Site icon BnBoi.Com

প্রবন্ধ (আ.হ) – আনিসুল হক

আমাদের দেশে হবে সেই মন্ত্রী কবে…

সম্প্রতি আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, মনমোহন সিং হয়তো কথা দিয়ে নিযুত অনুসারীর চিত্ত জয় করতে পারেন না, কিন্তু তিনি তাঁর কাজ দিয়ে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যের উন্নতি ঘটিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে পৃথিবীর দ্রুততম অগ্রসরমাণ অর্থনৈতিক শক্তিতেও উন্নীত করতে পেরেছেন। নানা কর্মসুচির মধ্য দিয়ে তিনি গরিব মানুষের নেতা হিসেবেও গণ্য হচ্ছেন। কথা নয়, কাজই মনমোহন সিংকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাসমেত দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এনেছে।
কথা নয়, কাজে বড় হবে−এ ধরনের মানুষ কি আমরা বাঙালি সমাজে পাব না?
কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ বরিশালের একান্নবর্তী বাড়িতে বসে ঘরকন্না করতেন, রান্নাঘরে উনুনের পাশেই বসে যেতেন কবিতার খাতা নিয়ে, তেল-হলুদ মাখা হাতেই রচনা করে ফেলতে পারতেন কবিতা। একটা লাগসই কবিতা তিনি লিখে গিয়েছিলেন−আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। তাঁর ছেলে জীবনানন্দ দাশ মায়ের এই চাওয়া পূরণ করতে পেরেছিলেন, তিনি একেবারেই কথা বলতে পারতে পারতেন না, মুখে কথা আটকে যেত, হাতের তালু ঘামত, কিন্তু লিখে রেখে গিয়েছেন অবিনাশী সব পঙ্ক্তিমালা, যা চিরকাল আলো দেবে বাঙালিকে। জীবনানন্দ দাশের মতো এ রকম একজন-দুজন মানুষ বাদ দিলে কুসুমকুমারী দাশের এই আক্ষেপ বাঙালি জাতির শাশ্বত আক্ষেপ হিসেবে আজও উচ্চারণযোগ্য −আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। আর সেই কথাটিকে আরও নির্দিষ্ট করে নিয়ে বলা যায়−আমাদের দেশে কবে সেই মন্ত্রী কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
দিনবদলের সনদ ঘোষণাকারী শেখ হাসিনা নির্বাচনে অভুতপূর্ব সাফল্য অর্জন করার পর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। সেই মন্ত্রিসভা ছিল একেবারেই খোলনলচে পাল্টে ফেলা। সেটা দেখে এই অরণ্যে রোদনকারী কলামলেখক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটা মন্তব্যকলাম লিখে ফেলেছিল। এই পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানানোর পরে অর্বাচীন লেখক পরামর্শ দিয়েছিল, মন্ত্রীরা যেন কথা কম বলেন। বলা হয়েছিল, টেলিভিশনগুলোর নিশিরাতের টকশোগুলোয় তাঁরা যেন একটু কম যান। আর সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল বর্তমান যুগের সবচেয়ে বিপজ্জনক বস্তুটি সম্পর্কে−যার নাম টেলিভিশন খবরের ক্যামেরা। যেকোনো আলোচনা-অনুষ্ঠান-বিয়ের দাওয়াত-সচিবালয়ের অফিস কক্ষের দুয়ার−সর্বত্রই এই আপাত নিরীহ যন্ত্রটি মূর্তিমাণ বিপদের মতো হাজির হয়। অত্যন্ত সুমিষ্ট ভাষায় আবদার জানায় চলমান ঘটমান কোনো একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন বিষয়ে মন্ত্রীর একটা মন্তব্যের জন্য। নানা কথাই মন্ত্রীরা বলেন। অনেক কথা বললে দুয়েকটা কথা অনবধানতাবশত বলা হয়ে যায়, যেটা স্িলপ অব টাং, অর্থাৎ কথার তোড়ে বলে ফেলা। পরে প্রচারমাধ্যমে আর সব কথা ফেলে দিয়ে রাখা হয় ওই জিহ্বার পিচ্ছিলতাজনিত বাক্যটিকেই। সেটিই প্রচারিত হয়। পরের দিন দেশজোড়া হইচই, মন্ত্রী এটা কী বললেন! এই সরকারের একেবারে শুরুর দিনগুলোতেই কাঙাল কলামলেখক এ বিষয় থেকে সাবধান থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল সদ্য নির্বাচিত ও অভিষিক্ত মন্ত্রীবর্গকে। কাঙালের কথা কেবল বাসি হলেই ফলে, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
মন্ত্রীদের কথা বলতেই হবে কেন? যেকোনো অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়েই কেন তাঁদের টেলিভিশন খবরের ক্যামেরাগুলোর সামনে দাঁড়াতে হবে এবং হক না-হক একটা মন্তব্য করতেই হবে? পৃথিবীর যাবতীয় বিপদ যে কথা থেকে সৃষ্টি হয়, তা কি তাঁরা জানেন না? নাকি টেলিভিশনের একটা জাদুকরী আকর্ষক ক্ষমতা আছে, তা মন্ত্রীদের চুম্বকের মতো টানে, তাঁরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিভি ক্যামেরার সামনে চলে আসেন এবং নিজের অজান্তেই কথা বলে ওঠেন?
আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মন্ত্রীরা মুখ খুলেছেন তো বিপদে পড়েছেন। যে মন্ত্রী যত কথা বলেছেন, তিনি তত অজনপ্রিয় হয়েছেন। বিএনপির জোট সরকারের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো চিহ্নিত হয়েছিলেন ‘আল্লার মাল’ বলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও যেই উপদেষ্টার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল গণমাধ্যমে কথা বলার, তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে বিতর্কিত।
এ সরকারের আমলে এই অপ্রীতিকর কাজটির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যাঁর ওপরে বা যিনি স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তিনি হলেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। তিনি কথা বলেছেন বেশি, বিতর্কও তাই তাঁর কথা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে বেশি। গতকালকের সংবাদপত্রেও জ্বলজ্বল করছে তাঁর পরিবেশিত খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য: বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রচলিত আইনেই হবে। এ বিষয়ে আমরা কত কথাই না শুনলাম বিভিন্ন মন্ত্রীর মুখ থেকে, আর সেসব কত বিচিত্র ও কত পরস্পরবিরোধী। আমরা শুনেছি, বিডিআর ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং পাওয়া যায়নি।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও মন্ত্রীদের মুখের বাঁধ খুলে গেছে। তাঁরা বলে চলেছেন। এক মন্ত্রী বললেন, যাঁরা টিপাইমুখ নিয়ে কথা বলছেন, তাঁরা না জেনে বলছেন। টিপাইমুখে বাংলাদেশের উপকার হবে। আরেক মন্ত্রী বললেন, সব বাঁধই ক্ষতিকর, তবে টিপাইমুখ নিয়ে কী হবে তা ভারতের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে। এক মন্ত্রী বললেন, ভারতের হাইকমিশনার কুটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন। আরেক মন্ত্রী বললেন, ভারতের হাইকমিশনার কুটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেননি। সবই বচনামৃত। আমাদের মন্ত্রীরা কথাসরিৎসাগর বা তার প্রণেতা হয়ে উঠেছেন।
যে মন্ত্রীদের কথা নিয়ে কথা বলছি, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্কও আছে। আমি তাঁদের এবং এই সরকারের সাফল্য কায়মনোবাক্যে কামনা করি। করি বলেই একেবারে হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই এই আকুল আবেদন জানাই, দয়া করে কথা কম বলুন। নীরবতা হীরণ্ময়। মতিয়া চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করে না এমন মানুষ বাংলাদেশে কমই আছে। তিনি হাসিনা সরকারের গত মেয়াদে কথা কম বলে কাজ বেশি করে কৃষি খাতকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সবার কাছে স্নরণীয় হয়েছিলেন। সেই মতিয়া চৌধুরীও কথা বলতে শুরু করেছেন। বেয়াদবি নেবেন না, বলতে বাধ্য হচ্ছি, যেসব কথা তিনি অন্যের পারিবারিক ব্যাপারে বলছেন, তা তিনি বলেছেন, নিজের কান এখনো নিজের বিবেককে এটা মানাতে পারছে না।
একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। তিনি কথা কমই বলছেন। কম বলছেন বলে বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে না আর তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হচ্ছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই বাক্সংযম অক্ষুণ্ন রাখুন বরং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করে দিন।
টিপাইমুখ বাঁধ ফারাਆার মতো নয়। বিদ্যুৎ যদি উৎপাদন করতে হয়, পানি ছাড়তেই হবে। বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখলে বন্যার প্রকোপ কমতে পারে, শীতকালে পানির প্রবাহ বাড়লে তা আমাদের রবিশস্য উৎপাদনে অবদানও রাখতে পারে। আবার টিপাইমুখ বাঁধ থেকে যদি ভারত সেচ প্রকল্পের জন্য পানি সরায়, তাহলে আমাদের হিস্যা কমে যাবে। শীতকালে পানির প্রবাহ বাড়লে আমাদের রবিশস্যের ভুমি জলমগ্ন হয়ে আবাদি ভুমির পরিমাণ কমতে পারে। ভুমিকম্পপ্রবণ এলাকায় জলাধার ভুমিকম্পের আশঙ্কা বাড়াতে পারে। কাজেই এটার কিছু ভালো দিকও থাকতে পারে, কিছু খারাপ দিকও আছে। পৃথিবীতে এমন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারে না, যেটার নেতিবাচক প্রভাব নেই। আসলে যা দরকার তা হলো স্বচ্ছতা। আমাদের জানতে হবে আসলে ভারত কী করছে। বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর এর প্রভাব কী পড়বে সে বিষয়টাও জরিপের আওতায় থাকতে হবে। চুলচেরা বিশ্লেষণের পর যদি আমরা দেখি, এতে আমাদের উপকারই, তবে আমরা এটাকে স্বাগত জানাব। যদি দেখি আমাদের অপকারের পরিমাণই বেশি হবে, আমরা প্রতিবাদ জানাব। কিন্তু আগে থেকেই মন্ত্রীরা কেউ যদি বলেন, এতে উপকার হবে, কেউ বলেন, এতে কিছু অপকার হবে, এসব কথামালা শুধু কোলাহলই তৈরি করবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
বলা হয়ে থাকে, তোমাকে কান দেওয়া হয়েছে দুটো, মুখ একটা, বেশি শোনো, কম বলো। তার চেয়েও বেশি করা দরকার কাজ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বিদ্যাসাগরচরিত। তাতে তিনি বাঙালির চরিত্র নিয়ে কতগুলো লক্ষ্যভেদী মন্তব্য করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভুরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া ওঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হূদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিਆার ছিল। কারণ সর্ববিষয়েই তিনি ইহাদের বিপরীত ছিলেন।’
নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হওয়া থেকে আমাদের মন্ত্রীরা নিজেদের নিবৃত্ত রাখুন। এই লেখাটির শুরুতে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাকপ্রতিভাহীনতার বিপরীতে কর্মবীরত্বের প্রশস্তির কথা উল্লেখ করেছি। আমাদের মন্ত্রীরাও সবাই হয়ে উঠুন কর্মবীর, বাক্যবীর নন। কুসুমকুমারী দাশের প্রার্থনা ও প্রত্যাশা আমাদের মন্ত্রীদের মধ্যেই চরিতার্থ হোক। আমাদের মন্ত্রীরা কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হয়ে উঠুন। তাতে শব্দদুষণ কেবল কম হবে তা-ই নয়, আমাদের মন্ত্রীদের জনপ্রিয়তার পারদও ওপরের দিকেই থাকবে। ছয় মাস তো তেমন কিছু সময় নয়, সবে তো কলির সন্ধ্যা।

ক-য়ে ক্রিকেট খ-য়ে খেলা

স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। স্বামী আছেন আরেক শহরে। তিনি হাসপাতালে ফোন করলেন। ‘আমি ৭ নম্বর কেবিনের পেসেন্টের হাজব্যান্ড। কী অবস্থা বলেন তো এখন?’
যিনি ফোন ধরেছেন তিনি তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা দেখছেন টেলিভিশনে। শুধু তিনি একা দেখছেন তা-ই নয়, হাসপাতালের আরও অনেক দর্শনার্থী, কর্মচারীও ভিড় করে টেলিভিশন দেখছেন। তাই তিনি অবস্থার বর্ণনা দিলেন, ‘খুব ভালো অবস্থা। আমরা দুজনকে আউট করেছি। এরই মধ্যে একজন ডাক। লাঞ্চের আগেই আরেকজনকে আউট করা যাবে, চিন্তা করবেন না।’
স্বামী বেচারা ডাকের মানে যদি হাঁস বুঝে থাকেন, তাহলে তাঁর জ্ঞান হারানো ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকবে?
এবার শুনুন একটা সত্যিকারের হাসপাতালের গল্প। বাংলাদেশ-ভারত খেলা হচ্ছে। ঢাকার একটা বড় বেসরকারি হাসপাতালের লবিতে বড় একটা টেলিভিশন স্থাপন করা হয়েছে। রাত বাড়ছে। এই লবিতে বসে যাঁরা খেলা দেখছেন তাঁরা সবাই গুরুতর রোগীদের আত্মীয়স্বজন। কারও বাবাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে, কারও ছেলের অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়েছে, কারও বা স্বামীর ক্যানসার। এঁদের সবারই মন খারাপ করার জন্য বাস্তব পরিস্থিতি আর কারণ রয়েছে। কিন্তু সেই বাস্তবতা ভুলে তাঁরা হাততালি দিয়ে উঠছেন। একটু আগেও তাঁদের মন বড়ো খারাপ ছিল। ভারত ৩৭০ করেছে। রানটা ডিঙোনো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ব্যাট করতে নেমে ইমরুল কায়েস দারুণ পেটাচ্ছেন। রানের গড় খুব ভালো। একটা করে চার হচ্ছে আর তাঁরা সোল্লাসে চিৎকার করে উঠছেন। একটু পরে ইমরুল কায়েস আউট হয়ে গেলেন। খেলার গতি থিতিয়ে এল। সাকিব আল হাসান আউট হওয়ার পরে বোঝা গেল, আর আশা নেই। এই দর্শকদের মধ্যে নেমে এল চরম হতাশা। ‘আমরা আপনার বাবার ভেন্টিলেটর খুলে নিতে যাচ্ছি,’ ডাক্তার বললেন এক দর্শনার্থী তরুণকে। বাবার যে বাঁচার আশা আর নেই, ছেলে সেটা আগে থেকেই জানে। নেই, তবুও তো এখনো আছেন। একটু পরে বাবা থাকবেন না। এরপরে বলতে হবে, ছিলেন। বাবা অতীতকাল হয়ে যাবেন। ‘ভেন্টিলেটর খুলে নিতে যাচ্ছি’—এ কথা শোনার পরও তরুণটির আফসোস তার বাবার জন্য নয়, বাংলাদেশের আরেকটা খেলোয়াড়ের আউট হওয়া নিয়ে। ইস, নাইম যদি থাকত! ও তো ছক্কা মারতে জানে। ওর নামই না ছক্কা-নাইম!
সত্যিকারের এই গল্প শুনে আমার নিজের চোখটাও ছলছল করে ওঠে। এটা কি ক্রিকেটের জন্য আমাদের ভালোবাসা, নাকি দেশের জন্য?
কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা! ক্রিকেট তো একটা খেলাই। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবে। সেটা বড় নয়, আসল লক্ষ্য হলো আনন্দ। কিন্তু সেই খেলা আমাদের কীভাবে এ রকম ঘোরতর নিমজ্জনের মধ্যে নিয়ে যায়! আপন-পর ভুলিয়ে দেয়। প্রিয়জনের মৃত্যুর ব্যথা ভুলিয়ে দেয় প্রিয় দলের সাফল্য বা ব্যর্থতা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল না হয় নিজের দেশের দল, আমাদের বহু ব্যর্থতার দেশে একটুখানি সাফল্যের আশ্বাস, জীবনের নানা মাঠে মার খেতে খেতে একটুখানি বিজয়ের সম্ভাবনা, কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলে যে আমরা মেতে উঠি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে নিয়ে, প্রিয় দল হেরে গেলে এই দেশে অন্তত চার-পাঁচজন মারা যান হূদ্যন্ত্র বন্ধ হয়ে, তার কী মানে?
মনটা একটু আর্দ্র হয়ে উঠল কি? আচ্ছা আচ্ছা, এবার তাহলে একটা কৌতুক। ২০০৭ সাল। বাংলাদেশের সঙ্গে হেরে গেছে শিরোপা-প্রত্যাশী ভারত। তারপর শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকেই। ধোনি আর বাইরে বেরোতে পারছেন না। তিনি একটা পারলারে গিয়ে মাথায় লম্বা চুল লাগালেন। কপালে টিপ, ঠোঁটে রঞ্জিনী বুলিয়ে, ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে মেয়ে সেজে তিনি উঠেছেন ট্রেনে। এ সময় তাঁর পাশে আরেকজন তরুণী এসে বসল। সে তাঁকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি ধোনি?’ ধোনি আঁতকে উঠলেন, ‘কী করে টের পেলেন?’
‘আরে, টের পাব না? আমি তো শেবাগ।’
ক্রিকেট নিয়ে বিখ্যাত সাহিত্যিকেরা কী কী লিখেছেন? এ কথা বললে আমার বন্ধু ক্রীড়ালেখক উৎপল শুভ্র নিশ্চয়ই আমাকে মারতে আসবেন। বলবেন, ক্রিকেট নিজেই সাহিত্য, সাহিত্যিকদের লেখার অপেক্ষায় ক্রিকেট বসে নেই! কথা সত্য, ক্রিকেট নিয়ে লেখা হয়েছে লাখ লাখ পাতা, সেসব ক্রিকেট-সাহিত্য বলেই গণ্য। কাজেই ক্রিকেট-লেখকেরা নিজেরাই সাহিত্যিক। কথাটা যে সত্য, তা তো শুভ্রর নিজের লেখা পড়লেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ ক্রিকেট নিয়ে কি কিছু লিখেছিলেন? শুভ্র বলেছেন, বল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু উক্তি পাওয়া যায়, যেমন, ‘বল দাও মোরে বল দাও।’ কিন্তু সেটা ফুটবল না ক্রিকেট নিয়ে সে বিষয়ে পণ্ডিতেরা এখনো স্থিরমত হতে পারেননি। কিন্তু বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কি কিছু কল্পনা করা যায়? ২০১১ সালের বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দিয়ে। আমরা প্রাণভরে গেয়েছি, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ফলে এখানেও রবীন্দ্রনাথ। তবে বাংলা ক্রিকেট-সাহিত্য কিংবা ক্রিকেট-সাংবাদিকতায় রবীন্দ্রনাথের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে একটা কাহিনি অন্তত পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটে। বরিয়া মজুমদার নামে একজন লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায় ক্রিকেট-সাংবাদিকতা শুরুর দিনগুলোর কথা। বাংলা ক্রিকেট-সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ব্রজরঞ্জন রায় আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকদের রাজি করালেন ক্রিকেটের জন্য স্থান বরাদ্দ করতে। ব্রজরঞ্জন লিখবেন বিনিপয়সায়, বলাইবাহুল্য। পত্রিকার উদ্যোক্তারা রাজি হলেন। কিন্তু ব্রজরঞ্জন পড়লেন মুশকিলে। এই ক্রিকেটীয় পরিভাষাগুলোর তর্জমা কী হবে? উপায়ান্তর না দেখে তিনি দেখা করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে প্রচণ্ড উৎসাহ দিয়েছিলেন, অভয় দিয়েছিলেন। ‘তুমি বাংলা করতে আরম্ভ করে দাও, পরিভাষা আবিষ্কার করতে থাকো, আজকে তুমি যা লিখতে শুরু করবে, একদিন তা-ই প্রমিত বলে চালু হয়ে যাবে।’ রবীন্দ্রনাথ এই কনসালটেন্সির জন্য কোনো পয়সা নেননি, বরিয়া মজুমদার আমাদের জানাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের এই আশ্বাসের পরও যে কেন ব্রজরঞ্জন আমাদের এলবিডব্লিউর একটা বাংলা প্রতিশব্দ উপহার দিলেন না! হয়তো সেটা হতে পারত ‘উপূপা’ (উইকেটের পূর্বেই পা)। কট বিহাইন্ডের বাংলা হতে পারত ‘পাছে ধরা’ বা ‘পিছে ধরা’। স্লিপের বাংলা কি হতে পারত পিচ্ছিল বা পিছলা? কিন্তু তা হয়নি, অগত্যা আমাদের ইংরেজি দিয়েই চালাতে হচ্ছে।
বাংলা ভাষার হাল জমানার লেখক-কবিরা ক্রিকেট নিয়ে প্রচুর লিখছেন। সম্ভবত লিখতে বাধ্য হচ্ছেন। শামসুর রাহমান ক্রিকেটানুরাগী ছিলেন, নির্মলেন্দু গুণ তো এখন প্রায় পেশাদার ক্রিকেট (ও ফুটবল) লেখক। ওই বাংলায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখের ক্রিকেট-লেখার খ্যাতি আছে।
অন্তত একজন নোবেল বিজয়ী লেখকের ক্রিকেটপ্রীতি বহুল প্রচারিত। তিনি হ্যারল্ড পিন্টার (১৯৩০-২০০৮)। নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, কবি। ব্রিটিশ নাটকের সবচেয়ে অগ্রগণ্য প্রতিনিধি হিসেবে ২০০৫ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলেছেন, গেইটি ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি ছিলেন, ছিলেন ইয়র্কশায়ার ক্রিকেট ক্লাবের আজীবন সমর্থক। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্রিকেট আমার জীবনের প্রধান অবসেশনগুলোর একটা। আমি সারাক্ষণই ক্রিকেট খেলি, দেখি, পড়ি।’ ক্রিকেট নিয়ে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান উক্তিটা হলো, ‘আমি এ রকম ভাবতে চাই যে ঈশ্বর এই পৃথিবীতে যা কিছু সৃজন করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে মহান সৃষ্টি হলো ক্রিকেট। এটা সেক্সের চেয়ে মহত্তর, যদিও সেক্স জিনিসটাও কম ভালো নয়।’ কথাটা ভাবার মতো। একই কথা আমিও বলতে পারতাম, কিন্তু সেটা ক্রিকেট নিয়ে নয়, ফুটবল নিয়ে। ফুটবলের সঙ্গে ওই ব্যাপারটার বেশি মিল, কিন্তু ক্রিকেটের সঙ্গে যদি তাকে তুলনা করতে হয়, তাহলে বলতে হয়, তাতে কেবল শরীরী আশ্লেষ জড়িত নয়, আছে হূদয়পুরের জটিলতাও, ফুটবল হয়তো নিছকই কামনার ব্যাপার, ক্রিকেট হয়তো প্রেমপূর্ণ কামনা। নাটকের লোক পিন্টার বলেছেন, ‘ক্রিকেট আর নাটকের মধ্যে অনেক মিল। যখন কেউ স্লিপে একটা ক্যাচ মিস করে, যখন আম্পায়ার একটা এলবিডব্লিউর আবেদন নাকচ করে দেন, তখন যে উত্তেজনাটা তৈরি হয় সেটা ঠিক যেন মঞ্চনাটকেরই উত্তেজনা।’ পিন্টারের কাছে দুই প্লেই এক, খেলা অর্থে প্লে আর নাটক অর্থে প্লে। তাই তো, ব্যাপারটা তো আগে খেয়াল করিনি। আমিও তো তাহলে খেলোয়াড়, কারণ আমিও তো প্লে লিখেছি। সেটা ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলিনি। টেনিস বল দিয়ে ছয় চারা বা আমরা বলতাম কিংকং, সেটা খেলেছি প্রচুর। আর খেলতাম ফুটবল। এর কারণটা অর্থনৈতিক। ৩৫ টাকা দিয়ে একটা ৩ নম্বর ফুটবলই আমাদের পাড়ার ছেলেদের পক্ষে কেনা বড় কঠিন ছিল। ফুটবল তো জাম্বুরা দিয়েও খেলা যায়, কচুরিপানার শুকনো বৃন্ত দিয়ে পোঁটলা বানালেও খুব ভালো ফুটবল হতো আমাদের সময়। কিন্তু ক্রিকেট খেলতে আয়োজনটা করতে হতো বেশি। কাঠের তক্তা কাটো, উইকেট বানাও, পিচ বানাও। না, আমরা ক্রিকেট খেলিনি তেমন। তখন জানতাম, রাজার খেলা ক্রিকেট, খেলার রাজা ক্রিকেট। আমাদের ছোটবেলার খেলার মাঠের সঙ্গীসাথিদের কেউই তো রাজার ছেলে ছিল না। সেই ক্রিকেট কি এখন প্রজার খেলা হয়ে উঠেছে? বাংলাদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে পথে পথে মানুষের হুল্লোড় দেখে ক্রিকইনফো লিখেছে, এটা হলো পিপলস ওয়ার্ল্ড কাপ। মানুষের বিশ্বকাপ। লিখেছে, বাংলাদেশ বিশ্বকাপকে তার আত্মা ফিরিয়ে দিয়েছে। শুনতে ভালোই লাগছে। ক্রিকেট এই উপমহাদেশে এনেছিল ব্রিটিশ প্রভুরা, প্রথমে তারা এটা খেলত একঘেঁয়েমি কাটাতে, তারপর— উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা যেমন বলছেন—তারা খেলত, ন্যাটিভদের আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করার সুবিধার জন্যে, তারপর তারা স্থানীয়দেরকেও খেলাটা শেখাতে লাগল, তখন উদ্দেশ্যটা ছিল ‘বাদামি সাহেব’ তৈরি করা। এখন উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে, সাহেবদের ‘জেন্টলমেন’স গেম্স’-কে বস্তিতে নামিয়ে এনেছে প্রাক্তন অনেক কলোনি, আর বনেদি ক্রিকেটের বিশ্বকাপকে বাংলাদেশ করে তুলেছে সকলের বিশ্বকাপ, গণমানুষের সার্বজনীন উৎসব। বাংলাদেশের মাধ্যমেই শুরু হোক গণতন্ত্রের পথে ক্রিকেটের যাত্রা, রাজার খেলা হয়ে উঠুক সবার খেলা, সাধারণের, নিম্নবর্গেরও।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১

বদলের শপথে উদ্বুদ্ধ হোক বাংলাদেশ

দুটি ঘটনা ঘটবে একসঙ্গে। এক আন্তরিকতম শপথের বৃহত্তম প্রদর্শনী হবে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে। একই সঙ্গে ১৯ জুন বিকেল সাড়ে চারটায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোয় সরাসরি সম্প্রচারিত হবে আমাদের বদলে যাওয়ার আর বদলে দেওয়ার শপথ। সরাসরি সম্প্রচারিত হবে কক্সবাজার থেকে। তার সঙ্গে কন্ঠ মেলাব আমরা সবাই, দেশের যে যে প্রান্তেই থাকি না কেন, যারা কক্সবাজারে যেতে পারব না সশরীরে। সেই শপথবাক্যগুলো আগেই প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। আমরা সবাই একযোগে ওই সময়ে শপথটা আবারও উচ্চারণ করব।
১৯ জুন শুক্রবার দুপুর থেকেই প্রথম আলো বন্ধুসভার হাজার হাজার বন্ধু শপথের ব্যানার নিয়ে অবস্থান নেবেন সমুদ্রসৈকতে। এই সেই শপথের ব্যানার, সারা দেশের লক্ষাধিক মানুষ যেখানে লিখেছেন তাঁদের বদলে যাওয়ার আর বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার। প্রথম আলোর শপথযান সারা দেশ ঘুরে সে সব শপথ লেখা ব্যানার নিয়ে এসেছে ঢাকায়। তারপর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে, প্রতিষ্ঠানে চলেছে শপথ সংগ্রহ কর্মসুচি। কী যে স্বতঃস্কুর্তভাবে মানুষ এগিয়ে এসেছিল এই কর্মসুচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশে! অনেকেই এগিয়ে এসেছেন নিজের উদ্যোগে, নিজ পাড়ায় বা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গেছেন শপথের ব্যানার। নিজের ছোটখাটো বদভ্যাসগুলো বদলানোর কথা লিখেছেন অনেকেই। যেমন−ধুমপান না করা বা গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখা। অনেকেই করেছেন বড় ধরনের শপথ, স্কুল করবেন বা গরিব শিশুদের জন্য একটা কিছু করবেন; কারও কারও শপথ যৌতুক না নেওয়ার, কারও শপথ দেশের জন্য যেকোনো ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত থাকার। সেই সব শপথের ব্যানার নিয়ে আমরা দাঁড়াব কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে।
ঢাকা থেকে অনেকেই যাবেন। যাবেন আমাদের অগ্রগণ্য লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী আর তারকারা। সংগীতশিল্পীরা অন্য কোনো গান গাইবেন না, গাইবেন কেবল বদলে যাওয়ার গান। বুদ্ধিজীবীরা সেখানে ভাষণ দেবেন না, দাঁড়াবেন শপথের ব্যানার নিয়ে।
কী হবে এই প্রদর্শনী করে? শপথ তো আসলে নিজের কাছে, নিজের বিবেকের কাছে করতে হয়; সেটা মানা না-মানার বাধ্যবাধকতাও নিজের কাছেই। তাহলে?
আসলে আমরা একটা জাগরণ সৃষ্টি করতে চাই। চাই একটা বিশ্বাস পুনর্জাগ্রত করতে। বলতে চাই, পরিবর্তন দরকার আর পরিবর্তন সম্ভব। ১৯৫২ সালে ভাষাসৈনিকেরা বিশ্বাস করেছিলেন পরিবর্তনে, পরিবর্তন এসেছে; একাত্তরে মুক্তিকামী মানুষ বিশ্বাস করেছিল বিজয় অর্জন সম্ভব, স্বাধীনতা এসেছিল; নব্বইয়েও আমরা বিশ্বাস রেখেছি পরিবর্তনের শক্তিতে, গণতন্ত্র এসেছিল। এবার আমরা বিশ্বাস করি, দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। দেশকে উন্নত দেশে বদলে দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব। সম্ভব, যদি আমরা বিশ্বাস রাখি যে আমরা পারব। যদি আমরা মানি যে পরিবর্তনটা জরুরি। যদি আমরা পরিবর্তনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর না করে তাকাই নিজের দিকে, বদলাই নিজেকে আর প্রত্যেকে হয়ে উঠি পরিবর্তনের পথের একেকজন নিষ্ঠাবান কর্মী।
আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এবার একটু তরঙ্গ জাগুক। আমাদের স্বপ্নহীন জীবনে জেগে উঠুক নতুন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন একটা বদলে যাওয়া আলোকিত উন্নত দেশের, উন্নত সমাজের।
দেশের যে প্রান্তেই থাকি না কেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথের সুতোয় আমরা সবাই বাঁধা। তাহলে বন্ধু, দেখা হচ্ছে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে।
এবার কয়েকটি জরুরি কথা। ভাটার সময় কেউ সমুদ্রে নামব না। কক্সবাজারের সৈকতে চোরাবালি বা চোরাখাদও আছে, কাজেই সবাই সাবধান থাকব। কেউ সৈকতে কোনো ধরনের ময়লা ফেলব না। নিজের যাতায়াত, খাওয়া ইত্যাদির দায়দায়িত্ব হাসিমুখে তুলে নেব নিজের ওপর। অন্যকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে যাব সহাস্যমুখেই। আর প্রত্যেকেই ব্যানার নিয়ে যেতে চাইব দুরতম প্রান্তে, যাতে এক জায়গায় ভিড় না হয়ে এই প্রদর্শনীটি সত্যি সত্যি হয়ে ওঠে পৃথিবীর বৃহত্তম শপথ প্রদর্শনী। স্থাপিত হয় একটা বিশ্বরেকর্ড।
আর এর মাধ্যমে আরেকটি লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে চাই। ব্যানার হাতে সাত কিলোমিটার লম্বা মানবসারি যখন সমুদ্রসৈকতে দাঁড়াবে, তখন তা হয়ে উঠবে ১২০ কিলোমিটার অখন্ড প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতের একটি উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন। প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে এটা হতে পারে আমাদের প্রচারণার বড় হাতিয়ার এবং প্রেরণা। সারা দেশ ঘুরে আমরা যাচ্ছি কক্সবাজারে, কক্সবাজার থেকে শপথের আলো ছড়িয়ে দেব সারা দেশে, আর বাংলাদেশের অপূর্ব সম্পদ ও সম্ভাবনার বার্তা ছড়িয়ে দেব সারা পৃথিবীতে।

সামিনা মিনা ওয়াকা ওয়াকা…

রমণীর সহিত পুরুষের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হইতে পারে না, তাহা বুঝিতে এই কলমচি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের বহু সময় লাগিয়া গেল। কারণ নশ্বর জীবনে সে কখনও ফুটবল খেলে নাই। ধাবন্ত বল লাগিয়াছিল বিষমদেশে, পুরুষ সঙ্গীরা সেই বেদনা বুঝিয়াছিল, নারীসঙ্গীরা বোঝে নাই, বুঝিবার কথাও নহে।…অতএব বিধি এই যে, পুরুষের সহিত তোমার নিষেপ্রম বন্ধুত্ব ও নারীর সহিত তোমার শত্রুতাপূর্ণ প্রেম হইবে।

জানি না, ঠিক উদ্ধার করতে পারলাম কি না! স্মৃতি থেকে লিখছি, বহুদিন আগে একটা ফটোকপি দিয়েছিলেন কবি ব্রাত্য রাইসু, এই কবিতাটির। মাত্র গতকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাই মনে রাখতে পারি না, আর কোন সুদূরকালে পড়া একটা কবিতা! তবুও কিছু কিছু তো মনে আছে!
স্মৃতিভাণ্ডার জিনিসটাও খুব রহস্যময়, নয় কি? কত কিছু ভুলে যাই। আবার কত কিছু মনে পড়ে! বর্ষা এলেই যেমন মনে পড়ে শৈশবের কথা! এবার বর্ষায় মনে পড়ছে বৃষ্টিস্নাত ফুটবলের দিনগুলো! আমাদের প্রজন্মের কোন বালক আছে, যে বৃষ্টির দিনে ফুটবল খেলেনি! মাঠের মধ্যে হলুদ ব্যাঙের মেলা বসেছে, সেই সন্ধ্যা থেকেই তারা ডেকে চলেছে একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, আর তারই মধ্যে সকাল কিংবা দুপুরে, বিকেল হলে তো কথাই নেই, নেমে পড়া গেল ফুটবল খেলতে। পানির ওপরে বল পড়লে কী রকম পিছলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঠ পরিণত হলো চষা ইরিখেতে। তাই বলে কি হতোদ্যম হবে বালকের দল? খেলা শেষে যখন বাড়ি ফেরার পালা, তখন কে রহিম, কে বিশু, বাবা-মার পক্ষেও আলাদা করা সম্ভব নয়। শুধু নিজ দায়িত্বে যে যার ঘরে ফিরে গেল বলে রক্ষে। ফিরেই কুয়োর পাড়, কিংবা টিউবওয়েলের তলে বসে পড়া। কাদামাটি সরে যাচ্ছে, কর্দমমূর্তির নিচ থেকে স্বরূপে বেরিয়ে পড়ছে মানবশরীরটা!
ফুটবল নাকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক খেলা! লিখেছে টাইম ম্যাগাজিন। সাদা খেলতে পারে, কালো খেলতে পারে, বেঁটে খেলতে পারে, ঢ্যাঙ্গা খেলতে পারে, কৃশকায়রা দারুণ খেলে; আবার রোনালদো লুইস নাজারিও ডি লিমা ওরফে দাদাদোর মতো মোটাসোটারাও কম যান না। ফুটবল খেলতে তেমন খরচাপাতি লাগে না, অন্তত আমাদের কালে আমাদের পাড়ায় লাগত না। ২২ টাকার তিন নম্বর ফুটবল একটা হলেই চলত। সেই টাকাটাও আমরা জোগাড় করতে পারতাম না। আট আনা করে চাঁদা দেওয়ার ক্ষমতাও তো সবার ছিল না। মুচির ছেলে, রিকশাওয়ালার ছেলে আর গৃহপরিচারক ছেলেটাও যে খেলত আমাদের সঙ্গে। তবে পাড়ায় একজন সম্পন্ন ঘরের ছেলেও থাকত, যার বাবা তাকে একটা আস্ত ফুটবল কিনে দিয়েছেন। তো সে তো একা খেলতে পারবে না, আমাদেরও তার সঙ্গে নিতে হবে। সেই ফুটবল পাম্প করতে পাড়ার সাইকেলের মেকানিকের কাছে যাওয়া, ভেসলিন কিনে বলের সেলাইয়ে মাখানো, আবার বল ফুটো হয়ে গেলে লাল ব্লাডারটা বের করে তাতে পট্টি লাগানো, কাজ তো কম ছিল না। সেসবও যদি না জুটত, তবে জাম্বুরা গাছে জাম্বুরা ফলত কেন? বৃক্ষ তোমার নাম কী! ফলে পরিচয়। জাম্বুরাগাছের নাম ফুটবলগাছ হলেও আমাদের কালে আমাদের পাড়ায় নামকরণের যথার্থতা সপ্রমাণ হতো বটে।
আর গ্রামের বাড়ি গেলে? আমন ধান কাটা হয়ে গেছে। জীবনানন্দ দাশের সোনালি খড় পড়ে আছে এদিক-ওদিক। কাটা ধানের গোড়া তখনো খেতে। হলুদ লম্বা ঠ্যাঙের রোগাটে শালিকটাকে উড়িয়ে দিয়ে তার মধ্যে চলছে ফুটবল খেলা। শুকনো কচুরিপানার ফোলা বৃন্তগুলো একসঙ্গে জড়ো করে একটা পিণ্ড বানানো হলে চমৎকার ফুটবল হতো। বাতাস ভরা ফুটবলের মতো সেটা মাটিতে পড়লে লাফাতও খুব।
ফুটবল কেবল গণতান্ত্রিক নয়, ওটা সাম্যবাদীও বটে। গরিবের জন্যও তা খেলনযোগ্য, অতিসহজেই। আর খালি পা না জুতা-পা? ওই ইতিহাস আপনারা জানেন। ভারত প্রথমবার যখন বিশ্বকাপ খেলতে গেল, খালি পায়ে খেলার অনুমতি না পাওয়ায় তারা খেলেনি। আমি যত দিন ফুটবল খেলেছি, খালি পায়েই খেলেছি। আমাদের ছোটবেলা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার চেয়ে কম অনাড়ম্বর ছিল না।
তাতে অগৌরবের কিছু নেই। দুঁদে ক্রীড়া-সাংবাদিক উৎপল শুভ্র একটা গল্প শুনিয়েছেন। জার্মানি বিশ্বকাপের সময় জার্মানির দুজন নাগরিকের সঙ্গে তাঁর কথা হচ্ছিল ব্রাজিলের ফুটবল আর জার্মানির ফুটবলের ঘরানা নিয়ে। ওই জার্মানরা তাঁকে বুঝিয়েছেন, জার্মানির ফুটবল কোনো দিনও লাতিন আমেরিকার ফুটবল হতে পারবে না। কারণ একজন লাতিন আমেরিকান ফুটবল খেলে খালি পায়ে, আশৈশব খালি পায়ের সঙ্গে ফুটবলটাকে লেপ্টে জড়িয়ে রেখে সে বড় হয়, ফুটবলের সঙ্গে তার সম্পর্কটা অঙ্গাঙ্গী, অন্যদিকে জার্মানি বছরের অনেকটা সময় ঢেকে থাকে বরফে, জুতা পরা পায়ে ফুটবলের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আর যা-ই হোক, আত্মিক হয় না! কাজেই জার্মানি খেলে জার্মানির মতো, আর লাতিন আমেরিকানরা খেলে তাদের মতো! লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে ফুটবল জীবনযাপনের অংশ, ফুটবল সেখানে প্রধান ‘খাদ্য’ এবং একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।
আর আমরা খেলি আমাদের মতো। আমাদের বালকবেলা মানেই ফুটবল। সেই ফুটবলের কোনো জাগতিক উদ্দেশ্য ছিল না, কেবল ছিল অনাবিল আনন্দ! আর ছিল মোহামেডান-আবাহনী। এখন যেমন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা দিয়ে দেশ ছেয়ে গেছে, তখন এত ব্যাপকভাবে না হলেও, মোহামেডান-আবাহনীর খেলার মৌসুমে বহু বাড়িতে বহু ছাত্রাবাসের ছাদে আবাহনী-মোহামেডানের পতাকার প্রতিযোগিতা শুরু হতো!
তারপর এল টেলিভিশন। তারপর এল সরাসরি বিশ্বকাপ দেখানো। জিকো, সক্রেটিস, ব্যাজ্জিও, পাওলো রসি, আর এলেন মারাদোনা। কোথায় গেল আমাদের সেই নিষ্পাপতার কাল? টেলিভিশনে বিশ্বকাপ আর ইদানীং ইংলিশ লিগ আর স্প্যানিশ লিগ দেখার পর যখন আবাহনী-মোহামেডান খেলা দেখি, বুকটা ভেঙে যেতে চায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, দেখিস, একদিন আমরাও…।
আমাদের দেখা হয় না কিছুই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর সংগঠন ও বাঙালি বইয়ে লিখেছেন, আমাদের সমুদয় ব্যর্থতার পেছনে আমার ঊনস্বাস্থ্য, আমাদের অপুষ্টি! টাকা থাকলে যে বহু কিছু হয়, তার প্রমাণ জাপান, তার প্রমাণ কোরিয়া। কিন্তু টাকা থাকলেই তো পেলে হয় না, মারাদোনা হয় না, ইতো হয় না, মেসিও হয় না। গরিব ঘরের এই ছেলেগুলো, যাঁদের বাড়িতে ঠিকমতো খাবার জুটত না, স্কুলে যাওয়া হতো কি হতো না, তাঁরা একেকজন হয়ে উঠলেন এই গ্রহের সবচেয়ে নামী মানুষ, সবচেয়ে দামি মানুষও। আমাদের কেন হয় না?
জানি, আমরা খেলুড়ে জাতি নই, লড়াকুও নই। আমরা হাঁটি না, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলতেও আমাদের রিকশা লাগে! কিন্তু সেটা তো সবার বেলায় সত্য নয়। আমাদের রিকশাওয়ালা, আমাদের কৃষক, আমাদের মুটে মজুররা কী গাধার শ্রমটাই না স্বীকার করেন! তাহলে? তবে আমরা জাতি হিসেবে বিশ্বনাগরিক বটে। সিএনএনে দেখলাম, বাংলাদেশের একটা মফস্বল শহরের আকাশরেখা দেখাচ্ছে, তাতে কত দেশের যে পতাকা! একটা বালকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো, তার গায়ে আর্জেন্টিনার পোশাক। পরকে আপন করে তোলার মতো এই উদারতা আর কোন জাতির মধ্যে আছে, কে জানে? এরই মধ্যে দুজনের মৃত্যুসংবাদ এসেছে, একজন আর্জেন্টিনার পতাকা লাগাতে গিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে ভূমিস্থ হয়ে মারা গেছেন, আরেকজন আত্মঘাতী হয়েছেন পতাকা কিনে না দেওয়াতে! মারাদোনাকে যেবার বিশ্বকাপের খেলা থেকে বাদ দেওয়া হলো, এরশাদ-আমলে, সেবার আমাদের জাতীয় সংসদে নিন্দাপ্রস্তাব পাস করা হয়েছিল।
ফুটবল নিয়ে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যে বহুত বাগিবতণ্ডা অতীতে হয়েছে, সে খবর বিজ্ঞ পাঠক আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন। এবারও বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ফরাসি দলের অঁরি হাত দিয়ে বল এগিয়ে দিলে গ্যালাস সেটাকে গোল বানিয়ে ছাড়েন, আর তাতেই আয়ারল্যান্ডের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়, এই নিয়ে আয়ারল্যান্ডে কম কূটনৈতিক উত্তেজনা হয়নি! ফুটবল মাঠে আর মাঠের বাইরে মজার কাণ্ডও কম ঘটেনি। ১৯৩০ সালের কথা। উরুগুয়েতে বিশ্বকাপ হচ্ছে। সেমিফাইনালে খেলছে পরাক্রমশালী আমেরিকা আর আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা একটা বিতর্কিত গোল দিল। আমেরিকার কোচ সেটা মেনে নিতে পারছেন না। রেফারিকে গালি দিতে দিতে তিনি ছুটলেন মাঠের মধ্যে। তাঁর দলের একটা খেলোয়াড়কে শুশ্রূষা করতে হবে। তিনি তাঁর ডাক্তারি ব্যাগ ছুড়ে মেরে বের করলেন ক্লোরোফরমের বোতল। ছিপিটা খুলে লাগাবেন আহত খেলোয়াড়ের জখমে। ছিপি খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন চেতনানাশকের গুণে। সব খেলোয়াড় তাঁকে স্ট্রেচারে তুলে মাঠের বাইরে নিয়ে গেল। হাততালি দিতে লাগল ৮০ হাজার দর্শক।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ চলছে। আপনারা খেলা উপভোগ করছেন। এই সময় লেখা উপভোগের সময় নয়। বিশ্বের ৩০০ কোটি লোক এই একটা চর্মনির্মিত বায়ুভর্তি গোলকের পেছনে দিবানিশি ছুটে চলেছে। এটা এখন বিরাট ব্যবসা। ফিফার প্রেসিডেন্ট এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি! এই সময় এই লেখা কে পড়বে?
কেউই পড়বে না, তাই নির্ভয়ে বলি, এখন পর্যন্ত, বিশ্বকাপে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে কেনানের গানটা, শুনতে ও পড়তে, আমাকে দাও মুক্তি, আমাকে দাও অগ্নি, আমাকে দাও যুক্তি, আমাকে নাও ঊর্ধ্বে, দেখো চ্যাম্পিয়ন, এখনই যাও মাঠে, আমাকে দাও রূপ, আমাদেরকে দাও না গৌরব! আর দেখতে ও শুনতে ভালো লেগেছে কী! শাকিরার জোড়হাতের নৃত্যভঙ্গিমা, তাঁর কদমফুলোপম হলুদ-সবুজে ঢাকা দেহবল্লরীর আফ্রিকীয় ভারতীয় নৃত্যলহরী:
সামিনা মিনা এহ এহ
ওয়াকা ওয়াকা এহ এহ
সামিনা মিনা ঝাংগালেওয়া
দিস টাইম ফর আফ্রিকা।
সামিনা মিনা ওয়াকা ওয়াকার অর্থ আমি জানি না, কিন্তু এর ছন্দ আর লয় আমাকে অবিরাম দোলা দিয়ে যাচ্ছে। এই লেখা শুরু করেছিলাম একটা কবিতা দিয়ে। ফুটবলকে গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী এমনকি পণ্যবাদী বলতে পারেন, এখনো এটাকে লিঙ্গনিরপেক্ষ বলা যাবে না। প্রথম গোলটা ‘সবার জন্যে শিক্ষা’র মহান উদ্দেশে উৎসর্গ করে পৃথিবীবাসীকে তার এক নম্বর লক্ষ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফিফা এবং তার সঙ্গে জাতিসংঘ ও শাকিরা নিশ্চয়ই মহৎ কাজ করেছেন, তবু আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকব, যেদিন ১১ জন খেলোয়াড়ের ৫ জন নারী নেওয়া বাধ্যতামূলক হবে। আচ্ছা, তা না হোক, অন্তত মেয়েদের বিশ্বকাপটা তো জমজমাট হতে পারে। হবে নিশ্চয়ই।
কিন্তু তার পরও এই কবিতাটির সঙ্গে প্রত্যেক বালকের একটা ছেলেবেলার স্মৃতি হানা দেবেই, ফুটবলটা বালকদের মাঝেমধ্যে ভীষণ ব্যথাও দিয়েছিল বটে। বালিকারা সেই দুঃখ বুঝবে না!
আমাদের আরও কত বেদনাই তো বালিকারা বোঝেনি!

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১০

Exit mobile version