Site icon BnBoi.Com

আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর

আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু

ভূমিকা

কিশোর আলোতে প্রথমে “টুনটুনি ও ছোটাচ্চু” নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। বছর শেষে সেগুলো দিয়ে একটি বই লেখা হলো। আমি ভাবলাম, আমার কাজ শেষ-আর লিখতে হবে না কিন্তু আমার বাচ্চাকাচ্চা পাঠকেরা টুনটুনি এবং ছোটাচ্চুর গল্পের জন্যে এমন চাপ দিতে থাকলো যে, আমি আবার কিছু গল্প লিখলাম। বছর শেষে আবার একটা বই বের হলো, সেই বইয়ের নাম দিলাম “আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু” তখন ভাবলাম, এবারে সত্যি সত্যি লেখা শেষ–আর লিখতে হবে না! বাচ্চারা কিন্তু চাপ থামাল না, চাপ দিতেই থাকল, তখন বাধ্য হয়ে আবার লিখতে থাকলাম–সবাই যেন পড়তে পারে সে জন্যে এগুলো লিখেছি আমার ওয়েব সাইট www.mzi.rocks এ! বছর শেষে আবার বইটা বের হলো, এবারে নাম দিয়েছি “আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু” আশা করছি এবারে সত্যি সত্যি টুনটুনি ও ছোটাচ্চুকে নিয়ে লেখা শেষ!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৩.০১.২০১৭

.

একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর

বড় চাচা এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আজকের পেপারটা কই?”

বড় চাচার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না, কেউ উত্তর দিবে বড় চাচা সেটা অবশ্যি আশাও করেননি। বড় চাচা নরম টাইপের মানুষ, হাসি-খুশি থাকেন, গলা উঁচিয়ে কথা বলেন না, চিৎকার করেন না, তাই কেউ তার কথার উত্তর দেয় না! বড় চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “দেখেছিস কেউ?”

বাচ্চারা মেঝেতে উবু হয়ে কী একটা খেলা খেলছিল, দেখে খুবই নিরীহ খেলা মনে হলেও হঠাৎ হঠাৎ সবাই মিলে মারামারি শুরু করে, দেখে মনে হয় পারলে বুঝি একজন আরেকজনের চোখ তুলে নেবে। তারপর আবার শান্ত হয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা গুনতে থাকে। তারপর আবার মারামারি শুরু করে। ভয়ঙ্কর একটা মারামারি শেষ করে একজন বড় চাচার প্রশ্নের। উত্তর দিল, বলল, “না বড় মামা।”

বড় চাচাকে সবাই বড় চাচা বলে না, অনেকে বড় মামা বলে। কেউ কেউ বড় ফুপা ডাকে। তার মানে এই নয় যে সবাই সম্পর্ক ঠিক করে ডাকাডাকি করে–এই বাসায় যার যাকে যা ইচ্ছা সেটা ডাকে। বড় চাচার ছোট মেয়েটা তাকে মাঝে মাঝে বড় আব্বু ডেকে ফেলে।

বড় চাচা বললেন, “এই শান্ত, তোকে বলেছি না সকালবেলা পেপারটা তুলে এনে ভিতরে রাখবি?”

শান্ত সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা হিসাব করতে করতে বলল, “বলেছ।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

“তাহলে তুলে আনিস না কেন?”

“পেপার না দিলে আমি কোত্থেকে তুলে আনব? কালকেও পেপার দেয় নাই, আজকেও দেয় নাই।”

বড় চাচা একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী বলছিস? পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না?”

কোনো একজন উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু বাচ্চারা আবার হুটোপুটি করে মারামারি শুরু করে দিল। অন্য কারো বাসা হলে এই মারামারি বন্ধ করার চেষ্টা করত, কিন্তু এই বাসায় কেউ চেষ্টা করে না, মারামারি শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করে। মারামারি শেষ হলো, তখন। একজন বলল, “না বড় মামা, পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না।”

বড় চাচা বললেন, “কী আশ্চর্য! পেপার দিবে না কেন?”

শান্ত বলল, “বড় চাচা, তুমি এ রকম পুরানা মডেলের মানুষ কেন?”

বড় চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “পুরানা মডেল? আমি?”

“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”

বাচ্চারা সবাই খেলা বন্ধ করে বড় চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বড় চাচা (কিংবা বড় মামা কিংবা বড় ফুপা কিংবা বড় আব্বু) তুমি খুবই পুরানা মডেল।”

“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”

“কেন আমি পুরানা মডেল?”

সবাই কিছু-না-কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শান্ত তার অভ্যাসমতো দাবড়ানি দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “কারণ তুমি এখনও কাগজের পত্রিকা পড়ো। পৃথিবীতে কেউ কাগজের পত্রিকা পড়ে না। সবাই ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ে।”

বড় চাচা মাথা চুলকালেন। সবাই তখন কথা বলতে শুরু করল। একজন বলল, “পত্রিকা পড়তে হবে কেন? টেলিভিশনের সামনে বসে থাকলেই সব খবর পেয়ে যাবে। বিজ্ঞাপন দেখবে, নিচে স্ক্রল করা খবর।”

আরেকজন বলল, “আসলে পড়তেও হয় না। বসে থাকলেই হয়। তুমি সব খবর শুনতে পাবে। দেখতেও পাবে।”

আরেকজন বলল, “ফেসবুক আরো ভালো। তোমার কাছে খবর আসতে থাকবে আর তুমি লাইক দিতে থাকবে।”

আরেকজন বলল, “যে খবর পত্রিকায় ছাপাতে সাহস পায় না সেই খবরও ফেসবুকে পাওয়া যায়। মনে নাই সেই দিন আমরা দেখলাম, কী ভয়ঙ্কর”

অন্যেরা তখন তাকে থামিয়ে দিল, তারা সবাই মিলে যে ভয়ঙ্কর ভিডিওটা দেখছে সেটা বড়দের জানার কথা নয়। একজন বলল, “বড় চাচা কিছু একটা পড়ে তোমার যদি পছন্দ না হয় ফেসবুকে তুমি যা ইচ্ছা বলে গালি দিতে পারবে।”

আরেকজন বলল, “মনে নাই সেই দিন শান্ত ভাইয়া কীভাবে একজনকে গালি দিল?”

শান্ত তার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “চোপ।”

বড় চাচা তাদের সব কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। কেমন যেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কিন্তু আমি খবরের কাগজ পড়তে চাই। নতুন একটা কাগজের ভাজ খুলে সেটার দিকে তাকাতে আমার কাছে ভালো লাগে। নতুন খবরের কাগজের একটা অন্য রকম গন্ধ আছে।”

বাচ্চারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, শান্ত নাক কুঁচকে বলল, “গন্ধ?”

বড় চাচার ছোট মেয়ে শিউলি ফিসফিস করে বলল, “আব্বুর মনে হয় ব্লাড প্রেশার হয়েছে।”

অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, ব্লাড প্রেশার। নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশার।”

শান্ত বলল, “এই জন্যে বড় চাচার মাথা আউলে গেছে।”

বড় চাচার মাথা আউলে যাওয়া নিয়ে কাউকে অবশ্যি খুব ব্যস্ত হতে দেখা গেল না। তারা আবার খেলায় ফিরে গেল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ গোনাগুনি তারপর হঠাৎ হুটোপুটি, চিৎকার, মারামারি।

কিছুক্ষণ পর টুনিকে বড় চাচার কাছে দেখা গেল। বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো, তোদের মারামারি শেষ? সবাই ঠিক আছে তো?”

“এটা মারামারি না বড় চাচা। এটা একটা বোতাম নিয়ে খেলা। যে বোতামটা পায় সে সেটা ধরে রাখতে চায়, অন্যেরা সেটা কেড়ে নেয়। সেইটাই খেলা।”

বড় চাচা বললেন, “ও।” তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এখন বোতামটা কার কাছে আছে?”

“লিটুর কাছে ছিল, লুকিয়ে রাখার জন্যে গাধাটা মুখের ভিতরে রেখেছে। যখন কাড়াকাড়ি শুরু হলো তখন কোঁৎ করে গিলে ফেলেছে।”

বড় চাচা আঁতকে উঠে বললেন, “গিলে ফেলেছে? সর্বনাশ! এখন?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এখন কিছু না। গাধাটা এর আগে আরেকবার যখন একটা এক টাকার কয়েন গিলে ফেলেছিল, তখন ডাক্তারের কাছে নিয়েছিল, ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নাই। বাথরুমের সাথে বের হয়ে আসবে।”

“বের হয়েছিল?”

“শান্ত ভাই বলেছে বের হয়েছে।”

“শান্ত কেমন করে জানে?”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “টাকা-পয়সার ব্যাপার শান্ত ভাইয়া সবচেয়ে ভালো জানে।”

বড় চাচা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, টুনি বলল, “এই বোতামটা অনেক ছোট। লিটু গাধাটা হজম করে ফেলবে।”

“ডাক্তারের কাছে নিতে হলে বলিস।”

“বলব বড় চাচা।”

কথা শেষ করেও টুনি চলে গেল না, তখন বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কিছু বলবি?”

টুনি মাথা নাড়ল, তখন বড় চাচা বলল, “বলে ফেল।”

“তুমি পেপারওয়ালাকে ফোন করে একটু খোঁজ নিবে সে আসলেই বাসায় পত্রিকা দিচ্ছে কি না।”

বড় চাচার কাছে টেলিফোন নম্বর ছিল, ফোন করে জানা গেল পেপারওয়ালা নিয়ম করে প্রত্যেক দিন খুব ভোরে পেপার দিয়ে যাচ্ছে। টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “বড় চাচা, শান্ত ভাইয়াকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে লাভ নাই। শান্ত ভাইয়ার মতো ফাঁকিবাজ মানুষ একজনও নাই। কাল থেকে আমি তোমার পেপার তুলে আনব।”

বড় চাচা বললেন, “তুই?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

বড় চাচা পুরান মডেলের মানুষ, টেলিভিশন না দেখে কিংবা কম্পিউটারে ডাউনলোড না করে সত্যিকারের পেপার পড়েন বলে টুনি মনে মনে বড় চাচাকে পছন্দ করে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। নতুন পেপার খুলে তার ভেতর অন্য রকম একটা গন্ধ পাওয়াটাও তার কাছে মজার মনে হয়। কিন্তু এগুলো তো আর বলা যায় না, তাই সে এসব কিছুই বলল না, এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে যা কিছু হতে পারে। এইভাবে কোনো কিছু না বলে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাঝে টুনি এক্সপার্ট।

পরদিন ভোরে বাসার সামনে সিঁড়ি থেকে পেপারটা আনতে গিয়ে টুনি আবিষ্কার করল সেখানে কিছু নেই। হয় পেপারওয়ালা পেপার দেয় নাই, তা না-হলে সে দেওয়ার পর কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। পেপারওয়ালাকে ফোন করার পর সে কসম কেটে বলল যে সে পেপারটা দিয়ে গেছে।

কাজেই পরের দিন টুনি ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল। এলার্ম শুনে ঘুম থেকে উঠে জানালার কাছে বসে রইল। সে ঠিকই দেখল পেপারওয়ালা তার সাইকেলের পিছনে বোঝাই করে পেপার নিয়ে তাদের বাসার সামনে থেমেছে। সাইকেলটা থামিয়ে একটা পেপার নিয়ে তাদের সিঁড়িতে রেখে আবার সাইকেলে উঠে চলে গেল। টুনি তখন ঘুম ঘুম চোখে নিচে গিয়ে দরজা খুলে পেপারটা নিতে গিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই! পেপারটা এর মাঝে কেউ একজন নিয়ে গেছে। মুহূর্তে টুনির ঘুম ছুটে গেল–সে ডানে বামে তাকাল, কোথাও কোনো মানুষ নেই। কী আশ্চর্য! কে নিয়েছে পেপারটা?

রাত্রিবেলা বসার ঘরে দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল দেখছেন, সেখানে খুব সুন্দরী দুইজন মহিলা নানা রকম শাড়ি-গয়না পরে চিৎকার করে ঝগড়া করতে করতে একজন আরেকজনের চুল ধরে টানাটানি করছে। ঝুমুখালা দাদির (কিংবা নানির) পায়ে রসুন ভাজা এক ধরনের তেল মাখিয়ে দিতে দিতে টেলিভিশনের দৃশ্যটা দেখে আনন্দে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। বড় চাচা খুবই বিরস মুখে একটা পুরানো ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। বাচ্চারা চামচ টানাটানি করে কী একটা খেলা খেলছে তখন টুনি বসার ঘরে হাজির হলো। সে বড় চাচার কাছে গিয়ে বলল, “বড় চাচা, কোনো একজন চোর প্রত্যেক দিন সকালে তোমার পেপার চুরি করে নিয়ে যায়।”

টুনি সবাইকে শুনিয়ে কথাটা বলতে চায়নি কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি সবাই কথাটা শুনে ফেলল এবং সবাই ঘুরে টুনির দিকে তাকাল। শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “কী বললি? আমাদের বাসা থেকে চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়? এত বড় সাহস? আমি যদি চোর ব্যাটাকে খুন না করে ফেলি।”

ঝুমু খালা বলল, “কাল সকালেই আমি ঝাড় দিয়া পিটায়া খাটাশের বাচ্চা খাটাশকে সিধা করে ফেলব।”

যে সবচেয়ে ছোট সে বলল, “ধরে সোজা ক্রসফায়ার।”

আরেকজন বলল, “ধরে গণপিটুনি। সোজা গণপিটুনি।”

শুধু দাদি বললেন, “আহা বেচারা গরিব মানুষ। একটা পেপার চুরি করে আর কত পয়সাই বা পায়! নিতে চায় নিয়ে যাক!”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “দাদি তুমি কী বললে? চোর চুরি করতে চাইলে চুরি করবে? বাসার দরজা খোলা রেখে সাইনবোর্ড লাগাব, চোর ভাইয়েরা, আসেন! চুরি করেন!”

শান্তর কথা শুনে বেশ কয়েকজন খুব আনন্দ পেল; তারা হা হা হি হি করে হাসতে লাগল। শান্ত রেগেমেগে বলল, “তোরা কি ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি?”

দাদি বললেন, “তোদের হয়েছেটা কী? একটা পেপার নিয়ে এত হইচই? এমন তো না যে কোহিনুর হীরা চুরি গেছে।”

ছোটদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী শাহানা বলল, “কোহিনুর হীরা চুরি গেলে কিছু করার থাকে না দাদি। ব্রিটিশেরা কোহিনুর হীরা চুরি করে নিয়ে গেছে না?”

প্রায় সবাই চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই নাকি? কখন? কীভাবে? কোথায়? পুলিশ ধরে নাই?”

শাহানা বিরক্ত হয়ে বলল, “বহু দিন আগে। ব্রিটিশ আমলে, নিয়ে তাদের মিউজিয়ামে রেখে দিয়েছে।”

“তাই বল।”

একসাথে সবাই কোহিনুর হীরা চুরি নিয়ে কৌতূহল হারিয়ে ফেলল। সবাই আবার পেপার চুরিতে ফিরে এলো। শান্ত মুখ সুচালো করে বলল, “কীভাবে চোরটাকে ধরা যায় বল দেখি।”

দাদি বলল, “চোর ধরতে হবে না। একটা চিঠি লিখে টানিয়ে রেখে দে।”

“চিঠি?”

“হ্যাঁ।”

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “চিঠিতে কী লিখব?”

“মানুষটাকে অনুরোধ করবি, পেপার চুরি না করার জন্যে। লিখবি Iাকার দরকার থাকলে বলতে, দশ-বিশ টাকা দিয়ে দেব।” কথা শেষ করে দাদি ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই না ঝুমু?”

দাদি যেটাই বলে ঝুমু খালা সেইটা সব সময় মেনে নেয়। একটু আগে ঝুমু খালা চোরকে ঝাড়পেটা করতে চেয়েছিল এখন দাদির সাথে সুর মিলিয়ে বলল, “আহা! গরিব মানুষ। টাকার কষ্ট অনেক বড় কষ্ট। ভালো করে মায়া করে একটা চিঠি লিখলেই আর চুরি করবে না।”

বসার ঘরে যারা ছিল তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ বলল, চিঠি লিখলে সেই চিঠি পড়ে চোর আর পেপার চুরি করবে না। অন্য ভাগ বলল, চিঠি লিখে কিছুতেই চোরকে পেপার চুরি বন্ধ করানো যাবে না। চোর চোরই থেকে যাবে।

এই বাসায় সবাই অবশ্যি সবসময় দাদির (কিংবা নানির) সব কথা শুনে, তাই এইবারও দাদির কথা শোনা হলো। একটা কাগজ এনে সেখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা হলো :

প্রিয় পেপার চোর মহোদয়।

আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহণ করিবেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখ এবং বেদনার সহিত লক্ষ করিতেছি যে, গত কিছুদিন যাবৎ আপনি নিয়মিতভাবে আমাদের পেপার চুরি করিতেছেন। অনুগ্রহ করিয়া পেপার চুরি বন্ধ করিবেন, কারণ আমাদের অনেকেই শুধু যে পেপার পড়িতে না পারিয়া দেশ, সমাজ এবং জাতি সম্পর্কে তথ্য হইতে বঞ্চিত হইতেছে তাহা নহে, পেপার না পড়িতে পারিয়া মানসিকভাবে ভাঙিয়াও পড়িতেছে।

উল্লেখ্য যে, যদি আপনি কোনো প্রকার অর্থকষ্টের কারণে এই কার্য করিতে বাধ্য হইয়া থাকেন তাহা হইলে আপনি আমাদের সহিত যোগাযোগ করুন। আমরা আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত।

বিনীত

এই বাসার সকল সদস্যবৃন্দ।

শান্ত এই চিঠিটা নিচে দরজার উপর লাগিয়ে দিতে নিয়ে গেল। চিঠিটা লাগানোর আগে সে নিচে আরো একটা লাইন যোগ করল। লাইনটি এ রকম :

বিশেষ দ্রষ্টব্য : বান্দরের বাচ্চা বান্দর, তোরে যদি ধরতে পারি পিটিয়ে তোর ঠ্যাঙ ভেঙে দিব। খোদার

কসম! পেপার চুরি বন্ধ করার এই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে অবশ্যি ছোটাচ্চু সেদিন কিছুই জানতে পারল না। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাজের চাপ অনেক বেশি, মাঝে মাঝেই তার বাসায় আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। আজকেও তাই হয়েছে।

ছোটাচ্চু ঘটনাটা জানতে পারল পরের দিন, যখন চিঠিটা টানিয়ে দেবার পরও পেপার চোর পরের দিনের পত্রিকাটাও চুরি করে নিয়ে গেল!

বসার ঘরে তখন দাদি (কিংবা নানি) ঝুমু খালাকে নিয়ে সিরিয়াল দেখছেন। সেখানে সাজুগুজু করে থাকা একজন পুরুষ মানুষ সাজুগুজু করে থাকা আরেকজন মহিলাকে নাকি গলায় কিছু একটা বলছে, যেটা শুনে ঝুমু খালার চোখ ছলছল করছে। বড় চাচা (কিংবা বড় মামা) অন্যমনস্কভাবে একটা বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। চাচি, খালা, মামা এবং অন্যেরা চা খাচ্ছেন কিংবা নিজেদের মাঝে রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন। বাচ্চারা তাদের লেখাপড়া, হোমওয়ার্ক শেষ করে (কিংবা শেষ না করেই) বসার ঘরের মেঝেতে শুয়ে-বসে একজন আরেকজনকে জ্বালাতন করছে।

এই সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটা বড় কেক আর সেটা দেখে বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “আজুকে ড্রাগ বাস্টিং কেসের বিল পেয়েছি, তাই ভাবলাম সবাই মিলে খাওয়ার জন্যে একটা কেক নিয়ে আসি।”

শান্ত বলল, “শুধু কেক?”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আর কী চাস?”

শান্ত বলল, “আমাদেরকে চায়নিজ খেতে নিয়ে যাও।”

আরেকজন বলল, “ধুর, চায়নিজ খেয়ে মজা নাই। পিঞ্জা খেতে নিয়ে যাও।”

আরেকজন বলল, “দুইটাই খাওয়া যায়।”

আরেকজন বলল, “তারপর আইসক্রিম–”

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলতে থাকত কিন্তু তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি জানো আমাদের বাসা থেকে প্রত্যেক দিন পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে?”

ছোটাচ্চু হাসতে হাসতে বলল, “তাই নাকি?” তারপর তার অফিসে কী হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকল। মনে হলো পেপার চুরির ঘটনাটা বুঝি কোনো ঘটনাই না!

টুনি ঠান্ডা গলায় বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি?”

ছোটাচ্চু বলল, “শুনেছি। বাসা থেকে পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

টুনি বলল, “তাহলে সেটা নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা হচ্ছে না?”

ছোটাচ্চু হা হা করে হাসল, বলল, “গত মাসে আমি হীরার নেকলেস চুরির একটা কেস ভ করেছিলাম মনে আছে?”

টুনি মাথা নাড়ল, মনে না রেখে উপায় নাই, ছোটাচ্চু সেটাতে হাজার রকম রং-চং লাগিয়ে গল্প করেছে। ছোটাচ্চু বলল, “আমি হীরার নেকলেস চুরির কেস সল্ভ করি, পেপার চুরি শুনে লাফানো কি আমাকে মানাবে বল?”

টুনি কোনো কথা বলল না। ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না?”

“কী বললি?”

“দাদি ভেবেছিল চোরের কাছে চিঠি লিখলে চোর আর চুরি করবে না। তাই না দাদি?”

ছোটাচ্চু প্রথমে চোখ কপালে তুলল তারপর পেটে হাত দিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, তুমি তাই ভেবেছ? চোরকে চিঠি লিখলে চোর সেই চিঠি পড়ে ভালো হয়ে যাবে!” তারপর আবার হা হা করে হাসতে লাগল।

দাদি বললেন, “আমার মনে হয় চিঠির ভাষাটা একটু কঠিন হয়ে গেছে, আরেকটু সহজ ভাষায় লেখা উচিত ছিল।”

শান্ত যে চিঠির শেষে খুব সহজ ভাষায় আরেকটা লাইন লিখে দিয়েছিল, তারপরও যে কোনো কাজ হয় নাই সেটা সে আর কাউকে বলল না।

হাসতে হাসতে ছোটাচ্চুর চোখে পানি এসে গেল, তখন টুনি বলল, “তুমি এ রকম বোকার মতো হাসছ কেন ছোটাচ্চু? দাদি তো তবু চুরি থামানোর চেষ্টা করেছে। তুমি তো কিছুই করছ না!”

ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি আল্টিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সি.ই.ও. দেশের প্রথম রেজিস্টার্ড প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি, আমি ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের ধরি, আর তুই ভাবছিস আমি একটা ছিচকে পেপার চোরকে ধরতে পারব না?”

“তাহলে ধরো।”

“ঠিক আছে। আগামীকাল এই সময়ে এই জায়গায় পেপার চোরকে হাজির করা হবে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “চোরকে কীভাবে ধরবে ছোটাচ্চু?”

“খুবই সোজা। বাসার দরজায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেব। সবকিছু রেকর্ড হয়ে যাবে। ইনফ্রারেড ক্যামেরা, রাতের অন্ধকারেও কেউ যদি কিছু করে তারও ভিডিও উঠে যাবে। দেখি তোর পেপার চোর কেমন করে পেপার চুরি করে।”

ছোটাচ্চু তখন খুবই গম্ভীরভাবে পকেট থেকে তার দামি ফোনটা বের করে কোথায় জানি ফোন করে দিল, কাকে জানি বলল আজ রাতের মাঝে বাসার সামনে একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিতে। ছোটাচ্চু এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, টেলিফোন করে এ রকম কাজ করে ফেলতে পারে।

.

সত্যি সত্যি রাতের বেলা একজন এসে কী যেন একটা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন বাসার ভিতরে বসে ক্যামেরায় কী হচ্ছে দেখতে পারব?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। এটা আসল সি.সি. ক্যামেরা না। একটা সাধারণ ভিডিও ক্যামেরা, ক্যামেরাটা খুলে টেলিভিশন না-হলে ল্যাপটপে দেখতে হবে। এখন সবাই দোয়া কর যেন কালকে পেপার চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়। আমরা চোরের চেহারাটা দেখতে চাই!”

কাউকে আলাদা করে দোয়া করতে হলো না। সকালবেলা পেপারওয়ালা পেপার দিয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝে পেপার উধাও হয়ে গেল। ক্যামেরাটা দরজার উপরে লাগানো আছে, সেখানে চোরের পুরো ভিডিও রেকর্ড করা আছে এখন শুধু দেখতে হবে কে সেই চোর!

বাসায় সবার মাঝে উত্তেজনা, কখন ছোটাচ্চু আসবে এবং কখন ভিডিওটা দেখা হবে। দিন আর কাটতে চায় না, শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হলো, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হলো। হোমওয়ার্ক শেষ হলো (কিংবা শেষ হলো না, কারণ শেষ করার চেষ্টাই করা হলো না)। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো, তারপর বসার ঘরে দাদিকে ঘিরে সবাই বসে ঘড়ি দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পর পর ছোটাচ্চুকে ফোন করা হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত ছোটাচ্চু এসে হাজির হলো। ছোটাচ্চু বাসায় ঢোকার সময় দরজার ওপর থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা খুলে এনেছে; এখন শুধু টেলিভিশন কিংবা ল্যাপটপে পুরো ভিডিওটা দেখা।

ছোটাচ্চু একটা তার বের করে টেলিভিশনের পিছনে লাগিয়ে সেটা তার ভিডিও ক্যামেরার সাথে লাগিয়ে নিল, তারপর কোথায় কী সুইচ টিপে দিতেই টেলিভিশনে ভিডিওটা দেখা যেতে শুরু হলো।

দরজার সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির সামনে হাঁটার পথ, তার সামনে রাস্তা। সকালবেলার দৃশ্য, রাস্তায় খুব বেশি মানুষ নেই, মাঝে মাঝে একজন-দুইজন হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ করে একটা রিকশা না-হয় সি.এন.জি.। সবাই ধৈর্য ধরে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তখন শেষ পর্যন্ত পেপারওয়ালাকে দেখা গেল। সে বাসার সামনে তার সাইকেলটা থামাল, স্ট্যান্ডটা বের করে সাইকেলটা দাঁড় করাল তারপর পিছন থেকে একটা পত্রিকা বের করে বাসার সামনে সিঁড়িতে রাখল। তারপর সাইকেলের কাছে গিয়ে সেটা ঠেলে একটু সামনে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে পেপারটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এক্ষুনি পেপার চোর আসবে, ঝট করে পেপারটা তুলে বের হয়ে যাবে। বসার ঘরে কোনো শব্দ নেই। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

ঠিক তখন বাসার সামনে একটা কুকুর এসে দাঁড়াল। কুকুরটা ডানে বামে তাকাল, তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে খবরের কাগজটা মুখে কামড়ে ধরে খুবই শান্তভাবে হেঁটে নেমে গেল। কুকুরটার মাঝে কোনো তাড়াহুড়া নেই, কোনো উত্তেজনা নেই, দেখে মনে হতে থাকে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক।

বাচ্চারা সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, শান্তর গলা শোনা গেল সবচেয়ে উপরে, বলল, “ইয়া মাবুদ! এইটা তো দেখি একটা কুত্তা!”

কুকুরটা যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই সেটার দিকে তাকিয়ে রইল, কুকুরটা হেলে-দুলে যেতে যেতে একসময় টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল!

ছোটাচ্চু ভিডিওটা বন্ধ করে কেমন যেন বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “একটা কুকুর!”

দাদি খুশি খুশি গলায় বললেন, “এই জন্যেই তো চিঠি পড়তে পারে নাই।”

বড় চাচা বললেন, “একটা কুকুর এতদিন থেকে আমার পেপার নিয়ে যাচ্ছে?”

বাচ্চাদের একজন বলল, “নিয়ে কী করে? পড়ে?”

আরেকজন তার মাথায় চাটি দিলে বলল, “ধুর গাধা! কুকুর পেপার পড়বে কেমন করে?”

“তাহলে কেন নিয়ে যায়?”

ঝুমু খালা তখন তার ব্যাখ্যা দিল, বলল, “একেক কুত্তার একেক রকম খেয়াল। খোঁজ নিয়া দেখো এই কুত্তার নিজের জায়গা আছে, সেইখানে সব পত্রিকা জমা করে রাখে।”

শান্ত জানতে চাইল, “কেন জমা করে?”

“মনে হয় বিছানার মতো করে তার উপরে ঘুমায়। মনে হয় কুত্তাটা জলা জায়গায় থাকে। সেইখানে পেপার দিয়ে জায়গাটা শুকনা রাখে।”

ঝুমু খালা অবশ্যি এখানে থেমে গেল না, কুকুরের সাইকোলজি নিয়ে আরো অনেকক্ষণ অনেক রকম কথা বলল।

টুনি ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু, ভিডিওটা আরেকবার দেখতে পারি?”

ছোটাচ্চু তখন ভিডিওটা আরো একবার চালু করল, সবাই মিলে তখন আরো একবার ভিডিওটা দেখল, প্রথমবারে যেটা দেখেছিল তার থেকে ভিন্ন কিছু কারো চোখে পড়ল না, শুধু টুনি সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। দেখা শেষ হবার পর টুনি আবার ভিডিওটা দেখল, তারপর আবার, তারপর আবার! অন্যেরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল, শান্ত বলল, “তুই বন্ধ করবি? এই কুত্তাটাকে দেখতে দেখতে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।”

টুনি তখন ভিডিওটা দেখা বন্ধ করল।

বড় চাচা বললেন, “তাহলে আমার পেপার দেখার কোনো উপায় নাই? একটা নেড়ি কুকুর আমার পেপার পড়া বন্ধ করে দেবে?”

ছোটাচ্চু বলল, “যদি ক্রিমিনালটা মানুষ হতো আমি তোমার প্রবলেম সল্‌ভ করে দিতাম। ক্রিমিনাল যখন কুকুর তখন কীভাবে সেটাকে সল্‌ভ

করব আমি জানি না! এই দেশে কুকুরের বিরুদ্ধে কোনো আইন নাই।”

বড় চাচা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ছোটাচ্চু বলল, “একটা বড় এলসেশিয়ান কুকুর নিয়ে আসতে পারি। বাড়ি পাহারা দেবে, ঐ নেড়ি কুকুর তখন ধারে-কাছে আসবে না।”

ছোট একজন বলল, “না, না, না, কুকুর আমার অনেক ভয় করে।”

শান্ত বলল, “কুকুরকে ভয় করার কী আছে? কাছে আসলে কষে একটা লাথি দিবি।”

ঝুমু খালা বলল, “কুকুর বান্ধা তাবিজ আছে। বাম হাতে কালা সুতা দিয়ে বাঁধতে হয়। কুকুর-বিড়াল কাছে আসবে না।”

বড় চাচা বলল, “তোমার তাবিজ বাসার দরজায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না? তাহলেই তো কুকুর আসত না।”

ঝুমু খালা বলল, “খালুজান, আপনি চিন্তা কইরেন না। আমি সকালবেলা ঝাড় নিয়া বাসার দরজার কাছে বসে থাকমু। কুত্তার কাছ থেকে আমি যদি আপনার পত্রিকা উদ্ধার না করি তাহলে আমার নাম ঝুমু না।”

টুনি হেসে বলল, “তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পারো না ঝুমু খালা! আমরা সবাই মিলে ডেকেও তোমার ঘুম ভাঙাতে পারি না।”

ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “সেইটা অবশ্যি সত্যি কথা। কেউ যদি ঘুম থেকে তুলে দেয়–খালুজান আমাকে ডেকে তুলে দিতে পারবেন না?”

বড় চাচা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে যদি সকালে ঘুম থেকে তুলতেই হয় তাহলে আমি নিজে গিয়ে কেন খবরের কাগজটা নিয়ে আসব না?”

ঝুমু খালা বলল, “কিন্তু খালুজান আপনি তো আমার মতোন কুত্তাটারে ঝাড় দিয়ে পিটাতে পারবেন না, পারবেন?”

বড় চাচা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে আবার থেমে গেলেন।

রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে টুনি টুম্পাকে বলল, “টুম্পা তোকে একটা কথা বলি, কাউকে বলবি না তো?”

টুম্পা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “বল। কাউকে বলব না।”

“কুকুরটা কিন্তু নিজে নিজে বড় চাচার পেপার নিচ্ছে না। কেউ একজন কুকুরটাকে দিয়ে পেপার নেওয়াচ্ছে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি।”

“তুমি কেমন করে বুঝলে?”

“দেখলি না কুকুরটা কত যত্ন করে পত্রিকাটা নিল। প্রথমে নাক দিয়ে ঠেলে সিঁড়ির কাছে নিয়ে তারপর এক কোনায় কামড় দিল, যেন পত্রিকাটা নষ্ট না হয়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, “আমার মনে হয় একজন মানুষ সকালবেলা একটা কুকুরকে দিয়ে সবার বাসা থেকে পত্রিকাগুলো জড়ো করে, তারপর বিক্রি করে।”

টুম্পা মাথা নাড়ল, সে টুনির সব কথা সব সময় বিশ্বাস করে।

টুনি বলল, “তা ছাড়া কুকুর কেন খামোখা পেপার নিয়ে যাবে? সে পেপার খেতেও পারে না, পড়তেও পারে না, গায়েও দিতে পারে না। কেউ একজন কুকুরকে ট্রেনিং দিয়েছে।”

টুম্পা আবার মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ।”

টুনি বলল, “পেপার চোরটাকে ধরতে হবে, কুকুরকে ধরে লাভ নাই।”

“কেমন করে ধরবে?”

টুনি বলল, “চিন্তা করছি।”

তারপর গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে শুরু করল। টুনি যখন চিন্তা করে তখন তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না বলে টুম্পাও চুপচাপ পাশে গালে হাত দিয়ে বসে রইল।

এ রকম সময় ঝুমু খালাকে দেখা গেল একটা শলার ঝাটা নিয়ে যাচ্ছে। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে ঝাড় নিয়ে কই যাও ঝুমু খালা?”

“নিচে। দরজার কাছে রেখে দিব।”

“কেন?”

“সকালে উঠে যেন খুঁজতে না হয়। কুত্তাটাকে এমন ঝাড়পেটা দিমু যে এইটা আর এই জন্মে এই বাসায় আসবে না।”

“কিন্তু তুমি তো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারো না।”

“মোবাইলে এলার্ম দিছি।”

“তুমি মোবাইলে এলার্ম দিতে পারো?”

“না। বড় খালুজান করে দিছে। কালকে কুত্তার জান শেষ।”

ঝুমু খালা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে। টুনি ফিসফিস করে বলল, “সর্বনাশ!”

টুম্পাও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“কাল সকালে সত্যি সত্যি কুকুরকে ঝাড়পেটা করলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ঝুমু খালাকে থামাতে হবে।” টুনি এক সেকেন্ড চিন্তা করল, চিন্তা করে বলল, “তুই নিচে যা। ঝুমু খালাকে কোনোভাবে ব্যস্ত রাখ।”

“তুমি কী করবে?”

“ঝুমু খালার ঘরে গিয়ে তার মোবাইলের এলার্ম এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে আসি।”

টুনি ঝুমু খালার ঘরের দিকে গেল আর ঝুমু খালাকে ব্যস্ত রাখার জন্যে টুম্পা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।

ঝুমু খালার ঘরে মোবাইলটা খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হলো না, টুনি কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এলার্মের সময়টা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিল। তারপর নিচে গেল দেখার জন্যে টুম্পা কীভাবে ঝুমু খালাকে ব্যস্ত রাখছে। নিচে গিয়ে দেখল টুম্পা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে আর ঝুমু খালা টুম্পার ডান পায়ের আঙুল ধরে টানাটানি করছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

টুম্পা কিছু বলার আগেই ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে উঠল, বলল, “এই বাসায় কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ আছে? নাই? সিঁড়ি দিয়ে মানুষ হেঁটে হেঁটে নামে, আর এই মেয়ে নামে ফাল দিয়ে দিয়ে–”

টুম্পা ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করল, “ফাল না, শব্দটা হচ্ছে লাফ।”

ঝুমু খালা আরো জোরে ঝংকার দিল, বলল, “থাউক, আমারে আর বেঙ্গলি শিখাতে হবে না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে? টুম্পা পড়ে গেছে?”

“হ্যাঁ। পড়ে ঠ্যাংয়ে ব্যথা পেয়েছে। মনে হয় রগে টান দিছে।” টুম্পা টুনির দিকে তাকাল, টুনি চোখ টিপে দিল তখন টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা, রগে টান মনে হয় বন্ধ হয়েছে। এখন ব্যথা নাই।”

ঝুমু খালা বলল, “রগে টান পড়লে এত সহজে বেদনা কমে না। মনে হয় গরম তেল দিয়ে মালিশ করতে হবে।”

টুম্পা বলল, “করতে হবে না ঝুমু খালা।”

ঝুমু খালা টুম্পার পায়ের আঙুলে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, “তুমি বেশি কথা বোলো না, চুপ করে বসে থাকো।”

কাজেই টুম্পা চুপ করে বসে রইল আর ঝুমু খালা তার পায়ের আঙুল ধরে টানাটানি করতে লাগল। টুনি তাদেরকে সেই অবস্থায় রেখে উপরে উঠে গেল।

তিনতলায় গিয়ে সে শাহানাকে খুঁজে বের করল। তাদের বাসায় শাহানা হচ্ছে জ্ঞানী মানুষ। মন দিয়ে লেখাপড়া করে, পৃথিবীর সবকিছু জানে, কারো যখন কিছু জানতে হয় তখন সে শাহানার কাছে আসে।

টুনিও শাহানার কাছে এলো, শাহানা মোটা একটা বই পড়ছিল, বইটা নামিয়ে রেখে টুনির দিকে তাকাল। টুনি বলল, “শাহানাপু, তুমি কী ব্যস্ত?”

শাহানা বলল, “কী বলবি বলে ফেল।”

“মনে আছে একবার আমরা সবাই শিশু পার্কে গিয়েছিলাম। শান্ত ভাইয়ার কাছে একটা কোকের ক্যান ছিল, সেটা খুলতেই ভেতর থেকে সব কোক ফেনা হয়ে বের হয়ে শান্ত ভাইয়ার মুখ, পেট, বুক সব ভিজিয়ে দিয়েছিল?”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ মনে আছে। শান্ত হচ্ছে একটা গাধা, কোকের মাঝে কার্বন-ডাইঅক্সাইড ডিজভ থাকে। যদি গরম করা হয় সেটা বের হয়ে আসে, আঁকালেও বের হয়ে আসে। এমনিতে দিনটা ছিল গরম আর গাধাটা তার ক্যানটা ঝাঁকাঝাঁকি করেছে, তাই যখন খুলেছে পুরো ক্যানের কোক কার্বন-ডাইঅক্সাইডের চাপে বের হয়ে এসেছে–মনে আছে গাধাটার কী অবস্থা হয়েছিল?”

টুনি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “একটা ছোট শিশি দিয়ে কি এ রকম কিছু করা সম্ভব?”

“কী রকম?”

“যে শিশিটা খুলতেই ভেতর থেকে সবকিছু হুস হুস করে বের হয়ে সবকিছু মাখামাখি করে ফেলবে?”

শাহানা সন্দেহের চোখে টুনির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

টুনি মাথা নিচু করে বলল, “প্লিজ শাহানাপু আজকে জিজ্ঞেস কোরো না। কালকে আমি নিজেই বলব।”

শাহানা একটু হাসল, বলল, “ঠিক আছে।” তারপর তার চশমা খুলে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল, তারপর বলল, “তোর সিক্রেট প্রজেক্টে তুই ঠিক কী করতে চাস আমি জানি না। ধরে নিচ্ছি কারো কোনো ক্ষতি না করে তাকে বোকা বানাতে চাস।”

টুনি বলল, “অনেকটা সে রকম।”

“তাহলে সবচেয়ে সোজা হচ্ছে কার্বন-ডাইঅক্সাইড। একটা ছোট শিশিতে একটু ভিনেগার আর খাওয়ার সোডা দিয়ে যদি ছিপিটা বন্ধ করিস তাহলে ভেতরে কার্বন-ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়ে প্রেশার তৈরি করবে। তাই ছিপিটা খুলতেই ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসবে। ঠিক কোকের ক্যানের মতো। তবে–” বলে শাহানা থেমে গেল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তবে কী?”

“কতটুকু ভিনেগারের সাথে কতটুকু খাওয়ার সোডা দিচ্ছিস সেটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। বেশি হয়ে গেলে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের প্রেশার অনেক বেশি হয়ে তোর শিশি ফেটে যেতে পারে, নিজে থেকে ছিপি খুলে যেতে পারে। কাজেই সাবধানে এক্সপেরিমেন্ট করে ঠিক পরিমাণটা বের করতে হবে।”

টুনি বলল, “বের করব শাহানাপু।”

শাহানা বলল, “দরকার হলে আমার কাছে নিয়ে আসিস, আমি এডজাস্ট করে দিব।”

টুনির মুখে এগাল থেকে ওগাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল। সে শাহানার গালে চুমু দিয়ে বলল, “শাহানাপু, তুমি হচ্ছ বেস্ট থেকেও বেস্ট।”

কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে শাহানার সাহায্য নিয়ে টুনি তার হাই প্রেশার শিশি তৈরি করা শিখে নিল। কাল সকালে পেপার দেবার পর এবং কুকুর এসে সেটা নিয়ে যাবার মাঝখানের কয়েক সেকেন্ড সময়ের মাঝে বাকিটা শেষ করতে হবে। সবকিছু আগে থেকে রেডি করে রাখলে সেটা অসম্ভব কিছু নয়।

টুনি তখন ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল।

.

সকালবেলা এলার্ম শুনে টুনি লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল। আগে থেকে সবকিছু রেডি করে রাখা আছে, একটা ছোট শিশিতে একটু খানি খাওয়ার সোডা এবং হাজার পাওয়ারের ভয়ঙ্কর কটকটে লাল রং। এর মাঝে এক চামচ ভিনেগার দিয়ে কর্ক দিয়ে শিশিটা বন্ধ করতে হবে। সেটা সে করবে

একেবারে শেষ মুহূর্তে। টেবিলের উপর স্কচ টেপ রাখা আছে, এক টুকরা ছিঁড়ে শিশিটাকে খবরের কাগজের উপর লাগিয়ে দেবে। তাহলেই কাজ শেষ।

টুনি ঘুম ঘুম চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখলেই সে কাজ শুরু করে দেবে। জানালার কাছে বসে থেকে থেকে টুনি যখন প্রায় অধৈর্য হয়ে গেল তখন সে পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখতে পেল। টুনি খুবই ধৈর্য ধরে তখন ভিনেগারের শিশি থেকে এক চামচ ভিনেগার শিশিতে ঢেলে নেয়। ভেতরে বিজবিজ করে ফেনা তৈরি হতে থাকে, টুনি তখন দেরি না করে কর্কটা শক্ত করে শিশিটার মুখে লাগিয়ে নেয়। তারপর এক টুকরো স্কচ টেপ ছিঁড়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। দরজার কাছে কান পেতে শুনল পেপারটা সিঁড়ির উপরে রেখে পেপারওয়ালা চলে যাচ্ছে।

টুনি তখন সাবধানে দরজা খুলে বের হয়, শিশিটা স্কচ টেপ দিয়ে পেপারটার উপরে লাগিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লাফিয়ে উপরে এসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সে কুকুরটাকে দেখতে পেল। বাসার সামনে এসে একবার ডানে-বামে তাকাল তারপর শান্ত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে পেপারটা শুকে সেটা কামড়ে ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। টুনি দেখার চেষ্টা করল আশেপাশে কোনো মানুষ আছে কি না, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।

ঘণ্টা খানেক পরে ঝুমু খালাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। বড় খালু যে মোবাইলে এলার্ম পর্যন্ত দিতে পারে না সেটা নিয়ে সে যথেষ্ট হা-হুঁতাশ করল। এই মানুষটাকে একা একা ছেড়ে দিলে সে কী বিপদ ঘটাবে সেটা নিয়েও সে নানা রকম আশঙ্কা প্রকাশ করল।

সকালবেলা যখন এই বাসার সব বাচ্চাকাচ্চা স্কুলে যাবার জন্যে রেডি হয়েছে তখন টুনি সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, “সবাই আজকে স্কুলে যাবার সময় চোখ-কান খোলা রাখবে।”

শান্ত বলল, “তোর কি ধারণা আমরা চোখ-কান বন্ধ রেখে হাতড়াতে হাতড়াতে এখানে-সেখানে বাড়ি খেতে খেতে স্কুলে যাই?”

টুনি শান্তর কথা না শোনার ভান করে বলল, “যদি দেখো কোনো মানুষের মুখ, হাত, শরীর লাল রঙে মাখামাখি তাহলে আমাকে জানাবে।”

“কেন?”

“সেটা আমি এখন বলব না। যদি দেখো তাহলে বলব।” শান্ত গরম হয়ে বলল, “এখন কেন বলবি না?”

“তোমার জন্যে। তুমি যদি জানো তাহলে তুমি মারপিট শুরু করে দিতে পারো সে জন্যে এখন বলব না। তোমার মেজাজ খুব গরম, আমি চাই না তুমি রাস্তা-ঘাটে মারামারি করো।”

শান্ত খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই কী বললি? কী বললি? আমার মেজাজ গরম? আমি মারামারি করি?”

টুনি খুবই শান্তভাবে বলল, “আমি এখন কিছুই বলব না। কিন্তু আজকে স্কুলে যাবার সময় কিংবা ফিরে আসার সময় যদি দেখো কোনো মানুষ লাল রঙে মাখামাখি হয়ে আছে তাহলে এসে আমাকে জানাবে।”

শান্ত বলল, “জানাব না কচু! আমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তোর জন্যে রাস্তাঘাটে রঙিন মানুষ খুঁজে বেড়াব। হাহ!”

বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে শান্ত ছুটতে ছুটতে টুনির কাছে গেল, বলল, “টুনি টুনি, শুনে যা কী হয়েছে।”

“কী হয়েছে?”

“এই রাস্তার মোড় দিয়ে হেঁটে আসছি, দেখি একটা পিচ্চি-এই এতটুকু সাইজ! (শান্ত সাইজটা দেখাল, যেটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য না) মুখ, পেট, বুক টকটকে লাল রং। আমি ডাকলাম আর সাথে সাথে দিল দৌড়। পিছনে পিছনে একটা কুত্তা। সেটাও দৌড়! এখন বল ব্যাপারটা কী হয়েছে?”

টুনি চোখ ছোট ছোট করে বলল, “মানুষটা পিচ্চি?”

“হ্যাঁ, মনে হয় দুই বছর বয়স হবে।”

“দুই বছর বেশি ছোট, দুই বছরের বাচ্চা হাঁটতেই পারে না।”

শান্ত অধৈর্য হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। না-হয় আরো বড় হবে, পাঁচ-ছয় বছর, কিংবা সাত-আট বছর–”

“কিন্তু ছোট বাচ্চা? বড় মানুষ না?”

“হ্যাঁ ছোট বাচ্চা।”

শান্ত আরো অধৈর্য হয়ে বলল, “বল ব্যাপারটা কী?”

টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, বলা যাবে না।”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “বলা যাবে না মানে?”

“বলা যাবে না মানে বলা যাবে না। মানুষটা যদি একটা বড় মানুষ হতো তাহলে বলতাম। কিন্তু মানুষটা যেহেতু ছোট বাচ্চা এখন আর বলা যাবে না।”

“কেন ছোট বাচ্চা হলে বলা যাবে না?”

“তাহলে তুমি বাচ্চাটাকে ধরে আছাড় দিবে। বাচ্চাটার ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে।”

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কেন আমি একটা ছোট বাচ্চার ঠ্যাং ভেঙে দিব?”

“তুমি যদি কথা দাও বাচ্চাটাকে কিছু বলবে না তাহলে বলতে পারি।”

শান্ত বলল, “কথা দিলাম।”

“ভালো করে বলো, কসম খেয়ে বললো।”

ব্যাপারটা কী হয়েছে জানার জন্যে শান্তর এত বেশি কৌতূহল হচ্ছিল যে শেষ পর্যন্ত কসম খেল।

টুনি তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। খুবই বিচিত্র কারণে এই দুর্ধর্ষ পেপার চোরের উপর কেউ আর সে রকম রাগ হলো না!

বিকেলবেলা টুনি টুম্পাকে বলল, “এই টুম্পা যাবি আমার সাথে?”

টুম্পা চকচকে চোখে বলল, “পেপার চোরের সাথে দেখা করতে?”

“হ্যাঁ।”

“যাব।”

“চল তাহলে।”

টুনি আর টুম্পা তখন পেপার চোরের সাথে দেখা করতে ঘর থেকে বের হলো। শান্ত যেখানে রংমাখা ছেলেটাকে দেখেছে সেখানে গিয়ে তারা এদিক-সেদিক তাকাল কিন্তু রংমাখা কোনো বাচ্চাকে খুঁজে পেল না। তখন তারা রাস্তার পাশে একটা ছোট চায়ের দোকানে হাজির হলো। যে মানুষটি চা তৈরি করছে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আঙ্কেল, আপনি কি এখানে কোনো বাচ্চাকে চিনেন যে একটা কুকুর নিয়ে ঘুরে?”

“ও। গুল্লু? তারে কে চিনে না, সবাই চিনে! আজকে কী করেছে খোদায় জানে, তার সারা শরীরে রং। একেবারে লাল বান্দর।”

টুনি আর টুম্পা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, টুনি তখন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “গুল্লু কী করে আপনি জানেন?”

“পত্রিকা বিক্রি করে। সবার পত্রিকা আট-দশ টাকা করে, গুল্লুর পত্রিকার অর্ধেক দাম! এই পোলা যে কোত্থেকে এত সস্তায় পত্রিকা আনে খোদা মালুম!”

টুনি বলল, “গুল্লুর সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”

“যদি তারে খুঁজে পাও, কথা বলো।”

“কোথায় পাব গুল্লুকে?”

মানুষটা এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখিয়ে বলল, “ঐ পোলা-মাইয়াদের জিজ্ঞেস করে দেখো। এরা মাঝে মাঝে একসাথে খেলে।”

টুনি তখন টুম্পাকে নিয়ে বাচ্চাগুলোর কাছে গেল, তারা রাস্তার পাশে ফুটপাতে আঁকিবুকি করে কিছু একটা খেলছে। টুনি আর টুম্পাকে দেখে সবাই উৎসুক চোখে তাদের দিকে তাকাল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি গুল্লুকে দেখেছ?”

বাচ্চাগুলো সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেল। তারা পথে-ঘাটে থাকে, তাদের একে অন্যকে দেখে রাখতে হয়। ভদ্রলোকেরা যখন তাদের খোঁজ করে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা ঝামেলা আছে। প্রায় টুনির বয়সী একটা মেয়ে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে?”

“এমনি। একটু কথা বলব।”

একজন ফিক করে হাসল, বলল, “আজকে আমাগো গুল্লু লাল বান্দর।”

টুনি বলল, “জানি। সেই জন্যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

টুনির বয়সী মেয়েটা বলল, “হে মনে হয় কথা বলবে না।”

“না বললে নাই। কিন্তু যদি কথা বলতে চায় আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে প্লিজ? আমরা দুইজন ঐ যে সামনে দোকানটা দেখছ তার বাইরে যে বেঞ্চ আছে সেখানে বসে থাকব।”

“ঠিক আছে।”

টুনি আবার বলল, “ওকে বোলো কোনো ভয় নাই!”

মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।

তখন টুনি আর টুম্পা দুইজন দোকানটার সামনে বেঞ্চে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকল। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হয় টুনি আপু, গুল্লু কি আসবে?”

টুনি বলল, “জানি না। দেখা যাক। এখন যেহেতু নামটা জেনে গেছি কোনো একদিন খুঁজে বের করে ফেলব। আজকে না আসলেও ক্ষতি নাই।”

মিনিট দশেক পর হঠাৎ করে টুনি আর টুম্পা দুজনেই দেখল একটা ছোট ছেলে গুটি গুটি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটির বয়স সাত আট বছরের বেশি হবে না, মাথার চুল এলোমেলো, একটা শার্ট, যার বোতাম খুব বেশি নেই এবং একটা কালো রঙের ঢোলা প্যান্ট। খালি পা। যেটা দর্শনীয় সেটা হচ্ছে তার সারা মুখে, বুকে এবং পেটে টকটকে লাল রং।

ছেলেটা একা আসছে না, তার পাশে পাশে হেঁটে আসছে একটা কুকুর। ভিডিওতে টুনি আর টুম্পা আগেই এই কুকুরটাকে দেখেছে। ছেলেটা একটা নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়িয়ে গেল, দেখে বোঝা যাচ্ছে বিপদ দেখলে যেকোনো সময়ে সে দৌড়ে পালাবে! টুনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি গুল্লু?”

গুল্লু মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “কাছে আসো, তোমার সাথে কথা বলি।”

“কী কথা?”

“এই তো তুমি কেন পেপার চুরি করো এই সব কথা!”

টুনির কথা শেষ হবার আগেই গুল্লু এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, পিছন পিছন তার কুকুর!

টুম্পা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “আর আসবে না।”

টুনি বলল, “মনে হয় আসবে। দেখা যাক।”

টুনির ধারণা সত্যি। কিছুক্ষণ পর আবার গুল্লুকে দেখা গেল। এবারে আরো সতর্ক, কুকুরটাও তার সাথে সাথে সতর্ক। টুনি গলা উঁচু করে বলল, “কী হলো? চলে গেলে কেন?”

উত্তরটা যেহেতু অনুমান করা যায় তাই গুল্লু কোনো উত্তর দিল না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে, কাপড়ে রং লেগেছে কেমন করে?”

গুল্লু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, ঠিক বোঝা গেল না। টুনি বলল, “কাছে এসে বলো।”

গুল্লু একটু কাছে এলো। টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে রং লেগেছে কেমন করে?”

“বোনের বিয়া ছিল। সেইখানে রং খেলছি।”

টুনি হি হি করে হাসতে শুরু করল, সাথে সাথে টুম্পাও। টুনি বলল, “মিছা কথা বলো কেন?”

গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “মিছা কথা না।”

“আমি বলি কেমন করে রং লেগেছে?”

গুল্লু হা-না কিছু বলল না। টুনি বলল, “আজকে সকালে তোমার কুকুরটা দিয়ে তুমি আমাদের বাসা থেকে যে পেপারটা চুরি করেছ সেইখানে একটা শিশি ছিল। তুমি যখন শিশি খুলেছ তখন ভুস করে সব রং বের হয়ে তোমার মুখে-শরীরে লেগে গেছে!” কথা শেষ করে টুনি হি হি করে হাসতে থাকে, সাথে টুম্পাও।

গুল্লু আবার দৌড় দেবার জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যেহেতু টুনির কথায় কোনোরকম অভিযোগ নেই এবং তার হাসিটা খুবই আন্তরিক তাই শেষ পর্যন্ত দৌড় দিল না।

মনে হলো পুরো ব্যাপারটার মজার বিষয়টা সেও ধরে ফেলেছে এবং সেও একটু হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। কিন্তু আমার আরো বেশি বুদ্ধি। ঠিক কি না?”

গুল্লু মাথা নাড়বে কি না বুঝতে পারল না, শেষে অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল।

টুনি বলল, “কাছে আসো। বসো। আমি তোমাকে কিছু করব না।”

গুল্লু এবারে টুনির কথা বিশ্বাস করে কাছে এসে দাঁড়াল। টুনি বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলল, “বসো।”

গুল্লু বসল। টুনি আর টুম্পার পা কে কুকুরটা গুল্লুর পায়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে। কুকুরটা কীভাবে জানি বুঝে গেছে এখানে কোনো বিপদ নেই। সে বেশ আরামে মাথাটা মাটিতে রেখে চোখ বন্ধ করল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা কী করে?”

গুল্লু বলল, “নাই।”

“মা?”

“জানি না।”

“জানো না?”

গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “বাড়িতে ছিল।”

“তুমি বাড়ি যাও না?”

গুল্লু মাথা নেড়ে জানাল সে বাড়ি যায় না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “থাকো কোথায়?”

গুল্লু হাত নেড়ে বলল, “এই তো।”

“খাও কোথায়?”

“হোটেলে। কাম করলে খাইতে দেয়।”

“কী কাজ?”

“কাটাকাটি, ধোয়াধুয়ি।”

টুনি বুঝতে পারল আলাপটা খুব ভালো এগুচ্ছে না। তাই অন্যভাবে চেষ্টা করল। কুকুরটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কুকুরের নাম কী?”

“বাঘা।” বাঘা নিজের নাম শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে একবার লেজ নেড়ে আবার চোখ বন্ধ করল।

“বাঘা তোমার বন্ধু?”

গুল্লু মাথা নাড়ল, দাঁত বের করে হাসল, বলল, “এখন কেউ আমার টেকা নিতে পারে না।”

“তোমার অনেক টাকা?”

গুল্লু লাজুক মুখে একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর কোমরে গুঁজে রাখা একটা টাকার বান্ডিল বের করে গুনতে শুরু করল। টুনি একটু পরেই বুঝতে পারল সে গুনতে পারে না, একটু পরে পরেই গুল্লুর হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

টুম্পা বলল, “আমার কাছে দাও, আমি গুনে দিই।”

গুল্লু প্রথমে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টুম্পার দিকে তাকাল, তার চেহারা দেখে মনে হলো সে তার জীবনে এ রকম আজগুবি কথা শুনে নাই। তার টাকা আরেকজনের হাতে তুলে দিবে গোনার জন্যে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে টাকার বান্ডিলটা টুম্পার হাতে তুলে দিল-টুম্পা টাকাগুলো গুনে বান্ডিলটা ফেরত দিয়ে বলল, “তিনশ বাহান্নো টাকা।”

“পাঁচশ হতে আর কত বাকি?”

টুম্পা হিসেব করে বলল, “একশ আটচল্লিশ।”

গুল্লু মুখ সুচালো করে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “পাঁচশ টাকা তোমার কেন দরকার?”

গুল্লু টাকার বান্ডিলটা তার কোমরে খুঁজতে খুঁজতে বলল, “একটা বিজনেস শুরু করুম।”

“কীসের বিজনেস?”

“চা-গরম। ফেলাক্সে গরম পানি আর চায়ের কাপ দিয়া বিজনেস। মেলা লাভ।”

টুনি মোটামুটি হিংসার চোখে এই বিজনেসম্যানের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

বাসায় ফিরে আসতে আসতে টুনি বলল, “আমাদের গরম পানি রাখার

একটা বড় ফ্লাস্ক আছে না?”

টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, শান্ত ভাইয়ের জন্মদিনের সময় কিনেছিল।”

“এটা কোনো কাজে লাগে?”

“না।“

“এইটা আমরা গুল্লুকে দিয়ে দেই না কেন?”

টুম্পা মাথা নাড়ল, “তুমি দিতে পারবে না। ঝুমু খালা দিতে দিবে না। ঝুমু খালা বাসার সব জিনিস আটকে রাখে।”

টুনি বলল, “তুই সেটা আমার উপর ছেড়ে দে!”

টুম্পা হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে অবশ্যি অন্য কথা। তোমার বুদ্ধির সাথে কেউ পারবে না!”

পরদিন সকালে টুনি রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা, তুমি একটু সরো দেখি আমি পানি গরম করব।”

ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “ছোট মানুষ রান্নাঘরে কেন? যাও বের হও।”

“কিন্তু আমার গরম পানি লাগবে।”

“আমি গরম করে দিব। তুমি বের হও।”

টুনি বলল, “কিন্তু ঝুমু খালা, আমার একটু পরে পরে লাগবে।”

“একটু পরে পরে? কেন?”

“আমি একটা সায়েন্স প্রজেক্ট করছি। স্কুলে নিতে হবে। একটা বোতলের মুখে একটা বেলুন লাগিয়ে বোতলটা যদি গরম পানিতে রাখো তাহলে বেলুনটা ফুলে ওঠে। কী হয় জানো তো? বোতলের ভিতরে যে বাতাস আছে–”

ঝুমু খালা টুনিকে থামিয়ে বলল, “আমার এত সাইন্স জানার দরকার নাই। যেইটুকু জানি তার যন্ত্রণাতেই বাঁচি না। রান্নাঘরের আগুনের মাঝে তোমার থাকার দরকার নাই, বের হও।”

“তাহলে আমার গরম পানি?”

“আমি কেতলিতে গরম করে দিব।”

“একটু পরে পরে গরম করে দিবে?”

ঝুমু খালা যখন সমস্যাটা সমাধান করার জন্যে চিন্তা করছে তখন টুনি তার মাথায় হঠাৎ করে বুদ্ধি আসার অনবদ্য অভিনয় করে বলল, “তার চাইতে একটা কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী কাজ?”

“কেতলিতে পানি গরম করে তুমি বড় যে ফ্লাস্কটা আছে তার মাঝে রাখো, আমার যখন দরকার হবে তুমি ফ্লাস্কটা থেকে বের করে দিবে।”

ঝুমু খালা একটু চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর তার অভ্যাসমতো একটু শাসন করে বলল, “এর পরে যখন সাইন্স পজিক করবা ঠান্ডা পানি দিয়া করবা, বুঝছ?”

টুনি বলল, “ঠিক আছে। আর শব্দটা সাইন্স পজিক না। সায়েন্স প্রজেক্ট।”

ঝুমু খালা ঝংকার দিল, “আমার এত কিছু জানার দরকার নাই। বিদায় হও।”

টুনি তখন খুব আনন্দের সাথে বিদায় হলো। তারপর টুম্পাকে খুঁজে বের করে তাকে ফিসফিস করে বলল, “আমি যখন বলব তখন ঝুমু খালাকে তুই রান্নাঘর থেকে বের করে নিয়ে যাবি, কিছুক্ষণ আটকে রাখবি। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।” টুনির উপর টুম্পার অগাধ বিশ্বাস, যখন সে ঝুমু খালাকে আটকে রাখবে তখন টুনি কী করবে সেটা জানতে পর্যন্ত চাইল না।

মিনিট দশেক পর টুনি টুম্পাকে সিগন্যাল দিল তখন টুম্পা নিজের ঘরে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”

ঝুমু খালা এবং আরো কয়েকজন টুম্পার ঘরে ছুটে গেল। টুম্পা মেঝেতে বসে তার পা ধরে চিৎকার করছে। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“আমার পায়ের রগে আবার টান পড়েছে।”

ঝুমু খালা বসে টুম্পার পা ধরে আঙুলগুলো টানতে টানতে বলল, “তুমি কী করছ?”

“কিছু করি নাই–শুধু চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে ঐ পর্দাটা সরাতে যাচ্ছিলাম–” টুম্পা পুরোপুরি অর্থহীন কথা বলতে থাকে, কথাগুলো যে অর্থহীন সেটাও কেউ বুঝতে পারল না!

ঠিক এই সময়ে টুনি বড় ফ্লাস্কের সব গরম পানি ঢেলে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখে। তারপর টুম্পার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে টুম্পা?”

টুম্পা বলল, “পায়ের রগে টান পড়েছে।”

টুনি টুম্পার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিতেই টুম্পা বলল, “মনে হয় রগটা একটু ঢিলা হয়েছে, ব্যথা কমেছে।”

ঝুমু খালা বিশাল একটা লেকচার দিতে শুরু করে, টুম্পা পুরোটুকু ধৈর্য ধরে শুনে!

মিনিট দশেক পর টুনি রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে একটা বাটি দিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, এই বাটিতে গরম পানি দাও।”

ঝুমু খালা গরম কড়াইয়ে কিছু সবজি ছেড়ে দিয়ে টুনির বাটিটা হাতে নিয়ে ফ্লাস্ক থেকে পানি ঢেলে দিল। পানিটা দেখেই তার কেমন সন্দেহ হয়, হাত দিয়ে দেখে পানিটা মোটেও গরম নয়–একেবারে ঠান্ডা!

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”

“পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে!”

“ঠান্ডা হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ”

“কেন?”

ঝুমু খালা ফ্লাস্কটা খুলে ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “মনে হয় এইটা নষ্ট হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই চায়নিজ মাল। চায়নিজ মাল দুই দিনে নষ্ট হয়ে যায়। কত তাড়াতাড়ি পানি ঠান্ডা হয়ে গেল।”

টুনি বলল, “আবার একটু গরম পানি দিয়ে দেখবে?” ঝুমু খালা বলল, “ঠিক আছে দেখি।”

এইবার টুম্পার ব্যাক পেকের জিপার আটকে গেল। সেই জিপার খুলে দেয়ার জন্যে টুম্পা তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”

ঝুমু খালা যখন সেই জিপার টানাটানি করে খুলছে তখন টুনি আবার ফ্রাস্কের গরম পানি ফেলে দিয়ে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখল। খানিকক্ষণ পর টুনি যখন গরম পানি আনতে গিয়ে দেখে পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে তখন ঝুমু খালার আর কোনো সন্দেহ থাকল না যে এই ফ্লাস্কটা নষ্ট হয়ে গেছে। চায়নিজ মাল কেনা যে খুবই বোকামি হয়েছে ঝুমু খালা সেইটা বারবার মাথা নেড়ে বলতে থাকল!

.

রাত্রে বসার ঘরে দাদির পায়ে রসুনে ভাজা গরম তেল মাখাতে মাখাতে ঝুমু খালা যখন বাসার সব খবর রিপোর্ট করছিল তখন বড় ফ্লাস্কটা নষ্ট হয়ে যাবার খবরটাও সে দাদিকে রিপোর্ট করল। টুনি ঠিক পাশেই বসেছিল, সে দাদিকে বলল, “দাদি এই নষ্ট ফ্লাস্কটা আমি নিই?”

“নে। কিন্তু নিয়ে কী করবি?”

“ভেতরে মাটি ভরে আঙর গাছ লাগাব!”

“আঙুর গাছ?” দাদি অবাক হয়ে বললেন, “আঙুরের গাছ পাওয়া যায় নাকি?”

“যদি না পাই তাহলে অন্য কিছু করব!”

পরদিন বিকালবেলা টুনি টুম্পাকে নিয়ে সেই “অন্য কিছু করার জন্যে বড় ফ্লাস্কটা নিয়ে বের হলো। রাস্তার মোড়ে একটু খোজাখুঁজি করতেই গুল্লু এবং বাঘাকে পাওয়া গেল। মুখের লাল রং একটু কমেছে কিন্তু পুরোপুরি ওঠেনি।

টুনি গুল্লুর দিকে ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”

গুল্লু অবাক হয়ে বলল, “নিব? আমি?”

“হ্যাঁ।”

“কত টাকা?”

টুনি আর টুম্পা হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমাকে টাকা দিতে হবে। এটা তোমাকে গিফট।”

গুল্লু তখন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফ্লাস্কটা হাতে নেয়। তাকে দেখে বোঝা যায় টুনি আর টুম্পা হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে সে সেই ঝুঁকি নিতে রাজি না। ফ্লাস্কটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সত্যি আমারে দিয়ে দিলা?”

“হ্যাঁ।”

“খোদার কসম?”

টুনি বলল, “খোদার কসম-তবে একটা শর্ত।”

“কী শর্ত?”

“আর কোনোদিন পেপার চুরি করতে পারবা না।”

গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “করমু না।”

“গুড।” টুনি বলল, “মনে রাখবা আমরা কিন্তু তোমার বিজনেস পার্টনার। তার মানে কি জানো?”

“কী?”

“আমাদের দুইজনকে ফ্রি চা খাওয়াতে হবে।”

গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “খাওয়ামু।”

“আর বিজনেস করে যখন তুমি বড় হয়ে অনেক বড় বিজনেসম্যান হবে, বিল গেইটসের মতো একজন হবে তখন আমাদের দুইজনকে দুইটা গাড়ি কিনে দিতে হবে।”

টুনির সব কথা সে বুঝতে পারল না, বিল গেইটসটা কী সে ধরতে পারল না কিন্তু তারপরও তাকে নিরুৎসাহিত হতে দেখা গেল না। মাথা নেড়ে বলল, “দিমু। খোদার কসম।”

একেবারে ফার্স্ট ক্লাস চা!

টুনি আর টুম্পা ছোট বলে বাসায় তাদেরকে সব সময় চা খেতে দেয়া। হয় না। সেটা নিয়ে অবশ্যি এখন টুনি আর টুম্পার কোনো দুঃখ নেই। যখনই তাদের চা খেতে ইচ্ছে করে তারা মোড়ের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসে, গুল্লু তখন তাদের চা খাওয়ায়।

একেবারে ফার্স্ট ক্লাস চা!

 গো-গো-গোল্ডেন ফাইভ

বসার ঘরে দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখছেন, বড়দের কেউ কেউ খবরের কাগজ পড়ছে, কেউ কেউ ঝুমু খালার তৈরি পায়েশের মতো চা খাচ্ছে, ছোটরা মেঝেতে উবু হয়ে বসে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলছে–তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চাদের একজন মাথা তুলে বলল, “তুমি আজকে কিছু আনো নাই?”

ছোটাচ্চু বলল, “কী আনব?”

“এই তো, চকোলেট না-হলে আইসক্রিম না-হলে কেক–”

আরেকজন বলল, “না-হলে পিজ্জা, না-হলে ফ্রায়েড চিকেন”

আরেকজন বলল, “না-হলে কাচ্চি বিরিয়ানি, না-হলে জালি কাবাব–”

আরেকজন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ছোটাচ্চু তখন ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, “চুপ কর দেখি। তোদের হয়েছেটা কী? সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করিস? মাত্র কালকেই এত বড় একটা চকোলেট কেক আনলাম–”

শান্ত বলল, “মোটেই এত বড় না ছোটাচ্চু, আমি মাত্র চার স্লাইস খেয়েছি!”

একজন চোখ কপালে তুলে বলল, “চার স্লাইস!”

তখন বাচ্চারা কে বেশি সুইস খেয়েছে কে কম সুইস খেয়েছে সেটা নিয়ে নিজেরা নিজেরা ঝগড়া-ঝাটি করতে লাগল। ছোটাচ্চু একটা চেয়ার টেনে দাদির পাশে বসে অন্যমনস্কভাবে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রইল। বোঝা যাচ্ছিল ছোটাচ্চু টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সেখানে কী দেখাচ্ছে সেটা দেখছে না। কিছু একটা চিন্তা করছে।

ছোটাচ্চু হঠাৎ করে মাথা তুলে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই টুনি।”

রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলায় টুনি এই মাত্র সেক্টর কমান্ডার হয়েছে, কাজেই সে অন্য কমান্ডারদের কাকে কী করতে অর্ডার দিবে চিন্তা করতে করতে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল।

ছোটাচ্চু বলল, “তুই আমার সাথে একটু দেখা করবি। আমার ঘরে।”

কথাটা এমন কিছু ভয়ানক কথা নয়, কিন্তু কী হলো কে জানে, হঠাৎ করে সব বাচ্চা খেলা বন্ধ করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। শুধু যে তাকাল তা নয়, কঠিন চোখে আগুন ছড়িয়ে তাকাল।

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “কী হয়েছে? তোরা এভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন?”

একজন বলল, “তুমি শুধু টুনির সাথে কথা বলতে চাও কেন?”

আরেকজন বলল, “আমাদের পছন্দ হয় না?”

আরেকজন বলল, “তুমি টুনিকে যেটা বলতে চাও সেইটা আমাদেরকেও বলতে হবে।”

সবাই তখন একসাথে চিৎকার করে বলল, “বলতেই হবে। বলতেই হবে।”

ঠিক তখন টেলিভিশনে একজন সাজুগুজু করে থাকা মহিলা খুবই কাঁদো কাঁদো গলায় আরেকজন ত্যালতেলে চেহারার মানুষকে কিছু একটা বলছিল, বাচ্চাদের চিৎকারের জন্যে দাদি সেটা শুনতে পেলেন না। দাদি (কিংবা নানি) খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই! তোরা চিৎকার থামাবি? তোদের জ্বালায় শান্তিমতো একটা নাটক পর্যন্ত দেখতে পারি না।”

বাচ্চারা হয় দাদির কথা শুনল না কিংবা শুনলেও তাঁর কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না। আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “বলতে হবে। আমাদের সবাইকে বলতে হবে। এক্ষুনি বলতে হবে।”

দাদি আরো গলা উঁচিয়ে বললেন, “ভাগ এখান থেকে। দূর হ সবগুলো।”

সবাই তখন উঠে ছোটাচ্চুকে ধরে রীতিমতো টেনে টেনে তার ঘরে নিয়ে যেতে শুরু করল। শুধু টুনি সেই টানাটানিতে যোগ দিল না। সবার পিছনে পিছনে শান্ত মুখে হেঁটে হেঁটে ছোটাচ্চুর ঘরে গেল।

ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে বাচ্চারা ছোটাচ্চুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে তার চেয়ারে বসিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, “বলো এখন, তুমি টুনিকে কী বলতে চাইছিলে। বলো।”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আরে! তোরা কী পাগল হয়ে গেলি নাকি? সব কথা সবাইকে বলতে হবে? আমি কি আলাদা করে টুনির সাথে একটু কথা বলতে পারব না?”

সবাই চিৎকার করে বলল, “না, পারবে না।”

“কী মুশকিল! তোদের যন্ত্রণায় আমাকে পাগল হয়ে যেতে হবে।”

একজন বলল, “তোমাকে পাগল হতে হবে না ছোটাচ্চু, তুমি আগে থেকে পাগল।”

ছোটাচ্চু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন টুনি এগিয়ে এসে বলল, “ছোটাচ্চু–”

বাচ্চারা টুনির কথা শোনার জন্যে চেঁচামেচি থামিয়ে চুপ করল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সি.ই.ও. হতে পারো কিন্তু তোমার মাথায় বুদ্ধি খুব বেশি নাই।”

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি তুই?”

“তুমি যদি শুধু আমার সাথে কথা বলতে চাও তাহলে সেটা গোপনে শুধু আমাকে বলতে হবে। সবার সামনে বললে হবে না। এখন দেরি হয়ে গেছে, সবাই জেনে গেছে, এখন যেটা বলতে চাও সেটা তোমাকে সবার সামনেই বলতে হবে। বলো, কী বলতে চাও।”

ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “যা ভাগ এখান থেকে। আমার কাউকেই আর কিছু বলতে হবে না।”

টুনি শান্ত গলায় বলল, “বলে ফেলো ছোটাচ্চু। এই বাসায় কোনো কিছু গোপন নাই, আমরা সবাই সবার সব কিছু জানি।”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ গজগজ করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, বলছি।”

সবাই আরেকটু এগিয়ে এসে ছোটাচ্চুকে ঘিরে দাঁড়াল। ছোটাচ্চু একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফারিয়া একটা প্রজেক্ট করছে, সেটা ছেলে মেয়েদের বিজ্ঞান এবং গণিত-ভীতি নিয়ে। ফারিয়া সে জন্যে কয়েকটা স্কুলে একটা জরিপ চালাতে চায়, সেই জন্যে বলেছে টুনির সাথে একটু কথা বলবে।”

বাচ্চারা ছোটাচ্চুর কথা শুনে খুবই হতাশ হলো, একজন বলল, “এই কথা? এই রকম ফালতু একটা কথা বলার জন্যে তুমি এ রকম ঢং করেছিলে? ছোটাচ্চু, টুনি ঠিকই বলেছে, তোমার মাথায় কোনো বুদ্ধি নাই।”

আরেকজন বলল, “আয় যাই। রাজাকারের খেলাটা শেষ করি।”

শুধু টুনি বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু। তুমি ফারিয়াপুর সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিও। আমি ফারিয়াপুকে আমাদের স্কুলে নিয়ে যাব।”

ছোটাচ্চু শুকনো মুখে বলল, “ঠিক আছে।”

বাচ্চারা সবাই তখন বসার ঘরে ফিরে গেল রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলার জন্যে। চিৎকার, চেঁচামেচি, হইচইয়ের মাঝখানে একসময় যে টুনি খেলা থেকে উঠে এলো সেটা কেউ লক্ষ করল না।

ছোটাচ্চুর ঘরের দরজা খুলে টুনি ভিতরে ঢুকে ছোটাচ্চুর বিছানায় বসে বলল, “বলো ছোটাচ্চু, তুমি আমাকে আসলে কী বলতে চাইছিলে এখন বলো।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “তুই কেমন করে বুঝলি?”

“না বোঝার কী আছে? তুমি এখনও মিথ্যা কথা বলা শিখো নাই। তুমি যখন মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করো তোমার নাকটা একটু মোটা হয়ে যায়, ঠোঁট কাঁপে আর বাম চোখটা ছোট হয়ে যায়।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “না-না-নাক মোটা হয়ে যায়?”

টুনি বলল, “এখন সেগুলো চিন্তা করে লাভ নাই ছোটাচ্চু, যেটা বলতে চাও সেটা বলে ফেলো। একটু পরে অন্যেরা চলে আসবে। অন্য সবাই চলে আসলে তুমি তোমার কথা থামিয়ে দিও। তখন আমি ফারিয়াপুর প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলব, আসলে কী নিয়ে কথা হচ্ছে কেউ টের পাবে না।”

ছোটাচ্চু আরো কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা চুলকাল, তারপর বগল চুলকাল, তারপর গলা পরিষ্কার করে তাকে একটা কাহিনি বলল। কাহিনিটা এ রকম :

ছোটাচ্চু তার অফিসে বসে কাজ করছে তখন তাদের অফিসের সেক্রেটারি রঞ্জনা এসে জানাল একজন মহিলা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। ছোটাচ্চু বলল, মহিলাকে পাঠিয়ে দিতে।

একটু পরেই মহিলা ছোটাচ্চুর অফিসে ঢুকল, মোটাসোটা নাদুসনুদুস মহিলা। ফর্সা, ঠোঁটে লিপস্টিক, বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের ভেতর। সব সময় ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে ভুরুর উপর পাকাপাকিভাবে ভাঁজ হয়ে গেছে। দেখেই মনে হয় দুনিয়ার সবার উপরে খুবই বিরক্ত।

ছোটাচ্চু মহিলাকে তার সামনের চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল, “বলেন ম্যাডাম আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?”

মহিলা খুবই সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি ডিটেকটিভ?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি একা না, আমাদের একটা বড় টিম আছে।”

“আপনার বয়স এত কম, আপনি কী করবেন?”

ছোটাচ্চু বিরক্তি চেপে বলল, “বয়সটা তো ইস্যু না। আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারি কি না সেটা হচ্ছে ইস্যু! আমরা একটা রেজিস্টার্ড প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন, আপনার যদি আমাদের পছন্দ না হয় আপনি আমাদের কাছে আসবেন না, অন্য কোথাও যাবেন!”

“আর তো কেউ নাই আপনারা ছাড়া।”

ছোটাচ্চু জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, “তা ছাড়া আমরা যে সব কেস নিই তাও তো নয়। পছন্দ না হলে আমরা কেস নিই না।”

মহিলা তার কুঁচকানো ভুরু আরো কুঁচকে বলল, “আমার কেসটা আপনারা নিবেন না?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমি সেটা বলিনি। আমি তো আপনার কেসটা এখনও জানিই না। বলেন আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি।”

মহিলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনারা আমার মেয়েটাকে বাঁচান।”

“কী হয়েছে আপনার মেয়ের?”

মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় ড্রাগস!”

ছোটাচ্চু আঁতকে উঠল, বলল, “ড্রাগস! কত বড় মেয়ে আপনার?”

“ক্লাস সেভেনে পড়ে। তেরোতে পা দিয়েছে।”

“এত ছোট মেয়ে ড্রাগস ধরেছে?”

“ধরেছে কি না জানি না, আমি সন্দেহ করছি।”

ছোটাচ্চু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি কেন সন্দেহ করছেন?”

“ড্রাগ এডিক্টের মতো ব্যবহার করে।”

“সেটা কী রকম?”

“কথা বলে না। একা একা থাকে। শুকিয়ে যাচ্ছে, কোনো কিছুতে মনোযোগ নেই। পড়ালেখা করতে চায় না। গত পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ হয় নাই।”

“গোল্ডেন ফাইভ?”

“হ্যাঁ”, মহিলা এবারে ফাঁসফাস করে কাঁদতে শুরু করল, বলল, “আপনি চিন্তা করতে পারেন, আমার মেয়ের পিছনে আমি এত সময় দেই আর সেই মেয়ের গোল্ডেন ফাইভ হয় না? তার জন্যে কতগুলো প্রাইভেট টিচার আর কোচিং রেখেছি আপনি শুনতে চান?”

ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, মহিলা তখন বলতে শুরু করল, “সকালে ফৌজিয়া ম্যাডাম, দুপুরে তালুকদার স্যার, তারপর প্যারাগন কোচিং, রাত্রে বিল্লাহ স্যার–”

ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ের জন্যে এইটা একটু বেশি হয়ে গেল না?”

“বেশি?” মহিলা বেশ অবাক হলো, বলল, “অন্যরা কী করে শুনবেন?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, শুনতে চাই না।”

মহিলা বলল, “মেয়েটার গানের গলা ভালো, সেই জন্যে আমি গানের স্কুলে নেই, অন্যরা তো তাও নেয় না, তাদের সবকিছু বন্ধ। মেয়েটা এখন গানও গাইতে চায় না। আমি ভেবেছিলাম টেলিভিশনে গানের কম্পিটিশনে দিব কিন্তু যদি প্র্যাকটিস না করে কেমন করে কম্পিটিশন করবে?”

ছোটাচ্চু চুপচাপ বসে রইল আর মহিলা টানা কথা বলে গেল। যখন দম নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ঠিক কী করতে হবে?”

“খোঁজ নিয়ে বের করবেন মেয়েটা আসলেই ড্রাগ নেয় কি না। নিলে কী ড্রাগ নেয় আর কার কাছ থেকে সেই ড্রাগ কিনে।”

ছোটাচ্চু মহিলার কথাবার্তা শুনে প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিল এই মহিলার কেসটা নিবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে রাজি হলো। ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে সত্যিই যদি ড্রাগ নেয়া শুরু করে তাহলে তাকে তো সাহায্য করা দরকার। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার মেয়ের নাম কী?”

“আইরিন। ভালো নাম মাহজাবিন বিনতে কায়েস।”

“মেয়ের ছবি আছে আপনার সাথে?”

“হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি।” বলে ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিল। ছোটাচ্চু ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল, ছবিতে ড্রাগ এডিক্ট হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। হাসি-খুশি একটা মেয়ে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাজব্যান্ড কী করেন?”

“ব্যাংকে চাকরি করে।”

“আপনার হাজব্যান্ড কি জানেন আপনি আমাদের এজেন্সিতে এসেছেন?”

“না জানে না। আমার হাজব্যান্ড একেবারে অপদার্থ। সংসারের কোনো কাজকর্মে নাই। মেয়েটাকে মানুষ করার সব দায়িত্ব আমার।”

ছোটাচ্চু ইতস্তত করে বলল, “আপনার হাজব্যান্ডকে ব্যাপারটা জানালে হতো না?”

মহিলা মাথা নাড়ল, বলল “উঁহু, তাকে জানিয়ে লাভ নাই। যা করার আমাকেই করতে হবে।”

ছোটাচ্চু তখন একটা ফরম বের করে মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা ফিল-আপ করে অফিসে জমা দিয়ে যান।”

মহিলা ফরম ফিল-আপ করে কিছু এডভান্স টাকা জমা দিয়ে চলে গেল।

ছোটাচ্চু কাহিনিটা এতটুকু বলে থেমে গেল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?”

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “আমাদের যে নতুন স্টাফ আছে তাদেরকে লাগিয়েছি। তারা আইরিনকে ছায়ার মতো ফলো করেছে কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পায় নাই। মেয়েটা মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে রিকশায় এক কোচিং সেন্টার থেকে আরেক কোচিং সেন্টারে যায়। ড্রাগের কোনো ব্যাপার যদি থাকে সেটা হয় কোচিং সেন্টারের ভিতরে, না-হয় প্রাইভেট টিউটরদের বাসায়। এখানেই আমরা আটকে যাচ্ছি, ভিতরে মেয়েটাকে ওয়াচ করতে পারছি না।”

টুনি সরু চোখে বলল, “সেই জন্যে আমাকে ডেকেছ?”

“হ্যাঁ।”

“আমাকে কী করতে হবে?”

“তুই ভিতরে গিয়ে মেয়েটাকে ওয়াচ করবি। কী করে না করে ওয়াচ করে আমাদের এসে বলবি।”

“আমি ভিতরে কেমন করে ঢুকব?” “দরকার হলে আমি তোকে ঐ কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেব।” টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি? কোচিং সেন্টারে? কখনো না।”

“প্লিজ!” ছোটাচ্চু মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “প্লিজ টুনি, প্লিজ, এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই।”

“তাই বলে আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হব? বড় হলে আমার ছেলেমেয়েদের সামনে আমি কেমন করে মুখ দেখাব? তারা যদি জানে তাদের মা কোচিং সেন্টারে গেছে তাহলে লজ্জার চোটে তারা আত্মহত্যা করে ফেলবে না?”

ছোটাচ্চু কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কিন্তু তুই তো আসলে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছিস না।”

ঠিক তখন কয়েকজন বাচ্চা ছোটাচ্চুর ঘরে এসে ঢুকল, ছোটাচ্চু সাথে সাথে কথা বন্ধ করে ফেলল। টুনি বলল, “না, আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছি না। কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হয়ে আমি কীভাবে সেখানে ফারিয়াপুর জরিপ করব? আমাকে তো কোচিং সেন্টারে ঢুকতেই দিবে না।”

ছোটাচ্চু কী বলবে বুঝতে না পেরে আঁ আঁ ধরনের একটা শব্দ করল। টুনি বলল, “তুমি ফারিয়াপুকে বুঝিয়ে বলো যাদের কোচিং সেন্টারে যেতে হয়েছে তাদের জরিপ নিয়ে লাভ নাই। তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। কাজেই আমরা যদি কোচিং সেন্টারে জরিপ না করি কোনো ক্ষতি হবে। ফারিয়াপু তার চল্লিশ পার্সেন্ট ডাটা এমনিতেই পেয়ে যাবে। তার সাথে বাকি ত্রিশ পার্সেন্ট যোগ করলে”

বাচ্চারা এই ঘরে বসে এই রকম বিরক্তিকর কথার কচকচানি শুনতে রাজি হলো না, তারা মুখ বিকৃত করে বের হয়ে গেল। টুনি আর ছোটাচ্চু তখন আবার আগের আলোচনায় ফিরে গেল, ছোটাচ্চু বলল, “তুই তো আর সত্যি সত্যি কোচিংয়ে ভর্তি হচ্ছিস না। তুই একটা মেয়েকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিস!”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “তাতে কী আছে ছোটাচ্চু, সবাই জানবে আমি কোচিং করি! কোচিংয়ের খাতায় আমার নাম লেখা হয়ে যাবে। ছিঃ!”

ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, তোকে একটা ভুয়া নামে ভর্তি করে দেব। কোচিংয়ের খাতায় তাহলে তোর আসল নাম উঠবে না।”

টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল, “ঠিক আছে তাহলে!”

.

পরদিন ছোটাচ্চুর সাথে টুনি বাসা থেকে বের হলো, অনেক সকাল হওয়ায় বাচ্চাদের বেশিরভাগ তখনো ঘুমে, তাই তারা সেটা টের পেল না। ছোটাচ্চু প্রথমে তাকে তার অফিসে নিয়ে আইরিনের ছবিগুলো দিল। ছবিগুলো ভালো করে দেখে টুনি তার ব্যাগের ভেতর সেগুলো ঢুকিয়ে নিল। ছোটাচ্চু তখন প্যারাগন কোচিং সেন্টারে ফোন করে একটু খোঁজখবর নিয়ে টুনিসহ সেখানে রওনা হলো।

টুনি ভেবেছিল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্যে তারা টুনির কাগজপত্র দেখতে চাইবে কিন্তু সে রকম কিছু হলো না, মনে হলো কেউ টাকা দিতে রাজি হলেই তাকে তারা ভর্তি করে নেয়। আইডি কার্ড বানানোর জন্যে একটা ফটো চাইল, টুনি বলল, পরদিন নিয়ে আসবে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারে টুনির নাম হলো তানিয়া জাহান, সংক্ষেপে তানিয়া।

টুনিকে কোচিং সেন্টারে ঢুকিয়ে ছোটাচ্চু চলে গেল, টুনি তখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকল। এই প্রথম সে একটা কোচিং সেন্টারে এসেছে। সে জীবনেও চিন্তা করেনি যে সে এ রকম একটা জায়গায় আসবে। একসাথে অনেকগুলো ঘরে ব্যাচে ব্যাচে কোচিং হয়। টুনি খোঁজখবর নিয়ে ক্লাস সেভেনের ঘরটাতে ঢুকল। সারি সারি গ্রাস্টিকের চেয়ার, সামনে একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপর কলম দিয়ে এবং মার্কার দিয়ে কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নানা রকম মন্তব্য লিখে গেছে, ছবি এঁকে গেছে। সেগুলো পড়ে পড়েই মনে হয় সময়টা পার করে দেয়া যাবে। ঘরের সামনের দেওয়ালে একটা হোয়াইট বোর্ড ঝুলানো, পিছনে একটা শেলফ, ময়লা-বিবর্ণ গাইড বই দিয়ে ঠাসা, দেখেই মন খারাপ হয়ে যায়। ঘরের দেওয়াল ময়লা, কোনায় কোনায় মাকড়সার জাল। মেঝেতে চিপসের খালি প্যাকেট, বাদামের খোসা, নানা ধরনের লিফলেট, মনে হলো আধখাওয়া সিগারেটের একটা টুকরাও আছে। তবে ঘরটার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে তার বোটকা গন্ধ।

টুনি মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসে, এখান থেকে দরজাটার দিকে তাকিয়ে কে আসছে সে দেখতে পারবে। ছেলে-মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। বেশিরভাগই একজন আরেকজনকে চিনে, নিজেদের ভেতর কথাবার্তা বলছে। টুনি সরাসরি কারো দিকে তাকাচ্ছিল না কিন্তু খুবই মনোযোগ দিয়ে কে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করতে থাকে। বেশিরভাগ কথাবার্তাই ফেসবুক, স্ট্যাটাস, লাইক এই সব নিয়ে। একটা দুইটা হিন্দি সিনেমার নাম শোনা গেল। স্কুলের স্যার-ম্যাডামদের গালাগাল করাও মনে হলো এদের খুব প্রিয় একটা কাজ। টুনি যদিও আইরিন মেয়েটার ছবিগুলো খুব ভালোভাবে দেখে এসেছে কিন্তু যখন সামনাসামনি দেখবে তখন চিনতে পারবে কি না বুঝতে পারছিল না। চেনা মানুষের ছবি দেখে চেনা যায়, অপরিচিত মানুষকে ছবি দেখে সে রকম চেনা যায় না।

কিন্তু আইরিন দরজা দিয়ে ঢোকা মাত্র সে তাকে চিনতে পারল। মেয়েটার চেহারার মাঝে একধরনের উদাসীনতা, মনে হয় নিজের দিকে সে নজর দেয় না। জামা-কাপড় কেমন যেন অগোছাল। এলোমেলো চুল, চোখে চশমা। আইরিন ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা পিছনে চলে গেল। সবার পিছনে এক কোনায় টেবিলে ব্যাগ রেখে সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখল। টুনি তখন আইরিনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। এখন সোজাসুজি তাকানো ঠিক হবে না। টুনি ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করল, খাতার মাঝখানে একটা ছোট চারকোনা আয়না টেপ দিয়ে লাগিয়ে এনেছে, আয়নাটা মেজ চাচির মেক-আপের কমপ্যাক্ট থেকে নেয়া। গাড়ির আয়নার মতো কনভেক্স মিরর হলে আরো ভালোভাবে অনেকটুকু জায়গা দেখা যেত, কিন্তু এখন এটা দিয়েই কাজ চলে যাবে, আইরিনের দিকে না তাকিয়েই সে আইরিনকে দেখতে পারবে। টুনি খাতাটা একটু নাড়াচাড়া করে আয়নার ভেতর দিয়ে আইরিনকে লক্ষ করতে থাকে। মেয়েটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন নিশ্চিত হলো কেউ তাকে লক্ষ করছে না, তখন সে পিছনের বইয়ের শেলফের কাছে গিয়ে গাদাগাদি করে রাখা ছেঁড়া, ময়লা, পুরনো গাইড বইগুলোর পিছনে হাত দেয়, মনে হয় সেখান থেকে সে কিছু একটা নেবে। কী হতে পারে সেটা? ড্রাগস?

ঠিক কী নেবে টুনি দেখতে পারল না কারণ ঠিক তখন তার পাশের মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখো আয়না দিয়ে?”

টুনি তার খাতায় লাগানো আয়নাটা লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “আয়নায় মানুষ কী দেখে?”

“চেহারা?”

“হ্যাঁ।” টুনি এবারে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার ভান করে মেয়েটার দিকে তাকাল, বলল, “আমার আই শ্যাডোটা মুছে গিয়েছে, তাই না?”

মেয়েটা একবার টুনির দিকে তাকাল তারপর ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “তোমার এত বড় চশমা, আই শ্যাডো দেখাই যায় না।”

“বড় হলে আমি কন্টাক্ট লেন্স পরব।”

“কন্টাক্ট লেন্স? চোখের ভিতরে যেটা পরে?”

“ভিতরে না, উপরে।”

“ঐ হলো, একই কথা।” মেয়েটা কেমন জানি গা-ঝাড়া দিয়ে বলল, “কন্টাক্ট লেন্সের কথা চিন্তা করলেই আমার গা শিরশির করে।”

মেয়েটা হাসি-খুশি টাইপের, কথা বলতে পছন্দ করে। কিন্তু টুনি আজকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, কারো সাথে বন্ধুত্ব করে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাই সে আলাপ বন্ধ করার জন্যে ব্যাগের ভেতর থেকে রং পেন্সিলের বাক্স থেকে কালো পেন্সিলটা বের করে সেটা দিয়ে নিজের চোখের নিচে আই লাইনারের দাগ দেয়ার ভান করল, তারপর আয়নাটা ঘুরিয়ে সে আবার আইরিনের দিকে তাকাল, মেয়েটি ডেস্কে মাথা ঝুঁকিয়ে কিছু একটা পড়ছে। শেলফের পিছন থেকে কী নিয়েছে জানা গেল না।

ঠিক তখন, কোথায় জানি এলার্মের মতো একটা কর্কশ শব্দ হলো। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তখন একটু নড়েচড়ে বসল আর প্রায় সাথে সাথে দরজা দিয়ে কোচিংয়ের টিচার এসে ঢুকল–মনে হলো মানুষটা বুঝি দরজার পাশেই এলার্মের শব্দের জন্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল! কমবয়সী চালবাজ ধরনের একজন মানুষ, তার হাতে ফটোকপি করা অনেকগুলো কাগজ। সে কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকাল, এতগুলো ছেলেমেয়ে দেখে তার মুখে একটা আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের স্বাগতম। সবাইকে লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।” মানুষটা ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্যারাগনকে বলেছে ফ্যারাগন, গোলাপকে বলেছে গোলাফ! কী বিচিত্র!

ঘরটা ছোট, হাঁটাহাঁটি করার জায়গা নাই, তার মাঝেই মানুষটা খুব কায়দা করে পায়চারি করার ভান করে থেমে গিয়ে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বলো?”

টুনির ইচ্ছে হলো বলে যে আপনারা প্যারাগনকে বলেন ফ্যারাগন! কিন্তু আসলেই তো আর সেটা বলা যায় না তাই সে চুপ করে রইল, অন্যেরাও বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, কিন্তু ঠিক কী বলল বোঝা গেল না। মানুষটা তখন নিজেই উত্তর দিল, বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মডেল টেস্ট! আমরা একটার ফর একটা মডেল টেস্ট নেই, যেন কোচিং সেন্টারের ছেলেমেয়েদের সব ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত হয়ে যায়।”

টুনির মুখটা নিশপিশ করতে লাগল বলার জন্যে যে শব্দটা ফ্রশ্ন’ না, শব্দটা প্রশ্ন কিন্তু এবারেও সেটা বলতে পারল না! মানুষটা টেবিলের উপর থেকে ফটোকপি করা একটা কাগজ তুলে দিয়ে সেটা উপরে তুলে সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এই যে দেখো মডেল টেস্টের ফ্রশ্ন! তোমরা যদি এই ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে ফারো, তোমাদের গোল্ডেন পাইভ কেউ আটকাতে পারবে না।”

টুনি মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলল, মানুষটা শুধু যে প্রশ্নকে ফ্রশ্ন বলে তা নয়, ফাইভকে বলে পাইভ! কী ভয়ঙ্কর!

মানুষটা হাতের কাগজটা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে আমরা সেটা গ্যারান্টি দেই। আমাদের গ্যারান্টি কঠিন গ্যারান্টি, গোল্ডেন না ফেলে টাকা পেরৎ!”

আবার ফেরতকে বলেছে পেরৎ! মানুষটা চোখ বড় বড় করে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা সবার দিকে তাকাল, মনে মনে হয়তো আশা করেছিল সবাই বুঝি হাততালি দিবে! কিন্তু কেউ কিছু বলল না।

মানুষটা মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, “আমরা লেখাড়া করি কী জন্যে?”

কেউ এবারেও কোনো কথা বলল না, সবাই মডেল টেস্ট দিতে এসেছে, সেটা দিয়ে চলে যাবে, কথাবার্তার মাঝে কারো উৎসাহ নেই। মানুষটা অবশ্যি হাল ছেড়ে দিল না, আবার জিজ্ঞেস করল, “বলো, আমরা লেখাড়া করি কী জন্যে?”

একজন খুবই অনিচ্ছার সাথে বলল, “শেখার জন্যে।”

মানুষটা মনে হলো ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “নো নো নো নো! শেখার জন্যে লেখাড়া করে বোকারা! অনেক কিছু শিখে বোকার মতো ঘরে বসে থাকে। বুদ্ধিমানরা লেখাড়া করে ফরীক্ষায় নম্বর ফাওয়ার জন্যে। শুধু ফরীক্ষায় তারা গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায় না, জীবনের সব জায়গায় গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায়। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি করে। দেশে-বিদেশে যায়। গাড়ি-বাড়ি থাকে। ভালো ঘরে বিয়ে হয়।” (বিয়ের কথা শুনে এক-দুইজন অবশ্যি ফিক করে হেসে দিল)

মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আর যারা শেখার জন্যে লেখাড়া করে তাদের কী হয়? তারা স্কুল-কলেজে চাকরি করে। মাসের শেষে কোনোবার বেতন ফায় কোনোবার বেতন ফায় না। ফ্রাইভেট টিউশনি করে।”

মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, “আপনার মতো?”

সবাই তখন হি হি করে হেসে ওঠে। মানুষটা রেগে উঠে বলল, “কে বলেছে? কে?”

কেউ উত্তর দিল না, শুধু হাসিটা কেমন জানি নিঃশব্দ একটা হাসিতে পাল্টে গেল। মানুষটার উৎসাহ হঠাৎ করে কেমন জানি একটু থিতিয়ে গেল, সে আর বক্তৃতা না বাড়িয়ে সবাইকে মডেল টেস্টের প্রশ্ন দিতে থাকে।

টুনি মাথা ঘুরিয়ে একবার আইরিনকে দেখল। ক্লাসে যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে মনে হয় সে লক্ষই করছে না। একমনে মাথা গুঁজে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছে। মডেল টেস্টের প্রশ্নটা পেয়েও সে সেটা সরিয়ে রাখল, মনে হলো উত্তর দেয়ার ইচ্ছাও নেই!

টুনি যদি মডেল টেস্টের উত্তর না দেয় কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু সে মোটামুটি মাথা খাঁটিয়ে মডেল টেস্টের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিছু সে জানে, সেগুলো নিয়ে সমস্যা নাই। যেগুলো জানে না সেগুলো সে লটারি করে ঠিক করল। অন্যদের শেষ করতে সময় লাগছে, টুনির মোটেই সময় লাগল না।

মডেল টেস্টের উত্তরগুলো নিয়ে মানুষটা সবাইকে সঠিক উত্তর লেখা একটা কাগজ দিয়ে মুখস্থ করতে লাগিয়ে দিল। কী ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার! সবাই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যখন উত্তর মুখস্থ করছে তখন টুনি আবার পিছনে বসা আইরিনকে তার খাতায় লাগানো আয়না দিয়ে লক্ষ করল, সে এখনও গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, মুখস্থ করার দিকে তার কোনো আগ্রহ নেই।

শেষ পর্যন্ত আবার সেই কর্কশ এলার্মের মতো শব্দ হলো এবং সবাই তখন তাদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। টুনিও উঠে আইরিনকে লক্ষ করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ভিড়ের মাঝে তাকে দেখা গেল না। টুনি একটু অপেক্ষা করে, যখন ভিড় কমে গেল তখন দেখল আইরিন নেই। আগেই চলে গেছে। টুনি পেছনের শেলফে পুরানো গাইড বইগুলোর পিছনে কিছু আছে কি না হাত দিয়ে দেখতে চাইছিল কিন্তু তার সুযোগ পেল না। দুইজন ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যে আর নড়ার লক্ষণ নেই। টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু ততক্ষণে অন্য ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা ঢুকতে শুরু করেছে। টুনি বাধ্য হয়ে তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেট খুলে কোচিং সেন্টারের বাইরে এলো। রাস্তার উল্টা পাশে ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি ডানে-বামে তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে ছোটাচ্চুর কাছে যেতেই ছোটাচ্চু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু দেখলি?”

টুনি বলল, “সে রকম কিছু না। শুধু”

“শুধু কী?”

“মেয়েটা ঘরটাতে ঢুকেই শেলফের বইয়ের পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা নিয়েছিল।”

ছোটাচ্চুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক লিড! কী নিয়েছে জানিস না?”

“উঁহু, দেখতে পারি নাই।”

“সমস্যা নাই, কালকে দেখবি। একটু আগে আগে চলে যাবি।”

“ঠিক আছে। কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

টুনি বলল, “এই কোচিং সেন্টারে যদি আমাকে কয়েক দিন যেতে হয় তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। কালকেই শেষ।”

ছোটাচ্চু বলল, “যদি কালকের মধ্যে কেস সলভ করতে পারিস তাহলে তো তোকে আর কোনোদিন যেতে হবে না।”

টুনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ ছোটাচ্চুর সাথে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ছোটাচ্চু বলল, “অফিসে চল, তোকে নানা ধরনের ড্রাগস চিনিয়ে দিই। কাল যদি কিছু একটা পেয়ে যায় তাহলে যেন চিনতে পারিস।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

ছোটাচ্চু মুখটা দার্শনিকের মতো করে বলল, “আমি বুঝতে পারি না, এই বয়সের বাচ্চারা কেমন করে ড্রাগস নেয়া শিখে যায়? কী সর্বনাশ!”

টুনি কোনো কথা বলল না।

.

পরদিন ছোটাচ্চু টুনিকে বেশ আগে প্যারাগন কোচিং সেন্টারে নামিয়ে দিয়ে গেল। টুনি ভেতরে ঢুকে তাদের ক্লাসের জন্যে ঘরটায় গিয়ে দেখে সেখানে অন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বসে মডেল টেস্ট দিচ্ছে। একটু পরেই কর্কশ একটা শব্দ হলো এবং ছেলেমেয়েরা তাদের খাতা জমা দিতে বের হতে শুরু করল। ছেলেমেয়েরা কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করতে করতে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে বের হচ্ছে, এই ফাঁকে টুনি ক্লাসের ভেতর ঢুকে ক্লাসের পিছনে শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পুরানো, ছেঁড়া, বিবর্ণ গাইড বইগুলো দেখার ভান করতে থাকে। আইরিন নামের মেয়েটা শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সেখান থেকে কোনো একটা কিছু বের করে এনেছিল। টুনি একটা গাইড বই বের করার ভান করে পিছনে হাত দেয়। হাতে কিছু একটা লাগল, জিনিসটা ধরতেই বুঝে গেল একটা বই। টুনি বইটা বের করে আনে, বইটার নাম থ্রি কমরেডস, বইয়ের লেখকের নাম এরিখ মারিয়া রেমার্ক!

কী আশ্চর্য! মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে আর সবাই সন্দেহ করছে সে ড্রাগস খায়! টুনি বইয়ের কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে দেখল, এই লেখকের আরো কয়েকটা বইয়ের নাম দেয়া আছে, একটা বইয়ের নাম, অল কোয়ায়েট ইন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট! টুনি এই বইটার নাম শুনেছে, লেখক নিশ্চয়ই বড় লেখক। বইটা জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা, লেখক নিশ্চয়ই জার্মান। একেবারে তার বয়সী এই ছোট মেয়েটা এত বড় বড় বই পড়ে আর তার মা ভাবছে সে বুঝি ড্রাগস খায়! কী আশ্চর্য! শুধু তা-ই না, তাকে ধরার জন্যে মেয়েটির মা ডিটেকটিভ লাগিয়েছে আর টুনি কী না ছোটাচ্চুর বুদ্ধি শুনে বই পড়া এই মেয়েটার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে! কী লজ্জা! কী লজ্জা! টুনির একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে করল।

টুনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বইটা শেলফের পিছনে যেখানে পেয়েছিল সেখানেই রেখে দিল। তার কাজ শেষ, এখন সে চলে যেতে পারে, ছোটাচ্চুকে বলতে পারে আইরিন নামে মেয়েটি মোটেও ড্রাগ খাওয়া মেয়ে নয়। মেয়েটি বই পড়তে ভালোবাসে, বাসায় যেহেতু বই পড়তে দেয় না তাই যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে। কিন্তু ছোটাচ্চু এক ঘণ্টা পর তাকে নিতে আসবে, আগে বের হয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ছোটাচ্চু ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। তাকে এখন অপেক্ষাই করতে হবে। শুধু যে অপেক্ষা করতে হবে তা নয়, চালবাজ মানুষটার ভুল উচ্চারণে কথাবার্তা শুনতে হবে। কীভাবে ছেলেমেয়েগুলো এই ঘরটার মাঝে গাদাগাদি বসে দিনের পর দিন এ রকম একজন মানুষের কথা শুনে?

টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে পড়ল। একসময় ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করে। নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে ঘরটার মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতে থাকে। একসময় আইরিনও ঘরটাতে ঢুকল। ঘরের পিছনে শেলফের সামনে গিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে শেলফের পিছনে হাত দিয়ে তার বইটা বের করে আনল। তারপর ঘরের একেবারে কোনার সিটটাতে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়তে শুরু করে। মনে হয় তার চারপাশে কী ঘটছে সে তা কিছুই শুনছে না–এখানে থেকেও সে এখানে নেই।

কিছুক্ষণ পর কর্কশ একটা এলার্মের মতো শব্দ হলো আর প্রায় সাথে সাথেই গতকালকের সেই চালবাজ মানুষটা এক গাদা কাগজপত্র নিয়ে হাজির হলো। টেবিলের উপর কাগজপত্রগুলো রেখে সে ঘরের মাঝে গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকাল, তারপর গলা

পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।”

টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবল যে মানুষের উচ্চারণ এত খারাপ সে কেন মুখ খুলে?

মানুষটার অবশ্যি উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বলো।”

কেউ কোনো কথা বলল না, মাছের মতো চোখের পাতি না ফেলে সবাই মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “আমাদের কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের মডেল টেস্ট। আমরা ফরতেক দিন মডেল টেস্ট নেই।”

টুনি অবাক হয়ে লক্ষ করল মানুষটা গতকাল যে কথাগুলো বলেছিল আজকেও সেই একই কথাগুলো বলছে! টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মতো, একই কথা একইভাবে প্রত্যেক দিন সবাইকে শোনানো হয়। কী আশ্চর্য। কোচিং সেন্টারে না এলে টুনি জানতেই পারত না এখানে কী হয়। টুনি মানুষটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ক্লাসের অন্যান্যদের লক্ষ করতে লাগল, কত রকম ছেলেমেয়ে, কত আশ্চর্য তাদের মুখের ভঙ্গি। মানুষটা তার বিচিত্র উচ্চারণে টানা কথা বলে যেতে লাগল, টুনি না শোনার চেষ্টা করে অন্যমনস্কভাবে বসে রইল।

“তানিয়া জাহান। তানিয়া–”

টুনি অন্যমনস্ক হয়ে ছিল বলে লক্ষ করেনি মানুষটা তাদের মডেল টেস্টের খাতাগুলো ফেরত দিচ্ছে। নাম ডাকা মাত্র সবাই তাদের খাতা নিচ্ছে কিন্তু তানিয়া জাহানের খাতাটি কেউ নিচ্ছে না এবং তখন টুনির মনে পড়ল এই কোচিং সেন্টারে তার নাম তানিয়া জাহান। সে হাত তুলে দাঁড়াল।

মানুষটা খাতা নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “মডেল টেস্টের ফরীক্ষায় তোমার কী সমস্যা হয়েছে?”

টুনির ইচ্ছা হলো বলে, শব্দটা ফরীক্ষা না, শব্দটা হচ্ছে পরীক্ষা। কিন্তু সেটা বলল না, বলল, “আমার কোনো সমস্যা নাই।”

“তাহলে মডেল টেস্ট এত খারাফ করছ কেন? মাত্র চল্লিশ ফেয়েছ।”

টুনি বলল, “চল্লিশ অনেক নম্বর।”

মানুষটা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে একশতে ফচানব্বই ফেলে ফাস। তোমাদের সবকিছু মুখস্ত করতে দিয়েছি না? মুখস্ত করলা না কেন? লেখাড়া মানেই মুখস্ত। মুখস্ত মানেই লেখাড়া।”

টুনি ভাবল বলে শব্দটা লেখাড়া না, শব্দটা লেখাপড়া এবং মুখস্থ মানেই লেখাপড়া কথাটা মোটেই সত্যি না। কিন্তু কিছু বলল না, একটু পরেই এখান থেকে চলে যাবে আর কোনোদিন আসতে হবে না, শুধু শুধু। এখন কথাবার্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। টুনি হাসি হাসি মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

মানুষটা দুই হাত নেড়ে প্রায় নাচার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, “তোমরা অন্য কোচিং সেন্টারে যাও, তারা তোমাদের উল্টাফাল্টা জিনিস মুখস্ত করতে দিবে। মুখস্ত করবে কিন্তু ফরীক্ষায় সেই জিনিস আসবে না। আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে কখনো সেইটা হয় না। যেটা মুখস্ত করবা সেইটাই ফরীক্ষায় ফাবে। গ্যারান্টি।”

টুনি এবারে আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলল, “আংকেল, পরীক্ষায় কোনটা আসবে সেইটা আপনারা আগে থেকে কেমন করে জানেন?”

মানুষটা কেমন যেন একটু খাবি খেল, তারপর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “সবাই আমাকে স্যার ডাকে, তুমি আংকেল ডাকো, ব্যাফারটা কী?”

টুনি বলল, “কিন্তু আপনি তো আমার স্যার না। যারা পড়ায় তারা স্যার। আপনি তো পড়ান না। আপনি মডেল টেস্ট নেন। মুখস্থ করার জন্যে কাগজ দেন। আপনি আংকেল।”

মানুষটা আরেকবার খাবি খেল। বলল, “আমি আংকেল?”

“হ্যাঁ।” দেখা গেল টুনির সাথে সাথে আরো অনেকে মাথা নেড়ে বলল, “আংকেল! আংকেল!”

মানুষটা এবারে কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল। টুনি তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে আগে থেকে জানেন আমাদের পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে?”

মানুষটা আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “তোমার এত কিছু জানার দরকার কী? আমরা কোন জায়গা থেকে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন আনি সেইটা আমাদের ব্যাফার। তোমরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছ, এখন চোখ বন্ধ করে আমাদের ফ্রশ্ন মুখস্ত করবে। বুঝেছ?”

টুনির কেমন জানি একটা জিদ চেপে গেল। সে ঠান্ডা গলায় বলল, “এক সেকেন্ড আংকেল।” তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে তার একটু মোটা ধরনের বল পয়েন্ট কলম বের করে কলমটা অনেকটা মাইক্রোফোনের মতো করে মানুষটার দিকে ধরে বলল, “আংকেল। এখন বলেন।”

‘আংকেল’ এবারে কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। একটু ভয়ে ভয়ে কলমটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা কী?”

“মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার। আপনি যেটা বলবেন সেইটা রেকর্ড হয়ে যাবে। বলেন আংকেল।”

মানুষটা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “বন্ধ করো। এইটা বন্ধ করো।”

টুনি মানুষটার কথা না শোনার ভান করে বলল, “আংকেল, এখন আপনি বলেন, পরীক্ষার আগে সব প্রশ্ন আপনারা কেমন করে পেয়ে যান?”

মানুষটা হঠাৎ করে ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর কেমন যেন ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে শুট করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের সব ছেলেমেয়ে টুনির দিকে তাকায়, প্রথমে কেউ কোনো কথা বলে না, তারপর হঠাৎ করে সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করে। টুনি চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আইরিন পর্যন্ত তার বই পড়া বন্ধ করে টুনির দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণের ভেতরেই দরজা দিয়ে চালবাজ মানুষটা ফিরে এলো, এবারে সে একা না, তার সাথে আরো কয়েকজন আছে। একজন মোটাসোটা, আরেকজন হালকা-পাতলা, আরেকজন টিশটাশ মহিলা। চালবাজ মানুষটা টুনিকে দেখিলে বলল, “এই মেয়েটা।”

মোটাসোটা মানুষটা বলল, “এই মেয়ে, তুমি আমাদের ইনস্ট্রাক্টরদের কথা রেকর্ড করার চেষ্টা করছ কেন? তোমার ভয়েস রেকর্ডারটা আমাকে দাও।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। দিব না।” তারপর মোটা বল পয়েন্ট কলমটা উপরে তুলে মাইক্রোফোনের মতো মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে ধরল। মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তখন টিশটাশ মহিলা বলল, “এই মেয়ে-তুমি নিজ থেকে যদি না দাও তাহলে আমাদের স্টাফ জোর করে তোমার কাছ থেকে এটা নিয়ে নেবে। তুমি আমাদের কোচিং সেন্টারে এসে আমাদের কথাবার্তা রেকর্ডিং করতে পারো না।”

টুনি বুঝতে পারল অবস্থাটা জটিল থেকে জটিল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু যেহেতু এটা শুরু হয়ে গেছে এখন থামার উপায় নাই। টুনি একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আন্টি, এটা ঠিক হবে না।”

টিশটাশ মহিলা বলল, “এটা ঠিক হবে না?” তুমি কেন বলছ এটা ঠিক হবে না মেয়ে?”

চালবাজ মানুষটা বলল, “এর নাম তানিয়া জাহান। তানিয়া।”

টিশটাশ বলল, “কেন এটা ঠিক হবে না তানিয়া?”

টুনি বলল, “আসলে এটা আমার আসল নাম না। এটা ছদ্মনাম।”

মানুষগুলো একসাথে বলল, “ছদ্মনাম?”

টুনি মাথা নড়ল, বলল, “আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে এখানে কী হয় সেটা ইনভেস্টিগেট করার জন্যে।”

সামনে দাঁড়ানো সবগুলো মানুষের চোয়াল একসাথে ঝুলে পড়ল। মোটাসোটা মানুষটা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কে-কে-কেন?”

“আমি জানি না। মনে হয় গভর্নমেন্ট থেকে দায়িত্ব দিয়েছে।”

মানুষগুলোর চোয়াল এমনিতে ঝুলে ছিল আরো ঝুলে পড়ার কোনো উপায় নাই, তাই এবারে জিভগুলো একটু বের হয়ে এলো। হালকা-পাতলা মানুষটা নাকি গলায় বলল, “গভর্নমেন্ট?”

টুনি উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির একটা কার্ড বের করে মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই যে কার্ডে ফোন নম্বর আছে ফোন করে দেখতে পারেন। ওয়েবসাইটটাও চেক করতে পারেন।”

টিশটাশ মহিলা কার্ডটা নিল, সবাই কার্ডটা ঝুঁকে পড়ে দেখল, তারপর নিজেদের ভেতর গুজগুজ-ফুসফুস করে নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। তারপর একজন কার্ডটা নিয়ে বের হয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর মুখটা কালো করে ফিরে এসে মাথা নাড়ল। টুনি বুঝতে পারল ছোটাচ্চুর সাথে ফোনে কথা বলে এসেছে, কী হচ্ছে ছোটাচ্চু কিছুই বুঝতে পারেনি কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে টুনি এখানে আছে।

মানুষগুলো নিজেদের ভেতর আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মোটাসোটা মানুষটা গলার মাঝে মধু ঢেলে বলল, “এই যে খুকি, মনে হয় আমাদের মাঝে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আমাদের ইনস্ট্রাক্টর ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, সেটা কীভাবে বলেছেন আর তুমি সেটাকে কীভাবে নিয়েছ এটা নিয়ে মনে হয় একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।”

টুনি হঠাৎ করে বুঝে গেল মানুষগুলো ভয় পেয়েছে। সে এখন ইচ্ছে করলে যা খুশি তা-ই বলতে পারবে, আরো ভয় দেখাতে পারবে। তাই কলমটা মাইক্রোফোনের মতো নিজের মুখের কাছে ধরে বলল, “আংকেল এখানে সবাইকে বলেছেন আমাদের পরীক্ষায় কী আসবে সেটা মডেল টেস্ট করিয়ে আমাদের মুখস্থ করিয়ে দেবেন। একশ ভাগ গ্যারান্টি। আমি জানতে চেয়েছিলাম আংকেল আগে থেকে কেমন করে জানবেন কোনটা পরীক্ষায় আসবে! স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্ন তো গোপন।”

মোটাসোটা মানুষ চালবাজ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এটা বলেছ?”

চালবাজ মানুষ খাবি খেয়ে বলল, “না মানে ইয়ে আমি শুধু বলেছি ফ্রত্যেক দিন আমরা মডেল টেস্ট নেই–”

যে কথাটা বলার জন্যে গত দুই দিন টুনির মুখটা নিশপিশ করছিল শেষ পর্যন্ত সেটা বলেই ফেলল, “আংকেল আপনি বলছেন ফরতেক, আসলে উচ্চারণটা হচ্ছে প্রত্যেক।”

কয়েক সেকেন্ড ঘরের মাঝে কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ একজন হাসি চাপতে না পেরে নাক দিয়ে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে ফেলল। হাসি খুবই সংক্রামক একটা ব্যাপার, তাই সেটা শুনে আরেকজন, তারপর আরেকজন, তারপর ঘরের সবাই প্রথমে চাপা তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। চালবাজ মানুষটা প্রথমে লাল তারপর নীল তারপর বেগুনি হয়ে গেল, তারপর বেগুনির মাঝে ছোপ ছোপ লাল আর নীল রং দেখা যেতে লাগল।

টুনি বুঝতে পারল সে এখন পর্যন্ত যেটুকু করেছে সেটা অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ছোটাচ্চু জানতে পারলে তার খবর হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। বড় কিছু অঘটন ঘটে যাবার আগে তার এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। টুনি তাই কিছুই হয়নি সে রকম একটা ভাব করে খুব ধীরে ধীরে তার ব্যাগের ভিতর তার খাতাপত্র ঢোকাল, তার মোটা কলমটা রাখল, তারপর ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু ঠিক কী বলবে কীভাবে বলবে বুঝতে না পেরে ইতিউতি করতে লাগল, খাবি খেতে লাগল।

টুনি ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে কোচিং সেন্টারের কুৎসিত বিল্ডিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এসে বুকের ভেতরে আটকে থাকা নিশ্বাসটা বের করে দিল। কোচিং সেন্টারে এইমাত্র নাটকটা করে আসা ঠিক হলো কি না সে এখনও বুঝতে পারছে না।

রাস্তায় পা দিয়ে সে মাত্র কয়েক পা হেঁটেছে তখন সে হঠাৎ শুনল পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে, “এই যে, এই যে শোনো–”

টুনি ঘুরে তাকাল, দেখল আইরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে হেঁটে আসছে। টুনি দাঁড়িয়ে গেল। আইরিন কাছে এসে বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ক্লাসটাতে ছিলাম, আমার নাম আইরিন।”

টুনি ভাবল বলে, আমি জানি! তোমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আমি এই কোচিং সেন্টারে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা বলল না। বলল, “আমার আসল নাম টুনি।”

“টুনি, তুমি আজকে কোচিং সেন্টারে যেটা করেছ সেটা এমনই আশ্চর্য ঘটনা যে আমি দেখে বেকুব হয়ে গেছি।”

টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “কাজটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না, মনে হয় বড় বড় মানুষদের সাথে বেয়াদবি করে ফেলেছি!”

“করলে করেছ। কিন্তু একেবারে সত্যি কথা বলেছ। তুমি আসলেই ডিটেকটিভ এজেন্সির মেয়ে? ডিটেকটিভ এজেন্সিতে এত ছোট মেয়ে কাজ করে?”

টুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “আমার ছোটাচ্চুর এজেন্সি। সেই জন্যে মাঝে মাঝে ছোটাচ্চুর জন্যে কাজ করে দেই। ছোটাচ্চু অবশ্যি খুবই বিরক্ত হয়। আজকে এখানে কি হয়েছে শুনলে মনে হয় আমাকে খুনই করে ফেলবে।”

আইরিন মেয়েটা হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসতে হাসতে কোনোমতে বলল, “ফরতেক–” তারপর আবার হাসতে শুরু করল, হাসি আর থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। হাসি নিশ্চয়ই খুবই ছোঁয়াচে একটা বিষয়, তাই আইরিনকে দেখে টুনিরও হাসি পেয়ে গেল। এখন সেও একটু একটু করে হাসতে শুরু করল।

অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আইরিন বলল, “কত দিন পর আমি হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলেই গিয়েছিলাম।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি হাসতে ভুলে গিয়েছ?”

আইরিন মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক জটিল ব্যাপার তোমাকে বললেও তুমি বুঝবে না।”

টুনি বলল, “ও।” তারপর চুপ করে গেল। একজনকে নিজে থেকে কথা বলতে দিতে হয়। মেয়েটা মনে হয় নিজে থেকেই বলবে তাই টুনি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

দুইজন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে আইরিন একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “আইসক্রিম খাবে?”

টুনি মাথা নাড়ল, “খাব।”

আইরিন বলল, “টেনেটুনে আমার একটা আইসক্রিমের পয়সা হবে, দুইজনে ভাগাভাগি করে খেতে হবে।”

টুনির কাছে কিছু টাকা আছে, ইচ্ছে করলে দুইজন মিলে দুইটা আইসক্রিম খেতে পারে কিন্তু টুনি কিছু বলল না। দুইজন মিলে একটা আইসিক্রম খেলে মেয়েটা তাড়াতাড়ি তার কাছে সহজ হবে, একধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।

টুনির ধারণা সত্যি, মেয়েটা একটুখানি খেয়ে টুনির হাতে আইসক্রিমটা দিয়ে বলল, “আমি যখন কোচিংয়ে আসি আম্মু আমাকে দরকার থেকে একটা পয়সা বেশি দেয় না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না।”

টুনি বলল, “তবু শুনি।”

“আমার আম্মুর ধারণা আমাকে দরকার থেকে বেশি টাকা দিলে আমি সেটা দিয়ে ড্রাগস কিনে খাব।”

কথা শুনে চমকে যাবার মতো টুনি একটা অনবদ্য অভিনয় করল। আইরিন বলল, “আমার আম্মুর যন্ত্রণায় জীবন শেষ। জিপিএ ফাইভ ছাড়া আম্মু আর কিছু বুঝে না।”

টুনি বলল, “সত্যি?”

আইরিন বলল, “জিপিএ ফাইভ নিয়ে তোমার আম্মু তোমাকে জ্বালায়?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ। আমি কোন ক্লাসে পড়ি আমার আব্বু আম্মু মনে হয় ভালো করে জানেও না।”

“সত্যি?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি।”

“তোমাকে প্রাইভেট পড়তে হয় না? কোচিং যেতে হয় না?”

টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমাদের বাসায় আমরা সবাই একসাথে থাকি। কেউ প্রাইভেট পড়ে না, কোচিংয়ে যায় না। বাসার নিয়ম হচ্ছে নিজে পড়লে পড়ো না পড়লে নাই।”

আইরিন প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করল, “না পড়লে নাই?”

টুনি মাথা নাড়ল। আইরিন খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার উপর কী ভয়ানক চাপ তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আব্বু বেশি কিছু বলে না কিন্তু আম্মু আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে। আমার আম্মু বাসা থেকে সব গল্পের বই সরিয়ে দিয়েছে।”

“সত্যি?”

আইরিন মাথা নাড়ল। বলল, “সত্যি। আমার গল্প বই পড়তে এত ভালো লাগে কিন্তু আমাকে পড়তে দেয় না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। চুরি করে পড়ি।”

টুনি কোনো কথা বলল না। আইরিন বলল, “ভোররাতে আম্মু ঘুম থেকে ডেকে তুলে, প্রথমে এক জায়গায় প্রাইভেট পড়তে পাঠায়, সেখান থেকে আরেক জায়গায়। স্কুলের পর কোচিং, রাতে আবার প্রাইভেট। পরীক্ষার পর খুনের আসামির মতো আমাকে একটা একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে দেখে। আমার পড়ালেখা থেকে মন উঠে গিয়েছে, পড়তে ইচ্ছা করে না। পরীক্ষা দিতেও ভালো লাগে না। গত পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয় নাই তাই আম্মুর কী রাগ! পারলে আমাকে খুন করে ফেলে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা উঠতে-বসতে শুধু খোটা দিয়ে কথা।”

দুইজন কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে যায়। তারপর আইরিন বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলে টুনি আমি কি ঠিক করেছি?”

“কী ঠিক করেছ?”

চুল কেটে ছেলে সেজে শার্ট-প্যান্ট পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব।”

টুনি ভয়ানক চমকে উঠল, বলল, “পালিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ, পালিয়ে যাব। একটা টেম্পুর হেল্পার হয়ে জীবন কাটিয়ে দিব। ভালো না আইডিয়াটা?”

টুনি মাথা চুলকাল, বলল, “ইয়ে মানে আমার মনে হয়—”

আইরিন বলল, “আমি এখনও কাউকে বলিনি আমার প্ল্যানটা। তোমাকেই প্রথমে বললাম।”

টুনি বলল, “থ্যাংকু।”

আইরিন অনেকটা নিজের মনে বলল, “আমি জানি কেউ যদি আমার প্ল্যানটা শুনে ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মাথা খারাপ হয় নাই। আমি যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যাই তাহলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আম্মুর অত্যাচারে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবেই যাবে। খোদার কসম।”

টুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আইরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি জানো আমার আম্মু কি করেছে?”

“কী করেছে?”

“আমি ড্রাগ খাই কি না দেখার জন্যে আমার পিছনে লোক লাগিয়েছে। পারলে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দেবে।”

টুনি খুব অস্বস্তির সাথে নিজের মাথা চুলকে এদিক-সেদিক তাকাল। মেয়েটা যদি শুধু জানতে পারে তার মা ডিটেকটিভ সতি সত্যি লাগিয়ে দিয়েছে আর সে হচ্ছে সেই ডিটেকটিভ তাহলে মনে হয় মেয়েটা হার্টফেল করেই মরে যাবে!

দুজনে তখন হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে এসেছে, টুনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “চলো আরেকটা আইসক্রিম খাই!”

“আরেকটা?”

“হ্যাঁ, আমার কাছে টেনেটুনে একটা আইসক্রিমের দাম হয়ে যাবে। আবার ভাগাভাগি করে খাব। আলাদা আলাদা খাওয়ার থেকে ভাগাভাগি করে খেতে বেশি মজা।”

আইরিন বলল, “ঠিকই বলেছ।”

তারপর তারা আরেকটা আইসক্রিম কিনে দুইজন ভাগাভাগি করে খেতে খেতে হাঁটতে থাকে। আইরিন বলল, “আমার পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যানটা কেমন মনে হচ্ছে?”

টুনি বলল, “মনে হয় ভালোই। তবে–”

“তবে কী?”

“এটা হোক প্ল্যান বি।”

“প্ল্যান বি?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আগে প্ল্যান এ কাজে লাগানো যাক। সেটা যদি কাজ না করে তখন প্ল্যান বি-তে যাবে।”

“প্ল্যান এ তাহলে কী হবে?”

“তুমি একটু আগেই বলেছ।”

আইরিন বলল, “আমি বলেছি?”

টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, বলেছ।”

“কী বলেছি?”

“তুমি বলেছ তুমি যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যাও তাহলে পাগল হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ বলেছি। আসলেই পাগল হয়ে যাব।”

টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে পাগল হয়ে যাচ্ছ না কেন? পাগল হয়ে যাও।”

“পাগল হয়ে যাব?”

“হ্যাঁ। ভান করো পাগল হয়ে যাচ্ছ।”

আইরিন কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ করে বুঝতে পারল টুনি কী বলছে। তার চোখ দুটো প্রথমে বড় বড় হয়ে গেল, সেখানে অবিশ্বাস, তারপর হঠাৎ করে তার সারা মুখ হাসির দমকে কেঁপে উঠল। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে টুনির পিঠে একটা থাবা দিয়ে বলল, “হায় খোদা! তোমার মাথায় এত দুষ্টু বুদ্ধি!”

টুনি বলল, “না, আইরিন এটা দুষ্টু বুদ্ধি না। বড়দের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে একটা রাস্তা। বড়রা আমাদের বুঝতে পারে না তো, তাই মাঝে মাঝে এ রকম একটা-দুইটা বুদ্ধি বের করতে হয়।”

“তুমি আগেও এ রকম করেছ?”

টুনি মাথা নাড়ল, “করেছি। নিজের জন্যে করতে হয় নাই, অন্যদের জন্যে করেছি। যে রকম আজকে একটু আগে–”

“একটু আগে কী?”

“ঐ যে কোচিং ক্লাসে মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করেছি।”

আইরিন চোখ কপালে তুলে বলল, “ঐটা ভুয়া?”

“হ্যাঁ।”

“ডিটেকটিভ এজেন্সি? সেটাও ভুয়া?”

“না, ওটা সত্যি। আমার ছোটাচ্চুর আসলেই একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। তবে ছোটাচ্চু কোচিং সেন্টারের দুই নম্বরি কাজকর্ম দেখার জন্যে আমাকে পাঠায় নাই।”

“তাহলে কী জন্যে পাঠিয়েছে?”

টুনি হঠাৎ করে বিপদে পড়ে গেল। ইচ্ছা করলেই সে বানিয়ে একটা উত্তর দিতে পারে, আইরিন কোনোদিন সেটা ধরতে পারবে না। কিন্তু যে মেয়েটার সাথে আইসক্রিম ভাগাভাগি করে খেতে খেতে বন্ধুর মতো গল্প করে করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে প্ল্যান এ দাঁড়া করাচ্ছে, তার সাথে কেমন করে মিথ্যা কথা বলে? তাই সে সত্যি কথাটাই বলল, “আইরিন, আমার এসাইনমেন্টটা তোমাকে বলা যাবে না।”

আইরিন হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টুনির দিকে তাকাল তারপর মেঘ স্বরে বলল, “তুমি আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে গিয়েছ? ঠিক কি না? আমার আম্মু তোমার ছোটাচ্চুকে আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে পাঠিয়েছে। সত্যি কি না বলো?”

টুনি ইচ্ছে করলেই হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতে পারত কিন্তু সেটা করল না। অপরাধীর মতো মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি।”

আইরিন কয়েক সেকেন্ড টুনির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি তাহলে আমার উপরে গোয়েন্দাগিরি না করে চলে যাচ্ছ কেন?”

ধরা যখন পড়েই গিয়েছে তখন সত্যি কথা বলাটাই ভালো। টুনি বলল, “আমার যা জানার দরকার জেনে গিয়েছি।”

“কী জেনেছ?”

“তুমি মোটেও ড্রাগ খাও না। লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ো। এখন পড়ছ এরিখ মারিয়া রেমার্কের লেখা থ্রি কমরেডস। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়া হয়েছে। কোচিং ক্লাসের পিছনের শেলফের দ্বিতীয় তাকের পিছনে তুমি বইটা লুকিয়ে রাখো।”

আইরিন চোখ কপালে তুলে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “তুমি কেমন করে জানো?”

“কোচিংয়ের ঘরটাতে বসে বসে তোমাকে লক্ষ করেছি। খুবই সোজা। আজকে তুমি আসার আগে শেলফের পিছনে বইটা দেখেছি। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠাটা ভাজ করা ছিল।”

টুনি কথা শেষ করে আইরিনের দিকে তাকাল তারপর বলল, “তুমি কী আমার উপর রাগ হয়েছ?”

আইরিন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, তোমার উপর রাগ হয়ে কী করব। রাগ হচ্ছে আমার আম্মুর উপর। আমাকে এইটুকু বিশ্বাস করে না। দেখেছ?”

টুনি আইরিনের পিঠে বন্ধুর মতো হাত রেখে বলল, “প্লিজ, তুমি আমার উপর রাগ হয়ো না। চলো এক জায়গায় বসে তোমার প্ল্যান এ ঠিকমতো রেডি করি, যেন কোনোদিন তোমার প্ল্যান বি পর্যন্ত যেতে না হয়। তোমার প্ল্যান বি খুবই ডেঞ্জারাস।”

আইরিন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “চলো।”

.

রাত্রে দাদির (কিংবা নানি) বসার ঘরে সবাই বসে নিজের কাজকর্ম করছে। এক কোনায় বসে বাচ্চারা খেলছে। ঝুমু খালা ট্রেতে করে তার বিখ্যাত পায়েশের মতো চা নিয়ে এসেছে, সবাই কাড়াকাড়ি করে সেটা খাচ্ছে, তখন ছোটাচ্চু বসার ঘরে ঢুকল। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বাঘের মতো গর্জন। করে বলল, “টুনি কই?”

টুনি বাচ্চাদের মাঝেই ছিল, চি চি করে বলল, “এই যে এইখানে।”

“এক্ষুনি আমার ঘরে আয়। তোর সাথে কথা আছে।”

কোচিং সেন্টারে গোলমাল পাকিয়ে বের হওয়ার পর টুনির সাথে আর ছোটাচ্চুর দেখা হয় নাই। তার মাঝে এত কিছু ঘটে গেছে যে ছোটাচ্চু রেগে যেতেই পারে। টুনির বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকে, কিন্তু সে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর পিছু পিছু তার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। বাচ্চারা সবাই উঠে দাঁড়াল তারপর তারাও লাইন বেঁধে টুনির পিছু পিছু ছোটাচ্চুর ঘরে রওনা দিল।

ছোটাচ্চু তার ঘরে ঢুকে পিঠ সোজা করে চেয়ারে বসল, তারপর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টুনিকে ডেকেছি। তোদের কাউকে ডাকিনি। তোর বের হ।”

বাচ্চারা কেউ বের হবার কোনো লক্ষণ দেখাল না। যে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। ছোটাচ্চু আবার গর্জন করল, “কী বলছি, কথা কানে যায় না? বের হ সবাই। গেট আউট।”

বাচ্চারা নড়ল না, ছোটাচ্চুর কথা না শোনার ভান করে দাঁড়িয়ে রইল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি যেটা বলতে চাও সবার সামনে বলে ফেলো। এই বাসায় সবাই সবকিছু জানে। কোনো গোপন জিনিস নাই।”

ছোটাচ্চু আস্তে আস্তে আরো রেগে উঠল, তারপর কঠিন গলায় বলল, “আজ সকালে কেন প্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে ফোন করে তোর কথা আমার কাছে জানতে চাইল? কেন?”

ছোটাচ্চু কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “কোচিং সেন্টার? ইয়াক থুঃ। ছি ছি ছি। ঘেন্না ঘেন্না। বমি করে দেই। টুনি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে? হায় হায় হায়!”

টুনি বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই নাই। ছোটাচ্চুর একটা কেস সলভ করার জন্যে ছোটাচ্চু আমাকে পাঠিয়েছিল।”

বাচ্চারা তখন একটু শান্ত হয়। একজন বলল, “তাই বলো!”

আরেকজন বলল, “ভিতরে কী রকম টুনি আপু? লোকজন কি চাবুক নিয়ে থাকে?”

“ব্রেন নষ্ট করার জন্য কী জানি ওষুধ খাওয়ায় সেইটা কি সত্যি?”

“যারা যায় তার নাকি আস্তে আস্তে জম্বির মতো হয়ে যায়?”

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা বন্ধ করবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বল, আজকে সন্ধেবেলা প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার সাথে টাকার বস্তা নিয়ে দেখা করতে এসেছে? কেন আমাকে বলছে গভর্নমেন্টকে রিপোর্ট না দিতে, তাহলে আমাকে সেই টাকার বস্তা দিয়ে দিবে! তুই কী করেছিস? কী বলেছিস তাদের?”

শান্ত আনন্দে চিৎকার করে বলল, “টাকার বস্তা? কোথায় ছোটাচ্চু টাকার বস্তাটা? আমাদেরকে দেখাও!”

আরেকজন বলল, “কত টাকা ভিতরে? গুনেছ?”

শান্ত বলল, “আমাদেরকে দাও ছোটাচ্চু, গুনে দেই! খোদার কসম এক টাকাও সরাব না।”

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা কি ভেবেছিস আমি দুই নম্বরি মানুষ? কেউ টাকার বস্তা নিয়ে আসলেই আমি সেটা নিয়ে নেব?”

শান্ত বলল, “ঠিক আছে তুমি না নিলে, আমাদেরকে দিয়ে দাও! কী বলিস তোরা?”

বাচ্চারা মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু আরো রেগে উঠল বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা থামাবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই বল। কী হয়েছে?”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু। কিছুই হয় নাই। তুমি আইরিনকে ওয়াচ করার জন্য পাঠিয়েছ, আমি ওয়াচ করেছি। মেয়েটা খুবই সুইট। কোনোরকম সমস্যা নাই, গল্প বই পড়তে ভালোবাসে। বইয়ের শেলফে মোটেও ইয়াবা লুকিয়ে রাখে না, গল্পের বই লুকিয়ে রাখে। থ্রি কমরেডস, এরিখ মারিয়া রেমার্কের বই। এরিখ মারিয়া রেমার্ক চিনেছ তো? যে অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট লিখেছিল।”

ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “আমাকে তোর এরিখ মারিয়া রেমার্ককে চিনাতে হবে না। যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমাকে টাকা ঘুষ দিতে চায়?”

টুনি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলল, “ওটা কিছু না।”

“কিছু না মানে? কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার কাছে টাকার বস্তা নিয়ে আসবে? কী করেছিস তুই?”

টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু করি নাই। শুধু–”

“শুধু কী?”

“যে লোকটা মডেল টেস্ট নেয় তার উচ্চারণ খুব খারাপ। প্যারাগনকে বলে ফ্যারাগন, গোলাপ ফুলকে বলে গোলাফ পুল, প্রত্যেককে বলে ফরতেক–”

বাচ্চারা হি হি করে হাসতে থাকে তখন ছোটাচ্চু তাদেরকে একটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”

বাচ্চারা চুপ করল। ছোটাচ্চু, “উচ্চারণ খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে?”

টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু হয় নাই। কিন্তু যখন বলল, পরীক্ষার আগেই তারা পরীক্ষার প্রশ্ন দিয়ে দেবে–”

“তাই বলেছে?”

“না। বলেছে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন–মানে পরীক্ষার প্রশ্ন।”

“তখন তুই কী করেছিস?”

“তখন আমি ভান করেছি তার কথা রেকর্ড করেছি। যখন আমার ভুয়া ভয়েস রেকর্ডার কেড়ে নিতে চেয়েছে তখন তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কথা বলে একটু ভয় দেখিয়েছি।”

বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “ঠিক করেছে। টুনি ঠিকই করেছে। একশ বার!”

শান্ত বলল, “প্যারাগন কোচিং সেন্টারকে জ্বালিয়ে দিতে হবে।”

আরেকজন বলল, “জ্বালো জ্বালো। আগুন জ্বালো।”

অন্যেরা বলল, “ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।”

তখন সবাই চিৎকার করে উঠল, “ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক।”

ছোটাচ্চু আরেকটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”

বাচ্চারা চুপ করল তখন ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে এখন আমি কী করব?”

টুনি হাত উল্টে বলল, “তোমার ইচ্ছা!”

তারপর খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বাচ্চারাও তার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। শান্ত চিৎকার করে বলল, “টুনি টুনি টুনটুনি–”

অন্যেরা চিৎকার করে বলল, “লাল গুলাফের শুভেচ্ছা!” তারপর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

ছোটাচ্চুর ঘরে যখন এসব ঘটছে তখন আইরিনের বাসায় সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করেছে।

আইরিনের আম্মু টেবিলে খাবার দিয়ে গলা উঁচু করে আইরিনকে খেতে ডাকলেন। আইরিন তার ঘরে, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। তখন আম্মু আবার ডাকলেন, এবারেও আইরিন কোনো জবাব দিল না। তখন আইরিনের আব্বু ডাকলেন, “আইরিন মা, খেতে আয়।”

এবারেও কোনো জবাব না শুনে আম্মু আর আব্বু দুইজনেই তার ঘরে গেলেন। দেখলেন আইরিন তার পড়ার টেবিলে পিঠ সোজা করে বসে আছে, হাতে একটা বই ধরে রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। আম্মু আইরিনের পিঠে হাত দিয়ে ডাকলেন, “আইরিন।”

আইরিন কেমন যেন ভয়ানকভাবে চমকে উঠে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী? কী? কী হয়েছে? কী হয়েছে আম্মু?”

আম্মু বললেন, “খেতে ডাকছি, শুনিসনি?”

“না আম্মু, অঙ্কটা মুখস্থ করছিলাম। শুনি নাই।”

“পরে মুখস্থ করবি। আয় খেতে আয়।”

আইরিন উঠে দাঁড়াল, তারপর অনেকটা রবোটের মতো হেঁটে হেঁটে খাবার টেবিলে গিয়ে পিঠ সোজা করে বসে রইল। চোখটা আধ-খোলা, ঠোঁট নড়ছে, কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে।

আম্মু আর আব্বু অবাক হয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আব্বু বললেন, “খেতে বসেছিস, এখন খা, মা।”

আইরিন বলল, “খাব আব্বু।”

আম্মু প্লেটে ভাত দিলেন। আইরিন ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, একটা একটা করে ভাত গুনতে লাগল।

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী করিস?”

আইরিন গোনা থামিয়ে বলল, “কিছু করি না।”

আম্মু প্লেটে সবজি দিলেন। একটা বড় পাবদা মাছ দিলেন, আইরিনের পছন্দের মাছ। আইরিন সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে মাছটা খেতে গিয়ে থেমে গেল। মাথা নিচু করে প্লেটের সাথে প্রায় মাথাটা ছুঁইয়ে মাছের মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, “কী করিস?”

“দেখো আম্মু। মাছটা কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখেছ?”

আম্মু আবার ধমক দিয়ে বললেন, “মাছ আবার তাকিয়ে থাকে কেমন করে? খেতে বসেছিস খা।”

আইরিন মাছটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল, ডানে-বামে মাথাটা নাড়াল, তারপর খেতে শুরু করল। আম্মু ধমক দিলেন, বললেন, “ঢং করবি না। ঠিক করে খা।”

আব্বু বললেন, “আহ্, কেন বকছ! মেয়েটাকে খেতে দাও।”

আইরিন খাওয়া শেষ করে আবার টেবিলে বসে দুলে দুলে অঙ্ক মুখস্থ করতে লাগল। রাত বারোটার সময় আম্মু এসে দেখলেন তখনো আইরিন গুনগুন করে কিছু একটা পড়ছে। আম্মু নরম গলায় বললেন, “যা, এখন ঘুমাতে যা।”

আইরিন বলল, “আর দুইটা অঙ্ক মুখস্থ করে নিই আম্মু।”

আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা, অনেক সকালে উঠতে হবে।”

“তাহলে আরেকটা অঙ্ক মুখস্থ করি? মাত্র একটা?”

“না। এখন ঘুমা।”

“পরে যদি গোল্ডেন ছুটে যায়?” কথা শেষ করে আইরিন কেমন জানি শিউরে উঠল।

আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা।”

আইরিন তখন বাধ্য মেয়ের মতো ঘুমাতে গেল। এক দিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে।

.

পরের দিন স্কুল থেকে এসে আইরিন ব্যাগটা ঘরে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। আম্মু এসে বললেন, “কী হয়েছে? শরীর খারাপ?

“না আম্মু। একটু মনে মনে রিভিশন দিচ্ছি।”

“যা, গোসল করে খেতে আয়।”

আইরিন উঠে বাথরুমে গেল এবং আম্মু সাথে সাথে শাওয়ারের শব্দ শুনতে পেলেন। আম্মু অবাক হয়ে সাবধানে বাথরুমের দরজায় উঁকি দিলেন, দেখলেন স্কুলের পোশাক পরে আইরিন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঝরঝর করে পানি তার চুল মাথা বেয়ে কাপড় ভিজিয়ে পড়ছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস তুই? কী করছিস?”

আইরিন জানতে চাইল, “কী করছি?”

“স্কুল ড্রেস পরেই গোসল করছিস?”

আইরিন অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকাল, তারপর জিভে কামড় দিয়ে বলল, “হায় হায়! কী বোকা আমি!”

আইরিন শাওয়ার থেকে বের হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু দেখলেন তার হাতে মার্কার দিয়ে লেখা গোল্ডেন ফাইভ! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো, হাতে গোল্ডেন ফাইভ লিখেছিস কেন?”

“যেন ভুলে না যাই। গোল্ডেন ফাইভ পেতেই হবে। তাই না আম্মু?”

আম্মু দুর্বল গলায় বললেন, “হ্যাঁ। পেতে হবে।”

আইরিন গলা উঁচিয়ে বলল, “পেতে হবে না। পেতেই হবে।”

আইরিনের পরিবর্তনটা খুবই স্পষ্ট। সারাক্ষণই বিড়বিড় করে কিছু একটা মুখস্থ করছে। কথা বললে একেবারে শুনতে পায় না। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে হঠাৎ শুনতে পায় এবং তখন ভীষণভাবে চমকে ওঠে। খেতে বসলে অন্যমনস্কভাবে খেতেই থাকে। রাতে ঘুমায় না। বাসায় সব আলো জ্বালিয়ে হাতে একটা বই নিয়ে মুখস্থ করতে করতে সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায়। বিড়বিড় নিজের মনে কথা বলে। একদিন গভীর রাতে রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে আম্মু গিয়ে দেখেন বিশাল একটা ডেকচিতে পানি চাপিয়ে আইরিন সেখানে চাল দিয়ে পানি গরম করছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস আইরিন?”

“ভাত রান্না করছি।”

“কেন?”

প্রশ্নটা শুনে আইরিন খুব অবাক হয়ে গেল, বলল, “কেন আম্মু? ভাত রান্না করতে হবে না?”

আম্মু বললেন, “না তোকে ভাত রান্না করতে হবে না। ঘুমুতে যা।”

আইরিন বলল, “ঘুমাতে পারি না আম্মু।”

“ঘুমাতে পারিস না?”

“না, ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি পরীক্ষা দিচ্ছি আর একটা প্রশ্নের উত্তরও মনে পড়ছে না। সব ভুলে গেছি। তখন মনে হয় গোল্ডেন ফাইভ হবে না। তখন ভয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না।”

আম্মু বললেন, “তোকে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।” •

আইরিন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, আম্মু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। আমার কিছু হয় নাই। আমি ভালো আছি, একদম ভালো আছি। আমার কোনো ঝামেলা নাই আম্মু। আমি ভালো আছি।”

আম্মু তখন আইরিনকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেন। আইরিন লম্বা হয়ে চোখ খোলা রেখে শুয়ে থাকে।

.

সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে আম্মু দেখলেন আইরিনের চোখ লাল (চোখ সাবান দিয়ে একটু ডলে দিলেই চোখ লাল হয়ে যায়। চোখের নিচে কালি (মার্কারের কালো রং হাতে লাগিয়ে চোখের নিচে ঘষে লাগানো হয়েছে) চুল এলোমেলো (হাত দিয়ে খিমচে খিমচে চুল এলোমেলো করা হয়েছে), চোখের দৃষ্টি উদ্ৰান্ত এবং ডান হাতটা একটু একটু কাঁপছে (এই দুটো অভিনয়)। আম্মু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “কী হয়েছে আইরিন?”

আইরিন জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু হয় নাই আম্মু। কিছু হয় নাই।”

“রাতে ঘুম হয়েছে?”

“হ্যাঁ আম্মু হয়েছে। শুধু”

“শুধু কী?”

“শুধু সারারাত স্বপ্ন দেখেছি।”

“কী স্বপ্ন দেখেছিস?”

“পরীক্ষা হচ্ছে আর আমি কোনো উত্তর মনে করতে পারছি না। তখন–”

“তখন কী?”

“কলম দিয়ে যেটাই লিখি লেখা হয় গোল্ডেন ফাইভ। আমি কাগজের পাতায় শুধু লিখছি গোল্ডেন ফাইভ গোল্ডেন ফাইভ–”

আম্মু মুখ কালো করে বললেন, “গোল্ডেন ফাইভ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে?”

“ঠিকই বলেছ আম্মু।”

আইরিন বলল, “এত বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি লেখা আছে গোল্ডেন ফাইভ।”

আইরিন মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, তারপর বলল, “না আম্মু, এখন দেখছি না।”

আম্মু বললেন, “না দেখলেই ভালো।”

.

আইরিন স্কুলে যাবার পর আম্মু তার ঘরে গিয়ে চমকে উঠলেন, সারা দেওয়ালে মার্কার দিয়ে লেখা, গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!

হঠাৎ করে আম্মু কেমন জানি অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। মনে হতে থাকে মেয়েটাকে চাপ দিয়ে বুঝি তার একটা বড় সর্বনাশ করে ফেলেছেন। আইরিনের বিছানায় বসে আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

রাত্রে ছোটাচ্চু টুনিকে বললেন, “টুনি তোর মনে আছে তোকে আইরিন নামে একটা মেয়েকে ওয়াচ করার জন্যে একটা কোচিং সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম?”

“মনে আছে ছোটাচ্চু।”

“সেই মেয়েটার খুব সিরিয়াস সমস্যা।” টু

নিকে খুব দুশ্চিন্তিত মনে হলো না। বলল, “কী সমস্যা?”

“মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যাচ্ছে?”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। তার মা আমাকে ফোন করেছিল। মেয়েটার ভয়াবহ অবস্থা।”

“কেন? কী করে?”

“প্রথমে দিন-রাত শুধু অঙ্ক মুখস্থ করত। তারপর দেখা গেল ঘুমাতে পারে না। তারপর–”

টুনি হাত তুলে বলল, “দাঁড়াও, আমি বলি। তারপর সারা রাত লাইট জ্বালিয়ে সারা বাসায় বই মুখস্থ করতে করতে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলের পোশাক পরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রেবেলা বড় ডেকচিতে ভাত রান্না করে, ঘরের দেওয়ালে লিখে রাখে গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!”

ছোটাচ্চু হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “তু-তু-তুই কেমন করে জানিস?”

“কারণ এইটা হচ্ছে প্ল্যান এ। এরপর আইরিন সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করবে। কাউকে চিনবে না। আরো আছে। শুনতে চাও?”

“তার মানে আইরিনের আসলে কিছু হয়নি! পুরোটা অভিনয়?”

টুনি মাথা নাড়ল, “পুরোটা প্ল্যান এ। সে নিজে যেটা প্ল্যান করেছিল সেটা অনেক ডেঞ্জারাস। সেটা এখন প্ল্যান বি। অনেক বুঝিয়ে তাকে প্ল্যান এ’তে রাজি করিয়েছি। যদি এই প্ল্যান কাজ করে তাহলে প্ল্যান বি’তে যেতে হবে না। বুঝেছ?”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, “তুই ভয়ঙ্কর ডেঞ্জারাস!”

“না ছোটাচ্চু আমি ডেঞ্জারাস না। তোমরা–বড় মানুষেরা হচ্ছ। ডেঞ্জারাস।”

“তুই কেমন করে এটা করলি? বেচারি মায়ের অবস্থা কী তুই জানিস? হাউমাউ করে কাঁদছে।”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি সব ঠিক করে দাও। মা’কে বোঝাও যেন আর কখনো গোল্ডেন ফাইভের জন্যে চাপ না দেয়। বোঝাও যেন আইরিনকে নিজের মতো করে লেখাপড়া করতে দেয়, গল্পের বই পড়তে দেয়, প্রাইভেট কোচিং থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। বোঝাও তাহলে আইরিন ঠিক হয়ে যাবে।”

ছোটাচ্চু তখনো হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। আবার বিড়বিড় করে বলল, “টুনি! তুই সাংঘাতিক ডেঞ্জারাস।”

টুনি কথা না শোনার ভান করে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি এখনই আইরিনের আম্মুকে ফোন করো। এক্ষুনি।”

ছোটাচ্চু ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে করছি।”

.

দুই দিন পর সবাই বসার ঘরে বসে আছে, দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়াল দেখছেন। বড় চাচা খবরের কাগজ পড়ছেন। কয়েকজন চাচি-খালা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন, ঝুমু খালা ডালপুরী ভেজে এনেছে, বাচ্চারা সেগুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে, ঠিক তখন ছোটাচ্চু বিশাল একটা কেক নিয়ে হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে হই হই করে উঠল। কেকটা নিয়ে টানাটানি করতে থাকল। একজন বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু, থ্যাংকু!”

ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না। থ্যাংকু যদি দিতে চাস আমার একজন ক্লায়েন্টকে থ্যাংকু দে। আইরিন নামে একটা মেয়ের মা এই কেকটা নিয়ে এসেছে।”

কেকটাকে বাক্স থেকে বের করতে করতে একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন কেক এনেছে আইরিনের মা?”

“লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপে মেয়েটার নার্ভাস ব্রেক ডাউনের মতো হয়েছিল। আমি তখন মাকে কয়েকটা আইডিয়া দিলাম, সেই আইডিয়া মতো কাজ করার পর মেয়েটা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে!”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া দিয়েছিলে ছোটাচ্চু?”

“পড়াশোনার কোনো চাপ না দিতে। যেটা পছন্দ করে সেটা করতে দিতে। বইয়ের দোকানে গিয়ে অনেকগুলো গল্পের বই কিনে সেগুলো পড়তে দিতে, প্রাইভেট কোচিং এসব থেকে সরিয়ে নিতে। এই রকম কয়েকটা আইডিয়া।”

শান্ত বলল, “এইগুলো তো সবাই জানে-আমিও দিতে পারতাম।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “আইরিনের মা সবগুলো আইডিয়া শুনেছে?”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “সব। মেয়েটাকে নিয়ে অফিসে এসেছিল। হাসি-খুশি সুইট একটা মেয়ে। তোর মতো বড় বড় চশমা। হাতে মোটা একটা বই।”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার মুখটা একটু নামাবে?”

“কেন?”

“আগে নামাও।”

ছোটাচ্চু মুখটা নামাল তখন টুনি ছোটাচ্চুর দুই গালে দুইটা চুমু দিয়ে বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু।”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে থ্যাংকু টুনি?”

টুনি কিছু বলার আগেই শান্ত বলল, “কী জন্যে আবার! এত বড় একটা কেক এনেছে সেই জন্যে। তাই না টুনি?”

টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, ছোটাচ্চু খুব সাবধানে কেউ যেন দেখতে পায় সেভাবে টুনির দিকে তাকিয়ে একটু চোখ টিপে দিল। টুনি তখন শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। কেকটার জন্যে। এইটা আমার সবচাইতে ফেভারিট কেক!”

 বইমেলা

বসার ঘরে বাচ্চারা এত হইহল্লা করছে যে দাদি অধৈর্য হয়ে একসময় চিৎকার করে বললেন, “এই! তোরা ষাঁড়ের মতো চিৎকার করা বন্ধ করবি?”

একজন বলল, “ষাঁড়ের মতো? ষাড় কি চিৎকার করে নাকি? ষাঁড় তো ডাকে হাম্বা হাম্বা করে।”

আরেকজন বলল, “ষাঁড় শিং দিয়ে গুতোগুতি করে। আমরা কী শিং দিয়ে গুঁতোগুতি করছি দাদি?”

আরেকজন বলল, “ষাঁড় হচ্ছে ছেলে গরু। আমাদের মাঝে ছেলে আর মেয়ে দুই-ই আছে। দাদি তোমার বলা উচিত ছিল ষাঁড় আর গাইয়ের মতো চিৎকার করা বন্ধ করবি?”

আরেকজন বলল, “না, না! বড় গরু হচ্ছে ষাঁড়। আমরা তো বড় না আমরা তো ছোট। বলা উচিত ছিল বাছুরের মতো চিৎকার করা বন্ধ করবি?”

সবাই রাজি হলো আর সবাই তখন বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বাছুরের মতো! বাছুরের মতো!”

ঝুমু খালা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে দাদিকে বলল, “খালা, আপনার নাতি-নাতনি কিন্তু ঠিক করে মানুষ হচ্ছে না। এরা কিন্তু বাছুরই থেকে যেতে পারে!”

দাদি বললেন, “এরা বাছুর থাকুক আর ছাগলই থাকুক আমার কোনো সমস্যা নাই। খালি যদি এরা এত চিৎকার করে আমার কানের পোকা নাড়িয়ে না দিত!”

বাচ্চারা তখন আগের থেকে জোরে চিৎকার শুরু করল। বলতে লাগল, “দাদি তোমার কানে আসলেই পোকা আছে? কী পোকা? কী পোকা? আমাদের দেখাবে?”

চেঁচামেচি আরো বেড়ে যেত কিন্তু ঠিক তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল, হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল। সবাই দেখার চেষ্টা করতে লাগল ছোটাচ্চুর হাতে কেক বা আইসক্রিম এ রকম কিছু আছে কি নেই। হাতে একটা ব্যাগ, সেই ব্যাগে শুধু কয়েকটা বই দেখে বাচ্চারা খুবই হতাশ হলো। একজন লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছোটাচ্চু! আজকেও তুমি কিছু আনো নাই?”

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “না। আনি নাই। আজকে আমার একটা ক্লায়েন্টের বিল পেয়েছিলাম, ভাবলাম তোদের জন্যে কিছু আনি।”

সবাই চিৎকার করে বলল, “তাহলে আনলে না কেন?”

“আনলাম না, করণ ভাবলাম তোদেরকে তার বদলে কোনো ফার্স্টফুডের দোকানে নিয়ে যাই।”

সবাই আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “চল, চল। ফার্স্ট ফুড, ফার্স্ট ফুড!”

ছোটাচ্চু বলল, “পরে মনে হলো সেটা ঠিক হবে না।”

হাহাকারের মতো শব্দ করে একজন বলল, “কেন ঠিক হবে না?”

ছোটাচ্চু বলল, “তার কারণ আমার মনে হলো তোদের খাই খাই অভ্যাস বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা হলেই শুধু খাই খাই। খাওয়া ছাড়া দুনিয়াতে আরো কাজ আছে।”

বাচ্চাদের মাঝে যে সবচেয়ে পাজি সে বলল, “ছোটাচ্চু খাওয়া ছাড়া অন্য যে কাজ আছে আমরা সেইটাও করি। প্রত্যেক দিন সকালে বাথরুমে গিয়ে–”

একজন ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল তাই বাথরুমে গিয়ে কী করে সেটা আর বলতে পারল না।

ছোটাচ্চু বলল, “তাই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমি তোদের আর খাওয়াতে নিয়ে যাব না। তার বদলে–”

সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “তার বদলে?”

“তার বদলে আমি তোদের মননশীল বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিশীল কাজে সাহায্য করব।”

ছোটাচ্চুর কথা শুনে সবাই একসাথে হতাশা আর যন্ত্রণার মতো শব্দ করল। একজন বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার এত বড় অধঃপতন হলো? তুমিও শেষ পর্যন্ত অন্যদের মতো হয়ে গেলে? হায় হায়!”

ছোটাচ্চু বলল, “আগে শোন তো আমি কী প্ল্যান করেছি!”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কী প্ল্যান করেছ?”

ছোটাচ্চু চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে দুই হাত নেড়ে বলল, “আমি তোদের সবাইকে বইমেলায় নিয়ে যাব।”

সবাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর একজন মিনমিন করে বলল, “বইমেলা?”

আরেকজন বলল, “বইমেলায় তো আমরা নিজেরাই যেতে পারি! আমরা তো প্রত্যেক বছরই যাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “এই বছর অন্য রকম। তার কারণ আমি তোদের সবাইকে বই কেনার জন্য পাঁচশ করে টাকা দেব।”

এবারে সব বাচ্চা মিলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল! চিৎকার থামার পর শান্ত প্রথম কথা বলল, “ছোটাচ্চু! মাত্র পাঁচশ টাকা? পাঁচশ টাকায় তো কিছুই হবে না! বইয়ের কত দাম তুমি জানো?”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “কেউ যদি মনে করে এই টাকায় তার কিছুই হবে না তাহলে তার টাকা নিতে হবে না!”

শান্ত তাড়াতাড়ি বলল, “না, না, আমি সেটা বলি নাই। অবশ্যই আমরা নিব। বইমেলায় খালি হাতে গিয়ে কোনো আনন্দ আছে?”

মুনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “আমাকেও দিবে ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু বলল, “অবশ্যই দেব। ছোট, বড়, মাঝারি সবাই টাকা পাবে।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “দাদি?”

ছোটাচ্চু বলল, “মা যদি বইমেলায় যেতে চায় তাহলে মাও পাবে।”

শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড! আমি দাদিকে বইমেলায় নিয়ে যাব। দাদি তুমি টাকাটা নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবে।”

ছোটাচ্চু বলল, “উঁহু, সেটা হবে না। যার টাকা তার। সে নিজে বই কিনবে, কিনে ক্যাশমেমো আমাকে দেখাতে হবে। এইটা হচ্ছে নিয়ম।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “সবাই টাকা পাবে ছোটাচ্চু?”

“হ্যাঁ। সবাই।”

“ঝুমু খালা?”

“একশবার। ঝুমু যদি বইমেলায় যায়, ঝুমুও পাবে।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “ঝুমু খালা তুমি কী বই কিনবে?”

ঝুমু খালা মুখ গম্ভীর করে বলল, “বইমেলায় গিয়ে দেখি কী বই আছে।”

“তুমি পড়তে পারো?”

“পারি না আবার? বানান করে করে সব পড়তে পারি। ইংরেজিটা খালি সমস্যা হয়।”

শান্ত তখন হাত পেতে বলল, “ছোটাচ্চু, আমার পাঁচশ টাকা এখনই দিয়ে দাও।”

“এখন? এখন কেন দেব?”

“তাহলে কখন দেবে?”

“বইমেলায় যখন যাবি তখন পাবি। আমি সবাইকে বইমেলায় একটা খাম ধরিয়ে দেব।”

মুনিয়া উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “নোটগুলো কি নতুন দিবে নাকি পুরাতন?”

ছোটাচ্চু হাসল, হেসে বলল, “অবশ্যই কড়কড়া নতুন নোট!”

মুনিয়া আনন্দে দাঁত বের করে হাসল। তাকে দেখে মনে হলো, পাঁচশ টাকা পাবে সেটা নিয়ে যত আনন্দ, তার থেকে বেশি আনন্দ কারণ নোটগুলো হবে কড়কড়ে নতুন নোট!

.

দু’দিন পর সবাই দলবেঁধে বইমেলায় হাজির হলো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দাদি এবং ঝুমু খালা আসতে পারল না, বাসায় মেহমান আসার কারণে দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছোটাচ্চু সবার হাতে একটা করে খাম ধরিয়ে দিল। সেই খাম খুলে দেখা গেল সত্যি সত্যি তার ভেতরে কড়কড়ে পাঁচটা একশ টাকার নোট। কড়কড়ে নোটগুলো ধরে উত্তেজনায় মুনিয়ার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। পাঁচশ টাকা দিয়ে পৃথিবীর কত কিছু কিনে ফেলা যায় কিন্তু ছোটাচ্চু বলে দিয়েছে বই ছাড়া আর কিছু কেনা যাবে না। শুধু বই-ই কিনতে হবে। যা ইচ্ছা তা-ই কিনতে দিলে আরও ভালো হতো কিন্তু শুধু বই কিনতেও মুনিয়ার কোনো আপত্তি নেই।

টুনি শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি কী বই কিনবে?”

শান্ত উদাস মুখে বলল, “আমি বই কিনে টাকা নষ্ট করব না।”

“কিন্তু ছোটাচ্চু বলেছে এই টাকা নিয়ে বই-ই কিনতে হবে।”

“ছোটাচ্চুকে পাঁচশ টাকার বই দেখালেই তো হলো।”

“বই না কিনে কেমন করে দেখাবে?”

শান্ত নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “তুই দেখ আমি কীভাবে ম্যানেজ করি।”

শান্ত কীভাবে বই ম্যানেজ করে দেখার জন্যে টুনি তার পিছু পিছু গেল। শান্ত কয়েকটা বইয়ের স্টল ঘুরে একটা স্টলের সামনে দাঁড়াল। সেই স্টলে একজন কমবয়সী কবি একটা কলম হাতে করে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, কেউ তার বই কিনলেই সে একটা অটোগ্রাফ দেবে। কিন্তু কেউ তার বই কিনছে না।

শান্ত একটু অপেক্ষা করে কমবয়সী কবির নামটা বের করে ফেলল, নামটা যথেষ্ট কায়দার নাম, তুফান তূর্য। শান্ত তখন কবির দিকে এগিয়ে গেল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কবি তুফান তূর্য?”

কবি তুফান সূর্যের চোখ চকচক করে উঠল, বলল, “হ্যাঁ। কেন?”

“না, এমনি। আপনার নাম অনেক শুনেছি তো।”

কবি এবারে রীতিমতো উত্তেজিত। বলল, “আমার নাম শুনেছ? কার কাছে শুনেছ?”

“আমার আপুর কাছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইংরেজিতে অনার্স।”

টুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে শান্তর বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার ক্ষমতা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে।

কবি তুফান তূর্য বলল, “তোমার বোন কবিতা পড়ে বুঝি?”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “খুব খুঁতখুঁতে। সবার কবিতা পড়তে চায় না। আপনারটা পড়ে।”

“তাই বুঝি?”

“হ্যাঁ। আপনার কবিতার বই বের হয়েছে?”

কবি তুফান তূর্য বলল, “হ্যাঁ। আমার প্রথম বই। নৈঃশব্দ্যের কান্না।”

“আমার আপু খুশি হবে। একটা কিনে নিয়ে গেলে অনেক খুশি হতো। একটা অটোগ্রাফসহ।”

“কিনে নিয়ে যাও একটা কপি। অটোগ্রাফ দিয়ে দিব।”

“কেমন করে কিনব? সব টাকা খরচ করে ফেলেছি।” বলে শান্ত খুবই বিষণ্ণ মুখে হাঁটতে শুরু করল, কয়েক পা হাঁটতেই কবি তাকে ডাকল, “এই যে ছেলে, শুনো।”

শান্ত এগিয়ে এলো। কবি তুফান তূর্য বলল, “আমি তোমার বোনকে একটা কবিতার বই অটোগ্রাফসহ দিয়ে দিই। কী বলো?”

“খুবই ভালো হয় তাহলে। আমার আপু যে কী খুশি হবে চিন্তাও করতে পারবেন না। আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করে তো!”

কবি তুফান তূর্য তার লেখা একটা কবিতার বই নিয়ে শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম তোমার আপুর?”

“শান্তা।” কবি তুফান তূর্য বড় বড় করে লিখল,

প্রিয় শান্তাকে
অনেক ভালোবাসা।
তুফান তূর্য

শান্ত বইটা হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে বের হয়ে এলো। স্টল থেকে বেশ খানিকটা সরে যাবার পর টুনি শান্তর কাছে এসে বলল, “শান্ত ভাইয়া”

শান্ত দাঁত বের করে হেসে বলল, “দেখলি, কেমন করে একটা বই ম্যানেজ করলাম? দেড়শ টাকা দাম!”

“দেখেছি।” টুনি বলল, “কাজটা একেবারে ঠিক হলো না। তুমি কেমন করে এত মিথ্যা কথা বলতে পারো? কবি তুফান তূর্যকে তুমি এইভাবে ঠকালে?”

“মোটেও ঠকাই নাই। উৎসাহ দিয়েছি। এখন এই মানুষটা কত উৎসাহ পেল চিন্তা করতে পারবি?”

“তাই বলে এইভাবে মিথ্যা কথা বলবে?”

“যা যা ভাগ।”

“তা ছাড়া বইয়ে লিখেছে শান্তা-তোমার নাম শান্ত।”

শান্ত হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল। বলল, “একটা মাত্র আকার! ওটা কোনো ব্যাপারই না। ঘষে তুলে ফেলব।”

শান্ত তখন আরো ফ্রি বই ম্যানেজ করার জন্যে এগিয়ে গেল। এবারে সে গেল বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার জায়গায়। সেখানে অনেক ভিড়। মানুষ ঠেলাঠেলি করছে, তার মাঝে একটার পর একটা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে। লেখক তার বইগুলো রঙিন কাগজে মুড়ে নিয়ে আসছে, লেখকের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তখন একজন বুড়ো মতন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আসে। তাকে প্রথমে ফুল দেয়া হয় তারপর সবার হাতে একটা করে বই দেয়া হয়, একজন মানুষ তখন বই এবং লেখক নিয়ে কিছু কথা বলে, তারপর সবাই বইয়ের মোড়ক খুলে। তখন হাততালি দেয়া হয়, সবাইকে নিয়ে ছবি তোলা হয়।

শান্ত সেই ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রইল। মোড়ক উন্মোচন করার জন্যে যখন অনেকের হাতে বই দেয়া হয় তখন শান্ত একটা বইয়ের জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে একটা বই পেয়ে যায়। সেও সবার সাথে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে বইটা নিজের কাছে রেখে দেয়। দেখতে দেখতে শান্তর বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকল। শুধু যে বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলল তা নয়, মোড়ক উন্মোচনের পর একটু মিষ্টি খাওয়ার আয়োজন থাকে, সেখানে শান্ত একটার পর মিষ্টি খেয়ে যেতে থাকল।

টুনি শান্তকে ছেড়ে মুনিয়া আর টুম্পাকে খুঁজে বের করল। তারা ছোটদের বইয়ের স্টলে বই দেখে যাচ্ছে। এত বই তার মাঝে কোনটা কিনবে সেটা নিয়ে মনস্থির করতে পারছে না। যেটাই দেখে সেটাই তাদের কেনার ইচ্ছা করে। টুনি তাদের বই কিনতে দিয়ে নিজের বইগুলো কিনতে বের হলো। ঘুরে ঘুরে একটা ভূতের বই, একটা গণিতের, আরেকটা প্রোগ্রামিংয়ের বই কিনল। তখনো কিছু টাকা রয়ে গেছে, সেই টাকা দিয়ে নতুন কোনো ভালো বই কেনা যাবে না, তাই ঠিক করল টাকাটা টুম্পা না হয় মুনিয়াকে দিয়ে দেবে। নিজেদের টাকার সাথে মিলিয়ে হয়তো ভালো কোনো একটা বই কিনে ফেলতে পারবে।

দুজনকে ছোটদের বইয়ের স্টলের একেবারে শেষ মাথায় খুঁজে পাওয়া গেল। তখনো বই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। টুনিকে দেখে মুনিয়া প্রায় ছুটে তার কাছে এসে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “টুনি আপু, কি হয়েছে জানো?”

মুনিয়া কাছাকাছি একটা স্টলের সামনে একজন বাবা আর মা এবং সাথে ছয়-সাত বছরের একটা ছেলেকে দেখিয়ে বলল, “ঐ ছেলেটাকে দেখেছ?”

“হ্যাঁ। দেখেছি। কী হয়েছে ছেলেটার?”

“ছেলেটা কাঁদছে দেখেছ?”

টুনি তখন লক্ষ করল আসলেই বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

মুনিয়া বলল, “কেন কাঁদছে জানো?”

“কেন?”

“বাচ্চাটা একটা বই কিনতে চাইছিল, তার আব্লু-আম্মু বইটা কিনে দিবে না, সেই জন্যে কাঁদছে।”

“কেন কিনে দেবে না?”

মুনিয়া বলল, “জানি না। কী সুন্দর একটা ভূত আর রাক্ষসের বই তবু তার আব্বু-আম্মু কিনে দিচ্ছে না।”

বইটা কেন কিনে দিচ্ছে না মুনিয়া না জানলেও টুনির কারণটা বুঝতে দেরি হলো না। বাবা-মাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা খুবই সাধারণ মানুষ, টাকা-পয়সা বেশি নেই। বাচ্চাকে নিয়ে বইমেলায় এসেছে কিন্তু বাচ্চাকে তার ইচ্ছা মতোন দামি বই কিনে দেবার ক্ষমতা নেই। টুনির বাচ্চাটার জন্যে যেটুকু মায়া হলো তার আব্বু-আম্মুর জন্যে তার থেকে অনেক বেশি মায়া হলো।

মুনিয়া বলল, “টুনি আপু, আমরা বাচ্চাটাকে বইটা কিনে দেই?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমরা বইটা কিনে দিলে তার আব্বু আম্মু লজ্জা পাবে। এমনি এমনি বইটা নিতে রাজি নাও হতে পারে।”

“কিন্তু দেখো বাচ্চাটা কীভাবে কাঁদছে। দেখে আমার একটু একটু কান্না এসে যাচ্ছে।” সত্যি সত্যি মুনিয়ার গলা কান্না কান্না হয়ে গেল।

টুনি একটু চিন্তা করল, তারপর বলল, “দেখি কী করা যায়। তুই যা, টুম্পাকে ডেকে আন।”

মুনিয়া তার বইয়ের ভারী ব্যাগটা টুনির কাছে রেখে টুম্পাকে ডেকে আনতে গেল। টুনি বাবা-মা আর বাচ্চাটার দিকে নজর রাখে তারা যেন চোখের আড়াল না হয়ে যায়। টুনি দেখতে পেল বাবা বইয়ের স্টল থেকে সস্তা একটা বই কিনে দিতে চাইছে কিন্তু বাচ্চাটা রাজি হচ্ছে না। সে এখন আর কাঁদছে না কিন্তু অভিমানে মুখটা ভার করে রেখেছে।

মুনিয়া গিয়ে টুম্পাকে ধরে এনেছে, টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “টুনি আপু তুমি ডেকেছ?”

“হ্যাঁ। আমাদের এখন একটা মিশন কমপ্লিট করতে হবে।”

“মিশন কমপ্লিট?”

“হ্যাঁ।”

“কী মিশন?”

টুনি সামনের স্টল থেকে বাবা-মায়ের সাথে হেঁটে যেতে থাকা বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে বাচ্চাটা দেখছিস, এই বাচ্চাটাকে তার আব্বু-আম্মু একটা বই কিনে দেয় নাই–”

টুনি কথা শেষ করার আগেই টুম্পা বলল, “আমি দেখেছি। ভূত আর রাক্ষসের বই। বইটার দাম দুইশ টাকা। বাবা-মায়ের কাছে এত টাকা নাই। আমি দেখেছি বাবা তার মানিব্যাগটা কয়েকবার দেখেছে–”

টুনি বলল, “তাহলে তো তুই জানিস। বাচ্চাটার কান্না দেখে মুনিয়ার কান্না পেয়ে যাচ্ছে তাই এখন আমাদের এই বাচ্চাটাকে এই বইটা কিনে দিতে হবে। কিন্তু এমনভাবে দিতে হবে যেন তারা কিছুতেই বুঝতে না পারে আমরা কিনে দিচ্ছি, তাহলে বাচ্চার আব্বু-আম্মু লজ্জা পাবে। কারো যখন টাকা থাকে না তখন গায়ে পড়ে তাদের সাহায্য করলে লজ্জা পায়।”

“তাহলে কীভাবে দিতে হবে?”

“আমি একটা প্ল্যান করেছি। তার আগে তুই গিয়ে দৌড় দিয়ে বইটা কিনে আন। মুনিয়া তুই এই বাচ্চাটা আর তার আব্বু-আম্মুকে চোখে চোখে রাখ যেন ভিড়ের মাঝে হারিয়ে না যায়।”

টুম্পার কাছে যথেষ্ট টাকা ছিল না। তাই টুনি আর টুম্পার বাড়তি টাকাটাও দিতে হলো, টুম্পা সেই টাকা নিয়ে বই কিনতে গেল। মুনিয়া একটা কাজ পেয়ে খুবই খুশি হলো। সে বাচ্চাটাকে দূর থেকে চোখে চোখে রাখতে লাগল যেন হারিয়ে না যায়। টুনি তখন তার ব্যাগ থেকে তার নোট বইটা বের করল, তারপর সেখান থেকে কয়েকটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সেগুলো ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করল। তারপর প্রত্যেকটা কাগজের টুকরায় লিখল “বিজয়ী” তারপর সেই কাগজগুলোকে ভাজ করে রাখল যেন ভেতরে কী লেখা আছে দেখা না যায়।

কিছুক্ষণের মাঝেই টুম্পা বইটা কিনে আনল, মোটাসোটা রঙিন একটা বই, ছোট বাচ্চাদের এরকম একটা বই খুব পছন্দ হতেই পারে।

টুনি বলল, “শোন, আমি আমার প্ল্যানটা বলি। আমি ভান করব যে আমি এই মেলায় ছোট বাচ্চারা কী রকম বই পছন্দ করে তার একটা জরিপ নিচ্ছি। কেউ যদি জরিপে অংশ নেয় তখন তাকে একটা লটারিতে অংশ নিতে দেয়া হবে। সেই লটারিতে যারা জিতবে তারা একটা বই উপহার পাবে।”

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি, তুমি বাচ্চাটাকে লটারিতে জিতিয়ে দেবে?”

হ্যাঁ। আমি অনেকগুলো কাগজের টুকরো নিয়েছি সবগুলোতে লিখেছি বিজয়ী। তাই বাচ্চাটা চোখ বন্ধ করে যেটাই তুলবে সেটাই হবে বিজয়ী।

মুনিয়া উত্তেজিত হয়ে বলল, “টুনি আপু তোমার মাথা ভর্তি খালি বুদ্ধি আর বুদ্ধি।”

টুনি হাসল, “এইটা এমন কিছু বুদ্ধি না। আমাদের বুদ্ধি দেখাতে হবে জরিপ নেওয়ার সময়।” তারপর টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের বাচ্চাটা আর তার আম্মু-আব্বুর কাছাকাছি তোর জরিপ নেব। তুই ভান করবি আমাকে চিনিস না, পারবি না?”

টুম্পা বলল, “পারব।”

মুনিয়া বলল, “আর আমি?”

“তুই একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখবি কী হচ্ছে।”

মুনিয়া বলল, “না টুনি আপু আমিও খেলতে চাই।”

টুনি বলল, “খেলতে চাস? এখানে খেলা কোনটা?”

“এই পুরোটাই তো খেলা টুনি আপু। আমি খেলব।”

“তুই কীভাবে খেলবি?”

“টুম্পা আপুর বদলে আমার জরিপ নেবে।”

টুনি বলল, “তুই বেশি ছোট। তুই পারবি না। বাচ্চাটার আব্বু-আম্মু বুঝে ফেলবে, তখন খুব খারাপ ব্যাপার হবে।”

মুনিয়া বলল, “না টুনি আপু, আমি পারব। তুমি পরীক্ষা করে দেখো।”

টুনি কিছুক্ষণ মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। তাহলে তোর জরিপ নেব। আমি তোকে যা প্রশ্ন করব তুই শুধু তার উত্তর দিবি। আর খবরদার হেসে ফেলবি না। ভান করবি যেন তুই আমাকে চিনিস না, আগে কখনো দেখিস নাই।”

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে চিনি না। তোমাকে কখনো দেখি নাই।”

টুনি তখন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “টুম্পা তুই তাহলে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। তুই সবগুলো বই নিয়ে যাবি। লটারির শেষে বইগুলো দেখাবি। সেখান থেকে যে বইটা নিতে চায় নেবে।”

টুম্পা বলল, “ঠিক আছে, বইগুলো দাও।”

টুনি তাদের সবগুলো বই টুম্পার কাছে দিয়ে দিল।

কথা বলার সময় তারা সারাক্ষণই চোখের কোনা দিয়ে বাচ্চাটা আর তার বাবা-মাকে চোখে চোখে রেখেছে। পরিবারটা এখন বাচ্চাদের বইয়ের স্টল থেকে সরে গিয়ে খালি মাঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ওরা দেখল কাছাকাছি একটা খালি বেঞ্চ পেয়ে সেখানে বাবা-মা বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে পড়েছে। বাচ্চাটা মুখ ভার করে বসে আছে, একটা কথাও বলছে না।

টুনি বলল, “মুনিয়া তুই দৌড়ে যা, ঐ বেঞ্চটাতে বাচ্চাটার পাশে বসে যা। মনে আছে তো তুই আমাকে আর টুম্পাকে চিনিস না?”

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে টুনি আপু। আমি তোমাকে আর টুম্পাপুকে চিনি না। কোনোদিন দেখি নাই।” তারপর দৌড়ে গিয়ে বেঞ্চটাতে বাচ্চাটির পাশে বসে গেল।

টুনি আর টুম্পা কয়েক মিনিট পর বেঞ্চটার দিকে রওনা দিল। টুনির এক হাতে নোট বুক অন্য হাতে একটা কলম। টুম্পার কাছে ব্যাগের ভেতর তাদের সবগুলো বই। বেঞ্চটার কাছে গিয়ে টুনি থেমে যায়, তারপর মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু, তুমি কী আমাদের একটা জরিপে অংশ নেবে? জরিপে অংশ নিলে তুমি একটা লটারি করতে পারবে–”

মুনিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “জরিপ মানে কী?”

টুনি মুনিয়ার উত্তর শুনে মুগ্ধ হলো, এই বয়সী বাচ্চার জরিপ শব্দটা জানা থাকার কথা নয়।

টুনি বলল, “জরিপ মানে হচ্ছে আমি তোমাকে কয়টা প্রশ্ন করব, তুমি তার উত্তর দেবে।”

মুনিয়া বলল, “তুমি কঠিন কঠিন প্রশ্ন করবে না তো? আমি কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। মোটেও কঠিন প্রশ্ন করব না। তোমার বই পড়তে ভালো লাগে কী না, কী রকম বই পড়তে ভালো লাগে এ রকম প্রশ্ন।”

“ঠিক আছে। বেশিক্ষণ লাগবে না তো?”

“না। বেশিক্ষণ লাগবে না।”

টুনি তার নোটবই নিয়ে রেডি হলো। পাশে বসে থাকা বাচ্চাটা খুব আগ্রহ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

“আমার নাম ঝিলিক।”

টুনি মুচকি হাসল, তারপর নাম লিখে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে ঝিলিক, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”

“আমি বেবি ক্লাসে পড়ি।” টুনি নোট বইয়ে ক্লাসটা লিখে নিল।

“তুমি যদি বেবি ক্লাসে পড়ো তাহলে নিশ্চয়ই এখনো পড়তে শিখোনি।”

মুনিয়া মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমি পড়তে পারি।”

টুনি বলল, “সত্যি পড়তে পারো? বাহ। ঐ যে বইয়ের স্টল আছে সেখানে কী লেখা আছে পড়ো দেখি।”

মুনিয়া বইয়ের স্টলের নামটি পড়ে শোনাল, দিনরাত্রি প্রকাশনী। টুনি খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “তুমি কী কোনো বই পড়েছ?”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ, আমি অনেক বই পড়েছি।”

“ভেরি গুড। তুমি কী বই পড়েছ তার নাম বলো দেখি।”

মুনিয়া বলল, “ছোটদের অ আ ক খ। ছোটদের এ বি সি ডি।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না না পাঠ্যবই না। গল্পের বই না-হয় কবিতার বই, না-হলে কমিক—”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ পড়েছি। দাদু আর রাম ছাগল, ভূতের বাচ্চা ভুতুয়া, হোজ্জার গল্প—”

টুনি বইয়ের নামগুলো লিখে নেয়ার ভান করতে থাকে। নামগুলো লিখে শেষ করার ভান করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী রকম বই পড়তে ভালো লাগে? ছবিওয়ালা বই না ছবি ছাড়া বই?”

“ছবিওয়ালা বই।”

“রঙিন ছবি নাকি সাদা কালো ছবি?”

“রঙিন রঙিন।”

“কী রকম বই পড়তে তোমার ভালো লাগে? রূপকথা নাকি ভূত নাকি হাসির গল্প?”

“আমার হাসির গল্প বই পড়তে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।”

টুনি সবকিছু লিখে শেষ করার ভান করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি টেলিভিশন দেখো?”

“দেখি।”

“তোমার টেলিভিশন দেখতে বেশি ভালো লাগে নাকি বই পড়তে?”

“টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কিন্তু আমাকে দেখতে দেয় না। বাসায় বড় মানুষেরা দিন-রাত খবর শুনে।”

“হিন্দি সিরিয়াল?”

“না। আমার আব্বু-আম্মু কখনো হিন্দি সিরিয়াল দেখে না। আমিও দেখি না।”

টুনি খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “ভেরি গুড। কখনো হিন্দি সিরিয়াল দেখবে না। আর তোমাকে বলে রাখি, টেলিভিশন দেখা থেকে বই পড়া অনেক বেশি ভালো। বুঝেছ?”

মুনিয়া মাথা নেড়ে বুঝে ফেলার ভান করল। টুনি নোট বইয়ে আরো কিছুক্ষণ লিখে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝিলিক, তোমার জরিপ নেয়া শেষ। এখন লটারি। কিন্তু তার আগে তোমাকে অন্য একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি।”

“করো।”

“তুমি ছোট একজন মানুষ, আব্বু-আম্মু ছাড়া একা এক বসে আছ, তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?”

মুনিয়া বলল, “ঐ যে আমার আব্বু-আম্মু বই কিনছে। হেঁটে হেঁটে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে তাই এখানে বসে আছি।”

টুনি-মুনিয়ার বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হলো। সে খুবই ভালোভাবে অভিনয় করে যাচ্ছে। বাসায় গিয়ে তাকে অভিনয়ের জন্যে একটা মেডেল দিতে হবে।

টুনি তার ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা ছোট ছোট কাগজগুলো বের করে তার হাতে ধরল, বলল, “এখান থেকে একটা কাগজ নাও। চোখ বন্ধ করে নিতে হবে।”

মুনিয়া চোখ বন্ধ করে ভাঁজ করা ছোট একটা কাগজ নিল। টুনি বলল, “খুলে দেখো কী লেখা। যদি বিজয়ী লেখা থাকে তাহলে পুরস্কার পাবে। যদি দুঃখিত লেখা থাকে তাহলে কোনো পুরস্কার নাই।”

“জিতলে কী পুরস্কার পাব? চিপসের প্যাকেট?”

“না, না। মোটেও চিপসের প্যাকেট না। জিতলে পুরস্কার হচ্ছে বই।”

“কী বই?”

“আমাদের কাছে অনেক রকম বই আছে। যেটা পছন্দ।”

মুনিয়া তখন খুব সাবধানে ভাঁজ করা কাগজটা খুলল, ভেতরে লেখা বিজয়ী এবং সেটা দেখে মুনিয়া আনন্দে পাগল হয়ে যাবার একটা অনবদ্য অভিনয় করল।

টুম্পা তখন তার ব্যাগ থেকে বইগুলো বেঞ্চে ছড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। টুনি বলল, “ঝিলিক। নাও, তুমি এখান থেকে একটা বই বেছে নাও।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “একটাই নেব, নাকি আরো বেশি?”

টুনি বলল, “না একটা। আমাদের অনেক জরিপ করতে হবে।”

মুনিয়া তখন বইগুলো থেকে একটা বই বেছে নেয়ার একটা অসাধারণ অভিনয় করল। তারপর বইটা বুকে চেপে ধরে তার কাল্পনিক আবু-আম্মুর কাছে ছুটে চলে গেল।

পাশে বাচ্চাটি একরকম বিস্ফারিত চোখে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। যে বইটি তার আব্বু-আম্মু কিনে দেয়নি সেই বইটিও এখানে আছে। সে কি জরিপে অংশ নিতে পারে না? লটারিতে অংশ নিতে পারে না? কিন্তু কীভাবে সেটা হতে পারে?

খুব সহজেই হয়ে গেল। টুনি বাচ্চাটার আব্বু-আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা কি আপনার বাচ্চার একটা জরিপ নিতে পারি? বেশিক্ষণ লাগবে না।”

আব্বু-আম্মু কিছু বলার আগেই বাচ্চাটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি জরিপ হব। জরিপ হব।”

টুনি বলল, “ভেরি গুড। তাহলে তোমার নাম বলো।”

“আমার নাম মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম খান জুয়েল।”

“ভেরি গুড জুয়েল। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”

“টু। ক্লাস টু। আমি পরীক্ষায় থার্ড হয়েছি।”

“বাহ্! এরপরের বার সেকেন্ড হবে। তারপরের বার ফার্স্ট।”

জুয়েল জোরে জোরে মাথা নাড়ল। টুনি ঠিক আগের মতোই একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেতে লাগল। জুয়েল খুবই উৎসাহ নিয়ে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকল এবং আড়চোখে ভূত এবং রাক্ষসের মোটাসোটা রঙিন বইটার দিকে তাকাতে লাগল।

দেখতে দেখতে জরিপ শেষ হয়ে গেল। দেখা গেল জুয়েল গল্প বই পড়তে খুবই পছন্দ করে। তার প্রিয় বই হচ্ছে ভূতের গল্প। তারও পছন্দ ছবিওয়ালা রঙিন বই এবং সেও টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে পছন্দ করে তবে সে নিজ থেকে ঘোষণা দিল যে টেলিভিশন দেখা মোটেই ভালো কাজ না।

জরিপ শেষ হওয়ার পর টুনি আবার তার ভাঁজ করা ছোট ছোট কাগজগুলো তার দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে জুয়েলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “জুয়েল এখন চোখ বন্ধ করে একটা কাগজ নাও।”

জুয়েল বিড়বিড় করে একটা দোয়া পড়ে তার বুকে ফুঁ দিল, নার্ভাসভাবে তার মায়ের দিকে তাকাল, এবং তার মা তাকে সাহস দিলেন।

টুনি বলল, “জুয়েল যদি দেখো লটারিতে তুমি জিত নাই, তাহলে মন খারাপ করবে না তো?”

জুয়েল খুব কষ্ট করে মাথা নাড়ল, বলল, “করব না।”

টুনি বলল, “এটা তো একটা লটারি, তাই কে জিতবে কে হারবে তার কোনো ঠিক নেই। বুঝেছ?”

জুয়েল ফ্যাকাসে মুখে বলল, “বুঝেছি।”

“নাও একটা কাগজ।”

জুয়েল অনেকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে একেবারে নিচের থেকে একটা কাগজ নিল। নিয়ে কাঁপা হাতে এটা ধরে রাখল।

টুনি বলল, “খুলো কাগজটা। না জিতলে মন খারাপ কোরো না কিন্তু।”

জুয়েল কাগজটা খুলল, ভেতরে লেখা–”বিজয়ী” অন্য কিছু লেখা সম্ভব না যদিও জুয়েলের পক্ষে সেটা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না।

কাগজটা দেখে মনে হলো জুয়েল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকল এবং সেইভাবে কাঁপা গলায় বলল, “আমি যে কোনোটা নিতে পারব?”

“হ্যাঁ। যেকোনোটা। কিন্তু একটার বেশি না।”

জুয়েল তখন রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ভূত আর রাক্ষসের বইটা ছো মেরে তুলে নিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরল। তাকে দেখে মনে হতে লাগল একটু আলগা করলেই বুঝি কেউ এসে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।

টুনি বলল, “এখানে আরো অন্য বই আছে, সবগুলো দেখে নাও একবার।”

জুয়েল রীতিমতো গর্জন করে বলল, “না। আমি এইটাই নিব।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

টুম্পা এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, এই প্রথম মুখ খুলল, বলল, “আপু আমাদের কিন্তু আরও অনেক জরিপ করা বাকি আছে। এক জায়গায় বেশি সময় দিলে জরিপ শেষ হবে না। ম্যাডাম তখন খুব রাগ করবে।”

টুনি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ। চলো অন্য বাচ্চা খুঁজে বের করি।”

টুম্পা বইগুলো ব্যাগে ঢাকাল তারপর দুজনে উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে, একটু পরেই মুনিয়া তাদের সাথে যোগ দিল।

দূর থেকে তারা জুয়েল আর তার আব্লু-আম্মুকে লক্ষ করল। বাচ্চাটা বইটা নিয়ে রীতিমতো লাফাতে লাফাতে হেঁটে যাচ্ছে। তার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে থাকা হাসি হাসি মুখটা দেখে টুনি, টুম্পা আর মুনিয়াও আনন্দে হাসতে থাকে।

.

সন্ধে হওয়ার পর ছোটাচ্চু সবাইকে নিয়ে মেলার মাঝখানের মাঠটাতে গোল হয়ে বসল, ছোটাচ্চু এখন সবার বইয়ের হিসেব নেবে। দেখবে সবাই তাদের টাকা ঠিকমতো খরচ করেছে কি না, ঠিকভাবে নিজেদের বই কিনেছে কি না। প্রমি কিংবা শাহানার মতো যারা একটু বড় তাদের দিয়ে শুরু করা হলো, দেখা গেল তারা শুধু যে ছোটাচ্চুর পাঁচশ টাকা খরচ করেছে তা নয়, তার সাথে নিজের জমানো টাকাও খরচ করে অনেক বই কিনেছে। তার মাঝে গল্প-উপন্যাস আছে, সায়েন্স ফিকশান আছে, এমনকি কটমটে জ্ঞানের বইও আছে। ছোটাচ্চু বইয়ের বান্ডিল হাতে নিয়ে রীতিমতো বইয়ের দাম বের করে যোগ দিয়ে মিলিয়ে নিল। মনে হচ্ছে ছোটাচ্চু মাত্রার বাইরে সিরিয়াস!

বাচ্চারা সবাই একে অন্যের বই দেখছে, কথা বলছে, হাসাহাসি করছে, তার মাঝে শুধু শান্তকে খুবই মনমরা দেখা গেল। সাধারণত সবসময়েই সে সবচেয়ে বেশি কথা বলে, আজকে তার মুখে কোনো কথা নেই, কেমন যেন চিমসে মেরে বসে আছে।

ছোটাচ্চু একটু বড় ছেলেমেয়ে শেষ করে শান্তর বইগুলো দেখতে চাইল, শান্ত একটু অপরাধীর মতো ভঙ্গি করে ছোটাচ্চুর হাতে তিনটা বই তুলে দিল। প্রথম বইটার নাম নৈঃশব্দ্যের কান্না, কবিতার বই এবং কবির নাম তুফান তূর্য। ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই কবিতার বই কিনেছিস? তুফান তূর্যের বই? তুফান তূর্য আবার মানুষের নাম হয় নাকি?”

শান্ত চুপ করে মাঠ থেকে একটা দুইটা ঘাস ঘেঁড়ার চেষ্টা করতে থাকল। ছোটাচ্চু বইটা খুলে রীতিমতো চমকে উঠল! বলল, “এ কী! ভেতরে কবির অটোগ্রাফ এবং ভালোবাসা। ব্যাপারটা কী? তোর নাম শান্ত কিন্তু ভালোবাসাটা শান্তাকে! শান্তাটা কে?”

টুনি পুরো ব্যাপারটা জানে কিন্তু সে চুপ করে রইল।

ছোটাচ্চু শান্তর পরের দুইটা বই নিল একটা বইয়ের নাম “হাঁস মুরগির বিষ্ঠা থেকে সার” অন্যটা “সহজ টোটকা চিকিৎসা”-এই বই দুটি সে মোড়ক উন্মোচনের ভিড় থেকে কজা করেছে, বইয়ের কী নাম, সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি!

ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ হাঁ করে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুই এ কী বই কিনেছিস? বইয়ের দামগুলো দেখে বলল, “সব মিলিয়ে তুই তো দুইশ টাকাও খরচ করিসনি। বাকি টাকা কই?”

শান্ত মাথা চুলকে খানিকক্ষণ ইতিউতি করে শেষ পর্যন্ত সত্যি কথাটা বলে ফেলল। তার আসল পরিকল্পনা ছিল নানা জায়গা থেকে কিছু ফ্রি বই ম্যানেজ করে নগদ পাঁচশ টাকা মেরে দেবে। কিন্তু তার খুবই কপাল খারাপ, মোড়ক উন্মোচনের ভিড়ের মাঝে ফ্রি বইয়ের জন্য যখন ধস্তাধস্তি করছিল তখন পকেটমার তার পকেট থেকে কড়কড়া পাঁচটা একশ টাকার নোট হাওয়া করে দিয়েছে। তার আম এবং ছালা কিংবা চা এবং চায়ের কাপ কিংবা কাঁঠালের কোয়া এবং বিচি দুই-ই গেছে। পকেট মারা যাবার পর তার এত মুড খারাপ হয়েছে যে সে আর ফ্রি বইয়ের জন্যে চেষ্টা করেনি, মেলায় মুখ কালো করে ঘুরে বেড়িয়েছে।

ছোটাচ্চু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তোর উচিত শাস্তি হয়েছে। এখন বসে বসে হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে সার বানিয়ে তোর ঘিলুর মাঝে ঢালতে থাক। টোটকা ওষুধ হিসেবে মাঝে মাঝে এক চামচ খেয়েও নিবি। বুঝেছিস?”

শান্ত খুবই মনমরা হয়ে বলল যে তার আসলে খুবই গাধামো হয়েছে। বইমেলা ঘুরে ঘুরে সে দেখেছে অনেকগুলো ফাটাফাটি বই আছে। তার ঐ বইগুলোই কেনা উচিত ছিল। জিম করবেটের শিকার কাহিনি। কনটিকির ভ্রমণ। এপোলো থার্টিনের মহাকাশ-অভিযান। অসাধারণ সব বই। দেখলেই জিভে পানি এসে যায়।

ছোটাচ্চু গজগজ করতে করতে টুনি, টুম্পা আর মুনিয়ার বইগুলো হাতে নিল। বইগুলো খুবই সুন্দর কিন্তু দাম হিসেব করতে গিয়ে দেখলে দুইশ টাকা কম। ছোটাচ্চু বলল, “কী হলো? দুইশ টাকা কম কেন? টাকা কোথায়? খরচ করিসনি?”

টুনি, টুম্পা আর মুনিয়া একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, দুইশ টাকার হিসাব কেন মিলানো যাচ্ছে না সেটা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না। টুনি শেষ পর্যন্ত বলেই দিল, ছোটাচ্চু যে নিয়ম করে দিয়েছে সেই নিয়মের বাইরে তো আর তারা যায়নি। তারা বই-ই কিনেছে কিন্তু নিজেদের জন্যে নয়, অন্যের জন্যে। কাজটা নিশ্চয়ই খুব বড় অপরাধ হতে পারে না!

কীভাবে কীভাবে পরিকল্পনা করে তারা জুয়েল নামের বাচ্চাটাকে ভূত এবং রাক্ষসের বইটা দিয়েছে শুনে ছোটাচ্চু অবশ্য খুবই মজা পেল। শুধু ছোটাচ্চু না অন্যেরাও আনন্দে হি হি করে হাসতে লাগল। ছোটাচ্চু এত খুশি হলো যে সে একেবারে একটা বক্তৃতা দিয়ে দিল। বলল, “তোরা যেটা করেছিস সেটা খুবই সুইট একটা কাজ। একটা ছোট বাচ্চার বইটার এত শখ অথচ মা-বাবা সেটা কিনে দিতে পারছে না, শুনে তো কষ্ট লাগতেই পারে। কিন্তু বইটা এমনভাবে দিলি যেন বাবা-মায়ের আত্মসম্মানে আঘাত না লাগে, এটা অসাধারণ একটা কাজ। তোরা এত ছোট কিন্তু তোদের এরকম ম্যাচুরিটি–আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি! আমি এত খুশি হয়েছি যে আমি কি করব জানিস?”

সবাই জানতে চাইল, “কী করবে ছোটাচ্চু?”

“তোদের তিনজনকে আরো পাঁচশ টাকা করে দেব।”

শুধু তিনজন নয়, সবাই মিলে তখন আনন্দে এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে মনে হলো বইমেলায় সবাই রীতিমতো চমকে উঠল! ছোটাচ্চু তখন তখনই পকেট থেকে তিনটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে তিনজনের হাতে ধরিয়ে দিল। টুম্পা আর মুনিয়া নোর্টটা হাতে নিয়ে তখন তখনই আবার ছোটদের বইয়ের স্টলের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। তাদের আর এক মুহূর্ত দেরি করার ধৈর্য নেই।

একটু পর অন্যরাও উঠে দাঁড়াল। মেলার মাঝে ইতস্তত ঘুরে ঘুরে তারা নতুন বই দেখতে থাকে। টুনি একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে ছিল তখন শান্ত তার পাশে এসে বসল। টুনি লক্ষ করল তার হাতে কিছু নেই। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বইগুলো কোথায় শান্ত ভাইয়া?”

“ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।”

“ফেলে দিয়েছ?”

“হ্যাঁ। তোদের সবার হাতে এত সুন্দর সুন্দর বই আর আমার কাছে হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা! ছিঃ!”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি সুন্দর বই কিনতে চাও?”

“কীভাবে কিনব, বদমাইশ পকেটমারটা আমার পকেট মেরে দিল, ধরতে পারলে খুন করে ফেলতাম।” তারপর সে পকেটমারকে অত্যন্ত খারাপ ভাষায় একটা গালি দিল।

টুনি তার ব্যাগ থেকে ছোটাচ্চুর দেওয়া পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে শান্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও শান্ত ভাইয়া। এই টাকা দিয়ে তোমার পছন্দের বই কিনে নাও।”

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “তোর টাকা দিয়ে আমি বই কিনব?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“আমরা সবাই সুন্দর সুন্দর বই নিয়ে বাসায় যাব আর তোমার কোনো বই থাকবে না–এটা কেমন হবে?

“সত্যি দিচ্ছিস?”

“হ্যাঁ।”

“পুরোটা?” টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “পুরোটা।”

“পরে যদি ঝগড়া হয় ফেরত চাইবি না?”

“না। ফেরত চাইব না।”

“খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

শান্তর মুখ তখন একশ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল। টুনির হাত থেকে ছোঁ মেরে নোটটা নিয়ে সেটাকে একটা চুমু খেল, তারপর হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

টুনি বসে বসে দেখল শান্ত ভাইয়া নোটটা পকেটে রেখে সেই পকেটটা হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু মুখে নিশ্চয়ই বিশাল একটা হাসি।

দূর থেকে টুম্পা আর মুনিয়াকে দেখা যাচ্ছে ছোটাচ্চুটি করে বই কিনছে। বইয়ের বোঝা আর টেনে নিতে পারছে না-কী আনন্দ! টুনি আশপাশে তাকাল, বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাঁটছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। চশমা পরা খ্যাপা ধরনের একটা মেয়ে হেঁটে গেল, বাতাসে চুল ওড়ছে, কী সুন্দর লাগছে দেখতে। শাড়ি পরা দুজন মেয়ে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। কী সুন্দর কপালে লাল-সবুজ টিপ দিয়েছে। দেখতে কী ভালো লাগছে!

টুনি বসে বসে দেখে। তার মনে হয়, আহা বেঁচে থাকাটা কী আনন্দের!

লুডো টুর্নামেন্ট

মুনিয়া একটা লুডোর বোর্ড, তার ছক্কা আর খুঁটির বাক্স নিয়ে গিয়েছে টুম্পার কাছে। টুম্পা গভীর মনোযোগ দিয়ে কাগজ কেটে কেটে একটা প্রজাপতি বানাচ্ছিল। মুনিয়া তাকে বলল, “টুম্পা আপু, আমার সাথে লুডো খেলবে?”

টুম্পা বলল, “উঁহু। এখন খেলতে পারব না। দেখছিস না এই প্রজাপতিটা তৈরি করছি, তারপর এইটা রং করতে হবে, তারপর রং শুকাতে হবে। অনেক কাজ।”

মুনিয়া তখন গেল প্রমির কাছে, গিয়ে বলল, “প্রমি আপু তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”

প্রমি বলল, “কেমন করে খেলি, বলো! হোমওয়ার্ক এখনও শেষ হয় নাই যে।”

মুনিয়া তখন গেল শাহানার কাছে, শাহানাও বলল তার সময় নেই। মুনিয়া শান্তর কাছে যাবে কি না ঠিক করতে পারছিল না। কিন্তু যেহেতু দোতলার সিঁড়িতে তার সাথে দেখা হয়েই গেল তাই তাকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”

শান্ত চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “কী বললি তুই? লুডো? তোর সাথে? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে তোর মতো একটা গেন্দা বাচ্চার সাথে বসে বসে এখন আমি লুডো খেলব? আমার কি কাজের অভাব পড়েছে? যা যা-ভাগ এখান থেকে!”

শান্তর কথা শুনে মুনিয়া কিছু মনে করল না। শান্ত সব সময় এইভাবেই কথা বলে। ভালোভাবে কথা বললেই বরং মুনিয়া অবাক হতো। মুনিয়া তখন গেল টুনির কাছে। টুনি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল, মুনিয়াকে দেখে বলল, “কী খবর মুনিয়া?”

মুনিয়া বলল, “টুনি আপু, তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?” টুনি মাথা চুলকে বলল, “লুডো? তোর সাথে?”

“হ্যাঁ।”

টুনি বলল, “লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই, পুরোটা হচ্ছে লটারি। অন্য কিছু খেলিস না কেন?”

“আমি অন্য কোনো খেলা পারি না।”

“আয় তোকে দাবা খেলা শিখিয়ে দেই। দাবা হচ্ছে বুদ্ধির খেলা।”

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি বুদ্ধির খেলা খেলতে চাই না। আমি লুডো খেলতে চাই।”

“কেন তুই বুদ্ধির খেলা শিখতে চাস না?”

মুনিয়া বলল, “আমার বুদ্ধি ভালো লাগে না।”

টুনি একটু অবাক হয়ে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এই বাসায় এখন সবচেয়ে ছোট হচ্ছে মুনিয়া, সে এখনই বুঝে গেছে বুদ্ধি বিষয়টা ভালো না!

টুনি বলল, “ঠিক আছে তোর সাথে আমি লুডো খেলব কিন্তু একটু সময় দে, বইটার খুব ইন্টারেস্টিং একটা জায়গায় এসেছি তো এইটা শেষ করে আসি।”

মুনিয়ার অপেক্ষা করার সময় নাই। সে তখন গেল ঝুমু খালার কাছে, গিয়ে বলল, “ঝুমু খালা তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”

ঝুমু খালা বলল, “অবশ্যই খেলব। লুডো আমার সবচেয়ে পছন্দের খেলা। আমি দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা লুডো খেলতে পারি। তবে সাপ-লুডো একটু ভয় লাগে। সাপ দেখলেই আমার শরীর কী রকম জানি ইজিবিজি করে।”

মুনিয়া বলল, “এইগুলো তো সত্যি সাপ না।”

“সত্যি হোক মিথ্যা হোক কিছু আসে-যায় না। সাপ দেখলেই শরীর ইজিবিজি করে।”

“তোমার কোনো ভয় নাই ঝুমু খালা, আমি সাপ-লুডো খেলব না।”

ঝুমু খালা খুশি হয়ে বলল, “চমৎকার!”

মুনিয়া বলল, “তাহলে বোর্ডটা এখানে পাতব? গুটি বসাব?”

ঝুমু খালা বলল, “মুনিয়া সোনা, আমাকে দুইটা মিনিটি সময় দাও। ডালটা বাগাড় দিয়ে ফেলি, ভাতটা নামিয়ে মাছগুলো ভেজে ফেলি–”

মুনিয়া হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল, সে জানে এতগুলো কাজ কোনোভাবেই দুই মিনিটে শেষ হবে না। তাই তখন সে দাদির (কিংবা নানির) কাছে গেল নালিশ করতে। দাদি বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন, তার পাশে একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে বসে আছে। ছেলেটা দেখতে অনেক স্মার্ট আর চেহারা খুব সুন্দর। একটা কালো টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরে আছে।

মুনিয়াকে দেখে দাদি জিজ্ঞেস করলেন, “মুনিয়া তোর মুখটা এত ভার কেন? কী হয়েছে?”

“দাদি, কেউ আমার সাথে খেলতে চায় না।”

“কেউ তোর সাথে খেলতে চায় না? এত বড় সাহস? সবগুলোকে ডেকে আন, খুন করে ফেলব সবগুলোকে আজকে।”

“সত্যি ডেকে আনব?”

“হ্যাঁ সত্যি।”

“সত্যি খুন করে ফেলবে?”

“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? সবাইকে বল আমার একজন নাতি এসেছে, তার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেব।”

মুনিয়া তখন সবাইকে ডেকে আনল, দাদি তাদের সবাইকে খুন করে ফেলা হবে বলার পরও কাউকে সে রকম দুশ্চিন্তিত দেখা গেল না। দাদির এই নতুন নাতিটি কে এবং কোথা থেকে এসেছে সেটা জানার জন্যে সবার ভেতরেই একটু কৌতূহল।

দাদি তার নতুন নাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন, “এই যে এ হচ্ছে আমার ছোটবেলার বান্ধবী জোবেদার নাতি। জোবেদার নাতি মানে আমার নাতি।”

সবাই দাদির নাতিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মনে মনে এ প্লাস দিয়ে দিল। ছেলেটা স্মার্ট আর সুন্দর। জামা-কাপড়ও যথেষ্ট ভালো। এই বয়সের মেয়েরা খুব সুইট হয়, কিন্তু ছেলেরা কেমন যেন ভ্যাবলা ধরনের হয়ে যায়। কিন্তু এই ছেলেটা মোটেও ভ্যাবলা ধরনের নয়।

দাদি বললেন, “এর নাম মিশু।”

তারপর অন্যদের দেখিয়ে বললেন, “মিশু, এরা আমার নাতি-নাতনি। এদের থেকে খুব সাবধান, একজন থেকে আরেকজন আরো বেশি তাঁদড়।”

শান্ত আপত্তি করল, বলল, “দাদি কথাটা ঠিক বললে না তুমি। আমরা মোটেও তঁদড় না।”

দাদি বললেন, “ঠিক আছে। সেইটা নিয়ে আলোচনা না করলাম।” তারপর মিশুকে দেখিয়ে বললেন, “মিশু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে বলে এসেছে। অন্য কোথাও থাকতে চাইছিল, আমি বলেছি আমি থাকতে অন্য কোথাও কেন থাকবে? তাই এখন এই বাসায় কয়দিন থাকবে।”

প্রমি বলল, “মিশু ভাই, তুমি কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে?”

মিশু উত্তর দেবার আগেই দাদি বললেন, “মিশু যে কয়টা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে তার প্রত্যেকটাতে চান্স পেয়েছে। সবগুলোতে একেবারে প্রথম দিকে আছে, তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের যে কোনো ইউনিভার্সিটির যেকোনো সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারবে। তাই না মিশু?”

মিশু লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, বলল, “আপনি এমনভাবে বলছেন যেন এইটা সাংঘাতিক কিছু। এটা এমন কিছু না, আমার থেকে আরও কত ভালো ছাত্রছাত্রী আছে।”

দাদি বললেন, “থাকলে থাকুক, তাদেরকে তো আর আমি চিনি না! আমি চিনি তোমাকে।”

দাদি বললেন, “দেখবেন আপনার নাতি-নাতনিরা আরো ভালো হবে!”

দাদি চোখ কপালে তুলে বললেন, “আমার নাতি-নাতনি? এরা কোনোদিন বই খুলে দেখে মনে করছ? বইয়ের সাথে এদের কারো কোনো সম্পর্ক নাই।”

টুনি আপত্তি করল, “কী বলছ দাদি? শাহানা আপু হচ্ছে জিনিয়াস। সায়েন্স ফেয়ারে দুইবার গোল্ড মেডেল পেয়েছে।”

“হ্যাঁ, শাহানাটাই কেবল একটু লেখাপড়া করে। যাই হোক, তোরা মিশুকে নিয়ে যা–কোথায় থাকবে কী সমাচার ঠিক করে দে।”

মুনিয়া তখন দাদিকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল, “দাদি, তুমি বলেছিলে এদের খুন করবে। এরা কেউ আমার সাথে লুডো খেলতে চায় না।”

দাদির মনে পড়ল, মাথা নেড়ে বললেন, “ও হ্যাঁ। তোরা কেউ মুনিয়ার সাথে খেলতে চাস না কেন? বেচারি একটা লুডোর বোর্ড নিয়ে কতক্ষণ থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

সবাই একসাথে একটু যন্ত্রণার শব্দ করল। প্রমি বলল, “দাদি লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই, এইটা খেলার ইচ্ছা করে না।”

টুনি বলল, “আমি বলছিলাম মুনিয়াকে দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেই।”

হঠাৎ করে মিশু বলল, “আমি একটা কথা বলি?”

সবাই থেমে গেল, মিশুর দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিশু বলল, “তোমরা সবাই বলছ লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই। কিন্তু আমার মনে হয় আছে।”

শান্ত বলল, “আছে? যার ছক্কা বেশি পড়ে সে জিতে-এর মাঝে বুদ্ধিটা কোনখানে?”

মিশু হাসি হাসি মুখ করে বলল, “হ্যাঁ আছে। এর মাঝেও বুদ্ধি আছে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা একটা লুডো টুর্নামেন্ট করো, আমিও সেখানে খেলি।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি খেলে চ্যাম্পিয়ন হবে?”

মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “যদি চাই তাহলে হতে পারি।”

শান্ত চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তার মানে তুমি আমাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছ?”

মিশু বলল, “আমি ঠিক চ্যালেঞ্জ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না কিন্তু বলা যায় তোমরা কোনোভাবে মনে হয় আমাকে হারাতে পারবে না।”

“সত্যি?”

মিশু মাথা নাড়ল, প্রমি বলল, “দেখা যাক।”

শান্ত বলল, “ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া। ছোটাচ্চুকে বলি স্পন্সর করতে। টুর্নামেন্টের নাম হবে ‘ছোটাচ্চু লুডো টুর্নামেন্ট। এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা। আমি হব ইভেন্ট ম্যানেজার আর রেফারি। দাদি হবে চিফ এডভাইজার। ফাটাফাটি ইভেন্ট!”

মুনিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমার সাথে কে খেলবে?”

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। সবাই তখন লুডো টুর্নামেন্ট নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে।

.

শান্তর ঘরে মিশুর থাকার জায়গা করে দেয়া হলো। মিশু তার ব্যাক প্যাক থেকে বইপত্র বের করে বিছানায় রাখে। শান্ত বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল, সাইকোলজির একটা বই ধরতেই শান্ত বইটা তার হাত থেকে নিয়ে নিল, বলল, “এই বইটা তুমি দেখতে পারবে না।”

“কেন?”

“এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক দেখাই। এটা আমার ম্যাজিক বই।”

“ম্যাজিক বই?”

“হ্যাঁ।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ম্যাজিক বই?”

“এই দেখো–” বলে মিশু বইটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টে দেখাল। শান্ত কোনো ম্যাজিক দেখল না। খুবই সাধারণ একটা বই, ভুরু কুঁচকে বলল, “কোথায় ম্যাজিক?”

“এই দেখো।” বলে শান্ত বইটার উপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন দিল। তারপর বইটা খুলতেই দেখে প্রত্যেক পৃষ্ঠায় একটা ক্রস আঁকা।

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কী আশ্চর্য!”

মিশু জিজ্ঞেস করল, “কোনটা তোমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে?”

“এক্ষুনি বইটাতে কিছু ছিল না এখন প্রতি পৃষ্ঠায় ক্রস।”

মিশু বলল, “ক্রস? কোথায় ক্রস?” বলে সে বইটা আবার খুলে দেখায়, প্রতিটি পৃষ্ঠা আগের মতো, কোনো ক্রস নেই? শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বলল, “আমাকে শেখাবে কেমন করে এই ম্যাজিকটা দেখাও।”

মিশু বলল, “সবাইকে সবকিছু শেখানো যায় না। কোনো কিছু ভালো করে শিখতে হলে তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়।”

.

হাত-মুখ ধুয়ে মিশুকে নিয়ে শান্ত নিচে নাস্তা খেতে এলো। ঝুমু খালা টেবিলে গরম গরম ডালপুরী আর চা দিয়েছে। সবাই ঝুমু খালার বিখ্যাত ডালপুরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চা অবশ্যি সবার কপালে জুটে না–এই বাসায় একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত চা খাবার পারমিশন পাওয়া যায় না। ঝুমু খালার মন ভালো থাকলে মাঝে মাঝে এক-দুইজনকে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে আধা কাপ চা তৈরি করে দেয়।

আজকে ঝুমু খালার মন নিশ্চয়ই ভালো ছিল তাই টুম্পাকে আধ কাপ চা দিয়েছে। টুম্পা খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে সেই চা খাচ্ছে, তখন মিশু টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চায়ে একটু ম্যাজিক করে দিই?”

টুম্পা অবাক হয়ে বলল, “ম্যাজিক?”

“হ্যাঁ।”

শান্ত তখন চোখ বড় বড় করে হাত-পা নেড়ে নেড়ে বলল, “ও, তোরা কেউ জানিস না, মিশু ভাই আস্ত ম্যাজিশিয়ান। একেবারে জুয়েল আইচ!”

সবাই মিশুর দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

মিশু কিছু বলল না, শান্ত জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি মানে সত্যি! ডাবল সত্যি। একটু আগে বইয়ের উপরে আঙুল দিয়ে দাগ দিয়ে বইয়ের ভিতর ক্রস এঁকে ফেলেছে।”

টুম্পা বলল, “আমাদের দেখাবে?”

মিশু বলল, “অন্য সময় দেখাব। এখন বরং তোমাকে চায়ের ম্যাজিক দেখাই।”

“দেখাও।”

মিশু বলল, “ঠোঁটগুলো যতটুকু পারো ভেতরে নাও, তারপর চা খাও, দেখবে কী ম্যাজিক হবে! যত বেশি মুখের ভেতর নিতে পারবে তত বড় ম্যাজিক।”

সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। টুম্পা তার ঠোঁট দুটো মুখের ভেতরে নিয়ে তার চায়ে চুমুক দিতে গিয়েই চিৎকার করে চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে প্রায় কাঁদতে শুরু করে দিল।

সবাই ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”

টুম্পা হাত দিয়ে তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মিশু হা হা করে হেসে বলল, “কী আর হবে? কিছু হয় নাই! মুখে গরম চায়ের একটু ছ্যাঁকা খেয়েছে। মানুষের ঠোঁট গরম সহ্য করতে পারে, অন্য জায়গা পারে না, সেটাই দেখানো হলো!”

মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে কেউ নজর দিল না, টুনি টুম্পাকে হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে গেল, ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বরফ বের করে তার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল যন্ত্রণাটা কমানোর জন্যে। মিশু তখনো দুলে দুলে হাসছে। ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি মানুষটা তো ভালো না, ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাও!”

মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “কষ্ট? কষ্ট কখন দিলাম? গরম চায়ে শুধু একটু ছ্যাকা খেয়েছে! একটু মজা করলাম আর কিছু না।”

ঝুমু খালা বলল, “এই বাসায় এই রকম মজা চলে না।”

মিশু তখনো হাসি হাসি মুখ রেখে বলল, “ঠিক আছে! এই বাসায় যে রকম মজা চলে সেটাই করা হবে এখন থেকে। সেটা হচ্ছে লুডো টুর্নামেন্ট! ঠিক আছে?”

সবাই মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা নাড়ল।

.

মিশু খুবই বুদ্ধিমান এবং লেখাপড়া জানা ছেলে, দেখতেও খুব সুন্দর, জামা কাপড় ভালো, কথা বলে খুব সুন্দর করে কিন্তু মানুষটা মনে হয় ভালো না, ঝুমু খালা সেটা টের পেয়েছে সবার আগে। অন্যরাও আস্তে আস্তে টের পেতে লাগল।

যেমন সন্ধেবেলা মিশু বাসায় এসে টুম্পাকে খুঁজে বের করে বলল, “টুম্পা তোমাকে বিকেলে গরম চা দিয়ে ছ্যাকা খাইয়েছি সে জন্যে আমার খুব খারাপ লাগছে। তোমার সাথে ভাব করার জন্যে আমি তোমার জন্যে একটা চকোলেট কিনে এনেছি। তুমি চকোলেট খাও তো?”

টুম্পা মাথা নাড়ল, চকোলেট তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। বড় হয়ে সে চকোলেটের ফ্যাক্টরি তৈরি করবে বলে ঠিক করে রেখেছে।

মিশু বলল, “আমি চকোলেটটা দিচ্ছি, কিন্তু তুমি তার আগে আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবে?”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ?”

মিশু টুম্পার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল, “এই কাগজটা ভাঁজ করে দিতে পারবে?”

টুম্পা বলল, “পারব।”

তাহলে ভাঁজ করে দাও দেখি, “সাতবার ভাঁজ করবে।”

টুম্পা বলল, “সাতবার?”

“হ্যাঁ। সমস্যা আছে?”

টুম্পা বলল, “নাহ্।”

মিশু বলল, “তাহলে শুরু করে দাও, আমি চকোলেটটা বের করে রাখি। ভজ শেষ হলেই চকোলেট!”

টুম্পা কাগজটা মাঝখানে একবার ভাঁজ করল। তারপর আবার। তারপর আবার। ভাঁজ করার জন্যে কাগজটা মোটা হতে শুরু করেছে তাই আস্তে আস্তে কাজটা কঠিন হয়ে গেল। টুম্পা অনেক কষ্ট করে ছয়বার ভাঁজ করে আবিষ্কার করল কাগজটা সাতবার ভাঁজ করা অসম্ভব।

মিশু মুখের মাঝে একটা কপট দুশ্চিন্তার ভান ফুটিয়ে বলল, “কী হলো? থেমে গেলে কেন? করো।”

টুম্পা বলল, “করা যাবে না।”

মিশু বলল, “আহা-হা-তাহলে তো চকোলেটটাও তোমাকে দেয়া যাবে। তোমার জন্যে এনেছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে আমাকেই খেতে হবে!” বলে চকোলেটটার র‍্যাপার খুলে সত্যি সত্যি সে খেতে শুরু করল।

লজ্জায় আর অপমানে টুম্পার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ঘর থেকে প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল। কাছেই দাঁড়িয়ে শান্ত পুরো ব্যাপারটা দেখেছে; সে মাথা নেড়ে বলল, “কাজটা ভালো হলো না।”

মিশু চকোলেটের বারে আরেকটা বড় কামড় দিয়ে বলল, “কোন কাজটা?”

“টুম্পাকে এরকম লজ্জা দিলে? বেচারি–”

“লজ্জা দিয়েছি? আমি? মোটেও না।”

“টুম্পা কেমন করে জানবে একটা কাগজ সাতবার ভাঁজ করা যায় না?”

“জানা উচিত ছিল। প্রতি ভঁজে কাগজের সংখ্যা ডাবল হয়ে যায়। সাত ভজ মানে চৌষট্টি পাতা–একশ আটাইশ পৃষ্ঠা! একশ আটাইশ পৃষ্ঠার একটা বই ভাঁজ করতে রাজি হওয়ার আগে চিন্তা করা উচিত ছিল।”

শান্ত বলল, “টুম্পা ছোট একটা মেয়ে–”

মিশু চকোলেটের শেষ টুকরোটা মুখে দিয়ে খুব তৃপ্তি করে চিবুতে চিবুতে বলল, “ঠিক আছে টুম্পা ছোট মেয়ে–কিন্তু তুমি তো ছোট না। তুমি কি রাজি আছ?”

শান্ত বলল, “কীসে রাজি আছি?”

“আমি যেটা বলব সেটা করতে রাজি আছ?”

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “কী করতে বলবে?”

“খুব সোজা একটা কাজ। যদি করতে পারো তাহলে আমি তোমাকে একশ টাকা দিব। না পারলে তুমি আমাকে একশ টাকা দিবে।”

শান্ত সরু চোখে কিছুক্ষণ মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর বলল, “আমার কাছে এত টাকা নাই।”

“কত আছে?”

“দশ টাকা।”

“ঠিক আছে তুমি করতে পারলে আমি তোমাকে একশ টাকা দিব, না পারলে তুমি আমাকে দশ টাকা দিবে।”

“কাজটা কী আগে শুনি?”

মিশু বলল “তুমি তোমার এক পায়ের উপর দাঁড়াবে।”

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “ব্যস?”

“হ্যাঁ। তবে কোথায় দাঁড়াতে হবে সেটা আমি বলে দেব। জায়গাটা যদি তোমার পছন্দ না-হয় তোমার দাঁড়াতে হবে না। দেখে-শুনে যদি রাজি হও তাহলেই শুধু দাঁড়াবে।”

“কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে?”

মিশু বলল, “এক সেকেন্ড।”

শান্ত বলল, “মাত্র এক সেকেন্ড?”

“হ্যাঁ। মাত্র এক সেকেন্ড।”

“ঠিক আছে, কোথায় দাঁড়াতে হবে দেখাও।”

মিশু বলল, “আগে সবাইকে ডেকে আনো। সবার সামনেই কম্পিটিশনটা হোক। পরে বলবে আমি বোকা পেয়ে তোমাকে ঠকিয়ে দিয়েছি।”

শান্ত গরম হয়ে বলল, “আমি বোকা না।”

মিশু বলল, “ঠিক আছে, তুমি বোকা না। তবে জেনে রাখো, বোকা না হওয়া এক জিনিস আর বুদ্ধিমান হওয়া অন্য জিনিস।”

শান্ত সরু চোখে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল। মিশু বলল, “যাও সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো! আমাদের কম্পিটিশনটা দেখুক।”

কিছুক্ষণের মাঝেই সব বাচ্চারা হাজির হলো। মিশু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার আর শান্তর মাঝে এখন একটা প্রতিযোগিতা হবে। আমি শান্তকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াতে বলব। সে যদি এক সেকেন্ড সেখানে এক পায়ে দাঁড়াতে পারে আমি তাকে দেব একশ টাকা। যদি না পারে সে আমাকে দেবে মাত্র দশ টাকা।”

মুনিয়া বলল, “আমিও এক পায়ে দাঁড়াতে পারি। এই দেখো–” বলে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেল।”

মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “ভেরি গুড। যখন তোমার সাথে কম্পিটিশন হবে তখন তুমি দাঁড়াবে। এখন কম্পিটিশনটা হচ্ছে শান্তর সাথে।” মিশু শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “শান্ত, রেডি?”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “রেডি।”

“তাহলে ঐ দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াও। ডান পায়ের ডান সাইডটা দেয়ালে লাগিয়ে বাম পাটা এক সেকেন্ডের জন্যে উপরে তুলবে। বেশি না, মাত্র এক সেকেন্ড!”

শান্ত হাসি হাসি মুখে গেল, ডান পায়ের ডান দিকের অংশটা দেয়ালের সাথে লাগাল এবং হঠাৎ করে সবাই দেখল শান্তর মুখটা কেমন যেন চিমশে মেরে গেল। মনে হচ্ছে ডান পায়ের উপর ভর দিয়ে সে বাম পাটা তুলতে পারছে না! এক সেকেন্ডের জন্যেও না! কী আশ্চর্য!

মিশু বলল, “কী হলো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোলো বাম পা, ডান পায়ের উপর দাঁড়াও।”

শান্ত বোকার মতো একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “পারছি না!” তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে একটুখানি তুলে সাথে সাথে নামিয়ে ফেলল, বোঝাই যাচ্ছে সে দেয়ালের সাথে এক পা এবং শরীর লাগিয়ে অন্য পা তুলতে পারবে না।

মিশু হাত পেতে বলল, “দাও আমার দশ টাকা।”

শান্ত মুখটা কালো করে পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে মিশুকে দিল। টাকাটার জন্যে তার খুব দুঃখ নেই কিন্তু সবার সামনে সে যে বোকা বনেছে সে জন্যে তার খুবই লজ্জা লাগছিল।

শান্তর অবস্থা দেখে অন্য সবাই চেষ্টা করে আবিষ্কার করল দেয়ালের সাথে পা এবং শরীর লেগে গেলে কোনোভাবেই এক পায়ে দাঁড়ানো যায় না। মিশু মুখ গম্ভীর করে বলল, “পারবে না। এটা সম্ভব না। এক পায়ে দাঁড়ালে শরীরের সেন্টার অব গ্রেভিটি ব্যালেন্স করার জন্যে শরীরটা বাকাতে হয়। দেওয়াল থাকলে শরীর বাকানো যায় না, তাই এক পায়ে দাঁড়ানোও যায় না।”

মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনেও কেন জানি কেউই খুব চমৎকৃত হলো না।

.

রাতে ঘুমানোর সময় মিশু শান্তকে জীবন সম্পর্কে একটু জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করল। বলল, “বুঝলে শান্ত, বেশি ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে ঠিক জায়গায় দুই নম্বরি করতে হয়।”

শান্ত উঠে বসল, “তুমি দুই নম্বরি করো?”

“করি না? সব সময় করি। করতে হয়। যেমন–মনে করো পরীক্ষার সময় তুমি খুব ভালো পরীক্ষা দিলে, কিন্তু অন্যরা তোমার থেকেও ভালো পরীক্ষা দিল, তাহলে তোমার লাভ কী? তাই পরীক্ষার সময় তোমার ভালো পরীক্ষা দেওয়া যেমন দরকার, অন্যদের পরীক্ষা খারাপ করে দেওয়া সমান। দরকার।”

“অন্যদের পরীক্ষা তুমি কেমন করে খারাপ করবে?”

“অনেক রকম উপায় আছে। তোমাকে সোজা একটা উপায় শিখিয়ে দেই। ক্যালকুলেটরে ডিগ্রি থাকে আর রেডিয়ান থাকে। ছেলেমেয়েরা সবসময় ডিগ্রিতে হিসাব করে। আমি কী করি জানো?”

“কী করো?”

“ওদের ক্যালকুলেটর নিয়ে সেটাকে রেডিয়ানে সেট করে দেই। তারা তো আর সেইটা জানে না, তাই যখন ত্রিকোণমিতি করে সব হিসাব তখন ভুল হয়ে বের হয়। পরীক্ষায় এত বড় গোল্লা পায়–” কথা শেষ করে মিশু আনন্দে হা হা করে হাসতে থাকে।

শান্ত ঠিক বুঝতে পারছিল না অন্যদের পরীক্ষায় গোল্লা পাইয়ে দেওয়াটা ঠিক কাজ হচ্ছে কি না। কিন্তু কেউ তো অস্বীকার করতে পারবে না মিশু ভাইয়া খুবই ভালো ছাত্র, ভর্তি পরীক্ষায় সবগুলো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কাজেই সে যে কাজগুলো করে সেটা নিশ্চয়ই সঠিক কাজ। তবু তার ভিতরে খচখচ করতে থাকে।

.

পরদিন লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হলো। ছোট একটা টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার, সেখানে খেলোয়াড়রা বসবে। টেবিলে লুডোর বোর্ড। টেবিল ঘিরে দর্শকেরা বসে কিংবা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেবে। অনেক কষ্ট করে একশ টাকা জোগাড় করা হয়েছে। টুর্নামেন্টের বিজয়ীকে এই একশ টাকা নগদ দেয়া হবে। টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করার জন্যে দাদি (কিংবা নানি)-কে ধরে আনা হলো, দাদির সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। প্রথমে দাদিকে বলা হলো একটা বক্তৃতা দিতে। দাদি অবাক হয়ে বললেন, “বক্তৃতা? আমি?”

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ, তুমি।”

দাদি বললেন, “আমি কখনো বক্তৃতা দেই নাই। কেমন করে বক্তৃতা দিতে হয় জানি না।”

শান্ত বলল, “বক্তৃতা কেমন করে দিতে হয় কেউ জানে না! শুধু হাত উপরে তুলে গলা কাঁপিয়ে বলল, ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক।”

দাদি অবাক হয়ে বললেন, “ধ্বংস হোক? কে ধ্বংস হবে?”

“সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মেহনতি মানুষের শত্রু-এইসব।”

প্রমি শান্তকে ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি?” তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “লুডো খেলা নিয়ে কিছু একটা বলো।”

দাদি তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “মুনিয়া বেচারি লুডো খেলতে চাচ্ছিল, তোরা কেউ আগে খেলতে চাস নাই সে জন্যে মুনিয়ার মন খুব খারাপ ছিল। এখন তোরা খেলার আয়োজন করেছিস দেখে খুশি হলাম। দোয়া করি তোদের প্রতি দানে যেন বেশি করে ছক্কা ওঠে।”

দাদির বক্তৃতা শেষ হতেই সবাই জোরে জোরে হাততালি দিল। তখন প্রমি ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা এখন তুমি একটা বক্তৃতা দাও।”

ঝুমু খালা এক কথায় রাজি। শাড়িটা কোমরে প্যাচিয়ে হাত নেড়ে বক্তৃতা শুরু করে দিল, “দেশবাসী ভাই-বোনেরা আপনাদের লাল সালাম (প্রচণ্ড হাততালি শোনা গেল)। এই বাসার পুলাপান কিছু পাগল কিছু আধা পাগল (আবার হাততালি) তারপরেও তোমরা একটা লুডু খেলার আয়োজন করেছ, সেই জন্যে লাল সালাম (আবার হাততালি)। আমি এইখানে ঘোষণা দিয়ে গেলাম লুডু খেলা চলার সময় আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোমাদের চা-নাস্তা দিয়ে যাব।”

ঝুমু খালার কথা শেষ হবার পর এবারে শুধু হাততালি না, জঙ্গি স্লোগান শোনা গেল, “আমার খালা, তোমার খালা, ঝুমু খালা ঝুমু খালা।”

তারপর দাদি লুডোর বোর্ডের উপর একবার ছক্কাটা চাললেন, খেলার উদ্বোধন হয়ে গেল।

কার সাথে কে খেলবে খুব যত্ন করে সেটা তৈরি করা হয়েছে। তিনবার করে খেলা হবে তার মাঝে যে দুইবার জিতবে সে-ই হচ্ছে বিজয়ী। খেলা শুরু হওয়ার আগে মিশু জিজ্ঞেস করল, “এই লুডু টুর্নামেন্টে কে জিতবে বলে তোমাদের মনে হয়?”

কেউ কিছু বলার আগেই মুনিয়া হাত তুলে বলল, “আমি!”

“তুমি?”

মিশু বলল, “তুমি কেমন করে জানো তুমি চ্যাম্পিয়ন হবে?”

মুনিয়া বলল, “আমি খুব ভালো লুডো খেলতে পারি। আর আমি যখন চ্যাম্পিয়ন হব তখন আমি একশ টাকা পাব। আমার একশ টাকা দরকার।”

“এত ছোট মানুষ তুমি এত টাকা দিয়ে কী করবে?”

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “বলব না।”

মিশু বলল, “মুনিয়া তুমি কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবে না। শুধু শুধু আশা করে বসে থেকো না।”

মুনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, “হব না?”

“নাহ্। চ্যাম্পিয়ন হব আমি। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি।” মিশু মাথা নাড়ল, “লুডো খেলার মাঝে আমি হচ্ছি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”

মুনিয়ার ছোট মুখটা একটু কালো হয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে সাহস দিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মিশু মুনিয়াকে বলল, “কিন্তু তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে আগেই তোমার জন্যে একশ টাকা বের করে দেব।”

মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, “কোথা থেকে বের করবে।” “তোমার কাছেই আছে।” “আমার কাছে আছে?”

মিশু বলল, “হ্যাঁ। এই দেখো” বলে মুনিয়ার কানটা স্পর্শ করে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে আনে। সেটা দেখে মুনিয়ার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তার কানের ভেতর পাঁচ টাকার এত বড় একটা কয়েন আছে সে কখনো জানত না।

মিশু বলল, “কয়েনগুলো রাখার জন্যে কিছু একটা দরকার।” দেখা গেল সে রেডি হয়ে এসেছে। কফি টেবিলের উপর রাখা একটা খালি কৌটা নিয়ে সেখানে ঝন করে পাঁচ টাকার কয়েনটা. ফেলে আবার মুনিয়ার অন্য কান থেকে আরেকটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে আনে। তারপর নাক থেকে দুইটা কয়েন বের করে আনে। চোখ থেকে, চুল থেকে, ঘাড় থেকে কয়েন বের হতে থাকে আর মিশু কয়েনগুলো টিনের কৌটার মাঝে রাখতে থাকে। যখন মুনিয়ার শরীর থেকে বিশটা পাঁচ টাকার কয়েন বের হয়েছে

তখন মিশু বলল, “এই যে মুনিয়া একশ টাকা হয়ে গেছে। তোমাকে তোমার একশ টাকা দিয়ে দিই। সব কৌটার মাঝে জমা করে রেখেছি।”

মুনিয়া ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে কী না বুঝতে পারছে না। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করে কেমন করে? নিজের চোখে দেখেছে মিশু ভাইয়া তার কান থেকে, নাক থেকে কয়েনগুলো বের করছে। সে টুনির দিকে তাকাল, টুনি বলল, “মিশু ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করিস না। এগুলো ম্যাজিক। হাতের কারসাজি। তোর সাথে ঠাট্টা করছে।”

মিশু গম্ভীর মুখে বলল, “মোটেও কারসাজি না। এই দেখো কয়েনগুলো কৌটার মাঝে আছে।” মিশু কৌটাটা ঝাঁকুনি দিতেই ভেতরে কয়েনগুলো ঝনঝন করে উঠল। তারপর কৌটার মুখে তার প্রাস্টিক ঢাকনাটা লাগিয়ে কৌটাটা তাকে দিয়ে বলল, “নাও। তোমার জন্যে।”

মুনিয়া আগ্রহ নিয়ে কৌটাটা নিল। মিশু বলল, “শুধু মুখটা খোলার সময় সাবধান।”

“কেন?”

“এটা খোলার সময় তুমি যেটা ইচ্ছা চিন্তা করতে পারো কিন্তু হাতির কথা চিন্তা করতে পারবে না। হাতির কথা চিন্তা করলেই কিন্তু কয়েনগুলো ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”

“ভ্যানিশ হয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

মুনিয়া কয়েকবার কৌটার মুখটা খুলতে গিয়ে থেমে গেল। প্রত্যেকবার খোলার সময় তাকে নিশ্চিত হতে হয় সে যে হাতির কথা চিন্তা করছে না, তখন হাতির কথা মনে পড়ে যায়।

টুনি মুনিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “মিশু ভাইয়া তোকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এই কৌটার ভিতরে কিছু নেই। তুই খুলে দেখ।”

মুনিয়া শেষ পর্যন্ত কৌটাটা খুলে চিৎকার করে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ভিতরে একটা মরে শুকনো হয়ে থাকা টিকটিকি। কী ভয়ানক! একটু আগে শান্তর ঘরে জানালার ফাঁকে আটকে পড়ে মরে পড়ে থাকা এই টিকটিকিটা মিশু আবিষ্কার করে এখনই একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে!

মিশু দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই কৌটা খোলার সময় হাতির কথা চিন্তা করেছ তাই সব কয়েন ভ্যানিশ করে একটা মরা টিকটিকি চলে এসেছে!”

মুনিয়া বিষদৃষ্টিতে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল।

.

কিছুক্ষণের ভিতরে লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হয়। মিশু ঘোষণা দিয়ে রেখেছে কেউ তাকে খেলায় হারাতে পারবে না। দেখা গেল তার কথা সত্যি। সে অবলীলায় প্রথম খেলাটা জিতে গেল। মনে হলো ছক্কাটা তার কথা শুনে, যখনই ছয়ের দরকার হয় একটা ছয় উঠে আসে। লুডো খেলায় এ রকম ছয়ের ছড়াছড়ি সে আগে দেখেনি!

দ্বিতীয় খেলার সময়ও দেখা গেল ঝটপট মিশুর সব খুঁটি বোর্ডে উঠে এসেছে, তারপর দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। টুনি তখন মিশুর খেলাটা ভালো করে লক্ষ করল এবং মিশুর জিতে যাওয়ার কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করে ফেলল।

মিশুর কাছে দ্বিতীয় একটা ছক্কা আছে যেটা দেখতে হুবহু আসল ছক্কার মতোন। কিন্তু সেই ছক্কাটিতে কোনো পাঁচ নেই, পাঁচের বদলে সেখানে আরো একটি ছয় আছে। এই ছক্কাটি দিয়ে খেললে ছয় ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে ডাবল হয়ে যায়। মিশুর যখন ছয়ের দরকার হয় সে এটা দিয়ে খেলে। মিশু যেহেতু ম্যাজিক দেখায়, তার হাতসাফাই অসাধারণ। হাতের মাঝের লুকিয়ে রাখা ছক্কাটা কেমন করে বদলে দেয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও ধরা যায় না। ছক্কাটা যখন গড়িয়ে যায় তখন খুব ভালো করে তাকালে বোঝা যায় এই ছক্কার দুই পাশেই ছয়। টুনি মিশুকে ধরিয়ে দিবে কী না চিন্তা করল, কিন্তু মিশুর মতো ধুরন্ধর ছেলেকে শুধু ধরিয়ে দিলে হবে না, তাকে একটা শিক্ষাও দেয়া দরকার। টুনি তখন লুডো টুর্নামেন্ট থেকে উঠে উপরে গেল। শাহানা আপু ভরসা। যখন তার নিজের বুদ্ধিতে কুলায় না তখন সে শাহানা আপুর বুদ্ধি ধার নেয়।

শাহানা আপু খাতায় বিদঘুঁটে যন্ত্রের একটা ছবি এঁকে তার দিকে তাকিয়েছিল, টুনিকে দেখে বলল, “লুডো টুর্নামেন্ট কেমন চলছে?”

“ভালো, কিন্তু একটা সমস্যা আছে। তাই তোমার কাছে এসেছি।“

“কী সমস্যা?”

“মিশু ভাইয়া একটা দুই নম্বরি ছক্কা দিয়ে খেলছে।”

“দুই নম্বরি?”

“হ্যাঁ। এই ছক্কায় কোনো পাঁচ নেই। ছক্কার এই পিঠ আর ওই পিঠ দুই পিঠেই ছয়। সেটা চাললে বেশি ছয় ওঠে।”

“ধরিয়ে দিচ্ছিস না কেন?”

“ধরিয়ে দিলেই তো শেষ। আমি ধরিয়ে দেবার আগে মিশু ভাইয়াকে একটা শিক্ষা দিতে চাই। মিশু ভাইয়া মানুষটা ভালো না-মুনিয়াকে একটু আগে বোকা বানিয়ে হা হা করে হাসছে। যে মানুষ ছোট বাচ্চাদের জ্বালায় সেই মানুষ খুব ডেঞ্জারাস।”

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তুই কী করতে চাস?”

“আমাকে এমন একটা ছক্কা বানিয়ে দেবে যেটা দিয়ে যখন যেটা পেতে চাই সেটা পাব। ছয় চাইলে ছয় তিন চাইলে তিন। এক চাইলে এক।”

“কখন বানিয়ে দেব?”

“এই এক্ষুনি। বিকালের মাঝে টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাবে তার আগে।”

শাহানা আপু হাসল, বলল, “এত তাড়াতাড়ি এই রকম ছক্কা বানানো সম্ভব না। মিশু ভাইয়ার মতো আরেকটা ছক্কা বানিয়ে নে।”

টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু। আমি মিশু ভাইয়ার নকল করতে চাই না। নতুন কিছু করতে চাই যেন মিশু ভাইয়া টের পায় যে তার থেকে বুদ্ধিমান মানুষ আছে যে তাকে ঘোল খাওয়াতে পারে।”

শাহানা আপা ঠোঁট সুচালো করে উপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা কাজ করা যেতে পারে।”

টুনি হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমি বলেছি না, তুমি চাইলেই পারবে। বলো কী করতে হবে।”

“যেহেতু মেঝেতে বোর্ড পেতে খেলা হচ্ছে না, একটা ছোট টেবিলের উপর রেখে খেলা হচ্ছে তাই এই বুদ্ধি কাজে লাগানো যায়।”

“কী বুদ্ধি বলো?”

আমার কাছে ছোট ছোট খুব পাওয়ারফুল চুম্বক আছে। নষ্ট হার্ড ড্রাইভ থেকে বের করেছি। একটা ছক্কা নিয়ে মাঝখানে গর্ত করে সেই চুম্বকটা ঢোকাতে হবে। কাজটা সহজ না কিন্তু সম্ভব। ছক্কাটা মাঝখান থেকে কেটে ভেতরে গর্ত করে সেখানে এই খুব ছোট বিন্দি চুম্বকটা ঢোকাতে হবে। তারপর আবার দুই অংশ জুড়ে দিয়ে পালিশ করে নিয়ে ছক্কার ডটগুলো নতুন করে এঁকে দিতে হবে।”

“তারপর কী করব?”

“এটাকে দেখতে ছক্কার মতো মনে হলেও এটা আসলে একটা পাওয়ারফুল চুম্বক। আরেকটা চুম্বক দিয়ে এটাকে কন্ট্রোল করা যাবে। মনে করো এমনভাবে ছক্কাটা তৈরি হলো যেন ছক্কাটার নর্থপোল যখন নিচের দিকে থাকবে তখন ছয় উঠবে। আর যখন সাউথ পোল নিচের দিকে থাকবে তখন এক উঠবে। এবারে কেউ যখন খেলার সময় ছক্কাটা মারবে, টেবিলের নিচে আরেকটা চুম্বক ধরবি, যদি সেই চুম্বকটার সাউথ পোল উপরের দিকে রাখিস তাহলে সেই সাউথ পোলের আকর্ষণে ছক্কাটার নর্থ পোল নিচের দিকে চলে আসবে অর্থাৎ ছয় উঠবে।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি। আর যদি চুম্বকটা উল্টো করে ধরি তাহলে এক উঠবে।”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

টুনি শাহানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “প্লিজ, শাহানা আপু আমাকে এই ম্যাজিক ছক্কাটা বানিয়ে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

শাহানা বলল, “ঠিক আছে আমাকে ঘণ্টাখানেক সময় দে। ছক্কাটা বানাব কী দিয়ে সেটা আগে ঠিক করি।”

টুনি বলল, “আমার কাছে আরেকটা লুডো সেট আছে সেখানে একটা ছক্কা আছে, সেটা নিয়ে আসি?”

“যা নিয়ে আয়।”

টুনি ছুটে উপরে গিয়ে তার টেবিলের তাকের উপর থেকে লুডো সেটের ছক্কাটা নিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এসে শাহানার হাতে ধরিয়ে দিল।

এখন যে ছক্কাটা দিয়ে টুর্নামেন্ট খেলা হচ্ছে এটা তার থেকে একটু বড়, দেখতেও অন্য রকম, ঠিক টুনি যে রকম চাইছিল।

.

নিচে তখন লুডো টুর্নামেন্ট খুব জমে উঠেছে। সব খেলোয়াড়দের দুই গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে এক গ্রুপে মিশুকে কেউ হারাতে পারেনি। সে নিশ্চিতভাবে ফাইনাল খেলবে। অন্য গ্রুপ থেকে ফাইনালে কে আসবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব ছিল না কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে যে মুনিয়া উঠে আসবে। মুনিয়া ভালো খেলছে সেটা নয়, সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মুনিয়াকে জিতিয়ে দিতে।

যখনই কেউ মুনিয়ার বিপক্ষে খেলছে তখনই সে ইচ্ছে করে ভুল চাল দিয়ে হেরে যাচ্ছে। লুডো খেলায় সেটা খুব সহজ, যখন একটা খুঁটি পেকে যাবার কথা তখন ভুল করার ভান করে দ্বিতীয়বার ঘুরিয়ে আনা যায়। শুধু তাই না মুনিয়া যেন কেটে ফেলতে পারে সে জন্যে ইচ্ছে করে তার সামনে বিপজ্জনকভাবে সবাই নিজের খুঁটি ফেলে রাখে। মুনিয়া ছোট মানুষ তাই সে বুঝতে পারছে না যে সবাই ইচ্ছে করে তার সাথে হেরে যাচ্ছে! তার ধারণা সে নিজেই অসাধারণ লুডো খেলে জিতে যাচ্ছে। সে খুবই খুশি।

টুনি গিয়ে শান্তকে খুঁজে বের করল, তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলল, “শান্ত ভাইয়া তুমি একটা কাজ করে দেবে?”

“কত দিবি?”

টুনি মুখটা শক্ত করে বলল, “তুমি টাকা ছাড়া আর কিছু বুঝো না? কাজটা কী না শুনেই জিজ্ঞেস করলে কত দিব?”

“নিশ্চয়ই তোর কোনো একটা ফিচেল বুদ্ধির কাজ করতে হবে। টাকা ছাড়া হবে না।”

“আগে শুনে দেখো কী কাজ।”

“ঠিক আছে, বল।”

“আমি যখন বলব তুমি তখন লুডো খেলার এই ছক্কাটা কোনোভাবে গায়েব করে দেবে যেন আর কেউ খুঁজে না পায়।”

শান্ত চিন্তিত মুখে বলল, “তাহলে লুডো খেলবে কেমন করে? টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে না?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, না টুর্নামেন্ট বন্ধ হবে না। আমার কাছে অন্য ছক্কা আছে।”

“তার মানে তুই ছক্কাটা বদলে দিতে চাস?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“এখন জানতে চেয়ো না, পরে বলব।”

“শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে। দশ টাকা।”

“আগে কাজ শেষ করে তারপর টাকা।”

“দিবি তো?”

“দিব। তুমি আর একটা কাজ করে দেবে?”

“কত টাকা?”

টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু, এটার জন্যে কোনো টাকা নাই। আমাদের টুর্নামেন্টের ছবি তুলে দাও। ছবি আর ভিডিও। মিশু ভাইয়া যখন খেলে তখন লুডো বোর্ডের ভিডিও!”

“লুডো বোর্ডের ভিডিও?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“পরে বলব।”

“ঠিক আছে।”

.

শাহানা বলেছিল তাকে ঘণ্টা খানেক সময় দিতে। কিন্তু সে আধা ঘণ্টার মাঝে ম্যাজিক ছক্কাটা তৈরি করে দিল। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছক্কার মাঝে এত ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। চোখের কাছে নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় এটা মাঝখানে কেটে আবার জোড়া দেয়া হয়েছে।

শাহানা টুনির হাতে ছক্কা আর একটা চুম্বক দিল। টুনির ধারণা ছিল চুম্বক মানেই একটা লোহার বার, এক পাশে লাল অন্য পাশে কালো রং করা। কিন্তু শাহানা দিল চ্যাপটামতো একটা ধাতব টুকরো, এইটা নাকি চুম্বক। তারপর সেটা শাহানার টেবিলের উপর পরীক্ষা করল, টেবিলের উপর ছক্কাটা ছেড়ে দিয়ে টুনি নিচে চুম্বকটা ধরতেই ছক্কাটা কেমন জানি লাফ দিয়ে ছয় উঠে গেল! যতবার পরীক্ষা করল ততবার ছয়! আবার চুম্বকটা উল্টে ধরতেই ছয়ের বদলে এক উঠতে লাগল। যতবার পরীক্ষা করল ততবার এক। আর যখন চুম্বকটা নিচে রাখে না তখন এই ছক্কাটা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ছক্কা। টুনি খুশিতে শাহানাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “আপু তুমি একটা জিনিয়াস।”

শাহানা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছে বলল, “একটা ছক্কাকে ইঞ্জিনিয়ারিং করতে জিনিয়াস হতে হয় না!”

.

টুনি তার ম্যাজিক ছক্কাটা নিয়ে যখন নিচে নেমে এসেছে তখন মুনিয়া আর শান্তর মাঝে সেমিফাইনাল খেলা হচ্ছে। অন্য গ্রুপের বিজয়ী হিসেবে মিশু জিতে এসেছে। এখন এই খেলাটিতে মুনিয়া জিতে গেলে সে মিশুর সাথে ফাইনাল খেলবে। সবাই মুনিয়ার পক্ষে, শান্ত নিজেও মুনিয়ার পক্ষে, যদিও সে সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। প্রত্যেকবার ছয় ওঠার পর সে আনন্দের ভান করে এমন চিৎকার, চেঁচামেচি, হইচই করতে থাকে যে মনে হয় সে বুঝি লটারিতে লক্ষ টাকা পেয়ে গেছে। মুনিয়াকে জেতানোর জন্যে সে তার পাকা খুঁটিগুলো তাকে খেতে দিচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকবার তার একটা খুঁটি কাটা পড়লে সে যেভাবে চিৎকার করে আহাজারি করার ভান করতে থাকে যে দেখে মনে হয় খুঁটি নয় সে নিজেই বুঝি কাটা পড়েছে!

দেখতে দেখতে খেলা শেষ হয়ে গেল, মুনিয়া জিতে গিয়েছে এখন মিশুর সাথে ফাইনাল খেলা হবে। ঝুমু খালা এই মাত্র গরম গরম পিয়াজু ভাজা আর কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে সেগুলো খেল, তারপর ফাইনাল খেলা শুরু হলো। ছোট টেবিল ঘিরে দর্শকদের ভিড়, তার মাঝে টুনি তার চুম্বকটা টেবিলের নিচে ধরে উপরে ছক্কাটাকে নাচাতে পারবে।

খেলা শুরু হলো। প্রথম মুনিয়া চালল, একটা তিন উঠেছে। এরপর মিশু, টুনি লক্ষ করল খুব পাকা হাতে সে ছক্কাটা বদলে নিজের দুই নম্বরী ছক্কাটি দিয়ে খেলছে। সত্যি সত্যি ছয় উঠে গেল। সবাই একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল, শুধু টুনি শান্তভাবে বসে রইল, তার ভেতরে কোনো দুর্ভাবনা নেই। মিশু আরেকবার চালল, এবারে তিন উঠেছে। টুনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট দেখতে পেল মিশু দুই নম্বরী ছক্কাটা বদলে আবার আগের ছক্কাটি দিয়ে দিয়েছে। টুনি তখন শান্তর দিকে তাকিয়ে ছক্কাটি গায়েব করে দেওয়ার ইঙ্গিত করল।

শান্ত হঠাৎ হুংকার দিয়ে বলল, এই পাজি বদমাশ বেয়াদব ছক্কাটাকে একটা শাস্তি দেয়া দরকার। কত বড় বদমাশ ছক্কা, মুনিয়ার উঠেছে তিন আর মিশু ভাইয়ার বেলায় একটা ছয় আরেকটা তিন! পাজির পা ঝাড়া–”

মিশু বলল, “ছক্কার উপর রাগ হয়ে লাভ নেই। এটা হচ্ছে ভাগ্য।”

শান্ত বলল, “ভাগ্যের খেতাপুড়ি।” তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে লুডো বোর্ড থেকে ছক্কাটাকে নিয়ে নিচে ফেলে সেটাকে পা দিয়ে লাথি দিতে থাকল। তাতেও তার রাগ কমল বলে মনে হলো না, তখন কোথা থেকে একটা হাতুড়ি বের করে ছক্কাটাকে এক হাতুড়ির আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

সবাই এত অবাক হলো যে বলার মতো নয়! প্রমি বলল, “শান্ত! তুই একটা পাগল নাকি? ছক্কাটাকে গুঁড়ো করে ফেললি? টুম্পা বলল, “এখন খেলবে কেমন করে?”

মুনিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তাহলে আমরা খেলতে পারব না?”

টুনি বলল, “দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আমার কাছে আরেকটা লুডোর সেট আছে সেখান থেকে ছক্কাটা নিয়ে আসি।”

প্রমি বলল, “যা, নিয়ে আয়।”

টুনি বলল, “আমার জায়গাটা যেন কেউ না নেয়।”

প্রমি বলল, “কেউ নেবে না।”

সবাই যখন শান্তর পাগলামো এবং নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কথা বলছে টুনি তখন উঠে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এলো। ছক্কাটা তার পকেটেই আছে কিন্তু কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে সে জন্যে উঠে গিয়ে ছক্কাটা আনার ভান করতে হলো।

টুনি ছক্কাটা বোর্ডের উপর রেখে বলল, “নে মুনিয়া খেল।”

মুনিয়া খেলার আগে মিশু ছক্কাটা হাতে নেয় এবং ঘুরিয়ে দেখে হঠাৎ করে তার মুখটা জানি কেমন হয়ে যায়। এই ছক্কাটা আগের ছক্কা থেকে একটু বড়, দেখতেও ভিন্ন। কাজেই সে আর হাতসাফাই করে নিজের দুই নম্বরী ছক্কা দিয়ে বদলে দিতে পারবে না! বদলে দিলেই সবাই ধরে ফেলবে। মিশু ছক্কাটা নিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে মিশু ভাইয়া?”

মিশু বলল, “না, মানে ইয়ে-না–মানে কিছু বলব না।”

টুনি মুনিয়াকে বলল, “মুনিয়া খেল।”

মুনিয়া ছক্কাটা ফেলার আগে টুনি তাকে থামাল, বলল, “মুনিয়া এক সেকেন্ড দাঁড়া। তোকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেই।”

“মন্ত্র?”

“হ্যাঁ। লুডো খেলার মন্ত্র। এই মন্ত্র পড়লে ছয় ওঠে।”

“যাহ্!” মুনিয়া অবিশ্বাসের শব্দ করল, বলল, “ছয় ফেলার মন্ত্র আবার আছে নাকি?”

“আছে। তুই চেষ্টা করে দেখ। আসল সোলেমানী জাদু বই থেকে শিখেছি।”

মুনিয়া এবারে মনে হয় একটু বিশ্বাস করল। জিজ্ঞেস করল, “কী মন্ত্র?”

টুনি বলল, “ছক্কাটা ফেলার আগে বলবি–

পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরী ছক্কা
তুমি ভাব বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”

মুনিয়া একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “এইটা মন্ত্র?”

“হ্যাঁ। এইটা মন্ত্র আমার সাথে বল–”

মুনিয়া টুনির সাথে মন্ত্রটা বলল এবং ছক্কাটা ফেলল, সবাই দেখল ছক্কাটা বোর্ডের উপরে গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে একটা ডিগবাজি দিয়ে ছয় হয়ে গেল। দর্শকদের ভেতর থেকে বিশাল একটা আনন্দধ্বনি শোনা গেল।

টুনি আড়চোখে মিশুর দিকে তাকাল, দেখল মিশুর চেহারাটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে একবারও সন্দেহ করেনি এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তার চালাকিটা ধরতে পারবে। শুধু যে ধরে ফেলেছে। তা নয়, সেটা নিয়ে কবিতা বানিয়ে তাকে টিটকারি করছে। কী সর্বনাশ!

মুনিয়া আবার ছক্কা ফেলার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে; টুনিকে আবার মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে হলো, মুনিয়া আবার টুনির সাথে সাথে মন্ত্রটা উচ্চারণ করল এবং ছক্কা ফেলল। ছক্কাটা আবার গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে কেমন জানি ব্রেক করে একটা লাফ দিয়ে ছয় হয়ে গেল। আবার বিশাল আনন্দধ্বনি, শুধু মিশু ছক্কার এই বিচিত্র আবরণ দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

তৃতীয়বার ছক্কা খেলার সময় টুনি তার চুম্বকটা সরিয়ে রাখল, এবারে একটা চার উঠল। মুনিয়া তার দুটো খুঁটি তুলে একটা চার চেলে ছক্কাটা মিশুর দিকে এগিয়ে দিল।

মিশু আড়চোখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে ছক্কাটা ফেলল, ছক্কাটা গড়িয়ে যায় এবং সত্যি সত্যি একটা ছয় উঠে গেল। দর্শক এবারে একটু থিতিয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে বলল, “তুই আবার মিশু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে মন্ত্রটা বল, দেখি কাজ করে কি না।”

মুনিয়া মিশুর দিকে আঙুল নেড়ে নেড়ে বলল—

“পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরি ছক্কা
তুমি ভাবো বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”

মুনিয়ার মন্ত্রে কাজ হলো। দেখা গেল পরপর আরো দুটি ছয় উঠে তিন ছক্কার কারণে সব বাতিল হয়ে গেল। চতুর্থবার যখন খেলেছে তখন ছক্কাটা শুধু যে বিচিত্রভাবে লাফ দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে যে এক হয়ে গেল তা নয়, সেই অবস্থায় একটু ঘুরপাকও খেল। কাজেই মিশুর কপালে জুটেছে মাত্র এক।

সবাই আনন্দধ্বনি করল এবং আনন্দধ্বনি থামার পর মিশু শুকনো গলায় বলল, “কিছু একটা গোলমাল আছে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী গোলমাল মিশু ভাইয়া?”

“ছক্কাটা ঠিকভাবে পড়ছে না। কেমন যেন—”

“কেমন যেন কী?”

মিশু বাক্যটা শেষ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “না, কিছু।”

এতক্ষণে মন্ত্রটা অন্য সবাই শিখে গেছে কাজেই প্রতিবার দান চালার সময় সবাই সমস্বরে চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে লাগল এবং প্রতিবার মুনিয়ার কমপক্ষে একটা করে ছয় উঠতে লাগল। শুধু তা-ই না, মন্ত্রটা মিশুর বিরুদ্ধে কাজ করছে তাই প্রত্যেকবার তার এক উঠতে লাগল।

মিশুকে প্রথমে একটু হতবাক, তারপরে বিষণ্ণ, শেষে রীতিমতো অসুস্থ দেখাতে লাগল। সে যেহেতু বুদ্ধিমান তাই কিছুক্ষণের মাঝেই কী হচ্ছে বুঝে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল না। একবার খুবই দুর্বলভাবে বলল, “ইয়ে-মানে-একটা জিনিস লক্ষ করেছ! আমার উঠছে শুধু এক আর মু-ি নয়ার উঠছে শুধু ছয়। এটা খুবই বিচিত্র। প্রোবাবিলিটির নিয়ম অনুযায়ী এটা সম্ভব না।”

টুনি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ মিশু ভাইয়া। এইবারের টুর্নামেন্টে সবই আজব। আমি লক্ষ করছিলাম তুমি যখন খেলছিলে একবারও পাঁচ ওঠে নাই। এইটা কি সম্ভব?”

মিশু আমতা আমতা করে বলল, “পাঁচ? মানে পাঁ পা পাঁচ?”

“হ্যাঁ। প্রোবাবিলিটির নিয়ম কি বলে মিশু ভাইয়া? পাঁচ না উঠে তার বদলে ছয় ওঠার প্রোবাবিলিটি কি সমান নাকি বেশি?”

উপস্থিত দর্শকেরা অবশ্যি টুনি এবং মিশুর এই আলাপে কোনো কৌতূহল দেখাল না। তারা মন্ত্র এবং মন্ত্রের ফলাফল দেখেই খুশি, এ রকম আসলেই হওয়া সম্ভব কি না সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।

কিছুক্ষণের মাঝেই মিশু খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল এবং দেখা গেল মুনিয়া যখন তার সবগুলো খুঁটি পাকিয়ে ফেলল তখনো তার সবগুলো খুঁটি ঘরের মাঝে আটকা পড়ে আছে, লুডো খেলার ইতিহাসে এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না!

নিয়ম অনুযায়ী পরপর দুইবার খেলায় জিততে হবে। কিন্তু প্রথমবার হারার পরই মিশু পরাজয় স্বীকার করে নিল। সে আর খেলতে চাইল না।

.

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আবার দাদিকে প্রধান অতিথি হিসেবে ধরে আনা হলো। দাদির সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। দুইটা চেয়ারে দুইজনকে বসানো হয়েছে। ঝুমু খালা দাদির পাশে চেয়ারে বসতে রাজি হচ্ছিল না তখন দাদি তাকে একটা ধমক দিলেন, বললেন, “দেখছ না বাচ্চারা একটা অনুষ্ঠান করছে তুমি তার মাঝে ঝামেলা করছ। যা বলছে শুনো।”

ঝুমুখালা তখন কাঁচুমাচু হয়ে দাদির পাশে বসল। সবাই তখন বক্তৃতা দিল, দাদি বক্তৃতা দেয়ার সময় বললেন, “দিন-রাত খালি খেললে হবে না, লেখাপড়াও করতে হবে। এই দেখিস না মিশু লেখাপড়া করে কত বড় হয়েছে–”

টুনি তখন হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদি একজন যদি লেখাপড়া করে চোর হয় সেইটা ঠিক আছে?”

দাদি বললেন, “ধুর! সেইটা ঠিক হবে কেন? লেখাপড়া করে চোর হবে কেন?

“যদি হয়?”

“না, না। ছিঃ।” দাদি জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বলল, “লেখাপড়া করে কেউ যেন চোর না হয়।”

বক্তৃতা পর্ব শেষ হবার পর প্রথমে মিশুকে রানার্সআপের পুরস্কার হিসেবে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হলো। সার্টিফিকেটের এক কোনায় লাল কলম দিয়ে কে যেন লুডো খেলার মন্ত্রটা লিখে রেখেছে। সেটা দেখে মিশুর কান পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল।

মিশুর পর মুনিয়াকে তার পুরস্কারের একশ টাকা তুলে দেয়া হলো। দর্শকদের চিৎকারে ঘর ফেটে যাবার অবস্থা।

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “মুনিয়া তুই এত টাকা দিয়ে কী করবি? আমাকে অর্ধেক দিয়ে দে।”

“না দিব না।” মুনিয়া মাথা নেড়ে বলল, “আমার লাগবে।”

“কেন লাগবে?”

“বলব না।”

শান্ত বলল, “বল। শুনি।”

“উঁহু বলব না।”

টুম্পা বলল, “আমি জানি। বলব?”

মুনিয়া গলা উঁচিয়ে বলল, “না। তুমি বলতে পারবে না আপু। ভালো হবে না কিন্তু।”

কাজেই টুম্পা সেটা বলতে পারল না। বলতে না পারলেও কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ কারণটা কীভাবে কীভাবে জানি সবাই জেনে গেছে। তাদের বাসার সামনের রাস্তাটি প্রতিদিন ভোরে একজন মহিলা ঝট দেয়। তার ছোট একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চাটাকে পথের ধারে বসিয়ে রাখে। ধুলাবালির মাঝে নোংরা একটা শার্ট পরে সে বসে বসে চারিদিকে তাকায়, হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে। পথ থেকে নোংরা, ময়লা, সিগারেটের বাঁট তুলে মুখে দিয়ে দেয়। বাচ্চাটার জন্য মুনিয়ার খুব মায়া হচ্ছে। স্কুলে যাবার সময় তাকে পেলে মুনিয়া তার সাথে কথাবার্তা বলে। বাচ্চাটা ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ফিক করে হেসে দেয়। মুনিয়া এই বাচ্চার জন্য একটা সুন্দর জামা কিনতে চায়-খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে জন্যে একশ টাকার মতো লাগবে। সেই জন্যেই তার টাকাটা দরকার!

মিশুর আরো কয়েক দিন থাকার কথা ছিল কিন্তু সেই দিন বিকালেই সে চলে গেল। শান্ত তাকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। লুডো খেলার সময় আসলে কী কী ঘটেছে সেটা এতক্ষণে সবার কাছে জানাজানি হয়ে গেছে।

মিশুকে বিদায় দেবার আগে শান্ত বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া, তুমি বলেছিলে না বেশি ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই? মাঝে মাঝে দুই নম্বরি হতে হয়। বলেছিলে না?”

মিশু কথা না বলে চুপ করে রইল। শান্ত বলল, “কথাটা ঠিক না। দুই নম্বরি হওয়া খুবই ডেঞ্জারাস।”

মিশু এবারেও কথা বলল না, মুখটা শুধু আরেকটু শক্ত হয়ে গেল। শান্ত বলল, “তোমার মাথায় যে রকম বুদ্ধি, আমাদের টুনির মাথাতেও সে রকম অনেক বুদ্ধি! একেবারে চিকন বুদ্ধি। তোমার থেকে বেশি। তুমি দুই নম্বরি কাজ করেছ দেখে তোমাকে টাইট করে ছেড়ে দিয়েছে। দিয়েছে কি না?”

মিশু হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলল না। শান্ত দার্শনিকের মতো বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া। দুই নম্বরি মানুষ হওয়া ঠিক না! ধরা পড়লে মাইর খাওয়ার চান্স থাকে। মাইর মানে মাইর–উথাল-পাতাল মাইর। অস্থির মাইর! বেইজ্জতির চূড়ান্ত। বেইজ্জতি বলে বেইজ্জতি…।”

শান্তর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিশু প্রায় লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে গেল!

হ্যাকার

বসার ঘরে দাদি বসে টেলিভিশন দেখছেন, কী কারণে তার পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা এবং সেটা নিয়ে ঝুমু খালার উৎসাহের সীমা নেই। কী একটা গাছের পাতা হেঁচে ঝুমু খালা দাদির পায়ে মাখিয়ে দিয়েছে সে কারণে দাদির শরীর থেকে ঝাঁঝালো একধরনের গন্ধ বের হচ্ছে। বসার ঘরে যে-ই ঢুকছে ঝুমু খালা তাকেই তার এই টোটকা ওষুধের গুণগান শুনিয়ে যাচ্ছে। বলছে, “এই যে খালার পায়ে ধানকুচি গাছের পাতা ঘেঁচে দিছি, এই ওষুধ হচ্ছে ধন্বন্তরী।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “ধন্বন্তরী মানে কী?”

ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “ধন্বন্তরী মানে হচ্ছে ওষুধের বাবা ওষুধ।”

দাদি তখন একটু শুধরে দিলেন, বললেন, “ভালো ডাক্তার হচ্ছে। ধন্বন্তরী।”

ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “একশবার। ওষুধের বাবা ওষুধ হচ্ছে। ডাক্তার। ধন্বন্তরী ডাক্তার।”

মুনিয়া বলল, “কিন্তু দাদির শরীর থেকে কেমন যেন শুঁটকি মাছের মতো গন্ধ বের হচ্ছে।”

ঝুমু খালা বলল, “এই গন্ধ হচ্ছে চিকিৎসা। যত ভালো চিকিৎসা তত বেশি গন্ধ। খালারে জিজ্ঞেস করে দেখ তার পায়ের ব্যথা কমেছে কি না। জিজ্ঞেস করো।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “দাদি, তোমার পায়ের ব্যথা কমেছে?”

দাদি কী আর বলবেন, মাথা নাড়লেন, “মনে হয়ে কমছে।”

ঝুমু খালা বলল, “কাগজ আনন, লিখে দেই। কাল সকালে খালা যদি এই ঠ্যাং দিয়ে লাথি মেরে একটা থান ইট গুঁড়া করতে না পারেন তাহলে আমার নাম ঝুমু না।”

“তাহলে তোমার নাম কী ঝুমু খালা?”

ঝুমু খালা আবার মাথা চুলকাল, “তাহলে আমার নাম–তাহলে আমার নাম–”

ঝুমু খালার অবশ্যি নামটা বলতে হলো না, তার আগেই ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চারা তাকে দেখে হতাশার মতো একটা শব্দ করল, বলল, “ছোটাচ্চু। হায় হায়!”

ছোটাচ্চু বলল, “কী হয়েছে?”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “তুমি আজকে কিছু আনো নাই?”

“কী আনব?”

“এই তো, কেক, না-হয় পিজা, না-হয় ফ্রাইড চিকেন–”

টুম্পা যোগ করল, “না-হলে চকলেট না-হলে আইসক্রিম–”

ছোটাচ্চু বলল, “তোদের হয়েছে কী? সারাক্ষণ খালি খাই খাই করিস? বাসায় কি তোদের খেতে দেয় না?”

ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে বলল, “খেতে দেই না মানে? খাবার টেবিলে কেউ কিছু খায়? সবজি ভালো লাগে না, মাছে গন্ধ, ভর্তা ঝাল, মুরগি নরম, গোশত শক্ত, ডাল পাতলা–এরা কেউ কিছু খায়? খাবার জিনিস কিছু খায় না। খাওয়ার মধ্যে খালি আসইক্রিম আর কেক! তা যদি না-হয় তাহলে মনে হয় বাতাস খায়। বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকে!”

টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা, আমরা এখন বাতাসও খেতে পারব না। বাতাসে শুঁটকি মাছের গন্ধ।”

টুম্পার কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে। ছোটাচ্চু এদিক সেদিক কে বলল, “ঠিকই তো বলছিস। ঘরে গন্ধ কীসের?”

টুম্পা বলল, “ঝুমু খালার ধন্বন্তরী ওষুধ। দাদির পায়ে লাগিয়েছে। কালকে দাদি এই পা দিয়ে লাথি মেরে থান ইট গুঁড়া করবে! তাই না দাদি?”

দাদি কিছু বলার আগেই ঝুমু খালা বলল, “একশবার। কাগজ আনো, লিখে দেই।”

শান্ত আবার শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চু তোমার কাজটা ঠিক হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া কিছু আনো না–”

ছোটাচ্চু বলল, “শুধু খাই খাই করবি না। খাওয়ার বাইরেও একটা দুনিয়া আছে।”

“কী আছে?”

“এই দেখ।” বলে ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে একটা কার্ড বের করল।

সবাই কার্ডটা দেখার জন্যে এগিয়ে যায়। টুনি জিজ্ঞেস করল, “এটা কীসের কার্ড?”

“পেইন্টিং এক্সিবিশান। আমার এক বন্ধু আছে, তার একক চিত্র প্রদর্শনী।”

শান্ত বলল, “বুঝেছি। মডার্ন আর্ট। আগা-মাথা কিছু নাই। তাই না ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলবি না। আগা-মাথা কেন থাকবে না?”

শান্ত বলল, “আমি একবার গিয়েছিলাম, সব ছবি কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং, কোনো আগা-মাথা নাই। কিছু বুঝি নাই।”

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, ছবি বোঝার চেষ্টা কোরো না, ভালো লাগলে দেখবে ভালো না লাগলে দেখবে না। ধরে নেবে তুমি এই লাইনের মানুষ না। সবাই সব লাইনের মানুষ হয় না।”

শান্ত বলল, “সেইটা ঠিক বলেছিস। আমি এই লাইনের মানুষ না।”

ছোটাচ্চু বলল, “তোরা কে কে আমার বন্ধুর আর্ট এক্সিবিশনে যেতে চাস?”

টুনি বলল, “আমি।”

টুনির দেখাদেখি টুম্পা বলল, “আমি।”

সাথে সাথে মুনিয়া বলল, “আমি।”

শান্ত বলল, “চা-নাস্তা খাওয়ালে আমিও যেতে পারি।”

ছোটছু বলল, “ঠিক আছে কালকে বিকালে রেডি থাকিস, আমি নিয়ে যাব।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

.

পরের দিন বিকালবেলা ছোটাচ্চুর দেখা নেই, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টুনি ছোটাচ্চুকে ফোন করল, ছোটাচ্চু তখন খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, “কী সর্বনাশ! আমি কি বলেছিলাম তোদের নিয়ে আর্ট এক্সিবিশন দেখতে যাব?”

টুনি ঠান্ডা গলায় বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চু। আমরা তোমার জন্যে সেজেগুঁজে অপেক্ষা করছি!”

ছোটাচ্চু বলল, “বুঝলি টুনি, আমি একটা খুবই জরুরি কাজে আটকা পড়ে গেছি। একটা খুবই ইম্পরটান্ট কেস এসেছে, আমি না থাকলে হবেই না।”

টুনি তার গলার স্বর একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা করে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি আমাদেরকে বলেছ আমাদের নিয়ে যাবে, আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করে অপেক্ষা করছি।”

ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কিন্তু ইমার্জেন্সি তো ইমার্জেন্সি।”

টুনি বলল, “মোটেও ইমার্জেন্সি না। সত্যি কথাটা বলো যে তুমি ভুলে গেছ।”

“হ্যাঁ, মানে ইয়ে সেটাও একটু হয়েছে–” ছোটাচ্চু গলার স্বর হঠাৎ করে পাল্টে বলল, “তোরা একটা কাজ কর।”

“কী কাজ?”

“তোরা একটা সি.এন.জি. করে আমার অফিসে চলে আয়, আমি কাজ শেষ করে তোদেরকে নিয়ে এক্সিবিশানে চলে যাব।”

টুনি বলল, “আমরা চলে আসব?”

“হ্যাঁ চলে আয়।”

টুনি বলল, “আচ্ছা দেখি।” তারপর টেলিফোনটা রেখে দিল।

শান্ত বলল, “আমার আর কাজ নাই? আমি কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং দেখার জন্যে এখন আন্ডা-বাচ্চাদের নিয়ে সি.এন.জি. করে ছোটাচ্চুর অফিসে যাই? আমার এত ঠ্যাকা পড়ে নাই।”

টুম্পা বলল, “কাগের ঠ্যাং না কাকের ঠ্যাং?”

“একই কথা।”

মুনিয়া বলল, “আসলেই কাকের ঠ্যাং?”

শান্ত বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ পুরো কাকের ঠ্যাং। ছোটাচ্চুকে একটু খুশি করার জন্যে যেতে রাজি হয়েছিলাম। আসলে কি যেতে চাই নাকি? কক্ষনো যেতে চাই না।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “যেতে চাও না?”

শান্ত বলল, “খবরদার তোরাও যাবি না। গেলেই দেখবি বড় মোটা মোটা ফর্সা ফর্সা মানুষেরা পাঞ্জাবি পরে ঢং করে লম্বা লম্বা কথা বলছে! তোদের কোনো পাত্তাই দিবে না। উল্টো ধমক দেবে, বলবে, এই বাচ্চা এখানে কী করো? সরে যাও।”

“সত্যি?”

“একশ ভাগ সত্যি।”

আর্ট এক্সিবিশানের এই ভয়ংকর বর্ণনা শুনে মুনিয়া পিছিয়ে গেল। মুনিয়াকে পিছিয়ে যেতে দেখে টুম্পাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, তখন বাকি থাকল শুধু টুনি। টুনির যে খুব যেতে ইচ্ছে করছিল তা নয় কিন্তু ছোটাচ্চুকে ঠিক লাইনে রাখার জন্যে টুনি ঠিক করল সে একাই যাবে। তাদের বাসার কাছের বাস স্ট্যান্ড থেকে একটা বাসে করে খুব সহজে ছোটাচ্চুর অফিসে যাওয়া যায়।

কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই টুনি ছোটাচ্চুর অফিসে পৌঁছে গেল, এখানে সে আগে অনেকবার এসেছে। অফিসের সবাই তাকে চিনে। রঞ্জনা তাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “আরে আমাদের বড় ডিটেকটিভ চলে এসেছে! আমাদেরকে কি ভুলে গেছ নাকি?”

টুনি বলল, “না রঞ্জনাপু, তোমাদেরকে মোটেই ভুলিনি। ছোটাচ্চু আমাদের নিয়ে আসে না।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। আজকে কি হয়েছে জানো? ছোটাচ্চু বলেছে আমাদের বাসা থেকে নিয়ে আসবে, তারপর ভুলে গেছে।”

রঞ্জনা হি হি করে হেসে বলল, “আমাদের অফিসে সব সময় এটা হয়। এখানে সবাই সবসময় সবকিছু ভুলে যায়।”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চুর অফিসে কেউ আছে?” “হ্যাঁ, একটা ফ্যামিলি আছে। তুমি ভিতরে যাও, কোনো সমস্যা নেই।”

টুনি তখন ছোটাচ্চুর অফিসের দরজা খুলে তার অফিসে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উল্টোপাশে গদি আঁটা একটা চেয়ারে খুব কায়দা করে বসে আছে, টেবিলের সামনে কমবয়সী একজন পুরুষ আর মহিলা, পাশের চেয়ারে ছয়-সাত বছরের একটা ছেলে, সে খুবই বিরক্ত মুখে বসে আছে।

ছোটাচ্চু টুনিকে দেখে মুখে খুব একটা ভাব ফুটিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “ও, টুনি এসেছিস?”

ছোটাচ্চুর ভাব দেখে টুনির হাসি পেয়ে গেল কিন্তু টুনি হাসল না, সেও গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চু আমি এসেছি।”

“আয়। অন্যেরা কই?”

“আর কেউ আসেনি।”

“আর কেউ আসিনি? কী আশ্চর্য! আর্টে কারো ইন্টারেস্ট নেই?”

এটা এমন কিছু আশ্চর্য না কিন্তু ছোটাচ্চু ভান করল সে খুবই অবাক হয়েছে। গম্ভীর মুখে বলল, “ঠিক আছে টুনি, তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি এই ফ্যামিলির সাথে একটু কথা বলে নেই।”

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর ছোটাচ্চুর অফিসের অন্য পাশে বসে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে সেটা দেখার ভান করে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল তারা কী নিয়ে কথা বলছে। তার এরকম কথা শুনতে খুব মজা লাগে।

ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ, আপনারা জানি কী বলছিলেন?”

মহিলাটি বলল, “জি, আমি বলছিলাম যে আমাদের কাছে খুবই আজব মেসেজ আসতে শুরু করল।”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আজব মানে কী রকম?”

অনেকটা এ রকম, “ফেসবুক করা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই? কিংবা ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে একটা বই পড়ো। কিংবা, ফেসবুক না আসল বুক? আসল বুক আসল বুক। এই রকম ম্যাসেজ।”

ছোটাচ্চু বলল, “ও, আচ্ছা, কোনোরকম ভয়-ভীতি দেখায় না?”

“না। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট বিরক্ত করেছে। তখন আমরা এই মানুষটাকে ব্লক করে দিলাম, ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে সরিয়ে দিলাম। এক-দুই দিন শান্তিতে ছিলাম তারপর আবার শুরু হলো। নতুন একটা ফ্রেন্ড কিন্তু বোঝা গেল একই মানুষ। আমাদের জ্বালাতন শুরু করল, মাঝে মাঝে একটু ভয়ও দেখায়, বলে, ফেসবুক বন্ধ না করলে তোমাদের উপর মহাবিপদ হবে, সাবধান।”

ছোটাচ্চু বলল, “আপনারা কি আসলেই অনেক ফেসবুক করেন?”

এবারে পুরুষ মানুষটা বলল, “তা একটু করি। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। বাসায় আসার পর একটু রিলাক্সেশন।”

ছোটাচ্চু বলল, “কী করেন ফেসবুকে?”

“এই তো স্ট্যাটাস দেই, শেয়ার দেই। লাইক দেই। ছবি আপলোড করি। সেলফি আপলোড করি।”

“দুজনেই?”

“জি।”

মহিলাটি বলল, “আমার ফ্রেন্ড বেশি ওর থেকে।”

মানুষটা একটু রেগে গেল, বলল, “তুমি একজন মহিলা, মহিলার ফ্রেন্ড বেশি হবে না। তুমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেই সবাই এক্সেপ্ট করে।”

“তুমি ঠিক করে রিকোয়েস্ট পাঠাও, না করেছে কে?”

পুরুষ আর মহিলাটা ঝগড়া শুরু করে দিচ্ছিল, তখন ছোটাচ্চু তাদের থামিয়ে দিল, বলল, “আপনারা দিনে কত ঘণ্টা ফেসবুক করেন?”

“সাত-আট ঘণ্টা হবে।”

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “সাত-আট ঘণ্টা?”

“হ্যাঁ। ল্যাপটপ তো খোলা থাকে। একটু পরে পরে দেখি নতুন ছবিতে লাইক পড়েছে কি না। বুঝতেই পারেন নেশার মতো হয়ে গেছে।”

ছোটাচ্চু বলল, “তাহলে তো সমস্যাটা আপনাদের। সবরকম কাজকর্ম বন্ধ করে যদি শুধু ফেসবুক করেন তাহলে কেমন করে হবে?”

মহিলাটা বলল, “আমরা কী করি না করি সেটা আমাদের ব্যাপার, অন্যেরা সেখানে নাক গলাবে কেন? আমরা আপনার কাছে এসেছি অন্য ব্যাপারে। মানুষটা কে বের করে দেন। যতই চেষ্টা করি এই মানুষটাকে খসাতে পারছি না। ব্লক করে দিলে নতুন একাউন্ট থেকে জ্বালাতন শুরু করে।”

ছোটাচ্চু বলল, “মেনে নেন। মানুষটা তো খারাপ কিছু করে না, আপনাদেরকে ফেসবুক না করার জন্যে উপদেশ দিচ্ছে, ভালো উপদেশ। খুব ভালো উপদেশ।”

“কিন্তু মানুষটা কে সেটা বের করতে চাই। কীভাবে কীভাবে জানি আমাদের সব খবর জেনে যায়। আপনার এখানে আসার আগে আমাদের কি লিখেছে জানেন?”

“কী?”

“লিখেছে আমাকে ধরার জন্যে টিকটিকির কাছে যাচ্ছ? টিকটিকির বাবার সাধ্য নাই আমাকে ধরবে! হা হা হা।”

“তাই লিখেছে? টিকটিকি?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, এই মানুষটা জানল কেমন করে?” ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “ইন্টারেস্টিং! সব খবর জেনে যায়।”

টুনি চোখের কোনা দিয়ে এই আজব পুরুষ এবং মহিলা দুজনকে দেখল। পাশে তাদের ছোট বাচ্চাটা বিরস মুখে বসে আছে, তাদের বাবা-মায়েরা কী নিয়ে কথা বলছে সেটা নিয়ে কোনো কৌতূহল নেই, মুখে রাজ্যের বিরক্তি। বাচ্চাটার জন্যে তার খুব মায়া লাগল, টুনি ভাবল তাকে এই জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে তার সাথে একটু কথাবার্তা বলা যাক।

সোফা থেকে উঠে গিয়ে সে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে বলল, “তুমি কী আমার সাথে আসবে?”

বাচ্চাটা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। বোঝাই গেল সে এখান থেকে ওঠার জন্যে এক পায়ে খাড়া। বাবা-মায়ের কথাবার্তা তার স্নায়ুর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাচ্চাটাকে নিয়ে কিছু একটা দেখা। বেচারা একেবারে বোর হয়ে যাচ্ছে।”

টুনি মনে মনে বলল, “বোর নয়। বলো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হতে হতে টুনি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

ছেলেটা বলল, “রাফী।” টুনি এবারে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়ো।”

“তোমার স্কুলটা ভালো?”

ছেলেটা হা-সূচকভাবে মাথা নাড়ল।

“তোমার স্কুলের স্যার-ম্যাডামেরা বকা দেয়?”

ছেলেটা না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। বোঝা যাচ্ছে যতটুকু সম্ভব কম কথা বলে কাজ চালিয়ে নিতে চায়।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিছু খাবে?”

ছেলেটা না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কোনো ড্রিংকস খাবে? কোক, পেপসি?”

এবারে হা-সূচকভাবে মাথা নাড়া। টুনি রঞ্জনাপুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রঞ্জনাপু, তোমাদের অফিসে কি কোক না হলে পেপসি আছে?”

রঞ্জনা কম্পিউটারে কাজ করছিল, মনিটরের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বলল, “থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। আমাদের ফ্রিজ বোঝাই জাংকফুডে। আমরা জাংকফুড ছাড়া কিছু খাই না। কিচেনের ফ্রিজ থেকে নিয়ে নাও।”

টুনি ছেলেটাকে বলল, “চলো, তোমাকে কোল্ড ড্রিংকস দিই। ছেলেটা রঞ্জনার কম্পিউটার মনিটরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। টুনির কথা শুনল বলে মনে হলো না। টুনি তখন আবার ডাকল, “রাফী–”

ছেলেটা মনে হলো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর টুনির পিছু পিছু কিচেনের দিকে হেঁটে যেতে লাগল।

টুনি এর আগে কোনো অফিস দেখেনি, তাই অফিস কী রকম হয় জানে না। ছোটাচ্চুর অফিসে একটা কিচেন আছে, সেই কিচেনে ফ্রিজ আর মাইক্রোওয়েভ আছে। টুনি ফ্রিজ খুলে একটা কোকের বোতল বের করে রাফীকে খানিকটা ঢেলে দিল, নিজে খানিকটা নিল। চুকচুক করে কোক খেতে খেতে টুনি আবার ছেলেটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, “তোমার আরো ভাই-বোন আছে?”

ছেলেটা কথা না বলে খাওয়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। টুনির প্রশ্নের উত্তরে না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল।

“তুমি একা?”

এবারে হা-সূচকভাবে মাথা নাড়া।

“তার মানে তোমার আব্বু-আম্মুর পুরো আদরটা তুমি পাও?”

“পাও না?”

আবার না-সূচক।

“কেন পাও না?”

“আব্বু-আম্মু সারাক্ষণ ফেসবুক করে।” এই প্রথম ছেলেটি একটা পুরো বাক্য বলল। বাক্যটি যেভাবে উচ্চারণ করল বোঝা গেল আব্বু-আম্মুর এই কাজটি তার মোটেও পছন্দ নয়।

টুনি কী বলবে বুঝতে পারল না, বলল, “ও!” তারপর চুপ করে গেল, ছেলেটার সাথে আর কথা বলার চেষ্টা করল না।

কোক খাওয়া শেষ করে দুজনে কিচেন থেকে বের হয়ে আসে। রঞ্জনা তখনো ভুরু কুঁচকে কম্পিউটারের মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে। রাফী নামের ছোট ছেলেটা সোজা রঞ্জনার দিকে হেঁটে গেল। রঞ্জনার পিছনে দাঁড়িয়ে সে কম্পিউটার মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন যখন কম্পিউটারে কাজ করে তখন যে পিছনে দাঁড়িয়ে তার মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না মনে হয় সেটা এই বাচ্চাটা শিখেনি। সে কোনোরকম ভান না করে সোজাসুজি বেশ কৌতূহল নিয়ে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

টুনি দেখল মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থেকে রঞ্জনা কেমন একটা যন্ত্রণার মতো শব্দ করল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রঞ্জনাপু?”

“আমি করতে পারছি না।”

“কী করতে পারছ না?”

“নেট থেকে ফাইলটা নামাতে পারছি না। ফরমে ভেঙে যাচ্ছে।”

বিষয়টা কী টুনি বুঝতে পারল না তাই সে কিছু বলল না। কিন্তু রঞ্জনার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাফী নামের স্বল্পভাষী ছেলেটা বলল, “তোমার ওএস পুরানা। আপডেট না করলে পারবে না।”

রঞ্জনা এবং টুনি দুইজন একসাথে ছেলেটার দিকে তাকাল, এইটুকুন ছেলে একেবারে বড় মানুষের মতো কথা বলছে! রঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, “কী বললে তুমি?”

“তোমার ওএস পুরানা।”

“ওএস মানে কী?”

“অপারেটিং সিস্টেম।”

“তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি জানি।” বলে সে চুপ করে গেল।

রঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করতে হবে?”

“নতুন ওএস ডাউনলোড করো। তোমাদের নেট অবশ্যি স্লো। সময় লাগবে।”

টুনি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল, এইটুকুন ছেলে এত কিছু কেমন করে জানে! শুরুতে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে শুধু মাথা নেড়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এখন টকটক করে কথা বলছে!

রঞ্জনা বলল, “তার মানে এখন আমি কিছু করতে পারব না?”

বাচ্চা ছেলেটা কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “একটা প্লাগ ইন আছে, ডাউনলোড করে দেখতে পারো। নিজে নিজে ইনস্টল করতে পারবে না?”

রঞ্জনা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি খালি কম্পিউটারের সুইচ অন করতে পারি আর প্রোগ্রামের উপর কার্সর রেখে ক্লিক করতে পারি।”

রাফী জিজ্ঞেস করল, “আমি করে দিব?”

“তুমি?”

“হ্যাঁ। করে দিব?”

রঞ্জনা একটু ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে। করে দাও।”

“কাউকে বলবে না তো?”

রঞ্জনা অবাক হয়ে বলল, “কী বলব না?”

“এই যে আমি করে দিচ্ছি।”

“তুমি যদি চাও তাহলে বলব না।”

রঞ্জনা তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, রাফী তখন সেই চেয়ারে বসল, তারপর ঝড়ের বেগে মাউস আর কি-বোর্ডে হাত নাড়তে শুরু করে দেয়। টুনি হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

.

মিনিট দশেক পর রাফী যখন কাজ শেষ করে এনেছে তখন টুনি রাফীর কাছে গিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার আব্বু আর আম্মুর ফেসবুকে তুমি ঐ মেসেজগুলো পাঠাও? তাই না।”

রাফী এক সেকেন্ডের জন্যে কাজ থামিয়ে টুনির দিকে তাকাল। টুনি গলা নামিয়ে বলল, “কোনো ভয় নাই। কাউকে বলে দিব না।”

“খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

রাফী এবার একগাল হাসল, বলল, “হ্যাঁ। ম্যাসেজ পাঠিয়ে কোনো লাভ হয় নাই। এখন কী করব জানো?”

“কী?”

“তাদের ল্যাপটপের ওএস ক্র্যাশ করিয়ে দেব। একটা ফাটাফাটি ম্যালওয়ার আছে–”

.

আরো মিনিট দশেক পর রাফীর আব্বু-আম্মু বের হয়ে এলো। রাফী তখন টুনির সাথে বসে কিচেনে তার দ্বিতীয় গ্লাস কোক খাচ্ছে।

ছোটাচ্চু কিচেনে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “টুনি, বাচ্চাটাকে ছেড়ে দে। বাসায় যাবে।”

“ঠিক আছে ছোটাচ্চু।”

“এখানে তো কোনো খেলনা নেই, বাচ্চাটাকে কেমন করে ব্যস্ত রাখলি?”

“সমস্যা হয়নি। রঞ্জনা আপু অনেক সাহায্য করেছে।”

“গুড।”

রাফী তার আবু-আম্মুর পিছু পিছু অফিস থেকে বের হয়ে গেল। টুনি দেখল মুখটি খুবই বিরস। ভালো করে লক্ষ করলে অবশ্যি বিরস মুখের আড়ালে কৌতুকের চেহারাটাও বোঝা যায়।

.

ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে তার বন্ধুর পেইন্টিং এক্সিবিশানে যাওয়ার সময় বলল, “বুঝলি টুনি, দেশে সাইবার ক্রাইম খুব বেড়ে গেছে।”

টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “সাইবার ক্রাইম?”

“হ্যাঁ। মানে কম্পিউটারের ক্রাইম। আমাদের কাছে রোজ এক-দুইজন ক্লায়েন্ট আসে। আজকে যে রকম এসেছিল।”

টুনি কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা এটা সামাল দিতে পারি না। সামাল দিতে হলে কম্পিউটার এক্সপার্ট দরকার। অনেক বেতন দিয়ে এক্সপার্ট নিতে হবে।”

টুনি একবার ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কাছে খুব ভালো একজন এক্সপার্ট আছে। তোমার দরকার লাগলে বোলো।”

ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “সিরিয়াসলি একটা কথা বললাম আর তুই সেটা নিয়ে ইয়ারকি শুরু করলি! তোর কাছে এক্সপার্ট আছে মানে? কী বলিস?”

টুনি তাড়াতাড়ি বলল, “না, ছোটাছু, কিছু না। কিছু বলি নাই। কিছু বলি নাই।”

Exit mobile version