কি চাই?
কিছু চাই না, ভাই। পারগানার বাড়িতে আমরা একবার কুটুম হয়েছিলাম। তাই ঘটনাটা একটু জানতে চাই।
ও, তোমরা সেই বাজিকর?
হ্যাঁ।
তাহলে আর কি জানতে চাচ্ছ? এসব ঘটনার গোড়ায় তো তোমরাই।
হ্যাঁ, বহেরায় থাকতে অঘ্রান মাসে একটা গণ্ডগোল হয়েছিল বটে, কিন্তু—
কিন্ত আবার কি? তোমরা ঝামেলা না করলে আজ–
না, ভাই, পারগানা কিন্তু এমন কথা বলেনি। মানুষ তোমাদের ঠকিয়ে খায়, তোমরা বাধা দেও না। আমরা বাধা দিয়েছিলাম, তাও তো মুখে।
তাই বা করতে গেলে কেন?
বালি ম্লান হাসে। বলে, আরে ভাই, অন্যায় আমাদের হয়েছে, মানছি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে ওদের বাধতই। এক্ষেত্রে আমরা শুধু নিমিত্ত হয়েছি।
যুবকটি অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করে খানিকক্ষণ। তারপর বলে, হয়ত ঠিকই বলেছ। পারগানাও এমন কথা বলত।
তারপর বালি তার কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শোনে। পতিত সাউ মিথ্যাই শাসিয়ে আসেনি। বরং এই ঘটনায় তার লাভই হয়েছিল। কেননা লক্ষ্মণকে দাদন নিতে হতো না অন্যদের মতো। বহেরাতে পারগানা লক্ষ্মণই ছিল দাদনের ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম। থাকলেই সে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং লক্ষ্মণ পারগানা হিসাবে তা করতও। তাছাড়া বহেরার বাছাই জমি ক-খানাও ছিল লক্ষ্মণের পরিবারের বিভিন্ন জনের হাতে। এই জমির উপরেও পতিত সাউ এবং তার সহব্যবসায়ীদের লোভ ছিল। কাজেই এই সুযোগে সে হাতছাড়া করতে চাইল না। তারা ভালো করে জানে সাঁওতাল জাত বড় নিরীহ জাত। ফুর্তিতে থাকতেই তারা পছন্দ করে। মন ভারাক্রান্ত হয়, ঝামেলা হয়, কিংবা রক্তপাত হয় এমন কাজে তাই তারা মোটেই থাকে না। উত্তেজনা সঞ্চয় করে রাখে শিকার খেলার জন্য, নাচগান ও নেশার জন্য। এসব পতিত সাউরা ভালোমতোই জানত। কিন্তু এই পারগানা কিছুটা যেন অন্য ধাঁচের মানুষ। অনেক কিছুই বুঝত এবং যা বুঝত তাও তলিয়ে দেখতে চাইত। লক্ষ্মণ সোরেনই গ্রামের প্রথম ব্যক্তি যে ওজন ও পয়সার হিসাব বুঝতে শেখে। সুতরাং প্রতিপক্ষের কাছে সে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।
আর ঈশ্বরপ্রদত্ত সুযোগ বহন করে আনল এক বাজিকরের ছোকরা। পতিত সাউকে হিসাব বোঝাতে গেল! পতিত সাউ দারোগাকে কেন, দারোগা পতিত সাউকে কেনে। কি বা মোকদ্দমা, কে জানে রে ভাই? পারগানা জানতেই পারল না, অথচ তার ধান চাল গরু মোষ ক্রোক হয়ে গেল। হায়রে, হায়রে, কোন্ লোহারে বানাল এ শিকল? ঘোড়ার পিঠে সওয়ার দারোগা টাপ টাপ যায়।
এ কাহিনী শুনে পীতেম বিষাদগ্রস্ত হয়। আহারে এমন মানুষ, এমন মর্যাদাবান মানুষ। কোনো বাজিকর যা কোনোদিন পায়নি, লক্ষ্মণ পীতেমকে তাই দিয়েছিল। লক্ষ্মণ দিয়েছিল সম্রমপূর্ণ ব্যবহার। এমনকি সালমা পর্যন্ত চুপ করে থাকে। বহেরার সব মানুষ তাকেও জোহর করেছিল এক অপরিচিত অথচ সম্রান্ত ভঙ্গিতে।
আর সেই মানুষ! অনেকক্ষণ দু-জনে চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে দু-জনকেই ঢেকে দেয়। তখন সেই অন্ধকারের মধ্যে সালমা বলে, হাজার নাগ-নাগিনী আসছে মানুষকে গিলে খাবার জন্য! কি তাদের হিসহিস শব্দ! তাদের জিভ লক লক করে! তাদের চোখ থেকে আগুন বের হয়। পীতেম এ দেশ থেকে পালিয়ে চল।
১১-১৫. যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা
যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা আশা করেছিল ঠিক তেমনটি হয়। পেমার তলপেট যত স্কুল হতে থাকে আনন্দর আসা-যাওয়াও তত কমে। তারপর পেটের চামড়া যখন একেবারে টানটান হয়ে নাভিকে পর্যন্ত সমতল করে দিল, তখন আনন্দর আসা একেবারেই বন্ধ হল।
আর মালিকের পছন্দ-অপছন্দ সব থেকে আগে বোঝে চাকরবাকরেরা। পেমার দেখাশোনার জন্য যে দু-জন চাকরানি ছিল, প্রথমে তারা তাকে অবহেলা দেখাতে শুরু করে, তারপরে অবাধ্য হতে থাকে এবং সবশেষে অপমান করতে শুরু করে।
সালমা যখন আকারে ইঙ্গিতে এসব কথা বলেছিল তখন যে পেমা বোঝেনি এমন নয়। সে বয়সে নিতান্ত বালিকা হলেও সালমা বলার আগেই সে এসব চিন্তা করেছিল। কিন্তু এসব চিন্তাকে আমল দেওয়ার কোনো কারণ সে তার যাযাবরী রক্তে খুঁজে পায়নি। সালমা যা চিন্তা করেছিল তা হল, বয়সের অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতায় মানুষ পেমার মতো অপরিণামদর্শী যুবতীকে মূখ মনে করে। বয়সের অভিজ্ঞতা ও তজ্জনিত উপলব্ধি অন্য একটা বয়সের আবেগ এবং উপলব্ধিকে তির্যকভাবে দেখে। সালমা যখন পেমাকে সাবধান করে তখন সে নিজের যৌবনের কথা, তার মায়ের যৌবনের কখা, সবই ভুলে থাকে।
তাছাড়া পেমা প্রেমে উন্মাদ হয়েছিল। আনন্দর রাজকীয় চেহারা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যতদিন সে দলে ছিল সেই ক-দিনের গোপন অভিসার তার সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। আর এখন যে সমস্যা, তার সমাধান এখনই করতে হবে। এসব আগে থাকতে কিছুতেই স্থির করা যাবে না। আনন্দর অদর্শনে সে কষ্ট পায়, কাঁদে এবং পরিচারিকাদের অনুরোধ করে, ঘুষ দিয়ে আনন্দকে ডাকতে পাঠায়।
আনন্দ বিরক্ত হয়ে আসে, সামান্য সময় বসে কিন্তু কথাবার্তার বিশেষ উত্তর দেয় না। পেমা আহত এবং অপমানিত বোধ করে, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়।
তারপর বহুদিন আনন্দ আসে না। পেমা বারবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও আসে। খরচ-পত্তরও নিয়মিত পাঠায় না। সে। দু-জন পরিচারিকার একজন এবং দারোয়ান চলে যায় কোন অজ্ঞাত নির্দেশে। বস্তুত, আনন্দ আর এই আয়োজনের অর্থও খুঁজে পায় না। এ কথা ঠিক, এই বিদেশি মেয়েটা তাকে অস্বাভাবিক নেশাগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। এসব নিয়মে নেই। তবুও একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারছে না আনন্দ। সামান্য একটা দুর্বলতা এখনো রয়েছে তার।