রডরিগোর ষোল বছরের জন্মদিন উদযাপন করতে সবাই মিলে গেছিল লিসবনের সবচেয়ে অভিজাত বিপণীপল্লি অ্যাভেনিদা দে লিবারদাদে। সেদিন কিছু হুল্লোর হয়েছিল বটে। অভিজাততম রেস্তোরাঁতে পার্টি, নাচ, গান, শ্যাম্পেন, কেক, পাপাইয়ের স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ে রডরিয়োর প্রথমবার কিঞ্চিৎ স্কচ পান, তারপর ডিনার, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।
সেই ডিনারের মাঝখানেই একবার এক্সকিউজ মি বলে উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেছিল রডরিগো। আধঘণ্টা বাদেও সে না ফেরায় ভাঁজ ফ্যামিলি ত্রস্ত হয়ে রেস্তোরাঁতে শোরগোল তুলে ফেলেন এবং খোঁজাখুঁজি করতে করতে সেই রেস্তোরাঁর পেছনে রাস্তার ওপরে পাওয়া যায় রডরিগোর মৃতদেহ।
মৃতদেহে কোনো আঘাতের দাগ বা ধস্তাধস্তির চিহ্ন, কিছুই পাওয়া যায়নি। দামি ট্যুইডের শার্ট যেমনকার সাফসুতরো টিপটপ থাকার কথা, ঠিক তেমনই ছিল। কোথাও একফোঁটা রক্ত গড়ায়নি, কোনো গুলির শব্দ শোনা যায়নি।ওয়ালেট বা দামি ঘড়ি অথবা সোনার চেন কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু মৃত কিশোরটির চোখে এক মরণান্তিক আতঙ্কের ছায়া গাঢ় করে আঁকা ছিল। সেই ভয়ের ছবি চাইলেও এড়ানো যায় না। মার্টিনেজ এখনও দুঃস্বপ্নে রডরিগোর সেই ভয়ে, আতঙ্কে বেঁকে যাওয়া মুখখানি দেখেন, এখনও তার বমি উঠে আসে!
সন্ধে সাতটার সময় জনবহুল লিসবন শহরের মধ্যিখানে এমন কী ভয় পেল এক ষোল বছরের কিশোর যে সে হার্ট ফেইল করে মরেই গেল? ডাক্তাররা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো কারণ বার করতে পারেননি। শরীরের বাকি সমস্ত অর্গ্যান সম্পূর্ণ সুস্থ সবল, অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল কেউই বুঝতে পারেনি। যেমন এটাও কেউ বুঝতে পারেনি যে, ওয়াশরুমে থেকে রেস্তোরাঁর পেছনের রাস্তায় রডরিগো গেল কী করে? সেখান দিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই। ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে সেই রাস্তায় যেতে গেলে রেস্তোরাঁর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, আর সেপথ দিয়ে বেরোলে পরিবারের বাকিরা তো দেখতেই পেত!
বলাবাহুল্য, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পর্তুগালের পুলিশ বা পোলিজিয়া কিছুই সমাধান করে উঠতে পারেনি। আনসলভড মিস্ত্রি বলে কেস ফাইল ক্লোজ করে দেয় তারা, বাড়ি বয়ে এসে ফার্নান্দোর কাছে টুপি খুলে ক্ষমা চেয়ে যায়। মার্টিনেজের বয়েস তখন এগারো বছর, সেই বিভীষিকাময় আতঙ্কের দিনগুলি কাটাতে অনেক সময় লেগেছে তার। মাঝেমধ্যে তার নার্ভাস ব্রেকডাউনহতে শুরু করে, তার জন্যে রীতিমতো ব্যক্তিগত মনোবিদ নিয়োগ করতে হয় ফার্নান্দোকে।
ক্লান্ত ম্লান স্বরে কথা বলেন মার্টিনেজ, আবার রডসির কথা এখন কেন পাপাই?
প্রশ্নটার কোনো সিধে জবাব দেন না ফার্নান্দো, শুধু মাথা নিচু করে একই স্বরে ফের প্রশ্ন করেন, আমার দাদা ফ্রান্সিসকোর কথা কিছু শুনেছ মার্ট?
না, ফ্রান্সিসকোর কথা মার্টিনেজ বিশেষ কিছু শোনেননি, শুনে থাকার কথাও নয়। কারণ মার্টিনেজের জন্মের অনেক আগেই, মানে প্রায় উনিশশো উনষাট বা ষাট সাল নাগাদই অত্যন্ত কিশোর বয়সে ফ্রান্সিসকো মারা যান। কানাঘুষোয় শুনেছেন সেই মৃত্যুও খুব একটা স্বাভাবিক না।এখন কথা হচ্ছে যে এসব পারিবারিক কথা মার্টিনেজের জানা উচিত ছিল। কিন্তু রডরিগোর মৃত্যুর পরপরই মার্টিনেজকে খানিকটা জোর করেই এক রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেই থেকে শুরু করে যৌবনের অনেকটা কাল অবধি পরিবারের খুব একটা কাছাকাছি আসেননি মার্টিনেজ। কোথাও যেন মা বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয় তার কোথাও যেন তার মনে হত যে তার বাবা মা চাইলেই রডরিগোর মৃত্যু আটকাতে পারতেন! নিয়তি যেন মার্টিনেজ ও তার পরিবারের মধ্যে অভিমানের একটা দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছিল। তাই এসব পারিবারিক গল্পগাছা তিনি বিশেষ কিছুই শোনেননি। অবশ্য সিসিলিয়াকে বিয়ে করার পর থেকে পরিস্থিতি অনেক পালটায়। অভিজাত পরিবারের এই বুদ্ধিমতী মেয়েটি ব্যাপারটি বুঝতে বেশি সময় নেয়নি। এবং অনেক যত্ন ও ধৈর্যের সঙ্গে ফার্নান্দোর সঙ্গে মার্টিনেজের সুসম্পর্ক আবার ফিরিয়ে আনে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মার্টিনেজ, হায় সিসিলিয়া, দেখো তোমার একমাত্র সন্তানকে কোন অযোগ্য বাবার হাতে দিয়ে গেলে। হঠাৎই খুব অসহায় বোধ করতে থাকেন তিনি। তার শীত করতে থাকে।
ফ্রান্সিসকোর মারা যাওয়াটাও এইরকমই অদ্ভুতুড়ে ছিল মার্ট, সেই নিচু চাপা স্বরে বলে যেতে থাকেন, আশা করি তুমি যথেষ্ট ভালো করে পর্তুগালের ইতিহাস পড়েছ। আমাদের কলোনিগুলো কোথায় কোথায় ছিল নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার। এর মধ্যে আফ্রিকাতে সবচেয়ে বড় কলোনি ছিল গিনি অ্যান্ড কেপ ভার্দ, অ্যাঙ্গোলা আর মোজাম্বিক।
এতটা বলে একটু থামলেন ফার্নান্দো। মার্টিনেজ চুপ করে রইলেন। তিনি তার বাবাকে চেনেন এবং এও জানেন যে পোর্তুগালের গৌরবময় অতীতের প্রতি ফার্নান্দোর একটা চোরা টান আছে। মার্টিনেজেরও সেই টান ছিল কিশোরবয়সে। কিন্তু তার চিন্তাধারা পাল্টে যায় পরবর্তীকালে, মানে কৈশোর ও যৌবনের প্রাক্কালে। মার্টিনেজ প্রথম যৌবনে যে মেয়েটির প্রেমে পড়েন সে ছিল পারতিদো কম্যুনিস্তার, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সমর্থক। তার কাছেই সাম্য ও সৌভাতৃত্বের কথা শোনেন মার্টিনেজ। শোনেন সোভিয়েতের বিপ্লবের গল্প, পারি কমিউনের আখ্যান। সেই থেকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি মোহ কেটে যায় মার্টিনেজের।না, তিনি কোনওদিনই কমিউনিস্ট হয়ে যাননি, কারণ সেই সূত্রেই তিনি জানতে পারেন গুলাগের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানি ও পোল্যান্ডে রেড আর্মির অমানুষিক অত্যাচার আর অগণিত ধর্ষণের কথা। তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের গণহত্যার বীভৎস ছবি তো কৈশোরে তিনি নিজেই দেখেছেন। সেই থেকে তিনি রাজনৈতিক দিক থেকে মধ্যপন্থা নিয়ে চলেন। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার। প্রতি তার সুতীব্র ঘৃণা আছে, সে জাতীয়তার নামেই হোক কী কোনও আদর্শের নামে। মুশকিল হচ্ছে ফার্নান্দো বৃদ্ধ হয়েছেন, তার সঙ্গে এসব নিয়ে তর্ক করতে আর ইচ্ছে করে না মার্টিনেজের।