আইরিন মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক জটিল ব্যাপার তোমাকে বললেও তুমি বুঝবে না।”
টুনি বলল, “ও।” তারপর চুপ করে গেল। একজনকে নিজে থেকে কথা বলতে দিতে হয়। মেয়েটা মনে হয় নিজে থেকেই বলবে তাই টুনি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
দুইজন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে আইরিন একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “আইসক্রিম খাবে?”
টুনি মাথা নাড়ল, “খাব।”
আইরিন বলল, “টেনেটুনে আমার একটা আইসক্রিমের পয়সা হবে, দুইজনে ভাগাভাগি করে খেতে হবে।”
টুনির কাছে কিছু টাকা আছে, ইচ্ছে করলে দুইজন মিলে দুইটা আইসক্রিম খেতে পারে কিন্তু টুনি কিছু বলল না। দুইজন মিলে একটা আইসিক্রম খেলে মেয়েটা তাড়াতাড়ি তার কাছে সহজ হবে, একধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।
টুনির ধারণা সত্যি, মেয়েটা একটুখানি খেয়ে টুনির হাতে আইসক্রিমটা দিয়ে বলল, “আমি যখন কোচিংয়ে আসি আম্মু আমাকে দরকার থেকে একটা পয়সা বেশি দেয় না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না।”
টুনি বলল, “তবু শুনি।”
“আমার আম্মুর ধারণা আমাকে দরকার থেকে বেশি টাকা দিলে আমি সেটা দিয়ে ড্রাগস কিনে খাব।”
কথা শুনে চমকে যাবার মতো টুনি একটা অনবদ্য অভিনয় করল। আইরিন বলল, “আমার আম্মুর যন্ত্রণায় জীবন শেষ। জিপিএ ফাইভ ছাড়া আম্মু আর কিছু বুঝে না।”
টুনি বলল, “সত্যি?”
আইরিন বলল, “জিপিএ ফাইভ নিয়ে তোমার আম্মু তোমাকে জ্বালায়?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ। আমি কোন ক্লাসে পড়ি আমার আব্বু আম্মু মনে হয় ভালো করে জানেও না।”
“সত্যি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি।”
“তোমাকে প্রাইভেট পড়তে হয় না? কোচিং যেতে হয় না?”
টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমাদের বাসায় আমরা সবাই একসাথে থাকি। কেউ প্রাইভেট পড়ে না, কোচিংয়ে যায় না। বাসার নিয়ম হচ্ছে নিজে পড়লে পড়ো না পড়লে নাই।”
আইরিন প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করল, “না পড়লে নাই?”
টুনি মাথা নাড়ল। আইরিন খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার উপর কী ভয়ানক চাপ তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আব্বু বেশি কিছু বলে না কিন্তু আম্মু আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে। আমার আম্মু বাসা থেকে সব গল্পের বই সরিয়ে দিয়েছে।”
“সত্যি?”
আইরিন মাথা নাড়ল। বলল, “সত্যি। আমার গল্প বই পড়তে এত ভালো লাগে কিন্তু আমাকে পড়তে দেয় না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। চুরি করে পড়ি।”
টুনি কোনো কথা বলল না। আইরিন বলল, “ভোররাতে আম্মু ঘুম থেকে ডেকে তুলে, প্রথমে এক জায়গায় প্রাইভেট পড়তে পাঠায়, সেখান থেকে আরেক জায়গায়। স্কুলের পর কোচিং, রাতে আবার প্রাইভেট। পরীক্ষার পর খুনের আসামির মতো আমাকে একটা একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে দেখে। আমার পড়ালেখা থেকে মন উঠে গিয়েছে, পড়তে ইচ্ছা করে না। পরীক্ষা দিতেও ভালো লাগে না। গত পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয় নাই তাই আম্মুর কী রাগ! পারলে আমাকে খুন করে ফেলে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা উঠতে-বসতে শুধু খোটা দিয়ে কথা।”
দুইজন কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে যায়। তারপর আইরিন বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলে টুনি আমি কি ঠিক করেছি?”
“কী ঠিক করেছ?”
চুল কেটে ছেলে সেজে শার্ট-প্যান্ট পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব।”
টুনি ভয়ানক চমকে উঠল, বলল, “পালিয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ, পালিয়ে যাব। একটা টেম্পুর হেল্পার হয়ে জীবন কাটিয়ে দিব। ভালো না আইডিয়াটা?”
টুনি মাথা চুলকাল, বলল, “ইয়ে মানে আমার মনে হয়—”
আইরিন বলল, “আমি এখনও কাউকে বলিনি আমার প্ল্যানটা। তোমাকেই প্রথমে বললাম।”
টুনি বলল, “থ্যাংকু।”
আইরিন অনেকটা নিজের মনে বলল, “আমি জানি কেউ যদি আমার প্ল্যানটা শুনে ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মাথা খারাপ হয় নাই। আমি যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যাই তাহলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আম্মুর অত্যাচারে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবেই যাবে। খোদার কসম।”
টুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আইরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি জানো আমার আম্মু কি করেছে?”
“কী করেছে?”
“আমি ড্রাগ খাই কি না দেখার জন্যে আমার পিছনে লোক লাগিয়েছে। পারলে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দেবে।”
টুনি খুব অস্বস্তির সাথে নিজের মাথা চুলকে এদিক-সেদিক তাকাল। মেয়েটা যদি শুধু জানতে পারে তার মা ডিটেকটিভ সতি সত্যি লাগিয়ে দিয়েছে আর সে হচ্ছে সেই ডিটেকটিভ তাহলে মনে হয় মেয়েটা হার্টফেল করেই মরে যাবে!
দুজনে তখন হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে এসেছে, টুনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “চলো আরেকটা আইসক্রিম খাই!”
“আরেকটা?”
“হ্যাঁ, আমার কাছে টেনেটুনে একটা আইসক্রিমের দাম হয়ে যাবে। আবার ভাগাভাগি করে খাব। আলাদা আলাদা খাওয়ার থেকে ভাগাভাগি করে খেতে বেশি মজা।”
আইরিন বলল, “ঠিকই বলেছ।”
তারপর তারা আরেকটা আইসক্রিম কিনে দুইজন ভাগাভাগি করে খেতে খেতে হাঁটতে থাকে। আইরিন বলল, “আমার পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যানটা কেমন মনে হচ্ছে?”
টুনি বলল, “মনে হয় ভালোই। তবে–”
“তবে কী?”
“এটা হোক প্ল্যান বি।”
“প্ল্যান বি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আগে প্ল্যান এ কাজে লাগানো যাক। সেটা যদি কাজ না করে তখন প্ল্যান বি-তে যাবে।”