Site icon BnBoi.Com

অগ্রন্থিত গল্প – মাহমুদুল হক

অগ্রন্থিত গল্প - মাহমুদুল হক

দুর্ঘটনা

বছর পর শহর থেকে নিজ গ্রামে ফিরেছি। বিকালবেলা শুকনো খালের পুলটা পার হতে গিয়ে মনে পড়ল দুঃখী দুটি ভাইবোনের কথা। ভাবলাম এখন তারা অন্য কোথাও বসে–

দু বছর আগের কথা—

এই পুলটার উপর সারাদিন তারা দুই ভাইবোন বসে থাকত। সকালে অন্ধ ভাইয়ের হাত ধরে দুঃখিনী বোন এসে বসত এই পুলটার উপর। সূর্য ডুবার আগে আবার ছোটভাইয়ের হাত ধরে সে চলে যেত তাদের ভগ্ন কুটিরে। সমস্ত দিন দুই ভাইবোন গানের সুরে গেয়ে যেত তাদের জীবনের করুণ ইতিহাস… যাদের দয়া হত তারা পকেট থেকে দু-একটা পয়সা বার করে তাদের হাতে দিত। তাদের উপর দিয়ে কেটে যেত দুপুরের তপ্ত রৌদ্র… ঝরঝর বৃষ্টি… তবুও পেটের দায়ে তাদের এগিয়ে চলা।

সামনে মস্তবড় বাড়ি! বড় মার্চেন্ট অফিস! তার সামনে মানুষের ভিড় অত্যন্ত বেশি। সাহেবরা ওঠা-নামা করছে।

দ্রুত পা চালালাম! কারণ মেঘে আকাশ ছেয়ে আসছে! আকাশের বুক চিরে চকিত ইশারা! হঠাৎ কানে এল সেই কণ্ঠস্বর…! অতি পরিচিত… অতি মধুর। পাশের দিকে তাকিয়ে দেখি লাইট পোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ছেলেটা… আজও সে গেয়ে চলছে তার জীবন-কাহিনি… সেই একই সুরে! কিন্তু আজ সে একা। তার কাছে বা আশেপাশে বোনটাকে দেখলাম না।

কী মনে হল। তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দু বছরে তার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তার শরীরখানায় হাড়ই বিদ্যমান, বুকের পাঁজরা বার হয়ে পড়েছে…।

জিজ্ঞাসা করলাম, তোর বোন কোথায় রে?

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসতে চাইছিল তার, তবুও সে জোর করে বললে, আমার দুঃখী বোন নেই। মারা গেছে!

তারপর সব চুপচাপ। পকেট থেকে একটা আনি তার হাতে দিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। কিন্তু পিছন থেকে সে আমায় ডাকল, সাহেব! ও সাহেব! তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, কী দরকার? ততক্ষণ ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সে বললে, কিছু দূরেই আমার বাড়ি। এক্ষুনি পানি আসবে; দয়া করে আমাকে সেখানে একটু দিয়ে আসবেন?

নিজের আভিজাত্যবোধে তার হাত ধরে নিয়ে যাওয়াটা লজ্জাকর বলে মনে হল, তাই চুপচাপ এগিয়ে চললাম শ্লথ পদক্ষেপে।

কতক্ষণ চলেছি তা জানি না, তবে মনে হয় মিনিট দুয়েক। দূর থেকে হৈ হৈ শব্দ কানে আসল। দূর থেকে দেখলাম রাস্তার মধ্যে কে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত দেহে। খানিকবাদে একটা লোকের মুখে শুনলাম একটা অন্ধ ভিখারি একাকী রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের সাথে ধাক্কা লেগেছে। বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল তার দুটো চোখ—জোরে বাড়ির দিকে পা চালালাম। আমার বিবেক আমার নীচতা দেখে হয়তো বিমূঢ় হয়েছে; কেননা এর জন্য আমিই একমাত্র দায়ী, দায়ী আমার নিজের আভিজাত্যবোধ–

কার্তিক ১৩৬০ অক্টোবর ১৯৫৩

Exit mobile version