Site icon BnBoi.Com

রসমঞ্জরী – ভারতচন্দ্র রায়

রসমঞ্জরী - ভারতচন্দ্র রায়

০০. ভূমিকা (রসমঞ্জরী)

জয় জয় রাধা শ্যাম : নিত্য নব রসধাম : নিরুপম নায়িকানায়ক।
সর্ব্বসুলক্ষণধারী : সর্ব্বরসবশকারী : সর্ব্ব প্রতি প্রণয়কারক।।
বীণা বেণু যন্ত্র গানে : রাগরাগিনীর তালে : বৃন্দাবনে নাটিকানাটক।
গোপগোপীগণ সঙ্গে : সদা রাস রসরঙ্গে : ভারতের ভক্তিপ্রদায়ক।।

রাঢ়ীয় কেশরী গ্রামী : গোষ্ঠীপতি দ্বিজস্বামী : তপস্বী শাণ্ডিল্য শুদ্ধাচার।
রাজঋষি গুণযুত : রাজা রঘুরামসুত : কলিকালে কৃষ্ণ অবতার।।
কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ : সুরেন্দ্র ধরণীমাঝ : কৃষ্ণনগরেতে রাজধানী।
সিন্ধু অগ্নি রাহুমুখে : শশী ঝাঁপ দেয় দুঃখে : যার যশে হয় অভিমানী।।
তার পরিজন নিজ : ফুলের মুখটী দ্বিজ : ভরদ্বাজ ভারত ব্রাহ্মণ।
ভুরিশিট রাজ্যবাসী : নানাকাব্য অভিলাষী : যে বংশে প্রতাপ নারায়ণ।।
রাজবল্লভে কার্য্য : কীর্ত্তিচন্দ্র নিজরাজ্য : মহারাজা রাখিলা স্থাপিয়া।
রসমঞ্জরীর রস : ভাষায় করিতে বশ : আজ্ঞা দিলা রসে মিশাইয়া।।
সেই আজ্ঞা অনুসারি : গ্রন্থারম্ভে ভয় করি : ছল ধরে পাছে খল জন।
রসিক পণ্ডিত যত : যদি দেখ দুষ্ট মত : সারি দিবা এই নিবেদন।।

০১. নায়িকা প্রকরণ

শৃঙ্গার বীভৎস হাস্য রৌদ্র বীর ভয়। করুণা অদ্ভুত শান্তি এই রস নয়।।
অদ্যরস সকল রসের মধ্যে সার। নায়িকা বর্ণিব অগ্রে তাহার আধার।।

নায়িকার স্বীয়াদি ভেদ
স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্য বণিতা। অগ্রে এই তিন ভেদ পণ্ডিতবর্ণিতা।।

স্বীয়া নায়িকা
কেবল আপন নাথে অনুরাগ যার। স্বকীয়া তাহার নাম নায়িকার সার।।
নয়ন অমৃত নদী : সর্ব্বদা চঞ্চল যদি : নিজপতি বিনা কভু অন্য পানে চায় না।
হাস্য অমৃত সিন্ধু : ভুলায় বিদ্যুৎ ইন্দু : কদাচ অধর বিনা অন্য দিকে ধায় না।।
অমৃতের ধারা ভাষা : পতির শ্রবণে আশা : প্রিয়সখা বিনা কভু অন্য কানে যায় না।
নতি রতি গতি মতি : কেবল পতির প্রতি : ক্রোধ হলে মৌনভাব কেহ টের পায় না।।

মুগ্ধাদি ভেদ
মুগ্ধামধ্যে প্রগল্‌ভা তাহার ভেদ তিন। তিনেতে এ তিন ভেদ বুঝহ প্রবীণ।।

মুগ্ধা
মুগ্ধা বলি তারে যার অঙ্কুর যৌবন। বয়ঃসন্ধি সেই কাল বুঝ বিচঃক্ষণ।।
দেখিনু নাগরী : রূপের সাগরী : বয়সসন্ধি সময়।
শিশুগণ মিলি : রাঁধুবাড়ু খেলে :পুরুষে কিঞ্চিৎ ভয়।।
হংস খঞ্জরীটে : দেখি পদে দিঠে : কবে হল বিনিময়।
হৃদয়সরোজ : পূজিতে মনোজ : পণ্ডিতে হয় সংশয়।।

নবোঢ়া
এ যদি রমণে লাজে ভয়ে হয় স্তব্ধ। নবোঢ়া তাহাকে বলি প্রশ্রয়বিশ্রব্ধ।।

স্বকীয়া নবোঢ়া
হস্তেতে ধরিয়া : শয্যায় আনিয়া : যদি বা কোলে বসায়।
নানা বাক্যচ্ছলে : যত্নে কলে বলে : বাহিরে যাইতে চায়।।
নবোঢ়াকে বশ : করণ কর্কশ : সে রস কহিব কায়।
যেই পারা করে : স্থির করে ধরে : সেই জন ব্যামোহ পায়।।

পরকীয়া নবোঢ়া
আপনার পতি আছে : ভয়েতে না শুই কাছে : গায়ে হাত দেয় পাছে : এই ডরে ডরে হে।
প্রীতের বিষম কাজ : সে ভয়ে পড়িল বাজ : লাজে গলাইয়া লাজ : আশা বাসা করে হে।।
মুখের বাড়াও প্রীতি : হৃদয়ের হর ভীতি : তার পরে যেবা রীতি : রাখ রক্ষা কর হে।
যৌবন কমলাঙ্কুর : লোভে না করিও চুর : হিয়া কাঁপে দুরদুর : পাছে যাই মরে হে।।

সামান্য নবোঢ়া
কি ছার ধনের আসে : আইনু তোমার পাশে : আগে জানিতাম নাহি এত দায় হবে হে।
মুখ দেখি শোষে মুখ : বুক দেখি কাঁপে বুক : মনে হতে মন পড়ে কিসে প্রাণ রবে হে।।
কেবা ইহা সহিবেক : আমা হতে নহিবেক : ক্রুদ্ধ হও যদি নিজ ধন ফিরে লবে হে।
যেবা তীর্থে নাইলাম : তারি পুণ্য পাইলাম : অতঃপর ক্ষমা দেহ আমারে না সহে হে।।

বিশ্রব্ধ নবোঢ়া
স্তন দুটি করে ছ্যাঁদা : উরু দুটি ভুজে বাঁধা : লাজে ভয়ে মুদিল নয়ন।
প্রথমেতে নিরুত্তর :না না না তা : টাল টোল এখন তখন।।
যদি খেয়ে লাজ ভয় : কিঞ্চিত সঞ্চিত হয় : তবে আর না যায় ধারণ।
নবীন ভূষণ বাস : নব সুধা হাস বাস : নর রস কে করে গণন।।

মুগ্ধার ভেদ
মুগ্ধার প্রভেদ দুই করিয়া বর্ণনা। অজ্ঞাতযৌবনা আর বিজ্ঞাতযৌবনা।।

অজ্ঞাতযৌবনা
হয়েছে যৌবন যার নহে অনুভব। অজ্ঞাতযৌবনা তাকে বলে কবি সব।।
সখা সখী মেলি : ধাওয়াধাওয়ি লেলি : হারি কেহ যেন চোর।
অন্য দিনে ধাই : সবা আগে যাই : আজ কেন হারি মোর।।
নিতম্ব হৃদয় : ভারি হেন লয় : চক্ষু কর্ণে পড়ে জোর।
কটি দেখি ক্ষীণ : খসে পড়ে চীন : বাড়ে ঘাগরার ডোর।।

বিজ্ঞাতযৌবনা
নিজ নবযৌবন যে ব্যক্ত করে ছলে। বিজ্ঞাতযৌবনা তাকে কবিবর বলে।।
দেখিলাম ঘরে ঘরে : সকলে কাঁচলী পরে : নানা বর্ণে উড়ায় উড়ানি।
পরিহাস্যজন যত : নানা ছলে কহে কত : বাহিরায় হইল পোড়ানী।।
দেহের কি কব কথা : সকল শরীর ব্যথা : কত শত বিছার জ্বলনী।
তোরে বলি প্রিয় সই : লাজে কারে নাহি কই : পাছে জানে জনক জননী।।

মধ্যা
লজ্জা আর রতিআশা সমান যাহার। রসিক পণ্ডিতে কহে মধ্যা নাম তার।।
রতি রসে কৃতি পতি : মোরে ভালবাসে অতি : দেয় নিজাঙ্গুরী কণ্ঠমালা।
আঁখিআড়ে নাহি রাখে : সদা কাছে কাছে থাকে : সুখ বটে কিন্তু এক জ্বালা।।
নখাঘাত দেখি বুকে : দন্তচিহ্ন দেখি মুখে : সখি হাসে কর্ণে লাগে তালা।
শয্যা ঠেকি এই দোষে : না শুইলে পতি রোষে : শরীর হইল ঝালাপালা।।

প্রগল্‌ভা
প্রগল্‌ভা সে রতিরসে পূর্ণ আশা যার। রতি প্রীতি আনন্দেতে মোহ হয় যার।।

মধ্যা প্রগল্‌ভা ধীরাদি ভেদ
মানকালে মধ্যা প্রগল্‌ভার তিন ভেদ। ধীরাধীরা আর ধীরাধীরা পরিচ্ছেদ।।
মুগ্ধার এ ভেদ নাই ভয় তার মূল। ক্রোধ হলে এক ভাব ক্রন্দনআকুল।।
প্রকারে প্রকাশে ক্রোধ যে জন সে ধীরা। সোজাসোজি যার ক্রোধ সে জন অধীরা।।
কিছু সোজা কিছু বাঁকা যার হয় ক্রোধ। ধীরাধীরা বলে তারে পণ্ডিত সুবোধ।।

মধ্যা ধীরা
আজি প্রভু দড় দড় : বেশ বনায়েছ বড় : শ্বেত রক্ত চন্দনের : চাঁদ ভালে ধরেছ।
মন দেখি ভাঙ্গা ভাঙ্গা : নয়ন হয়েছে রাঙ্গা : বুঝি কোন দোষ দেখি : মোরে রোষ করেছ।।
তোমা বিনা প্রভু নাই : যাইবার নাহি ঠাঁই : কুমুদের চাঁদ যেন : তেন মন হরেছ।
অপরাধ ক্ষমা কর : নূতন চন্দন পর : এই লও নবমালা বাসীমালা পরেছ।।

মধ্যা অধীরা
সোহাগ করিয়া নিত্য : বসহ আমার ভৃত্য : আজি দেখি এ কি কৃত্য : দর্পণেতে চাও হে।
অধরে কজ্জলদাগ : নয়নে তাম্বুলরাগ : অলক্তাক্ত ভাল ভাগ : কার কাছে পাও হে।।
মোরে প্রাণ বলে ডাক : অন্যের নিকটে থাক : বুঝিলাম মনে রাখ : মন কলা খাও হে।
তোমা দেখি হয় ভীতি : কঠিন তোমার রীতি : বুঝিনু তোমার প্রীতি : যাও যাও যাও হে।।

মধ্যা ধীরাধীরা
তুমি মোর প্রাণপতি : কখন ধরিলা রতি : বুঝি সুখে ভুলেছিনু : তেঁই নাই মনে হে।
বুকে দেখি নখচিহ্ন : অধর দর্শনে ভিন্ন : ভালে আলতার দাগ : রক্তিমা নয়নে হে।।
শ্রমযাক মুখ ধোও : ক্ষণেক শয্যায় শোও : ছুঁয়ে শুদ্ধ কর মালা : তাম্বুল চন্দন হে।
কত জান ভারিভুরি : দেখিতে দেখিতে চুরি : পরিহার নমস্কার : তোমা হেন জনে হে।।

প্রগল্‌ভা ধীরাধীরা
কাজের সময় : যত কথা হয় : এবে কোথা রয় : মনে না থাকে।
কেমন ধরম : কেমন রকম : কেমন মরম : কহিব কাকে।।
ধিক্ বিধাতায় : এ হেন আমায় : দিয়াছে তোমায় : ইহারি পাকে।
দেখি হে চঞ্চল : ছোঁবে কি অঞ্চল : এ কাজে কি ফল : কে তোমা ডাকে।।

প্রগল্‌ভা অধীরা
কোন ফুলে বঁধু : পান কর মধু : হয়ে এলে যদু : পোড়াতে মোরে।
আল্‌তা কজ্জল : সিন্দুর উজ্জ্বল : জাগিয়া বিকল : নয়ন ঘোরে।।
এতেক বলিয়া : ক্রোধেতে জ্বলিয়া : কমল ফেলিয়া : মারিল জোরে।
কাঁদিয়ে নাগর : গুণের সাগর : কোথায় আদর : থাকয়ে চোরে।।

প্রগল্‌ভা ধীরাধীরা
জাগিয়া নয়ন : তোমার যেমন : আমার তেমন : সকল বটে।
সব কাজে মম : ফলে তরতম : কিসে আমি কম : বুঝিলে বটে।।
বিধি কৈল নারী : লাজ দিল ভারী : তেঁই সে না পারি : তোমার হঠে।
বৃক্ষমূলে হানি : শিরে চাল পানি : চরণ দুখানি : নৌকার তটে।।

জ্যেষ্ঠাদি ভেদ
এই ধীরা এ অধীরা এই ধীরাধীরা। জ্যেষ্ঠা আর কনিষ্ঠা দ্বিভেদ হয় ফিরা।।
পতির অধিক স্নেহ যারে সেই জ্যেষ্ঠা। অল্প স্নেহ যারে তারে বলয়ে কনিষ্ঠা।।

ধীরা জ্যেষ্ঠা
স্ত্রীর বুঝি ধীর ক্রোধ : দূরে গেল শোধবোধ : বন্ধু করে উপরোধ : ধীরে ধীরে কহিছে।
যদি পেয়ে থাক দোষ : তবু যুক্ত নহে রোষ : হাস্য কর পরিতোষ : কামানলে দহিছে।।
রক্তপদ্ম দুটি পায় : ভ্রমর নূপুর তায় : নিত্য নানারস খায় : আজি তাই রহিছে।
আকূল আমার প্রাণ : তবু নহে সমাধান : কঠিন তোমার মান : পরিমাণ নহিছে।।

ধীরা কনিষ্ঠা
স্ত্রীর দেখে স্থির মাস : করিবারে সমাধান : বন্ধু করে অপমান : ক্রোধে ক্রোধ হরিব।
কিসে মোর পেয়ে দোষ : কেন কর এত রোষ : কিসে হবে পরিতোষ : বল তাই করিব।।
কেহ বুঝি কহিয়াছে : গিয়াছিনু কারো কাছে : অঙ্গে বুঝি চিহ্ন আছে : তবে কিসে তরিব।
আরম্ভিয়া ছিল ক্রোধ : তা করিল উপরোধ : এত দূরে শোধবোধ : কত সেধে মরিব।।

অধীরা জ্যেষ্ঠা
যদ্যপি অধীরা হয়ে : গালি দিলা কটু করে : তবু থাকিলাম সয়ে : না সয়ে কি করিব।
তুমি প্রাণ তুমি ধন : তোমা বিনা অন্য জন : যদি জানে মোর মন : পরীক্ষা আচরিব।।
রুষ্ট হলে কটু কও : তুষ্ট হলে কোলে লও : আমা বিনা কারো নও : এই গুণে তরিব।
ছলছুতা মিছা সাঁচা : না জানি বিস্তর প্যাঁচা : প্রাণেশ্বরী প্রাণ বাঁচা : নহে আজ মরিব।।

অধীরা কনিষ্ঠা
বিনা দোষে দেও গালি : মাথে কলঙ্কের ডালি : মুখে যেন চুনকালি : কিসে মুখ চাহিব।
হয়েছি তোমার প্রভু : কত দোষ পাই তবু : গালি নাই দেই কভু : কত গালি খাইব।।
বিনয়ে না মানে বোধ : যদি নাহি ছাড় ক্রোধ : এত দূরে শোধবোধ : দেশ ছেড়ে যাইব।
তোমার যেমন মর্ম্ম : আমার তেমন কর্ম্ম : ইশাদ থাকিও ধর্ম্ম : কার্য্যকালে পাইব।।

ধীরাধীরা জ্যেষ্ঠা
একবাক্যে বুঝি রাগ : আর বাক্যে অনুরাগ : হৃদয়ে হইল দাগ : বুঝিতে না পারিয়া।
কি করিলে হও তুষ্ট : কি কহিলে হও রুষ্ট : অদৃষ্ট হইল দুষ্ট : কিসে যাবে সরিয়া।।
যদি অপরাধী হই : নিতান্ত করিয়া কই : তোমা বিনা কারো নই : দুঃখে লও তারিয়া।
তুমি ধ্যান তুমি জ্ঞান : তুমি মান অপমান : তোমা বিনা নাহি আন : দেখিনু বিচারিয়া।।

ধীরাধীরা কনিষ্ঠা
একবাক্যে দেখি রোষ : আর বাক্যে বুঝি তোষ : না বুঝিনু গুণ দোষ : বড় দায় পড়িল।
কি করিলে ভাল হবে : বল ভাই করি তবে : নহে ঘরে লয়ে রবে : আমার কি বহিল।।
পদ্মিনী ভ্রমরপ্রিয়া : ভ্রমরে খেদায়ে গিয়া : তাহারি বিদরে হিয়া : বুঝি তাই ফলিল।
প্রমোদসময় নইক : আমারে না হয় হউক : ক্রোধটি তোমার রউক : যা হবার হইল।।

পরকীয়া নায়িকা
অপ্রকাশে যার মতি পরপতি সনে। পরকীয়া তাহারে বলয়ে কবিগণে।।

পরকীয়া ভেদ
উঢ়া আর অনূঢ়া বিভেদ হয় তার। উঢ়া সেই বিবাহ হইয়া থাকে যার।।
অনূঢ়া সে জন যার হয় নাই বিয়া। পিত্রাদি অধীন হেতু সেও পরকীয়া।।

অনূঢ়া
শুন শুন প্রাণবঁধু : পিয়াইয়া মুখমধু : এমত করিলে বশ কত গুণ কব হে।
অন্য সঙ্গে যদি পিতা : করে মোরে বিবাহিতা : কেমনে তাহার সঙ্গে তোমা ছাড়ি রব হে।।
এমত করিয়া কর্ম্ম : নহে যেন স্ত্রীর ধর্ম্ম : বুকে মুখে হলে দাগ কলঙ্কিনী হব হে।
যাবৎ না বিভা হয় : তাবৎ এমন হয় : তাবতি এমত পীড়া দুজনেতে সব হে।।

উঢ়া
আপনার পতি আছে : সদা তারে পাই কাছে : তথাপি দারুণ মন পর লাগি মরে গো।
সঙ্কেত তরুর মূলে : সঙ্কেত নদীর কূলে : ঘাটে ভাঙ্গামাঠে মাঠে অন্ধকার ঘরে গো।।
কিঙ্কিণী-কঙ্কণ-রোল : লুকায়ে চুম্বন কোল : মরনে নাহিক সুখ কোটালের ডরে গো।
পরপতিরতি আশ : ঘর ছাড়ি পরবাস : সুখ যদি নহে লোক তবে কেন করে গো।।

পরকীয়ার অন্যভেদ
বিদগ্ধা ললিতা গুপ্তা কুলটা মুদিতা। পরকীয়া নানাভেদ প্রাচীন লিখিতা।।

বিদগ্ধা
বিদগ্ধ দ্বিমত হয় বাক্য আর কাজে। কথা শুনি কার্য্য দেখি বুঝি বা অব্যাজে।।

বাগ্বিদগ্ধা
চিরপরবাসী স্বামী : বিরলে কাতর আমি : বসন্তে মাতিল কাম কেমনে বা থাকিব।
প্রভুর কুসুমোদ্যান : বড় মনোহর স্থান : মনুষ্যের গম্য নহে সেই স্থানে যাইব।।
ডাকে পিক অলিকুল : ফুটে নানাজাতি ফুল : গাইয়া প্রভুর গুণ রজনী পোহাইব।
করিতে আমার তত্ত্ব : হইবে যাহার সত্ত্ব : সেই বঁধু তারে দেখা সেইখানে পাইব।।

ক্রিয়াবিদগ্ধা
সুখে শুয়ে পতি আছা : রামা বসে তার কাছে : ইশারায় উপপতি পিকডাকে ডাকিল।
রামা বলে হলো দায় : পাছে পতি টের পায় : না দেখি উপায় ভেবে স্তব্ধ হয়ে রহিল।।
কোকিল ডাকিছে হোর : কাম ভয়ে পাছে ঘোর : শ্রান্ত আছ নিদ্রা যাও বলে চক্ষু ঢাকিল।
জাগ্রত আমার প্রিয় : কেহ ডাকে বনপ্রিয় : আর কি তোমারে ভয় বলে দুই রাখিল।।

লক্ষিতা
পরপতিমতিআশা ঢাকিতে যে নারে। লক্ষিতা করিয়া কবিগণ বলে তারে।।
আজি প্রভু দেশে এলে : রতিচিহ্ন কিসে পেলে : সোহাগ পড়ুক মরে সতীপনা হরিলে।
তুমি এলে বার্ত্তা পেয়ে : দেখিতে আইনু ধেয়ে : আছাড় খাইনু পথে সে তত্ত্ব না করিলে।।
মুখে বল দন্তচিহ্ন : বুক বলে নহে ছিন্ন : আলু থালু বেশ দেখি বুঝি লতা ধরিলে।
নষ্ট হই দুষ্ট হই : তোমা বিনা কারো নই : কলঙ্ক এড়াবে নাহি সে জন না মরিলে।।

গুপ্তা
হয়েছে হতেছে হবে পরসঙ্গে রতি। গুপ্ত করে যে জন সে জন গুপ্তমতি।।
মুখে বুকে দেখি দাগ : শাশুড়ী করেন রাগ : একে তো বিরহে মরি আর অই ভয় লো।
কান্দিয়া পোহাই নিশা : আবেশে হারাই দিশা : কেমন কেমন করে অধর হৃদয় লো।।
স্তন নিজ নখাঘাতে : অধর পীড়িয়া দাঁতে : কোনমতে নিবারণ করি এ সময় লো।
এইরূপে দিবারাতি : রাখিয়াছি কুজ জাতি : চক্ষু খেয়ে তবু লোক কত কথা কয় লো।।

কুলটা
পতি বর্ত্তমানে যার অনেকেতে কাজ। কুলটা তাহারে বলে পণ্ডিতসমাজ।।
আরে বিধি নিদারুণ : কি তোর স্মরিব গুণ : কুলটার আশা পূর্ণ করিতে না পারিলি।
হস্ত পদ চক্ষু কান : দিলি দুই দুই খান : উড়িবারে দুই খান পাখা দিতে নারিলি।।
চৌদ্দ ভুবনে যত : পুরুষ বিবিধ মত : সবার বুঝিতে বল তাই বুঝি সারিলি।
এ দুঃখ বা কত সব : অন্যের কি কথা কব : চতুর্ম্মুখ রজোগুণ তবু তুই নারিলি।।

মুদিতা
পরসঙ্গে রতিআশে উল্লসিতা যেই। বিঘ্নহীন দেখিয়া মুদিতা হয় সেই।।
প্রবাসে রয়েছে পতি : ননদী প্রসূতবতী : বিধবা শাশুড়ী ঐ দৃষ্টিহীন রয় লো।
দেবর বিলাস রায় : শ্বশুর ভবনে যায় : মন্দ মন্দ গন্ধবহ বিদরে হৃদয় লো।।
অস্ত গেছে দিনমনি : যতেক রসিক ধনি : ওই শুন বংশীধ্বনি : করয়ে ললিত লো।
রোমাঞ্চ হতেছে মোর : খসিছে কাঁচালী ডোর : কেন সই ওষ্ঠাধর : হতেছে কম্পিত লো।।
পরকীয়া সুখ যত : ঘরে ঘরে শুনি কত : অভাগীর ধর্ম্মভয় এত করে মরি লো।
পরপুরুষের মুখ : দেখিয়া যে হয় সুখ : এ কি জ্বালা সদা জ্বলি হরি হরি হরি লো।।

সামান্য বনিতা
ধনলোভে ভজে যেই পুরুষ সকলে। সামান্য বনিতা তারে কবিগণ বলে।।
স্বকীয়া ধর্ম্মের বশে : পরকীয়া প্রীতি রসে : অমূল্য যৌবন ধন পুরুষেরে দেই লো।
আমার যৌবনধন : ভোগ করে যেই জন : মান বুঝি মূল্য করে দিতে পারে যেই লো।।
যখন যে ধন চাই : সেইক্ষণে যদি পাই : আমার মনের মত বন্ধু হবে সেই লো।
ধনিক রসিক জানি : নাগর মিলাবে আনি : আপনার মর্ম্ম কথা কয়ে দিনু এই লো।।

সামান্য বনিতার ভেদ
অন্যভোগ দুঃখিতা আর বক্রোক্তি গর্ব্বিতা। মানবতী আদিভেদে সামান্য বনিতা।।

বক্রোক্তিগর্ব্বিতা
গর্ব্বিতা দ্বিমত হয় রূপে আর প্রেমে। দুইটি একত্র হলে হীরা যেন হেমে।।

রূপগর্ব্বিতা
মুখ দেখি যদি আরশী ধরে। দড় বলে ছায়া সে লয় হরে।।
মদন জানিত অধিক করে। দেখিতাম কিন্তু গিয়াছে মরে।।

প্রেমগর্ব্বিতা
অনিমিষ আঁখি স্থির চরিত্র। আপনার বঁধু করিয়া চিত্র।।
আমারে দেখয়ে এ কি বিচিত্র। কেহ বঁধু সখী শত্রু কি মিত্র।।

অন্যসম্ভোগদুঃখিতা
কহ দূতি গিয়াছিলে কোন বনে। বড় শোভয়ে অঙ্গ ফুলাভরণে।।
নিজবেশ করে দড় আইলি লো। কই গেলি নরাধমসন্নিধি লো।।
ভুলিয়াছিলি আর ভুলাইলি রে। মধু গূঢ় বনে কত পাইলি রে।।

মানবতী
এস পরাণ-পুত্তলি এস : মরে যাই কিবা বেশ : আলোতে রহ হে রূপ ভাল করে হেরি রে।
আলতা কজ্জলদাগ ভালে : অরুণ প্রকাশ রাহু গালে : ভাবে আছ ভাল জানি ভারিভুরি হেরি রে।।

নায়িকার অবস্থাভেদ
এ সব নায়িকা পুনঃ অষ্টমত হয়। বিপ্রলব্ধা সম্ভোগ তাহার পরিচয়।।
বাসসজ্জা উৎকণ্ঠিতা ও অভিসারিকা। বিপ্রলব্ধা তার পর স্বাধীনভর্ত্তৃকা।।
খণ্ডিতা তাহার পর কলহান্তরিতা। প্রোষিতভর্ত্তৃকা এই অষ্ট পরিমিতা।।

বাসসজ্জা
পতি হেতু বাসঘরে যেই করে সাজ। বাসসজ্জা বলে তারে পণ্ডিতসমাজ।।
আঁচড়িয়া কেশপাশ : পরিয়া উত্তম বাস : সখীসঙ্গে পরিহাস গীতবাদ্য ঘটনা।
চামর চন্দন চুয়া : ফুলমালা পানে গুয়া : হাতে লয়ে শারীশুকে কামরস পঠনা।।
কিঙ্কিনীকঙ্কণ হার : বাজুবন্ধ সীঁতি টাড় : নূপুরাদি অলঙ্কার নিতি নব পর না।
যোগী যেন যোগাসনে : বসিয়া ভাবয়ে মনে : কতক্ষণে পতিসঙ্গে হইবে ঘটনা।।

উৎকণ্ঠিতা
স্বামীর বিলম্ব যেই ভাবে অনুক্ষণ। উৎকণ্ঠিতা তাহারে বলয়ে কবিগণ।।
হইল বহু নিশি : প্রকাশ হয় না দিশি : আইল কেন নাহি কালিয়া।
পিকের কলরব : ডাকিছে অলি সব : অনলে দেও দেহ জ্বালিয়া।।
তিমির ঘনতরে : সভয়ে বনচরে : ফিরয়ে কিবা পথ ভুলিয়া।
অপর সখীরসে : রহিল পরবশে : মদন মোরে দিল জ্বালিয়া।।

অভিসারিকা
স্বামীর সঙ্কেতস্থলে যে করে গমন। তারে অভিসারিকা বলয়ে কবিগণ।।
নিকট সঙ্কেতসময় আইল : শুনে রসময়ী মূরলী গাইল : ধরি ধনুঃশর মদন ধাইল : চলে নিধুবনে কামিনী।
পিক কলকলি শারীশুক ধ্বনি : ফুটে বনফুল ভ্রমর গুনগুনী : তাহাতে মিলিত নূপুর রুণরুণী : শীঘ্র চলে মৃদুগামিনী।।
বাছিয়া পরিলেক নীল অম্বর : মদন হেম গৃহে মেঘাড়ম্বর : পথিকজন ডর করিতে সম্বর : ঝাঁপিল তাহে তনু দামিনী।
বদন সরসিজ গন্ধযুত মন : মোহিত সহচরী ভ্রমর শিশুগণ : তথি মলয়াচল গতি মন্দ পবন : যাওল দ্রুত সখি যামিনী।।

বিপ্রলব্ধা
সঙ্কেতে স্থানেতে গিয়া নাহি পায় পতি। বিপ্রলব্ধা বলে তারে পণ্ডিত সুমতি।।
তিল পরিমাণ মান : সদা করি অনুমান : গুরুভয় লঘুভয় গেলা।
গৃহ ছাড়ি ঘন ঘন : করিমাল আরোহণ : সিন্ধু তরিনু ধরি ভেলা।।
হরি হরি মরি মরি : উহু উহু হরি হরি : তব নহে হরি সনে মেলা।
পর দুঃখ পরশ্রম : পরজনে জানে কম : অপরূপ খলজন খেলা।।

স্বাধীনভর্ত্তৃকা
কোলে বসে যার পতি আজ্ঞার অধীন। স্বাধীনভর্ত্তৃকা তারে বলে সুপ্রবীণ।।
শুন শুন প্রাণনাথ : নিবেদি হে যোড়হাত : পূরিল সকল সাধ : কিছু শেষ রয় হে।
বেঁধে দেহ মুক্তকেশ : বিনাইয়া দেহ বেশ : তুমি মোরে ভালবাস : লোকে যেন কয় হে।।
দেখিয়া তোমার মুখ : অতুল হইল সুখ : পাসরিনু যত দুখ : আছিল যে ভয় হে।
যত কাল জীয়ে রই : তোমা ছাড়া যেন নই : নিতান্ত করিয়া কই : মনে যে রয় হে।।

খণ্ডিতা
অন্য ভোগচিহ্ন অঙ্গে আসে যার পতি। খণ্ডিতা তাহার নাম বলে শুদ্ধমতি।।
আইস বঁধু দ্রুত হয়ে : কেন আইস রয়ে রয়ে : মরিব বালাই লয়ে : কিবা শোভা পেয়েছ।
কপালে সিন্দূরবিন্দু : মলিন বদনইন্দু : নয়ন রক্তের সিন্ধু : মোর দিকে ধেয়েছ।।
অধরে কজ্জল দাগ : নয়নে তাম্বুল রাগ : বুঝি কেবা পেয়ে লাগ : মোর মাথা খেয়েছ।।
তোমার কি দোষ দিব : বাপমায়ে কি বলিব : হরি হরি শিব শিব : যম মোরে ভুলেছে।।

কলহান্তরিতা
কলহে খেদয়ে পতি পশ্চাৎ তাপিতা। কবিগণে বলে তারে কলহান্তরিতা।।
ক্রোধে হয়ে হতজ্ঞান : কৈনু তোরে অপমান : এখন আকুল প্রাণ : দেখিতে না পাইয়া।
ফুটিছে বিবিধ ফুল : ডাকে ভৃঙ্গ অলিকুল : সামালিব এই শূল : কার মুখ চাহিয়া।।
কাতর হইয়া অতি : বিস্তর করিয়া নতি : চরণে ধরিল পতি : না চাহিনু ফিরিয়া।
করিনু যেমন কর্ম্ম : ফলিল তাহার ধর্ম্ম : মরুক এমত মর্ম্ম : দুঃখে যাই মরিয়া।।

প্রোষিতভর্ত্তৃকা
পরবাসে পতি যার মলিনা বিরহে। প্রোষিতভর্ত্তৃকা তারে কবিগণ কহে।।
অনল চন্দন চুয়া : গরল তাম্বুল গুয়া : কোকিল বিকল করে অতি।
বিধবার মত বেশ : অস্থিচর্ম অবশেষ : তাপে কাম পোড়ায় বসতি।।
মনোজ তনুজ মত : কোদণ্ড করিয়া হত : হাতে লয় পিণ্ডের পদ্ধতি।
সখীমুখে মান শুনি : পতি এলো হেন গণি : দেখিয়া শ্বাসের গতাগতি।।

প্রোষৎভর্ত্তৃকা
যার কাছে আসি পতি প্রবাসগমন। প্রোষিতভর্ত্তৃকা মধ্যে তাহার গণন।।
এ আট লক্ষণে তার না মিলে লক্ষণ। নবমী নায়িকা হতে পারে কেহ কন।।
কিন্তু অষ্ট নায়িকা সকল গ্রন্থে কয়। নবমী কহিতে গেলে গণ্ডগোল হয়।।
অতএব দ্বিধা বলি প্রোষিতভর্ত্তৃকা। প্রোষিতভর্ত্তৃকা আর প্রোষ্যৎপতিকা।।
পুনঃ শুন ওহে প্রাণ : পতি পরবাসে যান : তুমি কি করিবে এবে সত্য করি কহিবে।
এবে জানিলাম দড় : তোমা হইতে পতি বড় : নহে কেন আগে যান তুমি পাছে রহিবে।।
যদি বড় হতে চাও : তবে আগে আগে যাও : নহে তুমি লঘু হবে আমার কি বহিবে।
এবে সুখ দেয় যারা : পিছে দুঃখ দিবে তারা : কয়ে অবসর আমি কত জ্বালা সহিবে।।
ইত্যাদি কহিয়া দিনু নায়িকা যতেক। পতির গমনকালে সবার প্রত্যেক।।
পুথি বাড়ে সকলের করিতে কবিতা। অনুভবে বুঝি হবে লক্ষণ মিলিতা।।

নায়িকাদি উত্তমাদি ভেদ
উত্তমা মধ্যমা আর অধমা নিয়মে। এ সব নায়িকা তিন মত হয় ক্রমে।।

উত্তমা
অহিত করিলে পতি যেবা করে হিত। উত্তমা তাহার নাম বলয়ে পণ্ডিত।।

মধ্যমা
হিত কৈলে হিত করে অহিতে অহিত। মধ্যমা তাহার নাম মধ্যমচরিত।।

অধমা
হিত কৈলে অহিত করয়ে যেই জন। অধমা তাহার নাম বলে কবিগণ।।

চণ্ডী নায়িকা
পতি প্রতি করে যেই অকারণ ক্রোধ। চণ্ডী তার নাম বলে পণ্ডিত সুবোধ।।

০২. নায়িকা সহায়

বেশভূষা করে দেয় পরিহাস। কথা কৈতে খেতে শুনে শিখায় বিলাস।।
যার কাছে বিশ্রাম বিশ্বাস কথা কয়। সহচরী সখী সেই পঞ্চ মত হয়।।
সখী নিত্যসখী প্রিয়সখী প্রাণসখী। অতিপ্রিয়সখী এই পঞ্চমত সখী।।

সখী
আমার নিকটে রয়ে : মরম আমারে কয়ে : এমত শিখাব কথা সুধাবৃষ্টি করিবে।
আঁচড়িয়া দিব কেশ : বানাইয়া দিব বেশ : থাকুক পতির মন মুনিমন ভুলিবে।।
হাবভাব লীলা হেলা : শিখাইব নানা খেলা : আসিতে আমার কাছে কাহারে না ডরিবে।
দোষ যত লুকাইব : গুণ যত প্রকাশিব : বড় দায়ে ঠেক যদি আমা হতে তরিবে।।

দূতীসখী
নায়ক নায়িকা যেই করয়ে বচন। বিরহ যাপন করে দূতী সেই জন।।
স্বয়ং দূতী আদ্যদূতী এই যে প্রকার। আদ্যদূতী তিন মত শুন ভেদ তার।।
অমিতার্থ নিশ্চয়ার্থ আর পত্রহারী। বিশেষ বিশেষ শুন করিয়া বিচারি।।
ইঙ্গিতে যে কর্ম্ম করে অমিতার্থ সেই। নিশ্চয়ার্থ আজ্ঞা পায়ে কর্ম্ম করে যেই।।
পত্র লয়ে কর্ম্ম করে পত্রহারী সেই। বিশেষিয়া বুঝ সবে কয়ে দিনু এই।।

আদ্যদূতী
সিন্দূর চন্দন চুয়া : ফুলমালা পান গুয়া : পড়ে দিতে পারি যদি ভুলে চন্দ্রবদনী।
কুমন্ত্র এমত জানি : বিষ দেখে রাজা রাণী : অপ্রীতি করিতে পারি কাম কামকরণী।।
যে নারী না নর জানে : যে নর না নারী মানে : তাহারে মিলাতে পারি দিনে করে যামিনী।
নাগর নাগরী যত : হও মোর অনুগত : সিদ্ধি করে মনোরথ যাই দ্রুতগামিনী।।

 ০৩. নায়ক প্রকরণ

নায়ক নায়িকা দুই শৃঙ্গারে প্রধান। নায়িকা বর্ণিনু শুন নায়ক সন্ধান।।
পতি উপপতি আর বৈশিক নাগর। স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্যার ঘর।।
বেদমত বিভা করে যে জন সে পতি। উপপতি সেই যার পিরীতে বসতি।।
কোনরূপে ধনলোভে হয় সংঘটন। বৈষয়িক বৈশিক নাগর সেই জন।।

পতিভেদ
অনুকূল দক্ষিণ ধৃষ্ট শঠ চারি মত। পতিভেদ কেহ বলে তিনে কেহ রত।।
একে অনুরাগ যার সেই অনুকূল। দক্ষিণে সে যার ঘরে পরে হয় তুল।।
ধৃষ্ট সেই দোষ করে পুনঃ করে হঠ। কপট বচনে পটু সেই জন শঠ।।

অনুকূল
ওলো ধনি প্রাণধন : শুন মোর নিবেদন : সরোবরে স্নান হেতু যেয়ো না লো যেয়ো না।
যদ্যপি বা যাও ভুলে : অঙ্গুলে ঘোমটা তুলে : কমলকানন পানে চেয়ো না লো চেয়ো না।।
মরাল মৃণাল লোভে : ভ্রমর কমল ক্ষোভে : নিকটে আইলে ভয় পেয়ো না লো পেয়ো না।
তোমা বিনা নাহি কেহ : ঘামে পাছে গলে দেহ : যায় পাছে ভেঙ্গে কটি ধেয়ো না লো ধেয়ো না।।

দক্ষিণ
তোমার নিকটে যত : দিব্য করি কহি কত : বাহির হইবামাত্র পর দেখি ভুলে লো।
তোমার যেমন প্রীতি : পরসঙ্গে সেই রীতি : কহিলাম আপনার দোষগুণগুলি।।
কি করে ধর্ম্মের ভয় : লোকলাজে কিবা হয় : দেখিতে পরের মুখ ফিরি কুলি কুলি লো।
তুমি যদি হও রুষ্ট : অন্যে করিবেক তুষ্ট : ইহা বুঝি মোর সঙ্গে ছেড়ে দেহ ঠুলি লো।।

ধৃষ্ট
দোষ দেখে একবার : কৈল নানা তিরস্কার : লাজ পেয়ে আনু ফিরে তবু দয়া হল না।
ভুজপাশে বান্ধ্যা ধর : নিতম্ব প্রহার কর : দশনেতে কর ক্ষত অভিমানে গলো না।।
দূর কৈলে দূর হব : গাল দিলে সয়ে রব : আমারে সহিল সব তোমারে তো সলো না।
পুরুষ পরশমণি : যারে ছোঁয় সেই ধনী : ইহা বুঝে অনুক্ষণ দূর দূর বলো না।।

শঠ
কালি করেছিনু : আনিতে ভুলিনু : ক্ষম সেই অপরাধ।
যে বল করিব : যাহা চাহ দিব : পূরাহ সকল সাধ।।
অঙ্গেতে যে দাগ : তোমারি সোহাগ : মিথ্যা দেহ অপবাদ।
আমার পরাণ : হরিণী সমান : তোমার চক্ষু নিবাদ।।

উপপতি
নিজ নারী আছে ঘরে : যাহা বলি তাহা করে : নানা রূপ গুণ ধরে : তাহে মন রয় না।
করিতে অন্যায় সঙ্গ : সদাই সরস অঙ্গ : এ বড় অপূর্ব্ব রঙ্গ : ধর্ম্মভয় হয় না।।
যাইতে সঙ্কেতস্থান : সতত আকূল প্রাণ : অপরাধ জ্ঞান মান : কিছু মনে লয় না।
ব্যক্ত হলে কালামুখ : বাড়ীতে নাহিক সুখ : রমণেতে নানা দুখ : তবু ক্ষমা হয় না।।

বৈশিক নাগর
গিয়াছিনু সরোবরে : স্নান করিবার তরে : দেখিয়াছি একজন অপরূপ কামিনী।
চক্ষু মুখ পদ্ম ছন্দ : কিবা ছন্দ কিবা মন্দ : নীলাম্বরে ঝাঁপে তনু মেঘে যেন দামিনী।।
ঈশ্বর সদয় হন : দূতী মিলে একজন : এই ক্ষণে তার কাছে যায় দ্রুতগামিনী।
যত চাহে দিব ধন : দিব নানা আভরণ : কোনমতে মোর সঙ্গে বঞ্চে এক যামিনী।।

নায়কের উত্তমাদি ভেদ
উত্তম মধ্যম আর অধম নিয়মে। নায়িকার যে ক্রম নায়ক সে ক্রমে।।
বাসসজ্জা আদি নায়িকার ভেদ যত। নায়ক সে ভেদ হয় লক্ষণ সম্মত।।
উপপতি বৈশিকেতে সকলি বিদিত। পতি প্রতি রসাভাষ কেবল খণ্ডিত।।
স্বকীয়ার রসাভাষ জান অভিসার। পতির খণ্ডিত ভাব তেমতি প্রকার।।
সর্ব্বজন সুসম্মত আর ভাব সব। উদাহরণেতে দেখ কর অনুভব।।

বাসসজ্জা
শয়ন সময় : বন্ধু রসময় : করে রমণীর মোহন সাজ।
অন্য কার্য্য ছলে : শয্যাঘরে চলে : সাধিতে আপন গোপন কাজ।।
হাতে লয়ে যন্ত্র : গান কামতন্ত্র : মনে পেয়ে লাজ পায় এ লাজ।
ভাবে খাটে বসি : প্রাণের প্রেয়সী : আসিতে না জানি কতেক ব্যাজ।।

উৎকণ্ঠিত নায়ক
কেন না আইল প্রিয়া : বিরহে বিদরে হিয়া : স্থির হব কি করিয়া : ধৈর্য্য আর রহে না।
কিবা কোন কার্য্যপাকে : ভীতা কিবা দেখে তাকে : নহে এতক্ষণ থাকে : কামে সে কি দহে না।।
পান গুয়া গন্ধমালা : অগ্নিসম দেয় জ্বালা : করিলেক ঝালাপালা : তনু প্রাণ রহে না।
আসিবেক কতক্ষণে : তবে সুখ পাব মনে : বিনা তার দরশনে : আর তাপ সহে না।।

অভিসারক নায়ক
দ্বিতীয় প্রহর রাতে : মোরে কহিয়াছে যেতে : সময় হইল প্রায় স্থির মন টলিল।
সুখের কি জানে লেখা : গেলে মাত্র পাব দেখা : অনেক দিনের পর আজি আশা ফলিল।।
অন্ধকার দেখি আলো : গৌর লোক দেখি কালো : শত্রুজনে মিত্র ভাব জলে স্থল হইল।
রজনীতে দিবা মত : তিমির হইল হত : কুপথে সুপথ জ্ঞান তাহে মন লইল।।

বিপ্রলব্ধ নায়ক
সুখের সময় ঘরে : স্বীয়া নানা রস করে : তাহা ছাড়ি আইলাম পরআশা করিয়া।
গুরু ভয় লঘু করে : অন্ধকারে নাহি ডরে : ছাড়িয়া আপন বেশ পরবেশ ধরিয়া।।
সঙ্কেত স্মরণ করে : এসেছিল বেশ ধরে : আমার বিলম্ব বুঝি ঘরে গেল ফিরিয়া।
আসিয়া সঙ্কেত ঠাঁই : দেখিত পাইল নাই : আহা মরি অন্য কেবা লয়ে গেল হরিয়া।।

স্বাধীনভার্য্যা নায়ক
তুমি প্রাণ তুমি ধন : তুমি মন তুমি গণ : হৃদয়ে যে ক্ষণ থাক সেই ক্ষণ ভাল লো।
যত জন আর আছে : তুচ্ছ করি তোর কাছে : ত্রিভুবনে তুমি ভাল : আর সব কালো লো।।
তোমার বদনচাঁদ : অঞ্চলে চঞ্চল চাঁদ : আমার মোহন ফাঁদ অন্ধকারে আলো লো।
করেছি বিস্তর সেবা : আজি মোরে সাজাইবা : আমার মাথার কিরা : যদি মোরে টালো লো।।

খণ্ডিত নায়ক
আসিব বলিয়া গেলা : অন্য সঙ্গে হল মেলা : শরীরেতে চিহ্ন আছে লুকাবে কি বলিয়া।
মোর সঙ্গে কথা কয়ে : বঞ্চিলা অন্যেরে লয়ে : কতেক করিলা ভাব এ কান্তেরে ছলিয়া।।
ভিন্ন ভিন্ন দেখি বেশ : আলুথালু দেখি কেশ : দেখিয়া তোমার ভাব দেহ যায় জ্বলিয়া।
কে সাধিল মনোরথ : খণ্ডিয়া পীরিতি পথ : নিজ স্থানে যাও তুমি আমি যাই চলিয়া।।

কলহান্তরিত নায়ক
অল্প অপরাধ পেয়ে : কেন বা দিনু খেদায়ে : এবে কার মুখ চেয়ে কামজ্বালা সারিব।
বিবেচনা নাহি করি : এখন ঝুরিয়া মরি : অনুমানে হেন বুঝি রহিতে না পারিব।।
পুনঃ দূতী পাঠাইব : প্রীতি করি আনাইব : সবে এক দোষ তাহে পতি হয়ে হারিব।
হারি মানি দ্বন্দ্ব যাউক : তার অভিমান থাউক : তাহা বিনা এ সঙ্কটে তরিবারে নারিব।।

প্রোষিতভার্য্যা নায়ক
কোথায় রহিল বামা : বিরহে দহিয়া আমা : নিরন্তর কামজ্বালা কত আর সহিব।
পিক ডাকে কুহু কুহু : ভ্রমর গুঞ্জরে মুহু : সাপেখেকো বায়ুজ্বালা কত আর বাহিব।।
চন্দন কমলদল : পোড়া যেন দাবানল : সুধাকর বিষধর কত সয়ে রহিব।
আলো দেখি অন্ধকার : পুরস্কার তিরস্কার : হেন বুঝি অবশেষে উদাসীন হইব।।

প্রোষিতপত্নী নায়ক
যদি যাবে আমা ছেড়ে : প্রাণ কেন লও কেড়ে : আপন উদ্বেগ হেতু অগ্নি লয়ে যাবে লো।
তোমা সঙ্গে যাবে তাপ : আমি এড়াইব শাপ : খেতে শুতে অনুক্ষণ মনস্তাপ পাবে লো।।
প্রবোধ করিয়া তায় : ঠেকিবে দারুণ দায় : এমত হইবে ব্যক্ত সম্বিত হারাবে লো।
কয়ে দিনু শেষ মর্ম্ম : বুঝিয়া করহ কর্ম্ম : পদে পদে পাবে জ্বালা ক পদ এড়াবে লো।।

ইত্যাদি বুঝিয়া নায়কের অষ্টমত। উদাহরণেতে অনুভবে পাবে যত।।

 ০৪. নায়ক সহায়

পীঠমর্দ্দ বিট বলি চেটক বিদূষক। এই সব ভেদ হয় বিস্তর নায়ক।।

পীঠমর্দ্দ
রমণী করিলে ক্রোধ যে করে সান্ত্বনা। ধর্ম্মধী সচিব পীঠমর্দ্দ সেই জনা।।

রমণীরত্ন সহে না আঁচ : টুটয়ে অগ্নি পরশে কাঁচ : করিতে মান দিবে না স্থান দিবে না স্থান।
কি করে ক্ষোভ সহে আমার : অবলাজাতি মৃদু আকার : জ্বলয়ে বহ্নি নহে সে মান নহে সে মান।।
রস তাপে হিমে বিনাশ পায় : তপনে তাপ শুকায়ে যায় : রসিয়ে মান রবে কোথায় রবে কোথায়।
প্রমদা বন্ধন সংসারেরি : প্রমদা আকার আহ্লাদেরি : সতত রাখহ সুযত্নে তায় সুরত্ন প্রায়।।

বিট
কালশাস্ত্রে যেই জন পরমনিপূণ। বিট বলি তার নাম ধরে নানাগুণ।।

চুমু আলিঙ্গন : কামের দীপন : মন্ত্র তন্ত্র আদি যত।
যাহে নারী বশ : যাহে বাড়ে রস : এমত জানিবা কত।।
বেশভূষা বাস : সন্দেহ সম্ভাষ : নৃত্য গীত নানামত।
ফিরি নানা ঠাঁই : আর কর্ম্ম নাই : আমার এই সতত।।

চেটক
সন্ধান চতুর যেই সময় ঘটক। কবিগণ তার নাম বলয়ে চেটক।।

যখন বিরলে পাব : তখন নিকটে যাব : যদি ক্রোধে গালি দেয় তবু সহে রহিব।
নয়নের ভঙ্গি করি : ফল কিম্বা ফুল ধরি : চারি চক্ষে এক হলে ইসারায় কহিব।।
স্নানেতে যখন যায় : ধরিতে বসন তায় : কৌতুকে কুম্ভীর হয়ে জলে ডুবি রহিব।
দুঃখ বিনা নহে সুখ : দেখিতে সে চাঁদমুখ : গ্রীষ্ম হিম বৃষ্টি বাতে পরাঙ্মুখ নহিব।।

বিদূষক
কিবা রোষে কিবা তোষে যার পরিহাস। বিদূষক তার নাম হাস্যের বিলাস।।

চন্দন কজ্জল রাগ : বদনে যে দেখ রাগ : অপমান এই দেখ মুখে কালীচূণ লো।
দেখ দেখ শোভে কিবা : চাঁদে আলো হেন দিবা : দোহাই দোহাই তোর প্রাণ মোর যায় লো।।
করিয়া পরীক্ষা যদি : রসের তরঙ্গ নদী : দুই জনে ডুবি আইস কে হয় নিপুণ লো।
আপনি দোষের ঘর : পরীক্ষা করিতে ডর : আমার মাথায় দোষ এতো বড় গুণ লো।।

০৫. শৃঙ্গার নিরুপণ

আদ্যরসের দুই ভেদ শুনহ প্রয়োগ। প্রথমতঃ বিপ্রলম্ভ দ্বিতীয় সম্ভোগ।।

বিপ্রলম্ভ
বিপ্রলম্ভ চারিমত শুনহ প্রকাশ। পূর্ব্বরাগ মান প্রেম বৈচিত্ত্য প্রবাস।।

পূর্ব্বরাগ
অঙ্গসঙ্গ হওনের পূর্ব্ব যে লালস। তারে বলি পূর্ব্বরাগ তাহে দশ দশা।।
লালস উদ্বেগ জড় কৃশ জাগরণ। ব্যগ্র রোগা বায়ু মোহ নিদানে মরণ।।
প্রত্যেক বলিতে হয় কবিতা বিস্তর। অনুভবে বুঝে লবে নাগরীনাগর।।

মান
যেই ক্রোধে দম্পতির রসের বিচ্ছেস। সেই মান অহেতু সহেতু দুই ভেদ।।
অহেতু যে মান সেই অনায়াসে বধ্য। সহেতুর তিন ভেদ গুরু লঘু মধ্য।।
অন্যার সহিত পতি যদি কথা কয়। তাহে জন্মে লঘুমান বাক্যে দূর হয়।।
অন্য নামগুণ পতি যদি কানে লয়। তাহে জন্মে মধ্যমান পরীক্ষায় ক্ষয়।।
অন্য ভোগচিহ্ন যদি দেখে পতিগায়। তাহে জন্মে গুরুমান প্রমাণেতে যায়।।
সাম ভেদ ক্রিয়া দান নতি ত্যাগ রোষ। এই সাত মান ভাঙ্গে হয় পরিতোষ।।
প্রিয়বাক্যে স্তব করে তারে বলি সাম। আত্মগুণ তার দোষ ভেদ তার নাম।।
সখী দ্বারা ভয় প্রদর্শন সেই ক্রিয়া। দান যাহে বস্ত্র মাল্য ভূষণাদি দিয়া।।
নতি সেই যাহে পায় ধরে নমস্কার। ঔদাস্য প্রকাশ সেই ত্যাগ নাম যার।।
রোষ সেই যাহে ভয় কষ্টের বিস্তার। মান শান্তি চিহ্ন অশ্রু লোমাঞ্চ সীৎকার।।
অবশ্য এ সব রূপে মানের বিকাশ। অসাধ্য হইলে তারে বলি রসাভাস।।
প্রত্যেক বর্ণিতে হয় কবিতা বিস্তর। অনুভবে বুঝে লবে নাগরী নাগর।।

প্রেমবৈচিত্ত্য
নিকটে পরম অনুরাগের নিমিত্ত। ছলায় বিরহ হয় সে প্রেমবৈচিত্ত্য।।

প্রবাস
প্রবাস দ্বিমত হয় নিকট ও দূর। দশ দশা হয় তাহে বিষাদ প্রচুর।।
প্রথমেতে চিন্তা দ্বিতীয়েতে জাগরণ। তৃতীয়েতে উদ্বেগ চতুর্থে ক্ষীণতন।।
পঞ্চমে মিলন ষষ্ঠে প্রলাপ বিষাদ। সপ্তমেতে ব্যাধি হয় অষ্টমে উন্মাদ।।
নবমেতে মোহ হয় দশমে মরণ। অনুভবে বুঝে লবে দেখিয়া লক্ষণ।।

সহবাস
সহবাসে চারি ভেদ করিয়া বাখান। সংক্ষিপ্ত সঙ্কীর্ণ সম্পূর্ণ সমৃদ্ধিমান্।।
পূর্ব্বরাগ পরে অল্প প্রিয়সম্ভাষণ। সংক্ষিপ্ত তাহার নাম চিত্তবিনোদন।।
মানান্তে পতির সঙ্গে মিলন যে হয়। সঙ্কীর্ণ তাহার নাম কবিগণ কয়।।
কিঞ্চিৎ প্রবাস পরে হয় যে মিলন। সম্পূর্ণ তাহার নাম কহে কবিগণ।।
সুদূর প্রবাস পরে মিলন যে রস। সে রস সমৃদ্ধিমান্ দম্পতি অবশ।।

সহবাসের প্রকার
দর্শন স্পর্শন কথা পথরোষ বাস। বনখেলা জলখেলা গীতবাদ্য হাস।।
লুক্কাওন মধুপান আদি নানা মত। অনন্ত অনন্তভাব বিরচিব কত।।

দর্শন
দরশন তিনমত নাগরী নাগরে। সাক্ষাতে স্বপন আর পটে চিত্রধরে।।

সাক্ষাৎ দর্শন
নয়নে নয়ন : বদনে বদন : চরণে চরণ আদেশি রহ।
হৃদয়ে হৃদয় : প্রাণ সমুদয় : পরাণে আলয় ভাঙ্গিয়া লহ।।
গমনে গমন : রমণে রমণ : বচনে বচন বিনয় কহ।
পেয়েছি দরশ : পরম পরশ : সকলে সরস হইয়া রহ।।

স্বপ্ন দর্শন
নিদ্রার আবেশে : রজনীর শেষে : মনোহর বেশে : বঁধু আসিয়া।
প্রেমপারাবার : করিল বিস্তার : নাহি পাই পার : যাই ভাসিয়া।।
সে সরস হইল : মনেতে রহিল : সে কথা কহিল : মৃদু হাসিয়া।
ধরম করম : সরম ভরম : নরম মরম : গেল নাশিয়া।।

চিত্র দর্শন
দেখিবারে চিত্র : করিলাম চিত্র : এ বড় বিচিত্র : হইল তায়।
দেখিতে বদন : মাতিলেক মন : ছাড়িয়া সদন : চেনন যায়।।
না পানু দেখিতে : নারিনু রাখিতে : লিখিতে লিখিতে হইল দায়।
চিত্রের পুতুল : করিল আকুল : হারানু দুকূল : চিত্রের প্রায়।।

০৬. ভাব প্রকরণ

আলম্বনাদি কথন
আলম্বন বিভাবন আর উদ্দীপন। এই তিন ভাবের শুনহ বিবরণ।।
আলম্বন সেই যাহে রসের আশ্রয়। নায়ক নায়িকা দুই তার বিনিময়।।
নানাবিধ অনুভবে বলি বিভাবন। যাহে রস বাড়ে তাহে বলি উদ্দীপন।।

উদ্দীপন
গুণ স্মরা নাম লওয়া নিত্য রূপ দেখা। গীতবাদ্য শুনার আর কর্ম্ম রেখা লেখা।।
সুগন্ধি ভূষণ মেঘ পিকভৃঙ্গরব। চন্দ্র আদি নানামতে উদ্দীপন সব।।

বিভাবন
ভাব হাব হেলা হাস শোভা দীপ্তি কান্তি। মধুরতা উদারতা প্রগলভতা ক্লান্তি।।
ধৈর্য্য লীলা বিলাস বচ্ছিত্তি মৌগ্ধ্য ভ্রম। কিলকিঞ্চিৎ মোট্টায়িত মুট্ট মত শ্রম।।
বির্ব্বোক লালিত্য মন চকিত বিকার। নানামত অনুভব কত কব আর।।

ভাবহাবাদি পরিচয়
চিত্তের প্রথম সেই বিকার যে ভাব। গলা চক্ষু ভুরু আদি বিকাশেতে হাব।।
বক্ষ কাঁপে বস্ত্র খসে তারে বলি হেলা। প্রিয় কৃতকর্ম্ম চেষ্টা তারে বলি লীলা।।
হাসে সেই হাস্যে বলি বৃথা হয় যেই। পরিচ্ছদ বনা শোভা মধুরতা সেই।।
শোভা কান্তি দীপ্তি ভ্রম ব্যাপ্ত আছে এই। শ্রম অঙ্গ শ্লথ যেই ক্লান্তি হয় সেই।।
কার্য্য বিপরীত আদি সেই প্রগল্‌ভতা। ক্রোধেও বিনয় বাক্য সেই উদারতা।।
ধৈর্য্য সেই দুঃখেতে প্রেমের নহে হ্রাস। সাক্ষাতে প্রফুল্ল অঙ্গ সেই সে বিশ্বাস।।
অল্প আভরণে শোভা বিচ্চিত্তি সে হয়। বিভ্রম হইলে ব্যক্ত বেশবিপর্য্যয়।।
ক্রন্দনেতে হাস্য আর অভয়েতে ভয়। আক্রোধেতে ক্রোধ কিলকিঞ্চিৎ সে হয়।।
প্রসঙ্গেতে অঙ্গভঙ্গ সেই মোট্টায়িত। অঙ্গ ছুলে মুখে ক্রোধ সেই কুট্টমিত।।
বির্ব্বোক বাঞ্ছিত বস্তু পেয়ে অনাদর। অঙ্গভঙ্গ ঝনৎকার লালিত্যে সুন্দর।।
লজ্জায় না কহি কার্য্য চেষ্টায় জানায়। বিকার তাহারে বলে বুঝ অভিপ্রায়।।
জ্ঞাতকে অজ্ঞান সম মৌগ্ধ্য সেই হয়। চকিত ভ্রমর আদি দর্শনেতে ভয়।।
যৌবনাদি অভিমান জন্য মদ হয়। মনস্তাপ আদি যত কবিগণ কয়।।
কেশ বাস খসে অঙ্গমোড়া হাই উঠে। লোমাঞ্চ প্রফুল্ল গদ্‌গদি ঘর্ম্ম ছুটে।।

সাত্ত্বিক ভাব
স্তম্ভ হয় ধর্ম্ম বয় লোমাঞ্চ প্রকাশ। বিবর্ণ কম্পন অশ্রু গদ্‌গদ ত্রাস।।
প্রিয় বিনা সুখ যত দুঃখ সে তো হয়। প্রিয় পাইলে দুঃখে সুখ রাগ তারে কয়।।

০৭. বয়োবিভাগ

যৌবন কথন
যৌবনের চারি ভেদ শুন বিবরণ। আগে বয়ঃসন্ধি পরে নবীন যৌব।।
তারপরে যুবা ভাবে উন্মাদ লক্ষণ। তার পরে বৃদ্ধভাব বুঝ বিচক্ষণ।।
যৌবনের সন্ধিকাল দ্বাদশ বৎসর। দশম নিয়ম কন ব্যাস মুনিবর।।

যৌবন পরম ধন : স্ববশ ইন্দ্রিয়গণ : শিশু বৃদ্ধ দেখি লোক রসকথা কহে না।
বালকের নাহি শুদ্ধি : বৃদ্ধ হলে হতবুদ্ধি : যুবা বিনা রস আর : কোনখানে রহে না।।
যুবা সূর্য্য বলমান্ : যুবা চন্দ্র দ্যূতিমান : যুবা বিনা সংসারের ভার অন্যে বহে না।
বিনা নর কিবা অন্য : যৌবন সকল ধন্য : যৌবন হইলে নষ্ট দেখি দেহ রহে না।।

নারীর যৌবন বড় দুরন্ত। শরীর মাঝে পোষে বসন্ত।।
বিনোদ বিননে বিনায়ে বেণী। পুরুষে দংশিতে পোষে সাপিনী।।
কত কত অলি নয়নে ঘোরে। মধুবাক্যে কত কোকিল ঝোরে।।
মলয় বাতাস শ্বাসেতে বহে। সৌরভে সুরভি গৌরব নহে।।
কমলকানন আননে থাকে। বান্ধুলী মধুর অধর রাখে।।
দুখানি বিষাণ নিশান রাগি। হৃদয়ে মলয় রেখেছে ঢাকি।।
লোহিত কমলে মৃণাল সাতে। আভরণে ঢাকি রেখেছে হাতে।।
ত্রিবলীডোরেতে বান্ধি অনঙ্গ। কটিতটে থুয়ে দেখয়ে রঙ্গ।।

সম্বরে অম্বর দিয়া কান্তার। মদন সদন রসভাণ্ডার।।
কিশলয় করিকরের ভয়ে। চরণের তলে শরণ হয়।।
যৌবনমরম জানে না যেবা। পণ্ডিত তাহারে বলয়ে কেবা।।
জপ তপ জ্ঞান দান যে কিছু। সকলি যৌবনধনের পিছু।।
যৌবন এ তিন অক্ষর লেখ। যে জন সরম উত্তম দেখ।।
যৌবনমরম যে জনে নাই। প্রথম ছাড়িয়া তাহার ঠাঁই।।
যদ্যপি যৌবনে উদ্যম করে। প্রথমের মতো গলিয়া মরে।।
ভারতচন্দ্রের ভারতী যোগ। যৌবনেতে কর যৌবন ভোগ।।

 ০৮. জাতিকথন

স্ত্রীজাতি কথন
অতঃপর চারি জাতি বর্ণিব কামিনী। পদ্মিনী চিত্রিণী আর শঙ্খিনী হস্তিনী।।

পদ্মিনী
নয়নকমল : কুঞ্চিত কুন্তল : ঘন কুচস্থল মৃদু হাসিনী।
ক্ষুদ্র রন্ধ্রনাসা : মৃদু মন্দ ভাষা : নৃত্য গীতে আশা সত্যবাদিনী।।
দেবদ্বিজে ভক্তি : পতি অনুরক্তি : অল্প রতিভক্তি নিদ্রাভোগিনী।
সুললিত কায় : লোম নাহি হয় : পদ্মগন্ধ কয় সেই পদ্মিনী।।

চিত্রিণী
প্রমাণ শরীর : সর্ব্বকর্ম্মে স্থির : নাভি সুগভীর মৃদুহাসিনী।
সুকঠিন স্তন : চিকুর চিকণ : শয়ন ভোজন মধ্যচারিনী।।
তিন রেখাযুত : কণ্ঠ বিভূষিত : হাস্য অবিরত মন্দগামিনী।
কমনীয় কায় : অল্প লোম হয় : ক্ষারগন্ধ কয় সেই চিত্রিণী।।

শঙ্খিনী
দীঘল শ্রবণ : দীঘল নয়ন : দীঘল চরণ দীঘল পাণি।
সুদীঘল কায় : অল্প লোম হয় : মীনগন্ধ কয় শঙ্খিনী জানি।।

হস্তিনী
স্থূল কলেবর : স্থূল পয়োধর : স্থূল পদকর ঘোরনাদিনী।
আহার বিস্তর : নিদ্রা ঘোরতর : বিহারে প্রখর পরগামিনী।।
ধর্ম্ম নাহি ডর : দন্ত ঘোরতর : কর্ম্মেতে তৎপর মিথ্যাবাদিনী।
সুপ্রশস্ত কায় : বহু লোম হয় : মদ গন্ধ কয় সেই হস্তিনী।।

পুরুষ কথন
চারি জাতি নায়িকার শুনহ নায়ক। শশ মৃগ বৃষ অশ্ব সন্তোষদায়ক।।
পদ্মিনীর শশ পতি মৃগ চিত্রিণীর। বৃষে শঙ্খিনীর তুষ্টি অশ্বে হস্তিনীর।।
রূপ গুণ দোষ সব নায়িকার মতো। চারি জাতি নায়কের লক্ষণ সম্মত।।
রসভাণ্ড মত রসদণ্ড ভেদ হয়। ছয় আট দশ বার পরিমাণ কয়।।
নরনারী স্বভাবেতে বিশেষ যে হয়। কহিতে কবিতা বাড়ে ক্ষোভ এই হয়।।

Exit mobile version