Site icon BnBoi.Com

চারের অঙ্ক – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

চারের অঙ্ক - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. বছর দশ-বারো আগেকার কথা

০১.

বছর দশ-বারো আগেকার কথা।

তখন ভোরবেলা সংবাদপত্রের পাতা খুললেই প্রথম পৃষ্ঠাতে শহরের এখানে-ওখানে নিত্য আট-দশটা খুনখারাপির কথা দেখা যেত না।

এ অশাস্তি আর অস্থিরতা ছিল না এ শহরের জনজীবনে। এত আতঙ্ক আর খুনোখুনি রক্তপাতও ছিল না।

সেই সময়ই দুমাসের মধ্যে পর পর দুটি খুনের সংবাদ সংবাপত্রে প্রকাশিত হল। নিহত ব্যক্তিরা শহরের গণ্যমান্য কোন বিশেষ পরিচিত ব্যক্তি না হলেও, প্রত্যেকেই তারা যাকে বলে ধনী এবং নামী জুয়েলার্স। এবং জুয়েলারির ব্যবসা ছাড়াও কলকাতা শহরে তাদের গাড়ি বাড়ি ও প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স প্রত্যেকেরই ছিল। এবং তাদের হত্যার ব্যাপারে বিশেষ যে ব্যাপারটা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেটা হচ্ছে প্রত্যেকেরই গলায় একটা নীল রেশমী রুমাল জড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগ নানাভাবে অনুসন্ধান করেও তিন-তিনটে নিষ্ঠুর হত্যাব্যাপারের কোন হদিসই করতে পারেনি।

শীতের এক সকালে কিরীটী তার বসবার ঘরে বসে গায়ে একটা শাল জড়িয়ে আরাম করে চা-পান করছে, এমন সময় জংলী ওইদিনকার সংবাদপত্রটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

কৃষ্ণা পাশেই বসেছিল। সে-ই প্রথমে জংলীর হাত থেকে সংবাদপত্রটা নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাটা খুলে তার ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে বলে উঠল, দেখেছ, আবার সেই নীল রুমাল! আবার একজন জুয়েলার!

কিরীটী মুখ তুলে কষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললে, মানে?

আবার আর একজন জুয়েলারকে গলায় নীল রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণা বলল।

তাই নাকি! কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা ব্যগ্রতার সুর।

হ্যাঁ। ভদ্রলোকের নাম শশধর সরকার। বৌবাজারে মস্ত বড় জুয়েলারি শপ সরকার জুয়েলার্স-এর প্রোপ্রাইটার ছিলেন।

দেখি! কিরীটী হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল।

প্রথম পৃষ্ঠাতেই সংবাদটা প্রকাশিত হয়েছে।

আবার সেই নীল রুমাল! আবার একজন জুয়েলার! এই নিয়ে হল তিনজন।

এবারে নিহত হয়েছেন বিখ্যাত জুয়েলারি শপ সরকার জুয়েলার্স-এর প্রোপাইটার শশধর সরকার। ভদ্রলোকের বয়স বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ হবে। তার দোকানের মধ্যেই তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিস-তদন্তে প্রকাশ, শনিবার বেলা আড়াইটে নাগাদ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দোকান বন্ধ করে সকলের সঙ্গে শশধর সরকার বের হয়ে যান। রাত্রি আটটা পর্যন্ত তিনি বালিগঞ্জে যতীন দাস রোডে তার বাড়িতেই ছিলেন। রাত আটটা নাগাদ একটা ফোন-কল পেয়ে তিনি বের হয়ে যান। বাড়ির কেউ বলতে পারেনি কোথা থেকে ফোন-কলটা এসেছিল এবং কে করেছিল বা কোথায় তিনি গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে কেবল বেরুবার সময় বলে যান একটা বিশেষ কাজে বেরুচ্ছেন, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই ফিরে আসবেন। কিন্তু রাত বারোটা বেজে গেল—যখন তিনি ফিরলেন না, তখন শশধর সরকারের স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। চারদিকে জানাশোনা জায়গায় ফোন করতে থাকেন, কিন্তু কেউ তার কোন সংবাদ দিতে পারে না। একসময় রাত শেষ হয়ে গেল, কিন্তু শশধর সরকার ফিরলেন না। পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ দোকান থেকে ফোন এল।

দোকানের একজন কর্মচারী—বিনয়ভূষণ ফোন করে। রবিবার দোকান বন্ধ, সে বাসায়ই ছিল। বৌবাজার অঞ্চলেই তার বাসা। একটি ছোকরা এসে তার বাসায় তাকে কথাটা জানায়। ছেলেটি ওই পাড়ারই, বিনয়ভূষণকে চিনত।

বিনয়বাবু, শীগগিরই একবার দোকানে যান!

দোকানে! আজ তো রবিবার, দোকান বন্ধ!

তা তো জানি। ছোকরাটি বলে, দেখলাম আপনাদের দোকানের কোলাপসিবল গেটটা খোলা!

খোলা? সে কি?

হ্যাঁ। ব্যাপার কি দেখবার জন্য ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, দোকানের ভেতর সব আলো জ্বলছে, আর

কি?

কে একটা লোক মেঝেতে পড়ে আছে। আমি ছুটতে ছুটতে এসেছি আপনাকে খরবটা দিতে।

বলাই বাহুল্য, অতঃপর বিনয়ভূষণ উঠি-কি-পড়ি করে সঙ্গে সঙ্গে দোকানে ছুটে যায় এবং দেখে ছোকরাটির দেওয়া সংবাদ সত্য। শুধু তাই নয়, মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়—তাদের মালিক শশধর সরকার। তার গলায় একটা নীল রুমাল বাঁধা। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসছে। প্রথমটায় ওই বীভৎস দৃশ্য দেখে বিনয়ভূষণ আতঙ্কে যেন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে সে-ই পুলিশে ফোন করে সংবাদটা দেয়।

পুলিশ আসে। ঘরের মধ্যে শো-কেসগুলো যেমন ছিল তেমনিই আছে। প্রত্যেক শো-কেসে নানা ধরনের অলঙ্কার সাজানো যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে। কোনটার তালা বা চাবি ভাঙা হয়নি। এমন কি দোকানের চাবির গোছাটা শশধর সরকারের জামার পকেটেই পাওয়া গেছে। দোকানের যে দারোয়ান হনুমানপ্রসাদ দোকানের প্রহরায় থাকত রাত্রে, তাকে দোকানের পেছনদিককার একটা ঘরে খাটিয়ার ওপর নিদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়। বেলা দশটার সময়ও সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে তার। ঘুম ভাঙানো হয়, কিন্তু সে কোন কিছুই জানে না। সন্ধ্যার দিকে তার এক দেশওয়ালী পরিচিত ব্যক্তি এসেছিল, দুজনে মিলে লোটা-দুই সিদ্ধির শরবৎ খেয়েছিল। তারপর তার সেই লোকটা চলে যায়, আর হনুমানপ্রসাদ খাটিয়ায় শুয়ে নিদ যায়। সে কিছু জানে না-রামজীর কসম। দোকানের অন্যান্য কর্মচারীদের শুধিয়ে ও খাতাপত্র দেখে যতদূর জানা গেছে, দোকান থেকে কোন অলঙ্কারাদি বা সিন্দুকের টাকাকড়ি কিছুই চুরি যায়নি। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা শুধু হত্যাই—স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই হত্যা করা হয়েছে, কোন চুরিচামারির ব্যাপার নেই এই হত্যার সঙ্গে।

কৃষ্ণা বললে, পড়লে?

কিরীটী বললে মৃদু কণ্ঠে, হুঁ।

মনে হল কিরীটী যেন কি ভাবছে।

সত্যিই কিরীটী ভাবছিল। হঠাৎ কাগজটা রেখে কিরীটী উঠে সোজা গিয়ে ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে লাগল বৌবাজার থানায়।

থানা-অফিসার বিকাশ সেন তার পরিচিত।

বিকাশ থানাতেই ছিল, সে-ই ফোন ধরে অপর প্রান্তে। ও. সি. বৌবাজার থানা স্পিকিং–

কে, বিকাশ? আমি কিরীটী।

আরে, মিস্টার রায়! কি খবর? হঠাৎ?

কাগজে দেখলাম, তোমার এলাকায় কে একজন শশধর সরকার পরশু রাত্রে খুন হয়েছে!

হ্যাঁ, আবার সেই নীল রুমাল মিস্টার রায়—

জানি। তা কোনকিছুর কিনারা করতে পারলে বা হদিস করতে পারলে?

না। তবে—

কি?

তার গলায় পেঁচানো ছিল যে নীল রুমালটা, যার সাহায্যে বেচারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, সেই রুমালটা পরীক্ষা করতে করতে একটা জিনিস নজরে পড়েছে, জানেন মিস্টার রায়?

কি বল তো?

ছোট্ট করে লাল সুতোয় লেখা একটা সাঙ্কেতিক ইংরাজি অক্ষর ‘3’ অর্থাৎ তিন।

আমিও ঠিক ওই কথাটাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম বিকাশ। যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।

মানে?

টেলিফোনে সব কথা হতে পারে না। তোমার হাতে যদি সময় থাকে তো চলে এস একবার আমার বাড়ি।

যাবার কথা যখন আপনি বলছেন, তখন হাতে হাজার কাজ এবং সময় না থাকলেও যেতে হবে। আমি এখুনি আসছি। বলে বিকাশ টেলিফোনটা রেখে দিল অপর প্রান্তে।

কিরীটীও রিসিভারটা নামিয়ে রেখে পুনরায় সোফায় এসে বসল।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? কাকে আসবার জন্য জরুরী তাগিদ দিলে গো ফোনে?

বৌবাজার থানার ও. সি. আমাদের বিকাশ সেনকে।

আমাদের বিকাশবাবু!

হ্যাঁ। ও হয়ত এখুনি এসে পড়বে। তুমি বরং কিছু ভালমত জলখাবারের ব্যবস্থা কর কৃষ্ণা। জান তো, বিকাশ সেন কিরকম পেটুক মানুষ!

কৃষ্ণা হেসে বলে, জানি, সে ব্যবস্থা হবেখন। কিন্তু ব্যাপারটা কি বল তো? হঠাৎ এত জোর তলব কেন ভদ্রলোকটিকে?

আজকের সংবাদপত্রে দ্বিতীয় পৃষ্ঠার অ্যাডভার্টাইজমেন্ট—বিজ্ঞাপনের পাতাটা দেখ। একটা বিজ্ঞাপন আছে নিশ্চয়ই, যদি আমার অনুমান মিথ্যা না হয় তো!

বিজ্ঞাপন? কীসের বিজ্ঞাপন? কৃষ্ণা যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই শুধায়।

বেদ পাঠের। কিরীটী মৃদু হেসে বলল।

মানে?

আহা, দেখই না আগে বিজ্ঞাপনটা আছে কিনা!

কৃষ্ণা বিনা বাক্যবায়ে অতঃপর সংবাদপত্রটা তুলে নিয়ে দ্বিতীয় পৃষ্ঠাটা খুলে চোখ বুলোতে শুরু করে।—এ তো দেখছি বিবাহ, হারানো প্রাপ্তি ও নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনেই পাতা ভর্তি! দেখতে দেখতে বলে কৃষ্ণা।

তোমার চোখে দেখছি চালসে পড়েছে কৃষ্ণা! ডাঃ জিতেন চক্রবর্তীর কাছে একদিন তোমাকে না নিয়ে গেলে চলছে না! কাগজটা দাও, দেখাচ্ছি। আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো-নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপনটা আছে আজকের কাগজেও।

কৃষ্ণার হাত থেকে কিরীটী হাত বাড়িয়ে কাগজটা টেনে নিল।

কয়েক মুহূর্ত চোখ বুলিয়েই কিরীটী বলে উঠল, বলছিলাম না—নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপনটা বের হয়েছে, এই দেখ—

দেখ! বলে কৃষ্ণা কাগজটার ওপরে ঝুঁকে পড়ল।

পৃষ্ঠার মাঝামাঝি কলমে সত্যিই একটা বক্স-করা বিচিত্র বিজ্ঞাপনের প্রতি কিরীটী অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, পড়।

কৃষ্ণা ঝুঁকে পড়ল।

একটা বাক্স-করা বিজ্ঞাপন পাইকা টাইপে ছাপা হয়েছে ছোট কবিতার মত।

এ যে দেখছি একটা কবিতা!

আহা, পড়ই না।

একে চন্দ্র অস্তমিত
দুইয়ে পক্ষ কর্তিত
তিনে নেত্র উৎপাটিত
চারে বেদ পঠন-পাঠন
যা হলেই সমাধান।
নতুন কিতাবে নতুন ছড়া
শীঘ্রই প্রকাশ হচ্ছে—

কৃষ্ণা বার-দুই পড়ল বিচিত্র বিজ্ঞাপনটা। তারপর বললে, নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপন মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ। কিরীটী মৃদু হেসে বলে, নতুন এক কিতাবই বটে! রক্তের হরফে লেখা হচ্ছে। শেষ পরিচ্ছদটি কেবল এখন বাকি। সেটি লেখা হলেই অর্থাৎ সমাপ্ত হলেই পুস্তকটি শেষ!

কৃষ্ণা বুঝতে পারে বিজ্ঞাপনের মর্মার্থটা সে ঠিক উদ্ধার করতে পারেনি। তাই বলে, মনে হচ্ছে ওই বিজ্ঞাপনের মধ্যে কোন রহস্যের গন্ধ তুমি পেয়েছ!

রহস্য বলে রহস্য—মারাত্মক রহস্য! তবে বেচারী এখনও বুঝতে পারেনি—

কি?

অতি দম্ভে যেমন লক্ষাধিপতি হত হয়েছিল, তেমনি তারও মৃত্যুবাণ তার অতি দম্ভের ছিদ্রপথে বের হয়ে এসেছে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, কিছুদিন ধরেই ওই বিজ্ঞাপনটা বেরোচ্ছিল, তবে শেষ দুটি লাইন আজই যোগ করা হয়েছে এবং সমাপ্তির রেখা টানার ইঙ্গিতটি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

কার কথা বলছ?

মেঘের আড়ালে থেকে যিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেই মেঘনাদের কথা!

ঠিক আছে, তুমি হেঁয়ালিই গাও, আমি চললাম। কৃষ্ণা রাগতভাবে উঠ দাঁড়ায়।

আরে বসো বসো, চটছ কেন?

না, যাই-বিকাশবাবুর খাবারের ব্যবস্থা করি গে।

সে হবে’খন। বসো না।

কৃষ্ণা আবার সোফায় বসে পড়ে।

কিরীটী বলে, সংবাদপত্রে তোমার নজর পড়েছে কিনা জানি না, গত দুমাসে আরও দুজন জুয়েলার এই শহরে খুন হয়েছে–

সে তো হচ্ছেই কত!

তা হচ্ছে, তবে ওই পূর্বের দুটি খুন ও গতকালের খুনের মধ্যে দুটো বিশেষত্ব আছে এবং বিশেষত্ব একটা অঙ্কের মত–

কি রকম?

এক নম্বর হচ্ছে, যে দুজন গত দুমাসে নিহত হয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই ধনী ব্যক্তি শহরের মধ্যে এবং প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী; শুধু ব্যবসায়ীই নয়, সোনা-রুপার ব্যবসায়ী, অর্থাৎ জুয়েলার্স ছিল। দু নম্বর, একটু থেমে মৃদু হেসে বলে, দু নম্বর—বল তো কি? স্মিত হাস্যে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল কিরীটী।

প্রত্যেককেই গলায় একটা করে নীল রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, তাই তো?

চমৎকার। আর কিছু? কিরীটী সহাস্যে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তখনও।

আর!

হ্যাঁ, আর–, কিরীটীর কথা শেষ হল না, বাইরে গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল ওই সময়। কিরীটী বললে, ওই বোধ হয় আমাদের সেন সাহেব এল!

বাইরের কলিংবেল বেজে উঠল ওই সঙ্গে। শোনা গেল তার শব্দ।

জংলী! কিরীটী ডাকে।

বলুন। জংলী সাড়া দিল।

দরজাটা খুলে দাও, বোধ হয় বিকাশবাবু এলেন।

০২. চা-জলখাবার নিয়ে আসি

যাই, চা-জলখাবার নিয়ে আসি।

কৃষ্ণা সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়, একটু পরেই সিঁড়িতে একটা ভারী জুতোর মচমচ শব্দ শোনা গেল।

মোটা মানুষ বিকাশ সেন, বৌবাজার থানার ও. সি.সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল।

এস বিকাশ!

বিকাশ ধপ করে একটা সোফার উপরে বসতে বসতে বললে, বাপস! বলুনএবারে রায় সাহেব, ঊর্ধ্বশ্বাসে একেবারে ছুটে আসছি জীপ নিয়ে!

কিরীটী হাসল।

হাসছেন আপনি! আর এদিকে—

দেহের ওজনটা একটু কমাতে পার না? তাহলে আর হাঁপাতে হয় না!

আপনিও ওই কথা বলবেন রায় সাহেব! ঘরে-বাইরে যদি ওই একই কথা শুনতে হয়—

কেন হে, ঘরে আবার তাগিদ দিচ্ছে কে?

কে আবার! সখেদে বলল বিকাশ, তাগিদ দেবার যার ক্ষমতা বা অধিকার আছে।

বল কি, ভদ্রমহিলাও তোমার পেছনে লেগেছেন?

অথচ জানেন, গত আট মাসে আমার বিশ সের ওয়েট কমে গেছে! এভাবে ওয়েট কমতে থাকলে

তাই নাকি? তা আট মাস পূর্বে কত ছিল—কত?

আড়াই মণও নয়—ছ’মাসের কম।

কিরীটী গম্ভীর হবার চেষ্টা করে কোনমতে হাসি চেপে বলে, তাহলে তো সত্যিই যথেষ্ট কমে গেছে!

বলুন তাহলে—আরও কমলে হাঁপ ধরবে না? স্রেফ ব্যাঙাচিতে—

নির্ঘাত পরিণত হবে।

আমার পরিবারটিকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন, মোটা না হয় একটু আমি সামান্যই, তাহলেও আমার মত অ্যাকটিভ অফিসার কজন আছে উপরিওয়ালারা, বলুন তো!

তা কথাটা মিথ্যা নয়, মোটাসোটা হলে কি হবে, বিকাশ সেন সত্যিই খুব কর্মঠ অফিসার, সরকারী মহলে যথেষ্ট নামও আছে, কিরীটীর সেটা অজানা নয়।

যাগগে ওসব কথা, বলুন এখন-হঠাৎ আসতে বললেন কেন ফোন করে—

বসো বসো, আগে চা-জলখাবার খেয়ে সুস্থ হও।

কৃষ্ণা ওই সময় একপ্লেট সন্দেশ ও চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

কেমন আছেন বিকাশবাবু? কৃষ্ণা প্রশ্ন করে।

নমস্কার বৌদি। ভাল, চমৎকার। কেবল চারদিকে বদমাশ শয়তানগুলো জ্বালাতন করে মারছে। এই দেখুন না, গত পরশু একজন আবার নীল রুমালের ফাসে খতম হয়েছেন—আর হবি তো হ আমারই চৌহদ্দির মধ্যে।

ভাল কথা বিকাশ, সেই নীল রুমালটা এনেছ? কিরীটী প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, এই যে—বলতে বলতে পকেট থেকে ছোট একটা কাগজের প্যাকেট বের করল বিকাশ সেন।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। নাও শুরু কর বিকাশ।

বিকাশকে বলবার আগেই সে প্লেটটা টেনে নিয়েছিল।

কিরীটী কাগজের মোড়কটা খুলতেই একটা দামী বিলাতী সেন্টের গন্ধের ঝাপটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের নাকে এসে লাগল। নীল রঙের—আকাশ-নীল রঙের একটা বড় সাইজের রেশমী রুমাল।

কিরীটী রুমালটা মেলে ধরে দেখতে দেখতে বললে, হুঁ, হত্যাকারী মহাশয় দেখছি। রীতিমত সৌখীন ব্যক্তি! বন্দুক, রিভলবার, ছোরাছুরি নয়—একেবারে একটি সেন্টনিষিক্ত আকাশ-নীল রঙের রেশমী রুমালকেই হাতিয়ার করেছেন! জেনুইনিটি আছে বলতে হবে, কি বল বিকাশ?

একটা বড় আমসন্দেশ গালে পুরে চিবুতে চিবুতে বিকাশ বললে, তা যা বলেছেন। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, যে রেটে এ শহরে নীল রুমালের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করছে, শেষ পর্যন্ত না আমাদের পুলিশ মহলের কণ্ঠদেশেই তা চেপে বসে!

কিরীটী হো-হো করে হেসে ওঠে বিকাশের কথায়।

বিকাশ আর একটা সন্দেশ মুখে পুরতে পুরতে বলে, অতি উপাদেয়, কোথাকার সন্দেশ বৌদি? কোন্ দোকানের?

কৃষ্ণা জবাব দেয়,–দোকানের নয়।

তবে?

আমার হাতে তৈরি।

আঃ! কি ইচ্ছা করছে জানেন বৌদি?

কি? সহাস্য মুখে তাকাল কৃষ্ণা বিকাশ সেনের দিকে।

হাত দুটো আপনার সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিই।

কিরীটী আর কৃষ্ণা দুজনেই হাসে।

সন্দেশের রেকাবিটা নিঃশেষ করে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিতে নিতে বিকাশ বললে, কি কিরীটীবাবু, রুমালটা থেকে কিছু হদিস পেলেন?

আপাতত যা মনে হচ্ছে, তা হচ্ছে রুমালের সাধারণত যা সাইজ হয়ে থাকে তার থেকে কিছু বড়। সাধারণ সিল্কের রুমাল আর এক কোণে রুমালটার সাঙ্কেতিক ইংরাজী অক্ষর 3 লেখা ছাড়া বিশেষ কোন হদিস মিলছে না, তবে–

তবে?

ওই 3 সাঙ্কেতিক অক্ষরটিকে যদি বিশেষ একটা ইঙ্গিত বলে ধরে নেওয়া যায় তো বলতে হবে

বিকাশ সাগ্রহে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল, কি মিস্টার রায়?

পরশুর হত্যাটি নিয়ে যে তিনটি হত্যাকাণ্ড এই দু মাসে এই শহরে সংঘটিত হয়েছে। এই ধরনেরই নীল রুমালের সাহায্যে, সেগুলির মধ্যে অর্থাৎ সেই হত্যাকাণ্ডগুলির মধ্যে একটা বিশেষ যোগাযোগ বা যোগসূত্র হয়ত আছে।

ঠিক। আমারও তাই মনে হয়েছিল। একই ব্যক্তির দ্বারা সব কটি হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছে মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ।

অর্থাৎ হত্যাকারী একই ব্যক্তি, এই তো বলতে চান আপনি? বিকাশ বললে।

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, মনে হচ্ছে তো সেই রকমই।

কিন্তু একটা কথা–, বিকাশ বলে।

কি বল তো? কিরীটী বিকাশের মুখের দিকে তাকাল।

ওটা যদি ইংরাজি ‘3’ না হয়ে বাংলার ‘ও’ হয়।

না।

কি না?

ওটা ইংরাজির 3 ই।

কি করে স্থিরনিশ্চয় হলেন?

একটা বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিনা জানি না। বিকাশ–

বিজ্ঞাপন।

হ্যাঁ, বিজ্ঞাপনটা কিছুদিন থেকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে—

কি বিজ্ঞাপন বলুন তো?

কিরীটী তখন দৈনিক প্রত্যহে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন—যেটা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং যে বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুক্ষণ পূর্বে তার কৃষ্ণার সঙ্গে আলোচনা চলছিল সেটা সম্পর্কে বললে।

সত্যি? দেখি বিজ্ঞাপনটা।

কিরীটী কাগজটা এগিয়ে দিল।

বিকাশ বিজ্ঞাপনটা বারকয়েক পড়ল। তারপর বললে, হুঁ। বিজ্ঞাপনটা সত্যিই বিচিত্র তো! তাহলে–

ঠিক তাই বিকাশ, পর পর তিনটি হত্যাকাণ্ডই বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা যদি সংঘটিত হয়েও থাকে, তাহলেও pre-planned premeditated, পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে হয়–

তা তো বুঝলাম, কিন্তু—

কি বল?

উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই আছে!

তা আছে বৈকি। হত্যাকারী কিছুটা maniac হলেও, হত্যাগুলোর পেছনে তার একটা উদ্দেশ্য সুনিশ্চিত আছে। হয়ত প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ—কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পূর্বে তোমাকে কতকগুলো ব্যাপারে ভাল করে অনুসন্ধান নিতে হবে।

কিন্তু কি অনুসন্ধান করি বলুন তো? ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে আর কেউ ছিল বলেই তো এখনও জানা যায়নি। পেছনের গ্যারাজে যে ব্যাটা দারোয়ান ছিল, সে ব্যাটা তো সিদ্ধির নেশায় সে রাত্রে ঝুঁদ হয়েছিল।

আচ্ছা সংবাদপত্রে যে নিউজ বের হয়েছে–সেদিন রাত আটটা নাগাদ কার কাছ থেকে একটা ফোন-কল পেয়ে শশধর সরকার বার হয়ে যান বাড়ি থেকে–

হ্যাঁ, তার স্ত্রী তো বলতে পারলেন না, ফোন-কলটা কোথা থেকে এসেছিল! কেবল বললেন, তাঁর স্বামী নাকি তাকে বলেছিলেন ফোন-কলটা জরুরী।

জরুরী তো বটেই—একেবারে মৃত্যু-পরোয়ানা। তাই বলছিলাম, সেটার কোন ট্রেস করা যায় কিনা দেখ।

কেমন করে সম্ভব তা? অটোমেটিক ফোন–

তবু দেখ, চেষ্টা করলে হয়ত জানতেও পার। তারপর ওই বিনয়ভূষণ—

সেখানেও একটা ধোঁয়া।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। ওই বিনয়ভূষণকে শশধরবাবুর স্ত্রী জানতেন না। তবে একটা সংবাদ পেয়েছি, দিন পনেরো আগে দোকানের চাকরি থেকে নাকিবিনয়কে বরখাস্ত করেছিলেন শশধর সরকার।

কি করে জানলে?

দোকানের একজন কর্মচারী যতীন সমাদ্দারই বললে এনকোয়ারির সময়। যে ফোন করেছিল শশধরের স্ত্রী সুনয়না দেবীকে সে বিনয়ভূষণের নাম করে ওই সব বলে। তাছাড়া আরও একটা কথা আছে, সে-রাত্রে তো নাকি বিনয়ভূষণ কলকাতাতেই ছিল না।

তবে কোথায় ছিল?

অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, বিকাশ বললে, বিনয়ভূষণ দিন দশেক আগে। থাকতেই তার বৌবাজারের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে শ্রীরামপুর চলে গিয়েছিল সেখানে একটা দোকানে চাকরি পেয়ে। সে-রাত্রে শ্রীরামপুরেই ছিল। ওই দিন সকালে কলকাতায় আসে কি একটা কাজে।

কিরীটী বললে, তা বিনয়ভূষণের চাকরি গিয়েছিল কেন, জানতে পেরেছ কিছু?

হ্যাঁ, চুরির ব্যাপারে—

চুরি?

হ্যাঁ। কিছু দামী জুয়েল্স্ চুরির ব্যাপারের সন্দেহে তার চাকরি যায়।

আচ্ছা শশধর সরকারের ফ্যামিলি মেম্বারস কজন? কে কে আছে বাড়িতে?

নিঃসন্তান ছিলেন উনি। স্ত্রী এবং একটি পোয্য ভাইপো রাজীব সরকার—আর চাকরবাকর, দারোয়ান, ড্রাইভার।

রাজীব সরকার কি করে?

সেও তার কাকার সঙ্গে দোকানেই বসত। এখন বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা যেমন ধোঁয়াটে তেমনি রীতিমত রহস্যজনক। আমি তো মিঃ রায়, কোন আলোর বিন্দুও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

সুনয়না দেবী ও রাজীব সরকারকে ভাল ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলে?

করেছি।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু জানতে পারা গেল না?

না। তারা বললেন, শশধরবাবু নাকি অত্যন্ত অমায়িক ও সৎ চরিত্রের লোক ছিলেন। কখনও কারও সাতে বা পাঁচে থাকতেন না। তার কোন শত্রু ছিল না। ওই ভাবে তার মৃত্যুটা তাদের কাছে কল্পনাতীত।

আচ্ছা দোকানটা কত দিনের? কিরীটী প্রশ্ন করে।

শুনলাম দোকানটা নাকি উনিই করেছিলেন—বছর পাঁচেক হল। ছোট দোকন থেকে পাঁচ বছরে বিরাট কারবার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ওটা পৈতৃক সম্পত্তি নয় তাহলে? পাঁচ বছরের ঐশ্বর্য?

হ্যাঁ। ওঁর বাপ রামজীবন সরকার সামান্য একজন কারিগর ছিলেন। শশধরও তাই ছিলেন। বাপ বছর আষ্টেক আগে মারা যান। বছর পাঁচেক আগে কাজ ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন বসেছিলেন, তারপর ছোট্ট একটা দোকান খোলেন। তারপর ধীরে ধীরে

নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমে সরকার জুয়েলারির আবির্ভাব—তাই তো?

হ্যাঁ।

তা শশধর কোথায় চাকরি করত, কোন্ দোকানে-কিছু জানা গেছে—

সে খবরও নিয়েছি, বিরাট জুয়েলার্স বি. কে. সরকার অ্যান্ড সন্সের নামটা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে

মনে থাকবে না কেন? সে তো প্রায় বছর পাঁচেক আগে কি সব আভ্যন্তরীণ কারণে প্রতিষ্ঠানটা বন্ধ হয়ে যায়।

হ্যাঁ, সেখানেই চাকরি করতেন শশধর সরকার এক সময়।

কিরীটী কিছুক্ষণ যেন কি ভাবল। তারপর বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, একটা খোঁজ নিতে পার বিকাশ–

কি বলুন তো?

বি. কে. সরকার অ্যান্ড সন্সের মালিক বা মালিকদের মধ্যে কেউ আছেন কিনা এবং যদি থাকেন তো বর্তমানে কে কোথায় আছেন, কি করছেন—

তা পারব না কেন?

হ্যাঁ, খবরটা সংগ্রহ কর তো। ভাল করে সন্ধান নাও। আলোর বিন্দু হয়ত দেখতে পাব এক-আধটা, আর–

আর কি?

সংবাদপত্রের ওই বিজ্ঞাপনের কথাটাও যেন ভুলে যেয়ো না।

একটা কথা বলব মিস্টার রায়?

বল।

সংবাপত্রে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে নীল রুমাল হত্যা-রহস্যগুলোর সত্যি কোন যোগাযোগ আছে বলে কি আপনি মনে করেন মিস্টার রায়?

নাও থাকতে পারে। হয়ত কোনটার সঙ্গেই কারও কোন সম্পর্ক নেই। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।

তবে?

সেই যে একটা কবিতা আছে না—যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, মিলিলে মিলিতে পারে—কিন্তু আর না বিকাশ, এবার আমি একটু বেরোব।

বিকাশ বুঝতে পারে, কিরীটী আপাতত বর্তমান প্রসঙ্গের ওপরে যবনিকাপাত করতে চায়। কিরীটী রায়কে বিকাশ ভাল করেই চেনে। যতটুকু সে বলেছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তার বেশি একটি কথা তার মুখ থেকে আর এখন বের করা যাবে না।

তাহলে আমিও উঠি।

এস।

বিকাশ সেন উঠে পড়ল।

 ০৩. ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে

ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে দেখে কৃষ্ণা শুধোয়, বেরোচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ, একটু ডালহাউসি যাব।

সংবাদপত্র প্রত্যহের অফিসে বোধ হয়?

ঠিক।

তোমার কি সত্যিই মনে হয়–

কি?

ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে—

নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের কোন যোগাযোগ আছে কিনা?

হ্যাঁ, মানে—

কিন্তু কৃষ্ণার কথা শেষ হল না, নিচের কলিংবেলটা বেজে উঠল। কৃষ্ণা বললে, ওই দেখ, আবার যেন কে এল! সুব্রত ঠাকুরপো বোধ হয়—

মনে হচ্ছে, না। তার বেল বাজানো ঠিক ওই রকম নয়।

ওই সময় জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!

কি রে?

একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

ভদ্রলোক! কোথা থেকে আসছেন?

তা তো কিছু বললেন না, বললেন আপনার সঙ্গে কি বিশেষ দরকার আছে।

যা, ডেকে নিয়ে আয়।

জংলী নিচে চলে গেল। কৃষ্ণাও ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে সম্বোধন করে বললে, এখন আর বেরোব না।

সেই ভাল, ফুলকপির সিঙাড়া ভাজছিলাম–

সুব্রতকে খবর দিয়েছ?

কালই ফোনে বলেছি, এখুনি হয়ত এসে পড়বে।

ঠিক আছে, তুমি যাও।

কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। কিরীটী কান পেতে শোনে। দুজোড়া শব্দ। প্রথম শব্দটা জংলীর, তার সঙ্গে যে শব্দটা কানে আসে, সেটা থেমে থেমে-হাতে বোধ হয় একটা লাঠি আছে, লাঠির শব্দও কানে আসে।

সত্যিই তাই। পরমুহূর্তে জংলীর পেছনে পেছনে যে লোকটি ঘরে এসে প্রবেশ করে, তার বয়স খুব বেশি না হলেও দেখলে মনে হয় যেন অকালে বুড়ো হয়ে গেছে। রসকষহীন শুকনো পাকানো চেহারা, মুখটা লম্বাটে ধরনের, মুখে চাপদাড়ি, কণ্ঠার হাড় দুটো প্রকট, কপালে একটা জড়ল চিহ্ন। দুটি চোখে যেন শৃগালের মত অস্থির সতর্ক দৃষ্টি। ডান পা-টা মনে হয় পঙ্গু, হাতে একটা মোটা লাঠি। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি, গ্রে কলারের গরম সার্জের পাঞ্জাবির ওপর একটা দামী কাশ্মিরী সাল জড়ানো।

নমস্কার।

কিরীটী প্রতিনমস্কার জানায় হাত তুলে, নমস্কার বসুন।

হ্যাঁ, এই যে বসি। ভাঙা ভাঙা একটু যেন মোটা কর্কশ স্বর।

কোনমতে আগন্তুক কিরীটীর মুখোমুখি সোফাটার ওপরে বসে পাশে তার লাঠিটা রাখলেন। তারপর বললেন, আপনিই নিশ্চয় রায়মশাই?

হ্যাঁ।

আগন্তুক পকেট থেকে একটা দামী সোনার সিগারেট কেস বের করেন, কেস থেকে একটা দামী বিলাতী সিগারেট নিয়ে কেসটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, সিগারেট!

না ধন্যবাদ।

সিগারেট চলে না বুঝি? ধূমপানে বুঝি অভ্যস্ত নন? তা ভাল, বড় বদ অভ্যাস–

চলে, তবে সিগারেট নয়—সিগার আর পাইপ।

সুদৃশ্য দামী একটা ম্যাচবক্স-হোলডার থেকে কাঠি বের করে সিগারটে অগ্নিসংযোগ করতে তৎপর হন আগন্তুক।

কিরীটী লক্ষ্য করে, আগন্তুকের দুহাতের তিন আঙুলে আংটি, তার মধ্যে ডান হাতের অনামিকায় যে আংটিটা রয়েছে সেটায় একটা বেশ বড় সাইজের হীরে বসানো রয়েছে এবং অন্য আংটি দুটো মীনে করা।

হীরেটার দাম খুব কম করেও হাজার দশেক তো হবেই। দামী হীরে। জ্বলজ্বল করছে। বেশভূষা, সোনার সিগারেট কেস, হাতের হীরের আংটি—সব কিছুই যেন নির্দেশ করছে যে আগন্তুক একজন ধনী ব্যক্তি।

সিঁড়িতে ওই সময় দ্রুত জুতো-পরা পায়ের শব্দ শোনা গেল।

কিরীটী বুঝতে পারে সুব্রত আসছে।

পরমুহূর্তই সুব্রত ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে ওঠে, বৌদি–

কিন্তু বাকি কথা সে শেষ করতে পারে না। ঘরের মধ্যে কিরীটীর সামনে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখে থেমে গেল এবং সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকাল।

আয় সুব্রত, বস্।

বৌদি—

বস, এখনও দেরি আছে।

সুব্রত বুঝতে পারে, কিরীটী তাকে বসতে বলছে। আর কোন কথা না বলে সে কিরীটীর পাশেই বসে পড়ল।

হ্যাঁ  এবারে বলুন তো আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? প্রশ্নটা করে কিরীটী আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

আমার নাম শিবানন্দ বসু। বালিগঞ্জে বোস অ্যান্ড কোং নামে যে জুয়েলারি শপটা আছে তার প্রোপ্রাইটার—মানে মালিক আমি।

তা আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো বোস মশাই?

ভদ্রলোক কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে থাকেন। আড়চোখে সুব্রতর দিকে তাকান।

ও, সুব্রত আমার অন্তরঙ্গ ও সহকারী। আমাকে যা বলার, ওর সামনে আপনি তা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন শিবানন্দবাবু। তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে। বিশেষ কোন কারণে আপনি একটু চিন্তিত?

সত্যিই তাই রায় মশায়। ব্যাপরটা হচ্ছে—

বলুন?

আপনার নজরে পড়েছে কিনা জানি না, গত দুমাসের মধ্যে এই শহরে–

আপনি কি সেই নীল রুমালের ফাঁস লাগিয়ে যে সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেই কথাই

ঠিক তাই। কিন্তু আশ্চর্য, বুঝলেন কি করে?

আপনি একজন নামকরা জুয়েলার বললেন না? যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তারাও সবাই জুয়েলার ছিলেন কিনা—

ঠিক। সেই কারণেই আমি এসেছি আপনার কাছে একটা পরামর্শের জন্য।

কীসের পরামর্শ বলুন তো?

আমার কেমন একটা ভয় ঢুকেছে মনে। কে জানে এবার আমারই পালা কিনা!

কিরীটী হেসে ফেলে।

হাসছেন যে রায় মশাই?

হাসছি এই কারণে, কলকাতা শহরে তো অনেক জুয়েলার আছেন, বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী শিবানন্দের বাঁ-হাতের মধ্যমায় মীনাকরা আংটিটার দিকে তাকিয়ে থেমে যায়।

শিবানন্দর দৃষ্টি এড়ায় না বোধ হয় ব্যাপারটা। বলেন, কি দেখছেন?

না, কিছু না। কি বলছিলেন বলুন?

বুঝতেই পারছেন রায় মশাই, ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি বড় নার্ভাস হয়ে পড়েছি–

কেন বলুন তো?

বলেন কি! বেটাদের যত আক্রোশ তো দেখছি সব আমাদের জুয়েলার্সদের ওপরেই। বেটারা যেন আমাদের সব খতম করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাই ভয়ে ভয়ে আছি সর্বক্ষণ। রাতে ঘুম নেই, আহারে রুচি নেই—জেগে জেগে যেন কেবলই ওই নীল রুমালের আতঙ্ক দেখছি, ভয়াবহ এক বিভীষিকা।

তা শিবানন্দবাবু, সেজন্য আমার কাছে এসেছেন কেন? আমি তো আর আপনাকে কোন প্রোটেকশান দিতে পারব না! তা যদি কেউ পারে তো পুলিসই পারবে।

তা কি আর জানি না রায় মশাই—

তবে?

পুলিস হয়ত আমার কথায় কানই দেবে না।

তা কেন? বলেন তো টালিগঞ্জ থানার ও. সি.-কে আমি বলে দিতে পারি—

না না, মশাই, বরং আপনি যদি কোন পথ বাতলাতে পারেন—

না, ক্ষমা করবেন। তাছাড়া—

আহা, সাহায্য না করতে পারেন, উপদেশ তো কিছু দিতে পারেন।

বাড়িতে গোটা দুই দারোয়ান রাখুন।

তা কি আর বাকি রেখেছি রায় মশাই-তিন-তিনজন দারোয়ান বহাল করেছি। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছি না, স্বস্তিতে বাইর ঘোরা-ফেরা পর্যন্ত করতে পারছি না।

সুব্রত কিরীটীর পাশে বসে শিঃশব্দে এতক্ষণ শিবানন্দ বোসের কথাবার্তা শুনছিল। এবারে বললে, আপনি বরং এক কাজ করুন শিবানন্দবাবু–

কি বলুন তো?

মাসখানেকের জন্য কাউকে কোথায় যাচ্ছেন না জানিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসুন।

সেই পরামর্শ দিচ্ছেন!

হ্যাঁ। নীল রুমালের ব্যক্তিটির সত্যিই যদি আপনার উপরে কোন আক্রোশ থাকে তো মাসখানেক অন্তত তো আপনার খোঁজ পাবে না—

কিন্তু তারপর? সব কিছু ফেলে দিয়ে তো আমি অজ্ঞাতবাসে বাকি জীবনটা কাটাতে পারি না। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত যদি তারা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলে।

শিবানন্দবাবু? কিরীটী আবার কথা বলে।

আজ্ঞে।

আপনার ছেলেমেয়ে কটি?

নেই।

নেই মানে? আপনার কোন সন্তানাদি নেই?

না। আমার স্ত্রীর কোন সন্তান হয়নি। দুঃখের কথা আর বলেন কেন?

তবে আপনার বিষয়-আশয়ের ওয়ারিশন কে?

কে আর–ওই নানু, বোম্বেটে ভাগ্নেটারই শেষ পর্যন্ত হবে পোয়া বারো!

ভাগ্নে!

হ্যাঁ, ভাগ্নে নয়—বলতে পারেন কুলাঙ্গার। লেখাপড়া করল না, মানুষ হল না, কাজকর্মও শিখল না। সর্বক্ষণ পার্টি করে বেড়ায়।

কোন পার্টির লোক তিনি?

কে জানে মশাই, এদেশে তো হাজারটা পার্টি। নামও জানি কি ছাই তার যে বলব কোন্ পার্টি শ্রীমানের। বুঝলেন, দিতাম গলা-ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে বাড়ি থেকে, কিন্তু ওই যে–

কি?

তার মামী–মামার অর্ধাঙ্গিনীটি, সে যে নানু বলতে অজ্ঞান। বলেছিলাম একবার তাড়িয়ে দেব, তা ঘন ঘন ফিট হতে শুরু করল গিন্নীর। শেষে সাপের ছুঁচো গেলার মত চুপ করে রামবুদ্ধ হয়ে বসে আছি। মরুক গে—যা খুশি ওরা করুক গে। অথচ মশাই, ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালই ছিল—

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। স্কুল-ফাইন্যাল পাস করে বিদ্যাসাগরে বি. এসি. পড়ছিল, তারপরই মাথায় ঢুকল পোকা। ব্যাস, সব কিছু শিকেই উঠল। এখন দিবা-রাত্র পাটি করছেন আর আমার অন্নধ্বংস, ধনক্ষয় করছেন।

কিরীটী মনে মনে বলে, ঠিকই করছে-বর্বরস্য ধনক্ষয়! কিন্তু মুখ দিয়ে তার সে কথাটা বের হল না, কেবল মিটিমিটি হাসে।

শিবানন্দ এবারে বললেন, আমি অবিশ্যি আপনার পরামর্শ এমনি চাই না, তার জন্যে পারিশ্রমিক দিতে আমি কার্পণ্য করব না—

ঠিক আছে শিবানন্দবাবু, আপনার কথাটা আমি ভেবে দেখব।

দেখবেন?

হ্যাঁ, দেখব।

ব্যস, ব্যস—তাহলেই আমি খুশি। বড় বিপদে পড়েছি রায় মশাই, এ বিপদ থেকে আপনি আমাকে উদ্ধার করুন—আমিও আপনাকে খুশি করে দেব। আচ্ছা, তাহলে আমি উঠি। নমস্কার।

নমস্কার।

শিবানন্দ অতঃপর উঠে পড়লেন এবং লাঠির সাহায্যে পঙ্গু ডান পা-টা সামান্য টেনে টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী একদৃষ্টে শিবানন্দর ক্রমঅপস্রিয়মাণ দেহটা ও চলার ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে ছিল।

সুব্রতর সেদিকে নজর পড়ায় বললে, কি দেখছিস রে কিরীটী?

কিরীটী সে কথায় জবাব না দিয়ে বলল, কেমন বুঝলি সুব্রত।

কীসের কি বুঝলাম?

বলছিলাম, ভদ্রলোকের আগমন ও প্রত্যাগমন থেকে কি তোর মনে হল!

বেশ ভয় পেয়ে গেছেন মনে হল।

তা ঠিক, তবে ওই যে একটা কথা আছে না আমাদের দেশে–

কি?

ভেক না নিলে ভিক্ষে মেলে না!

সুব্রতর কথার জবাব দেওয়া হল না, কৃষ্ণা এসে ঘরে প্রবেশ করল। হাতে তার প্লেটে গরম গরম সিঙাড়া।

সুব্রতও সব কিছু ভুলে গিয়ে হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিল এবং বিনা বাক্যব্যয়ে সিঙাড়ার সদ্ব্যবহার শুরু করে দিল।

কৃষ্ণা মুখোমুখি বসতে বসতে বললে, কে এসেছিল গো?

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে হেসে বললে, নীল রুমাল।

মানে!

ওই আর কি, নীল রুমালের আতঙ্কে আতঙ্কিত এক ভদ্রলোক। সুব্রত বললে।

তাই নাকি? কি রকম?

সুব্রতই সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে গেল সিঙাড়ার স্বাদ নিতে নিতে।

কিরীটী হঠাৎ ওই সময় বলে উঠে, ব্যাপারটা নিয়ে আজ সকাল থেকে চিন্তা করতে করতে একটা ব্যাপার আমার কাছে যেন এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে সুব্রত–

কি বল তো?

নীল রুমালের ব্যাপারটায় পূর্বপরিকল্পিত দৃঢ় সঙ্কল্প কারও-না-কারও আছে। কিরীটী তার সামনের নিচু টেবিল থেকে সুদৃশ্য চন্দনকাঠের সিগারের বাক্সের ডালাটা খুলে একটা সিগার তুলে নিয়ে সেটায় অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে।

পূর্বপরিকল্পিত দৃঢ় সঙ্কল্প!

হ্যাঁ। এই দুই দিন—তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে, এবারে চতুর্থ ব্যক্তির পালা, চারের অঙ্ক আর কি–

বলিস কি!

কিন্তু ভাবছি, সেই চতুর্থ কে? কার জন্য হত্যাকারীর নীল রুমাল অপেক্ষা করেছে?

০৪. সুব্রত বললে, তাহলে তুই বলতে চাস

সুব্রত বললে, তাহলে তুই বলতে চাস কিরীটী, নীল রুমালের ফাঁস আরও একজনকে গলায় নিতে হবে!

তাই তো মনে হচ্ছে। তবে—

তবে কি? এবারে ওই শিবানন্দরই পালা নাকি?

কিরীটী মৃদু হাসল।

হাসছিস যে! আমারও মনে হয়—

কি মনে হয় রে?

ভদ্রলোক যেভাবে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তোর কাছ ছুটে এসেছিলেন—

কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীতও তো হতে পারে?

মানে?

অতি সতর্কতায় মতিভ্রম! যাগগে সে কথা। তারপরই হঠাৎ যেন কি মনে পড়েছে এমনি ভাবে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ রে সুব্রত–

কি?

হীরেন সরকারের সঙ্গে তোর জানশোনা ছিল না?

কোন্ হীরেন সরকারের কথা বলছিস?

আরে ওই যে সরকার জুয়েলার্সদের বাড়ির ছেলে—

হ্যাঁ, ছিল তো। তা কি হয়েছে তাতে?

তাকে একবার ডাকতে পারিস?

পারব না কেন? দীর্ঘকাল দেখা-সাক্ষাৎ নেই অবিশ্যি, তাহলেও দেখা করে তোের কথা বললে আসবেই। কিন্তু কেন?

কেন আবার কি—একটু আলাপ-সালাপ করতাম ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কি।

কি হবে আলাপ করে?

কোথা থেকে কি হয়, কেউ কি কিছু বলতে পারেনা তাই কিছু বলা যায়?

বেশ, কালই যাব তার ওখানে একবার।

তাই যাস। আচ্ছা তোরা বস, আমি বিকাশকে একটা ফোন করে আসি। বলতে বলতে কিরীটী উঠে পড়ল সোফা থেকে।

কিন্তু ফোনে বিকাশ সেনকে থানায় পাওয়া গেল না, তখনও সে থানায় ফিরে যায় নি। এ. এস. আই. বললেন, কখন ফিরবেন তিনি বলতে পারেন না।

কিরীটী ফিরে এসে সোফায় বসতে বসতে বললে, খুব করিৎকর্মা ব্যক্তি আমাদের এই বিকাশ সেন। হয়ত সকালে আজ যা বলেছি, সেই সব নিয়েই সে মেতে উঠেছে। যাক গে, মরুক গে—তারপর তোর ব্যাপার কি বল্ তো সুব্রত!

কেন? ব্যাপার আবার কি?

এদিকে যে ভুলেও পা মাড়াস না!

কে বললে? প্রায়ই তো আসি, কৃষ্ণাকে জিজ্ঞাসা কর।

সুব্রত কখনও কৃষ্ণাকে নাম ধরে ডাকে, কখনও বৌদি বলে ডাকে।

কি করিস বাড়িতে বসে বসে?

কি আর করব, বই পড়ি।

তা ভাল। শেষ পর্যন্ত দেখবি ওই শুকনো বইয়ের পাতাগুলো ক্রমশ আরও নীরস হয়ে উঠছে। বুঝলি না তো সময়ে! অত করে বললাম তখন, চোখ কান নাক মুখ বুজে ঝুলে পড়।

সুব্রত হাসতে হাসতে বলে, দুঃখ হচ্ছে?

আমার নয়, তোর—তোর কথা ভেবে সত্যিই দুঃখ হচ্ছে। কুন্তলার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিস?

না।

কেন?

কেন আবার কি, প্রয়োজন হয় না বলে!

মেয়েটাও হয়েছে তেমনি কৃষ্ণা, সুব্রতটা বুড়বাক বলে সেও গো ধরে বসে আছে।

কৃষ্ণা চুপ করে থাকতে পারে না, বলে, দায় পড়েছে তার! হ্যাংলামি করতে যাবে কেন—তার নিজস্ব একটা প্রেসটিজ নেই!

প্রেসটিজ! একে তুমি প্রেসটিজ বল কৃষ্ণা।

তা নয় তো কি?

বাইরে প্রেসটিজের মিথ্যে একটা মুখোশ মুখে এঁটে, ভেতরে ভেতরে সর্বক্ষণ চোখ মোছা–

থাম তো-মেয়েদের তুমি ভাব কি!

ঠিক যা ভাবা উচিত তাই ভাবি।

সুব্রত ওদের কথা শোনে বসে বসে, আর মৃদু হাসতে থাকে।

তরল হাসি-গল্পের মধ্যে দিয়ে আরও অনেকক্ষণ কাটিয়ে একসময় সুব্রত যাবার জন্য যেমন উঠে দাঁড়িয়েছে, কৃষ্ণা বললে, এ কি, উঠছ কোথায়?

বাঃ, যেতে হবে না!

হবে। তবে বিকেলে-দুপুরের খাওয়া এখানে।

সুব্রত বসে পড়ে বলল, তথাস্তু দেবী।

.

হাতে কিছু কাজ ছিল বিকাশের। কাজগুলো সারতে সারতে বেলা দুপুর গড়িয়ে যায়। প্রায় দেড়টা নাগাদ সে থানায় ফিরে এল।

অতক্ষণ ধরে কাজ করলেও তার মাথার মধ্যে কিন্তু সর্বক্ষণ কিরীটীর সকালের কথাগুলোই ঘোরাফেরা করছিল।

কিরীটী যা বললে, তা কি সত্যি! তিন-তিনটি হত্যার মধ্যে সত্যিই একটা সুস্পষ্ট যোগাযোগ আছে! অবিশ্যি তিনটি হত্যার মধ্যে দুটি ব্যাপারে অদ্ভুতমিল আছে—প্রথম, প্রত্যেকেই শহরের জুয়েলার্স, অবস্থা ভাল;দ্বিতীয়, প্রত্যেকেরই গলায় নীল রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণেই কি কিরীটীর ধারণা, একই ব্যক্তি তিন-তিনটি নিষ্ঠুর হত্যার পেছনে রয়েছে? একজনেরই অদৃশ্য হাতের কারসাজি তিনটি হত্যাই?

আশ্চর্য নয়!

কিন্তু কথা হচ্ছে উদ্দেশ্য কি থাকতে পারে ওই ধরনের নৃশংস হত্যার?

কি উদ্দেশ্যে একটা লোক অমন নৃশংস ভাবে একটার পর একটা জুয়েলারকে হত্যা করে চলেছ এ শহরে?

ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ কি?

কিন্তু কীসের আক্রোশ? কি ধরনের আক্রোশ?

ঝনঝন করে পাশে টেলিফোনটা টেবিলের উপরে বেজে উঠল। আঃ, শালারা একটু নিশ্চিন্তে বসে বিশ্রামও করত দেবে না। ঘণ্টাচারেক হন্তদন্ত হয়ে রোদে ছোটাছুটি করে এসে একটু বসেছি-একান্ত বিরক্ত ভাবেই ফোনটা তুলে নিল : ও- সি. বৌবাজার স্পিকিং!

ও প্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে, বিকাশ—আমি কিরীটী।

সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ সেনের মুখের ওপর থেকে বিরক্তির মেঘটা যেন কেটে যায়। সে উগ্রীব হয়ে ওঠে, সোজা হয়ে বসে।

বলুন, বলুন রায় সাহেব—

তুমি এখান থেকে যাবার পর সকালে একবার ফোন করেছিলাম।

আমি এই ফিরছি। কি ব্যাপার বলুন তো? ফোন করেছিলেন কেন?

সকালে তখন কয়েকটা কথা তোমাকে বলতে পারিনি—

কি কথা?

এর আগে যে দুজন জুয়েলার এ শহরে নীল রুমালের ফঁসে নিহত হয়েছে, তারা কোথায় কি ভাবে কখন নিহত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে ডিটেলস্ খবরাখবর একটা যোগাড় করতে পার?

কিছুটা সংগ্রহ করেছি রায় সাহেব—

করেছ? খুব ভাল সংবাদ–

হ্যাঁ। আর সেই খবরের জন্যই এতক্ষণ বাইরে ঘুরে এলাম।

কি জানতে পারলে বল? টেলিফোনেই বলব, না

না, শোন, আমি আগামী কাল সকালেই দিন-কয়েকের জন্য দিল্লী যাচ্ছি প্লেনে—

হঠাৎ দিল্লী?

ওখানে এক মন্ত্রী মশাইয়ের দপ্তর থেকে একটা গোপন কনফিডেনসিয়াল দলিল বেপাত্তা হয়ে গেছে, তাই মন্ত্রী মশাই কিছুক্ষণ আগে এক জরুরী ট্রাঙ্ককল করেছিলেন আমায়–

তাহলে?

কি তাহলে?

এদিককার কি হবে?

কীসের—তোমার নীল রুমাল রহস্যের?

হ্যাঁ।

ভয় নেই, আমার ধারণা বা অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে আমাদের নীল রুমালের ভদ্রলোকটি এখুনি আবার তার হাত প্রসারিত করবেন না, কিছুটা অন্তত সময় নেবেন।

কিন্তু যদি না নেয়—

নেবে। অন্তত দিন পনেরো-কুড়ি তো নেবেই—সাধারণ যুক্তিতে। কারণ—

কি?

পুলিসকে যে তৃতীয়বার বোকা বানাল, সেই আত্মশ্লাঘা বা আত্মতৃপ্তিটা অন্তত কিছুদিন তো একটু যাকে বলে চেখে চেখে উপভোগ করবেই, মনে মনে হাসবে। ভয় নেই ভায়া, তার ওই আত্ম-অহমিকাই তার রথচক্র গ্রাস করবে ঠিক সময়ে। গতি রুদ্ধ হবে।

বলছেন!

হ্যাঁ, বলছি। যাক, যা বলছিলাম, ওই খবরগুলো কীভাবে সংগ্রহ করলে?

ফোনেই বলি–

না, থাক। বরং তুমি এখন আছ তো?

হ্যাঁ।

আমিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাচ্ছি। সংবাদটা ফোন মারফত আদান-প্রদান না হওয়াই ভাল।

অন্য প্রান্তে কিরীটী ফোন রেখে দিল।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই কিরীটী থানায় এসে হাজির হল।

বিকাশ তখন স্নান সেরে চাট্টি মুখে দিয়ে কোনমতে সবেমাত্র নিচের অফিসে এসে বসেছে।

আসুন মিস্টার রায়!

তারপর, বল। কিরীটী বসতে বসতে বললে, কতটুকু কি সংবাদ সংগ্রহ করলে?

প্রথম ব্যক্তি নিহত হয় নীল রুমালের ফাসে, ঠিক আজ থেকে দুমাস আগে এক শনিবার রাত্রি আটটা-নটার মধ্যে কোন এক সময়। কারণ—

কারণ? কিরীটী বিকাশের মুখের দিকে তাকাল।

রাত সোয়া আটটা নাগাদ শ্যামবাজার অঞ্চলে তার জুয়েলারির দোকান বন্ধ করে বেরুতে যাবেন শ্ৰীমন্ত পোদ্দার, ঠিক তখন একটা ট্যাকশি এসে থামে তার দোকানের সামনে–

বলে যাও।

লোকটির যে বর্ণনা দোকানের কর্মচারীদের একজনের কাছে পাওয়া গেছে তা হচ্ছে, লোকটি মধ্যবয়সী, রোগা। পাকানো চেহারা। পরনে দামী স্যুট ছিল।

আর কিছু? আর কোন বিশেষত্ব?

না, তেমন কিছু রিপোর্ট নেই আর।

হুঁ, বলে যাও।

 ০৫. বিকাশ সেন আবার শুরু করে

বিকাশ সেন আবার শুরু করে, আগন্তুক বলে, সে আসছে কোন এক বনেদী ধনীর বাড়ি থেকে। তার কর্তা তাকে পাঠিয়েছেন, কিছু গয়নার অর্ডার দেবেন; তাই তাকে একটিবার তার ক্যাটালগ বইটা নিয়ে তার সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ জানান। শ্ৰীমন্ত পোদ্দার বলাই বাহুল্য, উৎফুল্ল হয়ে সেই আগন্তুকের সঙ্গে দোকান বন্ধ করে তারই ট্যাকশিতে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যান।

তারপর?

সারাটা রাত তিনি বাড়িতে ফেরেন না, কাজেই ছোট ভাই ও তার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে খোঁজখবর করেন।

অবিবাহিত ছিল শ্ৰীমন্ত পোদ্দার?

হ্যাঁ। তারপর যা বলছিলাম, পরের দিন সকাল ছটা নাগাদ তাকে গঙ্গার ধারে স্ট্র্যান্ড রোডে এক বেঞ্চির উপর এক ভদ্রলোক বেড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করেন। বেঞ্চির ওপর উপবিষ্ট শ্ৰীমন্ত পোদ্দার, গলায় নীল রুমালের ফাঁস-মৃত। তিনিই একজন প্রহরারত পুলিসকে ডেকে সংবাদটা দেন। পকেটে ছিল শ্ৰীমন্ত পোদ্দারের একটি ব্যাগে শদুই টাকা, গোটা দুই চেক-প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার, কিছু খুচরো পয়সা আর দোকানের চাবির গোছাটা।

অবিকল দেখছি তোমার শশধর সরকারের মতই ব্যাপারটা। স্রেফ হত্যার জন্যই হত্যা করা হয়েছিল শ্ৰীমন্ত পোদ্দারকেও তাহলে! কিরীটী বললে।

তাই তো দেখা যাচ্ছে।

তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি?

তাঁর নাম হারাধন সামন্ত। তারও জুয়েলারির একটা দোকান ছিল রাধাবাজারে। দোকানের নাম সামন্ত জুয়েলার্স। বছর চারেক হল সাজিয়ে-গুছিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গেই দোকনের পত্তন। শ্ৰীমন্ত পোদ্দাররের মৃত্যুর ঠিক কুড়ি দিন পরের ঘটনা, তিনিও রাত আটটার পর দোকান বন্ধ করতে যাবেন, সেই সময়–

আবার এক আগন্তুকের আবির্ভাব তো?

হ্যাঁ, তবে এবার ট্যাকশি নয়, একটা প্রাইভেট গাড়িতে চেপে তার আবির্ভাব ঘটে। কিছু দামী জড়েয়ার গয়না কিনবে, তাই এসেছিল। সঙ্গে হাতে ঝোলানো একটা কালো রঙের অ্যাটাচি কেস।

আগন্তুককে নিয়ে সামন্তমশাই তার দোকানের প্রাইভেট রুমের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন। আধঘণ্টা পরে ভদ্রলোক বের হয়ে গেলেন। কর্মচারীদের মধ্যে জনা-দুই ও দারোয়ান তখন প্রভুর ঘর থেকে বেরোবার অপেক্ষায় বসে, কিন্তু সামন্তমশাই আর ঘর থেকে বেরোন না। এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা, দু ঘণ্টা কেটে গেল, তখন একজন কর্মচারী অধৈর্য হয়েই গিয়ে দরজার সামনে এসে ডাক দিল।

কোন সাড়া পাওয়া গেল না সামন্তর তাই না?

হ্যাঁ, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে কর্মচারীটি চিৎকার করে উঠল। চেয়ারের ওপর উপবিষ্ট সামন্তমশাই, গলায় নীল রুমালের ফাঁস, মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে আছে, চোখের মণি দুটো যেন কোঠর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসছে।

হুঁ। আচ্ছা সেই আগন্তুকের চেহারার কোন বর্ণনা পেয়েছ?

পেয়েছি। রোগা পাকানো চেহারা, চোখে কালো কাচের একটা চশমা, পরনে দামী স্যুট।

কিরীটী যেন চিন্তিত। কি যেন ভাবছে মনে হল।

বিকাশ বলতে লাগল, এবারেও কোন কিছু চুরি যায়নি।

স্বাভাবিক। কিরীটী মৃদু গলায় বললে, কারণ হত্যার জন্যই যেখানে হত্যা, সেখানে তো অন্য কিছুর নিদর্শন থাকতে পারে না। ভাল কথা, সামন্তমশাই বিবাহিত ছিলেন?

হ্যাঁ। স্ত্রী ও দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর বছরখানেক আগেই খুব ধুমধাম করে। ছেলেদের একজনের বয়স বারো, আরেকজনের আট বছর। কিছুদিন আগে বালিগঞ্জ অঞ্চলে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করতেও শুরু করেছিলেন।

আচ্ছা বিকাশ—

বলুন।

সেই রুমাল দুটো দেখেছ?

হ্যাঁ। একজিবিট হিসেবে লালবাজারেই আছে। দেখে এলাম। অবিকল সেই একই ধরনের আকাশ-নীল রঙের রেশমী রুমাল এবং তাদের একটির কোনায় ইংরাজী সাঙ্কেতিক অক্ষর 1 ও অন্যটিতে 2 লেখা।

কিরীটী বললে, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তিনটি হত্যার পেছনে একই ব্যক্তির অদৃশ্য হাত রয়েছে, সে সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ রইল না।

আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। বিকাশ সেন বললে।

আরও একটা ব্যাপার হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই তোমার নজরে পড়েছে বিকাশ–

কি বলুন তো?

প্রথম ব্যক্তি শ্ৰীমন্ত পোদ্দারের মৃত্যুর কুড়ি দিন পরেই নিহত হলেন হারাধন সামন্ত, এবং তার ঠিক দিন-কুড়ি পরে তৃতীয় ব্যক্তি নীল রুমালের ফঁসে প্রাণ দিলেন আমাদের শশধর সরকার।

হিসেব তো তাই দাঁড়াচ্ছে।

এবং দুবার এক আগন্তুকের আবির্ভাব এবং তৃতীয় কিস্তিতে সামান্য অদল-বদল-a telephone call from some unknown person! হয়ত শশধরেরও দোকানে। প্রবেশ করে সেই রোগা লম্বা পাকানো চেহারার আগন্তুকের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল। তাহলেই ভেবে দেখ, মোটামুটি হত্যাকারীর একটা চেহারার বর্ণনা যেমন আমরা পাচ্ছি, তেমনি এও বোঝা যাচ্ছে, হত্যাকারী একজন—একাধিক ব্যক্তি না। খুব planned wayতে সে হত্যা করে চলছে একের পর এক।

আপনার কথায় তাই তো মনে হচ্ছে মিস্টার রায়!

তোমাকে এখন বাকি কাজটি করতে হবে সেন—

কোন কাজটা বলুন তো?

বছর পাঁচেক আগে কি সব আভ্যন্তরিক কারণে তুমি বলছিলে না, সরকার অ্যান্ড, সন্স বিখ্যাত জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়

হ্যাঁ।

কেন বন্ধ হয়েছিল,-কারণটা কি, এবং সেই পরিবারের সকলে এখন কে কোথায়। আছে, কে কি করে, তাদের প্রত্যেকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটা খোঁজখবর নিতে বলছিলাম না—নিয়েছ?

না! কিন্তু আপনার কি মনে হয় মিস্টার রায়—

কি?

সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারের সঙ্গে বর্তমান হত্যা-রহস্যগুলোর কোন যোগাযোগ আছে বলে আপনার মনে হয়?

হয়ত নেই, আবার হয়ত থাকতেও পারে।

তাছাড়া ব্যাপারটা তো অনেক দিন আগেকার

হ্যাঁ, পাঁচ বছর আগেকার ব্যাপার। কি জান বিকাশ, হত্যার বীজ যে এক-এক সময় কখন কোথায় কীভাবে রোপিত হয় বা অঙ্কুরিত হতে থাকে, কেউ তা বলতে পারে না। বিশেষ করে এই ধরনের হত্যার ব্যাপার। তাই ব্যাপরটা সম্পর্কে আমি জানতে চাই।

বেশ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংবাদগুলো আমি আপনাকে জানাবার চেষ্টা করব। সে আর এমন কঠিনই বা কি!

আজ তাহলে আমি উঠি, বুঝলে?

চা খাবেন না?

না।

কিরীটী উঠে পড়ল।

.

থানা থেকে বের হয়ে কিরীটী সোজা গেল তার গাড়িতে করে ডালহৌসি স্কোয়ারে প্রত্যহ নামক দৈনিক সংবাদপত্রের নতুন হেড অফিসে।

সেখানকার একজন নিউজ-এডিটর সঞ্জীব লাহিড়ীর সঙ্গে কিরীটীর বিশেষ পরিচয় ছিল। অল্প বয়স খুব চালাক-চতুর এবং চটপটে ছোকরা।

সঞ্জীব তার অফিস-কামরায় ছিল না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই হয়ত সে ফিরবে। একজন বলায় কিরীটী তার ঘরে বসে অপেক্ষা করতে থাকে।

বিশ মিনিট পরে সঞ্জীব ফিরে এল।

কিরীটীকে দেখে সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, দাদা যে! কি খবর?

একটা খবর চাই।

কি খবর?

কিরীটী তখন ‘প্রত্যহে’ প্রকাশিত বিচিত্র বিজ্ঞাপনটির কথা উল্লেখ করে বললে, একটু খোঁজ নিয়ে বলতে পার সঞ্জীব, ওই বিজ্ঞাপনটা কতদিন থেকে প্রকাশ হচ্ছে এবং কে দিয়েছে?

বসুন, আমি দেখছি।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই সঞ্জীব যা সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে এল তা হচ্ছে-বিজ্ঞাপনটি গত দুমাস ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। দিল্লী থেকে নতুন এক পাবলিশার্স কনসার্ন বিজ্ঞাপনটি দিচ্ছে। বেদপাল পাবলিশিং কোম্পানি। দরিয়াগঞ্জে তার অফিস।

ঠিকানাটা টুকে নিয়ে কিরীটী উঠে পড়ল।

.

পরের দিন সকালের প্লেনেই কিরীটী দিল্লী চলে গেল।

সেখানে মন্ত্রী মশাইয়ের বাড়িতেই তার সঙ্গে দেখা হল কিরীটীর। প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মশাই রামস্বামী বললেন, ব্যাপারটা যেমন বিস্ময়ের, তেমনি অতীব রহস্যজনক মিস্টার রায়!

খুলে বলুন।

দপ্তরের এক বিশেষ secret document-যার মধ্যে ভারতের বর্ডারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার details ছিল, সেটা অফিস-ঘরের আয়রন সেফ থেকে খোয়া গেছে।

শেষ কবে documentটা দেখেছিলেন?

তা দিন পনেরো আগে।

চুরি গেছে যে জানতে পারলেন কবে?

দিন সাতেক আগে। প্রধান মন্ত্রী documentটা দেখতে চাইলে খোঁজ করতেই ব্যাপারটা জানা গেল।

সিন্দুকের চাবি কার কাছে থাকে?

Of course সর্বদা আমারই জিম্মায়।

তার মানে, সেটা আপনি ছাড়া আর কারও খোলবার উপায় ছিল না?

নিশ্চয়ই না।

কে কে জানত আপনার অফিসের documentটা সম্পর্কে?

আমার personal secretary মিস্টার প্রতাপ সিং ছাড়া আর কেউ জানত না।

তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন?

করেছি। সে কিছু বলতে পারছে না।

ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব বিশ্বাসী?

নিঃসন্দেহে।

কোথায় যেতে পারে বলে দলিলটা আপনার মনে হয়—মানে documentটা? Any idea?

খবর পেয়েছি সেটা পাকিস্তানে চালান হয়ে গেছে।

ক্ষতির সম্ভাবনা আছে তাতে নিশ্চয়ই?

ক্ষতি! তা কিছুটা তো আছে বটেই। কিন্তু তার চাইতেও বেশি যেটা চিন্তার কারণ হয়েছে, এভাবে যদি secret documents সেফ থেকে পাচার হয়ে যেতে থাকে—

সমূহ বিপদ!

বলুন, তাই নয় কি? প্রধান মন্ত্রী তো বিশেষ খাপ্পা হয়েছেন—

স্বাভাবিক।

একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে, যেমন করে হোক!

আপনার Secret Intelligence Branch-এর officer-রা করতে পারলেন না?

তারা ওইটুকু সংবাদই সংগ্রহ করতে পেরেছে। সেগুলি পাকিস্তানে চালান হয়ে গেছে। I want your help, মিস্টার রায়।

দেখি কি করতে পারি।

মন্ত্রী মশাইয়ের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে কিরীটী বেদপাল পাবলিশিং কোম্পানির খোঁজে দরিয়াগঞ্জে গেল।

কিন্তু যা সে মনে মনে আশঙ্কা করেছিল—ওই নামে কোন পাবলিশিং কোম্পানির কোন অস্তিত্বই নেই।

০৬. দিন চারেক বাদে কিরীটী

দিন চারেক বাদে কিরীটী কলকাতায় ফিরে এল।

আগেই দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককল করে দিয়েছিল কিরীটী, গাড়ি এয়ারপোর্টে পাঠাবার জন্য।

বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকতেই দেখে সুব্রত বসে আছে।

সুব্রত জানত কেন কিরীটী দিল্লী গেছে। সে বললে, কি হল, দিল্লীর ব্যাপারের কোন হদিস করতে পারলি?

ব্যাপারটা জটিল। সময় শেষ, তবে মনে হচ্ছে—

কি?

কিরীটী সোফার ওপরে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, আমাদের বিকাশ সেনকেও কথা দিয়েছি, নচেৎ কটা দিন ওখানে আরও থেকে প্রাথমিক ব্যাপারটা শেষ করে আসতাম।

কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল, তার হাতে ছোট একটা ট্রের উপর ধূমায়িত দু কাপ কফি নিয়ে।

শরীর ভাল আছে তো? কৃষ্ণা সহাস্যে শুধায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।

কফির কাপটা হাতে নিতে নিতে কিরীটী বললে, ভাল। নে সুব্রত।

সুব্রতও একটা কাপ তুলে নিল। কৃষ্ণা পাশেই বসল কিরীটীর।

শীতের ছোট বেলা বাইরে তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পড়ন্ত আলোর সঙ্গে একটা আবছায়া ঘনাচ্ছে যেন।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, এখানে বেশ শীত পড়েছে দেখছি।

সুব্রত বললে, হ্যাঁ, পরশু থেকে। দিল্লীতে শীত কেমন পেলি?

রাজধানীর ব্যাপার তো, কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, হাড়-কাপানো! তার পর তোর হীরেন সরকারের সঙ্গে দেখা করেছিলি সুব্রত?

গিয়েছিলাম।

গিয়েছিলি? কবে আসছে?

তার পক্ষ আসা সম্ভব নয়।

কেন? আসতে চায় না বুঝি?

না, বেচারী মাস আষ্টেক ধরে একেবারে শয্যাশায়ী।

শয্যাশায়ী! কি হয়েছে কি?

লোয়ার মটোর প্যারালিসিসে পা দুটো পঙ্গু, শয্যা থেকে উঠতেই পারে না। রোগা। হয়ে গেছে।

তাই নাকি!

তাই দেখলাম। বললে, তুই ডেকেছিস, আলাপ করতে চাস-এ যে তার কি সৌভাগ্য! কিন্তু আসতে পারবে না–

কিরীটী বললে, তাতে আর কি হয়েছে, আমরাই না হয় যাব আজ।

আজই যাবি?

হ্যাঁ। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করা একটিবার বিশেষ দরকার। তা ভদ্রলোকের অবস্থা কেমন দেখলি? দোকান উঠে যাবার পর–

দোকানটা ওদের তিনজনের ছিল—মানে জ্যাঠতুত, খুড়তুত তিন ভায়ের। ওদের বাবা কাকা জ্যাঠারা অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।

তারপর?

ওরা তিন ভাই-ই দোকানটা দেখাশোনা করছিল-চলছিলও বেশ। হঠাৎ একদিন আবিষ্কৃত হল, ভেতরে ভেতরে শনির দৃষ্টি পড়েছে দোকানটার ওপরে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। যেদিন ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ ওরা জানতে পারল, দেখলে ওদের কারিগরেরাই ওদের পথে বসিয়েছে।

কারিগরেরা পথে বসিয়েছে কি রকম?

আসলে ওদের তিনজনের একজনও কাজকর্ম কিছু জানত না। ধনী গৃহের ছেলে,–সোনার চামচ মুখে দিয়ে সব জন্মেছিল। কখনও দোকানের কাজকর্ম যেমন কিছু শেখবার চেষ্টা করেনি, তেমন কাজকর্মও বুঝত না। ওদের ছোট কাকাই সব দেখাশোনা করছিল, তার আর দু ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওরা মধ্যে মধ্যে সেজেগুজে দোকানে আসত। আর মোটা মাসোহারা নিত। তিন ভাই দামী দামী গাড়িতে চড়ত, বাবুয়ানী করত। একজনের ছিল রেস খেলার বাতিক, একজনের দেশভ্রমণের বাতিক, আর হীরেনের। ছিল থিয়েটারের বাতিক–

থিয়েটার।

হ্যাঁ। ভাল চেহারা না থাকলেও অভিনয় সে ভালই করত। নামও করেছিল। একটা নামকরা পাবলিক রঙ্গমঞ্চে অ্যামেচার অভিনেতা হিসাবে অভিনয় করত। হীরেনের বাবা আগেই মারা গিয়েছিল। ছোট ভাই কর্তাদের মধ্যে। মেজ কর্তার সন্তানাদি ছিল না। বড়কর্তার দুই ছেলে—হরেন্দ্র আর নীরেন্দ্র।

কিরীটী নিঃশব্দে শুনতে থাকে।

বাইরে আসন্ন সন্ধ্যার ধূসরতা নামে। সেই সঙ্গে শহর কলকাতার চাপ-চাপ ধোঁয়া।

সুব্রত বলতে লাগল, ছোটকর্তার মৃত্যুর পর তিন ভাই দোকানে বসতে শুরু করল। তবে ওই নামেই—সব ভরসা কর্মচারীদের ওপরেই। কেউ কোন কাজ জানো না। ওরা যা করে, যা বোঝায়—তাই ওরা বোঝে।

মাস আষ্টেক বাদে এক খরিদ্দার এল-ভদ্রলোক তো মহা খাপ্পা–

কেন?

যে গহনা তিনি করে নিয়ে গিয়েছেন, তার বোল আনার মধ্যে বারো আনাই নাকি খাদ। পরীক্ষা করে দেখা গেল কথাটা মিথ্যা নয়, সত্যিই তাই। ওরা আর কি করে, খেসারত দিল মোটা টাকার।

Interesting!

কেবল ওই খরিদ্দারটিই নয়—বিরাট ঢালাও কারবার, মাস দুয়েকের মধ্যে আরও বিশজন খরিদ্দার ওই একই কমপ্লেন নিয়ে এল। সোনায়ই যে কেবল খাদ তাই নয়, জড়োয়া গয়নার মধ্যে যে সব জুয়েলস দিয়েছে তাও মেকী।

তিন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসল, এ কি ব্যাপার! কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গেছে, তলে তলে দোকান ফাঁক। সোনা যত স্টকে ছিল এবং যত রেয়ার জুয়েলস্ ছিল, সব উধাও। ঝাঝরা হয়ে গেছে দোকানটা। সবচাইতে পুরনো চারজন কর্মচারী ছিল—তাদেরও তারা ডাকল, এবং কর্মচারী চারজন কারা জানিস?

জানি শশধর, শ্ৰীমন্ত আর হারাধন নিশ্চয়ই। কিরীটী বললে।

তুই জানলি কি করে?

জানি। কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তির নামটি কি শিবানন্দ বসু?

তুই জানলি কি করে?

জানি। তারপর একটু থেমে বললে, তাহলে দেখছি, আমার অনুমান ভুল নয়। কিরীটীর চোখের মণি দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

কৃষ্ণা বললে, কেমন করে ওদের নাম তুমি জানলে গো? শশধর শ্রীমন্ত আর হারাধন না হয়—

বিজ্ঞাপনের কবিতাটা তোমরা ভুলে গেলে কৃষ্ণা! তাছাড়া শিবানন্দ যে এসে ছিল নিজেই।

তবে? কৃষ্ণা শুধায়।

কি তবে?

তাকেও মরতে হবে নাকি?

অঙ্ক অনুযায়ী তাই তো হওয়া উচিত। কবিতার মিলের জন্যই। যাক, ধোঁয়াটে ব্যাপারটা পরিষ্কার এখন বোঝা যাচ্ছে। খুব জটিল নয়।

হত্যাকারীকে ধরতে পেরেছ? কৃষ্ণা শুধায়।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, একেবারে যে পারছি না তা নয়। তবে উদ্দেশ্যটা-হত্যার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর মোটিভ যখন জানা গেছে, বাকি রহস্যটুকুও উদ্ঘাটিত করতে আর বেশি বেগ পেতে হবে না। তুই বস্ সুব্রত, স্নান করে জামাকাপড়টা বদলে আসি।

কৃষ্ণা আর সুব্রত বসে বসে গল্প করে।

কিরীটী ভেতরে চলে যায়।

আধ ঘণ্টা পরে কিরীটী ফিরে এল। পরনে তার গরম পায়জামা ও পাঞ্জাবি, গায়ে একটা সাদা শাল।

সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, উত্তিষ্ঠ বৎস!

এখন কোথায় আবার বেরুবি?

কোথায় মানে? তোর সেই পরিচিত পঙ্গু ভদ্রলোক হীরেন সরকারের ওখানে!

এখুনি?

আজ এবং ইমিডিয়াটলি। চল্ ওঠ। বেশি রাত হয়নি, মাত্র আটটা-শীতের রাত এমন কিছু নয়।

সুব্রত জানে কিরীটীকে থামানো যাবে না। ও যখন যাবে বলেছে, তখন যাবেই। কাজেই সে উঠে দাঁড়াল।

এই রাত্রে না গিয়ে কাল সকালে গেলেই হত।

না, চ। হীরেনের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

কখন ফিরবে? কৃষ্ণা শুধায়।

বৌবাজার থেকে ফিরতে আর কতক্ষণ লাগবে! কিরীটী বলে।

সুব্রত বলে, সে তো বৌবাজারে থাকে না। সে এজমালি পৈতৃক বাড়ি তো কবেই দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে সরকারদের!

তবে? ভদ্রলোক এখন থাকেন কোথায়?

ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছে হীরেন অন্য একটা বাড়িতে থাকে।

তাই নাকি? তবে তো সে কাছেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তো তাহলে ফিরতে পারব। নে, চল্।

ওরা দুজনে বের হয়ে গেল।

 ০৭. ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি

ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি-বাঁয়ে একটা রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকে একটা গলির মধ্যে দোতলা একটা বাড়ি।

নিচের ঘরে আলো জ্বলছিল। কলিংবেল টিপতেই একটু পরে ঘরের দরজাটা খুলে গেল, কে?

ওরা দুজনে দরজার গোড়াতেই তখনও দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী। পাতলা দোহারা চেহারা। পরনে একটা সিল্কের শাড়ি। চোখ-মুখ খুব সুশ্রী না হলেও উচ্ছল যৌবনরসে ও প্রসাধনে সুন্দরই দেখাচ্ছিল তরুণীকে। দুহাতে চারগাছা করে সোনার চুড়ি।

কাকে চান?

সুব্রতই কথা বললে, হীরেন বাড়ি আছে?

আছেন তরুণী বললে।

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তখন তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

সুব্রত বললে, বলুন গিয়ে তাকে, সুব্রত এসেছে—সঙ্গে কিরীটী।

নিচের ঘরে ওদের বসিয়ে তরুণী ওপরে চলে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এসে ওদের বললে, কিন্তু এখন তো দেখা হবে না।

হবে না? কেন?

তিনি ঘুমোচ্ছেন।

ঘুমোচ্ছে! এত তাড়াতাড়ি? সুব্রতই আবার প্রশ্ন করে।

রোজ এই সময়টা ঘুমের ওষুধ খান রাত্রে ঘুম হয় না বলে। ইঞ্জেকশান দেবার পর ঘুমোচ্ছেন।

ওঃ। তাহলে আর কি হবে! কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে সুব্রত।

কিরীটী বললে, হুঁ। চল, ফেরা যাক।

আচ্ছা, নমস্কার। আসি।

তরুণীও প্রতিনমস্কার জানালো দুটি হাত তুলে, নমস্কার।

ফিরে এসে ওরা গাড়িতে উঠে বসল।

কিধার জায়গা সাব? হীরা সিং শুধায়।

একবার শ্যামবাজার চল হীরা সিং-নাট্যমঞ্চ থিয়েটারে।

হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।

সুব্রত একটু যেন বিস্মিত হয়েই বলে, আজ তো বুধবার, থিয়েটার নেই!

জানি। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।

তবে?

সজনীবাবু নিশ্চয়ই আছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করব।

সজনী গুপ্ত নামকরা একজন নাট্যকার ও নাট্য-পরিচালক এবং দীর্ঘদিন ধরে নাট্যশালার সঙ্গে জড়িত।

গাড়ি চলেছে শ্যামবাজারের দিকে। কিরীটী চুপচাপ বসে সিগার টানছে।

ব্যাপার কি বল তো কিরীটী, হঠাৎ নাট্যমঞ্চে কেন?

সন্দেহের একটা নিরসন করব মাত্র। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

কীসের সন্দেহ?

চল্ না!

থিয়েটারের সামনে যখন ওরা এসে নামল, তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। কাউন্টার বন্ধ, তবে লবিতে আলো ছিল।

লবিতে দেওয়ালের শো-কেশে বর্তমান নাটকের সব স্টীল টাঙানো। কিরীটী গেটে উপবিষ্ট দারোয়ানকেই শুধাল, সজনীবাবু হ্যায় দারোয়ান?

জী। উপরমে।

ওরা ওপরে উঠে গেল দোতলার সিঁড়ি দিয়ে। সরু প্যাসেজটার শেষপ্রান্তে সজনী গুপ্তর ঘর।

কিরীটী আর সুব্রত ঘরে ঢুকতেই সজনী বললেন, আসুন, আসুন—কি সৌভাগ্য আমার। বসুন, বসুন।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসতে বসতে কিরীটী বলল, সজনীবাবু, আপনার নতুন নাটকের স্টীল দিয়ে নিশ্চয়ই একটা অ্যালবাম তৈরি করেছেন?

হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

আছে সেটা এখানে?

আছে।

একবার দেখতে পারি?

দাঁড়ান, আগে চায়ের কথা বলি। সজনী বেল বাজালেন।

বেয়ারা রামলাল এসে ঘরে ঢুকতেই তিনি আবার বললেন, তিন কাপ ভাল চা নিয়ে আয় রামলাল।

রামলাল চলে গেল।

সজনী ঘরের আলমারি খুলে একটা ফটোর অ্যালবাম বের করে কিরীটীর সামনে। এগিয়ে দিলেন।

সুব্রত তখনও বুঝে উঠতে পারছে না, ব্যাপারটা কি! কেন কিরীটী এখানে এল আর কেনই বা তার চলতি নাটকের নির্বাচিত দৃশ্যগুলোর অ্যালবামের প্রয়োজন হল।

কিরীটী অ্যালবামটা টেবিলের উপরে রেখে পাতা উলটোতে উলটোতে চতুর্থ পৃষ্ঠায় একটা ফটোর প্রতি সজনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললে, এই মেয়েটি কে সজনীবাবু?

ও তো সঞ্চারিণী বিশ্বাস!

সুব্রতও ততক্ষণে ফটোটার ওপর ঝুঁকে পড়েছে এবং ঝুঁকে পড়েই চমকে উঠেছে। কোথায় যেন মেয়েটিকে সে দেখেছ! কিন্তু কোথায় দেখেছে, সেই মুহূর্তে কিছুতে মনে করতে পারল না।

মেয়েটি কতদিন আপনার থিয়েটারে আছে?

তা প্রায় বছর পাঁচেক হল। কিছু বেশিও হতে পারে। Talent আছে মেয়েটির। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু ঘরের মেয়ে, কেন বলুন তো?

হীরেন সরকারকে আপনি জানেন?

জানব না কেন—একসময় তো এখানে অভিনয় করত, এখানকারই আর্টিস্ট ছিল!

অভিনয়-ক্ষমতা কেমন ছিল?

খুব ভাল অভিনয় করত। বেচারী হঠাৎ মাস আষ্টেক আগে কি হয়ে যেন পঙ্গু হয়ে গেছে—একেবার শয্যাশায়ী।

থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

সঞ্চারিণী বিশ্বাসের সঙ্গে হীরেন সরকারের যথেষ্ট দহরম-মহরম ছিল, তাই না?

সজনী হাসলেন।—ঠিক। এখনও বোধ হয় তার keepingয়েই আছে সঞ্চারিণী।

হীরেন সরকারের তো আর্থিক অবস্থা এখন তেমন সুবিধার নয়, তবে?

তবু কেন সঞ্চারিণী তার সঙ্গে আছে, তাই না?

হ্যাঁ।

ওসব মশাই ভালবাসাবাসির ব্যাপার–দুর্জ্ঞেয়!

কিরীটী হেসে বললে, তাই দেখছি।

ইতিমধ্যে চা এসে গিয়েছিল।

চা-পান করতে করতে একসময় কিরীটী বললেন, অসুখ হবার পর হীরেন সরকারের সঙ্গে আপনার আর কখনও দেখা হয়েছে সজনীবাবু?

না। ওই সঞ্চারিণীর কাছেই মধ্যে মধ্যে তার খবর পাই।

রাত নটা নাগাদ অতঃপর কিরীটী উঠে দাঁড়াল।-আজ চলি সজনীবাবু।

কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো, হঠাৎ সঞ্চারিণী ও হীরেন সরকারের খোঁজখবরে আপনার কি প্রয়োজন হল রায়সাহেব? সজনী প্রশ্ন করলেন।

একটা কবিতার শেষ পঙক্তি মিলছিল না, সেটা মেলাবার জন্য এসেছিলাম আপনার কাছে।

কবিতার শেষ পংক্তি! কথাটা বলে সজনী কেমন যেন বিস্ময়ের সঙ্গে তাকান কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ। আচ্ছা চলি। Good night.

সুব্রতর কাছে ব্যাপারটা তখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।

দুজনে এসে আবার গাড়িতে উঠে বসল।

কিরীটী বললে, কোঠি চল হীরা সিং।

হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।

.

গৃহে প্রত্যাবর্তন করে আহারাদির পর কিরীটী, সুব্রত ও কৃষ্ণা তিনজনে বসবার ঘরে এসে বসল। জংলী ওদের কফি দিয়ে গেল।

এতক্ষণ কিরীটী একটা কথা বলেনি, সুব্রতও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও, সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারছিল, কোন কিছুর একটা সমাধানের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে সে পৌঁছেছে।

ভ্রূ-যুগল সরল। চোখে একটা আনন্দের দীপ্তি ঝকঝক করছে।

কিরীটী?

উঁ।

মনে হচ্ছে যেন—

কীসের কি মনে হচ্ছে?

নীল রুমালের রহস্য যেন তোর কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে!

তা এসেছে। চারের অঙ্ক প্রায় মিলের মুখে। এখন কেবল শেষ পর্বের শেষ অধ্যায়ের পূর্ববর্তী অধ্যায়টি বাকি।

মানে?

শিবানন্দ-কাহিনী শিবানন্দ!

হ্যাঁ। প্রথমে শ্ৰীমন্ত, তারপর হারাধন, তারপর শশধর, এইবার শ্রীমান শিবানন্দের পালা। আর তাহলেই গ্রন্থ সমাপ্ত। কিন্তু ওই সঙ্গে একটা কথা কি মনে হচ্ছে জানিস?

কি?

ওরা প্রত্যেকেই deserved it! তাহলেও একটা কথা থেকে যাচ্ছে–

কৃষ্ণা শুধায়, কি গো?

কিরীটী বললে, আইন যদি সবাই যে যার খুশিমত হাতে তুলে নেয়, তাহলে আইন বলে আর কোন কিছু থাকে না। আইন-আদালত সব প্রহসন হয়ে যায়। তাই বলছিলাম—

কি? স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা প্রশ্নটা করে।

আইন ভাঙার দণ্ড আইনভঙ্গকারীকে মাথা পেতে নিতেই হবে। শান্ত গলায় কিরীটী জবাব দেয়।

সুব্রত বললে, শিবানন্দকে তুই বাঁচাতে পারবি?

পারব কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করব। তার বাড়ির চারপাশে পাহারাও রাখা হয়েছে।

বাইরে শীতের রাত তখন নিঝুম হয়ে এসেছে।

সুব্রত হঠাৎ উঠে পড়ে বলে, এবারে তাহলে উঠি রে—

কিরীটী বলে, মাথা খারাপ নাকি!

কৃষ্ণা বলে, আরে, তোমার বিছানা আমি করে রেখেছি।

০৮. সুব্রত হাসতে হাসতে বলে

সুব্রত হাসতে হাসতে বলে, একেই বলে সুগৃহিণী!

কৃষ্ণা হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তর দেয়, তুমি কি বুঝবে গৃহিণীর স্বাদ-চিরটা কাল তো ব্রহ্মচর্য আশ্রমেরই পাণ্ডাগিরি করলে।

সুব্রত সখেদে বলে ওঠে, হায় ব্রুটাস, তুমিও-না, একটা ব্যবস্থা এবারে করতে হয় দেখছি—

কৃষ্ণা উৎসাহিত হয়ে উঠে বলে, সত্যি বলছ! কুন্তলাকে তাহলে সুসংবাদটা–

তিষ্ট—তিষ্ট দেবী, অত ব্যাকুল হয়ো না। সুব্রত বলে, আগে কৌশলে না হয় তার মতামতটা জেনে নাও।

সে আর জানতে হবে না, কৃষ্ণা বলে, হুঁবলে পাগলা খাবি, না আঁচাব কোথায়!

না দেবী কৃষ্ণা, সে ভদ্রমহিলাটিকে তাহলে এখনও সম্যক চিনতে পারনি।

তাই বুঝি! আচ্ছা দেখি–

কিরীটী বাধা দেয়, কেন বাজে সময় নষ্ট করছ কৃষ্ণা, ও মহাপাষণ্ড, ওর মুক্তি নেই।

সুব্রত হো হো করে হেসে ওঠে, দেখছ। কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, তোমার স্বামীরত্নটি আমাকে কেমন চিনেছে! কিন্তু রাত কত হল?

সকলেই দেওয়ালের গায়ে বসানো সুদৃশ্য ইলেকট্রিক ওয়াল-ক্লকটির দিকে একসঙ্গে দৃষ্টিপাত করল।

রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট।

সুব্রত বললে, না, এমন কিছু রাত হয়নি।

কৃষ্ণা হেসে বলে, কফি চাই তো?

সুব্রত বলে, এই জন্যই তো তোমাকে আমার এত পছন্দ–

খুব হয়েছে। বসো আনছি।

কেন, জংলী—

জংলী! তার এখন মধ্যরাত্রি।

বলতে বলতে কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

সুব্রত তার নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।

কৃষ্ণাও এতক্ষণে হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত প্রায় পৌনে একটা।

শীতের রাত্রি, বাইরে যেন বরফ ঝরছে। ঠাণ্ডাও পড়েছে প্রচণ্ড। কিরীটী ঘুমোয়নি। সোফা-কাম বেডটার ওপর পিঠের তলায় একটা ডানলোপিলোর বলিশ দিয়ে মুখে পাইপ গুজে আধ-শোয়া আধ-বসা অবস্থায় রয়েছে। চোখ দুটি বোজা।

ব্যাপারটা মোটামুটি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কিরীটীর কাছে।

দীর্ঘদিনের স্বর্ণব্যবসায়ী সরকার ব্রাদার্সের অতবড় নামকরা প্রতিষ্ঠানের ইমারতের তলায় কতকগুলো দুষ্ট ইঁদুর বাসা বেঁধেছিল এবং পুরাতন মালিকদের মৃত্যুর পর নতুন সব অনভিজ্ঞ তরুণ মালিকদের হাতে যখন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এসে পড়ল, সেই সুবর্ণ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে দুষ্টু হঁদুরের দল এতটুকু দেরি করেনি।

কৌশলে ওদের অনভিজ্ঞতার সুযোগে প্রতিষ্ঠানটাকে ক্রমশ একটু একটু করে শোষণে শোষণে ঝাঁজরা করে ফেলেছে।

নদীর এক পাড়ে ভেঙেছে, অন্য পাড় গড়ে উঠেছে।

হীরেন সরকাররা তিন ভাই সর্বস্বান্ত হয়েছে, আর অন্য দিকে শশধর, শ্রীমন্ত, হারাধন ও শ্রীমান শিবানাথ নিভৃতে ওই বুদ্ধুদের চোখের আড়ালে আখেরটাই নিজের নিজের কেবল গুছিয়ে নেয়নি, এক-একজন শাঁসালো হয়ে উঠেছে।

তারপর একদিন অকস্মাৎ ভ্রাতৃত্রয়ের যখন চেতনা হল, তখন ওই চার মূর্তিকে ধরাছোঁয়ার আর উপায় নেই। প্রমাণ নেই—কোন প্রমাণ নেই!

অতএব যা হবার তাই হল, অতদিনকার অত বড় প্রাতিষ্ঠানটা পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হল।

ওর সঙ্গে নাটকের প্রথম অঙ্কের উপর হল যবনিকাপাত।

তারপর বেশ কিছুদিন পরে শুরু হল নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক। আবার যবনিকা উত্তোলিত হল রঙ্গমঞ্চের।

শ্ৰীমন্ত, শশধর, হারাধন, শিবানন্দ-যে যার মত করে জুয়েলারি শপ খুলে ব্যবসা শুরু করে দিল, সরকার প্রতিষ্ঠানের অন্ধকার সুড়ঙ্গ-পথে অর্জিত মূলধন নিয়ে। দিনে দিনে সকলেরই ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হাস্যে তাদের প্রতি কৃপাবৃষ্টি করতে লাগলেন। কিন্তু চার মূর্তি তখনও কল্পনাও করতে পারেনি, তাদের ভাগ্যাকাশে মেঘের সঞ্চার শুরু হয়েছে।

মেঘ ক্রমশ ঘন হতে ঘনতর হতে থাকে।

তারপরই অতর্কিতে এল বজ্রঘাত—সেই মেঘের বুক থেকে।

শ্ৰীমন্তকে তার মূল্য শোধ করতে হল। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল। নম্বর এক।

তারপরই বজ্ৰ নামল হারাধনের মাথায়, পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারও হল। নম্বর দুই।

দুজনের প্রায়শ্চিত্ত দিবসের মধ্যে মাত্ৰকুড়ি দিবসের ব্যবধান। ঠিক কুড়িদিন পরে আবার বজ্র নেমে এল। এবারে শশধর—নম্বর তিন।

কি চমৎকার অঙ্কশাস্ত্রানুযায়ী বিচার!

কোথাও কোন ত্রুটি বা ভুলচুক নেই। একটি একটি করে বোড়ের চাল।

এবারে মধ্যে আর দিন তেরো-চোদ্দ বাকি। পূর্ব-পরিকল্পনানুযায়ী যদি চলতে থাকে তাহলে চতুর্থ—অর্থাৎ চারে বেদ-শ্রীমান শিবানন্দ।

আর তাহলেই দ্বিতীয় অঙ্কের উপরে যবনিকাপাত।

ঘটনাচক্রে তার দৃষ্টিতে যদি ওই অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটা না পড়ত, তাহলে হয়ত নাটক দ্বিতীয় অঙ্কেই নিঃশব্দে শেষ হয়ে যেত।

প্রেক্ষাগৃহে অন্ধকার নেমে আসত। আর হয়ত কোনদিনই আলো জ্বলত না।

কিরীটী কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আপন মনেই মৃদু হাসে।

কিন্তু ওই নাটকের সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যে মঞ্চের গ্রীনরুমে আরও একটি যে নাটক সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রধান অভিনেতাটি কে?

নেপথ্য থেকে কার অদৃশ্য কালো হাত একের পর এক নীল রুমালের ফাস গলায় পরাচ্ছে? নটশিরোমণি সেই ব্যক্তি সন্দেহ নেই।

কি গো, শোবে না?

কিরীটীর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায় কৃষ্ণার ডাকে।

কে? ও, কৃষ্ণা।

শুতে যাবে না? রাত যে শেষ হতে চলল?

কটা রাত?

রাত আড়াইটে।

হ্যাঁ, চল।

কিরীটী শয়নকক্ষে প্রবেশ করে শয্যায় আশ্রয় নিল।

.

পরের দিন সকালে কিরীটীর যখন নিদ্রাভঙ্গ হল, অনেক বেলা হয়ে গেছে, বেলা প্রায় সাতটা।

প্রচুর রোদে ঘর ভরে গেছে।

কৃষ্ণা বার-দুই এসে চা নিয়ে ফিরে গেছে। ঘুমোচ্ছে দেখে কিরীটীকে আর ডাকেনি।

সাতটা নাগাদ কিরীটীর ঘুম ভাঙতেই দেখে ঘরে ঢুকছে কৃষ্ণা।

কৃষ্ণা বললে, চা আনি?

কিরীটী বললে, হ্যাঁ, নিয়ে এস। কিন্তু ডাকনি কেন, এত বেলা হয়ে গেছে!

কৃষ্ণা বললে, তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি চা আনি।

সুব্রত উঠেছে?

কখন! বিকাশবাবু তো কোন্ সকালেই এসে হাজির—তার সঙ্গে বসে গল্প করছে।

বিকাশ এসেছে! যাক, নচেৎ আমাকেই যেতে হত তার ওখানে।

কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী হাত মুখ ধুয়ে বসবার ঘরে এসে যখন ঢুকল, সুব্রত তখন বিকাশ সেনকে তাদের গতরাত্রের অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করছিল।

কিরীটীকে ঘরে ঢুকতে দেখে বিকাশ বললে, সরকার-বাড়ির সব ঠিকুজি নক্ষত্র যোগাড় করে ফেলেছি, রায়সাহেব!

বসতে বসতে মৃদু হেসে বলল কিরীটী, চা-জলখাবার হয়েছে?

মিসেস রায় কি বাকি রেখেছেন তা—অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।

জংলী ওই সময় ট্রেতে করে তিন কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে এসে ঘর প্রবেশ করল।

চা-পান করতে করতে কিরীটী বললে, বল, এবার শোনা যাক, কি সংবাদ সংগ্রহ করলে!

তিন ভাই-বিকাশ বললে।

তা তো জানি।

শুনেছেন তাহলে? মেজ ভায়ের কোন সন্তানাদি ছিল না। বড় ভায়ের দুই ছেলে নীরেন্দ্র, হরেন্দ্র আর ছোট ভাইয়ের এক ছেলে হীরেন্দ্র।

তা আগেই শুনেছি, কিন্তু হরেন্দ্র এবং নীরেন্দ্র এখন কি করছে? কি করে তাদের চলে, জানতে পারলে কিছু?

হীরেন্দ্র অসুস্থ, পক্ষাঘাতে পঙ্গু। কারও সঙ্গে দেখা করে না।

তাও জানি। আর বাকি দুজন?

ওদের মধ্যে দেখলাম, সদ্ভাব নেই। বিজনেস গুটিয়ে ফেলবার পর—যদিও একই বাড়িতে থাকে এখনও, ধার-দেনা শোধ করেও যা অবশিষ্ট ছিল তাও কম নয়। কলকাতার ওপরে খান-দুই বাড়ি। একটা ল্যান্সডাউন মার্কেটের সামনে, অন্যটা শ্যামবাজার অঞ্চলে। নীরেন্দ্র ও হরেন্দ্রর ভাগে শ্যামবাজারের বড় বাড়িটা পড়ল, ছোট বাড়িটা পেল হীরেন্দ্র। নগদ টাকাও ওদের কিছু ছিল, তা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেল।

তারপর? কিরীটী শুধায়।

নীরেন্দ্র বড় ভাই ওদের মধ্যে, কোনমতে সামলে-সুমলে নিয়ে এখন পুরাতন মোটরের বেচা-কেনার ব্যবসা করে। মোটামুটি ভালই চলে যাচ্ছে। হরেন্দ্রর আগে থাকতেই রেস খেলার নেশা ছিল, এখনও আছে। সংসারে স্ত্রী ও দুটি মেয়ে, দুটিই বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে। শ্যামবাজারের বাড়ির নিচের তলাটা নিয়ে সে থাকে।

সংসার চলে কি করে তার? রোজগারপত্তর কি?

সেটাই আশ্চর্য! কিছুই তেমন করে না—যতদুর সংবাদ পেয়েছি। তবে বেশ। সচ্ছলতার সঙ্গেই চলে যায় বলে মনে হল। কিন্তু বেশি প্রশ্ন করতে পারিনি।

কেন?

যেমন ষণ্ডাগুণ্ডা মার্কা চেহারা, তেমনি কাঠগোঁয়ার, বদমেজাজী। মানে মানে সরে এসেছি।

আর নীরেন্দ্র।

ভদ্রলোক যথেষ্ট অমায়িক, ভদ্র। বললেন, দেখুন না, বরাতের ফের—কি ছিলাম আর কি হয়েছি! কোন বংশের ছেলে হয়ে আজ পুরনো গাড়ি বেচাকেনার ব্যবসা করছি!

ওদের মুখে কিছু শুনলে না আর? ব্যবসাটা গেল কেন?

হ্যাঁ, ওদের কজন পুরনো কর্মচারীই নাকি ওদের পথে বসিয়েছে যোগসাজস করে একত্রে চুরি করে।

শ্ৰীমন্ত, শশধর, হারাধন আর শিবানন্দ,-তাও জানি।

হ্যাঁ। ওদের ওপর দেখলাম হরেন্দ্রবাবুর ভীষণ রাগ। পারলে যেন টুটি ছিঁড়ে ফেলে।

কিরীটী হেসে বললে, স্বাভাবিক।

 ০৯. এবার কি কর্তব্য বলুন

এবার কি কর্তব্য বলুন?

কথাটা বলে বিকাশ সেন প্রত্যাশাপূর্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।

অপেক্ষা করতে হবে! কেন?

প্রশ্নটা করে বিকাশ সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

কার হত্যাকারী এখন তার চতুর্থ শিকারটিকে খতম করার প্ল্যান করছে-কী ভাবে এবার নীল রুমাল হাতে আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটবে–

কিন্তু–

ভয় নেই বিকাশ, এবারে অত সহজে তাকে কাজ হাসিল করতে দেওয়া হবে না।

.

সত্যি-সত্যিই দেখা গেল কিরীটী যেন নীল রুমালের দ্বারা হত্যাকাণ্ডগুলির ব্যাপারে একেবারে হাত ধুয়ে বসে আছে। ও যেন ভুলেই গেছে ব্যাপারটা।

দিন দুই পরে আবার সে দুদিনের জন্য ট্রাঙ্ককল পেয়ে দিল্লী থেকে ঘুরে এল।

আরও দিন দুই পরে।

গত সন্ধ্যা থেকেই অসময়ে আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, ফলে শীতটাও যেন হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

কিরীটী গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে আরাম করে বিছানার ওপর বসে বসেই গরম গরম কফি পান করছিল।

এমন সময় জংলী এসে ঘর ঢুকল, বাবুজী! কি রে? বিকাশবাবু!

কিরীটী আর মুহূর্ত দেরি করে না। সঙ্গে সঙ্গে কফি শেষ করে কম্বলটা গা থেকে ফেলে উঠে দাঁড়াল। পাশে খাটের বাজু থেকে গরম ড্রেসিং গাউনটা টেনে গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে সোজা এসে বসবার ঘরে ঢুকল।

কি খবর বিকাশ-সকাল বেলতেই—

যা হবার তা হয়ে গেছে মিস্টার রায়। হতাশার সুরে বলে উঠল বিকাশ সেন।

সত্যি!

হ্যাঁ, নীল রুমাল আবার ফাঁস লাগিয়েছে–

কোথায়?

বালিগঞ্জে বোস অ্যান্ড কোং জুয়েলারি শপের প্রোপ্রাইটার—

কে, শিবানন্দ?

হ্যাঁ, শিবানন্দ বসু। বিকাশ বলে।

আশ্চর্য! ভাবতে পারিনি, সে এত তাড়াতাড়ি আবার নীল রুমাল হাতে নিয়ে আবির্ভূত হবে। এবারে আমার ক্যালকুলেশনটা দেখছি ভুল হয়ে গেল।

ভুল হয়ে গেল।

হ্যাঁ। ভেবেছিলাম, হত্যাকারী এবারে আরও সতর্ক হবে। কিন্তু দেখলাম, হাতের পাঁচ আর সে হাতে রাখতে চায় না—আগেভাগে মিটিয়ে দিয়ে প্রোগ্রামটা তার খতম করতে চায়। তা সংবাদটা পেলে কখন? কার কাছে?

রথীন তালুকদার তো এখানকার থানার ও. সি.-সেই-ই আমাকে ঘণ্টাখানেক আগে জানাতেই সেখানে গিয়ে ব্যাপারটা চাক্ষুষ দেখে সংবাদটা দিতে আমি ছুটে এসেছি আপনার কাছে।

রথীনবাবু কখন জানতে পারলেন?

শেষ রাত্রে।

কি করে জানলেন?

Some unknown person ভোররাত সাড়ে তিনটে নাগাদ তাকে ফোন করে সংবাদটা দেয়–

কি সংবাদটা দিয়েছিল?

Rather interesting! ফোনে তাকে বলে, ও মশাই থানা-অফিসার, ঘুমোচ্ছেন এখনও? আপনার এলাকায় যে নীল রুমাল ফস পরিয়েছে—বোস অ্যান্ড কোং জুয়েলারি শপের প্রোপ্রাইটারকে। বলেই ফোন কনেকশান কেটে দেয়। বুঝতেই পারছেন, এ শহরের সব থানা-অফিসারদের মধ্যে আমাদেরও এ নীল রুমালকে কেন্দ্র করে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল—প্রত্যেকেই যেন আমরা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। তাই ফোনটা পাওয়া মাত্রই রথীন কালবিলম্ব না করে তখুনি ছুটে যায়।

তারপর?

দোকানঘরের কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া ছিল না, রথীন দুজন কনেস্টবল নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখল, ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছিল–

দারোয়ান-কোন দারোয়ান ছিল না?

না, দোকানে রাত্রে যে দারোয়ানটি পাহারায় থাকত, তার কোন পাত্তাই নেই। পরে অবিশ্যি তাকে মুখ ও হাত-পা-বাঁধা অবস্থায় দোকানের পেছনে একটা ঘরে পড়ে থাকতে দেখা যায়-গোঁ গোঁ করছিল, যাক যা বলছিলাম, দোকানের কোলাপসিবল গেটটায় তালা দেওয়া ছিল না, কেবল টানা ছিল।

রতীনবাবু কি করলেন?

ওই সময় সুব্রত এসে ঘরে ঢুকল।

বিকাশ বলতে থাকে, সে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল ভেতরে আলো জ্বলতে দেখে। দোকানের মধ্যে সব আললাগুলো জ্বলছে। তীব্র চোখ-ঝলসানো আলোতেই চোখে পড়ল, কাউন্টারের সামনেই শিবানন্দ বসুর মৃতদেহটা পড়ে আছে। তার গলায় ফাঁস দেওয়া একটি আকাশ-নীল রঙের রুমাল।

রুমালটা দেখেছেন আপনি?

হ্যাঁ, সেই একই ধরনের রুমাল। এবং রুমালের কোণে ইংরাজি সাঙ্কেতিক অক্ষর 4 লেখা এবারে।

মৃতদহ এখন কোথায়?

দোকানেই পড়ে আছে। দোকানে পুলিস-প্রহরা বসানো হয়েছে। রথীন আমার অনেককালের বন্ধু। সে-ই দোকান থেকে আমাকে ফোন করায় তার থানায় আমি ছুটে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি সংবাদটা আপনাকে দিতে।

চল, একবার যাওয়া যাক সেখানে।…একটু অপেক্ষা কর বিকাশ, আমি এখুনি আসছি।

কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

এবং মিনিট কয়েক পরেই বিকাশের জীপেই কিরীটী ও সুব্রতকে নিয়ে বিকাশ রওনা হল।

গাড়িতেই বসে সুব্রত সব শুনল।

.

দোকানের মধ্যে তখনও রথীন ছিলেন।

তিনি নানাভাবে দারোয়ানটাকে প্রশ্ন করছেন তখন, অনেক কষ্টে তার জ্ঞান ফেরানো হয়েছে। বেচারা কেবলই বলছে, দোহাই হুজুরের, সে কিছু জানে না। রাত সোয়া দুটো কি আড়াইটে নাগাদ তার মালিক এসে তাকে ডাকাডাকি করতেই সে ঘুম থেকে উঠে দোকানের গেট খুলে দেয়।

তারপর কি হল, বল?

আমি দরজা খুলে দিলাম, মালিক দোকানে এসে প্রবেশ করলেন।

তারপর?

তারপর তাজ্জব কি বাৎ! মালিক সহসা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার মাথায় একটা ভারী ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করতেই আমি পড়ে যাই—জ্ঞান হারাই। তারপর আর কিছু জানি না।

কিরীটী বললে, রথীনবাবু, কিছু চুরি বোধ হয় যায়নি?

ঠিক বলতে পারছি না, তবে কোন তালা বা আয়রন সেফের তালা তো ভাঙা দেখছি না।

হুঁ! মৃতদেহটা কোথায়?

ওই যে কাউন্টারের পেছনে।

হঠাৎ ওই সময় কিরীটীর নজরে পড়ে কাউন্টারের নিচে কি যেন একটা পড়ে আছে। ঝুঁকে জিনিসটা তুলে দেখেই চমকে ওঠে। কিন্তু সে কিছু না বলে সবার অলক্ষ্যে সেটা পকেটে রেখে দেয়।

অতঃপর সকলে উঁচু কাউন্টারের পেছনে এগিয়ে গেল।

মৃতদেহটা তখনও উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রেশমী রুমালটা কেবল গলা থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে। গায়ে একটা শাল জড়ানো, পরনে ধুতি।

কিরীটী মুহূর্তকাল মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে আরও সামান্য একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে মৃতদেহটা উলটে দিতেই মৃতদেহটা চিৎ হয়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মুখ দিয়ে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বের হয়ে এল, এ কি!

কি হল? একই সঙ্গে রথীন, সুব্রত ও বিকাশ প্রশ্নটা করে।

না, কিছু না। কিরীটী বললে।

সুব্রত এতক্ষণে চিনতে পারে। কিছুদিন আগে শশধরের মৃত্যুর পরদিন শিবানন্দ বসু পরিচয়ে যে আতঙ্কিত খঞ্জ ভদ্রলোকটি কিরীটীর গৃহে গিয়েছিল এ সে লোক নয়।

সুব্রত বলে, তাই তো! এ কে তাহলে?

রথীনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শুধাল, আর ইউ সিওর রথীনবাবু, ইনিই শিবানন্দ বসু?

নিশ্চয়ই। দারোয়ান সনাক্ত করেছে, শিবানন্দর ছেলে একটু আগে এসেছিল, সেও তো সনাক্ত করে বলে গেছে, এ তারই বাপ। রথীন বললেন।

তবে, কিরীটী যেন মুহূর্তকাল কি চিন্তা করে। তারপর বলে, রথীনবাবু, এখুনি আমাদের বেরোতে হবে।

কোথায়?

হত্যাকারীকে ধরতে চান তো?

হত্যাকারী। সে কি আর এতক্ষণ ত্রিসীমানায় কোথাও আছে?

ত্রিসীমানায় না থাকলেও মহাশয় ব্যক্তিটি তার নিজস্ব ডেরায় সুস্থ বহাল তবিয়তেই নিশ্চিন্তে বসে বা শুয়ে আছে।

কি বলছেন?

হ্যাঁ, চলুন—আর দেরি নয়। চল বিকাশ।

রথীন জানতেন কিরীটীকে, তার শক্তির কথা জানতেন—ইতিপূর্বে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের কোন সুযোগ না ঘটলেও। কাজেই তিনি আর দ্বিরুক্তি করেন না। সঙ্গের পুলিসপ্রহরীর জিম্মায় আপাতত দোকানঘর ও মৃতদেহ রেখে বাইরে এসে বিকাশেরই জীপেই উঠে বসল সকলে।

বিকাশই জীপ চালাচ্ছিল। শুধালে, কোন দিকে যাব?

বেলগাছিয়ায়।

বিকাশ বিনা বাক্যব্যয়ে জীপে স্টার্ট দিয়ে এগোতে লাগল।

সকাল নটা বাজে প্রায় তখন।

সুব্রতর কাছে তখন সমস্ত ব্যপারটা যেমন ঝাপসা, তেমনি অস্পষ্ট। সে বুঝতে পারছিল না, কিরীটী কেন বেলগাছিয়ায় চলেছে।

রাস্তায় আর কথা হল না। কেউ জিজ্ঞাসাও করে না, কেন তারা বেলগাছিয়ায় চলেছে!

সকালের দিকে রাস্তায় তখনও তেমন ভিড় জমে ওঠেনি।

বেলা পৌনে দশটা নাগাদ ওরা বেলগাছিয়া ব্রীজ ক্রস করে একটা সরু রাস্তার সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে কিরীটীর নির্দেশে সকলে নামল।

রথীনবাবু, আপনার সঙ্গে পিস্তল আছে?

আছে। রথীন জবাব দেন।

চলুন।

১০. সরু রাস্তাটা থেকে সকলে

সরু রাস্তাটা থেকে সকলে এসে একটা অপ্রশস্ত গলির মধ্যে প্রবেশ করল।

আগে আগে কিরীটী, পশ্চাতে ওরা তিনজন। নিঃশব্দে ওরা তিনজন কিরীটীকে অনুসরণ করে।

একটা তিনতলা বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়াল।

বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কলিংবেলটা টিপতেই একজন প্রৌঢ় ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল।

কিন্তু লোকটা চারজনের মধ্যে পুলিসের পোশাক পরা দুজনকে দেখে হঠাৎ যেন কেমন বোবা হয়ে যায়।

তোমার মা বাড়িতে আছেন?

মা!

হ্যাঁ। আছেন? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

আছেন। লোকটি বলে।

কোথায়?

দোতলায়। খবর দেব?

না। আসুন রথীনবাবু, এস বিকাশ। বলে কিরীটীই প্রথমে দোতলার সিঁড়ির দিকে। এগিয়ে যায়।

ভৃত্যটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিসের লোক বলে বাধা দিতে সাহস পায় না বোধ হয়।

দোতলায় উঠতেই সামনের ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে যে ভদ্রমহিলা ওদের সামনে এসে দাঁড়াল, বিকাশ ও রথীন তাকে চিনতে না পারলেও সুব্রত তাকে চিনতে পারে।

নমস্কার সঞ্চারিণী দেবী। চিনতে পারছেন! কিরীটীই কথা বললে।

সঞ্চারিণী বিশ্বাসের মুখের ভাবটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না তো।

চিনতে পারছেন না। কয়েকদিন আগেই তো আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল।

কোথায় বলুন তো?

বলছি। আপনার তিনিটি নিশ্চয় এখানেই আছেন?

তিনি!

হ্যাঁ, হীরেন সরকার?

তিনি এখানে থাকতে যাবেন কেন?

যে কারণে আপনি সেদিন তার ওখানে ছিলেন, সেই কারণেই হয়ত তিনিও আপনার এখানে! সরে দাঁড়ান, আমরা ঘরে যেতে চাই

ঘরে যাবেন!

কেন, আপত্তি আছে? কিরীটী শুধোয়।

তা আছে বৈকি! বিনা ওয়ারেন্টে আমার ঘরে আপনাদের ঢুকতে দেব কেন?

মিথ্যে চেষ্টা করছেন সঞ্চারিণী দেবী। তাকে পালাবার সুযোগ আপনি করে দিতে পারবেন না। কারণ আমি জানি, ওই সিঁড়ি ছাড়া দোতলা থেকে নামবার আর কোন রাস্তা নেই। এ বাড়িটার detils আপনাদের থিয়েটারেরই এক অভিনেত্রীর কাছ থেকে পূর্বাহেই আমার সংগ্রহ করা আছে।

সঞ্চারণী বিশ্বাস যে বোবা।

সরে দাঁড়ান। সঞ্চারিণী সরে দাঁড়াল। সকলে ঘরে প্রবেশ করল।

শয্যার ওপরে কে যেন পেছন ফিরে আগাগোড়া একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

কিরীটী মুহূর্তকাল দাঁড়াল, তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে এক হেঁচকা টান দিয়ে কম্বলটা ফেলে দিতেই যে লোকটি উঠে বসল সে হীরেন সরকার।

হীরেন সরকার বলে ওঠে, কে আপনারা? এসবের মানে কি?

হীরেনবাবু, নমস্কার। এঁরা দুজন থানা-অফিসার, আর আমাকে আপনার না চেনার কথা নয়–

না, আপনাকে আমি চিনি না—never seen you before in my life!

সুব্রতও অবাক হয়ে হীরেন সরকারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

কিরীটী আবার ব্যঙ্গভরে বলে ওঠে, চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য! আমার বাড়িতে গিয়ে আমার মুখোমুখি বসে শিবানন্দ বোস সেজে অত কথা বলে এলেন, আর এর মধ্যেই সব ভুলে গেলেন? না না, তাও কি হয়!

কি আবোল-তাবোল বকছেন মশাই! আট মাসের ওপর আমি

আপনি পঙ্গু-শয্যাশায়ী, তাই না? আর তাতেই বুঝি খোসমেজাজে একবার ল্যান্সডাউনের বাড়িতে আর একবার এখানকার বাড়িতে যাতায়াত করে থাকেন? শুনুন হীরেনবাবু, আর যার চেখেই ধুলো দিন না কেন, কিরীটী রায়ের চোখে আপনি ধুলো দিতে পারেন নি। প্রথম দিনই মোলাকাতের সময় আমার ওখানে আপনার সত্যকার পরিচয়টা আমার চোখের সামনে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।

হীরেন সরকার বাবা।

হ্যাঁ, আপনার হাতের মীনা করা একটা আংটি-ওই যে এখনও আপনার ডান হাতের অনামিকায় রয়েছে বাংলায় ওপরে লেখা হীরেন-অন্য আংটিগুলো পরার সময় ওটা যদি খুলে রেখে যেতেন। কিন্তু এখন তো বুঝত পারছেন, পাপ আর গরল চাপা দেওয়া যায় না!

সকলেরই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল আংটিটির ওপরে।

সত্যিই আংটিটার ওপরে মীনা করা হীরেন নামটা।

সহসা হীরেনের চোখমুখে একটা হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। সে কালো কালো একঝাক দাঁত বের করে বললে, বেশ মেনে নিলাম, আপনার ওখানে শিবানন্দ ছদ্ম পরিচয়ে আমি গিয়েছিলাম। তা তাতে হয়েছেটা কি।

আর কিছুই হয়নি, কেবল ধরা পড়ে গেছেন।

ধরা পড়ে গেছি!

হ্যাঁ। আপনিই যে শ্ৰীমন্ত, হারাধন, শশধর ও শিবানন্দর হত্যাকারী—

কি পাগলের মত যা-তা বলছেন!

পাগল কিনা সেটা আদালতেই প্রমাণ হবে।

বেশ বেশ, তাই না হয় প্রমাণ করবেন। আপনারা আমার অতিথি-বসুন, চা খান। সঞ্চারিণী, বলে উঁচু গলায় ডাক দিল হীরেন সরকার।

সঞ্চারিণী এসে ঘরে ঢুকল।

এঁদের চায়ের ব্যবস্থা কর, এঁরা আমার অতিথি।

এখানে চা-পান করতে আমরা আসিনি হীরেনবাবু। উঠুন, আমাদের সঙ্গে এখুনি আপনাকে যেতে হবে। কিরীটী শান্ত কঠিন গলায় বললে।

যাব যাব, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? যেখানে খুশি নিয়ে যেতে চান আমাকে যাব—My mission is over-যে চারজন শয়তান একদিন ষড়যন্ত্র করে আমদের পথে বসিয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে কীটের মত শ্বাসরোধ করে ধ্বংস করেছি।

বিকাশ সেন অবাক হয়ে চেয়েছিল হীরেন সরকারের মুখের দিকে। অবাক বিস্ময়েই শুনছিল যে ওর প্রতিটি কথা।

লোকটি শয়তান, না বদ্ধ উন্মাদ!

হীরেন সরকার অতঃপর উঠে দাঁড়াল। রোগা, পাকানো চেহারা।

কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। পঙ্গুত্ব কোথা তার শরীরে নেই।

এখন বুঝতে পারছি, সেদিন আপনার বুদ্ধির দৌড়টা যাচাই করবার জন্য আপনার সামনে শিবানন্দ পরিচয়ে না গেলেই হয়ত ভাল করতাম কিরীটীবাবু!

সবাই চুপ, কারও মুখে কোন কথা নেই।

হীরন সরকার বলতে থাকে, আপনার কীর্তিকলাপ ও অত্যাশ্চর্য শক্তির সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন পরিচিত মিস্টার রায়। চাক্ষুষ ও সাক্ষাৎ আমাদের মধ্যে পরস্পর-পরিচয়ের সৌভাগ্য না ঘটলেও, আপনার কথা শুনে শুনে মনে হত কি জানেন?

কি?

পড়তেন আপনি মুখোমুখি সেরকম একজনের পাল্লায়, বোঝা যেত সত্যিকারের আপনার ক্ষুরধারটা—যাচাই হয়ে যেত হাতে হাতে ব্যাপারটা। আর তাই ওই চার-চার বিশ্বাসঘাতক শয়তানের ধ্বংসযজ্ঞে নেমে পরপর তিনজনকে হত্যা করবার পরও যখন দেখলাম আপনার টনক নড়ল না, আর স্থির থাকতে পারলাম না।

নিজেই গেলেন আমার কাছে?

হ্যাঁ।

এবং সেটাই হয়ে দাঁড়াল আপনার জীবনের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল।

তা হয়ত হয়েছে। তবু জানি, আপনি ছাড়া বোধ হয় দুনিয়ায় কারও সাধ্য ছিল আমাকে ধরে। ধরা পড়েছি বলে আমার কোনও দুঃখ নেই মিস্টার রায়, আমার প্রতিজ্ঞা আমি পূর্ণ করেছি। I have done my duty!

কিন্তু এ কাজ কেন করতে গেলেন, হীরেনবাবু? কেন যেন কিরীটীর মনের মধ্যে হীরেনের প্রতি একটা মমতা জাগে।

কেন করতে গেলাম!

হ্যাঁ, আইন ছিল দেশে, আইনের আশ্রয় নিলেই তো পারতেন।

কিছু হত না তাতে করে। আইনের সাধ্য ছিল না ওই পাষণ্ডদের কেশ স্পর্শ করে। ওই ধূর্ত শয়তান শৃগালের দলকে ধরা যেত না হাতেনাতে। তাই ওই পথটাই আমি বেছে নিয়েছিলাম।

তারপর একটু কেশে বললে হীরেন সরকার, কিন্তু আপনি সত্যি বলুন তো, আমাকে সন্দেহ করলেন কি করে?

যে মুহূর্তে জানতে পেরেছিলাম, ওরা চারজনই আপনাদের পূর্বতন কর্মচারী ছিল এবং ওদেরই জন্য আপনাদের ব্যবসায় ভরাড়ুবি হয়েছিল তখনি–

কি?

ওদের হত্যার মোটিভটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তবে—

তবে?

মোটিভটা খুঁজে পেলেও তখনও স্থিরনিশ্চিত হতে পারিনি, আপনাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে কে এ কাজ করেছে! কিন্তু আপনার আমার গৃহে আসা ও তারপর আপনার হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার আট মাস আগে থাকতে পঙ্গু বনে যাবার ইতিহাস, আপনার অভিনয়-ক্ষমতা সব মিলিয়ে আপনার উপরেই আমার সন্দেহটা পড়ে।

কেবল কি তাই?

আরও আছে।

কি?

সংবাদপত্র প্রত্যহে প্রকাশিত ধারাবাহিক বিজ্ঞাপনটাও আমার চোখের দৃষ্টি খুলে দিয়েছিল। আর শেষ ও মোক্ষম প্রমাণ–

কি?

পকেট থেকে কিরীটী সোনার একটা সিগারেট কেস বের করল।

এই সোনার সিগারেট কেসটা! এটা শিবানন্দর দোকানের শো-কেসের তলায় পড়ে থাকতে দেখে সবার অলক্ষ্যে তুলে নিতেই আর মনে সন্দেহের অবকাশ মাত্রও রইল না আমার।—চিনতে পারছেন এটা?

হীরেন সরকার হেসে হাত বাড়ল—নিশ্চয়ই। দিন ওটা।

উঁহু, এটা আদালতের property এখন—

দেবেন না?

না।

Exit mobile version