারণ মাচাবাঁধা পুরোনো দড়ি, চোখের সামেন আস্তে আস্তে ছিঁড়ে দু-টুকরো হয়ে গেল, একরাশি বিছানা-বালিশ ঝুপঝাঁপ নীচে পড়ল, তার সঙ্গে একপাটি লাল বিদ্যাসাগরি চটিও পড়ল।

আশ্চর্য হয়ে ওপর দিকে চেয়ে দেখি যে কঁকড়াচুল ছোকরা, কানে মাকড়ি ও এক পায়ে চটি পরে মাচার বাঁশ ধরে ঝুলছে। আস্তে আস্তে বাঁশটিও খুলে এল আর সেও নেমে পড়ল।

নেমেই জমিদারবাবুকে বলল, এই তো দেখা হল, তাহলে দিন দশ টাকা।

আমরা সবাই তো হাঁ!

তারপর বুড়ি চাপা গলায় বললে, এই খোকা, পালিয়ে যা বলছি। এখানে থাকলে তোকে এরা বিপদে ফেলবে। ভালো চাস তো পালা।

খোকার কিন্তু সেদিকে কানই নেই। জমিদারবাবুকে আবার বলল, কই, বের করুন টাকা। এই তো আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলাম।

ঠানদিদির এতক্ষণ কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবার বুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে? ওই যে কানে মাকড়ি?

বুড়ি তেড়িয়া হয়ে উঠল, উটি আমার ছেলে আর ওই রোগা মানুষটি আমার স্বামী। কেন, আপনার কোনো আপত্তি আছে? না কি আর কিছু জিজ্ঞেস করবার আছে?

ঠানদিদি বললেন, তা বাছা, আছে বই কী। তোমাদের এখানে ব্যাপারখানা কী বলো তো? রাত্তিরে লণ্ঠন নিয়ে আনাগোনা। চানের ঘরে চোরা দরজা, মাটির নীচে গলিখুঁজি, গোপন ঘরে বাক্স-প্যাটরা– এসব চোরাই মাল নাকি?

ঘরে এমনি চুপচাপ যে একটা আলপিন ফেললে শোনা যায়।

বুড়ি বললে, কেন, তাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তো দিন ধরিয়ে। বাইরেই তো পুলিশের সঙ্গে আপনাদের আত্মীয়-স্বজনরা ঘোরাফেরা করছে, ডাকুন-না ওদের।

শ্যামাদাসকাকা আর বিরিঞ্চিদা ঠানদিদিকে বলতে লাগল, কী দরকার ছিল তোমার এসবের মধ্যে নাক গলাবার? এখন আসুক পুলিশ, আসুন সেজোদাদামশাই, আসুন পিসেমশাই, তুমি ঝোলো, আমরাও ঝুলি।

পকেটে এক কুচি চুইংগাম সেঁটে ছিল, সেটিকে বের করে, লোম ছাড়িয়ে মুখে পুরতে যাব, অমনি বন্ধ দরজায় আবার ঠেলা। বাইরে থেকে মোটা গলার ডাক শোনা গেল, দরজা খুলুন মশাই, আমরা পুলিশের লোক। না খুললে বোমা দিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকব।

ঘরময় চুপচাপ। বাক্সের ভেতরে, বাক্সের পিছনে, হারমোনিয়ামের পাশে, পর্দার আড়ালে, যে-যেখানে পারল লুকিয়ে পড়ল। রোগা ভদ্র লোক আর তার ঝাকড়াচুল ছেলে তর তর করে অন্য একটা মাচায় চড়ে বসল।

বাইরে থেকে বোধ হয় ইন্সপেক্টরবাবুই হবেন, হাঁক দিয়ে বললেন, যে দরজা খুলবে তাকে পাঁচ টাকা দেব।

তারপরই একটা অদ্ভুত গাঁক-গাঁক শব্দ, ওরে বাবা রে! মেরে ফেললে রে! খেয়ে ফেললে রে! ওরে হারান হতভাগা, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে, শুট কর–উ হু হু হু! কামড়ে দিয়েছে রে! এই শুট কর, শুট কর।

দাড়িওয়ালা এক দৌড়ে দরজা খুলে হাট করে দিল। ব্যস্ত হয়ে ডাকতে লাগল, আ-আ-আ, টেঁপি-টেঁপি-টেঁপি, কিত-কিত-কিত, আয় টেঁপি-টেঁপি তি-তি-তি।

আর দেখতে দেখতে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল লাল চোখওয়ালা, ভীষণ হিংস্র চেহারার সেই গোরুটা, সঙ্গে আবার ঠিক তারই মতন দেখতে একটি বাচ্চা।

দাড়িওয়ালা তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল, ওরে আমার সোনামুখো বেচারারা। তোদের সঙ্গে দুষ্ট লোকেরা কত খারাপ ব্যবহারই-না করেছে। আহা বাছা রে, একেবারে মুখগুলো শুকিয়ে গেছে।

পুলিশরা যে গোরর ভয়ে কে কোথায় ভেগেছে তার পাত্তা নেই।

এদিকে টেঁপি আর টেঁপির বাচ্চা, খিদের চোটে, বুড়োর পেন্টেলুনটাই খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে।

এই টেঁপি কী হচ্ছে কী। টেঁপি সাবধান। নাঃ, এ তো ছাড়ে না দেখি– দাঁড়া, তোদের খাবার ব্যবস্থা কচ্ছি।

এই বলে বুড়ো ভাঙা মাচার দড়ি খুলে, তাই দিয়ে গোরু দুটোকে বেঁধে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। আমরাও দারুণ একটা সোয়াস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, যে-যার জায়গা থেকে বেরিয়ে এলাম। এতক্ষণ বাদে আমিও চুইংগামটাকে আঙুল থেকে ছাড়িয়ে মুখে পুরলাম।

অমনি একটু কাষ্ঠ হেসে ইন্সপেক্টরবাবু, গোটা দশ পুলিশ, সেজোদাদামশাই আর বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই ঘরে এসে ঢুকলেন। চমকে গিয়ে চুইংগামটা চেবাবার আগেই গিলে ফেললাম। ধেৎ।

 ১২. সারি সারি তো সব

সারি সারি তো সব এসে ঢু। এদের হাত থেকেই পালাবার জন্যে কাল থেকে কী না করা হয়েছে। যাক গে, ঘরের মধ্যে যারা ছিল, তারা ঝগড়াঝাটি ভুলে দল বেঁধে, তৈরি হয়ে নিল। প্রথমে দাঁড়ালেন জমিদারবাবু, তার পাশে ঠানদিদি, তারপর শ্যামাদাসকাকা, তারপর বিরিঞ্চিদা, তারপর বুড়ি, তারপর ঝাকড়াচুল, তারপর রোগা বেচারা আর সব শেষে, একটু পেছনের দিকে সরে, আমি।

ঘরের মধ্যে দেখলাম এ ছাড়াও বারো-চোদ্দোজন লোক।

ইন্সপেক্টরবাবু পকেট থেকে একটা ছোটো কালো খাতা আর লাল পেনসিল বের করে বললেন, কোথা থেকে যে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি নে। ভুবনডাঙার ঠ্যাঙাড়েরা ধরা পড়বার পর একসঙ্গে এতগুলো ক্রিমিনাল দেখা গেছে কি না সন্দেহ।

পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল, সে দেখলাম খোশামুদের একশেষ, একগাল হেসে বললে, হাঁ স্যার, দেখবেন এবার খবরের কাগজে আপনার নাম বেরুবে। একটা চক্র-টক্রও পেয়ে যেতে পারেন, বলা যায় না, হয়তো তিসরা বিভাগ।

-ওই ছোটো ছেলেটাকে দিয়ে শুরু করে দিন স্যার, কচি আছে, ধমক-ধামক করলে হয়তো একটু-আধটু সত্যি কথা বললেও বলতে পারে।

তাই শুনে বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই এমনি অদ্ভুত চেঁচিয়ে উঠলেন, ও কাজও করবেন না মশাই, ওর কচিপানা মুখ দেখে বিচারবুদ্ধি হারাবেন না। ওই হল গিয়ে পালের গোদা, মশাই, ওই হল সর্দার।

সেজোদাদামশাই কী বিরক্ত!

–আরে রাখো! তোমাদের বিরিঞ্চিটিও কম পাজি নয়।

ইন্সপেক্টরবাবু হকচকিয়ে গেলেন মনে হল, এক বার এর মুখ দেখেন, এক বার ওর মুখ। শেষটা আমি নিজেই এগিয়ে এসে বললাম, আমার নাম গুপি চক্রবর্তী, বয়স এগারো, ক্লাস সেভেনে পড়ি, মাথায় সাড়ে চার ফুট, ওজন–

ইন্সপেক্টরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, থামো ছোকরা! বড় বেশি কথা বল!

দেখলে তো মজা? আবার ঠানদিদিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম আর ঠিকানা?

ঠানদিদি মাথায় কাপড় আরো টেনে দিয়ে ইন্সপেক্টরবাবুর দিকে পিঠ ফিরিয়ে বললেন, ও মাগো!

সেজোদাদামশাই বললেন, লিখুন, নিস্তারিণী দেবী। ৪৩, হরিশংকর লেন, কলিকাতা।

ইন্সপেক্টর এ-সবই খাতায় টুকে বললেন, এখানে আসার অভিপ্রায়–?

বিরিঞ্চিদা ঝুঁকে পড়ে বললে, গয়ার কথাটা বলবে।

সেই খোশামুদে লোকটা বললে, উঁহু! সাক্ষীকে হামলা করবেন না।

ঠানদিদি ভারি খুশি হয়ে বললেন, গয়ায় যাচ্ছিলুম, পথ হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি, তাতে দোষটা কী হয়েছে গা?

ইন্সপেক্টরবাবু তাই টুকতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় সেজোদাদামশাই ছুটে এসে রেগেমেগে বললেন, কী মিছে কথা! পাছে আমার গুরুদেবকে–এদের সামনে তার নাম করাও পাপ পাছে তাঁর চরণে আমার মার গয়নাগাটিগুলো দিয়ে ফেলি, তাই তুমি সেসব নিয়ে সরে পড়নি বলতে চাও, বউঠান? ওই গয়নার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার, বাকি আমার আর ইয়ে গুপির বাবার। ওদিকে গুরুদেব সোনার গাড়র অভাবে কী কষ্টই-না পাচ্ছেন?

ইন্সপেক্টর খচখচ লিখতে লিখতে, একবার থেমে সেজোদাদামশাইয়ের জামা ধরে টেনে জিজ্ঞেস করলেন, গুরুদেব কার সোনার গাড় নিয়েছেন না কী যেন বললেন, ভালো করে শুনতে পেলাম না। আরেক বার কথাগুলি বলবেন স্যার?

শুনে তো আমার দারুণ হাসি পেল। সেজোদাদামশাই কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। ইন্সপেক্টর একটু অপেক্ষা করে বুড়িকে বললেন, আপনার নাম ও পেশা?

বুড়ি বললেন, আমার নাম স্বভাবসুন্দরী দাসী। আর পেশার কথা আমি কিছু বলতে পারব, সে আমার অনেক উপকার করেছে।

খোশামুদে লোকটি বললে, কী আপদ। পেশার কথা কে শুনতে চায়? আপনার কী করা হয়। তাই বলুন।

–আর কী করা হবে? রান্না করা হয়। আমার খোকা কিন্তু জমিদারবাবুকে চেনে না।

খোকা বুড়ির হাত ছাড়িয়ে হাঁড়িমুখ করে বললে, এতদিন চিনিনি, এবার খুব চেনা গেছে। দিন, মশাই, আমার একশো টাকা।

জমিদারবাবু তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, আহা, থামো থামো, বলেছি তো দেব।

ইন্সপেক্টরবাবু হতাশ হয়ে পাশের লোকটিকে বললেন, আমি তো কিছু বুঝে উঠলাম না, শম্ভ, তুমি একটু দেখো তো।

শম্ভু তখন তড়বড় করে এগিয়ে এসে বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকাকে লাইন থেকে টেনে বের করে এনে, ধমক দিয়ে বলল, আপনারাই যে রিংলিডার সেকথা অস্বীকার করে কোনো ফল হবে না মশাই, আপনাদের কপালে লেখা রয়েছে বদমায়েশ, ধড়িবাজ। বিলেতে ওই যেসব চোরাকারবার ধরা পড়েছে, তার গোড়াতেও যদি আপনারা থাকেন তো কিছুই আশ্চর্য হব না। নিন, এখন ভালো চান তো বলে ফেলুন আগাগোড়া সব ব্যাপারটা।

তখন বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা ঢোক গিলে, জিব কামড়ে, আমতা আমতা করে, এক জন থেমে, এক জন জোরে, আমাদের কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার পর থেকে সব কথা মোটামুটি বলল।

শুনে ইন্সপেক্টরবাবু বললেন, বটে।

তারপর বিরিঞ্চিার পিসেমশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, কী যেন বলছিলেন আপনি?

পিসেমশাই বললেন, কী আর বলব মশাই, আমার বন্ধু ঘেঁটুর মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে-টিয়ে ঠিক। টোপর কেনা, পুরুতঠাকুরকে বায়না, বরপণের টাকা হাফ ও নেবে আর হাফ আমি নেব সব ঠিক, আর মাঝখান থেকে একেবারে ভাগলুয়া। বল, হতভাগা পালালি কেন?

বিরিঞ্চিদা মুখ লাল করে বললে, শ্যামাদাস যে বললে, ওই মেয়ে ভীষণ রাগী, নাকি চটে গেলে নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়?

–কী? শ্যামাদাস বললে। বাঃ, চমৎকার কথা, শ্যামাদাস বললে। আর শ্যামাদাস কী করেছে। তা জানিস? নিজের মামাকে বেদম পিটে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কেন তা জানিস? কারণ মামা বলেছিল, বলাই চাটুয্যেই-বা কী, আর গোষ্ঠ পালই-বা কী, ছিল শুধু একজন– ব্যস্ ওই পর্যন্ত তার নামটুকুও বলবার আগেই মামাকে একেবারে ফ্ল্যাট, একেবারে মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে এত বড়ো পাজি। কৈমন ঠ্যাঙাড়ে সব সঙ্গী জুটিয়েছ, এবার বুঝতে পারছ আশা করি?

বুড়ি এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিল, এবার বললে, ওমা। কোথায় যাব গো। একটা চোর, একটা ফেরারি, একটা খুনে। ওই ছোকরাটার কথা তো জিজ্ঞেস করতেও ভয়ে হাত-পা পেটে সেঁদোচ্ছে। এই চার-চারটে লোক আমাদের বাড়িতে রাত কাটাল তবু যে বেঁচে আছি তাই রক্ষে।

ইন্সপেক্টরবাবু একটু হাসলেন।

–যা বলেছেন মা-ঠাকরুন। এবার আসুন, এইসব চোরাইমালের গাদার একটা হিসেব দিন। বুড়ি যেন আকাশ থেকে পড়ল।

-ওমা বলে কী। আমার বিয়ের যৌতুক বাবা কত কষ্ট করে দিয়েছিল পঁচিশ বছর ধরে আগলেছিনা। যাতে উই না ধরে, যাতে ডাকাতে না নেয়, তাকে বলে কিনা চোরাইমাল।

বলে একটা ভাঙা হারমোনিয়ামের পিঠে হাত বুলোত লাগল।

এমনি সময় দাড়িওয়ালা ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই ইন্সপেক্টরবাবু মনিব্যাগ বের করলেন, ক-মাসের মাইনে দেয়নি?

বুড়ো তো আহ্লাদে আটখানা।

–ছ-টি মাস দেয়নি স্যার। সম্পর্কে দাদা হই, সব কাজ করিয়ে নেয়, নিজেদের গোরুকে নিজেরা ভয় পায়। ছ-মাস মাইনে দেয়নি, ছ-যোলং চৌষট্টি।

ইন্সপেক্টরবাবু ওর হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, আপাতত এইটে নাও তো। আচ্ছা এসব জিনিস চুরি করে আনে কারা? চালানই-বা করে কারা?

বুড়ো খুশি হয়ে বললে, সে আমাদের লোক আছে স্যার, নিজের হাতে সব ট্রেনিং দিয়েছি। কম-সেকম পনেরো-কুড়িজন ভাড়া খাটে। সবচেয়ে চালাক কে জানেন?–ওই ঝাঁকড়াচুল– উমমা–

বুড়ি আর রোগা বেচারা ওর মুখ চেপে ধরে বলল, না দেখুন ভীষণ মিথ্যেবাদী, দেখুন।

ইন্সপেক্টর সব কথা খাতায় টুকে নিয়ে বললেন, ব্যস্, মালার ব্যাপার ছাড়া আর সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কিছু ভাববেন না আপনারা, ফঁসি বন্ধ করে দেব। চাই কী এক-আধজনকে জেলে না-ও দিতে পারি। কিন্তু মালাটাই যে ভাবিয়ে দিলে মশাই। ওটি না পেলে কি মাইনে বাড়বে? দেখুন জমিদারবাবু, এতক্ষণ কিচ্ছু বলিনি এবার কিন্তু রেগে গেছি। আপনি নাহয় বড়োলোক কিন্তু তাই বলে আমার উন্নতি বন্ধ করে দিতে পারবেন তা ভাববেন না। ঠিক বলছেন এটা আপনার মালা নয়?

জমিদারবাবু মাথা নাড়লেন। ইন্সপেক্টরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, নয় কেন বলুন? এটা কীসে মন্দ?

জমিদারবাবু মহা ফাঁপরে পড়ে গেলেন, ইয়ে মানে এটা আমার গিন্নি পরতেন না– ওই ঝাকড়াচুল– এইটুকু বলেই জমিদারবাবু থামলেন।

–আহা থামলেন কেন? ওই ঝাঁকড়াচুল কি?

জমিদারবাবু কিছু বলবার আগে সে ছোকরাই এগিয়ে এসে বলল, আমি বলব স্যার?

জমিদারবাবু ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গিয়ে বললেন, আরে চুপ চুপ, দেব রে এক-শো টাকা নিশ্চয় দেব। এ তো দেখি আচ্ছা গেরো।

ইন্সপেক্টর বললেন, দেখুন বাজে কথা রেখে আগাগোড়া খুলে বলুন।

জমিদারবাবু কোঁচা দিয়ে মুখ মুছলেন।

–একটুও বাদ দিতে পাব না?

–না, সব শুনব।

–কিন্তু কিন্তু গিন্নি যে রেগেমেগে পুলিশের সম্বন্ধে

–আচ্ছা আচ্ছা সেইটুকু নাহয় ছেড়েই দিলেন।

জমিদারবাবু তখন একটা নীচু দেখে বাক্সের ওপর বসে পড়ে বললেন, বেশ তবে সব কথাই শুনুন। আমাদের সাতপুরুষের জিনিস ওই মালা। লাখ টাকা ওর দাম। লাখ টাকা দিয়ে ইনসিওর করা। হারালে লাখ টাকা পাওয়া যায়। গিন্নি প্রাণ দিয়ে সেটি আগলান। সারাদিন গলায় ঝোলে, সারারাত বালিশের নীচে থাকে। সেই মালা বালিশের তলা থেকে উধাও। কেউ কোথাও নেই, ঘর ভেতর থেকে বন্ধ, শুধু বালিশের নীচে মালাগাছি নেই।

তাই নিয়ে গিন্নি যে অতটা রসাতল করবেন এ আমার ভাবনার বাইরে ছিল মশাই। আর ইসিওরেন্স কোম্পানিকে বছরে বছরে টাকা গুনে দেওয়া হয়েছে, তাদের বাঙালি সায়েবেরও যে কী সন্দেহবাতিক সে আর কী বলব! কেমন করে গেল, কোথা দিয়ে গেল, বললেই হল কিনা চুরি, দেব না টাকা, আগে প্রমাণ করুন সত্যি চুরি গেছে। এইরকম। তখন কী আর করা যায়, এই ছোকরার পায়ের ছাপটা দেখাতে হল!

শুনে সবাই অবাক, ওমা সে কী? ছোকরার পায়ের ছাপ আবার কী?

জমিদারবাবু তখন অপ্রস্তুত মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি সবটা বলতে হবে, গিন্নি শুনলে–

–আহা কী জ্বালা, বলুন বলুন, গিন্নিকে আবার কে বলতে যাচ্ছে?

–তবে শুনুন। ইয়ে মানে ছোকরাকে বললাম তোকে কিছু করতে হবে না, জানলার বাইরে দাঁড়াবি আমি গরাদের ফঁক দিয়ে গলিয়ে দেব, তুই উধাও হবি। পরে রেলের ক্রসিং-এ আমার হাতে দিয়ে দিবি। তাহলে তোকে এক-শো টাকা দেব। তোর কোনো বিপদ নেই। বলুন মশাই, ছিল ওর কোনো বিপদ যে এখন ও-রকম তেড়িয়া হয়ে থাকবে?

না, না, সে তো বটেই।

–সে তো বটেই আবার কী? ব্যাটা মালা নিয়ে বেমালুম উধাও। রেলের ধারে তার দেখা নেই। এদিকে গিন্নির জ্বালায় আমি যেখানে যাই পুলিশও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দেয়। সেই থেকে আপনারা যে আমার পেছনে ছিনেজেকের মতো একনাগাড়ে লেগে রয়েছেন মশাই। দে রে বাপ মালাটি, ইসিওরের টাকায় আমার কাজ নেই, মালাটা এখন গিন্নিকে ফিরিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।

ছোকরা অমনি শ্যামাদাসকাকাকে দেখিয়ে দিলে।

আপনার কথায় বিশ্বাস করেই মালা নিয়ে সরে পড়েছিলাম, আপনারাই যে পেছনে পুলিশ লাগাবেন তা কি আর ভেবেছিলাম। রেলের ধারে গিয়ে দেখি ধরপাকড় চলছে, তখন বেগতিক বুঝে ওই ভদ্রলোকের পকেটে মালা চালান করে দিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমি নাকে কানে খত দিয়েছি সোনাদানা আর ছোঁব না। ইস্কুলে ভরতি হব। যদি মন্টু-পটলাদের ক্লাসে নেয় অবিশ্যি।

তাই শুনে বুড়ি আর বেচারা ভদ্রলোক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওকে সে কত আদর! ওই বুড়োধাড়ি ছেলেকে, ভাবো এক বার!

 ১৩. এদিকে সবাই তো

 

এদিকে সবাই তো শ্যামাদাসকাকার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তখন দুই পকেট উলটে দিয়ে, দুই হাত শূন্যে তুলে বললে, প্রমিস্, আমার কাছে নেই। দেখতে পারেন ঝেড়ে ঝুড়ে। মালা কোন কালে ওই গুপে লক্ষ্মীছাড়াকে দিয়ে দিয়েছি। কী দরকার রে বাবা পরের জিনিসে, বিশেষ করে যখন তার মধ্যে এত বিপদ! গুপে, মালা দিয়ে দে, ভালো চাস তো।

আমিও তখুনি শার্ট খুলে ফেলে দিয়ে, প্যান্টেলুন ঝেড়েঝুড়ে সবার সামনে দেখিয়ে দিলাম যে আমার কাছে মালাটালা তো নেই-ই, অনেকগুলো বোতামও নেই।

ইন্সপেক্টরবাবু অবাক হয়ে গেলেন।

–তাহলে সেটাই-বা গেল কোথায় আর এটাই-বা কার?

ঝাঁকড়াচুল আবার এগিয়ে এসে মাথা চুলকে বললে, আজ্ঞে স্যার, ওটা আমার। বাবার মনোহারি দোকান থেকে নিয়েছিলুম।

বেচারা ভদ্রলোক অনেক সয়ে ছিলেন, এবার কিন্তু দারুণ রেগে, ছেলের দুই কান মলে দিয়ে বললেন, কেন নিয়েছিলি হতভাগা, বল নিয়েছিলি কেন? তাই চেনা চেনা লাগছিল।

ছেলে বললে, পরে প্রাইভেটলি বললে চলত না? আহা, অত চটো কেন বলো তো? দু-জনারই লাভ হত।

ইন্সপেক্টরবাবু আবার নোট বই খুলে বললেন, ধীরে ধীরে বল, নইলে টোকা যায় না।

ঝাঁকড়াচুল বললে, বলে-টলে শেষটা ফ্যাসাদে পড়ব না তো?

–আরে না না। তা ছাড়া, পুরুষ-বাচ্চা, পড়লেই-বা অত ভয় করলে চলবে কেন?

–না, তবে জেলে দিলে তো আর চন্দননগরে খেলতে যাওয়া যাবে না। আচ্ছা, দশ টাকা দেন তো বলতে পারি।

ইন্সপেক্টর হতাশ হয়ে শঙ্কুকে বললেন, তাই দাও তো ওকে।

ছোকরা ভারি খুশি হল।

–বুঝলেন স্যার, ভেবেছিলাম জমিদারবাবুর কাছে এইটে চালিয়ে দিয়ে, আসলটা বেচে সারাটা জীবন সুখে থাকব।

জমিদারবাবু হতভম্ব।

–ইস্! কী সাংঘাতিক বিশ্বাসঘাতক।

বুড়ি দারুণ চটে গেল।

–দেখুন, সাবধানে কথা বলবেন। খোকার একটা মানসম্মান আছে তো। তা ছাড়া যে নিজের স্ত্রীর মালা নিজে চুরি না করে তোক ভাড়া করে করায়, তার মুখে অত কথা শোভা পায় না।

বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা আর আমি বলতে লাগলাম, তারপর? তারপর কী হল?

ঝাঁকড়াচুল বিরক্ত হয়ে বললে, হবে আবার কী ছাই! তোমরা আসল মালা নিয়ে হাওয়া। আমি নকল মালা নিয়ে বাড়ি এসে দেখি, মার দিয়া কেল্লা– শিকার ঘরের মধ্যে। কিন্তু হবে কী, গোর-খোজা করেও তো মালাটা পেলুম না। কী করলে বলো দিকিনি? ভুল করে আমার মালাটাও কার যেন পকেটে ফেলে রাখলাম। ওদিকে আসলটা কোথাও পেলাম না।

ইন্সপেক্টরবাবু আমার দিকে তাকালেন।

–কচি মুখ দেখে বোঝা যায় না তুমি কত বড়ো শয়তান। মালা বের করে দাও।

সেজোদাদামশাইও ধমক দিতে লাগলেন। ভালো চাস তো এখুনি দিয়ে দে হতভাগা। আগে থেকেই জানি শেষটা এমনি হবে। তোর বাবাকে তখুনি বলেছিলাম, দিনা ওকে হাতঘড়ি কিনে, ওতেই ওর কাল হবে। তা কে শোনে বুড়োর কথা। দে শিগগির মালা। কী করবি ও দিয়ে তুই? তোকে–ইয়ে তোকে এত্তগুলো চুইংগাম দেব।

বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই আবার বললেন, বাস্তবিক এতগুলো ধড়িবাজ একসঙ্গে একটা ফ্যামিলির মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না।

ঘরের মধ্যে আর বাকি যারা ছিল তারাও মহা কাঁওম্যাও লাগিয়ে দিলে, দিয়ে দে রে ব্যাটা, দিয়েই দে-না।

–আরে দে দেও রে, আউর কেয়া, ইত্যাদি।

শেষে জমিদারবাবু আমার কাছে এসে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, আমার অবস্থাটা এক বার ভেবে দেখো বাবা, মালা না পেলে গিন্নি আমার একখানা হাড়ও আস্ত রাখবেন না। দে বাপ মালাটা, আমিও তোকে এক ডজন চুইংগাম দেব।

কী আর করা। দাড়িওয়ালাকে বললাম, সর্দার, তুমি পথ দেখিয়ে আগে আগে চলল।

দাড়িওয়ালা তখুনি রওনা দিল, আমরা একের পর এক তার পেছন-পেছন চললুম।

নিমেষের মধ্যে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। কে যেন মোমবাতির টুকরোটাও তুলে নিল। আমাদের পেছনের চোরাকুঠুরি অন্ধকারে মিশে গেল।

ঘরের বাইরে সরু গলি এঁকেবেঁকে শেষে কয়েকটা ধাপ বেয়ে একেবারে রান্নাঘরে গিয়ে শেষ হল।

রান্নাঘরের দরজার বাইরে মোটা খুঁটিতে শেকল দিয়ে কেঁপি আর তার বাচ্চা বাঁধা রয়েছে দেখলাম। আমাদের দেখে তারা দুজন সামনের পা মাটিতে ঠুকে জিব দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল।

আমরা খানিকটা তফাত রেখে পেরোলাম। দাড়িওয়ালা বললে, আহা আমার টেপু-সোনার বুঝি আবার খিদে পেল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এর মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে গেল; কিন্তু বাড়ির বাইরেটা ঠিক তেমনি আছে। বনের গাছপালাও এতটুকু বদলায়নি। শুধু রাতটা কেটে গিয়ে কখন দিন হয়ে গেছে। আকাশের মাঝখানটা ঘন নীল, গাছের ডালপালা রোদে ঝলমল করছে আর অনেক ওপরে একটা চিল ছোট্ট একটা কালো দাগের মতো কেবলই ঘুরছে।

বাড়ি ছেড়ে যেই জঙ্গলের পথ ধরলাম, কোত্থেকে আরও গোটা কতক লোক এসে জুটল। আমার মনে হচ্ছিল প্রায় সিকি মাইল লম্বা একটা লাইন হয়ে আমরা চলেছি।

শুনলাম ওরা জমিদারবাবুর সেই ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোক।

চলতে চলতে বিরিঞ্চিদা পিসেমশাইয়ের কাছে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, তা হলে বিয়েটা

পিসেমশাই বললেন, থাক্, তোর আর অত ভাবতে হবে না, আমার ভাগনে বেটার সঙ্গে তার বিয়ে হবে। সে তোর চেয়ে ঢের ঢের ভালো।

শ্যামাদাসকাকা এবার সাহস পেয়ে বলল, তা হলে আমার ইয়ে—

পিসেমশাই বললেন, আরে সে ব্যাটা কি অত সহজে মরে? আমি যে ওর কাছে টাকা ধারি। দিব্যি চাঙা হয়ে উঠেছে। মারলিই যখন আরেকটু ভালো করে মারলি না কেন?

সেজোদাদামশাই ঠানদিদিকে বললেন, কী বউঠান, স্যাঙাতরা তো যে-যারটা গুছিয়ে নিচ্ছে, তোমার কিছু বলবার নেই?

ঠানদিদি কোনো কথা না বলে কাপড়ের মধ্যে থেকে একটা বড়ো লাল বটুয়া বের করলেন। চলতে চলতে তার মুখ খুলে দু-চারটে জিনিস বেছে নিয়ে বটুয়াটা সেজোদাদামশায়ের পায়ের কাছে ফেলে দিলেন।

সেজোদাদামশাই যেমনি সেটি তুলে নিলেন ঠানদিদি বললেন, গুপি, বাবাকে বলিস অর্ধেক যেন চেয়ে নেয়।

ততক্ষণে আমরা গাছতলায় বিরিঞ্চিদার গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি। সেখানে এসেই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, মাঝখানে রইলাম আমি। বললাম, একটা খোঁচা-মতন জিনিস চাই। সোয়েটার বোনার একটা কাঁটা দাও ঠানদিদি।

ঠানদিদি হাঁড়িমুখ করে বললেন, এ বেঘোরে সে আমি কোথায় পাব?

মেয়েদের যা কাণ্ড, সঙ্গে একটা দরকারি জিনিস অবধি রাখে না। বললাম, তা হলে একটা লাইন-টানা রুলার হলেও চলবে।

সবাই চুপচাপ। বললাম, তা হলে কি জিনিসের অভাবে সব পণ্ড হয়ে যাবে?

তখন শ্যামাদাসকাকা গাড়ির ভেতরের খোপ থেকে একটা লম্বা শক্ত তার বের করে দিল। আমি সেটি নিয়ে সামনের বাঁ-দিকের জানলার ভেতরে গুঁজে দিয়ে অনেক কসরত করে মালাটা বের করলাম।

কাল জানলার কাচ তোলবার সময়, হাত থেকে ফসকে কাচের পাশ দিয়ে, খাঁজের ভেতর পড়ে গেছল।

মালাটাকে পেন্টেলুনে ঘষে তুলে দেখালাম। মাঝখানকার হিরেটা ধুকধুক্ করতে লাগল। জমিদারবাবু ছুটে এসে বললেন, আরে এই তো আমার হারানিধি! এরই জন্যে তো আমি ঘরছাড়া। দে রে বাপ, একটু বুকে করি।

সঙ্গেসঙ্গে ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোকেরাও এগিয়ে এল। তাদের মধ্যে একজনের চোখ হঠাৎ ছোটো হয়ে উঠল।

–সে কী মশাই! এটাও যে মেকি।

আমরা ধমক দিয়ে উঠলাম, বললেই হল মেকি। এইটেই জমিদারবাবুর গিন্নির আদত মালা। মেকি হবে কেন।

সে লোকটা কিছুতেই থামবে না। আরে মণি চেনাই আমার পেশা। তারজন্য এরা আমাকে তিন-শো টাকা মাইনে দেয়, আমি নকল মুক্তো চিনব না? কী যে বলেন। এ যদি সাচ্চা হয় তো আমি।

জমিদারবাবু বললেন, স-স-স–চুপ চুপ, ওকথা মুখে আনবেন না, গত বছর নেহাত ঠেকায়। পড়ে সেটি বেচতে বাধ্য হয়েছিলাম। তা এটাই-বা মন্দ কীসের? পঁচিশ টাকার পক্ষে কী-এমন। খারাপ বলুন? গিন্নিই যখন টের পাননি, আপনাদের আর কি আপত্তি থাকতে পারে?

তারা বললে, আপত্তি কিছুই নয় তবে কোম্পানিতে রিপোর্ট করে দিতে বাধ্য আমরা।

তা করুনগে রিপোর্ট, করুন পাসপোর্ট, খালি আমার গিন্নি যেন না শোনেন। চেপে যান মশাই, পাঁচ টাকা খাইয়ে দেব সবাইকে।

দাড়িওয়ালা বলল, পাঁচ টাকাই নেই আপনার, খাওয়াবেন কী দিয়ে?

ইন্সপেক্টর বললেন, সবই বুঝলাম বাড়ির তলার গোলকধাঁধা ছাড়া।

বুড়ি বললে, বলুন আমাদের সবাইকেই ছেড়ে দেবেন, তা হলে বলি। খোকা ইস্কুলে পড়বে, আমরাও রিটায়ার করব।

ইন্সপেক্টর হাসলেন, কাজটা আপনারা যে খুব ভালো করেছেন বলছি নে; তবে কিনা আপনাদের নামে তো আর কেস হচ্ছে না ঠাকরুন। জমিদারবাবুর গিন্নির মালা খুঁজে দেবার কথা, সে তো দিয়েইছি। গিন্নিমাই আমাকে পুরস্কার দেবেন। আপনাদের নামে কেস যখন হবে তখন হবে। আপাতত জিনিসগুলো সব জমা দিয়ে দেবেন।

বুড়ি বললে, আর আমার খোকা?

শম্ভু বলল, ঘুস খায়, আবার খোকা!

খোকা রেগে গেল। এক পয়সা পেলাম না মশাই, আবার ঘুস খাই, মানে?

জমিদারবাবু দাড়িওয়ালার দিকে তাকালেন। সে বললে, নেই বলছি ওঁর টাকা।

বুড়ি বলল, শুনুন তা হলে। সেকালে বাড়িটা ছিল এক সাহেবের। সে জুতো পচিয়ে এখানে মদ তৈরি করত। দেখতে দেখতে বড়োলোক হয়ে গিয়ে দেশে চলে গেল। পরে সে লাটসাহেব না বড়ো ডাক্তার না কী যেন হয়ে আবার এসেছিল। খুব সস্তায় বাড়ি বেচে দিয়ে গেল। ঠাকুরদা কিনে রাখলেন, বাবা আমাকে যৌতুক দিলেন। অমন ভালো সুড়ঙ্গ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দেখে, আমরা ওগুলোকে একটু কাজে লাগালাম। দোষ তো আমাদের এইটুকু।

ইন্সপেক্টরবাবু খাতা পেনসিল পকেটে পুরে জমিদার গিন্নির মালা হাতে নিয়ে জমিদারবাবুকে বললেন, চলুন।

বুড়ি আর বেচারা ভদ্রলোক ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে অনুনয়-বিনয় করতে করতে চললেন।

অমনি কর্পূরের মতো সবাই যার যেখানে মিলিয়ে গেল। পিসেমশাই, সেজোদাদামশাই পর্যন্ত চলে গেলেন। বাকি রইলাম আমি ঠানদিদি, বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা।

আমরা ফ্যালফ্যাল করে এ-ওর দিকে চেয়ে রইলাম। খানিক বাদে আমি বললাম, এক ডজন চুইংগাম কি সত্যি কেউ কাউকে দেয়!

বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা একসঙ্গে বলে উঠল, কক্ষনো দেয় না। বরাবর তোকে বলছি-না জীবনটা হচ্ছে খানিকটা রাবিশ, একটা ডাস্টবিন। এখন চল, একটা কারখানার চেষ্টা করা যাক।

ভারি খুশি লাগল, ভাবলাম বগাই নিশ্চয় আমাকে কাল সারা দিনরাত খুঁজেছে!

Exit mobile version