Site icon BnBoi.Com

কায়না – ময়ূখ চৌধুরী

কায়না - ময়ূখ চৌধুরী

 ১. কায়না

সৈনিকের প্রথম অভিজ্ঞতা
কায়না
প্রথম পরিচ্ছেদ –রহস্যময় মৃত্যু

কায়না!

মৃত্যুগহ্বর!

হ্যাঁ, উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় ভাষা কায়না শব্দটির অর্থ-যাতনাদায়ক মৃত্যুগহ্বর!

কায়না! একবার, মাত্র একবারই ওই ভয়ানক শব্দ উচ্চারণ করেছিল স্থানীয় পুলিশ কর্মচারী, তারপরই তার মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! মি. হুইংক্লির মুখে পূর্বোক্ত ঘটনা শুনে চমকে উঠলেন পর্যটক আত্তিলিও গত্তি, কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে মৃত্যু হল?

হ্যাঁ।–উত্তর রোডেশিয়ার প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি বললেন, স্থানীয় পুলিশ জনৈক নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে তার বক্তব্য পেশ করতে উদ্যত হয়, কিন্তু কায়না শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গেসঙ্গেই তার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। ঘটনাটা হঠাৎ শুনলে খুব অদ্ভুত ও অলৌকিক মনে হয়, তবে একটু ভেবে দেখলে সমস্ত বিষয়টার একটা যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা করা সম্ভব। লোকটির হৃৎপিণ্ডের অবস্থা ভালো ছিল না, আর অনেকটা পথ সে দৌড়ে এসেছিল তাই অত্যধিক পরিশ্রম ও উত্তেজনার ফলে দুর্বল হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটা খুব অসম্ভব নয়। আমি স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে দু-বার কায়নার নাম শুনেছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও কায়না সম্বন্ধে কোনো জ্ঞাতব্য বিষয় আমার কর্ণগোচর হয়নি; কারণ সেবারেও মৃত্যু এসে অতর্কিতে বক্তার কণ্ঠরোধ করেছিল।

আত্তিলিও বললেন, প্রথমবারের ঘটনা তো শুনলাম। দ্বিতীয়বারের ঘটনাটা বলুন।

কমিশনার মি. হুইংক্লি বললেন, একটি স্থানীয় বৃদ্ধার মুখে আমি দ্বিতীয়বার ওই কথাটা শুনেছিলাম। সে আমাকে জানিয়েছিল, কায়নার ভিতর তার চার পুত্র সন্তানকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর কোনো কথা শোনার সুযোগ আমার হয়নি। কারণ ওইটুকু বলেই বৃদ্ধা চুপ করেছিল।

আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, ভয়ে চুপ করেছিল?

উত্তর এল–না। সেই মুহূর্তেই তার মৃত্যু হয়েছিল।

আত্তিলিও বৃদ্ধার মৃত্যুকে বিষপ্রয়োগে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু কমিশনার হুইংক্লি জানালেন আত্তিলিওর সন্দেহ অমূলক।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মি. হুইংক্লি, তারপর বললেন, আমার মনে হয় কায়নার কথা উল্লেখ করেছিল বলেই যে বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল তা নয়, বরং ঠিক উলটো ব্যাপারটা ঘটেছিল।

অর্থাৎ আপনি বলতে চান মৃত্যু আসন্ন বুঝেই বৃদ্ধা কায়নার বিষয়ে উল্লেখ করতে সাহস পেয়েছিল?

হ্যাঁ। স্থানীয় অধিবাসীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত সজাগ। আসন্ন মৃত্যুকে তারা অনুভব করতে পারে। অন্তিম মুহূর্তে বৃদ্ধা কায়নার রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল; দুর্ভাগ্যক্রমে তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যু তার কণ্ঠ রোধ করে।

গল্প করতে করতে পূর্বোক্ত ঘটনা দুটির বিবরণ দিচ্ছিলেন উত্তর রোডেশিয়ার প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি এবং দুই বন্ধুর পাশে বসে সাগ্রহে তার কথা শুনছিলেন আত্তিলিও গত্তি। বন্ধু দুটির নাম প্রফেসর ও বিল। বন্ধুদের সম্পূর্ণ নাম আত্তিলিও তার কাহিনির মধ্যে উল্লেখ করেননি, অতএব আমরাও তাদের প্রফেসর আর বিল নামেই ডাকব।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করেছিলেন কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আফ্রিকার জীবজন্তু ও মানুষ সম্বন্ধে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য উক্ত মহাদেশের কয়েকটি স্থানে তিনি ভ্রমণ করতে উদযোগী হয়েছিলেন। ওই কাজে তার সহায় ছিলেন পূর্বোক্ত দুই বন্ধু, প্রফেসর ও বিল। উত্তর রোডেশিয়ার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত অনেকগুলো জলাভূমি আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও এবং তার দুই বন্ধু। শুধু তাই নয়, বিস্তীর্ণ জলাভূমিগুলোর অবস্থান নির্ণয় করার উপযুক্ত একটি মানচিত্রও তারা তৈরি করে ফেলেছিলেন। স্থানীয় গভর্নর অভিযাত্রীদের সাফল্যে খুশি হয়ে তিন বন্ধুকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আহারাদির পর তারা গভর্নরের লাইব্রেরিতে এলেন কফি পান করার জন্য।

প্রফেসর হঠাৎ উত্তর রোডেশিয়ার বনভূমি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য করলেন। জলাভূমিগুলো পরিদর্শন করে ফিরে আসার সময়ে ওই অঞ্চলের গ্রানাইট পাথর দেখেই তিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন–

এমন অদ্ভুত নিসর্গ দৃশ্য আমি আফ্রিকার কোনো জায়গায় দেখিনি।

অরণ্যের পটভূমিতে অবস্থিত অসংখ্য প্রস্তরসজ্জিত গুহার দৃশ্য বিলকেও অভিভূত করে দিয়েছিল।

নৈশভোজে উপস্থিত রাজপুরুষদের মধ্যে প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি উত্তর রোডেশিয়ার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত–ওই অঞ্চলের কোনো বৈশিষ্ট্যই তার অজানা ছিল না।

মি. হুইংক্লি বললেন, কোনো শ্বেতাঙ্গ এই অঞ্চল পরিদর্শন করেননি। এখানে গাড়ি চলার রাস্তা নেই। যতদূর জানি, খনিজ দ্রব্যও পাওয়া যায় না। মাম্বোয়া নামক যে নিগ্রো জাতি এখানে বাস করে তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারা লাজুক প্রকৃতির এবং শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে আসতে অনিচ্ছুক–সরকারও তাদের ঘাঁটিয়ে অনর্থক বিপত্তির সৃষ্টি করতে চান না।

মি. হুইংক্রির কথা শুনে প্রফেসর ও বিল দুজনেই দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তারা দুজনেই উৎসাহের সঙ্গে জানালেন যে, ওই অঞ্চলের বিচিত্র নিসর্গ-দৃশ্য দেখে তাদের ধারণা হয়েছে প্রকৃতি দেবীর বহু গোপন তথ্য সেখানে লুকানো আছে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে তাদের পক্ষে সেই গোপন রহস্যগুলো আবিষ্কার করা খুব কঠিন হবে না। আত্তিলিও কোনো কথা বলেননি, সঙ্গীদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি তখন পর্যন্ত–ওই ধরনের অভিযানের সাফল্য সম্বন্ধে তাঁর দ্বিধা ছিল, তাই কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি আত্তিলিও সাহেব।

মি. হুইংক্রি হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনারা যদি মৃত্যুগহ্বর আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে একটা কাজের মতো কাজ হয় বটে!

মৃত্যুগহ্বর! সে আবার কী?

তিন বন্ধুই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

কমিশনার মি. হুইংক্লি তখন যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে–কায়না নামক এক মৃত্যুগহ্বরের কথা স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে শোনা যায় বটে, কিন্তু বাস্তব জগতে উক্ত স্থানের সত্যিই কোনো অস্তিত্ব আছে কি না সে-বিষয়ে তিনি খুব নিঃসন্দেহ নন। হয়তো সবটাই গুজব অথবা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন স্থানীয় মানুষের কল্পনার ব্যাপার। তবে পর পর দু-বার কায়না শব্দটি যে মি. হুইংক্লির শ্রুতিগোচর হয়েছিল সে-কথাও তিনি জানিয়ে দিলেন এবং তারপর পুলিশ কর্মচারী ও বৃদ্ধার মৃত্যু নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল সেই আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ এই কাহিনির শুরুতেই বলা হয়েছে।

সব কথা শুনে বিল আর প্রফেসর ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। সম্ভব হলে সেই মুহূর্তেই তারা মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে যাত্রা করতে প্রস্তুত! আত্তিলিও বন্ধুদের কথায় খুব উৎসাহ প্রকাশ না-করলেও কায়না-অভিযানে তার আপত্তি ছিল না। শেষকালে অবশ্য বিপদের গুরুত্ব বুঝে প্রফেসর ও বিল পিছিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহাযুদ্ধের সৈনিক আত্তিলিও গত্তি একবার কাজ শুরু করে পিছিয়ে আসতে রাজি হলেন না–উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বার বার তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে।

সেসব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

গভর্নরের বাড়ি থেকে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসতেই তিন বন্ধু অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করে ফেললেন। তারা জানতেন স্থানীয় সরকার তাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু সরকারের সাহায্য পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। কাজটা খুবই কঠিন। মাম্বোয়া জাতির প্রধান ব্যক্তিরা অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে বিভিন্ন উপায়ে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে এবং সেই বাধাবিপত্তি জয় করে প্রায় ৩০,০০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে শ্বাপদসংকুল অজানা স্থানে এক গোপন গুহার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যে কতখানি কঠিন, সে-কথা অন্তত আত্তিলিওর অজ্ঞাত ছিল না বিপদের গুরুত্ব বুঝেই তিনি এই অভিযান সম্পর্কে প্রথমে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু অভিযানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আত্তিলিওর মনের ভাব বদলে গেল। বাস্তব জগতে যদি সত্যিই মৃত্যুগুহার অস্তিত্ব থাকে, তবে যেমন করেই হোক ওই জায়গাটা খুঁজে বের করার, প্রতিজ্ঞা করলেন আত্তিলিও।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ত্রয়ী

কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি যে প্রথম মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষের বাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে আফ্রিকা মহাদেশ সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার জন্যই আফ্রিকা ভ্রমণে উদযোগী হয়ে উওর রোডেশিয়াতে পদার্পণ করেছিলেন, সে-কথা এই কাহিনির প্রথম পরিচ্ছেদেই বলা হয়েছে।

কিন্তু সেনাবাহিনীর মানুষটি হঠাৎ সৈনিকের ভূমিকা ত্যাগ করে পর্যটকের ভূমিকা গ্রহণ করতে উৎসুক হয়ে উঠলেন কেন সে-কথা জানতে হলে কমান্ডার সাহেবের পূর্বজীবন নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। প্রফেসর ও বিল নামে আত্তিলিওর যে দুজন বন্ধুর নাম ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সঙ্গেও বর্তমান কাহিনির পাঠকদের বিশেষ পরিচয় হওয়ার প্রয়োজন আছে।

প্রথমেই ধরা যাক আত্তিলিওর কথা, কারণ তিনি হলেন এই কাহিনির নায়ক।

সুদীর্ঘ চার বৎসর ধরে জ্বলতে জ্বলতে প্রথম মহাযুদ্ধের সর্বগ্রাসী অগ্নি যখন নির্বাণলাভের উপক্রম করছে–অর্থাৎ যুদ্ধের শেষ দিকে–হঠাৎ আহত হলেন আত্তিলিও সাহেব। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে মিশরে পাঠানো হল। আত্তিলিওর বুকে গুলি লেগেছিল; তার উপর ফ্লু রোগের আক্রমণ তাকে যক্ষ্মার কবলে ঠেলে দিল। মাত্র তেইশ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে আত্তিলিও খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসক তাকে বললেন, সাহারা মরুভূমিতে সূর্যের তাপে উত্তপ্ত বালির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকলে আত্তিলিওর অসুখ ভালো হয়ে যাবে।

আত্তিলিও ডাক্তারের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। গরম বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে তিনি বসে থাকতেন। মাত্র একমাস পরেই তিনি সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন, তাঁর দেহ রোগমুক্ত হয়েছে এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

ইতিমধ্যে বিস্তর আরব-বেদুইনের সঙ্গে তিনি ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। মরুভূমির মধ্যে একটা সজীব নরমুণ্ড দেখে তারা কৌতূহলী হয়ে ছুটে আসত এবং লুপ্ত বালুকার গর্ভে আত্তিলিওকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে খুবই আশ্চর্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাকে পর্যবেক্ষণ করত। ওই সময়ে আরবি ভাষার সঙ্গে আত্তিলিওর পরিচয় হয়।

সাহারার তপ্ত বালি আত্তিলিওর যক্ষ্মারোগ সারিয়ে দিল। গুলির আঘাতে তার দেহে যে-ক্ষত হয়েছিল, সেই ক্ষতস্থানও শুকিয়ে গেল। কিন্তু এইবার এক নতুন দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে আক্রমণ করল। যক্ষ্মার চেয়েও মারাত্মক এই রোগের নাম আফ্রিকা-জ্বর। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ আফ্রিকাকে ভালোবেসে পাগল হয়–অরণ্য, পর্বত, নদী ও মরুভূমি-সজ্জিত এই বিশাল মহাদেশ তার দ্বিপদ ও চতুষ্পদ সন্তানদের নিয়ে বিদেশি মানুষকে এমন দুর্ভেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে ধরে যে, কিছুতেই তার নিস্তার থাকে না। আফ্রিকা-জ্বরে আক্রান্ত মানুষ পৃথিবীর কোনো স্থানেই স্বস্তি পায় না–বার বার সে ঘুরে ফিরে আসে আফ্রিকার বুকে, বন্য প্রকৃতির সাহচর্য উপভোগ করার জন্য। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন বিদেশি এই আফ্রিকা-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন।

পূর্বোক্ত আফ্রিকা-জ্বর আত্তিলিও সাহেবকে আক্রমণ করেছিল। নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করার আয়োজন শুরু করলেন। উক্ত মহাদেশের বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তিনি একটি অভিযান পরিচালনা করার সংকল্প করেন এবং ওই কাজে তাকে সাহায্য করার উপযুক্ত মানুষের সন্ধান করতে থাকেন। সেই সময়ে প্রফেসরের সঙ্গে আত্তিলিও গত্তির সাক্ষাৎ হয়। আত্তিলিওর অভিযানে বিজ্ঞান-বিষয়ক যেকোনো ব্যাপারেই প্রফেসরের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হত। প্রফেসরের সম্পূর্ণ নাম উল্লেখ করেননি আত্তিলিও; তিনি ভদ্রলোককে প্রফেসর বলেই ডাকতেন, আমরাও তাই ডাকব। আত্তিলিওর লিখিত বিবরণী থেকে শুধু এইটুকু জানা যায় যে, প্রফেসর একজন ফরাসি চিকিৎসক।

এবার বিলের কথা বলছি। সংবাদপত্রে অভিযান-পরিচালনার কাজে সহকারীর জন্য যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন আত্তিলিও, সেই বিজ্ঞাপন দেখেই বিল আকৃষ্ট হয়। বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে বিল একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিল। চিঠি পড়ে আত্তিলিও জানতে পারলেন যে, বিল মোটা মাহিনায় একটি হিসাব-পরীক্ষার প্রতিষ্ঠানে কার্যে নিযুক্ত আছে এবং অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছে। হিসাবপরীক্ষা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে বিল যেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেছে, সেই অভিজ্ঞতা আত্তিলিওর কাজে লাগতে পারে বলেই বিলের বিশ্বাস এবং আত্তিলিও যদি তাকে অভিযানে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে হিসাবপরীক্ষার অফিসে মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে সে যে সাগ্রহে অভিযানে যোগ দিতে রাজি আছে, এই কথাও জানিয়ে দিয়েছে বিল লিখিত আবেদনপত্রে।

এই ধরনের বহু চিঠি আসত প্রতিদিন, কিন্তু বিলের চিঠি হঠাৎ আত্তিলিওর খুব ভালো লেগে গেল। পত্রযোগে তিনি বিলকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। প্রথম দর্শনেই তিনি বিলকে পছন্দ করলেন, কয়েক মিনিট কথা বলেই তিনি বুঝলেন, ঠিক বিলের মতো মানুষকেই তার প্রয়োজন। বিলের পূর্বজীবন সম্বন্ধে আলোচনা করে আত্তিলিও জানলেন, মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই এক দুর্ঘটনার ফলে সে পিতৃমাতৃহীন হয়েছিল। বিলের এক আত্মীয়া তাকে সন্তানস্নেহে পালন করেছিলেন, তাঁর যত্নেই বিল মানুষ হয়েছে। যে-দুর্ঘটনার ফলে বিল তার মা-বাবাকে হারিয়েছিল, সেই ঘটনার কথা সে আত্তিলিওকে বলেনি। পরে অবশ্য বলেছিল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ পরিণাম সম্বন্ধে অবহিত থাকলেও নিয়তির নিষ্ঠুর চক্রান্তকে বাধা দিতে পারেননি আত্তিলিও। যে-দুর্ঘটনার ফলে বিল প্রথমে মা এবং পরে বাবাকে হারিয়েছিল, সেই ঘটনার বিশদ বিবরণ আগে শুনলে হাতিশিকারের জন্য বিলের অস্বাভাবিক আগ্রহের কারণ অনুমান করে আত্তিলিও সাবধান হতেন, কিছুতেই তাকে আফ্রিকায় নিয়ে যেতেন না।

বিলের মা-বাবা যে অভাবিত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, নিউইয়র্কে সংঘটিত সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা হচ্ছে বাস্তব জীবনের এক ভয়াবহ নাটক; এবং সেই নাটকের রক্তরঞ্জিত শেষ দৃশ্যের যবনিকা পড়েছিল অরণ্য-আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।

যথাসময়ে সেই কাহিনি আমরা জানতে পারব।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নাম-মাহাত্ম্য

গভর্নরের বাড়ি থেকে নৈশভোজে আপ্যায়িত হয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসার পথে তিন বন্ধুর মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল এবং সেই আলোচনার ফলে তারা যে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে অভিযান চালানোর সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, সে-কথা আগেই বলেছি, এখন দেখা যাক পরবর্তী ঘটনার স্রোত তিন বন্ধুকে কোন পথে নিয়ে যায়।

কয়েকদিন পরের কথা। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে বসে আছেন তিন বন্ধু। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে রাতের খানা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল একটি ছোকরা চাকর। তিন বন্ধু লুব্ধ দৃষ্টিতে দেখলেন, ছোকরার হাতের উপর মস্ত বড়ো থালাতে ঝোলের মধ্যে শুয়ে একটা মুরগি, সর্বাঙ্গ থেকে ধূম-উদগিরণ করছে। চিকেনকারি! গরম!

তিন বন্ধুর রসনা সজল হয়ে উঠল।

হঠাৎ কী খেয়াল হল, প্রফেসর বলে উঠলেন, কায়না!

ঝনঝনাৎ! অ্যালুমিনিয়ামের থালাটা ছোকরার হাত থেকে ছিটকে পড়ল মাটির উপর!

দারুণ ক্রোধে চেঁচিয়ে ওঠার উপক্রম করলেন আত্তিলিও, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরিয়ে আসার আগেই চাকরটা তিরবেগে তাঁবুর বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আত্তিলিও তৎক্ষণাৎ চাকরদের তাঁবুর দিকে পা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছোনোর আগেই তিনি শুনতে পেলেন কয়েকটা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, পরক্ষণেই দ্রুত ধাবমান পায়ের আওয়াজ।…

তিন বন্ধু হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তারা তিনজন ছাড়া আশেপাশে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই, নিগ্রো চাকররা সবাই অদৃশ্য হয়েছে।

না, সবাই নয়, জামানি নামক জুলু জাতীয় যে রাঁধুনিটি অভিযাত্রীদের একান্ত বিশ্বাসের পাত্র ছিল, সেই লোকটি স্থান ত্যাগ করে পালায়নি। পলাতক পাঁচটি চাকরই ছিল উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় অধিবাসী। প্রফেসরের মুখে কায়না শব্দটি শোনার সঙ্গেসঙ্গেই ছোকরা চাকর সকলের কাছে সেই সংবাদ বিতরণ করেছে এবং তার ফলেই বিহ্বল হয়ে মানুষগুলো যে গা-ঢাকা দিয়েছে, এ-বিষয়ে অভিযাত্রীদের কোনো সন্দেহ ছিল না।

রাতের লোভনীয় খাদ্য মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে, চাকররা উধাও হয়েছে জিনিসপত্র ফেলে, তিন বন্ধুর চোখ-মুখ কিন্তু আনন্দে উজ্জ্বল। একটা স্পষ্ট সত্য তারা বুঝতে পেরেছেন : ভৃত্যদের দারুণ আতঙ্ক প্রমাণ করেছে মৃত্যুগহ্বর অলীক কল্পনা নয়। বাস্তব জগতেই বিরাজ করছে ওই ভয়-দেখানো ভয়ানক কায়না।

শুকনো খাদ্যের টিন খুলতে খুলতে অভিযাত্রীরা প্রতিজ্ঞা করলেন, কায়না নামের ওই বিভীষিকাকে যেমন করেই হোক তারা আবিষ্কার করবেন।

প্রতিজ্ঞা করা সহজ, প্রতিজ্ঞা রাখা সহজ নয়।

উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় মানুষ মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের এড়িয়ে চলতে লাগল। মাম্বোয়া জাতির কোনো লোকের কাছে পথের সন্ধান চাইলে সে ভুল পথের নির্দেশ দিত, কাজ করতে বললে পলায়ন করত ঊধ্বশ্বাসে। চারদিক থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত তিন বন্ধুর কানে, এখানে-ওখানে চোখে পড়ত শূন্যে ভাসমান ধোঁয়ার কুণ্ডলী মাম্বোয়াদের সংকেত।

অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য এখন আর মাম্বোয়াদের অজানা নয়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ভেসে যায় ধোঁয়ার অক্ষরে লেখা কুণ্ডলীপাকানো দুর্বোধ্য সতর্কবাণী–সাবধান! সাদা মানুষ এসেছে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে।

ঢাকের আওয়াজ ও ধোঁয়ার সাংকেতিক অর্থ সঠিকভাবে বোধগম্য না হলেও মাম্বোয়াদের মনোভাব অভিযাত্রীরা বুঝতে পেরেছিলেন।

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেও জনপ্রাণীর সাক্ষাৎ পেলেন না তিনবন্ধু। অভিযাত্রীদের আগমন-সংবাদ আগেই পেয়ে যেত গ্রামবাসীরা এবং সঙ্গেসঙ্গে তারা যে স্থান ত্যাগ করত সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই! অভিযাত্রীরা বুঝলেন, মাম্বোয়া-জাতি তাদের বয়কট করছে!

অবশেষে তারা জেলা-কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বললেন। কমিশনার তাঁদের কথা শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন এবং সক্রিয়ভাবে অভিযাত্রীদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু মাম্বোয়াদের মধ্যে যারা কমিশনারের একান্ত অনুগত ছিল, তারাও তাঁর কথায় অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিতে রাজি হল না। অবশেষে চারজন মাম্বোয়া বন্দি অভিযাত্রীদের দলে কাজ করতে সম্মত হল। তারা বোধ হয় ভেবেছিল, দিনের পর দিন বন্দি অবস্থায় গাধার খাটুনি না-খেটে (ওই সময়ে একটা রাস্তা তৈরির কাজে তারা নিযুক্ত ছিল) যদি পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছু অর্থ উপার্জন করা যায়, তাহলে ক্ষতি কী? তা ছাড়া, ভালোভাবে কাজ করলে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জেলা কমিশনার। অতএব বন্দি চারজন মহা উৎসাহে অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিল।

ইতিমধ্যে কমিশনার সাহেবের সঙ্গে অভিযাত্রীদের দস্তুর মতো বন্ধুত্ব পেয়ে গেছে। কমিশনার বেশ বুদ্ধিমান মানুষ, তিনি রটিয়ে দিলেন গুহাবাসী জন্তুজানোয়ার দেখার জন্যই অভিযাত্রীরা এই অঞ্চলে পদার্পণ করেছেন। ধাপ্পায় কাজ হল; মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের সঙ্গে কিছুটা সহজভাবে মেলামেশা শুরু করল। তিন বন্ধু এবার সাবধান হয়েছেন। কায়নার নাম-মাহাত্ম্য যে বিপত্তির সূচনা করেছিল, তা এত শীঘ্র ভুলে যাওয়ার কথা নয়–কেউ আর কায়নার নাম মুখে আনতেন না।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – গুহাতে মৃত্যুর হানা

কায়না-অভিযান ভালোভাবে চালানোর জন্য একটা মানচিত্রের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উক্ত বস্তুটিকে কোথাও পাওয়া গেল না বলে অভিযাত্রীরা ঠিক করলেন, তারা নিজেরাই এলাকাটা পরিদর্শন করে একটা চলনসই মানচিত্রের খসড়া তৈরি করে নেবেন।

কাজটা দু-চার দিনের মধ্যে হওয়ার নয়, বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই যে কয়দিন ওটা তৈরি না হয়, সেই কয়দিনের জন্য একটা স্থায়ী আস্তানার প্রয়োজন। অতএব স্থায়ীভাবে একটা তাবু খাটানো হল। তবুটা যেখানে পাতা হয়েছিল সেই জায়গাটার চারিদিকে পড়েছিল অজস্র গ্রানাইট পাথর। সমস্ত অঞ্চলটা যেন গ্রানাইট পাথরের রাজত্ব–যেদিকে চোখ যায় খালি পাথর আর পাথর।

একটা তাবু খাঁটিয়েই কাজ শেষ হল না। জিনিসপত্র সাজসরঞ্জাম মজুত করার জন্য কয়েকটা কুঁড়েঘর তোলা দরকার। কিন্তু শক্ত পাথুরে-মাটির ওপর খুঁটি পুঁতে ঘর তোলা কি দু-চারজনের কাজ? তা ছাড়া বাক্স-বন্দি অজস্র সাজসরঞ্জাম বহন করার জন্যও তো কিছু লোকের দরকার। খুঁটিনাটি আরও যেসব কাজ ছিল তার জন্যও লোক চাই, অর্থাৎ বেশ কিছু জনমজুর না হলে অভিযাত্রীদের আর চলছে না।

তিন বন্ধুর সঙ্গে যে চারজন মাদোয়া-বন্দি কাজ করার জন্য এসেছিল, তাদের, এবার পদোন্নতি ঘটল। খাটুনির কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে আত্তিলিও তাদের জনমজুর সংগ্রহ করার কাজে নিযুক্ত করলেন তারা হয়ে গেল রিক্রুটিং অফিসার!

কাজটা তাদের খুব পছন্দ হয়েছিল; ওই কাজে তারা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিল। মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক এবং নানারকম উপহার পেয়ে মাম্বোয়ারা ভারি খুশি; সেই সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই লুব্ধ জনতার স্রোত এমনভাবে বাড়তে লাগল যে মাসখানেক পরেই অভিযাত্রীরা দেখলেন লোকের অভাবে বিপন্ন হওয়ার কোনো কারণ আর নেই।

মাম্বোয়ারা খুব মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। মাম্বায়া সর্দার অভিযাত্রীদের জানাল, তার প্রজাদের মধ্যে চারজনকে তারা বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছেন বলে সে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং সবরকমে তাদের সাহায্য করতে সে প্রস্তুত। বন্দি চারজন স্থানীয় মানুষ, অন্তত শতাধিক গুহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল, তবু যদি প্রয়োজন হয় সর্দার নিজে তাদের সাহায্য করবে–অবশ্য যদি তারা সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করেন।

খুব ভালো কথা। খুব আনন্দের কথা। বিল ও প্রফেসর মাম্বোয়া-সর্দারের কথায় ও ব্যবহারে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কিন্তু আত্তিলিওর মনে খটকা লাগল–হঠাৎ মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের সাহায্য করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠল কেন? এটা অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ নয় তো? আত্তিলিও বন্ধুদের কাছে তার সন্দেহ প্রকাশ করলেন না, মনের কথা মনেই চেপে রাখলেন।

অভিযানের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে চালানোর জন্য অভিযাত্রীরা পরামর্শ করতে বসলেন। পরামর্শের ফলে স্থির হল, প্রত্যেক দিন তিন বন্ধু তিন দিকে যাবেন। বন্দি মাম্বোয়া চারজনের মধ্যে দুজন যাবে প্রফেসরের সঙ্গে, দুজন যাবে বিলের সঙ্গে এবং জামানি নামক জুলু-অনুচরটি থাকবে আত্তিলিওর সঙ্গে। পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি দল হবে তিনটি ভিন্ন পথের পথিক।

অল্প সময়ের মধ্যে একটা বৃহৎ এলাকা পরিদর্শন করার পক্ষে ওই পরিকল্পনা খুবই উপযোগী ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভাবতে গেলে বলতে হয় পরিকল্পনাটা ছিল অতিশয় মারাত্মক। কারণ, গুহার মধ্যে প্রবেশ করে অভিযাত্রীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো হিংস্র জন্তুর সম্মুখীন হন, তবে সম্পূর্ণ এককভাবেই তাকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হবে। নিগ্রোদের মধ্যে কেউ গুহার ভিতর প্রবেশ করতে চাইবে না–তারা অপেক্ষা করবে গুহার বাইরে এবং গুহার ভিতর থেকে আচম্বিতে শ্বাপদকণ্ঠের হিংস্র গর্জন কানে এলে তারা যে পদযুগলের দ্রুত ব্যবহার না-করে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা আছে কি? নিগ্রোরা স্থানীয় মানুষ, খুব সহজেই পথ চিনে তারা তাবুতে ফিরে আসতে পারবে, কিন্তু বিদেশি অভিযাত্রী শ্বাপদের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলেও গুহার বাইরে এসে নিগ্রোদের দেখা না-পেলে আবার বিপদে পড়বেন–ছোটো বড়ো অসংখ্য গ্রানাইট পাথরের দুর্গ, সুড়ঙ্গ আর গোলকধাঁধা ভেদ করে তার পক্ষে সঠিক পথের নিশানা ধরে তাবুতে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব।

এইসব বিপদের সম্ভাবনা তুচ্ছ করেই অভিযাত্রীরা অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিপদ যে হয়নি তা নয়, হয়েছিল। জামানি এবং মাম্বোয়া পথপ্রদর্শকেরা সকলেই গুহার সান্নিধ্য অপছন্দ করত। পথ দেখিয়ে গুহার সামনে নিয়ে যেতে তাদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু গুহার প্রবেশপথ থেকে প্রায় ফুট পঞ্চাশ দূরে এসেই তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত, কিছুতেই আর অগ্রসর হতে চাইত না। তাদের দোষ নেই; কয়েকদিনের ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে তাদের ভয় পাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ ছিল।

একটা অজানা গুহার মধ্যে একদিন হঠাৎ বিলের সঙ্গে একটা হায়নার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। বিল গুলি ছুড়ল–গুহার অস্পষ্ট অন্ধকারে তার নিশানা ভালো হয়নি–ফলে জটা মরল না। আহত হল। দ্বিতীয়বার গুলি চালিয়ে হায়নাটাকে হত্যা করার আগে জটা বিলের হাঁটুতে একবার নখের আঁচড় বসিয়েছিল। বিল ক্ষতটার দিকে নজর দেয়নি। হায়না মেরে সে গুহার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল এবং তারপরেও ক্ষতচিহ্নটাকে সামান্য আঘাত বলে তুচ্ছ করেছিল। তাচ্ছিল্যের পরিণাম বিলের পক্ষে ভালো হয়নি। সেইদিনই সন্ধ্যার সময়ে তার ক্ষতটা এমন ভীষণভাবে বিষিয়ে উঠল যে আত্তিলিও ভাবলেন বিলকে বাঁচানোর জন্য ওই পা-টিকে হয়তো কেটে ফেলতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই বিল সেযাত্রা আরোগ্য লাভ করতে সমর্থ হয়।

আর একবার ভারসাম্য হারিয়ে প্রফেসর হঠাৎ পড়ে গেলেন একটা শুকনো গাছের ডালপালার মধ্যে। ডালগুলোতে পাতা ছিল না একটিও। কিন্তু কাটা ছিল প্রচুর পরিমাণে। কাটার আঘাতে প্রফেসরের জামাকাপড় হল ছিন্নভিন্ন, দেহের চামড়ায় হল একাধিক ছিদ্রের সৃষ্টি এবং ওই ছিদ্রপথে কাটার বিষ প্রফেসরের রক্তে ঢুকে তাকে শয্যাশায়ী করে দিল। কাটার মধ্যে কী ধরনের বিষ ছিল ভগবানই জানেন–ঝাড়া দশদিন ধরে প্রফেসর ভুগলেন প্রচণ্ড জ্বরের আক্রমণে।

জ্বরের কবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে একটু সুস্থ হয়েই প্রফেসর আবার মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। এবার আর কাটা নয়, দু-দুটো সিংহের সঙ্গে প্রফেসরের দেখা হল একটা অজানা গুহার মধ্যে। প্রফেসর গুলি ছুড়লেন, গুলি লাগল না। সিংহরা আক্রমণের চেষ্টা না-করে বিদ্যুদবেগে গুহার বাইরে অদৃশ্য হলরাইফেলের গর্জিত অগ্নিশিখা তাদের মোটেই পছন্দ হয়নি। প্রায় অন্ধকার গুহার ভিতর দু-দুটো সিংহের মারাত্মক সান্নিধ্য থেকে অক্ষত অবস্থায় পরিত্রাণ পেয়ে খুশি হয়ে প্রফেসর বাইরে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু তার মাম্বোয়া সঙ্গীদের তিনি দেখতে পেলেন না। প্রফেসর বুঝলেন হয় তারা সিংহের কবলে পড়েছে, আর না হয় সিংহদের দেখে গা ঢাকা দিয়েছে। শেষোক্ত সন্দেহই সত্যি, সিংহদের দেখে তারা দৌড়ে পালিয়েছিল। প্রফেসর যদি বুদ্ধিমানের মতো গুহার সামনে অপেক্ষা করতেন তাহলে তিনি অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতেন। কারণ, মাধোয়ারা তাবু থেকে আত্তিলিওকে নিয়ে অকুস্থলে ফিরে এসেছিল। প্রফেসরকে অবশ্য সেখানে পাওয়া যায়নি। মাম্বোয়াদের না দেখতে পেয়ে প্রফেসর নিজেই তাবুতে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলেন এবং দিশাহারা হয়ে গন্তব্যস্থলের বিপরীত দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে মাম্বোয়াদের সাহায্যে আত্তিলিও যখন আড়াই দিন পরে প্রফেসরকে আবিষ্কার করলেন, তখন ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং জ্বরের আক্রমণে ভদ্রলোকের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়।

আমাদের কাহিনির নায়ক স্বয়ং আত্তিলিও সাহেবও সঙ্গীদের মতোই গুহার ভিতর বিপন্ন হয়েছিলেন।

সিংহ নয়, হায়না নয়, একটি ছোটো গোলাকার মাংসপিণ্ডের রোমশ শরীরের উপর হোঁচট খেয়ে আত্তিলিও প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। একদিন বিকেল বেলা আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর জামানি তাকে একটা সুড়ঙ্গের সামনে এনে জানাল ওটা একটা গুহার প্রবেশপথ। পথটা ছিল নীচু, খুবই সংকীর্ণ। অতি কষ্টে ভিতরে প্রবেশ করলেন আত্তিলিও, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। অনেকক্ষণ ওইভাবে চলার পর তার মনে হল এতক্ষণে বোধ হয় তিনি সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে গুহার ভিতর পৌঁছেছেন। হাতের টর্চ জ্বেলে তিনি দেখলেন তার অনুমান সত্য–বিজলিবাতির ক্ষীণ আলোকধারা হারিয়ে গেছে এক অন্ধকার-আচ্ছন্ন গুহার বিপুল বিস্তৃতির মধ্যে। ওই বিশাল গুহার অভ্যন্তরে পদার্পণ করলে প্রস্তরবেষ্টিত গলিপথগুলোর ভিতর পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে, অতএব ভিতর দিকে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ হবে কি না ভাবতে লাগলেন আত্তিলিও এবং ভাবতে ভাবতেই হামাগুড়ি-দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পায়ের উপর সেই বস্তুটির অস্তিত্ব অনুভব করলেন! সঙ্গেসঙ্গে গুহার শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল একটা শব্দ ফাসস! পরক্ষণেই জুতোর চামড়ার উপর ধারালো বস্তুর সংঘাতের শব্দ!

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – জ্ঞান হারালেন আত্তিলিও

টর্চের আলোটা তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে পায়ের উপর ফেলে আত্তিলিও দেখলেন, তার জুতোর সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে হলুদের উপর কালো কালো ছাপ-বসানো একটা রোমশ ফুটবল! সেই অতিজীবন্ত ও অতি ক্রুদ্ধ ফুটবলের মতো গোলাকার বস্তুটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে মার্জারকণ্ঠের গর্জনধ্বনি, সঙ্গেসঙ্গে জুতোর উপর ধারালো নখের আঁচড় কাটার শব্দ।

লেপার্ডের বাচ্চা! বিড়াল জাতীয় জীবের স্বভাব অনুযায়ী বাচ্চাটা সমস্ত দেহটাকে গোল করে পাকিয়ে আত্তিলিওর জুতোটাকে চেপে ধরেছে এবং তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে মোটা হান্টিং বুট-এর চামড়া!

বাচ্চাটার চেষ্টা সফল হত কি না বলা মুশকিল, কিন্তু আত্তিলিও তাকে সেই সুযোগ দিলেন না। সজোরে লাথি মেরে বাচ্চাটাকে তিনি দূরে সরিয়ে দিলেন। জন্তুটার ছিটকে পড়ার আওয়াজ, শোনা গেল। অন্ধকার গুহার গর্ভে শ্বাপদ-শিশুর ছোটো শরীরটা আত্তিলিওর দৃষ্টিগোচর হল না, কিন্তু রুষ্ট প্রতিবাদ ভেসে এল তার কানে–ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে বাচ্চাটা তার বিরক্তি ও ক্রোধ জানিয়ে দিচ্ছে!

আচম্বিতে সেই শব্দে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠল আরও অনেকগুলো বাচ্চা লেপার্ড : ফ্যাঁস, ফ্যাঁস, ফ্যাঁসস…।

অন্ধকারের ভিতর শ্বাপদ শিশুদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না আত্তিলিও, কেবল তাদের ক্রুদ্ধ বিড়ালের মতো গর্জনধ্বনি তার কানে ভেসে আসতে লাগল।

আত্তিলিও ভয় পেলেন।

অনেকটা লেপার্ডের মতো দেখতে চিতা নামক যে-জন্তুটি আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করে, সেই চিতার বাচ্চা দেখলে তিনি ভয় পেতেন না; কিন্তু আত্তিলিওর অভিজ্ঞ চক্ষু ভুল করেনি, জন্তুটা চিতার বাচ্চা নয়, লেপার্ড-শিশুই বটে। চিতা ভীরু জানোয়ার, লেপার্ড হিংস্র ও ভয়ংকর। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো লেপার্ড মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক, বিশেষ করে বাচ্চার বিপদের আশঙ্কায় অন্ধকার গুহার ভিতর ক্ষিপ্ত লেপার্ড-জননীর আক্রমণ যে কতখানি মারাত্মক হতে পারে, সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিওর মতো দুঃসাহসী মানুষও ভয় পেয়েছিলেন।

তিনি বুঝেছিলেন, দিনের বেলা অন্ধকার গুহার আশ্রয় ছেড়ে বাচ্চাদের মা বড়ো লেপার্ডটা বাইরে বেড়াতে যাবে না–সে নিশ্চয়ই গুহার ভিতরে কোথাও অবস্থান করছে এবং বাচ্চাদের নিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্যে যে দ্বিপদ জন্তুটি তার আস্তানায় অনধিকার প্রবেশ করেছে, তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আত্তিলিও বাচ্চাদের মা বড়ো লেপার্ডটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু অন্ধকারে অভ্যস্ত একজোড়া শ্বাপদচক্ষু যে তার গতিবিধি লক্ষ করছে, সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিও অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিলেন।

বাচ্চাগুলো ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে এতক্ষণ ক্রোধ প্রকাশ করছিল, হঠাৎ তারা একসঙ্গে চুপ করে গেল। আত্তিলিওর অনুমান এইবার নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হল : বাচ্চাদের আকস্মিক নীরবতা বড়ো লেপার্ডটার সান্নিধ্য প্রমাণ করে দিয়েছে।

পালাতে পারলে আত্তিলিও পালিয়েই যেতেন। কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময়ে আক্রান্ত হলে অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ করতে হবে, আত্মরক্ষার চেষ্টা করাও সম্ভব হবে না। অতএব পলায়নের চিন্তা ছেড়ে গুহার ভিতর দাঁড়িয়ে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তিনি প্রস্তুত হলেন। গুহার দেয়ালে পিঠ রেখে আত্তিলিও টর্চের আলো ঘুরিয়ে বড়ো লেপার্ডটাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

হঠাৎ তার মাংসপেশিগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেল–দুটো বিরাট পাথরের মাঝখানে টর্চের আলোকধারার মধ্যে ভেসে উঠেছে একজোড়া বৃহৎ নিস্পলক চক্ষু!

চোখ দুটো গোল, সবুজ এবং জ্বলন্ত!

মা-লেপার্ড!

বিপদের মুখোমুখি হতেই বিপদের ভয় কেটে গেল। আত্তিলিওর কম্পিত হাত দুটো হঠাৎ সৈনিকের অভ্যস্ত দৃঢ়তায় রাইফেল ও টর্চ আঁকড়ে ধরল, টর্চের আলোতে জ্বলন্ত চোখ দুটির উপর নিশানা স্থির করতে লাগলেন আত্তিলিও।

লেপার্ড লাফ দিল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটল রাইফেলের গুলি। গুলি লাগল, কিন্তু শ্বাপদের গতি রুদ্ধ হল না। সশব্দে লেপার্ড এসে আছড়ে পড়ল গুহার প্রস্তর-প্রাচীরের উপর। শ্বাপদের নিশানা ভুল হয়নি, কিন্তু আত্তিলিও স্থান পরিবর্তন করেছেন বিদ্যুদ্‌বেগে। লেপার্ড দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার আগেই আবার গর্জে উঠল রাইফেল, গুলি জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল।

তীব্র উত্তেজনা কেটে যেতেই আত্তিলিও ক্লান্তি বোধ করলেন। কিন্তু ওই বিপজ্জনক গুহার মধ্যে বিশ্রাম করার ইচ্ছা তার ছিল না। সুড়ঙ্গের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি দ্রুতবেগে হামাগুড়ি দিতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই গুহার বাইরে এসে প্রখর সূর্যালোকের নীচে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

জীবনে সর্বপ্রথম জামানি তার প্রভুর আদেশ অমান্য করল। সে কিছুতেই মৃত লেপার্ডের দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে রাজি হল না।

না, মাসাংগা, না,–জামানি বলল, এই জন্তুটার চামড়া আমি ছাড়াতে পারব না। এটা লেপার্ড নয়, এটা হচ্ছে লেপার্ডের দেহধারী প্রেতাত্মা! ওটার চামড়া ছাড়িয়ে নিলেই প্রেত ওই দেহ থেকে বেরিয়ে আমাকে আক্রমণ করবে। মাসাংগা! এই দেশটা ভালো নয়, আমাদের এখনই এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।

আত্তিলিও অবশ্য জামানির উপদেশে কর্ণপাত করেননি। মাঙ্গেয়াদের সন্দেহ চলে গেছে, অভিযাত্রীরা এখন তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। এই হচ্ছে অনুসন্ধান-কার্য চালানোর উপযুক্ত সময়, এখন কি ফিরে যাওয়া যায়? মাম্বোয়াদের এখন ধারণা হয়েছে, অভিযাত্রীরা কেবল গুহার ভিতর জন্তুজানোয়ার দেখার জন্যই এখানে এসেছেন। এটা অবশ্য তাদের কাছে পাগলামি, তবে এই ধরনের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতে তাদের আপত্তি নেই। সাদা মানুষরা যদি গুহার মধ্যে ঢুকে জন্তুজানোয়ারের আঁচড়-কামড় খেতে চায় এবং সেই কাজে সাহায্য করলে যদি টাকাপয়সা, সিগারেট আর নানারকম উপহার পাওয়া যায়, তাহলে তাদের সাহায্য করতে আপত্তি কী? তবে হ্যাঁ, কায়নার কথা না-বললেই হয়।

অবশ্য অভিযাত্রীরা কায়নার নাম আর ভুলেও উচ্চারণ করতেন না।

একদিন হঠাৎ দুটি মাম্বোয়ার কথা আত্তিলিওর কানে এল। আত্তিলিও ছিলেন তাঁবুর ভিতরে, মাম্বোয়ারা তাকে দেখতে পায়নি। তিনি শুনলেন একজন মাম্বোয়া বলছে, খুব সম্ভব যে পাঁচটা ছেলে আগে সাদা মানুষের কাজ করত, তারা ভুল করেছে। বোধ হয় ওরা সাদা মানুষের কথা বুঝতে পারেনি।

তার সঙ্গী বলল, হতে পারে। কিংবা হয়তো ওটা ছিল সাদা মানুষের ক্ষণিকের খেয়ালমাত্র। তবে সেই খেয়াল কেটে গেছে, আমরা এখন যেদিকে যেতে বলি ওরা সেইদিকেই যায়। ওরা যেদিকে গেলে আমাদের মাতব্বররা বিপদ হবে বলে মনে করে, সেদিকে ওরা কখনোই পা বাড়ায় না।

আত্তিলিওর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। মাম্বোয়াদের বিশ্বাস অভিযাত্রীরা মৃত্যুগহ্বর নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। মানচিত্রটা নিয়ে আত্তিলিও দাগ দিতে লাগলেন। তার পরিকল্পনা ছিল খুবই সহজ।

মাম্বোয়ারা নিশ্চয়ই কায়নার ধারেকাছে অভিযাত্রীদের উপস্থিতি চাইবে না, অতএব মৃত্যুগহ্বর যেখানে অবস্থান করছে তার থেকে দূরে দূরেই মাথোয়ারা তাদের পরিচিত করার চেষ্টা করবে। যে জায়গাগুলো একবার দেখা হয়ে যায়, ম্যাপের গায়ে সেই জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে রাখতেন অভিযাত্রীরা। ম্যাপটাতে দাগ দিতে দিতে এক সময় তারা নিশ্চয় দেখতে পাবেন, কোন এলাকাটা বাদ দেওয়া হচ্ছে। একবার যদি তাদের চোখে ধরা পড়ে, একটা নির্দিষ্ট এলাকা মাম্বোয়ারা এড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে সেই অঞ্চলটায় অভিযান চালালেই মৃত্যুগহ্বরের সন্ধান পাওয়া যাবে।

কিন্তু হা, এখানে একটা কিন্তু আছে।

যেসব এলাকায় যাওয়া হয়েছে, ম্যাপের গায়ে সেই এলাকাগুলিকে ফুটকির দাগ বসিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে; এখন পেনসিলের লাইন টেনে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন জায়গা ম্যাপের উপর চক্রাকারে ছড়িয়ে আছে, অর্থাৎ সেইসব স্থানে এখন পর্যন্ত অভিযাত্রীদের পায়ের ধুলো পড়েনি। কিন্তু সেই ছোটো ছোটো টুকরো টুকরো অনাবিষ্কৃত এলাকার পরিধি বড়ো কম নয়। এইভাবে আর কতদিন অভিযান চালানো সম্ভব? ইতিমধ্যেই অভিযাত্রীরা বেশ কয়েকবার বিপদে পড়েছেন। অজানা গুহার অন্ধকারে অনিশ্চিত প্রত্যাশায় দিনের পর দিন জীবন বিপন্ন করা কি বুদ্ধিমানের কাজ? তিন মাস তো হয়ে গেল, আর কত দিন?

অতএব পরামর্শ সভা বসল।

প্রফেসর এবং বিল অভিযান চালানোর বিপক্ষে রায় দিলেন। প্রফেসরের বক্তব্য হচ্ছে : তিন মাস অনুসন্ধান চালিয়ে এক-শো উনত্রিশটা গুহার ভিতর তারা পদার্পণ করেছেন, কিন্তু মৃত্যুগহ্বর এখন পর্যন্ত তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। কায়নার অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রফেসর মোটেই নিঃসন্দেহ নন। তিনি আরও জানালেন এই অঞ্চলের বিভিন্ন গুহার মধ্যে প্রাচীন গুহামানবের বসবাসের নিদর্শন এবং বিবিধ প্রকার খনিজবস্তুর অস্তিত্ব তাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিয়েছে। অথচ এইসব দিকে চোখ না-দিয়ে অর্থ আর সময়ের অপব্যয় করা হচ্ছে এক অলীক বস্তুর পিছনে! অতএব এই অভিযান এখনই বন্ধ করা উচিত।

বিলও প্রফেসরকে সমর্থন জানাল, দুজনেরই মত হচ্ছে : চুলোয় যাক কায়না। মরীচিৎকার পিছনে ছুটে এসে অনেক বস্তুর সান্নিধ্য আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি, যেগুলো প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাণীবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিরাট আবিষ্কার বলে গণ্য হতে পারে।

অকাট্য যুক্তি। তবু আত্তিলিও বন্ধুদের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। আত্তিলিও শেষ চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমি স্বকর্ণে শুনেছি একজন মাম্বোয়ার কথা। লোকটা তার সঙ্গীকে বলছিল আমরা নাকি কখনোই সেদিকে যাইনি যেদিকে আমাদের গতিবিধি মাম্বোয়া-প্রধানরা পছন্দ করে না।

বিল বলল, খুব সম্ভব আমাদের অজ্ঞাতে কায়নার সামনে দিয়ে আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আসল জায়গাটা ছাড়িয়ে মাম্বোয়াদের সঙ্গে আমরা অন্যদিকের গুহায় গুহায় ঘুরেছি। এই দশ বছর ধরে ঘোরাঘুরি করলেও আমরা মৃত্যুগহ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারব না।

ঠিক আছে–আত্তিলিও বললেন, যেসব গুহাতে খনিজদ্রব্য বা ঐতিহাসিক বস্তুর নিদর্শন আছে বলে মনে হয়, তোমরা সেইসব গুহাতে সন্ধান চালিয়ে আবিষ্কারের সম্মান লাভ কর তোমাদের আমি কায়নার পিছনে সময় নষ্ট করতে বলব না। সঙ্গে যত খুশি লোক নাও, তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এতদিন ধরে এত কষ্ট সহ্য করার পর এত তাড়াতাড়ি আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। অন্তত আরও একমাস আমি দেখব। নির্দিষ্ট একমাসের মধ্যে যদি কোনো ফল না-পাই, তাহলে কথা দিচ্ছি আমি কায়না অভিযানে ইস্তফা দেব।

আত্তিলিওর প্রস্তাবে কারো আপত্তি হল না। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।

পরের দিন ১৫ সেপ্টেম্বর স্বয়ং মাম্বোয়া-সর্দার আত্তিলিও সাহেবের সঙ্গী হল। ইতিপূর্বে সর্দার তাদের উপদেশ, নির্দেশ দিয়েছে, কোথায় কোন পথে গেলে নূতন নূতন গুহার সন্ধান পাওয়া যাবে জানিয়েছে, কিন্তু সে ব্যক্তিগতভাবে কখনো অভিযাত্রীদের সঙ্গী হয়নি। খুব সম্ভব সে বুঝেছিল, অভিযাত্রীরা শীঘ্রই তাদের দেশ ছেড়ে বিদায় নেবেন।

সর্দারের সঙ্গে কয়েকজন মাম্বোয়া অনুচর ছিল। তারা সকলেই বিভিন্ন গুহার সন্ধান দিয়ে আত্তিলিওকে সাহায্য করতে চাইল। উৎসাহের আধিক্যে আত্তিলিও সেদিন তেরোটা নূতন গুহা পরিদর্শন করে ফেললেন। একদিনে এতগুলো গুহা অভিযাত্রীদের মধ্যে কেউ ইতিপূর্বে পরিদর্শন করতে পারেননি। চোদ্দো নম্বর গুহাটার মুখে যখন আত্তিলিও পদার্পণ করলেন তখন সন্ধ্যা প্রায় আগত, অস্পষ্ট অন্ধকারের প্রলেপ পড়েছে পৃথিবীর বুকে।

আত্তিলিও চোদ্দো নম্বর গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। সঙ্গীরা গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

গুহার মধ্যে তখন অস্পষ্ট অন্ধকার।

আত্তিলিও চমকে দেখলেন, আবছা আলো-আঁধারের ভিতর থেকে তার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক বিরাট সৰ্পৰ্দানব পাইথন!

এত মোটা আর এত লম্বা সাপ কখনো দেখেননি আত্তিলিও। চকিতে রাইফেল তুলে তিনি গুলি চালালেন। পাইথনের মাথা উড়ে গেল ছিন্নভিন্ন হয়ে, কিন্তু তার মুণ্ডহীন বিরাট শরীরটা মৃত্যুযাতনায় আত্তিলিওর চারপাশে আছড়ে পড়তে লাগল একটা অতিকায় চাবুকের মতো!

আত্তিলিও অনায়াসে ছুটে পালাতে পারতেন, কিন্তু তার বুদ্ধিভ্রংশ হল। সেইখানে দাঁড়িয়েই তিনি বার বার গুলি চালিয়ে সরীসৃপের অন্তিম আস্ফালনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। অজগর-জাতীয় বৃহৎ সরীসৃপের দেহ মৃত্যুর পরেও বেশ কিছুক্ষণ অন্ধ আক্ষেপে কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী পাকিয়ে ছটফট করতে থাকে। এই সাপটাও ছিল বিরাট–তার চামড়া ছাড়িয়ে পরে যখন মাপ নেওয়া হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল পাইথনটার দৈর্ঘ্য হচ্ছে আটত্রিশ ফুট এবং দেহের সবচেয়ে স্থূল জায়গাটার মাপ হচ্ছে তিন ফুট নয় ইঞ্চি!

এত মোটা, এত লম্বা একটা সর্পিল দেহ যদি চাবুকের মতো সজোরে কোনো মানুষের গায়ে আছড়ে পড়ে, তাহলে মানুষটার যে অবস্থা হয়, আত্তিলিও সাহেবেরও সেই অবস্থা হল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে ক্ষণিকের জন্য তিনি অনুভব করলেন একটা মস্ত পাহাড় যেন তার দেহের উপর ভেঙে পড়ছে! পরক্ষণেই তাঁর চৈতন্যকে লুপ্ত করে নামল মূর্ছার অন্ধকার…

.

যষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পথের নিশানা

জ্ঞান ফিরে এলে আত্তিলিও দেখলেন, তিনি তাঁবুর মধ্যে তাঁর নিজস্ব বিছানাতে শুয়ে আছেন এবং তার কপালে কাপড় ভিজিয়ে ঠান্ডা জলের প্রলেপ দিচ্ছে জামানি।

ক্লান্তিজড়িত স্বরে প্রফেসর আর বিলকে ডেকে দিতে বললেন আত্তিলিও। তাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে মহা খুশি জামানি। একগাল হেসে সে জানাল, তারা দুজনেই বাইরে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু মাসাংগার কথা বলা উচিত নয়।

আত্তিলিওর সমস্ত সত্তা আবার ডুবে গেল গভীর নিদ্রার অন্ধকারে…

দ্বিতীয়বার চোখ মেলে আত্তিলিও দেখলেন, তার মাথার কাছে একটা আলো জ্বলছে, বন্ধুরাও কাছেই আছে। প্রফেসর আত্তিলিওকে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, আত্তিলিও যদি কথা বলার চেষ্টা না-করে তবে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে তার আপত্তি নেই। অজ্ঞান হওয়ার কারণটা প্রফেসরের মুখ থেকেই শুনলেন আত্তিলিও–সর্পদানবের দেহের প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ে একটা পাথরে মাথা ঠুকে যাওয়ার ফলেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।

জামানি, মাম্বোয়া-সর্দার এবং দলবল গুহার ভিতর রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন শুনেই বুঝেছিল, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রথমে কেউ সাহস করে ভিতরে প্রবেশ করেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও তিনি যখন বেরিয়ে এলেন না, তখন জামানির অনুরোধে মাম্বোয়া-সর্দার গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে রাজি হয়। গুহার ভিতর অচৈতন্য অবস্থায় আত্তিলিওকে পড়ে থাকতে দেখে তারা তাকে তুলে আনে এবং সবাই মিলে ধরাধরি করে তার দেহটাকে বহন করে নিয়ে আসে। তাবুতে। আত্তিলিও এই পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন, কিন্তু যখন প্রফেসর জানালেন, আটদিন ধরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন, তখন চমকে উঠলেন আত্তিলিও–আটদিন! বলে কী!

চুপ করো!–প্রফেসর চমকে উঠলেন, বিশ্রাম নাও। কথা বলবে না। সব ঠিক আছে। আমি আর বিল তোমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

আত্তিলিও হাতের ওপর ছুঁচ ফোঁটার যন্ত্রটা অনুভব করলেন–ইঞ্জেকশন। আলোটা নিভে গেল। দু-জোড়া পা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল তাবুর বাইরে। দু-চোখের পাতার নিদ্রার স্পর্শ সমগ্র অনুভূতি ও চৈতন্যকে অবলুপ্ত করে নামছে নিবিড় অন্ধকার… আত্তিলিও ঘুমিয়ে পড়লেন…

একমাস পরে নভেম্বরের ২১ তারিখে প্রফেসর রায় দিলেন আত্তিলিও এইবার স্বচ্ছন্দে কাজকর্ম করতে পারেন। বিগত একমাস গত্তি সাহেবকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়নি, দুই বন্ধু তাকে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছিলেন। প্রফেসরের ঘোষণা শুনে মহা উৎসাহে আত্তিলিও অনেকদিন পরে ম্যাপ খুলে বসলেন। ম্যাপটার গায়ে এক জায়গায় খুব বড়ো করে একটা ফুটকির চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। চিহ্নিত স্থান হচ্ছে সেই গুহা, যেখানে একমাস আগে আত্তিলিও অতিকায় পাইথনের দেখা পেয়েছিলেন। চিহ্নটার পাশে কে যেন পেনসিল দিয়ে লিখে রেখেছে : শুক্রবার ১৩ অক্টোবর। শুভদিন। হুররে!

শুভদিন, না ঘোড়ার ডিম!–আত্তিলিও বলে উঠলেন, আবার হুররে লিখে আনন্দ জানানো হয়েছে! কেন? এত আনন্দ কীসের?

দেখো, দেখো, ভালো করে দেখো। বিল গর্জন করে উঠল।

আত্তিলিও ভালো করে দেখলেন, সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক–কী!

এইবার আত্তিলিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। সুদীর্ঘ বিশ্রাম হৃত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় যে সময়টা তিনি অতিবাহিত করেছেন সেই সময়ে বিল আর প্রফেসর পরিদর্শন করেছেন গুহার পর গুহা। যেসব এলাকা দেখা হয়ে গেছে, সেখানে ফুটকির চিহ্ন। চিহ্নগুলোকে লক্ষ করলে দেখা যায়, কেবল পূর্ব ও দক্ষিণেই ফুটকির ছড়াছড়ি। ফুটকিগুলো সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা জায়গাকে বৃত্তের আকারে ঘিরে ধরেছে। একটু অসমান আর খাপছাড়া হলেও ফুটকিগুলো মোটামুটি একটা সরলরেখার রূপ ধরেই এগিয়েছে এবং বৃত্তের আকারে যে-স্থানটিকে ঘিরে ফেলেছে, সেটা সুগোল না হলেও বৃও বটে। ওই বৃত্তাকার স্থানটির চারপাশেই ফুটকি-চিহ্ন দেখে বোঝা যায় ওই জায়গাটা এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ফুটকিগুলো সোজা এগিয়ে এসে যেখান থেকে ঘুরে অনাবিষ্কৃত অঞ্চলটাকে নির্দিষ্ট করছে, সেই চিহ্নর বেষ্টনী শুরু হয়েছে ঠিক পাইথনের গুহার পর থেকে। অর্থাৎ পাইথনের গুহা অবধি সোজাসুজি এগিয়েছে অভিযাত্রীরা, কিন্তু উক্ত গুহার পরবর্তী স্থানে পদার্পণ করেই তারা বামে ও দক্ষিণে ঘুরে গেছেন। কিন্তু কেন? হ্যাঁ, ঘুরে যাওয়ার কারণটা বেশ স্পষ্ট। চিহ্নিত স্থানের লিখিত তারিখ দেখলেই বোঝা যায় পাইথনের গুহার পর থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা বিল আর প্রফেসরকে বাঁয়ে আর ডাইনে নিয়ে গেছে, সরলরেখা ধরে তাদের এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। ক্রমাগত বাঁয়ে আর ডাইনে ঘুরেছেন তারা, ফলে আবিষ্কৃত স্থানগুলোতে ফুটকির চিহ্ন পড়ে পরিত্যক্ত জায়গাটাকে বৃত্তের আকারে পরিস্ফুট করেছে ম্যাপের ওপর।

স্পষ্টই বোঝা যায়, ওই জায়গাটার উপর প্রফেসর আর বিলের উপস্থিতি পছন্দ করে না মাম্বোয়ারা, তাই তারা প্রফেসর ও বিলকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। আরও শোনা গেল আত্তিলিও যখন বিশ্রাম নিতে বাধ্য হয়ে বিছানায় শুয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন, সেই সময় বিল আর প্রফেসরকে সাহায্য করার জন্য রোজই এসেছে মাম্বোয়া-সর্দার স্বয়ং–দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ওই জায়গাটা থেকে অভিযাত্রীদের দূরে রাখার জন্য তার প্রচেষ্টা দুই বন্ধুই লক্ষ করেছেন। প্রফেসর ও বিলের মনোভাব বুঝতে পারেনি মাম্বোয়া-সর্দার; কারণ, সব বুঝেও কিছু না-বোঝার অভিনয় করেছেন দুই বন্ধু আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে তার ফলেই মানচিত্রের গায়ে ফুটকি-চিহ্ন বেষ্টিত গোল জায়গাটা ধরা পড়েছে।

ম্যাপের উপর ওই গোল চিহ্নবিহীন জায়গাটা দেখতে দেখতে আত্তিলিওর গলা থেকে একটা অস্ফুট অর্থহীন শব্দ বেরিয়ে এল। প্রফেসর হাসলেন, হ্যাঁ, ওইখানেই আছে–কোনো সন্দেহ নেই এ-বিষয়ে।

দারুণ উৎসাহে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। কায়না সম্বন্ধে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, এখন আবার আশায় উদ্দীপনায় তার রক্তে উৎসাহের জোয়ার লাগল। প্রফেসরের ওষুধের চাইতে ম্যাপের চিহ্নগুলো তার স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি উপযোগী হয়েছে সন্দেহ নেই।

পরের দিন সকালে সবাই যখন বেরিয়ে গেল, আত্তিলিও তখন জামানিকে ডেকে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। আত্তিলিও বুঝেছিলেন জামানির সাহায্য ছাড়া তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে তিনি জামানির সামনে প্রলোভনের জাল ফেলতে শুরু করলেন, সেইসঙ্গে জুলু জাতির স্বাভাবিক মর্যাদাবোধ ও অহংকারে সুকৌশলে আঘাত দিয়ে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা চলল… আত্তিলিও কি বোঝেন না, জামানি তার দেশ জুলুল্যান্ডে ফিরে যেতে চায়? এই। হতভাগা মাম্বোয়াদের দেশ আর ভালো লাগে না সে-কথাও তিনি জানেন। তিনি নিজেই কি এই দেশ পছন্দ করছেন? মোটেই না, মোটেই না। তবে কাজ শেষ না-করে তো এই পাথুরে-নরক ছাড়ার উপায় নেই। জামানি যদি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে চায়, তবে তারও উচিত হবে তাকে সাহায্য করা; কারণ কার্যসিদ্ধি হলেই তো তিনি চটপট এখান থেকে সরে পড়তে পারবেন। আর আত্তিলিওর যে অপেরা হ্যাট টুপিটার মধ্যে দারুণ সব জাদুবিদ্যা লুকানো আছে বলে জামানি বিশ্বাস করে, সেই টুপিটা তো জামানিকেই উপহার দিতে চাইছেন তিনি। তবে এমন একটা মূল্যবান উপহারের বিনিময়ে তারও কি মাসাংগাকে সাহায্য করা উচিত নয়?… কায়না-আবিষ্কারের পর আত্তিলিও নিশ্চয়ই তাকে জুলুল্যান্ডে নিয়ে যাবেন, সমস্ত জুলুল্যান্ডের মানুষ অবাক হয়ে দেখবে–হ্যাঁ, একটা পুরুষের মতো পুরুষ বটে জামানি।

জামানি প্রথমে আত্তিলিও কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারেনি, পরে যখন বুঝল, তখন তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তবে জুলু জাতির আদর্শ পুরুষের মতো পুরুষ হলে তো মাম্বোয়াদের কায়নাকে ভয় করা চলে না, তাই বুক ঠুকে শপথ করে জামানি বলল, কায়না অভিযানে সে মাসাংগাকে সাহায্য করবে। মাম্বোয়াদের কথাবার্তা সে শুনতে চেষ্টা করবে এবং কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য শ্রুতিগোচর হলে সেই সংবাদ সে আত্তিলিওকে জানাবে।

আত্তিলিও অবশ্য ভালোভাবেই জানতেন, কোনো গোপন রহস্যের সন্ধান পেলেও জামানি চট করে তাঁকে সংবাদ দেবে না। কিন্তু তার জুলু অনুচরটি তাদের সবাইকে ভালোবাসত, কাজেই নানারকম ছলছুতোয় সে যে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে, সেই ভরসা তিনি রাখতেন। বিশেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, জুলুল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে সে হয়তো কিছুটা দুঃসাহস প্রকাশ করতে পারে। আর একটা ছোটোখাটো বিষয়কেও বোধ হয় জামানি উপেক্ষা করবে না–অপেরা হ্যাট টুপিটার প্রলোভন খুব তুচ্ছ নয় তার কাছে।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ – ভয়াবহ পর্বত

১৯২৮ সালের ২৯ নভেম্বর সকাল বেলা আত্তিলিও ঘোষণা করলেন নিহত পাইথনের গুহাটাকে তিনি আর একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।

পূর্বোক্ত গুহার সামনে এসে বিল ও প্রফেসর দুটো ভিন্ন পথ অনুসরণ করলেন। অজানা পথে হয়তো তারা বিপদে পড়তে পারেন, তাই অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে তার দলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ লোকগুলোকে নিয়ে মাম্বোয়া-সর্দার তাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হল।

আত্তিলিও বর্তমানে পাইথনের গুহার খুব কাছাকাছি থাকতেন, অতএব তাকে সাহায্য করার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি মাম্বোয়া-সর্দার। তবু সাবধানের মার নেই, তাই সর্দারের আদেশে ছয়জন মাম্বোয়া আত্তিলিওর সঙ্গে থেকে গেল। ওই লোকগুলো ছিল দুর্বল ও ব্যক্তিত্বহীন। নিতান্ত নিয়মরক্ষার জন্যই তারা আত্তিলিওর সঙ্গে ছিল। এক নজরে লোকগুলোর চেহারা জরিপ করে আত্তিলিও বুঝে নিলেন নিষিদ্ধ এলাকায় জোর করে প্রবেশ করতে চাইলে এরা তাঁকে বাধা দিতে পারবে না।

হঠাৎ জামানি বলে উঠল, ওই যে মাসাংগা! তুমি একটা বুনো শুয়োর চাইছিলে না? ওই দেখো, একটা শুয়োরের পায়ের ছাপ।

কোনোদিনই শুয়োর মারতে চাননি আত্তিলিও সাহেব, বিশেষ করে সেই মুহূর্তে আফ্রিকার বৃহত্তম বন্য শূকরও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু তিনি জামানির অব্যক্ত ইশারা বুঝতে পারলেন। জমির উপর সত্যি সত্যিই ওয়ার্ট হগ নামক বন্য শূকরের টাটকা পায়ের ছাপ ছিল। পদচিহ্নগুলো এগিয়ে গেছে নিষিদ্ধ এলাকাটার দিকে। মাম্বোয়ারা পায়ের ছাপগুলো দেখেছিল, তারা সন্ত্রস্তভাবে পরস্পরের সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। আত্তিলিও সেদিকে দেখেও দেখলেন না। এমন উৎসাহের সঙ্গে তিনি মাম্বোয়াদের ঠেলতে ঠেলতে শূকরের পায়ের ছাপগুলোর দিকে এগিয়ে চললেন যে, তারা কোনো ছুতো ধরে আপত্তি করারও সময় পেল না। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে তাঁদের চোখে পড়ল একটা পাহাড়। ভীষণ-দর্শন, প্রস্তরবহুল ওই পাহাড়টা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র মাম্বোয়ারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী হল? শিকার কোথায়?–আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন।

ওই যে। অনেক দূরে একটা কম্পিত ঘাসঝোঁপের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল একজন মাম্বোয়া।

এগিয়ে চলো। জামানি হুকুম দিল।

কিন্তু কেউ আর এক পা নড়ল না।

চলে এসো আমার সঙ্গে, ধমকে উঠলেন আত্তিলিও, তোমরা কি পুরুষমানুষ, না আর। কিছু?

পুরুষমানুষরা এবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে সামনে এগিয়ে গেল। আবার থামল। যে-লোকটি আত্তিলিওর দুই নম্বর বাড়তি বন্দুকটা বহন করছিল, সে অস্পষ্ট জড়িতস্বরে কী যেন বলল। বলার সঙ্গেসঙ্গে সে হাতের বন্দুক মাটিতে নামিয়ে রাখল। তৎক্ষণাৎ তার পাশে যে লোকটি দড়ির বান্ডিল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে দড়িটাকে মাটিতে ফেলে দিল। তৃতীয় ব্যক্তি খাদ্য ও বিভিন্ন সরঞ্জামপূর্ণ থলিটাকে ফেলে ভারমুক্ত হল। পরক্ষণেই তারা একসঙ্গে ছুটতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আত্তিলিওর দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হল ছয়টি ধাবমান মনুষ্য-মূর্তি।

আত্তিলিও এইবার পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। পাশে ভয়ার্ত জামানি। অদূরে পাহাড়–পাথরে পাথরে রুক্ষ, শ্রীহীন, অনুর্বর। চারিদিক চুপচাপ শান্ত। কোথাও জীবনের সাড়া নেই, একটি পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। এই নীরবতা অস্বস্তিকর। মানুষের মন এমন জায়গায় আনন্দ পায় না! আফ্রিকার পরিবেশ এখানে প্রস্তরসজ্জায় রুক্ষ, স্তব্ধতায় ভয়ংকর।

জামানি মাম্বোয়াদের ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো মাটি থেকে তুলে নিল। দারুণ আতঙ্কে তার দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হচ্ছিল।

চলে এসো পাহাড়ের উপর,–ধমকে উঠলেন আত্তিলিও, তুমি না জুলু-যোদ্ধা?

মনে হল জামানি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু আত্তিলিও তার গর্বে ঘা দিয়েছেন–একটিও কথা না-বলে সে সোজা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

পাহাড়ের তলায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো পাথর ছিল। পাথরগুলোর ভিতর থেকে একটা সংকীর্ণ গিরিপথের সন্ধান পাওয়া গেল। ওই পথ বেয়ে উপরে উঠে আত্তিলিও দেখলেন, তাঁরা দুজন যেখানে এসে পৌঁছেছেন, সেটা হচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার উপর অবস্থিত একটা প্রশান্ত প্রশস্ত সমতল জায়গা।

সমতল জায়গাটার একপাশে দুটো মস্ত পাথর আত্তিলিওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করল। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

পাথর দুটোর মাঝখানে দেখা গেল একটা গর্ত। গর্তটা প্রায় গোলাকার, চওড়ায় সেটা বারো ফুটেরও বেশি।

কায়না?…

কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু আত্তিলিওর দৃঢ় ধারণা হল, গর্তটাই কায়না। নিজের চোখকে তিনি প্রায় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না–মাসের পর মাস যার জন্য কষ্ট সহ্য করেছেন অভিযাত্রীরা, নিদারুণ বিপদের মুখে প্রাণ বিপন্ন করেছেন বারংবার সেই মৃত্যুগহ্বর আজ আত্তিলিওর পায়ের তলায়।

একবার উঁকি দিয়ে গর্তের ভিতর দৃষ্টিকে চালনা করলেন আত্তিলিও। কিন্তু দেখা গেল না। দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে ধাক্কা মারল। আত্তিলিও সেই গন্ধটা সহ্য করতে পারলেন না, পিছিয়ে এলেন।

গহ্বরের নিবিড় অন্ধকারের ভিতর কিছুই চোখে পড়ছে না। কিন্তু গর্তটা কি খুব গভীর? পাথরটা এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে অনেকগুলো শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করল, কিন্তু একেবারে তলা থেকে পাথরটার পতনজনিত শব্দ শুনতে পেলেন না তিনি। এবার একটা বড়ো পাথর তিনি ছুঁড়ে দিলেন। একটা অস্পষ্ট শব্দ গর্তের তলা থেকে ভেসে এল। আত্তিলিও বুঝলেন পাথরটা নীচে পৌঁছোল।

জামানি, আত্তিলিও বললেন, এইবার তুমি নিশ্চয়ই টুপিটা পাবে।

নিতান্ত কর্তব্যবোধেই জামানি ধন্যবাদ দিল। তার চোখে-মুখে উৎসাহ বা আনন্দের কোনো চিহ্ন আত্তিলিও দেখতে পেলেন না।

জামানির দোষ নেই। স্বয়ং আত্তিলিও সাহেবই কি খুব উৎসাহ বোধ করছিলেন? ওই অন্ধকার গহ্বরের ভিতর কোনো অজ্ঞাত বিভীষিকা লুকিয়ে আছে কি না কে জানে! এটাই যে কায়না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে একটা রহস্যময় গহ্বরের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

সাফল্যের মুখে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন আত্তিলিও। বর্তমানে তার অবস্থাটা হল, যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই মুহূর্তে তার কর্তব্য কী হতে পারে সেটাই তিনি বুঝতে পারছিলেন না। একবার ভাবলেন শূন্যে রাইফেলের আওয়াজ করে প্রফেসর আর বিলকে ডাকলে হয়? তারপর মনে হল, ওরা এখন কোথায় আছে কে জানে! যদি অনেক দূরে থাকে, তাহলে তো গুলির শব্দ শুনতে পেলেও আত্তিলিও যে তাদের ডাকছেন এই কথাটা বুঝতে পারবে কি? গুলি তো কত কারণেই চালানো হয়। তারপর মাম্বোয়া-সর্দার? সেও তো এক সমস্যা। বিল আর প্রফেসরের সঙ্গে মাম্বোয়া-সর্দারও তো তার দলবল নিয়ে আসবে। তারা যে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে বিদেশিদের মৃত্যুগহ্বরের ভিতর ঢুকতে দেবে, এমন তো মনে হয় না!

অবশ্য এত সব ভাবনাচিন্তা না-করে আত্তিলিও তাবুতে ফিরে গিয়ে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন এবং পরের দিন তাদের নিয়ে এখানে চলে আসতে পারতেন অনায়াসে। এই সহজ উপায়টা যে তাঁর মাথায় আসেনি, তা নয়। কিন্তু উপায়টা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি সেটাকে নাকচ করেছেন। কী বলবেন তিনি বন্ধুদের কাছে? মৃত্যুগহ্বর আবিষ্কার করেও তার ভিতর তিনি একা প্রবেশ করতে সাহস পাননি? বন্ধুদের সাহায্য গ্রহণ করা জন্য ফিরে এসেছেন? এমন কথা বলতে পারবে না মহাযুদ্ধের প্রাক্তন সৈনিক কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি।

অতএব আত্তিলিও ঠিক করলেন, ওই গহ্বরের ভিতর ঢুকে আজই তিনি ভিতরটা দেখবেন। দড়িটাকে তিনি হস্তগত করলেন, তারপর গর্তের মুখে অবস্থিত প্রকাণ্ড পাথর দুটোর মধ্যে একটার সঙ্গে দড়িটা বাঁধলেন। দড়ির একপ্রান্ত পাথরের সঙ্গে বাঁধা হল, অপর প্রান্তটা তিনি বাঁধলেন নিজের কোমরের সঙ্গে। যে-থলিটার মধ্যে খাবারদাবার এবং নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছিল, সেটার ভিতর থেকে সব কিছু তিনি বের করে ফেললেন। তারপর সেই থলিটা বুকে ঝুলিয়ে তিনি প্রস্তুত হলেন মৃত্যুগহ্বরের ভিতর অবতরণ করার জন্য। থলিটা অবশ্য একেবারে শূন্যগর্ভ ছিল না, দুটি নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুকে থলির মধ্যে ভরেছিলেন আত্তিলিও টর্চ এবং পিস্তল।

জামানিকে ডেকে আত্তিলিও বললেন, সে যেন কোনো কারণেই স্থানত্যাগ না করে। তারপর তিনি তাকে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে দড়ি ধরে তাকে ধীরে ধীরে গর্তের ভিতর নামাতে হবে। জামানির ওষ্ঠাধর নড়ে উঠল। কিন্তু শব্দ শোনা গেল না। সম্মতিসূচক ইয়েস, মাসাংগা কথাটা তার ঠোঁটের ভিতরেই জমে গেল, উচ্চারিত হল না। দারুণ আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল জামানি, তবু সে নির্দেশ-অনুযায়ী দড়িটা ধরল। সাবধানে আস্তে আস্তে, তাকে দড়ি ছাড়তে বললেন আত্তিলিও। লাটাই থেকে যেভাবে সুতো ছেড়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়, ঠিক সেইভাবেই জামানিকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঘুড়ি ওঠে উপরদিকে, এখানে আত্তিলিও নামছেন নীচের দিকে এবং সুতোর স্থান নিয়েছে জামানির হাতের দড়ি আর লাটায়ের স্থান গ্রহণ করেছে একটা মস্ত পাথর।

খুব সন্তর্পণে আত্তিলিও নামতে শুরু করলেন। গর্তের মুখে পা রাখতে-না-রাখতেই কয়েকটা পাথর তার পায়ের ধাক্কায় গর্তের মধ্যে ছিটকে পড়ল সশব্দে। সেই শব্দে সাড়া দিয়েই যেন অন্ধকার গহ্বরের ভিতর থেকে কী-একটা বস্তু ছুটে এল। আর পরক্ষণেই

পরক্ষণেই আত্তিলিওর মুখের উপর পড়ল এক প্রচণ্ড থাপ্পড়! সঙ্গেসঙ্গে কানের পর্দা ফাটিয়ে এক তীব্র চিৎকার!

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ – মৃত্যু-বিভীষিকা

মুখের উপর সজোরে চপেটাঘাত পড়তেই আত্তিলিও চোখ বন্ধ করে ফেললেন এবং তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলেন দড়িবাঁধা পাথরটাকে।

একটা মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন তিনি, তারপর সম্মুখে দৃষ্টিপাত করে তিনি দেখলেন, আক্রমণকারী জীবটি হচ্ছে মস্ত বড়ো একটা নিশাচর পাখি! অন্ধকারে গহ্বরের ভিতর থেকে উড়ে আসার সময়ে তার মুখের উপর পাখিটার ডানার ঝাঁপটা লেগেছিল। অন্ধকারে অভ্যস্ত নিশাচর দিনের আলোর মধ্যে এসে প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েছিল, গহ্বরের কাছেই একটা শুকনো গাছের ডালপালার মধ্যে চুপ করে বসে ছিল পাখিটা।

এই ঘটনাটা অবশ্য আত্তিলিওর পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল। পাখিটা তাকে ভবিষ্যতের ভয়াবহ সম্ভাবনা সম্পর্কে সাবধান করে দিল–জামানির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে তার অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হতে পারে, এই ঘটনায় তার প্রমাণ পেলেন আত্তিলিও।

জামানির দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, সে দড়ি ছেড়ে মাটির উপর শুয়ে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে পাথরটা না-ধরলে তার দেহটা ছিটকে পড়ত গহ্বরের ভিতর এবং তলদেশে পতিত হয়ে অথবা পাথরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে তার অবস্থা যে হত নিতান্ত শোচনীয়, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আত্তিলিও ঠিক করলেন, গর্তের ভিতর নামার সময়ে তিনি আর জামানির উপর নির্ভর করে নিজের জীবনকে বিপন্ন করবেন না। জামানিকে ভূমিশয্যা ত্যাগ করতে বললেন তিনি। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে মাথা তুলল জামানি, তারপর বিস্ফারিত দুই চক্ষুর ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চারদিক নিরীক্ষণ করতে লাগল।

ভূ-ভভূত! সহসা আর্তনাদ করে উঠল জামানি, তার ভীত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে পূর্বোক্ত নিশাচর পক্ষীর উপর!

ভূতের নিকুচি করেছে! বলে আত্তিলিও একটা পাথর ছুঁড়ে মারলেন। মস্ত বড়ো পাখিটা ডানা ঝটপট করে শূন্যে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কী? দেখেছ?

আত্তিলিও জামানির মুখের দিকে তাকালেন। জামানি মাথা নেড়ে জানাল, দেখেছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি দেখেই আত্তিলিও বুঝলেন, উড়ন্ত জীবটির পক্ষিত্ব সম্বন্ধে জামানির সন্দেহ দূর হয়নি। খুব সম্ভব সে ভাবছিল, ওটা পাখি না হয়ে একটা ছদ্মবেশী প্রেতাত্মাও হতে পারে!

আত্তিলিও আর জামানির সঙ্গে কথা বললেন না, নেমে পড়লেন গহ্বরের ভিতর। এইবার অবশ্য তিনি দড়িটাকে জামানির হাতে সমর্পণ করেননি; খুব সাবধানে ঝুলতে ঝুলতে তিনি নামতে শুরু করলেন দড়ি ধরে। যে-পাথরটার সঙ্গে আত্তিলিওর দেহসংলগ্ন দড়িটা বাঁধা ছিল, সেই পাথরটা ছিল খুবই গুরভার, অতএব তার দেহের ভারে পাথরটা স্থানচ্যুত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

আত্তিলিও নামছেন, নামছেন আর নামছেন…উপর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ আলোর আভাসও ক্রমে লুপ্ত হয়ে গেল; তার মাথার উপর, পায়ের নীচে, সামনে পেছনে চতুর্দিকে বিরাজ করছে। এখন সীমাহীন অন্ধকার, অন্ধকার আর অন্ধকার…

গুহার প্রস্তর-প্রাচীর থেকে বেরিয়ে আসা একটা পাথরে আত্তিলিওর পা ঠেকল। পাথরটা খুব ধারালো, কিন্তু সেটার উপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে নির্ভর করা যায়। আত্তিলিও কিছুক্ষণ সেই পাথরটার উপর পা রেখে বিশ্রাম করলেন, তারপর আবার দড়ি ধরে অবতরণ-পর্ব…

কয়েকটা আলগা পাথর আত্তিলিওর দেহের ধাক্কা খেয়ে সশব্দে ছিটকে পড়ল, কয়েকটা নিশাচর পক্ষী ডানা মেলে উড়ে গেল, তাদের ডানার শব্দ ভেসে এল আত্তিলিওর কানে।

গহ্বরের প্রস্তর-প্রাচীর থেকে বেরিয়ে-আসা পাথরগুলো পা দিয়ে অনুভব করছিলেন আত্তিলিও এবং মাঝে মাঝে ওই পাথরগুলোর উপর পা রেখে তিনি ক্লান্ত বাহু দুটিকে বিশ্রাম দিচ্ছিলেন। পর পর চারটে পাথরের উপর বিশ্রাম নিয়ে পঞ্চম পাথরটির উপর অবতীর্ণ হলেন আত্তিলিও। একহাতে দড়ি আঁকড়ে অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরে তিনি গুহার তলদেশ আবিষ্কার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গর্তের চারপাশের দেয়াল থেকে ছোটো-বড়ো অসংখ্য পাথর বেরিয়ে এসে দেয়ালটাকে এমন অসমান করে তুলেছে যে, টর্চের আলো সেই প্রস্তরের বেষ্টনী ভেদ করে গুহার তলায় পৌঁছাতে পারল না। আত্তিলিও সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন : পঁচাত্তর ফিট দীর্ঘ রজুর দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেছে, উপর থেকে তাঁর কণ্ঠস্বরে সাড়া দিয়ে জামানির উত্তরের রেশ অস্পষ্ট হয়ে দুজনের মধ্যে এক ভয়াবহ দূরত্বের আভাস দিচ্ছে, কিন্তু গহ্বরের তলায় পা দেওয়া তো দূরের কথা, তলদেশ এখনও রয়েছে তার দৃষ্টিসীমার বাইরে! গর্তটা নিশ্চয়ই অতল অসীম নয়, কিন্তু এই ভূতুড়ে গহ্বরের গভীরতা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে? কোথায় কত দূরে গেলে পাওয়া যাবে নীচের মাটি?

হঠাৎ আত্তিলিওর পায়ের তলায় পাথরটা নড়ে উঠল। চমকে উঠে তিনি দড়িটা চেপে ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না–পাথরটা তার দেহের ভারে স্থানচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ল; সঙ্গেসঙ্গে আত্তিলিও সাহেবও ছিটকে পড়লেন সীমাহারা শূন্যতার মাঝে!

তাঁর দেহটা দেয়াল থেকে দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে নীচের দিকে পড়তে লাগল, গুহার পাত্র-সংলগ্ন ধারালো পাথরগুলো ধারালো ছুরির মতোই নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে দংশন করতে লাগল বারংবার, হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আত্তিলিওর দেহটা স্থির হয়ে গেল। পঁচাত্তর ফিট লম্বা দড়ির দৈর্ঘ্য শেষ হয়ে গেছে। রজ্জবদ্ধ অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে লাগলেন আত্তিলিও, তাঁর মনে হল, কোমরে-দড়ি বাঁধা তাকে দু-টুকরো করে ভেঙে ফেলতে চাইছে।

আত্তিলিও সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে একটা আঠার মতো ঘন চটচটে বস্তুর উষ্ণ অস্তিত্ব অনুভব করলেন : রক্ত। ধারালো পাথরগুলো খোঁচা মেরে তাঁর পতনোন্মুখ শরীরটাকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। কিন্তু রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর চাইতে তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে দড়িটা। কোমরের উপর, পাঁজরের দু-পাশে শক্ত দড়ি যেন কেটে কেটে বসছে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় আত্তিলিওর শরীরটা এখনও আস্ত আছে, ভগ্নাংশে পরিণত হয়নি। বুকের সঙ্গে বাঁধা থলির ভিতর থেকে টর্চটা বার করে আত্তিলিও সেটাকে জ্বেলে ফেললেন এবং চারদিকে দৃষ্টি চালনা করে অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। গুহাটা মোটামুটি বৃত্তাকার। তার আনুমানিক ব্যাস প্রায় চল্লিশ ফিট। গুহার ছাদ এবং ভূমির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় শূন্যে দোল খাচ্ছেন আত্তিলিও; পূর্বোক্ত দুটি স্থানের দূরত্ব তার দেহের থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট হবে। গুহার নীচে মাটি প্রায় দেখা যাচ্ছে না, অগণিত নরকঙ্কাল ও অস্থিময় নরমুণ্ডের আবরণে গুহার তলদেশের মৃত্তিকা প্রায় অদৃশ্য। অস্থিপঞ্জরগুলো কোথাও ধবধবে সাদা, কোথাও-বা সময়ের স্পর্শে হলুদ হয়ে এসেছে।

ঝুলতে ঝুলতে আর দুলতে দুলতে আত্তিলিও টর্চের আলোটাকে গুহা-গহ্বরের কিনারাতে ফেললেন।

গুহার দেয়াল যেখানে নেমে এসে গুহাভূমিকে স্পর্শ করেছে, সেইখানেই মেঝের উপর এক জায়গায় আত্তিলিওর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল; হাড়ের স্তূপের মধ্যে কিছু যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।

সচল বস্তুগুলোর স্বরূপ নির্ণয় করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওই জায়গাটা তিনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।

অকস্মাৎ দারুণ আতঙ্কে তার শরীরের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল। স্তূপীকৃত অস্থিপঞ্জর আর কঙ্কাল-করোটির মধ্যে বিচরণ করছে কয়েকটা কেউটে সাপ! আত্তিলিও গুনে দেখলেন, সেখানে অবস্থান করছে সাত-সাতটি বিষধর সরীসৃপ।

টর্চের আলোতে বিরক্ত হয়ে কেউটেগুলো অনধিকার প্রবেশকারীকে সন্ধান করছে। তাদের দীর্ঘ মসৃণ দেহ কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। আবার খুলে খুলে যাচ্ছে।

সাপগুলো বুঝতে পারল, তাদের বিরক্তির কারণটি কোথায় অবস্থান করছে। শত্রুর নাগাল না-পেয়ে হিংস্র আক্রোশে ফণা তুলে তারা দুলতে লাগল একবার পেলে হয়।

অনেকের ধারণা, কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মাটিতেই কেউটে সাপের বাস দেখা যায়। ওই ধারণ ভুল। কেউটে পরিবারের অন্তর্গত অন্তত চারটি বিভিন্ন জাতের সাপ আফ্রিকাতে বাস করে। উপযুক্ত ভয়াবহ তথ্য আত্তিলিও সাহেবের অজ্ঞাত ছিল না; তিনি এ-কথাও জানতেন যে, দেহের যেকোনো স্থানে কেউটের ছোবল পড়লে তাকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকের যাত্রী হতে হবে।

আত্মরক্ষার জন্য তিনি যা করলেন, তা পরবর্তীকালে তার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। বাঁ-হাতের টর্চ ঘুরিয়ে তিনি সাপগুলোর উপর আলো ফেললেন এবং ডান হাতের পিস্তল থেকে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলেন। পরপর ছয়বার অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠল পিস্তল, প্রত্যেকটি গুলি অভ্রান্ত লক্ষ্যে ছয়টি সরীসৃপের দেহ বিদ্ধ করল–একটিও গুলি ব্যর্থ হল না।

সাত নম্বর কেউটের দিকে ফাঁকা পিস্তলটা ছুঁড়ে মারলেন আত্তিলিও, সাপটা চট করে গুহার গায়ে একটা ফাটলের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হল।

দড়িটা আত্তিলিওর কোমরে কেটে বসছিল, সেই যন্ত্রণা আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। যা থাকে বরাতে মনে করে শরীরটাকে রজ্জ্বর বন্ধন থেকে মুক্ত করে তিনি লাফিয়ে পড়লেন গুহার মেঝের উপর। সাপগুলো তখনও মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছিল, আত্তিলিও জুতো-পরা পায়ের লাথি চালিয়ে সেগুলোকে নিরাপদ ব্যবধানে পাঠিয়ে দিলেন। তারপরই একটা অস্থিময় নরমুণ্ডের উপর হোঁচট খেয়ে তিনি পড়ে গেলেন!…

কতক্ষণ মূৰ্জিত হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা আত্তিলিও নিজেও বলতে পারবেন না। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে আহত ও রক্তাক্ত শরীরের পরিচর্যায় মনোনিবেশ করলেন। উপর থেকে ছিটকে পড়ার সময়ে পাথরের খোঁচা লেগে যেসব জায়গা কেটেকুটে গিয়েছিল, সেই ক্ষতস্থানগুলোর উপর তিনি ব্যান্ডেজ বেঁধে ফেললেন। অবশ্য সেইজন্য তাঁকে পরনের শার্টটা ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল। গহ্বরের গায়ে যে-ফোকরটার ভিতর দিয়ে সাত নম্বর সাপটা অন্তর্ধান করেছিল, সেই ফুটোটার কাছে গিয়ে আত্তিলিও লক্ষ করলেন বাইরের বাতাস পূর্বোক্ত গর্তটার ভিতর দিয়ে সশব্দে গুহার ভিতর প্রবেশ করছে। আত্তিলিও এইবার বুঝলেন, আশি ফিট গভীর এই গহ্বরের ভিতর সাপগুলো কোন পথে এসেছে। স্তূপীকৃত অস্থিপঞ্জরের ভিতর থেকে একটা হাড় নিয়ে তিনি চটপট ওই ফোকরটার মুখ বন্ধ করে দিলেন।

এতক্ষণে আত্তিলিও সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তার দেহে রক্ত চলাচল করছে স্বাভাবিকভাবে। এই ভয়ানক গহ্বরটা যে কায়না, এ-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই তার।

মাম্বোয়া-সর্দারদের আদেশে এই সুগভীর গহ্বরের মধ্যে অপরাধীদের নিক্ষেপ করা হত। অপরাধের গুরুত্ব সবসময় খুব বিবেচ্য নয়, মাম্বোয়া-সর্দার বা মাতব্বরদের অপ্রীতিভাজন হলেই উক্ত ব্যক্তিকে বিসর্জন দেওয়া হত কায়নার গর্ভে। মাম্বোয়ারা এই রীতি পছন্দ করত না, কিন্তু তারা জানত কেউ যদি শ্বেতাঙ্গদের কাছে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধান দেয়, তবে মাম্বোয়া-সর্দারদের আদেশে সেই ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য। সেইজন্যই তারা মুখ খুলত না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু যখন কাছে এগিয়ে এসেছে তখনই তারা মুখ খুলতে চেয়েছে। আত্তিলিওর মনে পড়ল নিগ্রো পুলিশম্যান ও স্থানীয় বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটির কথা। মরার আগে তারা মৃত্যুগহ্বরের রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল, কারণ তারা বুঝেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মাম্বোয়া-সর্দারদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরার করার আগেই মৃত্যুর স্পর্শে তাদের জিহ্বা হয়ে যায় স্তব্ধ। ওইসব ঘটনাগুলো বার বার আত্তিলিওর মনে পড়তে লাগল।

মৃত্যুগহ্বরের ভিতর যেসব মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, তাদের কথা মনে হতেই শিউরে উঠলেন আত্তিলিও। অনাহারে আর তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযাতনা ভোগ করেছে। ওইসব হতভাগ্যের দল, তিল তিল করে শুকিয়ে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে মৃত্যুর দিকে। সেইজন্যই এই গুহার নাম দেওয়া হয়েছে কায়না অর্থাৎ যাতনাদায়ক মৃত্যগহ্বর।

নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য যুগ যুগ ধরে মাম্বোয়া-সর্দাররা এই প্রথা বাঁচিয়ে রেখে জনসাধারণের উপর নিষ্ঠুর সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। মাম্বোয়া জাতির মাতব্বরদের এই নৃশংসতায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই–পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় সর্বদেশে সর্বক্ষেত্রে এই ধরনের একদল লোক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত কায়েমি স্বার্থকে বজায় রাখার জন্য।

আত্তিলিও হঠাৎ চমকে উঠলেন : এসব তিনি কী ভাবছেন? মানুষের দুঃখকষ্টের কথা না-ভেবে তার নিজের কথাই এখন চিন্তা করা উচিত। মাম্বোয়াদের মধ্যে প্রচলিত একটা ভয়ানক প্রবাদবাক্য তাঁর মনে পড়ল–এখানে যে প্রবেশ করে, তার উদ্ধারের আশা নেই!

আত্তিলিওর মনে হল, মূখের মতো অন্য মানুষের দুঃখের কথা ভেবে তিনি মূল্যবান সময়ের অপচয় করছেন। যদি এই গহ্বরের বাইরে তিনি না যেতে পারেন, তবে তার দেহের কঙ্কালটিও একদিন এই গুহার অস্থিস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকবে। আত্তিলিও এইবার মৃত্যুগহ্বরের গর্ভ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

দড়িটা উপরে ঝুলছিল। আত্তিলিও সেটাকে লক্ষ করে লাফ মারলেন। বৃথা চেষ্টা, লাফিয়ে ওই দড়িটাকে করায়ত্ত করা সম্ভব নয়। তিনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেন, প্রতিধ্বনি তাঁকে বিদ্রূপ করল, উপর থেকে জার্মানির কণ্ঠস্বরে কোনো উত্তর এসে পৌঁছাল না তার কাছে।

আত্তিলিও এইবার অন্য উপায় অবলম্বন করলেন। অনেকগুলো পাথর আর নরকঙ্কাল টেনে জড়ো করলেন দড়িটার নীচে, তারপর ওই পাথর আর হাড়ের স্তূপের উপর আরোহণ করে এক সময়ে দড়িটাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হলেন।

কিন্তু এখনও ঝামেলা অনেক–দড়ির শেষ প্রান্তে যে গিট আছে সেটাকে না-খুললে চলবে না। ইতিমধ্যে টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে এসেছে, আলোটা কাঁপতে শুরু করল। আত্তিলিওর সমস্ত শরীর তখন অবসাদে ভেঙে পড়তে চাইছে, কেবল দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি তাকে দু-পায়ের উপর খাড়া করে রেখেছিল! কম্পিত হস্তে দড়ির গিটটা একসময়ে খুলে ফেললেন আত্তিলিও। পিস্তল আর টর্চ ব্যবহারের যোগ্য ছিল না, তাই সে দুটির পরিবর্তে কয়েকটা হাড়ের টুকরো আত্তিলিও তাঁর হাতের থলির মধ্যে ভরে নিলেন। শ্রান্ত দেহে অনেকটা দূরত্ব তাকে দড়ি ধরে অতিক্রম করতে হবে, ওই অবস্থায় হাড়গোড় দিয়ে ওজন বাড়িয়ে নিজেকে ভারগ্রস্ত করলে বিপদের সম্ভাবনা আছে বুঝেও মৃত্যুগহ্বর থেকে কিছু নিয়ে যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেননি আত্তিলিও। জীবনের আশা তিনি ত্যাগ করেছিলেন, তবু যদি জীবিত অবস্থায় কায়নার বাইরে পদার্পণ করতে পারেন, তবে ওই হাড়গুলো বিল আর প্রফেসরের সামনে প্রমাণস্বরূপ দাখিল করতে পারবেন ভেবেই আত্তিলিও বাড়তি ওজনের ঝাট বহন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

হাত আর পায়ের সাহায্যে যেভাবে মানুষ সাধারণত দড়ি বেয়ে উপরে উঠে, সেইভাবে চেষ্টা করলে খুব সম্ভব আত্তিলিও ব্যর্থ হতেন। শ্রান্ত-ক্লান্ত বাহু ও পায়ের মাংসপেশি সুদীর্ঘ রজ্জুপথে বেশিক্ষণ তার দেহভার বহন করতে পারত কি না সন্দেহ। তাই আত্তিলিও একটা কৌশল অবলম্বন করলেন। দড়িটাকে তিনি দক্ষিণ উরুর তলা দিয়ে চালিয়ে দিলেন, তারপর যে-অংশটা তিনি অতিক্রম করছিলেন, দড়ির সেই অংশটুকু ডান দিকের ঊরুর তলা দিয়ে ঘুরিয়ে দক্ষিণ বাহুর ঊর্ধাংশের উপর ফেলে দিচ্ছিলেন। এইভাবে যে দড়ির বেষ্টনী তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ডান পা ঝুলিয়ে রেখে বাঁ-পা দিয়ে গুহার দেয়ালে বেরিয়ে-আসা পাথরের মাঝে মাঝে ধাক্কা মেরে উপরে উঠেছিলেন আত্তিলিও। দোদুল্যমান রঞ্জুর দুটি অংশ পরস্পরের সঙ্গে এবং আত্তিলিওর দুই পায়ের মাঝখানে ঘর্ষিত হয়ে শূন্য পথে ভাসমান দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছিল; ফলে ক্লান্ত শরীরটা অল্প আয়াসেই ঝুলিয়ে রেখে মাঝে মাঝে দম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন তিনি।….

তবু মাঝে মাঝে ক্লান্ত মুঠির বাঁধন খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, মাঝে মাঝেই দড়ির উপর শিথিল হয়ে এসেছে হাতের আঙুলগুলো, কিন্তু কিছুতেই হাত ছাড়েননি আত্তিলিও, শক্ত করে বার বার আঁকড়ে ধরেছেন দড়িটাকে…

গহ্বরের উপরদিকে তিনি যত উঠছিলেন, নিরেট অন্ধকার ততই হালকা হয়ে গহ্বরের বহির্দেশে উজ্জ্বল সূর্যালোকের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল। সেই আলোর আভাসই প্রেরণা দিয়েছে, শিথিল আঙুলের বাঁধন খুলে যেতে আবার দড়িটাকে চেপে ধরেছেন দৃঢ় মুষ্টিতে।

আত্তিলিও উপরে উঠতে লাগলেন অতি কষ্টে, ধীরে ধীরে, অতি সন্তর্পণে…

অবশেষে এক সময় তিনি গহ্বরের মুখে এসে পৌঁছালেন। মাথাটা গর্তের বাইরে ঠেলে দিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলেন : ভগবানকে ধন্যবাদ, জামানি যথাস্থানেই অবস্থান করছে।

আত্তিলিওকে দেখামাত্রই জামানির দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, ওষ্ঠাধর হল বিভক্ত এবং সর্বশরীরে জাগল কম্পিত শিহরন!

সাহায্য করো, আত্তিলিও ভগ্নস্বরে বললেন, তাড়াতাড়ি করো!

জামানি অবরুদ্ধ কণ্ঠে আর্তনাদ করে, মাসাংগা! তোমার নিজের আত্মা!

আত্তিলিওর হাত ধরার চেষ্টা না-করে সে ধপাস করে মাটির উপর পড়ে গেল।

আত্তিলিও পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে গহ্বরের মুখে দড়ি বাঁধা পাথরটা চেপে ধরে পতন থেকে আত্মরক্ষা করলেন। তারপর শেষ শক্তি দিয়ে নিজের পতনোন্মুখ দেহটাকে টেনে আনলেন গহ্বরের বাইরে। শ্রান্ত ও অবসন্ন শরীরে অতি কষ্টে শ্বাস টানতে টানতে আত্তিলিও শুনলেন জামানির আর্তনাদ–মাসাংগা! তুমি মরে গেছ! আমি জানি, তুমি মরে গেছ! মরে তুমি ভূত হয়েছ। তবে কেন থলির মধ্যে তোমার মুণ্ডু আর হাড়গুলো নিয়ে এলে আমার কাছে! মাসাংগা! আমি তোমার বিশ্বস্ত অনুচর, আমার সঙ্গে তোমার এ কী ব্যবহার, মাসাংগা!

আত্তিলিও হাসে নি!

হেসে ওঠার ক্ষমতা তার তখন ছিল না।

২. শয়তানের ফাঁদ

সৈনিকের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা
শয়তানের ফাঁদ

প্রথম পরিচ্ছেদ – অর্ধেক মানব আর অর্ধেক দানব

প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি নামক মিত্রপক্ষের জনৈক সেনাধ্যক্ষ আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে উদযোগী হন। ওই কাজে তার প্রধান সহায় ছিল তার দুই বন্ধু প্রফেসর ও বিল। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ফরাসি বৈজ্ঞানিক, দ্বিতীয় মানুষটি হচ্ছে আমেরিকার এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দুঃসাহসী যুবক। বন্ধু দুটিকে নিয়ে যে অঞ্চলে প্রথম পদার্পণ করলেন আত্তিলিও, সেই জায়গাটি হল আফ্রিকার অন্তর্গত উত্তর রোডেশিয়া। পূর্বোক্ত স্থানে কায়না নামে এক ভয়াবহ মৃত্যুগহ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে অভিযাত্রীরা স্থানীয় সরকারকে অবাক করে দিয়েছিলেন। কায়নার গহ্বর থেকে অসংখ্য নরকঙ্কাল, করোটি, পাথরের গয়না এবং জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ওইসব জিনিস উপহার হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম নীচে দেওয়া হল :

গভর্নমেন্ট অব নর্দার্ন রোডেশিয়া, আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়, রয়্যাল অ্যানথ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম অব ফ্লোরেন্স এবং জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসর্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

উত্তর রোডেশিয়াতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্মে সাফল্য অর্জন করার ফলে অভিযাত্রীদের সামনে দক্ষিণ রোডেশিয়ার রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। দক্ষিণ রোডেশিয়া সরকার সাধারণত বিদেশিদের প্রবেশ করার অনুমতি দেন না, কিন্তু অভিযাত্রীদের বিভিন্ন গবেষণাকার্যের সাফল্যে খুশি হয়েই পূর্বোক্ত গভর্নমেন্ট নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বিবরণ পাঠকদের কাছে নীরস লাগবে বলে আত্তিলিও ওইসব বিজ্ঞান-বিষয়ক তথ্য ও তত্ত্ব এখানে পরিবেশন করেননি, লিপিবদ্ধ করেছেন তার অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর কাহিনি।

দক্ষিণ রোডেশিয়াতে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন আত্তিলিও। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, সেখানে গিয়ে এক বিপজ্জজনক নাটকের মধ্যে তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে ভয়াবহ নাটকের স্মৃতি আত্তিলিওর মানসপটে দুঃস্বপ্নের মতো জেগে থাকবে। সেই বন্য-নাটকে একাধিক ভিলেন বা খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল প্রকাণ্ড এক নরখাদক সিংহ, এক শয়তান জাদুকর এবং ক্রোধে উন্মত্ত এক-শো জুলুযোদ্ধা!

নায়কের ভূমিকায় ছিল পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এক সুদর্শন জুলুযোদ্ধা, নায়িকার স্থান নিয়েছিল এক ষোড়শী জুলুবালিকা।

উল্লিখিত প্রধান চরিত্রগুলো ছাড়া কিছু কিছু এক্সট্রা অর্থাৎ অতিরিক্ত চরিত্রের উপস্থিতি নাটকটিকে জমিয়ে তুলেছিল, যেমন–প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জুলু সর্দার, নরমাংস-লোলুপ শত শত সিংহ, এবং আত্তিলিও, বিল, প্রফেসর প্রভৃতি অনিচ্ছুক অভিনেতার দল।

মূল নাটকে আত্তিলিওর ভূমিকা ছিল খুবই ছোটো, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছিল তার অভিনয়ের সাফল্যের উপর; এবং ওই দুটি মানুষের একজন হলেন স্বয়ং আত্তিলিও! তবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও তিনি ঘাবড়ে যাননি, বেশ ভালো হয়েছিল তার অভিনয়। না, ভালো বললে কিছুই বলা হয় না–এমন চমৎকার, এমন মর্মস্পর্শী হয়েছিল তার অভিনয় যে, সমস্ত ঘটনা শোনার পর মনে হল সৈনিকের পেশা গ্রহণ না-করে পেশাদার অভিনেতার বৃত্তি অবলম্বন করলে অনেক বেশি যশ ও খ্যাতির অধিকারী হতে পারতেন কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি।

কমান্ডার সাহেব প্রথমে তার অভ্যাস অনুযায়ী রাইফেল হাতেই আসরে নেমেছিলেন, কিন্তু নাটকের প্রয়োজনে অস্ত্রত্যাগ করে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন জাদুকরের ভূমিকায় রাইফেলের পরিবর্তে তখন তার হাতে ম্যাজিকের বাক্স! সেসব ঘটনার বিবরণ যথাস্থানে দেওয়া হবে।

পূর্বোক্ত নাটকের বিবরণী দেওয়ার আগে যখন এত কথাই বললাম, তখন যে পটভূমির উপর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল সেই রঙ্গমঞ্চটি সম্বন্ধেও পাঠককে অবহিত করা প্রয়োজন।

মঞ্চটি ছিল ওই অভিনব নাটকেরই উপযুক্ত–আয়তনে বিশাল এবং চমকপ্রদ দৃশ্যসজ্জায় সুশোভিত। জুলুল্যান্ডের উত্তর অংশে বিরাজমান ইনিয়াতি পর্বতমালার অরণ্যসজ্জিত বিপুল বিস্তৃতি নিয়ে গঠিত হয়েছিল উল্লিখিত নাটকের স্টেজ বা মঞ্চ।

উত্তর রোডেশিয়া ত্যাগ করে এগারোজন নিগ্রো অনুচর নিয়ে অভিযাত্রীরা ইনিয়াতি পর্বতমালার দিকে অগ্রসর হলেন। পূর্বোক্ত নিগ্রোদের সংগ্রহ করেছিল জামানি নামক আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর ও রাঁধুনি। সকলেই জানত যে, তাদের গন্তব্যস্থল হচ্ছে জুলুল্যান্ড।

জামানি জুলুল্যান্ডের অধিবাসী, অতএব স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে তার পক্ষে খুশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ভয়ানক সমস্যা তাকে এমনভাবে বিব্রত করে তুলেছিল যে দেশে ফেরার আনন্দ সে প্রথমে উপভোগ করতে পারেনি। সমস্যাটা হচ্ছে এই :

আত্তিলিওকে কায়নার ভয়াবহ গহ্বর থেকে উঠতে দেখেছিল জামানি, আর তৎক্ষণাৎ বুঝে নিয়েছিল প্রভুর মতো দেখতে ওই জীবটি হচ্ছে প্রভুর প্রেতাত্মা; কারণ, একটা নিঃসঙ্গ মানুষ মৃত্যুগহ্বরের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করে আবার জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারে, এমন অসম্ভব কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়… কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার জামানির মনে খটকা লাগল–একটা আস্ত ভূতের পক্ষে নিরেট রক্তমাংসের দেহ নিয়ে সবসময় চলাফেরা কি সম্ভব? আবার ঘর্মাক্ত হল জামানির মস্তিষ্ক… অবশেষে বিস্তর চিন্তা করে, বিস্তর মাথা ঘামিয়ে, আসল ব্যাপারটা সে ধরে ফেলল–আত্তিলিও হচ্ছেন, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক প্রেত! না হলে, কায়নার মতো ভয়াবহ মৃত্যুগহ্বরের ভিতর থেকে একটা আস্ত মানুষ কি কখনো জ্যান্ত অবস্থায় ফিরতে পারে?…

যাই হোক, প্রেত-মানুষ যে তার প্রতি অত্যন্ত সদয় হয়ে তাকে মাতৃভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে এই চমকপ্রদ তথ্যটি আবিষ্কার করার পরই মনের মেঘ কেটে গেল, উৎফুল্ল হয়ে উঠল জামানি।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – জুলুদের দেশে আত্তিলিও

আত্তিলিও তার অভিযাত্রীদল নিয়ে জুলুল্যান্ডের ভিতর এসে পৌঁছোলেন। তিনি জানতেন দলের নেতা হিসেবে দলীয় নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব এখন থেকে তাঁকেই বহন করতে হবে। শ্বেতাঙ্গ সরকার অভিযাত্রীদের জুলুল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি দিলেও তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে অসম্মত। সরকার স্পষ্ট জানিয়েছিলেন অভিযাত্রীরা জুলুল্যান্ডে প্রবেশ করার ফলে যদি কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে সেজন্য অভিযাত্রীরাই দায়ী হবেন–স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট জুলুদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছুতেই হস্তক্ষেপ করবেন না, অবশ্য বিদ্রোহ কিংবা গণহত্যা সংঘটিত হলে আলাদা কথা।

ওসব কথা শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র নন আত্তিলিও। তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারতেন; জুলুদের ভাষা তিনি এমনভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে, ওই ভাষা বলতে বা বুঝতে তার কিছুমাত্র অসুবিধা হত না। আত্তিলিও তার জুলু-অনুচর জামানির কাছে যা শুনেছিলেন, তা থেকে জুলুদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তাঁর মোটামুটি একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। তিনি বুঝেছিলেন যে জাত্যভিমানে গর্বিত জুলুজাতি অতিশয় সাহসী ও সহজ-সরল আধুনিক জীবনযাত্রার পদ্ধতি তাদের পছন্দ নয়, তারা অনুসরণ করে পূর্বপুরুষদের প্রচলিত রীতিনীতি। আফ্রিকার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত জাতিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জুলুজাতি।

সব কিছু শুনে আত্তিলিওর মনে হয়েছিল জুলুল্যান্ডে তাদের বিশেষ কিছু অসুবিধা হবে না। নিশ্চিন্ত মনে দলবল নিয়ে তিনি একটা বৃত্তাকার পর্বতচূড়ার দিকে অগ্রসর হলেন। উক্ত পাহাড়ের উপর অবস্থান করছিল অনেকগুলো কুটির। সেই কুটিরগুলোই ছিল আত্তিলিওর লক্ষ্যস্থল। এখানে বাস করে জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসো। শ্বেতাঙ্গ সরকার কখনো তার কথার উপর কথা বলেন না; স্থানীয় ব্যাপারে জিপোসো হচ্ছে জুলুরাজ্যের মুকুটহীন রাজা।

দেখো, প্রফেসর বললেন, সর্দারের নিশ্চয়ই চল্লিশটি বউ আছে।

ঠিকই বলেছেন প্রফেসর। তবে সর্দার-পত্নীদের সঠিক সংখ্যা অনুমান করার জন্য প্রফেসরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করলে ভুল হবে জুলুজাতির সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে যারা অবহিত, তাদের পক্ষে যেকোনো জুলু-পুরুষের আস্তানার সম্মুখীন হয়ে উক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর সংখ্যা বলে দেওয়া খুবই সহজ। জুলুরা গ্রামবাসী নয়; প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তার বউদের নিয়ে স্বতন্ত্রভাব বাস করে সবচেয়ে বড়ো কুটিরটাতে বাস করে কর্তা স্বয়ং এবং গোরু রাখার জন্য যে বিস্তীর্ণ স্থানটিকে বেড়ার সাহায্যে ঘিরে ফেলা হয়, সেই ঘেরা-জায়গার চারপাশে মালিকের স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট থাকে একটি করে কুটির। পূর্বোক্ত পত্নীরা তাদের নিজস্ব সন্তানসন্ততি নিয়ে ওইসব কুটিরে বাস করে। অতএব বৃহত্তম কুটিরটির আশেপাশে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কুটিরগুলোর সংখ্যা দেখে অনায়াসেই আস্তানার মালিকের স্ত্রীর সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। বহু কুটির নিয়ে গঠিত জুলুদের এই আস্তানাকে বলে ক্রাল। একটি ক্রাল থেকে আর একটি ক্রালের দূরত্ব খুব কম নয়। বেশ কয়েক মাইল দূরে দূরে অবস্থিত কাল প্রায়ই দেখা যায় জুলুদের দেশে।

প্রফেসর বললেন, দেখো, ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

হ্যাঁ, ওরা অপেক্ষা করছিল। পুরুষদের নিয়ে গঠিত এক বৃহৎ জুলু জনতা নির্বাক হয়ে অপেক্ষা করছিল। তাদের চারপাশে দণ্ডায়মান জুলু মেয়েরা কলকণ্ঠে উত্তেজনা প্রকাশ করলেও পুরুষরা ছিল প্রস্তরমূর্তির মতো নিশ্চল, নীরব।

জিপোসোর নিজস্ব গুপ্তচর বিভাগ যে অতিশয় সক্রিয়, এই ঘটনা থেকেই তা বোঝা যায়। কারণ জিপোসোর আস্তানা বা ক্রালের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে অভিযাত্রীরা কোনো মানুষকে দেখতে পাননি, অথবা ঢাকের আওয়াজও তাদের শ্রুতিগোচর হয়নি–অথচ যথাস্থানে পৌঁছেই দেখলাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক বিপুল জনতা। জুলুরা কীভাবে বাস করে সে-কথা আগেই বলেছি, কাজেই দূরদূরান্তে অবস্থিত বিভিন্ন কাল থেকে যে ওইসব মানুষকে যথাসময়ে ডেকে আনা হয়েছে, এ-কথা অনুমান করা কঠিন নয়।

ভিড়ের মধ্যে জুলুদের অধিনায়ক জিপোসো দাঁড়িয়েছিল জনতার ঠিক মাঝখানে। তার অঙ্গ বেষ্টন করে ঝুলছিল একটা লেপার্ডের চামড়া। কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য জানোয়ারের লেজ ওই লেপার্ড চর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জুলুসর্দারের অঙ্গের শোভা বর্ধন করছিল। তার কেশশূন্য মস্তকে উষ্ণীষের অভাব পূরণ করেছিল অনেকগুলো রঙিন পাখির পালক। বহু বর্ণে রঞ্জিত ওই পালকগুলো বাতাসের ধাক্কায় দুলছিল, আর সঙ্গেসঙ্গে প্রখর সূর্যালোকে জ্বলে জ্বলে উঠছিল দোদুল্যমান রামধনুর রঙিন সমারোহ।

জিপোসোর গায়ের রং কালো নয়–হালকা বাদামি। সেই বাদামি দেহের অপূর্ব ভঙ্গি, উন্নত মস্তক ও কালো দুই চোখের তীব্র উদ্ধত চাহনি যেন নীরব ভাষায় এক প্রচণ্ড পুরুষের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করতে চাইছে–প্রথম দর্শনেই মনে হয়–হ্যাঁ, একটা পুরুষের মতো পুরুষ বটে সর্দার জিপোসো।

সালাগালে, আত্তিলিও বললেন, তুমি শান্তিতে থাক।

স্যাগাবোনা, জা বাব, স্মিতহাস্যে উজ্জ্বল হল জুলুসর্দারের মুখমণ্ডল, ফদার, তুমি শান্তিপ্রিয় মানুষ।

জার্মানি হাঁটু পেতে বসে সর্দারের সামনের ভূমিতে ললাট স্পর্শ করল। জিপোসো একবার তার দিকে তাকিয়ে জামানির অভিবাদন গ্রহণ করল, তারপর আত্তিলিওর দিকে ফিরল, আমি শুনেছি তুমি ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছ।

মুহূর্তের মধ্যে আত্তিলিও অনুভব করলেন প্রবল প্রতাপশালী এই জুলুসদারের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছে। জনতার প্রবল হর্ষধ্বনি থেকে বোঝা গেল, জুলুরাও অভিযাত্রীদের পছন্দ হয়েছে। আত্তিলিওর অনুচর জামানি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করল। যোদ্ধাদের হাতে বর্শাগুলো আনন্দের আবেগে শূন্যে দুলে উঠল বারংবার, সঙ্গেসঙ্গে সমবেত নারীকণ্ঠে জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি!

তারপর সর্দার জিপোসোর আদেশে মহামান্য অতিথিদের জন্য এল মেহগনি কাঠের আসন, খাদ্য, পানীয়। সকলে মিলে একসঙ্গে পানভোজন করতে করতে গল্পগুজব আরম্ভ করলেন।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রফেসরের কীর্তি

জামানি কাজের লোক। অভিযাত্রীরা যেদিন জুলুদের দেশে পদার্পণ করলেন, সেইদিনই রাতের দিকে তাদের বসবাসের উপযুক্ত একটা সুন্দর উপত্যকা আবিষ্কার করে ফেলল জামানি। এক সপ্তাহ লাগল সব গুছিয়ে ঠিকঠাক করতে, ইতিমধ্যে কুলির সাহায্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থাও হয়েছিল–তারপর স্থায়ীভাবে একটা তাঁবু খাঁটিয়ে বেশ কিছুদিন জুলুদের দেশে থাকার বন্দোবস্ত করলেন অভিযাত্রীরা।

স্থায়ী আস্তানা পেতে ফেলার পরই ম্যাজিক, জাদুবিদ্যা, ডাকিনী-তন্ত্র প্রভৃতি অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে অভিযাত্রীদের পরিচয় হতে লাগল প্রতিদিন। জুলুরা অলৌকিক কার্যকলাপে বিশ্বাসী। তাদের ধারণা প্রতিদিনে ছোটোখাটো ব্যাপার থেকে শুরু করে যাবতীয় আকস্মিক ঘটনা বা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মার দল। প্রেতাত্মার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন জাদুকরের সাহায্যপ্রার্থী হয়। জুলুদের উপর তাই জাদুকরদের প্রভাব খুব বেশি।

আত্তিলিও এবং তার দুই বন্ধু আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ সম্বন্ধে গবেষণা করতে এসেছিলেন, তাই জুলুজাতির গড়পড়তা দৈহিক পরিমাপ দরকার ছিল। মাপ দেওয়ার আগে প্রত্যেক জুলু তার পছন্দসই জাদুকরের কাছ থেকে কবচ বা তাবিজ সংগ্রহ করেছিল–ওই কবচ নাকি তাদের সাদা মানুষের ম্যাজিক থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু মাপ নেওয়া ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অভিযাত্রীদের কাছ থেকে তামার তার, টম্বাকো (তামাক), দেশলাই, ছোরা প্রভৃতি উপহার পেয়ে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। জিনিসগুলো তাদের যে সত্যি সত্যি দিয়ে দেওয়া হল, সে-কথা তারা প্রথমে বুঝতে পারল না–এমন মূল্যবান সব উপহার কেন তাদের দেওয়া হচ্ছে? তারা তো সাদা মানুষদের জন্য কিছুই করেনি! তবে?… অবশেয়ে যখন তারা বুঝল ওইসব জিনিস তাদের উপহার দেওয়া হয়েছে এবং এগুলো আর ফেরত নেওয়া হবে না, তখন তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই জাগল আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাস। উত্তেজিত আনন্দিত জুলুদের সশব্দ হাস্যধ্বনি শুনে অভিযাত্রীরাও খুশি।

কিন্তু অভিযাত্রীরা যখন প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে মুখের ছাপ নেবার চেষ্টা করলেন, তখন তারা দেখলেন এই ব্যাপারটা আগের মতো সহজে হওয়ার নয়। প্যারিস প্লাস্টারের ছাপ তোলার হাঙ্গামা যথেষ্ট। ঘন আঠার মতো অর্ধতরল জিনিসটা যখন ব্যক্তিবিশেষের মুখের উপর মাখানো হয়, তখন সেই লোকটির নাকের দুই ফুটো দিয়ে দুটি বড়ো খড় চালিয়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং পূর্বোক্ত তরল প্লাস্টার শুকিয়ে শক্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই লোকটির একটুও নড়াচড়া করার উপায় থাকে না। মুখের গোঁফদাড়ি প্রভৃতি ছাপ তোলার আগে তেল দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হয়; কিন্তু তেলের পরিমাণ কম হলে প্লাস্টারের ছাঁচ বা মুখোশ টেনে নেওয়ার সময় মুখের গোঁফদাড়ি ছিঁড়ে মুখের ছাপের সঙ্গে উঠে আসে! ব্যাপারটা মোটেই আরামদায়ক নয়।

তবে এইসব অসুবিধা সহ্য করতে জুলুদের বিশেষ আপত্তি ছিল না। তাদের আপত্তির কারণ অন্য। জুলুদের সামনেই অভিযাত্রীরা জামানির মুখের ছাপ নিলেন। জুলুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটা দেখল, কিন্তু একজন মুখের ছাপ দিতে রাজি হল না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ওই ছাপ তুলতে দিলে তাদের দ্বিতীয় মুখ সাদা মানুষদের সঙ্গে থেকে যাবে এবং কোনো শত্রু যদি উক্ত দুই নম্বর মুখ-এ আঘাত করে তবে মুখের প্রকৃত অধিকারীর উপর সেই আঘাত এসে পড়বে। অতএব বহু মূল্যবান উপহারের বিনিময়েও তারা মুখের ছাপ তুলতে দিতে রাজি নয়।

কয়েকজন জাদুকর গম্ভীরভাবে জানাল, জাদুবিদ্যার সাহায্যে এমন অভিনব দুর্ঘটনা থেকে জুলুদের রক্ষা করার ক্ষমতা তাদের নেই। ব্যস! হয়ে গেল! জাদুকর যেখানে ভয় পায়, সেখানে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আছে কার?…ইতিপূর্বেও কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের প্রচেষ্টা সংস্কার-অন্ধ মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে, মনে হল আত্তিলিওর দলও কুসংস্কারের কাছে পরাজিত হবে। কিন্তু অভিযাত্রীরা জানতেন কুসংস্কারকে পরাস্ত করতে হলে তার বিরুদ্ধে অন্ধ-সংস্কারকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয় অবশ্য যদি সে-রকম সুযোগ পাওয়া যায়।

সুযোগ এল অপ্রত্যাশিতভাবে।

বহু দূরবর্তী এক ক্রাল থেকে জনৈক জুলুযোদ্ধা অভিযাত্রীদের তাঁবু পরিদর্শন করতে এল। তার বাঁ-দিকের গাল ফুলেছে দেখে আত্তিলিও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল বেচারা দাঁতের ব্যথায় ভুগছে, খারাপ দাঁতের জন্যই তার গণ্ডদেশের ওই দুরবস্থা। সিগারেট উপহার দিয়ে আত্তিলিও তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন, তারপর দাঁতের চিকিৎসা করার জন্য এগিয়ে এলেন প্রফেসর।

লোকটিকে হাঁ করতে বলে প্রফেসর তার মুখের ভিতর একটা ক্ষতযুক্ত গর্ত দেখতে পেলেন। লবঙ্গ দিয়ে তৈরি একরকম চটচটে আঠার মতো ঘন পদার্থ দিয়ে ক্ষতটাকে ঢেকে দিলেন প্রফেসর। ওই অদ্ভুত চটচটে পদার্থটি প্রফেসরের নিজস্ব আবিষ্কার। যাতনাদায়ক দাঁতের রোগে ওই বস্তু ছিল অব্যর্থ ঔষধ। কিছুক্ষণের মধ্যে চটচটে জিনিসটা জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়, আর তৎক্ষণাৎ দাঁত ব্যথার উপশম হয় মন্ত্রের মতো। লোকটাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনে মিলে তাকে ক্যানভাসের উপর শুইয়ে ফেলে মুখে প্যারিস প্ল্যাস্টারের প্রলেপ লাগাতে শুরু করলেন। হঠাৎ দাঁতের যন্ত্রণা কমে যাওয়ায় লোকটাও অবাক হয়ে গিয়েছিল, বাদ-প্রতিবাদ না-করে সে প্রফেসর আর আত্তিলিওর হাতে আত্মসমর্পণ করল। কিছুক্ষণ পরে কাজ শেষ হয়ে যেতেই অভিযাত্রীরা তার মুখের উপর থেকে শক্ত প্লাস্টারের ছাপ, অর্থাৎ লোকটার মুখের ছাপ তুলে ফেললেন।

জুলুযোদ্ধা হতভম্ব হয়ে একবার গালের উপর হাত বুলিয়ে নিল, একবার হাঁ করল, তারপর আবার মুখটা বন্ধ করল। তার ভয়ানক দাঁতের ব্যথা এমন চটপট সেরে যাওয়ায় সে যে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অভিযাত্রীরা তাকে কিছু উপহার দেবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রফেসরের হাতে একটা আসাগাই (বর্শা) গুঁজে দিল।–ডাক্তারের ফি।

পরক্ষণেই দেখা গেল দারুণ আনন্দে চিৎকার করতে করতে জুলুযোদ্ধা তিরবেগে ছুটছে! অসহ্য যন্ত্রণা থেকে এমন আকস্মিকভাবে মুক্তি পেয়ে তার উল্লাস যেন ফেটে পড়তে চাইছে…

পরের দিন অভিযাত্রীরা দেখলেন দ্বিতীয় মুখ সম্বন্ধে জুলুদের ভয় ভেঙে গেছে একদিনের মধ্যেই। স্ত্রী-পুরুষ নিয়ে সর্বসমেত উশটি জুলু এসে অভিযাত্রীদের জানাল, দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুখের ছাপ তুলে চিকিৎসা করাতে তাদের আর আপত্তি নেই। আরোগ্যলাভ করতে পারলেই তারা খুশি, দ্বিতীয় মুখ নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে চায় না!…

চিকিৎসার ফল হল অতীব সন্তোষজনক। জুলুরা নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, হাতে তৈরি সুন্দর সুন্দর কাঠের জিনিস ও আসন অভিযাত্রীদের উপহার দিল। ইতিপূর্বে ওইসব জিনিস দাম দিয়েও কিনতে পারেননি অভিযাত্রীরা বিনীতভাবে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে অসম্মতি জানিয়েছিল জুলুরা। এখন সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই ওইসব বস্তু উপহার দিয়ে রোগমুক্ত জুলুরা অভিযাত্রীদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। অভিযাত্রীরা যে শুধু নানারকম ভালো ভালো উপহারই পেয়েছিলেন তা নয়, শতাধিক স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। এইজন্য অবশ্য প্রফেসরকেই ধন্যবাদ দিতে হয় তাঁর দাঁতের রোগের অব্যর্থ দাওয়াই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ত্রাস ও বিভীষিকা

জুলুদের দেশে বৃষ্টিপাত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বৃষ্টিপাতের ফলে বিস্তীর্ণ প্রান্তরগুলো হয়ে ওঠে সবুজ ঘাসের রাজত্ব এবং ওই ঘাসজমি থেকে আহার্য সংগ্রহ করে জুলুদের গৃহপালিত গোরুর পাল মনের আনন্দে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। গোরু হচ্ছে জুলুদের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। গোরুর বিনিময়ে তারা পত্নী সংগ্রহ করতে পারে, তা ছাড়া গোমাংস ও গোদুগ্ধ তাদের উদরের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেও সাহায্য করে।

বর্ষার জল যে শুধু জুলুদের গো-সম্পদ বৃদ্ধি করে তা নয়, অবিশ্রান্ত ধারাপাত দেশের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখে। বৃষ্টিপাতের ফলে শ্যাম-সবুজ অরণ্যের বুক থেকে আহার্য সংগ্রহ করে তৃণভোজী জেব্রা, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি জন্তু বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয় এবং ওইসব পশুর মাংসে জীবনধারণ করে জুলুল্যান্ডের অগণিত সিংহের দল। কিন্তু বৃষ্টি না হলে বন্য পশুরা শুষ্ক বনভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়, আর ক্ষুধার্ত সিংহরা আকৃষ্ট হয় গোমাংস ও নরমাংসের প্রতি ফলে জুলুল্যান্ডের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধ্বংস করে শুরু হয় ভয়াবহ বিভীষিকার রক্তাক্ত তাণ্ডব।

অনাবৃষ্টি যে জুলুদের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকর, কতখানি প্রাণঘাতী সর্বনাশ যে ডেকে আনতে পারে বৃষ্টিবিহীন খরার জ্বলন্ত অভিশাপ–তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিলেন অভিযাত্রীরা…

আত্তিলিও এবং তার দলবল জুলুল্যান্ডে পদার্পণ করার কয়েক মাস পরেই সেখানে অনাবৃষ্টির সূত্রপাত হয়। শুষ্ক বনভূমি থেকে আহার্য সংগ্রহ করতে না-পেরে বহু তৃণভোজী পশু মৃত্যুবরণ করল। যারা বাঁচল তারা অন্যত্র যাত্রা করল তৃণশ্যামল অরণ্যের সন্ধানে। দক্ষিণ দিকের পথে ছুটল ইম্পালা, অরিক্স, ইল্যান্ড,, জেব্রা, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি তৃণভোজী পশু। ধাবমান পশুদের খুরে খুরে ধুলো উড়ে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে দিল। পাহাড়ের চূড়ার বিভিন্ন আস্তানা থেকে জুলুরা সেই ধুলোর মেঘ লক্ষ করতে লাগল উদবিগ্ন চিত্তে। অনাবৃষ্টির দ্বিতীয় মাসের মাঝামাঝি সময়ে অদৃশ্য হল সেই ধুলোর মেঘ। সেইসঙ্গে অন্তর্ধান করল তৃণভোজী পশুর দল। বলিষ্ঠ সিংহের দলও তৃণভোজীদের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করেছিল, কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক জন্তুগুলো থেকে গেল জুলুল্যান্ডের শুষ্ক অরণ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক একদল তরুণ সিংহ, অভিজ্ঞতার অভাবে যারা বেপরোয়া; বৃদ্ধ সিংহ, দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে যারা অশক্ত, কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারির কৌশল ও চাতুর্যে যারা ভয়ংকর; এবং শাবক সমেত সিংহীর দল, যারা বাচ্চার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

ক্ষুধার্ত সিংহরা এইবার জুলুদের গোরুদের দিকে নজর দিল। বর্শাধারী জুলুযোদ্ধার দল সতর্কভাবে তাদের গোরু রক্ষা করতে সচেষ্ট হল। সিংহরা তখন মানুষের উপর হামলা শুরু করল। কয়েকবার নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করে জন্তুগুলো খেপে গেল। দলবদ্ধ নেকড়ের মতোই তারা মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, কুটিরের দরজা বন্ধ করেও কেউ আর নিরাপদ বোধ করে না–দরজা ভেঙে নরখাদক সিংহের দল মানুষ ধরতে আরম্ভ করল। সিংহের এমন অদ্ভুত ভয়ংকর আচরণ ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।

এককভাবে চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। জুলুরা দল বেঁধে অস্ত্র হাতে ভ্রমণ করত। কাটাগাছের বেড়া দিয়ে জুলুল্যান্ডের ক্রালগুলোকে ঘিরে ফেলা হল। ওইসব ক্রালের চারপাশে সারারাত আগুন জ্বলত। দৈবাৎ আগুন নিভে গেলেই হানা দেবে নরভুক শ্বাপদ। তাই শয্যা আশ্রয় করার আগে প্রত্যেক জুলু কুটিরের বহির্ভাগে অবস্থিত অগ্নিকুণ্ডে সারারাত জ্বলবার মতো কাঠ আছে। কি না দেখে নিত, ওইসঙ্গে কাটার বেড়ার মধ্যেও ফাঁক আছে কি নেই দেখতে তাদের ভুল হত না।

এত সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন ঢাকের আওয়াজে দুর্ঘটনার সংবাদ ভেসে আসতে লাগল। দিনে-রাতে, যেখানে সেখানে, যখন-তখন সিংহরা আক্রমণ চালাতে শুরু করল। নিরস্ত্র বালিকা থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ অস্ত্রধারী যোদ্ধা পর্যন্ত কোনো মানুষকেই রেয়াত করত না হিংস্র শ্বাপদ। দলবদ্ধ সিংহের সঙ্গে বর্শা হাতেই লড়াই করে প্রাণ দিল বহু জুলুযোদ্ধা। তাদের সাহস ও বীরত্বের তুলনা হয় না, কিন্তু ক্ষিপ্ত সিংহদের নিরস্ত করা গেল না কিছুতেই সমগ্র জুলুল্যান্ডের উপর মাংসলোলুপ শ্বাপদের নখদন্তে সৃষ্ট হল সন্ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব।

অভিযাত্রীদের কাজকর্মও ব্যাহত হল। জুলুদের পক্ষে দূরদূরান্তের ক্রাল থেকে এখন আর অভিযাত্রীদের তাবুতে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু অভিযাত্রীরা জুলুদের সাহায্য করতে প্রস্তুত হলেন। প্রফেসর বিলকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সিংহের কবল থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত মুষ্টিমেয় হতভাগ্যের চিকিৎসা করতে শুরু করলেন। অনেকে তাঁর চিকিৎসার গুণে বেঁচে গিয়েছিল।

আত্তিলিও গত্তি চিকিৎসার বিষয়ে একেবারে আনাড়ি। কিন্তু তিনিও জুলুদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। তবে ঔষধপত্র বা শল্যচিকিৎসকের ছুরির পরিবর্তে তার হাতে ছিল গুলিভরা রাইফেল। বিলকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন প্রফেসর তার চিকিৎসা কার্যে সাহায্য করার জন্য, সুতরাং সম্পূর্ণ এককভাবেই সিংহ-নিধনে নিযুক্ত হলেন আত্তিলিও। খরার তৃতীয় মাসের মধ্যেই তার রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল তিরিশটা সিংহের গর্জিত কণ্ঠ।

কিন্তু তারপরই বিপদ এল অতর্কিতে।

এক শয়তানের চক্রান্তে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন আত্তিলিও।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দুয়ারে মৃত্যুর ছায়া

টোয়াবেনি ছিল জুলুল্যান্ডের আতঙ্ক। কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। সে নিজেও লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার আগ্রহ প্রকাশ করত না। অভিযাত্রীরা অনেকবার জামানিকে পাঠিয়ে উক্ত ব্যক্তিকে তাদের তাঁবুতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু টোয়াবেনি সাড়া দেয়নি। দুর্দান্ত প্রতাপশালী জিপোসা সর্দার পর্যন্ত টোয়াবেনিকে এড়িয়ে চলত। আত্তিলিও যখন নিজেই এগিয়ে গিয়ে টোয়াবেনির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন তখন তাঁর সঙ্গী হল জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসো স্বয়ং। স্পষ্টই বোঝা যায় টোয়াবেনির আস্তানার মধ্যে আত্তিলিওর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলেই জিপোসো তার সঙ্গে গিয়েছিল।

আত্তিলিও একটা কম্বল নিয়ে গিয়েছিলেন টোয়াবেনিকে উপহার দেবার জন্যে। টোয়াবেনি একবার আত্তিলিওর দিকে দৃষ্টিপাত করল, পরক্ষণেই কম্বলটা টান মেরে ছিনিয়ে নিয়ে সে সবচেয়ে বড়ো কুঁড়েঘরটার ভিতর ঢুকে গেল। একটু পরেই অবশ্য কুটিরের বাইরে এসে আত্তিলিওকে উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিল টোয়াবেনি। সেইসঙ্গে ভদ্রতা করে একথাও জানালে যে, তার ক্রাল সর্বদাই আত্তিলিওকে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত। ইচ্ছে হলেই তিনি যেন তার আস্তানায় চলে আসেন।

টোয়াবেনির ব্যবহার ছিল বেশ স্বাভাবিক ও ভদ্র, কিন্তু আত্তিলিওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ওই লোকটির সম্বন্ধে বার বার সাবধান করে দিল–অন্তরের অন্তস্থলে তিনি অনুভব করলেন টোয়াবেনি তাকে পছন্দ করছে না, সুযোগ পেলেই সে শত্রুতা করবে। অবশ্য প্রথম সাক্ষাৎকারের পর বেশ কয়েকবার আত্তিলিও তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তবে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। দুটি মানুষের মধ্যে বার বার দেখাসাক্ষাৎ ঘটলে সাধারণত ঘনিষ্ঠতা হয়, কিন্তু নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে টোয়াবেনি নিজেকে সর্বদাই স্বতন্ত্র করে রেখেছে, মন খুলে কখনো সে কথা বলেনি আত্তিলিওর সঙ্গে।

চোদ্দোটি স্ত্রীর স্বামী এবং তিরিশটি কন্যার পিতা ছিল টোয়াবেনি। তার পরিবারবর্গের মধ্যে কারো সঙ্গেই আত্তিলিওর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কিন্তু টোয়াবেনির ষোলো বছরের মেয়ে দাবুলি আত্তিলিওর প্রতি আকৃষ্ট হল। খুব সম্ভব বনবালা মদাবুলি তার সহজাত সংস্কার দিয়ে আত্তিলিওর মধ্যে এক সহানুভূতিসম্পন্ন বন্ধুকে আবিষ্কার করেছিলেন। মেয়েটির জীবনে যে একটি সত্যিকারের বন্ধুর দরকার হয়েছিল, পরবর্তী ঘটনাস্রোত থেকে আমরা শীঘ্রই তা জানতে পারব।

একদিন মধ্যাহ্নে জলন্ত আফ্রিকার সূর্য যখন আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে সেইসময় রাইফেল হাতে আত্তিলিও এলেন টোয়াবেনির ক্রালে। সিংহের আক্রমণ থেকে তার ক্রালকে নিরাপদ রাখার জন্য টোয়াবেনি কী ব্যবস্থা করেছে সেইটা দেখাই ছিল আত্তিলিওর উদ্দেশ্য। টোয়াবেনির আস্তানার সামনে গিয়ে আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন–ক্রালটাকে বেষ্টন করে বিরাজ করছে কণ্টকসজ্জিত গাছপালার এক বিরাট দুর্ভেদ্য ন্যূহ, এবং ব্যুহের চারপাশ ঘিরে সারারাত ধরে জ্বলবার জন্যে সংগৃহীত হয়েছে রাশি রাশি শুকনো কাঠ–একবার তাকিয়েই বোঝা যায় শতাধিক লোকের সাহায্য ছাড়া এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

আত্তিলিও আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন দিনদুপুরে লোকজন, গোরুবাছুর এমনভাবে বেড়ার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে কেন? সিংহগুলো কি এখানে প্রখর দিবালোকের মধ্যেই হানা দিতে শুরু করেছে?… পানীয় জল আনতে গোরুবাছুর চরাতে মানুষজন নিশ্চয়ই বেড়ার বাইরে যাতায়াত করে কিন্তু কোন পথে? কণ্টক-শোভিত ব্যুহের কোথাও তো এতটুকু কঁক দেখা যাচ্ছে না।…

একটা পথের রেখা পাওয়া গেল। আত্তিলিওর মনে হল ওই পথেই লোক চলাচল করে। সন্ধিগ্ধ চিত্তে সেই পথ ধরে বেড়ার দিকে অগ্রসর হলেন আত্তিলিও, আর হঠাৎ তার সামনে প্রায় দশ ফুট জায়গা ফাঁক হয়ে গেল এবং বিভক্ত ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করল স্বয়ং টোয়াবেনি!

জা বাব, ভিতরে এসো টোয়াবেনি বলল, তাড়াতাড়ি করো। চারপাশে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে সিংহরা। আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওরা আমাদের লক্ষ করছে।

আত্তিলিও ভিতরে প্রবেশ করলেন। এমন চমৎকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং বিস্ময়কর দ্বারপথের আবিষ্কার করার জন্য টোয়াবেনির বুদ্ধির তারিফ করলেন আত্তিলিও।

প্রশংসা শুনে খুশি হলেন টোয়াবেনি। এতদিনের মধ্যে সেইদিনই শুধু তার কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্বের আভাস পাওয়া গেল–দেখো, কত সহজে কোনো শব্দ না-করে এটা খোলা যায় আর বন্ধ করা যায়।

আত্তিলিও দেখলেন দুটি দড়ির সাহায্যে টোয়াবেনি তার নিরাপদ আশ্রয়ের ভিতর থেকেই কুটিরের ভিতর অবস্থিত দরজাকে ইচ্ছানুযায়ী খুলতে পারে। প্রতিরোধের এমন কৌশল যার মগজ থেকে উৎপন্ন হয়, সেই মগজের অধিকারী যে অতিশয় বুদ্ধিমান সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। টোয়াবেনি জানাল একটু আগেই দরজাটা আর একবার ব্যবহার করার দরকার হয়েছিল। আত্তিলিও ঘটনার বিশদ বিবরণ শুনতে চাইলেন।

আমার গোরুর দল মাঠে ঘাস খাচ্ছিল, হঠাৎ সিংহ তাদের আক্রমণ করল, টোয়াবেনি বলতে লাগল আমি ঘরের ভিতর থেকে দড়ি টেনে দরজা খুলে দিতেই আমার ছেলেরা গোরুগুলোকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দুটো বাছুর এর মধ্যেই সিংহের আক্রমণে মারা পড়েছিল। সিংহেরা যখন বাছুর দুটোর মাংস খেতে ব্যস্ত, সেই সময়টুকুর সুযোগ নিয়েই আমার ছেলেরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিল–আর তারা ভিতরে আসামাত্রই আমি আমার দড়ি টেনে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক সময়মতোই দরজাটা আমি বন্ধ করেছিলাম। কারণ, খিদের প্রথম ঝোঁক কেটে গেলেই সিংহগুলো ভিতরে আসার চেষ্টা করত। ওই পাহাড়টার ওপারে আমার ভাই-এর আস্তানায় ছেলেরা এখন চলে গেছে। ভাই-এর ক্রালটাকে ঘিরে এইরকম একটা বেড়া দেওয়া দরকার, তাকে সাহায্য করবার জন্যই রওনা হয়েছে আমার ছেলেরা।

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল টোয়াবেনি। তার মুখের উপর ফুটে উঠল। নিস্পৃহ ঔদাসীন্যের পরিচিত ভঙ্গি আর একটি কথাও না-বলে সে হঠাৎ পিছন ফিরে অদৃশ্য হল তার নিজস্ব কুটিরের ভিতরে।

সঙ্গেসঙ্গে বেড়ার সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত কুটিরের ভিতর থেকে একটা মুখ বাইরে উঁকি দিল।

মদাবুলি!

আত্তিলিও দেখলেন জুলু বালিকার মুখে আজ আনন্দের চিহ্ন নেই। বিষণ্ণভাবে সে আত্তিলিওকে তার কুটিরের ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করল।

আত্তিলিও ভিতরে ঢুকলেন। মদাবুলি জানাল তার মা গেছে সপত্নীদের সঙ্গে গল্প করতে অন্য কুটিরে। মায়ের অনুপস্থিতিতে শিষ্টাচারের ত্রুটি হতে দেয়নি মেয়ে বসবার জন্য অতিথিকে একটা কাঠের আসন এনে দিল মদাবুলি।

কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর আত্তিলিও জানালেন মদাবুলির মুখে বিষাদের মেঘ তার ভালো লাগে না, তিনি তার হাসিমুখ দেখতে চান।

মদাবুলির মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা দিল। কিন্তু শুধু এক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই দু-হাতে মুখ ঢেকে সে কেঁদে উঠল। তারপরই মেঝের উপর শুয়ে পড়ে সে ফোঁপাতে লাগল। কান্নার আবেগে তার দেহটা কাঁপতে লাগল থরথর করে।

আত্তিলিও হয়ে গেলেন হতভম্ব। টোয়াবেনি যদি এই কান্নার শব্দ শোনে তাহলে সে কী মনে করবে? …কথাটা চিন্তা করতেই আত্তিলিওর খারাপ লাগল। তিনি মনে মনে কামনা করলেন এই মুহূর্তে যেন কেউ এসে পড়ে, তাহলে এই অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি থেকে তিনিও পরিত্রাণ পেতে পারেন। এই কথা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তার কানে এল। কিন্তু না–কেউ এল না। খুব সম্ভব আত্তিলিও ভুল শুনেছেন। একটা মোরগ ক্রুদ্ধস্বরে ডেকে উঠল, গোয়ালের বেষ্টনী থেকে ভেসে এল গোবৎসের করুণ কণ্ঠধ্বনি–তারপর আবার সব চুপচাপ।–কান্নার প্রথম আবেগ সামলে নিল মদাবুলি, দুএকবার ফুঁপিয়ে সে আত্মসংবরণ করল। অবশেষে মমর্যাতনার তীব্র উচ্ছ্বাস কেটে গেল, শান্ত সংযত স্বরে কথা বলতে পারল জুলু বালিকা, টোয়াবেনি ওকে খুন করবে কিংবা আমাকে।

আমাকে অর্থাৎ মদাবুলিকে খুন করা টোয়াবেনির মতো বাপের পক্ষে খুব অসম্ভব নয়, কিন্তু আত্তিলিওর জিজ্ঞাস্য হল এই ও কে?

ধীরে ধীরে সব কিছুই জানতে পারলেন আত্তিলিও। ও হচ্ছে এক তরুণ জুলুযোদ্ধা, নাম নগো। উক্ত জুলু যুবকের সঙ্গে আত্তিলিও ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। মদাবুলি অসংকোচে জানাল সে আর নগো পরস্পরকে বিবাহ করতে চায়। টোয়াবেনিকে তিরিশটা গোরু কন্যাপণ হিসেবে দিতে চেয়েছিল গো, কিন্তু টোয়াবেনি তার সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে রাজি হয়নি।

এতগুলো গোরুর বিনিময়েও টোয়াবেনি কন্যাদান করতে রাজি হয়নি শুনে অবাক হয়ে গেলেন আত্তিলিও! নগোকে তিনি খুব ভালো করেই জানেন, পাত্র হিসাবে সে চমৎকার ছেলে তবে টোয়াবেনির রাজি না-হওয়ার কারণ কী?

তার প্রশ্নের উত্তরে বালিকা জানাল টোয়াবেনি একসময়ে প্রভাবশালী জাদুকর ছিল। টোয়াবেনির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করে সর্দার জিপোসো এবং ইনডানাদের সভা (জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সভা) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জাদুকরের সম্মানিত পদ থেকে খারিজ করে দেয়। এই ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। অভিযোগ যে এনেছিল সে হচ্ছে জুলুদের এক ছোটোখাটো নেতা, গো তারই পুত্র। কিছুদিন আগে অভিযোগকারী–অর্থাৎ, গোর পিতা সিংহের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। শত্রু হিংহের কবলে মারা গেছে বটে কিন্তু টোয়াবেনির বিদ্বেষ আজও জাগ্রত যার অভিযোগের ফলে টোয়াবেনি পদমর্যাদা হারিয়েছে, তার পুত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না।

টোয়াবেনির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বক্তব্য কী ছিল, অথবা কোন ধরনের ছিল–এই সব প্রশ্নের উত্তর না-দিয়ে বার বার আত্তিলিওকে এক কথা বলতে লাগল, বাবা বলেছে গোর। সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্মতি দেবার আগে সে মেয়ের আর গোর মরা মুখ দেখবে।

আত্তিলিও জুলুদের নিয়মকানুন যেটুকু জানেন, তা থেকে বুঝলেন এই বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।

জা বাব, মদাবুলি বলল, আমি তোমার সাহায্য চাই।

তা তো বুঝলুম, আত্তিলিও মনে মনে বললেন, কিন্তু আমি বিদেশি মানুষ, জুলুদের সামাজিক ব্যাপারে হাত দেব কী করে?

তাঁর মৌনব্রত দেখে মন্দাবুলি নিরস্ত হল না। সে আত্তিলিওকে এই ব্যাপারে টোয়াবেনির সঙ্গে কথা কইতে অনুরোধ করল। সে এ-কথাও বলল আত্তিলিও যদি জিপোশোকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বলেন, তাহলে হয়তো মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে সর্বাধিনায়ক জিপোসো যদি চায় তাহলে টোয়াবেনির ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এই বিবাহ হওয়া সম্ভব, জুলুল্যান্ডে জিপোসোর কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা তারও নেই।

অশ্রুসজল চক্ষে বালিকা বার বার তার সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল, তার বিশ্বাস আত্তিলিও যদি হস্তক্ষেপ না-করেন তাহলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।

এই মেয়েটিকে তিনি কী উপায়ে সাহায্য করতে পারেন সেই কথাই ভাবছিলেন আত্তিলিও, হঠাৎ তার চোখের সামনে মদাবুলির সমস্ত শরীর হল আড়ষ্ট, মুখ হল রক্তহীন, বিবর্ণ ও বিকৃত!

আত্তিলিও চমকে উঠলেন, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো এক ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা তার মনে এল, নিশ্চয়ই ওকে অজান্তে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?

আর ঠিক সেই মুহূর্তে মদাবুলির পিছনে ছায়া-আচ্ছন্ন কুটিরের যে জায়গায় মধ্যাহ্নের সূর্যালোক প্রবেশ করেছিল, সেই আলোক-উজ্জ্বল স্থানে আবির্ভূত হল দ্রুত ধাবমান এক ছায়া!

আত্তিলিও বুঝলেন বিষ-টিষ কিছু নয়; অতিজাগ্রত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রখর অনুভূতি দিয়ে আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েছে বনবালা দারুলি তাই এই ভাবান্তর।

বালিকার পিছনে, এই ছ-ফিট দূরে কুটিরের প্রবেশপথে নড়ে উঠেছে সর্পিল ছায়া।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বিপদ

সাপের মতো লম্বা দোদুল্যমান ছায়াটা যে একটি আন্দোলিত লাঙ্গুলের ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়, এ-কথা সহজেই বুঝলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে ছায়ার পিছনে অবস্থিত নিরেট কায়ার স্বরূপ নির্ণয় করতেও তাঁর ভুল হল না–সমগ্র আফ্রিকাতে ওইভাবে চাবুকের মতো লেজ আছড়াতে পারে একটিমাত্র জীব–সিংহ!

ভয়াবহ পরিস্থিতি। দরজার ওপাশে অপেক্ষা করছে ক্ষুধিত শ্বাপদ! যেকোনো মুহূর্তেই সে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে!

সতৃষ্ণ নয়নে রাইফেলটার দিকে তাকালেন আত্তিলিও। ছায়া দেখে বোঝা যায় সিংহ ওত পেতে বসে আছে দরজার বাইরে বাঁ-দিকে। ডান দিক দিয়ে ঘুরে রাইফেল তুলতে গেলে অস্ত্র তুলে নেবার আগেই সিংহ তাকে দেখতে পাবে এবং তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাঁ-দিক দিয়ে ঘুরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাইফেলের নল ধরে সেটাকে আনা যায় বটে, কিন্তু ওইভাবে অস্ত্রটাকে বাগাতে হলে সিংহের খুব কাছাকাছি যেতে হয়।

আত্তিলিও শেষোক্ত উপায় অবলম্বন করতে চাইলেন। তিনি বসে ছিলেন, এইবার উঠে দাঁড়ালেন; আস্তে আস্তে, নিঃশব্দে।

দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন আত্তিলিও। কাটাগাছ ঘেরা অতি উঁচু বেড়াটাকে যে জানোয়ার লাফ মেরে ডিঙিয়ে আসতে পেরেছে, সে নিশ্চয়ই অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও বৃহৎ দেহের অধিকারী। দারুণ ক্ষুধার্ত না হলে সিংহ এমন দুঃসাহসের পরিচয় দেয় না–আত্তিলিও বুঝলেন সিংহকে হত্যা না করতে পারলে আজ মৃত্যু তার নিশ্চিত।

কিন্তু ঘরের মেঝেতে বিছানো মাদুরটাই গোলমাল বাধাল। প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে কট কট শব্দে প্রতিবাদ জানাতে লাগল মাদুর! আত্তিলিও মনে মনে মাদুরটাকে অভিশাপ দিলেন। কুটিরের ভিতর বদ্ধ স্থানে ওই কট কট শব্দটা তার কানে পিস্তলের আওয়াজের মতো আঘাত করছিল, অপেক্ষমাণ শ্বাপদ যে ওই আওয়াজ থেকেই শত্রুর গতিবিধি বুঝতে পারছে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য উপায় না-থাকায় আত্তিলিও ওইভাবেই এগিয়ে চললেন। তিনি জানতেন, উজ্জ্বল দিবালোকের ভিতর দাঁড়িয়ে কুটিরের ম্লান অন্ধকারে জন্তুটা ভালো দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটু পরে অন্ধকারটা সহ্য হয়ে গেলেই সে ভিতরে ঢুকে পড়বে। ইতিমধ্যে যদি তিনি কিছু না করতে পারেন, তবে সিংহের কবলে তার এবং মদাবুলির অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হতে পারে সে-কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলেন আত্তিলিও।

মদাবুলির সমস্ত শরীর তখন আড়ষ্ট। চোখে না-দেখেও সে বুঝতে পেরেছে একটা ভয়ংকর ঘটনার প্রস্তুতি চলেছে তার পিছনে। বালিকার ভীতিবিহ্বল দুই চক্ষু লক্ষ করছে আত্তিলিওর গতিবিধি এবং তার জিহ্বা হয়ে গেছে মৌন, নির্বাক। খুব ধীরে ধীরে তাকে পেরিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালেন আত্তিলিও সাহেব।

প্রবেশপথের মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সিংহ। তার দেহটা আত্তিলিওর চোখের আড়ালে, অদৃশ্য, দৃষ্টিগোচর হচ্ছে শুধু ছায়া আর কর্ণগোচর হচ্ছে দেয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর জান্তব শব্দ।

চট করে থাবা চালিয়ে দিলেই এখন সিংহ আত্তিলিওকে ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু রাইফেলটা এসে গেছে তার হাতের নাগালের মধ্যে যা করতে হয় এখনই করতে হবে, সময় নেই–আত্তিলিও হাত বাড়ালেন।

তাঁর ঘর্মাক্ত হাতের মুঠি রাইফেলের ঠান্ডা নলটাকে স্পর্শ করল। সঙ্গেসঙ্গে কানে এল শ্বাপদ কণ্ঠের গর্জনধ্বনি। রাইফেল উঠে এল হাতে। একটা সোনালি বাদামি দেহ চমকে উঠল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো–

প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়লেন আত্তিলিও! পশুরাজ ভারসাম্য রাখতে পারল না, সংঘাতের . ফলে সেও মাটির উপর গড়িয়ে পড়ল।

সিংহ আবার উঠে আক্রমণ করার আগেই আত্তিলিও গড়াতে গড়াতে খোলা দরজা দিয়ে কুটিরের বাইরে চলে গেলেন। আকস্মিক বিপদে আত্তিলিওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি, গড়াগড়ি দেবার সময়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছিলেন তিনি অন্ধকার কুটির থেকে বাইরে তীব্র সূর্যালোকের মধ্যে এসে তাঁর চক্ষু যে সাময়িক দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে সেই ভয়াবহ তথ্য চরম মুহূর্তেও তিনি ভুলে যাননি, হাতের রাইফেলটাও তিনি হস্তচ্যুত হতে দেননি–অস্ত্রটাকে তিনি ধরে রেখেছিলেন শক্ত মুঠিতে।

আত্তিলিও যে-মুহূর্তে রোদের দিকে পিছন ফিরে রাইফেল তুলে কুটিরের ভিতর দৃষ্টিপাত করলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সিংহও ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল এবং চূড়ান্ত ফয়সালা করার জন্য তাকে লক্ষ করে লাফ দিতে উদ্যত হল–হাঁটু পেতে বসে রাইফেল উঁচিয়ে বললেন আত্তিলিও, শুয়ে পড়ো মদাবুলি।

বিনা বাক্যব্যয়ে শুয়ে পড়ল মদাবুলি। সঙ্গেসঙ্গে প্রচণ্ড সিংহনাদ। রাইফেলের কর্কশ ধমক। বারুদের উগ্র গন্ধের সঙ্গে মিশল শ্বাপদ-দেহের দুর্গন্ধ এবং রক্তাক্ত গন্ধ!

আবার জাগল শ্বাপদ কণ্ঠের ভৈরব হুংকার! রক্তাক্ত শরীরে গর্জে উঠল আহত সিংহ, মাথার উপর দুলে দুলে উঠল ঝাকড়া কেশর; তার জ্বলন্ত দৃষ্টি একবার পড়ছে ধরাশায়ী াবুলির দিকে, আবার ঘুরে যাচ্ছে কুটিরের বাইরে উপবিষ্ট অস্ত্রধারী মানুষটার দিকে সে এখনও ঠিক করতে পারছে না কার উপর প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। সিংহ মনস্থির করার আগেই আত্তিলিওর রাইফেল আবার অগ্নিবর্ষণ করল। লক্ষ্য ব্যর্থ হল না, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল সিংহের মাথার খুলি সব শেষ! পশুরাজ আর কোনোদিন নরমাংস খেতে চাইবে না।

…কিন্তু মদাবুলি? সে কথা কইছে না কেন? বালিকার দেহের উপর ঝুঁকে পড়লেন আত্তিলিও। সিংহ তার দেহস্পর্শ করতে পারেনি। সে অজ্ঞানও হয়নি, দারুণ আতঙ্ক সাময়িকভাবে তার বাশক্তি ও চলৎশক্তিকে লুপ্ত করে দিয়েছে, কিন্তু তার চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত দুই চোখের নীরব ভাষায় বালিকা আত্তিলিওকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল।

আর তারপর যেন শুরু হল নরকগুলজার। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল বহু মানুষের পায়ের আওয়াজ। ভয়ার্ত গোরু বাছুরের হাম্বা ধ্বনি। টোয়াবেনি এসে উপস্থিত হল চেঁচাতে চেঁচাতে। সেইসঙ্গে সেখানে ভিড় করল বহু নারী ও বালক-বালিকা, সিংহের মৃতদেহ নজরে আসামাত্র আবার পিছিয়ে গেল সভয়ে।

আত্তিলিও কুটিরের বাইরে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে তিনি রাইফেলে আবার গুলি ভরে নিয়েছেন এবং তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মদাবুলির বাপ টোয়াবেনি। টোয়াবেনির জলন্ত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে আত্তিলিওর মনে হল চোখ নয়, একজোড়া ধারালো ছুরির ফলা ঝকঝক করছে হত্যার আগ্রহে। তিক্ত কণ্ঠে আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, সিংহ ভিতরে এল । কী করে?

অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে উত্তর এল, জানি না। আমি কুটিরের ভিতরে ছিলাম। সিংহ কী করে এসেছে বলতে পারব না।

টোয়াবেনি একটু থামল, তার পাতলা নাকের উপর ফুটে উঠল কুঞ্চনরেখার চিহ্ন, বলল, গন্ধ পাচ্ছি, আমি ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ – রহস্যময় ঢাক ও নিগ্রোদের অজ্ঞতা

ভয়, টোয়াবেনি আবার বলল, আমি ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি।

খুব অদ্ভুত কথা সন্দেহ নেই। ভয়ের আবার গন্ধ কী? কিন্তু শুধু যে কথাটাই অদ্ভুত তা নয়, টোয়াবেনির বলার ভঙ্গিও ছিল অদ্ভুত রহস্যময়।

আত্তিলিও বেড়ার গায়ে লাগানো দরজার দিকে চাইলেন। দরজাটা ঠিক মদাবুলির কুঁড়েঘরের দিকে–সব ঠিক আগের মতোই আছে? … না! সব ঠিক নেই। আত্তিলিও সাহেবের তীক্ষ্ণদৃষ্টি ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে তাঁর জুতোপরা পায়ের ছাপগুলো ধুলোর উপর থেকে অদৃশ্য। খুব তাড়াতাড়ি কেউ ওই ছাপগুলো মুছে ফেলেছে!

কে? কেন? কোন উদ্দেশ্যে?

নীচু হয়ে ভালো করে জমি দেখতে লাগলেন আত্তিলিও–তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটা পায়ের ছাপ উক্ত ব্যক্তির দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেই সবুট পদচিহ্নকে প্রায় লুপ্ত করে তার উপর আত্মপ্রকাশ করেছে আর একটা গুরুভার জীবের সুগভীর পদচিহ্ন–সিংহের পায়ের দাগ।

ব্যাপারটা এইবার আত্তিলিওর বোধগম্য হয়েছে। কোনো এক ব্যক্তি টোয়াবেনির আস্তানায় তার উপস্থিতির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছিল বলেই জুতোর ছাপগুলো হয়েছে অদৃশ্য, উক্ত ব্যক্তির পরিচয় আর উদ্দেশ্যও এখন তার কাছে গোপন নেই।

সিংহের মুখে যদি তার দেহটা টোয়াবেনির ক্রাল ছেড়ে অদৃশ্য হত, তবে কারো পক্ষে সঠিক ঘটনার অনুমান করা সম্ভব ছিল না; কারণ, আত্তিলিও যে অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন সে-কথা শুধু জানত টোয়াবেনি। হ্যাঁ, মৃন্দাবুলিও জানত আত্তিলিওর উপস্থিতি কিন্তু নরখাদক সিংহ তার নিকটস্থ দুটো মানুষকে জীবিত রাখত কি? অতএব দেখা যাচ্ছে জুতো পরা পায়ের ছাপগুলো যদি মুছে ফেলা যায়, তাহলে সিংহের কবলগ্রস্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের উপস্থিতির আর প্রমাণ থাকে না তৃতীয় ব্যক্তির সম্মুখে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, বনের জানোয়ার মানুষের ইচ্ছা পূরণ করবে কেন? তা করবে না, কিন্তু বন্ধ দরজা যদি হঠাৎ খুলে গিয়ে খাদ্যসংগ্রহের পথ উন্মুক্ত করে দেয়, তবে সবচেয়ে কাছাকাছি জ্যান্ত খাবারের দিকেই এগিয়ে আসবে মাংসলোলুপ শ্বাপদ এবং মন্দাবুলির যে কুঁড়েঘরটাতে আত্তিলিও ঢুকেছিলেন সেটা যে দরজার সবচেয়ে নিকটবর্তী কুটির সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। সমস্ত পরিকল্পনাটি নিখুঁত। গোলমাল শুনে অন্যান্য কুটির থেকে বেরিয়ে এসে জুলুরা কেউ আত্তিলিওর জুতোর ছাপ দেখতে পেত না। আত্তিলিও যদি সিংহের মুখে উধাও হতেন, তবে তো কথাই নেই–কিন্তু যদি তাকে ফেলে মৃন্দাবুলিকে তুলে নিত তাহলেও নিকটেই অবস্থিত আত্তিলিওকে নিশ্চয়ই সে জ্যান্ত রাখত না, এবং নখে দন্তে ছিন্নভিন্ন অভিযাত্রীর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে টোয়াবেনি যখন শপথ করে বলত তার অজ্ঞাতসারে সাদা মানুষটি মদাবুলির কুটিরে প্রবেশ করেছে, তখন তার কথাই অভ্রান্ত সত্য বলে গৃহীত হত–এমনকী সর্বাধিনায়ক

জিপোসোর মতো বুদ্ধিমান মানুষও আত্তিলিওর মৃত্যুর জন্য নরখাদক সিংহকেই দায়ী করত–কাটার বেড়াতে ঘেরা আস্তানার মধ্যে সিংহের অনুপ্রবেশ কী করে ঘটল তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।

আর একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল, আত্তিলিওর ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেল, তবে ওই দরজাটা চমৎকার। খুবই কার্যকরী দরজা। এবার ওটা দয়া করে খুলে দাও, আমি বাইরে যাব।

আত্তিলিও ভেবেছিলেন টোয়াবেনি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, চিৎকার করে অভিশাপ দেবে, হাতের বর্শা তুলে মারতে আসবে কিন্তু না। সে-রকম কিছুই সে করল না। এক গাল হেসে দড়ি ধরে টান মারল টোয়াবেনি, দরজা খুলে গেল আর দরজা খোলার সময়ে তার একটা পা এসে পড়ল অবশিষ্ট একমাত্র জুতোর ছাপটার উপর। •

ওই ছাপটাকে অবহেলা করা ঠিক হয়নি, আত্তিলিও বললেন, কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেছে, ওটা আমি দেখে ফেলেছি।

এখন সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন আত্তিলিও–তিনি আর মন্দাবুলি যখন কথা বলছিলেন তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি মেয়ের কথা শুনেছে টোয়াবেনি, তারপর ফিরে গিয়ে নিজস্ব কুটিরের নিরাপদ স্থান থেকে দড়ি টেনে দরজা খুলে দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করেছে ক্ষুধার্ত সিংহের জন্য–সে জানত চারদিকে ওত পেতে বসে আছে দলে দলে নরখাদক শ্বাপদ, দরজা খোলা থাকলে এক বা একাধিক সিংহের আবির্ভাব ঘটবেই ঘটবে। টোয়াবেনি যা ভেবেছিল তাই হল। খোলা দরজা দিয়ে একসময়ে প্রবেশ করেছে পূর্বোক্ত সিংহ; শয়তান জাদুকরও সঙ্গেসঙ্গে দরজা বন্ধ করতে একটুও দেরি করেনি! তারপর সে অবাধ্য কন্যা ও পরচর্চায় নিযুক্ত সাদা মানুষটার অপঘাত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছে সাগ্রহে! সিংহ তার শিকার নিয়ে মন্দাবুলির কুটির থেকে বেরিয়ে এলেই সে আবার দড়ি টেনে শ্বাপদের পলায়নের পথ মুক্ত করে দিত কিন্তু এমন চমৎকার পরিকল্পনাটা নষ্ট হয়ে গেল রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমায়। গুলির আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে এসেছে টোয়াবেনি–সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝেছে সর্বনাশ হয়েছে, সব কিছু ভেস্তে দিয়েছে সাদা মানুষের রাইফেল…।

উদবিগ্ন চিত্তে তাবুর দিকে পা চালালেন আত্তিলিও। পথের মধ্যে আর কোনো সিংহের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অন্যদিনের মতো সিংহ শিকারের চেষ্টা করলেন না তিনি। সিংহের আকস্মিক আক্রমণ তাকে ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছিল–অন্তত সেদিনটা তিনি ওই ভয়ংকর জীবের মারাত্মক সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন। নরখাদকের চাইতে নরঘাতকের দুরভিসন্ধির কথা ভেবেই তিনি বেশি উদবিগ্ন বোধ করেছিলেন তিনি বুঝেছিলেন মদাবুলি আর নগো এখন মোটেই নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে শয়তানের চক্রান্তে তাদের প্রাণহানি ঘটতে পারে। আত্তিলিও যে তার শয়তানি ধরে ফেলেছিলেন, সিংহের আবির্ভাবের রহস্য যে তার কাছে গোপনীয় নেই, সে-কথা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে টোয়াবেনি–অতএব আত্তিলিওর উপরেও সে হামলা চালাতে পারে যখন-তখন এবং সেই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা যে কমান্ডার সাহেবের মনে উঁকি দেয়নি তা নয়।

কাল সকালে উঠে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে জিপোসোর সঙ্গে দেখা করা–আত্তিলিও মনে মনে বললেন। তিনি জানতেন সর্বাধিনায়ক তার কথা বিশ্বাস করবে।

তাবুতে ঢুকতেই জামানি তাকে জানাল পরিস্থিতি খুব খারাপ। সারাদিন ধরে টমটম (ঢাক) বেজেছে। ওই শব্দের সূত্র ধরে জানা গেছে যে, দলবদ্ধ সিংহের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে জুলুদের দুটি আস্তানা। বিল আর প্রফেসর বিশ্রাম নিতে তাবুতেও এসেছিলেন, সিংহ-ঘটিত দুঃসংবাদ কর্ণগোচর হওয়ামাত্র তারা ওষুধপত্র আর রাইফেল নিয়ে অকুস্থলের দিকে ছুটে গেছেন। তবে আরও খারাপ খবর আছে–জুলুল্যান্ডের পশ্চিম অংশে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে।

বিদ্রোহ! কার বিরুদ্ধে? চমকে প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও।

জাতির মাতব্বর আর জাদুকরদের বিরুদ্ধে, জামানি বলল, ওরা সিম্বাদের (সিংহদের) থামাতে পারছে না বা থামাচ্ছে না। একজন জুলু-সর্দারকে তির ছুঁড়ে মেরে ফেলা হয়েছে। জিপোসোর হয়ে খাজনা আদায় করতে গিয়েছিল ওই সর্দার। তার অনুচরকে তির মেরে খুন করা হয়েছে শুনে জিপোসো ভয়ানক খেপে উঠেছে, সে চলে গেছে হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে সঙ্গে গেছে জুলুল্যান্ডের সেরা দু-শো যোদ্ধা।

বাঃ। চমৎকার, আত্তিলিও ভাবলেন, জিপোসোর কাছ থেকে এখন আর কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না।

আর সুকামবানা–জামানি আবার বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু হঠাৎ থেমে গিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল।

সুকামবানা নামক লোকটিকে চিনতেন আত্তিলিও। সে ছিল জুলু-শিকারিদের জাদুকর, অত্যন্ত বেয়াড়া ধরনের লোক টোয়াবেনির স্বল্প সংখ্যক বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। ধাঁ করে আত্তিলিওর মাথার ভিতর একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল–সুকামবনা আর টোয়াবেনির অশুভ যোগাযোগ কোনো ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের সূচনা করছে না তো?..

নৈশভোজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আত্তিলিও তাঁর তাঁবুতে জামানিকে ডেকে পাঠালেন। জামানি সহজভাবেই তার সঙ্গে দেখা করতে এল, কারণ, প্রত্যেক রাতেই পরের দিনের কর্মসূচি সে আত্তিলিওর কাছে জানতে পারত। কিন্তু সেসব কথা না-তুলে মাসাংগা যখন তাকে সুকামবানার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে ঘাবড়ে গেল। মুখ ফসকে দু-একটা কথা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জামানি তখন মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছে, কিন্তু এখন আর আত্তিলিও তাকে ছাড়তে রাজি নন–জেরার মুখে সে আরও কয়েকটা গোপনীয় কথা ফাঁস করে ফেলল। শেষকালে আত্তিলিও যখন শপথ করে বললেন সর্বাধিনায়ক জিপোসোকে তিনি কিছু বলবেন না, তখনই সব কিছু খুলে বলতে রাজি হল জামানি।

জামানির বক্তব্য সংক্ষেপে পরিবেশিত হলে যা হয় তা হচ্ছে এই

বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা জুলুদের পূজা প্রার্থনাআর কাকুতিমিনতি শুনেও অবিচলিত; বৃষ্টির নাম নেই, খরদাহে জ্বলছে জুলুদের দেশ, সিংহরা সংখ্যায় বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে তাদের সাহস আর ঔদ্ধত্য জন্তুগুলো এখন আর মানুষকে ভয় করে না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য জুলুল্যান্ডের মানুষ অতীন্দ্রিয় জগৎকে অর্থাৎ প্রেতাত্মাদের দায়ী করছে। আত্তিলিওর কাছে টোয়াবেনি বলেছিল তার ছেলেরা নাকি টোয়াবেনির এক ভাই-এর কালে গেছে একটা বেড়া বাঁধার কাজে সাহায্য করতে–কথাটা আদপেই সত্যি নয়। একদল ক্ষিপ্ত জুলুকে সংঘবদ্ধ করার জন্য টোয়াবেনির ছেলেরা যেখানে গিয়েছিল সেটি হচ্ছে আর এক শয়তানের আস্তানা–সুকামবানার ক্রাল!

জামানির বক্তব্য থেকে আরও একটি তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন আত্তিলিও সুকামবানার সঙ্গে নাকি জরুরি পরামর্শ করেছেন আনজিয়ানা স্বয়ং! এই অতি মূল্যবান সংবাদটি অবশ্য সুকামবানা নিজেই জুলুদের জানিয়েছে, জামানিও বাদ যায়নি।

এই পর্যন্ত বলেই জামানি হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল, তার কথাগুলো মুখের ভিতর আটকে যেতে লাগল বার বার; ভাঙা ভাঙা গলায় ফিস ফিস করে ভয়ার্ত জামানি যা বলল তা থেকে আত্তিলিও বুঝলেন সুকামবানা নাকি সবাইকে বলেছে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী হচ্ছে এক জুলুযোদ্ধা! সুকামবানার মতে উক্ত জুলুযোদ্ধার চোখ দুটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অমঙ্গলের অভিশাপ এবং এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধার লাভ করতে হলে অবিলম্বে অভিশপ্ত চক্ষুবিশিষ্ট ওই মানুষটিকে শাস্তি দেওয়া দরকার কিন্তু অনেক মানুষের ভিড়ের ভিতর থেকে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে হলে গন্ধ বিচারের সভায় যে-মানুষটি ওইভাবে বিচার করতে সক্ষম, সেই অদ্বিতীয় জাদুকরকে তার অধিকৃত পদ থেকে খারিজ করে তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ঈর্ষাকাতর জ্ঞানী ব্যক্তিদের সভা এবং সর্দার জিপোসো। বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা এই অবিচারে ক্রুদ্ধ হয়েছেন, অনাবৃষ্টির জন্য জিপোসোর অবিচারও কিছুটা দায়ী বলে মতপ্রকাশ করেছে সুকামবানা।

জিপোসো এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিচারে টোয়াবেনিকে যে দোষী সাব্যস্ত করে জাদুকরের সম্মানিত পদ থেকে বিচ্যুত করা হয় তা শুনেছিলেন আত্তিলিও–অতএব তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন সুকামবানার উল্লিখিত জাদুকরটি টোয়াবেনি ছাড়া আর কেউ নয়।

জামানির কাছ থেকে আরও একটি সংবাদ জানতে পারলেন আত্তিলিও। সংবাদটি হচ্ছে এই–

জিপোসো বিদ্রোহ দমনে যাত্রা করার আগে সুকামবানা গন্ধের সাহায্যে বিচার করার অনুমতি চেয়েছিল। জিপোশো অনুমতি দেয়নি। সে জানত গন্ধ বিচার অনিবার্যভাবেই নরহত্যা ঘটাবে, এমনকী গণহত্যার মতো বীভৎস কাণ্ড ঘটাও অসম্ভব নয়।

কিন্তু জিপোসো এখন অনুপস্থিত, সুকামবানা আর টোয়াবেনিকে বাধা দেবে কে? আত্তিলিও বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই কাল ওরা গন্ধ বিচারের সভা ডাকছে।

না, না, কাল নয়, জামানি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কাল নয় মাসাংগা, কাল কিছু হবে না।

তবে? কবে হবে ওই বিদঘুঁটে কাণ্ড?

জবাব নেই। জামানি আবার বোবা। মাসাংগার অনেক অনুরোধ-উপরোধেও তার মৌনভঙ্গ হল না।

পরের দিন কোথাও গেলেন না আত্তিলিও, তাবুতেই বসে থাকলেন। ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। আত্তিলিও ঢাকের ভাষা জানেন না, কিন্তু ঘন ঘন দ্রুততালে সেই ধ্বনিতরঙ্গের প্রবল উত্তেজনা তিনি অনুভব করতে পারলেন। ঢাক কী বলছে জানার জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু জানবেন কী করে? তাঁবুর নিগ্রোরা হঠাৎ ঢাকের ভাষা ভুলে গেছে! আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর জামানিও ব্যতিক্রম নয়। বার বার প্রশ্ন করে একই উত্তর পেলেন আত্তিলিও–ঢাকের ভাষা তারা নাকি কিছুই বুঝতে পারছে না! এক রাতের মধ্যে আয়ত্ত-বিদ্যার এমন হঠাৎ বিলুপ্তি এবং স্মরণশক্তির এমন আকস্মিক বিপর্যয় দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আত্তিলিও!…

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ – গন্ধের বিচার

রাত এল। যথানিয়মে আবার এল প্রভাত। আজ আর ঢাক বাজছে না। আগের দিনের অবিরাম ধ্বনিতরঙ্গের পরে এই অস্বাভাবিক স্তব্ধতা যেন ভয়ংকর এক ঘটনার পূর্বাভাস।

আত্তিলিও উঠে দাঁড়ালেন, জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হলেন, তারপর পদার্পণ করলেন তাঁবুর বাইরে। জামানিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমি টোয়াবেনির কাছে যাচ্ছি। তুমিও সঙ্গে চলো। আত্তিলিও যা ভেবেছিলেন তাই হল–জামানি তার আদেশ অমান্য করে দাঁড়িয়ে রইল এবং বার বার তাকে তাঁবু ছেড়ে বাইরে যেতে নিষেধ করল। সে এ-কথাও বলল, তার নিষেধ অগ্রাহ্য করা মাসাংগার উচিত নয়।

আত্তিলিও শুনলেন না। তিনি জানতেন জামানি তাকে ভালোবাসে, তার বিপদ হতে পারে বলেই সে তাকে কোথাও যেতে বারণ করছে। কিন্তু আত্তিলিওর কানে তখনও বাজছে জুলু বালিকার কাতর প্রার্থনা–জা বাব, আমি সাহায্য চাই।

আত্তিলিও অনুমান করেছিলেন মদাবুলি আর গোর সর্বনাশ করার জন্য এক চক্রান্তের জাল বুনছে দুই শয়তান টোয়াবেনি ও সুকামবানা। চক্রান্তকারীদের কী করে বাধা দেবেন সে-কথা আত্তিলিও নিজেও ভাবতে পারেননি, বিশেষত ষড়যন্ত্রের চেহারাটা তখন পর্যন্ত তার কাছে অস্পষ্ট–কিন্তু যে ভয়াবহ বিপদের ফলে দুটি নিরাপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে চলেছে, তাতে যথাসাধ্য বাধা দেওয়া উচিত মনে করেই তিনি টোয়াবেনির আস্তানা লক্ষ করে যাত্রা করেছিলেন। সঙ্গে ছিল নিত্যসঙ্গী রাইফেল আর ক্যামেরা। পথে যেতে একটা সিংহের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। ক্যামেরার সাহায্যে পশুরাজের আলোকচিত্র গ্রহণ করতেও তার ভুল হয়নি। সিংহটা তাকে আক্রমণের চেষ্টা না-করে বিলক্ষণ সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। সেদিন সকালে গুলির আওয়াজে জুলুদের কাছে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে রাজি ছিলেন না আত্তিলিও।

প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে তিনি টোয়াবেনির ক্রালের নিকটে অবস্থিত পাহাড়ের উপর এসে পৌঁছালেন। সেখান থেকে চারদিকে দৃষ্টিসঞ্চালন করে তিনি দেখলেন তার উলটোদিকে যে পাহাড়টার উপর এই সময়ে টোয়াবেনির গোরুগুলো ঘাস খেয়ে বেড়ায়, সেখানে তারা নেই–গোরুগুলোকে কালের ভিতর তাদের নির্দিষ্ট আবেষ্টনীর মধ্যে আজ বন্দি করে রাখা হয়েছে। আস্তানার দরজাটা খোলা এবং সেই উন্মুক্ত প্রবেশপথের মুখে ভিড় করেছে জুলু-রমণীর দল। দ্বারের বাইরে ছোটো ছোটো কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে উত্তেজিত স্বরে কথা কইছে প্রায় শ-খানেক পুরুষ। বিস্তীর্ণ মাঠের এখানে ওখানে কালো কালো ছাপ দেখে আত্তিলিও বুঝলেন, যেসব ঝোঁপঝাড় বা শুষ্ক নালার মধ্যে সিংহের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা ছিল, সেই জায়গাগুলো জুলুরা আগুনে পুড়িয়ে সাফ করে ফেলেছে।

দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন আত্তিলিও। এই মুহূর্তে পিছন ফিরে তিনি যদি যাত্রা করেন তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। যেখানে আছেন, সেখান দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদের ভয় নেই। কিন্তু অত দূর থেকে কিছু দেখা বা শোনার আশা তাহলে একেবারেই ত্যাগ করতে হয়। সামনে এগিয়ে গেলে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তবে এটুকু বিপদের ঝুঁকি নিলে হয়তো তিনি এমন দৃশ্য দেখতে পাবেন যা ইতিপূর্বে ইউরোপ বা আমেরিকাবাসী কোনো শ্বেতাঙ্গের দৃষ্টিগোচর হয়নি। হয়তো এসব দুর্লভ দৃশ্যের আলোকচিত্র গ্রহণ করার সুযোগও পেতে পারেন তিনি, এবং–

এবং বরাত ভালো থাকলে রক্তারক্তির ভয়াবহ সম্ভাবনাকেও হয়তো রোধ করতে পারবেন।

মুহূর্তের আবেগে পরিচালিত হলেন আত্তিলিও, হাতের রাইফেল মাটিতে নামিয়ে তিনি পাহাড় ভেঙে নীচের দিকে নামতে লাগলেন। আত্তিলিও ভেবেছিলেন, নিরস্ত্র অবস্থায় গেলে জুলুরা নিশ্চয়ই তার মনোভাব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করবে না। তা ছাড়া রাইফেল এখন কোন কাজে লাগবে? অবস্থা যদি ঘোরালো হয়, তবে শ-খানেক বর্শার বিরুদ্ধে একটা রাইফেল নিয়ে তিনি কী করতে পারেন?

পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে নামতে তিনি যখন অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছেন সেই সময়ে হঠাৎ জনতার ভিতর থেকে একটা উত্তেজিত তীব্র স্বর সকলকে সাবধান করে দিল।

এক-শো লোকের জনতা এক মুহূর্তে চুপ, সকলের দৃষ্টি পড়েছে আত্তিলিওর দিকে! পাহাড়ের মাঝামাঝি নেমে এলেন আত্তিলিও। জনতা কথা কইল না, নিঃশব্দে তাঁকে লক্ষ করতে লাগল। নীচু জায়গাটা পার হয়ে পরবর্তী উচ্চভূমির উপর পা রাখলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে মুখর হয়ে উঠল মৌন জনতা! সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়।

উঁচু জমি পার হয়ে এসে দাঁড়ালেন জুলুদের মাঝখানে–তৎক্ষণাৎ চিৎকার, গোলমাল, হইহই, ধুন্ধুমার কাণ্ড!

আত্তিলিও জুলুদের কাছে বিনীত ভদ্র ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত, কিন্তু জনতার মধ্যে কেউ তাকে ভদ্রতাসূচক অভিবাদন জানিয়ে অভ্যর্থনা করল না। ভদ্রতা, শিষ্টতা প্রভৃতি সৌজন্যবোধ সেদিন জুলুদের ভিতর থেকে অন্তর্ধান করেছে সাদা মানুষের অনধিকার চর্চায় তারা বিরক্ত, কয়েকজন আবার বিরূপ মনোভাব গোপন করতেও চাইল না। আত্তিলিও দেখেও দেখলেন না, বুঝেও বুঝলেন না। সোল্লাসে হাত নেড়ে তিনি জুলুদের অভিবাদন জানালেন, সালাগাতলে!

একজন উত্তর দিল। সেই একজন অবশ্য খুব সাধারণ মানুষ নয়; যে-লোকটি আত্তিলিওর অভিবাদনে সাড়া দিয়েছিল সে হচ্ছে জুলুদের মধ্যে এক প্রাচীন ইনডানা (জ্ঞানী ব্যক্তি)। সাহস ও বীরত্বের জন্য সে যৌবনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং জুলুদের সামাজিক ব্যাপারে তার মতামতের মূল্য ছিল খুব বেশি।

ওই বিশিষ্ট লোকটির সঙ্গে আত্তিলিও সাহেবের যে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে কোনো তরফ থেকেই কৃত্রিমতার স্থান ছিল না।

স্খলিত চরণে এগিয়ে এসে পূর্বোক্ত ইনডানা আত্তিলিওর হাতে হাত দিয়ে করমর্দন করল।

আত্তিলিও বললেন, ওদের জানিয়ে দাও আমি এখানে দর্শক হিসাবে এসেছি। যা দেখব, যা শুনব, সে-কথা আমি শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষের কাছে বলব না।

ভীষণ চেঁচামেচি গোলমাল হচ্ছিল। হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলল ইনডানা। কয়েক মিনিট ধরে নির্বাক জুলুজনতাকে উদ্দেশ করে সে কথা বলল। প্রথমেই সে জনতাকে জানিয়ে দিল সাদা মানুষের সঙ্গে ম্যাজিকের বাক্স (ক্যামেরা) ছাড়া কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই, অতএব তার উদ্দেশ্য খারাপ নয়। তারপর অভিযাত্রীদের সততা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রমাণ হিসেবে সাদা মানুষদের বিভিন্ন কীর্তিকলাপের কথা বলতে আরম্ভ করল–সিংহের আক্রমণে আহত জুলুদের চিকিৎসা করে অভিযাত্রীরা যে অনেককে বাঁচিয়ে তুলেছেন সেইসব কথা সে উল্লেখ করল, সিংহ শিকারের কথা, দাঁতের ব্যথা উপশম করে জুলুদের আরাম দেওয়ার ইতিহাস প্রভৃতি সব ঘটনার কথাই সে বলেছিল এবং পরিশেষে সাদা মানুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান উপহারগুলোর কথাও সে জনতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলল না।

ইনডানার কথা শেষ হল। সঙ্গেসঙ্গে মুখ খুলল সুকামবানা। ঝড়ের বেগে সে অনেক কথাই বলে গেল। উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত সেই দ্রুত বাক্যঝটিকার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হচ্ছে–

চুলোয় যাক সাদা মানুষরা!

জনতা এইবার একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। জনতার এক অংশ জানাল আত্তিলিওর উপস্থিতি তাদের কাছে আপত্তিকর নয়, অপর অংশ বিদেশিকে ঘটনাস্থলে থাকতে দিতে অসম্মত। আত্তিলিও কোনোদিকে নজর দিলেন না, নির্লিপ্তভাবে তিনি ম্যাজিকের বাক্স হাতে ফটো তুলতে শুরু করলেন।

সুখের বিষয় অকুস্থলে টোয়াবেনি উপস্থিত ছিল না। সে থাকলে হাওয়া বদলে যেত। আত্তিলিও পূর্বোক্ত ইনডানাকে ভোটের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করতে বললেন। ভোট নেওয়া হল। শূন্যে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে জ্বলে জ্বলে উঠল অনেকগুলো বর্শাফলক অধিকাংশ মানুষই হাতের অস্ত্র তুলে ধরে আত্তিলিওর স্বপক্ষে রায় দিল। যারা বিদেশির উপস্থিতি চায়নি, তারা বিনা বাক্যব্যয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি মেনে নিল। এই ব্যাপারে সুকামবানার আর কিছু বলার উপায় থাকল না। জনতাকে উদ্দেশ করে সে একটি হুকুম দিল, সঙ্গেসঙ্গে আত্তিলিওর উপস্থিতি ভুলে গেল জনতা–সুকামবানা আর জ্ঞানী ব্যক্তিদের মাঝখানে রেখে তারা গোল হয়ে বসে পড়ল।

তারপর বৃত্তাকারে উপবিষ্ট জনতার ভিতর থেকে জাগল মিলিত কণ্ঠে সংগীতধ্বনি। খুব ধীরে ধীরে মৃদুস্বরে গান গাইছে জনতা। ঐকতান সংগীত শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই কুটির থেকে বেরিয়ে এল টোয়াবেনি! চতুর্দিকে দণ্ডায়মান জুলু-মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে সরে দাঁড়াল, বৃত্তাকারে উপবিষ্ট পুরুষরা বৃত্ত ভেঙে তাকে মধ্যস্থলে প্রবেশ করার পথ ছেড়ে দিল। টোয়াবেনি কারো দিকে চাইল না, তার গতিবিধি এখন সম্মোহিত ব্যক্তির মতোই আড়ষ্ট এবং তার ভাবলেশহীন চক্ষু দুটির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে একটা শানিত বর্শাফলকের উপর। ওই বর্শাটাকে মাটিতে পুঁতে তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছিল পুরুষের দল।

টোয়াবেনির উপস্থিতির সঙ্গেসঙ্গে সম্মিলিত কণ্ঠের মৃদু সংগীতধ্বনি বেজে উঠল। টোয়াবেনির পাতলা ছিপছিপে শরীরটা দুলতে লাগল একবার সামনে, একবার পিছনে… তীব্রতম পর্যায়ে উঠে গেল গায়কদের কণ্ঠস্বর… উদারা, মুদারা, তারা… তারপর আবার নীচের দিকে নেমে আসতে লাগল সুরের ঢেউ, মৃদু থেকে হল মৃদুতর, অস্পষ্ট এবং পরিশেষে বিরাম লাভ করল স্তব্ধতার গর্ভে। গান থামল। এখন মৌন জনতার নির্নিমেষ দৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য হল টোয়াবেনি। আত্তিলিও অনুভব করলেন এক ভয়ংকর প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে নির্বাক মানুষগুলো।

টোয়াবেনির নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত; তার দেহে বুঝি ভর করছে প্রেতাত্মা। আচম্বিতে এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে সে ভূপৃষ্ঠে প্রোথিত বর্শার কাছ থেকে ছিটকে অনেক দূরে এসে পড়ল, তারপর ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক জুলু-যোদ্ধার দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করল। আবার ঘুরে এসে সে লাফিয়ে লাফিয়ে যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে শুঁকতে লাগল। এক একটি লোককে দু-বার, তিনবার করে সে কল, তবু শেষ হল না গন্ধের বিচার এবং ক্লান্ত হল না টোয়াবেনি, যন্ত্রের মতো লাফাতে লাফাতে সে যোদ্ধাদের দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল বারংবার…

আত্তিলিও অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন এইভাবে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে কী করে? অনেকেই, বিশেষ করে অভিজ্ঞ শিকারিরা জানেন, মানুষ অথবা জানোয়ার ভয় পেলে তাদের শরীর থেকে এক ধরনের গন্ধ নির্গত হয় কিন্তু সেই গন্ধকে আবিষ্কার করতে পারে বিশেষ কয়েক শ্রেণির পশুর ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয়। হয়তো দীর্ঘকাল অনুশীলন করার ফলে বন্য পরিবেশের মানুষ টোয়াবেনি ওই বিদ্যাকে আয়ত্ত করেছে, হয়তো সত্যিকার অপরাধীর দেহনিঃসৃত ঘামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে ভয়ের গন্ধ এবং অনুশীলন করে যদি কেউ ওই গন্ধের স্বরূপ নির্ণয় করতে পারে তার পক্ষে অপরাধীকে শনাক্ত করা খুবই সহজ। কিন্তু অনাবৃষ্টির জন্য কোনো মানুষ অপরাধ বোধ করে ভয়ার্ত হয়ে উঠবে না, কাজেই গন্ধের বিচার এখানে একবারেই অকেজো। জুলুদের পক্ষে সব কিছুই বিশ্বাস করা সম্ভব হলেও আত্তিলিওর পক্ষে এমন কড়া গাঁজা হজম করা দুঃসাধ্য।

ওই যে! ওই যে সেই লোক, যার দুই চোখে জড়িয়ে আছে অমঙ্গলের অভিশাপ তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠল টোয়াবেনি। জনতা চিৎকার করে উঠল।

শূন্যে লাফিয়ে উঠল এক-শো যোদ্ধা, তাদের ঘর্মাক্ত দেহে চকচক করে উঠল সূর্যরশ্মি। একটি লোকের হাত চেপে ধরল টোয়াবেনি, শুরু হল ধস্তাধস্তি। জনতা ছুটে এসে দুজনকে ঘিরে ফেলল। অত লোকের হুটোপুটির ভিতর ধৃত ব্যক্তির চেহারা দেখতে পেলেন না আত্তিলিও, তবে বুঝলেন গন্ধের বিচার শেষ হয়েছে–

ধরা পড়েছে অপরাধী!

.

নবম পরিচ্ছেদ – ক্রুদ্ধ জনতা

আত্তিলিও অবাক হয়ে ভাবছেন টোয়াবেনির ষড়যন্ত্রের শিকার কে হতে পারে, হঠাৎ তার পাশ কাটিয়ে কেউ যেন ছুটে বেরিয়ে গেল। তিনি ঘুরে দেখলেন একটি মেয়ে। সে ছুটছিল তিরবেগে, পিছন থেকে তার মুখ দেখতে পেলেন না আত্তিলিও, তবু মেয়েটিকে তিনি চিনতে পারলেন মন্দাবুলি! তাকে চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন আত্তেলিও; তাকে কেউ দেখতে পায়নি সকলেরই ব্যগ্র দৃষ্টি সেইখানে, যেখানে জুলুদের মাঝখানে টোয়াবেনির সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। একটি হতভাগ্য মানুষ! জনারণ্যের ভিতর থেকে তার চেহারা দেখতে না-পেলেও মদাবুলির আচরণেই আত্তিলিও বুঝে গেছেন টোয়াবেনির কবলে পড়ে যে-মানুষটি ছটফট করছে সে গো ছাড়া আর কেউ নয়। আর সঙ্গেসঙ্গে ধাবমান জুলু বালিকার উদ্দেশ্যও তিনি ধরে ফেলেছেন–সে ছুটে চলেছে সর্বাধিনায়ক জিপোসোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।

আত্তিলিওর ভ্রূ কুঞ্চিত হল।

চারদিকে অগণিত নরখাদক সিংহের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি এড়িয়ে অরণ্য-প্রান্তর ও পর্বতের দুস্তর বাধা ভেদ করে বালিকা কি জিপোসোর সঙ্গে দেখা করতে পারবে? পারবে কি সেই লোকটাকে বাঁচাতে যে এখন ছটফট করছে ক্ষিপ্ত কুসংস্কার-অন্ধ জনতার মধ্যে?…

হ্যাঁ, ছটফট করছে গো, তাকে চেপে ধরেছে ক্রুদ্ধ জনতা। একদল জুলুযোদ্ধা তাকে শূন্যে তুলে ফেলল, তারপর হাতে হাতে তুলে নিয়ে এল একটা মস্ত গাছের নীচে। আত্তিলিও গাছটার দিকে তাকালেন, পত্রবিহীন ওই বিশাল শুষ্ক বৃক্ষটির নাম তিনি শুনেছেন–যাতনাদায়ক বৃক্ষ। তার জুলু অনুচর জামানি একদিন তাকে পূর্বোক্ত গাছটির নাম এবং কার্যকারিতা সবিস্তার জানিয়ে দিয়েছিল। জামানির মুখ থেকেই আত্তিলিও শুনেছেন যে, গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে প্রাচীনকালে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হত–রজ্জবদ্ধ অপরাধীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচগান চালাত বর্শাধারী যোদ্ধার দল এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খুঁচিয়ে মারত ওই হতভাগ্য মানুষটিকে…।

আত্তিলিও সচমকে ভাবলেন তাকেও কি আজ ওইরকম বীভৎস হত্যাকাণ্ডের দর্শক হতে হবে? তা ছাড়া আর একটা ভীষণ সম্ভাবনার কথা তার মনে হল।

নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করলেই সিংহ যেমন মানুষখেকো হয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই মানুষের ভিতরকার পশুও রক্তপাতের জন্য হন্যে হয়ে উঠে নগোর রক্তপাতে উল্লসিত। জনতার মধ্যে যদি রক্তের তৃষ্ণা জাগে, তাগলে তারা কি আত্তিলিওকে রেহাই দেবে?…

ইতিমধ্যেই তাদের পরিবর্তন এসেছে। শান্তশিষ্ট মানুষগুলো বন্য পশুর মতোই ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তাদের চোখে-মুখে এখন রক্তলোলুপ শ্বাপদের হিংস্র অভিব্যক্তি!

আত্তিলিওর পা দুটো তাকে ঘটনাস্থল থেকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল সেইখানে, যেখানে পড়ে আছে তার রাইফেল–প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তিনি পলায়নের ইচ্ছা দমন করলেন।

ষোলো বছরের একটি বালিকা যদি এই ক্ষিপ্ত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধাচরণে প্রবৃত্ত হয়, নিরপরাধ মানুষের প্রাণ রক্ষা করার জন্য ওইটুকু মেয়ে যদি চতুর্দিকে ভ্রাম্যমাণ শত শত নরখাদক সিংহের ভয়াবহ উপস্থিতি অগ্রাহ্য করতে পারে, তবে আত্তিলিওর মতো একজন সৈনিক পুরুষের পক্ষে পালিয়ে আত্মরক্ষার চিন্তা করাও অন্যায়।

তিনি পলায়নের ইচ্ছা দমন করে যেকোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলেন।

চারপাশে দণ্ডায়মান জনতা ও গোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন আত্তিলিও ক্রুদ্ধ জনতার আস্ফালন এখন থেমে গেছে, তারা ধীরভাবে অপেক্ষা করছে ইনডানাদের কথা শোনার জন্য। যতই রাগ হোক, জুলুরা ইনডানা উপাধিপ্রাপ্ত জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মতামত কখনো অগ্রাহ্য করে না। সব সমেত তিনজন ইনডান সেখানে উপস্থিত ছিল।

প্রথমেই এগিয়ে এল সেই ইনডানা, যে প্রথমেই আত্তিলিওর সঙ্গে করমর্দন করেছিল। ওই লোকটি নগোর কাছে জানতে চাইল সে অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছে কি না। গো জানাল সে নিরপরাধ। ইনডানাটি তখন জনতাকে জিপোসোর জন্য অপেক্ষা করতে অনুরোধ করল। তার কথার ভঙ্গিতে বোঝা গেল গোর অপরাধ সম্বন্ধে সে নিজেও নিঃসন্দেহ নয়।

এইবার দুনম্বর ইনডানা তার অভিমত প্রকাশ করল। তার কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে গাছের সঙ্গে বেঁধে গোকে মেরে ফেলা উচিত। জুলুদের প্রাচীন পদ্ধতি অনুসারে ধীরে ধীরে খুঁচিয়ে মারার পক্ষপাতী সে নয়, চটপট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করতেই সে ব্যগ্র কারণ, জিপোস অকুস্থলে এসে পড়ে সব ওলটপালট করে দিতে পারে এমন সম্ভাবনার কথাও জনতাকে সে জানিয়ে দিল এবং শুভ কার্যে বিলম্ব না-করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে পরবর্তী বক্তাকে স্থান ছেড়ে দিল।

জনতার একাংশ প্রবল হর্ষধ্বনিতে সমর্থন জানাল, আর এক দলের তরফ থেকে শোনা গেল শ্লেষতিক্ত ব্যঙ্গধ্বনি!

এইবার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল তিন নম্বর ইনডানা। তার বক্তব্য হচ্ছে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী বিচার না-করলে অন্যায় হবে; অতএব গরম জলের সাহায্যে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ নির্ণয়ের যে প্রাচীন প্রথা আছে, সেই প্রথা অনুসারেই গোর বিচার হওয়া দরকার। গোর ডান হাত ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দিয়ে যদি দেখা যায় সে অক্ষত আছে, তবেই বোঝা যায় সে নির্দোষ।

জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে এই প্রস্তাব সমর্থন করল। সঙ্গেসঙ্গে কুটিরের ভিতর থেকে একটা মস্ত বড় হাঁড়ি নিয়ে এল টোয়াবেনি। আত্তিলিও বুঝলেন, শয়তানটা আগে সব ঠিক করে রেখেছিল। গোর সামনে ফুটন্ত গরম জলের হাঁড়ি রাখা হল। সে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু শয়তান টোয়াবেনি বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে গোর ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল হাঁড়ির ভিতর।

কয়েক মুহূর্ত… গোর হাত ছেড়ে দিল টোয়াবেনি… সঙ্গেসঙ্গে বাঁ-হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল নগো–গরম জল তার হাতটাকে ঝলসে দিয়েছে।

ওই হচ্ছে অপরাধী, চেঁচিয়ে উঠল সুকামবানা, বেঁধে ফেলো ওকে গাছের সঙ্গেতারপর ধীরে ধীরে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে ওকে শেষ করে দাও। শয়তান গোই বৃষ্টি বন্ধ করেছে আর সিম্বাদের (সিংহদের) লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের উপর।

তৎক্ষণাৎ জন বারো বলিষ্ঠ যোদ্দা নগোকে ধরে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে ঘিরে শুরু হল উদ্দাম নৃত্য। নাচতে নাচতে বর্শাধারী যোদ্ধারা গোল হয়ে ঘুরতে লাগল গোকে মাঝখানে রেখে। গোর সামনে দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময়ে প্রত্যেক যোদ্ধা তার দেহ লক্ষ করে সজোরে বর্শা চালনা করতে লাগল এবং এমন অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে চালিত বর্শা ফলকের গতিবেগ তারা রোধ করছিল যে, লক্ষ্যস্থলের মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে এসেই থেমে যাচ্ছিল অস্ত্রের শানিত ফলক!

এখন সময় হয়নি–

ধীরে ধীরে কমে আসবে লক্ষ্যস্থলে ও দংশন-উদ্যত বর্শাফলকের মধ্যবর্তী দূরত্ব, মৃদু আঘাতে রক্ত পান করবে একটির পর একটি শানিত বর্শা, অজস্র অগভীর ক্ষত থেকে ঝরতে থাকবে রক্তের ধারা, তারপর এক সময়ে প্রচণ্ড আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে যাবে হতভাগ্য গোর হৃৎপিণ্ড। কিন্তু

কিন্তু নির্বাক ও নিশ্চেষ্ট হয়ে এই বীভৎস্য দৃশ্য দেখার জন্যই কি অপেক্ষা করছেন আত্তিলিও?

.

দশম পরিচ্ছেদ – জাদুকরের ভূমিকায় আত্তিলিও

অনাবৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, চিরস্থায়ী হতে পারে না। আত্তিলিও আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না, কোনো আশা নেই, এখানে সেখানে কিছু কিছু মেঘ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু বৃষ্টি সুদূর পরাহত।

পকেট ব্যারোমিটার নামক যে ছোটো যন্ত্রটি সর্বদা আত্তিলিওর সঙ্গী, সেই যন্ত্রটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তিনি। ব্যারোমিটারের কাঁটা দেখে বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি আসন্ন, খুব সম্ভব দু-চারদিনের মধ্যেই বর্ষণ শুরু হবে। কিন্তু আত্তিলিওর তো দু-দিন পরে হলে চলবে না, এই মুহূর্তে বৃষ্টির দরকার–তবে?…

আত্তিলিও ঘড়ি দেখলেন। ঠিক এগারোটা বেজেছে। প্রায় এক ঘণ্টা হল মদাবুলি চলে গেছে। এখান থেকে। সমবেত কণ্ঠে ঐকতান সংগীত বেজে উঠেছে তীব্র শব্দে, দ্রুততর হয়ে উঠছে নৃত্যের ছন্দ–বর্শা গুলো কিন্তু এখনও গোর দেহ স্পর্শ করেনি। গোর দিকে তাকালেন আত্তিলিও। একটুও বিচলিত হয়নি সে। তার সুশ্রী মুখণ্ডলে গভীর অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের চিহ্ন!…

আত্তিলিও চিন্তা করতে লাগলেন। একজন ইনডানা যেন একটু আগেই কী বলছিল.. কী বলছিল?… হা, হা মনে পড়েছে দু-ঘণ্টা পরেই দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এই এলাকায় পদার্পণ করছে সর্দার জিপোসো এবং এলাকার মধ্যে এসে পড়লে সর্বাধিনায়ক তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে কতক্ষণ অজ্ঞ থাকবে বলা শক্ত–অতএব দু-ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছিল উক্ত ইনডানা।

দু-ঘণ্টা? এই দু-ঘণ্টা যদি জনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন আত্তিলিও তাহলে বোধ হয় নগোর প্রাণরক্ষা হয়। কিন্তু এই ক্ষিপ্ত জনতাকে কি অতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? …আত্তিলিও দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন।

একটা তীব্র চিৎকার আত্তিলিওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।

না, ন্‌গো নয়–চেঁচিয়ে উঠেছে জনতা! রক্তপাত শুরু হয়েছে! আঘাত মারাত্মক নয়, কিন্তু বর্শার আঘাতে গোর জানু থেকে গড়িয়ে নামছে রক্ত!

আর রক্ষা নেই–আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠবে তারপর হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করে একসময়ে নেমে আসবে মৃত্যু!

দাঁড়াও! থামো, চেঁচিয়ে উঠলেন আত্তিলিও। নাচ থেমে গেল। দারুণ বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল যোদ্ধার দল।

আত্তিলিও বললেন, দাঁড়াও, জুলুরা, দাঁড়াও! বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা এখনই বৃষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছে।

এক-শো মানুষ মুখ তুলল আকাশের দিকে। পরক্ষণেই জাগল ক্রুদ্ধ গুঞ্জনধ্বনি। কোথায় বৃষ্টি? আসন্ন বৃষ্টিপাতের কোনো চিহ্নই নেই নীল আকাশের বুকে। কারো দিকে চাইলেন না আত্তিলিও, কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না তিনি, সোজা এসে দাঁড়ালেন জনতার মাঝখানে।

একটু অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনো, যে ইনডানার সঙ্গে আত্তিলিওর বন্ধুত্ব ছিল, সেই লোকটি এবার এগিয়ে এল। জনতাকে উদ্দেশ করে সে যে আদেশ-বাণী উচ্চারণ করল, তার মর্মার্থ হচ্ছে ধৈর্যধারণ করে সাদা মানুষের ম্যাজিকের বাক্স কী করে সেইটা দেখাই এখন জুলুদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।

আত্তিলিও ততক্ষণে তার ম্যাজিকের বাক্স অর্থাৎ ক্যামেরা বাগিয়ে ধরেছেন এবং অতি মন্থর পদে অগ্রসর হয়েছেন গোর দিকে। ক্যামেরার লেন্স গোর বুকের কাছে ধরে ফিসফিস করে আত্তিলিও বললেন, চেঁচাও।

জোরেই চেঁচিয়েছিল গো। এমন কর্ণভেদী মনুষ্যকণ্ঠের আর্তস্বর ইতিপূর্বে কখনো আত্তিলিওর শ্রুতিগোচর হয়নি।

দেখছ? বিজয়গর্বে ঘুরে দাঁড়ালেন আত্তিলিও জনতার দিকে, এক-শো বর্শার সামনে দাঁড়িয়ে যে ভয় পায়নি, সে এখন চেঁচিয়ে উঠেছে, এখন বুঝেছ আমার ক্ষমতা?

জুলুরা চমৎকৃত! সত্যি কি ভয়ংকর ওই ম্যাজিকের বাক্স? আরও ভয়ংকর ওই বাক্সের চোখটা (লেন্স)?

এইবার একটা লম্বা বক্তৃতা শুরু করলেন আত্তিলিও। অভিভূত জুলু-অভিনেতা স্তম্ভিত বিস্ময়ে সেই আজগুবি, অদ্ভুত আর অসম্ভব কথাগুলো শুনতে লাগল। যত রকমের বিদঘুঁটে অবিশ্বাস্য বিষয়বস্তু আত্তিলিও ভাবতে পেরেছিলেন, সবগুলিই তিনি পরিবেশন করেছিলেন সেই বক্তৃতার মধ্যে।

টোয়াবেনি আর সুকামনা রাগে কাঁপছিল। তাদের দিকে নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন আত্তিলিও, কী হে! এইবার? তোমরা কী বলতে চাও?

অনেক কিছুই হয়তো বলার ছিল। কিন্তু শয়তান চুপ করে রইল। তারা জানত জুলুরা এখন তাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করবে না–সাদা মানুষের ম্যাজিকের বাক্স, আর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা এখন তাদের অভিভূত করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে আত্তিলিও আর এক কাজ করেছেন–পকেট থেকে সিগারেট বার করে বিলিয়ে দিয়েছেন জুলুদের মধ্যে। জুলুল্যান্ডে সিগারেট অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য আর লোভনীয় বস্তু। অধিকাংশ লোকই সিগারেট নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল হত্যার আগ্রহে যারা একটু আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তারাই এখন ধোঁয়া ওড়াচ্ছে নির্বিকারভাবে!

আত্তিলিও জানতেন এই পরিবর্তন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। আবার খেপে উঠবে জনতা। তবে কিছুটা সময় তো পাওয়া গেল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই আত্তিলিওর উর্বর মস্তিষ্কে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পরিকল্পনা–দেখছি? আত্তিলিও কম্পাস বার করে সকলের সামনে ধরলেন, এই দেখ, ছোট্ট বর্শাটা (কম্পাসের কাটা) কেমন কাঁপছে? এর মানে কী জান?

জুলুরা মাথা নাড়ল–না, সাদা মানুষের ভেলকি তারা বুঝতে পারে না। এর মানে হচ্ছে, আত্তিলিও বললেন, এখনই বৃষ্টি শুরু হবে। সামনের গাছটার ছায়া এই জায়গায় পড়লেই বৃষ্টি নামবে।

আত্তিলিও তার ডান পায়ের গোড়ালি মাটিতে ঠুকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। জনতা এখন আর হিংস্র নয়। তাদের অস্বাভাবিক উন্মাদনা কেটে গেছে। আত্তিলিও জুলুদের স্বভাব জানতেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন উপস্থিত জনতার মধ্যে অনেক মানুষই এখন সর্বাধিনায়ক জিপোসোর আইন ভঙ্গ করার শোচনীয় পরিণাম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। আত্তিলিও হয়েতো জনতার শুভ বুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলে নগোকে রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু টোয়াবেনি আর সুকামবানা তাকে সেই সুযোগ দিল না। শান্ত জনতাকে আবার তারা উত্তেজিত করে তুলল।

…মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে… গাছের ছায়াটা সরে সরে এসে আত্তিলিওর চিহ্নিত স্থানের খুব কাছেই এসে পড়েছে।

চাপা গলায় গর্জে উঠল টোয়াবেনি, ছায়াটা ঠিক জায়গায় এসে পড়লেই বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার কথা। যদি তা না হয় তবে গোকে হত্যা করা হবে। একটু থামল টোয়াবেনি, তার অবরুদ্ধ কণ্ঠ সাপের মতো হিস হিস করে উঠল, তারপর সাদা মানুষের পালা।

আত্তিলিও জানতেন সেটা সহজ নয়। জুলুরা তার গায়ে হাত দিতে সাহস করবে না। তবে টোয়াবেনি যে তাকে খুন করার চেষ্টা করবে সে-বিষয়ে আত্তিলিওর কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

সময় কাটতে লাগল ধীরে ধীরে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এগিয়ে আসতে লাগল গাছের ছায়া নির্দিষ্ট স্থানের দিকে। অবশেষে এল সেই চরম মুহূর্ত, আত্তিলিওর চিহ্নিত স্থানে উজ্জ্বল রোদের আলোকে লুপ্ত করে নামল অন্ধকারের প্রলেপ–

গাছের ছায়া এসে পড়েছে চিহ্নিত স্থানের উপর।

জুলুরা আকাশের দিকে মুখ তুলল–নির্মেঘ আকাশে জ্বলছে মধ্যাহ্ন সূর্য, বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনাই সেখানে দেখা যাচ্ছে না।

জনতার মধ্যে আবার জাগল হিংস্র উত্তেজনা। আবার শুরু হল উদ্দাম নৃত্য। এবার তারা দেরি করতে চায় না, কয়েকটা আসাগাই (বর্শা) গোর দেহে বিভিন্ন স্থানে আঘাত করল। ক্ষতচিহ্নগুলো খুবই তুচ্ছ ছিল বটে, কিন্তু আত্তিলিও জানতেন কিছুক্ষণের মধ্যেই আঘাতের বেগ জোরালো হয়ে উঠবে–রক্ত দেখে খেপে উঠবে.জুলুরা, সঙ্গেসঙ্গে মারাত্মক গম্ভীর হয়ে চেপে বসতে থাকবে বর্শাফলকের দংশন এবং এক সময়ে চমর আঘাতে নেমে আসবে মৃত্যু।

আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত। তিনি বুঝেছেন আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোর মৃত্যু অবধারিত। তারপর তার পালা। টোয়াবেনির ইঙ্গিত পেলেই তারা যে আত্তিলিওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন নিসন্দেহ। তার একমাত্র ভরসা সর্বাধিনায়ক জিপোসো। কিন্তু জিপোসোকে যে এখানে নিয়ে আসতে পারে, সেই মদাবুলি এখন কোথায়? চতুর্দিকে ভ্রাম্যমাণ নরভুক সিংহদের নজর এড়িয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে জিপোসোর সঙ্গে দেখা করতে সমর্থ হয়েছে কি জুলুবালিকা?..

একটা বর্শার ফলা নগোর বুকে বিদ্ধ হল। হৃৎপিণ্ডের একটু উপরে। এগিয়ে এল আর একটা বর্শা। আত্তিলিও বুঝলেন চরম আঘাত পড়ার সময় এগিয়ে আসছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করবে গো। আর তারপরেই যে রক্তাক্ত বর্শাফলকগুলো নেচে উঠবে তার চারপাশে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আত্তিলিও সেই দুরবস্থার কথা কল্পনা করে চমকে উঠলেন–গোর মতো নির্বিকার মুখে অবিচলিতভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার সাধ্য তার নেই…

আত্তিলিও নিজের শ্রবণশক্তিকে বিশ্বাস করতে পারলেন না–গোর নাম ধরে কে যেন ডাকছে!

কিন্তু না, ভুল হয়নি–উপত্যকার তলা থেকে নারীকন্ঠের চিৎকার ভেসে এল আবার, নগো! গো!

আত্তিলিও দেখলেন পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে ছুটে আসছে মদাবুলি। পাহাড়ের অপর প্রান্তে যেখানে আত্তিলিও সাহেব রাইফেল রেখে এসেছিলেন সেখানেও আবির্ভূত হয়েছে অনেকগুলো বর্শাধারী মনুষ্যমূর্তি! সর্দার জিপোসো এসে পড়েছে সসৈন্যে।

জনতা সচমকে ফিরে দাঁড়াল, তারপর প্রাণপণে ছুটে পালাতে চেষ্টা করল। কেউ পালাতে পারল না, জিপোসোর সৈন্যরা প্রত্যেকটি মানুষকেই বন্দি করে ফেলল।

মদাবুলি ছুটতে ছুটতে এসে আত্তিলিওর সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।

আত্তিলিও বলে উঠলেন, ভয় নেই, গো বেঁচে আছে।

হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তর দিল মদাবুলি, তুমি–তুমিও বেঁচে আছ?

ঠিক দুদিন পরেই বৃষ্টি নামল জুলুল্যান্ডে।

.

একাদশ পরিচ্ছেদ – সর্বাধিনায়ক জিপোসো

আহত গো আরোগ্য লাভ করার সঙ্গেসঙ্গেই জিপোসোর আস্তানাতে বিচারসভা বসল। বলাই বাহুল্য বিচারক ছিল জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসা।

বিচারের ফলাফল দেখে আত্তিলিও বুঝলেন জুলুদের নেতা অসাধারণ তার দূরদর্শিতা, রাজনীতিজ্ঞান ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি অতুলনীয়।

ইনডানা বা জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সম্বন্ধে কোনো আলোচনা উঠল না। সর্বাধিনায়ক শুধু বলল, উক্ত জ্ঞানী ব্যাক্তিদের জিহ্বা সম্বন্ধে সংযত হওয়া উচিত এবং যেহেতু তারা মূখের মতো কথা বলে এক অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, সেইজন্যে কয়েক দিন সম্পূর্ণ মৌন থেকে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

গন্ধের বিচারে যে যোদ্ধার দল অংশগ্রহণ করেছিল, তারা রেহাই পেল না। আদালতের রায় অনুসারে প্রত্যেক যোদ্ধাদের উপর জরিমানা ধার্য হল–উত্তমরূপে প্রস্তুত একটি আসাগাই (বর্শা), তিনটি বাছুর ও তিনটি ছাগল। জন্তুগুলো যেমন তেমন হলে চলবে না, দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সেরা জন্তুগুলোকেই দাবি করেছে আদালত।

সাধারণ যোদ্ধাদের চার গুণ বেশি জরিমানা ধার্য হল সুকামবানার উপর। জরিমানার ফলে যে পশু আদায় করা হল, সেই জন্তুগুলোর মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ গোকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেওয়া হল। অবশিষ্ট অংশ গ্রহণ করল সর্দার জিপোসো, আদালতের ব্যয়নির্বাহ করার জন্যে ।

টোয়াবেনিকে নিজের হাতে শাস্তি দিল না জিপোসো। ওই শয়তান জাদুকরের কুকীর্তির বিশদ বিবরণসহ তাকে প্রেরণ করা হল ইশোয়ি নামক স্থানের ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। শ্বেতাঙ্গদের বিচারে টোয়াবেনির যে কী দুরবস্থা হবে সে-বিষয়ে জিপোসো ছিল দস্তুরমতো সচেতন।

নিজের হাতে দণ্ডবিধান করে জুলুদের সমালোচনার বিষয়বস্তু হতে চায়নি বলেই সাদা মানুষদের হাতে টোয়াবেনির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল সর্দার জিপোসো। অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত এক রক্ষীবাহিনী টোয়াবেনিকে নিয়ে রওনা হল উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে।

জুলুদের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে পরিবারের কর্তা মারা গেলে বা অক্ষম হলে ওই পরিবারের সব দায়িত্বই সর্দারকে বহন করতে হয়। টোয়াবেনির পরিবারভুক্ত মানুষগুলোর জন্য খুব ভালো ব্যবস্থাই করেছিল জিপোসো।

তবে টোয়াবেনির অন্যতম কন্যা মদাবুলি সম্বন্ধে আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠকের কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক কারণ, উল্লিখিত জুলুবালিকা হচ্ছে এই অরণ্য-নাটকের নায়িকা।

জিপোসো মন্দাবুলির সঙ্গে গোর বিবাহের ব্যবস্থা করল। তবে টোয়াবেনির পরিবর্তে যেহেতু এখন কন্যার অভিভাবকের স্থান নিয়েছে জিপোসো, তাই বরকে পূর্ব-প্রতিশ্রুত তিরিশটি গোরু কন্যাপণ দিতে হবে জিপোসোরই শ্রীহস্তে! বিচারের এই অংশটুকু শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায় রাজ্যের সর্বত্র কী ঘটেছিল সে নিয়ে সর্বাধিনায়ক সর্বদাই অবহিত না হলে গোর কন্যাপণের প্রতিশ্রুতি জিপেসোর কর্ণগোচর হয় কী করে?…

আত্তিলিওর জুলু অনুচর জামানিকে নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে? জিপোসোর বিচারসভাতে জামানিকেও ডাকা হয়েছিল। সে আত্তিলিওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিল বলেই একটা দুর্ঘটনা গতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু জুলু জাতির অধিনায়কের পক্ষে সমস্ত ব্যাপারটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে খুব অন্যায় হয় না বরং জাতীয় স্বার্থে সেটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য জিপোসো একবারও বলেনি যে, জামানি মূখের মতো জুলুজাতির গোপন তথ্য সাদা মানুষের কাছে ফাস করে দিয়েছে, এবং যে-মানুষ বিদেশিদের কাছে এতখানি বিশ্বস্ত হতে পারে, দেশের বাইরে তার উপস্থিতি জাতির পক্ষে বিপজ্জনক। না, না, এসব কথা মোটেই বলেনি জিপোসো, বরং জামানির প্রশংসায় সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। জিপোসো জানাল তার দেশের যে-মানুষটি এমন অদ্ভুত জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী তাকে সে হারাতে পারে না। জাতীয় স্বার্থে ওই লোকটির সর্বদাই অবস্থান করা উচিত দেশের মধ্যে। অতএব সর্বধিনায়কের নিজস্ব পরামর্শদাতার সম্মানজনক পদে জামানিকে বহাল করা হল এবং টোয়াবেনির ক্রাল-এর যাবতীয় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ও ভোগ করার অধিকার দেওয়া হল জামানিকেই।

জামানিকে শুধু ঘরই দেয়নি জিপোসো, ঘরনির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। দুটি জুলু যুবতীর সঙ্গে জামানির বিবাহের ব্যবস্থা করে দিল সর্বাধিনায়ক জিপোসো। দু-দুটো বউ পেয়ে জামানি এত খুশি হল যে, কন্যাপণ হিসাবে জিপোসোকে এক কুড়ি গোরু দিতেও আর আপত্তি হল না। আত্তিলিও বুঝলেন, জিপোসো সকলের প্রতি সুবিচার করল বটে সেইসঙ্গে নিজের সম্পত্তির পরিমাণও বাড়িয়ে ফেলল সুকৌশলে!

সকলেরই যখন বিচার হল, তখন আত্তিলিওর দলবলই-বা বাদ যায় কেন? জিপোসোর পরিবর্তে অন্য কোনো নেতা হলে সে স্পষ্টই বলত, শোনো ভাই! তোমরা এখানে এসে সিংহ মেরেছ, দাঁতের ব্যথা সারিয়েছ। ভালো ভালো উপহারও দিয়েছ–সব সত্যি; কিন্তু আগে বলো তো ভাই, এখানে তোমাদের কে আসতে বলেছে? শুধু জুলুদের উপকার করে উদার-হৃদয়ের পরিচয় দিতেই তোমাদের শুভাগমন হয়েছে, এমন কথা বিশ্বাস করার মতো মূর্খ আমরা নই। যা হয়ে গেল তার জন্য দেশের লোকের কাছে তোমরা খুবই অপ্রিয় হয়ে উঠবে। জুলুরা তোমাদের ভয় করবে, এড়িয়ে চলবে–কারণ, যেকোনো সময়ে তাদের গোপনীয় কথা তোমরা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস করে দিতে পার। আর এখন তো জুলুল্যান্ডে বৃষ্টি নেমেছে, কাজেই তৃণভোজী পশুরা আবার এখানে ফিরে আসবে এবং সিংহের দলও হামলা না-করে বুনো জানোয়ারের দিকে আকৃষ্ট হবে। অতএব, তোমরা আমাদের দেশ ছেড়ে চটপট বিদায় হও, জুলুরা তাদের ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানো পছন্দ করে না।

হ্যাঁ, অন্য কোনো নেতার পক্ষে ওই কথা বলাই স্বাভাবিক, কিন্তু জিপোসো হচ্ছে অসাধারণ মানুষ–অপ্রীতিকর বক্তব্যকে সে উপস্থিত করতে পারে সুন্দরভাবে। অনর্থক তিক্ততাকে পরিহার করতে ভালোভাবেই জানে সর্বাধিনায়ক জিপোসো।

অভিযাত্রীরা যে এখন পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করার কথা মুখেও আনেননি সেদিকে নজর না-দিয়ে সমবেত জনতাকে জিপোসো জানিয়ে দিল, বিদেশি আগন্তুকরা জুলুদের জন্য যথেষ্ট স্বার্থত্যাগ করেছেন–অতএব তারা দেশত্যাগ করার আগে দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা অবশ্য কর্তব্য। গোকে হত্যা করার অনুষ্ঠানে লিপ্ত হওয়ার জন্য অভিযুক্ত জুলু-যোদ্ধাদের আদেশ দেওয়া হল, তারা যেন প্রত্যেকেই গৃহনির্মিত কারুশিল্পের একটি করে নিদর্শন অভিযাত্রীদের উপহার দেয়–কারণ, পূর্বোক্ত এক-শো অভিযুক্ত যোদ্ধা আত্তিলিওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, অতএব উল্লিখিত উপহার জরিমানাস্বরূপ দিয়ে তারা বিদেশি অতিথির মার্জনা লাভ করতে পারবে। এইটুকু শাস্তি যথেষ্ট বলে মনে করল না জিপোসো; সে জানাল অভিযাত্রীদের জিনিসপত্র সসম্মানে গাড়িতে তুলে দিয়ে তাদের জুলুল্যান্ড পরিত্যাগ করার কাজে সাহায্য করতে হবে এবং ওই সাহায্যের ভার গ্রহণ করার জন্য পারিশ্রমিক দাবি করা চলবে না এ-কথাও জানিয়ে দিতে ভুলল না জিপোসো।

এমন চমৎকার বিচারের ফলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উৎসাহ বা আনন্দের লক্ষণ দেখা গেল না। ম্রিয়মাণ জনতাকে লক্ষ করে জিপোসো গর্জন করে উঠল, তোমাদের জন্য যেন মাসাংগাদের যাত্রা করতে দেরি না হয়ে যায়। কাল সকালেই ওঁরা দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, তোমাদের ত্রুটির ফলে যদি যাত্রা করতে দেরি হয়, তবে জরিমানার পরিমাণ হবে দ্বিগুণ! কথাটা যেন মনে থাকে!

এইবার ভাষণ দিতে উঠলেন আত্তিলিও। খুব সহজ সরলভাবে নির্বিকারমুখে তিনি জানালেন যে নেতা এমন সুন্দরভাবে বিচার করতে পারে এবং নির্বাক অতিথির মনোভাব বুঝতে পেরে তার ইচ্ছা পূরণের জন্য চেষ্টিত হয়, তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা তার নেই। তবে এমন একজন অধিনায়কের নেতৃত্ব লাভ করে সমগ্র জুলুজাতি যে ধন্য হয়েছে এ-বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ।

পরের দিন সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের ভিতর দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন অভিযাত্রীরা। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, যে লোকগুলো একদিন আগে বৃষ্টির জন্য নরহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তারাই আজ হাঁটু পর্যন্ত কাদাজলের ভিতর মালপত্র ঘাড়ে নিয়ে বিব্রত! বৃষ্টিপাতের অবস্থা দেখে অভিযাত্রীরা বুঝলেন বৃষ্টি এখন সহজে থামছে না, অন্তত বেশ কিছুদিন ধরে চলবে অনর্গল ধারাবর্ষণ। হঠাৎ জুলুল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় পূর্ব-পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আত্তিলিও সাহেব জিপোসোর কাছে প্রকৃত মনোভাব ব্যক্ত করেননি। যাওয়ার আগে অশ্রুসজল অভিযাত্রীদের বিদায় জানাল জামানি।

জুলু-যোদ্ধারা খুব মনমরা হয়েই অভিযাত্রীদের মোট বহন করার কার্যে নিযুক্ত হয়েছিল, ভালো ভালো হাতে-গড়া কারুশিল্পও তারা অভিযাত্রীদের উপহার দিতে বাধ্য হয়েছিল জিপোসোর আদেশে অতএব তাদের মুখে-চোখে যে খুব আনন্দের চিহ্ন ফুটে ওঠেনি সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে তাদের মুখে হাসি ফুটল–আত্তিলিও সাহেব উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে কুণ্ঠিত হননি, এমনকী উপহারের বিনিময়েও অর্থ দিয়েছিলেন মুক্তহস্তে।

জুলুদের বিদায় করে অভিযাত্রীরা এইবার নিজেদের মধ্যে আলোচনাসভা ডাকলেন। হঠাৎ জুলুল্যান্ড থেকে বিদায় নেওয়ায় তাঁদের কর্মসূচির পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছিল। আলোচনার ফলে স্থির হল, মোজাম্বিক এবং দক্ষিণ রোডেশিয়ার ভিতর দিয়ে যাবেন বিল ও প্রফেসর। কোনো অজ্ঞাত কারণে হাতি শিকারের জন্য অস্বাভাবিক আগ্রহ প্রকাশ করছিল বিল; কয়েকটা হাতির ভবলীলা সাঙ্গ করতে না-পারলে তার স্বস্তি নেই। অতএব ঠিক হল, বায়রা থেকে ইউরোপ হয়ে যাত্রা করার আগে প্রফেসরের সঙ্গে আত্তিলিও দেখা করবেন।

তারা স্থির করলেন কেপটাউন থেকে ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকাতে গিয়ে নতুন করে একটা অভিযানবাহিনী সংগঠিত করবেন এবং আফ্রিকার যেসব স্থান আজও অনাবিষ্কৃত সেখানে পূর্বোক্ত অভিযানবাহিনীর সাহায্যে গবেষণার কাজ চালাবেন।

পরবর্তী অভিযানের জন্য যে-জায়গাটা আত্তিলিও মনোনীত করেছিলেন, সেটি হল আফ্রিকার কিভু অরণ্য–অতিকায় দানব-গরিলার বাসস্থান।

অভিযাত্রীদের জল্পনাকল্পনা শুনে অদৃশ্য নিয়তির ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটেছিল মনে হয়; কারণ–

বায়রা থেকে জাহাজ ধরতে পারেনি বিল, তার আগে সে নিজেই ধরা পড়ে গেল এক স্বর্ণকেশী সুন্দরীর হাতে। কিন্তু তারপরই নববধূর সান্নিধ্য ত্যাগ করে বিল ছুটে গেল এক সাংঘাতিক ভবিতব্যের দিকে–

এইবার প্রফেসরের কথা। কেপটাউনে বন্ধুবর আত্তিলিওর সঙ্গে দেখা করার পরিবর্তে তিনি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন এবং আমাদের কাহিনি থেকেও বিদায় গ্রহণ করলেন এখান থেকেই আত্তিলিও গত্তির অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির মধ্যে আমরা আর প্রফেসরকে দেখতে পাব না…।

এদিকে কাহিনির নায়ক আত্তিলিও কিভুর জঙ্গলে দানব-গরিলার সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু গরিলার পরিবর্তে তার সম্মুখে আবির্ভূত হল দলবদ্ধ এক জান্তব বিভীষিকা! সেই চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ নিয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে আত্তিলিওর পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি।

অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৭৯

৩. শত্রু – প্রথম খণ্ড

সৈনিকের তৃতীয় অভিজ্ঞতা
শত্রু – প্রথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – আত্তিলিওর সঙ্গী

বর্তমান কাহিনিতে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার আগে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি বলেছেন, এই ঘটনা যদিও বহুদিন আগে ঘটেছে, তবু এখনও মহিষ শব্দটি যদি তিনি শোনেন অথবা উক্ত পশু সম্বন্ধে কোনো আলোচনা যদি তাঁর শ্রুতিগোচর হয়, তাহলে তাঁর সর্বাঙ্গের মাংসপেশি হয়ে যায় আড়ষ্ট–এখনও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে তিনি যেন শুনতে পান শত শত খুরের ভয়াবহ ধ্বনি, এখনও তার মানসপটে ভেসে ওঠে সেই ভয়ংকর দৃশ্য যেখানে প্রান্তরের উপর দণ্ডায়মান তার অসহায় দেহ লক্ষ করে ছুটে আসছে শত শত জীবন্ত বিভীষিকা, সম্মুখে অবস্থিত মনুষ্যমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করে মাটিতে মিশিয়ে দেবার জন্য…

এই ভীতিপ্রদ কাহিনি পরিবেশন করার আগে আফ্রিকার বুকে আত্তিলিওর প্রথম অভিজ্ঞতার বিবরণী পাঠকের দৃষ্টিগোচর হওয়া দরকার–ওই বিবরণ পাঠ করলেও পাঠক বুঝতে পারবেন আফ্রিকাবাসী বিভিন্ন জীবজন্তুর মধ্যে কেবল মহিষ নামক জীবটি সম্বন্ধে আত্তিলিওর বিদ্বেষমূলক মনোভাব নিতান্ত অকারণে সৃষ্ট হয়নি। কমান্ডার সাহেব তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, আফ্রিকাবাসী যাবতীয় মহিষকেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে শত্রু বলে মনে করেন। আফ্রিকার অরণ্যে পদার্পণ করার সঙ্গেসঙ্গেই মহিষ সম্বন্ধে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন আত্তিলিও। যে শোচনীয় ঘটনার ফলে পূর্বোক্ত শৃঙ্গধারী পশুটি সম্পর্কে আত্তিলিওর মনে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হয়েছিল, সেই ঘটনার বিশদ বিবরণীর মধ্যে বর্তমান কাহিনির শুরু।

আত্তিলিও গত্তির বয়স যখন কুড়ির কিছু বেশি, সেই সময়ে শিকার-কাহিনি, অভিযান-কাহিনি ও জীবজন্তু বিষয়ক প্রচুর পুস্তক পাঠ করে তার ধারণা হল ওইসব ব্যাপারে তার জ্ঞান সম্পূর্ণ। হয়েছে–এইবার একটা অভিযানে বেরিয়ে পড়লেই হয়। তিনি মনে করলেন কয়েকটা ঘোড়া, রাইফেল আর গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলেই আফ্রিকার দুর্গম অরণ্যে অভিযান শুরু করা যায়। অ্যাংলো ইজিপশিয়ান সুদানের অজ্ঞাত স্থানগুলোকেই অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছিলেন আত্তিলিও সাহেব। পরে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন পুথিগত বিদ্যা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মূল্য এক নয়।

একে অল্প বয়সের গরম রক্ত, তার উপর বিস্তর বই-টই পড়ে আত্তিলিও হয়ে পড়েছেন সবজান্তা–অতএব সকলের মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি উপস্থিত হলেন সুদানের খার্তুম নামক স্থানে। শুধু গন্তব্যস্থল সম্পর্কে পরিচিত মানুষের মতামত উপেক্ষা করেই ক্ষান্ত হননি আত্তিলিও, সকলের সাবধানবাণী তুচ্ছ করে তিনি মেলামেশা শুরু করলেন মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে। আত্তিলিওর শুভার্থীরা তাঁকে একবাক্যে ওই বিপজ্জনক লোকটির সংশ্রবে আসতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু স্বজান্তা আত্তিলিও কারো কথায় কান দিলেন না। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল মহম্মদ আলি এবং আত্তিলিও গত্তির সম্পর্ক হচ্ছে কায়ার সঙ্গে ছায়ার মতোই অবিচ্ছিন্ন, উপযুক্ত দুটি মানুষকে সর্বত্রই দেখা যায় একসঙ্গে।

খার্তুমের মানুষ মহম্মদ আলিকে ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদী বলেই মনে করত। তাদের ধারণা হচ্ছে উক্ত ব্যক্তি খার্তুম ছেড়ে কোথাও যায়নি, এবং সুদানের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যদি কেউ তার কাছে কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করতে যায় তবে সেই নির্বোধ তিব্বতের লামার বিষয়েও মহম্মদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করতে পারে–কারণ, মহম্মদ আলির কাছে সুদানের বন্যপ্রাণী আর তিব্বতের লামা দুই-ই সমান। দুটি বিষয়েই সে সমান অজ্ঞ।

আত্তিলিও কিন্তু স্থানীয় মানুষের কথা বিশ্বাস করেননি। তাঁর মতে মহম্মদ বাঁচাল বটে, কিন্তু মিথ্যাবাদী নয়। মহম্মদের মুখে যেসব ভয়ানক ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, সেইসব ঘটনা যে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ না হয়ে ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদীর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনাশক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এমন কথা আত্তিলিওর মনে আসেনি–মহম্মদ সম্পর্কে জনসাধারণের অভিমত ঈর্ষাকাতর মানুষের নিন্দা বলেই মনে করেছিলেন আত্তিলিও। সুতরাং আত্তিলিওর বিচারে শিকার-অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হল যে ব্যক্তি, তার নাম মহম্মদ আলি।

সমগ্র খার্তুমের মানুষ একদিন বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে দেখল, আত্তিলিও সাহেব মহম্মদ আলিকে তার পথপ্রদর্শকের কার্যে নিযুক্ত করেছেন। আত্তিলিও পরে জানতে পেরেছিলেন, কথার জাল বুনে চতুর মহম্মদ তাকে যে পারিশ্রমিক অর্থ দিতে রাজি করিয়েছিল, সেই টাকার অঙ্কটা ছিল যথেষ্টর চাইতেও বেশি। অবশ্য মহম্মদের পক্ষে পারিশ্রমিক অর্থ শেষ পর্যন্ত হস্তগত করা সম্ভব হয়নি।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মহম্মদ আলির মৃত্যু

ছয়জন স্থানীয় অধিবাসী নিয়ে গঠিত ছোটো দলটিকে নিয়ে ফাংপ্রভিন্স নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন আত্তিলিও। তিনি এবং মহম্মদ আলি ঘোড়ায় চড়ে দলের আগে আগে চলছিলেন। নির্দিষ্ট স্থানে এসে এক ব্যক্তির মুখে আত্তিলিও শুনলেন ওই অঞ্চলের সবচেয়ে আশ্চর্য দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে আটশো মহিষের একটি বিরাট দল। এমন প্রকাণ্ড দল বড়ো একটা দেখা যায় না। পূর্বোক্ত মহিষযূথকে স্বচক্ষে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করেছে মাত্র কয়েকটি লোক। তারা সকলেই একবাক্যে জানিয়েছে এমন চমকপ্রদ ও ভয়াবহ দৃশ্য কখনো তাদের চোখে পড়েনি। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন আত্তিলিও–শত শত অতিকায় মহিষ প্রায় এক মাইল স্থান ধরে সারিবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করেই তাঁর সর্বাঙ্গ হয়ে উঠল রোমাঞ্চিত! তিনি ঠিক করলেন যেভাবেই হোক ওই মহিষযূথকে তিনি একবার স্বচক্ষে দর্শন করবেন।

তাঁবুতে ফিরে তিনি লোকজনদের জানিয়ে দিলেন উল্লিখিত মহিষযুথের উদ্দেশে তিনি শীঘ্রই যাত্রা করবেন বলে মনস্থ করেছেন এবং ওই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যেকোনো বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে তিনি প্রস্তুত।

আত্তিলিওর ঘোষণা শেষ হতে-না-হতেই মোটবাহক, রাঁধুনি, ছোকরা-চাকর প্রভৃতি যে ছয়জন লোক দলে ছিল তারা সকলেই প্রাণপণে কণ্ঠস্বরের প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল! সেই তুমুল কোলাহলের মধ্যে তাদের বক্তব্য কিছুই বুঝতে পারলেন না আত্তিলিও। তিনি স্বয়ং এইবার চেঁচাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ তারস্বরে চেঁচিয়ে আত্তিলিও দলের মধ্যে স্তব্ধতার সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। তারপর তিনি মহম্মদ আলিকে ডেকে দলের লোকদের এমন অসংগত আচরণের কারণ জানতে চাইলেন।

মহম্মদ আত্তিলিওকে জানাল তার পরিকল্পনা শুনে উৎসাহিত হয়েই দলের মানুষ হঠাৎ কোলাহল করে উঠেছিল, অতএব ওই নিয়ে আত্তিলিওর আর চিন্তা করা উচিত নয়।

না, আত্তিলিও আর চিন্তা করেননি সেদিন এবং পরের দিন যখন তারা রওনা হলেন, তখনও দলের লোকদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর নিয়ে মাথা ঘামাননি আত্তিলিও–কিন্তু তিনদিন পরে এক মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতে উঠেই যখন তিনি আবিষ্কার করলেন মহম্মদ ছাড়া প্রত্যেকটি লোকই হঠাৎ তাবু থেকে অদৃশ্য হয়েছে, তখনই কয়েকদিন আগে কণ্ঠস্বরের তীব্র প্রতিযোগিতার কথা তার মনে হল এবং মহম্মদ আলি যে দলের লোকের উৎকণ্ঠার বিপরীত ব্যাখ্যা করে মনিবকে ধোঁকা দিয়েছে এ-বিষয়ে তার সন্দেহ রইল না একটুও।

মহম্মদকে ডাকলেন আত্তিলিও। দলের যাবতীয় মানুষ তাঁবু ছেড়ে উধাও হয়েছে এই খবর পাওয়ামাত্র যেন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল মহম্মদ আলি। তৎক্ষণাৎ ঘোড়া সাজিয়ে সে জানাল, সবচেয়ে বড়ো মহিষের মাথাটা আত্তিলিওকে যোগাড় করে দেবে বলে যে প্রতিজ্ঞা সে করেছিল, সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে সে দৃঢ়সংকল্প হতচ্ছাড়া পলাতকদের সে বুঝিয়ে দেবে মহম্মদ আলি কোন ধরনের মানুষ, কারো সাহায্য ছাড়াই মহিষযুথের সংবাদ সে সংগ্রহ করতে সক্ষম এবং ওই খবর আনার জন্য এক মুহূর্ত দেরি না-করে এখনই সে যাত্রা করতে প্রস্তুত।

বলতে বলতেই সে তড়াক করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসেছে, আর হতভম্ব আত্তিলিওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে!

হঠাৎ আত্তিলিওর মনে হল মহম্মদ আলিও বোধ হয় অন্যান্য অনুচরদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছে। নিখুঁত আরবীয় পদ্ধতিতে ফাঁকি দেওয়ার এইটাই বোধ হয় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও আধুনিক কায়দা। আত্তিলিও সাহেবের সন্দেহ সত্য, না, অন্যায়ভাবে মহম্মদের বীরত্ব ও সদিচ্ছার প্রতি সন্দিহান হয়ে তিনি উক্ত আরব দেশীয় মানুষটির প্রতি অবিচার করেছিলেন–সে-কথা কোনোদিনই জানা সম্ভব হবে না। কারণ, এতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনার স্রোত একটা প্রহসনমূলক নাটকের সূচনা করছিল–আচম্বিতে ঘটনাচক্রের দ্রুত পরিবর্তন সেই প্রহসনকে রূপান্তরিত করল এক বিয়োগান্ত নাটকের রক্তাক্ত দৃশ্যে।

এই ভয়ংকর পরিবর্তনের জন্য দায়ী হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড বন্য মহিষ। যে-দলটাকে আত্তিলিও অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন, এই জন্তুটা সেই দলভুক্ত নয়–একটা দলছাড়া মহিষের একক উপস্থিতি সমস্ত ঘটনাস্রোতকে বদলে দিয়েছিল।

মহম্মদ তখনও ঘোড়ার পিঠে দৃশ্যমান, আত্তিলিও প্রাণপণে চেঁচিয়ে তাকে ফিরে আসতে বলছেন–হঠাৎ ঝোঁপজঙ্গল ভেদ করে আত্তিলিওর থেকে প্রায় তিনশো ফিট দূরে আবির্ভূত হল এক কৃষ্ণকায় বিপুলবপু বন্য মহিষ! জন্তুটা ঝড়ের বেগে ধেয়ে এল মহম্মদ আলির বাহন আরবি ঘোড়াটার দিকে!

সাবধান! চেয়ে দেখো–সামনে বিপদ! চেঁচিয়ে মহম্মদকে সাবধান করে দিলেন আত্তিলিও, পরক্ষণেই ছুটলেন তাবুর ভিতর থেকে রাইফেল হস্তগত করার জন্য।

মুহূর্তের মধ্যেই রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলেন আত্তিলিও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে প্রচণ্ড সংঘর্ষে মিলিত হল মানুষ ও ঘোটক! আত্তিলিও সচমকে দেখলেন মহিষের একটা শিং ঘোড়ার বুকের ভিতর ঢুকে গেছে! পরক্ষণেই দেখা গেল ঘোড়াটাকে শিং বিধিয়ে শূন্যে তুলে ফেলেছে। মহিষ এবং দারুণ যাতনায় মহিষের মাথার উপর ঘোড়া করছে ছটফট!

মহম্মদ আলি ছিটকে পড়েছিল কয়েক গজ দূরে, ছুটে পালানোর জন্য সে তাড়াতাড়ি ভূমিশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই মহিষ তাকে লক্ষ করে ছুটে এল! ঘোড়াটা তখনও মহিষের মাথার উপর শৃঙ্গাঘাতে বিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছিল, কিন্তু ঘোটকের দেহভার মহিষাসুরের গতিরোধ করতে পারল না–সে এসে পড়ল ভূপতিত মহম্মদ আলির দেহের উপর!

ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন আত্তিলিও; অভ্যস্ত আঙুলের স্পর্শে রাইফেলের বুলেট সশব্দে মহিষের হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। আত্তিলিও দৌড়ে এলেন মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ জন্তু দুটির দিকে। ঘোড়াটা তখনও অসহ্য যাতনায় ছটফট করছিল। আত্তিলিওর রাইফেল তার মৃত্যুকে সহজ করে দিল। মহিষের দেহে প্রাণ ছিল না, গুলি লাগার সঙ্গেসঙ্গেই সে মারা গেছে।

মহম্মদের অবস্থা খুবই শোচনীয় মহিষ আর ঘোড়া জড়াজড়ি করে তার উপরই পড়েছে, দুটি বিশাল দেহের নীচে পিষ্ট হয়ে সে এখন মৃত্যুপথের যাত্রী।শিং দুটো মস্ত বড়ো, প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বলে উঠল মহম্মদ, যেমন… যেমন… আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম. তার কণ্ঠ রুদ্ধ হল, কালো গোঁফ দুটির নীচে রক্তমাখা দাড়ির ভিতর থেকে যে-হাসিটি ফুটে উঠেছিল, সেই হাসির রেখা হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মৃত্যুর স্পর্শে–হাসতে হাসতেই মৃত্যুবরণ করল মহম্মদ আলি।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মহিষ

পূর্বোক্ত ঘটনার পর থেকেই মহিষ সম্বন্ধে তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ পোষণ করতেন আত্তিলিও গত্তি।

একাধিক পুস্তকে মহিষ-বিষয়ক তথ্য পাঠ করে আত্তিলিও জেনেছিলেন ওই জন্তুটি আক্রান্ত না হলে অথবা প্ররোচিত হলে বিনা কারণে কখনো মানুষকে আক্রমণ করে না। কিন্তু মহম্মদ আলি ও তার বাহন আরবি ঘোড়াটার মৃত্যু দেখে আত্তিলিও বুঝেছিলেন কেতাবে লিখিত তথ্য আংশিক সত্য হলেও হতে পারে, সর্বাংশে সত্য কখনোই নয়। এইখানে আফ্রিকার মহিষ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা দরকার। মহিষগোষ্ঠীর কোনো জন্তুকেই নিরীহ বলা চলে না, মহিষ মাত্রেই ভয়ংকর জীব। গৃহপালিত মহিষও উত্তেজিত হয়ে মানুষের প্রাণবিপন্ন করেছে এমন ঘটনা বিরল নয়। মহিষগোষ্ঠীর বিভিন্ন জন্তুর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জীব আফ্রিকার কেপ-বাফেলো। লেপার্ড, হায়না প্রভৃতি মাংসাশী জানোয়ার কখনো কেপ-বাফেলোর ধারেকাছে আসে না। স্বয়ং পশুরাজও পূর্ণবয়স্ক কেপ-বাফেলোর সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় অনিচ্ছুক ক্রোধে আত্মহারা না হলে সিংহ কখনো মহিষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। রুদ্রমূর্তি মহিষকে দেখে সিংহ চম্পট দিয়েছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। মহিষ-পরিবারের সকল পশুরই প্রধান অস্ত্র শিং আর খুর–কেপ-বাফেলো নামক আফ্রিকার অতিকায় মহিষও ওই দুটি মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়; উপরন্তু তাদের মাথার উপর থাকে পুরু হাড়ের দুর্ভেদ্য আবরণ–শিরস্ত্রাণের মত মাথার উপর ওই কঠিন অস্থি-আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখদন্ত কিংবা রাইফেলের বুলেট মহিষের মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে না। ওই অস্থি-আবরণের ইংরেজি নাম বস অব দি হর্নস; সংক্ষেপে বস। বস-এর দু-দিকে অবস্থিত শিং-এর দৈর্ঘ্য সাধারণত ৩৬ ইঞ্চি থেকে ৪৫ ইঞ্চি, তবে ৫৬ ইঞ্চি লম্বা শিংও দেখা গেছে। পূর্বোক্ত মহিষের আয়ু তিরিশ বছর, কিংবা আর একটু বেশি। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত অধিকতর বলশালী তরুণ মহিষদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে অনেক সময় প্রাচীন মহিষরা দল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দলছাড়া মহিষ নিঃসঙ্গ অবস্থায় বিচরণ করে এবং সমগ্র পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী সম্বন্ধে প্রচণ্ড বিদ্বেষ পোষণ করে। নিঃসঙ্গ পুরুষ মহিষই সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার। মহম্মদকে হত্যা করেছিল ওইরকম একটি নিঃসঙ্গ ভয়ংকর গুন্ডা মহিষ।

আফ্রিকাবাসী মহিষদের মধ্যে কেপ-বাফেলো নামক জন্তুটি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে, কিন্তু আরও দুই জাতের মহিষ আফ্রিকাতে দেখা যায়। গ্যামা নামে একরকম মহিষজাতীয় জানোয়ার আরব দেশে চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া আছে বনগোরু বা পিগমি বাফেলো। কেপ-বাফেলোর কাধ মাটি থেকে পাঁচ ফিট কিংবা আর একটু বেশি উঁচু হয়, কিন্তু পিগমি বাফেলোর কাঁধের উচ্চতা মাটি থেকে মাত্র তিন ফিট; তার শিং ধারালো, তবে ছোটো এবং দেহের রং তার অতিকায় জ্ঞাতি ভাইয়ের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়–রক্তাভ-পীত বর্ণে রঞ্জিত ঘন রোমশ দেহ নিয়ে একা অথবা জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে ওই খর্বকায় মহিষ। কেপ-বাফেলোর মতো দলবদ্ধ হয়ে পিগমি বাফেলো বা বনগোর কখনো বাস করে না।

আকারে ছোটো হলেও ওই মহিষগুলো যে কতখানি শক্তি সাহস ও ক্ষিপ্রতার অধিকারী হয়, নিম্নলিখিত ঘটনা থেকেই তা বোঝা যাবে।

বেলজিয়ান কঙ্গোর জঙ্গলে আত্তিলিও সাহেব একবার একটা ওকাপিকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরার চেষ্টা করেন। ওকাপি হচ্ছে নিরামিষভোজী দুষ্প্রাপ্য পশু। একটা ওকাপিকে জীবন্ত অবস্থায় ধরার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছিলেন আত্তিলিও হঠাৎ একদিন সৌভাগ্যক্রমে মাম্বুটি পিগমি জাতির নিগ্রো পথপ্রদর্শকরা একটা ওকাপিকে ঘেরাও করে ফেলল। ওকাপির পদচিহ্নের কাছাকাছি বনগোরু বা খর্বকায় মহিষের টাটকা পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন আত্তিলিও। কিন্তু ওকাপির জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিলেন বলে তাড়াহুড়োর মধ্যে তিনি পিগমিদের কাছে খর্বকায় মহিষ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করেননি।

খুব মনোযোগের সঙ্গে ওকাপিকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলল। একটা বৃহৎ আকার নিয়ে গোল হয়ে অবস্থান করছিল সবাই, মাঝখানে ওকাপিকে লক্ষ করে সেই চলন্ত মনুষ্যবৃত্তের পরিধি ক্রমশ ছোটো হয়ে আসতে লাগল… আচম্বিতে সবুজ উদ্ভিদের জাল ভেদ করে দুটি রক্তাভ বিদ্যুঝলকের প্রচণ্ড আবির্ভাব! কী হচ্ছে-না-হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই দারুণ সংঘাতে ওকাপি-শিকারিরা চতুর্দিকে ছিটকে পড়তে লাগল, আত্তিলিওর মাথা থেকে উড়ে গেল হেলমেট আর হাত থেকে বেরিয়ে গেল রাইফেল এক মুহূর্তের জন্য আত্তিলিও অনুভর করলেন তাঁর পায়ের তলা থেকে সরে গেছে মাটি এবং দেহ হয়েছে শূন্যপথে উড্ডীয়মান–পরক্ষণেই মৃত্তিকার কঠিন স্পর্শ আর চোখের সামনে সর্ষেফুল!

হইচই, চিৎকার, ধুন্ধুমার–যাচ্ছেতাই ব্যাপার!

দুটো বেঁটে বেঁটে মহিষ ধাঁ করে মানুষের ব্যুহ ভেদ করে বিদ্যুৎঝলকের মতো অন্তর্ধান করল। সেইসঙ্গে পালিয়ে গেল আত্তিলিও সাহেবের এত সাধের ওকাপি!

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মূল্যবান উপদেশ

খর্বকায় বামন মহিষের ধাক্কা খেয়ে নাস্তানুবুদ হওয়ার কয়েকদিন পরেই এক ইংরেজ-শিকারির সঙ্গে হঠাৎ আত্তিলিওর আলাপ হয়ে গেল। ওই ইংরেজ শিকারিটি সারাজীবন ধরে আফ্রিকাতে বন্য মহিষের গতিবিধি লক্ষ করেছে, বহু মহিষ শিকার করেছে এবং তার ফলে মহিষ-চরিত্র সম্বন্ধে সে হয়ে উঠেছে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ। ইরামা নামক স্থানে একটি দোকান থেকে শ্বেতাঙ্গরা জিনিসপত্র কিনতেন–আমাদের আত্তিলিও সাহেবও একদিন ওই দোকানে উপস্থিত হলেন কয়েকটা প্রয়োজনীয় বস্তু ক্রয় করার জন্য। পূর্বে উল্লেখিত ইংরেজ-শিকারিও একই উদ্দেশ্যে সেই সময়ে দোকানে উপস্থিত হয়েছিল।

তছোটো বুশ ব্লাউজ ও শর্ট পরিহিত আত্তিলিওর অনাবৃত বাহু ও পায়ের বিভিন্ন স্থানে আঘাতজনিত কালশিরার চিহ্ন দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠল দোকানদার। তাকে সংক্ষেপে ওকাপি ও খর্বকায় মহিষ-ঘটিত দুর্ঘটনার কথা বলে প্রসঙ্গ শেষ করে দিলেন আত্তিলিও, তারপর টিনে বন্ধ শুষ্ক আনাজ ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু মহিষ শব্দটি কানে যাওয়ামাত্র আগন্তুক ইংরেজ আত্তিলিওর দিকে ছুটে এল।

লোকটির কথাবার্তায় তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চিহ্ন দেখে আত্তিলিও বুঝলেন সে তাঁকে নিতান্তই তৃতীয় শ্রেণির শিকারি মনে করছে। তিনি গরম হয়ে উঠলেন এবং শিকারি-জীবনের কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, আত্তিলিও গত্তি নিতান্ত সাধারণ মানুষ নয়। লোকটি তখন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং আবিষ্কৃত তথ্য নিয়ে কথা কইতে শুরু করল। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আত্তিলিও যখন তার সান্নিধ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হলেন, তখন মূল্যবান সময়ের অপচয় হওয়ার জন্য তিনি মনে মনে বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কয়েক বছর পরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্তিলিও উপলব্ধি করেছিলেন ইরামার এক অখ্যাত দোকানে দাঁড়িয়ে অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ-শিকারির কাছ থেকে মহিষ-চরিত্র সম্পর্কে কিছু জ্ঞানলাভ করেছিলেন বলেই তিনি সময়কালে কর্তব্য স্থির করে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

মহিষ-প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলেছিল ওই ইংরেজ-শিকারি। সুদীর্ঘ শিকারি-জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে সে জানতে পেরেছিল আক্রমণ-উদ্যত ক্ষিপ্ত মহিষকে বাধা দিতে পারে প্রশস্ত নদী, আগুনের জ্বলন্ত প্রতিবন্ধক এবং–

এবং মানুষের মৃতদেহ!

কথাটা শুনতে খুবই অদ্ভুত বটে, কিন্তু ইংরেজ-শিকারি দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল, মৃতদেহের উপর মহিষ কখনো আক্রমণ চালায় না–সে মৃতদেহ লক্ষ করে ছুটে আসবে, কিন্তু সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়বে কিছুতেই মরা মানুষকে স্পর্শ করবে না। দূরে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার তেড়ে এসে থমকে দাঁড়াবে–এমনি করে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর এক সময়ে প্রস্থান করবে মহিষ। আত্তিলিওর হঠাৎ-পাওয়া নতুন বন্ধু বলেছিল, যে মুহূর্তে মহিষ দেখবে মানুষটা নড়াচড়া না-করে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে, সেই মুহূর্তেই সে ধরে নেবে ওটা মৃতদেহ আর তৎক্ষণাৎ সে থেমে যাবে।

কিন্তু, আত্তিলিও প্রতিবাদ করেছিলেন, মহিষ দেখবে কেমন করে? অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি যেসব জানোয়ার শিং দিয়ে আঘাত করে, তারা তো চোখ বন্ধ করে আঘাত হানতে অভ্যস্ত।

বাঃ! বেশ বলেছ! বিজয়গর্বে হুংকার দিয়ে উঠল ইংরেজ-শিকারি, এতদিন আফ্রিকাতে থেকে তুমি এই কথা বললে? তাহলে কী জানলে ঘোড়ার ডিম! মহিষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাথা উঁচু রেখে শত্রুকে লক্ষ করে এই বৈশিষ্ট্যের কথা কি তোমার জানা নেই?

তাই তো! ঠিক কথা! এইবার আত্তিলিওর মনে পড়ল মহম্মদের মৃত্যুকালীন ঘটনা ঘোড়াটাকে শিং দিয়ে আঘাত করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মহিষ মাথা উঁচু করে রেখেছিল, একেবারে সামনে এসে একবারই সে মাথা নামিয়েছিল চরম আঘাত করার জন্য।

বাঃ! বেশ বলেছ! সুযোগ পেয়ে আবার বিদ্রূপ করল ইংরেজ-শিকারি, আঘাত করার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত মহিষ তার মাথা উঁচু করে রাখে, কারণ ওই জন্তুটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের শয়তান। সে জানে মাথা নীচু করলে খুলির উপর বসানো পাথরের মতো শক্ত হাড়ের বস তার মস্তিষ্ক ও কপালকে শত্রুর আক্রমণ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে পারে, তবু সে মাথা উঁচু করে রাখে। কেন জান? কারণ, শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত মহিষ তার শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করে অধ্যর্থ সন্ধানে আঘাত হানতে চায়। আর সেইজন্যই সে মাথা তুলে শত্রুকে দেখতে থাকে, অন্যান্য শিংওয়ালা জন্তুর মতো চোখ মুদে আক্রমণ করে না। মহিষের সামনে যদি কখনো যাও, তবে এই কথাগুলো মনে রাখবে, কখনো ভুলবে না।

ইংরেজ-শিকারির উপদেশ আত্তিলিওর মনে গেঁথে বসে গিয়েছিল। অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় অকস্মাৎ অবচেতন মনের গহন অন্তস্থল থেকে ওই কথাগুলো ভেসে এসেছিল তাঁর স্মৃতির দরজায় এবং সেইজন্যই নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন আত্তিলিও সাহেব।

কিন্তু যে আধ-পাগলা ইংরেজ সারাজীবন ধরে মহিষ-চরিত্র নিয়ে গবেষণা করে ওই জন্তু সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ হয়েছিল, সেই মানুষটা তার নিজের কথাগুলোই একদিন ভুলে গেল। একবারই ভুল করেছিল ইংরেজ-শিকারি, কিন্তু ভ্ৰম-সংশোধনের সুযোগ সে আর পায়নি। আত্তিলিওর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই একটি আহত মহিষের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ইংরেজ-শিকারি প্রাণ হারিয়েছিল।

উক্ত ইংরেজ যেখানে মারা যায়, সেই জায়গাটা হচ্ছে অ্যাংকোলে নামক নিগ্রো জাতির বাসস্থান। ইংরেজ-শিকারির আরও একটি কথার সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়েছিলেন আত্তিলিও ওই অঞ্চলেই এবং সেই প্রমাণটা যে উপস্থিত করেছিল সে শ্বেতাঙ্গ নয়–জনৈক কৃষ্ণকায় অ্যাংকোলে-শিকারি।

মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর উপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন আত্তিলিও–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভয়াবহ পরিস্থিতি

অ্যাংকোলে-শিকারির অদ্ভুত কৌশল ও স্নায়ুর উপর তার আশ্চর্য সংযম দেখে ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু কতখানি মানসিক শক্তি থাকলে মানুষ নির্বিকারভাবে ওই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে সে-বিষয়ে তাঁর ধারণা সেদিন খুব স্পষ্ট ছিল না।

দু-বছর পরে তিনি নিজে যখন ওই অবস্থায় পড়লেন, তখনই বুঝতে পারলেন কী অসাধারণ মানসিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল পূর্বোক্ত ক্ষুদ্রকায় নিগ্রো শিকারি।

খুব ভেবে দেখলে অবশ্য বলতে হয় আত্তিলিওর অবস্থা ওই নিগ্রো শিকারির চাইতেও খারাপ ছিল–অ্যাংকোল-শিকারি স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল এবং ওইরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তার পেশাগত শিক্ষা আর সুদীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির ইতিহাসও ধর্তব্য কিন্তু আত্তিলিও সাহেব কোনোদিনই বন্য মহিষের মতো বদখত জানোয়ারের সম্মুখীন হওয়ার অভিলাষ পোষণ করেননি, ঘটনাচক্রের শিকার হয়েই এক অভাবনীয় বিপদের সামনে রুখে দাঁড়াতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।

যখনকার কথা বলছি সেই সময়ে আত্তিলিও গত্তি আফ্রিকার কিভু হ্রদের তীরবর্তী সাময়িক আস্তানা থেকে চিবিন্দা নামক স্থানের অরণ্যে অভিযান চালানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তাঁর অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল দানব-গরিলা। ওই জীবটির সম্বন্ধে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

দৈবক্রমে একদিন আত্তিলিওর সঙ্গে একজন বেলজিয়ামের অধিবাসীর পরিচয় হয়ে গেল। ওই লোকটি জানাল কিভু হ্রদ আর টাঙ্গানিকা হ্রদের মধ্যবর্তী প্রান্তরে তার সঙ্গে গেলে একদল মহিষের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবেন আত্তিলিও সাহেব। গরিলা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে সেই সময় মাথা ঘামাচ্ছিলেন না আত্তিলিও, কিন্তু লোকটি বলল আড়াইশো মহিষ নিয়ে গঠিত ওই প্রকাণ্ড দলটার ফটো তোলার কাজ চিড়িয়াখানাতে ফটো নেওয়ার মতোই সহজ হবে। এত সহজে আড়াইশো মহিষের একটা প্রকাণ্ড দলকে তার ক্যামেরাতে বন্দি করা যাবে শুনে রাজি হয়ে গেলেন আত্তিলিও।

তুমি একটা উইয়ের ঢিপি বেছে নেবে, লোকটি বলল, ওই ঢিপির পিছন থেকে ফটো তুলবে যত খুশি। এমন সুযোগ আর কখনো পাবে না।

বেলজিয়ানের কথায় খুব নিশ্চিন্ত হয়ে আত্তিলিও গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হলেন। ব্যাপারটা মোটেই বিপজ্জনক নয়, চিড়িয়াখানাতে যাওয়ার মতোই সোজা–অতএব শিকারে যাওয়ার উপযুক্ত বুট পরার প্রয়োজন মনে করেননি আত্তিলিও; শহর-অঞ্চলে যে সাধারণ জুতো পরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন সেই জুতো জোড়া পায়ে চড়িয়ে তিনি চললেন মহিষযুথের আলোকচিত্র সংগ্রহ করতে রাইফেলটা তিনি নিয়েছিলেন নিতান্ত অভ্যাস বশে। তাঁবুর লোকজন দরকারি কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই বাছাবাছি না-করে যে-নিগ্রোটিকে সামনে পেলেন তাকেই তিনি ডেকে নিলেন রাইফেলটা বহন করার জন্য। আত্তিলিও দুটো হাতই খালি রাখতে চেয়েছিলেন–লম্বা লেন্স আর ক্যামেরা ভালোভাবে ব্যবহার করতে হলে দুই হাতই খালি রাখা দরকার। সবচেয়ে ভালো ক্যামেরাটাকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন আত্তিলিও…

প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বেলজিয়ান বন্ধুর নির্দেশে পথের উপর এক জায়গায় মোটরগাড়িটা থামানো হল। ঘন উদ্ভিদের জালে আচ্ছন্ন একটা সরু পথের উপর দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল আত্তিলিওর নতুন বন্ধু তাকে অনুসরণ করলেন আত্তিলিও। লোকটি জানাল নদীর যেখানে মহিষের দল সন্ধ্যার সময়ে জলপান করতে আসে সেই জায়গাটা সে ভালোভাবেই জানে–খুব তাড়াতাড়ি চলার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে সে বলল মহিষদের আসার সময় হয়েছে, এখনই তারা এসে পড়বে।

মিনিট দশেক হাঁটার পরে সকলে এসে থামল একটা খোলা জায়গার উপর। আত্তিলিও দেখলেন প্রচণ্ড সূর্যের তাপে শুষ্ক প্রান্তরের এখানে ওখানে বর্ষার কাদা শুকিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে এবং সেই শুষ্ক কর্দমপিণ্ডগুলোর মধ্যবর্তী স্থানের মাটি ফেটে দেখা দিয়েছে অজস্র ফাটল। হাঁটার সময়ে ওই ফাটলে পা পড়লেই চিতপটাং হওয়ার সম্ভাবনা। আত্তিলিও চারপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন–ডান দিকে প্রায় সিকি মাইল দূরে রুজিজি নদী, সামনে নাতিদীর্ঘ নলখাগড়ার নিবিড় সমাবেশ আর বাঁ-দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল চোখে পড়ে উইঢিপির পর উইটিপি। ওইখানে, অসংখ্য উইঢিপির মধ্যে একটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল বেলজিয়ান, ওই জায়গাটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো। চটপট চলে যাও ওইখানে, দেরি কোরো না।

খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে কথা বলছিল বেলজিয়ান বন্ধু; তার মতোই স্বরে আত্তিলিও জানতে চাইলেন উক্ত ব্যক্তি কোথায় অবস্থান করতে চায়।

আমাকে নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না, লোকটি উত্তর দিল, কাছাকাছি থাকব। আত্তিলিও দেখলেন বেলজিয়ান তার নিজস্ব ভৃত্যকে নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা তার মোটেই ভালো লাগল না। সমস্ত জায়গাটা খুব নির্জন, অস্বস্তিকর। ফটো তোলার পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে সেই মুহূর্তে ফিরে যেতে পারলে খুশি হতেন আত্তিলিও। তাঁর সঙ্গী বন্দুকবাহক নিগ্রোটির মনোভাবও বোধ হয় সেইরকম অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে লোকটি হঠাৎ কথা কইতে শুরু করল। আত্তিলিও তার একটা কথাও বুঝতে পারলেন না। আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন ছয়টি ভাষায় তিনি লোকটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার ভাষাও লোকটির কাছে সমান দুর্বোধ্য! পর পর ছয়বার ভাষা থেকে ভাষান্তরে প্রবেশ করলেও আত্তিলিওর বক্তব্য ছিল একটি–ওহে বাপু! দয়া করে একটু চুপ করো তো! মুখের ভাষা না-বুঝলেও তার কণ্ঠস্বর আর ভাবভঙ্গি থেকে লোকটি শেষপর্যন্ত বক্তার বক্তব্য অনুধাবন করতে সমর্থ হল। সে চুপ করল।

পরে অবশ্য আত্তিলিও জানতে পেরেছিলেন ওই লোকটি তাকে একটা জরুরি সংবাদ পরিবেশন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল–দুর্ভাগ্যক্রমে তার কথা আত্তিলিও বুঝতে পারেননি, আর সেইজন্যই যথাসময়ে খবরটা শুনে সতর্ক হওয়ার সুযোগ তার হল না।

খবরটা হচ্ছে এই : বেলজিয়ানের চাকরের কাছে আত্তিলিওর বন্দুক-বাহক জানতে পেরেছিল যে, তারা নদী পার হয়ে বিপরীত তীর থেকে মহিষদের উপর গুলি চালিয়ে কয়েকটা জন্তুকে হত্যা করবে বলে ঠিক করেছে। বেলজিয়ানটির কফির আবাদ আছে; সেই আবাদে নিযুক্ত মজুরদের মাংস সরবরাহ করার জন্যই মহিষ শিকারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। মাঝখানে নদী থাকায় অপর পার্শ্বে অবস্থিত বেলজিয়ান-শিকারি ও তার ভৃত্যের অবস্থা দস্তুর মতো নিরাপদ। কিন্তু এপারে আর দুজন মানুষের পক্ষে ব্যাপারটা যে কতখানি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিওকে সাবধান করে দেবার চেষ্টা করেছিল তাঁর বন্দুকবাহক।

আত্তিলিওর পক্ষে অবশ্য নবপরিচিত বন্ধুর সদিচ্ছায় সন্দিহান হওয়া স্বাভাবিক নয়–প্রায় আড়াইশো মহিষের মাঝখানে গুলি চালিয়ে দিলে তাদের কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটা যে কারো কাছে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতো সহজ মনে হতে পারে এমন কথা আত্তিলিও সাহেবই-বা ভাববেন কেমন করে? তিনি শুধু জানতেন মহিষের দল এখনই এসে পড়বে, অতএব চটপট একটা উইঢিপির পিছনে আশ্রয় নেওয়া উচিত এই মুহূর্তে। দলটা এসে পড়লে আর নড়াচড়া করা সম্ভব হবে না, কয়েকশো বন্য মহিষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ছিলেন আত্তিলিও। নির্দিষ্ট উইঢিপির পিছনে গিয়ে স্থান গ্রহণ করতে প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেল। আত্তিলিও তাঁর টেলিফটোর অ্যাপারেচার ঠিক করছেন নিবিষ্টচিত্তে আচম্বিতে তাঁর পায়ের তলায় গুরুগম্ভীর শব্দ তুলে মাটি কাঁপতে শুরু করল। পিছন থেকে বন্দুকবাহক নিগ্রোর অস্ফুট ভয়ার্ত স্বর আত্তিলিওর কানে এল, কিন্তু তিনি পিছনে চাইলেন না, তার দুই চোখের স্তম্ভিত দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ হয়েছে সেইদিকে যেখানে নলখাগড়ার ঝোঁপ ভেদ করে খোলা মাঠের উপর আত্মপ্রকাশ করছে মহিষের দল! আত্তিলিওর মনে হল সেই চলন্ত জান্তব স্রোতের যেন বিরাম নেই–কতগুলো মহিষ আছে ওখানে?…

ভয়ংকর এবং চমকপ্রদ দৃশ্যটাকে আরও জমকালো করে তুলেছে অস্তায়মান সূর্যের আলোকধারা–

মাথার উপর জ্বলছে রক্তরাঙা আকাশের পট, তলায় এগিয়ে চলেছে মেঘের মতো কালো এক শরীরী অরণ্য; সেই জীবন্ত ও চলন্ত অরণ্যের মাথায় মাথায় বাঁকা তলোয়ারের মতো শিংগুলোতে জ্বলে জ্বলে উঠছে রক্তলাল রবিরশ্মি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো–সঙ্গেসঙ্গে সহস্র খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন কম্পিত পৃথিবী করছে ধূলি-উদগিরণ। অপূর্ব দৃশ্য!

আত্তিলিও মনে মনে তার নবপরিচিত বন্ধুকে ধন্যবাদ দিলেন। সে ঠিক জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে। এখান থেকে ফটো তোলা সবচেয়ে সুবিধাজনক। হাওয়ার গতি অবশ্য ভালো নয়, তবে মহিষরা যে তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে না সে-বিষয়ে আত্তিলিও গত্তির মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।

চব্বিশটা আলোকচিত্র গ্রহণ করার পর আত্তিলিও ক্যামেরার স্বয়ংক্রিয় ম্যাগাজিন থেকে ব্যবহৃত ফিল্ম সরিয়ে নূতন ফিল্ম সংযোগ করতে সচেষ্ট হলেন। নীচু হয়ে ওই কাজ করছিলেন তিনি। পুরানো ফিল্ম সরিয়ে নতুন ফিল্ম লাগাতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগে। তবে আত্তিলিওর বোধ হয় মিনিট খানেকের উপর আরও ত্রিশ সেকেন্ড লেগেছিল; কারণ, তার পায়ের তলায় তখন জেগে উঠেছে প্রচণ্ড কম্পন–শত শত চলন্ত চতুম্পদের পদাঘাতে মাটি কাঁপছে ভূমিকম্পের মতো!

ক্যামেরাতে নতুন ফিল্ম লাগিয়ে আত্তিলিও আবার উইটিপির আড়াল থেকে মুখ বাড়ালেন। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কের চমক। মহিষযূথ খুব কাছে চলে এসেছে। এমন অপ্রত্যাশিত সান্নিধ্য আত্তিলিওর ভালো লাগল না। জন্তুগুলো তার ডান দিক দিয়ে নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, এখন মনে হচ্ছে তাদের গতিপথ একটু বদলে যাওয়ার ফলেই মহিষয়ূথ তার কাছাকাছি এসে পড়েছে।

অবশ্য জন্তুগুলোর মধ্যে কোনো উত্তেজনা বা উগ্রতার চিহ্ন দেখা দেয়নি। তবু আত্তিলিও ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবে নিতে পারলেন না। মুহূর্তের মধ্যে তিনি কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। মহিষের দল সোজাসুজি নদীর দিকে এগিয়ে গেলেই তিনি আবার ক্যামেরা হাতে নেবেন, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে ততক্ষণ ক্যামেরার চাইতে রাইফেলের সান্নিধ্য বেশি বাঞ্ছনীয়।

দৃষ্টি সামনে রেখে তিনি পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শিকারির প্রসারিত হস্তের এই ইঙ্গিত প্রত্যেক বন্দুকবাহকের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও রাইফেলের স্পর্শ পেলেন না আত্তিলিও সাহেব। সম্মুখে চলমান ভয়ংকর মিছিল থেকে চোখ ফেরানো নিরাপদ নয়, তাই চোখের দৃষ্টি যথাস্থানে রেখেই তিনি চাপা গলায় ডাকলেন–এই!

ফল হল একইরকম, প্রসারিত হস্তের মতো অবরুদ্ধ কণ্ঠের ইঙ্গিতও হল ব্যর্থ–হাতে এসে পৌঁছাল না রাইফেল।

লোকটা কি গাধা নাকি? সক্রোধে দুই চোখে আগুন ছড়িয়ে পিছন ফিরলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল বিদ্যুৎ তরঙ্গ–

কেউ নেই পিছনে!

লোকটা যে কখন পালিয়েছে বুঝতেই পারেননি আত্তিলিও। এখন তার দ্রুত ধাবমান দেহটা তার চোখে পড়ল। এর মধ্যেই সে অনেক দূর চলে গেছে, তার শরীরটা দেখাচ্ছে ছোট্ট, নদী থেকে লোকটির দূরত্ব এখন এক-শো গজও হবে না।

আত্তিলিও মনে মনে ভাবলেন, মহিষগুলো নিশ্চয়ই ওকে দেখতে পেয়েছে। সেইজন্যই তাদের গতিপথের পরিবর্তন ঘটেছে।

কিন্তু তার ধারণা যদি সত্য হয় তাহলে তো সমূহ বিপদ। মহিষরা যে-পথ ধরে এগিয়ে আসছে, সেই পথের মাঝখানেই তো রয়েছেন তিনি একটু পরেই তো আড়াইশো মহিষের দল এসে পড়বে তার উপর! এখন উপায়!

বন্দুকবাহক নদীর ধার থেকে একবার আত্তিলিওর দিকে তাকাল, হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল রাইফেলটা সে ওইখানেই রেখে দিয়েছে–তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর মধ্যে। জল ছিটকে উঠল, আর তাকে দেখা গেল না।

আত্তিলিও এইবার মহিষযুথের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারা এগিয়ে আসছে একইভাবে, তবে তাদের গতিবেগ বর্ধিত হয়নি, বেশ হেলেদুলে সহজভাবেই এগিয়ে আসছে তারা।

একটি লোককে ছুটতে দেখেও যখন তারা উত্তেজিত হয়নি, তখন আর একটি লোকের ধাবমান শরীরও বোধ হয় তাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে না–ভাবলেন আত্তিলিও।

দূরত্বটা চোখ দিয়ে মেপে নিলেন তিনি–নিতান্তই যদি তেড়ে আসে, তাহলেও আমাকে ওরা ধরে ফেলার আগেই আমি রাইফেলটার কাছে গিয়ে পড়ব।

সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি ছুটতে শুরু করলেন। সঙ্গেসঙ্গে বন্দুকের আওয়াজ পর পর তিনবার। আত্তিলিও ভাবলেন তার বেলজিয়ান বন্ধু বন্দুকের শব্দে মহিষগুলোর দৃষ্টি অন্যত্র আকৃষ্ট করে তাকে সাহায্য করতে চাইছে। কথাটা ভাবতেই তার মনের জোর বাড়ল, আরও জোরে পা চালিয়ে ছুটতে লাগলেন তিনি।

আবার বন্দুকের শব্দ। ডান পায়ের গোড়ালিতে অসহ্য যন্ত্রণা। ছিটকে পড়লেন আত্তিলিও। ক্যামেরাটা দারুণ জোরে তার বুকে আঘাত করল। মাটিতে আছাড় খেয়ে জ্ব থেকে ঝরতে লাগল রক্তের ধারা। একবার উঠতে চেষ্টা করলেন আত্তিলিও। আর সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কী হয়েছে। আত্তিলিও ভেবেছিলেন তাঁর পায়ে গুলি লেগেছে, কিন্তু না, তা নয়–পাথরের মতো শক্ত মাটির ফাটলে তার পা আটকে গেছে। ফাটলের গ্রাস থেকে পা টেনে বার করলেন আত্তিলিও। পা মচকে গেছে ভীষণভাবে, গোড়ালির হাড় ভেঙে যাওয়াও আশ্চর্য নয়। মহিষের দল এদিকে ভীষণ উত্তেজিত। গুলি খেয়ে কয়েকটা জন্তু মারা পড়েছে। সমস্ত দলটা এখন আত্তিলিওর দিকেই ছুটে আসছে।

একবার পা ফেলার চেষ্টা করেই থেমে গেলেন আত্তিলিও। নদী সামনে, একটি দৌড় দিলেই তিনি নিরাপদ।

কিন্তু দৌড়ানো তো দূরের কথা, সহজভাবে হেঁটে চলার ক্ষমতাও তার নেই।

সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল অ্যাংকোলে-শিকারির কথা। মড়ার ভান করে পড়ে থেকে সেই লোকটি মহিষকে ফাঁকি দিয়েছিল। অতি দুঃখে আত্তিলিওর হাসি এল। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। তাঁর, সর্বশরীর কাঁপছে থর থর করে মৃতদেহের অভিনয় করার এইটাই তো উপযুক্ত সময়!

অ্যাংকোলেকে পরীক্ষা করেছিল একটি মহিষ, তাকে পরীক্ষা করতে আসবে আড়াইশো মহিষের বিপুল বাহিনী।

নাঃ, অসম্ভব, আত্তিলিওর পক্ষে মড়ার ভান করে এই চতুষ্পদ মৃত্যুদূতদের ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার সুপ্তচেতনা ভেদ করে জাগ্রত চৈতন্যের দ্বারে আঘাত করল এক আধপাগলা ইংরেজ শিকারির কণ্ঠস্বর–মনে রেখো, ওরা মাথা তুলে রাখে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওরা মাথা তুলে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করে..

হ্যাঁ, উপায় আছে! একটিমাত্র পন্থা অবলম্বন করলে হয়তো যমদূতদের কবল থেকে উদ্ধার লাভ করা সম্ভব নতুন আশায় বুক বাঁধলেন আত্তিলিও। মহিষ চরম আঘাত হানবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মাথা তুলে শত্রুকে লক্ষ করে; অতএব ধাবমান মহিষযূথকে যদি তিনি হঠাৎ চমকে দিতে পারেন, তবে হয়তো জন্তুগুলো তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারে।

আত্তিলিও জানতেন মহিষের চক্ষু বিবর্ধক শক্তিসম্পন্ন। তার সামান্য গতিবিধি তাদের চোখে ধরা পড়বে অসামান্য দ্রুতবেগে বর্ধিত আকারে–অতএব দুই হাত নেড়ে যদি তিনি তাদের ভড়কে দিতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো এযাত্রা বেঁচে যাবেন। আড়াইশো ধাবমান মহিষের সামনে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবশ্য খুবই কঠিন, কিন্তু হাত নেড়ে চিৎকার করা ছাড়া বর্তমান অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার যখন অন্য উপায় নেই, তখন উপযুক্ত বিপজ্জনক পদ্ধতির আশ্রয়গ্রহণ করার সংকল্প করলেন আত্তিলিও–

এক টান মেরে মাথা থেকে তিনি খুলে ফেললেন হেলমেট, প্রস্তুত হলেন চরম মুহূর্তের জন্য…

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – শরীরী ঝটিকার গতিপথে

পায়ে পায়ে জাগছে ভূমিকম্প, শৃঙ্গে শৃঙ্গে জ্বলছে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ, ধেয়ে আসছে মূর্তিমান মৃত্যুর শরীরী ঝটিকা–

আড়াইশো মহিষের উন্মত্ত বাহিনী!

কখন যে তারা এসে পড়েছে বুঝতে পারেননি আত্তিলিও, তিনি শুধু চিৎকার করছেন গলা ফাটিয়ে আর মাথার হেলমেট খুলে সজোরে নাড়ছেন সেটাকে–ডাইনে, বাঁয়ে, মাথার উপর সর্বত্র! জন্তুগুলো তাঁর এত কাছে এসে পড়েছিল যে, মহিষ দলপতির খোলা চোখ দুটোকেও তিনি দেখতে পেলেন। ভাবলেশহীন নির্বিকার দৃষ্টি মেলে জন্তুটা তার দিকে তাকিয়েছিল নির্নিমেষ নেত্রে। দারুণ আতঙ্কে আত্তিলিও চোখ মুদে ফেললেন, কিন্তু তার হাত দুটো যন্ত্রের মতো ঘুরতে লাগল–ওই অঙ্গ দুটি যেন তাঁর নিজস্ব নয়, হঠাৎ যেন হাতের উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছেন তিনি–অদৃশ্য এক শক্তি যেন হাত দুটিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার!

মুদিত নেত্রে সজোরে হাত নাড়তে লাগলেন তিনি, সেইসঙ্গে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার চোখে না দেখতে পেলেও তাঁর শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতে লাগল অনেকগুলো গুরুভার দেহের প্রচণ্ড পদধ্বনি। দ্রুত ধাবমান সেই ধ্বনিতরঙ্গ তার দু-পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ডাইনে আর বাঁয়ে… অবশেষে একসময়ে আত্তিলিওর পিছনে বহু দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল বিলীয়মান শব্দের ঢেউ দূরে অপসৃত মৃত্যুর পদধ্বনির মতো…।

যাক! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আত্তিলিও! এই যাত্রা বেঁচে গেছেন তিনি! হাতে রাইফেল না থাকায় তিনি ভেবেছিলেন এইবার মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পরে বুঝলেন নিরস্ত্র ছিলেন বলেই তিনি অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে অব্যাহতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। রাইফেল হাতে থাকলেই গুলি চালাতেন তিনি, কিন্তু লাভ কী হত? কয়েকটা জন্তু গুলি খেয়ে মারা পড়ত, তারপরই তার দেহের উপর দিয়ে ছুটে যেত চতুষ্পদ জনতার জান্তব ঝটিকা–শত শত খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতেন তিনি, প্রান্তরের বুকে একদা-জীবিত মনুষ্যদেহের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পড়ে থাকত দলিত, বিকৃত, রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ড।

মহিষ-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যার অমূল্য উপদেশ যথাসময়ে স্মরণে আনতে পেরে বেঁচে গেলেন আত্তিলিও, সেই ইংরেজ-শিকারি কিন্তু সময়কালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গিয়ে গুলি চালিয়েছিল এবং তার ফলেই মৃত্যুবরণ করেছিল সে। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস।

আত্তিলিও জানতেন বর্তমানে তিনি নিরাপদ। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী নয় সেই নিরাপত্তা। মহিষয়ূথ এখনই আবার ফিরে আসবে। যেভাবে অ্যাংকোলে-শিকারির কাছে ছয়-ছয়বার ঘুরে এসেছিল একক মহিষ জোবি, ঠিক সেইভাবেই তার কাছে ঘুরে আসবে মহিষের দল–পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন আত্তিলিও গত্তি।

অনুমান নির্ভুল। ঘুরে এসেছিল মহিষযূথ। তবে আত্তিলিওকে তারা দেখতে পায়নি। পা ভেঙেছে কি অস্ত আছে সে-বিষয়ে একটুও মাথা না-ঘামিয়ে জ্বালাযন্ত্রণা তুচ্ছ করে তিনি ছুটেছিলেন নদীর দিকে। মহিষগুলো যখন অকুস্থলে ফিরে এসেছিল, আত্তিলিও তখন নদীতীর থেকে বন্দুকবাহকের পরিত্যক্ত রাইফেলটা তুলে নিয়ে ঝাঁপ খেয়েছেন নদীর জলে! প্রায় পাঁচ ফিট গভীর কর্দমাক্ত জলের ভিতর দিয়ে রাইফেলে ভর দিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন এবং অতি কষ্টে নদী পার হয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে শক্ত জমির উপর একসময়ে এসে পড়লেন আত্তিলিও। সঙ্গে সঙ্গে একগাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বেলজিয়ান বন্ধু!

আত্তিলিওর শোচনীয় অবস্থা তার নজরেই পড়ল না। মহানন্দে চিৎকার করে সে বলে উঠল, কী? কেমন দেখলে? আমি তোমায় বলেছিলাম কি না..

আত্তিলিও সাহেবেরও অনেক কিছু বলার ছিল। বলেননি। কারণ কথা বলতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন তাঁর স্বরযন্ত্র কিছুক্ষণ পর্যন্ত মৌনব্রত পালন করতে চায়–অতএব বন্ধু সম্বন্ধে তাঁর যে ব্যক্তিগত অভিমত জানানোর জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, সেই বক্তব্যকে তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেন।

আমি তোমায় বলেছিলাম কি না? প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে বন্ধুবর বলল, ঠিক চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতোই সহজ হবে সমস্ত ব্যাপারটা এখন দেখলে তো?

হ্যাঁ, সবই দেখলেন আত্তিলিও, সবই শুনলেন। পরে তিনি বন্ধুকে কী বলেছিলেন জানি না। কারণ আত্তিলিও গত্তি তার আত্মজীবনীতে সেসব কথা লিপিবদ্ধ করেননি। তবে বাকশক্তি ফিরে পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তিনি যে বন্ধুকে বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত করে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন এ-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ এবং সেই ভাষণের ফলে উভয়ের বন্ধুত্ব খুব গাঢ় হয়েছিল বলেও মনে হয় না।

৪. শত্রু – দ্বিতীয় খণ্ড

সৈনিকের চতুর্থ অভিজ্ঞতা
শত্রু – দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – নূতন অভিযানের উদ্যোগ

এই কাহিনীর প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি আফ্রিকাবাসী যাবতীয় মহিষকেই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শত্রু বলে মনে করতেন। মহিষ সম্বন্ধে কমান্ডার সাহেবের এমন অদ্ভুত বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠার মূলে যেসব কার্যকারণ বর্তমান ছিল, সেইসব ঘটনার বিবরণ প্রথম খণ্ডের পাঠকদের অজানা নয়। রাইফেলে সিদ্ধহস্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও শৃঙ্গধারী মহাকায় মহিষের মধ্যে স্থাপিত তুলনামূলক শত্রুতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় উভয়পক্ষই আঘাত হানতে বিলক্ষণ পটু, জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল প্রাকৃতিক পরিবেশ আর যোদ্ধাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর–অতএব এই শত্রুতা সমানে-সমানে হয়ে ছিল বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হয় না। কিন্তু পরস্পরবিরোধী যে দুটি শত্রুর সংঘাতের ফলে বর্তমান কাহিনির অবতারণা তাদের মধ্যে এক পক্ষ ছিল দানবের মতো বিপুল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী–অপরপক্ষ খর্বকায় দুর্বল, নগণ্য; মহাবলিষ্ঠ শত্রুর এক চপেটাঘাতেই তার মৃত্যু ছিল অনিবার্য।

অতিকায় দানব ও খর্বকায় মানবের অসম শত্রুতার ফলে ক্ষুদ্রদেহধারী বামনের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে হলেও শেষ পর্যন্ত বামনই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। যে-অস্ত্রের সাহায্যে এমন অসাধ্যসাধন করতে সে সমর্থ হয়েছিল, সেই অস্ত্রটি হচ্ছে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আত্তিলিও সাহেব পূর্বোক্ত দুই শত্রুর মাঝখানে এসে পড়েছিলেন নিতান্ত ঘটনাচক্রের শিকার হয়ে, রাইফেল হাতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবেলাও করেছিলেন তিনি আদর্শ সৈনিকের মতো কিন্তু এই কাহিনির নায়ক নন আত্তিলিও গত্তি। প্রকৃত নায়কের সম্মান কাকে দেওয়া যায় সেই বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে আমি এইবার কাহিনি শুরু করল্লাম সেখান থেকে, যেখানে ঠ্যাং ভেঙে আত্তিলিও তাঁবুর ভিতর শয্যাগ্রহণ করেছেন।

হ্যাঁ, শয্যা না-গিয়ে আর উপায় কী? মহিষের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে তাঁর শ্রীচরণের যে কী দুরবস্থা হয়েছিল সে-কথা নিশ্চয়ই প্রথম খণ্ডের পাঠকদের মনে আছে। মধ্য আফ্রিকার বাকাভা অঞ্চলে অবস্থিত কিভু নামক বৃহত্তম হ্রদের তীরে তাবুর ভিতর শুয়ে আত্তিলিও তাঁর ভাঙা পা সুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর স্বপ্ন দেখছিলেন।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু অবশ্য অন্য লোকের কাছে খুব মনোরম লাগবে না। আত্তিলিওর স্বপ্ন যদি চোখের সামনে নিরেট দেহ নিয়ে দাঁড়ায়, তবে অধিকাংশ মানুষই যে আতঙ্কে চমকে উঠবে । সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আত্তিলিও সাধারণ মানুষ নন, বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার উদ্দেশ্যেই তিনি শ্বাপদসংকুল অরণ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন তাই দূরে দৃশ্যমান অরণ্যসজ্জিত পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে তিনি যে-জীবটির স্বপ্ন দেখতেন, সে হচ্ছে আফ্রিকা তথা সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম বানরজাতীয় জীব–দানব-গরিলা।

কিভু হ্রদের অদূরে বিরাজমান ওই পর্বতশ্রেণির উপর হাজার হাজার বছর ধরে যে মহারণ্য রাজত্ব করছে, সেখানে কোনো মানুষ বাস করে না। অতি দুঃসাহসী পিগমি জাতিও সেখানে কেবলমাত্র দিনের আলোতে প্রবেশ করতে সাহস পায়। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যের নিবিড় অন্তঃপুর থেকে প্রতি প্রভাতে শিশু-সূর্যকে অভিনন্দন জানিয়ে তীব্রস্বরে ডেকে ওঠে দানব-গরিলা। মানুষের যাতনা-কাতর আর্তনাদের মতো অতিকায় কপিকণ্ঠের সেই রবি-বন্দনা কানে গেলে শ্রোতার সর্বাঙ্গে জেগে ওঠে আতঙ্কের শিহরন! ওইভাবে চিৎকার করে প্রভাত-সূর্যকে অভ্যর্থনা জানায় বলেই স্থানীয় মানুষ গরিলার নাম দিয়েছে গাগি অর্থাৎ রাত্রির যে অবসান ঘটায়। গরিলার কণ্ঠস্বরে সাড়া দিতেই যে সূর্যদেব প্রত্যহ পূর্বাচলে আত্মপ্রকাশ করেন এ-বিষয়ে পিগমি জাতির সন্দেহ নেই কিছুমাত্র।

পিগমিরা দু-দুবার খবর পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তারা আত্তিলিওকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক, তাঁর জন্য তারা অপেক্ষা করছে সাগ্রহে। পিগমিদের খবর পেয়ে গরিলার সন্ধানে যাত্রা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে তখনই অভিযান শুরু করতে পারছিলেন না।

তাঁর মানসিক অবস্থা বোধ হয় আহত অঙ্গটিকে আরোগ্য লাভ করতে সাহায্য করেছিল, কারণ অপ্রত্যাশিতভাবে চিকিৎসক তাকে জানালেন গোড়ালির হাড় জোড়া লেগে গেছে, আত্তিলিও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

বেলজিয়ামের উপনিবেশ-মন্ত্রীর হাত থেকে অনেক কষ্টে দানব-গরিলার বাসস্থানে প্রবেশ করার একটা পারমিট বা ছাড়পত্র আদায় করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও।ওই অঞ্চলে প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া খুব কঠিন, তবে কয়েকটা অভিযানে সাফল্য লাভ করেছিলেন বলেই আত্তিলিও

সাহেব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিষিদ্ধ বনভূমিতে বাস করার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। নির্দিষ্ট তিন মাসের মধ্যে একটি  দানব-গরিলা শিকারের অনুমতিও নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। তবে নিছক শিকারের বাসনা চরিতার্থ করতে গেলে সরকারের অনুমতি পাওয়া যেত না–আত্তিলিও সাহেব নিহত গরিলার দেহ নিদর্শন হিসাবে প্রেরণ করতে চেয়েছিলেন এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটির নাম উইটওয়াটারসর‍্যান্ড ইউনিভার্সিটি অর জোহানেসবার্গ।

দেরির জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন আত্তিলিও। চিকিৎসক যেদিন পায়ের অবস্থা সন্তোষজনক বলে রায় দিলেন, সেইদিন সন্ধ্যার সময়ে আত্তিলিও সাহেবপ্রাদেশিক কমিশনারের সঙ্গে দেখা করলেন। কমিশনারের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া গেলেও যেসব কথা উক্ত ভদ্রলোকের মুখ থেকে শুনেছিলেন আত্তিলিও, সেগুলো তার কানে আদৌ মধুবর্ষণ করেনি।কমিশনার সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন একটির বেশি গরিলাকে কোনো কারণেই হত্যা করা চলবে না। আত্মরক্ষার ছুতো তিনি শুনতে রাজি নন, কারণ এর আগে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ জঙ্গলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেকগুলো গরিলাকে হতাহত করেছে। আহতদের সংখ্যা নিহতের চাইতে বেশি। হত্যাকারীরা অবশ্য বলেছে আত্মরক্ষার জন্যই তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু কমিশনার তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। কমিশনার সাহেব আত্তিলিওকে জানিয়ে দিলেন ওই ধরনের ঘটনা ঘটলে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। কঠোর শাস্তিটা কীরকম হতে পারে জানতে চেয়ে আত্তিলিও শুনলেন অর্থদণ্ডের পরিমাণ খুব কম করে বিশ হাজার ফ্রাঙ্ক এবং কঙ্গো থেকে বহিষ্করণ। অবশ্য বহিষ্করণের আগে একবার জেল খাটতে হবে, তবে জেলের মেয়াদ কতদিন হতে পারে সে-বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছেন না কমিশনার।

জেল! জরিমানা! বহিষ্করণ!–আত্তিলিও হতভম্ব।

কমিশনার বিনীতভাবে জানালেন একটু কড়াকড়ি করতে হয়েছে। গরিলারা দুষ্প্রাপ্য জীব, বিশেষ করে অতিকায় দানব-গরিলা অতিশয় দুর্লভ তাই সরকার তাদের রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ঠিক আছে, আত্তিলিও বললেন, আপনার অমূল্য গরিলাদের মধ্যে একটির বেশি জন্তুকে লক্ষ করে আমি গুলি ছুড়ব না। প্রাণ গেলেও আমার কথার নড়চড় নেই জানবেন।

আত্তিলিও চলে এলেন। কমিশনার তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। স্থানীয় অধিবাসীরা উচ্চভূমিতে অবস্থিত জঙ্গলের কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছিল, ভিতরে যাওয়া তো দূরের কথা। কমিশনারের চেষ্টাতেই কয়েকটি নিগ্রো আত্তিলিওর সঙ্গী হতে রাজি হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে ওই ভদ্রলোকের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করলেন আত্তিলিও।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মাম্বুটি পিগমি

সারাদিন ধরে অত্যন্ত ধীরে ধীরে আর কষ্টকরভাবে পথ চলার পর আত্তিলিও সদলবলে এসে পৌঁছালেন পাহাড়ের উপর একটা সমতলভূমিতে। ওই সমতলভূমির পিছনে বিরাজ করছিল অরণ্যের সবুজ প্রাচীর। খোলা জায়গাটার উপর সকলে এসে দাঁড়াতেই আত্তিলিওর অনুচরদের ভিতর থেকে উঠল প্রবল হাস্যধ্বনি। হঠাৎ লোকগুলোর এমন হাসিখুশি হয়ে ওঠার কারণটা কী হতে পারে ভেবে এদিক-ওদিক দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ পড়ল একদল অতি খর্বকায় মানুষের দিকে। সেই বেঁটে বেঁটে বামনদের দেহে ছিল নামমাত্র আবরণ, তাদের উচ্চতা ছিল চার ফিটের মতো বামনদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা লোকটির দৈর্ঘ্য চার ফিট ছয়-ইঞ্চির বেশি হবে না। লোকগুলোর ছোটো ছোটো কুঞ্চিত মুখের সঙ্গে বাঁদরের মুখের সাদৃশ্য খুব বেশি। ওইরকম কুৎসিত মুখ, খর্বকায় দেহের মধ্যস্থলে সুগোল উদরের স্ফীতি আর সরু সরু পা দেখে মামুটি পিগমি জাতিকে যদি কেউ খুব হাস্যকর বলে মনে করে তাহলে তাকে বোধ হয় দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু মাষুটি পিগমিদের দলে যে ছোটোখাটো বৃদ্ধটি ছিল, সে আত্তিলিওর নিগ্রো অনুচরদের হাস্যস্রোত পছন্দ করল না। বৃদ্ধের মাথা থেকে ঝুলছিল একটা বেবুনের চামড়া, তার নাকের গড়নও ছিল অদ্ভুত হাড়ের উপর-অংশ চেপটা, তলার দিকটা হঠাৎ ঠেলে উঠেছে উপর দিকে। দুই চোখে বন্য উগ্রতার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে পূর্বোক্ত নিগ্রোদের দিকে একবার কটাক্ষপাত করল বৃদ্ধ–এমন ভয়ংকর সেই চোখের প্রভাব যে, তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল হাস্যধ্বনি, সকলের মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্যের নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি।

ইয়াম্বো, বাওয়ানা (সুপ্রভাত, মহাশয়), বৃদ্ধ বলল।

বলার সঙ্গেসঙ্গে হাতের বর্শাতে ভর দিয়ে সে হেলে দাঁড়াল।

তার দুই চোখ এখন আত্তিলিওর দিকে। দৃষ্টিতে বন্ধুত্বপূর্ণ কৌতূহলের আভাস। কেউ বৃদ্ধের পরিচয় না-দিলেও আত্তিলিও বুঝলেন সে হচ্ছে পিগমিদের অধিনায়ক সুলতানি কাসিউলা–কয়েকদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে আত্তিলিওর জন্য।

ইয়াম্বা, বাওয়ানা, বৃদ্ধের সঙ্গীরা সমস্বরে অভ্যর্থনা জানাল। চোখের ভাষা যে পড়তে জানে সে পিগমিদের ঝকঝকে চোখগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝবে বামনরা নির্বোধ নয়। একটু পরেই যে নবাগত সাদা-চামড়ার মানুষটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেই আগন্তুককে দুই চোখ দিয়ে জরিপ করে নিচ্ছে খর্বকায় পিগমিরা বুঝে নিতে চাইছে লোকটি কেমন হবে।

মুহূর্তের মধ্যেই পিগমিদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন আত্তিলিও। ছোটোখাটো লোকগুলোকে তার খুব ভালো লেগে গেল। পিগমিরা আত্তিলিওর মনোভাব বুঝতে পারল। তৎক্ষণাৎ তারা তাবু ফেলার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁবু খাটানোর কাজ শেষ। মোটবাহকরা চটপট শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পারিশ্রমিক নেবার জন্য। প্রাপ্য অর্থ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই লোকগুলো দৌড় দিল–লোভনীয় বকশিশ টম্বাকো (তামাক) নেবার জন্য তারা এক মুহূর্ত দেরি করল না। তাদের অদ্ভুত আচরণের অর্থ খুবই পরিষ্কার আত্তিলিওর কাছে রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই লোকগুলো স্থান ত্যাগ করতে চায়। তাদের বিবেচনায় এই অঞ্চল রাত্রিকালে ঘোরতর বিপজ্জনক।

পিগমিরা এর মধ্যে গাছের ডালপালা দিয়ে একটা সাময়িক আচ্ছাদন নিজেদের জন্য তৈরি করে ফেলেছে এবং অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে আত্তিলিওর রাঁধুনির রান্নার স্বাদ গ্রহণ করছে। নিবিষ্টচিত্তে। রান্না তো ভারি, গাদা গাদা সিদ্ধ আঁটা। কিন্তু সেই খাদ্য পেয়েই তারা খুব খুশি, আর রাঁধুনিও তাদের পরিতুষ্ট করতে ব্যস্ত। একটু আগেই তার অট্টহাস্য যে পিগমিদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল সেই কথা সে ভোলেনি, অপ্রীতিকর ব্যাপারটা মুছে ফেলে সে পিগমিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ন্‌গাগি

খুব ভোরে বীভৎস চিৎকারের শব্দে আত্তিলিওর ঘুম ভেঙে গেল। এমন উৎকট আওয়াজ আগে কখনো শোনেননি তিনি। তবু চিৎকারের কার্যকারণ অনুমান করতে তার ভুল হল না। চটপট তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন আত্তিলিও। পিগমিরা আগেই উঠেছে এবং অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে পড়েছে।

উত্তেজিত স্বরে আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, নগাগি?

পিগমিদের নেতা কাসিউলা গম্ভীরভাবে বলল, নদিও, নগাগি (হ্যাঁ, গরিলা)।

সমবেত পিগমিরা মাথা নেড়ে সর্দারের কথায় সায় দিল। তার পর সদ্য জাগ্রত শিশু সূর্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। আত্তিলিওর পায়ের তলায় অবস্থিত উঁচু জমিটার অনেক নীচে কিভু হ্রদের জল যেখানে আয়নার মতো ঝকঝক করছে, মনে হল সেই তরল আয়নার উপর থেকেই উঠে আসছে প্রভাত সূর্য।

কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন আত্তিলিও। সঙ্গে রইল খর্বকায় পিগমি পথপ্রদর্শকের দল। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে আত্তিলিও ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু এমন কষ্টকর পথ চলার অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি। পথ বলতে কিছু নেই–ঘন সন্নিবিষ্ট বৃক্ষ, ঝোঁপ, লতা, ঘাসজঙ্গল প্রভৃতি নিয়ে গঠিত উদ্ভিদের প্রাচীর ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতি মুহূর্তে মনের মধ্যে জেগে ওঠে সর্পাঘাতের সম্ভাবনা। মাথার উপর ডালপালা আর লায়ানা লতার মধ্যে সাপ লুকিয়ে থাকলে তাকে ছোবল মারার আগে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়; পায়ের কাছে যেখানে শুকনো ঝরা পাতা আর শ্যাওলার মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় সেখান থেকেও লুকিয়ে-থাকা সাপ যেকোনো মুহূর্তে ছোবল বসাতে পারে শুধু তাই নয়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে যদিও ঘন জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না, তবু প্রতি মুহূর্তে ঝোঁপঝাড়ের ভিতর থেকে আত্মগোপনকারী হিংস্র পশুর আক্রমণের আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা চমকে চমকে উঠতে থাকে, সেইসঙ্গে চোখে পড়ে বিষাক্ত কীটপতঙ্গের আনাগোনা। কয়েকটা বিচিত্র ধরনের কীট আত্তিলিওর পরিচিত নয়, সেগুলোকে তার আরও বেশি ভয়ানক বলে মনে হল। কাটাগাছের ডালগুলো তাদের ধারালো আলিঙ্গনের চিহ্ন বসিয়ে দিতে লাগল আত্তিলিওর পরিচ্ছদ আর চামড়ার উপর, অসংখ্য নাম-না-জানা গাছের বিষাক্ত স্পর্শে ফুলে ফুলে উঠল তার মুখ আর হাত, সঙ্গেসঙ্গে আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বালা-যন্ত্রণা। এর ওপর আবার শ্বাসকষ্টও ছিল–উচ্চভূমির ভারী বাতাস টানতে তার বিলক্ষণ কষ্ট হচ্ছিল, কয়েক ঘণ্টা পথ চলার পরই তার দৃষ্টি হয়ে এল ঝাপসা, কান করতে লাগল ভো ভো! দাঁতে দাঁত চেপে রাইফেল আঁকড়ে ধরে অতিকষ্টে এগিয়ে যেতে। লাগলেন আত্তিলিও সাহেব।

আত্তিলিওর সঙ্গী কাসিউলা নামক পিগমিদের নেতা এবং তার বারোজন অনুচর খুব সহজেই পথ চলছিল। উদ্ভিদের জটিল জালের ভিতর দিয়ে তাদের ছোটোখাটো শরীর চটপট পথ করে নিচ্ছিল, কিন্তু মস্ত গুরুভার দেহ নিয়ে আত্তিলিও যাচ্ছিলেন আটকে আর আটকে তিনি যখন গাছপালার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে পথ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন এবং পায়ের তলায় গর্তগুলো দেখতে না-পেয়ে ধপাধপ আছাড় খাচ্ছেন, পিগমিরা তখন হালকা শরীর নিয়ে গর্তের উপরের। ঘাসপাতা মাড়িয়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে! তাদের জুতো ছাড়া খালি পা খুব সহজেই নরম মাটি, শ্যাওলা ও শিকড়বাকড়ের উপর চেপে পড়ছে কিন্তু আত্তিলিও সাহেবের জুতো-পরা পা যাচ্ছে পিছলে আর পিছলে, তিনি খাচ্ছেন হোঁচটের পর হোঁচট! জঙ্গলের ছায়ার মতোই নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে পিগমিরা, আবার ফিরে এসে সর্দারকে সামনের পথের খবরাখবর দিচ্ছে ফিসফিস করে, তারপরই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে ভূতুড়ে ছায়ার মতো!…

আচম্বিতে আত্তিলিওর খুব কাছেই জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল এক তীব্র চিৎকার! ক্রুদ্ধ সিংহের গর্জনের চাইতেও ভয়ংকর, যাতনাকাতর কুকুরের কান্নার চাইতেও করুণ, মরণাহত মানুষের আর্তনাদের চাইতেও ভয়াবহ সেই চিৎকারের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সকাল বেলা যে চিৎকার শুনেছিলেন আত্তিলিও, এই শব্দটা মোটেই সে-রকম নয়। প্রথম চিৎকারের পরেই খুব কাছ থেকে আরও অনেকগুলো কণ্ঠের সাড়া পাওয়া গেল–কণ্ঠস্বরগুলো একইরকম তীব্র, একইরকম উগ্র, একইরকম ভয়ংকর! তারপর আবার সব চুপচাপ!

চিৎকারগুলো যে গরিলাদের কণ্ঠ থেকেই এসেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু জন্তুগুলো কোথায় অবস্থান করছে বুঝতে পারলেন না আত্তিলিও। গাছের পাতার কম্পনও তাঁর চোখে পড়ল না, তাই তাদের গতিবিধিও ধরতে পারলেন না তিনি–তবে একটা উগ্র গন্ধ তার নাকে এসেছিল বটে। আত্তিলিও ভাবতে লাগলেন এই বুঝি একজোড়া রোমশ বাহু জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরে!

গরিলা সম্বন্ধে যেসব গল্প শুনেছিলেন আত্তিলিও সেই গল্পগুলো এখন তার মনে পড়তে লাগল। নিগ্রোদের মধ্যে অনেকেই নাকি গরিলার কবলে পুড়ে অদৃশ্য হয়েছে, শ্বেতাঙ্গ শিকারিদের মধ্যে যারা গুলি চালিয়েছে কিন্তু গরিলাকে হত্যা করতে পারেনি এবং তার ফলে গরিলার প্রচণ্ড মুষ্টি যাদের সর্বাঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে তাদের কথা মনে পড়ল আত্তিলিও সাহেবের, গরিলার নখাঘাতে ছিন্নভিন্ন পিগমিদের কাহিনিও তাঁর স্মরণপথে উঁকি দিল, আর

আর ঠিক সেই সময় মটাৎ করে একটা গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ এল আত্তিলিওর বাঁ-দিক থেকে!

বিদ্যুদবেগে শব্দ লক্ষ করে ঘুরলেন তিনি, কিন্তু কিছুই তার নজরে পড়ল না।

আবার একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ এল সামনের দিক থেকে। পরের শব্দটা উঠল ডান দিকে। তারপর এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল সেই শব্দ–কাদের ভারী পায়ের চাপে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে শুকনো গাছের ডাল। সেইসঙ্গে বড়ো বড়ো গাছের পাতার আলোড়ন-ধ্বনি। অরণ্যের বুকে শব্দের তরঙ্গ তুলে সরে যাচ্ছে অনেকগুলো অতিকায় জীব। যদি তাদের মধ্যে কারো হঠাৎ আত্তিলিওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার শখ হয়, তাহলে কী হবে? ঘন উদ্ভিদের জাল ভেদ করে আক্রমণকারীকে আবিষ্কার করার আগেই তো আত্তিলিও পড়ে যাবেন দানবের খপ্পরে! রাইফেল চালানোর সময় পাওয়া যাবে কি?

না, সেসব কিছু হল না। অন্তত এবারের মতো গরিলারা আত্তিলিও আর তার দলবলকে রেহাই দিল। জন্তুগুলো সরে যাচ্ছে।

যে-পাহাড়টার উপর আত্তিলিও তাঁর পিগমি সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই পাহাড়ের নীচের দিকেই সশব্দে নেমে যাচ্ছে গরিলার দল। যাওয়ার আগে তারা বুঝি জানিয়ে দিয়ে গেল, সাবধান! চলে যাও এখান থেকে! কথা না-শুনলে বিপদ হবে!

হ্যাঁ, চলে যেতেই চাইলেন আত্তিলিও। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাতে তার একটু সময় লাগবে। সেদিন অন্তত দানব-গরিলার সান্নিধ্যে আসার জন্য একটুও উৎসুক ছিলেন না আত্তিলিও, বরং ওই ভয়ংকর জীবের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্যই তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। কম্পাসের দিকে তাকিয়ে তিনি পিছন ফিরে তাঁবুর দিকে যাত্রা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন পিগমি-সর্দারের কাছে। সর্দার কাসিউলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, তারপর সোজা এগিয়ে চলল নিজের খুশিমতো। পিছন ফিরে তাবুর রাস্তায় পা বাড়াল । আত্তিলিওর মেজাজ খারাপ হল; লোকটা আবার কিশোয়াহিলি ভাষা ভালো বুঝতে পারে না, কিন্তু ওই ভাষা ছাড়া আর কীভাবে আত্তিলিও ভাব প্রকাশ করবেন? এত তাড়াতাড়ি তো আর পিগমিদের ভাষা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। অতএব বার বার হাত নেড়ে পূর্বোক্ত ভাষাতেই তিনি বলতে লাগলেন, তোমাকে পিছন ফিরতে বলছি না? আমি তাঁবুতে ফিরতে চাই।

সর্দার কাসিউলা খুব অমায়িকভাবে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ আত্তিলিওর কথা সে বুঝেছে। কিন্তু যে-পথ ধরে এগিয়ে গেলে তাবুতে পৌঁছানো যাবে বলে ভাবছিলেন আত্তিলিও, ঠিক তার উলটো দিকের পথ ধরেই হাঁটতে লাগল কাসিউলা! এমন নির্বিকার মানুষকে নিয়ে কী করা যায়? উপায়ান্তর না-দেখে আত্তিলিও শেষ পর্যন্ত কাসিউলাকেই অনুসরণ করলেন। ফলে দেখা গেল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি এসে পড়েছেন তাবুর সামনে! আত্তিলিও বুঝলেন কম্পাস প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্য না-নিয়েও পিগমিরা নিখুঁতভাবে পৃথ চলতে পারে। শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও পিগমিরা কখনো পথ ভুল করে না। সত্যি, তাদের দিকনির্ণয় করার ক্ষমতা অদ্ভুত।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বামন ও দানবের দেশ

কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। আত্তিলিও দানব-গরিলার স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারলেন। কিন্তু দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পিগমিদের মতো সহজভাবে পথ চলার কায়দাটা রপ্ত করতে পারলেন না। প্রত্যেকদিন অরণ্য ভ্রমণ সাঙ্গ করে আত্তিলিও ভাবতেন, আর নয়, এবার অন্তত কয়েকটা দিন বিশ্রাম নেব।

পরের দিন কাসিউলা এসে ডাকামাত্র তিনি আবার বেরিয়ে পড়তেন, রহস্যময় অরণ্য যেন দুর্বার আকর্ষণে তাকে টেনে আনত তাবুর বাইরে।

প্রত্যেকদিন কাসিউলা তার শ্বেতাঙ্গ অতিথিকে নিয়ে যেত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। ওই জায়গাগুলো ছিল গরিলাদের রাতের আস্তানা। তারা চলে যাওয়ার পর তাদের পরিত্যক্ত আস্তানা পর্যবেক্ষণ করে আত্তিলিও দুটি গরিলা-পরিবারের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন। পরিবার দুটি দিনের বেলা একসঙ্গে ভ্রমণ করত, কিন্তু রাত হলে তারা আশ্রয় নিত পৃথক আস্তানায়।

ওই আস্তানাগুলো তৈরি করতে গরিলারা যথেষ্ট পরিশ্রম করত। দুটি বড়ো গাছের নীচে রাত্রিবাসের জন্য আস্তানা তৈরি করা হত। প্রথমে গাছের তলায় মাটির উপর থেকে ঝোঁপঝাড়, শিকড়বাকড় তুলে জায়গাটা পরিষ্কার করত গরিলারা, তারপর সেই জায়গাটার উপর প্রচুর পরিমাণে শ্যাওলা, গাছের পাতা প্রভৃতি বিছিয়ে প্রস্তুত করত একটি আরামদায়ক বিছানা। অন্তঃপুরের গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টাও ছিল–মোটা মোটা লায়ানা লতা টেনে এনে পর্দা দেওয়ার চেষ্টা দেখা যেত ওই আস্তানায়।

গরিলাদের সঙ্গে যখন ছোটো বাচ্চা থাকে তখন মেয়ে-গরিলা আর বাচ্চারা গাছের উপর আশ্রয় গ্রহণ করে। দৈত্যাকৃতি পুরুষ গরিলা গাছের নীচে পূর্বে উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসারে তার নিজের আস্তানা ও শয্যা তৈরি করে, তারপর সেখানে নিদ্রা দেয়। তবে একবারে চিতপাত হয়ে তারা শুয়ে পড়ে না, গাছের গুঁড়িতে পিঠ লাগিয়ে তারা নিদ্রাসুখ উপভোগ করে। ঘুমের সময়েও বিপদের আশঙ্কায় তাদের ইন্দ্রিয় থাকে অতিশয় জাগ্রত, একেবারে অচৈতন্য হয়ে তারা কখনোই নিদ্রার ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করে না।

ভোর হলেই আবার গরিলারা বেরিয়ে পড়ে আহারের সন্ধানে। আত্তিলিও তাঁর পিগমি-বাহিনী নিয়ে গরিলাদের পরিত্যক্ত আস্তানা থেকে পদচিহ্ন ধরে জন্তুগুলোকে অনুসরণ করতেন। এই ব্যাপারে কাসিউলার দক্ষতা অসাধারণ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্তিলিও সাহেব গরিলাদের পথ-চলার চিহ্ন আবিষ্কার করতে না-পারলেও কাসিউলা নির্ভুলভাবে জন্তুগুলোর গন্তব্য পথ নির্ণয় করতে পারত। কী করে পারত সেটা অবশ্য আত্তিলিও বুঝতে পারেননি। কয়েক জায়গায় গরিলাদের পায়ের ছাপ তুলেছিলেন আত্তিলিও প্লাস্টার অব প্যারিস নামক পদার্থের সাহায্যে। সবচেয়ে বড় পায়ের ছাপ ছিল ১৪ ইঞ্চি লম্বা, ৬ ইঞ্চি চওড়া এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে কনিষ্ঠ অঙ্গুলি পর্যন্ত পদচিহ্নের বিস্তার ৭ ইঞ্চি। জন্তুটার দেহের ওজন সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা দেবার জন্য আত্তিলিও বলেছেন পিগমিদের পায়ের ছাপ যতই গম্ভীর হয়, তার চারগুণ গম্ভীর হয়ে মাটির উপর পড়ে গরিলার পদচিহ্ন।

ওই পায়ের চিহ্ন দেখে গরিলাদের চিনতে পারত কাসিউলা। পিগমিরা তাদের এলাকার প্রত্যেকটি গরিলার নামকরণ করেছিল। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু শুধু পায়ের ছাপ দেখেই কাসিউলা বলে দিত কোন কোন জন্তুর পদচিহ্ন! এ-বিষয়ে তার একবারও ভুল হয়নি।

খুব ধীরে ধীরে পা চালিয়ে গরিলাদের অনুসরণ করতেন আত্তিলিও। অতিকায় বানরগুলোর গতিবিধি তিনি লক্ষ করতেন জঙ্গলের আড়াল থেকে অথবা গাছের উপর থেকে।

গরিলারা প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উদরস্থ করে। কারণ, তাদের দেহের পরিধি যেমন বিরাট, তাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত জিনিসগুলোর আকার তেমনই অতিশয় ক্ষুদ্র। মিয়ান্দো নামক এক ধরনের শাক তাদের প্রিয় খাদ্য। মিয়ান্দো ভক্ষণে ব্যস্ত একদল গরিলাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আত্তিলিও সাহেবের। একটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে অবস্থান করেছিল মিয়ান্দো শাকের খেত, কয়েক মিনিটের মধ্যেই গরিলারা জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলল! খেতের সমস্ত শাক উদরস্থ করেই দলটা আবার খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যাত্রা করল দলপতির নির্দেশে।

আহার্য বস্তু সংগ্রহ করার জন্যই গরিলারা সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে বাধ্য হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটা বিস্তীর্ণ এলাকার ফলমূল, শাকসবজি তারা উদরস্থ করে ফেলে, অতএব খুব বেশি ঘোরাঘুরি না-করলে তাদের রাক্ষুসে খিদে মিটবে কেন? গরিলাদের প্রিয় খাদ্য হচ্ছে মিয়ান্দো শাক, বুনো কলা, বুনো পেঁয়াজ আর কচি বাঁশের গোড়া। ভোরবেলা থেকে শুরু করে বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত চলে তাদের ভ্রমণ আর আহার পর্ব–তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের খাদ্যসংগ্রহের বিরাম নেই। খুব সম্ভব সেইজন্যই তারা প্রতিরাত্রে নূতন নূতন রাতের আস্তানা তৈরি করতে বাধ্য হয়। আহারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তারা বিকালের দিকে আগের আস্তানা থেকে এত দূরে এসে পড়ে যে, সেখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না–অতএব রাত্রিবাসের জন্য নূতন ঘর না-বেঁধে আর উপায় কী?

দুপুর বেলা গরিলারা যখন বিশ্রাম করে সেইসময় কয়েকদিন তাদের লক্ষ করেছিলেন আত্তিলিও। কয়েকটি পূর্ণবয়স্ক গরিলাকে সটান ঘাসের উপর লম্বা হয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে দেখা গেল, কয়েকটা জন্তু আবার গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে ঘুম লাগাচ্ছে। একদিন একটা গরিলা-বাচ্চার কাণ্ড দেখে খুব মজা পেয়েছিলেন আত্তিলিও। একটা কিশোরবয়স্ক গরিলার সঙ্গে বাচ্চাটা খেলা করছিল। গাছের উপর-নীচে ছুটোছুটি করে তারা পরস্পরকে তাড়া করছিল খেলার ছলে, কখনো-বা লায়ানা লতা ধরে ঝুলছিল প্রবল উৎসাহে, আবার কখনো-বা লুকোচুরি খেলার আনন্দে তারা মশগুল। হঠাৎ বাচ্চাটা খেলা ছেড়ে তার মায়ের কাছে এসে পড়ল। মা বসে বসে ঢুলছিল, বাচ্চার বোধ হয় সেটা পছন্দ হল না। সে প্রথমে মায়ের চারপাশে লাফালাফি করল, তারপর বুকের উপর লাফিয়ে উঠে চুল ধরে টানতে লাগল; অর্থাৎ যতরকমে সম্ভব মাকে বিরক্ত করতে শুরু করল। গরিলা-মা প্রথমে কিছু বলেনি, কিন্তু অত্যাচার যখন অসহ্য হয়ে উঠল তখন চোখ বন্ধ রেখেই বাচ্চাকে একটি মৃদু চপেটাঘাত করল সে। থাপ্পড় খেয়ে বাচ্চাটা ফুটবলের মতো গোল হয়ে গড়াতে গড়াতে ছিটকে পড়ল অনেক দূরে! অবশ্য পরিত্রাহি চিৎকার করে সে জানিয়ে দিয়েছিল মায়ের ব্যবহারটা তার মোটেই ভালো লাগেনি।

গরিলা দলপতির গতিবিধি লক্ষ করা কিন্তু এত সহজ নয়। পথ চলার সময়ে সে থাকে দলের আগে। দল যখন পিছিয়ে আসে, সে তখন সকলের পিছনে। দলের গরিলারা যখন আহারে ব্যস্ত, দলপতি সেইসময় চারধারে ঘুরে ঘুরে টহল দেয়, নজর রাখে চারদিকে শত্রুর আবির্ভাব হলে তার প্রথম মোকাবেলা করে দলপতি। দৈর্ঘ্যে ছয় ফিট ছয় ইঞ্চি, রোমশ কৃষ্ণ দেহের পৃষ্ঠদেশে কালোর বদলে রুপালি রঙের ছোঁয়া-মাখানো বিরাট শরীর নিয়ে গরিলা দলপতি যখন ধীর পদক্ষেপে বনের পথে বিচরণ করে, তখন মনে হয় অরণ্য-সম্রাট তার রাজত্ব পরিদর্শন করে ফিরছে!

গরিলারা যখন স্থানত্যাগ করে অপরস্থানের উদ্দেশে রওনা হত, ঠিক সেইসময় তাদের অনুসরণ করতেন না আত্তিলিও। কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি বুঝেছিলেন পিগমিদের মতো নিঃশব্দে ঘন জঙ্গলের ভিতর চলাফেরা করার ক্ষমতা তার নেই। ভারী জুতো আর ভারী শরীর নিয়ে ধুপধাপ করে বনের মধ্যে যাতায়াত করতে গিয়ে গরিলাদের চমকে দেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাদের মেজাজ খারাপ থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, সে-রকম বিপজ্জনক কিছু না-ঘটলেও অতি দ্রুতবেগে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে তারা যে অনুসরণকারীদের ফাঁকি দেবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ধাবমান গরিলাদের নাগাল পেতে হলে আবার কয়েক ঘণ্টা ঊর্ধ্বশ্বাসে তাদের পিছু পিছু ছোটা দরকার। সেইখানেই আত্তিলিওর প্রবল আপত্তি, ঘন জঙ্গলের মধ্যে অনর্থক ছোটাছুটি করে কষ্ট পেতে তিনি মোটেই রাজি ছিলেন না। অতএব গরিলারা কিছুদূর এগিয়ে গেলে পিগমি-সর্দার কাসিউলার নির্দেশ অনুসারে তাদের পিছু নিয়ে এগিয়ে যেতেন আত্তিলিও এবং ওইভাবে চলাফেরা করার ফলে অনুসরণকারী মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হতে পারেনি গরিলার দল। একটা জায়গা ছেড়ে আর একটা জায়গার উদ্দেশে গরিলাদের পদচালনা করতে দেখলেই আত্তিলিও বসে পড়তেন একটা গাছের গুঁড়ির উপর। তারপর বেশ খানিকটা সময় কেটে গেলে তিনি আবার তাদের পিছু নিতেন। ওই সময়টা চুপচাপ বসে–থেকে আত্তিলিও পিগমিদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চেষ্টা করতেন।

আগেই বলেছি ওই অঞ্চলের গরিলাদের প্রত্যেকটি পশুরই নামকরণ করেছিল পিগমিরা। কিটাম্বো নামে একটা মস্ত পুরুষ-গরিলাকে পিগমিরা ভীষণ ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কের সঙ্গে একটা শ্রদ্ধার ভাবও দেখেছিলেন আত্তিলিও। একদিন কাসিউলাকে ডেকে আত্তিলিও জিজ্ঞাসা করলেন এমন ভয়ানক জন্তুটাকে তারা হত্যা করেনি কেন? উত্তরে কাসিউলা জানাল শ্বেতাঙ্গদের আইনে গরিলা মারলে শাস্তি পেতে হয় বলেই তারা উক্ত কিটাম্বোর অস্তিত্ব সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। আত্তিলিও বুঝলেন কাসিউলা মিথ্যা কথা বলছে। গরিলার মাংস যে পিগমিদের প্রিয় খাদ্য এবং শ্বেতাঙ্গ শাসকের আইন অমান্য করে তারা যে সুযোগ পেলেই গরিলা শিকার করে সেই তথ্য আত্তিলিওর অজ্ঞাত ছিল না। সাদা মানুষের আইনের কথা নিতান্তই বাজে কথা, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মহাশক্তিধর কিটাম্বোর হিংস্র আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার সাহস ছিল না বলেই পিগমিরা তাকে কখনো হত্যার চেষ্টা করেনি।

স্বয়ং কমিশনার সাহেব আত্তিলিওকে জানিয়েছিলেন পিগমিদের গরিলা শিকার থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও বেলজিয়ামের শ্বেতাঙ্গ-সরকার সুবিধা করতে পারেননি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে সুবিধা পেলেই পিগমিরা গরিলা মেরেছে। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যের ভিতর ঢুকে দোষীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। কিন্তু সরকারের আইনের সাহায্য ছাড়াই গরিলারা যে খর্বকায় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে তার কারণ হচ্ছে তাদের নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য। মাঝে মাঝে গরিলা শিকার করলেও কয়েকটা অতি-বৃহৎ অতিহিংস্র গরিলার সামনে যেতে ভয় পেত পিগমিরা, তাদের বর্শা আর তিরধনুক নিয়ে ওইসব অরণ্যচারী দানবের মোকাবেলা করা অসম্ভব। কিটাম্বোর মতোই ভয়ানক আর একটি পুরুষ-গরিলা পিগমিদের এলাকার মধ্যে বাস করত। কিটাম্বোকে নিয়ে পিগমিরা বিশেষ মাথা ঘামাত না, কিন্তু মোয়ামি ন্‌গাগি নামক অপর গরিলাটি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যথেষ্ট। মোয়ামি ন্‌গাগিকে পারলে নিশ্চয়ই হত্যা করত কাসিউলা, সেই চেষ্টাও যে হয়নি তা নয়–তবে পূর্বতন অভিজ্ঞতার ফলে কাসিউলা জেনেছিল ওই ভয়ংকর দানবের সামনে গেলে পিগমিদের মৃত্যু অবধারিত, তাই অনর্থক দলের লোকের প্রাণ বিপন্ন না-করে অন্য উপায়ে তাকে বধ করতে চেয়েছিল পিগমি-সর্দার সুলতানি কাসিউলা।

মোয়ামি ন্‌গাগি নামের ভয়ংকর গরিলাটি সম্পর্কে সব কথা খুলে বলেছিল কাসিউলা আত্তিলিওর কাছে। নিজেদের জীবন বিপন্ন না-করে জন্তুটাকে হত্যা করার অন্য উপায় থাকলে সে তাই করবে এ-কথাও বলেছিল কাসিউলা–কিন্তু সেই অন্য উপায় যে কী হতে পারে সে-বিষয়ে সে কোনো আলোচনা করেনি এবং আত্তিলিও সাহেবও ওই ব্যাপারে পিগমি-সর্দারের নীরবতা নিয়ে মাথা ঘামাননি। মাথা ঘামালে ভালো করতেন, অন্তত কয়েকটা ভয়ংকর মুহূর্তের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। পরে যখন কাসিউলার পরিকল্পনা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তখন আর বিপদকে এড়িয়ে যাওয়ার সময় ছিল না তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত! অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাইফেল হাতে সেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়েছিলেন আত্তিলিও নিতান্তই আত্মরক্ষার জন্য।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – গরিলারাজ মোয়ামি ন্‌গাগি

পিগমিদের ভাষায় মোয়ামি ন্‌গাগি কথাটার অর্থ হচ্ছে গরিলার রাজা। পিগমিদের এলাকার গরিলাদের মধ্যে পূর্বোক্ত গরিলাটি ছিল সবচেয়ে বড়ে, সবচেয়ে ভয়ংকর। গরিলারা খুব শান্তশিষ্ট নয়, কিন্তু গরিলারাজ মোয়ামি ন্‌গাগির মতো হিংস্র ও উগ্র চরিত্র গরিলাদের মধ্যেও দেখা যায় না।

পিগমি-দলপতি কাসিউলা ওই গরিলাটিকে ঘৃণা করত। ঘৃণাটা অহেতুক নয়। কয়েক বছর আগে কাসিউলার দলভুক্ত ছয়টি পিগমি-শিকারির সঙ্গে তার ছেলেরাও গিয়েছিল খাবারের জন্য সাদা পিঁপড়ে ধরতে। হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে গরিলারাজ মোয়ামি গ্লাগি পিগমিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাসিউলার এক ছেলে এবং তার এক সঙ্গী গরিলার ভয়ংকর আলিঙ্গনে ধরা পড়ল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের সর্বাঙ্গ হয়ে গেল চূর্ণবিচূর্ণ। দলের অন্য সবাই পালাল। দুটি মানুষকে হত্যা করেও দানব ক্ষান্ত হতে চাইল না, মৃতদেহ দুটি মাটিতে ফেলে সে পলাতক পিগমিদের তাড়া করল।

আত্মরক্ষার জন্য পিগমিরা এইবার তাদের প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করল। গরিলা তেড়ে এলে পিগমিরা পালাতে পালাতে বর্শাদণ্ড উলটো করে মাটিতে বসিয়ে দেয়–বর্শাদণ্ড এমনভাবে মাটিতে গেঁথে যায় যে, ধারালো ফলার মুখটা ঘোরানো থাকে অনুসরণকারী গরিলার দিকে এবং ওইভাবে বর্শাদণ্ড মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার সময়ে পলাতকরা এক মুহূর্তের জন্যও থামে না, তাদের গতিবেগ থাকে অব্যাহত। ফলে যে-পথ দিয়ে পিগমিরা পালাতে থাকে সেই পথের জায়গায় জায়গায় ঘন পত্রপল্লবের অন্তরাল থেকে মাটির উপর কোনাকুনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকগুলো বর্শার উদ্যত ফলা গরিলাকে অভ্যর্থনা করার জন্য! ক্ষিপ্ত গরিলা নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করে না, দারুণ ক্রোধে সাময়িকভাবে সাবধান হওয়ার কথাও সে ভুলে যায় তার ফলে পিগমিদের পিছু নিয়ে ছুটতে ছুটতে সে এসে পড়ে বল্লমে কণ্টকিত পথের উপর, আর অনিবার্যভাবেই দানবের ধাবমান বিপুল দেহের গতিবেগে একটা-না-একটা বর্শা সবেগে ঢুকে যায় তার বুকে কিংবা পেটে!

সেদিনও পূর্বোক্ত কৌশল প্রয়োগ করল পলাতক বামনের দল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ভীষণ গর্জন করে থমকে দাঁড়াল গরিলারাজ–তার বিপুল উদরদেশে গভীরভাবে বিদ্ধ হয়েছে একটি বর্শা!

পিগমিরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে আহত জন্তুটাকে লক্ষ করতে লাগল। গরিলা বর্শাটাকে পেট থেকে বাইরে আনার জন্য প্রাণপণে টানাটানি শুরু করল। সেজন্য জন্তুটার খুবই কষ্ট হচ্ছিল সন্দেহ নেই, কারণ বর্শাফলকের দুই প্রান্ত বাঁকা হুক-এর মতো তৈরি করে পিগমিরা একবার শরীরের ভিতর ঢুকলে ওই বাঁকানো ফলা দুটো আর সহজে বাইরে আসতে চায় না।

কয়েকবার টানাটানি করেও যখন গরিলা বর্শাটাকে পেট থেকে বাইরে আনতে পারল না, তখন সে ঝোঁপঝাড় ভেঙে বনের ভিতর অদৃশ্য হল। পিগমিরা ভাবল জন্তুটা জঙ্গলের মধ্যে কোথাও মরে থাকবে। কয়েক মাস পরে আহত গরিলা আবার পিগমিদের এলাকাতে দর্শন দিল। এবার সে একা নয়, এক সুবৃহৎ গরিলা-পরিবারের দলপতি হয়ে ফিরে এসেছিল মোয়ামি গাগি তার দেহ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বভাব আগের চেয়েও উগ্র, আগের চেয়েও ভয়ংকর!

কাসিউলার গল্প শুনে খুব মজা পেয়েছিলেন আত্তিলিও। পিগমিদের হাত পা নেড়ে বলার ভঙ্গিটা সত্যি উপভোগ্য। গল্প হিসাবে তাদের বক্তব্য ভালোভাবেই উপভোগ করেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু কথাগুলো তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। পরে অবশ্য তিনি জানতে পেরেছিলেন কাসিউলার কথা নিতান্ত রটনা নয়, প্রকৃত ঘটনা। তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দিয়েছিল পিগমি সর্দার কাসিউলা এবং সেই প্রমাণের ধাক্কায় আত্তিলিও সাহেবের প্রাণপাখি দেহের খাঁচা ছাড়ার উপক্রম করছিল!

ঘটনাটা এবার বলছি।

একদিন দুপুর বেলা আত্তিলিও যখন কিটাম্বোর দলের পিছু নিয়েছেন, সেই সময় হঠাৎ কাসিউলা থমকে দাঁড়াল। সে উগ্রীব হয়ে কিছু শুনল, বাতাসে কয়েকবার ঘ্রাণ গ্রহণ করল, তারপর পার্শ্ববর্তী ঝোঁপঝাড় পরীক্ষা করতে লাগল।

ব্যাপারটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। অধিকাংশ সময়েই ওইভাবে গরিলাদের গন্তব্যপথ নির্ণয় করে থাকে কাসিউলা, কাজেই আত্তিলিওর মনে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়নি। কিন্তু সে যখন ফিসফিস করে বলল, ওই যে, ওদিকে গেছে ন্‌গাগি, এবং সামনের পর্বতচূড়ার দিকে অগ্রবর্তী অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আত্তিলিওকে এগিয়ে যেতে বলল, তখনই তার সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। আত্তিলিও সাহেব দারুণ উত্তেজনায় অসতর্ক হয়ে পড়েছিলেন, তার উপর দুর্গম অরণ্যে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করার ফলে তিনি এত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, কাসিউলার আচরণের অসংগতি তার নজর এড়িয়ে গেল। তিনি যদি সতর্ক থাকতেন তবে নিশ্চয়ই জানতে চাইতেন অন্যান্যবারের মতো সামনে এগিয়ে পথপ্রদর্শক হওয়ার পরিবর্তে হঠাৎ কাসিউলা এখন নিজে পিছনে থেকে তাকে এগিয়ে যেতে বলছে কেন? আত্তিলিওর বরাত খারাপ, কাসিউলাকে কোনো প্রশ্ন না-করে তিনি বোকার মতো পায়ের ছাপগুলোকে অনুসরণ করলেন।

পাহাড়ের গা ছিল ভীষণ খাড়া। হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন আত্তিলিও।মসার রাইফেলটা যাতে লতা আর উদ্ভিদের জালে জড়িয়ে না যায় সেদিকেও তাকে লক্ষ রাখতে হয়েছিল, তাই আশেপাশে দৃষ্টি দেবার অবসর তার হয়নি। আত্তিলিও বরাবরই লক্ষ করেছেন জঙ্গলের পথে পিগমিরা ছায়ার মতো নিঃশব্দে তার সঙ্গে এগিয়ে যায়। তাই তাদের সাড়া শব্দ না-পেলেও বামনরা যে তার পিছন পিছন আসছে সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন নিঃসন্দেহ। ঝোঁপঝাড় আর লতাপাতার ব্যুহ ভেদ করে খাড়াই বেয়ে উঠছিলেন আত্তিলিও, মনে মনে ভাবছিলেন এই সময় যদি পাহাড়ের উপর থেকে কোনো গরিলা হঠাৎ তাদের উপর লাফিয়ে পড়ে তাহলে তিনি তো রাইফেল ব্যবহার করার সুযোগই পাবেন না–তলা থেকে বর্শা চালিয়ে পিগমিদের পক্ষেও ওইরকম আক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। গরিলা যদি ওইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে তার প্রকাণ্ড দেহের ভারে পিষ্ট হয়ে সকলের মৃত্যু হবে, জন্তুটাকে আর কষ্ট করে হাত পা চালাতে হবে না–

অতএব চটপট পাহাড়ের উপর সমতল ভূমিতে পা রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আত্তিলিও।

হাঁপাতে হাঁপাতে আর দুড়দাড় শব্দে ঝোঁপঝাড় ভাঙতে ভাঙতে আত্তিলিও পাহাড়ের উপর একটা ডিম্বাকৃতি সমতলভূমির উপর এসে পৌঁছালেন। ওইরকম শব্দ করে গরিলার পিছু নেওয়া নির্বোধের কাজ, কিন্তু আত্তিলিও ঘন জঙ্গলের মধ্যে পিগমিদের মতো নিঃশব্দে দ্রুত চলাফেরা করতে পারতেন না। উপরে পৌঁছে ঝোঁপঝাড়, ঘাসপাতা আর বৃক্ষশাখার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে আর রাইফেলটাকে মুক্ত করলেন আত্তিলিও, তারপর যে লায়ানা লতাটা এর মধ্যে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল সেটাকে টানাটানি করে সরিয়ে দিলেন তিনি। যাই হোক, এতক্ষণ বাদে একটা সমতল স্থানে পা রাখতে পেরে আত্তিলিও একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মৃদুস্বরে কাসিউলাকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি–আচম্বিত তার কানের পর্দা ফাটিয়ে জেগে উঠেছে তিন-তিনটি কণ্ঠের বীভৎস চিৎকার।

পরক্ষণেই সামনের ফাঁকা জায়গার বিপরীত দিকে অবস্থিত জঙ্গল ভেদ করে আবির্ভূত হল তিনটি বিপুলাকৃতি গরিলা!

এতক্ষণ পরে আত্তিলিওর বুদ্ধি খুলল–

কাসিউলা পরিচয় করিয়ে না-দিলেও মুহূর্তের মধ্যেই তিনি বুঝে ফেললেন আক্রমণকারী গরিলাদের সামনে এগিয়ে এসে যে দানবটা দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে কিটাম্বো নয়–স্বয়ং মোয়ামি

গাগি! উক্ত গরিলার মেজাজ খুব ভালো নয় বলেই শুনেছিলেন আত্তিলিও, অন্তত সেই মুহূর্তে তার খারাপ মেজাজ যে আরও খারাপ হয়েছে সে-বিষয়ে আত্তিলিওর একটুও সন্দেহ ছিল না।

আরও একটি বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলেন। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল পিগমিরা ধারেকাছেই আছে। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ নেই, সম্পূর্ণ একক অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আর তাকে লক্ষ করে ধেয়ে আসছে তিন-তিনটি মারমুখো গরিলা!

আত্তিলিও দেরি করলেন না, রাইফেল তুললেন। সবার আগে ধেয়ে আসছে গরিলারাজ মোয়ামি গ্লাগি, তার জ্বলন্ত কয়লার মতো দুই প্রদীপ্ত চক্ষু আর হাঁ করা মুখের দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি।

জন্তুটার বুক লক্ষ করে তিনি গুলি ছুড়লেন। গরিলা মাটিতে পড়ল না! সে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল! তার গতিবেগ হয়ে উঠল দ্রুত থেকে দ্রুততর–ঝড়ের বেগে সে এগিয়ে

আসতে লাগল আত্তিলিওর দিকে।

আত্তিলিও হতভম্ব! এত কাছ থেকে তিনি কি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন? গরিলা তখন তার কাছ থেকে প্রায় বিশ ফিট দূরে আছে। রাইফেলে গুলি ছিল না, চটপট গুলি ভরে আত্তিলিও আবার রাইফেলের ঘোড়া টিপলেন।

দ্বিতীয় বারের উদ্যম ব্যর্থ হল না। গরিলা থেমে গেল, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। জন্তুটা এত কাছে এসে পড়েছিল যে, তার দেহের ধাক্কায় একটা গাছের ডাল ভেঙে ছিটকে এসে লাগল আত্তিলিওর হাঁটুতে।

গরিলারাজ মোয়ামি ন্‌গাগি সেখানেই মৃত্যুবরণ করল। কিন্তু তখনও আত্তিলিওর বিপদ কাটেনি। দানবের দুই সহচারী ধেয়ে আসছে তাকে লক্ষ করে। রাইফেল তুললেন আত্তিলিও, আর সঙ্গেসঙ্গে তার মনে পড়ল কমিশনার সাহেবের সাবধানবাণী–

জেল! জরিমানা! বহিষ্করণ!

ওরে বাবা! গরিলার চাইতে কমিশনারের আইন কিছু কম বিপজ্জনক নয়! আত্তিলিও শূন্যে রাইফেল তুলে তিনবার আওয়াজ করলেন। বরাত ভালো, তাতেই কাজ হল। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে মেয়ে-গরিলা দুটো পালিয়ে গেল বনের মধ্যে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্তিলিও মাটিতে বসে পড়লেন। তার আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ছিল না। একটু দূরেই ধরাশায়ী গরিলারাজের প্রকাণ্ড মৃতদেহটা তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। আর হঠাৎ যেন জাদুমন্ত্রের গুণে জনশূন্য অরণ্য দলে দলে মানবসন্তান প্রসব করতে শুরু করল! একটু আগেই যেখানে জনমানুষের চিহ্ন ছিল না, সেখানেই কোথা থেকে কে জানে এসে দাঁড়াল একদল বেঁটে বেঁটে মানুষ। মামুটি পিগমি!

সুলতানি কাসিউলা বীর বিক্রমে এগিয়ে এসে মৃত গরিলার মস্ত বড়ো উদরের উপর পা তুলে দিল, তারপর পেটের উপর একটা শুষ্ক ক্ষতচিহ্নের দিকে আত্তিলিওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাল কয়েক বছর আগে ওই জায়গাতেই পিগমিদের বর্শা বিঁধেছিল।

যাক এতদিনে প্রতিশোধ নেওয়া হল, সগর্বে বলে উঠল কাসিউলা, মোয়ামি ন্‌গাগি মারা গেছে।

আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ তখন রাগে জ্বলছে। কাসিউলা যে কিটাম্বোর নাম করে মোয়ামি ন্‌গাগির ডেরার দিকে তাকে চালিত করেছিল সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই–পিগমিদের বর্শা, আর তিরধনুক ওই দানবের বিরুদ্ধে অচল বলে স্বয়ং আত্তিলিওকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে কাসিউলা!

খুব রেগে গেলেন আত্তিলিও, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। কাসিউলার ভুলটা যে নিতান্তই ইচ্ছাকৃত সে-কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

মাঘ-ফাল্গুন ১৩৭৯

৫. নরখাদক দেবতা

সৈনিকের পঞ্চম অভিজ্ঞতা
নরখাদক দেবতা
প্রথম পরিচ্ছেদ – কাপালালোর পরামর্শ

আত্তিলিও গত্তি তাঁর পূর্বতন অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন যেকোনো নূতন স্থানে পদার্পণ করার সঙ্গেসঙ্গেই স্থানীয় মানুষ তাকে অভ্যর্থনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ওয়াকাঁপাগা নামক নিগ্রোদের গ্রামে পৌঁছে তিনি একটি মানুষকেও দেখতে পেলেন না। তবে হ্যাঁ, কয়েকটা ছাগল গ্রামের ভিতর থেকে ব্যা-ব্যা শব্দে আগন্তুকদের সম্বন্ধে তাদের মতামত জানিয়েছিল বটে!

ব্যাপারটা কী? আত্তিলিও মোটবাহকদের সর্দার কাপালালোকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকগুলো কি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল?

কাপালালো মনিবের সম্মতির জন্য অপেক্ষা না-করে মোটবাহকদের মালপত্র সেখানেই নামিয়ে রাখতে আদেশ করল, তারপর পুবদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, শোনো।

আত্তিলিও কান পেতে শুনলেন নির্দিষ্ট দিক থেকে ভেসে আসছে সংগীত ও বাদ্যের সুমধুর ধ্বনি। তাঁর মনে হল দূরবর্তী নদীতটই পূর্বোক্ত গীতবাদ্যের উৎসস্থল। সম্ভবত ওইখানেই সমবেত হয়েছে গ্রামের সমস্ত মানুষ।

বিয়ের ব্যাপার নাকি? আবার প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও।

উত্তর এল না। কাপালালো হঠাৎ বোবা হয়ে গেছে। আত্তিলিও-বিরক্ত হলেন। চারদিন ধরে কুম্ভীর-সংকুল জলপথে নৌকা চালিয়ে এবং আগুন-ঝরা রোদের ভিতর বারো ঘণ্টা পা চালিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পথের মধ্যে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য কীটপতঙ্গ, তাদের কামড়ের জ্বালায় তাঁর সর্বঅঙ্গ জ্বলছে–বলাই বাহুল্য শরীরের এমন অবস্থায় বিয়ের উৎসব দেখার ইচ্ছে তার ছিল না।

এখন তিনি তাঁবু খাঁটিয়ে ভিতরে ঢুকে বিশ্রাম নিতে চাইছেন। বিশ্রামের আগে পরিষ্কার জল আর সাবান সহযোগে সমস্ত শরীর ধুয়ে পতঙ্গের দংশনে ক্ষতবিক্ষত স্থানগুলোতে আইওডিন লাগানো দরকার এখন কি উৎসব-টুৎসব ভালো লাগে?

অতএব আত্তিলিও গর্জে উঠলেন, বিয়ে-ফিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাতে চাই না। গাঁয়ের সর্দারকে এখনই ডেকে আনে। লোকজন লাগিয়ে সে এখনই পানীয় জল আর স্নানের উপযুক্ত জলের ব্যবস্থা করুক। তারপর জ্বালানি কাঠ, ফল, ডিম, মুরগি সব চাই ঝটপট! জলদি!

কাপালালো এক পা নড়ল না। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে সে আত্তিলিওর দিকে তাকাল। তার চোখের ভাষা অতিশয় স্পষ্ট–আহা! অবোধ বালক! তুমি জানো না তুমি কী বলছ!

খুব বিশ্বাসী মানুষ কাপালালো। তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আত্তিলিওর অগাধ আস্থা। এর আগে সে কখনো মনিবের আদেশ অমান্য করেনি। এমন বিশ্বাসী প্রভুভক্ত অনুচর যদি হঠাৎ অবাধ্য হয়ে পড়ে তাহলে মনিব আর কী করতে পারেন? নিরুপায় আত্তিলিও আসন গ্রহণ করলেন একটা কাঠের বাক্সের ওপর।

বিরক্ত বা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, বেশ শান্তভাবেই এবার প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও, ব্যাপারটা কী বল তো?

কুমির, কাপালালোর উত্তর, কাল দুই যমজ বোনের মধ্যে ছোটো মেয়েটিকে কুমিরে নিয়েছে।

তাহলে এটা কি শোকসভা? শোক প্রকাশের পর্ব শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমরা কি এইখানেই বসে থাকব?

ওয়াকাঁপাগা জাতির প্রতিবেশী অন্য আর একটি নিগ্রোজাতির মানুষ কাপালালো। প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে অনেক তথ্যই তার জানা আছে। আত্তিলিওর প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল–বিদেশিদের উপস্থিতি এই সময়ে ওয়াকাঁপাগা জাতি পছন্দ করবে না, কারণ এখন তারা চফু-মায়া নামক দেবতাকে পূজা নিবেদন করতে ব্যস্ত।

আত্তিলিও কিছু কিছু স্থানীয় ভাষা জানতেন। চফু-মায়া কথাটার অর্থ তিনি বুঝতে পারলেন–মৃত্যুদূত!

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা আবার কী? প্রেতাত্মা?

না, বাওয়ানা। চফু-মায়া হচ্ছে একটা কুমির। নদীতে আর জলাভূমিতে যেসব কুমির বাস করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আর সবচেয়ে ভয়ানক জন্তুটার নাম চফু-মায়া। গতকাল নাইনি। মেয়েটিকে চফু-মায়া নিয়ে গেছে। ঠিক বছর দুই আগে নাইনির বড়ো বোনকেও ওই জন্তুটা খেয়ে ফেলেছিল। দুটি মেয়েই ছিল যমজ বোন।

আত্তিলিও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ওই হতচ্ছাড়া কুমিরটাকে মারার চেষ্টা না-করে লোকগুলো তাকে পুজো করছে? আশ্চর্য ব্যাপার!

হ্যাঁ, বাওয়ানা, কাপালালো বলল, ওয়াকাঁপাগারা তাকে খুশি করার চেষ্টা করছে। ওরা আশা করছে পুজো পেয়ে যদি চফু-মায়া খুশি হয় তাহলে সে আর ওদের উপর হামলা করতে আসবে না।

আফ্রিকায় আসার পর থেকেই কুমির সম্বন্ধে আত্তিলিও যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা থেকে তিনি বুঝেছেন ওই ভয়ংকর সরীসৃপকে শায়েস্তা করতে পারে শুধু শক্তিশালী রাইফেল। স্থানীয় নিগ্রোদের বর্শা আর তির-ধনুক কুমিরের শক্ত চামড়া ভেদ করে মর্মস্থানে আঘাত হানতে পারে না। কিন্তু জলে নামার জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে ওয়াকাঁপাগা জাতি কুমিরের কবল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে না কেন সেই কথাটাই আত্তিলিও সাহেবের জিজ্ঞাস্য।

অনেকবার সেই চেষ্টা হয়েছে, কাপালালো বলল, কিন্তু এখানে খুব বড়ো গাছ পাওয়া যায় না। হালকা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বেড়া লাগিয়ে দেখা গেছে কোনো লাভ নেই। কুমির লেজের আঘাতে ওইসব বেড়া ভেঙে দেয় অনায়াসে। তা ছাড়া জলে নেমে বেড়া লাগানোর সময়ে বহু মানুষ কুমিরের খপ্পরে প্রাণ হারায়।

আত্তিলিও বললেন, ওরা তাহলে ফাঁদ পাতে না কেন? ফদের সাহায্যে ওই শয়তান জানোয়ারগুলোকে নিশ্চয় কাবু করা সম্ভব?

আত্তিলিওর কথা শুনে চমকে উঠল কাপালালো আর মোটবাহকের দল বাওয়ানা বলে কী!

অজ্ঞান অবোধকে জ্ঞান বিতরণ করার চেষ্টা করল কাপালালো, চফু-মায়া হচ্ছে ওয়াকাঁপাগাদের দেবতা। নিজের দেবতাকে কেউ কখনো ফাঁদ পেতে মারার চেষ্টা করতে পারে?

অকাট্য যুক্তি। সত্যিই তো, দেবতা যতই অত্যাচার করুক, সে দেবতা তো বটে! ঠিক আছে, আত্তিলিও বললেন, কয়েকটা কুমিরকে আমি গুলি চালিয়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। এখন চটপট তাঁবু খাঁটিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে ফেলো। ওয়াকাঁপাগাদের সাহায্য তো পাওয়া যাবে না।

একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিল কাপালালো। তারপর সব লোকগুলোকে অন্যান্য কাজে লাগিয়ে দিল। কিন্তু হাজার কাজের মধ্যেও তার দুই চোখের সতর্ক দৃষ্টি ছিল আত্তিলিওর উপর। অতএব আত্তিলিও যখন সংগীতধ্বনি যেদিক থেকে ভেসে আসছে সেইদিকে পদচালনা করার উদ্যোগ করলেন, তৎক্ষণাৎ তার সামনে ছুটে এল কাপালালো-না, বাওয়ানা, ওদিকে যেয়ো না! কাপালালোর কণ্ঠস্বরে উদবেগের আভাস। কোথাও যাব না?

ওখানে? আত্তিলিও নদীর দিকে হাত দেখালেন।

না, কুমিরদের উপর গুলি চালাতে যেয়ো না, দারুণ উদবেগে কাপালালোর কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল, ওখানে গেলে আর একটা সাদা মানুষের যেভাবে মৃত্যু হয়েছে, তোমারও সেইভাবে মৃত্যু হবে।

কী আজেবাজে বকছ?আত্তিলিও ধমকে উঠলেন, এই অঞ্চলে কোনো সাদা মানুষ আসে না।

নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে কাপালালো একটি ঘটনার উল্লেখ করল। ঘটনাটা ঘটেছিল অনেকদিন আগে। কাপালালো তখন বালক মাত্র। সেই সময় জনৈক বেলজিয়ান শিকারির কাছে মোটবাহকের কাজ করেছিল কাপালালো। ওয়াকাঁপাগাদের আস্তানার কাছে এসে উক্ত শিকারি যখন শুনল বহু স্থানীয় মানুষ কুমিরের কবলে প্রাণ হারিয়েছে, তখনই সে জলাভূমিতে গিয়ে রাইফেল চালিয়ে নরখাদক সরীসৃপদের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলার সংকল্প করল।

নিগ্রোরা তাকে নিষেধ করেছিল। শিকারি কারো কথায় কান দিল না। একটা ক্যানো (বিশেষ ধরনের নৌকা) নিয়ে কুমির-শিকারে যাত্রা করল বেলজিয়ান শিকারি। তার সঙ্গে ছিল দুজন স্থানীয় মানুষ। শিকারির কাছ থেকে প্রচুর হাতির মাংস পেয়ে লোক দুটি রাইফেলধারী শ্বেতাঙ্গকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। একদিন খুব ভোরে যাত্রা করল পূর্বোক্ত তিনটি মানুষ এবং জলার ধারে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করতে লাগল মোটবাহকের দল, ওয়াকাঁপাগাদের জনতা এবং কাপালালো স্বয়ং। কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে ভেসে এল রাইফেলের আওয়াজ। তারপরই জাগল মনুষ্যকণ্ঠের অস্ফুট আর্তনাদ। জনতা বুঝল কুমিরের কবলে প্রাণ হারাল তিনটি দুঃসাহসী মানুষ। ক্যানো নৌকাটাও নিখোঁজ হয়ে গেল; সেইসঙ্গে হারিয়ে গেল দাঁড়-বইঠা, নিগ্রোদের দুটি বর্শা, শিকারির রাইফেল।

কাপালালোর গল্প শুনে সমস্ত ব্যাপারটা কী ঘটেছিল সহজেই অনুমান করতে পারলেন আত্তিলিও। জলাভূমির মধ্যে কোনো একটি কুমিরকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল বেলজিয়ান শিকারি, তারপরই আহত জন্তুটার আক্রমণে অথবা অন্য কোনো কুমিরের হামলার মুখে নৌকোটা ভেঙেচুরে ডুবে গিয়েছিল বলেই মনে হয়। কারণ, একবারের বেশি গুলির শব্দ শোনা যায়নি। নৌকো চালিয়ে অকুস্থলে গিয়ে লোকগুলোর সন্ধান নেওয়ার সাহস কারুরই ছিল না। সেধরনের চেষ্টা করেই-বা কী লাভ হত? জলের মধ্যে এক ঝাক মানুষখেকো কুমিরের কবলে পড়লে তিনটি মানুষের পক্ষে কিছুতেই আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়। ওই অঞ্চলের জলাভূমি অসংখ্য নরখাদক কুম্ভীরের বাসস্থান।

কয়েক বছর আগে আরও একটি সাদা মানুষ এখানে এসেছিল,কাপালালো আবার বলতে শুরু করল, সেই লোকটি ছিল ভারি সাহসী, প্রকাণ্ড জোয়ান। আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেই সাদা মানুষ হাতি, সিংহ আর মোষের সামনে গিয়ে ফটো তুলছে। জন্তুগুলোর সামনে যাওয়ার সময়ে সে একটুও ভয় পেত না। তার সঙ্গে রাইফেল থাকত। সে গুলি চালিয়ে শিকারও করত। তার হাতের টিপ ছিল দারুণ ভালো, কোনো সময়েই গুলি ফসকাত না। ওই লোকটিও চফু-মায়ার কথা শুনে তাকে মারতে গিয়েছিল। চফু-মায়া হল দেবতা–তাকে মারা কি সম্ভব? সেই সাদা মানুষটাকে খেয়ে ফেলেছিল চফু-মায়া।

কাপালালোর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে আত্তিলিও বুঝলেন ওই লোকটি ছিল ইংল্যান্ডের মানুষ। ফটো তোলা এবং শিকার ছিল উক্ত ইংরেজের নেশা। আত্তিলিও কাপালালোর মুখ থেকে ওই ইংরেজ-শিকারি সম্পর্কে আরও সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। দিনের বেলা নাকি ঘুমিয়ে কাটাত ইংরেজ, আর রাইফেল ও ক্যামেরা নিয়ে নদীর ধারে অপেক্ষা করত সারারাত জেগে। খুব সম্ভব নদীতটে বিশ্রামরত কুমিরের ফটো তোলার চেষ্টা করেছিল সে। অথবা এমনও হতে পারে কুম্ভীর ও জলহস্তীর দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিরল দৃশ্য আলোকচিত্রে তুলে নেওয়ার জন্য সে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তার সঠিক উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা আর জানা সম্ভব নয়, কারণ এক রাতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ইংরেজ-শিকারি। অকুস্থলে গিয়ে গ্রামবাসীরা ভিজে মাটির ওপর শিকারির দেহের ছাপ এবং রাইফেল দেখতে পায়। ওইখানেই ছিল কুমিরের গুরুভার দেহের সুগভীর পদচিহ্ন। মাটির উপর দিয়ে মনুষ্য-শরীর টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্নও ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। শিকারি যে হঠাৎ নিদ্রার আবেশে অসাবধান হয়ে পড়েছিল এবং সেই সুযোগে জল থেকে উঠে এসে ধূর্ত চফু-মায়া যে শিকারির নিদ্রাকে চিরনিদ্রায় পরিণত করে দিয়েছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কাপালালোর বিবৃতি শুনে আত্তিলিওর বক্তব্য হল নদীগর্ভে অবস্থিত অসংখ্য কুমিরের মধ্যে যেকোনো একটি জীবের পক্ষেই শিকারিকে গ্রাস করা সম্ভব, কিন্তু স্থানীয় নিগ্রোরা ওই লোকটির মৃত্যুর জন্য চফু-মায়াকে দায়ী করছে কোন প্রমাণের জোরে?

উত্তরে কাপালালো জানাল পায়ের ছাপ দেখেই স্থানীয় মানুষ বুঝতে পেরেছিল উক্ত শিকারির হন্তারক হচ্ছে চফু-মায়া স্বয়ং। ওই বিরাট কুমিরটার পদচিহ্নের বৈশিষ্ট্য স্থানীয় নিগ্রোদের সুপরিচিত, পায়ের ছাপ শনাক্ত করতে তাদের ভুল হয়নি একটুও।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল কাপালালো। সংগীত ধ্বনি এবার এগিয়ে আসছে। তাদের দিকে। যেদিক থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছিল সেইদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই আত্তিলিওর দিকে ফিরল কাপালালো, বাওয়ানা, কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাও। এমন ভাব করবে যেন তুমি এখানকার কোনো খবরই রাখো না। দুটি কুমারী মেয়ে মারা পড়েছে, আর দুজনই হচ্ছে যমজ। কাজেই এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। কোনো সাদা মানুষের চোখ যা দেখেনি, সেই আশ্চর্য জাদুর খেলা দেখতে পাবে তুমি। শুধু একটু ধৈর্য চাই।

পথের বাঁকে এইবার আত্মপ্রকাশ করল একটি ছোটোখাটো মানুষ। দুটি মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল ওই লোকটি। তার পিছনে হইহই করতে করতে ছুটছিল শত শত লোকের জনতা। আত্তিলিও এবং তাঁর সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল সবাই। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না।

আমাকে বিশ্বাস করো বাওয়ানা, কাপালালো বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাও।

জায়গাটা ছিল খুব গরম আর কটুগন্ধে পরিপূর্ণ। তবু আত্তিলিও স্থান ত্যাগ করলেন না। সেই রাতেই তিনি স্থির করলেন কয়েকটা দিন কাপালালোর কথামতো চলবেন। ভালোই করেছিলেন বলতে হবে, জায়গা ছেড়ে চলে গেলে এক আশ্চর্য দৃশ্য থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন।

দৈর্ঘ্যে পঁয়ত্রিশ ফিট এবং ওজনে চার টন এক মহাশক্তিধর অতিকায় দানবের বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল একটি নগণ্য মানুষ এবং সেই চমকপ্রদ দ্বন্দ্বযুদ্ধের দৃশ্যটিকে স্বচক্ষে দর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন আত্তিলিও গত্তি। যথাসময়ে উক্ত ঘটনার বিবরণ পাঠকের দৃষ্টিগোচর হবে।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ওয়াকাঁপাগাদের গ্রামে আত্তিলিও

ওয়াকাঁপাগাদের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রায় এক সপ্তাহ লাগল। ওয়াকাঁপাগা এক আদিম জাতি, আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে তারা অনিচ্ছুক। তাদের দোষ দেওয়া উচিত নয়। বেলজিয়ানরা কঙ্গোতে উপনিবেশ স্থাপন করার পর ওয়াকাঁপাগাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে এমন কথা বলা যায় না। বেলজিয়ান শাসক ওয়াকাঁপাগাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করার চেষ্টা করেছিল। কোনো লাভ হয়নি। তারা এক পয়সাও রোজগার করে না, ট্যাক্স দেবে কোথা থেকে? তখন তাদের ভিতর থেকে শক্তসমর্থ লোকগুলোকে বেলজিয়ান সরকার ধরে নিয়ে গেল রাস্তা তৈরির কাজের জন্য। অর্থাৎ বেগার খেটে তাদের খাজনা দিতে হবে। এর মধ্যে আবার ওয়াকাঁপাগাদের আস্তানায় হল এক পাদরির আবির্ভাব। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম প্রচার করার সঙ্গেসঙ্গে পাদরিসাহেব ওয়াকাঁপাগা-জাতির রীতিনীতির নিন্দাও শুরু করলেন। স্থানীয় মানুষ খেপে গেল। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়াত বলা মুশকিল, কিন্তু সমস্ত সমস্যার সহজ সমাধান করে দিল চফু-মায়া–ফাঁকা বুঝে সে একদিন পাদরিসাহেবকে টপ করে খেয়ে ফেলল। ওইসঙ্গে বেলজিয়ান অফিসারটিকেও যদি চফু-মায়া ফলার করে ফেলত তাহলে ওয়াকাঁপাগারা অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যেত।

আত্তিলিওর মন্তব্য শুনে ওয়াকাঁপাগাদের জাদুকর বিরস বদনে ঘাড় নেড়েছিল, লোকটার সঙ্গে অনেকগুলো সৈন্য ছিল যে!

যাই হোক, বেলজিয়ান সরকারের আচার আচরণ ওয়াকাঁপাগারা মোটেই পছন্দ করত না। পূর্বে উল্লিখিত বেলজিয়ান ও ইংরেজ শিকারির মৃত্যুর পর তাদের গ্রামে সরকারি তদন্ত হয়েছিল। শিকারিদের অপঘাত মৃত্যুর জন্য ওয়াকাঁপাগা জাতির উপর মোটা টাকার জরিমানা ধার্য করা হল এবং সেই টাকা পাওয়া গেল না বলে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ শাসক ওয়াকাঁপাগাদের ভিতর থেকে অনেকগুলো জোয়ান মানুষ নিয়ে গেলেন বেগার খাটার জন্য। অর্থাৎ বেগার খেটেই জরিমানার টাকা শোধ দিতে হবে!

এমন সব ঘটনার পর আত্তিলিও সাহেবকে দেখে গ্রামের লোক যদি ভাব জমানোর জন্য এগিয়ে না-আসে তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। আত্তিলিও তাদের দোষ দেননি। তবে ওয়াকাঁপাগাদের মনোভাব দেখে তার মনে হয়েছিল সঙ্গে একদল সৈন্য থাকলে নিরাপত্তা সম্বন্ধে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। অবশ্য সৈন্য না-থাকলেও কাপালালো ছিল। ছোটোখাটো একটা সৈন্যদলের চাইতে কাপালালোর একক উপস্থিতি যে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

কয়েকটা দিনের মধ্যে ওয়াকাঁপাগাদের সর্দার, জাদুকর প্রভৃতি মাতব্বর শ্রেণির হোমরা চোমরাদের সঙ্গে মেলামেশা করে কাপালালো তাদের বুঝিয়ে দিল আত্তিলিও গত্তি লোকটা খারাপ নয় এবং সরকারের সঙ্গে ওই সাদা মানুষটার কোনো সম্পর্ক নেই। কাপালালো আরও বলল যে, যদি ওয়াকাঁপাগারা তাদের জাদুর খেলা আত্তিলিওকে দেখাতে রাজি হয় তাহলে তিনি তাদের অনেক টাকা দেবেন। ওই টাকা বেলজিয়ান শাসকের হাতে তুলে দিলে আর বেগার খাটার জন্য তাদের লোকগুলোকে সরকার ধরে নিয়ে যাবে না।

বেলজিয়ান কঙ্গোতে প্রবেশ করার আগে আত্তিলিও একটা পঞ্চাশ ডলারের বিল ভাঙিয়ে বেলজিয়ান মুদ্রায় খুচরো করে নিয়েছিলেন। সেই খুচরো টাকার পরিমাণ কম নয়–তিনটি থলে ভরতি টাকা যখন আত্তিলিও তুলে দিলেন ওয়াকাঁপাগা-সর্দারের হাতে, তখন আর তার সদিচ্ছায় কারো সন্দেহ রইল না। ওয়াকাঁপাগা জাতির মধ্যে যে-মানুষটিকে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বলে মনে করা হয় এবং যার কথা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বেদবাক্যের মতোই অভ্রান্ত, সেই মাতুংগো নামক ব্যক্তিটি বলে উঠল, বাওয়ানা আমার বন্ধু। তাকে সব কিছুই দেখানো হবে।

আগামীকাল, মাতুংগোর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো সর্দার, আবার নদীর ধারে কুমারী মেয়েরা নাচবে। ওরা নাচবে চফু-মায়ার জন্য। এবং বাওয়ানার জন্য।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি

আধুনিক সভ্যতা যাদের স্পর্শ করেনি, সেইসব আদিম জাতি খুব সরল ও বিশ্বাসী হয়। ওয়াকাঁপাগা জাতিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। একবার বন্ধুভাবে গ্রহণ করার পর তারা আত্তিলিওর কাছে কিছুই গোপন করার চেষ্টা করল না। কাপালালো যে জাদুর খেলার উল্লেখ করেছিল এইবার সেই জাদু-রহস্য খোলাখুলিভাবে জানতে পারলেন আত্তিলিও।

পর পর দুটি যমজ ভগ্নীকে অবিবাহিত অবস্থায় ভক্ষণ করেছে চফু-মায়া, এখন ওয়াকাঁপাগা জাতির সামাজিক নিয়ম অনুসারে ওই কন্যা দুটির পিতাকে হন্তারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।

কারণটাও বুঝিয়ে বলা হল। যদি যুদ্ধে কন্যাদের পিতা নিহত হয় তাহলে তার আত্মা কুম্ভীরের উদরে আবদ্ধ কন্যা দুটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে আর এক পৃথিবীতে সেখানে শোক-দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ। আর যদি কন্যাদের পিতা যুদ্ধে জয়ী হয়, তবে কুমিরের পেট চিরে সে কন্যাদুটিকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করবে এবং মুক্ত আত্মা দুটি সর্বদাই পিতার সঙ্গে থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে সুখে-আনন্দে পরিপূর্ণ করে রাখবে, তাদের চেষ্টায় পিতৃদেবের ধনসম্পদও বৃদ্ধি পাবে।

চফু-মায়ার কবলে নিহত যমজ ভগ্নীদের পিতার নাম নগুরা-গুরা। লোকটির দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন–ক্ষীণকায়, শান্তশিষ্ট এই বয়স্ক মানুষটি লড়াই করবে নরভুক অতিকায় কুম্ভীরের সঙ্গে? অসম্ভব, নিশ্চয়ই তিনি কোথাও ভুল করছেন!

তুমি কী বলতে চাও, নগুরা-গুরার দিকে আঙুল দেখিয়ে জাদুকর মাতুংগোকে জিজ্ঞাসা করলেন আত্তিলিও, ওই লোকটি চফু-মায়ার সঙ্গে লড়াই করবে?

হ্যাঁ, বাওয়ানা।

একা? ওর হাতে রাইফেল থাকবে তো?

ও একাই লড়বে। ওর হাতে রাইফেল থাকবে না।

জাদুকরের কুটিরের মধ্যে চুপ করে বসে ছিল নগুরা-গুরা। মাথা নেড়ে সে মাতুংগোর কথায় সায় দিল।

আবার আত্তিলিওর প্রশ্ন, তবে বোধ হয় বিশেষ ধরনের কোনো ফাঁদ নিয়ে ও লড়াই করবে?

না, বাওয়ানা। ফাঁদের সাহায্য ছাড়াই ও লড়বে। ওর হাতে একটা ছুরি আর একটা দড়ি। একমাত্র ওর নিজস্ব ডান হাতটা ছাড়া আর কেউ ওকে সাহায্য করতে আসবে না।

নগুরা-গুরা নামক ছোটোখাটো মানুষটি আবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

জাদুকর মাতুংগো বলল, চফু-মায়া যখন বোঝে বিপদের ভয় বিশেষ নেই তখনই সে দেখা দেয়। আর ওয়াকাঁপাগাদের পক্ষে চফু-মায়ার মোকাবিলা করার ওই একটি সুযোগই আছে। দড়ি আর ছুরি হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র যা দিয়ে চফু-মায়ার সঙ্গে লড়াই করা যায়।

মাতুংগোর কণ্ঠ শান্ত, নিরুবেগ। আত্তিলিও সবিস্ময়ে দেখলেন নগুরা-গুরার ভাবভঙ্গিতেও কিছুমাত্র উত্তেজনার চিহ্ন নেই। অসম্ভব আত্মবিশ্বাস আর সাহসের অধিকারী না হলে কোনো মানুষই নরখাদক কুম্ভীরের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধের নামার আগে এমন নিশ্চিন্তভাবে বসে থাকতে পারে না।

মাতুংগোর গলার স্বর আত্তিলিওর কানে এল, তুমি নিজের চোখেই সব দেখবে।

নগুরা-গুরা সায় দিল, হ্যাঁ, সময় এলেই দেখতে পাবে।

…সময় এল কয়েক সপ্তাহ পরে।

অন্তর্বর্তী দিনগুলো অবশ্য একঘেয়ে লাগেনি আত্তিলিওর কাছে। প্রত্যেক দিন বাদ্য সহযোগে নৃত্যগীত চলত নদীর ধারে। রোদের তাপ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটা ছায়াঘেরা জায়গা বেছে নিতেন আত্তিলিও। তারপর সেখানে বসে উপভোগ করতেন ওয়াকাঁপাগা জাতির নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। ঢালের উপর বর্শাদণ্ডের আঘাতে বাজনা বাজিয়ে গান গাইত যুবকের দল, নাচতে নাচতে নদীর জলে নামত কয়েকটি কুমারী মেয়ে, গায়ের জামা আর মাথার টুপি খুলে ভাসিয়ে দিত জলে পরক্ষণেই নদীর বুক ছেড়ে উধ্বশ্বাসে উঠে আসত সেইখানে, যেখানে বসে আছে নগুরা-গুরা। মুহূর্তের মধ্যে কাছাকাছি দুটি মেয়ের হাত চেপে ধরত নগুরা-গুরা, তারপর চারদিকে দণ্ডায়মান জনতার ব্যুহভেদ করে ছুটত মেয়ে দুটির হাত ধরে। সমবেত জনতাও চিৎকার করতে করতে ছুটত তাদের পিছনে।

কোলাহল থেমে যেত ধীরে ধীরে। পরিশ্রান্ত লোকগুলো কুটিরে প্রবেশ করত আহারাদি সাঙ্গ করে বিশ্রাম নেবার জন্য।

বহুদিন আফ্রিকাতে কাটিয়ে কয়েকটি বিষয়ে আত্তিলিও খুব সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অধিকাংশ মানুষই নিগ্রোদের জাদুবিদ্যার অনুষ্ঠান প্রভৃতিকে বুজরুকি বলে উড়িয়ে দেয় কিন্তু আত্তিলিও জানতেন এই অনুষ্ঠানগুলো মোটেই বুজরুকি নয়, ওইসব ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনস্তত্ত্বের জটিল বিজ্ঞান।

জাদুকররা মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে বিশেষত তার নিজের জাতির মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে, দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল। তারা খুব ভালোভাবেই জানে মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যকে কেমন করে কাজে লাগাতে হয়। উদাহরণস্বরূপ নদীর ধারে নাচগান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যাপারগুলোকে ধরা যাক–

রোজ সকালে তুমুল কোলাহল তুলে একই দৃশ্যের বার বার অভিনয় করার ফলে স্থানীয় মানুষের মনে দুর্ঘটনার স্মৃতি খুব দাগ কেটে দেবে, তারা ভবিষ্যতে অসাবধান হবে না, সুতরাং দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমবে।

নদীর ধারে চিৎকার-চেঁচামেচির ফলে কুমিরের দল হবে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত, সুযোগ পাওয়ামাত্র তারা মানুষকে আক্রমণ করবে। অর্থাৎ নাগুবা-গুরাকে যাতে চফু-মায়া এগিয়ে এসে আক্রমণ করে সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে। প্রতিদিন মেয়েদের গায়ের জামা আর মাথার টুপি ভেসে যাচ্ছে চফু-মায়ার আস্তানার দিকে, ওইসব জিনিসগুলো থেকে ক্রমাগত প্রিয় খাদ্যের গন্ধ পেতে পেতে নরমাংসের লালসায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নগুরা-গুরার দিকে চফু-মায়াকে আকৃষ্ট করার এটাও এক অভিনব কৌশল! রণক্ষেত্র সাজানোর সঙ্গেসঙ্গে চফু-মায়ার প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধাটিকেও প্রস্তুত করা হচ্ছিল ধীরে ধীরে কুটিরের মধ্যে প্রতিদিন সঙ্গোপনে মাতুংগো যে কী মন্ত্র দিত নগুরা-গুরার কানে সে-কথা জানা সম্ভব নয় আত্তিলিওর পক্ষে, কিন্তু ছোটোখাটো মানুষটির মধ্যে মাতুংগোর প্রভাব যে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। নিপুণ কর্মকার যেমন ভোতা লোহাকে শান দিতে দিতে ধারালো অস্ত্রে পরিণত করে, ঠিক তেমনিভাবেই জাদুকর মাতুংগোর হাতে শান খেতে খেতে ঝরে পড়ছিল নগুরা-গুরার আলস্য-অবসাদ আর আতঙ্কের অনুভূতি তুচ্ছ মানবের ক্ষুদ্র দেহের অন্তস্থল ভেদ করে জন্মগ্রহণ করছিল এক প্রতিহিংসাপরায়ণ দৈত্য!

নগুরা-গুরার মুখের দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও বুঝতে পারতেন সে বদলে যাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি, চোয়ালের কাঠিন্য আর দৃঢ় পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায় নগুরা-গুরার ভিতর জেগে উঠেছে অদম্য আত্মবিশ্বাস নরখাদক অতিকায় কুম্ভীরের সঙ্গে দ্বৈরথরণে অবতীর্ণ হতে সে একটুও ভীত নয়! এমনকী আত্তিলিও সাহেবেরও একসময় মনে হল একটা কুমিরকে হাতাহাতি লড়াইতে মেরে ফেলা এমন কী কঠিন কাজ?

দুর্ভেদ্য বর্মের মতো কঠিন চর্মে আবৃত ৩৫ ফিট লম্বা ধূর্ত ও হিংস্র নরভুকের বিরুদ্ধে ছুরিকাসম্বল একটি মানুষের জয়লাভ করার সম্ভাবনা খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল আত্তিলিওর কাছে–এও কি মন্ত্রের প্রভাব? না, মনস্তত্ত্বের মহিমা?…

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দ্বৈরথ

সোম, মঙ্গল, বুধ–

তিনদিন হল নাচগান প্রভৃতি সব অনুষ্ঠান বন্ধ। নদীতট নির্জন। মেয়েরাও নদী থেকে জল আনতে যায় না। জাদুকর মাতুংগোর নির্দেশ–কেউ যেন নদীর ধারে না-আসে; আবার নতুন আদেশ না-পাওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বজায় রাখতে হবে।

বৃহস্পতিবার সকালে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে কাপালালো প্রবেশ করল আত্তিলিওর তাবুতে, তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

কাপালালোর কথামতো তাকে অনুসরণ করলেন আত্তিলিও। কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার। এমনকী ছাগলদেরও দেখা যাচ্ছে না। ফিসফিস করে কাপালালো জানাল যতক্ষণ পর্যন্ত মাতুংগো আদেশ না-দিচ্ছে ততক্ষণ একটি প্রাণীও কুটিরের বাইরে আত্মপ্রকাশ করবে না। মাতুংগো জানিয়েছে বাওয়ানার রাইফেলের শব্দই হচ্ছে গ্রামবাসীদের বেরিয়ে আসার সংকেত। লোকজনের উপস্থিতি বা কথাবার্তার শব্দে জাদুবিদ্যা প্রয়োগের ব্যাঘাত হতে পারে বলেই নাকি এই ব্যবস্থা! সমগ্র এলাকার মধ্যে শুধু একটা ছাগকণ্ঠের ব্যা ব্যা ধ্বনি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ছাগলের গলার আওয়াজটা ভেসে আসছিল কুয়াশায় ঢাকা নদীতট থেকে।

নদীর ধারে পৌঁছে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ছাগশিশুটিকে দেখতে পেলেন আত্তিলিও। নিতান্তই কচি বাচ্চা, কুমিরের প্রিয় খাদ্য।

কথা না-বলে প্রায় তিরিশ ফুট দূরে অবস্থিত আর একটা গাছের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল কাপালালো। গাছটা খুব শক্ত, কিন্তু নমনীয়। ওয়াকাঁপাগারা ওই জাতের গাছ থেকেই তাদের ধনুক তৈরি করে। আত্তিলিও দেখলেন, নির্দিষ্ট গাছটির ডগার দিকে একটা দড়ি বাঁধা আছে। দড়ির পাক খুব আলগা অবস্থায় ঝুলতে ঝুলতে ছাগশিশুর কাছাকাছি গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।

ঘন সন্নিবিষ্ট একটা ঝোঁপের কাছে আত্তিলিওকে টেনে নিয়ে গেল কাপালালো। তারপর তার পাশেই সে গুঁড়ি মেরে বসল। সঙ্গেসঙ্গে একটু দূরে আর একটা ঝোঁপের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল আরও দুটি মনুষ্য-মূর্তি।

একজন হচ্ছে নগুরা-গুরা। তার ডান হাতের পুরোবাহু থেকে কবজি পর্যন্ত জড়িয়ে অবস্থান করছে গাছের ছালের পুরু আবরণ বা ব্যান্ডেজ।

অপর লোকটি মাতুংগো। তার হাতে একটা অদ্ভুত অস্ত্র। সে যখন নীচু হয়ে মাটি থেকে দড়ির ঝুলে-পড়া অংশটা তুলে হাতের অস্ত্রটার মাঝামাঝি জায়গায় জড়িয়ে নিচ্ছে, ঠিক তখনই বস্তুটির স্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেন আত্তিলিও।

জিনিসটা হচ্ছে দোলা ছুরি; দুটো ধারালো ফলার মাঝখানে বসানো আছে শক্ত কাঠের বাঁট। ওই বাঁটের মাঝখানে শক্ত করে দড়িটা বেঁধে মাতুংগো হঠাৎ নগুরা-গুরার কাধ চেপে ধরল। জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে দড়ি বাঁধা দোলা ছুরিটা তুলে নিল নগুরা-গুরার হাতে। একবার তীব্র দৃষ্টিতে নগুরা-গুরার চোখের দিকে তাকাল মাতুংগো–আবার ঝাঁকুনি! খুব জোরে মাথা নাড়ল নগুরা-গুরা, তারপর ঘুরে গিয়ে ছাগশিশুর নিকটবর্তী গাছটার পিছনে বসে পড়ল। আত্তিলিওর মনে হল জাদুকর মাতুংগোর চোখের দৃষ্টি থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি ধাক্কা মেরে নগুরা-গুরার দেহটাকে যথাস্থানে বসিয়ে দিল!

এতক্ষণে সমস্ত পরিকল্পনাটা আত্তিলিওর কাছে পরিষ্কার হল। নগুরা-গুরার সর্বাঙ্গে যে তৈলাক্ত বস্তুটি মাখানো আছে, সেই পদার্থটির গন্ধ মানুষের গায়ের গন্ধ ঢেকে রাখবে–ছাগশিশুর ক্রন্দনে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এলেও চফু-মায়া তার ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে মানুষের উপস্থিতি বুঝে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে না।

তারপর কী ঘটবে সহজেই অনুমান করা যায়। আচম্বিতে একটা মানুষকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখলেই কুমির তেড়ে যাবে, মুহূর্তের জন্য খুলে যাবে দুই চেয়ালের প্রকাণ্ড হাঁ, পরক্ষণেই শত্রুকে মুখগহ্বরে বন্দি করার চেষ্টায় সশব্দে বন্ধ হয়ে যাবে দন্তসজ্জিত দুই চোয়ালের মরণফাঁদ।

সেই হাঁ-করা মুখের সুযোগ নেবে নগুরা-গুরা–পলকের মধ্যে কুমিরের মুখগহ্বরে হাত ঢুকিয়ে এমন কায়দায় সে ছুরিটা ধরবে যে, কুমিরের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে দংশনের চাপে ছুরির দুটো ফলাই সরীসৃপের মুখের ভিতর নরম মাংস ভেদ করে এফেঁড়-ওফেঁড় হয়ে বসে যাবে; কিন্তু দুটো ধারালো ফলা মাঝখানে অবস্থিত শক্ত কাঠের টুকরোটার জন্য কুমির মুখের হাঁ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারবে না এবং সেই একটুখানি ফাঁকের ভিতর থেকেই চট করে হাত টেনে নিয়ে নিরাপদ ব্যবধানে সরে যাবে নগুরা-গুরা।

অসম্ভব, আত্তিলিও ভাবলেন, এ হচ্ছে উন্মাদের চিন্তা। ওইটুকু কাঠের টুকরো কখনোই কুমিরের প্রচণ্ড দুই চোয়ালের চাপ উপেক্ষা করে টিকে থাকতে পারবে না। নগুরা-গুরার ডান হাত ধরা পড়বে কুমিরের মুখের মধ্যে; জন্তুটা যদি তাকে জলের ভিতর না-নিয়ে যায় তাহলেও লোকটার বাঁচার আশা নেই কারণ কামড়ের চাপে তার হাতখানা নিশ্চয়ই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ক্ষতস্থানে গ্যাংগ্রিন-এর যে পচনক্রিয়া শুরু হবে তাতেই লোকটির মৃত্যু অবধারিত।

নগুরা-গুরার অবস্থা বুঝে উদবিগ্ন হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। উদ্ভিদের বন্ধন জাল থেকে রাইফেলটাকে তিনি মুক্ত করে নিলেন, তারপর যথাসম্ভব নিঃশব্দে সেফটি-ক্যাচ সরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের সাইট কুড়ি গজের মধ্যে নির্দিষ্ট করতে সচেষ্ট হলেন।

হঠাৎ রাইফেলের উপর এসে পড়ল একটা হাত।

আত্তিলিও চমকে উঠলেন–হাতের অধিকারী জাদুকর মাতুংগো! জাদুকরের দুই চোখের গভীর দৃষ্টি আত্তিলিওকে তার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিল–তিনি বলেছিলেন কোনো কারণেই মানুষ ও সরীসৃপের দ্বন্দ্বযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবেন না।

মাতুংগোর ঠোঁট নড়ে উঠল, কোনো শব্দ হল না, কিন্তু ওষ্ঠাধরের কম্পন দেখে তার বক্তব্য বুঝতে পারলেন আত্তিলিও–

চফু-মায়া আসছে। তুমি একটুও নড়বে না।

ছাগশিশুর কান্না তখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। চুপ করে অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার জন্য আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট। মনে হচ্ছে কিছুই ঘটবে না। কুয়াশা সরে যাচ্ছে। আত্তিলিও ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন–ঘড়ির কাঁটা বলছে এখানে আসার পর কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেছে।

হঠাৎ মাতুংগোর কনুইয়ের চাপ পাঁজরের উপর অনুভব করলেন আত্তিলিও। দুই চোখের দৃষ্টি এদিক-ওদিক চালিত করলেন তিনি, কিছুই নজরে পড়ল না। কোনো অস্বাভাবিক শব্দও তার কানে এল না। নগুরা-গুরা বসে আছে পাথরের মূর্তির মতো, তার পিঠের মাংসপেশিতে এতটুকু কম্পনের সাড়া নেই। একইভাবে কাঁদছে আর কাঁদছে ছাগলের বাচ্চা। আত্তিলিওর চোখে-কানে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ল না।

হঠাৎ আত্তিলিও সাহেবের পাঁজরের উপর থেকে কনুইয়ের চাপ সরে গেল। মাতুংগো কী করে ভয়ংকরের আগমনবার্তা পেয়েছিল বলা যায় না, কিন্তু নদীর জলে একটা হলদে-সবুজ বস্তুর চলমান অস্তিত্ব এইবার আত্তিলিওর চোখে পড়ল। ছাগশিশুর ভয়ার্ত দৃষ্টি এখন নদীর দিকে, আর্তস্বর তীব্র থেকে তীব্রতর!

ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে নদীর জলে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা প্রকাণ্ড মাথা! আত্তিলিওর মনে হল তিনি স্বপ্ন দেখছেন–এমন প্রকাণ্ড কুৎসিত মস্তকের অস্তিত্ব বাস্তবে কল্পনা করা যায় না। জল ছেড়ে উঠে এল ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতা অতিকায় কুম্ভীর চফু-মায়া!

দড়িতে বাঁধা ছাগল-বাচ্চার কয়েক ফিট দূরে এসে থমকে দাঁড়াল কুমির। আত্তিলিও বুঝলেন এইবার সে শিকারকে কামড়ে ধরবে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মাতুংগো। চিৎকারটা বোধ হয় যুদ্ধের সংকেত-মুহূর্তের মধ্যে গাছের আড়াল থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে এল নগুরা-গুরা, ছাগশিশুর মাথার ওপর দিয়ে মেলে দিল প্রসারিত দক্ষিণ হস্ত।

বিদ্যুদ্‌বেগে এগিয়ে এসে শত্রুকে আক্রমণ করল চফু-মায়া। সশব্দে খুলে গেল দুই ভয়ংকর চোয়াল। একটা তুচ্ছ মানুষের দুর্বল হাত লক্ষ করে এগিয়ে এল চফু-মায়ার দন্ত-কণ্টকিত করাল মুখগহ্বর। পরক্ষণেই আবার ভীষণ শব্দে চোয়াল দুটি বন্ধ হয়ে গেল কুমির বুঝি বজ্রকঠিন দংশনে চেপে ধরেছে শত্রুর হাত!

আত্তিলিও চমকে উঠলেন… না! নগুরা-গুরা সরে এসেছে! তার ডান হাত এখনও অক্ষত অবস্থায় দেহের সঙ্গে সংলগ্ন, কিন্তু যে-অস্ত্রটা একটু আগেও তার ডান হাতের মুঠির মধ্যে ছিল সেই দোলা ছুরিটাকে আর যথাস্থানে দেখা যাচ্ছে না!

চফু-মায়া পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল–পরক্ষণেই এক প্রকাণ্ড ডিগবাজি খেয়ে শূন্য পথে প্রায় পনেরো ফিট উচ্চতা অতিক্রম করে তার বিশাল দেহ এসে পড়ল নদীগর্ভে! ফোয়ারার মতো ছিটকে উঠল জল, চফু-মায়া হল অদৃশ্য!

তারপর নদীর জল তোলপাড় করে জাগল ঢেউয়ের পর ঢেউ! থর থর করে কাঁপতে লাগল গাছে বাঁধা দড়ি! জলের তলায় আত্মগোপন করে চফু-মায়া প্রাণপণে ছুরি আর দড়ির মারাত্মক আলিঙ্গন থেকে মুখগহ্বরকে মুক্ত করতে চাইছে!..

আত্তিলিও বুঝলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধের পালা শেষ; জয়ী হয়েছে নগুরা-গুরা। সঠিক সময়জ্ঞান, ক্ষিপ্রতা এবং সংযত স্নায়ুর সাহায্যে ওই মানুষটি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে।

কিন্তু চরম মুহূর্তে অসীম সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দিলেও বিপদ কেটে যেতেই নগুরা-গুরার অবস্থা হয়েছে নির্জীব জড়পদার্থের মতো। নদীর বুক থেকে ছিটকে এসে জলের ধারা তার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিচ্ছে তবু তার খেয়াল নেই। চোখ পাকিয়ে সে তাকিয়ে আছে আলোড়িত জলরাশির দিকে; মনে হচ্ছে এত বড়ো জীবটাকে সে যে স্বহস্তে মর্মঘাতী আঘাতে পর্যুদস্ত করেছে, ঘটনার এই সত্যতা তার নিজের কাছেই এখন অবিশ্বাস্য!

মাতুংগো তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে একটা হাত রাখল নগুরা-গুরার কাঁধের উপর। আত্তিলিও জানতেন তার অনুচর কাপালালো ওই অঞ্চলের এক সাহসী শিকারি–কিন্তু তিনি দেখলেন ঘটনার ভীষণতা তাকেও স্তম্ভিত করে দিয়েছে! সম্মোহিত মানুষের মতোই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাপালালো!…

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – আত্তিলিওর বিপদ

নদীর বুক থেকে প্রবল বেগে উঠে আসছে উচ্ছ্বসিত জলধারা, সবেগে দুলছে আর দুলছে বৃক্ষে আবদ্ধ লম্ববান রঞ্জু চফু-মায়ার বিশাল দেহ জলের তলায় অদৃশ্য থাকলেও তার মৃত্যুকালীন আক্ষেপ নদীতটে দণ্ডায়মান দর্শকের কাছে অতিশয় স্পষ্ট।

কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও চফু-মায়া ছুরির মারাত্মক দংশন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। দোলা ছুরির ফলা দুটো এমন গভীরভাবে মুখের ভিতর বিধে আটকে আছে যে, বেচারা কুমির না-পারছে মুখ বন্ধ করতে, না-পারছে মুখ খুলতে! সে প্রাণপণে টানাটানি করছে, সঙ্গেসঙ্গে ছুরির মাঝখানে বাঁটে-বাঁধা দড়িতে পড়ছে টান টানাটানির ফলে যন্ত্রণা বাড়ছে; জন্তুটার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘাসে-পাকানো দড়িটা ভীষণ শক্ত। সেটা ছিঁড়ে ফেলা চফু-মায়ার মতো শক্তিশালী জীবের পক্ষেও সম্ভব নয়। ছুরির সঙ্গে আবদ্ধ দড়িটাকে যে গাছের ডালে বাঁধা হয়েছে, সেই ডালটা যদি টানাটানিতে ভেঙে পড়ে তাহলে যন্ত্রণা থেকে রেহাই না-পেলেও কুমির অন্তত সীমাবদ্ধ গণ্ডির বন্ধন দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে কিন্তু তা হওয়ার নয়। আগেই বলেছি ওই জাতের গাছ যেমন নমনীয়, তেমনই কঠিন। গাছটি যে চফু-মায়ার টানাটানি অগ্রাহ্য করে তার অখণ্ডতা বজায় রাখতে সমর্থ সে-কথা জেনেই পূর্বোক্ত বৃক্ষশাখায় দড়ি বেঁধে নরখাদকের মৃত্যুফঁদ সাজিয়েছে জাদুকর মাতুংগো।

চফু-মায়া সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা পোষণ করলেও তার যন্ত্রণা দেখে ব্যথিত হলেন আত্তিলিও। তিনি স্থির করলেন জলের উপর আহত কুমিরটা একবার মাথা তুললেই তিনি গুলি চালিয়ে তাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দেবেন।

আচম্বিতে নদীর বুক থেকে ছিটকে এল রক্তাক্ত জলের ধারা আত্তিলিওর দিকে, সচমকে এক লাফ মেরে সরে গেলেন তিনি। ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত জলের ধারাটা নদীতটে নিঃশেষ হয়ে যেতেই আবার এগিয়ে গেলেন আত্তিলিও। কিন্তু রাইফেল তুলে ধরার আগেই তার চোখে পড়ল নদীর জলে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি! সেই জীবন্ত ও চলন্ত কাষ্ঠখণ্ডগুলোর স্বরূপ-নির্ণয় করতে আত্তিলিওর ভুল হল না–আহত চফু-মায়ার দিকে ধেয়ে আসছে কুমিরের দল! দীর্ঘকাল ধরে নদী ও জলের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছে যে শয়তান, ছিনিয়ে নিয়েছে জাতভাইদের মুখের গ্রাস বারংবার সে আজ অসহায় বুঝে প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসছে কুমিরের ঝক; চফু-মায়ার মৃত্যুযাতনা তারা উপভোগ করতে চায়, তার দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে তারা আজ বসাতে চায় ভোজের আসর!

দ্রুত, অতি দ্রুতবেগে এগিয়ে আসতে লাগল হিংস্র সরীসৃপের দল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আত্তিলিও তাকিয়ে রইলেন সেই মাংসলোলুপ মিছিলের দিকে। চফু-মায়া তখনও কাবু হয়নি, প্রবল বিক্রমে সে তখনও ছুরি আর দড়ির মারাত্মক বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে হঠাৎ দলের ভিতর থেকে একটা দুঃসাহসী কুমির এগিয়ে এসে কামড়ে ধরল চফু-মায়ার লেজ!

ওই ঝটাপটির মধ্যে লক্ষ স্থির করা খুবই কঠিন, তবু আত্তিলিও রাইফেল তুলে নিশানা করতে সচেষ্ট হলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে লাঙ্গুলের উপর দন্তাঘাতের যাতনা অনুভব করে চফু-মায়া এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে জল থেকে ছিটকে উঠল শূন্যে!

বাওয়ানা!

আত্তিলিওর কানে এল উদবিগ্ন কণ্ঠের আহ্বান। মুহূর্তের জন্য তার পার্শ্বদেশে কী-যেন-একটা বস্তুর আঘাত অনুভব করলেন তিনি। অজ্ঞাতসারে তার মাংসপেশি সংকুচিত হল, আঙুলের চাপ পড়ল রাইফেলের ট্রিগারের উপর সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে অগ্নিউদগার করে হাত থেকে ঠিকরে বেরিয়ে গেল রাইফেল। দোদুল্যমান রঞ্জু এবার তার পাঁজরের উপর থেকে সরে এসে আঘাত করল পায়ের উপর পরক্ষণেই ধনুক-ছাড়া তিরের মতো আত্তিলিওর দেহ এসে পড়ল কুম্ভীরসংকুল নদীগর্ভে!

পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি ডুবে গেলেন। কয়েক মহূর্তের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন নদীর তলদেশে। চটচটে কাদার মারাত্মক বন্ধন থেকে নিজেকে কোনোরকমে মুক্ত করে আত্তিলিও ভেসে উঠলেন, তারপর তীরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।

জল এখন চিবুক পর্যন্ত। কিন্তু আত্তিলিও আর অগ্রসর হওয়ার সাহস পেলেন না। তার চারদিকে ঘুরছে কুমিরের দল, এখন পর্যন্ত তারা যে আত্তিলিওকে আক্রমণ করেনি এটাই আশ্চর্য। আত্তিলিওর মনে হল দারুণ আতঙ্কে তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। সেটা বরং ভালো, আত্তিলিও ভাবলেন, মৃত্যুর আতঙ্কের চাইতে মৃত্যু অনেক ভালো। এখন ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ততই মঙ্গল…

জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে প্রায় নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়েছিলেন আত্তিলিও, হঠাৎ তার মনে পড়ল নগুরা-গুরার কথা। আফ্রিকার এক আদিম মানুষ যদি ভয়কে জয় করে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে পারে, তবে মহাযুদ্ধের সৈনিক হয়ে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি কি ক্লীবের মতো মৃত্যুর মুখে আত্মসমর্পণ করবেন? কখনোই নয়।

আত্তিলিও আবার অগ্রসর হলেন তীরভূমির দিকে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই একটা পাথরের উপর তার পা পড়ল। জল এখন কাঁধের নীচে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন আত্তিলিও। সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারলেন কেন কুমিরগুলো তাকে আক্রমণ করেনি। চফু-মায়া এখনও লড়াই করছে। দোলা ছুরির নিষ্ঠুর দংশন চফু-মায়ার শক্তিশালী চোয়াল দুটিকে অকেজো করে দিয়েছে বটে, কিন্তু কাটা-বসানো লেজের চাবুক হাঁকড়ে সে আক্রমণকারী শত্রুকুলকে বাধা দিচ্ছে বিপুল বিক্রমে। কুমিরের দল এখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত, তুচ্ছ একটা মানুষকে নিয়ে তারা মাথা ঘামাচ্ছে না–আগে চফু-মায়া, তারপর…।

স্টেডি, বাওয়ানা, মাথার উপর থেকে ভেসে এল কাপালালোর কণ্ঠস্বর, স্টেডি।

সচমকে মুখ তুলে আত্তিলিও দেখলেন তার মাথার উপর একটা গাছের ডালে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে কাপালালো–ডালটাকে নীচু করে আত্তিলিওর নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে সে প্রাণপণে। তার পিছনে ঘন পাতার আড়ালে বসে রয়েছে আরও দুটি মানুষ। তাদের মধ্যে একজন শক্ত মুঠিতে কাপালালোর দুই পায়ের গোড়ালি ধরে রেখেছে এবং তার পশ্চাত্বর্তীর হাতের মুঠিতে রয়েছে পূর্ববর্তী মানুষটির পা। আত্তিলিওর সঙ্গে সেই জীবন্ত শিকলের প্রথম সংযোগস্থল হচ্ছে কাপালালো। খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তিনটি মানুষের আলিঙ্গনে-আবদ্ধ জীবন্ত শৃঙ্খল, আরও ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগল বৃক্ষশাখা জলের দিকে…

এইবার, কাপালালো বলল, যতটা সম্ভব উঁচু হয়ে গাছের ডালটা ধরো বাওয়ানা। তারপর অপেক্ষা করো।

শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আত্তিলিও লাফালেন। ডালটা ধরে ফেললেন তিনি। ডাল ধরলেও শরীরটাকে উপরে তোলা সম্ভব হল না, তাঁর অবশ দেহ আবার ঝুলে পড়ল নীচের দিকে। কিন্তু হাতের আঙুলগুলো লোহার সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল ডালটাকে। আত্তিলিওর দেহের ওজন সেই আঙুলের বাঁধনকে শিথিল করতে পারল না।

রেডি!

কাঁধের সন্ধিস্থলে একটা তীব্র যাতনা অনুভব করলেন আত্তিলিও। পরক্ষণেই অভিশপ্ত নক্ৰসংকুল নদীগর্ভ থেকে তার দেহটা প্রবল আকর্ষণে শূন্যে উঠে এল! কাপালালো আর তার দুই সঙ্গী তাকে কী করে উদ্ধার করেছিল এবং জলের উপর দোদুল্যমান সেই বৃক্ষশাখায় ভারসাম্য বজায় রেখে কোন প্রক্রিয়ায় আত্তিলিওর অচেতন শরীরটাকে তারা শক্ত মাটির নিরাপদ আশ্রয়ে নামিয়ে এনেছিল সেই রহস্য আত্তিলিওর কাছে আজও অজ্ঞাত কারণ, নিগ্রোরা যখন তার উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত, তিনি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সব ভালো যার শেষ ভালো

এটা নাইনির গয়না, হাতির দাঁতের তৈরি, একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন আত্তিলিও, আর এই তামার ব্রেসলেট হল নাইনির বোনের সম্পত্তি। ওই ক্রস হচ্ছে পাদ্রী সাহেবের জিনিস। ।

আচ্ছন্নের মতো শুয়ে শুয়ে কথাগুলো শুনতে পেলেন আত্তিলিও। তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? স্বপ্ন কি কথা কয়? অতি কষ্টে চোখের পাতা মেলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলেন তিনি। একটা চোখ খুলল। আরেকটা খুলল না, কারণ সেই চোখটার উপর লাগানো ছিল ব্যান্ডেজ গোছের একটা আবরণ। যে-কণ্ঠস্বর মগ্নচৈতন্যের দ্বারে আঘাত করে আত্তিলিওর চেতনা ফিরিয়ে এনেছিল, সেই কণ্ঠস্বরের মালিককে সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মধ্যেও চিনতে পারলেন আত্তিলিও –মাতুংগো!

কাপালালোকেও সেখানে দেখতে পেলেন আত্তিলিও। তার তাঁবুর মধ্যে তারই বিছানার কাছে মাটির উপর দুজনে বসে ছিল। একটা ক্যানভাসের উপর পড়ে ছিল কয়েকটা জলে-ভেজা জিনিস। মেয়েদের দুটি অলংকার। একটা ক্রস। একটা পুরানো ধরনের ক্যামেরার লেন্স। একটা মস্ত সোনার ঘড়ি এবং ঘড়ির সঙ্গে আটকানো একটা ভারী সোনার চেন ইত্যাদি…

বাওয়ানা এইবার আমাদের কথা বিশ্বাস করবে। মাতুংগো বলল, সে যখন দেখবে নগুরা-গুরা চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে এই জিনিসগুলো উদ্ধার করেছে তখন আর আমাদের কথা সে অবিশ্বাস করতে পারবে না।

সে এই জিনিসগুলিকেও স্বচক্ষে দেখবে। কাপালালো বলে উঠল এবং তার হাত থেকে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি দ্রব্য এসে পড়ল মাটিতে রাখা ক্যানভাসের উপর। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা জিনিস হাতির দাঁতে তৈরি, কতকগুলো আবার ধাতব বস্তু। ওই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে নরভুক কুম্ভীরের অপরাধের অকাট্য প্রমাণ। বছরের পর বছর ধরে ওই জিনিসগুলো জমেছে ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতার উদর-গহ্বরে।

কিন্তু–আত্তিলিও জানতে চাইলেন, কুমিরগুলো কি চফু-মায়াকে খেয়ে ফেলেনি? জিনিসগুলো পাওয়া গেল কী করে?

কাপালালো আর মাতুংগো চমকে উঠল। তারা বুঝতেই পারেনি কখন আত্তিলিওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। এবার দুজনেই হেসে ফেলল।

তোমার বন্দুকের আওয়াজ শুনে গ্রামের সব লোক দৌড়ে এসেছিল, কাপালালো বলল, তারাই তোমাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। আর দড়ি ধরে টেনে চফু-মায়ার ছিন্নভিন্ন দেহটাকে তারাই তুলে এনেছে ডাঙার উপর। চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে যে জিনিসগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো এখন নগুরা-গুরার সম্পত্তি। কাল সে জিনিসগুলো গ্রিক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করবে। ওগুলোর বদলে সে পাবে অনেকগুলো ছাগল।

কিছুদিন আগে মাতুংগো একটা কথা বলেছিল। সেই কথাটা হঠাৎ এখন আত্তিলিওর মনে পড়ল, যমজ বোনদের আত্মা ওদের পিতাকে খুশি করবে। ওই আত্মা দুটির কল্যাণে পিতার ধনসম্পদ বাড়বে, বৃদ্ধ বয়সে সে খুশি হবে।

মাতুংগো বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না। কাপালালোকে ঠেলে সরিয়ে দিল সে। এটা পান করো, সযত্নে আত্তিলিওর মাথাটা তুলে ধরে একটা কাঠের পাত্র তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল মাতুংগো।

কৃতজ্ঞচিত্তে তরল ওষুধটা পান করে ফেললেন আত্তিলিও। পানীয়টা বলকারক এবং মশলার গন্ধে পরিপূর্ণ।

ঘুমাও,মাতুংগো বলল। আত্তিলিওর মাথাটা সে আবার ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল বালিশের উপর।

ঘুমাও, বাওয়ানা, কাপালালো বলল, আর ভয় নেই। সব ভালো যার শেষ ভালো।

বৈশাখ ১৩৮০

৬. প্রতিহিংসা

সৈনিকের ষষ্ঠ অভিজ্ঞতা
প্রতিহিংসা
প্রথম পরিচ্ছেদ – রহস্যময় অন্তর্ধান!

পূর্ব আফ্রিকার পর্তুগিজ উপনিবেশ মোজাম্বিক-এর রাজধানী বায়রার ২,০০০ শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী একদিন অবাক হয়ে ভাবতে লাগল সিডনি ব্যাঙ্কে বিল নামে যে হিসাবরক্ষকটি কাজ করে সে হঠাৎ সেইদিন সকালে তার গৃহে অনুপস্থিত কেন? মাত্র তিনদিন আগে ওই শহরে যে মানুষটি পদার্পণ করেছেন, সেই আত্তিলিও গত্তি নামক নবাগত ভদ্রলোকের সঙ্গে বিলের আসন্নপ্রসবা তরুণী বধূ মারিয়ার শহর ত্যাগ করে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও অত্যন্ত রহস্যময়। আত্তিলিওর নিজস্ব গাড়িতে তাঁরই নিগ্রো ড্রাইভারের সঙ্গে মারিয়ার যাত্রা শুরু; সেই সময় যারা মেয়েটিকে দেখেছে তারা চমকে উঠেছে মেয়েটির মুখ মৃতের মতো বিবর্ণ, রক্তশূন্য!..

কমান্ডার আত্তিলিও গত্তির অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি যাঁরা প্রথম থেকে পাঠ করেছেন, তাঁদের কাছে বিল নামধারী যুবকটি অপরিচিত নয়। কিন্তু কায়নাও শয়তানের ফঁদ যাঁদের দৃষ্টিগোচর হয়নি, সেইসব পাঠকের পক্ষেও বর্তমান কাহিনির রসগ্রহণ করতে কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না, যখন তারা জানতে পারবেন যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে আত্তিলিও গত্তি নামক মিত্রপক্ষের জনৈক সৈনিকের নেতৃত্বে আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মানুষ, জীবজন্তু ও অরণ্যসম্পদ সম্পর্কে গবেষণা করতে উক্ত মহাদেশে পদার্পণ করেছিলেন দুটি শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রী–প্রফেসর, এক ফরাসি চিকিৎসক এবং বিল, এক দুঃসাহসী মার্কিন যুবক।

প্রফেসর এই কাহিনিতে অনুপস্থিত, শুধু প্রসঙ্গ উঠল বলেই তাঁর নামের উল্লেখ। বিলকে কেন্দ্র করে বর্তমান বিষয়ের অবতারণা।

প্রথম পরিচয়ের সময়ে আত্তিলিও সাহেব ওই যুবকের আফ্রিকা ভ্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি। পরবর্তীকালে আত্তিলিও জানতে পেরেছিলেন অগণিত হস্তিযুথের সংখ্যাকে রাইফেলের সাহায্যে যথাসম্ভব কমিয়ে দেবার জন্যই আফ্রিকার অরণ্যে বিলের আবির্ভাব। হাতি শিকারের জন্য তার অস্বাভাবিক আগ্রহের আসল কারণটা যখন গোপন রইল না, তখন মনে মনে অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও–কিন্তু সেইসময় বিলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার উপায় ছিল না, নিয়তির নিষ্ঠুর নির্দেশে রক্তাক্ত এক পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে অমোঘ ভাগ্যচক্র।

অনেক শিকারির কাছে হাতি-শিকার নিতান্তই একটা শখ, কিন্তু বিলের ব্যাপারটা তা নয়। সমগ্র হস্তীজাতি সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করত বিল। তার বাল্যকালে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী একটি হাতি এবং সেই ঘটনাবিলের মনোরাজ্যে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা করে–শৈশব থেকে কৈশোর আর কৈশোর থেকে যৌবনের পরিণতি এক শোকার্ত শিশুর চিন্তার জগতে ধীরে ধীরে অনুভূতির জন্ম দেয়, দুঃখ-বেদনার পরিবর্তে জেগে ওঠে প্রতিহিংসার রক্ত-লোলুপ সংকল্প।

ঘটনাটা ঘটেছিল আমেরিকার ডেট্রয়েট নামক স্থানে। বিল যখন পাঁচ বছরের শিশু সেইসময় তার বাপ-মা তাকে পূর্বোক্ত স্থানে সার্কাস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সার্কাসের হাতিদের মধ্যে একটি হস্তিনী ছিল শিশুদের অত্যন্ত প্রিয়। লক্ষ লক্ষ শিশু তাকে দেখার জন্য ভিড় করত। হস্তিনীর স্বভাবচরিত্র খুবই শান্ত, বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য খোকা-খুকুর হাত থেকে বাদাম প্রভৃতি লোভনীয় খাদ্যের উপহার গ্রহণ করেছে ওই জন্তুটি, কোনোদিনই তার আচরণে উগ্রতার আভাস দেখা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে খেপে গেল–তীব্র বৃংহন-শব্দে চারদিক কাঁপিয়ে সে ছিঁড়ে ফেলল পায়ের শিকল, তারপরই শুরু হল ভয়ংকর কাণ্ড। সার্কাসের দড়ি আর বেড়া ভেঙেচুরে উড়িয়ে ছুটে চলল ক্রোধোন্মত্ত হস্তিনী, চলার পথে মানুষজন যাকে পেল তাকেই খুঁড়ে জড়িয়ে ধরে সজোরে ছুঁড়ে ফেলল এদিক-ওদিক এবং অনেকগুলো মানুষকে হতাহত করার পর সে এসে দাঁড়াল একটা মালবহনকারী শকটের সামনে। অন্ধ ক্রোধে আত্মহারা হস্তিনী তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির উপর। তার খর্বাকৃতি গজদন্ত দুটি শকট ভেদ করে গুরুভার বস্তুটিকে অতি সহজেই শূন্যে তুলে ফেলল–পরক্ষণেই শকটসমেত হস্তিনীর প্রকাণ্ড মৃতদেহ ভীষণ শব্দে গড়িয়ে পড়ল মাটির উপর! বোধ হয় হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে জন্তুটার মৃত্যু ঘটেছিল। হইহই! চিৎকার! ধুন্ধুমার!

(হস্তিনীর গজদন্তের কথা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই–এশিয়ার হাতিদের মধ্যে নারীজাতি উক্ত মহাস্ত্রে বঞ্চিত হলেও প্রকৃতির কৃপায় আফ্রিকার মহিলারা পুরুষদের মতোই দন্তসজ্জায় সুসজ্জিতা, ভয়ংকরী। বলাই বাহুল্য যে, সার্কাসের হস্তিনী ছিল আফ্রিকার জীব।)

যাই হোক, ওই গোলমালের মধ্যে বাচ্চা বিলকে তার বাপ মা-র কাছ থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে এনেছিল সার্কাসের জনৈক কর্মচারী। একটু পরেই বিল দেখতে পেল মায়ের মৃতদেহ পড়ে আছে মাটির উপর, পাশেই হাঁটু পেতে বসে আছেন বাবা। এক বছর পরেই বিলের বাবা মারা গেলেন। স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যুর শোক তাঁর আয়ুক্ষয় করে দিয়েছিল।

ওই দুর্ঘটনার তেইশ বছর পরে নিউইয়র্ক শহরে বিল আর আত্তিলিওর সাক্ষাৎকার। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিজ্ঞান বিষয়ক অভিযানকার্যে সাহায্য করার জন্য সঙ্গী হিসাবে বিলকে নির্বাচিত করেছিলেন আত্তিলিও। তার সিদ্ধান্ত জানার সঙ্গেসঙ্গে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বিলের মুখ। প্রথমেই আত্তিলিওর কাছে বিল যে-প্রশ্নটি করেছিল তার মর্ম হচ্ছে আফ্রিকাতে হাতি-শিকারের সুযোগ আছে কি না।

শুধুহাতি কেন, আত্তিলিও উত্তর দিয়েছিলেন, সিংহ, লেপার্ড, বন্য মহিষ, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি সব জানোয়ারই ওখানে বাস করে। চেষ্টা করলে গণ্ডার শিকারের সুযোগ হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু, বিল জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমি হাতি মারতে চাই। জঙ্গলের পথে ঘোরাঘুরি করার কায়দাকানুন শিখে গেলে আমি কি দু-একটা হাতি শিকার করতে পারব না?

আত্তিলিও জানালেন হাতি মারতে গেলে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। বিনা অনুমতিতে আফ্রিকায় কোথাও হাতি মারতে দেওয়া হয় না, হাতি শিকারের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা দরকার। বিভিন্ন উপনিবেশের আইন অনুযায়ী অনুমতিপত্রের জন্য যে মূল্য ধার্য করা হয়, সেটা হচ্ছে বিশ থেকে পঞ্চাশ ডলারের মধ্যে। বেআইনিভাবে হাতি শিকার করলে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়ে থাকেন কর্তৃপক্ষ।

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে বিল জানিয়ে দিল আইন ভঙ্গ করে হাতিশিকারে তার আগ্রহ নেই। টাকাটা কোনো প্রশ্ন নয়, হাতিশিকারের অনুমতি পাওয়ার জন্য অর্থব্যয় করতে আমি কুণ্ঠিত নই। বিলের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার আভাস, কিন্তু হাতি মারতে হলে কি খুব বেশি অভিজ্ঞতার দরকার? আর আমরা যে-অঞ্চলে যাচ্ছি সেখানে কি হাতি আছে?

আফ্রিকার যে অঞ্চলে অভিযাত্রীরা প্রথমে পদার্পণ করেছিলেন, সেই জায়গাটা হচ্ছে গজরাজ্যের প্রিয় বাসস্থান–রোডেশিয়া। শিকারের অভিজ্ঞতার জন্য বিলকে তালিম দেবার দরকার হয়নি, কারণ মাছকে কখনো সাঁতার কাটার তালিম নিতে হয় না–দক্ষ শিকারির অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়ে জন্মেছিল বিল, শিকার তার রক্তে রক্তে। দূরদর্শিতা, কষ্টসহিষ্ণুতা প্রভৃতি শিকারিসুলভ সব গুণই তার ছিল, সেইসঙ্গে ছিল তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি এবং অতি বলিষ্ঠ একজোড়া পা–দুর্গম জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বনচারী নিগ্রোরাও যখন শ্রান্ত ক্লান্ত, তখনও দৃঢ় পদক্ষেপে পথ ভেঙে এগিয়ে যেতে বিলের আপত্তি নেই। উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করলেও বিপদের সময়ে বিল সম্পূর্ণ শান্ত, সংযত, নির্বিকার।

কয়েক মাসের মধ্যেই আফ্রিকাবাসী বিভিন্ন হিংস্র পশুর সম্মুখীন হল বিল। জন্তুগুলোকে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি। অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা অসম্ভব, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মরণফাঁদ থেকে অনায়াসে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে এসেছে বিল, একবার নয়, বহুবার।

ওইসব দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার-এ লিপ্ত হয়ে বিল তার কর্তব্যে কখনো গাফিলতি করেনি। ভোর হওয়ার আগেই সে বেরিয়ে যেত, ফিরে আসত প্রাতরাশের সময়ে। কখনো কখনো অভিযাত্রীদের কর্মবিরতির পরে সে জঙ্গলের পথে বেরিয়ে পড়ত নূতন অভিজ্ঞতার সন্ধানে। কঠিন পরিশ্রমের পর আত্তিলিওর দলবল যখন বিশ্রাম নিতে ব্যর্থ, বিলের উৎসাহ-বহ্নি তখনও প্রদীপ্ত! বিশ্রাম শয্যা ছেড়ে সে এগিয়ে চলেছে শিকারের খোঁজে, সঙ্গে রয়েছে আত্তিলিওর নিগ্রো পথপ্রদর্শক ও বন্দুকবাহক মাততানি!

শিকারের সন্ধানকার্যে মাতোনির দক্ষতা ছিল অসাধারণ, পথপ্রদর্শক হিসাবেও তার তুলনা হয় না। কিন্তু প্রথম বছরের শেষ দিকে সে আত্তিলিওকে চুপি চুপি জানিয়ে দিল হাতিদের সঙ্গে লম্বা মাসাংগার (মাতোনির ভাষায় বিলের নামকরণ!) দেখা হওয়াটা প্রেতাত্মাদের অভিপ্রেত নয়–অতএব যতই চেষ্টা করা যাক লম্বা মাসাংগা কখনো হাতির দেখা পাবে না!

ব্যাপারটা সত্যি বড়োই অদ্ভুত। মাততানির সঙ্গে যথাস্থানে গিয়ে হস্তীযুথের সাক্ষাৎ পেয়েই তাড়াতাড়ি হাতি শিকারের পারমিট বা অনুমতিপত্রের জন্য সচেষ্ট হয়েছে বিল এবং অনুমতিপত্র নিয়ে পূর্বোক্ত স্থানে উপস্থিত হয়ে দর্শন করেছে আফ্রিকার নিসর্গশোভা হাতিরা সেখানে অনুপস্থিত! কয়েকদিন আগেও যেখানে দলে দলে হাতি বিচরণ করেছে, সেখানে আজ একটি হাতিরও পাত্তা নেই! সব ভোঁ ভাঁ!

কিছুদিন পরেই অভিযানের কাজে অভিযাত্রীরা গেছেন আর এক অঞ্চলে। আগেকার অনুমতিপত্র এখানে অচল, কারণ এখানে রাজত্ব করছে আর এক সরকার। সেখানেও হাতিদের দেখা গেল বিল, সঙ্গেসঙ্গে চেষ্টাচরিত্র আর অর্থব্যয় করে আরও একটি পারমিট জোগাড় করল সে, কিন্তু তারপরই আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! বিলও হাতিশিকারের অনুমতি পেয়েছে আর হাতির দলও হাওয়া হয়ে গেছে সেই তল্লাট ছেড়ে! আশ্চর্য কাণ্ড!

অভিযাত্রীরা যখন মাম্বোয়া জাতির আস্তানায় কায়না বা মৃত্যুগহ্বরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত, সেই সময়ে বিলের কাছে জমেছে সাত-সাতটি হাতি শিকারের অনুমতিপত্র কিন্তু অযথা অর্থব্যয় ছাড়া কোনো লাভ হয়নি, একটিও হাতি মারতে পারেনি বিল।

কায়না অভিযানে সাফল্য লাভ করে মাম্বোয়াদের নিয়েই বিল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মাম্বোয়াদের দেশে প্রায় সবরকম শিকারই সুলভ, কিন্তু হাতিরা ওখানে বাস করে না। তা ছাড়া হাতি শিকারের পক্ষে যে-মানুষটির সাহায্য অপরিহার্য, সেই মাততানিকে আগেই মোজাম্বিক সীমান্তে দক্ষিণ রোডেশিয়াতে তার নিজস্ব গ্রামে পৌঁছে দিয়ে অভিযাত্রীরা এসেছিলেন উত্তর রোডেশিয়ার মাম্বায়া রাজ্যে–অতএব হাতির পিছনে তাড়া করার সুযোগ পেল না বিল। সকলে ভাবল বিল বোধ হয় হাতির কথা ভুলে গেছে।

কায়না অভিযানে সাফল্য লাভ করে মাম্বোয়াদের দেশ ছেড়ে অভিযাত্রীরা এলেন জুলুল্যান্ডে। আত্তিলিওর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেখানকার পরিস্থিতি বেশ ভালো প্রথমত কয়েকশো মাইলের মধ্যে হাতির বসবাস নেই, দ্বিতীয়ত নরখাদক সিংহদের নিয়ে সকলে এমন ব্যতিব্যস্ত যে অন্য বিষয়ে মাথা ঘামানো অসম্ভব। ইনিয়াতি পর্বতমালার মধ্যে জুলুদের দেশে কয়েক মাস কাটিয়ে দিলেন সবাই। এর মধ্যে একবারও বিলের মুখে হাতি শব্দটি শোনা গেল না। অবশেষে সর্দার জিপোশোর আদেশে অভিযাত্রীরা একদিন জুলুল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হলেন–প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে যে মুহূর্তে তারা জুলুল্যান্ডের বাইরের পথটার উপর এসে পড়লেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই বিলের মুখে পরিচিত শব্দটি আবার শুনতে পেলেন সকলে হাতি! বিল দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিল অভিযাত্রীরা যা খুশি করতে পারেন, যেখানে খুশি যেতে পারেন কিন্তু সে এখন হাতির সন্ধানে যাত্রা করতে বদ্ধপরিকর, অন্য কোনো বিষয়ে মাথা ঘামাতে সে মোটেই রাজি নয়। বিল আরও জানাল বায়রা থেকে লন্ডন হয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার ভাড়ার টাকা রেখে বাকি সব টাকা প্রয়োজনবশে খরচ করতে তার আপত্তি নেই–একেবারে কপর্দকশূন্য হওয়ার আগে সে হাতি শিকারের আশা ছাড়বে না।

বিলের আগ্রহ আর সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে আত্তিলিও আবার মাততানির সঙ্গে দেখা করলেন–এবং প্রফেসর আর বিলের সঙ্গে ওই নিগ্রোশিকারির বায়রা পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

তারপরই হল বিচ্ছেদ। একদিকে গেলেন আত্তিলিও অন্যদিকে বিল আর প্রফেসর। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আর বন্ধুদের খবর পাননি আত্তিলিও। দীর্ঘকাল পরে নূতন অভিযানের উদ্যোগে বায়রাতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আত্তিলিও হঠাৎ বিলের দেখা পেলেন।

বন্দরের মধ্যে যখন আত্তিলিওর নৌকা প্রবেশ করছে, সেইসময়ে একটি পর্তুগিজ লঞ্চ-এর উপর দণ্ডায়মান বিলের দীর্ঘদেহ তার নজরে পড়ল। আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন অন্তত দশ মাস আগে যার আমেরিকাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা, সেই মানুষটি এখন হাত দুলিয়ে দন্তবিকাশ করে তাকে তারস্বরে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে! তার পাশেই যে সুন্দরী তরুণীটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই আত্তিলিও বুঝলেন সে বিলের স্ত্রী।

মিনিট দুই পরেই বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে মিলিত হলেন আত্তিলিও। শুরু হল করমর্দনের পালা, তুবড়ির মতো ছুটল বাক্যস্রোত। অভিযানের সাজসরঞ্জাম নৌকা থেকে ডাঙার উপর নামল; সেগুলোকে ভালোভাবেই আত্তিলিও তদারক করলেন, ফাঁকে ফাঁকে তবু কথাবার্তার বিরাম নেই। বিল এবং তস্য পত্নী নিজস্ব গাড়ি চালিয়ে আত্তিলিওকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল, পথে গাড়ির মধ্যেও চলেছে অবিরাম বাক্যের স্রোত। মধ্যাহ্নভোজের সময়েও আলাপের পালা অব্যাহত, সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ঘনিয়ে এল তখনও কথার শেষ নেই–অবশেষে আত্তিলিও যখন তার লোকজনের কাজকর্ম পরিদর্শন করতে শুল্কবিভাগে ছুটলেন তখনই শেষ হল অবিশ্রান্ত বাক্যের ফুলঝুরি। বিলের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাই এর মধ্যে শুনেছেন আত্তিলিও। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিম্নে বর্ণিত হল।

জুলুল্যান্ড থেকে প্রফেসর আর মাততানির সঙ্গে বায়রা শহরে আসার পথে প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনো হাতিকে পরলোকে পাঠানোর সুযোগ পায়নি বিল। তারা যখন বায়রোতে এসে পৌঁছাল, তখন রাজনৈতিক আবহাওয়া খুব খারাপ। ইউরোপের বুকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনা পর্তুগিজ উপনিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। প্রফেসরকে তার মাতৃভূমি অর্থাৎ ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন ফরাসি দূতাবাসের কর্তৃপক্ষ। বিলের হাতে তখনও বেশ কিছু টাকা, সময়ও প্রচুর–অতএব নূতন উদ্যমে আবার হাতির সন্ধানে জঙ্গলের দিকে যাত্রার করার জন্য প্রস্তুত হল বিল। বিল নির্ঘাত হাতির পিছনেই তাড়া করত, কিন্তু লিসবন থেকে ম্যরিয়া নামে যে-মেয়েটি বায়রাতে এসেছিল তাকে দেখে বিলের মন বদলে গেল। হাতির কথা ভুলে ম্যরিয়ার মনোরঞ্জনে সচেষ্ট হল বিল।

কিছুদিনের মধ্যেই সে জানতে পারল ম্যরিয়ার দিক থেকেও তার প্রতি অনুরাগের অভাব নেই। অতঃপর ঘটনাচক্রের অনিবার্য পরিণতি, অর্থাৎ বিবাহ। বিয়ের পর সিডনি ব্যাঙ্কে একটা দস্তুরমতো ভালো চাকরি নিয়ে ম্যরিয়ার সাহচর্যে আদর্শ দম্পতির জীবনযাপন করছিল বিল। আত্তিলিওর সঙ্গে যখন বিলের আবার দেখা হল তখন পরবর্তী সপ্তাহ থেকে একটি নয়দিন ব্যাপী ছুটি উপভোগের আনন্দে সে মশগুল।

শুল্কভবনের দিকে আত্তিলিওকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বিল গল্প করছিল। এখানকার আবহাওয়া তার এবং নববধূর স্বাস্থ্যের উপযুক্ত বলে অভিমত প্রকাশ করল বিল; সামাজিক পরিবেশ চমৎকার, স্থানীয় ক্লাবগুলোতে নানাধরনের খেলাধুলার সুযোগও আছে–পরিশেষে তার বক্তব্য হল মানুষের জীবন যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়ে কত সুন্দর হতে পারে বিয়ের আগে সে-ধারণা তার ছিল না।

বিলের কথাবার্তা এই পর্যন্ত বেশ উপভোগ করেছিলেন আত্তিলিও, অকস্মাৎ বজ্রাঘাত!

এখন আমার ছুটি, বিলের কণ্ঠস্বর আনন্দে উদবেল, হাতি শিকারের নতুন পারমিট পেয়েছি। ভিলা মাচাডো নামে যে-জায়গাটা রয়েছে, সেখানে দানবের মতো অতিকায় একটা হাতি ভীষণ অত্যাচার করছে। এবারের ছুটিতে সেই হাতিটাকেই সাবাড় করব। খবরটা দিয়েছে। মাততানি। সেও আমার সঙ্গে যাচ্ছে। কী মজা!

আবার হাতি! আত্তিলিওর মুখ শুকিয়ে গেল–সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্য আর মোটা মাইনের চাকরি বিলের মন থেকে প্রতিশোধের রক্তাক্ত সংকল্পকে মুছে ফেলতে পারেনি!

শুষ্কস্বরে তিনি বললেন, মাততানি? সে কোথা থেকে এল? তোমাদের পৌঁছে দিয়ে তার তো দেশে ফিরে যাওয়ার কথা–এতদিন সে এখানে কী করছে?

একগাল হেসে বিল জানাল সেইরকম কথাই ছিল বটে, কিন্তু মাতোনির জায়গাটা ভালো লেগে গেল বলে সে আর দেশে ফিরল না। বিল আরও বলল যে, ব্যাঙ্কের কাজে অন্তত এক সপ্তাহের ছুটি না-পেলে শিকারে যাওয়া অসম্ভব; সেইজন্যই সে এতদিন হাতিদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে একসময়ে না একসময়ে সুযোগ যে পাওয়া যাবে সে-বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল না। সেই উদ্দেশ্যেই বরাবর নিগ্রোশিকারি মাতোনির সঙ্গে সে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে। এখন নয়দিনের লম্বা ছুটি পাওয়া গেছে আর অতিকায় এক হস্তীর সংবাদও উপস্থিত, অতএব মাতোনিকে নিয়ে হস্তিনিধনের অভিযানে যাত্রা করার এমন সুবর্ণসুযোগ হেলায় হারাতে সে রাজি নয়।

আত্তিলিওর সবসময়েই মনে হয়েছে বিল আর হাতির যোগাযোগ এক অশুভ পরিণতির সূত্রপাত করবে। কোনোদিন তিনি বিলের হাতি শিকারের আগ্রহে উৎসাহ প্রকাশ করেননি। এখনও সম্ভব হলে তিনি বাধা দিতেন, কিন্তু বিল এখন তার অধীনে অভিযানকার্যে ব্যাপৃত নয়–তাকে তিনি বাধা দেবেন কী উপায়ে? একমাত্র ভরসা ম্যরিয়া।

আত্তিলিও বললেন, তুমি বলতে চাও কালই তুমি বউকে ফেলে রাইফেল ঘাড়ে হাতির পিছনে ছুটবে?… অসম্ভব। ম্যরিয়া কখনোই রাজি হবে না।

বিল সানন্দে দন্তবিকাশ করল, আজ বিকেলে আমি ম্যরিয়াকে সব কথা খুলে বলব। বিয়ের আগে ম্যরিয়া আমাকে শিকার ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিল। আমি বলেছিলাম কয়েকটা হাতিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে আমি শিকারে ইস্তফা দেব। ম্যরিয়া খুব ভালো মেয়ে। আমার প্রস্তাবে তার আপত্তি হয়নি। আমি যে এতদিন শিকারে যাইনি তার কারণ স্ত্রীর অসম্মতি নয়–ছুটি পাইনি বলেই আমি হাতি শিকারের চেষ্টা করতে পারিনি। বুঝলে বন্ধু, এবার এমন বিরাট দুটি গজদন্ত আমি তোমার সামনে নিয়ে আসব যে, তেমন জিনিস তুমি জীবনে দেখনি।

আত্তিলিও দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ভবি ভোলবার নয়!…

বিল যেদিন চলে গেল সেদিনটা ছিল শনিবারের সকাল। ম্যরিয়া খুব সপ্রতিভ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে দুশ্চিন্তা ও উদবেগের আভাস আত্তিলিওর কাছে গোপন থাকেনি। শুধু কণ্ঠস্বর নয়, বন্ধুপত্নীর মুখ-চোখে সংশয় ও আশঙ্কার চিহ্ন দেখেছিলেন আত্তিলিও। শিকারের সরঞ্জাম নিয়ে বিল ছিল ব্যস্ত ও উত্তেজিত, স্ত্রীর ভাবান্তর সে লক্ষ করল না।

যাওয়ার আগে বন্ধুকে শেষবারের মতো নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন আত্তিলিও। অন্তত এই হাতিটার পিছু নিতে বিলকে তিনি নিষেধ করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা অকারণ নয়–মাতোনির কাছ থেকে এর মধ্যেই পূর্বোক্ত হস্তীর দৈহিক আয়তন ও স্বভাবচরিত্রের যে বিবরণ আত্তিলিওর কর্ণকুহরে পরিবেশিত হয়েছিল তাতে বন্ধুর নিরাপত্তা সম্বন্ধে শঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিল হেসে জানিয়েছিল তাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা করতে সে সমর্থ। ওই ভয়ংকর জীবের পশ্চাদ্ধাবনের সংকল্প থেকে বিলকে নিরস্ত করতে না-পেরে আত্তিলিও তার সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

বিল তার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, ধন্যবাদ। কিন্তু আমি জানি কালই তোমার বায়রা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেছে। অকারণে কারো কাজের ক্ষতি হয় তা আমি চাই না। আমার জন্য দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। আমি জানি কী করে হাতি মারতে হয়। দুই চোখের একটু উপরে একটা সরলরেখার মধ্যে অবস্থিত দুর্বল জায়গাটা কমলালেবুর মতো বড়ো–ওইখানে গুলি বসাতে পারলে হাতির নিস্তার নেই। ত্রিশ ফুটের বেশি দূরত্ব থেকে গুলি চালানো উচিত নয়; অতএব হাতি তেড়ে এলে স্থিরভাবে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এসে পড়ে নির্দিষ্ট পাল্লার মধ্যে–তাই নয় কি? এসব ব্যাপার আমি জানি। খেপা জানোয়ারের সামনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে নিশানা করার ক্ষমতা যে আমার আছে সে-কথা তো তোমার অজানা নয়। অতএব বন্ধু, ভয়ের কোনো কারণ নেই।

বিল চলে গেল। আত্তিলিও কর্মসূচি বদলে ফেললেন। যদিও জরুরি কাজে পরের দিনই তার অন্যত্র যাওয়ার কথা, কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল কাজটা এমন কিছু দরকারি নয় যে এই মুহূর্তে হইহই করে ছুটতে হবে–বরং বিল ফিরে এলে তার সঙ্গে দেখা করে যাওয়াই বিবেচনার কাজ। স্থানত্যাগের পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে বায়রাতেই থেকে গেলেন আত্তিলিও এবং টেলিফোন করে ম্যরিয়াকে জানিয়ে দিলেন বিল ফিরে আসার আগে তিনি এই জায়গা ছেড়ে কোথাও নড়ছেন না।

তোমার চিন্তার কারণ নেই, আত্তিলিও বললেন, বিল যেকোনো সময়ে ফিরে আসতে পারে।

না! না! হঠাৎ টেলিফোনের ভিতর দিয়ে ম্যরিয়ার অস্বাভাবিক কণ্ঠ তীব্রস্বরে ফেটে পড়ল আত্তিলিওর কানে, ও আর আসবে না!

আত্তিলিও স্তম্ভিত! আবার ভেসে এল নারীকণ্ঠের দ্রুত উক্তি, ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! আচ্ছা, গুড নাইট।

আত্তিলিও ভাবলেন ম্যরিয়া তার কথা বুঝতে পারেনি, সে বোধ হয় ভেবেছে সেই রাতেই বিলের ফিরে আসার কথা বলছেন তিনি, সেইজন্যই এই প্রতিবাদ। অর্থাৎ তার বক্তব্য হচ্ছে এত তাড়াতাড়ি বিল ফিরে আসতে পারে না।

ম্যরিয়া কী বলতে চেয়েছিল তা সঠিকভাবে অনুধাবন করলেন আত্তিলিও মঙ্গলবার দুপুরে। সেদিন মধ্যাহ্নভোজের পর একটি ছোটোখাটো দিবানিদ্রা দেবার উদ্যোগ করছেন আত্তিলিও, এমন সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন।

ফোন তুলতেই ম্যরিয়ার কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে চলে আসুন। আত্তিলিও হতভম্ব, সেকী! কী হয়েছে?

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদিক থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল। ম্যরিয়া ফোন রেখে দিয়েছে।

নিশ্চয় বিল আহত অবস্থায় ফিরে এসেছে, আত্তিলিও ভাবলেন। তিনি জামাকাপড় পরে নিজস্ব গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার বমবো গাড়ি চালিয়ে উপস্থিত হল বিলের বাড়িতে। ম্যরিয়া মাথায় হেলমেট চড়িয়ে বারান্দার উপর থেকে পথের দিকে তাকিয়েছিল। কোনো ভূমিকা না-করে সে আত্তিলিওকে বলল, বিলের কিছু হয়েছে।

কেন? বিলের কোনো খবর পেয়েছ?

খবর পাইনি বলেই বুঝতে পারছি কিছু হয়েছে। বিল কথা দিয়েছিল সোমবারের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবে। আজ মঙ্গলবার, অথচ তার দেখা নেই। কিন্তু এখন কথা বলার সময় নয়, চলুন আমরা যাই। তর্ক করবেন না, দয়া করে চলুন। এক্ষুণি চলুন। এই মুহূর্তে।

আত্তিলিও বোকার মতো বললেন, কোথায় যেতে হবে তা তো জানি না।

উত্তর এল, আমি জানি। রেনল্ট। ভিলা মাচাডোর রাস্তায় যেতে হলে রেনল্টে যেতেই হবে। ওখানকার গাঁয়ের মানুষের কাছে নিশ্চয়ই ওর খবর পাওয়া যাবে।

আত্তিলিও বন্ধুপত্নীকে বাড়িতে অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানালেন এবং তিনি যে এই মুহূর্তে অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে যথাসম্ভব শীঘ্র ম্যরিয়াকে প্রয়োজনীয় সংবাদ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করবেন সে-কথা জানাতেও ভুললেন না। কিন্তু ম্যরিয়া বাড়ি থাকতে রাজি নয়।

আমি খাবারদাবার তৈরি রেখেছি। পানীয় জল, কম্বল, ফ্ল্যাশ-লাইট প্রভৃতি সব কিছুই সাজানো আছে। বিলের বাড়তি বন্দুকটাও সঙ্গে নিচ্ছি–হয়তো অস্ত্রটা ব্যবহার করার দরকার হতে পারে। আর এক মিনিটও নষ্ট করা উচিত নয়। চলুন।

আত্তিলিও বুঝলেন ম্যরিয়া কোনো কথা শুনবে না, সে যাবেই যাবে। অগত্যা বন্ধুপত্নীকে নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার বমবো গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পথের শেষে

গাড়ি ছুটছে। দীর্ঘ পথ। যাত্রীরা মৌন। দুশ্চিন্তা ও উদবেগ যাত্রীদের নির্বাক করে রেখেছে। শুধু চালনচক্রের ওপর অভ্যস্ত দক্ষতায় ঘুরছে ড্রাইভার বমবোর হাত।

যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। সংকীর্ণ পথের উপর এক জায়গায় পড়ে ছিল একটা গাছ। অনেক কষ্টে সেই বাধা ভেদ করে গাড়ি ছুটল। জোর করে সঙ্গে আসার জন্য বন্ধুপত্নীর উপর বিরক্ত হয়েছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু ক্রোধ প্রকাশ করে লাভ নেই–ম্যরিয়া অটল, অবিলম্বে বিলের খবর পাওয়ার জন্য যেকোনো বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে প্রস্তুত।

নির্দিষ্ট স্থানে ৩২নং মাইলপোস্টের কাছ রাস্তা থেকে একটু দূরে ফাঁকা জায়গার উপর তাঁবুটা যাত্রীদের দৃষ্টিগোচর হল। তাঁবুতে ঢুকে বিলের দেখা পাওয়া গেল না।

আত্তিলিও ম্যরিয়াকে জানালেন শয্যার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমিয়ে সকাল বেলা বেরিয়ে গেছে, খুব সম্ভব এখনই সে মাতোনিকে নিয়ে ফিরে আসবে। ম্যরিয়াকে যাই বলুক না কেন বিলের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আত্তিলিওর মনেও তখন সংশয় উপস্থিত বিছানাতে বিলের দেহের ছাপ থাকলেও সে যে কখন শয্যাত্যাগ করেছে সে-কথা অনুমান করা সম্ভব নয়।

আত্তিলিওর প্রবোধ বাক্য শুনে খুশি হল না ম্যরিয়া, সত্যিকার অবস্থাটা সে জানতে চায় ধাতুনির্মিত যে বাক্সটার মধ্যে বিল খাবারদাবার নিয়ে এসেছিল সেই বাক্সের ডালা খুলে মেয়েটি ভিতরে দৃষ্টিপাত করল। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কের চমক! সব কিছুই অটুট অবস্থায় আছে, একটুকরো খাবারও বাক্স থেকে অদৃশ্য হয়নি! অর্থাৎ তিনদিন আগে এখানে পৌঁছেই হাতির পিছু নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে বিল আর মাততানি, ফিরে এসে খাদ্যগ্রহণের সুযোগ হয়নি বলেই তাদের খাদ্যসামগ্রী অটুট ও অক্ষত অবস্থায় যথাস্থানে বিরাজ করছে! তিনদিন নিখোঁজ তারা!

ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে মানুষ যেমন করে প্রিয়জনের শবাধারের ডালা বন্ধ করে, ঠিক তেমনি করেই বাক্সের ডালা বন্ধ করল ম্যরিয়া। এতক্ষণ পরে মেয়েটির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। বিলের নাম ধরে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠে সে লুটিয়ে পড়ল পরিত্যক্ত শয্যায়, তার দুই চোখ বেয়ে নামল তপ্ত অশ্রু।

আত্তিলিওর জীবনে এমন দুঃসহ রাত্রি কখনো আসেনি। শোকের প্রথম আবেগ কেটে যেতেই ম্যরিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে, দারুণ আশায় বুক বেঁধে বার বার ছুটে এসেছে পথের উপর আবার নিরাশ হৃদয়ে স্থলিত পদক্ষেপে প্রবেশ করেছে তাঁবুর মধ্যে। সমস্ত রাত এবং পরের দিন সকাল পর্যন্ত সে ওইভাবেই কাটিয়েছে। ওই দীর্ঘসময়ের মধ্যে কোনো খাদ্য তো দূরের কথা, এক কাপ চা পর্যন্ত পান করতে রাজি হয়নি ম্যরিয়া। বার বার অনুরোধ করেও তাকে কিছুই খাওয়াতে পারলেন না আত্তিলিও। এক রাতের মধ্যে তিন-তিনবার নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা হয়েছে, হতচকিত গ্রামবাসীরা বিমূঢ়ভাবে ঘাড় নেড়েছে না, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা তাদের চোখে পড়েনি।

দিনের আলো ফুটতেই আবার অনুসন্ধান শুরু হল। একটার পর একটা গ্রাম পরিদর্শন করলেন আত্তিলিও আর ম্যরিয়া। সবসুদ্ধ প্রায় পাঁচ-ছয়টা গ্রামে তারা পদার্পণ করেছেন, সব জায়গায় একই উত্তর–সাদা চামড়ার কোনো মানুষের খবর জানে না স্থানীয় মানুষ। অবশেষে ৩৪নং মাইলপোস্টটার কাছে এসে যে-গ্রামটাকে তারা দেখলেন, সেটা ছিল সম্পূর্ণ জনশূন্য।

গ্রাম পরিদর্শন করে যাত্রীরা বুঝলেন দু-দিন আগেও সেখানে লোকজন বাস করত। হঠাৎ গৃহত্যাগ করে গ্রামসুদ্ধ লোকের বনের ভিতর উধাও হওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পেলেন না আত্তিলিও। কিন্তু ম্যরিয়া দৃঢ়ভাবে জানালেন জনশূন্য গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিলের অন্তর্ধান রহস্য। তার ধারণা গ্রামের মধ্যে খুব শীঘ্রই মানুষের দেখা পাওয়া যাবে।

ম্যরিয়ার চিন্তাধারা যে অভ্রান্ত সে-কথা প্রমাণিত হল বুধবার সকাল দশটার সময়ে।

ধূলিধূসর ক্লান্ত দেহে বিস্তর ঘোরাঘুরির পর আবার ৩৪নং মাইলপোস্টের কাছে ফিরে এসে যাত্রীরা পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্যে একটি মনুষ্যমূর্তির সাক্ষাৎ পেলেন। পূর্বোক্ত মনুষ্যটি কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করছিল, সাদা চামড়ার সামনে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা তার ছিল না। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কিছুমাত্র মর্যাদা না-দিয়ে ড্রাইভার বমবো লোকটিকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে যাত্রীদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। লোকটি স্থানীয় মানুষ, নাম–জাটা। জাটা চোখে-মুখে আতঙ্কের চিহ্ন পরিস্ফুট। প্রথমে সে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি, কিন্তু ম্যরিয়ার অবস্থা দেখে তার মনে সহানুভূতির উদ্রেক হল। আতঙ্কের পরিবর্তে স্নিগ্ধ কোমল অভিব্যক্তির ছায়া পড়ল জাটার মুখে, চলো।

সম্মোহিতের মতো জাটাকে অনুসরণ করল ম্যরিয়া। প্রায় ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর একটা ফাঁকা জায়গার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল স্থানীয় মানুষ, তার উদবিগ্ন দৃষ্টি এখন আত্তিলিওর দিকে। হঠাৎ জাটার পাশ দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল ম্যরিয়া। এত তাড়াতাড়ি সে চালিয়েছিল যে, আত্তিলিও কিংবা নিগ্রোটি তাকে বাধা দেবার সুযোগ পেলেন না।

নারীকণ্ঠের অবরুদ্ধ আর্তস্বর শোনা গেল; আত্তিলিও ছুটে গেলেন ম্যরিয়ার দিকে। পরক্ষণেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি, কয়েক মুহূর্তের জন্য আড়ষ্ট হয়ে গেল তার সর্বাঙ্গ।

আত্তিলিওর সম্বিৎ ফিরে এল যখন তিনি দেখলেন ম্যরিয়ার দেহ রক্তচিহ্নিত মাটির উপর লুটিয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি ছুটে এসে তিনি মূর্তি বন্ধুপত্নীর পতনোন্মুখ দেহটাকে ধরে ফেললেন। এতক্ষণে সন্ধানপর্ব শেষ! সামনেই মাটির উপর জমাট শুষ্ক রক্তের ছড়াছড়ি এবং সেই শোণিত-চিহ্নিত ভূমিতে পড়ে আছে দুটি বিকৃত, নিষ্পিষ্ট, ছিন্নভিন্ন মনুষ্যদেহ বিল আর মাততানি!

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রক্তের ঋণ রক্তেই শুধব

আত্তিলিও চিৎকার করে বমবোকে বললেন সে যেন এখনই শহর থেকে ডাক্তার, নার্স আর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে। জাটা নামক নিগ্রোটিকে তিনি বমবোর পথপ্রদর্শক হয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চটপট শহরে পৌঁছানোর পথ স্থানীয় মানুষের নখদর্পণে, তাই বমবোর সঙ্গে জাটাকে যেতে বলেছিলেন আত্তিলিও। তার মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই বিদ্যুদবেগে অন্তর্ধান করল বমবো আর জাটা। মূৰ্ছিতা ম্যরিয়াকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন আত্তিলিও প্রাণহীন জড় পদার্থের মতো…

অনেকক্ষণ পরে লোকজন নিয়ে হাজির হল বমবো। ম্যরিয়ার অচেতন দেহটাকে বমবো আর আত্তিলিও ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলে দিলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানালেন স্নায়ুর উপর অত্যধিক চাপ পড়ার ফলে মেয়েটি জ্ঞান হারিয়েছে, কিন্তু ভয়ের কারণ নেই–সে নিশ্চয়ই আরোগ্য লাভ করবে। ম্যরিয়াকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটল শহরের হাসপাতাল অভিমুখে।

এইবার ভালোভাবে অকুস্থল পর্যবেক্ষণ করলেন আত্তিলিও। হস্তীযুথের পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত মৃত্তিকার বুক শুষ্ক রক্তের অক্ষরে যে শোচনীয় কাহিনির বর্ণনা ফুটে উঠেছিল, সেটা অনভিজ্ঞের কাছে দুর্বোধ্য হলেও ঝানু শিকারির চোখে সেই চিহ্নগুলো ছিল ছাপানো বইয়ের অক্ষরের মতোই স্পষ্ট–অতএব অকুস্থল পরিদর্শন করার পর আর প্রকৃত ঘটনা আত্তিলিওর অজ্ঞাত রইল না।

শহর থেকে আগত ডাক্তারটির প্রশ্নের জবাবে আত্তিলিও বললেন, মানুষ আর হাতির পায়ের ছাপ দেখে সহজেই বুঝতে পারছি জন্তুটার মগজ লক্ষ করে বিল গুলি চালিয়েছিল। খুব সম্ভব চিৎকার করে যুথপতিকে প্ররোচিত করেছিল বিল। হাতিটা তাকে লক্ষ করে ছুটে আসতেই বিল গুলি ছুঁড়েছিল। মগজের যে-জায়গায় আঘাত লাগলে হাতির মৃত্যু অবধারিত, সেই দুর্বল স্থানটির উপরে ও নীচে অবস্থান করছে কঠিন হাড়ের দুর্ভেদ্য আবরণ। অপ্রত্যাশিতভাবে মস্তক সঞ্চালন করার ফলেই বোধ হয় হাতির মর্মস্থান থেকে একটু দূরে গুলি লেগেছিল এবং ক্রোধে ও যাতনায় ক্ষিপ্ত দানব এসে পড়েছিল বিলের দেহের উপর। এই ধরনেরই একটা ব্যাপার ঘটেছিল সন্দেহ নেই। বিল ছিল লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, নিতান্ত দুর্ভাগ্যবশত তার নিশানা ব্যর্থ হয়েছে।

অতঃপর আত্তিলিও ঘটনার যে বিশ্লেষণ করলেন তা হচ্ছে এই–

বিল দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর সুযোগ পায়নি। যূথপতিকে অর্থাৎ বিলের আততায়ীকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল মাতোনি। তার নিক্ষিপ্ত গুলিও ক্ষিপ্ত হস্তীর গতি রোধ করতে সমর্থ হয়নি। হাতিদের দলপতি যখন বিলের দেহের উপর ক্রোধ চরিতার্থ করছিল, তখন দৌড়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল মাততানি–দুঃখের বিষয় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ছুটে এসেছিল শরীরী ঝটিকার মতো ক্রুদ্ধ হস্তীযুঞ্চ এবং মাততানির দেহটাকে পিষে দলে আবার প্রবেশ করেছিল অরণ্যের গর্ভে। অকুস্থলের নিকটস্থ ভূমিতে একটি স্থানীয় মানুষের পদচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন আত্তিলিও। খুব সম্ভব ওই লোকটির কাছে খবর পেয়েই গ্রামবাসীরা সতর্ক হয়েছিল। পুলিশের ভয় তো ছিলই, কিন্তু পুলিশের চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর মত্ত মাতঙ্গের আক্রমণ আশঙ্কা করেই গ্রাম ছেড়ে বনের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছিল গ্রামের মানুষ।

আত্তিলিও যখন ওইভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করছিলেন তখন ডাক্তারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল ড্রাইভার বমবো। সে জানাল আত্তিলিওর অনুমান অভ্রান্ত। জাটা নামক পূর্বে উল্লিখিত যে লোকটি যাত্রীদের অকুস্থলে নিয়ে এসেছিল, সে নিজেই ছিল বিলের পথপ্রদর্শক। মাততানির সঙ্গে জাটার বন্ধুত্ব ছিল; মাতোনির পরিবর্তে তার বন্ধু জাটা বিলকে হাতিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল–দুর্ঘটনার স্থলে নিকটবর্তী ভূমিতে জাটার পায়ের ছাপই দেখেছেন আত্তিলিও। বমবো বেশ বুদ্ধিমান লোক, ওইসব দরকারি খবর সে এখানে এসে জোগাড় করে ফেলেছে কিছুক্ষণের মধ্যে।

আত্তিলিও সাহেবও একটি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন বিলের আততায়ীর একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি এখন সম্পূর্ণ সচেতন। আফ্রিকার হাতির সামনের দুটি পায়ে চারটি আঙুল, পিছনের পায়ে তিনটি–কিন্তু বিলের হত্যাকাণ্ডের জন্য যে খুনি হাতিটা দায়ী, সেই জন্তুটার সামনের বাঁ-পায়ে চারটির পরিবর্তে রয়েছে তিনটি আঙুল। অসংখ্য হাতির পদচিহ্নের ভিতর থেকে অপরাধীকে খুঁজে নিতে এখন আর অসুবিধা নেই শুধু তিন আঙুলের বৈশিষ্ট্য নয়, এমন গভীর ও বৃহৎ পদচিহ্ন আগে কখনো আত্তিলিওর চোখে পড়েনি। পায়ের ছাপ দেখেই আত্তিলিও বুঝতে পারলেন আফ্রিকার অতিকায় হস্তীকূলেও বিলের হত্যাকারীর মতো প্রকাণ্ড হস্তী নিতান্তই দুর্লভ। ।

শয়তান, আত্তিলিও সক্রোধে প্রতিজ্ঞা করলেন, তোমাকে আমি শেষ করব।

বিলের দলিত ও ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ হাসপাতালের গাড়িতে তুলে দিতে গেলেন আত্তিলিও। জিজ্ঞাসা করে ডাক্তার জানতে পারলেন আত্তিলিও এখন ওই হাতিটাকে অনুসরণ করবেন।

হ্যাঁ, জন্তুটা আমার বন্ধুকে হত্যা করেছে, আত্তিলিও বললেন, রক্তের ঋণ আমি রক্তেই শুধব। কিন্তু আপনি এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

গাড়িটাকে তাহলে আমি এখনই আবার পাঠিয়ে দেব, ডাক্তার বললেন, হয়তো আর একটা মৃতদেহকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হবে!

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অরণ্য-ভৈরব

বুধবার সকালে বিল এবং মাতোনির মৃতদেহ পেয়েছিলেন আত্তিলিও। সেদিনই অর্থাৎ বুধবারে, রাতের দিকে বমবো এসে জানাল জাটার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রাম এখনও জনমানবশূন্য। আত্তিলিওর দলভুক্ত অভিযাত্রীদের মধ্যে যে চারজন নিগ্রো ছিল, তারা সাগ্রহে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। কিন্তু আত্তিলিও তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলেন অভিযানের বিভিন্ন কাজে দক্ষ হলেও এই অরণ্য তাদের পরিচিত নয়, অতএব লোকগুলোর প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। বুঝেই তাদের নিবৃত্ত করা হল।

বৃহস্পতিবার সকালে আত্তিলিওর দলবল বায়রা ছেড়ে অন্যত্র যাত্রা করল। আত্তিলিও অবশ্য তখন তাদের সঙ্গ গ্রহণ করেননি, কথা হল পরে তিনি তাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। বিলের সৎকার-কার্যে তিনি উপস্থিত ছিলেন, মহা সমারোহের সঙ্গে তাকে কবর দেওয়া হল। হাসপাতালে গিয়ে ম্যরিয়ার সাক্ষাৎ লাভ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। চেষ্টা সফল হয়নি; চিকিৎসকরা জানালেন যদিও মেয়েটির অবস্থা খুব খারাপ নয়, তবু লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা এখন চলবে না। আত্তিলিও জেনে খুশি হলেন যে, ম্যরিয়ার গর্ভস্থ শিশু বেশ ভালোই আছে।

সমস্ত কর্তব্যের পালা চুকিয়ে আত্তিলিও চললেন হন্তারক হস্তীর সন্ধানে, সঙ্গে ড্রাইভার বমবো। হত্যাকাণ্ড যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সেখানকার মানুষ যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু এবার পুলিশের সাহায্যে গ্রামের সর্দারকে পাকড়াও করলেন আত্তিলিও। পুলিশ-অফিসার ঘোষণা করল সর্দার যদি আত্তিলিওকে হাতির সন্ধান পেতে সাহায্য না করে, তাহলে তাকে পদচ্যুত করে সেই জায়গায় অন্য সর্দারকে নিযুক্ত করা হবে।

তারপর এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে তাই হল। বিলের হত্যাকারী হস্তী এবং তার দলবল সম্বন্ধে সর্দারের ছিল অপরিসীম আতঙ্ক। আতঙ্ক অহেতুক নয়–পুলিশ যা-ই করুক, খুন করবে না; কিন্তু সাদা শিকারির গুলি যদি ফসকে যায় তাহলে উক্ত হস্তীবাহিনীর দলপতি হয়তো গ্রামের উপর হানা দিতে পারে এবং সে-রকম ঘটনা ঘটলে বহু মানুষ যে প্রাণ হারাবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অতএব সর্দার নানাভাবে আত্তিলিওকে ভুলপথে চালিত করতে সচেষ্ট হল।

কায়না নামক মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে গিয়ে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি বুঝেছিলেন, স্থানীয় মানুষ কেমন করে বিদেশিকে দিগভ্রান্ত করে দেয়। সর্দারের চালাকি খাটল না, কয়েকদিনের মধ্যেই আত্তিলিও পূর্বোক্ত হস্তী ও তার দলবলের সন্ধান পেয়ে গেলেন।

পায়ে-চলা বনপথের উত্তর দিকে অবস্থিত জলাভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আত্তিলিও সর্দারকে বললেন, কাল আমি ওইদিকে যাব। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। আমি জানি ওইখানেই আছে সেই শয়তান।

আচমকা মুখের উপর চড় মারলে মানুষের যে অবস্থা হয়, সর্দারের মুখের অবস্থাও হল সেইরকম। স্খলিতস্বরে সে বলল, সাদা মানুষ! তুমি মরবে। তমার আগে অনেক কালো আর সাদা শিকারি ওই জন্তুটাকে মারতে গিয়ে মরেছে। তুমিও তাদের মতো মরবে।

আত্তিলিও বুঝলেন তাঁর অনুমান যথার্থ। ওইখানেই আছে বিলের হত্যাকারী।

কাল আমরা যাচ্ছি, আত্তিলিও ঘোষণা করলেন। পুলিশ অফিসার ভয় দেখিয়ে যে-কথাটা বলেছিল, সেই কথাটাও তিনি সর্দারকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুললেন না।

অবশ্য পুলিশের কাছে সর্দারের সম্বন্ধে অভিযোগ করেননি আত্তিলিও। যতদূর জানা যায় আত্তিলিও সাহেবের বায়রা ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত উক্ত সর্দারকে সর্দারি করতে দেখা গেছে। ঘটনাটা অন্যরকম হতে পারত–কারণ, পরের দিন সকালে আত্তিলিও আর সর্দারকে দেখতে পাননি। এক রাতের মধ্যে সে এলাকা ছেড়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। মুখে যাই বলুন, মনে মনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেননি আত্তিলিও। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি?

সর্দারের অনুপস্থিতি শিকারীর সংকল্পে বাধা দিতে পারল না। বমবোকে সঙ্গে নিয়ে জলাভূমি পার হলেন আত্তিলিও। তিনি অনুমান করেছিলেন স্যাঁৎসেঁতে জলাভূমির পরেই শক্ত মাটির দেখা পাওয়া যাবে। অনুমানে ভুল হয়নি–জলার সীমানা শেষ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রস্তর-আবৃত কঠিন ভূমি, এখানে ওখানে ফাঁকা জায়গার উপর বিচ্ছিন্নভাবে মাথা তুলেছে সবুজ উদ্ভিদের সারি এবং ছোটো বড়ো পাথরের টুকরো। একটা উঁচু জায়গার উপর উঠে জলের কল্লোলধ্বনি শুনতে পেলেন আত্তিলিও। উচ্চভূমির পরেই একটা খাদ। বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে চলে গেছে সেই খাদ ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়। দু-পাশে খাড়া মাটির দেয়াল-বসানো ফঁকটা দশ ফুটের কম নয়। খাদের বিপরীত দিকে একটা ঝরনা দেখতে পেলেন আত্তিলিও। ওই ঝরনার শব্দই তিনি শুনেছেন একটু আগে।

শুকনো গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য ঝরনার কাছে গেলেন আত্তিলিও আর বমবো। খাদটাকে তারা ডিঙিয়ে যাননি, প্রায় বিশ ফুট খাড়াই ভেঙে ওঠানামা করে তারা ঝরনার কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

কিন্তু জলপান করতে গিয়ে তারা চমকে উঠলেন–আশেপাশে ভিজে জমির উপর ফুটে উঠেছে বহু হাতির পায়ের চিহ্ন! সেই পায়ের ছাপগুলোর ভিতর থেকে তিন আঙুলের প্রকাণ্ড পদচিহ্নটি আত্তিলিওর দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করল অতি সহজেই। একটু আগেও তার আচরণে সতর্কতার চিহ্নমাত্র ছিল না, চলার পথে বমবোর সঙ্গে তিনি মাঝে মাঝেই কথা বলছেন–এখন পায়ের ছাপগুলো দেখামাত্র তার মনে হল অতর্কিতে মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

সূর্যরশ্মি অত্যন্ত প্রখর; মেরুদণ্ডের উপর ঘর্মস্রোতের অস্বস্তিকর অনুভূতি। নিস্তব্ধ বনভূমির ভিতর থেকে ভয়ংকর শব্দের আভাস–সত্যিই কি শব্দ হয়েছে? না, মনের ভ্রম?… এতক্ষণ হাতির সাক্ষাৎ লাভ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও, এখন তার মনে হল এত তাড়াতাড়ি জন্তুটার সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হয়। শিকারির মন এখনও তৈরি হয়নি, আর একটু সময় পাওয়া দরকার…।

আত্তিলিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টিকে চালিত করলেন। পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া দরকার। অবস্থাটা তার ভালো লাগছে না–সামনে পশ্চিম দিকে বিরাজ করছে নিবিড় অরণ্য। উত্তর ও দক্ষিণে মুক্ত প্রান্তরের উপর টুকরো টুকরো পাথরের ভিড়, পূর্বদিকে অর্থাৎ তাঁদের পিছনে হাঁ করে আছে গভীর খাদ।

ওই দেখো, সভয়ে আঙুল তুলে দেখাল বমবো।

সচমকে নির্দিষ্ট দিকে ঘুরলেন আত্তিলিও। সশব্দে দুটি বৃক্ষকে ধরাশায়ী করে অরণ্যের অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে এক অতিকায় হস্তী! এক নজর তার দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও বুঝলেন এই জন্তুটাই বিলের হত্যাকারী। বহুদিন আফ্রিকায় বনেজঙ্গলে ঘুরেছেন আত্তিলিও, কিন্তু এমন প্রকাণ্ড হাতি কখনো তার চোখে পড়েনি।

সম্পূর্ণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আত্তিলিও আর বমবো। জন্তুটা ফাঁকা মাঠের উপর শিকারিদের থেকে প্রায় ২০০ ফুট দূরে অবস্থান করছিল। আত্তিলিও জানতেন হাতি দূরের জিনিস

ভালোভাবে দেখতে পায় না, অতএব এখনও তার নজরে পড়ার ভয় নেই।

কিন্তু হাওয়া? শিকারিদের দিক থেকে হাতির দিকেই ছুটে যাচ্ছে হাওয়া। অতিকায় জন্তুটা শুড় তুলে সন্দেহজনকভাবে বাতাস পরীক্ষা করছে এবং আশপাশ থেকে ভেসে-আসা শব্দের তরঙ্গ ধরার চেষ্টায় সবেগে দুলে দুলে উঠছে বিশাল দুটি কান–হাতির ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রখর। আত্তিলিও বুঝলেন তারা ফাঁদে পড়েছেন। দোষ তাঁর। বমবো অনভিজ্ঞ, সে শিকারি নয়–ড্রাইভার। তা ছাড়া বমবো যেখানকার অধিবাসী সেই অঞ্চলে হাতি নেই, উক্ত পশুটির স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে তাই সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে। আত্তিলিও যদি আর একটু সতর্ক হতেন তাহলে বিপদকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর শরীরী প্রতিচ্ছবি…

আত্তিলিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দানব আবার জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করতে উদ্যত হয়েছে। বিপদের মুখ থেকে উদ্ধার পেয়েছেন মনে করে আত্তিলিও যখন ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ শূন্যে শুড় তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াল অতিকায় হস্তী–আত্তিলিও বুঝলেন জন্তুটা তাঁদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে।

শিকারিদের বাঁ-দিক থেকে খুব ধীরে ধীরে ঢালু জমি বেয়ে আসতে লাগল হাতি, সঙ্গেসঙ্গে কান দুলিয়ে সন্দেহজনক শব্দ ধরার চেষ্টাও চলল।

আত্তিলিও রাইফেল তুললেন কাঁধে।

হাতি আরও এগিয়ে এল। চোখে না-দেখলেও ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে সে জেনে গেছে শিকারিরা কোথায় আছে।

দানবের চলার গতি বাড়ল। কমে আসতে লাগল দানব ও মানবের মধ্যবর্তী দূরত্ব।

নব্বই ফুট। আত্তিলিওর পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। আশি ফুট। সর্বাঙ্গে আতঙ্কের শিহরন, বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডের গতি বুঝি থেমে যেতে চায়–রাইফেলের নিশানা স্থির করলেন আত্তিলিও।

সত্তর ফুট। মাথার মাঝখানে দুই চোখের একটু উপরে একটা ক্ষতচিহ্ন। বিলের গুলি ওইখানে কামড় বসিয়ে দাগ করে দিয়েছে।

ষাট ফুট। বিল তো হাতির মর্মস্থানে গুলি চালিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার! হাতিটা এখনও বেঁচে আছে কী করে? ..

পঞ্চাশ ফুট। বিল যেখানে গুলি করেছে সেই জায়গাটা থেকে এক ইঞ্চি উপরে আমি গুলি চালাব। মনে মনে ভাবলেন আত্তিলিও।

চল্লিশ ফুট। প্রকাণ্ড দুই গজদন্ত উদ্যত জিঘাংসায় প্রসারিত। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকেই দাঁত দুটো শিকারিদের দেহে বিদ্ধ হবে।

ত্রিশ ফুট। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলের ছাপ। কর্কশ শব্দ, আগুনের ঝলক। তীব্র তীক্ষ্ণ বৃংহণ-ধ্বনি। হাতি থমকে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু রাইফেলের বুলেট তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারেনি।

পালাও, বাওয়ানা!

আবার জাগল গজকণ্ঠে ভয়ংকর ধ্বনি। শব্দ এগিয়ে আসছে। আত্তিলিও পিছন ফিরে পলায়মান বমবোকে অনুসরণ করলেন। বমবো এক লাফে খাদ পার হয়ে গেল। মুহূর্তের দ্বিধা দশ ফুট ফাঁকটা কি পার হওয়া যাবে? পরক্ষণেই এক প্রচণ্ড লক্ষ্যে শূন্যপথ অতিক্রম করে খাদের বিপরীত পার্শ্বে এসে পড়লেন আত্তিলিও।

ছুট! ছুট! ছুট! সামনে বমবো, পিছনে আত্তিলিও! সুদীর্ঘ শুণ্ড আর প্রকাণ্ড দুই গজদন্তের মারাত্মক স্পর্শের আশঙ্কায় পলাতকদের সর্বাঙ্গে আতঙ্কের শিহরন–যেকোনো মুহূর্তে ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে ক্রোধোন্মত্ত হস্তী।

হঠাৎ একবার পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল বমবো এবং হোঁচট খেয়ে পড়ল মাটির উপর। সে একবার ওঠার চেষ্টা করেই নিশ্চল হয়ে গেল, আত্তিলিও দেখলেন তার ভয়ার্ত চক্ষু তারকার নির্নিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে তাঁরই পিছন দিকে!

বমবোর স্তম্ভিত দৃষ্টির হেতু নির্ণয় করার জন্যে আত্তিলিও একবারও পিছন পানে চাইলেন না, তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ওঠ! ওঠ!

বমবো উঠল না।

ওঠ–

ক্রুদ্ধ হস্তীর তীব্র বৃংহণ ভেসে এল পিছন থেকে, আত্তিলিওর মনে হল তার কানের পর্দা বুঝি ফেটে গেল।

এবার আর পিছন ফিরে না-তাকিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি, সঙ্গেসঙ্গে তাঁর অবস্থাও হল বমবোর মতো–সম্মোহিত মানুষের স্তম্ভিত দৃষ্টি মেলে তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন এক ভয়ংকর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য!

নিদারুণ ক্রোধে সংহার-মূর্তি ধারণ করেছে ক্ষিপ্ত গজরাজ, কিন্তু সে এখনও অবস্থান করছে। খাদের বিপরীত পার্শ্বে! বাধাটাকে ডিঙিয়ে আসার চেষ্টা না-করে খাদ পার হওয়ার কোনো সেতুপথ আছে কি না সেইটাই এখন তার অনুসন্ধানের বিষয়। পারাপারের পথ আবিষ্কার করতে

-পেরে নিষ্ফল আক্রোশে গাছগুলোকে সে সবেগে উৎপাটিত করে নিক্ষেপ করছে ভূমিপৃষ্ঠে, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র কর্ণভেদী বৃংহণ শব্দে কঁপছে আকাশবাতাস!

আচম্বিতে অরণ্যের অন্তঃপুর থেকে ভেসে এল বহু হস্তীর কণ্ঠ-নিঃসৃত ভয়ংকর ধ্বনি, দলপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে আসছে দানবের দল! কিছুক্ষণ পরেই তাদের দেখা পাওয়া গেল। ঢালু জমির উপর দিয়ে দলপতিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল ধূসরবর্ণ চলন্ত পর্বতের সারি–আত্তিলিও গুনে দেখলেন সেই ভয়ংকর বাহিনীতে অবস্থান করছে দু-দু-শো বন্য হস্তী।

ব্যাপারটা শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয় বটে, কিন্তু ক্রোধোন্মত্ত হস্তীযুথের সামনে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাদের সংখ্যা গণনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও। নিষ্ফল ক্রোধে চিৎকার করে আকাশ ফাটালেও হাতিদের মধ্যে কেউ খাদ ডিঙিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতে রাজি নয়!

আত্তিলিওর মনে পড়ল খুব ছোটোবেলায় একটা বইতে তিনি পড়েছিলেন–প্রতি পদক্ষেপে খুব বেশি হলে সাড়ে ছয় ফুট জায়গা অতিক্রম করতে পারে হাতি; একটা সাত ফুট চওড়া খাদ পার হওয়ার ক্ষমতা তার নেই।

কেতাবি তথ্য নিয়ে আর মাথা ঘামাননি তিনি। কিন্তু কথাটা যে সত্যি সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে খাদটাকে দুটো তুচ্ছ মানুষ লাফিয়ে পার হয়ে গেছে, সেই খাদটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমিত বলশালী হস্তীযুথের সামনে! হাতি লাফাতে পারে না এবং সাড়ে ছয় ফুটের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে পা ফেলার ক্ষমতাও তার নেই–অতএব দশ ফুট চওড়া খাদের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আত্তিলিও নিজেকে বেশ নিরাপদ মনে করলেন।

কিন্তু এই নিরাপত্তা যে নিতান্ত সাময়িক সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল বমবো।

আত্তিলিও যখন হাতিদের সংখ্যা নির্ণয় করতে ব্যস্ত, বমবো তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল, গুলি চালাও বাওয়ানা, গুলি চালাও।

মাঝখানে খাদের বাধা থাকায় হাতির পক্ষে গুলি খেয়ে প্রতি-আক্রমণ চালানোর সুযোগ ছিল না। ভালো শিকারি সর্বদাই শিকারকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিতে চায়, তাই একতরফা সুবিধা নিয়ে গুলি চালাতে অনিচ্ছুক ছিলেন আত্তিলিও–কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য তিনি রাইফেল তুলতে বাধ্য হলেন। বিশালকায় যূথপত দাঁতের আঘাতে মাটি আর পাথর তুলে ফেলছে খাদের গর্তে, সঙ্গীরাও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে একাগ্রচিত্তে যেকোনো সময়ে মাটি ও পাথরে ভরাট হয়ে খাদের উপর হাতিদের পারাপার করার উপযোগী একটা সেতু গড়ে উঠতে পারে এবং সে-রকম কিছু ঘটলে গোটা দলটাই যে ওই পথে খাদ পার হয়ে মানুষ দুটিকে আক্রমণ করতে ছুটে আসবে, সে-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখাতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি হলেন না আত্তিলিও, রাইফেল তুলে সর্দার-হাতির মাথার উপর তিনি লক্ষ্য স্থির করতে লাগলেন। বিলের গুলিতে চিহ্নিত ক্ষতস্থানের একটু উপরেই আত্তিলিওর নিক্ষিপ্ত প্রথম গুলির দাগ; ওই দাগের একটু উপরে বিধল রাইফেলের দ্বিতীয় বুলেট। হাতি একটুও কাবু হল না, আঘাতের যাতনায় সে আরও কেঁপে গেল এবং দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁত বসিয়ে মাটি তুলে ফেলতে লাগল খাদের মধ্যে। আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন–এ কেমন হাতি? মাথার উপর দুর্বলতম স্থানে ভারী রাইফেলের গুলি অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এমন হাতির কথা তিনি কখনো শোনেননি। মাথা ছেড়ে তিনি নিশানা করলেন কর্ণমূলে।

গর্জে উঠল রাইফেল। হাঁটু পেতে বসে পড়ল মত্ত মাতঙ্গ। উপবিষ্ট অবস্থায় তার দেহটা একবার দুলে উঠল, তারপর প্রচণ্ড শব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির উপর–সব শেষ!

যূথপতির মৃত্যু দেখে থমকে গেল হাতির দল। শূন্যে কয়েকবার রাইফেলের আওয়াজ করলেন আত্তিলিও। হস্তীযূথ এইবার শঙ্কিত হল। প্রথমে রণে ভঙ্গ দিল শাবকসহ হস্তিনীর দল, তারপর তাদের অনুসরণ করে বনের মধ্যে অদৃশ্য হল সমগ্র বাহিনী। অকুস্থলে পড়ে রইল কেবল যূথপতির প্রকাণ্ড প্রাণহীন দেহ। বিল, মাততানি এবং আরও অনেক শিকারি ও স্থানীয় মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী খুনি জানোয়ারটা শেষ পর্যন্ত আত্তিলিওর রাইফেলের গুলিতে ইহলীলা সংবরণ করল।

নিহত হস্তীর মস্তক পরীক্ষা করে একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া গেল। রাইফেলের তিনটি বুলেটই হাতির মাথায় লেগে চূর্ণবিচূর্ণ–ভাঙাচোরা বুলেটের ত্র্যহস্পর্শে চিহ্নিত ওই করোটিকে পাঠানে হয়েছিল জাদুঘরে; পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল হাতির মগজের উপর যেখানে মর্মস্থলের অবস্থান, সেই নির্দিষ্ট স্থান থেকে পাক্কা সাড়ে নয় ইঞ্চি উপরে রয়েছে এই সৃষ্টিছাড়া জন্তুটার মর্মস্থান! তামাম দুনিয়ার হাতিদের মধ্যে এমন বিকৃত মস্তিষ্ক-র উদাহরণ কোথাও পাওয়া যায়নি। মস্তিষ্কের ওই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের জন্যই শিকারিদের নিক্ষিপ্ত গুলির পর গুলি ব্যর্থ হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে হতভাগ্য বিল এবং খাদটা না-থাকলে বমবো আর আত্তিলিওর অবস্থাও যে বিলের মতোই হত সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – বিদায় আফ্রিকা ১৯৩৯

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কামান-গর্জন যখন শুরু হল, আত্তিলিও তখন আফ্রিকার এক দুর্গম অঞ্চলে বিভিন্ন গবেষণায় ব্যস্ত। আফ্রিকা ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না, কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল বলে তিনি আমেরিকাতে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। আফ্রিকা থেকে বিদায় নেবার আগে তিনি দ্বিতীয়বার কিভুর অরণ্যে প্রবেশ করে একটি মস্ত বড়ো গরিলা শিকার করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির জন্য প্রিটোরিয়া মিউজিয়াম অব সাউথ আফ্রিকা।

তবে মোয়ামি ন্‌গাগি নামে যে-জন্তুটাকে তিনি আগে মেরেছিলেন, সেটার সঙ্গে অন্য গরিলার তুলনা হয় না। উক্ত মোয়ামি ন্‌গাগি হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম গরিলা–অন্তত এখন পর্যন্ত অত বড়ো গরিলা কেউ শিকার করতে পারেনি।

কিবালির নিম্নভূমিতে অবস্থিত বনে-জঙ্গলে হানা দিয়ে ওকাপি নামক দুষ্প্রাপ্য পশুকে বন্দি করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও। একটি নয় দুটি নয়–পাঁচ-পাঁচটি ওকাপিকে তিনি ধরেছিলেন। এক ধরনের অদ্ভুত জিরাফের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও। জন্তুগুলোর নাম দিয়েছিলেন অকোয়াপিয়া কিবালেনসিস।

ওইসব বিচিত্র তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ করার জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আত্তিলিও ভ্রমণ করেছেন। ক্রিস্টাল পর্বতমালার অরণ্যে, লুয়ালালাবা ও কাসাই নদীর তটভূমিতে অ্যালবার্ট, এডওয়ার্ড, টাঙ্গানিকা প্রভৃতি হ্রদের তীর থেকে তীরে–সর্বত্র অশ্রান্ত পদক্ষেপে ঘুরেছেন আত্তিলিও, রহস্যময়ী আফ্রিকার বুকের ভিতর থেকে গোপন সম্পদ উদ্ধার করে নিয়ে আসতে চেয়েছেন লোকচক্ষুর গোচরে…

উনচল্লিশ জাতের পশুপক্ষী, সরীসৃপ এবং ছেষট্টি রকমের কীটপতঙ্গ ও দু-শো অজ্ঞাত উদ্ভিদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও।

আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়ার সময়ে তিনি বলেছিলেন, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয় তাহলে আবার আমি ফিরে আসব আফ্রিকাতে, আবার এখানে শুরু করব গবেষণা আর অনুসন্ধানকার্য। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৮০

Exit mobile version