Site icon BnBoi.Com

কালো পাখী – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কালো পাখী - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. ইউসুফ মিঞা

ইউসুফ মিঞাকে আমি অনেক দিন থেকেই চিনি।

বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে, প্যাঁকাটির মত সরু লম্বা চেহারা। দেহের কোথাও মাংস বলে কোন পদার্থ আছে বলে মনে হত না ওকে দেখলে। কেবল যেন কতকগুলো হাড়, তার উপরে চামড়া। ছোট ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা দাড়ি। মধ্যে মধ্যে মেহেদীতে সে তার সেই দাড়ি রাঙিয়ে নিত। পরনে একটা চেককাটা লুঙ্গি, গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবির মত একটা জামা; ঐ ছিল তার পোশাক।

টেরিটি বাজারে ওর একটা দোকান ছিল চিড়িয়ার। দানা ধরণের দুষ্প্রাপ্য পাখী কেনাবেচা করত ইউসুফ মিঞা। ও পাখী বলত না। বলত, চিড়িয়া।

চিড়িয়ার জাত চিনতে ইউসুফ মিঞা ছিল অদ্বিতীয়। সামান্যক্ষণ পাখীটাকে পর্যবেক্ষণ করেই বলে দিতে পারত ইউসুফ, কোন্ জাতের কোথাকার পাখী আর তার কিম্মত কত হতে পারে বা হওয়া উচিত।

বাজারে ঢুকতেই বাঁ-হাতি দুটো ঘরে তার দোকান ছিল। সামনের ঘরটার পিছনে আর একটা মাঝারি সাইজের ঘর। দুটো ঘর ভর্তি নানা ধরনের ঘোট বড় মাঝারি খাঁচায় নানা ধরনের পাখী। সর্বক্ষণই কিচিরমিচির শব্দ করছে বা শিস দিচ্ছে কিংবা মধুর শব্দে ডেকে ডেকে উঠছে।

একপাশে একটা চৌকি পাতা। সেই চৌকির উপরেই বসে থাকত ইউসুফ মিঞা সারাটা দিন। সামনে থাকত তার টাকা-পয়সার ক্যাশ বাক্সটা। রাত্রে ঐ চৌকিটার উপরেই শুয়ে ঘুমাত, দোকানের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে।

পিছনদিকে ঘর দুটোর একটা সরু ফালি বারান্দা মত-তাও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তার একদিকে রান্নার ব্যবস্থা, অন্যদিকে কলপায়খানার ব্যবস্থা।

মোটমাট সামনের দরজা বন্ধ করে দিলে ঐ ঘর দুটির মধ্যে প্রবেশের কোন দিক দিয়ে আর কোন রাস্তা ছিল না।

ইউসুফ মিঞা চট্টগ্রামের লোক—তবে ব্যবসার খাতিরে কলকাতার টেরিটি বাজারে এসে ঐ ঘর দুটিতে আস্তানা গাড়বার পর থেকে দেশ চট্টগ্রামের সঙ্গে আর কোন সম্পর্কই ছিল না দীর্ঘ অনেকগুলো বৎসর।

ইউসুফ মিঞার বিবি ছিল না, অনেক কাল আগেই গত হয়েছিল। ছিল একটি ছেলে-সুলতান। সুলতানের বয়েস বছর আঠারো-উনিশ এবং সেও তার শৈশব থেকে তার আব্বাজানের সঙ্গে থেকে চিড়িয়ার কারবার করতে করতে চিড়িয়া সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছিল।

বাপের মত ছেলে রোগা-শুটকো নয়। বেশ তাগড়াই জোয়ান।

অনেক বছর আগে কিরীটীর একবার একটি কাকাতুয়া পোষার শখ জেগেছিল মনে এবং একটি বেশ ভাল কাকাতুয়ার সন্ধান করছে জেনে আমিই তাকে সেদিন টেরিটি বাজারে ইউসুফ মিঞার দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম।

কিরীটীর পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম আমি, বাবুকে একটা ভাল কাকাতুয়া দিতে পার ইউসুফ মিঞা?

কেন পারব না আজ্ঞে—একটা ভাল কাকাতুয়ার বাচ্চাই আছে আমার কাছে-অস্ট্রেলিয়া

থেকে আনা—তার দামটা একটু বেশি পড়বে বাবু।

কিরীটী তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে ঘরভর্তি রাখা নানা ধরনের রঙ-বেরঙের বিচিত্র সব পাখী ও তাদের বিচিত্র কলকাকলী শুনছিল।

দামের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না মিঞা। কোথায় তোমার কাকাতুয়া দেখাও। বললাম আমি।

দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। উঠে দাঁড়াল ইউসুফ মিঞা।

পিছনের ঘর থেকে ইউসুফ একটি খাচা নিয়ে এল।

খাঁচার মধ্যে নীলচে সাদা রঙের কাকাতুয়ার বাচ্চা। ভাল করে এখনও শরীরে রোঁয়া গজায়নি। মানুষের মত এ কাকাতুয়া কথা তো বলবেই, তাছাড়া সর্বক্ষণ জেগে পাহারাও দেয়। ইউসুফ মিঞা বলে।

কিরীটী কথাটা বিশ্বাস করেনি অবশ্য সেদিন। মৃদু হেসেছিল।

বাবু হাসছেন! ঠিক আছে, মাস পাঁচ-ছয়ের মধ্যে যা বললাম তা যদি না হয় তো ইউসুফ মিঞার চিড়িয়া ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন—দাম আমি ফেরত দিয়ে দেব। ইউসুফ মিঞা বলে।

জিজ্ঞাসা করলাম, তা কত চাও?

আজ্ঞে আটশো টাকা।

বল কি মিঞা।

আজ্ঞে যেমন চিড়িয়া তার দামও তেমনি।

আশ্চর্য! কিরীটী কিন্তু অতঃপর কোন দর-দাম করেনি।

বলেছিল কেবল, সঙ্গে অত টাকা নেই, পরের দিন এসে কাকাতুয়াটা নিয়ে যাবে। শখানেক টাকা অ্যাডভান্স রেখে চলে এসেছিল।

বলা বাহুল্য, পরের দিনই গিয়ে সেই কাকাতুয়াটা কিনে এনেছিল কিরীটী। এবং ইউসুফ মিঞা যে মিথ্যা বলেনি, মাস চারেকের মধ্যেই সেটা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।

সে কিরীটীকে কিরীটী এং কৃষ্ণাকে কৃষ্ণা বলে ডাকত।

আমাকে দেখলেই বলে উঠত, সুব্রত এসেছে কিরীটী, সুব্রত এসেছে।

কৃষ্ণা হাসত। কিরীটী হাসত।

কিন্তু জংলী ক্ষেপে যেতো যখন কাকাতুয়াটা চেঁচাতে শুরু করত, এই জংলী, বাবুকে চা দে, আমাকে জল দে। এই জংলী-জংলী! ভূত!

কৃষ্ণার জংলীর প্রতি সম্ভাষণটাকে চালাত।

কে বলবে একটা পাখী—ঠিক যেন একটা মানুষ কথা বলছে! কথাও স্পষ্ট।

পাখীটা কিন্তু বেশীদিন বাঁচেনি।

বছর দুই বাদে হঠাৎ কি হল—হঠাৎ মরে গেল এক সন্ধ্যায় পাখীটা।

দুটো দিন কিরীটী কেমন যেন গুম হয়ে রইল। মনে খুব লেগেছিল পাখীটার মৃত্যু কিরীটীর। খবর পেয়ে আমি গেলাম। বললাম, এর জন্য এত মুষড়ে পড়েছিস! চল, ইউসুফের কাছ থেকে আর একটা কাকাতুয়া যোগাড় করে নিয়ে আসি!

এ যেন গাছের ফল, আঁকশি দিয়ে টানলেই হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়বে! ইউসুফ সত্যিই বলেছিল-এ পাখীর তুলনা নেই। কিরীটী বলে।

তা বলে তেমনটি আর মিলবেই না, তারই বা কি মনে আছে? চল, ওঠ।

গেলাম ইউসুফের ওখানে।

ইউসুফ ছিল। সব শুনে বললে, ও চিড়িয়া তো চট করে মেলে না বাবু! একটিই ছিল, আপনাদের দিয়েছিলাম। এখন কোথায় পাব?

আনিয়ে দিতে পার না একটা?

যে এনেছিল সে একজন জাহাজের খালাসী। তার জাহাজ অস্ট্রেলিয়ায় গেলে ওই রকম কাকাতুয়া সে এনেছে বার দুই।

সে আর আসবে না?

চিড়িয়া পেলেই আসবে। প্রায় বছরখানেক সে আসে না।

এক বছরের মধ্যে আর আসেনি সে?

না, তার জাহাজ তো এদিকে বড় একটা আসে না। মধ্যে মধ্যে কখনও আসে। একজন গোয়ানিজ-ডি’সিলভা নাম তার।

হতাশ হয়েই অতঃপর আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।

অথ কাহিনীর উপক্রমণিকা বা মুখবন্ধ। অতঃপর দেড় বৎসরাধিককাল পরে যে কাহিনীর যবনিকা উত্তোলন করতে চলেছি তার সঙ্গে ঐ ইউসুফ মিঞার নামটা জড়িয়ে গিয়েছিল।

০২. সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ

সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ সহসা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

সংক্ষিপ্ত সমাচার : টেরিটি বাজারে নৃশংস খুন। টেরিটি বাজারের এক পাখীওয়ালা ইউসুফ মিঞাকে তার ঘরের মধ্যে গলাকাটা মৃতাবস্থায় রক্তাপুত পাওয়া গিয়েছে।

বর্ষাকাল—এবারে বৃষ্টি বা মনসুন শুরু হয়েছে শ্রাবণের একেবারে শেষে। গতকাল বিকেল থেকে শহরে প্রবল বর্ষণ চলেছে একটানা প্রায় বলতে গেলে।

রাস্তাঘাট প্রায় জলমগ্ন। বৃষ্টি একবার সামান্যক্ষণের জন্য ধরে, আবার প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। বিকেলে গতকাল এসেছিলাম কিরীটীর ওখানে কিন্তু গৃহে ফেরা হয়নি প্রবল বর্ষণের জন্য।

সকালবেলা তখনও আকাশটা যেন স্লেটের মত ধূসর ও ভারি হয়ে আছে। থেকে থেকে বর্ষণ হচ্ছে। কিরীটীর বসবার ঘরে আমি কিরীটী ও কৃষ্ণা চা পান করছিলাম। আমার হাতে

ঐদিনকার সংবাদপত্রটা।

সহসা পাতা ওলটাতে ওলটাতে সংবাদটি আমার চোখে পড়ল।

চমকে উঠলাম।

এ কি!

কি হল? কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকাল।

ইউসুফকে কে যেন তার দোকানঘরে নৃশংসভাবে খুন করে গিয়েছে।

ইউসুফ?

হ্যাঁ রে। সেই টেরিটি বাজারের চিড়িয়াওয়ালা-ইউসুফ মিঞা।

কি লিখেছে?

গতকাল সকালে তার দোকানঘরের মধ্যে তাকে রক্তাক্ত গলাকাটা মৃত পাওয়া গিয়েছে।

তার একটা ছেলে ছিল না—কি যেন নাম? কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে।

সুলতান।

সুলতান ছিল না বুঝি ঐ সময়? সেও তো বাপের কাছেই থাকত?

সে রাত্রে সে দোকানে ছিল না। বরাহনগরে তার এক বন্ধুর ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। ভোরাত্রে গিয়ে দেখে দোকানের দরজাটা ভেজানো। দরজা ঠেলে খুলতেই একরাশ পাখী চারদিক থেকে তার চারপাশে ডেকে ডেকে উড়তে থাকে। ঘরের আলোটা নেভানো ছিল।

থতমত খেয়ে প্রথমটায় ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে সে অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর এগুতে গিয়ে পায়ে কি বেধে গিয়ে, মেঝের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর কোনমতে উঠে আলো জ্বালতেই চোখে পড়ে তার বাপজান মেঝের উপর পড়ে আছে রক্তাপ্লুত অবস্থায়। তার গলাটা কাটা। সে তখুনি চিৎকার করে আশপাশের সকলকে ডাকে। অতঃপর পুলিস আসে। কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি।

কিরীটী সংবাদটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, লোকটা তো যতদূর মনে পড়ে বেশ নিরীহ শান্তশিষ্ট টাইপের ছিল!

তাই তো ভাবছি, অমন একটা লোককে কে খুন করতে পারে? আর কেনই বা করল অমন করে?

কথা আমার শেষ হল না, জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবু!

কি রে?

একটা লোক দেখা করতে চায়।

এত সকালে বৃষ্টি মাথায় করে আবার কে এল? বললাম আমি।

কিরীটী বলে, কি চায়? কোথা থেকে আসছে?

আজ্ঞে বললে, বিশেষ দরকার নাকি আছে আপনার সঙ্গে।

যা, কোথা থেকে আসছে, কি নাম-জিজ্ঞাসা করে আয়।

আজ্ঞে বললে, টেরিটিবাজার থেকে আসছে।

টেরিটিবাজার! চমকে উঠি।

হ্যাঁ-ইউসুফ মিঞার ছেলে সুলতান।

যা, এই ঘরে নিয়ে আয়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দেয়।

জংলী চলে গেল।

একটু পরেই জংলীর পিছনে পিছনে যে যুবকটি এসে ঘরে ঢুকল তার বয়স বাইশতেইশের মধ্যে।

যুবকটি সুলতানই। বেশ কয়েক বছর পরে হলেও তাকে আমাদের কারোর চিনতে কষ্ট হয় না, কারণ বার-দুই ওকে ইউসুফের দোকানে দেখেছিলাম, তবে অন্য বেশভূষায়। তখন পরনে ছিল চেককাটা এক লুঙ্গি আর সাদা ময়লা পাঞ্জাবি। চুলের বাহারও বিশেষ ছিল না সে-সময়।

সাদামাটা চেহারা ও বেশ। আজ কিন্তু চেহারা ও বেশভূষায় অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল। মাথায় টেরি, কেয়ারী করে ছাঁট চুল ও ঠোটের উপরে বাটারফ্লাই গোঁফ, মেহেদী রাঙানো নুর দাড়ি। রংটা মাজা-মাজা। পেশল বলিষ্ঠ দেহের গড়ন। পরনে পায়জামা ও লক্ষ্ণৌ চিকনের পাঞ্জাবি।

চিড়িয়াওয়ালা ইউসুফ মিঞার বেটা বলে আজ যেন চিনবারই উপায় নেই সুলতানকে। যেন কোন খানদানী মুসলমানের ঘরের ছেলে। বেশ সৌখীন, চেহারায় ও বেশভূষায়।

বাবুজী, আপনারা দুজনেই আছেন ভালই হল, সেলামালেকুম বাবুজী। আমাকে চিনতে পারছেন?

কিরীটী বললে, বস সুলতান।

কিরীটীর আহ্বানে কোনরকম সংকোচ না করে পায়ের জুতো খুলে ঘরের পুরু দামী কাপেট মাড়িয়ে এসে একটা সোফার উপর আমাদের মুখোমুখি বসল, আপনারা যে গরীবকে চিনতে পারবেন বুঝিনি। বাবুজী, একটা বিশেষ কারণে আপনার কাছে এসেছি। সুলতান কিরীটীর মুখের দিকেই তাকিয়ে বলে কথাটা।

খবরের কাগজে একটু আগেই পড়ছিলাম, তোমার আব্বাজান–

হ্যাঁ বাবুজী, আমার আব্বাজানকে পরশু রাত্রে আমার অবর্তমানে কারা যেন শেষ করে রেখে গিয়েছে।

তুমি ছিলে না?

না বাবুজী, বরাহনগরে এক দোস্তের ওখানে গিয়েছিলাম। খানাপিনা শেষ হতে হতে অনেক রাত হল, তারপর কোন বাস বা গাড়ি পেলাম না, হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এসেছি।

কত রাতে পৌঁচেছিলে?

রওনা হয়েছিলামই তো রাত তিনটের পর, পৌঁছতে পৌঁছতে সেই প্রায় সাড়ে চারটে। আশেপাশে কোন জনমনিষি নেই, দরজা ঠেলে আব্বাজানকে ডাকতে যাব, হঠাৎ দেখি দরজা খুলে গেল-হাতের ঠেকা লেগেই।

আমি শুধালাম তারপর। চমকে গিয়েছিলাম। আব্বাজান তো কখনো দরজা খুলে শোয় না, খুব সতর্ক মানুষ! শোবার আগে দরজা ঠিক বন্ধ হল কিনা ভাল করে পরীক্ষা না করে কখনো শুতে যায় না। সেই মানুষ দরজা খুলে রেখেছে—কেমন যেন খটকা লাগল।

দরজা খুলে যেতে প্রথমে তোমার চোখে কি পড়েছিল সুলতান? প্রশ্ন করে কিরীটীই এবারে।

অন্ধকার-পাখার ঝটপট শব্দ। মনে হল যেন অন্ধকার ঘরটার সধ্যে সব পাখীগুলো খাচা থেকে বের হয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে। প্রথমটায় কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলাম, অন্ধকারেই বোধহয় কয়েক পা এগিয়েছিলাম, হঠাৎ বাধা পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম অন্ধকারে।

কিসে বাধা পেলে?

তখন বুঝতে পারিনি, পকেটে টর্চ ছিল না, তাই কোনমতে অন্ধকারেই উঠে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দেওয়ালে আলোর সুইচটা টিপে দিতেই সব কিছু নজরে পড়ল। মেঝের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে আমার আব্বাজান, ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত আর ঘরের সব পাখীর খাঁচার দরজাই বলতে গেলে খোলা। উড়ছে, বসছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে-সব যেন ওলটপালট তছনছ। কিন্তু সে-সব কিছু দেখবারও আমার সময় হয়নি। ছুটে গিয়ে আব্বাজানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, আব্বাজান! আব্বাজান!

সেই সময় নজরে পড়ল আব্বাজানের গলাটা একেবারে দু-ফাঁক করে কাটা।

তারপর—তুমি কি করলে সুলতান?

আমার চেঁচামেচিতে আশপাশের দোকান থেকে সবাই ছুটে এল। তারাই তখন পুলিসে  খবর দেয়। পুলিস এল, সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ কোন হদিস দিতে পারল না। কেউ কিছু বলতে পারল না। কেউ কিছুই নাকি জানে না—জানতেও পারেনি।

.

সুলতানের মুখে সব কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল কিরীটী।

তারপর একসময় প্রশ্ন করল, কিন্তু তুমি আমাদের কাছে এসেছ কেন?

বাবুজী, আমার আব্বাজানের কাছেই আপনার কথা শুনেছিলাম। আপনি খুব বড় একজন গোয়েন্দা, আব্বাজানই একদিন আমাকে বলেছিল। হঠাৎ কাল রাত্রে আপনাদের কথা আমার মনে পড়ল বাবুজী। কালই আসতাম, কিন্তু বৃষ্টির জন্য আসতে পারিনি। জানি না আমার আব্বাজানকে অমন করে কে খুন করেছে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কথা জানতে পারছি আমার মনের দুঃখ যাবে না। কেবলই মনে হচ্ছে সে-রাতে যদি আমি বরাহনগরে না যেতাম তবে হয়ত ঐ ঘটনা ঘটত না। আমার আব্বাজানকে অমন করে প্রাণ দিতে হত না। মনে হচ্ছে তাই আমিই দায়ী-আমার আব্বাজানের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। বলতে বলতে গলাটা যেন কান্নায় বুজে এল সুলতানের।

চোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

একটু থেমে হাতের পাতায় চোখের অশ্রু মুছে সুলতান বললে, জানেন বাবুজী, আব্বাজান সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে যেতে দিতে চায়নি—বলেছিল আজ বরাহনগরে নাই গেলি বেটা, কিন্তু শুনিনি তার কথা। দোস্ত মুসুদ নিমন্ত্রণ করেছে—অনেককালের দোস্তী আমাদের–তাছাড়া অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ ছিল না—তাই আব্বাজানের কথায় কান দিইনি।

সুলতানের দু চোখের কোল আবার অশ্রুতে ভরে ওঠে।

বাইরে আবার বৃষ্টি নামল বেশ জোরে।

বাবুজী, আপনার যোগ্য পারিশ্রমিক হয়ত আমি দিতে পারবো না-তবে সাধ্যমত দেবো-কিছু টাকা আমি সঙ্গেই এনেছি। বলে একশো টাকার খান তিনেক নোট জামার পকেট থেকে বের করল সুলতান!

টাকা তুমি রাখ সুলতান। কিরীটী বললে।

বাবুজী, আপনি কি তাহলে আমাকে কৃপা করবেন না!

আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার আব্বাজানের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে। আমার পারিশ্রমিকের জন্য তুমি ভেবো না, আগে কাজটা হোক তারপর যা খুশি তোমার তুমি দিও।

বাবুজী!

এখন কয়েকটা প্রশ্নের আমার জবাব দাও সুলতান!

বলুন?

তোমাদের কি কোন দুশমন বা শত্রু ছিল?

দুশমন!

হ্যাঁ, তোমার বা তোমার আব্বাজানের?

আমরা ঐখানে আজ বিশ সালেরও উপরে আছি। আব্বাজানকে সবাই ওখানে খুব ভালবাসত-কারণ দায়ে অদায়ে আব্বাজান সকলকেই অর্থ বা তাগদ দিয়ে সাহায্য করত। আমার সঙ্গে অবিশ্যি কখনও কখনও কারও ঝগড়াঝাঁটি মারামারিও হয়েছে, কিন্তু–

আচ্ছা ঐ ব্যবসায় তোমাদের লাভ হত কি রকম সুলতান?

মিথ্যে বলব না বাবুজী, আব্বাজান ঐ ব্যবসা করে বেশ কিছু জমিয়েছিল।

কত টাকা হবে?

তা দশ বারো হাজার তো হবেই।

সে টাকা কোথায় সে রাখত?

ঘরে একটা হাঁড়ির মধ্যে।

সে টাকাগুলো আছে তো?

হাঁড়িটা যেমন ছিল তেমনই আছে, সে আমি ঐদিনই দেখেছি।

তাহলে টাকার জন্য নয়!

কি বললেন বাবুজী?

না, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সুলতান, কেউ টাকা-পয়সার লোভে তোমার আব্বাজানকে খুন করেনি। আচ্ছা সুলতান!

বলুন বাবুজী?

০৩. কিরীটী একটু থেমে বলে

কিরীটী একটু থেমে বলে, কাউকে তুমি সন্দেহ কর, যে তোমার আব্বাজানকে খুন করতে পারে?

আমার মাথার মধ্যে তো কিছুই আসছে না বাবুজী, অমন নিষ্ঠুরভাবে কেউ আব্বাজানকে হত্যা করতে পারে!

আচ্ছা সুলতান?

বলুন বাবুজী।

পাখী কিনতে তো অনেকেই আসত তোমাদের কাছে?

তা আসত। অনেক সময় অনেক বড় বড় রহিম আদমীও আমাদের ঐ দোকানে পাখীর খোঁজে এসেছে।

গত সাতদিনের মধ্যে বা ধর দিন দশ-পনেরোর মধ্যে এমন কোন বিশেষ খরিদ্দার তোমাদের দোকানে এসেছিল কি, মানে আমি বলতে চাই সাধারণ পাখীর খদ্দের নয়, কোন দামী পাখী যা হয়ত এদেশে চট করে পাওয়া যায় না?

তেমনি তোকই কিছু মনে পড়ছে না বাবুজী!

সব সময়ই কি তুমি দোকানে থাকতে?

না, তা থাকতাম না বটে। আব্বাজানই সব সময় থাকত দোকানে। দোকান ছেড়ে কখনও আব্বাজান ইদানীং কোথায়ও যেত না।

হয়ত তুমি যখন ছিলে না, তখন আসতে পারে?

তা পারে হয়ত। ভাল কথা, মনে হচ্ছে কথাটা আপনার জানা উচিত।

কি কথা বল তো?

দিন পনের-ষোল আগের ব্যাপার। ডি’সিলভার সঙ্গে একটা লোক একটা সিঙ্গাপুরী ময়না নিয়ে এসেছিল। ঐ ধরণের ময়না আট-দশ বছরে হয়ত একটা-আধটা আসে।

সিঙ্গাপুরী ময়না?

হ্যাঁ। দেখতে ভারি সুন্দর। কালো কুচকুচে-ঠোঁটটা ঠিক সাধারণ ময়নার মত হলদে নয়, হলদে আর সাদায় মেশানো, অনেকটা ফিকে সোনার মত রং, চোখ দুটো লাল। ঐ পাখীকে শেখালে সে যে কেবল মানুষের মত শেখানো বুলিই কপচায় তা নয়, মানুষের মত যা আপনি জিজ্ঞাসা করবেন তার মনিব সম্পর্কে, সব বলবে। মনিব যদি বেরুবার সময় কোথায় সে যাচ্ছে এবং কখন ফিরবে বলে যায়—কেউ এসে মনিব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ঠিক বলে দেবে। অথচ না জানা থাকলে অন্য ময়না থেকে চট করে ঐ ময়নার পার্থক্য বোঝা যায় না।

ভারি আশ্চর্য তো!

হ্যাঁ  বাবুজী, সত্যিই ওই পাখীর তুলনা নেই। দামও তেমনি।

কি রকম দাম?

দু হাজার তো বটেই—

বল কি সুলতান! একটা পাখীর দাম দু হাজার।

অমন চিজ, তার দাম হবে না! লক্ষ্ণৌর এক নবাবের ঐরকম একটা পাখী ছিল। নবাব মরবার পর সে পাখীটা চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

সেই রকম একটা ময়না এসেছিল তোমাদের দোকানে?

হ্যাঁ, ডি’সিলভার সঙ্গের লোকটি অমনি একটি ময়না এনেছিল।

ইউসুফ কিনেছিল ময়নাটা?

হ্যাঁ।

কতোয়?

হাজার টাকায়।

তারপর?

যে লোকটি ডি’সিলভার সঙ্গে এসেছিল ঐ ময়না নিয়ে, সে কিন্তু ঐ ময়নার গুণাগুণ জানত না। ডি’সিলভাও সঠিক জানত মনে হয় না। তবে ডি’সিলভা আব্বাজানের সঙ্গে ব্যবসা করে করে রীতিমত চালাক হয়ে উঠেছিল-আব্বাজানের মুখের হাবভাব দেখেই চিড়িয়ার দাম কিছুটা অনুমান করে নিত। তারপর দামদস্তুর শুরু করত। ঐভাবে দামদর করতে করতেই আঁচ করে নিলে ডি’সিলভা, চিড়িয়াটা দামী না সাধারণ চিড়িয়া একটা।

তারপর?

চিড়িয়া চিনতে আব্বাজানের জুড়ি এ শহরে ছিল না। আব্বাজানের মুখে শুনেছি প্রথম যৌবনে আব্বাজান লক্ষ্ণৌর এক সাহেবের কাছে চাকরি করত। তার ছিল চিড়িয়া পোর শখ। দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের চিড়িয়া এনে নিজের বাড়ির বাগানে বিরাট বিরাট খাঁচা তৈরী করে তার মধ্যে জড় করেছিলেন। সাহেবের যে চিড়িয়া পোরই শখ ছিল তাই নয়, চিড়িয়া চিনতেও তার জুড়ি দ্বিতীয় কেউ ছিল না। চিড়িয়া দেখেই তিনি বলে দিতে পারতেন কি জাতের কোন দেশের চিড়িয়া সেটা, তার কি গুণাগুণ। দীর্ঘ ছয় বছর তার কাছে থেকে আব্বাজান চিড়িয়া সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিল। পরে কলকাতা শহরে এসে চিড়িয়ার ব্যবসা শুরু করে।

কিন্তু সেই সিঙ্গাপুরী ময়নাটার কথা তুমি কি বলছিলে সুলতান? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

সুলতান আবার বলতে শুরু করে, সেই লোকটা চিড়িয়া বেচে চলে গেলে আব্বাজানকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অত দাম দিয়ে ঐ ময়নাটা কিনলে কেন? আব্বাজান বললে, যে দামে কিনেছি তার তিন গুণ দামে চিড়িয়াটা বিক্রি হবে বেটা। তুই বরং এক কাজ কর, রায় সাহেবকে একটা খবর দিয়ে আয়।

মানে আমাকে।

হ্যাঁ, কিন্তু আসি-আসি করতে করতে আমার আসা হয়নি আপনার কাছে। ইতিমধ্যে একটা ব্যাপার ঘটেছিল–

কি?

চিড়িয়াটা কেনবার ঠিক দিন সাতেক পরে এক সন্ধ্যায় বিরাট একটা গাড়িতে চেপে একজন সুটপরা ভদ্রলোক আমাদের দোকানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল। সে এসেই সেই চিড়িয়াটার খোঁজ করল। আব্বাজান বললে, আছে, কিন্তু দাম তিন হাজার টাকা পড়বে।

তারপর?

লোকটি চিড়িয়াটা দেখতে চাইল, আব্বাজান দেখাল, আর আশ্চর্য, খাঁচা সমেত চিড়িয়াটা তার সামনে এনে রাখতেই, চিড়িয়াটা হঠাৎ বলে উঠল, রবিন রবিন রবিন! আব্বাজান তখন শুধায় লোকটিকে, চিড়িয়াটা কি আপনার চেনা? আপনার নাম কি রবিন?

লোকটি কি জবাব দিল?

বললে না না, ওই চিড়িয়া আমি আগে কখনও দেখিইনি, তাছাড়া আমার নামও রবিন নয়। আব্বাজান আর কোন কথা বলে না। লোকটা দর-কষাকষি শুরু করল এবং শেষ পর্যন্ত দরে না পোযাতে লোকটা চলে গেল।

কত টাকা দিতে চেয়েছিল লোকটা?

দু হাজার পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলি।

হুঁ। তারপর আর সে আসেনি?

না।

পাখীটা এখনও তাহলে বিক্রী হয়নি?

না। তবে—

কি?

সে রাত্রে আবার যখন একে একে চিড়িয়াগুলোকে খাঁচায় ভরলাম—সেই ময়নাটাকে কিন্তু দেখতে পেলাম না।

সে পাখীটা নেই?

না।

পুলিসকে কথাটা তুমি জানিয়েছিলে সুলতান?

না। মনে হয়নি। আজ আপনার কথা শুনে হঠাৎ মনে হওয়ায় কথাটা আপনাকে বললাম।

অনেকক্ষণ অতঃপর কিরীটী চুপ করে রইল। একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে ধূমপান করতে লাগল। মনে হল কিরীটী যেন কি ভাবছে।

সুলতান!

বাবুজী?

ডি’সিলভা কলকাতায় এলে কোথায় থাকে তুমি জান?

না তো বাবুজী। তবে সে আর কোথায় থাকবে—তার জাহাজেই থাকত। আচ্ছা সেই লোকটিকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে?

কেন পারব না—নিশ্চয়ই পারব।

লোকটা দেখতে কেমন বল তো?

লোকটা বেঁটে, গায়ের রং খুব ফর্সা, চ্যাপ্টা নাক, ছোট ঘোট চোখ, পুরু ঠোঁট। ভারতীয় বলে ঠিক মনে হয় না।

বয়স কত হবে?

বছর চল্লিশ হবে।

আচ্ছা আজ তুমি যাও সুলতান, কাল হয়ত তোমার দোকানে একবার যেতে পারি। স্ব্যার দিকে দোকানে থাকবে তো?

থাকব।

অতঃপর সুলতান বিদায় নিল।

.

সুলতান বিদায় নেবার পরও অনেকক্ষণ কিরীটী নিঃশব্দে বসে বসে চুবোট টানতে থাকে। বুঝতে পারি কোন একটা চিন্তু কিরীটীর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বাইরে বৃষ্টি সমানে ঝরতে থাকে। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি বিদায় নিলাম।

কিরীটী তখনও পূর্ববৎ সোফাটার উপর বসে অন্যমনস্কভাবে ধূমপান করে চলেছে।

বাইরে বের হয়ে দেখি কিরীটীর বাসার সামনে বেশ জল জমেছে। প্রায় গোড়ালি ড়ুবে যায়। হীরা সিংকে ডাকলাম।

হীরা সিং আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দেবে?

কেউ নেই সাক্-ঠারিয়ে, হাম আভি গাড়ি লয়তেহেঁ।

হীরা সিং শেষ পর্যন্ত আমাকে গৃহে পৌঁছে দিয়ে গেল।

সারাটা দ্বিপ্রহর আমি ইউসুফের হত্যার ব্যাপারটাই চিন্তা করতে লাগলাম। সুলতানের কথায় মনে হল কোন ডাকাতি বা রাহাজানির ব্যাপার নয়। ইউসুফকে হত্যা করার পিছনে কারও কোন গুঢ় উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সেটা কি? কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

সেই ময়নাটার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই তো?

ময়নাটা নিখোঁজ হয়েছে।

সুলতানের কথা শুনে মনে হয় ইউসুফ মিঞার নৃশংস হত্যার সঙ্গে হয়ত ঐ কালো পাখীটার কোন যোগসূত্র কোথাও আছে এবং ঐ হত্যার পিছনে কোন গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।

.

সন্ধ্যার দিকে আবার কিরীটীর ওখানে গিয়ে দেখি কিরীটী তার বসবার ঘরে বসে আপনমনে তাস নিয়ে একা একা পেসেন্স খেলার মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে। পাশের সোফায় গিয়ে বসলাম।

আড়চোখে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে, কিন্তু তার মুখের কোথাও কোন চিন্তার রেখা পর্যন্ত যেন নেই।

একটা ইংরাজী পিকটোরিয়াল টেনে নিয়ে সামনের সেন্টার টেবিলের উপর রেখে তার পাতা ওলটাতে লাগলাম।

নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একসময় কিরীটীই কথা বলল, তুই চলে যাওয়ার একটু পরেই পূর্ণ লাহিড়ী এসেছিলেন।

ডি. সি.?

হ্যাঁ।

হঠাৎ?

সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা ছিলেন।

ভদ্রমহিলা?

হুঁ।

কে সে?

সিঙ্গাপুরের এক বিখ্যাত জুয়েল-মার্চেন্ট মিঃ জোসেফের বর্মিনী স্ত্রী মা’থিন।

হঠাৎ কি ব্যাপারে তোর কাছে এসেছিলেন?

ভদ্রমহিলার একটি বহু মূল্যবান মুক্তার হার চুরি গিয়েছে।

মুক্তার হার!

হ্যাঁ-তার ধারণা সেটা ভারতবর্ষে এসেছে।

হঠাৎ ঐ রকম ধারণার কারণ?

কারণ একটা আছে বৈকি।

কি রকম?

ভদ্রমহিলার রঘুনাথন নামে এক মালয়ালী ভৃত্য ছিল। মাসখানেক আগে হঠাৎ রঘুনাথন নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এক সকালে—অনেক খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায় না এবং ঐ দিনই ভদ্রমহিলা জানতে পারেন তার বহুমূল্যবান সেই মুক্তার মালাটিও পাওয়া যাচ্ছে না।

মালাটা কোথায় ছিল?

আগের দিন একটা পার্টিতে ভদ্রমহিলা ঐ মুক্তার মালাটি গলায় পরে পার্টিতে যান ফেরেন অনেক রাত্রে একটু মত্ত অবস্থাতেই। তার স্পষ্ট মনে আছে রাত্রে গৃহে ফিরে শয়নের পূর্বে মালাটি গলা থেকে খুলে নিজের মাথার বালিশের তলায় খুলে রেখে দিয়েছিলেন। দুপুরে সেই মালার কথা মনে পড়ায় মালার খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন বালিশের নীচে মালাটি নেই। তখন তিনি ঘরের সর্বত্র খোঁজেন, যদি অন্য কোথায়ও রেখে থাকেন রাত্রে, কিন্তু বহু অনুসন্ধান করেও সেটির আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।

তারপর?

আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল–

কি?

ভদ্রমহিলার একটি ময়না পাখী ছিল—

ময়না পাখী?

হ্যাঁ, ঠিক যেমনটি আমরা আজ সুলতানের মুখে শুনেছি তেমনি একটি ময়না ঐ মহিলার ছিল। রঘুনাথনের নিরুদ্দেশের সঙ্গে সঙ্গে খাঁচাসমেত ঐ ময়নাটিও নিখোঁজ।

সত্যি!

হ্যাঁ। আর সেই কারণেই পরশু সকালের প্লেনে ঐ মহিলা কলকাতায় এসে পৌঁচেছেন-এখানকার পুলিসের সাহায্যে যদি কোন উপায়ে বের করা যায় তার মুক্তার মালাটি-কারণ তার স্থির বিশ্বাস ঐ মুক্তার মালা, ময়না পাখীটি ও রঘুনাথনের সঙ্গে একটা যোগাযোগ আছে। পূর্ণ লাহিড়ী তাই মহিলাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন।

তবে কি কিরীটী–

কি?

ঐ ইউসুফের হত্যার সঙ্গে–

আমার ধারণা তাই সুব্রত। এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তো ইউসুফ ঐ ময়নাটিকেই কিনেছিল ডি’সিলভার সঙ্গের সেই লোকটির কাছ থেকে—ওই পর্যন্ত বলেই সহসা কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

সুব্রত!

কি? চল, একবার বেরুব।

রাত তখন আটটা হবে। বাইরে বৃষ্টি নেই বটে তবে আকাশ মেঘে মেঘে থমথম করছে।

এ সময় কোথায় বেরুবি? বাইরে আকাশের অবস্থা ভাল নয়। বললাম আমি।

কিরীটী সে কথায় কর্ণপাত না করে বললে, তুই বস্ সুব্রত, চট করে জামাটা গায়ে দিয়ে আসছি আমি।

কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

গাড়ি যখন রসা রোডে পড়ল ওভারব্রীজটার তলা দিয়ে, ঝমঝম করে বর্ষণ শুরু হয়ে যায়।

কিন্তু চলেছিস কোথায় এই বৃষ্টির মধ্যে?

প্রশ্নটা করে তাকালাম আমি আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটীর মুখের দিকে। অন্ধকারে কিরীটীর মুখটা ভাল দেখা যায় না। কিরীটী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করতে ব্যস্ত হয় লাইটারের সাহায্যে। চুরোটটা ধরানো হলে পর বলল, আমাকে নয় হীরা সিংকে উদ্দেশ করে, হীরা সিং, গ্র্যান্ড হোটেল।

হীরা সিং নিঃশব্দে কেবল একবার মাথাটা হেলাল।

প্রবল বর্ষণের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে-ওয়াইপার দুটো ঘন ঘন ওঠানামা করছে। উইস্ক্রীনের মসৃণ গাত্রের উপর কিন্তু তাতে করে সামনের রাস্তাটা যে খুব স্পষ্ট দেখা যায় তা নয় বরং ভিতরের বাষ্পে কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যায়।

ট্রাম, লরি, বাস, ট্যাক্সি ও প্রাইভেট কারগুলো যথাসাধ্য নিজেদের বাঁচিয়ে এদিক ওদিক চলেছে।

তারই মধ্য দিয়ে ছাতা মাথায় পথিকের দল চলেছে। পথের দু পাশে দোকানের সামনে প্রবল ধারার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষের ভিড় জমেছে।

ভাবছিলাম কিরীটী হঠাৎ এ্যাণ্ড হোটেলে এ সময় চলেছে কেন?

হঠাৎ কিরীটীর কথায় চমক ভাঙল।

সুব্রত।

কি?

ম্যাডাম মা’থিন গ্ৰাণ্ডে উঠেছেন–তার ওখানেই যাচ্ছি। একদম মনে ছিল না রেভদ্রমহিলা আজ সন্ধ্যার সময় তার সুইটে ড্রিঙ্কের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

কথাটা যদিও আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়—কারণ কিরীটী এই বৃষ্টির মধ্যে কেবল এক স্বল্পপরিচিতা মহিলার ড্রিঙ্কের আমন্ত্রণে তার হোটেল-সুইটে চলেছে, কথাটা আর যেই বিশ্বাস করুক আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

তাই চুপ করেই রইলাম।

তোকে কিন্তু একটা কাজ করতে হবে সুব্রত!

কি? আবার তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে অন্ধকারে।

আমি যখন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলব, তুই যতটা সম্ভব চারদিক নজর দিয়ে দেখবি।

তুই কি ড্রিঙ্কের নিমন্ত্রণ রাখতেই চলেছিস?

তাছাড়া আর কি! ভদ্রমহিলা খুব অ্যাকমপ্লিশড্‌–আলাপ করে আনন্দ পাবি। চোখে-মুখে একটা বুদ্ধির প্রাখর্য আছে।

আমি কোন জবাব দিই না।

.

হোটেলে পৌঁছে-লিফটে তিনতলায় উঠে লম্বা করিডোরটা অতিক্রম করে নির্দিষ্ট সুইটের সামনে গিয়ে পৌঁছলাম।

বেল টিপতেই ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে আহ্বান এল, কাম ইন!

০৪. সুইটের সিটিং রুমে

ভিতরে প্রবেশ করে সুইটের সিটিং রুমেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে মুখোমুখি হলাম।

ভদ্রমহিলা সত্যিই সুন্দরী—দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত নিঃসন্দেহে।

বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। রোগা পাতলা গড়ন। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর। পরনে বর্মিনীদের ধরনে একটি দামী সিল্কের লুঙ্গি ও গায়ে আন্দির ফুলহাতা জামা। মুখের গড়ন ঠিক বর্মিনীর মতই।

পাতলা একটা প্রসাধনের ছাপ মুখে। মাথায় বিরাট একটি প্যাগোড়া খোঁপা। দু হাতে তিনগাছা করে হীরকখচিত চুড়ি, গলায় হীরার কণ্ঠি, কানে হীরার দুল। উজ্জ্বল আলোয় হীরকখণ্ডগুলি যেন ঝিলিক হানছিল।

গুড ইভনিং—আসুন মিঃ রায়, আপনার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছিলাম। কথাটা বলে। মহিলা আমার দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় কিরীটীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

আমার বন্ধু-সহকারী—সুব্রত রায়।

মহিলা প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে বললেন, আপনারা দুজনেই রায়?

হ্যাঁ। হাসল জবাবে কিরীটী।

বসুন।

মুখোমুখি দুটো সোফায় আমরা বসলাম। মহিলাও বসলেন মুখোমুখি।

বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ। কিরীটী জবাব দিল।

বৃষ্টি দেখে ভাবছিলাম বোধ হয় আসতে পারবেন না!

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এ সময় বৃষ্টি তো হবেই-মনসুন–

উনি যখন আপনার সহকারী—আমরা নিঃসংকোচেই কথাবার্তা বলতে পারি মিঃ রায়, তাই তো?

হ্যাঁ।

মালা!

মহিলার ডাকে ভিতরের ঘর থেকে একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের বর্মী তরুণী বের হয়ে এল।

ইয়েস ম্যামু—

বুঝলাম মালা ঐ মহিলার পরিচারিকা।

মালাও দেখতে সুন্দরী এবং পরিচারিকা হলেও তার বেশভূষা দামী এবং চোখে-মুখে প্রসাধনের চিহ্ন সুস্পষ্ট।

মালা, ড্রিঙ্কস্! কি দেবে বলুন মিঃ রায়-হুইস্কি?

আনুন।

আমার কাছে কিন্তু সব রকম ড্রিঙ্কসই আছে-অন্য কিছু যদি

না, হুইস্কিই আনতে বলুন।

বলা বাহুল্য ইংরাজীতেই কথাবার্তা চলছিল। ভদ্রমহিলা চমৎকার শুদ্ধ ইংরাজী বলেন।

মালা চলে গেল।

আরও আধঘণ্টা পরে। দ্বিতীয় রাউণ্ড ড্রিঙ্কস চলেছে তখন। দেখলাম ভদ্রমহিলা বেশ ভালই ড্রিঙ্কস করতে অভ্যস্ত।

কিছুক্ষণ নানা ধরনের কথাবার্তার পর হঠাৎ একসময় ভদ্রমহিলা বলেন, মিঃ লাহিড়ী বলছিলেন, আপনি ঠিকই আমার হারটা উদ্ধার করে দেবেন।

কিরীটী কোন জবাব দেয় না।

মহিলা আবার বলেন, আমি যখন আমার স্বামীকে বললাম, এ আর কারও কাজ নয়-ওই রঘুনাথনেরই কাজ আর সে হারটা চুরি করে সোজা ইণ্ডিয়াতেই এসেছে, জোসেফ কি বলেছিল জানেন?

কি?

বলেছিল তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জেনো সে হার আর কোনদিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। কারণ রঘুনাথনকে কোনদিনই আর trace করতে পারবে না। আচ্ছা মিঃ রায়–

বলুন?

একবার ওর দেশে গিয়ে খোঁজ করলে হত না?

একটা কথা মিসেস জোসেফ–

কি বলুন তো?

ওই রঘুনাথনের কোন ছবি আপনার কাছে আছে?

ছবি? You mean, Photo?

হ্যাঁ।

আমার album-এর মধ্যে থাকতে পারে। Yes-হ্যাঁ, মনে পড়েছে-আমার পাখীটার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ও যখন একদিন পাখীটাকে খাওয়াচ্ছিল আমি পাখীটার একটা ফটো নিয়েছিলাম—বোধ হয় সেটা আমার album-এ আছে।

রঘুনাথনই কি পাখীটাকে খাওয়াত নাকি?

হ্যাঁ। পাখীটা ওকে খুবই ভালবাসত। বেশীক্ষণ ওকে না দেখতে পেলেই পাখীটা চেঁচাত নাথন নাথন করে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। সামনে এলে চুপ করত।

মিসেস জোসেফ!

বলুন?

Album কি আপনার সঙ্গে আছে?

হ্যাঁ।

একবার দেখতে পারি album-টা?

আনছি আমি।

মহিলা উঠে গেল এবং একটু পরেই সুদৃশ্য চামড়ার দামী একটা অ্যালবাম হাতে ঘরে এসে ঢুকলেন।

এই যে—

মহিলা নিজেই পাতা উলটে ফটোটা বের করে দিলেন।

কিরীটী হাতে নিয়ে অ্যালবামের ফটোটা দেখতে লাগল। আমিও দেখি। হঠাৎ চোখ তুলতেই নজরে পড়ল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মালা।

মালার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে সরে গেল চট করে দরজার আড়ালে।

এই ফটোটা আমি নিতে পারি?

নিশ্চয়ই-খুলে নিন না।

কিরীটী অ্যালবাম থেকে ফটোটা খুলে নিল। পোস্টকার্ড সাইজের সিপিয়া প্রিন্টিং করা ফটোটা। খুব ভাল উঠেছে ফটোটা।

পাখীটার ক্লোজ-আপে ফটোটা তোলায় রঘুনাথনের মুখটাও স্পষ্ট উঠেছে। রঘুনাথন বোধ হয় ফটো তোলার সময় যে ফটো তুলছিল তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।

মহিলা আবার বললেন, জোসেফ আমাকে ইণ্ডিয়াতে আসতে দিতে চায়নি—একপ্রকার জোর করেই আমি চলে এসেছি-কারণ হারটার সঙ্গে আমার একটা সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে ছিল—

কি রকম? কিরীটী প্রশ্ন করে।

জোসেফ আমার স্বামী হলেও বলব, মানুষ বড় কৃপণ-প্রকৃতির।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। হাত দিয়ে তার কখনও একটা পয়সা গলে না। তবু গতবছর আমাদের ম্যারেজঅ্যানিভারসারি ডে-তে সে ওই পার্লের হারটা আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল—আর আমাদের এগার বছরের ম্যারেড লাইফে ওই প্রথম তার বিবাহ বার্ষিকীতে মূল্যবান প্রেজেন্ট আমাকে। যার দাম কমপক্ষেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা!

কিন্তু তাই যদি বলেন তো—

কিরীটী মুখের কথা শেষ হল না, মা’থিন বললেন, বুঝতে পেরেছি, আপনি আমার এ হীরার সেটটার কথা বলছেন তো?

হ্যাঁ–মানে–

কিন্তু ওই সেটটা জোসেফের দেওয়া নয়।

যদি কিছু মনে না করেন তো–

মনে করবার কিছু নেই মিঃ রায়-মা’থিন হাসলেন। হেসে বললেন, এটা আমার বাবার বিয়েতে দেওয়া উপহার।

কিন্তু মনে হচ্ছে ও হীরাগুলো নকল নয়—অনেক দাম হবে।

আমার বাবার আমিই একমাত্র সন্তান। বাবারও জুয়েলারীর ব্যবসা আছে-রেঙ্গুনের একজন ধনী নামকরা জুয়েলার আমার বাবা।

একটা কথা বলব মিসেস জোসেফ?

বলুন?

অ্যালবামের প্রথম পাতাতেই যে ফটোটা দেখলাম আপনার পাশে—তিনি নিশ্চয়ই আপনার স্বামী?

হ্যাঁ, আমার স্বামী। তাহলেও আমিই কিন্তু প্রথম পক্ষ। আমাদের দুজনার মধ্যে বয়সের পার্থক্য অনেক। প্রায় বাইশ বছর।

বাইশ বছর!

হ্যাঁ। যখন আমাদের বিয়ে হয় আমার বাইশ আর আমার স্বামীর চুয়াল্লিশ-rather he was an old man at that time. বাবার এতটুকুও ইচ্ছা ছিল না আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মত দিতে হয়েছিল আমার একান্ত ইচ্ছা দেখে।

বলতে বলতে একটু থামলেন মা’থিন। হাতের গ্লাসটা তার শূন্য হয়ে গিয়েছিল, একটা বড় পেগ গ্লাসে ঢেলে সোড়া মিশিয়ে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন আবার মা’থিন, জোসেফ দামী ও রেয়ার জুয়েলসের সন্ধানে বলতে গেলে সারা পৃথিবীটা ঘুরেছিল তার দীর্ঘ বাইশটা বছর-জীবনের বিচিত্র তার সে অভিজ্ঞতা। মধ্যে মধ্যে সে রেঙ্গুনে আসত, আমাদের মার্চেন্ট স্ট্রীটের বাড়িতে থাকত। ওই আসা যাওয়াতেই তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

মা’থিন আবার থামলেন।

তারপর?

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বাইরের ঘরে বসে বসে জোসেফ তার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা-নানা ধরনের দামী-রেয়ার জুয়েলসের বিচিত্র সব কাহিনী আমাকে শোনাত। গল্প

উপন্যাসের চাইতেও সে-সব রোমাঞ্চকর। আমি অদ্ভুত একটা thrill যেন অনুভব করতাম। সেই সব কাহিনী জোসেফের মুখে শুনতে শুনতে। একটু একটু করে তার প্রতি আমি আকৃষ্ট হই-হয়ত সমস্ত ব্যাপারটা আপনাদের কাছে absurd—অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তবু আমি যেন কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম, আর সেই আকর্ষণই আসলে তার প্রতি অনুরক্ত করে তোলে ক্রমশঃ।

আমি বললাম ঐ সময়, rather interesting!

মা’থিন বলতে লাগলেন, ও কয়েকদিন পরে চলে যেত, আমি কিন্তু ওর পথ চেয়ে থাকতাম। আবার কবে আসবে! লুকিয়ে আমি অবশেষে ওকে পত্র লেখা শুরু করি। ওর জবাব আসত আমার এক বান্ধবীর ঠিকানায়। বলতে পারেন ঐ চিঠি লেখালেখির মধ্যে দিয়েই আমাদের পরস্পরের মধ্যে নিবিড় এক ভালবাসা গড়ে ওঠে।

তারপর?

তারপর আর কি, একদিন আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বাবা-মা প্রথমটায় খুব আপত্তি করেছিল, কিন্তু আমার জেদের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হল। চলে এলাম স্বামীর সঙ্গে সিঙ্গাপুরে….কিন্তু বিয়ের পর পাচটা মাসও গেল না, আমার ভুল ভেঙে গেল।

ভুল!

তাই বলব-ভুলই। কারণ দেখলাম আমাদের গৃহে যখন সে গিয়ে অতিথি হত, তখনকার আলাপ-আলোচনা ও পরবর্তীকালে চিঠিপত্রের লেনদেনের ভিতর দিয়ে যে আলাপ-আলোচনা আমাদের হয়েছে সেটা জোসেফের চরিত্রের একটা দিক মাত্র এবং সেটা তার চরিত্রের আদৌ আসল দিক নয়।

কি রকম?

জিজ্ঞাসা করলাম আমিই মা’থিনের মুখের দিকে তাকিয়ে।

যদিও ইতিমধ্যে আমরা—আমি বা কিরীটী দুটো পেগের বেশী খাইনি, মা’থিন কিন্তু ছটা পেগ শেষ করে সপ্তম শুরু করেছিলেন।

লিকারের প্রভাবে তখন তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। চোখের তারা দুটো চক করছে। বেশ নেশা হয়েছে—আর হবারই কথা।

অনর্গল সে বকে চলেছে। নেশার প্রভাবে মানুষ এমনিই হয়—বল্লাহীন হয়ে পড়ে।

হাতের গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে মা’থিন বললেন, মানুষটা দেখলাম জীবনে দুটি বস্তুই ভালবেসেছে—আর তা হচ্ছে ঐসব জুয়েলস ও অর্থ। তার মনের সমস্ত কোমলতা-সেন্টিমেন্ট-আশা-আকাঙক্ষা সব যেন ঐ নীরস পাথরগুলো এবং অর্থকে ঘিরেই। অবিশ্যি। সে যে আমাকে কোনরকম অবহেলা বা অযত্ন করত তা নয়—কিন্তু একজন অল্পবয়সী যুবতীর পক্ষে তার কি মূল্য বলুন-স্বামীর অবহেলা বা অযত্ন তবু সহ্য হয়—কিন্তু ক্যালাসনেস সহ্য হয় না!

মা’থিন আবার থামলেন।

একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, আমি যেন দিন-কে-দিন হাঁফিয়ে উঠতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে আর টিকতে পারতাম না-আমি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। ক্লাবে পার্টিতে যোগ দিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। অবশেষে ড্রিঙ্ক করতে শুরু করলাম।

আপনার স্বামী জানেন না এসব?

সব জানে। কিন্তু সে কখনও আজ পর্যন্ত আমার কোন ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার করেনি। সেই থেকে গত কয় বছর ধরে সে আছে তার জুয়েলস আর অর্থ নিয়ে, আর আমি আছি আমার নিজস্ব জীবন নিয়ে। গত বছর আমাদের ম্যারেজ-অ্যানিভারসারিতে আমি বলেছিলাম, আমাকে তো আজ পর্যন্ত কিছুই প্রেজেন্ট করলে না—এবারে এমন কিছু দাও যাতে অন্তত মনে হয় আমারও একটা প্রয়োজন তোমার জীবনে আছে।

তারপর?

ও বললে, কি চাও বল?

যা চাই প্রাণে ধরে দিতে পারবে তো।

পারবো-বল।

তোমার সিন্দুকের মধ্যে একবার একটা বাক্সে তুমি কতকগুলো সেরা মুক্ত দেখিয়েছিলে-ঐ মুক্তোগুলো দিয়ে আমাকে একটা হার করে দাও।

বেশ–দেব। বললে জোসেফ।

সেই মুক্তো দিয়েই বোধ হয় হারটা তৈরী হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কিন্তু এক কথায় মুক্তোগুলো তিনি আপনাকে প্রেজেন্ট করে দিলেন, আশ্চর্য লাগছে। প্রথমটায় আমারও তাই মনে হয়েছিল, পরে মনে হল ওই মুক্তোগুলো সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে জোসেফ সংগ্রহ করেছিলো–ওগুলো সে বেচত না। অনেক টাকার অফার পেয়েও কখনও বেচেনি।

কেন?

সত্যিই আশ্চর্য ছিল যেন সেই মুক্তোগুলো। সাদা মুক্তোগুলোর ভেতর থেকে যেন অদ্ভুত দ্যুতি বের হত—কোনটা নীল—কোনটা গোলাপী—কোনটা কমলালেবুর রঙ-জোসেফ বলত ওই ধরণের মুক্তো একই প্রকারের ও একই সাইজের বেশী হয় না। অত্যন্ত রেয়ার স্পেসিমেন সেগুলো। তাই ওর ওই মুক্তোগুলোর প্রতি একটা অদ্ভুত মমতা ছিল-প্রাণে ধরে কখনো বেচতে পারেনি। কিন্তু আমাকে দিলে সেগুলো বেচাও হল না, ঘরের জিনিস ঘরেই রইল তার চোখের সামনে-আমাকেও উপহারের সান্ত্বনা দেওয়া হল-তাই বোধ হয় সেগুলো দিয়ে আমাকে একটা হার করে দিতে তার আপত্তি হয়নি।

মুক্তোর হারটা চুরি যাবার পর নিশ্চয়ই তাহলে আপনার স্বামীর খুব লেগেছে?

শুধু লাগেনি মিঃ রায়, ও যেন পাগল হয়ে গিয়েছে মুক্তোর হারটা হারিয়ে যাওয়ায়। খায় না দায় না কোথায়ও বের হয় না—এমন কি ব্যবসা পর্যন্ত গুটিয়ে বসে আছে সেই অবধি।

স্বাভাবিক। বলি আমি।

ছাব্বিশ বছর ধরে একটা একটা করে মুক্তোগুলো সে সংগ্রহ করে আগলে রেখেছিল যখের ধনের মত-কাজেই বুঝতে পারছেন সেই মুক্তোগুলো ওইভাবে চুরি যাওয়ায় তার মনের অবস্থা কি হতে পারে! সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, এখন আমার মনে হচ্ছে যদি মুক্তোগুলোর ওপরে লোভ না করতাম তবে তো সে আমাকে দিত না আর সেগুলোকে অমন করে হারাতেও হত না। সব কিছুর জন্য আজ তাই আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আমি যেন কিছুতেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না।

মা’থিনের চোখের কোল দুটো জলে ভরে আসে। নেশায় রক্তিম চোখ দুটো জলে টলমল করতে থাকে। আর এও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, মুখে ওই মহিলা একটু আগে যাই বলুক-ওর স্বভাবে-চরিত্রে যতই অসামঞ্জস্য থাক, ও ওর স্বামী জোসেফকে সত্যিই ভালবাসে। আর হয়ত নিজেও সে কথাটা নিজে জানে না।

কথা বলা বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েছিল মা’থিনের, সে অতঃপর কেমন যেন ঝিম দিয়ে বসে থাকে।

রাত বেশ হয়েছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তখন প্রায় সোয়া এগারোটা। বাইরে এখনও বৃষ্টি পড়ছে কিনা কে জানে।

শীততাপনিয়ন্ত্রিত হোটেলের ঘরের মধ্যে বসে সেকথা জানবারও উপায় ছিল না।

কিরীটীও চুপচাপ বসে।

তার বসবার ভঙ্গির মধ্যে শীঘ্র ওঠবার কোন লক্ষণই যেন পরিলক্ষিত হয় না।

ঘরের মধ্যে আমাদের তিনজনকে ঘিরে একটা স্তব্ধতা থমথম করছে।

হঠাৎ কিরীটীই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললে, আচ্ছা মিসেস জোসেফ, আপনার যে হারটা খোয়া গিয়েছে তার মধ্যে কতগুলো মুক্তো ছিল বলতে পারেন?

ওই মুক্তোর মালার মধ্যে যে মুক্তোর কথা একটু আগে বলেছি সব তা ছিল না।

তবে?

রেয়ার ও মূল্যবান মুক্তো ছিল গোটা-কুড়িক—তার মধ্যে ব্ল কুইন মুক্তোটি ছাড়াও গোটা এগারোর দাম সব চাইতে বেশী—অন্তত বিশ হাজার তো তার দাম হবেই। বাকিগুলো ছিল যদিও আসল মুক্তো, তাহলে অত দামের নয়।

আর কতগুলো মুক্তো ছিল?

বোধ হয় সব সমেত আটচল্লিশটা। কিন্তু ও কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন মিঃ রায়?

কারণ মুক্তোগুলো সব হয়ত পারব না আমরা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে।

পারা যাবে না?

না। কারণ আমার অনুমান–

কী?

মুক্তোর মালাটা যে চুরি করেছে সে সঙ্গে সঙ্গেই হার থেকে মুক্তোগুলো খুলে ফেলেছে। কেন–ও কথা বলছেন কেন?

যেহেতু চোরের ঐ মালার মধ্যে সত্যিকারের আসল ও রেয়ার যে মুক্তোগুলো ছিল সেগুলোর উপরেই লোভ ছিল। সে হয়ত তাই মালাটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মালা থেকে সে মুক্তোগুলো খুলে নিয়েছে—আর সব মুক্তোগুলোও হয়ত একজনের কাছে নেই।

কি বলছেন আপনি মিঃ রায়?

মুক্তোগুলো লুকিয়ে রাখতে হলে সেটাই প্রকৃষ্ট উপায়। আচ্ছা যে বিশেষ মুক্তোগুলোর। কথা একটু আগে আপনি বললেন তার এক-একটির সাইজ কি রকম হবে?

কম-বেশী এক একটা মটরের আকার হবে।

আচ্ছা মিসেস জোসেফ, আজ রাত অনেক হল, এবারে আমরা উঠব।

সে কি, এত রাত্রে কিছু না খেয়ে যাবেন?

আজ নয়—যদি আপনার মুক্তোগুলো উদ্ধার করতে পারি তাহলে একদিন সে ভোজ খাওয়া যাবে।

সে রাত্রের মত অতঃপর আমরা বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

০৫. বৃষ্টি তখনও ঝরছে

বাইরে বের হয়ে দেখি বৃষ্টি তখনও ঝরছে।

তবে বর্ষণ প্রবল নয়—ঝিরঝিরে বর্ষণ। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন কালো। এলোমেলো জলে হাওয়া বইছে। গাড়িতে উঠে বললাম, আমাকে নামিয়ে দিয়ে যা কিরীটী।

আর কৃষ্ণা হয়ত ওদিকে আমাদের জন্য গরম খিচুড়ি করে অপেক্ষা করছে। হীরা সিং, কোঠি চল।

আমি আর প্রতিবাদ করলাম না।

গাড়ি কিরীটীর গৃহের দিকেই চলল।

কিরীটী।

উ? তুই কি সত্যিই মনে ভাবিস কী? ঐ মুক্তোগুলোর সন্ধান করতে পারবি? সেগুলো হয়ত এতদিনে কোন্ সুদূরে পাচার হয়ে গিয়েছে!

সম্ভব নয়।

কেন?

প্রথমতঃ ঐ মুক্তোগুলোর দাম একমাত্র সাচ্চা জহুরীর কাছেই—সবাই ওর মূল্য বুঝবে; দ্বিতীয়ত, যে মুক্তোগুলো সরিয়েছে সে ভাল করেই জানে জোসেফের প্রাণ ছিল ঐ মুক্তোগুলো এবং সে রীতিমত একজন জুয়েলার হিসাবে পরিচিত ব্যক্তি—তার অর্থও আছে, কাজেই সে এত সহজে ব্যাপারটা হজম করে নেবে না হয়ত; তৃতীয়ত, ঐ মুক্তো ক্রয়ের জন্য উপযুক্ত খরিদ্দার চাই–

কিন্তু ধর, সে যদি সিঙ্গাপুরেই ওর খরিদ্দার পেয়ে গিয়ে থাকে?

পেলেও সে মুক্তোগুলো ঐ সিঙ্গাপুরে বসেই বেচা-কেনার সাহস পাবে না। কাজেই তাকে সিঙ্গাপুর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবেই এবং সেদিক দিয়ে ভারতবর্ষের মত জায়গাই হচ্ছে

সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান।

তাহলে মুক্তো-চোর বর্তমানে নিশ্চয়ই এখানেই এসেছে তোর ধারণা?

নিঃসন্দেহে।

কিন্তু ইউরোপেও তো সে যেতে পারে?

পারে, কিন্তু সেখানে বিক্রি করার চাইতে এখানে তার আরও সুবিধে হবে। তাছাড়া এই ব্যাপারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট আর একটা বিশেষ ব্যাপার তুই ভুলে যাচ্ছিস কেন সুব্রত?

কি?

সেই কালো পাখীটা!

কালো পাখী?

হ্যাঁ রে, সেই ময়না পাখীটা!

তোর কি ধারণা তাহলে সত্যিসত্যিই ঐ কালো পাখীটার সঙ্গে জোসেফের মুক্তোগুলো চুরি হওয়ার কোন যোগাযোগ আছে?

কেবলমাত্র ধারণা নয় সুব্রত, আমি বলতে পারি এখন একেবারে স্থিরনিশ্চিত।

সত্যি?

হ্যাঁ, যার প্রথম পর্বের মুক্তোর মালাটি চুরি—দ্বিতীয় পর্বে মা’থিনের ভৃত্য রঘুনাথনের অকস্মাৎ নিরুদ্দেশ ও সেই সঙ্গে কালো পাখীটা-তৃতীয় পর্বে উভয়ের ভারতে আগমন –চতুর্থ পর্বেহতভাগ্য চিড়িয়া-ব্যবসায়ী ইউসুফ মিঞার অজ্ঞাতে অগ্নিতে হস্তপ্রসারণ—পঞ্চম পর্বে তার নৃশংস মৃত্যু ও সেই সঙ্গে পুনরায় কালো পাখীটির নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া—সব ঘটনাগুলোই যদি বিচার করিস তো দেখবি একের অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এবং যা আমাদের চক্ষুকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে বলে দিচ্ছে মুক্তোগুলো সিঙ্গাপুর থেকে ভারতবর্ষেই এসেছিল।

তারপর?

তারপরের ব্যাপারটি অবশ্যই কিছুটা জটিল।

জটিল কেন?

জটিল হচ্ছে, ওই ঘটনার সঙ্গে ডি’সিলভা কেমন করে জড়িত হয়ে পড়ল! তারপর যে স্যুট-পরিহিত লোকটি—দেখতে বেঁটে, গায়ের রং ফর্সা, চেপ্টা নাক, ছোট ছোট চোখ, পুরু ঠোঁট, বছর চল্লিশ বয়স—যার বর্ণনা শুনে ভারতীয় বলে মনে হয় না, ময়নাটা কিনতে ইউসুফের দোকানে এসেছিল দিনসাতেকের মধ্যেই—সে লোকটি কে? সে অবশ্যই ময়নাটার খোঁজ পেয়েছিল, কেমন করে পেল?

হয়ত ডি’সিলভার কাছে শুনেছিল সে।

না।

কেন?

তাই আমার ধারণা। সে কোনক্রমে জানতে পারে ব্যাপারটা। তাই ময়নাটা হাতাবার জন্য দু হাজার টাকা পর্যন্ত দর তুলে একটা চান্স নিয়েছিল মাত্র, তাতে যখন হল না সে চলে গেল। অবশ্যই সে চোখের আড়ালে গেলেও ময়নাটার লোভ ছাড়তে পারেনি এবং সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।

তুই কি তবে বলতে চাস কিরীটী, সেই লোকটাই—

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সুব্রত সে-ই ইউসুফের হত্যাকারী ও ময়না-চোর।

তাহলে ডি’সিলভা বা যে লোকটি ময়না বেচেছিল তারা কি–

না, তারা ময়নাটার সত্যিকারের দাম জানত না, কল্পনাও করতে পারেনি।

ডি’সিলভার সঙ্গে যে লোকটি ময়না বেচতে এসেছিল সে কি রঘুনাথন?

সম্ভবতঃ নয়।

তবে কে?

সে এক তৃতীয় ব্যক্তি। হয়ত—

কী?

ইউসুফের মত তাকেও বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে ওই ময়নাটার জন্যই।

বলিস কি!

হ্যাঁ–ময়নাটা চুরি পর্যন্তই তার শেষ কীর্তি। তারপরেই তাকে লোভের দণ্ড দিতে হয়েছে। আমি তোর কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না এখনও। তাছাড়া তুই ধারণাই বা করছিস কি করে রঘুনাথন নিহত হয়েছে?

ঐ মুক্তোগুলো অভিশপ্ত রে।

অভিশপ্ত-মানে?

মানে সেই মুক্তোই রঘুনাথনের মৃত্যুর কারণ বলে।

মুক্তোগুলো!

হ্যাঁ-কিন্তু আর না, বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি। কৃষ্ণার টেম্পারের মারকারী কলমটা হয়ত এখন শেষ উর্ব সীমানায় আরোহণ করেছে আমাদের বিলম্বের জন্য, চল।

গাড়ি এসে ঐ সময় দোরগোড়ায় থামল।

বৃষ্টি তখনও ঝিরঝির করে অবিশ্রান্ত পড়ছে।

০৬. কৃষ্ণা সত্যিই চটে গিয়েছিল

কৃষ্ণা সত্যিই চটে গিয়েছিল।

কারণ ইদানিং কিরীটীর রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় কিরীটীর খাওয়া বিশ্রাম সম্পকে সে অত্যন্ত সজাগ থাকত। এতটুকু অনিয়ম সে বরদাস্ত করতে পারত না।

দুজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে কৃষ্ণা বলে, এই তোমাদের ঘণ্টা-দুই! তুমি একটা অঘটন না  ঘটিয়ে ছাড়বে না দেখছি!

মরতে তো একদিন হবেই প্রিয়ে-তা সে মৃত্যু যদি করোনারী হয় তার চাইতে সুখের মৃত্যু আর কি হতে পারে!

ঠিক আছে, একটা মুহূর্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, মনে থাকবে কথাটা আমার।

ভুল হয়ে গিয়েছে-মুখ ফসকে বের হয়ে গিয়েছে, আর এমনটি হবে না—এবারটির মত ক্ষমা-ঘেন্না করে

থাক, থাক। কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দিলি তো চটিয়ে ওকে! বললাম আমি।

কিরীটী মৃদু হাসল।

চল্ আর দেরি করিস না, সত্যিই অনেক রাত হয়েছে-খাবার টেবিলে গিয়ে বসা যাক।

তুই হ্যাঁ, আমি আসছি—আমায় একটা জরুরী ফোন করতে হবে।

এত রাত্রে কাকে আবার ফোন করবি?

পূর্ণ লাহিড়ীকে।

এই রাত পৌনে বারোটায়?

কথাটা জরুরী, তাকে জানানো দরকার এখুনি।

কথাটা বলে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে ডায়েল করে।

একটু পরেই বোধ হয় অন্য পাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

হ্যাঁ আমি কিরীটী, লাহিড়ী সাহেব। রেঙ্গুনগামী জলযান জাহাজটা কবে ছাড়ছে ক্যালকাটা পোর্ট থেকে একটা খবর নিতে পারেন? এখুনি পারবেন? ঠিক আছে, জেনে এখুনি এই রাত্রেই আমাকে জানান।

জাহাজটা তো পোলিশ জাহাজ, তাই না? হ্যাঁ যা-আচ্ছা—

ফোনটা রেখে দিয়ে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চল্।

.

টেবিলে খেতে বসে দেখি দুজনার মত প্লেট।

বললাম সামনে দণ্ডায়মান কৃষ্ণাকে, কি ব্যাপার, তুমি খাবে না?

না। কৃষ্ণ বলে।

তাহলে আমিও খাব না। বললাম আমি।

আমি খেয়েছি। কৃষ্ণা জবাব দেয়।

বিশ্বাস করি না।

বাঃ, বিশ্বাস না করার কি হয়েছে, সত্যিই আমি খেয়েছি।

বিশ্বাস করব না কেন, সত্যিই তুমি খাওনি এখনও। বলি আমি, যাও তোমারটাও নিয়ে এস, একসঙ্গেই খেতে খেতে আজকের অভিযানের গল্প তোমায় শোনাব।

ও আমি শুনতে চাই না।

নাই শুনলে—কান বন্ধ করে খেয়ে যেও।

বলছি খেয়েছি আমি!

সত্যি তোমাকে নিয়ে পারি না সুব্রত।

অনেক দেরিতে বুঝেছ দেবী। যাও, ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে, ত্বরা কর দেবী।

কৃষ্ণা অতঃপর আর দেরি করে না-আমাদের সঙ্গেই বসে পড়ে। খাওয়া প্রায় যখন শেষ হয়ে এসেছে-পাশের ঘরে ফোন বেজে উঠল। ক্রিং ক্রিং ক্রিং…।

কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল।

হ্যালো—হ্যাঁ কিরীটী, কি বললেন, কাল সকালে ভোর পাঁচটায় ছাড়বে জাহাজ! যেমন করে হোক আপনাকে পোর্ট পুলিসের সাহায্যে বাটোরির ডিপারচারের সময় অন্ততঃ ঘণ্টা কয়েক পিছিয়ে দিতে হবে। আরে পারবেন পারবেন—সবই জানতে পারবেন—শুনুন, ভোর পাঁচটা নাগাদ আপনি এখানে চলে আসবেন। আঁ হ্যাঁ, এই গরীবের গৃহে। ঠা, দুজন আর্মড কনস্টেবল নেবেন ও নিজে আগ্নেয় অস্ত্রের দ্বারা শোভিত হয়ে আসবেন। কিছু মুশকিল নয়-আপনি অনায়াসেই ঐ ব্যবস্থাটুকু করতে পারবেন মিঃ লাহিড়ী। আচ্ছা, আপাততঃ গুড নাইট।

কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে খাবার ঘরে আবার ফিরে এল।

সুব্রত!

কি?

রাত এখন সাড়ে বারোটা—ঠিক তিন ঘণ্টা সময় দেব-যা শুয়ে পড় গিয়ে—একটু ঘুমিয়ে নে—ঠিক ভোর চারটেয় উঠতে হবে।

ব্যাপার কি? অত ভোরে কোথায়ও যেতে হবে নাকি?

হ্যাঁ!

কোথায়?

কালই জানতে পারবি। হ্যাঁ, শুয়ে পড় গে।

কিরীটী কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

লাহিড়ীর সঙ্গে ফোনে একটু আগে কিরীটীর যে কাটা-কাটা একতরফা কথাগুলো হল তাতে এইটুকু বুঝতে পেরেছি, কোন একটি জাহাজের সিডিউল ডিপারচার যাতে ক্যানসেল করা হয় সে সেইমত লাহিড়ীকে নির্দেশ দিল।

কিন্তু কেন? তবে কি ঐ জাহাজেই মুক্তা-চোর পগারপার দেবার মতলব করেছে? কিন্তু সে কে? লোকটা কে? সেই চ্যাপাটা মুখ-ভোতা নাক-কুতকুতে চোখ লোকটা যে ডি’সিলভার সঙ্গে এসেছিল ময়নার সওদা করতে ইউসুফের দোকানে, সে-ই তাহলে সকল নাটের গুরু?

কিরীটীর চোখমুখের চেহারা দেখে মনে হয় সে কোন একটা স্থির সিদ্ধান্তে ইতিমধ্যে পৌঁচেছে। কোন রহস্যের শেষ মীমাংসার কাছাকাছি এসে চিরদিন কিরীটী সহসা অমনি গম্ভীর হয়ে যায়। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়ে নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিলাম, কিন্তু ঘুম আসে না।

বাইরে আবার বৃষ্টি জোরে শুরু হল। হয়ত কালকের রাতের মত আজও সারাটা রাতই বৃষ্টি ঝরবে।

এখন অন্ততঃ বুঝতে পারছি-মা’থিনের সেই বহুমূল্যবান মুক্তোর মালার সঙ্গেই জড়িত আছে সেই আশ্চর্য ময়না পাখীটির চুরি যাওয়া এবং হতভাগ্য ইউসুফের হত্যা।

কিন্তু যোগসুত্রটা কোথায়? কোথায় মুক্তোর মালার সঙ্গে সেই ময়না পাখীটীর যোগাযোগ রয়েছে? কোন্ অদৃশ্য সূত্রে দুটি ব্যাপার ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত যেন একটা সম্ভাবনা মনের পাতায় উঁকি দিয়ে যায়।

তবে কি—

কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয় অত গুলো মুক্তো–

তাছাড়া–

নাঃ, সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে।

চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একে দুপেগের নেশা—তার উপরে ভরপেট গরম খিচুড়ি ও মাংসের কোর্মা—আপনা থেকেই কখন দু চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে বুজে এসেছিল।

কিরীটীর ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল।

এই সুব্রত, ওঠ ওঠ!

ধড়ফড় করে শয্যার ওপর উঠে বসলাম।

তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে-কৃষ্ণার চা রেডি-এখনি হয়ত লাহিড়ী সাহেব এসে যাবেন।

০৭. আকাশ কালির মত কালো

রাত তখন তিনটে পঁয়ত্রিশ।

বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে-তবে খুব প্রবল বর্ষণ নয়। আকাশ কালির মত কালো।

হাত মুখ ধুয়ে চায়ের টেবিলে এসে দেখি চা ও প্রাতঃরাশ ইতিমধ্যেই কৃষ্ণা প্রস্তুত করে ফেলেছে।

কিরীটী তখনও টেবিলে এসে পৌঁছয়নি। একটু পরেই কিরীটী ঘরে এসে ঢুকল একেবারে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েই। গরম গরম ওমলেট ও টোস্ট শেষ করে চায়ের কাপে যখন আমরা চুমুক দিচ্ছি, নীচে লাহিড়ী সাহেবের জীপের ফন শোনা গেল।

ভদ্রলোক খুব পাংচুয়াল, এসে গেছেন। কিরীটী বলে।

আমি কোন জবাব দিই না। চায়ের কাপটায় চুমুক দিতে থাকি।

কৃষ্ণা!

কী?

জংলী হীরা সিংকে তুলে দিয়েছে তো গাড়ি বের করবার জন্য?

হ্যাঁ।

তোর গাড়িতে যাবি নাকি? প্রশ্নটা আমিই করি কিরীটীকে।

হ্যাঁ।

তবে লাহিড়ী সাহেবকে জীপ আনতে বললি?

প্রথমতঃ জীপ গাড়িটাই তো একটা মার্কামারা গাড়ি, তার উপরে পুলিসের জীপ! আমরা আমার গাড়িতেই যাব।

নীচে নেমে এসে দেখি লাহিড়ী সাহেব জীপ থেকে নেমে সিগারেট টানছেন। পাশেই কিরীটীর গাড়ি দাঁড়িয়ে।

সুপ্রভাত।

কিরীটীই প্রথমে স্বাগত জানায়।

সুপ্রভাত।

লাহিড়ী সাহেব?

বলুন।

আপনার জীপ আমাদের ফলো করবে একটু দূরত্ব রেখে।

সেইমত ব্যবস্থা হল, লাহিড়ী কোন প্রতিবাদ জানালেন না।

ট্রামরাস্তায় এসে আমাদের গাড়ি পড়ল। যতদূর দৃষ্টি চলে একেবারে জনহীন রাস্তা। ঝিরঝির বৃষ্টি যেন একটা কুয়াশার পর্দার মত থিরথির করে কাঁপছে। পথের দুপাশে ইলেকট্রিক আলোগুলো ঝাপসা-ঝাপসা মনে হয়।

হীরা সিং?

জী সাব্‌!

গাড়ি চালাতে চালাতেই সাড়া দিল কিরীটীর ডাকে হীরা সিং।

আউটট্রাম ঘাট চল।

নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল হীরা সিং।

বুঝতে পারলাম প্রশ্ন না করেও, গতরাত্রে কিরীটী ফোনে যে রেঙ্গুনগামী জলযান জাহাজটির কথা বলেছিল লাহিড়ীকে এবং যেটা আজই প্রত্যুষে ছাড়বার কথা, সেই জাহাজেই আমরা চলেছি।

কিরীটী কিছু একটা মনে মনে স্থির করেছে।

একবার আড়চোখে অন্ধকারে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু বোঝবার উপায় ছিল না কিছু তার মুখের দিকে চেয়ে।

রাত প্রায় চারটে বাজে। হু-হু করে ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া চলমান গাড়ির জানলা-পথে। আমাদের চোখেমুখে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। ডানদিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বাঁয়ে রেস কোর্স-দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায় আমাদের চোখের সামনে।

গাড়ি একটু পরেই আউটট্রাম ঘাটের সামনে এসে দাঁড়াল। সকলে গাড়ি থেকে নামলাম। বিরাট জাহাজের মাস্তুলের লাল নীল বাতি চোখে পড়ে। জেটির মুখেই জলপুলিসের অফিসার মিঃ সুন্দরম দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিরীটী ও লাহিড়ীকে দেখে বললেন, গুড মর্ণিং।

লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, সব ঠিক আছে তো মিঃ সুন্দরম?

হ্যাঁ।

ক্যাপ্টেন?

তাকে আগেই সংবাদ দিয়েছি, তিনি জাহাজে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

চলুন তাহলে জাহাজে যাওয়া যাক।

সুন্দরমের কথা মিথ্যা নয়, ক্যাপ্টেন মিঃ বার্টন ডেকের উপরেই দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সাদা নেভি ড্রেস পরিহিত দীর্ঘকায় পুরুষ মিঃ বার্টন।

রাতের আকাশে শেষ অন্ধকারে আলোর ছোপ ধরেছে-বৃষ্টি তখনও ঝিরঝির করে পড়ছে।

লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করেন, কোন্ কেবিন?

চোদ্দ নম্বর কেবিন। মিঃ বার্টন জবাব দিলেন।

এমবারকেশন কখন শুরু হবার কথা? কিরীটী প্রশ্ন করে।

ভোর পাঁচটা থেকে। আর ঘণ্টা দেড়েক আছে বাকি।

চলুন তাহলে আমরা চোদ্দ নম্বর কেবিনেই যাই লাহিড়ী সাহেব!

চলুন। লাহিড়ী বলেন।

ক্যাপ্টেন বার্টনই আমাদের চোদ্দ নম্বর কেবিনের দিকে নিয়ে চললেন। সিঁড়ি দিয়ে আমরা দোতলায় উঠলাম। লাউঞ্জ ডেক পার হয়ে সরু প্যাসেজের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

শেষ প্রান্তের ডান দিকের কেবিনটাই চোদ্দ নম্বর কেবিন। কেবিনের দরজায় কার্ড ঝুলছে দেখলাম একটা।

মিঃ ও মিসেস থি’ব।

ক্যাপ্টেনের কাছেই কেবিনের চাবি ছিল। তারই সাহায্যে কেবিনের দরজা খুলে কেবিনের মধ্যে আমরা চারজন প্রবেশ করলাম। আমি, কিরীটী, লাহিড়ী ও ক্যাপ্টেন।

আপনারা তো মিঃ লাহিড়ী এই কেবিনেই এখন থাকবেন? ক্যাপ্টেন প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ মিঃ বার্টন, আপনি যেতে পারেন এখন। তবে একটা কথা, আমরা না বলা পর্যন্ত জাহাজ ছাড়বেন না।

না না, ছাড়ব না।

ঠিক আছে, তাহলে আপনি এখন যেতে পারেন।

ক্যাপ্টেন বার্টন কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন।

লাহিড়ী এবারে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মিঃ রায়, এবারে অন্ততঃ আপনার এই বিচিত্র অভিযানের রহস্যটা যদি খুলে বলেন–

বলছি, কিন্তু মিঃ জোসেফকে যে কলকাতায়ে পাঠিয়ে দেবার জন্য সিঙ্গাপুর পুলিসকে একটা ওয়ারলেস মেসেজ পাঠাতে বলেছিলাম, পাঠিয়েছেন তো?।

হ্যাঁ, কাল রাত্রেই মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে। এবারে কিছু আলোকসম্পাত করুন!

মিঃ জোসেফের যে মূল্যবান ও রেয়ার পার্সগুলো খোয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবচাইতে মূল্যবান ও পৃথিবীর অন্যতম রেয়ার যে মুক্তোটা তার নাম হচ্ছে ব্লু কুইন।

ব্লু কুইন!

হ্যাঁ। তার ওজন হবে প্রায় দেড়শ গ্রামের উপর। ঐ মুক্তোটি সম্পর্কে একটি কিংবদন্তী আছে।

কি রকম?

খুব lucky ঐ মুক্তোটি—অর্থাৎ যার কাছে ঐ মুক্তোটি থাকবে, ভাগ্য তাকে চারদিক থেকে ঐশ্বর্য এনে দেবে।

এ কাহিনী আপনি কোথায় শুনলেন?

ম্যাডাম মা’থিনের মুখেই শুনেছি। তিনিই আমাকে বলেছিলেন কথাটা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। জোসেফ তার স্ত্রীকে তার বার্থ-ডেতে রেয়ার মুক্তোগুলো দিয়ে মালা করে দিয়েছিল, তার মধ্যস্থলে লকেটের মত ছিল ঐ মুক্তোটি-রু কুইন মালা চোর বিশেষ করে ঐ রুকুইনের লোভেই মালাটি চুরি করেছিল।

কে সে?

কালো পাখী রঘুনাথন। তাহলে সেই রঘুনাথনই— হ্যাঁ, তবে শেষ পর্যন্ত সে সেটি হজম করতে পারবে না। কেন?

কারণ সে এখনও বুঝতে পারেনি যে তার প্রেমই তার গলায় ফাঁস হয়ে এঁটে বসতে চলেছে।

প্রেম?

হ্যাঁ।

তাহলে এর মধ্যে নারীও আছে?

আছে বৈকি। আর নারী একজন ছিল বলেই শেষ পর্যন্ত আমরা হয়ত মুক্তোগুলো উদ্ধার করতে পারব।

কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন, ঐ মুক্তোর মালার সঙ্গে ইউসুফ মিঞার হত্যার ব্যাপারটা জড়িয়ে আছে।

মিথ্যে আমি বলিনি লাহিড়ী সাহেব, ঠিকই বলেছি। কালো পাখীটাই ইউসুফের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে তার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছিল।

কালো পাখী।

সেই ময়নাটার কথা ভুলে গেলেন?

না ভুলিনি, কিন্তু সেই ময়নার সঙ্গে ইউসুফের মৃত্যুর কী সম্পর্ক তা তো বুঝতে পারছি না! লাহিড়ী ববেন।

মুক্তোর মালাটা রঘুনাথন চুরি করে মালা থেকে সম্ভবত মুক্তোগুলো খুলে ফেলে।

কেন?

কিরীটী বলে, তার কারণ মালার সব মুক্তোগুলোই সমান মূল্যের ছিল না। তার মধ্যে যে মুক্তোগুলোর দাম বেশি, সেগুলো ঐ রু কুইনের সঙ্গে ময়নার খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে রঘুনাথন সম্ভবত ময়নাকে খাইয়ে দেয়।

বলেন কি?

আমার অনুমান তাই।

তারপর?

রঘুনাথন দলে নিশ্চয়ই একা ছিল না—আর ঐ ধরনের চুরির ব্যাপারে সাধারণতঃ একাধিক লোকই থাকে। সেই কারণেই বিশেষ করে রঘুনাথনকে হয়ত ঐ বিশেষ পন্থাটা নিতে হয়েছিল, তার ভাগিদারের হাত থেকে কিছু দামী মুক্তো অন্ততঃ সরিয়ে ফেলবার জন্য। তবে নিঃসন্দেহে যে পদ্ধতিটা সে মুক্তোগুলো সরিয়ে ফেলবার জন্য গ্রহণ করেছিল সেটা সত্যিই অভিনব তো বটেই, সেই সঙ্গে রঘুনাথনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিরও পরিচয় তা থেকে আমরা পাই।

লাহিড়ী প্রশ্ন করেন ঐ সময়, কিন্তু ওই ভাবেই যে রঘুনাথন কিছু দামী মুক্তো সরিয়েছিল, আপনি অনুমান করলেন কি করে?

অনুমান করেছি দুটো ঘটনা থেকে।

কোন্ দুটো ঘটনা?

প্রথম ঘটনাটা হচ্ছে, মুক্তোর মালাটি অদৃশ্য হওয়াতে সঙ্গে সঙ্গে রঘুনাথন ও সেই অত্যাশ্চর্য ময়না পাখীটিরও অন্তর্ধান–

দ্বিতীয়?

দ্বিতীয় হচ্ছে, সেই পাখী কিনে ইউসুফ মিঞাকে মৃত্যুবরণ করতে হল বলে। ইউসুফের মৃত্যুর ব্যাপারটা ভেবে দেখুন-হত্যাকারী একাই একজন বা একাধিক থাকুক সেরাত্রে নিশ্চয়ই এসেছিল পাখীটা সরিয়ে নেবার জন্য। হয়ত ইউসুফ মি জেগে উঠে বাধা দেয়—যার ফলে তাকে নৃশংসভাবে খুন হতে হয়।

কিন্তু আপনার অনুমানই যদি সত্য হয় মিঃ রায়-রঘুনাথন পাখীটা বেচবে কেন?

রঘুনাথন বেচেছে কে বললে আপনাকে? সুলতানের মুখে, পাখীটা যে বেচতে এসেছিল, তার চেহারার যে বর্ণনা আমরা পেয়েছি, তার সঙ্গে রঘুনাথনের চেহারার মিল তো আমরা পাইনি।

তবে? কে এসেছিল পাখী বেচতে?

রঘুনাথন নয়-তৃতীয় কোন ব্যক্তি যে পাখীর পেটে ঐ মুক্তো আছে নিশ্চয়ই জানত না।

তাই যদি হয় তো সে পাখীটা পেল কোথা থেকে? রঘুনাথন কি পাখীটাকে প্রহরায় রাখেনি?

নিশ্চয়ই রেখেছিল।

তবে?

সে ব্যাপারটা জানতে হলে আমাদের ডি’সিলভাকে প্রয়োজন। কারণ ডি’সিলভার সঙ্গেই সে লোকটা ইউসুফ মিঞার কাছে পাখীটা বেচতে গিয়েছিল। কিন্তু আর না-চুপ-ওরা বোধ। হয় এসে গেছে-পায়ের শব্দ পাচ্ছি!

সত্যিই প্যাসেজে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

কুইক-দরজার দুপাশে সব সরে দাঁড়ান! কিরীটী চাপা গলায় নির্দেশ দিল।

সঙ্গে সঙ্গে আমরা দরজার দুপাশে—একদিকে কিরীটী ও অন্যদিকে আমি ও লাহিড়ী সরে দাঁড়ালাম। একটু পরেই দরজা খুলে গেল কেবিনের।

প্রথমে একজন দামী সুট পরিহিত পুরুষ ও তার পশ্চাতে এক বর্মিনী নারী কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করল। এবং তারা কিছু বোঝবার আগেই চকিতে কিরীটী ওদের সামনে এগিয়ে কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিল, মিঃ থি’ব, কোন রকম পালাবার চেষ্টা করো না বা গোলমাল করো না, পুলিস কমিশনার মিঃ লাহিড়ী তোমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন।

০৮. বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত

আমি তখন বিস্ময়ে যেন একেবারে অভিভূত।

থি’ব নামধারী লোকটিকে না চিনলেও তার সঙ্গিনী নারীকে চিনতে পেরেছিলাম—ম্যাডাম মা’থিন।

থি’বর নার্ভের কিন্তু সত্যিই প্রশংসা করতে হয়। নিঃশব্দে সে তখন কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার দেহের গঠন বেশ বলিষ্ঠ। তার চ্যাপ্টা মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলদেটে মুখ দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না সে একজন বর্মীই।

পূর্ণ লাহিড়ী ইতিমধ্যে থি’বর পাশে এসে দাঁড়িয়ছিলেন, তার হাতে পিস্তল। বলা বাহুল্য কালো পাখী লাহিড়ীর অঙ্গে পুলিস অফিসারের ইউনিফর্মই ছিল।

অল্প দুরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে মা’থিন। সেও কিরীটীর মুখের দিকেই চেয়ে ছিল।

থি’বই প্রথমে কথা বললে, কিন্তু আমি তো এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না মশাই! এভাবে আমার বিনা অনুমতিতে আমার রিজার্ভভ কেবিনে অনধিকার প্রবেশই বা করেছেন কেন আর আমাকে এভাবে ইনসাল্ট করবারই বা দুঃসাহস হল কি করে আপনাদের?

কিরীটী পূর্ণ লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললে, মিঃ লাহিড়ী, arest him!

তাই নাকি? ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে ওঠে থি’ব, কিন্তু কেন জানতে পারি কি?

ব্লু কুইন ও অন্যান্য কিছু মূল্যবান মুক্তো সরানোর জন্য এবং টেরিটিবাজারের ইউসুফ  মিঞাকে হত্যা করবার অপরাধে।

মশায়েরা কি গাঁজায় দম দিয়ে এসেছেন। আবার ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে ওঠে থি’ব।

মিসেস জোসেফ, কিরীটী এবারে অদূরে দণ্ডায়মান নির্বাক মা’থিনের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার বুদ্ধির তারিফ করি ম্যাডাম-কিন্তু তাহলেও বলব

কিরীটীর কথা শেষ হল না। আমাদের সকলের দৃষ্টি তখন মা’থিনের উপর গিয়ে পড়েছিল মুহূর্তের জন্য, আর সেই মুহূর্তটুকুরই সুযোগে অঘটনটা ঘটে গেল।

একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে টলে পড়ল মা’থিন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাঘের মত ঐ বয়সেও কিরীটী থি’বর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে যুযুৎসুর পঁচে ধরাশায়ী করে।

শীগগিরি হাতকড়া লাগান মিঃ লাহিড়ী। কিরীটী চেঁচিয়ে ওঠে।

পূর্ণ লাহিড়ী মুহূর্ত দেরি করেন না-পকেট থেকে হাতকড়া বের করে থিবির হাতে পরিয়ে দেন।

হিংস্র দুটো চোখের দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, থি’ব যেন কিরীটীকে সুযোগ পেলে মুহূর্তে শেষ করে দেবে–

কিরীটী থি’বর হাতে হাতকড়া পরানো হতেই এগিয়ে যায় ভূপতিত মা’থিনের দিকে।

রক্তে তার সমস্ত জামা লাল হয়ে উঠেছে।

একটা ছোট ছোরা তার বামদিককার বক্ষে সমূলে বিদ্ধ।

থেকে থেকে মা’থিনের সমস্ত দেহটা আক্ষেপ করছে।

হঠাৎ ঐ সময় কেবিনের দরজাটা খুলে গেল, জাহাজের একজন খালাসী একটা খাঁচা হাতে কেবিনের মধ্যে এসে ঢুকল—তার পশ্চাতে ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেন কেবিনের মধ্যে পা দিয়েই বলে ওঠেন, Good God! এ কি?

ক্যাপ্টেন, শীগগিরি আপনার জাহাজের ডাক্তারকে ডাকুন-বাঁচবে না বুঝতে পারছি, তবু let us try!

ক্যাপ্টেন ছুটে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন।

মা’থিন-মা’থিন।

চমকে আমরা ফিরে তাকালাম।

খাঁচার মধ্যে কালো ময়না পাখীটা বলছে, মা’থিন-মা’থিন।

খালাসীটা তখনও হতভম্ব হয়ে খাঁচাটা হাতে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই জাহাজের ডাক্তার এল। কিন্তু বাঁচানো গেল না মা’থিনকে। সে মারা গেল।

শুধু মৃত্যুর আগে একটা কথা সে কোনমতে টেনে টেনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে গেল, কিরীটী যেন মুক্তোগুলো পেলে তার স্বামী জোসেফকে পাঠিয়ে দেয়। সে পারল না মুক্তোগুলো উদ্ধার করতে।

স্ট্রেচারে করে ঢাকা দিয়ে মা’থিনের মৃতদেহটা জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হল এবং থি’বকে হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিস-ভ্যানে সশস্ত্র প্রহরীর জিম্মায় তুলে দেওয়া হল।

.

ঐদিনই দ্বিপ্রহরে। গরাদের মধ্যে হাতকড়া অবস্থায় থি’ব। কিরীটী নানাভাবে তাকে প্রশ্ন করল, কিন্তু থি’ব একেবারে যেন বোবা। তার মুখ থেকে একটি কথাও বের করা গেল না। এবং মুক্তোগুলো যে কোথায় আছে তারও কোন সন্ধান করা গেল না।

অবশেষে কিরীটী বললে, ও মুখ খুলবে না মিঃ লাহিড়ী। ডি’সিলভার সন্ধান যতদিন না পাওয়া যায় আমাদের অপেক্ষাই করতে হবে। আপনি সমস্ত জাহাজে জাহাজে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছেন তো?

হ্যাঁ, আশা করছি দু-চারদিনের মধ্যেই ডি’সিলভার সন্ধান পাব।

ঠিক আছে চলুন, আপনার অফিস-ঘরে যাওয়া যাক। কিরীটী বললে।

সকলে আমরা লাহিড়ীর অফিস-ঘরে এসে ঢুকলাম। চেয়ারে বসে একটা চুরোটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে কিরীটী বললে, পাখীটা কোথায়?

আমার কোয়ার্টারেই আছে। কিন্তু পাখীটা যেন ক্রমশঃ কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে মিঃ রায়-কিছু খাচ্ছেও না!

স্বাভাবিক। মুক্তোগুলো হজম করতে পারবে কেন? বেচারী। ইচ্ছা ছিল অমন একটা rare specimen যদি বাঁচানো যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে তা আর সম্ভব হবে না। ও না মরলে আমাদেরই ওকে মারতে হবে-মুক্তোগুলো ওর পেট থেকে উদ্ধার করবার জন্য।

কিন্তু থি’ব যদি জানতই পাখীটার পেটেই মুক্তোগুলো আছে, পাখীটাকে মারেনি কেন? লাহিড়ী প্রশ্ন করে।

এমন একটা আশ্চর্য পাখী—ওর দামও তো কম নয়—তাই ভেবেছিল হয়ত পাখীটার পায়খানার সঙ্গে যদি মুক্তোগুলো বের হয়ে আসে, তাহলে মুক্তোগুলোও পাওয়া যায়, পাখীটাকেও মারতে হয় না।

পরের দিনই পাখীটা মারা গেল। পাখীটার পেট চিরে ফেলা হল-বারোটা বড় আকারের মুক্তো ও রু কুইন পাখীটার পেটের মধ্যেই পাওয়া গেল। নাড়ীর মধ্যে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘা-ই পাখীটার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

লাহিড়ী বলেন, চমৎকার পন্থা নিয়েছিল দেখছি লোকটা মুক্তোগুলো সরাবার অন্যের দৃষ্টি থেকে।

নিঃসন্দেহে। আর তারও হয়ত পাখীটার উপরে লোভ ছিল বলে শেষ পর্যন্ত পাখীটা মারতে পারেনি।

০৯. তিনদিন পরেই তার পাওয়া গেল

তিনদিন পরেই তার পাওয়া গেল, জোসেফ কলকাতায় আসছে সিঙ্গাপুর থেকে দিন দুয়েকের মধ্যেই এবং ওই দিনই ডি’সিলভার সন্ধান পাওয়া গেল।

অস্ট্রেলিয়ার বন্দরে এম. এস. বাটোরি জাহাজে সে ছিল। অস্ট্রেলিয়া সরকার তার কলকাতায় আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।

পরের দিন ডি’সিলভাও এসে পৌঁছাল।

ডি’সিলভাকে রঘুনাথনের ফটো দেখানো হল, কিন্তু ফটো দেখে সে বললে তার সঙ্গে গিয়ে ইউসুফ মিঞাকে ময়নাটা বিক্রি করেছিল সে ওই লোক নয়।

কিরীটী প্রশ্ন করল, তবে সে লোকটা কোথায়?

সে তো হুজুর কলকাতাতেই থাকে।

কলকাতায় থাকে?

আজ্ঞে।

কোথায় থাকে কলকাতায় জান?

খিদিরপুরের এক বস্তীতে। তার নাম রতিলাল-জাহাজের মাল খালাস করে।

তারপর কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে যা বললে ডি’সিলভা, রতিলালকে ডি সিলভা অনেক দিন আগে থাকতেই চেনেতার বস্তীর বাসায় সেবার গিয়ে তার ঘরে ওই ময়নাটা সে দেখতে পায়। রতিলাল বলে, জাহাজের মাল খালাস করতে করতে খাঁচাসমেত ঐ পাখীটা সে দেখতে পায়। পাখীটা রবিন রবিন বলে ডাকছিল।

পাখীটা দেখেই চিনতে পারে ডি’সিলভা পাখীটা মূল্যবান। সে-ই তখন রতিলালকে বলে, পাখীটা বেচলে সে অনেক টাকা পাবে। আর সে যদি চায় তো ডি’সিলভা পাখীটা বিক্রী করে দিতে পারে।

রতিলাল সম্মত হয়—তখন ডি’সিলভা তাকে নিয়ে ইউসুফের কাছে যায়।

ইউসুফ পাখীটার দাম পাঁচশো টাকা দিতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাজার টাকায় পাখাটী ইউসুফ কিনে নেয়।

তারপর?

তারপর আর আমি কিছু জানি না হুজুর, তবে রতিলাল আমাকে পাখীটা হাজার টাকায় বিক্রী করে দেওয়ার জন্য একশো টাকা দিয়েছিল।

কিরীটী অতঃপর মিঃ লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন একবার রতিলালের ওখানে যাওয়া যাক এখুনি!

তখুনি ওরা জীপে করে রওনা হল রতিলালের সন্ধানে।

রতিলাল তার ডেরায় ছিল।

সুলতান যেমন বর্ণনা দিয়েছিল, রতিলালকে দেখতে ঠিক তেমনই। তার জন্ম জানা গেল পেগুতে।

তার মা ছিল বর্মী এবং বাপ ছিল এক পাঞ্জাবী।

মোচির মাইনে সে কাজ করত। চুরির ব্যাপারে তার চাকরি যায়। তারপর সে জাহাজের খালাসী হয়ে কলকাতায় চলে আসে।

তার কাছে আরও একটা কথা জানা গেল।

যেদিন সে ইউসুফকে ময়নাটা বিক্রী করে আসে, সেইদিনই সন্ধ্যার দিকে এক সাহেব খোঁজ করতে করতে তার ডেরায় আসে পাখীটার সন্ধানে।

তারপর?

আমি বলে দিলাম, পাখীটা ইউসুফ মিঞাকে বিক্রী করেছি। শুনে সে চলে গেল।

কিরীটীর পরামর্শে রতিলালকে লালবাজারে নিয়ে আসা হল।

থি’বর ফটো তাকে দেখানো হল।

ফটোটা দেখেই রতিলাল বললে, ওই লোকটাই পাখীর সন্ধানে তার কাছে গিয়েছিল।

একজন সার্জেন্ট এসে ঘরে ঢুকে স্যালুট দিল মিঃ লাহিড়ীকে, স্যার!

ইয়েস!

মিঃ জোসেফ বলে এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

নিয়ে এস এই ঘরে।

জোসেফ এসে ঘরে ঢুকল।

বয়েস হয়েছে লোকটার। মাথার চুল প্রায় অর্ধেক পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।

মিঃ লাহিড়ী?

আমিই লাহিড়ী। বলুন!

আমার মুক্তোগুলো পাওয়া গিয়েছে?

পেয়েছি, বারোটা।

ব্লু কুইন?

সেটাও পাওয়া গিয়েছে।

আঃ, আপনি আমাকে নিশ্চিত করলেন।

কিন্তু আর মুক্তোগুলোর কোন সন্ধান এখনও করতে পারিনি।

না পেলেও ক্ষতি নেই-ব্লু কুইন পাওয়া গিয়েছে তাতেই আমি খুশি। ভাল কথা, আমার স্ত্রী কোথায় জানেন? গ্রাণ্ডে খোঁজ করেছিলাম কিন্তু তারা বললেন কয়েকদিন আগেই নাকি সে হোটেল ছেড়ে চলে গিয়েছে।

মিঃ জোসেফ?

কিরীটীর ডাকে ওর মুখের দিকে তাকাল জোসেফ।

দেখুন তো এই ফটোটা—এই লোকটাকে আপনি চেনেন?

থি’বর ফটোটা এগিয়ে দিল কিরীটী জোসেফের সামনে।

এ কি! এ ফটো আপনি কোথায় পেলেন? জোসেফ বলে ওঠে।

চেনেন ফটোর লোকটিকে?

নিশ্চয় চিনি—এ তো থি’ব।

কতদিন পরিচয় আপনার সঙ্গে থি’বর?

তা বছর দুয়েক তো হবেই-সিঙ্গাপুরেই ও থাকে—আমার বাড়িতে কতদিন এসেছে।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও ওর আলাপ ছিল?

ছিল বৈকি। অনেক দিনের আলাপ ওদের-রেঙ্গুন থেকেই।

লোকটা কি করত সিঙ্গাপুরে?

ওরও জুয়েলারী ব্যবসা ছিল; কিন্তু ওর সম্পর্কে এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

কারণ আমাদের ধারণা–

কী?

ওরই পরামর্শে রঘুনাথন আপনার ভৃত্য, মুক্তোর হারটা চুরি করেছিল।

সর্বনাশ! কি বলছেন আপনি?

তাই।

রঘুনাথনও ধরা পড়েছে নিশ্চয়ই?

না। যতদূর মনে হচ্ছে সে হয়ত আর বেঁচে নেই!

বেঁচে নেই?

না। থি’বই সম্ভবত-হয়তো তাকে হত্যা করেছে।

বলেন কি?

আরও একটা দুঃখের সংবাদ আছে মিঃ জোসেফ।

দুঃখের সংবাদ?

হ্যাঁ, আপনার স্ত্রী বেঁচে নেই।

মা’থিন নেই?

অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে ওঠে জোসেফ।

না, তাকে ঐ থি’বই হত্যা করেছে।

সংক্ষেপে মিঃ লাহিড়ীই তখন সেদিনকার জাহাজের কেবিনের ঘটনাটা বিবৃত করেন।

জোসেফ ব শুনে যেন গু হয়ে বসে থাকে।

তার দু চোখের কোলে জল টলমল করতে থাকে।

ব্যাপারটা মোটামুটি অতঃপর সব বোঝা গেলেও, থি’ব কিন্তু কিছুই স্বীকার করল না। সে যেমন চুপ করে ছিল তেমনই চুপ করে রইল।

জোসেফ মুক্তোগুলো আইডেনটিফাই করার পর মুক্তোগুলো তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল।

সেদিন সন্ধ্যায় কিরীটীর গৃহে তার বাইরের ঘরে বসে ওই মুক্তো-চুরির কাহিনীই কিরীটী বলছিল।

মিঃ লাহিড়ী প্রশ্ন করেন, কিন্তু আপনি জেনেছিলেন কি করে যে পরের দিন জাহাজেই মা’থিন ও থি’ব যাচ্ছে রেঙ্গুনে?

কিরীটী বললে, সেরাত্রে মা’থিনের অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার মধ্যেই আমি টিকিট দেখতে পাই জাহাজের একটা খামের মধ্যে টিকিটটা ছিল-খামের উপরে লেখা ছিল, মিসেস থি’ব-আর জাহাজের ডিপারচারের তারিখ ও সময় লেখা ছিল। তারপর মা’থিনের মুখে সব কথা শুনে আমার ধারণা হয়, মা’থিনই মিসেস থি’ব পরিচয়ে রেঙ্গুনে পালাচ্ছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে মনের মধ্যে আমার খটকা ছিল তখনও।

কী?

মা’থিনও কি তবে ঐ চুরির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট? থি’ব নামটা কোন বর্মীর-মনে হয়েছিল বুড়ো জোসেফকে ছেড়ে হয়ত মা’থিন থি’বর সঙ্গে পালাচ্ছে। কিন্তু পরে মা’থিনের চোখে জল দেখে বুঝতে পেরেছিলাম ধারণাটা আমার ভুল। মা’থিন সত্যি-সত্যিই তার স্বামীকে ভালবাসত—আর তার জন্যই সে মুক্তোগুলো উদ্ধারের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

তারপর?

তারপরও আমার ধারণা যে মিথ্যা নয়, সেটা তো প্রমাণই হয়ে গেল, যখন থি’ব মা’থিনকে হত্যা করল আমাদের চোখের সামনে। এবং তার শেষ কথাগুলোও তাই প্রমাণ করেছে। থি’বই শেষ পর্যন্ত মুক্তোগুলো হাতিয়েছে জানতে পেরে সে হয়ত থি’বর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিল এবং রেঙ্গুন পর্যন্ত তার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।

যদিও সঠিকভাবে কিছুই জানা গেল না, তাহলেও কিরীটীর অনুমান যে মিথ্যা নয় তাই আমাদের সকলের মনে হয়।

Exit mobile version