Site icon BnBoi.Com

নবনীতা দেব সেন গল্প সমগ্র

নবনীতা দেব সেন গল্প সমগ্র

আমার আধার কার্ড নেই

 

পুষ্পেন্দু এসে বললে, দিদি আপনার আধার কার্ডটা একটু লাগবে—

আধার কার্ড? আমার আবার আধার কার্ড কোথায়?

কেন হয়নি দিদি?

আবার কেন? কপাল মন্দ বলে, বাড়িতে কানাই, ঝরনা, নীলু, নীলুর বর, নীলুর পুত্র, ষষ্ঠী, পদ্ম, সক্কলের ঘর আলো করে আধার কার্ড রয়েছে। টুকটাক কত কাজেও লাগছে। আমারই কেবল কথায় কথায় পাসপোর্ট দেখাও/প্যান কার্ড দেখাও/কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করতে হয়। একখানা আধার কার্ড থাকলে আর কিছুই লাগে না। কী গোরু, কী মানুষ, এ জন্মের মতো নিশ্চিন্ত। আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে নয়, তার বিপরীত। কপাল বলে তো একটি বস্তু আছে? যে কোনও হস্তরেখাবিদ, ভৃগু, বাবা সালিমালি খান, বশীকরণী মহাদেবী, শ্মশান তন্ত্রের সাধক, রাস্তাঘাটে সবাই আপনার কপাল নিয়ে চিন্তিত। একবার বাগে পেলেই আপনাকে আপনার স্বরূপ জানিয়ে দেবেন, প্রকৃত পরিচিতি দিয়ে দেবেন। মাভৈ! কিন্তু আধার কার্ড কী বলুন তো? বনের বাঘের গলার ইলেকট্রনিক কলারের মতো আপনার ন্যায়সংগত অস্তিত্বের হিসেব রাখা। কিন্তু সেটাই বা আমার হচ্ছে কই?

বারংবার চেষ্টা করেও আমার আধার কার্ডের তারিখ জুটছে না। জুটছে না বলব না, জুটছে, তার পরে যেই যাবার দিনটি আসছে, আমি একবার সকালে উঠে কানাইকে, একবার বাবুসোনাকে ভিড় চেক করতে পাঠাচ্ছি। কানাই বললে, এবেলা থাক, পারবেন না, ওবেলা ভিড় কমলে যাবেন। ওবেলায় গিয়ে বাবুসোনা ফিরে এসে বলল, আজ আর হবে না দিদিভাই, ওদের ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলেছে, বলল, কী একটা যন্ত্র খারাপ হয়ে গিয়েছে। সে যাক, তোমাকে সামনের মাসের দু-তারিখে ডেকেছে! একবার পরের দু-তারিখ পর্যন্ত কোনও রকমে প্রাণধারণ করতেই হয়। আটকে থাকে একশোটা ফর্মালিটি, আধার কার্ড যার চাবি।

পরের মাসের দু-তারিখ আসছেন, আমি ড্রাইভার ভাড়া করেছি। কানাইকে নিয়ে সশরীরে চললুম হাজিরা দিতে। দেখি অফিসের বাইরে অবধি লোকজন, তারা হট্টগোল করছেন। কানাই ভেতরে গেল, আমি গাড়িতেই বসি, আমার পালা এলে, কানাই ডাকলে, সময়মতো যাব। এখন কতক্ষণ বসতে হবে কে জানে?

একটুও দেরি না করে কানাই ফিরে এল। কিন্তু মুখে হাসি নেই কেন?

আর বলবেন না দিদি!

কেন? মেশিন সারেনি?

সেইটে সেরেছে। কানাই সান্ত্বনা দিল। কিন্তু অন্য একটা জরুরি মেশিন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, দিদি।

মানে…?

মানে আজকেও কার্ড হল না আপনার। কী একটা অমঙ্গল লেগে রয়েছে আপনার এই আধার কার্ডের ব্যাপারে। আমাদের তো সক্কলের কী সুন্দর চটপট হয়ে গেছে। মেশিনও ভাঙেনি, এত ঘোরায়ওনি। দেখা যাক কবে এখন মেশিন সারে?

এমন সময়ে একটি ফোন এল।

ম্যাডাম, আমি কে এম সি থেকে বলছি, আমি কিছুদিন আগে ফোন করেছিলাম, আপনাকে পাইনি। আমাদের একটা পত্রিকা বের হয় আমাদের খুব ইচ্ছে এবারে একটা রম্য রচনা দেন।

কে এম সি, মানে সেই মুরগি ভাজার দোকান? আপনারা বাংলায় পত্রিকা বের করেন? বাঃ, দারুণ খবর তো!

ওপাশের নারীকণ্ঠ এবারে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে পড়লেন। তার পরে সামলে নিয়ে বললেন,মুরগিভাজার দোকানের নাম কে এফ সি, ম্যাডাম। আমাদের নাম কে এম সি। কলকাতা মিউনিসিপল কর্পোরেশন। আমাদের একটা হাউস ম্যাগাজিনের মতো আছে, বুঝেছেন ম্যাডাম? তাতে আপনি আগে সন্দীপনদার সময়ে মাঝে মাঝে লিখেছেন, মনে পড়ছে ম্যাম? আমি সেই সব কথা বলছি না, এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে সব আমাদের অফিসে।…ম্যায়, লুক এভরিথিং ইস বেটার দ্যান বিফোর, লিখে খুন, ম্যাম, ইয়ে, আমরা সামান্য কিছু দক্ষিণাও দেব।

সন্দীপনের নাম করলে না বলা যায় না। আমি রাজি হয়ে গেলুম। কিন্তু যৎসামান্য দক্ষিণার অঙ্কে রাজি হলুম না। অনেক শুল্ক দিই আমরা, আমাদের কাজেরও দক্ষিণা চাই যথাযথ। তিনি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে ম্যাডাম, ওটা জিগ্যেস করে নিতে হবে। একটু পরে সতেজ কণ্ঠে ফোন এল, ঠিক আছে ম্যাম। স্যার বললেন, ওটাই দেওয়া হবে। এর পরে মাঝে মাঝেই মিষ্টি গলায় ফোন আসে, কতদূর হল ম্যাম? আমি বলি, হচ্ছে, হবে। অসম্ভব ব্যস্ততায় কাটছে।

কিন্তু সেদিন এর ব্যতিক্রম ঘটে গেল। ওরা ডেট দিয়েছেন, আমি প্রস্তুত, আর তো গাড়ি ড্রাইভার ভাড়া করা হয়েছে। কানাইকে সঙ্গে নিয়েছি। অফিসের সামনে গিয়ে কানাইকে ভিতরে একটু পাঠিয়েছি খবর আনতে। তখুনি কানাই ফিরে এসেছে,

নামতে আর হল না, দিদি!

কেন?

আজকেও ওদের যন্ত্র খারাপ। ওই দেখছেন না লোকজন চেঁচামেচি করছে, রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে? এর মধ্যে যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেল। কাজ বন্ধ। গত মাসেও মেশিন নষ্ট ছিল। ভালো করে সারায় না কেন কে জানে? সামনের মাসের ৫ তারিখে ডেট দিল। আমার মাথায় খুন চেপে গেল। কাকে খুন করি? কে এম সি-কে, আবার কাকে? আমার আধার কার্ডের জন্য ব্যাকুলতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। রোজ রোজ লাইনের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চেক করতে দূত পাঠাচ্ছি। আমার চান্স কতক্ষণে আসবে, আন্দাজ করে বলে দেবে আর কতক্ষণ লাগবে? প্রতিবার সব প্রয়াস বানচাল হয়ে যাচ্ছে। তিনবার ডেট পেরিয়ে গেল, হল না। আমার তো উনআশি বছর বয়েস, নিয়মমাফিক এবারে একদিন চলে যাবার ফাইনাল ডেট পেয়ে গেলে আধার কার্ড না থাকলে যে শ্মশানেই ঢুকতে দেবে না! স্বর্গের দরজাও খুলবে না। আধার কার্ডের অভাবে সত্যি সত্যি জগৎ আঁধার হয়ে যাবে? আধার কার্ডই তিন ভুবনের পাসপোর্ট। আমার চাই-ই চাই আধার কার্ড!

ম্যাম, কতদূর হল? আমার মেজাজটা সেদিন সুস্থ ছিল না। ঠিক দুপুর বেলা শান্তিমতো লিখতে বসব তার উপায় নেই। একদিক থেকে আমাকে কে এম সি-র তাগাদা, আরেকদিকে কে এম সি-কে আমার তাগাদা। আধার কার্ডের আকুল তৃষ্ণায় খেপে গিয়ে বিকট কণ্ঠে বললুম, আপনারা আমাকে আমার আধার কার্ড দিচ্ছেন না মাসের পর মাস হয়ে গেল, তার বেলায় তাগাদা দিয়ে ফল হয় না, আর আমার লেখার বেলায় তাগাদা দিলেই ফল হবে বুঝি? যেমন ভাবে আধার কার্ডের প্রগতি হচ্ছে, সেইভাবেই আমার রচনাও এগোবে। বলেই ফোন বন্ধ করে দিই।

তারপরের দিন, কিঞ্চিৎ সসংকোচে, আমি কে এম সি থেকে বলছি। ম্যাম, রম্যরচনাটা কি…? মানে আমাদের তো ডেট এসে পড়ছে?

তাই নাকি? ডেট রাখেন আপনারা? ঠিক আছে, লিখে দিচ্ছি, তবে এই আধার কার্ড নিয়েই লিখব। যে কাণ্ডটা চলেছে! লেখাটা কতটা রম্য হবে সেটা আপনাদের ওপরেই নির্ভর করছে। দেব? বলুন, ছাপবেন তো?

তাই-ই দিন। কী করব ম্যাম, ইনভাইটেড আর্টিস্ট তো।

মিনিট পনেরো পরে আরেকটি ফোন।ম্যান, ইনি আপনার আধার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবেন। কোনও অসুবিধে হবে না। একটু কথা বলুন।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় ফোন ধরেই বললেন, কোন ওয়ার্ড?

ওয়ার্ড? আমি তো হাসপাতালে নেই।

ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে বললেন, আহা মিউনিসিপ্যালিটির কত নম্বর ওয়ার্ড আপনাদের? কোথায় থাকেন?

বালিগঞ্জে, গড়িয়াহাটে, হিন্দুস্থান পার্কে!

বালিগঞ্জে আলাদা, গড়িয়াহাট আলাদা। ঠিক করে বলুন।

আমরা হিন্দুস্থান পার্কে থাকি। গড়িয়াহাটের কাছেই।

মিউনিসিপ্যালিটির নম্বর জানেন?

নম্বর? আমি তো ওসব–মানে, এখানে আগে ছিলেন দুর্গা, এখন আছেন তিস্তা, বুঝলেন কিছু?

ওয়ার্ডের নম্বর বলুন, কাউন্সিলরের নাম নয়।

ওয়ার্ডের নম্বর? আমি ঠিক জানি না–দাঁড়ান, কানাই? আমাদের পাড়ার ওয়ার্ডের নম্বর কত জানিস নাকি রে?

এইট্টি সিক্স, ছিয়াশি, দিদি।

এইট্টি সিক্স, ছিয়াশি। আমি পুনরাবৃত্তি করি। (বাঃ কানাই আমাকে কক্ষনও বসিয়ে দেয় না!)

ব্যস। ত্রিকোণ পার্কে চলে যাবেন, খুব কাছেই, আপনাদের পাড়ার ক্যাম্পে, যে কোনও দিন বিকেল চারটের মধ্যে, ওরাই করে দেবে সব, কোনও ভাবনা নেই।

আরে মশাই, না! ওই খানেই তো রেগুলার আমার সপরিবার যাওয়া আসা আর স্রোতে ভাসা চলেছে, ওটাই তো আমার টেম্পরারি ঠিকানা, বলতে পারেন! সবটা বলবার সুযোগ দিলেন না, খুব ব্যস্ত মানুষ, বাক্যের মাঝখানেই ফোন রেখে দিলেন।

.

দিন কয়েক বাদে, আবার ফোন এল।

বলুন?

নবনীতা দেব সেন ম্যাডাম বলছেন? আমি কলকাতা করপোরেশন থেকে বলছি। এবারে অন্য এক মহিলা কণ্ঠ।

কী প্রসঙ্গে ফোন? লেখা? না আধার কার্ড?

আধার কার্ড বিষয়ে সেদিন তো শিবতোষ দত্ত আপনাকে ফোন করেছিলেন, সব জানিয়ে দিয়েছেন। কার্ড হয়ে গিয়েছে তো?

কেউ কিছুই জানাননি।

কিছুই জানাননি? দাঁড়ান, এইখানে কথা বলুন তো।

কিছুই জানাননি। কেবল, যেখানে আমরা রোজ ধরনা দিচ্ছি সেইখানে যেতে বলেছেন।

এবার এক ভারিক্কি পুরুষ কণ্ঠ গম্ভীরভাবে ফোন ধরলেন।

নমস্কার ম্যাডাম। আমি ঘোষাল বলছি। আপনাকে উনি যেখানে যেতে বলছেন, সেটা কোথায়?

ত্রিকোণ পার্কে।

ঠিকই তো বলেছেন, ওখানেই তো আপনাদের পাড়ার ক্যাম্প।

.

আমি তো বলিনি ক্যাম্প কোথায় জানি না? আমি বলছি কার্ড কবে কখন হবে, সেটা জানিয়ে দিতে। আমার বয়েস আশির কাছাকাছি, পা চলে না, আমার পক্ষে গিয়ে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার, বা গাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই এসব জানিয়ে একটা ফিক্সড টাইমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলুম। সেটা কি খুব বেশি চাওয়া? এবারে আমাকে তো লিখতেই হয় সিনিয়র সিটিজেনদের অসম্ভব হ্যারাসমেন্টের বিষয়ে কলকাতা করপোরেশনের দায়িত্বহীনতা নিয়ে।

ইনি ধৈর্য ধরে সব শুনলেন। শুনে হালকা সুরে বললেন, বুঝেছি, ম্যাডাম। এই ব্যাপার? কোনও ভরসা নেই, আপনারা ব্যস্ত মানুষ, তায় এজেড, সত্যিই তো এতখানি সময় নষ্ট করা সম্ভব না, আমাদের লোক যাবে আপনার বাড়িতে, আধার কার্ডের যা কিছু লাগে, ঘরে বসেই করিয়ে নিয়ে আসবে। আমাদের এরকম ব্যবস্থা তো আছেই ম্যাডাম, অসুস্থ, বা অশক্ত নাগরিকদের জন্য। কোনও ভাবনা নেই আপনার। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, আমাদের লোক যাবে আপনার বাড়িতে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়ে, মেশিনপত্তর, আলোটালো সব নিয়ে যাবে। আপনি রিল্যাক্স করুন। আগে কেন জানাননি? তাহলে আগেই চলে যেত।

আগে জানাইনি? সেই ব্যবস্থাটা শুরু হওয়া ইস্তক জপ করে চলেছি। কানে তুলছে কেন?

আধঘণ্টার মধ্যেই আবার ফোন। এবারে তরুণ কণ্ঠ।

করপোরেশন থেকে বলছি। আমার নাম শ্যামল নন্দী। নবনীতা দেব সেন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলব।

বলছি। বলুন।

আপনার ঠিকানাটা একটু বলবেন? আমরা আসছি।

মহানন্দে ঠিকানা বললুম। আজকেই?

হ্যাঁ ম্যাডাম, আজকেই।

কখন আসবেন?

এই তো, আমরা এখানে কাজ শেষ হলে সাড়ে চারটে নাগাদ চলে আসব। একটা প্যান কার্ড, কি ভোটার আইডি, কি পাসপোর্ট রেডি রাখবেন যেখানে আপনার ছবি আছে। আর আমাদের একটা ফর্ম ফিলআপ করতে হবে আপনাকে। ব্যস!

আর কিছু?

নাঃ, আর কিছু লাগে না।

.

বেল বাজল। শ্যামলের বাঁশি! এক, দুই, তিন, চার জন ছোকরা এল, বড়সড় ব্যাগ নিয়ে, গরমে পুড়তে পুড়তে। কানাই তাদের শরবত-এর ব্যবস্থা করে তদারকির ভার নিয়ে নিল। আমি নীচে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপরে কমপিউটার, স্ক্যানার, অনেক তারের গোলা, আলো, প্রিন্টার, এই সব সাজানো। করপোরেশনের আধার কার্ডের অফিসের চেহারা দেওয়া হয়েছে আমাদের বৈঠকখানা ঘরটিকে। তারপরে চলল যাবতীয় অকহতব্য গোপন মধুর কর্ম, যথা, দশটি আঙুলের সযতনে স্পর্শন। অঙ্গুলিস্পর্শনের আর তদ্দারা তাদের ছাপ গ্রহণের কাণ্ডটি মোটেও সরল নয়, সব আঙুলের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। কোনওটা কাঁচের ওপরে দিব্যি চেপে বসে, কোনওটা বসবেই না! অজস্রবার ছবি তুলেও দশটা আঙুলের ছবি এল না এ-হাতে ও-হাতে মোট তিন জন গোঁ ধরে বাদ রইলেন। কে না জানে, হাতের দশটা আঙুল সমান হয় না।

কথায় কথায় গোরুরও আধার কার্ড হচ্ছে শুনেছি। জিগ্যেস করলুম কীভাবে হয়? ছেলেগুলি খুবই দুঃখিত। গোরুর খবর জানে না। কিন্তু তাদেরও আধার কার্ড হচ্ছে যে ইদানীং, সেটা জানে। যখন আমার নয়নতারা দুখানির অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ আর পুঙ্খানুপুঙ্খ। চিত্রগ্রহণ হচ্ছিল ছোটবেলায় দিল্লিকা কুতুব দেখো আগ্ৰাকা তাজমহল দেখো, হাওড়াকা ব্রিজ দেখোর মতন দেখতে চৌকো চৌকো গোদা কালো চশমা-ক্যামেরা পরিয়ে, সেই সময়টায় ওদের মধ্যে একটি তরুণ একান্ত মনোযোগে তার ফোন থেকে কী যেন খুঁজে খুঁজে সারা হচ্ছে। আমার কাজ ফুরোলে আমি জিগ্যেস করলুম, কী খুঁজছ ভাই?

একগাল হেসে একটা ছবি বের করে, বিজয়গর্বে ছেলেটি আমাকে দ্যাখাল, পেয়েছি! একটি গোরুর মুখের ছবি। তার একটা চোখের সামনে ছোট্ট আলো ফোকাস করা হচ্ছে, আমার মতোই, কিন্তু দুটোর বদলে কেবল একটি চৌকো কালো চশমা ক্যামেরা পরিয়েছে।

এক চোখ?

গোরুদের বেলায় একটা একটা করে চোখের ছবি তোলা হয় কিনা? দুই চোখ যে মুখের দুদিকে। আপনাদের একসঙ্গেই দুই চোখের ছবি হয় ম্যাডাম। এইটুকুই তফাত মাত্র গোরুর আর মানুষের বেলায়। বুইলেন।

মাত্র এইটুকুই? বুইলুম। গোরুর এবং আমার যে এটাই প্রধান ফারাক, এটা জেনে নিয়ে মনেপ্রাণে তৃপ্ত হয়ে আমি প্রশ্নে ক্ষান্ত দিলুম। এ জন্মের মতো আধার কার্ডের পালা শেষ।

যাক! দেড়মাস বাদে খবর আসবে। ততদিন নিশ্চিন্তি। থ্যাংক ইউ কে এম সি! কে এম সি জিন্দাবাদ।

.

না, আমি ভুল বলেছিলুম, পালা শেষ নয়, পুনশ্চ আছে।

আজকে একটা ফোন এল।

আমি কে এম সি থেকে বলছি। নবনীতা দেব সেন ম্যাডাম আছেন? আধার কার্ডের ব্যাপারে।

বুক ধসে গেল। এখনও মেটেনি? ভুল হয়েছিল কোথাও? আ-বা-আ-র শুরু হবে?

কী ব্যাপার, বলুন তো।

নমস্কার। আমি জগবন্ধু বলছি, কেএমসি থেকে। আপনি শিববাবুকে বলেছিলেন? আমাকে শিববাবু বলেছেন আপনার আধার কার্ডের ব্যাপারে। কোনও ভাবনা নেই ম্যাডাম, যে কোনও দিন বিকেল চারটে নাগাদ চলে আসুন, আমরা সব করে দেব, কবে আসবেন, বলুন?

অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার আধার কার্ড হয়ে গেছে যে?

কী করে হল? আমাদের মেশিন তো–

মেশিন তো বাড়িতে এসেছিল, চার জন করিতকর্মা ছেলে এসেছিল, টালিগঞ্জ না কোথা থেকে, অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে। থ্যাংক ইউ।

হয়ে গেল! দুমিনিট স্তব্ধতা। অবশ্য আমাদের শিববাবু বলেছিলেন কয়েকদিন আগেই। কিন্তু তখন মেশিনটা চালু ছিল না বলে আর–

ঠিক আছে, থ্যাংক ইউ। হয়ে গেলেই তো হল।

দেড়মাস পরে বোঝা যাবে, হল কি হল না। আপাতত নিশ্চিন্ত।

.

দ্বিতীয় ভাগ

হ্যালো? কে এম সি? মিস্টার ঘোষাল আছেন? কিংবা শিবতোষ দত্ত?

ধরুন।

হ্যালো ঘোষাল বলছি।

মিস্টার ঘোষাল? আমি অমুক বলছিলুম। সেদিন কথা হল।

আ-বা-র? সেদিন হয়নি আধার কার্ড?

হ্যাঁ-হ্যাঁ। ছেলেগুলি খুব ভালো। এসেছিল। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।

ওয়েলকাম। দেড় মাস পরে পেয়ে যাবেন।

মিস্টার ঘোষাল? মানে, আচ্ছা, আরেকটা কথা ছিল যে? জলের ব্যবস্থাটা কে দ্যাখেন? সাত সপ্তাহ আমাদের একবেলা করে জল আসছে, তাও ট্যাংক ভরছে না…বেদম জলকষ্টে আছি…মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি এসেছে। আমাদের বিরাশি বছরের বাড়ি কোনও দিন এমন হয়নি।

দেখুন ম্যাডাম, স্যরি, কিন্তু জলের ব্যাপারটা তো আমরা দেখি না, আপনাকে ওয়াটার সাপ্লাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে–

অঃ। দয়া করে একটু যদি তাদের ফোন নম্বরটা…?

শারদীয়া বর্তমান ২০১৭

আরে, পেহলে হমে তো জীনে দো?

আমার বন্ধু সান্ত্বনা খুব বড় ডাক্তার, গাইনি। ভাগলপুরে গিয়ে দেখে এসেছি তার অসীম নামযশ, জনপ্রিয়তা। নাইবার-খাবার সময় পায় না সারাদিনে। নিজের বাড়ির একতলাতে তার চেম্বার আর মস্ত নার্সিংহোমও। সন্ধে সাতটাতেও তাকে দুপুরের ভাত খেতে দেখেছি। সারাদিনে ওপরে আসার সময় হয়নি তার। নিজের সন্তান নেই তাই তার জীবন। উৎসর্গ করেছে অপরের সন্তানকে সুস্থ, সতর্কভাবে এই পৃথিবীতে আনার কাজে। স্বামী মধুবাবু এক সফল ব্যবসায়ী, তিনি সত্যিই মধুময় স্বভাবের মানুষ। প্রকৃত জীবনসঙ্গী, সদাসর্বদা স্ত্রীর পাশে আছেন। স্ত্রী মধ্যাহ্নভোজে না এলে, সেদিন তিনিও পেটে কিল মেরে বিস্কুট খেয়ে সাতটা অবধি অপেক্ষা করেন স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে খাবেন বলে। এমন দাম্পত্য ঈশ্বরের করুণা! দেখেও সুখ! এই বয়েসেও দুজন দুজনের প্রাণাধিক। দুয়েকদিনেই টের পেলুম ওদেশে ডাক্তারি করতে হলে শুধু ডাক্তারি জানলেই হবে না, আরো বেশি এলেম চাই। মেয়েদের ওপরে ওদেশে অশেষ অত্যাচার চলে, সেইসব যথাসাধ্য আগলে-সামলে মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনার ডাক্তারি। পেশাদারি ডাক্তারি যতটা, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা তারচেয়ে ঢের বেশি।

একদিনের কথা বলি, আমি বেরিয়ে যেতে যেতে দেখলুম একটি মেয়ে এসেছে কোলে শিশু নিয়ে, সে ডাক্তারের রুগিদের লাইনে দাঁড়াচ্ছে না, ভিড়ের একপাশে সরে আছে, আর বলছে সে সবার শেষে দেখাবে। আমি বুঝলুম না। কেউ যে কোনোদিন ইচ্ছে করে লাইনের শেষে দেখাব বলে, এমনটা তো দেখিনি। ফিরে এসে দেখি সান্ত্বনার চেম্বার শেষ, সেই মেয়েটি বাচ্চাকে নিয়ে হেসে হেসে সান্ত্বনার সঙ্গে ঊড়ে চা খাচ্ছে। সান্ত্বনা আলাপ করিয়ে দিল, পুরোনো পেশেন্ট বলে।

ওপরে এসে ওদের গল্পটা বলল সান্ত্বনা। ওর ভাষাতেই বলি ও একদিন চেম্বারে সদ্য ঢুকেছি, পাঁচটি মেয়ে এসে ঢুকল। ওরা অপেক্ষা করছিল বাইরে। কত আর বয়েস, উনিশ-কুড়ি হবে?

নমস্তে ডাগদরসাব। একসঙ্গে পাঁচজনে নমস্কার করল। আমরা বাঁকে গ্রাম থেকে এসেছি।

আমি প্রতিনমস্কার করে বলি, বোসো। তোমাদের মধ্যে রুগি কে?

ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে রইল। বিরক্ত হয়ে আমি বলি, সময় নেই আমার, বলো কাকে দেখাতে এসেছ। কে পেশেন্ট?

আমরা সবাই পেশেন্ট, ডগদরসাব।

কী হয়েছে তোমাদের? দেখে তো প্রত্যেককেই দিব্যি স্বাস্থ্যবতী লাগছে। ব্যাপারটা কী?

ওরা বলল, এখনো কিছুই হয়নি, জী সাব।

এবার আমি অবাক। এবং বিরক্ত।–তা হলে? কিছুই হয়নি তো কেন এসেছ তোমরা? আমার সময় কত কম তা তো দেখতেই পাচ্ছ? কোনো রোগের টিকা, ইঞ্জেকশন, কিছু নিতে চাও?

আমাদেরও সময় কম, ডাগদরসাব। টিকা নয়, ওই রকমেরই অন্য কিছু। জলদি জলদি চাহিয়ে জী সাব। তাড়া আছে আমাদের। এই জন্যেই আপনার কাছে আসা। প্লিজ ফিরিয়ে দেবেন না।

টিকা নয়, অসুখও করেনি, কী চাই তোমাদের, এত জলদি জলদি?

আমরা লুপ পরতে চাই। আজকেই। আমাদের পরশু থেকেই আবার চাকরি। তাই আজকেই চাই। সময় নেই।

লু-প? পরবে তোমরা? কিন্তু কেন?

কিংবা কপার-টি হলেও হবে।

তোমাদের তো কারুরই শাদি হয়নি? কী এমন কাজ করো তোমরা, যেখানে কুমারী মেয়েদের লুপ পরে আসতে হয়। এ কেমন আইন?

মেয়েদের মুখ শুকিয়ে গেল। ইতস্তত করে একজন বলেই ফেলল, আইন নেই। এমনি। আত্মরক্ষার খাতিরে। আমরা বিহার সরকারের কাজ করি। গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপদেশ দিই, আমাদের বলা হয়, সরকারি হেলথ ভিজিটর, সব রকম উপদেশ দিতে হয় তো? স্বামী-স্ত্রীদেরও।

কেমন উপদেশ?

এই যাতে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কিছু খাওয়ার বা রান্না করার আগে ও পরে হাত ধোয়া, সজি ভালো করে ধুয়ে নেওয়া, পরিবারপিছু অন্তত একটা টয়লেট থাকার প্রয়োজনীয়তা, পাকা টয়লেট থাকা উচিত, সেই টয়লেট ব্যবহারের ট্রেনিং, ফ্যামিলি প্ল্যানিং, মানে বিভিন্ন উপায়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং শিক্ষা দেওয়া, কনডোম, লিপিস লুপ, কপার-টি, এসব বিলি করা, শিশু পালন, ছোঁয়াচে রোগীর যত্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, উকুনের ওষুধ, মশার ওষুধ, মাছি বসতে না দেওয়া, জল জমতে না দেওয়া–সব কিছুই। গ্রামের মানুষদের সবই শেখাতে হয় তো। হেলথ ভিজিটরদের খুব প্রয়োজন আছে। পুরুষকে বলি, মদ খেতে নেই, আর খেয়েও স্ত্রীর সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে হয়, মারধর করতে নেই, আর কনডোম ব্যবহার করা মোটেই বোকামি নয়, বরং বুদ্ধির কাজ। নিজের পক্ষেও শুভ, সন্তান আটকানোর জন্যেও উপকারী। মেয়েদেরও এই সবই শেখাই, আর অল্পবয়েস থেকেই ওদের পুরুষসঙ্গে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি, যাতে ফাঁদে না পড়ে। তাই আমাদের তো কাজটা খুব বিপদসঙ্কুল, পুরুষমানুষরা খেপে যায়। মেয়েরাও ভুল বোঝে। অনেক ক্ষেত্রে এই হেলথ ভিজিটর মেয়েদেরকেই ধরে ধরে রেপ করে দেয় গ্রামের ক্রুদ্ধ পুরুষেরা। তাদের শিক্ষা দিয়ে দেবে। আমরা তাই লুপ পরে নিয়ে কাজে বেরুতে চাই। আজ অবধি আমরা কোথাও চাকরি করিনি, স্কুল থেকে বেরিয়ে এই প্রথম।

তোমরা এতদূরে ভাগলপুরে এলে কেন, বাঁকে-গ্রাম তো বেশ দূরে। ওখানে ডাক্তার ছিল না? চাইলে, সব সরকারি হাসপাতালেই তো লুপ পরিয়ে দেবে।

না ডাকদরসাব, দেয় না। কেউ দিল না। সবাই তো পুরুষমানুষ। কেউ বলে, বাবাকে নিয়ে এসো, কেউ বলে, বরকে নিয়ে এসো। বিয়ে হয়নি? তো লুপ কেন? বদমাইশি করতে ইচ্ছে? তোদের এত সাহস, লুপ পরে বদমাইশি করবি? ও সব হবে না। ভাগ! ছেলেরা বুঝতেই পারে না আমাদের ভয়টা কিসের? রেপ তো আটকাতে পারব না, ডাগদরসাব, অন্তত অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটা তো আটকাই? আমরা আসলে যাতে এই কাজটা না করি, সেটাই ওরা চায়। কিন্তু কাজ না করলে খাব কি? আমাদের সংসার চলে এই বেতনে।

আমি তো থ! কত সহজেই এই কচি কচি মেয়েগুলো বলছে, রেপ হওয়া তো আটকাতে পারব না, অন্তত অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটা আটকাই। কেন বলছে? কী অদ্ভুত ভাবনা।

আসল যন্ত্রণার গল্পটা পরে শুনলুম।

পাশের গ্রামের একটি মেয়ে, সে হেলথ ভিজিটর হয়ে এক গ্রামে কাজ করতে গিয়ে রেপড় হয়েছিল। সেটা সবাই জানত, তা নিয়ে গ্রামে অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হবার খবর জানতে পেরে গ্রামের সবাই ওকেই ছি ছি করল। সেই বাচ্চার জন্মের দায় যে ওর নয়, সকলে সেটা ভালো করেই জানত। জেনেও ওকেই একঘরে করে দিল গ্রামের লোক।–বাবাকেও তার দায় নিতে দিল না, ওদেরকে একঘরে করে দেবে বলল। তাদের আরো ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে ওরা সাহস করল না অন্তঃসত্ত্বাকে ঘরে রাখতে। গত সপ্তাহে মেয়েটি গলায় দড়ি দিল। রেপের জন্যে, দেয়নি। সেটা নিয়ে বেঁচেছিল, লড়ছিল, কিন্তু গ্রামের লোকেদের অন্যায় অত্যাচার ওকে বাঁচতে দেয়নি। আমরা তাই লুপ পরতে এসেছি শহরে। লুপ তো আমরাই বিলি করি গ্রামে গ্রামে, কিন্তু পরতে তো জানি না? যেখানে যাই ডাক্তারেরা বলে, তোরা অসচ্চরিত্র মেয়ের দল। বদ উদ্দেশ্য নিয়ে লুপ পরতে চাইছিস। আমরা অবিবাহিতাদের লুপ পরাব না, অসামাজিক পাপকাজে সহায় হব না। লুপ পরাটা কি পাপকাজ? তোমরা রেপও আটকাতে পারবে না, অন্তঃসত্ত্বা হওয়াও আটকাতে দেবে না? এ কীরকম সমাজ? এ কীরকম ডাক্তারি? আরে, পেহলা হমে তো জীনে দো?

সেদিন আমি ওদের পাঁচজন হেলথ ভিজিটরকেই লুপ পরিয়ে দিয়েছিলুম। সত্যিই নেহাত ছেলেমানুষ, সদ্য স্কুল থেকে বেরিয়েছে। প্রথম চাকরি। সংসারের একমাত্র চাকুরে। তারপরে আর ওরা আসেনি। ধরে নিয়েছি ভালো আছে। ওদের ভুলে গিয়েছি।

আজ পুরো এক যুগ বাদে ওই মেয়েটি কোলে শিশু নিয়ে এসে জানাল ডাগদরসাবকে, ওর বাচ্চাকে আশীর্বাদ দিতে হবে। এখন ওরা লুপ খুলে ফেলেছে। ওদের চারজনের বিয়ে হয়েছে, তিনজনে মা হয়ে গিয়েছে, সবাই সুখী আছে। ওরা সবাই এই লেডি ডাগদরসাবকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। ওদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য অনেকখানি দায় লুপ-এর । ওদের কথায় বিশ্বাস করে, সহযোগিতা করে, সহানুভূতি নিয়ে কোনো ডাক্তারই ওদের দেখতে চাননি দিনের পর দিন। বদ্ধ সংস্কারে অন্ধ ছিলেন সকলেই। ওরা সেই সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে, কুমারী হয়েও লুপ পরতে চাইবার দুঃসাহস করেছিল, শুধু বাঁচবার তাগিদে,–আরে, পেহলা হমে তো জীনে দো?

আমি অবাক হয়ে সান্ত্বনার হাসিভরা তৃপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলুম, এই তো চেয়েছি আমরা। বিহারের নেহাত অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়েগুলো, কিন্তু শিক্ষা তাদের বোধবুদ্ধি বাড়িয়েছে, জীবনের কাজে লেগেছে।

বিহারের নতুন যুগের ওই শিশু বড় হচ্ছে আত্মবিশ্বাসী মায়ের কোলে।

সান্ত্বনা বলল, মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে। এরকম ঘটলে মনে হয় বিহারে বসে ডাক্তারি করা সার্থক।

ঠিক জায়গায় আছ, সান্ত্বনা, তোমার মতো আধুনিক মনের দরকার আছে এইখানে।

নবকল্লোল আশ্বিন ১৪২২

 জয় জয়ন্তী

প্রেসিডেন্সিতে কো-এডুকেশনে ভর্তি হওয়া মাত্র দুই দাদা খ্যাপাতে শুরু করল তিতলিকে।

খুব সাবধান। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, বিশেষত প্রেসিডেন্সিতে।

আর যাদবপুরে বুঝি নেই?

ছোড়দা পড়ে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং, দাদা পড়ে মেডিক্যাল কলেজে। দাদার গার্লফ্রেন্ড নেই, ভীষণ ব্যস্ত পড়াশুনো নিয়ে। ছোড়দার তো ছিল, সুমনা। এখনো আছে কিনা জানা নেই। যাদবপুরের ব্যাপার। তিতলি প্রেমে পড়বে না মনস্থ করেই প্রেসিডেন্সিতে গেছে। কিন্তু দাদাদের খোঁচায় সে অবশেষে পড়েই গেল প্রেমে।

বাড়ি ফিরে এসে তার মুখে জয় ছাড়া বুলি নেই। জয় আজ ক্লাসে এই বলেছে, প্রফেসর খুব খুশি হয়েছেন। ইন্টারকলেজিয়েট ডিবেটিং কম্পিটিশনে জয় আজ ফাটাফাটি ডিবেট করেছে। জয় আজ কি দারুণ ক্রিকেট খেলল, পাঁচটা বল মেরেছে পরপর, তার পরে ক্যাচ লুফেছে দুটো। জয় আজ কফি হাউস ফাটিয়ে হিন্দি গান গেয়েছে।

মাঝে তিতলির মন খারাপ, জয় কলকাতার বাইরে ইন্টার কলেজিয়েট ক্রিকেটে খেলতে গেছে। দেখা হচ্ছে না। বিরহ দশা দেখে ছোড়দা খেপিয়ে মারল। তিতলি বিরক্ত হয়ে দুই কিল বসিয়ে পালিয়ে যায়।

আস্তে আস্তে এমন হল, এক সঙ্গে পড়া, এক সঙ্গে আড্ডা, এক সঙ্গে খেলা দেখা, জয়ের সঙ্গে সব সময়েই জুড়ি বেঁধে ঘুরচে তিতলি, কিন্তু জয় কোনো দিন তিতলিদের বাড়িতে আসেনি। মা ক্রমশই উদবিগ্ন হচ্ছেন, এটা কী হল? দাদারা যতই হাসাহাসি করুক, ব্যাপারটা ফ্যালনা নয়, ফার্স্ট ইয়ারেই প্রেমে গদগদ হলে পড়াশুনোর দফা রফা। তিতলি কিন্তু বলে জয় ওদের ক্লাসে বেস্ট স্টুডেন্ট। প্রফেসরেরা খুব ভালোবাসেন। ক্লাস শুদ্ধু ওর প্রেমে গদগদ। তিতলি একলা নয়।

তিতলি ছোড়দাকে বলেছে মনের কথাটা। জয়ের সবই তার ভালো লাগে, শুধু একটা জিনিস ছাড়া। সিগারেট খাওয়া। কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না তিতলি। না ছোড়দাকে, না জয়কে। শুনে ছোড়দার উৎসাহ বেড়ে গেল। ছোড়দা আজকাল অসভ্যের মতো খেপাচ্ছে, তিতলি মাঝে মাঝে লাল হয়ে যায়।

সে যে যাই বলুক, কলেজে পা দিতে না দিতেই মেয়ের এমন জয়-জয় বাতিক মা-র কিন্তু খুবই খারাপ লাগছে। প্রেসিডেন্সিতে দিতে ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলেন। তবে সব শুনে তো মনে হয় ছেলেটা গুণী। তবু মায়ের মনে উদবেগ, বাচ্চা মেয়ে, কিছুই জানে না পৃথিবীর। কিসের মধ্যে গিয়ে পড়ছে। ছেলেটাও তো বাচ্চাই? তাই স্বচক্ষে দেখে নিতে চান। কৌতূহল বাঁধ মানতে চায় না। বাবা বেচারা এসব কিছুই জানেন না, এ সবই মায়ের ডিপার্টমেন্ট।

জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে মা একদিন বললেন, জয়কে একদিন নিয়ে আয় না বাড়িতে, কেমন, দেখি?

ছোড়দা রেডি। নিয়ে আয়। (আসুক একবার, কেমন ছেলে বাজিয়ে দেখে নেব ভাব)।

দাদা একটু চুপচাপ ছেলে, সেও বলে ফেলল, সত্যি, নিয়ে আয় একবার বাড়িতে। কফি হাউসে বেশি বেশি হই-হুঁল্লোড় করিস না। ভালো দেখায় না।

মা নিজেই বললেন, ছোড়দার জন্মদিনে জয়কে ডাকতে। জন্মদিন এসে গিয়েছে।

নাচতে নাচতে এসে তিতিলি ঘোষণা করল, জয় বলেছে, আসবে!

তিতলির উত্তেজনার অন্ত নেই। বাড়ি-ঘর গোছাতে লাগল। বিশেষ করে নিজের ঘরটা, যেখানে জয় বসবে।

মা কিন্তু বাদ সাধলেন।

শোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া চলবে না জয়কে। সকলের সঙ্গে বসার ঘরেই বসবে।

জয় সাদা ফুল ভালোবাসে না, তার শ্রাদ্ধ শ্রাদ্ধ লাগে। তাই গ্ল্যাডিওলি আনল। তিতলি। লাল গোলাপি মেরুন হলুদের ম্যাজিক। ঠিক ওর মনের সঙ্গে রং মিলন্তী। ঘরটা হেসে উঠল।

ছোড়দা তো খ্যাপায়ই, দাদাও খ্যাপাতে শুরু করেছে, ওর খ্যাপামি দেখে। তিতলি আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর ফুল সাজাচ্ছে। যদি আর কারে ভালোবাসো যদি আর ফিরে নাহি আসো তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও…

.

ছোড়দার জন্মদিনে ছোড়দার বন্ধুরা আসবে ছটার সময়ে। জয় এসে যাবে পাঁচটায়। তাকে ফিরতে হবে তো সল্টলেকে? এই গড়িয়া থেকে? শীতকালে?

পৌনে পাঁচটা থেকে বাড়ির সবাই রেডি। ছেলেটা আশা করি পাঙ্কচুয়াল?

পাঁচটায় বেল বাজাল।

তিতলি দৌড়ে গেল, জয় এসেছে।

ছোড়দাও গেল গেট খুলতে, আফটার অল, অতিথি তো, বাড়ির ছেলেরা না গেলে হয়?

কিন্তু গেট খুলেই ছোড়দা অবাক। কই, জয় তো আসেনি? এ আবার কে? আরে, এ তো একটা ঝাকড়া চুলো জিন্স-টি শার্ট-পরা স্মার্ট মতন মিস্টি মতন মেয়ে এসেছে। জয় কই?

জয় আসেনি?

অবাক ছোড়দাকে আরও অবাক করে দিয়ে তিতলি ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ছোড়দা, মীট জয়। দ্য গ্রেট জয়াবতী মুখার্জি। আমার ছোড়দা, যার কথা তোকে বলেছি।

হাসিমুখে জয় হাত বাড়িয়ে দিল ছোড়দার থমকে থাকা হাতের দিকে।

কৃত্তিবাস পুজো সংখ্যা ২০১৮

ঠাকুমার গল্প

রঞ্জন বিমর্ষ মুখে উস্কোখুস্কো চুলে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে এসে ঘরে ঢুকল।

নবনীতাদি, ঠাকুমার–

কী হয়েছে ঠাকুমার? হাতের কাজ ঠেলে দিয়ে খাড়া হয়ে বসি।

রঞ্জনের ঠাকুমাটি আমাদের বড় প্রিয়জন। নব্বই ছুঁয়েছেন–এই বয়েসে তো একটু ভয়-ভয় করেই।

শরীর খারাপ করেছে? কী হয়েছে ঠাকুমার?

শরীর না। মাথাটা।

সে আর নতুন কী! মাথা তো অনেকদিনই নিজের খেয়ালখুশিতে চলছে।

এ অন্য পরিচ্ছেদ–ভীমরতি এখন ভয়াল পরিণতির দিকে! শনৈঃ শনৈঃ- রঞ্জনটাকে নিয়ে বড় ঝামেলা। দুটো কথা বিশ্বাস করি, তো পরের তিনটে করি না। মুখচোখ দেখলে কিছুতেই টের পাওয়া যাবে না সত্যি বলছে না গুল মারছে। দুটোই তো অবিকল একরকমভাবে। পরিবেশিত হয়। সত্যিটাকে মনে হবে গুল, আর গুলটা সত্যি। বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হয় না, আবার বিশ্বাস না-করলেও ঠকে যেতে পারি!

ঠিক করে বল তো দেখি কী হয়েছে! ঠাকুমার আমার প্রিয় মানুষ হবার বহু কারণ রয়েছে। তার কয়েকটা বলতে পারি। ধরুন, আপনি বনের মধ্যে হঠাৎ, একা, রাত্রিবাস করতে বাধ্য হয়েছেন। আপনার ভয় করছে। তখন যদি ঠাকুমা থাকতেন আপনার কাছে। তিনি আপনার বালিশে তিনবার থাবড়া মেরে একটা মন্ত্র পড়ে দিতেন। মন্ত্রটা জরুরি। শিখে রাখুন! আমার তো যাযাবর স্বভাব, এখানে সেখানে হট্টমন্দিরে শয়ন করার সময়ে এই মন্ত্রটা খুবই কাজে লাগে।

বালিশে তিন থাবড়ার পর, বলুন :

কপ ফোল! কপ ফোল! কপ ফোল!
সাপ-চোরা-বাঘা তিনে নিষ্ফল! নিষ্ফল! নিষ্ফল!
যদ্দুর যায় কপ ফোলের এই রা-ও
সাপ-চোরা-বাঘা তিনে না বাড়াও পা-ও,
যদি বাড়াও পা-ও, দোহাই আমার ওস্তাদের মাথা খাও
মন আমার গুরুদেবের পায়!!
ওম্ গুরু দেবঃ শিবঃ/গুরুদেবঃ শিবঃ/গুরুদেবঃ শিবঃ, ওঁ..ম ম ম!

পরবর্তী স্টেপ, তিনবার, তিনদিকে ঘুরে ঘুরে ভক্তিভরে নমস্কার নিবেদন।

সেই মন্তর অবশ্যই শুনতে পাবে জগতের যত সাপ, চোর আর বাঘের দল। তিন গুষ্টির কেউই আর পা বাড়াবে না এদিকে–ওস্তাদের বাঁধন দেওয়া আছে না? এক্কেবারে নিশ্চিন্দি!–শুধু আরশোলা আর মাকড়সার জন্যে ঠাকুমার কোনও মন্তর আছে কিনা জেনে নিতে হবে। এইটেই বাকি।

ঠাকুমার কীর্তিকাহিনি কি অল্প? খুব বিশিষ্ট মহিলা। এই সেদিন নীল আর্মস্ট্রং যে চাদে বেড়াতে গিয়েছিল, সেটাই টিভিতে আবার করে দেখাচ্ছিল। নাতিরা গিয়ে ঠাকুমাকে বলল,

ঠাকুমা শুনেছ, কী হয়েছে? কী দেখলাম টিভিতে? চাঁদে মানুষ নেমেছে!

কী? তুমি কী কইলা মনু? চান্দের কথাডা কী কইলা?

চান্দে গিয়া মানুষ নামসে ঠাকুমা–চান্দ আর দূরে নাই–

নামসে কও ক্যান? ওঠসে কইতে হয়। মানুষ আকাশে নামে কী কইর‍্যা? চান্দে ত ওঠা লাগে। এইয়া কি পুষ্করিণী? তা, সেই মানুষ করসে কীডা, চান্দে যাইয়া?

ওই তো, হাঁটাচলা করছে, মানে ভেসে বেড়াচ্ছে আরকি, পা ডুবে ডুবে যাচ্ছে। তো, ভালো করে হাঁটা যায় না চাঁদের মাটিতে–।

আহা রে। পা-ও তো ডুইব্যা যাইবই। বর্ষাকাল না? এক্কেরে ভাইস্যা বেড়াইতাসে বেচারা? আহা হা। তা অহন না যাইয়া শুখা সিজনে যায় নাই ক্যান? অহন তো আকাশেও মাঘ বিদ্যুৎ-চান্দে যাওন কি সহজ ভ্রমণ? পথখান কি কম? দেইখ্যা মনে হয় কাছেই–চান্দ কিন্তু বহুদূর! কতদূর জানো? এক্কেরে হিমালয় পর্বত-টবর্ত পার হইয়া কৈলাস পর্বতের কাছে…বলেই হাত জোড় করে নমস্কার!

ঠাকুমার অভিনবত্ব বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সবাই মিলে গুলতানি করছে নাতিরা। ঠাকুমা গুটিগুটি উপস্থিত।

ও মনু তোমরা করো কী? সাড়ে তিনটার অ্যারোপ্লেলেন উইড়্যা গেল, অহন তরা চা খাইবি না? এইডা তো তগো চা খাওনের টাইম! খ্যাল করায়া দিতাসি। ঠাকুমা নিজে চা খান না।

বেলা সাড়ে তিনটের এরোপ্লেন! এরকমও হয় নাকি? আটটার মেল ট্রেন, দশটা পনেরোর প্যাসেঞ্জার, বড়জোর সাড়ে নটায় পাশের বাড়ির খুকুর স্কুলবাস–এসব হিসেব রাখতে পারে মানুষ। তাই বলে সাড়ে তিনটের এরোপ্লেন দেখে ঘরের কাজকর্মের টাইম শিডিউল বানানো! হ্যাঁ, সাড়ে তিনটের সময়ে আকাশ দিয়ে একটা জেট প্লেন যায় এবং ঠাকুমা তাই দিয়ে বিকেলটা শুরু করেন। লও লও সব তাস গুছাও এইবারে–চায়ের টাইম–সাড়ে তিনটার অ্যারোপ্পেলেন উইড়্যা গেসে গিয়া, সে-ই কখন…।

সেই ঠাকুমার কি ভীমরতি হয়? তবে হ্যাঁ, ওঁর মাঝে মাঝে খেয়াল চাপে। নানারকমের উদ্ভট খেয়াল। নাতিরাও তার মোকাবিলার জন্য সদাসর্বদা প্রস্তুত। ওই ঠাকুমারই নাতি তো তারা!

যেমন, একদিন ঠাকুমার মনে হল সকলেই তাকে গঙ্গাস্নান করাবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। যেমনই মনে হওয়া অমনই অ্যাকশন শুরু। একই কথা ননস্টপ রিপিট করে যাবার অদম্য ক্ষমতা অনেক ঠাকুমারই থাকে। ওঁরও আছে। সকাল থেকে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই কথাটা একবার বলে নিচ্ছেন।

ও মনু তপন? ও বাপধন চন্দন? আরে আরে রঞ্জইন্যা, পলাও কোথায় তরা যে কইসিলা তোমারে গঙ্গাচ্ছান করাইতে লইয়া যামু ঠাকুমা, ত কই লয়্যা গেলি না তো?

ও বউমা। একবারডি গঙ্গাচ্ছানে লইয়া যাবা আমারে?

ও তারাপদ, তোমার মায়েরে একবার গঙ্গাচ্ছান করাইয়া আনবা না তুমি? লয়্যা চল না বাবা–গঙ্গায় দুইডা ডুব দিয়া আসি গা? বড় প্রাণে লয়–

অবশেষে নাতিরা ঠাকুমাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে দুটো ঘর পার করে দাওয়ায় নিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নামিয়ে এনে বলল,

এই তো, গঙ্গা। গঙ্গায় এসে গেছি ঠাকুমা, স্নানটা তবে সেরে নাও চটপট।

ঠাকুমা চোখ বড় বড় করে রোদে খটখটে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাপ রে! জোয়ার আইছে! ইশ..কী বড় বড় ঢেউ! সমুদ্রের মতো লাগে।

তারপর নাতিদের বললেন,আ-রে, তারা আমারে ধইর‍্যা থাক।…আমি তো স্রোতে ভাইস্যা যাইতাসি–গায়ে তো শক্তি নাই–ওঃ জলের কী টান…!

নাতিরা ঠাকুমাকে ধরে রইল। ঠাকুমা চোখ বুজে, নাক টিপে ধরে, গুনে গুনে তিনটি ডুব দিয়ে উঠলেন বিড় বিড় করে মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে। তিন নম্বর ডুবের পরেই হাত বাড়িয়ে দিলেন–গামছাখান দেহি, গামছা দেওয়া হল। তারপর জয় জয় দেবী সুরধুনীগঙ্গে গাইতে গাইতে গা মাথা মুছে ঠাকুমা আবার মহানন্দে নাতিদের কোলে চড়ে খাটে ফিরে এলেন। পুণ্যস্নান সারা!

আহ! কী আরাম! শরীলখান য্যান্ জুড়াইয়া গেল! গঙ্গাচ্ছান বলিয়া কথা।

.

এইটেকে ভীমরতি বলে ধরা হয়, তবে এরকমটা তো নতুন কিছুই ঘটনা নয়। আজ তাহলে রঞ্জনের এত বিচলিত লাগার কারণ কী?

কেন, ঠাকুমা নতুন করে কী করলেন আবার? এবার কি সমুদ্রস্নান? পুরীতে যাবেন?

রঞ্জন গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, জ্যাঠামশাইকে মেরে ফেলেছেন।

সে…কী…! আমার মাথাটা ঘুরে গেল। বিলেতের কাগজেই এসব পড়েছি কেবল! কী ভয়ানক!

সকালে উঠে দেখি ঠাকুমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কাপড়ের খুঁটে নাকচোখ মুছছেন আর কাঁদছেন। রঞ্জন বলতে শুরু করল।

ক্যান, ঠাকুমা কান্দো ক্যানে?

আমার অমূল্যাডা আর নাই!

হ্যাট। যতো বাজে চিন্তা! কে কইল নাই! জ্যাঠা এক্কেরে ফিটফাট। ঠিকঠাক।

না। নাই। আমি জানি। সে নাই। তরা আমারে মিছা কথা কস। হা..রে…অমূল্যা…!

ঠাকুমা নাইবেন না, খাবেন না, কথা বলবেন না, একনাগাড়ে, হাপুস নয়নে, জ্বলজ্যান্ত জ্যাঠামশাইয়ের জন্য পুত্রশোকে কাঁদবেন। কার আর সেটা বরদাস্ত হয়। বাড়িসুদু লোকে তাকে বোঝাচ্ছি জ্যাঠা দিব্যি আছেন, ফুর্তিতেই আছেন। কোন্নগর থেকে তেমন ঘনঘন গড়িয়া এসে উঠতে হয়তো পারছেন না ইদানীং-তাই বলে এমন অমঙ্গুলে কান্না কাঁদতে হবে?

ঠাকুমা কারুর কথাই বিশ্বাস করছেন না। আমি জানি। তরা আমারে ভুলাস।

প্রত্যেকে চেষ্টা করে হার মেনে গেলাম। এদিকে ফোনে ঠাকুমা কথাবার্তা কিছুই শুনতে পান না। জ্যাঠার সঙ্গে ফোনে যে কথা বলিয়ে দেব, তার উপায় নেই। কিছুতেই বুঝ মানানো যাচ্ছে না ঠাকুমাকে। অথচ মায়ের চোখের জলে নাকি সন্তানদের অকল্যাণ হয়–এ অশ্রু অবিলম্বে থামানো দরকার। সমূহ বিপত্তির শান্তি করতে জ্যাঠামশাইকে কোন্নগর থেকে সোজা ট্যাক্সি ভাড়া করে গড়িয়াতে নিয়ে আসা হল। এবার ছেলেকে সশরীরে মায়ের সম্মুখে উপস্থিত করে দেওয়া হবে।

রবিবার সকালে জ্যাঠামশাই এলেন–হাসিখুশি। ট্যাক্সি ভাড়াটা এখান থেকেই দেওয়া হয়েছে–জ্যাঠামশাই হাতে করে কোন্নগর থেকে চমৎকার মাখা সন্দেশ এনেছেন ঠাকুমার জন্য। এবারে সমস্যার অবসান।

আমরা নাচতে নাচতে গিয়ে বলি :

ঠাকুমা, জ্যাঠামশাই এসেছেন?

কে আইল?

জ্যাঠামশাই।

কার জ্যাঠা?

আমাদের জ্যাঠামশাই।

হেইডা কেডা?

কেডা মানে? তোমার বড় ছেলে!

সে তো অমূল্যা আছিল।

হ্যাঁ, সেই তো। আছিল আবার কী কথা? জ্যাঠামশাই এসেছেন তোমার কাছে।

অমূল্যা আইছে?

হ্যাঁ-হ্যাঁ, বলছি তো।

অমূল্যা এই বাসাতে আইছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে আর বলছি কী? এই বাসাতে আইছেন। আমাদের জ্যাঠামশাই। তোমার অমূল্য।

আইল কেমনে?

ট্যাক্সি করে।

টেকশি কইরা? বাপরে! খাড়াও দিনি, কাপড়খানা পালটায়া লই।

তাড়াতাড়ি তোরঙ্গ থেকে একটা তসরের কাপড় বের করেন। হুড়োহুড়ি করে সেটি গায়ে জড়িয়ে, সুতির কাপড়টা খুলে রেখে ঠাকুমা বললেন,

কই, কই গ্যাল অমূল্যা? দাও অরে ডাইক্যা দ্যাও। ঠিক কথা কও তো মনু?

জ্যাঠামশাই ঘরে ঢুকে যেই নীচু হয়েছেন প্রণাম করতে, ঠাকুমা ঠিকরে সরে গিয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।

আহাহা থাউকগ্যা, থাউকগ্যা, পরনামে কাজ নাই–এই যে হাত তুইল্যা এমনি এমনি করিয়া নমো নমো করো, নমো নমো করো–বলতে বলতে নিজের বুকের কাছে দুই হাত জড়ো করে ঠাকুমাও জ্যাঠামশাইকে ভক্তিভরে নমস্কার করলেন। প্রণাম করা, আশীর্বাদ করা, যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম বাদ। ঠাকুমার এহেন আধুনিকতা দেখে জ্যাঠামশাই একটু ঘাবড়ে গেলেন মনে হল। বিজয়ার সময়েও তো এটা ছিল না। জ্যাঠামশাই চেয়ারে বসলেন। ঠাকুমা চুপচাপ তাকে মেপে যাচ্ছেন। কথা নেই। জ্যাঠার অস্বস্তি হল। সাধারণত ঠাকুমার অনেক প্রশ্ন থাকে।

তা মা ভালো আছ তো?

হ। আমি তো আছি ভালোই। তুমি কেমন আছ শুনি!

ভালোই আছি।

আইলা কী করিয়া?

ট্যাক্সিতে।

টেকশি চলাচল করে?

তা করে। খরচা আছে।

খরচা তো থাকবই। এই পার-ওই পার বইলা কথা!

জ্যাঠা এবারে সন্দেশের বাক্স এগিয়ে দ্যান,

মা, তোমার ল্যাইগ্যা সন্দেশ আনছি।

থাউক। ওইখানেই রাইখ্যা দাও। সন্দেশও নাকি বানায়? বা-ব্বাঃ!

কেন বানাবে না? বেশ ভালো সন্দেশ। অন্যরকম। একটু খেয়ে দ্যাখো।

–থাউক। খাইয়া কাম নাই। ভালো না হইয়া পারে! কইথিক্যা আনছ! সহজ কথা? এক্কেরে ওইপার থিক্যা!

ওই নামেই এপার-ওপার। সবই এক, মা।

ঠাকুমা একটুখন চুপ করে থাকেন।

তা, খাও কী?

মানে?

মানে ভাতটাত খাইতে পারো?

হ্যাঁ…ভাতটাত খেতে পারব না কেন?

রান্ধিয়া দ্যায় কে?

কেন, তোমার বউমা?

আ-হাঃ! এইডা তুমি কী কইলা অমূল্যা! বউ-মা-ও?

ঠাকুমা ডুকরে ওঠেন।

বউমাও? হায় হায় রে, আমারে এই খবরডাও কেও দেয় নাই? আমারে কেও কিসসুই কয় না, বউমার খবরখান আমারে দিলই না–, ঠাকুমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেন। জ্যাঠা এবারে মৃদু লাঠিচার্জের মতো মৃদু ধমক লাগান।

কী আবার খবর দিব? শুধু শুধু কাইন্দো না তো মা। তার যদি খবর কিছু হইত, তোমারে দিতই।

ছেলের বকুনি খেয়েই ঠাকুমার কান্না বন্ধ। নাক-চোখ মুছে,–তা কও, বউমা আছে কই?

ঘরেই? যাইব ক্যানে?

তা ভালো, তা ভালো। লগে লগেই আছ দুইজনায়। সেই ভালো। রান্ধিয়া বাড়িয়া দিতাসে। হেইখানে যাইয়াও সেবাযত্ন পাইতাসো বউমার। শুইন্যাও শান্তি!

জ্যাঠামশাই দিশাহারা। কিছুতেই ঠাহর পাচ্ছেন না। ঠাকুমার আসল সমস্যাটি তাকে জানানো হয়নি। ছেলেকে দেখতে চান, মন কেমন করছে ছেলের জন্য–এটুকুই বলা হয়েছে তাকে। জ্যাঠামশাইয়েরও নয় নয় করেও তো বয়েস পঁচাত্তরের ওপরে। ওসব অলুক্ষুণে কথা তাঁকে খুলে বলা যায় না। জ্যাঠামশাইয়ের মনে মনে নানারকম হোঁচট লাগছে, কিন্তু একটা জিনিস তিনি গিলতে পারছেন না।

মা, কও দেহি তুমি আমারে প্রণাম করতে দিলা না ক্যান? ঠিক কইরা কও

জিভ কেটে মাথা নেড়ে ঠাকুমা বলছেন, ছি, ছি, পরনাম করতে হয় নাকি। ওইপার থিক্যা আইস্যা তুমিই তো সক্কলের পরনাম নিবা। তা ভালো, আইছ আমারে দেখনের লেইগ্যাই আইছ, সন্দেশ লইয়া আইছ। খুব ভালো, কিন্তু তাও এট্টা কথা বুঝি না। তুমি আইলা কীভাবে?

তুমিই পরনাম–নিবা-টা জ্যাঠামশাই বুঝতে না পারলেও আলোচনা চালিয়ে যান মুখখানা যারপরনাই বিভ্রান্ত দেখাতে থাকে যদিও।

কইতাসি ত, ট্যাকসি কইরা! কয়বার কমু? শোন নাই?

টেকশি ওইপারেও যায়?

যাইব না ক্যান? যাইতে তো মানা নাই?

না, মানে…আচ্ছা তুমি নীচে আইলা কীভাবে? হেইডা কও। নাকি, টেকশি এককেরে উপর অবধি চলিয়া যায়?

জ্যাঠা এবার উদভ্রান্ত।

এইডা তুমি কী কইলা মা? ট্যাকসি তিনতলার উপ্রে উঠে নাকি? আমিই সিঁড়ি দিয়া নাইমা আইসা বড় রাস্তা থিক্যা ট্যাকসি ধরি।

সিঁড়ি! সিঁড়ি দিয়া উপর-নীচ করো?

না তো কি? তিনতালা বাসায় কি লিফট বানায় নাকি!

অসুবিধা হয় না?

না অহন পর্যন্ত তো হয় নাই। তবে ফিউচারের কথা কওন যায় না।

তাহলে মনে হয় সিঁড়িডা কমপ্লিট করসিল রাবণে? আমি তো জানি, আধা-খাচরা। হইয়া পইরা আছে, কমপ্লিট হয় নাই–তাই জিগাইসি, নীচে আইলা কেমনে?

রা-ব-ণের সিঁড়ি! আমি কি স্বর্গে আছি মা?

এই কথাটায় মা ফোঁস করে উঠলেন।

স্বর্গ না তো কী? তুমি হইলা গিয়া তোমার বাবার বড় পোলা। তুমি স্বর্গে যাবা না তো কি নরকে যাবা! তুমিও কও অমূল্যা–

জ্যাঠার আর ধৈর্য থাকে না।

কিন্তু মা, হেইডা তো বহু পরের কথা, আগে তো মরি? অহন তো আমি বাইচ্যা আছি, স্বর্গে যামু, না নরকে যামু, এই প্রশ্নটা কেও করে নাই আমারে। তুমিই কইলা ক্যাবল।

কী কইল্যা? তুমি বাইচ্যা আছ? অমূল্যা তুমি বাইচ্যা আছ? তুমি জীবিত? তুমি স্বর্গে যাও নাই? ওঃ হো-হো…আমার অমূল্যা মরে নাই রে..। আমার অমূল্যা বাইচ্যা আছে রে…ওঃ হো হো…ঠাকুমার আনন্দাশ্রু অঝোরধারায় ঝরতে লাগল। এবং গলা ছেড়ে ওঃ হো-হো-কান্নাটা অবিকল মড়াকান্নার মতো শোনাতে লাগল। এর চাইতে সেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে–অমূল্যা আর নাই-কান্নাটাই ছিল ভালো।

জ্যাঠামশাই এতক্ষণে সবটা বুঝতে পারেন। ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে জ্যাঠামশাই বললেন, মাগো, আসো, তাইলে প্রণামডা অহন কইরা লই?

লও, লও, কর না পরনাম তোমার যত ইচ্ছা। তখন কি জানি? আমি তো জানি তুমি ওইপার থিক্যা…তাই তো হড়বড় করিয়া শুদ্ধা কাপড়খানা পরিয়া আইলাম।

জ্যাঠামশাইয়ের চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে ঠাকুমা মিষ্টি করে হাসেন। তারপরে হাত বাড়ালেন, কই দ্যাও তো দেহি সন্দেশডা যে আনছিলা? জিনিসখান কেমুন, দেখি খাইয়া–

.

আমি হাঁপ ছেড়ে বলি, যাক! সব ভালো যার শেষ ভালো!

কিন্তু শেষটা ভালো কিনা সেটাই তো সংশয়। সেদিন, ঘণ্টেশ্বরের পৈতের দিনে সিরিয়াস কেলো করেছেন। রঞ্জন গুছিয়ে বসেছে।

এতক্ষণে আমার চায়ের কথা মনে পড়ল। চা খাবি তো? রঞ্জন?

আর কী আছে, সঙ্গে কী দেবে?

আজকে হয়েছে মাংসের ঘুগনি।

গ্রেট! লাগাও চা। ঘন্টের পৈতের দিনে বাড়িতে অত লোক, তার মধ্যে ঠাকুমা, বাবা, জ্যাঠা, কাকামণি প্রত্যেকের প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছেন। ব্যাপক কেলো।

ঠাকুমার কেলোর কীর্তিগুলো শুনতে আমি সর্বদাই আগ্রহী।

কী কেলো রে? কী কেলো?

বাড়িতে উৎসব, সবাই জড়ো হয়েছেন। জড়ো হওয়া মানেই সবার আগে ঠাকুমার কাছে যাওয়া। তিন ছেলেই একত্রে উপস্থিত। জ্যাঠামশাই বেচারি তখনও স্বর্গের সিঁড়ির স্মৃতির দ্বারা তাড়িত–তাই তিনিই ঠাকুমাকে প্রণাম করে বললেন :

মা, আমারে চিনো?

চিনুম না ক্যান?

আমার নাম কী? কও দেহি।

ঠাকুমা হঠাৎ জিব কেটে সলজ্জ ঘোমটা টেনে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর চোখের কোণ দিয়ে মিটিমিটির হেসে, ফিসফিস করে জ্যাঠামশাইকে প্রায় কানে কানে বললেন,

কমু কী কইরা? তোমার নাম যে আমারে লইতে নাই মনু? ভাসুরঠাকুরের নামে তোমার নাম দিসি কিনা! তুমি হইলা আমাগো বড় পোলা! সক্কলের আগে তুমি!

শুনে তো সকলেই স্তব্ধ।

তার ভাসুরের নামে নাম? মোটেই না। তার ভাসুরঠাকুর তো ঠাকুর্দার দাদা-বাবাদের জ্যোঠামশাই হন, তার নাম তো ক্ষেত্রপ্রসাদ। জ্যেঠুর নাম অমূল্য। কেসটা কী হল! ঠাকুমাই। বললেন, আইচ্ছা, নামের গোড়ার অক্ষর কইয়া দিতাসি–স-য়ে ফয়ে আস্ফ দিয়া নাম শুরু! বাস! অইসে! ঘরসুন্ধু মানুষ বজ্রাহত! ক্ষেত্ৰপ্ৰসাদে স-য়ে ফয়ে আস্ফ কই? সে তো কেবল স্ফটিকেই থাকা সম্ভব? এ পরিবারে তো ওই নামের কোনও পূর্বসূরী আছেন বলে এখনও শুনিনি।

এই স-য়ে ফ-য়ে-আস্ফ শুনে অবধি চেয়ারের পিঠ ধরে সেই যে দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, জ্যাঠা আর বসেননি।

এবারে জ্যাঠা একা নন–বাবা, কাকা সকলেই বিচলিত হয়ে ঠাকমাকে চেপে ধরলেন।

ঠিক কইর‍্যা কও দিনি মা? তোমার কয়ডা পোলা? তাদের নাম কী কী?

কাকু বললেন, মা, আমার পানে চাইয়া দ্যাখো। –কও তো আমি কে? আমার নাম কী? কাকুর চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে ঠাকুমাও মরিয়া। আর চালাকি চলছে না। এবার ঠাকুমা পুত্রের চোখে চোখে সোজাসুজি তাকালেন।

হঃ! তোমারে চিনি না? আমার পোলা, আমি চিনুম না। নাম শোনবা? ক্যান মনু, আপন আপন নামগুলো তগো মনে নাই? তবে শুইন্যা লও এই আমি কইয়া দিলাম।

তারপরেই হঠাৎ নামতা পড়বার মতো গড়গড় করে একঝাক নাম আবৃত্তি করে গেলেন

বনবিহারী-বিনোদবিহারী-বিমানবিহারী-পুলিনবিহারী-রাসবিহারী-তপন-স্বপন-চন্দন রঞ্জন-কাঞ্চন। লও। আমার সব কয়ডা পোলাপাইনের নাম। গইন্যা লও।

ঘরসুদ্ধ শ্রোতা নির্বাক।

ঠাকুমার তিন সন্তান। অমূল্য, তারাপদ, সদানন্দ। কেউ এই লিস্টে নেই। তাদের পুত্রেরা অবশ্য আছে। কিন্তু বাকি পাঁচজন বিহারীবাবুরা যে কারা, পরিবারের কেউই বলতে পারল না। ঠাকুমা নামগুলি পেলেন কোথায়? নাতিদের নাম না হয় বোঝা গেল,–ছেলেদের নাম বিস্মরণ, সেও না হয় কষ্টেসৃষ্টে বোধগম্য হল, কিন্তু ওই পাঁচটা উটকো নাম কাদের? ঠাকুমা যে ইষ্টমন্ত্রের মতো মুখস্থ আউড়ে গেলেন। বিরাট এক রহস্য সৃষ্টি করল ওই অচেনা নামাবলি। ওরা কারা?

.

রহস্যের মীমাংসা করলেন ঠাকুমারই ছোটভাই, আমাদের মামাদাদু। ঠাকুমার ওই একটিমাত্র ভাই। মামাদাদু বললেন, ওই পাঁচটিই তাদের পাঁচ দাদার নাম। মামাদাদুর জন্মের আগেই তারা গত হয়েছেন মা শীতলার কৃপায়, ঠাকুমার বয়স তখন চার বছর। এই কারণেই মামাদাদুর নাম হয়েছে শীতলাচরণ। ঠাকুমার বিয়ে হয়েছে ন বছরে। ঠাকুর্দাও দেখেননি এই সম্বন্ধীদের। কোথা থেকে যে তুলে এনেছেন ঠাকুমা শৈশবের বিস্মৃত নামগুলি, বসিয়ে দিয়েছেন নিজের সন্তানদের নামের সারিতে, তার অতিপ্রিয়জনদের তালিকায়। কিন্তু স-য়ে ফ-য়ে-আস্ফটার সমাধান মামাদাদুও জানেন না। ওটার কিনারা হল না।

.

এই ঘটনার উপসংহার বাকি আছে দিদি। এখানেই শেষ নয়। পরদিন সকালে উঠে ঠাকুমা মাকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, বউমা, আমি কেডা? এ-হেন অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থাণুবৎ। কও দিনি? আমি কেডা?

প্রায় গোপন কথা বলাবলির মতো ফিসফিস করে মাকে জিগ্যেস করলেন ঠাকুমা, ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে। অগত্যা তার বউমা বললেন, মা, আপনি আমার শাশুড়ি, এই বাড়ির কর্তামা, আনন্দমোহিনী।

ঠাকুমা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে, সন্দিগ্ধ সুরে বললেন, আনন্দ মোহিনী? হেইডা আবার কেডা? বউমা? ওই নামখান কার?

মা-র প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। তখন আমরা গেলাম অভয় দিতে। ওই লাইনেই নয়। ট্র্যাক বদল।

আরে! তুমি তো আমাদের ঠাকুমা, আমাদের চিনতে পারছ না?

আঃ হা। তাই ক। আমি তো রঞ্জন-চন্দনের ঠাকুমা। বাস বাস আর কইতে লাগব না। বুঝছি।

রঞ্জন থামল। এই গল্পের টীকা হয় না। আমি শুধু চায়ের কাপটা এগিয়ে দিই। রঞ্জন চা-টা শেষ করে আবার শুরু করল।

মেজদির নাতি হয়েছে। তাকে নিয়ে এসেছে ঠাকুমার কাছে। ঠাকুমা বসে আছেন বিছানায়, তার কোলে দেওয়া হল। ঠাকুমা তো পুতিকে কোলে করে খুব খুশি। অনেক আদর করছেন, ছড়া কাটছেন। ফরসা ধবধবে ছোট্ট বাচ্চাটা, মাসখানেক, মাস দেড়েকের হবে, তার পরনে কিছু নেই। কেবল কোমরে কালো ঘুনসিতে একটা তামার পয়সা বাঁধা। ঠাকুমা আদর করতে করতে জিগ্যেস করলেন, ভারি সোন্দর! এইডা কি হইসে? পোলা, না মাইয়া?

সবাই সমস্বরে বলে উঠেছি, কেন ঠাকুমা? ও তো তোমার কোলেই আছে; ছেলে না মেয়ে দ্যাখাই তো যাচ্ছে সেটা

ঠাকুমা কেমন লজ্জা পেয়ে গেলেন। আস্তে করে মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বললেন, অতশত আমার মনে নাই, তরাই কইয়া দে আমারে—

.

আমি এবারেও কী বলব, ভেবে পাই না, শেষে রঞ্জনই কথা বলে।

এ তো একরকম। কিন্তু গতকাল যা ঘটল সেটা ক্লাসিক। দুপুরের দিবানিদ্রার পর উঠে ঠাকুমার বেজায় ফুর্তি। ব্যাপক চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন। সারা মুখ উল্লাসে ঝলমল করছে, কণ্ঠস্বরে বিয়েবাড়ির ব্যস্ততা।

কই রে তপইন্যা, রঞ্জইন্যা, আমার চন্দনবুড়াটা, কই গেলি তরা সব? আয়, আয়, শীঘ্র আইস্যা আমারে তোল, আমারে তোল, আমারে পুড়াও সদানন্দ, ও তারাপদ, ও অমূল্যা, দৌড়িয়া আসো বাবারা, আমারে পুড়াও! আমরাই দৌড়ে যাই।

ও ঠাকুমা, হল কী তোমার! ও কী আকথা-কুকথা বলছ?

আহা, আমারে পুড়াইবি আর কখন? আমি ত মসি। রাইতেই মইরা গিসি, তরা কেউ বোঝ নাই। আর বিলম্ব না, জলদি জলদি পুড়া আমারে-রাইত হইলে তো মোশকিল, –দিনে দিনেই লইয়া চল্

ছিঃ ঠাকুমা, অমন বলে না, তুমি মরবে কেন! ষাট! তুমি মরনি।

হ, হ, আমি মরসি, আমি মরসি। আমার পোলাগুলা গেল কই? ডাইক্যা দে, পুড়াইতে ক আমারে।

আরে না, ঠাকুমা, মরনি তুমি! এই দ্যাখো, মরলে কি ব্যথা লাগে? বলেই সাবধানে ঠাকুমার পায়ে এক রামচিমটি।

উঃ হু হু হু..ঈ..শ কী পাজি! মরা মানুষেরে ব্যথা দেয়। মরসি, তবু জ্বালাস? তগো লজ্জাশরম নাই?

আহা, মরা মানুষকে কি ব্যথা দেওয়া যায়! তাহলে তো পোড়ালেও তুমি ব্যথা পাবে। পাবে না? তুমি বেঁচেই আছ ঠাকুমা। জিন্দা মানুষ তুমি।

তরা পোলাপাইন, তরা কিসু বোঝে না। আমি বাসি য্যান মরসি। আর তরা কও মরি নাই। ল ল আমারে পুড়াইতে ল।

না গো ঠাকুমা। সত্যি বলছি, তুমি মরনি। তুমি স্বপ্ন দেখেছ। স্বপ্ন। চিমটিতে ব্যথা পেলে, দেখলে না?

স্বপন ছিল ওইটা?

হ্যাঁ ঠাকুমা। স্বপ্ন।

মরি নাই?

না, না, মরবে কেন?

ঠিকঠাক কইতাসো তোমরা?

ঠিকঠাকই কইতাসি ঠাকুমা, মর নাই তুমি। বাইচ্যা আছে। জিন্দা আছ। শ্বাসপ্রশ্বাস পড়তাসে তোমার। স্বপ্নই দেখসিলা তুমি।

তৃপ্ত, উজ্জ্বল মুখখানি মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ, নিষ্প্রভ, মলিন হয়ে গেল ঠাকুমার।

যাঃ, খোয়াবই দ্যাখতাসি ক্যাবল? এইবারেও মরণ হইল না তাইলে?

খুব দুঃখী মুখে ঠাকুমা চোখ বুজে জপের মালা নাড়াচাড়া শুরু করে দিলেন। আপন মনেই বললেন, মরি নাই? দু-র ছাই!

.

রঞ্জন চুপ করে গেল। স্তব্ধতা ভেঙে আমি বলি, ঘুগনিটা খা। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তারপর? আজকে কী বলছেন ঠাকুমা? আজ কেমন মুড?

আজ? আজ যখন আমি বেরুচ্ছি আমাকে বললেন, রঞ্জইন্যা, তুমি কি নয়াপাড়ায় যাও? নয়াপাড়ার দাদুরে একবার দেইখ্যা আইস। ঘরদুয়ার সব বানের জলে ভাইস্যা গেসে, শিবমন্দিরের উচা চাতালে পইড়্যা আছে স্ত্রী-পুত্র লইয়া গরুছাগলের লগে। আমি বললাম, হ্যাঁ, দেখে আসব।

নয়াপাড়াটা কোথায়, রঞ্জন?

ঠাকুমার ভেসে যাওয়া বাপের বাড়ি। বিরাশি বছর আগেকার বন্যার খবর নিতে পাঠিয়েছেন আমাকে।

দেশ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০২

নেশাড়ু অ্যান্ড কোং

আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই। এবারে দোল অন্যরকম হবে। এবারে দোলে সত্যি সত্যি ভাঙের শরবত তৈরি করা হবে বাড়িতে। সেই অনেক, অনেক বছর আগে একবার পুজোর সময়ে সত্যনারায়ণ পার্কে গিয়েছিলুম মারোয়াড়ি দোকানের বাদাম পেস্তা দেওয়া ভাঙের শরবত খেতে। আমার বড় মেয়ে পিকো, স্বাতী (গঙ্গোপাধ্যয়), দীপংকর চক্রবর্তী, রঞ্জন মিত্র আর আমি। পিকো তখন ইস্কুলে। বুদ্ধি করে নিজে গাড়ি চালাইনি, পাছে ভাং-টাং খেয়ে ফিরে আসতে না পারি? স্বাতী-সুনীলের পুরোনো ভোজপুরী ড্রাইভার মহেন্দ্রকে নেওয়া হল, তার প্রধান কারণ, সে-ই শুধু নিশ্চিত জানে কোন দোকানে মিলবে। দীপংকর দোকানিকে অন্তরালে নিয়ে গিয়ে বলে দিল, চার গেলাস ভাং সমেত রেগুলার, আর দুই গ্লাস ভাং ছাড়া বাদাম-পেস্তার শরবত, বাচ্চা আর ড্রাইভারের জন্য। কিন্তু কাউকেই কথাটা বলা চলবে না।

যথাকালে বড় বড় গ্লাস ভর্তি অপরূপ স্বর্গীয় স্বাদ-গন্ধের শরবত এল। মনে হল চুমুক দিয়ে গ্লাসভর্তি গলে যাওয়া গোলাপ-গন্ধী কুলফি মালাই খাচ্ছি বুঝি। আরে? কই কিছুই হচ্ছে না তো? একটু উন্নত মানের সঘন প্যারামাউন্টের শরবত। এতগুলো টাকা গোল্লায় গেল গো!

তারপরে বোঝা গেল বাড়ি গিয়ে। কেউ অদৃশ্য জলের মধ্যে পা দিয়ে ফেলার ভয়ে শাড়ি তুলে লক্ষ্য দিচ্ছি, কেউ নিজের পেটে ড্রাম বাজিয়ে মার্চ করছে, কেউ পুরুত হয়ে ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ করছে। সে এক অপরূপ কাণ্ড। পিকোই কেবল বুক ফুলিয়ে দেখছ, আমার কিছু হয়নি বলে সব্বাইকে সামলাচ্ছে।

সেই যে আমাদের বাড়িতে বিজয়ার দিনে মা সিদ্ধির শরবত তৈরি করতেন, তার চেয়ে আর একটু ঘন। এটুকুই। সে শরবতও ছোটদের আর বড়দের দুরকম হত, বড়দেরটায় সিদ্ধি এক চিমটি বেশি, বাচ্চাদের সিদ্ধির পরিমাণ নামমাত্র।

কোনোদিন কারুর মধ্যে নেশার চিহ্ন দেখিনি। শুধু একবার কালীপুজোর সময়ে দীপংকর, আর রঞ্জন সিদ্ধি বেটে শরবত বানিয়েছিল। আমার মা-কে দেওয়া হচ্ছিল না, কিন্তু মা খোঁজ করলেন,–কই দেখি, কী বানিয়েছিস? শুধু তলানিটুকু বাকি ছিল। মাকে সেটাই দেওয়া হল। ভয়ে কাঁটা হয়ে। ওতেই নাকি চরম নেশা হয়। মায়ের কিন্তু কিছুই নেশা হয়নি তাতে। একমুখ হেসে বিজয়গর্বে বললেন,–এত কড়া কড়া ওষুধ খাই, আমাকে কোনো নেশা কাবু করতে পারবে না। ওষুধের বিষের জোর একদম সাপের বিষের মতন! হুঁ হুঁ বাবা!

কিন্তু দীপংকর আর সমীরের নেশা হল। ওরা তো মায়ের মতো কড়া কড়া ওষুধ খায় না! সমীর ছিল আমার পাতানো ছেলে, রাঢ় বাংলার এক গ্রামে তাদের বাস। সমীরের কথা আপনারা জানেন, সেই যে ভক্তিমান ছেলেটিকে কুম্ভমেলায় পেয়ে ছেলে পাতিয়ে নিয়েছিলুম। রঞ্জনের বেদম ঘুম পেল, আর কিছু নয়। আমারও ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। পিকো-টুম্পাকে সিদ্ধি দেওয়া হয়নি, বলাও হয়নি কিছু। ওদেরই সিদ্ধি খেয়েছি ভেবে উত্তেজনায় ঘুম ছুটে গেল। নানান পাগলামি করতে লাগল। যেমন, কালী সাজা, সমীরের আর দীপংকরের মত্ততার দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।

প্রথমে দীপংকর। আমরা স্থির করেছিলুম মায়ের ঘরে নো এন্ট্রি বোর্ড লাগিয়ে দেব। কিন্তু দীপংকর কথা শোনার ছেলে? তদুপরি সিদ্ধির দ্বারা শক্তিমান। সে গান গাইতে গাইতে এবং নাচতে নাচতে মাসিমার ঘরেই প্রবেশ করল, আআয় আআয় হআঁস, চই চই চই..মাসিমা বললেন, বা, বা, বেশ সুন্দর কিন্তু অন্য একটা গান গাইলে হতো না? দীপংকর তক্ষুনি মহা উৎসাহে রাজি। সে চিৎকার করে যাত্রাপালার গান ধরল, নাটকীয় ভাবে হাত-পা নেড়ে।… ওকে ছুঁস নে পাগোল! ও যে বিষের বড়ি ইইই– মা বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে, বাবা, তুমি একটু বিশ্রাম নাও।

ইতিমধ্যে মজা বুঝে পিকো টুম্পা একটা বজ্জাতি শুরু করেছে। আমার দুটো জাপানি মুখোশ ছিল, একটি লাল-কালো, একটি সাদা। সাদা মুখোশ পরে টুম্পা সমীরের সামনে গিয়ে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। পিকো লাল কালোটা মুখে পরে হাতে পিঠ চুলকোনোর আঙুলওলা মোষের শিং-এর ডান্ডাটা খাঁড়ার মতন মাথার ওপরে তুলে টুম্পার বুকে আলগোছে এক পা তুলে দাঁড়াল। এ সবই ঘটছে মায়ের সামনে, মায়ের ঘরে। সমীর মায়ের খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে বলছিল–আমাকে ভকতি দাও, শকতি দাও মা গো,–এবারে টান শুয়ে পড়ল পিকো-টুম্পার যুগ্ম প্রজেক্ট, জ্যান্ত, ফ্ৰকপরা, মুখোশ পরা। কালীমূর্তির সামনে। আর আকুল হয়ে বলতে লাগল, আমাকে ক্ষমা করে দে মা, আমার সব ব্যাড ইভিলগুলোকে তুই দয়া করে গুড ইভিল করে দে মা। আর ওইরকম করব না মা! আমরা হেসে গড়াচ্ছি। পিকো-টুম্পা গম্ভীর। ওরা যেই হেসে মুখোশ খুলে ফেলল, ঘোর কাটল সমীরের। সবাই অট্ট হাসছি, সেই হাসিতে সমীরও যোগ দিল। মা ওদের খুব বকুনি দিলেন। হাসতে হাসতে সমীর কিন্তু কিছুই বলল না।

কিছুদিন আগে, দোল উপলক্ষে সিদ্ধি খাওয়া হবে স্থির হল। মা আর মাথার ওপরে নেই। পিকো-টুম্পা দূরে যে যার সংসারে। দীপংকরটা চলে গিয়েছে জন্মের মতো। সমীর তার গ্রামে। রঞ্জন চাকরি করে অনেক দূরের পাহাড়ি শহরে। আপাতত এ-বাড়িতে আছি শুধু কানাই ঝর্না নীলু অমিত, বাবুসোনা, আমি আর শ্রাবস্তী। আর আছে, ছোট ছোট চারপেয়ে ছেলে-মেয়েরা, ভুতুম, কেলটুশ, আর তাদের দিদি তুরতুরিয়া। শ্রাবস্তী বলেছে অফিসের বন্ধুদের কাছ থেকে একটু ভাং চেয়ে আনবে। তার পরে শরবত বানানো হবে। বাড়ি শুষ্টু সবাই উত্তেজিত, দোলে ভাঙের শরবত হবে।

দোল এসে পড়ল বলে। শ্রাবস্তী অফিস থেকে ভাং এনে দেখাল, পাকা তেঁতুলের ডেলার মতো দেখতে। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। সে শিখেও এসেছে কেমন করে এটা দিয়ে শরবত বানাতে হয়। অবিশ্যি এমন না, যে ও না জানলে কেউ বানাতে পারবে না। কানাই জানে বাঁকুড়া স্টাইলের সিদ্ধির শরবত। আর নিলু জানে ওদের ক্যাম্পের স্টাইলের সিদ্ধির শরবত। কানাই বলল, ওদের গ্রামের ভাঙের শরবতটায় ওরা ক্ষীর মালাই গুলে দেয়। নীলু বলল, ওদের ক্যাম্পের সিদ্ধির শরবতটায় বাদাম পেস্তা বেটে দেয়। শুধু ঝর্না বলল সে কোনোদিন খায়নি, ভাঙের শরবত বানাতেও জানে না, খেতেও চায় না। দুউর দুর। জ্যাত্তো নেশার জিনিস।

আমরা নিশ্চিন্ত। একটা না একটা বানানো হবেই হবে। চয়েস অনেক।

আফিম নয় তো রে? আফিসের ডেলাও কিন্তু এমনি দেখতে হয়।

আরে দূর, কেউ ফ্রি-তে আফিম দেবে? আর, মাগো, তোমার-আমার কাছে আফিমও যা ভাংও তাই।

ওর কাছেই রইল ভাং-এর ডেলা। এমনই কপাল, একটু জমিয়ে সবাই মিলে ভাং খাব কী, ঠিক দোলের আগের দিন কেশ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। খালি মাথা ঘুরে ঘুরে ঠশঠশ করে মৃগী রুগিদের মতো মুখ ঠুকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে। থ্যাবা হয়ে, চার পা এলিয়ে আহা, ঠিক যেন সদ্যোজাত বাছুর। যন্ত্রণার চোখ বুজে আসছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। এ কী রে বাবা? কুকুরদের আবার মৃগী হয় নাকি? শুনিনি তো কখনো? মুখে অবিশ্যি গাজলা উঠছে না। আমরা গিয়ে বুকে হাত দিয়ে দেখছি হার্ট চালু কিনা। পশুপ্রাণীর ডাক্তারবাবুকে পাওয়া গেল না, বাইরে গেছেন। কেল্টশের জন্যে আমরা ভেবে অস্থির। ইতিমধ্যে শ্রাবস্তী তার ট্রাউজার্সের পকেট থেকে ভাঙের ডেলাটা আনতে গেল, কানাইকে দিয়ে দেবে। সে ওটা দিয়ে যা পারে করুক। বাঁকুড়া হোক, কিংবা ক্যাম্প, এসে যায় না। যা হয় একটা কিছু হলেই হল। তরিবত করে সিদ্ধির শরবত খাওয়ার ভাবনা এখন চুলোয় গেছে, কেশের জন্য সবাই উদবিগ্ন।

একটু পরেই শ্রাবস্তী এসে খুব উত্তেজিত গলায় বলল, আমার প্যান্টের পকেট থেকে ভাং-এর গোল্লাটা কে নিল? প্যান্টটা মাটিতে পড়ে আছে, পকেটে ভাঙের ডেলাটা নেই। কে নিয়েছ, বল শীগগির! কেশ ওর পিছু পিছু একটুখানি এসেই ফের চার পা ছেতরে পড়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ খোঁজ করার পরে আমাদের একটা সম্ভাবনা মাথায় এল। আচ্ছা, গন্ধে গন্ধে লোভী কেন্টুশ গিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ভাং-এর ডেলাটা খেয়ে ফেলেনি তো? নিশ্চয়ই তারই ফলে এত মাতলামি করছে? কী কাণ্ড!

যাক, তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই, শুধু একটু তেঁতুল গোলা? কী লেবুর জল? নাঃ, কেশ টক ভালোবাসে না। কোনোটাই খাওয়ানো যাবে না। কী করা?

আহা, একটু দুধ খাওয়ালে হয় না?

কিন্তু কেন্টুশ কিছুতেই খেতে এল না। চলতে গলে পড়ে যেতে থাকল, আর সেখানেই শুয়ে ফুরফুর করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকল। তার খিদেই পেল না।

থাকুক অমনি করে, আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে যাবে। বিষ তো নয়।

দুদিন ধরে ওর ঘোর কাটেনি, কুকুরছাড়া তো? পরিণত বয়স্ক কুকুর হয়তো আর একটু দ্রুত সেরে উঠত। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল কেশ, আমাদের চা খাবার সময়ে আবার বিস্কুট চাইতে লাগল হেংলু হয়ে। আঃ, আমাদের হৃৎপিণ্ডের গতি সহজ হল।

আর কোনোদিন কারুর প্যান্টের পকেট থেকে গন্ধে গন্ধে কিছু চুরি করে খায়নি কেশ। কেশের কেলোর কীর্তির সেখানেই ইতি হল।

এখন সে অতি সাবধানি ভদ্দরলোক। সাধ্যসাধনা করে কিছু না দিলে খায় না। বিস্কুট দিলেও তিন বার শুঁকে পরীক্ষা করে তারপরে ভেবেচিন্তে মুখে নেয়। একবার ভুল করে কেশও বড় হয়ে গেল?

শারদীয়া কলকাতা পুরশ্রী ১৪২৪

বাপ রে বাপ!

শুভ বুধবার দিনে, বিকেলবেলায়, অশ্লেষা নয়, মঘা নয়, ত্র্যহস্পর্শ নয়, সোমেশবাবু হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। রহস্যঘন অন্তর্ধান। ইন্দ্রাণী খোঁজ করতে করতে প্রায় পাগল। জানা গেল অফিসে নাকি তিন মাসের ছুটি নিয়েছেন। মেডিক্যাল লিভ। অথচ ওঁকে কেউ অসুস্থ দেখেনি। বেশ ফুর্তিতে ছিলেন ছুটি নেবার সময়ে। বেরোনোর পথে স্টেনো মেয়ে জেনিফারের চুল টেনে দিয়ে গেছেন। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমেই একটা মিঠে পান খেয়েছেন–তারপর কোনদিকে যে গেছেন সেটা আর কেউ বলতে পারছেন না। অফিসের গাড়ি নেননি। বাড়িতে একটা হেঁয়ালি চিঠি লিখে গেছেন–ইন্দ্রাণী আই হ্যাড নো চয়েস। এক্সকুজ মি–ক্যে সেরা সেরা–হোয়াট উইল বি উইল বি, দ্য ফিউচারস নট আওয়ার্স টু সী–আর ডায়েরিতে গোটা গোটা হরফে লিখে গেছেন–উৎকণ্ঠ আমার লাগি যদি কেহ প্রতীক্ষিয়া থাকে, সেই ধন্য করিবে আমারে। আর অফিসের ড্রয়ারে ঠিক জহরলাল নেহরুর মত করে প্যাডের পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছেন–The woods are lovely, dark and dup,/But I have promises to keep,/ And miles to go before I leap. শেষ শব্দটা ভুল লিখেছেন সেটা নিয়েও ইন্দ্রাণী অত্যন্ত চিন্তিত। ব্যাংকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গেছেন। ড্রয়ারে জয়েন্ট একাউন্টের চেকবই পাশবই রেখে গেছেন। ছুটির মাইনে নেবার জন্যে তিনটি অথরিটি পত্র সই-করা। সঙ্গে আরেকটি খাম–ওপরে লেখা–ফর ক্যালকাটা পুলিশ–ভিতরে নোট–প্লিজ ডু নট লুক ফর মি। রাদার লুক আফটার মাই ফ্যামিলি। আইল বি ব্যাক ইন টাইম। পুলিশে ইন্দ্রাণীর দাদা কাজ করেন–তিনি গম্ভীর মুখে নোটটি নিয়ে পকেটে পুরেছেন। তারপর অফিসের ডিরেক্টর ঘোষদা, চৌহান আর রণু ব্যানার্জীর সঙ্গে ইন্দ্রাণীর দাদার একটা পরামর্শ সভা হয়েছে। মাস ঘুরতে চলল, পুলিশ কিছুই মীমাংসা করতে পারছে না। আপন বড় সম্বন্ধী থাকা সত্ত্বেও? ইন্দ্রাণী দাদাকে যাচ্ছেতাই করছেন। দাদা কেবলই বলেন, চেষ্টা তো করছি রে। খোঁজ তো করছি রে! এখন তোর কপাল আর আমার হাতযশ?

তা, দুটোর কোনোটাই বিশেষ কাজে দিচ্ছে না। দুমাস হয়ে গেছে।

ইন্দ্রাণী এখন কেবলই ভাবেন আর হা-হুঁতাশ করেন, আহা, তখন মতটা দিলেই হত। তবু ঘরেই থাকতো লোকটা। অত করে হাতে পায়ে ধরে বললেও, ইন্দ্রাণী কিছুতেই রাজি হতে পারেননি। ওঃ, কী বোকামিই হয়েছে। সোমেশ যাই বলুন, ইন্দ্রাণী কেবলই হাউমাউ করে কেঁদেছেন, আর বলেছেন, ওরে বাপ রে! সে কি হয়–মা-বাবা কী ভাববেন!–বান্টু, মিন্টু, সন্টুর কী হবে?–পাড়ার লোকে কী বলবে?-না, না, না, খব্বদার না! এ কী সব্বোনেশে কথা–জন্মেও শুনিনি–ছিঃ–

সোমেশ একের পর এক বই এনে রাত জেগে পড়েন আর একটা বই শেষ হলেই ইন্দ্রাণীকে পড়ানোর চেষ্টা করেন–পঁচিশ বছরের জগতে কতবারই তো এমনটি হয়েছে। এই ভারতবর্ষেই কি হয়নি? এই তো বম্বেতেই ফ্যারা রুস্তম আছে

একটা করে বই এনে সোমেশ ইন্দ্রাণীকে দেন, আর ইন্দ্রাণী টান মেরে সেই বইটি তক্ষুনি জানলা গলিয়ে ফেলে দেন। বই গিয়ে সোজা পড়ে পাশের বাড়ির সদ্য খোঁড়া গর্তের খেতে। সোমেশ ডাকেন,

বান্টু-মিন্টু-সন্টু।

যাই বাবা!

পাশের বাড়ির বাগানে একবার যাও তো।

এক্ষুনি নিয়ে আসছি বাবা!

সোমেশ কাদা ঝেড়েঝুড়ে বই আবার তাকে তোলেন। ইন্দ্রাণী কিছুতেই পড়তেন না।

না, না, না–ওসব কেলেঙ্কারি কাণ্ড আমি কিছুতেই হতে দেব না–মরে গেলেও না। না, না, না।

সোমেশবাবু কত বুঝিয়েছেন, তোমার বাবা-মা-র ভাবনার কী আছে? তাদের মেয়ে তো জলে পড়বে না? আমরা যেমন আছি তেমনই তো থাকব? আর পাড়ার লোকে যা খুশি বলুক, ক্ষতি নেই, দুদিন বাদে পরিবর্তন আসছে না। তাদের ছেলেমেয়ের জীবনে তো কোনও মৌলিক পরিবর্তন আসছে না। তাদের যত্নআত্তি দেখাশুনো শিক্ষাদীক্ষা সবই যেমনকে তেমনই থাকবে তো। ক্ষতি যদি জগতে কারুর হয় ইন্দু, সে কেবল তোমারই। তা আমার জন্য এইটুকু স্যাক্রিফাইস করতে পারবে না? সতী-সাবিত্রীর দেশের মেয়ে তুমি, স্ত্রীরা এখানে স্বামীর জন্যে কী না করেছে?

যে যাই করুক। এমনধারা অন্যায় আব্দার তো বাবা কস্মিনকালেও শুনিনি। না, ওতে মত দিতে পারব না–না, না! ইন্দ্রাণীর সেই এক জেদ।

প্লিজ ইন্দু, দেখতে পাচ্ছ না, কীরকম বকচ্ছপ মূর্তি হচ্ছে তোমার স্বামীর। গেঞ্জি পরে লোকের সামনে বেরুতে পারি না, সাঁতারের ক্লাবে যাওয়া তো কবেই বন্ধ হয়েছে–একবার হ্যাঁ বল, লক্ষ্মীটি, বুঝতে পারছ না কী কষ্ট আমার?

হ্যাঁ, এইবারে বুঝতে পারছেন বটে ইন্দ্রাণী। তখন বোঝেননি। দুয়ে দুয়ে চার দিব্যি মিলে যাচ্ছে এতদিনে।

চিরকালই সোমেশের চেহারায় সেই মেয়েলি মিষ্টতাটা আছে, লালিমা পাল (পুং) গোছের একটা লাবণ্য, যাকে বলে লালিত্য। আবার স্বভাবেও ইদানীং কেমন-কেমন একটা বিতিকিচ্ছিরি ভাব দেখা দিয়েছিল, দিন দিন যেন পদিপিসি টাইপের স্বভাব হচ্ছে তোমার–গাল দিচ্ছিলেন স্বামীকে ইন্দ্রাণী। একেই তো উঁটাচচ্চড়ি খেতে ভয়ানক লোভ হয়েছিল, প্লেটের পাশে উঁটা চিবিয়ে পাহাড় করছিলেন, শরৎচন্দ্রের স্ত্রী চরিত্ররা যেমন করে থাকেন, যার জন্যে মাঝে মাঝে অফিসে দেরিও হয়ে যাচ্ছিল তার–আর তার চেয়েও ভয়ংকর কথা, বাড়িতে মেয়েরা এলেই আর রক্ষে নেই। অমনি সোমেশবাবু এসে হামলে পড়বেন, বাঃ, বাঃ, কী শাড়ি এটা, আঁ? মিসেস গুলাটি? দেখি! দেখি! অর্গানজা প্রিন্ট বুঝি? দারুণ তো?–কিম্বা, আরে? বালাজোড়া কবে গড়ালেন মিসেস রয়? আগে দেখিনি তো? দারুণ কাজটা করেছে কিন্তু! কভরি সোনায় হল? ইন্দ্রাণীর গা জ্বলে যেত স্বামীর এই মেয়েলিপনায়। গলার স্বরটি তো ঠিক মুখশ্রীর মতনই মধুমাখা, ইদানীং যেন আরো মিষ্টি হচ্ছিল, ফোনে মাঝে মাঝে ওঁকে ওঁদের রিসেপশনিস্ট জেনিফারের সঙ্গে গোলমাল করে ফেলেছেন ইন্দ্রাণী। এ ছাড়া ইদানীং যে কথায় কথায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল সোমেশবাবুর, সে ব্যাপার তো বাড়িশুদ্ধ সকলেরই নজরে পড়ছে।

ভয়ংকর আপশোস হতে থাকে ইন্দ্রাণীর। ইন্দ্রাণী কিছুতেই রক্ত পরীক্ষা করানোর পাগলামিতে সায় দেননি। সোমেশ খেপে উঠেছিলেন নিজের রক্তের ক্রোমোজোম টেস্ট করাতে। প্রায়ই খবরের কাগজ পড়তে পড়তে মার্জিনে লিখে ফেলতেন X+Y Y+Y X+X! ইন্দ্রাণী বলতেন, তোমার নতুন করে কিসের এতো প্রমাণ দরকার? বান্টি-মিন্টু-সন্টু তো ঘুরে বেড়াচ্ছে জগৎ সমক্ষে, কিন্তু সোমেশের তাতে শান্তি ছিল না।

ওটা তো অতীত। আমি জানাতে চাই ভবিষ্যতের কথাটা–

তবে জ্যোতিষীর কাছে চলো।

জ্যোতিষ নয়, ডাক্তার। ইন্দু, ডাক্তার! আমাকে জানতেই হবে–বুঝতে পারছ না, এটা তো ইচ্ছাকৃত ঘটনা নয়, যা ঘটে যাচ্ছে, যা ঘটতে চলেছে–বি সায়েনটিফিক

ভেবে ভেবে ইন্দ্রাণীর বুক ফেটে যাচ্ছে। সত্যিই তো ওঁর এতে হাত ছিল না। ভগবানের মার। কেন যে তখন ইন্দ্রাণী রাজি হলেন না? কেন যে মত না দিয়ে গোঁয়ারের মতন জেদ ধরে রইলুম। এতবড় সর্বনাশটা আর হতো না তা হলে! এই দুনৌকোয় পা রেখে চলা সইতে না পেরে, হয় হিমালয়েই চলে গেছেন, নয়তো আত্মঘাতী হয়েছেন, সোমেশবাবু। হিমালয়ের সম্ভাবনাটা কম নয়, কেননা বুটজোড়া, ওভারকোট আর দস্তানাগুলোও পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় চিন্তায় আর কান্নায়-কান্নায়ই বোধহয় অসময়ে চোখে চালসে চশমা হয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। তিন মাস হয়ে ঘুরতে চলল, সোমেশের খোঁজ নেই। ক্রমশ তিনি পাশের বাড়ির গাজর খেতের মাটিকাদামাখা বইগুলো তাক থেকে নামিয়ে আঁচল দিয়ে ঝেড়েমুছে পড়তে শুরু করলেন ক্রিস্টিন জর্গেনসেন্-এর আত্মজীবনী, ক্যান মরিসের আত্মকথা, ফ্যারা রুস্তমের বিবরণী–পড়তে পড়তে প্রায় স্থির করে ফেলেছেন, দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন,-সোমেশ কাম ব্যাক। ব্লাড টেস্টিং পারমিটেড; এমন সময়ে একটা টেলিগ্রাম এল–সোমেশ চৌধুরী এক্সপায়ার্ড থ্রি মান্থস্ এগো অ্যাট ডক্টর চেঞ্জিংকরস্ নার্সিংহোম–সোমা।

ইন্দ্রাণী ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন সোফার উপরে। তারপরে শুরু হল হাহাকার–সে কি আছাড়ি পিছাড়ি কান্না-হরিদাসী, গঙ্গাঠাকুর হার মেনে গেল; ডাক্তারবাবু এসে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে অজ্ঞান করে ফেললেন, তবে নিশ্চিন্তি। অজ্ঞান হবার আগে ইন্দ্রাণী কেবল বলতে পারলেন, ওই সোমাটা আবার কে?

জ্ঞান ফিরতে ইন্দ্রাণী চোখ মেলেই দেখলেন পাশের ঘাটে তার ফ্যাশনেবল ছোট ননদ শুয়ে শুয়ে ফেমিনা পড়ছে। সোহিনী এয়ার হোস্টেস, থাকে প্রধানত বম্বেতে। মাঝে মাঝে হুটহাট করে চলেও আসে কলকাতাতে, হিল্লিদিল্লি ঘুরতে ঘুরতে। ইন্দ্রাণী খুশি হয়ে বলেন, তুই এখানে? কবে এলি?

প্লাক করা ভুরুর ধনুক বেঁকিয়ে নীল রং করা চোখের পাতা কাঁপয়ে ভ্রমরকালো পল্লবের ছায়ায় তিরস্কার ঘনিয়ে এনে সুন্দরী ননদ বললে, ছিঃ ইন্দু, তুই বলে না! যাঃ!

আরেঃ! তুমি! ইন্দ্রাণী তো হাঁ।

অভিমানে মুচকি হেসে সোমেশ বলল ঠোঁট ফুলিয়ে, আ-হা! আমি না তো আবার কে? সে হাসিতে তার ঠোঁটের শকিং পিংক লিপস্টিক থিরথিরিয়ে কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল ইন্দ্রাণীর বুকও। এ কে? সরু ভুরুর মাঝখানে নীল টিপ, শ্যাম্পু করা বয়েজ-কাট চুল কপাল উড়ে পড়ছে, দুহাতের দশটা নোখে ম্যাচিং শকিং পিংক নেল পলিশ, সেই আঙুল দিয়ে খুব ডেলিকেটলি ফেমিনাটা ধরে আছেন সোমেশবাবু। পাশের বেডসাইড টেবিলে লম্বা গেলাশে কুয়াশা অরেঞ্জ স্কোয়াশ। কপালের উড়ো চুল আস্তে করে সরিয়ে সোমেশ বললেন, মেন দেখছ? আমার নাম এখন সোমা।

তাই বলো! তুমিই সোমা। আর আমি ভাবছি- ইন্দ্রাণীর ভয়টা কেটে গেছে। বাঃ। বেশ তো? তেমন তো কিছু নয়। রাস্তায় হাততালি দিয়ে ঢোল বাজিয়ে নাচগান করে বেড়ায় যারা, তাদের মতন তো একটুও দেখাচ্ছে না সোমেশকে। ঠিক সোহিনীর মতো দেখাচ্ছে, যে ছোট ননদটিকে ইন্দ্রাণীর খুবই পছন্দ।

চিরদিনকার মেয়েলি সোমেশ এখন পরমাসুন্দরী হয়ে উঠেছেন। নীল নাইলনের ট্রান্সপ্যারেন্ট নাইটির তলায় সোমেশের ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস দেখে তিন ছেলেমেয়ের মা ইন্দ্রাণী রীতিমতো লজ্জা পেলেন। রূপসী বলেও ইন্দ্রাণীর খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনিও ঠিক এতটা রূপসী নন। ইশ, কী সরু কোমর। যেন মাছিটি। ইশ, কী ফিগার! অনায়াসে যে-কোনো বিউটি কটেস্টে নামতে পারবেন সোমেশ। বয়স কুড়ি বছর কমে গেছে। ইন্দ্রাণীর রীতিমতো ঈর্ষাই হয়। রাগী গলায় বলে ওঠেন, ছিলে কোথায় অ্যাদ্দিন, শুনি?

কেন টেলিগ্রামেই তো জানিয়েছি। ডক্টর চেঞ্জিংকর-এর নার্সিংহোমে। সেখানে কেবল অপারেশনই হয় না, আফটার-কেয়ার ক্লাসেসও হয়, বড় বড় বিউটিশিয়নরা এসে আমাকে চলতে, ফিরতে, বলতে, কইতে, সাজতে, গুজতে শিক্ষা দিয়েছেন। আমাকে কেমন লাগছে? ভালো না? মাত্র তিন মাসে?

ইন্দ্রাণী এ কথাটার উত্তর না দিয়ে বললেন, তারপর?

তারপর মানে?

কী করবে ভাবছ এবার? বোনের মতন উড়োজাহাজের গিন্নিপনা? নাকি তেল সাবানের বিজ্ঞাপন?

দুর দুর। ও বয়সে ওসব কি আর হয় গো? আমার লীভও তো শেষ। সোমবারই জয়েন করতে হবে।

তার মানে?

মানে তিন মাসের ছুটিতে গেছলুম। ছুটি ফুরিয়েছে, আবার অফিস যেতে হবে। পুনর্মুষিকো!

মানে, ওই চাকরিতেই–?

হ্যাঁ, ওই চাকরিতেই তো। চাকরি বদলানোর কোনো কারণ আছে কি? ইন্ডিয়ান কনস্টিটুশানে স্ত্রী-পুরুষের ইকোয়াল রাইট এসব ক্ষেত্রে।

ইন্দ্রা চমৎকৃত হল।

সত্যিই তো। মেয়েমানুষ যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, তবে কোনো অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির একজন সিনিয়র একজিকিউটিভ মেয়ে হয়ে গেলেই বা কার কী? বরং যা চেহারা খুলেছে সোমেশের তাতে একটা লিফটই উল্টে পাওনা হওয়া উচিত। পাবলিক রিলেশনস অফিসারের কাজে এফিসিয়েন্সি বাড়বে বই কমবে বলে তো মনে হচ্ছে না। মনে মনে ভরসা পেয়ে আদুরে গলায় ইন্দ্রাণী বলেন, হ্যাঁ গো, তোমাকে আমি কী বলে ডাকব তবে এবার থেকে?

কেন? যা বললে এক্ষুনি, তাই বলবে। অবিশ্যি সোমাও বলতে পারো। গালে টোল ফেলে হাসলেন সোমেশবাবু। ইন্দ্রাণীর অতি পরিচিত অতি প্রিয় সেই পুরোনো হাসি, শকিং পিংক লিপস্টিকের রেশমী চাদর মোড়া হয়ে কেমন যেন অচেনা দেখাল।

তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুই বদলাবে না ইন্দু ভয় পেও না তুমি হাসলেন সোমা চৌধুরী, আসলে প্রবলেম অন্যত্র। প্রবলেম হবে লীগ্যালি সেকশুয়াল আইডেনটিটি চেঞ্জ করবার সব হ্যাপা পোয়ানো। চাকরিতে, পাসপোর্টে সর্বত্র নাম বদল, তারপর আগেকার সব সার্টিফিকেটগুলিতে কোর্ট এ্যাফিডেভিট করো–নতুন সিগনেচার করো-চল্লিশ বছরের আইডেনটিটি হঠাৎ বদল করা কি সহজ? উঃ, মা গো!

আমি কি এখন তবে মিসেস সোমা চৌধুরী ও মেয়েতে মেয়েতে বিয়ে কি এদেশে আইনসিদ্ধ হয়? ইন্দ্রাণীর প্রশ্নে সোমেশের হাসি শুকিয়ে গেল।

বোধহয় তুমি আমাকে ডিভোর্স করতে পারো এই গ্রাউন্ডে কিন্তু সেটা কমপালসরি কিনা সে খোঁজটা নেওয়া হয়নি। ইন্দু, আমাকে তুমি ছেড়ে যাবে না তো ভাই? সোমেশের মিঠে সরু গলায় আন্তরিক উদ্বেগ ছলছলাৎ করছে দেখে ইন্দ্রাণীর ধড়ে প্রাণ এল। যা প্রাণের টানটা আছে তাহলে। বান্টি-মিন্টু-সন্টু কই?–সোমেশ প্রশ্ন করেন।

ছেলেমেয়েগুলোকে মামাবাড়িতে নিয়ে গিয়েছে শনি-রবিবারের ছুটিতে। ইন্দ্রাণীর বৃদ্ধ বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতেই গেছে তারা, এমন বললেও খুব ভুল হবে না।

ট্রাঙ্ককল করতে হবে না, সোমবারই তারা এসে পড়বে। বোলপুর গেছে। মনের ভেতরে হালকা একটা বাতাস বয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। যাক!

তোমার মা-বাবার শরীর ভালো তো? বাবার ছানি কাটার কি হল?

আঃ! আরেকবার আরাম পেলেন ইন্দ্রাণী। পারিবারিক দায়িত্ববোধটোধগুলোও সব ঠিকঠাক আছে।

কাটাবেন এবারে। তোমার জন্য ভেবে ভেবে দুটো ছানিই পেকে উঠেছে। অমন করে পালাতে হয়?

তা হলে তো উপকারই হয়েছে বলতে হবে? কনুই দিয়ে ইন্দ্রাণীকে একটা মেয়েলি ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসলেন সোমেশ।

সোমবার দিনে নতুন নামে অফিসে জয়েন করলেন জ সোমা চৌধুরী। মিস্ কিংবা মিসেস কিছুই লেখবার দরকার নেই, এই মস্ত সুবিধা হয়েছে আজকাল। সোমেশের পক্ষে আইডিয়াল বন্দোবস্ত। মিও নন, মিসেসও নন, আর মিস্টার তো ননই।

সোমবার অফিসে হই-হই পড়ে গেল। একমাত্র অফিসের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিসেপশনিস্ট, যার সঙ্গে তার মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল, সেই জেনিফারই কেবল অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর সবাই ফ্ল্যাট। গোলাপি শিফনের আঁচল উড়িয়ে মজ এস চৌধুরী তার মার্ক ফোর অ্যাম্বাসাডার থেকে নামলেন, গায়ের মৃদুল ফরাসি সৌরভে, চোখের চটুল কটাক্ষে ভুরুতে-চুলেতে-আখিপল্লবে ভুবনমোহিনী হয়ে। গেটে বাহাদুর প্রথমে আটকে দিয়েছিল। পরে গাড়ির নম্বর দেখে ছেড়ে দিল। আলগোছে একটা সেলামও ঠুকে দিয়েছিল নেহাত অভ্যাসের বশে। সোমেশের অভ্যাস সেলামের উত্তরে কপালে ডান হাতটা আলতো করে ঠেকানো। অভ্যাসমতো সেটা করতেই বাহাদুরের চোয়াল ঝুলে পড়ল।

হায় রাম। চাউধ্রি সাব চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। ততক্ষণে সোমেশ লিফটে।

বুড়ো লিফটম্যান ইব্রাহিম সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল কৌনসী ফ্লোর–, সোমেশ বললেন, ভালো আছ, ইব্রাহিম?

সড়াৎ করে শ্বাস টেনে ইব্রাহিম তার টুলের ওপর বসে পড়ল, তার হাত লিফটের বোতামে না গিয়ে পড়ল গিয়ে নিজের কপালে হিজিবিজিকাটা ছকে।

ইনশাল্লা। চাউধ্রি সাহাব। তৌবা। তৌবা।

এখন থেকে আর চৌধুরী সায়েব না, ম্যাডাম চৌধুরী বলবে, বুঝলে তো ইব্রাহিম? সোমেশ মিষ্টি হেসে বলেন–কই লিফ্ট চালাও?

লিফট থেকে নেমে নিজের ঘরে ঢুকলেন বিনা বাধায়। টুলে নিধিরাম ছিল না। একটু পরেই বেল বাজালেন মজু চৌধুরী। নিধিরাম পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে সাহেবের সিটে এক অপরিচিতা সুন্দরীকে দেখে এতদূর অবাক, যে আপত্তি পর্যন্ত করার কথা মনে পড়ল না তার। অনেক ফাইল জমেছে তিন মাসে। ফাইলে চোখ রেখেই অভ্যাসমাফিক সোমেশ বলে, জল।

জগড়নাথ। নিধিরাম শব্দ করে ওঠে!

এ-কড়ও হলা? সাহাব-অর-স-র-ব-নাসও হই গলা রে হায়, হায়! হাহাকার করে ওঠে নিধিরাম। মুহূর্তের মধ্যে ঘরভর্তি দর্শক জড়ো হয়ে যায়। লাফিয়ে উঠে চৌহান বলল, গুড গ্রেশাস। হোয়াট লাক। চাউ৮ি সাবনে তো দিল্ ধড়কা দিয়া। একদম্ জিনৎ আ, সায়রা বানু-সোমেশ চাউধ্রি ইজ গন্, লং লিভ সোমা চাউধ্রি

ঘোষদা বলল, বড্ডই আপশোস হচ্ছে কেন যে তোর বউদিকে বিয়েটা করে ফেলেছিলুম।

চালু ছোকরা রণু ব্যানার্জী বললে, অ্যাবসলুটলি র‍্যাভিশিং এস কে। মে আই হ্যাভ আ ডেট উইথ ইউ দিস স্যাটারডে নাইট? লেটস গো ডান্সিং। শ্যাল উই?

গোলাপি স্লিভলেসে ভূমিকম্প তুলে সোমেশ বললেন, থ্যাংকু রণু! আইল থিংক অ্যাবাউট ইট।

কেবল তার বয়স্ক পি.এ.রাধাকৃষ্ণণ খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। দক্ষিণের মানুষ তিনি, চট করে অবাক হন না বড় একটা। আগে সাদা সাহেবের কাছে কাজ করেছেন, তার বদলে এলেন কালো সাহেব। এমন পুং সাহেবের বদলে না হয় স্ত্রী সাহেব। রাধাকৃষ্ণণের তাতে কি? গম্ভীর মুখে খাতা-পেনসিল নিয়ে বসলেন এসে, চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই।

ইয়েস স্যার? সরি, ইয়েস ম্যাডাম? শ্যাল উই বিগিন? ওদিকে অফিসময় ততক্ষণে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সকলেই উত্তেজিত, শশব্যস্ত, সোমেশ চৌধুরী ছাড়া কারুর মুখে কোনো কথা নেই।

হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরলেন সোমা চৌধুরী। ইন্দ্রাণীও আজ অপ্রস্তুত। প্রতিযোগিতার উচিত স্পিরিটে বিউটি পার্লারে গিয়ে মাথার চুলের ডগা থেকে নোখের আগা পর্যন্ত নতুন করিয়ে এনেছেন। একমাত্র প্রবেলম, কোমরটাকে কিছু করা যায়নি। ওখানে সোমেশের একচ্ছত্র জয়। দরজা খুলে এক রূপসী আরেক রূপসীকে রিসিভ করলেন। ঠিক সোহিনী এলে যেমন দোরগোড়াতেই ইন্দ্রাণীকে বউদি ভাই বলে জড়িয়ে ধরে, সোমেশ একেবারে তেমনি ঢঙে দরজাতেই ইন্দ্রাণীকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষে, হ্যালো ডালিং বলে ঘরে পা দিলেন।

ছি! ছি। ও কী হচ্ছে? আপনার অজান্তেই বকে ফেলেছেন ইন্দ্রাণী। চোখ টিপে সোমা চৌধুরী বললেন, ওতে কিছু হবে না! তারপরেই ভুরু উঁচিয়ে ঠোঁট গোল করে কমপ্লিমেন্ট দেন, ই-ই—কী-ই দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে ইন্দু। চুলটা কোথায় করালে? ফেসিয়ালও করিয়েছ না? বেশ ভালো কাজ তো ওদের।

এসব কথায় কান না দিয়ে চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে ইন্দ্রাণী বললেন, তারপর? আপিসে সবাই তোমায় দেখে কী বললে?

হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে, হাভানা সিগারটি ধরিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে গায়ে সুতি ডুরের আঁচলটি জড়িয়ে নিয়ে, চায়ের কাপ হাতে সোমেশ গল্প জুড়ে দেন–আপিসে আজ কত কী হলো। বাহাদুর, ইব্রাহিম, নিধিরাম, চৌহান, ঘোষদা, রাধাকৃষ্ণণ, রণু ব্যানার্জী–কেউ বাদ যায় না। কেবল জেনিফারের মুখ ভার করার কথাটা বলেন না। রণু ব্যানাজীর অফার শুনে চমকে ওঠেন ইন্দ্রাণী।

সে কি গো, যাবে নাকি তুমি নাচতে? আঁ? হায় রে পোড়াকপাল আমার শেষে কিনা–

দুর দুর। তুমিও যেমন। বলে সোমেশ প্রবল একটি কটাক্ষ হানেন, থ্যাংকু বলাটা কার্টসি, বুঝলে না?

এমন সময়ে হরিদাসী এসে বললে, বাবুর কাছে ঘনশ্যামবাবু এয়েচেন। গঙ্গাঠাকুর ও হরিদাসী যথাসাধ্য বাবুর সঙ্গে সোজাসুজি কথোপকথন এড়িয়ে চলেছে। তারা একটু বিব্রত বোধ করছে। বোঝাই যাচ্ছে, পাড়ার ভৃত্যকুলের কাছে তাদের মুখ দেখানোর উপায় নেই। বাড়ির কর্তা মেয়েমানুষ হয়ে গেছেন, এমন ধারা অনাচ্ছিষ্টি কাণ্ড কেউ কি বাপের জন্মেও শুনেছে? চোখে দেখা তো দূরস্থান। দুজনই খুব পুরোনো, ইন্দ্রাণীর শ্বশুর-শাশুড়ির টাইমের লোক। এই সংসারে অপরিহার্য দুজনেই। এই গঙ্গাঠাকুর, এই হরিদাসী, ইন্দ্রাণীর বিয়েতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তার বাপের বাড়ি গিয়েছিল।

আঃ! হরিদাসী, ফের! বলেছি না দুদিন ধরে বাবু বাবু করবি না? সোমেশবাবু খিঁচিয়ে ওঠেন। প্লাকড ভুরুতে জট পাকিয়ে যায়।

কী বলব তবে? মা? আর মাকে তবে কি বলব? আগেকার মতন, বউদিদি? ছানিপড়া চোখ হরিদাসী খুবই সরলভাবে তাকায়। ইন্দ্রাণীর শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে সোমেশ-ইন্দ্রাণী বাবু-মা ডাকে প্রমোশন পেয়েছেন।

তা তো বটে? এক মিনিট ভুরু কুঁচকে সিগার কামড়ে চুপ করে থাকেন সোমেশ। তারপরেই মুখ থেকে চুরুট সরিয়ে বলেন, মাকে মা আর আমাকে মেমসাহেব বলবে। বাবু-টাবু বলবে না।

হরিদাসী একনজরে মুখের পানে চায়–এই সেই লোক, যাকে সে বহুবৎসর কাল দাদাবাবু বলবার পর সম্প্রতি বাবু বলতে শুরু করেছিল। তারপর ফোকলা গালের গর্তে টোল ফেলে কেমন-কেমন হাসে। হেসে বলে, বেশ! তাই বলব। মেমসায়েবের কাছে। ঘনশ্যামবাবু এয়েছেন। হলো তো?

ঘনশ্যাম সোমেশের ইস্কুলের বন্ধু। রোজ সন্ধেবেলায়, রাতে খাবার আগে পর্যন্ত দাবা খেলাটা তাদের কলেজ যুগ থেকেই নেশা। এক পাড়ায় বাড়ি হওয়ার দরুণ এই নেশাটি বিয়ের পরেও ভাঙেনি।

ফরাসি সুগন্ধ বিলিয়ে, আঁচল এলিয়ে, চুল ফুলিয়ে সোমেশ হাস্য বদনে ঘরে ঢুকতেই ঘনশ্যাম চমকে উঠলেন। তারপরেই মুখ ভেংচে চেঁচিয়ে ওঠেন, এ্যাঃ। ছিছিছি ই-কী করিচিস রে ব্যাটা সোমা? অ্যাত্তে করে তোকে বারণ কলুম–বল্লম, এটা অ্যামেরিকা বিলেত নয়, ওসব কীর্তি করতে যাসনি, সব্বোনাশ হবে–শুনলিনি? সেই, যা জেদ ধরবি, তাই?

কেন রে ঘনা? বেশ ভালো দেখাচ্ছে না? একটু দমে গিয়ে প্রশ্ন করেন সোমেশ। চোখে অনিশ্চয়তা।

তোমার মাথা। ঠিক বাঁদরের মতন দেখাচ্ছে। মাথা নিচু করে বোর্ড থেকে ঘুটিগুলো বাক্সে তুলে ফেলতে থাকেন ঘনশ্যাম।

ঘুঁটি তুলে ফেলছিস যে? খেলবি না?

কী খেলব?

ন্যাকামো রাখ!

বলি ন্যাকামোটা কে কচ্চে? রোজ রোজ এসে তোমার সঙ্গে দাবা খেলি, আর পাড়ার লোকে নিন্দে করুক। না রে সোমা, কম্মোটি আমি আর পারব না। গিন্নি অ্যালাউ করবে না। ছেলেপুলে বড় হচ্ছে, তারাই বা কী ভাববে। আমার দ্বারা লীলাখেলা হবে না ভাই।

ঘনা! কাতর আর্তনাদ বেরোয় সোমেশের গলা চিরে। এ তুই কী বলছিস ভাই ঘনা? তুই কি পাগল হলি? এ যে আমাদের বিশ বছরের নেশা রে! কে আবার কী বলবে এতে?

ওসব কথা থাক। দ্য পাস্ট ইজ পাস্ট। তুমি বরং এখন থেকে আমার বউয়ের সঙ্গে সাপলুডো খেলতে যেও রোজ দুপুরবেলায় আমি কিছু বলব না। ঘনশ্যামের গলা অভিমানে বুজে এল, শালা। বিশ্বাসঘাতক। ইস্টুপিড কোথাকার। এত করে বারণ করলুম।

সোমেশের চোখের জল আর বাঁধ মানে না। চোখে আঁচল তুলে দেন তিনি। আর ছিঃ ছিঃ বলতে বলতে বেরিয়ে যান ঘনশ্যামবাবু। প্রায় দৌড়ে পালালেন।

ঠিক এমনই সময়ে নীচে উঁক ভঁক করে হর্ন বেজে ওঠে। ছেলেমেয়েরা এসে গেছে বলতে বলতে ছুটে এলেন ইন্দ্রাণী। ডুরে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে, সর্বাঙ্গে অপরূপ ঢেউ খেলিয়ে সোৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন সোমেশ, সদ্য হারানো বন্ধুর দুঃখু ভুলে। হাতে জ্বলন্ত সিগার, গায়ে কমলাডুরের আঁচল। মাস্কারা-ঘন চোখে অপত্য স্নেহের অমৃতধারা। সারপ্রাইজ।–ছেলেমেয়েরা জানে না বাবা ফিরে এসেছেন।

বাবা।

বাবা।

বাবা। দুড়দাড় দৌড়াতে দৌড়তে সিঁড়ি থেকেই চেঁচাতে চেঁচাতে, উল্লাসে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকল বান্টি-মিন্টু-সন্টু। গেটের কাছ বাবার প্রিয় চুরুটের গন্ধটি পেয়েই তাদের মন নেচে উঠেছে। খবর পৌঁছে গেছে প্রাণে। বাবার গন্ধ। বাবা এসে গেছেন। ঘরে ঢুকেই স্ট্যাচু। বজ্রাহত। নিশ্চুপ।

নিবাত নিষ্কম্প তিনটি স্তব্ধতা। তারপরেই পাঁচ বছরের সন্টুটা কেঁদে ফেললে, বাবা কই? ডুরে শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে সন্টুকে কোলে তুলতে যান সোমেশ। তার আগেই সে ছুটে গিয়ে ইন্দ্রাণীর হাঁটুতে মুখ গুঁজেছে। ছোট ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে মা দেখান ওই গ্লামারাস তরুণীটির দিকে

এই তো বাবা।

ন্না ন্না ও বাবা না। সন্টু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকে। ছোট্ট শরীরটা গুটিয়ে আরো ছোট দেখায়। বান্টি এখন ক্লাস এইটে, সদ্য গোঁফের রেখার ছায়া পড়েছে ঠোঁটের ওপরে। মিন্টুরাণী পড়ছেন ক্লাস সিক্সে, একটা হালকা প্রজাপতির মতন দেখতে।

গেটে বাবার সিগারের পরিচিত গন্ধটি তাদের তিন মাস ধরে হারানো বাবার পুনরাগমনের খবর দিয়েছিল, কিন্তু এ কে এসে বসে আছে বাবার ইজিচেয়ারে। বাবা কই? এ যে ছোটপিসি। আবার ঠিক ছোটপিসিও নয়। অন্য কেউ। এ কে?

নেলপলিশচিত্রিত দশ আঙুল বাড়িয়ে মিষ্টি আদুরে গলায় সোমেশ ডাকলেন, ছি, সন্টু কাঁদে না বাবা। এসো, কোলে এসো–এই দেখ, দেখ না, তোমাদের জন্যে কী সুন্দর ক্যাডবেরি এনেছি–

সন্টু নড়ল না। বান্টিও নড়ল না। মিন্টুই শুধু পায়ে পায়ে একটু এগোল। সোমেশ ডাকলেন, কই রে আয়? এই দ্যাখ আরেকটা কী মজার সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্যে–পাশের ভ্যনিটি ব্যাগটা হাতে নেন সোমেশ। সন্টু নড়ল না।

যাও, কাছে যাও- ইন্দ্রাণী এবার সন্টু-বান্টি দুই অবাধ্য পুত্রের পিঠে দুই ঠেলা মেরে বললেন, ছিঃ! ও কী হচ্ছে কি? অসভ্যতা?

অমন করতে নেই, সন্ট-বান্টু, বাবা ডাকলে যেতে হয়। ছেলেমেয়েদের পেছু পেছু, ঘনশ্যামবাবুও আবার কখন ওপরে উঠে এসেছিলেন। এবার টের পাওয়া গেল। ঘনশ্যামবাবু বললেন, যা, বাবা ডাকছে, অমন কোরো না। কাছে যাও। বাবা বলে কথা–ধুতিই পরুক আর শাড়িই পরুক। বাবা, বাবাই। যাও, কাছে যাও–

বাবা বাবাই মানে? নেপথ্যে হরিদাসীর গলা পাওয়া গেল। বাবা ডাকছে মানে? এখন কি আর বাবা বলে ডাকলে চলবে নাকি? এখন বলতে হবে মা। কী বলে ডাকবে তোমাকে তোমার ছেলেমেয়েরা, বাবু? এই য্যাঃ, কী যেন বলে, মেমসায়েব? তোমার ছেলেমেয়েরা তোমায় বাবার বদলে কী নাম ধরে ডাকবে? মেমসায়েব, না মা? ঘরের বাইরে থেকে বোমা ফেলতে লাগল হরিদাসী। সোমেশের মনে পড়ল জন মরিস যখন জ্যান মরিস হলেন, তারও তখন বড় বড় সন্তান ছিল। জ্যানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-পরিবারের ভাবভালোবাসা তো এতটুকুও নষ্ট হয়নি। কী যোগাযোগে, কী উষ্ণতায়, কোথাও কিছু কম পড়েনি। কিন্তু জ্যানের ছেলেমেয়েরা এখন তাকে কী বলে ডাকে? জ্যান বলে? না ড্যাডি বলে? আত্মজীবনীতে কি সেটার উল্লেখ ছিল না? ভাবতে ভাবতে সোমেশের নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে বেরুল। নাকটি তিনি থুপে থুপে মুছে দিলেন। তবুও মনে পড়ল না।

সন্টু এবার স্পষ্ট গলায় বলল, ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে, না, বাবার কাছে যাব না। বান্টি কিছুই বলল না। টেবিলের ওধার থেকে কেবল তাকিয়ে বাবাকে দেখতে লাগল। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, কবজিতে সোনার বালা, আঙুলে জ্বলন্ত হাভানা সিগার, কমলা ধনেখালির ডুরে, কপালে ম্যাচ-করা কুমকুমের টিপ, প্লাক-করা ভুরু, মাস্কারা মাখানো আঁখিপল্লব, স্লিভলেস ব্লাউজ, ফর্সা পেট–বান্টি শক্ত করে চোখটা বুজে ফেলল। ঠোঁটটা একটু কুঁচকে গেল। বান্টি নড়ল না। কেবল মিন্টু আরও এক পা এগোল। মাকে বলল, বাপিয়া এটা কি পারফিউম মেখেছে গো মা? কী মিষ্টি গন্ধটা–, মিন্টু চিরকালের ন্যাকা, এক নম্বরের বাপ-সোহাগি মেয়ে। বাবা না ডেকে ওই বাপিয়া ডাকটি সে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে।

হরিদাসী জলখাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছিল। দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে একগাল ফোকলা হাসি দিল। যেন দিব্যকর্ণ খুলে গেছে তার–এমন উজ্জ্বল হাসিতে কাঁধের ওপর মাথাটি হেলিয়ে বল্লে, বাঃ! এই তো দিব্যি হিল্লে হয়ে গেছে। বাপিয়া। মিন্টুরানির ডাকটিই অ্যাদ্দিনে মানিয়েছে সব চে ভালো। বাপিয়া। যা বাবা যা, সন্টুবাবা, মিন্টুরানি, বান্টু, বাবুর কাছে যাও বাছারা। অমনধারা করতিনি, বাপিয়ারা ডাকলি যেতি হয়–বাপ বলে কথা।

শারদীয়া যুগান্তর ১৯৮১

মেঘদীপের গার্লফ্রেন্ডরা

আজকালকার দিদিমা-ঠাকুমারা তো আগেকার মতো সহজে পরের প্রজন্মকে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দিয়ে পুজোর ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন না? তারাও সেজেগুজে সন্ধেবেলায় পার্টি করতে বেরোন, রবীন্দ্রসদনে, নন্দনে, আইসিসিআর-এর মঞ্চে তাদের নৃত্য-গীত প্রদর্শন করতেও দেখা যায়। শুধু দর্শকদের আসনেই নয়। তা বলে তারা তো বয়স লুকোচ্ছেন না? একবার নাতি-নাতনির প্রসঙ্গ তুলেই দ্যাখো না? যে যাঁর অতুলনীয় নাতি-নাতনির গল্পের ঝুলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন তক্ষুনি। আমি তো হিয়ামনের কথা মাঝে-মাঝেই যত্রতত্র বলে ফেলি। আমি একা নই, অনেকেই বলেন। তবে পুরুষমানুষেরা চেষ্টা করেন এসব তুচ্ছ সাংসারিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকতে। (নাতি? হ্যাঁ, আছে আছে। আহা, ভালো থাক। তাকে নিয়ে অত গল্প জোড়াব কী আছে? সব বাচ্চাই ছোটবেলায় সব মা-বাপের চোখে ওইরকম আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ)

সেদিন সন্ধেবেলায় দিব্বি মনের সুখে আড্ডা দিচ্ছিলুম। মনের সুখের কারণ এই যে, আজকাল আমি লক্ষ করেছি আমরা যারা দিদিমা-ঠাকুমা হয়েছি, তাদের আড্ডার মধ্যে নাতি-নাতনিদের গুণপনা সবার অজান্তে ঢুকে পড়বেই পড়বে, আর যাঁদের সে-সৌভাগ্য হয়নি অর্থাৎ যাঁরা নাতিসুখ পাননি, বেচারা তাদের নিদারুণ ভাবে বের করে দেবেই দেবে। আমার দিব্বি মনে আছে, আমিও একদা ওই শেষের দলেই ছিলুম। সেই সন্ধেটির বৈশিষ্ট্য এই যে, সেখানে বিমিশ্র উপস্থিতি নয়, অবিমিশ্র দাদু-ঠাকুমাদেরই জমজমাট আড্ডা বসেছিল।

সেদিন আমরা টুসির কাছে তার নাতির গপ্পো শুনছিলুম, টুসিরা সদ্য ফিরেছেন কিনা মেয়ের বাড়ি থেকে। আমাদের অনেক বন্ধুর বার্ষিক সফরসূচিতে একবার করে সাত সাগর পেরনো থাকে আজকাল। বিদেশ-দর্শনের জন্য নয়, নাতি-নাতনির টানে বিদেশযাত্রা। সুনীল-স্বাতী, টুসি-আশিস, সীমা-পি.কে. নন্দিতা-ড. বাগচী, উমা, টুনু, কত বলব? এঁদের কথা তো না-ভেবেই মনে এল, খুঁজলে আরও অনেক নাম পাব। আমি এখন বসেছি মেঘদীপের গল্প বলতে। টুসির নাতি মেঘু থাকে ইংল্যান্ডে, তার ব্যস্ত মা-বাবার কাছে।

সেবারে টুসি যেতে, একটু যেন অন্যরম লাগল মেঘদীপকে।

তাদের অতি আদরের নাতিবাবুটি দাদু-দিদুকে দেখলেই আহ্বাদেপনা শুরু করে, এইবারে সে যেন একটু গম্ভীর-গম্ভীর একটু দূর-দূর? বলি, ব্যাপারটা কী? শরীরটরির ঠিক আছে তো? ইশকুলের রেজাল্ট ঠিকঠাক? খেলাধুলোর ক্ষেত্রে হারজিত-এর আকস্মিক কিছু নয়? একটু কেমন-কেমন লাগছে যেন ছেলেটাকে? অনেকটা বেড়েছে মাথায়, কিন্তু বয়স তো সবে এগারো হল। ব্যাপার কী? হাবভাব তো ভালো ঠেকছে না?

মেয়ে বুলা বললে, হ্যাঁ, মেঘুর মনটা বড় খারাপ, মা।

কেন? কেন?

কেন আবার? ওর গার্লফ্রেন্ড হয়নি একটাও, এদিকে ওর বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে ইকুলে সবাই খ্যাপার বোধহয়। সবটা তো খুলে বলে না।

গার্লফ্রেন্ড হয়নি বলে খ্যাপায়? সে কী রে। আমাদের সময়ে তো গার্লফ্রেন্ড হলেই বন্ধুরা ছেলেদের খ্যাপাত।

এখানে আলাদা হিসেব, মা। মুখ গুঁজে পড়লেই তো হবে না, ইশকুলেও তোমার সামাজিক সফলতা চাই, তাই গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড হওয়া না-হওয়াটা ছেলেমেয়েদের প্রেস্টিজের পক্ষে জরুরি। পিয়ার প্রেশার থাকে প্রচুর।

কিন্তু বুলা, ওর তো মোটে এগারো–প্রি-টিন—

তাতে কী? ওই বয়সেই ওসব হওয়ায় কথা এদেশে!

এ নিয়ে মেঘুর সঙ্গে কথা বলা দরকার।

দিদিমা চেপে ধরলেন মেঘুকে।

কেন দাদাভাই তোমার মনখারাপ? গার্লফ্রেন্ড হয়নি বলে? সময় হলেই হবে।

সময় তো হয়েছে, দিদা।

তবে কেন তোমার গার্লফ্রেন্ড হচ্ছে না? কারণটা কী মনে হয় তোমার? সেটা বদলে ফেললেই হল? তুমি এমন টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম, এত সুন্দর চুল তোমার।

ওখানেই তো আমার দোষ, দিদা। আমার চশমার লেন্স খুব পুরু তো, বেজায় স্টুডিয়াস দেখায়। স্টুডিয়াস ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ করে না। আর তা ছাড়া, আমি তো ম্যাথুস-এ বেস্ট বয়। সেটাও খারাপ

দুর দুর চশমার পাওয়ার খুব হাই, পুরু কাঁচ, সেটা আবার একটা কারণ হতে পারে? আর অঙ্কে ক্লাসের বেস্ট বয়, সেটাও কারণ হতে পারে না। কক্ষনও না!

কিন্তু আমার যে বেস্ট ফ্রেন্ড, জুনিয়ার, সে খুব চালাক, আর সব কিছু জানে-বোঝে দিদা। জুনিয়ার আমাকে বলেছে, গার্লস হেট ম্যাথস অ্যান্ড দোজ হু আর গুড অ্যাট ইট। ও বলেছে, তুই একটু খারাপ করে দ্যাখ না অঙ্কে? দেখবি এফেক্ট হবে। চশমার তো কিছু করা যাবে না। পরে বাবাকে বলে চোখে কনট্যাক্ট লেন্স পরে নিস।

অঙ্কে খারাপ করতে বলে দিল? আচ্ছা, ছেলে তো। ওর সঙ্গে আর মিশতে হবে। না। মনে-মনে টুসি এই কথাগুলো বললেও মুখে বেরিয়ে এল স্কুল শিক্ষিকা-দিদিমার আকুল জিজ্ঞাসা, অঙ্কে খারাপ করো বললেই হল? কেমন করে খারাপ করবি?

নো প্রবলেম। খারাপ করা সহজ তো, দিদু। ইচ্ছে করে দুটো অঙ্ক ছেড়ে দিলেই রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে। মেঘদীপের মুখে হাসি ফুটেছে। লেটস সি? দিদু স্তম্ভিত।

এই অবস্থায় দাদু-দিদু চলে গেলেন ইউরোপে। ফিরে এসেই প্রশ্ন, হ্যাঁ রে, মেঘুর অঙ্কের টেস্ট হয়েছে?

হয়েছে।

অঙ্ক-টঙ্ক ছাড়েনি তো?

হ্যাঁ, ভদ্দরলোকের এক কথা। দুটো অঙ্ক ছেড়েছে।

সে কী রে বুলা। সাউথ পয়েন্টের দিদিমণিটির শ্বাস আটকে গেল।

মেঘুদাদা ইচ্ছে করে দু-দুটো জানা অঙ্ক ছেড়ে এল?

এল তো।

তাতে গার্লফ্রেন্ড হল?

হল তো।

আরও আশ্চর্য এবারে দিদিমণি।

সত্যি? অঙ্কে খারাপ করলে প্রেমিকা হয়? আমরা তো জানি ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের পছন্দ করে মেয়েরা। অন্তত আমাদের সময়ে তো তাই ছিল। কণ্ঠস্বর কঠোর হচ্ছে।

আমাদের সময়েও দেশে তাই-ই ছিল, মা। ইংল্যান্ডে হয়তো অন্যরকম?

গার্লফ্রেন্ড কি ওরই ক্লাসে পড়ে? নাম কী তার?

একসঙ্গেই পড়ে, বাবা ইংরেজ, মা পাঞ্জাবি। ওর নাম মিনি।

তুই দেখেছিস?

বেশ দেখতে, বাচ্চা প্রীতি জিন্টার মতো।

তো, গার্লফ্রেন্ড কী বলেন দাদুভাইকে?

বলেছেন তো এই ৫ নভেম্বর, গায় ফকস ডে-তে ময়দানে যেতে, সেখানে তিনি থাকবেন, দুজনে মিলে বাজি পোড়ানো দেখবেন।

সে তো পরশুদিন!

হ্যাঁ মা, পরশু সন্ধেবেলায় মেঘুকে নিয়ে যেতে হবে ওর প্রথম ডেট-এ।

বুলা মুখ টিপে হেসেই অস্থির। যেন খেলা-খেলা, পুতুলের বিয়ে দিচ্ছে।

কার সঙ্গে যাবে?

আমার সঙ্গে, আবার কার সঙ্গে? বাবার কি সময় আছে নাকি? ডাক্তার মানুষ।

দিদিমা একটু হতচকিত, মা নিজেই ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে তার জীবনের প্রথম ডেট-এ? কোথায় মা-বাবাকে লুকিয়ে ছেলেমেয়েরা গোপনে ডেটিং করবে, নিত্যিনতুন মিথ্যে কথা তৈরি করতে প্রাণান্ত হবে, তা নয়, এখানে দেখি উল্টো? বুলারও কি মাথা খারাপ হল? যাকগে, যে-দেশের যে-নিয়ম তাতেই তো চলতে হবে!মেঘুর বান্ধবী যখন বলেছে তাকে মিট করবে ওই ময়দানে, বাপ-মা সেখানে সময়মতো না নিয়ে গেলে ছেলেরই মানসম্মান নষ্ট।

৫ তারিখে সেজেগুজে মায়েতে-ছেলেতে রওনা হল, মেঘদীপ খুব খুশি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নার সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে। সুন্দর পোশাকে স্মার্টলি সেজেছে মায়ের উপদেশ মতো। নাচতে-নাচতে বেরুল সে। বুলার মুখে তেমন টেনশন দেখতে পেল না টুসি। বা-ই!–সি-ইউ! হেসে-হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। এদিকে দিদিমা তো দাদুর সঙ্গে পাশাপাশি বসে নিবিষ্ট চিত্তে ভুরু কুঁচকে টিভি-তে গায় ফকস ডে উদযাপনের উৎসব দেখছেন। ভিড়ের মধ্যে মেঘু বা তার গার্লফ্রেন্ডের চিহ্ন যদি দেখা যায়? বাচ্চা প্রীতি জিন্টার মতো কেউ?

রাত হতে বুলা ফিরল সপুত্রক। ফিরেই যে যার নিজের ঘরে চলে গেল, দাদু-দিদিমাকে কেউ দেখতে পেল বলে মনে হল না। দিদিমা চেঁচিয়ে ফেললেন, কী রে? হল তোদের ডেট করা?

মা, একদম ওই নিয়ে কথা নয়! পরে বলব সব। ফিসফিস গলায় বুলা বলল তার মা-কে।

পরে, মানে মেঘু ঘুমিয়ে পড়তেই, বুলা জানাল, তারা গিয়ে দ্যাখে সেখানে লোকে-লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যে কোথায় মেঘদীপ, কোথায় বা তার গার্লফ্রেন্ড! নিজের হাতটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। মিনিকে মোটে খুঁজেই পাওয়া যায়নি, সে বেচারিও তার মায়ের হাত ধরে ভিড়ের মাঝখানে কোথায় যে দাঁড়িয়েছিল কে জানে? ওরা বাজি পোড়ানো দেখে চলে এসেছে। মেঘুর খুব মনখারাপ, তার মায়ের মেজাজ খারাপ তার চেয়ে বেশি। রাতে শুয়ে দিদিমা দাদুকে বললেন,

সত্যি বলতে কী, আমি তো মেঘুর ডেটিং চাইনি এত অল্প বয়সে, কিন্তু আমারও মনটা এমন খারাপ-খারাপ করছে কেন?

তা করবে না? আহা, বাচ্চাটা একটা আশা করে বেরিয়েছিল? দাদুর সোজা উত্তর।

কয়েকদিন আর এ-বিষয়ে কিছু শোনা গেল না। তারপরে ছেলে বাড়ি এসে জানান। দিল, আবার সে অঙ্কে ১০০-তে ১০০পাচ্ছে। আর একটাও অঙ্ক ছেড়ে আসে না। অংকের টিচার ধরে ফেলেছেন যে, মেঘু ইচ্ছে করে উত্তর দেয় না। দারুণ বকুনি দিয়েছেন, আর ওরকম করা চলবে না, তাতে গার্লফ্রেন্ড হোক আর না-হোক।

পরের বছরে দাদু-দিদিমা গিয়ে দ্যাখেন নাতির ইশকুল বদল হয়েছে, সে এখন দারুণ এক নাক-উঁচু ইশকুলের ছাত্র। সেখানে অনেক নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি। একদিন নাতি ইশকুল থেকে ফিরে ব্যাগ নামাতে নামাতেই মা-কে বললে,

মা, আমাদের কাল ইশকুলের পরে ডিটেন করবে বলেছে। দেরি হবে, ভাবনা কোরো না।

কেন? কেন? কেন তোকে ডিটেন করবে। অমন বললেই হল?

বাঃ, পানিশ করবে না? রুল ব্রেক করেছিলুম যে! মেঘদীপ মায়ের অজ্ঞতায় আশ্চর্য!

এবার মায়ের আরও বিস্ময়ের পালা। এবং ক্রোধের।

কেন? কোন রুল তুই ব্রেক করেছিলি? কেনই বা?

আমি এসএমএস করছিলুম।

ক্লাসের মধ্যে?

এবারে মেঘু চুপ।

কী এসএমএস করছিলি? ক্লাসের মধ্যে?

এবারে দিদিমণি দিদার আধখানা বুজে-যাওয়া গলা শোনা গেল।

ক্লাসের মধ্যে তোদের মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকতে দিল কেন? বলেছিল না বারণ? লকারে রেখে যাওয়ার কথা নয়? মায়ের কিন্তু তীক্ষ্ণ-কণ্ঠ।

বারণই তো? আমি তো ভুলে-ভুলে নিয়ে ফেলেছিলম ভিতরে।

ভুলে-ভুলে? আর এসএমএস-টাও কি ভুলে-ভুলে করে ফেলেছিলি? দুষ্টুমি করবে শাস্তি তো পাবেই।

আশ্চর্য। আমি কি কমপ্লেন করেছি? আমি তো বলেইছি, রুল ব্রেক করেছি, পানিশমেন্ট হবে, তাই বলিনি? আর কোনও দিনও মোবাইল নিয়ে যাব না ক্লাসের মধ্যে। এসএমএস করার চান্সও থাকবে না তা হলে। ফোনটা থাকলেই লোভ হয়। শুধু একঘণ্টা কাল ডিটেল্ড হব স্কুলের পরে। তোমরা ভাবনা কোরো না, আইল বি ফাইন।

কত বড় হয়ে গিয়েছে এই কিছুদিনের মধ্যেই, মেঘুর এখন বারো পূর্ণ।

.

হপ্তা দুয়েক পরেই, আবার একদিন ইশকুল থেকে এসে মেঘু ঘোষণা করলে, আবার আমি কাল ডিটেল্ড হচ্ছি, মা। আমিও জেনি-ও।

এবারে তোমার অপরাধ কী?

আমরা দুজনের ক্লাসের মধ্যে কাগজের টুকরোয় কমেন্টস এক্সচেঞ্জ করছিলুম তো, তা-ই। টিচার ধরে ফেলেছেন।

ফোন নেই, তাও তোমাদের রক্ষে নেই? এবারে টুকরো কাগজ?

আমি কী করব, আমি তো আগে লিখিনি, জেনি লিখেছিল।

কী লিখেছিল মেয়েটা তোকে?

আমাকে আই লাভ ইউ নোটিস পাঠাচ্ছিল। বারণ করলে শুনছিল না। আমি তার উত্তর দেব না?

টিচাররা সেসব দেখলেন?

হ্যাঁ, দেখলেন তো।

বে-শ। মায়ের ক্ষোভ এবারে ফোঁস করে ওঠে।

তুমি কী লিখেছিলে দাদুভাই? খারাপ কিছু লেখখানি তো?

আমি? না, খারাপ কেন হবে? ওঃ, মেয়েটা আমাকে যা জ্বালায় না দিদা ভীষণ বিরক্ত করে। কিছুতেই আমার কথা শুনবে না, আমি ওকে ডেট করতে চাই না, ও ব্লন্ড, পাকাচুলের মতো দেখায়, কিন্তু ও আমাকে ডেট করবেই করবে। খালি-খালি আই লাভ ইউ ওই সমস্ত কথা লিখে নোট পাঠাচ্ছে ক্লাসের মধ্যে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে নয় কিছু না! তাই আমি একটাতে লিখেছিলাম, বাট আই ডোন্ট। তার পরেরটায় লিখলাম, জাস্ট ড্রপ ডেড। আর শেষেটাতে লিখেছিলাম, জাম্প ফ্রম তা ক্লিফ। এই তো কেবল? কী এমন খারাপ কথা? পিছনে লাগলে যে কেউই বলবে। জেনি বলত না, যদি আমি ওকে এইরকম ভাবে বিরক্ত করতাম?

পরের দিন বিকেল। দুজনকেই ডিটেন করেছে ইশকুলে। বিচারসভা বসছে হেডমাস্টারের ঘরে। ফিরতে দেরি হবে।

বাড়িতে সবাই প্রস্তুত : কী জানি কী হয়। কত রাতে ফেরে?

ডোরবেল বাজল খানিক পরেই।

কী রে? ডিটেনশন পিছিয়ে দিল।

না। স্কুলব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে শ্রীমান মেঘদীপের একগাল হাসি। ছেড়ে দিলেন।

.

আরাম করে সফটি আইসক্রিম আর চকোলেট কেক খেতে-খেতে মেঘু বললে, হেডমাস্টার বললেন, এক তো রুল ভেঙে ক্লাসের মধ্যে চিঠি চালাচালি করেছ। দুই, একটি মেয়েকে এত বিশ্রী বিশ্রী কথা কেন লিখেছ? জেনি বলছে সে তোমারে শুধু আই লাভ। ইউ লিখেছিল, তার উত্তরে তুমি আমি দেখি জেনি-র মুখ ভয়ে এতটুকু। কেমন করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তখন বললুম–

হা স্যর, কথাটা ঠাট্টা করেই বলেছিল ও, আমারই অতটা রেগে যাওয়া ঠিক হয়নি, সব দোষ আমার, জেনি-কে পানিশ করবেন না, ওকে আপনি ছেড়ে দিন, ও বেচারির কোনও দোষ নেই। আমাকে পানিশ করুন আমি রুল ভেঙেছি। হঠাৎ অত রেগে গিয়ে ক্লাসের মধ্যে বিশ্রী বিশ্রী করে চিঠি লেখালিখি আমার উচিত হয়নি। ওকে ছেড়ে দিন স্যর।

সব শুনে, দুজনেরই সব চিঠি পড়ে, আমাকে শিভালরাস জেন্টলম্যান বলে খুব আদর করে ছেড়ে দিলেন স্যার। জেনিসকেও একটু বকুনি দিয়ে ছেড়ে দিলেন। কী ভালো না দিদা, আমাদের হেডমাস্টার? অথচ সবাই তাকে ভয় পায় খুব।

সত্যি খুব চমৎকার মানুষ। কিন্তু তুমি তার মুখ রাখবে তো দাদুভাই? এই যে মোবাইলের পরে চিঠি চালাচালি, সব ক্ষমা করে দিলেন, আবার কিছু বাধিয়ে বোসো না যেন। এরপর আর ছেড়ে দিতে পারবেন না উনি।

ধ্যেৎ, তা কখনও হয়। আমি না শিভালরাস জেন্টিলম্যান হয়ে গেছি? আর নিয়ম ভাঙা মানায়।

দিদু তখন শিভালরাস জেন্টিলম্যানকে কোলে জড়িয়ে একটা চুমু খেলেন।

 

Exit mobile version