Site icon BnBoi.Com

আলোকলতা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

আলোকলতা - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

 ১. আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকা

আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকাই।

পৃথক পৃথক ভাবে মণিকা পত্র দিল তার প্রিয় তিন বন্ধু অতুল, রণেন ও সুকান্তকে।

এবারে পূজার ছুটিতে এস বেনারস, কাশী। কাশীতে দিদিমার বাড়িতে ছুটিটা এবারে কাটানো যাবে।

আপত্তি আর কি থাকতে পারে। প্রত্যেকবারই পূজায় ছুটির কয়েকটা দিন চারজনে মিলে কোথাও না কোথাও গিয়ে হৈ হৈ করে কাটিয়ে আসে।

গতবার গিয়েছিল ওরা লক্ষ্ণৌ, তার আগের বার শিলং। এবারে না হয় কাশীই হোক।

জায়গাটা তো আর বড় কথা নয়। সকলে মিলে কয়েকটা দিনের জন্য এক জায়গায়। একত্রে মিলিত হয়ে হৈ হৈ করে আনন্দ করা। তা সে লক্ষ্ণৌই হোক, শিলংই হোক বা কাশীই হোক—এমন কি পাতাল বলে সত্যি যদি কিছু থাকত সেখানে যেতেও আপত্তি ছিল না। অবিশ্যি কাশীতে মণিকার দিদিমার ওখানে ছুটি কাটানো যে এই প্রথম তা নয়।

বছর তিনিকে আগে একবার পূজাবকাশটা ওরা কাশীতে মণিকাদের ওখানেই কাটিয়েছিল এবং সেবারে বেশ কিছুদিনই কাশীতে ওরা থেকেছিল।

তার কারণও অবশ্য একটা ঘটেছিল।

ছুটির মাঝামাঝি হঠাৎ মণিকা অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে সামান্য অল্প অল্প জ্বর—কিন্তু তিন-চারদিনেও সেই অল্প অল্প জ্বর যখন গেল না এবং ক্রমে জ্বরের সঙ্গে দু-একটা করে

উপসর্গ দেখা দিতে লাগল তখন সকলেই চিন্তিত হয়ে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত রোগটা গিয়ে টাইফয়েডে দাঁড়ায় এবং পুরো এক মাস লাগে মণিকাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে।

কাজেই দশ-পনের দিনের জায়গায় মাসখানেকের কিছু উপরেই সকলকে থাকতে হয়েছিল কাশীতে সেবারে।

এ ছাড়াও মধ্যে মধ্যে যে সকলেরই কাশীতে মণিকাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল না, তাও নয়।

.

মণিকার দিদিমা ছিলেন কাশীতে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাশীবাসিনী। মণিকারও ত্রিসংসারে ঐ এক বুড়ী দিদিমা ছাড়া আপনার জন বলতে কেউ ছিল না।

মণিকা এম.এ. পাশ করে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে কলকাতাতেই থাকে। অথচ বুড়ী দিদিমাকে সর্বদা কাশীতে দেখাশোনা করবারও একজন কারও দরকার। বুড়ী দিদিমার জন্য মণিকার সর্বদাই একটা দুশ্চিন্তা।

কাশীতে অবিশ্যি সেরকম স্ত্রীলোকর অভাব ছিল না, কিন্তু দিদিমার খুঁতখুঁতে মন, কাউকেই তেমন পছন্দ হয় না।

এমন সময় দেশের গ্রাম থেকে নিরাশ্রয়া সুবালা গ্রামের একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে তীর্থপর্যটন করতে করতে কাশীতে এসে উঠল মণিকাদেরই বাড়িতে।

সুবালা ব্রাহ্মণের মেয়ে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশী নয়।

সুবালা অভাগিনী। ছোটবেলায় মা-বাপকে হারায়। মামা-মামীর কাছেই মানুষ। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়াও কিছু শিখেছিল এবং মামা-মামীর চেষ্টাতেই একপ্রকার নিখরচায়ই এক মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে বিবাহও হয়েছিল সুবালার। মেধাবী ছাত্রটি সুবালার রূপে মুগ্ধ হয়েই স্বেচ্ছায় বিবাহ করেছিল সুবালাকে।

শুধু রূপসী বললেই সুবালা সম্পর্কে যেন সবটুকু বলা হয় না। আগুনের মত রূপ ছিল সুবালার। প্রখর সে রূপের জৌলুসে পুরুষ তো ছার, মেয়েদের চোখই ঝলসে যেত। কিন্তু বিনা পণে বিবাহের বাজারে রূপের জৌলুসে বিকিয়ে গেলেও সুবালার স্বামীভাগ্য ছিল না। তাই বিবাহের পর ছমাস না যেতেই সুবালা হাতের নোয়া ও সিঁথির সিঁদুর মুছে মামা-মামীর কাছে ফিরে এল।

এবং দুভাগ্য যখন আসে একা আসে না—মামার গৃহে ফিরে আসবার মাসখানেকের মধ্যেই মামা গেলেন মারা।

সুবালা শীঘ্রই সংসারে সকলের চক্ষুশূল হয়ে উঠল। দুঃখের অপমানের অন্ন তিক্ত হতে তিক্ততর হয়ে উঠতে লাগল সুবালার মুখে দিন যত যায়।

মৃত্যু-আকাঙক্ষায় রাত্রি ও দিনের মুহূর্তগুলো কাটতে লাগল।

এমনি করে অনেকগুলো বছর কেটে গেল বৈধ্যবের। তারপর একদিন গ্রামের একদল প্রবীণা তীর্থযাত্রীর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এসে কাশীতে মণিকার দিদিমার ওখানে উঠল সুবালা।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী সুবালা অতি সহজেই মণিকার দিদিমার স্নেহকে জয় করে নিল। ফলে যাবার সময় সকলে ফিরে গেল, কিন্তু সুবালা থেকে গেল মণিকার দিদিমার ওখানেই। সেও আজ বছর পাঁচেকের কথা।

সুবালাকে পেয়ে মণিকার দিদিমাও নিশ্চিন্ত হলেন এবং মণিকাও দিদিমা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হল।

রান্না ও গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ সুবালা তো করেই, অবসর সময় ভাগবত রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি পড়ে শোনায় বুড়ী দিদিমাকে।

সুবালার অল্প বয়স ও আগুনের মত রূপ দেখে প্রথমটায় মণিকার বুড়ী দিদিমা মনে মনে একটু ইতস্তত করেছিলেন সুবালাকে গৃহে স্থান দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে কিনা।

কিন্তু দেখা গেল বয়স অল্প ও আগুনের মত রূপ থাকলেও সুবালার চরিত্রে একটা সংযত আভিজাত্য আছে ও সেই সঙ্গে আছে একটা অদ্ভুত নিষ্ঠার ও তীক্ষ্ণ মর্যাদাবোধ। ছ্যাবলা নয়, অত্যন্ত সংযমী। ধীর-স্থির।

নিশ্চিন্ত হলেন মণিকার বুড়ী দিদিমা।

সুবালার চরিত্রে আর একটি গুণ ছিল, আলসেমিকে সে কখনও এতটুকু প্রশ্রয় দিত। সাংসারিক কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে সময়টা সুবালা বই পড়ে অথবা উলের বা সেলাইয়ের কাজ করে কাটাত।

পাড়ার গৃহস্থদের উলের সেলাইয়ের কাজ করে সুবালা দুপয়সা বেশ উপার্জনও করত।

.

কাশীতে মণিকার দিদিমার বাড়িটা জঙ্গমবাড়ির একটা গলির মধ্যে। সেকেলে ধরনের তিনতলা পুরাতন বাড়ি। বাড়িটা বছর পনের-ষোল আগে চাকরিতে অবস্থানকালেই মণিকার দাদু কাশীশ্বর চৌধুরী কিনেছিলেন একটা মৌকায় মাত্র পাঁচ হাজারে।

সংসারে তাঁর আপনার বলতে ছিল স্ত্রী সারদা ও একমাত্র নাতনী মণিকা। মণিকা কাশীশ্বর চৌধুরীর একমাত্র সন্তান কন্যা রেণুকারও একমাত্র সন্তান। বহু অর্থব্যয় করে মনোমত পাত্রে কন্যা রেণুর বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু মণিকার যখন মাত্র চার বৎসর বয়স তখন একটা রেল-অ্যাকসিডেন্টে জামাই ও মেয়ে একসঙ্গে মারা গেল। সেই হতে মণিকা দাদু ও দিদিমার স্নেহযত্নেই মানুষ।

কাশীশ্বরের ইচ্ছা ছিল সরকারের চাকরি হতে অবসর নেওয়ার পর জীবনের বাকী কটা দিন দেবাদিদেবের লীলাভূমি কাশীধামেই নিঝঞাটে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। পেনসন নেওয়ার মাত্র যখন মাস চার-পাঁচ বাকী হঠাৎ এমন সময় অকস্মাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কর্মস্থল হতে ফিরে করোনারী থ্রম্বোসিসে এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলেন কাশীশ্বর।

প্রথম ও একটিমাত্র আক্রমণেই সব শেষ হয়ে গেল। মণিকা সেবার আই.এ. পরীক্ষার জন্য কলকাতার হস্টেলে থেকে প্রস্তুত হচ্ছে। মণিকার দাদু তখন মীরাটে কার্যস্থলেই ছিলেন। সেখানেই ঘটল দুর্ঘটনা। তার পেয়ে কলকাতা থেকে মীরাটে মণিকা ছুটে গেল। এবং মীরাট থেকে সোজা এসে দিদিমাকে নিয়ে উঠল কাশীর বাড়িতে। বাড়িটা খালিই, তালা দেওয়া ছিল। ভাড়া দেওয়া হয়নি কখনও।

কটা দিন কাশীতে থেকে সাধ্যমত সব গোছগাছ করে দিয়ে মণিকা আসন্নবর্তী পরীক্ষার জন্য আবার ফিরে এল কলকাতায়।

বুড়ী দিদিমার একমাত্র বন্ধন মণিকা ম্যাট্রিক পাস দেওয়ার পর হতেই কলকাতার হস্টেলে সেই যে গিয়ে ডেরা বেঁধেছে—সেই যেন পাকাপোক্তভাবে তার দিদিমার আশ্রয়নীড় হতে হয়েছে বিচ্ছিন্ন। ক্রমে হস্টেল-জীবনেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। একটি একান্তভাবে একেবারে নিজের ঘর বাঁধবার স্বপ্ন যে বয়সে মেয়েদের মনে এসে বাসা বাঁধে ঠিক সেই বয়সেই হস্টেলের স্নেহবন্ধনহীন ভাসা-ভাসা জীবনের মধ্যে পড়ে কেমন যেন দায়িত্বহীন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে সে। হস্টেলে থেকেই একটার পর একটা পরীক্ষায় পাস করে দিল্লীর এক কলেজে চাকরি নিয়ে আবার সেই হস্টেল-জীবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাড়ির সঙ্গে ও দিদিমার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এখন মাসান্তে এক-আধখানা চিঠিতে এসে পর্যবসিত হয়েছে।

গ্রীষ্মের ছুটিটা যদিও এসে কাশীতে দিদিমার কাছে কাটিয়ে যায়, পুজোর ছুটিতে তাও আসে না। তিন বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে কোথাও না কোথাও গিয়ে ছুটিটা কাটায়।

দিদিমার সঙ্গে মণিকার সম্পর্কটি বড় মধুর। মেয়ে-বন্ধু মণিকার একজনও নেই। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা উঠলে বলে, মেয়েদের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি! মনের পরিধি বা ব্যাপ্তি ওদের মধ্যে কোথায়? ছোটখাটো স্বার্থ নিয়েই তো ওরা মশগুল থাকে।

মণিকার বন্ধু অতুল, রণেন ও সুকান্ত দিদিমার পরিচিত।

মধ্যে মধ্যে দিদিমা ঠাট্টা করেছেন নাতনীকে, আচ্ছা মণি, এইভাবে বাউণ্ডুলের মত চাকরি নিয়ে হস্টেলে না থেকে তোর ঐ তিন বন্ধুর মধ্যে যাকে হোক একজনকে বিয়ে করেই না হয় সংসার পাত্ না!

এইবার তুমি ঠিক বলেছ দিদিমা। একজনকে বিয়ে করি আর দুজন মুখ গোমড়া করে বসে থাকুক। জবাবে বলেছে মণি।

দিদিমাও হাসতে হাসতে বলেছেন, তাহলে না হয় কলির দ্রৌপদী হয়ে ওদের তিনজনকেই একসঙ্গে বিয়ে কর ভাই।

ভুলে যাচ্ছ কেন দিদিমা, এটা কলি যুগই। এ যুগে দ্রৌপদীদের সতী বলে কেউ ভোরবেলায় স্মরণ করে না—স্বৈরিণী বলে কলঙ্ক রটায়। তাছাড়া বিয়ে করা মানেই তো দুজনকে হারানো, এতদিনের বন্ধু ওরা আমার, ওদের একজনকেও হারাতে পারব না।

শেষ পর্যন্ত দেখিস ভাই, ওই তিনের বন্ধুত্বই একদিন না তোর পক্ষে বিষ হয়ে ওঠে। কথায় বলে মেয়ে-পুরুষ!

এত বছরেও যখন বিষ হয়নি-বন্ধুত্ব আমাদের জীবনে অমৃত হয়ে থাকবে!

হলেই ভাল। দিদিমা আর প্রসঙ্গটাকে টানতে চান নি। ওই তিন বন্ধুকে নিয়ে দিদিমার কথা ছেড়ে দিলেও, মণিকাকে কম নিন্দা ও গ্লানি সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু কোন নিন্দাকেই যেন মণিকা গায়ে মাখতে চায়নি।

অনেকদিন বাদে পূজাবকাশের কয়েকটা দিন আনন্দে হৈচৈ করে কাটাবে বলে মণিকার ওখানে এল সকলে কাশীতে। কিন্তু পৃজাবকাশের আনন্দঘন দিনগুলোর মধ্যে আকস্মিকভাবে এমনি করে যে ভয়াবহ মৃত্যুর ছায়া নেমে আসবে এ কেউ কি ওরা স্বপ্নেও ভেবেছিল! আগের রাত্রে যখন একত্রে সকলে মিলে বসে প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হৈ হৈ করে তাস খেলেছে, তখনও তারা বুঝতে কি পেরেছিল রাত্রি প্রভাত হবে দলের একজনের জীবনাবসানের ভিতর দিয়ে! বুঝতে কি পেরেছিল ওরা কেউ চারজনের মধ্যে একজনও যে তাদেরই একজনের পশ্চাতে মৃত্যু এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে! অমোঘ অনিবার্য। অতুল, রণেন, সুকান্ত ও মণিকা। চারজনের মধ্যে যে কেবল দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয় তাই নয়—নিবিড় ঘনিষ্ঠতাও ছিল। চারজনই অবিবাহিত। অতুল সাইকোলজির প্রফেসর, রণেন ডাক্তার, সুকান্ত ইঞ্জিনিয়ার আর মণিকা প্রফেসর। অতুল, সুকান্ত ও রণেনের মণিকা সম্পর্কে সঠিক মনোভাবটা বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও এবং তিনজনের মধ্যে একজনও কথাবার্তায় বা আভাসে-ইঙ্গিতে ঘুণাক্ষরে কখনও কিছু না প্রকাশ করলেও এটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হত না যে, মণিকা সম্পর্কে একটা দুর্বলতা তিন বন্ধুরই আছে। তিন বন্ধুর মধ্যে সর্বপ্রকার আলোচনা হত, কেবল দুটি বিষয় নিয়ে কখনও আলোচনা হত না—পরস্পরের বিবাহ ও মণিকা সম্পর্কে। ওই জায়গাটিতে ওরা যেন অতি সতর্ক ছিল। কোনক্রমে কখনও কোন আলোচনার মধ্যে অতর্কিতেও যদি ঐ দুটি ব্যাপার এসেও যেত প্রত্যেকেই অতি সতর্কতায় এড়িয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যেত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

এদের তিনজনের মধ্যে অতুল ধনী পিতার পুত্র। নিজেও মেধাবী ছাত্র হিসাবে অল্প বয়সেই ভাল চাকরি পেয়েছে। রণেন কিছুদিন হল বিলাতী ডিগ্রী ডিপ্লোমা নিয়ে এসে একজন তরুণ চিকিৎসক হিসাবে ক্রমে চিকিৎসা-জগতে নাম করতে শুরু করেছে। রণেনের আর্থিক অবস্থা ভাল না হলেও মোটামুটি। ছাত্র হিসাবে সেও বরাবর মেধাবী ও বৃত্তি পেয়ে এসেছে। দুজনের চেহরার মধ্যে কারোরই এমন বিশেষ কিছু আকর্ষণীয় ছিল না। তবে স্বভাবে দুজনেই নম্র, বিনয়ী, ধীর ও সহিষ্ণু। তৃতীয় বন্ধু সুকান্ত গরীবের ছেলে, বাপ গরীব স্কুলমাস্টার। বাপের ক্ষমতা ছিল না ছেলেকে খরচপত্র করে উচ্চশিক্ষায় মনোমত উচ্চশিক্ষিত করে তোলেন। কিন্তু সুকান্তর ভাগ্যক্রমে তার এক সহায় জুটেছিল নিঃসন্তান এক ধনবতী মাসী। মাসী তার মায়েরও বড়। সুকান্তরা চার ভাই ও পাঁচ বোন। ভাই বোনদের মধ্যে সুকান্ত তৃতীয়। সুকান্তকে একপ্রকার দত্তক পুত্রের মতই বরাবর তার মাসী নিজের কাছে রেখে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করে তুলেছেন। সুকান্ত ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে একটি বিলাতী ইলেকট্রিক্যাল ফার্মের বড় চাকুরে, মেসোরই সুপারিশে ভাল চাকুরিতে ঢুকেছে প্রায় বছর দেড়েক হল। সুকান্ত তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে সুশ্রী। দীর্ঘ পেশল চেহারা, গোরাদের মত টকটকে গায়ের রং। আরও একটি তার গুণ আছে, সে একজন সুকণ্ঠী এবং সুগায়কও। আর মণিকা? মণিকার গায়ের রং কালো হলেও সমগ্র দেহ এমন একটি লাবণ্যে ঢলঢল, বিশেষ করে মুখখানি, তার বুঝি তুলনা হয় না। রোগাটে চেহারায় এমন একটি সৌন্দর্যময়ী সজীবতা আছে যে মনে হয় জীবনপাত্রখানি তার বুঝি সুধারসে উছলে উঠছে। সৌন্দর্যময়ী, মাধুর্যময়ী ও লাবণ্যময়ী।

রণেন, সুকান্ত ও অতুল এদের কলেজে আই.এস-সি ক্লাসেই পরিচয়। পূজার ছুটিতে ও গ্রীষ্মের ছুটিতেই বরাবর তিন বন্ধুতে মিলে কোন-না-কোন জায়গায় গিয়ে কিছু হৈচৈ করে আসত। অমনি এক পূজার ছুটিতেই পুরীতে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রসৈকতেই ওদের প্রথম পরিচয় হয় মণিকার সঙ্গে। মণিকা তখন বি.এ. পড়ছে। মণিকারও অভ্যাস ছিল পূজার ছুটিতে কোথাও-না-কোথাও বেড়াতে যাওয়া। দেশভ্রমণের একটা অদ্ভুত নেশা বরাবরই তার ছিল তার সেই ছোটবেলা থেকেই। পুরীর সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ছুটির পর কলকাতায় ফিরে এসে চারজনের দেখাসাক্ষাৎ হওয়াটা ছিল একটা নিত্যকার ব্যাপার এবং প্রতি রবিবারের ছুটিটা বটানিকসে বা ডায়মণ্ডহারবারে অথবা নৌকো করে গঙ্গায় কিংবা দক্ষিণেশ্বরে—কোথাও-না-কোথাও সারাটা দিন হৈচৈ করেই কাটত ওদের চারজনের। একটি মেয়ে ও তিনটি পুরুষের মধ্যে এই হৃদ্যতা বেশ যেন বিচিত্র। এমনি করে ক্রমে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। শিক্ষা-সমাপনান্তে এক-একজন যে-যার কর্মপথে এগিয়ে গেল, ছাড়াছাড়ি হল চারজনের মধ্যে। অতুল গেল হুগলী কলেজে প্রথমে, সেখান হতে কুচবিহারে; রণেন পাটনায় প্র্যাকটিস করতে লাগল, সুকান্ত রইল কেবল কলকাতায়। মণিকা চাকরি নিয়ে গেল দিল্লীতে। কিন্তু পূজা-অবকাশে ঠিক চারজনে কোথাও-না-কোথাও একত্রে এসে মিলিত হত। সমস্ত ছুটিটা হৈচৈ করে কাটিয়ে তারপর এক বৎসরের জন্য যে-যার কর্মস্থানে যেত ফিরে। কেবল সুকান্তই বেশীদিন থাকতে পারত না। দিন–দশেক পরে সে কলকাতায় ফিরে যেত। এইভাবে তাদের পরস্পরের পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতায় দীর্ঘ আট বৎসর কেটে গিয়েছে। এবারে মণিকার আমন্ত্রণে সকলে পূজার ছুটিতে কাশীতে এসে মিলিত হয়েছে। এবং দুর্ঘটনাটা ঘটল সাতদিন পরে। ঠিক কোজাগরী পূর্ণিমার দিনতিনেক পরে রাত্রে।

 ২. অভাবনীয় আকস্মিক দুর্ঘটনা

দিদিমার বাড়ির ঘরগুলো স্বল্পপরিসর বলেই মণিকা প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছিল শয়নের। একটা ঘরে দিদিমার সঙ্গে মণি নিজের শয়নের ব্যবস্থা করেছিল। বাকী তিনটি ঘরে তিনজনের শোবার ব্যবস্থা। দোতলায় ইংরাজী Eপ্যাটার্নের পরিকল্পনায় চারখানি ঘর। প্রথম ঘরটিতে অতুল, দ্বিতীয় ঘরে রণেন, তৃতীয় ঘরে মণি, তার দিদিমা ও সুবালাদি এবং শেষঘরে সুকান্ত। রাত সাড়ে এগারোটার পরে তাস খেলা শেষ হলে যে-যার ঘরে শুতে যায়। পরের দিন প্রত্যুষে মণি অন্যান্য দিনের মত প্রভাতী চা তৈরী করে প্রথমে ঘুম ভাঙিয়ে সুকান্তকে চা দেয়, তারপর ডেকে তোলে রণনকে এবং চা দেয়। সর্বশেষে অতুলের ঘরের ভেজানো দ্বার ঠেলে ভেতরে ডাকতে গিয়ে দেখে অন্যান্য দিনের মত তার দরজায় ভিতর হতে খিল ভোলা নেই; ভোলাই আছে। একটু যেন আশ্চর্যই হয় মণিকা, অতুলের চিরদিনের অভ্যাস—সে কখনও শয়নঘরের দরজা ভিতর হতে বন্ধ না করে শোয় না। এখানে আসবার পরও গত সাতদিন সকালে অন্তত চার-পাঁচবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডেকে তবে মণিকে দরজা খোলাতে হয়েছে। দরজা প্রথম ধাক্কাতেই খুলে যেতে বেশ একটু বিস্মিত হয়েই চায়ের কাপ হাতে মণি অতুলের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

অতুল চেয়ারের ওপর বসে আছে। চায়ের কাপটি হাতে এগুতে এগুতে ঠাট্টা করেই মণি বলে, কি ব্যাপার বল তো অতুলানন্দ স্বামী!

তিন বন্ধুর সকলের নামের সঙ্গে একটা নন্দ যোগ করে স্বামী বলে ডাকে মণি। ওরা তিন বন্ধুই প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমরা ত্রয়ী ঘোরতর সংসারী। স্বামীজী মোটেই নয়!

মণিকা ঠাট্টা করে বলেছিল, উঁহু, এ ঠিক তা নয়। এ অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানো আর কি!

একত্রে যুগপৎ সকলেই প্রশ্ন করে, তার মানে, তার মানে?

উঁহুঁ। Thus far and no further! কতকগুলো এমন ব্যাপার আছে সংসারে যার রহস্যটুকু উদঘাটিত হয়ে গেলেই সকল মাধুর্য তার নষ্ট হয়ে যায়।

এই ব্যাপরের পরেই কিন্তু একটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটে। যদিচ তিন বন্ধু জানে আজ পর্যন্ত একজন ব্যতীত বাকী দুজন সে ঘটনা সম্পর্কে একেবারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কিন্তু মণিকা জানে তিন বন্ধুর প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা করে তাকে একই অনুরোধ জানিয়েছে এবং প্রত্যেককেই মণিকা একই জবাব দিয়ে মৃদু হাসির সঙ্গে নিবৃত্ত করেছে। ব্যাপারটা হচ্ছে মণিকার বন্ধুদের ঐ ধরনের সম্বোধনের কিছুদিন পরেই একদিন অতুল বলে, মণিতুমি নিশ্চয়ই জান আমাদের চারজনের বন্ধুত্বের মধ্যে কোথাও এতটুকু গলদ নেই। তোমার সেদিনকার রহস্যজনক উক্তি বুঝতে পারিনি মনে কোরো না।

মণি কৌতুক হাস্যের সঙ্গে অতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, বুঝতে পেরেছ! কি বল তো অতুলানন্দ স্বামী?

সত্যি, ঠাট্টা নয়! Be serious মণি!

I am seriousgo on! মণি গম্ভীর হবার ভান করে।

তুমি যদি আমাদের তিনজনের মধ্যে কাউকে বিয়ে কর, জেনো, বাকি দুজন আমরা এতটুকুও দুঃখিত হব না।

সত্যি বলছ?

ভগবানের নামে শপথ নিয়ে বলছি, সত্যি।

নাস্তিকের মন নিয়ে আর ভগবানকে টানাটানি কোরো না অতুলানন্দ স্বামী।

বিশ্বাস কর আমি যা বলছি—

করলাম, কিন্তু আমার নিজস্ব একটা মতামতও তত থাকতে পারে এ ব্যাপারে!

নিশ্চয়ই।

তাহলে শোন, বিধাতা এ জীবনে বোধ হয় আমার ঘর বাঁধার ব্যাপারে বিষম একটা কৌতুক করে বসে আছেন!

মানে?

মানে তোমাদের তিনজনের মধ্যে এমন বিশেষ বিশেষ কতকগুলো গুন আছে, একমাত্র যাদের সমম্বয়েই আমি বিবাহে স্বীকৃত। অতএব বুঝতেই পারছ তা যখন এ জীবনে হবার নয় তখন–

তাহলে আর কি হবে? তাই তো ভেবেছি এ জীবনের তপস্যা পরজন্মে মনোমত পতিলাভ।

পরে রণেন ও সুকান্তও ঠিক অনুরূপ অনুরোধই জানিয়েছিল মণিকাকে এবং মণিকাও পূর্ববৎ জবাবই দিয়েছিল তাদেরও।

কিন্তু মণিকার সম্বন্ধেও অতুল কোনো সাড়া দেয় না। আরও একটু এগিয়ে এসে মণিকা বলে, কি গো অতুলানন্দ স্বামী, চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছ নাকি?

এবারেও সাড়া না পেয়ে ভাল করে তাকায় মণিকা অতুলের দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে ও, হাত হতে চা-ভর্তি কাপটা মাটিতে পড়ে ঝঝন্ শব্দে গুঁড়িয়ে যায়। অত্যন্ত ধীরস্থির মণিকা চিরদিন সাধারণত মেয়েরা যে স্নায়বিক হয় অদপেই সে ধরনের সে নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে শিথিল হাত হতে চায়ের কাপটা পড়ে মাটিতে চূর্ণ হয়ে যাবার ঠিক পূর্বে ক্ষণেকের জন্য সম্মুখেই উপবিষ্ট নিশ্চল অতুলের মুখের দিকে তাকিয়েই যেন একটা ভয়ের অনুভূতি তাকে বিকল করে দিয়েছিল। অস্ফুট একটা আর্ত শব্দ কোনমতে চাপতে চাপতে ছুটে ঘর হতে বের হয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে ডাকে, রণেন, সুকান্ত-শীগগিরী!

সুকান্ত সবে তখন চায়ের কাপটি শেষ করে নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল শয্যার পাশেই মেঝেতে হাত বাড়িয়ে এবং শয্যা হতে তখনও সে গাত্রোখান করেনি। আর রণেন চায়ের কাপ অর্ধেক নিঃশেষ করেছে। মণিকার চাপা আর্ত ডাকটা উভয়েরই কানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই দুজনেই প্রায় একসঙ্গে দুঘর হতে বের হয়ে আসে সামনের বারান্দায়। মণিকার সর্বশরীরতখনও উত্তেজনায় কাঁপছে। একবার মাত্র ওদের ডেকেই যেন তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখখানা তার ভয়ে ও উত্তেজনায় কেমন হয়ে গিয়েছে। একটা বিবশ অসহায় নিষ্ক্রিয়তা।

দুজনেই ব্যগ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কি? কি হয়েছে মণি?

অতুল—কোনক্রমে মণিকা বেল নামটাই উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়।

অতুল! কি হয়েছে অতুলের? সুকান্ত প্রশ্ন করে, কিন্তু রণেন ততক্ষণে খোলা দরজা দিয়ে অতুলের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

কি? কি হয়েছে অতুলের? সুকান্ত আবার প্রশ্ন করে।

কিন্তু মণিকার কণ্ঠে কোন জবাব আসে না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সুকান্তর মুখের দিকে, অগত্যা সুকান্তও ঘরের মধ্যে যায়। মণিকা তাকে অনুসরণ করে আচ্ছন্নভাবে যন্ত্রচালিতের মত।

নির্বাক স্থির জড়পদার্থের মত দাঁড়িয়ে আছে রণেন চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট অতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে।

অতুল!

অতুলের গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কিন্তু মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সমস্ত মুখখানার ওপরে একটা কালো ছায়া পড়েছে। চোখ দুটি খোলা এবং আতঙ্কে বিস্ফারিত দুহাত মুষ্টিবদ্ধ—অসহায় শিথিলচেয়ারের দুপাশে ঝুলছে। হাঁটু দুটো একটু ভাঁজ করা। বারেক মাত্র তাকিয়েই কারও বুঝতে কষ্ট হয় না যে অতুল মৃত। ডাক্তার রণেনের পক্ষে তো নয়ই, সুকান্তরও বুঝতে দেরি হয় না অতুল মৃত।

গত রাত্রে আহারাদির পর সাড়ে নটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত চারজনে একত্রে সুকান্তর ঘরে বসে তাস খেলেছে। এবং তাস খেলতে খেলতে প্রত্যহ যেমন হৈ-হুল্লোড় হাসি তামাসা হয় তেমনিই হয়েছে। বরং গত রাত্রে যেন একটু বেশীই কৌতুকপ্রিয় দেখা গিয়েছিল অতুলকে। এমনিতেই কারণে অকারণে অতুল একটু বেশী হাসে, গত রাত্রে তার সে হাসির মাত্রা যেন অন্যান্য দিনের চাইতে একটু বেশীই বলে মনে হচ্ছিল। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা অতুল।

কোন রাগ ছিল না তার দেহে। সুকান্ত ও রণেন তবু মধ্যে মধ্যে অসুখে বা পেটের গোলমালে ভুগেছে, কিন্তু গত সাত আট বৎসরের মধ্যে একদিনের জন্যও অতুলকে অসুস্থ হতে দেখা যায়নি। সে সবার চাইতে বেশী পরিশ্রমী—চঞ্চলও সে তিনজনের মধ্যে সকলের চাইতে বেশী। সেই নীরোগ সুস্থ অতুল! হঠাৎ তার এমন কি হল যে হঠাৎ চেয়ারে বসে বসেই তার প্রাণ বের হয়ে গেল। প্রথমটায় প্রায় মিনিট দশেক তিনজনের মধ্যে কারও মুখেই কোন কথা সরে না। তিনজনেই যেন বোবা নিশ্চল। অতুলের মৃত্যু শুধু অভাবনীয় নয়, যেন চিন্তারও অতীত।

অনেকক্ষণ মৃত অতুলের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে ওরা তিনজন পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। সকলের বোবা দৃষ্টিতে একটি মাত্র প্রশ্ন : এ কি হল?

শরৎ-প্রভাতের সোনালী আলো মুক্ত বাতায়নপথে ঘরের মধ্যে এসে যেন সেই প্রশ্নই করছে, কি হল?

জানালার পাল্লার উপরে একটা চড়ুই পাখি লাফালাফি করে কিচিরমিচির শব্দ করছে। দিদিমা এখনও গঙ্গাস্নান সেরে বাড়ি ফেরেননি। দাই জাকীয়ার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, সুবালাদির সঙ্গে নিত্যকার ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করা নিয়ে খিটিমিটি চলেছে নীচে। দিদিমার দক্ষিণ হস্ত ঐ সুবালাদি। আজ দীর্ঘ পাঁচ বছর গাঁ হতে এসে দিদিমার আশ্রয়েই থাকেন। একবেলা রান্না সুবালাদিই করেন। মণিকা ঘরে এলেও বেশীক্ষণ কিন্ত দৃশ্যটা সহ্য করতে পারে না। ঘরের বাতাসে যেন এতটুকু অক্সিজেনও নেই, কেমন যেন শ্বাসরোধ করছে।

মণিকা বারান্দায় বের হয়ে এল। রেলিংয়ের সামনে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে বেশ খানিকটা আকাশ দেখা যায়। শরতের আকাশ। পেঁজা তুলোর মত কয়েক টুকরো মেঘ নীল আকাশের বুকে ইতস্তত সঞ্চরণশীল। প্রাণের সংবাদ নিয়ে সকালে সূর্যের আলো দিগন্ত প্লাবিত করে দিচ্ছে। এই শুচিস্নিগ্ধ প্রভাতের প্রশান্তিতে কেন মৃত্যু এল! অতুল! অতুল! গত সাতদিনের খুঁটিনাটি কথা মনে পড়ছে। গতকালও এমন সময় অতুলের ঘরে বসেই চা-পান করছিল ও।

অতুল বলছিল চা-পান করতে করতে, এ যাত্রায় তার বেশীদিন থাকা হবে না, দু-চারদিনের মধ্যেই এবারে তাকে বম্বে রওনা হতে হবে। সেখানে কিসের একটা কনফারেন্স আছে। পরশুদিন সকলে মিলে সারনাথ গিয়েছিল। রণেন ও সুকান্ত ভিতরে ছিল, মণিকা আর অতুল বাইরে বেড়াচ্ছিল। সূর্যের শেষ আলোটুকু নিঃশেষ হতে চলেছে তখন পৃথিবীর বুক হতে।

চারদিকে আবছা আলোর একটা স্লান বিধুর বিষণ্ণতা। অতুল হঠাৎ বললে, একটা কথা এবারে আমি তোমাকে বলব স্থির করেছি মণি।

কৌতুকস্মিত কণ্ঠে মণিকা জবাব দিয়েছিল, বলবেই যখন স্থির করেছ অতুলানন্দ স্বামী, বলেই ফেল চটপট। মনের মধ্যে আর পুষে রেখো না। বেশীক্ষণ পুষে রাখলে জমাট বেঁধে যাবার আবার ভয় আছে।

না, না—ঠাট্টা নয়—

ঠাট্টা যে নয় সে তো বুঝতেই পারছি। তবে আর বিলম্ব কেন? বলেই ফেল। হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল মণিকা।

আমি বিবাহ করব স্থির করেছি কথাটা যেন কোনমতে উগরে দেয় অতুল।

সুসংবাদ। কবে? কৌতুকস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় মণিকা অতুলের মুখের দিকে।

যবে কনে বলবে প্রস্তুত–সেই দিনই।

কেন, কনে কি এখনও প্রস্তুত নয়? আবার সেই কৌতুক জেগে ওঠে মণিকার কণ্ঠে।

বুঝতে পারছি না।

বল কি! তবে কি রকম বিয়ের ঠিক করলে? হাসতে শুরু করে মণিকা, কনের মনের সংবাদই এখনও মিলল না, অথচ স্থির করে ফেললে বিয়ে করছ!

তাই তো কনেকে শুধাচ্ছি—

বুঝেও যেন না বোঝার ভান করে মণিকা বলে, মানে?

সেই জবাবই তো চাই তোমার কাছে মণি—

ক্ষণকাল মণিকা চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমার জবাব তো তুমি পেয়েছ অনেক দিন আগেই অতুল। আমি তোমাদের তিনজনকেই ভালবাসি। এবং সেই ভালবাসার মধ্যে

আমি বিচ্ছেদ বা দুঃখ আনতে চাই না।

এ ধরণের platonic ভালবাসার কোন অর্থই হয় না। আর জান, এ ভালবাসায় আমি তৃপ্তও নই। আমি চাই আমার ভালবাসাকে পরিপূর্ণভাবে একান্তভাবে আমারই করে পেতে। জীবনের সর্ব ব্যাপারে ভাগ দিতে ও ভাগীদার হতে আমি রাজী আছি, কিন্তু ভালবাসার ব্যাপারে নয়।

কিন্তু এতদিন তো তুমি তাতেই তৃপ্ত ছিলে, অতুলানন্দ!

না। সে তোমার ভুল।

ভুল?

হ্যাঁ, একেবারেই ভুল।

এরপর নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মণিকা, তারপর বলে, আমাকে তুমি ক্ষমা কর অতুল।

না, না। না, আজ আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে মণি।

মণিকা নির্বাক।

কি, চুপ করে রইলে যে?

কি বলব বল। সবই তো তোমরা জান। আমাকে পাওয়ার চিন্তা তুমি ভুলে যাও।

তা আর সম্ভব নয় মণি। গত তিন বৎসর যুদ্ধ করে নিজের সঙ্গে আমি আজ ক্ষতবিক্ষত। এই আমার শেষ সঙ্কল্প। আমি তোমায় চাই। অতুল হাত বাড়িয়ে আবেগের সঙ্গে মণিকার একখানা হাত অন্ধকারেই চেপে ধরে, মণি!

হাত ছাড় অতুল। অধীর হয়ো না। এত বড় বন্ধুত্বকে ক্ষুন্ন হতে দিও না।

হঠাৎ এমন সময় শুকনো পাতার উপর কার যেন দ্রুত পলায়মান পদশব্দ শোনা গেল। দুজনেই চকিত হয়ে প্রশ্ন করে, কে? কে?

ইতিমধ্যে দুজনের একজনের খেয়াল হয়নি কখন একসময় সন্ধ্যার অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গিয়েছে।

খেয়াল হতেই মণিকা বলে ওঠে, উঃ, দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রণেন আর সুকান্তর এখনও কোন পাত্তা নেই কেন? ওরা আবার কোথায় গেল?

অল্প দূরেই এমন সময় সুকান্তর গলা শোনা যায়, অতুল, মণি,তোমরা কোথায়? বাড়ি ফিরবে না? টাঙ্গাওয়ালা যে তাগাদা দিচ্ছে।

একটু এগুতেই সুকান্ত ও রণেনের সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে গেল। ও সম্পর্কে দুজনের মধ্যে গত দুদিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার আর কোন আলোচনাই হয়নি।

.

মণিকার দুচোখের কোল জলে ভরে ওঠে। নীচে দিদিমার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কৃষ্ণের শতনাম করতে করতে গঙ্গাস্নান সেরে এই বোধ হয় তিনি ফিরলেন।

৩. রণেন আর সুকান্ত পরস্পর

রণেন আর সুকান্ত পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। পরস্পরের দৃষ্টিতে পরস্পরের প্রতি যেন একই প্রশ্ন চোখের তারায় ফুটে উঠলেও মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। সুকান্তই প্ৰথুমে কথা বললে দুজনের মধ্যকার বিশ্রী স্তব্ধতাটা ভেঙে, ভাবতেই পারছি না আমি রুণু-সত্যিসত্যিই অতুল আমাদের মারা গিয়েছে!

কিন্তু কি করে মরল তাই ভাবছি।

সেটা পরের কথা। এখন আমাদের কি করা কর্তব্য বল?

মৃত্যুটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আমাদের এখুনি নিকটবর্তী থানায় একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন। মৃদু কণ্ঠে রণেন বলে।

থানায়! মানে পুলিসে! কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সুকান্ত যেন কেমন নিজেই চমকে ওঠে। কণ্ঠস্বরে একটা সুস্পষ্ট ভীতির আভাস পাওয়া যায়।

হ্যাঁ, থানায় সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু তার আগে একজন বাইরের ডাক্তারকে ডাকলে হত না? রণেন যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করার ছলে কথাটা বলে।

ডাক্তার! ডাক্তার এসে এখন কি করবে? তাছাড়া তুমিই যখন উপস্থিত আছ! সুকান্ত জবাবে বলে।

বাইরের একজন ডাক্তারেরও প্রয়োজন বইকি। একটা death certificate-ও তো চাই মৃতদেহ সৎকার করতে হলে!

কেন, তুমি?

না, আমার পক্ষে death certificate দেওয়া ভাল হবে না।

তবে!

ডাঃ মজুমদারকেই না হয় তাহলে ডাকা যাক।

বেশ, তাই হোক।

ডাঃ বিলাসবিহারী মজুমদার পাড়াতেই থাকেন। তাঁকেই ডেকে আনতে গেল রণেন।

এদিকে মণিকার বুড়ী দিদিমার কাছে কিন্তু আর চাপা রইল না দুঃসংবাদটা। সুকান্তই জানাল। বুড়ী অতুলকে মৃত দেখে একেবারে কেঁদে ফেললেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত এই ছেলে তিনটি বুড়ীর। এবং এই দীর্ঘদিনের পরিচয়ে একটা স্নেহের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল এদের সঙ্গে। বুড়ী দিদিমা অতুল, রণেন ও সুকান্তকে নিজের জনের মতই দেখতেন।

সুবালাদিও সব শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটু পরেই ডাঃ মজুমদার এলেন। ডাক্তার এ বাড়িতে বিশেষ পরিচিত। হাসিখুশি ও রসিক মানুষ। রণেন ডাক্তারকে ডাকতে গিয়ে আসল সত্যিকারের সংবাদটি দেয়নি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উচ্চকণ্ঠে ডাক্তার দিদিমাকে ডাকতে লাগলেন, সক্কালবেলাতেই আবার চৌধুরীগিন্নীর বাড়িতে কার অসুখ হল? কোথায় চৌধুরী গিন্নী?

দোতলার বারান্দায় মণিকা দাঁড়িয়ে ছিল, তার সঙ্গেই ডাঃ মজুমদারের প্রথমে চোখাচোখি হল, এই যে মণি মা! কার অসুখ হল আবার বাড়িতে? রণেনবাবু জরুরী তলব দিয়ে একেবারে টেনে নিয়ে এলেন!

মণিকার কণ্ঠে সাড়া নেই এবং মণিকার ভীতিবিহ্বল ফ্যাকাশে মুখখানার দিকে হঠাৎ তাকিয়েই ডাক্তারের মনে কেমন যেন খটকা লাগে। দাঁড়িয়ে যান ডাঃ মজুমদার এবং ব্যগ্র উৎকণ্ঠার সঙ্গেই এবারে প্রশ্ন করেন, কি ব্যাপার মণি মা? এখানে এমন করে দাঁড়িয়ে যে?

ডাঃ মজুমদার মণিকাকে মণি মা বলে ডাকতেন এবং মণিকা ডাক্তারকে ডাক্তার জ্যাঠা বলে ডাকত।

ঐ ঘরে যান ডাক্তার জ্যাঠা। নিম্ন কণ্ঠে কোনোমতে কথাগুলো বলে মণিকা।

কি হয়েছে?

ঐ ঘরে—

বিস্মিত হতভম্ব ডাঃ মজুমদার অগত্যা নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন। ঘরে ঢুকেও প্রথমটায় তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না। তারপর অতুলের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাক্যস্ফুর্তি হয় না। He is dead! অর্ধস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ডাক্তার মজুমদার। সকলের মুখের দিকেই অতঃপর একবার তাঁর দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।

রণেন, সুকান্ত, মণিকা, দিদিমা ও সুবালাদি সকলেই স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কথা নেই। এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করলেন ডাক্তার। মৃতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মৃদু কণ্ঠে বললেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হচ্ছে মণি মা! থানায় শিউশরণকে একটা সংবাদ দাও। আমি তো death certificate দিতে পারব না। বলতে বলতে রণেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমার ডিসপেনসারিতে গিয়ে কম্পাউণ্ডার হরিকে বলুন সে যেন এখুনি সাইকেলে করে থানায় গিয়ে আমার নাম করে শিউশরণকে একটা খবর দিয়ে আসে—এখুনি এ বাড়ির ঠিকানায় আসতে বলেছি আমি। যান—আর দেরি করবেন না। তাই তো! তাই তো!

ডাক্তার নীরবে মাথা দোলাতে লাগলেন আপন মনেই।

 ৪. পূজার অবকাশটা কাটাতে

এবারেও পূজার অবকাশটা কাটাতে কিরীটী ও সুব্রত শিউশরণের ওখানে এসে দিন পাঁচেক হল উঠেছে।

সকালবেলা কাজে বের হবার আগে শিউশরণ পোশাক পরে টেবিলে বসে কিরীটী ও সুব্রতর সঙ্গে চা-পান করতে করতে খোসগল্প করছিল। এমন সময় রণেনকে নিয়ে একটা সাইকেল রিকশায় চেপে ডাঃ মজুমদারের কম্পাউণ্ডার এসে হাজির।

হরি কম্পাউণ্ডার একাই আসতে চেয়েছিল সাইকেল নিয়ে, কিন্তু রণেন একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে দুজনেই এসেছে থানায়। থানায় না দেখা পেয়ে এসেছে নিকটবর্তী শিউশরণের। বাসায়। ভৃত্যের মুখে ডাঃ মজুমদারের কম্পাউন্ডারের নাম শুনে শিউশরণ তাদের ঘরেই আহ্বান জানায়। ভৃত্যের পশ্চাতে হরি কম্পাউণ্ডার ও রণেন এসে ঘরে প্রবেশ করে। রণেনই নিজের পরিচয় ও বক্তব্য সংক্ষেপে পেশ করে।

শিউশরণ হাসতে হাসতে কৌতুক করে কিরীটীকে বলে, এই নাও কিরীটী, তুমি আসার সঙ্গে সনেই হত্যাসংবাদ! চল, যাবে নাকি একবার অকুস্থানে?

কিরীটী একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে, না হে। তুমিই যাও।

উঁহুঁ। একা তীর্থদর্শনে পুণ্যসঞ্চয় হয় না। তোমাকেও সঙ্গী চাই। ওঠ—চল।

যাও না হে! কিরীটী এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

না। তোমাকেও যেতে হবে। চাই কি তুমি সঙ্গে থাকলে হয়ত অকুস্থানেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। বখেড়া মিটিয়ে নেওয়াই ভাল। চল।

অগত্যা কিরীটীকে উঠতেই হল।

.

ছজন একটা সাইকেল রিকশায় যাওয়া চলে না তাই আর দুটিকে ডাকতে হল। একটায় উঠে বসে রণেন ও কিরীটী, অন্যটায় শিউশরণ ও সুব্রত, হরিকম্পাউণ্ডার ও একজন কনস্টেবল আর একটাতে।

ইতিমধ্যেই কাশী শহর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। পূজায় এবারে লোকসমাগমও অনেক হয়েছে শহরে। রাস্তায় ও দোকানে দোকানে নানাবয়েসী স্ত্রী-পুরুষের ভিড়—তাদের মধ্যে নিত্য গঙ্গাস্নান-যাত্রীদেরও আনাগোনা চলেছে। খোদাইচৌকির থানা থেকে গোধূলিয়ার দূরত্ব খুব বেশী নয়। হেঁটে গেলে মিনিট কুড়ি-পঁচিশের বেশী লাগে না। কিরীটী তাই প্রথমটায় বলেছিল পথটুকু হেঁটেই যাবে কিন্তু শিউশরণ রাজী হয়নি।

চলন্ত রিকশায় রণেনের পাশে বসে কিরীটী নানা প্রশ্ন করছিল। কিরীটীর সজাগ তীক্ষ্ণ শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি ওদের কথাবার্তার প্রতি নিয়োজিত থাকলেও, অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে একটা চুরুট টানতে টানতে রাস্তার দুধারে চলন্ত জনতার প্রতি আকৃষ্ট ছিল।

আপনি বলছিলেন রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত আপনারা চারজনে তাস খেলেছেন, তারপর শুতে যান যে যার ঘরে!

হ্যাঁ।

শুতে যাবার পর আপনি কোনোরূপ চিৎকার বা অস্বাভাবিক কোনো শব্দ শোনেননি?

না। সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ গঙ্গায় দাঁড় টেনেছিলাম। খুবই ক্লান্ত ছিলাম, শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গে মণিকার ডাকে।

হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী প্রশ্ন করেছিল, আপনি কি করেন রণেনবাবু?

আমি ডাক্তার। পাটনায় প্র্যাকটিস করি।

আপনিই কি ডক্টর আর চৌধুরীপাটনায় হার্ট ডিজিজ স্পেসালিস্ট?

হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় রণেন।

আপনি নিজে যখন একজন ডাক্তার সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন ডাঃ মজুমদারকে আবার ডাকা হল যে? কিরীটী রণেনের মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করে।

কারণ মৃতদেহ দেখেই বুঝেছিলাম, আমাদের বন্ধু অতুলের মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাছাড়া আর একটা কথাও আমার ঐ সঙ্গে মনে হয়েছে। যেভাবে বাড়ির মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তাতে করে স্বভাবতই সকলের ধারণা হবে বাড়ির মধ্যেই কেউ আমরা তাকে হত্যা করেছি; তাই তো আমি নিজে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও আর একজন বাইরের ডাক্তারকে ডাকা ও থানায় সংবাদ দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত বলে আমার মনে হয়েছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের, আমাদেরই মধ্যে একজনের এভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হল কেন? আর এর জন্য আমরাই কেউ দায়ী কিনা এটাও আমাদের জানা প্রয়োজন, নয় কি?

নিশ্চয়ই। সত্যিই আপনার সৎ সাহসের আমি প্রশংসা করছি ডাঃ চৌধুরী।

সৎ সাহসের কথাটা বাদ দিলেও অতুলের মৃত্যুটা যে কত বড় মর্মান্তিক আঘাত আমাদের পক্ষে, বাইরের লোক আপনারা বুঝতে ঠিক পারবেন না কিরীটীবাবু। এবং শুধু মর্মান্তিক নয়, অত্যন্ত লজ্জারও ব্যাপার। অতুলের মৃত্যু-রহস্যের একটা মীমাংসা বিশেষভাবেই প্রয়োজন। আমাদের বিবেকের দিক থেকেও। যতক্ষণ না এই ব্যাপারের মীমাংসায় আমরা পৌঁছতে পারব ততক্ষণ আমরা পরস্পর আমাদের পরস্পরের কাছেই থাকব guilty-দোষী।

কথাগুলো বলতে বলতে ডাঃ রণেন চৌধুরী শেষের দিকে নির্বাক কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও আপনার নাম আমার বিশেষ পরিচিত মিঃ রায়। আজকে আমাদের এত বড় বিপদের দিনে আপনাকে এ সময়ে এখানে পাওয়ায় সত্যি বলতে কি কতখানি যে নিশিন্ত হয়েছি বলতে পারব না। আপনি বোধ হয় ভগবান-প্রেরিত। আমাদের আজকের লজ্জা ও অপমান থেকে আপনি অন্তত যদি আমাদের মুক্তি দিতে পারেন—

কিরীটী নিরুত্তর থাকে।

কিরীটী তখন মনে মনে ভাবছে।

দীর্ঘদিনের চার বন্ধু। তিনজন পুরষ একজন নারী। না জানলেও সাধারণ মানব-চরিত্রের দিক দিয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক, পরস্পরের বন্ধুত্ব ছাড়াও তিন বন্ধুর মধ্যবর্তিনী ওই নারী বান্ধবীকে কেন্দ্র করে ঐ তিনটি পুরুষের মনে এই দীর্ঘদিনে নিশ্চয় কিছু না কিছু দুর্বলতা ছিল। আর শুধু দুর্বলতাই বা কেন, হিংসা বা একটা বিদ্বেষ গড়ে ওঠাও তেমন কিছু বিচিত্র বা আশ্চর্য নয়।

হঠাৎ কিরীটী রণেনকেই প্রশ্ন করে, ডাঃ চৌধুরী, আচ্ছা একটা কথা, আপনারা চারজনের মধ্যে কে কে বিবাহিত?

কেউ নয়। আমরা তিন বন্ধু ও মণিকা কেউই বিবাহ করিনি।

কেউ বিবাহ করেননি?

না।

কেউ বিবাহিত নয়! দীর্ঘ নয় বৎসরের বন্ধুত্ব! তিনটি কৃতবিদ্যা কুমার ও একটি কুমারী। তিন পুরুষের মধ্যবর্তিনী এক নারী। তারই মধ্যে এসেছে অস্বাভাবিক মৃত্যু।

কিরীটীর মনে হয় জীবনে ইতিপূর্বে এমন জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন সে খুবই কম হয়েছে। স্নেহ ভালবাসা রাগ দ্বেষ হিংসা ও ঘৃণমানব-মনের গোপন অবগহনে যে সব স্বাভাবিক বৃত্তিগুলো আনাগোনা করে এক্ষেত্রে কোনটির প্রভাব পড়েছে কে জানে! আর কেমনই বা সেই মধ্যবর্তিনী নারী!

কিরীটীর চিন্তাপ্রবাহে ছেদ পড়ে। সাইকেল রিকশা গলির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এগুবে না বাকি সামান্য পথটুকু পদব্রজেই যেতে হবে।

.

প্রথমে রণেন, তার পশ্চাতে শিউশরণ ও সর্বশেষে কিরীটী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে। ডাঃ মজুমদার পাশের ঘরেই শিউশরণের অপেক্ষায় ছিলেন, তিনিও এগিয়ে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। কিরীটী কক্ষমধ্যে পা দিয়ে প্রথমেই তার চিরাচরিত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মাঝারি আকারের ঘরটি। দক্ষিণ দিকটা চাপা। পুর্বে দুটি জানালা। জানলা দুটিই খোলা। যে চেয়ারটার ওপরে মৃতদেহ রয়েছে তারই হাত-দেড়েক ব্যবধানে একটা ক্যামবিসের খাটিয়ার ওপরে নিভাঁজ একটি শয্যা বিছানো। শয্যাটি ব্যবহৃত, শয্যাটিতে কেউ রাত্রে শয়ন না করলেও একটা ব্যাপার কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, শয্যার মাঝামাঝি একটা জায়গায় শয্যার চাদরটা যেন একটু কুঁচকে আছে। বোধ হয় কেউ ঐ জায়গাটায় বসেছিল। এবং তাতে করেই বোঝা যায় শয্যায় কেউ না শয়ন করলেও কেউ শয্যায় বসেছিল। শিউশরণ মৃতদেহের সামনে এগিয়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোধ হয় মৃতদেহ পরীক্ষা করছিল। এবারে সেই দিকে তাকাল কিরীটী। যে চেয়ারটার ওপরে মৃতদেহ উপবিষ্টাবস্থায় রয়েছে সে চেয়ারটা সাধারণ কাঠের নয়, স্টীলের ফ্রেমে লোহার চাদরে তৈরী। এবং চেয়ারের পাশেই ডান দিকে একখানা বই বাংলা বই, মেঝেতে পড়ে আছে। এবারে মাথার উপরে তাকাল কিরীটী। শেডে ঢাকা ইলেকট্রিক আলো। আলোটি নেভানো।

কিরীটী রণেনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ডাঃ চৌধুরী, প্রথমে যিনি আজ সকালে এই ঘরে ঢুকে মৃতদেহ আবিষ্কার করেন তিনি কি ঐ আলোটা নেভানো দেখেছিলেন, না আলোটা জ্বলছিল?

ঘরের আলোটা নেভানো রয়েছে। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে যেন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায়। সকলেই একে একে জবাব দেয়—আলো নোনোই ছিল।

এবারে কিরীটী মণিকাকেই প্রশ্ন করে, আপনি তো প্রথম সকালে এ ঘরে ঢোকেন চা। নিয়ে, তখন কি আলোটা নেভানো ছিল, না জ্বলছিল?

লক্ষ্য করিনি তো!

আচ্ছা সাধারণত উনি, মানে অতুলবাবু, কি ঘরের দরজা বন্ধ করেই শুতেন?

দরজা বন্ধ করে শুত এবং প্রত্যেক দিনই সকালে ওকে ডেকে ওঠাতে হত। তাই তো আজকে ঘরের দরজা খোলা পেয়ে একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম। জবাবে মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো মণিকা বলে।

কিরীটী মনে মনে ভাবে, শোবার ঘরের দরজা শয়নের পূর্বে যার চিরদিন বন্ধ করে শোয়াই অভ্যাস—কেন আজ তার দরজা খোলা ছিল? কেন?

বোঝা যায় মৃত ব্যক্তি বিছানায় শোয়নি গত রাত্রে, আগের রাত্রের সেই হাফশার্টটা পরা, চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থাতেই মারা গিয়েছে, চেয়ারের পাশেই মেঝেতে একটা বই—সব কিছু মিলে স্বাক্ষর দিচ্ছে শয়নের পূর্বে সে বই পড়ছিল বা পড়বার চেষ্টা করছিল এবং গত রাত্রে সেক্ষেত্রে আলোটা ঘরের জ্বলবে না কেন? কে নেভাল আলো? কেনই বা নেভাল? কেন?

আচ্ছা মণিকা দেবী! কিরীটীর ডাকে মণিকা আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়। রাত্রে কি আপনাদের বাড়ির দোতলার সিঁড়ির মুখের যে দরজাটা দেখলাম সেটা বন্ধ থাকে না?

না, খোলাই থাকে। জবাবে বলে মণিকা।

বাড়িতে বর্তমানে আপনারা কজন আছেন?

দিদিমা, সুবালাদি, ঝি জাকিয়া আর আমরা চারজন। কয়েকদিনের জন্য একটা ঠিকে চাকর রাখা হয়েছে, তা সে রাত্রে নটা-দশটার পর বাড়ি চলে যায়। রাত্রে এখানে শোয় না।

গত রাত্রে দোতলায় আপনারা কে কে ছিলেন? আবার প্রশ্ন কিরীটীর।

এই ঘরে অতুল, পাশের ঘরে রণেন, তার পরের ঘরে আমি সুবালাদি ও দিদিমা, তার পাশের ঘরে সুকান্ত।

কোন্ ঘরে বসে গত রাত্রে আপনারা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তাস খেলেছেন?

সুকান্তর ঘরে।

কেউ আপনারা মনে করে বলতে পারেন, গতকাল সমস্ত দিন ও শুতে যাবার আগে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কখন কখন এবং কতবার অতুলবাবু বা আপনারা এঘরে এসেছেন?

প্রথমেই ডাঃ রণেন চৌধুরী বললে, সিটিতে আমার এক সহপাঠী ডাক্তার আছেন, কাল সকালে চা-জলখাবার খেয়েই আমি ক্যামেরাটা লোড করে নিয়ে বের হয়ে যাই। বেলা চারটে পর্যন্ত সেই বন্ধুর ওখানেই ছিলাম। খাওয়াদাওয়া সেখানেই করি। এখানে ফিরে আসি বেলা পাঁচটা নাগাদ। অতুল তখন বাড়ি ছিল না। আমি ফিরে আসবার আরও আধঘণ্টা পরে অতুল ফেরে। প্রায় ছটা নাগাদ আমরা গঙ্গায় নৌকা বাইবার জন্য যাই। রাত আটটায় ফিরে আমার ঘরেই সকলে বসে আড্ডা দিই। রাত নটায় খাওয়াদাওয়া সেরে তাস খেলতে বসি। সাড়ে এগারোটায় তাস খেলা ভাঙলে সোজা নিজের ঘরে শুতে যাই। ক্লান্ত ছিলাম, শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। গতকাল দিনে বা রাত্রে একবারের জন্যও এ ঘরে আমি আসিনি। আর দেখিওনি অতুল কতক্ষণ এ ঘরে ছিল বা কবার এসেছিল।

কথাগুলো যেন জবানবন্দির মতই একটানা গুছিয়ে বলে গেল ডাঃ রণেন চৌধুরী।

অতুলবাবু বাড়ি ছিলেন না, আপনি একটু আগে বললেন, আপনি যখন বাড়ি ফেরেন। অতুলবাবু কখন বের হয়েছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন বা কতক্ষণের জন্য বাইরে ছিলেন জানেন কিছু ডাক্তার চৌধুরী? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না, আমি বলতে পারি না।

মণিকা দেবী, আপনি?

বেলা দুটো পর্যন্ত সে বসে চিঠি লিখেছিল ঘরে আমি জানি। ঠিক দুটো বাজতে চিঠিগুলো ডাকে ফেলতেই বাইরে গিয়েছিল। মণিকা জবাবে বলে।

ডাকঘর কতদূর এখান থেকে? দুটোর সময় বের হয়ে সাড়ে পাঁচটায় ফিরলেন চিঠি পোস্ট করে!

বলতে পারি না, অন্য কোথাও হয়ত যেতে পারে।

একটা কথা মণিকা দেবী, ঠিক দুটোর সময়ই যে অতুলবাবুবাইরে গিয়েছিলেন ঠিক আপনার মনে আছে?

হ্যাঁ। তার কারণ অতুল চলে যাবার পরেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রী অতুলের ঘরের আলোটা ঠিক করতে আসে বংশী এসে যখন মিস্ত্রী এসেছে বললে তার আগে আমার একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। ঘর থেকে বেরুতে যাব এমন সময় ঘরের ওয়াল-কুকটায় ঢং ঢং করে দুটো বাজল। তাইতেই সময়টা আমার মনে আছে।

মণিকার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিরীটী। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন হঠাৎ অত্যন্ত সজাগ ও তীক্ষ্ণ হয়ে মণিকার কথা শুনছিল। চোখেমুখে একটা অদ্ভুত ব্যাকুল সুতীব্র উৎকণ্ঠা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গতকাল ইলেকট্রিক মিস্ত্রী এসেছিল এই ঘরের আলো ঠিক করতে?

হ্যাঁ।

কেন?

ঘরের আলোটা পরশু রাত্রে হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। গতকাল সকালে উঠেই অতুল বলেছিল মাঝরাত্রে উঠে আলো জ্বালতে গিয়ে আলো জ্বলে নি, সুইচেও নাকি শক দিচ্ছিল। মণিকা জবাবে বলে।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কজনই কৌতূহলের সঙ্গে কিরীটীর প্রশ্ন ও প্রশ্ন করার পর জবাব শুনছিল।

অন্য কেউ না বুঝলেও সুব্রত ও শিউশরণ কিরীটীর পর পর প্রশ্নগুলো শুনে বুঝতে পেরেছিল বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই কিরীটী সকলকে প্রশ্ন করছে। ঘরের মধ্যেই প্রাপ্ত কোনো-না-কোনো একটা সূত্র কিরীটীকে সজাগ করে তুলেছে।

কিরীটী কিন্তু আর প্রশ্ন করে না কাউকে। হঠাৎ যেমন প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল, হঠাৎই আবার তেমনি চুপ করে যায়। ঘরের মধ্যে সকলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। মিনিট দু-তিন নিস্তব্ধে কেটে যায়।

আবার কিরীটীই প্রশ্ন শুরু করে। এবারে ডাঃ মজুমদারকে।

মৃতদেহ দেখে মৃত্যুর কারণ আপনার কি মনে হচ্ছে ডাঃ মজুমদার?

খুব সম্ভব কোনো একটা শকে মারা গিয়েছেন।

ইলেকট্রিক শক বলে আপনার মনে হয় কি?

হতে পারে। মৃদু কণ্ঠে ডাঃ মজুমদার বলেন।

তাহলে মৃতদেহ চেয়ারে কেন? কিরীটী যেন নিম্নকণ্ঠে নিজেকেই নিজে প্রশ্নটা করে। বলতে বলতে হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ থেকে একসময় আপন মনেই নিঃশব্দে কয়েকবার মাথাটা দোলায় এবং পূর্ববৎ অনুচ্চ কণ্ঠেই বলে, তা হতে পারে! তা হতে পারে!

সকলেই যুগপৎ কিছুটা বিস্ময় ও বোকার মতই যেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মৃদুচ্চারিত স্বগতোক্তিগুলো বোঝবার ব্যর্থ প্রয়াস পায়।

কিন্তু কিরীটী সময়ক্ষেপ করে না। অতঃপর মৃতের জামার পকেটগুলো খোঁজ করতে গিয়ে একটা পোস্টকার্ড পেল। কার্ডটা লিখেছে অতুলেরই এক বন্ধু দেরাদুন হতে। সে লিখেছে দুন এক্সপ্রেসে সে কলকাতায় যাচ্ছে। পথে কাশী স্টেশনে যেন অতুল তার সঙ্গে দেখা করে, বিশেষ প্রয়োজন আছে।

দুন এক্সপ্রেস বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছবে। চিঠিটা কিরীটী পকেটে রেখে দিল। তারপরে শিউশরণের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টোচ্চারিত কণ্ঠে বলে, শিউশরণ, এবারে তুমি তোমার কাজ কর ভাই। তবে আগে একটা চাদর দিয়ে মৃতদেহটা ঢেকে দাও।

কিরীটীর নির্দেশমতই একটি বড় চাদর এনে মৃতদেহটা ঢেকে দেওয়া হল।

এবং সকলে অতঃপর কিরীটীরই ইচ্ছামত সুকান্তর ঘরে গিয়ে বসল।

৫. জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত

জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত হয় শিউশরণ। যার জবানবন্দি নেওয়া হবে তাকে ছাড়া অন্য সকলকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলা হয়।

প্রথমেই ডাক পড়ল ডাঃ রণেন চৌধুরীর।

ডাঃ রণেন চৌধুরী। বলিষ্ঠ গঠন। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। হত্যার অকুস্থানের সর্বাপেক্ষা নিকটে ছিল; পাশেই ঘর। দুই ঘরের মধ্যবর্তী একটি দরজা ছিল। দরজাটায় অতুলের ঘর হতে শিকল ভোলা ছিলো। ডাঃ রণেন নিহত অতুলের বিশেষ বন্ধু। দীর্ঘদিনের পরিচয়। অবিবাহিত,

অবস্থাপন্ন, বৃত্তি চিকিৎসক।

শিউশরণ তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি সকালে কটা আন্দাজ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান?

সকাল নটায়। জবাব দেয় ডাঃ চৌধুরী।

রাত্রি সাড়ে এগারোটার পর খেলা শেষ হতেই ঘরে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন? কিন্তু ঘুমোবার আগে পর্যন্ত পাশের ঘরে কোনো শব্দ শুনেছিলেন?

শুনেছিলাম। কি যেন একটা কবিতা মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করছে অতুল।

মাঝরাতে একবারও আপনার ঘুম ভাঙেনি?

না।

মণিকা দেবীর ডাকে এ ঘরে আজ সকালে ঢোকবার আগে পর্যন্ত ওঁর মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?

না।

ডাঃ চৌধুরী একটা কথা, আপনি জানতেন নিশ্চয়ই পরশু রাত্রে এই ঘরের আলোটা খারাপ হয়ে গিয়েছে? প্রশ্ন করে কিরীটী।

জানতাম।

আচ্ছা আলোটা ঠিক করবার জন্য কে এবং কখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে খবর দিয়েছিল জানেন কিছু?

বলতে পারি না। বোধ হয় মণিই দিয়ে থাকবে।

অতুলবাবু গতকাল বিকেলে স্টেশনে যাবেন জানতেন? কই, না তো?

হুঁ। আচ্ছা একটা কথা, কিছু মনে করবেন না—মণিকা দেবীকে আপনি ভালবাসেন নিশ্চয়ই?

বাসি।

কখনও মণিকা দেবীকে নিয়ে আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবীর অনুপস্থিতিতে কোনো আলোচনা হত না?

কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে হঠাৎ যেন ডাক্তার একটু বিহ্বল হয়েই পড়ে, কয়েক সেকেণ্ড স্তব্ধ হয়ে থাকে। পরে মৃদুচ্চারিত কণ্ঠে বলে, হয়েছে দু-একবার কিন্তু সেও উল্লেখযোগ্য এমন কিছু নয়।

প্রশ্নটা যদিও একান্তভাবেই ব্যক্তিগত তবুও জিজ্ঞাসা করছি ডক্টর চৌধুরী, আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবীর প্রতি কারও বেশী দুর্বলতা ছিল বলে কি আপনার মনে হয়?

থাকতে পারে কারও তবে আমি জানি না। আমার অন্তত ছিল না।

না, জানলেও আপনি বলতে ইচ্ছুক নন! কোটা সত্য ডক্টর চৌধুরী?

কিরীটী স্মিতভাবে প্রশ্ন করে।

যা মনে করেন। নিরাসক্ত উদাস মৃদু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় ডাঃ চৌধুরী।

আচ্ছা এখানে আসবার পর মণিকা দেবী সম্পর্কে আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে কি কোনো আলোচনা বা বচসা হয়েছিল recently?

না।

আপনার বন্ধুর মৃত্যুর ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন?

বাইরের আর কাকে করব বলুন। করতে হলে সন্দেহও আমাদের তিনজনকেই করতে হচ্ছে। হয় আমি, নয় সুকান্ত, নয় তো মণি।

হতে পারে, হয়ত আপনাদের তিনজনের মধ্যেই একজন আপনাদের বন্ধুকে হত্যা করেছেন। গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত কিরীটীর কথাগুলো যেন অকস্মাৎ বজ্রসম ধ্বনিত হল।

সোজা সরল স্পষ্ট অভিযোগ।

রণেন, যতই বলুক, কিরীটীর শেষের কথার কঠিন ইঙ্গিতে যেন সে বিমৃঢ় নির্বাক হয়ে যায়।

আপনি মানে–বলতে চান আমাদের—

হ্যাঁ, আপনাদের তিনজনের মধ্যেই একজন।

কিন্তু–

এর মধ্যে আমার কোনো সংশয় বা কোনো কিন্তুই নেই ডক্টর চৌধুরী। প্রথমতসম্ভাবনার দিক দিয়ে যদি আপনাদের বন্ধুর হত্যার ব্যাপারটাকে বিচার করেন তাহলে আপনাদের তিনজনের পক্ষেই তা সম্ভব। দ্বিতীয়ত মোটিভ যদি বা বলেন, উদ্দেশ্য আপনাদের তিনজনের যতটা ছিল আর কারোরই সেটা থাকা সম্ভব নয়।

বন্ধু হয়ে বন্ধুকে হত্যা করব! এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?

সে আলোচনা পরের জন্য আপাতত তোলা রইল, এইটুকু বর্তমানে শুধু বলতে পারি, মোটিভ একটা ছিল যার জন্য বন্ধু হয়েই বন্ধুকে পথের কাঁটা হিসাবে সরানো হয়েছে।

তাহলে ধরেই নিচ্ছেন আপনি এটা একটা দুর্ঘটনা নয়—হত্যা? এবং—

হ্যাঁ, নিষ্ঠুর হত্যা। কঠিন ঋজু কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।

এবার ডাক পড়ল সুকান্ত হালদারের।

অতীব সুশ্রী বলিষ্ঠ চেহারা। কেবল নারী কেন, যে কোনো পুরুষের চোখেও আকর্ষণীয়। ধনী মেসো-মাসীর আশ্রয়ে পালিত, উচ্চশিক্ষিত। ইঞ্জিনীয়ার বৃত্তি, ভাল চাকরিতে নিযুক্ত। অবিবাহিত। রণেন, অতুল ওমণিকার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা।

ঘটনার দিন রাত্রে তারই ঘরে তাস খেলা হয়, তারপর রাত সাড়ে এগারোটায় খেলা ভাঙার পর অন্য সকলে যে যার ঘরে শুতে গেলে নিজেও শয্যায় আশ্রয় নেয়। রাত্রে ঘুম ভাঙেনি বা কোনোরূপ শব্দও শোনেনি।মণিকার ডাকে বাইরে এসে আজ সকালে অতুলের ঘরে ঢুকে জানতে পারে যে অতুল মৃত।

কালকের আপনার movements সম্পর্কে আমাকে in details একটা idea দিতে পারেন মিঃ হালদার?প্রশ্ন করে এবারে কিরীটী।

কাল সকাল থেকেই শরীরটা ভাল না থাকায় সারাটা দিনই প্রায় ছটা পর্যন্ত ঘরে খিল এঁটে শুয়েছিলাম। সারাদিন কিছু খাইওনি। সন্ধ্যায় অতুলের ডাকাডাকিতেই বাইরে বের হই। রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত গঙ্গায় নৌকোয় ঘুরে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তাস খেলে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙিয়েছে মণিকা সকালে চা নিয়ে এসে।

অতুলবাবু যে কাল বিকেলের দিকে স্টেশনে যাবেন তা আপনি জানতেন?

না।

সন্ধ্যায় ফিরে আসবার পর রাত্রে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত অতুলবাবু কি তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন?

যেতে পারে তবে আমি দেখিনি।

বিয়ে না করবার কোনো কারণ আছে আপনার এত বয়স পর্যন্ত?

মনের মত সঙ্গী না পেলে বিয়ে করে কি হবে?

মণিকা দেবীকে আপনারা সকলেই ভালবাসেন?

প্রশ্নটা একান্ত ভাবেই ব্যক্তিগত নয়, কি, মিঃ রায়? রূঢ় কণ্ঠে যেন জবাব দেয় সুকান্ত।

নিশ্চয়ই। প্রশ্নটা করতে বাধ্য হয়েছি এইজন্য যে, নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে আপনাদের বন্ধু অতুল বোস নিহত হয়েছেন।

নিহত হয়েছেন মানে? আপনি কি মনে করেন—

কথাটা সুকান্তের শেষ হল না, কিরীটী সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেয়, হ্যাঁ—তাঁকে হত্যাই করা হয়েছে এবং শুধু তাই নয়, আপনারই কোনো এক বন্ধু, আপনার অতি নিকট বন্ধু অতুল বোসকে হত্যা করেছেন।

আপনি পাগল মিঃ রায়! আপনি জানেন না আমাদের সম্পর্ক একদিনের নয়। দীর্ঘ নয় বৎসরের ঘনিষ্ঠতা আমাদের। তাছাড়া একটা কথা নিশ্চয়ই আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, এখানে আপনাকে ডেকে এনেছেন কে? দারোগা সাহেব—শিউশরণের দিকে ফিরে তাকিয়ে সম্বোধন করে সুকান্ত, আপনার করণীয় আপনি করতে পারেন, third person-এর interference আমরা সহ্য করব না।

জবাব দিল এবারে শিউশরণ, মিঃ রায়ের কথার জবাব দেওয়া-না-দেওয়া আপনার ইচ্ছে মিঃ হালদার, তবে জানবেন যাই আপনি বলুন সেটা আপনার against-এ বা for-এ evidence হিসাবেই আমরা নেব। আর উনি তৃতীয় ব্যক্তি নন। আমারই লোক। এই হত্যার তদন্তের ব্যাপারে উনি সরকারের পক্ষ হতেই কাজ করছেন।

কিন্তু–

এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নেই মিঃ হালদার। উনি যা প্রশ্ন করছেন তার জবাব দেবেন কিনা আমি জানতে চাই।

মিনিট দুই স্তব্ধ হয়ে থেকে সুকান্ত মৃদু কণ্ঠে বলে, বেশ কি জানতে চান বলুন?

আপনি তো একজন ইলেকট্রিকাল ইনজিনীয়ার, তাই তো? আবার কিরীটীই প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

বাড়িতে ছোটখাটো ইলেকট্রিক সংক্রান্ত কিছু হলে আপনি দেখেশুনে দেন না কখনও?

সে রকম কাজ হলে দিই, তবে ছোটখাটো ব্যাপারে আমার মিস্ত্রীরাই কাজ করবার যা করে।

এ ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা পরশু রাত্রে খারাপ হয়েছিল আপনি জানতেন?

না, আজ সকালেই প্রথম মণির মুখে একটু আগে শুনলাম।

মিস্ত্রী কাল কাজ করতে এসেছিল দুপুরে তাও কি জানতেন না?

না। বললাম তো একটু আগে আপনাকে শরীর খারাপ ছিল বলে সারাদিন ঘর থেকে বের হইনি।

এখানে আসবার পর খুব ইদানীং আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবী সম্পর্কে কোনোরূপ আলোচনা বা বচসা কিছু হয়েছিল কি?

কি mean করছেন আপনি?

নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মিঃ হালদার, কি আমি বলতে চাইছি

আপনার ও প্রশ্নের জবাব দেবার মত আমার কিছু নেই।

মণিকা দেবীকে ডাকা হল। এবারে তার জবানবন্দি।

সুন্দরী শিক্ষিতা, দিল্লীতে অধ্যাপিকার কাজ করে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় সমস্ত মুখের ওপরে যেন একটা নিরতিশয় বেদনার ছায়া ফেলেছে। দীর্ঘ নয় বৎসরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব মণিকার অতুল, রণেন ও সুকান্তর সঙ্গে। দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় যেন ও ভারী মুষড়ে পড়েছে।

বসুন মণিকা দেবী। কিরীটীই বলে।

আমি এবারে ওদের পুজোর ছুটিটা এখানে কাশীতে কাটাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে এনেছিলাম মিঃ রায়। আবেগে কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসে, চোখের কোল দুটি ছলছল করে, এমনি একটা দুর্ঘটনা ঘটবে যদি স্বপ্নেও জানতাম! সত্যি, ভাবতেও পারছি না—অতুল, অতুল নেই আর!

অন্যদিকে মুখটা ফেরায় মণিকা বোধ করি উগত অশ্রুকে সকলের দৃষ্টি হতে আড়াল করবার জন্যই।

আপনার লজ্জা ও দুঃখ আমি বুঝতে পারছি মিস গাঙ্গুলী, কিন্তু কি করবেন বলুন?

বোধ হয় সান্ত্বনা দেবারই চেষ্টা করে কিরীটী, আকস্মিক দুর্ঘটনার ওপরে তো আমাদের কারোরই কোনো হাত নেই, দৈব!

কিরীটী কিছুক্ষণ সময় দেয় মণিকাকে কিছুটা সামলে নেওয়ার জন্য।

কিরীটী আবার শুরু করে, এই নিষ্ঠুর হত্যার—-

কিরীটীর কথা শেষ হল না, চমকে অশ্রুসিক্ত চোখে ফিরে তাকায় চকিতে মণিকা প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে। অর্ধস্ফুট বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়, হত্যা!

হ্যাঁ, মণিকা দেবী। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি, অতুলবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—নিষ্ঠুর হত্যা।

না–না! আর্ত চাপা কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় মণিকা, You dont really mean it!

সত্যিই হত্যা মণিকা দেবী! অতুলবাবুকে হত্যা করাই হয়েছে!

অতুল—

হ্যাঁ। এবং হত্যা বলেই এই ব্যাপারের একটা মীমাংসা হওয়া একান্তই প্রয়োজন, নয় কি?

মণিকা চুপ। মণিকার মনের অবগহনে তখন যেন একটা প্রচণ্ড ঝড়ের আলোড়ন চলেছে। অতুল নিহত! কিন্তু কেন? কেন সে নিহত হল? নিরীহ অতুল! কে তাকে হত্যা করলে? এ কি ভয়াবহ নিষ্ঠুর কথা!

মিস গাঙ্গুলী?

অ্যাঁ! চমকে তাকায় মণিকা কিরীটীর ডাকে তার মুখের দিকে।

এ ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা যে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সে সংবাদ আপনি কখন মিস্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন?

আমি! আমি সংবাদ পাঠিয়েছিলাম? কই না তো! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় মণিকা কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনি সংবাদ দেননি?

না। চিরদিন অত্যন্ত ভোলা মন আমার। বরং কাল দুপুরে ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আসবার পর, অতুল যে তার ঘরের আলোটা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল, হঠাৎ সে কথাটা মনে পড়ায় বিশেষ লজ্জিতই হয়েছিলাম।

আপনি তাহলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রীকে খবর দেননি?

না।

যে মিস্ত্রী আলো সারাতে এসেছিল সে কি আপনাদের পূর্বপরিচিত?

না।

হুঁ। লোকটার বয়স কত হবে বলে আপনার মনে হয়?

একটু বেশী বলেই মনে হয়েছিল। জাতিতে বোধ হয় বেহারী।

আপনার সঙ্গে লোকটার কি কথা হয়?

তার সঙ্গে আমার কোনো কথাই হয়নি বলতে গেলে। বংশী লোকটাকে নিয়ে এসেছিল—আমি শুধু ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিলাম।

লোকটা যখন ঘরে কাজ করে আপনি তখন ঘরে ছিলেন না?

না। কতক্ষণ যে কাজ করেছে এবং কখন যে কাজ করে চলে গিয়েছে তাও জানি না।

আশ্চর্য! লোকটা কাজ করে পয়সা নিয়ে যায়নি?

হ্যাঁ, সুবালাদিই নাকি দিদিমার কাছ থেকে চেয়ে তিন টাকা দিয়ে দিয়েছিল।

হুঁ। কিরীটী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবে। অতঃপর বলে, আচ্ছা অতুলবাবু যে দুটোর সময় চিঠি ফেলতে বাইরে বের হয়েছেন বলে আপনার ধারণা, তখন যে তিনি স্টেশনে গিয়েছিলেন তা জানেন?

স্টেশনে! কই না তো! স্টেশনে সে যাবে কেন?

গিয়েছিলেন তিনি। আচ্ছা কোনো চিঠি গতকাল তাঁর নামে এসেছিল জানেন?

হ্যাঁ, একটা চিঠি এসেছিল বটে।

কার চিঠি সেটা জানেন?

না। বংশী এনে আমার হাতে দেয়, আমি চিঠিটা তার হাতে দিয়ে দিই।

বাড়িতে ফিরে তিনি ঘরে যাননি?

যতদূর মনে পড়ছে, না। সে যখন ফিরে আসে, আমরা, মানে আমি ও রণেন বাইরের বারান্দায় বসে চা ও ডালমুট ভাজা খাচ্ছিলাম। অতুল ডালমুট বড় ভালবাসত,How nice ডালমুট, বলতে বলতে সে বারান্দাতেই একটা মোড়ায় বসে চা ও ডালমুট খেতে শুরু করে। তারপরই বোধহয় পৌনে ছটা বা ছটা নাগাদ আমরা গঙ্গায় নৌকোয় ঘুরতে বের হই। যতদূর মনে পড়ছে সে ঐ সময়টা বাইরেই বারান্দায় ছিল, ঘরে যায়নি।

রাত্রে বাসায় ফিরে?

বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ আমরা সকলে তিনতলার ছাদে গল্প করে নীচে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে সুকান্তর ঘরে গিয়ে তাস খেলি।

সুকান্তর ঘরে বসেই কি বরাবর তাস খেলতেন আপনারা রাত্রে?

তার কোনো ঠিক নেই, প্রতিরাত্রেই গত সাতদিন ধরে তাস খেলেছি আমরা—কখনও বারান্দায়, কখনও রণেনের ঘরে। তবে গতকাল রাত্রে সুকান্তই তার ঘরে খেলতে বললে, তাই–

হুঁ। রাত সাড়ে এগারোটায়খেলা শেষ হবার পর অতুলবাবুকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন?

দেখেছি এবং তাকে দরজা বন্ধ করতেও শুনেছি। তাই তো আজ সকালে তার ঘরের দরজা খোলা দেখে আমি আশ্চর্যই হয়েছিলাম!

এমন তো হতে পারে কোনো এক সময় হয়ত রাত্রে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন? কথাটা বলে শিউশরণ।

তা হতে পারে। কিরীটী বলে।

রাত্রে একবার অতুল উঠতই। তবে উঠলেও শোয়ার আগে আবার সে দরজা বন্ধ করেই দিত বরাবর। কখনও তার দরজা দিতে ভুল হত না-বললে মণিকা।

মিস গাঙ্গুলী, আপনি বলেছিলেন গতরাত্রে খেলা শেষ হবার পর অতুলবাবু আপনার সামনেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দরজা বন্ধ করবার সঙ্গে সঙ্গেই কি আপনি শুতে যান?

হ্যাঁ। আমার আগেই অতুল শুতে যায়।

রণেনবাবু?

রণেন আমাদের আগেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।

আচ্ছা মিস গাঙ্গুলী, রাত্রে শোবার পর কোনোপ্রকার শব্দ বা অস্বাভাবিক কোনো কিছু শুনতে পেয়েছিলেন?

না।

বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েননি নিশ্চয়ই?

না।

ঘুম আসছিল না বলে অনেক রাত পর্যন্ত, তা প্রায় গোটা দুই হবে জেগে বই পড়েছি। ওই সময়ের মধ্যেও কোনো শব্দ বা কিছু–

সেরকম কিছু না, তবে বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়েছি। ভাবছিলাম হয়ত কেউ বাথরুমে যাচ্ছে রাত্রে।

ঘরে আপনার দিদিমা ও সুবালাদি ছিলেন, বলছিলেন না? আপনি যখন ঘরে শুতে যান তখন কি তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন, না জেগে ছিলেন?

দুজনেই ঘুমিয়ে ছিল।

সকালে আপনার ঘুম ভাঙে কটায়?

ভোর ছটায়। দিদিমা উঠে যাবার কিছু পরেই।

এবার একটু ইতস্তত করে কিরীটী বলে, মণিকা দেবী, অতুলবাবুর এই ধরনের আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যুতে আপনি যে অত্যন্ত শ হয়েছেন বুঝতে পারছি। এবং এও নিশ্চয়ই আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলা বুঝতে পারছেন—আমাদের পক্ষে এ রহস্যের মীমাংসায় পৌঁছাতে হলে কতকগুলো delicate প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে। সেক্ষেত্রে আপনাদের প্রত্যেকেই বিশেষ করে আপনি যদি আমাদের সর্বতোভাবে না সাহায্য করেন, তাহলে—

বলুন কি জানতে চান?

কিছু মনে করবেন না, আপনাদের চারজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা, কথায় বলে দশ পা একত্রে গেলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়, তা এক্ষেত্রে আপনারা চারজন নিশ্চয়ই একে অন্যের খুব নিকটতম সংসর্গেই এসেছিলেন এবং আপনাদের চারজনের মধ্যে একা আপনিই নারী। পুরুষ ও নারীর এই বয়সের ঘনিষ্ঠতার মধ্যে সাধারণত যে সম্পর্কের সম্ভাবনাটা দেখা দেওয়া খুব স্বাভাবিক বুঝতে পারছেন আশা করি, কি আমি বলতে চাই মিস গাঙ্গুলী?

তিনজনই আমার অত্যন্ত প্রিয়। মৃদুকণ্ঠে মণিকা জবাব দেয়।

তাহলেও হাতের পাঁচটা আঙুল তো সমান হয় না মণিকা দেবী।

না। কিন্তু এক্ষেত্রে বোধ হয় কারও প্রতি কোনো আকর্ষণের তারতম্য ছিল না আমার।

মনকে আপনার খুব ভাল করে প্রশ্ন করে দেখুন। এত সহজে জবাব দেবার চেষ্টা করবেন না।

ঠিকই বলছি। মণিকার স্বর দৃঢ়।

আচ্ছা, এদের মধ্যে কেউ কোনোদিন আপনার কাছে কোনো excuse me for my language—মানে propose করেন নি?

এবার একটু থেমে ইতস্তত করে মণিকা জবাব দেয়, করেছিল। তিনজনই।

পরে সংক্ষেপে সংকোচের সঙ্গে মণিকার ঘটনাটা বিবৃত করে।

এছাড়া আর কোনো ঘটনা? অনুগ্রহ করে লজ্জা বা দ্বিধা না করে খুলে বলুন।

মণিকা দিন দুই আগেকার সারনাথের ঘটনাটাও বিবৃত করে।

আর কোনোদিনের কোনো ঘটনা?

সুকান্ত–কথাটা বলতে গিয়েও ইতস্তত করে যেন মণিকা।

বলুন, থামবেন না, বলুন। উদগ্রীব-ব্যাকুল কণ্ঠে মিনতি জানায় কিরীটী মণিকাকে।

গত বছর পুজোর ছুটিতে আমরা দার্জিলিং যাই। সেখানে এক রাত্রে সুকান্ত আমার ঘরে এসে ঢোকে—হঠাৎ–

তারপর?

.

মণিকার দার্জিলিং-বিবৃতি।

দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের স্মৃতি। রাত্রে হোটেলের ঘরে ফায়ারপ্লেসের সামনে চুপচাপ বসে মণিকা। গায়ে একটা কম্বল জড়ানো। পুজো সেবার ছিল অক্টোবরের শেষে। শীতও সেবারে দার্জিলিংয়ে বেশ কড়া পড়েছিল। অতুলের এক প্রফেসর বন্ধুর বাড়ি কার্ট রোডে, তারাও সস্ত্রীক দার্জিলিং এসেছে, নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের চারজনকেই কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার মত হওয়ায় মণিকা যেতে পারেনি। সুকান্ত, অতুল ও রণেন গিয়েছে নিমন্ত্রণে।

রাত বোধ করি বারোটা হবে। হঠাৎ দরজার গায়ে মৃদু ন পড়ল।

কে?

আমি। দরজাটা খোল মণি।

মণিকা উঠে দরজাটা খুলে দিল, এ কি! সুকান্ত তুমি একা! ওরা কই?

ওরা তাসের আড্ডায় বসেছে। হয়ত আজ রাত্রে ফিরবেই না। মিঃ ও মিসেস চামেরিয়ার তাসের প্রচণ্ড নেশা। তুমি একা, তাই চলে এলাম।

বেশ করেছ, বস। মণিকা চেয়ারটায় গিয়ে বসল।

গায়ের গ্রেট কোটটা খুলে খাটের বাজুর ওপরে রেখে দিল সুকান্ত। পাশের একটা চেয়ার খালি থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সুকান্ত বসছে না।

দেওয়ালের গায়ে অগ্নির রক্তাভ শিখাগুলো যেন আনন্দে নৃত্য করছে। বাইরে আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সমস্ত দার্জিলিং শহরটা শীতে যেন কুঁকড়ে রয়েছে।

বসো সু। আবার মৃদু আহ্বান জানায় মণিকা।

তথাপি সুকান্ত কিন্তু বসল না। চেয়ারে উপবিষ্ট মণিকার পাশে এসে দাঁড়াল, মণি?

বসো। মণিকা আবার জানায় সুকান্তকে।

মণিকার কাঁধের উপরে ডান হাতটা রাখল সুকান্ত।

কাঁধের ওপরে সুকান্তর হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল মণিকা।

চোখের মণি দুটোতে যেন এক অস্বাভাবিক দীপ্তি।

চাপা কণ্ঠে সুকান্ত ডাকে, মণি?

সুকান্তর স্বরের অস্বাভাবিকতা অকস্মাৎ মণিকার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে তাকে সচকিত করে তুলল। তখনও তাকিয়ে মণিকা সুকান্তের মুখের দিকে।

সম্মুখের ফায়ার-প্লেসের অগ্নির রক্তাভ আলোর আভায় সুকান্তর গৌর মুখখানা যেন রাঙা টকটক করছে।

কি হয়েছে সু? শরীর অসুস্থ বোধ করছ না তো? উদ্বিগ্ন-ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে মণিকা উঠে দাঁড়ায়।

না। বসো।

কই দেখি কপালটা? আরও একটু এগিয়ে এসে মণি হাতটা দিয়ে সুকান্তর কপাল স্পর্শ করতে উদ্যত হতেই মুহূর্তে দু বাহু দিয়ে সুকান্ত মণিকাকে নিজের বুকের ওপরে টেনে নিয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, মণি! মণি!

এবং পরক্ষণেই সুকান্তর উত্তপ্ত ওষ্ঠ মণিকার কপাল ও কপোলে মুহুর্মুহুঃ চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দেয়।

মণিকা ঘটনার আকস্মিকতায় এমন বিহ্বল হয়ে যায় যে বাধা দেবারও প্রথমটায় অবকাশ পায় না।

থরথর করে গভীর উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ কাঁপছে সুকান্তর। দেহের সমস্ত শিরায় শিরায় যেন একটা তরল অগ্নির জ্বালা। রোমকূপে-কূপে একটা উত্তপ্ত কামনার প্রদাহ। ভুয়ো বালির বাঁধ কামনার বন্যাস্রোতে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সে আগুনের তাপে মণিকার শরীর যেন ঝলসে যায়।

না! না! না! কোনো বাধাই মানব না! কোনো যুক্তি কোনো নিষেধ শুনব না! তুমি—তুমি আমার! আমার!

জোর করে ছাড়াতে চেষ্টা করে নিজেকে মণিকা সুকান্তর কঠিন বাহুবন্ধন হতে কিন্তু সুকান্ত আরও নিবিড় করে তার দুটি বাহুর বেষ্টনী, না মণি, না!

সুকান্ত! প্রায় একটা ধাক্কা দিয়েই নিজেকে এবারে মুক্ত করে নেয় মণিকা।

শোন মণি, এ নিষ্ঠুর খেলার অবসান হোক। সুকান্ত তখনও কাঁপছে উত্তেজনার আধিক্যে, আজ জানতে চাই তুমি আমার হবে কিনা?

আমি কারও নই। তোমাদের কারোরই হতে পারি না।

কারোরই হতে পার না! এত অহঙ্কার তোমার! তুমি কি ভেবেছ এমনি করে দিনের পর দিন আমাদের তিনজনকে তুমি বাঁদর-নাচ নাচিয়ে বেড়াবে! হিংস্র কামনামত্ত আদিম পশুপুরুষ সভ্যতার খোলস ফেলে নখর বিস্তার করেছে।

কি বলছ তুমি!

ঠিকই বলছি। তুমি জান তিনজনই আমরা তোমায় চাই। আমরা তিনজনই তোমাকে কামনা করি, তাই কি তুমি এইভাবে খেলছ আমাদের নিয়ে?

খেলছি তোমাদের নিয়ে?

হ্যাঁ, খেলছ। কিন্তু এ চলবে না। এতদিন ওদের আমি সুযোগ দিয়েছি। তারা avail যখন করেনি—আমি আর অপেক্ষা করব না। হয় তুমি আমার হবে, না হয় আমাদের সামনে থেকে তোমায় চিরদিনের মত সরে যেতে হবে।

অতুল, রণেন তোমার বন্ধু মণিকার স্বর যেন ভেঙ্গে পড়তে চায়।

বন্ধু! হ্যাঁ, বন্ধু বলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলাম। আর যদি তারা আমার পথে দাঁড়ায় জেনো তাদের হত্যা করতেও আমি পশ্চাৎপদ হব না। কতকগুলো ক্লীব জড় পদার্থ! কণ্ঠস্বরে ঘৃণা ও আক্রোশ যেন মূর্ত হয়ে ওঠে।

সুকান্ত তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?

পাগল! না হলেও পাগল হতে বেশি দেরি হবে না আর তোমাদের এই আদর্শের ন্যাকামি নিয়ে আর কিছুদিন থাকলে। বন্ধুত্ব! মনে মনে অহোরাত্র কামনার হিংসায় জর্জরিত হয়ে বাইরে বন্ধুত্বের ভান করব আমরা আর তুমি কেবল মিষ্টি হাসি ও দুটো চোখের ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের শান্ত রাখবার চেষ্টা করবে! নিশ্চয়ই তুমি ভাবছ, তোমার ঐ যৌবনের রঙের ঝাপ্টা এই তিনটে বোকার চোখে দিয়ে–

সুকান্তর কথাটা শেষ হল না। মণিকার ডান হাতটা চকিতে একটি চপেটাঘাত করল সুকান্তর গালে।

থমকে থেমে গেল সুকান্ত।

Get out! এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও!

প্রজ্বলিত অগ্নির মধ্যে একটা জলের ঝাপটা দিলে যেমন সহসা সেটা নিস্তেজ হয়ে যায়, সুকান্তরও মণিকার একটিমাত্র চপেটাঘাতের চকিত বিহ্বলতায় তার ক্ষণপূর্বের সমস্ত প্রদাহ ও কামনার জ্বালা দপ্ করেই নিভে যায়।

নিঃশব্দে সুকান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং শুধু ঘর থেকেই নয়, ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের ঘর হতে সুটকেসটা নিয়ে একেবারে হোটেল ছেড়েই চলে গেল।

বাকি রাতটুকু পথে পথে কাটিয়ে পরের দিনই সে দার্জিলিং ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে গেল।

পরের দিন সকালে রণেন ও অতুল ফিরে এল। সুকান্তের খোঁজ করতে মণিকা বললে, সে তোকই ফেরেনি রাত্রে!

দুই বন্ধু আশ্চর্য হয়ে তখুনি খোঁজাখুঁজি শুরু করে। কিন্তু সারাটা শহরেও তার দেখা মিলল না। সকলে তখন ব্যাকুল উৎকণ্ঠায় গিয়ে পুলিসে সংবাদ দেয়।

চতুর্থ দিনে অতুল সুকান্তর একটা টেলিগ্রাম পায়, আমি হঠাৎ কলকাতায় চলে এসেছি। ভালই আছি।

বুঝতে ঠিক পারে না অতুল আর রণেন, সুকান্তর ঐ ধরনের বিচিত্র ব্যাপারটা। তবে ওরা জানত সুকান্ত বরাবরই একটু বেশীমাত্রায় খেয়ালী, কারণে অকারণে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে।

পরে বন্ধুদের সঙ্গে সুকান্তর যখন দেখা হল, বলেছিল হাসতে হাসতে, হঠাৎ কি খেয়াল হল চলে এলাম। হঠাৎ যেন মধ্যরাত্রে সেদিন হোটেলে ফেরবার পথে মনে হল ফগে ভর্তি দার্জিলিং শহরটা বিশ্রী। যত শীঘ্র সম্ভব শহরটা পরিবর্জন করাই ভাল। অতএব কালবিলম্ব আরনা করে কাউকে কিছু না বলে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে রাত্রে বের হয়ে পড়লাম।

***

কিন্তু দিল্লীতে ফিরে মণিকা কয়েকদিন পরে একখানা চিঠি পেল সুকান্তর।

মণি,

জানি না সে রাত্রের আমার পশুবৎ আচরণকে তুমি এ জীবনে ক্ষমা করতে পারবে কিনা। তবু জেনো সে রাত্রের যে সুকান্তকে তুমি দেখেছিলে তার সন্ধান আর তুমি কোনো দিনও পাবে না। এবং আমার সেদিনকার আচরণের জন্য দায়ী তোমার প্রতি আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা সুতীব্র আকাঙক্ষাই। আমার সে আকাঙক্ষাকে তুমি ঘৃণা করো না। প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যেই থাকে চিরন্তন আদিম একটা বৃত্তি যাকে এ যুগের লোকেরা বলবে কু, আর থাকে আজকের দিনের তথাকথিত সভ্যতার আচরণে ক্লিষ্ট ভীরু একটা বৃত্তি যাকে তোমরা সগৌরবে বলে থাক সু। কিন্তু জান, এই কু বা সু কোনোটাই মিথ্যা নয় বরং প্রথমটাই আমার মতে নির্ভেজাল সত্য পরিচয়, যুগে যুগে মানুষে আজও যা নিঃশেষ করে ফেলতে পারিনি আমরা সভ্যতা ও তথাকথিত শিক্ষার কষ্টিপাথরে ঘষেও। সে যা চায় তা প্রাণ খুলে অতি বড় দুঃসাহসের সঙ্গেই চায়। চাইতে গিয়ে সরমে পিছিয়ে আসে না। কিন্তু যাক সে কথা। কারণ এ যুগে কুকেও কেউ ক্ষমার চক্ষে দেখবে না। সত্য ও নির্ভীক হলেও তার মনুষ্যসমাজে মর্যাদা নেই। মনে মনে যাই আমি স্বীকার করি না কেন, আমিও বোধ হয় সু-এরই বশ। সেই বৃত্তিতেই ক্ষমা চাইছি। আশা করি সে রাত্রের স্মৃতিকে তুমি মনে মনে পোষণ করে রাখবে না অন্তজ্বালায় ও ঘৃণায়।

ইতি

অনুতপ্ত সুকান্ত

চিঠিটা পেয়ে সেদিন মণি তোমার মনে কি ভাব হয়েছিল ভোলনি নিশ্চয়ই! কারণ মুখে, তুমি যতই বড়াই করো না কেন সুকান্তর সে রাত্রের অকুণ্ঠ সতেজ পুরুষ-আহ্বান তোমারও দেহে কামনার তীব্র দাহন জ্বেলেছিল। তুমি কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে গিয়েছিলে:

সু—আমার সুকান্ত

ভুল আমারই। স্বীকার করতে আজ আর আমার কোনো লজ্জা নেই। আমার এ নারীমন আমার অজ্ঞাতে যে একটিমাত্র বিশেষ পুরুষের জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছিল তাকে তুমিই সবল বাহুতে নাড়া দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও জাগিয়ে তুলেছিলে। সে রাত্রের আমার প্রত্যাখ্যানকে অস্বীকার করে জোর করে যদি তুমি আমায় অধিকার করতে, সাধ্য ছিল না আমার তোমাকে না ধরা দিই। কেন নিলে না জোর করে কেন?

কিন্তু না! না—এসব কি লিখেছে মণিকা! তাড়াতাড়ি চিঠির কাগজ ছিঁড়ে ফেলে কুটিকুটি করে সেটা উড়িয়ে দেয়। তারপর লেখে :

সুকান্ত,

ভুল দোষ ত্রুটি নিয়েই মানুষ। যা হয়ে গেছে তার জন্য মনে কিছু করো না। আমরা পরস্পরের বন্ধু। এর মধ্যে কাউকে কারও ক্ষমার প্রশ্ন আসতেই পারে না। সে সব কথা আমি ভুলে গিয়েছি। ভালবাসা নিও–

তোমাদের মণি।

সংক্ষেপে মণিকা কিরীটীকে নিজেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের সুকান্ত-কাহিনী বলে যায়। কিন্তু আসল কথাটি চাতুর্যের সঙ্গে কাহিনীর মধ্যে গোপন করে গেলেও মণিকার গলার স্বরে এবং বিবৃতির সময় তার চোখমুখের ভাবে কিরীটীর তীক্ষ্ণ সজাগ অনুভূতির অগোচর কিছুই থাকে না।

এতক্ষণে যেন অন্ধকারে ক্ষীণ :স্টা আলোকের রশ্মি দেখতে পায় কিরীটী। বুঝতে পারে এখন সুস্পষ্ট ভাবেই যেটা এখানে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে ক্ষীণ কুয়াশার মতই অস্পষ্ট ছিল, তার চিরাচরিত অনুমানের ভিত্তির ওপরে রণেন চৌধূরীর মুখে অতুলের মৃত্যুসসংবাদ পেয়ে সেটা একেবারে মিথ্যা নয় এবং এই মৃত্যু-রহস্যের মূলে হয়ত তার অনেকখানি ছড়িয়ে আছে।

ডাক পড়ল মণিকা দেবীর পর প্রথমে দিদিমার।

দিদিমা পেটের গোলমালের জন্য কয়েক বৎসর ধরে আফিম খান। তিনি অতুলের মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষ কোনো আলোকসম্পাতই করতে পারলেন না। তাছাড়া দিদিমা কানেও একটু খাটো। তাঁকে প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, এরকমটি যে হবে তা আমি জানতাম দারোগাবাবু। তিনটে পুরুষ আর ও এক মেয়ে।

কিরীটী সচকিত হয়ে ওঠে, কেন দিদিমা? আপনি কি ওদের মধ্যে তেমন কিছু কখনও দেখেছেন?

তেমন পাত্রীই আমার নাতনী নয়। মেয়ে আমার খুব ভাল। আর ওরা তিনজনও বড় ভাল, কিন্তু কথায় বলে বয়েসের মেয়ে-পুরুষ! ঘি আর আগুন! যত সাবধানেই রাখ অনর্থ ঘটতে কতক্ষণ!

কিরীটী বোঝে দিদিমাকে আর বেশী ঘাঁটিয়ে লাভ হবে না।

কিরীটীর ইঙ্গিতে শিউশরণ দিদিমাকে বিদায় দেয়।

 ৬. সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির

সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির। সুবালা।

পদশব্দে মুখ তুলে তাকিয়েই কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল।

কিরীটীরই ভাষায়–

স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম যেন প্রথমটায়। একটা জ্বলন্ত আগুনের রক্তাভ শিখা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়াল হঠাৎ।

এত রূপ মানুষের দেহে কখনও সম্ভব কি!

শুভ্র পরিধেয় শ্বেতবস্ত্রে সে রূপ যেন আরও স্পষ্ট আরও প্রখর হয়ে উঠেছিল।

বিস্ময় ও আকস্মিকতায় কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেলে আবার ভাল করে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকালাম এবং তখুনি আমার মনে হল সে রূপ বা দেহশ্রীর মধ্যে এতটুকু স্নিগ্ধতা নেই। জ্বলন্ত উগ্র উষ্ণ। তৃষ্ণা মেটে না, চোখ যেন ঝলসে যায়।

আরও একটা জিনিস যেটা আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার ছোট কপাল, বঙ্কিম জ্ব-যুগল ও ঈষৎ চাপা নাসিকার মধ্যে যেন একটা উগ্র দাম্ভিকতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। দৃঢ়বদ্ধ চাপা ওষ্ঠ ও সরু চিবুক নিদারুণ একটা অবজ্ঞায় যেন কুটিল কঠিন।

এমন কি তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটির মধ্যেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটা তাচ্ছিল্যের ও অবজ্ঞার ভাব।

কপাল পর্যন্ত স্বল্প ঘোমটা টানা।

তার ফাঁকে ফাঁকে কুঞ্চিত কেশদাম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

বয়স ত্রিশের বেশী নয়।

কিরীটীই প্রথম কথা বললে, আপনিই সুবালা দেবী?

হ্যাঁ। নিম্নকণ্ঠে শব্দটা উচ্চারণ করলে সুবালা।

বসুন।

কিরীটীর বলা সত্ত্বেও উপবেশন না করে সুবালা নিঃশব্দে বারেকের জন্য ঘরের মধ্যে উপস্থিত কিরীটী, শিউশরণ ও সুব্রত সকলের মুখের দিকে দৃষ্টিটা যুগপৎ বুলিয়ে নিয়ে কিরীটীকেই প্রশ্নটা করল, আমাকে আপনারা ডেকেছেন কেন?

অতুলবাবুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, শুনেছেন বোধ হয়? কথাটা বললে কিরীটী।

শুনেছি। তেমনি নিম্ন শান্ত কণ্ঠের জবাব।

গত রাত্রে আপনি মণিকা দেবীর সঙ্গে একই ঘরে শুয়েছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ।

কাল রাত কটা আন্দাজ আপনি ঘুমোতে যান মনে আছে কি আপনার?

ও ঘরে আমি রাত দশটায় সকলের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলেই যাই। বিছানায় যাই রাত এগারোটা আন্দাজ।

সারদা দেবী—মানে মণিকা দেবীর দিদিমা তো ওই একই ঘরে ছিলেন?

হ্যাঁ।

সারদা দেবীর আফিমের অভ্যাস আছে শুনলাম!

হ্যাঁ।

সারদা দেবী সাধারণত রাত্রে ঘুমোন কেমন?

সাধারণতঃ ভাল ঘুম হয় না তাঁর। নেশায় একটা ঝিমানো ভাব থাকে।

কানেও তো একটু কম শোনেন উনি শুনলাম!

সে এমন বিশেষ কিছু নয়।

রাত সাড়ে এগারোটার পর মণিকা দেবী ঘরে ঢুকে আলো জ্বালান। তার আগে পর্যন্ত মানে রাত এগারোটা পর্যন্ত আপনি কি করছিলেন?

একটু আগেই তো আপনাকে বললাম রাত এগারোটায় আমি শুতে যাই।

হ্যাঁ, কিন্তু ঘরে গিয়েছেন আপনি রাত দশটায়। দশটা থেকে এগারোটা এই এক ঘণ্টা আপনি কি করছিলেন?

একটা বই পড়ছিলাম।

তারপর?

তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি।

শুয়েই নিশ্চয়ই ঘুমোননি?

না। তবে বোধ হয় মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘুম এসে গিয়েছিল।

মণিকা দেবী রাত সাড়ে এগারোটায় যখন ঘরে ঢোকেন, জানেন আপনি?

ঠিক কখন সে ঘরে প্রবেশ করেছে জানি না। তবে মাঝরাত্রে একবার ঘুম ভেঙে যেতে দেখেছিলাম ঘরে আলো জ্বলছে—মণি বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একটা বই পড়ছে।

আবার আপনি ঘুমিয়ে পড়েন?

হ্যাঁ।

কখন ঘুম ভাঙল?

ভোর পাঁচটায়।

অত ভোরে কি সাধারণত আপনি বিছানা ত্যাগ করেন?

হ্যাঁ, ভোর-ভোরই আমি ঘরের কাজকর্ম সেরে রাখি।

আজও তাই করেছেন?

হ্যাঁ। ঘুম ভাঙতেই নিচে চলে যাই কাজকর্ম সারতে।

মণিকা দেবী তখন কি করছিলেন?

ঘুমোচ্ছিল।

সারদা দেবী?

তিনি তার কিছুক্ষণ বাদেই উঠে গঙ্গাস্নানে যান।

অতুলবাবু যে মারা গিয়েছেন আপনি জানলেন কখন?

দিদিমণি গঙ্গাস্নান থেকে ফিরে আসবার পর তাঁকে যখন মণি বলে সেই সময়।

তার আগে টের পাননি?

সুবালা নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থাকে।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, তার আগে টের পান নি?

অ্যাঁ! সুবালা যেন চমকে ওঠে, কি বলছেন?

বলছিলাম তার আগে কিছু টের পাননি?

না।

কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবে, তারপর প্রশ্ন করে, কাল রাত্রে কোনো রকম শব্দ শুনেছেন সুবালা দেবী?

শব্দ! কই না তো!

এ-বাড়িতে আপনি কতদিন আছেন?

বছর পাঁচেক হবে।

অতুলবাবু, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু এঁদের তো আপনি ভাল করেই চেনেন?

হ্যাঁ। ওঁরা মধ্যে মধ্যে এখানে এসে থাকেন।

দেখুন সুবালা দেবী, যে ঘটনা ঘটেছে এবং সেই ঘটনার সঙ্গে পাকেচক্রে যাঁরা জড়িত হয়ে পড়েছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র আপনিই সম্পূর্ণ তৃতীয় পক্ষ। তাই কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই এবং আপনার কাছ হতে চাই তার নিরপেক্ষ জবাব।

আমি কিছুই জানি না।

আমার প্রশ্ন না শুনেই বলছেন কি করে যে জানেন না?

বুঝতেই পারছেন এদের আশ্রয়েই আমি আছি। ত্রিসংসারে আমার আপনার কেউ নেই।

কিন্তু এটা নিশ্চয়ই চান হত্যাকারী ধরা পড়ুক?

হত্যাকারী! মানে?

মানে অত্যন্ত সহজ। অতুলবাবুকে কেউ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে—

হত্যা!

হ্যাঁ।

এই ধরনের কিছু যে হবে এ আমি পূর্বেই অনুমান করেছিলাম।

কেন বলুন তো?

এই তো স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক!

তাছাড়া কি? নেহাৎ এদের আমি আশ্রিত নচেৎ একটি মেয়েকে নিয়ে তিনটি অবিবাহিত পুরুষ—ক্ষমা করবেন। বলতে বলতে হঠাৎ সুবালা থেমে গেল।

থামলেন কেন? বলুন কি বলছিলেন?

লেখাপড়া জানা সব শিক্ষিত এরা। এদের হাবভাবই আলাদা। আমরা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অশিক্ষিত গেঁয়ো মেয়েমানুষ।

সুবালার প্রতিটি কথার উচ্চারণে তীক্ষ্ণ একটা চাপা শ্লেষ অত্যন্ত বিশ্রীভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেটা কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়ায় না।

কিরীটী তার স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি ব্যাপারটা সহজেই অনুমান করে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কথার মোড়টা একটু ঘুরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা সুবালা দেবী, এদের চারজনকেই, মানে আমি মৃত অতুলবাবুর কথাও বলছি—কি রকম মনে হয়?

তা সকলেই ভদ্র মার্জিত শিক্ষিত—

এদের পরস্পরের সম্পর্কটা?

প্রত্যেকের সঙ্গেই তো প্রত্যেকের গলায় গলায় ভাব দেখেছি। তবে কার মনে কি আছে কেমন করে বলি বলুন?

তা বটে। আচ্ছা মণিকা দেবী তাঁর তিনটি বন্ধুকেই সমান চোখে দেখতেন বলে আপনার মনে হয়?

মনে কিছু অন্যরকম আছে কিনা বলতে পারি না, তবে বাইরে কারও প্রতি মণির কোনো বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।

গত দু-একদিনের মধ্যে এঁদের পরস্পরের মধ্যে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা বলতে পারেন?

না।

এঁদের তিন বন্ধুর মধ্যে সব চাইতে কাকে বেশী ভাল বলে আপনার মনে হত সুবালা দেবী?

অতুলবাবুকেই।

অতঃপর ক্ষণকাল আপন মনে কিরীটী কি যেন ভাবে। তারপর সুবালার দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন সুবালা দেবী।

সুবালা ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কিরীটী ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে পায়চারি করতে শুরু করে।

সুব্রত ও শিউশরণ কেই কোনো কথা বলে না।

মণিকা দেবীকে আর একবার ডাক তো শিউশরণ?

হঠাৎ যেন কি একটা কথা মনে পড়ায় কিরীটী শিউশরণকে কথাটা বললে।

শিউশরণ কিরীটীর নির্দেশমতই মণিকাকে ডাকতে গেল।

মিনিট খানেকের মধ্যেই শিউশরণের সঙ্গে মণিকা এসে ঘরে ঢুকল।

আসুন মণিকা দেবী। আপনাকে আবার কষ্ট দিচ্ছি বলে দুঃখিত। কিরীটী বললে।

মণিকা কিরীটীর কথার কোনো জবাব দিল না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়েই থাকে।

আচ্ছা মণিকা দেবী, এইবারের ছুটির মত আর কখনও আগে আপনারা সকলে এই বাড়িতে কি একত্রে এসে কাটিয়েছেন?

কিরীটীর প্রশ্নে মণিকা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ।

কতদিন আগে?

তিন বছর আগে।

কতদিন সেবারে আপনারা এখানে ছিলেন?

এক মাস প্রায় হবে।

অনেকদিন সেবারে ছিলেন তো?

হ্যাঁ। আমার সেবারে টাইফয়েড হয়, তাই বাধ্য হয়েই বাকী কথাটা আর শেষ করে না মণিকা।

হুঁ। আচ্ছা তিনজনেই মানে তিন বন্ধুই আপনার সেবা করতেন সমান ভাবে, না? প্রশ্ন করে আবার কিরীটী।

তা করত। তবে বেশীর ভাগ সময় অতুল ও সুবালাদিই আমার ঘরে থাকত।

আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মনে যদি অবিশ্যি কিছু না করেন?

বলুন?

বলছিলাম আপনার সুবালাদিকে কি রকম মনে হয়? প্রশ্নটা করে কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মণিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ যেন চমকে মণিকা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন! হিন্দুঘরের ব্রতচারিণী বিধবা সুবালাদি—

কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাসির একটা বঙ্কিম রেখা জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়। আপনি নারী হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অন্য এক নারী সম্পর্কে আমার প্রশ্নটা ঠিক–

না, সেরকম কিছু থাকলে অন্তত আমার দিদিমার নজর এড়াত না, মিঃ রায়। দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দেয় মণিকা কিন্তু তথাপি কিরীটীর মনের সংশয়টা যেন যায় না। অদৃশ্য একটা কাঁটার মতই একটা সংশয় যেন কিরীটীকে বিঁধতে থাকে।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।

মণিকা চলে গেল।

.

মণিকা ঘর থেকে চলে যাবার পর কিরীটী নিঃশব্দে আপন মনেই কিছুক্ষণ ধূমপান করে। তারপর অর্ধদগ্ধ চুবরাটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে শিউশরণের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, শিউ, চল আর একবার অতুলবাবুর ঘরটা দেখে আসা যাক।

চল। কিরীটী যখন পাকেচক্রে একবার এই ব্যাপারে এসে মাথা দিয়েছে, মীমাংসায় একটা পৌঁছনো যাবেই। তাই কিরীটীর উপরেই সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিল শিউশরণ।

সকলে পুনর্বার যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরে এসে প্রবেশ করল। চাদরে আবৃত মৃতদেহটা তেমনি রয়েছে চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট। কিরীটী তার অভ্যস্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চতুর্দিকে তাকাতে লাগল আর একবার। ঘরের পূর্ব কোণে একটা জলচৌকির উপরে একটা মাঝারি আকারের চামড়ার সুটকেস। এগিয়ে গিয়ে কিরীটী সুটকেসটার সামনে দাঁড়াল।

সুটকেসের উপরে অতুলের নাম ও পদবীর আদ্যক্ষর ইংরাজীতে লেখা। নীচু হয়ে কিরীটী সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করতেই ডালা খুলে গেল। বোঝা গেল সুটকেসে চাবি দেওয়া ছিল না। তালাটা খোলাই ছিল। ডালাটা সুটকেসের তুলল কিরীটী। কতকগুলো জামাকাপড়, খানকতক ইংরাজী বই।

একটা একটা করে কিরীটী বইগুলো তুলে দেখতে লাগল। একান্ত শিথিল ভাবেই কিরীটী সুটকেস হতে ইংরাজী বইগুলো একটা একটা করে তুলে দেখতে শুরু করে।

বইগুলো বিখ্যাত বিদেশী গ্রন্থকার কর্তৃক রচিত নামকরা সব সাইকোলজি ও সেকসোলজি সংক্রান্ত।

বইগুলো অন্যমনস্কভাবে উলটে দেখতে দেখতে আচমকা কিরীটীর মনের চিন্তা-আবর্তে এসে উদিত হয় একটা কথা এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী সুটকেসের পাশে হাতের বইগুলো নামিয়ে রেখে পুনবার এগিয়ে যায় চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট ও চাদরে আবৃত মৃতদেহের সন্নিকটে এবং নীচু হয়ে চেয়ারের পায়ার কাছেই ভূপতিত বইটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে গিয়ে সহসা চেয়ারের পায়ার দিকে দৃষ্টি পড়ে।

শিউশরণ তখন তার নোটবুকে ক্ষণপূর্বে শোনা জবানবন্দির কতকগুলো পয়েন্টস্ টুকে নিতে ব্যস্ত। কিরীটীর প্রতি তার নজরটা ছিল না।

যে চেয়ারটার উপরে মৃতদেহ উপবিষ্ট ছিল তারই একটা পায়ার সঙ্গে ও দেখতে পেল জড়ানো সরু একটা তামার পাত।

চেয়ারটা যদিও তৈরী ষ্টীলের এবং রঙটা তার অনেকটা তামাটে, সেই কারণেই সেই তামাটে বর্ণের সরু স্টীলের পায়ার সঙ্গে জড়ানো সরু একটা তামার পাত চট করে সহজে কারও দৃষ্টিতে না পড়বারই কথা। সেই কারণেও বটে এবং প্রথম দিকে মৃতদেহ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে কিরীটীর মন বেশী নিবিষ্ট ছিল বলেই ব্যাপারটা ওর নজর এড়িয়ে গিয়েছে প্রথম দিকে।

কৌতূহলভরে কিরীটী হাত দিয়ে চেয়ারের পায়া থেকে সরু তামার পাতটা খুলে নেবার চেষ্টা করল। এবং খুব বেশী শক্ত করে জড়ানো না থাকায় অল্প আয়াসেই সেটা খুলে নিল।

তামার পাতটা হাতে নিয়ে কিরীটী পরীক্ষা করে।

তার মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলো বিশেষ ভাবেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুরাতন একটা তামার পাত!

বুঝতে কষ্ট হয় না চেয়ারের পায়াটার দিকে তাকিয়ে যে, পায়ার সঙ্গে তামার পাতটা বরাবর জড়ানো ছিল না।

শিউশরণের নজর পড়ে কিরীটীর দিকে।

কি দেখছ অমন করে, রায়?

একটা সরু তামার পাত—

তামার পাত! বিস্মিত শিউশরণ পাল্টা প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। বলতে বলতে কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের এদিক-ওদিক আবার তাকায়।

চোখের শ্যেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা একসময় ঘুরতে ঘুরতে দরজার পাশেই দেওয়ালের গায়ে যেখানে আলোর সুইচটা তার উপরে গিয়ে নিবদ্ধ হল।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কিরীটী সইটার সামনে দেওয়ালের কাছে।

সাধারণ প্ল্যাস্টিকের সুইচ।

সুইচের উপরের অংশটা কোনো একসময় ভেঙে গিয়েছিল বোধ হয়। খানিকটা অংশ নেই। অথচ আশ্চর্য, জানা গিয়েছে পরশু এ ঘরের আলোটা নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মিস্ত্রীও এসেছিল, তবু ভাঙা সুইচটা বদলানো হয়নি বোঝাই যাচ্ছে।

অন্যমনস্ক ভাবেই কিরীটী সুইচটা টিপল কিন্তু দেখা গেল ঘরের বালটা জ্বলছে না। আবার এগিয়ে গেল কিরীটী ঝুলন্ত বালবটার কাছে এবং তাকিয়ে রইল ঝুলন্ত বালবটার দিকে।

শিউশরণ অবাক হয়ে কিরীটীকে প্রশ্ন করে, কি হল?

সুটকেসটা মাটিতে নামিয়ে রেখে, ঐ চৌকিটা এনে ঐ বালবটা খোল তো শিউশরণ!

কেন হে? হঠাৎ বালবটার কি আবার প্রয়োজন হল?

খোল না বালবটা! যা বলি কর!

শিউশরণ আর কথা বাড়ায় না। কিরীটীর নির্দেশমত চৌকিটা এনে তার উপরে দাঁড়িয়ে বালবটা খুলে কিরীটীর হাতে দিল।

বালবটা হাতে করে একবার ঘুরিয়ে দেখেই গম্ভীর কণ্ঠে আত্মগত ভাবেই যেন কিরীটী মৃদুভাবে বলে, ফিউজ হয়ে গিয়েছে!

কি বললে?

কিছু না!

বলতে বলতে কিরীটী আবার এগিয়ে যায় দেওয়ালের গায়ে সুইচটার সামনে।

সুইচটা নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করে। এবারে হঠাৎ কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, একটা সরু তারের অংশ সুইচের তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে।

এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে যায় তার মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলিতে কম্পন তুলে। চোখের তারা দুটো চচক্ করে ওঠে। ও নিম্নকণ্ঠে বলে, so this is that!

কি হল হে?

পেয়েছি—

কি পেলে?

তামার পাত ও ফিউজ বালবের রহস্য।

হেঁয়ালি গাঁথছ কেন বল তো?

হেঁয়ালি নয় শিউশরণ, সাধারণ সাংকেতিক নিয়ম।

তারপর হঠাৎ আবার কি মনে পড়ায় কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এগিয়ে গিয়ে ক্ষণপূর্বে রাখা মাটি হতে বইটা হাতে তুলে নিল।

বইটা কিন্তু সাইকোলজি বা সেকসোলজি সংক্রান্ত নয়। শরৎচন্দ্রের একখানা বহুখ্যাত উপন্যাস। চরিত্রহীন।

বইটা হাতে করে অন্যমনস্ক ভাবে বইয়ের পাতাগুলো ওলটাতে লাগল কিরীটী।

অনেক হাতে ঘুরেছে। অনেক হাতের ছাপ বইটার সর্বত্র।

পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ বইয়ের একটা পাতার মার্জিনে লাল কালিতে বাংলায় লেখা একটি টিপ্পনী নজরে পড়তেই কিরীটীর চোখের দৃষ্টি সজাগ হয়ে ওঠে। মন হয়ে ওঠে সচেতন।

সুন্দর মুক্তার মত ছোট ছোট হরফে গোল গোল লেখা।

কিরণময়ী, দুঃখ করো না। উপীন্দ্র নপুংসক।

ক্ষণকাল স্থির একাগ্র দৃষ্টিতে লাইনটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরীটী। তারপর আবার একসময় বইটার বাকি পাতাগুলো বেশ একটু মনোযোগ সহকারেই উলুটে চলে। কিন্তু আর কোথায়ও কোন টিপ্পনী ওর চোখে পড়ে না।

কি ভেবে কিরীটী চরিত্রহীন বইখানা হাতে নিয়েই পুনরায় সুটকেসটার কাছে এগিয়ে এল। এক এক করে এবারে সুটকেস হতে জামাকাপড়গুলো বের করে পাশে নামিয়ে রাখতে লাগল।

শুধু কাপড়জামা ও বই-ই নয়, নিত্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি অনেক কিছুই সুটকেস হতে বের হয়। এবং শেষ পর্যন্ত একেবারে তলায় পাওয়া গেল বইয়ের আকারে একটা মরোক্কো লেদারে বাঁধানো সুদৃশ্য খাতা।

সাগ্রহে কিরীটী খাতাটা তুলে নিয়ে মলাটটা ওল্টালো।

প্রথম পাতাতেই লেখা: ছিন্নপাতার দল।

তবে নিচে লেখা: অতুল।

মনের মধ্যে একটা কৌতূহল উঁকি দেয়। কিরীটী খাতার পৃষ্ঠাগুলো উলুটে চলে সাগ্রহ উত্তেজনায়। অতুলের ডায়েরী।

কোথাও তারিখ বড় একটা নেই। অসংলগ্ন স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো যেন এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে।

লেখা কখনও ইংরাজীতে, কখনও বাংলায়।

দু-একটা পৃষ্ঠা এদিক-ওদিক থেকে পড়ে কিরীটী।

তারপর একসময় ডায়েরীটা জামার পকেটে ভরে নেয়।

.

আরও কিছুক্ষণ পরে।

কিরীটীর নির্দেশক্রমেই শিউশরণ সকলকে ডেকে আপাতত তার বিনানুমতিতে যেন কাশী কেউ না ত্যাগ করে নির্দেশ দিয়ে ও মৃতদেহের উপরে পাহারার ব্যবস্থা করে সকলে বিদায় নিয়ে ঐ বাড়ি হতে বের হয়ে এল।

৭. সেইদিনই দ্বিপ্রহরে

সেইদিনই দ্বিপ্রহরে।

আহারাদির পর শিউশরণ একটা জরুরী তদন্তে বাইরে বের হয়েছে। সুব্রত একটা নভেল নিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।

কিরীটী একটা আরামকেদারার ওপরে একটা বা চুরুট ধরিয়ে ঐদিন সকালে তদন্তের সময় মৃত অতুলের সুটকেসে প্রাপ্ত ডায়েরীটা নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ডায়েরীর পাতাগুলো উল্টে চলেছে।

এক জায়গায় লেখা:

মাঝে মাঝে ভাবি মণি কি ধাতুতে গড়া! সত্যিই কি ওর মনের মধ্যে কোন নারীমন আছে? না দেহেই শুধু ও নারী! মনের দিক দিয়ে ও নপুংসক! এই দীর্ঘ পরিচয়ের মধ্যে আমাদের তিন পুরুষ বন্ধুর কেউই কি ওর মনে কোন আঁচড়ই কাটতে পারিনি!

.

আবার এক পাতায় লেখা:

বাবা মা এত করে বলছেন বিবাহের জন্য। কিন্তু কেমন করে তাঁদের বলব বিবাহ করলে আমি সুখী হতে পারব না। সমস্ত মন আমার আচ্ছন্ন করে রয়েছে সে। অথচ নিজের মনে নিজেই যখন বিশ্লেষণ করি অবাক হয়ে যাই। কি আছে ওর? রূপ তো নয়ই। ওর মত মেয়েরও বাংলাদেশে অভাব নেই। আচ্ছা ও কি কোন জাদু জানে! নচেৎ এমন করে আমাদের প্রত্যেককে ও আকর্ষণ করে কেন?

***

মাঝে মাঝে ভারি জানতে ইচ্ছে করে আমাদের সম্পর্কে ওর মনোভাব কি? যে যাই বলুক ও তো মেয়েমানুষই! নিশ্চয়ই ওর মনের মধ্যে কারও সম্পর্কে কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকা সম্ভব। সুকান্ত ও রণেনকে জিজ্ঞাসা করব খোলাখুলি! না না, ছিঃ! কি ভাববে ওরা! যদি হাসে! ব্যঙ্গ করে! না না, সে হবে মর্মান্তিক। কিন্তু এমন করে মনের সঙ্গেই বা কতকাল যুদ্ধ করা যায়? এর চাইতে স্পষ্টাস্পষ্টি একদিন সব কিছুর মীমাংসা করে নেওয়াই তো ভাল।

.

I dont believe Sukanta! বিশ্বাস করি না ওকে আমি। তলে তলে নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে সুকান্তর কোন বোঝাপড়া হয়েছে।

কিন্তু তাই যদি হয়, বন্ধু বলে ক্ষমা করব না সুকান্তকে।

একজন আমরা ওকে পাব বাকি দুজন পাবে না, না—এ হতে পারে না।

তার চাইতে এ অনেক ভাল।

বহুবল্লভাই ও থাক।

ও আমাদের দ্রৌপদী!

.

কিরীটী পাতার পর পাতা উল্টে চলে—সবই প্রায় একই ধরনের কথা। সেই একটি মেয়ের জন্য মনোবিকলন। কখনও রাগ, কখনও অভিমান, কখনও হিংসা। লেখার প্রতিটি কথার মধ্য দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।

কিরীটী দু-এক লাইন করে পড়ে আর উল্টে যায়।

হঠাৎ মাঝামাঝি একটা পাতায় এসে ওর মন সচেতন হয়ে ওঠে যেন নতুন করে।

***

উঃ! চোখ যেন ঝলসে গেল আমার। আগুনের একটা হঠাৎ ঝাপ্টা যেন চোখের দৃষ্টি আমার কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দিয়ে গেল। মূর্তিমতি অগ্নিশিখা যেন। আলোর একটা শিখা যেন ঊর্ধ্বে বঙ্কিম হয়ে উঠেছে।

কি নাম দিই ওর? অগ্নিশিখা! না বহ্নিশিখা?

.

আবার এক জায়গায়।

না, আমার মনের ভুল নয়। ওর চোখের দৃষ্টিতেই ও ধরা পড়েছে। দুপুরবেলায় সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম হঠাৎ চোখাচোখি হল একেবারে সামনাসামনি।

কি যেন ও নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছিল। হঠাৎ এমন সময় উপরে মণির গলা শুনতে পেলাম। দুরদুর করে উঠল বুকের ভিতরটা।

ছিঃ ছিঃ—মণি যদি জানতে পারে লজ্জায় যে তার কাছে আর এ জীবনে মুখ দেখাতে পারব না। বলবে, এই তোমার ভালবাসা! এই চরিত্রের তুমি গর্ব কর!

মণির অসুখ। রাত্রে শিয়রে বসে আছি মণির মাথায় আইস্-ব্যাগটা ধরে। বোধ হয় একটু তামত এসেছিল। হঠাৎ একটা আগুনের মত তপ্ত স্পর্শে চমকে চোখ খুলে তাকালাম। আমার বাঁ হাতটা চেপে ধরেছে।

চাপা গলায় বললে, বাইরে চল! কথা আছে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতই উঠে বাইরে এলাম। সাপের চোখের সম্মোহন দৃষ্টি যেন তার ছিল।

আমি আর পারছি না অতুলবাবু—

এসব কি বলছেন আপনি!

এ জীবনে কোন দিনই বলবই না ভেবেছিলাম, কিন্তু পারলাম না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এ কদিনে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছি–

ছিঃ ছিঃ! এ-কথা আপনারও যেমন বলা মহাপাপ, আমার শোনাও মহাপাপ!

পাপ!

হ্যাঁ। তাছাড়া ভুলে যাচ্ছেন আপনার সত্য পরিচয়।

ক্রুদ্ধা ভুজঙ্গিনীর মতই মুহূর্তে সে গ্রীবা বেঁকিয়ে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলে, কি বললেন?

আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ নন, ঘরে যান।

দেখ অতুলবাবু,আর যে-ই চরিত্রের বড়াই করুক তোমরা কেউ অন্তত করো না। তোমাদের সম্পর্কের কথা পরস্পরের মধ্যে আর কেউ না বুঝুক আমার চোখে চাপা দিতে পারবে না।

এসব কি বলছেন আপনি! সকলকে নিজের মত ভাববেন না। রাগে তখন আমার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় অন্য দিকে মুখ ফেরালাম।

সব চরিত্রবান যুধিষ্ঠিরের দল। বলতে বলতে চলে গেল সে। হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম আমি সেখানে।

.

তারপরই লেখা:

যাক। ও সুস্থ হয়ে উঠেছে।

উঃ! কি সাংঘাতিক ঐ বহ্নিশিখা! সাপের চেয়েও সাংঘাতিক মেয়েমানুষ! এ কদিন সর্বদা আমার একটা ভয় ছিল হয়ত আমার নামে মণির কাছে ও অনেক কিছু বানিয়ে বলবে। কিন্তু বলেনি।

.

তারপর আবার এক জায়গায় লেখা:

দাজিলিংয়ের ব্যাপারটা যে কি হল বুঝতে পারলাম না।

হঠাৎ সুকান্ত কাউকে না বলে-কয়ে রাতারাতি দাজিলিং হতে উধাও হয়ে গেল কেন!

মণি যতই চুপ করে থাক আমার স্থির বিশ্বাস নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে।

আর যার দৃষ্টিকেই ওরা এড়িয়ে যাক না কেন ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের হাবভাব,চোখে চোখে নীরব ইশারা স্পষ্ট আমার কাছে।

আমার কেন জানি মনে হয় আমাদের মধ্যে সুকান্তর ওপরেই মণির দুর্বলতা একটা আছে।

শেষ পর্যন্ত ভাগ্যলক্ষ্মী সুকান্তর গলায়ই করবে মাল্যদান!

.

তারপর শেষ পাতায়:

আবার কাশী। আবার সেই তপ্ত অগ্নিশিখার সম্মুখীন হতে হবে।

না বলতেও তো পারব না।

মণির আমন্ত্রণ। যেতেই হবে।

***

না। ও নিষ্ঠুর।

হৃদয় বলে ওর কোন বস্তু নেই।

সত্যি কি তাই!

***

আশ্চর্য ব্যবহার বহ্নিশিখার! এবার যেন মনে হচ্ছে ও একেবারে সম্পূর্ণভাবে বদলে গিয়েছে। অবশ্য নিজেও আমি মনের দিক দিয়ে কোন ক্ষীণতম আকর্ষণও অনুভব করছি না।

আচ্ছা এরই বা কারণ কি! ওর দিকে তাকালে আকর্ষণের বদলে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণাই বোধ করি।

ও রূপে মনের তৃষ্ণা তো মেটেই না, স্নিগ্ধও হয় না মন। বরং মনের মধ্যে জ্বলতে থাকে।

আর মণি!

দিন-দিনই যেন আকর্ষণ বাড়ছে।

ওকে দেখার তৃষ্ণা বুঝি এ জীবনে মেটবার নয়।

কিন্তু হায় রে তৃষ্ণা! ও যে মরীচিকা! মিথ্যা! মায়া!

৮. ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল

পরের দিন সকালেই ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল।

কোন তীব্র বৈদ্যুতিক কারেন্টের আঘাতেই অতুলের মৃত্যু ঘটেছে। সন্ধ্যার দিকে ঐ দিনই শিউশরণের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে কিরীটী, সুব্রত ও শিউশরণের মধ্যে ঐ সম্পর্কেই আলোচনা চলছিল।

Electrocution-য়ে মৃত্যু! অভিনব উপায় অবলম্বন করা হয়েছে হত্যা করবার জন্য।

কিরীটী বলছিল, অতুলবাবুর শরীরের মধ্যে হাই ভোল্টের কোন ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রবেশ করিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে সেটুকু বোঝা গেল। কিন্তু কথা হচ্ছে আলোর সুইচটা অন্ করেছিল কে? অতুলবাবু নিজেই, না হত্যাকারী?

শিউশরণ প্রশ্ন করে, কি তুমি বলতে চাও কিরীটী? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় শিউশরণ কিরীটীর মুখের দিকে।

বলছি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে নিজেই অতুলবাবু আলোটা জ্বেলে নিজের ঘরের মধ্যে যে মৃত্যুফাঁদ পাতা ছিল তাতে নিজেই অজ্ঞাতে পা দিয়েছিলেন, না অতুলবাবু সে রাত্রে তাসের আড্ডা হতে ফিরে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বরাবর গিয়ে শয্যা নিয়েছিলেন, তারপর কোন একসময় সেই ঘরে হত্যাকারী প্রবেশ করে।

তাহলে তোমার ধারণা হত্যাকারী অতুলবাবুর বিশেষ পরিচিতই ছিল? প্রশ্নটা করে শিউশরণ।

নিশ্চয়ই। সে রকমই যদি হয়ে থাকেও কোন সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে শেষের ব্যাপারটাই যদি ঘটে থাকে তাহলে বুঝতে হবে একান্ত আকস্মিক ভাবেই মৃত্যু এসেছিল সে রাত্রে বিশেষ তাঁর একজন পরিচিত জনের হাত দিয়েই–

আর একটু খোলসা করে বল, রায়।

দেখ শিউশরণ, আমার অনুমান প্রথমোক্ত ভাবেই অতুলবাবুকে আকস্মিক ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাসের আড্ডা হতে ফিরে খুব সম্ভবত অতুলবাবু আলো জ্বেলে শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করতে যাবেন এমন সময় হয়ত হত্যাকারী ঘরে প্রবেশ করে। এবং খুব সম্ভবত হয়ত হত্যাকারী গিয়ে অতুলবাবুর শয্যার ওপরে উপবেশন করে ও তাই দেখে অতুলবাবু চেয়ারে বসতে যান—এই পর্যন্ত কথাটা বলতে বলতেই হঠাৎ কিরীটী কি ভেবে যেন থেমে যায় এবং চাপা অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই তাই!

বিস্মিত সুব্রত ও শিউশরণ দুজনেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি? কি নিশ্চয়ই, কিরীটী?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই! কিন্তু–কিন্তু কেন! আর তাই যদি হয়ে থাকে মণিকা দেবীর জানা উচিত ছিল। মণিকা দেবীর নিশ্চয়ই জানা উচিত ছিল। কিরীটী স্বগতোক্তির মতই যেন আপন মনে কথাগুলো বলে চলে।

সুব্রত ও শিউশরণ কিরীটীর মৃদুচ্চারিত কথাগুলো শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কিরীটী চেয়ার থেকে উঠে ঘরের মধ্যে তখন পায়চারি শুরু করেছে।

কোন একটা বিশেষ চিন্তা তার মাথার মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে এবং সেই চিন্তার আবর্তেই কিরীটী সহসা ব্যাকুল ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

অথচ এও সুব্রত জানে নিজে থেকে স্বেচ্ছায় যতক্ষণ নিজেকে কিরীটী ব্যক্ত না করে ততক্ষণ কোনমতেই কোন সাড়া তার কাছ হতে পাওয়া যাবে না।

হঠাৎ আবার একসময় পায়চারি থামিয়ে কিরীটী শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, চল শিউশরণ, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।

বাইরে! কোথায় যাবে?

চলই না। আগে হতেই মেয়েলী কৌতূহল কেন? সুব্রত চল। ওঠ।

অগত্যা উঠতেই হল ওদের দুজনকে।

.

রাস্তায় বের হয়ে কিরীটী গোধূলিয়ার দিকেই চলতে শুরু করে।

মন্থর অলস পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে কিরীটী আগে আগে আর ওরা দুজনে নির্বাক তাকে অনুসরণ করে চলেছে।

কোথায় চলেছে কিরীটী!

চলতে চলতে ক্রমে ওরা জঙ্গমবাড়িতে মণিকা দেবীদের বাড়ির কাছাকাছিই এসে দাঁড়াল।

অপ্রশস্ত সরু গলিপথটায় আলোর ব্যবস্থা এত কম যে সমগ্র গলিপথটা একটা আলো-আঁধারিতে যেন কেমন থমথম করছে।

হঠাৎ কিরীটী শিউশরণকে চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, মণিকাদের ঠিক উল্টো দিকে ঐ দোতলা বাড়িটায় কে থাকে শিউশরণ?

কেমন করে বলব না খোঁজ নিয়ে? শিউশরণ নিরাসক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়।

তাহলে চল একবারটি না হয় খোঁজ নিয়েই দেখা যাক।

ব্যাপার কি?

বুঝতে পারছ না? উপরের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখ। ঐ বাড়ির দোতলা থেকে মণিকা দেবীদের বাড়ির দোতলার বিশেষ একটা ঘরের জানালাটা খোলা থাকলে এবাড়ির কোন কোন লোকের চোখে ঘটনাচক্রে বা দৈবাৎ যাই বল মণিকা দেবীদের বাড়ির ঐ ঘরের কোন কিছু হয়ত দৃষ্টিগোচরও হতে পারে। এবং মণিকা দেবীদের বাড়ির প্ল্যানটা একটু ভেবে দেখলেই মনে পড়বে ঐ যে বন্ধ জানালাটা দেখছ মণিকা দেবীদের বাড়ির ওটাই সেই ঘর—অকুস্থান, যেখানে অতুলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে। অতএব–

কিরীটীর কথায় দুজনে তাকিয়ে দেখতেই মনে হল, সত্যি তাই তো।

শেষোক্ত কথার জের টেনে কিরীটী তখন বলছে, অতএব চলই না একবার ঐ বাড়িটায় চুঁ মেরে দেখা যাক।

চল।

সকলে এগিয়ে গেল।

কিন্তু দরজার কড়া নাড়তে হল না। দরজার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ বন্ধ দরজা খুলে গেল এবং খোলা দ্বারপথে একজন লংস ও হাফসার্ট পরিহিত পুরুষ একটা সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে আসছেন দেখা গেল।

অ মশাই, শুনছেন? কিরীটীই আহ্বান জানায়।

সাইকেল-হাতে ব্যক্তি থামলেন, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ। আপনি এই বাড়িতেই থাকেন বুঝি?

হ্যাঁ। কেন বলুন তো? কি চাই? রুক্ষ ভারী কণ্ঠস্বর।

আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।

আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না! তাছাড়া এখন আমার সময় নেই। পূর্ববং রুক্ষ কণ্ঠস্বর।

এবারে শিউশরণ এগিয়ে এসে হিন্দীতে বললে, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমি খোদাইচৌকির থানা-অফিসার, থানা থেকেই আসছি।

থানা-অফিসার! এবারে ভদ্রলোক তাকালেন।

হ্যাঁ। একটু ভেতরে চলুন, কয়েকটা কথা আছে।

সকলে এসে ভদ্রলোকের বাড়ির নীচের তলাকার একটা ঘরে প্রবেশ করল। ভদ্রলোক ঘরে সর্বাগ্রে প্রবেশ করেই সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।

মাঝারি আকারের ঘর। নীচু ছাত।

ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন কোন বাহুল্য না থাকলেও একটা ছিমছাম পরিচ্ছন্ন ভাব আছে।

ঘরের মধ্যস্থলে একটা তক্তপোশ পাতা। তার উপরে একটা শতরঞ্চ বিছানো। এবং খান-দুই চেয়ার।

দেওয়ালে একটি বাংলা-ইংরাজী দেওয়ালপঞ্জী ভিন্ন অন্য কোন ছবি নেই।

বসুন—ভদ্রলোকই আহ্বান জানালেন।

তক্তপোশের ওপরেই সকলে উপবেশন করে।

ঘরের আলোয় ভদ্রলোকের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলিষ্ঠ গঠন। চওড়া কপাল। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। মধ্যখানে সিঁথি, ঠোঁটের উপরে একজোড়া ভারী গোঁফ।

আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

রণলাল চৌধুরী।

দেখুন মিঃ চৌধুরী, এই সময় হঠাৎ এসে আপনার কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিরক্ত করছি বলে আমরা বিশেষ দুঃখিত। অবশ্য বেশী সময় আপনার আমরা নষ্ট করব না। যে জন্যে এসেছি সেই কথাই বলি। আপনি শুনেছেন হয়ত আপনার বাড়ির সামনের বাড়িতেই পরশু এক ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন।

শুনেছি।

আচ্ছা আপনাদের এই বাড়িতে উপরে নীচে কখানা ঘর মিঃ চৌধুরী?

ওপরে দুখানা-নীচে দুখানা।

আপনাদের family member কজন?

Family member বলতে আমরা দুজন। আমি আর আমার বুড়ো বাবা।

বাড়ির কাজকর্ম করার লোক নেই?

ঠিকে রাঁধুনী ও ঝি আছে। আর আমার দোকানের একটা বাচ্চা চাকর রাত্রে এখানে এই ঘরে থাকে।

ও। আপনার বুঝি দোকান আছে?

হ্যাঁ। চকে Electric goods-এর একটা দোকান আছে।

হুঁ। ওপরে আপনি কোন ঘরে থাকেন জানতে পারি কি?

রাস্তার ওপরের ঘরটাতেই থাকি।

আচ্ছা সাধারণত কত রাতে আপনি শুতে যান?

রাত বারোটা-একটার আগে বড় একটা আমি ঘুমোই না।

অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন?

হ্যাঁ। বইটই পড়ি আর কি।

পরশু রাত্রে?

তা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত প্রায় জেগে বই পড়েছি।

আপনার ঘরের জানলা খোলা ছিল- mean রাস্তার দিকের জানলাটা?

হ্যাঁ। জানলা-দরজা আমার ঘরের সব সময় ভোলাই থাকে।

মিঃ চৌধুরী, আপনি বলতে পারেন পরশু রাত্রে সাড়ে এগারোটা থেকে রাত বারোটার মধ্যে সামনের বাড়ির দোতলার ঠিক আপনার ঘর থেকে সামনের ঘরে কোন কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন?

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করছেন বলে যেন মনে হয়।

কিরীটীর চোখের দৃষ্টি কিন্তু রণলাল চৌধুরীর ওপরেই নিবদ্ধ থাকে।

মিঃ চৌধুরী, যদি কিছু দেখে থাকেন বা শুনে থাকেন তো বলুন। কারণ আপনি হয়ত নিশ্চয়ই শুনেছেন মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—কিরীটী বলে।

তার মানে! কি আপনি বলতে চান? মার্ডার? সুস্পষ্ট একটা আতঙ্ক রণলাল চৌধুরীর কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।

সত্যিই তাই।

হত্যা! খুন!

হ্যাঁ।

অতঃপর রণলাল চৌধুরী কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে।

ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতার পীড়ন যেন চলেছে।

তাহলে আমি যতটুকু জানি বলাই উচিত। সে রাত্রে দোকান থেকে ফিরতে আমার অন্যান্য দিনের চাইতে একটু রাতই হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে ঢুকতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালতে যাব হঠাৎ একটা তীব্র নীল আলোর ঝাপটায় যেন চোখ দুটো আমার ঝলসে গেল। হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। খেয়াল যখন হল আমার ঘরের খোলা জানালাপথে সামনের বাড়ির ঘরটা দেখলাম অন্ধকার। ব্যাপারটা যে কি ঘটল কিছুই বুঝতে পারলাম না।

শুধু একটা নীল আলোর ঝাপ্টা? আর কিছু দেখেননি বা শোনেননি?

না।

কিছুক্ষণ আবার স্তব্ধতা।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে কিরীটীই, ঐ বাড়ির সঙ্গে আপনার জানাশোনা নেই?

হ্যাঁ। মণিকা দেবীর দিদিমার সঙ্গে পরিচয় আছে। আমিও তাঁকে দিদিমা বলেই ডাকি। এবং উনিও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।

ও! কতদিন এ বাড়িতে আপনারা আছেন?

তা বছর দশেক তো হবেই।

সুবালা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই?

কে? ঐ রাঁধুনী মেয়েটা? রণলালের কণ্ঠে একটা সুস্পষ্ট অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য।

হ্যাঁ।

না মশাই। মেয়ে তো নয় একেবারে পুরুষের বাবা। বিশ্রী ক্যাটকেটে কথাবার্তা!

আচ্ছা রণলালবাবু, অবসর সময় আপনার কেমন করে কাটে?

এই বইটই পড়ে, না হয় ক্লাবে তাস খেলে কাটাই।

তাহলে বই পড়া আপনার অভ্যাস আছে?

অভ্যাস কি বলছেন! চার-চারটে লাইব্রেরীর মেম্বার আমি!

শরৎ চাটুয্যের বই আপনার কেমন লাগে?

কেমন লাগে বলছেন? শরৎবাবুর লেখার আমি একজন গোঁড়া ভক্ত।

চরিত্রহীন বইটা পড়েছেন?

নিশ্চয়ই। বার চার-পাঁচ পড়েছি। সোৎসাহে জবাব দেয় রণলাল।

চরিত্রহীন উপন্যাসে কিরণময়ী সত্যি কাকে ভালবাসত বলে আপনার মনে হয় রণলালবাবু? দিবাকরকে না উপীন্দ্রকে?

কিরণময়ী ভালবাসত উপীন্দ্রকেই। দিবাকরের মত একটা গর্দভকে কোন মেয়েমানুষ ভালবাসতে পারে নাকি?

সুব্রত নিবাক হয়েই রণলালের সঙ্গে কিরীটীর কথাবার্তা শুনছিল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না সুব্রত, হঠাৎ কিরীটী রণলালের মত একজন সদ্যপরিচিত লোকের সঙ্গে শরৎ-সাহিত্য প্রসঙ্গ নিয়ে মেতে উঠল কেন! অথচ এও তো সে জানে এ ধরনের ঘরোয়া আললাচনা কখনও কিরীটী নিজের মনোমত ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে ছাড়া করে না। তার স্বভাববিরুদ্ধ।

আর শিউশরণ তো স্পষ্টই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। এই জন্যই কি হঠাৎ কিরীটী এ সময় বাড়ি হতে বের হয়ে এল।

রণলাল চৌধুরীর সঙ্গেই যদি তার পরিচয় করবার প্রয়োজন ছিল তবে বললেই তো হত তাকে। থানা থেকেই লোক পাঠিয়ে কিরীটী এই লোকটাকে ডেকে নিয়ে যেতে পারত। সেজন্য এ সময়ে এতদূর ছুটে আসবার কি প্রয়োজন ছিল!

আচ্ছা আমরা তাহলে চলি রণলাল। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভারী আনন্দ হল। আর এভাবে হঠাৎ এসে অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করে গেলাম বলে মনে কিছু করবেন না। কিরীটী বিনয়ে যেন বিগলিত হয়ে যায়।

না না বরং আপনাদের সঙ্গেও তো আমার আলাপ হল। অবশ্য আপনারা না এলে আমিই হয়ত যেতাম। কিন্তু জানেন তো, ঠিক সাহস পাইনি। হাজার হোক কেউ স্বেচ্ছায় কি পুলিসের সামনে যায়! বলে রণলাল নিজেই হেসে ওঠে।

রণলালের ওখান হতে বিদায় নিয়ে তিনজনে আবার খোদাইচৌকির দিকেই ফিরছিল।

হঠাৎ একসময় শিউশরণ প্রশ্ন করে, রণলালবাবু যে নীল আলোর কথা বললেন, ব্যাপারটা তোমার কি মনে হচ্ছে কিরীটী? Something electrical ব্যাপার নয় তো? তুমি তো বলছিলে এবং ময়না তদন্তেও প্রকাশ অতুল বোসকে electrocution করে হত্যা করা হয়েছে!

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ। তাই কি?

একবার কাল সকালে মণিকা দেবীদের বাড়িতে অতুল বোস যে ঘরে থাকত সেই ঘরের ইলেকট্রিক কানেকশনটা দেখে এলে হত না?

শিউশরণের কথায় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটা হাসির বঙ্কিম রেখা জেগে ওঠে।

অতুল বোসের মৃত্যু-তদন্তের ব্যাপারে যদিও সুব্রত প্রথম হতেই উপস্থিত এবং তৎসংক্রান্ত সকল প্রকার আলোচনাই সে শুনেছে, সে কিন্তু একটি কথাও বলেনি।এবারের হত্যা-তদন্তে সে যেন এক নীরব দ্রষ্টা ও শ্রোতা মাত্র। তবে মুখে কোনরূপ প্রশ্ন বা মন্তব্য না করলেও মনে মনে সে সমগ্র ব্যাপারটাই নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনায় বিচার বিশ্লেষণে একটা মীমাংসায় পৌঁছবার চেষ্টা শুরু হতেই করে আসছিল।

হঠাৎ একটা কথা সুব্রতর মনে পড়ে। পরশু সকালে মণিকা দেবীদের গৃহ হতে ফেরবার পথে কথাপ্রসঙ্গে কিরীটী বলেছিল: হাই ভোলটের কারেন্টে বেচারার মৃত্যু হয়েছে। প্রমাণের খানিকটা অংশ সরিয়ে ফেললেও হত্যাকারী আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি। কারণ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার কিছুটা মালমসলা তখনও ঐ ঘরে অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু কি সে প্রমাণ! এখন সহসা একটা সম্ভবনা বিদ্যুৎ-চমকের মতই সুব্রতর মনে ভেসে ওঠে: অতুল বোসের মৃতদেহটা চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট ছিল। চেয়ারটি স্টীলের পাত ও রডে তৈরী। ইলেকট্রিক কারেন্টে মৃত্যু। তবে কি ঐ স্টীলের চেয়ারটাই!

কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। না শিউশরণ, তার আর প্রয়োজন নেই। বললাম তো, হত্যাকারী তার নিদর্শন স্বরূপ যে প্রমাণটুকু হয় ইচ্ছা করে অপসারণের প্রয়োজন মনে করেনি অথবা নিয়তিরই নিষ্ঠুর ইঙ্গিতে তাকে আকর্ষণ করেনি বলেই ফেলে রেখে গিয়েছে, সেইখানেই সে ধরা পড়ে গিয়েছে।

কি সে প্রমাণ? কথাটা শিউশরণ না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারে না।

একটা তামার পাতের রিং মত যেটা অতুল বোসের মৃতদেহ যে চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট ছিল তার পায়ার সঙ্গে লাগানো ছিল। মৃদু কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী সহসা যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। কিন্তু যাক সে কথা। আমি ভাবছি হত্যাকারীর দুঃসাহসিক বুকের পাটার কথা। এত বড় দুঃসাহস হল কি করে! একপক্ষে অবিশ্যি ভালই হয়েছে, একটা জায়গায় এসে আমি হোঁচট খাচ্ছিলাম বার বার। ঠিক রাত কটায় অতুলকে হত্যা করা হয়েছে! এখন বুঝতে পারছি রাত সাড়ে এগারোটা থেকে রাত পৌনে বারোটার মধ্যেই।

বলতে বলতে সহসা শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, বুঝলে শিউশরণ, এ হত্যার পরিকল্পনা একদিনের বা হঠাৎ কোন এক বিশেষ মুহূর্তের আকস্মিক নয়। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে স্থিরীকৃত। কিন্তু তার পশ্চাতে আছে হয়ত কোন বিচিত্র অনুভূতির গোপন পীড়ন যেটা দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে হত্যাকারীর মনের অবগহনে তার হত্যার মতই একটা পাশবিক জিঘাংসা বা লিন্সাকে জাগিয়ে তুলেছে। সঙ্কল্প হয়েই ছিল শুধু মাত্র সুযোগের ও স্থানের অপেক্ষা, সেই সুযোগ ও স্থান মিলে গেল এবারে পূজাবকাশের ছুটিতে কাশীতে। হত্যাকারীর মনের মধ্যে যে বিচিত্র সঙ্কল্পটা বিষের ধোঁয়ার মতই ধোঁয়াচ্ছিল, যেটা ছিল কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট, বিচিত্র অনুকূল পরিবেশে সেটা অকস্মাৎ হয়তো কোন কারণে নখদন্ত বিস্তার করে আত্মবিকাশ করেছে। এবং আমার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে বোধ হয় হত্যা করবার জন্য যে পরিকল্পনাটুকু হত্যাকারী করেছে সেটা পূর্বপরিকল্পিত নয়, হঠাৎই হয়ত তার মনে সম্ভাবনাটুকু উদয় হওয়ায় কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে পরিকল্পনাটা। And it became successful! হতভাগ্য অতুল বোসের মৃত্যু ছিল ঐরূপ এক দুর্ঘটনাতেই, ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনা। কথাগুলো একটানা বলে কিছুক্ষণ কিরীটী স্তন্ধ থাকে। তারপর আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, একটি ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করব। এবং আশা করি তারপরই এ রহস্যের ওপরে যবনিকা ভোলা যাবে।

.

দিন দুই পরে। অহল্যাবাঈ ঘাট, রাত্রি বোধ করি এগারোটা হবে। স্থানটি ঐ সময় একপ্রকার নির্জন বললেও হয়। চাঁদ উঠতে দেরি আছে। শুক্লপক্ষের মেঘমুক্ত আকাশে একরাশ তারা ঝিকমিক করে জ্বলছে। গঙ্গার জলে পড়েছে সেই আকাশের তারার স্তিমিত আলোর ক্ষীণ দীপ্তি।

ঘাটের কাছে পর পর দুটি নৌকো বাঁধা। অস্পষ্ট আলোছায়ায় সেই নৌকোর সামনে একটি নারীমূর্তি উপবিষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পশ্চাতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দীর্ঘকায় কে একজন সিঁড়ি ভেঙে ঘাটের কাছে নেমে আসছে। একজন পুরুষ। পুরুষ নারীর পশ্চাতে এসে দাঁড়াল। অস্পষ্ট আলোছায়ায় তাকেও ভাল করে চেনা যায় না। নারীমূর্তি ফিরে তাকাল, কে?

আমি।

ও, তুমি! এস, বস। নারী আহ্বান জানাল।

কিন্তু কি ব্যাপার বল তো! এভাবে এই জায়গায় চিঠি দিয়ে দেখা করবার জন্য ডেকে আনবার মানে কি? যা বলবার আমার ঘরে রাত্রে এসেও তো বলতে পারতে। পুরুষ বলে।

না। বলতে পারতাম না তার কারণ কারও না কারও নজরে পড়ে গেলে পরের দিন সকালে তুমি বা আমি কেউই কি আর মুখ দেখাতে পারতাম! আর যাই করি এত বড় নির্লজ্জ অন্তত দিদিমার সামনে হতে পারতাম না।

কিন্তু এখনও আমি বুঝতে পারছি না, মণি, এভাবে এত রাত্রে এ জায়গায় কেন তুমি ডেকে এনেছ আমাকে!

কেন ডেকে এনেছি জান? অতুলের মৃত্যুর ব্যাপারটা একবার ভোলাখুলি তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।

আশ্চর্য! সে আলোচনার জন্য এইভাবে এত রাত্রে চিঠি লিখে গঙ্গার ঘাটে ডেকে আনবার কোন প্রয়োজনই তো ছিল না মণি।

ছিল।

কেন?

কারণ লোক-নিন্দা ও লোকেদের কথা ছেড়ে দিলেও একটা কথা আমাদের তিনজনের একজনও কি অস্বীকার করতে পারব যে, আমাদের তিনজনের মধ্যেই একজন অতুলের এই নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী?

সত্যিই কি তুমি তাই মনে কর মণি?

কিরীটীবাবু মনে করেন। গতকাল তাই তিনি আমাকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

মিঃ কিরীটী রায় আর কি মনে করেন? নিশ্চয়ই আমাদের তিনজনের মধ্যে যে হত্যাকারী তাকেও তিনি তাঁর অপূর্ব বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে সনাক্ত করে ফেলেছেন! বলেই ফেল না! সে কথাটাই বা লুকোচ্ছ কেন? আমাদের তিনজনের মধ্যে কে? তুমি, আমি, না রণেন?

পুরুষ আর কেউ নয়, সুকান্ত। এবং নারী মণিকা।

সুস্পষ্ট ব্যঙ্গে সুকান্তর কণ্ঠস্বর এবারে আরও কঠিন মনে হয়, কিন্তু সেই কারণে এমনি করে এই রাত্রে গঙ্গার ঘাটে টেনে এনে এ নাটক সৃষ্টি না করলেও পারতে মণি। এবারে তোমাকে আমি সত্যিই বলছি, এই তেলাপোকা আর কাঁচপোকার নাটক এখানেই আমি শেষ করতে চাই। আমার কি ইচ্ছে হচ্ছে জান? একজন তো গেছেই, বাকি দুজনকেও শেষ করে অবশেষে নিজেকে হত্যা করে এই নবৎসরের নাটকের ওপর যবনিকা টেনে দিই। আসলে তুমি কি জান মণিকা! একটি harlot!

সুকান্ত!

চেঁচিয়ে কোন লাভ নেই মণিকা। এখন দেখতে পাচ্ছি চিঠি দিয়ে আজ রাত্রে এখানে তুমি আমাকে ডেকে এনে একপক্ষে ভালই করেছ। আমাদের চারজনের এই নাটকের শেষ দৃশ্যটুকু তোমাকে ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারব। অপূর্ব এক ভালবাসার অভিনয় তুমি এই দীর্ঘ নবৎসর ধরে করছ। সত্যিই তুমি অনন্যা!

সুকান্ত! আর্ত করুণ কণ্ঠে যেন চিৎকার করে ওঠে মণিকা।

থাম। শোন, মনে পড়ে তোমার দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের কথা! সে রাত্রের ঘটনার জন্য পরে আমি অনুতপ্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, হয়ত আমাদের তিনজনের মধ্যে আমাকে বাদ দিয়ে অতুল বা রণেনকে তুমি মনে মনে ভালবাস, কিন্তু তুমি অগ্রসর হতে পারছ না আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বের কথা ভেবেই। পাছে আমাদের দুজনের মনে আঘাত লাগে একজনকে তুমি বরণ করলে। পরে বুঝেছিলাম ভুল আমারই। ভালবাসা তোমার চরিত্রে নেই। ভালবাসতে তুমি কাউকেই কোনোদিন পারবে না। ভালবাসতে হলে যে মনের দরকার, যে কোমল অনুভূতির প্রয়োজন সেইখানেই ঝুলি তোমার শূন্য। সেইখানেই তোমার চরিত্রের পরম দৈন্য। যে নারীর মনে ভালবাসার অনুভূতি নেই অথচ রূপ ও যৌবন আছে, সে বিকৃত মনেরই সমগোত্রীয়। তাই তোমার সংসর্গে যা অবশ্যম্ভাবী তাই ঘটেছে, অতুল নিহত হয়েছে। এবার হয়ত আমাদের পালা কিন্তু অতদূর আমি গড়াতে দেব না।

সুকান্তর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।

সভয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে মণিকা ভয়ার্ত ব্যাকুল কণ্ঠে, সুকান্ত! সু—

হাঃ হাঃ করে বজ্রকণ্ঠে হেসে ওঠে সুকান্ত। হাসির শব্দটা একটা প্রতিধ্বনি তুলে নির্জন অহল্যাবাঈ ঘাট হতে নিশীথের গঙ্গাবক্ষের উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ে।

হ্যাঁ, নির্জন এই অহল্যাবাঈ ঘাটে গঙ্গার উপকূলে কেউ নেই। তোমাকে গলা টিপে হত্যা করে অন্ধকারে ঐ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাব। হাঃ হাঃ! আবার পাগলের মত অট্টহাসি হেসে ওঠে সুকান্ত। এগিয়ে গিয়ে সুকান্ত মণিকার ডান হাতের সুকুমার মণিবন্ধটা চেপে ধরে লৌহ-কঠিন মুষ্ঠিতে।

সুকান্ত! সুকান্ত—আমি-মণিকা ব্যাকুল কণ্ঠে কি যেন বলবার চেষ্টা করে।

কেই শুনতে পাবে না। কেই জানতে পারবে না—দুহাতে মণিকার গলাটা টিপে ধরে সুকান্ত।

ঠিক এমনি সময় ঘাটের কাছে অন্ধকারে যে নৌকো দুটো বাঁধা ছিল তার একটার মধ্যে একটা ঝটাপটির শব্দ শোনা যায় এবং পরক্ষণেই কে একজন ব্যাঘ্রের মত ঘাটের ওপরে নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়ে সুকান্তকে আক্রমণ করে।

সুকান্ত, ছাড়। ছাড়—খুনী শয়তান–

সঙ্গে সঙ্গে প্রায় নৌকোর ভেতর থেকে কিরীটী, শিউশরণ ও সুব্রত ঘাটের সিঁড়ির উপর লাফিয়ে পড়ল। রণেনের আক্রমণ থেকে সুকান্তকে মুক্ত করে দেয় কিরীটী।

সুকান্ত ও রণেন দুজনেই তখন হাঁফাচ্ছে।

রণেন কিন্তু চেঁচিয়ে বলে, না না ওকে ছাড়বেন না মিঃ রায়। সুকান্ত–সুকান্তই অতুলকে হত্যা করেছে।

.

আরও আধ ঘণ্টা পরে রণেন, সুকান্ত ও মণিকাকে নিয়ে কিরীটী ও শিউশরণ থানায় গিয়ে হাজির হল। থানার অফিসঘরে সকলে প্রবেশ করে এবং কিরীটী সকলকে বসতে অনুরোধ করে।

আরও কিছুক্ষণ পরে কিরীটী বলতে শুরু করে, আজ রাত্রে কিছুক্ষণ আগে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সে জন্যে আমি বিশেষ দুঃখিত এবং আপনাদের তিনজনের কাছেই সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। অতুলবাবুর মৃত্যুরহস্যের উদঘাটনে পৌঁছবার জন্য আমি ছোট্ট একটা একত্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে একত্সপেরিমেন্টের সমাপ্তিটা যে এমন বিশ্রী তিক্ত ব্যাপারে গিয়ে দাঁড়াবে সত্যি আমি তা ভাবিনি। আপনারা তিনজনেই বিশ্বাস করুন আজকের ক্ষণপূর্বে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে একসপেরিমেন্টের পরিকল্পনা আমি করে মণিকা দেবীকে দিয়ে সুকান্তবাবুকে রাত্রে গঙ্গার ঘাটে দেখা করবার জন্য চিঠি দিইয়ে এবং নৌকো ভাড়া করে সেই নৌকার মধ্যে অন্ধকারে রণেনবাবুকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলাম, সবটাই এই সৎ উদ্দেশ্যেই করেছিলাম যে আজকের এই ছোট্ট একসপেরিমেন্টের ভেতর দিয়েই আমরা অতুলবাবুর হত্যারহস্যের একটা মীমাংসায় পৌছাব এবং হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারব। যদিও হত্যাকারী কে আমরা বুঝতে পেরেছি তাহলেও কিছুক্ষণ পূর্বে গঙ্গার ঘাটে আপনাদের তিনজনকে কেন্দ্র করে যে অপ্রীতিকর ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা এখন বুঝতে পারছি অবশ্যম্ভাবীই হয়ে উঠেছিল। এবং ঐ অপ্রীতিকর ব্যাপারটা আজ রাত্রে গঙ্গার ঘাটে না ঘটলেও দু-এক দিনের মধ্যেই যে ঘটত সে বিষয়ে এখন আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

কিরীটীর কথাগুলো যেন রণেন, সুকান্ত ও মণির কর্ণকুহরে গলিত সীসের মতই প্রবেশ করল।

তিনজনেই ওরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নির্বাক। কিরীটী কিন্তু ওদের কারোর দিকেই তাকাচ্ছে না। ওদের যেন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগে ব্যস্ত।

সমস্ত ঘরটার মধ্যে যেন একটা শ্বাসরোধকারী আবহাওয়া জমাট বেঁধে উঠেছে। সিগারেটটায় অগ্নিসংযোগ করে তাতে গোটা দুই টান দিয়ে হঠাৎ কিরীটীই নিজের রচিত শ্বাসরোধকারী ঘরের মৃত্যুশীতল স্তব্ধতাটা ভেঙে দিল, অতুলবাবুর হত্যার পশ্চাতে আছে একটা দীর্ঘদিন ধরে লালিত হিংসা। দিনের পর দিন দীর্ঘ কয়েক বৎসর ধরে তিনটি পুরুষের মনের অবগহনে একটি নারীকে কেন্দ্র করে চলেছিল এক হিংসার কুটিল ভয়ঙ্কর বিষমন্থন। শুনে আশ্চর্য হবেন না আপনারা কেউ, অতুলবাবু নিহত না হয়ে রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু আপনাদের দুজনের একজন নিহত হতে পারতেন। এবং অতুলবাবু নিহত না হয়ে আপনাদের মধ্যে একজন কেউ নিহত হলে, অতুলবাবু ও অন্য একজনকে হয়ত আজকের এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত। আজকের এই পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, প্রত্যেকেই আপনারা তিন বন্ধু আপনাদের ঐ বান্ধবীর জন্য পরস্পরের প্রতি দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে নিরতিশয় ঘৃণা ও হিংসা পোষণ করেছেন। হয়ত বা মনে মনে কত সময় পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করবার সঙ্কল্পও করেছেন। কিন্তু হত্যার সঙ্কল্প করলেই কিছু হত্যা করা যায় না। তার জন্য চাই ক্ষণিক একটা বিকৃত উন্মাদনা, ভয়ঙ্কর একটা প্রতিজ্ঞা। এ তো হঠাৎ হত্যা করা নয়। এ যে স্থির মস্তিষ্কে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হত্যায় লিপ্ত হওয়া। ভাবুন তো একবার বাইরে বন্ধুত্বের মুখোশ এঁটে মনের মধ্যে সন্তর্পণে হত্যার জন্য ছুরি শানিয়েছেন। দিনের পর দিন মনের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড হিংসা ও ঘৃণা পোষণ করে বাইরে ভালবাসা ও প্রেমের চটকদার অভিনয় করেছেন। এবং আজ রাত্রে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা দীর্ঘদিনের ঐ গোপনে মনের মধ্যে লালিত পরস্পরের প্রতি পরস্পরের প্রচণ্ড হিংসা ও ঘৃণা ঐ মণিকা দেবীকে কেন্দ্র করে।

কিরীটী কথাগুলো বলে ক্ষণকালের জন্য চুপ করে থাকে।

হঠাৎ রণেনবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, উঃ,ঘরের মধ্যে বিশ্রী গরম! জানলাগুলো একটু খুলে দিতে বলুন না। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ঘরের তিনটে জানলার মধ্যে দুটো জানলার কবাটগুলো খোলাই ছিল, বাকি জানলার পাল্লা দুটোও এগিয়ে গিয়ে কিরীটী হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিল।

ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কটায় ঢং ঢং করে রাত তিনটে ঘোষণা করল। ইতি মধ্যেই রাত্রিশেষের প্রহরগুলিতে শিশিরের একটা সিক্ততা দেখা দিয়েছে। একটা আর্দ্র ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব।

নিস্তব্ধ সকলে একে অন্য হতে অল্প অল্প ব্যবধানে বসে আছে ঘরের মধ্যে। তিনটি ফাঁসির আসামী যেন রাত পোহালে ফাঁসি হবে তারই অধীর ব্যাকুল প্রতীক্ষ্ণয় প্রহর গুনছে। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তিনটি প্রাণহীন পুতুল যেন।

কিরীটীর কঠিন নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, শুধু আপনারাই ঐ দোষে দোষী নন রণেনবাবু, সুকান্তবাবু। সর্বত্র চলেছে আজ ঐ হিংসার কুটিল আবর্ত। যুগ যুগ ধরে মানুষের শুভবুদ্ধির ও ভালবাসার দুশ্চর তপস্যা ব্যর্থ হয়েছে। হিংসা! হিংসা: হিংসা সর্বত্র! বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে অতুলবাবুর হত্যার ব্যাপারে ফিরে আসি।

শিউশরণ এখানে বাধা দেয়, কিন্তু–

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বুঝেছি তোমার খটকা কোথায় লাগছে শিউশরণ! ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আর কেউ নয় হত্যাকারীই স্বয়ং সকলের চোখে ধুলো দেবার জন্য ঐ বেশ নিয়েছিল।

তারপর একটু থেমে যেন দম নিয়ে তার অসমাপ্ত বক্তব্যে ফিরে আসে, আমার মনেও ঐখানেই খা লেগেছিল। এবং সেইজন্যই আসলে ছোট একটা একসপেরিমেন্টের আয়োজন করেছিলাম আজ রাত্রে আমি গঙ্গার ঘাটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাতে করে অতুলবাবুর নৃশংস হত্যারহস্যের জটিল অংশের দুইয়ের তিন অংশ পরিস্কার হয়ে গেলেও বাকি ও শেষ অংশটুকু এখনও অস্পষ্টই আছে। এবং সেইজন্যই গঙ্গারঘাট হতে সকলকে নিয়ে আমি এখানে এসে মিলিত হয়েছি। তারপর হঠাৎ শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, বাইরে এইমাত্র পদশব্দ পেলাম। দেখ উনিও বোধ হয় এসে গেলেন। তাঁকেও এই ঘরে নিয়ে এস, যাও।

বিস্মিত নির্বাক সকলের সামনে দিয়েই শিউশরণ ঘর হতে বের হয়ে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুবালা দেবীকে নিয়ে ঐ ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

যুগপৎ ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সকলেই নির্বাক বিস্ময়ে সুবালা দেবীর দিকে তাকাল নীরব দৃষ্টি তুলে। শিউশরণ তার চেয়ারটাই এগিয়ে দিল সুবালাদেবীর দিকে, বসুন।

কেবল মণিকার কঠ হতে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ, সুবালাদি!

বসুন সুবালা দেবী। কিরীটী বললে।

নিঃশব্দে সুবালা দেবী শিউশরণের খালি চেয়ারটায় উপবেশন করে।

মণিকা দেবী, সুবালা দেবী, রণেনবাবু, সুকান্তবাবু আপনারা সকলেই উপস্থিত এখানে সে রাত্রে যাঁরা ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিলেন। একটা কথা না বলে পারছি না, সকলেই আপনারা সেদিনকার আপনাদের প্রদত্ত জবানবন্দিতে কিছু কিছু গোপন করেছেন। একান্ত পৈশাচিক ভাবেই সে রাত্রে আপনাদেরই চারজনের মধ্যে একজন অতুলবাবুকে হত্যা করেছেন। এবং এও আমি জানি আপনাদেরই মধ্যে কে তাঁকে হত্যা করেছেন। তাই আবার আজ এখন শেষ অনুরোধ আপনাদের জানাচ্ছি, এখনও আপনারা যে যা গোপন করেছেন খুলে বলুন। অকাট্য প্রমাণ দিয়ে আমায় সাহায্য করুন হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেবার।

কিরীটীর শেষের কথাগুলো যেন ঝমঝম্ করে ঘরের মধ্যে একটা বজ্রের হুঙ্কার ছড়িয়ে গেল।

সকলেই স্তব্ধ। নির্বাক। কারও মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই।

সহসা সুকান্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘরের খোলা দরজার দিকে পা বাড়ায়। কিরীটীর কঠিন কণ্ঠ শোনা গেল, ঘর ছেড়ে যাবেন না সুকান্তবাবু! বসুন!

তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কণ্ঠে সুকান্ত চেঁচিয়ে ওঠে, No, No! This is simply inhuman torture!I cant stand it any more!I cant!

না, আপনার এখন যাওয়া হতে পারে না। এগিয়ে আসে এবারে শিউশরণ।

শিউশরণকে দুহাতে পাগলের মতই ঠেলে ঘর হতে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায় সুকান্ত, Let me go! Let me go! যেতে দিন, আমাকে যেতে দিন!

এবারে এগিয়ে এল রণেন, না, না। দাঁড়াও সুকান্ত। যদি আমাদের তিনজনের মধ্যেই একজন সত্যিই অতুলের হত্যাকারী হই—let that be decided once for all!

খিঁচিয়ে ওঠে সুকান্ত, decide করবে? কি decide করবে শুনি যে আমরাই একজন অতুলকে বন্ধু হয়ে হত্যা করেছি? ছিঃ ছিঃ! এর চেয়ে গলায় দড়ি দাও তোমরা।

এবারে মণিকা বলে, সুকান্ত, রণেন,তোমরা কি পাগল হলে?

সহসা রণেন ঘুরে দাঁড়ায় মণিকার কথায় তার দিকে এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে, খেপবার আরও কি কিছু বাকি আছে মণিকা! তবু যদি সে রাত্রে তোমাকে আমি সকলে শুতে যাবার পর অতুলের ঘর থেকে আমার ও তার ঘরের মধ্যবর্তী দরজা দিয়ে দ্রুতপদে বের হয়ে তোমার শোবার ঘরে যেতে না দেখতাম!

কি বলছো তুমি রণেন! বিস্ময়ে যেন চেঁচিয়ে ওঠে মণিকা।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। অন্ধকার ঘর দেখে ভেবেছিলে তখনও বুঝি আমি ঘরে ঢুকিনি! তখনও বুঝি আমি বাথরুম থেকে ফিরিনি। কিন্তু সব—সব আমি দেখেছি। তুমি আমার চোখের সামনে দিয়ে ঘরের এক মাঝের দরজা দিয়ে অতুলের ঘর থেকে বের হয়ে অন্য মাঝের দরজা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলে। দেখেছি, আমি সব দেখেছি।

রণেন! রণেন,এসব তুমি কি বলছ! আমি তোমরা—তুমি ও অতুল ঘর ছেড়ে চলে আসবার পর প্রায় আধঘণ্টা সুকান্তর ঘরে দাঁড়িয়েই গল্প করেছি।

হ্যাঁ, she is right! সমর্থন করে সুকান্ত।

শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করা আর বৃথা সুকান্ত। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে রণেন।

না, মিথ্যে নয়। যা বলেছি তা সত্যি। মণিকা আবার বলে।

থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে। ঘৃণাভরে মুখ ফেরায় রণেন।

এতক্ষণে কিরীটী কথা বলল, না রণেনবাবু, মণিকা দেবী, সুকান্তবাবু ও আপনি কেউই আপনারা মিথ্যে কথা বলেননি। কিন্তু এ কথাগুলো সে দিন জবানবন্দির সময় প্রত্যেকে আপনারা যদি গোপন না করতেন তবে এত কষ্ট করতে হত না আমাকে হত্যাকারীকে ধরতে। কথাটা বলে কিরীটী এবং শিউশরণের মুখের দিকে তাকাল এবং নিঃশব্দে চোখে চোখে কি যেন ইঙ্গিত জানাল এবং শিউশরণ নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে গেল।

এবারে সুবালা দেবী, এঁরা সকলেই যেটুকু যা গোপন করেছিলেন বললেন। আপনিও যা গোপন রেখেছেন বলুন! কিরীটী কথাগুলো বললে সুবালা দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি যা জানতাম সব বলেছি। শান্ত ধীর কণ্ঠস্বর।

না, বলেননি। আপনি এখনও বলেন নি কেন আপনি সে রাত্রে অতুলবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন!

মিথ্যে কথা। তার ঘরে আদৌ আমি যাই নি সে রাত্রে।

কিন্তু সাক্ষী যে আছে সুবালা দেবী!

ঠিক এই সময় শিউশরণের সঙ্গে রণলাল চৌধুরী এসে সেই ঘরে প্রবেশ করল, এসবের মানে কি দারোগাবাবু! সেই সন্ধ্যা থেকে থানায় এনে আমাকে আটকে রেখেছেন! ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে রণলাল। তার কণ্ঠে রীতিমত বিরক্তি।

কি করি বলুন রণলালবাবু! সে রাত্রে যদি সত্যি কথাটা বলতেন তবে মিথ্যে কষ্ট দিতে হত না আপনাকে। জবাব দেয় কিরীটী।

তার মানে? এসব কি আপনি বলছেন?

ঠিকই বলছি। সুবালা দেবী স্বীকার যাচ্ছেন না যে সে রাত্রে সুবালা দেবী অতুলবাবুর ঘরে বসে অন্ধকারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু আপনি তো সব দেখেছেন। Eye witness! আপনিই বলুন না?

কিরীটীর কথায় রণলাল ও সুবালা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে তারা কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরের প্রতি নিষ্পলক স্থির দৃষ্টিতে।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলে যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। সকলেই নির্বাক। বিমূঢ়।

এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করে সুবালা।

এখনও বুঝতে পারছেন না? আশ্চর্য! সুবালা দেবী, আপনি একজন পাকা অভিনেত্রী সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনার, ধর্মের কল বাতাসেই নড়েছে। এত করেও আপনি সব দিক বজায় রাখতে পারেননি।

কিরীটীবাবু? তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে মণিকা।

হ্যাঁ মণিকা দেবী, অতুলের হত্যাকারিণী উনিই। সুবালা দেবী। অবশ্য পরিকল্পনাটি ওঁর নয়, ওনার। রণলালবাবুর। এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকারই যুগ্ম প্রচেষ্টায় অতুলবাবু নিহত হয়েছেন।

বলেন কি! প্রশ্নটা সকলেই প্রায় একসঙ্গে করে।

মৃতু-ফাঁদ পেতেছিলেন রণলাল তাঁরইপ্রেমিকা সুবালার অনুরোধে। তারপর সেই মৃত্যুফাঁদকে সক্রিয় করে তোলেন উনি শ্রীমতী সুবালা দেবী। কিরীটী জবাব দেয়।

হঠাৎ ঐ সময় পাগলের মত চীৎকার করে ওঠে রণলাল সুবলার দিকে তাকিয়ে, হারামজাদী! তবে তুই সব বলেছিস? তোকে আমি খুন করব!

বলতে বলতে অতর্কিতে রণলাল ঝাঁপিয়ে পড়ে সুবালার ওপরে এবং তার কণ্ঠ টিপে ধরে দুহাতে। কিন্তু কিরীটী সতর্ক ছিল, নিমেষে সে এগিয়ে দুজনের মধ্যখানে এসে পড়ে এবং বলপ্রয়োগে রণলালকে ছাড়িয়ে দেয়। রণলালকে পুলিসের প্রহরায় অতঃপর একটা চেয়ারের উপর বসিয়ে কিরীটী বলে, বসুন রণলালবাবু। প্রেমের গতিটা বড় কুটিল! চরিত্রহীনের দিবাকরকে বুঝেও যে কেন আপনি বুঝতে পারলেন না, সত্যিই লজ্জার কথা। কিরণময়ী দিবাকরকে ভালবাসেনি কোনদিনও, ভালবেসেছিল সে উপেনকেই অর্থাৎ অতুলবাবুকেই।

সুবালাদি! মণিকার কণ্ঠ হতে কথাটা আর্ত চিৎকারের মতই শোনাল।

হ্যাঁ, মণিকা দেবী। বিধবা কিরণময়ীর উপেনকে সেই ভালবাসাই হল কাল। হতভাগিনী কিরণময়ী যেমন জানত না যে উপনের সমস্ত মন জুড়ে ছিল পশু বৌঠান, তেমনি সুবালাও জানতেন না যে অতুলের সমস্ত মন জুড়ে ছিল মণিকা দেবী। তাছাড়া আরও একটা মারাত্মক ভুল সুবালা করেছিলেন, স্বৈরিণীর মত উপচিকা হয়ে নিজেকে এক শিক্ষিত মার্জিত অন্যের প্রেমে অন্ধ পুরুষের সামনে দাঁড় করিয়ে।

আবার রণলাল চেঁচিয়ে ওঠে, স্বৈরিণী! মনে মনে তবে তুই অতুলকেই চেয়েছিস! আমাকে নিয়ে কেবল খেলাই করেছিস! উঃ! কি বোকা আমি! কি বোকা!

হ্যাঁ, বড় মারাত্মক খেলা! মৃদু হেসে কিরীটী বলে।

কিন্তু তবে—তবে সুবালাদি অতুলকে খুন করলে কেন? আবার মণিকাই প্রশ্ন করে।

সেটা সুবালা দেবী বলতে পারবেন না হয়ত। কিন্তু আমি জানি। কিন্তু আজ আর নয়। রাত পোহাল। এবারে আপনারা বাড়ি যান সকলে।

সমস্ত দৃশ্যটার উপরে কিরীটী তখনকার মত একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিতে চাইল।

কিন্তু শেষটুকু না শুনে কেউ যেতে রাজী নয়।

কিরীটী তখন অদূরে পাষাণপ্রতিমার মত নিশ্চল উপবিষ্ট সুবলার দিকে আর একবার তাকাল।

হতাশা অপমান ও দুর্নিবার লজ্জায় উপবিষ্ট সুবালার মাথাটা বুকের উপরে ঝুলে পড়েছে।

নিষ্ফলা এক নারীর পক্ষে এ যে কত বড় মর্মঘাতী কিরীটী তা বুঝতে পারে। মৃদুকণ্ঠে তাইসে শিউশরণকে লক্ষ্য করে বললে, এদের দুজনকেই তাহলে অন্যঘরে রেখে এস শিউশরণ।

শিউশরণের নির্দেশে তখন রণলাল ও সুবালা স্থানান্তরিত হল।

তাহলে এবারে আপনাদের বলি সব কথা। কিরীটী বলতে শুরু করে ব্যর্থ প্রেমের এক মর্মন্তুদ কাহিনী। হতভাগিনী সুবালা! I pity her! জ্বলন্ত আগুনের মত রূপ নিয়ে এসেও সে হল নিষ্ফলা। কিন্তু যৌবন তার সহজাত কামনার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিল তার দেহ ও মনে। সেই অতৃপ্ত কামনার আগুন বুকে নিয়ে সুবালা এসে মণিকা দেবীর দিদিমার কাছে আশ্রয় নিল। দিন কেটে যাচ্ছিল একরকম করে, এমন সময়ে পাশের বাড়ির রণলাল চৌধুরী সুবালার সামনে এসে দাঁড়াল। সুবালার আগুনের মত রূপে রণলাল মুগ্ধ পতঙ্গের মতই পুড়ে ঝলসে গেল কিন্তু অর্ধশিক্ষিত মিস্ত্রী রণলাল সুবালার মনকে পুরোপুরি আকর্ষণ করতে পারল না। বোধ হয় রুচির সংঘাত।

সুবালার মনের মধ্যে ছিল একটা পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ, তাই সে তার অতৃপ্ত যৌনকামনায় জ্বলতে থাকলেও রণলালকে গ্রহণ করতে পারলে না মন থেকে। কিন্তু একেবারে হাতছাড়াও করলে না সম্ভবত রণলালকে। মুগ্ধ পতঙ্গকে আকর্ষণ করবার যে এক ধরনের তৃপ্তি—পুরুষকে আকর্ষণ করবার যে সহজাত নারীতৃপ্তি মনে মনে সেটাই সুবালা উপভোগ করতে লাগল রণলালকে দিয়ে। কিন্তু হতভাগ্য প্রেমমুগ্ধ রণলাল সুবালার মনের আসল সংবাদ না পেয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, সুবালা তার করায়ত্ত!

এমনি যখন অবস্থা, মণিকা দেবীর আমন্ত্রণে অতুলবাবু, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু এলেন সেবারে কাশীতে। এবং বলাই বাহুল্য সুবালা সত্যি সত্যিই এবারে অতুলবাবুর প্রতি আকৃষ্ট হল। এবং সে আকর্ষণ ক্রমে বর্ধিত হয়ে চলল মণিকা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও তার সেবার মধ্য দিয়ে অতুলবাবুর কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে। সৌভাগ্যক্রমে এ সংবাদ আমার গোচরীভূত হয় তদন্তের দিন অতুলবাবুর সুটকেস হাতড়াতে গিয়ে, তাঁর সুটকেসের মধ্যে তাঁর স্বহস্তলিখিত রোজনামচাখানি পেয়ে ও পড়ে। অতুলবাবুও যে সুবালার রূপে প্রথম দিকে কিছুটা আকর্ষিত হননি তা নয়, কিন্তু তাঁর মণিকা দেবীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম শিক্ষা ও রুচি তাঁর মনের ওপরে করাঘাত হেনে তাঁকে সজাগ করে দিল। তিনি সজাগ হয়ে সরে গেলেন।

রুদ্ধ নিশ্বাসে সকলে কিরীটীর কথা শুনছে। বোবা বিস্ময়ে সকলেই নির্বাক।

কিরীটী পকেট হতে সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করলে। জ্বলন্ত সিগারটায় গোটাকয়েক টান দিয়ে আবার তার বক্তব্য শুরু করল।

যা বলছিলাম, অতুলবাবুও সাবধান হলেন কিন্তু সুবালা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার আর ফেরবার পথ ছিল না। এবং সোজাসুজি ভালবাসা বিকারে একদিন সুবালা অতুলবাবুর হাত চেপে ধরলে। অতুলবাবু জানালেন প্রত্যাখ্যান। প্রত্যাখ্যানের লজ্জা ও অপমান নিয়ে সুবালা ফিরে এল আর সেই লজ্জা ও অপমানের ভিতর হতে জন্ম নিল এক ভয়ঙ্কর কুটিল প্রতিহিংসা, পদাহতা নারী সর্পিণীর মত ছোবল তুলল। এই প্রতিহিংসা-অনলে ইন্ধন যোগায় দুটি বস্তু—এক অতুলের প্রত্যাখ্যান আর দুই মণিকা দেবীর চাইতে ঢের বেশী রূপবতী হয়েও অতুলকে আকর্ষণ না করতে পারায় মণিকা দেবীর কাছে তার পরাজয়।

প্রতিহিংসার ঐ আগুন তিন বৎসর ধরে সুবালা বুকের মধ্যে পুষে রেখেছে সুযোগের প্রতীক্ষ্ণয়। সেই সুযোগ এল এবারে যখন আবার আপনারা সকলে কাশীতে এলেন। এবং খুব সম্ভবত হয়ত অতুলবাবুর প্রতি প্রতিহিংসা নেবার জন্য সুবালা রণলালের শরণাপন্ন হয়। কারণ যেভাবে অতুলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে সে পরিকল্পনা কোন নারীর মস্তিষ্ক-উদ্ভুত যে নয় এ ধারণা আমার প্রথম দিনই হয়েছিল। তাই প্রথম দিনই সন্দেহের তালিকা থেকে মণিকাদেবীকে আমি বাদ দিয়েছিলাম। যাহোক তারপর রণলালের আবির্ভাব ঘটল রঙ্গভূমে। এবং রণলালেরই পরামর্শমত, অবশ্য সবই আমার অনুমান, সুবালা কোন কিছুর সাহায্যে অতুলবাবুর ঘরের আলোটা নষ্ট করে মিস্ত্রীবেশী রণলালের প্রবেশের সুযোগ করে দেয় ওদের বাড়িতে। সুযোগমত মিস্ত্রীরূপী রণলাল রঙ্গভূমে প্রবেশ করে সবার অলক্ষ্যে মৃত্যু-ফাঁদ পেতে রেখে গেল।

পূর্বেই বলেছি অতুলবাবুকে হত্যা করা হয় বৈদ্যুতিক কারেন্ট প্রয়োগে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী রণলালের পক্ষে হাইভোল্টের পরিকল্পনাটি কার্যকরী করা সহজই ছিল এবং সম্ভবতপরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে যত রাজ্যের ট্র্যাশ ইংরাজী পেনী সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনীর বাংলা অনুবাদ পড়ে পড়ে। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে হত্যার ব্যাপারে ফিরে আসি।

অতুলবাবুর ঘরে বসবার লোহার চেয়ারটার পায়ার সঙ্গে ও ঘরের অলোর সুইচবোর্ডের সঙ্গে একটা তামার পাত ও তারের সাহায্যে যোগাযোগ করে রাখা হয়েছিল এমন ভাবে যে, বেচারী অতুলবাবু ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ইলেকট্রিক কারেন্টে তরঙ্গায়িত সেই চেয়ারটায় একটিবার গিয়ে বসলেই আর তাঁর পরিত্রাণ থাকবে না। Direct 220 Volt. A.C. current—অপূর্ব, নিষ্ঠুর, অব্যর্থ মৃত্যুফাঁদ। এইখানে হত্যাকারী একটু risk নিয়েছে। যদি অতুলবাবু চেয়ারে একেবারেই না সে রাত্রে বসতেন! সেই ভেবেই হত্যাকারী পূর্ব হতেই বোধ হয় অতুলবাবুর ঘরে ঢুকে অন্ধকারে তাঁর শয্যার উপরে নিঃশব্দে বসেছিল অতুলবাবুর অপেক্ষায়।

অতুলবাবু ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলেই ঘরের মধ্যে হত্যাকারীকে দেখতে পেয়ে বোধ হয় চমকে যান। এবং খুব সম্ভবত তখন হত্যাকারী সুবালা অতুলবাবুকে চেয়ারটায় উপবেশন করতে বলে। কোনরূপ সন্দেহ না করে অতুলবাবু হয়ত চেয়ারে গিয়ে বসেন আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাড়াতাড়ি তখন সুইচ অফ করে সুবালা রণলালের নির্দেশমত মৃত্যুফাঁদের সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে ঘরের মাঝের দরজা দিয়ে অর্থাৎ রণেনবাবুর ঘরের ভেতর দিয়ে পালায়।

মানসিক চাঞ্চল্যে এইখানে হত্যাকারী মারাত্মক তিনটি ভুল করে। এক নম্বর অতুলবাবুকে যে রাত্রে শয়নের পূর্বে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ পড়াশুনা করেন সেই তথ্যটি পূর্ব হতে জানা থাকায় এবং লোকের মনে সেই ধারণা জন্মাবার জন্য চেয়ারের পাশে একখানা বই ফেলে রেখে যায় যেটা হয়ত নিজেই সে রাত্রে সে পড়েছিল ও তার হাতে ছিল। ভুল করেছিল অতুলবাবুর সুটকেস থেকে সাধারণত যে ধরনের বই তাঁর প্রিয় যেমন সাইকোলজি ও সেকলেজির কোন একখানা বই সেখানে না রেখে তারই অর্থাৎ হত্যাকারীরই বহু-পঠিত প্রিয় চরিত্রহীন উপন্যাসখানা সেখানে ফেলে রেখে গিয়ে। দু নম্বর ভুল করে সে চেয়ারের পায়া থেকে তামার পাতের রিংটা না খুলে নিয়ে গিয়ে ও সুইচবোর্ডের সঙ্গে যুক্ত তারের সবটুকু খুলে নিতে না পারায়, তাড়াতাড়ি টানাটানিতে বোধ হয় তারের একটা অংশ সুইচ-বোর্ডে লেগেছিল ছিঁড়ে গিয়ে। তিন নম্বর ও সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল করে সে মানসিক চাঞ্চল্যে সাধারণ দ্বারপথটা না ব্যবহার করে ঘরের মধ্যবর্তী দ্বারপথটা যাবার সময় ব্যবহার করে। সে হয়ত কল্পনাও করেনি ঘরের মধ্যে ঐ সময় ঠিক অন্ধকারে রণেনবাবু এসে প্রবেশ করেছেন। সোজা পথে ঘর হতে বের হলে ঐ সময় বারান্দায় তাকে কেউ দেখলেও হয়ত অতটা সন্দেহ জাগত না।

এমন সময় রণেনবাবুই প্রশ্ন করেন, কিন্তু মিঃ রায়, আপনি জানলে কি করে যে সুবালা দেবীই হত্যাকারী?

কিরীটী জবাব দিল, দুটি কারণে। প্রথমত অতুলবাবুর ডায়েরী পড়ে এবং দ্বিতীয়ত মৃত অতুলবাবুর চেয়ারের সামনে চরিত্রহীন উপন্যাসখানা পেয়ে। প্রথমটায় চরিত্রহীন উপন্যাসটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু অতুলবাবুর সুটকেস ঘাঁটতে গিয়ে তার মধ্যে কয়েকখানা সেকসোলজি ও সাইকোলজির বই দেখে চেয়ারের কাছে মাটির ওপরে পড়ে থাকা বইখানা আবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবারে গিয়ে বইখানা তুলে নিয়ে দেখি শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন। পূর্বেই শুনেছিলাম অতুলবাবু সাইকোলজির প্রফেসর। সাইকোলজির প্রফেসর অতুলবাবু রাত জেগে চরিত্রহীন উপন্যাস পড়বেন কেমন যেন মনে খটকা লাগল।

এই সময় হঠাৎ রণেনবাবু বলে ওঠেন, বাংলা উপন্যাস বা বই বড় একটা ও পড়তই না। বিশেষ করে নভেল বা উপন্যাস ছিল তার দুচক্ষের বিষ।

আমারও সেই রকমই মন বলেছিল, যাহোক কৌতূহলভরেই বইখানার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতার মার্জিনে দেখলাম রিমার্ক পাস করা হয়েছে—কিরণময়ী, দুঃখ করো না , উপীন্দ্র নপুংসক। হাতের লেখা দেখে বুঝলাম কোন স্ত্রীলোকের রিমার্ক। এই ধরনের টিপ্পনী করা অভ্যাস বই পড়ে নারীদেরই সাধারণত থাকে বা ঐজাতীয় মনোবৃত্তিসম্পন্ন পুরুষদের থাকে। তাছাড়া বইয়ের প্রথমেই টাইটেল পেজে ছোট্ট করে এক জায়গায় লেখা ছিল সুবালা। বুঝলাম সেটা তারই বই। সমস্ত ব্যাপারটা যোগ করে ভাবতে গিয়ে মনে হল যেভাবেই হোক ঐ হত্যারহস্যের মধ্যে সুবালার অন্তত কিছুটা যোগাযোগ আছেই। কিন্তু সকলের জবানবন্দি থেকে কোন কিনারা হল না।

সন্দেহ পড়েছিল আমার রণেন ও সুবালার ওপরেই বেশী। অথচ এও বুঝেছিলাম একাকিনী সুবালার পক্ষে এ হত্যা ঘটানো সম্ভবপর নয়। সুবালা সুন্দরী যুবতী। পুরুষ মাত্রেই তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু কার সাহায্য নিল সুবালা। স্বভাবতই মনে হল সুবালা যদি কারও সাহায্য নিয়ে থাকে তো সে আশেপাশেরই কোন যুবক হবে। তাই হানা দিলাম সর্বপ্রথমেই পাশের বাড়িতে। রণলালের সাক্ষাৎ মিলল এবং তার সঙ্গে কথায়বাতায় বুঝলাম, সুবালার প্রতি রণলাল যে বিরাগ দেখাচ্ছে সেটা আসল সত্য নয়। অভিনয় মাত্র। যাতে তাদের ওপরে কারও সন্দেহ না পড়ে। কিন্তু তা যেন হল, সুবলাই যদি হত্যা করে থাকে, তার movemets ধোঁয়াটে জবানবন্দিতে পরিষ্কার হয়নি। তাই গঙ্গার ঘাটে আজ রাত্রের অভিনয়ের আয়োজন। কিন্তু তাতে একটা ব্যাপার প্রমাণিত হলেও সুবালার ব্যাপারটা হল না। কারণ মণিকা দেবীকে shield করবার জন্য রণেন ও সুকান্তবাবু তখনও সত্যি কথা সবটুকু বললেন না।

কিন্তু কি প্রমাণিত হল বলছিলেন? প্রশ্ন করে সুকান্ত।

প্রমাণিত হল এই যে, সত্যিই আপনারা দুজনেই মণিকা দেবীকে অন্তর দিয়ে ভালবাসেন। এবং আপনাদের দুজনের একজনও অতুলবাবুর হত্যার সঙ্গে জড়িত নন।

তারপর বলুন? রণেন বলে।

তারপর আর কি, পূর্বাহ্নেই আমি শিউশরণের সাহায্যে সুবালা ও রণলালকে পৃথক পৃথক ভাবে থানায় ডাকিয়ে এনে দুটি পৃথক ঘরে আটকে রেখেছিলাম। তার পরের ব্যাপারটা তো সর্বসমক্ষেই ঘটল। নূতন করে বিবৃতির প্রয়োজন রাখে না। কিন্তু শেষ কথা আবার আপনাদের বলছি—আপনি মণিকা দেবী, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু, আপনাদের মধ্যে এবারে যত শীঘ্র সম্ভব একটা শেষ মীমাংসা করে নিন। কারণ আগুন নিয়ে এ বড় বিষম খেলা। দেখলেন তো চোখের সামনেই।

তিনজনেই মাথা নীচু করে।

কারও মুখ দিয়েই কোন কথা বের হয় না।

কিরীটী শিউশরণের দিকে তাকিয়ে বললে, শিউশরণ, এঁরা আজ তোমার অতিথি, মিষ্টিমুখ করাও অন্তত এক কাপ করে চা—

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! শিউশরণ লজ্জিত ভাবে ঘর হতে প্রস্থান করলে বোধ হয় চায়ের যোগাড় দেখতেই।

Exit mobile version