Site icon BnBoi.Com

গল্প (আনিসুল) – আনিসুল হক

সমাপ্ত চুম্বনের ১৯ বছর পর…

‘মা, বাবাকে তুমি প্রথম কিস্ করেছ কখন?’ পরশ জিজ্ঞেস করে। হাইস্কুলে যাচ্ছে পরশ (১৭), এখনো যে মাকে এই সব প্রশ্ন করছে, তার মানে ছেলেটা এখনো সরল আছে—সুমি আড়চোখে দেখে নেয় ছেলেটাকে। কত বড় হাত-পা হয়ে গেছে ছেলের, খালেদের চেয়েও মনে হয় লম্বা হয়েছে সে। মনে মনে মাশাল্লাহ বলে দুবার, মায়ের নজর না আবার লাগে ছেলের গায়ে।
সুমির মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হতে থাকে রবীন্দ্রসংগীত, এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে, দেখা পেলেম ফাল্গুনে। বাংলাদেশের বসন্ত! ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল, গাছে গাছে পুঞ্জিত আম্রমুকুল। আমগাছে কালচে পাতা, তার ওপরে লালচে মুকুল, মাছি ভনভন করছে আর কেমন একটা মাদকতাভরা গন্ধ!
‘এই মা, কী ভাবছ?’ পরশের প্রশ্নে বর্তমানে ফিরে আসে সুমি। কত দূরে বাংলাদেশ, জামালপুরে বাড়ির চাতালে হেলে পড়া সিঁদুরে আমের গাছ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সারি সারি আমগাছ! কত দূরে তার ছাত্রবেলা! এখানে, এই নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের লাল ইটের ফ্ল্যাটে পাঁচতলায় লিভিং রুমে বসে তারা মায়ে-পুতে গল্প করছে। কোয়ালিটি টাইম কাটাচ্ছে। কাঠের মেঝে, কার্পেটে মোড়ানো, বড় বড় সোফা, একপাশে একটা ৭২ ইঞ্চি টেলিভিশন, তাতে এটিএন বাংলা চলছে, বিজ্ঞাপনই দেখানো হচ্ছে বিরতিহীন। বাংলাদেশে এখন চৈত্র মাস, নিউইয়র্কে এখনো ঘোরতর শীত, ঘরের ভেতরে হিটার অন বলে অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছে না।
খালেদ ওয়াশরুমে ছিল, এসে বসে পড়ে মা আর ছেলের ঠিক মাঝখানে। সোফাটা দেবে যায় খানিকটা। হাতে টিভির রিমোটটা নিয়ে খালেদ চ্যানেল পাল্টায়। চ্যানেল আইতে কী একটা টকশো হচ্ছে।
সুমি বলে, ‘দেখলি, তোর বাবা কী রকম জেলাস? এসে ঠিক মাঝখানে বসল।’
খালেদ বলে, ‘আচ্ছা আচ্ছা, আয় পরশ, তুই মাঝখানে বস, কেয়ারটেকার সরকার। কী নিয়ে কথা হচ্ছে?’
পরশ—তার গলা পুরুষালি হয়েছে, নাকের নিচে গোঁফের অর্ধস্ফুট রেখা—বাবা-মায়ের মধ্যখানে বসে বলে, ‘মাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সাথে মায়ের প্রথম দেখা হয়েছিল কীভাবে?’
খালেদ গলা খাদে নামিয়ে বলে, ‘কঠিন প্রশ্ন।’
পরশ কাঁধ নাড়ে, ‘এইটা কী করে হার্ড কোশ্চেন হয়? এটা তো তোমাদের দুজনারই জানা।’
সুমি তখন খিকখিক করে হেসে ওঠে। ওর শরীর কাঁপছে। পুরো সোফাটাই দুলছে নৌকার মতো।
পরশ বিস্মিত, ‘কী হলো, হাসো কেন?’
সুমি বলে, ‘খালেদ, বলব?’
খালেদ বলে, ‘ওমা! বলো। দাঁড়াও। দুই কাপ চা বানায়া আনি। নাকি তিন কাপ? পরশ, তুইও খাবি?’
‘খাব।’
খালেদ ওঠে। ওদের কিচেন এই রুমের সঙ্গেই লাগোয়া। সে তিন কাপের মতো পানি চুলায় বসায়। পানি টগবগিয়ে ওঠে অচিরেই। শব্দ হয়। নিউইয়র্কে থাকলেও ওরা চা খায় বাংলাদেশের ইস্পাহানি। একেবারে দুধ-চিনি দিয়ে ঘন কড়া চা বানিয়ে খায়।
‘শোন, তোর বাবার সাথে আমার দেখা হলো প্রথম ঢাকায়। জুনিয়র রেডক্রসের ক্যাম্পিং হয়েছিল আজিমপুর গার্লস স্কুলে। সেখানে। আমি গেছি জামালপুর থেকে। আর ও গেছে ময়মনসিংহ থেকে। আমি তখন পড়ি সিক্স গ্রেডে। আর তোর বাবা পড়ে টেন গ্রেডে।’
‘সেই প্রথম দেখা?’ পরশের কণ্ঠে কৌতূহল।
‘হ্যাঁ।’ সুমি বলে, ‘শোনো, আমাকে চিনি একটু কম দিয়ো, খালেদ। তোর বাবা আমাকে এসে বলল, মামু, মামু, আমারে চিনছ?’
‘মানে কী?’ পরশ ভুরু কোঁচকায়।
‘মানে হলো, তোর বাবার এক ক্লাসমেট আমার মামা। তোর জয়নাল নানাকে মনে আছে?’
‘নাই। বাদ দাও।’ পরশ গল্প এগিয়ে নিতে চায়।
‘এর আগে নাকি জয়নাল মামা আর তোর বাবা জামালপুরে আমাদের বাসায় এসেছিল। আমাকে আগেই দেখেছে। আমার মনেটনে নাই। তার মনে আছে। এসে বলছে, আমারে চিনছ? আমি তোমার খালেদ মামু।’
‘হি হি হি,’ পরশ হাসে। হাসলে ছেলেটাকে যা সুন্দর দেখায়! সুমি আবার বিড়বিড় করে ‘মাশাল্লাহ’ বলে। ‘তারপর কী হলো?’ খালেদের চোখেমুখে সত্যিকারের জিজ্ঞাসা।
‘আমি বলি, চিনি নাই। তোর বাবা বলে, আমি খালেদ মামু। জয়নালের ক্লাসমেট। তোমাদের বাড়িতে গেছি না? শোনো মামু, এই খামটা একটু ওই যে লম্বা করে মেয়েটা আছে না, রানী, ওকে একটু দিতে পারবা?’ সুমি হেসে সোফার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
ওপাশ থেকে তিন কাপ চা ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে এই দিকে আসতে আসতে খালেদ চেঁচায়, ‘এই, এই, বানিয়ে কথা বোলো না।’
‘বানাচ্ছি না। বানাচ্ছি না।’ সুমি বলে, ‘মানে বুঝলি? রানী নামের একটা মেয়েকে তোর বাবার পছন্দ হয়েছে। তাকে সে চিঠি লিখেছে। আমাকে বলে সেই চিঠি রানীকে পৌঁছে দিতে।’
‘হা হা হা,’ পরশ এবার গলা ফাটিয়ে হাসে। ‘তারপর? তুমি পৌঁছায় দিলা চিঠিটা?’
‘দেব না! আমার খালেদ মামু আমারে দিতে বলছে! হি হি হি।’
‘তারপর? রানীকে লাইক করে বাবা, তাকে তুমি কেন বিয়ে করলা?’ পরশ চা হাতে নিয়ে গলায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে।
‘আরে আগে শোন। খালি তোর বাবা রানীকে পছন্দ করে তাই না, আমার জন্যও একটা ছেলে জোগাড় করে আনে।’
‘এই, এই সব কী বলো? বানায়া বইলো না, সুমি।’ খালেদ চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে হাসিমুখে বলে।
‘শোন, শোন, বাবা। পুরাটা শোন। তার নাম ছিল ডায়মন্ড। সেই জন্যে আমার মনে আছে,’ সুমির কণ্ঠে হাসি।
‘ডায়মন্ড তো মেয়েরা ভুলতে পারে না,’ পরশ হাসে।
‘এই, পুরুষবাদী কথা বলবি না।’ সুমি গলায় কৃত্রিম রাগ ফোটায়।
‘না না। তোর মা আসলেই ডায়মন্ড ভাইকে ভুলতে পারে নাই। এর সঙ্গে হিরার কোনো সম্পর্ক নাই।’ এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে টেলিভিশনের রিমোট, খালেদের চোখ টিভিতে।
সুমি বলে, ‘ডায়মন্ড ভাই ছিলেন ময়মনসিংহের রেডক্রসের বড় ভাই। বড় লিডার। তিনি তখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছেন। মানে হাইস্কুল শেষ। তাঁর নাকি আমাকে পছন্দ হয়েছে।’
পরশ বলে, ‘তুমি না বললা, তুমি সিক্স গ্রেডে? আর ডায়মন্ড হাইস্কুল কমপ্লিট করেছে। তাইলে তো অনেক সিনিয়র। এজ গ্যাপ তো বেশি হয়ে গেল।’
‘তোর বাপকে বল। তারই বুদ্ধি। সে ডায়মন্ডকে নিয়ে এল আমার কাছে। রেডক্রসের ক্যাম্পিং মানে মাঠের মধ্যে টেন্ট। সাদা সাদা সব তাঁবু। তারই একটা ধরে আছি আমি। ক্লাস সিক্সে পড়ি। দুই বেণী মাথায়। সেই বুড়া হাবড়াকে ধরে এনে তোর বাবা বলে, মামু মামু, এনার নাম ডায়মন্ড। এনার সাথে গল্প করো। বলে তোর বাবা উধাও। আমি বলি, জি, মামা, বলেন। উনি বলেন, আমাকে মামা বইলো না। আমি বলি, কী বলব? উনি আর কথা বলতে পারেন না। হি হি হি।’
সুমির হাতের কাপ থেকে চা ছলকে পড়ে। পরশ টিসু পেপার এগিয়ে দেয়। ‘উফ! মাকে বোধ হয় আজকে হাসিরোগে পেয়েছে।’
‘বাবা, তুমি ডায়মন্ডকে রেখে কই গেছিলা?’ পরশ প্রশ্ন করলে সুমির হাসি পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে দেয়।
খালেদ বলে, ‘আরে, তোর মা বানিয়ে বলছে।’
‘তারপর কী হলো?’ পরশ জানতে চায়।
‘তারপর তো আমি জামালপুরে ফিরে গেলাম। ওই লোক রেগুলার আমাকে চিঠি লেখে। আমি জবাব দেই না। একদিন তোর বাবা সেই ডায়মন্ডকে নিয়ে আমাদের জামালপুরের বাড়িতে হাজির।’
‘আরে না। কাজে গেছলাম জামালপুরে। তাই তোমাদের বাসায় গেছলাম। ডায়মন্ড ভাইকে নিয়ে যাইনি।’ খালেদ প্রতিবাদ করে।
সুমি বলে, ‘আব্বা টের পেয়ে যান। তখন জয়নাল মামাকে ডেকে ঝাড়ি দেন। এই, তোর বন্ধুবান্ধবগুলান এই রকম কেন? তোর বন্ধু খালেদ তার ডায়মন্ড ভাইকে নিয়ে এসে আমার মেয়েকে জ্বালাতন করে কেন?’
‘তারপর?’ পরশ শুধায়।
‘তারপর তোর বাবা আর ডায়মন্ডকে নিয়ে জ্বালাতন করতে আসেনি। আমি জামালপুর কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। তোর বাবা তখন ইউনিভার্সিটির টিচার হয়ে গেছে। আমি হলে সিট পাই নাই। রেবেকা খালার বাসায় থেকে বহুত কষ্ট করে ক্লাস করি। কী আর করা। গেলাম আমার খালেদ মামুর কাছে। মামু, আমাকে হলের সিট জোগাড় করে দেন। মামু বলে, হলে থাকবে? তোমার তো কষ্ট হবে। আচ্ছা, সোমবার এসো। দেখি কী করতে পারি। যাই সোমবারে। উনি আমাকে বলেন, চা খাবে? আমাকে চা বানিয়ে খাওয়ান। এইভাবে সোমবারে যাই, বুধবারে যাই। শনিবারে যাই।’
খালেদ বলে, ‘তারপর রবিবারে যাই, সোমবারে যাই, মঙ্গলবারে যাই, বুধবারে যাই।’
পরশ লজ্জা পায়, ‘বুঝসি বুঝসি, রোজ যাও। তারপর?’
‘তারপর আর কী? মামু বলে, শোনো, তোমার এত কষ্ট করে হলে ওঠার দরকার কী? আমার তো বাসা আছে। তুমি তো আমার বাসাতেই উঠতে পার। তখন আমি বলি, প্রোপোজাল ছেলের বাসা থেকে পাঠাতে হয়। তুমি প্রোপোজাল পাঠাও।’
‘এর আগে না আপনি করে বলতে? এরপর তুমি করে বলা শুরু করলা?’ পরশের প্রশ্ন।
খালেদ বলে, ‘মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন করেছিস, বাবা। বাংলা ভাষায় সিনেমায়, নাটকে এই আপনি থেকে তুমিতে আসতে যে কত পৃষ্ঠা আর কত রিল খরচ করতে হয়!’
পরশ বলে, ‘তারপর কী হলো?’
সুমি বলে, ‘আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটির ক্লাবে রিসেপশন পার্টি হলো।’
‘আর ডায়মন্ড মামু?’ পরশ হাসে।
‘তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর। আমি কি তার খবর জানি নাকি?’
পরশ বলে, ‘আর রানী। বাবা, তোমার রানী কই?’
‘জানি না।’
সুমি চেঁচায়, ‘জানে জানে। তোর বাবা বলবে না। তোর বাবার কবিতার খাতায় দেখবি, তাকে নিয়ে কত কবিতা লেখা।’
‘আমি তো বাংলা পড়তে পারি না, মা।’
‘আচ্ছা, তোকে আমি ইংলিশে ট্রান্সলেট করে দেব।’ খালেদ বলে, ‘পড়ে দেখিস। তোর মা কী রকম লায়ার। আর তোর মা যে খালি ডায়মন্ড কেনে, মার্কেটে গেলেই একটা করে ডায়মন্ড কিনে আনে, কেন আনে এখন বোঝ।’
‘চিন্তা কর! কী বলে তোর বাবা। এই, তুমি তো একটা কমপ্লেক্স ক্যারাক্টার। এইভাবে কেউ ভাবে?’
পরশ মধ্যস্থতা করে। সে তখন কিচেনের সিংকে, কাপ-পিরিচগুলো ধুচ্ছে। গলা উঁচিয়ে বলে, ‘কিন্তু মা, তুমি কিন্তু আমার আসল প্রশ্নটাই এড়িয়ে যাচ্ছ। তোমরা প্রথম কিস করলে কখন? বিয়ের কত দিন আগে? কোথায়?’
খালেদ আর সুমি পরস্পরের মুখের দিকে লাজুক ভঙ্গিতে তাকায়।
‘মনে নাই রে।’ খালেদ বলে।
পরশ বলে, ‘মনে নাই? এটা হতে পারে? ফার্স্ট কিস কেউ ভোলে?’
‘মনে থাকলেও এটা তোকে বলতে পারব না, বাবা।’ সুমি বলে, ‘আমাদের কালচারে এই সব কথা কেউ ছেলেমেয়ের সঙ্গে শেয়ার করে না।’
‘বিয়ের কত দিন আগে, সেটা বললে কী হয়?’
‘ধর, দুই মাস।’ সুমি বলে।
‘কোথায়? মানে ডেটিং প্লেস কোনটা ছিল?’ পরশ জানতে চায়।
সুমি বলে, ‘বাবা, আমরা তো ঠিক ডেটিং করি নাই। ওই শব্দটাই তো আমাদের কালচারে নাই। তবে প্লেসটা আমি তোকে বলি। রিকশায়। বসন্তকালে। আমাদের ইউনিভার্সিটির রাস্তা ভরা আমগাছ। আমের মুকুলের গন্ধ আসছিল। আর একটা কোকিল ডেকে উঠেছিল। এই সময় তোর বাবাকে বললাম, আমাকে একটা চুমু খাও। ও বলল, বলো কী, চারদিকে আমার ছাত্রছাত্রী। আমি বললাম, না, চুমু তোমাকে খেতেই হবে। সে আমার হাতটা ধরে একটা চুমু দিল।’
‘ধ্যাৎ! হাতে কিস খেলে সেটাকে কিস বলে নাকি?’ পরশ হতাশ।
‘আমাদের সময়ে সেটাই অনেক বড় ব্যাপার ছিল, বাবা। পরশ, যাও, শাওয়ার সেরে নাও। আমি খাবার গরম করি। লাঞ্চ করব।’
পরশ ওঠে। বাথরুমে যায়। সুমি খালেদের হাত ধরে বলে, ‘খালেদ, এবার দেশে গেলে আমরা একটা রিকশায় করে ঘুরব দুজনে, আচ্ছা? ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে যাব। ওই আমগাছগুলোর নিচ দিয়ে রিকশা চলবে। এবার তুমি আমাকে একটা চুমু খেয়ো। এখন তো আর চারপাশে তোমার ছাত্রছাত্রীরা থাকবে না। নিয়ে যাবে, বলো, খালেদ?’
‘অবশ্যই নিয়ে যাব। অবশ্যই।’ সুমিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে খালেদ বলে। সুমির চোখ ছলছল করে। সুমির গ্রিনকার্ডে ঝামেলা হচ্ছে। একবার বাইরে গেলে আর ফিরতে পারবে না আমেরিকায়। ১৫টা বছর সুমি দেশের বাইরে। এর মধ্যে আব্বা মারা গেছেন। আম্মা জামালপুর ছেড়ে ঢাকায় এসে ছোট ভাই সুজনের বাসায় থাকেন। তাঁদের জামালপুরের বাড়ির সামনের খুলিতে সেই হেলে পড়া সিঁদুরে আমের গাছটা কি এখনো আছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আমগাছগুলো?
‘আমের মুকুলের গন্ধওয়ালা পারফিউম কিনতে পাওয়া যায় না, খালেদ? ফাল্গুনের শেষে হঠাৎ বৃষ্টি। ঢাকায়। ময়মনসিংহে। জামালপুরে। আমাদের উঠোনে। টিনের চালে। তারপর বৃষ্টি উধাও। রংধনু উঠল আকাশে। মাটিতে সোঁদা গন্ধ। আর আমগাছতলায় বিন্দু বিন্দু মুকুলের আল্পনা। আমি খুব মিস করি, খালেদ। আমি খুব মিস করি। আর কী মিস করি জানো? রিকশা। ওয়ার্ল্ড কাপের ওপেনিংয়ে রিকশায় ক্যাপ্টেনদের চড়িয়ে খুব ভালো করেছে বাংলাদেশ।’
‘আর আমি মিস করি রিকশায় খাওয়া আমাদের অসমাপ্ত প্রথম চুম্বন।’ সুমির ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দ্রুত একটা চুমু খেয়ে নিয়ে খালেদ বলে। ক্যাচ করে শব্দ ওঠে। পরশ বাথরুম থেকে বেরোল। ওরা নিজেদের পরস্পরের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়।
টেবিলে প্লেট সাজায় পরশ। ন্যাপকিন দেয় খালেদ। সুমি গরম করা খাবারগুলো টেবিলে রাখে। খালেদ বলে, ‘থ্যাংক ইউ, পরশ, তোর মাকে ওই কোশ্চেনটা করার জন্যে।’
‘কোন কোশ্চেনটা, বাবা?’
‘এই পরশ, তুই ভাত খাবি না একটু? কয়বেলা বার্গার খেয়ে থাকবি?’ ছেলের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে সুমি তাড়াতাড়ি বলে। সুমির মাথার মধ্যে রিকশার ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। আশ্চর্য, সেই বেলের আওয়াজে সুরও ফুটছে—মধুর বসন্ত এসেছে, আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে…তার এই দুপুরটায় কী যে ভালো লাগছে!

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৮, ২০১১

ছাপাখানায় একটা ভূত থাকে

আমাদের বাসায় আমরা বাস করি মিনির মায়ের মতো করে। মিনির মাকে আশা করি আপনারা চিনেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পের যে মিনি, তার মা। তার ধারণা ছিল, পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমাশ, আরশোলা-শুয়োপোকা, সাপ-বাঘ তার বাসার দিকেই ধেয়ে আসছে। আমাদের ধারণা ঠিক অতটা আন্তর্জাতিক নয়। পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে ধেয়ে না এলেও দেশের সব কুখ্যাত ভয়ঙ্কররা যে আসছে, তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। আমরা শুয়ে পড়ি রাত সাড়ে এগারোটায়, ওঠি সকাল সকাল। মেয়ের স্কুল, কর্ত্রীর অফিস।
এমনি এক বাসায় রাত সাড়ে এগারোটায় দোরঘণ্টি বেজে উঠল ভয়াবহ আর্তনাদের মতো।
আমাদের পিলে উঠল চমকে।
কে হতে পারে?
আমাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানকে বলা আছে, পরিচিত-অপরিচিত যে-ই আসুক, ইন্টারকম ফোনে কল করে জানাতে হবে, বাসায় মেহমান আসছেন। আর অপরিচিত হলে আমাদের অনুমতি ছাড়া কারও আমাদের ফ্ল্যাটের গেট অবধি পৌঁছানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
গেট থেকে কোনো ফোন আসেনি? তাহলে?
হতে পারে পাশের বাসার কেউ। হয়তো রাত-বিরেতে কোনো প্রেস রিলিজ দেওয়ার কথা মনে পড়েছে। সংবাদপত্রে চাকরি করি—এই এক অসুবিধা। যেকোনো খবর বা বিজ্ঞাপন ছাপানোর দরকার হলে লোকে সরাসরি বা ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। যেমন, যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম, তখন কারও কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র নষ্ট হওয়া মাত্রই আমাকে অনুরোধ করত, সেটা সারিয়ে দিতে। যেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে রেডিও বা টেলিভিশন যন্ত্রের মেরামতি শেখানো হয়!
আমার স্ত্রী কণ্ঠে উদ্বেগ আর চেহারায় আতঙ্ক ফুটিয়ে বললেন, দেখো তো কে?
আমি নিজের কাপুরুষতা অপ্রমাণের স্বার্থে দরজার ম্যাজিক হোলে চোখ রাখলাম, কিন্তু ওপাশের অস্পষ্ট আলোয় ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না, মধ্য রাতের আগন্তুকটা কে।
আমি গলায় জোর এনে বললাম, কে?
আনিস ভাই, আমি জাফর। জাফর আহমদ।
ও জাফর। আমাদের পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। জাফর, এত রাতে?
সম্পাদক সাহেবের নির্দেশ। তাই আসতে হলো।
সম্পাদক সাহেবের নির্দেশের কথা শুনে আমি মন্ত্রতাড়িতের মতো দরজা খুলে দিলাম।
আসো মিয়া। বসো। কী ব্যাপার?
জাফর হেসে বলল, আপনি শিব্রামের গল্প পড়েন নাই? সম্পাদকেরা কী করে লেখকদের কাছ থেকে গল্প আদায় করে। এভাবেই আসতে হয়। জাফর নিজের পায়ের জুতা খুলতে লাগল।
বসার ইচ্ছা। আমি বললাম, জুতা খুলতে হবে না। ঘটনা কী?
জাফর বলল, ঘটনা সামান্য। কিন্তু বসে বলি। আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে সে ড্রয়িং রুমে ঢুকল এবং বসে পড়ল।
সোফায় নয়, মেঝেতে। যাকে বলে আসন পেতে বসা। বেটা মনে হচ্ছে মেলা রাত করে ফিরবে। আমার ঘুমের সময় হয়ে এল।
আমার মনের অনুভূতি মিশ্র। জাফর যদি গল্প চাইতে এসে থাকে, আর তা যদি সত্যি সম্পাদক মহোদয়ের আদেশের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে আমি খানিকটা শ্লাঘা বোধ করতেই পারি। কিন্তু সম্পাদক সাহেব যদি অন্য কোনো কারণে জাফরকে পাঠিয়ে থাকেন…যেমন জাফর যাও, রাত বেশি হয় নাই, আনিসের কাছে যাও, ওকে দেখিয়ে আনো, কালকের মধ্যেই এই গোলটেবিল বৈঠকটার বিবরণী আমি পুরো ছাপাতে চাই। শোনো, যাওয়ার সময় ওর জন্য এক কেজি টাঙ্গাইলের চমচম নিয়ে যেও। আনিস মিষ্টি পছন্দ করে। কী রকম ভুঁড়ি হয়েছে দেখো না। এ ধরনের কোনো কারণ হলে আমার খুব খুশি হওয়ার কারণ নাই। এখন জাফরকে বসিয়ে রেখে চার পাতা আমাকে দেখে দিতে হবে।
জাফর বলল, আনিস ভাই, আপনার সময় নষ্ট করব না। আমি একটা অন্য রকম পাতা করছি। আধিভৌতিক গল্প সংখ্যা। আপনি একটা ভূতের গল্প লিখে দেন।
আমি বললাম, মিয়া, রাত ১২টায় এসে তুমি গল্প চাও। ফোন করলেই তো হতো।
জাফর বলল, সম্পাদক সাহেবের নির্দেশ। আপনি ছাড়া এত রাতে কার কাছে যাব? জাফর ইকবাল স্যারকে ফোন করছি, উনি মনে হয় মোবাইল অফ করে রেখেছেন। আর সত্যি কথা বলতে কী, আপনি ছাড়া আর কেউ চাহিবা মাত্র লেখা দেয় না। আমাদের বিশ্বজিত্ চৌধুরীকে বললেও অন্তত সাত দিন। কেবল আপনিই পারেন এক রাতে গল্প লিখে দিতে। কালকে আমার পেস্টিং। আপনি আজ রাতেই লেখেন।
আমি বললাম, জাফর, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলা, তাই না। রাতে তো আমি গল্প লিখি না। আমি লিখি সকালে। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমাব। ভোরবেলা উঠে তোমার গল্প ধরব। তোমার খাতিরে নয়। সম্পাদক সাহেবের খাতিরে।
আমার পাজামার পকেটে মোবাইল ফোন নড়ছে। ফোন হাতড়ে বের করে দেখলাম, তিনটা মিস্ড কল। তিনটাই কর্ত্রীর।
আমি রিং ব্যাক করলাম।
অ্যাই, কে? উনি বললেন।
আর বোলো না, জাফর।
কেন আসছে? এত রাতে?
গল্প চাইতে।
এত রাতে? আক্কেল নাই?
আক্কেল থাকলে কেউ সাহিত্য সম্পাদক হয়?
আরে বলতেছো কেন। ও শুনতেছে না?
না। সাহিত্য সম্পাদকের সব কথা শুনতে হয় না। আসো জাফরের সঙ্গে কথা বলো।
না, বলো, আমি ঘুমায়া পড়সি।
আচ্ছা বলতেছি। রাখো তুমি।
জাফর আমার ঘরের জিনিসপত্র দেখছে। ড্রয়িং রুমের দেয়ালে অনেক মুখোশ আছে। সেসবের দিকে তাকিয়ে সে মুচকি মুচকি হাসছে।
কী মিয়া, হাসো ক্যান?
জাফর যেন অন্য জগতে আছে। আমার কথা শুনতেই পাচ্ছে না।
আমি বললাম, জাফর, একটু কোল্ড ড্রিংকস দেব। ফ্রিজে আছে।
জাফর বলল, না দরকার নাই। বাইরে আজকে জোছনা। মহিনের ঘোড়াগুলো এখনো ঘাসের লোভে চরে, পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।
আমি বলি, ওই মিয়া, কাব্য করার আর টাইম পাইলা না। রাইত বারোটায়?
জাফর বলল, আনিস ভাই, আমি কিন্তু ছোটবেলায় গান শিখতাম। রবি ঠাকুরের গান। শুনবেন?
এত রাতে? এইটা কি গান শোনার সময়?
অফিসে কাজের চাপে কোনোদিন একটা লাইন গানও গাইতে পারি না। আজকে আপনার বাড়িতে আসার পথে দেখি উথালপাথাল জোছনা।
মাত্র দুই দিন আগে কোরবানির ঈদ গেল। আজকে তো পূর্ণিমাই হবে। জোছনা থাকাই স্বাভাবিক।
আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের মাতাল সমীরণে। জাফর গান গাচ্ছে। তার গানের গলা আশ্চর্য রকমের ভালো।
আমি বললাম, জাফর খেয়াল করেছো ওয়ার্ডিংগুলা, আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে, ঘর মোছা নিয়া যে কেউ গান লিখতে পারে, তাও জ্যোত্স্নারাতের গানে কেউ ঘর ধোয়া-মোছা, ঝাড়ু দেওয়ার কথা লিখতে পারে, ভাবাই যায় না। কী মডার্ন!
গান কেমন লাগল?
ভালো। রীতিমতো গায়কদের মতো।
আমি আসলে গান শিখতাম। ওস্তাদ মিহির লালার কাছে আমি আঠারো বছর গান শিখেছি।
আচ্ছা। তোমার এ প্রতিভার কথা জেনে খুশি হলাম। মাঝে মধ্যে অফিসে তুমি গান শুনাবা। একজন গৃহপালিত গায়ক স্টকে থাকা সব সময়ই ভালো।
আমি এবার যাই। তবে একটা অনুরোধ। গল্পটা আপনি রাতের বেলাতেই লিখবেন। গল্পের ইলাস্ট্রেশন আমি করে রেখেছি।
ইলাস্ট্রেশন করে রাখছ মানে। আমি তো গল্প লিখিই নাই।
ইলাস্ট্রেশন করতে গল্প লিখতে হয় না। দেখেন, কেমন ফিট করে।
জাফর যাওয়ার সময় নেপালের কাঠমান্ডু থেকে আনা ১০টা নরমুণ্ডশোভিত ভয়ঙ্করদর্শন মুখোশটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হাসল।
ও চলে গেলে আমি হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়ে গেছে।
পরের দিন ভোরবেলাই উঠতে হলো। আমি সোজা লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম। জাফরের গল্পটা লিখে দেওয়াই উচিত।
ভূতের গল্প আমি লিখতে পারি না। আমার ভূতেরা সব হাসির কাণ্ড করে। খুবই ফ্রেন্ডলি প্রকৃতির হয়। আধিভৌতিক গল্প তো একেবারেই আসে না আমার হাতে। অযৌক্তিক কোনো কিছু এই পৃথিবীতে আমি ঘটতে দেখিনি।
গল্পটা লিখে ফেলে খুব একটা স্বস্তি হলো। প্রত্যেকবার লেখা শুরু করার আগে আমি ভাবি, লেখার প্রতিভা আমি হারিয়ে ফেলেছি। আর পারব না। পরে যখন লেখা শেষ হয়, তখন মনে হয়, নিজেকে ফিরে পেয়েছি। খুব আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।
গল্পটা হাতে করে আমি অফিসে গেলাম অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই। গিয়ে দেখি জাফর নাই।
আমি পেস্টিং রুমে গেলাম। জাফর আসে নাই?
জাফর ভাই তো পাতার কাজ গত রাতেই শেষ করে দিয়ে চলে গেছেন।
কী বলে? ও না আমার কাছে গল্প চাইল। আমি লিখে নিয়া আসলাম। অযথা খাটাইলো।
পাতা তো প্রেসে রাতেই চলে গেছে। রাতের বেলাতেই ছাপা হয়ে গেছে। একটু পরে ছাপানো কপি দেখতে পাবেন।
আমি জাফরকে ফোন দিলাম। মোবাইলে। জাফর তুমি কই?
আমি। বাসায় আনিস ভাই। কালকে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ হয়েছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সেই দুইটা।
আমার কাছে যে গল্প চাইলা, এমন ভাব করলা, আমার গল্প ছাড়া তোমার পত্রিকাই ছাপা হবে না।
তাই তো। আপনার গল্প ছাড়া আমার পাতা হবে নাকি?
তাইলে এখন এই গল্প আমি কী করব।
আপনি আরেকটা গল্প লিখেছেন?
আরেকটা মানে। একটাই হয় না।
আপনার গল্প তো ছাপা হয়েছে। আমি নিজে মেকআপ করে পেস্টিং করে দিয়েছি।
আমি তোমাকে কবে গল্প দিলাম?
কালকে রাত ১২টা কি সাড়ে ১২টার দিকে আপনার মেইল এল। আমি চেক করে দেখি গল্প। খুব খুশি হইছি আনিস ভাই। রাতে নিজেই প্রুফ দেখে গল্প পেস্টিং করে ফেলেছি।
কী বলো তুমি। তুমি আমার বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে আসছ?
মানে কি?
তুমি কালকে রাতে আমার বাসা থেকে বের হয়ে আবার অফিসে গেছ?
আমি তো কালকে রাতে আপনার বাসায় যাই নাই।
জাফর ইয়ারকি কইরো না।
আনিস ভাই, আমি আপনার সাথে ইয়ারকি করব, আপনি ভাবতে পারলেন।
তাইলে আমি তোমার সাথে ইয়ারকি করতেছি?
সেই অধিকার আপনার আছে। আপনি সিনিয়র। ইয়ারকি করতে পারেন। আমি তো পারি না।
আমি খুবই রেগে যাচ্ছি। রেগে যাওয়া আমার স্বভাবের মধ্যে নাই। আর চাকরি করতে গেলে রাগ, মান-অপমানবোধ এই সব দূরেই রাখতে হয়। কিন্তু এইটা চাকরির বিষয় নয়। এটা হলো আমার লেখকতা নিয়ে বিদ্রুপ। জাফর আমার সাথে খুব বড় ফাজলামো করছে। এইটা আমি সহ্য করব না।
একটু পরে অফিসে শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী ছাপা হয়ে চলে এল। আমাদের সহকর্মী ও বন্ধু উত্পল শুভ্রর অভ্যাস আগেভাগে পত্রিকা পড়ে ফেলা। এখনো আমি দেখছি, ও পিয়নের হাত থেকে সাময়িকী ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। আগেভাগে পড়বে। পত্রিকা বাজারে যাওয়ার আগেই।
একটু পরে এল ও। বলল, চল, চা খাই। তোর গল্পটা পড়ি নাই। পড়ব।
আমার গল্প মানে?
তোর গল্প ছাপা হচ্ছে, জাফর তোকে বলে নাই।
বলছে, কী গল্প?
এই যে…‘ছাপাখানায় একটা ভূত থাকে’/আনিসুল হক…
আমি ওর হাত থেকে পত্রিকাটা নিয়ে পড়তে লাগলাম, আমাদের বাসায় আমরা বাস করি মিনির মায়ের মতো করে। মিনির মাকে আশা করি আপনারা চিনেছেন। উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পের যে মিনি, তার মা। তার ধারণা ছিল, পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমাশ, আরশোলা-শুয়োপোকা, সাপ-বাঘ তার বাসার দিকেই ধেয়ে আসছে। আমাদের ধারণা ঠিক অতটা আন্তর্জাতিক নয়। পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে ধেয়ে না এলেও দেশের সব কুখ্যাত ভয়ঙ্কররা যে আসছে, তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। আমরা শুয়ে পড়ি রাত সাড়ে এগারোটায়, ওঠি সকাল সকাল। মেয়ের স্কুল, কর্ত্রীর অফিস।
এমনি এক বাসায় রাত সাড়ে এগারোটায় দোরঘণ্টি বেজে উঠল ভয়াবহ আর্তনাদের মতো…
আমার কপালে ঘাম জমছে। আমি তো গল্পটা জাফরের হাতে এখনো দিইনি। তাহলে?

আনিসুল হক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৪, ২০০৯

যাওয়া

বাবা বললেন, শাহিন, অন্যরা যাচ্ছে যাক, তুই কিন্তু যাবি না।
না বাবা, যাব না।
অন্যের ছেলেরাও ছেলে। অন্য বাবারাও বাবা। তবু তোর যাওয়ার দরকার নাই? তুই কী বলিস!
জি, আমিও তা-ই বলি।
আমি কিন্তু আমার কথা ভেবে কথাটা বলছি না। তোর মার কথা ভেবে বলছি। বুঝিসই তো, মেয়েমানুষ। মায়ার শরীর।
বাবা, আমি যাচ্ছি না। এত বলতে হবে না।
মানে তুই কিন্তু ভাবিস না যে আমি একজন স্বার্থপর বাবা। মোটেও আমি স্বার্থপর নই। কিন্তু তোর মাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। খালি কাঁদবে। তার কান্না ভয়াবহ। একটুও শব্দ হবে না। কিন্তু অনর্গল পানি পড়তে থাকবে। চেরাপুঞ্জি হয়ে যাবে বাড়িটা।
বাবা, তুমি কথা বলো সুন্দর।
তোর মায়ের হয়েছে কি, অনেক ছেলেমেয়ের শখ ছিল। মিনিমাম ১১টা ছেলেমেয়ে হলে সে সুখী হতো। একটা ফুটবল টিম বানাতে পারত বোধহয়। তোর একটা বড় বোন হয়েছিল রে। বাঁচল না। ও খুব কান্নাকাটি করত। বাড়ির পেছনে তার কবর দেওয়ার কথা। তোর দাদা বলল, খবরদার। গোরস্থানে দাও। এইখানে কবর দেওয়া হলে এই মহিলার কান্না জীবনেও থামবে না। তা-ই করা হলো। কিছুদিনের মধ্যেই তুই পেটে চলে এলি। ভাগ্যিস এলি। কিন্তু তোর জন্মের সময়ই ওর পেটের টিউমার কেটে ফেলে দিতে হলো। একটামাত্র ছেলে নিয়েই ওকে থাকতে হলো। এইটা ও চায়নি। অনেক ছেলেমেয়ে চেয়েছিল। বুঝলি?
জি বাবা। বুঝেছি। আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা, এটাকে কী বলে। হাতের যষ্টি, না ষষ্টি?
যষ্টিই মনে হয় বলে। শোন, আমি কিন্তু অতটা স্বার্থপর না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সবার যাওয়া উচিত। পাকিগুলোকে বোঝানো দরকার, বাঙালি কাপুরুষ না।
না বাবা। বন্ধুরা যাচ্ছে, ওরাই বুঝিয়ে দিতে পারবে। আমাকে যেতে হবে না।
আচ্ছা, তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুই ঘুমা।
বাবা, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি শোও। প্রেসারের ওষুধ খেয়েছ?
হ্যাঁ। খেয়েছি।
যাও তাহলে, শুয়ে পড়ো।
বাবা চলে গেলে শাহিন শুয়ে পড়ল। তার চোখে ঘুম নাই। সে ভাবল, মনঃসংযোগ করবে। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। এবার সে শুধু ঝিঁঝির ডাক শুনবে। অন্য সব শব্দ বাদ দিয়ে সে শুধু ঝিঁঝির শব্দে কান পাতল। তারপর সে নিজেকে বলল, শাহিন, শুধু কুকুরের ডাক। শেয়ালেরটা না। এইবার সে শুধু কুকুরের ডাক শুনছে।
দরজায় খুট করে শব্দ হলো। তার মন-শাসনে বিঘ্ন ঘটল। কে?
আমি! মার গলা। ঘুমাসনি?
না। ঘুম আসছে না।
শোন। তোর কিন্তু যুদ্ধে যাবার-টাবার দরকার নাই। বুঝছিস?
জি বুঝছি।
আসলে তোর বাবার শরীরটা তো তুই জানিসই। ব্লাড প্রেসারের রোগী। টেনশন সে একদম নিতে পারবে না। যদি সকালবেলা উঠে দেখে তোর বিছানা পড়ে আছে তুই নাই, তাহলে নির্ঘাত মাথায় রক্ত উঠে মরে যাবে।
‘না, মারা যাবে না। কারণ আমি যাচ্ছি না।’
তোর বাবার মতো নরম মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। একটা মুরগি তার সামনে জবাই করা যায় না। কী করে যে এই জগতে আছে! ঘুমা।
আচ্ছা।
শোন। তুই কিন্তু ভাবিস না আমি স্বার্থপর মা। আমি কেন স্বার্থপর হতে যাব। সব মা-ই তার ছেলেকে-মেয়েকে পেটে ধরে। অন্যদের ছেলেরা যেমন মায়ের ছেলে, তুইও তেমনি। তোকে তো আমি আটকাতে পারি না, তাই না? কিন্তু তোর বাবার কথা ভাবলে আর বলতে পারি না যে যা। তুই গেলে লোকটা বাঁচবে না। যাস না বাবা। বুঝলি?
জি, যাব না।
তোর কথায় জোর নাই। আমার হাত ধরে বল, যাবি না।
দাও, তোমার হাত কত দিন ধরা হয় না! ধরি।
বল, যাব না।
যাব না।
মা ফিরে গেলেন। বাবা জেগে। বললেন, আছে এখনো?
আছে।
জেগে আছে?
হ্যাঁ।
যাবে না। তুমি ঘুমাও।
না, যাবে কেন? তুমি ঘুমাও।
পরের দিন ভোরবেলা নামাজ পড়তে উঠলেন মা। প্রথমেই উঁকি দিলেন শাহিনের ঘরে। না যায়নি। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। গরমের মধ্যে গায়ে চাদর দেওয়ার কী হলো। অবশ্য শেষরাতে একটু বৃষ্টিমতো হয়েছে।
বাবা উঠলেন তারপর। উঁকি দিলেন ছেলের ঘরে। জানালা খোলা। আসন্ন সকালের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছেলে আছে। যায়নি।
বাবা বললেন, তোমার জন্যে ছেলেটা আমার যেতে পারল না।
মা বললেন, আমার জন্যে হবে কেন, তোমার জন্যে। ব্লাড প্রেসারটা সামলাতে পারলা না। এত মাংস খেলে কী হবে।
রোদ উঠল। মা নাশতা বানাচ্ছেন। চালের আটার রুটি। আর আখের গুড়। গরম গরম খেতে হবে•••
ছেলেকে ডাকতে হবে। তার ঘরে গেলেন। হাতে রুটিবেলা আটা। আঁচলটা যাতে হাতে না লাগে, সে জন্যে হাতটা উঁচু করে ধরা। বাবা ওঠ। বাবা।
কাঁথা সরালেন। ভেতরে একটা বালিশ আর একটা কোলবালিশ। ছেলে চলে গেছে।
মা বললেন, শাহিনের বাবা। আসো। নাশতা খাও।
শাহিন উঠল না? বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
না। অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। ঘুমাক। তুমি নাশতা খাও।
আছে তো?
আছে।
তোমার জন্যে যেতে পারল না। তোমার জন্যে। বাবা থালায় রুটি তুলে নিলেন।

আনিসুল হক
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮

Exit mobile version